
প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা

জানুয়ারী
২০২৩

কবিতা
ঘরের কাছেই আফ্রিকার ড্রাগন পাহাড় দেখার অনুভূতি! - সুদীপ পাকড়াশী
প্রচ্ছদঃ সুরজিত সিনহা
লেখক/লেখিকাবৃন্দ

মানবিক মুল্যবোধের চরম অবক্ষয়
মিজানুর রহমান মিজান
বিশ্বনাথ, সিলেট, বাংলাদেশ
প্রবন্ধ

সকল প্রশংসা এক মাত্র বিশ্বপ্রভু মহান আল্লাহর প্রাপ্য। যিনি এ জগত সংসারের যাবতীয় বস্তুর সৃষ্টিকর্তা, হেফাজতকারী, পরিচালনাকারী ও সর্বশেষ মৃত্যুদাতা। কারণ ‘জগতের সকল প্রাণী মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে’। তিনি এক, অদ্বিতীয়, তাঁর সমতুল কেহ নেই। সর্বশ্রেষ্ঠ, শেষ নবী হযরত মোহাম্মদ (স:) আল্লাহর প্রেরিত নবী। হাজার হাজার সালাম ও দরুদ পেশ করি হযরত মোহাম্মদ (স:)’র নামে। মানুষকে আল্লাহ আশরাফুল মাখলুকাত নামে অভিহিত করেছেন সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব বলে। কারণ মানুষের মধ্যে রয়েছে বিবেক, জ্ঞান, বুদ্ধি, বিবেচনাসহ সচেতনতাবোধ সম্পন্নতা।আল্লাহ মানুষের জন্য দিক নির্দেশনা দিয়েছেন কিভাবে জীবনযাত্রা পরিচালিত হবে। এ সমস্ত বোধ শক্তি থাকার মুল মন্ত্র হল সৎ, সত্য সঠিক পথে পরিচালিত হওয়া, হারাম–হালাল, বৈধ-অবৈধ বুঝে হালাল ও বৈধ আয়ের মাধ্যমে জীবন পরিচালনা করা। অত:পর নীতি নৈতিকতা, ভদ্র, নম্র আচার আচরণের মাধ্যমে জীবন নামক তরী বেয়ে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌছানো। প্রত্যেক মানুষের পিছনে মৃত্যু দূত সব সময় রয়েছেন। নির্দিষ্ট ও নির্ধারিত সময়ে সবাইকে চলে যেতে হবে। এক মিনিট আগেও না, এক মিনিট পরেও না। পশু পশু হয়ে জন্মায়। তাকে পশুত্ব অর্জন করতে হয় না। কিন্তু মানুষকে মনুষ্যত্ব অর্জন করতে হয়। মনুষ্যত্বের মুলে রয়েছে নীতি, নৈতিকতা, মানবিক, হালাল, বৈধ পন্থা অনুসরণ করে অভীষ্ট গন্তব্যে পৌঁছানো। সুতরাং তা অর্জন করতে অনেক কঠিন, কঠোর ও বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে ঈপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছানো প্রত্যেক নরনারীর ঐকান্তিক কামনা ও বাসনা থাকা চাই। কিন্তু আমরা বর্তমানে কতটুকু মানবিক ও মনুষ্যত্ব সম্পন্ন মানুষের পরিচয় দিচ্ছি? তাই জিজ্ঞাস্য?
বর্তমানে সামান্য স্বার্থের লোভে আমরা যে পরিচয় দিচ্ছি তা কতটুকু নৈতিক, মানবিক ও মনুষ্যত্ব নির্ভর? দু’একটি উদাহরণ দিলেই তা স্বচ্ছ আয়নায় পরিস্ফুটিত হবে সহজে। এইতো গতকল্য একটি ভিডিও দেখে হলাম আশ্চর্যান্বিত। কুমিল্লা জেলার এম এ জলিল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক স্কুলের নিকটেই তিনির বাসা। সে বাসায় স্কুল থেকে বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়ে তিনি চলছেন।আরো টিনের নির্মিত ছয়টি কক্ষ রয়েছে, তাতেও প্রধান শিক্ষকের রোম থেকে সংযোগ দেয়া হয়েছে। একজন শিক্ষকের বেতন বর্তমানে ৩০/৪০ হাজার। এতো টাকা পেয়েও তিনি অবৈধ, অনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িত। প্রাপ্ত বেতনে যদি শিক্ষকের জীবন যাপন কঠিন হয়।তবে একজন মসজিদের ইমাম, শ্রমিক, কৃষক মাত্র ৪/৫ হাজার টাকায় এবং একজন কৃষক কত অমানবিক পরিশ্রম করে ৬/৭ হাজার টাকায় তাঁদের জীবন চলে। শিক্ষক মহোদয় কি খান? কোথায়, কিভাবে ব্যয় করেন? তিনি কি সোনা রুপা খেয়ে ফেলেন? আর শ্রমিক, কৃষকের, ইমামের জীবন যদি অল্প বেতনে সংকুলান সম্ভব হয়। তবে কেন শিক্ষকের উচ্চ বেতন পেয়েও সংকুলান হয় না। উপজেলা নির্বাহী অফিসারের জবাবে তিনি বলেছেন ৭/৮ বৎসর যাবত এভাবে চলছেন। কিন্তু অন্যান্যরা বলেছেন আরো দীর্ঘ দিন থেকে ব্যবহারের কথা। আমি আমার মুরব্বিয়ানদের মুখ থেকে প্রায়ই শুনতাম একটি প্রবাদসম বাক্য। যা হচ্ছে “বৈধ, হালাল উপার্জনে রয়েছে বরকত(মুরাদ)”। অবৈধ ও হারাম উপার্জনে বরকত (মুরাদ) শব্দটির অনুপস্থিতি। শাক-সবজি খেয়ে কৃষক, শ্রমিক অনেক বলবান, অপরদিকে বিরিয়ানি খেয়ে হচ্ছেন ডায়াবেটিস, কোলেস্টেরল সমৃদ্ধ। খানা খাদ্যে নিষেধাজ্ঞা সমৃদ্ধ। শিক্ষক মানুষ গড়ার কারিগর, সম্মানী ব্যক্তি। কিন্তু কাজকর্ম নিন্দিত। (সব নয়) একজন শিক্ষক সত্য ও সততার হবেন প্রতীকী। বিগত ১২জানুয়ারি ২০২১ দৈনিক সিলেটের ডাক পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত “৬ বছর অনুপস্থিত থেকে নিয়মিত বেতন-ভাতা নিচ্ছেন প্রধান শিক্ষক” এবং সুরমা নিউজ টুয়েন্টিফোর ডট কম’র ১০ সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখের প্রকাশিত সংবাদ “থাকেন আমেরিকায়, করেন সিলেটে প্রধান শিক্ষিকার চাকুরী” শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদ পাঠে জানা যায়, হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার বৈরাগিপুঞ্জি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আমেনা খাতুন স্কুলে ৬ বছর যাবত অনুপস্থিত থেকে নিয়মিত বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা নিচ্ছেন। অভিভাবকরা বিষয়টি লিখিতভাবে প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের সিলেট বিভাগীয় পরিচালককে জানালে অভিযোগের সত্যতা তদন্ত পূর্বক একটি বিভাগীয় মামলা করা হয় এবং মামলায় তার দুই বছরের বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি স্থগিত করা হয়। ঐ শিক্ষকের কর্মকান্ডে ছাত্ররা বা সন্তানরা কি শিখবেন? তা পাঠকের বিবেচ্য! ঐ শিক্ষকদ্বয়ের এ জাতীয় মন মানসিকতা কি
সত্যিকার নৈতিকতা ও মানবতাবোধের? আমরা কোথায় চলেছি, আকাশে না পাতালে? অবক্ষয়ের মাধ্যমে হচিছ বঞ্চিত প্রকৃত বাস্তবতা থেকে? ব্যক্তি, গোষ্ঠী, সমাজ, জাতি যাচ্ছি রসাতলে।
আরেকটি কাহিনী সে দিন আমি আমার এক বন্ধুর মুখ থেকে শুনে হতবাক হয়ে গেলাম। আমাদের সমাজে অধিকাংশ ক্ষেত্রে যৌথ সম্পত্তি। খুব কম সংখ্যক বাটোয়ারা দলিল হয়ে থাকে। মৌখিক ভাবে চিহ্নিত করে সকলেই ভোগ করতে অভ্যস্ত। এক সময় ছিল একজন তার অংশের ভূমি বিক্রি করতে চাইলে অন্য শরিকান সাক্ষী হিসাবে দলিলে স্বাক্ষর দেবার প্রচলন। তাই ভাতিজা তার অংশের জমি বিক্রি করবে। এখন অন্য শরিকানের সাক্ষী প্রদান আবশ্যক। সেহেতু ভাতিজা বলছে চাচাকে সাক্ষী প্রদান করতে। জমির তার অংশের বিক্রির কথা স্পষ্ট করে বলেছে চাচাকে। চাচা সাক্ষী দিয়াছেন বিশ্বাস করেই দলিল না দেখে। এখানে একটি কথা উল্লেখ করতেই হয়। কবরস্থান কিন্তু যৌথই থাকে। কারণ সেখানে কবরস্থ হবেন সবাই। কিন্তু আমাদের উল্লেখিত ভাতিজা মিথ্যা ও প্রতারণার আশ্রয় নেয়। চাচা তা ঘুণাক্ষরে ও টের পাননি। ভাতিজার অংশের আংশিক ভূমিসহ কবরস্থানের দুই তৃতীয়াংশ দলিলে লিখে সাক্ষীর কলামে চাচার স্বাক্ষর নেয়। আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা অতীব প্রয়োজন। ক্রেতা ঐ বংশেরই একজন। উভয়ে চক্রান্ত করে তা বাস্তবায়ন করছে লোভ দেখিয়ে ক্রেতা বিক্রেতাকে। গোপনে তাদের মধ্যে আঁতাত, শলা পরামর্শে কাজটি করা হয়েছে। দিন যায় কথা থাকে। চাচা কবরস্থ ভূমির অংশ বিক্রি করেননি তিনির সত্যে অটল। অপরদিকে বিক্রেতা ক্রেতা এক সময় গোপন আঁতাতে ধরে ফাটল। বের হয়ে আসে গোপন কথা জনসমক্ষে। তখন কিন্তু নদীর জল অনেক বয়ে গেছে। বিক্রেতা দলিল দ্বারা টাকার বিনিময়ে তার নামে কবরের দুই অংশ রেকর্ড করে নেয় টাকা ও শক্তির প্রভাবে। চাচা তাদের সাথে পেরে উঠতে পারছেন না দুর্বল বলে। কিন্তু ভূমিটুকু কবরস্থান বলেই রেকর্ড হয়। এখন কথা হল কবরস্থান বিক্রি হয় না তা বিজ্ঞজন মাত্রই জ্ঞাত। তারপরও হয়ে যায়, যাচ্ছে। সাক্ষী দেবার কারণে চাচার কবরের অংশটুকু থেকে তিনি হলেন বঞ্চিত। সর্বশেষ কথা হল এ ক্ষেত্রে কবরস্থান নিয়েও মানুষ প্রতারণা, প্রবঞ্চনা, ঠকানোর ধান্ধায় লিপ্ত। আর বাকি কি রয়েছে? প্রতারকও তো কবরস্থানে যাবেন শেষ পর্যন্ত। তা থেকে তো কোন ক্রমেই রেহাই নেই। সুতরাং মানুষের মনুষ্যত্ব, মানবিকতা, নীতি-নৈতিকতা কোথায়, কোন অবস্থায় কি ভাব দাঁড়িয়েছে। সম্মানিত পাঠক ও বিজ্ঞজনের আর ব্যাখ্যা করে দেখাবার প্রয়োজন নেই। যে কেহ অতি সহজে অবশ্যই বুঝে নিতে কষ্ট হবার কথা নয়। আরো তদন্ত করলে যে বের হবে না তা কি নিশ্চয়তা দিয়ে বলা যাবে? শুধু শিক্ষকদের কথা নয়। দেশের প্রতিটি সেক্টরে অনুরুপ দায়িত্বহীনতার ভুরিভুরি প্রমাণ মিলবে। দু’একজনের জন্য কেন হবে ঐ সমাজ কলঙ্কিত?
যে কোন কাজে ব্যক্তির চারিত্রিক সংশোধন সর্বাগ্রে প্রয়োজন। ব্যক্তি সংশোধিত না হলে সামগ্রিক কাজ সুষ্ঠু ভাবে সম্পন্ন অসম্ভব। আবার ব্যক্তি সংশোধিত হলেই চলবে না। প্রয়োজন সমষ্টি। কারণ পৃথিবীর কোন কিছুই সংঘবদ্ধ ব্যবস্থাপনা ব্যতিরেকে উন্নতির শিখরে পৌছতে পারে নাই, পারবে না। সুতরাং সম্মিলিত শক্তির গুরুত্ব অপরিসীম। তারপরও কথা থেকে যায়। কোন কিছুতেই কিছু হবে না। যতক্ষণ মানুষকে সঠিক অর্থে সঠিক মানবতা, নৈতিক গুণাবলী সমৃদ্ধ ও মানবিক মানুষ বানানো যাবে না। এ দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে ঘুষ, দুর্নীতি মারাত্মক ব্যাধি রূপে আক্রান্ত সমাজ।এ থেকে পরিত্রাণের আবশ্যকতা অত্যন্ত জরুরী। নৈতিকতা ছাড়া যেমন কেহ ভাল হতে পারেন না,তদ্রুপ মানবিক এবং সামাজিক মুল্যবোধের অভাবে পূর্ণতায় আসা সম্ভব নয়। মুল্যবোধের অবক্ষয় যাতে না ঘটে সেদিকে আমাদেরকে সজাগ, সুদৃষ্টি ও লক্ষ্য রাখতেই হবে। তাহলে হয়ত আমরা পেতে পারি সুন্দর ও সঠিক সমাজ ব্যবস্থা। পরিশেষে এ প্রত্যাশা সর্বাত্মকরণে প্রতিটি ক্ষেত্রে অবক্ষয় থেকে উটে আসার। তথা দায়িত্বশীল, কর্তব্যপরায়ণ ও নৈতিকতাবোধে কাজ করার, দায়িত্ব পালন করার।তা না হলে কবির ভাষায় বলতে হবে আক্ষেপের সুরে, “রাত পোহাবার কত দেরী, পাঞ্জেরী”।
