সূর্যাশীষ পাল
গল্প সমগ্র ২
প্রচ্ছদঃ সুরজিৎ সিনহা, হলদিয়া, পঃ বাংলা
আমার
দ্বৈত জীবন
সুব্রত মজুমদার
সুব্রত মজুমদারের জন্ম কলকাতায়। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স এন্ড টেক্নলোজি, থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে তিনি পাড়ি দেন সুদূর আমেরিকায়। সেখানেই তাঁর পেশাগত জীবনের পাশাপাশি চলতে থাকে লেখালেখি। নানা ধরেনের ওয়েবজাইনে তাঁর লেখা ছাপা হয়েছে এবং তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করা ও ভিন্ন স্বাদের লেখাগুলি অগণিত পাঠকদের মনোরঞ্জন ও প্রশংসা অর্জন করেছে। লেখকের মূল বৈশিষ্ট্য তাঁর ভ্রমন ও অ্যাডভেঞ্চার প্রিয়তা।
সকালবেলায় আরাম করে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে খবরের কাগজ পড়ছিলাম। মেয়ের ডাকে খবরের কাগজের পাতা থেকে চোখটা তুলে তাকালাম ওর দিকে। দেখলাম মেয়ের হাতে একটা ময়লা ভাঙ্গাচোরা সুটকেস্। বড়বড় চোখদুটোকে ঘুরিয়ে সে তার হাত পা নেড়ে অনেক কথা আমাকে বলে গেল। এইটুকু বুঝলাম যে সে বলতে চাইছে যে সুটকেসটা পুরনো আর এখনো তার ভিতর থেকে মশলার গন্ধ বেরোচেছ। আরো জানতে পারলাম যে সুটকেসের ভিতরে শীলনোড়া আর কিছু বাসন ছিল সেগুলো সে নিচে বেস্মেন্টে রেখে দিয়েছে। আমরা কেন এত পুরনো জিনিস এতদিন ধরে ফেলে না দিয়ে রেখে দিয়েছি এই নিয়ে আমাকে বেশ ভালো রকমের একটা লেক্চার দিল। পরিষ্কার আমায় জানিয়ে দিল যে সে রিসাইকেল্ করার গাড়িতে গিয়ে দিয়ে আসবে সুটকেসটা আর এই ধরনের আরো অনেক জঞ্জাল। মেয়ে এখন বড় হয়েছে। এককালে আমি হুকুম করতাম ও শুনত এখন ও হুকুম করে আমি শুনি।
দেখতে দেখতে তিরিশটা বছর কেটে গেল আমেরিকায়। একদিন এই দেশেই থুড়ি এই বিদেশেই হয়ত আমার মৃত্যু হবে। যখন আমি দেশে ছিলাম তখন আমার একটাই পরিচয় ছিল। আমি ছিলাম ইন্ডিয়ান্। এই দেশে আসার পর আমার সেই পরিচয়ের সঙ্গে যোগ হল আর একটা পরিচয়। আমার নতুন পরিচয় হল-ইন্ডিয়ান আমেরিকান্। অনেকটা দাঁড়কাকের ময়ূর পুচেছর মত। গত তিরিশ বছর ধরে এই পরিচয়ের তাৎপর্য্য উপলব্দি করার চেষ্টা করে চলেছি। ফেলে আসা জগৎটাকে আঁকড়ে ধরে থাকার যেমন আপ্রাণ চেষ্টা করেছি আবার নতুন জগৎটাকে মানিয়ে নেওয়ার জন্য যা যা করার তারও কোন ত্রুটি রাখিনি। হেমন্ত মুখার্জীর গানের সাথে সাথে শুনেছি লাওনেল্ রিচির গাওয়া গান। প্রথম প্রথম আমার নিজেকে মনে হত সদ্য বিবাহিত কনে বৌয়ের মত। বাপের বাড়ি ফেলে এসে শশুরবাড়ির সবকিছুকে মানিয়ে নেওয়ার মত অনেকটা। সাটল্ককের মত দুটো জগতে ঘোরা ফেরা করতে করতে কেন জানিনা আমার মনে হয় দুটো জগৎকেই আমি বোধহয় ফাঁকি দিয়ে এলাম। গাছেরও পেলেম না আবার তলারও পেলেম না। ইংরেজও হতে পারলাম না আবার বাঙালীয়ানাটাও ভুলে গেলাম।
সদর দরজার সাথে আমার জীবনের একটা গভীর সম্বন্ধ আছে। সদর দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে যখন বাড়ির ভিতরে ঢুকি তখন বুঝতে পারিনা যে আমি আমেরিকায় আছি। বাড়ির ভিতরটাকে আমরা ফেলে আসা কলকাতার বাড়ির মত করে রাখি যাতে ঘুনাক্ষরেও যেন আমরা ভুলে না যাই আমাদের উৎপত্তি কোথা থেকে। বাড়ির ভিতরে আমরা বা-লায় ছাড়া কথা বলিনা। মাছের ঝোল, মাংস, ডাল তরকারি হাত দিয়ে ভাতের সঙ্গে মেখে কব্জি ডুবিয়ে খাই। চাটনি বা অম্বল হলে আমরা আঙ্গুলেরও ব্যবহার করে থাকি। ঘুনাক্ষরেও কিন্তু আমরা আমাদের এই আচার ব্যবহার আমাদের আমেরিকান বন্ধুবান্ধবদের জানাই না, গোপন করে রাখি। প্রথম প্রথম ভয় হতো যদি ওরা জানতে পারে তাহলে হয়ত ওরা আমাদের দেশে ফেরৎ পাঠিয়ে দেবে রিটার্ন ভিসা দিয়ে। অবশ্য আমরা যখন ওদের সঙ্গে লাঞ্চ করি তখন কে বলবে আমাদের দেখে যে আমরা আমরা কাঁটা চামচ ছাড়া শুধু হাত দিয়ে সব কিছু সাবাড় করে দিতে পারি। তখন আমরা বনে যাই পাক্কা সাহেব। বা-ালীয়ানা তখন মনে হবে সঙ্কুচিত ভীত কৃতদাসের মত লুকাইয়েছে ছদ্মবেশে। যদিও মাছের ঝোল আর ভাত আমাদের সবথেকে প্রিয় তবে আমেরিকান খানাদানার ধারকাছ দিয়ে যে একেবারে যাইনা তা নয়। আমেরিকান স্যান্ডউইচ্ আমাদের খুবই প্রিয়। বাইরে থেকে বোঝা না গেলেও আমরা অবশ্য ওটার একটা ইন্ডয়ান ভার্সানও বানিয়ে ফেলেছি। দুটো রুটির ভিতরে আমরা লাগাই একটা পাতলা লেয়ার, কখনো সেটা হয় শসা টমেটো আর পেঁয়াজ, কখনো বা ঘুগনির আবার কখন বা পাওভাজির। বানানোর সুবিধা ছাড়াও আমার ধারণা হার্ডকোর এই আমেরিকান্ সোসাইটির সাথে, এই শেভ্রলে আর অ্যাপেল্পাইয়ের দেশে এই একটা স্যান্ডউইচ্ এর মধ্যে দিয়ে আমরা ওদের সঙ্গে ব্লেন্ড করে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছি। আমেরিকায় আসার আগে আমার গর্ব ছিল যে যেহেতু দেশে আমি ইংলিশ্ মিডিয়াম্ ঝর্ণা, ফুল, পাখি, প্রজাপতি - সব কিছুই প্রাণবন্ত হয়ে উঠত তার ক্যামেরার লেন্সের জাদুতে। কথা মতো পরের দিন ভোরবেলায় সবাই মিলে সায়নের কারে করে লোনাভালা খান্ডালার উদ্দেশ্যে রওনা দিল। খান্ডালার রাজামাচি গার্ডেনে পৌঁছে সায়ন মেতে গেল তার নতুন ক্যানন এস. এল. আর ক্যামেরায় ফটো তুলতে। আগস্ট মাসের বর্ষায় বৃষ্টির ধারা সহ্যাদ্রি পর্বত বেয়ে নীচে নেমে সুন্দর জলপ্রপাতের আকার ধারণ করেছে। যেদিকেই চোখ যায় সেই দিকেই কেবল সবুজের সমারোহ। বৃষ্টির জলে ভিজে গাছের পাতাগুলো সবুজ পান্নার মত চকচক করছে। এই রকম
অনাবিল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যে নিজেকে পেয়ে প্রকৃতি প্রেমিক সায়ন আনন্দে আত্মহারা, তার খুশির সীমা নেই। মনের আনন্দে গাছপালা, ফুল, পাখি, অর্কিডের ছবি তুলতে লাগল সায়ন। এদিকে সায়ন যখন ছবি তুলতে ব্যস্ত, তখন নিজের মনে গুনগুন করে গান জুড়ে দিল সাগরিকা। তার মিষ্টি গান শুনতে শুনতে প্রবালের কলেজের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেল। সাগরিকার প্রতি প্রবালের দুর্বলতা সেই কলেজের দিন থেকেই, স্কুলে পড়াশোনা করেছি আমার জন্মগত ভাবে ইংরিজি ভাষাটার ওপর একটা দখল একটা অধিকার আছে। ভুলটা ভাঙ্গতে বেশী সময় লাগল না এদেশে আসার পরে। ধাক্কাটা খেলাম যখন দেখতাম কলেজ, অফিস আর দোকানের লোকেরা হাঁ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে আমি কিছু বলার পরে। ‘লেডি ফিংগার’ যে ‘ওকরা’, ব্রিন্জল্’ যে ‘এগ্প্ল্যান্ট’ আর ‘সিডিউল্’ যে ‘স্কেডুল্’ এই সব শিখতে সময় লেগেছিল। মনে আছে ভুলে বাবাকে চিঠিতে এইসব নতুন বানানে চিঠি লিখলে উনি পরের চিঠিতে সেই সব বানান কারেক্ট করে আমায় পাঠাতেন। বাবা নিশ্চই অবাক হয়ে ভাবতেন যে ছেলে বিদেশে গিয়ে কি করে এরকম বানান ভুল করছে। আমি বাবার চিঠিটা পড়ে মনে মনে হাসতাম, আর খুব মজা পেতাম। ইংরিজি ভাষাটাও যে অন্য সব ভাষার মতই খটমট এই ব্যাপারে বাবাকে একটা চিঠি দেব ভেবেছিলাম কিন্তু দেওয়া আর হয়ে ওঠেনি। যখন এই দেশে আসি তখন এদেশে অর্থাৎ আমেরিকায় দেশী মানে আমাদের ভারতবর্ষের কোন জিনিস বড় একটা পাওয়া যেত না। অতএব বলা বাহুল্য বৌয়ের শাড়ী থেকে শুরু করে, দেশের বড়ি, সরষের তেল, নানা রকমের মশলা, পাটালি গুড় এমন কি লেড়ো বিস্কুট আর ডালমুট্ হয়ে উঠেছিল অমুল্য। কালোবাজারীদের মত আমরা সেইসব জিনিসকে আঁকড়ে রাখতাম। তিল তিল করে খরচা করা হত তাদের, কারণ পরের বার দেশে যাওয়ার আগে ওসব জিনিস আর পাওয়া যাবে না। তখনই কিনেছিলাম ওই সুটকেসটা। ওত বড় সুটকেস সচারাচর চোখে পড়ে না। তাই চোখে পড়া মাত্র আমার আর আমার স্ত্রীর মধ্যে চোখাচোখি হয়ে গেল।কিনে ফেললাম কোন দ্বিধা দ্বন্দ না করে। আমরা ওই সুটকেসটার মধ্যে পুরে কত শত জিনিস নিয়ে আসতাম আজ ভাবতে বসে অবাক লাগছে। আমার স্ত্রীর কাজ ছিল কেনা আমার কাজ ছিল সজত্নে সেগুলোকে ওই সুটকেসের মধ্যে ঢোকানো। শুধু ঢোকানো বললে বোধহয় ভুল বলা হবে। কাস্টমস্ এর চোখে ফাঁকি দিয়ে কি করে পাটালি গুড়, সর্ষের তেল আর মশলাপাতি নিয়ে আসা যায় এই নিয়ে বোধহয় একটা গবেষণা মুলক বইও লিখতে পারতাম। মনে আছে আমরা একবার একটা নারকেল কোরা যায় এমন একটা বঁটি আর একটা শীল নোঁড়াও এনেছিলাম ওই সুটকেসটার মধ্যে করে। ফুড্প্রসেসর আসার পরে ওগুলোর দিকে আমরা আর ফিরেও তাকাইনি বহু বছর। অতি বড় সাহসী হওয়া সত্তেও কোন রকম সবজি কখন আনতাম না। ওটা ছিল একেবারে নো নো কাস্টমস্ কাছে। মনে পড়ে একবার দেশ থেকে ফিরে সুটকেস্ খুলে দেখলাম কয়েকটা পটল এক কোনে উঁকিঝুঁকি মারছে। প্রথমটায় একটু হকচকিয়ে গেলাম। তারপরেই বুঝলাম যে ঠাকুমা লুকিয়ে তার প্রিয় নাতির অতি প্রিয় পটল অজান্তে কখন ঢুকিয়ে দিয়েছে সুটকেসের মধ্যে। চোখের জল সেদিন চেপে রাখতে পারিনি। আজকাল সবকিছুই এদেশে পাওয়া যায়, দেশ থেকে আনার আর দরকার হয় না। তবু ফেলে আসা সেইদিনগুলোর কথা ভোলা যায় না।
সুটকেসটা একটানা দশ বছরের ওপর ধরে আমাদের কোলকাতা যাতায়াতের ধকল বয়েছে। বিগত বেশ কয়েক বছর আমরা কেউ আর ওর দিকে ফিরেও তাকাইনি। এক জায়গায় পড়ে থাকতে থাকতে আর ধুলো ময়লা লেগে লেগে ওর চেহেরার পরিবর্তন হয়েছে। আগের মত আর চক্চকে চেহারাটা নেই। ওকে আমরা ভুলে গেছি, ওর প্রয়োজন আমাদের কাছে ফুরিয়ে গেছে। ও আজ বাতিল। কিন্তু ওর সারা শরীরে এখনও মশলার গন্ধটা লেগে আছে। শীলনোড়া আর পুরনো বাসনগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলাম অনেক্ষন। ওরা আমায় স্মরণ করিয়ে দিল পিছনে ফেলে আসা অনেক স্মৃতি, অনেক স্নেহের স্পর্শ, অনেক আদর, অনেক ভালোবাসার কথা। তাদের অনেকেই আজ আর ইহলোকে নেই। আজ অনেকদিন পরে তাদের কত্থা ভেবে আমার দুটো চোখ জলে ভরে এল। আমি চিৎকার করে মেয়েকে ডাকলাম ‘‘ওরে সুটকেস্টা রিসাইকেল্ করার গাড়িতে নিয়ে যাস্ না। ওটাই যে এখন আমার সব। ওটা ছাড়া নিজের বলে আমার যে আর কিছুই নেই। ওটা জঞ্জাল নয়, ওটা আমার সবথেকে প্রিয়। ওটাকে আমি যক্ষের ধনের মত আগলে রাখব, যত্ন করে রাখব এবার থেকে আমার জীবনের শেষ দিন পর্য্যন্ত। ’’
সাড়া পেলাম না মেয়ের, জানতে পারলাম সে রওনা দিয়েছে সুটকেসটাকে নিয়ে রিসাইকেল্ করার গাড়ির উদ্দেশে।
Comments
Top
বৃন্দাবন কুঠি
তাপসকিরণ রায়
জব্বল্পুর, মধ্যপ্রদেশ
রানাঘাট চুর্নী নদীর ধারে গোল গোল গম্বুজ আকারের বড় বড় পড়ো দুটো ঘর ছিল। আমরা ওগুলোকে গোলঘর বলেই জানতাম। ছোটবেলায় আমরা তা দেখেছি। পালচৌধুরী জমিদারের সময়কার সে সব পড়ো ঘর বাড়ি জানি না এখনো আছে কি না!
ওই গোলঘর ছাড়িয়ে সদর রাস্তা পেরিয়ে এক কোনায় ছিল পড়ো পুরনো জমিদার বাড়িরই এক অংশ। বাড়ির সামনে ছিল দু দুটো বিরাটাকার প্রবেশ দ্বার-- এক কালে নাকি তাতে বড় বড় লোহার দরজা ছিল। গেটের ওপরের দিকে রঙ চটা দেয়াল, ভাঙাচোরা, খসা প্লাস্টারের ভিতরেও ভালো ভাবে নজর করলে দেখা যাবে কোন এক কোণের দিকে লেখা আছে--বৃন্দাবন কুঠি। ওর সঙ্গে প্রায় লাগোয়া হাড় জিরজির কঙ্কালের মত দাঁড়িয়ে ছিল বিশাল জমিদার বাড়িটা। ছোট বেলায় বন্ধুরা মিলে ভয়ে ভয়ে ঢুকেছি ওসব ঘরে। ভিতরের ঘরগুলি থাকত অন্ধকার। দিনের বেলাতেই তাতে আলো ছায়া খেলা করত, একটা গা ছমছম পরিবেশ ছিল-- প্রায় আধ কিলোমিটার জুড়ে পড়ে থাকা বাড়িটা লোক শূন্য খাঁ খাঁ করত!
আমি তখন ছোট ছিলাম-- ন দশ বছরের। ভূতপ্রেত দত্যি দানার গল্প শুনে মনে বড় ভয় ঢুকে গিয়ে ছিল। রাতের বেলা পথে একা চলতে পারতাম না। সঙ্গে বন্ধু বান্ধব থাকলে ঠিক আছে-- নতুবা ঘর থেকে বেরোবার প্রশ্নই ওঠে না।
সেদিন রাতের পড়া করছিলাম। জয়দেব এলো আমার কাছে। ও আমার স্কুলে পড়ে। এক ক্লাসেই পড়ি আমরা, বলল, তপন তোকে শীলাদি ডেকেছেন, বলেছেন, খুব দরকার, আজই একবার দেখা করতে। কথা কটা বলে ও নিজের ঘরে চলে গেলো।
শীলাদি আমার স্কুলের মেডাম, আমি ও জয়দেব তাঁর কাছে টিউশনিও পড়ি। স্কুলে তাঁকে আমরা,মেডাম আর স্কুলের বাইরে, দিদি ডাকি। গত দুদিন আমি স্কুলে যাই নি টিউশনিতেও যেতে পারি নি। কারণ শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না-- সর্দি কাশি, জ্বর-জ্বর ভাব চলছিল। হাফ ইয়ারলি পরীক্ষা সামনে ছিল। এ সময় স্কুল কামাই, টিউশনিতে অনুপস্থিতি এসব কারণেই বোধহয় শীলাদি ডেকে পাঠিয়েছেন। শীলাদির বাড়ী যাবো বলে তৈরি হলাম। পথে বের হবার আগে মনে হল,আরে একা যেতে পারবো তো!পথে ভয় পাবো না তো? আগে মনে হলে জয়দেবের সঙ্গেই চলে যেতে পারতাম। ভাবলাম রাস্তায় তো লাইট আছে। আর তা ছাড়া পথে লোকজনের যাতায়াত এখনো থাকবে। রাত বেশী হয় নি। সাহস জুটালাম মনে। পা বাড়ালাম রাস্তার দিকে। শীলাদির বাড়ি বেশী দূরে না-- যেতে পাঁচ সাত মিনিটের বেশী লাগে না। সোজা পথে হাঁটলাম দু মিনিট, এবার রাস্তা দুদিকে মোড় নিয়ে চলে গেছে। সামনেই পড়ে গম্বুজ আকারের গোলঘরগুলি। ও দিকে আলো নেই, অন্ধকারে গোলঘরগুলি ভূতের আস্তানার মত দাঁড়িয়ে ছিল। ওর পাশ থেকেই আমায় যেতে হবে।
গোলঘর পার হয়ে সামান্য এগোলে ছোট একটা মাঠ, সেখানে প্রায় রোজই আমরা খেলতে আসতাম। না, দিনের বেলা, না ভয়, না ভুতের কোন কথা মনে পড়ত না, কিন্তু রাতের বেলা! ওগুলোর কথা ছাড়া আর অন্য কিছুই মনে পড়ে না! পড়বি তো পড়, ঠিক আমার চোখ গিয়ে পড়ল বৃন্দাবন কুঠির গেটের দিকে। গেটের দিকে চোখ পড়ায় আলাদা কিছু মনে পড়ছিল না, মনে পড়ল, সামনে আমার মস্ত বড় ভূতুড়ে রাজ প্রাসাদ-- যেন ঘুমিয়ে আছে।ভয়ের সময় দেখেছি-- এমনি ভয়ের কথাই সব মনে পড়ে! তবু কেন যেন আর একবার চোখ গিয়ে পড়ল বৃন্দাবন কুঠির দিকে! আর,আর একি! দেখলাম সুন্দর একটা মেয়ে ওখানে দাঁড়িয়ে আছে! আশ্চর্য অন্ধকারেও তাকে আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম! ও আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। আর আমিও ওই দিকে তাকিয়ে আছি, চোখ সরাতে ইচ্ছে হচ্ছিল না-- অদম্য ইচ্ছা নিয়ে কেবল তার দিকেই তাকিয়ে ছিলাম। দেখলাম, পরমা সুন্দরী এক রমণী, যার শরীর ভরা আভরণ, চকমকে শাড়িতে যার দেহ মোড়া। আমায় ইশারাতে হাতছানি দিয়ে ডাকছিল!
আমি চমকে উঠলাম, শরীরের মধ্যে দিয়ে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেলো-- দেহে কেমন যেন ঝিমঝিম অনুভব করতে লাগলাম! মনে করতে পারছিলাম না-- আমি কে? আমি যেন ঠিকানা বিহীন কেউ-- কোথায় যাচ্ছি, কোথায় যাবো, সব, এক সময়, সব ভুলে গেলাম!
বৃন্দাবন কুঠির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে দেখি মা! হ্যাঁ, দেখি মা আমার হাতছানি দিয়ে ডাকছেন। আমি তখন অন্য আমি! মনে হল ওই তো আমাদের বাড়ি-- বৃন্দাবন কুঠি
--আমি, হ্যাঁ, আমি বৃন্দাবন।
--বৃন্দাবন! বৃন্দাবন! -- মা আমায় ডেকে উঠলেন। মার কাছে এগিয়ে গেলাম।
--কোথায় গেছিলি বাবা, তোকে যে অনেকক্ষণ ধরে খুঁজে বেড়াচ্ছি !
--নৌকা বিহারে মা! কেন তুমি জানো না মা! মামা আমায় সকালেই নৌকা বিহার করাবেন বলেছিলেন, বৃন্দাবন বলে উঠলো।
তখন ভোরের কাক ডাকা সকাল ছিল। কুঠির রোশনদানে তখন মোমের শেষ অংশটুকু জ্বলছিল।
--মামার সঙ্গে!
বৃন্দাবনের কথা শুনে আঁতকে উঠলেন মা, তোকে বলেছিলাম না খোকা, তুই মামার সাথে কোথাও যাবি না!
--কেন,মা! মামা তো আমায় খুব ভালবাসেন। আমায় নতুন পরিচ্ছদ কিনে দেন, আমার জন্যে অনেক অনেক মিষ্টি কিনে আনেন। আমাদের বাড়ি যখন এলেন ঝুড়ি ঝুড়ি ফল মিষ্টি নিয়ে এসেছিলেন!
--না, ই বুঝিস না, মামার কাছে যাবি না। ও তোকে--
--কি মা-- আমাকে--
এমনি সময় বৃন্দাবন মামাকে দেখল দূরের নদীর পারের রাস্তা ধরে আসছেন। ধোপদুরস্ত হয়ে বৃন্দাবনের দিকে এগিয়ে এলেন তিনি। হাসলেন, বললেন, কেমন লাগলো, বৃন্দাবন? নৌকা বিহার ভালো লেগেছে?
--খুব ভালো, মামা! আরও কিছু বলতে চাইছিল বৃন্দাবন, বলতে চাইছিল, রোজ ভোরে এমনি নৌকো বিহার করবো, মামা! কিন্তু থেমে গেলো ও,মার কথা মনে হয়ে গেলো। একটু আগেই মা তার বলেছেন, মামার সঙ্গে কোথাও যাবে না। ও কিছুতেই বুঝতে পারলো না, কেন ওর মা বাবা এমনি বলেন! বৃন্দাবনের মামা, সংঘাত, বললেন, কি হল কি বলবে বল?
মামার দিকে তাকাল বৃন্দাবন, বলল, না, কিছু বলব না।
বৃন্দাবনের বাবা আদিত্য রায় চৌধুরী, জমিদার। বর্তমানে বেশ কিছু দিন ধরে অসুস্থ তিনি। শয্যাগত। দু বেলা ডাক্তার এসে দেখে যাচ্ছেন তাঁকে। তবু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। মনে হচ্ছে ধীরে ধীরে আদিত্য পালচৌধুরীর দিন ফুরিয়ে আসছে! বুঝতে পারছেন তিনি, আর বেশী দিন তিনি বাঁচবেন না।
তাঁর এক মাত্র ছেলে বৃন্দাবন, তাঁর মৃত্যুর পর একমাত্র উত্তরাধিকারী ও। কিন্তু ও খুব ছোট--দশ বছর মাত্র ওর বয়স! ও কি করে বুঝে নেবে তাঁর বাবার সম্পত্তি? সে তো এসবের কিছুই বোঝে না! চিন্তায় চিন্তায় আরও ক্ষয়ে যাচ্ছিলেন আদিত্য। চিন্তার ওপর দুশ্চিন্তা তাঁর মাথায় আরও বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে তাঁর একমাত্র শ্যালক! সংঘাত। ওর মতিগতি তাঁর ঠিক লাগে না। ওপরে ওপরে আদিত্যকে শ্রদ্ধা দেখাবার ভান করে। কিন্তু সেটা যে অতিরিক্ত-- শুধু মাত্র দেখানো— তা আদিত্য বুঝতে পারেন। সংঘাত ঘরভেদী বিভীষণ বললে ভুল হবে না। ও বহুদিন ধরে এখানেই আছে-- নিজের ঘর বাড়ি থাকলেও কোন দিন যাবার নাম করে না।
সংঘাত ঘরে ঢোকেন, কেমন আছেন এখন? ফল পথ্যি ওষুধপত্র খাচ্ছেন তো ঠিক মত? আদিত্যের দিকে তীক্ষ্ণ নজরে তাকিয়ে বললেন, সত্যি আপনার দিকে আর তাকাতে পারছি না! দিন দিন শরীরের গতি ভাঁটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
চুপ করে থাকেন আদিত্য।
--চিন্তা করবেন না জামাইবাবু, আমি আছি, সবকিছু আপনার মত করেই দেখে নিতে পারব।
--জানি কিন্তু মনে রেখো, বৃন্দাবন আছে-- আর--
--আরে সে চিন্তা আপনি করবেন না, ওকেই বুঝিয়ে শুনিয়ে দেবো আমি। আপনি নিশ্চিন্তে চোখ বন্ধ করতে পারেন!
আদিত্য ভাবেন, বলে কি সংঘাত! সে যে তাকে এখনি চোখ বন্ধ করিয়ে দিতে চায়!
বৃন্দাবনকে কাছে ডাকেন মা, মায়াবতী--গলার স্বর নিচু করে বলেন, বৃন্দাবন,বাবা! তুমি ছোট, বোঝো না। তোমার মামা কিন্তু তোমার ভালো চান না। তাঁর কাছে কম যাবে। একা কখনো তাঁর সাথে কোথাও যেও না, বাবা!
--ঠিক আছে আর যাবো না, মা-- কিন্তু মা, মামা তো আমায় খুব ভালোবাসেন!
মায়াবতীর রাগ হয়, না, তোমায় বলেছি না, তুমি ওঁর সঙ্গে কোথাও যাবে না!
বৃন্দাবন বুঝতে পারে না। তার মনে হয়, মামা তো তার কত ভালো, দেখা হলেই মিষ্টি হেসে কত কথা বলেন! খাবারের কথা,ঘুরতে যাবার কথা, শিকারে নিয়ে যাবার কথা বলেন, আর আজই তো নৌকা বিহারে নিয়ে গেলেন! তবু সে মাকে বলল, ঠিক আছে মা, তুমি বলছ,আমি আর কোথাও যাবো না-- মামার কথা শুনব না-- মামার সঙ্গে কথাও বলব না।
এমনি এক দিনের কথা, বেশ রাত তখন--বৃন্দাবন তখন তার মা, মায়াবতীর সঙ্গে ঘুমাচ্ছিল। মামা সংঘাত ওদের ঘরে ঢুকলেন, দেখলেন, বৃন্দাবন আর মায়াবতী গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। সংঘাত বৃন্দাবনকে ধাক্কা দিয়ে জাগাবার চেষ্টা করলেন, কয়েকবার চেষ্টায় বৃন্দাবন জাগল না। সংঘাত পাঁজা কোলে করে ওকে বাইরের ঘরে নিয়ে এলেন। গেটে তখন দুই প্রহরী জাগ্রত। কিন্তু তাদের সংঘাত বশ করে নিয়ে ছিলেন। হঠাৎ ঘুম ভাঙ্গল বৃন্দাবনের। দেখল, এ কি! সে কি করে এ ঘরে এলো!
--তোমার সঙ্গে কথা আছে বৃন্দাবন! --সংঘাত হেসে বলে উঠলেন, তোমায় আমিই নিয়ে এলাম,আমি নৌকা বিহারে যাচ্ছি --মনে হল তুমিও যেতে পারো --নৌকা বিহার তোমার খুব ভালো লাগে।
বৃন্দাবনের মার কথা মনে পড়ে গেলো-- ও বলে উঠলো, কিন্তু মা--
--মাকে আমি বলেছি তো, তোমার মা বললেন, ঠিক আছে এবারটা ঘুরে আসুক বৃন্দাবন,আর কখনো যাবে না-- তুমি যাবে তো আমার সঙ্গে?
বৃন্দাবনের মন নেচে উঠলো। মা তাকে যেতে বলেছেন। ঠিক আছে সে এবারের মত ঘুরে আসুক, আর না হয় যাবে না। ভোরের নৌকা বিহার খুব, খুব সুন্দর লাগে ওর-- নদীর বয়ে যাওয়া স্রোত, পারের দু ধারের গাছ পালা। বাড়ি ঘর ফসলের খেত, জেলেদের মাছ ধরা, আকাশের লালিম ছটা, সত্যি বৃন্দাবনের খুব ভালো লাগে!
বৃন্দাবন গিয়ে বজরাতে উঠে বসলো। সাজানো বড় নৌকো-- তাতে ঘর বানানো, তার জানালাতে রঙ্গিন পর্দা, ভেতরটায় দুটো ঘর তাতে ঝালর সাজানো!
--আমি ওপরে গিয়ে বসব, মামা? উচ্ছল বৃন্দাবন বলে উঠলো।
--হ্যাঁ, হ্যাঁ, তোমার জন্যে ওপরেই ব্যবস্থা আছে, বাঁকাভাবে ঈষৎ হেসে সংঘাত বলে উঠলো।
বজরা তখন মাঝ নদীতে, চুর্নী নদীর খরা স্রোত নিয়ে বয়ে যাচ্ছে অথই জল রাশি। মামা ডাকলেন, বৃন্দাবন দেখে যা, দেখে যা!
বৃন্দাবন তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে এলো বাইরে। ঘরের বাইরে, ছইয়ের বাইরে।
--দেখ,দেখ কত বড় মাছ! সংঘাত নৌকোর এক কিনারায় ঝুঁকে দাঁড়িয়ে বলে উঠলো। বৃন্দাবন পড়িমরি করে ছুটে গেলো মামার পাশে মাছ দেখতে।
--ওই, ওই দেখ কত বড় মাছ!
বড় মাছ দেখতে বৃন্দাবন ঝুঁকে পড়ল নদীর দিকে আর সেই মুহূর্তে সংঘাত আচমকা বৃন্দাবনের দুটো পা তুলে ধরে ঠেলে দিলো জলের দিকে।
--মামা! একটা মাত্র চীৎকার শোনা গেলো বৃন্দাবনের, ও গভীর জলের মধ্যে পড়ে গেলো। খরস্রোত জল তাকে আরও কিছুটা দূরে ঠেলে নিলো। ও জলের গভীরে তলিয়ে যাচ্ছিল। আর একটিবার ওর মাথার কিছু অংশ মুহূর্তের জন্যে ভেসে উঠে নদীর অতল জলে তলিয়ে গেলো।
বৃন্দাবন প্রাণ ফাটা চীৎকার দিয়ে উঠলো... এবার যেন বৃন্দাবনের সত্ত্বা হারিয়ে যেতে লাগলো-- কোথায় যেন হারিয়ে যেতে লাগলো-- কোন গভীর অতলে! এ কি চারিদিক অন্ধকার কেন! আমি কোথায়, আর, এই কি সেই পোড়ো বাড়ী! সেই বাড়ী! তপন ভয় পেল। ধড়ফড় করে ও উঠে বসলো-- ছুটে বের হল সে ওই পড়ো বাড়ী থেকে। বৃন্দাবন কুঠিতে সে কি করে এলো! আর ও যা স্বপনের মত দেখল সেটা কি শুধুই স্বপ্ন ছিল!
