প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা
জানুয়ারী
২০২৩
কবিতা
ঘরের কাছেই আফ্রিকার ড্রাগন পাহাড় দেখার অনুভূতি! - সুদীপ পাকড়াশী
প্রচ্ছদঃ সুরজিত সিনহা
লেখক/লেখিকাবৃন্দ
মানবিক মুল্যবোধের চরম অবক্ষয়
মিজানুর রহমান মিজান
বিশ্বনাথ, সিলেট, বাংলাদেশ
প্রবন্ধ
সকল প্রশংসা এক মাত্র বিশ্বপ্রভু মহান আল্লাহর প্রাপ্য। যিনি এ জগত সংসারের যাবতীয় বস্তুর সৃষ্টিকর্তা, হেফাজতকারী, পরিচালনাকারী ও সর্বশেষ মৃত্যুদাতা। কারণ ‘জগতের সকল প্রাণী মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে’। তিনি এক, অদ্বিতীয়, তাঁর সমতুল কেহ নেই। সর্বশ্রেষ্ঠ, শেষ নবী হযরত মোহাম্মদ (স:) আল্লাহর প্রেরিত নবী। হাজার হাজার সালাম ও দরুদ পেশ করি হযরত মোহাম্মদ (স:)’র নামে। মানুষকে আল্লাহ আশরাফুল মাখলুকাত নামে অভিহিত করেছেন সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব বলে। কারণ মানুষের মধ্যে রয়েছে বিবেক, জ্ঞান, বুদ্ধি, বিবেচনাসহ সচেতনতাবোধ সম্পন্নতা।আল্লাহ মানুষের জন্য দিক নির্দেশনা দিয়েছেন কিভাবে জীবনযাত্রা পরিচালিত হবে। এ সমস্ত বোধ শক্তি থাকার মুল মন্ত্র হল সৎ, সত্য সঠিক পথে পরিচালিত হওয়া, হারাম–হালাল, বৈধ-অবৈধ বুঝে হালাল ও বৈধ আয়ের মাধ্যমে জীবন পরিচালনা করা। অত:পর নীতি নৈতিকতা, ভদ্র, নম্র আচার আচরণের মাধ্যমে জীবন নামক তরী বেয়ে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌছানো। প্রত্যেক মানুষের পিছনে মৃত্যু দূত সব সময় রয়েছেন। নির্দিষ্ট ও নির্ধারিত সময়ে সবাইকে চলে যেতে হবে। এক মিনিট আগেও না, এক মিনিট পরেও না। পশু পশু হয়ে জন্মায়। তাকে পশুত্ব অর্জন করতে হয় না। কিন্তু মানুষকে মনুষ্যত্ব অর্জন করতে হয়। মনুষ্যত্বের মুলে রয়েছে নীতি, নৈতিকতা, মানবিক, হালাল, বৈধ পন্থা অনুসরণ করে অভীষ্ট গন্তব্যে পৌঁছানো। সুতরাং তা অর্জন করতে অনেক কঠিন, কঠোর ও বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে ঈপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছানো প্রত্যেক নরনারীর ঐকান্তিক কামনা ও বাসনা থাকা চাই। কিন্তু আমরা বর্তমানে কতটুকু মানবিক ও মনুষ্যত্ব সম্পন্ন মানুষের পরিচয় দিচ্ছি? তাই জিজ্ঞাস্য?
বর্তমানে সামান্য স্বার্থের লোভে আমরা যে পরিচয় দিচ্ছি তা কতটুকু নৈতিক, মানবিক ও মনুষ্যত্ব নির্ভর? দু’একটি উদাহরণ দিলেই তা স্বচ্ছ আয়নায় পরিস্ফুটিত হবে সহজে। এইতো গতকল্য একটি ভিডিও দেখে হলাম আশ্চর্যান্বিত। কুমিল্লা জেলার এম এ জলিল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক স্কুলের নিকটেই তিনির বাসা। সে বাসায় স্কুল থেকে বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়ে তিনি চলছেন।আরো টিনের নির্মিত ছয়টি কক্ষ রয়েছে, তাতেও প্রধান শিক্ষকের রোম থেকে সংযোগ দেয়া হয়েছে। একজন শিক্ষকের বেতন বর্তমানে ৩০/৪০ হাজার। এতো টাকা পেয়েও তিনি অবৈধ, অনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িত। প্রাপ্ত বেতনে যদি শিক্ষকের জীবন যাপন কঠিন হয়।তবে একজন মসজিদের ইমাম, শ্রমিক, কৃষক মাত্র ৪/৫ হাজার টাকায় এবং একজন কৃষক কত অমানবিক পরিশ্রম করে ৬/৭ হাজার টাকায় তাঁদের জীবন চলে। শিক্ষক মহোদয় কি খান? কোথায়, কিভাবে ব্যয় করেন? তিনি কি সোনা রুপা খেয়ে ফেলেন? আর শ্রমিক, কৃষকের, ইমামের জীবন যদি অল্প বেতনে সংকুলান সম্ভব হয়। তবে কেন শিক্ষকের উচ্চ বেতন পেয়েও সংকুলান হয় না। উপজেলা নির্বাহী অফিসারের জবাবে তিনি বলেছেন ৭/৮ বৎসর যাবত এভাবে চলছেন। কিন্তু অন্যান্যরা বলেছেন আরো দীর্ঘ দিন থেকে ব্যবহারের কথা। আমি আমার মুরব্বিয়ানদের মুখ থেকে প্রায়ই শুনতাম একটি প্রবাদসম বাক্য। যা হচ্ছে “বৈধ, হালাল উপার্জনে রয়েছে বরকত(মুরাদ)”। অবৈধ ও হারাম উপার্জনে বরকত (মুরাদ) শব্দটির অনুপস্থিতি। শাক-সবজি খেয়ে কৃষক, শ্রমিক অনেক বলবান, অপরদিকে বিরিয়ানি খেয়ে হচ্ছেন ডায়াবেটিস, কোলেস্টেরল সমৃদ্ধ। খানা খাদ্যে নিষেধাজ্ঞা সমৃদ্ধ। শিক্ষক মানুষ গড়ার কারিগর, সম্মানী ব্যক্তি। কিন্তু কাজকর্ম নিন্দিত। (সব নয়) একজন শিক্ষক সত্য ও সততার হবেন প্রতীকী। বিগত ১২জানুয়ারি ২০২১ দৈনিক সিলেটের ডাক পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত “৬ বছর অনুপস্থিত থেকে নিয়মিত বেতন-ভাতা নিচ্ছেন প্রধান শিক্ষক” এবং সুরমা নিউজ টুয়েন্টিফোর ডট কম’র ১০ সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখের প্রকাশিত সংবাদ “থাকেন আমেরিকায়, করেন সিলেটে প্রধান শিক্ষিকার চাকুরী” শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদ পাঠে জানা যায়, হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার বৈরাগিপুঞ্জি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আমেনা খাতুন স্কুলে ৬ বছর যাবত অনুপস্থিত থেকে নিয়মিত বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা নিচ্ছেন। অভিভাবকরা বিষয়টি লিখিতভাবে প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের সিলেট বিভাগীয় পরিচালককে জানালে অভিযোগের সত্যতা তদন্ত পূর্বক একটি বিভাগীয় মামলা করা হয় এবং মামলায় তার দুই বছরের বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি স্থগিত করা হয়। ঐ শিক্ষকের কর্মকান্ডে ছাত্ররা বা সন্তানরা কি শিখবেন? তা পাঠকের বিবেচ্য! ঐ শিক্ষকদ্বয়ের এ জাতীয় মন মানসিকতা কি
সত্যিকার নৈতিকতা ও মানবতাবোধের? আমরা কোথায় চলেছি, আকাশে না পাতালে? অবক্ষয়ের মাধ্যমে হচিছ বঞ্চিত প্রকৃত বাস্তবতা থেকে? ব্যক্তি, গোষ্ঠী, সমাজ, জাতি যাচ্ছি রসাতলে।
আরেকটি কাহিনী সে দিন আমি আমার এক বন্ধুর মুখ থেকে শুনে হতবাক হয়ে গেলাম। আমাদের সমাজে অধিকাংশ ক্ষেত্রে যৌথ সম্পত্তি। খুব কম সংখ্যক বাটোয়ারা দলিল হয়ে থাকে। মৌখিক ভাবে চিহ্নিত করে সকলেই ভোগ করতে অভ্যস্ত। এক সময় ছিল একজন তার অংশের ভূমি বিক্রি করতে চাইলে অন্য শরিকান সাক্ষী হিসাবে দলিলে স্বাক্ষর দেবার প্রচলন। তাই ভাতিজা তার অংশের জমি বিক্রি করবে। এখন অন্য শরিকানের সাক্ষী প্রদান আবশ্যক। সেহেতু ভাতিজা বলছে চাচাকে সাক্ষী প্রদান করতে। জমির তার অংশের বিক্রির কথা স্পষ্ট করে বলেছে চাচাকে। চাচা সাক্ষী দিয়াছেন বিশ্বাস করেই দলিল না দেখে। এখানে একটি কথা উল্লেখ করতেই হয়। কবরস্থান কিন্তু যৌথই থাকে। কারণ সেখানে কবরস্থ হবেন সবাই। কিন্তু আমাদের উল্লেখিত ভাতিজা মিথ্যা ও প্রতারণার আশ্রয় নেয়। চাচা তা ঘুণাক্ষরে ও টের পাননি। ভাতিজার অংশের আংশিক ভূমিসহ কবরস্থানের দুই তৃতীয়াংশ দলিলে লিখে সাক্ষীর কলামে চাচার স্বাক্ষর নেয়। আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা অতীব প্রয়োজন। ক্রেতা ঐ বংশেরই একজন। উভয়ে চক্রান্ত করে তা বাস্তবায়ন করছে লোভ দেখিয়ে ক্রেতা বিক্রেতাকে। গোপনে তাদের মধ্যে আঁতাত, শলা পরামর্শে কাজটি করা হয়েছে। দিন যায় কথা থাকে। চাচা কবরস্থ ভূমির অংশ বিক্রি করেননি তিনির সত্যে অটল। অপরদিকে বিক্রেতা ক্রেতা এক সময় গোপন আঁতাতে ধরে ফাটল। বের হয়ে আসে গোপন কথা জনসমক্ষে। তখন কিন্তু নদীর জল অনেক বয়ে গেছে। বিক্রেতা দলিল দ্বারা টাকার বিনিময়ে তার নামে কবরের দুই অংশ রেকর্ড করে নেয় টাকা ও শক্তির প্রভাবে। চাচা তাদের সাথে পেরে উঠতে পারছেন না দুর্বল বলে। কিন্তু ভূমিটুকু কবরস্থান বলেই রেকর্ড হয়। এখন কথা হল কবরস্থান বিক্রি হয় না তা বিজ্ঞজন মাত্রই জ্ঞাত। তারপরও হয়ে যায়, যাচ্ছে। সাক্ষী দেবার কারণে চাচার কবরের অংশটুকু থেকে তিনি হলেন বঞ্চিত। সর্বশেষ কথা হল এ ক্ষেত্রে কবরস্থান নিয়েও মানুষ প্রতারণা, প্রবঞ্চনা, ঠকানোর ধান্ধায় লিপ্ত। আর বাকি কি রয়েছে? প্রতারকও তো কবরস্থানে যাবেন শেষ পর্যন্ত। তা থেকে তো কোন ক্রমেই রেহাই নেই। সুতরাং মানুষের মনুষ্যত্ব, মানবিকতা, নীতি-নৈতিকতা কোথায়, কোন অবস্থায় কি ভাব দাঁড়িয়েছে। সম্মানিত পাঠক ও বিজ্ঞজনের আর ব্যাখ্যা করে দেখাবার প্রয়োজন নেই। যে কেহ অতি সহজে অবশ্যই বুঝে নিতে কষ্ট হবার কথা নয়। আরো তদন্ত করলে যে বের হবে না তা কি নিশ্চয়তা দিয়ে বলা যাবে? শুধু শিক্ষকদের কথা নয়। দেশের প্রতিটি সেক্টরে অনুরুপ দায়িত্বহীনতার ভুরিভুরি প্রমাণ মিলবে। দু’একজনের জন্য কেন হবে ঐ সমাজ কলঙ্কিত?
