top of page
সূচীপত্র

প্রচ্ছদঃ সুরজিৎ সিনহা, হলদিয়া 

সূচীপত্র

পর্ব - ২

প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা ​

প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা ​

bijaya.jpg

পুজো বার্ষিকী 

১৪২৮

***

পর্ব - ২

maaforall.jpg

গল্প 

kolkata-sketch1.jpeg

রম্যরচনা

somiron.jpg
Watercolor Butterfly 6

ভ্রমণ

airport.jpg

প্রবন্ধ

kadombori1.png

কৃতজ্ঞতা

mothersday.jpg

লেখক ও লেখিকাবৃন্দ

প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা ​

প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা ​

কবিতাঃ জিষ্ণু সেনগুপ্ত

গ্যালোপিং সাহিত্য

জিষ্ণু সেনগুপ্ত

কবিতা

girl.jpg

শিয়ালদহ

ক্লান্তির কবিতা

মি তো কিছুই পারি না, আমার না পারা সংলাপের, ভৌতিক বাস্তবতা আমাকেই অবাক করে। ঠিক যেমন অবাক করে বর্ষণ-বিহীন ধূসর মেঘ-পুঞ্জকে। মালিনী আমায় বলেছে, আমরা চরকের মেলায় যাব। আমার এখন ররবীন্দ্রনাথ পড়তে ভালো লাগে না। তাক ভর্তি সমগ্র ভাসিয়ে দিয়েছি, সামুদ্রিক শূন্যতায়। মালিনী আবার এনে দেবে, একটা বেশি আনবে, আমি জানি।

 

শাশ্বত বলেছে সবুজ দেখতে, বয়স হচ্ছে, আরাম হবে। আমার দুঃখ হয় না, মালিনীর হয়।মালিনী বলেছে কবিদের দুঃখ হয় না। সাধারণের হয়, কারণ ওরা স্বপ্ন দেখে কবিতার মত, আর আমরা কবিতা লিখি স্বপ্নের মত। আমি দুঃখ-বিহীন, দুঃখ-অভিমান আর না পারার কান্না পুড়িয়ে দিয়েছি অশোক-আগুনে। রিতর্ণা সিগারেট ছাড়তে বলেছিল, আমি ছেড়েছি আর রিতর্ণা আমায়। এখন পকেটে সিগারেট নেই, ক্লান্তি আছে।

দমদম

দুঃখের কবি

শাশ্বত বলেছে আমি কবিদের মতন দুঃখ নিয়ে নেশা করি। সকালে মালিনী ফোন করেছিল, আজ রাতে আমরা বৃষ্টি দেখতে যাব। যখন কংসাবতীর জলে জেগে উঠবে উন্মত্ত ইউনিকর্ন, তখন আমরা বসব, হিজিলের সংসারে, আকাশের প্রতিবেশী হয়ে।

 

মালিনী আমার বুকে মাথা রেখে প্রশ্ন করে, ”ভালোবাসো?!”, আমি মালিনীকে ভালোবাসি না, মালিনী বলেছে কবিদের ভালোবাসতে নেই, কারণ আমার না পারার কান্নায় আফিমের কারবার।

 

আকাশে সপ্তর্ষি, মালিনী তাকিয়ে থাকে এক জীবন উল্লাস নিয়ে। আমার ঈর্ষা হয়, আমার কিছু না পারা বোকা পেন্সিলকে আরও নিবিড়ভাবে জড়িয়ে বলে, ”পারবে, পারবে, পারলে তুমিই একমাত্র পারবে”।

মালিনী গোলাপ বেশি পছন্দ করে। আমি শিউলি দিয়েছি, ওকে চন্দ্রমল্লিকা বেশি মানায়। মালিনী খোপা করে না। ওর গন্ধটা কৃষ্ণচূড়ার মত, আমার প্রিয় ফুল।

সোদপুর

মন্দবাসার কবিতা

কাল শাশ্বত এসেছিল। শাশ্বত বলে আমার কবিতা দুর্বোধ্য, সাধারণ বর্জিত। তাই আমার কবিতায় রডোডেন্ড্রন, ওর স্বপ্নে উষ্ণতম বনরাজী।

শাশ্বত রাতে আসে। ও জানে আমি রাত্রি পছন্দ করি। শাশ্বত কাল নেরুদা দিয়েছে, আমি পড়িনি। আজ পড়ছি, কুড়িটি প্রেমের কবিতা। আমি ভালোবাসতে ভালোবাসি না, ভালোবাসাকে ভালোবাসি। মালিনী বলেছে ভালোবাসলে কবিতা লেখা যায় না। ভাঙলেই প্রকৃত কবি। শাশ্বত বলেছে প্রেমের কবিতা লিখতে। আমি লিখি না। ওতে সুখ হয়। মালিনী বৃষ্টি ভালোবাসে, আমি রোদ্দুর। মালিনী চলে যাবে, আমি জানি।

ব্যারাকপুর

প্রশ্ন কবি

মি, মালিনীকে নিয়ে সুজাউদ্দিনের দরগায় যাই। আমি ঈশ্বর মানি না, মালিনী মানে।সেখানে পুরুষ ও নারীর নিরঙ্কুশ ঘনিষ্ঠতার অধিকার আছে। তাই বিদ্রোহ নেই। আমি মহাকাশে রটিয়ে দিয়েছি, স্পর্শহীন রাতের ইশতেহার। সেখান থেকেই চরকের মাঠে যাই, আকাশ দেখতে।

আকাশের বিক্ষিপ্ত কল্পনার সাহিত্যিক বাস্তবতায়, কবিতার পুষ্পবৃষ্টি। মালিনীর হলুদ ওড়নায় বৈশাখী বিশ্বাস। আমার বুকের দুটো বোতাম মালিনীর বাধ্য। আমরা চুমু খাই। মালিনীর বুকে, আমার পরিচিত ব্যর্থতার আঁচিল। আমি উর্যাকে ভালোবাসি। মালিনী আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে, ”তোমাকে পারতেই হবে...”।

আমি প্রশ্ন করি,

“আচ্ছা মালিনী আমরা কি পালটে যাচ্ছি? এই যে তেপান্তরের মাঠ, শরতের  কাশবন, আকাশ ছোঁয়া শঙ্খচিল, উড়োজাহাজ, পক্ষীরাজ, মেঘ প্রাসাদের রাজকন্যা। ওদের ধর্ম কি মালিনী?”

মালিনীঃ- উদযাপন!!! জীবনের নান্দনিক উদযাপন!

~বনে-বনান্তরে

মন্দবাসার শহরে

জোৎস্নায়, অশোক ছায়ায়

মালিনীকে, দুঃখের কবিতা

বসন্ত উদ্যমে,

জীবনের নান্দনিক উদযাপন।

মালিনী-ধ্যাত!!

নৈহাটি

প্রজাপতির কবিতা

শাশ্বত বলেছে আমার গল্পে কোনো ন্যারেটিভ নেই, বড় প্রাণের অভাব। আমার কিছু বলার নেই, আমার কোনো গল্প নেই, দুঃখ আছে। আমার হয়তো জন্মই হয়নি এখনো কিংবা মৃত্যু হয়েছে ইতিহাসে। আমার নিরুত্তাপ শব্দ, বিক্ষিপ্ত চিন্তাধারার সংজ্ঞাহীন পংক্তি ”পারিবার নয় দেখিবার”।

ব্যান্ডেল(অন্তিম স্টেশন)

শেষের কবিতা

ঘুম ভেঙেছে, নামতে হবে। শাশ্বত পরে বলবে, ঘন্টাখানেক গ্যালোপিং সাহিত্যা, মিনিট ১৫ সময় নষ্ট। আমি কবিতা বিক্রি করি না, কিনতেও বলি না, ৭০৪৪৭৬৭৭১৪ এই নম্বরে ক্র‍য় মূল্য ফেরত দেওয়া হয়। মালিনী বলেছে আমরা চরকের মেলায় যাব আজ। আমি পৌছে গেছি। অন্তিম স্টেশন, গাড়ি থামছে। হয়তো চিরকালই মালিনীকে ভালোবেসেছি। গদ্যের প্রশয়ে বেড়ে উঠেছে কবিতার ম্যানগ্রোভ। মালিনীর আবদার, শেষ কবিতা। সময় শেষ, লোডশেডিং।

কার শেড

“একা বেঁচে থাকতে শেখো প্রিয়

তোমার নামে শিরনি দিয়েছি, তারার মাজারে।

আমায় নিয়ে আর ভেবো না, আরাম প্রিয়

মনে স্বস্তি জেনো, শুধুই ফূর্তি মেনো

দোলন-চাঁপার মৌসুমে আমি টানছি ইতি এবার,

তোমার বন্ধ ঘরে শোবার স্বভাব না করেছি কবার?!

তোমার মনের গতি

তোমার মনের গতি রাতের দুরপাল্লার গাড়ি,

আমি ধরতেও না পারি, আমি ক্যামনে যাব বাড়ি।

টিকিট কেটে রেখেছিলাম যাত্রা সময় ভুলে

এখন ইস্টিশনে বেজায় অন্ধকার।“ -আসির আমান

সুপ্রভাত মেট্যা

তমলুক, পূর্ব মেদিনীপুর

কবিতাঃ প্রদীপ প্রামানিক

প্রদীপ প্রামানিক

সুভাষগ্রাম, কলকাতা

অর্ক চক্রবর্তী

কবিতা; সুপ্রভাত মেট্যা
কবিতাঃ অর্ক চক্রবর্তী

Comments

Top

মাধুকরী পুজো বার্ষিকী ২০২৮: পর্ব ২

কবিতা

দলনেতা

দাদা ওরা সমাজকর্মী,  দলকর্মী বললে রাগ
যেহেতু আমরা সাধারণ মানুষ তাই, সবাই ভাগ-
দাদা ওরা সমাজকর্মী সমাজ নিয়ে ভাবে- জনগণের সেবা টাকা, নিজের পকেটে ভরে
দেশের সেবায় ঘুম আসে না, ঘরের মধ্যে পায়চারি,
যত দেশের সেবা করে ততোই গাড়ি- বাড়ি।
গরিব মানুষের ঘর দেবে, মধ্যবিত্তের লোন - জনসেবায় হয়ে উঠবে, ওরাই আপনজন।
দুর্যোগ ও ত্রাণ দেবে, দেবে তাদের অর্থ -
ভিতরে ভিতরে চুক্তি থাকে, গোপন কিছু শর্ত।
জ্ঞানীগুণী ধার ধারে না, "ওরা" কোন ছা-
সুস্থ জীবন বাঁচতে হলে, "দাদার" কাছে যা।
দাদা ওরা সমাজকর্মী দেশের কথা ভাবে -
যেমন কথা তেমন কাজ, যে কোনো উপায়ে।
গিরগিটির মতো রং পাল্টায় সময়ের ব্যবধানে। জনগণের ঘুরতে হয়, তাদেরই টানে টানে-
দ্বিমত হলে এক ঘরে, জীবন সংশয়।
বোমা পড়বে, না গুলি চলবে, সেটা নিয়ে ভয়!

fisherman.jfif

রূপনারায়ণের চরে আমরা

রূপনারায়ণের চরে আমরা।
দুপুর ছায়াহীন সেই চর জেগে আছে।
হোগলা বনের সারি।
অদূরতম নদীর স্বরে কথা বলছে মেয়েরা....

শীত --
ক্রমশ মৃদু হয়ে ভালো লাগছে আমাদের গায়ে।
চড়ুইভাতির ছেলেরা, অল্প হাওয়ায় পায়ে বল নিয়ে খেলা করছে।
রন্ধনের গন্ধ আসছে নাকে।
খোলা মনে উড়ে বেড়াচ্ছে কবিতারা
আমার হৃদয় থেকে উঠে এসে
নদীর ঠিক উপরে পাখিদের ডানার স্রোতে
রোদলাগা পঙ্ ক্তির
কী খুশির হাওয়ায় হাওয়ায়....

একান্ত

ঝুম বিকালে বৈরাগী তোর আলখাল্লার খুঁটে
কয়েক জন্ম মিলিয়ে যাওয়ার আগেই কিছু দেখা।
চোখ বুজে শেষ আলোয় রাঙা বসতবাড়ি ঘিরে
দুই পলকের মধ্যিখানে শূন্য আকাশ লেখা—
বিদায় প্রস্থ মৃত্যু নাহয়
পরের পায়ে ছড়িয়ে দেওয়ার
আলগোছা রোখ নির্বিশেষে
গুছিয়ে তুলে রাখা—

নিঝুমতলার বটে ঝুড়ির অন্ধকারে ছায়ায় ছায়া
জাপটে ধরে রাস্তা থেকে অচিনপথে হারিয়ে যাওয়া
সঙ্গী চিনেই হাত ধরেছি বাউল হব বলে।
ধূলায় ধুধু রুক্ষ জটায় শ্রাবণ বিকেল জানে—
সর্বনাশের আশীর্বাদে
হৃৎকমলে পিদিম জ্বলা
মাটির বসত সাঁঝবেলাতে
গুছিয়ে বসার মানে।।

জবা রায়

ময়মনসিংহ, বাংলাদেশ

কবিতাঃ জবা রায়

Comments

Top

কবিতা

মাধুকরী পুজো বার্ষিকী ২০২৮: পর্ব ২

'অস্তিত্ব পোড়ানোর দিনরাত'


বিনাশী একতারা দেখে যাও
ওজনের ভারে এখানে জমেছে বিষাদ 
খুব কাছে-
সাপ্তাহিক যন্ত্রণা শোনাতে আসা
বছরের শেষ সোমবার
ক্রসফায়ারে মারা গেলো পরশুদিন
এরপর থেকে ঘনীভূত গতকাল
জীবন খাতায় লিখে যাচ্ছে ভুল তথ্য 
দেহ ক্ষয়ের শব্দ দিয়েও 
সেসব অনুবাদ করতে পারেনি আগামীকাল 
কারণ-
মহাকালের চল্লিশতম চোখটি
এখনো অপূর্ণতার কান্নায় আত্মগোপন করে।

'গায়ে মাখা সময়'

গুনের ধোঁয়া মিলিয়ে গেলেই
অধিকার বুঝতে চায় যাযাবর পেন্ডুলাম 
প্রমাণ পাওয়া প্রায়শ্চিত্ত নিয়ে 
যখন সে বেজে ওঠে 
পরজীবি প্রেমে জগদম্বার শেখরে
তখন আঁকে রঙিন প্রচ্ছদ
জাগতিক আলোক বিন্দু মেপে
ফাগুনের মতো নরম ব্যথার আশঙ্কা 
সেও করে
বাকি কথা পরে হবে ভেবে
খসে পড়া রাত বিরাতের এককোষী মন
বেখেয়াল আবার কখনো মাতাল হয়
খুঁজতে থাকে পালাগানের রিনরিনে স্বর
কিছু দূরে-
মিলিয়ে যাওয়া শব্দের ফলাফল 
ছড়িয়ে দেয় উপভোগের ঘ্রাণ। 

'চক্রের সিলেবাস'

নুভবের সঠিক অনুবাদ নিয়ে কেউ জন্মায় না
বরং...
মহাসাগরীয় প্লেট উলটে প্রশ্নের সম্মুখীন হলে
মানুষ ফিরে আসে নিজের কাছে
ভূত্বক ফুঁড়ে অতীতকে স্মরণ করে 
বৈধ নথিপত্র জমা পড়লেই
বুলি কপচিয়ে সে পায় মাটির স্পর্শ 
চেনা গন্ধে পুরাতন বিশ্ব খুলে
যদি মিশরীয় ভুলের সম্মুখীন হয়
তাহলে অমাবস্যা গায়ে মাখে
কারণ আংশিক ক্ষয়ের যাপন নিয়ে 
যত মানুষ জন্মক্ষণ ভুলে গেছে
তাদের আয়োজন ছিল কেবল দুঃখী হবার। 

গল্প

শারদ প্রাতে

শারদ প্রাতে

 শ্রেয়া বাগচী 

himadri3.jpg

Comments

Top

মাধুকরী পুজো বার্ষিকী ২০২৮: পর্ব ২

র মাত্র দুই দিন। তারপরই ঢাকে কাঠি পড়বে। রিটায়ারমেন্টের পর শহরের দক্ষিণ প্রান্তে এই ফ্ল্যাটটি কিনেছিলেন অবিনাশ দত্ত। স্ত্রী অনুলেখা আর ছেলে আকাশ এই নিয়ে ছোট সংসার। যদিও ছেলে ফ্ল্যাট কেনার কিছুদিনের মধ্যেই চাকরি পেয়ে চলে যায় অন্য শহরে। দূরে বলতে দেশের একদম অন্য প্রান্তে, পুনেতে। সুতরাং অবিনাশ-অনুলেখার নিঃসঙ্গ অবসর জীবনে ওরা দুজনেই একে অপরের সঙ্গী। ওনাদের ফ্ল্যাটবাড়ির দুর্গাপুজোটা বেশ বিখ্যাত। অনেকবার সেরা আবাসনের পুজো হিসেবে অনেক নিউজ চ্যানেল থেকে পুরস্কার পেয়েছে। গতবার মহামারী-সচেতনতা নিয়ে যে থিম করলো অনেক স্বীকৃতিও পেলো ওদের এই "জীবন-যাপন" আবাসন। অবিনাশের মনে পড়ে তিনবছর আগের দুর্গাপুজোতেও ওনার এই দুই কামরার ফ্ল্যাটটা আলোকিত হয়ে উঠতো। না তা শুধু মা দূর্গা আসার কারণে নয় আকাশ ও বছরে এই একবারই আসতো বেশ কটা দিন হাতে নিয়ে। অনুলেখা-অবিনাশ দুজনে এয়ারপোর্ট থেকে গিয়ে রিসিভ করে আনতেন প্রতিবছর। সারাবছর ধরে অনুলেখা থাইরয়েড, কোমর, হাঁটুতে ব্যথা এসব রোগে কাহিল হয়ে থাকলেও ওই দশটা দিন যেন নিজেই দশভূজা হয়ে উঠতেন। ছেলে আসবে বলে দুদিন আগে থেকে রান্নার উৎসব লেগে যেত বাড়িতে। অবিনাশ দেখতেন লেখা একবার রান্নাঘরে গিয়ে রান্নার বৌকে ইন্সট্রাকশন দিচ্ছেন আবার মাঝে মাঝে আকাশের ঘরে এসে ধুলো ঝেড়ে যাচ্ছেন। খাটের উপর উঠে ঝুল ঝাড়ছেন, পর্দা লাগাচ্ছেন, আরও কত কি অত কি লেখা যায় শুধু অনুভব করা যায়। খেয়েদেয়ে দুপুরে ভাত-ঘুম এর অভ্যাস অনেকদিনের অনুলেখার। তা আকাশ আসার দুইদিন আগে থেকে সেসব চুকে যেত। দুপুরবেলা বসে বসে নিরিবিলিতে ক্ষীরের মালপোয়া, লবঙ্গ লতিকা, রসমালাই এসব বানিয়ে যেতেন অনুলেখা। আর উঠতে বসতে বকা খেতেন অবিনাশ। "তোমাকে শুধু বাজারটা একটু গুছিয়ে করতে বলি তাও তুমি পারো না।সব ভুলে চলে আসো। এখন আমি ছেলেটাকে কি দিয়ে খেতে দেব বলতো? বেআক্কেলে মানুষ একদম।" বকাগুলো শুনতে কি যে ভালো লাগতো অবিনাশ এর যেন কলেজ প্রেম এর দিনগুলো মনে করিয়ে দিতো। আকাশ যেদিন আসতো অনুলেখা তার আগেরদিন মনে হয় ঘুমতোই না। সকাল হতেই এয়ারপোর্ট গিয়ে হাজির হতেন দত্ত দম্পতি সেই অপেক্ষা করতে যে কি ভালো লাগতো। আকাশ এলে তাকে এয়ারপোর্ট এই জড়িয়ে ধরে কি যে কান্না লেখার দেখেই বাবা-ছেলে দুজনেই লজ্জা পেয়ে যেত। তারপর যেন পরের দশ দিন ঝড়ের বেগে বেরিয়ে যেতো। সপ্তমীতে আকাশ এর স্কুল-কলেজ এর বন্ধুরা এসে আকাশকে নিয়ে বেরিয়ে যেত। অষ্টমীর দিনটা অবশ্যই আকাশ এর তার মা-বাবার জন্য তোলা থাকতো। সকালে মা এর কেনা ধুতি-পাঞ্জাবি পড়ে অঞ্জলি দেওয়া আর রাতে মা-বাবাকে নিয়ে আশেপাশের ঠাকুরগুলো দেখিয়ে আনা এই বাঁধাধরা ছিল আকাশের। নবমীর রাতে পুজোর কালচারাল অনুষ্ঠান এ আকাশ এর ঢাক বাজানোর ফার্স্ট প্রাইজটা যেন অবসম্ম্ভাবী ছিল প্রতিবার। ফ্ল্যাট বাড়ির সব কচি কচি মেয়েগুলো তখন অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো আকাশ এর দিকে লক্ষ্য করেছেন অবিনাশ অনেকবার। লক্ষীপুজোর পর দিন ছেলের রিটার্ন ফ্লাইট থাকতো। সেই কারণে আলাদা করে লক্ষীপুজো তুলেই দিয়েছিলেন অনুলেখা ওই ফ্ল্যাট এ বাড়োয়ারি যেটা হতো তাতেই থাকতেন। বলতেন "আকাশ যেবার ঘরে লক্ষী আনবে সেবার আবার পুজো হবে"। ফেরার সময় কোনোদিনই যেতেন না অনুলেখা এয়ারপোর্ট এ। অবিনাশ ঝাপসা চোখে দেখতেন ছেলেটা ভেতর গিয়ে হাত নাড়ছে। আবার আরেকটা বছরের অন্ধকার। অবিনাশ-অনুলেখা দুজনেই আকাশকে বলেছেন বহুবার বিয়ে নিয়ে। ছেলে এড়িয়ে যায়। অবিনাশ এর মনে পড়ে লেখা কত করে বলেছে "কেউ যদি পছন্দ থাকে বল আমাদের, আমরা কথা এগোই, দুই পরিবার এ কথা বলি"। কিছুই বলতো না আকাশ। কত সম্বন্ধ এদিক-ওদিক থেকে আসতো সব বলতেন ছেলেকে অনুলেখা। আকাশ বলতো "না মা আমি এখনো স্ট্যাবল হইনি। আমাকে আরেকটু সময় দাও"। সেই লাস্ট বার যেবার আকাশ এলো পুজোতে ওনারা এবার খুব জোর করলেন, চেপে ধরলেন। সেবার। হ্যা সেবারই তো। ছেলে বলে উঠেছিল সেই সাংঘাতিক কথাটা। প্রায় তিন বছর ধরে ছেলের একটা সম্পর্ক আছে। একসাথেই থাকে তারা। ভালোবাসে একে অপরকে। দুজনেই তারা পুরুষ ।"হ্যাঁ আমি আদিত্যকে ভালোবাসি বাবা"। যেরকম অবিনাশ দত্ত ভালোবেসে এলো অনুলেখা সেনকে আমিও বাসি আমার আদিত্যকে। কোনো পার্থক্য নেই। ভালোবাসায় ভালোবাসাটাই নিয়ম বাবা আর কিছু নিয়ম হয় না কোনো নিৰ্দিষ্ট পদ্ধতি হয় না। পারবো না আমি আর কাউকে ভাবতে"। কথাটা শুনে যেন মনে হয়েছিলো অষ্টমীতেই বিসর্জন হয়ে গেলো। অবিনাশ কিছু বললেন না। অনুলেখা কত বোঝালেন ছেলেকে। সাইক্রিয়াটিস্ট দেখাবেন, ওখানের চাকরি ছেড়ে দিলেই হয়ে যাবে। এখানে ওর জন্য তো মেয়ের লাইন রয়েছে। সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু আকাশ অবিচল। দৃঢ় -প্রতিজ্ঞ সে। অবিনাশ সেই দিন সন্ধেবেলা ছেলের হাতে খাম দিলেন একটা বললেন "কাল ভোরের ফ্লাইট এ তুমি চলে যাবে। এতে টিকিট আছে। মাস গেলে যে টাকা তুমি আমাদের পাঠাও তার প্রয়োজন নেই, এমনিতেও ওই টাকা আমরা তুলি না, জমাই হয়, আমার পেনশন দিয়ে আমাদের সাচ্ছন্দে চলে যায়। সকাল সকাল বেরিয়ে পড়ো। ফ্লাইট মিস যেন না হয়"। একটা ঘাড় নেড়েছিলো আকাশ আলতো করে। সেই শেষ কথা দুজনের। পরেরদিন নবমীর সকালে ছেলে ক্যাব ডেকে চলে গেলো এয়ারপোর্ট। অনুলেখার সেদিন খুব জ্বর এলো। আকাশ রোজ রাতে নিয়ম করে যে ফোন করতো বারণ করে দিলেন অবিনাশ। অনুলেখাকেও খুব কড়াভাবে নিষেধ করেছিলেন ছেলের সাথে যোগাযোগ করতে। প্রথম প্রথম আকাশ অনেক চেষ্টা করলেও সেও ছেড়ে দিলো। যোগাযোগ কমতে কমতে মাসে একটা ফোনে এসে ঠেকেছিল। তাও অনুলেখাই শুধু কথা বলতেন। পাঁচ মিনিট হয়তো। বাজার-ঘাটে, পেনশন তুলতে, ডাক্তার এর ক্লিনিক এ ছেলের কথা জিগেস করলে এড়িয়ে যেতেন অবিনাশ। আকাশ এর বন্ধুদের সাথে দেখা হলে কথোপকথনে বুঝতেন ফেসবুকে যোগাযোগ আছে ওদের। আর তারা অনেক আগেই জানে আকাশ এর এই ব্যাপারটা। একটা জিনিস লক্ষ্য করেন ছেলের বন্ধুগুলো এই সব নিয়ে খুব মুক্ত ভাবধারার। যেন এমনটা তো হতেই পারে হয়ই তো। খুব স্বাবাভিক। তা সে ওরা মনে করতে পারে কিন্তু অবিনাশ পারবেন না। অন্তত এই জীবন এ তো নয়ই।             

