top of page
Durga1.jpg
পুজো বার্ষিকী 
১৪২৮
Durga-Trina-Dutta.jpg

প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা ​

প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা ​

প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা ​

সূচীপত্র

প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা ​

প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা ​

কবিতা

গ্যালোপিং সাহিত্য - জিষ্ণু সেনগুপ্ত

শিল্পী - মেঘমল্লার (ডালাস, টেক্সাস)

লেখক/লেখিকাবৃন্দ

গল্প

প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা ​

প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা ​

প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা ​

কবিতাঃ সুদীপ্ত বিশ্বাস

কবিতা

সুদীপ্ত বিশ্বাস

ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট এবং কালেক্টর

রানাঘাট, নদীয়া, পঃ বাংলা

Sudipta-Biswas.jpg

পুজো বার্ষিকী ১৪২৮ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

কবিতা

সুদীপ্ত বিশ্বাস

ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট এবং কালেক্টর

রানাঘাট, নদীয়া, পঃ বাংলা

Sudipta-Biswas.jpg

আশার বাষ্প

হামারী এসে জীবন কাড়ছে তবু
আমরা চেয়েছি গেয়ে যেতে সেই গান
শবের উপরে জমছে শবের স্তুপ,
কবরের পাশে বেঁচে ওঠে কিছু প্রাণ।

রাত্রির বুকে বাড়ছে আঁধার রোজই
ফুল তবু ফোটে শবদেহটার পাশে
চাঁদ নেই তবু দূরের আকাশে দেখ,
কিছু ছোট তারা আলো দেয়, ভালোবাসে।

মৃত্যু আসছে কাড়ছে মায়ের কোল
কত ভাবনারা আর তো পেল না ভাষা
বেশ কিছু ফুল অকালেই ঝরে গেল,
মৃত্যুর পরও থেকে যায় প্রত্যাশা। 

দূরের তারার ক্ষীণকায় স্মিত আলো
সংকেতে বলে সংগ্রাম আছে বাকি
তারা খসে গেলে মৃত্যুর গান গেয়ে,
তখনও দেখবে ডাকছে ভোরের পাখি।

 

ইঞ্জেকশন!

লোকে আমায় ভয়ই পেত, বাসত না কেউ ভালো
মনে মনে সবাই আমায় দিত অনেক গালও।
তারপরে যেই কোভিড এল, তাক ধিনা ধিন ধিন
অনেক দিনের পরে এল শোধ তোলবার দিন।
আমার জন্য এখন লোকের হয় না রাতে ঘুম
লাইন দিয়ে চলছে সবার সুচ-ফোটানোর ধুম!
আমায় নিয়ে কাড়াকাড়ি, চলছে যে রাজনীতি 
সুচ দেখে আর আমজনতার একটুও নেই ভীতি! 
ফার্স্ট ডোজের পরে আবার মিলবে কবে ডোজ?
নিয়ম করে সবাই এসে যাচ্ছে নিয়ে খোঁজ। 
দুটি ডোজের মধ্যে আবার গ্যাপ যদি যায় বেড়ে
হাঁ-হাঁ করে অমনি সবাই মারতে আসে তেড়ে।
কাঁদছে সবাই ঠোঁট ফুলিয়ে যাদের আছে বাকি
এত্ত ভালোবাসা আমি কোথায় বলো রাখি?

cremation.jfif
কবিতাঃ আবু আফজল সালেহ

প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা ​

কবিতা

আবু আফজাল সালেহ

কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

চুয়াডাঙ্গা, বাংলাদেশ

পুজো বার্ষিকী ১৪২৮ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

বৃষ্টিমাথায় ছবি আঁকি

 

বৃষ্টি বাদল ভোরবেলাতে

দ্যাখো দ্যাখো খোলো আঁখি

কদম গাছে বৃষ্টিমাখা

হাজার রকম রঙিন পাখি।

কালো পাখি হলুদ পাখি

কত্তরকম ডাকাডাকি

পীত হলুদে লাল খয়েরি

শাখা পাখির ছবি আঁকি।

 

 

পাঁকা গমখেতের সৌন্দর্য
 

নীলিমায় সাদা মেঘের মিনার
আকাশ পারে পারাবত ওড়ে
সোনাবালুতীরে ঝাউবন-- সবুজ ঢেউ
নীল নোনাজলের গর্জন,পাড় ভাঙে
অতল-রহস্যে সুউচ্চ নারিকেল বীথির উচ্ছ্বাস।

এমন সেন্টমার্টিনে এক কবিতা দাঁড়িয়ে
তার ছেড়ে দেওয়া আঁচল--
পাঁকা গমখেতের দুলে ওঠা ঢেউয়ের সৌন্দর্য ওড়ে।

বিজয়ী চুম্বন
 

দিও চারিদিকে ঘন কুয়াশার রহস্য
হিংসা-বিদ্বেষ,বায়বীয় অহংকার
জলপাথরে লুকায়িত বেদনার ছাপ।
এমন হিংস্রতার ছায়ায় তোমার
হরিণ পায়ের নূপুরধ্বনি--
যেন কার্তিকের সোনালি ধানক্ষেতের ঢেউ।

যতই জোৎস্নালোক ছায়াবৃত হোক
টিয়া ঠোঁটের উচ্চারণ বুজি, খুঁজি
তোমার কপালে এঁকে দেবো বিজয়ী চুম্বন।

 

শিশির ভেজা গোলাপ
 

রনাতলে শরীর ভিজিয়ে নিলে
যেন শিশির ভেজা গোলাপ।
কতদিন সূর্যের সঙ্গে তোমার আড়ি!
শীতনিদ্রা ছাড়তে
সূর্যপাপড়িতে ওম নাও এবার।

তুমি ও গোলাপ
গোলাপ ও তুমি
শিশির ভেজা গোলাপ তুমি।

 

touch.jpg

ভালোবাসতে মঙ্গলে যেতে হয় না
 

ভালোবাসতে হলে মঙ্গলগ্রহে যাওয়া লাগে না
ঝুপড়িতেই হয়
আটচালায় হয়--
অট্টালিকাতেও ভালোবাসা থাকতে চায়।

মনের ওপর ভালোবাসার পরিণতি;
তবে শিখতে হয়।

 

ওড়া ও ভালোবাসা শিখতে হয়
 

'ওড়া' আর 'উড়তে পারা' এক নয়
'ভালোবাসা' আর 'ভালোবাসতে পারা' এক নয়।
পাখির ওড়া শিখতে হয়;
ভালোবাসাও শিখতে হয়--
অন্যথা বিপথগামী হতে হয়। 

কবিতাঃ পলাশ দাস

কবিতা

পলাশ দাশ

প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা ​

পুজো বার্ষিকী ১৪২৮ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

কবিতাঃ পার্থ সরকার

বিজ্ঞাপন 

মাটির ফাটলের পাশে 
একটা সম্ভ্রান্ত বিজ্ঞাপন রেখেছি 

থমকে থাকা রোদের আকাশ 
আর হাওয়ার গায়ে 
একটা সম্ভ্রান্ত বিজ্ঞাপন রেখেছি 

জলের স্রোতহীন শরীরের পাড়ে 
একটা সম্ভ্রান্ত বিজ্ঞাপন রেখেছি 

পাথরের অহংকারের গায়ে 
একটা সম্ভ্রান্ত বিজ্ঞাপন রেখেছি

একটা সচিত্র সম্ভ্রান্ত বিজ্ঞাপন 
শিকড়, কাণ্ড ও পাতা   

 

women.jpg

কবিতা

পার্থ সরকার

প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা ​

         পুজো বার্ষিকী ১৪২৮ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

women.jpg

অজাতশত্রু বিস্ফোরণ শোধনাগারে

     

জাতশত্রু বিস্ফোরণ শোধনাগারে  

বর্ষা ত্রুটিযুক্ত 

তুচ্ছ হয় 
তড়িৎগতির জাগরণে 
জানবাজারের জীবিকা 

সরে যায় 
বিচ্ছেদ 
অক্ষর পরিচয়হীন 
যোগচিহ্ন 
নবকেতনের 

বিস্ফোরণ 
শোধনাগারে 

ছত্রাকার 
ঘটিবাটির 
জলপানি 

চিহ্ন নেই দেশদ্রোহিতার । 

শ্রীকৃষ্ণকীর্তন

প্রবন্ধ

প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা ​

পুজো বার্ষিকী ১৪২৮ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

বড়ু চণ্ডীদাসের

শ্রীকৃষ্ণকীর্তন

দিলীপ মজুমদার

পর্ণশ্রী, বেহালা, কলকাতা

chaitanya.jfif

[বড়ু চণ্ডীদাসের প্রামাণ্য জীবনী পাওয়া যায় নি। অনুমান করা হয় তিনি পঞ্চদশ শতকের মানুষ। মিথিলার কবি বিদ্যাপতির সমসাময়িক। বিদ্যাপতির মতো তাঁর লেখায় নাগর-বৈদগ্ধ্য নেই। জয়দেবের পরে তিনি রাধাকৃষ্ণ প্রেমলীলার কাব্য লিখেছেন। গীতিরস থাকলেও তাঁর শ্রীকৃষ্ণকীর্তন একটি কাহিনীকাব্য। নানা কারণে এই কাব্যটি বাংলাসাহিত্যে উল্লেখযোগ্য]


।।জন্মখণ্ড।।
কংসাসুরের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন দেবতারা। সৃষ্টি যাচ্ছে রসাতলে। চিন্তিত দেবতারা। একটা প্রতিবিধান করা দরকার। দেবতারা এলেন দেবাদিদেব ব্রহ্মার কাছে। সব শুনলেন ব্রহ্মা। তিনি দেবতাদের নিয়ে গেলেন সাগরে। সেখানেই আছেন শ্রীহরি। একমাত্র তিনিই করতে পারেন প্রতিবিধান। দেবতাদের স্তবে তুষ্ট হলেন শ্রীহরি। তিনি তাঁদের একটি শ্বেত ও একটি কৃষ্ণ কেশ দিয়ে বললেন যে একটি কেশ থেকে বসুদেবপত্নী রোহিণীর গর্ভে জন্ম নেবেন বলরাম, আর দেবকীর গর্ভে জন্ম নেবেন বনমালী কৃষ্ণ। কংসাসুর নিহত হবেন এই কৃষ্ণের হাতে।
কংসাসুর নিধনের ব্যাপারে দেবতাদের মন্ত্রণার কথা কানে গেল নারদমুনির। সে কথা কংসকে জানাবার জন্য তিনি ছুটে এলেন তাঁর কাছে। তাঁর রঙ্গ কৌতুক দেখে কংস যখন হাসছিলেন, তখন নারদ বললেন, ‘হাসছ হাসো, কিন্তু তোমার বিনাশ আসন্ন।’
এ কি কথা বলছেন নারদমুনি! হাসি বন্ধ হয়ে গেল কংসের। কার হাতে মৃত্যু হবে কংসের? নারদ বললেন, ‘দেবকীর অষ্টম গর্ভে জন্মাবে যে সন্তান, তার হাতেই মৃত্যু হবে তোমার।’ নারদের কথা শুনে সচকিত কংস। না, তিনি কোন ঝুঁকি নেবেন না। দেবকীর সব সন্তানকেই হত্যা করবেন তিনি। নিজের ভগ্নী বলে কোন দয়া-মায়া করা যাবে না।
এদিকে কংসের কাছ থেকে নারদ এলেন বসুদেবের কাছে। বললেন, ‘শোনো বসুদেব, তোমার পত্নী দেবকীর অষ্টম গর্ভে জন্ম নেবেন ভগবান নারায়ণ। তিনি হত্যা করবেন কংসকে। তাই কংস তাঁকে হত্যা করতে উদ্যত হবেন। কি করে দেবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তানকে রক্ষা করতে হবে, সে পথ তোমাকে পরে বলে দেব।’
আতঙ্কগ্রস্ত কংস দেবকীর ছয়টি গর্ভ নষ্ট করে দিলেন। সপ্তম গর্ভে শ্বেতকেশ থেকে জন্ম হল বলভদ্রের। জননীর গর্ভপাতের ছল করে বলভদ্র আশ্রয় নিলেন রোহিণীর গর্ভে। অষ্টম গর্ভে কৃষ্ণকেশ থেকে জন্ম হল শঙ্খচক্রগদাপদ্মধারী শ্রীকৃষ্ণের। দেবকীর অষ্টম গর্ভের কথা শুনে কংস প্রহরীদের মোতায়েন করেছেন। সন্তানের জন্ম হলে সঙ্গে সঙ্গে হত্যা করা হবে তাকে। শত্রুর শেষ রাখবেন না কংস।
দশমাস পরে এক অন্ধকার বর্ষণমুখর রাতে জন্ম হল কৃষ্ণের। দেবতাদের অনুগ্রহে সে কথা অবগত হলেন বসুদেব। আর ঠিক একই সময়ে যশোদা প্রসব করলেন একটি কন্যা সন্তান। প্রায় অচৈতন্য ছিলেন যশোদা, তাই জানতে পারলেন না কন্যা সন্তানের কথা।
পূর্ব পরামর্শমতো বসুদেব দেবকীর নবজাত সন্তানকে কোলে নিয়ে নামলেন পথে। দৈবমায়ায় কংসের প্রহরীরা তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। কৃষ্ণকে নিয়ে যশোদার গৃহে এলেন বসুদেব। কৃষ্ণকে যশোদার কোলে দিয়ে যশোদার কন্যা সন্তানকে নিয়ে এলেন দেবকীর কাছে। সেই কন্যার কান্নার শব্দে নিদ্রাভঙ্গ হল প্রহরীদের। খবর গেল কংসের কাছে। কালবিলম্ব না করে তিনি ছুটে এলেন কারাগৃহে। কংস সেই নবজাত কন্যাকে আছড়ে ফেললেন পাথরে। সেই সময় এক দৈববাণী হল: তোমারে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে। তাহলে কি গোকুলের নন্দসন্তান তাঁর মৃত্যুর কারণ হবে। কংস পুতনাকে পাঠালেন নন্দগৃহে । স্তন্যপানের ছলনায় কৃষ্ণ তাকে বধ করলেন। তারপর গেল যমলার্জুন। সেও নিহত হল। এভাবে নিহত হল কেশী আদি অসুর। প্রমাদ গুনলেন কংস। 
নন্দ আর যশোদার স্নেহচ্ছায়ায় বর্ধিত হতে লাগলেন কৃষ্ণ। ধীরে ধীরে প্রকাশিত হতে লাগল তাঁর অনুপম দেহলাবণ্য। তাঁর ললাটের দুই দিক লঘু এবং মধ্যভাগ প্রশস্ত। নাসিকা ও লোচন সুগঠিত। ভ্রূ বঙ্কিম। ওষ্ঠাধর প্রবালসদৃশ। করযুগল আজানুলম্বিত। বক্ষস্থল মরকত মণিফলকসদৃশ। কটিদেশ সূক্ষ্ম, জঙ্ঘা রামরম্ভাসদৃশ। কেশরাসী কুঞ্চিত ও দীর্ঘ। পরিধানে পীতবস্ত্র। হাতে মনোহর বংশী।
কৃষ্ণের সম্ভোগের জন্য দেবতাদের নির্দেশে দেবী লক্ষ্মী সাগরের গৃহে পদ্মার উদরে জন্মগ্রহণ করলেন। অপরূপ সৌন্দর্যশালিনী সেই কন্যার নাম হল রাধা। নপুংসক আইহনের সঙ্গে বিবাহ হল রাধার। রাধার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নিযুক্ত করা হল কুদর্শনা বৃদ্ধা বড়াইকে ।
।। তাম্বুলখণ্ড ।।
দধি-দুগ্ধের পসরা নিয়ে বড়াই ও সখীদের সঙ্গে রাধা বনপথে প্রত্যহ যান মথুরায়। একদিন চলতে চলতে রাধা বড়াইকে পেছনে ফেলে চলে এলেন বকুলতলায়। তারপরে খেয়াল হল তাঁর সঙ্গে বড়াই তো নেই। এদিকে রাধার হদিশ না পেয়ে বড়াইএর মনেও জাগল শঙ্কা। কর্তব্যে এই ত্রুটি ক্ষমা করবে না আইহনের পরিবার।
পথ চলতে চলতে বড়াই দেখতে পেলেন গোচারণরত এক রাখালকে। কাছে গিয়ে বড়াই বুঝলেন রাখাল তাঁর পরিচিত। নাম তার কানাই। হয়তো কানাই পারবে রাধার হদিশ দিতে। কানাই অর্থাৎ কৃষ্ণ বড়াইকে দেখে বললেন, ‘কি গো, বৃন্দাবনের পথে পথে এমন করে ঘুরে বেড়াচ্ছ কেন?  কিছু হারিয়েছে না কি?’
বড়াই বললেন, ‘সুন্দরী নাতনীকে নিয়ে আসছিলাম। তাকে আর খুঁজে পাচ্ছি না।’
কৃষ্ণ বলেন, ‘সে কি! হারিয়ে গেল! নাম কি তার? দেখতে কেমন?’
-‘ বৃন্দাবনের পথেই হারিয়েছি তাকে। নাম তার চন্দ্রাবলী। ত্রৈলোক্যসুন্দরী সে। বাছা, আমাকে তুমি মথুরার পথ বলে দাও।’
কৃষ্ণ বলেন, ‘নিশ্চয়ই বলে দেব মথুরার পথ। তবে একটা শর্তে। তুমি আমাকে তোমার নাতনীর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবে, বুঝলে!’
-‘এ আর এমন কি! তোমার সঙ্গে তার আলাপ করিয়ে দেব, কথা দিলাম।’
-‘বেশ। তাহলে তার রূপের একটু বর্ণনা দাও।’
-‘শোনো তবে। তার কেশপাশে সুরঙ্গ সিন্দুর দীপ্তি পাচ্ছে, যেন সজল মেঘের ভিতর দিয়ে উদয় হচ্ছে সূর্যের। তার অম্লান আননের দ্যুতি কনককমলের মতো। তাকে দেখলে মোহগ্রস্ত হয় তপস্বীরও মন। তার অলকাবলির ললিতকান্তি দেখে তমালকলিকারা লজ্জিত হয়। তার কজ্জলশোভিত অলস লোচন দেখে নীলোৎপল প্রবেশ করে জলে। শঙ্খ লজ্জা পায় তার কণ্ঠদেশ দেখে। পক্কদাড়িম্ব অভিমানে বিদীর্ণ হয় তার পয়োধরযুগলকে দেখে। কটিদেশ তার ক্ষীণ, গুরুভার বিপুল নিতম্ব। মত্ত রাজহংস অপেক্ষা অনুপম তার গতি।’
রাধার রূপ বর্ণনা শুনে কৃষ্ণ কামকাতর হয়ে উঠলেন। বললেন, ‘রাধার রূপ বর্ণনা শুনে আমি কাতর হয়ে পড়েছি। এমন পুষ্পিত, মধুকরগুঞ্জিত বসন্তে আমি আর ধৈর্য রাখতে পারছি না।  তুমি তাকে নিয়ে এসো।’
-‘ কথা রাখব তোমার। এখন তুমি বলে দাও মথুরার পথ। আমি ঠিক রাধাকে নিয়ে আসব তোমার কাছে।’
অবশেষে রাধার দেখা পেলেন বড়াই। রাধার হাতে তুলে দিলেন কর্পূর, তাম্বুল, ফুল আর নেত্রবস্ত্র; বললেন এসব পাঠিয়েছেন কৃষ্ণ। বড়াইএর কথা শুনে অতীব ক্রুদ্ধ হলেন রাধা। মাটিতে ফেলে দেন কৃষ্ণপ্রদত্ত দ্রব্যাদি। তখন বড়াই তিরস্কার করে বলেন, ‘ছিঃ, এমন কাজ করতে নেই।  নন্দনন্দন কৃষ্ণ যে তোমার বিরহে কাতর।’
রাধা বলেন, ‘ঘরে আমার সুলক্ষণযুক্ত স্বামী আছেন। নন্দদুলাল গোপালক কৃষ্ণ আমার কে? তার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক স্থাপন করতে আমার বয়েই গেছে।’
প্রত্যুত্তরে বড়াই বলেন, ‘যে দেবতাকে স্মরণ করলে পাপমুক্তি ঘটে, তার সঙ্গে প্রেম সম্পর্ক হলে তুমি যে বিষ্ণুলোকে যাবে।’
- ‘দরকার নেই বিষ্ণুলোক। বড়াই তোমার মতলবটা কি? বয়স তো অনেক হল, এসব কুকথা বলতে লজ্জা করে না তোমার? আর কক্ষনো বলবে না এসব কথা।

।। দানখণ্ড ।।
দিনকয়েক পরের কথা। আবার দধি-দুগ্ধের পসরা সাজিয়ে বড়াইএর সঙ্গে রাধা চলেছেন মথুরার পথে। এদিকে রাধার গমন পথে মহাদানী সেজে বসে আছেন কৃষ্ণ। রাধা কাছে আসতে তিনি বললেন, ‘শোনো রাধা, আমি দানী, দান আদায় করি। এতদিন ফাঁকি দিয়েছ তুমি। আজ আর পারবে না ফাঁকি দিতে। তোমার কটিদেশ এত ক্ষীণ যে হাতের মুঠোয় ধরা যায়; দাড়িম্বসদৃশ তোমার স্তনযুগল বড় সুন্দর। আমার প্রাপ্য দান পরিশোধ করে আমাকে আলিঙ্গন করো।’
কৃষ্ণের কথা শুনে রাধা হতবাক। বড়াইকে তিনি বলেন, ‘তোমার কৃষ্ণ তো বড় নির্লজ্জ। কামলালসা চরিতার্থ করার জন্য সে মহাদানী সেজেছে। আমার যৌবন, আমার কটিদেশ, আমার স্তনযুগলের কথা বলে কেন সে? কেন আমাকে সে অপমান করছে? এর একটা বিহিত করো তুমি।’
কৃষ্ণ বলেন, ‘রাজার কাছ থেকে পথ আর হাটের শুল্ক আদায়ের ভার নিয়েছি। দধি-দুগ্ধের পসরা নিয়ে তুমি প্রতিদিন যাও মথুরায়। কিন্তু দান দাও না। তোমার বহু দান বাকি পড়েছে।’
খড়ি পেতে দান গণনা করেন কৃষ্ণ, তারপর বলেন, ‘তোমার নয় লক্ষ কড়ি বাকি পড়েছে; বারো বছরের দান।’
রাধা বিরক্ত হয়ে বলেন, ‘কি যা তা বলছ! আমার বয়স এগারো, তাহলে বারো বছরের দান বাকি থাকে কি করে! দেখো কানাই, আমি সম্ভ্রান্ত বংশের কন্যা, সম্ভ্রান্ত বংশের বধূ, আমার রুপ-যৌবনে লাভ কি তোমার? গাছের উপর পাকা বেল দেখে কাকের লোভ হলেও সে কি তা খেতে পারে? তোমাকে মিনতি করছে, আমার মান রাখো, আমাকে যেতে দাও।’
কৃষ্ণ বলেন, ‘তোমার রূপ দেখে আমি পাগল হয়েছি রাধা।’
--‘ তাহলে গলায় পাথর বেঁধে জলে ডুবে মরো।’
-‘ তুমি আমার গঙ্গা, তুমি আমার বারাণসী, তুমি সর্বতীর্থসার।’
-‘ ছি ছি, লজ্জা হয় না তোমার! আমি না তোমার মাতুলানী!’
-‘ সে সম্বন্ধ সত্যি নয়। সত্যি হল, আমি দেবরাজ, আর তুমি আমার রানি।’
- ‘ কামজ্বরে ভুগছ তুমি। বিকারের ঘোরে বলছ এ সব।’
-- ‘যাই বলো রাধা, কিন্তু আমার হাত থেকে পরিত্রাণ পাবার আশা ছেড়ে দাও।’
--‘ ছি কানাই, ছিঃ। শুল্ক আদায়ের ছলনায় তুমি তোমার মামির উপর বলপ্রয়োগ করছ! জানো না, পরস্ত্রীর প্রতি লোভ মহাপাপ!’
কৃষ্ণ গম্ভীরভাবে বলেন, ‘বসুদেব আর দৈবকীর পুত্র আমি। কংসাসুর আমার মাতুল। সেই সূত্রে তুমি আমার শ্যালিকা, মাতুলানী নও। এ সব বাজে কথা বাদ দাও। একবার প্রসন্ন হয়ে আমার দিকে মুখ তুলে চাও। তোমার উন্নত পয়োধরে পীড়ন করো আমাকে। তাহলেই দূর হবে আমার সন্তাপ। রাধা, তোমার দেহের মাপ সাড়ে তিন হাত, তার জন্য দান হবে দুই কোটি মুদ্রা। মাথায় ফুলের মালার  দান লক্ষ মুদ্রা। তোমার সুন্দর কেশরাশির দান দুই লক্ষ মুদ্রা। সীমন্তের সিন্দূর দুই লক্ষ মুদ্রা। নিষ্কলঙ্ক আননের দান চার লক্ষ মুদ্রা। নীলোৎপলসদৃশ নয়ন দুটির দান পাঁচ লক্ষ। গরুড়সদৃশ নাসিকার দান ছয় লক্ষ। কর্ণকুণ্ডলের জন্য সাত লক্ষ, দন্তরাজির জন্য আট লক্ষ, বিম্বফলের মতো অধরের জন্য নয় লক্ষ, বাহুদুটির জন্য এগারো লক্ষ, নখপংক্তির জন্য বারো লক্ষ মুদ্রা দান দিতে হবে তোমাকে। না, না, শেষ নয় এখানে। তোমার স্তনযুগলের জন্য তেরো লক্ষ, কটিদেশের জন্য চোদ্দ লক্ষ, কদলীসদৃশ উরুর জন্য পনেরো লক্ষ, চরণযুগলের জন্য যোল লক্ষ আর হেমপটনিন্দিত জঘনের জন্য চৌষট্টি লক্ষ মুদ্রা দান দিতে হবে।’
--‘এ সব কি বলছ তুমি? কিসের ঘাট? কিসের দান? এ সব কপটতা ছাড়ো। মানুষের দেহের উপর আবার দান ধরা হয় না কি! দেখো কানাই, পরদার গ্রহণে বিষম পাপ। ভৈরবপত্তনে গিয়ে দেহ বিসর্জন দিয়ে তুমি পাপমুক্ত হও। ’
রাধার কথা শুনে কৃষ্ণ হেসে বলেন, ‘রাধা তোমার উরুদুটিই ভৈরবপত্তন; তা যখন এত কাছে আছে, তাহলে দূরে যাই কেন! কলসি বেঁধে গঙ্গায় ডুবে মরার কথা বলছ? তোমার কুচযুগলই তো কলসির মত, সেই কলসি বেঁধে আমি লাবণ্যগঙ্গাজলে ডুবে মরতে রাজি।’ এরপরে একটু গম্ভীর হয়ে কৃষ্ণ বলেন, ‘পাপ খণ্ডনের কৌশল আমি জানি রাধা, তোমার কাছে সে সব শুনব কেন?’

রাধা বলেন, ‘তোমার আসল অভিসন্ধি বুঝতে বাকি নেই আমার। অনেক হয়েছে, এবার পথ ছাড়ো।’-‘ আমার আসল অভিসন্ধি? তা যখন বুঝেছ, তখন এসো আমার কাছে। রতিদান করো রাধা, না হলে ছাড়ব না তোমাকে, কিছুতেই না। ’রাধা বুঝতে পারেন, কৃষ্ণের হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়া অসম্ভব। তিনি বড়াইকে বলেন, ‘আমি পাখি হলে এখান থেকে উড়ে যেতাম। দেখো বড়াই, কৃষ্ণ যদি বলপ্রয়োগ করে তাহলে আমি প্রাণত্যাগ করব। নিজের মাংসের জন্য হরিণী জগতের বৈরী। আমার রূপই কাল হল। সেই রূপে প্রলুব্ধ কৃষ্ণ। কিন্তু তার আশা পূর্ণ হবে না। ’রাধার কথা শুনে একটুও বিচলিত হন না কৃষ্ণ। বরং আত্মপ্রশংসায় মুখর হয়ে ওঠেন। জানান যে কালো জগতের আলো। এ সব শুনে আরও হতাশ হন রাধা। পথ ছেড়ে দেবার জন্য কাতর অনুরোধ করেন কৃষ্ণকে। কিন্তু কৃষ্ণ অবিচলিত, তখন রাধা বড়াইকে বলেন, ‘বড়াই তোমার কি মনে হয়, নন্দনন্দন কৃষ্ণ আমার যোগ্য? মর্কটের গলায় কি গজমুক্তা মানায়?’ চতুর বড়াই দেখতে থাকেন রাধাকে। মুখে প্রতিবাদ করছেন, কিন্তু তাঁর সর্বাঙ্গে রতিরঙ্গের লক্ষণ প্রকট। ঈষৎ হেসে বড়াই বলেন, ‘এত দেরি হল কেন তোমার ? তুমি কি বনে কৃষ্ণের সঙ্গে ছিলে?’

।| নৌকাখণ্ড ।।

অনেক দিন রাধার সঙ্গে দেখা হয় নি কৃষ্ণের। তাই তাঁর মন বড় ব্যাকুল। কি ভাবে দেখা পাওয়া যায় রাধার? বড়াইকে কৃষ্ণ বলেন, ‘রাধাকে মথুরার হাটে যাবার কথা বলো। বলো যে এবার ভিন্ন পথে যাবে, তাহলে কৃষ্ণ তার হদিশ পাবে না। ’বড়াই সম্মত হন। কৃষ্ণকে তিনি যমুনার ঘাটে নৌকা গিয়ে অপেক্ষা করতে বলেন। বড়াইএর কথা শুনে কৃষ্ণ এমন নৌকা তৈরি করেন, যাতে মাত্র দুজনের স্থান হয়। এরপর আরও একটা বড় নৌকা তৈরি করেন তিনি, আর সেটা ডুবিয়ে রাখেন জলে। বড়াইএর কথা শুনে যথাসময়ে ঘাটে এলেন রাধা। কিন্তু দেখা গেল বড়াই সেখানে নেই। নদীতে একটা নৌকা আছে। কিন্তু বড্ড ছোট সে নৌকা। সখীদের নিয়ে সে নৌকায় যাওয়া অসম্ভব।  একজন একজন করে পার হতে হবে।কিন্তু কোথায় ঘাটোয়াল? রাধা ভালো করে তাকিয়ে দেখে বুঝলেন, ঘাটোয়াল আর কেউ নয়, সেই নন্দনন্দন কৃষ্ণ। কি আর করেন রাধা! নৌকায় উঠে তিনি ঘাটোয়ালকে বলেন, ‘ওহে ঘাটোয়াল, আমাকে পার করে দাও তাড়াতাড়ি। পথে বলপ্রয়োগের চেষ্টা করো না। মনে রেখো, আমাদের সম্পর্কের কথা। তোমার মা যশোদা আমার ননদ, আর তুমি আমার ভাগনে।’

।। ভারখণ্ড ।।

বৃন্দাবনের অভ্যন্তরে গিয়ে কৃষ্ণ চামর গাছের ডাল কেটে তৈরি করেন বাঁক। ঝামা দিয়ে ঘষে চিকন করে তোলেন তাকে। পাটের দড়ি দিয়ে তৈরি করেন শিকে। এ ভাবে রাধার জন্য প্রস্তুত হয় ভার। কিন্তু রাধার বুঝতে বিলম্ব হয় না কৃষ্ণের অভিসন্ধি। নিশ্চয়ই তার কোন বদ মতলব আছে। রাধার পেছন পেছন আসতে থাকেন কৃষ্ণ। রাধা কৃষ্ণকে বলেন, ‘আমার পেছন পেছন আসছ কেন? তোমার কি লজ্জা নেই? তবুও আসছ? বেশ, আমার সঙ্গে আসতে চাও যদি, তাহলে এই দধি-দুগ্ধের ভার বহন করো। ’ছদ্মরাগে কৃষ্ণ বলেন, ‘এ কি বলছ রাধা? আমি হলাম ত্রিভুবনের অধিপতি। জমলার্জুন আর শকটাসুরকে আমি বধ করেছি। কংসাসুরকে বধ করার জন্য আমার জন্ম। সেই আমি ভার বহন করব তোমার ? যৌবনের অ্হংকারে এসব কি যা তা বলছ তুমি?’- ‘যমুনার ঘাটেই তো এক প্রহর বেলা কেটে গেল। মথুরার হাটে কখন যাব? আমার সখীরা সব এগিয়ে গেছে। তুমি ভার বহন করবে কি না বলে দাও। রাজি না হলে আমি আমার হার বিক্রি করে অন্য কোন ভারীকে নিযুক্ত করব।’ রাধার কথা শুনে এগিয়ে এলেন কৃষ্ণ। ভার বহনের ছলনায় নষ্ট করে দিলেন দধি-দুগ্ধ। হায় হায় করে উঠলেন রাধা, কৃষ্ণকে হাত লাগাতে বললেন তিনি। কৃষ্ণ বললেন, ‘তোমার কথায় লোকে আমাকে উপহাস করছে। আমি কেমন করে তোমার ভার বহন করব ? ’রাধা বলেন, ‘গোয়ালা হয়ে কে না ভার বহন করে? দেখো কানাই, দয়া করে এখন এটুকু

করো, ফেরার পথে তোমার ইচ্ছা পূর্ণ করব। ’রাধার কথা শুনে আনন্দিত হলেন কৃষ্ণ। ভারখণ্ডান্তর্গত ছত্রখণ্ড। বড়াইএর কাছে রাধা তাঁর বিড়ম্বনার কাহিনি ব্যক্ত করেন। ছলনাময় কৃষ্ণের আচরণ বুঝতে পারেন না তিনি। কখনও কৃষ্ণ মহাদানী সাজেন, কখনও আবার ভারবহনকারী। ভার বহন করতে গিয়ে কৃষ্ণ নষ্ট করে দিয়েছেন রাধার পসরা। কিন্তু কোন অনুতাপ নেই তাঁর। কৃষ্ণ এর পরেও বলে যাচ্ছেন রাধার দেহসম্ভোগের কথা। রাধাকে নীরব দেখে কৃষ্ণ আবার তোষামোদ শুরু করেন। প্রশংসা করতে থাকেন রাধার রূপের। বলে যান যে রাধা তাঁর বিরহজ্বালা দূর করতে পারেন। বড়াই কৃষ্ণকে জানান যে তাঁর কাকুতি-মিনতিতে তুষ্ট হয়েছেন রাধা। দ্রবীভূত হয়েছে তাঁর হৃদয়। সম্মত হয়েছেন তিনি রতিদানে।বড়াই কৃষ্ণকে বলেন, ‘খর রৌদ্রে রাধা ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তুমি তার মাথায় ছত্র ধারণ করে তাকে কুঞ্জে নিয়ে যাও। ’সে কথা শুনে কপট রাগ করে কৃষ্ণ বলেন, ‘কি? আমাকে রাধার মাথায় ছত্র ধারণ করতে করতে হবে? এত অপমান?’ রাধা বলেন, ‘সুরতির আকাঙ্খা থাকলে অপমান সহ্য করতে হবে।’ কৃষ্ণ বলেন, ‘রাধা, আর বিরহজ্বালা সহ্য করতে পারছি না।’

-‘ যোগী সেজে বসে আছ তুমি। বিরক্ত করছ পরনারীকে। বিয়ে করে সংসার করতে পারো না?’
গম্ভীর হবে কৃষ্ণ বলেন, ‘আমি হরি, আমিই হর, আমি মহাযোগী, আমি দেবাদিদেব। তোমার কাছে করজোড়ে রতি ভিক্ষা করছি রাধা।’

।। বৃন্দাবনখণ্ড ।।
কালিন্দী নদীর তীর। মন্দ মন্দ বায়ু প্রবাহিত হচ্ছে। অভিসারে এসেছেন কৃষ্ণ। অপেক্ষা করে আছেন রাধার জন্য। রাধার জন্য শয্যারচনাও প্রস্তুত। বাজছে সংকেতবেণু।
বড়াই রাধাকে বললেন, ‘রাধা তুমি আর বিলম্ব করো না। তুমি তো জানো কৃষ্ণ বড় অভিমানী । তোমার বিলম্বে তার অভিমান হবে।’
বড়াইএর মুখে বৃন্দাবনের কথা শুনে আনন্দিত হলেন গোপবালিকারা। রাধাকে নিয়ে তাঁরা যাত্রা করলেন বৃন্দাবনের দিকে। বড়াইকে সম্মুখে রেখে চলতে লাগলেন চন্দ্রাবলী। গোপবালিকারা গান গাইতে লাগলেন মনের আনন্দে। কৃষ্ণের কাছে গিয়ে তাঁরা বললেন, ‘ হে কৃষ্ণ,  লজ্জা সংকোচ ত্যাগ করে আমরা এসেছি তোমার কাছে। আমাদের তুমি ত্যাগ করো না কানাই।’
তাঁদের কথা শুনে কৃষ্ণ আনন্দিত হলেন। নানাভাবে তাঁদের মনস্তুষ্টি বিধানের চেষ্টা করলেন তিনি। তাঁরা চলে যাবার পরে কৃষ্ণের হৃদয়াসীনা হয়ে বসলেন রাধা। তখন তাঁর বসন স্খলিত, জঘন কাঞ্চিমুক্ত ।
কৃষ্ণ গাঢ়কণ্ঠে বললেন, ‘রাধা, তোমার জন্য রচনা করেছি এই বৃন্দাবন। এখানে একটি নিভৃত স্থান আছে , তোমাকে সেখানে নিয়ে যাব।
তারপরে কৃষ্ণ রাধার রূপের প্রশংসা শুরু করলেন। তাঁর দেহের বিবিধ অঙ্গগুলিকে তুলনা করতে লাগলেন বিবিধ ফুলের সঙ্গে। রাধার চরণযুগল হৃদয়ে ধারণ করার অনুমতি প্রার্থনা করে তিনি বলতে লাগলেন, ‘রাধা, তুমি আমার  রতনভূষণ, তুমিই আমার জীবন।’

।। কালীয়দমনখণ্ড ।।
বৃন্দাবনের মধ্য  দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে যমুনা নদী। সেই নদীতে কালীদহ নামে আছে একটি গভীর হ্রদ।  সেই হ্রদে বাস করে কালীয়নাগ নামে এক বিষধর সাপ। তার উগ্র বিষে হ্রদের জল বিষময়। কোন জন্তু পান করতে পারে না সেই জল।
গোপীদের বিদায় দিয়ে মথুরা নগরে যাবার পথে জলক্রীড়া করার ইচ্ছা হল কৃষ্ণের। কালীদহের কদম্বতলায় এলেন তিনি। গোপবালকদের নিষেধ অমান্য করে কদম্ববৃক্ষ থেকে তিনি ঝাঁপ দিলেন কালীদহে।
কালীয় নাগ সপরিবারে দংশন করতে লাগল কৃষ্ণকে। তীব্র বিষের জ্বালায় চৈতন্য হারালেন কৃষ্ণ। লোকমুখে এ কথা শুনে ছুটে এলেন নন্দ আর যশোদা। মাটিতে লুটিয়ে কাঁদতে লাগলেন তাঁরা।  কাঁদতে লাগল গোপবালকেরা। সেই বিলাপে মুখরিত হল চারদিক।
বলভদ্র বুঝতে পারলেন কৃষ্ণ আত্মবিস্মৃত হয়ে মোহগ্রস্ত হয়েছেন। তাঁকে জানাতে হবে পূর্ব বৃত্তান্ত। তাহলেই তাঁর চৈতন্য ফিরে আসবে।
বলভদ্র কৃষ্ণের ঈশ্বরসত্তার কথা, নানা অবতাররূপে পৃথিবীকে রক্ষা করার কথা বলায় কৃষ্ণের চৈতন্য ফিরে এল। সকলে স্বস্তির শ্বাস ফেললেন।

।। বস্ত্রহরণখণ্ড ।।
সখীদের সঙ্গে নিয়ে গজপতিছন্দে রাধা জল আনতে চলেছেন যমুনায়। ঘাটেই দেখা কৃষ্ণের সঙ্গে। কৃষ্ণকে দেখে সখীরা বিহ্বল। চোখে তাঁদের পলক পড়ে না।
রাধা কৃষ্ণকে বললেন, ‘একটু সরে দাঁড়াও কানাই। আমাদের জল ভরতে দাও।’ 
কৃষ্ণের এমন ভাব যেন তিনি চেনেন না রাধাকে। বললেন, ‘কে তুমি? কার বধূ? কেন জল আনতে এসেছ যমুনায়?’
রাধা রেগে গিয়ে বলেন, ‘যার বধূ  হই না কেন, তাতে তোমার কী?’
কৃষ্ণ বলেন, ‘কাঁধের কলস নামিয়ে রাখো। কথা আছে তোমার সঙ্গে।’
-‘কি কথা?’
-‘এই তাম্বুল নাও তো আগে।’
-তাম্বুল দিয়ে কি বলতে চাও তুমি?’
-‘শোনো সুন্দরী, আমি হলাম সমস্ত যমুনার অধিকারী।’
-‘বুঝতে পেরেছি তোমার মতলব। তোমার সঙ্গে কোন কথা নেই আমার।’
রাধার মন জয় করার জন্য কৃষ্ণ তাঁকে স্বর্ণময় কিঙ্কিনী, পট্টবস্ত্র, স্বর্ণময় বাঁশি  দিতে চাইলেন। রাধা সম্মত হলেন না কিছুতেই। তখন কৃষ্ণ বললেন, ‘রাধা, ডালিমের মতো তোমার পয়োধর দুটি আমার মন মাতিয়েছে।’
রাধা ক্রুদ্ধভাবে বলেন, ‘আমার পয়োধর মাকাল ফল সদৃশ। দেখতে সুন্দর, কিন্তু মুখে দিলেই মৃত্যু।’
রাধার নিষ্ঠুর কথা শুনে দুঃখ পেলেন কৃষ্ণ। বড়াই তিরস্কার করলেন রাধাকে। তিনি রাধাকে সরস বচনে কৃষ্ণের তুষ্টি বিধান করতে পরামর্শ দিলেন। কৃষ্ণও জানালেন তাঁর বিরহজ্বালার কথা।
রাধা বললেন, ‘পথে-ঘাটে কেন তুমি প্রকাশ্যে এ সব বলো কানাই! কে কোথায় শুনতে পাবে । আমার শাশুড়ি বড় দুর্জন, শুনতে পেলে আমার দুর্দশার অন্ত্য থাকবে না।’
কৃষ্ণ আর পীড়াপীড়ি করলেন না। ফিরে গেলেন রাধা।
দিনকয়েক পরে সখীদের নিয়ে রাধা আবার এলেন যমুনার তীরে। কৃষ্ণ বললেন, ‘রাধা, তুমি যমুনার জলে স্নান করতে পারো।  সর্পভয় আর নেই। তাকে আমি হত্যা করেছি।’
কৃষ্ণের আশ্বাসে জলে নামলেন রাধা ও তাঁর সখীরা। জলকেলিতে মত্ত হয়ে উঠলেন তাঁরা। এই সুযোগে কৃষ্ণ তাঁদের বসন-ভূষণ নিয়ে উঠে বসলেন কদম্বতরুতে। সে কথা জানতে পেরে গোপীরা বড় বিড়ম্বনা বোধ করতে লাগলেন। অর্দ্ধজলমগ্ন হয়ে দক্ষিণ বাহুদ্বারা বক্ষোদেশ আবৃত করে রাধা বলতে লাগলেন, ‘এ তোমার কি ব্যবহার কানাই? দাও আমাদের বসন দাও’
কৃষ্ণ বলেন, ‘তীরে উঠে হাত জোড় করে দাঁড়াও। তাহলেই পাবে তোমাদের বসন-ভূষণ।’
অগত্যা তাই করতে হল রাধা ও তাঁর সখীদের। কৃষ্ণ দুচোখ ভরে দেখলেন নগ্ন যুবতীদের রূপ। তারপরে ফিরিয়ে দিলেন বসন-ভূষণ। শুধু লুকিয়ে রাখলেন রাধার হারটি।

।। হারখণ্ড ।।
যশোদার কাছে এসে রাধা অভিযোগের সুরে বললেন, ‘তোমার কানাই আমার পট্টবস্ত্র আর সাতলহরী হার অপহরণ করেছিল। শেষ পর্ষন্ত পট্টবস্ত্র ফেরত দিলেও সে হার ফেরত দেয় নি এখনও।’
অবাক হয়ে যশোদা বলেন, ‘সে কি কথা!’
-‘ কৃষ্ণ বড় বেয়াড়া হয়ে উঠেছে। শাসন করো তাকে। যখন তখন সে আমাকে আর আমার সখীদের উৎপীড়ন করে। কংস যদি এ কথা জানতে পারে, তবে বড় অনর্থ হবে।’
যশোদা কৃষ্ণকে ডেকে তিরস্কার করে বললেন, ‘তোমার জন্য আর কত গঞ্জনা সহ্য করব আমি! কুবুদ্ধি পরিত্যাগ করো কানাই। সংযত করো মনকে।’

।। বাণখণ্ড ।।
যশোদার কাছে কৃষ্ণের নামে অভিযোগ করে এসেছিলেন রাধা। সে জন্য ক্রুদ্ধ হয়ে আছেন কৃষ্ণ। বড়াই তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, ‘রাধা বাড়াবাড়ি করছে। তোমার কথা বলতে গেলাম তাকে, সে আমাকে গালমন্দ করল। নিজেকে সতী বলে ঘোষণা করল। তুমি দেব বনমালী, অথচ রাধা তোমাকে একটুও সমীহ করে না।’
এ রকম অবস্থায় কি করা যায় তা জানতে চান কৃষ্ণ। বড়াই বলেন, ‘শোনো কানাই, আমি রাধাকে বৃন্দাবনে নিয়ে আসছি। তুমি তার উপর স্তম্ভন, মোহন, দহন, শোষণ, উচাটন বাণ নিক্ষেপ করো।’
মথুরার পথে যমুনা পার হয়ে রাধা এলেন বৃন্দাবনে। দেখলেন কদম্বতলায় বসে আছেন কৃষ্ণ । রাধাকে দেখে কৃষ্ণ বলেন, ‘অকারণে আমার এত নিন্দা করছ কেন? আজ আমি প্রতিশোধ নেব। পঞ্চবাণে আঘাত করব তোমাকে। দেখি কে বাঁচায় তোমাকে! এরপরে আমি আইহন আর কংসকেও হত্যা করব।’
বাণের কথা শুনে ভীত হলেন রাধা। প্রাণরক্ষার জন্য মিনতি করতে লাগলেন তিনি। কিন্তু কৃষ্ণ কোন কথা শুনলেন না। তিনি বাণ নিক্ষেপ করলেন। অনুতাপ করতে করতে রাধা মূর্চ্ছিতা হলেন। রাধার মনে জেগে উঠল কৃষ্ণপ্রেম। বড়াইএর অনুরোধে রাধার জ্ঞান ফিরিয়ে দিলেন কৃষ্ণ।

।। বংশীখণ্ড ।।
সখীদের সঙ্গে যমুনার ঘাটে স্নান করতে যান রাধা। নদীর তীরে বসে থাকেন কৃষ্ণ। যুবতীদের রঙ্গ দেখেন। কখনও বাজান করতাল, কখনও বা মৃদঙ্গ। সখীরাও কৃষ্ণের সঙ্গে রঙ্গ-তামাশায় মেতে ওঠেন। রাধা কিন্তু নিস্পৃহ থাকেন।
রাধার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য কৃষ্ণ তৈরি করেন এক মোহন সুন্দর বাঁশি। সে বাঁশিতে আবার সোনা ও হিরের কাজ। সে বাঁশির সুর আকুল করে তোলে মনকে। ব্যাকুল হয়ে ওঠে রাধার মন। 
পরের দিন রাধা সেই সুরের আকর্ষণে আবার যান যমুনার ঘাটে। কিন্তু ঘাট যে শূন্য। কোথায় কৃষ্ণ! কোথায় সে মোহন বাঁশির সুর! রাধা বড়াইকে বলেন কৃষ্ণের কথা। তিরস্কার করে বড়াই বলেন, ‘কত বড় বংশের কন্যা তুমি, কত বড় বংশের বধূ। কেন পরপুরুষের সঙ্গ কামনা করছে? আগে যা হবার হয়েছে, নতুন করে আবার কেন পাপে জড়াতে চাইছ?’
ঠিক তখনি মাঝ বৃন্দাবন থেকে ভেসে আসে বাঁশির সুর।
কি যে জাদু আছে সে সুরে! রাধার প্রাণ আকুল হয়ে ওঠে। বর্তমান ভুলে যান তিনি। কাতর অনুরোধ করে তিনি বড়াইকে বলেন, ‘যেমন করে পারো আমার কানাইকে এনে দাও বড়াই ।’
ঘরের কাজে আর মন বসে না রাধার। এলোমেলো হয়ে যায় তাঁর জীবন। আগুন জ্বলে মনে । দাবানলের মতো দৃশ্যমান নয় বলে কেউ বুঝতে পারে না। রাধা যদি পাখি হতেন, তাহলে উড়ে চলে যেতে পারতেন তাঁর দয়িতের কাছে ।
সরস বসন্ত এসেছে ধরায়। রাধা অনুভব করেন তীব্র বিরহজ্বালা। বড়াইকে নিয়ে তিনি বৃন্দাবনে যান। কৃষ্ণের সন্ধানে। কিন্তু কৃষ্ণের দেখা পান না। ফিরে আসতে হয় ব্যর্থ হয়ে।গভীর রাতে আবার ভেসে আসে বাঁশির সুর। রাধা আকুল পাগলপারা। শয্যায় উঠে বসেন তিনি। স্বামী আইহনকে নিদ্রিত দেখে চুপিসারে বেরিয়ে পড়েন। পাগলের মতো খুঁজতে থাকেন কানাইকে। তারপরে মূর্চ্ছিতা হয়ে পড়েন। তাঁকে ভোরবেলা উদ্ধার করে আনেন বড়াই।
রাধার অবস্থা দেখে বড় দুঃখ হয় বড়াইএর। রাধাকে তিনি বলেন, ‘চলো, যমুনায় জল আনতে যাই। কৃষ্ণ সেখানে  থাকবে। তুমি ছল করে চুরি করে আনবে তার বাঁশি।’
--‘কি করে চুরি করব বাঁশি?’
-‘আমি মন্ত্র পড়ে কৃষ্ণকে নিদ্রিত করে রাখব। সেই সুযোগে তুমি বাঁশি চুরি করবে।’
--‘লাভ কি হবে বাঁশি চুরি করে?’
--‘লাভ আছে। সেই বাঁশি নিতে তোমার কাছে আসতে হবে কানাইকে।’
বড়াইএর পরিকল্পনামতো রাধা কৃষ্ণের বাঁশি চুরি করেন। তখন কৃষ্ণ বিলাপ শুরু করেন। বড়াই বলেন, ‘তুমি গোপীদের অপমান করেছ। প্রতিশোধ নেবার জন্য তারাই বাঁশি চুরি করেছে।’
কৃষ্ণ যান গোপীদের কাছে। হঠাৎ দেখতে পান দূরে দাঁড়িয়ে রাধা মুচকি হাসছেন। চোর কে তা বুঝতে বাকি থাকে না। কিন্তু রাধা কিছুতেই স্বীকার করতে চান না। অনুনয়ে কোন কাজ না হওয়ায় কৃষ্ণ ভীতি প্রদর্শন করে বলেন, ‘প্রাণে বাঁচতে চাও তো ফেরত দাও বাঁশি। না হলে তোমার বসন-ভূষণ কেড়ে নেব, বেঁধে রাখব তোমাকে, হত্যা করতেও দ্বিধা করব না, বুঝলে ?’
রাধা বলেন, ‘মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছ কানাই। যাও বড়াইকে ধরো। সেই চতুরা বুড়ি লুকিয়ে রেখেছে তোমার বাঁশি।’
বিভ্রান্ত কৃষ্ণ বলেন, ‘তুমি বড়াইএর দোষ দাও, বড়াই তোমার দোষ দেয়। কিন্তু রাধা, আমি জানি বড়াই নয়, তুমিই লুকিয়ে রেখেছ আমার বাঁশি।’
কথা বলতে বলতে কৃষ্ণ রাধার বস্ত্রাঞ্চল ধরে বলেন, ‘বাঁশি না পেলে যেতে দেব না তোমাকে ।’
তখন মধ্যস্থতা করতে এগিয়ে আসেন বড়াই, কৃষ্ণকে বলেন, ‘তুমি হাতজোড় করে বিনীতভাবে রাধার কাছে বাঁশি চাও কানাই।’
বড়াইএর কথামতো কৃষ্ণ রাধার কাছে হাতজোড় করে দাঁড়ান। রাধা বলেন, ‘এরপর থেকে আমার কথামতো চলার প্রতিশ্রুতি দেলে বাঁশি ফেরত পাবে।’
কৃষ্ণ প্রতিশ্রুতি দেন। 
রাধা বলেন, ‘আমি বিরহে কাতর হলে তুমি আমাকে সঙ্গ দেবে। কোন অন্যথা হবে না তো !’
কৃষ্ণ জানান যে কোন অন্যথা হবে না।
রাধা তখন বাঁশি ফেরত দেন কৃষ্ণকে।

।। রাধাবিরহ ।।
দীর্ঘকাল দেখা নেই কৃষ্ণের। এদিকে চৈত্রমাস এসেছে। ঋতুরাজ বসন্তের সমারোহ চারদিকে । বিরহজ্বালায় দগ্ধ হচ্ছে রাধার হৃদয়।
কোথায় গেলেন কৃষ্ণ!
নিজের প্রতিশপুতি কি ভুলে গেলেন তিনি!
বড়াইকে সঙ্গে নিয়ে রাধা যান বৃন্দাবনে। মোহিনী বেশ ধারণ করে কদম্বতলায় রচনা করেন শয্যা। অপেক্ষা করেন, অপেক্ষা করেন, কিন্তু কৃষ্ণের দেখা পাওয়া যায় না।
বৃন্দাবনের পথে পাগলের মতো ঘুরতে ঘুরতে রাধা একদিন দেখলেন গোচারণরত কৃষ্ণকে। তাঁর কাছে গিয়ে রাধা বলেন, ‘কানাই আমি যদি কোন দোষ করে থাকি, ক্ষমা করো। কিন্তু তোমার বিরহ আর সহ্য করতে পারছি না।’
কৃষ্ণ কঠিনভাবে বলেন, ‘তোমার কাঁদুনিতে ভুলছি না। আমার আশাত্যাগ করো, নিজের বাড়িতে যাও।’ 
এ কথা বলে সেখান থেকে চলে যান কৃষ্ণ। চোখের জলে ভাসতে থাকে রাধার বুক। নারদের মুখে খবর পাওয়া যায় কদম্বতলায় শয্যা রচনা করে বসে আছেন কৃষ্ণ।  বড়াইকে নিয়ে ছুটে যান রাধা। কৃষ্ণকে দেখে আনন্দে মূর্ছা যান তিনি। বড়াইএর অনুরোধে রাধাকে গ্রহণ করেন কৃষ্ণ। মিলন হয় তাঁদের। তারপরে রাধা নিদ্রিতা হলে কৃষ্ণ বড়াইকে বলেন, ‘আমি মথুরায় চললাম। তুমি রাধাকে সাবধানে রাখবে।’ জাগ্রত হয়ে কৃষ্ণকে দেখতে না পেয়ে হাহাকার করে ওঠেন রাধা। কয়েক দিন পরে রাধার কাতর অনুরোধে কৃষ্ণের সন্ধানে বড়াই যান মথুরায়। সেখানে তিনি কৃষ্ণের আশ্চর্য পরিবর্তন দেখতে পান। দেখতে পান রাধা সম্পর্কে কৃষ্ণের আর কোন আগ্রহ নেই। কংসাসুরকে বধ করাই এখন তাঁর একমাত্র লক্ষ্য। কৃষ্ণ বড়াইকে জানান যে রাধা বড় প্রগলভ, তাঁকে দেখলে কৃষ্ণের হদকম্প হয়, তাই রাধার মুখ দর্শনের বিন্দুমাত্র ইচ্ছা তাঁর নেই।

ঈশ্বর প্রদত্ত গুণ

গল্প

পুজো বার্ষিকী ১৪২৮ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

ঈশ্বর

প্রদত্ত গুণ

জয়দীপ চক্রবর্তী

himadri1.jpg

প্রায় বারো বছর ধরে মনের মধ্যে জমে থাকা প্রশ্নের আজ সঠিক উত্তর খুঁজে পেলো স্বর্নাশীষ ও বিদুষী। তাদের একমাত্র ছেলে কল্পক আজ বারো বছরের। মাস তিন চারেক বয়স থেকেই বাবা মাকে একটার পর একটা চমক দিয়ে এসেছে কল্পক।
স্বর্নাশীষ কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। একটি কসমেটিক্স উৎপাদন সংস্থায় বেশ উচ্চ পদে চাকরি করে ও। নিয়মিত রুটিন মেনেই অফিস থেকে বাড়ি ফিরতে রোজ দেরী হয় স্বর্নাশীষের। ছেলের জন্মের পরও সেই নিয়মের কোনও ব্যতিক্রম ঘটেনি। তবে সদ্য হওয়া বাবা তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার চেষ্টা করে রোজ। কোনোদিন সফল হয় আর কোনোদিন ব্যর্থ। স্বর্নাশীষ যখনই বাড়ি ফেরে সদ্যজাত কল্পক মাথা ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকায়। সে যত সংগোপনে, যত নিঃশব্দেই ঘরে ঢুকুক না কেন বাবার উপস্থিতি ছেলে ঠিক টের পেয়ে যায়। তাড়াতাড়ি ফিরলে স্বর্নাশীষের দিকে তাকিয়ে এক গাল হাসি দেয়। এই হাসি দেখার জন্যই স্বর্নাশীষের তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরা। তবে কিভাবে এই সদ্যজাত শিশুর পক্ষে তার বাবার বাড়ি ফেরার খবর জানা সম্ভব হয়, তা শত চেষ্টা করেও বাড়ির কেউই বুঝতে পারে না। তাই অবাক হওয়া ছাড়া তাদের আর কোনও উপায় নেই।     
এরপর কল্পক ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠেছে, আর বিভিন্ন ঘটনার মাধ্যমে প্রতিবেশী, আত্মীয় স্বজন, স্কুলের সহপাঠী, শিক্ষক, শিক্ষিকা সবাইকে অবাক করে তুলেছে। 
স্বর্নাশীষদের পাশের ফ্ল্যাটের মেয়ে অক্সিতা কল্পকের থেকে মাস ছয়েকের ছোট। দুই পরিবারের মধ্যে বেশ সদ্ভাব। সেই সুবাদে অক্সিতা কল্পকের খেলা সঙ্গী। অক্সিতার পাঁচ বছরের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে বেশ কয়েকজন কচিকাঁচা একত্র হয়ে খেলায় মেতেছে। লুকোচুরি খেলা। পাশাপাশি ফ্ল্যাট দুটির বিভিন্ন জায়গায় সকলে অন্তর্ধান হয়েছে। সকলকে খুঁজে বের করার ভার পড়েছে কল্পকের ওপর। করিডরে দাঁড়িয়ে শর্ত অনুযায়ী একশত গুনেছে সে। গোনা শেষ হলে করিডরে দাঁড়িয়েই অক্সিতা কোন ফ্ল্যাটের কোন ঘরের কোন-খানে আছে তা বলে দিল কল্পক। অন্যদের খুঁজতেও বেশি সময় নিলো না ও। প্রতিটি ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ওই ঘরে কে কোন জায়গায় আছে তা বলে দিল। শুধু বাচ্চারাই নয়, তাদের অভিভাবকরাও বেশ বিস্মিত। 
পাড়ায়, স্কুলে সর্বত্র কল্পক একটি আলোচনার বিষয়। কেউ বলে ওর মধ্যে একটা ঐশ্বরিক ক্ষমতা আছে। কেউ বলে কল্পক ম্যাজিক জানে। তবে এই ব্যাপারে কল্পককে জিজ্ঞাসাবাদ করে কেউ সঠিক উত্তর পায় নি। যে উত্তর ও দিয়েছে সেটা কেউ বিশ্বাস করেনি। ও বলেছে, চোখ বন্ধ করে এক মনে ভাবলেই নাকি ও সব কিছু বুঝতে পারে। স্বর্নাশীষ ও বিদুষীকে কল্পক অন্য উত্তর দিয়েছে। তবে সেটাও ঠিক বিশ্বাস করতে পারেনি ওরা। 
যাইহোক সকলে এক বাক্যে এটা স্বীকার করে যে কল্পকের জন্মসূত্রে পাওয়া একটি বিশেষ গুণ আছে। তবে সেই গুণের জন্য কোনোরূপ দর্প নেই কল্পকের। কেবল মাত্র প্রয়োজন বা মজা দিতেই ও ওর এই বিশেষ ক্ষমতা ব্যাবহার করে। 
তবে প্রয়োজন হয় প্রায়শই। স্বর্নাশীষের অফিস পিকনিকে সপরিবারে যাবে ওরা। সকাল বেলা তারই প্রস্তুতি পর্ব চলছে বাড়িতে। বিদুষী পড়েছে বেশ বিপদে। সারা মুখে একটা উদ্বিগ্নতা মেখে আলমারি, ওয়ারড্রব সর্বত্র হাতরে বেড়াচ্ছে ও। মায়ের এমন অবস্থা দেখে কল্পক জিজ্ঞাসা করল, 
- মা, কিছু খুঁজছ? 
- হ্যাঁ 
- কি খুঁজছ বল। আমি খুঁজে দিচ্ছি।
বিদুষী ওর সদ্য কেনা একটা অন্তর্বাস খুঁজছিল। অন্তর্বাসটি বেশ দামী। বিশেষ অনুষ্ঠানের জন্যই কেনা। মাত্র একদিন ওটা ব্যবহার করেছে বিদুষী। ও কি খুঁজছে সেটা সাত বছরের ছেলেকে বলতে বেশ সংকোচ হচ্ছিল ওর। তবে আর কোনও উপায় না দেখে ছেলেকে বলেই ফেলল কথাটা। কল্পক ওদের শোবার ঘরে দাঁড়িয়ে একবার মাত্র ঘার একদিক থেকে বিপরীত দিকে ঘোরাল। তারপর বলল, ওটা খাটের পাশ দিয়ে পড়ে গেছে। দাঁড়াও, আমি তুলে দিচ্ছি। 
পিকনিকে গিয়েও সবাইকে চমকে দিল কল্পক। বাবা-মারা যেন নিশ্চিন্তে ও নির্বিঘ্নে এই পিকনিকটি সম্পূর্ণ ভাবে উপভোগ করতে পারে সেজন্য তাদের ছেলেমেয়েদের ব্যস্ত রাখার আয়োজন করা হয়েছে। তাদের জন্য রয়েছে বিভিন্ন গেম, কুইজ, আর আত্ম প্রতিভা প্রকাশের সুযোগ। কেউ সেখানে গান গাইছে। কেউ নৃত্য পরিবেশন করছে। কেউ বা কবিতা আবৃত্তি করছে। 
স্বর্নাশীষ তার সহকর্মীদের সাথে সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে নেশায় গলা ভিজিয়েছে। বিদুষীও স্বামীর সঙ্গ দিয়েছে। সে যে এই সুরা পানে অভ্যস্ত তা তার পানের ভঙ্গিমা, পরিমাণ ও তার অবস্থা দেখে সহজেই অনুমেয়। বিদুষীর কলেজ জীবনে কারণে অকারণে পান চলত। এখনও মাঝে মধ্যে আসরে বাসরে সুরা-পান চলে। 
নেশায় সবে মাত্র একটা ঝিমুনি ভাব এসেছে। এমন সময় স্বর্নাশীষের এক সহকর্মী এসে এমন একটা খবর দিল যে তা শুনে স্বর্নাশীষ ও বিদুষীর নেশা ছুটে গেল। তারা ছুটে গেল তাদের ছেলের কাছে। কল্পক তখন সকলের অভিবাদন কুড়চ্ছে। 
কল্পক গান, আবৃতি, নাচ কোনটাতেই পারদর্শী নয়। তাই বলে সে দমে যাওয়ার পাত্র নয়। তার বয়েসই সকলে যখন  এক এক করে তাদের প্রতিভার পরিচয় দিয়ে হাততালি কুড়চ্ছিল, তখন কল্পক আর চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। ও বলল, আমি একটা ম্যাজিক দেখাবো। অনুষ্ঠান সঞ্চালক সাদরে কল্পককে তার প্রতিভা প্রকাশের সুযোগ করে দিল। শুধু বাচ্চারাই নয়, বেশ কিছু অভিভাবকরাও ছিল সেখানে। কল্পক সেই দর্শকমণ্ডলীর থেকে একটি রুমাল চেয়ে নিলো। এক ভদ্রমহিলা তার রুমালটি কল্পকের হাতে দিলেন। কল্পক সেটা হাতের মুঠোয় রেখে নিজের মুখের সামনে ধরল। তারপর মনে মনে নানারকম মন্ত্র আওরায়ে সে রুমালটি যার রুমাল তাকে ফেরত দিয়ে বলল, আপনি এটা যেখানে খুশি, যার কাছে খুশি লুকিয়ে ফেলুন। আমি চোখ বন্ধ করে ঘুরে দাঁড়াচ্ছি। আমার চোখ বেধে দিন। 
কল্পকের কথা অনুসারে ওর চোখ বেঁধে রুমাল লুকিয়ে ফেলা হল। তারপর চোখ খুলে দেওয়া হল। কল্পক ভীড় কাটিয়ে এক ভদ্রমহিলার সামনে গিয়ে বলল, দিন, রুমালটা বের করে দিন। ওটা আপনার ব্লাউজের ভেতর লোকানো আছে। ভদ্রমহিলা বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পেছন ফিরে রুমালটা বের করে দিলেন। এই ভদ্রমহিলা ছিলেন স্বর্নাশীষের বসের স্ত্রী। একটু বেশি চালাকি করতে গিয়ে সাত বছরের ছেলের কাছে বেশ বোকা বনে গেলেন উনি। উপস্থিত দর্শক মণ্ডলী তখন করতালি দিয়ে কল্পককে অভিবাদন জানাচ্ছে। 
এই ম্যাজিকটা কল্পক স্কুলেও দেখিয়েছে বহুবার। টিফিনের সময়, বা অফ পিরিয়ডে লোকানো পেন্সিল, ই-রেজার, পেন প্রভৃতি খুঁজে দিয়ে কল্পক ওর বন্ধুদের বার বার অবাক করে দিয়েছে। কল্পক মেধাবী ছাত্র না হলেও পড়াশোনাটা ও বরাবরই আন্তরিকতা ও দায়িত্বের সাথে করে। তাই প্রথম দশ জনের মধ্যে ওর নাম বরাবরই থেকে এসেছে। ওকে যে প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় হতেই হবে, এমন বাধ্যবাধকতা স্বর্নাশীষ বা বিদুষী কারোর তরফ থেকেই ছিল না। ছেলের এই পড়াশোনায়

তারা খুশি। স্কুল থেকে পড়াশোনার জন্য কোনও পুরষ্কার না পেলেও বাবা মার থেকে বরাবর নতুন ক্লাসে ওঠার জন্য নিজের মনের মত পুরস্কার পেয়ে এসেছে কল্পক। শুধু পড়াশোনার জন্যই নয়, ছোটখাটো যে কোনো সাফল্যের জন্যই কিছু না কিছু উপহার ও পেয়েছে নিয়মিত। স্বর্নাশীষ প্রায়শই অফিস যাওয়ার সময় মানিব্যাগ, হাতঘড়ি, রুমাল প্রভৃতি খুঁজে পায় না। যথারীতি সেসব খুঁজে দেবার ভার পড়ে কল্পকের ওপর। ও সেটা দায়িত্বের সাথে পালন করে বাবার থেকে ক্যাটবেরী, আইসক্রিম প্রভৃতি আদায় করতে ভোলে না। স্বর্নাশীষও স্বেচ্ছায় সেই আবদার মেনে নেয়। তবে বিনা কারণে ছেলে কে সে কিছুই দিতে রাজি নয়। তার কথায়, জীবনে সবকিছুই অর্জন করে নিতে হয়। ফ্রিতে কিছুই পাওয়া যায় না। 

এমনভাবেই চলতে থাকল। ওরা তিনজন নিজেদের বাঁধাধরা রুটিনে বাধা থাকল ব্যস্ততার সাথে। তবে ছুটির দিনগুলিতে তিনজন একত্রে কখনও কোথাও বেড়াতে গিয়ে, কখনও সিনেমা দেখে, কখনও বা বাইরে কোথাও খেতে গিয়ে ছুটি উপভোগ করত।
কল্পকের ঈশ্বর প্রদত্ত গুণটির জন্য ওদের যেমন কিছু সুবিধে হয়, তেমনই অনেক ঝক্কি ঝামেলাও পোহাতে হয়। পাড়া প্রতিবেশীর কিছু হারিয়ে গেলেই কল্পকের ডাক পড়ে। কল্পক তাদের পরিষ্কার জানিয়ে দেয় যে, যে জিনিস সে কখনও দেখেনি, সেটা তার পক্ষে খুঁজে দেওয়া সম্ভব নয়। 
তা বলে প্রতিবেশীর উপকারে কল্পক যে আসে না তা নয়। কল্পকের বয়স বছর দশ। ওদের অ্যাপার্টমেন্টের তিন পরিবার মিলে পৌষ মেলায় গিয়েছে। তিন পরিবার বলতে সপরিবারে স্বর্নাশীষ, বাবা মার সাথে অক্সিতা, আর বাবা মার সাথে পাঁচ বছরের আয়ুষ। আয়ুষ ছেলেটি বেশ চঞ্চল। ওকে পাশে দাঁড় করিয়ে, ওর মা কানের দুল কিনছিল। সেই সময়ে ও এক পা এক পা করে হাঁটতে হাঁটতে মেলার ভিড়ে এমন ভাবে হারিয়ে গেল যে ওকে আর খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছিল না। কল্পক তখন দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে মেলায় ঘুরে, মিনিট পাঁচেকের মধ্যে আয়ুষকে এনে ওর বাবা মার কাছে হাজির করল।  
যতই সেটা মানুষের উপকারে আসুক না কেন, দীর্ঘদিন ধরে শরীরের মধ্যে কোনও অস্বাভাবিক কিছু বয়ে বেড়ানো উচিৎ নয়। বিদুষীদের খুব তাড়াতাড়ি একজন ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিৎ। বিদুষীর একজন কাছের বন্ধু এমন উপদেশই দিল। উপদেশটা ফেলে দিতে পারল না বিদুষী। তবে ওরা যে ব্যাপারটা নিয়ে ডাক্তারের সাথে আলোচনা করেনি তা নয়। ওদের পারিবারিক ডাক্তার কল্পকের এই আচরণের মধ্যে ক্ষতির কিছু দেখেনি। আর উনি বলেছিলেন যে, কল্পকের বয়স বাড়ার সাথে সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু এখন বিদুষীরা দেখছে বয়স বাড়ার সাথে সাথে উপসর্গ আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। কল্পক এখন থেকে থেকেই জোরে জোরে নিঃশ্বাস নেয়। ইদানীং ওর নাকের অগ্রভাগ বেশ ঘামছে। কল্পকের এখন বয়স বারো বছর। এমন কিছু দেরী হয়তো এখনও হয়নি। বন্ধুর কথা মেনে স্থানীয় এক ডাক্তারের সাথে ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করলে উনি সব শুনে একজন নাক-কান-গলার বিশেষজ্ঞ ডাক্তারকে দেখাতে বললেন। কল্পককে একজন নামকরা নাক-কান-গলার বিশেষজ্ঞ ডাক্তারকে দেখানো হল। উনি নানা রকম পরীক্ষা নিরীক্ষা করে কল্পকের এইরকম আচরণের কারণ বিষদে ব্যাখ্যা করলেন।  প্রায় বারো বছর ধরে মনের মধ্যে জমে থাকা প্রশ্নের সঠিক উত্তর খুঁজে পেলো স্বর্নাশীষ ও বিদুষী।
কল্পকের যেকোনো জিনিস সহজে খুঁজে পাওয়ার কারণ হল ওর তীব্র ঘ্রাণ শক্তি। সাধারণ মানুষের মস্তিষ্কের তুলনায় প্রায় চল্লিশ গুণ বেশি অংশ কল্পকের মস্তিষ্কে ঘ্রাণ সংক্রান্ত কার্যাবলী নিয়ন্ত্রণে বরাদ্দ। মানুষের নাকে সাধারণত ষাট লক্ষ ঘ্রাণ রিসেপ্টর থাকে, কিন্তু এই ছেলের সেই সংখ্যাটা তিরিশ কোটির কাছাকাছি। তাছাড়া কল্পকের শ্বাস গ্রহণ আর ঘ্রাণ নেওয়ার পরি-কাঠামোটা আলাদা আলাদা ভাবে গঠিত। তাই ওর শ্বাস গ্রহণ, ঘ্রাণ গ্রহণ দুটোই অবিরাম চলতে থাকে। ক্রমাগত মিউকাস নিঃসরণের ফলে ওর নাকে ঘ্রাণ অণুগুলো আটকে থাকে, যা ওকে গন্ধ শুঁকে চিনতে সাহায্য করে।  
রাসায়নিক পরীক্ষা চালানোর জন্য স্বর্নাশীষ সম্প্রতি যে মডেলটি তৈরি করেছে সেটা সত্যি প্রশংসার দাবী রাখে। সেই সঙ্গে একটি নতুন কেমিক্যাল প্ল্যান্টের নকশাও প্রস্তুত করেছে ও। কিন্তু উচ্চমহলে প্রদর্শন করার দিন ওগুলোকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না। নিজের ড্রয়ারে তালা বন্দীই করে রেখেছিল স্বর্নাশীষ। প্রতিটি ড্রয়ারের ডুপ্লিকেট চাবি রয়েছে অফিস অ্যাডমিনদের কাছে। কোনোভাবে সেই চাবি জোগাড় করে সবার অলক্ষ্যে সেগুলো সরিয়েছে কেউ। কিন্তু সে কে?
এই নকশা ও মডেল উচ্চমহল দ্বারা স্বীকৃত হলে স্বর্নাশীষের পদোন্নতির একটি সম্ভাবনা রয়েছে। সহকর্মীদের মধ্যে অনেকেই সেটা চায় না। তাই তাদের মধ্যে কেউ অতি দক্ষতার সাথে  নকশা ও মডেল ড্রয়ার থেকে অদৃশ্য করে পুনরায় সেই ড্রয়ার তালাবন্দি করেছে। 
স্বর্নাশীষের মাথায় যেন বাজ পড়েছে। কিছুক্ষণ নিজের চেয়ারে বসে কি করবে ভাবতে লাগল। না, এই ঘটনা কাউকেই জানালো না ও। বিশেষ প্রয়োজনের কথা বলে ঘন্টা খানেকের ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে গেল ও। বাড়ি থেকে কল্পককে নিয়ে অফিসে চলে এলো স্বর্নাশীষ। আসার পথে ছেলেকে তার বাবা অফিসে নিয়ে আসার কারণ বিস্তারিতভাবে বলেছে। কল্পককে হঠাৎ অফিসে দেখে সহকর্মীরা বেশ অবাক। কারো কোনও প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে কল্পককে দিয়ে নিজের ড্রয়ারটিকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করালো স্বর্নাশীষ। প্রতিটি জিনিষেরই আলাদা আলাদা গন্ধ রয়েছে। জিনিসগুলো ড্রয়ারে না থাকলেও তার গন্ধ এখনও ড্রয়ারে লেগে রয়েছে। তবে সাধারণ মানুষের পক্ষে সেটা অনুধাবন সম্ভব নয়। সেই ঘ্রাণ ভালো করে অনুধাবন করে বাবার সাথে সারা অফিস ঘুরে বেরালো কল্পক। আর কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ ও খোঁজাখুঁজির পর স্টোর রুম থেকে স্বর্নাশীষের হারিয়ে যাওয়া জিনিস উদ্ধার করে কল্পক। 
স্টোররুমে সিসিটিভি ক্যামেরা রয়েছে। তা থেকে অপকর্মটি কে করেছে তা সহজেই জানা গেল। স্বর্নাশীষের দুটো সিট পড়ে বসা এক সহকর্মীর কাজ এটা। চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হল সেই লোকটিকে। 
স্বর্নাশীষের নকশা ও মডেল উচ্চমহলে বেশ প্রশংসিত হল। ফলস্বরূপ স্বর্নাশীষের জুটল পদোন্নতি। আর কল্পক? সে তার বাবার থেকে উপহার পেল একটি দামী ল্যাপটপ। সেই ল্যাপটপ নিয়ে ভীষণ খুশি সে। 
বাড়িতে ল্যাপটপ আসার খবর পেয়েই পাশের ফ্ল্যাটের অক্সিতা ছুটে এসেছে। দুজন মিলে অনেকক্ষণ ধরে চলল এই নতুন আনা ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রটির কার্যকারিতা নিয়ে নানা প্রকার পরীক্ষা নিরীক্ষা ও আলোচনা। একটা অন্যরকম খুশি মেখে রয়েছে দুজন। এটাই বোধহয় কল্পকের পাওয়া শ্রেষ্ঠ পুরষ্কার। 
এই ঈশ্বর প্রদত্ত গুণের সদ্ব্যবহার করে ভবিষ্যতেও এমনভাবে মানুষের উপকারে আসতে চায় কল্পক। তবে কিছু পাওয়ার আশায় নয়, মনের তাগিদে। সেখানেই হবে এই গুণ লাভের প্রকৃত সার্থকতা।