Comments
Top
জন্মদিনের পায়েস
অয়ন দাস
দূরে কোথাও একটা ডাহুক পাখি ক্লান্ত স্বরে একটানা ডেকেই চলেছে। দূরের সীমানা কতটা হতে পারে, এটা ভাবতে ভাবতেই এক অদ্ভুত সমাপনে ঠিক এই সময়েই দোতলার কোনও ঘর থেকে রেডিওতে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গলায় "দূরে কোথায়, দূরে দূরে" গানটা মন্মথবাবুর কানে ভেসে এল। ধূপের গন্ধের মত সুরের রেশ ছড়িয়ে পড়ছে মনের আনাচে কোনাচে। মন কেমন করা ভালো লাগা আর একই সাথে অচেনা এক নিরাসক্তির বৈপরীত্যের অনুভূতিতে মন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল। ক্লান্তিতে আনমনে চোখ বুজতে যেতেই টেবিলের উপর রাখা গত রাতের লেখা সদ্য কবিতাটায় চোখ পড়ল।
১৩ই আষাঢ়, ১৪২৫
সোমবার রাত,
|| ছেলেবেলা ||
আমার যা কিছু মূল্যবান, দূর্লভ, দুষ্প্রাপ্য
সবই সেই ছেলেবেলার;
যা কিছু প্রাচীন, গভীর, গোপন,--- সবকিছুই
প্রত্নতাত্ত্বিকের জমা ডাকটিকিটের মত
ছেলেবেলার পোস্টকার্ডে সেঁটে আছে।
ঘন্টা, মিনিট, সেকেন্ড এর কাঁটা
স্থবির হয়ে
হঠাৎ থেমে গেছে;
জানলার ফাঁক দিয়ে চুইয়ে আসা
ছোটবেলার এক-চিলতে রোদ্দুরের টাইমফ্রেমে।
আইসক্রিমের মত গলে গলে যায় সময়
টুপটাপ করে খসে পরে, ঝরে পরে মুহূর্ত
পল, অনুপল.....
ধাবমান সময়যানের দিকে
এগিয়ে আসা প্রতিটা দিন
আর আলোকিত নয়।
ছেলেবেলার চৌকাঠ পেরিয়ে
বড় হয়ে আমি
নতুন কিছুই শিখিনি, জানিনি;
ধার করা আলো, আর
প্রতিবর্ত ক্রিয়ায়
যা কিছু চিনেছি, তা
অভ্যস্ত চোখ ও মনের
দ্রুত গাণিতিক সমীকরণ।
আমার আবিষ্কারের, সবকিছুই জমা হয়ে আছে
আবছা ফেলে আসা, ছোট্ট
ছেলেবেলার উঠোনে।
স্মৃতির কোটরে যা কিছু ছিল
সবই বদলে গেছে
ক্ষয়ে, নুয়ে, ভেঙ্গে গেছে;
রোদে জলে ধুয়ে গেছে, মুছে গেছে।
মনের কোনায়, ল্যাম্পপোস্টের খুটেতে
আজও ছেঁড়া ঘুড়ির মত
আটকে আছি হারিয়ে যাওয়া
ছেলেবেলার সেই ছোট্ট ‘আমি’।
টেবিলে রোজনামচা লেখার মোটা খাতাটা পরে আছে।
মন্মথবাবু তেমন ভাবে বিখ্যাত না হলেও, যৌবনে খুব একটা অপরিচিত ছিলেন না সাহিত্যের পরিমন্ডলে। বেশ কিছু উপন্যাস, কয়েকটি গল্প আর কবিতা বই-এর সুবাদে পাঠক-পাঠিকাদের মাঝে নামডাকও হয়েছিল। এখন সব কিছুই অতীত। সারাদিনই অবকাশ; অখন্ড অবসর নিয়ে লিখতে গেলেও শব্দ, অক্ষর ধরা দেয় না। সময়ের চোরাস্রোতে ভাটার টানে পিছিয়ে পড়েছেন। আধুনিক লেখার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারেন না নিজেকে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে হীনমন্যতায় অপাংতেয় মনে হয় নিজেকে।
নামেই রোজনামচা, রোজ তো দূরের কথা, সপ্তাহান্তেও দু-পাতা লেখা হয় কি না সন্দেহ! মাঝে মাঝে হঠাৎ স্মৃতির
সরোবরে ঘাই মারে পুরোনো অতীত, ফেলে আসা নানা টুকরো ঘটনা। বেলাশেষে ছায়ারা দীর্ঘ হয়। বৃত্ত পরিক্রমায় জীবনের এই শেষ প্রান্তে এসে মন্মথবাবু অনুভব করেন, সময়ের গতিপথে, ভাবনার দৃষ্টিভঙ্গিও পালটে যায়। আজ থেকে কুড়ি-পঁচিশ বছর আগের ঘটনাও আজকের প্রেক্ষাপটে অন্য রকম ভাবে ধরা দেয় মনের ক্যানভাসে। ছেঁড়া ছেঁড়া এই অনুভূতি গুলিই ছড়িয়ে ছিটিয়ে এই খাতায় লিখে রাখেন মন্মথবাবু। শুধু লেখা নয়, এ যেন নিজের সাথে নিজের কথা বলা; আত্মকথন। মানুষের জীবনে কথা বলার লোকের বৃত্ত যখন ছোটো হয়ে আসে, নিজের সাথে নিজে কথা বলাই কি একমাত্র অবলম্বন হয়ে ওঠে?
১৪ই আষাঢ়, ১৪২৫
মঙ্গলবার সকাল, গতকাল সারা রাত বৃষ্টি হয়েছে। ভোর হয়েছে অনেকক্ষণ আগেই। বেলা বাড়লেও দিনের আলো ম্লান। বাতাসে মাটির সোঁদা গন্ধ। ভিজে স্যাঁতস্যাঁতে দিন, একটু শীত শীত করছে। বারান্দায় এক-চিলতে রোদ সোনালী নরম মিঠে রোদ্দুর এসে পায়ের পাতায় লুটিয়ে পড়েছে। তেমন তেজ নেই, একটু বাদেই মিলিয়ে যাবে সুউচ্চ অট্টালিকার আড়ালে। মানুষ এখন পাশে বাড়তে পারে না, মাথায় বাড়ে। দু বছর আগেও সামনে একটু সবুজের ছোঁওয়া ছিল, প্রোমোটারদের দৌলতে সেটুকুও আর নেই। দুপুর বেলায় সূর্যের প্রখর তাপে নিজের ছায়া যখন ছোটো হয়ে আসে, তখন অনুভূত হয় এই ছায়ার মতই আমিও খুব দ্রুত ছোটো হয়ে ফুরিয়ে আসছি। জীবনের প্রয়োজনে জন্মের পর থেকে ছোটো থেকে বড় হয়েছিলাম, এখন মৃত্যুর প্রয়োজনে বড় থেকে ক্রমশ ছোটো হচ্ছি। জীবনের দীর্ঘ চলার পথে এখন শুধু অতীতের স্মৃতিটুকুই সম্বল। ভাবনা গুলো মাকড়সার জালের মত এলোমেলো হয়ে যায়, তার মাঝেই আচমকা হঠাৎ করে মনের কোন অতল গহ্বর থেকে ফেলে আসা নানা মূহুর্ত জলছবির মত ভেসে ওঠে দিনের আলোর মত স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
অনন্ত সময় নিয়ে বসে আছি। আমি কি স্বার্থপর? আঁতিপাঁতি করে খুঁজেও কেন দেখতে পাই না নিজের সন্তানদের মুখ! একি স্মৃতিভ্রষ্টতা? তাহলে কেন চোখ বন্ধ করলেই যা কিছু দেখি, সেই শৈশবের ঘটনা এসে পড়ে বারে বারে? কত পুরোনো, অথচ আজও স্পষ্ট! কিন্তু কই, ওরা যে এই এত বড় হল, বিদ্বান হয়ে স্কলারশিপ পেল বাইরে পড়তে যাবার সময়, সেই স্মৃতি কেন আবছা? দুই ছেলেমেয়ের দুজনেই বাইরে কর্মরত। চাকরি আর বিবাহসূত্রে
দুজনেই গ্রীন-কার্ড পেয়ে বিদেশেই থেকে যাবে বাকি জীবন। নতুন বছরের প্রথমে নিয়ম করে রঙিন পোষ্টকার্ডের মধ্যে দাদুভাই আর দিদুনের ছবি দেখতে পাই। আমারই মত অশক্ত সত্বেও দু-এক জন এখনও যারা পায়ে হেঁটে চলতে সক্ষম, তারা এলে বইয়ের ফাঁকে গুঁজে রাখি তাদের দেখাবো বলে। তারা চলে গেলে মনে হয়, যাহ্, কিছুই তো বলা হল না! নিজেকেই প্রশ্ন করি, “কি হে জ্ঞানপাপী, সত্যিই কি ভুলে গেলে; না কি ইচ্ছাকৃত ভোলার অভিনয় করলে?” অবাক হয়ে ভাবি, স্বার্থপরতার সঙ্গে এও কি আমার আত্ম-প্রবঞ্চনা?
১৮ই আষাঢ়, ১৪২৫
শনিবার সকাল,
মানুষের ছায়া তাঁর গায়ের সঙ্গে লেপটে থাকে বলে সে তাঁর নিজের ছায়ার স্বরূপ বুঝতে পারে না। ভুল বললাম; বুঝতে পারে তখন, যখন বেলাশেষে সূর্য ঢলে পড়ে পশ্চিম আকাশে। নিজের ছায়া যতটা লম্বা হয়ে ওঠে, অতীতের প্রবল পরাক্রান্ত সেই মানুষটা সংকুচিত হয়ে ক্রমেই ততটা খাটো হতে থাকে।
সময়ের প্রবাহ স্রোতে ঘটমান অসংখ্য মুহূর্ত তৈরী হয়, আবার পরক্ষণে তা অতীতে পর্যবসিত হচ্ছে অতি দ্রুত। এই বিশাল ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে একটা ছোট্ট গ্রহ এই সবুজ পৃথিবী। তাঁর মধ্যেও কোটি কোটি প্রাণের সমষ্টিতে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কীটাণুকীট নগণ্য আমার এই অস্তিত্ব। মহাবিশ্বে অপরিমেয় অনন্তের মধ্যে আমার এই বিন্দুসম জীবনের তাৎপর্য কতটুকু?
প্রতি দিনের মত আজকের দিনটাও অতি সাধারণ। তবু একটু আলাদা বিশেষত্ব আছে বোধহয়। গত পাঁচ বছর আগে এই দিনটা আমার কখনই মনে থাকত না, অথচ যে মনে রাখত সবসময়, সে ছুটি নিয়ে চলে গিয়েছে পুরোপুরি অনেক দূরের দেশে। দেওয়ালের গায়ে ছেঁড়া ক্যালেন্ডারের পাতায় দাগ দিয়ে রেখে অপেক্ষা করে এখন এই দিনটা শুধু মনে রাখি, সৌজন্যে এই ওল্ড-এজ হোমের আথিতেয়তা। যেদিন এই বুড়ো-বুড়িদের স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম, সেদিন এখানের নিয়ম অনুযায়ী আমার ঠিকুজি কুষ্ঠি সব কিছু এরা নিয়ে রেখেছিল। প্রথম দিকে এক বছর ধরে মোটা লাল চালের ভাত আর ট্যালট্যালে নানা রকম সব তরকারির ঝোল খেতে খেতে যখন জিভের টেস্ট বাড্গুলি তাঁদের কাজকর্ম ভুলে গিয়েছিল, সেই সময় হঠাৎ একদিন এর অন্যথা ঘটল। যত্ন করে দুপরে খাবার পাতে রোজকার সু(!) খাদ্যের সঙ্গে ওই একটা আলাদা প্লেটে অল্প একটু দুধ গোলা ভাত, সঙ্গে কয়েকটা ভাঙ্গা চিনে বাদাম আর দু/চারটে কিশমিশ। সে-দিন না কি আমার পৃথিবীতে আবির্ভাব ঘটেছিল। তাই এই মহাভোজ! খাবার পর আমার হাতে ছয় ইঞ্চি মাপের একটা ক্যাডবেরি আর হ্যাপি বার্থ-ডে লেখা পোষ্টকার্ড সাইজের একটা সুদৃশ্য খাম আমার হাতে দেওয়া হল। কয়েকজন আমায় ঘিরে ধরে হ্যাপি বার্থ-ডে গানটা গাইলো কয়েক লাইন। আমায় হাসি হাসি মুখ দাঁড়াতে বলা হল, আর একজন এই অনুষ্ঠানের ফটো তুলে নিল ক্যামেরায়। বিদেশে আমার ছেলে– মেয়েকে পাঠাবে বলে।
ওহ্, বলা হয় নি আর একটা কথা; ফটো তুলে ওরা চলে যাবার সময় আমার দাঁত নেই বলে ক্যাডবেরিটাও নিয়ে গেল। আমারও বলিহারি। লজ্জার মাথা খেয়ে চাইতে গিয়ে আরো লজ্জা পেলাম। দোষের মধ্যে বলেছিলাম, দাঁত নেই তো কি হয়েছে! আমাকে দাও না; আমি চুষে চুষে খাবো!
হায় ভগবান! তারপর কত কথাই না শুনতে হল! চুষে খাবো বলাতে, সেটা অশ্লীলভাবে হাত নেড়ে কত ভাবেই না বোঝানো হল আমায়! আমি না কি বুড়ো ভাম, রসের নাগর! তিনকাল ঠেকে মরার সময় হল, এখনও রস কমলো না!
ছিঃ ছিঃ, লজ্জায় মাটিতে মিশে যাই! ধিক্!
ঘর ছেড়ে সবাই বেড়িয়ে গেলে, চৌকিতে শুয়ে চোখ বুঝে বিধাতার কাছে বললাম, কি প্রয়োজন ছিল এই নাটকের? আমার জন্মদিনটা কি ঘটা করে ওদের মনে করিয়ে দেবার এতটাই দরকার ছিল তোমার? তারপর থেকে আর ওদের কাছে কিছু চাই নি। পরের বছরেও আবার সেই পায়েসের প্লেট। তবে এবার আর আগের বারের মত ভুল করি নি। ওরা যা যা করতে বলেছিল, লক্ষী ছেলের মত শুনে তাই তাই করেছি। সেই দিনের পর থেকে ঐ পায়েস টুকুর স্বাদটা যেন জিভে লেগে থাকে সবসময়। বহুমুত্র রোগের প্রকোপে আক্রান্ত বহুদিন আগে থেকেই, মিষ্টি যে খুব ভালোবাসি তাও নয়; তবু ওই মিষ্টি পায়েসের স্বাদটা ভুলতে পারি না কেন?
লোকে বলে, বয়স বাড়লে না কি নোলা বাড়ে! সত্যি কি তাই? তবে কি শেষের দিন এগিয়ে এলো বলেই শুধু খাই খাই ভাব আমার?
পাঁচ বছর আগে পর্যন্ত যে ছিল আমার সব সময়ের ছায়াবর্তিনী, সে আবার এসব শুনলেই মুখ-ঝাপটা দিত। একটু আগেই যেন সেই চেনা মিঠে গলায় শুনলাম,- “বুড়ো বয়সে ভীমরতি! বয়স হলে সুখী মানুষের না কি দুঃখবিলাসী ভাবনা দানা বাঁধে মনের মধ্যে। আজকের এই শুভ দিনে অনাছিষ্টি ভাবনা কেন? সুখে থাকতে কি ভুতে কিলোয়?”
প্রথমে বুঝতে পারি নি; চমকে গিয়েছিলাম। তারপর বুঝতে পেরে একগাল হেসে বললাম, “না গো, তা নয়। আমার এই নিস্তরঙ্গ জীবনে কি কোনো ঢেউ আছে? তোমায় কত ডাকি, তোমার তো আমার কাছে এসে আগের মত গল্প করার সময়ই হয় না। আমায় কি তুমি কখনও দুখী দেখেছো, বল? তোমায় বিয়ে করে ঘরে আনার পর থেকে সেই শেষের দিন অবধি তো দুজনের খুনসুটিতেই সংসারে এত বছর কাটিয়ে দিলাম! তুমি চলে যাবার পর আমার কথা বলার, শোনার লোক কই আর!”
- “ধ্যাত, তুমি ঠিকমত আমায় ডাকোই না, তাই তো আমি আসি না; আজ আমায় ভাবছিলে বলেই না এলাম!”
- “তুমি আর যাবে না তো আমার কাছ থেকে? “বল, থাকবে সব সময়?”
- “হ্যাঁ রে বাবা থাকবো, থাকবো, থাকবো। তিন সত্যি! এবার বিশ্বাস হল তো?”
- “হ্যাঁ, হল। তুমি তো মিছে কথা বল নি কখনও আমার সঙ্গে! তোমার কথা বিশ্বাস না করে উপায় আছে!”
- “ঠিক। এবার থেকে আর যাবো না তোমায় ছেড়ে কখনও। এখন থেকে তোমার কাছেই থাকবো আমি।”
- “বাহঃ, খুব ভালো হবে তাহলে। তুমি যখন এসেই গিয়েছো, তখন একটা কাজ করবে?”
- “কি বল?”
- “আজ তো আমার জন্মদিন, তাই আজ ওরা খাবারের সঙ্গে আলাদা করে একটু পায়েস দেবে আমায়। আমি চাইলে ঠাট্টা করে, মস্করা করবে; তুমি ওদের বলে দেবে, আমায় যাতে আর একটু বেশি করে পায়েস দেয়?”
- “আচ্ছা, ঠিক আছে; বলে দেব। সকাল থেকে কত কথা বলে চলেছে! আজ তুমি খুব ক্লান্ত। আজকের দিনে মন খারাপ করতে নেই। তুমি চোখ বোজো এখন। এসো, আমি আগের মত তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিই। ঘুম থেকে উঠে পায়েস খাবে।”
রান্নার মাসি সুরমা, খাবারের থালার সঙ্গে অতিরিক্ত পায়েসের প্লেটটা নিয়ে ২১ নম্বর ঘরে কাউকে না পেয়ে বারান্দায় এসে দেখে, দাদু হাঁ করে ঘুমিয়ে আছে। মাথাটা গাছের ছায়ার দিকে হেলে আছে, হাসি হাসি মুখ। বুড়ো বয়সের এই এক রোগ! গাল তোবড়ানো ফোকলা দাঁতে নিজের মনে কি যে বিড়বিড় করে কথা বলে, তা ভগবানই জানেন!
খাবারটা ঘরের টেবিলে রেখে, কাঁধ ধরে নাড়াতে গিয়েই কাঠের মত শক্ত দেহটা সশব্দে টুল থেকে দড়াম করে আছড়ে পড়লো নিচে শান বাঁধানো মেঝের উপর।
বিরক্তিভরা মুখে নিচের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে সুরমার অভিজ্ঞ চোখ বুঝলো, আজ আর তাড়াতাড়ি কাজে ফাঁকি দিয়ে বাড়ি যাওয়া যাবে না।
...কাজের ফ্যাঁকড়া বাড়লো; কারণ, বুড়োটা মারা গিয়েছে অনেকক্ষণ আগেই!
Comments
Top
অন্যরকম
পুজো
দেবদাস ভট্টাচার্য্য
ডালাস, টেক্সাস
অনেকক্ষণ থেকে অস্বস্তি হচ্ছিল ভুজঙ্গর। কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করে বিছানায় উঠে বসলেন। নিভাননীকে একটু ঠেলে বুঝে গেলেন ওঠবার নয়, ঘুমের ওষুধ সেঁধিয়ে গেছে মস্তিষ্কের কোষে কোষে। না খেলে ঘুম হয় না। নিভাননীর ঘুম না হলে তার ঘুমেরও দফা রফা। এটাই বেশ। রাতের ঘণ্টা ছয়েক নিশ্চিন্ত। বালিশের তলা হাতড়ে বুঝলেন টর্চটা নেই। মনে পড়ল সন্ধ্যেবেলা বাগানে গেছলেন বুলবুলি পাখির বাসা দেখতে, দুটো ডিম পেড়েছে। অন্য সময় দেখা পাওয়া যায় না মা-বাবা কারুরই। রাত্রে কিন্তু দুজনে এসে পাহারা দেয়। ছোট্ট বেদানা গাছের এমন জায়গায় বাসা বেঁধেছে যে বেড়াল, ভাম যে কোন সময় অঘটন ঘটাতে পারে। যেদিন থেকেই নজরে এসেছে সেদিন থেকেই সন্ধ্যেবেলা বার কয়েক গিয়ে দেখে আসেন। দু-একবার ছোট্ট করে আঙ্গুলের পেছন দিয়ে হাত বুলিয়ে দিয়েছেন, প্রথম প্রথম শিউরে উঠত, এখন আর করে না। চিনে গেছে, এ হাত আশ্রয়ের হাত। বসে থাকে নিশ্চিন্তে। আর তাতেই সমস্যায় পড়েছেন। নিবারণও মাঝে মাঝে লক্ষ্য রাখে। বেশী ভয় পাড়ার হুলো বেড়াল কয়েকটাকে নিয়ে। শেষমেষ উদ্বেগ ঢাকতে তার জাল দিয়ে ঘিরে দিয়েছেন, বেড়ালগুলোর থেকে অন্তত নিশ্চিন্ত হওয়া গেছে। টর্চটা বসার ঘরেই থেকে গেছে। অন্ধকারে খানিক চোখ সওয়ালেন। তারপর ঠাওর করার চেষ্টা করলেন। মন বলছে ঘরের মধ্যে তৃতীয় ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটেছে। খানিক পরেই বুঝতে পারলেন তাঁর অনুমান অভ্রান্ত। মনের আস্বস্তি তিনি বুঝতে পারেন, এটা তাঁর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়, কোনদিন ফাঁকি দেয়নি। অনেক বিপদের আগাম আঁচ তিনি আগেও পেয়েছেন কয়েকবার। ভুজঙ্গবাবু দ্রুত বিশ্লেষণ করা শুরু করে দিলেন। রাতের আঁধারে ঘরের মধ্যে কোন সুহৃদ ঢোকেনি, এটা ভয়ানক রকমের সত্য। এবার বোঝার চেষ্টা করলেন বিপদের সম্ভাবনা কতটা। একটা ছায়া সিন্দুকের কাছে দেওয়ালের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। বুঝতে পেরেছে ঘরের একজন ঊঠে পড়েছে। কিন্তু সেটা মহিলা না পুরুষ বুঝতে পারছে না। আগন্তুকের থেকে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কতটা তাই বোঝার চেষ্টা করলেন। রাতের অন্ধকারে ঢুকেছে, ডাকাত নয়। দেখে মনে হয় না সঙ্গে এখানে আর কেউ আছে। বাইরে থাকলেও থাকতে পারে। অস্ত্র? তা থাকলেও থাকতে পারে। বন্দুক লাঠি নিয়ে আর যাই হোক চোর ঢুকবে না। তবে ছোরা-ছুরি থাকতে পারে।কিন্তু চোর কি ওসব নিয়ে আক্রমণ করেছে কোনদিন? মনে হয় না। কিন্তু ছুরি নিয়ে যদি লাফিয়েও পড়ে প্রথম ধাক্কা এ মশারি সামলে নেবে। যেমন তেমন মশারি এ নয়।
রীতিমত বিশেষ অর্ডার নিয়ে, যথেষ্ট সময় নিয়ে ভুবন দর্জির হাত থেকে বেরিয়েছে। দুপক্ষই চুপচাপ। একজন মশারির ভেতর, অন্যজন বাইরে। ধৈর্য্য পরীক্ষা। মনে মনে হাসলেন ভুজঙ্গ। জমিদার হোক আর নবাব হোক একদঙ্গল খুদের থেকে তাদের রেহাই নেই। মশা! তাঁর ভেঙ্গে পড়া বাড়ী, অযত্নের বাগান আর কেউ দখল করার কথা ভাবতেই পারে না। ঝাঁকে ঝাঁকে পঙ্গপালের মত দাপিয়ে বেড়ায় সারা দিন। নিবারণ মাঝে মধ্যে ধোঁয়া দেয় বটে তবে তা বেশীক্ষণ থাকে না। বড়জোর আটটা। আক্রমন শুরু হবার আগেই সবাই ঢুকে পড়ে মশারির ভেতর। রাতের খাওয়ায় বাহুল্য নেই। এই মশার জন্য এ বাড়ীতে কেঊ টেকে না। ভাবতে ভাবতেই চটাস করে শব্দ হল। হাসলেন ভুজঙ্গ। আক্রমণ শুরু হয়ে গেছে। একটু গলা খাঁকারি দিলেন।
- 'তা কি নাম হে তোমার?'
বেশ চুপচাপ কাটল কিছুটা। আবার একটা চটাস করে শব্দ। তারপর একটা বিরক্তিকর গলা – 'আমার নাম নিয়ে কি হবে। পুলিশ বাড়ীর লোক গ্রামের লোক যাকে ইচ্ছে হয় ডাকুন।'
বেশ মজা লাগল ভুজঙ্গর। কথাবার্তায় মার্জিত ভাব। বললেন – 'তবু, তুমি তোমার নাম বলবে না? বাবা মার দেওয়া একটা নাম তো আছে। ভালো নাম, ডাক নাম।'
- 'একটা নাম বললে সেটা আসল কিনা আপনি ধরতে পারবেন? যদি বলি আমার নাম ঘেঁটু, কিংবা ধরুন নাড়ু কিছু ফারাক ধরতে পারবেন? আমাকে কি আপনি চেনেন?'
- 'তা সত্যি কথা বলতে তোমাকে আমি চিনি না। আমার গ্রামের লোক বলে মনে হয় না। হলে কি আর এ বাড়ীতে ঢুকতে?'
- 'সে ঢুকেই টের পেয়েছি। ছ্যাঃ, ছ্যাঃ। জমিদার বাড়ী? ভুতুড়ে বাড়ীর হাল এর চেয়ে অনেক ভালো মশায়। একটা কুকুর বেড়ালেরও টিকি দেখতে পেলুম না।'
আঁতে ঘা লাগার কথা। একটু লাগলও। তবে সামলে নিলেন, ওসব গা সওয়া হয়ে গেছে এখন। সত্যি কথায় এখন আর দুঃখ পান না, পেতে নেই। নিচের এই গোটা তিনেক ঘর ছাড়া প্রায় সবটাই ভেঙ্গে পড়েছে। নিজেদের জন্য দুটো আর একটাতে সারাদিনের সারাক্ষণের সব কিছু সামলাবার লোক নিবারণ এবং রান্নার হরিঠাকুর। ছেলে মেয়েরা আর আসে না, এলে থাকার অসুবিধে হয় বড়। নিবারণ বাতে কাবু, হরিঠাকুর রাতকানা, যাওয়ার কোন ঠিকানা নেই, তাই থেকে গেছে। মাইনে নেয় না, দিতেও হয় না, দেওয়ার ক্ষমতাও নেই। ভুজঙ্গ সোজা সাপটা বলে দিয়েছিলেন, - 'থাকলে থাকো না থাকলে যাও।' একে একে সবাই চলে গেছে। কি ছিল, কি হল। জ্ঞান হওয়া ইস্তক জৌলুষ দেখে এসেছেন ভুজঙ্গ, আর দেখতে দেখতে তাঁরই জমানাতেই সব শেষ। আপনা থেকেই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল বুক কাঁপিয়ে, এমনই জোরে অন্ধকারের আগন্তুকও শুনতে পেল।
- 'দুঃখ পেলেন দেখছি। নানা আমি সে ভাবে বলতে চাইনি।' লোকটার গলায় সমবেদনার সুর। ভুজঙ্গর মনটা একটু হাল্কা হল। লোকটা চোর হতে পারে কিন্তু কিছুটা হলেও মন আছে। এবার একটা নাম না হলে কিন্তু বড্ড অসুবিধে হচ্ছে।কথাবার্তা জমছে না। ভুজঙ্গ গলায় একটু আন্তরিকতা ঢাললেন। কেন যেন লোকটাকে শুধুমাত্র চোর বলে ভাবতে কষ্ট হচ্ছে।
তখন থেকে আমার নামটা জানার জন্য বেশ চেষ্টা চালাচ্ছেন দেখছি। ওটি হচ্ছে না। নাম বলা বারণ। যেমন ইচ্ছে ধরে নিন একটা।
- 'সে আমি ধরেই রেখেছি। যেমন চোর, চোরা, চোরু, চোর চূড়ামনি। না না, চোরচূড়ামনি হল চোরেদের সেরা। তুমি
বাপু একেবারেই কাঁচা। নাহলে এভাবে হাতে নাতে ধরা পড়। তোমাকে বোকা চোর বলতে কোন আপত্তি নেই আমার।'
- 'আমার আছে। সে ভাবে দেখতে গেলে আমি চোর নই।'
- 'তুমি চোর নও? ভারী অবাক হলেন ভুজঙ্গ। তাহলে বাপু তুমি কে? কি জন্য এই মধ্য রাত্রে জমিদার বাড়ীতে ঢুকে বসে আছ?'
- 'জমিদার বাড়ী?' ফিক করে হালকা হাসির আওয়াজ হল। অন্ধকারেও ভুজঙ্গ ঠিক বুঝতে পারলেন। বুকের কোথাও লাগল একটু। অনেকেই এ নিয়ে মজা করে। কোবরেজ অন্নদাচরণ সবার সামনেই অনেকবার বলেছেন – 'ভুজঙ্গ, বলি কি কলকাতায় একটু খোঁজখবর নিয়ে দেখ। আরশোলা, ব্যাং বিদেশে রপতানি হচ্ছে দেদার, মশা কেন হবে না? মশা কি ফেলনা? বিশেষ করে জমিদার বাড়ীর মশা, এদের শরীরেও জমিদার রক্ত বইছে কত পুরুষ ধরে,এখনো বয়ে নিয়ে চলেছে প্রতিদিন। না না, তুমি বাপু এবারে একটু ভবতে শুরু কর ... ঝাঁকে ঝাঁকে জমিদার মশা, একি আর কলকাতার নর্দমার জলের ডেঙ্গু মশা? আর তোমার অভয় পেয়ে যে ভাবে বাড়ছে এরা। তা বাড়ুক, তুমি যদি এর সদব্যবহার কর, কে তোমাকে থামাবে? বিদেশী মূদ্রার একটা পথ খুলে যাবে।'
গা জ্বালা করে, কিন্তু হজম করতে হয়। বড়ই দুরবস্থা চলছে। ছেলে মেয়ে দুজনেই রাজ্যের বাইরে। চাকুরি করে। দেওয়া নেওয়ার কোন বালাই নেই, কিন্তু সংসার চালাতে বেশ কষ্ট হয়। জমির ধানে পেটে-ভাতে চলে যায় এই পর্যন্ত, অল্প বাড়তি ধান বিক্রীর টাকায় বেশী কিছু করা যায় না। এ বাড়ী সারিয়ে আগের জৌলুষ ফিরিয়ে আনা কি চাট্টিখানি কথা! আর ফিরিয়ে হবেই বা টা কি? থাকবে কে? বেশ চলছে গড়িয়ে গড়িয়ে যেমন, তেমনি চলুক। নতুন কিছু করা বা ভাবা কোনটাই তাঁর দ্বারা আর হবে না। চিন্তায় ছেদ পড়ল। পরিস্থিতি নিয়ে হুঁশ এল। ঘরের মধ্যে চোর, বৌ ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে অচেতন, কাজের লোক দুটোর কোন সাড়াশব্দ নেই, টেনে ঘুমুচ্ছে না হলে চোর সেঁধুল কি করে? তিনি একা কি আর সামলাতে পারবেন? কথায় কথায় ভোর পর্যন্ত টেনে দিতে পারলে।
- 'কি হোল চুপ করে গেলেন যে বড়? কিছু ফন্দি আঁটছেন, তাই তো? কি ভাবে আমাকে কব্জা করা যায়, তাই না?'
ধরা পড়ে একটু দমে গেলেন ভুজঙ্গ। দিনের আলো পর্যন্ত টানার কথাই ভাবছিলেন, তা হলে চাক্ষুস দেখা যাবে লোকটা কেমন। দমে গেলেও সামলে নিলেন। মিথ্যে কথা তাঁর ধাতে নেই, সে জমিদার হোন বা না হোন। বললেন -'তা বাপু কথাটা তুমি নেহাৎ ভুল বল নি। সেরকম যে একটা চিন্তা ভাবনা মাথায় খেলছিল না তাই বা বলি কি করে। নাঃ, একেবারে যতটা বোকা ভাবছিলাম ততোটা বোকা তুমি নও। তবে বোকার তকমাটা তোমার লেগেই থাকল, না হলে এত কাঠ খড় পুড়িয়ে এ বাড়ীতে তুমি ঢুকতে যাবেই বা কেন। ঢোকার মত মেলা বাড়ি পাবে তুমি এ গ্রামে, নগদ টাকা, এট সেটা করে মন্দ হত না। তা না করে কোন বুদ্ধিতে তুমি এ বাড়ীতে ঢুকলে তাই আমার মাথায় ঢুকছে না। একটু ঝেড়ে কাশো না বাপু।'
চুপচাপ কাটল কিছুক্ষণ। তারপর চটাস চটাস বেশ কয়েকটা শব্দ।
- 'কি মশা পুষেছেন মশাই। রক্তখেকোর দল। জবজবে করে নিম তেলে মেখেছি, কিন্তু দিব্যি প্যাট প্যাট করে হুল ঢুকিয়ে দিচ্ছে।' একরাশ বিরক্তি ঝরাল লোকটা।
- 'এ জমিদার বাড়ীর মশা বাপু, পোষ্য বলতেই পার। তবে খরচাপাতি নেই। জমিদারের রক্ত বইছে ওদের শরীরে সেই কত পুরুষ ধরে তার কি ঠিক আছে? নিম তেল ওদের কিস্যু করতে পারবে না। ভারী তৃপ্তি বোধ করলেন, একটু গর্বও। আর কিছু নিয়ে গর্ব করার নেই এখন।'
- 'রক্ত চোষার অভ্যেস জমিদারের রক্তে থাকবে এ আর নতুন কি। এমন কি মশাদেরও দিয়ে চোষাচ্ছেন। পোয়া খানেক টেনে নিয়েছে ইতিমধ্যে। ম্যালেরিয়া না হলেই হল।'
- 'মুখ সামলে হে ছোকরা।' চলাক করে খানিক রক্ত উঠে গেল মাথায় ভুজঙ্গর। এ তল্লাটে খোঁজ নিয়ে দেখ, এমন অপবাদ কেউ দিতে পারবে না। নেহাৎই সাদা মাঠা জমিদার ছিলেন আমাদের পূর্বপুরূষ। আমিও জ্ঞান হওয়া ইস্তক দেখিনি এমন কিছু হয়েছে এ বাড়ীতে। আমার ঠাকুর্দা, আমার বাবা আর এই আমি, অন্তত তিন পুরুষে এমন অপবাদ কেউ দেয়নি। রক্ত চুষতে জানলে আজ এটা জমিদার বাড়ীই থাকতো। তুমিই তো বলেছো ভুতের বাড়ী এর চেয়ে ভালো। কি বলনি?'