সবকিছুর একটা পন্থা থাকে, শৃঙ্খলা থাকে, থাকাই উচিত। দেখতে দেখতে বছর ঘুরে আর একটা পুজো আসে। কিন্তু তার আগে আসে মহামারী। অবিনাশ খবর পান আকাশের শহরের অবস্থা খুব শোচনীয়। সেই একবার ফোন করে খোঁজ নিতে বলেন লেখাকে যে ছেলে বেঁচে আছে কিনা একবার জানতে। না ঠিকই আছে আকাশ আর তার সঙ্গী এখনো পর্যন্ত। শুনে যেন ভেতরটা শীতল হয় দুজনের। সেবারের পুজোটা জৌলুসহীন হলো ফ্ল্যাট এর বাইরে, ভেতরে সব জায়গায় অনুলেখা কেমন যেন নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছিলো একটু একটু করে। দিনে দু-একটা কথা যেটুকু না বললেই নয়, তাছাড়া আর ওনাদের কোনো কথা হতো না। সারাদিন লেখা পূজা-অর্চনা নিয়েই মেতে থাকতো দেখেছেন অবিনাশ। বেশির ভাগ দিন রাত এ কিছু খায় না। দিনেও আজ এই ব্রত, কাল ওই উপোস করে অনিয়ম করতো। বোঝানোর চেষ্টা করেছেন অনেক স্ত্রীকে অবিনাশ। কিন্তু সবই মনে হয় বিফল হতো। সেবছর শীত থেকে শরীর একদম খারাপ হতে থাকে অনুলেখার। সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকলো থাইরয়েড, সুগার সমস্ত। গত ফেব্রুয়ারী তে তারপর মহামারী কেড়ে নিলো অনুলেখাকে। দুজনেই ছিলেন হাসপাতালে। অবিনাশ ফিরলেন লেখাকে ছাড়াই। শেষ দেখাও হলো না। আসলে ডাক্তার রা বলেছিলেন ভেতর থেকে ভীষণ ভেঙে পড়েছিলেন অনুলেখা। অসুখ এর সাথে লড়াই করার শক্তি বা ইচ্ছা কোনোটাই ছিলো না ওনার। একথা অবশ্য অবিনাশ এর চেয়ে আর ভালো কে জানবেন? ঘরে ফিরে এসে ছেলেকে এই প্রথম বার ফোন করে বললেন "মা নেই। চলে গেলেন পরশু। আমি হাসপাতাল থেকে আজ ফিরলাম। তোমার আসার কোনো প্রয়োজন নেই, আমি গুছিয়ে নেবো"। ছেলের শুধু আগের মতোই একটা সংক্ষিপ্ত উত্তর "আচ্ছা বাবা"। তারপর থেকে সত্যিই নিঃসঙ্গ জীবন অবিনাশ এর। নিজের জন্য আলাদা করে ভাবতে বা করতে ইচ্ছে হয় না। সকালে প্রাতঃভ্রমণে গিয়ে দু একজন পুরোনো বন্ধুদের সাথে কথা, আর সারাদিনে কিছু আত্মীয় -স্বজন এর ফোন আর বই পড়া এভাবেই কাটে দিন। ভীষণ এক হয়ে যাচ্ছিলেন অবিনাশ। অনুলেখার ফটোর সামনে দাঁড়িয়ে কত কেঁদেছেন অবিনাশ। কত বার ক্ষমা চেয়েছেন। তবু যেন ভাঙতে পারেন না নিজের ভেতর এর সংস্কার এর পাহাড়টাকে। ভাইঝি-ভাইঝি জামাই ফোন করে বিদেশ থেকে বলে "এগুলো খুব নরমাল কাকু। আমাদের এখানে এসব নিয়ে কেউ ভাবেই না, বাধা দেওয়া তো দূরের কথা। আমাদের দেশেও তো দেখো সর্বোচ্চ আদালত স্বীকৃতি দিয়েছেন"। হাজার বোঝানোতেও বরফ গলতো কিন্তু বরফ এর পাহাড়টা সরতো না একটুও। তারপর এলো দ্বিতীয় ঢেউ। ততদিনে অবিনাশ ভ্যাকসিনেটেড। টিভিতে পেপার এ কি সাংঘাতিক, মর্মান্তিক খবর সব। অবিনাশ এর ভেতরটা সংশয়ে ভরে যায়। আকাশ এর শহরটা যেন মৃত্যুপুরী বহু ইচ্ছে হয় একবার খোঁজ নিতে আকাশ এর। কিন্তু ভেতর এর পাহাড়টা কে যেন টেনে সরাতেই পারেন না। তোলপাড় হয়ে যায় সব, শেষে একদিন ফোন করেই বসেন আকাশকে। ফোনের ওপাশে তখন আদিত্যের গলা। আকাশ গত সপ্তাহ থেকে হস্পিটালইজেড।আইসিইউতে। মহামারী গ্রাস করতে এসেছে তাকে। আস্তে আস্তে ফোনটা নামিয়ে রেখে দেন অবিনাশ। লেখা চলে যাওয়ার পর শুধু তাকে একা করে যান নি বড় বেশি ভীতু করে গেছেন। আর যেন ভয়কে জয় করার শক্তি পান না ভেতর থেকে। ঠাকুর -দেবতার ওপর অসীম ভক্তি কোনোদিনই ছিল না অবিনাশ এর। তবে উনি নাস্তিক নন।আজ একবার লেখার খুব যত্নের ঠাকুর ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ান অবিনাশ। চোখের জলে ভেসে যায় বুক। আপনা থেকেই হাতটা জড়ো হয়ে যায় যেন। পাশে থাকা অনুলেখার ছবির দিকে তাকিয়ে বলেন "লেখা, আমি বড় একা আজ। দেখো আজ আমার একাকিত্ব ভাগ করে নেওয়ার জন্য ও তুমি আর নেই। "ফটোটা নিয়ে একবার ভালো করে মুছে ভাবতে থাকেন, এই তো লেখা, এই তো তার কত সাধ এর সাধনার, যত্নের ঘর, সংসার গৃহস্থালি সব কিছু ফেলে চলে গেছে। ওনাকে নিঃশেষ করে। আজ আকাশ মৃত্যুর সাথে লড়ছে। হয়তো সে ও ....। কি থাকবে পড়ে? কি থাকে পড়ে? উনি একা? কাকে নিয়ে বাঁচবেন? সেই পাহাড় প্রমাণ উঁচু সংস্কারটাকে নিয়ে? যেটাকে উনি রোজ কুঠার দিয়ে আঘাত করেও সরাতে পারেন না? আজ যখন জীবনের একেবারে কিনারায় এসে হিসেব করতে বসেছেন তখন কি মনে হচ্ছে না জীবন আর সেই জীবনকে আষ্ঠে-পৃষ্ঠে বেঁধে থাকা মানুষগুলোর চেয়ে বড় সত্যি, বড় নিজের এই জগতে আর কিছুই নেই? কিছুটা নেই। পারবেন কি সাথে করে নিয়ে যেতে নিজের ভেতরের এই পাহাড়টা কে? কেউ তো কিছুই পারে না নিতে? তবু সারা জীবন ধরে জীবনের সাথে কি লড়াই। আজ যদি আকাশ ও? সেও কি পারবে তার সমাজের কাছে সিলমোহর এর অপেক্ষায় থাকা ভালোবাসা যার জন্য সে দূরে করে নিয়েছে নিজের মা-বাবার থেকে তাকে সাথে করে নিয়ে যেতে? তাহলে? তাহলে কিছুই না। অবিনাশ ফোন করেছেন আদিত্যকে। খোঁজ নিয়েছেন নিয়মিত দুজনের। মহামারীকে হারিয়ে ফিরে এসেছে আকাশ তার আদিত্যের কাছে। অবিনাশ বুঝেছেন আকাশ আদিত্যকে ছাড়া সম্পূর্ণ নয়। আকাশ তো কোনোদিনই আদিত্য ছাড়া সম্পূর্ণ হয় না। আকাশ এর কথা হয়েছে বাবার সাথে। ভিডিও কল এ কেঁদেছে অনুলেখার ফটো নিয়ে কেউ স্ত্রী এর জন্য কেউ মা এর জন্য । পুজো আসার দুই মাস আগেই অবিনাশ দুই ছেলের জন্য টিকিট কেটে পাঠিয়েদিলেন মেইল এ। আজ মহাসপ্তমী। মহামারীর প্রকোপে বেশ কম। আকাশ এ বাড়ি ছাড়ার পর দত্তবাড়ির ফ্ল্যাট এর সামনে দিয়ে আর টুনি ঝোলানো হয় না। এই প্রথম টুনি ঝোলানো হলো। অবিনাশ একা মানুষ। যতটা পেরেছেন ঘর-বাড়ি নতুন করে সাজিয়ে-গুছিয়েছেন।নতুন পর্দা এনে লাগানো করিয়েছেন ঘরে ঘরে। সাধ্য মতো বাজার করেছেন। দুই ছেলের জন্য পছন্দ করে ধুতি-পাঞ্জাবি কিনেছেন। অনুলেখার ফটোর কাছে গিয়ে জিগেস করেছেন কিছু আনতে ভুল হলো কিনা? রাতে উত্তেজনায় ঘুম হয়নি। ভোরবেলা ফ্লাইট এ ওঠার আগে ফোন করেছে আকাশ। ব্যালকনিটার সামনে গিয়ে দেখেন নবপত্রিকা স্নান এর তোড়জোড় চলছে। আকাশটা আজ ভীষণ রকম নীল। ভীষণ খোলা ভীষণ নির্মল যেন। আকাশ-আদিত্য নিশ্চয় প্লেন এ বসে গেছে। ঢাক বাজছে হালকা। কানের কাছে যেন অনুলেখা হেসে হেসে বলে যাচ্ছে "বেয়াক্কেলে মানুষ একেবারে"। মাইকে তখন বিরূপাক্ষের গলায় "শান্তি রূপেণ সংস্থিতা, ক্ষমা রূপেণ সংস্থিতা"।। 

প্রবন্ধ

তত্ত্ববোধিনী

Comments

Top

মাধুকরী পুজো বার্ষিকী ২০২৮: পর্ব ২

sukhomoy.jpg

সমাজ  সংস্কারে  তত্ত্ববোধিনী  

পত্রিকার ভূমিকা এবং অক্ষয়কুমার দত্ত

সুখময় ঘোষ

শ্রীরামপুর, হুগলী

Akshay_Kumar_Datta_photo.jpg

অক্ষয়কুমার দত্ত

নবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে সংস্কারপন্থীরা সমাজ চেতনায় পরিবর্তন আনতে লেখনীকে প্রয়োজনীয় অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করেছিলেন। সমাজ সংশোধক সুচিন্তিত প্রবন্ধাদি তাঁদের প্রধান হাতিয়ার হয়েছিল। ব্রাহ্মসমাজের তত্ত্ববোধিনী সভার মুখপত্র তথা তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা এই উদ্দেশ্যে বাংলার পাঠকবর্গের সামনে নতুন বার্তা নিয়ে এসেছিল যা এককথায় ছিল অসাধারণ। এর সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই পত্রিকার লেখক ও পৃষ্ঠপোষক সকলেই ছিলেন সংস্কারপন্থী। উনিশ শতকের শ্রেষ্ঠ গদ্যলেখক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজনারায়ণ বসু, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ এই পত্রিকার নিয়মিত লেখক ছিলেন। এই সমস্ত বিখ্যাত মানুষদের লেখার মাধ্যমে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের এক নবযুগের সূচনা হয় ।
১৮৪২ সালের জুন মাসে অক্ষয়কুমার দত্ত এবং টাকির প্রসন্নকুমার ঘোষের উদ্যোগে ‘বিদ্যাদর্শন’ নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল। পত্রিকাটি উচ্চমানের এবং বেশ জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু ছয় মাসের পরেই পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। পত্রিকাটির জনপ্রিয়তা দেখে মহর্ষি  দেবেন্দ্রনাথ  ঠাকুরের মনে  একটি  আদর্শ  পত্রিকা  প্রকাশ করার  ইচ্ছা  উদয় হয়। এর ফলস্বরূপ তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার জন্ম।
তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সম্পাদক নির্বাচনের জন্য পরীক্ষা নেওয়া হয়েছিল। পরীক্ষা নিয়েছিলেন স্বয়ং দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রথম সম্পাদক হয়েছিলেন অক্ষয়কুমার দত্ত। ১৮৪৩ সালের ১৬ আগস্ট (১ ভাদ্র, ১৭৬৫ শক) অক্ষয়কুমার দত্তের সম্পাদনায় তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা প্রথম প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকায় অক্ষয়কুমার দত্তের দেশের হিতার্থে লেখা বস্তুতত্ত্বের নির্ণায়ক প্রবন্ধ ও দর্শনমূলক মূল্যবান রচনা বঙ্গসাহিত্যের সমৃদ্ধির সূচনা করেছিল। বেদান্তসর্বস্ব  ব্রহ্মবিদ্যার প্রচার  তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার মুখ্য উদ্দেশ্য হলেও জ্ঞানবিজ্ঞান, সাহিত্য,‌ ইতিহাস, ধর্ম, অর্থনীতি, রাজনীতি এবং দর্শনশাস্ত্রের তাত্ত্বিক রচনাও এতে প্রকাশিত হত। তত্ত্ববোধিনী সভার সভ্যদের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করত এই পত্রিকা। প্রাথমিকভাবে এটি সাপ্তাহিক সংবাদপত্র হিসাবে যাত্রা শুরু করেছিল। পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মহাভারতের অনুবাদ এবং দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঋকবেদ সংহিতার অনুবাদও এই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এই দুই অনুবাদ জনসাধারণের কাছে এতটাই গ্রহণযোগ্য হয়েছিল যে ভারতের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ভাষায় তাহা অনূদিত হয়েছিল। তৎকালীন কলেজের শিক্ষিত তথাকথিত নব্যযুবকেরা এবং পণ্ডিত ব্যক্তিগণ ইংরাজী শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে বাংলাভাষায় কোন পত্রপত্রিকা পড়তে কুণ্ঠিতবোধ করতেন। কিন্তু অক্ষয়কুমারের রচনা পাঠ করার জন্য উক্ত যুবসম্প্রদায় ও পণ্ডিতেরা তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা প্রকাশিত হলে আগ্রহের সাথে সেটি পাঠ করতেন।
অক্ষয়কুমার দত্তের সম্পাদক হিসাবে প্রথম পারিশ্রমিক ছিল ৩৯ টাকা। দক্ষ পরিচালনার জন্য সেটা ৩৯ টাকা থেকে বেড়ে ৪৫ টাকা হয়েছিল এবং পরবর্তীকালে সম্পাদক হিসাবে প্রাপ্য হয়েছিল ৬০ টাকা। চলার পথে অক্ষয়কুমারের সম্পাদনায় পত্রিকাটির অনেক পরিবর্তন হয়েছিল। যেমন পত্রিকায় বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হত, সূচীপত্র সংযোজিত হয়েছিল। পুস্তক সমালোচনার জন্য একটি আলাদা বিভাগ যুক্ত করা হয়েছিল। 
বাংলার সংস্কৃতি ও সভ্যতার উন্নতিতে এই পত্রিকার বিশেষ অবদান ছিল। বাঙালীর যুবকদের সামনে দিশা দেখাতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বাঙালীদের অংশগ্রহণ এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতালাভের উপযুক্ত করে নিজেদের গড়ে তোলার জন্য তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় নিয়মিত লেখা প্রকাশিত হত। সমাজ সংস্কার ব্যতীত শাসকবর্গের অত্যাচারের বিরুদ্ধেও প্রতিবাদী চরিত্র বজায় রেখেছিল এই পত্রিকা। অক্ষয়কুমার দত্ত সর্বপ্রথম এই পত্রিকায় নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের কথা প্রকাশ করেন। এই সংবাদ প্রকাশের পরেই সকলেই জানতে পারেন কিভাবে নীলচাষীদের প্রতি ক্রীতদাসদের মত ব্যবহার করা হত। পরে তার সূত্র ধরেই হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট ’-এ তাঁর জ্বালাময়ী লেখনী  ধারণ করেছিলেন।
‘ব্রাহ্মধর্ম আন্দোলন’-কে ছড়িয়ে দিতে এই পত্রিকা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। এই পত্রিকার প্রকাশের উদ্দেশ্য ছিল: ‘ব্রাহ্মসমাজ যাতে স্থানে স্থানে স্থাপিত হয় এবং যে রূপেতে সর্বোৎকৃষ্ট পরম ধর্ম বেদান্ত প্রতিপাদ্য ব্রহ্মবিদ্যার প্রচার হয়, তাহার সাধন’। পূর্ববঙ্গে ব্রাহ্মধর্ম প্রচার মূলত এই পত্রিকার মাধ্যমেই হয়েছিল। ঢাকায় প্রতিষ্ঠার প্রধান স্থপতি ব্রজসুন্দর মিত্র তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা পাঠ করেই ব্রাহ্মসমাজ গঠন করেন। যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতা এবং স্বল্পসংখ্যক কর্মী থাকা সত্ত্বেও ব্রাহ্মসমাজের কর্মপরিধি ব্যাপ্ত হয়েছিল এই পত্রিকার সৌজন্যে। পত্রিকার মূল্য ছিল বার্ষিক তিন টাকা। অক্ষয়কুমারের সম্পাদনকালে পত্রিকার সংখ্যা হয়েছিল সাতশোর মত। ফুলস্কেপ কাগজের আকারের প্রকাশিত তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার পৃষ্ঠার সংখ্যা  ছিল আট থেকে বারো। ভাষার উৎকর্ষতার দিক দিয়ে অক্ষয়কুমার দত্ত তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় সাধুভাষার পরিবর্তে চলিতভাষা প্রয়োগের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। আমারদিগের, তোমারদিগের, করিবেক, যাইবেক ইত্যাদি শব্দগুলিকে তিনি সাধুভাষায় রূপান্তরিত করেছিলেন।
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ইচ্ছা ছিল তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় শুধু বিশুদ্ধ ধর্মতত্ত্বের বিষয়ে রচনা প্রকাশিত হবে। কিন্তু অক্ষয়কুমার চাইতেন বিজ্ঞান ও জড়বাদী বিষয়ক লেখাও পত্রিকায়

ছাপা হবে। শেষপর্যন্ত অক্ষয়কুমারের ইচ্ছাই প্রাধান্য পেয়েছিল। তাঁর সম্পাদনায় তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় বিজ্ঞান ও যুক্তি -নির্ভর লেখা প্রকাশিত হত। এইসমস্ত সুচিন্তিত রচনার জন্য এই পত্রিকার মর্যাদা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়। তত্ত্ববোধিনীতে প্রবন্ধগুলি নির্বাচিত করা হত ‘পেপার কমিটির’ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে। এই কমিটির সদস্যরা ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, রাজনারায়ণ বসু, শ্রীধর ন্যায়রত্ন, রাধাপ্রসাদ রায়, শ্যামচরণ মুখোপাধ্যায়, আনন্দচন্দ্র বেদান্তবাগীশ এবং অক্ষয়কুমার দত্ত প্রমুখ। প্রবন্ধগুলির বিষয়বস্তু ও মৌলিকত্বের জন্য শিক্ষিত সমাজের অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল এই লেখাগুলি। সেইসময় শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীরা নিম্নমানের বলে বঙ্গভাষাকে অবজ্ঞার চোখে দেখতেন, কেউই বাংলা পুস্তক  প্রকাশ্যে সাহস করে পড়ে দেখতেন না। দেখলেও  গোপনে  পড়তেন।  কিন্তু তত্ত্ববোধিনীতে প্রকাশিত রচনাগুলির গাম্ভীর্য এবং প্রকাশনার মানের কারণে শিক্ষিত সমাজের কাছে লেখনীগুলি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল। প্রকাশিত প্রবন্ধগুলির আবেদন পাঠকদের মনে এমন রেখাপাত করত যে তার প্রভাব হত সুদূরপ্রসারী। একবার নিরামিষ খাদ্যের উপকারিতা নিয়ে প্রবন্ধ প্রকাশ হলে বহু তরুণ পাঠক আমিষ খাদ্যাভ্যাস ছেড়ে নিরামিষাশী হয়েছিল। মদ্যপান বিরোধী লেখনীর জেরে বহু মানুষ মদ্যপান ত্যাগ করেছিলেন। কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত যখন ‘ সংবাদ প্রভাকর’-এর সাহায্যে লেখকগোষ্ঠী তৈরী করছেন ঠিক তার পরেই তত্ত্ববোধিনীর জন্ম হয়। বঙ্গদেশের তৎকালীন শ্রেষ্ঠ লেখক সমাজ এই পত্রিকার প্রকাশনার সাথে যুক্ত ছিলেন। এঁদের মধ্যে অক্ষয়কুমার দত্তের রচনাগুলি শিক্ষিত সমাজের কাছে এতটাই গ্রহণযোগ্য ছিল যে পাঠককুল সেগুলি পাঠ করবার জন্য ব্যাগ্রভাবে পত্রিকা প্রকাশের দিনটির জন্য অপেক্ষা করতেন। তাঁর সরল জ্ঞানপ্রদ রচনাগুলি বাংলার গদ্যসাহিত্যে যুগান্তর এনেছিল এবং এক ‘চারুপাঠই’ তাঁকে বঙ্গসাহিত্যে অমর করে রাখবে। বঙ্গসাহিত্যের মধ্যযুগের এই তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা  প্রকাশনার মানের ক্ষেত্রেও উৎকর্ষতা বজায় রাখতে পেরেছিল। ‘প্রবন্ধ নির্বাচন কমিটি’ বা ‘পেপার কমিটি’-র অন্যতম সদস্য রাজা রামমোহন রায়ের পুত্র রাধাপ্রসাদ রায় এই পত্রিকাটির প্রকাশনাকে আকর্ষক করার জন্য একটি মুদ্রণযন্ত্র দান করেছিলেন।
১৮৫৯ সালে তত্ত্ববোধিনী সভা উঠে গেলে পেপার কমিটিও রদ হয়ে যায়। তখন এই পত্রিকার পরিচালনার ভার পড়ে কোলকাতা ব্রাহ্মসমাজের উপর। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা ১৯৩২ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছিল। অক্ষয়কুমারের পর এই পত্রিকার সম্পাদনার ভার পড়েছিল বাংলা  সাহিত্যের উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কদের হাতে। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন নবীনচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অয্যোধ্যানাথ পাকড়াশী, হেমচন্দ্র বিদ্যারত্ন, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ  ঠাকুর।
তত্ত্ববোধিনী ধর্মবিষয়ক পত্রিকা হলেও এই পত্রিকা প্রথাগত হিন্দুধর্মকে প্রচার করেনি। সামনে এনেছিল নতুন যুগের যুক্তিবাদ-আশ্রিত ব্রাহ্ম হিন্দুধর্মকে। সেই দিক দিয়ে বিচার করলে এই পত্রিকা ছিল যুগচেতনার জীয়ন কাঠি। তাঁর সঙ্গে যুক্ত ছিল অক্ষয় কুমার দত্তের মত যুক্তিবাদী, বিদ্যাসাগরের মত মানবদরদী এবং রাজনারায়ণ বসুর মত ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন – ‘ব্রাহ্মসমাজের বিদ্যাবাগীশের ব্যাখান অনেকেই শুনিতে পায় না। তাহার প্রচার হওয়া আবশ্যক। আর রামমোহন রায় জীবদ্দশায় ব্রহ্মজ্ঞানবিস্তার উদ্দেশ্যে যে সকল গ্রন্থ রচনা করেন, তাহারও প্রচার আবশ্যক। এতদ্ব্যতীত যে সকল বিষয়ে লোকের জ্ঞানবৃদ্ধ্বি ও চরিত্র শোধনের সহায়তা করিতে পারে এমন সকল বিষয়ও প্রকাশ হওয়া আবশ্যক। আমি এই চিন্তা করিয়া ১৭৬৫ শকে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা  প্রকাশের সংকল্প করি।’
দেবেন্দ্রনাথের উক্তিতেই প্রকাশ তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল নীতিধর্ম প্রচার। সেইজন্য এর বিষয় ছিল সীমাবদ্ধ, বিদ্যাচর্চার দিকটা ছিল গৌণ।                     তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার উল্লেখযোগ্য কীর্তি ছিল মহাভারত ও উপনিষদের অনুবাদ ও প্রচার। যদিও এর লক্ষ্য ছিল ধর্মচেতনার উন্মেষ, তথাপি প্রাচীন ধর্মগৌরবেকে দেশবাসীর চেতনার মধ্যে জাগ্রত করার মানসিকতাই ফুটে ওঠে। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার প্রকৃতিতে সীমাবদ্ধতা থাকলেও নবচেতনা সৃষ্টিতে যথার্থ ভূমিকা ছিল। অন্যদিকে বিদ্যাসাগর ও অক্ষয় কুমার দত্তের মত ব্যক্তিত্ববান মনীষীরা থাকায় এই পত্রিকা দেবেন্দ্রনাথের চিন্তাধারার বেড়াজাল থেকে মুক্ত হতে পেরেছিল। অক্ষয়কুমারের ‘বাহ্যবস্তুর সহিত মানব প্রকৃতির সম্বন্ধবিচার’- এর মত লেখা এই পত্রিকাতেই ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। সমকালীন বিষয়ে রচনাও আলাদাভাবে গুরুত্ব পেয়েছে এই তত্ত্ববোধিনীতে। সেটা সম্ভব হয়েছিল অক্ষয়কুমার দত্তের প্রভাবেই।  


তথ্যসূত্র –ঃ                            

                                          
(১) রামতনু লাহিড়ী ও  তৎকালীন বঙ্গসমাজ-শিবনাথ শাস্ত্রী                 
(২) বাঙ্গালা সাহিত্যের কথা -  শ্রী সুকুমার সেন                      
(৩) হুগলী জেলার ইতিহাস ও  বঙ্গসমাজ- সুধীরকুমার মিত্র          
                                                                                       
                                                                                        