যে কোন কাজে ব্যক্তির চারিত্রিক সংশোধন সর্বাগ্রে প্রয়োজন। ব্যক্তি সংশোধিত না হলে সামগ্রিক কাজ সুষ্ঠু ভাবে সম্পন্ন অসম্ভব। আবার ব্যক্তি সংশোধিত হলেই চলবে না। প্রয়োজন সমষ্টি। কারণ পৃথিবীর কোন কিছুই সংঘবদ্ধ ব্যবস্থাপনা ব্যতিরেকে উন্নতির শিখরে পৌছতে পারে নাই, পারবে না। সুতরাং সম্মিলিত শক্তির গুরুত্ব অপরিসীম। তারপরও কথা থেকে যায়। কোন কিছুতেই কিছু হবে না। যতক্ষণ মানুষকে সঠিক অর্থে সঠিক মানবতা, নৈতিক গুণাবলী সমৃদ্ধ ও মানবিক মানুষ বানানো যাবে না। এ দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে ঘুষ, দুর্নীতি মারাত্মক ব্যাধি রূপে আক্রান্ত সমাজ।এ থেকে পরিত্রাণের আবশ্যকতা অত্যন্ত জরুরী। নৈতিকতা ছাড়া যেমন কেহ ভাল হতে পারেন না,তদ্রুপ মানবিক এবং সামাজিক মুল্যবোধের অভাবে পূর্ণতায় আসা সম্ভব নয়। মুল্যবোধের অবক্ষয় যাতে না ঘটে সেদিকে আমাদেরকে সজাগ, সুদৃষ্টি ও লক্ষ্য রাখতেই হবে। তাহলে হয়ত আমরা পেতে পারি সুন্দর ও সঠিক সমাজ ব্যবস্থা। পরিশেষে এ প্রত্যাশা সর্বাত্মকরণে প্রতিটি ক্ষেত্রে অবক্ষয় থেকে উটে আসার। তথা দায়িত্বশীল, কর্তব্যপরায়ণ ও নৈতিকতাবোধে কাজ করার, দায়িত্ব পালন করার।তা না হলে কবির ভাষায় বলতে হবে আক্ষেপের সুরে, “রাত পোহাবার কত দেরী, পাঞ্জেরী”।
কবিতা
সাহেব সেখ
মুর্শিদাবাদ, পঃ বাংলা
আমি দিয়াছি মোক তোমারে
আমি দিয়াছি মোক তোমারে,
আমি দিয়াছি দুহাত ভরে।
আমি পেয়েছি তোমারি দর্শন,
মনেরও অন্দরে, মনেরও অন্দরে।
অশ্রুসজল নয়নে,
চেয়ে রয়েছি গগনে।
আমি একা এই মহাপাবনে,
পুড়িতেছি ক্ষণে ক্ষণে।
আমি দিয়াছি মোক তোমারে,
আমি দিয়াছি দুহাত ভরে।
আমি পেয়েছি তোমারি দর্শন,
মনেরও অন্দরে, মনেরও অন্দরে।
প্রেমেরও আগুনে পুড়ে,
প্রভু কাঁদে মাঝি কাঁদে।
দাঁড় যে চলে যায় বয়ে,
দূর থেকে দূরে, দূর থেকে দূরে।
আমি দিয়াছি মোক তোমারে,
আমি দিয়াছি দুহাত ভরে।
আমি পেয়েছি তোমারি দর্শন,
মনেরও অন্দরে, মনেরও অন্দরে।
বাগান শূন্য করে,
ফুল যায় মালিকের সঙ্গে।
মালী তুই ফেলিস অশ্রু ওরে,
কেউ নেই পৃথিবীতে, কেউ নেই পৃথিবীতে।
আমি দিয়াছি মোক তোমারে,
আমি দিয়াছি দুহাত ভরে।
আমি পেয়েছি তোমারি দর্শন,
মনেরও অন্দরে, মনেরও অন্দরে।
তোর জন্য
সারাদিন মন করে উড়ু উড়ু সেই তো তোরই জন্য
এলো চুল মেলে টোল ফেলে গালে হাসলেই তুই অনন্য।
তোর জন্যই শব্দ চয়ন স্বপ্নেও খুঁজি তোকে
স্বপ্নেই দিই চুম্বন এঁকে তোর ঠোঁটে গালে চোখে।
শুধু একবার আড়চোখে তুই চাইলেই আমি ধন্য
সারাদিন মন করে উড়ু উড়ু সেই তো তোরই জন্য।
পড়ার টেবিলে আনমন আমি সেও তো তোরই জন্য
তোকে মন দিতে এতটুকু আমি করিনিকো কার্পণ্য।
সাইরেন বাজে বুকেতে আমার নিশ্বাসে নিকোটিন
ক্যানভাস জুড়ে একটাই ছবি আঁকি আমি সারাদিন।
তোর পিছে পিছে স্টীমবোট আমি নাই কাজ কিছু অন্য
ফাঁকি দিই ক্লাস আমি বারোমাস সেও তো তোরই জন্য।
গীতিকবিতাঃতোমার দান
যে কর্মভার করেছো দান করতে যেন পারি
কর্মমুখর এই যে ভুবন সবই তো তোমারি।
দাও হে শক্তি মনের মাঝে
সদাই যেন থাকি কাজে
তোমার দেওয়া কর্মে যেন না হই অহংকারী
যে কর্মভার করেছো দান করতে যেন পারি।
তোমার কাজের যোগ্য করে
নাও না তুমি আমায় গড়ে—
তোমার কর্মযজ্ঞে যেন সামিল হতে পারি
যে কর্মভার করেছো দান করতে যেন পারি।
ভুবনভরা সৃষ্টি তোমার সারি সারি
বিশ্বময় কর্ম তোমার রকমারি
তোমার আশিষ ইচ্ছা বিনা করতে কিছুই নারি
যে কর্মভার করেছো দান করতে যেন পারি।
তোমারই জন্য
তোমারই জন্য শিউলি শরৎ তোমরই জন্য কবিতা
এতো ভালোলাগে গান ও গল্প তোমরই জন্য সবিতা।
তোমারই জন্য পূর্ণিমা চাঁদ রূপালী জ্যোৎস্না ধারা
তোমারই জন্য সবিতা আমি সারাদিন দিশাহারা।
তুমি আছো তাই ঘরেতে অভাব
তবু আমি কত সুখী
ক্ষণিকের তরে অন্তরে কভু হই নিতো জানো দুখী।
রাংতায়ে মোড়া এ জীবন মোর
কত যে রংঙের মেলা
তোমারই জন্য সবিতা আমার রঙিন ফাগুন বেলা।
তোমারই জন্য বাজে গো বাঁশরী বুক ভরা তার সুর
রিনিঝিনি রিনিঝিনি বাজে তোমার পায়ে নূপুর।
বুকেতে আমার দিলে যে ছন্দ তাই হল কবিতা
আমার সকল কবিতায় তুমি ধরা দিলে সবিতা।
কামনাবহ্নি
প্রেম নয়, প্রেম নাই— মনে হয় ভুল
শুধু ভালোবাসি আমি কামনার ফুল।
আকাঙ্ক্ষার ধন তুমি, উদগ্র বাসনার
দেহহীন প্রেম কভু ছিল না আমার।
নীল চাঁদ জোছনায় নীল নদীকূল
নীল রাত নির্জনে কামিনী মুকুল
ছড়াক সুরভি তার চঞ্চলি প্রাণ
প্রতি রাতে পাই যেন তারই আঘ্রাণ।
অমৃত সুধারস দেহভান্ড ভরে
আকন্ঠ করি পান তৃষিত অন্তরে।
চাই না বৈরাগ্য সাধন মোক্ষ মুক্তি আর
জ্বলুক জ্বলুক শিখা বহ্নি কামনার।
কবিতা
সুকান্ত পাল
জিতপুর, মুর্শিদাবাদ
কবিতা
রাজর্ষি চট্টোপাধ্যায়
উত্তরপাড়া, হুগলী, পঃ বাংলা
নারী
পুরুষ তুমি যতই মারো,
মরবো কিন্তু লড়বো আরো৷
বুটের নিচে দাবিয়ে রেখে,
পারবেনা কো দমিয়ে রেখে৷
পুরুষ তুমি যতই মারো,
মরবো কিন্তু লড়বো আরো৷
যতই তুমি শাসিয়ে রাখো,
জন্ম দেবো লাখো লাখো৷
পুরুষ তুমি যতই বাড়ো,
জন্ম নাহি দিতে পারো৷
ধর্ষণের বর্ষণেতে যতই ভাবো জিতলে তুমি,
নারী ছাড়া ধরিত্রী তো হবেই হবে মরুভূমি৷
দুর্বল বলে তকমা দিয়ে,
তাচ্ছিল্য তো করতেই পারো৷
পুরুষ তুমি যতই মারো,
লাখো নারী লড়বে আরো৷
পুরুষ তুমি যতই মারো,
সংঘবদ্ধ হচ্ছি আরো৷
মা-বোন বলে ভুলিয়ে রেখে,
পারবেনা কো থামিয়ে দিতে৷
মারবে গুলি ফাটবে খুলি,
যন্ত্রণাতো দিতেই পারো।
পুরুষ তুমি যতই মারো,
জেনে রেখো লড়বো আরো৷
ইরাবতী তোমাকে
ইরাবতী ইরাবতী পড়ে কি আমায় তোমার মনে
ফাল্গুনের দিবালোকে দেখা তোমার সনে
মনে পড়ে ফাগুন বেলায় অপূর্ব সেই আলো?