বরফ-মরুর দেশে

ভ্রমণ

পুজো বার্ষিকী ১৪২৮ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

বরফ-মরুর দেশে

অমিত বন্দ্যোপাধ্যায়

বরোদা, গুজরাট

Baraf1.JPG
Baraf2.JPG

Spiti is “a world within a world” …….. “a place where Gods live”
                                                                          Rudyard Kipling, Kim

আসতে পারব, এমন নিশ্চয়তা ছিল না একেবারে গোড়ার থেকেই। সুযোগটা এসেছিল একেবারে হঠাৎ। একটা geological field workshop আয়োজিত হবার কথা, Association of Petroleum Geologists, বা সংক্ষেপে, APG-র তরফ থেকে, জুলাই ১১ থেকে ১৬, হিমাচল প্রদেশের স্পিতি উপত্যকায়। সময়টা ২০০৪ সাল, কর্মসূত্রে ভারতদর্শনে তখন আমার অবস্থান অন্ধ্রপ্রদেশের রাজামুন্দ্রী শহরে। এখান থেকে আমি ও শ্রীহরি রাও মনোনীত হয়েছি। যাবার রাস্তা মানালী থেকে রোহতং পাস ও কুনজুম পাস হয়ে, আরো ৪-৫ ঘণ্টার পথ পেরিয়ে, প্রায় তিব্বতের প্রান্তসীমায়। এদিকে খবরে শুনছি, উত্তর ভারতে ভারী বর্ষা – হিমাচলে বন্যা – বিপাশা নদীতে জলস্ফীতি, ইত্যাদি। বুঝতে পারছিলাম না, আদৌ দিল্লী থেকে এগোতে পারব কিনা আগে। তখন দিল্লী থেকে একটা ছোট dornier বিমান চলত, সিমলা ছুঁয়ে কুলু অবধি – আবহাওয়া ঠিক না থাকলে বা পর্যাপ্ত যাত্রী না পেলে মাঝেমধ্যেই সেটা বাতিলও হয়ে যেত! এই বর্ষায় পাহাড়ি পথ যতটা সম্ভব এড়ানোর চেষ্টাতে সেই ছোট্ট বিমানেই কুলুর পথে রওনা দিলাম। সমতল পেরিয়ে পাহাড়ের কাছে আসতেই ঢুকে পড়লাম মেঘের রাজ্যে – উপরে, নীচে, চারপাশে শুধুই সাদা/ধূসর তুলোর মত মেঘ। মাঝেমধ্যে মেঘের জানালা দিয়ে চকিতের মতো দেখা দিয়েই মিলিয়ে যাচ্ছে কিছু পাহাড়ী ঘরবাড়ি/জলধারা/খেত ইত্যাদি। একসময়ে মেঘের ফাঁকে সাদার ঝলক দেখে বুঝলাম, এসে পড়েছি বরফের কাছাকাছি – ইন্দ্রাসন শৃঙ্গটি দেখেই চিনলাম, এবং আরো কয়েকটি শৃঙ্গ – যা বোধহয় মানালীর পশ্চিমে/দক্ষিণে আমরা দেখতে পাই। নতুন আশায় মন চনমনিয়ে উঠল – হিমালয় তাহলে দর্শন দিচ্ছেন – আমাদের আগামীর পথে স্বাগত জানাচ্ছেন! কেউ কেউ বলেন, দেবতাত্মা নিজে না চাইলে, মানুষ হাজার চেষ্টাতেও তার দর্শন পায় না। কুলু ও মানালীর মাঝামাঝি Bhuntarএ বিপাশা নদীর ধারে ছোট্ট এয়ারপোর্ট। নদীর একটা বাঁকের মুখ থেকেই রানওয়ে শুরু হয়েছে, তাই প্লেন নামার সময়ে নদীর জল প্রায় ছুঁয়ে ফেলতে ফেলতে হঠাৎ রানওয়েতে ঢুকে পড়ে। এখানে এসে খবর পেলাম, কুলু থেকে মানালী যাবার সোজা রাস্তাটি এখনো পুরোপুরি বাহনযোগ্য হয়ে ওঠেনি। চলতে হবে একটু ঘুরপথে – বিপাশার পূর্বধার দিয়ে, যে রাস্তা গেছে Naggar ও পাথরিকুল হয়ে। এ পথে পড়ে Roerich Estate – অতীতের বিখ্যাত সিনেমা শিল্পী দেবিকারানী ও তাঁর স্বামী, চিত্রশিল্পী Nikolai Roerich দের ব্যক্তিগত বাসগৃহ, যা এখন সংগ্রহালয় – দেখে নেওয়া হল সেটাও। 
পথের অনিশ্চয়তার কারণে মানালী এসে পড়েছি একদিন আগে, আজ ৯ জুলাই, শনিবার। অথচ APG নির্ধারিত হোটেলে আমাদের বুকিং রবিবার থেকে। কাজেই একদিনের মতো আশ্রয় নেওয়া গেল বিপাশা নদীর ঠিক পাশে সরকারী লজে। মনে পড়ল, যখন প্রথম মানালী আসি, ১৯৭৮ সালে, তখন এই বাড়িটি সবে তৈরি হচ্ছিল। সেই সময়ের মানালী ছিল একটা ছোট্ট ঘুমন্ত গ্রাম, চারধারে শুধু পাইন আর চীর এর শোভা – তার একমাত্র পর্যটকনিবাস ছিল এর ঠিক পাশের বাড়ীটি, এখন তার জীর্ণদশা - ব্যবহৃত হয় সরকারী ডরমিটরি হিসাবে। কিন্তু সেদিনের বিপাশা নদী তার স্বচ্ছ জলের অবিশ্রান্ত গর্জনের মাধুর্য হারিয়ে আজ বয়ে নিয়ে চলেছে শুধুই শহরের শ’খানেক হোটেলের বর্জ্য আর পঙ্ক! 
অসময়ের মানালী, রাস্তাঘাট ফাঁকা, যদিও দোকানীরা পসরা সাজিয়ে বসেছে অনেকেই। ভুটিয়া বাজারে এক বৃদ্ধ দোকানীর কাছে sleeping bag কিনেছিলাম বছর দুই আগে। সেই বৃদ্ধ এখনো রয়েছেন, এবং আশ্চর্য, সেই একই দামে সেই ব্যাগ বিক্রি করছেন! পরদিন সকালে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম হিড়িম্বা দেবীর মন্দিরে – আকাশছোঁয়া পাইনগাছের ঘন প্রহরার মাঝ দিয়ে রাস্তা – পর্যটকের অভাবে সে জায়গাও স্বভাবতঃই ফাঁকা। সংলগ্ন চত্বরে অন্যসময়ে মেলা বসে যায়। ফেরার বেলা পথসংক্ষেপ করার লোভে রাস্তা হারিয়ে ফেললাম আপেলবাগানের মধ্যে – অনেকটা উল্টো হাঁটতে হল। দুপুরের দিকে গিয়ে উঠলাম আমাদের নির্ধারিত হোটেলে – ম্যাল সংলগ্ন জনঅরণ্য থেকে অনেকটাই ওপরে উঠে এসে, বেশ অভিজাত হোটেলপাড়ায় – হোটেল Snowcrest Manor – মানালির হোটেলগুলির মধ্যে নাকি এটাই সবচেয়ে উঁচুতে! পাহাড়ের ঢালের ওপর হোটেল, চারপাশে ঘিরে রয়েছে আপেলবাগান, নেমে গেছে অনেক নীচে অবধি। বড় বড় পাতিলেবুর মাপের কচি কচি আপেলে সব গাছ ভর্তি। সামনে থেকে দেখা যায় গোটা মানালী শহরের বিস্তার, নীচে বিপাশা নদী, পেরিয়ে ওপারের পাহাড়, তার গা বেয়ে আমাদের আগামীর চলার পথ – রোহতং পাসের অভিমুখে।
একে একে আমাদের অন্য participants দের সঙ্গে দেখা হল। কেউ কেউ দীর্ঘদিনের চেনা, আবার পরিচয় হল অনেক নতুনজনের সঙ্গেও। বেশীরভাগ ONGC থেকেই, তবে কয়েকজন geologist অন্য কোম্পানী থেকেও এসেছে। আমাদের আগামী কয়েকদিনের পথের দিশারী হিসাবে এসেছেন Geological Survey of India বা GSI থেকে অবসরপ্রাপ্ত ডিরেক্টর, প্রবীণ ডঃ ভার্গব, যিনি এই অঞ্চলে কাজ করে চলেছেন বিগত প্রায় দুই দশক ধরে। স্পিতির geology বিষয়ে ডঃ ভার্গবকে একজন বিশেষজ্ঞ মনে করা হয়। জায়গাটাকে চেনেন নিজের হাতের তালুর মতোই – যা আমরা পরের কয়েকদিনে প্রতিপদে টের পেয়েছি। আরও এসেছেন অধ্যাপক দিলীপ মুখোপাধ্যায়, IIT, Roorkee থেকে, যদিও শারীরিক কারণে তিনি আমাদের যাত্রাসঙ্গী হতে পারলেন না। এঁরা দুজনে জানালেন যেখানে যেতে হবে, সেই স্পিতি উপত্যকা ও সংলগ্ন পীন উপত্যকার বিষয়ে বিভিন্ন জ্ঞাতব্য বিষয়। জানালেন যাত্রাপথের নানান সাবধানতার কথা। আমাদের পথে পড়বে ১৩,০৫০ ফুট উচ্চতায় রোহতং পাস, এবং ১৪,৯৩০ ফুটে কুনজুম পাস – এইসব জায়গায় altitude sickness খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার, তাই যথাবিহিত সাবধানতা অবলম্বন করা, কিছু কিছু শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা মেনে চলা খুবই জরুরী। তাছাড়া, দলের বেশীরভাগেরই জীবনে এই  প্রথম এতটা উচ্চতায় আসা। আমাদের মোট ২৬ জনের দলটি বিন্যস্ত থাকবে ৮টি গাড়ীতে। প্রত্যেক গাড়ীতেই থাকবে অক্সিজেনের বোতল, জল, ইত্যাদি। ভোর ছটার মধ্যে রওনা দিতে হবে, গন্তব্য Kaza পৌঁছতে বিকেল/সন্ধ্যে হয়ে যাবে। মানালী থেকে Kaza র দূরত্ব যদিও মাত্র ২০৫ কিমি – সমতলে ভালো রাস্তায় ওই দূরত্ব হয়তো ঘণ্টা তিনেকেই পৌঁছান যায়, কিন্তু এক্ষেত্রে পথের দুর্গমতার কারণে ৯-১০ ঘণ্টাও লেগে যেতে পারে। থাকতে হবে Kaza তে, ১৪,৫০০ ফুট উচ্চতায়, স্পিতি নদীর ওপর, তাঁবুতে। আমাদের প্রত্যেকের গাড়ীর নম্বর ও তাঁবুর নম্বর জানিয়ে দেওয়া হল। আমার গাড়ীর সঙ্গী মুম্বই থেকে আসা রোহিত কোটেচা, কুলকর্নি আর শ্রীহরি রাও। তাঁবুর সঙ্গী থাকবে চেন্নাই থেকে আসা গোপীনাথ ও অরিজিতদা।

সকাল থেকেই মেঘলা আকাশ, মাঝেমধ্যে কুয়াশা, তারই মধ্যে রওনা দিলাম। মানালী ছাড়িয়ে, বিপাশা নদীর পূর্বধারে পাহাড়ের গা বেয়ে রাস্তা ওপরে উঠতে লাগল। দুপাশের প্রহরী পাইন-বার্চ ও আপেল বাগানের সীমানা ছাড়িয়ে গাছপালাও ক্রমশঃ পাতলা হতে লাগল। দূরে দূরে এক-আধটা গ্রাম। দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম মারহি – এখানে একটু থামা, প্রাতঃরাশ সাঙ্গ করে, ফের চলা শুরু। যত ওপরে উঠছি, হাওয়ার দাপট ক্রমশঃ বাড়ছে। কোথাও কোথাও অনেক ওপর থেকে ঝর্ণা এসে ঝাঁপিয়ে পড়ছে পথের পাশে, কখনো পথের ওপরেই – তার দুধ-সাদা ফেনার ওপর সূর্যের আলো এসে যেন শত-শত রামধনু তৈরী করছে! মাঝেমধ্যে দূর পাহাড়ের উঁচুতে মেঘ-বরফের লুকোচুরি দেখা দিতে লাগল। শ্রীহরি অত্যুৎসাহে ছবি তুলে চলেছে। কোটেচা তার সপরিবারে রোহতং ভ্রমণের গল্প শোনাচ্ছে। এ রাস্তা বছরের বেশীরভাগ সময়েই বরফে বন্ধ থাকে, কেবল জুন থেকে অক্টোবর যাতায়াত সম্ভব হয়। একসময়ে পথের পাশেই ধূলিমলিন বরফের দেখা পাওয়া গেল – ধূলোয় প্রায় লাল হয়ে গেছে, কাছে গিয়ে একটু খুঁড়লে, ভেতরের সাদা ঝকমকিয়ে উঠছে। হঠাৎ দেখি, রাস্তার দুপাশে প্রায় মানুষ-সমান উঁচু বরফের পাঁচিল, তার মাঝ দিয়ে রাস্তা। রোহতং পাস আর বেশী দূরে নেই। বরফ দেখার উত্তেজনায় high altitude সংক্রান্ত সব সতর্কীকরণ ভুলে গিয়ে সকলেই নেমে গিয়ে বরফের ওপর অল্পবিস্তর দৌড়ঝাঁপ করে নিলাম। রোহতং পাসকে বলা হয়, বৈচিত্র্যময় লাহু-স্পিতি উপত্যকার প্রবেশদ্বার। বিপাশা নদীর উৎপত্তিও এর কাছাকাছি, Beas Kund থেকে। উপকথায় আছে, একসময়ে লাহুলের মানুষজন পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে কুলু যাবার পথ না পেয়ে মহাদেবের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। তখন নাকি মহাদেব পাহাড়ের মধ্যে পদাঘাত করে পথ সৃষ্টি করে দিলেন, তৈরী হল রোহতং গিরিবর্ত্ম! এতক্ষণ গিরিখাদের পাশ দিয়ে আসতে আসতে হঠাৎ যেন একটা প্রায় সমতলভুমিতে এসে পড়লাম। চারিদিকে শুধু বরফ, মাঝে ছোট্ট মন্দির নাগদেবতার – সেটা প্রদক্ষিণ করে, তবে সব গাড়ীর আগে চলা। মরশুমে এখানে প্রচুর দোকানপাট বসে, তার চিহ্ন চারিদিকে ছড়ানো। থাকে স্কি করা, ঘোড়া বা ইয়াকের পিঠে চড়ার ব্যবস্থাও। আকাশ এখনো বেশ মেঘলা, যদিও ডঃ ভার্গব আশ্বাসবাণী শুনিয়ে চলেছেন যে স্পিতিতে ঢুকলেই একদম পরিষ্কার আকাশ পাওয়া যাবে।

Baraf3.JPG

রোহতং পেরিয়ে, পথ খানিকটা নীচের দিকে গেছে – ছোট্ট গ্রাম, গ্রামফু। এখান থেকে পথটা দুভাগ হয়ে গেছে – পশ্চিমে লাহু-স্পিতি জেলার সদর শহর কেলং হয়ে চলে গেছে কাশ্মীরের লে অবধি। একদা এটি ছিল পৃথিবীর দ্বিতীয় উচ্চতম motorable রাস্তা। আর আমরা যাব পূর্বদিকে, চন্দ্র নদীর ধার দিয়ে। পথ অত্যন্ত খারাপ – মাঝেমধ্যে পুরো রাস্তাই ধুয়ে গেছে পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝর্ণার জলে। খুব সাবধানে পার করতে হচ্ছিল গাড়িগুলোকে। এইরকম একটা জায়গায় আটকে গেল একটা গাড়ি – টাটা সুমোগুলো কোনক্রমে চলে এলেও, সবুজ কোয়ালিস গাড়িটা কিছুতেই নড়তে পারছিল না। একটা বড় বাসও আটকে পড়েছিল, অনেক স্থানীয় মানুষের সাহায্য পাওয়া গেল – কোনমতে উদ্ধার হোল সে যাত্রা। 
কোটেচা অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে ছিল, এবার একবার গাড়ী থামিয়ে হঠাৎ বমি করে বসল। আমাদের যাত্রায় altitude sickness এর প্রথম শিকার। পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে জানি, এই altitude sickness আটকাতে রসুন ভীষণ কাজে দেয়। আমি কাঁচা রসুন সঙ্গেই এনেছিলাম, মানালী থেকেই অন্যদেরও দিয়েছিলাম। কিন্তু শুদ্ধ নিরামিষাশী, পুরোদস্তুর গুজরাটি কোটেচাকে কিছুতেই দেওয়া যায়নি। দেখলাম, ও লাঞ্চপ্যাকটাও খোলেনি। ও খানিকটা সুস্থ হলে, আবার রওনা দিলাম – যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি চলতে থাকল গাড়ী। কুনজুম পাসের কাছাকাছি পৌঁছতে, মনে হল চারপাশের বরফাবৃত পাহাড়গুলো যেন একদম হাতের কাছে চলে এল। পাশেই দেখা গেল পৃথিবীর দ্বিতীয় দীর্ঘতম হিমবাহ – Bara Shigri glacier। কুনজুম পাসের উচ্চতা ৪৫৫১ মি, বা ১৪,৯৩০ ফুট। একদম ওপরে এখানেও একটা ছোট্ট মন্দির – বোধহয় দুর্গার, এবং চারপাশে প্রচুর পতাকা টাঙানো রয়েছে। কুনজুম পাসের পূর্বদিক থেকেই উৎপত্তি স্পিতি নদীর – সোজা পূর্বমুখী গিয়ে Khab নামক এক জায়গায় গিয়ে পড়েছে শত নদীতে – শত তিব্বত থেকে ভারতে প্রবেশ করার ঠিক পরেই। এই স্পিতি নদীর অববাহিকা ধরেই আমাদের আগামী কয়েকদিনের পরিক্রমা – আমাদের এখানে আসার মূল উদ্দেশ্য। স্পিতি উপত্যকাকে বলা হয় museum of Indian Geology – হিমালয় পর্বতের উৎপত্তির বিভিন্ন পর্যায়গুলি এখানের ভূতাত্ত্বিক গঠনে যেমন সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে, তেমনটা আর কোথাও নেই। সেজন্যই APG এই অঞ্চলটাকে বেছে নিয়ে আমাদের ডেকে এনেছে কর্মজীবনের প্রাত্যহিকতার একঘেয়েমি থেকে – একটু তাজা অক্সিজেনের সন্ধানে!
কুনজুম পাস থেকে কিছুটা এগিয়ে আরেকটি ছোট্ট জনপদ, লোসার। স্পিতি/কিন্নরগামী সব বিদেশী পর্যটকদের এখানে নাম নথিভুক্ত করাতে হয়। আমাদের গাড়ীগুলোরও কিছু কাগজপত্রের কাজ রয়েছে, আমরা সেই ফাঁকে চা-পর্ব সেরে ফেললাম একটা ছোট দোকানে। ডঃ ভার্গব কাছেই একটা পাথরের মধ্যে কিছু ফসিলের নমুনা দেখালেন। মাঝেও কয়েকবার থেমে কিছু কিছু ভূতাত্ত্বিক গঠন দেখিয়েছেন। ওঁর মতে, স্পিতির বিশাল ভূতাত্ত্বিক বৈচিত্র্যকে ভালোভাবে দেখতে/জানতে হলে, অন্ততঃ বছর দেড়েক সময় দেওয়া দরকার। অথচ আমাদের হাতে সময় মাত্র চার-পাঁচ দিন! কাজেই, কয়েকটি খুব গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল বা type area কোনমতে দেখা যেতে পারে।
কিন্তু ওদিকে কোটেচা এখন আরো অসুস্থ হয়ে পড়েছে – কাজেই ঠিক হোল, আমাদের গাড়ীটা আর কোথাও না থেমে যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব Kaza পৌঁছবে – সেখানে সরকারী হাসপাতাল আছে। এখন রাস্তা অনেকটাই সমতল, কারণ আমরা তিব্বত মালভূমির এক প্রান্তদেশে ঢুকে পড়েছি। একপাশ দিয়ে নদী বয়ে চলেছে, আর ছোট ছোট ঘাস ও প্রচুর নুড়িপাথরের মধ্যে দিয়ে সাপের মত এঁকে-বেঁকে চলে গেছে পিচ-বাঁধানো রাস্তা। ঘণ্টা দুয়েক পরে যখন Kaza পৌঁছলাম, তখন সবে অন্ধকার নামছে। ডাক্তার দেখে সঙ্গে সঙ্গে অক্সিজেন ও স্যালাইনের ব্যবস্থা করলেন, জানালেন severe dehydration হয়ে গেছে, রাতটা observationএ থাকা ভাল। তারপর আমাদেরও পরীক্ষা করলেন – রক্তচাপ প্রত্যেকেরই বেড়ে গেছে, এত উচ্চতায় এটাই স্বাভাবিক। কোটেচাকে ওখানে রেখে, রাতে ড্রাইভারের ওখানে থাকার ব্যবস্থা করে, ফিরলাম আমাদের তাঁবুতে। 
এখানে স্পিতি নদী অনেকটা চওড়া হয়ে গেছে, নদীর বুকে বিশাল বিশাল চড়া পড়েছে। সেইরকমই একটা চড়ায় আমাদের তাঁবুগুলো সাজানো হয়েছে। মাঝে একটা বড় রান্না/খাবার তাঁবু, তার চারপাশে আমাদের থাকার তাঁবুগুলো। একেকটাতে তিনজন করে থাকার ব্যবস্থা। আরেকপাশে টয়লেট ও স্নানের আলাদা কয়েকটা তাঁবু। সব জিনিসপত্র একদিন আগে বড় ট্রাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। জেনারেটর চালিয়ে হয়েছে আলোর ব্যবস্থা, আবার ছোট পাম্প চালিয়ে নদীর জল তুলে ট্রাকের ড্রাইভার কেবিনের মাথায় রাখা জলের ট্যাঙ্কে ওঠানো হচ্ছে। হাত ধোওয়ার জন্য দুটো washbasin রাখা, আছে জল গরমের ব্যবস্থাও, অভিনব কাঠের আগুনের geyser এ। থাকার তাঁবুতে তিনজনের খাট-বিছানা ছাড়াও, একটা ছোট টেবিল ও চেয়ার রাখা – নাঃ, এই দুর্গম অঞ্চলে এত সুন্দর ব্যবস্থাপনার জন্য APG-র যতই প্রশংসা করা যায়, কম হয়!
লাহু-স্পিতি জেলার স্পিতি মহকুমার সদর শহর এই Kaza – ৩৬০০ মি উচ্চতায়, এখানেই রয়েছে পৃথিবীর উচ্চতম অবস্থানের পেট্রোল পাম্পটি। এখানের আরো একটি বিশেষত্ব – এত উচ্চতায় এটাই সম্ভবতঃ হিমালয়ের একমাত্র জায়গা যেখানে সারাবছর যাতায়াত করা যায়! আমরা যে পথে এলাম, সেটা ছাড়াও এখানে পৌঁছানোর আরো একটি রাস্তা আছে, সিমলা থেকে কিন্নর উপত্যকা হয়ে – সেপথে যেহেতু খুব উঁচু কোনো পাস ইত্যাদি নেই, সেটি প্রায় সারাবছরই খোলা থাকে। কিন্তু দূরত্ব এপথের দ্বিগুণেরও বেশী। এখান থেকে বেশ কয়েকটি ট্রেকিং রুট শুরু হয়েছে। কিছু হোটেল, সরকারী Rest House ইত্যাদিও রয়েছে। বেশ কয়েকজন বিদেশী/বিদেশিনীকে দেখলাম, ট্রেকিং করতে এসেছে। 
এই workshop এর আগে এবং পরেও, হিমালয়ের অনেক জায়গায় আমার ঘোরার সৌভাগ্য হয়েছে, কিন্তু এই অঞ্চলের চেহারা যেন একেবারেই অন্যরকম। চারদিকে শুধু ধূসর-বাদামী নেড়া পাহাড়, তাতে পাথরের চেয়ে মাটির প্রলেপই বেশী, কদাচিৎ অল্প কিছু গাছপালা দেখা দিচ্ছে মরুভূমির রুক্ষ সৌন্দর্য নিয়ে। শীতে তাপমাত্রা নেমে যায় শূন্যের বেশ কয়েকধাপ নীচে। এমনকি এখনো, সূর্যাস্তের পরেই বেশ ঠাণ্ডা থাকে। স্থানীয় মানুষজন খুব সহজ-সরল, সদা হাসিমুখ ও উপকারী। বৌদ্ধ ও হিন্দু উভয় সম্প্রদায়ই আছেন। বৌদ্ধ গুম্ফাগুলি দেখলে বোঝা যায়, বৌদ্ধধর্মের একটি অন্যতম প্রাচীন ধারা এ অঞ্চলে সযত্নে সংরক্ষিত। 
পরের তিন-চারটে দিন যেন স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে কেটে গেল – সকালে উঠে তৈরী হয়ে, গরম ব্রেকফাস্ট সেরে রওনা দেওয়া, মাঝে ডঃ ভার্গব নির্দেশিত জায়গায় থামা, সেখানের study, আবার চলা। কোথাও চড়তে হচ্ছে পাহাড়ের ধাপ বেয়ে বেশ কিছুটা ওপরে।  অনেক রকমের আগে-না-দেখা ফসিল দেখলাম, বেশ কিছু geological features যা পাঠ্যবইতেই পড়া ছিল, দেখতে পেলাম চাক্ষুষ – যেন হিমালয়ের বিশাল ক্যানভাসে কোনো শিল্পীর সযত্নে আঁকা ছবি। কিছু বিশেষ প্রজাতির ফসিল – দেখিনি কখনো আগে – ডঃ ভার্গব খুঁজে খুঁজে দেখালেন। রাস্তা করার জন্য কোথাও কোথাও পাথর ভাঙা হয়েছে – সেখানে fresh exposure পেয়ে গেলাম অনেকেই ব্যস্ত হয়ে পড়লাম ফসিল কুড়োতে। মাঝেমধ্যে বেশ খানিকটা হাঁটতে হচ্ছিল, কোনো একটা বিশেষ feature খুঁজে পাওয়ার জন্য। একজায়গায় তো একটা বড় অঘটন থেকে অল্পের জন্য বেঁচে গেলাম। গাড়ী ছেড়ে আমরা একটা নড়বড়ে সাঁকোতে স্পিতি নদী পেরিয়ে অন্যপাশের পাহাড়ে চড়ছিলাম – খুব খাঁড়া, প্রায় vertical পাহাড়, একটু উঠেই কিছুক্ষণ থামতে হচ্ছিল। অথচ বর্ষীয়ান ডঃ ভার্গব দিব্যি উঠে যাচ্ছেন, প্রায় সবার আগে! শ্রীহরি একটু পিছিয়ে পড়েছিল ছবি তোলার জন্য। হঠাৎ দেখি ও নীচে থেকে চিৎকার করছে – আমাদের এক সঙ্গী এ কে সিং এর শ্বাস আটকে দুচোখ ঠেলে বেরিয়ে এসেছে – অক্সিজেন দিলেও নিতে পারছে না! শেষে অনেক চেষ্টায় একবার শ্বাস নিতে পারল, আমরাও যেন প্রাণ হাতে ফিরে পেলাম! ওকে আরো একটা অক্সিজেন বোতল দেওয়া হল, ক্রমশঃ খানিকটা সুস্থ হয়ে উঠল। ওর সঙ্গে আরো দুয়েকজনকে নীচে রেখে, আমরা ওপরে যথাবিহিত study সেরে, এবার নামার সময়ে দেখি আরেক বিপত্তি – এত খাড়াই জায়গা থেকে নামার পথ পাই না! অনেক চেষ্টায় কোনোভাবে নামা গেল, কিন্তু ওদিকে আখতারদা রয়ে গেছে ওপরে – সাহস পাচ্ছেনা নামতে। আরো সমস্যা, জায়গাটাতে পাথর কম, বালি আর নুড়িই বেশি, আর অল্প কিছু ছোট ঘাস। অনেক মানসিক দাওয়াই প্রয়োগ করে, অবশেষে নামানো গেল!
সেইদিনই দুপুরের পর আমরা গেছিলাম এ অঞ্চলের প্রাচীনতম বৌদ্ধ গুম্ফা, Tabo Monastery তে। হাজার বছরের পুরনো, এর আদি স্থাপনা নাকি ৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে! পরে বিভিন্ন সময়ে আবার সংস্কার হয়েছে। ৩০৫০ মি উচ্চতায়, এটি বিশ্বের দ্বিতীয় প্রাচীনতম বৌদ্ধ গুম্ফা। আদি গুম্ফাটি বিরাট চওড়া মাটির দেওয়ালে ঘেরা ছোট মত ঘর, ঢুকতে হয় প্রায়ান্ধকার সুড়ঙ্গের মত একচিলতে জায়গা দিয়ে। ভেতরের দেওয়ালগুলো জুড়ে আছে অনেক চিত্রকলা, কোথাও এক ইঞ্চি জায়গা খালি নেই। রয়েছে নানান মূর্তি – বুদ্ধ, ও সেইসঙ্গে আরো অনেক দেবদেবী। এবং আশ্চর্য, সমস্ত মূর্তি আর paintings এর মৌলিক রং নাকি এখনো অবিকৃত রয়েছে! UNESCO থেকে World Heritage Site এর মর্যাদা দেওয়া হয়েছে এই “Ajanta of the Himalayas” কে! একপাশে রয়েছে প্রাচীন পুঁথি ও পাণ্ডুলিপির এক সংগ্রহশালা। জনশ্রুতি, বার্ধক্যে নাকি এখানেই অবসরযাপনের পরিকল্পনা দালাই লামার!
আরেকদিন field work শেষে পৌঁছে গেলাম Kibber নামের ছোট্ট একটা গ্রামে। ৪২০০ মি উচ্চতায় এটিই নাকি পৃথিবীর উচ্চতম motorable গ্রাম। রয়েছে বিজলিবাতিও। কিন্তু আমরা ওখানে পৌঁছতেই শুরু হয়ে গেল গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। ফলে বেশীক্ষণ থাকা গেল না। এখানেই আরেকটা মজার জিনিস দেখেছিলাম – এক পাহাড় থেকে দূরের অন্য এক পাহাড়ের গ্রামে জিনিসপত্র আদান-প্রদানের ropeway! ফেরার সময়ে দেখে নিলাম Kye Monastery – বিশ্বের নয়নাভিরাম গুম্ফাগুলির মধ্যে অন্যতম। স্পিতি উপত্যকার বৃহত্তম এটি, একটা ন্যাড়া পাহাড়ের ঢালে বিস্তীর্ণ জায়গা জুড়ে বানানো। এখান থেকে পুরো উপত্যকা সুন্দরভাবে দৃশ্যমান। মূল গুম্ফার চূড়ায় ত্রিশূল দেখে বোঝা যায়, তিব্বতী বৌদ্ধরা শিবেরও উপাসক। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল, সাম্প্রতিক এক লেখকের শিব-সংক্রান্ত বিখ্যাত কল্পকাহিনীতে তিব্বতেরই কোনো এক অঞ্চলকে শিবের উৎপত্তিস্থল দেখানো হয়েছে! (Ref: Amish Tripathi, The Shiva trilogy)।
আজ এখানের শেষ রাত। সন্ধ্যায় campfire হোল, অনেকের বিবিধ সুপ্ত প্রতিভা বেরিয়ে এলো। এমনকি, বর্ষীয়ান ডঃ ভার্গব ও ডঃ শ্রীনিবাসনও নেচে নিলেন খানিকটা।! এবার যে যার ঘরে ফেরার পালা। অনেক কিছু পাওয়া ও আরো অনেক অপূর্ণতা নিয়েই পরদিন নেমে এলাম মানালী, সেই একই হোটেলে। রাতে valedictory function এ সবাই নিজস্ব মতামত জানালেন এই workshop নিয়ে, তবে একটা ব্যাপারে দেখা গেল সকলেই একমত – এরকম উদ্যোগ আরো বেশি, আরো ঘন ঘন হওয়া উচিৎ। কয়েকদিনের মিলনমেলা সাঙ্গ হল, বিসর্জনের বাজনা কানে নিয়ে, হিমালয়কে আরেকবার বিদায় জানিয়ে, সবাই যে যার রোজনামচার গন্তব্যে ফেরত চললাম।

কবিতাঃ মধুসূদন গোস্বামী

কবিতা

মধুসূদন গোস্বামী

বেঙ্গালুরু

প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা ​

পুজো বার্ষিকী ১৪২৮ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

কান্না বারণ এখানে

কান্না বারণ এখানে -

সবাই যে জেনে যাবে আমি মৃত।

কেউ দাঁড়াবেনা তোমাদের পাশে-

আমি এখন এক অস্পৃশ্য ক্ষত।

অথচ এই তো সেদিন –

কান্নার সোরগোলে, মৃত্যুর হা্তছানি।

ঝাঁকে ঝাঁকে প্রতিবেশীকুল –

চোখে জল, হাহুতাস, সান্ত্বনার বাণী।

হিমঘরে দুদিনের বন্দীদশা –

সজ্ঞানে হয়েছে মনে, বেঁচে আছি ক্ষীণ ।

শ্বাস কষ্ট তবু মাঝে মাঝে –

নিঃশ্বেসিত বায়ুমন্ডল – শ্বাসবায়ু হীন।

 

বিশাল ধরার মাঝে –

অফুরন্ত প্রাণবায়ু, অপার ভান্ডার।

তবুও পা্রোনি দিতে বুক ভরা শ্বাস –

মানুষ না ভগবান- দোষ তবে কার?

মন চায় আরো কিছুক্ষণ –

অবশিষ্ট প্রাণবায়ু বিদায়ের বেলা,

উত্তরীয়ে ঢাকা হল আপাদমস্তক –

শেষ বুঝি তোমাদের কারিগরী খেলা?

কান্না বারণ এখানে –

আসবেনা কেউ ফুলের তোড়া হাতে,

চন্দনের টিপ দেবেনা কেউ।

আতর শিশি কেউ এনেছ সাথে?

ভয় ছিল সবাকার মনে –

আমার শেষ নিঃশ্বাস যদি বয়ে আনে,

শক্তিধর ভাইরাস যদি করে ভর-

তোমাদের সবাকার প্রাণে?

 

মৃত্যুহীন প্রাণ –

কে কোথায় দেখেছে কোনোদিন?

মরণের পরে তবু সহানুভূতি ছিল,

আজ শুধু ঘৃণা বহি দেহ হল লীন।

women.jpg
কবিতাঃ সৌভিক সিকদার

কবিতা

সৌভিক সিকদার

পুজো বার্ষিকী ১৪২৮ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

নারী

মি মানি না কাঁটাতার
আমার সারা শরীরজুড়ে শুধুই স্বাধীনতার বিশাল পাহাড়।
রক্ত চক্ষু শয়তানের কারাগার ছেড়ে আজ আমি পলাতক..
ঈশ্বর তো আমার সাথেই,ভয় কি আমার হয়! 
বিপ্লবের রক্তমাখা রাত হোক, বা হোক রোমান যুদ্ধ আমি আবার হেরেও জিতবো চিরণ যখন আমার সঙ্গী।
মরে গিয়েও আমি আবার পুনরায় জীবিত হব।
ভেঙে দেবো সমাজে সব স্বার্থগণ্ডি।
পর্দা আমার চোখে নয় পুরুষ!তোমার চোখেই কামের কু-দৃষ্টি।
আমাকে শোষণ করেছো তুমি, বন্দী করেছো টারটারাস কারাগারে।
তাও আমি মুক্ত হবো পুরুষ!
দেবো মিথ্যা বিশ্বাস এর কাগজ সব জ্বালিয়ে।
আমি শকুন্তলা নই, না আমি সীতা আমি অনন্ত আগুনের সেই না বোঝা প্রদীপের জ্বলন্ত শিখা।                      

আজ আমায় পারবে না অন্ধকারে দমিয়ে দিতে না পারবে দিতে বনবাস 
আমি সেই মানুষ যে এক পুরুষ কেই রাখি গর্ভে ন’মাস।
আমি মানি না মিথ্যা আইন ঈশ্বর এর নকল বুলি,
ইন্দ্রও তো কামুক হয়ে যা।                                          

যখন আমি নিজের বস্ত্র খুলি।          

আমায় পারবে না চুপ করিয়ে রাখতে,              

না পারবে পাথর মেরে করতে হত্যা                          

আমি আবার পুনরায় জীবিত হবো পুরুষ,            

করে দেবো তোমাদের ঈশ্বর বিশ্বাস মিথ্যা।        

আমি সীতা নই আমি খাদিজা নই না আমি মেরী                                                          
আমি হলাম স্বাধীন আত্মা আমি হলাম নারী।

womenday.jpeg

গল্প 

শেষ প্রতিশোধ

পুজো বার্ষিকী ১৪২৮ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

শেষ প্রতিশোধ

পার্থ বোস

ব্যাঙ্গালর

talking1.jpeg

প্রদীপ্ত জেনেশুনেই পোস্টিংটা দিল্লীতে নিয়েছে। একটি বেসরকারি ব্যাঙ্কে চাকরী পেয়েছে সে। মনামি দিল্লী চলে যাবার পড় থেকে প্রদীপ্ত ফন্দি আঁটছিল কিভাবে দিল্লী যাওয়া যায়। কিন্তু এ কথাটা সে গোপন রেখেছে সকলের থেকে।
ফেসবুক, টুইটার, লিংকডিন, ইন্সটাগ্রাম কোথাও মনামির কোন হদিস সে পায় নি। তাই দিল্লীতে এসেই যতগুলো বাঙালি সংগঠন আছে কোন না কোন অছিলায় ফোন করে মনামির খোঁজ করছে তন্ন তন্ন করে। 
কথায় বলে টেলিপ্যাথির একটা জোর আছে। সেটা প্রমাণ হয়ে গেল – যেদিন হঠাৎ করে প্রদীপ্ত মনামির দেখা পেল।
প্রদীপ্ত দাঁড়িয়েছিল দিল্লীর চাঁদনি চকের মোড়ের কাছে অটো ধরবে বলে। হঠাৎ সে দেখতে পেল রাস্তার ঠিক বিপরীত দিকে মনামি দাঁড়িয়ে আছে রাস্তা পার হবে বলে। 
নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না প্রদীপ্ত।
মনামি রাস্তা পার হয়ে আসতেই প্রদীপ্ত বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে একটু আদিখ্যেতা করেই বলল “আরে তুমি এখানে কি করে?  কেমন আছো? ”
সেই শুরু প্রদীপ্ত আর মনামির নতুন এপিসোড। প্রায় মাস খানেক হতে চলেছে ওরা প্রায়ই এখানে সেখানে দেখা করে গল্পগুজব করে।
প্রদীপ্ত অনেকবার চেষ্টা করেছে মনামি কোথায় থাকে জানতে - মনামি কিন্তু বলেনি। এ ব্যাপারে প্রদীপ্তর কোন তাড়াহুড়ো নেই। সে ‘ধীরে চলো’ নীতি নিয়েই এগোচ্ছে।
সেদিন বসেছিল চাঁদনি চকের কাছেই একটা কুলফি কাফেতে। সন্ধ্যে সবে সবে নেমেছে। বাইরে তখন ঝিরঝিরে বৃষ্টি পরছে। কিন্তু প্রদীপ্তর রোমান্টিক মনে তখন রোমান্সের তুফান খেলে চলেছে।
অনেকদিন ধরে চেপে রাখা কথাটা বেড়িয়ে এলো মুখ থেকে - “মনামি তোমাকে আমি তীব্র ভাবে ভালবাসি। সত্যি বলতে দিল্লী আসাই তোমার কারণে।” 
মনামি উত্তর করতে দেরি করল না এক সেকেন্ডও – “কিন্তু আমি তো তরুণের জন্যই অপেক্ষা করে আছি। আমার বিশ্বাস সে খুব তাড়াতাড়ি সেরে উঠবে।”
প্রদীপ্ত মনামির এই উত্তরটা একেবারেই আশা করেনি। তীব্র বিস্ময় নিয়ে সে বলল – “কিন্তু আমি তো শুনেছি ডাক্তার বলেছে তরুণ আর কোনদিনই ভালো হবে না।”
মনামি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে মুচকি হেসে বলল “তুমি ভুল জানো। বিশ্বাস না হয় মৈনাককে ফোন করে তরুণকে দেখে আসতে বল না। তাহলেই জানতে পারবে।”
সেদিন সারা রাত প্রদীপ্ত ঘুমাতে পারেনি। এতো খাটাখাটনির পর শেষে এই ভাবে তীরে এসে তরী ডুবে যাবে? – প্রদীপ্ত মনামির উত্তরটা মেনে নিতে পারছিল না কিছুতেই। তাদের মাঝে সেই তরুন এখনও উপস্থিত – এটা ভাবলেই প্রদীপ্তর মাথা আগুন হয়ে উঠছিল। তার মনে পড়ে যাচ্ছিল প্রায় বছর চারেক আগেকার সব কথা।
কাঁকিনাড়ার বিবেক পল্লি – এই পাড়াতেই প্রদীপ্ত, তরুণ, মৈনাক এক সাথেই ছোট থেকে বড় হয়েছে। এই পাড়ার এক মাত্র ক্লাব - সুভাস সংঘ। এই ক্লাবের বাৎসরিক অনুষ্ঠানে গান করার জন্য প্রদীপ্তর ক্লাস-ফ্রেন্ড মনামিকে নিয়ে এসেছিল পাড়াতে। সেই অনুষ্ঠানেই মৈনাক আর তরুণের সঙ্গে মনামির পরিচয়।
এদের এই তিন বন্ধুর মধ্যে তরুণ পড়াশুনা সবচেয়ে ভালো ছিল। সে যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে কম্পিউটার সাইন্সে বিই পরছিল। প্রদীপ্ত কমার্স নিয়ে ব্যারাকপুরের রাস্টগুরু সুরেন্দ্রনাথ এ ভর্তি হয়েছিল। মনামির সঙ্গে প্রদীপ্তর আলাপ এখানেই। মনামিও কাঁকিনাড়ার অন্য পাড়ায় থাকত । ফলে কলেজে এক সাথেই যাতায়াত করত তারা। মৈনাক ছিল কলকাতার বঙ্গবাসীর কমার্সের ছাত্র। প্রদীপ্ত, তরুণ, মৈনাক - এরা তিনজনই ছিল পাড়ার ক্লাব সুভাস সংঘের একটিভ মেম্বার। প্রদীপ্তর বাবা ছিল সুভাস সংঘের সেক্রেটারি।
তরুণ পাড়ার এক বিত্তশালী ফ্যামিলির ছেলে। বাবা মা দুজনেই কেন্দ্রীয় সরকারের উচ্চ পদস্থ কর্মচারী। তরুণকে দেখতে শুনতে বেশ ভালো। ফর্সা রঙের সঙ্গে কোঁচকান চুল তরুণকে মেয়েদের কাছে আরও বেশী করে আকর্ষণীয় করে তুলেছিল। ফলে তরুণ মনামির বন্ধুত্বের সম্পর্ক প্রেমে পরিণত হতে বেশী সময় লাগেনি।
পূর্ব পরিচিত হলেও প্রদীপ্তর মনের খবর মনামি কোনদিনই রাখেনি। রাখলে জানতো ভগ্ন হৃদয় নিয়ে এক ব্যর্থ প্রেমিক সর্বদা হাসি মুখ নিয়ে তাদের সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
তরুণের সব ভালোর মাঝে তার এক বদ নেশা মনামিকে দুর্ভাবনায় ফেলেছিল। দুবেলা গাঁজা না টানলে তরুণ সুস্থ থাকতে পারত না। এ নেশাটা সে কলেজ ক্যাম্পাস থেকেই ধরেছিল। কোন কোনদিন নেশার পরিমাণ এতটাই বেশী হয়ে যেত যে তরুণ মনামির সাথে কথা বলতে বলতেই চৈতন্য হারিয়ে ফেলত। 
এই নেশা নিয়ে তাদের মধ্যে অশান্তি শুরু হয়েছিল বেশ কিছুদিন থেকে। মনামি রাগ করে কয়েকবার সম্পর্ক ভেঙ্গে দিয়েছিল। কিন্তু তরুণ এসে ধরত প্রদীপ্তকে। প্রদীপ্ত আবার মনামিকে বুঝিয়ে সুজিয়ে রাগ ভাঙ্গাত।
তরুণ বহুবার প্রতিজ্ঞা করেছে এই নেশা সে ছেড়ে দেবে। কিন্তু সেটা আর হয়ে ওঠেনি। পরিমাণে কমালেও পুরো ছেড়ে দেয়া সম্ভব ছিল না তরুণের।
সেদিন তরুণের বাড়ীতে পার্টি ছিল। তরুণ অন ক্যাম্পাসে একটা নাম করা এম-এন-সিতে চাকরী পেয়েছিল। সে কারণেই পার্টি।
পার্টিতে পাড়ার জনা দশেক বন্ধুর সঙ্গে মনামিও নিমন্ত্রিত  ছিল। রাত তখন নটার আশপাস হবে। ফিস-ফ্রাই,  চিকেন কাবাব সহযোগে  কোল-ড্রিইংস আর বিয়ারের যথেচ্ছ ধ্বংসসাধন চলেছে। মনামি হঠাৎ আবিষ্কার করল তরুণ সেখানে নেই। খোঁজ করতেই দেখা গেল সে একলা দোতলার ছাদে বসে এক মনে গাঁজায় দম দিয়ে চলেছে। দেখেই মনামি রেগে অগ্নি শর্মা। বিস্তর চেঁচামেচি করে সে নিচে নেমেন এলো। খুঁজতে একাই গেছিল নেমে এলো একাই। কিন্তু এক তলায় নামার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এক তীব্র আর্তনাদ শুনতে পাওয়া গেল।
দোতলার ছাঁদ থেকে পরে গেছে তরুণ। তবে পুরপুরি মাটিতে না পড়ে নারকেল গাছের একটা শক্ত পাতায় ঝুলে ছিল। কিন্তু তার মাথাটা কার্নিশে আঘাত লেগেছে তীব্র ভাবে। রক্তাত্ত্ব তরুণকে দেখে সবাই হতভম্ব।
দুমাস ধরে যমে মানুষে টানাটানির পড় যখন তরুণকে হসপিটাল থেকে ছাড়া হল, তখন সে নব্বই-ভাগ ব্রেইন ড্যামেজ বিশিষ্ট এক পারালাইসিস রুগী।
সকলের ধারণা হল ছাদে গিয়ে মনামি অত্যন্ত অশান্তি করার জন্য তরুণ সুইসাইড করার চেষ্টা করেছিল। মনামি এতটা বাড়াবাড়ি না করলেই ভালো হত।

তরুণের বাবা-মাও মনামির প্রতি প্রায় একই মনোভাব পোষণ করত। প্রদীপ্ত কিন্তু মনামির পক্ষ নিয়েই মনামিকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল – মনামি যা করেছে যে কোন মেয়েরই সেটা করা উচিত ছিল। মনামি নিজে কিন্তু চরম আত্মগ্লানিতে ভুগছিল। মানুষের বক্র চাউনি আর হুল ফোটান কথায় মনামি কিন্তু কাঁকিনাড়ায় আর বেশিদিন থাকতে পারল না। এর মাস তিনেক পর একটা অনামি কলেজে এম-বিয়ে করতে সে দিল্লী চলে যায়। তারপর থেকে সে কোন দিন আর কাঁকিনাড়ায় ফেরেনি। এবং পূর্ব পরিচিত সমস্ত বন্ধু-বান্ধদের থেকে সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল। তরুণরাও কাঁকিনাড়া ছেড়ে পাকাপাকি ভাবে কলকাতার মৌলালির কাছে একটা ফ্লাটে চলে আসে। আসলে তরুণকে প্রায়ই মল্লিক বাজারে অবস্থিত ইন্সটিটিউড অব নিউরোসাইন্স হসপিটালে মাস দু তিন বার আসতে হোত। কাঁকিনাড়া থেকে অত দূর যাতায়াত করে তরুণের শারীরিক অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। তাই ওরা কাঁকিনাড়ার বাড়ীটা বিক্রি করে মৌলালিতে একটা ফ্ল্যাট কেনে যাতায়াতের সুবিধার জন্য। এরপর বিবেকানন্দপল্লির সবার মধ্যে থেকেই ধীরে ধীরে তরুণ আর মনামির স্মৃতি ম্লান হয়ে আসে। প্রদীপ্ত কিন্তু ভুলতে পারেনি মনামিকে। কিন্তু আজ এতো কিছুর পর মনামির মুখ থেকে তরুণের কথা শুনে প্রদীপ্ত সম্পূর্ণ দিশেহারা। কি করবে বুঝে উঠতে পারছিল না। অনেক ভেবে প্রদীপ্ত মৈনাককে ফোন করল। কিন্তু সে আসল সত্যি কথাটা বলতে পারল না। প্রথমে কিছুক্ষণ খেজুরে আলাপ করে বলল “জানিস তো মাস খানেক আগে হঠাৎ করে মনামির সঙ্গে দেখা। তারপর থেকে ওর সাথে প্রায়ই দেখা হয়। কিন্তু কাল ও আমাকে হঠাৎ করে প্রপোজ করেছে। কিন্তু আমার খুব খারাপ লাগছে। তরুণ যদি সুস্থ হয়ে এটা শোনে কেমন খারাপ লাগবে বলত। আমি সেটা ওকে বললাম। ও বলছে তরুণ কখনওই ভালো হবে না। আমি এটা ঠিক মেনে নিতে পারছি না। তাই তোকে বলছিলাম- তুই একবার মৌলালি তে গিয়ে দেখবি তরুণ কেমন আছে।” মৈনাক সর্বদা বন্ধুদের সাহায্য করার জন্য পা বাড়িয়েই থাকে– তাতে নিজের বা নিজের ফ্যামিলির কোন সমস্যা হলেও পরোয়া করে না। মৈনাক পরদিনই ছুটল মউলালি। তরুণরা মৌলালিতে শিফট হবার প্রথম প্রথম এক দু বার আসলেও মৈনাকের এই শেষ তিন বছরে আসা হয়নি একবারও। তরুণের বাবা তথাগত রায় মৈনাককে এতদিন পর দেখে একটু আশ্চর্য হল। মৈনাক তরুণ কেমন আছে জানতে চাইলে তথাগত যা বলল মৈনাক সেটা কোন দিন আশা করেনি। তথাগত বলল- “ভগবানের কাছে কি পাপ করেছি জানি না। নইলে ভগবান আমাদের এত কষ্ট দিচ্ছেন কেন? একটু আশার আলো দেখছিলাম বুজলে। এই তিন বছর ধরে

ক্রমাগত ফিজিওথেরাপি আর মেডিসিন চলার ফলে তরুণ হাতের আঙ্গুলগুলো মাঝে মাঝে নড়াতে পারছিল। কিন্তু মাস ছয়েক আগে তরুণের জন্মদিনের দিন ওর মা একটা কেক বানিয়ে ছিল। ওর সামনে রেখে ওর হাত ধরে কেকটা কাটিয়ে কেকটা একটু মুখ দিয়েছিল ওর মা। কি হল বুঝলাম না। হঠাৎ ওর চোখ উল্টে হাত পা বেঁকে কেমন বেহুশের মতো হয়ে পরল। সঙ্গে সঙ্গে হসপিটাল নিয়ে গেলাম। ডক্টর দেখে বলল একটা স্ট্রোক হয়ে গেছে। ছেলের কোন সাড়া শব্দ নেই। শুধু নিশ্বাস পড়ছে। ডক্টর বলল বাহাত্তর ঘণ্টার পর জ্ঞান ফিরতে পারে। কিন্তু চার দিন পরও জ্ঞান ফিরল না। ব্যাঙ্গালর থেকে বড় ডাক্তার এল। সে চেক করে বলল - রোগী কোমায় চলে গেছে। এখান থেকে বেড়িয়ে আসা আর সম্ভব নয়। তরুণ সেই থেকে ঐ হসপিটালের একটা কেবিন এ শুয়ে আছে আজ ছ’মাস হল। ”মৈনাক তীব্র বেদনার সঙ্গে বলল “এত কিছু ঘটে গেছে আমরা তো কিছুই জানি না। একবার তো পাড়ার কাউকে ফোন করতে পারতেন।” তথাগত খুব বিতৃষ্ণার সঙ্গে বলল “তোমাদের ঐ বিবেকপল্লীর কিছু বিবেকহীন লোকের ফোন নাম্বার আমার কাছে ছিল। তাদের আর ফোন করতে ইচ্ছা করছিল না।” মৈনাক লজ্জিত মুখ নিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে বসেছিল। চোখ দুটো তার জলে ভরে গেছে। নিজেকে একটু সামলে বলল “মনামি এসেছিল তরুণকে দেখতে?” তথাগত বেদনাপূর্ণ গলায় বলল “ঐ অভাগী মেয়েটার কথা আর বলো না। খুব অন্যায় করেছি ওর সাথে আমরা সবাই।” মৈনাক বিস্ময়ে প্রশ্ন করল “ওর সাথে অন্যায় হয়েছে! কি রকম?” তথাগত একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল “সে তো অনেক কথা। মনামি দিল্লী চলে যাবার পর থেকে প্রায়ই আমাকে ফোন করত তরুণ কেমন আছে জানতে। আমরা সত্যি বলতে ওর সঙ্গে ভালভাবে কথা পর্যন্ত বলতাম না। মনের মধ্যে একটা বিতৃষ্ণা কাজ করত। বাঙ্গালরের ডাক্তার তরুণকে দেখে যেদিন বলল ও পুরপুরি কোমায় চলে গেছে ঠিক সেদিনই মনামি আমাকে ফোন করেছিল। আমি তখন হসপিটালেই। আমি বললাম তিন চারদিন ধরে যা যা হয়েছে। ও কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। আর বারবার বলতে থাকল আমি সেদিন কেন ওকে এভাবে বকতে গেলাম। এই বলতে বলতেই ফোনটা কেটে দিলো। আমি আর রিং ব্যাক করিনি। আর ভগবানের কি খেলা দেখ ঠিক সেই সময়েই আমার সাথে দেখা হল তোমাদের বিবেকপল্লীতেই আমার প্রতিবেশী ছিল রজত সাহার স্ত্রীর সঙ্গে।”
মৈনাক ঘাড় নেড়ে বলল “হ্যাঁ, হ্যাঁ রজতকাকুর তো স্ট্রোক হয়েছিল কয়েক মাস আগে।” তথাগত সম্মতির সুরে বলল “হ্যাঁ, উনি ওনার হাসব্যান্ডকে নিয়ে এসেছিল হসপিটালে। উনি আমাকে দেখেই কেঁদে ফেললেন। উনি যা বললেন তাতে তো আমি আকাশ থেকে পড়লাম। কাঁদতে কাঁদতে উনি বললেন – 'দাদা আমি ভয়ে এতদিন কিছু বলতে পারিনি। আজও আপনাকে সাহায্য করতে পারব না। তবু একটা গোপন কথা আপনাকে বলছি – যেদিন তরুণ ছাদ থেকে পড়ে যায় আমি ছিলাম আমার বাড়ীর ছাদে। আমি প্রায় প্রতিদিনই ঐ সময়টা ছাদেই একটু পায়চারি করতাম। আমার ছাদে আলো ছিল না। ফলে কেউ আমাকে দেখতে পাইনি। কিন্তু আমি সব দেখেছি। সেদিন মনামি নেমে যাবার পর পরই ছাদে প্রদীপ্ত উঠেছিল। তরুণ তখন ছদের রেলিঙে ঝুঁকে দাঁড়িয়েছিল। প্রদীপ্ত এসেই পিছন থেকে তরুণকে জোরে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েই নিচের সিড়িঁতে নেমে যায়।”
মৈনাক প্রায় চেঁচিয়ে উঠে বলল “সে কি প্রদীপ্ত এটা করেছে - ভাবতেই পারছি না।” তথাগত বলল “আমিও ভাবতে পারিনি। উনি আরো বললেন উনি নাকি এর আগেও দেখেছে প্রদীপ্ত পকেটে করে গাঁজা এনে তরুণকে দিত। মানে প্রথম থেকে প্রদীপ্তর ইনটেনশন ছিল তরুণকে শেষ করার।”
মৈনাক উত্তেজিত হয়ে বলল “আপনি এখনও এসব আমাদের পাড়ার কাউকে জানাননি কেন?”
-“কাকে জানাব? রজতবাবুর ওয়াইফ কোন অশান্তি চান না। উনি কোন সাক্ষী দিতেও পারবেন না। তাহলে আমি কিসের জোরে বলব। আর প্রদীপ্তর বাবা ঐ ক্লাবের সেক্রেটারি তার উপর উনি এক জন বিশিষ্ট পার্টি লিডার।”
মৈনাক নিজের হাত কচলাতে কচলাতে বলল “ব্যাপারটাকে এই ভাবে চুপ করে সহ্য করে যেতে হবে?” তথাগত হতাশের সুরে বলল “প্রদীপ্ত এক সাথে দুটো পরিবারকে শেষ করল। আমাদের পরিবারের কথা তো শুনলে। এবার মনামিদের কথা বলি। রজতবাবুর ওয়াইফের সাথে কথা বলে বুঝতে পারি মনামির ব্যাপারে আমাদের কত ভুল ধারণা ছিল। আমি সে কথা বলব বলেই তখনই মনামিকে ফোন করি। ফোনটা ধরল ওর মা। উনি যা বললেন তাতে আমার স্ট্রোক হবার জোগাড়। আমার সাথে কথা বলার পরই মনামি রান্নাঘরে ঢুকে গায়ে আগুন দেয়। অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় ওরা ওকে তখনই হসপিটালে নিয়ে যাচ্ছে। আমি আর থাকতে পারিনি। তরুণের সমস্ত দায়িত্ব ওর মায়ের উপর দিয়ে আমি সঙ্গে সঙ্গে প্লেনে করে দিল্লী চলে যাই। মেয়েটার কাছে আমাকে ক্ষমা চাইতেই হবে। দুদিন যমে মানুষে টানাটানি হল। সময় যত যাচ্ছে অবস্থার অবনতি হচ্ছে। এর মধ্যে আমি ডাক্তারকে বারবার অনুরোধ করি - আমি এক বার ওর সাথে কথা বলতে চাই। খুব অনুরোধের পর একটা সুযোগ মিলল। ডাক্তার বলল যতটা কম সময়ে নেয়া যায়। আমি দেখা করে ওকে বললাম প্রদীপ্তর এই শয়তানি। ও খুব উত্তেজিত হয়ে পড়ল  –কিছু যেন বলতে চাইছিল। সারা মুখ-চোখ লাল হয়ে উঠল। ওর তীব্র কষ্ট হচ্ছিল বুঝতে পারছিলাম। তারপর হঠাৎ করেই ও স্তব্ধ হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে নার্স -ডাক্তারবাবুদের দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়ে গেল। কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না -  মনামি আমাদের ছেড়ে চলে গেল চিরতরে। আমি পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম।”
কথা ছিল মৈনাক তরুণদের বাড়ী থেকে বেড়িয়েই প্রদীপ্তকে ফোন করবে। কিন্তু মৈনাকের ইচ্ছা করছিল না। রাগে দুঃখে তার ঠিক কি করা উচিৎ সে ভেবে পাচ্ছিল না। তাই সে তরুণদের বাড়ী থেকে বেরিয়ে ধীর পায়ে হাঁটছিল। কিন্তু অপরদিকে প্রদীপ্তর ধৈর্য বাগ মানছিল না। 
মোবাইলর রিঙটা বাজতে শুরুর করল। মৈনাক দেখল প্রদীপ্ত ফোন করেছে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফোনটা ধরল। অপর প্রান্ত থেকে প্রদীপ্তর উত্তেজিত গলা ভেসে এলো – “কিরে, কি কথা হল? তরুণ কেমন আছে?”
মৈনাক তীব্র রাগকে চেপে স্বাভাবিক গলায় বলল – “তরুণ এখন বেশ ভালো আছে। ও খুব তাড়াতাড়ি কথাবার্তাও বলতেও শুরু করবে। আচ্ছা সত্যি করে বলত - তুই সত্যি কি মনামির সাথে কথা বলেছিস?”
‘তরুণ আবার কথাবার্তা বলতে শুরু করবে’ - এটা শুনেই প্রদীপ্তর মাথাটা ঘুরতে শুরু করেছিল। তবু নিজেকে সামলে বলল – “আরে হ্যাঁ রে। আমি অকারণে কেন মিথ্যা বলতে যাবো। “
মৈনাক বলল – “আমার মনে হয় তোর ডাক্তার দেখানো উচিৎ। তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। কারণ মনামি ছয় মাস আগে মারা গেছে।”
প্রদীপ্ত তীব্র অবিশ্বাসের সুরে বলল – “কি বলছিস আবোল তাবোল। আমি তো আজ বিকালেও ওর সাথে কথা বলেছি।”
মৈনাক গম্ভীর গলায় বলল “তুই কার সাথে কথা বলেছিস- সেটা তুই আর তোর বিকৃত মস্তিষ্ক জানে। কিন্তু তুই আসল সত্যিটা শোন- মনামি আজ আর নেই। কিন্তু আজ আমরা সবাই জানি সেদিন রাতে তরুণকেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলেছিল। তলে তলে তরুণকে কে গাঁজা সাপ্লাই করতো। তরুণ কথা বলতে শুরু করলেই আমরা কোর্টে যাবো।”
প্রদীপ্তর মুখে কোন উত্তর নেই। মৈনাকের কানে প্রদীপ্তর ঘন ঘন নিশ্বাস পড়ার শব্দ আসছিল। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বলল – “তোকে আমি পড়ে ফোন করছি।”
মৈনাকের কাছে প্রদীপ্তর আর কোনদিন কোন ফোন আসে নি। কিন্তু একটা মর্মান্তিক খবর একটা ইংরাজি দৈনিকের মাধ্যমে দিল্লী থেকে আছড়ে পড়েছিল বিবেকপল্লীতে– দিল্লীর গীতা কলোনির এলেকার এক বহুতল ফ্লাটের ছাদ থেকে পড়ে এক বাঙালি যুবকের রহস্যজনক মৃত্যু। মাথা সম্পূর্ণ চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেছে। 
প্রাথমিকভাবে পুলিশের অনুমান যুবক আত্মহত্যা করেছে। ইদানীং যুবকের মস্তিষ্ক বিভ্রম দেখা দিয়েছিল। সে অফিস থেকে বেড়িয়ে রাস্তা ধারে দাঁড়িয়ে একা একা হাত পা নেড়ে কথা বলত। রেস্টুরেন্টে ঢুকে একটা টেবিল বুক করে দুজনের খাবার অর্ডার দিত। আর এমন ভাবে কথা বলতে বলতে খেত যেন তার সামনে কেউ বসে আছে।
দিল্লীতে যুবকের কোন বন্ধু বা পূর্ব পরিচিত কেউ ছিল না। পকেটে থাকা আইডি কার্ড থেকে অনুমান করা হচ্ছে যুবকের নাম – প্রদীপ্ত সরকার। একটি বেসরকারি ব্যাঙ্কে চাকরী করত।এ ঘটনার এক সপ্তাহ পর সুভাষ
 সংঘ খুব ঘটা করে এক শোক সভা আয়োজন করেছিল। হাজার হোক ক্লাবের সেক্রেটারির ছেলের অকাল মৃত্যু - আয়োজন তো বড় হবেই। দুই মিনিটের নীরবতা পালনের সময় মৈনাকের চোখে-মুখে ছিল এক তৃপ্তির হাসি আর হাতে ছিল একটা চিঠি। যে চিঠিটা দু-এক দিন আগেই দিল্লী থেকে তার কাছে পৌঁছেছে। তাতে লেখা ছিল – “মাস পাঁচেক আগে আমি খুঁজে খুঁজে মনামির মামা বাড়ি গেছিলাম। সেখানেই শুনেছিলাম- মনামি মারা গেছে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করিনি। আজও করি না। তুই ভাবছিস আমি পাগল হয়ে গেছি। কিন্তু আমি মনামিকে দেখতে পাই। কিন্তু ঐ তরুণের জন্য ও আজও আমাকে পছন্দ করে না। আমি এটা মেনে নিতে পারি না। মনামি আমার। ওকে আমার থেকে কেউ ছিনিয়ে নিতে পারবে না। কিন্তু আজ হঠাৎ করে তরুণের জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে। এক সাথে কত খেলেছি, আড্ডা মেরেছি। আজ যেন বন্ধু হিসাবে একটা কর্তব্য অনুভব করছি - ওকে যে এভাবে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে, তার বিরুদ্ধে আমাকে প্রতিশোধ নিতেই হবে। আর সেটাই হবে আমার শেষ প্রতিশোধ। – ইতি প্রদীপ্ত”

সরস্বতীর অভিশাপ

গল্প 

পুজো বার্ষিকী ১৪২৮ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

সরস্বতীর

অভিশাপ

বিবেকানন্দ পণ্ডা

হাওড়া, পশ্চিম বঙ্গ

teacher.jpg

ক শিমুলিয়া ভোলানাথ উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলের গেট দিয়ে সকাল ১১টা নাগাদ তমোজিতের গাড়িটা যখন ভেতরে ঢুকছে তখন মাইকে বাজছিল "মোর বীণা ওঠে কোন সুরে বাজি।" কিন্তু পর মুহূর্তেই সব বদলে গেল, একটি ছেলে উত্তেজিত হয়ে ঘোষণা করতে লাগল " আনন্দ সংবাদ, আনন্দ সংবাদ, আমাদের মধ্যে এখন এসে গেছেন আমাদের পরম শ্রদ্ধেয়, আমাদের প্রাক্তন ছাত্র, বিশিষ্ট বিজ্ঞানী প্রফেসর তমোজিৎ প্রধান। তাঁকে স্বাগত জানাচ্ছেন আমাদের সহকারী শিক্ষক তন্ময় দাস। "গাড়ি থেকে নামতে না নামতেই তন্ময় একগুচ্ছ গোলাপ নিয়ে স্বাগত জানালেন তমোজিৎকে, বললেন "আপনি যে আপনার সব ব্যস্ততা সরিয়ে রেখে আমাদের স্কুলের প্লাটিনাম জুবিলিতে আসতে রাজি হয়েছেন তাতে আমরা অভিভূত।" ছাত্রছাত্রীরা সবাই দলবেঁধে পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। সবাই তাকে নিয়ে গেল প্রধান শিক্ষক সত্যজিৎ রায়ের কক্ষে। ছাত্রছাত্রীরা সুযোগ পেলেই তাকে প্রণাম করে যাচ্ছে। প্রধান শিক্ষকের কক্ষে তখন সমস্ত শিক্ষক শিক্ষিকাদের ভিড়, তারা তাদের হাতের মোবাইলে অন্তত একবার বিশিষ্ট বিজ্ঞানীকে নিজেদের সঙ্গে একই ফ্রেমে বন্দি করতে চায়। প্রধান শিক্ষক একে একে সমস্ত শিক্ষক শিক্ষিকাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তমোজিৎ চারিদিকে তাকিয়ে তার পুরনো স্কুল জীবনটাকে একবার অনুভব করার চেষ্টা করে, পারে না, কত যে বদলে গেছে চারপাশটা। সেই ছোট স্কুল বাড়িটার পাশে উঠেছে একটা বিশাল বিল্ডিং। খেলার মাঠটা অনেক সুন্দর হয়েছে। আগে তো গোটা মাঠটা আগাছা আর ছোট বড় গাছে ছেয়ে থাকত। এখন গোটা স্কুলের চারিদিকে বিশাল পাঁচিল। স্কুলের মাঠের একপাশে বসেছে স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা স্বর্গীয় ভোলানাথ জানার মর্ম্মর মূর্তি।  
স্কুলের প্রাঙ্গণে অস্থায়ী মঞ্চ তৈরি করে চলছে সভার কাজ। তমোজিতের সঙ্গে একে একে এই চক শিমুলিয়া গ্রামের অন্যান্য বিশিষ্টজনদেরও মঞ্চে ডেকে নেওয়া হল। গতকাল শ্রীপঞ্চমী ছিল, এখনো ঠাণ্ডার রেশ রয়েছে। প্রধান শিক্ষক সত্যজিৎবাবুর ভাষণ দিয়ে সভার কাজ শুরু হল। তমোজিৎকে উত্তরীয় পরিয়ে সম্বর্ধনা জানালেন প্রধান শিক্ষক, আর মানপত্র পাঠ করে তার হাতে সেটি তুলে দিলেন জীবন বিজ্ঞানের শিক্ষিকা তমালী হালদার। নিজের পুরনো স্কুলে এসে এমন সম্বর্ধনা পেয়ে তমোজিৎ একেবারে অভিভূত। স্কুল সম্পর্কে বলতে উঠে গ্রাম প্রধান জগদীশ মালাকার জানালেন কি ভাবে এই স্কুল জেলার মধ্যে রেজাল্টের দিক দিয়ে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তারপর তমোজিতের উদাহরণ দিয়ে সব ছাত্রকে উদ্বুদ্ধ করলেন। ক্রমে অন্য বক্তারাও স্কুল নিয়ে তাঁদের সুচিন্তিত মতামত রাখতে লাগলেন। তমোজিৎ বলতে উঠে বলল, "তোমরা আজ যারা ছাত্র, তারা শুধু একটা কথাই মনে রাখবে, শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য জ্ঞানার্জন, আর তার মাধ্যমে নিজেকে সমাজের কল্যাণকর কাজে নিয়োজিত করা। যে শিক্ষা সমাজের কল্যাণ করে না, মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটায় না, তাকে শিক্ষা না বলে অশিক্ষা বলা উচিৎ। লেখাপড়া করে শুধু ভাল রেজাল্ট করলেই চলবে না, ভাল মানুষ হতে হবে।" চারিদিকে তুমুল হাততালি। এর শুরু হল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আর সামনের সারিতে চেয়ারে বসে মাঘ মাসের মিঠে কড়া রোদে গা এলিয়ে দিয়ে তমোজিৎ ডুবে গেল ২৬ বছর আগে ছেড়ে যাওয়া তার স্কুল জীবনের স্মৃতিতে।
আজ সকালেই মুম্বাই থেকে ফ্লাইটে কোলকাতা আর তার পর প্রায় দেড় ঘণ্টার গাড়ি পথে চক শিমুলিয়া গ্রাম এসেছে তমোজিৎ। ক্লান্তি থাকলেও নিজের ছেড়ে যাওয়া গ্রাম, স্কুল দেখার উৎসাহেই সে ছুটে এসেছে এত দুরে। সেই কবে ছেড়েছে গ্রাম। বাবার ছিল ট্রান্সফারের চাকরি, বিডিও অফিসে কাজ। সেই সূত্রে একাদশ শ্রেণীতে এসে ভর্তি হয়েছিল চক শিমুলিয়া ভোলানাথ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। লেখাপড়াতে সব সময়েই সে ভাল ছিল, তাই এখানের সব শিক্ষক শিক্ষিকাদের বাড়তি নজর থাকত তার ওপর। স্কুলের ছেলে মেয়েদের স্বতঃস্ফূর্ত বন্ধুত্ব আর গ্রামের খোলামেলা পরিবেশ কয়েকদিনেই আপন করে নীল তাকে। অনেক বন্ধুকেই মনে পড়ে আজ। সুনীল, নির্মল গৌর, নবীন, রবি, বনানী, অনামিকা, গীতা, সবাই এখন কে কোথায় কে জানে! ভেবেছিল এতদিন পরে নিজের স্কুলে পা দিয়ে হয়ত পুরনো কোন বন্ধুর দেখা পাবে। কাউকে না পেয়ে একটু হতাশই হল সে, আসলে ২৬ বছর সময়টা তো কম নয়। তাদের সময় বিজ্ঞান বিভাগের ক্লাসের মেয়েরা ডান দিকের বেঞ্চগুলোতে বসত, আর ছেলেরা বসত বাঁ দিকে। গ্রামের মেয়েরা একটু লাজুক প্রকৃতির, কথাবার্তা খুব কম হত। প্রথম প্রথম তো কোন মেয়ের সঙ্গেই তার আলাপ ছিল না।  
সেবার স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠানে বিজ্ঞান বিভাগের সবাই রবি ঠাকুরের 'বিদায় অভিশাপ' কবিতাটা আবৃত্তি করবে বলে ঠিক করল। অনামিকা খুব সুন্দর কবিতা আবৃত্তি করে, তাই সেই হবে দেবযানী। 'কচ' কে খোঁজার জন্য বাংলার স্যার মধুবাবু একে একে বিভিন্ন ছেলের টেষ্ট নিলেন। অবশেষে মধু স্যার 'কচ' হিসেবে তাকেই ঠিক করলেন। কবিতা বলতে উঠে একটা মজার ঘটনা ঘটেছিল। কবিতার প্রথম দিকে তমোজিৎ ও অনামিকা ঠিকঠাক বলছিল। আবৃত্তির একজায়গায় অনামিকার কণ্ঠে দেবযানী বলে চলে, "সে কি আমি দেখি নাই? ধরা পড়িয়াছ বন্ধু, বন্দী তুমি তাই মোর কাছে। এ বন্ধন নাড়িবে কাটিতে। ইন্দ্র আর তব ইন্দ্র নয়।" এর পর কচে’র বলার কথা, "শুচিস্মিতে, সহস্র বৎসর ধরি এরই লাগি করেছি সাধনা?" কি যে হল তমোজিতের, ভুল করে বলে বসল, "অনামিকে, সহস্র বৎসর ধরি এরই লাগি করেছি সাধনা?" চারিদিকে হাসির রোল উঠল। মধুবাবু দরজার আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে কান মলে বলেছিলেন, "বাঁদর একটি।" কিন্তু তারপর থেকেই ক্রমে ক্রমে অনামিকার সঙ্গে দূরত্বটা কমতে থাকে। চলতে থাকে ক্লাস নোট দেওয়া নেওয়া। গ্রামের প্রায় সবাই চেনা, তাই তাদের চোখে ধুলো দিয়ে দুজনের কোথাও ঘুরে বেড়ান বা একান্তে সময় কাটানো প্রায় অসম্ভব ছিল। ক্লাস নোট দেওয়া নেওয়ার সময় চলত ছোট ছোট চিঠির আদান প্রদান, তার মধ্যেই ছিল নতুন প্রেমের শিহরণ। দেখতে দেখতে কোথা দিয়ে একটা বছর কেটে গেল। স্কুলের সরস্বতী পূজোর দায়িত্বটা থাকত দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীদের ওপর। স্কুলের সেবারের নাটক 'আমি সিরাজের বেগম'। ক্লাসের পর চলতে থাকল রিহার্সাল। সিরাজের চরিত্রে নির্মল, বেগম লুৎফাঊন্নিসা হল অনামিকা। আর মোহনলালের চরিত্রে তমোজিৎ। গীতা ছিল ঘসেটি বেগমের ভূমিকায়। সুনীল ও গৌর যথাক্রমে মীরজাফর ও জগৎশেঠের চরিত্রে। রিহার্সাল শেষ হতে হতে সন্ধ্যে হয়ে যেত। অনামিকার বাড়ি বেশ কিছুটা দুরে জংগল পথে, রাতে একা মেয়ে যাওয়ার বিপদ অনেক, তাই প্রায়ই অনামিকাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে দিতে চলতে থাকত হৃদয় বিনিময়ের শেষ না হওয়া গল্প। অনামিকা বিজ্ঞানের ছাত্রী হলেও পাপ, অভিশাপ এগুলোকে খুব ভয় পেত। পূজোর আগের দিন অনেক কাজ, রিহার্সাল হবে রাত অবধি, তাই দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীরা সবাই রাতে স্কুল হস্টেলে থাকবে ঠিক করল। অনামিকা সেদিন এমন একটা আগুনরঙা ঝলমলে শাড়ি পরে এসেছিলো যে তমোজিৎ না তাকিয়ে থাকতে পারছিল না, বারবার চোখ চলে যাচ্ছিল ওর দিকে। সারাদিনের বিভিন্ন পূজোর কাজ আর প্যাণ্ডেলের সাজ সজ্জার পর স্কুলের একটা ক্লাস ঘরে নাটকের অন্তিম রিহার্সাল শুরু হল। মধুবাবু ধরে ধরে সবাইকে শিখিয়ে দিচ্ছিলেন।   
"স্যার চলুন খাওয়ার আয়োজন হয়েছে" প্রধান শিক্ষক সত্যজিৎ রায়ের কথায় ঘোর কাটে তমোজিতের। অনেক রকম খাওয়ার আয়োজনই ছিল। সমস্ত শিক্ষক শিক্ষিকা, প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী ও গ্রামের বিশিষ্টজনদের সঙ্গে খাওয়ার খেতে খেতে আলোচনা চলছিল স্কুল নিয়ে। সত্যজিৎবাবু খেতে খেতে বললেন, "আজ রাতটা আপনাকে আমাদের এখানেই থেকে যেতে হবে। এই চক শিমুলিয়া গ্রামে তো আপনার থাকার মত কোন জায়গা সেরকম নেই, তাই আপনার থাকার ব্যবস্থা আমাদের অঙ্কের মাষ্টারমশাই তন্ময়বাবুর বাড়িতে করা হয়েছে, কিছু মনে করবেন না যেন।" 
"তা কেন, আমিও তো এই গ্রামেই কাটিয়েছি। তাছাড়া তন্ময়বাবুর বাড়িতে থাকলে রাতে অনেক গল্পই করা যাবে।"
বিকেলে ছাত্রছাত্রীদের বিভিন্ন ক্রীড়া প্রতিযোগিতা চলছিল। সন্ধের পর শুরু হল দু দুটো নাটক। একটা  ছাত্রছাত্রীদের আর একটা শিক্ষক শিক্ষিকাদের। ছাত্রছাত্রীরা অভিনয় করল 'বাঞ্ছারামের বাগান' আর শিক্ষক শিক্ষিকাদের নাটক 'ঝিন্দের বন্দী' । শিক্ষক শিক্ষিকাদের নাটক 'ঝিন্দের বন্দী'র শঙ্কর সিং এর চরিত্রে সত্যজিৎবাবু, কস্তূরী বাই এর চরিত্রে তমালী ম্যাডাম আর ময়ূরবাহনের ভূমিকায় তন্ময়বাবু। তন্ময়বাবু অসাধারণ অভিনয় করলেন। নাটক দেখতে দেখতে চেয়ারে তমোজিতের পাশে বসে জগদীশবাবু সমানে বক্‌ বক্‌ করে যাচ্ছিলেন। "আপনি অঙ্কের স্যার তন্ময়বাবুর বাড়িতে থাকবেন তো, ওখানে আপনার কোন অসুবিধা হবে না। তন্ময়বাবু খুব ভালো মানুষ, আর খুব ছাত্র দরদী, গরীব ছাত্রদের বাড়িতে ডেকে বিনে পয়সায় পড়ান।" 
"তাহলে তো তন্ময়বাবু খুব উদার হৃদয়ের মানুষ" যোগ করে তমোজিৎ। জগদীশবাবু   উৎসাহ পেয়ে বলতে থাকেন, "তা তো বটেই", তার পর গলা নামিয়ে বলতে থাকেন, "তবে একটা কথা শোনা যায় ওনার সম্পর্কে। সে অনেক আগে, তখন উনি কলেজের ছাত্র, গ্রামে ফিরছিলেন। হঠাৎ দেখেন একটা কম বয়সী মেয়ে সুবর্ণরেখার জলে ভেসে যাচ্ছে। উনি মেয়েটিকে উদ্ধার করে তাড়াতাড়ি হসপিটালে নিয়ে গিয়ে সুস্থ করে তুলেন। মেয়েটি নাকি সুইসাইড করতে গিয়েছিল। চারিদিকে ঢি ঢি পড়ে গেল, এ মেয়ের বিয়ে হবে কি করে! সবাইকে অবাক করে দিয়ে কয়েক দিন পর তন্ময়বাবুই বিয়ে করলেন মেয়েটিকে। কে জানে কেন মেয়েটি সুইসাইড করতে গিয়েছিল! লোকে অনেক কিছুই বলে। অবশ্য অনেক বছর তো হয়ে গেল, গাঁয়ের পুরনো লোকজন ছাড়া আর বিশেষ কেউ এ ঘটনা জানেও না।"