গল্প

জমাদার পাখি

Comments

Top

মাধুকরী পুজো বার্ষিকী ২০২৮: পর্ব ২

জমাদার পাখি

দেবার্ঘ্য মুখার্জী

deadbody.jpg

কাককে জমাদার পাখি বলে জানিস তো? কাঠের চেয়ারে শরীরটাকে হেলিয়ে দিয়ে বললো নিমাই দত্ত। কথাটা যার উদ্দেশে সেই সোমনাথ অবশ্য মুখটা না তুলেই বললো, আমরা পুলিশরা জমাদারদের থেকে কম কি?
নিমাই দত্ত এর ভুরুটা কুঁচকে গেল, মানে আমি তুই আমরা সবাই জমাদার?
তাছাড়া আবার কি? এবার মাথাটা তুললো সোমনাথ। শালা, কোন নরকের কিট, কোথায় কি নোংরা করে রাখছে, তাদের খুঁজে বের করো, কোনো তাকে খাঁচায় ভর, কোনটাকে টিপে পিষে মেরে ফেলো, এই তো করি আমরা, তাই না? তাহলে আর কাকের সাথে কি তফাৎ আছে? কাক নোংরা খেয়ে সাফ করছে, তাও তাদের মানুষ সম্মান না দিয়ে তাড়িয়ে বেড়ায়, খেয়াল করে দেখো আজ পর্যন্ত কোনো মানুষকে পুলিশের লোককে সম্মান দিতে দেখেছো? যতটুকু করে মুখেই, পিছন ফিরলেন, চার অক্ষর দিয়ে সম্ভাষণ করে।
নিমাই দত্ত, পোড়খাওয়া পুলিশ অফিসার, মুখে হালকা হাসি এনে বললো, কি হয়েছে তোর? প্রেমে প্রত্যাখ্যান নাকি বাড়িতে কেও কিছু বলেছে?
না না ওসব কিছুই না, বলে সোমনাথ।
হম হম বাবা, লোক চরিয়ে খাই, আমাকে বোকা বানাবে তুমি? মুচকি হেসে বললো নিমাই দত্ত ভালো লাগছে না গো নিমাইদা। রোজ রাতে ডিউটি পড়ছে, সারারাত ধরে, যত মদমাতালের দল ঘুরে বেড়ায়, সেগুলোকে সামলাও। তার ওপর গত পরশুদিন ওই যে বৈষ্ণব পাড়ার ফ্ল্যাটে বৃদ্ধা খুন হলো না, খুব খারাপ লাগলো যেন তো। সামান্য সাড়ে চার হাজার টাকা আর কানের দুল চুরি করতে পেরেছে, তার জন্য বুড়িটাকে মেরে দিলো? 
কান খোঁচাটা কানে দিয়ে চোখটা আধবোজা করে সুড়সুড়ি দিচ্ছিল নিমাই দত্ত, এবার সেটা থামিয়ে বললো "পুলিশের এত খারাপ ভালো বিচার করা চলে না", কটা দিন যাক, ডিউটি তো শিফট হবেই। তুই পারলে শেঠ রোডের দিকটা একটু রাতের দিকে টহল দিস, টু পাইস ইনকাম হবে। দেশি মদের ঠেকটা বারবার বলা সত্ত্বেও গভীর রাতের পরে খোলা থাকে। 
আচ্ছা শোনো না, পরশু যে মিটিংটা  আছে না, ওটার ডিউটি ডিস্ট্রিবিউশন কি হয়ে গেছে? বললো সোমনাথ না না, আজ ঠিক হবে, তুই আমাকে ওই রেপ কেসটার ফাইলটা দেখা।ফাইলটা এগিয়ে দেয় সোমনাথ, আবার ও নিজের কাজে মন দেয় সে। কাজের ফাইল নিয়ে কথা বলতে বলতে নিমাইদা ঘড়িটা দেখে বললেন, নাঃ, বেরিয়ে পর ফাস্ট রাউন্ডটা মেরে আয়। আমিও এবার কোয়াটারে ফিরবো।
বাইক এ স্টার্ট দিয়ে বেরিয়ে পড়লো সোমনাথ। মাত্র আট মাস হলো পুলিশের চাকরিটা পেয়েছে সে। ওদের পাড়ার MLA স্বপন সাধুখাঁর হয়ে অনেক বছর খেটে, এটা সে জোগাড় করেছে। ওর বাড়ির লোকও বিশ্বাস হারিয়েছিল, কিন্তু স্বপনদার ওপর খুব ভরসা ছিল সোমনাথের। যখন বডি বিল্ডিং করতো, ক্লাব-এ, তখন থেকে স্বপনদাকে চেনে সে, সামান্য লোকাল নেতা থেকে, ধীরে ধীরে স্বপনদা যে ভাবে উঠে এসেছে, সোমনাথও তার রাজনৈতিক দাদার সাথে সাথে ক্ষমতা পেয়েছে অনেক। এক ধাপে, অনেকটা ওপরে চাকরিটা করে দিয়েছে দাদাই। এসব ভাবতে ভাবতে, মিত্তিরবাগান লেনের বামদিকের মোড়টা ঘুরতেই দেখতে পেলো সামনে কি একটা যেন বসে আছে রাস্তার ওপর।
আচমকা ওরম অন্ধকারে উঁচু ঢিপির মতো কি একটা বসে আছে দেখে হাতের কন্ট্রোলটা হারিয়ে ফেলেছিলো, একটু সামলে নিয়ে, এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো সে। দূর থেকে একটা মানুষ আপদমস্তক চাপা দিয়ে বসে আছে মনে হচ্ছে।
আর ঠিক এই জায়গাটাতেই আলো নেই, এগিয়ে গিয়ে যে লাইট পোস্টটাতে লাইট আছে ওটার সামনেই দাঁড়িয়েছে সোমনাথ, ঘাড়টা ঘুরিয়ে পিছনে দেখলো সে।
তারপরই একদম পুলিশের ভঙ্গিতে বললো, কে রে? মরার জন্য এই মোড়ের মুখে বসে আছিস?  কোনো শব্দ এলো না।
এই কথা বলিস না কোনো?
নঃ, সাড়া নেই কোনো।
ওরে ওই, মুখে কথা নেই কেন রে, কিছু চুরি টুরি করেছিস নাকি রে? দাঁড়া তো, বলেই, বাইকের স্ট্যান্ডটা বাম পায়ে ফেলে দিয়ে, সুঠাম শরীরটা নিয়ে দাঁড়ালো সোমনাথ।
কোমরে গোঁজা টর্চটা বের করে ফেললো সেই সন্দেহজনক কালো মূর্তিটার ওপর।সোমনাথের দিকে পিছন ফিরে বসে আছে মূর্তিটা, আপদমস্তক পুরোনো কম্বলের মতো কিছু দিয়ে ঢাকা।
পিস্তলটা একবার হাত দিয়ে দেখে নিলো সোমনাথ, মনকে জোর দিলো, হা সেটা ঠিক জায়গাতেই আছে, দরকারে নিতে পারবে।
ওই ওই, কথা বল, নাহলে গুলি করে দেব, মুখে বলতে বলতে এগিয়ে যাচ্ছিলো, মূর্তির দিকে । হাত চার দূর থেকে, বাম হাতে টর্চ আর ডান হাতে পিস্তলটা নিয়ে মূর্তিটাকে ঘুরে সামনের দিকে এল সোমনাথ। 
ওই মুখ টোল, টোল বলছি মুখ। সামনে কনফিডেন্স দেখালেও, বুকটা কেমন যেন দূর দূর করছিলো সোমনাথের।
আলোটা মুখের ওপর পড়তেই দেখলো, কোনো একটা মেয়ে। পাগলী টাগলী হবে।
কিন্তু তাও ভরসা নেই, যা দিন কাল, কে এমন পাগলী সেজে বসে আছে কে জানে। ওই কে রে তুই? এখানে কি করছিস?
সামান্য কাছে এগিয়ে মুখে আলো ফেলে দেখতে লাগলো সে, নাঃ এটা পাগলী কোনো সন্দেহ নেই, উফফ কত কি না ভাবছিলো সে, মুখে বলল ওই শালী, এখানে কোথা থেকে এলি, পিস্তলটা খাপে ভোরে নিলো সে, সরে বস এখন থেকে, আর একটু হলেই চাপা পড়ে মরতিস |
এক মুহূর্ত কি ভেবে নিয়ে, সোমনাথ এবার নিজের বাইক এর কাছে ফিরে আসে। রয়েল এনফিল্ডটা,একটা বিকট ভুমভুম শব্দ করে এগিয়ে যায়। 
কিছুটা এসে, পাগলীটার কথা ভেবে মনে মনে হাসছিলো সে। মিত্তিরবাগান লেন, পূর্ব পাড়া, জানকী ঘোষ লেন হয়ে সোজা ললিত মোহন স্ট্রিট ধরে এগিয়ে গেল সে। আজ যেন শুধুই ওই পাগলিটার কথা মনে পড়ছিলো ওর। আগে তো ওটাকে দেখেনি কখনো, আচ্ছা ওটা মুখে কালী ঝুলি মেখে, বসে থাকা টেররিস্ট নয় তো? বা চুরি করতে বেরিয়েছিল, কিন্তু ওকে দেখেই ওরম নাটক করছিলো। ভালো করে না দেখে চলে আসাটা মনে হয় ঠিক হয়নি তার।এসব ভাবতে ভাবতে কখন আবার বাইকটা মিত্তিরবাগান লেনের দিকে ঘুরিয়ে নিলো সে পিছন দিক দিয়ে আবার গলিটাতে ঢুকে এল সে।
বাইকটার আলোতে, দূর থেকে অন্ধকার কালো জীবের মতো লাগছে পাগলিটাকে। ঠিক সেই খানেই সেই ভাবেই, বসে আছে সে। ঘড়িটা দেখলো সোমনাথ, ১২:২০ বাজছে, পুরো পাড়াটা, থম থম করছে, সামনেই একটা নতুন ফ্লাট হচ্ছে বলে বেশ কিছুটা জায়গা ফাঁকা পড়ে আছে| বাইকটা কিছুটা দূরে দাঁড় করিয়ে রেখে পাগলির দিকে এগিয়ে গেলো সোমনাথ । পিস্তলটা নিলো না সে, শুধু টর্চটা জ্বলছে, পিছন থেকে, কম্বলটা এক ঝটকাতে খুলে ফেললো সে| পাগলী কিন্তু নড়লো না, ঠায় তেমনই বসে আছে, চুলটা খোলা আছে, হালকা আলোতে বোঝা যাচ্ছে সবুজ রঙের কোনো জামা পরে আছে, ডান কাঁধের দিক থেকে অনেকটা ছেঁড়া পিঠ পর্যন্ত। টর্চের আলো দিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো। বয়েস খুব বেশি না, ৩০ এর কম হবে। ময়লা জামা, নিচের দিকে তেমন ই ময়লা একটা সায়া পরে বাবু হয়ে বসে আছে মেয়েটা। 
মেয়ে পুলিশ ছাড়া অপরাধী হলেও তাকে ধরতে পারে না সোমনাথ কিন্তু এভাবে রাস্তায় বসে কেন থাকবে পাগলীটা? আর কিছু উত্তর দিচ্ছে না ওর কথা, এটা যেন তার পৌরষত্বে আঘাত দিলো। 
পুলিশের কালো পালিশ করা চকচকে বুটটা দিয়ে মেয়েটার পিঠের ছিঁড়ে যাওয়া জামার মধ্যে দিয়ে শরীরের যে অঙ্গ দেখা যাচ্ছে সেখানে ঘষতে লাগলো সোমনাথ। 
একবার একবার মনে হলো, কাজটা ঠিক করছে না, কিন্তু ২৬ বছরের পৌরষত্ব নাকি সরকারি ফৌজির তেজীয়ান ঔদ্ধত্য কোনটা বেশি গুরুত্ব পেলো জানা নেই, একটা পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছিলো সে। ধীরে ধীরে বুটটা ছেঁড়া অংশ দিয়ে ভিতরে ঢুকিয়ে দিচ্ছিল সে, আর এক ঝটকাতে, টান মারতেই, ফাঁস করে শব্দ করে জামাটা ছিঁড়ে গেল, জামার টানে একটু হোঁচট খেলেও, একজন যুবতীর উন্মুক্ত পিঠটা দেখতে মন্দ লাগছিলো না,  ঈষৎ সরে গিয়ে, মেয়েটির লজ্জা অঙ্গের কতটা দেখা যাচ্ছে মুচকি মুচকি হেসে দেখতে লাগলো । শরীর চর্চার আখড়াতে, স্যার বলতেন, পুরুষ শরীর গঠন করে সমাজকে রক্ষা করবে বলে, তাই তো সে পুলিশ হয়েছে, সমাজকে রক্ষা করছে, তবে তার কি একজন মেয়ের সম্মান হানির অধিকার আছে? মনের অন্য কোনটা, বলে উঠলো, এ হলো পাগলী, আর কোনো সম্মান নেই, এর সাথে যা ইচ্ছা করে যায়, 
আর কি হলো কে জানে, সোমনাথ, মেয়েটার খোলা চুলটা ধরে টানতে টানতে নতুন ফ্লাটটার নিচের অন্ধকারে চলে গেল, একদমই অন্ধকার জায়গাটা, নরম বালির মতো কিছু পায়ে ঠেকতেই, মেয়েটাকে ছাড়লো সে। তারপর মেতে উঠলো সেই আদিম খেলাতে যা যুগযুগ ধরে হয়ে আসছে নারী আর পুরুষে কখনো বা ইচ্ছা কখনো বা অনিচ্ছায়। সময় কত গেলো কে জানে, ব্রাউন বেল্টটা খাঁকি প্যান্টের ওপরে আটকে নিয়ে বাইক স্টার্ট দিলো সে।

বেলা তখন ওই ৯:৩০ মতো হবে থানার ডিউটি অফিসার অশোকবাবু ব্যাংকের চেক হারানোর একটা রিপোর্ট লিখছিলেন এমন সময়, গদাধর আসে ঢুকলও থানায়, চোখটা একবার ওপরে তুলে বললেন, কিরে গদা? 
গদাধর বললো, ছোড়দা আমাকে পাঠালও, ছোড়দার নতুন যে ফ্লাটটা উঠছে ওই মিত্তিরবাগান লেন এ, ওটার নিচে একটা মেয়ে খুন হয়ে পড়ে আছে।
অশোকবাবু, বললেন হুম, পাশে নিমাই দত্ত বসে ছিলেন, তার দিকে তাকিয়ে বললেন, নিমাইদা একবার দেখুন না গিয়ে কেসটা কি।
সেদিন ঠিক সন্ধে ৬:৩০ এ থানায় ঢুকলও সোমনাথ। কনস্টবল সুবীর পাত্র ওকে দেখেই বললো, বড়বাবু আপনাকে ভিতরে একবার ডাকছেন স্যার। হাজিরা খাতায় এন্ট্রি করে অফিসার ইনচার্জ এর রুম এ ঢুকে শরীরটা টান্ করে স্যালুট করলো সে। ওসি সাহেব তখন বসে কথা বলছেন MLA স্বপন সাধুখাঁ আর বিল্ডার বিশ্বসর পাত্র ওরফে বিশুর সাথে, পাশে দাঁড়িয়ে গদাধর। 
সোমনাথকে সামনের চেয়ারটা দেখিয়ে বসতে বললেন ওস।
কাল তোমার তো নাইট ডিউটি ছিল? কিছু দেখেছিলে? 
কি দেখার কথা বলছেন স্যার? তেমন আলাদা কিছু তো ছিল না তেমন, শুধু  শেঠ রোডের দিকে বাংলার দোকানটা খোলা ছিল বলে একটু কোরকে দিয়ে এসে ছিলাম, আর তো তেমন...
না না ওসব না, কোনো পাগলী দেখেছিলে মিত্তির লেন এর ওই দিকে? বা কোনো সন্দেহ জনক কেউ কে ওই মিত্তিরবাগান লেন এর ভিতরে?
কাল? উমমম একটু ভেবে নেবার ভান করে সোমনাথ, না স্যার, আমি কাল তো তেমন কিছু দেখিনি, আর পাগলী টাগলি তো একদমই না, ওই দিকে তো এনার ফ্লাটটা হচ্ছে, নিচে বালি পড়েছিল, বিশুর দিকে ইঙ্গিত দেয় সোমনাথ।   
হা ওই বালির ওপর তেমন কিছু চোখে পড়েছিল? বললেন ওসি
না তো, কি হয়েছে স্যার?
বিশু এবার মুখ খুললো, কোন শুয়ারের বাচ্চাএকটা পাগলীকে মেরে ফেলে গেছে আমার বিল্ডিংটার নিচেই, আর জায়গা পেলো না। স্যার এলাকার ছেলে না কেও, আমি আমার নেটওয়ার্ক এর সব্বাইকে বলে রেখেছিলাম, কেও হলে আমি তো জানতে পারতামই। 
স্বপন সাধুখাঁ বললেন, না না, এলাকার ছেলে না, দূর থেকে কেও এসে করেছে কাজটা, আমার তো আবার কালকেই মিটিং আছে, আপনি আজকেই কেউ কে গ্রেফতার করুন, নাহলে বিরোধীরা আওয়াজ তুলবে, এটা আমার সম্মানহানি হবে, আমি চাইছি, কেউ কে একটা তুলে এনে ফাটকে রাখুন, আমি স্টেজ এ দাঁড়িয়ে পুলিশের তৎপরতা নিয়ে দুটো কথা বলে দেব। বুঝলেন কিছু? ওসি কে উদ্দেশ্য করে বললেন। হা স্যার, ওসি মাথা নাড়লেন। 
আমি উঠি, এই রাতের মধ্যে কোনো একটা হাড় হাভাতের বাচ্ছাকে তুলে এনে সাইজও করে দিন, শুনুন পাগলির খুন নিয়ে কেও ঠিক ভুলের বিচার করবে না, কিন্তু অপরাধীর সাজা হয়েছে, এটা পাবলিক সেন্টিমেন্ট এর জন্য গুরুত্বপূর্ণ বেপার। 
ওসি বললেন, প্রাইমারি ইনভেস্টিগেশন বলছে, রেপ করে খুন, কাল ফুল পোস্টমর্টেম রিপোর্টটা হাতে পাবো, তারপর ডিএনএ স্যাম্পল টেস্ট বা ওসব কিছু একটা করে নেবো না হয়। পাগলির রেপ? ভুস, কেও ওসব নিয়ে মাথা ঘামায় না, স্বপন সাধুখাঁ হেসে মন্তব্য করে । স্রেফ খুন করেছে মদের ঘোরে; এসব বলে দিন, আমি উঠলাম। যাবার আগে, সোমনাথের চওড়া কাঁধে হালকা চাপড় মেরে গেলেন স্বপনবাবু। হালকা হালকা ঘাম দিচ্ছিল সোমনাথের।ওরা বেরিয়ে যেতেই, ওসি বললেন, যাও তুলে নাও কোনো বেটাকে, রাতের দিকে ঘুরে বেড়ায় এমন কোনো হালকা ফুলকা অপরাধীকে তুলে আনবে, নিমাইদাকে বলে দাও, সার রাত জামাই আদর দিয়ে, কাল কোর্ট এ চালান করবে, আচ্ছা স্যার, সোমনাথ উঠে গেল।কনস্টবল দুজনকে নিয়ে জীপ এ করে বেরিয়ে গেলো সে অপরাধী আন্তে। রাত তখন ৮:৩০ মতো হবে ছিঁচকে চোর সন্তু ওরফে চিতুকে কোমরে দড়ি পড়িয়ে আনলো থানায়, চিতু থানায় এসে, অনেক কাকুতিমিনতি করে বোঝাতে লাগলো, সে কয়েকদিন ধরে জ্বরে ভুগছে, তাই চুরি করতে বেরোচ্ছে না। তাছাড়া এখন সে চুরির কাজ ছেড়েই দিয়েছে, এসব কাজে রিস্ক বেশি। বাড়িতে তেমন জিনিস পত্র লোকেরা এখন রাখেন, সব থাকে ব্যাংকে।নিমতার দিকে একটা ইঁটের পাঁজায় কাজ করছে সে। তার মালিককে ফোন করলেই জনাতে পারবে সবাই। জ্বরের জন্য সেখানেও বেশ কিছু দিন যেতে পারে নি চিতু। কিন্তু হয়, তার যে বিধি বাম সে বোঝেনি। ফাটকে তাকে ঢুকতেই হলো। প্রাইমারি রিপোর্ট লিখে নিলো সোমনাথ, ঠিক আগের দিনের মতো আজ ও সে বাইক নিয়ে নাইট ডিউটিতে বেরোলো|এদিক সেদিক ঘুরে মিত্তির বাগান লেন এ ঢুকলও সে। ফ্ল্যাটের নিচেতে দুজন কনস্টবল বসে আছে, রয়েল এনফিল্ডের আয়জে উঠে দাঁড়িয়ে স্যালুট করলো। একবার বাইকটা থামিয়ে সোমনাথ বললো কিরে সব ঠিক তো? হা স্যার একজন উত্তর দিলো, এগিয়ে গেলো সে। পরদিন মিটিং এ স্বপন সাধুখাঁ বিস্তর হাততালি পেলেন, থানার ওসি সভায় ১০ মিনিট আর জন্য এসেও ছিলেন, ওনার পিঠ চাপড়ে স্বপনবাবু বললেন, আমার আর আমাদের পুলিশ ডিপার্টমেন্ট আর সম্মান বাঁচালেন, আপনি। বন্ধুগণ একজন মানুষ আমাদের কাছে শুধুই মানুষ, সে সুস্থ না অসুস্থ আমরা দেখি না, আমরা চাই বিচার ব্যবস্থা সব দিক খতিয়ে দেখে, অপরাধীকে শাস্তি দিক, আবার ও হাততালি। সভার সেক্যুরিটিইর ডিউটিতে দায়িত্বে ছিল সোমনাথ আর তিনজন কনস্টবল।

চিতু চোর, পুলিশের মারের ভয়ে বা অর্থের অভাবে উকিল দিতে পারলো না, তাই কোর্ট তাকে এক মাসের পুলিশ রিমান্ড এ রেখে দিলো, পরে উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে ছেড়ে দিলো। পাগলির বডি কেও ডিমান্ড করলো না, তাই সরকারি হাসপাতালের গাদার মড়ার লিস্ট এ আরো একটা লাশ হিসাবে শুয়ে থাকলো সে। মতের ওপৰ ৩-৪ মাসের মধ্যে সবাই ভুলে গেলো, কোনো নারী তার সম্মান আর প্রাণ দুটোই সেদিন অন্ধকার রাত্রিতে বালির স্তূপে শব্দহীন ভাবে ত্যাগ করেছিল, যার একমাত্র সাক্ষী হয়ে থাকলো জমাট বাধা নিকষ কালো অন্ধকার।
বিরোধী দলের একটি ছেলে মনোজিৎ ওরফে সোনাই গত কয়েক রাত ধরে খুব উৎপাত শুরু করেছে এলাকাতে। রাতের অন্ধকারে শাসক দলের ছেলেদের বাড়ি হামলা চালায়, শিবতলা মাঠের দিকে বিধায়ক আর তার সহযোগীদের উপযুক্ত শাস্তির দাবিতে পোস্টার লাগায়, কিন্তু সব থেকে বাড়াবাড়িটা করেছে গত পরশু, "এলাকার উন্নয়ন আটকে আছে বিধায়ক পুলিশের অশুভ গোপন আঁতাতে, এলাকার মানুষ গর্জে উঠুন"। সকাল থেকেই একটা মিটিং চলছিল আজ, এলাকার মানুষকে নিয়ে গভীর আলোচনাতে বসেছেন সদর থানার বড়বাবু লোকাল থানার বড়বাবু, এলাকার ডাক্তার অমূল্য ঘোষ, বিধায়ক মশাই, উকিল সীতারাম সেনাপতি সবাই বসে, কথা হচ্ছিলো, কি করা যাবে। স্থানীয় মানুষের পালসটা বুজে নিতে চাইছিলো সরকার আর পুলিশ।
চা, বিসকুট আরো না না খাদ্যের সুগন্ধে ভোরে উঠেছিল থানাটা, রিপোর্ট লিখতে যারা এসেছিলো, সবাই একবার করে, বড়োবাবুর রুম আর দিকে তাকাচ্ছিলো, সবাই চলে গেলে, স্বপনদা সোমনাথকে ফোন করে ডাকলেন পার্টি অফিসের মধ্যে ভিতরে বসে আছে জানা ২০ ছেলে ছোকরা, সবকটাই মার্কামারা ছেলে, চেনা মুখ, সোমনাথকে দেখেই বললেন, তোরা বাইরে যা, কথা বলবো আমি, ওরা বেরিয়ে যেতেই, একটা মুখ বন্ধ মোটা খাম আর ছোট্ট কাগজে, ঠিকানা আর সময় লিখে হাতে দিয়ে বললেন, আজ যেন হয়ে যায়, বড়বাবু কে বলা আছে।
রাতের অন্ধকারে, ভূপতি আর মনসুর আলীকে সাথে নিয়ে অপারেশন চালায় সোমনাথ, প্রথমে কিছুটা বাধা দিয়েছিলো সোনাই আর তার দল, কিন্তু সোমনাথকে পুলিশের লোক দেখে শেষে সারেন্ডার করলো সে, ও আসলে বুঝতে পারেনি, এটা সরকারি নয়, বেসরকারি কাজ। গ্রেফতার করার ভঙ্গিতে হাঁটু গেড়ে রাস্তাটার ওপরে বসিয়ে রেখেছিলো সোনাইদের তারপর মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে একটা একটা করে গুলি করে মারলো।

সোমনাথ পদোন্নতি করলো, আর বলাই বাহুল্য স্বপন সাধুখাঁর আশীর্বাদ ছিল তার মাথার ওপর তাই একই থানায় বহাল থাকলো সে।
একদিন ঘুমাচ্ছিলো সোমনাথ, ঠিক রাত ১২ নাগাদ, ফোনটা বাজলো তার, স্বপনদার নামটা ভেসে আছে মোবাইল এ, ঘুম জড়ানো চোখেই সে বললো হা দাদা বোলো, শিগগির আয় আমার বাড়ি, একা আসবি, থানায় জানাবি না।
কি হয়েছে দাদা, ঐদিক থেকে উত্তর এল না কেটে গেলো ফোন।
সোমনাথ রাত বিরেতে এমন বহুবার স্বপনদার ডাকে গেছে, বহু কাজ পর্দার আড়ালে করে এসেছে যা সরকারি নিয়মে করা যায় না।
সার্ভিস পিস্তলটা রেখে, অন্য পিস্তলটা জিনসের প্যান্টের পিছনে রেখে বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। মিনিট দশেক যাবার পরেই, চোখটা যেন ঘুমে বুজে আসছিলো, একটু মনটা অন্য দিকে গেছে, আর সামনে দেখলো, কি যেন দাঁড়িয়ে আছে, মারলো ব্রেক, উল্টে গেল গাড়িটা।
পিচের রাস্তায় শরীরটা ছেঁচড়াতে ছেঁচড়াতে নিয়ে চললো তার। একটু ধাতস্ত হতে, উঠে বসার চেষ্টা করলো সে, মাথায় এল, ধাক্কা মারলো কাকে? মরে গেলোনা তো!! 
এদিক ওদিক চেয়ে দেখলো, কেও নেই, ইস, ঘুমের ঘোরে কি বলতে কি দেখলাম, ব্রেকটা বাজে ভাবে মেরে ফেলেছি, হাতের চেটো দুটো ছোড়ে গেছে। একটু জল পেলে ভালো হতো।
পিছনের দিকে একটা জলের কল ছিল না, খেয়াল হতেই সেদিকে ফিরলো সে, আর দেখলো, তার থেকে হাত ৫-৬ দূরে সেদিনের সেই পাগলীটা দাঁড়িয়ে আছে। শরীরে কোনো বস্ত্র নেই, খুব আস্তে আস্তে হেটে হেটে আসছে তার দিকে, দুটো পায়ের ফাঁক দিয়ে চুইয়ে চুইয়ে রক্ত পড়ছে তার, শরীরের না না জায়গাতে কালশিটের দাগ। 
সোমনাথ ভাবছে স্বপ্ন দেখছে, চোখটা মুছে নিলো সে, নাঃ, সত্যি সত্যি সেই পাগলীটা এগিয়ে আসছে তার দিকে। 
উঠবার চেষ্টা করলো সোমনাথ, না, পায়ের সেই জোর নেই তার, আর হয় তো বা ৩ হাতে দূরে মেয়েটা, পিছন থেকে পিস্তলটা বের করে পর পর চালিয়ে দিলো, কিছুই লাভ হলো না, সে এগিয়ে আসছেই, সোমনাথ চিৎকার করে বললো, এই যা যা, নাহলে গুলি করবো, আমি পুলিশের লোক, যা সামনে থেকে।
আর একদম সামনে এসে যেতেই, মুখ থেকে রক্ত বমি করতে লাগলো মেয়েটা, ছলকে ছলকে উঠে আস্তে লাগলো লাল রক্ত, আর সোমনাথের সারা শরীর ভিজে যাচ্ছিলো। রাস্তার মধ্যে মুখটা বুজে গোঙাতে লাগলো সে, চোখটা খুলতে সোমনাথ দেখলো মাথায় আর পায়ে চোট পেয়েছে সে, শুয়ে আছে হাসপাতাল এর বেড এ। অনেকেই এসেছিলো দেখা করতে, স্বপনদা নিজে ফোন করেছিলেন ওর শরীর কেমন আছে সেটা জানতে, চোটটা সারতে ২ সপ্তাহ লাগলো তার।
আরো এক সপ্তাহ পরে ডিউটিতে জয়েনও করে গেলো। সামনেই ইলেকশন আসছে, তাই সরকারি কাজের পাশাপাশি, রাজনৈতিক কাজকর্ম বেড়ে উঠলো সবার। আজ খুন, কাল পাড়ায় বোমাবাজি, পরশু থানা ঘেরাও, সেই রাত্রির স্মৃতিটাও মুছে যেতে লাগলো আস্তে আস্তে করে 
বিল্ডার বিশুর সবকটা ফ্লাট বিক্রি শেষ, একদম নিচের তলাতে একটা ছোট্ট পার্টি অফিস করে দিয়েছে সে। সেটারই উদ্বোধন আজ। সামনেই ইলেকশন, এলাকাতে বুথ ভিত্তিক কাজ ভাগ করার পালা এবার, পুলিশের চাকরি করে বলে, সরাসরি কোনো কাজ সোমনাথকে দিচ্ছে না স্বপনদা তবে, বিরোধী পক্ষের ছেলেগুলোকে, একটু সান্টিং করে দিস তো, কিংবা, অমুক দিন ঘেরাও তমুক দিন ধর্ণা অবরোধ হলে, পুলিশের ভিতরের খবরাখবর সোমনাথ টাইম টু টাইম দাদার কানে তুলে দেয়।