কিশোরীর কাজল আঁখি লেগেছিলো বড়ই ভালো
ইরাবতী ইরাবতী তুমি জীবন্ত নদী
একবারটি দেখতে পাবো সুযোগ হয় যদি
ইরাবতী ফিরতে কি চাও ফেলে আসা দিনে?
স্মৃতি বড় বেদনার
ফিরে আসে ক্ষণে ক্ষণে
তোমার সাথে শেষ বার যদি দেখা করতে চাই
জীবন যদি সুযোগ দেয় শেষের কথা বলব তাই
ইরাবতী দুই দশক বাদে যদি তাকাও একবারটি ফিরে
ফিরে যাবো অতীত দেশে ফেলে আসা দিনের তীরে
ফিরেবে না আর ফিরবে না যে বাসন্তী অতীত আমার
বয়েস বেড়ে দিনগুলো রোজ আজ ফ্যাকাসে ধুসর বারবার
প্রতিষ্ঠা প্রতিদানের সংগ্রহশালার
নিঃসঙ্গ তারবার্তা
ভেঙে পড়া শিশু
পড়শি সন্দেহজনক যন্ত্রীর
ব্যথার দিনে হাওয়া বদলের হাতছানি
প্রতীক হারিয়ে ফেলে কেনাকাটার মুর্খামি
আবদার পাতা ওলটানোর
তবু
প্রতিষ্ঠা
প্রতিদানের সংগ্রহশালার
নামজাদা শৃঙ্খলের
পুনশ্চ কলাকৌশলের
কেউ ছাড়তে রাজি নয় বিবিধ জমি
পৃথিবী জানে ছিঁড়ে যায় একাকার বাঁধনে
প্রসাদের দাবী
আবিষ্কারের গোড়াতেই আইনঅমান্য আন্দোলন
শূন্য কাহিনী নিস্তরঙ্গ।
কবিতা
পার্থ সরকার
নারী
ওহে নারী, তোমার দাবিটা কী শুনি!
শুনি তোমার কিসের চাহিদা।
অল্পতে যা পেয়েছ,
তাতে কী আশ মেটে না?
ওহে নারী, তুমি ইস্কুলে যাবে?
লেখাপড়া ধরলে, বিয়েটা কী আর হবে?
ঘুরে দেখতে চাও এই জগতটাকে?
সাহস তো দেখছি কম নয়!
অসময়ে বাড়ির বাইরে বেরোবার
অনুমতি তোমায় কে দেয়?
নারী গো, তুমি ঘরের লক্ষ্মী
ঘরেই তোমায় মানায়,
যখন তখন বাইরে বেরলে
প্রতিবেশীরা কি মেনে নেয়?
অনেক তো হল বয়স
এখনও ছেলেমানুষী, সেকি?
খেলাধুলো ছেড়ে এবার
একটু খুন্তি নাড়ো দেখি।
ওহে নারী, তুমি কি স্বপ্ন দেখ?
তবে তা দেখার কি কোনো মানে হয়?
তুমি তো আর পুরুষ নও
তাই স্বপ্নের কথা ভুলে যাও।
নারী তোমার দাবি শুনলাম বটে,
তবে অস্বাভাবিক চাহিদা শুনিয়ে লাভ কি হল তাতে?
কবিতা
অর্কপ্রভ চৌধুরী
এলোমেলো
দৃশ্যটা এখন পেপার ওয়েট
চশমা ব্যতিত আর কিছু নেই কাছে।
এলোমেলো হাওয়া চাপা পড়ে থাক
কাগজের স্তুপ খোলা চোখ
কাছটাকে বেশ ভালো দেখে।
দূরে দেখার ইচ্ছে নেই
ঘটে কম, তার বেশিটাই রটে।
হাতের কাছে কলম কালি
দোয়াত গিয়েছি ভুলে -----
চাপা পড়া কথাদের মতো
বেহিসেবে --------
খালি চোখ দেখছে ভালো
বিশ্বাস গুটিসুটি বুকের ভেতর
গুনগুন বাজে ----- বেঁচে থাক
বেজে যাক্ কুয়াশার এই রোদে!
কবিতা
নারায়ণ চন্দ্র মিস্ত্রি
সল্টলেকে বইমেলা, খুঁজে আর পাইনে!
ফরমেশি তালিকাঃ দাঁড়িয়েছি লাইনে।
ফাস্ট ফুড স্টল ফেলে,
বাঁয়ে গিয়ে “রবি” পেলে--
কবিদের আড্ডাটা খুঁজে পাবে ডাইনে!
কলকাতা বইমেলাঃ লিমেরিক
ডাঃ রুদ্রজিৎ পাল
কসবা, কলকাতা
নিরঞ্জন
নদীর কাছে এসো,
কান পেতে দেখো ওই,
জল তরঙ্গের সুরমালা ভেসে আসে;
অপার্থিব সৌন্দর্যের মাঝে,
দেবীর আগমনের প্রাক্কালে,
ক্লান্ত কৃষকের দেহখানি পড়ে থাকে পাশে।
অশ্রুজলে সিক্ত মাটি,
বয়সের ভারে জর্জরিত মুখমণ্ডল,
কবিতা
ডঃ মন্থনকুমার দাস
লক্ষ্ণৌ, উত্তরপ্রদেশ
ক্লান্ত দেহাবশেষের প্রতিটি অঙ্গে স্বপ্ন ভাঙার হতাশা;
ধনী মহাজনের লালসার অগ্নি,
খাজনা ও ঋণের দুর্বিষহ ভ্রুকুটি,
দেবীপক্ষের শারদ প্রাতে সমাধিস্থ এই রাগচন্দন, কৃষ্ণবর্ণ চাষা।
শরতের নীল আকাশের ওপর পারে,
রাশি রাশি মেঘমালার কোণে,
নারদের বীণায় বাজে যখন কোমল গান্ধার;
এই ধরিত্রীর বুকে চিতায় তখন,
কঠিন বাস্তবতার লেলিহান শিখা স্বর্গমুখী,
তার মাঝেই নিঃসহায়তার কলরব
"মা, আসছে বছর এসো আবার.."।
গল্প
মাতাল
কৃষ্ণতরু বর্মন
ডালাস, টেক্সাস
মাতাল। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের একটি খুবই পরিচিত শব্দ। জড়িয়ে আছে হাজার রকমের নানান কাহিনী। কোনটা মজার, আবার কোনটার আড়ালে থেকে যায় এক কঠিন বাস্তব। আর সব কাহিনীই যে সব সময় খুব মজার হয় তা কিন্তু নয়।
বড় হয়েছি দক্ষিণ কলকাতার কাছাকাছি। তখনকার দিনে এখনকার মত অত কংক্রিটের জঙ্গল ছিল না। বেশ ফাঁকা ফাঁকা জায়গা জুড়ে বাগান সমেত সব বাড়ি। মস্ত খেলার মাঠ পেরিয়ে আম, জাম আর সবেদার বাগান। পুরোনো আমলের কিছু বাড়ি, একটা মন্দিরও চোখে পড়ত। বেশ নির্জন ছিল চারপাশ। গাড়ি-ঘোড়ার দৈনন্দিন যানজট, অহেতুক ঝুটঝামেলা, মানুষের ভিড় এসব একেবারেই ছিল না। খোলা পরিবেশে সবুজ রঙটা তখনও বেঁচে, আকাশ ছিল গাঢ় নীল। শীতের ভোরে দূর্বাঘাসের মাথায় শিশিরের স্নিগ্ধতা টাটকা থাকত অনেকক্ষণ। প্রকৃতির সবুজ কোলে মাথা রেখে খোলা আকাশের নিচে একেবারে নির্ঝঞ্ঝাটে আমাদের বড় হওয়া। প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নেওয়ার জায়গা ছিল অনেক। আজ হয়ত আর পাওয়া যায় না। সে যাই হোক, তখনকার দিনেও এই অল্প সংখ্যক মানুষের মধ্যেই কেউ কেউ আবার সন্ধ্যা গড়াতে না গড়াতেই একটু আধটু খেয়ে রাস্তা চওড়া করে বেড়াতেন। কথাবার্তা একটু আধটু লাগামছাড়া হলেও ওদের নিয়ে আমাদের যে একটা বিশাল ঝামেলায় পড়তে হত তা কিন্তু নয়। পাড়াতে উৎপলদা ছিলেন এমনই একজন চরিত্র।
তখন শহরে খুব লোডশেডিং। আর রোজ হত বলেই ব্যাপারটা গা সওয়া হয়ে গিয়েছিল। দিনের বেলাটা মোটামুটি কেটে গেলেও সমস্যা ছিল সন্ধ্যার পর। একে তো সরু রাস্তা, তার ওপর অন্ধকারে কে কোথা দিয়ে হুড়মুড় করে এসে ঘাড়ে পড়বে কে বলতে পারে? রাস্তায় হাজার হাজার গাড্ডা, বৃষ্টির কথা ছেড়ে দিলুম...অসভ্য গরুগুলো একটু ইয়ে করলেই ব্যাস, পিচ উধাও। পড়তে পড়তে বেঁচে গেছি কতবার। গরমের সময় সব বাড়িতেই গরমে হাত পাখা টানার চলন ছিল। দিদা, ঠাকুমা কিম্বা মায়েদের ঘুমতে ঘুমতে হাত পাখা টানার কনসেপ্টটা আজও অবাক করে। তবে মা আবার ওটাকে আরেকটা বিশেষ কাজে ব্যবহার করতেন। প্রয়োজনে পিঠের ওপর ডুগডুগি বাজানোর সময়ও কাজে লাগত এই শখের কারুকাজ করা তালপাতার পাখাটি।