- 'তা বলেছি।' লোকটার গলায় একটু দুখী দুখী ভাব। 'সত্যি কি হাল হয়েছে বাড়ীটার। অথচ বাবার সঙ্গে যখন আসতুম ।'
- 'বাবার সঙ্গে আসতে?' কথাটা লুফে নিলেন ভুজঙ্গ। 'তার মানে অনেক দিন ধরে যাওয়া আসা আছে এ বাড়ীতে? সুলুক সন্ধান সব জান দেখছি। আমার তখনই বোঝা উচিৎ ছিল। হুট করে কোন আনকোরা চোরের এ ভাবে ঢুকে পড়াতো সম্ভব নয়। বাপের সঙ্গে থেকে থেকে হাত পাকিয়েছ, তাই না?'
- 'খবর্দার, আমার বাবা নিয়ে অমন কথা বলবেন না।' গর্জন করে উঠল লোকটা এমন ভাবে যে ভুজঙ্গ ভয়ানক চমকে উঠলেন। নিভাননী পাশ ফিরলেন। ঘুম জড়ানো গলায় কিছু বিড় বিড় করে আবার ঘুমিয়ে পড়লেন। ভুজঙ্গর মাথাটা কেমন গোলমাল হয়ে গেল। একটা চোরের মধে এমন প্রতিবাদী গলা তিনি ভাবতেই পারছেন না। তার মানে বাবাকে খুব শ্রদ্ধা ভক্তি করে লোকটা। তাঁর ছেলে-মেয়ের মতো নয়। চোখটা ভিজে এল। ধরা গলায় কিছুটা সামলে নিয়ে বললেন, 'বাবাকে খুব ভালোবাসো বুঝি?'
- 'এতে আবার নতুন কি আছে?' বাবার প্রসঙ্গে লোকটারও গলা নিচে নেমে এল। 'বাবা-মাকে ভালো না বেসে আপনার মতো লোকজনকে ভালোবাসতে আমার ভারী বয়েই গেছে।' আবেগ, অভিমান ঘরের ভেতরের হাওয়াটাকে বেশ ভারী করে তুলল। কিছুক্ষণ বেশ চুপচাপ। দুজনেই পেছনে তাকিয়ে দেখছে। কত স্মৃতি, কত ভালোলাগার ক্ষণ। চটাস চটাস শব্দও আর হচ্ছে না। মশারা বেশ টানছে। ভুজঙ্গই কথা শুরু করলেন আবার – 'তা বাবাকে যদি এত ভালোবাসো, তাহলে এ কাজে নামা কেন বাপু? জনগনের ধোলাই, পুলিশের মার এসব কি তোমার বাবার ভালো লাগবে? চুরি করাটা কি কোন ভালো কথা?'
- আমি তো চুরি করতে ঢুকিনি।' নির্বিকার গলায় বলল লোকটা।
- 'তো কি করতে ঢুকেছ বাপু তুমি এ বাড়ীতে? আমাকে দেখতে?' প্রায় ভেংচি কাটলেন ভুজঙ্গ।
- 'আপনার কি মনে হয় কিছু চুরি করার মত আছে এ বাড়ীতে?' ভুজঙ্গর কথা ভুজঙ্গকেই ফিরিয়ে দিল লোকটা। রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে যা দেখার দেখে নিয়েছি। দু-চারটে কাঁসার বাসন এখনো বেশ আছে, কিন্তু ওতে এখনকার চোরদেরও মন উঠবে না। ঘাড়ে করে বয়ে নিয়ে বিক্রি বাটা করে পোষাবে না।
- 'তা বাপু তোমাদের পোষানোর ক্ষমতা আমার নেই। অন্য বাড়ি দেখো। ভোর হয়ে আসছে, কেটে পড়। নিবারণ জেগে উঠবে, লোকজনও জেগে যাবে।'
- 'কিন্তু আমার কাজটা তো হল না। যার জন্য এত রক্ত দিলুম, এতক্ষণ আপনার সঙ্গে তর্ক বিতর্ক করলুম, সেই কাজটাই তো বাকী থেকে গেল।'
- 'তখন থেকেই মনটা খচ খচ করছিল। একটা কিছু উদ্দেশ্য আছে। না হলে আমার ঘরে চোর? কি ব্যাপারটা খুলে বলো না বাপু। কাঁচা ঘুমটা ভাঙ্গালে, কি চাই তোমার?'
- 'একটা দলিল। আমার বাস্তুভিটের দলিল।'
- 'দলিল? ভুজঙ্গর মুখ হাঁ হয়ে গেল। মশারির বাইরে থাকলে নির্ঘাৎ ডজন খানেক মশা ঢুকে যেত। বিষ্ময়ের ঘোর কাটিয়ে উঠে জড়ানো গলায় বললেন - 'কার দলিল, কিসের
দলিল? আমার কাছে কেউ রেখেছিল?'
- 'না, আপনার বাবার কাছে রেখেছিলেন আমার ঠাকুর্দা। টাকা ধার নিয়েছিলেন কিনা।'
- 'ওঃ, তা কি নাম তোমার ঠাকুর্দার?'
- বললে কি আপনি চিনবেন? উষ্মা প্রকাশ পেল লোকটির গলায়। 'আমার বাবাকে আপনি চিনবেন।'
- 'কি নাম?'
- 'তারাপদ, চন্ডীপুরের। মাষ্টার মশায় হিসেবে লোকে চিনত ওনাকে।'
- 'তুমি তারার ছেলে?' গলা বুজে এল প্রায় ভুজঙ্গর। তারাপদ, তারাপদ! স্মৃতির ভারে প্রায় ডুবে গেলেন। স্কুলের কতগুলো বছর কেটেছে একসঙ্গে। জমিদার বাড়ীর রমরমা ছিল না, তাই তারাপদ বা অন্য ছেলেদের সঙ্গে মিশতে কোন সমস্যাই ছিল না। সেই তারাপদর ছেলে ঢুকেছে রাতের অন্ধকারে তাঁর ঘরে দলিল ফেরৎ পেতে? ভারী মন খারাপ হল ভুজঙ্গর।
মশারী তুলে বাইরে বেরিয়ে এলেন ভুজঙ্গ। সলতে কমানো হ্যারিকেনটা উস্কে দিয়ে ডাকলেন - 'এদিকে এস।' অন্ধকার ঠেলে একজন এগিয়ে এল। কালো, লম্বা ছিপছিপে একটি ছেলে, সারা গায়ে তেল চকচক করছে। কাছে আসতেই নিম তেলের গন্ধ নাকে এসে লাগল। অনেক্ষণ তাকিয়ে দেখলেন ছেলেটিকে। তাঁর ছেলের চেয়ে একটু বয়সে ছোট হবে। স্কুলের পর ছাড়াছাড়ি, তারপর মাঝে মধ্যে এ বাড়ীর উৎসবে আসত তারাপদ ছেলের হাত ধরে। হঠাৎ করে সব যোগাযোগ আবার বন্ধ হয়ে গেল। ভুজঙ্গও আর খোঁজ নেননি। কেন নেননি এত দিন পরে তার আর কোন উত্তর পেলেন না নিজের থেকে।
- 'কি নাম তোমার? এবার নিশ্চয় নাম বলতে দ্বিধা নেই?'
- 'দ্বিজেন। বাবা মা দিজু বলেই ডাকতেন।'
- 'ডাকতেন? নেই আর?' গলা ভারী হল ভুজঙ্গর।
- 'বাবা মারা গেছেন ছ’বছর হল। মা মারা গেছেন গত মাঘে। একবছর হয়নি এখনো।'
- 'আমার কাছে দলিল আছে তোমাদের বাস্তুর কে বলেছে তোমাকে?'
- 'মা। বাবাই কোন সময় বলে থাকবেন মাকে। মা’র চিকিৎসায় বেশ কিছু ধার হয়ে গেছে। ঋণ রেখে মা বাবাকে দায়ী রেখে যেতে চাই না।'
- 'তা দিনের বেলায় আমাকে এসে বললে পারতে, রাতের বেলায় চুরি করার দুর্বুদ্ধিটা মেনে নেওয়া যায় না।'
- 'কত বছরের দেনা, কত টাকার দেনা কিছুই জানি না। আপনি আমাকে চেনেন না। এসে বাবার পরিচয় দিয়ে দলিল ফেরৎ চাইলে আপনি দিয়ে দিতেন?' একটু ঊষ্মা ঝরল গলায় দিজুর।
- 'হয়ত দিতাম না, কারণ আমি তোমাকে চিনি না। কিন্তু এই চুরির চেষ্টা তারাপদ মেনে নিতে পারত?'
- 'ভুল হয়েছে মানছি।' গাঢ় হল দিজুর গলা। 'কিন্তু এ ছাড়া আমার পথ কিছু কি ছিল?'
ভুজঙ্গ ভাবলেন খানিক। মেনে নেওয়া যায় না, আবার ফেলে দেওয়া যায় না। কোনটা ঠিক তা বুঝে উঠতে পারছেন না। কৌতূহলী গলায় জিজ্ঞেস করলেন – 'তা কি ভাবে দলিলটা নেবে ভেবেছিলে?'
- 'অত ভাবিনি।' নিরাসক্ত গলায় জবাব দিল দিজু। তিনদিন আপনার এই জানলা দিয়ে উঁকি মেরে গেছি। বড়সড় সিন্দুকটা দেখেছি, দলিলের মত দরকারী কাগজ ওর ভেতরেই থাকবে বলে আমার বিশ্বাস।
- 'তা ঠিক।' সায় দিলেন ভুজঙ্গ। 'দলিল কেমন দেখতে তুমি জান?'
মাথা নাড়ল দিজু। জীবনে দলিল দেখেনি। হাসলেন ভুজঙ্গ। সিন্দুকটা দেখিয়ে বললেন - 'যাও খুঁজে নাও।' হ্যারিকেন নিয়ে এগিয়ে গেল দিজু। বিশাল ভারী তালা ঝুলছে, হাত দিয়ে তুলতে গিয়ে বেগ পেতে হল। মিয়ানো গলায় বলল – 'এত সাংঘাতিক ভারী তালা!'
- 'কেন তুমি তৈরি হয়ে আসনি? তুমি কি ভেবেছিলে তালা খোলা থাকবে জমিদারবাড়ীর সিন্দুকে?'
- 'না তা ভাবিনি।' বলে কোমর থেকে একটা বাঁকান তার বের করে তালার ভতর ঢুকিয়ে এদিক সেদিক ঘোরাতে থাকল। কিছুক্ষণ ঘুরিয়ে হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিল।
ভুজঙ্গ দেখছিলেন একদৃষ্টিতে। বললেন -' বাস এই নিয়ে এসেছিলে জমিদার বাড়ীর সিন্দুক খুলতে?' দিজু জবাব দিল না। অসহায় ভাবে দৈত্যাকার লোহার তালাটিকে দেখছিল। ভুজঙ্গ উঠলেন। মশারি তুলে বালিশের তলা থেকে প্রায় একফুট লম্বা একটা চাবি বের করলেন। অবাক হয়ে দেখছিল দিজু। ভুজঙ্গ দুবার ঘুরিয়ে তালা খুললেন। বললেন - 'ঠিক আছে ধরে নাও,
সিন্দুক খোলা। এবার তোমার কাজ কর। আমরা সবাই কিন্তু ঘুমোচ্ছি। দিজু সিন্দুকের পাল্লা ধরে উপরে তুলল। বেজায় ভারী। তিন বারের চেষ্টায় উঠল কিন্তু যথেষ্ট শব্দ করে। ভুজঙ্গ বললেন - 'তোমার কি মনে হয় এই শব্দে কারোর ঘুম ভাঙতো না?'
- 'তা ভাঙতো।' মেনে নিল দিজু।
- 'মেনে নিলাম এই শব্দেও কারোর ঘুম ভাঙেনি। ধরে নাও আমরা ঘুমোচ্ছি। নাও এগোও।'
হ্যারিকেন নিয়ে ঝুঁকে সিন্দুকের ভেতর তাকাতেই মাথা ঘুরে গেল দিজুর। কাগজের পাহাড়। এর থেকে একটা দলিল খোঁজা তাও রাতের অন্ধকারে? ধপ করে বসে পড়ল দিজু। ভুজঙ্গ তাকিয়ে ছিলেন। বললেন - 'কি হল?'
- 'অ্যাত্ত কাগজ! এর থেকে খুঁজবো কি করে?' আর্তনাদ শোনাল দিজুর গলা।
- 'সে কি! জমিদার বাড়ী নিয়ে তো বেশ শ্লেষ করছিলে, তাই না? তা তুমি কি ভেবেছিলে শুধু তোমাদের দলিলটা পড়ে আছে, আসবে আর তুলে নেবে?' দিজু কোন উত্তর দিল না। কল্পনা আর বাস্তবে ভারী ফারাক। কেমন যেন মনে হয়েছিল, কাজটা হয়ে যাবে। কিন্তু কোনদিন ভাবেনি এ রকমও হতে পারে। ভুজঙ্গর দিকে তাকিয়ে বলল - 'আপনি বের করে দিতে পারেন?'
- 'আমি?' অবাক গলায় বললেন ভুজঙ্গ। 'আমি কোনদিন ওই সিন্দুক খুলেই দেখিনি। কতপুরুষ ধরে জমেছে কত দলিল, হিসেব, মামলার কাগজ তার কোন ইয়ত্তা আছে।'
- 'ওতে সব রকমের কাগজ আছে? এত বছরের জমিদারির?' হতাশ হয়ে দুহাতে কপাল টিপে ধরল দিজু। 'তাহলে কি হবে কাকাবাবু?'
কাকাবাবু! ভুজঙ্গ কেমন যেন আনমনা হয়ে গেলেন। কাকাবাবু! তারাপদর হাত ধরে যখন আসত তখন ওই নামেই ডাকত ছেলেটা। কত বছর হয়ে গেল। তারাপদর আগে এখন চন্দ্রবিন্দু, আর তিনি এখনও টিকে আছেন ভাঙ্গা জমিদারীর একমাত্র ওয়ারিশ হয়ে। তার দিকে তাকিয়ে আছে ছেলেটা। কিছু একটা করতে হবে। দিজুর দিকে ফিরলেন, বললেন - 'এক কাজ কর। সিন্দুক থেকে সব কাগজ গুলো এক এক করে বের করে এই মেঝেতে রাখো। সাবধানে বের করবে কারন কোন কাগজের কি অবস্থা জানা নেই।'
- 'এই গোটা ঘরটাতো ভরে যাবে কাকাবাবু। হাঁটা চলা করতে পারবেন না কেউ।'
- 'তা যাবে। আর হাঁটা চলার লোক বলতে তো কয়েকজন। ও ঠিক ম্যানেজ হয়ে যাবে। নাও, শুরু কর। ভোর হয়ে আসছে।'
দিজু ঘরটাকে একবার ভালো করে পরখ করে নিল। জমিদার বাড়ী। এ ঘরে আগেও এসেছে, তখন ছোট ছিল। হাল্কা স্মৃতি। একদিকে বিছানা। নিভাননী তখনো ঘুমিয়ে। দ্রুত হাত ঘরটাকে গোছানো শুরু করল এমনভাবে যে কিছুক্ষণের মধ্যে একটা ছোট বৃত্ত তৈরি হয়ে গেল। ভুজঙ্গ হ্যারিকেন তুলে ধরলেন, দিজু এক এক করে গোছা গোছা কাগজ সিন্দুক থেকে বের করে মেঝেতে সাজাতে লাগল। কাজ যখন শেষ হল তখন সূর্য উঠে গেছে। ঘরের মাঝখানে
কাগজের পাহাড়। ঘেমে গেছে দুজনে। দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে হাসল, আংশিক সফলতার হাসি। এখনো অনেক কাজ বাকি। নিভাননী ঘুম ভেঙ্গে হঠাৎ ঘরের মধ্যে কাগজের পাহাড়ের পাশে ভুজঙ্গকে বসে থাকতে দেখে ভয়ানক অবাক হলেন। মশারির ভেতর থেকে বললেন, স্বপ্ন দেখলুম আমাদের ঘরে কার্তিক এসেছে। এতো দেখছি কাগজ। এত কাগজ কোত্থেকে এল গো রাতারাতি? ভুজঙ্গ হাসলেন। বললেন, - 'তোমার স্বপ্নের কার্তিক ওই যে বসে আছে।' হাত দিয়ে একপাশে বসা দিজুকে দেখিয়ে দিতেই নিভাননীর দুচোখ কপালে ওঠার যোগাড়। আর ওই কার্তিকই সিন্দুক থেকে সব কাগজ টেনে বের করেছে।
- 'কি হবে এ কাগজ দিয়ে?' নিভাননীর বিষ্ময় কাটে না। 'আর এই ছেলেটা কাদেরগো?'
অনেক আবর্জনা জমে ছিল সিন্দুকে। পরিষ্কার করতে হবে। তিনটে জমি ছাড়া আমাদের তো আর কিছু নেই। আর এদের একটা দলিল। বাকী সব পুড়িয়ে দেব। দিজুর দিকে ফিরলেন, বললেন - 'আজ বাড়ি যাও। খেয়েদেয়ে একটা টানা ঘুম দিয়ে কাল সকাল সকাল এস। কাল থেকে কাজশুরু। এক একটা করে পড়ে পড়ে দেখতে হবে। সময় লাগবে। এখানেই থাকবে কদিন, কাজ শেষ করে তোমার কাগজ নিয়ে বাড়ী যেও। নিভাননীর দিকে ফিরে বললেন, বলব সব বলব। চল দেখি, হরিঠাকুরের চা কতদুর। নিবারণ এল না এখনো।' বাগানে চেয়ার পেতে বসে আছেন ভুজঙ্গ। বাতাসে শিউলি ফুলের গন্ধ। ঘোষ পাড়ায় ঢাকের বাজনা, প্রতিমায় মাটি পড়ছে। মা আসছেন। নিবারণ এক কাপ চা দিয়ে গেছে। দু’সপ্তাহ কি ভাবে কাটল টেরও পেলেন না। কি সাঙ্ঘাতিক উত্তেজনা। কত মামলার রায়, উকিলের চিঠি, সাক্ষ্য-প্রমানের খরচের হিসেব, ধার-দেনা-সুদ-বন্ধক, জমি কেনা-বেচার নানান খতিয়ান, জমিদারির আয়-ব্যয়। মাথা ঘুরে যাওয়ার দাখিল। ভুজঙ্গ জীবনে নিজে এত সব কোন কিছু করেননি আর হিসেবও রাখেননি, সিন্দুকের ভেতর এত তথ্য প্রমাণ আছে তা কোনওদিন স্বপ্নেও ভাবেননি। কত বছর আগের সে সব মুহূর্তগুলো যেন সময়ের সীমা পেরিয়ে এসে চোখের সামনে ভাসছিল। দিজুতো নাওয়া খাওয়া ভুলে ডুবে ছিল কাগজে। অদ্ভুত নেশার মত পেয়ে বসেছিল, একটু সময় পেলেই বসে যেত। এ দু’সপ্তাহে এ বাড়ীরই একজন হয়ে গেল দিজু, নিভাননীর স্বপ্নে পাওয়া কার্তিক। ছেলে-মেয়ে দুরের, তাই দিজুই আস্তে আস্তে ঢুকে পড়েছিল সেই শুন্যস্থানে, অদ্ভূত মায়া। দিজুর দলিল পাওয়া গেছিল। ভিটে বিক্রী করে ধার-দেনা শোধ করে হাতে আরও প্রায় পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা ছিল। ভুজঙ্গর হাতে পুরোটা তুলে দিয়ে বলেছিল - 'কাকাবাবু, আমি কারোর দেনা রেখে যেতে চাই না। হিসেব কষলে অনেক টাকা হয়, অত টাকা পাবো কোথায়? যা আছে তাই নিয়ে আমাদের সবাইকে ঋণমুক্ত করুন। কম টাকা নয়। একসঙ্গে অত টাকা দেখেননি, যদিও জমিদার বংশের উত্তরাধিকারী। অনেক্ষণ তাকিয়ে থেকে চোখ সরিয়ে নিয়েছিলেন। বেশ আছেন, কি দরকার নতুন করে জড়িয়ে পড়ার। তা ছাড়া টাকা তো আর তিনি ধার দেননি, নেওয়ার অধিকারও তাঁর উপর বর্তায় না। দিজুকে জিজ্ঞেস করেছিলেন - 'কোথায় যাবে ঠিক করেছ? ভিটে তো বিক্রি করে দিলে।' উত্তরে একগাল হেসে ফেলেছিল দিজু। রবি ঠাকুরের কবিতা তুলে এনেছিল- 'তাই লিখে দিল বিশ্বনিখিল দু’বিঘার পরিবর্তে।' কিন্তু যাওয়া আর হয়ে ওঠেনি দিজুর। নিবারণ এসে ছোঁ মেরে তুলে নিয়েছিল টাকাটা। চার নম্বর ঘর সারাই হল। নিবারণ নিজে থেকে করাল। তারও বয়স হচ্ছে, একজন ছোকরা ওয়ারিশ থাকা অত্যন্ত জরুরি। নিভাননীও খুশি হয়েছিলেন। কার্তিক ওরফে দিজু পাকাপাকি ভাবে এ বাড়ীর চার নম্বর ঘরের পাঁচ নম্বর সদস্যপদ পেয়ে গেল। সিন্দুকের কাগজের পাহাড় থেকে একটা ছোট অতি সাধারণ দলিল পাওয়া গেছিল। উকিলের থেকে বুঝে এসেছিল দিজু। ভুজঙ্গর কোন উৎসাহ ছিল না, ছিল শুধু দিজুর, নিবারণের। দলিলটা মধ্য কলকাতার একটা মাঝারী বাড়ীর। কোন এক সাহেব টাকার অভাবে বিক্রি করে দিয়েছিল ভুজঙ্গর কোন এক ঊর্ধতন পুরুষকে। উকিলের থেকে দালাল, দালালের থেকে প্রোমোটার। দেড়কোটির একটু বেশী দাম পাওয়া গেল। অনেক টাকা। ভুজঙ্গ বিহ্বল হয়ে বললেন - 'এত টাকা নিয়ে আমি কি করব?' দিজু বলল - 'গ্রামের মানুষদের একটু চিকিৎসার ব্যবস্থা তো করা যেতে পারে। এতটা জমি, এতগুলো টাকা, একটা কিছু কাজে লাগুক। কি বলেন কাকিমা?' নিভাননী মাথা নাড়লেন।
খবর রটে যেতে দেরী হল না। জমিদার বাড়ীতে স্বাস্থ্যকেন্দ্র! গ্রামের মানুষের মুখে হাসি আর ধরে না। কোবরেজ অন্নদাচরণ সবার আগে। জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন - 'কাজের মত কাজ করলি ভুজঙ্গ।' জমিদারের রক্ত বলে কথা। তবে হুল ফোটাতে ছাড়লেন না। বললেন – 'আগে মশা দিয়ে রক্ত চোষাতিস, এখন সিরিঞ্জ দিয়ে। আগে ফোঁটা ফোঁটা, এখন বোতল বোতল।' বলে হো হো করে হাসলেন। ভুজঙ্গর আজ আর কোন খারাপ লাগল না। বললেন – 'তোকে দিয়েই শুরু করাব, দেখিস।'
তাকিয়ে ছিলেন ভুজঙ্গ। দিজুর দিন-রাত এক হয়ে গেছে। শুনশান ভুতুড়ে জমিদার বাড়ী লোকে লোকে ছয়লাপ। চিৎকার চেঁচামেচি মেশিনের ঘড়ঘড়, এ যেন কয়পুরুষ আগের জমিদার বাড়ী। বোধনের দিন স্বাস্থ্যকেন্দ্র উদ্বোধন হবে। কাজ চলছে পুরোদমে। খবর কাগজেও বেরিয়েছে। অনেক ডাক্তার যারা এ গ্রাম থেকে পাশ করে দেশ বিদেশে ছড়িয়ে আছে, তারাও যোগাযোগ করেছে। আসবে তারা মাঝে মধ্যে, সবার রক্তেই লুকিয়ে থাকে কম বেশী মানুষকে ভালোবাসার ইচ্ছে। সবাই স্বার্থপর নয়, অর্থলোলুপ নয়। অবাক হচ্ছেন ভুজঙ্গ, চেনেন না এদের, দেখেননি কোনদিন। কিন্তু আজ সব এক ছাতার তলায় এসে জড় হয়েছে। অদ্ভুত ভালোলাগায় বুক ভরে যাচ্ছে ভুজঙ্গর, বুক ভরে গেছে নিভাননীরও। ছেলে-মেয়ে খবর পেয়েছে, আসবে জানিয়েছে। খুশি উপছে পড়ছে। পূজো আসছে, মা আসছেন। এবার অন্যভাবে, অন্যরূপে।
Comments
Top
নিত্যহরির
কথা
দেবদাস ভট্টাচার্য্য
ডালাস, টেক্সাস
- কি পাব বলত ঠাকুর সোজা কথায়? ঘোলাটে চোখে তাকাল জগাই। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। টলছে পা।
মৃদু হাসলেন নিত্যানন্দ মহাপ্রভু। আয়ত দৃষ্টি মেলে ধরলেন, মহাসাগরের গভীর নীল জলের সম্মোহনী টানে উদ্ধত দুর্বিনিত দুই মাতাল জগাই-মাধাই প্রায় ভেসে যায় আর কি! চোখ নামিয়ে নিল দুজনে। ও চোখে কি অত সহজে চোখ রাখা যায়? মাধাই ফিস ফিস করে জগাই কে বল্ল – সব্বোনেশে চোখ রে জগাই, তাকাস নে। যাদু করছে আমাদের। কাল কে তুই মেরে কপাল ফাটিয়ে দিলি, কি রক্ত, কি রক্ত ! আজ দ্যাখ সেই আমাদেরকেই আবার পথে আটকেছে!
জগাই ভারী বিরক্ত হল মাধাইর কথায়! যাদু না ছাই। সে ক্ষমতা থাকলে কালকে অমন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মার খায়? মাধাইর দিকে তাকিয়ে বল্ল – ফিস ফাস আমার ভাল লাগে না মাধাই। গোটা নদীয়া আমাদেরকে চেনে। জগাই কাউকে ভয় পায় না, জগাইকেই সবাই সমঝে চলে।
জগাই দু’হাত আকাশে তুলে আস্ফালন করে। আমার কথার জবাব দিলে না তো ঠাকুর? কি পাব আমরা তোমার আখড়ায় যোগ দিলে?
স্মিত হাসলেল নিত্যানন্দ। দুই মাতালের কাঁধে হাত রাখলেন। শিউরে উঠল দুই মাতাল। জগাইর কথার পুনরাবৃত্তি করলেন – কি পাবে?
জগাই একটু অস্থির হয়ে বল্ল – সেই কথাই তো জানতে চাইছি তখন থেকে। একটু খোলসা করে দাও না ঠাকুর।
আকাশের দিকে তাকিয়ে দু’হাত ছড়ালেন চির পরিচিত ভঙ্গিমায় –মদগুরু মৎসের ঝোল পাবে, চির যুবতীর কোল পাবে।
একটা হেঁচকি তুলল মাধাই। জগাইর হাতের মাটির ভাঁড়ে তখনো কিছু অবশিষ্ট কারণ বারি। সেদিকে একবার সতৃষ্ণ দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে মাধাইর কাছ ঘেঁষে এল জগাই, আস্তে আস্তে বল্ল – আমি যা শুনলুম তুইও কি তাই শুনলি?
মাধাই দুর্বৃত্ত মাতাল হলেও জগাইর মত রগচটা নয়। এক আধটু বিচার বিবেচনা করে তবে কিছু বলে। ধূলো ঘামে ভেজা ঘন কালো চুলে হাত ঢুকিয়ে ঘাঁটতে ঘাঁটতে বল্ল – শুনতে আমরা কেউই ভুল করিনি। কিন্তু কোথাও একটা প্যাঁচ আছে, ধরতে পারছি না।
জগাইর চোখ বড় বড় হয়ে গেল – তাহলে ঠিকই শুনেছি বল। কিন্তু মদগুরু কথাটারমানে কি বলত মাধাই? তুই পিতাম্বর আচায্যির টোলে আমার চেয়ে দুবছর বেশী পড়েছিস।
শব্দটা কোনদিন পিতাম্বর আচায্যির টোলে পড়েছে বলে মনে পড়ল না, পড়লেও তা কি আর মনে থাকে? একবার ভাবল, এই ঠাকুরকে একবার জিজ্ঞেস করে। কিন্তু জগাইর কাছে মান থাকে না। বল্ল – খুব শক্ত শব্দরে জগাই। আমার সঙ্গে যারা পড়েছিল তাদেরকে জিজ্ঞেস করে দেখিস কেউই বলতে পারবে না।
জগাইর চোখ বুজে এসেছিল, বল্ল – একটা সমস্যা থেকে আর একটা সমস্যা বাড়াসনে মাধাই। তুই না জানিস ঠাকুরকে জিজ্ঞেস কর।
মাধাইর শ্লাঘাতে ঘা পড়ল। আসহিষ্ণু গলায় বল্ল – আমি কি বলেছি, আমি জানি না। টোলের কথা তুললি বলেই বললাম। সব কিছু কি আর টোলে শেখায়?
নিত্যানন্দর মধ্যে ঈশ্বর আবেশ এসে গেছে। হরি নামের মাদকে চোখ ঢুলু ঢুলু, দুহাত আকাশের দিকে তুলে মন্দ্রস্বরে হরি নাম করে চলেছেন।
মাধাই সেদিকে আড়চোখে তাকিয়ে বল্ল –মদগুরু মানে মাগুর, সংস্কৃত শব্দ। তুই এসব বুঝবি না।
জগাই বিড় বিড় করে বল্ল – কি বলেছিল ঠাকুর পুরোটার মানে করে দেত।
মাধাই হাতের ভাঁড়টা মুখে উপুড় করে দিল, কিছু ছিল না। বিরক্ত হয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল – এই দ্যাখ, তোর ওই রসিকা মাগী কি ঠকান ঠকাল। কড়কড়ে টাকা দিলুম আর দু তিন চুমুকেই সব শেষ? কালকে এর একটা বিহিত করবই জগাই, তুই কিন্তু বাধা দিবি না। মাঝে মধ্যে ধার দেয় বলে কি মাধাইর মাথা কিনে নিয়েছে নাকি?
জগাই নিজের ভাঁড়টা মাধাইর দিকে এগিয়ে দিল, বল্ল – নে, এখান থেকে দুচুমুক মেরে দে। আরা যে কথাটা জিজ্ঞেস করেছিলাম তার জবাবটা দে দিখি।
মাধাই মুখে একটা তাচ্ছিল্যর শব্দ করে বলল – থাক, থাক। আমাকে দিতে হবে না। তুই খা। একই টাকা দিলুম, একসঙ্গে খাওয়া শুরু করলুম, তোরটা থাকে কি করে?
জগাই,মাধাইর সঙ্গে তর্ক করে কোনদিন পারে না। আজকেও হাল ছেড়ে দিল। বল্ল – ঠিক আছে, কাল ও মাগীকে ধরব। তার আগে এই ঠাকুরের সঙ্গে একটা হেস্তনেস্ত করে নিই।
মাধাই বল্ল – স্রেফ ভুজুং ভাজুং দিচ্ছে জগাই। মাগুর মাছের ঝোল আর চিরযুবতীর কোল দেবে বললেই হল! একি রাস্তা ঘাটে গড়াগড়ি দিচ্ছে নাকি?
জগাইর চোখ খুলে গোল্লা গোল্লা হয়ে গেল। বল্ল – বলিস কিরে মাধাই, চিরযুবতীর কোলে বসে মাগুর মাছের ঝোল দিয়ে ভাত? আহা রে!
টপ টপ করে কয়েক ফোঁটা জল জগাইর জিভ দিয়ে নিচে পড়ল। খেতে বড় ভালবাসে। মাধাই মনে মনে গজরাল খানিক। একেবারে মোক্ষম জায়গায় ঘা দিয়েছে ঠাকুর। কিন্তু জানল কি করে?
জগাইর দিকে তাকাল মাধাই। ঢুলু ঢুলু চোখ। কি ভাবছে জগাই তা বেশ জলের মতই স্পষ্ট। তাকাল ঠাকুরের দিকে। তাঁর চোখও ঢুলু ঢুলু। দুজনে দু আবেশে বিভোর। কিন্তু বিপরীত মেরুর। বুঝতে পারল না মাধাই। জগাইকে একটা রাম চিমটি দিল মাধাই। অল্প চোখ খুলে হাসল জগাই। বল্ল – বেশ লাগছে রে মাধাই। তুই একবারটা ভাব দেখি, গরম গরম সাদা চালের ভাত, মাগুর মাছের ঝোল, আর খাচ্ছিস কোথায় বসে একবার ভেবে দ্যাখ – সুন্দরী যুবতীর কোলে বসে। অহো, কি কাথাই আজ তুমি শোনালে ঠাকুর!