কবিতা
সাহেব সেখ
মুর্শিদাবাদ, পঃ বাংলা

আমি দিয়াছি মোক তোমারে
আমি দিয়াছি মোক তোমারে,
আমি দিয়াছি দুহাত ভরে।
আমি পেয়েছি তোমারি দর্শন,
মনেরও অন্দরে, মনেরও অন্দরে।
অশ্রুসজল নয়নে,
চেয়ে রয়েছি গগনে।
আমি একা এই মহাপাবনে,
পুড়িতেছি ক্ষণে ক্ষণে।
আমি দিয়াছি মোক তোমারে,
আমি দিয়াছি দুহাত ভরে।
আমি পেয়েছি তোমারি দর্শন,
মনেরও অন্দরে, মনেরও অন্দরে।
প্রেমেরও আগুনে পুড়ে,
প্রভু কাঁদে মাঝি কাঁদে।
দাঁড় যে চলে যায় বয়ে,
দূর থেকে দূরে, দূর থেকে দূরে।
আমি দিয়াছি মোক তোমারে,
আমি দিয়াছি দুহাত ভরে।
আমি পেয়েছি তোমারি দর্শন,
মনেরও অন্দরে, মনেরও অন্দরে।
বাগান শূন্য করে,
ফুল যায় মালিকের সঙ্গে।
মালী তুই ফেলিস অশ্রু ওরে,
কেউ নেই পৃথিবীতে, কেউ নেই পৃথিবীতে।
আমি দিয়াছি মোক তোমারে,
আমি দিয়াছি দুহাত ভরে।
আমি পেয়েছি তোমারি দর্শন,
মনেরও অন্দরে, মনেরও অন্দরে।
তোর জন্য
সারাদিন মন করে উড়ু উড়ু সেই তো তোরই জন্য
এলো চুল মেলে টোল ফেলে গালে হাসলেই তুই অনন্য।
তোর জন্যই শব্দ চয়ন স্বপ্নেও খুঁজি তোকে
স্বপ্নেই দিই চুম্বন এঁকে তোর ঠোঁটে গালে চোখে।
শুধু একবার আড়চোখে তুই চাইলেই আমি ধন্য
সারাদিন মন করে উড়ু উড়ু সেই তো তোরই জন্য।
পড়ার টেবিলে আনমন আমি সেও তো তোরই জন্য
তোকে মন দিতে এতটুকু আমি করিনিকো কার্পণ্য।
সাইরেন বাজে বুকেতে আমার নিশ্বাসে নিকোটিন
ক্যানভাস জুড়ে একটাই ছবি আঁকি আমি সারাদিন।
তোর পিছে পিছে স্টীমবোট আমি নাই কাজ কিছু অন্য
ফাঁকি দিই ক্লাস আমি বারোমাস সেও তো তোরই জন্য।
গীতিকবিতাঃতোমার দান
যে কর্মভার করেছো দান করতে যেন পারি
কর্মমুখর এই যে ভুবন সবই তো তোমারি।
দাও হে শক্তি মনের মাঝে
সদাই যেন থাকি কাজে
তোমার দেওয়া কর্মে যেন না হই অহংকারী
যে কর্মভার করেছো দান করতে যেন পারি।
তোমার কাজের যোগ্য করে
নাও না তুমি আমায় গড়ে—
তোমার কর্মযজ্ঞে যেন সামিল হতে পারি
যে কর্মভার করেছো দান করতে যেন পারি।
ভুবনভরা সৃষ্টি তোমার সারি সারি
বিশ্বময় কর্ম তোমার রকমারি
তোমার আশিষ ইচ্ছা বিনা করতে কিছুই নারি
যে কর্মভার করেছো দান করতে যেন পারি।
তোমারই জন্য
তোমারই জন্য শিউলি শরৎ তোমরই জন্য কবিতা
এতো ভালোলাগে গান ও গল্প তোমরই জন্য সবিতা।
তোমারই জন্য পূর্ণিমা চাঁদ রূপালী জ্যোৎস্না ধারা
তোমারই জন্য সবিতা আমি সারাদিন দিশাহারা।
তুমি আছো তাই ঘরেতে অভাব
তবু আমি কত সুখী
ক্ষণিকের তরে অন্তরে কভু হই নিতো জানো দুখী।
রাংতায়ে মোড়া এ জীবন মোর
কত যে রংঙের মেলা
তোমারই জন্য সবিতা আমার রঙিন ফাগুন বেলা।
তোমারই জন্য বাজে গো বাঁশরী বুক ভরা তার সুর
রিনিঝিনি রিনিঝিনি বাজে তোমার পায়ে নূপুর।
বুকেতে আমার দিলে যে ছন্দ তাই হল কবিতা
আমার সকল কবিতায় তুমি ধরা দিলে সবিতা।
কামনাবহ্নি
প্রেম নয়, প্রেম নাই— মনে হয় ভুল
শুধু ভালোবাসি আমি কামনার ফুল।
আকাঙ্ক্ষার ধন তুমি, উদগ্র বাসনার
দেহহীন প্রেম কভু ছিল না আমার।
নীল চাঁদ জোছনায় নীল নদীকূল
নীল রাত নির্জনে কামিনী মুকুল
ছড়াক সুরভি তার চঞ্চলি প্রাণ
প্রতি রাতে পাই যেন তারই আঘ্রাণ।
অমৃত সুধারস দেহভান্ড ভরে
আকন্ঠ করি পান তৃষিত অন্তরে।
চাই না বৈরাগ্য সাধন মোক্ষ মুক্তি আর
জ্বলুক জ্বলুক শিখা বহ্নি কামনার।
কবিতা
সুকান্ত পাল
জিতপুর, মুর্শিদাবাদ



কবিতা
রাজর্ষি চট্টোপাধ্যায়
উত্তরপাড়া, হুগলী, পঃ বাংলা
নারী
পুরুষ তুমি যতই মারো,
মরবো কিন্তু লড়বো আরো৷
বুটের নিচে দাবিয়ে রেখে,
পারবেনা কো দমিয়ে রেখে৷
পুরুষ তুমি যতই মারো,
মরবো কিন্তু লড়বো আরো৷
যতই তুমি শাসিয়ে রাখো,
জন্ম দেবো লাখো লাখো৷
পুরুষ তুমি যতই বাড়ো,
জন্ম নাহি দিতে পারো৷
ধর্ষণের বর্ষণেতে যতই ভাবো জিতলে তুমি,
নারী ছাড়া ধরিত্রী তো হবেই হবে মরুভূমি৷
দুর্বল বলে তকমা দিয়ে,
তাচ্ছিল্য তো করতেই পারো৷
পুরুষ তুমি যতই মারো,
লাখো নারী লড়বে আরো৷
পুরুষ তুমি যতই মারো,
সংঘবদ্ধ হচ্ছি আরো৷
মা-বোন বলে ভুলিয়ে রেখে,
পারবেনা কো থামিয়ে দিতে৷
মারবে গুলি ফাটবে খুলি,
যন্ত্রণাতো দিতেই পারো।
পুরুষ তুমি যতই মারো,
জেনে রেখো লড়বো আরো৷
ইরাবতী তোমাকে
ইরাবতী ইরাবতী পড়ে কি আমায় তোমার মনে
ফাল্গুনের দিবালোকে দেখা তোমার সনে
মনে পড়ে ফাগুন বেলায় অপূর্ব সেই আলো?