যাক সে সব কথা। তা সেদিনও পাড়ায় যথারীতি লোডশেডিং। অক্টোবরের শেষের দিকে বাতাসে শীতের ছোঁয়া। ফিরতে একটু দেরীই হয়েছিল। রাতের অন্ধকারে বাসস্ট্যান্ড প্রায় খাঁ খাঁ করছে। মাফলার দিয়ে নাক মুখ ঢেকে এগোতেই কানে এল গোঙানির শব্দ। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছি, এ উৎপলদাই হবে...রোজকার মতই আজও মাল টেনে টাল হয়ে আছে। কাত মেরে পড়ে আছে বেকায়দায়। একটু এগোই... আছে না গেছে? অন্ধকারে বডি তো দেখছি, কিন্তু মুণ্ডটা কোথায়? হাত ধরে টান মারতেই মুণ্ডুটা বেরিয়ে এল। যাক, একদম ঠিক জায়গাতেই এখন এটি শুধু কাজ করলেই হয়। কথায় বলে মাল খেলে নাকি হুঁশ থাকে না, কে বলল? এ বাবাজীর জ্ঞান একেবারে টনটনে। হ্যাঁচকা টান পড়তেই খেঁকিয়ে উঠলেন –
‘টান মারলি কেন? তোকে কে টান মারতে বলেছে, যদি পড়ে যেতাম।'
যাত্তেরি! হাসবো না কাঁদবো, যে বাছাধন পড়েই আছে সে আবার নতুন করে পড়বে কি? বলে উঠলাম,
- ‘আরে ও উৎপলদা, যাও না, এবার বাড়ি যাও অনেক রাত হয়েছে’ আমি তো বলেই খালাস। কিন্তু যাবে কি করে? আর এই শীতের রাতে রাস্তায় তো কোন রিক্সা টিক্সাও দেখছি না। যাই বল বাবা আমার একার পক্ষে এটাকে বয়ে নিয়ে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া... এ তো মহা মুস্কিল! এদিকে বিড়বিড় করতে করতে উৎপলদা কোন রকমে উঠে বসেছে। আমার দিকে তাকিয়ে একেবারে খ্যাঁক খ্যাঁক করে বলে উঠল,
- ‘তুই এত রাতে কি করছিস, আড্ডা মেরে ফিরছিস? দাঁড়া না, কাল কাকুর সঙ্গে একবার দেখা হোক’। আ মলো যা... শা... মাল খেলে কি হবে জ্ঞান বেশ টনটনে। আরে আমিই টেনে তুললাম আবার আমাকেই শাসানি। এইজন্য বলে কারোর উপকার করতে নেই, বিশেষ করে মাতালদের তো একদমই নয়। এত টেনেছে যে কাছে যাওয়াই মুস্কিল। শেষমেশ একটা রিক্সাতে অনেক বলে কয়ে তুলে বিদায় করে দিই। সে যাই হোক শীতের রাতে ঐ রিক্সাওয়ালাকেই সেদিন দেবদূতের মত মনে হচ্ছিল। তবে দেবদূত বাবাজীও একটু বেসামাল। রতনে রতন চেনে। যাক গে, একজন তো পাওয়া গেল যে ওর দুঃখ কষ্ট বোঝে। পরেও যে উৎপলদাকে নিয়ে যে আমার মত অনেককেই ঝামেলাতে পোহাতে হয়েছে, তা বলাই বাহুল্য।
গোরার বাবা একটু নেশা ভাং করতেন। সেটা আমরা পাড়ার চ্যাংড়া ছেলেরা অনেকেই জানতাম। তবে খুব বেশী নাটকীয় ভূমিকায় উনি এর আগে কখনো অবতীর্ণ হন নি। একদিন বিকেলে ক্লাবের বারান্দায় বসে আড্ডা মারছি। সেদিন বোধহয় ওনার একটু চড়েই গিয়েছিল। একটা ম্যাটাডোর ভ্যান গেছে রাস্তায় আটকে। তাকিয়ে দেখি সামনে গোরার বাবা। নট নড়ন চরণ। উত্তমকুমার স্টাইল। হাত দুটো তোলা। নেশাতুর গলায় গাইছেন – ‘যাব বলে তো আসি নি’। কাতর মুখে ড্রাইভার যতবার বলছে – ‘ও দাদা, একটু সরে দাঁড়ান না।’ ঠিক ততবারই কাকুর ঐ এক স্টাইল – ‘যাব বলে তো আসি নি।’ গানের কথাতেই বুঝিয়ে দিচ্ছেন যে উনি সরার পাত্তর নন। 'ওগো বঁধু সুন্দরী' ছবিতে কিশোরদার গানের দ্বিতীয় সংস্করণ আর কি! তবে এই গানের স্টাইল দেখলে বাপীদা যে তার ভারী শরীর নিয়ে ভিমরি খেতেন, তা আমি হলফ করে বলতে পারি। পরে অনেক কষ্টে ওনাকে বাগে আনা হয়েছিল। সত্যি কথা বলতে কি কাকুকে প্রায় একপ্রকার চ্যাংদোলা করেই...সে এক যা তা অবস্থা!
বয়স তখন অল্প। এন্টারটেইনমেন্টের লিমিটেড অপশন বলতে চূড়ান্ত আড্ডা আর খেলা। পাড়ার মাঠে ফুটবলটাই বেশি হত। নানা ধরণের টুর্নামেন্ট লেগেই থাকত সারা বছর। বিভিন্ন জায়গা থেকে নামী দামী খেলোয়াড়রা অংশ নিতেন। আমাদের আশেপাশের টিম নিয়ে চলত ফুটবল লীগ। বেশ কাটত দিনগুলো। আর ফাইনাল খেলার দিন, পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে নিয়ে আসা হত ইষ্টবেঙ্গল কিম্বা মোহনবাগান দলের নামী খেলোয়াড়দের। আমার মনে পড়ে মানস ভট্টাচার্য, কৃষ্ণেন্দু রায়, জেভিয়ার পায়াস, তপন দাস, গৌতম সরকার, তরুন দে, শিবাজী ব্যানার্জী,
ভাস্কর গাঙ্গুলীর মত সব নামী খেলোয়াড়রা কোন না কোন সময় প্রধান অতিথি হয়ে আমাদের মাঠে উপস্থিত ছিলেন। খেলা শেষ হবার পর সব মিটে গেলে শুরু হত ক্লাবের সামনে বনভোজনের আয়োজন। সে এক বিচিত্র উন্মাদনা! বড় বড় ডেচকিতে চলছে হাবিজাবি রান্না আর হুলুস্থুল। ওপেন টু অল। কচিকাঁচা, বাচ্চা, বুড়ো সব্বাই হাজির। চেঁচামেচি, হৈ চৈ, এক জমজমাট সন্ধ্যা। সে একটা সময় গেছে, আজকাল যেন সব কিছুই বড্ড যান্ত্রিক। মনের সঙ্গে যোগাযোগ কম। পরিবেশও গেছে পালটে। সব ছোট ছোট গ্রুপ, লবি। পছন্দ অপছন্দের অজস্র সুক্ষ দেওয়াল। ইনভিজিবল কাঠিতন্ত্র। মানুষকে ছোট করেই মানুষের আনন্দ। আর তাছাড়া সর্ষের মধ্যেই ভূত। হাজার সর্ষে ছুঁড়ে মারলেও ভুতেরা খিলখিলিয়ে হাসে। উল্টে ভূতের সংখ্যাই বাড়ে। তাই চারদিকেই ওদেরই রাজত্ব। যাক গে যেটা বলছিলাম। সব খাওয়া দাওয়া মিটে গেলে তখনই হত সমস্যা। এত রাতে এই বড় বড় ডেকচি, থালা, হাতা, খুন্তি ধোবে কে। ঠিক হত সকালে যা করার করা যাবে। একটা রাতের তো ব্যাপার। পরের দিন সকালে যেটা করা হত, সেটা মোটেই ঠিক ছিল না। রাস্তা দিয়ে কোন মাতাল গেলেই ‘সাত সকালে মাল খেয়েছিস কেন?’ বলে ধরে আনা হত। ‘ছেড়ে দিন না দাদা, এই কান মুলছি আর খাব নি, এই উঠবোস করছি’ বলে উঠবোস করলেও ছাড়া হত না কারণ ওকে দিয়েই এঁটো বাসনগুলো ধুইয়ে নেওয়া হত। তবে দু-একজন একেবারে যে হাত লাগাত না তা নয়। একবার এক মাতাল ইয়া একটা ডেচকি ধুতে ধুতে বলল –
- 'আমি হাফ ধুচ্ছি, তুমি হাফ ধুয়ে নাও’। অবাক হয়ে বললাম,
– ‘ধুর এই ভাবে হয় নাকি। একটা ডেকচির আবার হাফ-ফুল ধোয়া যায় নাকি! যত্তসব! তাহলে তুমি সকালে হাফ চান কর আর বাকিটা বিকেলে...’