তমোজিৎ একটু অবাক হয়ে বলে, "জগদীশবাবু, লোকে যাই বলুক না কেন, তন্ময়বাবু ব্যাপারে আপনি যা বললেন, তাতে ওনার ওপর আমার শ্রদ্ধা আরো বেড়ে গেল।" নাটকের পর সব কুশীলবরা মঞ্চ থেকে নিচে নেমে এলে তন্ময়বাবু তমোজিতের দিকে তাকিয়ে বলেন, "চলুন, একটা রাত এই গরীবের বাড়িতে কষ্ট করে কাটিয়ে দেবেন। আপনার মত বিশ্ববরেণ্য মানুষের এক দিনের সাহচর্য্যে আমরা ধন্য হই।" তমোজিৎ একগাল হেসে বলে, "একি বলছেন আপনি? আজ আপনার যা অভিনয় দেখলাম তাতে তো আমার মনে হচ্ছিল যে স্টেজের ওপর ময়ূরবাহনের সাজে স্বয়ং সৌমিত্র চট্ট্যোপাধ্যায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তাছাড়া ছাত্রবৎসল হিসেবে আপনার সুনাম এখন চারিদিকে। তাই আজকের রাতটা আপনার বাড়িতে কাটাতে পারলে আমি নিজেকেই ধন্য বলে মনে করব।" পাশ থেকে তমালী ম্যাম বলে ওঠেন, "স্যার, তন্ময়বাবুর মেয়ে গত বৎসর ডাক্তারি পাস করেছে। ওই আমাদের গ্রামের একমাত্র ডাক্তার, আপদে বিপদে আমাদের একমাত্র অবলম্বন।" রাতের খাওয়া শেষ করে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পাঁচ মিনিটেই তন্ময়বাবুর বাড়িতে পৌঁছে গেল তমোজিৎ। সুবর্ণরেখার পাড়ে বড় হাটটা ছাড়িয়ে ছোট্ট দোতলা বাড়ি। দরজা খোলাই ছিল। বারান্দার আলো এসে পড়েছে সামনের গোলাপ আর গাঁদায় ভরা বাগানে। তমোজিৎকে নিয়ে তন্ময়বাবু ঢুকলেন বাড়ির বৈঠক খানায়। ভেতর থেকে একটি বছর ২৫ এর মেয়ে বেরিয়ে এল, আলো আঁধারে তার মুখটা ঠিকমত দেখতে পায় নি তমোজিৎ। "এ আমার মেয়ে শ্রীময়ী, আর শ্রীময়ী ইনি হলেন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী তন্ময় প্রধান, উনি আমাদের স্কুলের প্লাটিনাম জুবিলি তে প্রধান অতিথি হয়ে এসেছেন,"  নীরবতা ভেঙ্গে বলেন তন্ময়। শ্রীময়ী

গড় হয়ে প্রণাম করে, আর তমোজিৎ শশব্যস্ত হয়ে ধরে ফেলে, "থাক মা থাক, দীর্ঘজীবী হও। তারপর তোমার ডাক্তারি প্র্যাকটিস কেমন চলছে?" কথা বলতে বলতে তিনজনই ভেতরের ঘরের দিকে পা বাড়ায়। বাড়ির টিউবের আলোতে এবার ভালো করে শ্রীময়ীকে দেখে তমোজিৎ। অনেকদিন আগে দেখা স্মৃতির অতলে তলিয়ে যাওয়া অনামিকার মুখটা মনের পর্দাতে ভেসে ওঠে। অনামিকার সঙ্গে এই মেয়ের মুখের গড়ন, চেহারার আদলে অদ্ভুত মিল। "মায়ের শরীরটা ভাল নেই, তাই তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েছে।" শ্রীময়ী বলে চলে, "রাত হয়েছে, আপনিও ক্লান্ত, চলুন আপনাকে শোয়ার ঘর দেখিয়ে দিই।"  তন্ময় বলে ওঠে, "হ্যাঁ তাই ভাল, আপনি শুয়ে পড়ুন, কাল সকালে মিতু, মানে আমার স্ত্রীর সঙ্গে আপনার আলাপ করিয়ে দেব।"
সারাদিনের ছুটোছুটিতে তমোজিৎ সত্যি খুব  ক্লান্ত ছিল, তাই আর না কথা বাড়িয়ে শোয়ার ঘরে পা বাড়ায়। বিছানায় শুয়ে কিন্তু ঘুম আসে না। জঙ্গল ঘেরা আর পাশ দিয়ে বয়ে চলা সুবর্ণরেখার দৌলতে এই চক শিমুলিয়া গ্রামে জানুয়ারীর শেষেও হাড় কাঁপুনি ঠাণ্ডা। বাইরে একটানা ঝিঁঝিঁ ডেকে চলেছে, সঙ্গে হাওয়ার শোঁ শোঁ শব্দ। শেয়ালের ডাকও শুনতে পেল একবার। কেমন একটা অস্বস্তি মনের গভীর থেকে পাক খেতে খেতে গলা দিয়ে দলা পাকিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। তার জীবন এতদিন স্ত্রী প্রতিভা আর ছেলে বিকাশকে নিয়ে সুখেই কেটেছে। ছেলে সেট পরীক্ষা দিয়ে আমেরিকায় পড়ছে। প্রতিভা একটা মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিতে কাজ করে। গবেষণা, সুনাম, অর্থ, সব কিছু  সবসময় তার পেছনে ধাওয়া করেছে, কোন পুরনো স্মৃতি সেভাবে কখনো তাকে বিব্রত করে নি। আজ কিন্তু বার বার তার মনে পড়ছে অনামিকার কথা, বিশেষ করে স্কুলে সরস্বতী পূজোর সময়কার কথাটা।  
পূজোর আগের রাতে রিহার্সাল শেষ হতে হতে রাত ১১ টা। নির্মল, গৌর, গীতারা খাওয়ার জন্য হোস্টেলে চলে গেলেও রাতে নির্জন ক্লাস ঘরে তখনো বসে থাকল শুধু তমোজিৎ আর অনামিকা। ক্লাস ঘরের এক কোনে রাখা ছিল সরস্বতী প্রতিমা, ঠিক হল পরদিন ভোর ভোর প্যান্ডেলে প্রতিমা রাখা হবে। অনামিকা তাড়া লাগায়," কিরে, খাবি চল?" তমোজিৎ মুচকি হেসে বলল, দাঁড়া, দাঁড়া,  দুদিন পরে হায়ার সেকেণ্ডারী পরীক্ষা, পড়া না করে মা সরস্বতীর সামনে রাত জেগে রিহার্সাল করছি, মায়ের কাছে প্রার্থনা করে একটু পাপটা কমিয়ে নি।" অনামিকা একটা বেঞ্চের ওপর চড়ে বসে পা দুলোতে দুলোতে ব্যাঙ্গের সুরে বলে, "তুই পাপের ভয়ে প্রার্থনা করবি? যাক্‌ তোর যখন শুভ বুদ্ধির উদয় হয়েছে, তাহলে আমার হয়েও একটু প্রার্থনা করে দিস, যাতে আমার পাপটাও কম হয়।" তমোজিৎ মজা করে বলেছিল, "তুই যা সেজে এসেছিস তাতে তোকেই একটা জ্যান্ত সরস্বতী মনে হচ্ছে। মা তোর সব দোষ এমনিতেই মাফ করে দেবেন।" ঘরের কোনে রাখা মূর্তিটার দিকে দেখিয়ে সে বলেছিল, "আমি ওই মাটির সরস্বতীর কাছে কিছু চাই না, জ্যান্ত সরস্বতীর কাছেই আমার মনের কথা জানাচ্ছি।" কথাগুলো বলেই হাঁটু গেড়ে বসে গিয়েছিল অনামিকা পায়ের কাছে। অনামিকা হেসে ফেলেছিল, তারপর সরস্বতীর ভঙ্গিমায় হাত তুলে গম্ভীর হয়ে বলে ওঠে "তথাস্তু:, এখন বল বৎস, কি তোমার মনো বাঞ্ছা?" সেই নির্জন ক্লাস রুমে তমোজিতের মাথাটা তখন কেমন দপদপ করে ওঠে, সারা শরীরে যেন বিদ্যুতের তরঙ্গ। টলতে টলতে উঠে দাঁড়ায় সে। তারপর সটান এগিয়ে গিয়ে দুহাতে জাপটে ধরে অনামিকার মাথা, মুখ নিচু করে আলতো করে ঠোট ছোঁয়ায় অনামিকার কপালে। থরথর করে কাঁপতে থাকে অনামিকা, কাঁপাকাঁপা গলায় বলে, "কি করছিস তুই, সামনেই যে মা সরস্বতী!" তমোজিতের সারা শরীরে তখন আগুন, ফিসফিসিয়ে বলে, "ওটা মাটির পুতুল, তুই ই আমার সরস্বতী।" তার পরের আধ ঘণ্টায় শরীরের আগুনে পুড়ে ছারখার হয়ে গেল স্থান, কাল, ন্যায়, অন্যায়, ভাল মন্দ, অতীত, বর্তমান সব সবকিছু। আগুন যখন নিভল তখন কেউই আর কথা বলার মত অবস্থাতে ছিল না। শুধু হোস্টেলে ফিরে যাওয়ার আগে ফোঁপাতে ফোঁপাতে অনামিকা বলেছিল, "তুই কেন এমন করলি তমোজিৎ, শেষ পর্যন্ত মা সরস্বতীর সম্মুখে এমন কাজ! আমাদের পাপের বোঝা যে অনেক ভারী হয়ে গেল রে, দেবতার রোষ থেকে আমরা বাঁচব না।" সেদিন তমোজিৎ একটাও কথা না বলে মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল।
পরদিন পূজোর সময় দু একবার অনামিকার মুখোমুখি হলেও সবাই সাথে থাকায় আর কোন কথা হয় নি দুজনের। রাতে মঞ্চস্থ হল 'আমি সিরাজের বেগম'। নাটকে অভিনয় করতে গিয়ে বার বার তাল কাটতে থাকে তমোজিৎ ও অনামিকার। গীতা তো একবার গ্রিনরুমে বলেই ফেলল, "কি হয়েছে বলত তোদের দুজনেই, এত ভুলে যাচ্ছিস কেন?" নাটকের পর তমোজিতকে একা পেয়ে অনামিকা মৃদুস্বরে বলে "আমরা কিন্তু কাজটা ঠিক করি নি, এর ফল যে কি হবে কে জানে!" তমোজিৎ কি বলবে খুঁজে পেল না, কিছু সময় চুপ করে থেকে বলল, "পরীক্ষার আর বেশি বাকি নেই, এখন ওসব ভুলে যা লেখাপড়ায় মনে দে, দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে।" অনামিকা একটা শ্লেষের হাসি দিয়ে বলেছিল, "ভুলে যা কথাটা ছেলেরা যত সহজে বলতে পারে মেয়েদের পক্ষে ভুলে যাওয়া টা ততটাই কঠিন।" চক শিমুলিয়াতে এর পরের দিনগুলো খুব দ্রুত কেটে যায় তমোজিতের। উচ্চমাধ্যমিকে ভাল ফল করে আই আই টি মুম্বাইতে পড়তে যায় তমোজিৎ। অনামিকাও ভাল ফল করেছিল, তবে তমোজিতের বাবার ট্রান্সফার হয়ে যাওয়ায় চক শিমুলিয়ার সঙ্গে সব যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায় তমোজিতের, তাই অনামিকার ব্যপারে আর কোন খবর পায় নি। বরং বলা ভাল খবর পেতে চায় নি। আসলে ওই রাতের ঘটনার পর তার মনে একটা অপরাধ বোধ তৈরি হয়েছিল, তাই কোনদিনও অনামিকার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে নি, বরং নিজেকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে। ভয়ে অনামিকার কথা সে ভাবতে চাইত না। এই গ্রামে এসে আর তারপর শ্রীময়ীকে দেখার পর না চাইলেও আবার পুরনো কথাগুলো তার মনে ভিড় জমিয়েছে। ভাবতে ভাবতে তমোজিতের গলা শুকিয়ে কাঠ। উঠে জল খেয়ে আবার ঘুমোনোর চেষ্টা করে। চাকরি, গবেষণা, সংসার এ সব নিয়েই এতদিন মেতে ছিল সে, অনামিকার কথা তো এতদিন তাকে নাড়া দেয় নি! চক শিমুলিয়াতে এবার না এলেই বুঝি ভাল হত। 
পরদিন সকালে উঠে স্নান করে পোষাক পরে তৈরি হয় তমোজিৎ, কোলকাতা থেকে দুপুরের ফ্লাইট ধরতে হবে। শ্রীময়ী চা নিয়ে আসে, "বাবা আর মা আপনার জন্য অপেক্ষা করে আছে, আসুন ব্রেকফাস্ট করবেন।" শ্রীময়ী মেয়েটা কিন্তু বেশ, খুব প্রাণোচ্ছল, হাসিখুশি, দেখলে শুধু যে অনামিকাকে মনে পড়ে যায় তা নয়, কেমন যেন স্নেহের বাঁধনে বাঁধতে ইচ্ছে হয়। এসব ভাবতে ভাবতে তমোজিৎ চা শেষ করে শ্রীময়ীর সাথে এসে উপস্থিত হয় ডাইনিং হলে, একটু দূরে চেয়ারে চোখে চশমা দিয়ে এক মধ্যবয়সী মহিলা বসে আছেন। তমোজিৎকে দেখেই এগিয়ে আসেন তন্ময়। "আসুন তমোজিৎবাবু, পরিচয় করিয়ে দি," ভদ্রমহিলার দিকে ইঙ্গিত করে বলে," আমার স্ত্রী মিতু মানে...।" কথা শেষ হওয়ার আগেই ভদ্রমহিলার দিকে হাত জোড় করে এগিয়ে যায় তমোজিৎ। ভদ্রমহিলা উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার করে বলেন "কেমন আছেন প্রফেসার, আমি অনামিকা।" অনামিকাকে দেখে তমোজিৎ থ হয়ে যায়, মুখের ভাষা হারিয়ে গেছে, কোনক্রমে প্রতিনমস্কার করে। মনের মধ্যে এক ভয়ঙ্কর আলোড়ন, 'এ যে সত্যিই অনামিকা, চুলে সামান্য পাক ধরেছে আর শরীর কিছুটা ভারী হয়েছে আগের থেকে, তবে চিনতে কোন অসুবিধা হয় না।' অনামিকা বলতে থাকে, "বসুন প্রফেসর, আসলে গতকাল রাতে আমার শরীরটা ঠিক ছিল না, তাই তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েছিলাম।"

তমোজিতের কথা হারিয়ে গেছে, অনামিকা একতরফা কথা বলে চলে আর তমোজিৎ কোনদিকে না তাকিয়ে মাঝে মাঝে সৌজন্যমূলক হুঁ হাঁ বলে খাওয়া চালিয়ে যাচ্ছিল আর বোঝার চেষ্টা করছিল, 'অনামিকা কি সত্যিই তাকে চিনতে পারে নি, না অভিনয় করে যাচ্ছে তার সাথে। তন্ময়বাবু ও কি তাদের সম্পর্কের কথা কিছু জানেন না?' এখন মনে হচ্ছে যত তাড়াতাড়ি এখান থেকে পালাতে পারবে ততই মঙ্গল। "বুঝলেন প্রফেসার আমার মেয়ে যেদিন জন্মালো সেদিন মহাষষ্ঠী, মনে হল মা দুর্গা এলো আমার কোলে, নাম রাখলাম শ্রীময়ী।" অনামিকা বলে চলে, "সময় কত তাড়াতাড়ি ছুটে চলে, আমার সেদিনের সেই একরত্তি মেয়েটা এখন ডাক্তার, গত পূজোয় ২৫ বছর পূর্ণ করল। মেয়ের তো এবার বিয়ে দিতে হবে। জগৎটা খুবই জটিল। এত খারাপ মানুষের মাঝে একটা ভাল মানুষ খুঁজে পাওয়া খুবই কঠিন।" তমোজিতের মনে হতে লাগল সবার উপস্থিতিতে অনামিকা একটা কসে থাপ্পড় বসাল তার গালে, গলা দিয়ে খাওয়ার আর নামতে চাইছে না। বিদায় নিয়ে বেরিয়ে আসে তাড়াতাড়ি, বাইরে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। গাড়িতে ওঠার আগে তন্ময়বাবু বলেন, "বিয়ের আগে একটা বড় দুর্ঘটনাতে পড়ে অনামিকা, তার পর থেকেই ওর কিছুট মানসিক সমস্যা দেখা দেয়, পুরনো সব কথা মনে করতে পারে না। যাই হোক আমাদের চক শিমুলিয়া স্কুলের পক্ষ থেকে আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ, সময় পেলে আবার আসবেন, আমাদের ছেলে মেয়েরা আপনাকে দেখে উদ্বুদ্ধ হবে।" 
দুদিকে ফাঁকা মাঠ আর জংগলের মাঝ দিয়ে হু হু করে এগিয়ে চলে গাড়ি। পেছনের সিটে মাথা দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছে তমোজিৎ, মনের মধ্যে হাজার চিন্তার ঝড়। আজ থেকে ঠিক ২৬ বছর আগে সে ছেড়েছে চক শিমুলিয়া গ্রাম। অনামিকার মেয়ে শ্রীময়ী-র বয়স ও ২৫ হল। জানুয়ারীতে সরস্বতী পূজো হওয়ার প্রায় নয় সাড়ে নয় মাস পরে হয় অক্টোবরের দুর্গাপূজা। কথাগুলো মনে হতেই তার মেরুদণ্ড দিয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত নিচে নেমে যেতে থাকল। তাহলে কি শ্রীময়ী শুধু অনামিকার মেয়ে নয়, সে কি তারও...। না আর ভাবতে পারছে না সে। এখন এই কষ্ট আর কাপুরুষতা নিয়ে তাকে সারা জীবন কাটাতে হবে? নিজের মেয়ে হলেও শ্রীময়ীকে সে মেয়ের পরিচয় দিতে পারবে না! তার জন্যই তাহলে অনামিকা সুইসাইড করতে গিয়েছিল!

সে তো তাহলে খুনি! চক শিমুলিয়াতে এসে যে চরম সত্যের মুখোমুখি তাকে হতে হল, তাতে তার এতদিন ধরে তিল তিল করে গড়ে তোলা সব ইমেজ কেমন যেন এক লহমায় চুরচুর হয়ে ধুলোয় লুটয়ে পড়ল। মনে হতে লাগল এই গ্রামের সবাই হয়ত জানে ঘটনাটা, তাই স্কুলের সবাই তাকে সম্বর্ধনা দিয়ে চরম উপহাস করল। তন্ময়বাবুও কি পিছন ফিরে হাসছিলেন তাকে দেখে? সবার কাছে তো সে এখন এক ভয়ঙ্কর শয়তান, আর তন্ময়বাবু এক মহামানব যে তার ওগরানো বিষ গলায় ধারণ করে নীলকণ্ঠ হয়েছে। তার এই শিক্ষা, সম্মান, গবেষণা সব, সব আজ মিথ্যে হয়ে গেল।

মা সরস্বতীর মূর্তির সাক্ষাতে ২৬ বছর আগে মুহূর্তের উত্তেজনায় যে অন্যায় সে করেছিল এতদিন পর তা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে কি চরম সাজা দিলেন তিনি! চোখ খুলে গাড়ির কাচ দিয়ে বাইরে তাকাল তমোজিৎ। পথের ধারে কতকগুলি মলিন বসনের গাঁয়ের ছেলে মেয়ে নাচতে নাচতে তালি দিয়ে খেলা করছে। তমোজিতের যেন কানে এসে লাগল ওরা সবাই তালি দিয়ে বলছে, "দ্যাখ দ্যাখ, ওই নোংরা লোকটা একটা পরিষ্কার মানুষের পোষাক পরে কেমন ভয় পেয়ে পালাচ্ছে, পাছে কেউ চিনে নেয়।" চোখ ঘুরিয়ে নেয় জানালার কাঁচ থেকে, মাথা বোঁ বোঁ করছে। প্রচণ্ড ঘামছে সে, আর বিড়বিড় করে বলছে, "অনামিকা আমায় ক্ষমা কর। আমি জানি তুমি আর শ্রীময়ী দুজনেই তন্ময়বাবুর কাছে ভাল আছ। হে ঈশ্বর আমায়  শান্তি দাও, আমায় শান্তি দাও।"

কবিতাঃ অনীক চক্রবর্তী

কবিতা

অনীক চক্রবর্তী

হায়দ্রাবাদ

প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা ​

পুজো বার্ষিকী ১৪২৮ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

রুদ্ধ
 

লো একটা সিগারেট ধরাই ইরিনা রাতুশিনস্কায়া *
যেমন তুমি চেয়েছিলে.......
অন্তত ধোঁয়াগুলোকে মুক্তি দিই 

একটাও চড়ুই আসেনা এখানে আর
বিষণ্ণ বসন্ত গেলে রুগ্ন বর্ষা শুধু
আর কঠিন উত্তাপ ছড়ায় সূর্যের বরফ্শীতল হৃদয়
এই দোরগোড়ায়
ততটুকুই স্মৃতি
কুড়িয়ে বাড়িয়ে যতটুকু সঞ্চয়
রুটির টুকরো

চলো একটা সিগারেট ধরাই
অন্তত স্মৃতিগুলোকে মুক্ত করি
এ কারাবাসে

একটাও চড়ুই আসেনা
এখানে 
কম দামে জীবনের কালোবাজারি হয়
কুড়িয়ে বাড়িয়ে 
যতটুকু সঞ্চয়
তাই নিয়ে 
চলো, একটা সিগারেট ধরাই।

১৪ই জুলাই, ২০২০
হায়দরাবাদ 

*ইরিনা রাতুশিনস্কায়া (জন্ম - ৪ঠা মার্চ, ১৯৫৪; মৃত্যু - ৫ই জুলাই, ২০১৭) : 
ভিন্নমতাবলম্বী সোভিয়েত কবি। তদানীন্তন সোভিয়েত রেজিম এর বিরোধিতার জন্য কেজিবির কোপে পড়েন এবং ফলস্বরূপ ভোগ করতে হয় দীর্ঘ হাজতবাস। কেজিবি যখন ইরিনাকে আটক করে তখন তার বয়স ২৮। ওদেসায় ছাত্রাবস্থায় কেজিবি তাকে মেয়েদের একটি দলে যোগ দেওয়ার আদেশ দেয়, যে দলের মূল কাজ ছিল বিদেশীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে তাদের খবরাখবর কেজিবিকে পৌঁছে দেওয়া। পরবর্তীতে বিবিসির কাছে দেওয়া সাক্ষাৎকারে কবি বলেন, "এটা ছিল অনেকটা একধরনের যৌনকর্মী হিসাবে কাজ করার মত -দেহব্যবসা করে গুপ্তচরবৃত্তি। আমি স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। আমি স্পষ্ট বলে দিয়েছিলাম আমি সহযোগিতা করতে পারব না। তখন থেকেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম কেজিবি - আজ হোক‌- কাল হোক- আমার পিছনে লাগবে।"

প্রমিথিয়াস 
 

যারা এখনো গুহামানবের মতো ভালোবাসে
যারা এখনো গুহামানবীর মতো ভালোবাসতে পারে
যারা ভালোবাসার রঙে মনজঙ্গলের দেওয়ালে দেওয়ালে খুঁজে পায় গুহাচিত্র
যারা জানে বাউলের গানে দোতারার তারে রক্ত ঝরে
যারা জানে প্রজাপতির রঙ-বেরঙ আদতে camouflage
যারা শত প্রযুক্তি পার করেও ফিরে আসে এক সরল palaeolithic আস্তানায় দৈনন্দিন
তেমনই এক আদিম আলিঙ্গনের দুই প্রান্ত আমি চিনতাম।
 
শ্বেত বল্কল বেশে                            
নিষ্পত্র ভুর্যের জঙ্গলে, তুষারপ্রান্তে
তাদের বল্গা-শিকার আমি দেখেছি। 
আর ফিরে এসেছি আয়নায় তোমার কাছে
বারেবার।
 
তারপর
 
রাতের আঁধারে চুপিচুপি আমরা চুরি করে এনেছি কত আগুন
কতবার

প্রতিদিন দানবী ঈগল খুবলে খাবলে উপড়ে নিয়েছে আমাদের রক্তাক্ত যকৃৎ
 
তবুও
চুরি করে এনেছি আগুন
আর মশাল থেকে মশাল জ্বেলেছি
এঁকেছি গুহাচিত্র
এঁকে চলেছি গুহাচিত্র
বারেবার
 
কারণ আদিম আলিঙ্গনের দুই প্রান্তের মানব মানবীরা একদিন ফিরে আসবেই
আর তুষার প্রান্তর পেরিয়ে তারা খুঁজে পাবে সংকেত
খুঁজে পাবে মনজঙ্গলের গুহাচিত্র, দোতারার রক্ত আর প্রজাপতির camouflage.....
সেই palaeolithic আস্তানায়।
 
বা হয়তো তোমার আয়নায়
আমাকে।

touch.jpg

সম

বিতায় যাকে খুঁজছিলাম সেই আশ্বিনের আকাশ আজ হঠাৎ ডানা মেলে উড়ে এলো হুড়মুড় একটা উদ্বাস্তু চড়ুইয়ের সাথে কাকভোরে।

অনেক দিন আগে কাশরোদ্দুর যেন এমন ছিলো ব্যাঙ্গলোর ছাড়িয়ে, স্টেট হাইওয়ের পথে গাড়ি থামিয়ে যেখানে মাটির কাঁধে ঝুঁকে পড়ে প্রেমকামড় বসিয়েছিলো রাস্তার ওপারের শুকনো গুলমোহরের ডাল

সিগারেট ধরিয়ে আমরা জেনেছিলাম আমাদের পথ চলা 
সমস্ত সব রাস্তার থেকে বেশি। একরত্তি ধোঁয়া 

থেকে গিয়েছিলো কাশ আকাশে।


আজ হঠাৎ ডানা মেলে উড়ে এলো। 
কাশভোরে ।।

ইদিপাস

ধিকাংশ বাঙালীর মনে একটা ভুল ধারণা আছে যে কাশফুল শুধুমাত্র ফোঁটে বাঙলার মাটিতেই। এটা ঠিক নয়। ভারতবর্ষের বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে তো বটেই, বিদেশের মাটিতেও বিস্তৃত এলাকা জুড়ে কাশবন আমি দেখেছি। যতদূর জানি এধরনের ফুলকে পরিভাষায় বলে catkins। অবশ্য ভুলও হতে পারে। আমি উদ্ভিদ বিশারদ নই। তবে অনুবাদে যতই খামতি থাক ভ্রান্তিবিহীন অনুরণন, 
কারণ, 
একথা হলফ করে বলতে পারি যেখানে যখনই কাশফুল পেয়েছি
আকাশপানে চেয়েছি
আর দেখেছি
পেঁজা তুলোর মেঘে মেঘে
শরতের আদর মেখে
আকাশ বড় ফুরফুরে
আর দূরে, বহুদূরে 
সেই কাশদুপুরে
দৌড়ে দৌড়ে ঘুরে ঘুরে
দুর্গা, অপু, বিভূতিভূষণ 
আর ফোকলা হাসিমেখে ইন্দির ঠাকুরণ।
সেই ধানক্ষেত, স্টীম ইঞ্জিন, রেলগাড়ি,
কচি কুয়াশার আধ্ ভোরে আকাশবাণীর আলোয়
আমার মধ্যবিত্ত বাড়ি 
আশ্বিনের শারদপ্রাতে সেখানে আলোক মঞ্জরী।
এবার বুঝি ঢাক বাজবে
এইবার বুঝি চিন্ময়ীর হবে মৃন্ময়ী রূপে অবতারণ 
বিশ্ব চরাচর জুড়ে মাতৃশক্তি নারীশক্তির আরাধন
আর পরিত্যক্ত ক্ষেতের মাঝে পুড়িয়ে ফেলা বালিকার নিগৃহীত জীবন
আমাদের 
ক্লেদাক্ত 
মানসপটের 
অনুরণন।

তাই
যেখানে যখনই কাশফুল পেয়েছি
আকাশপানে চেয়েছি
আর পেঁজা তুলোট মেঘের শার্সিতে দেখেছি
শহরে শহরে
গ্রামে গ্রামে
হাটে বাজারে
লাঞ্ছনার ইতিহাস।

 

দরপেশ
 

কটা নদী।

দোকানি আকাশের কাছ থেকে বিকেলের রঙ কিনে বহমান। সোনাগলানো কাঁচরঙ, দুধেআলতা, কামরাঙা, সিঁদূরগলানো, লোহাজ্বালানো, পাখির বাসা পোড়ানো এক জীবন শাদা জামা। নির্ভেজাল সাদা
যার মাঝে রক্তের লাল, খয়েরি ঘাম, সোনাগলানো কাঁচরঙ, লোহাজ্বালানো দুধেআলতা, পাখির বাসা পোড়ানো রাঙা সিঁদূর, বারংবার বন্দী রামধনু আকাশ।

আচ্ছা, কত রঙ কয়েদ করলে রঙ পাল্টে ফেলা যায় ইচ্ছেমতো? কতদিন? কতবার?
নাকি রঙগুলো সব বেহাঙ্ড়া? যতই আলাদা করো সব মিলেমিশে আবার সফেদ? আবার এক জীবন শাদা জামা?

এক ঝোলাব্যাগ ভর্তি মানুষের ইতিহাস
তাদের মরণবাচন গান, হাঁতুড়ি কোদালের জরাজীর্ণ ফুসফুসের ধুকপুকানি।

এক বুকপকেটবেঁধা কলম ভরা আশ্চর্য সব কবিতা আশ্চর্য সব মানুষের দোকানি আকাশের রঙের বেসাতি পুষিয়ে দেওয়া একবুক নদীর গান
টালমাটাল কত কবিতা বেঁধে রাখলে ইতিহাস পাল্টানো যায়?
কতদিন? কতবার? ইচ্ছেমতো?

একমুখ হাসি জুড়ে কতকথা তোমার আমার
আর, বিকেলটাকে বুকজলে নিজের করে নিয়ে নদীর একমুঠো প্রতিবাদ ............
মৃত্যুশয্যায় ধুঁকছে আজ।

একচোখ বর্তমানে
পিঞ্জরে পিঞ্জরে
আমরা দেখছি।
আমরা দেখছি কত বাঁধ বাঁধলে নদীকে হাতকড়া পড়ানো যায় চিরন্তন।

আমরা দেখছি
সর্পিল পাহাড়ি রাস্তায় রাস্তায় ডাইনিরা সব হাসছে।
আমরা দেখছি। 

আমরা ম্যাক্'বেথ।

নক্ষত্র নয়
 

ঠাকুমা যখন মারা যায়, তখন আমি খুব ছোটো। লোডশেডিং এর রাতে বাবার হাত ধরে চলেছি। চাঁদের আলোয় রুপোর নদী শহরতলীর অনাদৃত গলি। আকাশপানে চেয়ে বাবা বললেন ঠাকুমা এখন এক নক্ষত্র।

কাঁটায় বেঁধা দিন রাত এখন।

আলকাত্‌‍‍রায় আটকে পড়া মাছির ছটফটানির,

গোঙানির কাল।

চাঁদের আলোয় রুপোর নদীর রেললাইন।

যাদের ছায়া আমাদের দেশকালে কোনো দাগ কাটে না তারা পথযাত্রী।

তাদের বেদনায় ফোটে না কোনো ফুল।

তাদের চেতনায় হয় না সবুজ পান্না আমাদের ।

যারা নিছকই খবরের কাগজের কিছু ছবি।

তারাও ক্লান্ত হয়।

হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে পথভ্রান্ত হয়।

সহস্রাব্দের মড়কের ক্লান্তি নিয়ে তারা যখন ঘুমিয়ে পড়ে, চাঁদের আলোয় রুপোলী রেললাইন তখন তাদের শীতল করে। 
হিমশীতল কাটা কিছু লাশ। 

নক্ষত্র নয়।

birds.jpg

গল্প

মৃত্যুর শব্দ

প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা ​

পুজো বার্ষিকী ১৪২৮ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

Maitrayee Mukhopadhyay.jpg

মৃত্যুর শব্দ 

মৈত্রেয়ী মুখোপাধ্যায়

পঃ মেদিনীপুর, পঃ বাংলা 

women edu.jpg

(১)

পাহাড়ের গা ঘেঁষে বাঁক নিতে গিয়ে বেসামাল হয়ে গেল গাড়িটা। গড়িয়ে পড়ল খাদে। গাড়ির ভেতরে থাকা মানুষগুলোর আর্তনাদে কান চেপে ধরল মোহিনী। আহহ্, কি ভয়ানক আওয়াজ! গাড়ির ভেতরে থাকা সকলের মুখ অস্পষ্ট। নিজেকে সেই অজানা যাত্রীদের মাঝে দেখে আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল মোহিনী। ধড়ফড় করে উঠে বসল। কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম গড়িয়ে পড়ল গাল বেয়ে। দুঃস্বপ্ন। খাট থেকে নামল কোনো রকমে। পা কাঁপছে। ডাইনিংয়ে এলো। বোতলে জল নেই। রান্নাঘরে জল ভরতে গিয়ে চোখ গেল জানালার দিকে।
আশ্চর্য, জানালা তো প্রতিদিন সন্ধ্যে হলেই লাগিয়ে দিই। আজ কি তবে ভুলে গিয়েছিলাম? মনে করার চেষ্টা করল মোহিনী। জানালা বন্ধ করতে গিয়ে বাইরের দিকে চোখ পড়তেই ক্ষণিকের জন্য ভয় লাগল ওর। জমাট অন্ধকার ঝুলে আছে আকাশে। এক্ষুনি যেন ঢুকে পড়বে ঘরে। তাড়াতাড়ি জানালা বন্ধ করে শোবার ঘরে গেল। ঘড়ি জানান দিচ্ছে মধ্যরাত; দুটো বেজে দশ মিনিট। আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ল। কিছুতেই ঘুম আসছে না। এপাশ ওপাশ করতে করতে একসময়  ঘুমিয়ে পড়ল।

(২)

মোহিনী একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করে। এই ফ্ল্যাট ওর কেনা নয়, ভাড়ায় আছে। ওর এক কলিগ ঠিক করে দিয়েছিল এটা। ছোটোর ওপরে বেশ ভালো। খোলামেলা। ওর বেডরুম লাগোয়া একফালি বারান্দাও আছে। ভালো না লাগলে বারান্দাতে এসে বসে। সাথে বই আর কফি। জায়গাটা নিরিবিলি। আসলে এখনো সেভাবে বাড়িঘর গজিয়ে ওঠেনি এই দিকটায়। ফ্ল্যাটের উত্তরদিক পুরো ফাঁকা। বেশ কিছুটা দূরে একতলা একটা বাড়ি আছে। পরিত্যক্ত। এরকম জায়গায় পরিত্যক্ত বাড়ি দেখে মোহিনী একটু অবাকই হয়েছিল। ওর মা-বাবা মাঝেমধ্যে মেয়ের কাছে এসে থেকে যান কয়েকদিনের জন্য। নিজের বাড়ি ছেড়ে তাঁরা খুব একটা আসতে চান না বাঁকুড়ায়।

ব্যাংক থেকে ফিরেই আবার বেরনোর জন্য তৈরী হলো মোহিনী। অফিস কলিগের জন্মদিনের নিমন্ত্রণ। সন্ধ্যে হয় হয়। বেরোনোর আগে ভালো করে দেখে নিল সব জানালা গুলো বন্ধ করেছে কিনা। বসার ঘরের আলো নেভাতে গিয়ে থমকালো। নাহ্,থাক। জ্বলুক এটা।

বাড়ি ফিরল যখন তখন দশটা পেরিয়ে গেছে। খুব ক্লান্ত লাগছে। চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছে ঘুমে। ইদানিং একটা বিষয় লক্ষ্য করছে মোহিনী। সন্ধ্যে হয়ে গেলেই ক্লান্ত লাগে খুব , কাজ করতেও ইচ্ছে হয় না। ছুটির দিনেও হয় এরকম।

মাকে বলতে মা বলেছিলেন,

— সারা সপ্তাহ কাজের এতো চাপ থাকে তোর তাই এরকম লাগছে। ও কিছু নয়। ছুটিছাটায় তো কাছেপিঠে কোথাও ঘুরে আসতে পারিস।

একা একা কোথাও যেতে ওর ভালো লাগেনা। এখানে ওর সেরকম কোনো বন্ধু নেই। মনের দুটো কথা বলারও লোক নেই। আসা থেকে দেখছে ওর ফ্ল্যাটের উল্টো দিকের ফ্ল্যাটের দরজায় বড় তালা ঝুলছে। তিনতলায় ও একা!

দরকার ছাড়া কোথাও বেরোয় না। রান্নাবান্না, ঘরের সব কাজ নিজেই করে। ওতেই বেশিরভাগ সময় কেটে যায়। আর অবসরের সঙ্গী বই। ছোট থেকেই বই পড়তে ভালবাসে মোহিনী। দুষ্প্রাপ্য কয়েকটি বইও আছে ওর সংগ্রহে। তার মধ্যে একটি বই খুঁজতে তিনবার কলকাতা ছুটেছে ও। বইটির বিষয়ে জানতে পারে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে। তখনই বইটিকে বেশ ইন্টারেস্টিং মনে হয়েছিল ওর। অবশেষে আগের সপ্তাহে কলেজ স্ট্রিটে অনেক ঘুরে খুব পুরনো ছোট্ট এক বই দোকানে পেল বহু আকাঙ্ক্ষিত সেই বই। এক কপিই অবশিষ্ট ছিল দোকানে। যেন ওর আসার অপেক্ষাতে ছিল। অনেক দিন আগেই বইটির প্রকাশনা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বইটি এক অনামী লেখকের লেখা। একটাই উপন্যাস। কাহিনীতে অনেক মোড়। রহস্য না ভৌতিক এখনো বুঝতে পারেনি মোহিনী। বইটি হাতে নিলেই মোহিনীর মনে হয় বইটি যেন ওকে টানছে চুম্বকের মতো।

(৩)

রাতের খাওয়া শেষ করে অফিসের কাজ করছিল মোহিনী। একটানা বসার জন্য পিঠে ব্যথা করছে। টেবিলে রাখা নতুন বইটার দিকে দেখল। বাকি কাজটুকু কাল সেরে নেবে। এখন আর করতে ইচ্ছে করছে না। ফাইলগুলো গুছিয়ে রেখে বইটা নিয়ে খাটে হেলান দিয়ে শুলো। পড়তে পড়তে  বুকের ওপরেই বই রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিল।
আবার সেই স্বপ্ন। পাহাড়ের বাঁক, খাদে পড়ন্ত গাড়ি, আর্ত চিৎকার আর তার সাথে একটা মুখ; বীভৎস সে মুখ। ক্রোধে ঘৃণায় জ্বলছে দুটো লাল চোখ। মুখের অর্ধেক কঙ্কাল, অর্ধেক চামড়া; গলে পড়ছে গাল বেয়ে। ঠোঁটের কষে শুকনো রক্ত। ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে অদ্ভুত শব্দ করতে করতে এগিয়ে আসছে সেই মুখ, একটু একটু করে। তীক্ষ্ম কর্কশ শব্দ। পচা মাংসের গন্ধ। গা গুলিয়ে আসছে মোহিনীর। আসছে, এগিয়ে আসছে সে, লক্ষ্য মোহিনী।
চিৎকার করে উঠল মোহিনী। দরদর করে ঘামছে। গলা শুকিয়ে গেছে। চোখ গেল বালিশের পাশে। বইটা খোলা অবস্থায় আছে। উঠে চোখে মুখে জল দিল। অনেকটা  জল খেলেও গলার ভেতরটা আরো শুকিয়ে যাচ্ছে যেন। বইটা টেবিলে রাখতে গিয়ে দেখল ঘড়িতে একটা বেজে দশ মিনিট হয়েছে সবে। ঘরের আলোটা জ্বলছিল এতক্ষণ। আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ল।

এরকম স্বপ্ন আগে কখনো তো দেখিনি। কেন একই স্বপ্ন দেখছি বারবার? তাও এতো স্পষ্ট? ঐ বইটা পড়ার জন্যই কি? প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছিল মোহিনী। শেষে মনকে বোঝালো স্বপ্নের সাথে বইয়ের কোনো সম্পর্ক নেই। ভয় পাওয়ার কি আছে এত? ভগবানের নাম স্মরণ করল। এসব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ল। বাইরে তখন টিপ্ টিপ্ করে বৃষ্টি নেমেছে।

পরের দিনটা শুরু হল আকাশের মুখ ভার দিয়ে। বৃষ্টি এখন হচ্ছেনা আর। তবে শেষ রাতে ভালোই বৃষ্টি হয়েছে। রাস্তাঘাট ভেজা। অফিস থেকে বেরোতে একটু দেরি হয়ে গেল মোহিনীর। রাস্তাঘাট আজ কেমন ফাঁকা ফাঁকা। লোকজন বিশেষ  নেই।  অটো থেকে নেমে গলির শেষেই ওর ফ্ল্যাট। রাস্তাটায় আলো জ্বলছে না। কালো মেঘে অসময়ে সন্ধ্যে নেমেছিল অনেকক্ষণ। ব্যাগ থেকে ফোন বের করে ফোনের টর্চ জ্বালতে গিয়ে দেখে জ্বলছে না। আশ্চর্য তো, ফোনের কী হলো। বিরক্ত হল মোহিনী। আচমকা পায়ের শব্দে ও দাঁড়িয়ে গেল। পিছনে ঘুরে দেখল। কেউ নেই। পায়ের শব্দও থেমে গেছে। আবার হাঁটা শুরু করতেই আবার সেই শব্দ। পা ঘষটে চলার মতো শব্দ। ঝোড়ো হাওয়া বইছে। এবার ভয় লাগল মোহিনীর। রাস্তায় একটা মানুষ তো দূর, কুকুরও নেই। প্রায় ছুটতে ছুটতে এসে ফ্ল্যাটে ঢুকল। মুখ লাল হয়ে গেছে। হাঁপাচ্ছে। ওর এরকম অবস্থা দেখে ফ্ল্যাটের দাড়োয়ান অবাক।

— আপনি ঠিক আছেন ম্যাডাম?

— হ্যাঁ।

মোহিনী কথা না বাড়িয়ে নিজের ঘরে এল। কিছুক্ষণ বসার পর একটু ধাতস্থ হল। মাথাটা যেন ভারী হয়ে আছে। কোনোরকমে রান্না শেষ করেই মাকে ফোন করল।

— হ্যালো, মা, কেমন আছো? বাবা কেমন আছে?

— ভালো আছি রে। তোর বাবা তো তার বাগান নিয়ে ব্যস্ত। তুই কেমন আছিস? শরীর ঠিক আছে তো? কাজ কেমন চলছে?

মাকে ঘটনা গুলো বলবে ভেবেও চেপে গেল। বেকার  চিন্তা করবে।

— ভালো আছি। কাজ হচ্ছে ভালোই। চাপ আছে কাজের।

আর টুকটাক কিছু কথা বলে ফোন রাখল মোহনা। মনটা বেশ হালকা লাগছে এখন। আজ আর বইটা পড়বে না ঠিক করেছিল। কিন্তু রাত্রে খাওয়ার পরে পড়তে ইচ্ছে হচ্ছে খুব। মন চাইছে পড়তে, মাথা চাইছে না। এক অদ্ভুত অবস্থা। অবশেষে মনের জয় হল।

 

(৪)

আজ আর শুলোনা। খাটেই বইটা খুলে বসল। পড়তে পড়তে এতই মগ্ন হয়ে গিয়েছিল যে খেয়াল করেনি কখন বারোটা বেজে গিয়েছে। চার্চের বারোটার ঘন্টা বাজতে চমক ভাঙল ওর। এতো রাত অব্দি সচরাচর জাগে না। ভোরে ওঠা ওর অভ্যেস।

বইটা বেশ ইন্টারেস্টিং। সূক্ষভাবে প্রকৃতির বর্ণনা আছে। যতক্ষণ পড়ছিল, ওর মনে হচ্ছিল, যেন সেই জায়গাতেই ও আছে। চারপাশে পাহাড়, রডোডেনড্রনের লাল-লাল ফুল, সরু রাস্তা। এসব ভাবতে ভাবতে বই রেখে ঘরের জানালা বন্ধ করল মোহিনী। বৃষ্টি পড়ছে হালকা। বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে। আলো নেভানোর আগে দেখল বারোটা বেজে দশ ছুঁইছুঁই।

শুতে যাবে, এমন সময় ধপ করে কিছু পড়ার শব্দ হলো। চমকে উঠল। তাড়াতাড়ি আলো জ্বালালো ঘরের। কোথাও অস্বাভাবিক  কিছু চোখে পড়ল না। কিন্তু শব্দটা এই ঘরেই হয়েছে। চারিদিক ভালো করে দেখল; ডাইনিং, বসার ঘর সব জায়গা। নাহ্। কিছু নেই। ঘরে আসতেই চোখ গেল টেবিলের  দিকে। বই গায়েব। এখানেই তো রেখেছিল। গেল কোথায়? আবার একপ্রস্থ খোঁজাখুঁজি। কি মনে হতে ডাইনিং রুমে এসে দেখল সেখানের চেয়ারে আছে বইটা।আশ্চর্য, এখানে এলো কী করে? তবে কি আমিই এক খেয়ালে এখানে রেখেছিলাম? তাই যদি হয় তবুও এত জোরে শব্দটা কোথায় হল? বাইরে? তাই হবে হয়তো। ভাবল মোহিনী। বইটা ঠিক জায়গায় রেখে শুয়ে পড়ল। কিছুতেই ঘুম আসছে না ওর। কোথায় একটা কুকুর অনবরত কেঁদে চলেছে। কুকুরের কান্নার শব্দে রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে যাচ্ছে। বৃষ্টি বোধহয় থেমেছে। কেমন এক অস্বস্তি লাগছে মোহিনীর। কেন এরকম হচ্ছে, বুঝতে পারছে না। প্রতিটা ঘটনার মধ্যে সংযোগ খোঁজার চেষ্টা করল। সব অস্পষ্ট। মাথা ব্যথা করছে। গল্পের লাইনগুলো মনে আসছে বারবার। সেই রডোডেনড্রনের লাল রং, নাম না জানা অর্কিড, পাহাড়ের সারি..।

 

(৫)

আজ রবিবার। রোদ ঝলমলে সকাল। কে বলবে গতকাল মেঘে ঢাকা ছিল আকাশ? আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতি বোঝা দায়। মোহিনী কফির কাপ হাতে বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল। রাতের ঘটনাগুলো মাথায় আসতেই ভাবল এর একটা বিহিত করতেই হবে। কিন্তু কীভাবে? কারো সাথে এই বিষয়ে আলোচনা করবে সেরকম তো কেউ নেই ওর। মা-বাবা জানলে চিন্তা করবে অকারণ। ভাবনায় ছেদ পড়ল। কলিংবেলের শব্দ। এতো সকালে কে এলো? দরজা খুলতেই একটু অবাকই হল মোহিনী। অস্মিতা আর মিতালি এসেছে, অফিস কলিগ। ওরা প্রায় সমবয়সী।

— আরে তোরা! আয়, ভেতরে আয়।

— বেশ সাজিয়েছিস তো রুমটা। সোফায় বসতে বসতে বলল মিতালি।

— ঐ আরকি। একটু বোস তোরা। আমি ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থা করি।

— তুই একা কেন করবি, আমরা হেল্প করছি। উঠতে গিয়ে বলল অস্মিতা।

— আরে দরকার নেই। পাস্তা করতে আর কতক্ষণ লাগে। চা খাবি না কফি?

— কফি খাবো পরে। অস্মিতার দিকে তাকিয়ে বলল মিতালি। অস্মিতা মাথা নাড়ল, সম্মতি জানাল।

— ঠিক আছে। তোরা ঘরগুলো ঘুরে দেখ ততক্ষণ, আমি আসছি।

— হ্যাঁ, হ্যাঁ।

ওরা দুজন মিলে ঘরগুলো ঘুরে দেখছিল। টেবিলের ওপর রাখা বইটা নিয়ে পাতা ওল্টাচ্ছিল অস্মিতা।

— কি দেখছিস রে অস্মি? ব্যালকনি থেকে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে জিগ্যেস করল মিতালি।

— একটা বই। বেশ পুরনো মনে হচ্ছে।

— বইটার নাম কি? জিগ্যেস করল মিতালি।

ফোন বেজে উঠল অস্মিতার। অচেনা নাম্বার।

— হ্যালো, কে বলছেন?

ও প্রান্ত থেকে কোনো উত্তর নেই।

বার কয়েক হ্যালো,হ্যালো করে শেষে ফোন কেটে দিল অস্মিতা।

— ফোন করা কেন ভাই চুপ থাকবে যখন। বিরক্তিকর। অস্মিতার মুখে বিরক্তির ছাপ।

— চলে আয়, পাস্তা রেডি। রান্নাঘর থেকে খাওয়ার ডাক পড়ল।

সবাই ডাইনিং টেবিল ঘিরে বসল। খেতে খেতে বেশ গল্প চলছিল। মোহিনী ভাবছিল ওর সেই স্বপ্নের কথাটা বলবে কিনা। বিশ্বাসযোগ্য তো নয়। বিজ্ঞানের যুগে দাঁড়িয়ে ভূতপ্রেত নিয়ে ভাবতেও কষ্ট হয়। কি মনে করবে ভেবে ওদের বলল না। যা হবে দেখা যাবে। ছোটো থেকেই সাহসী বলে সুনাম আছে ওর। ক্যারাটেতে ব্ল্যাক বেল্ট।

— এবার কাজের কথা শোন; যে জন্য এতো সকালে আসা। খাওয়ার শেষে বলল মিতালি।

— এক মিনিট। কফিটা নিয়ে আসি।

কফির কাপে ছোট্টো চুমুক দিয়ে অস্মিতা বলল, কফিটা দারুণ হয়েছে মোহি।

— এবার শোন। ভাবছিলাম দার্জিলিংয়ে ঘুরতে গেলে কেমন হয়? পরের সপ্তাহে পরপর চারদিন সরকারি ছুটি পড়েছে। আর দুদিন নিজেরা ছুটি নিয়ে নেব ম্যানেজ করে। এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মোহিনীর মুখের দিকে তাকাল মিতালি।

একটু ভেবে মোহিনী বলল, আইডিয়া ভালো। কিন্তু কারা কারা যাচ্ছি?

— এই তো আমরা তিনজন আর আমার এক মাসতুতো দিদি। জামাইবাবু ওখানেই ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের উচ্চপদস্থ অফিসার। সব ব্যবস্থা উনি করে রাখবেন। দিদি কয়েকদিনের জন্য এসেছিল এখানে। প্ল্যানটা তারই। এবার বল, যাবি? উৎসাহ নিয়ে প্রশ্ন করল মিতালি।

মোহিনী হেসে বলল, ওকে, নো প্রবলেম। মাও বলছিল কোথাও ঘুরে আসার জন্য।

— টিকিটের ব্যবস্থা আমিই করছি। একসাথে কাটলে পরপর সিট পাওয়া যাবে।

— সোয়েটার নিতে ভুলিসনা যেন। জুলাই মাসেও ওখানে ঠান্ডা থাকবে। বলল অস্মিতা।

—ঠিক আছে তবে, আজ আসি রে। আমরা বৃহস্পতিবার রওনা হব। হাতে আর তিন দিন সময়। টিকিট বুক করে তোকে পাঠিয়ে দেব। বেরোতে বেরোতে বলল মিতালি।

— হ্যাঁ রে। অফিসে তো দেখা হচ্ছেই।

অস্মিতা হেসে বলল, সে আর বলতে।

— আসছি রে।

— সাবধানে যাস। আসিস আবার।

— হ্যাঁ; তুইও যাস। বাই। হাত নেড়ে চলে গেল ওরা। 

ওরা চলে যেতেই মাকে ফোন করে বেড়াতে যাওয়ার কথা বলল মোহিনী। বাড়ি থেকে কোনো আপত্তি নেই।

মন খুশি খুশি হয়ে গেছে ওর। অনেকদিন পর কোথাও বেড়াতে যাবে। মা-বাবার সাথে গেলে আরো ভালো লাগত। ওর ইচ্ছে আছে মা-বাবাকে নিজের টাকায় বেড়াতে নিয়ে যাবে, দূরে কোথাও। দুপুরে লিস্ট বানাতে বসল কি কি নিয়ে যাবে আর কিছু কিনতে হবে কিনা। কয়েকটা জিনিস কিনবার আছে। বিকেলে বেরোতে হবে। এসবের মাঝখানে বইটার কথা মনেই পড়লনা ওর। 

(৬)

সন্ধ্যে নামার আগেই ঘরে চলে এল। এটা ওটা করে অনেক কিছুই কেনা হয়ে গেছে। রাতে তাড়াতাড়ি খেয়ে জিনিসপত্র সব গোছাতে বসল। অফিসের কিছু কাজ বাকি ছিল। সেগুলো শেষ করে যখন শুতে গেল তখন এগারোটা বেজে গেছে। চোখ ভারী হয়ে আসছে ঘুমে।

শোবার সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়ল মোহিনী। গভীর ঘুম। স্বপ্ন বিহীন রাত। পরের দিন আবার বাঁধাধরা রুটিন মাফিক কাজ। অফিসের কাজ সেরে ফিরতে একটু বেশিই দেরি হয়ে গেল মোহিনীর। রাতের খাবার কিনে নিয়ে এসেছে। দরজা খুলে আলো জ্বালাতে গিয়ে দেখে জ্বলছে না। অদ্ভুত ব্যাপার। সিঁড়িতে তো আলো জ্বলছে। বাল্বটা খারাপ হয়ে গেল নাকি? টিউবটাও তো জ্বলছেনা। অন্ধকারেই হাতড়ে হাতড়ে ডাইনিংয়ে এলো।

সেখানেও একই অবস্থা। খোলা জানালা দিয়ে রাস্তার ভেপার ল্যাম্পের মৃদু আলো ঘরে এসে পড়ছে। হালকা আলো-আঁধারিতে দেখল মাটিতে কিছু একটা পড়ে আছে। জিনিসটির দিকে এগিয়ে যেতেই অদ্ভুত কান্ড। ঘসঘস শব্দ করে পিছোচ্ছে বাক্সের মতো জিনিসটা। মোহিনী যত এগোচ্ছে তত পিছিয়ে যাচ্ছে বস্তুটি। মোহিনী যেন মোহাবিষ্ট হয়ে পড়েছে। মরীচিকার পিছনে ছুটছে। ব্যালকনির দরজা খুলতেই দেখল ভারী জিনিসটা রেলিংয়ের পাশে পড়ে আছে। রাস্তার আলোয় স্পষ্ট দেখল জিনিসটা আর কিছুই নয়, সেই বই। হঠাৎ দমকা হাওয়ায় চোখে ধুলো ঢুকে গেল ওর। চোখ জ্বলছে, তাকাতে পারছেনা। কোনোরকমে ঘরে ঢুকে চোখে জল দিল। জ্বালা ভাব কমেছে একটু। চোখ ঠিক হতেই দেখল আলো জ্বলছে ঘরে। একটু আগে যা হল মনে আসতেই ছুটে শোবার ঘরে গিয়ে দেখল বইটা টেবিলেই আছে! তবে একটু আগে যে বারান্দায় ছিল, আর, তার আগে ডাইনিংয়ে? ওটা তো চোখের ভুল নয়। বারান্দায় যেতে গিয়ে দেখল দরজার ছিটকিনি লাগানোই আছে। এতক্ষণ যা হলো তার কোনো চিহ্নই আর নেই। মোহিনীর মনে এক অজানা ভীতি চেপে বসল। ওর পা কাঁপছে। খাটে বসে একের পর এক সাজাচ্ছে ঘটনাগুলো। কেন হচ্ছে, তার কোনো উত্তর পেলনা। বইটাই কি তবে..কিন্তু এও কি সম্ভব? এরকম কখনো শোনেনি তো। বইটা আপাতত আর পড়বেনা ঠিক করল ও। তখনই মনে পড়ল গতকাল তো পড়েনি, আর কোনো ভয়ের স্বপ্নও দেখেনি। কিন্তু বইটা পড়তে যে ওর ভীষণ ইচ্ছে করছে। সেই পাহাড়... না। ঐ বই নিয়ে আর ভাববে না মোহিনী, কিছুতেই না। রাতে আজ আর অফিসের কাজ করতে ইচ্ছে হলোনা। কি মনে হতে বইটা হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখল। হঠাৎ চোখ গেল শেষ পৃষ্ঠায়। পৃষ্ঠাটি ফাঁকা! হলদেটে হয়ে গেছে। ভালো করে ভেতরের পৃষ্ঠাগুলো দেখল। সব ঠিক আছে শুধু শেষ পাতাটা বাদে। বইটা রাখল মোহিনী। দশটা বেজে দশ মিনিট। শুয়ে শুয়ে বিভিন্ন বিষয়ে  চিন্তা করতে লাগল। আচমকাই মনে পড়ল বারান্দার দরজা বন্ধ করেই ও বেরিয়ে ছিল সকালে। তাহলে বইটা বারান্দায় কী করে গেল? দরজা খুলল কে? মনে হতেই অজানা আতঙ্ক ঘিরে ধরল ওকে। পাশ ফিরে চোখ বন্ধ করে ঘুুুমোনোর চেষ্টা করতে লাগল। মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল ওর। কেন ভাঙল বুঝতে পারলো না ঘুমের ঘোরে। খসখস করে একটা আওয়াজ হচ্ছে। একটু পরেই শব্দটা থেমে গেল। তখনই কোথায় একটা কুকুর কেঁদে উঠলো, আকাশ- বাতাস কাঁপিয়ে। কুকুরের কান্না অশুভ, বলে সবাই। কোনো পশুরই কান্না ভালো লাগে না মোহিনীর। মন খারাপ লাগে। ফুল স্পিডে চলা ফ্যানের শব্দের ভেতর দিয়েও কান্নার আওয়াজ আসছে। শুনতে শুনতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল জানেনা। ঘুম ভাঙল একেবারে সকালে।আজ অনেক কাজ আছে। আর দুদিন পরে রওনা হবে। গতকাল টিকিট ফোনে পাঠিয়ে দিয়েছিল মিতালি। রেডি হতে হতে বইটার দিকে দেখল একবার। ঠিকই আছে। সব স্বাভাবিক।

 

(৭)

বুধবারের সন্ধ্যা। কাল সকালে গাড়িতে করে হাওড়া যাবে সবাই। দুপুরে ট্রেন। ব্যাগ গোছানো শেষ। বইটা কি নেব? নেবে ভেবেও নিলো না। টেবিলে রেখে দিল। বেড়াতে গেলেও গল্পের বই ওর সঙ্গী হয়। ট্রলি আর হ্যান্ড ব্যাগটা বসার ঘরে রাখল। রাত্রে তাড়াতাড়ি খেয়ে নিল। ভোরে উঠতে হবে। উফফ্, যা আনন্দ হচ্ছে না! কখন যে যাবে! ফোনে গান চালিয়ে কাজ করছিল মোহিনী। গুনগুন করে নিজেও গাইছিল। সব ঠিকঠাক আছে কিনা দেখে নিল আরেকবার। 

গান থেমে গেল। ফোন বাজছে। অচেনা নাম্বার। ফোনটা রিসিভ করল।

— হ্যালো।

অন্যদিকে কোনো শব্দ নেই।

— হ্যালো, কে বলছেন?

নিরুত্তর।

ফোনটা রাখতে যেতেই কানে এলো ফ্যাসফ্যাসে আওয়াজ। ভয়ে ফোন কেটে দিল মোহিনী। নাম্বারটা ব্লক করতে গিয়ে দেখল ঐ নাম্বার নেই কল লিস্টে! আবার দেখল লিস্টটা। বিকেলবেলায় মা শেষ ফোন করেছিল ওকে। এখন বাজে আটটা বারো। ফোনটা এসেছিল দু-তিন মিনিট আগে। আবার সেই ভয় মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। ভাবতে পারছেনা আর। ফোনে অ্যালার্ম দিয়ে শুতে গেল। ঘুম আসতে অসুবিধে হলো না। বেড়াতে যাওয়ার আনন্দে- উত্তেজনায় ভুলে গেল বইটার কথা।

সকালে উঠেই চোখ গেল টেবিলের দিকে। বইটা আছে ওখানেই। সাড়ে সাতটার দিকে গাড়ি এলো। ওরা তিনজন এখান থেকে যাচ্ছে, আর মিতালির মাসিমণি ওঁর বাপের বাড়ি থেকে সোজা হাওড়ায় চলে আসবেন। কলকাতায় বাপের বাড়ি। ট্রেন ছাড়ল ঠিক সময়ে। বাবাকে ফোন করে জানিয়ে দিল মোহিনী। সবাই গল্প করছে। টুকটাক খাওয়াদাওয়াও চলছে। ইন্দ্রাণী মাসিমণিকে খুব ভালো লেগেছে মোহিনীর। হাসিখুশি মানুষ। বয়স খুব বেশি হলে চল্লিশ হবে। বিভিন্ন বিষয়ে গল্প হচ্ছিল। এগারোটার দিকে ওরা নিউ জলপাইগুড়িতে নামল। মেসোমশাই নিতে এসেছিলেন ওদের, অফিসের জিপ নিয়ে। উনিও মাসিমণির মতো হাসিখুশি, গল্প করতে ভালবাসেন। কাছেই একটা হোটেল বুক করে ছিলেন। রাতটা ওখানেই কাটিয়ে পরের দিন সকালে রওনা হবে দার্জিলিংয়ের উদ্দেশ্যে। রাতটা নির্বিঘ্নেই কাটলো। 

পরের দিন সকালে অল্প কিছু খেয়ে নিয়ে ওরা বেরিয়ে পড়ল। মেসোমশাই নিজেই ড্রাইভ করছেন। রাস্তাঘাট ওনার চেনা। শিলিগুড়িতে এলো যখন, নটা বেজে গেছে। সেবক রোডের পাশে একটা ছোটো দোকানে টিফিন করল সবাই। স্টিম মোমো মোহিনীর খুব পছন্দের। 

শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং অনেকটা রাস্তা। সতর্কতা আর দক্ষতার সাথে গাড়ি না চালালে যে কোনো মুহূর্তে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। পাহাড়ের গা ঘেঁষে ঘুরে ঘুরে ওপর দিকে উঠছে গাড়ি। দূরে অবিন্যস্ত পাহাড়ের সারি। সবুজ চা বাগান। পাহাড়ের কোলে ছোটো ছোটো বাড়ি। কোনো কোনো বাড়ির কাছে রঙিন পতাকা উড়ছে। ওগুলোতে বুদ্ধদেবের বাণী লেখা থাকে মেসোমশাইয়ের কাছ থেকে জানল মোহিনী। সোয়েটার, মাফলারের ভেতর দিয়েও ঠান্ডা লাগছে মোহিনীর। মাঝে আবার ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি হয়ে গেল। মেঘগুলো কতো কাছে! হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে যেন। গাড়ির ভেতরে বসেই মোহিনী  ফোনে কয়েকটা ছবি তুললো। জানলার কাঁচের জন্য খুব স্পষ্ট আসেনি ছবিগুলো। সারা রাস্তা মজা করতে করতে বাংলোয় এসে পৌঁছল যখন, তখন দুপুর হয়ে গেছে। বাংলোয় এক নেপালি ভদ্রলোক রান্নার কাজ করেন। বাগানের পরিচর্যার জন্য একজন মালি আছেন। বাংলোর ঠিক পিছন দিকেই পাইন গাছের সারি। কিছু ফার্ণ গোত্রের গাছও আছে। তিন বান্ধবী মিলে চারপাশটা ঘুরে ঘুরে দেখছিল।

একটা গাছের সামনে গিয়ে দাঁড়াল মোহিনী। লাল লাল থোকা থোকা ফুল।

— আরে, এই তো রডোডেনড্রন! বলল অস্মিতা।

ওর দিকে তাকিয়ে মোহিনী বলল, কি সুন্দর রঙ না!

— হ্যাঁ রে। মিতালি কোথায় গেল?

— মোহি, অস্মি তাড়াতাড়ি এদিকে আয়। মিতালি চিৎকার করে ডাকছে।

পাইন গাছগুলোর পাশে দাঁড়িয়ে আছে মিতালি।

আঙুল তুলে সামনের দিকে দেখাল,

— গাছের ফাঁক দিয়ে দেখ। কী বলত ওটা?

দুজনেই একসাথে বলল, পাহাড়।

— হ্যাঁ, কি পাহাড়? নাম কি?

— কি নাম? অস্মিতা জিগ্যেস করল।

— কে টু।

অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মোহিনী বলল, কাঞ্চনজঙ্ঘা!

— ইয়েস। হেসে উঠল মিতালি।

মেঘের চাদর সরতেই কাঞ্চনজঙ্ঘা আরেকটু স্পষ্ট হল। অবাক চোখে দেখছে মোহিনী। ছবির কাঞ্চনজঙ্ঘা ওর সামনে!