কিশোরীর কাজল আঁখি লেগেছিলো বড়ই ভালো
ইরাবতী ইরাবতী তুমি জীবন্ত নদী
একবারটি দেখতে পাবো সুযোগ হয় যদি
ইরাবতী ফিরতে কি চাও ফেলে আসা দিনে?
স্মৃতি বড় বেদনার
ফিরে আসে ক্ষণে ক্ষণে
তোমার সাথে শেষ বার যদি দেখা করতে চাই
জীবন যদি সুযোগ দেয় শেষের কথা বলব তাই
ইরাবতী দুই দশক বাদে যদি তাকাও একবারটি ফিরে
ফিরে যাবো অতীত দেশে ফেলে আসা দিনের তীরে
ফিরেবে না আর ফিরবে না যে বাসন্তী অতীত আমার
বয়েস বেড়ে দিনগুলো রোজ আজ ফ্যাকাসে ধুসর বারবার

প্রতিষ্ঠা প্রতিদানের সংগ্রহশালার
নিঃসঙ্গ তারবার্তা
ভেঙে পড়া শিশু
পড়শি সন্দেহজনক যন্ত্রীর
ব্যথার দিনে হাওয়া বদলের হাতছানি
প্রতীক হারিয়ে ফেলে কেনাকাটার মুর্খামি
আবদার পাতা ওলটানোর
তবু
প্রতিষ্ঠা
প্রতিদানের সংগ্রহশালার
নামজাদা শৃঙ্খলের
পুনশ্চ কলাকৌশলের
কেউ ছাড়তে রাজি নয় বিবিধ জমি
পৃথিবী জানে ছিঁড়ে যায় একাকার বাঁধনে
প্রসাদের দাবী
আবিষ্কারের গোড়াতেই আইনঅমান্য আন্দোলন
শূন্য কাহিনী নিস্তরঙ্গ।

কবিতা
পার্থ সরকার
নারী
ওহে নারী, তোমার দাবিটা কী শুনি!
শুনি তোমার কিসের চাহিদা।
অল্পতে যা পেয়েছ,
তাতে কী আশ মেটে না?
ওহে নারী, তুমি ইস্কুলে যাবে?
লেখাপড়া ধরলে, বিয়েটা কী আর হবে?
ঘুরে দেখতে চাও এই জগতটাকে?
সাহস তো দেখছি কম নয়!
অসময়ে বাড়ির বাইরে বেরোবার
অনুমতি তোমায় কে দেয়?
নারী গো, তুমি ঘরের লক্ষ্মী
ঘরেই তোমায় মানায়,
যখন তখন বাইরে বেরলে

প্রতিবেশীরা কি মেনে নেয়?
অনেক তো হল বয়স
এখনও ছেলেমানুষী, সেকি?
খেলাধুলো ছেড়ে এবার
একটু খুন্তি নাড়ো দেখি।
ওহে নারী, তুমি কি স্বপ্ন দেখ?
তবে তা দেখার কি কোনো মানে হয়?
তুমি তো আর পুরুষ নও
তাই স্বপ্নের কথা ভুলে যাও।
নারী তোমার দাবি শুনলাম বটে,
তবে অস্বাভাবিক চাহিদা শুনিয়ে লাভ কি হল তাতে?
কবিতা
অর্কপ্রভ চৌধুরী
এলোমেলো
দৃশ্যটা এখন পেপার ওয়েট
চশমা ব্যতিত আর কিছু নেই কাছে।
এলোমেলো হাওয়া চাপা পড়ে থাক
কাগজের স্তুপ খোলা চোখ
কাছটাকে বেশ ভালো দেখে।
দূরে দেখার ইচ্ছে নেই
ঘটে কম, তার বেশিটাই রটে।
হাতের কাছে কলম কালি
দোয়াত গিয়েছি ভুলে -----
চাপা পড়া কথাদের মতো
বেহিসেবে --------
খালি চোখ দেখছে ভালো
বিশ্বাস গুটিসুটি বুকের ভেতর
গুনগুন বাজে ----- বেঁচে থাক
বেজে যাক্ কুয়াশার এই রোদে!


কবিতা
নারায়ণ চন্দ্র মিস্ত্রি
সল্টলেকে বইমেলা, খুঁজে আর পাইনে!
ফরমেশি তালিকাঃ দাঁড়িয়েছি লাইনে।
ফাস্ট ফুড স্টল ফেলে,
বাঁয়ে গিয়ে “রবি” পেলে--
কবিদের আড্ডাটা খুঁজে পাবে ডাইনে!

কলকাতা বইমেলাঃ লিমেরিক
ডাঃ রুদ্রজিৎ পাল
কসবা, কলকাতা
নিরঞ্জন
নদীর কাছে এসো,
কান পেতে দেখো ওই,
জল তরঙ্গের সুরমালা ভেসে আসে;
অপার্থিব সৌন্দর্যের মাঝে,
দেবীর আগমনের প্রাক্কালে,
ক্লান্ত কৃষকের দেহখানি পড়ে থাকে পাশে।
অশ্রুজলে সিক্ত মাটি,
বয়সের ভারে জর্জরিত মুখমণ্ডল,

কবিতা
ডঃ মন্থনকুমার দাস
লক্ষ্ণৌ, উত্তরপ্রদেশ
ক্লান্ত দেহাবশেষের প্রতিটি অঙ্গে স্বপ্ন ভাঙার হতাশা;
ধনী মহাজনের লালসার অগ্নি,
খাজনা ও ঋণের দুর্বিষহ ভ্রুকুটি,
দেবীপক্ষের শারদ প্রাতে সমাধিস্থ এই রাগচন্দন, কৃষ্ণবর্ণ চাষা।
শরতের নীল আকাশের ওপর পারে,
রাশি রাশি মেঘমালার কোণে,
নারদের বীণায় বাজে যখন কোমল গান্ধার;
এই ধরিত্রীর বুকে চিতায় তখন,
কঠিন বাস্তবতার লেলিহান শিখা স্বর্গমুখী,
তার মাঝেই নিঃসহায়তার কলরব
"মা, আসছে বছর এসো আবার.."।
গল্প
মাতাল
কৃষ্ণতরু বর্মন
ডালাস, টেক্সাস

মাতাল। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের একটি খুবই পরিচিত শব্দ। জড়িয়ে আছে হাজার রকমের নানান কাহিনী। কোনটা মজার, আবার কোনটার আড়ালে থেকে যায় এক কঠিন বাস্তব। আর সব কাহিনীই যে সব সময় খুব মজার হয় তা কিন্তু নয়।
বড় হয়েছি দক্ষিণ কলকাতার কাছাকাছি। তখনকার দিনে এখনকার মত অত কংক্রিটের জঙ্গল ছিল না। বেশ ফাঁকা ফাঁকা জায়গা জুড়ে বাগান সমেত সব বাড়ি। মস্ত খেলার মাঠ পেরিয়ে আম, জাম আর সবেদার বাগান। পুরোনো আমলের কিছু বাড়ি, একটা মন্দিরও চোখে পড়ত। বেশ নির্জন ছিল চারপাশ। গাড়ি-ঘোড়ার দৈনন্দিন যানজট, অহেতুক ঝুটঝামেলা, মানুষের ভিড় এসব একেবারেই ছিল না। খোলা পরিবেশে সবুজ রঙটা তখনও বেঁচে, আকাশ ছিল গাঢ় নীল। শীতের ভোরে দূর্বাঘাসের মাথায় শিশিরের স্নিগ্ধতা টাটকা থাকত অনেকক্ষণ। প্রকৃতির সবুজ কোলে মাথা রেখে খোলা আকাশের নিচে একেবারে নির্ঝঞ্ঝাটে আমাদের বড় হওয়া। প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নেওয়ার জায়গা ছিল অনেক। আজ হয়ত আর পাওয়া যায় না। সে যাই হোক, তখনকার দিনেও এই অল্প সংখ্যক মানুষের মধ্যেই কেউ কেউ আবার সন্ধ্যা গড়াতে না গড়াতেই একটু আধটু খেয়ে রাস্তা চওড়া করে বেড়াতেন। কথাবার্তা একটু আধটু লাগামছাড়া হলেও ওদের নিয়ে আমাদের যে একটা বিশাল ঝামেলায় পড়তে হত তা কিন্তু নয়। পাড়াতে উৎপলদা ছিলেন এমনই একজন চরিত্র।