মুখটা একটু কাঁচুমাচু করে বলল,
– ‘তোমরা সারারাত খেলে আর আমাকে দিয়ে এই এঁটো ডেচকিগুলো...’। মৃদু ধমক দিয়ে বললাম – ‘ধ্যাত্তারি, থাকলে কি আর তোমায় দিতাম না? দেখলে তো আর নেই। ভাল করে ধোয় তো দেখি, দেখো আবার যেন লেগে না থাকে।’ ব্যাজার মুখে বাবাজী আবার কাজে লেগে পড়ত। তবে চলে যাওয়ার আগে কয়েকটা টাকা ভাঁজ করে বুক পকেটে গুঁজে দিতেই ছোপ পড়া কেলো দাঁতে আবার মিলিয়ন ডলার হাসি। কত অল্পে যে মানুষ সন্তুষ্ট হত আজ সত্যি ভাবতে অবাক লাগে। চাহিদা আর লোভের চোরাবালিতে আজ আমরা এতটাই নিমজ্জিত যে কিছুতেই আমরা সন্তুষ্ট হই না। সত্যি কথা বলতে কি এই অল্প বয়েসে এই ধরনের কিছু দুষ্টুমি করলেও কাউকে দিয়ে আমরা ফ্রিতে কিছু করাতাম না।
মাতালদের কান্ডকারখানা নিয়ে কথা বলতে গেলে অনেক কথাই বলা যায়। আবার অনেক ঘটনাই আজ আর মনে পড়ে না। তবে মাঝে মাঝে মনের ক্যানভাসে ভেসে উঠে কিছু কিছু চেনা মুখ আর তার সঙ্গে জুড়ে থাকা নানা বিচিত্র কান্ডকারখানা। তখনকার দিনে মাঠে প্যান্ডেল করে যাত্রাপালার চল ছিল। প্যান্ডেল বলতে প্রথমে বাঁশ পুঁতে তার ওপর ত্রিপল। প্রচুর মানুষ আসতেন এই যাত্রাপালা দেখতে। কলকাতার প্রায় সব নামী যাত্রা সংস্থাগুলোই বেশ কয়েকবার আমারদের পাড়ায় যাত্রা করে গেছে। তা একবার মনে আছে এক মাতাল যাত্রা শুরু হওয়ার পরেই মাঠের কোনের দিকের একটু অন্ধকার দেখে ত্রিপল ফাঁক করে বেশ কিছু বিনা টিকিটের দর্শকদের ঢুকিয়ে দিয়েছিল। তারপর স্বেচ্ছা সেবকদের নজরে পড়ায় বেচারা পালিয়ে বাঁচে। কে বলে ওদের নাকি হুঁশ থাকে না? দিব্বি পালিয়েছিল ধরা পড়ার আগেই। পরের দিন ক্লাবে সালিশি ডেকে কান ধরে উঠ-বোস একেবারে বউএর সামনে। বউ একেবারে লতা কন্ঠী, কাই কাই করে সবার মাথা খেয়েছিল। একবার অভিনেতা অনুপকুমার আমাদের পাড়ায় নাটক করতে এসেছিলেন। সঙ্গে ছিলেন ওনার স্ত্রী অলকা গাঙ্গুলী। বেশ মজার নাটক। মজার মজার ডায়লগ, দর্শকদের ঘন ঘন হাততালি আর হাসির মাঝে অনুপকুমারের অসাধারণ অভিনয়। হঠাৎ তাল গেল কেটে, সব চুপচাপ। স্টেজে তৃতীয় ব্যাক্তির আগমন। অনুপকুমার, অলকাদেবী দু-জনেই একটু থমকে গেছেন। নেশার ঘোরে একটা মাতাল কোন ফাঁকে স্টেজে উঠে একেবারে অনুপকুমারের সামনে। তাকে আবার নামিয়ে তবেই নাটক শুরু। এ রকম কত ঘটনাই না ঘটেছে।
আর একটা ঘটনা বলি। কার্তিকদা খুব নেশা করতেন। সারাদিন কাজ করে এসে আকণ্ঠ না গিল্লে তার চলত না। বউ ভেগে গিয়েছিল আগেই। প্রাণের সাথী বলতে ঐ একটা নেড়ি কুকুর। নিরীহ এই প্রভুভক্ত প্রাণীটি কিন্তু প্রায়ই তার প্রভুর হাতে উত্তম মধ্যম খেত। তবে তার একটা কারণও ছিল। এই সারমেয়টি যা কিছু কুড়িয়ে পেত মুখে করে এনে সোজা কার্তিকদার ঘরে। পাড়াতে যার যেটা হারাতো প্রথমেই খোঁজ নিত কার্তিকদার বাড়িতে। আর শুনেছি সেখানে পাওয়াও যেত। আমি একবার স্ব-চক্ষে একটা খুন্তি মুখে ব্যাটাকে দৌড়তে দেখেছি। কিন্তু ফেলুদা - খুন্তি তো আর রাস্তায় পরে থাকে না, তাহলে ও পেল কি করে। তুমি ভাব ফেলুদা - আমি বলছি - ও ব্যাটা নির্ঘাত চুরি করেছিল। আমি শুনেছি অনেকেরই হাত-টান আছে কিন্তু কুকুরেরও যে মুখ-টান তা না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। প্রায় প্রতিটি সন্ধ্যায় এই হাজার হাজার অভিযোগ আর নেশার ঘোরে যত তবলার চাঁটি কার্তিকদা কুকুরটার ওপরই বাজাত। তবে অসম্ভব ভালোও বাসত। একটু চোখের আড়াল হলেই খোঁজ খোঁজ। খুঁজে পেলে কোলের মধ্যে নিয়ে ওটাকে বকতে বকতে ফিরত। তা এই কুকুরটা মরে যাবার পর কার্তিকদার কান্না দেখতে পাশের পাড়ার লোকও এসে হাজির। বলাবাহুল্য তারপর পাড়ার লোকের আর কারোর কিছু হারাতো না।
সময় বড় নির্মম, দ্রুত চলে যায়। স্কুল কলেজ পেরোতে না পেরোতেই হঠাৎ যে কবে দুম করে চুলে পাক ধরে গেল কে জানে। সংসার জীবনের এটা ওটা সেটার মধ্যেই প্রত্যাশিত প্রেশার কিম্বা সুগার। কিছু না কিছু আছে। রাজ্যের বড়ি গেলো। ম্যারাথন রেসের বাতিল ঘোড়াগুলোও দেখে ফিঁক করে হাসে। একটাই বাঁচোয়া যে স্মৃতিগুলো কিন্তু দুম করে ছেড়ে চলে যায় না। এখনো চোখ বুঝলে চোখের পাতায় এসে বসে, একটু নিরিবিলিতে। কিছুটা সময় সম্পূর্ণ নিজের মত করে ভাবতে থাকি, আর সেটার বিষয়বস্তু যদি 'মাতাল'ই হয় তো হোক না ক্ষতি কি? আর ভিতরের হাসিটা ভিতরেই থাক, বাইরে থেকে তো আর কেউ দেখছে না।
প্রবন্ধ
গোপনীয়েষু
অপর্ণা চক্রবর্তী
টালিগঞ্জ, কলকাতা
১
"আমার একলা আকাশ থমকে গেছে
রাতের স্রোতে ভেসে
শুধু তোমায় ভালবেসে"
দু-এক মুঠো শান্তি ছাড়া এখনও জমাতে পারিনি বিশেষ কিছুই। খরুচে বদনাম আছে। শোধ করার ক্ষমতাও নেই। তবু আপনার কাছে ধার চেয়ে লিখতে বসলাম। হ্যাঁ, লিখছি আপনাকেই...
আপনার ওই জানলাটা - আমাকে ধার দেবেন কবি ? অমন একটা জানলা পেতে বড় লোভ হয়।
রোদ উঁকি দেওয়া সকালের জানলা, ছুটির দুপুরে অলস জানলা, মন খারাপের উদাস জানলা, কাশ ফুলের দোলার জানলা, জোনাকির আলোয় রাত জাগা জানলা, ভালোবাসায় ভাসতে ভাসতে খোলা আকাশ দেখার একলা উদাস ওই জানলাটা - আমাকে ধার দেবেন?
আমার নিজস্ব যেটুকু পৃথিবী আছে, সেখানে আমি বাউন্ডুলে। আমার নিজস্ব যেটুকু আকাশ আছে, সেখানে আমি স্বাধীন। সেই স্বাধীন ডানায় ভর করে একদিন আপনার কাছে উড়ে যেতে পারি ওই জানলার জন্য। ঠোঁটে বয়ে নিয়ে যেতে পারি - ঘর বাঁধার খড়কুটো। তারপর বেলাশেষে জানলার পাশে বসে ভাগ করে নিতে পারি বিষন্নতা।
বলুন - ধার দেবেন জানলাটা?
২
"ভেবেছিনু মনে মনে দূরে দূরে থাকি"
কেন জানি না সবুজ দেখলে শুধু আপনাকেই মনে পড়ে কবি। শহর পেরিয়ে বহুদূর সবুজের ঘেরাটোপে যেখানে আপনার বারান্দা, নিজের সাথে যেখানে আপনার খেলনা বাটির সংসার, জানলার বাইরে হাত রাখলে যেখানে ইলশেগুঁড়ি স্পর্শ করা যায়, আমি আপনার সেই ঘরখানি কল্পনা করি প্রতিদিন।
প্রতিদিন আমার শহুরে চানঘরে একলা হলেই চারপাশে শুকনো পাতা ঝরার শব্দ পাই। সেই শব্দ আমাদের আলাপের মতোই স্নিগ্ধ, নরম, প্রত্যাশাহীন। আমার মনের ভিতর যে পথ ধরে আপনার চলাচল, সন্ধ্যা হলেই সেই পথের পাশে আমি প্রদীপ জ্বালি।
গাঢ় অন্ধকারে বন্ধ একটি দরজার ওপাশে আমার অজস্র না বলা কথা ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে বহুদিন আগে। ওদের ঘুম ভাঙিয়ে আপনাকে উপহার দেব কোনোদিন।
নিদ্রাহীন রাতে- খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে- জ্যোৎস্নার গায়ে লিখে রেখেছি আমার সমস্ত সমর্পণের কথা। পাখির মতো লালিত অনুভূতির পালক দিয়ে চিঠি লিখেছি শুধু আপনাকেই।
আমার প্রতি আপনার ঔদাসীন্য আমাকে ব্যথিত করেনি কখনও। কারণ - এ পূজা আমার একান্ত নিজস্ব। জীবন বড় কম সময়ের সম্পদ, নিজেকে আর একটিও অপ্রেমের দিন দেব না, এইটুকুই প্রতিশ্রুতি।
৩
"কোন্ গোপনবাসীর কান্নাহাসির
গোপন কথা শুনিবারে--বারে বারে
কান পেতে রই ..."