তারপর নিজের ভাঁড়ের দিকে দৃষ্টি চলে গেল। বল্ল – মাধাই, ঠাকুর তো এটা নিয়ে কিছু বলেনি। তাই না? এতো সোনায় সোহাগারে মাধাই। দিব্যি খেয়ে দেয়ে দু চুমুক টেনে আবার সুন্দরী যুবতীর কোলে শুয়ে পড়া। যুবতীদের দিয়ে কি আর ঠাকুর ফিরিয়ে নেবে? তুই কি বলিস মাধাই?
জগাইর চোখ আবার ঢুলু ঢুলু হয়ে গেল।
মাধাইর বিশ্বাস হচ্ছিল না। সতর্ক হয়ে চলে সে। কোথাও একটা ফাঁক আছে, এই ঠাকুর একটা মস্ত বড় চালিয়াত সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। সাবধান না হলে ডুববে সবাই, কিন্তু জগাই তো ডুবে বসে আছে। আবার একটা চিমটি কাটল মাধাই। জগাইর চোখ একটু ফাঁক হল। বল্ল – কিছু বলবি মাধাই?
মাধাই বলার জন্য উদ্গ্রীব। হিস হিস করে বল্ল – ঠাকুর বল্ল আর তুই বিশ্বাস করে নিলি। একটু খতিয়ে দেখবি না?
খতিয়ে দেখা জগাইর পোষায় না। বল্ল – কি দেখব আর মাধাই? ঠাকুর মানুষটা ভাল। আমাদের কি ভালো লাগে তা খোঁজ নিয়ে আমাদের বলেছে, যাতে করে আমরা আর কোনদিন ঠাকুরের উপর হামলা না করি। ঠাকুরের আখড়া দেখেছিস জগাই? মাধাই বোঝানোর চেষ্টা করে। সকাল হলেই হরিবোল হরিবোল করতে করতে
ঝোলা নিয়ে সব বেরিয়ে পড়ে ভিক্ষায়। ভিক্ষাতে কি দেয়, জগাই? আর যাই দিক মাগুর মাছ কি দেয়?
জগাইর চোয়াল ঝুলে পড়ে। আমতা আমতা করে বলে – ওদের কোন পুকুর টুকুর তো থাকতে পারে। কেউ হয়ত দান করেছে। কি পারে না?
তা পারে। মাধাই স্বীকার করে। সেখান থেকে প্রতিদিন আমাদের জন্য মাগুর মাছ ধরবে? কে ধরবে জগাই?
প্রতিদিন না হলেও মাঝে মধ্যে পাওয়া গেলে ক্ষতি কি বল? সাফাই গায় জগাই। মাছ প্রতিদিন না পেলেও পেতে পারি। কিন্তু একবার একটি সুন্দরী যুবতী পেলে সেতো আর পালিয়ে যাবে না।
আখড়ার পাশ দিয়ে আমরা কত বার গেছি। মাধাইর ধন্দ কাটে না। একেবারে হা হা করে খোলা। আজ পর্যন্ত কোন মেয়েমানুষ আমার চোখে পড়েনি। তুই দেখেছিস জগাই?
জগাই স্বীকার করে সে দেখেনি। তা হলে? দুই মাতাল ঘোলা চোখে দু’জনের দিকে তাকিয়ে থাকে।
মাধাই ফিস ফিস করে – এই আমি বলে রাখলুম জগাই, এ মানুষটা সুবিধের নয়।
তা হলে কি মিছে কথা কইছে আমাদের? ফোঁস করে ওঠে জগাই, পুরনো মাতাল জেগে ওঠে। মারবো এই ভাঁড় ছুঁড়ে আবার?
মাধাই শিউরে ওঠে – না না আর মারিস নে। এখনো দ্যাখ কালকের কাটা দাগটা দ্গ দ্গ করছে। মিছে কথা হয়ত কইছেন না, কিন্তু কথার কিছু মারপ্যাঁচ থাকতে পারে।
চোখ খুললেন নিত্যানন্দ। নিখাদ ভালবাসা, করুণার টলটলে দিঘি দুচোখে। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে দুই মাতাল, ঘোলা চোখে ঘোর লাগে। এগিয়ে আসেন কাছে, আরো কাছে। প্রবল আকর্ষণে টেনে নেন দুই মাতালকে নিজের বুকে। বাধা দেওয়ার ক্ষমতা কোথায়? বিশাল চেহারার দুই দুর্বিনীত মাতাল যেন নেহাত দুই শিশু। শান্ত স্বরে বলেন – যা বলেছি, তার সবই পাবে। কিচ্ছু বাদ যাবে না।
বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় কিন্তু ঠেলে ফেলতেও পারে না। মিন মিন করে জগাই। মিছে কথা কইছেন না তো?
হাসেন নিত্যানন্দ। আমাদের কি মিছে কথা বলা সাজে?
কিন্তু বড় ঠাকুর? মাধাইর দ্বিধা কাটে না। আপনার রক্ত দেখে তাঁর সেই তীব্র অগ্নি দৃষ্টির কথা ভাবলে আমি এখনও শিউরে উঠি। অভয় দিলেন নিত্যানন্দ – ওঃ, গৌ্রাঙ্গ ঠাকুরের কথা বলছ? তাঁর যে দয়ার শরীর। ও আমি সামলে নেব।
থামল নিত্যচরণ। ভাল গল্প বলে। রবিবারের দুপুর। সোফায় আধ শোওয়া হয়ে ঠ্যাং নাচাচ্ছিল হরিচরণ। প্রতি রবিবারের একই চিত্র। আজকেও অন্যথা নয়। দুই বন্ধু, কিন্তু নিত্যচরণ বিপত্নিক। রবিবার হলেই হানা দেয়। নিত্যচরণের একটু কিন্তু ছিল, কিন্তু হরিচরণের বউ রাধা রাজি করিয়েছে। সপ্তাহের ছ’টা দিন চাকরের হাতে রান্না খেয়ে কাটাক, একটা দিন না হয় একটু মুখ পালটানো। পাড়ায় গলায় গলায় দু বন্ধুকে কেউ কেউ বলে গৌর-নিতাই, কেউ কেউ বলে জগাই-মাধাই। মদ্যপ কেউ নয়, আবার ধর্মপ্রাণ কেউ নয়। তবু এটাই এদের ডাক নাম। একা থাকলে ঠিক নামে ডাকে, কিন্তু জুটি বাঁধলেই বিপদ।
আজ জগাই-মাধাইর গল্প শোনাচ্ছিল নিত্য। আর সোফায় শুয়ে শুয়ে শুনছিল হরি। নিত্য থামতেই বল্ল – ধাঁধা টা কিন্তু থেকেই গেল।
কোন ধাঁধা ? সবটাই তো জলবৎ। নিত্য আড় ভাঙ্গে।
মদগুরু মাছের ঝোল আর চিরযুবতীর কোল। আড়চোখে পর্দার দিকে তাকাতে ভুলে না হরি। শ্রীমতীর চরণ দুখানা না দেখা গেলেই মঙ্গল। রাধাকে হরি ওই নামেই ডাকে, শ্রীকৃষ্ণও ওই নামে ডাকতেন শ্রীরাধাকে।
নিত্য হাসে। বলে – মাধাই ঠিকই ধরেছিল। নিতাই ঠাকুরের কথার চাল ওটা। মদগুরু মানে শ্রীগুরু। শ্রীগুরুর বচনামৃতকেই মদগুরু মাছের ঝোল বলেছিলেন নিত্যানন্দ।আর চিরযুবতী? হরি উৎসুক। আহা কি সুন্দর টোপ।চিরযুবতীর কোল। কে না টলবে বল? এখনই শুনলে ভেতরটা কেমন গুড় গুড় করে। নিমিলিত চোখে কড়িকাঠের দিকে তাকায় হরি। কেমন যেন একটা ভাব আসা ভাব। ঠ্যাং নেচেই চলেছে তির তির করে।
তাই নাকি? একেবারে বিষ্ফোরণ ঠিক সময়ে। পর্দা ঠেলে ঢুকেছে রাধা। যুবতীর নাম শুনলে বুকের ভেতর গুড় গুড় করে তাই না?
তড়াক করে উঠে পড়েছে হরি। সব ভাব উধাও। দেখল খর চোখে তাকিয়ে আছে রাধা। সাফাই গাইতে চেষ্টা করল হরি – ওটা একটা উপমা আর কি। তুমি আছ, বুক কি আর গুড় গুড় করতে পারে? চা’টা তো নিয়েই আসবে, একটু ভাব আসছিল, গেল সব চটকে।
চোখ বুজে পড়ে ছিল নিত্য। রাধা-হরির মাঝে নাক গলায় না খুব একটা, তবে রাধার হার অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়লে রাধার পক্ষ নিয়ে সওয়াল জবাব করে।
চোখ বুজেই একটা ছোট্ট ফোড়ন কেটে দিল – মিথ্যে কথা বলতে নেই হরি। বউদির মন রাখতে ওরকম মিথ্যে কথা নাই বা বললি।
মিথ্যে কথা? আকাশ থেকে পড়ে হরি। মিথ্যে কথার তুই কি দেখলি নিত্য? ঝাঁঝিয়ে ওঠে হরি।
দেখলাম বলেই তো বউদিকে সাবধান করে দিলাম। নিত্য নির্বিকার। বউদি তুমি নিশ্চয় শুনেছ হরির কথা – তোমাকে দেখে নাকি ওর ভাব চটকে গেল! ছি ছি, আমি ভাবতেও পারি না।সর্বনাশ করিসনি নিত্য, তোর ধর্মে সইবে না।
তোর বউ নেই বলে আমার বউর উপর নজর দিবি?
আহা কথার কি ছিরি দ্যাখ। তেতে ওঠে রাধা। নজর দেওয়া আবার কি? আমি কি আম তেঁতুল না মিষ্টি? বয়স তো হল, কথার লাগাম দাও।
নারদ, নারদ। দু’হাত উপরে তুলে নাচের ভঙ্গিতে শরীর দুলিয়ে দিল নিত্য। লাগিয়ে দে মা, লাগিয়ে দে। জয় তারা।
মেয়েদের সম্মান করতে শেখ হরি। বউদি ওকে ছেড় না।
বেরো, বেরো শালা আমার বাড়ী থেকে। রবিবারের দুপুরে হাজার টাকা কেজির পাঁঠা মাংসের ঝোল টেনে নারদের রোল নিয়েছিস? আমাদের জন্ম জন্মান্তরের সম্পর্ককে তুই ভেঙ্গে দিতে চাইছিস? গজরায় হরি।
তুমি চেপে বসে থাকো ঠাকুরপো, একদম নড়বে না।
চেপে বসে আছিই বউদি। চা’টা খেয়ে নড়ব, তার আগে নয়। কিন্তু হরির ব্যাপারটা ফয়সালা করার দরকার।
কালসাপ, দুধ কলা দিয়ে কালসাপ পুষেছ শ্রীমতী। রাধার দিকে ঘুরে যায় হরি। একঘরে হয়ে যাচ্ছে। খাল কেটে কুমির এনে ঢুকিয়েছ। আমাদের সুখের সংসার ভেঙ্গে দিতে এসেছিস শালা? তোকে এ বাড়ী থেকে তাড়াব আমি।
কি করে তুমি ঠাকুরপোকে তাড়াও আমি দেখব। ঝাঁপায় রাধা। কাউকে এভাবে কেউ বলে?
ও নিয়ে তুমি মন খারাপ কর না বউদি। অভয় দেয় নিত্য। হরি বল্লেও থাকব, না বল্লেও থাকব। কিন্তু তোর ব্যাপারটা কি বলত হরি? নারী কি ভোগের জিনিষ? মনে পাপ রাখতে নেই। মন-মুখ এক কর।
কোনকালে ছিল না ঠাকুরপো, আর আজ এই বুড়ো বয়সে তার কি কন পরিবর্তন হয়? আমি আশাও করি নে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে হরির পাশে সোফায় বসে পড়ল রাধা।
আমি হাল ছাড়িনি বউদি। ফাগুন মাসের দিকে তোমাকে আর হরিকে নিয়ে একবার নবদ্বীপ যাব। নিত্যানন্দ মহাপ্রভু আর নেই, কিন্তু অনেক আখড়া আছে। তার কোন একটাতে ভর্তি করে দেব হরিকে। আর তুই আমার বউকে নিয়ে সটকাবি। হরি-রাধার বদলে নিত্য-রাধা, তাই না? ছি ছি, কি কথা। কানে আঙ্গুল দেয় নিত্য হাসতে হাসতে। অবশ্য তোর idea টা খারাপ নয়। তোর এখন নিজেকে শুদ্ধ করার সময় এসেছে, আত্মা শুদ্ধি। মনে তোর বড় পাপ হরি। শ্রীহরির পায়ে নিজেকে সমর্পণ কর। তাহলে সব পাবি।
কি পাব নতুন করে? চোখ বুজে বিড় বিড় করে হরি।
“কি পাব” – নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর কাছে জগাইর প্রশ্ন আবার উঠে আসে এত বছর পরে, এক রবিবারের দুপুরে এক সাধারন মানুষের কাছে আর এক সাধারন মানুষের প্রশ্ন হয়ে, নিত্যচরনের কাছে হরিচরনের প্রশ্ন। রাধাও তাকিয়ে থাকে নিত্যচরনের দিকে। পরিবেশটা কেমন যেন পালটে যায়। তিনজনে চুপচাপ।
হঠাৎ নিত্য উঠে দাঁড়ায়। দু’হাত উপরে তোলে গৌ্র-নিতাইর সেই চিরায়ত ভঙ্গিমায় – কি পাবি হরি? চিরযুবতীর কোল পাবি। এই পৃথিবীতে কোন নারী চিরযুবতী থাকতে পারে? তুই কি বোকা রে হরি। এটা বুঝতে পারলি না? চিরযুবতী হল ধরিত্রী, শস্য শ্যামলা পৃথিবী, তার কোন জরা নেই, চিরসুন্দরী সে। মৃত্যুর আগেও তার কোলে, মৃত্যুর পরেও তার কোলে।
Comments
Top
স্মৃতিভ্রংশ
দেবদাস ভট্টাচার্য্য
ডালাস, টেক্সাস
কিছুদিন হল সমস্যটা দেখা দিয়েছে। চট করে কোন কিছু মনে করতে পারেন না অবনী। বয়স ৭৩ হল। সব কিছু ঠিক আছে। খিদে হচ্ছে ঠিকঠাক, প্রতিদিন দু-কিলোমিটার পালা করে হাঁটছেন একটুও না হাঁপিয়ে, বাগানের মাটি কুপোনো থেকে শুরু করে আগাছা বাছা, জল দেওয়া, নিড়েন দেওয়া। ভুবন মালি আছে বটে, তবে কে মালি আর কে মালিক তা বোঝা যায় না। অবনীকে রীতিমত ধমক দিয়ে কাজ করায় ভুবন। খুরপি এদিক ওদিক চলে গেলে ভয়ানক ধমক খান অবনী।
- ‘কত্তাবাবা, পরশুও তুমি ঠিক এরকম করে চালিয়েছিলে খুরপি। গন্ধরাজ গাছটা এখনো সেরে ওঠেনি। কতটা দূর থেকে নিড়েন দেবে তা দেখিয়ে দিয়েছি। মনে থাকে না কেন বলো তো?
ধমক খেয়ে আমতা আমতা করেন অবনী। বলেন - বলেছিলি বুঝি? মনে পড়ছে না রে। আজকাল সব ভুলে যাচ্ছি কেন বলতো?
ধুতিলাল অনেক সময় এই মুহূর্তগুলোতে এসে পড়ে চা নিয়ে। ভুবনকে এই মারে কি সেই মারে। কোনকালে বিহারের ছাপড়ার বাসিন্দা ছিল মনে পড়ে না। ৩৬ বছরে সব মিলিয়ে বার চারেক গেছে। বৌ মারা যাবার পর আর যায়নি। এখন ছেলে মেয়ে নাতি নাতনি নিয়ে ভরা সংসার ওখানে। ধুতিলালের কোন টান নেই। এখানেই বেশ থাকে। রেগে গেলে বাংলা বন্ধ, ভোজপুরী ছুটতে থাকে। ভুবন আবার উড়িষ্যার। রাগলে সেও কম যায় না। উড়িয়াতে চিল চিৎকার। বেশীরভাগ সময় ঝগড়াটা দশ-পনেরো মিনিটের বেশী স্থায়ী হয় না। ভুবনের একটু শ্বাসের টান আছে। কাশী শুরু হয়। কাশতে কাশতে বসে পড়ে। ঝগড়া থামিয়ে তখন ধুতিলাল দৌড়ায় জল আনতে। প্রতিপক্ষ এত অল্পে রণে ভঙ্গ দিলে ঝগড়া জমে কি করে? অবনী বা ভাগ্যলক্ষ্মী কেউ আজকাল আর ঝগড়ার মাঝখানে পড়ে থামানোর চেষ্টা করেন না, আগে করতেন। আজকেও তাই ঘটল। অবনীকে ভুবনের ধমকটা ঠিক হজম করতে পারেনি ধুতিলাল, তবে সেটা অবনীকে ভালোবেসে নয়। কত্তাবাবার কাছে ভুবন মান্যি গন্যি লোক হয়ে ঊঠছে আর সে যেই জায়গায় ছিল সেই জায়গায়। বয়সে ধুতিলাল বড় অবনী এবং ভুবনের চেয়ে। তাই স্বাভাবিক চোখে ধুতিলালের কতৃত্ব সবার উপরে থাকা উচিত। কিন্তু সে বিহারী, ভুবনের কথায় খোট্টা তায় আবার লেখাপড়ার পাঠ নেই। ভুবন সে তুলনায় সিক্স পাস। মুখে বলে, কিন্তু কত্তাবাবা কি আর তার সার্টিফিকেট চেয়ে পরখ করেছে কোনদিন? তবে কথাবার্তায় একটু পড়াশোনার ছাপ আছে। দুঃখ হয় ধুতিলালের, ইস কেন যে তার বাবা তাকে ফোর ক্লাসের পরে আর স্কুলে পাঠালো না। যেদিন ধুতিলাল তুলসীদাসের রামায়ন পড়া শুর করল তার পরদিন থেকেই স্কুল বন্ধ। আর পড়াশোনা করার দরকার নেই। এটাই তাদের বংশের ধারা। ধুতিলালের মন সায় দেয়নি প্রথম প্রথম কিন্তু মেনে নিতে হয়েছিল। বাবার হাত ধরে কলকাতায়, তারপর কোলকাতা থেকে বর্ধমান, সেখান থেকে পুরুলিয়া আর তারপরে এই কত্তাবাবার বাড়ি। এখানেই কেটে গেল ৩৬টা বছর। ছেলে মেয়েরা তার চেয়ে বেশী পড়াশোনা করেছে, তবে সবাই যে চাকরি করছে তা নয়, যে যার মত করে সংসার গুছিয়ে নিতে পেরেছে। কত্তাবাবা অনেক টাকা দিয়েছেন তার পরিবারে, ধুতিলালের কল্পনার বাইরে। মানুষটা এত ভালো তাই আর ছেড়ে যাওয়া হয়নি, আরা যেতই বা কোথায়? বৌ মরে যাওয়ার পরে ছেলে মেয়ের সংসারে আর জড়াতে চায়নি ধুতিলাল। তর তর করে স্মৃতি এসে সামনে দাঁড়ায়, মান অভিমান সব গলে জল। সন্ধ্যে হলেই ছবি বদল। চান করে মালকোঁচা মেরে ধুতি পরে বসে পড়ে ধুতিলাল, ঘরের বিজলি আলো বন্ধ করে হ্যারিকেন জ্বালে। বিজলি চলে গেলে ছন্দপতন হতে পারে সেটা কারোরই পছন্দ নয়। ছোট্ট তেপায়ায় সিয়া-রাম-হনুমানের ছবির সামনে ধূপ জ্বলে, রেকাবিতে বাতাসা আর কলা। একটু পরে ভুবন এসে ঢোকে চান করে পরিপাটি করে চুল আঁচড়ে লুঙ্গির মত ধুতি পরে হাতে একটা ছোট্ট ঘটি। ধুতিলাল উঠে গিয়ে তিনটে পাথরে ছোট্ট গ্লাস নিয়ে আসে। ভুবন সাবধানে ঘটি থেকে ভাঙ্গের সরবত ঢালে তিনটে গ্লাসে সমান করে। যত্ন করে তিন নম্বর গ্লাসটা ঢাকা দিয়ে সরিয়ে রাখে যদি কত্তাবাবা এসে পড়েন। ভক্তিভরে ভাঙ্গের সরবত উৎসর্গ করে ধুতিলাল সিয়া-রাম-হনুমানজির কাছে। ভাঙ্গের গ্লাস কপালে ঠেকিয়ে ধীরে ধীরে চুমুক চলে, কোন কথা হয় না। সরবত শেষ হলে শুরু হয় তুলসীদাসী রামায়ন, সুর করে থেমে থেমে পড়ে ধুতিলাল। প্রায় পুরোটাই মুখস্থ। ভাব-আবেগ টলটল করে দুজনের মধ্যে, সিয়ার দুঃখে টপ টপ করে জল পড়ে ধুতিলালের চোখ থেকে। ভুবনের চোখও ছাপিয়ে আসে যতটা না সিয়ার দুঃখে, তার চেয়েও নিজের অতীত ভেবে। সিয়া-রামের ভালোবাসার মতই গার্গী-ভুবনের ভালোবাসার জীবন শুরু হয়েছিল। পায়ে কাঁটা ফুটেছিল কবে ভুবন জানে না। গার্গীও বলেনি। পা ফুলে যন্ত্রনা একদিন। গ্রামের হাতুড়ে ডাক্তার, সেখান থেকে মফস্বলের হাসপাতাল, সেখান থেকে কোলকাতা। ডাক্তার বলল টিটেনাস হয়ে গেছে। এক সকালে ভুবন দেখল হাসপাতালের বেডে তার দুহাতের মধ্যে হাসি হাসি মুখে অপলকে তাকিয়ে আছে গার্গী। নার্স এসে আস্তে করে শুইয়ে দিল গার্গীকে, চোখের পাতা দুটো বন্ধ করে দিয়ে একটা বেডশীট টেনে দিল। বলল ডাক্তার বাবু ডাকছেন কিছু কাগজ সই করতে হবে। কিসের সই জিগ্যেস করতে গিয়েও জিগ্যেস করা হয়নি, মুখ খুলতেই পারছিল না। তবে বুঝতে কষ্ট হয়নি। দেশে আর ফেরেনি ভুবন। অল্প জমি আছে, বাড়ীতে মা আর ভাই। বাবাও নেই। সে আর ভাগ বসাতে চায় না ওই জমিতে। তারপর এ ঘাট ও ঘাট। কতগুলো বছর। একটা সাইকেল সারাইয়ের দোকানে কাজ করত তখন ভুবন। বাজার ফেরত সাইকেল টায়ার পাংচার, ভুবনের হাতে ধুতিলালের সাইকেল। সেই প্রথম পরিচয়। একে অপরকে জানা। একদিন ভুবনকে জোর করে হাত ধরে নিয়ে এল কত্তাবাবা আর ভাগ্যলক্ষ্মীর কাছে। ভাগ্যলক্ষ্মী অবাক হয়ে বললেন – ও ধুতি, এ আবার কাকে ধরে আনলি? ধুতি গম্ভীর মুখে বলল – বয়স হচ্ছে কত্তামা। কত্তাবাবার বাগানের হালটা আর চোখে দেখা যায়না। আমার ঘরে আর একটা খাট ঢুকে যাবে। অনেক জায়গা আছে। অবনী হেসে বললেন – তোর একজন সঙ্গী চাই তুলসিদাসী রামায়ন শোনার জন্য তাই না? যুতসই এতদিন কাউকে খুঁজে পাসনি, এবার পেয়ে তাই টেনে এনেছিস, সেটাই বললে পারতিস। আমার বাগানের অজুহাত আর টানা কেন। এরও আর কোন পিছু টান নেই সে দেখেই বুঝেছি। এতগুলো ঘর খালি পড়ে আছে নীচে, তারই একটা খালি করে দে।
ব্যস, সাইকেল সারাই থেকে বাগানের পরিচর্যা। নিষ্প্রাণ যন্ত্রের সংগ থেকে বেরিয়ে এসে মিলে গেল সজীব সতেজ রংবাহারী বন্ধুদের। পালটে গেল ভুবন। এত আনন্দ এর আগে সে পায়নি। বাতাসের দোলা খেয়ে নরম সবুজ গাছের ডাল তার গাল ছুঁয়ে গেলে আনন্দের শিরশিরানী বয়ে যেত সারা শরীরে। হাসি ফুটল মুখে। সারা দিন কথা বলা শুরু হল নতুন বন্ধুদের সঙ্গে যদিও তারা সরাসরি জবাব দিত না। চুপ করে শুনত ভুবনের কথা। সেই শুরু। আজও চলে আসছে। গাছের ডাল পালা ছাটার সময় আস্তে আস্তে করে বোঝাত – বাবারা, এতে তোদের কোন কষ্ট হবে না দেখিস। আমরাওতো নখ চুল কাটি, কি কাটিনা বল? তাতে কি কষ্ট হয়? বরং হাল্কা লাগে। তোদেরও হাল্কা করে দিচ্ছি একটু।
অবনী শোনেন, আর অবাক হন। এত দরদ গাছেদের জন্য? বাগানের চেহারা গেছে পালটে। সবাই বাগানে আসে। অবনীর বন্ধু বান্ধবরাও আসেন। তারাও চিনে গেছে এই গাছ পাগল লোকটাকে। সমীহ করে চলে। একবার এক মহিলা এসে একটা হলুদ গোলাপ দেখে লোভ সামলাতে পারেননি। টুক করে তুলে নিয়ে খোঁপায় গুঁজে নিয়েছিলেন। আঁতকে উঠেছিলেন অবনী, এই না ভুবন দেখে ফেলে। এবং ভুবন দেখেও ফেলেছিল। কাছে এসে খুব শান্ত গলায় বলেছিল – মা ঠাকরুণ, কেঊ যদি এসে টকাস করে আপনার মাথা থেকে একটা চুল ছিঁড়ে নেয় কেমন লাগবে আপনার? মহিলা থতমত খেয়ে বললেন – মানে? চোখে চোখ রেখে শান্ত গলায় ভুবন বলল – ব্যথা লাগবে আপনার তাই না? মহিলা না বুঝেই মাথা নাড়লেন। ভুবন আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে বলল – আমার ওই বন্ধুরও ব্যথা লেগেছে। আমাকে বললে আমি তুলে এনে দিতাম। ও খুশি হয়ে দিত। হন হন করে চলে গেল ভুবন। ভদ্রমহিলার স্বামী অবনীকে বললেন – তোমার এই মালীর মাথার গোলমাল আছে অবনী, এই আমি বলে দিলুম। ও পাগল। অবনী হেসে বলল – ওকে আমি তোমার চেয়েও বেশীদিন চিনি। হ্যাঁ ও পাগল, তবে গাছ পাগল। বড্ড ভালোবাসে ও গাছকে। আমিও কতবার ধমক খাই ওর কাছে। ভদ্রমহিলার অবাক হবার ঘোর কাটেনি তখনো। বললেন – তাহলে কি এটা সেই সেলফিস জায়েন্টের বাগান? এই বাগানে ফুল তোলা মানা।
অবনী বললেন – তা কেন? তিনটে ফ্লাওয়ার ভাসে রোজ ফুল সাজায় ভুবন, ঠাকুর ঘরে, বসার ঘরে আর আমাদের শোয়ার ঘরে। ওর বন্ধুদের কথায় ভুলিয়ে ফুল তুলে আনে। অবনী দেখছিলেন ভুবনকে। বিড় বিড় করতে করতে হলুদ পাতাগুলো খসিয়ে ফেলছে গাছ থেকে। অবনী জানেন ভুবন কি বলছে ওদের।
ভদ্রমহিলা বললেন – আপনাদের শোবার ঘরে ওই মালী ঢোকে? এ মা, কি লজ্জার কথা! আমার কত কিছু ফেমিনাইন জিনিষ ছড়িয়ে থাকে।বাইরের লোক সেখানে ঢুকে যাবে? না না , যতই বিশ্বস্ত হোক এটা কিন্তু একটু বাড়াবাড়ি লাগছে আমার। আপনাদের কথা অবশ্য আলাদা। অবনী কিছু জবাব দিলেন না।
ভাগ্যলক্ষ্মী কাছেই ছিলেন। এগিয়ে এসে বললেন – ও মা, ভুবন বাইরের হতে যাবে কেন? ভুবন আমার অপুর বয়সী। এক ছেলে আর এক মেয়ের বাপ। বাড়ী এলে দুপুরে সোজা আমার ঘরে ঢুকে পড়ে। বলে, মা সামনে কয়েকটা চুল পেকে গেছে। তুলে দাওতো। ভুবন কি দোষ করল?
ভদমহিলার খুঁতখুঁতুনি যায় না। বলেন – পেটের ছেলে আর এই মালী কি এক? আমি বুঝি না বাপু আপনাদের রকমসকম।
অবনী এতক্ষন চুপ করে শুনছিলেন। বললেন – আস্তে বলুন, ভুবন শুনলে কষ্ট পাবে। আজপর্যন্ত একদিনও যায়নি যেদিন ভুবন আর ধুতিলাল আমাদের দুজনকে প্রনাম করেনি।
ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলার ঘোর যেন আর কাটে না। ভদ্রলোক বললেন – এ চরিত্র যে তুমি রবিঠাকুর আর শরৎচন্দ্রের থেকে তুলে আনলে। বাস্তবে আবার এসব হয় নাকি, ধুস।
ভাগ্যলক্ষ্মী একটু অসন্তুষ্ট হলেন। শরৎচন্দ্রের চরিত্রগুলো কি কল্পনা? একেবারে বাস্তবের থেকে তুলে আনা, সবার তো আর কথাশিল্পীর চোখ নয়। এটা নিয়ে আর আলোচনা হোক তিনি চাইছিলেন না। তর্ক করে ভদ্রমহিলা আর ভদ্রলোকের কাছে কি আর প্রমাণ করবেন তিনি? ধুতিলাল আর ভুবন দুজনেই তো আর মিথ্যে নয়, আর মিথ্যে হয়েও যাবে না। কথা ঘোরালেন – যেতে দিন ওদের কথা।
স্মৃতিসমুদ্রে হারিয়ে যাচ্ছিল ভুবন। পড়া থামিয়ে মুখ তুলল ধুতিলাল। হনুমান আশোকবনে সিয়া’মার সঙ্গে দেখা করে রামের স্মারক অঙ্গুরীয় তুলে ধরেছেন। বাকরূদ্ধ সিয়া’মা। দু’চোখ ছাপিয়ে হু হু করে নেমে আসছে অলকানন্দা। টের পেল মহাসাগর। ধরিত্রী শুষে নেবে এই মহাপ্রবাহ? কোন অধিকারে? তার আগেই তুলে নিতে হবে এই মহাপবিত্র অশ্রুধারা। উচ্ছাসে উদ্বেল হয়ে ঊঠল মহাসাগর। মহাকল্লোল তুলে সহস্র সহস্র ফেনায়িত তরঙ্গ আছড়ে পড়তে লাগল তটভূমিতে। মহাপ্রলয় আসন্ন বুঝি। রুদ্ধবাক দশানন, বোঝার চেষ্টা করছেন হঠাৎ মহাসাগর ক্রুদ্ধ হোল কেন? ডুবে যাবে স্বর্ণলঙ্কা? উদ্বেগে প্রাসাদ শিখরে উঠে এলেন দশানন। প্রমাদ গুনলেন হনুমান। তাঁর উপস্থিতি এখনই দশাননের গোচরীভূত হোক তা কোনওমতেই কাম্য নয়। উপায়? রামভক্ত হনুমান অঞ্জলি পাতলেন। একি, অঞ্জলি যে ছাপিয়ে যায়। কি করবেন? প্রভুকে স্মরণ করে অঞ্জলির প্রবাহ ধারা নিজের বুকের দিকে বইয়ে দিয়ে বললেন – হে প্রবাহমানা অমৃতগঙ্গা,
তোমার উচ্ছাস স্তিমিত হোক, বিশ্বচরাচরের কল্যানে আজ তুমি পবননন্দনের বুকে সমাহিত হও। যেদিন প্রভু শ্রীরামচন্দ্র দুষ্ট দশাননকে বধ করে আমার সিয়া’মাকে সসম্মানে মুক্ত করবেন আমিও তোমাকে মুক্ত করে মহাসাগরের সঙ্গে মিলনের পথ উন্মুক্ত করে দেব। মন্দীভূত হল মহাপ্রবাহ। এক সময় তা থেমে গেল। বৃষ্টিভেজা পলাশের মত আয়ত চোখ দুটি অর্ধুন্মুক্ত হল। সামনে করজোড়ে পবননন্দন হনুমান। সিয়া’মা বললেন – কে তুমি পুত্র?