 

(৮)

দুপুরে ঘুমানোর অভ্যেস নেই মোহিনীর। শুয়ে ফোন ঘাটছিল। মিতু আর অস্মি ঘুমিয়ে পড়েছে। একটা খাটে ওরা তিনজন। মাসিমণি আর মেসোমশাই  অন্য ঘরে। ঘরটা বেশ বড়। মেঝে কাঠের। কাচের বড়ো বড়ো জানালা তিনটে বন্ধ। পরদা সরানো আছে। বাইরেটা দেখল ও। কেমন যেন ছায়া ছায়া ভাব। মেঘের পাতলা আস্তরণ গাছপালার ডালে আটকে আছে। ঘুম ঘুম লাগছে মোহিনীর। পাতলা কম্বলটা ভালো করে গায়ে চাপা নিয়ে অচিরেই ঘুমিয়ে পড়ল। একটা সরু পাহাড়ি পথ। পথের একপাশে গুল্ম জাতীয় গাছ নাম না জানা সাদা আর বেগুনি রঙের ফুলে ভরে আছে। ফাঁকা রাস্তা। একাই হাঁটছে মোহিনী।

ধোঁয়া মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে খাদ থেকে  কুয়াশা উঠছে ওপরে। কুচো কুচো মেঘ এসে ছুঁয়ে যাচ্ছে ওকে। আনমনে হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর এসে পড়েছে । অন্ধকার নামছে। ফিরবার পথ ধরল। অনেকক্ষণ তো হাঁটছি, তাহলে এখনো বাড়ি পৌঁছতে পারলাম না কেন? চিন্তা হচ্ছে এবার। এমন সময় কড়াৎ শব্দে বাজ পড়ল সামনের পাহাড়ের মাথায়। তার সাথে সোঁ সোঁ করে বাতাস। ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে এগোচ্ছে ও। বাতাসের ধাক্কায় ঠিকমতো  হাঁটতে পারছেনা। কানে এলো সেই ফ্যাসফ্যাসে স্বর। কাছে এগিয়ে এসেছে, একদম কানের কাছে; 'সময় শেষ' তীক্ষ্ম অস্পষ্ট স্বরে কানের পর্দা যেন চিরে যাচ্ছে। পিছন দিকে ঘুরতে যেতেই শক্ত দুটো হাত চেপে ধরল ওর গলা। মোহিনী আপ্রাণ চেষ্টা করছে ছাড়াতে, পারছে না। দম বন্ধ হয়ে আসছে ওর।

কঙ্কালের হাত টুঁটি টিপে ধরেছে; আঙুলগুলো সাঁড়াশির মতো বসে যাচ্ছে গলায়। আর পারছেনা মোহিনী। তখনই হঠাৎ ওর পায়ের তলার মাটি সরে গেল। খাদে পড়ছে ও, গভীর কালো খাদটা ওকে গিলবে বলেই হাঁ করে আছে। ভয়ংকর অট্টহাস্যে চারপাশ কেঁপে উঠল। মোহিনী চেঁচিয়ে উঠল, বাঁচাও, বাঁচাও..।

— এই মোহি, এই মোহি, কী হল তোর? মোহিনীর কাঁধে ঝাঁকুনি দিল অস্মিতা।

ওর চিৎকার শুনে সবাই ছুটে এসেছে ওদের ঘরে।

অস্মিতাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল মোহিনী। এখনও ভয়ে কাঁপছে।

মিতালি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, শান্ত হ, শান্ত হ। স্বপ্ন দেখেছিস। তোর কোনো ভয় নেই, আমরা আছি তো তোর সাথে।

এক গ্লাস জল নিয়ে এসে মোহিনীকে খাইয়ে দিলেন ইন্দ্রাণী।

— কোনো ভয় নেই। আমরা তো আছি। কোনো অসুবিধে হলেই বলবে আমাকে।

মেসোমশাই ওর মাথায় হাত রেখে কোনো মন্ত্র পড়লেন, মনে হয় গায়ত্রী মন্ত্র। ওকে আশ্বস্ত করে ওনারা চলে গেলেন।

সন্ধ্যে নেমেছে। ছটা দশ বাজে।

— চল্ লুডো খেলি। এরকম মুখ ভার করে বসে থাকতে হবে না তোকে। মোহিনীকে একরকম জোর করেই খেলতে বসালো মিতালি। চা আর পকোড়া খেতে খেতে খেলা চলল। মাসিমণিও ওদের সাথে খেলতে বসে পড়েছেন।মোহিনীর খেলাতে মন নেই। অন্যমনস্ক। সেই স্বপ্নের রেশ এখানো কাটেনি। খেলা শেষে মাকে ফোন করল ও। অনেকক্ষণ কথা হলো, যদিও স্বপ্নের কথাটা পুরোপুরি বললো না। ঠিক হলো পরের দিন টাইগার হিল যাওয়া হবে। টাইগার হিল থেকে সূর্যোদয় দেখার মতো। সবার কাছেই শুনেছে মোহিনী। কেন জানি ওর ইচ্ছে করছে না যেতে। মন সায় দিচ্ছে না। 

রাতে শুয়ে শুয়ে অনেক ভাবল। স্বপ্ন তো স্বপ্নই। তাতে অত ভয় পাবার কি আছে? ও এতো ভীতু নয় যে ঘরে লুকিয়ে বসে থাকবে। নিজের মনেই হাসলো। বইটা কি টেবিলেই আছে? ধুর, কি বোকা বোকা কথা। বইটা তো নিয়েই আসেনি। টেবিল ছাড়া আর কোথায় থাকবে? মাথাটা নির্ঘাত গেছে। আবার মনে মনে হাসলো মোহিনী। 'গুডনাইট' বলে ওরা দুজন অনেকক্ষণ ঘুমিয়ে গেছে। মনে মনে একশো থেকে এক গুনতে গুনতে ঘুমিয়ে পড়ল মোহিনী।

 

(৯)

ভোর চারটে। গাড়ি  টাইগার হিলের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। বাইরে খুব ঠান্ডা। হাওয়া বইছে। অন্ধকার রাস্তা। টাইগার হিল অবজারভেটরি থেকে যখন সূর্যোদয় দেখল, মোহিনীর মনে হল যেন ওর জীবন সার্থক। এ এক ঐশ্বরিক সৌন্দর্য। কাঁচা সোনার সাথে রক্তিম আভা, আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ছে এভারেস্টের চূড়ায়। ছবি ক্যামেরা বন্দি করার পরে পরেই মেঘ এসে ঢেকে দিল সূর্যকে। রাস্তায় এসে সবাই এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করল খানিকক্ষণ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছে মোহিনী। ওর ফিরতেই ইচ্ছে করছিল না। এই এক অদ্ভুত ব্যাপার পাহাড়ের। এই রোদ ঝলমল করছে আবার পরক্ষণেই মেঘ করে বৃষ্টি। ওখান থেকে ওরা গেল একটি বৌদ্ধ গুম্ফায়। মোহিনীর ভালো লাগল জায়গাটা। খুব শান্ত পরিবেশ। দুপুরে ওরা একটা ছোট্ট রেস্টুরেন্টে খেল। সামনেই একটা চা বাগান আছে দেখে সবাই মিলে গেল সেখানে। 

সময় কতো তাড়াতাড়ি কেটে যায়। জিপে করে ফিরতে ফিরতে ভাবছিল মোহিনী। মেসোমশাই ভালোই গাড়ি চালান। বেশ দক্ষ। রাস্তার পাশে খাদ এতো দেখলেই ভয় লাগে। কালো মেঘ কোথা থেকে এসে আকাশ ছেয়ে ফেলল। রাস্তায় সামনে-পিছনে দ্বিতীয় কোনো গাড়ি নেই। হেডলাইটের আলোয় কুয়াশার বুক চিরে সাবধানে এগোচ্ছে ওদের গাড়ি। বাঁদিকে পাহাড়, ডান দিকে খাদ। আবার সেই স্বপ্নের কথা মনে হতেই ভয় হল মোহিনীর। এরকম আবহাওয়াই দেখেছিল ও স্বপ্নে। জানালার কাচ নামানো তাও মৃদু ফরফর একটা শব্দ হচ্ছে। পাশে রাখা বড় টোট ব্যাগটার চেন খোলা।  ব্যাগটায় ওর সখের দামি ক্যামেরা ছাড়া আর কিছু ছিলনা। শব্দটা ব্যাগটার ভেতর থেকেই আসছে না? একটু ঝুঁকে দেখতে গেল ও। হঠাৎ আকাশ চিরে বিদ্যুৎ ঝলসে উঠল। বিকট একটা শব্দ। গাড়িটা খাদের দিকে পাল্টি খেল। সকলের আতঙ্কের চিৎকার আর বাজ পড়ার শব্দ পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসছে। দরজা খুলতে পারার আগেই খাদে পড়ে গেল জিপ। অতলে তলিয়ে গেল। একরাশ কুয়াশা দলা পাকিয়ে ওপরে উঠে এলো। 

আস্তে আস্তে চোখ খুলল মোহিনী। গাড়ির দরজা খুলতে পেরেছিল শেষে, ছিটকে পড়েছে তাই। বাকিদের কি হল জানে না। মাথা তুলবার চেষ্টা করল; পারল না। প্রচন্ড যন্ত্রণা হচ্ছে মাথায়। গরম কিছু গড়িয়ে পড়ছে কপাল বেয়ে, রক্ত মনে হয়। যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। ও কি মরতে চলেছে? মা-বাবার মুখটাও আবছা ভাবে মনে পড়ল। কি একটা পড়ে আছে ওর থেকে সামান্য দূরে, বাক্সের মতো। কিন্তু বাক্স নয় মনে হয়। অন্ধকার নেমে আসছে চারদিকে। ওর চোখ জুড়েও নেমে আসছে অমাবস্যার রাত। সেই ফ্যাসফ্যাসে স্বর আবার শুনতে পাচ্ছে মোহিনী, 'সময় শেষ'। ধীরে ধীরে বুজে যাচ্ছে ওর চোখ। শেষবারের মতো মোহিনী আবছা দৃষ্টিতে বিদ্যুতের আলোয় দেখতে পেল, তার খুব চেনা একটা নাম জ্বলজ্বল করছে ঐ 'বাক্স'র মতো জিনিসটার গায়ে; 'মৃত্যুর শব্দ'। 

ঘড়িতে তখন পাঁচটা বেজে দশ মিনিট শূন্য সেকেন্ড।  

নিরুকাইমারা

গল্প

প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা ​

পুজো বার্ষিকী ১৪২৮ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

নিরুকাইমারা

মধুসূদন গোস্বামী

বেঙ্গালুরু

maple1.jpg

বেঙ্গালুরুতে এসেই ভেবেছিলাম জেঠুর সঙ্গে দেখা করতে হবে। অনেক খুঁজে মোবাইল থেকে উদ্ধার করলাম ঠিকানাটা। 
ছোটোবেলাকার জেঠুকে খুব একটা মনে নেই আমার। বাবার মুখে শুনেছি জেঠু আর জেঠিমা বেশীরভাগ সময় কাটিয়েছেন বাংলার বাইরে। কখনো সুরাট, কখনো লখনউ, কখনও অন্ধ্রের রয়ালাসীমাতে। আমার যখন আট থেকে দশ বছর বয়েস তখন জেঠু দুর্গাপুরেই থাকতো। শুভদা অর্থাৎ জেঠুর একমাত্র ছেলে প্রতীক, আমার থেকে প্রায় সাত আট বছরের বড়। দুর্গাপুরের একটা নামকরা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ত। তবে পড়াশোনার চাইতে খেলাধুলাতে শুভদা ছিল জিনিয়াস। ওখানকার নামকরা ক্লাবগুলো শুভদাকে নেবার জন্য পড়িমরি করে উঠে লাগত। দুর্গাপুরে থাকতে অবশ্য প্রায় প্রতি শনিবার কিম্বা রবিবার আমরা একসাথে রাত্রিতে খেতাম- কখনো আমাদের টাউনশিপের বাড়ীতে বা জেঠুর আমবাগানের বাড়ীতে। দু এক বার আমরা একসাথে দুর্গাপুর ব্যারাজে গিয়ে পিকনিক ও করেছি। তখন আমি ক্লাস ফাইভে কি সিক্সে পড়ি। এরপর জেঠুরা হঠাৎ করে গুজরাট না কোথায় যেন চলে যায়।   
আমাদের গ্রামে খুব ধূমধাম করে রাসযাত্রার উৎসব হত। প্রতি বৎসর ওই সময়টাতে আমরা দুর্গাপুর থেকে তিন চার দিনের জন্য গ্রামের বাড়ীতে চ’লে আসতাম। সারা গ্রাম আত্মীয় কুটুম্বে গম গম করত। নানা রকমের ভুরি ভোজের আয়োজন হত আর রাতের বেলায় যাত্রা গান ।
তখন বোধহয় আমি প্লাস টু তে। বাবা কোনমতেই রাজি হচ্ছিলেন না সেবার গ্রামে আসতে- কারণ আমার ফাইনাল পরীক্ষা। আমি সেই প্রথম জেদ ধরেছিলাম গ্রামে যাবো বলে- কারণ টা আর কিছুই নয়- শুনেছিলাম সেবার নাকি জেঠুরা গ্রামে আসবে। চুটিয়ে গল্প করা যাবে জেঠুর সাথে, শুভদার সাথে।
জেঠু জেঠিমা আসলেও সেবার শুভদা আসতে পারেনি- ওর তখন প্রচণ্ড পড়ার চাপ। বোধ হয় থার্ড ইয়ার চলছিলো আই আই টি চেন্নাই এ। শুভদার সাথে আমার আর দেখা হয়নি- কারণ দু বছর পরেই ও জার্মান চলে যায় একটা ভালো কোম্পানির অফার নিয়ে। 
সকাল বেলার জলখাবারটা জেঠিমার বানানো আলুর চপ, বেগুনি আর কলাই সেদ্ধ দিয়ে মুড়ি। দাদু, আর জেঠিমার নজর এড়িয়ে জেঠু একসময় আমাকে এক পাশে ডেকে নিয়ে বললে, “চল বাবাই, তোকে আমাদের গ্রামের নদীটা দেখিয়ে নিয়ে আসি। জেঠু বরাবরই গ্রামের গাছ পালা, নদী নালা, পুকুর পাড় আর ধানের ক্ষেতের মাঝে সরু জলান রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া - এই সব খুব পছন্দ করতো। বাইরে না বেরুলে তো শুভদাকে মানুষ কোরতে পারবেনা, তাই গ্রাম ছেড়ে চলে যায় বাইরে। নইলে নাকি কোন দিনই গ্রাম ছেড়ে যেতে চায়নি। 
আমাদের গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ডাংরা নদীটা খুব একটা চওড়া নয় – বছরের বেশীর ভাগ সমতেই শুধু বালি ধু ধু। কিছু কিছু জায়গাতে অবশ্য সারা বছর জল জমে থাকে- খুব পরিষ্কার, তাকালে মুখ দেখা যায়। এখন বর্ষা পেরিয়ে, শরত ও হেমন্তকে ডিঙ্গিয়ে এসে, গ্রামে শীতের আমেজ। নদীটার বুকে ব’য়ে যাওয়া জলধারা খরস্রোতা না হলে কি হবে-কিন্তু কি শীতল আর স্বচ্ছ! ধবধবে সাদা পাজামা পাঞ্জাবির তোয়াক্কা না করে পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই জেঠু আমাকে টেনে নামাল জলে- বলল, ববাই, জলের গভীরতা তো বেশী নয়, তাই জলের স্রোতের সাথে সাথে হামাগুড়ি দিয়ে ভেসে যা- দারুণ লাগবে। এরপর প্রায় এক মাইলের মতো নদীর বুকে ভেসে যাওয়া – পাশে জেঠু, দারুণ মজা হয়েছিলো। বিকেলবেলায় আবার গেলাম নদীর ধারে। বিশেষ একটা জায়গায় নদীর কোল ঘেঁসে কতকগুলো বিশাল মাপের  পাথর মাথা উঁচু করে রয়েছে। একটু উপরে কয়েকটা মস্ত ঝাঁকড়া বাবলা গাছ দাঁড়িয়ে জায়গাটার স্তব্ধতাকে যেন একটা অন্য রূপ দিয়েছে। আস্তে আস্তে সন্ধ্যে নেমে আসছে – অদূরে গ্রামের রাস মন্দির থেকে কাঁসর ঘণ্টার আওয়াজ শোনা যাছে। হঠাৎ দেখি, চুপচাপ বসে থাকা জেঠুর চোখে জল। বললাম – কি হল জেঠু! 
একটু সামলে নিয়ে জেঠু বলেছিল- “বাবাই, এই জায়গাটা কখনো ভুলবি না- এইখানেই, আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগে, ওই পাথরগুলোর উপর শুইয়ে রেখে, আমাকে যিনি সবচেয়ে ভালবাসতেন – আমার ঠাকুমার মুখে আগুন দিতে দেখেছি- আমার বাবাকে। আর দশ বছর আগে এইখানেই আমার মায়ের শরীরটাকেও পোড়ানো হয়েছিলো। অনেক দূরে থাকতাম বলে দুদিন পরে বাড়ি পৌঁছেছিলাম- মাকে শেষ সময়ে দেখতে পাইনি- তোর বাবা মুখে আগুন দিয়েছিল। মা নাকি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমাকে দেখতে চেয়েছিলেন”। 
সেদিন, প্রায় পাঁচ ছয় বছর আগে - আরও অনেক কথা জেঠু আমাকে বলেছিল যা আমার মনে আজও গেঁথে আছে।   
এর পর আমি আরও কয়েকবার গ্রামে গিয়েছি- কিন্তু জেঠুর সাথে দেখা হয়নি। শুনেছিলাম জেঠিমার হঠাৎ করে মারা যাবার পর জেঠু কেমন যেন হয়ে গিয়েছিলেন এবং কাজকর্ম ছেড়ে দিয়ে ছিলেন। খবরটা শুনে আমারও খুব খারাপ লেগেছিল। জেঠিমার মতো অত হাসিখুশি প্রাণবন্ত জীবন সাথীকে হারানো সত্যিই জেঠুর মতো মানুষের পক্ষে মর্মান্তিক ছিল। আসলে শুভদা যে মা বাবাকে ছেড়ে অত দূরে চলে যেতে পারবে, ওনারা কেউই ভাবতে পারেননি। তাই শুভদা জার্মান চলে যাওয়ার পর জেঠিমা আর সুস্থ থাকেননি। জেঠিমার মৃত্যুর খবর শুনে আমার সেদিন আর একটা কথা মনে পড়েছিল- যা আমাকে জেঠু নদীর তীরে বসে বলেছিল। জেঠু বলেছিল – “ববাই, আমার খুব ভয় হয় যে, আমি যেমন মায়ের মৃত্যুর সময় তার কাছে থাকতে পারি নি, হয়তো আমার শেষ সময়ে শুভ কিম্বা তুমি কাউকে কাছে পাবো না”।
বছর ছয়েক আগেকার কথা আমার এখন সিটি বাসে এ চেপে জেঠুর বাড়ীর দিকে এগিয়ে যেতে যেতে মনে পড়ছে। পাশের সহযাত্রীর কাছে জানলাম যে আর দুটো স্টপেজ পরেই মালেশ্বরাম। তারপর খুঁজে পেতে হবে-৩০৩, ফিফথ মেন, সিক্সথ ক্রস।  
এই কয়েক মাসেই আমি বেঙ্গালুরু শহরটার প্রেমে পড়ে গেছি। আমাদের দুর্গাপুরের মতো প্যাঁচপ্যাঁচে গরম নেই, একটু হাঁটলেই ঘামে জবজবে হতে হয় না। প্রচুর সবুজের সমারোহ আর মৃদু শীতল হাওয়া মনটাকে সারাক্ষণ উৎফুল্ল রাখে। বেঙ্গালুরু শহরটাতে পা দিয়েই আমাকে আকর্ষণ করেছিল অনেক রকমের ফুল ভর্তি রঙ বাহারের গাছ – কয়েকটা মাত্র নামই আমি জোগাড় করতে পেরেছি- বাগেমারা অর্থাৎ ওমান’স টাংগ, বুরুগা মারা অর্থাৎ রেড সিল্ক কটন, কাক্কেমারা অর্থাৎ গোল্ডেন শাওয়ার, নিরুক্কাই মারা অর্থাৎ আফ্রিকান টিউলিপ ইত্যাদি। কানাড়াতে ‘মারা’ মানে গাছ।
জেঠু একবার বলেছিল, “আমার ঘরের সামনেই দেখবি উঁচু উঁচু সব নিরুকাই মারার ভিড়। লাল লাল ফুল ফুটে রয়েছে – অনেকটা আমাদের পলাশ ফুলের মতো। তবে মোরগের ঝুঁটি র সাথে বুঝি তুলনাটা বেশী চলে”। আর নিরুকাই মারার বাংলা নাম যে রুদ্র পলাশ, তা জেঠুই আমাকে বলেছিল।
শুভদাই জেঠি মাকে নিয়ে এসেছিল বেঙ্গালুরুতে। গাছে গাছে ঢাকা বেশ একটা শান্তিপূর্ণ জায়গা দেখে নর্থ বেঙ্গালুরুর এই ছবির মতো অঞ্চলটাকেই বেছে নিয়েছিল শুভদা। মাকে খুশী করার জন্য একটা ভালো বাড়ী কিনে ফেলেছিল। জেঠীমা বরাবর বলত জেঠুকে – “আর  এখানে ওখানে ঘুরতে পারবো না, এবার কোথাও থিতু হও- একটা নিজের ঘর হোক-আর আমি একটা মনের মতো বাগান করবো”। বাগান করার খুব শখ ছিল জেঠিমার। জেঠু বলত, “আমার দ্বারা তো আর হল না, এবার শুভ করুক”। শুভদা আই আই টি থেকে বেরিয়েই বেঙ্গালুরুতে একটা নামকরা এম এন সি তে

ঢুকে পড়ল। দু বছরের মধ্যেই মালেশ্বারামে ঘরটা কিনল। বাড়ীটার নাম রাখল মায়ের নামে -লাবন্যময়ী। মায়ের বাগানে যখন অনেক ফুল ফুটতে শুরু করেছে, তখন একদিন মায়ের কাছে ধীরে সুস্থে পাড়লো কথাটা। রাজী করাল নিজের জার্মান যাওয়ার ব্যাপারে। এরপর একদিন জেঠুর কাছে খবর এল যে শুভদা বিয়ে করেছে তারই প্রজেক্ট ম্যানেজারের মেয়েকে। প্রথম প্রথম জেঠিমাকে বোঝানো খুবই মুস্কিল ছিল জেঠুর পক্ষে, ভেবেছিল আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে, কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। জেঠিমার শেষকৃত্য বেঙ্গালুরুতেই করেছিল জেঠু - শুভদাকে জানতে দেয়নি। দরজায় তালা ঝুলতে দেখে হতাশ হলাম। গেটে কোন তালা নেই দেখে বুঝতে পারলাম, বাড়ীর মালিক সামনা সামনি কোথাও আছেন। গেটের সামনের গাছগুলো আমার চেনা। আশে পাশে পড়ে থাকা নিরুকাই মারার ফুল মাড়িয়ে ভেতরে ঢুকলাম। বাড়ী টার পিছনে প্রকাণ্ড বাগান- কত রকমের গোলাপ আর স্থলপদ্মর মেলা। নিশ্চয়ই জেঠিমার হাতের লাগানো! কিন্তু জেঠিমার অবর্তমানে ওগুলোর যত্নকে করে! গেটটা খোলা দেখেই ঢুকে পড়েছিলাম- চমক ভাঙল একজনের ডাকে। - “এক্সকিউজ মী” – অর্থাৎ চোখেমুখে জিজ্ঞাসার চিহ্ন- কে আমি, কাকে চাই, ইত্যাদি। কী ভেবে নিজেই পরিষ্কার ইংরেজিতে বললেন বয়স্ক ভদ্রলোক- “মিস্টার ব্যানার্জি এবং মিসেস ব্যানার্জি বোধহয় সামনেই কোথাও গিয়েছেন, আপনি চাইলে আমার বাড়ীতে এসে বসতে পারেন”। 
‘মিসেস ব্যানার্জি’ শুনে হতভম্ব হয়ে গেলাম। জেঠু কি তাহলে আবার বিয়ে করেছে?- এই বয়েসে! ছেলে বউ জানে ব্যাপারটা! মুহূর্তের মধ্যে আমার মনের ভেতর জেঠুর ছবিটাই পালটে গেল। মনে হোল, কয়েক বছর আগেকার গ্রামের সেই শ্মশান ঘাটে বসে  আত্মীয় পরিজনের কথা ভেবে জেঠুর চোখের জল ফেলা নিতান্তই লোক দেখানো,- কৃত্রিমতায় ভরা । লোকটা জেঠিমার কথা কোন দিনই ভাবেনি- সারাজীবন এখানে ওখানে ঘুরে বেড়িয়েছে- নিজের উচ্চাকাঙ্খা হাসিল করতে শুভদাকে জার্মানি পাঠিয়েছে- এখন ছেলের পয়সাতে বেঙ্গালুরুতে বসে আবার বিয়ে করে আয়েস করছে।
ওরা ফিরে আসার আগেই তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে মেন রাস্তায় উঠলাম- এখুনি বাস ধরতে হবে- মেসে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে হয়ে যাবে।
কিছু না খেয়েই শুয়ে পড়েছিলাম। রাত দশটা নাগাদ কেউ একটা কল করেছিল আমার মোবাইলএ। ঘুমের ঘোরে শুনেছিলাম জেঠুর গলা, “হ্যালো, - বাবাই?  আমি জেঠু বলছিরে- তুই কি আমার..”  সুইচ্‌টা অফ করার আগে বলেছিলাম – সরি, রং নাম্বার।
আর কয়েকদিন পরেই দুর্গাপূজা। শুনেছিলাম, বেঙ্গালুরুতে খুব ধুমধাম করে দুর্গাপূজা হয়। ভেবেছিলাম, এবছর নতুন চাকরীতে ঢুকেছি- ছুটি পাওনা নেই একেবারে- তাই জেঠুর কাছেই থেকে যাবো। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস আর কী! এখন তো মনে হচ্ছে, এই শহরটাতে আর থাকাই উচিত হবেনা। হঠাৎ করে, কোলকাতার সল্ট লেক অফিস থেকে একটা ডাক এল- দুদিনের ট্রেনিং এ র জন্য। ভালোই হোল- শনিবার, রবিবারটা দুর্গাপুরে বাড়ীতে কাটানো যাবে। জেঠুর ব্যাপার টাও বাড়ীতে জানানো যাবে।
খেতে বসে, মা হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করলো- হ্যাঁ রে বাবাই, তোর জেঠুর বাড়ীতে গিয়েছিলি ? মনের ক্ষোভটা লুকিয়ে রেখে বললাম – না মা, একেবারই সময় পাইনি। মাকে হঠাৎ খুব গম্ভীর মনে হল। কিছু না বলে কাজের আছিলায় ভেতরে চলে গেল। খাওয়া হতেই আবার ধরলাম মাকে- “তখন জেঠুর ব্যাপারে কিছু বলতে গিয়ে চুপ করে গেলে?” মনে মনে ভাবলাম, ব্যাপারটা আমি জানি, জেঠু আবার বিয়ে করেছে এই তো? মা হঠাৎ ওয়াড্রোব থেকে একটা নীল রঙের খাম বের করে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়েই – আসছি বলে পাশের ঘরে ঢুকে পড়ল। খামটা খোলা- জেঠুর চিঠি আছে ভেতরে- বাবাকে লেখা।
“কল্যাণীয় দিবাকর, বেঙ্গালুরুতে এসে অনেক কিছুই হারালুম। তোর বৌদিকে হারানোর সংবাদটা দিয়ে ছিলাম বছর খানেক আগে, কিন্তু কে জানতো, এত কম সময়ের মধ্যেই আরেকটা দুঃসংবাদ তোমাদের জানাতে হবে। খবরটা অনেকদিন ধরেই বুকের মধ্যেই চেপে রেখে ছিলাম- কাউকেই জানাতে পারিনি- বা ইচ্ছে হয়নি। সত্যি বলছি দিবু, জার্মান থেকে যেদিন কার অ্যাকসিডেন্টে শুভর মৃত্যু সংবাদটা এল, সেদিন আর বেঁচে থাকার কোন অর্থ ছিলনা আমার কাছে। পাশাপাশি কাউকেই ব্যাপারটা জানতে দিই নি। ভাবছিলাম এই ঘর দোর রেখে আর কী হবে! সব বিক্রি করে দিয়ে কোথাও চলে যাবো। কয়েকদিন একা একা বাগানটা তে বসে তোমার বৌদির সাথে মনে মনে কথা বলতাম। অভিযোগ করতাম, ছেলেটাকেও নিয়ে গেল আমার কাছ থেকে বলে। কিন্তু ভগবানের ইচ্ছে বোঝার ক্ষমতা কার আছে বল! কয়েকদিন আগে, কয়েকটা প্রায় শুকিয়ে যাওয়া গোলাপ চারাতে জল ঢালছিলাম, হঠাৎ একটা সিটি ট্যাক্সি এসে দাঁড়ালো গেটের সামনে। এক বিদেশী তরুণীকে ট্যাক্সি থেকে নামতে দেখে শুধু আমিই নয়, আশে পাশের সবাই উৎসুক হয়ে তাকিয়ে ছিল। ট্যাক্সি ড্রাইভার বাড়ীর নাম্বারটা ম্যাডামকে বুঝিয়ে দিয়ে, একটা লাল রঙের ঢাউস ট্রলি ব্যাগ নামিয়ে রেখে চলে গেল। এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলাম, উনি কে, কাকে চান। মেয়েটির ইংরাজি উচ্চারণ অত ভালো নয়। নামটা বলল- আঞ্জেলীকা, জার্মানির হামবুর্গ থেকে আসছে আর আমার বাড়ীতেই এসেছে – প্রতীক ব্যানার্জীর বাবার সাথে দেখা করবে। গেটের বাইরের উৎসুকতাকে এড়ানোর জন্য মেয়েটিকে ওর ঢাউস ট্রলি ব্যাগ সুদ্ধ ঘরের ভেতরে নিয়ে এলাম। বললাম- আমিই প্রতীকের বাবা- কী বলবে বল। মেয়েটি হঠাৎ কাঁধে ঝোলানো ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে একগুচ্ছ পোস্ট কার্ড সাইজের ফটো বের করে আমার সামনে তুলে ধরল। শুভর সাথে একসঙ্গে তোলা ফটোগুলো দেখে বুঝতে বাকী থাকল না যে এই মেয়েটিই শুভর বিবাহিত স্ত্রী। কিন্তু শুভর চলে যাওয়ার পর আমার কাছে এতদূরে কেন এসেছে- বুঝতে পারলাম না। ওদের দেশেই আরও একটা বিয়ে করে সুখে ঘর করতে পারত। আমার চোখে মুখে একটা অবিশ্বাস কিম্বা অবহেলার ভাব লক্ষ্য করলো মেয়েটা। এরপর বড় ব্যাগটা থেকে একটা ডাইরি বের করে আমার হাতে দিল। বুঝলাম, পুরোপুরি তৈরি হয়ে এসেছে। ডাইরিটা শুভর লেখা। মেয়েটা ডাইরিটার কয়েকটা পাতা আমার চোখের সামনে তুলে ধরল। শুভর সাথে ওর প্রথম পরিচয়ের দিন থেকে সুরু করে শুভর মৃত্যুর দুদিন আগেকার লেখা পাতাগুলো আমার সামনে জ্বলজ্বল করতে লাগলো।  
শুভ ডাইরিতে লিখে রেখেছে- “আঞ্জেলিকাকে দেখে নিশ্চয়ই মায়ের ভালো লাগবে- আমাদের ক্ষমা করতে বেশী দেরী লাগবে না মায়ের”। 
“অদ্ভুত মেয়ে আঞ্জেলিকা- রোজ বায়না ধরবে - কবে ইন্ডিয়া যাবো বলে।“ 
ডাইরির শেষ পাতাটা লেখা শুভর অ্যাকসিডেন্টের দুদিন আগেকার।–“ আঞ্জেলিকা মা হতে চলেছে- খবরটা শুধু আমার কাছে নয়, আমার মা বাবার কাছেও কত আনন্দের হবে! আর দেরী করা যাবে না। ওকে কয়েকটা মাস মায়ের কাছেই রেখে আসব। মেয়ে হলে ওর নাম রাখব নিরুকাই কিম্বা শুধু নীরু। নিরুকাই ফুল মায়ের খুব প্রিয় তাই।“ আস্তে আস্তে আঞ্জেলিকা আমার বাড়ীর নতুন সদস্য হয়ে গেল। প্রতীক্ষায় আছি আর এক নতুন আগন্তুকের – আমাদের শুভর উত্তরসূরীর। তোমরা আমার আশীর্বাদ ও ভালোবাসা নিয়ো - ইতি দাদা।“
পুনশ্চ“ শুনলাম বাবাই বেঙ্গালরুতে একটা এম এন সি তে জয়েন করছে। ওকে অবশ্যই আমার ঘরে আসতে বল- এখানেই থাকতে পারে ও।“   
জেঠুর চিঠিটা শেষ হতেই মনে মনে বললাম, “তোমার ওখানে না থাকলেও- ক্ষমা চাইতে তো যেতেই হবে জেঠু! আর আমাদের নীরুকে দেখতে।“

চলজ্জীবন

গল্প

প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা ​

পুজো বার্ষিকী ১৪২৮ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

চলজ্জীবন তীর্থঙ্কর ভট্টাচার্য

সন্তোষপুর

theif.jpg

॥১॥

বিবারের বেলা। রেশন দোকান খোলে নি এখনো। বৃষ্টি বাদলায় ক'দিন যা তা অবস্থা। অগত্যা দাঁড়িয়ে রইলেন অসিতবাবু। আশেপাশে এদিক ওদিক তাকালেন কয়েকবার। একটু দূরে একটা জিলিপি কচুরির দোকান। জটলা করে খাচ্ছে কয়েকজন। সেদিকে দেখে একবার লোভ লাগলেও ঠোঁট চেটে সংবরণ করে নিলেন অসিতবাবু। একজনকে হেঁকে জিজ্ঞাসা করলেন 'এ এখনো খোলে নি?' একজন উত্তর দিল 'এর মধ্যে খুলে দেয়। কি জানি আজ কি হয়েছে।' বলতে বলতেই বাইক নিয়ে আরেকজন মধ্যবয়সী লোক এসে দাঁড়াল। তাকাল বন্ধ রেশন দোকানের দরজার দিকে। তারপর বাইকের স্টার্ট বন্ধ করে নেমে পড়ল। বোঝা গেল ইনি দ্বিতীয় খদ্দের। একটা রিক্সা এসে দাঁড়াল। ব্যাগ হাতে নিয়ে একজন বয়স্ক মহিলা নামলেন। পায়ে ব্যথা। তার পিছন পিছনই বাইক নিয়ে এল রেশনের দোকানদার ছেলেটা। এসে বাইক থেকে নামল। 'কি গো সাড়ে দশটা ত বাজতে চলল, এতক্ষণে?' মহিলা বললেন। লাইনে দাঁড়িয়ে পড়লেন। দোকানদার দোকান খুলতে লাগল।

দোকান খুলতে খুলতে আবার তারপর গোছাতে গোছাতে আরও সময় লাগছে। 'কি হল কি' একবার বললেন অসিতবাবু। দ্বিতীয় খদ্দের জানালা দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারতে লাগল।

এরই মধ্যে পাশের গলি থেকে এসে পড়ল বাঁইকা। রেশন দোকানে কাজ করে সকালবেলাটা। বাঁইকা এসে পড়াতে দোকানদার মাল দেওয়া শুরু করল।
এর মধ্যে বৃষ্টি এসে গেল আবার গুঁড়িগুঁড়ি। ওপর দিকে তাকিয়ে হাসলেন অসিতবাবু। মাল নেবার সময়ে বাঁইকাকে বললেন 'তোর দেশ ত ঝাড়খণ্ড?' বাঁইকা মাথা নাড়ে। অসিতবাবু বলেন 'মিথিলা?' বাঁইকা বলে 'বন্দারপুর গাঁও।' অসিতবাবু বললেন 'তোদের দেশে কী ভাদ্র মাসে বর্ষাকাল?' হাঁ করে তাকায় বাঁইকা, কিছুই বুঝতে পারে না। অসিতবাবু স্কুলের মাস্টারমশায়ের ভঙ্গিতে বলে ওঠেন 'ভরা বাদর মাহ ভাদর।' বাঁইকা মাল ব্যাগে ভরে দেয়। অসিতবাবু নিয়ে চলে আসেন। বিদ্যাপতি মিথিলারই লোক ছিলেন বটে।


॥২॥

বাঁইকা পরের লোকটার স্লিপ নেয় হাতে। ইংরেজিটা পড়তে পারে তাই অসুবিধা হয় না। গ্রামের স্কুলে সেভেন অবধি পড়েছিল। তারপর আর ভাল লাগত না। স্কুল থেকে পালাত রোজ। গিল্লি ডাণ্ডার খেলায় মেতে উঠত গিয়ে মাঠে। বিড়িও খেয়েছিল। শেষে বাবা রেগে গিয়ে ইস্কুল ছাড়িয়ে দিল। তারপর ও বাড়ি থেকে পালাল একবার। ফিরে এসে ক্ষেতের কাজে লাগল। সেখানে মন টিকলো না- চলে এল কলকাতা। দেশের চেনা এক কাকা ওকে এইখানে নিয়ে এল আর তারপরে এই কাজে লাগাল। রেশন দোকানে কাজ।


॥৩॥

রঘুদার এখন বয়স হয়েছে। আগের মত অত হুড়োহুড়ি করে কাজকর্ম আর পারে না। তবে কাজ জানে ভাল। গ্যারেজটা চলছে না আজ কয়েক মাস ঠিকঠাক। হাতে টাকা পয়সার একেবারেই অবস্থা খারাপ। বৌ এর ক্ষয়কাশ আছে, ওষুধ ফুরিয়ে গেছে-কিনতে পারছে না। গ্যারেজের দুটো ছেলে আছে- ওদের মাস মজুরি দিতেই হাতে টান। গত মাসে মজুরি দেরিতে দিয়েছিল এ মাসে সেটা আর পারেনি। ছেলেদুটো খাবে কী? রঘুদার গিন্নী দিব্যি করিয়ে নিয়েছিল যেন ওদের মজুরি এই মাসে ঠিক সময়ে দিয়ে দেয়।
কি আর করবে। গ্যারেজটা বড় রাস্তার পাশেই বলে সুবিধা ছিল- কিন্তু এখন যা মন্দার বাজার, কিছুই চলছে না। কোনোমতে খাওয়াটা জুটছে। রঘুদার মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। স্বামীটা ড্রাইভারই করে একজন ডাক্তারের। এইভাবে চলে। 

সারাদিন বসে বসে মাছি তাড়াল গ্যারেজে। কাজের ছেলেদুটো ঝাঁট দিয়ে বৃষ্টির জল সরাল সারাদিন ধরে। বিকেলে যন্ত্রপাতিগুলো মুছল। আস্তে আস্তে ঘরের দিকে রওনা দিল সবাই সন্ধ্যা নামার আগেই। কোনো কাজ নেই সারাদিন।
 

॥৪॥

অসিতবাবুর সেদিন কাজ শেষ করতে করতে রাত হল। নিজের ঘরে বসেই কাজ করছিলেন অফিসের।মে য়ে খেলছিল নীচে ভাইঝির সাথে। স্ত্রী পাশের ঘরে টিভি সিরিয়াল নিয়ে ব্যস্ত। রবিবার হলেও কাজের চাপ ছিল। লকডাউনে ওয়ার্ক ফ্রম হোমে কাজ হল অতিথি। কাজের কোনো তিতিক্ষণ নেই। প্রতিটি লোক নিজের কাজ বাঁচাতে মরীয়া। অতএব সকলেই প্রাণপণে খাটছে অবিরত। অসিতবাবুকেও সেই তালে খাটতে হচ্ছে। শেষে রাত প্রায় পৌনে দশটায় দরজা খুলে ঘরে ঢুকল মেয়ে আর ভাইঝি। সমস্বরে বলে উঠল 'খেতে ডাকছে, রাগ করছে খুব।' মুখ ঘুরিয়ে তাকালেন অসিতবাবু ওদের দিকে। চোখ দুটো বড় বড় করে বললেন 'তাই নাকি? খুব রাগ করছে? কী বলেছে?' ওরা মুখ চাওয়া চাওয়ি করল। অসিতবাবু কম্পিউটার বন্ধ করতে শুরু করলেন। ভাইঝিকে বললেন 'বাবা খেতে নেমেছে?' ভাইঝি মাথা নেড়ে বলল 'হ্যাঁ'। 'আচ্ছা চল আসছি।' বলে অসিতবাবু টেবিল গোছাতে লাগলেন। ওরা ছুটে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। অসিতবাবুর ভাই কদিন হল সপরিবারে এসে আছে এখানে। ওদের ওখানে কাজের লোক আসছে না বলে মুস্কিলে পড়েছে খুব। পরশুই চলে যাবে ওরা। দুটো মেয়েতে মিলে কদিন বেশ মেতে আছে। এই এলাকাতে কাজের লোকেরা আসছে এখনো। এরা কদিন এসে থাকাতে বেশ লাগছে অসিতবাবুর। ভাইঝিটা বেশ ভালো ছড়া বলে। 

'এতক্ষণে সময় হল আসার?' রাগ উপচে পড়ল অসিতবাবুর স্ত্রীর। সেদিকে গোবেচারা মুখ করে তাকিয়ে খেতে বসে পড়লেন তিনি। একটু সামলে নিয়ে কোনাকুনি বসা ভাইঝিকে ছড়া শোনাতে বললেন। রিনরিনে গলায় দু লাইন বলল- তারপর আর বলল না।
খাওয়া শেষ হল। 'আবার কি ঘরে ঢুকে কাজে বসা হবে নাকি এখন?' প্রশ্ন ছুটে এল। অসিতবাবু জবাব দিলেন 'নাঃ, আজকের মত খতম হয়েছে।'

- 'যাক বাঁচা গেছে।' 
ভাইয়ের সাথে খাওয়া শেষে গল্প গুজব করে নিলেন খানিকক্ষণ অসিতবাবু। 


॥৫॥

সকালে রেশন দোকানে বাবুটা কি যেন জিজ্ঞেস করছিল। রাতে ঘরে বসে বসে জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকার সময়ে হরেনকে দেখতে পেয়ে মনে পড়ল বাঁইকার। হরেন উল্টো দিকের বাড়িটাতে থাকে। রঘুদার গ্যারেজে কাজ করে। হরেনের সাথে ভাব আছে বাঁইকার। প্রথমবার দেখা হয়েছিল পেচ্ছাপখানায়। কদিন দেখা হয়ে ভাব হয়ে গেছে। ওরা দুজনে একসাথে দুপুরের খাওয়াটা সারে। একেক দিন রঘুদার গ্যারেজেও বাঁইকা গেছে ওর কাছে। বাবু টা রঘুদার গ্যারেজে প্রায়ই গাড়ি নিয়ে যায়। বাবুটা বেশ পয়সাওয়ালা লোক। দু হাতে সব মিলিয়ে গোটা চারেক আংটি। বাবুটাকে চেনে বাঁইকা। পাড়াতেই থাকে। মাসে দু মাসে একবার করে রেশন নিতে আসে। পাড়ার লোকজন অনেকেই চেনে বাবুটাকে। পাঞ্জাবি আর প্যান্ট পরে পাড়ায় বেরোয় একেক দিন। একদিন দেখেছিল মোড়ের ক্লাবে গিয়ে চ্যাংড়া ছেলেদের সাথে ক্যারাম খেলতে। 
বাঁইকা অন্যদিকে মন দেয়। এই এক চিলতে ঘরটা ওর থাকার জায়গা। একটা সিঁড়ির চাতালকে ঘর বানিয়ে একটা জানালা বসানো। সেখানেই ও থাকে। পরেশদা আর সাধন থাকে সদর ঘরটাতে। পরেশদা ওকে এই ঘরটার ব্যবস্থা করে থাকতে দিয়েছিল যখন আড়াই বছর আগে ও প্রথম আসে। তখন ওর থাকার জায়গা ছিল না। রেশনের মালিক ওর থাকার বন্দোবস্ত এদিক ওদিক খোঁজ খবর নিচ্ছিল। সেই সময় পরেশদার সাথে ওর দেখা হয়। পরেশদা নিজে থেকে ওদের ঘরের এইখানে বাঁইকাকে ডেকে এনে থাকতে দিয়েছিল। ওরা এখানে ভাড়া দিয়ে থাকে। পরেশদা আর সাধন কি রকম যেন খুড়ো-ভাইপো হয়। বাঁইকার কাছ থেকে কোনো ঘর ভাড়া ওরা নেয় না। সাধন আগে ওষুধের দোকানে কাজ করত। এখন ওষুধ সাপ্লাই দেয় দোকানে দোকানে। পরেশদা এম্বুলেন্স চালায়। পরেশদার বয়স চল্লিশের ওপর। সাধনের হবে বছর তিরিশ। ওদের ঘরে ডাঁই করা ওষুধের বাক্স আর শিশি বোতল। সিঁড়ির নীচেও মাল ডাঁই করা। প্রথম প্রথম ওষুধের গন্ধে অসুবিধা হত বাঁইকার এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছে। ওদের ঘরটাতে বাঁইকা খুব কমই ঢুকেছে। এতদিনে খুব বেশি হলে দুই কি তিনবার হবে। হাবেভাবে বোঝা যায় পছন্দ করে না ওরা। রাতে ওদের ঘরে বাইরে থেকে লোক আসে। কোনোদিন বাইক, কোনোদিন গাড়ি। তারা অচেনা লোক। বাঁইকা একবার দুবার দেখেছে কয়েকজনকে। ঘরে ঢুকে ওরা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলে দরজা বন্ধ করে। এক এক দিন চেঁচামেচি হয়। কোনো কোনো দিন মদের গন্ধ আসে আর হৈ হুল্লোড়ের আওয়াজ হয়। বাঁইকা এ নিয়ে অত মাথা ঘামায় না এখন আর। যাদের আশ্রয়ে আছে তাদের জন্য অনেক কিছুই সহ্য করে চলতে হয়। তাছাড়া শরীর টরীর খারাপ হলে সাধনের দেওয়া ওষুধ ভরসা। কাজেই ওদের মত চলাই ভাল। ওরা বাঁইকার অনেক উপকার করেছে। 

 

॥৬॥

রঘুদা আজ গ্যারেজে যেতে পারেনি। গত রাত থেকে ওর গিন্নীর অবস্থা খুব খারাপ। আজ খুব ভোরে তাকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটতে হয়েছে। হাতে এখন টাকা নেই, সরকারি হাসপাতাল হল ভরসা। ছেলে দুটোর ভরসায় গ্যারেজ রেখে গিন্নীকে নিয়ে এসেছে হাসপাতালে। রাত্রে ঘুমোতে পারেনি। কাশতে কাশতে দুইবার রক্ত বেরিয়েছে। ডাক্তার না দেখালেই নয় একবার। যে ডাক্তারকে দেখাত, তার কাছে নিয়ে যাওয়ার মত আর পয়সা নেই। পাশের বাড়ির লোক বলল সরকারি হাসপাতালের কথা। ভোরবেলা গ্যারেজের একটা পুরনো গাড়ি করে চলে এসেছে। লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে কুপন পেয়েছ। তারপর বসে আছে। হাসপাতালে ভিড় আছে। একবার তাকাল রঘুদা গিন্নীর দিকে। চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে। মাঝে মাঝে কাশির দমক উঠছে। মেডিকেল রিপোর্ট আর কাগজগুলো একটা প্যাকেটে কোলের ওপর রাখা। কোনমতে হেলান দিয়ে বসে আছে। 

একটু বাদে ডাক এল। মাঝবয়সী ডাক্তারবাবু। রোগী দেখলেন, কাগজপত্র দেখলেন। জানালেন একই ওষুধ চলুক আর যত শিগগির সম্ভব হাসপাতালে ভর্তি রেখে চিকিৎসা করতে হবে। 

বেরিয়ে এল রঘুদা সব কথা শুনে। গিন্নীকে নিয়ে গিয়ে গাড়িতে বসাল। ফোন করল জামাইকে। সব বুঝিয়ে বলল ডাক্তার যা  যা বলেছে। জামাই বলল সে আপাতত কিছু টাকা পাঠিয়ে দিতে পারবে ওষুধ কেনার জন্য। 

এই হাসপাতালে ভর্তির ব্যাপারে খোঁজ নিতে গেল রঘুদা। এখানে বেড খালি নেই। কাউন্টারের বাবু পরামর্শ দিল আরেকটা হাসপাতালে নিয়ে যাবার, আশেপাশের লোকজনেরা আরও দুটো সরকারি হাসপাতালে র নাম করল। রঘুদা এসে গাড়িতে উঠল। গাড়িতে করে গিন্নীকে বাড়িতে রেখে আরও দু তিনটে সরকারি হাসপাতালে গেল রঘুদা। কোথাও বেড খালি নেই। সন্ধ্যায় ফিরে এল বাড়িতে ক্লান্ত শরীরে। এসে দেখে বাড়িতে মেয়ে এসেছে। মায়ের কাছে বসে আছে। খানিকটা স্বস্তি হল। জামাই টাকাটা পাঠিয়ে দিয়েছে তাহলে। 


॥৭॥

অন্যান্য দিনের মত বাঁইকা দোকানে স্লিপ কাটছিল আর মাল দিচ্ছিল। একটা শোরগোল শোনা গেল। সামনে কচুরির দোকানটাতে। কে একজন বলল সাধনকে থানায় নিয়ে গেছে। রেশনের দোকানদার হেঁকে জিজ্ঞেস করল 'কি হয়েছে গো?' একজন বলল 'শুনছি নাকি সাধনকে থানায় নিয়ে গেছে।' দোকানদার বাঁইকাকে বলল 'কি রে? তোর ঘরের সাধনকে ত পুলিশে ধরেছে।' 
বাঁইকা কিছুই জানত না। সে এদিক ওদিক তাকাল। খাবারের দোকানের শোরগোলটা খানিক বাদে কমে গেল। বাঁইকার এখন ঘরে যাওয়ার উপায় নেই। দোকানে মেলা খদ্দের। বিনা পয়সার সরকারি চাল গম নিতে এখন রোজ অনেক লোক হচ্ছে। কিন্তু ওর উদ্বেগটা রয়ে গেল। দুপুরের দিকে খাবারের দোকানদার খবর দিল যে সাধনকে সত্যিই পুলিশে অ্যারেস্ট করেছে। টিভিতে খবরের চ্যানেলে দেখাচ্ছে সে খবর।
-' ব্যাপারটা হয়েছে কি?' রেশনের দোকানদার জিজ্ঞাসা করল। খাবারের দোকানদার -
বলল 'বেশি দামে ব্ল্যাকে ওষুধ বিক্রি করছিল সাধন। এক টিভি চ্যানেলের লোক সে খবর পেয়ে গিয়ে টিভিতে খবর করে দিয়েছে। তার জেরেই সাধনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে।'
- 'তোমাকে কে বলল?'
- 'টিভিতে দেখিয়েছে। আমার দোকানে খেতে এসে একজন বলছিল।'

উপস্থিত সকলে অবাক হয়ে গেল। সাধনকে এখানে চেনে বেশ কিছু লোক। ওর এই কীর্তির

কথা কতজন জানত সন্দেহ। যাই হোক একটা কাণ্ড ঘটেছে চাঞ্চল্যকর। বাঁইকা কি করবে বুঝতে পারছিল না।

একটু বাদেই রেশনের দোকানদারের মোবাইলে ফোন এল। থানা থেকে। থানায় বাঁইকাকে ডাকছে।


॥৮॥

থানায় বাঁইকাকে পুলিশবাবুরা বসিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করল। কি নাম, বয়স কত, কোথায় বাড়ি, কে কে আছে বাড়িতে এসব। দেশের বাড়িতে ওর বাবার ফোন নাম্বার নিল। ফোন করে বাবার সাথে কথা বলল। ওর ভোটার কার্ড নাম্বার আর আধার কার্ড নাম্বার নিয়ে নিল বাবার কাছ থেকে। ওর নিজের কাছে ছিল না। তারপর বলল ' হয়ে গেছে, যা এবার।' বাঁইকা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। থানায় ও সাধনকে দেখতে পেল না। অনেকটা আশ্বস্ত হয়ে বাঁইকা বাইরে এসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। একটা হাবিলদার বলছিল ' আবার ডাকা হবে, আসবি তখন।' 

ভয়ে দুরুদুরু বুকে যখন ও আসছিল থানায় তখন ওর পা কাঁপছিল। রেশনের দোকানদার বলে দিয়েছিল থানা কিভাবে যেতে হয়। হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছিল। এখন বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। বাঁইকা একটা দোকানের ছাউনিতে দাঁড়াল। ছাতুর শরবৎ বিক্রি হচ্ছে। কিনে নিয়ে খেয়ে নিল। ভিতরটা অনেকটা আরাম হল এবার। দাঁড়িয়ে রইল খানিকক্ষণ। ওর কাছে ছাতা নেই। আরও মিনিট পনেরো বাদে বৃষ্টিটা ধরল। তাড়াতাড়ি হাঁটা লাগাল বাঁইকা। রেশন দোকানে হেঁটে পৌঁছতে এখনো আধা ঘন্টা; বাজে বেলা একটা কুড়ি। 

পথে দেখা হল রঘুদার গ্যারেজের হরেন বলে বাঁইকার সাথীর সাথে। একটা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে হরেন চাইল। কিন্তু বাঁইকার সময় ছিল না। দোকানে ফিরতেই রেশন মালিক জিজ্ঞাসা করল 'কি রে? কি হল থানায়?' বাঁইকা জানাল সব। রেশন মালিক আর কিছু বলল না। একবার শুধু বলল - 'আবার তোকে ডাকবে।' বাঁইকা গুদামঘরটাতে ঢুকে গেল মাল বের করতে।

 

॥৯॥

রঘুদার একটু দেরিতে ঘুম ভেঙেছে আজ। কদিন ধরে গিন্নীর অসুখের চিন্তায় চিন্তায় রাতের ঘুমের দফা রফা। বাড়ি থেকে বেরিয়ে গ্যারেজের দিকে পা বাড়াবে এমন সময়ে দেখে জামাই ছুটতে ছুটতে এসে হাজির। 'এই কি ব্যাপার?' চমকে উঠে একটু চেঁচিয়েই জিজ্ঞাসা করল রঘুদা। 
-' শিগগির এস, ডাক্তারবাবুর গাড়ি খারাপ।'
কোনো সময় নষ্ট না করে ওরা চলে এল গ্যারেজে। সকালবেলা হঠাৎ ডাক্তারবাবুর গাড়ি খারাপ। এদিকে হাসপাতালে জরুরি কাজ। এক নেতার ভাইয়ের অবস্থা খুব খারাপ- যেতেই হবে যত তাড়াতাড়ি হয়। নয়ত ডাক্তারবাবুর ওপর কোপ নামবে। 

রঘুদা দেখে বলল 'এত বিকেল গড়াবে, তাড়াতাড়ি ত হবে না।' ডাক্তারের কপালে চিন্তার ভাঁজ, মোবাইলটা নিয়ে কাকে যেন ফোন করতে গেল, কিন্তু ফোন কেউ ধরল না সম্ভবত:। অস্থির হয়ে পাদচারণা করল ডাক্তার কয়েকবার। রঘুদা জামাইকে বলল 'বাইক আছে, বাইকে করে দিয়ে আসবি?' জামাই ডাক্তারবাবুর দিকে একবার তাকিয়ে বলল 'আচ্ছা, জিজ্ঞাসা করি।' 
সে গিয়ে ডাক্তারের কাছে আস্তে আস্তে কিছু একটা বুঝিয়ে বলল। ডাক্তারবাবু বলল 'আচ্ছা ঠিক আছে।' তখনই সে রঘুদাকে হাত নেড়ে ইশারা করল। রঘুদা বাইক বের করতে গেল আর ডাক্তারবাবু গাড়ি থেকে ব্যাগ বের করতে গেল। 

বাইকের পিছনে বসে ডাক্তারবাবু ব্যাগ কাঁধে হাসপাতালে রওনা দিয়ে দিলেন। ওঁর গাড়ির ড্রাইভারই বাইকের চালক। সৌভাগ্যক্রমে তখন বৃষ্টি ছিল না। রঘুদা গাড়ি মেরামতির কাজে লেগে গেল।

প্রায় সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় আবার ডাক্তারবাবু বাইকের পিছনে এসে রঘুদার গ্যারেজে নামলেন। হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করলেন  'হয়ে গেছে গো গাড়ি?' রঘুদার হেসে মাথা নাড়ল। 
- 'আজ একটা বড় উপকার করলে তুমি আমার।' বললেন ডাক্তারবাবু। 'তুমি তো ওর শ্বশুর, না?' জিজ্ঞাসা করলেন উনি। আবার মাথা নাড়ল রঘুদা। 
- 'শুনলাম ওর শাশুড়ির খুব অসুখ, একটু দেখি ত, চলো।' 
রঘুদা হাঁ করে চাইল একবার। তারপর হাতটা থুতনিতে ঠেকিয়ে বলল 'আচ্ছা আসুন। ডাক্তারের কাছে যেতে পারছি না, হাসপাতালেও ত বেড খালি নেই, আর এদিকে …' 
রঘুদার পিছন পিছন ওরা রঘুদার ঘরের দিকে পা চালাল। 

ডাক্তারবাবু রোগী দেখলেন। কাগজপত্র আর রিপোর্টগুলো দেখলেন। দেখে বললেন 'আজই রাতে ওষুধ পাঠিয়ে দেব, তারপর দেখছি কী করা যায়।'

 

॥১০॥

পরেশদাকে রাতে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। পরেশদা অনেক রাতে ফিরেছিল। বাঁইকা তখনও জেগে। সকালবেলা পরেশদা বাঁইকাকে শিখিয়ে দিয়েছিল পুলিশ যাই জিজ্ঞাসা করুক বলবি তুই কিছু জানিস না। বাঁইকা শুনেছিল দাঁড়িয়ে। কিন্তু রাতে ওদের বাড়িতে পুলিশের দরজা ধাক্কাধাক্কি আর হাঁকাহাঁকি। বাঁইকা সিঁড়ি দিয়ে নেমে দেখে দুজন পুলিশ পরেশদাকে ধরে রেখেছে আর বাকি তিনজন ডাঁই করা ওষুধের বাক্সগুলো লাথি মেরে মেরে সরিয়ে সরিয়ে দেখছে। একজন সিঁড়ির নিচে এসে বলল ' এদিকে আরও আছে স্যার।' 
বাঁইকাকে দেখে ওরা বলল ' তুই এখানে থাকিস?' 
বাঁইকা মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।
-' আর কে থাকে?'
-' আর কেউ না স্যার।'
-' আর কে আসে এখানে?'
- ' চিনি না স্যার। আসে কভি কভি কেউ।' 

ওরা পরেশদাকে নিয়ে গেল বাইরে। বাঁইকাকে বলে গেল সকাল আটটায় থানায় হাজির হতে।

বাঁইকা ভীষণ মুস্কিলে পড়ল। যে ওকে থাকতে দিয়েছে তাকেই ধরে নিয়ে গেল পুলিশ। এদিকে ওকেই থানায় হাজির হতে হবে। চিন্তায় চিন্তায় বাঁইকা কাহিল হয়ে যাচ্ছিল। 

                 

॥১১॥

বাড়িটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে অসিতবাবুর। ভাই সপরিবারে চলে গেছে পরশু দিন। জীবনটা আবার একঘেয়ে হয়ে গেছে। মেয়েও তার সঙ্গিনী হারিয়ে সারাদিন কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। গতকাল অসিতবাবু সারাদিন মেয়ের সঙ্গে ইউটিউবে ফিল্ম দেখেছেন। আজ যেন সময় কাটতেই চাইছে না। পাড়ায় একটা ওষুধ পাচারের কাণ্ড ঘটেছে। দুটো লোক ধরা পড়েছে। তাই নিয়ে স্কুল আর কলেজের বন্ধুদের WhatsApp group খানিকক্ষণ সরগরম করেছেন। তারপর আবার একঘেয়েমি লাগছে। ছাদে গিয়ে একটু সিগারেট টানবেন কি না ভাবছেন, এমন সময়ে কলিং বেল বাজল। ওপরের বারান্দা থেকে মুখ বাড়িয়ে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন ' কে?' 
একটা রোগা লোক উপর দিকে তাকিয়ে জবাব দিল ' আমি দাদা, একটু শুনবেন?' 
-' কি ব্যাপার?' 
-' পুরনো মোবাইল ফোন আছে? যদি বিক্রি করেন- একটা দরকার ছিল স্মার্ট ফোন।' 
লোকটাকে দেখে সাধারণ বিক্রিওলা মনে হায় না। অসিতবাবু বললেন ' মোবাইলের দোকানে যান না, এর জন্য লোকের বাড়িতে ডাকাডাকি করে কেউ?' 
-' মানে আমি একটু সস্তায় চাইছি। আমার ছেলের জন্য। অনলাইন ক্লাসের জন্য লাগবে, পুরনোটা জল পড়ে নষ্ট হয়েছে, আর সারানো যাচ্ছে না।' 
-' সস্তা মানে কত সস্তা? এখন নতুন ফোন সস্তায় পেয়ে যাবেন দোকানে।' 
লোকটা কি যেন চিন্তা করল তারপর বলল 'পাওয়া যাবে, তাই না?' - 'হ্যাঁ?' আস্তে আস্তে চলে গেল লোকটা। অসিতবাবুর লোকটাকে ছিটগ্রস্ত মনে হল। আজকালকার দিনে এমন লোক হয় না। লোকটাকে কাছাকাছি আর কোথাও কখনো দেখেছেন বলে মনে হল না। উটকো অকর্মার আনাগোনা বেশ বেড়ে গেছে।


॥১২॥

বাঁইকার বাড়িটা পুলিশ দরজা সিল করে দিয়ে গেছে। বিছানা আর জামাকাপড় নিয়ে বাঁইকা কদিনের জন্য হরেনের ঘরে আছে। দুজনে খুব কষ্ট করে রাতে শুচ্ছে। এর পরে একটা থাকার জায়গা পেতেই হবে। থানায় সেদিন ওকে পুলিশের বাবুরা অনেক কিছু জিজ্ঞাসা করেছিল। বাঁইকা সেসব আর্দ্ধেক বোঝেই নি। বেশীরভাগই জানি না বলে সেরে দিয়েছে। পরেশদার কথাটা ওর মাথায় ছিল। ভয়ে ভয়ে ছিল খুব। সাধন আর পরেশদা কাউকেই ও তারপর থেকে দেখে নি চোখে। শুধু এটুকু বুঝেছে পরেশদা আর সাধন মিলে ওষুধ পাচার, ওষুধ ব্ল্যাকের কারবার চালাত। ওদের সাথে আরও লোক আছে। 
সেদিন বাঁইকার রেশন দোকানের কাজ কামাই হয়ে গিয়েছিল। থানা থেকে এসে নিজের মাল হরেনের বাড়িতে নিতে নিতে সারা দিন গেছে। বৃষ্টিতে ভিজে ঠাণ্ডা ও লেগে গিয়েছিল। যাইহোক এখন সেটা কমেছে। হরেনের ঘরে কোনো জানালা নেই। ভিজে কাপড়গুলো দড়িতে টানানো। ভিতরে একটা স্যাঁতসেঁতে ভাব। জায়গাও দুজনের পক্ষে কম। বাঁইকা শুয়ে শুয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে ভাবছিল সারাদিনের পরে। হরেন শুয়ে ছিল পাশে। দুজনের গল্প করা আর খাওয়া শেষ। কাল থেকে আবার কাজে যাওয়া।


॥১৩॥

রঘুদার গিন্নীর হিল্লে হয়ে গেছে। ডাক্তারবাবু সে রাতেই ওর জামাইকে দিয়ে ওষুধ পাঠিয়ে দিয়েছিল। যে নেতার ভাইয়ের চিকিৎসা করছেন ডাক্তারবাবু হাসপাতালে, তাকে ধরে সেই সরকারি হাসপাতালে তার একটা ভর্তির বন্দোবস্ত হয়ে গেছে। কালকেই নিয়ে যেতে হবে। ডাক্তারবাবুই সব ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। সেদিন রঘুদা ঐ উপকারটা না করলে রুগীর প্রাণ রক্ষা মুস্কিল হত। রঘুদার গিন্নীর কাশীর জেরটা ওষুধগুলো খেয়ে একটু কমেছে। রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়েছে। কিন্তু গ্যারেজে এখনও বেশি কাজ নেই, রোজগারের দুশ্চিন্তাটা যায় নি। রঘুদা গ্যারেজের ছেলে দুটোকে বলেছে পরের মাসে মাইনে দিতে দেরি হবে। এবারে আর তার গিন্নী টের পাবে না- হাসপাতালে থাকবে। ডাক্তারবাবু বলেছে পুরোপুরি ঠিক করে তবেই বাড়িতে ফেরত আনতে। 


॥১৪॥

বাঁইকার সকাল সকাল ঘুম ভেঙে গেছে। বাইরে এসে দাঁড়িয়েছিল রোদে। স্যাঁতসেঁতে ঐ ঘরে আর পারছিল না থাকতে। ভেতরে হরেন তখনো ঘুমোচ্ছে। রঘুদার বাড়ির সামনে গ্যারেজে গাড়ি দাঁড় করানো-কোথায় যাবে কে জানে। ওই দিক থেকে হাফ প্যান্ট আর গেঞ্জি পরা সেই বাবুটা ছুটতে ছুটতে আসছে। যে বাবুটা বলছিল ওর দেশ ঝাড়খণ্ড কি না। পায়ে বেশ দামী একটা জুতো পরা। আজ সকালে আকাশটা পরিষ্কার। তাই বাবু সকালে কসরৎ করতে বেরিয়ে পড়েছে। বাঁইকা হাসল মনে মনে। শহরের বাবু কি আর বোঝে কসরৎ বলে কাকে। 

বাবুটা এগিয়ে এল।

'কি রে তোর কী খবর?' জিজ্ঞেস করল বাবু বাঁইকাকে। বাঁইকা শুধু হাসল।' তোর ত সাঙ্ঘাতিক খবর শুনছি চারদিকে রে। করেছিস কী?' বাঁইকা কিছু বলতে পারে না, তাকিয়ে থাকে। বাবু বলে চলে 'এখন কোথায় আছিস, ওই বাড়িটাতেই নাকি?' মাথা নাড়ে বাঁইকা, জানায়- না।
- 'তাহলে আছিস কোথায়?' বাঁইকা তাকিয়ে রইল। বাবু বলে 'আমার বাড়ির গ্যারেজটাতে ত জায়গা খালি আছে, চলে আয় থাকবি। একজন থাকলে সুবিধাও হয়- কে এল কে গেল আশেপাশে লক্ষ্য রাখতে পারবি। কি রে পারবি না?' 
বাঁইকা চেয়ে থাকে খানিকক্ষণ আর তারপর মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে।
-' যা নিয়ে আসবি মালপত্র, আমার বাড়ির গ্যারেজে থাকবি তুই। যতদিন হয় থাকিস। ভাড়া টাড়া কিছু চিন্তা নেই। ' 
বিহ্বল হয়ে বাবুর দিকে তাকিয়ে থাকে বাঁইকা। মুখে কোনো কথা বেরোয় না। একটু দূরে রাস্তার ধারে রঘুদার গ্যারেজের সামনে গাড়িটা স্টার্ট নেওয়ার শব্দ করে ওঠে- গিন্নীকে নিয়ে রঘুদা রওনা দেয় হাসপাতালের দিকে।

পরিবর্তন

প্রবন্ধ

প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা ​

পুজো বার্ষিকী ১৪২৮ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

পরিবর্তন

তাপস বিশ্বাস

cremation.jfif

ত্তরের দশক। আমার গড়ে ওঠার দশক – চোখের সামনে সব ভেঙ্গে পড়ার দশক – ভেঙ্গে পড়েও আবার ঘুরে দাঁড়ানোর দশক – হারিয়ে যাওয়ার দশক – নিজেকে ফিরে পাওয়ার দশক। এ শুধু আমার একার নয়, সারা পশ্চিমবঙ্গের, সারা দেশের কথা। আজ কথায় কথায় শুনি পরিবর্তন, কিন্তু সে এক সময় যখন সমুদ্রের ঢেউ এর  মতো আছড়ে পড়ছে ঘটনার পর ঘটনা, আমাদের সমাজ জীবনকে দম নিতে দেয়নি, এতটুকু ফুরসত দেয়নি একটু ভেবে দেখার। আমরা কেমন যন্ত্রচালিতের মত ভেসে গেছি সে ঢেউ এর ধাক্কায়।

হ্যাঁ, আজও ভুলতে পারি না সে দশকের কথা, প্রত্যেকটি ঘটনায় আমি সাক্ষী, আমার যোগ তার শিরায় উপশিরায়। একাত্তরে আমি ভর্তি হই বি ই কলেজে (of late IIEST, Shibpur), পাশ করে বেরিয়ে আসি ছিয়াত্তরে। বেরিয়ে এসে চাকুরীর জন্য খুব অপেক্ষা করতে হয়নি। চলে গেছিলাম ত্রিপুরার আগরতলায়। তবে সে তো আমার ব্যাক্তিগত হিসাব। সময় কিন্তু থেমে ছিল না। সত্তরের দশক আপন গতিতে এগিয়ে গিয়েছিল তার পরিনতির দিকে।

উনিশশো একাত্তর। কলেজে তখন চরম বিশৃঙ্খলতা। আমরা কোর্সের পাঁচ বছর মিলিয়ে প্রায় হাজার দেড়েক ছাত্র। তাদের মধ্যে কেউ বি পি এস সেফ, কেউ তথাকথিত নকশাল, আর ছাত্র পরিষদ এগিয়ে আসছে দুর্বার গতিতে। টালমাটাল অবস্থার মধ্যে, কখনো পেটোর আওয়াজ, হাতাহাতি সেও আবার কখনো কখনো রক্তাক্ত। বুঝতে পারতাম না কোন দিকে ঝুঁকবো, কে ফিরিয়ে আনবে আমাদের ছাত্র জীবনের সততা, কমিটমেন্ট।

ছুটিতে বা সপ্তাহের শেষে কোলকাতায় বাড়ীতে ফিরতাম। সেখানেও বিশৃঙ্খলতা, তবে বোধহয় আরও চড়া সুরের। নিত্যানন্দ লাইব্রেরী, আমাদের ছোটবেলার, বড় নিজের, বড় আদরের। এক ভোরে শুনি অমুকদা ঐ লাইব্রেরীর সামনে পাগলা কুকুরের মত ছুটোছুটি করছে। হাতে খোলা রিভলবার, রাস্তার মাঝখানে তার ছোটভাই এর টাটকা লাশ। আরও শুনলাম ঐ ছোটভাই নাকি ছিল খোঁচড়। ‘খোঁচড়’ শব্দটা তখন অভিধানে এক বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে। ঐ টাটকা লাশ ছিল আমার বন্ধু, সেও নাকি খোঁচড়! আর অমুকদা তখন কোলকাতা পুলিশের দোর্দণ্ডপ্রতাপ সাব-ইন্সপেক্টর।

বাড়ীর পাশেই ছিল গার্লস স্কুল। ঐ স্কুলে আমার বড়দিদি পড়াশুনো করেছে চল্লিশের দশকে। আশির দশকে আমার ভাইঝি ঐ স্কুল থেকেই পাশ করে বেরিয়েছে। আমার ভাইঝি ছিল ঐ স্কুলের ফার্স্ট গার্ল, এখন সে জীবনে প্রতিষ্ঠিত। অথচ সেই স্কুল চিহ্নিত হয়েছিল বুর্জোয়া শিক্ষার কারখানা হিসেবে। একদিন দুপুরে, সেদিন বাড়ীতে আছি, পরপর কয়েকটা পেটোর আওয়াজ। বাড়ী থেকে বেরিয়ে দেখি ঐ স্কুলের অফিসঘর থেকে গলগল করে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। কারা যেন ভাঙচুর করে আগুন লাগিয়ে গেছে ‘বুর্জোয়া’ তৈরির আঁতুড়ঘরে।

এই পারিপার্শ্বিকতার মধ্যেও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও কিন্তু থেমে নেই। কিছু আদর্শবান মানুষ সে যুগেও ছিলেন যাঁরা যে কোন মূল্যে সমাজের প্রতি নিজেদের দায়িত্বপালন করতে ভোলেন নি। এমনি এক মানুষের অনুপ্রেরণা আর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় এক সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত হচ্ছিল গান, আবৃত্তি আর ছোটদের নাটক, পাড়ার মাঠে। হঠাৎ ফোন এল লোকাল থানা থেকে – খবর আছে বেশ কিছু নকশাল গা ঢাকা দিয়েছে ঐ অনুষ্ঠানের মাঠে। ‘কোম্বিং’ হবে মনে চিরুনী তল্লাশি। ‘কোম্বিং’ শব্দটা আমাদের কাছে ততদিনে বেশ পরিচিত। সে তো খুব একটা জঘন্য ব্যাপার। পাড়ার এক বিশিষ্ট মানুষের কাছ থেকে থানায় ফোন গেল – “না, এভাবে একটা অনুষ্ঠান আপনারা নষ্ট করে দেবেন না”। অনেক কথার পর ঠিক হল পুলিশ কর্ডন করে রাখবে। অনুষ্ঠানের শেষে শুরু করবে তাদের সার্চ। একটু পরেই আবার থানা থেকে ফোন এল। এবার অন্য গলা ফিসফিস করে বলল, “কোন রকমে রাত্তির দশটা পর্যন্ত অনুষ্ঠান চালিয়ে নিয়ে যান। রাত্তির নটার পর আমরা আর ওখানে থাকতে পারব না, অন্য জায়গায় চলে যেতে হবে”। সেদিন অনুষ্ঠান চালিয়ে নিয়ে যাবার জন্য কয়েকজনের সাথে আমাকেও স্টেজে উঠতে হয়েছিল, কারণ প্রিপারেশন ছাড়াও আবৃত্তি করার অভ্যেস আমার কিছুটা ছিল। আমাদের পাড়ার ভূবনদা। অঙ্ক আটকালেই স্কুলের

ছেলেমেয়েরা দৌড়ত তার কাছে। ক্রিকেটে সাউথ ক্যালকাটা টুর্নামেন্টে তো থাকতেই হবে, ফুটবল ম্যাচেও ভূবনদাকে দরকার। কালীপূজোয় উড়ন ছাড়াটা তখন আমার কাছে একটা চ্যালেঞ্জ। আর ভূবনদা ছাড়ে, ফাঁকা মাঠের উপর দিয়ে ম্যানহাইটে হরাইজোনটালি গিয়ে ঠিক যেখানে মাঠের শেষ আর বস্তির শুরু, তার আগেই আকাশে উড়ে যায়। কোথায় হারিয়ে গেল পাড়ায় পাড়ায় এই ভূবনদারা। উনিশশো একাত্তর। এ বঙ্গের পাড়ায় পাড়ায় যখন বাজছে দুঃস্বপ্নের ঢক্কানিনাদ, ও বঙ্গে তখন গড়ে উঠেছে মুক্তিবাহিনী।

‘দাবায়ে না থাকার’ প্রতিশ্রুতি নিয়ে এগিয়ে এসেছেন বঙ্গবন্ধু। দূরের কোন নতুন এক রেডিও স্টেশন থেকে রোজ সকালে এক নির্দিষ্ট সময়ে ভেসে আসে সেই গান ‘আজ একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি প্রতিধ্বনি আকাশে বাতাসে ওঠে রণি, বাংলা দেশ আমার বাংলা দেশ’।

এই বঙ্গে চরম প্রশ্ন আর দ্বিধা যখন আমাদের অবক্ষয়ের পথে ঠেলে দিচ্ছে, আমরা অনুপ্রাণিত হই বেঁচে থাকার যুদ্ধে সামিল হওয়ার। ঐ নির্দিষ্ট সময়টা আমরা রেডিওর সামনে থেকে নড়তে পারি না, আশা নিরাশার দোলায় দুলতে দুলতে শুনি রোজকার লড়াইয়ে মুক্তিবাহিনীর জেতা বা হেরে যাওয়ার ঘটনা। ন মাসের যুদ্ধ শেষ হয় তাদের গ্যেরিলা বাহিনীর শক্তি আর ইন্ডিয়ান ফোর্সের সহায়তায়। শেখ মুজিব তাঁর আওয়ামী লীগকে সাথে নিয়ে আসেন ক্ষমতায়, পত্তন হয় আজকের বাংলা দেশের।

আমাদের এখানে জারী হয়েছে প্রেসিডেন্সী রুল। মানুষের মুণ্ডুর দাম তখন বাড়ছে কমছে, শেয়ার বাজারে সেন্সেক্সের মত। এরপর সিদ্ধার্থ রায় আসলেন, থাকলেন সাতাত্তর পর্যন্ত। যার শেষ দুবছর এমারজেন্সী। প্রেক্ষাপট পালটাচ্ছে অতি দ্রুত। আমরা নিজেরদেরকে সামলাতে পারছি না সেই উত্তাল ঢেউ এর মাঝখানে। তবু সময় তার নিজের নিয়মে এগিয়ে চলেছে।

আমাদের শিল্প-সংস্কৃতি কিন্তু থেমে নেই। কি করে থাকবে! আছেন সত্যজিৎ, আছেন মৃণাল সেন, আছেন তপন সিনহারা। তৈরী হচ্ছে একটার পর একটা চলচিত্র তখনকার পটভূমিতে। আমরা মুগ্ধ তাঁদের সৃষ্টিতে। পঁচাত্তরে আসল আমাদের বব ডিলান ‘গৌতম চট্টোপাধ্যায়’। গড়ে উঠল ভারতবর্ষের প্রথম রকব্যান্ড, আমরা পেলাম ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’। এর সাথে ছিল বাঙালির বহুদিনের সমৃদ্ধ নাটকের পরম্পরা।

তৈরি হল নতুন নতুন ফরম্যাট – ‘ইচ্ছে করলেই হাঙরের ও দাঁত দেখতে পাবে, যখন মহীন বাবুর ছুরিটা বাতাসে ঝলসাবে, কেউ দেখতে পাবে না পাবে না’। আমাদের সবার প্রিয় শ ম্ভু মিত্র অবশেষে পেলেন ‘ম্যাগসেস’ পুরস্কার।

সত্যিই অনেক কিছু দেখেছি, সব মনে রাখতে পারিনি। মনে পড়ে যায় ‘আতঙ্ক’ ছায়াছবিতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে বলা সুমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সেই বিখ্যাত ডায়ালগ “মাস্টার মশাই, আপনি কিন্তু কিছুই দেখেন নি”। এই দশকের শেষের দিকে যখন ভারতবর্ষের প্রধান মন্ত্রী ঘন ঘন বদলাচ্ছে, এলেন জ্যোতি বসু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর পদে। আমরা বোধহয় আবার শুরু করেছিলাম স্বপ্ন দেখতে, এক সুস্থির পশ্চিমবঙ্গের।

একটা গুরুত্বপূর্ণ উপস্থিতির প্রসঙ্গ বাকি রয়ে গেল। শুধু গুরুত্বপূর্ণ বললে অনেকটাই কম বলা হবে। কারণ অল্প সময়ের মধ্যেই সে হয়ে দাঁড়ালো জনগণের দৈনন্দিন জীবনের নিয়ামক, দেশে ও বিদেশে। হ্যাঁ, টেলিভিশনের কথা বলছি। পঁচাত্তরে আসে কোলকাতায়। ছিয়াত্তরে তৈরী হল ‘দূরদর্শন’, ছড়িয়ে পড়ল গ্রামে গঞ্জে তার সুদূরপ্রসারী সম্ভাবনা নিয়ে। চলচিত্র জগতে আসল প্রথম টিনএজ লাভস্টোরি ‘ববি’। সমাজ প্রকাশ্যে স্বীকৃতি দিল টিনএজ প্রেম, আর আমাদের অন্তরে লুকিয়ে রাখা কথাগুলো দুরন্ত ধারায় বেরিয়ে আসল। আমরা যারা গান ভালবাসি, তাদের জন্য কিশোর-পঞ্চম জুটি একটার পর একটা সৃষ্টি করে গেলেন।

যখন পিছন পানে তাকাই, না কোন বিতর্ক নয় প্লিজ, সত্তরের দশকের পটভূমিতে আজকের এই পরিবর্তন কিছুটা জোলো মনে হয়।   

Debashis Pattanakye.jpg

কবিতা

দেবাশিস পট্টনায়েক

জন্ম ১৯৬৭ সালে মেদিনীপুর জেলার (পূর্ব মেদিনীপুর) তমলুক মহকুমায়। চাকরি সূত্রে দিল্লী নিবাসী, গবেষণা ও অধ্যাপনায় নিযুক্ত। কবিতা লেখা শখ।

কবিতাঃ দেবাশিস পট্টনায়েক

প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা ​

পুজো বার্ষিকী ১৪২৮ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

রক্তধারা
 

মা: 
কিরে খোকা - 
আমার উপর রেগে আছিস?
 
খোকা: 
না মা, রাগ নয়, অভিমান; 
তাও যখন বয়স কম ছিল।
 
মা: 
অভিমান! কেন রে?
 
খোকা:
মনে আছে, ছোটবেলায় যখন 
তোমার সঙ্গে লুকোচুরি খেলতাম,
তোমাকে খুঁজে না পেলে 
ভয়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠতাম! 
তুমি ছুটে এসে আদর করে 
আমার কান্না থামাতে। 
এখন কেন আসো না?
 
মা:
আমিতো লুকিয়ে যাই নি,  
জেগে আছি তোর মনের মাঝখানে।
 
খোকা: 
তাইতো পথ চলতে পারি; 
তাও যখন ঝড় ওঠে, 
আকাশে মেঘ জমে, 
অন্ধকার নেমে আসে,
মনে হয় ছোটোবেলার মতো 
তোমার হাত ধরে রাস্তা হাঁটি ।
 
মা:
তখনতো আমার হাত ছেড়ে 
ছুটে পালাবার চেষ্টা করতিস; 
ভয়ে অস্থির হয়ে যেতাম 
ভিড়ের মাঝে হারিয়ে যাস যদি!
 
 
খোকা:  
বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে 
যখন কোন মা ও ছেলেকে একসাথে 
রাস্তায় হেঁটে যেতে দেখি। 
খুঁজে বেড়াই তোমাকে সব মায়ের মধ্যে। 
সেদিন হঠাৎ স্বপ্ন দেখলাম 
মন্দিরের মাঝখানে তুমি 
একা শুয়ে আছো; 
মন্দিরটা ঠিক চিনতে পারলাম না। 
তাইতো মন্দির দেখলেই ছুটে যাই, 
খুঁজতে থাকি তোমাকে। 
সবাই ভাবে যে আমি বুঝি 
বড়কিছু পাওয়ার প্রার্থনায় 
ভগবানের দ্বারস্থ হচ্ছি ।
 
মা: 
ভগবানে বিশ্বাস, ধর্মে মতি  
তোর কোন কালেই ছিল না, 
পূজার আগে ফল-মূল-মিষ্টি 
চুরি করে খেতিস।
 
খোকা: 
আমি যে জন্ম থেকেই দীক্ষিত; 
দীক্ষা তখনই সম্পূর্ণ হলো 
যখন গুরুর উপর অভিমান 
শ্রদ্ধায়, পূজায় পরিণত হলো।
 
মা: 
আবেগটা চিরকালই তোর একটু বেশি।
 
খোকা:
তোমার থেকেইতো পাওয়া মা, 
মনে পড়ে ফুটবল খেলতে গিয়ে 
হাত-পা কেটে গেলে তুমি 
বোরোলিন লাগাতে লাগাতে বকতে থাকতে –
'কালকে খেলতে যাস, 
তোর একদিন কি আমার একদিন'।
 
মা:
নিজেকে ঠিক রাখতে পারতাম না, 
তোর কিছু হলে মনে হত 
শরীরে রক্ত প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে! 
তখন তুই একেবারেই অবুঝ ছিলিস।
সিগারেট খাওয়া ছেড়েছিস? 
না খাস এখনও?
 
খোকা:
খুব চেষ্টা করেও ছাড়তে পারছিলাম না,
হাতে যখন দুটো কাদার তাল পেলাম, 
তখন মনে হল শিল্পীর নিপুণ হাতে 
মূর্তি বানাতে হবে। 
পূজার ছলে সিগারেটের নেশা 
ছেড়ে দিয়েছে একলব্য।
 
মা: 
আমার ফটোর সামনে দাঁড়িয়ে 
কি ভাবিস অমন করে?
 