তখন শহরে খুব লোডশেডিং। আর রোজ হত বলেই ব্যাপারটা গা সওয়া হয়ে গিয়েছিল। দিনের বেলাটা মোটামুটি কেটে গেলেও সমস্যা ছিল সন্ধ্যার পর। একে তো সরু রাস্তা, তার ওপর অন্ধকারে কে কোথা দিয়ে হুড়মুড় করে এসে ঘাড়ে পড়বে কে বলতে পারে? রাস্তায় হাজার হাজার গাড্ডা, বৃষ্টির কথা ছেড়ে দিলুম...অসভ্য গরুগুলো একটু ইয়ে করলেই ব্যাস, পিচ উধাও। পড়তে পড়তে বেঁচে গেছি কতবার। গরমের সময় সব বাড়িতেই গরমে হাত পাখা টানার চলন ছিল। দিদা, ঠাকুমা কিম্বা মায়েদের ঘুমতে ঘুমতে হাত পাখা টানার কনসেপ্টটা আজও অবাক করে। তবে মা আবার ওটাকে আরেকটা বিশেষ কাজে ব্যবহার করতেন। প্রয়োজনে পিঠের ওপর ডুগডুগি বাজানোর সময়ও কাজে লাগত এই শখের কারুকাজ করা তালপাতার পাখাটি।
যাক সে সব কথা। তা সেদিনও পাড়ায় যথারীতি লোডশেডিং। অক্টোবরের শেষের দিকে বাতাসে শীতের ছোঁয়া। ফিরতে একটু দেরীই হয়েছিল। রাতের অন্ধকারে বাসস্ট্যান্ড প্রায় খাঁ খাঁ করছে। মাফলার দিয়ে নাক মুখ ঢেকে এগোতেই কানে এল গোঙানির শব্দ। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছি, এ উৎপলদাই হবে...রোজকার মতই আজও মাল টেনে টাল হয়ে আছে। কাত মেরে পড়ে আছে বেকায়দায়। একটু এগোই... আছে না গেছে? অন্ধকারে বডি তো দেখছি, কিন্তু মুণ্ডটা কোথায়? হাত ধরে টান মারতেই মুণ্ডুটা বেরিয়ে এল। যাক, একদম ঠিক জায়গাতেই এখন এটি শুধু কাজ করলেই হয়। কথায় বলে মাল খেলে নাকি হুঁশ থাকে না, কে বলল? এ বাবাজীর জ্ঞান একেবারে টনটনে। হ্যাঁচকা টান পড়তেই খেঁকিয়ে উঠলেন –
‘টান মারলি কেন? তোকে কে টান মারতে বলেছে, যদি পড়ে যেতাম।'
যাত্তেরি! হাসবো না কাঁদবো, যে বাছাধন পড়েই আছে সে আবার নতুন করে পড়বে কি? বলে উঠলাম,
- ‘আরে ও উৎপলদা, যাও না, এবার বাড়ি যাও অনেক রাত হয়েছে’ আমি তো বলেই খালাস। কিন্তু যাবে কি করে? আর এই শীতের রাতে রাস্তায় তো কোন রিক্সা টিক্সাও দেখছি না। যাই বল বাবা আমার একার পক্ষে এটাকে বয়ে নিয়ে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া... এ তো মহা মুস্কিল! এদিকে বিড়বিড় করতে করতে উৎপলদা কোন রকমে উঠে বসেছে। আমার দিকে তাকিয়ে একেবারে খ্যাঁক খ্যাঁক করে বলে উঠল,
- ‘তুই এত রাতে কি করছিস, আড্ডা মেরে ফিরছিস? দাঁড়া না, কাল কাকুর সঙ্গে একবার দেখা হোক’। আ মলো যা... শা... মাল খেলে কি হবে জ্ঞান বেশ টনটনে। আরে আমিই টেনে তুললাম আবার আমাকেই শাসানি। এইজন্য বলে কারোর উপকার করতে নেই, বিশেষ করে মাতালদের তো একদমই নয়। এত টেনেছে যে কাছে যাওয়াই মুস্কিল। শেষমেশ একটা রিক্সাতে অনেক বলে কয়ে তুলে বিদায় করে দিই। সে যাই হোক শীতের রাতে ঐ রিক্সাওয়ালাকেই সেদিন দেবদূতের মত মনে হচ্ছিল। তবে দেবদূত বাবাজীও একটু বেসামাল। রতনে রতন চেনে। যাক গে, একজন তো পাওয়া গেল যে ওর দুঃখ কষ্ট বোঝে। পরেও যে উৎপলদাকে নিয়ে যে আমার মত অনেককেই ঝামেলাতে পোহাতে হয়েছে, তা বলাই বাহুল্য।
গোরার বাবা একটু নেশা ভাং করতেন। সেটা আমরা পাড়ার চ্যাংড়া ছেলেরা অনেকেই জানতাম। তবে খুব বেশী নাটকীয় ভূমিকায় উনি এর আগে কখনো অবতীর্ণ হন নি। একদিন বিকেলে ক্লাবের বারান্দায় বসে আড্ডা মারছি। সেদিন বোধহয় ওনার একটু চড়েই গিয়েছিল। একটা ম্যাটাডোর ভ্যান গেছে রাস্তায় আটকে। তাকিয়ে দেখি সামনে গোরার বাবা। নট নড়ন চরণ। উত্তমকুমার স্টাইল। হাত দুটো তোলা। নেশাতুর গলায় গাইছেন – ‘যাব বলে তো আসি নি’। কাতর মুখে ড্রাইভার যতবার বলছে – ‘ও দাদা, একটু সরে দাঁড়ান না।’ ঠিক ততবারই কাকুর ঐ এক স্টাইল – ‘যাব বলে তো আসি নি।’ গানের কথাতেই বুঝিয়ে দিচ্ছেন যে উনি সরার পাত্তর নন। 'ওগো বঁধু সুন্দরী' ছবিতে কিশোরদার গানের দ্বিতীয় সংস্করণ আর কি! তবে এই গানের স্টাইল দেখলে বাপীদা যে তার ভারী শরীর নিয়ে ভিমরি খেতেন, তা আমি হলফ করে বলতে পারি। পরে অনেক কষ্টে ওনাকে বাগে আনা হয়েছিল। সত্যি কথা বলতে কি কাকুকে প্রায় একপ্রকার চ্যাংদোলা করেই...সে এক যা তা অবস্থা!