উদ্বোধন শেষে, ফ্লাটটার একদম টপ ফ্লোর এ, নিজেরদের মধ্যে একটা পার্টি রেখেছিলো বিশু। মদ মেয়েছেলে, কোনো কিছু অভাব ছিল না, যুদ্ধে নামার আগে, যেমন সৈনিকদের উৎসাহ দেওয়া হতো, হয় তো তেমনই সবার অলিখে স্বপনদাই নির্দেশ দিয়েছিলো, কাজের ছেলেগুলোকে, একটু গরম করে দিতে। মদটা সোমনাথ বেশি খেয়ে ফেলেছিলো সেদিন, সবাই চলে গেলেও, সে আর একটা ছেলে তখনও ছিল ওই রুম এ। পার্টি এর শুরুতে ৪,৫ টা মেয়েছেলে রুম এ ছিল সেটা সোমনাথের মনে আছে, কিন্তু পরে কে, কার সাথে চলে গেছে সেটা সে দেখেনি, কিন্তু এখন নেশা চোখে, দূরে অর্ধেক শুয়ে থাকা মেয়েটাকে দেখতে পাচ্ছিলো, ঊর্ধ্বাঙ্গ সম্পূর্ণ উন্মুক্ত, আধশোয়া করে মেঝের কার্পেটে পড়ে আছে মেয়েটা।
নেশা গ্রস্ত শরীরটা টানতে টানতে এগিয়ে গেলো তার দিকে সোমনাথ, পায়ের চেটোতে আদর করতে করতে ওপর দিকে উঠছিলো, বুকের কাছে আসতেই দেখলো, মেয়েটার শরীরে অনেক কালশিটের দাগ, একটু চমক লাগলো, মুখের দিকে তাকাতেই ভয়ে পড়ে গেল সোমনাথ, এটা তো সেই পাগলীটা। গলার কাছে আঙুলের দাগগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে । সেদিন শক্ত হাতে ঠিক ওই ভাবে চেপে ধরেছিলো তার গলাটা সোমনাথ। 
একটু সরে এসেই, পাশের ছেলেটাকে লাথি মেরে জাগাতে গেলো সে, নাঃ নড়লো না, এত নেশা হয়েছে তার, ছেলেটার নাম মনে পড়ছে না, আর গলা দিয়ে একটা আওয়াজ ও এল না। স্বভাবসিদ্ধভাবেই, কোমরের ডান পাসটা দেখতে গেলো সে, নাঃ আনেনি পিস্তলটা আজ।
হামাগুড়ি দিয়ে পাগলীটা এগিয়ে আসছে তার দিকে, সেই একই ভাবে, উরু বেয়ে তার নেমে আসছে রক্ত, সেদিন রাতের কথাটা আবার মনে পড়ছে সোমনাথের, শরীরের শেষ শক্তিটুকু দিয়ে মেয়েটাকে ভোগ করেছিল সেদিন সে, মেয়েটি একটা টু শব্দ করেনি মুখ থেকে, হয় তো বোবা সে, কিন্তু কোন পিশাচ তাকে ভর করেছিল সোমনাথ জানে না, মেয়েটার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দটা কানে আসছিলো তার, অসহ্য লাগছিলো রিন্ রিনে কান্নাটা।
একহাতে মুখটা অন্য হাতে গলাটা শক্ত পেশীবহুল হাতে চেপে ধরেছিলো সোমনাথ, গোঙানির শব্দ পাচ্ছিলো সে, পা দুটো বালির ওপর ছুঁড়ছিল মেয়েটা। তারপর থেমে গেল সবটা। মুখ দিয়ে রক্ত উঠেছিল তার বেশ মনে আছে, বাইক এ`ওঠার আগে, নিজের রুমালে সেই রক্ত মুছেছিল সে, সোমনাথের পাটা ধরেছে পাগলীটা। কালো কালো নখগুলো চেপে বসছে তার পায়ের ওপর। 
আঃ করে ওঠে সোমনাথ, পাগলির কষ দিয়ে রক্ত মেশানো লালা ঝরছে চোখের মনি দুটো একদম সাদা,সোমনাথ পুলিশের ট্রেনিং ব্যবহার করে, উল্টে গিয়ে ছাড়িয়ে নিলো নিজেকে, একটা পাক খেয়ে সরে এসে দেখলো পাগলী নেই। 
তাহলে সে কি নেশার ঘোরে এটা দেখছিলো, নঃ, গোটা ঘরে কোত্থাও নেই পাগলীটা, শুয়ে পড়লো মেঝেতে সোমনাথ, কি হচ্ছে তার সাথে এসব। একটা মাত্র ভুল করেছিল সেদিন, তার জন্য...
সিলিং এর দিকে তাকাতেই, চমকে গেল, পাগলীটা সিলিং এর ওপর মাকড়সার মতো করে ঝুলছে, ওপর থেকে তার শরীর থেকে ঝরে পড়া রক্ত রস, সোমনাথের ওপর পড়ছে, বিশাল জোরে একটা শব্দ হলো, পাশের লাইট পোস্ট এ ট্রান্সফরমারটা ব্লাস্ট করলো, অন্ধকার সব দিকে। আর ধপাস করে একটা শব্দ হলো কোনো কিছু মেঝেতে পড়বার। প্রাণ বাঁচাবার জন্য হাত পা ছুড়তে শুরু করলো সোমনাথ, কোনো কিছু ঠাওর করতে পারছিলো না ও। 
হঠাৎ কিসে যেন ইস্পাতের মতো কঠিন ফলা দিয়ে পিঠটা চিরে দিলো ওর, শার্টটা ফরফর করে ছিঁড়ে গিয়ে, পিঠে  কিছুটা গভীর ক্ষত হয়ে গেলো, যন্ত্রণাতে কুঁকড়ে গেল সোমনাথ।দরজাটা খুলতে হবে তাকে, অন্ধকারে, ছুটোছুটি লাগলো সে, মোবাইল ফোনটাও হাতের কাছে পেলো না খুঁজে, এই নিকষ কালো অন্ধকারে একবার এই দেওয়াল তো একবার ওই দেওয়ালে ধাক্কা খেতে লাগলো, একবার সাউন্ডবক্স এর তারে পা জড়িয়ে পড়ে গেলো সে, মাথাটা ঠুকে গেলো, কাঁচের বোতলে, কাঁচ ভেঙে কপাল ভেদ করে ঢুকে গেল তার, উফফফ মাগোওও করে আর্তনাদ করলো সে, চুপচাপ সব কিছু, কিন্তু কিছু একটা ঘরের মধ্যে ঘুরছে, বেশ ভালো বুঝেছে সোমনাথ, 
এমন সময় টান পড়লো গলাতে, ইলেকট্রিকের তারটা গলায় কিভাবে প্যাঁচ লেগে গেছে তার, জানলার দিকে কিসে যেন টানছে তাকে। জিভটা বেরিয়ে আসছে ওর, দুই হাতে তারটা ছাড়াবার চেষ্টা করছে সে, ঠিক তখনই দেখলো, তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সোনাই, কপালের ঠিক মদ্ধিখানে গুলির ক্ষতটা এখনো টাটকা, সোমনাথের কষ্ট দেখে সে হাসছে।সেদিন রাত্রিরের কথাটা মনে পড়ছে সোমনাথের, সোনাইরা শুধু কয়েকটা প্ল্যাকার্ড আর লাল রঙের কৌটো নিয়ে বেরিয়েছিল, সাথে দুজন সঙ্গী ছিল তার, তাদের সাথে ছিল শুধু মোটা লাঠি, তাই এক কোথায় তারা নিরস্ত্র ছিল বলাই যায়, সেখানে সোমনাথ, ভূপতি আর মনসুর আলীর কাছে অটোমেটিক পিস্তল ছিল, সঙ্গী ছেলে দুটো হাতের লাঠি নিয়ে তেড়ে গেছিলো ওদের দিকে ঠিকই, কিন্তু সোনাই নিজেই মানা করে তাদের। সোমনাথকে উদ্দেশ্য করে বলে, স্বপনদা এর সাথে তুই আমি একসাথেই কাজ করতাম, কিন্তু আমাদের লক্ষ্য এখন আলাদা, তুই চাকরি পেয়ে জীবনে প্রতিষ্ঠিত, হয়ে আদর্শের কথা হয় তো বা ভুলে গেছিস, কিন্তু আমি এখনো সেই একই আছি। আজও মানুষের দুঃখে আমার মন কাঁদে রে সোমনাথ। দিনের পর দিন, এলাকার জমি দখল, আর গরিবের শোষণ ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না, তাই বাধ্য হয়ে বিরোধী দলে নাম লেখালাম, তুই সরকারি কর্মচারী, জানি বাধ্য হয়েই গ্রেফতার করছিস, তবে পুরোনো সঙ্গীকে মিথ্যা মামলাতে ফাসাবি না বিশ্বাস রাখি।সোমনাথ তখন ওদের দিকে বন্দুক উঁচিয়ে আছে। এবার ইশারা করে বসতে বললো।সোনাইরা বসে যেতে, পিছন থেকে গুলি করে মারে তাদের। পুরোনো বন্ধুর কথাটা রেখেছিলো সোমনাথ, মিথ্যা কোনো কোনো মামলাই করেনি তার নামে, উল্টে সোনাইয়ের নাম একজন রাজনৈতিক দুষ্কৃতকারীর দলে লিখিয়ে দিয়েছিলো সে। পুলিশের খাতায় রেকর্ড হয়ে থাকে, নিজেদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারার সমস্যা নিয়ে খুন হয়েছে কুখ্যাত দুষ্কৃতকারী সোনাই। এই কাজের জন্য বেশ গর্ব হয় তার, কিভাবে একা হাতে এত বড় অপারেশনটা সারলো সে, দুঃখের একটাই যে সরকারি তকমা ছিলো না এটাতে, নাহলে একটা মেডেল তো বাধা ছিল তার।
এবার আঘাত এল, শরীরের নিচের অংশে, সেই ধাতব কঠিন নখের মতো কি যেন তার মোটা জিনসের প্যান্টটা ফালাফালা করতে দিতে লাগলো, আর পারছে না সোমনাথ, ওরম দানবের মতো চেহারা তাও, যন্ত্রণাতে, দুম দুম করে পাটা ছুড়ছে মেঝের ওপর, নরম ফরাস পাতা আছে মেঝেতে, শব্দ হচ্ছে না তাই, শুধু রক্ত ঝরে সাদা ফরাসের রং টা লাল হয়ে যাচ্ছে।
ঘরের মধ্যে অনেকগুলো কালো কালো মূর্তির মতো কিছু যেন দেওয়াল বেয়ে ঘুরছে, যাদের মধ্যে কয়েকজনকে বেশ চেনা লাগছে সোমনাথের, নকুল ওরফে হাত কাটা নকুল, দাগি আসামি ছিল, আর একজন শিবু, বিরোধীদলের হয়ে কাজ করতো, আরেকজন বটুক সোনাইয়ের ভাই, সেদিন রাত্রিতে রং আর তুলি হাতে ওই ছেলেটাই পোস্টার লাগাচ্ছিল দেওয়ালে। এদের মধ্যে একটাই মিল, এরা সবাই মৃত, আর সবারই মৃত্যু হয়েছে সোমনাথের হাতে, নানা সময়ে, আজ না জানি কোন অন্ধকার গহবর থেকে উঠে এসেছে এরা।সোমনাথের শরীরটা নেতিয়ে থেমে গেল, কালো কালো মূর্তিগুলো আস্তে আস্তে মিলিয়ে যেতে লাগলো ঘর থেকে।

"খবর যখন তখন" এর মহিলা সাংবাদিক, বলছেন, গভীর রাত্রিতে, মদ্যপ অবস্থাতে, মার্ পিট্ বেঁধে যায় মিত্তিরবাগান লেনের বহুতলের টপ ফ্লোর এ দুই ব্যাক্তির মধ্যে, আমাদের কাছে খবর আছে, তাদের মধ্যে একজন পুলিশ কর্মচারি ছিলেন, নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে ওনাকে, অন্য ব্যক্তিটি এলাকার কুখ্যাত দুষ্কৃতকারী, স্থানীয় বিধায়ক আমাদের জানিয়েছেন, খুব কড়াভাবে তদন্ত করার নির্দেশ নীতি দিয়েছি, এইভাবে একটি ফাঁকা বহুতলের মধ্যে ওরা কিভাবে উঠে এসেছিলো, এবং কোনোই বা এই খুন? অনেকে বলছেন এটা হলো আগামী নির্বাচন কে লক্ষ করে এলাকাতে ত্রাস সঞ্চারের চেষ্টা, যদিও বর্তমান নির্বাচিত সরকার, এই এলাকাতে পুনরায় জিতে আসার ব্যাপারে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী।ক্যামেরা তে রাজীব সেনের সাথে আমি পিয়ালী "খবর যখন তখন"।
 

ভাস্কর সিনহা

দোহা, কাতার

কবিতাঃ ভাস্কর সিনহা

Comments

Top

কবিতা

মাধুকরী পুজো বার্ষিকী ২০২৮: পর্ব ২

হিসাবান্তে
 

আলো জাগলেই
আমি আর আমি
এই, তাই সবের
বয়স্থ লেজুড়খানি।
উদ্ধত সেই পথে
মিয়ম্রাণ বাকী কুশীলব।
গর্বে কভু হলে ফাঁকি
দুনিয়া জুড়ে কম্পভূমি।
আত্মজতে শুধু বর্মাভাস-
অন্তরের শ্বাস-মাষের
না রয় নির্যাস।
বেলান্তে ঘনালে
আঁধার-
মুখোমুখি, 
আমি আমার।
কি ছেড়েছি, 
কি পেয়েছি-
হিসাব মিলিয়ে নেবার।
জানি আমি
দিয়ে ফাঁকি
খোলসখানা শক্তপোক্ত।
অন্তরে বাস 
করিছে জেনো
চূড়ান্ত এক রিক্ত।

হঠাৎই যদি

হঠাৎ যদি তোমায় পেতুম
দামোদরের ধারে।
হঠাৎ যদি চমকাতো বাজ
শুভ্র আকাশ মাঝে।
কৈশোরের সেই মোহাবেশ
ছোটায় প্রমত্ত ঘোরে।
একবারনা পাগলামি সব
মেলে ধরতুম পাখায়
রঙবেরংএর বর্ণচ্ছটায়
প্রজাপতির মায়ায়।
কি যে চাব, কি যে পাব
জানিনে তার হিসেব।
সঙ্গী শুধু মনের সাথে
চক্ষে চক্ষে ভাসার।
ভালো থাকিস-
মজায় থাকিস!
এই তো বলি শুধু।
অন্ধকারে একটি কোণে
আপনি আপনমণি।

দিগন্তে বিলীন
 

ফুটপাথে ঝেঁপে
নামে সাঁঝ।
আঁধার এলানো বেলায়
হঠাৎ আগুন-
জ্বলে- পুড়ে খাক
কৈশোরের স্বপ্নগোলা-দিন।
ঘোরা-ফেরা মনখারাপ।
টুকটাক্
টুংটাং প্রেয়সীর গালি।
শালওয়ার, মার শাড়ি টাঙ্গাইল।
দলা দলা কিছু অস্থিভস্ম
ছড়িয়ে যাবে উত্তরে, পূবে, পশ্চিমে-
যেদিকে খুশী
হাওয়াসঙ্গী মনে।
দুদিনের এই রাগ,
ক্রোশ, আবেগ-
প্রশমিত হয়ে যাবে-
রমণে, আশ্লেষে
লোভে, হীনতায়।
দুহাতে কুশ্রীতা মেখেছি কতো-
ক্ষুদ্র তরঙ্গে বিলীন মহাবিশ্বে।
সব আছে, সব থাকে
আজানুলম্বিত ভূমে।
না জানা, মুখচোরা, 
সুরতাল বিলীয়মান
দিগন্তছোঁয়া পটে।

প্রবন্ধ

অনবদ্য লিওনার্দো

Comments

Top

মাধুকরী পুজো বার্ষিকী ২০২৮: পর্ব ২

অনবদ্য  লিওনার্দো ও  

মানসী মোনালিসা    অনিশা দত্ত

লেখিকা পরিচিতি :                                                                                               

প্রাঃ অধ্যাপিকা (ফলিত গণিত), বর্ধমান উওমেন্স কলেজ, নামী পত্র পত্রিকায় নিয়মিত লেখিকা

শিক্ষা মূলক পুস্তক, শিশু-কিশোর পুস্তক, গল্পের বই, স্কুল -কলেজ পাঠ্য পুস্তক প্রণেতা, রাজী ক্লাসিক্স -এর অনুবাদক,  আকাশ বাণী কলকাতায় প্রাঃ কথক, 'বিজ্ঞান মেলা' পত্রিকার প্রাঃ প্রধান সম্পাদক

women.jpg

লিওনার্দো  দ্য  ভিঞ্চির  উল্লেখমাত্র  প্রথমেই  মনে  পড়ে, Monalisa  বা ফরাসী  ভাষায় La Gloconda অর্থাৎ উচ্ছলা। তবে, চিত্রশিল্পী তাঁর দ্বিতীয় পরিচয়। তিনি ছিলেন Polymath বা বিশ্বশ্রেষ্ঠ প্রতিভাধর, সর্বগুণ বিশারদ ও অনন্য কীর্তিমান।  

আকর্ষণীয় দেহসৌষ্ঠব ও অতুল্য রূপ নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, Vinci শহরে। পিতl ঐশ্বর্যবান Fruosino di Antonia da Vinci। মাতা কৃষক কন্যা Caterina। পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত মাতুলালয়ে মায়ের কাছে মানুষ। ১৪৫৭তে পিতার কাছে আসেন। প্রাথমিক শিক্ষায় ল্যাটিন, জ্যামিতি ও গণিত। চোদ্দ বছর বয়স থেকে Andrea de Verrochio-র কাছে অঙ্কন শৈলীর শিক্ষানবিশীতে ছিলেন। বিশ বছর বয়সে Florence -এর Guild of St Lake -এ  Master Artist এর স্বীকৃতি পান।   

তিনি বিশিষ্ট বিজ্ঞানী, ধীমান গণিতজ্ঞ, নিপুণ স্থপতি, অন্যতম প্রযুক্তি বিশারদ, ভূবিদ, জীববিজ্ঞানী, আবহাওয়াবিদ। প্রথম রোবট তিনি তৈরী করেন। ফরাসী সম্রাটের দরবারে সেই সিংহ রোবট সভা পেত। যেটি সম্রাটকে অভিবাদন করতো। প্রথম হেলিকোপটার তৈরীর পরিকল্পনাও তাঁর। সেলাই মেশিনে এর অটোমেটিক ববিন, ওয়াশিং মেশিনকে দ্রুতগতি ঘোরানোর কায়েদা তাঁর বুদ্ধিমত্তার বিকাশ। 

দ্বিতীয় পরিচিতিতে, তিনি অমর চিত্রশিল্পী, ভাস্কর ও সংগীতজ্ঞ। শুধুমাত্র অসাধারণ পেইন্টার নন, ছিলেন অসামান্য নকশাকার, স্থানীয় সমস্ত ক্যাথিড্রালের, গম্বুজ, মিনার, মনুমেন্টের প্ল্যানিং তাঁর উর্বর মস্তিষ্কের ফসল। 

বিজ্ঞান ও ইঞ্জিনিয়ারিং গবেষণায়, তাঁর ১৩,০০০ পাতার নোটবুকে লেখা ও ড্রয়িং লিপিবদ্ধ আছে। প্রাণী-উদ্ভিদ প্রকৃতির শিলা বিন্যাস ইত্যাদির অনুশীলন ও পর্যবেক্ষণ শুধু অঙ্কনে নয়, যন্ত্র উদ্ভাবনায়ও কাজে এসেছে। লেখক-গবেষক তো ছিলেন। বিজ্ঞান ভিত্তিক অনুশীলনের সিংহভাগ বর্তমানে Bill Gates এর সংরক্ষণে রয়েছে। বছরে একবার সেগুলি পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে প্রদর্শিত হয়। একটি মানুষের মধ্যে এতো রূপ, গুণ, মেধা, বৈশিষ্ট্য ও কৃতিত্বের সমাবেশ, পৃথিবীতে দ্বিতীয় দৃষ্টান্তে নেই। তিনি যেন প্রকৃতির বরপুত্র।   

ঘূর্ণীঝড়ের পূর্বাভাসও তাঁর জ্ঞানের পরিধিতে ছিল। তাঁর অংকিত চিত্রে সুস্পষ্ট ঘূর্ণীঝড়ের অঙ্কন শৈলী, বর্তমানে স্যাটেলাইট ক্যামেরা থেকে গৃহীত চিত্রের অনুরূপ। বাল্যকালে তাঁর বাসস্থানের ওপর দিয়ে তোলপাড় করা ঘূর্ণীঝড় প্রত্যক্ষ করেছিলেন। 

Arono নদীর জল ফুলে ফেঁপে উঠেছিল। সারা Florence শহর ছিল বন্যা কবলিত। Bellin Zones এর কাছে আল্পস থেকে নেমে এসেছিলো বিরাট ধ্বংস। এইসব প্রাকৃতিক বিপর্যয় ইতিহাস গ্রাহ্য, প্রামাণ্য দলিল সমেত। তিনি নোটবুকে লেখেন, পাহাড় -উপত্যকা ভেঙে পড়েছিল, সাত মাইল জুড়ে তৈরী হয়েছিল হ্রদ। ঘূর্ণীঝড়ের তুলির টান কল্পনা প্রসূত নয়, নিখুঁত পর্যবেক্ষণ।

সবচেয়ে বিখ্যাত দুটি ছবি হলো, 'মোনালিসা' ও 'লাস্ট সাপার'। আরেকটি বিখ্যাত পেইন্টিং হলো, 'ভার্জিন এন্ড চাইল্ড উইথ সেন্ট অ্যান', প্রাকৃতিক দৃশ্যপট তুলনাহীন। মেরী তাঁর জননী অ্যান -এর  কোলে বসে আছেন ও অ্যান  ঝুঁকে আছেন শিশু যীশুর দিকে। ছবি গুলি বাঁকাভাবে আঁকা, যেটি ছবির পৃথক বৈশিষ্ট্য। ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে রাখা এই ছবির মুখমন্ডলের সঙ্গে মোনালিসার মুখমন্ডলের সাদৃশ্য আছে। 

'ষ্টার অফ বেথেলহেম' এর একটি বিশাল চিত্র (১৬০ সে মিঃ/১৪০ সে মিঃ) রঙিন কাগজে কালো চক দিয়ে আঁকেন এই ড্রয়িংগুলিতে গণিতজ্ঞের জ্যামিতি-ভিত্তিক কুশলী রেখাবিন্যাস। যেহেতু এনাটমি - বিশেষজ্ঞ ছিলেন, মানুষের দৈহিক গঠনের সাযুজ্য তাঁর অঙ্কনে এসেছে। একাধিক ড্রয়িং এ ক্যারিকেচার বা ব্যঙ্গমূলক চিত্র পাওয়া গেছে। কথিত আছে, যখনি তাঁর চোখে কোনো মুখের বৈশিষ্ট্য ধরা পড়তো, তিনি তাঁকে অনুসরণ করে তাকে পর্যবেক্ষণ করতেন। 'মোনালিসা' প্রতিকৃতিটি ইতালিয়ান সম্ভ্রান্ত মহিলা লিসা গেহেরাদিন এর। তিনি বিশাল বিত্তশালী সিল্ক ব্যবসায়ী Francesco Gioconda -র পত্নী। প্রস্তাব ছিল তাঁদের দ্বিতীয় পুত্রের জন্ম উপলক্ষ্যে ওটি নতুন গৃহের ড্রয়িং রুমে শোভা পাবে। 'মোনা' ইতালিয়ান শব্দের অর্থ সৌজন্যে সম্বোধন 'ম্যাডাম'। 

১৫০৩ থেকে শুরু করে তাঁদের গৃহেই, অনবদ্য চিত্র মোটামুটি শেষ হয়েছিল, ১৫০৭-এ।তবু শিল্পী তাঁর শ্রেয়তম চিত্রে তুলির টান দিয়ে গেছেন আমৃত্যু। তিনি যখনি যেখানে যেতেন, এটি সাথে নিয়ে ভ্রমণ করতেন, কখনো কাছ ছাড়া করেনি। 

  

'মোনালিসা' ছবির আসল মাপ '৩১/২০.৮"। Louvre গিফট শপে, সাধারণত: যে পোস্টার পাওয়া যায়, তার মাপ এর চেয়ে বড়। ১৯১১-এ আসল ছবি চুরি হয়ে গেছিলো। দুবছর পর এটি ফ্লোরেন্স হোটেলের ঘরের এক ট্রাঙ্কের গোপন কক্ষ থেকে উদ্ধার হয়।  

'মোনালিসা' বিশ্বের অন্যতম সৃষ্টির সিংহাসনে। মোনালিসার  হাসি  দ্য  ভিঞ্চি কোডের ঐতিহাসিক রহস্য ঘন অথবা নিগূঢ় চক্রান্তের সংকেত।

কলাবিশারদদের মতে, মোনালিসার মুখাবয়ব পুরুষ ও রমণীর সংমিশ্রণ। হিন্দুদের অর্ধ নারীশ্বরের কল্পনা নয়, একই আননে, পুরুষের কাঠিন্য ও রমণীর কোমলতা মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। মোনালিসার পশ্চাৎপটে বাঁদিকের ও ডানদিকের নীচের সীমারেখা একই সরল রেখায় নেই, রয়েছে ওপর নীচে। বামদিকের লাইন, ডানদিকের লাইন থেকে নীচু করে আঁকা, যার জন্য বাম দিক থেকে দেখলে, মোনালিসাকে আকারে বড় দেখায়। ওষ্ঠের দুটি প্রান্ত ও আঁখি পল্লবের সীমানা বিন্দুগুলিতে নিপুণ তুলির ছায়াঘন টানে যে রহস্য আনীত, তাতে তার হাসির সঠিক প্রকৃতি নির্ণয় দুরূহ। পেইন্টিং ও ড্রয়িং, দুয়েতেই ছিলেন সিদ্ধহস্তl জন্মসূত্রে তিনি ছিলেন Left Hander, কিন্তু উভয় হস্তই সমান নৈপুণ্যে ব্যবহার করতে পারতেন। অর্থাৎ সব্যসাচী।  'মোনালিসা ' বাম হস্তের শিল্পকলা।  

কিন্তু শেষ জীবনে বাম হাত খানিক অকেজো হয়ে যাওয়ায়, 'মোনালিসা' এ শেষ তুলির টান গুলি ডান হাতের।  

লিওনার্দোর ধারণায়, মানবাত্মার পূর্ণ বিকাশ হতেই পারে না, যদি তাতে পৌরুষ ও নারীত্ব দুটি গুণই অর্জিত না হয়। অসামান্য বুদ্ধিমত্তা ও নৈপুণ্যের অধিকারী হওয়ায়, ছবির মধ্যে চতুর সংকেত ও ধাঁধার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। লিওনার্দোর 'স্বপ্রতিকৃতি' ও 'মোনালিসা', এই দুয়ের কম্পিউটার বিশ্লেষণে, উভয়ের মধ্যে যথেষ্ট সাদৃশ্য লক্ষ্যিত হয়েছে। সর্বাংশে পুরুষ বা নারী নন, উভয়ের সার্থক সংমিশ্রণ। 'MISS -MASTER  PIECE'  :

উদ্দীপনা ও উর্বরতার প্রতীক মিশর-এর দেবতা হলেন 'Amon' ও দেবী 'Isis'। 'Isis' এর পৌরাণিক নাম পিক্টোগ্রাফে লেখা হতো 'Lisa'। দুটি শব্দের যোগে দাঁড়ায়, Amonlisa। খুব সহজ Anagram বা অক্ষর পরিবর্তনে দাঁড়াবে 'Monalisa'। বিজ্ঞানীর গভীরজ্ঞান  ও শিল্পীর সূক্ষ চেতনা দুয়ের মেলবন্ধনে তাঁর আত্মোপলব্ধি বাস্তবায়িত হয়েছে। ছবিটিতে চোখের পাতা অদৃশ্যপ্রায় এবং আবছা ভ্রূ-যুগল, কারণ বারবার পরিষ্কার করার কারণে এগুলি ক্ষতিগ্রস্ত। 

বর্তমান কম্পিউটার 'মোনালিসা'র হাসির গুণাগুণ বিশ্লেষণ করে জানিয়েছে, ৮৩% সুখী, ৯% বিরক্ত, ৬% ভীত, ২% রাগী। বলা যেতে পারে, ১% এর কম নিরপেক্ষ এবং ০% আধ্যাত্মিক। ১৫১৭তে তিনি ফ্রান্স থেকে আবার ছবিটিকে নিয়ে ইতালি আসেন। ১৫১৯-এ তাঁর প্রয়াণের পর সহকারী শিল্পী Salai অকৃতদার লিওনার্দোর শিল্পকর্ম উত্তরাধিকার সূত্রে পান। তিনি লিওনার্দোর পরম মিত্র ও শুভাকাঙ্ক্ষী ফ্রান্সের সম্রাট ফ্রান্সিস ১ কে একসহস্র স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে বিক্রয় করেন। তারপর থেকে ছবিটি ফরাসী রাজপ্রাসাদের বিভিন্ন অংশে শোভা পেত। ফরাসী বিপ্লবের সময় এটিকে প্রাসাদেই গুপ্ত কক্ষে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। তারপর Louvre  museum -এ আনীত হয়। 

'মোনালিসা' অঙ্কনের দশ বৎসর পূর্বে লিওনার্দো এক তরুণতর 'মোনালিসা'-র ছবি এঁকেছিলেন। এই 'ইতিপূর্বা মোনালিসা' কিছুদিন আগে সিঙ্গাপুরে এক প্রদর্শনীতে আত্মপ্রকাশ করেছিল। এটি বিশ-বাইশ বছরের তরুণী মোনালিসা। প্রথমে এটিকে নকল মোনালিসার ধারণায় জুরিখের ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির  বিশেষজ্ঞগণ  বাতিল করে দেন। 

২০১৩-তে  কার্বন টেস্টিং-এ সুনিশ্চিত হওয়া গেছে, এটিও দ্য ভিঞ্চির হস্ত নৈপুণ্যের শিল্প কর্ম। ষোড়শ শতকের গোঁড়ায় এটি আঁকা হয়। তার দশ বছর পর বিশ্ববন্দিত মোনালিসার সৃষ্টি। মূল ফ্রেমে ফাটল ধরায়, নতুন ফ্রেম লাগানো হয় ১৮৮৮ ও ১৯০৫-এ নিপুণ নবীকরণ হয়।লিওনার্দোর জীবনীকার Giorgio Vasar। 

পৃথিবীর ইতিহাসে, সর্বোচ্চ বীমাকরণ 'মোনালিসা' ছবির। ১৯৬২-র মূল্যায়নে, দশ কোটি লক্ষ ডলার, ২০১৮-র মূল্যায়নে পঁষট্টি কোটি লক্ষ ডলার।

ছবিটি বর্তমানে bulletproof কাঁচের আধারে নিয়ন্ত্রিত তাপ ও শৈত্যে সংরক্ষিত আছে।বছরের পর বছর ছবিটি প্রেমপত্র ও কবিতায় অভিনন্দিত হয়ে এসেছে।

রম্যরচনা

রম্যরচনা

Comments

Top

মাধুকরী পুজো বার্ষিকী ২০২৮: পর্ব ২

BasobRoy_edited.jpg

পাদ সমাচার 

বাসব রায় 

বেসরকারি হাইস্কুল শিক্ষক 

রাজবাটি , দিনাজপুর , বাংলাদেশ

toilet.jpeg

'পাদ' একটি অন্যতম জৈবরাসায়নিক প্রক্রিয়া৷ এ বিষয়ে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয় তবে যতদূর ধারণা হয় তাতে মনে হয় পরিপাকতন্ত্রে খাদ্য হজম পদ্ধতির সাথে নিঃসৃত এসিডের একটি সম্পর্ক বিদ্যমান এবং সেজন্যই গ্যাসজাত একটি ঘটনা ঘটে যা দুর্ঘটনা হিসেবে আমাদের সামনে 'পাদ' বলে পরিগণিত হয়৷ নির্জন স্থানে এই কাজটি নিরাপদে সাড়া যায় তবে জনাকীর্ণ স্থানে বিষয়টি একটি অস্বীকৃত অসামাজিক কাজ বলে মনে করা হয় যদিও এমন ভাবনা ভাবা মোটেই উচিত নয়৷ 