খোকা:
অনুভব করি দেবীকে 
আমার শিরায় ধমনীতে। 
ঘাটে বাঁধা নৌকা,  
যাত্রার দেরী আছে; 
ভাটার টান সেই শেষ রাতে। 
মন্দিরে পূজার ঘন্টা, 
বট গাছের ছায়া, 
আঁচলের শীতল হাওয়া, 
পাখির কূজন, 
স্মৃতির মধুর আবেশ - 
আমার কপালে জয়টিকা,
আমিও তোমার মতো অমৃত পান করেছি।

কবিতা
 

ই আকাশে 
আলো আঁধারী কুহকী মায়ায়
যুবতী জ্যোৎস্নার সোনালী চুল নিয়ে 
খেলা করে কামুক হাওয়া।
ব্যথার মেঘ আছড়ে পড়ে 
সাদা পাহাড়ের বুকে,
ঝরনা হয়ে বয়ে যায় 
রাত জাগা পাখির ব্যকুল সুরে।
নূতন সূর্য হাসে,
হাতছানি দিয়ে ডাকে -
পাখি ডানা মেলে উড়ে আয়,
রঙের নেশা আঁকব চোখে,
এক মুঠো আবির মাখিয়ে দেব মনে;
বুক চুইয়ে রক্ত ঝরবে,
শরীর যাবে ঝলসে।

 

ব্যথা

কৃষ্ণচূড়া শিমুল পলাশের লাল
ঢেকে দিয়ে মেঘের কালো চাদরে,
তাণ্ডব উল্লাসে মদোন্মত্ত ঘূর্ণিঝড়ের
রুদ্র নৃত্য মন্দিরের বুকে।
রাত্রির আবছা ছায়ার ছদ্মবেশে 
ভিনদেশী শত্রুর আক্রমণ সঙ্গোপনে 
অরক্ষিত, অপলকা সোনার কেল্লার দ্বারে।
খাঁচায় নিরুদ্ধ পাখিটা, যে চোখ বুজে
স্বপ্ন দেখছিল আকাশের উষ্ণতার, বকুলের গন্ধের,
ঝরে গেল তার একগুচ্ছ সোনালী পালক
বিদ্যুদ্দীপ্তির চকিত রুষ্ট ভ্রুকুটিতে।
ঠিক তখনি, ঘুমপাড়ানি গানের মধুর মমতায়
টুপ-টাপ টুপ-টাপ, রিমঝিম রিমঝিম;
কাজলাদীঘির পাড় চুইয়ে বৃষ্টির ফোঁটা 
রামধনু রঙ মেখে ফুল হয়ে ফোটে
অজানা গহীন জঙ্গলের গায়ে।
ঝলসানো পাখি গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে, 
আবার গান ধরবে - সাগরের নীলের।

সীতা


চোখের জলে বেঁধে মনের ব্যথা
নীরবে যেও না চলে।
তোমাকে আজ যারা বাঁধে
ধর্মের দোহাই দিয়ে কলঙ্কের জালে,
কাল তারাই মুছে দেয় কালো দাগ 
পাথরের গায়ে পা ঘসে।
দেখো ওই শুষ্ক চোখের দিকে তাকিয়ে,
নেই যাদের লুকানোর জায়গা মায়ের বুকে,
তুমি হও তাদের প্রতিবাদের ভাষা।
অশোকের নীচে বসে 
জ্বালিয়ে ছিলে যে আগুন 
দাও ছুঁড়ে তা ওদের বুকে,
ধিকিধিকি জ্বলুক সে আগুন 
জ্বালিয়ে দিতে সব লঙ্কা।


দীক্ষণ
 

থের বাঁকে যারা হারিয়ে গেছে,
রাস্তার দুধারে যারা ঝরে পড়েছে,
না জানি কখন সঙ্গোপনে
তারা এঁকে দিয়েছে আমার কপালে  
ধূলার ব্যথার তিলক,
ধূসর রঙে রাঙিয়ে দিয়েছে উত্তরীয়,
কানে কানে বলে গেছে -
আগুন বড় সুন্দর, শীতল।
অভয় মন্ত্রে, অশনি মানিক হারে,
যাকে তোমরা অভিষিক্ত করলে 
সে অভিশঙ্কাকে উপাচার সাজাতে দাও
মাদল রাগে রুদ্র সুন্দরের আরাধনায়,
অশান্ত কাল বৈশাখীর বাসন্তী উল্লাসে।
ফাল্গুন নয়, আমাকে বৈশাখ হতে দাও।


বিবর্তন
 

রাস্তায় ধূলার উপর উপুড় হয়ে শুয়ে
ডাগর ডাগর অপলক চোখে সীমাহীন বিস্ময়ে
এক মনোরম দৃশ্য দেখছে দুধের শিশুটা -
খুঁটিতে বাঁধা মা-ছাগল ধীরে ধীরে
জাবর কাটছে পরমতৃপ্তিতে চোখ বন্ধ করে,
তিনটে শাবক লাফালাফি করে দুধ খাচ্ছে।
দেখতে দেখতে হঠাৎই কি মনে হল
ডুকরে কেঁদে উঠে ঘরের পানে ছুটল শিশু।
বাঁশের বাতা দিয়ে ঘেরা খড়ের ছাউনি,
ফোকর দিয়ে উঁকি দেওয়া সোনালী রোদের 
গা বেয়ে কুণ্ডলী পাকাচ্ছে কালো সঁপিল ধোঁয়া,
ঘুঁটের উনুনে মাটির হাঁড়িতে ফুটছে ভাত,
মনে ফুটছে অশ্রুভেজা ভাদ্রের ভাবনা,
ছেঁড়া কাপড়ে কোন রকমে ঢাকা শীর্ণ শরীর, 
রান্নাঘরে গালে হাত দিয়ে বসে থাকা রাঁধুনীর
চোখে কুয়াশা ভরা অবশ শীতল অলসতা।
মায়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল শিশু -খিদে পেয়েছে,
দূরে সরিয়ে দিল মা পিঠে এক থাপ্পড় মেরে -
'চুপ করে বস ওখানে, ভাত দিচ্ছি এখুনি।'
তাড়াতাড়ি করে ভাতের ফ্যান গড়াতে লাগল মা;
বুকের পাঁজরে লুকোতে চায় ব্যথায় টনটন 
ঘর্মাক্ত নিদ্রাকাতর আহত শুষ্ক স্তন।

মিতা
 
"...
ক্ষুধিত ভুজঙ্গ তমিস্র রাত
নিবিড় নিঠুর প্রণয় আশ্লেষে
নৈঃশব্দ্যের, নিঃসঙ্গতার, বিষণ্ণতার বিষ
ছড়িয়ে দিচ্ছিল শিথিল ছায়ামাখা শরীরে।
আশার জয়ধ্বজা উড়িয়ে,
প্রেমের লাবণ্য ছড়িয়ে,
রূপকথার রাজকুমার স্মিত হাস্যে
সুরের মালা দিলে পরিয়ে।
ব্যথার কুয়াশা ভেদ করে,
অবসন্নতার পাষাণ চূর্ণ করে,
ভাষার আলোকে চোখ মেললাম।
জীবন ময়ূর নেচে উঠল
বৃষ্টিভেজা লতা-গুচ্ছের আবেশঘন উল্লাসে,
শ্রাবণের কূলভাঙ্গা নদীর 
চঞ্চল উচ্ছল কলকল্লোলে।..."
 
ওই দ্যখো -
পাগলের মত আবোল তাবোল বকছি
কবিতার খাতা খুলে।
আকাশে মেঘ, ঝড় উঠেছে,
এমন দূর্যোগে চলে যেও না যেন ;
চা বানিয়ে নিয়ে আসছি,
গল্প করে রাতটা কাটিয়ে দেব।
শীতল ঘোমটা পরে তন্দ্রা আসে যদি
গানের আঁচলে ঢেকে দিও আমাকে,
জাগিয়ে রেখো হাতের উষ্ণ ছোঁয়ায়।
ভোরের আলো ফুটলে একসাথে বেরিয়ে পড়ব
যে যার অফিসের পথে।
ট্রেনের কামরায় জানালার ধারে বসে
তোমার লেখা চিঠি পড়তে পড়তে
রাস্তা যাবে ফুরিয়ে।


রামের আপন দেশে
 

হল্যা -
আর ঘুমিও না শীলাভুত হয়ে 
অপবাদের ব্যথা বুকে বেঁধে।
দেখো আকুল আর্তি নিয়ে 
বাদলের ধারা বাউলের ছদ্মবেশে 
ঝরে পড়ছে তোমার দুয়ারে।
দাও সাড়া সৃষ্টির আবহানে
ভেঙে ওই পাষাণকারা
আপন দৃঢ় দীপ্ত পদাঘাতে।
জীবননদী বয়ে যাক যৌবন উল্লাসে,
সবুজের ছোঁয়া লাগুক পৃথিবীর গালে।
 

বিকেল বেলার বৃষ্টি

নেকদিন পরে ছমছম করে বৃষ্টি,
সঙ্গে শনশন হাওয়ার দমক।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি,
থেকে থেকে অকারণে হঠাৎ করে 
বৃষ্টির ফোঁটা ছুঁয়ে যাচ্ছে আমাকে বারবার।
যেমন করে ছুঁয়েছিল সে,
প্রথম বৃষ্টিতে ভেজা একসাথে 
এক ছোট্ট ছাতার নীচে 
স্কুল ছুটির পর বাড়ির পথে,
এক কিশোরীর চপল হাসির লহর,
বৃষ্টির কলতান, ক্ষণিকের ছোঁয়া,
তড়িৎ-পৃষ্ট শিহরণ দেহের সব রোমকূপে।...

আমার পূজা ছিল মনে মনে
তাকিয়ে থাকতাম ক্লাসের মাঝে,
সে তাকিয়ে থাকত বোড়ের পানে
বা বইয়ের কালো কালো অক্ষরের দিকে।
ফিরিয়ে নিত দৃষ্টি তখনই 
কখনো ভুলে চোখে চোখ পড়লে।
সে দিনটা ছিল শনিবার,
ঝেপে নেমে এসেছিল বৃষ্টি 
ঠিক স্কুল ছুটির সময়।
ভিজতে ভিজতে হাঁটছিলাম একা,
হঠাৎ ভেসে এল একটা সুন্দর গন্ধ,
দেখলাম মাথার উপর এক রঙিন ছাতা,
একগাল হেসে পাশে দাঁড়িয়ে সে,
যেন বর্ষণসিক্ত সদ্য প্রস্ফুটিত এক ফুল।
বন্ধুদের দল ছেড়ে অপেক্ষা করছিল 
আমার জন্য, তারও বাড়ি এই পথে
তাই যতটা রাস্তা একসাথে যাওয়া যায়।
হাওয়ার তালে মনের খুশিতে 
গান গেয়ে উড়ছিল এক বুলবুলি 
আর ভিজে যাওয়া এক কিশোর মন।
তার নিশ্বাসের গরম হাওয়া 
পাখনা হয়ে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিল 
আমাকে কোন অজানা স্বপ্নের দেশে।
জানিনা কেন মধুর হাসির উচ্ছ্বাস 
অকারণে বারবার উপচে পড়ছিল
তার লাল ঠোঁটের বাঁধ ভেঙে।
রাস্তায় জমে থাকা জল
ছিটিয়ে দিচ্ছিল পা দিয়ে,
আমার মনের সব রঙ ঝরে পড়ে
মিশে যাচ্ছিল ঐ জলের সাথে।
রাস্তার মোড়ে চোখের উপর চোখ রেখে 
হাত ধরে বলেছিল 
আর হবে না দেখা 
চলে যাচ্ছে সে স্কুল ছেড়ে 
দূরে কোথায় বাবা-মায়ের সাথে।
কদম গাছের তলায় ঠায় দাঁড়িয়ে 
দেখলাম অদৃশ্য হল সে
ধীরে ধীরে রাস্তার বাঁকে
একবারও পিছন ফিরে না তাকিয়ে। ...

এমনি কোন বর্ষণমুখর অবসরে
সে কি একবারও ফিরে তাকায় না
বছরকাল পেরিয়ে সেই বৃষ্টিভেজা দিনটাতে!
আজ বৃষ্টির ফোঁটা বারবার 
আমার শরীর ছুঁয়ে গেল,
মন ভিজল না,
ছাতা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে।

 

প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা ​

পুজো বার্ষিকী ১৪২৮ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

গল্প

সময়ের কাটাঁ

সময়ের কাঁটা

গীতাঞ্জলী ঘোষ

newspaper1.jpg

 (১)
সিন্ধুদের বাড়ির পেল্লাই বড় ঘড়িটায় ঢং ঢং করে রাত্রি বারোটার ঘন্টা পড়ল। ঘড়িটা বেশ পুরনো। সিন্ধুদের চার পুরুষের ইতিহাস বহন করছে। শুধু তাই নয়, শোনা যায় এই চার পুরুষের দীর্ঘ দুশো বছরের মধ্যে ঘড়ি নাকি একবারের জন্যও ভুল সময় দেয়নি বা খারাপ হয়ে যায়নি। তাদের পরিবারের বিশ্বাস এই ঘড়ি যেদিন ভুল সময় দেবে, সেদিন তাদের বংশেরও খারাপ সময় শুরু হবে। অংশু কুমার সিন্ধু মানে অর্ধেন্দু কুমার সিন্ধুর নাতি তার বন্ধু বিনয়কে চুপি চুপি এও বলেছে যে তার ঠাকুরদা মনে করেন এই বংশের পুরুষদের প্রাণপাখি ঐ ঘড়ি। শুনে বিনয় একটু ঠাট্টা করে বলেছিল, “প্রাণপাখি? মানে ঘড়ির কোনো ক্ষতি হলে  তোরা সবাই মরে যাবি? হাঃ হাঃ। বেশ মজার তো।“
সিন্ধুরা এই অঞ্চলের সামন্ত। সাধারণ মানুষের কাছ থেকে খাজনা আদায় ছাড়াও, তাদের অগাধ পুঁজির আরেকটা উৎস হল কাঠের ব্যবসা। কোনো এক জ্যোতিষী সিন্ধু বাড়ির কোনো এক পূর্বপুরুষকে বলেছিলেন যে কাঠের ব্যবসায় তাদের লাভ হবে প্রচুর। সেই শুনেই তারা কাঠের ব্যবসায় হাত দেয়। ভাগ্যক্রমেই হোক অথবা অন্য কোনো কারণেই হোক, জ্যোতিষীর সেই কথা ফলে যায়। তবে অর্ধেন্দু সিন্ধুর ছোটো ছেলে অস্টেন্দু সিন্ধু পারিবারিক সম্পত্তির প্রতি কোনো আগ্রহ না দেখিয়ে বিলেতে পড়তে চলে যায় এবং সেখানেই থেকে যায়, আর ফেরেননি। 
ঘড়িটায় গমগমে শব্দে বারোটার ঘন্টা পড়ার সাথে একটা কুকুর কোথাও ডেকে উঠল। হঠাৎ দেখা গেল একটা লম্বা ছায়ামূর্তি টলমল পায়ে এগিয়ে আসছে। লোকটার পরনে হাঁটু অব্দি লম্বা কোর্ট, মাথায় হ্যাট। কোনোভাবে তার জামাকাপড় ভিজে গেছে, টপ টপ করে জল পড়ছে তার ঐ ঢিলে লম্বা কোর্ট থেকে। লোকটা অতি কষ্টে পা টেনে টেনে হাঁটছে। যে কুকুরটা এতক্ষণ ডাকছিল, সে এবার লোকটার কাছে এসে চুপচাপ তাকিয়ে রইল। কিছুটা দুর যাওয়ার পর লোকটা হাঁটু গেড়ে পেটে দুহাত চেপে বসে পড়ল। তারপর আস্তে আস্তে তার ঐ রোগা লম্বা শরীরটা নুইয়ে পড়ল মাটিতে। চোখের সামনে সবকিছু কেমন ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে এল। একসময় দুচোখের পাতা বন্ধ হয়ে গেল। লম্বা শরীরটা অন্ধকার রাস্তায় লুটিয়ে পড়ল। কুকুরটা কাছে এসে কিছুক্ষণ শুঁকল লোকটার জামা কাপড়, তারপর চুপ করে বসে পড়ল তার পাশে। 


(২)
আজ বেশ সকাল সকাল ঘুম ভেঙে গেছে অলির। ভোরের দিকে কিছু একটা স্বপ্ন দেখছিল, এখন ঠিক মনে করতে পারছে না। কিন্তু স্বপ্নটা এতটাই জীবন্ত ছিল যে ঘুম থেকে উঠে সে দেখে ঘেমে তার পরনের নাইট গাউনটা ভিজে গেছে, এমনকি বিছানার যেখানে সে শুয়েছিল সেখানটাও ভিজে একসা। এমন সময় গোগোল ঘরে ঢুকে দিদির বইয়ের সেল্ফ থেকে কোনো বই নিতে এসেছিল। দিদির দিকে আর চোখে তাকিয়ে সে বলে উঠল, “ মহারানীর এখনও কি সকাল হয়নি! নটা তো বাজতে চলল”। অলি তার ভাইয়ের স্বভাবের সাথে পূর্বপরিচিত। বিভিন্নভাবে দিদিকে উৎপাত করে সে। “হ্যাঁ রে। আমি তো মহারানী। আর মহারানীদের অত সকাল সকাল ঘুম ভাঙ্গে না”। বলেই কানটা মুলে দিল। 
“আঃ! ছাড়, মা দেখ দিদি আমাকে মারল”, বলে চেঁচিয়ে উঠল গোগোল। গোগোল আর অলির মা লীলাদেবী রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন শাড়ীর আঁচলে হাত মুছতে মুছতে। রবিবারের সকাল, জলখাবারে লুচি আলুর দম বানাতে হবে, বাড়ীর সকলের আবদার।
“কী হল কি? সকল সকাল আমার সময় নষ্ট করিস না। অনেক কাজ পড়ে আছে।“
“মা দেখ, দিদি আমার কান ধরে টানল। আমি তো এখন বড়ো হয়েছি নাকি।”
“বেশ করেছি”। বলে আবার ভাইয়ের কানটা ধরে টানল অলি।
“আর ঝামেলা করিস না। গিয়ে মুখ হাত ধো”। বলে আবার রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালেন লীলাদেবী। 
মুখ হাত ধুয়ে চায়ের কাপ হাতে বেশ গুছিয়ে অলি বসল সোফার ওপর। একটি আই টি সেক্টরে চাকরি করে সে। পুরো সপ্তাহে তার কাজে খুব চাপ থাকে, নিউজ পেপার পড়ার সময় পায় না। যদিও তার এইসব রাজনীতির কূটকচালি পড়তে ভালোও লাগে না। কিন্তু তারই মাঝে মাঝে একেকটা বেশ ইন্টারেস্টিং স্টোরি থাকে, সেগুলো সে পড়ে। আগের কিছুদিনের নিউজ পেপার নিয়ে তাই ঘাঁটাঘাঁটি করছিল অলি। একটা খবরের প্রতি তার চোখ আটকালো, যদিও ঘটনাটা খুবই সামান্য। লেখা আছে, পদার্থ বিজ্ঞানী প্রমথ কুমার চৌধুরী হঠাৎ নিখোঁজ। প্রমথবাবুর স্ত্রী জানিয়েছেন, তিনি তার মেয়েকে নিয়ে কিছুদিন বাপের বাড়ি গিয়েছিলেন। দুদিন আগে প্রমথবাবুর নিজেরই আনতে যাওয়ার কথা ছিল স্ত্রী আর মেয়েকে। তাঁর স্ত্রী মালিনী অনেকবার ফোন করছিলেন। রিং হচ্ছিল কিন্তু ফোন তোলেননি প্রমথবাবু, আর তাই তিনি তাড়াতাড়ি করে বাড়ি ফিরে আসেন। প্রথমে তিনি কিডন্যাপ বলে মনে করেছিলেন, কিন্তু কিডন্যাপারদের কোনো ফোন কল বা চিঠি কিছুই আসেনি। তাই তিনি থানায় রিপোর্ট করেন। 
অলি নিউজ পেপারটা কোলে রেখে সামনে টেবিল থেকে ফোনটা তুলে নিয়ে টক টক করে আঙ্গুলের ছোঁয়ায় কস্তুরীর নাম্বারটা বের করে কল করল। কস্তুরী অলির কলেজের বন্ধু যার সাথে অলির এখনও পর্যন্ত বেশ ভালো যোগাযোগ রয়েছে। কস্তুরী নিউজ রিপোর্টার।এই নিউজ পেপার অফিসেই চাকরি করে। 
“হেই, লং টাইম অলি। অনেকদিন পর ফোন করলি”।
“ আচ্ছা, শোন না! একটা খবর জানার ছিল।“
“ হ্যাঁ। বল। অল ওকে?”
“ তোদের নিউজ পেপারে একটা স্টোরি কভার করেছে, ওটা সম্পর্কে একটু জানার ছিল।  পদার্থবিজ্ঞানী প্রমথ কুমার চৌধুরীর ঐ রহস্যজনকভাবে উধাও হয়ে যাওয়া….
“ আরে হ্যাঁ ঐ প্রমথ চৌধুরীর মিসিং। ব্যাপারটা বেশ আনেক্সপেক্টাবল। কিছুদিন আগেই তো উনার একটা লেখা বেরিয়েছিল ঐ সোলার অ্যান্ড লুনার ইকলিপস নিয়ে। উনি ওর উপরেই রিসার্চ করতেন।“
“ কেন আনেক্সপেক্টাবলে কেন বলছিস?”
“ দেখ যতটুকু আমি শুনেছি আর উনার স্ত্রী মালিনীদেবী বলেছেন তা থেকে এটা স্পষ্ট যে ভদ্রলোক খুব শান্ত ধরনের, নিজের কাজের বাইরে কোনো কিছুরই সেরকম খবর রাখতেন না। কোনো শত্রু থাকতে পারে, সেটা উনার স্ত্রী বিশ্বাস করতেই চান না। আর তাই উনি প্রথম থেকেই খুব সিওর ছিলেন যে এটা কোনো পাতি কিডন্যাপারদের কাজ। কিন্তু পরে যখন ফোন কল বা চিঠি কিছুই আসে না, তখন বাধ্য হয়েই তিনি থানায় রিপোর্ট করেন।“
“হুঁ”, অলি একটু গম্ভীর ভাবে বলল। “নিউজ পেপারে একই লিখেছে। আর তুই উনার ইন্টারিউয়ের ব্যাপারে কি বলছিলি…. কোন নিউজ পেপারে বেরিয়েছে?”
“স্টোরিটাতো একটা ইংলিশ পেপার কভার করেছে।“
“ওকে। হ্যাভ ইউ দেট নিউজ, জাস্ট সেন্ড মি দেন।“
“ওকে। আই উইল সেন্ড”
“তুই কি এর মধ্যে কোনো রহস্য খুঁজছিস।“ কাথাটা বলেই ফিক করে হেসে উঠল কস্তুরী।
“আরে না না। রহস্য কিছু খুঁজছি না। তুই তো জানিস এরকম টাইপের স্টোরির প্রতি একটা আলাদাই attraction কাজ করে।“
“তা জানিনা আবার। কলেজে যা করতিস….”
দুই বন্ধু পুরনো স্মৃতি চারণ আর ঠাট্টা তামাশায় মেতে উঠল। 
“আচ্ছা শোন এই নিউজের কিরকম কি প্রগ্রেস জানাস আমাকে। অবশ্য আমি কল করে তোকে জেনে নেব।“

 

(৩)
অলির অফিসে এখন কফি ব্রেক চলছে। বাকি কলিগরা সব কফি হাতে নিজেদের মধ্যে মশকারায় ব্যস্ত। কেউ কেউ আবার কফির কাপে রাজনীতির ঝড় তুলেছে। অলির পাশের ডেস্কে ঋত্বিকা বসে। রিত্তিকার টেবিল থেকে নিউজ পেপারটা তুলে অলি বলল, “এনি ইন্টারেস্টিং নিউজ টুডে?” 
“এখনও দেখিনি। এত সকাল থেকে চাপ যাচ্ছে। বসের হঠাৎ অর্ডার এই টেন্ডার দুটো আজই কমপ্লিট করে পাঠাতে হবে।“ 
অলি নিউজ পেপারটা উল্টাতে শুরু করল। এটা অন্য নিউজ পেপার, নাম 'নিয়মিত'। এই খবরের কাগজ তার বাড়িতে নেওয়া হয় না। হেডিংগুলোয় চোখ বোলাচ্ছিল অলি।
হঠাৎ কি মনে হতে ফোনটা হাতে নিয়ে হোয়াটস অ্যাপটা খুলে কস্তুরীকে একটা টেক্সট করল, “রাতে তোর সাথে কথা আছে আর প্রমথ কুমার চৌধুরীর ইন্টারভিউ আর লেখাটা তুই আমাকে এখনও সেন্ড করলি না।“ এন্টার বাটনটা প্রেস করল অলি। ডবল টিক পড়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ডবল টিকে নীল রঙের ছোঁয়া পেল। কস্তুরীর নামের তলায় লেখা অনলাইন। এক সেকেন্ডের মধ্যেই অনলাইনের বদলে টাইপিং ফুটে উঠল। 
“ওকে ম্যাম। রাতে কথা বলছি। এই সরি একদম ভুলে গেছি। পাঁচ মিনিটের মধ্যে সেন্ড করছি।“ কস্তুরীর প্রত্যুত্তর। 
এরপর ফোনটা টেবিলে রেখে রিভলভিং চেয়ারে শরীর এলিয়ে চোখ বন্ধ করে বসল অলি। আজকের মতো অফিসের কাজ তার কমপ্লিট। এবার বেরোতে পারলে হয় অফিস থেকে।
রাত আটটার সময় কস্তুরী নিজেই অলিকে কল করল। স্ক্রিনে কস্তুরীর নামটা ফুটে উঠতেই অলি ডাইনিং থেকে চট করে নিজের ঘরে চলে এল। 
“হ্যালো। অফিস থেকে ফিরেছিস?”
“হ্যাঁ ম্যাডাম। বাড়ি এসে ফ্রেশ হয়ে তবে কল করলাম। এখন জলদি করে বল তো কি কথা। আমায় আবার একটা স্টোরি নিয়ে রাতে বসতে হবে।“

“প্রমথ কুমার চৌধুরীর কেসের কি প্রগ্রেস?  নতুন কিছু জানতে পারলি?”
“নাহ্! আসলে প্রমথ চৌধুরীর স্টোরিটা আনন্দ কভার করছে। আর আমার অন্য স্টোরি কভার করা নিয়ে ব্যস্ততা ছিল, তাই আর জিজ্ঞেস করা হয়নি।“ 
কস্তুরীর পাঠানো প্রমথ কুমার চৌধুরীরর ইন্টারভিউটা অলি অফিস থেকে ফেরার পথেই মেট্রোতে বসে পড়ে নিয়েছিল। অলির মানুষটাকে বড্ড অদ্ভুত মনে হয়েছে। বিভিন্ন প্রশ্নের যা উত্তর তিনি দিয়েছেন তার সারমর্ম হল আমাদের বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড ট্রাইকোয়েট্রার নীতি মেনে চলছে,  যেখানে তিনটে ডাইমেনশন এক অসীম সময়ের সুতোয় গাঁথা। সময়ই একমাত্র, যে এই তিনটে ডাইমেনশনের সমস্ত ঘটনাবলিকে পৃথক করে রেখেছে তিনটে রেখার মাধ্যমে। জ্যামিতিক ভাষায়, X, y অ্যান্ড z প্লেন। অর্থাৎ সব ডাইমেনশনের সমস্ত অধিবাসী এক জায়গাতেই আছে, কিন্তু সময়ের পার্থক্য তাদের আলাদা করে রেখেছে। তিনি আরও বলেছেন সময়ের এই তিনটে রেখা এক বিন্দুতে মিলিত হচ্ছে বা বলা যায় একটি বিন্দু থেকে উৎপত্তি হচ্ছে। গ্রাফে যাকে বলে অরিজিন (০,০,০)। এই অরিজিনেই একমাত্র সময় স্থির, তবে তা বেশিক্ষণ স্থির থাকে না। একমাত্র এই বিন্দুতে কিছুক্ষণের জন্য তিনটে ডাইমেনশনের সকল ঘটনা, সকল অধিবাসী একসাথে উপস্থিত হতে পারে ঐ কিছুক্ষণ সময়ের জন্য তার কারণ ঐ পয়েন্টে সময় স্থির। পদার্থ বিজ্ঞানি প্রমথ কুমার চৌধুরীরর থিওরী অনুযায়ী, ইক্লিপস হল সেই সময় যখন তিনটে ডাইমেনশন ক্ষণিকের জন্য একই মুহূর্তে একই স্থানে পাশাপাশি অবস্থান করে। এইসময় এক ডাইমেনশন থেকে অন্য ডাইমেনশনে যাওয়া যায়। এরকম ধরনের কথাবার্তা অন্য কেউ বললে অলি এক তুড়িতে সবকিছু উড়িয়ে দিত। কিন্তু এই কথা একজন পদার্থ বিজ্ঞানীর। উড়িয়ে দেওয়া যায় না। 
রাতে ডিনার খাওয়ার পর এইসব নিয়েই ভাবছিল। ছোটবেলায় যে চিন্তা ভাবনা বড়রা আজগুবি বলত, এখন সেই সমস্ত আজগুবি ঘটনাই বৈজ্ঞানিক প্রমাণে জীবন্ত হয়ে উঠছে।  ভাবতে ভাবতে অলির দু চোখের পাতা কখন যে বুজে এল তার খেয়াল নেই। আস্তে আস্তে ঘুমের মধ্যে ছোট্টবেলায় দাদুর কাছে শোনা সুয়োরানি দুয়োরানির দুনিয়ায় হারিয়ে গেল সে। 

 

(৪)
- “এই কী রে? ঘুমিয়ে পড়লি নাকি? এই কস্তুরী।“
কস্তুরী ঘুমে ভরা চোখদুটো হাতের তালুতে কচলে নিয়ে বলল, “না না। ঐ চোখটা একটু লেগে গেছিল। ধুর! ভালোলাগে না। আর কতক্ষণ বসে থাকতে হবে এখানে?” হাত ঘড়িটা দেখে নিয়ে বলল “রাত একটা বাজতে চলল। কোথাও কিছু নেই। ফিরে চল অলি।“ 
“দাঁড়া না। আমার মন বলছে এখানে কিছু গন্ডগোল আছে।“ 
পাঁচদিন আগে কস্তুরী হঠাৎই অলিকে ফোন করে জানায় যে প্রমথবাবুর স্টোরিটা আনন্দ তার কোনো ব্যক্তিগত অসুবিধার জন্য কভার করতে পারছে না তাই স্টোরির দায়িত্ব এসেছে কস্তুরীর ওপর। এই খবর তার রহস্যপ্রেমী বন্ধু শুনলে যে খুবই আনন্দিত হবে তা বলাবাহুল্য। এরপর দুটো ঘটনা হয়েছে যে কারণে এখন তারা এই মাঝরাতে অন্ধকারে ঝোপঝাড়ের আড়ালে বসে রাজপ্রাসাদের ন্যায় বিশাল এক বাংলোর প্রতি নজর রাখছে। প্রথম ঘটনা, অলি আর কস্তুরী একদিন প্রমথবাবুর বাড়িতে যায়। তাঁর স্ত্রী মালিনী দরজা খুলে কেমন একটু ভয় ভয় মুখ নিয়ে জানতে চায় “কী ব্যাপার? আপনারা! কি চাই?” 
কস্তুরী নিজেকে রিপোর্টার বলে পরিচয় দিতে যাবে, অলি তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে, “আমরা পি এইচ ডি স্কলার, স্যারের ল্যাবেই কাজ করি। আসলে এরকম একটা ঘটনা শুনে ল্যাবে সবার খুব মন খারাপ। তাই আমরা দুজন একটু দেখা করতে এলাম আপনার সাথে, যদি কোনোভাবে সাহায্য করতে পারি। আমরা কি একটু ভেতরে গিয়ে কথা বলতে পারি?” যদিও মালিনীদেবীর খুব একটা ইচ্ছা ছিল না ওদের ভেতরে আসতে বলার। কিন্তু কথাটা বলে অলি আর কস্তুরী একরকম জোর করেই বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল। মালিনীও কেমন একটু আড়ষ্ট হয়ে বসল চেয়ারে। অলি আবার বলল, “আপনার মেয়েকে দেখছি না?” 
“হ্যাঁ। ও এখন মামারবাড়ীতে ওর দাদু, দিদার কাছে আছে।“ অলি এবার একটু গুছিয়ে বসে মালিনির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনি কেসটা উইথড্র করেছেন শুনলাম। প্রমথবাবু মানে স্যারের কোনো খবর পেয়েছেন?
মালিনী একটু ঘাবড়ে গেল। নিজেকে তাড়াতাড়ি স্বাভাবিক করে বলল,
হ্যাঁ মানে না। আসলে আমার মনে হয় কিডন্যাপার কোনোভাবে জেনে গেছে যে আমি থানায় রিপোর্ট করেছি আর তাই হয়তো ওরা কল করছে না। সেই কারণেই আমি উইথড্র করে নিই কেসটা। 
কস্তুরী উঠে দাঁড়িয়ে দেওয়ালে লাগানো ফটোগুলোর দিকে দেখছিল। হাল্কা গোলাপি রঙের দেওয়াল, তার গায়ে অনেক ফটো ফ্রেম - পারিবারিক ছবি, প্রমথবাবুর ছাত্রজীবনের ছবি, মালিনি আর মেয়ের সাথে ছবি ইত্যাদি। একটা ফটো দেখিয়ে কস্তুরী জিজ্ঞেস করল, “এই ছোটো ছেলেটা কে?”
নয়-দশ বছরের স্কুলের ইউনিফর্ম পরা একটা ছেলের ছবি। ছবিটা দেখে বেশ পুরোনো মনে হচ্ছে। মালিনী শঙ্কিত গলায় বলল, “ওটা প্রমথর ছোটবেলার ছবি।“ বলেই শাড়ীর আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মুছল। যেন কোন কারণে খুব ভয় পেয়ে আছে। 
অলি বলল, “একটু জল পাওয়া যাবে?” 
“হ্যাঁ।“ মালিনী রান্নাঘরের ভেতরে গেল জল আনতে। কস্তুরী আর অলি একবার চোখ চাওয়াচাওয়ি করল। হঠাৎ ভেতর থেকে কেউ একজন ডেকে উঠল, “মালিনী”। গলাটা কোনো ছোটো ছেলের। দুবার ডাকার পর, কোনো উওর না পেয়ে বিরক্তিসুচক শব্দ করে ছেলেটা ডাইনিং এ এল। 
“মালিনী, কোথায় গেলে!”.... অলি আর কস্তুরী ছেলেটাকে দেখেই হতভম্ব হয়ে গেল। ছেলেটাও এরকম অচেনা দুটো মেয়েকে দেখে হকচকিয়ে গেল। কস্তুরী আস্তে আস্তে মাথাটা বামদিকে ঘুরিয়ে দেওয়ালে সাজিয়ে রাখা ফটোফ্রেমগুলোর মধ্যে প্রমথবাবুর ছোটবেলার ফটোটার দিকে তাকাল। এক মুখ, এক দেখতে। যেন দশ বছরের প্রমথ চৌধুরী ফটো থেকে বেরিয়ে এসেছেন। অলি খুব অস্পষ্ট স্বরে বলল, “how is it possible!”
আচমকা এক শব্দে সকলেরই সম্বিত ফিরল। মালিনীদেবীর হাত থেকে জল ভর্তি কাঁচের গ্লাস পড়ল মেঝেতে। কাঁচের টুকরো ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে। অলি কিছু বলার আগেই মালিনী সামনে এসে দাড়াল। 
“আপনারা যান এখন। প্লিজ চলে যান।“ বলে একরকম জোর করেই অলি আর কস্তুরীকে বাড়ি থেকে বের করে দিল। দুই বন্ধু বাইরে এসে কিছুক্ষণ কোনো কথা বলতে পারল না। দুজনের মাথাতেই অজস্র প্রশ্ন ভিড় করেছে। কিন্তু তার থেকেও বড় প্রশ্ন হল ছেলেটা কি সত্যিই প্রমথ চৌধুরী? অবিকল একই দেখতে, অলি প্রথম কথা বলল। 
“কে এই বাচ্চাটা?
উনার তো এক মেয়ে আছে। তাহলে কে? ইনি কি সত্যিই ছবির ঐ প্রমথ চৌধুরী?”
“কিন্তু সেটা কি করে সম্ভব? উনার কোনো রিলেটিভ হতে পারে, তাহলে মলিনীদেবী এরকম অদ্ভুত react করলেন কেন”….. কস্তুরী থেমে যায়। 

চারিদিক নিস্তব্ধ। মাথার ওপর খোলা আকাশের বুকে টুনি বালবের মতো মিটমিট করছে অসংখ্য তারা। মৃদু হাল্কা ভিজে হাওয়াতে অলি আর কস্তুরী দুজনের চুলই কেঁপে কেঁপে উঠছে। দুই বন্ধু যার দিকে তাদের লক্ষ্য স্থির করে বসে আছে, সেটা তিনতলা উঁচু প্রশস্ত পরিখা বেষ্টিত একটি বায়োলজিক্যাল ল্যাব। মূল জনস্রোত থেকে অনেকটাই ভেতরে, চারপাশে বেশ ঘন জঙ্গলে ঘেরা ল্যাবটা। এই ল্যাব ডক্টর হুমায়ূন খাঁ এর, তিনি একজন ইমিউন বায়োলজিস্ট। ডক্টর হুমায়ূন খাঁ এর ল্যাবের প্রধান কাজ হল বিভিন্ন ফরেইন অ্যান্টিজেন এর against এ অ্যান্টিবডি তৈরি করা এবং তার robust প্রোডাকশন। ইনি প্রমথ কুমার চৌধুরীর কলিগ। একই ইনস্টিটিউটে কাজ করেন। অলি আর কস্তুরী নিউজ পেপারের স্টোরি কভারের জন্য যখন ইনস্টিটিউটের অনেকের সাথেই কথা বলছিল তখন অলির কেমন যেন সন্দেহ হয় ডক্টর হুমায়ূনকে। যেন অতিরিক্ত ভদ্রতা করছিলেন। মুখমণ্ডলে একটি দীর্ঘ ব্যাসের হাসি সবসময়ই যেন ঝুলছে। উনার অফিসে সেদিন অলি আর কস্তুরীকে মাত্রাতিরিক্ত আদর আপ্যায়ন করেছিলেন।
“আরে এস এস। সরি তোমাদেরকে আপনি না বলে তুমি বলছি। তোমরা আমার মেয়ের বয়সী। তা তোমরা রিপোর্টার! বাহ্! বেশ সাহসী বলতে হবে তাহলে তোমাদের। রিপোর্টারদের শুনেছি অনেক বিপদের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয়।“ 
“হ্যাঁ তাতো একটু হয়ই। তবে সত্যের সন্ধান করতে গেলে ওটুকু তো নিতেই হবে। আপনাকে কিছু প্রশ্ন করব।“ কস্তুরী প্রথম কথা শুরু করেছিল। 
“তা বেশ বেশ। তবে সত্যের সন্ধান ভালো হলেও তার ফলটা অনেকসময় খারাপ হয়ে যায়। হে হে। তা বল আমি তোমাদের কি জানাতে পারি?” 
অফিসের ভেতর আর একটি লোক বসেছিল ডানদিকে সোফার ওপর। উঠে দাঁড়াতেই বোঝা গেল লোকটা বেশ  লম্বা আর লম্বা হওয়ার জন্যই সামনের দিকে দেহটা একটু ঝুঁকে আছে। লোকটার পরনে হাঁটু পর্যন্ত ঝোলা গলাভর্তি কালো কোর্ট। মাথায় একটা বেশ বড় হ্যাট। হ্যাটটার জন্য লোকটার মুখটা ঠিক দেখা যাচ্ছে না। সে অনেক্ষণ ধরেই কিছু বলবে বলবে বলে উশখুশ করছিল। হঠাৎ ডক্টর হুমায়ূন বলে ওঠেন, 
“এ কি জিমি! তুমি এখনও যাওনি? বললাম তো আমি একটু পরে গিয়ে দেখছি।“ জিমি বলে লোকটি অফিস থেকে বেরিয়ে গেল। অলি দেখল লোকটার হাঁটার মধ্যে এক অসংগতি, পা টা একটু টেনে টেনে চলে। 
“সরি ফর দ্যা interruption। ডক্টর হুমায়ূন এর গলায় আবার সেই মিছরির মিষ্টতা। আসলে বুঝতেই পারছ ল্যাবে সবসময় এক্সপেরিমেন্ট চলে। এখন আবার নতুন একটা এক্সপেরিমেন্ট করব ভাবছি। আর সেটা ডিজাইন করতেই এখন ব্যস্ত একটু।“
সেদিন প্রশ্নোত্তর পর্ব শেষ হবার পর তিনি অলি আর কস্তুরীকে ল্যাবে আসার জন্য নিমন্ত্রণ ও জানান। আর তাঁর কথামতো দুই বন্ধু ঘুরেও গেছে একবার। 
“আচ্ছা, আপনি আপনার ল্যাব ইনস্টিটিউট থেকে এত দূরে কেন বানিয়েছেন?” অলি জিজ্ঞেস করেছিল।
“আসলে আমার ভিড়ভাট্টা বেশি সহ্য হয় না। আর নিজের রিসার্চের কাজ আমি একটু গোপন রাখতেই পছন্দ করি।“ 
এমন কি কাজ করেন ডক্টর হুমায়ূন যে যেখানে সব সাইন্টিস্টদের ল্যাব রয়েছে, সেখান থেকে এত দূরে….. এই প্রশ্নই এত রাতে এখানে টেনে নিয়ে এসেছে তাদের।

অলি বাইনোকুলারটা চোখে দিয়ে মাঝে মাঝেই কিছু দেখার চেষ্টা করছিল। হঠাৎ সে কস্তুরীর হাতটা ধরে আলতো টান মেরে ফিসফিসিয়ে বলল, “ওঠ।“ ওরা দুজনে অত্যন্ত ধীর পায়ে লতানো গাছগুলো মাড়িয়ে এগিয়ে চলল। পাতার মচমচানি শব্দে তন্দ্রাচ্ছন্ন সিকিউরিটি গার্ডটার তন্দ্রা ভঙ্গ হল। সে  একটু এগিয়ে দেখতে গেল কিসের শব্দ। সেই সুযোগে দুজনে ঢুকে গেল ভেতরে। ভেতরে ঢুকতেই তারা সিঁড়ি দেখতে পেল সামনে। কিছু সিঁড়ি ওপরে উঠে গেছে। আর কিছু নিচে নেমে গেছে। তার মানে আন্ডার গ্রাউন্ডে কোনো ফ্লোর আছে। মুখ চাওয়াচওয়ি করল দুই বন্ধু। আলতো পায়ে তারা সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামতে শুরু করল। যত এগোচ্ছে যেন এক অন্ধকার কুপে প্রবেশ করছে। যত এগোয় সিঁড়ির সংখ্যা যেন আরও বেড়ে যায়। 
বেশ কিছুক্ষণ পর তারা দেখতে পেল ক্ষীণ হলুদ আলো ঠিকরে বেরোচ্ছে কোথাও থেকে। সেই আলোর দিকে এগিয়ে যেতেই এক বিশাল হল ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল। আলোটা ঐ ঘর থেকেই নিঃসৃত হচ্ছে। কাচের দরজা ঠেলে ঢুকতেই ঠাণ্ডা হাওয়া ঝাপটা মারল শরীরে। ঘরটি শীততাপ নিয়ন্ত্রিত। তাপমাত্রা অতিরিক্তই কম। কারণ শীত করতে শুরু করল কিছুক্ষণের মধ্যেই। কিন্তু কি আছে এই বিশাল ঘরে? আলোটা এতটাই কম কি ঠিক করে কিছুই বোঝা যায় না। অলি তার ফোনের টর্চটা জ্বালাল। তারা দেখল সমগ্র ঘর জুড়ে সারি সারি কাচের লম্বা বাক্স দাড় করিয়ে রাখা। আরেকটু ভালো করে লক্ষ্য করতেই বোঝা গেল যে এই বাক্সগুলোর সাইজের মধ্যে একটা সিকোয়েন্স রয়েছে। তিনটে করে বাক্স যার প্রথমটা লম্বায় বেশ ছোট, মাঝেরটা বেশ বড়ো আর তিন নম্বরটি মাঝের থেকে ছোটো কিন্তু প্রথমটার থেকে বড়। এই সিকোয়েন্স মেনেই বাকি সব বাক্স রয়েছে। কিছু লেখা রয়েছে  বক্সের এক কোণে। কি লেখা সেটা দেখতে এগিয়ে গেল কস্তুরী। যা দেখল তাতে তার রক্ত হিম হয়ে গেল। একজায়গায় স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে পড়ল সে। মনে হল তার পা দুটো কেউ আঠা দিয়ে আটকে দিয়েছে মাটির সাথে। অলি কিছু বুঝতে না পেরে বলল, “কি হল কস্তুরী?” কস্তুরী অত্যন্ত কষ্টে ভয়ে মাথাটা আস্তে আস্তে ঘোরালো অলির দিকে। চোখেমুখে ভয়ের ছাপ। অলি কি ব্যাপার দেখতে এগিয়ে গেল। গিয়ে যা দেখল তাতে তারও একই অবস্থা হওয়ার জোগাড়। ঐ কাচের বাক্সগুলোয় রাখা আছে সারি সারি নগ্ন দেহ। প্রথম বাক্সে একটা নয় দশ বছরের ছোটো ছেলের দেহ, তার পাশেরটায় মধ্য বয়সের এক পুরুষ। আর তৃতীয়টিতে বৃদ্ধ। সব বাক্সগুলোয় ঠিক একই সিকোয়েন্স সব বডি রাখা। দেখে মনে হয় না তারা কেউ বেঁচে আছে। কেমন সাদা রক্তশূন্য ফ্যাকাসে হয়ে আছে। কস্তুরী মুখে হাত চেপে বমির উদ্রেক করল। অলিরও দেখেই গা গুলিয়ে উঠল। অলি এবার মোবাইলের টর্চের আলোয় বাক্সের ওপর লেখাটাকে পড়তে চেষ্টা করল। 
“রবার্ট জেফারসন, ১৯৬৭, Tuesday দুপুর ৩:৩০।“ পাশের বাক্স দুটোতেও একই নাম, শুধু সময়টা আলাদা। 
অলি আরও কয়েকটা কাচের বাক্স দেখল। তিনটে করে কাচের বাক্সে একই নাম, সময় আলাদা। কস্তুরী কেমন যেন এখনও ব্যাপারটাকে হজম করতে পারছে না। “কী এসব? এত বডি এখানে, এভাবে”…. শেষ করতে পারল না কস্তুরী। তার আগেই অলি ডাকল, “কস্তুরী”। 
কস্তুরী দেখল অলি একটা বাক্সের সামনে দাঁড়িয়ে কিছু দেখাচ্ছে। 
“কস্তুরী, এই বক্সটা খালি” তার পাশের বক্সের বডিটা দেখেই চমকে উঠল কস্তুরী। দুজনেই অস্ফুটে বলে উঠল, “ডক্টর প্রমথ চৌধুরী।“ হঠাৎ তাদের পায়ের তলার মাটি দুলে উঠল। কি হল বোঝার আগেই তাদের শরীর দুটো হাল্কা হয়ে এল। এক অন্ধকার মহাশূন্যে যেন হারিয়ে যেতে লাগল তারা। 

 

(৫)

ফরেনসিক রিপোর্টটা ভালো করে পড়ছিল ইন্সপেক্টর দাখিল। পুরো নাম নিশান্ত দাখিল। লোকাল থানার ওসি তিনি। সৌম্যদর্শন অবাঙালি পুলিশ অফিসারটি লম্বায় প্রায় ছ ফুটের কাছাকাছি, শ্যমজ্জ্বল, চোখে মুখে বুদ্ধির ছাপ। বেশিদিন হয়নি তিনি জয়েন করেছেন। এরই মধ্যে এফিশিয়েন্ট পুলিশ অফিসার হিসেবে বেশ নাম করেছেন। এই নিয়ে চারবার হল তিনি রিপোর্টটা পড়লেন। কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না কি হচ্ছে। দুদিন আগেই একটা ডেডবডি পাওয়া গেছে বেল স্ট্রিটের উত্তর দিকের রাস্তার মোড়ে। ডেডবডিটা আবিষ্কার করে স্থানীয় মানুষজন। লোকটার পরনে হাঁটু পর্যন্ত ঝোলা কালো কোর্ট, মাথায় হ্যাট। শরীরে কোথাও কোনো আঘাত বা ক্ষত কিছুই নেই। প্রথমে সকলে ভেবেছিল কোনো মাতাল হয়তো মদ খেয়ে পড়ে আছে। কিন্তু অনেকক্ষণ একইভাবে পড়ে থাকতে দেখে সন্দেহ হয়। লোকটার নিঃশ্বাস- প্রশ্বাস কিছুই পড়ছে না। তার মানে মারা গেছে। প্রথমেই পুলিশে খবর দেয় তারা।  লোকটির পরিচয় কিছু জানা যায়নি। জামার পকেটে কোনো ওয়ালেটও ছিল না। কেউ বডি ক্লেইম করতেও আসেনি। অগত্যা পোস্টমর্টেম এর পর থানা থেকেই ব্যবস্থা করে সৎকার করা হয়। সেই রিপোর্ট এসেছে আজ। ফরেনসিক বিভাগের ডক্টর শ্রীবাস্তব জানিয়েছেন, “লোকটার বডিতে এক অদ্ভুত অটোঅ্যান্টিবডি পাওয়া গেছে যা সেলফ রিসেপ্টরকে recognise করে। এবং recognise করে তখনই যখন সেই রিসেপ্টর এর সাথে তার পরিপূরক লিগান্ড যুক্ত হয়। লিগান্ডের অনুপস্থিতিতে অ্যান্টিবডি সেল্ফ রিসেপ্টর এর সাথে বাইন্ড করতে পারে না।“ মানুষের শরীরে সেল সারফেসে কিছু মলিকিউল থাকে যা বিভিন্ন কেমিক্যাল সিগনাল recognise করতে পারে। সেল সারফেসে থাকা এই মলিকিউলকে রিসেপ্টর বলে আর সেই কেমিক্যাল সিগন্যালিং মলিকিউলকে বলা হয় ligand। কিন্তু মজার বিষয়  এক্ষেত্রে রিসেপ্টর যে কেমিক্যাল ligand এর সাথে bind করে তা নিঃসৃত হয় যখন মানুষ ইমোশনালি ভীষণ সক্রিয় হয়ে ওঠে। তার মানে স্বাভাবিক অবস্থায় এই এন্টিবডির কোনোরকম কার্যকারিতা দেখা যায় না। কিন্তু এইরকম অ্যান্টিবডির উপস্থিতি আগে কোথাও বলা নেই। ইন্সপেক্টর দাখিলের এসব প্রায় মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছিল। এর ফল কি হতে পারে, এটা কি  সংক্রামক কিছু এইসব প্রশ্ন মাথায় ঘুরছিল। কি করবে, কার কাছে এই সকল প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে? দাখিল পকেট থেকে তার মোবাইলটা বের করে ডক্টর শ্রীবাস্তবের নাম্বারে কল করল। “হ্যালো,” অপরদিকে একটা গুরুগম্ভীর আওয়াজ। “হ্যালো ডক্টর শ্রীবাস্তব, আমি ইন্সপেক্টর দাখিল বলছি। ব্যস্ত আছেন? একটা ইম্পর্ট্যান্ট কথা ছিল।“ “ও হ্যাঁ দাখিল বল।“

“বলছি আপনি যে অ্যান্টিবডির কথা বলছিলেন, আমি ওটার সম্পর্কে বিশদে জানতে চাই।“ 
“দেখো দাখিল, আমি যতটুকু জানি সবটাই তোমাকে জানিয়েছি। এর থেকে বেশি…”বলে কিছু ভাবলেন ডক্টর শ্রীবাস্তব। “তবে আমি তোমাকে একজনের নাম বলতে পারি যিনি তোমাকে এই বিষয়ে জানতে সাহায্য করতে পারেন।“ 
“অবশ্যই। কাইন্ডলি বলুন। আপনার সাথে যদি চেনাজানা থাকে, তাহলে তো খুবই ভালো হয়।“ 
“আমার সাথে ডাইরেক্টলি কোনো চেনা জানা নেই তবে আমি তার গড ফাদারকে চিনি।“ 
“গড ফাদার!” দাখিলের গলায় বিস্ময় ফুটে ওঠে। ডক্টর শ্রীবাস্তব একটু হেসে বলেন,
“তোমাকে আমি একটা অ্যাড্রেস আর টাইম টেক্সট করছি। চলে এস।“ ফোনটা কাটতেই টুং টুং করে ম্যাসেজ ঢুকল দাখিলের ফোনে।
“সত্যানন্দ ক্লাব, নগর পল্লী। কাল ঠিক সন্ধ্যে ছয়টা।“

(৬)
“প্রাণ হল পরমাত্মার এক অমর সৃষ্টি। হ্যাঁ ঠিকই শুনেছেন। এই সৃষ্টি অমর, এর কোনো মৃত্যু নেই। প্রাণ আছে যে দেহে তাই প্রাণী। বিশালাকৃতির হাতি যেমন পরমাত্মা থেকে সৃষ্টি হয়েছে, ঠিক তেমনই একটি ক্ষুদ্র পিপড়েও এসেছে পরমাত্মা থেকেই। আমরা সকলেই এক এবং অদ্বিতীয়। আদিমতম সৃষ্টির অংশ এই প্রাণীকুল।

মানুষ এবং একটি কুকুরের মধ্যে শুধু পার্থক্য শরীরে, অন্তরাত্মার কোনো পার্থক্য নেই। উপলব্ধি করার যে ক্ষমতা মানুষের মধ্যে এসেছে তা শুধুমাত্র অনুশীলনের দ্বারা। আধ্যাত্মিক অনুশীলন“ এতটা বলে থামলেন সত্যানন্দ মহারাজ। রোগা হারজীর্ণ শরীরে মেরুদন্ড সোজা করে পদ্মাসনে বসে আছেন তিনি। খালি গা, কপালে সাদা লাল তিলক, বন্ধ চোখ দুটো কোটরাগত।  ধূসর বর্ণের চুল জটায় পরিণত হয়ে কাঁধের দুপাশ দিয়ে বুকের কাছে ঝুলছে। শীর্ণ দেহ হলেও দেহের মধ্যে এক অদ্ভুত জ্যোতির আভাস রয়েছে। গেরুয়া রঙের একফালি কাপড় কোমরে শক্ত করে বাঁধা।
মাটি থেকে কয়েক ফুট উঁচু একটি বেদীতে আসনের ওপর বসে আছেন তিনি। আর তাঁর সম্মুখেই শতরঞ্জি বিছানো মেঝেতে বসে আছে কম করে জনা তিরিশেক লোক। সকলেই পদ্মাসনে নিজ নিজ আসনে উপবিষ্ট। চোখ সকলেরই বন্ধ। সমগ্র ঘর জুড়ে লালচে আলো খেলা করছে, টিম টিমে সেই আলোয় নিস্তব্ধ চারপাশের পরিবেশ। ইন্সপেক্টর দাখিলের মনে হল পৃথিবীর কোলাহল ছেড়ে দূরে এক প্রশান্তির জগতে প্রবেশ করেছেন তিনি, মিটমিটে আলোয় কেমন নেশা ধরে যাচ্ছে। ঘরে উপস্থিত মানুষদের পোশাক দেখেই বোঝা যাচ্ছে সম্ভ্রান্ত পরিবারের ভদ্রলোক সকলে। দাখিলের আসতে একটু দেরি হয়েছে। সে দেখল ডান দিকের প্রথম সারির কোণের দিকে ডক্টর শ্রীবাস্তব চোখ বুজে বসে আছেন। এখানে আসতে বলার কারণটা ঠিক কি সেটা দাখিল এখনও বুঝতে পারছে না। এই সাধুবাবা তার কোন্ প্রশ্নের উত্তর দেবেন?
প্রায় দশ মিনিট পর ঘরের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ হল। ডক্টর শ্রীবাস্তব দেখতে পেয়েছেন দাখিলকে। কাছে এসে বললেন, “কখন এলে তুমি?” 
“প্রায় পনেরো মিনিট। এই সাধুবাবার স্পিচের মাঝখানে। একটু লেট হয়ে গেছি। তবে…”
“কেন আমি তোমাকে এখানে ডেকেছি বুঝতে পারছ না তাই তো?” সহজাত হাসিটা হেসে ডক্টর শ্রীবাস্তব বললেন। 
“হ্যাঁ মানে, এইরকম জায়গায় আমি কি তথ্য পাব?”
“পাবে পাবে।“ দাখিলের কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললেন “ঐ যে চশমা পড়া ভদ্রলোককে দেখছ…” দাখিল দেখল এক ভদ্রলোক হাতজোড় করে বিনয়ের সাথে আসনে উপবিষ্ট সাধুবাবাকে প্রণাম করছেন।
“উনি হলেন ডক্টর হুমায়ূন খাঁ, একজন প্রখ্যাত ইমিউনো বায়োলজিস্ট। তোমার প্রশ্নের উত্তর উনি একমাত্র দিতে পারবেন।“
ডক্টর শ্রীবাস্তব দাখিলকে ডক্টর হুমায়ূন খাঁ এর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। স্বাভাবিক আলাপচারিতা এবং নিজেদের পেশা সম্পর্কে দুয়েকটা কথা বলার পর তিনি নিজেই দাখিল কে নিমন্ত্রণ জানালেন একদিন নিজের ল্যাবে আসতে। দাখিল সুযোগটা সাথে সাথে লুফে নিল। 
“সিয়োর ডক্টর খাঁ। ইনফ্যাক্ট আমি কালই আসতে পারি বিকেলের দিকে, যদি আপনার কোনো অসুবিধা না থাকে।“
ডক্টর হুমায়ুন বিনয়ের হাসি হেসে বললেন,
“অবশ্যই। অনেক কিছু নতুন জিনিসপত্র দেখতে পাবেন। বিকেলেই চলে আসুন। আমি ফাঁকাই থাকব।“

“আরেকটা প্রশ্ন করতে চাই, যদি কিছু মনে না করেন।“

“সত্যানন্দ মহারাজকে বিশ্বাস না করে উপায় কোথায় বলুন। বুঝেছি। আমি একজন বৈজ্ঞানিক তাই ভাবছেন, তাই তো? দেখুন জীবনের রহস্য বড়ই জটিল। শুধু জন্ম- মৃত্যু এই জীবনের সত্য নয়। এর বাইরেও অনেক সত্য আছে। সত্যানন্দ মহারাজ সেইসমস্ত সত্য সৃষ্টি করেছেন। আর সেই সৃষ্টির পথ তৈরি হয়েছে সাইন্স এর সমস্ত নিয়ম মেনেই। উনার শরণাপন্ন হন, সব বুঝতে পারবেন।“ বলে ভক্তিভরে কপালে দুই হাত জোড় করে ঠেকালেন ডক্টর হুমায়ুন খাঁ।
ফেরার পথে হাঁটতে হাঁটতে দাখিল ডক্টর শ্রীবাস্তব কে ঠাট্টার সুরে জিজ্ঞেস করল,
“তা আপনি এসবে কবে ভিরলেন?” 
“কি সবে?”
“এই যে সত্যানন্দ মহারাজ।“
“হয়ে গেল বেশ কয়েকমাস।“ 
“তার মানে আপনারও এসবে বিশ্বাস প্রবল? আর বিশ্বাসে ভক্তি!”
“তোমার কিরকম লাগল উনাকে”
“কি আবার লাগবে? যতসব বুজরুকি। আমার এসবে কোনোদিনই বিশ্বাস ভক্তি কিছুই নেই। তবে আপনাদের বাবাজির কথা বলার স্টাইলটা বেশ attractive। আর ঐ attraction, মানুষজন মনে হয় শিষ্য হয়ে যায়।“ 
“জানি না। তবে আমি শুনেছি উনার নাকি অদ্ভুত ক্ষমতা আছে। উনি অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত পরিবর্তন করতে পারেন।“
“হা হাহা হাহা…এ তো আবার আরেক কাঠি ওপরে যায়। এতদিন জানতাম এই সমস্ত বাবাজি ভবিষ্যত বলতে পারেন। ইনি আবার পরিবর্তনও করতে পারেন! তা আপনি উনার এই অসীম ক্ষমতার কিছু পরিচয় পেলেন?”
“সেই পাওয়ার অপেক্ষাতেই তো রয়েছি,” বলে মুচকি হাসলেন ডক্টর শ্রীবাস্তব। 

 

(৭)
চোখটা খোলার চেষ্টা করল কস্তুরী। চোখের পাতা দুটো খুলেই বন্ধ হয়ে আসছে খালি খালি। মাথাটা অত্যধিক ভারী লাগছে। চোখের সামনে সবকিছু কেমন অস্পষ্ট, ঝাপসা। শরীরে কোনো জোর নেই। কোথায় আছে ঠিক বুঝতে পারছে না। বুকটা তেষ্টায় ফেটে যাচ্ছে। তার ঠোঁটদুটো হাল্কা নড়ে উঠল, “জল”।
হঠাৎই কেউ বোতল থেকে একটু জল তার মুখে ঢেলে দিল। 
“কস্তুরী, এই কস্তুরী ঠিক আছিস তো?” ফিসফিসিয়ে অলি বলল।
“অ…অলি”! হাতে ভর দিয়ে উঠে বসার চেষ্টা করল কস্তুরী। অলি তাকে ধরে দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসাল।
“কি যে ঘাড়ের কাছে ইনজেক্ট করল! এখনও ঘাড়টা ব্যথা।“
কস্তুরীরও ব্যথা করছে ঘাড়টা। মনে পড়ল সেই নগ্ন রক্তশূন্য দেহগুলোর কথা। মনে হতেই আবার গাটা গুলিয়ে উঠল। আস্তে করে বলল, 
“এই প্রফেসর কী করছে এই ল্যাবে?” 
“কী করছে থেকেও প্রধান প্রশ্ন হল কেন করছে এবং কিভাবে করছে।“
“তুই নিশ্চয় বুঝতে পেরেছিস যে ঐ হল ঘরটায় বডিগুলো একটা টাইম স্কেলে সাজানো। মানে প্রত্যেকটা মানুষের কৈশোর, যৌবন আর বার্ধক্য এইভাবে সাজানো। একটা মানুষের জীবনের তিনটে ফেজ পাওয়া তখনই সম্ভব যদি ঐ নির্দিষ্ট টাইম স্কেল থেকে তাদের নিয়ে আসা যায়। সেদিন প্রমথ চৌধুরীর বাড়িতে যে ছেলেটিকে আমরা দেখেছিলাম সে আসলে সত্যিই প্রমথ চৌধুরীর কৈশোর অবস্থা। আর যে বডিগুলো আমরা দেখে ডেডবডি বলে ভাবছিলাম ওগুলো ডেডবডি নয়। কারণ ডেডবডি হলে প্রমথ চৌধুরীর তিনটে বাক্সের প্রথমটা খালি থাকত না।“
“তার মানে তুই বলতে চাইছিস সেদিন মালীনির বাড়িতে ঐ ছেলেটিই একটা সময় ঐ বক্সে ছিল!” কস্তুরী বলল।
“বলতে চাইছি নয়, বলছি। কিন্তু কি করে হল আর কেন! কেন? কী করছে ডক্টর হুমায়ুন খাঁ।“ অলি তার নীচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরল, কপালে তার চিন্তার ভাঁজ। 
“আচ্ছা, তোর মনে আছে প্রমথ চৌধুরীর ইন্টারভিউটা? ওখানে উনি বলেছিলেন সময়ের মাধ্যমে বিভিন্ন ডাইমেনশন পৃথক থাকে, কি একটা ট্রিকোয়েট্রা না কি বেশ!”
“হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়েছে। উনি এও বলেছিলেন যে সোলার এবং লুনার ইকলিপসের সময় তিনটে ডাইমেনশন একটি পয়েন্টে মিলিত হয়।“
“হ্যাঁ, আর ঠিক ঐ সময়ই এক ডাইমেনশন থেকে আর এক ডাইমেনশনে কেউ চাইলে যেতে পারে”, অলি বলল। “এখন এই তিনটে ডাইমেনশনকে যদি আমি পাস্ট, প্রেজেন্ট আর ফিউচার ধরি, তাহলে ব্যাপারটা অনেক পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে।“ অলির কথাটা শেষ হওয়ার আগেই ঘরের দরজা বাইরে থেকে খোলার শব্দ হল। ছ'ফুট লম্বা, দৈত্যাকার দেহের  টাক মাথা একটা লোক এগিয়ে এল। আর তার ঠিক পেছনেই ডক্টর হুমায়ুন খাঁ ঢুকলেন। মাথার ওপরে সিলিং থেকে ঝুলন্ত বাল্বের হলুদ আলোয় ডক্টর হুমায়ুনের চোখদুটো জ্বলজ্বল করছে। ঠোঁটের কোণে সেই চিরপরিচিত হাসি। 
“ছোটো মেয়ে তোমরা। কোথায় সাজবে, ঘুরবে, লাইফটা এনজয় করবে তা নয় এসব বিপদের মধ্যে”…. বলে চুকচুক করে একটা আওয়াজ করলেন,
“এবার বেঘোরে প্রাণটা খোয়াবে। এইজন্য বলি এত কৌতুহল ভালো নয়।“ 
“আপনার উদ্দেশ্যটা ঠিক কি বলুন তো? এত বডি…ওগুলো কোনোটাই ডেডবডি নয় সেটা তো বোঝাই যাচ্ছে, তাহলে কি করেছেন আপনি ঐ মানুষগুলোর সাথে? কোনো সিডেটিভ দিয়ে রেখেছেন? কি করে করলেন এসব?” অলি চিৎকার করে উঠল।
“কামডাউন। এত উত্তেজনা ভালো নয়। কি করে করলাম সে তোমরা দেখতেই পাবে কারণ তোমাদের সাথেও ওটাই করা হবে যা ওদের সাথে করা হয়েছে”।
“দেখুন আমরা অনেক কিছুই বুঝে গেছি। তাই ভাববেন না আপনি বেঁচে যাবেন। এর জন্য ভয়ংকর শাস্তি পেতে হবে আপনাকে।“
“হাঃ হাঃ হাঃ কে শাস্তি দেবে? তোমরা? আগে নিজেদের প্রাণটা থাকে নাকি সেটা দেখ। আমি যা করেছি, ঠিক করেছি। মানুষই তো মানুষের জন্য বাঁচে। তাই আমি মানুষের শরীরকেই কাজে লাগাচ্ছি অ্যান্টিবডি প্রোডাকশনে।“ কথাটা বলে তিনি ঐ দৈত্যাকার লোকটিকে আদেশ দিলেন,
“এ দো লারকী কে উপর নজর রাখ না, কহি উর না যায়।“
ডক্টর খাঁ এবং তার অনুচর চলে গেলেন। 

পরেরদিন ঐ দৈত্যের মতো লোকটা আরও  দুই সঙ্গীকে নিয়ে এল। তারা এসেই অলি আর কস্তুরীকে টেনে তুলে তাদের হাত পেছনে দড়ি দিয়ে বাঁধতে শুরু করল। হাত বাঁধা হয়ে গেলে চোখ ঢেকে দিল কালো কাপড়ে।
“কি করছেন কি আপনারা? কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাদের? ছাড়ুন বলছি, ছেড়ে দিন আমাদের”, কস্তুরী চিৎকার করে উঠল।
লোকগুলো অলি আর কস্তুরী কে টেনে নিয়ে গেল একটা ঠাণ্ডা ঘরে। দুজনকে দুটো চেয়ারে বসিয়ে চোখের বাঁধন খুলে দিল। এই ঘরটা বেশ বড়। ঘরটার কোণের দিকে কাঁচ দিয়ে ঘেরা ছোট্ট আরেকটা ঘর। তাতে অনেক ধরনের ইলেকট্রনিক মেশিন ফিট করা আছে আর কিছু কম্পিউটার। ক্ষণে ক্ষণে কম্পিউটার স্ক্রিনে আলোর পরিবর্তন হচ্ছে। সাদা অ্যাপ্রণ পরা প্রায় জনা পনেরো লোক সেখানে ব্যস্ত ভাবে ছোটাছুটি করছে। ডক্টর হুমায়ূন খাঁ স্টার্ট বলে চিৎকার করে উঠলেন আর সাথে সাথে দুটো জোরালো আলো জ্বলে উঠল অলি এবং কস্তুরীকে ঘিরে। তারা দেখল ঘরটার সমগ্র মেঝে জুড়ে একটা বিশাল বড় চাকতি আঁকা আর সেই চাকতির ভেতরে ফুলের পাপড়ির মতো আকৃতি বিশিষ্ট খাঁজ কাটা অংশগুলি একে অপরের সাথে সংযুক্ত হয়ে একটা সিমিট্রিক্যাল প্যাটার্ন তৈরি করেছে। এই চাকতির ঠিক কেন্দ্রবিন্দুতে বসানো হয়েছে তাদের। পয়েন্ট ওফ্ অরিজিন। মিষ্টি একটা সুর মৃদুস্বরে বাজছে। সেই সুরের সাথে হঠাত চাকতিটা ঘুরতে শুরু করল। পাপড়িগুলো একে একে সরে সরে যাচ্ছে। সুরটার মধ্যে কেমন একটা ঝিম ধরানো ভাব আছে। তারা দেখল তাদের মুখোমুখি দাড়িয়ে আছে দুটি নগ্ন মেয়ে। সেই মেয়ে দুটির দেহ সাদা, ফ্যাকাসে, রক্তশূন্য। দৃষ্টি স্থির, চোখের পাতা পড়ছে না। আরেকটু কাছে এগিয়ে আসতেই তারা চিনতে পারল। এ তো তারা নিজেরাই। অলির সামনে দাঁড়িয়ে আছে সতেরো বছরের অলি আর কস্তুরীর সম্মুখে পনেরো বছরের কস্তুরী। ধীরে ধীরে ফ্যাকাসে নারী দেহ দুটিতে বিন্দু বিন্দু রক্তের ফোঁটা দেখা গেল, চোখদুটো রক্তজবার মতো লাল, রক্তধারা গড়িয়ে পড়ছে গাল বেয়ে। এক পা এক পা করে রোবটের মতো এগিয়ে এল তারা। যেন ভীষণ রেগে গেছে। আচমকা ঐ দুই নগ্ন নারী অলি এবং কস্তুরীর গলা টিপে ধরল। দম বন্ধ হয়ে এল দুজনের। ডক্টর হুমায়ূন খাঁ পৈশাচকভাবে হাসতে হাসতে বললেন,
“আমার আবিষ্কার। হাঃ হাঃ হাঃ। আমি তৈরি করেছি। আমি আমি। আমি এই জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক।“ 
হঠাৎ বন্দুকের গুলির শব্দ শোনা গেল। 
“হ্যান্ডস আপ ডক্টর হুমায়ুন খাঁ। কেউ এক পা নড়ার চেষ্টা করবেন না। আপনাদের আমরা চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলেছি।“ 
“আরে ইন্সপেক্টর দাখিল যে। আসুন আসুন। দেখুন আমার অমর সৃষ্টি আর আপনার প্রশ্নের উত্তর। এই অ্যান্টিবডি একমাত্র তৈরি হয় যখন মানুষ ইমোশনালি অ্যাক্টিভ হয়ে ওঠে।“ 
নগ্ন নারী দেহদুটি ডক্টর হুমায়ুন খাঁ এর চোখের ইশারায় দাখিলের দিকে ছুটে যেতেই ট্রিগার প্রেস করল দাখিল। পুলিশ ফোর্স এতক্ষণে ভেতরে ঢুকে পড়েছে। দাখিল অলি এবং কস্তুরীর হাতের বাঁধন খুলে দিল।
“আপনারা তাড়াতাড়ি বাইরে গিয়ে গাড়িতে বসুন। কুইক কুইক। কথা বলার বেশি সময় নেই।“ এরপর দাখিল হুমায়ুনের দিকে রিভলভার তাক করে বলল,
“একদম বেশি চালাকি করার চেষ্টা করবেন না। আপনার সব চালাকি ধরা পরে গেছে। পান্ডে, তোলো এই মালটাকে গাড়িতে।“ পান্ডে আদেশ পাওয়া মাত্র ডক্টর খাঁ এর কলারটা এসে ধরল। ডক্টর হুমায়ূন খাঁ পাগলের মতো চিৎকার শুরু করলেন,
“পারবে না। এইভাবে আমাকে তোমরা আটকাতে পারবে না। আমি সর্বশক্তিমান। সময় আমার হাতের মুঠোয়”। পান্ডে কোনো কথায় পাত্তা না দিয়ে তাকে টেনে গাড়িতে তুলল।


(৮)
হসপিটাল বেডে প্রায় চারদিন পর জ্ঞান ফিরল পদার্থ বিজ্ঞানী প্রমথ কুমার চৌধুরীর। এখন তিনি অনেকটাই সুস্থ। আজ তাঁর ঘরে উপস্থিত আছে অলি, কস্তুরী, ইন্সপেক্টর দাখিল, ডক্টর শ্রীবাস্তব, প্রমথবাবুর স্ত্রী মালীনি আর তাঁরই কৈশোর অর্থাৎ দশ বছরের প্রমথ চৌধুরী। ঘরে সকলের মধ্যে একটা টান টান উত্তেজনা কাজ করছে পুরো ঘটনাটা জানার জন্য। প্রমথ বাবু একটা বড় নিঃশ্বাস নিয়ে বলতে শুরু করলেন,
“আশা করি আপনারা আমার ইন্টারভিউটা সকলেই পড়েছেন। হ্যাঁ ওটাই হয়েছিল কাল। আসলে আমি আমার ল্যাবে একটা মেশিন তৈরি করি যা টাইমকে একটি বিন্দুতে অর্থাৎ আমার ইন্টারভিউয়ে বলা অরিজিন, তাকে বেশ কিছুক্ষণ স্থির রাখতে পারে। মানে ঐ নির্দিষ্ট পয়েন্টে টাইমের এক্সটেনশন। ডক্টর খাঁ আমার কলিগ। আমরা একই ইনস্টিটিউটে কাজ করি। তার স্ট্রিম যদিও আলাদা। আমি প্রথম থেকেই আমার কাজের কথা গোপনই রাখতাম, কাউকে বলতাম না। একদিন রিসার্চ লাউঞ্জে কফি খেতে খেতে আমরা দুজনেই নিজের কাজ নিয়ে আলোচনা করছিলাম। আপনারা নিশ্চয় জানেন যে ডক্টর খাঁ একজন ইমিউন বায়োলজিস্ট। তিনি বললেন, এক অদ্ভুত এন্টিবডির খোঁজ তিনি পেয়েছেন যা এক ligand receptor complex কে recognise করে। আর এই ligand হল কিছু কেমিক্যাল মলিকিউল যা মানুষের ইমোশনের সাথে কানেক্টেড। অর্থাৎ রাগ- দুঃখ- আনন্দ ইত্যাদি সময়ে বডিতে নিঃসৃত হয়। আর যখন এই ligand তার specific receptor এ bind করে তখন অ্যান্টিবডি প্রোডাকশন বডিতে বাড়তে থাকে। তিনি বললেন হিউম্যানের ওপর এই এক্সপেরিমেন্ট তিনি করতে চান। আমি তখনও বুঝতে পারিনি যে হিউম্যান বডিকে তিনি অ্যান্টিবডির মাস প্রোডাকশন এর জন্য ব্যবহার করার পরিকল্পনা করছেন। আমার মতে এতদিন ধরে এইসমস্ত রিসার্চ কাজের সাথে যুক্ত থেকে উনার মানসিক বিকৃতি ঘটেছিল।“ 
“আমার একটা প্রশ্ন আছে প্রমথবাবু,” অলি বলল। “আপনি আপনার ইন্টারভিউতে ট্রিকোয়েট্রার কথা উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু হুমায়ূন খাঁ এর ল্যাবে triquetra নয়, ছিল এক চাকতি যার কেন্দ্র বিন্দুর সাথে যুক্ত ছিল ফুলের পাপড়ির মতো দেখতে….”
“হ্যাঁ।“ অলিকে থামিয়ে দিয়ে প্রমথ বাবু বলে উঠলেন। “You are right।“ তারপর একটা বড় দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন,
“শুধুমাত্র তিনটে ডাইমেনশন নয়, অসংখ্য ডাইমেনশন সময়ের সূক্ষ ব্যবধানে একে অপরের সাথে যুক্ত। তাই ট্রাইকেট্রা নয়, সেদিন যে চাকতি তোমরা দেখেছ ওটাই অ্যাকচুয়াল শেপ অফ লাইফ অ্যান্ড টাইম। আমার দেওয়া ইন্টারভিউয়ের বেশ কয়েকদিন পর আমি এই থিওরি আবিষ্কার করি। সেদিন কফি ব্রেকে আমি আমার এই রিসার্চের কাথাটা ইম্পালসিভলি বলে ফেলি ডক্টর হুমায়ুনকে। এমনকি তার জন্য যে এক্সপেরিমেন্ট ডিজাইন করি, তার কথাও বলেছিলাম। ও আমার অফিস থেকে কোনোভাবে আমার ডিজাইন করা এক্সপেরিমেন্ট এর ড্রাফ চুরি করে তার একটা কপি বানিয়ে অরিজিনালটা আমার অফিসেই রেখে দেয়। কিন্তু ঐ ড্রাফটের সব লেখা পুরোপুরিভাবে বুঝতে পারেনি তার ভাড়া করা পদার্থবিদরা। আর ঠিক তাই ওর দরকার পড়ল আমাকে। সেদিন সন্ধ্যেবেলায় আমি আমার ফ্ল্যাটে একাই ছিলাম। মালিনি তানিকে নিয়ে বাপের বাড়ি গেছিল কিছুদিনের জন্য। হঠাৎ ঘাড়ের কাছে হুল ফোটার একটা ব্যাথা পেলাম, ব্যস তারপরেই চোখের সামনে আমার সব ঝাপসা হতে শুরু করল। চোখ খুললাম যখন তখন দেখি ঠিক ঐ জায়গাটায় বসে, যেখানে তোমরা ছিলে। হুমায়ূন স্টার্ট বলার সাথে সাথে চাকতি ঘুরতে শুরু করল। আর দুদিক থেকে এগিয়ে এল দুটো নগ্ন পুরুষ দেহ। আমারই পাস্ট আর ফিউচার। চাইলে সময়ের বিভিন্ন অংশ থেকেই তুলে আনা যায় একই মানুষের বিভিন্ন দৈহিক অবস্থাকে। আমার এই হাইপোথিসিসটাই কাজে লাগানোর পরিকল্পনায় ছিল হুমায়ূন, আর তাই আমাকে দরকার ছিল। কারণ ও যে সমস্ত পদার্থবিদদের দিয়ে ল্যাবে কাজ করাচ্ছিল তারা ড্রাফট দেখে ক্যালকুলেশন করে আর আমার বানানো মেশিনের থিওরি দেখে ঐ মেশিনটা তো বানিয়ে ফেলেছিল, কিন্তু টাইম স্কেলে তিনটের বেশি দৈহিক অবস্থাকে আনতে পারছিল না।“ 
“আমার একটা প্রশ্ন আছে।“ কস্তুরী বলে উঠল। “আপনার পাস্ট অর্থাৎ দশ বছরের প্রমথ চৌধুরী ওখান থেকে পালাল কি করে আর পালিয়ে আপনার বাড়িতেই ফিরে এল কি করে। মানে ওর ফিউচারে কি হতে চলেছে তার মেমোরি তো ওর এখনও তৈরি হয়নি।“
“একদম ঠিক। এই ব্যাপারে সাহায্য করেছে জিমি। জিমি ছিল হুমায়ুনেরই এক এক্সপেরিমেন্টাল হিউম্যান।“ ডক্টর শ্রীবাস্তব এবার কথা বললেন “জিমির বডিতে ঐ অ্যান্টিবডি তার সেল্ফ সেলগুলোকেই ডেসট্রয় করতে শুরু করেছিল। ও মারা গেছে। আর ওটাই ওর মৃত্যুর কারণ,” শ্রীবাস্তব দাখিলের দিকে তাকিয়ে বললেন।
দাখিল তার পকেট থেকে ফোন বার করে একটা ফটো দেখিয়ে বলল, “দেখুন তো চিনতে পারেন কি না।“
“এই তো জিমি। ওই আমার পাস্টকে বাঁচিয়েছিল হুমায়ুনের হাত থেকে আর ওকে রেখে এসেছিল মালিনির কাছে।“
সকলেই মন্ত্রমুগ্ধের মতো সব কথা শুনল। এ যেন কোনো এক সাই ফাই সিনেমা চলছে তাদের সামনে। এও যে সম্ভব কেউ ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না, আবার অবিশ্বাস করতেও পারছে না। কারণ প্রমাণ রয়েছে সবকিছুর। বাইরে বেরিয়ে আসার সময় অলি ইন্সপেক্টর দাখিলকে জিজ্ঞাসা করল,
“আপনি এসবের সাথে জড়ালেন কি করে? আর কিভাবে জানলেন আমরা ওখানে আছি।“
“দেখুন জড়াতে তো হতই। কারণ এরকম একটা ক্রাইম আর পুলিশ জড়াবে না! তবে আপনাদেরকে আমরা accidentally খুঁজে পেয়েছি। প্রমথ বাবুর মতো আমিও কৃতজ্ঞ জিমির কাছে। ওর ডেডবডির পোস্টমর্টেম রিপোর্টই সব জানতে সাহায্য করল। আর একজন হলেন আমাদের ফরেনসিক ডক্টর শ্রীবাস্তব। উনিই আমাকে সত্যানন্দ মহারাজের সৎসঙ্গে ডক্টর হুমায়ূনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। ডক্টর হুমায়ুনের ল্যাবে আসার আমন্ত্রণ পাই, উনাকে জিমির কেসের কথাটাও বলি তবে তখনও অব্দি জিমির পরিচয় আমার কাছে অজ্ঞাত ছিল। উনার ল্যাবে এসে, কথা বলেই আমার মানুষটাকে বেশ রহস্যজনক মনে হয়। আর তারপরেই আমি অনুসন্ধান করতে শুরু করি, তাতে সাহায্য করেন সত্যানন্দ মহারাজ। 
“সত্যানন্দ মহারাজ কে?” 
“উনি ডক্টর হুমায়ুনের স্পিরিচুয়াল গাইড। সত্যানন্দ মহারাজকে প্রায় সব কথাই বলতেন ডক্টর হুমায়ূন। তবে এই সত্যানন্দ মহারাজ নিজে থেকে কিছু বলেননি। উনার কথার মাধ্যমে অনেক ইঙ্গিত দিয়েছিলেন।“
“আমি কি একবার দেখা করতে পারি এই মহারাজের সাথে?” 
“ডেফিনিটলি। কাল চলুন। আমিও যাব।“ 