বয়স তখন অল্প। এন্টারটেইনমেন্টের লিমিটেড অপশন বলতে চূড়ান্ত আড্ডা আর খেলা। পাড়ার মাঠে ফুটবলটাই বেশি হত। নানা ধরণের টুর্নামেন্ট লেগেই থাকত সারা বছর। বিভিন্ন জায়গা থেকে নামী দামী খেলোয়াড়রা অংশ নিতেন। আমাদের আশেপাশের টিম নিয়ে চলত ফুটবল লীগ। বেশ কাটত দিনগুলো। আর ফাইনাল খেলার দিন, পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে নিয়ে আসা হত ইষ্টবেঙ্গল কিম্বা মোহনবাগান দলের নামী খেলোয়াড়দের। আমার মনে পড়ে মানস ভট্টাচার্য, কৃষ্ণেন্দু রায়, জেভিয়ার পায়াস, তপন দাস, গৌতম সরকার, তরুন দে, শিবাজী ব্যানার্জী,
ভাস্কর গাঙ্গুলীর মত সব নামী খেলোয়াড়রা কোন না কোন সময় প্রধান অতিথি হয়ে আমাদের মাঠে উপস্থিত ছিলেন। খেলা শেষ হবার পর সব মিটে গেলে শুরু হত ক্লাবের সামনে বনভোজনের আয়োজন। সে এক বিচিত্র উন্মাদনা! বড় বড় ডেচকিতে চলছে হাবিজাবি রান্না আর হুলুস্থুল। ওপেন টু অল। কচিকাঁচা, বাচ্চা, বুড়ো সব্বাই হাজির। চেঁচামেচি, হৈ চৈ, এক জমজমাট সন্ধ্যা। সে একটা সময় গেছে, আজকাল যেন সব কিছুই বড্ড যান্ত্রিক। মনের সঙ্গে যোগাযোগ কম। পরিবেশও গেছে পালটে। সব ছোট ছোট গ্রুপ, লবি। পছন্দ অপছন্দের অজস্র সুক্ষ দেওয়াল। ইনভিজিবল কাঠিতন্ত্র। মানুষকে ছোট করেই মানুষের আনন্দ। আর তাছাড়া সর্ষের মধ্যেই ভূত। হাজার সর্ষে ছুঁড়ে মারলেও ভুতেরা খিলখিলিয়ে হাসে। উল্টে ভূতের সংখ্যাই বাড়ে। তাই চারদিকেই ওদেরই রাজত্ব। যাক গে যেটা বলছিলাম। সব খাওয়া দাওয়া মিটে গেলে তখনই হত সমস্যা। এত রাতে এই বড় বড় ডেকচি, থালা, হাতা, খুন্তি ধোবে কে। ঠিক হত সকালে যা করার করা যাবে। একটা রাতের তো ব্যাপার। পরের দিন সকালে যেটা করা হত, সেটা মোটেই ঠিক ছিল না। রাস্তা দিয়ে কোন মাতাল গেলেই ‘সাত সকালে মাল খেয়েছিস কেন?’ বলে ধরে আনা হত। ‘ছেড়ে দিন না দাদা, এই কান মুলছি আর খাব নি, এই উঠবোস করছি’ বলে উঠবোস করলেও ছাড়া হত না কারণ ওকে দিয়েই এঁটো বাসনগুলো ধুইয়ে নেওয়া হত। তবে দু-একজন একেবারে যে হাত লাগাত না তা নয়। একবার এক মাতাল ইয়া একটা ডেচকি ধুতে ধুতে বলল –
- 'আমি হাফ ধুচ্ছি, তুমি হাফ ধুয়ে নাও’। অবাক হয়ে বললাম,
– ‘ধুর এই ভাবে হয় নাকি। একটা ডেকচির আবার হাফ-ফুল ধোয়া যায় নাকি! যত্তসব! তাহলে তুমি সকালে হাফ চান কর আর বাকিটা বিকেলে...’
মুখটা একটু কাঁচুমাচু করে বলল,
– ‘তোমরা সারারাত খেলে আর আমাকে দিয়ে এই এঁটো ডেচকিগুলো...’। মৃদু ধমক দিয়ে বললাম – ‘ধ্যাত্তারি, থাকলে কি আর তোমায় দিতাম না? দেখলে তো আর নেই। ভাল করে ধোয় তো দেখি, দেখো আবার যেন লেগে না থাকে।’ ব্যাজার মুখে বাবাজী আবার কাজে লেগে পড়ত। তবে চলে যাওয়ার আগে কয়েকটা টাকা ভাঁজ করে বুক পকেটে গুঁজে দিতেই ছোপ পড়া কেলো দাঁতে আবার মিলিয়ন ডলার হাসি। কত অল্পে যে মানুষ সন্তুষ্ট হত আজ সত্যি ভাবতে অবাক লাগে। চাহিদা আর লোভের চোরাবালিতে আজ আমরা এতটাই নিমজ্জিত যে কিছুতেই আমরা সন্তুষ্ট হই না। সত্যি কথা বলতে কি এই অল্প বয়েসে এই ধরনের কিছু দুষ্টুমি করলেও কাউকে দিয়ে আমরা ফ্রিতে কিছু করাতাম না।
মাতালদের কান্ডকারখানা নিয়ে কথা বলতে গেলে অনেক কথাই বলা যায়। আবার অনেক ঘটনাই আজ আর মনে পড়ে না। তবে মাঝে মাঝে মনের ক্যানভাসে ভেসে উঠে কিছু কিছু চেনা মুখ আর তার সঙ্গে জুড়ে থাকা নানা বিচিত্র কান্ডকারখানা। তখনকার দিনে মাঠে প্যান্ডেল করে যাত্রাপালার চল ছিল। প্যান্ডেল বলতে প্রথমে বাঁশ পুঁতে তার ওপর ত্রিপল। প্রচুর মানুষ আসতেন এই যাত্রাপালা দেখতে। কলকাতার প্রায় সব নামী যাত্রা সংস্থাগুলোই বেশ কয়েকবার আমারদের পাড়ায় যাত্রা করে গেছে। তা একবার মনে আছে এক মাতাল যাত্রা শুরু হওয়ার পরেই মাঠের কোনের দিকের একটু অন্ধকার দেখে ত্রিপল ফাঁক করে বেশ কিছু বিনা টিকিটের দর্শকদের ঢুকিয়ে দিয়েছিল। তারপর স্বেচ্ছা সেবকদের নজরে পড়ায় বেচারা পালিয়ে বাঁচে। কে বলে ওদের নাকি হুঁশ থাকে না? দিব্বি পালিয়েছিল ধরা পড়ার আগেই। পরের দিন ক্লাবে সালিশি ডেকে কান ধরে উঠ-বোস একেবারে বউএর সামনে। বউ একেবারে লতা কন্ঠী, কাই কাই করে সবার মাথা খেয়েছিল। একবার অভিনেতা অনুপকুমার আমাদের পাড়ায় নাটক করতে এসেছিলেন। সঙ্গে ছিলেন ওনার স্ত্রী অলকা গাঙ্গুলী। বেশ মজার নাটক। মজার মজার ডায়লগ, দর্শকদের ঘন ঘন হাততালি আর হাসির মাঝে অনুপকুমারের অসাধারণ অভিনয়। হঠাৎ তাল গেল কেটে, সব চুপচাপ। স্টেজে তৃতীয় ব্যাক্তির আগমন। অনুপকুমার, অলকাদেবী দু-জনেই একটু থমকে গেছেন। নেশার ঘোরে একটা মাতাল কোন ফাঁকে স্টেজে উঠে একেবারে অনুপকুমারের সামনে। তাকে আবার নামিয়ে তবেই নাটক শুরু। এ রকম কত ঘটনাই না ঘটেছে।