আঃ, কি স্বস্তি। কাল শুরু হবে এর পর থেকে। মাথায় ঠেকিয়ে বই বন্ধ করল ধুতিলাল। তাকাল ভুবনের দিকে। চোখ বন্ধ। ভুবন, এই ভুবন? সাড়া নেই ভুবনের। হ্যারিকেনের আলোটা বাড়িয়ে দিল ধুতিলাল। দু’চোখ বুজে আছে ভুবন আর হূ হূ করে নামছে জলের ধারা। খুব আলতো করে নিজের ধুতির কোঁচা খুলে চোখ মুছিয়ে দিল। ধীরে ধীরে চোখ খুলল ভুবন। লজ্জা পেয়ে বলল – কি কান্ড বলত ধুতিদাদা। তুমি ডাকছ আর আমি শুনতেই পাইনি।
পাবে কি করে? ভেংচি কাটল ধুতিলাল। যেবারেই এই অধ্যায়ে এসেছি, অমনি শুরু হয়েছে তোর অনাচ্ছিষ্টি কান্ড। পরের বারে তাহলে এই অধ্যায়টা বাদ দিয়ে দেব। ক্ষমা চেয়ে নেব সিয়ামা’র কাছে।
না না, সে কি কথা। ব্যস্ত হয়ে পড়ল ভুবন। এ হলগে মহাগ্রন্থ। অসম্পূর্ণ করে পড়তে নেই।
তোর এই পাগলামি জেগে উঠলে এই পথটাই নিতে হবে। ধমক দেয় ধুতিলাল।
কি করব ধুতিদাদা? অসহায় শোনালো ভুবনের গলা - সিয়ামা’র চোখে জল দেখলে ভেতরের পাগলটাও জেগে ওঠে। মেরে ফেলার ক্ষমতাতো আমার নেই। ঘুম পাড়িয়ে রাখি, কিন্তু জেগে ওঠে মাঝে মধ্যে।
-আমারটা কেন জাগে না বলতো? দুজনে চমকে তাকিয়ে দেখে অবনী এসে দাঁড়িয়েছেন। কালেভদ্রে আসেন অবনী, এই যেমন আজ এসে পড়েছেন।
পাথরে গ্লাসটা এগিয়ে দেয় ভুবন, ধুতিলাল বিছিয়ে দেয় একটা আসন। ভুবন বলে – অমন কথা বলতেও নেই, ভাবতেও নেই। ও সব্বোনেশে জিনিষ মনে না আসাই ভাল কত্তাবাবা।
- আজ কি কি মনে করতে পারেননি কত্তাবাবা। উদ্বিগ্ন হল ধুতিলাল।
পাথরের গ্লাসে হালকা করে চুমুক দিয়ে বললেন – বেড়ে বানিয়েছিস তো ধুতি! বাঃ, বাঃ বেশ লাগছে খেতে। হ্যাঁ, কি বলছিলি যেন আজ কি মনে করতে পারিনি? সে বড্ড সব্বোনেশে দিনরে ধুতি। ও দিনটা কি কেউ ভোলে? করুণ শোনাল অবনীর গলা।
- কি দিন কত্তাবাবা? নিজের সমস্যা ছেড়ে ব্যস্ত হয়ে ঊঠল ভুবন।
- সকালে নিয়ম করে যেভাবে হাঁটি সে ভাবে হাঁটতে বেরিয়েছিলাম। গিন্নি মুখ তুলে বলল, বেরুচ্ছ? খোকার ফোন আসবে কিন্তু। আমি বললুম, সে তো প্রতি সপ্তাহে রবিবার রবিবার আসে। আজ তো রবিবার নয়। আজ তা হলে ফোন কেন? বিশেষ কিছু আছে নাকি? গিন্নি দেখলুম কেমন যেন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ, তারপর বেরিয়ে গেল।
ভুবন, ধুতিলাল একসঙ্গে বলে উঠল - তারপর? এ যেন রুদ্ধশ্বাস রোমাঞ্চ।
পাথরের গ্লাস খালি করে ধুতির কোঁচায় মুখ মুছতে যাচ্ছিলেন, ধুতিলাল পরিস্কার নিপাট গামছা এগিয়ে দিল। সব মজুত করা থাকে। অবনী মুখ মুছলেন। বললেন – হেঁটে ফিরে দেখি খোকার ফোন, তোদের কত্তামার গলায় বিস্তর অভিযোগ।
আমি ঢুকতেই ফোন এগিয়ে দিয়ে বলল, খোকার ফোন, এই নাও, কথা বল। চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পড়ে বললুম, হ্যাঁরে খোকা, আজ এই অসময়ে ফোন করলি যে বড্ড। সবাই ভালো আছিস তো? বৌমা, তিরি, তুতুন সবাই ভালো তো? ওদিক থেকে খোকার গলা ভেসে এল, একটু অন্যরকম। বলল, বাবা আজকাল তোমার ঘুম ঠিক-ঠাক হচ্ছে? আমি বললুম, হচ্ছে মানে, বেশ ভালোই হচ্ছে। যেমন হোত, তেমনই। তোর মার এই নিয়ে অভিযোগ, ঘুমোলে সাড় থাকে না, একি ঘুম রে বাবা! আচ্ছা বলতো খোকা, জেগে থাকলে সাড় থাকবে, আবার ঘুমোলেও সাড় থাকবে তাহলে এতো আধো নিদ্রা, আধো জাগরণ। সেটা কি ভালো? ওদিক থেকে খোকা বলল – সেটা ভালো নয় ঠিক, কিন্তু তুমি আমাকে বললে কেন আজ অসময়ে ফোন করেছি? আজ কি দিন বাবা? আমি বললুম, বুধবার। ভাদ্র মাস। পূজো আসছে। তিথি নক্ষত্র জানতে চাস? দাঁড়া পাঁজিটা দেখি। কিন্তু তোর কি হল বলতো, বাংলা মাসের তিথি নক্ষত্র জানতে চাইছিস ফোন করে? অ্যাই শুনছো, পাঁজিটা দাও খোকা তিথি নক্ষত্র জানতে চাইছে। খোকা বিরক্ত হল, অবাকও হোল, বলল – ড্যাড, ইঊ ফরগট হোয়াটস দি ডে টুডে? বিরক্ত হলে খোকার মুখে ইংরেজি চলে আসে।
অন্যসময় ঝরঝরে বাংলা, যদিও নাতি নাতনি ইংরেজিতে স্বচ্ছন্দ বেশী।
- ওটার মানে কি কত্তাবাবা? ধুতিলালের নিরীহ প্রশ্ন।
- খোকা বলছিল আজকের দিন কি দিন সেটা ভুলে গেছ বাবা?
- তুমি কি বললে কত্তাবাবা? ধুতিলাল উৎসুক। উৎসুক ভুবনও কিন্তু এই মুহূর্তে দুজন ঝাঁপিয়ে পড়বে এটা তার কাম্য নয়।
অবনী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বললেন-এই প্রথম বার ভুলে গেলুম বুঝলি। আচ্ছা ধুতি, তোরও তো মনে থাকার কথা, কই তুইতো একবার উচ্চবাচ্য করলি না।
ধুতিলাল মাথা চুলকে বলল – কি ভুলে গেলুম বল তো কত্তাবাবা?
- তোদের কত্তামার জন্মদিনরে আজ। প্রতি বছর কালীঘাট যাই, এবছর মনেই পড়ল না। ভারী অবাক লাগছে রে। কেন এমন হল? নিজের জন্মদিন ভুলি তা ঠিক আছে, সেটা ভুলে যাওয়াই ভাল। কিন্তু তা বলে গিন্নীর জন্মদিন? না রে, খোকা সেটাই বোঝাচ্ছিল। কিছু একটা হয়েছে আমার।
- কি হয়েছে কত্তাবাবা? ব্যাকুল দুজনেই, ভুবন আর ধুতিলাল।
- অ্যলঝাইমার। অবনী ছাদের দিকে মুখ তুলে বললেন।
- কি মার কইলেন? তোতলাতে থাকে ধুতিলাল। যেন না শুনলেই ভাল।
- অ্যলঝাইমার। অবনী মুখ নামিয়ে বললেন। খোকা এটাই সন্দেহ করেছে।
- এটা নিশ্চয় কোন ব্যামো নয়? অনেক্ষন পরে মুখ খুলল ভুবন।
- ব্যামো নয় কিরে? ভারী কঠিন ব্যামো। রায় দিলেন অবনী। তোদের বোঝার কথা নয়। স্মৃতিভ্রংশ।
- কি হয় এতে কত্তা? ধুতিলাল ভারী চিন্তায় পড়েছে।
- সব আস্তে আস্তে মানুষ ভুলে যায়। কিচ্ছু মনে করতে পারে না। আজকে তোর কত্তামার জন্মদিন ভুলেছি, এর পরে তোদের নামও ভুলে যেতে পারি। মায় নিজের নামটাও। হাঁটতে গিয়ে দেখলি আমি ফিরছি না। বাড়ীর রাস্তা ভুলে গেছি। আস্তে আস্তে কাউকে চিনতে পারব না। নিজের গিন্নীকেও না।
- বালাই ষাট, বালাই ষাট। ওরকম অলুক্ষনে কথা বলবেন না কত্তাবাবা। ধমক দিল ধুতিলাল, কিন্তু ভেতরে ভেতরে কেঁপেও উঠল। যদি সত্যি সেরকমটা হয়?
- ব্যাপারটা ফ্যালনা নয় রে ধুতি। অবনী যেন ভবিষ্যতটা দেখতে পাচ্ছেন।
- সে আর এমন বড় কথা কি? আস্বস্ত করল ভুবন। এই আমার কথাই ধরেন। ছোট বেলায় ডাঙ্গুলি খেলতে গিয়ে শ্রীপতি মাষ্টারের কপাল ফুলিয়েছিলুম নাকি হোলির আগুনে একটা খড়ের গাদায় আগুন ধরিয়ে ছিলুম সে কি আর এখন মনে আছে? মনে না থাকলে কার কি যায় আসে কত্তা। যত ভোলা যায় ততই ভাল। আমি যেমন ভুলতে চাই কিন্তু পারছি না। গলা ধরে এল ভুবনের।
মনটা খারাপ হয়ে গেল অবনীর। সত্যি তো কত স্মৃতি বুকে করে বয়ে বেড়ানো বছরের পর বছর। এদের কেন অ্যলঝাইমার হয় না কেন কে জানে?
- কিন্তু কত্তা, ধুতিলালের ধন্দ যায় না, এটাতো খোকাবাবার কথা। ডাক্তারতো কিছু বলেনি।
- তা বলেনি। তবে খোকা বলল শহরে গিয়ে চেক করাতে। সে বড্ড হ্যাপা রে ধুতি। কিন্তু তোরা দুজন ভুলে গেলি কি করে আজ তোদের কত্তামার জন্মদিন?
ভুবন প্রতিবাদ করে উঠল। বলল – আমি তো ভুলিনি। এটা কি ভোলার মত কথা। কত্তামা হলুদ গোলাপ ভালোবাসেন। একটা ফুটেছিল। আলাদা করে দিয়ে এসেছি সকালে, প্রনামও করেছি। ভারী খুশি হয়েছিলেন। বললেন, তোর কত্তাবাবার আক্কেলটা দেখলি ভুবন। হন হন করে বেরিয়ে গেল। যাক তুই তবু মনে রেখেছিস। ধুতিও আজ আসেনি, তোর কত্তাবাবার মতই ভুলে মেরে দিয়েছে।
ধুতিলাল প্রায় মাটির সঙ্গে মিশে যায় আর কি। অপরাধী গলায় বলল – কত্তাবাবা, তোমার সঙ্গে আমাকেও নিয়ে চল। মাথার ব্যামো বলে কথা। কি করে ভুলে গেলুম কে জানে?
- আমার মনে হয় এটা এখনও গুরুতর হয়নি। আমার গ্রামে দিনু কোবরেজকে দেখেছি বুড়োদের মাথার মাঝখানটাতে কিছু একটা লেপে দিত কালো কালো বেড়ালের পায়খানার মত। বড্ড বিটকেলে গন্ধ। অতে নাকি মাথার ব্যামো ভালো হয়। ভুবন গম্ভীর গলায় নিদান বাতলায়। দিনু কোবরেজ এতদিনে ওপারে বুড়ো দেব-দেবীদের চিকিৎসা করছেন নিশ্চয়। সেখান থেকে ডেকে আনা যাবে না। তবে ধীরা কোবরেজকে একবার দেখাতে পারেন। বয়স হয়েছে, লোকে মান্যি গন্যি করে।
ধীরা কোবরেজের মনটা আজ ভালো নেই। না থাকারই কথা। কাল থেকে মনটা খচ খচ করছে। বিনয় ডাক্তারের আস্পর্ধা দেখে ভারী অবাক হয়েছেন। আর সেই সঙ্গে কালু চোরেরও। ধীরা ঠিক করেছেন ওকে কেলো বলবেন কারন আরও একটা কালু আছে। কিছুই জানতে পারতেন না যদি না কেলো চোর এসে গুহ্য কথাটা ফাঁস করে দিত। প্রতিদিনই রাত ৯ট ১০টা পর্যন্ত চেম্বারে আরাম করে বসে থাকেন, তবে চেয়ারে নয়। আরাম কেদারায়। ওই নাম মাত্র চেম্বার। তিনি বলেন ধন্নন্তরী আলয়। শুনতে সেকেলে, লোকে বিষেশ করে উঠতি বয়সী ও মাঝ বয়সীরা টিপ্পনী কাটে। বয়স্করা একটু সমীহ করে, অনেক সফলতার ইতিহাস লোকের মুখে মুখে ঘিরে যতট না তাঁকে নিয়ে তার চেয়ে ঢের বেশী তাঁর স্বর্গীয় বাবাকে নিয়ে। সাক্ষাৎ ধন্বন্তরী ছিলেন। অনেকে বিশ্বাস করে, অনেকে করে না। খুব একটা যায় আসে না তাঁর। বাবার থেকে জ্ঞান, কোলকাতায় বেশ কয়েক বছর আয়ুর্বেদ নিয়ে পড়াশোনা করলেও তিনি জানেন বাবার সঙ্গে তাঁর তুলনা হয় না। শুধুমাত্র নাড়ী ধরে চোখ বুজে বসে থাকতেন অনেক্ষণ, রোগীও ধৈর্য হারায় হারায়, তারপরেই রোগ নির্ণয় করে দিতেন। ক্যানসারের মত মারণ রোগও তিনি ধরে ফেলতে পারতেন, তবে একজন ছাড়া কাউকে বাঁচাতে পারেননি। অদ্ভুত ক্ষমতা চিল তাঁর রোগ নির্ণয়ের। ধীরা আজও সেই রহস্যের চেষ্টায় মশগুল। রাত বাড়লে সব শুনশান হয়ে গেলে আরাম কেদারায় বসে নিজের নাড়ী ধরে বোঝার চেষ্টা করেন। কিছু কিছু ধরতে পারেন তবে বাবার মত নয়। কালও এমনি বসে ছিলেন, খাওয়ার দেরী আছে দেখে নিজের নাড়ী ধরে নিলেন। হঠাৎ পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করে কেউ একজন বসে পড়ল – প্রণাম কোবরেজ বাবা।
চমকালেন না, কোনওদিন চমকান না। কোবরেজদের ধীর স্থির হওয়া বড্ড জরুরী। হাল্কা গলায় বললেন – কে রে তুই? প্রনাম যখন করেছে তখন ছোট হবেই, তা ছাড়া রাতে তার কাছে কোন রুগী আসে না। হ্যারিকেনের হালকা আলোয় লোকটাকে দেখলেন। আলো বাড়ালেন না। কালো কুচকুচে, তেলকালী মাখা সারা মুখে। লোকটি বলল – আমি কালু, কোবরেজবাবা। ধীরা হাতড়ালেন – কোন কালু বলত? হাটতলায় তেঁতুল গাছের নীচে দলবল নিয়ে যে বসে থাকে?
লোকটা ভারী আহত হল মনে হল। অভিমানী গলায় বলল – মরে গেলেও যেন অমন না হই বাবা। আমিও তেমন কোন মহাপুরুষ নই, তবে ওরকম নই। ও হল কালাচাঁদ আর আমি হলুম কালীকিঙ্কর।
ধীরা হাসলেন। বললেন- মনে হচ্ছে তোমার বড্ড অপছন্দ, কিন্তু বাপু কালী আর কেষ্টতে ভারী মিলমিশ আছে।
-তা বলতে পারব না কোবরেজবাবা। তবে ওই হাটতলার কালু হওয়ার চেয়ে বাবলা গাছে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়লে পুণ্যি হবে। লোকটার গলায় আহত অভিমান।
-আচ্ছা, আচ্ছা সে না হয় হল। কথা ঘোরালেন ধীরা। তেল কালী মেখে রাতে বেরিয়েছ, তা আমার চেম্বারে কেন বাপু? সুবিধে হবে না আগে থেকে বলে রাখলুম। রান্নাঘরে গোটা কয়েক কাঁসার থালা, গ্লাস বাটী ছাড়া কিচ্ছু নেই। আলমারীও ঢুঁ ঢুঁ।
কালু তাচ্ছিল্যের একটা শব্দ করে বলল- সে কি আর আমি না দেখে এয়েছি? গিন্নীমা আটা মাখছেন, আর সরো দিদি ঠাকরুণ কিছু একটা ভাজছেন, মনে হল ওল ভাজা। থালা গেলাস গুলো জানলার ধারেই ছিল, টুক করে সব কটাই তুলে নিতে পারতুম, কিন্তু নিই নাই।
-তা আমাকে এত দয়া কেন কালু? ধীরা হঠাৎ উৎসাহ বোধ করতে শুরু করলেন।
-আপনি হলেন কোবরেজবাবা, সাক্ষাৎ ধ্বন্বন্তরী। মানুষের জীবন মরন আপনার হাতে। আপনার বাড়ী থেকে বাসন সরালে কি আমার ধম্মে সইবে বাবা?
-ও বাবা, তুমি আবার ধম্মকম্ম করো নাকি?
-করি কোবরেজবাবা। হাটতলার ওই কালু করে না। বেশীদিন টিকবে না ও। তা যেতে দ্যান। তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে পড়েছিলাম, আপনার রান্নঘরে আলো দেখে থমকে গেলুম। বুঝলুম, কাজে যাওয়ার সময় হয়নি এখনো। মধ্য রাত্তির থেকে আমার কাজ কিনা। মেঘলা ছিল একটু, তাই ঠাউর হয়নি। ভাবলুম দু দন্ড কাটিয়ে যাই আপনার সঙ্গে, পূন্যি হবে। সেই সঙ্গে একটা গুহ্য কথাও জানিয়ে যাই।
-গুহ্য কথা? ধীরা সোজা হয়ে বসলেন। কাকে নিয়ে?
-আজ্ঞে আপনার কাছে বলছি যখন, তাখন আপনাকে নিয়েই। বিনু ডাক্তার আজকাল আপনার বড্ড বদনাম করছে কোবরেজবাবা। বলে, যত্ত সব ভুজুং ভাজুং। তোরাও তাই বিশ্বাস করিস। বিশল্যাকরনী, ফুঃ। সে রামচন্দ্রের হনুমান ছিল তাই আনতে পেরেছিল। তোদের কোবরেজকে বল একটা চারপায়া পুষতে। তারপরে হিমালয় নিয়ে ভাবা যাবে। শুনলে গা জ্বলে যায় বাবা।
-বলেছে বিনু ডাক্তার এমন কথা? ধীরার যেন বিশ্বাস হয় না। উত্তেজিত হয়ে পড়ছিলেন। কিন্তু সামলে নিলেন। তিনি কোবরেজ। বললেন-তোমাকেও একটা গুহ্য কথা বলি শোন। রক্তে চিনি আর চাপ – দূটোই বেড়েই চলেছিল বিনু ডাক্তারের। শহরে নামি দামী ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ খাচ্ছিল। কিছুদিন পরে চিঁ চিঁ করতে করতে আমার কাছে হাজির। বলল, তুই বাঁচা আমাকে ধীরা। নাড়ী দেখলুম, কিডনির এখন তখন অবস্থা।
-আপনিও গলে জল হয়ে গেলেন। শ্লেষ করতে ছাড়ল না কালু।
-কি করব বল, কোবরেজদের ধর্মই তো সেটা, না হলে পতিত হব যে। টানা তিন মাস ওষুধ খেয়েছে। তবেই না গলায় জোর এসেছে। সবার সামনে একদিন এই গুহ্য কথাটা ফাঁস করে দিও।
-সে আর বলতে কোবরেজবাবা। পুরো হাটের মাঝখানেই হাঁড়ি ভাঙ্গব। আজ চলি তাহলে বাবা। পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল কালু।
কয়েকমিনিট পরেই রান্নাঘর থেকে গিন্নীর চিল চিৎকার – ওগো দৌড়ে এস, কি সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড।
পড়িমরি করে দৌড়োলেন ধীরা। হাউমাউ করে কাঁদছে সরো।
-কি হয়েছে? ব্যস্ত হলেন ধীরা।
-কি হয়ে গেছে বুঝতে পারছ না? কবেই বা বুঝেছিলে? গিন্নীর চিৎকারে আরো ঘাবড়ে গেলেন ধীরা।
সরোকে বললেন, কি হয়েছে রে সরো? কাঁদতে কাঁদতে সরো বলল-সব্বোনাশ হয়ে গেছেগো দাদা। বৌদি রুটি
বেলে আমাকে দিচ্ছিল, আমি সেঁকছিলুম। তোমাকে খেতে ডাকব, থালা আনতে গিয়ে দেখি সব সাফ। ওই জানলার ধারে ছিলগো দাদা, আমরা দুটো জ্যান্ত মেয়েমানুষ বসে আছি, এই ভর সন্ধ্যেতে কি করে কে সরাল গো দাদা। বামুন বাড়ীর বিধবা আমি, নির্জলা একাদশী করি। এই আমি বলে রাখছি দাদা, তে রাত্তির কাটবে না ওর দেখে নিও। দীর্ঘশ্বাস ফেলে পা বাঢ়ালেন ধীরা। খাওয়ার একটা ব্যবস্থা করতে হবে। হাটতলায় ঝাঁটুর বাসনের দোকান এখনো খোলা আছে হয়ত।
সেই কথাই ভাবছিলেন বসে আজ ধীরা। কালু চোর আর বিনু ডাক্তার। কার কথা বিশ্বাস করবেন। এমন সময় দোর ঠেলে কেঊ একজন ভেতরে ঢুকল, পেছন পেছন আরো দুজন। একজন এসে চেয়ার টেনে বসে পড়ল। বাকী দুজন ঢিপ ঢিপ করে প্রনাম ঠুকল ধীরার পায়ে। হ্যারিকেন টেনে আলোটা বাড়াতে যাচ্ছিলেন। বাধা পেলেন।অধো অন্ধকারে একটা হাত এগিয়ে এল – তোর তো দ্যাখা লাগে না, অনুভবের ব্যাপার। আমার নাড়ীটা একটু দ্যাখতো ধীরা। আমি অবনীরে।
-কোন অবনী? হাতড়াতে থাকেন ধীরা।
অবনীর গলায় একটু ঊষ্মা ঝরল – তুই কি ঠাট্টা করছিস? এ তল্লাটে অবনী মুখুজ্জে একটাই আছে।
আরও কিছুক্ষণ হাতড়ালেন ধীরা, কিন্তু ধরতে পারলেন না। লোকটা যেভাবে তুই তোকারী করে বলছে তার মানে খুব পরিচত বন্ধু স্থানীয়। কিন্তু কে অবনী মুখুজ্জে? তারপর দপ করে জ্বলে উঠল আলো মাথার কোষে কোষে। ওঃ, অবনী!
আধো অন্ধকারেই হাতটা ধরে ফেলল ধীরা। বলল – অবনী। কি কাণ্ড বলত। কিছুতেই মনে করতে পারছিলুম না। বয়স হচ্ছে, বুঝলি।
হাসিটা ছেড়েই দিলেন ধীরা, পেটের ভেতর থেকে, বুকের মাঝখান ছুঁয়ে আনাবিল আনন্দে ছড়িয়ে পড়তে থাকল। অবনীও হেসে ফেললেন। দেখা দেখি ধুতিলাল আর ভুবনও।
হাসি থামিয়ে ধীরা বললেন- কি বলছিলি, তোর নাড়ী দেখতে? তোকে দেখেই তোর নাড়ী আমি টের পাই অবনী, ধরার দরকার হয় না। তবু যখন বলছিস তখন দে, আমার কোবরেজি বিদ্যেটা ঝালিয়ে নিই। এখন বেশীরভাগ সময় আমার উপরেই কাটাই। এ যুগে কে আর আমার সামনে হাত পেতে বসে থাকবে বল। প্যাটাপ্যাট ইনজেক্সান অথবা টপাটপ বড়ি এটাই এখন চলে।
সময় কেটে চলেছে। ধীরার হাতে অবনীর হাত। ধুক ধুক ধুক ধুক, এক একটা স্পন্দনকে যেন আলাদা করে আজ বুঝতে পারছেন ধীরা। মনে হচ্ছে এক একটা স্পন্দনও যেন তাঁর মাথায় পল আনুপলে বিশ্লেষিত হচ্ছে। প্রত্যেকটি আলাদা, কোনটি ধীর, কোনটি চঞ্চল। আশ্চর্য হচ্ছেন ধীরা। এ কেমন অনুভূতি? এমনটাতো আগে কোনদিন হয়নি।
- কিছু বুঝছিস ধীরা? আস্তে করে বলল অবনী। খোকা বলল অ্যলঝাইমার হতে পারে। সত্যি রে ধীরা আজকাল অনেক কিছু কেমন ভুলে যাচ্ছি।
- আবার মনেও পড়ছে অনেক কিছু, তাই না? এই যে সন্ধ্যেবেলা আধো অন্ধকারে তুই আমি হাত ধরাধরি করে বসে আছি, কিছু তোর মনে পড়ছে অবনী?
- মনে পড়বে না মানে? দপ করে আগুন ছড়িয়ে পড়ল স্মৃতির কোষে কোষে। পায়রা ছানা ধরতে গিয়ে বাবার একটা ভারী সখের ফুলদানী ভেঙ্গে গেছল। ভয়ে দুজনে চিলে কোঠার ঘরে ভাঙ্গা চেয়ার টেবিল কাঠের আড়ালে হাত ধরা ধরি করে বসে ছিলুম অনেক রাত পর্যন্ত। শেষে টুনাই পিসি উদ্ধার করে, মার খাইনি কেউ। আমার বাড়ীতে সে রাত্তিরে থেকে গেছলি তুই, সেই প্রথম। তারপর অবশ্য অনেকবার থেকেছিস।
- এটা কি অ্যলঝাইমার অবনী? তোর নাড়ীতে একজন বয়স্ক সুস্থ মানুষের জীবন স্পন্দন। কিছু ভলবি, কিছু মনে পড়বে, কিছু হারাবি, কিছু ফিরে পাবি। এই হোল জীবন, ঠিক কিনা বল?
হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরলেন, হাসছেনদুজনে হা হা করে। অবাক হয়ে দেখছিল ভুবন আর ধুতিলাল।
ধুতিলাল মুখ খুলল, বলল-তা হলে কত্তাবাবার কিছু হয়নি, তাই না কোবরেজবাবা?
-কিস্যু হয়নি তোর কত্তাবাবার। হেসে আশ্বস্ত করলেন ধীরা।
-আর বাবা আমার? হাতটা বাড়িয়ে দিল ধুতিলাল। আমি কিন্তু কত্তাবাবার চেয়ে বড়।
বেশ কিছুক্ষন নাড়ি দেখলেন ধীরা। তারপর বললেন-পঞ্চভূতে মানে পাঁচ শক্তিতে চলছে এই পৃথিবী। আমাদের জীবনও তাই। ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, বোম – মাটি, জল, সূর্য, বায়ু আর আকাশ – এই হল পঞ্চ শক্তি, আমাদের জীবনের উৎস। যখন মারা যাব, তখনও মিশে যাব আমরা এই পঞ্চভূতে। কিছু বুঝলি ধুতি, ভুবন? জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন ধীরা।
-বুঝতে পারছি বাবা, দুজনেই বলে উঠল।
-তা হলে শোন। ধীরা খুব আস্তে আস্তে করে বলতে থাকলেন, কৃত্রিম জীবন থেকে বেরিয়ে এসে যারা এই পঞ্চশক্তির কাছাকাছি নিজের জীবন ধারা প্রবাহিত করে তারা অনেকদিন পর্যন্ত সুস্থ জীবনের স্বাদ নিতে পারে। তোরাও তাই। অনেকদিন ভালো থাকবি দেখিস। আয়তো সবাই মিলে একটু ভালো করে হাসি!
Comments
Top
সদ্গতি
দেবদাস ভট্টাচার্য্য
ডালাস, টেক্সাস
তোম্বা মুখ করে বসেছিলেন নবেন, হাতে মহানিমের সরবত। ধরণী কবরেজের দাওয়াই, একসপ্তাহের উপর ঘুম হচ্ছে না। ‘মহাবায়ু কুপিত, উর্ধমুখী’, রায় দিয়েছিলেন ধরণী হাতের নাড়ী ছেড়ে দিয়ে। বলেছিলেন,’এ তোমার নাকু কোম্পাউণ্ডারের ক্ষমতার বাইরে হে।‘ নাকু ডাক্তারের আসল নাম নরেন। তেঁতুল গাছে ঊঠে কাঠবেড়ালীর বাচ্চা চুরি করতে গিয়ে বিপত্তি ঘটিয়েছিল ছেলেবেলায়। নাকটা অস্বাভাবিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। কথা এখন সব নাকীসুরেই বেরোয়, সেই থেকে নরেন হয়ে গেল নাকু। স্কুলের বদমাইস ছেলেগুলো ওকে দিয়ে অনেক কাজ করিয়ে নিত আর তার মধ্যে একটা হল অন্ধকারে বাঁশ বনে ওকে বসিয়ে রাখা। ভূত পেত্নী শাঁকচুন্নীদের তখন রমরমা। সন্ধ্যেবেলা বাজার ফেরৎ পাকা আমের ব্যাগ বা জিলিপির ঠোঙ্গা ফেলে কত বাচ্চা পালিয়েছে, কিছু বড়রাও বাদ যায় নি। বিয়ের দিন রাত্তিরে অন্ধকার ঘরে নাকু খাটের তলায় লুকনো শালীদের এমন ভয় পাইয়ে দিয়েছিল যে নাকুর বৌ একমাস নাকুর ঘরে ঢোকেনি। শেষমেষ শালীদের সঙ্গে ভারী রকমের জরিমানা দিয়ে বৌর মান ভাঙ্গিয়েছিল। নবেনের স্ত্রী প্রিয়বালা একটু কুণ্ঠিত গলায় বলেছিলেন,’আহা, এ তোমার ভারী অন্যায় দাদা। নাকু ডাক্তারকে নীচের দিকে ঠেলা কি ঠিক হচ্ছে? হতে পারে ও তোমার সঙ্গে সঙ্গে ঠুকোঠুকি করে, কিন্তু ঘুষো ঘুষি তো করে না। আর তোমাকেও কোনদিন অশ্রদ্ধাও করেনি।‘ প্রিয়বালার একটু দুর্বলতা আছে নাকু ডাক্তারকে নিয়ে, মানুষটা খারাপ নয়। এই গ্রামে কোন পাশ করা ডাক্তার এসে বসবে? দু’সপ্তাহের উপর জ্বরে ভুগে বড় মেয়ে রাইকে নিয়ে নাকু ডাক্তারের কাছেই ছুটতে হয়েছিল ধরনীর কাছে আর ধন্না না দিয়ে। এক লহমায় দেখেই নাকু বলেছিল,’বৌদি, এটা কিন্তু টাইফয়েড। এতদিন মেয়েটাকে না ভোগালেই পারতে। ওষুধ দিচ্ছি, তবে একবার রক্ত পরীক্ষাটা করিয়ে নিও।‘ খবর নিশ্চয় পেয়েছিল নাকু, গায়ে পড়ে চিকিৎসা করানোর কথা তোলেনি। প্রসঙ্গটা তুললেন না প্রিয়বালা, অযথা খুঁচিয়ে লাভ কি? বয়স্ক মানুষ, নবেনের চেয়ে বড় কিন্তু বন্ধুর মত। নবেন নাম ধরেই ডাকে ধরণীকে, মাঝে মধ্যে দাবার আসর বসে। নাকে এক খাবলা নস্যি ঠেসে দিয়ে বেশ কয়েকবার রাম হাঁচি হাঁচলেন ধরণী। বোমা ফাটার মত আওয়াজ হয়, তাই রাই বলেছিল – রাম হাঁচি। ধরণীর সাফাই রেডি ছিল, বলেছিলেন,’দ্যাখ বালা, ডিগ্রি নাই তাই ডাক্তার নয়।‘ প্রিয়বালাকে বালা বলেই ডাকেন ধরনী অনেক দিন থেকেই। বললেন,’ ডাক্তারর সহকারী হয়ে কাজ করেছে, তাই কম্পাউণ্ডার। এই সত্যটা তো আর মিথ্যে হয়ে যাচ্ছে না। যতই নামের পাশে ডাক্তার লিখুক না কেন, আসলে নাকু কি তা ও নিজেই জানে। ইচ্ছে করলে ঠুকে দিতে পারি। নকল ডাক্তার নিয়ে আবহাওয়া বেশ গরম। ঠুকে দিলেই পুলিশ, জেল আর জরিমানা। নেহাত গ্রাম, তাই কেউ এ নিয়ে মাথা ঘামায় না। আর তা ছাড়া আমি অতটা খারাপ নই বালা। ওর পরিবারটা পথে বসুক এটা আমি চাই না।‘
প্রসঙ্গ ঘোরাতে চাইলেন প্রিয়বালা। বললেন,’নাকুর কথা থাক, আপনার বন্ধুর ব্যাপারটা দেখুন। এক হপ্তার উপর হয়ে গেল, রোজ রোজ মাঝ রাত্তিরে চমকে জেগে উঠে বসে ভিকন বাঁশ কে গাল মন্দ করে। নাকু ডাক্তারের কাছে যাই নি দাদা, ঘুমের ওষুধে আমার বেশ আপত্তি।‘ ধরনী ভারী খুশি হয়ে আহ্লাদের গলায় বলেছিলেন,’এই একটা সিদ্ধান্ত তুমি এক্কেবারে ঠিক নিয়েছ। ঘুমের ওষুধ যেদিন খেলে সেদিন ঠিক, পরের দিন যেই কে সেই। আর খেতে খেতে কিছুদিন পরে ওটাও কাজ করবে না। এতে অবশ্য নাকুর কোন দোষ দেখিনে। ওর হাত পা বাঁধা। ওদের যে রোগের যা ফিরিস্তি দেওয়া আছে তার বাইরে যাওয়ার জো নেই। হুঁ হুঁ এ কি আর আয়ুর্বেদ যে রোগীর মত করে রোগ চিকিৎসা করবে?’