(৯)
“আমরা সকলেই সময়ের হাতের পুতুল। সময়ের সাথে আমাদের শরীর, শরীরের ভেতরে প্রত্যেকটা অণু পরমাণু পরিবর্তিত হয়ে চলেছে ক্রমশ। সময়ই হল সর্ব শক্তিমান ঈশ্বর।“ 
অলি সত্যানন্দ মহারাজের কথাগুলো শুনছিল মন দিয়ে। প্রায় আধঘন্টা ধরে মহারাজ বক্তৃতা দিলেন, তারপর মেডিটেশন চলল প্রায় পনেরো মিনিট। অলি আর চুপ করে বসে থাকতে না পেরে যে ঘরে তাদের অপেক্ষা করতে বলা হয়েছে সেই ঘরে এসে এদিক ওদিক হাঁটতে লাগল। এটা সত্যানন্দ মহারাজের ঘর। ঘরটা বেশি বড় নয়, মাঝারি সাইজের। ভেতরে আসবাবপত্রও আহামরি কিছু নেই, একটা ছোটো চৌকি, মাঝারি হাইটের দেরাজ। সামনে একটা টি টেবিল, তার পাশে দুটো চেয়ার। কোণে রাখা আলমারি আর দেওয়ালের মাঝে ঝুলে ভর্তি কিছু জিনিস রাখা আছে। 
আপনি আলমারির পেছনে কি করছেন? ইনস্পেক্টর দাখিলের প্রশ্নে  অলির চিন্তায় ছেদ পড়ল।  আলমারির পেছনে কিছু দেখছিল সে। 
হ্যাঁ? না কিছু না। এমনি। অলি সামনে এসে টেবিলের পাশে রাখা একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ল।
প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট ধরে অপেক্ষা করার পর সত্যানন্দ মহারাজ ঘরে এসে ঢুকলেন। এতক্ষণে ঘরের আলোয় স্পষ্টভাবে অলি দেখল তাকে। বয়স পঞ্চাশের উপরেই হবে, গায়ে গেরুয়া রঙের ফতুয়া আর একফালি গেরুয়া কাপড় কোমরে বাঁধা। চুল লম্বা হয়ে ঘাড় পর্যন্ত নেমে এসেছে, বুক পর্যন্ত লম্বা দাড়ি, চোখের দৃষ্টি শান্ত- উজ্জ্বল। 
“আরে আপনারা দাড়িয়ে কেন? বসুন বসুন।“ সত্যানন্দ মহারাজ অলি এবং ইন্সপেক্টর দাখিলের উদ্দেশে বললেন। ঘরে ঢুকতেই অলি এবং ইন্সপেক্টর দাখিল উঠে দাড়িয়েছিল। মহরাজ নিজে তার চৌকির ওপরে উপবেশন করলেন। অলি কোনভাবে ভণিতা না করে মহারাজের চোখের দিকে সোজা তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“প্রমথ চৌধুরী কে চেনেন আপনি?” 
”কে? এই নামে আমি কাউকে চিনি না তো। তবে হ্যাঁ নিউজ পেপারে পড়েছি একটা খবর…. আপনি কি ঐ খবরে উল্লেখ করা প্রমথ চৌধুরীর কথা বলছেন?“ 
- “ও আপনি খবরটা পড়েছেন তাহলে?”
- “অঙ্গে গেরুয়া দেখে কি ভাবছেন যে এই জগৎ সভ্যতার সাথে আমি সকল সম্পর্ক ত্যাগ করে দিয়েছি?” ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি হেসে কথাটা বললেন সত্যানন্দ মহারাজ। “ আসলে গভীর সাধনার পর আমি উপলব্ধি করেছি যে খারাপ ভালো, লৌকিক অলৌকিক, সব কিছু নিয়েই এই জগৎ সংসার। আমার মন ইহজগতে সবসময় না থাকলেও শরীর তো আছে ইহজগতেই। আমরা যারা শরীর পেয়েছি, তারা খুবই ভাগ্যবান বা ভাগ্যবতী। তাই শরীরের সাথে মানুষের চেতনার যে অংশটি যুক্ত তার চাহিদা তো পূরণ করতেই হবে। কৌতূহল হল মানবমনের সহজাত চাহিদা। দুঃখ শুধু উনার স্ত্রী আর মেয়ে তানির জন্য। ওরা যে ওর জীবনের সাথে জড়িত”। এতটা বলার পর এক লম্বা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে আবার জিজ্ঞেস করলেন, “হঠাৎ আপনার এমন কেন মনে হল যে প্রমথবাবুর সাথে আমার কোনোভাবে সম্পর্ক আছে”।
অলি খুব মন দিয়ে মহারাজের কথাগুলো এতক্ষণ ধরে শুনছিল। “আসলে আপনার বলা কথা আর প্রমথবাবুর চিন্তাধারার মধ্যে এক অদ্ভুত মিল রয়েছে।“
“সে তো থাকবেই। এই বিশ্ব ব্রহ্মান্ডে আমরা সকলেই যে এক। একই বিন্দু থেকে আমাদের সকলেরই উৎপত্তি আবার সেই একই বিন্দুতে মিলিয়ে যাব। এই অমোঘসত্য যে উপলব্ধি করতে পারবে, তাদের চিন্তাধারায় মিল পাবেন। এই পুলিশবাবুই তো এখন উপলব্ধি করছেন…কি!”
ইন্সপেক্টর দাখিল যেন একটু লজ্জা পেল, স্মিত হাসি দেখা দিল ঠোঁটের কোণে। সত্যানন্দ মহারাজের বলা প্রত্যেকটি কথাকে যে খুব সমর্থন করেছেন মনে মনে, তা ইনস্পেক্টর দাখিলের হাবভাব দেখেই বুঝতে পারছিল অলি।  
অনেক ধন্যবাদ আমাদের এতটা সময় দেওয়ার জন্য। আজ উঠি তাহলে। নমস্কার। অলি উঠে পড়ল। দেখাদেখি দাখিলও উঠল।
বাইরে এসে অলি দাখিলকে বলল, “আপনিও তাহলে মহারাজের এক পরম শিষ্য”।
“একদমই না। আমি উনাকে সম্মান করি যেহেতু এই কেস সলভের ক্ষেত্রে উনি আমাকে ইন্ডিরেক্টলি সাহায্য করেছেন, আর সেকারণেই উনার কাজকে সমীহ করি”।
এই মহারাজ ভদ্রলোককে আগেও কোথাও দেখেছি মনে হচ্ছে, কেমন চেনা চেনা, অলি মনে মনে বলে উঠল। কিন্তু কোথায়?
দুজনে গাড়িতে উঠল। পলকের মধ্যে একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে গাড়িটা মেন রোডে গিয়ে উঠল।

(১০)
কোথা থেকে একঝাঁক মেঘ এসে ধূসর কালো রঙ মেখে মুখ ভার করে বসে আছে, মাথার ওপরে নীল শূন্যতাকে তার বিশাল কলেবর ব্যাপ্ত করেছে। মনে হচ্ছে সমগ্র আকাশ নিজের ভারে আছড়ে পড়বে ধরিত্রীর বুকে। বাড়ির পেছনে মস্ত গাছটা দুলতে শুরু করল- ঝড়ের পূর্বাভাস। ক্ষণিকের মধ্যে পবন দেব তার তীক্ষ্ণ ফলা দিয়ে আঘাত করল পৃথিবীর অধিবাসীদের। সেই আঘাতে গাছের পাতা থরথর করে কেঁপে উঠল, রাস্তায় পড়ে থাকা প্লাস্টিক উড়ে গেল নিরুদ্দেশের দিকে। রোহনদের বাড়ির ময়নাটা দুলন্ত খাঁচাটায় ছোটাছুটি শুরু করল। অলির কোকড়ানো চুলগুলোও তিরতির করে কেঁপে উঠল, শিরশিরানি জেগে উঠল অলির শিরায় শিরায়। ছাদে দাঁড়িয়ে প্রকৃতির রূপের এই পরিবর্তন দেখছিল অলি। নীচে মা দুতিন বার ডেকেছে, অলি আসছি বলেও যেতে পারছে না। প্রকৃতির সৌন্দর্য আটকে রেখেছে তাকে। চোখ দুটো বন্ধ করে অলি নিজেকে মিশিয়ে দিতে চাইল এই সময়ের সাথে, এই মুহুর্তের সাথে। মাথার ভেতর ঘটনাগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে, এই মেঘেদের মতোই পুঞ্জীভূত হয়ে আসছে, জড়িয়ে যাচ্ছে একে অপরের সাথে। অলি বুঝতে পারছে ঘটনাগুলোর মধ্যে যোগসূত্র আছে। কিন্তু সিকোয়েন্সটা ঠিক কোনদিকে! লাল- গোলাপি রঙের একটা স্ফুলিঙ্গ আকাশের বুক চিরে ছুটে গেল এদিক থেকে ওদিক। অলির একবার মনে হল নীচে চলে যায়, পরমুহূর্তেই মনে হল দেখি না এরপর ঠিক কি হয়। আসলে মানুষের মন এমনই। কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে মানুষ কত অজানাকে যে জানল, কত অসাধ্যই না সাধন করল। এই কৌতূহলই প্রচলিত পথ ভেঙে নতুন পথের দিশা দেখায়, যা কিছু অসম্ভব সব আস্তে আস্তে সম্ভব হতে শুরু করে। মেঘ গর্জনের শব্দ শোনা গেল- গুরুগম্ভীর আওয়াজ, টিপটিপ করে বৃষ্টির জলের ফোঁটা এসে পড়ল অলির গোলাপি ঠোঁটে, কপালে। অলি তাকাল। বেশ খানিকক্ষণ নিজের প্রতিপত্তি দেখিয়ে অসুরের বেশে আসা মেঘ ধীরে ধীরে পাতলা হয়ে এল। সেই পাতলা হয়ে আসা মেঘের কোনো এক কোণ থেকে ঠিকরে বেরোলো আলো। সেই আলোয় অনেক কিছু স্পষ্ট দেখতে পেল অলি। তার মাথার ভেতরের মেঘ কেটে যাচ্ছে ক্রমশ। মেঘ সরে উজ্জ্বল হয়ে আসছে কিছু মুখ, খুব চেনা, সুন্দর করে সাজানো মুখ। অলি ছাদ থেকে নীচে নেমে এসে কস্তুরীকে একটা ফোন করল চটপট। তারপর কিচেনে এসে মায়ের বানানো গরম গরম পিয়াজি মুখে পুরল। মনটা ফুরফুরে লাগছে এবার।  

 

(১১)
নমস্কার সত্যানন্দ বাবু। আজকে আবার একটু জ্বালাতে এলাম আপনাকে। অলি বলল। ইন্সপেক্টর দাখিল দাড়িয়েছিল অলির পাশে। আজ কস্তুরীও এসেছে অলির সাথে। আসলে সেদিনের পর থেকে কিছু প্রশ্ন খালি মাথার ভেতর ভীষণ উৎপাত করছে। তাই চলেই এলাম আপনার কাছে। আপনি তো সকলকে সাহায্য করেন, আজ আমাদেরকে একটু করুন। 
অবশ্যই। মানুষ মানুষকে সাহায্য করবে, এটাই তো পরম ধর্ম। 
প্রমথ কুমার চৌধুরীর সাথে আপনার কি সম্পর্ক? মহারাজ এবার একটু বিষম খেলেন, সঙ্গে সঙ্গে সামলে নিয়ে অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবে বললেন, যা সেদিন বলেছিলাম উত্তরটা একই থাকবে। আমি উনাকে চিনি না।

আপনি চেনেন। আর তার থেকেও বড় বিষয় প্রমথবাবু আপনাকে আরও ভালো করে চেনেন। অলি আরও শান্তভাবে বলল। 

আচ্ছা, আপনি কি করে জানলেন প্রমথবাবুর মেয়ের নাম তানি। নিউজ পেপারের কোথাও উনার মেয়ের নামের কোনো উল্লেখ তো নেই। 

সত্যানন্দ মহারাজ এবার বেশ হকচকিয়ে উঠলেন। অলি মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করল

আপনার আসল নাম কি।“
“সত্যানন্দ মহারাজ। সকলে আমাকে ঐ নামেই চেনে।“
“সকলে যে নামে আপনাকে চিনবে আর আপনার প্রকৃত নাম যে এক- তা তো নাও হতে পারে। আমি বলছি আপনি কে। আপনি হলেন প্রমথ চৌধুরী।“
সত্যানন্দ মহারাজ হেসে উঠলেন। “কি বলছেন আপনি? পাগলের মতো কথা বলছেন। একবার বলছেন প্রমথ চৌধুরীর সাথে আমার কোনো সম্পর্ক আছে কি না। আবার পরক্ষণে বলছেন আমিই নাকি প্রমথ চৌধুরী।“ 
“আপনি প্রমথ চৌধুরীর এক অন্য সময়ের দৈহিক অবস্থা। কারণ আপনার আলমারির পেছনে ফটোটা তাই বলছে।“ অলি এবার চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে আলমারির পেছন থেকে একটা ছোটো ফটোফ্রেম বার করে আনল। 
এই ফটোটা কি, কারা আছে এতে সেটা কি আমি বলব নাকি আপনি বলবেন!
সত্যানন্দ মহারাজ ধপ করে বসে পড়লেন চৌকির ওপর। 
আপনি বরং ভাবুন কি করে আপনার সাজানো প্ল্যান সব ভেস্তে গেল। আমাদের আরেকটা কাজ আছে, বলে অলি চোখের ইশারায় ইন্সপেক্টর দাখিলকে বাইরে বেরোতে বলল। 
বাইরে এসে দাখিলের গাড়িতে চেপেই অলি বলে, “একবার প্রমথবাবুর বাড়ি যেতে হবে।“ 

প্রমথ চৌধুরী নিজের স্টাডি টেবিলে বসে বই পড়ছিলেন। অলিকে ঢুকতে দেখেই উঠে দাঁড়ালেন তিনি, “আপনি সেদিন সব কথা বলেননি আমাদের।“
“কি কথা বলিনি?”
“এটাই যে সকলের চোখে ধুলো দিয়ে কোন এক সময় আপনি হুমায়ূন খাঁ এর ল্যাবে থাকা ঐ মেশিন অপারেট করে অন্য এক টাইম স্কেল থেকে নিজের আরও একটি দৈহিক অবস্থাকে বের করে আনেন কারণ আপনি আপনার ভবিষ্যত জানতেন। আপনি জানতেন ভবিষ্যতে একসময় আপনি একজন spiritual guide হয়ে উঠবেন। তবে হুমায়ূন খাঁ বা তার ল্যাবে কেউই ধরতে পারেনি আপনি কি করেছেন। আর আপনার ঐ দৈহিক অবস্থা সত্যানন্দ মহারাজ নাম নিয়ে তাঁর স্পিরিচুয়াল গাইড হয়ে এইসমস্ত রিসার্চের আইডিয়া দেন। কারণ একজন পদার্থবিদ হয়ে বায়োলজির এত কিছু জানা সম্ভব নয়। আসলে আপনি প্রচুর বায়োলজির বই ঘেঁটে হিউম্যান বডিকে অ্যান্টিবডি প্রোডাকশনের জন্য ব্যবহার করার কথা প্রথম ভাবেন। আর আপনিই দাখিলকে বিভিন্ন ইঙ্গিত দিয়ে ধরিয়ে দেন ডক্টর হুমায়ূনকে। কারণ এই মেশিনটা তৈরি করার মতো ফান্ড আপনার কাছে ছিল না। ২০১৩র হিউম্যান রাইটসের একটি কেসে আপনি ফেসেছিলেন, ফান্ডিং এজেন্সিগুলো আপনাকে বয়কট করে। পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে আপনি এতদিন বিদেশে ছিলেন। অপেক্ষা করছিলেন পরিস্থিতি একটু ঠান্ডা হওয়ার। বিদেশে থাকার সময় আপনার কলিগ ডক্টর হুমায়ুন আপনাকে অনেক সাহায্য করেন আর আপনি তাকেই কাজে লাগান নিজের অভিসন্ধি চরিতার্থে। হুমায়ূন খাঁ আপনাকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করেছেন শুধু। এই খবরটা সাতবছর আগে নিউজপেপারেই আমি পড়েছিলাম। সেদিন পুরোনো কাগজ ঘাঁটতে ঘাঁটতে আমার চোখে পড়ে ওটা, ওখানে ছোট করে আপনার একটা ছবিও বেরিয়েছিল। “
“আমিই যে ডক্টর হুমায়ূনকে এসব করতে বলেছি তার প্রমাণ কি?” প্রমথবাবু কাষ্ঠ হাসি হেসে বললেন।
“প্রমাণ তো আছে। সত্যানন্দ মহারাজের ঘরে আমি আপনার ফ্যামিলি ফটোগ্রাফ দেখেছি। আপনাদের মুখের মিলও রয়েছে, যদিও সেটা আমি ধরতে পারতাম না যদি না ঐ ফটোটা আমার চোখে পড়ত। মহারাজ বাবাজিকে একটু চাপ দিলেই সব কথা উনি বলে দেবেন। আর পুরোনো ফাইল ঘাঁটলে তো আপনার কেস তো বেরোবেই। আপনিও হুমায়ূন খাঁয়ের মতো সমান দোষী, তাই শাস্তি আপনাকেও পেতে হবে,” বলে অলি ইন্সপেক্টর দাখিলের দিকে তাকাল। 

 

(১২)
আজ ২৩ শে জুলাই, পূর্ণগ্রাস চন্দ্রগ্রহণ। রাত নটা কুড়ি থেকে শুরু হবে। এখন ঘড়িতে নটা বাজছে। বেল স্ট্রিটের রাস্তা ধরে অফিস থেকে বাড়ি ফিরছিল কস্তুরী। রাস্তায় লোকজন বেশ কম, ফাঁকাই বলতে গেলে। এক আধটা গাড়ি হুস করে পেরিয়ে যাচ্ছে। অফিস থেকে পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরতে তার প্রায় চল্লিশ মিনিট সময় লেগে যায়। আজ সে কোনো ক্যাব বুক করেনি। হাঁটতে বেশ ভালোই লাগছে। নিউ বেল স্ট্রিটটা অনেকটা লম্বা হয়ে চলে গেছে হিবস স্ট্রিটের দিকে। প্রায় পঁচিশ মিনিট লেগে যায় পুরো স্ট্রিটটা হাঁটতে। বেল স্ট্রিটের শেষে যখন সে পৌঁছে গেছে, ঢং ঢং করে ঘন্টা পরার আওয়াজ হল। কিন্তু এই এরিয়াতে কোনো চার্চ তো নেই। কস্তুরী দেখল বেল স্ট্রিটের ক্রসিংটা আর নেই। তার বদলে রয়েছে এক বিশাল বাড়ি। ঘণ্টার শব্দটা ঐ বাড়ি থেকেই আসছে বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু এই বাড়িটা এল কোথা থেকে, এটা তো এখানে ছিল না। কস্তুরী বাড়িটার দিকে এগিয়ে গেল। বাড়ীর সামনে বাহারি গাছ। ল্যাম্প পোস্টের হাল্কা আলোয় কস্তুরী দেখল বড়ো গেটটার এক পাশে ছোট্ট করে লেখা 'সিন্ধু ভিলা, ১৯৩২।' 
তবে কি প্রমথবাবুর কথা মত সেই অরিজিন টাইম পয়েন্ট? কস্তুরীর চোখ চলে গেল উপরের ব্যালকনিতে। একটা বছর তেরোর ছেলে তার দিকেই নীচে তাকিয়ে আছে। বাক্সে রাখা সেই রক্তশূন্য ফ্যাকাসে বডিগুলোর কথা মনে পড়ে গেল তার। অন্য ডাইমেনশন ভাবলেই তার ওটাই প্রথম মনে পড়ে। সে আর দাঁড়াল না। ছেলেটা এখনও ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। কস্তুরী পেছন ফিরে হনহন করে হাঁটা দিল। সে আর মনে করতে চায় না ঐ ঘটনাগুলো।

অমিয়গরল

প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা ​

পুজো বার্ষিকী ১৪২৮ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

গল্প

অমিয়গরল

সুস্মিতা হালদার

talking.jpeg

(১)
ড়িতে প্রায় রাত নটা বাজে। প্রিয়া সিনেমা হলের সামনে যে বড় মাঠটা আছে, যেখানে শারদোৎসবের পুজোটা হয়, ওর একধারে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিলাম মনের আয়েশে। বাড়িতে সিগারেট গাঁজা খাওয়া বারণ, তাই বাইরে বেরোনোর নাম করে এই পিপাসা দুটি মিটিয়ে ফেলতে হয়। আমি ঝাড়গ্রামের ছেলে। আগে এটি পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় ছিল, এখন নিজেই একটা জেলা হয়ে গেছে। সে যা হোক … এখানকার ছেলেদের দুটি প্রকট ক্যাটেগরি হয়। মানে আমাদের জেনারেশানের ছেলেদের। একটি হল, সুন্দর করে ছোট করে ছাঁটা চুলে পরিমিত তেল নেওয়া শান্ত স্নিগ্ধ ভদ্র পড়ুয়া ছেলে। এদের দেখলেই বোঝা যায়, ‘সাইকেল চালাতে চালাতেও ম্যাথস প্র্যাকটিস করা’ টাইপের । আর একটি ক্যাটেগরি হল, জন্মে পড়াশোনার ধার না ধারা, কোনমতে ঘষটে ঘষটে স্কুলের গণ্ডি পেরোনো অকালপক্বের দল। আমি হলাম এই দ্বিতীয়  ক্যাটেগরির। স্কুল জীবনেই বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে সিগারেট ধরেছিলাম, কলকাতায় গিয়ে গাঁজা। তবে পয়সার অভাবে ড্রিঙ্কস ধরা হয় নি, এই যা। কথাবার্তাগুলো শুনলেই লোকে ভাববে একে কেন শ্রীঘরে রাখা হয় না। অথচ কী করি, মুখে যতই স্টিচ করি, আজেবাজে কথাগুলো বেরিয়েই পড়ে। স্কুলের বইয়ে পড়েছি বাক-স্বাধীনতা আছে। ওইটাই এমন ইনজেকশনের মত রক্তে মিশে গেছে যে, মনে থাকে না। জারে গঙ্গাজল ভরে রাখার মত হল এই বাক-স্বাধীনতার মৌলিক অধিকার। যাক গে, এলোপাথাড়ি না বকে, আসল কথাটা বলি। আমি হলাম চেন স্মোকার। কমপক্ষে সাত-আটটা সিগারেট না হলে মনে ধরে না। দ্বিতীয়টা শেষ করে, তৃতীয়টায় টান দিতে দিতে রাস্তায় পায়চারি করছিলাম। হঠাৎ একটা চেনা গলার স্বর ভেসে এল।
-“তীর্থ না?”
পিছন ফিরে দেখি একজন মাঝবয়েসি ভদ্রলোক সাইকেল থেকে নেমে আমার দিকে আসছেন। কাঁধে একটা ঝোলা ব্যাগ।  
-“হ্যাঁ, কিন্তু আপনাকে তো চিনলাম না? আপনি?” সিগারেটটা হাতে নিয়েই প্রশ্ন করলাম। 
-“তীর্থ মানে আমাদের তীর্থ? ২০০৩-এর উচ্চ মাধ্যমিক ব্যাচ? কুমুদকুমারী ইন্সটিটিউশনের?”
-“হ্যাঁ, তীর্থঙ্কর। কিন্তু আপনি?”
-“আমায় চিনতে পারছিস না? আমি স্বর্ণেন্দু।”
নামটা শুনে ক্ষণিকের জন্য আমার চোয়াল শক্ত হয়ে গেছিলো।... তবু পারলাম না ওভাবে থাকতে। যতই হক এক সময়ের খুব কাছের বন্ধু তো।
- “... তা কী করে চিনব বল?” একটু থেমে কথা শুরু করি, “যা চেহারা বানিয়েছিস? বিশাল মোটা হয়ে গেছিস। ভুঁড়ি গজিয়েছে। মুখ ভর্তি দাড়ি। বয়েসটাই তো বোঝা যাচ্ছে না। আমি তো ভাবলাম পঞ্চাশ বছরের বৃদ্ধ।” 
আমার কথাটা শুনে স্বর্ণ হো হো করে হাসতে লাগল। অনেকদিন পর এই হাসিটা আবার শুনলাম। স্বর্ণ স্কুল কলেজ জীবনে দেখতে অসাধারণ ছিল। একটা ছেলেও ওর প্রেমে পড়ে যাবে দেখলে। আর গলাটা- কী যে রোমান্টিক ছিল ! গলা এখনও একই আছে। শুধু চেহারাটাই বদলেছে।
-“তা বল তোর কী খবর? এখানে দাঁড়িয়ে?” স্বর্ণ প্রশ্ন করে।
-“আরে শালা, আর বলিস না মাইরি। আমার উচ্চ কণ্ঠধারী পিতেশ্বরের জ্বালায় বাড়িতে একটু সিগারেট খাবার উপায় নেই। আর আমার শঙ্খ কণ্ঠধারী মাতাঠাকুরাণী তো টিপিকাল গোয়েন্দা। গন্ধ শুঁকেই বুঝে যাবে ছেলে সিগারেট খেয়েছে। সেই জ্বালায় বাইরে খেয়ে গা ভাসিয়ে বাড়ি ফিরি।” 
স্বর্ণ আবার ‘হো হো’ করে হাসতে শুরু করে।
-“তুই এখানে? কী খবর তোর?” আমি এবার প্রশ্ন শুরু করি।                    
-“কলকাতা থেকে ফিরলাম। স্টিলে। বাড়ি যাচ্ছি।” 
-“কলকাতা? কীসের জন্য?” 
-“শনি-রবিবার কলকাতায় ক্লাস থাকে। ওখানে একজনের সাথে মিলে একটা আঁকার ছোটখাটো স্কুল খুলেছি।”
-“কলকাতা যাস? কোথায়?”
-“শোভাবাজারের দিকে।”
-“আমি তো কলকাতাতেই থাকি। যাদবপুর, বাঘাযতীনের ওইদিকে।” 
-“তা তোর কী কাজ এখন? চল না, আমার বাড়ি। জমিয়ে আড্ডা হবে।”
-“মানে?” আমি আঁতকে উঠি, “এত রাতে?” 
-“ঝাড়গ্রামে এটা রাত? সবে নটা বাজে। আজ রাতটা আমার সাথে কাটিয়ে দিবি চ।... কত বছর পর দেখা হচ্ছে।”
-“আজ না রে। বাড়িতে খুব ঝামেলা হয়ে যাবে। পরে আসব একদিন। এই তো মাত্র ক’টা দিনের জন্য বাড়ি এসেছি। বাড়িতে তো এমনিতেই থাকা হয় না।”
-“বউ রাগ করবে?” স্বর্ণ খোঁচা মারে।
-“আরে ওসব বৌ-টৌ নেই। বিয়েই করিনি। মা-বাবা খেপে যাবে।”
-“আরে চল না। কাকিমাকে আমি ফোনে বলে দিলে কিছু মনে করবেন না।”
একথাও স্বর্ণর মনে আছে? আমার মা-বাবা আমার ওপর যতই হুম্বিতুম্বি করুক, স্বর্ণকে ভরসা করত। আমাকে তো বলত, স্বর্ণর সঙ্গে সারাক্ষণ থাকি, তাও ওকে দেখে একটু ভদ্র হতে পারি না! কিন্তু এত বছর পর, এত রাতে ওর বাড়িতে যেতে আমার অস্বস্তিই হচ্ছিল। অজুহাত দেওয়ায় অতটা পোক্ত নই আমি। দুবার হোঁচট খেয়ে সত্যিটা বলেই দিলাম। 
-“তোর বাড়িতে কেউ কিছু মনে করবে না?”
- “আমরা তো দুটি প্রাণী। মনে করতে আর কে আছেন?”
- “দুটি...? কাকু-কাকিমা মানে তোর বাবা-মা, জেঠু জেঠিমারা?”
-“মা বাবা তো মারা গেছেন। এই বছর দুয়েক হল। আর এখন তো জয়েন্ট ফ্যামিলি নেই। বছর পাঁচেক আগেই জেঠুরা আলাদা হয়ে গেছেন। ওঁরা তো এখানে থাকেন না। বম্বেতে ছেলে-বৌমার সাথে থাকেন। চল না, বাড়ি গিয়ে সব কথা হবে।”
স্বর্ণর জোরাজুরি ফেলতে পারলাম না। ওর সাইকেলের পেছনে চড়েই গেলাম ওদের বাড়ি। আজ রাতটার জন্য।  


(২)
দত্তদের বাড়ির গা বেয়ে বেঁকে গেছে রাস্তাটা। বাছুরডোবা থেকে বলরামডিহির দিকে। সাইকেল নিয়ে ওইদিকে বাঁকল স্বর্ণ। রাস্তার কোণে বাঁদিকের বাড়িটার দিকে অভ্যাসবশত চোখ পড়ে গেল। চন্দ্রাবতীর বাড়ি। একসময়ের জৌলুস ধরা বাড়িটা এখন কেমন যেন থম মেরে গেছে। দেখলাম, স্বর্ণ একটিবারের জন্যও তাকাল না বাড়িটার দিকে। সত্যি, মানুষ কীভাবে এত সহজে ভালবাসা অস্বীকার করতে পারে? আমি আজ অবধি প্রেমে পড়িনি ঠিকই, কিন্তু যদি পড়তাম, এভাবে ভালবাসাকে পায়ে ঠেলে সরিয়ে দিতে পারতাম না।
যেতে যেতে দু একটা কথা ছাড়া বেশী কিছু জিজ্ঞাসা করল না স্বর্ণ। আমিও কিছু বলিনি। ‘প্রভাত রজনী’ কোচিং সেন্টার পেরিয়ে, অলি গলি দিয়ে এসে পৌঁছলাম স্বর্ণর বাড়ির সামনে। এদিকটা অনেকটা ভেতরে। তাই টিমটিমে ল্যাম্প পোস্টের আলো ছাড়া রাস্তায় ভাল আলো নেই। ওই আলোতেই দেখলাম, বাড়িটা বেশ সাজিয়েছে।  টাকা কামিয়েছে তার মানে অনেক। পাঁচিলে পেন্টিং-এ শোভা পাচ্ছে লতাপাতার আড়ালে নারী মূর্তি। তপোবনের শকুন্তলার মত।
-“এগুলো তোর আঁকা?” থাকতে না পেরে করেই ফেললাম।  
-“হ্যাঁ। খারাপ হয়েছে?” 
-“বেশ ভাল হাত হয়েছে তো তোর।” 
-“এশিয়ান পেইন্টস্ দিয়ে করা। ভেতরে দেওয়ালেও আছে। চল, ভেতরে চল।” 
লোহার গেটটা খুলে সাইকেল ঢোকাতে ঢোকাতে কথাগুলো বলে স্বর্ণ। 
দরজায় বেল দিতেই বেরিয়ে এলেন বছর তিরিশের এক ভদ্রমহিলা। আন্দাজ করে বুঝলাম, স্বর্ণর স্ত্রী। তাও আমার সাথে ওঁর আলাপটা করিয়ে দেয় স্বর্ণ।
-“তীর্থ, এ কৃতিকা, আমার স্ত্রী। আর কৃতিকা,... তীর্থর কথা তো তুমি শুনেছ। আমার ছেলেবেলার বন্ধু।”
-“বাব্বা, আমার গল্প করেই রেখেছিস আগের থেকে?”
কৃতিকা গায়ে শাড়ির আঁচলটা টেনে নেয় ভাল করে। যদিও মুখ দেখে মনে হল বেশ বিরক্তই হয়েছে এত রাতে আমি উড়ে এসে জুড়ে বসলাম বলে, তবু মুখে আতিথেয়তার মিষ্টি হাসি টেনে রাখল।  
-“আসুন ভেতরে আসুন। জুতোগুলো ভেতরে ঢুকিয়ে রাখুন। আমাদের ছোট পাঁচিল তো। কুকুর ডিঙিয়ে চলে আসে। মুখে করে নিয়ে চলে যায়।”
গ্রিল দেওয়া বারান্দার একপাশে জুতো রাখার দুটো র‍্যাক রাখা আছে পাশাপাশি। ওর একটায় জুতোগুলো তুলে রেখে বৈঠকখানার মত ঘরটায় বসলাম। বাড়িটার আদল সেরকম বদলায় নি। শুধু রঙ টঙ করে চাকচিক্য বেড়েছে। ঘর দোর দেখেই বোঝা যাচ্ছে, কৃতিকা বেশ গুছিয়ে রাখতে পারে ঘর। নিশ্চয় চাকরি বাকরি করে না। ঘর-সংসার আর স্বামী সেবা নিয়েই থাকে।
-“তীর্থ, তুই একটু বোস। আমি আসছি একটুখানি।” আমাকে সোফাটায় বসতে বলে কৃতিকাকে প্রায় ঘর ভেতরে টেনে নিয়ে গেল স্বর্ণ, “তুমি একটু এদিকে এস।” আমি এই ফাঁকে বাড়িতে টুক করে একটা ফোন করে জানিয়ে রাখলাম। মা-ই ফোনটা ধরেছিল। তাই পটিয়ে ম্যানেজ করা গেছে সহজে।
মিনিট দুয়েকের মধ্যে হাতে একটা জলের গ্লাস নিয়ে অতিথি সেবার প্রথম পর্যায় শুরু করে কৃতিকা।
-“আপনি একটু বসুন। জল খান একটু। ও স্নানে গেল। চলে আসবে এখনি। বেশিক্ষণ লাগবে না।”
-“তুমি, মানে...আপনি বসুন। দাঁড়িয়ে কেন?” সৌজন্যর খাতিরে সৌজন্য দেখাতেই হয় আমায়।
-“বসছি।... আপনি এখানে থাকেন না?” 
-“ঝাড়গ্রামে মা বাবা থাকেন। আমি কলকাতায় থাকি। ওখানেই একটা স্টুডিও আছে। রোজকার সব তো ওখান থেকেই। মাসে দু’বার করে বাড়ি আসি।” 
-“আপনি জামদায় থাকেন, না?”
-“আপনি এটাও জানেন? বাব্বা ! স্বর্ণ তো আমার ঠিকুজি কুষ্ঠি সব বলে দিয়েছে দেখছি।”
-“হুঁ, ও আপনাদের খুব মিস করে। প্রায়ই বলে আপনাদের কথা।”  
নখ খুঁটতে খুঁটতে মাথা নিচু করে উত্তর দেয় কৃতিকা। 
-“আমাদের? মানে?”
-“মানে, এই... আচ্ছা, আপনি মাছ-মাংস খান তো?”
দেখলাম কৃতিকা কথাটা ঘুরিয়ে দিল।
-“আপনাকে ব্যস্ত হতে হবে না। এমনিই হঠাৎ করে এসে আপনাকে ঝামেলায় ফেলেছি।... যা আছে তাই দিন। স্বর্ণ যে কী করে না! এখনও পাগলামি গেল না। নাছোড়বান্দা, আমায় আসতেই হবে এখানে। এমন করে বলল, ফেলতে পারলাম না।”
আমি ইতস্তত করে বলেই ফেললাম কথাগুলো। 
-“বেশ হয়েছে তো। না হলে হয়ত আর আসতেনই না কোনদিন। জামদায় বাড়ি। তাও তো এত বছরে আসেন নি। আজ ও না এরকম করে ধরে বেঁধে নিয়ে এলে, আপনি তো আসতেনই না। আমার সাথেও আর পরিচয় হত না।”
সামাজিক সৌজন্যে কৃতিকা খুব পরিপক্ব দেখছি।
আমি আর কোন উত্তর দিলাম না। শুধু ঘাড় চুলকে হাসলাম মাত্র।
-“আপনি রাতে কী খান? ভাত না রুটি?”
-“যা দেবেন তাই।” সহজ হতে চেষ্টা করলাম আমি, “আমি সর্বভুক। আমিষ নিরামিষ সব খাই। আপনাকে এখন আর রান্না করতে হবে না। মুড়িটুড়ি দিয়ে দিন না।”  
-“রান্না চাপাই নি তো এখনও। রোববার কলকাতা থেকে ফেরার ওর কোন ঠিক থাকে না। বেশি রাতে ফিরলে ভাত-টাত খায় না, তখন দুজনেই মুড়ি খেয়ে শুয়ে পড়ি। শনি রবি আমাদের রান্নার কোন ঠিক নেই। শনিবার তো রান্না চাপাই না। আমি একলাই থাকি। একলার জন্য আর রাঁধতে ইচ্ছে করে না। রবিবার ও এলে জেনে নিয়ে রান্না চাপাই।... বলুন কী খাবেন?”
-“বেশ আছেন আপনারা।... আপনারা যা খান তাই করুন। আমার কোন অসুবিধে নেই খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে।” 
-“আচ্ছা, আপনি বসুন, আমি চটপট রান্নাটা চাপিয়ে আসি। মুখ-হাত ধোবেন তো?”
-“স্বর্ণ আসুক। আপনাকে ব্যস্ত হতে হবে না।”
-“আসছি তাহলে আমি।”
কৃতিকা চলে যাওয়ার পর সোফার ওপর গা এলিয়ে বসলাম। হেমন্তকাল, নভেম্বর মাস চলছে। একটু শিরশিরে ঠাণ্ডা ভাব আছে। স্বর্ণদের নিচের এই ঘরটা বরাবরই একটু স্যাঁতস্যাঁতে ঠাণ্ডা। খানিক বসে থাকার পর স্বর্ণ এলো। সাদা পায়জামা আর শান্তিনিকেতনী বাটিক প্রিন্টের পাতলা সুতির পাঞ্জাবি। গায়ে একটা সুতির চাদর জড়ানো। শৌখিনতা এখনও পিছু ছাড়ে নি স্বর্ণর। মিষ্টি পারফিউমের গন্ধই সেটা বুঝিয়ে দেয়। ওর এই শৌখিনতাটা চন্দ্রাবতীর হাতে গড়া। যে মানুষ ওকে এভাবে শৌখিন স্মার্ট করল তাকেই ভুলে গিয়ে কৃতিকার মত মেয়েকে বিয়ে করল!
-“চল, আমার ঘরে চল। জমিয়ে আড্ডা দেওয়া যাবে। রান্না হতে এখনও ঘণ্টা খানিক লাগবে। বারোটার আগে আমার খাওয়া হয় না।”
বৈঠকখানার আলো নিবিয়ে স্বর্ণর পেছন পেছন বেরিয়ে এলাম। রান্না ঘরের পাশ দিয়ে সরু একটা বারান্দা। সেখান দিয়ে পেরিয়ে পেছনের বাগানটা পড়ে। স্বর্ণ ওইদিকে নিয়ে গেল আমায়। রান্নাঘর থেকে সদ্য চাপানো তরকারির গন্ধ আসছে। তেলে সবে পেঁয়াজ, লঙ্কা ছাড়ার গন্ধ। গন্ধেই খিদে পেয়ে গেল। রান্নাঘরে উঁকি মেরে কৃতিকাকে জানিয়ে গেল স্বর্ণ।
-“এই পাশটা জেঠুদের ছিল না?” আমি প্রশ্ন করলাম স্বর্ণকে। বাগানটা ওদের কমন ছিল। বাগানে দুটো কুয়ো, একটা স্বর্ণরা ব্যবহার করত, আর একটা জেঠুরা। আমাদের স্কুল জীবনের শেষ থেকেই পার্টিসন নিয়ে কথা শুরু হয়েছিল। ও যখন কলেজে ঢোকে তার পর পরই পার্টিশান মামলা ফাইল হয়।... আমার আর কলেজ হল কোথায়? স্কুলের গণ্ডি পেরিয়েই পড়াশোনায় ক্ষান্ত দিলাম। কতদিন আর ঘষটাতে ভাল লাগে !
-“হ্যাঁ, ছিল। একটা সেটলমেণ্ট হল। জেঠুরা আমাদের বিক্রি করে দিয়ে বম্বে শিফট হয়ে গেলেন।”
-“আর ওই মামলাটা? পার্টিশনের?”
-“তোর মনে আছে?... ওটা তুলে নেওয়া হয়েছে। নিজেদের মধ্যে সেটলমেণ্ট হয়ে গেছে, তাই আর খামকা ওসবের জাল বাড়িয়ে কী হবে?”
-“এদিকে তোর ঘর মানে?”
-“ও... আমার আঁকার স্টুডিও। বইপত্রও আছে। এ তল্লাটের চাবি আমার জিম্মায় থাকে। ছবি টবি, দামি রঙ টঙ সব এদিকে থাকে। কৃতিকার আবার একটু বেশি গুছিয়ে রাখার স্বভাব। শেষ মেষ সব নষ্ট করে বসে পাছে, বেশি গোছাতে গিয়ে। তাই ওকে এদিকটায় আসতে দিই না।”
-“ছবি বিক্রি হয়?”                                                
-“হয় টুকটাক। ছবি বিক্রি করে তেমন পয়সাকড়ি হয় না। স্কুলগুলো থেকেই যা হয়। দু’তিন জায়গায় আঁকার স্কুল খুলেছি। টুকটাক টিউশানও করি। খড়গপুরে একটা দোকানও খুলেছি, পার্টনারশিপে। হাতে আঁকা শাড়ি বিক্রির। শুধু শাড়ি না, পাঞ্জাবি, চুড়িদার এসবও আছে। সাজের অর্নামেণ্টস্ও বিক্রি করি। হাতে বানানো। ছোটখাটো কুটির শিল্প টাইপের।”
- “বাব্বা ! অনেক কিছু করে ফেলেছিস তো এর মধ্যে !”
-“পেট তো চালাতে হবে। হলেই বা দুটি প্রাণীর পেট।... আয় এ ঘরে আয়।”
দরজার তালা খুলতে খুলতে বলতে থাকে স্বর্ণ। এ পাশটা পুরো সামনের ঘরের বিপরীত। এ ঘরে এলে অগোছালো, ভোলাভালা স্বর্ণর ছোঁয়া পাওয়া যায়। ঘরগুলো দেখলেই বোঝা যাচ্ছে, মাসে এক-দু’বারের বেশি ঝাড়া মোছা হয় না। ঝুল, ধুলোর গন্ধে ভর্তি। কৃতিকার হাতের ছোঁয়া যে এ সীমানায় কোনকালে লেগেছে তা তো মনে হয় না। একটা ছোট চৌকিতে তোশক বালিশ পাতা আর ঘরের চার কোণে ডাঁই হয়ে পড়ে আছে আর্ট পেপার, ক্যানভাস আর রঙ তুলি। শুধু কয়েকটাই শাড়ি, বিছানার চাদর দিয়ে ঢাকা রয়েছে। মেঝেতে একটা নোংরা শতরঞ্চি  পেতে আমায় বসতে বলল স্বর্ণ। নিজেও বসল, একটা পাশ বালিশ কোলে নিয়ে। 
-“তোর অসুবিধা হচ্ছে না তো?” আমায় প্রশ্ন করে স্বর্ণ।
-“অসুবিধা? আমার? হাঃ হাঃ, আমি তো এর চেয়েও নোংরা ঘরে থাকি রে।”
স্বর্ণ আবার হো হো করে হেসে ওঠে। একটা ঝুমঝুম নূপুরের শব্দ শুনে দরজার দিকে তাকালাম।  দেখি, কৃতিকা আসছে দু কাপ চা নিয়ে।
-“এসব আবার এখন করতে যাওয়ার কী দরকার ছিল? একেবারে ভাত খেয়ে নিতাম।” যদিও খিদেয় পেট জ্বলছিল, তাও একটু ভদ্রতা দেখালাম। 
-“আরে, কিছু অসুবিধা নেই। খান তো।” কৃতিকা দু কাপ চা আর এক প্লেট পকোড়া নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। যাওয়ার সময় একবার ফিরে স্বর্ণকে বলে গেল, “ঠিক বারোটার সময় চলে এসো ওঁকে নিয়ে। গল্পে মজে গিয়ে সময় ভুলে যেওনা যেন।”


(৩)
পকোড়া সাঁটাতে সাঁটাতে পুরনো বন্ধুদের কথা জিজ্ঞাসা করছিল স্বর্ণ। দেখলাম অনেকক্ষণ ধরেই, আমাদের নাটক-নাচের দলটার প্রায় সবার কথাই ওর মনে আছে। শুধু বাদ পড়ে গেল একজনই। থাকতে না পেরে নিজেই আগ বাড়িয়ে পাড়লাম কথাটা।
-“স্বর্ণ, তুই চন্দ্রাকে ভুলেই গেছিস বল। তা তো ভুলবিই। জীবনে এমন গৃহিণী নারী এলে প্রথম প্রেমকে কি কেউ মনে রাখে?”
আমার কথাটা যেন হঠাৎ একটা নিস্তব্ধতার পর্দা টেনে দিল। রাস্তায় কুকুরগুলোর ডাকটা বড় জোরে কানে এসে বাজছে। খানিক চুপ থেকে স্বর্ণই শুরু করল।
-“চন্দ্রার সাথে তোর যোগাযোগ আছে?”
-“হুঁ।”
-“দেখা হয়?”
-“না। সেভাবে না। মাঝে মধ্যে ভিডিও কল করি। ও-ও করে।” 
-“আমি একবার দেখেছিলাম। গত বছর। রবীন্দ্রসদনে ওর একটা প্রোগ্রাম ছিল। গেছিলাম।” 
-“তুই জানলি কোথা থেকে?”
-“ফেসবুক পেজে।” 
-“ফ্রেন্ডলিস্টে আছিস?”
-“না। মাঝে মধ্যে দেখি ওর পেজটা। কভার ফোটোয় ওর আর হাজব্যাণ্ডের ছবিটা... খুব সুন্দর। ওখানেই ও দিয়েছিল, রবীন্দ্রসদনের প্রোগ্রামের পোস্টটা। ওর আর হাজব্যাণ্ডের ডুয়েট ছিল। সত্যি মানিয়েছে দুজনকে দারুণ। আমি ওর যোগ্য ছিলাম না।”                     -“বাঃ, স্বর্ণ। এতদিনে এটুকু তো অন্তত বুঝেছিস। তাও শুনে ভাল লাগল।... একটা মেয়ের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার পর...!” আমি হঠাৎ একটু উত্তেজিত হয়ে উঠি।
-“আমি ছিনিমিনি খেলেছি? তোরা সবাই আমায় ভুল বুঝলি তীর্থ?” 
চন্দ্রাবতী আর স্বর্ণ আমার অনেক ছেলেবেলার বন্ধু। চন্দ্রাবতীকে আমি চিনতাম স্বর্ণর মারফৎ। আমি আর স্বর্ণ একই স্কুলে পড়তাম। আমি ছিলাম ক্লাসে পেছনের দিক থেকে ফার্স্ট বয়, আর ও মোটামুটি ভাল ছেলে। চন্দ্রাবতী সারদাপীঠ স্কুলের ফার্স্ট গার্ল। দারুণ বুদ্ধিমতী। স্কুল লাইফে ফার্স্ট সেকেন্ডের মধ্যে র‍্যাঙ্ক করে এসেছে বরাবর। উচ্চ মাধ্যমিকের সময় ক্লাস ইলেভেনে ও আর. বি. এম. স্কুলে চলে আসে। সেসময় সারদাপীঠে হাইয়ার সেকেন্ডারি সেকশন খোলেনি, কি ওর বছরে খুলল এরকম কিছু একটা। আর. বি. এম.- এ সায়েন্স নিয়ে ও ভর্তি হল। অদ্ভুতভাবেই সায়েন্সে দারুণ রেজাল্ট করেও ও চলে গেল নাচ নিয়ে পড়তে বিশ্বভারতী থেকে। আর স্বর্ণ কলকাতায় আর্ট কলেজে ভর্তি হল। স্বর্ণর সাথে চন্দ্রার আলাপ ক্লাস এইটে। কল্যাণীদির আঁকার স্কুলে। কল্যাণীদি ঝাড়গ্রামের বিখ্যাত আঁকার শিল্পী। আমার সঙ্গে সরাসরি আলাপ নেই ওঁর। কিন্তু বাজারে মাঝেমধ্যেই দেখতাম কোন এক দোকানের সামনে বসে চলন্ত মানুষের ছবি আঁকছেন। বেশিরভাগ বাজারের শিবমন্দিরের উল্টোদিকের দোকানগুলোর কাছে, না হয় রেলগেটের সামনে গৌরাঙ্গ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের কাছে-পিঠে দেখতাম ওঁকে। খুব ঝাপসা মনে আছে। এখন তো বাজারের শিবমন্দির, মেন রেলগেট, তার পাশের গৌরাঙ্গ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার- এ সবই পাল্টে গেছে। ঝাড়গ্রামের মানচিত্রে এখন নতুন ফ্লাইওভার, শহুরীকরণের চিহ্ন জুড়ে গেছে। আমাদের ঝাড়গ্রাম এখন আর নেই। শুধু বামদা আর কদমকাননটাই যাও তারই মধ্যে একই রকম আছে।  
আমার সাথে চন্দ্রার আলাপ চন্দ্রারই বাড়িতে হয়। একদিন স্বর্ণ স্কুল ফেরৎ আমায় জোর করে ধরে নিয়ে যায় চন্দ্রার বাড়ি। সারদাপীঠের মেয়েগুলো বেশির ভাগই হয় স্কুল বাস নয় সাইকেলে ফিরত। সাইকেলে এমন পাঁই পাঁই করে দৌড়ত যে একটু প্রেমট্রেম নিবেদন করার সুযোগও পাওয়া যেত না। আর. বি. এম. -এর গেটের কাছে গিয়ে দাঁড়ালে স্কুল ছুটির পরে তাও বা এক-দুটোর দিকে একটু তাকিয়ে দেখা যেত। আমি ভয়ে ভয়েই দাঁড়াতাম। গার্লস স্কুল, হেড মিস্ট্রেস তো সাংঘাতিক কড়া বলে শুনেছি। যদি ঝামেলা পেকে যায়! তাই দূর থেকেই দেখতাম। প্রপোজ ট্রোপোজ করতে যেতাম না। স্কুল ছুটির পর, আমি সুন্দরী মেয়ে দেখার আশায় এভাবে আর. বি. এম. স্কুলের গেটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকতাম বলে আমার বন্ধুরা আমায় ‘তীর্থের কাক’ বলে হাসাহাসি করত, আওয়াজ দিত। মেয়েগুলোও বেশ মজা পেত, যখন কোন একটা ছেলে আমার দিকে ‘তীর্থের কাক’ ডাকটা ছুঁড়ে দিয়ে সাইকেল নিয়ে সাঁই করে উড়ে যেত, আর আমি ক্যাবলার মত ফ্যালফ্যালিয়ে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। 
আমি আর স্বর্ণ একসাথে বাড়ি ফিরতাম। আমার সাইকেল আদ্দেক দিন খারাপ হয়ে পড়ে থাকত, চেন খুলে। তাই স্বর্ণর সাইকেলের পেছনে চেপেই যেতাম। ও আমায় নামিয়ে দিয়ে বাড়ি ফিরত, ধর্মশালার আশেপাশের অলিগলি ঘুরে। আমাদের স্কুল ছুটি হয়ে গেলে আমরা বেরিয়ে পড়তাম, আমি আর স্বর্ণ আর. বি. এম.-এর মাঠের কাছে এসে দাঁড়াতাম। সারদাপীঠের বাসের সেকেন্ড ট্রিপটা গেলে আবার দুজনে রওনা হতাম বাড়ির দিকে।
প্রথম প্রথম বুঝতাম না, স্বর্ণ কেন রোজ এভাবে অপেক্ষা করে, কার জন্যই বা করে। কেউ তো আসে না। তবে এতে আমারই ভাল হত। দু’চারটা সুন্দরী মেয়ে দেখে মনটা বেশ চাঙ্গা হয়ে যেত। একদিন স্বর্ণকে জিজ্ঞাসা করেই ফেলি, কার জন্য রোজ রোজ ওয়েট করে ও। সেইদিনই ও আমায় প্রথম চন্দ্রার বাড়ি নিয়ে যায়। প্রথম প্রথম স্বর্ণর সাথে যেতাম। তারপর মাঝে-সাঝে আমি একাই চলে যেতাম। চন্দ্রার মা-বাবা ভীষণই লিবারাল। বাবা ডাক্তার, আর মা হাউস ওয়াইফ। ভীষণ কালচারড ফ্যামিলি। ওদের বাড়িটাও অদ্ভুত সুন্দর। পুরনো বনেদি কাঠামোর ওপর আধুনিকতার ছোঁয়া। ওর বাবা-দাদু দুজনের তৈরি। প্রথমে দাদু তৈরি করেন বাড়িটা, তার পর বাবা নিজের মত করে আধুনিকতার ছাপ দেন। দোতলা বাড়ি, বিশাল ছাদ, ছোট্ট একটা উঠোন, আর বিরাট একটা বাগান। কত রকমের ফুলের গাছ ছিল ওদের বাড়িতে। চন্দ্রার পার্সোনাল রুমটা আমার খুব পছন্দ ছিল। ওই ঘরটা সারা বাড়িটার মধ্যে অন্য রকম। ওর বাবার পরিকল্পনায় বানানো। এ ঘরটা থেকে সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত দেখা যায়- পুবে পশ্চিমে দু দিকেই বড় বড় জানালা। চন্দ্রার পিসি খুব সুন্দর রান্না করতেন আর খাওয়াতে ভালবাসতেন। প্রায় রোববারই ওর বন্ধুবান্ধবদের ডেকে নিয়ে ভোজবাড়ি হত রীতিমত। আমি আর স্বর্ণ তো ছিলামই, আরও দু’চারজন আসত- আঁকা আর নাচের স্কুলের। চন্দ্রা প্রথম প্রথম আঁকা আর নাচ দুটোই শিখত। ও আঁকত বেশ ভাল, তবে শুধু স্কেচ করতে বেশি পছন্দ করত। পরে যদিও আঁকার চর্চাটা ছেড়েই দিল। স্বর্ণর খুব ইচ্ছে ছিল নাচ শেখার। কিন্তু ওর পরিবার খুব রক্ষণশীল। একজন ছেলে নাচ শিখবে, এটা ছিল ওঁদের কাছে খুবই অপমানজনক বিষয়। নাচটা ছিল ওঁদের কাছে শুধু মেয়েদেরই শেখবার জিনিস। তাই নাচ শেখবার অপূর্ণ আশা রয়েই গিয়েছিল স্বর্ণর। ইচ্ছে পূরণ করত অন্যভাবে- ‘নাচ’ আঁকার মাধ্যমে। চন্দ্রা নতুন নতুন পোজ, মুদ্রা তৈরি করত আর স্বর্ণ সেগুলোকে বেঁধে রাখত ছবি আঁকায়। চন্দ্রা কত্থক, মণিপুরী, ভারতনাট্যম আর রবীন্দ্রনৃত্য চারটেই শিখেছিল। বঙ্গীয় সঙ্গীত পরিষদ থেকে রবীন্দ্র নৃত্যে সেভেন্থ ইয়ার আর বাকি তিনটেয় ফিফথ ইয়ার অবধি পরীক্ষাও দিয়েছিল। চন্দ্রার নাচের পরীক্ষার আগের দিন অনেক রাত অবধি স্বর্ণ থাকত ওদের বাড়িতে। আমায় ওর বাড়িতে ম্যানেজ করার দায়িত্ব দিত। বলতে হত, আঁকার দিদিমণি আটকে রেখেছেন। চন্দ্রার দেখে দেখে স্বর্ণ একটু একটু নাচও শিখে ফেলেছিল। ওর নাচের স্বপ্ন একবারই বাস্তবের মাটির ছোঁয়া পেয়েছিল। ২০০৭ সালের ৪ই নভেম্বর। ঝাড়গ্রামের ডি. এম. হলে প্রথম পরিবেশনা ছিল আমাদের ‘ঐহিক’ দলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান উপলক্ষে — ‘পূরবী: একটি শেষের কবিতা’। ওয়েস্টার্ন ব্যালে, বল ডান্সের ঘরানায় রবীন্দ্র নৃত্যের পরিবেশন — ‘ডান্স থিয়েটার’ ফর্মে। চন্দ্রা ছিল নায়িকার ভূমিকায় আর নায়ক স্বর্ণ । আমার স্পষ্ট মনে আছে ‘প্রাণ চায় চক্ষু না চায়’ আর ‘আমি চিনি গো চিনি’ গান দুটো কম্পোজ করেছিল ওয়ালজ্ নাচের স্টেপে। আজও চোখ বুজলেই সামনে ভেসে ওঠে ‘আমি চিনি গো চিনি’ নাচটা। চন্দ্রা আর স্বর্ণর ডুয়েট। গোলাপি রঙা গাউনে চন্দ্রা, রেশম রেশম চুলগুলো এলিয়ে পড়েছে ওর পিঠে। আর অফ হোয়াইট শার্ট আর ব্রাউন প্যান্টে স্বর্ণ। হলুদ-সাদা আলোয় আলো-আঁধারি খেলা। স্টেজের ওপর দুটো ছায়া মূর্তি যেন মিশে যাচ্ছে পরস্পরের সাথে- সুরের খেলায় মেতে- দুটো মূর্তি যেন আকৃতি নিচ্ছে একটা পরিপূর্ণ মূর্তির- প্রকৃতি আর পুরুষের- যেন অর্ধনারীশ্বর!

পুরো পরিকল্পনাটাই ছিল চন্দ্রার। আমি পুরো অনুষ্ঠানের টিকিট বিক্রি আর ফোটো তোলার দায়িত্বে ছিলাম। প্রচুর লোক হয়েছিল, ঝাড়গ্রামের বুকে ডি. এম. হলে রেকর্ড ভিড়। অনেকে বসার জায়গা না পেয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছিলেন। প্রথম পরিবেশনায় এমন সাকসেসে আমরা সবাই অনেক স্বপ্নের জাল বুনেছিলাম।... কিন্তু খুব বোকা ছিলাম আমি। তখনও বুঝিনি স্বর্ণর আসল চেহারাটা। ও যে একদিন চন্দ্রার স্বপ্ন চুরমার করে দিয়ে চলে যাবে অন্য মেয়ের কাছে- ভাবতেও পারিনি।   

(৪)-

“স্বর্ণ, তোর একবারও মনে হয় না, চন্দ্রাকে ঠকিয়ে তুই পাপ করেছিস? শিল্পের অপমান করেছিস? শিল্প প্রেম ছাড়া হয় না। প্রেমে প্রতারণা মানে শিল্পেরও অসম্মান।” স্বর্ণর কথার উত্তরে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলাম আমি।-“তীর্থ! ... আমার কিছু করার ছিল না। আমার হাত পা বাঁধা ছিল। আমি চন্দ্রাকে বিয়ে করলে ওরই ক্ষতি হত।”-“মানে?” স্বর্ণর শেষ কথাটা আমায় অদ্ভুতভাবে নাড়িয়ে দিয়েছিল।-“বলব পরে। খেয়ে এসে। অনেক কথা আছে। শেষ হবে না। আগে বল তোর খবর। তোরই তো খবর নেওয়া হল না।”-“এতবার তো নিলি। আবার?... তা আমার কী শুনবি বল?”-“কলকাতায় কী করছিস?”-“আমাদের এখানের বিশুদাকে চিনিস?”-“বিশুদা মানে বিশ্বনাথ?... বিশ্বনাথদা? কদমকাননের দিকে যাঁর বাড়ি।”-“হ্যাঁ, ও তো টলিউড ইন্ডাস্ট্রির টেকনিশিয়ান। ওকে ধরে-টরে ফিল্মের লাইনে ক্যামেরাম্যানের কাজে ঢুকেছিলাম। তা সেরকম সুবিধা করতে পারলাম না। ওই ছোটখাটো ফ্লপ ডিরেক্টরগুলো ডাকে মাঝে মাঝে। কম পয়সায় কাজ উশুল করার জন্য। একটা স্টুডিও খুলেছি। ফোটো স্টুডিও। কাজ ভালই আসে। বিয়েবাড়ি এসবে ভিডিও করতে যাই। আর ঝাড়গ্রামে মাঝে মাঝে এসে বাবার ব্যবসা-পত্তরও দেখি। বাবা যতদিন বেঁচে আছেন বাবাই মূলত দেখছেন। তারপর তো আমায় দেখতেই হবে।”-“বিয়ে করবি না?”-“পাগল ! এমন গাঁজা বিড়ি খাওয়া লোককে কোনো মেয়ের ঘাড়ে চাপিয়ে তার সর্বনাশ করার কী দরকার বাবা! আর নিজে কতটুকু রোজগার করি যে আবার সংসার পাতব? ওসব রোজকার টোজগার আমার দ্বারা হবে না।” -“মা বাবার পর তোকে দেখবে কে তবে?”-“ও চলে যাবে। বাউণ্ডুলে লোক। এসব সংসার টংসার পোষায় না।”-“একটা কথা জিজ্ঞাসা করব?” আমতা আমতা করে জিজ্ঞাসা করে স্বর্ণ। আমি মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বলি। -“চন্দ্রা এখানে আর আসে না? ওদের বাড়িতে এখন কে থাকেন?” জানতে চায় স্বর্ণ।-“সেসব জেনে আর কী হবে? ওকে কি ফেরাতে পারবি?”একটা ছোট্ট শ্বাস আপনা থেকেই বেরিয়ে আসে। মনে হল, স্বর্ণ হয়ত চন্দ্রার সাথে যোগাযোগ করানোর জন্যই আমায় ধরে নিয়ে এল ওর বাড়িতে। বিয়ের পরে পরকীয়ায় মেতে ওর জীবনটা শেষ করার প্ল্যান করছে নাকি? তার জন্যই এই অভিনয়? ছেলেবেলার খুব কাছের এক বিশ্বাসের বন্ধুকেও হঠাৎ অবিশ্বাস করতে শুরু করি আমি। অবশ্য হঠাৎ কেন বলছি। আমার মনে অবিশ্বাসের বীজটা তো ওই বুনেছিল। আজ থেকে দশ বছর আগে। চন্দ্রার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার পরও আমার সাথে অভিনয় করে গিয়েছিল, যেন ওর সাথে চন্দ্রার সব ঠিকঠাক চলছে। ওর জন্যই আমি একদিন চন্দ্রা আর ওর বাড়ির লোকের কাছে অপমানিত হয়েছিলাম। 

সেই দিনটা ছিল ভরা গ্রীষ্মের দুপুরবেলা। চন্দ্রা তখন মাস্টার্স শেষ করে বাড়িতে বসে, চাকরির পরীক্ষার জন্য তৈরি হচ্ছিল। নাচের স্কুল-কলেজে পড়ানোর চাকরি। আমাদের    দলটাও তখন বেশ কয়েক জায়গায় ছোট ছোট পারফরমেন্স নামিয়ে পরিচিতি পেতে শুরু করেছে- মেদিনীপুর জেলায়। দলটা স্বর্ণ বা চন্দ্রা কারোরই গড়া নয়, আমাদের মানে আমার আর স্বর্ণর এক বন্ধুর গড়া। যদিও পরবর্তীকালে দলটা চন্দ্রারই হয়ে যায়, ওই বন্ধু কিছু ব্যক্তিগত অসুবিধার জন্য চন্দ্রাকেই দায়িত্বটা দিয়ে দেয়। নিজে থাকে একজন সদস্যমাত্র হয়ে। তবু আমরা বলি, দলটা আমাদেরই। চন্দ্রা তখন একক পারফর্ম খুব কম করত, করলে দলের সাথেই করত। রবীন্দ্রজয়ন্তী উপলক্ষে একটা গীতি-আলেখ্য নিয়ে চিন্তাভাবনা চলছে। বেশ কয়েকদিন আমরা একসাথে বসে রিহার্স্যালের ব্যাপারে সবকিছু ঠিক করে ফেললাম। এমনিতেই সেবার চিন্তাভাবনাতেই এত সময় চলে গিয়েছিল যে রিহার্স্যালের জন্য মাত্র পনেরো দিন হাতে ছিল, কি তাও নয়। কিন্তু দেখি চন্দ্রা বা স্বর্ণ কারোরই কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। স্বর্ণকে কিছু বললেই  ধেনাই পেনাই করে কথা ঘুরিয়ে দেয়। এদিকে রবীন্দ্রজয়ন্তীর আর দিন সাতেক বাকি। বাধ্য হয়ে একদিন সটান চলে গেলাম চন্দ্রার বাড়ি। তখনও প্রস্তুত ছিলাম না ঘটনাটার জন্য। -“তুইও কবে থেকে নাটক করতে শুরু করলি?” আমার একটা খুব সাধারণ প্রশ্নের উত্তরে চন্দ্রার এই প্রশ্নটা প্রথমটায় ঠিক ধরতে পারিনি। খুব সহজভাবেই তো জিজ্ঞাসা করেছিলাম, “এরকম ল্যাদ খেয়ে পড়ে আছিস কেন? কবে শুরু করবি রিহার্স্যাল ? জানি তোর কনফিডেন্স আছে। কিন্তু ওভার কনফিডেন্স ভাল না। সাতদিনে উঠবে এ জিনিস? পর পর এতগুলো ভাল শো করার পর এটা মাটিতে মিশিয়ে দিলে মানসম্মান নিয়ে টানাটানি হবে তো?”অনেকক্ষণ চুপচাপ আমার কথাগুলো হজম করার পর চন্দ্রা প্রশ্নটা করেছিল, “নাটক দেখাতে এসেছিস আমার কাছে? তুইও কবে থেকে নাটক করতে শুরু করলি?”-“নাটক? কী বলছিস কী তুই?”-“কেন? তোর বন্ধু বলে নি কিছু? নাকি তোকে শিখিয়ে পড়িয়ে পাঠিয়েছে, আমায় পরীক্ষা করার জন্য?”-“বন্ধু?... মানে স্বর্ণ? শিখিয়ে পড়িয়ে… পরীক্ষা? কী বলছিস? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। স্বর্ণ তো খালি স্লিপ খেয়ে যাচ্ছে। ও কি এবার করবে না, না কি?”অবাক চোখে প্রশ্ন করি আমি। -“কেউই করবে না। শুধু এবার না, আর কোনদিনের

জন্যই না। এই দলটা আমার কাছে আর এক্সিস্ট করে না।”

-“মানে?” প্রায় আঁতকে উঠি আমি।

-“আর স্বর্ণ করবে পারফর্ম? হুঁ! ও তো বিয়েতে মেতে আছে এখন। হয়তো দেখবি যা, ২৫শে বৈশাখেই বিয়ের ডেট ফেলেছে।” চন্দ্রা খুব সহজ ভাবে কথাগুলো বললেও ওই কথাগুলোয় যে কতখানি বিদ্রূপ মিশে ছিল, তা সেদিন বুঝতে না পারলেও আজ বুঝি।
-“বিয়ে?... এসব কী বলছিস চন্দ্রা?”
-“তুই সত্যিই কিছু জানিস না?” চন্দ্রা তখনও আমার কথা বিশ্বাস করতে পারছে না।
-“না। কী হয়েছে তোদের?”
সেদিন চন্দ্রার মুখ থেকেই জানতে পারি, স্বর্ণ নাকি স্পষ্ট জানিয়েই দিয়েছে, ওর পক্ষে চন্দ্রাকে বিয়ে করা সম্ভব নয়। স্বর্ণ নিজে থেকেই দীর্ঘ ন’বছরের সম্পর্কের ইতি টেনেছে। ওর বাড়ি থেকে অন্য একটি মেয়ের সাথে বিয়ের ব্যাপারে ‘পাকা’ কথা হয়ে গেছে। বাড়ির কথা কেটে কোনোভাবেই এ বিয়ে আটকানো সম্ভব নয়। তাই চন্দ্রাকে জীবন থেকে সরিয়ে দেওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই স্বর্ণর কাছে। ... কথাগুলো বিশ্বাস করতে পারিনি প্রথমে। স্বর্ণর মতো একজন ছেলে এভাবে প্রেমে প্রতারণা করতে পারল? যদি ওর ফ্যামিলি মেনে নাই নেবে তাহলে সেটা আগে থেকেই চন্দ্রাকে জানিয়ে রাখেনি কেন? চন্দ্রার সাথে আমার পরিচয় স্বর্ণর বন্ধু হিসেবে। স্বর্ণ যা করল, চন্দ্রার কাছে আমার মুখ দেখাবার অবকাশ রাখল না। জানিনা কেন, স্বর্ণর ওই কাজের জন্য নিজেকে বড় লজ্জিত মনে হয়েছিল স্বর্ণর বন্ধু হিসেবে। স্বর্ণ-চন্দ্রার সম্পর্ক চন্দ্রার বাড়ি থেকে খুব ভালোভাবেই মেনে নিয়েছিলেন। চন্দ্রার বাবা-মাও চেয়েছিলেন স্বর্ণকেই জামাই হিসেবে পেতে। স্বর্ণ সেটা খুব ভাল করেই জানত। শুধু তাই নয়, আমাদের দলের সকলেই জানত স্বর্ণ চন্দ্রাকেই বিয়ে করবে। এত লোক জানাজানি করার পর এভাবে চন্দ্রাকে ত্যাগ করতে পারল? এভাবে চন্দ্রাকে অপমান করতে? চন্দ্রার মা তো সেদিন আমার মুখের ওপর বলেই দিয়েছিলেন, “তীর্থ, আমি তোমায় অনেক বিশ্বাস করতাম বাবা। তুমি সত্যিই কিছু জানতে না- স্বর্ণ অন্য মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কে আছে? আমার মেয়ের সাথে যা করে গেছে সেটা জাস্ট ‘আই ওয়াশ’? তুমি তো অন্তত চন্দ্রার ভাল চেয়ে এটুকু উপকার করতে পারতে? একবার হলেও তো আমাদের জানাতে পারতে?... তাতে কি বন্ধুর স্বার্থে খুব আঘাত লেগে যেত?”
আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েছিলাম। কাকিমার মুখের ওপর কিছু বলার মত মুখ রাখেনি স্বর্ণ। কীই বা বলব আমি? সান্ত্বনা দেব? লাভ হবে কিছু?... আমার তখন প্রচণ্ড ভয় হচ্ছে চন্দ্রাকে নিয়ে। চন্দ্রা খুব তেজী আর অভিমানী। খুব চাপা স্বভাবের। স্বর্ণকে ও পাগলের মত ভালবাসত। প্রতারণা সহ্য করতে না পেরে যদি ও কিছু একটা করে বসে? নিজের ভয়কে সামাল দিতে শুধু একটা কথাই বলেছিলাম চন্দ্রাকে, “তোর উচিত বিয়ে করে নিজের মত করে জীবন সাজানো। স্বর্ণর জন্য নিজের জীবনটা নষ্ট করিস না। ও ওর মত থাকুক, তুই তোর মত করে সুখী হোস।”
-“তোর কি মনে হয়, আমি ওর জন্য জীবন নষ্ট করব?... কোনদিনও সেটা হতে দেব না আমি। কিন্তু মনে রাখিস একটা কথা, যে জ্বালায় আমি জ্বলছি, ওকেও একদিন সেই জ্বালায় জ্বলতে হবে। এ আমার অভিশাপ। ও জীবনে কোন দিনও সুখী হতে পারবে না।”
কথা গুলো নাগাড়ে বলে ছুট্টে গিয়ে নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল চন্দ্রা। আমার সামনে তেজটুকুই রেখে গিয়েছিল, চোখের জলটা অভিশাপের তেজে ঢেকে রেখে। 
সেদিনের পর থেকে স্বর্ণর সাথেও আমার দূরত্ব বাড়তে থাকে। আমি জানতাম বন্ধু হিসেবে আমি স্বর্ণর খুব ভরসার জায়গা। কিন্তু চন্দ্রার সাথে ও যেটা করল, সেটার পর ওর সাথে বন্ধুত্ব রাখতে আমার রুচিতে বেধেছিল। ও যেভাবে চন্দ্রাকে ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিল, সেভাবে আমি একদিন নিজের থেকেই ওর সাথে সব সম্পর্ক চুকিয়ে বেরিয়ে এসেছিলাম। চন্দ্রা দল থেকে বেরিয়ে এসেছিল। আমাদের কারোর বারণ শোনেনি। চন্দ্রার পর আর সেভাবে কেউ হাল ধরতে পারল না। নামেই ‘দল’ হয়ে পড়ে রইল কয়েক বছর। তারপর আমরা সব এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লাম। দলটার আর কোন অস্তিত্বই রইল না। চন্দ্রার সাথেও আমার প্রায় দেড়-দু’বছর যোগাযোগ ছিল না। লজ্জায় নিজের থেকে আর যেতে পারিনি ওর বাড়ি। ফোনও করতে পারিনি। যোগাযোগটা আবার নতুন করে গড়েছিল ও-ই, ওর বিয়ের কার্ড দিয়ে। নিজেই বাড়ি বয়ে দিতে এসেছিল কার্ডটা। ওর বিয়ের নিমন্ত্রণের সূত্রেই ওর সাথে আগের মত যোগাযোগ শুরু হল।
-“চন্দ্রা এখন কোথায়? আর কোন শো টো করছে না?” স্বর্ণর প্রশ্নে অন্যমনস্কতা কাটে আমার। কথা বলতে বলতে বার বার মনে পড়ছিল পুরনো কথাগুলো। অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে ছিলাম।           -“হুঁ? ও না... ও তো এখন রেস্টে আছে। শো টো করছে না।... কেন বল তো?” আনমনা ভাবে উত্তর দিয়ে ফেললাম আমি।
-“রেস্ট? কেন, কী হয়েছে?”
প্রশ্নটায় ঘোর কাটে আমার। স্বর্ণকে এতটা বলাটা কি ঠিক হবে? চন্দ্রা বারবারই আমায় বলেছিল কথাটা শুধু আমায় জানাল ও, অন্য বন্ধু-বান্ধব বা আর পাঁচকান যেন না করি। 
-“ও তো এখন দিল্লিতে। ওর হাজব্যান্ডও তো এখন ওখানেই আছেন। ডান্স অ্যাকাডেমি আছে ওঁর তো। চন্দ্রা তো কোন কলেজে ডান্স ফ্যাকাল্টিতে আছে বোধহয়। ওর মা-বাবা মাঝে মাঝে এখানে থাকেন, মাঝে মাঝে মেয়ে-জামাইয়ের কাছে। আমি কথা ঘোরানোর চেষ্টা করি।”
-“কী হয়েছে ওর? শো করছে না কেন? রেস্টে আছে বললি?”
-“মানে, ইয়ে...” দোনামনা করতে করতে বলেই ফেলি কথাটা, “অ্যাকচুয়েলি ও তো এখন... প্রেগন্যান্ট। এটা ফোর্থ টাইম। আগে তিনবার অলরেডি মিসক্যারেজ হয়ে গেছে।... তাই এখন ডাক্তার বারণ করেছেন শো টো করতে। অ্যাডভান্সড স্টেজ।”
স্বর্ণর মুখে একটা ম্লান হাসি। কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল দেখছিলাম, কিন্তু থেমে গেল। কাছে এসে আমার কাঁধে আলতো করে চাপ দিল। আলগা ভাবে শুধু বলল, “চল, খেয়ে নিবি চল। বারোটা পেরিয়ে গেছে। আর রাত করিস না।”