সাধারণত: প্রচলিত শিষ্টাচার অনুযায়ী এটিকে তিনস্তরে ভাগ করা যায়৷ যেমন (১) নীরব ক্ষরণ, (২) হালকা ফ্লুট সিস্টেম এবং (৩) সশব্দে ক্ষরণ৷ এসব প্রক্রিয়ার সাথে একটি গন্ধ জাতীয় বাতাসেরও উদগীরণ হয় যা কখনই সুগন্ধি বিশেষ হয় না৷ বেশিরভাগক্ষেত্রে নীরবক্ষরণ প্রক্রিয়ায় উৎকট গন্ধ নির্গত হয় যা খুবই অশোভনীয় একটি বিষয়৷ দ্বিতীয়ত: হালকা ফ্লুট সিস্টেমটা কিছুটা হারমোনিয়ামের 'পা' বা কোমল 'ধা'(দা)-র রিটের মতন একবার চাপ দিলে যেমনটি আওয়াজ বের হয়৷ এই হালকা ফ্লুট সিস্টেমে কিছুটা দুর্গন্ধ থাকে৷ সর্বশেষ প্রক্রিয়াটি বড়ই জটিল৷ সাধারণত:বাদ্যরত ঢাক বা ঢোলের চামড়া হঠাৎ ফেটে গেলে যেরকম আওয়াজ বেরোয় ঠিক তেমন শব্দের সৃষ্টি হয় তবে এই জোরালো শব্দযুক্ত পাদ প্রক্রিয়ায় গন্ধের সন্ধান কম পাওয়া গেছে আজ পর্যন্ত৷ যেহেতু প্রক্রিয়াটির সম্পূর্ণ কার্যক্রম এবং সংঘটিত স্থানটি পশ্চাৎদেশ তাই এটি একটি সেনসেটিভ আত্মসম্মানজনিত বিষয়ও বটে এবং বিশেষভাবে লজ্জাজনক কাজ৷ নীরবক্ষরণ প্রক্রিয়াটিতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায়৷ বিভিন্ন স্বাদের দুর্গন্ধ নিঃসৃত হতে পারে৷ পঁচা বা বাসি, কোষ্টকাঠিন্যজনিত জমাট ভারী গন্ধেরও আভাষ পাওয়া যায়৷

আফটারঅল বিষয়টি মোটেই সুখকর নয়৷ দ্বিতীয় ফ্লুট সিস্টেমটাতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নিজেকে লুকানো কঠিন হয়ে পড়ে৷ স্বভাবগতভাবেই আমরা লোকজনের সামনে এই প্রক্রিয়াটি সারতে চাই না৷ কিন্তু নির্গত বায়ুচাপটি অধৈর্যবশতঃ নির্গত হলে ভেঁপুর মতো বেজে ওঠে যা নেহায়েতই একটা কেলেঙ্কারি বটে৷ বিশেষত: শেষতক যে প্রক্রিয়াটি এটি সবসময়ই সম্মান হানিকর৷ প্রসঙ্গত: সাউন্ডসিস্টেমটি সাধারণত বয়স অনুপাতে নির্ধারিত হয়৷ প্রসঙ্গত: উল্লেখ্য যে পুলিশের সামনে কোনো এক ব্যক্তির সশব্দ পাদের জরিমানা করা হয়েছে পঞ্চাশ হাজার টাকা মাত্র৷ জীব বৈচিত্র্যের মাঝে এই প্রক্রিয়াটি আবহমানকালের একটি ঐতিহ্য৷ বস্তুত: এই প্রক্রিয়া থেকে প্রাণীকুলের আমৃত্যু নিস্তার নেই৷ কম হোক বা বেশি হোক এটা সবার ক্ষেত্রেই নির্ধারিত৷ যাহোক, এই পাদ প্রক্রিয়া বর্তমান সময়ে প্রাণীজগৎ ছাড়াও সামাজিক প্রেক্ষাপটে দেখা দিয়েছে৷ শব্দহীন এবং দুর্গন্ধ শূন্য পাদ সামাজিক কিংবা রাষ্ট্রীয় বা বৈশ্বিক ক্ষেত্রে বরাবরই চলমান৷ কে কার ওপর কখন পাদ ছুঁড়ে দিচ্ছে তা উপলব্ধি করা বেশ কঠিন৷ দলাদলি বা বৈষম্যজনিত কারণে পাদ পদ্ধতিটির প্রচলন ক্রমাগত বেড়েই চলছে৷ জীবের পাদ প্রক্রিয়া ক্ষতিকর যতখানি তার চেয়ে ঢের ক্ষতিকর সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় পাদ৷ রাষ্ট্রপদ্ধতি গণতান্ত্রিক বা সমাজতান্ত্রিক হোক রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পর পরস্পরের ওপর নিয়মিত পাদ চালিয়ে যাচ্ছে৷ আমরা সকলেই এসব নীরব শব্দহীন পাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ শিকার৷ একটু কৌশলী হলে পার্সোনাল পাদ নিয়ে উৎকণ্ঠার কারণ নেই তবে সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় কিম্বা বৈশ্বিক পাদ নিয়ে একটা উৎকণ্ঠা থেকেই যায় -৷

গল্প 

স্বপ্ন যখন সত্যি

Comments

Top

স্বপ্ন যখন সত্যি

অদিতি সুর

village1.jpg

মাধুকরী পুজো বার্ষিকী ২০২৮: পর্ব ২

"রেতে ভ্রমর এলো গুনগুনিয়ে..."
নিত্যদিনের কাজের ফাঁকে গুনগুন করে গান করাটা রঞ্জনাদেবীর অনেকদিনের অভ্যাস।গান গাইতে ওনার বরাবরই ভালো লাগে। ইচ্ছা ছিল ভালো গানের মাস্টারের কাছে গান শিখে গলাটাকে আরও খোলতাই করার। ছোটবেলা অবশ্য ওনার ইচ্ছা দেখে ওনার বাপি ওনাকে ওনার পাড়ার সুবীর নন্দী স্যারের গানের স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলেন। সকালে উঠে উনি তখন রোজ মন দিয়ে রেওয়াজ করতেন। বিকেলেও স্কুল থেকে ফিরে এক ঘন্টা রেওয়াজ ছিল ওনার রোজের রোজনামচা। বাপি মা ওকে খুব উৎসাহ দিতেন। তখন টুকটাক পাড়ায় সরস্বতী পুজোর ফাংশান কিম্বা দুর্গাপুজোর বিজয়া সম্মিলনীতে গান গাইতেন রঞ্জনাদেবী।গান শেষে শ্রোতাদের করতালি শুনে ওনার মতো ওনার বাপিও ভীষণ খুশি হতেন। স্কুলের ফাংশানগুলোতেও তখন শিক্ষিকারা ওনাকে আগে গান গাইতে ডাকতেন। ঠাম্মি অবশ্য বাপির ওনাকে নিয়ে এত আদিখ্যেতা একদমই পছন্দ করতেন না। উনি মুখ বেঁকিয়ে বলতেন "এসব তবু নিজের ছেলের জন্য করতিস খোকা তাও মানতাম। এসব শিখে মেয়ে কি করবে শুনি? সেই তো ওকে বিয়ে দিয়ে দিতে হবে আর পরের ঘরে গিয়ে এইসব জলাঞ্জলি দিয়ে উনুনের আগুনে সব বিসর্জন দেবে।"
ওর বাপি অবশ্য ঠাম্মির এসব কথায় কোনদিনও পাত্তা দিতেন না। উনি হেসে বলতেন" আমার মেয়েকে সেই ঘরেই বিয়ে দেবো যারা ওর গানের কদর করবে।" 
কিন্তু সব সুখ হয়তো সবার ভাগ্যে সহ্য হয় না। রঞ্জনাদেবীর হয়নি। ক্লাস এইটের ফাইনাল অঙ্ক পরীক্ষার দিন হঠাৎ ওনার বাপির শরীর খারাপ হয়। ডাক্তার বদ্যি ডেকেও খুব একটা লাভ হয় না। একটা ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকে সব শেষ হয় যায়।তার সাথে রঞ্জনাদেবীর সব স্বপ্নও ভেঙে চুরমার হয়ে যায় চিরকালের মত।
দাদা চলে যাওয়ার পর তিন দেওর বিধবা বৌদি আর ভাইজির ভার নিতে রাজি হলেন না।এসব ঝামেলা অহেতুক নিয়ে নিজেদের মাথাব্যথা করতে তিনজনই অস্বীকার করেন। রিংকুর ঠাম্মিও ছেলেদের মুখের ওপর কিছু বলতে পারেন না বা বলা ভালো বলতে চাননি।অগত্যা ওঁর মা ওদিকের সব পাট চুকিয়ে দিয়ে ওকে নিয়ে নিজের বাপের বাড়ি চলে আসেন।

রঞ্জনাদেবীর মায়ের বাপের বাড়িতে দাদু দিদিমা ছাড়া ছিলেন এক অবিবাহিত মাসি। তিনি জন্মান্ধ। বাপির গত হওয়ার পর সেখানেই এসে মা মেয়েটা আশ্রয় নেয়। ওঁর দাদু ছিলেন সরকারি স্কুলের শিক্ষক, তাই তার পেনশনের টাকায় তখন এতগুলো মানুষের পেট চলতো।তবে তখনকার দিনে পেনশন এখনকার দিনের মত বেশি ছিল না। তাই গান শেখা তখন এক নিছক আয়েশিপনা ছাড়া আর কিছুই না। রঞ্জনাদেবীর মা ফলস পিকো আর টুকটাক সেলাই করে সংসারে কিছু টাকা দিয়ে সাহায্য করতেন। রঞ্জনাদেবী কোনরকমে বারো ক্লাসের গণ্ডি পেরোতে না পেরোতেই ওর জন্য ভালো ছেলে দেখে মা ওর বিয়ে দিয়ে দেন।ততদিনে দাদু গত হয়েছেন। দিদিমার শরীরও তথৈবচ। সব মিলিয়ে সংসারের অবস্থা বেশ খারাপ।এমত অবস্থায় মেয়েকে কলেজে পড়ানোর থেকে পাত্রস্থ করতে পারাটা রঞ্জনাদেবীর মায়ের কাছে অধিক জরুরী বলে মনে হয়েছিল। তাই রীতিমত ঘটক দেখে ওকে পাত্রস্থ করা হয়। মাত্র উনিশেই বিয়ে হয়ে পরের ঘরে চলে আসেন রঞ্জনাদেবী। 
*************
"কি গো জলখাবার কি হলো?"
"হ্যাঁ আনছি।"
স্বামীর ডাকে তাড়াতাড়ি লুচি বেলতে লাগেন রঞ্জনাদেবী। আজকাল বড়ো একঘেয়ে লাগে ওনার সবকিছু। আগে কত উৎসাহ নিয়ে সংসারের সব কাজ উনি করতো। বয়স তো আর কম হলো না ওঁর। তা প্রায় পঞ্চাশ। স্বামীর থেকে বারো বছরের ছোট উনি। তাই স্বামী কোনদিন ওঁর তেমন বন্ধু হতে পারেন নি। সবসময় একটা দূরত্ব থেকেই গেছে দুজনের মধ্যে।
লুচিগুলো ভেজে গরম সাদা আলুর তরকারি বাটিতে সাজিয়ে টেবিলে নিয়ে আসে রঞ্জনাদেবী। সাদা আলুর তরকারি আর লুচি খুব ভালোবাসেন ওঁর স্বামী অশোক। তবে আজ পর্যন্ত কোনদিন এই নিয়ে একটা প্রশংসা করতে শোনেনি রঞ্জনাদেবী।
"তোমাকে একটা মিষ্টি দেবো?"
পেপার দেখতে দেখতে গরম লুচি ছিঁড়ে আলুর তরকারির বাটিতে ডুবিয়ে খাচ্ছিলেন অশোক। রিংকুর কথার উত্তরে শুধু "না" বলেন।
"বলছি পাপাইরা কখন আসবে গো আজকে?"
"সন্ধ্যে ছটায় ফ্লাইট ল্যান্ড করবে। আসতে আসতে এক ঘণ্টা আরো লাগবে। কেন?"
গম্ভীর হয়ে বলেন অশোক।
"না এমনি। ওদের জন্য একটু ভালো মন্দ বানাতে হবে। দিদুন খুব ডিম ভরা ট্যাংরা মাছের ঝোল খেতে ভালোবাসে। বাজার থেকে ওটা মনে করে এনো কিন্তু। সাথে বেগুন আর অবশ্যই চালকুমড়ো।"
"আচ্ছা।"

আজ রিংকুর একমাত্র ছেলে পাপাই, বৌমা সুমি আর ওর আদরের একমাত্র নাতনি রিয়া আসবে ওঁর বাড়িতে। ওরা দুবাইতে থাকে। ছেলে বছরে একবার পরিবার নিয়ে ছুটি কাটাতে বাড়িতে আসে। তবে এবার পাকাপাকিভাবেই দেশে ফিরছে। এখানেই বেশ ভালো একটা চাকরি পেয়েছে। যদিও বৌমার তেমন একটা আসার ইচ্ছা ছিল না। রঞ্জনাদেবী বৌমার মনের কথা বুঝতে পেরেই ওদের দু -একদিন এই বাড়িতে কাটিয়ে বাড়ির পাশের পাড়াতে ছেলের জন্য কেনা ফ্ল্যাটেই ওদের থাকতে বলেছেন। উনি চান ওরা যেন ওদের মত করে ভালো থাকে। সবসময় ঝামেলা অশান্তি থেকে দূরে থাকতে ভালোবাসেন রঞ্জনাদেবী। 

তবে নাতনিটা বড়ো নেওটা ওনার। ওর জন্যই খারাপ লাগে একটু। বৌমা আবার ওনার সাথে বেশি মিশতে দেয় না নিজের মেয়েকে। বড়লোক বাপ মায়ের একমাত্র মেয়ে সুমি।ডাকসাইটে সুন্দরী সাথে উচ্চ শিক্ষিতা আর চাকুরীরতা। মফস্বলে বেড়ে ওঠা কম পড়াশুনা জানা আনস্মার্ট শাশুড়ির কোন গুণই তার কখনোই চোখে পড়ে না। অবশ্য এর মধ্যে তেমন কিছু দোষ দেখেন না রিংকু। পাপাই নিজেই যখন মাকে তেমন ধর্তব্যের মধ্যে ধরে না। তার কাছে তার বাবার মতামতটাই আসল। তার কাছে মা শুধু আছে রান্নাবান্না আর বাকি সংসার সামলানোর জন্য। তবে রঞ্জনাদেবীর এটা দেখে ভালো লাগে যে নাতনিটা ক্লাস সেভেনে পডলেও সে তার মা বাবার মতো নাক উচুঁ না। রিয়া কাউকে কখনো তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে না।*****

তবে নাতনিটা বড়ো নেওটা ওনার। ওর জন্যই খারাপ লাগে একটু। বৌমা আবার ওনার সাথে বেশি মিশতে দেয় না নিজের মেয়েকে। বড়লোক বাপ মায়ের একমাত্র মেয়ে সুমি।ডাকসাইটে সুন্দরী সাথে উচ্চ শিক্ষিতা আর চাকুরীরতা। মফস্বলে বেড়ে ওঠা কম পড়াশুনা জানা আনস্মার্ট শাশুড়ির কোন গুণই তার কখনোই চোখে পড়ে না। অবশ্য এর মধ্যে তেমন

কিছু দোষ দেখেন না রিংকু। পাপাই নিজেই যখন মাকে তেমন ধর্তব্যের মধ্যে ধরে না। তার কাছে তার বাবার মতামতটাই আসল। তার কাছে মা শুধু আছে রান্নাবান্না আর বাকি সংসার সামলানোর জন্য। তবে রঞ্জনাদেবীর এটা দেখে ভালো লাগে যে নাতনিটা ক্লাস সেভেনে পডলেও সে তার মা বাবার মতো নাক উচুঁ না। রিয়া কাউকে কখনো তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে না।
**************
সমস্ত রান্নাবান্না সেরে সন্ধ্যেবেলা একটু বসার সময়ই পাপাইরা বাড়িতে এসে উপস্থিত হয়।রঞ্জনাদেবী অনেকদিন পর ওদের দেখে ভীষণ খুশি হন। দুদিন হৈ চৈ করে কেটে যায় ওদের। তারপরে পাপাইরা নিজেদের ফ্ল্যাটে চলে যায়। রঞ্জনাদেবীও আবার নিজের সংসারে ব্যস্ত হয়ে পড়েন আগের মত।
ছেলে রোজই বাবাকে ফোন করে কথাবার্তা বললেও মায়ের সাথে তার খুব একটা কথা বলার সময় হয় না। আর এখানে এসে বৌমা আবার নতুন চাকরিতে যোগ দিয়েছে। সে কখনোই নিজের শাশুড়ী মাকে ফোন করার সময় পায় না। তবে রিয়া রোজ দিন স্কুল থেকে ফিরে এসেই ঠাম্মাকে ফোন করে।
এরকম একদিন বিকেলে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে এসে রিয়া রঞ্জনাদেবীকে ফোন করে।
"হ্যালো ঠাম্মি।"
"বলো দিদুন। তুমি কখন ফিরলে।"
"এই তো ফিরলাম। তুমি আগে বলো তুমি কি জানো পরশু কি ডে?"
"কি দিদুন?"
"পরশু উইমেন্স ডে। তাই আমার স্কুলে আমি তোমাকে নিয়ে যাবো।"
"আমি! আমি তোমার ইস্কুলে গিয়ে কি করবো দিদুন? আমি তো ইঞ্জিরিতে কথাও বলতে পারিনা।"
"উফ দিদুন। এত চিন্তার কিছু নেই। আমাদের একটা প্রোগ্রাম হচ্ছে উইমেন্স ডে উপলক্ষে।আমাদের বলেছে তোমার দেখা তোমার প্রিয় ওম্যানকে কাল স্কুলে নিয়ে যেতে। তোমাদের সেই প্রোগ্রামে কিছু একটা গিফট দেবে। আর আমি টিচারদের বলেছি তুমি খুব ভালো গান গাও।তো আমার গানের টিচার রিকোয়েস্ট করেছেন তুমি যেন কাল প্রোগ্রামে একটা গান গাও।"
"অ্যা! সেকি! আমি গান গাইবো তোমার ইস্কুলে?"
"হ্যাঁ। আমার জন্য এটুকু করবে না ঠাম্মি?"
"আমি গান গাইতে ভালো পারিনা..."
"এসব তুমি একদম বলবে না। আমি তোমাকে গুনগুন করে গান গাইতে শুনেছি। ইউ আর অ্যান awsome সিঙ্গার।"
"কি যে বলো দিদুন! কিন্তু তোমার মা যাবেন তো দিদুন আমাদের সাথে।"
"মা এখনো জানে না প্রোগ্রামটার ব্যাপারে। কিন্তু আমি পুরোটা বললে নিশ্চয়ই যাবে।"

রিয়ার ফোনটা রেখে দিয়ে একটু চিন্তায় পড়ে যান রঞ্জনাদেবী। এই বয়সে অত লোকের সামনে কি করে যে উনি গান গাইবেন ভেবেই ওনার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যায়। সেই কোন ছোট বয়েসে উনি স্টেজে গান গেয়েছেন। তখন স্টেজে ওঠার আগে বাপি ওনাকে সাহস দিতেন। আজ এত বছর বাদে আবার গান গাওয়া। সেটা কি সম্ভব! মানে উনি কি পারবেন ঠিকভাবে গাইতে? নিজের মনকেই প্রশ্ন করেন রঞ্জনাদেবী। এদিকে নাতনিটার কথা মনে পড়তেই মনে জোড় আনেন উনি। রিয়া কষ্ট পাক সেটা উনি একদমই চান না।

পরদিন সকালে রিয়া রঞ্জনাদেবীর বাড়িতে চলে আসে ওনাকে ওর সাথে স্কুলে নিয়ে যাওয়ার জন্য।এদিকে সারারাত টেনসন করে ঠিকভাবে ঘুমানও নি রঞ্জনাদেবী। রিয়াকে একা বাড়িতে আসতে দেখে উনি ওকে জিজ্ঞেস করেন "তোমার মা যাবেন না দিদুন?"
"না গো। মাম্মার যেন আজ কি সব কাজ রয়েছে অফিসে।"
ছেলের ফ্ল্যাটের সামনে দিয়ে গাড়িতে ওঠার সময় রঞ্জনাদেবী সুমিকে ফ্ল্যাটের গেটের সামনে দাঁড়ানো দেখতে পান। উনি হাসি মুকে সুমিকে জিজ্ঞেস করেন,
"বৌমা তুমি যাচ্ছ না কেন আমাদের সাথে?"
ওর কথায় মুখ বেঁকিয়ে সুমি বলে "আপনি যান আপনার নাতনির সাথে। তার আমাকে এখন দরকার পড়ে না সেটাই দেখতে পাই।"
রঞ্জনাদেবী বুঝতে পারেন বৌমা ওনার নাতনির স্কুলে যাওয়াটা ভালো চোখে দেখছেন না।তবে রিয়ার জেদের জন্য হয়তো কিছু বলতেও পারছে না।

**************
অনুষ্ঠানে পৌঁছে রঞ্জনাদেবী রিয়ার সাথে সামনের সারিতে গিয়ে বসে। রিয়ার গানের ম্যাডাম এক এক করে সব অভ্যাগতদের স্টেজে ডেকে একটা করে ফুলের বোকে আর গিফট দেন নারী দিবস উপলক্ষ্যে। তারপর প্রিন্সিপাল ম্যাম নারী দিবস উপলক্ষে ভাষণ দেন। তার ভাষণের পরেই শুরু হয় মূল অনুষ্ঠান। উপস্থিত সকল দর্শকদের মধ্যে অনেকেই গান নাচ কবিতা আবৃত্তি করেন। একদম শেষের দিকে রঞ্জনাদেবী গান গাইতে স্টেজে ওঠেন। উনি একটা রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন করেন। হলে উপস্থিত সকল দর্শক ওনার গলার জাদুতে মুগ্ধ হয়ে ওনার গান শুনতে থাকেন। ওনার গানটা শেষ হতেই রিয়ার প্রিন্সিপাল ম্যাম ওনাকে আর একটা গান গাওয়ার জন্য রিকোয়েস্ট করেন। উনি আর কি করেন। আর একটি রবীন্দ্রসংগীত সাবলীল ভাবে সকলকে গেয়ে শোনান।
অনুষ্ঠান শেষে সকলেই ওনার গানের অনেক তারিফ করতে থাকেন। রিয়া ওর ঠাম্মার পুরো গানের অনুষ্ঠানটা মোবাইলে রেকর্ড করে রাখে। তারপর ও ওনার সাথে নিজের সব বন্ধুদের পরিচয় করিয়ে দেয়। রিয়ার বেস্ট ফ্রেন্ড সৌমিলি রঞ্জনাদেবীকে প্রণাম করে রিয়াকে বলে    "ইউ আর লাকী রিয়া উওর ঠাম্মা ইস আ ওয়ান্ডারফুল সিঙ্গার।"
রিয়া হেসে বলে "আই নো। সি ইস দা বেস্ট গ্র্যান্ড মাদার ইন দা ওয়ার্ল্ড।"
গাড়িতে উঠে ও রঞ্জনাদেবীকে হঠাৎ জড়িয়ে ধরে বলে "ইউ আর বেস্ট ঠাম্মা।"
অনেক দিন পর এতজন দর্শকের সামনে গান গাইতে পারে আনন্দে, উত্তেজনায় রঞ্জনাদেবীর চোখেও জল চলে আসে।
রিয়া উত্তেজনায় ফুটতে ফুটতে ওর মাকে ফোন করে।
"হ্যালো মাম্মা"
"আজ প্রোগ্রাম কেমন হলো?"
"Awsome মাম্মা। ঠাম্মা আজ গান গেয়ে সবাইকে মুগ্ধ করে দিয়েছে। এত ভালো গান গেয়েছে ঠাম্মা কি আর বলবো! আমি এখনি তোমাকে, পাপাকে আর দাদুকে ঠাম্মার ভিডিওটা পাঠাচ্ছি।"
জীবনে প্রথম এত সম্মান,ভালোবাসা পেয়ে ভীষণ খুশি হন রঞ্জনাদেবী। নিজের একরত্তি নাতনির চিবুকে হাত দিয়ে চুমু খেয়ে উনি বলেন "ধন্যবাদ দিদুন। তুমি অনেক বড়ো হয়ো। আরো বড়ো মনের মানুষ হও।"

গল্প 

রাখহরির রান্না

Comments

Top

মাধুকরী পুজো বার্ষিকী ২০২৮: পর্ব ২

রাখহরির রান্না

রূপা মন্ডল

হাওড়া, পশ্চিম বঙ্গ

oldman.jpg

(১)

বুড়োদার বিয়ের সময় একজন আমাদের বাড়িতে রান্নার ঠাকুর হিসেবে এসেছিলো তার নাম রাখহরি। রাখহরির সঙ্গে এসেছিলো তার তিনজন অ্যাসিস্ট্যান্ট| সেদিন রাখহরির রান্না যারা যারা খেয়েছিলো আজও দেখা হলেই বলে সেকথা - "মুখে লেগে থাকার মতো!"

রাখহরি তখন আমাদের এলাকায় একচেটিয়া রান্নার কাজ করে যাচ্ছে। সবাই বলতো রাখহরি মা অন্নপূর্ণার বর লাভ করেছে। তাই সে যাই রান্না করুক না কেন, অসাধারণ হয়ে যায়।রাখহরির রান্না করা বিভিন্ন পদ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে খেয়েছি তার মধ্যে সুক্ত, পায়েস, মুড়িঘন্ট, ছোলার ডালের হালুয়া প্রভৃতি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। রাখহরির বাড়ি ছিল মেদিনীপুরে। সে সর্বক্ষণ মুখে পান ঠেসে রাখতো। তার সঙ্গে থাকতো একটা রুপোর কৌটো। তাতে তবক দেওয়া পানের খিলি থাকতো। মাঝে মাঝে একটা খিলি বের করে মুখে চালান করে কাঁধের গামছায় হাত মুছে আবার সে কাজে মন দিতো।

রাখহরিকে কখনো রাগ করতে দেখিনি। অনুষ্ঠানের আয়োজকদের বায়নাক্কার সীমা থাকতো না - কিন্তু রাখহরি সব হাসি মুখে সামলে নিতো। কোনো জিনিসের যোগান না থাকলে সে অন্য জিনিস দিয়ে এনে দিতো আকাঙ্ক্ষিত স্বাদ। প্রত্যেকটি অভ্যাগত না খাওয়া পর্যন্ত রাখহরি কোনো কিছু মুখে তুলতো না।

খাওয়াদাওয়া শেষ হলে রাখহরি অনুষ্ঠান বাড়ির কমবয়সী ছেলেদের সঙ্গে আড্ডা জমাত। সে দলে আমরাও পড়তাম।

(২)

- সে এক দিন ছিল বুঝলে খোকা। গ্রামের মাতব্বররা মিলে মিটিং ডেকে ঠিক করত কার অনুষ্ঠান বাড়িতে কি কি রকমের রান্না হবে। এক একটা অনুষ্ঠানে অন্তত: পঞ্চাশ রকমের পদ। মোচার ঘণ্ট থেকে শুরু করে মাছের বাটি চচ্চড়ি পর্যন্ত। সেই সময়ে বিভিন্ন ধরণের ঘণ্ট রান্না শেখার জন্য আমাকে যেতে হয়েছিল 'ঘণ্ট' গ্রামে। সেখানে সব বাড়িতে প্রতিদিন কোন না কোন ঘণ্ট রান্না হয়। সে এক মজার ব্যাপার বুঝলে!

- ঘণ্ট গ্রামের নাম কখনও শুনিনি তো? সে কোথায় গো?

- সে অনেক দূর। বাঁকুড়া জেলা থেকে আরো দুশো কিলোমিটার যেতে হয়। পোস্তর চাষ হয় সেখানে। ঘণ্ট আর সাদা পোস্ত সেখানকার লোকজন প্রতিদিন খায়।

- তা তুমি কি কি রান্না শিখলে সেখানে?

- অনেক কিছু। ঘণ্ট, সাদা পোস্ত, আমের মোরব্বা দিয়ে চাটনি, বিউলীর ডালের ধোঁকা, পোস্ত-বড়ির সাতকাহন, মাছের সরুচাকলি, গয়নাবড়ির ঝাল-টক, মোতিচুরের পায়েস – আরও কত কি।- তারপর?

- তারপর আর কি? যখন বাড়ি ফিরে এলাম, আমার হাতের রান্না খাওয়ার জন্য ডাক পড়ল স্বয়ং জমিদার মশাইয়ের কাছ থেকে। জমিদার গিন্নী তো ভীষণ খুশী। আমি বহাল হ'লাম তাঁদের খাস মহলের রান্নাঘরে। তার আগে সেখানে মহিলা ভিন্ন কোন পুরুষ প্রবেশ করত না।

- তারপর?