তারপর নাড়ী টিপে বসে রইলেন ধরণী, ওই রোগীর নাড়ীতেই রোগের নাড়ীনক্ষত্র টেনে বার করা। এ কি আর সবাই পারে? রোগের চিকিৎসা নয়, রোগীর। নবেন কিছুক্ষন পরে অধৈর্য হয়ে উঠেছিলেন,’ওই জন্য তোর কাছে কেউ যায় না আজকাল। কার অত সময় আছে বলত। ঝিন ঝিন করছে হাত। অন্য ভাবে নিস না ধরণী, লোকে অন্য কথা বলে।‘
ধরণী রাগ করলেন না, কোবরেজদের রাগ করতে নাই, নাড়ীর ছোট্ট ছোট্ট বিট সারা শরীরের কথা জানান দেয়, একটাও মিস করা যায় না। চোখ বুজেই বললেন,’কে কি বলল তাতে আর আমার কি যায় আসে বল। তুই বোধ হয় ভাকু মিদ্দার তৃতীয় পক্ষের বৌর কথা বলছিস। নরম গোলগাল ফর্সা হাত ধরে আমি নাকি ঘণ্টার উপর বসেছিলাম নাড়ী দেখার নাম করে। তাই তো?’
নবেন কিছু বলতে যাচ্ছিলে, বলা হল না। প্রিয়বালা ধমক দিয়ে থামিয়ে দিলেন,’তোমার অত আজেবাজে কথা না বললে কি চলছে না? দাদার কাজটাতে বাগড়া দিচ্ছ কেন?’ ধমক খেয়ে নবেন কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে বসে রইলেন। আরও মিনিট কুড়ি নাড়ী টিপে বসে থাকার পর হাত ছাড়লেন ধরণী। বললেন,’যা আশঙ্কা করেছিলুম, তাই। ঊর্ধমুখী মহাবায়ু।‘ ব্যশ তারপর থেকেই সকালের দার্জিলিং চা জায়গা বদল করেছে। মহানিমের সরবত ছাড়া মহাবায়ুকে প্রশমিত করবে কে? ধরণী নিয়ম করে সকালে আসছেন, নবেনের দার্জিলিং চা
ধরনীর হাতে আর নবেনের হাতে মহানিম। হাল ছেড়ে দিয়েছেন নবেন। বাটীতে ভেজানো সবুজ মুগ। তারই এক মুঠ মুখে ফেলে চায়ে চুমুক দিলেন ধরণী। গালাগাল মুখে উঠে আসছিল, একচুমুক মহনিমের জলে ফের পেটে ফেরত পাঠালেন নবেন।
‘কালকে ঘুম কেমন হল বল নবেন? ভিকন বাঁশ এসেছিল, না আসেনি?’
‘মনে হয় গত দু’দিন আসেনি দাদা’, জবাব দিলেন প্রিয়বালা। ‘আমি অন্তত ওকে জাগতে দেখিনি। আমার ঘুম বরাবর পাতলা।‘ নবেন চুপ করে রইলেন। প্রিয়বালা ভুল বলেনি, গত দু’দিন ভালোই ঘুমিয়েছেন। এটা কি মহানিমের মাহাত্ম্য কিনা কে জানে। ভয়ানক জ্বালাচ্ছিল বেশ কয়েকদিন। একই কথা ঘ্যানর ঘ্যানর করা কানের কাছে। ভিকনের জমিটা কিনেছিলেন অনেকদিন হল, ন্যায্য দাম দিয়েছেলন বাজার দরে। তাঁর পুকুরের ধার ঘেঁষে জমিটা। নবেনের ইচ্ছে ছিল পুকুরটা বাড়ানো আর কিছু পছন্দ সই আম গাছ লাগানো। বছর খানেকের উপর হল ভিকন দেহ রেখেছে। পুকুর বাড়ানোর কাজ শুরু হয়েছে, বাগড়া দিয়েছে একটা খেজুর গাছ। লম্বা সিড়িঙ্গে, এখন আর রস দেয় না কিন্তু খেজুর কুল হয়। কাঠ কুল, খেলে বিচিতে আঁশ থাকে না, এক কামড়েই বিচি আলাদা হয়ে মুখ থেকে বেরিয়ে আসে। ভালো মিষ্টি, কিন্তু আম বাগানের পক্ষে বেমানান। এমন জায়গায় গাছটা যে না কাটলেই নয়। সব কিছু ঠিকঠাক, যেদিন গাছ কাটা হবে তার আগের দিন রাত্তিরে ঘুমটা সবে এসেছে এমন সময় ভিকন হাজির। বলল,’ও নবেন ভাই, একটা কথা বলার ছিল।‘ নবেনের চোখ কপালে ওঠার যোগাড়। বললেন,’তুমি কোত্থেকে?’ ভিকন ভারী মনমরা হয়ে বলল,’আমাদের কি আর থাকার কোন ঠিকানা আছে? দ্যাহটা গেছে, নামের আগে চন্দ্রবিন্দু এয়েছে এই পর্যন্ত। একটা কথা বলার ছিল বলেই আসা। জমির দাম তুমি ন্যায্য দিয়েছ, আমার কিছু আপত্তি নাই। বড় খোকাকে দু’হাজার টাকা দিয়ে গয়ায় পাঠিয়েছিলে পিন্ডি দিতে, কালীঘাটে গিয়ে মাথা ন্যাড়া হয়ে মরা গঙ্গার নর্দমার ধারে কিছু চাল ছড়িয়ে এয়েছে।‘ নবেন চমকে ঊঠে বলল,’গয়া যায় নি হতভাগা? আমাকে বলল যে সব কাজ ঠিক ঠাক করে এসেছে আর তুমিও নাকি স্বপ্নে ওকে আশীর্বাদ করেছ।‘‘বলেছে বুঝি?’ হতাশ হল ভিখন।‘টাকাটা ঘোড়ার রেসে লাগিয়ে খুইয়েছে। গুহ্য কথাটা তোমাকে বলে ফেললুম নবেন, ওকে জানিও না, পরের বছর শ্রাদ্ধটাও দেবে না।‘ নবেন তেতে ঊঠে বললেন,’কেন, পিণ্ড না পেলে খাওয়া হবে না? শরীর তো নেই, খাওয়ার নোলাটা
এবার তো ছাড়তে পার। খেয়ে খেয়েই তো মরলে, মরার পর আর নাই বা খেলে’। ভিখন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, অন্তত নবেনের তাই মনে হল। শরীর নেই তাই কোন আওয়াজ হল না। বলল,’কথা তোমার ফেলনা নয় নবেন ভাই। তবে পরকালের জন্য শ্রাদ্ধটা দরকার। ও তুমি বুঝবে না। বলি আত্মার সদগতি, ঊর্ধগতি বলে একটা ব্যাপার আছে সে তুমি মান আর নাই মান। নেবু পণ্ডিতকে মনে আছে নবেন?’
‘মনে থাকবে না মানে? কি কানমলা না খেয়েছি। ধাতুরূপ,শব্দরূপ,ব্যাসবাক্য,সমাস – ওঃ, জ্বালিয়ে দিয়েছিল।‘
‘আমিও কম কানমলা খাইনি। তবে আমার মেয়াদটা কম ছিল। ক্লাস এইটে ডুব দিলুম, আর উঠিনি। তোমরা টেন পর্যন্ত টেনেছিলে নেবু পণ্ডিতকে।‘
‘কিন্তু সে তো কবে মরে ভূত হয়ে গেছে, বহুকাল হল’। নবেনের অবাক ভাব কাটে না। ‘দ্যাখা হল নাকি তার সঙ্গে?’
‘সেই কথাই তো বলছিলুম।‘ ভিকনের গলায় একটু উত্তেজনার আভাষ।‘তোমার বাতাবী লেবু গাছের নিচে হঠাত দেখা।‘
‘অ্যাঁ, বল কি হে,’ নবেন আঁতকে উঠলেন।‘আমার লেবু গাছে আস্তানা গেড়েছে নেবু পণ্ডিত? মতলবটা কি বলত?’
‘উঁহু, গেড়েছে না। গেড়েছিল। আমাকে দেখেই পাকড়াল। আরে, ভিকন না? পালাতে গিয়েও পারিনি।‘
‘শব্দরূপ, ধাতুরূপ ধরেছিল?’
‘নাহ, তা ধরেনি। কিন্তু ভারী কাজের কথা বলল। পরলোকের গুহ্য কথা। এতদিন শুধু এদিক ওদিক ঘুরে বেড়িয়েছে, সদ্গতি হয়নি। দুঃখ করছিল। ছেলেরা সব হিল্লী দিল্লী করছে কিন্তু বাপের কথা একবারও ভেবে দেখেনি। ঘুমের মধ্যে দু দুটো ছেলেকে নড়া ধরে ভয় দেখিয়েছে, বুঝিয়েছে, কাকুতি মিনতি করেছে। কাজ হয় নি। ছেলেরা সাফ বলে দিয়েছিল ওসব গয়ায় পিণ্ডি দেওয়া শুধু পাজির পাঝাড়া পাণ্ডাদের আস্কারা দেওয়া। ও তারা করতে পারবে না। ছোট ছেলে এক কাঠি উপরে। বিরক্ত হয়ে বলেছিল সকালে তার কোথায় যাওয়ার আছে। ঘুমের ব্যাঘাত তার পছন্দ নয়। আরো একটা উপদেশও দিয়েছিল নেবু পন্ডিতকে।‘
নবেন ভারী অবাক হয়ে বললেন,’বলো কি হে। নেবু পন্ডিতকে উপদেশ?’
‘তাই নিয়ে দুঃখ করছিল পন্ডিত। বলল, হতভাগা ছোঁড়া আমকে বলল সোজা গয়া চলে যেতে, টিকিট লাগবে না, হাওয়াই জাহাজের চেয়েও জোরে ভেসে যেতে পারবে হাওয়ার সঙ্গে। গয়ায় সব পিণ্ড খেতে তো আর তেনার আসেন না। অনেক পড়ে থাকে। তারই একটা খেয়ে নিতে।‘
‘ভারী দুঃখ হচ্ছে নেবু পণ্ডিতের কথা ভেবে। ছেলেগুলো সব কুলাঙ্গার’। তেতে উঠেছিলেন নবেন।
‘খাঁটি কথা, নবেন ভাই। সেদিন সন্ধ্যেবেলা আমার জমির ওই খেজুর গাছটার নিচে বসে অনেক কিছুই ভাবছিলুম। হঠাৎ দেখি হুস করে নেবু পণ্ডিত আমার পাশ দিয়ে উপরের দিকে উঠে যাচ্ছে। ধড়মড় করে উঠে কিছুদূর গেলুম পণ্ডিতের সঙ্গে। নেবু পণ্ডিতের মুখটা কেমন আলোয় আলো। বলল, ভিকন চললুম রে। এতদিনে সদগতি হল। নাতিটা শেষমেষ গয়ায় গিয়েছিল। রবিঠাকুর, বিদ্যাসাগর, রামঠাকুর, এদের সঙ্গে দেখা হবে বলে মনে হচ্ছে। ভাবতেই কেমন আনন্দ হচ্ছে রে ভিকন। তবে তোর সদগতির কোন আশা দেখছিনে। তাই বলছিলুম নবেন ভাই, ওই শ্রাদ্ধটা বোধহয় দরকার। একটু একটু করে উপরে উঠব, অনেক কাল লেগে যাবে, সদগতি হলেও হতে পারে।‘
আরো কিছু বলবে বলে মুখ খুলেছিল ভিকন, কিন্তু হুস করে ফাটা বেলুনের মত চুপসে গেল। ঘুম ভেঙ্গে ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসেছিলেন নবেন। ঘেমে গেছেন। প্রিয়বালাও ঊঠে পড়েছিলেন। দু ঢোক জল খাইয়ে গামছা দিয়ে ঘাম মুছিয়ে উৎকন্ঠিত হয়ে জিগ্যেস করেছিলেন,’কি হোল বলত? শরীর খারাপ লাগছে?’
না। ভালো চায়ের লিকার বানিয়েছে প্রিয়বালা, গন্ধে ভুর ভুর করছে। নবেনের বিকেলের চায়ে কোন বাধা নেই, কয়েকটা কোবরেজি বড়ি যোগ হয়েছে।
চায়ে চুমুক দিয়ে ধরণী বললেন,’তুই আর ভালো মানুষ হয়ে থাকিস না। ভিকনের সাহস বেড়েছে, এখন দিনে দুপুরে হানা দিচ্ছে। এরপরে খাওয়ার সময়ে হানা দেবে, চাই কি এই বিকেলের চায়ের সময়ও ভুশ করে ভেসে উঠে আবার ফুস করে মিলিয়ে যেতে পারে। না হে নবেন, ওকে দু’কথা শুনিয়ে দে। বড্ড বাড় বেড়েছে দেখছি। মরার আগেতো শুধু ভালো ভালো খাওয়া নিয়ে ভালো মানুষ হয়ে থাকত। আমি বারণ করেছিলুম, ওরে ভিকন এভাবে তেল মশলা গুরু পাচ্য খাবার তোর লিভারের বারোটা বাজিয়ে দেবে। সংযমী হ একটু। উলটে আমাকে দু’কথা শুনিয়ে দিত। বলত, শরীরতো যাবে একদিন ধরণীদাদা, রোখা যাবে না। যখন রোখাই যাবে না তখন ভালোটা ছাড়ব কেন? ভারী কষ্ট পেয়েছিল বেচারা শেষের দিকে। জন্ডিসে কাবু হয়ে পড়ল, খেতেই পারত না।‘ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ধরণী। ‘তা আজকে কিছু বলছিল ভিকন? পরকালের গুহ্য কথাগুলো জানলে বেশ মন্দ হোত না।‘
পরের দিনের সকালের মহানিমের কথা ভেবে নবেনের মন এমনিতেই তেতো ছিল। ভিকনের কথা আসতেই চিড়বিড় করে উঠলেন নবেন, ’তুমি কি করে ভাবলে কিছু বলিনি আমি? জোর ঝেড়েছি। বলেছি, তোর জন্যই আমার ঘুমের দফারফা, প্রেশার, সকালে আমার হাতে মহানিম। শুনে ফিচিক করে হাসল, বলল-আমিও যদি মহানিম রোজ সকালে খেতাম তা হলে জণ্ডিসটা হত না, আরো কিছুদিন ভালো খাওয়াটা টানা যেত। চালিয়ে যাও, আমার জন্যই তোমার এই মহা ওষুধ। স্বয়ং রবি ঠাকুরও খেতেন কিনা।‘
ধরণী খুশি হয়ে বললেন,’বাঃ, ভিকনের আক্কেল হয়েছে দেখছি। তা সে মরার পরে হলই বা। দেখলি নবেন, ধরণী কোবরেজের দাওয়াই নিয়ে ট্যাঁ ফুঁ করার জায়গা নেই। তা আসল কথা কিছু বলল, ইয়ে মানে ওই পরকালের কথা?‘
প্রিয়বালার ভালো লাগছিলনা, গা ছম ছম করে এসব কথা আলোচনা হলে, কিছু অশুভ আত্মার উপস্থিতি টের পায় যেন। বললেন,’থাক না এসব কথা। তোমরা বরং দাবা নিয়ে বসো, মাথার চিন্তাগুলো অন্যদিকে দাও’। প্রিয়বালা উঠে গেলেন। সন্ধ্যা দিতে হবে।
ধরণী ফিস ফিস করে বললেন,’জানিস নবেন, ভিকনের ব্যাপারটা কেমন যেন নেশার মত টানে আমাকে। ওপারে কি হচ্ছে কিচ্ছু জানা যায় না এপার থেকে, সবটাই আঁধার, কুয়াশায় মোড়া। আদৌ কিছু আছে কিনা? এখন মনে হয় আছে। না হলে ভিকনের মত বাকীরা আছে কোথায়? নেবু পণ্ডিত বা কোথায় গেল? না হে যত ভাবি তত রহস্য ঘনায়।‘
‘আমারও তোমার মত অবস্থা।‘ স্বীকার করলেন নবেন।‘ঘুমটা মাটি হচ্ছে ঠিকই, তবে রহস্যটা ধরার জন্য মুখিয়ে আছি। কিন্তু ভিকন ভাংছে না, কিংবা ভাঙ্গতে পারছে না। ঠিক সময়টাতে ফুস করে হাওয়া হয়ে যায়। আমার মনে হয় পরকালেরও একজন কর্তাব্যক্তি আছেন, যিনি চান না গুহ্য কথা ফাঁস হোক। তাই যতবার ভিকন বলতে চেয়েছে ততবারই ফুস করে দিয়েছেন।‘
‘আগে পিছু থেকে কিছু আন্দাজ করতে পারিস?’ জানতে চাইলেন ধরণী।
‘কিছুটা, পুরো নয়। আমার মনে হয় ভিকন সদ্গতির জন্য মরিয়া হয়ে ঊঠেছে।‘ জানলা দিয়ে বাইরের দিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিলেন নবেন।‘নেবু পন্ডিতের চলে যাওয়াতে বড্ড একা লাগছে, মনে ভাবছে ওর বুঝি আর সদ্গতি হল না’।
‘কিন্তু ওরা থাকছে কোথায়? ভিকনদের মত মানুষেরা কিংবা নেবু পণ্ডিতের মত মানুষেরা।‘ স্বগোতোক্তি করলেন ধরণী।
কপাল টিপে বসে চিলেন নবেন। হঠাত সোজা হয়ে বসে বললেন,’আমার কি মনে হয় জান ধরণীদা, ওরা ওদের ভারী কোন পছন্দের জায়গায় আটকে থাকে। যতদিন টান থাকে ততদিন আটকে থাকে লাটাইর সুতোতে ঘুড়ির মত। টান ছিঁড়ে গেলেই ভোঁ কাট্টা। আমার বাতাবী লেবুর গাছে নাকি নেবু পণ্ডিত আটকে ছিল। ভিকনতো তাই বলল।‘
‘বলিস কিরে?‘ অবাক হলেন ধরণী। ‘এত দিন থানা গেড়ে বসেছিল তুই জানতেই পারিস নি। বালাকে বলিস না আবার, ভয়ে ওদিকে পা বাড়াবে না। কিন্তু ভিকনের আস্তানা কোথায়?’
দুজনে চুপচাপ বসে রইলেন, সামনে দাবার ঘুঁটি সাজানো, কিন্তু একটাও চাল চলেনি। দুজনে সেদিকে তাকিয়েই বসে, চিন্তা একটাই। ভিকন কোথায়?
***********************
সকালে লাঠি ঘোরাতে ঘোরাতে ধরনী হাজির হয়ে দেখেন নবেন মহানিমের সরবত শেষ করে ফেলেছেন। চোখে মুখে অনিদ্রার ছাপ নেই। বললেন,’কি হে, কাল ভিকন আসেনি? ভোঁ কাট্টা? কিন্তু কি করে? এর মধ্যে তো কেঊ গয়া যায়নি।‘
নবেন দাঁড়িয়ে পড়ল, উত্তেজনায় চোখ চক চক করছে। বললেন,’আমি জানি ওর আস্তানা, চল যাওয়া যাক, ফিরে এসে চা খেও।‘
ধরণী অবাক হয়ে বললেন,’বলিস কি রে? তোকে ভিকন বলেছে? আমাকে বলিসনি তো?’
‘উঁহু, বলেনি খোলসা করে। কিন্তু আমি ধরে ফেলেছি।‘ পা বাড়ালেন নবেন, পেছন পেছন ধরণী।
ভিকনের জমিতে কাজ হচ্ছে। পুকুর খোঁড়া হয়েছে, নবেনের পুরনো পুকুরের সঙ্গে জুড়ে দেবে বর্ষা এলেই। বেশ দিঘীর মত দাঁড়াবে। নতুন খোঁড়া পুকুরের মাটি দিয়ে বাঁধাই হচ্ছে পুকুরের পাড়, তৈরি হচ্ছে নতুন বাগানের জমি। নানান রকমের আম এসে বসবে। একটা লম্বা সিড়িঙ্গে খেজুর গাছ এখনও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। পুকুর কাটা আর কিছুটা এগোলেই কাটা পড়বে গাছটা। দু’জনে এসে দাঁড়ালেন। ধরণী বললেন,’কি হল নবেন, ভিকনের আস্তানা দেখাবি বলেছিলি না?’ ‘এটাই ভিকনের আস্তানা ধরণীদা।‘ গাছটাকে জরিপ করতে করতে বললেন নবেন। অবাক হয়ে দেখছিলেন ধরনী। অবিশ্বাসের গলায় বললেন,’কি করে জানলি?’‘এখানেই নেবু পণ্ডি তের সঙ্গে ভিকনের শেষ দেখা।‘
ধরণী বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলায় দুলছেন, গায়ের রোম খাড়া হয়ে উঠেছে। নবেনের কথা ফেলতেও পারছেন না, আবার নিতেও পারছেন না। ‘কি আছে এখানে যাতে ভিকন আটকে আছে এখানে?’ কথাটা স্বগতোক্তির মত করে বললেও শুনতে পেয়েছেন নবেন।
বললেন,’সেটাই তো আমি ভাবছি, ধরণীদা। কেন এখানে ভিকন আটকে আছে? কিছু কি আছে এখানে, সেটাই কি আমাকে বলার জন্য ওর আপ্রাণ প্রয়াস, কিন্তু বলতে পারেনি।‘
হঠাত লাফিয়ে উঠলেন নবেন। ‘মনে আছে তোমার, ভিকন গাছ বাওয়ায় কেমন ওস্তাদ ছিল। যে গাছ বাওয়ায় ওস্তাদ সে যদি কিছু রেখে থাকে তাহলে গাছের উপরেই আছে। মাটিতে পুঁতে রাখলে বৃষ্টিতে ধুয়ে ভেসে যেতে পারে, বা যায়গাটা পরে চেনা নাও যেতে পারে। কিন্তু গাছের উপরে রাখলে বিশেষ করে কাঁটাওয়ালা খেজুর গাছে তা হলে তা কোনদিন হারাবে না। গাছ বাড়বে আপন খেয়ালে, আর লুকনো জিনিষ আরও সুরক্ষিত হবে। অবশ্য এটা আমার ধারনা ধরণীদা, ঠিক নাও হতে পারে।‘ নবেনের কথা একেবারে ফেলে দিতে পারছেন না ধরণী। বললেন,’ডাক কাউকে, গাছে উঠুক’।
অনেক দিনের পুরনো খেজুর গাছ, নারকেল গাছের মত মসৃণ হয়ে আছে। দুশো টাকার রফায় কোদাল ফেলে নগেন উঠে এল, নারকেল গাছ বাইতে পারে ও। পায়ে দড়ি জড়িয়ে কোমরে কাটারি গুঁজে সড় সড় করে উঠে গেল নগেন। নবেন নীচ থেকে চেঁচিয়ে বললেন,’এক এক করে ডাল কাটতে থাক। থামতে বললে থামবি।‘
খচাখচ কাটারি চলছে আর ঝুপঝাপ ডাল পড়ছে। গাছ প্রায় ন্যাড়া হয়ে এল। ধরণী বললেন,’না রে নবেন, উপরে কিছু নেই। মিছি মিছি দুশো টাকা দিলি’।
নবেনেরও তাই মনে হচ্ছিল। হঠাত টুং করে শব্দ হল, একটা জং ধরা নস্যির কৌটো পড়েছে নীচে। নবেন হেঁকে বললেন,’এবার নীচে নেমে আয়। আর কাটতে হবে না।‘
কৌটো খুলতে বেগ পেতে হল বেশ। ছিপি জং ধরে আটকে গেছে। কোদালের বাঁট দিয়ে আস্তে আস্তে ভাঙ্গা হল। জীর্ণ ন্যাকড়ার ভেতর থেকে বেরুল একটা ছোট আংটি। নবেনের গলার কাছে এক দলা কান্না, কোনমতে বললেন,’আমার পৈতের আংটি ধরণীদা। হারিয়ে গেছিল, কি মার না খেয়েছিলাম বাবার হাতে।‘
****
‘নবেন ভাই, আমার লজ্জাটাকে আর সবাইকে জানিও না’।
ভিকন ভাসছে, চোখে মুখে আলো। ‘বড় খোকাকে বলো আর গয়া যেতে হবে না। আমি উপরের টান অনুভব করছি নবেন ভাই, একে আটকানো আমার ক্ষমতার বাইরে। ভেবেছিলুম আমার লজ্জা যেন কেউ টের না পায় কোনদিন। কিন্তু বুঝতে পেরেছিলুম এর নিস্পত্তি না হলে আমার সদ্গতি হবে না। বলি বলি করেও তোমাকে বলতে পারিনি। আমাকে ক্ষমা করে দিও ভাইটি’।
নবেনের মনে হল ভিকন কাঁদছে। মনটা খারাপ হয়ে গেল। বললেন,’ভিকন, আমার মনে কোন দুঃখ নেই, কোন অভিযোগ নেই। ভালো থেকো কি তোমাকে বলা যায়, জানি না।‘
ভিকন দূরে সরে যাচ্ছে। হাওয়ায় ভেসে এল কয়েকটা কথা, ’মহানিমের সরবতটা কিন্তু ছেড়ো না।‘
Comments
Top
সমুদ্রে
সুমাত্রা
মন্দিরা বসু
সেদিনের সেই ছোট্ট ফুটফুটে সুমি‚ আজ সুমাত্রা। সুমাত্রা বসু। স্কটিশচার্চ কলেজ থেকে এবার ইতিহাসে ফার্ষ্ট ক্লাস ফার্ষ্ট হয়েছে। উঃ‚ কি ভালো লাগছে সুমির। আমার সমস্ত পরিশ্রম আজ সার্থক। সকালে তাড়াতাড়ি ঘুম ভাঙ্গতেই ইন্টারনেটে নিজেই দেখেছে। কিন্তু কিভাবে বলা যায়? ডাকবে? নাঃ‚ তার আগে একটু বেরোতে হবে। ব্যাস নিঃশব্দে বাড়ী থেকে বেরিয়ে সোজা নিউমার্কেট। একটা বড় লালগোলাপের তোড়া কিনে একটা ট্যাক্সী করে বাড়ী ফিরল।তাড়াতাড়ি না ফিরলে বাপি আবার অফিসে বেরিয়ে যাবে। সিঁড়ি দিয়ে উঠেই একদম মায়ের মুখোমুখি।
- 'হ্যাঁ, রে সুমি‚ কাউকে কিছু না বলে‚ ফট করে কোথায় বেরিয়েছিলি‚ সক্কালবেলা?' মা বললো।
- 'আজ তোর রেজাল্ট আউট হয়েছে না? রোল নং টাও আমাকে দিস নি যে আমি নেট এ দেখবো। আমাদের তো দারুন টেনশন হচ্ছে।' পৌষালীর গলা পেয়েই সৌমদীপ তাড়াতাড়ি টয়লেট থেকে বেরিয়ে এল।
সুমির মাকে উদ্দেশ্য করে বললো - ‘কি গো, সুমি ফিরেছে আমাকে ডাকনি কেন? নিজে একাই বকে চলেছ? আর সুমি তোর কি ব্যাপার বলতো? সক্কাল বেলাই নিখোঁজ?’
- ‘হা, হা, হা‚ সারপ্রাইজ সারপ্রাইজ’ বলে দুজনের সামনে গোলাপের তোড়াটা তুলে ধরল।'
মা‚ বাপি দুজনেই একসঙ্গে বলে উঠল - 'মানে কি সারপ্রাইজ? গোলাপ কেন‚ তোর রেজাল্ট কি হল?'
- ‘হুঁম‚ গেস করো‚ গেস করো ...... নাঃ পারলে না তো?’
- 'সুমাত্রা বসু ফার্ষ্ট ক্লাস ফার্ষ্ট‚ কি বিশ্বাস হচ্ছে? বলেই বাপি আর মাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরল|
বাপি চেঁচিয়ে উঠল - ‘সাবাস‚ ওয়েলডান‚ ওয়েল ডান মাই সুইট বেবি।’ মা কাছে টেনে কপালে একটা চুমু খেল‚ সত্যি আজ এত আনন্দ হচ্ছে বলার নয়। বাপি সঙ্গে সঙ্গে - ‘আজ নো অফিস। আজ নো রান্নাবান্না। চলো সবাই মিলে আজ লংড্রাইভে যাবো। বাইরে খাবো। দ্যাটস ইট।’ ‘ও বাপি‚ দাঁড়াও‚ আমি আগে মার্কশিটটা নিয়ে আসি। কলেজে বন্ধুদের সঙ্গেও একটু সেলিব্রেট করে নি। লক্ষ্মী বাপি‚ তুমি আজ অফিস চলে যাও। কাল আমরা সকালেই বেরিয়ে পড়বো, প্রমিস।’ বাপি বলল ‘বলছিস? মা-ও বললো ‘সত্যিই তো ওকে বন্ধুদের সঙ্গে একটু আনন্দ করতে দাও।মার্কশিটটাও তো আনতে হবে।’ ‘রাইট‚ রাইট ইউ আর।তাহলে ঐ কথাই রইল। কাল সকাল সাতটায় আমরা বেরিয়ে পড়বো‚ ডান?’ সুমি উত্তর দিল ‘ডান।’
তারপর সুমি কলেজে যেতেই‚ সব্বাই হৈ হৈ করে এসে সুমিকে ঘিরে ধরলো। ট্রিট‚ ট্রিটচাই‚ কোন অজুহাত চলবে না। সুমাত্রা মোটামুটি রেডি হয়েই এসেছিল। বলল দাঁড়া‚ আগে মার্কশিটটা নিই‚ তারপর সবাই মিলে ক্যান্টিনে যাবো।তার আগে রুসা গিয়ে কানাইদাকে স্পেশাল কিছু তোদের যা ইচ্ছা অর্ডারটা দিয়ে আয়‚ বানাতেও তো সময় লাগবে।
রুমেলা বলল ‘আরে সেটা তোকে ভাবতে হবে না। আমরা অলরেডি অর্ডার দিয়ে দিয়েছি।’
‘না রে‚ তোর খুব বেশী খসাবো না। কোল্ডড্রিন্ক‚ এগডেভিল আর লাষ্টে জমিয়ে এককাপ করে কফি। কি রে অসুবিধা করলাম না তো?’ বললো তুহিন।
সুমি বলল ‘ধ্যাৎ ছাড়তো। আজ তোদের যা মনে হয়েছে তাই খাওয়াবো। রুমি‚ চল তো মার্কশিটটা নিয়ে আসি।’
মায়ের ফোন ‘এই সুমি আমি সবাইকে খবর দিয়ে দিয়েছি। সবাই প্রাণ ভরে তোকে আশীর্বাদ জানিয়েছে।’
সুমি ‘ওঃ মা এখন থাক না‚ প্লিজ। আমাকে একটু সেলিব্রেট করতে দাও। পরে বাড়ী গিয়ে কথা হবে‚ ওকে।’ ফোনটা কেটে দিল। এবার সারাদিন হৈহুল্লোড় করে ক্লান্ত শরীরে সন্ধ্যেবেলা বাড়ী ফিরল সুমি। বাপিও অফিস থেকে এসে গেছে কিছু খাবার দাবার কিনে নিয়ে। সুমি গিয়ে ধপ করে ওদের সামনে বসে পড়ল। ক্লান্তিতে শরীর আর বইছে না।তবু মা‚ বাপির সঙ্গে খানিক গল্প করে উঠে গেল ফ্রেশ হতে| টয়লেট থেকে বেরিয়ে সামান্য কিছু মুখে দিয়ে বাই করে শুতে চলে গেল। কাল আবার সকালে উঠতে হবে| সৌমরাও তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ল। অবশ্য পৌষালী সকালের জন্যে একটু গুছিয়ে রেখে তার পর শুতে গেল।
সকাল থেকেই সৌম্য হাঁক ডাক করে সবাইকে জাগিয়ে ঠিক সাতটাতেই বেরিয়ে পড়ল। তারপর সারাদিন যত হৈহৈ মজা করে ঘোরাঘুরি হল। রাস্তাতেই ব্রেকফাষ্ট সেরে নিয়েছিল। কোথায় যাওয়া হবে কোন উদ্দেশ্য নেই গাড়ী ছুটেই চলেছে। অবশেষে ডায়মন্ডহারবারে গঙ্গার ধারে দাঁড়িয়ে পড়লো। পুরো সাত ঘন্টা ড্রাইভ করে সৌম্য ওখুব ক্লান্ত। আর সুমিতো লাফ দিয়ে নামল। পেছনে ধীরে সুস্থে পৌষালী।
পৌশালী বলে ‘উঃ তোমার এখনো এতো এনার্জি? বাব্বা‚ সেই কোন সকালে বেরিয়েছ এখনও সুমি জেদ না করলে তুমি থামতে না।’
‘অফকোর্স। আমি আরো কিছুদুর গিয়ে তবে থামবো ঠিক করেছিলাম। ঐ সুমির জন্যেই বাধ্য হয়ে.......’