(৫)
রাতে খাওয়া দাওয়ার পর একতলার একটা ঘরে আমার শোবার ব্যবস্থা করে দিল কৃতিকা। আতিথেয়তায় নৈপুণ্য আছে বেশ। আন্তরিকতা কতটা রয়েছে জানি না, বোঝবার চেষ্টাও করি নি। কিন্তু ঘরসংসারের কাজ, সেবাযত্ন এসব করতে ওর বেশ ভালো লাগে। সেটা খুব ভালো করেই বোঝা যায় খাওয়ার সময় পরিবেশন করা দেখলে। যদিও খাবারের বিবরণ দিতে আমি পছন্দ করি না; নজর টজর লাগার ভয়ে নয়। পদগুলোর নাম জানিনা বলে নিজে ঠিক স্বচ্ছন্দ নই। কৃতিকার রান্নার হাতও বেশ ভালো। স্বর্ণ শুধু এগুলোই চেয়েছিল চন্দ্রার কাছ থেকে? আর পাঁচজন পুরুষ যা চায় একটা মেয়ের কাছ থেকে। সেবাযত্ন, ভালো ভালো রান্না করে খাওয়ানো, স্বামী সংসার নিয়ে মেতে থাকা... আর... থাক... আর একটা নাই বা বললাম। ওটা বলতে আমার রুচিতে বাধে। চন্দ্রা কোনদিনই গৃহিণী মানসিকতার ছিল না, ঘরোয়া গৃহবধূ হতে সে আজও পারে নি। হয়ত স্বর্ণর চন্দ্রাকে বিয়ে না করা আর কৃতিকার সাথে ঘর বাঁধার পেছনে চন্দ্রার এই ‘ঘরোয়া গৃহবধূ’ হয়ে উঠতে না পারাটা দোষ হয়ে রয়ে গেছে, কৃতিকার এই গুণের কাছে। বাথরুমে হাত মুখ ধুয়ে ফোনটা একবার দেখে নিলাম। আমার ফোন বেশিরভাগ সময় ‘সাইলেন্ট’ মোডেই থাকে। বড় বিরক্ত করে মারে তাই ‘সাইলেন্ট’ করে রেখে দিই। আর তার ফল হল, ফোন নামে যে একটা বস্তু রয়েছে সেটাই ভুলে যাই। দেখলাম, বাবার ফোন ছিল- তিনটে। প্রায় সাড়ে বারোটা বাজে, মা-বাবা কেউই একটার আগে ঘুমোয় না। তাই ঝুপ করে একবার কল টিপেই ফেললাম। মিনিট পাঁচেক কথা বলে আমার জন্য গুছিয়ে রাখা ঘরটায় গেলাম। এই ঘরগুলো একই রকম রয়েছে প্রায়। দশ বারো বছর আগে যা দেখেছিলাম খুব একটা পাল্টায় নি। খাওয়া দাওয়ার পর একটু ধোঁয়া না হলে শরীরটা খারাপ লাগে। ঘরের আনাচে কানাচে অ্যাশট্রে খুঁজছিলাম। নেই। স্বর্ণর বোধহয় এই সিগারেটের নেশা টেশা নেই। চন্দ্রা অবশ্য একদমই পছন্দ করত না এসব নেশা। আমিই কতবার গালাগালি খেয়েছি ওর কাছে। তাও আমায় সিধে করতে পারে নি। স্বর্ণ ক্লাস টেনে একবার ধরবে ধরবে করছিল, চন্দ্রার ধাতানিতে বেচারা ভয়ে নেশা করার কথা মনে আনাই বন্ধ করে দিয়েছিল। উশখুশ করতে করতে ঘরের বাইরে বেরোতে যাচ্ছি একটা অ্যাশট্রের খোঁজে, দেখি স্বর্ণ নিজেই হাজির একটা ছোট অ্যাশট্রে, গ্লাস আর জলের জগ নিয়ে। 
-“নে, এবার ঘুমিয়ে পড়। সব ঠিকঠাক আছে তো? আমরা মশারি টাঙিয়ে শুই। তাই ও টাঙিয়ে রেখেছে। এদিকটায় খুব মশা হয়। তোর অসুবিধা হলে মশারি খুলে ম্যাট দিয়ে দিতে পারিস”। ঘরের চারদিকটা ঘুরে দেখে নিতে নিতে কথাগুলো বলল স্বর্ণ।   
-“আরে ঠিক আছে, অসুবিধা নেই। বোস না একটু। এখনি শুয়ে পড়বি? ঘণ্টাখানেক একটু গপ্প টপ্প করতাম। এখনি ঘুম আসবে না আমার। তোর বউ যা খাইয়েছে ব্যায়াম করতে হবে মনে হচ্ছে।”  
-“হেঁ হেঁ ... আমারও ঘুমোতে দুটো তিনটে বেজে যায়। ঘণ্টাখানেক তো গল্প করাই যায়।” 
-“তোর বউ শুয়ে পড়েছে?” 
-“এই গেল শুতে। ও তো দোতলায় শোয়।”
-“এতো দেরী করে যাস, ওর ঘুমের অসুবিধা হয় না?” 
-“অসুবিধা...?” একটু চুপ থেকে উত্তর দেয় স্বর্ণ, “আমরা তো একসাথে শুই না।... ও ওর মত থাকে, আমি আমার মতো।”
কথাটা আমার ঠিক বিশ্বাস হল না। জিজ্ঞাসা করলাম, “কেন? কাজের চাপের জন্য কি সংসার জীবন অবহেলা করাটা ঠিক?”                                                       
-“বাব্বা! তুই সংসার জীবন সম্পর্কে দারুণ জ্ঞানলাভ করেছিস দেখছি। তাহলে আর দেরি কেন, বিয়েটা করে ফেল না। বলিস তো আমি মেয়ে দেখে দিচ্ছি।”
স্বর্ণ ‘হো হো’ করে হেসে উঠল। ওর এই হাসিটা শুনলে চন্দ্রার একটা কথা মনে পড়ে যায়। স্বর্ণ যখনই এরকম হাসত, চন্দ্রা মুচকি হেসে টিপ্পনী কাটত, “ভীমরতি ধরেছে। পাগলামি দেখো!” মানেটা হল পেটে খিদে মুখে লাজ। স্বর্ণর এই হাসিটা ওর ভীষণ পছন্দের। কিন্তু সেটা বলতে পারত না লজ্জায়। তাই সাদরে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করত স্বর্ণর হাসিটা। যাতে এমন মিষ্টি প্রত্যাখ্যানে স্বর্ণ আর একবার অমন করে হেসে ওঠে।
স্বর্ণকে বলতে যাচ্ছিলাম চন্দ্রার কথাটা। কিন্তু গিলে নিলাম। বলেই কী হবে! শুধু শুধু পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটা। অন্য একটা কথা বললাম।      
-“ফাজলামি করিস না তো। ওসব বিয়ে টিয়ে আমার ভাল লাগে না।”   
-“বিয়েটা আমারও ভালো লাগে নি। আমিও চেয়েছিলাম, তোর মত জীবন কাটিয়ে দিতে। কিন্তু পারলাম কই?”
স্বর্ণর গলার স্বরটা একটু অন্যরকম লাগল।    
-“তুই বিয়ে করতে চাস নি... মানে?”
-“সত্যি কথাগুলো আজ বলতে পারি? দশ বছর আগে যেগুলো বলার জন্য তোর বাড়িতে গিয়েছিলাম একদিন। প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে, প্রায় আধভেজা ভিজে। কিন্তু তুই সেদিন আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছিলি। মুখের ওপর দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছিলি। প্রচণ্ড বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। যেসময় মানুষ কুকুর বিড়ালকেও বাড়ি থেক তাড়ায় না, সে সময় তুই আমাকে একটুক্ষণ বসার জন্যও বলিস নি। প্রচণ্ড কান্না পেয়েছিল সেইদিন। মনে হয়েছিল একটা বাজ যদি আমার ওপর এসে পড়ত, তোদের সবার আমার ওপর প্রতিশোধ নেবার ষোল-কলা পূর্ণ হত।”
-“কী বলছিস স্বর্ণ?”
স্বর্ণর গলার স্বরে একটা ভাপসা হয়ে আসা কান্না দলা পাকিয়ে আসছিল। আমি কাছে গিয়ে ওর কাঁধে হাত দিলাম। ও নিজেকে সরিয়ে নিল। 
-“তীর্থ, তুই শুধু চন্দ্রার কথাগুলোই সেদিন শুনে গিয়েছিলি। আমারও যে কিছু বলার থাকতে পারে সেটা বুঝিস নি। অপরাধ আমি করেছিলাম, সেটা আজও স্বীকার করি। কিন্তু তোকে বলে সেই অপরাধবোধটা একটু হাল্কা করতে চেয়েছিলাম। তার অবকাশ তুই আমায় দিস নি।”  
ওর কথাগুলো শুনে নিজের ওপর খারাপ লাগছিল। কী বলব কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। তাও বললাম, “বল। আজ শুনব। আয় বোস।” 
মশারিটা সরিয়ে একটুখানি জায়গা করে নিয়ে খাটের ওপর দুজনেই বসলাম। বড় আলোটা বন্ধ করে নাইট বাল্বটা জ্বালিয়ে দিলাম। শুধু শুধু অন্যের কারেন্ট পুড়িয়ে লাভ কী ! শেষ হয়ে আসা সিগারেটটা ফেলে দিয়ে আর একটা ধরালাম। 
-“কী রে বল?... স্বর্ণ!”
-“চন্দ্রাকে আমি বিয়ে করতে অস্বীকার করেছিলাম ঠিকই, কিন্তু উপায় ছিল না আমার কাছে। আমার বাড়িতে প্রথমে বলিনি চন্দ্রা আর আমার সম্পর্কের কথা। আমার চিন্তায় ছিল, কোন স্কুলে আর্ট টিচারের চাকরি পেলে চন্দ্রাকে বিয়ে করে আলাদা হয়ে যাব। ঝাড়গ্রামে অল্প ভাড়ায় বাড়ি পাওয়াটা তখন তেমন অসুবিধা ছিল না। আমি জানতাম চন্দ্রাকে আমার বাড়ি থেকে মেনে নেবে না। তাই যাতে আমাদের সম্পর্কটা কোনভাবে নষ্ট না হয়, তার জন্য ওকে  আমার বাড়ি যেতে দিতাম না। আমিই যেতাম ওর বাড়ি। বাবা একদিন আমায় দেখে ফেলেন চন্দ্রার বাড়ি যাচ্ছি, সেসময়। আমার দাদা, মানে জেঠুর ছেলে চিনত চন্দ্রাকে। ও বলে দেয় আমাদের সম্পর্কের কথা। বাবার কাছে। আমি জানতামও না দাদা কীভাবে জেনেছিল আমাদের সম্পর্কের কথা।... সেইদিন প্রচণ্ড অশান্তি হয়েছিল। আমায় বলে দেওয়া হয়, আমি যেন আর চন্দ্রার সাথে মেলামেশা না করি। আমি জানিয়ে দিয়েছিলাম, আমি বিয়ে করলে ওকেই করব। দরকারে আলাদা হয়ে গিয়েও। ... তার ফল হল উল্টো।”
-“কী হয়েছিল?” 
-“রাতারাতি বাবার এক কলিগের মেয়ের সাথে বিয়ের পাকা কথা বলে দেয়।”
-“কলিগের মেয়ে? মানে কৃতিকা?”  
-“হ্যাঁ।”     
-“আচ্ছা, একটা কথা বল তো। চন্দ্রাকে বিয়ে করায় তোর ফ্যামিলির, মানে তোর বাবার আপত্তি কোথায় ছিল?”
-“শুধু বাবা না, বাবা, মা, জেঠুরা … সবারই আপত্তি ছিল। প্রথমত স্ট্যাটাস প্রবলেম। চন্দ্রার বাবা নামকরা ডাক্তার। ঝাড়গ্রামে দারুণ প্র্যাকটিস ওঁর। অনেক বড় বংশের মেয়ে। দাদু অ্যাডভোকেট ছিলেন। সবাই অনেক এডুকেটেড  ... আমার বাবা...”
-“কিন্তু তোর বাবাও তো স্কুলের টিচার ছিলেন। জেঠু কলেজের প্রফেসর। তাহলে?” প্রশ্নটা না করে থাকতে পারলাম না। 
-“আভিজাত্যে তো চন্দ্রার বাড়ির ধারে কাছে আমাদের বাড়ি যায় না। তখন চন্দ্রার ফ্যামিলিকে ঝাড়গ্রামে সবাই এক ডাকে চেনে। আমাদের ক্ষেত্রে তো সেটা নয়।  ছেলের বাড়িকে সবসময় আভিজাত্যে, টাকায় মেয়ের বাড়ির চেয়ে বেশি হতে হয়। সেটাই তো নিয়ম সমাজের।” 
-“শুধু এটার জন্যই এত আপত্তি?”
-“না। আর একটা ছিল প্রধান কারণ।... চন্দ্রার প্রফেশন।”
-“প্রফেশন?”
-“হ্যাঁ। চন্দ্রা নৃত্যশিল্পী। নাচকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে। সায়েন্সে দুর্দান্ত রেজাল্ট করার পরও কেন মেডিক্যাল বা ইঞ্জিনিয়ারিং-এ গেল না! এটাই তো আসল আপত্তির কারণ। আমাদের বাড়িতে নাচ ব্রাত্য। অন্যান্য আর্ট ফর্ম তাও চলবে। নাচ চলবে না। নৃত্যশিল্পীকে এঁরা ‘নাচনী’ বলেন। নাচে শরীর দিয়ে দর্শকের মন জয় করা হয়, হাততালি কুড়নো হয়- এসব এঁদের ধারণা।” 
অন্ধকারে বোঝা যাচ্ছিল না স্বর্ণর চোখের ভাষাটা। কিন্তু ওর ফোঁপানোর শব্দটা শুনতে পেলাম। নাইট বাল্বের আলো-আঁধারিতে মনে হল যেন স্বর্ণর চোখে জল। 
-“তীর্থ, আমি অনেক চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছি। নিজেকে কাপুরুষ মনে হত তখন। প্রতিটা দিন প্রতিটা রাত ভাবতাম আমি কী ভীষণ মেরুদণ্ডহীন। তখন আমার হাতে উপায় ছিল না আর চন্দ্রাকে বিয়ে করার। আমি তখন একটার পর একটা টিউশন খুঁজে চলেছি। কিন্তু টিউশন থেকেও খুব বেশি টাকা আসত না। এসব আর্টের লাইনে চাকরি, প্রতিষ্ঠা খুব সময় সাপেক্ষ। তাও খুব ক্ষীণ। কপালে থাকলে হবে, না থাকলে বেকার হয়ে ঘুরে বেড়াতে হবে। আমার হাতে রোজগার নেই। কবে রোজগার করতে পারব জানি না। এই অবস্থায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে চন্দ্রার সঙ্গে সংসার করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তখন সংসার টানতে গিয়ে চন্দ্রার জীবন কেরিয়ারও শেষ হয়ে যেত। আর বিয়ে করে আমাদের বাড়িতে এলে ওকে নাচ ছাড়তে হত সারাজীবনের মত। ওকে নাচ ছেড়ে দিতে বলা মানে ওকে খুন করার সমান। ও নাচ ছেড়ে এক মুহূর্ত বেঁচে থাকতে পারবে না। সবদিক বিবেচনা করে দেখলাম, আমারই উচিত ওর জীবন থেকে সরে যাওয়া। তাই ওকে আমার জীবন থেকে সরিয়ে দিয়ে মুক্তি দিয়েছিলাম ওকে, আমার হাত থেকে। মিথ্যেই সাজিয়ে বলেছিলাম কৃতিকার সাথে আমার অ্যাফেয়ারের কথাটা। ওটা না বললে ওকে সরাতে পারতাম না, আমিও সরতে পারতাম না ওর জীবন থেকে।”
-“স্বর্ণ... তুই আমায় ক্ষমা করিস। আমি সত্যি তোকে বুঝতে পারি নি। চিনতে পারি নি।” আপনা থেকেই কথাটা বেরিয়ে এল। কিন্তু স্বর্ণ তখন নিজের আবেগে মেতে। আমার কথাটা শোনার অবস্থায় ও ছিল না। 
-“তীর্থ, বাবা আমায় দিব্যি দিয়ে রেখেছিলেন। চন্দ্রাকে বিয়ে করলে উনি আত্মঘাতী হবেন। ... এই দিব্যির পর আমি পারিনি রে, কথা কেটে বেরিয়ে আসতে। শুধু একটাই করতে পেরেছিলাম।”
-“কী?”
-“চন্দ্রা যতদিন বিয়ে করেনি, আমি অপেক্ষা করেছিলাম।”
-“অপেক্ষা?”
-“হুঁ। কৃতিকার সাথে আমার বোঝাপড়া হয়েছিল। কৃতিকাকে চন্দ্রার কথা সবই বলেছিলাম। এও বলেছিলাম, চন্দ্রা যদি কোনদিন বিয়ে না করে আমার পক্ষেও কাউকে কোনদিন বিয়ে করা সম্ভব নয়। কৃতিকাকে বলেছিলাম অপেক্ষা করতে পারলে করুক, না হলে অন্য কাউকে বিয়ে করে নিক। কৃতিকা কথা রেখেছিল। ওর বাড়িতে আর আমার বাড়িতে বলেছিল, আমি যতদিন না ঠিকমত রোজগার করছি, আমাকে বিয়ে করা ওর পক্ষে সম্ভব নয়। ও নিজের থেকেই এই কথাটা বলতে বলেছিল আমায় আমার বাড়িতে, যাতে চন্দ্রার দিকে সন্দেহের তীর না যায়।... তীর্থ, তুই ভাববি নিজের বউকে বড়- মহান করে দেখাচ্ছি। না, সেটা নয়। কৃতিকা সামাজিকভাবে, আইনত আমার স্ত্রী হলেও আমি ওকে সেই স্বীকৃতি দিতে পারিনি।”
-“মানে? এসব কী বলছিস?”
-“কৃতিকা আমার কাছে বন্ধুর মত। ও আমার জন্য যেটুকু করেছিল, তাতে আমি কৃতজ্ঞ ওর কাছে।” 
-“কিন্তু কৃতিকাকে স্ত্রীর স্বীকৃতি দিস নি মানে?”
-“হিন্দুমতে আমাদের বিয়ে হয়নি। আমি বাড়িতে বলেই দিয়েছিলাম যে এটা আমি পারব না।  চন্দ্রা ছাড়া কারও সিঁথিতে সিঁদুর দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।  আমাদের রেজিস্ট্রি ম্যারেজ হয়। এই নিয়ে তুমুল অশান্তি হয়। কিন্তু আমি বাড়ির কাছে এই ব্যাপারে মাথা নোয়াতে পারিনি। ফলস্বরূপ বাবাকে হারাতে হল। অশান্তির থেকে স্ট্রোক। তারপর বছর তিনেক পর মারা যান। বাবার মৃত্যুর শোক আর আমার জেদ মাও মানতে পারেন নি। ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। ঠিক এক বছর পর মাও মারা যান। মা মৃত্যুর আগে অবধি আমাকেই দায়ী করে গেছেন বাবার মৃত্যুর জন্য।”
স্বর্ণ হঠাৎ আমার হাতদুটো ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। ওকে জীবনে এই প্রথম কাঁদতে দেখলাম। এত যন্ত্রণা জমে ছিল ওর বুকের মধ্যে? আর আমি এতদিন ওকে শুধু ভুলই বুঝে এসেছি?
তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নেয় স্বর্ণ। পাঞ্জাবির হাতায় চোখ দুটো মুছে নিয়ে আবার শুরু করে।
-“কৃতিকার সাথে কোনদিনই আমার স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক হয়নি। একই বাড়িতে থাকলেও আমার পক্ষে সম্ভব হয় নি সেটা। কৃতিকা হয়ত অনেক বড় মনের। তাই সেটা মেনে নিয়েছে। কোনদিন কোন অভিযোগ জানায় নি।”
ওর এই কথাটার জন্য আমি একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না। তার মানে সমাজের কাছে ওরা দুজনে শুধুই স্বামী-স্ত্রীর অভিনয় করে চলেছে? কৃতিকা কোনদিনই মা হবার স্বাদ পাবে না?
-“তীর্থ, আমি কি সত্যিই খুব বড় অপরাধী? আমার অপরাধের কোন ক্ষমা নেই?”
আমি কী বলব কোন উত্তর খুঁজে পেলাম না। স্বর্ণ আমার উত্তরের প্রতীক্ষা না করে নিজের মনেই বলে চলে।
-“চন্দ্রা আজ তো সত্যিই সুখী রে। ওর যোগ্য একজনের সঙ্গে ঘর বাঁধতে পেরেছে। নাচ নিয়ে রয়েছে, যেটা ওর ভালবাসা, প্রেম। কত জায়গায় পারফর্ম করছে। আনন্দবাজারে, পত্রিকায় দু’তিন বার দেখেছি ওর নাচের প্রোগ্রামের রিভিউ। ইউটিউব চ্যানেলও তো বেশ পপুলার। কলেজেও তো ডান্স ফ্যাকাল্টি পজিশনে আছে। এসব কি ও পেত আমার সাথে বিয়ে হলে? ওকে সরিয়ে দিয়ে ভালই করেছি বল। অন্তত সুখে তো আছে।” 
সুখ কি এত সহজেই চেনা যায়? খ্যাতি, গ্ল্যামার হয়ত পাচ্ছে চন্দ্রা, অনেক অল্প বয়েস থেকেই। কিন্তু ও যে সুখী সেটা কী করে জানব? বুঝবই বা কী করে? ওর এই বিয়েটাই ছিল স্বর্ণকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য। যাতে স্বর্ণর কাছে ও হেরে না যায়, ওকে দেখাতে পারে যে ও স্বর্ণকে ছাড়াই সুখী হতে পেরেছে। কিন্তু সেটা শুধু দেখানোতেই রয়ে গেছে না কি ও সত্যিই সুখী সেটা কি এতদূর থেকে বোঝা যায়? আমি, চন্দ্রা, আমরাও তো ভেবেছিলাম স্বর্ণ সুখী আছে। কিন্তু আজ যা শুনলাম এটা তো একটা ধ্রুব সত্য, তাই না? “সুখ নামে শুক পাখি থাকে না খাঁচায়/মরে সে কাঁদিয়া মরে/যে তাহারে শেকলেতে বেঁধে নিতে চায়।”
কথাগুলো শুধু ভেবেই গেলাম, স্বর্ণকে কিছু আর বললাম না। 
-“স্বর্ণ, একটা কথা বলব? যদিও এটা তোদের ব্যক্তিগত ব্যাপার, তবু বন্ধু হিসেবে একটা অনুরোধ।”
-“কী? বল।”
-“যা হয়েছে ভুলে যা। চন্দ্রাও ওর মত সংসার করছে, তুইও কৃতিকাকে বিয়ে করেছিস। যখন বিয়েই করলি, ওকে সত্যিকারের সেই স্বীকৃতি দেওয়াটা কি উচিত নয়? না হলে ওর প্রতিও অন্যায় করা হয়।”
কথাটা শুনে স্বর্ণ ছিটকে উঠে গেল খাট থেকে- “ছিঃ! চুপ কর তীর্থ।... এই অন্যায়টা আমায় করতে দে। এটার অন্যথা আমি পারব না। কৃতিকাকে কোন দিনই মা হবার স্বাদ দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।”
-“কিন্তু...?”
-“কারণটা জানতে চাস?... আমার সাথে আসবি?”
স্বর্ণ আরও কিছু বলতে চায় আমায়, নিজের থেকেই।
-“কোথায় যাব?”
-“আমার আঁকার স্টুডিওতে। বাগানের ওধারের বাড়িতে।”
-“এত রাতে... ওদিকে?”
-“আয় না। আসবি একটুখানি?” স্বর্ণর কথায় সেই ছোটবেলার আবদারটা আবার খুঁজে পেলাম। তাই আর না করতে পারলাম না। 
-“চল। কিন্তু এদিকটা খোলা পড়ে থাকবে। কৃতিকা ঘুমিয়ে পড়েছে হয়ত এতক্ষণে। খিড়কি  দরজাটা খোলা রেখে যাওয়া ঠিক হবে?” 
-“বাইরে থেকে তালা দিয়ে দেব।”  
সারাদিনের পর আমার শরীর জুড়ে তখন ঘুম ছেয়ে এসেছে। তাও অদ্ভুত একটা উত্তেজনা আর চাপা কৌতূহলে রাজি হলাম স্বর্ণর না বলা কথা শোনবার জন্য ওর আঁকার স্টুডিওতে যেতে। হেমন্তের রাত, শিরশিরে বাতাস বইছে। স্বর্ণর বাড়ির দিকটায় গাছপালা বেশি, তাই ঠাণ্ডাও বেশি। আমার সাথে চাদর তাদর কিছু ছিল না। স্বর্ণর কাছ থেকে ওরই একটা চাদর চেয়ে নিলাম। খিড়কির দোরটায় বাইরে তালা দিয়ে দুজনেই গেলাম বাগানের পেছনের বাড়িটায়। বাগানটায় ছোট্ট একটা আলো জ্বলছিল। অন্ধকারই বেশী। খুব আবছা দেখা যাচ্ছিল চারদিক। গাছের আড়ালে চোর ছ্যাঁচোড় বসে আছে কিনা প্রমাদ গুণতে গুণতে চটপট পা চালালাম। স্বর্ণর কথাগুলো আজ বিশ্বাস না করে উপায় নেই। এত বছর পর এসে কী প্রয়োজনেই বা সে মিথ্যে গল্প সাজাবে? আজ তো ও বা চন্দ্রা দুজনেই নিজেদের মত করে প্রতিষ্ঠিত- সংসারীও। তাও ছোট্ট একটা খটকা ঘুরপাক খাচ্ছিল মনের ভেতর। স্বর্ণ যা বলল সব কি সত্যি? নাকি খানিকটা ওর অলীক কল্পনা? সত্যি কি কৃতিকার সাথে ওর স্বামী-স্ত্রী সম্পর্ক হয়নি, যা আছে তা সামাজিক আইনি ছাপ্পামাত্র? ভরা যৌবন কি বিন্দুমাত্রও হাতছানি দেয়নি?


(৬)
না, যৌবন হাতছানি দিয়েছে। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই। কিন্তু এ হাতছানি বড় অন্যরকম। বুঝলাম সেটা রাতের আলো-আঁধারিতে ওর আঁকার স্টুডিওর ঘরগুলো ঘুরে দেখতে দেখতে। যে ঘরে বসে প্রথম আমরা গল্প করছিলাম তার পেছনে আর একটা ঘর রয়েছে। ও ঘরে যাওয়ার দরজাটা এ ঘরের মধ্যেই রয়েছে। ও ঘরে যেতে গেলে এ ঘরটার মধ্যে দিয়েই যেতে হয়। দরজাটার সামনে একটা টেবিল রাখা ছিল। পর্দা দিয়ে ঢাকা দরজা, সামনে টেবিল। তাই প্রথম যখন এ ঘরে বসে গল্প করি, ওটা চোখে পড়ে নি। টেবিলটা সরিয়ে দরজার তালাটা খুলল স্বর্ণ।  -“আয়”, পর্দাটা সরিয়ে আমায় ডাকল।
এ কী! এ ঘর চন্দ্রার ছবিতে সাজানো! সারা ঘরের দেওয়াল জুড়ে সাজানো চন্দ্রার ছবি। নানান রকম নাচের ভঙ্গিমায়। অয়েল পেন্টিং সবই। কিন্তু দূর থেকে দেখলে মনে হয় ক্যামেরায় তোলা। আমি কাছে গিয়ে দেখলাম। অবিকল চন্দ্রার মুখ। খুঁত নেই কোথাও।  
-“এগুলো তোর আঁকা?”
-“হ্যাঁ। আর একটা চলছে। শেষ হয়নি। এই দেখ।” 
পুরোন শাড়ি দিয়ে ঢাকা ক্যানভাস থেকে কাপড়টা সরিয়ে দিল স্বর্ণ। ক্যানভাসে অসম্পূর্ণ একটা ছবি। স্বর্ণ আর চন্দ্রার। আমাদের দলের প্রথম অনুষ্ঠানের থেকে নেওয়া একটা দৃশ্য। গোলাপি রঙা গাউনে চন্দ্রা আর অফ হোয়াইট শার্ট, ব্রাউন প্যান্টে স্বর্ণ। স্বর্ণর দু’হাতে আলতো ভাবে ধরা আছে চন্দ্রার মুখটা। ওর চোখের পাতায় স্বর্ণর ঠোঁট। ছবিটায় কিছুটা রঙ শুরু হয়েছে। এখনও অনেকখানি স্কেচ হয়ে পড়ে আছে।
-“যেদিন চন্দ্রাকে সরিয়ে দিয়েছি আমার জীবন থেকে, সেই দিনটা ছিল আমার কাছে বিভীষিকার মত। কিছু খেতে পারতাম না, ঘুমোতে পারতাম না। সারা শরীরে অসম্ভব জ্বালা করত, কেমন অবশ লাগত শরীরটা।” ছবিটার দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আপন খেয়ালে বলতে থাকে স্বর্ণ, “একদিন একটা ছোট খাতা কিনে আনি। প্রথম প্রথম স্কেচই করতাম। চন্দ্রার নাচের ভঙ্গিমাগুলো মনে করে করে।”
-“বাড়িতে কেউ জানেন না এগুলোর কথা?”
-“না।”
-“কৃতিকা?”
-“ও-ও কিছু জানে না। প্রথমে, ... আমার একটা পুরনো খাতাপত্রের ট্রাঙ্ক ছিল ওটায় ঢুকিয়ে রাখতাম। চাবি দিয়ে। চাবিটা আমার কাছে থাকত সবসময়। ট্রাঙ্কটা কেউ ঘাঁটতেন না। খাটের তলে থাকত। জেঠুরা এপাশটা আমাদের বিক্রি করে চলে যাওয়ার পর আমি এদিকটাই আমার আঁকার স্টুডিও করে ফেলি। মা তখনও বেঁচে।... হুঁ, বাবাও ছিলেন তখন, তবে শয্যাশায়ী। নিজের মত করে সাজিয়ে নিলাম এপাশটা। প্রতিদিন রাতে এঘরে এসে ছবি আঁকতাম। মোমের আলোয়। পাছে সারারাত আলো জ্বালালে কোনভাবে কেউ জানতে পারেন।” 
-“কিন্তু কৃতিকাও কোনদিন প্রশ্ন করেনি?”
-“বিয়ের রাতেই কৃতিকাকে জানিয়ে দিয়েছিলাম একটা কথা। আমি অ্যান্ড্রোজেনাস।”
-“হোয়াট? এসব কী বলছিস! পাগল হয়ে গেলি নাকি?” আমি প্রায় চিৎকার করে উঠলাম।
-“এটা ছাড়া কোনকিছুই আটকানো যেত না। যতই হোক, স্বামীর শারীরিক ডিফিকাল্টি কোন স্ত্রীই সকলের কাছে খোলাখুলি বলতে পারবে না। এমনকি শাশুড়ি বা নিজের মা-র কাছেও না। কৃতিকা কতটা বিশ্বাস করেছিল জানি না। কিন্তু মুখে কোনদিন কিছু প্রকাশ করে নি।”    
-“হয়ত ও-ও চন্দ্রার মতই তোকে পাগলের মত ভালবাসে। তাই এই স্যাক্রিফাইস।”
-“স্যাক্রিফাইস করেছে অনেক সেটা মানি। আমি জানি, আমি দু’জন নারীর ভালবাসা-প্রেম-ইমোশন নিয়ে খেলেছি। কৃতিকার প্রতি অন্যায়ের চেষ্টা করেছি কমপেনসেট করে দেওয়ার। ওর গায়ে যাতে কোন কালি না লাগে, সবার কাছে নিজের শারীরিক অক্ষমতাই কারণ হিসেবে দেখিয়েছি। মা অনেকবার জোর করেছিলেন আমাকে ডাক্তার দেখানোর জন্য। যাই নি। অশান্তি হয়েছে। সত্যি ঢাকতে গিয়ে বারবার মিথ্যের আশ্রয় নিয়েছি। পরিবারে সব অশান্তিরই মূল কারণ হয়ে আমি রয়ে গেলাম। অন্তত মা-বাবা মৃত্যুর দিন অবধি এটাই বিশ্বাস করে গেলেন। ...আর চন্দ্রা... সেও তো সারাজীবন আমায় ভুলই বুঝে গেল।”
-“কথা বলবি চন্দ্রার সঙ্গে? সত্যিটা জানিয়ে ভুল বোঝাবুঝিটা তো অন্তত মেটানো যেত।” নরম ভাবে প্রশ্ন করলাম।
-“না থাক। আমায় ভুল বুঝলে ও সুখী হবে।” 
-“কিন্তু, এভাবে তুই সারাজীবন কাটাবি কী করে? মনের মধ্যে কষ্ট যন্ত্রণা সব চেপে রেখে গুমরে গুমরে ? ... এখনও তোর জীবনের অনেক বাকি। ভুলে যা না, পুরনো স্মৃতি। প্রেম আসে আবার চলে যায়। তা সারাজীবন মনের মধ্যে পুষে রাখার মানে হয় না।”
-“তাই? তোকে কে বলল, আমি কষ্টে আছি?”
-“কথা ঘোরাস না।”
-“আমি এভাবেই বাঁচতে চাই রে। ... শুধু একটা অনুরোধ। চন্দ্রাকে এসবের কিছু জানাস না। এখন যেভাবে আছি, এভাবেই থাকতে চাই। এটুকু কেড়ে নিস না আমার থেকে।”
স্বর্ণর হাত দুটো ধরে ঘাড় নেড়ে আশ্বাস দিয়েছিলাম, যন্ত্রের মতই। এই কি তবে সত্যিকারের প্রেমের ভবিতব্য? দুঃখের যন্ত্রণাতেই প্রেমের সুখ? প্রেমকে আঁকড়ে রাখতে গিয়ে স্বর্ণ হারিয়েছে বৈবাহিক জীবনের সুখ, পরিবারের ভালোবাসা। সমাজের কাছে নিজের পরিচয় করে নিয়েছে একজন ‘ইম্পোটেন্ট’ হিসেবে। রাতের অন্ধকারে এ ঘরে একলাই চালায় অভিসার? তাও নিছক কল্পনায়। রক্তমাংসের মানুষটা হয়ত তাকে কোনদিনই ছোঁয়া দেবে না। একটা কথা বার বার মনে পড়ছিল। চন্দ্রার সেই কথাটা। “যে জ্বালায় আমি জ্বলছি, ওকেও একদিন সেই জ্বালায় জ্বলতে হবে। ও জীবনে কোনদিনও সুখী হতে পারবে না ।” চন্দ্রার সেই অভিশাপই কি আজ স্বর্ণের জীবনে ফলে গেল? না কি এ অপরাধের গ্লানি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য স্বেচ্ছায় বেছে নেওয়া একটা পথ মাত্র? মর্ষকাম?... হয়ত এসব কিছুই নয়। প্রেমেরই এক লীলা। রাধার অভিশাপে বনমালী হয়ত কোন এক জন্মে রাধা হয়ে নেমে এসেছে মর্ত্যে।  

কবিতাঃ বাসব রায়
BasobRoy_edited.jpg

প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা ​

পুজো বার্ষিকী ১৪২৮ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

কবিতা

বাসব রায় 

রাজবাটি, দিনাজপুর, বাংলাদেশ

রাখালের ঘুড়ি

 

কটা সুতোছেঁড়া ঘুড়ি আকাশকে 

সহজেই পেয়ে যায় 

মাঠের রাখাল আকাশ চায় না 

ঘুড়িটাকে চায় 

 

ঘুড়িটা মিলিয়ে যায় মেঘ আর নীলে 

হয়তো ওখানেই সে তার ঠিকানা গড়ে 

 

বর্ণিল ঘুড়িটাকে হারিয়ে 

রাখাল আকাশের দখল নিতে চায় 

ওর ডানা নেই বাতাসে উড়োনোর৷ 

 

আবার নতুন একটা ঘুড়ি বানাতে বসে 

কঞ্চির আঁঠায় রঙিন কাগজ দিয়ে 

ঘুড়ি হয়, লাটাইয়ে সুতো ভরে 

সারাদিন ঘুড়ি উড়োয়৷ 

রিরংসা 

 

র্ষায়ও আগুন জ্বলে 

অন্তর- বাহির সবখানে 

খুব কাছেই পিপাসা অপেক্ষায় 

রাতের আগুন আরও জ্বালা ধারায়৷ 

 

আত্মবিস্মৃত হই 

রক্তের কণায় কণায় আস্ফালন 

প্রজ্বলিত আকাঙ্ক্ষায় 

কামনার দহন৷ 

 

নিজেকে ডোবাই 

নিজেকে হারাই 

ক্লান্তির কাছে আত্মসমর্পণ করি - 

মরেও মরার সাধ জাগে আবার৷

অদৃশ্য চাঁদ

 

তকাল একটা ঘুট্‌ঘুটে অন্ধ চোখে পৃথিবীকে দেখেছি - 

কৃষ্ণগহ্বর থেকে আসা আমি নতুন আগন্তুক 

 

পৃথিবীর বড় আবিষ্কার তেলের ঘানি 

বলদ ঠুলি চোখে বৃত্তাকারে অনবরত হাঁটছে 

বিষয়বস্তুর কিছুই সে জানে না৷ 

 

কোন ঠুলি ছাড়াই অনেকে দেখতে পায় না 

লালকে কালো দেখে কিংবা হলুদকে ধূসর 

 

বুকপাঁজরে জমাট বেঁধেছে মহাকালের দ্বন্দ্ব 

সে সকাল দেখে না, দেখে না মিষ্টি বিকেল 

সে শুধু রাত দেখে যেখানে চাঁদের দেখা মিলেনি হাজার বছর - 

নেতিবাচক নয় ইতিবাচক 

 

কটা আংশিক ছোবলে নেতিবাচক ভাবনারা দোদুল্যমান 

ভাবনাগুলো নতুন করে আলো আর অন্ধকারের পার্থক্য বুঝতে চেষ্টা করে 

 

আমি ইতিবাচক হতে বলি 

একদম সোজা এবং দৃঢ় 

প্রচণ্ড ঝড়ও যেখানে লেজগুটিয়ে পালায় 

 

বিচ্ছেদের সেতার সে বাজবেই 

ধরে নিয়ো সবটুকু প্রেম সেখানেই জমা 

 

বাঁশিতে যমুনার ঢেউ তুলো, দেখবে তীরে নিষ্পলক দাঁড়িয়ে শাহজাহান৷ 

village.jpg

আবার নতুন সবুজ 

খবরে প্রকাশ পৃথিবী ছোট হয়ে আসছে 

এর আয়ূ ক্রমশঃ নিম্নগামী 

সঙ্গতকারণে, বোধহয় মনগুলোও সমানতালে ছোট হওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছে; 

 

এইতো সেদিনও আকাশটাকে বিরাট বড় মনে হয়েছিল, বিশাল-- 

নীলে নীলে আদিগন্ত কী অপূর্ব সৌন্দর্য! 

শ্রাবণের পাগল মেঘগুলো কালো রঙে আকাশটাকে ঢেকে দিয়ে ছোট করে ফেলেছে৷ 

 

একটি মন পৃথিবীর চেয়েও বড় হতে পারতো 

বিস্তৃত অন্তরীক্ষে ছড়ানো থাকতো শুধু ভালোবাসা আর ভালোবাসা -----! 

সংকোচনের সংকোচে ধীরে ধীরে ছোট হয়ে আসছে চারপাশ, সংকুলান বলে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই৷ 

 

কষ্টগুলো চাপা থাকে ছোট্ট অন্তঃকরণে 

নিভৃতে তা জ্বলে - 

অতঃপর একদিন ধুঁকে ধুঁকে মৃত অন্তরটির সৎকার হয় -

দু'একদিনের স্মৃতিচারণ মাত্র 

অবশেষে ভুলে যাওয়া মাটিতে আবার নতুন সবুজ৷

সুখ

প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা ​

পুজো বার্ষিকী ১৪২৮ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

গল্প

সুখ      

দেবযানী পাল

deadbody.jpg

দিনের শেষে বান্ধবী সুতপার বাগানে বসে চায়ে চুমুক দিতে দিতে সুচরিতা বললো, “সুতপা, সুখ কথাটা এতবার বলি আর বলতেও শুনি, এর সত্যিকারের সংজ্ঞা কি বলতো? সেই কবেকার কথা, সুখী গৃহকোণ শোভে গ্রামাফোন, মনে আছে তোর? আর নুতন কনের জন্য উপহার সুখে থাক লেখা কাপড়ের টুকরো? একটু ভেবে সুতপা উত্তর দিল, সুখ কথাটি কিন্তু নানা প্রসঙ্গে নানাভাবে ব্যবহার করা যায়। শোন আমার কাহিনী|  ১৯৪৭ এ স্বাধীনতার আগে আমরা ছিলাম উত্তরবঙ্গের বর্ধিষ্ণু রংপুর শহরে পরম আনন্দে, মহাসুখে। বাড়ির কাছেই ছিল সারাবছর প্রায় শুকনো একটি নদী। বর্ষার ভরা জলে খরস্রোতাকে মনে হত যেন মনমোহিনী এক দুরন্ত মেয়ে। মনে পরে কখনও বাবা আমাকে পিঠে নিয়ে জল আর কচুরিপানায় ঢাকা নড়বরে কাঠের সেতুটি পেরিয়ে ওপারে বন্ধুদর্শনে যেতেন। সে ছিল এক ঔত্সুক্যেভরা সুখ।গরমে কিন্তু প্রকৃতির রূপের পরিবর্তনে এক শান্তিময় সুখের অনুভুতি হত। অনন্ত আকাশের সীমানার সাথে মিশে যাওয়া সুদুর প্রসারিত ধানক্ষেত, গাছ, ফুল, ফল আর স্নিগ্ধ সবুজের মাখামাখি চারিদিকে।

আবার হাড়কাঁপানো শীতের হিমভেজা স্নিগ্ধ ভোরের কাঁচা সোনামাখা রোদে কাপড়ে মাথা ঢেকে সবাই মিলে মুড়ি খাওয়া, সে ছিল একসাথে খুশির সুখ। আর বিভিন্ন ঋতুতে ঘুমন্ত সুর্যমামাকে না জাগিয়ে আধ-অন্ধকারে ঠাকুমার পুজোর জন্য ফুল আনতে যাওয়া ছিল উত্তেজনায় ভরা হৃত্কম্পের সুখ। আমাদের শহরের জমিদারের মতিলাল ও রাজলক্ষ্মী নামের দুটো হাতী ছিল। প্রতিদিন বিকেলে আমরা ওদের আস্তাবলে ফেরার প্রতিক্ষায় থাকতাম। ওদের গলায় বাঁধা ঘন্টার শব্দে সজাগ হয়ে দেখতাম দূরে বিশাল বোঝা নিয়ে হেলতে-দুলতে ওরা আসছে, মাহুত ওদের  ডাকলে ওরা আস্তে একটা শব্দ করে প্রত্যুত্তর দিত। সুচরিতার অবাক চোখের দিকে তাকিয়ে সুতপা বলে চললো, তুই হয়তো বুঝবিনা, প্রতিদিনের কয়েক মুহুর্তের এই আনন্দে মাখা খুশীতে আমরা ছিলাম সুখী।  

আমার বাবা, প্রতিদিনই ভোরে আমাকে নিয়ে সাইকেলে শহরের উত্তরে যেতেন। ওখান থেকে সূর্যালোকে উদ্ভাসিত স্বর্নবর্নের কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপ দেখতাম চোখভরে। দুজনে পরম

ভক্তিভরে দেবতাত্মা হিমালয়কে প্রনাম জানাতাম। সেই শ্রদ্ধা মিশ্রিত আনন্দের সুখের কিন্তু এখনো শেষ নেই, কারণ সে হল মনেগাথা চিরস্থায়ী সুখ। ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হবার পর, সুতপা বলে চললো, আমরা পূর্ববঙ্গ এখন বাংলাদেশ, চিরদিনের মতো ছাড়লাম।এখনো মনে পরে শেষ সন্ধ্যায় প্রায় প্রাণহীন, আলোহীন রংপুর ছেড়ে ঘোড়াগাড়ীতে স্টেশনে আসার আগে আমার বান্ধবীকে আমার পুতুল-খেলনাপাতি দিলাম এক শর্তে যে ফিরে এসে সবকিছু ফেরত নেবো। কিন্তু আর কখনও ফিরে যাইনি।

কখনও সখনো মনের অতল গভীরে অব্যক্ত বেদনায় মাখা নানা স্মৃতির স্বল্প আলোগুলো সারারাত জোনাক পোকার মত জ্বলে।

রংপুর ছাড়ার দিন শহর থেকে ফেরার সর্বশেষ ট্রেনটির ঠিক আগের ট্রেনটি আমার নিয়েছিলাম।সারা পথে লোকে ঠাসা দূর্বিসহ অবস্থা পেরিয়ে পরদিন সান্ধ্য আইনের অন্ধকারে কলকাতা শহরে এসে পৌঁছলাম। পরে শুনেছি, রংপুর থেকে ফেরার  সর্বশেষ নটি শুধু মৃতদেহ নিয়ে কলকাতায় ফিরেছে। সত্যই, প্রিয় দেশ ছেড়ে আসার অপরিসীম মনোবেদনার যেমন কোনো স্বান্তনা নেই তেমনি বেচেঁ ফেরার পরম সৌভাগ্যেরও কোনো ব্যখ্যা নেই।

সুচরিতা বললো, সুতপা তুই হয়তো জানিস ভাবাবেগ বিশারদের মতে নিরাশা, হতাশা, ইত্যাদি  জীবনে যাইই আসুক না কেন, একদল মানুষ এর মধ্যে থেকেও চিরকালই চিরসুখী।দুঃখ, কস্ট, আনন্দ, বেদনাতে এরা অটল। অপর এক দলের, মনস্তাত্তীকদের মতে, ঘটনা ও সময়ের সাথে সাথে সুখ আর দুঃখের অনুভূতিরও রদবদল হয়। এই দল চিরকালই সুখ-দুঃখের টানটানিতে ভোগেন।

আসন্ন সন্ধ্যার নিস্তব্দতা ভেঙ্গে সুতপা বললো, আমার মনে হয়, সুখ-দুঃখ, আশা-নিরাশা, শান্তি-অশান্তি সবই একে অন্যের পরিপূরক। হয়তো সেইই চিরসুখী যে সারাজীবন সবকিছুর টানাটানির মধ্যেও মানসিক সাম্যতা ও শান্তি বজায় রাখতে পেরেছেন। সর্ব্বজনবন্দীত বৌদ্ধ আধ্যাত্মিক গুরু দালাই লামা বলেছেন, সুচরিতা বললো, সুখ বলে কিছুই নেই। তবে সর্ব জীবের প্রতি, অনুকম্পা আর করুনা থেকেই সুখানুভুতির জন্ম। 

সুখে থাকো সবাই এইই প্রার্থনা।

কবিতাঃ মৌ চক্রবর্তী

প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা ​

পুজো বার্ষিকী ১৪২৮ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

কবিতা

মৌ চক্রবর্তী

শিরোনাম 

 

ক বৃষ্টি হলুদপাতা

 

ঋক

পায়ের পাতায় বৃষ্টি মন মনের পাতায় জল

টাপুর টুপুর বৃষ্টি মেয়ে একটু কথা বল

 

হলুদপাতা

 

বন্দি জীবন ভেঙে দু - হাতে রাত্রি

ব্যয় হয় বুঝি

ক্ষয় হয় বুঝি

কুয়াশার চোখে জল

অস্থির সমাধির পাশে সঞ্চয়

মেলে খিদের দিনরাত

কার্নিশে বসে এঁটো খায় কাক

এও কি জীবনের মতন নয়

সদর খুলে ঢুকে আসে সময়

দরিদ্র ভিক্ষুক

নরম মাটির মতন সেও খুব চুপ

বায়স দেয় অমোঘ প্রতিধ্বনি

নিজের ফিরে ফিরে ফিরে আসে বৃষ্টিমেঘ অমনি

কিজন্যে চাঁদ জেগে

কিজন্যে ঋক থাকে কবিতার ধুলো মেখে

আজ দুই হৃদয়ের চোখে জল

টলমল টলমল

 

ঋক

দুপায়ে রেখে নাও কথার কথকতা

আজ সন্ধি হতে থাক দুই মনব্যথা

river.jpg
কবিতাঃ বিশ্বজিৎ মন্ডল

পুজো বার্ষিকী ১৪২৮ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

কবিতা

বিশ্বজিৎ মন্ডল

touch.jpg

নির্মাণ

মণের পর ঠিকঠাক দেখে নাও
তোমার সর্বস্ব ঠিক আছে কি না

নাকি তোমার শরীর ছেড়ে কোনো রাত -চরা বিহঙ্গ উড়ে গেছে পরবর্তী সন্ধের দিকে
তাল তাল সোনা ভেঙে নিপুন হাত এঁকে গেছে
অজন্তার পূর্ণ শরীর

ভাবি না নিন্দার দুরন্ত কোলাজ
কেবল গড়তে জানি, রাতের ভাস্কর্য..... 

কবিতা শুভজিৎ দাস

পুজো বার্ষিকী ১৪২৮ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

কবিতা

শুভজিৎ দাস

নিরুত্তাপ

 

শূন্যতার নানা বিভেদ 

শীর্ষ থেকে ছুঁড়ে দিচ্ছে

একবার ডাইনে একবার বাঁয়ে,

দুঃখের বিনিময়ে 

ছুটে আসা সংখ্যারা 

ধূসর আজ্ঞা পালন করে যাচ্ছে,

ভৌতিক উপন্যাসের পুতুলের ন্যায়ে

নিরুত্তাপ অগ্ৰগতিতে। 

crow.JPG

পুজো বার্ষিকী ১৪২৮ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

কবিতা

সরোজ কুমার রায়(সারথি)

কবিতাঃ সরোজ কুমার রায়
village2.jpg

অমৃতের সন্ধানে

   

দি আমি জানতাম

আমাকে মরতেই হবে,

বড় হয়ে আর খেলা যাবেনা

ডাংগুলি, মার্বেল নিয়ে;

ছোট্ট নাটকে ফালতু চরিত্রে

অভিনয় করতেই হবে!

উঠতাম কি তবে পুকুর থেকে

ডুব দিয়েছিলাম সবে!

 

পুলিশের থেকেও অনেক বড়ো

আমার মায়ের হাতে লাঠি,

একবার যদি পিঠে পড়ে

হাঁচি, সর্দি, কাশি।

 

গুপ্তধন আর তোলা গেলোনা

সলিলে হলো তাদের সমাধি

বুঝবে কি মা, খেলনা মার্বেল

হিরের চেয়েও যে অনেক দামি!

 

পটোল সেবার কান ধরেছিলো

আর খেলবে না বলে

দারোগার মত ওর বাপ বলছিলো-

ফেলে দে ওগুলো জলে।

 

আমি তো মায়া ছাড়তে পারিনি

ফন্দি এঁটে ছিলাম মনে।

প্রাণের সম্পদ জলে থাকবে কেন!

উচিত মূল্য ফিরিয়ে দেবো তাদের

অন্ধকার থেকে আলোয় এনে।

তারপর সময় অনেক হলো

আর খেলা হলো না, যা আসল

নকল খেলায় প্রাণ যায় যায়

যেমন করে বাঁচে ছাগল।

 

বুঝতে পারিনি কখন যে নাটক

এসে গেল সমাপ্তির পথে;

এখনো তাকালে পুকুরটার দিকে

পটোলের মুখ ওঠে ভেসে।

 

পুকুর যেন আমায় ডাকে;

দাঁড়িয়ে থাকি বেশ কিছুক্ষণ

মনে ভাবি যদি মার্বেলগুলি

থাকতো কাছে আমার অনুক্ষণ;

আদর করে বলতাম তাদের

কে বলল তোমরা পাঁজি

তোমরাও যাবে আমার সাথে

তোমাদের নিয়েই তো এই পৃথিবী।

 

পুরোনো মনটা ফেলে দিতে পারিনি

তাকিয়ে থাকি তাই  নির্ণিমেষে,

পুকুর পাড়ে মা যেন আমার

বকুনি দিতে আবার আসে।

পুজো বার্ষিকী ১৪২৮ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

কবিতাঃ যুবক অনার্য

কবিতা

যুবক অনার্য 

বিপন্ন সময়ের শব্দিত ঋণ

এর চেয়ে ভাল নেই - 
না ভালো লাগাকেই 
বেসেছি যে ভালো। বিলাসী জোছনায় 
অভিজ্ঞ মাতাল যেন, 
উত্থিত জলের কলস ছুঁয়ে 
শঙ্খিনী শরীর থেকে 
ছায়া খুলে মৃত্যুর পাদদেশে 
ফিরে গিয়ে দেখি- আমি 
রাতজাগা ভোর আর
পাখিদের মতো নই
নিষ্পাপ কেউ, শুধু জানি-
খুন না করেও আমি খুনি
খুব বেশি পরাজিত পাপী। 
এখানে প্রচ্ছন্ন কোনো পিপাসা নেই 
দুঃখ নদীর তীরে নগ্ন সুখের কাছে 
সন্ধ্যা তারার কাছে অকারণে 
সরে গেছি লজ্জাবতীর মতো 
আজন্ম সংবেদী আমি 
প্রেমে ও  বিপ্লবে ক্ষমাহীন 
হুলিয়া কাঁধে নিয়ে চিরদিন  

যেন আমি ফুলকে ভুল ভেবে

ভুলকে ফুল ভেবে অচেনা প্রেমিক সেজেলোভকে সাধুর কাছে গচ্ছিত রেখে আজ 

এসেছি এ জলবনে - তুমি 
ফিরিয়ে দিতে চেয়ে বোলো নাকো
থেকে যেতে -
এখন সময় নয় কল্পকথা চেলে
আত্মপ্রসাদ জুড়ে পিছলে পড়ে থাকা

এখানে কেবলি মাংসের ঘ্রাণ গুপ্ত ঘাতক 

পুরনো কুকুর  
সংঘাত 
নষ্ট নাগর  
সুযোগ বুঝে চলে যায় 
নিষিদ্ধ মাধবীর কাছে
মহুয়ার গন্ধে উন্মাদ  
যারা চৈতন্য ভুলে গিয়ে কেবলি 
পড়ে থাকে অন্ধকারে 
তলিয়ে যেতে যেতে
ফোটাতে পারে না 
একটিও গন্ধমাখা ফুল, 
রমণীর গোপন রাষ্ট্র থেকে  

ছিনিয়ে নেয় কেবলি  সম্ভ্রম। 

আমি তবে কি করে দাঁড়াই বলো 

নিজস্ব নিরাপদ বেষ্টনী তুলে! 

তার চেয়ে বরং 
আমাকে ফিরিয়ে দাও 
ফিরে যেতে বলো 
যেখানে পাপ যেখানে পাপী  
অবলা রমণীকে  
দাসত্বের দাগে রেখে  
সপাং শব্দ নিয়ে কুৎসিত হাসে
তার চেয়ে এই বড়ো ভালো

- আমি রজনীগন্ধার কাছ থেকে 
কিছুটা সৌরভ লুফে নিয়ে 
বেরিয়ে পড়বো 
প্রকাশ্য দিবালোকে -  

আমি - ফেরারি এক - 
আমার জন্যে বরাদ্দ অক্সিজেনটুকু 
রাষ্ট্র লুকিয়ে রেখেছে রাষ্ট্র যন্ত্রের ঊরুসন্ধিতে। 

তবু এই বেঁচে থাকা শুকিয়ে যায় না
টকটকে গোলাপের মতো
দ্রোহের আগুনে তার জমা আছে 
বিপন্ন সময়ের শব্দিত ঋণ।

কবিতাঃ সিদ্ধার্থ ঘোষ

পুজো বার্ষিকী ১৪২৮ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

কবিতা

সিদ্ধার্থ ঘোষ

অর্ধ(নর)নারীশ্বর

ছেলেটার গা'পাক দেয় সংখ্যা দেখলে
হাতে পাটিগণিত, চাকরিপ্রার্থী, কোচিং এ চলে।
- ছেলেটা যুবক না; যুবতী বোধহয়!

মেয়েটার প্রতিবিম্ব, শুকনো ঠোঁট, লিপস্টিক
প্রতিবিম্বের চোখে- ঘোড়া, রাজকুমার; সিনেমেটিক।
- মেয়েটা যুবতী না; যুবক বোধহয়!

কে ছেলে? কে মেয়ে? - বল হে প্রভু...
বিছানা, ঘুম; ঘুমিয়ে গেলেই সবাই শিশু!
গাঢ় রজনী-গন্ধ(।), মৈথুন, কামের অন্ধকার -
- ও ছেলে নয়, মেয়ে নয়; অর্ধ(নর)নারীশ্বর!

 

 

বাঙলার গান


বাঙলা বাড়ির গান, তার গলায় সাতনরি হার
ঝুনঝুন শব্দ, বাজনা; রাগের ভাব ছড়ায় সুর।

ভ্রমর ফুলের কামড়; ছেলেমেয়ে না পাগল-পাগলি
নদী থেমে থাকে, উপরে বয় মাঝি- ভাটিয়ালী।

মেঘে ঝড়ে মেঘ মল্লার, বাতাসে ঝরা পাতার রোদন
বাউল এর পোশাক- ষাঁড়ের শিং এ জাগায় জ্বলন।

লাল মাটি, ধামসা মাদল, সাঁওতালি মেয়ের দল
ও মা কোথায় চললি? রামপ্রসাদী সঙ্গে নিয়ে চল।

চোরের হাতে খুন-ঝুনি; গাইতে বলো কীর্তন
বেঁচে থাকুক গল্পকথা; ধর্ম নাকি সনাতন?

কে যায় নূপুর পরে? ঐ দিকে যায় ভেসে...
সময় হলে চুপটি করে বসবে পাশে এসে।

বসে অ-মন পাখি। এবেলা গান শোন পাখির -
ভবা ঠাকুর, লালন পাগল, রবি ফকির!

maple.jpg

জন্ম জন্মান্তর

পায়ের পাতায় নোনতা সাগর
জমাটি দুঃখ পাহাড় মাথার উপর।
জটা থেকে এঁকেবেঁকে চলে মিঠাজলা নদী ---    
জলতল বাড়ছে, খাচ্ছে খাবি !
ডুবতে ডুবতে দৃষ্টি উর্দ্ধগামী...
ঊর্ধ্বে আকাশ শূন্যে শুয়ে।
জীবনের খোঁজ - তারাতে তারাতে
কে যেন ডাক দেয়, দেয় ডাক!

ডাক ভেসে আসে হাওয়ায় হাওয়ায়
তরঙ্গ উঠে বাঁচতে চাওয়া হাতের ছোঁয়ায়।
তরঙ্গ ডাক পথ পায়, শ্বাসনালী
তারা খসে, ছাই পায় মাটি।
জন্ম থেকে জন্ম হয়; সুযোগ বুঝে দেহ ছাড়ে সবাই।
অন্তপর; আহ্নিক গতি, পরিক্রমা আকাশের বুকে!
সে মাতৃ জঠরে জঠরে টোকা মেরে ঘোরে
আবার মিঠাজলা নদী হয়ে বইবে বলে।

ছেঁড়া পাতার আওয়াজ


বাই ঘুমাই!
আমি আওয়াজ করি...
চুপ সকল,
স্বপ্ন কাজল আঁকা।
সব রাস্তা হাইওয়ে, উঁকি জীবন ছাড়া।  
বাজার ঘাট ফাঁকা
সবাই নিজের কাজ সারা।
নবজাতকের কান্না
ঢুলো চোখে- প্রতিশ্রুতি বন্যা
"আই ঘুম, যাই ঘুম, দত্ত পাড়া দিয়ে..."
দত্ত বাবু, তিনিও তো তিতি বিরক্ত
বন্ধ সদর।  কুকুরের জ্বলা চোখ।  বিড়াল ডাকা।  
অষ্ট প্রহর, পাখি ডাক।  তোমার পচা গন্ধ শোকা!    
আমার আর কাজ কি?
পাতায় পাতায় ঘোরা;
ছেঁড়া পাতায়
আওয়াজ তোলা ছাড়া।  
আমি সারা রাত আওয়াজ করি!
আওয়াজ এলো, কেউ কিছু শুনলো বুঝি?

গাছের গল্প

প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা ​

পুজো বার্ষিকী ১৪২৮ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

গল্প

গাছের গল্প

চৈতালী সরকার

morning1.jpg

'আর একটা বড়ো পেয়েছি'। দেখো দাদু, এত্ত বড়ো!' এবারে কালবৈশাখী অনেক দেরীতে এল। আকাশে কালো মেঘ জমতেই রীতিমতো উৎসবের আয়োজন। চার ভাইবোন গাছের নীচে ঝুড়ি নিয়ে হাজির। দীননাথ এই বয়সেও বাচ্চাদের সাথে ছুটে ছুটে আম কুড়োছেন। শিরদাঁড়া ঝুঁকে গেলেও নাতিনাতনিদের পাল্লা দিতে ওর জুড়ি নেই। তুতানের চিৎকারে একগাল হেসে দীননাথ ঝুড়িটি বাড়িয়ে দিলেন। 

চারকাঠা জায়গা নিয়ে বাড়ি। একটানা পাশাপাশি বেশ কয়েকটি ঘর। উঠোনের ঠিক মাঝখানে ফজলি আমের গাছটা। দীননাথ নিজের হাতে লাগিয়েছেন। সেও প্রায় একযুগ আগে !

স্কুল ছেড়ে কলেজ হোস্টেলে যাবার সময় দীননাথের খুব মনখারাপ হয়েছিল। মা-বাবা তো শুধু নয়, আমগাছটাও যে ওর বড্ড প্রিয়! আর একবার  ঝড় বৃষ্টিতে আম কুড়োনোর ধুমে জ্বর বাঁধিয়ে বসল দীননাথ। অনেকদিন কলেজ কামাই করল। তারপর যা হয়, যথারীতি গার্ডিয়ান কল!  

যেদিন প্রথম অলোকা ঘরে এল, কত প্ল্যান ছিল দীননাথের। পাকা বাড়ি করবেন। সবচেয়ে দামি রং লাগাবেন দেওয়ালে। অলোকার পছন্দ মতো শহরের বড়ো দোকান থেকে রং কিনেছিলেন। গ্রামে ইটের বাড়ি ওদের প্রথম। অনেক কসরত করে বাড়ি বানিয়েছেন। মেঠো রাস্তা দিয়ে ইট, সিমেন্ট, পাথর আনা চাট্টিখানি কথা নয়! অলোকা শখ করে বাথরুম দুটো করেছেন। চারখানা বেডরুম।

দুই ছেলে ছোটো থেকেই আলাদা ঘরে থাকে। অমর আর সমর দুজন সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্রের। অমর কিছুটা মা ঘেঁষা। সমরের ঝোঁক বাবার দিকে। একজন খেলাধুলায় ভালো, অন্যজন পড়াশোনায়। তাইতো অমর চাকরি আর সমর ব্যবসায় মন দিল।

চৈত্র মাসের অত্যন্ত গরমে অলোকা হাতপাখা নিয়ে মাদুর বিছিয়ে বিশ্রাম নেন আমগাছের নীচে। মাঝেমাঝে মৃদুমন্দ হাওয়ায় শরীর জুড়িয়ে যায়।
গালে পান পুড়ে ছুটির দুপুরে দীননাথের সাথে কত পুরোনো স্মৃতি আওড়ান। ছেলেদের বিয়ের কথা আলোচনা করেন। কখনো পাখির কিচিরমিচির শুনতে শুনতে দীননাথ ঘুমিয়ে পড়েন। এটাই যেন জীবনের পরম শান্তির লগ্ন! চোখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে তৃপ্তির রোশনাই।

নিজে পছন্দ করে অলোকা অমর সমরের বিয়ে দিলেন। নীলা পাশের গ্রামের মেয়ে। শহরের মেয়ে ছিল তনুশ্রী।

অলোকা মনে করত দুই জা হবে দুই বোন। তিনি নিজের মনের মতো করে ওদের গড়ে তুলবেন। সবচেয়ে বড়ো ইচ্ছা ছিল নাতিপুতির মুখ দেখা। তবে সব ইচ্ছা ত্যাগ করে অলোকা মাত্র দুদিনের জ্বরে চলে গেলেন। আমগাছের নীচে খাট রাখা হল। পায়ে টকটকে আলতা, সিঁথিতে রাঙানো সিঁদুরের রেখা দেখে প্রতিবেশীরা বলল, সতীসাধ্বী! 

দীননাথ নিজের হাতে গাছের ডালে দোলনা বানিয়েছেন। পাটের দড়ির সাথে কাঠের পিঁড়ি লাগিয়ে বসবার ব্যবস্থা। অনেকসময় পাশে বসে চার নাতিনাতনির খেলা দেখেন। চোখদুটো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। চশমার থেকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তিনি পুরোনো ছবি খোঁজার চেষ্টা করেন। সেই ছোটোবেলায় গাছের ডালে পা ঝুলিয়ে বসে মায়ের হাত থেকে মোয়া তুলে নেওয়া। প্রতিদিন নিত্যনতুন ছবি!

গাছের সঙ্গে আপন মনে কি যে বিড়বিড় করেন! একদিন বিল্টু বলল, 'আচ্ছা দাদু, তুমি গাছের সাথে কি কথা বলো? গাছ কি শুনতে পায়?' দীননাথ মাথা ঝাঁকিয়ে বলেছিলেন পায় দাদুভাই, সব শুনতে পায়।'

তিতলি বলল, 'আমরা তো গাছের কথা শুনতে পাই না?' দীননাথের একটাই কথা 'তোমারও পাবে, আমার মতো বুড়ো হলে।'

বাড়ির কোনো খবরই রাখেন না দীননাথ। এদিকে অন্দরমহলে ফাটল ধরেছে। সমরের ব্যবসা দিনদিন ফুলেফেঁপে উঠছে। নীলার ঠাঁটবাঁটও বেড়েছে। অমরের গোনা টাকা। তিতলি তুতানের পড়াশোনার খরচ আছে। দীননাথের পেনশনের জন্যই হয়তো এখনও হাঁড়ি আলাদা হয়নি। তবু কথায় কথায় ঝগড়া লেগেই থাকে। 
 

নীলা বিল্টু রিম্পার জন্য বেশি টাকা দিয়ে মাষ্টার রেখেছে। বড়জাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে, আমার বিল্টুকে ডাক্তার হতেই হবে। এমনি কি এত টাকা খরচ করছি। তনুশ্রীও কম যায় না। তুতানকে ও নিজেই পড়ায়। কন্ঠস্বর উঁচু করে বলে, টাকা থাকলেই পড়াশোনা হয় না। বাবামার পেটেও বিদ্যে চাই।

ঝোড়ো হাওয়ার দাপট ক্রমশ বেড়েই চলল। কালো মেঘের দমকা হাওয়ায় নিজেকে ছেড়ে দিল দীননাথ। আজ যেন সব বাঁধনহারা। মনের মধ্যে কিসের পেল সাড়া। কিছুতেই থামবে না। শুরু হল বৃষ্টি। বাচ্চারা এক দৌড়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। বৃষ্টির ফোঁটা ক্রমশ বড় হচ্ছে। সেদিকে দীননাথের হুঁশ নেই। এ কি খেলা চেপে বসেছে ওর মধ্যে। চোখের সামনে সেই স্মৃতি! মায়ের ডাকাডাকি অগ্রাহ্য করে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে আম কুড়োনোর ধুম! আজও যে থামবার জো নেই। 

ঐ একটা, আরও এক, এক থেকে দুই এইভাবে ঝুড়ি ভর্তি করতে হবে। দীননাথ ভিজতে ভিজতে আমগাছের নীচে আম খুঁজতে লাগল। কখনও নিজের মনেই বলে উঠল, অলোকা দেখো কতো আম! 'দাদু দাদু' চিৎকারের কোনো প্রত্যুত্তর নেই। এই মুহূর্তে বৃদ্ধ দীননাথ নয়, ছোট্ট দীননাথ, যুবক দীননাথ। কিছুতেই আজ তাকে থামানো যাচ্ছে না।
মাঝে মাঝে উপরের দিকে দুহাত তুলে নাচতে লাগলেন। দূর থেকে বিল্টু, তুতান দেখল অসীম আনন্দে দাদু কেমন খিলখিল করে হাসছে। এই হাসি ওরা কোনোদিন দেখেনি। দামাল শিশুর হাতপা ছুঁড়ে খেলার মতো!

ডাক্তার নাড়ি দেখে বললেন, অবস্থা খুব ভালো নয়। একটানা বৃষ্টিতে ভেজায় নিউমোনিয়া মনে হচ্ছে। রোগী ভুল বকতে শুরু করল। চারদিন আধো তন্দ্রায় কাটিয়ে পরিবারের মায়া ত্যাগ করলেন দীননাথ। আমগাছের নীচে ঠিক আগের মতো একটি খাট পাতা হল। সূর্যের প্রখর আলোকে আড়াল করে আছে আমগাছটি। দীননাথের বড্ড প্রিয় স্থান!

সেদিন বিল্টু তুতানের হাত ধরে নিয়ে গেল ওদের ঘরে। কত দামি দামি খেলনা! তুতান ব্যাটারি চালিত রেলগাড়ি ছুটিয়ে ঘরময় ছুটছে। পেছনে পেছনে  বিল্টু। ঠিক এমনসময় নীলা ঘরে ঢুকল। আজকাল ছেলেমেয়েরাও বুঝতে পারে মা জেঠিমার মনোভাব। কোনো একটা বিষয় পেলেই হল, অমনি ঝগড়া শুরু হয়ে যায়। কেউ কারোর থেকে কম যায় না। তুতান রেলগাড়ি ছেড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। নীলা বিল্টুর কান ধরে বলল, 'খেলনাগুলো ওকে যে দিয়েছিস ভেঙে গেলে কোথায় পাবি?' 

কয়েকদিন হল অমর সমর আলাদা হয়েছে। রান্নার ব্যবস্থা আলাদা হলেও বাড়ি ভাগ হয়নি। 

একদিন বাচ্চারা দেখল উঠোনে লোকের জটলা। মা জেঠিমা বারান্দায় দাঁড়িয়ে। লোকজনের মাঝখানে বাবা কাকা হাত নেড়ে বোঝাচ্ছেন। চার ভাইবোন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। দুভাগ করলে দুটো বেডরুম পাওয়া যাবে। সমস্যা এই গাছটি। উঠোনের ঠিক মাঝ বরাবর ফজলি আমগাছ। সীমানা সমান করতে এটি কাটা প্রয়োজন। গাছ কাটার ব্যাপারে অবশ্য কোনো পক্ষেরই আপত্তি নেই। 

হঠাৎই তুতানের ঘুম ভেঙে গেল জোরালো আওয়াজে। চোখ মুছতে মুছতে উঠে এল বারান্দায়। বাইরে তখন বিল্টু তিতলি রিম্পা দাঁড়িয়ে। ওরা নির্বাক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।  দুজন কালো মতো লোক আমগাছে কোদাল চালাচ্ছে। টুকরো টুকরো অংশ ছিটকে যাচ্ছে এদিক ওদিক। 

তুতান যেন পরিষ্কার দেখতে পেল দাদু জড়িয়ে ধরে গাছটিকে। দাদুর শরীর ক্ষতবিক্ষত। হাত পা আলাদা হয়ে যাচ্ছে দেহ থেকে। তবু আপ্রাণ চেষ্টায় জড়িয়ে ধরে আছে গাছটি। দাদু কি কিছু বোঝাতে চাইছে ওদের! কেউ শুনছে না। ওরা একের পর এক কোদালের ঘা মারছে দাদুর গায়ে। হাত পা আলাদা হয়ে যাচ্ছে দেহ থেকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই উপড়ে পড়ল গাছের ওপরের অংশ। তুতান দেখল দাদুও লুটিয়ে পড়েছে ভূমিতে। কেউ কি দেখতে পাচ্ছে না! ঐ তো, ঐ তো শুয়ে আছে দাদু। রক্তে ভিজে যাচ্ছে শরীর। ঠিক এইসময় তুতানের মুখ থেকে অস্ফুটে বেরিয়ে এল, দাদু! 