- আমাকে খাস মহলের খাস বাবুর্চি নিয়োগ করায় চাকরী গেল বহু পুরনো বামুনদি মোক্ষদার। সে তো প্রথমে অনেক কান্নাকাটি করল, হাতে-পায়ে ধরল গিন্নিমার। কিন্তু জমিদার মশাই অনড়। তখন মোক্ষদা আমাকে অভিসম্পাত দিতে লাগল। আমি পড়লাম দোটানায়। একজন গরীব মেয়ের চাকরী যাবে, তাও আমার জন্য – আমার সহ্য হচ্ছিল না। পরের দিন বললাম জমিদার মশাইকে, "বাবু, ওকেও রাখুন, গরীব মানুষ, চাকরী চলে গেলে বিপদে পড়বে।" জমিদার মশাই মোক্ষদাকেও রাখলেন তবে আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসাবে। মোক্ষদা তাতেই রাজি। সেও আবার বহাল হ'ল চাকরীতে। জমিদার মশাইয়ের বাড়িতে প্রায়ই অন্যান্য জমিদার মশাইরা কিংবা সাহেব-সুবোরা আসত। তারা এলেই আমাকে জমিদারমশাই বলতেন, "রাখহরি, মান রাখতে হবে কিন্তু। অবশ্য আমি জানি তুমি তা পারবে।" আমার যত রকমের বিদ্যেবুদ্ধি আছে উজার করে দিতাম। সবাই খুব প্রশংসাও করত।

কিন্তু বাধ সাধল ইংরেজ আমলের শেষে জমিদার প্রথার সমাপ্তির পর। সেই জমিদারীও রইল না, আর জমিদারবাবুও সেই শোকে বিছানায় শয্যাশায়ী হয়ে গত হ'লেন। শরীকী বিবাদে জমিদারীর চিহ্নমাত্র রইল না। তাই তো বলি বাবু, মানুষের দিন কখনও একরকম যায় না। সব পাল্টায়, রুচি থেকে রুজি, টাকা থেকে ফাঁকা – সব। শুধু রয়ে যায় স্বাদের স্মৃতি। কোথায় কবে কোন ভাল খাবার খেয়েছিলে – ঠিক তা মনে থাকে ।

এই বলে রাখহরি তার ঝোলা ব্যাগ আর পানের কৌটোটা নিয়ে উঠে পড়ে এগিয়ে যায় সদর দরজার দিকে।।

ভ্রমণ

Comments

Top

সবুজের কোলে

মাধুকরী পুজো বার্ষিকী ২০২৮: পর্ব ২

সবুজের কোলে

একমুঠো অবসর

সৌমেন্দ্র দরবার

বাগুইআটি,কলকাতা 

sk2.JPG

গ্যালারী - ১

ঙ্গল কি ভালো লাগে? সবুজ মেখে সময় কাটাতে? কিন্তু হাতে তো সময় নেই? তার ওপর বাজেট খুব কম। অথচ চাই মজা, নিরিবিলি, নির্জনতা আর সঙ্গে এডভেঞ্চার। আচ্ছা শাল, সেগুন, বাবলা, মেহগনি, হিজল, মহুয়া আর সবুজ বাঁশঝাড় যদি স্বাগত জানায়। মন্দ হয় না, তাই না। গাছের ডালে নিকষ কালো ফিঙেদের দোল খাওয়া। দূরে নাম না জানা হলুদ পাখির শিস দিতে দিতে উড়ে যাওয়া। গাছের মগডালে একঝাঁক টিয়ার গোপন মিটিং। নির্জন জঙ্গলের রাস্তায় হঠাৎ বনমুরগীর পালিয়ে যাওয়া অথবা হলুদ ছোপ হরিণদের লুকোচুরি।

পায়ে পায়ে জঙ্গলকে নিরীক্ষণ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেলে রাস্তার ধারের মাচায় একটু জিরিয়ে নেওয়া। রং বেরঙের প্রজাপতি ও ফড়িংদের শরীরে বুলিয়ে দেবে স্নেহের পরশ। শীতের রোদে জঙ্গলের মাঝের জলাশয়ে ঘড়িয়াল আর বিরল প্রজাতির কচ্ছপের রোদ পোহানো দেখতে দেখতে ভালোই লাগবে। 

এডভেঞ্চারের শখ থাকলে গাছের ডালে উঠে পূর্বপুরুষদের মতন চারিদিক অবলোকন করতে পারেন। বড়ো দীঘির ধারে চিপস বা বাদাম খেতে খেতে উপলব্ধি করতে পারেন জঙ্গলের নিস্তব্ধতা আর পাতার সন সন আন্দোলন। পড়ন্ত বিকেলে দেখা হয়ে যাবে ছোট্ট কাঠবেড়ালী আর মিষ্টি খরগোশের সঙ্গে। বৌ কথা কও বলে যাবে আমিও আছি কিন্তু! 

ঘড়িয়াল পুকুরের আবাসিক অনেকেই, নানা মাপের। কেউ কেউ ডাঙায় রোদ পোহায়, আবার কেউ কেউ জল থেকে মাথা বের করে রাখে শিকারের সন্ধানে। বেথুয়ার এই জঙ্গলে আছে চিতল হরিণ, শজারু, মেছোবিড়াল, বনবিড়াল, বুনো খরগোশ, বেজি, ভাম ইত্যাদি। আছে বিভিন্ন প্রজাতির সাপ, ময়ূর, বাজ, পেঁচাও। তা ছাড়া দেখা মিলবে রংবেরঙের বিভিন্ন প্রজাতির প্রজাপতির।

রাস্তার ওপর হঠাৎ সর্পের সাক্ষাতে ভয় পাবেন না, ওরা কিন্তু কারো ক্ষতি করে না। জঙ্গলের বুনো ফুলের গন্ধ করে দেবে মাতাল। সন্ধ্যার জনমানবহীন জঙ্গলে সঙ্গীর সাথে অথবা সপরিবারে হাঁটার সে এক অন্য অনুভূতি। গ্রীষ্মকালে শীতল হাওয়া আর শীতকালে শীতবুড়ির কামড় দুটোই অতি মনোরম।  

এরই মধ্যে কখন যে সূর্য ঝুপ করে বিদায় নেবে বুঝতেই পারবেন না। পায়ের নীচে শুকনো পাতার মড়মড় শব্দ যে পরিবেশ তৈরি করে তা শুধুই উপলব্ধি করতে হয় বলে বোঝানো যায় না। চাঁদের রুপোলি আলো জঙ্গলের ওপর বিছিয়ে দেয় শ্বেতশুভ্র চাদর। কটেজের দরজা খুলে দেখবেন মৃগরা আপনার অতিথি। রাতের খাওয়া সেরে জঙ্গলে খানিক পায়চারি নিস্তব্ধ, শান্ত, মোহময় অথচ অনাবিল উপলব্ধি। রাত গাঢ় হলে ঘুম ভেঙে শুনবেন শিয়ালের ডাক।  জানালায় হরিণদের শিঙ এর টোকা পেয়ে ভয় পাবেন না, ওরা শাকাহারি, মাংসাশী নয়। নিকষ কালো অন্ধকারে ঝিঁ ঝিঁ দের ডাক এক মোহময় পরিবেশ সৃষ্টি করে।পরদিন ভোরে জঙ্গলের সূর্যোদয়, গাছের ফাঁক দিয়ে নেমে আসছে সূর্যের বারি ধারা। শীতোষ্ণ উত্তাপ আপনার শরীর ভিজিয়ে দেবে। জঙ্গলের মাঝে বনবিভাগের তৈরি নিদিষ্ট জায়গায় দেখতে পাবেন কয়েকশো হরিণের নিঃশব্দ প্রাতরাশ। সাবধান শব্দ করা একদম নিষিদ্ধ। ছোটদের জন্য কটেজের কাছেই আছে ছোট পশুআলোয়। সেখানে আছে নীলগাই , ময়ূর, কাকাতুয়া আর ও অনেক কিছু।

আর আছে বাটারফ্লাই গার্ডেন ও দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের নামে নামাঙ্কিত প্রকৃতি বীক্ষণ কেন্দ্র এবং সংগ্রহশালা।  

এবার কৌতূহল নিবারণ। নদীয়া জেলার ৩৪ নং জাতীয় সড়কের ওপর কলকাতা থেকে ১৩৭ কিলোমিটার দূরের অভয়ারণ্য বেথুয়াডহরী। শান্ত, নির্জন দূষণ-হীন সবুজের কোলে দু দিন ছুটি কাটানোর অনবদ্ধ ঠিকানা। ১৮৫ একর জায়গা জুড়ে তৈরি অভয়ারণ্য সবুজের ডালি আর পশু পাখির সম্ভার নিয়ে আপনার অপেক্ষায়।  

পথের ঠিকানা: কলকাতা থেকে বহরমপুরগামী বাসে বা গাড়িতে ৩৪ নং জাতীয় সড়কের ওপর বেথুয়াডহরী। সময় লাগে আড়াই থেকে তিন ঘন্টা। শিয়ালদা থেকে লালগোলাগামী ট্রেনে বেথুয়াডহরী স্টেশন। সেখান থেকে টোটো বা রিক্সায় বেথুয়াডহরী অভয়ারণ্য।  
গৃহের ঠিকানা: ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেটস ফরেস্ট ডেভেলপমেন্ট এজেন্সির নন এ সি কটেজ। ভাড়া সাধ্যের মধ্যে।  
রসনাবিলাস: ঘরোয়া খাবার। চাইলে খেতে পারেন দেশি মুরগি কিংবা কচি পাঁঠা। 
ভ্রমণকাল: অক্টোবর থেকে মার্চ। বর্ষাকালে না যাওয়াই ভালো। পোকামাকড়ের উৎপাত।  

 

গ্যালারী - ২

উপনিষদ-১

প্রবন্ধ

Comments

Top

মাধুকরী পুজো বার্ষিকী ২০২৮: পর্ব ২

SanojCharaborty.jpg

উপনিষদ - ১ 

সনোজ চক্রবর্তী

পূর্ব মেদিনীপুর, পঃ বাংলা
 

uponishad.JPG

শিক্ষকদিবস ফুল-চন্দন আর বক্তৃতার বিভূতি নয়.... মুন্ডকো উপনিষদ বলছে- মহাশাল অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ গৃহস্থ শৌনক একবার আচার্য অঙ্গিরসের কাছে 'বিধিপূর্বক' উপস্থিত হয়ে বললেন--

"কস্মিন্নু ভগবো বিজ্ঞাতে সর্বমিদং বিজ্ঞাতং ভবতীত।"

শৌনক মহাগৃহস্থ কারণ তিনি সংসারের মধ্যে থেকে সংসার ধর্ম পালন করলেও তাঁর মনে কোনো মালিন্য ছিল না। বরং তিনি ছিলেন সকল সদগুণের  অধিকারী। 'বিধিবৎ' বলতে শিষ্য যখন 'উপসদন'- এ বা গুরুগৃহে যাবেন তখন তিনি রিক্ত হস্তে যাবেন না। তিনি যাবেন সমিৎপাণি হয়ে। অর্থাৎ যজ্ঞকাঠ নিয়ে যাবেন। গুরুগৃহ যাত্রায় এই প্রথাকে বিধিবৎ বলা হয়েছে। তাই শৌনক সমিৎপাণি হয়ে ঋষিবর অঙ্গিরসকে প্রণাম জানিয়ে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে বিনয়ের সঙ্গে প্রশ্ন করলেন--

"কস্মিন্নু ভগবো বিজ্ঞাতে সর্বমিদং বিজ্ঞাতং ভবতীত।"

কোন বস্তুকে জানলে সমস্ত বিজ্ঞেয় বস্তু বিজ্ঞাত অর্থাৎ বিশেষরূপে জ্ঞাত হওয়া যায়?

সেকালে গুরুগৃহে গুরুর পায়ের কাছে বসে নিতে হত শিক্ষা। উপনিষদ কথার অর্থ হল- আচার্যের কাছে বসে শিক্ষা। গুরুগৃহ হল উপসদন। শিষ্যের নিজ গৃহ ছেড়ে শিক্ষা লাভের জন্য গুরুগৃহে যাত্রা- ব্রহ্মচর্য। এই ব্রহ্মচর্য যাত্রায় শিষ্য সমিৎপাণি হয়ে উপসদনে যান।  শিষ্যের সমিৎপাণি হওয়ার একটি দিক গীতায় উল্লেখ আছে। ব্রহ্মচর্য আসলে গুরু সেবা করে তাঁর প্রসন্নতা লাভ করে বিনম্রতার সঙ্গে তাঁর কাছে প্রশ্ন নিবেদন করা।

গীতা বলছে--

" তিদ্বিদ্ধি প্রণিপাতেন পরিপ্রশ্নেন সেবয়া।"

প্রণিপাত পরিপ্রশ্ন ও সেবা এগুলো হল শিষ্যের ধর্ম। শিষ্য আচার্যের প্রতি শ্রদ্ধা পরায়ণ হবেন। তাই শাস্ত্র বলছে 'শ্রদ্ধাবান লভতে জ্ঞানম।'

আচার্যের প্রতি বিশ্বাস,তাঁর প্রজ্ঞায় আস্থাটুকু না থাকলে শিষ্য আচার্যর কাছে হাত পাতবে কি কারণে! তিনিই অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে যেতে পারেন এই আত্মবিশ্বাসে, শিষ্য  গুরুর চরণে নিজেকে নিবেদন করে দেবেন-এই হল শিক্ষার পূর্বশর্ত। আবার শিষ্যের মধ্যে থাকতে হবে অপার অনুসন্ধিৎসা। নিরবিচ্ছিন্ন জিজ্ঞাসা।

"অসতো মা সদগময়" --এই হবে শিষ্যের প্রার্থনা। সে অন্তর দিয়ে চাইবে অসৎ অর্থাৎ অপূর্নতা থেকে সৎ অর্থাৎ পূর্ণতায় উত্তীর্ণ হতে। সমিৎপাণির অন্য আর একটি তাৎপর্য রয়েছে---

সমিৎ বা কাঠটি হল ইন্ধনের প্রতীক, যার মধ্যে আগুন ঘুমিয়ে আছে। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থী মধ্যেও লুকিয়ে আছে সম্ভাবনা। মানুষের মধ্যে সুপ্ত ভাবে নিহিত থাকে যে পূর্ণতা শিক্ষা হল তারই প্রকাশ। আচার্যের পরিচর্চায় সেই পূর্ণতার প্রকাশ ঘটে। শিষ্য হল অধর-অরণি, নিচের কাঠ আর গুরু হল উত্তর অরণি, উপরের কাঠ।

শিষ্য নিজেকে পেতে দেবে, বিছিয়ে দেবে, নিবেদন করে দেবে গুরুদেবের চরণে। শিষ্য অর্থাৎ নিচের কাঠটি নিশ্চেষ্ট হয়ে পড়ে থাকবে  আর উপরের কাঠটি থাকবে সক্রিয়। উপরের কাঠটি নিচের কাঠটির উপর অবিরাম ঘর্ষণ করতে থাকবে তার ফলেই এক সময় দপ করে জ্বলে ওঠবে আগুন- এরই নাম অগ্নিমন্থন।  এই হল অন্ধকার থেকে আলোয় উত্তরণ। এখানে নিষ্ক্রিয় বলতে অনাগ্রহকে নির্দেশ করে না।

এখানে নিষ্ক্রিয়-এর অর্থ শান্ত বা অবিচল থাকা। নিষ্ক্রিয় বলতে বোঝায় শিক্ষকের কাছে সব পাব এই মনোভাব নিয়ে সম্পূর্ণ সমর্পণ। গীতা বলছে শিষ্যের আরও লক্ষণ হল--

" ইদং তে নাতপস্কায় নাভক্তায় কদাচন।

  ন চাশুশ্রষবে বাচ্যং ন চ যোহভ্যসূয়তি।"

তপস্যাহীনের জন্য শিক্ষা নয়। চতুর্দিকে সতত ধাবমান মনকে ফিরিয়ে এনে এক লক্ষে স্থির করাই তপস্যা। শিক্ষাকে যে শিক্ষার্থী সাধনা হিসাবে নেয় না তার শিক্ষা সম্পূর্ণ হয় না। আবার শিষ্যের মধ্যে তপ ভাব থাকলেও যদি  গুরুভক্তি না থাকে,তবে তার জন্যেও শিক্ষা নয়। আমরা ঈশ্বরের স্মরণাপন্ন হই কারণ তিনি সর্বশক্তিমান--

 " যেনাশ্রুতং শ্রুতং ভবতি,অমতং মতমবিজ্ঞাতং বিজ্ঞাতম্"---

যাকে জানলে অশ্রুত যা তা শোনা হয়, অচিন্তিত বস্তু চিন্তিত হয়,অজ্ঞাত বস্তু জ্ঞাত হয়ে যায়- তিনিই ঈশ্বর।

গুরুও ঈশ্বরতুল্য। শিষ্য যদি মনে করে আচার্যের থেকে নেওয়ার কিছুই নেই তবে তার ভক্তি ভাব আসবে কোথা থেকে! আবার শিক্ষার্থী ভক্ত ও তপস্বী হলেও শ্রবণেচ্ছু না হলে তার শিক্ষা নয় না।

ইংরাজী hearing ও Listening শব্দ দুটির বাংলা অর্থ শোনা। hearing শোনা হলেও Listening আসলে অনুধাবন। কান দিয়ে মরমে পশা। কান আর হৃদয়ের যৌথ ক্রিয়া Listening। উপনিষদ বলছে- " ওঁ ভদ্রং কর্ণেভি শৃণুয়াম"

আমরা কর্ণসমুহের দ্বারা যেন কল্যাণ-বচন শ্রবণ করি। আচার্য আর শিষ্যের এই সহযোগী কার্যকলাপে  কেমন হবেন আচার্য বা গুরু? গুরু হবেন-- " শ্রোত্রিয়ো অবৃজিনো অকামহত" তিনি হবেন নিষ্পাপ,তাঁর আচরণ হবে শুদ্ধ এবং অকামহত অর্থাৎ সবরকম বাসনার উর্দ্ধে হবেন তিনি। যেহেতু গুরুর প্রতি সেবাপরায়ন হওয়া শিষ্য হওয়ার পূর্বশর্ত তাই আচার্য হবেন অকামহত। শিষ্যের সেবার প্রতি তাঁর না থাকবে কোনো আসক্তি না থাকবে দাবী। তিনি তাঁর সকল জ্ঞান নিঃশর্তে প্রদান করবেন শিষ্যকে। এ যেন পুত্রের উত্তরাধিকার।

আজ আমরা উপনিষদের যুগ থেকে অনেক দূরে। পাল্টে গেছে শিক্ষা ব্যবস্থা। বিদ্যালয়,মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোই এখন উপসদন। ব্রহ্মজ্ঞান নয় অর্থকরী শিক্ষাই শিক্ষার মূল উপজীব্য। কর্ম সংস্থানের শিক্ষা, উপার্জনের শিক্ষা নিতেই শিষ্যর উপসদন যাত্রা। শিক্ষা এখন কেবল প্রয়োজনের শিক্ষা সেখানে অন্তরের যোগটাই নেই। সে কেবল আয়োজনের বাহুল্য।  চামচ যেমন খাদ্যের স্বাদ বোঝে না ঠিক তেমনই প্রয়োজনের শিক্ষায় মস্তিষ্কে শুধুমাত্র কতকগুলো তথ্য ঢুকিয়ে নেওয়া হয়। মননের কোনো স্থান নেই সেখানে। ছাত্র - শিক্ষক সম্পর্ক প্রয়োজনের আবর্তে পাক খাচ্ছে অবিরত। শ্রদ্ধা-স্নেহ-ভালোবাসার যতটুকু অবশিষ্ট তা অতি দ্রুত নিঃশেষিত হওয়ার পথে। শিক্ষায় আচার্য ও শিষ্যের অনুভবের অবস্থান অবসৃত। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় আমরা যা শিখি তার কতটুকু কাজে আসে ( শিক্ষকতা,চিকিৎসা এবংবিধ কতকগুলি পেশায় শিক্ষা বা চর্চার বেশির ভাগটুকু কাজে লাগে এই মাত্র)?  বরং কাজের মধ্য দিয়ে শিখি অনেক বেশি।

এক(১) এর পাশে ক্রমাগত শূন্য (০) বসালে তার মূল্য বাড়ে কিন্তু এক (১)টুকু সরিয়ে নিলে শূন্যের (০) আর কোনো মূল্য অবশিষ্ট রয় না। বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমরা যে কাজের বা জীবিকার শিক্ষা নেই সেগুলো ঐ শূন্যের (০) মতো, এক (১) ব্যতীত তার কোনো মূল্য নেই। এক (১) হল মানুষের মধ্যে নিহিত যে সদগুণ তার প্রকাশ, দেবভাবের প্রকাশ। নিজেকে আদর্শ মানুষ হিসাবে প্রকাশ।

নিহিত দেবভাব প্রকাশের জন্য শিষ্যকে সদগুরুর সান্নিধ্য নিতে হয়। তাঁর পায়ের কাছে বসে নিতে হয় সে শিক্ষা।

এই অস্থির সময়ে আচার্য-শিষ্য সম্পর্কের সেই ঐতিহ্য আর পরম্পরার কাছে ফিরে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই আমাদের সামনে। শিক্ষকদিবস শুধু ফুল-চন্দন আর বক্তৃতার বিভূতি নয়, শিক্ষকদিবস হোক দায়বদ্ধতা আর অঙ্গীকারের আত্মপ্রত্যয়। আমরাই পারি কারণ আমরা অমৃতস্য পুত্রাঃ। তাই আসুন আর একবার আশায় বুক বেঁধে নতুন আর এক আরম্ভের প্রত্যাশায় প্রত্যয়ী হই...

        ওঁ সহ নাববতু

             সহ নৌ ভুনক্তু

           সহ বীর্যং করবাবহৈ

            তেজস্বী নাবধীতমস্ত

                 মা বিদ্বিষাবহৈ

              ওঁ শান্তি: শান্তি: শান্তি:

      ওঁ সহ নাববতু-

পরমেশ্বর আমাদের অর্থাৎ শিষ্য ও গুরু উভয়ের চিত্তে ব্রহ্মবিদ্যা প্রকাশের দ্বারা উভয়কে সর্বতোভাবে রক্ষা করুন।

      সহ নৌ ভুনক্তু-

ব্রহ্মবিদ্যার ফল যে পরমানন্দ সেই আনন্দ-অমৃতে আমাদের পরিতৃপ্ত করুন।

      সহ বীর্যং করবাবহৈ-

আমরা উভয়েই যেন বীর্যবান হতে পারি।

       তেজস্বী নাবধীতমস্ত-

আমাদের অধীত বিদ্যা যেন নিষ্প্রভ না হয়।

          মা বিদ্বিষাবহৈ-

আমরা একে অপরকে যেন দ্বেষ না করি।

       ওঁ শান্তি:,শান্তি:,শান্তি:-

আত্মজ্ঞান লাভের যাবতীয় প্রতিবন্ধক উপশান্ত হোক।

উপনিষদ - ২

প্রবন্ধ

Comments

Top

মাধুকরী পুজো বার্ষিকী ২০২৮: পর্ব ২

SanojCharaborty.jpg

উপনিষদ - ২ 

সনোজ চক্রবর্তী

পূর্ব মেদিনীপুর, পঃ বাংলা
 

uponishad.JPG

খন কেউ কোন নিদিষ্ট বিষয়ে মনন করতে পারেন তখন তিনি ঐ বিষয়টিকে বিশেষভাবে জানতে পারেন। উপনিষদ বলছে---

"যদা বৈ মনুত্যেথ বিজানাতি।

নামত্বা বিজানাতি।"

যিনি মনন করেন তিনি বিশেষ ভাবে জানেন, যিনি করেন না তিনি জানতে পারেন না। মনন করার অর্থ হল কোনো বিষয়কে গভীরভাবে ভালোবাসা। ধ্যানের মতো গভীরে ডুব দেওয়া। ছেদহীন অসীম চিন্তা--  'নিরবচ্ছিন্ন তৈলধারাবৎ'--

একটি পাত্র থেকে অন্য একটি পাত্রে তেল ঢাললে যেমন ছেদহীন ধারায় তেল গড়িয়ে যায় ঠিক তেমনই। মহামতি বুদ্ধদেবের  সংকল্পের মতো--

"এই আসনে আমার শরীর শুকিয়ে যায় তো যাক,ত্বক-অস্থি-মাংস পচে গলে গেলেও এই আসন ছাড়ব না যতক্ষণ না পর্যন্ত নির্বাণ লাভ হয়।"

কৃতসংকল্প হয়ে বিষয়ে তলিয়ে যাওয়া, বিষয়ে নিবিষ্ট হওয়াই মনন। আর মননের ফলে বিশেষভাবে জানা বা উপলব্ধিই আসলে বিজ্ঞান।

উপনিষদ বলছে-- "নায়মাত্মা বলহীননে লভ্যঃ" 'বল'-হীনের জন্য আত্মজ্ঞান নয়। অর্থাৎ বিশেষ জ্ঞান বা বিজ্ঞান উপলব্ধ হয় তখনই যখন মানুষ 'বল'-শালী হয়।

এখানে বলশালী শুধু শরীরের সক্ষমতা নয়-- সংকল্প,চিন্তা,বুদ্ধির সক্ষমতাই আসল। মন তো সকলের আছে কিন্তু মনের ইচ্ছাশক্তি, সংকল্প তো সকলের সমান নয়। সংকল্প চালিত হয় চিত্ত বা বুদ্ধির দ্বারা।

"যাদৃশী ভাবনা যস্য সিদ্ধিভর্বতি তাদৃশী।"

যার ভাবনা যেমন তিনি তেমনই হন। তাই সত্য ও সুন্দরের চিন্তা করা উচিত। ধ্যানস্থ হওয়া উচিত তারই। আমাদের চরিত্র গঠনের মূলে রয়েছে শুদ্ধ চিন্তা। যদি আমরা উঁচু আদর্শের চিন্তা করি তবেই আমরা মহৎ হয়ে যাই।

চিন্তা এবং সৎ চিন্তাই উত্তরণের একমাত্র পথ। মানুষ যদি চিন্তা না করে তবে মনের দরকার কি? চিন্তাহীন মানুষ আসলে মৃতদেহ। পশুরা চিন্তা করতে পারে না, বিচার করতে পারে না, প্রশ্ন করতে পারে না--- মানুষ পারে--- তাই মানুষ শ্রেষ্ঠ।

এই পৃথিবীতে মানুষের কল্যাণকর যা কিছু আবিষ্কার,উদ্ভাবনের ইতিহাস তার রসদ আসলে মানুষের সংকল্প-চিন্তা-মনন। যদা বৈ শ্রদ্দধাত্যম মনুতে-- মানুষ যখন শ্রদ্ধাবান হন তখন তিনি মনন করতে পারেন। শ্রদ্ধা না থাকলে আমরা কোনো বিষয়কে গুরুত্ব দিতে চাই না।

বিশ্বাস বা শ্রদ্ধা থেকেই বিষয়ের প্রতি অনুরাগ আসে। তাকে চিন্তা বা মনন করার ইচ্ছা জাগে।

কৃতসংকল্প হয়ে তার সবটুকু জানতে পারলে আনন্দ লাভ হয়- আলোকিত হয় অন্তর। উঁচু জায়গায় যেমন জল জমতে পারে না, গড়িয়ে যায়, তেমনি  শ্রদ্ধাহীন অহংকারীর মধ্যে সৎগুণ স্থায়ী হয় না। নম্র, বিনীত ব্যক্তির মধ্যে সৎ গুণের প্রকাশ ঘটে, যে গুণগুলোই 'বল' বলে চিহ্নিত। 'প্রণিপাতেন পরিপ্রশ্নেন সেবায়া' শিষ্য বিনয়ী হলে আচার্য তাকে শিখিয়ে আনন্দ পান। আবার সদগুরু সর্বজ্ঞ, অতিবাদী হয়েও,হন নিরহংকারী। আমরা তো সবাই বলি কিন্তু সদগুরুর কথায় জোর থাকে। তাঁর কথাগুলো নিছক কথা নয়, শব্দমাত্র নয়।  তাঁর প্রতিটি কথাই অর্থবহ, সত্য। উপনিষদ আরো বলছে-- যিনি নিষ্ঠাবান তিনি শ্রদ্ধাবান--  "য বৈ নিস্তিষ্ঠত্যথ শ্রদ্দধাতি"।জানার জন্য নিরন্তর সচেষ্ট থাকাই হল নিষ্ঠা। নিষ্ঠা হল লেগে থাকা। একাগ্রতা ও আত্মসংযমের  সঙ্গে  কর্তব্যকর্মে লেগে থাকা।

যিনি কর্তব্যপরায়ণ হন তিনিই নিষ্ঠাবান হন--

"যদা বৈ করোত্যথ নিস্তিষ্ঠতি"।

"যদা বৈ সুখং লভত্যেথ করোতি।

নাসুখং লব্ধ্বা  করোতি"।

 কাজের মধ্যে দিয়ে মানুষ সুখ লাভ করে।  যে কাজ করে না, তার সুখ প্রাপ্তি হয় না।

সুত্রঃ - উপনিষদ

উপনিষদ - ৩ 

সনোজ চক্রবর্তী

পূর্ব মেদিনীপুর, পঃ বাংলা
 

উপনিষদ - ৩

প্রবন্ধ

Comments

Top

SanojCharaborty.jpg
uponishad.JPG

মাধুকরী পুজো বার্ষিকী ২০২৮: পর্ব ২

মানুষের শরীর চোদ্দটি ইন্দ্রিয়ের উপর আধারিত। দেহের সকল গতিবিধির মূলে ঐ চোদ্দটি ইন্দ্রিয়। চক্ষু,কর্ণ, নাসিকা,জিহ্বা,ত্বক-এরা জ্ঞানেন্দ্রিয় কারণ এরা বাইরের পরিবেশ থেকে কোনো না কোনো অনুভূতি বা জ্ঞান আহরণ করে। বাক,পানি,পাদ,পায়ু,উপস্থ- এই পাঁচ কর্মেন্দ্রিয়। এই পাঁচ কোনো না কোনো কাজে সাহায্য করে। মন, বুদ্ধি, অহংকার, চিত্ত-এরা হল অন্তরেন্দ্রিয়।

জাগতিক সকল কাজ সম্পন্ন করে এই ইন্দ্রিয়গুলি। এরা এককভাবে কাজ করলেও পরস্পর সম্পর্ক যুক্ত। আর সেটিই একটি সামগ্রিক ব্যবস্থা। মজার ব্যাপার হল, যে বা যারা কাজ করে, যেহেতু তারা কাজ করে তাই তাদের আধিপত্য বিস্তারের লক্ষণ দেখা যায় প্রায়শই।যখন আমরা কোনো উদ্যোগে বা প্রচেষ্টায় অংশ নিই অধিকাংশ ক্ষেত্রে মনে হয় "আমি ছাড়া এ কান্ডটি অসম্ভবই ছিল।"

অহম্ আমিই, মিথ্যে আত্মঅহমিকায় বুকের ভিতর অনেকখানি বাতাস ভরে জামার বোতামে টান অনুভব এ আমাদের স্বভাব সঙ্গত। আধিপত্য বিস্তারের এই মনোভাবটি রবীন্দ্র নাথের কবিতায় উৎকীর্ণ হয়েছে রূপকের আড়ালে- কাছির টানে চাকায় এগিয়ে চলেছে রথ।

অশেষ আয়োজন আর অসীম উৎসাহে ভক্তের দল লুটাচ্ছে মাটিতে। তাদের প্রণতি নিবেদনে নিজেকে ধন্য মনে করছে রথ, পথ, মূর্তি এমন কি ব্রাহ্মণও। আর সেই আত্মাভিমান দেখে অন্তর্যামী হাসছেন অন্তরালে।

একবার বাক, চক্ষু, কর্ণ ও মন নিজেদের মধ্যে কে বড় সে নিয়ে তর্ক বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। বাক বলেন তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ "বাগ্বাব বসিষ্ঠ:"

কারণ কথার দ্বারাই মানুষ নিজেকে প্রকাশ করেন। অন্যকে প্রভাবিত বা নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার উপায়ই হল বাক চাতুর্য।

চক্ষু বলেন তিনিই বরিষ্ঠ কারণ দৃষ্টিশক্তি পূর্ণ মানুষ ইহলোক ও পরলোকে নিরাপদে থাকেন।

কর্ণ বললেন যিনি প্রাচুর্যকে জানেন তার কাছে দেবতা ও মানুষের সব ভোগবস্তু অনায়াস হয়। তাই তিনি অর্থাৎ শ্রবণেন্দ্রিয়ই সকলের সার। মন বললেন তিনিই আশ্রয়। ইন্দ্রিয়দিগের সকল অভিজ্ঞতা তো তার কাছেই আশ্রয় লাভ করে। বিবাদের আর শেষ হয় না। আমি শ্রেষ্ঠ, আমি শ্রেষ্ঠ করতে করতে বাক, চক্ষু, কর্ণ, মন উপস্থিত হন পিতা প্রজাপতির কাছে।

বিনয়ের সঙ্গে বলেন-- "ভগবান, আমরা সকলেই দেহস্থিত হয়ে দেহকে নিয়ন্ত্রণ করি। আমাদের মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ?"