‘ওঃ বাপি আমি এতো ধকল আর সহ্য করতে পারছিলাম না। জানো তো কাল সারাদিন বন্ধুদের সঙ্গে হৈহৈ করেছি।রাতে কঘণ্টা রেষ্ট। আর পারা যায়?’
‘নাও চল পেটে তো ছুঁচোয় ডন দিচ্ছে। সামনেই সাগরিকা‚ সরকারী হোটেল ব্যবস্থাও ভালো শুনেছি। চল ওখানে গিয়ে একটু ফ্রেশ হয়ে লাঞ্চটা সেরে নিই।’
‘আবার ফিরতে তো সন্ধ্যে হয়ে যাবে’ বললো সৌম্য। বাপির কথা শেষ হওয়ার আগেই সুমি মায়ের হাত ধরে ঢুকে পড়েছে সাগরিকাতে। ওখানে ফ্রেশ হয়ে লাঞ্চ করে বেরিয়ে গঙ্গার ধারে বসে একটু রেষ্ট নিয়ে আবার শুরু হল যাত্রা।তবে এবার বাড়ীর উদ্দেশ্যে। বাড়ী ফিরে তিনজনেই এতো টায়ার্ড যে সবাই ফ্রেশ হয়ে একটু কফি খেয়ে একেবারে বিছানায়। তারপর আত্মীয়স্বজনের আসা যাওয়া, মামার বাড়ীতে যাওয়া এইসব করে কটা দিন বেশ কেটে গেল।এবার ইউনিভারসিটিতে ভর্তি হওয়ার পালা। সুমির অবশ্য কোন চিন্তা নেই। ওর রেজাল্টই ওর বড় প্রমাণ| তাও নিয়ম মত সবই করতে হল। বাপি ছিল সঙ্গে ফর্ম ফিলাপ করে জমা দিয়ে বাড়ী ফিরল।
নির্দিষ্ট দিনে এডমিশনও হয়ে গেল। ঐ দিন ওদের কলেজের তিনজনের সঙ্গে দেখাও হল। ওরাও চান্স পেয়েছে কলকাতা ইউনিভারসিটিতে। সুমি খুশিই হল। প্রথম থেকেই বন্ধু দু-একজন থাকলে সুবিধা হয়। ওদের সঙ্গে ঠিক করে নিল প্রথমদিন কটায় মিট করবে। তারপর রুটিন দেখে কোথায় ক্লাশ জেনে তবে সেই ঘরে যেতে হবে। ওদের বাই করে বাড়ী ফিরল সুমি। প্রথমদিন ইচ্ছে করেই সুমি মায়ের একটা শাড়ী পরে একটু সেজেগুজেই ইউনিভারসিটিতে গেল। ছেলেমেয়ে সবারই বেশ নজর পড়ছে সুমির দিকে।দেখতে তো ভালো রংটা অবশ্য একটু চাপা। তবে আজ হালকা গোলাপী শিফনটাতে দারুণ লাগছে ওকে। রুমেলা আর রুশার সঙ্গে রুটিন দেখে চলল তেরো নম্বর রুমে। ফার্ষ্ট পিরিয়ড প্রফেসর সমুদ্র সেনের। উনি খুবই গুণী মানুষ‚ গোল্ডমেডালিষ্ট। তাই শুধু নয় নিয়মিত ওনার লেখা আর্টিকেল পত্রপত্রিকাতে ছাপা হয়। তাই উনি স্বনামধন্য।সুমিও ওঁর লেখা কিছু কিছু পড়েছে ভালো লাগে ওনার লেখার ষ্টাইলটা। কিন্তু কোনদিন চাক্ষুষ দেখেনি শুধু ফটো দেখেছে। তাই মনে মনে একটু এক্সাইটেড ছিল। কারণ ছবিতেই ওনাকে দারুণ লেগেছে সুমির। স্যার ক্লাশে ঢুকতে সবাই উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান জানালো। উনি সবাইকে বসতে বললেন। সুমি কিন্তু ওনার মুখের দিকে চেয়ে বসার কথা ভুলেই গেল। পাশ থেকে রুমেলা হাত ধরে টান দিল ‘কিরে বস‚ সবাই হাসাহাসি করছে তো’।এবার সুমির খেয়াল হতেই ধপ করে বসে পড়লো। কিন্তু চোখ ওনার দিকে। কি সুপুরুষ চেহারা। লম্বা‚ দোহারা চেহারা‚ বয়েসটা বোধহয় ফর্টির কাছাকাছি হবে। চুলে দু-একটা রুপালীরেখা উঁকি দিচ্ছে। সবচেয়ে আকর্ষক ওঁর চোখদুটি| চোখে সত্যিই সমুদ্রের গভীরতা। সুমি তো ওঁর চোখের থেকে আর চোখ সরাতেই পারছে না। এপাশ থেকে রুশা লক্ষ্য করে ওকে ধাক্কা দিয়ে বলল ‘এই সুমাত্রা কি করছিস? স্যার কি ভাববেন বলতো?’ সুমির সম্বিত ফেরে তাইতো, ছি ছি‚ কি করছেও। বাড়ী ফিরেও বারবার অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছে সুমি। খালি সমুদ্র সেনের মুখটা চোখের সামনে ভাসছে। নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করে আমার এমন হচ্ছে কেন? কি যেন একটা ভালোলাগা অনুভুতি। একেই কি বলে লাভ এট ফার্ষ্ট সাইট? ধ্যাৎ, আমি এসব কি ভাবছি? উনি একজন বয়স্ক ভদ্রলোক। হয়তো ওনার স্ত্রী‚ পুত্র আছে। না না আমার এরকম ভাবা উচিৎ নয়। সারারাত বিছানায় এপাশ ওপাশ করেই কেটে গেল‚ একটুও ঘুম এল না। নাঃ কিছুতেই মন থেকে মুছে ফেলতে পারছে না। ঐ টানাটানা চোখ দুটি যেন ওকে আকর্ষণ করে চলেছে। অসম্ভব আমি কিছুতেই ওঁকে মন থেকে মুছে ফেলতে পারবো না। সকালে ঘর থেকে বেরিয়েই মায়ের মুখোমুখি| মায়ের নজরে পড়েছে চোখে মুখে অনিদ্রার ক্লান্তি|‘হ্যাঁ,রে সুমি, একি চেহারা তোর? সারা রাত ঘুমাসনি? আয়নায় চোখ মুখের অবস্থা দেখেছিস?’ শুরু হল মায়ের জেরা। ‘না না‚ মা কিছুই হয়নি তো। এমনি কাল ইউনিভারসিটির প্রথম দিন ছিল‚ তাই খুব এক্সাইটেড লাগছিল তো রাতেও গুলো ভেবেই ভালো ঘুম হয়নি’ বলে পাশ কাটিয়ে টয়লেটে ঢুকে গেলাম| সমুদ্র সেনের ফার্ষ্ট পিরিওড কিছুতেই মিস করা চলবে না। তাই চট করে অল্প ব্রেকফাষ্ট করেই বেরিয়ে পড়ল সুমি। মনে সেই একজনের চিন্তাই ঘোরাফেরা করছে। ওনার পড়ানোর ভঙ্গিটাও খুব সুন্দর। আর কি দরাজ গলার পরিস্কার উচ্চারণ সত্যি সবাই মুগ্ধ হয়ে শোনে।ক্লাশে গিয়ে সুমি পড়া শুনবে কি শুধু ওনার মুখের দিকেই তাকিয়ে আছে কিছুই তার কানে ঢুকছে না। দু-একবার স্যারের নজর পড়ে যাচ্ছে ওর দিকে| স্যার নিজেই যেন অপ্রস্তুত হয়ে যাচ্ছেন। নাঃ এভাবে হবে না। সুমি এবার সমুদ্র সেনের খবর নিতে শুরু করল। কোথায় বাড়ী‚ বাড়ীতে কে কে আছেন‚ সব জানা হয়ে গেল| নাঃ যা ভেবেছিল সেটা নয়। বাড়ীতে উনি বিধবা মাকে নিয়ে একাই থাকেন। নিউআলিপুরে নিজেদের দোতলাবাড়ী ওনার বাবাই করে গেছেন। এবার শুরু হল বাপির কাছে বায়না। বাপি‚ আমি সমুদ্র সেনের কাছে টিউশন নেব তুমি ব্যবস্থা করে দাও। অগত্যা বাপি গেলেন খোঁজ নিতে। কিন্তু বিধি বাম। উনি টিউশনি করেন না। সমুদ্র বললেন ‘দেখুন‚ আমি একটু লেখালেখি করি। এইসব নিয়েই ব্যাস্ত থাকি। সেইজন্য আমি কাউকে ঠিক সেভাবে পড়াতে পারি না। যার যা কিছু জিজ্ঞাস্য থাকে‚ আমি ক্লাসেই বারবার বলে বুঝিয়ে দিয়ে থাকি। তাও সবাইকে বলি যদি কারো কোন অসুবিধা হয় ক্লাসেই সমাধান করে নিতে।’ কিন্তু বাপি তো নাছোড়বান্দা। জানে সুমি যখন বলেছে যে করেই হোক রাজী করাতেই হবে। নাহলে
সুমির মুখের দিকে তাকানো যাবে না‚ হয়তো খাওয়া বন্ধ করে দেবে। উঃ ভাবতে পারছি না।বারবার রিকোয়েষ্ট করতে শেষে উনি বললেন দেখুন ও একটা কাজ করতে পারে। ছুটির পরে আমার সঙ্গে চলে যেতে পারে আমার বাড়ীতে যেদিন ওর সম্ভব হবে। আমি ওকে ঘণ্টাখানেক সময় দিতে পারি। তবে সেটা রোজ নয়‚ আর এর জন্যে কোন পারিশ্রমিকও আমি নিতে পারবো না। সুমিতো শুনে আহ্লাদে আটখানা। পরদিনই শুরু করলো যাওয়া।ওখানেই স্যারের মায়ের হাতে বানানো জলখাবার দুজনে মিলে খেয়ে তারপর পড়তে বসা।বলেছিলেন এক ঘণ্টা কিন্তু বোঝাতে গিয়ে কোথা দিয়ে দুঘণ্টা কেটে যেত কেউই বুঝতে পারতো না। সুমি তো বরাবরই সিনসিয়ার ষ্টুডেন্ট তাই মন্ত্র মুগ্ধের মত ওনাকে ফলো করতো। সমুদ্রও ওর একাগ্রতা দেখে খুব খুশি। ওনার সব নোটস সব সুমিকে দিয়েছেন জেরক্স করে নিতে। কিন্তু সুমি যতক্ষণ সমুদ্রের সামনে থাকে ও যেন সমস্ত জগৎ সংসার ভুলে যায়। কেবল হাঁ করে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। পড়া বোঝাতে গিয়ে সমুদ্রের ও মাঝে মাঝে ওর চোখে চোখ পড়ে যায়। সমুদ্রও বোধ হয় মনে মনে দুর্বল হয়ে পড়ছে সুমির প্রতি। কিন্তু নিজের আদর্শতাকে আবার বাস্তবে ফিরিয়ে আনে। ভাবে ও আমার ছাত্রী অল্প বয়েস এসব আমার ভাবাই ঠিক নয়। সমুদ্রের মা ব্যাপারটা কিছুটা আঁচ করেছেন। একদিন ছেলেকে বলেও ফেললেন ‘দেখ সমু‚ সুমাত্রা মেয়েটি কিন্তু বেশ। পড়াশুনায় তো ভালো বটেই ব্যবহারও বেশ নম্র। আর দেখতেও মোটামুটি সুন্দরীই বলা চলে‚ বল?’ ‘হ্যাঁ মা‚ কিন্তু তুমি এসব কথা বলছো কেন বলত?’ ‘না‚ এমনি বলছি| তুই যখন ফ্রেশ হতে যাস ও তখন রোজ আমার কাছে আসে। কি বানাচ্ছি‚ কেমন করে করছি আগ্রহ নিয়ে দেখে আমার সঙ্গে হাতও লাগায়। কদিনেই মেয়েটা বড় আপন করে নিয়েছে। ’এবার সমুদ্র উত্তর দেয় ‘দেখ মা‚ তুমি যে সম্পর্কের কথা ভাবছো মনে মনে সেটা কিন্তু ঘুণাক্ষরেও ওকে টের পেতে দিও না। মা তোমার ছেলের বয়েস হয়েছে আর সুমাত্রা সদ্য যুবতী। ’‘জানি রে সবই জানি। কিন্তু ওনিজেই তো হাবেভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে ও তোকে ভালোবেসে ফেলেছে সত্যি সত্যি। এক ফাঁকে টুক করে তোর ঘরে ঢুকে তোর ঘরটা একটু গুছিয়ে রেখে আসে। আমার চোখে কিছুই এড়ায় না।’ সমুদ্রও তো সত্যিই মনে মনে ওকে ভালোবেসে ফেলেছে। কিন্তু কিছুতেই প্রকাশ করতে পারে না। বয়েসটা ওর সামনে একটা ভারী পাথরের দেওয়াল হয়ে দাঁড়ায়।এমন করেই কেটে গেল তিনটে বছর। পরীক্ষা হয়ে গেছে। এখন আর সমুদ্রের বাড়ী যাওয়ার কোন ছুতো খুঁজে না পেয়ে শেষে মায়ের কাছে টুকটাক রান্না শিখে সেটা স্যারকে দেওয়ার অছিলায় রোজই হাজির হয়ে যায় সমুদ্রের খাওয়ার সময়। নিজে বসে স্যারকে খাওয়ায় আবার মায়ের জন্য রেখেও আসে। দেখতে দেখতে রেজাল্ট আউটের সময় এসে গেল।রেজাল্ট বেরোতে দেখা গেল সুমাত্রা দারুণ রেজাল্ট করেছে। সব স্যারেরাই প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
কিন্তু সুমি কারোর প্রশংসাকেই পাত্তা দেয় না ওর একজনের মুখের কথাটুকুই দরকার| বিকেলে কিছু খাবার আর একগোছা রজনীগন্ধা নিয়ে গেলো স্যারের বাড়ী। খাবার কিছুটা প্লেটে সাজিয়ে আর ফুলের গোছাটা হতে নিয়ে দাঁড়ালো সমুদ্রের সামনে। খাবারটা টেবলে রেখে ফুল হাতে নিয়ে নিচু হয়ে স্যারকে প্রণাম করতে যেতেই ‘এই কি করছো‚ ওঠ ওঠ’ বলে সুমির হাত ধরে দাঁড় করালো সমুদ্র। এবার একটা গিফ্ট প্যাক সুমির হাতে দিয়ে বললো ‘তোমার ভালো রেজাল্টের পুরস্কার।’ সুমি তাড়াতাড়ি খুলে দেখে একটা ডায়মণ্ডের নেকলেস। দারুণ খুশি। এবার আবদার নিজে হাতে পরিয়ে দিতে হবে।
সমুদ্র বলে ‘আমি তো এসব পরাতে হয় কিভাবে জানি না’।
‘ও সব জানি না পরিয়েই দিতে হবে‚ নইলে আমি নেব না। থাক তাহলে রেখেই দিন।’
‘উঃ‚ তুমি আমাকে মহাঝামেলায় ফেললে তো সুমি| আচ্ছা দেখি‚ এদিকে এস’ বলে অনেক চেষ্টা করে পরিয়ে দিল নেকলেসটা। এবার সুমি ঢিপ করে একটা প্রণাম করে দৌড়ে চলে গেল মায়ের কাছে। ‘কিরে‚ খুব খুশি লাগছে‚ কি ব্যাপার? রেজাল্ট তো ভালো হয়েছে জানি কিন্তু এটাতো অন্য খুশির খবর মনে হচ্ছে’ বলেন সমুদ্রের মা। সুমি কিছু বলার আগেই ঢিপ করে একটা প্রণাম করেই জড়িয়ে ধরে খুব আদর করতে লাগলো সমুদ্রের মাকে।
‘দেখ মেয়ের কাণ্ড। আরে কি ব্যাপার সেটাতো বলবি।’
‘এই দেখো মা তোমার ছেলে আমায় নিজে হাতে পরিয়ে দিয়েছে আমার ভালো রেজাল্টের পুরস্কার’‚বলে নেকলেসটা দেখায়।
মা বলে‚ ‘তাই? বাঃ ভারী সুন্দর মানিয়েছে তোকে।’
এবার খুব খুশিখুশি মুখে বাড়ী ফেরে সুমি।
‘কিরে সারাদিন কোথায় ছিলি? তোর বাপিও জানতে চাইছিল’ বলে পৌষালী।
কোথাও না মা‚ স্যারের বাড়ীতেই ছিলাম।
যদিও মেয়ে কিছুই শেয়ার করে না‚ তবু পৌষালীর মনে একটু খটকা লাগছে কিছুদিন ধরেই।
সব সময় স্যারের কথা‚ তার মায়ের কথা ছাড়া মেয়ের মুখে আজকাল আর কোন কথা নেই।বন্ধুদের কথাও কিছুই শোনা যায় না। মায়ের মন মেয়ের হাবেভাবে চলাফেরায় কিছুটা তো আন্দাজ করেই নিয়েছে। কিন্তু বয়সের ফারাকটা তো একটা বড় বাধা কি করে মেনে নেবে ভেবেই পায় না পৌষালী। এমনিতে তো সবই ঠিক আছে। অমন স্কলার ছেলে‚ বাড়ী‚ গাড়ী সবই আছে। বাড়ীতে শুধু মা ছাড়া কেউ নেই। সবদিক থেকেই ভালো। কিন্তু ওর বাপি কি মেনে নিতে পারবে? একমাত্র সন্তানকে ওরকম একজনের হাতে তুলে দিতে?
সুমি মাকে ধাক্কা দিয়ে বললো ‘হ্যালো কোথায় হারিয়ে গেছ তুমি? আমি সামনে দাঁড়িয়ে অথচ তুমি কোন অতলে তলিয়ে গেছ আমার দিকে নজরই নেই’। পৌষালীর উত্তরের অপেক্ষা না করে সুমি নিজেই বলল ‘তুমি বসো আমি চেঞ্জ করে আসছি।’ জামা পাল্টিয়ে এসে মায়ের মুখোমুখি বসলো সুমি।
এবার মায়ের চোখ পড়ল ‘হ্যাঁ রে, তোর গলায় ওকি? অমন সুন্দর ডায়মণ্ড নেকলেস কে দিলো তোকে?
‘সমুদ্র দিয়েছে মা। ও নিজে হাতে পরিয়ে দিয়েছে। ও‚ দাঁড়াও’ বলে উঠে গিয়ে মাকে একটা প্রণাম করল।
‘জানো মা ওর মাকেও প্রণাম করেছি| তারপর নেকলেসটা হাত দিয়ে ধরে বলে ‘ওর দেওয়া আমার জীবনের প্রথম গিফ্ট। এ যে আমার কাছে অমুল্য মা, তাইতো তোমাদের আশীর্বাদ নিয়ে তোমাদের স্বীকৃতি চেয়ে নিচ্ছি। মা তো হাঁ করে কথাগুলো শুনছে আর ভয়ে বুক শুকিয়ে যাচ্ছে। ওর বাপি শুনে কি বলবে? কিন্তু আর তো দেরী করা চলে না। আজই সব বলতে হবে ওর বাপিকে।
সুমি মায়ের মনের অবস্থা আন্দাজ করে বললো ‘মা‚ তুমি বাপিকে ভয় পাচ্ছো? তুমি কিছু চিন্তা করো না আমি আজই খাওয়ার সময় বাপিকে সব বুঝিয়ে বলবো।’
‘দেখো বাপি কিন্তু আপত্তি করবে না। বয়েস একটু বেশী তো কি হয়েছে মা। আগের দিনে তো এরকম বয়েসের ফারাকেই বিয়ে হত। আর সমুদ্রকে দেখলে মোটেই বোঝা যায় না ওর বয়েস চল্লিশ পেরিয়েছে। মায়ের মনের দ্বিধা তবু কাটতেই চায় না| রাতে খাওয়ার সময় ঠিক বাপির নজর পড়েছে নেকলেসটার দিকে। ‘বাঃ ওয়াণ্ডারফুল! এটাকে চয়েস করেছে রে? আমার মামনি না তোর মা? ’‘না বাপি‚ আমরা কেউই নই। আমার এমএর রেজাল্টের জন্যে সমুদ্র আমাকে গিফ্ট করেছে। নিজেই চয়েস করে এনেছে। ’‘তাই? বাঃ, পছন্দ আছে তো ছেলেটার। তোকে মানিয়েছেও খুব সুন্দর। ‘হুম ‚ তাহলে........ এবার আমাদের বাড়ীতে ডাক একদিন ওকে। ভালো করে আলাপ করি। ’‘বাপি শুধু ওকে বললে তো হবে না ওর মাকেও বলতে হবে। ’‘ও হ্যাঁ নিশ্চয় নিশ্চয়। এসব ক্ষেত্রে মা-বাবাদের তো প্রয়োজন হয়ই। ‘তুই এক কাজ কর মা। নেক্স্ট সানডেতে লাঞ্চে ওদের বলে দে। না না থাক এটা আমারই কর্তব্য। আমি নিজে ওদের বাড়ীতে গিয়ে বলে আসবো‚ আর ওর মায়ের সাথেও আলাপ করে আসব।’ সুমির তো আনন্দ আর ধরে না। বাপিকে কিছুই বলতে হল না। বাপি সবটা বুঝেও নিয়েছে একসেপ্টও করেছে। মা চুপ করে দুজনের কথা কেবল শুনেই গেল। কোন উত্তর করেনি। এবার ঘরে গিয়ে সৌম্যকে চেপে ধরল। তোমার কি ব্যাপার বলতো? তুমি যেন আগে থেকেই সব জানতে মনে হচ্ছে। আর সব কিছু বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে ও নিলে।একটা অতবয়স্ক ছেলে আর আমাদের সুমির কিই বা বয়েস?‘ দেখ চোখ কান খোলা রাখলেই সব বোঝা যায়। তুমি প্রথম থেকেই ধর না। সুমির জেদ ধরা সমুদ্রের কাছে পড়বেই সে।তারপর অমন সুপুরুষ চেহারা‚ অতো কোয়ালিফায়েড। নির্ঝঞ্ঝাট ফেমিলি। যদি বয়েসের বাধা নিয়ে তুমি আপত্তি কর‚ তাহলে আমাদের একমাত্র আদরের সন্তানকে হারাতে হবে জেনে রেখ। ‘তার চেয়ে মেয়ে যা চাইছে সেটা মেনে নাও। এতে সুমি আর আমরাও সুখে থাকবো। ’পরের রবিবার সমুদ্র তার মাকে সঙ্গে নিয়ে এল। মায়ের হাতে একটা বড় মিষ্টির প্যাকেট। সৌম্য বললো ‘এটার কি কোন দরকার ছিল দিদি? ’‘অবশ্যই ছিল। শুভ কাজের কথা বলতে গেলে মিষ্টি তো মাষ্ট। ’সবাই হো হো করে হেসে পরিবেশটা হালকা করে ফেলল।একেবারে সবাই মিলে খাওয়ার টেবলেই বসা হল| প্রচুর আয়োজন। খেতে খেতেই সৌম্য কথাটা পাড়লেন। সমুদ্রের মায়ের তো হাতে চাঁদ পাওয়ার অবস্থা। সুমি লাল শাড়ীতে আর লজ্জায় আরো লাল। আর সমুদ্র জানি বারণে ঈষৎ নত বদন। খাওয়া মিটলে একেবারে পঞ্জিকা দেখে সবচেয়ে কাছের দিনটাই ঠিক করা হল। ওরা চলে যাওয়ার পরে সুমি বাপির গলা জড়িয়ে ধরে আমার সুইট বাপি বলে খুব আদর করল। কারণ সুমি এতোটা আশাই করেনি একেবারে বিয়ের দিন পর্যন্ত ঠিক। ‘ওরে ছাড় ছাড় এখন কত কাজ আমার’ বলে বাপি বেরিয়ে গেল। বিয়ের জন্য বাড়ী বন্দোবস্ত করেই দুটো সুইজারল্যাণ্ডের টিকিট বুক করে তবে ফিরলেন সৌম্য। কিন্তু টিকিটের ব্যাপারটা গোপনই রইলো। মাত্র পনের দিনের মধ্যে দুই বাড়ীতেই জোগাড় যন্ত্র সব সারা। অবশ্যও বাড়ীতেও বেশীর ভাগ দায়িত্বই সৌম্য কাঁধে তুলে নিয়েছিল। নির্বিঘ্নে বিয়ে বৌভাত সব মিটে গেল। সুমিতো খুশিতে ঝলমল করছে।ওদিকে সমুদ্র আর তার মাও খুব খুশি। আর পৌষালীর মনে এখনো একটু দ্বন্দ তাই পুরোপুরি সবার তালে তাল দিতে পারছে না। বৌভাতের দিন ফিরে আসার ঠিক আগে সৌম্য আড়ালে সমুদ্রকে ডেকে বললো ‘এই নাও তোমাদের সারপ্রাইজ গিফ্ট। জানি তোমার ছুটি বেশী নেই তাই সাতদিনের সুইজারল্যাণ্ডের ছোট্ট টুর কাম হানিমুন। এটা কিন্তু আমার মামনিও জানে না। ’পরদিন সকালে দুবাড়ীর সবাই এয়ারপোর্টে। ওদের চেক ইন হয়ে গেছে। ভিতর থেকে এসে একবার দেখা করে বাই করে হাত ধরাধরি করে চলে গেল। সৌম্যরা আর সমুদ্রের মা সবাই আনন্দাশ্রু মুছতে মুছতে গাড়ীতে উঠে বাড়ীর দিকে রওনা দিল।
Comments
Top
কবি সম্মান
আইভি চট্টোপাধ্যায়
এক দেশে এক রাজা ছিলেন। উঁহু, রাজা নয়, রাজা নয়। এখন আবার রাজা কোথায়! এখন মন্ত্রীরাই রাজা। এক দেশে এক মন্ত্রী ছিলেন। মন্ত্রী খুব কবিতা ভালোবাসেন। রাজদরবারে নিত্য নতুন কবির আগমন। কবিকে সম্মান-প্রদর্শন,বিশেষ দক্ষিণা সহযোগে আপ্যায়ণ, নানা উত্সবে আমন্ত্রণ .. এমন সব রাজকীয় নিয়ম আছে। রাজকার্যে মন্ত্রী দেশে বিদেশে গেলে জনা দু’ তিন কবি, একজন আবৃত্তিকার, জনা দুই গাইয়ে সঙ্গে থাকেন।
মন্ত্রী নিজেও কবিতা লেখেন। দুর্জনেরা অবশ্য সেগুলোকে কবিতা বলতে নারাজ। নেহাত বাল্যখিল্য ছড়া। তবে ছড়া বলে কি আর কবিতা নয়! কে না জানে, ছন্দে লিখলেই কবিতা।মন্ত্রীর ছড়ার বই থুড়ি কবিতার বই দেশজুড়ে পাঠ্যপুস্তক হয়েছে। দুলে দুলে শিশুরা সে সব কবিতা মুখস্থ করে পরীক্ষার খাতায় লিখে আসে। মন্ত্রী নিজে সর্বক্ষণ ছড়া কেটে কেটে ছন্দে কথা বলতে ভালোবাসেন। স্বভাবকবি মন্ত্রী রোজই নতুন নতুন কবিতা থুড়ি ছড়া তৈরী করেন। সেসব কবিতা মন্ত্রীর সভাসদদের মুখে মুখে আরো প্রচার হয়। নিজের কবিতা ছাড়াও মহাকবিদের কবিতার লাইন মন্ত্রীর ঠোঁটস্থ। কবি জাতটার ওপর তাঁর প্রগাঢ় শ্রদ্ধা। দ্যাখ না দ্যাখ, কেমন টপাটপ কবিতা লিখে ফেলেন তাঁরা। রাজকার্যের বিপুল চাপ, রাজকর্মের নানা পরিকল্পনা, দেশের নানা সমস্যা। কম টেনশন! মন্ত্রী সে থেকে মুক্তি পাবার জন্যে কবিতা পড়েন। কবিতা তাঁকে সব টেনশন, সব সমস্যা থেকে মুক্তি দেয়। নানা দপ্তরের কাজের জন্যে অনেকগুলো কমিটি তৈরী করেছেন মন্ত্রী। প্রতি কমিটিতে একজন কবি থাকবেনই। বিশেষ সম্মান-দক্ষিণায় তাঁরা বিশেষভাবে নিয়োজিত। কর্ম-সংক্রান্ত মিটিং-এর শুরুতেই একটি কবিতাপাঠের ব্যবস্থা আছে। যাতে কাজ শুরুর আগে দপ্তরের সব কর্মীর মাথা টেনশন-মুক্ত হয়।
তবু মন্ত্রীর মনে সুখ নেই। নিত্য রাজসভায়, জনতার সভায় কবিতা উদ্ধৃতি দিতে গেলে নিত্যসঙ্গী একজন কবি চাই। তিনি মন্ত্রীর বক্তৃতা লিখে দেবেন, রাজসভায় কবিতা পাঠ করে সবার মাথা ঠান্ডা রাখবেন। তাছাড়া রাজদরবারে একজন সভাকবি না হলে চলে? এখন মুশকিল এই যে, মন্ত্রীর প্রিয় কবিরা সবাই এক এক দপ্তরের উপদেষ্টা পদে আছেন। কোনো একজনকে সভাকবির পদ দেওয়া যায় না। ইতিমধ্যেই মন্ত্রী একটা কবিতা অ্যাকাডেমি তৈরি করেছেন। বছরে একবার কবি-অ্যাকাডেমি-অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়। আর কী করা যায়!ভেবেচিন্তে মন্ত্রী এক কবিতা প্রতিযোগিতার আয়োজনের আদেশ দিলেন। প্রথম পুরস্কার পাওয়া কবিকে হাজার স্বর্ণমুদ্রা দক্ষিণার সঙ্গে ‘কবিকিঙ্কণ’ উপাধি দিয়ে সভাকবি পদে অভিষেক করা হবে। চারদিকে ধন্য ধন্য পড়ে গেল। অনেককাল দেশে এমন সংস্কৃতিমনস্ক রাজা, থুড়ি মন্ত্রী পাওয়া যায় নি। মানুষের উন্মাদনার সীমা নেই।
সেই দেশে থাকে এক ভোলারাম। চাষবাসই হোক, আর সংসারে জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠই হোক, ভোলারামের নিষ্ঠার অভাব নেই। তবু ভোলারামের কপালে কেবল নিন্দেমন্দ জোটে। সবচেয়ে বেশি লাঞ্ছনা বউয়ের কাছে। ভোলারামের বউ সর্বদাই নিজের ভাইদের সঙ্গে তুলনা করে ভোলারামকে নিষ্কর্মা অকর্মণ্য বলে বলে গঞ্জনা দেয়। বেচারা কিছুতেই আর বউ এবং শ্যালকদের খুশি করতে পারে না।
পুকুরঘাটের পড়শিনীদের জটলা থেকে খবর পেল বউ, একহাজার স্বর্ণমুদ্রার খবর। ব্যস, একবার সভাকবি হতে পারলেই হল। ‘খেটে রোজগার করার মুরোদ নেই, এবার ঘরে বসে রোজগারের সুযোগ এসেছে। আর কোনো অজুহাত শুনব না। একখান মাত্র কবিতা। তা পারবে না?’
শ্যালকরা বলল,‘এই একটা কাজ করে দেখাও তো বুঝি। আমাদের বোনটার কথা তো ভাবতে হবে তোমায়। একবার ভাবো দেখি, হাজার স্বর্ণমুদ্রা। আর তোমায় ক্ষেতের কাজে, ঘরের কাজে খাটাতে পারবে না কেউ। পায়ের ওপর পা তুলে জমিদারি করবে কেবল ।‘
বৌও বোঝালো,‘তা নয়ত কি? প্রথমেই তো কয়েক বিঘে জমি কিনে ফেলব। একটা মাত্র কবিতা লিখেই জমিদারি। এমন সুযোগ আর আসবে?’
শুনতে শুনতে ভোলারামের মনেও ঘোর লেগে গেল। জেগে জেগেও সভাকবি হবার স্বপ্ন। আহ, তাহলে আর বউয়ের গঞ্জনা শুনতে হবে না। আসতে যেতে শ্যালকরা কুর্নিশ করবে। সারা দেশে নাম ছড়িয়ে পড়বে। আহা, সত্যি সত্যি যদি এমনটা হয়!