======================
দূরে থাকলেও বুঝতে পারি আপনি বাড়ি ফিরলেন কিনা, ফেরার পথে দূরের দীগন্তরেখাটি বিষন্ন ছিল কিনা, আকাশ মেঘলা কিনা। বুঝতে পারি লিখতে বসলেন কিনা, জল খেলেন কিনা, আনমনে কিশোর কুমার গুনগুন করলেন কিনা। আপনি গায়ক হিসেবে তেমন ভালো নন। উচ্চারণেও থতমত। তবু গানই তো! আর তা নিজের জন্যই যখন গাওয়া...
এক এক দিন আপনার মুখ কিছুতেই মনে পড়ে না। কাজের মাঝেও এমন হয়। কিছুতেই মনে করতে পারি না আপনাকে। ভাত মাখা হাতে বা কীবোর্ড থেকে চোখ সরিয়ে তক্ষুনি ফোনটা দেখে নিতে ইচ্ছে হয়। সম্ভব হয়না বলে অস্থির লাগে। মন চাইছে একবার দেখে নিই, একবারই তো দেখবো, দেখি একটিবার, এইটুকু তো দেখতে চাওয়ার ইচ্ছা...
আমার এই অস্থির সময়েই ঠিক বুঝতে পারি - আপনার খাওয়া শেষ হয়েছে, কাজ শেষ হয়েছে।
আপনি ঠিক এই সময় আমার মতো ব্যস্ত নন, অস্থির নন, শান্ত চোখদুটো বন্ধ হয়ে আছে আবেশে। বুকের ওপর খোলা পাতায় উপুড় হয়ে আছে বনলতা সেন, নীরা, নন্দিনী বা মানসী। আসলে বুঝতে পারাটা একটা অভ্যাস। নিরব থাকলে সেই অভ্যাস আরও তীব্রতর হয়। কখনও কথা হয়নি আমাদের। আপনার ফোনটা আমি ইচ্ছা করেই ধরিনি। নিরবতায় আপনার সঙ্গ করতে বড় ভালবাসি। আমি একদিন ঠিক আপনার বুকের ওপর ওই কবিতার খোলা বইটা হয়ে যাব। তারপর কান পেতে জেনে নেব সমস্ত গোপনীয় কথা...
ছায়া পড়ে আছে একলা নদীর জলে,
ছুঁয়ে দিলে জেনো দুহাতেই থেকে যাব।
আমি হেমন্তে পাতা ঝরা লিখে রাখি,
তুমি তো তাকেই আমার চিঠি ভাবো।
৪
"সন্ধ্যার মেঘে করিবো দুকূল,
ইন্দ্রধনুরে চন্দ্রহার।
তারায় করিবো কর্ণের দুল,
জড়াবো গায়েতে অন্ধকার।"
আপনি যেদিন শহরের রাস্তায় পড়ে থাকা পলাশ কুড়িয়ে অফিস টেবিলে রেখে ছবি তুলেছিলেন, সেদিন আমিও ওই ছবি দেখে একটা বেমানান স্বপ্ন বুনেছিলাম। আজ সেকথাই আপনাকে লিখতে ইচ্ছে হচ্ছে।
ধান ক্ষেত, কলাবাগান, জোড়া বটতলা, বাঁশ গাছের আড়াল দেওয়া সবুজ জলের পুকুর ঘাট পেড়িয়ে, বুড়োশিব মন্দিরের পাশ দিয়ে সরু রাস্তা ধরে আর একটু এগিয়ে একটা একচালা বসতবাড়ি। দেড় দু'খানা ঘর, লম্বা বারান্দা, উঠোনের একপাশে হাঁসমুরগি, তুলসী মঞ্চ, কুলুঙ্গিতে গুছিয়ে রাখা টুকিটাকি সাধ।
রান্না ঘরে মাটির উনুন। কঞ্চিবেড়ার ফাঁক গলে সকালের আলো উপুড় হয়ে পড়েছে সংসারের হাঁড়ি পাতিল আর শিল-নোড়ার ওপর। চুড়ি পরা দুটো হাতের ঝুনঝুন ধ্বনির সাথে মিলেমিশে যাচ্ছে মশলা বাটার শব্দ। শিল ধুয়ে জিরা-আদার জলটুকু সে ঢেলে দিচ্ছে ফুটন্ত তরকারির ওপর। আপনার কাচা জামা কাপড়ের সাথে ডুরেপাড় ভেজা তাঁতের শাড়িটা মেলে দিচ্ছে রোদে। মাদুরের ওপর বাংলা বই আর সেলাইয়ের বাক্স খুলে রেখে, চুল শুকচ্ছে দুপুরবেলা।
বেলা গড়িয়ে দীগন্তরেখা বরাবর সোনালী রঙ ধরেছে। হাঁস-মুরগি গুলো সদ্য খোঁয়ারে ঢুকেছে । তুলসী মঞ্চ আলো করেছে মাটির প্রদীপ। অন্ধকারে দু'একটা জোনাকি টুপটাপ ফুটতে শুরু করেছে।
ঠিক তখনই - সরু কাঁচা রাস্তায় সাইকেলটা এসে পড়ে ঝংঝং আওয়াজ করে, ঘন্টি বাজে টিংক্রিং। দূর থেকে এই শব্দ শোনার জন্যই সে উৎকর্ণ থাকে সারাবেলা। তার অপেক্ষা শেষ হয়। সান্ধ্যকালীন ঈশ্বর বন্দনায় আর তার মন বসে না। চুড়ি পরা হাত দুখানি তাড়াহুড়োয় নমস্কার সেরে উঠে পড়ে। এরপর একে একে এগিয়ে দেয় আপনার হাত-পা ধোয়ার জল, গামছা, মুড়ির বাটি, গরম চা। রাত বাড়লে পরম মমতায় গরম ভাতের ওপর ঝোল ঢেলে দেয়। প্রয়োজন মতো হাতে হাতে এগিয়ে দেয় একটা কাঁচা লঙ্কা, জলের গ্লাস, পাখার বাতাস। খাওয়া শেষে এনে দেয় যত্ন করে কাটা দু'টুকরো কুঁচো সুপারি বা মৌরি দানা। তারপর অন্ধকার বারান্দায় গা ঘেঁষে বসে - আপনার সাথে ঝিঁঝিঁর ডাক শোনে, জোনাকির আলো দেখে। গৃহস্থালির ফাটল বেয়ে চাঁদের আলো চুঁইয়ে পড়ে আপনাদের গায়ে।
জীবনে কিছুটা অভাব, কিছুটা মান-অভিমান, অল্প চাহিদা, অনেকটা অপ্রাপ্তি, বেশ কয়েকটা সরু ফাটল আর চোখ ভর্তি স্বপ্ন থাকার প্রয়োজন খুব বেশী। এইসব রঙীন পাথর বুকের ভেতর নড়াচড়া করলেই জীবন উপলব্ধির ঐশ্বর্যে পরিপূর্ণ হয়।
চোখের সামনে আমার মোবাইল স্ক্রীন একটু একটু করে ঝাপসা হচ্ছে জলে। পলাশ ফুল ধরে রাখা আপনার শুভ্র করতলের ছবিটা ফেড আউট হতে শুরু করেছে। ফোনের আলো বন্ধ হয়ে অটোলক্ হবার আগে আপনাকে বলেছিলাম -
ওভাবে নরম আগুন ছুঁতে নেই কবি...
গল্প
বাউটি
আজ সকাল থেকেই সুমিতার মেজাজ আগুন হয়ে আছে। শাশুড়ির বাউটিগুলো খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। শাশুড়ির আলমারি তে নেই। বাড়িতে লোক বলতে নিজেরা চারজন ও লক্ষীকান্ত পুর থেকে আসা ১২ বছরের রাত দিনের কাজের মেয়ে মালতি। তারমধ্যে নিজের মেয়ে মেঘমা ব্যাঙ্গালুরুতে ইঞ্জিনারিং পড়ে। অনেক দিন আসেনি। সন্দেহের তীর প্রথমেই মালতির দিকে। ধমকেছে বল নিয়েছিস কিনা। নাগো আমি নিইনি। জানা আছে তোদের, শাসাতে থাকে। বল এখনো সময় আছে বার করে দে। নাগো আমি নিইনি। কাঁদছে ছোটো মেয়েটা। স্বামী রঞ্জন বলে ভালো করে খুঁজে দেখ। সব খুঁজেছি কোথাও নেই। বাড়িতে থমথমে পরিবেশ বৃদ্ধা শাশুড়ি সুমিতার ভয়েই কাঁটা। সুমিতার যা উগ্র মেজাজ। সুমিতা শাশুড়িকে এবার সন্দেহ করবে। সুমিতার মেয়ে হয়েছিল বলে শাশুড়ির দুঃখ আছেই। মেয়ের দিকে দুটো ছেলে। ওদের প্রতি টান বেশি
সুমিতা সবসময় সেটাই মনে করে। নিশ্চই ওখানে পাচার করেছে বলে দোষ দেবে। রঞ্জন বলে এসব করে লাভ নেই পুলিশ এ খবর দিই। পুলিশ কি করবে, আজ পর্যন্ত ওরা কিছু করতে পেরেছে? শুধু টাকা খাবার ধান্দা। যা করবার আমি করবো জানি কি করে বার করতে হয়। বলেই মালতির চুলের মুঠি ধরে মাটিতে ফেলে মারতে থাকে। মেয়েটা আছাড়ি পিছাড়ি করে আর্ত নাদ করছে। আওয়াজ পেয়ে পাশের তাপসের বাড়ির লোকেরা ছুটে আসে। কি করছো মরে যাবে। একে ছোটো মেয়ে, শিশু শ্রমিক রাখা বেআইনি তারপর.....। রঞ্জন থানায় যাও। রঞ্জন বুজতে পারে থানায় না গেলে সুমিতা একটা খুনোখুনি বাঁধাবে। আর দেরি না করে থানায় ডাইরি করে আসে। যা করার পুলিশ করবে। সন্ধ্যেবেলায় পুলিশ আসে সবাইকে জিগ্যেস শুরু করেছে। এক এক করে সবার পালা কাউকেই পুলিশ বিশ্বাস করে না। সুমিতার দিকে পুলিশই শীতল কঠিন নির্মম চাহনিতে তাকাতেই সুমিতার বুক ঢিপ ঢিপের শব্দ নিজেই শুনতে পাচ্ছে জিভ গলা শুকিয়ে যেতে আরম্ভ করেছে ......