আর একটা ঘটনা বলি। কার্তিকদা খুব নেশা করতেন। সারাদিন কাজ করে এসে আকণ্ঠ না গিল্লে তার চলত না। বউ ভেগে গিয়েছিল আগেই। প্রাণের সাথী বলতে ঐ একটা নেড়ি কুকুর। নিরীহ এই প্রভুভক্ত প্রাণীটি কিন্তু প্রায়ই তার প্রভুর হাতে উত্তম মধ্যম খেত। তবে তার একটা কারণও ছিল। এই সারমেয়টি যা কিছু কুড়িয়ে পেত মুখে করে এনে সোজা কার্তিকদার ঘরে। পাড়াতে যার যেটা হারাতো প্রথমেই খোঁজ নিত কার্তিকদার বাড়িতে। আর শুনেছি সেখানে পাওয়াও যেত। আমি একবার স্ব-চক্ষে একটা খুন্তি মুখে ব্যাটাকে দৌড়তে দেখেছি। কিন্তু ফেলুদা - খুন্তি তো আর রাস্তায় পরে থাকে না, তাহলে ও পেল কি করে। তুমি ভাব ফেলুদা - আমি বলছি - ও ব্যাটা নির্ঘাত চুরি করেছিল। আমি শুনেছি অনেকেরই হাত-টান আছে কিন্তু কুকুরেরও যে মুখ-টান তা না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। প্রায় প্রতিটি সন্ধ্যায় এই হাজার হাজার অভিযোগ আর নেশার ঘোরে যত তবলার চাঁটি কার্তিকদা কুকুরটার ওপরই বাজাত। তবে অসম্ভব ভালোও বাসত। একটু চোখের আড়াল হলেই খোঁজ খোঁজ। খুঁজে পেলে কোলের মধ্যে নিয়ে ওটাকে বকতে বকতে ফিরত। তা এই কুকুরটা মরে যাবার পর কার্তিকদার কান্না দেখতে পাশের পাড়ার লোকও এসে হাজির। বলাবাহুল্য তারপর পাড়ার লোকের আর কারোর কিছু হারাতো না।
সময় বড় নির্মম, দ্রুত চলে যায়। স্কুল কলেজ পেরোতে না পেরোতেই হঠাৎ যে কবে দুম করে চুলে পাক ধরে গেল কে জানে। সংসার জীবনের এটা ওটা সেটার মধ্যেই প্রত্যাশিত প্রেশার কিম্বা সুগার। কিছু না কিছু আছে। রাজ্যের বড়ি গেলো। ম্যারাথন রেসের বাতিল ঘোড়াগুলোও দেখে ফিঁক করে হাসে। একটাই বাঁচোয়া যে স্মৃতিগুলো কিন্তু দুম করে ছেড়ে চলে যায় না। এখনো চোখ বুঝলে চোখের পাতায় এসে বসে, একটু নিরিবিলিতে। কিছুটা সময় সম্পূর্ণ নিজের মত করে ভাবতে থাকি, আর সেটার বিষয়বস্তু যদি 'মাতাল'ই হয় তো হোক না ক্ষতি কি? আর ভিতরের হাসিটা ভিতরেই থাক, বাইরে থেকে তো আর কেউ দেখছে না।
প্রবন্ধ
গোপনীয়েষু
অপর্ণা চক্রবর্তী
টালিগঞ্জ, কলকাতা


১
"আমার একলা আকাশ থমকে গেছে
রাতের স্রোতে ভেসে
শুধু তোমায় ভালবেসে"
দু-এক মুঠো শান্তি ছাড়া এখনও জমাতে পারিনি বিশেষ কিছুই। খরুচে বদনাম আছে। শোধ করার ক্ষমতাও নেই। তবু আপনার কাছে ধার চেয়ে লিখতে বসলাম। হ্যাঁ, লিখছি আপনাকেই...
আপনার ওই জানলাটা - আমাকে ধার দেবেন কবি ? অমন একটা জানলা পেতে বড় লোভ হয়।
রোদ উঁকি দেওয়া সকালের জানলা, ছুটির দুপুরে অলস জানলা, মন খারাপের উদাস জানলা, কাশ ফুলের দোলার জানলা, জোনাকির আলোয় রাত জাগা জানলা, ভালোবাসায় ভাসতে ভাসতে খোলা আকাশ দেখার একলা উদাস ওই জানলাটা - আমাকে ধার দেবেন?
আমার নিজস্ব যেটুকু পৃথিবী আছে, সেখানে আমি বাউন্ডুলে। আমার নিজস্ব যেটুকু আকাশ আছে, সেখানে আমি স্বাধীন। সেই স্বাধীন ডানায় ভর করে একদিন আপনার কাছে উড়ে যেতে পারি ওই জানলার জন্য। ঠোঁটে বয়ে নিয়ে যেতে পারি - ঘর বাঁধার খড়কুটো। তারপর বেলাশেষে জানলার পাশে বসে ভাগ করে নিতে পারি বিষন্নতা।
বলুন - ধার দেবেন জানলাটা?
২
"ভেবেছিনু মনে মনে দূরে দূরে থাকি"
কেন জানি না সবুজ দেখলে শুধু আপনাকেই মনে পড়ে কবি। শহর পেরিয়ে বহুদূর সবুজের ঘেরাটোপে যেখানে আপনার বারান্দা, নিজের সাথে যেখানে আপনার খেলনা বাটির সংসার, জানলার বাইরে হাত রাখলে যেখানে ইলশেগুঁড়ি স্পর্শ করা যায়, আমি আপনার সেই ঘরখানি কল্পনা করি প্রতিদিন।
প্রতিদিন আমার শহুরে চানঘরে একলা হলেই চারপাশে শুকনো পাতা ঝরার শব্দ পাই। সেই শব্দ আমাদের আলাপের মতোই স্নিগ্ধ, নরম, প্রত্যাশাহীন। আমার মনের ভিতর যে পথ ধরে আপনার চলাচল, সন্ধ্যা হলেই সেই পথের পাশে আমি প্রদীপ জ্বালি।
গাঢ় অন্ধকারে বন্ধ একটি দরজার ওপাশে আমার অজস্র না বলা কথা ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে বহুদিন আগে। ওদের ঘুম ভাঙিয়ে আপনাকে উপহার দেব কোনোদিন।
নিদ্রাহীন রাতে- খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে- জ্যোৎস্নার গায়ে লিখে রেখেছি আমার সমস্ত সমর্পণের কথা। পাখির মতো লালিত অনুভূতির পালক দিয়ে চিঠি লিখেছি শুধু আপনাকেই।
আমার প্রতি আপনার ঔদাসীন্য আমাকে ব্যথিত করেনি কখনও। কারণ - এ পূজা আমার একান্ত নিজস্ব। জীবন বড় কম সময়ের সম্পদ, নিজেকে আর একটিও অপ্রেমের দিন দেব না, এইটুকুই প্রতিশ্রুতি।
৩
"কোন্ গোপনবাসীর কান্নাহাসির
গোপন কথা শুনিবারে--বারে বারে
কান পেতে রই ..."