তিনটে খাতার তিন দিস্তে কাগজ শেষ হয়ে গেল। কবিতা হল না। এক ডজন কলম খারাপ হয়ে গেল। দেখেশুনে বউ এক বাক্স পেনসিল এনে দিল। আর একখানা মোটা খাতা। লেখা পছন্দ না হলে মুছে মুছে লিখবে। খাতার ওপর ‘ওম সরস্বত্যই নম:’ লিখে মন্দির থেকে ফুল বেলপাতা এনে পুজো করে নিল ভোলারামও।
কিছুতেই কিছু হয় না। কবিতা লিখতে গেলে রচনা হয়ে যায়। কিংবা তাল দিয়ে দিয়ে গান। এমন কবিতা চলবে না। বেশ অন্যরকম লিখতে হবে, যা একবার শুনলেই সবার তাক লেগে যাবে। হাজার স্বর্ণমুদ্রা তো আর এমনি এমনি দেবে না।গ্রামের স্কুলের মাষ্টারমশাই কবিতার ক্লাস খুলেছেন। উপসর্গ হল মাথায় টনটনে ব্যথা। দাঁতে কনকনে যন্ত্রণা। কবিতার অ আ ক খ, কবিতার ব্যাকরণ, ছন্দ লয় মাত্রা সব শিখছে ছেলেরা। বউ ভোলারামকে কবিতা-ইশকুলে ভর্তি করে দিল।
কবিতার ক্লাসে গিয়ে কিন্তু ভোলারাম কিছুতেই জুত করতে পারে না। কবিতার ব্যাকরণ শুনতে গিয়ে ঘুম এসে যায়। ঘুমিয়ে পড়লে তো চলবে না। রাত জেগে জেগে নতুন নতুন শব্দ মুখস্থ করতে হয়। নতুন এদিকে বোসপাড়ার দুলো, নবীনগরের তুলো, মৌহাটির কুলো সব্বাই টপাটপ কবিতা নামিয়ে ফেলছে রোজ। মাষ্টারমশাই বলে দিয়েছেন, অন্তত একশ’টা কবিতা লিখে ফেলতে হবে। তার মধ্যে থেকে সেরা কবিতাখানা বেছে দেবেন তিনি।
পুকুরপাড়ে গিয়ে বউ সব খবরই পায়। এত কবিতা লিখে ফেলছে সবাই, অথচ নতুন মোটা খাতার পাতায় একটা পেন্সিলের আঁচড় কাটা হয় নি ভোলারামের। বউ বাড়িতে তুলকালাম করছে রোজ। কোনোদিন খাওয়া বন্ধ, কোনোদিন ঘুমোনো বন্ধ, কোনোদিন কথা বন্ধের শাস্তি চলছে।
একদিন মাষ্টারমশাইয়ের কাছে বেশ কান্নাকাটি করে ফেলল ভোলারাম। মাষ্টারমশাই বোঝালেন,‘শোনো বাবা ভোলারাম, কবিতা লেখা কিন্তু যার তার কম্মো নয়। শুধু গুটিকয় শব্দ সাজিয়ে দিলেই হবে না। প্রথমে শব্দটা মাথায় খেলাতে হবে। শব্দের এক একটা অক্ষর বেশ গভীরে প্রবেশ করবে, কুলকুণ্ডলিনী জাগ্রত হবে, শিরশির করবে সারা শরীর, সেই হল সৃষ্টির বিশেষ ক্ষণ। পাত পেড়ে বসে পড়লাম আর হাপুসহুপুস ভাত খেয়ে ফেললাম, তেমন তো নয়। কবিতা ছাড়া জীবন পানসে, এমন একটা গভীর অনুভুতি চাই। সাধনা চাই। অন্তরের প্রেরণা চাই। প্রেরণা বলতে কিন্তু রক্তমাংসের মানুষ নয়। অন্য একটা কিছু। গভীর একটা বোধ। সব সময় যা জাগিয়ে রাখবে। চেতনাকে জাগ্রত রাখা, ঘুমের মধ্যেও জেগে থাকা, অত সহজ নয়।‘ ততক্ষণে বুঝে ফেলেছে ভোলারাম, আর যা-ই হোক, কবিতা হবে না। বুকের মধ্যে টনটনে কষ্ট, মাথার মধ্যেটা ভার। একলা একলা হাঁটতে হাঁটতে নদীর ধারে এসে পৌঁছল। ‘কবিতাই হল না, আমার আর বেঁচে থেকে কি লাভ, এ জীবন লইয়া কি করিব’ নদীর জলে ঝাঁপ দিল ভোলারাম। শীতের বিকেল। কনকনে ঠান্ডা জল। সারা শরীর শিরশির করে উঠল। চমকে উঠল ভোলারাম। এই তো সেই অপার্থিব অনুভুতি! সারা শরীর শিরশিরিয়ে উঠে কুলকুণ্ডলিনী জাগ্রত হওয়া একেই বলে নাকি! ঠিকই তো। কবিতা ছাড়া জীবন পানসে, এ অনুভুতিটা বেশ চিনতে পারছে। আর একটা কি যেন বলছিলেন মাষ্টারমশাই? ওহো, চেতনাকে জাগ্রত রাখা। চোখ খোলা রাখো হে ভোলারাম, জেগে থাকো। ঠান্ডা জলে গলা পর্যন্ত শরীর ডুবিয়ে রেখে কাঁপতে কাঁপতে চারপাশে তাকাল।
কই, কিছুই তো দেখা যাচ্ছে না। চারদিকে জনমনিষ্যি নেই। নদীর ধারের দিক থেকে গাছের একটা লম্বা ডাল এঁকেবেঁকে এসে পড়েছে জলের মধ্যে। সেই ডালে বসে একটা কাক অলস ভঙ্গীতে এক একবার জলে ঠোঁট ডুবোচ্ছে, আবার মাথা তুলে এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখছে। ফের ঠোঁট ডুবোনো, ফের মুখ তুলে চারদিকে চাওয়া। নিরাসক্ত দার্শনিক ভঙ্গী। একহাত দূরে জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে একটা জলজ্যান্ত মানুষ ঠকঠকিয়ে কাঁপছে, সেদিকেও দৃষ্টি নেই কাকের।
হঠাত্ সত্যিই নাভিমূল পর্যন্ত শিউরে উঠল ভোলারামের। ‘রক্তমাংসের মানুষ হলে হবে না, প্রেরণা চাই’। তবে কি এই কাকই সেই ঈশ্বরপ্রেরিত প্রেরণা? তাহলে এখনই কবিতা আসবে? হে ভগবান, হে মা সরস্বতী, দাও দাও কবিতা দাও! দয়া করো ভগবান! আশীর্বাদ করো!
আচ্ছা, কাকের ভালো নামটা কি যেন! বায়স। বাহ, সারসের সঙ্গে মিল হয় বেশ। শ্বেত শুভ্র সারস, আর কালো কাক। না না কালো নয়, কালো নয়। কৃষ্ণ। ‘হে কালো কাক’ না বলে ‘অহো কৃষ্ণ বায়স’ বলা বেশি ভালো।
কাকটা ঠোঁট ডুবিয়ে একখানা জ্যান্ত মাছ তুলে আনল এ সময়। আপাদমস্তক শিউরে উঠল ভোলারাম। কৃষ্ণ বায়স। তীক্ষ্ণ ঠোঁট। ঠোঁটের ভালো প্রতিশব্দটা কি যেন! মনে পড়ল না। যাকগে, শব্দ মনে করতে গিয়ে কবিতাটা ছেড়ে গেলে মুশকিল। কৃষ্ণ বায়স কেমন হাঁ করে মাছ ধরছে দ্যাখো! ছটফটে মাছটাকে গপ করে গিলে নিল কাক! কৃষ্ণ বায়সের হাঁ মুখ। হাঁ নয়, হাঁ নয়। ভালো একটা শব্দ চাই। মুখের ভেতর। গহ্বর। ভাবতে ভাবতেই মাথায় কবিতার লাইন:
জলের মধ্যে ডুবিয়ে দাও
ডুবিয়ে দাও জলের গভীরে
তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণতর
হে কৃষ্ণগহ্বর
চঞ্চলা চপলকে গ্রাস করো
হে স্থিতধী কৃষ্ণ
আমি যে তোমার মন পড়তে পারি
নাচতে নাচতে বাড়ি এল ভোলারাম। মগ্ন ভাব, উদ্দীপ্ত দৃষ্টি।রকম সকম দেখে বৌও আর ঘাঁটাতে ভরসা পায় না। এমন মেজাজ না হলে কবিকে মানায়! মনে গভীর পুলক, বউ চিড়ে-মুড়ি বেঁধে পুঁটুলিতে খাতা-কলম ঢুকিয়ে দিল, রাজসভায় যাবে ভোলারাম।
‘ওসব খাতা ফাতা লাগবে না’, জোরে জোরে হাত নাড়ে কবি ভোলারাম, ‘কবিতা আমার মাথায় আছে।‘ বউ তো বটেই, শ্যালকদেরও সপ্রশংস দৃষ্টি। আহা, সরস্বতীর বরপুত্র বুঝি এমনই হয়! রাজসভার দৃশ্য টিভিতে লাইভ দেখানো হবে আজ। মন্ত্রীর শ্বেতশুভ্র বসন, মঞ্চের চারদিকে সাদা চাদর। সঞ্চালক বিগলিত হাস্য, মন্ত্রীর সিংহাসনের পাশেই বসার অধিকার যে আজ। পারিষদরা গম্ভীর মুখে সচেতনভাবে টিভি ক্যামেরার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে আছেন। সামনে সারি সারি টেবিলে সারি সারি মাইক্রোফোন। সারি দিয়ে বসে আছেন দেশের নামী দামী কবিরা, তাঁরা সকলেই আজ বিচারক।
বিশাল হলঘরের পেছনে একদিকে নীল রঙের অর্ধবৃত্তাকৃতি চাঁদোয়া। এক এক চাঁদোয়ার নিচে অন্তত তিনশ কবির বসার ব্যবস্থা। আরেকদিকে ফুল ফুল সিল্কের ছাউনির নিচে দর্শকের আসন। মঞ্চ, হলঘর, বসার সব জায়গা সাজানো হয়েছে সাদা রজনীগন্ধা, হলুদ গাঁদা আর নীল অপরাজিতায়। দরজার পাশে পাশে মঙ্গলঘটে ঘন সবুজ আম্রপল্লব। মঞ্চ জুড়ে সাদা আল্পনা, দেশের নামী চিত্রকর এঁকেছেন। মঞ্চের পেছনের দেয়াল জুড়ে চিত্রকররা ছবি এঁকেছেন। সবুজ মাঠ, লাল সূর্য, সোনালী তোরণ, নীল পতাকা।নামী অনামী সব কাগজ থেকে, পত্রিকা থেকে সাংবাদিক সমালোচক এসেছেন, একবাক্যে ঘাড় নাড়লেন। হ্যাঁ, জম্পেশ ব্যবস্থা হয়েছে বটে।
দেখেশুনে ভোলারামের মুখ শুকিয়ে গেল। কত কবি। কত দূর দূর থেকে এসেছে। শীর্ণমুখো, চশমাচোখো, হুঁকোমুখো। কেউ লম্বা দাড়ি, কেউ খোঁচা দাড়ি। কারো কাঁধে ঝোলা, কারো পরনে জোব্বা। কেউ লিখেই চলেছে। কেউ ল্যাপটপ নিয়ে একমনে টাইপ করে চলেছে। কেউ ফিসফিস করে কবিতা বলছে। কেউ বক্তৃতার মত একনাগাড়ে আবৃত্তি করে চলেছে। কোথাও বা পাঁচ সাতজনের এক একটি দল, তারা আবার বুড়ো কবি দেখলেই নাক কুঁচকে মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে। দশ বারোজন কবির একটা দল জোরে জোরে কবিতার আধুনিক ব্যাকরণ নিয়ে আলোচনা করছে। লম্বা সাদা দাড়ি, কাঁধে ঝোলা এক কবি মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে জোরে জোরে কবিতা আন্দোলনের ইতিহাস শোনাচ্ছেন। তাঁকে ঘিরে কবিতা-বিপ্লবীদের একটা বড় দল। সেদিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছেন বাউল-কবি। মাঝে মাঝে খোলা গলায় গানের সুরে কবিতা বলে উঠছেন। দর্শক আসন থেকে মুহূর্মুহু হাততালি। টিভির ক্যামেরা নিয়ে ছেলেমেয়েরা এদিক সেদিক ছুটে বেড়াচ্ছে। এত মজা, কাকে ছেড়ে কাকে ধরি ভাব। হাজার হাজার কবি। লক্ষ লক্ষ কবিতা। লম্বা কাগজে, মোটা খাতায়, ছবির মতো
পোস্টারে, পতাকার মত নিশানে। দেখেশুনে ভোলারামের গলা শুকিয়ে এল। তার তো কুল্লে সাড়ে পাঁচখানা লাইন। শোনাতে পারবে তো মন্ত্রীমশাইকে?
মন্ত্রীর ডানদিকে লম্বা টেবিলে দশজন বিশিষ্ট কবি। নানা দেশ থেকে আমন্ত্রণ করে আনা হয়েছে। তাঁরা কেউ কারো সঙ্গে কথা বলেন না। কেবলই ঘাড় নাড়েন, আর কাগজে কি সব লেখালেখি করেন। কারো কবিতা শুনে গম্ভীর মুখে এ ওর দিকে তাকান। সভার দর্শক জনতা হয়ত হাসতে হাসতে হাততালি দেওয়া শুরু করেছিল, কবিদের মুখ দেখে তাড়াতাড়ি শোকস্তব্ধ নীরবতা পালন করে। মন্ত্রীর বাঁ দিকে লম্বা লম্বা পাঁচখানা টেবিল।
পাঁচখানা টেবিল রাখার জন্যে এদিকটা সিঁড়ি করে দেওয়া হয়েছে। এক এক সিঁড়িতে এক একখানা টেবিল। যাতে সবাইকে বেশ দেখা যায়। এঁরা বিশেষ অতিথি। মন্ত্রীমশাইয়ের যে
কোনো সভার আয়োজনে এঁরা উপস্থিত থাকেন। দর্শকদের বিশেষ চাহিদার কথা মাথায় রেখে এই ব্যবস্থা। সিনেমা - অভিনেতা, নাট্য - অভিনেতা থেকে শুরু করে আবৃত্তিকার সঙ্গীতশিল্পী গাইয়ে বাজিয়ে গীতিকার চলচ্চিত্র -পরিচালক টিভি সিরিয়াল - পরিচালক প্রযোজকদের মস্ত দল। আছেন বিশিষ্ট খেলোয়াড়, ফুটবল ক্রিকেট টেনিস ব্যাডমিন্টন থেকে দাবা সাপলুডো খেলোয়াড়রাও। টিভিতে রিয়েলিটি শো করে উঠে আসা নতুন মুখের পাশাপাশি বিগত যুগের অভিনেতা সাহিত্যিক কবি গায়ক। সেকালের রাজাদের নবরত্ন - সভার কথা মাথায় রেখে মন্ত্রীর এই বিশেষ রত্নসভা। অন্তত নব্বই রত্ন। দর্শকের মূল আকর্ষণ।বিচারক কবিরা কবিতা শুনে গম্ভীর হয়ে পড়লে এই রত্নসভা মাথা নিচু করেন। কবিরা মুচকি হাসলে হাততালি দিয়ে হাসেন। কোন কবিতায় বিচারক কবিরা দন্ত - বিকশিত করে হাসেন। তখন রত্নসভার কেউ কেউ মুখের মধ্যে হাত দিয়ে বিশেষ আওয়াজ করেন। ভোলারাম আজ জেনেছে,এই বিশেষ মুদ্রাকে ‘সিটি মারা’বলে। এই মুদ্রাটি ব্যবহার হলে দর্শক আসন থেকে লোকজন উঠে নৃত্য প্রদর্শন করেন। রত্নসভাও তাতে যোগ দেন। মন্ত্রী হাততালি দিয়ে ঘাড় নাড়েন। নামী রঙ্গকৌতুক শিল্পী এ সভায় বিদূষকের পদে আছেন। তিনি তখন একটি শিঙা বাজিয়ে কবিকে সম্মান প্রদর্শন করেন।
এক একবার বিচারক কবিদের মধ্যে কবিতার ব্যকরণ ছন্দ মাত্রা বৃত্ত নিয়ে তর্ক লাগে। দর্শক শ্রোতারা উন্মুখ হয়ে জ্ঞানগর্ভ সেসব তথ্য শোনে। একসঙ্গে এতজন তত্ত্বজ্ঞানী সর্বজ্ঞানী কবির দেখা পাওয়া ভাগ্যের কথা। আবেগপ্রবণ কেউ কেউ জোড়হাত কপালে ঠেকিয়ে ফেলে। নবীন কবিরা ডায়েরির পাতায় নোট নিতে ব্যস্ত। প্রবীণ কবির দল গম্ভীর মুখে কখনো মাথা দুলিয়ে সায় দেন, কখনো রাগ করে মুখ ফিরিয়ে থাকেন। মন্ত্রীমশাই কবিতা শোনেন এক মনে। মাঝে মাঝে হাই তোলেন, তখন পাঠরত কবিকে সভা থেকে বার করে দেওয়া হয়। কবিতা শুনে মন্ত্রী মুচকি হাসলে কবিকে রৌপ্যমুদ্রা পুরষ্কার দেওয়া হয়। মন্ত্রীমশাইয়ের দন্তবিকশিত হলে স্বর্ণমুদ্রা পুরষ্কার। তারিফ করে মন্ত্রী ডানদিকে ঘাড় দোলান, তখনই কবিকে একটি কমিটিতে নিয়োগপত্র দেওয়া হয়। মন্ত্রীর ঘাড় যদি বাঁ দিকে দোলে, তখন কবিকে আগামী পূর্ণিমায় কবিসভার জন্যে আগাম দক্ষিণা দিয়ে নিমন্ত্রণপত্র দেওয়া হয়।
কবিতা শুনতে শুনতে মন্ত্রী পেছনপানে চাইলে রত্নসভার সবাই হাততালি দিয়ে ওঠেন। একজন বা দুজন বিশিষ্ট রত্ন পাঠরত কবিকে নিয়ে নৃত্য প্রদর্শন করেন। মন্ত্রী যদি সামনের দিকে ঝুঁকে চক্ষু মুদিত কারেন, কবিকে উজ্জ্বল তাম্রপাত্রে বিশেষ উপঢৌকন দেওয়া হয়। দেশের নামী অনামী ছোট বড় হাজার খানেক অ্যাড-এজেন্সি এই উপঢৌকন দেওয়ার জন্যে উন্মুখ অপেক্ষায় রাজসভার বাইরে সারি দিয়ে বিপণী খুলে রেখেছেন।
প্রথম তিন দিন ভোলারাম বসার জায়গাই পায় নি। দাক্ষিণাত্যের কবিরা বিদায় নেবার পর চারদিনের অপরাহ্নে সভায় বসার জায়গা পেল। কবিতা পড়ার ডাক পেল আরো তিনদিন পরে। খালি হাত, কাগজ কলম নেই। কবিকে দেখে সভা অবাক।
ভুল লোক মঞ্চে উঠে পড়েছে ভেবে টিভি ক্যামেরাগুলো রত্নসভার ছবি দেখাতে লাগল। জীর্ণ পোষাক, গলায় একটা উড়নি পর্যন্ত নেই, রুক্ষ চুল, শীর্ণ মুখ, খালি পা। অজানা শঙ্কায় পা দুটো কাঁপছে। মন্ত্রী বিগলিত হলেন। গরীব গুরবো মানুষ দেখলেই তাঁর চোখে জল আসে। উত্তরীয় তুলে চোখের জল মুছে অভয়মুদ্রায় হাত তুললেন,‘ মাটির গন্ধ বয়ে আনা কবি, আপনি কবিতা পড়ুন।‘ টিভি ক্যামেরা তাড়াতাড়ি সে ছবি তুলে নিল।
আলোর জোয়ারে ভোলারামের পায়ের কাঁপুনি শরীর জুড়ে। কাঁপা কাঁপা গলায় আবৃত্তি করল,
জলের মধ্যে ডুবিয়ে দাও
ডুবিয়ে দাও জলের গভীরে
তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণতর
হে কৃষ্ণগহ্বর
চঞ্চলা চপলকে গ্রাস করো
হে স্থিতধী কৃষ্ণ
আমি যে তোমার মন পড়তে পারি
জনতা নিশ্চুপ। সভা নি:শব্দ। আগামী লাইনগুলো কি হবে সেই ভাবনায় উত্কণ্ঠ। উদগ্রীব। ভোলারাম সবিনয়ে জানালো, তার পাঠ শেষ হয়েছে। জনতা অট্টহাস্য করে উঠল। বিচারক কবিরা বঙ্কিমহাস্যে একে অন্যের দিকে চাইলেন। রত্নসভা থেকে জোরে হুল্লোড় আর হাসির শব্দ ভেসে এল। প্রতিষ্ঠিত কবিরত্নরা স্বস্তির শ্বাস ফেলে হাসলেন। আরো একজন কবির উত্থানের ফাঁড়া কাটল।
কবিতা-বিপ্লবের সংগ্রামী কবিরা ভ্রু কুঁচকে চাইলেন। দীর্ঘদিনের কবিতা আন্দোলনের পর এ কি অনাসৃষ্টি! নবীন কবিরা তর্ক তুলল, কবিতাপাঠের আসরে কবির মিনিমাম একটা স্ট্যান্ডার্ড থাকা উচিত কিনা।
পারিষদের দল ধমকে উঠলেন,‘ওহে ছোকরা, এখানে রসিকতা করতে এসেছে? একে কবিতা বলে?’
মন্ত্রীমশাই চুপ করে বসে রইলেন। তাঁর অন্যরকম মনে হচ্ছে। এ তো কবিতা নয় শুধু, এ যেন এক গভীর অর্থবাহী সঙ্কেত। সম্প্রতি পশ্চিম সীমান্তের গুপ্তচর সংবাদ এনেছে, একদল বিদ্রোহী প্রজা আন্দোলনে নেমেছে। উত্তর সীমান্তের বন্ধুরাষ্ট্রের গুপ্ত সমাচার, প্রাণ সংশয় পর্যন্ত হতে পারে তাঁর। এ কবিতা কি তারই সঙ্কেত? এ কবি কি প্রাণঘাতী গুপ্তচর, নাকি প্রাণদায়ী দেবদূত? এ কবিতা বুঝতে হলে বিশেষ রাজনৈতিক জ্ঞান চাই, নাকি এ সঙ্কেত বোঝার জন্যে বিশেষ আধ্যাত্মিক জ্ঞান?
কবিতাবোদ্ধা হিসেবে দেশ তথা বিশ্বের সাংস্কৃতিক মহলে ইদানিং বেশ সুনাম হয়েছে তাঁর। সাম্প্রতিক অতীতে একদল বিদেশী বণিক তাঁর একটি কাব্যগ্রন্থ ত্রিশ হাজার স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে ক্রয় করে নিয়ে গেছে। এই নিয়ে প্রচ্ছন্ন একটু অহঙ্কারও আছে তাঁর। তিনি বুঝবেন না, এমন কবিতাও হয় নাকি!
গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘কবি, এ কবিতা বোঝাতে পারবে তুমি?
’বিচারক আসনের দিকে ফিরলেন, ‘আপনারা কেউ বোঝাতে পারবেন?’
পারিষদের দল নড়েচড়ে বসলেন। রত্নসভা গম্ভীরমুখে সমর্থনের ভঙ্গিমায় মাথা দোলাতে লাগলেন। বিচারক প্রবীণ কবিরা মন্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে জোরে জোরে ঘাড় ঝাঁকাতে লাগলেন। তার অর্থ ‘আমি বুঝেছি’ নাকি ‘আমি বুঝি নি’ তা বোধগম্য হল না। প্রবল উত্কণ্ঠায় কবিরা সবাই মঞ্চের দিকে চেয়ে রইলেন।
ভোলারাম কেবল মিটিমিটি হাসে।
মন্ত্রী নিশ্চিত হলেন। এ কবিতা যে সে কবিতা নয়। এর গূঢ় অর্থটা জানতেই হবে। কবিতা - সভার নিয়ম ভেঙে মন্ত্রী ঘোষণা করলেন, ‘এ কবিতার অর্থ যে ঠিক ঠিক বোঝাতে পারবে, তাকে পুরষ্কার হিসেবে সহ-সভাকবি পদ দেওয়া হবে।‘ এ পদটি আগে ছিল না। কবিসভা উল্লসিত। দর্শক উজ্জীবিত। মন্ত্রীর এহেন কর্মসূচীর জন্যে রাজসভা গর্বিত। রত্নসভার সদস্যরা টিভি ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে বললেন, মন্ত্রীমশাইয়ের এমন বিপ্লবী চিন্তার জন্যে অতি শীঘ্রই তাঁকে ‘অনলস সংগ্রামী কাণ্ডারী’ আখ্যা দিয়ে একটি সম্বর্ধনা দেওয়া হবে।
এবার অর্থ বোঝার পালা। নবীন কবিরা স্পষ্টত দুই দলে বিভক্ত।
একদল বলে, ‘তীক্ষ্ণ’ আঘাত। জেহাদের ডাক এ কবিতায়। তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণতর। ডু অর ডাই। মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন। জেহাদ চাই।
আরেক দল বলে, না না। এ আসলে প্রেমের কবিতা।
ওই যে ‘মন পড়তে পারি’ এর মধ্যেই এ কবিতার গভীর ভাব।
কবিতা - আন্দোলনের কবিরা বললেন, আসল কথাটা হল ওই ‘কৃষ্ণগহ্বর’। ব্ল্যাক হোল। পৃথিবীর ধ্বংসের বার্তা এ কবিতায়। জীর্ণ পুরাতনকে ভাসিয়ে ডুবিয়ে বিদায় করার অপূর্ব দর্শন।
অধ্যাত্মবাদী কবিরা বলেন, উঁহু।
‘হে স্থিতধী কৃষ্ণ’.. এটিই কবিতার মূল। মুলাধার চক্রের মত গভীর চিন্তা।
ভোলারামের হয়েছে মুশকিল। সকাল সন্ধ্যা তাকে পালা করে নানা দলের কবিদের সঙ্গে সিটিং দিতে হয়। একদল কবি ভোলারামকে সভাপতি করে একটি ‘কবিতা ওয়ার্কশপ’ শুরু করেছেন। সেখানে রোজ শব্দ ছন্দ মাত্রা তাল অক্ষরবৃত্ত নিয়ে ক্লাস হয়।
বসে বসে ঢুলুনি এসে গেলেও সেখানে উপস্থিত থাকতে হচ্ছে। টিভির বিভিন্ন চ্যানেলে ভোলারামকে নিয়ে বিশেষ অনুষ্ঠান, তাতে নিয়মিত হাজিরা দিতে হচ্ছে। ইন্টারনেটে ‘বাক - বিপ্লব’ নামে একটি ওয়েবসাইট হয়েছে, তাতে বিশেষজ্ঞ মতামত দিতে ডাক পড়ছে।
দীর্ঘ আলোচনা। সুদীর্ঘ বিশ্লেষণ। দীর্ঘতর ব্যাখ্যা।
দিনের শেষে রোজই দেখা যাচ্ছে, অবন্তী মথুরা কন্যাকুব্জ দাক্ষিণাত্য উত্তরাঞ্চল কামরূপ তিব্বত যত জায়গা থেকে আসা কবিই হোক না কেন, সব কবি এবং সব কবিতা -বিশেষজ্ঞ দাবি করছেন যে তাঁদের মতের সঙ্গেই একমত হয়েছেন বিশিষ্ট কবি ভোলারাম।
ভোলারামকে প্রশ্ন করা হলে তিনি ভীরু চোখে তাকিয়ে থাকেন।শরীর আরো শীর্ণ হয়েছে, অনিদ্রাজনিত কারণে চোখের কোণে কালি। রোজ দীর্ঘক্ষণ বসে থেকে থেকে কোমরে ব্যথা, ঘাড়ে স্পণ্ডিলাইটিস। কবি ভোলারাম কেন আর হাসেন না, এ নিয়ে খবরের কাগজে কাগজে দীর্ঘ সম্পাদকীয় লেখা হয়েছে। কেন এখনো কেউ কবিতার মর্মোদ্ধার করে খুশি করতে পারে নি তাঁকে, সে নিয়ে ইন্টারনেটের ব্লগে ব্লগে বিস্তর লেখালেখি চলছে।
এমনই সিটিং চলছে একদিন। টিভিতে লাইভ দেখানো হচ্ছে। ইন্টারনেটে এবং মোবাইলে দেশ বিদেশ থেকে মতামত আসছে। ‘ডুবিয়ে দাও জলের গভীরে’ নিয়ে তর্ক জমেছে। প্রবীণ কবি বললেন, ‘এখানে জলমানে জল নয়। জল মানে আত্ম - অনুসন্ধান।‘
কবিতা আন্দোলনের পথিকৃত বিশিষ্ট কবি, সম্প্রতি কবি-অ্যাকাডেমি পুরষ্কার পেয়েছেন, দীর্ঘ দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন, ‘আত্ম নয়, আত্ম নয়। আত্মা। সেই বিশেষ আত্মা,
যা কেবল মানুষ নয়, বৃক্ষ এবং লতাগুল্মে বাস করে। পশু পাখি পাহাড় নদী সর্বত্র বিরাজ করে।‘
নবীন কবি বললেন, ‘একেবারেই না। এখানে জল হল একটা সিস্টেম। জটাজুটধারী গভীর শিকড় সে সিস্টেমের। গভীর অনুপ্রবেশ চাই, তবেই চঞ্চলা চপলকে গ্রাস করা সম্ভব।‘
বিশিষ্ট গবেষক কবি, মন্ত্রীর সবগুলো কমিটির মাথায় আছেন, বললেন, ‘জলের গভীরে, তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণতর, বিশেষ ব্যঞ্জনা এখানেই। গভীর অর্থ। তীক্ষ্ণতর শব্দটি এখানে বিশেষ অনুধাবন করা দরকার।‘
সম্মানিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, সম্প্রতি রাজ দরবারে বিশেষ সম্মানে প্রধান পরামর্শদাতা পদ পেয়েছেন, বললেন, ‘না হে না। এখানে জল হল দেশ। দ্রাঘিমা আর বিষুবরেখার আলিম্পনে দেশ - মার্তৃকার আরাধনার কথা বলা হয়েছে।‘
হঠাত্ জানলার গরাদে একটি কাক এসে বসল। কৃষ্ণ বায়স। মাথাটা অনেকখানি ঝুঁকিয়ে কাক কি যেন দেখতে লাগল ঘরের মধ্যে। একবার ঠোঁট দিয়ে ঠুকরে নিল গরাদের গায়ে। গম্ভীর গলায় ডেকে উঠল, ‘ক্ব: .. ক্ব:’। তারপর উড়ে গেল।
সেদিকে তাকিয়ে হঠাত্ হেসে ফেললেন কবি ভোলারাম। হাততালি দিয়ে উঠলেন।
সঙ্গে সঙ্গে সারা ঘর হাততালিতে ভরে উঠল। ঠিক কোন ব্যাখ্যায় কবি প্রসন্ন হয়েছেন তা না বুঝলেও এটুকু বোঝা গেল যে, আজকের সিটিং ফলদায়ী হয়েছে। সম্ভবত সব শেষের অর্থবাহী ব্যাখ্যাটি কবির মুখে হাসি ফুটিয়েছে।
মন্ত্রীমশাই খুশি হয়ে হাসিমুখে টিভি ক্যামেরার সামনে হাত নাড়তে লাগলেন।
রাজ্যসুদ্ধ লোক, পুরুষেরা পথেঘাটে অফিস - কাছারিতে হাটেবাজারে কফিহাউসের আড্ডায়, মেয়েরা পুকুরঘাটে শপিংমলে অফিসে বিউটি পার্লারে, নব্য যুবক যুবতীরা টুইটার ফেসবুকে, ছেলেমেয়েরা কলসেন্টারে নাইটক্লাবে ডিস্কে, বিদ্যালয়ে কিশোর ছাত্রছাত্রীরা, পাড়ার চায়ের দোকানে অলস যুবকরা, মর্নিং ওয়াকের বৃদ্ধ বৃদ্ধারা সবাই একযোগে বলতে লাগল, এমন কবি আগে হয় নি। কাব্যপ্রতিভার সঙ্গে সুগভীর দেশপ্রেম, অধ্যাত্মবাদের সঙ্গে দর্শনের মেলবন্ধন, জেহাদ এবং শৃঙ্খলার সহাবস্থান এমনটি এই দিকপাল কাব্যের বিশেষ দিক।
অতিথিশালা থেকে রাজকীয় মর্যাদায় ডেকে এনে মন্ত্রীমশাই কবি ভোলারামকে যথোচিত সম্মান সহকারে রাজ - সভাকবির পদে অভিষেক করলেন।
আজ থেকে তিনি আর কেবল কবি নন,‘কবিকিঙ্কণ ভোলারাম’।
ভোলারামের বউ অবশ্য শব্দটা উচ্চারণ না করতে পেরে ‘কবিকিঙ্কর’ বলে ফেলছে। দুর্মুখ কিছু দুর্জন সে নিয়ে হাসাহাসিও করছে। তাতে কি? কবিকিঙ্কণ এখন সাধারণের ধরাছোঁয়ার অনেক দূরে। হাজার স্বর্ণমুদ্রা ছাড়াও পুরষ্কার এবং সম্মান হিসেবে মন্ত্রী একটি বড় মহল দিয়েছেন। নোবেল পুরষ্কারের জন্যে নাম পাঠানো হয়েছে। কবিকিঙ্কণ ভোলারামের আপ্তসহায়ক হিসেবে নবীন কবিদের একটি দল নিযুক্ত হয়েছে। কবির হয়ে রাজস্তুতি-স্তোত্র ও রাজসভা-গীতি লিখে দেওয়া তাঁদের কাজ। রাজসভায় নিত্য হাজিরা দেওয়া ছাড়া কবিকিঙ্কণের আর বিশেষ কাজ নেই।
কবিতাবোদ্ধা রাজনীতিক বিজ্ঞ সজ্জনকে সহ-সভাকবি পদ দেওয়া হয়েছে। তাঁর নামটি ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ডের জন্যে পাঠানো হয়েছে।
অবশেষে মন্ত্রীমশাইও পরিতৃপ্তির শ্বাস ফেলে রাজকার্যে মনোনিবেশ করেছেন।
Comments