প্রবন্ধ
মহাজীবনের
মণিকথা
সুদীপ ঘোষাল
নন্দনপাড়া, পূর্ব বর্ধমান
কবি নজরুল বন্ধুদের আড্ডায় ধূমকেতুর মতো আবির্ভূত হতেন আর সুরের অপূর্ব কন্ঠ নিয়ে তিনি মানুষকে আজীবন ভালবেসে গেছেন। যৌবন ধর্মের অতিরেকে সারা দেশটাকে চষে বেড়াতেন আনন্দের হিন্দোলে।বিদ্রোহী কবিতা ও গান লিখে তিনি বিদ্রোহী উপাধি পান দেশের জনগণের কাছে। কবিগুরু যৌবন মূর্তি নজরুলকে অতিশয় স্নেহ করতেন এখন পাঠকসমাজের নয়নতারা স্বরূপ গণ্য হয়েছিলেন। বিদেশি সরকারের রক্তচক্ষু অবহেলা করে দুরন্ত কবি, কবিতা গান ও প্রবন্ধের সাময়িকপত্রে আগুনের ফুলকি ছড়াতে লাগলেন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড শুরু হতে পারত তার লেখনীর গুণে। এর জন্য কিছু কলকাতায় কারারুদ্ধ থাকতে হয়েছিল বোধ হয় রাজনৈতিক চেতনার ক্ষেত্রে ইদানিং আর কোন কবি ও লেখক এতটা উদ্দীপনার সঞ্চার করতে পারেননি। তাঁর কাব্য ও গানে জাতি সম্প্রদায়ের উপলব্ধি ব্রিটিশ বিদ্বেষী মনোভাব সৃষ্টি করেছে। যে কবিতাসমূহ বিদ্রোহীর অস্থিরতা বোধ করে, সর্ববিধ শাসক, যৌবনকে বরমাল্য দিয়েছে তার সঙ্গে তার কবিতাকে। হিন্দু-মুসলমানের জাত বিচারকে অবহেলা করে উপেক্ষা করে তাদের মিলনের এক ছাতার তলায় এনেছিলেন। কবি নজরুলের অগ্নিবীণা ও হয়তো সেই ভাঙ্গার গান বিষের বাঁশি প্রভৃতি কাব্যসংগ্রহ সংগীত সংকলনের প্রচুর রসের আমদানি করা হয়েছে। বাবু বলে, বিংশ শতাব্দীর বাংলা মননে কাজী নজরুল ইসলামের মর্যাদা ও গুরুত্ব অপরিসীম। তার জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী বিশেষ মর্যাদার সঙ্গে উভয় বাংলাতে প্রতি বৎসর উদযাপিত হয়ে থাকে। আমরা তাঁকে প্রণাম জানাই। এই বলে মাষ্টারমশাই চুপ করলেন। তারপর বিরাজুল আমাদের শোনায় কবির গল্প। কবি নজরুল এক দরিদ্র মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার প্রাথমিক শিক্ষা ছিল ধর্মীয়। কৈশোরে বিভিন্ন লেটো দলের সাথে কাজ করতে করতে তিনি কবিতা এবং সাহিত্য সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান লাভ করেন। সেনাবিভাগে কিছুদিন কাজ করার পর তিনি সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। এসময় তিনি কলকাতায় থাকতেন। এসময় তিনি ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। প্রকাশ করেন বিদ্রোহী এবং ভাঙার গানের মতো কবিতা; ধূমকেতুর মতো সাময়িকী। জেলে বন্দী হলে পর লেখেন জবানবন্দী, এই সব সাহিত্যকর্মে শোষক বিরোধিতা ছিল সুস্পষ্ট। ধার্মিক মুসলিম সমাজ এবং অবহেলিত ভারতীয় জনগণের সাথে তার বিশেষ সম্পর্ক ছিল। তার সাহিত্যকর্মে প্রাধান্য পেয়েছে ভালোবাসা, মুক্তি এবং বিদ্রোহ। ধর্মীয় লিঙ্গভেদের বিরুদ্ধেও তিনি লিখেছেন। ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক লিখলেও তিনি মূলত কবি হিসেবেই বেশি পরিচিত। বাংলা কাব্যে তিনি এক নতুন ধারার জন্ম দেন। গজল, এর পাশাপাশি তিনি অনেক উৎকৃষ্ট মুক্তিগীতিও রচনা করেন। নজরুল গান রচনা এবং অধিকাংশে সুরারোপ করেছেন যেগুলো এখন "নজরুল গীতি" নামে পরিচিত এবং বিশেষ জনপ্রিয়ও পরিচিত হন।চা-রুটির দোকানে চাকরি করার সময় আসানসোলের দারোগা রফিজউল্লার সঙ্গে নজরুলের পরিচয় হয় এবং তাঁর সুবাদেই নজরুল ১৯১৪ সালে ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের দরিরামপুর স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন। রমেন আলোচনায় অংশ নেয়। সে বলে, এক বছর পর তিনি পুনরায় নিজের গ্রামে ফিরে যান এবং ১৯১৫ সালে আবার রানীগঞ্জ সিয়ারসোল রাজস্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হন। এ স্কুলে নজরুল একটানা অষ্টম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনা করেন। প্রিটেস্ট পরীক্ষার সময় ১৯১৭ সালের শেষদিকে নজরুল সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ছাত্রজীবনের শেষ বছরগুলিতে নজরুল সিয়ারসোল স্কুলের চারজন শিক্ষক দ্বারা নানাভাবে প্রভাবিত হন। তাঁরা হলেন উচ্চাঙ্গসঙ্গীতে সতীশচন্দ্র কাঞ্জিলাল, বিপ্লবী ভাবধারায় নিবারণচন্দ্র ঘটক, ফারসি সাহিত্যে হাফিজ নুরুন্নবী এবং সাহিত্যচর্চায় নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯১৭ সালের শেষদিক থেকে ১৯২০ সালের মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় আড়াই বছর নজরুলের সামরিক জীবনের পরিধি। এ সময়ের মধ্যে তিনি ৪৯ বেঙ্গলি রেজিমেন্টের একজন সাধারণ সৈনিক থেকে ব্যাটেলিয়ন কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার পর্যন্ত হয়েছিলেন। রেজিমেন্টের পাঞ্জাবি মৌলবির নিকট তিনি ফারসি ভাষা শেখেন, সঙ্গীতানুরাগী সহসৈনিকদের সঙ্গে দেশি-বিদেশি বাদ্যযন্ত্র সহযোগে সঙ্গীতচর্চা করেন এবং একই সঙ্গে সমভাবে গদ্যে-পদ্যে সাহিত্যচর্চা করেন। করাচি সেনানিবাসে বসে রচিত এবং কলকাতার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত নজরুলের রচনাবলীর মধ্যে রয়েছে ‘বাউন্ডুলের আত্মকাহিনী’ নামক প্রথম গদ্য রচনা, প্রথম প্রকাশিত কবিতা ‘মুক্তি, এবং অন্যান্য রচনা: গল্প ‘হেনা’, ‘ব্যথার দান’, ‘মেহের নেগার’, ‘ঘুমের ঘোরে’; কবিতা ‘আশায়’, ‘কবিতা সমাধি’ প্রভৃতি। উল্লেখযোগ্য যে, করাচি সেনানিবাসে থেকেও তিনি কলকাতার বিভিন্ন সাহিত্যপত্রিকা, যেমন: প্রবাসী, ভারতবর্ষ, ভারতী, মানসী, মর্ম্মবাণী, সবুজপত্র, সওগাত ও বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার গ্রাহক ছিলেন। তাছাড়া তাঁর কাছে রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, এমনকি ফারসি কবি হাফিজেরও কিছু গ্রন্থ ছিল। প্রকৃতপক্ষে নজরুলের আনুষ্ঠানিক সাহিত্যচর্চার শুরু করাচির সেনানিবাসে থাকাবস্থায়ই। আমরা এখন আলোচনায় মগ্ন জোয়ার সংস্থার নির্দিষ্ট ক্লাবঘরে।এখানে লাইব্রেরীও আছে। বিশু আবার বলে, প্রথম মহাযুদ্ধ শেষে ১৯২০ সালের মার্চ মাসে নজরুল দেশে ফিরে কলকাতায় সাহিত্যিক-সাংবাদিক জীবন শুরু করেন। কলকাতায় তাঁর প্রথম আশ্রয় ছিল ৩২নং কলেজ স্ট্রীটে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিসে সমিতির অন্যতম কর্মকর্তা মুজফ্ফর আহমদের সঙ্গে। শুরুতেই মোসলেম ভারত, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, উপাসনা প্রভৃতি পত্রিকায় তাঁর সদ্যোরচিত বাঁধন-হারা ও আরও নানা কবিতা প্রকাশিত হলে বাংলা সাহিত্য ক্ষেত্রে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। বাংলা সাহিত্যের এ নবীন প্রতিভার প্রতি সাহিত্যানুরাগীদের দৃষ্টি পড়ে। কবি-সমালোচক মোহিতলাল মজুমদার মোসলেম ভারত পত্রিকায় প্রকাশিত এক পত্রের মাধ্যমে নজরুলের ‘খেয়া-পারের তরণী’ এবং ‘বাদল প্রাতের শরাব’ কবিতাদুটির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন এবং বাংলার সারস্বত সমাজে তাঁকে স্বাগত জানান। নজরুল বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিসে মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক, সমকালীন মুসলমান সাহিত্যিকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হন। অপরদিকে কলকাতার তৎকালীন জমজমাট দুটি সাহিত্যিক আসর ‘গজেনদার আড্ডা’ ও ‘ভারতীয় আড্ডা’য় অতুলপ্রসাদ সেন, দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, ওস্তাদ করমতুল্লা খাঁ, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, শিশিরকুমার ভাদুড়ী, হেমেন্দ্রকুমার রায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, নির্মলেন্দু লাহিড়ী, ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ বাংলার সমকালীন শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীত ও নাট্যজগতের দিকপালদের সঙ্গে পরিচিত ও ঘনিষ্ঠ হবার সুযোগ পান। নজরুল ১৯২১ সালের অক্টোবর মাসে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন; তখন থেকে ১৯৪১ পর্যন্ত দু দশক বাংলার দু প্রধান কবির মধ্যে যোগাযোগ ও ঘনিষ্ঠতা অক্ষুণ্ণ ছিল।