======================
দূরে থাকলেও বুঝতে পারি আপনি বাড়ি ফিরলেন কিনা, ফেরার পথে দূরের দীগন্তরেখাটি বিষন্ন ছিল কিনা, আকাশ মেঘলা কিনা। বুঝতে পারি লিখতে বসলেন কিনা, জল খেলেন কিনা, আনমনে কিশোর কুমার গুনগুন করলেন কিনা। আপনি গায়ক হিসেবে তেমন ভালো নন। উচ্চারণেও থতমত। তবু গানই তো! আর তা নিজের জন্যই যখন গাওয়া...
এক এক দিন আপনার মুখ কিছুতেই মনে পড়ে না। কাজের মাঝেও এমন হয়। কিছুতেই মনে করতে পারি না আপনাকে। ভাত মাখা হাতে বা কীবোর্ড থেকে চোখ সরিয়ে তক্ষুনি ফোনটা দেখে নিতে ইচ্ছে হয়। সম্ভব হয়না বলে অস্থির লাগে। মন চাইছে একবার দেখে নিই, একবারই তো দেখবো, দেখি একটিবার, এইটুকু তো দেখতে চাওয়ার ইচ্ছা...
আমার এই অস্থির সময়েই ঠিক বুঝতে পারি - আপনার খাওয়া শেষ হয়েছে, কাজ শেষ হয়েছে।
আপনি ঠিক এই সময় আমার মতো ব্যস্ত নন, অস্থির নন, শান্ত চোখদুটো বন্ধ হয়ে আছে আবেশে। বুকের ওপর খোলা পাতায় উপুড় হয়ে আছে বনলতা সেন, নীরা, নন্দিনী বা মানসী। আসলে বুঝতে পারাটা একটা অভ্যাস। নিরব থাকলে সেই অভ্যাস আরও তীব্রতর হয়। কখনও কথা হয়নি আমাদের। আপনার ফোনটা আমি ইচ্ছা করেই ধরিনি। নিরবতায় আপনার সঙ্গ করতে বড় ভালবাসি। আমি একদিন ঠিক আপনার বুকের ওপর ওই কবিতার খোলা বইটা হয়ে যাব। তারপর কান পেতে জেনে নেব সমস্ত গোপনীয় কথা...
ছায়া পড়ে আছে একলা নদীর জলে,
ছুঁয়ে দিলে জেনো দুহাতেই থেকে যাব।
আমি হেমন্তে পাতা ঝরা লিখে রাখি,
তুমি তো তাকেই আমার চিঠি ভাবো।
৪
"সন্ধ্যার মেঘে করিবো দুকূল,
ইন্দ্রধনুরে চন্দ্রহার।
তারায় করিবো কর্ণের দুল,
জড়াবো গায়েতে অন্ধকার।"
আপনি যেদিন শহরের রাস্তায় পড়ে থাকা পলাশ কুড়িয়ে অফিস টেবিলে রেখে ছবি তুলেছিলেন, সেদিন আমিও ওই ছবি দেখে একটা বেমানান স্বপ্ন বুনেছিলাম। আজ সেকথাই আপনাকে লিখতে ইচ্ছে হচ্ছে।
ধান ক্ষেত, কলাবাগান, জোড়া বটতলা, বাঁশ গাছের আড়াল দেওয়া সবুজ জলের পুকুর ঘাট পেড়িয়ে, বুড়োশিব মন্দিরের পাশ দিয়ে সরু রাস্তা ধরে আর একটু এগিয়ে একটা একচালা বসতবাড়ি। দেড় দু'খানা ঘর, লম্বা বারান্দা, উঠোনের একপাশে হাঁসমুরগি, তুলসী মঞ্চ, কুলুঙ্গিতে গুছিয়ে রাখা টুকিটাকি সাধ।
রান্না ঘরে মাটির উনুন। কঞ্চিবেড়ার ফাঁক গলে সকালের আলো উপুড় হয়ে পড়েছে সংসারের হাঁড়ি পাতিল আর শিল-নোড়ার ওপর। চুড়ি পরা দুটো হাতের ঝুনঝুন ধ্বনির সাথে মিলেমিশে যাচ্ছে মশলা বাটার শব্দ। শিল ধুয়ে জিরা-আদার জলটুকু সে ঢেলে দিচ্ছে ফুটন্ত তরকারির ওপর। আপনার কাচা জামা কাপড়ের সাথে ডুরেপাড় ভেজা তাঁতের শাড়িটা মেলে দিচ্ছে রোদে। মাদুরের ওপর বাংলা বই আর সেলাইয়ের বাক্স খুলে রেখে, চুল শুকচ্ছে দুপুরবেলা।
বেলা গড়িয়ে দীগন্তরেখা বরাবর সোনালী রঙ ধরেছে। হাঁস-মুরগি গুলো সদ্য খোঁয়ারে ঢুকেছে । তুলসী মঞ্চ আলো করেছে মাটির প্রদীপ। অন্ধকারে দু'একটা জোনাকি টুপটাপ ফুটতে শুরু করেছে।
ঠিক তখনই - সরু কাঁচা রাস্তায় সাইকেলটা এসে পড়ে ঝংঝং আওয়াজ করে, ঘন্টি বাজে টিংক্রিং। দূর থেকে এই শব্দ শোনার জন্যই সে উৎকর্ণ থাকে সারাবেলা। তার অপেক্ষা শেষ হয়। সান্ধ্যকালীন ঈশ্বর বন্দনায় আর তার মন বসে না। চুড়ি পরা হাত দুখানি তাড়াহুড়োয় নমস্কার সেরে উঠে পড়ে। এরপর একে একে এগিয়ে দেয় আপনার হাত-পা ধোয়ার জল, গামছা, মুড়ির বাটি, গরম চা। রাত বাড়লে পরম মমতায় গরম ভাতের ওপর ঝোল ঢেলে দেয়। প্রয়োজন মতো হাতে হাতে এগিয়ে দেয় একটা কাঁচা লঙ্কা, জলের গ্লাস, পাখার বাতাস। খাওয়া শেষে এনে দেয় যত্ন করে কাটা দু'টুকরো কুঁচো সুপারি বা মৌরি দানা। তারপর অন্ধকার বারান্দায় গা ঘেঁষে বসে - আপনার সাথে ঝিঁঝিঁর ডাক শোনে, জোনাকির আলো দেখে। গৃহস্থালির ফাটল বেয়ে চাঁদের আলো চুঁইয়ে পড়ে আপনাদের গায়ে।
জীবনে কিছুটা অভাব, কিছুটা মান-অভিমান, অল্প চাহিদা, অনেকটা অপ্রাপ্তি, বেশ কয়েকটা সরু ফাটল আর চোখ ভর্তি স্বপ্ন থাকার প্রয়োজন খুব বেশী। এইসব রঙীন পাথর বুকের ভেতর নড়াচড়া করলেই জীবন উপলব্ধির ঐশ্বর্যে পরিপূর্ণ হয়।
চোখের সামনে আমার মোবাইল স্ক্রীন একটু একটু করে ঝাপসা হচ্ছে জলে। পলাশ ফুল ধরে রাখা আপনার শুভ্র করতলের ছবিটা ফেড আউট হতে শুরু করেছে। ফোনের আলো বন্ধ হয়ে অটোলক্ হবার আগে আপনাকে বলেছিলাম -
ওভাবে নরম আগুন ছুঁতে নেই কবি...