পিতা প্রজাপতি সরাসরি উত্তর না করে একটু কৌশল অবলম্বন করলেন, ঘুরিয়ে বললেন-- "এ প্রশ্নের মীমাংসা তো তোমরা নিজেরাই করে নিতে পার, তোমাদের মধ্যে যে দেহ ছেড়ে বেরিয়ে গেলে দেহ সর্বাপেক্ষা হীনবল হয়ে পড়ে এবং দেহকে অশুদ্ধ বলে মনে হয়, সেই শ্রেষ্ঠ।"

ইন্দ্রিয়গণ খুশি মনে ফিরে গেল। শুরুতেই বাক দেহ ছেড়ে বেরিয়ে গেল। এক বছর এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াল নিজের খুশি মত এবং এটা মনে করে উৎফুল্ল হল, তার অভাবে দেহ কত কষ্টে আছে। অন্যান্য ইন্দ্রিয়গন বেশ টের পাচ্ছে তার অভাব। হয়তো এতো দিনে মরেই গেছে দেহ।

বছর খানেক পর বাক ফিরে এল অবস্থাটা পরখ করতে। ফিরে তো চমকে গেল বাক! বেশ আছে তো শরীর! বাক জিজ্ঞাসা করল --

"আমি ছাড়া কি ভাবে কাটল এক বছর? কোনো অসুবিধা হয় নি? অভাব বোধ হয় নি?"

সবাই মিলে বলে উঠল--

"বোবা মানুষ যেভাবে বাঁচে সেভাবেই নিঃশ্বাস- প্রশ্বাস নিয়ে বেঁচে আছি আমরা। চোখ দিয়ে দেখছি, কান দিয়ে শুনছি, মন দিয়ে চিন্তা করছি, শুধু মাত্র কথা বলাটুকুই বন্ধ এই যা।"

বাক মন খারাপ করে ফের ঢুকে পড়ল শরীরে। এবার শরীর ছাড়ল চক্ষু। না জানি তার অভাবে কি নাই কি ঘটছে এই সব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে কেটে গেল এক বছর। বছর ঘুরতে চক্ষু ফিরে এল। এবার তো চক্ষুর, চক্ষু চড়ক গাছ! তাকে ছাড়া বহাল তবিয়তে রয়েছে সব। একটু হতাশ হয়ে বলল--

"আমাকে ছাড়া তোমরা বেঁচে আছ?"

বাক,কর্ণ,মন বলল--

"কেন থাকব না। তুমি ছাড়া তো তেমন কোনো অসুবিধা দেখি না। শুধু যা দেখতে পাচ্ছি না। নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ে দিব্যি বেঁচে আছি। বাকি সব কাজই তো চলছে। বাগিন্দ্রিয় দিয়ে কথা বলছি,কান দিয়ে শুনছি,মন চিন্তা করছে।" একথা তারা চক্ষুকে আনন্দের সঙ্গে জানাল।

চক্ষু একরাশ অবসাদ নিয়ে প্রবেশ করল শরীরে।

চক্ষু শরীরে প্রবেশ করার পর শরীর ছাড়ল কর্ণ। মজা করে ফিরে এল এক বছর পর। ভাবল তাকে ছাড়া বেশ জব্দ হয়েছে অন্যরা। প্রবল ধাক্কা খেল কর্ণ। তাকে ছাড়া বিশেষ কোন অসুবিধাই হয় নি। অন্যরা জানাল --

"নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের সাহায্যে কি আর বধির লোক বাঁচে না? তাছাড়া চোখ দিয়ে দেখা, বাগিন্দ্রিয় দিয়ে কথা বলা, মন দিয়ে চিন্তা করা সবই বজায় আছে।"

শোনা ছাড়া আর কোন কাজই বন্ধ ছিল না ঐ এক বছর এটা জেনে দম্ভ চূর্ণ হল কর্ণের সে আগের মতো শরীরে অবস্থান করল। এবার শরীর থেকে উধাও হল মন। সে ভাবল এদের অভাব যখন অনুভূত হয় নি তবে নিশ্চিত ভাবেই সেই শ্রেষ্ঠ।

এক বছর পর বেশ ফুরফুরে মেজাজে হাজির হল সে। অন্যদের মতোই সেও আশ্চর্য হল। তার অভাবে কোন অচলাবস্থা ঘটে নি। বেশ আছে সবাই। অবাক হয়ে মন জিজ্ঞাসা করল--

"আমাকে ছাড়া তোমরা রইলে কেমন করে?"

উত্তর এল একজন শিশু যেমন কোন চিন্তা ভাবনা ছাড়া নির্বিকার বাঁচে, সেভাবেই নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের সঙ্গে বেঁচে আছে তারা। চোখ, কান, বাগিন্দ্রিয় যার যার কাজ ঠিকঠাক করে যাচ্ছে। মন হতোদ্যম হয়ে শরীরে প্রবেশ করল। এরপর যখন মুখ্যপ্রাণ অর্থাৎ প্রাণবায়ু যখন শরীর ছাড়তে মনস্থ করল তখন শরীরের মধ্যে তোলপাড় শুরু হল। এর আগে বাক, চক্ষু, কর্ণ, মন শরীর ত্যাগ করায় এ পরিস্থিতি হয় নি।

যেমন ভাল ঘোড়া কষাঘাতে, পা বেঁধে রাখা খুঁটি সমূহ উপড়ে ফেলে তেমন মুখ্যপ্রাণ অন্য সকল ইন্দ্রিয়দের উপড়ে নিয়ে শরীর ছাড়ার উপক্রম হল। সেই অস্থিরতার আবহে বাক, চক্ষু,কর্ণ, মন সহ সকল ইন্দ্রিয়রা বুঝতে পারল তার কেউ স্বাধীন নয় তারা প্রাণের অধীন। প্রাণই তাদের প্রভু, তাদের নিয়ন্ত্রণকারী। তারই সেবায় তারা নিয়োজিত। সকল ইন্দ্রিয় সমবেত ভাবে প্রাণকে অনুরোধ করল শরীর না ছাড়তে। মনে নিল প্রাণই শ্রেষ্ঠ। তারা শ্রদ্ধা জানালো প্রাণকে।

জয়গান হল প্রাণের।

দেহস্থিত আত্মা প্রাণের মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করেন। প্রাণরূপে তিনিই সচল রাখেন ইন্দ্রিয়দিগকে। প্রাণহীন দেহ আত্মা হীন দেহ জড় নিশ্চল।

সুত্রঃ উপনিষদ।।

আলোচনা-কলম

সনোজ চক্রবর্তীর কলমে

Comments

Top

মাধুকরী পুজো বার্ষিকী ২০২৮: পর্ব ২

SanojCharaborty.jpg

সনোজ চক্রবর্তীর

কলমে

পূর্ব মেদিনীপুর, পঃ বাংলা
 

village4.jpg

রাতে হঠাৎই ছুটে আসে শাঁখের আওয়াজ ঝাঁকে ঝাঁকে। ছড়িয়ে পড়তে থাকে দূর পশ্চিম থেকে তরঙ্গের মতো। তখন আমরা ছাদে। স্থির বোঝার চেষ্টা করি ভূমিকম্প নয় তো! না, সেসব কিছুই নয়।

বন্যার্তের দল শঙ্খ বাজিয়ে নিজেদের অসহায় আর্তনাদ পৌঁছে দিতে চাইছে ঈশ্বরের কাছে।

অতি দ্রুত বাড়তে থাকা জলস্তরে ভয় পেয়েছে বন্যায় অভ্যস্ত পশ্চিমের মানুষজন। বিড়ির গনগনে আগুনে পাশের ছাদের এক মুরুব্বির মুখটা উজ্জ্বল হয়-

'পঁচাশির বন্যাকে ছাপিয়ে গেল! এখন বাঁধ ভাঙা ছাড়া উপায় নেই।"

কারেন্ট নেই। জলবন্দী মানুষগুলো রাতের আবছা আলোয় ছাদে ছাদে ঘুরে বেড়াচ্ছে ভুতের মতো। চাঁদের আলো ভাঙছে ঢেউ জলে। চারপাশে নিঃশব্দ যাপন। ঘোর বিপদের আশঙ্কায় থম মারা জনজীবন। ডোঙা চলাচলের ছলাৎ ছল নিঃশব্দতা সরিয়ে ভয় দেখাচ্ছে থেকে থেকে। পশ্চিমে শহরে লাগোয়া পাকা বাড়ির বিপদ তুলনায় কম। ফি-বছরের বন্যা বিভ্রাট মাথায় নিয়ে বাড়ির নিচের তলাটা ছেড়ে রাখা। দূর পশ্চিমে, মাটির বাড়ি গবাদি পশুর ঘর গেরস্থালী ভয় পায় বন্যাকে। পুবের শহর ঝাঁ-চকচকে। পুব আর পশ্চিমের সীমারেখা শীলাবতী। শীলাবতীর পুব আর পশ্চিম তীরে ছড়িয়েছে ঘাটাল শহর। ব্রিটিশ শাসনে পশ্চিমের কুঠীবাজার সহ কৌলীন্য ছিল পশ্চিম তটের। পুব তট ছিল জলাজঙ্গলময়। শহর পুনঃ গঠনে ঘনবসতি পশ্চিম তট ব্রাত্য হয়ে পড়ে। পুবে ধীরে ধীরে নগরজীবনের নির্মাণ সব মাথা তুলতে থাকে।

ঝুমি বা দ্বারকেশ্বরের জলের চাপ বাড়লে বন্যা প্লাবিত হয় ঘাটালের পশ্চিম তট। সবচেয়ে আশ্চর্যের প্লাবিত হয় ঝুমি বা দ্বারকেশ্বরের বাড়তি জলে নয়,  প্লাবিত হয় শীলাবতীর জলে।

দ্বারকেশ্বর ও শীলাবতী হুগলীর বন্দরের একটু আগে মিলিত হয়েছে পরস্পর। মিলিত সেই স্রোত রূপনারায়ণ। ঝুমি ও দ্বারকেশ্বরপর অতিরিক্ত জল রূপনারায়নে ঢুকতে দেয় না শীলবতীর স্রোতকে। ফুলে উঠতে থাকে শীলাবতী। ভাসিয়ে দেয় অপেক্ষাকৃত নিচু পশ্চিম তীর। যদি কোনো প্রকারে পুবের পাড় ভাঙে রেহাই পায় পশ্চিম। ফি-বছর বন্যায় পুব-পশ্চিমের কাছি টানাটানি চলতেই থাকে।

পশ্চিমের মানুষের দুর্ভোগ, দীর্ঘশ্বাস গিয়ে পড়ে পুবে। এ যেন যমে মানুষে টানাটানি। পুবের প্রতাপপুরে বাঁধে রাত জাগছে শ'দুই মানুষ। যে কোনো মূল্যে বাঁধ রক্ষা করতে হবে। বাঁধের হাল হকিকত, প্রতি মুহূর্তের গতিপ্রকৃতি তে নজর পশ্চিমের। বাঁধ না ভাঙলে জল ছুঁয়ে ফেলবে দোতলা। ভেসে যাবে চাল ধান দলিল দস্তাবেজ। পশ্চিমের মানুষদের হাত আছে কিন্তু আঙুল নেই একটাও। কেবল ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা 'বাঁধ ভেঙে দাও।'

শাঁখে ফুঁ দিয়ে, দাঁড়াতে পারলেন না আমার শ্বাশুড়ি-মা। বাতের ব্যথাটা বেড়েছে-- নিচতলা থেকে সংসারটা উপরে নিয়ে আসতে সারাদিন অনেক বার উপর নিচ করতে হয়েছে যে। ঠাকুর ঘরের মেঝেতে বসে পড়ে তিনি অস্ফুটে  প্রার্থনা করলেন 'পুবের বাঁধটা রক্ষা কর ঈশ্বর হাসপাতাল সহ সব ভেসে যাবে। আমরা পশ্চিমের মানুষেরা বন্যার জন্য তৈরি হলেও, ওরা অভ্যস্থ নয়। ওদের রক্ষা কর।'

পশ্চিমের এমন অনেকের কাছি টানাটানিতে ইচ্ছাকৃত শৈথিল্যে শেষ পর্যন্ত রক্ষা পেয়ে যায় পুবের বাঁধ।

-----------------------------------------------------------------------------------

 

বিশ্ব বন্ধুত্ব দিবস-ভালুক আর সেই দুই বন্ধু

কবার দুই বন্ধু হাঁটতে হাঁটতে গভীর বনে পথ হারিয়ে ফেলল। একজন বলল বাম তো অন্যজন বলল ডান। ফলে দু'জনের কেউই ফেরার পথের সঠিক হদিশ দিতে পারল না।অগত্যা সমাধান হিসাবে শোলে সিনেমার সেই বিখ্যাত কয়েনটা বের হল পকেট থেকে। টস্ করে ঠিক হল দিক।

এবং ঐ টস্ নিদিষ্ট পথেই দু'জন এগোতে থাকল দ্রুত পায়ে। কিছুটা পথ এগিয়ে তারা বুঝল- বন থেকে বেরানো তো দূরঅস্ত, তারা আরো আরো অনেক গভীরে চলে এসেছে। চারিদিকে কেমন যেন গা ছমছম পরিবেশ। ভয়ে সারা শরীর ঠান্ডা বরফ। এদিকে দিনের আলোও ফুরিয়ে আসছে দ্রুত।

হঠাৎ কিছুটা দূরে কুচকুচে কালো রং এর এক বিশালাকার ভালুক দেখতে পেল তারা। অবস্থাটা এমন যে ছুটে পালিয়ে যাওয়াও অসম্ভব। ভাবছেন এ আর নতুন কি কথা!

এর পরের ঘটনা তো সবারই জানা।

ঐ তো দু'জনের একজন গাছে চড়তে জানত। প্রিয় বন্ধুকে বিপদে ফেলে সে চড়ল গাছে। আর অন্যজন কি আর করবে! কোথায় যেন শুনেছিল ভালুক মরা মানুষ খায় না। তাই  মাথা খাটিয়ে শুয়ে পড়ল মাটিতে। শুয়ে পড়ল মরা মানুষের মতো। ভালুকটা এলো শুঁকে শুঁকে দেখল শুয়ে থাকা বন্ধুটাকে। ভালুকটা যখন শুঁকে শুঁকে দেখছিল শুয়ে থাকা বন্ধুটাকে তখন তার লোমগুলো নাকের ফু্ঁটোয়, ঘাড়ে, কানের লতিতে সুড়সুড়ি জাগাচ্ছিল। সহিষ্ণুতার শেষ সীমা পেরিয়ে নড়ে উঠল শুয়ে থাকা বন্ধুটি।

ভালুকটি বলে উঠল-- "ঢের হয়েছে ওঠ ওঠ এবার। যদিও তোদের প্রতিটা দিন হল- মরে থেকেও বাঁচার অভিনয় করে যাওয়া। কিন্তু এ যে উল্টো, মরা মানুষের অভিনয় তো আর চাট্টি খানেক কথা নয়!"

ধরা পড়ে গিয়ে লজ্জায় পড়ে গেল বন্ধুটি। তারপর পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা কিছুর খোঁজে তৎপর হল।

ভালুক বলল--

-- কি খুঁজছিস?

-- না না বন্ধুক-টন্ধুক নয়। মোবাইল...

-- মোবাইল! তুই কি মরার আগে সেলফি নিবি?

-- ধুর সে কি আর কোনো কাজে আসবে আসলে ছোট্ট একটা কাজ আছে।

-- কাজ?

-- আজ বিশ্ব বন্ধুত্ব দিবস।

-- তো!

-- আমার সঙ্গের বন্ধুটি একটু আগে আমাকে বিপদে ফেলে পালিয়েছে।

-- ওঃ তাই নিয়ে স্টেটাস দিবি।

-- না না তা নয়।

-- তো!

-- আজ সাত সকালে ঐ বন্ধুটি একটা ম্যাসেজ করেছিল "......  তোড়েঙ্গে দম মগর, তেরা সাথ না ছোড়েঙ্গে...." সেটা ডিলিট করব..

বলেই বন্ধুটি পকেট থেকে বের করল একটা মস্ত বড় মোবাইল।

আর তাই দেখে মুচকি হেসে ভালুক বলল--

-- তুই তো বেশ বোকা।

-- বোকা!

-- নয়তো কি! দেখ বন্ধু থাকবে, বন্ধুত্ব থাকবে,

বন্ধুত্ব দিবসও থাকবে, স্টেটাস থাকবে, ম্যাসেজ থাকবে। আসল থাকবে, নকল থাকবে। এটাই সিস্টেম। তার মধ্যে টিকে থাকাটাই আসল। রাখ রাখ বলছি মোবাইলটা। একটা কথা শুনে নে--

সব বন্ধু বিপদের বন্ধু হয় না আর সব ভালুক জ্যান্ত মানুষ খায় না। এই বলে ভালুকটা বনান্তরালে মিশে গেল।

-----------------------------------------------------------------------------------

ন্ধকারেরও খুব একটা প্রয়োজন আছে। অসম্ভব রকমের আড়াল করার শক্তি আছে অন্ধকারের। অন্ধকারে হাঁটতে হাঁটতে, আজীবন আলো নিয়ে থাকা মানুষটা বুঝতে পারেন এই অন্ধকারটুকু না থাকলে আজ বড্ড নেংটো দেখাত তাঁকে। এতক্ষণে মাটিতে মিশে যেতে হতো লজ্জায়।

কখনও কখনও লজ্জাটুকুও সরিয়ে দিতে হয় ফুঁ দিয়ে। লাইননের ব্যাগটা উপুড় করে দিতেই অন্ধকার সরিয়ে আলো ছড়িয়ে পড়ল টেবিলময়। "স্যার, এতো অনেক পুরানো, অনেক কিছুই পাল্টে গেছে যে!"

বইঘর- এর মালিক সুদীন ঠোঁট মুড়ে বইগুলোর পাতা উল্টাতে থাকেন। উদ্বিগ্ন হন আলোক স্যার--

"কোনোটাই কি চলবে না?"

বইগুলো হাতে নিয়েই সুদীন বুঝতে পেরেছেন যখের ধন আপনা থেকেই এসেছে তার হাতে কিন্তু আনন্দ প্রকাশে পাছে বেশি মূল্য চোকাতে হয় তাই অনাগ্রহ মিশিয়ে বলেন--

"চলবে না মানে চালিয়ে নিতে হবে আর কি।" আলোক স্যার আশ্বস্ত হন। টাকাকটা কাঁপাকাঁপা হাতে বুক পকেটে রাখেন স্যার। তারপর অন্ধকার সরিয়ে বাড়ির পথে পা বাড়ান।

বাড়ি বলতে একটা চাওড়া বারান্দা সহ এক কামরার রুম। চারদিকে চড়ানো বইপত্তর আর ধুলো মাখা স্যাঁতস্যাঁতে গন্ধ। একলা শোয়ার একটা তক্তপোশ। ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে ষাটোর্ধ রুগ্ন জীবন। এখন আর কেউ পড়তে চায় না স্যারের কাছে। স্যারের পড়ানো নাকি অচল--বাতিল হয়ে গেছেন স্যার। নতুন ছাত্র-ছাত্রী আজকাল আসে না। পুরানো কেউ কেউ আসে বছরের এই একটি দিনে।

যেমন আসবে কালকে, কেউ কেউ।

গত বছর এমন দিনে চেয়ারটাকে বিক্রি করেছিলেন স্যার- সেগুন কাঠের চেয়ার। তার ঠিক আগের বছর পড়ার টেবিলটা। পুরানো বইগুলো যে বইঘর নিয়ে নেবে এটা বিলক্ষণ জানতেন স্যার। ওগুলো কি আর শুধু বই! ওগুলো যে দুষ্প্রাপ্য পুঁথি। দীর্ঘশ্বাস ছুঁয়ে যায় দেওয়াল।

মনকে প্রবোধ দেন স্যার। এছাড়া আর উপায় কি! কাল পাঁচই সেপ্টেম্বর ছেলেগুলোর মুখ মিষ্টি করাতে হবে তো। দেওয়ালে ঝোলানে রাধাকৃষ্ণানের ছবির দিকে স্থির তাকিয়ে থাকেন আলোক স্যার। পরের বছর এমন দিনে হয়তো ওটা আর থাকবে না দেওয়ালে।

-----------------------------------------------------------------------------------

 

'দিন হল একটি ছেলে খুব জ্বালাচ্ছিল। দিন নেই রাত নেই ফোনের পর ফোন। পড়াতে হবে তাকে। যতই বলি আমি স্কুল ছাড়া পড়াই না সে ততই কোবিড, লকডাউন, স্কুল শাটডাউন এসব বলে দুর্বল করে দেয়। অগত্যা তাকে একদিন ডাকলুম। পড়ার পর সে বলল--

"আমি তাহলে তিন জনকেই ছেড়ে দিচ্ছি।" অবাক হই - "তিন জন?" সে জানায় তিন জনের কাছে পড়ে সে। "তিন জন কেন?" আমার প্রশ্নে সে অকপট জবাব দেয় তিন জনই যে সেরা।

আমি বলি-- "তিন জনই যদি সেরা হয় তবে দ্বিতীয় বা তৃতীয় জনের কাছে গেলে কেন?" "আসলে তাঁরা নিজেরাই সেরা মনে করে।"

ছেলেটা আরো জানায় প্রথম যার কাছে পড়ত তাঁকে-- কি? কেন? এহেন প্রশ্ন করায় তিনি বিরক্ত হতেন বলে দ্বিতীয় জনের কাছে যাওয়া।

দ্বিতীয় জনও-- কি?  কেন? এর উত্তর দেন নি। বলেছেন "কেউ তো জানতে চাইছে না!"তৃতীয় জন বলেছেন "অঙ্ক যখন পারছ তখন কি? কেন? কি আসে যায়!"

মনে মনে হাসি-- আসলে কমার্সের একটা বিশেষ সুবিধা রয়েছে না জেনেও পাশ করা যায়।ছক মুখস্থ করে অভ্যাসের উলবোনা। নব্বই শতাংশ তৈরি হয় ছাঁচে। দশ শতাংশ ভেতরটায় ঢোকে। কমার্সের চাকরি পাওয়াটাও সোজা। প্রতিযোগিতা ঐ দশ শতাংশে। আমি তাকে অনুরোধ করে বলি নিয়ম করে পড়ানো সম্ভব নয়, তাছাড়া আইনেরও বাঁধা আছে। ওর তিনজন স্যারের গল্প শুনে আমার গুরুদেব চিত্তরঞ্জন ঘোষের কথা মনে পড়ে। বিজ্ঞাপন নিয়ে বলতে গিয়ে স্যার বলেছিলেন গল্পটা--

এক গলিতে চারটি টেলার ছিল। প্রথম জনের বিজ্ঞাপন ছিল--- "গুড কাটার্স এন্ড ফিটার্স।"দ্বিতীয় জন লিখেছিল-- " বেটার কাটার্স এন্ড ফিটার্স।" তৃতীয় জনের সাইন বোর্ডে ঝকঝকে লেখা---"বেস্ট কাটার্স এন্ড ফিটার্স।" চতুর্থ জন কি বলেছিল?