ততক্ষণে আমগাছের দেহটি নিয়ে শুরু হয়ে গেছে দরকষাকষি।

বেঁচে থাকার গান

প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা ​

পুজো বার্ষিকী ১৪২৮ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

গল্প

বেঁচে

থাকার গান 

সুশোভন দাশ

ফিনল্যান্ড

village.jpg

ভার-ব্রিজের নীচে এক তাল দলা পাকানো কাদার মতো শুয়ে আছে প্রায় জনা পঞ্চাশেক শ্রমিক। তাদের দেহে স্পন্দনের নূন্যতম আন্দোলনটুকুও যেন হারিয়ে গেছে। অনেকের খালি গা আবার অনেকের গায়ে জামা বা গেঞ্জি জাতীয় কিছু আছে। কিন্তু দূর থেকে তাদের জামা ও গায়ের রঙ মাটির সাথে একেবারে মিশে গিয়ে আলাদা করার এতোটুকুও সুযোগ রাখেনি। স্ট্রীট ল্যাম্পের আলো সরাসরি তাদেরকে ছুঁতে পারেনি। আবছা অন্ধকারে বহুদিন চাপা পড়ে থাকা ঘাসের মতো ফ্যাঁকাসে আবরণ তাদেরকে ঢেকে রেখেছে। মাটিতে কান পাতলে অনেক দুরের শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। এখানেও তার অন্যথা হল না কিন্তু যে শব্দ শুনতে পাওয়া গেল তা সেই ঘুমন্ত শ্রমিকদের সম্মিলিত হৃৎস্পন্দন নয়। তা তাদের আগামী দিনের চিন্তার; না না, দুশ্চিন্তার চিৎকার। সেই চিৎকারে নেই কোনো বাহুল্যতা, নেই কোনো সুবিধাবাদীদের সুযোগ বাড়ানোর অজুহাত, নেই কোনো স্বপ্ন পূরণের স্বার্থপরতা। শুধু আছে বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে মানুষের আদিম চাহিদা খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থানের লড়াই।    
ভোরের আলো পূব আকাশের অন্ধকার চিরে বেরিয়ে আসতেই সেই কাদার তালে লেগে গেল এক ক্ষিপ্র চঞ্চলতা। ক্ষণকালের জন্য কিছুটা বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে পড়ে আবার তারা একজায়গায় জড়ো হয়ে বসল। ফাগুনের আগুন এখনো অতোটা তীব্র হয় নি। কিন্তু ভোরের আলোয় তাদের গা থেকে চুঁইয়ে পড়া পোড়া তামাটে রঙ অনেক আগুনের সাক্ষ্য প্রমাণ দিচ্ছে। নিষ্পলক চোখে একটা অজানা আশঙ্কা জমাট বেঁধে থমকে গেছে ঠিক যেমন ঝড়ের আগের নিষ্প্রাণ নীরবতা। ভোরের আলো লিখে দেয় এক নতুন দিনের সূচনা, এঁকে দেয় আশায় ভরা জলছবি। কিন্তু এখানে নতুন দিনে সূচনায় কে যেন থাবা বসিয়েছে জলছবিতে। আঁচড়গুলো এতটাই গভীর যে ভবিষ্যতের দিনের উপরেও তার দাগ রাখতে উদ্ধত। কপালের প্রতিটা ভাঁজে ভাঁজে তাদের একটাই প্রশ্ন-বেঁচে থাকার লড়াইয়ে এবার কি হাতিয়ার ফেলে আত্মসমর্পণ করতে হবে? 
সকাল সাতটায় গির্জার ঘণ্টা বাজার একটু পরেই প্যান্ট-শার্ট পড়া এক ভদ্রলোক মুখ-নাক একটা মাস্কে ঢেকে শ্রমিকদের থেকে প্রায় দশ হাত দূরে দাঁড়িয়ে যা বললেন তা আক্ষরিক অর্থে- ‘করোনা নামক এক সংক্রামিত রোগের কারণে এখানের কাজ আপাতত এক মাসের জন্য স্থগিত থাকবে। তবে পরিস্থিতি দেখে এর মেয়াদ আরো দীর্ঘায়ীত হতে পারে। তোমাদের যা পাওনা তা অফিস রুমে এসে নিয়ে যাও।‘
একটা গুঞ্জন ধীরে ধীরে বাড়তে থাকল। তাদের মাঝ থেকে এক যুবক দাঁড়িয়ে প্রতিবাদী ভঙ্গিতে জিজ্ঞাসা করল,- ‘কিন্তু আমাদের এখানে আনা হয়েছিল ছ’মাসের কাজ আছে বলে। তিন মাসও হল না তার মধ্যে আমাদের এমন ভাবে কাজ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে কেন?’
ভদ্রলোকটি এবার মুখ থেকে মাস্কটা সরিয়ে বললেন,- ‘এখানে কাজ বন্ধ থাকবে। কাউকে কাজ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে না। কিন্তু যদি কাজটাই না থাকে তাহলে তোমাদের মুখ দেখে তো আর কেউ টাকা দেবে না। আর কাজটা কোম্পানি বন্ধ করছে না, একেবারে প্রধানমন্ত্রী-মুখ্যমন্ত্রী থেকে অর্ডার এসেছে।‘ কথাগুলো বলেই ভদ্রলোক মাস্কটা আবার মুখে আটকে নিয়ে উল্টো দিকে হাঁটা দিলেন। গুঞ্জনটা একটা সোরগোলে পরিণত হল আর একে একে তা একটা লাইন করে অফিসের দিকে এগোল।
প্রায় আড়াই হাজার টাকা পেল সুধীর। খুচরোগুলো জামার পকেটে রেখে দুটো কড়কড়ে দু-হাজার টাকার নোট সঞ্চিত টাকার বান্ডিলে মুড়ে চোরা পকেটে চালান করে দিল। টাকা নিয়ে সবাই এদিক-ওদিক ছড়িয়ে পড়ল। বাঁধাধরা এক চায়ের দোকানের দোকানী অনেকটা বেলা করেই তার দোকান খুলল আজ। অন্যান্য দিন কাজের তাড়া আর ওভার টাইমের জন্য বলে সুধীর খুব বেশি সময় কাটায়নি এখানে। আজ আর কাজের কোনো তাড়া নেই তাই সকালের জল-খাবারের জন্যেও দোকানীকে বলল। কয়েক মিনিট পর দুটো সেঁকা পাঁউরুটি আর এক কাপ চা প্লেটে করে এগিয়ে দিল তার দিকে। সুধীরের সাথে আরো অনেকেই সেখানে খেতে এসে গল্প করছিল, কিন্তু টিভির সংবাদ দেখে তারা সবাই হঠাৎ চুপ করে গেল। সারা দেশে লকডাউন। বাস-ট্রেন কিছুই চলবে না। অন্যান্য দেশের মানুষের মুখে মাস্ক ঠিক যেমনটা আজ সকালে ওই ভদ্রলোকের মুখে ছিল। অনেক মানুষ মরে যাচ্ছে। বিশ্বের তাবড় তাবড় দেশের মাথারাও খুব আতঙ্কে আছে। তাদের মধ্যে চীন ও ইতালির নাম বার বার করে বলছে। আর যে কথাটা সব থেকে বেশি বার শুনল তা হল করোনা ভাইরাস। 
চা-খাবার শেষ করে সবাই বাস স্টপে এলো। অন্যান্য দিন রাস্তায় বাস-লরির অভাব হয় না কিন্তু আজ কিছু খাম-খেয়ালী ট্যাক্সি আর বাইক ছাড়া অন্যকিছু চোখে পড়ল না। একটা ট্যাক্সিকে দাঁড় করিয়ে সুধীর হাওড়া যাওয়ার কথা বলতে ড্রাইভার বলল,- ‘হাওড়া প্রায় আট-দশ ঘন্টার রাস্তা। এই বন্ধের বাজারে একেবারেই না। পাঁচ-দশ কিমির মধ্যে হলে বলুন নিয়ে যেতে পারি।’ সুধীর আর কথা বাড়াল না। মনে মনে ভাবল,- ‘পাঁচ-দশ কিমি হলে আমি নিজেই হেঁটে চলে যেতাম।‘ এলাকার দেড়-দু কিলোমিটারের মধ্যে একটা বড় বাস টার্মিনাল আছে। সবাই সেই বাস স্টপের দিকে হাঁটা দিল। এখানে অনেক মানুষ ভিড় করে আছে টিকিট কাউন্টারের সামনে। চেঁচামেচি করছে তাদের টিকিট নিয়ে। কিন্তু একটা বাসও আজ ছাড়ছে না। একটা টিভি দোকানের বাইরে দাঁড়িয়ে দেখল কলকাতায় পুলিশ নামিয়েছে। লোকজন বাইরে বেরোলেই পুলিশ লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছে আর তাড়া করছে। সারা রাজ্যেই নাকি এমন পুলিশ নামিয়ে দেবে। টিভিতে এমন পরিস্থিতি দেখে তার সবাই একে অন্যের মুখের দিকে তাকাল। কয়েক জন বলে উঠল,- এখানে আটকে গেলে থেকে যাব এখানে। বাড়ির বাইরে থাকা, এ আর নতুন কিছু নয় আমাদের কাছে।‘
সুধীর এখানে চুপ করে সবার কথা শুনল আর মনে মনে বেশ প্রমাদ গুনলো। সে প্রতি মাসে একদিন ছুটি নিয়ে বাড়ি আসে টাকা দিতে। বাড়িতে তার মা বৌ ও চার মাসের মেয়ে। বৌয়ের পক্ষে এখন অন্যের বাড়িতে কাজ করা একেবারেই অসম্ভব। তাই টাকা তাদের হাতে না দিলে তারা না খেয়েই মারা যাবে। যে ভাবেই হোক হাওড়া পৌঁছাতে পারলে বাড়ি ফেরার একটা আশা থাকে। না হলে যে কি হবে, তা তার চিন্তার বাইরে। অনেকে ঠিক করল হাইওয়ে ধরে হাঁটা দেবে বাড়ির উদ্দেশ্যে। কিন্তু সবাই একমত হল না। বাস-লরির অপেক্ষায় কিছুজন বাস টার্মিনালে থেকে গেল আর বাকিরা হাঁটা শুরু করল হাইওয়ে ধরে। সুধীরও হাঁটা দিল তাদের সাথে। একটু পরেই সূর্য মাঝ আকাশে এলো। অনেকেই এর মধ্যে ক্লান্ত হয়ে হাঁটার সিদ্ধান্ত থেকে সরে গিয়ে আবার বাস টার্মিনালে ফিরে যাওয়ার কথা ভাবছে। তিন কিলোমিটার পথও হেঁটে আসেনি এখনো আর এর মধ্যেই সব উল্টো সুরে গান ধরেছে দেখে সুধীরের বেশ রাগ হল। কয়েকবার একটু জোর গলায়,- ‘না না বাড়ি ফিরতেই হবে থামলে হবে না’ বলায় অনেকেই তাকে পাল্টা মেজাজ দেখিয়ে বলল,- ‘তোর এতোই যদি দম থাকে তাহলে না হেঁটে তুই দৌড়ে বাড়ি যা। আমরা ভাবছি বাস টার্মিনালেই ফিরে যাব’।

রাস্তার পাশে একটা ছোটো ধাবা দেখে সবাই সেখানে ঢুকলো একটু কিছু খেয়ে নেওয়ার জন্য। সুধীর একটু ইতস্তত করে ধাবার পাশের দোকান থেকে এক প্যাকেট মুড়ি কিনে গলার গামছার সাথে বেঁধে নিল। সবাই অল্প-বিস্তর কিছু খাবারের অর্ডার দিয়েছে ধাবায়। কিন্তু সুধীর কিছু অর্ডার না দিয়ে খাটিয়ার ধারে চুপ করে পা ঝুলিয়ে বসে আছে। তাদেরই দলের একজন বয়স্ক মানুষ সুধীরকে বলল,- ‘একটু কিছু খেয়ে নে। না হলে হেঁটে বাস টার্মিনালেও ফিরতে পারবি না।

’সুধীর মুখ নীচু করেই ঘাড় নাড়তে নাড়তে বলল,- ‘আমি বাস টার্মিনালে ফিরে যাব না।‘ ইতিমধ্যে এক ট্রাক ড্রাইভার ও তার সঙ্গী ভালো করে খেয়ে লুঙ্গিতে হাত মুছতে মুছতে নিজেদের মাল বোঝাই করা লরির দিকে গেল। ধাবার সামনের খোলা জায়গায় একরাশ ধুলো উড়িয়ে চারদিক অন্ধকার করে বড় রাস্তায় উঠল। ছোটো গাড়িগুলো পাকা রাস্তা পেলেই গতি বাড়িয়ে দেয় কিন্তু মাল বোঝাই করা এতো বড় লরি পাকা রাস্তাতেও বেশ ধুঁকিয়ে ধুঁকিয়ে চলতে লাগল। ধাবার সবাই সেদিকে লক্ষ্য না দিয়ে নিজের নিজের কাজ ও গল্পে মেতে রইল। কিন্তু এর মাঝেই হঠাৎই একটা ঘটনা ঘটে গেল। পাকা রাস্তা ধরে লরিটা একটু এগোতেই সুধীর দৌড়ে গিয়ে লরির পিছনে মাল বেঁধে রাখা দড়ির সাথে ঝুলে গেল। তারপর ধীরে ধীরে দড়ি ধরে একেবারে লরির উপরে গিয়ে শুয়ে পড়ল। যে বয়স্ক লোকটা সুধীরকে খাওয়ার কথা বলছিল সে হতভম্ব হয়ে ‘সুধীর চলে গেল চলে গেল’ বলে চিৎকার করে উঠল। তার চিৎকারে সবাই এদিক-ওদিক দেখে বুঝল সুধীর নেই। তারপর লোকাটার কাছে সুধীরের দৌড়ে লরির পিছনে উঠে যাওয়ার কথা শুনে সবাই রাস্তার ধারে এসে লরিটাকে দেখার চেষ্টা করল। ততক্ষণে লরি বাঁক পার হয়ে হাইওয়ে ধরে নিয়েছে। আর দূর থেকে লরির মাথায় কেউ আছে তা বোঝাই গেল না। 

লরির গতি খুব একটা বেশি না হলেও ফাঁকা মাথার উপর হাওয়া সুধীরকে বেশ নাজেহাল করে দিল। মাথার উপর সূর্যের তাপ প্রখর তবু সে নিজের শরীরে খুব ঠান্ডা অনুভব করল। দুপুরে কিছু খাওয়া হয়নি তার তাই খিদেটাও বেশ জোরে লেগেছে। ধাবায় বয়স্ক লোকটার কথা তার খুব মনে পড়ল। একটু কিছু খেয়ে নিলে তখন ভালই হত। কিন্তু খেতে গেলে এই লরিটা আর ধরা যেত না। তার ব্যাগের ভিতর মুড়ি আছে কিন্তু লরির ছাদে শুয়ে শুয়ে কি ভাবে খাবে তা বুঝে পেল না। এই অবস্থায় মুড়ি বের করলে হাওয়ায় উড়ে যাবে সবটাই। পেটে কিছুই যাবে না। খাওয়ার চিন্তা বাদ দিয়ে বাড়ির কথা ভাবতেই সকালের খবরের দৃশ্যগুলো তার চোখের সামনে ভেসে উঠল। মাথা তুলে রাস্তার দিকে তাকিয়ে সে কিছুই বুঝল না। লরি হাইওয়ে ধরে ছুটে চলেছে। আশে-পাশে দোকান-প্রসারী বলতে কিছুই নেই। দু-একটা গাড়ি হুস-হুস শব্দ করে তার পাশ দিয়ে চলে গেল। তাড়াতাড়ি করে সে মাথা নামিয়ে নিল। সময় যত কাটছে তার ততই ঠান্ডা লাগছে। নিজের ব্যাগ থেকে চাদরটা কোনো ভাবে বের করে মাথা-গলার সাথে খুব ভাল করে বেঁধে নিল ঠান্ডা হাওয়া আটকানোর জন্য। কিন্তু পেটের খিদে তার শরীরকে ক্রমশ আরো ঠান্ডা করে দিচ্ছে। 
হঠাৎ করে লরিটা একটা জায়গায় থেমে গেল। উঁকি মেরে সে দেখল জায়গাটা একেবারে ফাঁকা। কোনো টোল ট্যাক্স বা পুলিশের রাস্তা আটকানো নয়। এই সময় লরির ড্রাইভার ও খালাসী লরি থেকে নেমে রাস্তার ধারে খালের কাছে নেমে গেল। মিনিট দু-তিন পর তারা আবার লরিতে ফিরে এলো। এই অল্প সময়টুকুর মধ্যে সুধীর তাড়াতাড়ি করে নিজের ব্যাগ থেকে মুড়ি বের করে গোগ্রাসে যতটা পারল খেয়ে জলের বোতল থেকে একটু জল নিয়ে গলাটা ভিজিয়ে নিল। অনেকটা সুস্থ বোধ করছে সে এখন। বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা নেমেছে। লরির ছাদে শুয়ে শুয়ে ভাবল- এইভাবে হাওড়া পর্যন্ত চলে গেলে মাঝ রাতের মধ্যে সে বাড়ি ঢুকে যাবে। এমন সময় সে বুঝল লরি এবার ধীরে ধীরে গতি কমিয়ে দিয়ে খুব ধীরে ধীরে এগোচ্ছে। মাথা তুলে দেখল সামনে টোল ট্যাক্স। এখানে ক্যামেরা থাকে। যদি ধরা পড়ে তাহলে এখুনি তাকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে। একবার ভাবল সে লরি থেকে নেমে হেঁটে রাস্তার পাশ দিয়ে টোল ট্যাক্স পার হয়ে যাবে। পরক্ষণেই ভাবল একবার যদি লরি থেকে নামে তাহলে আর সে লরিতে উঠতে পারবে না। সাত-পাঁচ ভেবে সে নিজের চাদরটা দিয়ে আপাদমস্তক ঢেকে একেবারে মড়ার মতো শুয়ে রইল। কতক্ষণ সে এভাবে ছিল জানে না। লরির গতি যখন আবার বাড়ল তখন সে মুখের উপর থেকে চাদর সরিয়ে আকাশের তারা দেখতে পেল। 
টোল ট্যাক্স পেরিয়ে একটু সময় যেতে না যেতেই লরি হাইওয়ে থেকে নেমে একটা ধাবার সামনে দাঁড়াল। ড্রাইভার ও খালাসী যথারীতি একসাথে নেমে ধাবায় ঢুকলো খাবারের জন্য। একটু সুযোগ বুঝে সুধীর লরি থেকে নেমে বোতলে জল ভরতে এলো। ধাবার টিভিতে এবার খবর দেখে তার হাত-পা অসাড় হয়ে গেল। পুলিশ নেমেছে সব জায়গায়। একটা শ্রমিকের দলকে আটক করে তাদের উপর কীটনাশক ছড়ানো হচ্ছে। এক পলকে সেই শ্রমিকের দল দেখে সুধীরের চিনতে ভুল হল না। এই দলটা থেকেই সে সকালে ছিটকে বেরিয়ে এসেছে। জল ভরে নিয়ে লরির পিছনের অন্ধকারে গা ঢাকা দিল সে। সেখানেই সে আরো কিছুটা মুড়ি আর জল খেয়ে লরির উপর খুব সাবধানে উঠে শুয়ে পড়ল। টিভির সংবাদ, বাড়ির চিন্তা আর সারাদিনের ক্লান্তিতে কখন যে তার চোখ বুজে এসেছিল তা সে টের পায়নি। কতক্ষণ সময় কেটে গেছে তার কোনো হদিস ছিল না তার। হঠাৎ লরি চলা শুরু করার ঝাঁকুনিতে তার ঘুম ভাঙল। দু-হাত দিয়ে দড়ি শক্ত করে ধরল। ঝাঁকুনি আর ঠান্ডা হাওয়ায় তার ঘুম কেটে গেল। আর বেশি পথ বাকি নেই। টিভিতে পুলিশের কর্মক্ষমতা দেখে সে বুঝে গেছে হাওড়ায় নামা যাবে না। তাকে সুযোগ বুঝে আগে নেমে পুলিশের নজর বাঁচিয়ে বাড়ির পথ ধরতে হবে। লরি হাইওয়ে ছেড়ে শহরের রাস্তায় ঢুকেছে। জায়গাগুলো তার সব চেনা। ফাঁকা রাস্তা তাই লরি ভালো গতিতেই লিলুয়া পেরিয়ে গেল। সালকিয়া মার্কেট পেরিয়ে একটা বাঁকের মাথায় লরিটা একটু আস্তে হতেই সুধীর লাফিয়ে নেমে পড়ল। পথ-ঘাট সব শূন্য। এমন কিছু রাত হয়নি কিন্তু জনমানব হীন রাস্তার অস্বস্তিকর নীরবতা তার মনে একটা ভয়ের সঞ্চার ঘটাল। 
মানসিংহপুর এখান থেকে অনেক দূর। রাস্তার নির্জনতা দেখে গাড়ি পাবে সে আশা তার একেবারেই মরে গেল। কিন্তু বাড়ি তাকে যেতেই হবে। কোমরে গামছাটা ভাল করে বেঁধে নিয়ে চাদরটা খুব শক্ত করে জড়িয়ে নিল। তারপর রাস্তা ছেড়ে গলি পথ ধরে একেবারে রেল লাইনের ধারে। রেললাইন পার হওয়ার সময় কয়েকজন পুলিশের নজর পড়ে তার উপর। তারা টর্চের আলো ফেলতেই সুধীর দৌড় দিল। তাড়াতাড়ি রেললাইন পার হয়ে নেমে এলো জলা-জমির উপর। পুলিশের দল কিছুটা তার পিছনে ধাওয়া করে হাল ছেড়ে দিল। দূরে রাস্তার আলোর দিকে চোখ রেখে সুধীর এগিয়ে যেতে লাগল। অসময়ে বৃষ্টির জমা জল-কাদায় কয়েকবার পড়ে গিয়েও সে এগিয়ে যেতে থাকল। তার সারা শরীরে কাদার ছিটে। কোমর থেকে পা একেবারে কাদায় মাখামাখি। একবার সে রাস্তার ধারে উঠে এসেছিল রাস্তা দিয়ে হাঁটবে বলে, কিন্তু সেখানেও পুলিশের গাড়ি যাতায়াত করছে দেখে আবার জলাজমিতে নেমে এলো। প্রায় অবচেতন ভাবে কতক্ষণ যে হেঁটেছে তার ঠিক নেই। একটা সময় সে দেখল আকাশ একটু একটু করে পরিষ্কার হয়ে আসছে। পাখিদল কিচিরমিচির করতে করতে উড়ে যাচ্ছে। দূর থেকে নিজেদের গ্রামের সীমানা দেখে সে লাফিয়ে উঠল। তাড়াতাড়ি করে সে জমির আল ধরে ছুটতে থাকল। কিছুটা যেতে না যেতেই সে হাঁপিয়ে গিয়ে গতি কমিয়ে হাঁটতে লাগল। দিনের আলো বাড়তেই দূর থেকে কয়েকজনের দেখা পেল। কাল রাত থেকে পুলিশের পর এই প্রথম সে কোনো সাধারণ মানুষের দেখা পেল। জলা-জমি পেরিয়ে মাঠের এক প্রান্তে শুরু হয়েছে বাজার। মাঠ পেরিয়ে যখন সে বাজারে ঢুকলো তখন প্রায় সাতটা বাজতে চলেছে। বাজারের দু-এক জন তাকে দেখে চিনতে পেরে তার ফেরার খবর জানতে চাইল। সুধীরের মুখ থেকে ‘এইতো কাজ থেকেই ফিরছি’ শুনে অনেকে তার দিকে সন্দেহের দৃষ্টি দিল। সবার মুখে মাস্ক শুধু মাত্র সে বাদে। তাই একটা গন্ডগোলের আভাস পেতেই আর কথা না বারিয়ে সে তাড়াতাড়ি বাড়ির পথ ধরল। মোড় মাথায় আসতেই দু-টো মাস্ক পরা পুলিশ হঠাৎ করে একেবারে তার দশ হাতের মধ্যে চলে এলো। তার কাদা মাখা পোশাক আর মুখে মাস্ক নেই দেখে পুলিশ দুটো তার দিকে এগোতে থাকল। সুধীর তাড়াতাড়ি করে দৌড় দিল বাড়ির দিকে। কাল থেকে সারাদিন সে টিভিতে যা খবর দেখেছে তাতে সে এটা বুঝে গেছে যে মাস্ক ছাড়া বাড়ির বাইরে বেরলে পুলিশের মার অবধারিত আর বাইরে থেকে কেউ ফিরলে তাকে চিকিৎসার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে, না হলে এই অজানা রোগ পরিবারের সবাইকে ধরবে। 
বাড়ির একেবারে কাছে এসে সুধীর খুব জোরে জোরে মা আর বৌকে ডাকতে থাকল। সকাল সকাল এমন ডাকাডাকি শুনে তার মা বেরিয়ে এলো বাড়ির সামনে। পিছন পিছন তার বৌ ও এলো চার মাসের মেয়েকে কোলে নিয়ে। নিজের পরিবারকে দেখে সুধীরের মন আনন্দে ভরে গেল। খুব ইচ্ছা করল তার মেয়েকে সে কোলে নিয়ে একটু আদর করবে। কিন্তু সে বাঁশের বেড়ার কাছে এসে থেমে গেল। পুলিশ দু-টো তখন দৌড়ে আসছে তার দিকে। হঠাৎ সুধীর ঘুরে দাঁড়িয়ে তাদের দিকে হাত তুলে জোর গলায় বলল,- ‘দাঁড়াও। আমি তোমাদের কাছে আসছি এখুনি।‘ আচমকা এমন কথা শুনে পুলিশ দু-টো থমকে দাঁড়িয়ে গেল সেখানেই। কালবিলম্ব না করে সুধীর নিজের চোরা পকেট আর জামার পকেট থেকে সব টাকা বের করে বেড়ার মাথার উপর রেখে দিয়ে মা কে বলল,- ‘এগুলো ভালো করে ধুয়ে শুকনো করে তারপর ব্যবহার করবে। আমি দিন পনেরো পরে ফিরব। ভয়ঙ্কর রোগ হচ্ছে সবার। খুব সাবধানে থাকবে।’

কথাগুলো বলেই সুধীর পুলিশদের দিকে এগিয়ে গেল।
সুধীরের বৌ উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞাসা করল,- ‘তুমি চললে কোথায়? বাড়ি আসবে না?’
সুধীর হাসতে হাসতে বলল,- ‘জেলে যাচ্ছি না রে। ডাক্তারখানায় যাচ্ছি। বাইরে থেকে আসলে ডাক্তার দেখিয়ে তবেই ঘরে ঢুকতে পারব। এটাই এখন নিয়ম।‘
একটা পুলিশ তার লাঠির দিয়ে সুধীরের পেটে খোঁচা মেরে বলল,- ‘তোর জ্ঞান বেশ টনটনে তবে আমাদের দেখে ছুটলি কেন?’
সুধীর হাত জড়ো করে বলল,- ‘বাবু আমার এদিক-ওদিক করে ঠিক চলে যাবে কিন্তু ওদের টাকা না দিলে যে ওরা না খেতে পেয়ে মারা যাবে। চার মাসের মেয়ে আমার। ওদের খাবারের যোগাড় না করে আপনাদের সাথে যাওয়াটা কি ঠিক হবে বলুন?’

সুধীরের কথায় পুলিশ কর্মচারী দু-জন তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বলল,

-‘চল এবার তোকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই।’     

কবিতাঃ সন্দীপ ব্যানার্জী

পুজো বার্ষিকী ১৪২৮ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

কবিতা

সন্দীপ ব্যানার্জী

কবিতাঃ সাইদুর রহমান

বসন্ত আসে তাই 


মাঘের শুষ্ক হাওয়ার মতো
হা হুতাশ দিন চলে যায়।
চায়ের কাপে বাষ্প জমে মেঘে,
অশ্রুর মতো বৃষ্টি হয়ে ঝরে;
নিস্তব্ধ ডেকে যায় সারা দুপুর,
ভাত ঘুমের ব্যাঘাত হয়না বলে;
স্বপ্নের মাঝে হেঁকে যায় ফেরিওলা,

স্বপ্ন শেষে চোখ যে যাবে খুলে।

আর বসন্ত দাঁড়িয়ে পাশের গাঁয়ে

আমার ডাকের অপেক্ষা নিয়ে চোখে

                                           

অকালে একটি কোকিল পাঠিয়ে দিয়ে,
ফিসফিসায় জানলার পাশে এসে।
পাতা ঝরার কষ্ট বুকে নিয়ে,
যে দেহটি দাঁড়িয়ে থাকে মাঠে;
ঝরাতে চাইনা, তবু তো যায় ঝরে,
শুধু কালকে বসন্ত আসবে বলে!
বসন্ত আসে, বসন্ত আসবে তাই,
প্রত্যেক বার সব পাতা ঝরে যায়!
কেও যদি চায় পুরোনো পাতায় থাকুক,
কেও যদি বলে, সব বসন্ত এক;
তবে কি তা নিয়ম ভঙ্গ হবে?
সবাই কি আর নতুন বসন্ত চায়!
                  

maple.jpg

পুজো বার্ষিকী ১৪২৮ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

কবিতা

মোঃ সাইদুর রহমান সাঈদ

পটুয়াখালী,বাংলাদেশ

আমরা চারজন

❝কৈফিয়ত❞

বার প্রিয় হয়ে উঠার রোমাঞ্চিত-চেষ্টা__

বহুবছর হয়েছে ছেঁড়ে দিয়েছি!

তাই তো আমার শুধু "পালাই পালাই"!

আগের মত নেই আর অনাবিল-ঝর্ণার চঞ্চলতা__

দমিয়ে রাখি!!

 

বেশ অগোছালো!

 

সবসময় পারফেক্ট হয়েই থাকতে হয় না,

হতে হয় না একরোখা সহজ!

ঝর্ণার ঝিরি আকাঁবাকা,

আঁকাবাঁকা নদী আর সাগরগুলোই...  

শুকনো এ ধুলির ধরায় প্রাণ-সঞ্চারণের মাধ্যম।

বছরের বারোটা মাসই কি তুমি দেখতে পাও...

শরতের অমলিন শুভ্র মেঘমালা?

ফুলেফুলে সারামাস বসন্তের পসরা সাজে রয় না! 

ঝড় আসে,

বাদল ঝরে,

টিপটিপ শিশির পড়ে...পুকুর কিবা চালে..নুপুর বাজায়!

কখনো বাঁধ ভেঙে দমকা  হাওয়া হয়! 

এর নিয়ন্ত্রণ নিজ বিনা অন্যের হাতে সপতে নেই। 

কারণ,তারাই একে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে মিলিয়ে যায়! 

তাই, সবার হতে আড়াল করি_নিজেকে

গুটিয়ে নেই নিগূঢ়-কৃষ্ণ ব্লাকহোলে! 

অন্ততঃ যারা আমার শৈশবদ্রষ্টা

তারা জানে, আমি কি-দারুণ উন্মাদ-চঞ্চল!

মনে রেখ,সবাই নিথর-নিঃস্তব্দ-শান্ত স্বভাবের হয় না, 

কাউকে নিষ্প্রাণ ব'নে রইতে বাধ্য হতে হয়......

কিছু অভিমান,কিছু অপমান,আর কিছু আশাবাদীতার দরুণ!

 

আমার 'করুণ'-এ আমার-আমি সত্যই পাষান-নিদারুণ!!!

 

তবু বলি,ভালোবাসি এ কোলাহল,

ভালোবাসি জীবন নামের এ মৃত্যু!

ভালবাসি তোমায়, মায়াবী-লোচনা সে সুচতুর!

 

যদি ফুল হয়ে ফুটি তব বাগিচায়

রাখিও নয়নে নয়ন!

যদি ঝরি হায়,

তুলে নিও ফুল,

ভুলিও ভোরের মতন!! 

মাঝেমধ্যে রুক্ষবেশ ধরা অন্যায় কিছু নয়! 

তা-ও জীবনের অঙ্গ।

উপভোগ করতে হবে! 

আজো, অপ্রিয় হয়ে থাকার ব্যস্ত-অভিনয়ে

আমিই ভুলেই বসেছি প্রায় __যে,

কারো প্রিয় হতে পারি...

কোন হরিণীর সকরুণ-চকিত-ব্যগ্র দুটি চোখ

আমায়ও করে নিতে পারে প্রিয়! 

বন্ধুদের পশলা-আড্ডাতে... আমিও কারো__চকিত

মৌন সজাগ-দীঠির জ্বলজ্বল করে উঠা শুকতারার কারণ!! 

কেউ আমার কথা আঁকতে পারে....

ক্যানভাসের পিছন থেকেও!'

জানি, আমি জানি!কেউ আছে 

আত্মার মতো গোপন প্রায়.......

সে মরুছায়ার কোন এক মায়াজাল!

কিন্তু, আমি যে,

প্রিয় হয়ে উঠার চেষ্টা_বহুকাল হলো ভুলে গেছি!

 

আমি জানি,প্রিয় থাকার স্বরূপ-

তুলে দেয়া চির-চঞ্চল মাংসপিণ্ডটি!

আমি দেখেছি,

প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা ​

পুজো বার্ষিকী ১৪২৮ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

গল্প

আমরা

চারজন

রীনা নন্দী

কলকাতা

ladies.jpg

ই গল্পটা আমাদের চারজনকে নিয়ে। চারজন মানে পাশের বাড়ির জগত্তারিনী বউদি, আমি -- মানে পনেরো নম্বরের বয়স্কা পিসি, সামনের বাড়ির চন্দ্রিমা আর ওরই লাগোয়া বাড়ির বিনি কাকিমা। এই চারজন মহিলার সামাজিক অবস্থান, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, বয়স , শারীরিক ও মানসিক গঠন, গড়ন -- সবই আলাদা। এমনকি কথা বলার ধরণ, পছন্দ অপছন্দের বিষয় -- সেসবও আলাদা।  তবুও আমরা কিন্তু বন্ধু।  কাজকর্মের ফাঁকে ফাঁকে মাঝে মাঝেই আমরা বারান্দায় এসে দাঁড়াই। টুকটাক কথা বলি, হাসি ঠাট্টায় মাতি। কখনো সখনো বাগবিতন্ডাতেও জড়িয়ে পড়ি -- তারপর আবার নিজেদের দৈনন্দিন সংসারে ফিরে যাই। নিজের নিজের সংসার সামলাই। ব্যক্তিগত জীবনযাপনে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। এটাই আমাদের ডেলি রুটিন বলা যায় । 

আমাদের গল্পগাছা খুব যে সারগর্ভ কি উচ্চমার্গের -- তাও নয়। নিতান্তই কেজো, মেয়েলি ধরনের। তবে বিশ্বসংসারের ছোঁওয়াও তাতে লেগে থাকে। এইসব গল্প, আড্ডা, সাধারণ কথার মাঝেই কখনো সখনো তুফান ওঠে আমাদের মধ্যে। কথা বন্ধ হয়। একপক্ষ বারান্দায় এসে অন্য দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকে; অন্যপক্ষকে দেখেও দেখে না। অন্যের সমস্যা কানে এলে শুনতে খুব ইচ্ছে করলেও জোর করে শোনে না; ঘরে ঢুকে যায়। তারপর হঠাৎ করেই একদিন আবার মনোমালিন্য মিটে যায়। অবরুদ্ধ ঝর্ণার জলের মত দুই বারান্দায় দাঁড়ানো প্রতিবেশিনী কথা বলতেই থাকি। বলতেই থাকি। আর অন্য দুই বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা অপর দুই প্রতিবেশিনী মনে মনে যেমন স্বস্তি পায়; তেমনি আবার নিঃশব্দে আওড়ায় -- আদিখ্যেতা!  

এইসব ছুটকো ছাটকা মনোমালিন্য সত্ত্বেও আমরা চার মহিলা একে অপরকে সবচেয়ে ভালো চিনি, ভালো বুঝিও। বলতে গেলে, কিছুটা বিকর্ষণ আর অনেকটা আকর্ষণ কাজ করে আমাদের মধ্যে। 

সেদিন গল্পগাছা চলছিলো, তার মধ্যেই কিছুটা অনিচ্ছাকৃতভাবেই একটু নিষ্ঠুরতা ঘটে গেলো। সামনের বাড়ির চন্দ্রিমা, কিছুটা আমার আমার করে। বিশেষ করে ওর ছেলে বিধানকে নিয়ে এই 'আমার আমার' মুদ্রা দোষ কখনো কখনো উচ্চমাত্রা ছুঁয়ে যায়। ওর ক্লাস টুয়েলভে পড়া ছেলে যে কতটা মাতৃভক্ত, মাকে চোখে হারায় সেটা সে সাতকাহন করে বলছিলো। 

জানো তো মনোপিসি আমার ছেলেটা এখনো কি মা ঘেঁষা। ছেলেটা আমার বোকা খুবই। এখনো পড়াশোনা করার সময় বলবে, মা তুমি আমার পাশে বসে থাকো নইলে আমার পড়া ভালো হবে না। ' 

আমি অর্থাৎ মনোপিসি লক্ষ করি, বিনিকাকির মুখখানা কেমন কালো হয়ে গেছে কথাটা শুনে। বিনিকাকির ছেলেটা চাকরি নিয়ে বেঙ্গালুরুতে থাকে। বছরে একবার আসে আবার আসেও না। ছেলে, বউমা, নাতি -- সকলেরই অজস্র কাজকর্ম। সেসব ফেলে বউমা, নাতির কলকাতায় আসতে ভালো লাগে না। বিনিকাকি এসব একদিন খুব বিষণ্ণ গলায় আমার কাছে বলেছিলো। ওর গলার স্বরে বুঝতে পেরেছিলাম, বিনিকাকি একা থাকতে থাকতে আরো একা হয়ে যাচ্ছে। 

চন্দ্রিমার কথায় বিনিকাকি কেমন অসহায় অভিব্যক্তি নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে – আমি আড়চোখে লক্ষ করি। চন্দ্রিমাকে এখন থামাতে চাইলেও থামানো যাবে না। ওর কাছে' আমার ছেলে' একটা স্পেশাল টপিক। ও সেটা অনেকখানি না বলে ছাড়বে না। সুতরাং ……...

আমি চুপ করে যাই। তখনই শুনি নিশ্চুপ হয়ে যাওয়া বিনিকাকি বলে, 'আমার ছেলেটাও আমাকে চোখে হারাতো। সর্বক্ষণ মা মা। কত কথাই যে বলতো আমাকে। সেই যখন স্কুলে যেতো, কলেজে যেতো – তখন। এখন দিন বদলে গেছে। এখন আর মাকে তেমন মনে পড়ে না বোধহয়। সপ্তাহ শেষে রবিবার রবিবার ফোন করে অবশ্য।' বিনিকাকির মুখে অদ্ভুত হাসি দেখতে পাই। গভীর দুঃখ চাপা দিতে চাওয়া হাসি।

বিনিকাকি বলে, 'চন্দ্রিমা তোর ছেলেটা এখনো বেশ ছোটো। এখনো ওর মাকে প্রয়োজন পড়ে। যখন বড় হবে ক্রমশ প্রয়োজন ফুরবে। বাইরের পৃথিবী ডেকে নেবে ওকে। আমার বুলুটাকেও তো তেমনি দূরে সরিয়ে নিলো সবাই মিলে। ওর চাকরি, ওর বউ। বুলুর বউ সাহানাও ওকে দূর শহরে গিয়ে উন্নতির চূড়ায় ওঠবারই পরামর্শ দিয়েছে সবসময়। এই শহর , পুরনো বাড়ি, পুরনো জীবন কোনো কিছুর প্রতিই ওদের কোনো পিছুটান নেই। বুলুটার বোধহয় মনেই পড়ে না – মা তার থেকে কত দূরে এক শহরে একলা একটা বাড়িতে বসে বসে তারই কথা ভাবছে! '

আমার মনে পড়ে যায় বিনিকাকি কথায় কথায় একদিন বলেছিলো, ছেলে তাকে কয়েকবার এখানকার বাড়ি বেঁচে দিয়ে তার কাছে চলে যেতে বলেছিলো, কিন্তু বউমা চায়না সে হঠাৎ তার সংসারে উড়ে গিয়ে জুড়ে বসুক। বিনিকাকি বেঁচে আছে বলেই তার ছেলে কলকাতার বাড়িটা বেঁচে দিতে পারছে না। উপরন্তু মেনটেন‍্যান্সের খরচ যোগাতে হচ্ছে।  আবার ছেলের বউ শাশুড়ির ঝামেলা ঘাড়ে নিতেও চায়না। 

আমার কেমন মনে হয়েছিল, বিনিকাকি অল্প একটু বিষয় লুকিয়ে যাচ্ছে আমার কাছে কিংবা নিজের কাছেও। বিনিকাকির ছেলেও সম্ভবত মায়ের দায়িত্ব ঘাড়ে নিতে তেমন ইচ্ছুক নয়।  অবশ্য  বিনিকাকিও এই বাড়ি, এই পাড়া, এই শহর ছেড়ে যেতে চায় না কোথাও।আমি সেদিন চন্দ্রিমার দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য মাতৃ-অহং– এর হাত থেকে বিনিকাকিকে বাঁচাতে তৎপর হই। চেঁচিয়ে বলি, 'ও বিনিকাকি তোমার ঘরে ফোন বাজছে, দেখো কে আবার ফোন করলো।' 

বিনিকাকি আমার কথা শুনে তাড়াতাড়ি ঘরে যায়। যদিও আমি জানি কোনো ফোনই আসেনি ওর। চন্দ্রিমা ওর লম্বা চুল চিরুনি দিয়ে জোরে জোরে আঁচড়াচ্ছে। ওর টান টান চেহারায় দিনের আলো পড়ে বেশ সুন্দর দেখাচ্ছিল। ও আমার দিকে চেয়ে মৃদু হাসলো। একটু স্বগতোক্তির ঢঙে বলে, 'মনোপিসি মাঝে মাঝে জানো খুব মনখারাপ লাগে। 

কতদিন হয়ে গেলো বহরমপুর যাইনি। আজকাল দাদাও আমাকে বেশি ফোন করে না।'

আমি জিজ্ঞাসা করি, 'চন্দ্রিমা তোমার দাদার কটা ছেলেমেয়ে গো?'

- 'দুই ছেলে। ছেলে দুটো জুয়েল। পড়াশোনায় খুব ভালো। আসলে ওদের মায়েরও তো ইংলিশ মিডিয়াম ব্যাকগ্রাউন্ড। অফিস রিসেপশনিস্টের কাজ করে। দাদার সংসার এখন উচ্চবিত্তের সংসার। আমরা মধ্যবিত্ত মানুষ -- আমাদের সঙ্গে ঠিক আ‍্যাডজাস্ট করতে পারে না ওরা আজকাল। আমার ছেলেটা তো বাংলা মিডিয়ামে পড়ে। ওর বাবাকে বলেছিলাম অনেক

করে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ানোর কথা। রাজি হলো না। অনেক খরচের ভয়ে পিছিয়ে গেলো। দাদাটার জন্য মনটা খারাপ হয়। ওরাও আজকাল আড়ো আড়ো ছাড়ো ছাড়ো। আমরাও আর তেমন এগোতে ভরসা পাইনা। অথচ ছোটবয়সে ও আমাকে কি ভালোবাসতো! দাদা ছিলো আমার হিরো।'

আমি ওর কথা শুনে বুঝতে পারি, চন্দ্রিমা পিছুটান ভুলতে কষ্ট পাচ্ছে। কিন্তু এই সংসার ওকে ভুলতে বাধ্য করবে। 

- 'বুঝলে চন্দ্রিমা এটাই কালের নিয়ম। আমাকেই দেখো না, একসময় সোদপুরে আমাদের পৈতৃক বাড়িতে কত লোকজন ছিলো! এখন সবাই ছিটকে গেছে। বাড়িটাই আর নেই। বাড়ি বিক্রি করে যে যার সে তার। আমি তোমাদের এখানে ঘাঁটি গেড়েছি।'

চন্দ্রিমা আমার কথাগুলো আনমনা হয়ে শোনে। ততক্ষণে ওর খোলাচুল বেঁধে বিনুনি করা হয়ে গেছে। দেখতে পাই, পাশের বাড়ির জগত্তারিনী বউদি রোজকার শশব‍্যস্ততা নিয়ে হাজির হয়েছে বারান্দায়। আমি ঘরে যাওয়ার তোড়জোড় করছিলাম। ওর কথায় আটকে যাই। ওনার কথা না শুনে চলে গেলে বউদির মুখ ভার হয়। কথা অবশ্য তেমন কিছু না, ওনারও ছেলেকে নিয়েই কথাবার্তা ঘোরাফেরা করে। বউদি হন্তদন্ত ভঙ্গিতে বলে, 'আমার ধেড়ে খোকা ছেলের এতটুকু চক্ষুলজ্জা নেই গো। এই সাতফোর বেলায় বন্ধুবান্ধব নিয়ে হাজির। মা চা করে দাও, সিঙাড়া বানাও। আমি বলে বাতের ব্যথা নিয়ে মরছি – এখন ছেলের খিদমৎ খাটো।' তারপর স্বর নামিয়ে বলে, 'আসলে বউকে বলবে না কিছু; তিনি যে চাকরি করেন। আসলে বুঝলে না বউকে বলার সাহস নেই। তাছাড়া বাড়িতে যখন বুড়িমা আছে।'

চন্দ্রিমা ফুট কাটে, 'বৌদি তুমি আবার বুড়ি হলে কবে, এখনো সেজেগুজে বেরোলে ছেলেরা ঝারি মারে তোমার দিকে চেয়ে।' এইসব বলতে বলতে সে আমার দিকে মুখ ঘুরিয়ে চোখ মারে জগত্তারিনীর আড়ালে।

আসলে জগত্তারিনী তথা আমাদের জগু বউদি রূপের গরবে গরবিনী। যদিও রূপ যৌবন পশ্চিম আকাশে ঢলে গেছে বহুদিন আগেই। তবুও এমন সব প্রশংসায় লজ্জারাঙা হয়ে যায়। 

তাছাড়া বউদি মুখে ছেলের মুণ্ডপাত করলেও আদতে ছেলের এইসব অন্যায় আবদারে বেশ খুশিই হয়। বোধহয় ভাবেন, ছেলেটা আজও তারই আছে। বউয়ের হয়ে যায়নি। যত আবদার বুঝি মায়ের কাছে। 

আমি কখনও কখনও ভাবি, আমাকে ঘিরে থাকা এই তিন মহিলার প্রত্যেকেই একটা করে অবলম্বনকে ঘিরে বেঁচে আছে।  তিনজনেরই চিন্তা ভাবনায় তিনটি বিভিন্ন বয়সী পুত্রসন্তান । সে – কারোর সন্তান হয়ত দূরে থাকে, কেউ আবার কাছে। শুধু আমি – এই পাড়ার মনোপিসি একটা নিরাবলম্ব জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। বহুদিন ধরেই। বাবা মার পর আর তো সেভাবে কেউ মাথার উপর ছাতা ধরার মত ছিল না। বিয়ে থা করিনি তা নয়।  সেই কতদিন আগে স্বামী মারা গেলো। শ্বশুরবাড়ির পাট চুকিয়ে তারপর থেকেই একা জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। তাও সোদপুরের পৈতৃক বাড়িতে দূরসম্পর্কের ভাইপো, ভাইঝিরা ছিলো । বাড়ি বিক্রি হয়ে যাওয়ার পর কলকাতায় চলে এলাম ফ্ল্যাট কিনে। তারপর থেকেই তো উত্তর কলকাতার এই পাড়ায়। দীর্ঘদিন টিউশন পড়াচ্ছি বাচ্চা ছেলে মেয়েগুলোকে। ওরা আসে, যায়। কয়েক বছর অন্তর বদলে যায় মুখগুলো। খুব সতর্কভাবেই কাউকে সেভাবে কাছে টানিনা। তবুও এটা বলতেই হয়, ওদের উপস্থিতি আমার ভালো লাগে। মনে হয় ওরা ছোটো ছোটো পাখির মত। আমার জীবনে আসে, আমাকে মুখরিত করে, আবার চলে যায় । এভাবেই হয়ত পরবর্তী সময়েও ওরা আসবে, থাকবে ক'টা দিন, আবার চলেও যাবে। খুব বেশি কাউকে কাছে টানলে কষ্টে পড়বো। প্রথম প্রথম হয়েছেও এমন। এখন তাই খুব সর্তক থাকি। কারোর প্রতি দুর্বল হয়ে পড়লে কষ্ট বাড়বে। নিস্তরঙ্গ জীবনে তরঙ্গ উঠবে। বয়স বেড়ে যাচ্ছে; জীবনের অতিরিক্ত তরঙ্গ হৃদয়ে চাপ বাড়িয়ে তুলবে। সহ্য করতে অসুবিধা হবে। তাই-ই সন্তর্পণে এইসব দুর্বলতা থেকে নিজেকে দূরে রাখি। কারোর উপর যেন বেশি মায়া না পড়ে যায়। নিরাবলম্ব জীবন কাটাতে কাটাতে বুঝতে পারি উদাসীন জীবন কাটানোটাও বেশ কঠিন ব্যাপার। অনবরত চারপাশের বহতা জীবনের নানা মায়া যেন আমাকে দুর্বিপাকে ফেলবার ফন্দি এঁটে চলেছে। প্রকৃতপক্ষে আমরা কেউ-ই পদ্মপাতা হতে পারিনা, জলের বিন্দুগুলোর ছাপ রয়ে যায় মনের মধ্যে। এইভাবেই আমার জীবন চলে যাচ্ছে । 

মনে পড়ে যায়, চন্দ্রিমা আমাকে কচুবাটা পাঠিয়ে দেবে বলেছে। ভাতের পাতে খেলে ভালো লাগবে আমার; ও পাঠিয়ে দেবে আমায় ভাত খাওয়ার সময়। প্রায় ও এটা ওটা রান্না করলে আমার জন্য পাঠিয়ে দেয়। আমি মনে মনে ভাবি ওর ছেলেটার জন্য একটা চকলেট কিনে নিয়ে আসবো টিউশনি ফেরত।  ছেলেটা দিদা দিদা করে। 

সেদিন জগত্তারিনী বউদি একটা গল্পের বই চেয়েছিলো, ওর সময় কাটেনা। গত বছরের পুরনো শারদীয়াটা রদ্দিওলাকে বেচে দেবো ভেবেছিলাম। থাক্ বেচে আর কি হবে! জগু বউদি পড়ুক। বই টই পড়লে মহিলার মনটা একটু বাতাস পাবে। হাওয়া বাতাস না পেলে দেখেছি মানুষের মনও সঙ্কীর্ণ হয়ে যায়। 

আমাদের বিনিকাকি এখনো দু'টো লাইব্রেরির মেম্বার। একসময়ের গ্র্যাজুয়েট কাকিমাকে দেখলে অবশ্য বোঝা যাবে না সেটা। কলেজে পড়া সেই মেয়েটাকে বিনিকাকিরও কি মনে পড়ে! নিপাট সাদাসিধে ঘর গেরস্থালী সামলানো মহিলা। শুধু ঐ দুটো লাইব্রেরির মেম্বারশিপ তার অন্যরকম পরিচয় তার নিজের কাছেই জিইয়ে রেখেছে। প্রতি সপ্তাহে বিনিকাকি ঠিক সময় বের করে বই পাল্টাতে যায়। আমিও মাঝেমধ্যে ওর থেকে পছন্দমত বই হলে চেয়ে নিয়ে পড়ি। 

এইভাবেই কলকাতার এক পুরনো পাড়ার চার মহিলার দিনযাপন এগিয়ে চলে। কিছুটা একঘেয়ে সময় গুজরান, কিছুটা নিস্তরঙ্গ জীবনের নিশ্চিন্ততা নিয়ে ভালো মন্দে মেশানো সময়যাপন। গৃহস্থালির কাজ, নিজেদের সংসার, ছেলেমেয়েদের নিয়ে টানাপড়েন – এইসবের মধ্যে ক্লান্ত হতে হতে হঠাৎই আমরা কিছুক্ষণের জন্যে বারান্দায় আসি, একে অপরের সাথে কথা বলি, মুক্ত বাতাসে শ্বাস প্রশ্বাস নিই। জীবন প্রবাহিত হয় আমাদের ।

বর্ষার ছাতা

প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা ​

পুজো বার্ষিকী ১৪২৮ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

গল্প

বর্ষার ছাতা

কল্যান সেনগুপ্ত

কলকাতা

rainy-day-2-ibolya-taligas.jpg

বৃষ্টি পড়ছে সকাল থেকে। বাস থেকে নেমে ছাতা খুলেছি কলেজ বিল্ডিং অবধি যেতে হবে। কলেজের কম্পাউন্ড এর কাছে এসে দেখি সামনে সামনে ক্যালানে সুবোধ স্যার যাচ্ছে মাথায় বিরাট কালো ছাতা। ঢোলা কালো প্যান্ট, সাদা জামা দেখা যাচ্ছে। সুবোধ স্যার ক্লাসে এলেই হৈ হৈ চলতেই থাকে। উনি বললেও কেউ থামে না।অঙ্কের মাস্টার সুবোধ রায়। এত শক্ত একটা সাবজেক্ট তবু হয় হট্টগোল চলতেই থাকে। হতাশ হয়ে পিছন ফিরে ব্ল্যাক বোর্ডে ফর্মুলা লিখতে থাকেন। কোনো রাগ নেই। সব সময় হাসি মুখ। ছাত্র হিসেবে শুনেছি মারকাটারি ছিলেন কিন্তু শিক্ষক হিসেবে পাতে দেওয়া যায় না। সুবোধ স্যার কে দেখে মনে হয় বি-এড কেন শুধু স্কুলের জন্যে? কলেজের জন্যেও হওয়া উচিত ছিল। ক্লাস টেস্ট নিয়েছিলেন কিন্তু নম্বর দিচ্ছিলেন না। আমি জল পেড়িয়ে ছপছপ করে জলের ওপর লাফিয়ে লাফিয়ে ক্লাসে ঢোকার আগেই ধরলাম। সামনে পৌঁছানোর সময় বেশ কিছুটা জল ছিটল আমার ও ওনার গায়ে। কাছে গিয়ে স্যার স্যার ডাকতেই উনি পিছন ঘুরলেন। আমার চোখ ছানা বড়া। একি? আমাদের ক্লাসের আধুনিকা  সহপাঠী শ্রমণা।
থতমত খেয়ে বললাম "ও তুই? পিছন থেকে তোর বেল বটম আর কালো ছাতা দেখে বুঝতে পারিনি রে"।
রাগে গড়গড় করতে করতে বললে "আমাকে দেখে কি আতা কেলানে সুবোধের কথা মনে হচ্ছে? যত্ত সব।"
"না আসলে বড় কালো ছাতা দেখে স্যার .....
"দিলি তো জল ছিটিয়ে?" বলে বিড় বিড় করে চার ছয় অক্ষরের গালি দিল।
বিব্রত হয়ে বললাম "আসলে ছাতার জন্যে ঠিক"।
শ্রমণা গায়ের জল ঝাড়তে ঝাড়তে বিরক্তি নিয়ে বললে "তোকে আর ঠিক করা গেল না। চল চল। বলে নিজের গায়ের জল ঝাড়তে লাগল। পিছন থেকে ছাতা মাথায় মানুষ চেনা মুশকিল।
সুমনাকে আর কখনো কালো ছাতা মাথায় দেখিনি।
তিরিশ পেরোতেই বাবার মত চুল কমতে শুরু করেছে। অনেক কষ্টে এ পাড়ার চুল ও পাড়া করে চালাই। সময় লাগে আয়নার সামনে। ছোটমামা বললে -

"আমি যাবো তোর সাথে কুচ পরোয়া নেই।
মা বললে" দেখিস ছোটনবাবুর প্রথম হবু শশুর বাড়ী যাওয়া। তুই একটু দেখে নিয়ে যাস।সঙ্গে থাকিস। বিকেলে যাবো। দুপুর পেরোতেই আকাশের মুখ ভার। ছোটমামা দুপুরেই চলে এসেছে। আমি নতুন প্যান্ট আর জামা পড়ে রেডি। চাপা উত্তেজনা বুকে। কি হয়, কি হয়।কি জানি কি হয়। সিড়ির মুখে ছোট মামা এক ঝলক দেখে পিছনের জামাটা ভালো ভাবে গুঁজে দিয়ে পিঠে একটা চাপর মেরে বললে "আমাদের যাত্রা হল শুরু। এখন ওগো কর্নধার তোমারে করি নমস্কার"।
মা হেসে বললে "দুগ্গা দুগ্গা। কর্নধার তো তুই"
আমি বললাম "ছোট মামা চল একটা ছাতা নিয়ে বেরোই। আকাশটা ভালো ঠকছে না।
চটি পড়তে পড়তে বললে "তুই কি রে? কোন জগতে পড়ে আছিস? ছাতা নিয়ে মেয়ে দেখতে ঢুকব? চাপে পড়ে যাবি। লোক হাসবে। আমার মনে হচ্ছিল নিলে ভালই হত। ছোট মামার কথায় নিলাম না।

গড়িয়াহাট এ নেমে দেখি টপটপ পড়ছে গায়ে। ছোটমামা বললে এইতো কয়েকটা বাড়িরই পড়ে, চল দৌড় লাগাই। বলতে বলতে ঝমঝম করে নেমে গেল। বললাম দৌড়াতে দৌড়াতে "ছোট মামা, ইসস খুব ভুল হয়ে গেছে ছাতা ছাড়া বেড়িয়ে এসে। এবার ছোট মামা চুপ। আমাকে তাকিয়েও দেখছে না।
চাপ তো এবার আমার।
মেয়ের বাড়ির বারান্দায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে কিছুটা ভিজেই গেলাম। মেয়ের বাড়ির লোক বারান্দায় দাড়িয়ে। বলতে পারলাম না ছোট মামা চল বাড়ি যাই।
মেয়ের কাকা, বাবা হৈ হৈ করে ভিতরে নিয়ে গেল। মুছে ফেল "মাথা, গা হাত পা"।
দরকার নেই বলতে পারছি না। ছোট মামা গদগদ হয়ে তাড়াতাড়ি আমার মাথা মুছিয়ে  দিলে।নতুন  শার্ট,প্যান্ট ভিজে একদম ন্যাতা। মাথা মুছতে গিয়ে খেয়াল হল ইসস খুব ভুল হয়ে গেল। হবু কাকা শ্বশুর চিরুনি দিলে। সামনের আয়নায় দাড়িয়ে চুল আঁচড়াতে গিয়ে পুরো হোকাস ফোকাস। সবার সামনে কি করে এ পাড়া ও পাড়া করি। কোনো রকমে চিরুনি চালিয়ে পরীক্ষায় বসে পড়লাম। সঙ্গে সঙ্গে চা হাজির। সবাই মনে হল আমার মাথার চুলের দিকে তাকিয়ে আছে অবাক বিস্ময়ে। চারিদিকে বয়স্ক মহিলাদের ইতিউতি। দু চারটে গতে বাঁধা প্রশ্নের পর হবু শ্বশুরমশাই বললেন

"তোমার যে ছবিটা পাঠিয়েছিল সেটা কি অনেক পুরনো?
ইঙ্গিতটা পরিষ্কার। মাথায় হাত চলে গেল। ঠিক কথা সেখানে তো ঢেউ খেলছে সামনে। ঢেউ খেললে তো চাহনি ও স্বপ্নিল। কিন্তু এখন? সামনের মাঠ খালি। এখন আর পিছন থেকে সামনে আনার কোনো পথ খোলা নেই। চাকরির ইন্টারভিউর থেকেও খারাপ অনুভূতি হল। পেট গুরগুর শুরু হয়ে গেল। ছোট মামা ম্যানেজ দেবার চেষ্টা করলে।

"ওই ভিজে গেছে তো। তাই এরকম লাগছে"। শুকিয়ে গেলেই আবার.....।
যদি ওরা সন্দেহ করে থাকে অন্য ছেলে এসেছে কিনা তাহলে এক রকম। নাহলে নিশ্চয় চুল নিয়ে বলছে। ছাতা থাকলে আজ এত অপদস্ত হতে হত না। রাগে দুখ্যে মনে হচ্ছিল উঠে চলে যাই। ছোট মামার ওপর ভীষন রাগ হতে লাগল। কিন্তু সে আর আমার দিকে তাকাচ্ছে না। হবু শ্বশুর বাড়ির সবার মুখটা দুঃখী দুঃখী হয়ে গেল। যেন পাঁচন গিলিয়ে দেওয়া হয়েছে। মেয়ে রেগে মনেহয় আলাদা করে কোন কথাই বললে না। চেহারার এমন পরিবর্তন মেনে নিতে একটু সময় লাগছে।
কথা হল। খাওয়া হল। আমি মাঝে মাঝেই ওপার থেকে কিছু চুলকে এপারে আমার চেষ্টা চালিয়ে গেলাম। কিন্তু আয়না ছাড়া এসব করা খুব মুশকিল।
রাগে দুঃখ্যে ছোট মামার সঙ্গে বাড়ির ফেরার সময় কথাও বলিনি। বিয়ের পরে শুনেছিলাম কনে বাড়ি খুব হতাশ হয়েছিল আমায় দেখে। দরকারি কাজে ছাতা ছাড়া বাড়ি থেকে আমি বেরোইনা আর।
বৃষ্টি তখনও আসেনি। আসবো আসবো করছে। ছাতা নিয়ে যাচ্ছি অফিসে যদি হঠাৎ সে এসে যায়। সাবধানের মার নেই। দুপুরবেলা সে কালো হয়ে এল। চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেল।  তন্ময় বলল "দাদা আপনার ছাতা টা একটু দেবেন? ব্যাংক এ যাবো।

তন্ময়কে গেল ছাতা নিয়ে। প্রচণ্ড বৃষ্টি নামল আকাশ ভেঙে। সে ফিরে এল ঘন্টা খানেক পর জল সাঁতরে।পার্ক স্ট্রীট কামাক স্ট্রিট থই থই জল। তন্ময় এর জামা,প্যান্ট ভিজে গিয়েছে। খুব ব্যাজার মুখ করে বললে "দাদা আজ আপনার ছাতা আমাকে পুরো ডুবিয়েছে। আমি অবাক। কি হলো? ছাতা তো ডোবায় না বাঁচায়। বললাম "হয় মানছি জোরে বৃষ্টি হলে এই ছাতাতে হয় না। কিন্তু ডোবালো কি করে? কিছু না উত্তর দিয়ে সে বাথরুমে চলে গেল।দারোয়ানের থেকে একটা গামছা নিয়ে মাথা মুছে, জামা শুকোতে দিয়ে। আরেকটা জামা পরে এসে বসল। দেখলাম আমার থেকেও বেশি সতর্ক। তন্ময়। সে একটা জামা অফিসে এ রাখে সারা বছর।

বললে "এরকম অপ্রস্তুত আমি কখনো হয়নি।
ততক্ষণে ফ্লোরে তন্ময়কে ঘিরে ভিড় জমে গেছে। কি হয়েছে জানার জন্যে।
তন্ময় বললে "সবে লিফট থেকে নেমে পার্ক স্ট্রিট আর ক্যামাক স্ট্রিট  ক্রসিং এ দাড়িঁয়েছি রাস্তা পার হব। হুড়মুড় করে বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা শুরু হলো। ছাতার নব টিপলাম, খুলল না। দৌড়াতে শুরু করলাম। রাস্তার মাঝখানে দাঁড়াতে হল দুদিক থেকে গাড়ি আসছে। একটু সুযোগ বুঝে দুটি গাড়ির মধ্যে দিয়ে ওপরে ফুটপাতের শেডে গিয়ে দাড়ালাম। অনেক টাই পরা, স্কার্ট পরা মানুষ ফাইল হাতে, ব্রিফকেস হাতে সবাই আমাকে দেখে সরে দাড়ালে।আমি অচুৎ ভিজে গিয়ে। কিন্তু আমাকে সাংঘাতিক অপ্রস্তুত করে ছাতাটা হঠাৎ খুলে গেল।
শুধু খুলে গেল না। আসে পাশে দাঁড়ানো মানুষগুলোকে এক প্রস্থ বৃষ্টির জলে ভিজিয়ে দিল।
তারপর?
তারপরই তো আসল ব্যাপার। লোকে আমাকে শাপ শাপন্ত করতে লাগল, মহিলারা জোরে জোরে ইডিয়ট, বিড়বিড় করে রাস্কেল, গাধা এইসব বলতে লাগল। ছেলেরা কেউ চুপচাপ জামার জল ঝাড়তে লাগল। একজন তরুণ আমসি মুখে বললে "আপনি কি করলেন দেখুন। এই ভাবে ইন্টারভিউ দিতে যাওয়া যায়?"
কান গরম হয়ে গেল। আবার সেই খোলা ছাতা নিয়েই বেরিয়ে পড়লাম অন্য শেডের সন্ধানে। বৃষ্টি তখন খুব জোরে পড়ছে।
ছাতা তুমি কার? যার হাতে থাকে তার। প্রতি বছর জোর না ছাতা খারাপ হয় তার থেকে বেশি হারায়। ওর যেন হারানোতেই শেষ। সারা বছর আছে কিন্তু পরের শুরুতে অবশ্য সে থাকবে না। কোথায় যে যায় সেটাই প্রশ্ন। শ্যামলদা বাবার মুহুরী। রোজ বাড়িতে আসা যাওয়া। প্রথম বর্ষার শুরুতে প্রতিবারই আমার ফিল্ডিং ছাতা পাওয়া যায় না। ঠিক অফিসে এ বেরোনোর মুহূর্তে দেখা গেল নেই। খোঁজ, খোঁজ। পাওয়া যাবে না। তাই বর্ষা শেষে কাউকে ছাতা দিলে লিখে রাখলে ভালো হয়। সকাল থেকে বৃষ্টি পড়ছে আজ। ছাতা, ছাতা। কোথায় ছাতা? বাড়ি খুঁজেও পাওয়া গেল না। বেরোবার মুখে দেখি পরে আছে বাইরে ঘরের দোড় গোড়ায়। এইতো পেয়েছি। এত খুঁজছি কখন থেকে বলে তুলতে গেছি অমনি শ্যামল দা দৌড়ে এল " খোকন এটা আমার। ওটা নিয়ে যেয়ো না। তাহলে বাড়ি যেতে পারবো না।
আশ্চর্য্য! এটা তো আমারই মনে হচ্ছে দেখে। আমি জানি শ্যামলদাকে বৃষ্টির দিনে রাত বিরেতে বাড়ি ফিরতে বাড়ির ছাতা দেওয়া হয় অনেক সময়। দেখতে একদম আমার ছাতার মত। এমনকি মুঠির কাছে দুচারটে স্ক্র্যাচগুলোও মিলে যাচ্ছে। এমনকি ফোল্ডিং করে রাখার বোতামটাও ঝুলঝুল করছে। শ্যামলদা উঠে এসে ছাতাটা নিয়ে আমার দিকে নিস্পৃহ এক দৃষ্টি দিয়ে ভাঁজ করে ফেললে। বাবা বললে "খোকন আবার অফিসে এ ফেলে এসেছিস? এই নিয়ে কতগুলো হারাল?
আমি জানি, মানে স্থির বিশ্বাস, ওই ছাতাটা আমার আজ না পাওয়া ছাতা। বলতে গেলে কেউ বিশ্বাস করবে না । ওনার বয়েস বেশি, রেসপনসিবিল মানুষ  তাই উনি হারাতে পারেন না? উনি অন্যের ছাতা নিয়ে চলে যেতে পারেন না? মরসুমের শুরুতে ছাতা যার কাছে থাকে দেখলাম ছাতা তার। আগের মরসুমের কথা কেউ মনে রাখে না। অগত্যা মা তার আলমারি থেকে একটা নতুন খাপে ভরা বিদেশি ছাতা বার করে দিলে। পই পই করে বললে "সাবধান যেন না ভুলে কোথাও ফেলে আসিস না"। তাড়াহুড়ো করে সেই ফোল্ডিং ছাতা ব্যাগে ঢোকাই।
অফিসে থেকে ফেরার পথে আর্চিসের দোকানে নেমেছি। বৃষ্টি তখনও গুড়িগুড়ি পড়ছে।ছাতা বাইরের বালতিতে রেখে ঢুকেছি। কার্ড আর একটা পেন স্ট্যান্ড কিনে বেরিয়েই পড়লাম বিপদে। যখন রেখেছিলাম তখন কোন ছাতা ছিল না বালতিতে। আর এখন পাঁচটা ছাতা। তাহলে কোনটা আমার? এইরে, আমার ছাতাটা কেমন যেন দেখতে ছিল? সবগুলোই মনে হচ্ছে হতে পারে। মা কে ফোন করব? না, তাহলেই চেঁচামেচি শুরু হয়ে যাবে। ধরেই নেবে আমি এরমধ্যেই হারিয়েছি। তাহলে? মার ছাতা যখন লেডিস ছাতাই হবে। দুর ছাতা, কিছুতেই মনে পড়ছে না রং টা কি ছিল। আজই প্রথম নিয়ে বেড়িয়েছি। দোনামনা করে যেই গোলাপী ছাতার দিকে হাত বাড়িয়েছি, ব্যস হঠাৎ করে দোকান থেকে বেরোলেন এক সুন্দরী মহিলা আমার পাশ দিয়ে সেই গোলাপী ছাতাটা তুলে নিয়ে রাস্তায় নামলেন। ছাতা চোর নামটা জুড়তে গিয়েও জুড়ল না। এবার দম বন্ধ করে সামনের কালো ছাতাটা তুলেই কোনদিকে না তাকিয়ে রাস্তায় নেমে হন হন করে বাড়ির দিকে হাঁটা লাগালাম। পিছন ফিরে বার বার দেখেছি কেউ পিছনে আসছে কিনা। প্রথম মনে হচ্ছিল কেউ যেন আসছে। একটা বাড়ির তলার বারান্দায় দাড়িয়ে পড়লাম। যা থাকে কপালে। হেনস্থা হলে বাড়ি থেকে দূরে হওয়ায় ভালো। কিন্তু কিছুক্ষণ দাড়িয়ে বুঝলাম না কেউ আসেনি। বাড়ি ফিরেই আজ নিজের নাম ছাতায় সাদা পোস্টার কালারে বড় বড় করে লিখে রাখতে হবে। তারপর দেখি আমারটা কে নেয় বাড়িতে ঢুকে ছাতাটা বারান্দায় রেখে পা ধুতে গিয়েছি বাথরুমে এমন সময় মা চলে এল বারান্দায়।
দম বন্ধ করে হাতে জল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। আজ গেল মনে হয়। এইবার মার তর্জন গর্জন শুরু হবে। ইসস নীল রঙেরটা বালতি থেকে তুললে মনে হয় ঠিক ছিল। ভাগ্য কোনোদিন সহায় হল না।
কিছুক্ষণ সব চুপ। তারপর শুনলাম মা বলছে "দেখি, দেখি। যাক, আমার খুব ভয় ছিল  দাদার ওকে দেওয়া ছাতাটা আজ বেহাত না হয়। কাউকে হয়তো দান করে এল। খোকনের তো কিছু ঠিক নেই। এইতো ঠিক আছে মেড ইন জার্মানি স্ট্যাম্পটা আছে। বাথরুমে দাঁড়িয়ে হালকা মনে হল পাঁচটা ছাতার মধ্যে দুটোতে "মেড ইন জার্মানি স্ট্যাম্পটা ছিল। মা নিশ্চয়ই ঠিক ছাতাটা চেনে।নিশ্চিন্ত হয়ে মুখে জল দিলাম।

কবিতাঃ শান্তনু ঘোষ

পুজো বার্ষিকী ১৪২৮ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

কবিতা

শান্তনু ঘোষ  

কবিতাঃ দীপঙ্কর সাহা

তোমার দেশ

দেশ তোমার দেশ--
দেশপ্রেমের রঙীন শত শত বাঁকানো হাতের

হাতছানি ভাবায় না আর।
সেই কবে রক্তাক্ত পথে চলার শুরু, অন্তহীন সে পথ
পালাবদলের বজ্রকঠিন হুঙ্কার, বক্র চাহুনি আর

তোবড়ানো চিবুকের শপথে
কায়াহীন দের দলে দলে সেই চলার শুরু।
রণভেরী নেই, তবুও যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে হবে, 
যুদ্ধ তো নতুন খেয়াল নয়, যুদ্ধ  প্রাত্যহিক
আমার জঠরাগ্নির যুদ্ধ, তুমি শুনতে পেয়েছ?
উত্তাপ নিয়েছ কখনো?

গনগনে আঁচে ঝলসে যাওয়ার স্বাদ?

জানতে চাওনি কখনো, কারণ তুমি নির্লিপ্ত,

 আমি জানি শুধুই রক্তমাংসর লড়াই, প্রতিপক্ষ আমিও

eating.jpeg

এদেশ তোমার দেশ ---
কেবলি স্বপ্নজাল বোনা
সপেঁছিলাম আলোর টানে
দিকভ্রান্ত নবকুমারের মতো কাপালিকের সম্মুখে
কোনো কপালকুন্ডলার দেখা মেলেনি তন্ন তন্ন করে
স্পার্টার ঘোড়ার ভেতরের সৈনিক এর মতো নিশুতি ক্ষণের অপেক্ষায় ভাটা পড়েনি কখনো।
তবুওতো আপন করোনি।
সময়ের কোমল পরশ, অন্তহীন প্রতীক্ষা দুইই অমৃতের মতো পান করেছি,
সভ্যতার অনভ্যস্ত হাতে আলোর প্রহরী হওনি কেন তবে?
ভরসার ছাতায় মুখ ঢেকে দাওনি অশ্রুহীন নির্বিকারে?
তাহলে কিসের দেশ? কার দেশ?
এদেশ তোমার দেশ।

 

পুজো বার্ষিকী ১৪২৮ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

কবিতা

দীপঙ্কর সাহা  

বন্ধু আমার

ন্ধু মানে ঝগড়া ঝাঁটি মিটিয়ে ভালোবাসা

দুরত্ব সে যতই থাকুক ঘুচিয়ে কাছে আসা

বন্ধু মানে এক বাটিতে মুড়ি মাখা খাওয়া

বন্ধু মানে গুমোট কেটে উতল দখিন হাওয়া। 

নীল আকাশে ভাসছে কেমন সাদা মেঘের ভেলা

বন্ধু হলে সেই ভেলা হয় সঙ্গী সারাবেলা। 

বন্ধু সাথে পথ চলা এক দারুণ মজার গান

খুনসুঁটি আর টুকরো হাসি, ভোলায় মনপ্রাণ। 

বন্ধু মানে ঝড়ঝাপটায় জড়িয়ে ধরা ভাই

বিপদ বাঁধায় এগিয়ে আসে, আর কেহ যে নাই। 

ছাড়াছাড়ি হতেই পারে জীবন পথের মাঝে

বন্ধু সে তো প্রাণের সাথি মনেই সে বিরাজে

বন্ধু তোকে এই কথাটি হয়নি বলা ভাই

ভালবাসি, তোর মতো যে, আর তো কেহ নাই। 

eating.jpeg
এক্সচেঞ্জ অফার

প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা ​

পুজো বার্ষিকী ১৪২৮ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

গল্প

এক্সচেঞ্জ

অফার

শান্তনু ঘোষ

ক্সচেঞ্জ অফারে এবার নতুন একটা ফোন না কিনলেই নয়। এক বছরেরও বেশি সময় হয়ে গেল ফোনটায় কিছু না কিছু সমস্যা লেগেই রয়েছে। তাই একটা নামী অনলাইন শপিং সাইট থেকে এক্সচেঞ্জ অফারে ওর পুরোনো ফোনটাকে বিক্রি করে নতুন একটি কেনার সিদ্ধান্ত নিল রিতা।
- দেখতো ফোনটা কাটল কিনা? স্বামী জয়কে জিজ্ঞেস করল রিতা।
শাশুড়ির সঙ্গে মিনিট খানেক আগেই কথা হয়েছে রিতার। বিয়ে বাড়ির সাজগোজে ব্যস্ত রিতা তার স্বামীকে বলল, জানো, আমার ফোনে এ এক অদ্ভুত প্রবলেম হয়েছে।  যে ফোন করে সে যতক্ষণ না কাটে ডিসকানেক্ট হয় না। মামনির ফোনটা  কাটলো কিনা দেখতো।
সন্ধ্যায় জয়ের মামাতো বোনের বিয়ে উপলক্ষে জয়, রিতা আর ওদের দশ বছরের সোমলতা জয়ের মামা বাড়িতে যাবে। শ্বশুর-শাশুড়ি কাল থেকেই ও বাড়িতে। জয় ও রিতার মধ্যে সম্পর্কটা খারাপ হওয়া ইস্তক ও  জয়ের দিককার অনুষ্ঠান এড়িয়ে যেতে চায়। ও অনুভব করেছে এ সমস্ত অনুষ্ঠানে আত্মীয়স্বজনদের সমালোচনার চাহুনি। রিতা অবশ্য জয়কে এ বিষয়ে বলেও সেরকম সাড়া পায়নি। জয়ের মনে হয়, রিতা ওর মা সম্পর্কে শ্রদ্ধাশীল নয়।  আসলে শাশুড়ির ইনিয়ে-বিনিয়ে বৌমা সম্পর্কে ছেলের কাছে ধারাবাহিক অভিযোগের কারণে ওদের সম্পর্কটা আজকে অনেকটাই শীতল। অবশ্য শাশুড়ি সুকৌশলে ছেলের সামনে এমন ব্যবহার করবে যাতে ছেলের মধ্যে বৌমা সম্পর্কে যথেষ্ট উষ্মা হয়। তবে এক্ষেত্রে অনুরোধে ঢেঁকি গেলার উপক্রম হয়েছে। রিতা না করতে পারেনি। ফোনটা কাটতে গিয়ে জয় বুঝলো ওপ্রান্তে ওর মা (রিতা ওর শাশুড়ি কে মামনি বলে) তখনও ফোন কাটেনি। কৌতূহলবশতঃ কানে দিতেই জয় অস্পষ্ট ভাবে হলেও শুনতে পেলো,

girl1.jpg

ওপারে মা কাকে যেন বলে চলেছেন - "আর বলিস না, কেবল বাপের বাড়ি আর বাপের বাড়ি, আর পারিনা বাপু, জগতে আর যেন অন্য কেউ নেই, বিরক্ত লাগে, এমন ভাব দেখায় যেন চাকরি আর কেউ করে না। বারবার ওনাকে ফোন করে আসতে বলতে হবে, যত্তসব... ছেলেকে তো বুঝতে দিই না। ছেলের সামনে বেশি বললে আবার ছেলে বেঁকে বসতে পারে, তখন ছেলে আমার বেহাত হয়ে যাবে, তাই ওর সামনে কিছু বলিনা। হে... হে.... হে... বুঝিস ই তো...... সবই সংসার। আর শুনতে চাইলো না জয়। কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর ফোনটা রেখে রিতার দিকে ফিরে জয় বললো, আজকে ওখান থেকে এসে একটু প্যাকিং করে নিও, সে যত রাতই হোক। কালকে সকালেই আমরা যাচ্ছি...

- ওমা কোথায়? সাজগোজ থামিয়ে অবাক হলো রিতা। কাছে এসে রিতার দুই কাঁধে হাত রেখে মুচকি হাসি দিয়ে বলল, - 'জানিনা,....  বেরিয়ে ঠিক করবো... আগামী দিন কয়েকটা দিন আমাদের বোঝাপড়াটা ঝালিয়ে নেওয়াটা দরকার আমাদের সেকেন্ড হনিমুন কাটাবো, অবশ্য তোমার আপত্তি না থাকলে।

- ও হ্যাঁ, ভালো কথা, তোমার ফোনটা এক্সচেঞ্জ অফারে দিও না, ওটা রেখে দিও। আমি আরেকটা ফোন তোমায় কিনে দেবো।

- বলেই জয় বেরিয়ে যেতেই একরাশ বিস্ময় নিয়ে রিতা তাকিয়ে থাকলো তাঁর প্রায় বাতিলের খাতায় ফেলে দেওয়া মোবাইল ফোন টার দিকে.....

কৃতজ্ঞতার ছাপ তখন ওর দুটো চোখের কোনায় জলবিন্দুর রূপ নিয়েছে।  

পুজো বার্ষিকী ১৪২৮ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

মতামত

Please mention the "name of the article and the author" you would like to comment in the following box... Thank you.

bottom of page