ফিরব সে কথায় তার আগে ছাত্রটির শিক্ষকরা নিজেদের যা মনে করে সেটা বলে নেই--প্রথম জন হলদিয়া মহকুমার সেরা। দ্বিতীয় জন পূর্ব মেদিনীপুরের সেরা তৃতীয় জন অবিভক্ত মেদিনীপুরের সেরা। যাই হোক চতুর্থ টেলার সাইনবোর্ডে লিখেছিল--

" BEST OF THE LANE". খলের ছলের অভাব হয় না।

-----------------------------------------------------------------------------------

মরা যখন পৌঁছলাম তখন গ্রান্ড ক্যানেলের উপর পোন্তে ডি রিয়ালতোতে থিকথিক করছে ভিড়টা। না ভিড়টাতে আমাদের মতো পর্যটকের থেকে স্থানীয় ভেনিশিয়ানরাই সংখ্যায় বেশি। এখানে যারা আসেন তাদের সকলেই রিয়ালতোতে দাঁড়িয়ে ছবি তোলেন।

গ্রান্ড ক্যানেলের উপর এটিই প্রথম ব্রিজ ১১৮১ তে এ ছিল ভাসমান, ১২৫৫ নতুন করে কাঠ দিয়ে নির্মাণ হয় পোন্তে ডি রিয়ালতোর। বর্তমান পাথরের তৈরি রিয়ালতো ১৫৯১ এর। ফুটপাতে এক বাংলাদেশী ভাইয়ের থেকে যে সেল্ফি স্টিকটা কিনেছিলাম তা শেষ পর্যন্ত কাজে এলো না। বাবদা মুখ বাঁকিয়ে পোজ দিলেও ভিড়ের গুতোগুতিতে সেল্ফি নেওয়া সম্ভব হল না।

বাংলাদেশী ঐ ভাইটির থেকে জেনেছিলাম আজ এদের একটা বার্ষিক উৎসবের দিন রোগাতা স্তোরিকা- পাতি কথায় নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা। ভেনিসে হাতের কাছে আপনি অনেক বাংলাদেশী পেয়ে যাবেন। ভেনিসের হোটেলে সামুদ্রিক মাছের রকমারি পদ আপনি ভুলতে পারবেন না। বাবদার আবার মাছে বেশ অনীহা, গতদিন বাবদার কান্না শুনে পোস্ত বড়ার সুরাহা করেছিল এনায়েত চাচা। চাচাদের দু'পুরুষের হোটেল ব্যবসা এদেশে। এতো দূর দেশে বাংলা কথা শুনতে ও বলতে পেরে দমবন্ধ কষ্ট পেরিয়ে যে অফুরান আনন্দ বোধ হল তা নিজের দেশ দক্ষিণ ভারতে পাই নি।

ভেনিস আসলে অড্রিয়াটিক সাগরের নীল জলে ভাসমান এক স্বপ্ন। তার প্রতিটি আশ্চর্যকে ছুঁতে গেলে আপনাকে ভাসতেই হবে নীল জলে। শহরের জল পথে রয়েছে এখানকার বিখ্যাত গন্ডোলা- এক ধরনের শৌখিন সুন্দর নৌকা। বাবদা, আমি আর সুপর্ণা চেপে বসলাম গন্ডোলায়। নীল জল ঠেলে এগিয়ে চলল গন্ডোলা।  গাইড একে একে ঘুরিয়ে দেখালো স্বর্ণালি দ্বীপ  লিডো যেখানে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব বসে,বুরানো দ্বীপের নানা রঙের ঘর, বিখ্যাত অপেরা হাউস ট্যাট্রো দ্যা ফেনিস বা দ্যা ফিনিক্স, ভেনিসের ঐতিহ্যশালী গোথিক স্থাপত্য।

ভেনিসের কাঁচের শিল্প বিখ্যাত। ইচ্ছে হল এক টুকরো ভেনিস সঙ্গে নিয়ে নেওয়া যাক। দাম দস্তুর করে সুপর্ণা একটা কাঁচের রঙিন ফুলদানি পছন্দ করল। "দেখো দেখো কি সুন্দর" এই বলে ফুলদানিটা আমার দিকে এগিয়ে দিতেই বিপত্তি বাবদার হাত লেগে সেটা গেল পড়ে।ঝনঝন শব্দে সুন্দর ফুলদানিটা ছড়িয়ে পড়ল ফুটপাতে।

ঘুমটা গেল ভেঙে। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়ছে বাইরে। ঠান্ডায় মা- ছেলে গায়ে ঢেকে নিয়েছে পাতলা বেডশিট। সারা বেডশিটের গায়ে নীল জলের ঢেউ- ভাসছে প্রিন্টটেড নৌকা। গতকাল বিকেলে বেরিয়েছিলাম বানভাসি ঘাটাল শহরে। কথায় কথায় সুপর্ণা বলেছিল ঘাটালকে নাকি পশ্চিমবঙ্গের ভেনিস বলে। অবচেতনে রয়ে গিয়েছিল বানভাসি ঘাটাল। ঘাটাল--ভেনিস মিলেমিশে এমন স্বপ্ন ভ্রমণ! লোকে বলে ভোরের স্বপ্ন নাকি সত্যি হয়। তড়ি ঘড়ি সময় দেখলাম মোবাইলে। না এ যাত্রায় কিছু হল না রাত একটা বাইশ। বালিশে মাথা দিলাম- ভোরের আশায়।

-----------------------------------------------------------------------------------

 

সেই গল্পটা

"তুমি অযথাই চাপ নিচ্ছ!"

"অযথাই চাপ নিচ্ছি!" ভেঙিয়ে শ্রমনের কথা তাকেই ফেরত দেয় দিঠি।

"কবে তুমি বিবেচকের কাজ করেছ শুনি?" দিঠির গলায় অনুযোগ।

"আজই তো আর ফাইন্যাল করে ফেলছি না। দেখাই যাক না কেমন কি খরচ, কি ধরনের অ্যামিনিটিজ।" চলন্ত গাড়ি থেকেই জায়গাটাকে ঠাহর করতে করতে কথাগুলো বলে শ্রমন।

শ্রমন ভালই ড্রাইভ করে।

হাত উল্টে ঘড়ি দেখে সে। হরিশপুর যেতে এখনও মিনিট কুড়ি লাগবে ওদের। সরাসরি কোর্ট থেকেই আসছে। দিঠি শ্বশুর মশাইয়ের লাঞ্চের পর চলে এসেছিল কোর্টে। বৃদ্ধাশ্রমের সবটা বুঝে নিতে যদি মিনিট চল্লিশ লাগে তবে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত সোয়া আটটা।  ফিরলেই বাবার হাজারটা প্রশ্ন!

--- খোকা, এতো দেরি হল যে?

--- আজ একটা ভারচুয়াল হেয়ারিং ছিল বাবা সেনসেটিভ কেস।

--- ও,  তা বৌমার তো স্কুল ছুটি, এক সঙ্গে ফিরলি?

--- মার্কেটিং ছিল।

--- তা কি কি কিনলি খোকা?

--- ঐ তো তোমার দুটো লুঙ্গি, একটা গাম... তোমার সবেতেই বেশি বেশি কিউরিওসিটি!

--- আচ্ছা যা, আগে হাত মুখ ধুয়ে....

গাড়ি চালাতে চালাতে বাবার সঙ্গে পরপর সংলাপগুলো সাজিয়ে নিল শ্রমন।

-- ভাবছি ওদের সঙ্গে যদি সবটা মিলে যায় তবে আগামী মাসেই বাবাকে....

-- সবে তো মাসের আট আজ, তেমন হলে এ মাসেই, তবে তার আগে ওনাকে সবটা বুঝিয়ে বলতে হবে, এ ব্যবস্থাটা ওনার ভালর জন্যই। সারাদিনের বেশিটাই আমরা  দুজনই বাড়ির বাইরে থাকি, বয়স হচ্ছে...

ছেলেবেলায় বাবা যে দিন তাকে ভুদেবনগরের বোর্ডিং স্কুলে রেখে এসেছিল সেই দিনটা মনে পড়ল শ্রমনের। এদ্দিনে দারুণ একটা প্রতিশোধ নিতে পারবে সে। তবে বোর্ডিং এ পৌঁছে দিয়ে বাবাও ফিরেছিল কাঁদতে কাঁদতে। এক্ষেত্রে যা তেমনটা হবে না। গাড়িটা গেটের কাছে দাঁড় করাতেই, দারোয়ান গেট খুলে নমস্কার করল-- "আইয়্যে স্যারজী।"

বৃদ্ধাশ্রমটা বেশ পরিপাটি।

ঢুকেই সুন্দর একটা বাগান, গাছগাছালির মধ্যে পার্কের মতো বসার জায়গা। পাশেই পাথর বাঁধানো মন্দির-- পরিবেশ দেখে এমনিতেই ভাল লাগে যাবে। এই বয়সী মানুষদের প্রয়োজন বুঝে প্ল্যানিং।

আগে থেকেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল, দাড়োয়ান শ্রমন ও দিঠিকে নিয়ে গেল রিসেপশনে।রিসেপশন বলতে ছোট্ট একটা রুমে একটা বড় টেবিল ও পাশাপাশি কয়েকটা চেয়ার।শ্রমনের বয়সী একটা লোক ল্যাপটপ নিয়ে উল্টো দিকের চেয়ারে। হাতের ইশারায় শ্রমনদের বসতে বলে লোকটা আবার ডুবে গেল ল্যাপটপে।

"আসলে আমাদের একটু তাড়া ছিল,কথাবার্তা কি আপনার সঙ্গেই..."

দিঠির কথায় লোকটা ঘাড় নাড়ল, এবং এটুকু বুঝিয়ে দিল ওনার সঙ্গেই কথা বলতে হবে। "এক নজরে যেটুকু দেখলাম, খুব ভাল না হলেও  এ্যাভারেজ, চলবে। আপনাদের মান্থলি চার্জ কি?"

লোকটাকে সরাসরি কথাগুলো বলল দিঠি। "চার্জ নিয়ে আপনাকে অতো ভাবতে হবে না..."

লোকটা আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল, শ্রমন তাড়াতাড়ি করে বলল--

"তা কি করে হয়, আমাদেরও তো একটা প্ল্যানিং আছে!" এতক্ষণে লোকটা ল্যাপটপ থেকে মুখ তুলল "তুই কি এমাসেই মেসোমশাইকে রেখে যেতে চাস?" হঠাৎ তুই তোকারিতে একে অপরের দিকে তাকাল শ্রমন ও দিঠি। আবার চমকে দিল লোকটা--

"কি রে চিনতে পারলি না?"

লোকটকে তীক্ষ্ণ নজরে দেখল শ্রমন, না মনে পড়ছে না, এ লোক কোনো ভাবেই তার পূর্বপরিচিত নয়।

"ভুূদেবনগর শ্যামাস্মৃতি বিদ্যাপীঠ, মনে পড়ে?" একমুখ হাসি নিয়ে লোকটা তাকিয়ে রইল শ্রমনের দিকে। শ্রমন অনেক চেষ্টাতেও মনে করতে পারছে না লোকটাকে। মাঝের সময়টা তো আর কম নয়। "আসলে আপনাকে!"

"সেকি রে এখনও আপনি! মনে পড়ছে না! সেই যে তোর বাবা তুলে গালি দিলাম,  আর তুই রেগে গিয়ে.... কি আশ্চর্য এখনও মনে পড়ছে না!" শ্রমন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।

লোকটা হো হো হাসল--

"বুঝেছি আমাদের গেছে যে দিন, একেবারেই গেছে। যাকগে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মেসোমশাইকে এখানে দিয়ে যা। কোনো সমস্যা হবে না মেসোমশাই তো আমারও বাবার মতো।" শ্রমন আমতা আমতা করে বলল--

"না মানে বাবার জন্য নয়, আমরা এসেছিলাম  আমাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের জন্যে।যদি মান্থলি চার্জটা বলিস।"

"ওটা নিয়ে ভাবিস না তোর জন্য স্পেশাল হবে।" শ্রমনের পিঠে ভরসার হাত রাখে লোকটা।

চাকরিটা ভাল না লাগলেও, ছাড়তে পারছে না কানন। শেষ বয়সের মানুষগুলোর ছেলে-মেয়ের জন্য হাহাকার সহ্য করতে পারছে না সে।

এই নিয়ে এমাসেই চারটে ক্লায়েন্ট ভাগিয়েছে এক গল্প বলে। সবার স্কুল জীবনে এই গল্পটা থাকেই। যখনই কেউ ফোনে যোগাযোগ করে ফেসবুক থেকে তার ডিটেলস্ কালেক্ট করে নেয় কানন। ক্লায়েন্ট ওর বয়সী হলেই গল্পটা ফেঁদে দেয়।

জ লকডাউন। নইলে নিশ্চিত ঘুরে আসতুম। ছেলেকে দেখিয়ে দিতুম ঈশ্বরের ঘর।দু'চোখে এঁকে দিতুম বিস্ময় সাগর। পাশাপাশি বসে পড়তুম নিকোনো উঠোনে। চোখের সামনে অত্যাশ্চর্য ঢেউয়ের পর ঢেউ।" জানিস বর্ণপরিচয়ের অক্ষরগুলো বাংলা ব্যাপী ছড়িয়ে ছিল এখান থেকেই!"

"রিয়েলি!" চমকে উঠত ছেলে।

"শুধু কি তাই! মেয়েদের স্কুল, গরমের ছুটি, দামোদরে ঝাঁপ" ঢেউ গুনতে গুনতে বেলা যেত ফুরিয়ে। ফেরার বেলায়, হয়তো মাটির বারান্দা ভেঙে- ছেলে দু'হাতে ঝেড়ে ফেলতো ধুলো যত। হনহনিয়ে ছুটে আসত মায়ের বকুনি। মুঠো ভরা মাটি ছুঁইয়ে যেত কপাল।

"কি করছিস!"

মাটি কোথায়? এ তো আশীর্বাদ!"

আজ লকডাউন। নইলে নিশ্চিত ঘুরে আসতুম বীরসিং।

-- বাবা, বীরসিং ঘাটাল থেকে কত দূর হবে?

-- হ্যাঁ, তা প্রায় সাড়ে চার ক্রোশ।

-- চার ক্রোশ, কত কিমি বাবা?

-- চার ক্রোশ- তা হবে, প্রায় কিমি পনেরো।

-- মাত্র!

বুকের গভীর অন্ধকারে আলো জ্বালল কেউ! স্পষ্ট দেখতে পেলাম হাঁটুর উপর ধুতি বেঁটে খাঁটো চেহারার একটা মানুষ ছাব্বিশ ক্রোশ হাঁটছে ক্লান্তিহীন।

মা' ডেকেছে... ডাকটাই বড় কথা। 

----------------------------------------------------------------------------------

নম্বর বিতর্ক ও তার গোড়ার কথা

দুয়ারে পাশ, বা দুয়ারে নম্বর যাই বলুন না কেন এ নিয়ে সরকার যখন ঘোষণা রাখে তখন হইচই হয় নি কেন? কেন তখন চিৎকার করে জানানো হয় নি ইলিশ আর খয়রা এক হয়ে যাবে। ভুল হলে সরকারের পলিসির। ছেলেমেয়ে গুলোকে নিয়ে নিরন্তর হাসিঠাট্টা কি সংবেদনশীল মানুষদের কাজ হচ্ছে! এক সময় নম্বরটাকে যারা গুরুত্ব করত না আজ তারাই নম্বরের বাড় বাড়ন্তে নম্বরের গুরুত্ব নিয়ে চিন্তিত। আগে যখন পরীক্ষা হয়েছে। এবং পরীক্ষার্থীরা অনেক অনেক নম্বর পেত তখন একদল লোক বলত

"কি আছে ঐ নম্বরে? কি কাজে আসবে?

দেশের কিছু উপকার হবে? সেই তো আমেরিকার গোলামী। বুড়ো বাপ-মা বৃদ্ধাশ্রমে। নম্বরটা কেবল সংখ্যা মাত্র। শিক্ষা অন্য জিনিস। অনেক নম্বরের পঞ্চাননের থেকে কম নম্বরের পচা অনেক বেশি শিক্ষিত, পচা সোশ্যাল, মানুষের পাশে থাকে, বুড়ো বাপ মাকে দেখে।"

এবার সেই দলটাই বলতে শুরু করছে--

"নম্বরের কোন বাপ মা নেই। কোনো গুরুত্বই রইল না নম্বরের। পচাও স্টার মার্কস!" এর আগে প্রজেক্ট বা পাকটিক্যালের নামে কি নম্বরের ঢালাও বিতরণ হয় নি! এ ব্যবস্থা বরাবরের। এবার যেহেতু পরীক্ষা হয় নি তাই একটু বেশিই মনে হচ্ছে। যারা পরীক্ষক তাদের থেকে খোঁজ করুন প্রকৃত পক্ষে পরীক্ষার মূল্যায়নে একটি শিক্ষার্থী যে শতাংশ নম্বর পায়, আদপেও কি সে তার যোগ্য! নাকি সেখানেও কোনো সরলীকরণ ব্যবস্থা রয়েছে। সবটা জানলে দেখা যাবে এই নম্বর বিতর্ক ভুয়া। দেখুন আমরা অভিভাবকরা উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তির সময় দেখে নেই কোন স্কুলে ভাল লেখা পড়া হয় আর ভেতরে ভেতরে খোঁজ করি কোন স্কুল প্রজেক্ট বা পাকটিক্যালে হাত খুলে নম্বর দেয়। প্রজেক্ট বা পাকটিক্যাল আসলে যা শিখেছি তার ফলিত দিক। হাতে নাতে করে দেখানো। সেই দিক থেকে একটি শিক্ষার্থীর তত্ত্ব গত দিকটি যদি সঠিক ভাবে জানা সম্পন্ন হয় তবেই প্রজেক্ট বা পাকটিক্যালে সে সম্পন্ন হতে পারে।

পাকটিক্যালে ত্রিশ নম্বর থাকে, লিখিত সত্তর। প্রোজেক্টে কুড়ি, লিখিত আশি। অভিজ্ঞতায় দেখেছি আশিতে যে শিক্ষার্থী কুড়ি পায় তার প্রোজেক্টের নম্বর কুড়ি। শতাংশের হিসাবে লিখিত পরীক্ষায় আশিতে কুড়ি মানে ২৫% আর প্রোজেক্টের কুড়ি তে কুড়ি মানে ১০০%।এতোদিন যাদের পরীক্ষা হয়েছে তাদের অনেকেই এই সুযোগ পেয়েছে মার্কসীটে। প্রধান শিক্ষকের নির্দেশ, নেতার চমকানি, অভিভাবকের খিস্তি, টিউশনের বাজার বজায় রাখা এবং বিধ বহু কারণে লিখিত পরীক্ষায় ২৫% পাওয়া শিক্ষার্থী প্রোজেক্টে ১০০% নম্বর পেয়ে যায়। এগুলো লুকানো খেলা অপ্রকাশ্য। খয়রাতি আসলে বরাবরের ব্যবস্থা। এবারেরটা একটু চড়া দাগের মনে হচ্ছে তার কারণ পরীক্ষা হয় নি। হিসাব মতো একটু তলার দিকের ছেলেদের সুবিধা হয়েছে।

মানে যে পলিসিতে নম্বর দেওয়া হয়েছে সেটা হল শিক্ষার্থীর নবম শ্রেণীতে প্রাপ্ত নম্বরের ৫০%+দশমের পাকটিক্যালের (যেটা আমাদের সময়ে ১০ নম্বরের ওরাল ছিল) প্রাপ্ত নম্বরের ৫ গুণ। এবার হিসাবে আসুন - একটি নিম্ন মেধার শিক্ষার্থী যে নবমে পেয়েছে ২০ এবং তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া যাক তাকে দশমে ১০ এ ১০ দেওয়া হয়েছে, তার প্রাপ্ত নম্বর ২০×৫০%+৫০=৬০

এবার আসুন মধ্য মেধার একজন ৪০×৫০%+৫০=৭০ খুব ভাল ৭০×৫০%+৫০=৮৫

সাধারণত স্কুলগুলো নবম শ্রেণীর উত্তরপত্র একটু শক্ত হাতে মূল্যায়ন করে যাতে নম্বরের খিদেটা মরে না যায়। তার মানে সব মিলিয়ে যে হিসাবটা দাঁড়াল এই ব্যবস্থায় ভাল ও খুব ভাল শিক্ষার্থীদের বিশেষ কোন সুবিধা লাভ হয় নি। (যদি স্কুল কায়দা করে পরে নম্বর না বাড়িয়ে থাকে) সুবিধা পেয়েছে খারাপ ছাত্ররা তাদের পাশ করিয়ে দেওয়ার নিরিখে যদি একটু হাতখোলা নম্বর দেওয়া হয়ে থাকে তবে ব্যবস্থার সুবিধা তারাই পেয়েছে।

মূল্যায়ন যাই হোক কাজের ক্ষেত্রে নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা থাকলে যোগ্য ব্যক্তি বঞ্চিত হয় এটা বিশ্বাস হয় না।

----------------------------------------------------------------------------------

লতলায় একমাথা রোদ নিয়ে বসেছে মেজদি। তিন কেজি চালের হাঁড়ি আর পাঁচ কেজির কড়াটা নিয়ে গলদঘর্ম অবস্থা বেচারার। এগুলো তোলাই থাকে, কালেভদ্রে নামানো হয়। একটা সময় চার ভাই বোন আর মা'বাবার সংসারে মস্ত বড় না হলেও ভাতের হাঁড়িটাকে হাঁড়ি বলেই মনে হতে। জল ভর্তি হাঁড়ি উনুনে চড়াতে গিয়ে মায়ের ছোট্ট শরীরটা কোমর থেকে বেঁকে যেন হঠাৎ করে উপুড় হত হাঁড়ির মুখে। সেসময় আমরা ভাইবোনরা বাড়ছি ফলে পেটটাও বাড়ছে। রোজ দিন কেজি দুয়েক চাল ফুটত সকাল বেলা। বাবা চালের যোগানটা সামলাতে পারত না বলেই রাতে  রুটির বন্দোবস্ত পাকা হয়েছিল অনেক আগেই।

এখন সংসার ছোট হয়েছে।

সামাজিক নিয়মে কেউ নিকট দূরত্বে কেউবা আবার কালের নিয়মে অনতিক্রম্য দূরত্বে। সংসার ছোট হতে হতে এখন চার'শ গ্রাম চাল ফোটে রাইস কুকারে। রাতের রুটির রুটিন থেকে গেছে আগের মতোই। সংসারের কি বিচিত্র পরিহাস একসময় ভরাপেটের সাধ্য ছিল না বলে ক্ষুধা জমিয়েছি নিয়ম করে।

এখন স্বাচ্ছন্দ্য সঙ্গে থাকলেও খাওয়ার ইচ্ছেটাই গেছে শুকিয়ে। কলতলায় জল পড়ছে, দিদির মুখ ঝকঝক করে উঠল তার হাতে অনেকদিনের অব্যবহৃত তৈজসপত্র চকচকে হয়ে উঠল মুহূর্তে। এক হাতে হাঁড়ি আর অন্য হাতে কড়া দোলাতে দোলাতে মেজ'দি বলল--

"চক্কত্তি বাড়িতে কতদিন পর এমন হাঁড়ি কড়া উনুনে চাপবে!"

ছাত্র-ছাত্রীদের আমারা ভাই বোনেরা, বাড়ির একজনই মনে করেছি বরাবর।

----------------------------------------------------------------------------------

৯৬৮ সালের ১ লা সেপ্টেম্বর একটা অস্থায়ী আস্তানা। স্বপ্ন দেখার চোখ তখন থেকেই একটু একটু করে বড় হচ্ছিল। সবাই তো চায় সুন্দর একটা ঘর, সামনে বারান্দা। অবসর চুপি পায়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াবে। আলো হয়ে যাবে ভিতর আর বাইরের সবটুকু। তখন তো আর এমন ভারি ভারি কথা ছিল না 'কোয়ালিটি টাইম', হ্যাঁ আমরা ভালো সময় চেয়েছিলাম।

অবসর যে হেলাফেলার নয় অবসরই যে একটা এলাকার খোলনলচে পাল্টে দিতে পারে এ বিশ্বাস শক্ত করেছিলেন 'শিবুদা' নিজেই।

কিন্তু ঘর!

ঘর নিয়ে প্রত্যেকের নিজের নিজের স্বপ্ন থাকে ছবি থাকে। ঐ একটা জায়গায় আমাদের স্বপ্ন ভিন্নতর হয় নি। ছবি এঁকেছিলাম সবাই মিলে। কেউ ইঁট বসিয়েছি, কেউ পাঁক তুলেছি, কেউবা চাপিয়েছি টালি। আর সব মিলিয়ে যে ছবিটা তৈরি হল তার সঙ্গে অবাক মিলে গেল স্বপ্নটা। মিলে গেল হুবহু ৫৪' × ১২' বারান্দা সহ। শুরুতে পোদ্দারবাবু তো পাত্তাই দিলেন না। ছেলে ছোকরার দল বলে কিনা মহারাজ আসবেন। উদ্বোধন বলব না, ঘরের উদ্বোধন হয় না- গৃহপ্রবেশ হয়।

সেদিন গৃহপ্রবেশের মঞ্চে নরেন্দ্রপুরের মহারাজদের পাশে পোদ্দরবাবু বসতেই চান নি। পরে জানা যায় তাকে নাকি মানাত না ঐ মঞ্চে, তিনি যে প্যান্ট, শার্ট পরেছিলেন ঐ দিন। তারপর থেকে সুতাহাটার তৎকালীন বিডিও জ্যোতিষ পোদ্দার মহাশয় আমাদের পরিবারের একজন হয়ে যান। আমরা? আমরা "পল্লীজ্যোতি পাঠাগার"। অসংখ্য উজ্জ্বল চোখ স্বপ্ন দেখেছিল যে ঘরের। আনন্দিত ঘর " পল্লীজ্যোতি পাঠাগার"।

ছবি ৫০ বছর পূর্বে গৃহপ্রবেশের আগে সদ্য নির্মিত পল্লীজ্যোতি পাঠাগার।

-----------------------------------------------------------------------------------

জ রাখীবন্ধন। পথে ঘাটে একে অপরকে রাখী পরাচ্ছে আনন্দিত মানুষজন। শক্ত হচ্ছে সম্প্রীতি, পোক্ত হচ্ছে বন্ধুত্ব। যে লোকটা সুতো বেঁধে, লাড্ডু মুখে গুঁজে দিয়ে বুক-উপচানো কোলাকুলিতে মত্ত----

খোঁজ নিয়ে দেখুন আত্মমগ্ন সেজন প্রতিবেশীর ভালমন্দের খবর রাখে কি?

আপন স্বার্থে হচ্ছি আলগা

সমাজ এবং সংসারে-

একার মধ্যে একার যাপন

সিঁড়ি ভাঙার চক্করে।

পাশের বাড়ির একলা বুড়ো

দু'দিন হল কম্পজ্বর-

পরের কথা ভাবতে গেলে

আত্মসুখের ঘোর বিপদ।

বাপ-মা মরা কিশোরবেলা

কাকভোরেতে কাগজ দেয়-

স্কুল ছুট সে কোন গরজে

অন্ধগলির খোঁজ কে নেয়?

জীবন এখন ভাত ঘুমেতে

স্বার্থপরের ডিমে তা-

চড়তে সিঁড়ি হিসাব কষে

পরের মাথায় দিচ্ছে পা।

নিজের আখের গোছ করতে

কম্প্রোমাইজ মোটেই নয়।

লোকদেখানো সোশ্যাল হতে

ছলচাতুরী করতে হয়।

বন্ধু-পরব রাখীবন্ধন

সুতোর গুঁতোয় কিস্তি মাত।

সম্প্রীতি আর মানবতা

আত্মমগ্নের দিল-কি-বাত।

--------------------------------------------------------------------------------

তকাল  বাপ বেটা অনেকটা রাত জেগে ছিলাম। মা'কে সঙ্গে রেখেই কথাবার্তা হচ্ছিল। এই যে ক'দিন ঘাটালে আছি ছেলেকে প্রতিদিন শোয়ার আগে রামায়ণ, মহাভারতের গল্প বলতে হয়। মহাভারতেই ঝোঁক বেশি। সে কারণেই ইদানিং আমাকেও পড়তে হচ্ছে। ছেলের দৌলতে জানছি অনেক কিছু নতুন করে।

বিশ তারিখ বাবা দিবস ফেসবুকে বাবাদের নিয়ে বেশ কিছু ভালোলাগা পোষ্ট আমি ওর মা'কে যখন শোনাচ্ছিলাম তখন সেসবের বাবদাও কিছু শুনেছে। গতরাতে বাবা দিবস নিয়ে ওর কত কি প্রশ্ন! গতকাল রাতে বাবদাকে ভালো ছেলেদের কথা বললাম--  জমদগ্নি ও তার ছেলে পরশুরাম। শ্রমনকুমার ও তাঁর বাবা মায়ের গল্প, যযাতি ও পরুর গল্প। শান্তনু-দেবব্রত

--মানে পিতা-পুত্র সিরিজ। গল্পের শেষে ছেলে বলল - "আমার বাবা শান্তনু হবে না।" চকাস্ করে চুম খেলাম ছেলের কপালে। শব্দ শুনলে যিনি সবচেয়ে বেশি খুশি হতেন তিনি তখন গভীর ঘুমে। ছেলে বলল--

-- তোমার দাদুর নাম কি?

-- পতিতপাবন।

-- কি করত তোমার দাদু?

-- দাদু মাস্টার মশাই ছিলেন।

-- তাঁর বাবার নাম?

-- চন্দ্রমোহন চক্রবর্ত্তী।

-- কি করত?

-- পুজো করত। মৃত্যুর একঘন্টা আগে বলে দিয়েছিল এবার সে মরবে, যেন তাঁর মাথার

    কাছে গীতাপাঠ করা হয়।

-- তুমি কি তাঁকে দেখছ?

-- না।

-- তবে! কি করে জানলে?

-- শুনেছি।

-- চন্দ্রমোহনের বাবার নাম কি?

-- শিবনারায়ণ।

-- কি করত?

-- জানি না।

-- তাঁর বাবার নাম?

-- জানি না।

-- কে জানে? টীনা পিসি?

-- হয়তো না, কাকু জানে।

-- ছোট দাদু।

-- হু।

খানিক সময় দু'জনেই চুপচাপ। ছেলে থেকে থেকে উশখুশ করছে।

-- বাবা মশা ঢুকেছে বোধহয়। আলো জ্বেলে মশা নিধন হল। এবার নিশ্চিন্ত ঘুম।

-- বাবা পিঠটা চুলকে দেবে? শুরু করলাম।

-- হচ্ছে না, তোমার একটুও নখ নেই। এবার থেকে দাঁতে কাটা বন্ধ কর।

-- আচ্ছা বাবদা, এমনি করে তোর নাম কে  জানতে চাইবে?