এ.কে ফজলুল হকের সম্পাদনায় অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ১৯২০ সালের ১২ জুলাই সান্ধ্য দৈনিক নবযুগ প্রকাশিত হলে তার মাধ্যমেই নজরুলের সাংবাদিক জীবনের সূত্রপাত ঘটে। নভেম্বর মাসে নজরুল আবার কুমিল্লা যান। ২১ নভেম্বর ভারতব্যাপী হরতাল ছিল। নজরুল পুনরায় পথে নামেন এবং অসহযোগ মিছিলের সঙ্গে শহর প্রদক্ষিণ করে গাইলেন: ‘ভিক্ষা দাও! ভিক্ষা দাও! ফিরে চাও ওগো পুরবাসী।’ এ সময় তুরস্কে মধ্যযুগীয় সামন্ত শাসন টিকিয়ে রাখার জন্য ভারতে মুসলমানরা খিলাফত আন্দোলন করছিল। মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে অসহযোগ আর মওলানা মোহাম্মদ আলী ও শওকত আলীর নেতৃত্বে খিলাফত আন্দোলনের দর্শনে নজরুল আস্থাশীল ছিলেন না। স্বদেশে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে স্বরাজ বা স্বাধীনতা অর্জন আর মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে তুরস্কের সালতানাত উচ্ছেদকারী নব্য তুর্কি আন্দোলনের প্রতি নজরুলের সমর্থন ছিল; তথাপি ভারতের হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের সম্মিলিত সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের জন্যই তিনি ওই দুটি আন্দোলনে যোগদান করেন। বিশু বলে যায়, এবার শোনো সকলে মন দিয়ে কবির গল্প। ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে কুমিল্লা থেকে কলকাতা ফেরার পর নজরুলের দুটি ঐতিহাসিক ও বৈপ্লবিক সৃষ্টিকর্ম হচ্ছে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ও ‘ভাঙার গান’ সঙ্গীত। এ দুটি রচনা বাংলা কবিতা ও গানের ধারাকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছিল; ‘বিদ্রোহী’ কবিতার জন্য নজরুল বিপুল খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। ১৯২১ সালের শেষদিকে নজরুল আরেকটি বিখ্যাত কবিতা ‘কামাল পাশা’ রচনা করেন, যার মাধ্যমে তাঁর সমকালীন আন্তর্জাতিক ইতিহাস-চেতনা এবং ভারতীয় মুসলমানদের খিলাফত আন্দোলনের অসারতার পরিচয় পাওয়া যায়। নজরুল তাঁর রাষ্ট্রীয় ধ্যান-ধারণায় সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছিলেন মোস্তফা কামাল পাশার নেতৃত্ব দ্বারা, কারণ তিনি সামন্ততান্ত্রিক খিলাফত বা তুরস্কের সুলতানকে উচ্ছেদ করে তুরস্ককে একটি আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতন্ত্রে রূপান্তরিত করেছিলেন। তুরস্কের সমাজজীবন থেকে মোস্তফা কামাল যে মৌলবাদ ও পর্দাপ্রথা দূর করেছিলেন, তা নজরুলকে বেশি অনুপ্রাণিত করেছিল। তিনি ভেবেছিলেন, তুরস্কে যা সম্ভবপর, ভারত ও বাংলায় তা সম্ভবপর নয় কেন? বস্তুত, গোঁড়ামি, রক্ষণশীলতা, ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার ও আচারসর্বস্বতা থেকে দেশবাসী, বিশেষত স্বধর্মীদের মুক্তির জন্য নজরুল আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। ১৯১৭ সালের রুশ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবও নজরুলকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছিল। নজরুলের লাঙল ও গণবাণী পত্রিকায় প্রকাশিত ‘সাম্যবাদী’ ও ‘সর্বহারা’ কবিতাগুচ্ছ এবং কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল-এর অনুবাদ ‘জাগ অনশন বন্দী ওঠ রে যত’ এবং ‘রেড ফ্লাগ’ অবলম্বনে রক্তপতাকার গান এর প্রমাণ।১৯২২ সালে নজরুলের যেসব সাহিত্যকর্ম প্রকাশিত হয় সেসবের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল গল্প-সংকলন ব্যথার দান, কবিতা-সংকলন অগ্নি-বীণা ও প্রবন্ধ-সংকলন যুগবাণী। বাংলা কবিতার পালাবদলকারী কাব্য অগ্নি-বীণা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে এর প্রথম সংস্করণ শেষ হয়ে যায় এবং পরপর কয়েকটি নতুন সংস্করণ প্রকাশ করতে হয়; কারণ এ কাব্যে নজরুলের ‘প্রলয়োল্লাস’, ‘কামাল পাশা’ প্রভৃতি বাংলা সাহিত্যে সাড়া জাগানো এবং বাংলা কবিতার মোড় ফেরানো কবিতা সংকলিত হয়েছিল। নজরুলের অপর বিপ্লবী উদ্যম হলো ধূমকেতু পত্রিকার প্রকাশ। পত্রিকাটি সপ্তাহে দুবার প্রকাশিত হতো। বিশের দশকে অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলনের ব্যর্থতার পর সশস্ত্র বিপ্লববাদের পুনরাবির্ভাবে ধূমকেতু পত্রিকার তাৎপর্যপূর্ণ অবদান ছিল। এক অর্থে এ পত্রিকা হয়ে উঠেছিল সশস্ত্র বিপ্লবীদের মুখপত্র। পত্রিকাটি প্রকাশিত হতো ‘কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু, আয় চলে আয়রে ধূমকেতু। আধাঁরে বাঁধ অগ্নিসেতু, দুর্দিনের এ দুর্গশিরে উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।’ রবীন্দ্রনাথের এ আশীর্বাণী শীর্ষে ধারণ করে। ধূমকেতুর ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯২২ সংখ্যায় নজরুলের প্রচ্ছন্ন রাজনৈতিক কবিতা ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ প্রকাশিত হলে ৮ নভেম্বর পত্রিকার ওই সংখ্যাটি নিষিদ্ধ করা হয়। নজরুলের প্রবন্ধগ্রন্থ যুগবাণী বাজেয়াপ্ত হয় ২৩ নভেম্বর ১৯২২সালে তিনি সপরিবারে বাংলাদেশে আসেন। এসময় তাকে বাংলাদেশের জাতীয়তা প্রদান করা হয়। এখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।"হিন্দু না ওরা মুসলিম ঐ জিজ্ঞাসে কোন জন কাণ্ডারি বল ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মা'র" তাঁর লেখা এই লাইনে প্রকাশিত হয়েছে মানবপ্রেম। সমস্ত জাতিভেদ ভুলে একতার বাণী শুনিয়ে ছিলেন এই বিদ্রোহী কবি। "ঐ নতুনের কেতন ওড়ে কাল বোশেখির ঝড়।’ "আমার কৈফিয়ৎ নামে নজরুলের প্রথম কবিতা ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হয় ১৯১৯ সালে। এর আগে তিনি তীক্ষ্ম হীরকখণ্ডের মতো ‘বিদ্রোহী’ কবিতা লিখেছেন। ‘খেয়াপারের তরণী’র মতো ইসলাম সম্পৃক্ত কবিতা লিখেছেন, প্রেমের কবিতা লিখেছেন, ‘সর্বনাশের ঘণ্টা’র মতো কবিতা লিখেছেন—এতেই বোঝা যায় নজরুল বহুভাবে বিপরীত দিকে ধাবিত হয়েছেন। নজরুলের অনেক কবিতা যেমন-বিদ্রোহী, দারিদ্র্য, আমার কৈফিয়ৎ অনেক গতিশীল কবিতা। প্রথমেই কবি নিজেকে বর্তমানের কবি বলে আখ্যায়িত করেছেন। প্রার্থনা করো যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস, যেন লেখা হয় আমার রক্তে তাদের সর্বনাশ; ’কবিতার স্তবকে বর্তমানের কবি কথাটার বিশদ বিবরণ লক্ষণীয়। অন্যায়, অবিচার, অসাম্য, শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে চির বিদ্রোহী কবি নজরুলের সমগ্র সাহিত্যে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠেছে। এর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছেন মানবপ্রেমিক নজরুল। মানুষের অফুরন্ত ভালোবাসা, মানুষের বেদনা, যাতনা, পীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। এক কথায় মানবপ্রেম।আমি জানি, নজরুলের ছোটগল্পে এক নতুন ভাবধারা সৃষ্টি হয়েছে। তাঁর ‘বাউন্ডুলের আত্মকাহিনি’ গল্পে যেভাবে নিচতলার জীবনের কথা উঠে এসেছে তেমন রূপায়ণ বাংলা সাহিত্য ছোটগল্পে ছিল না। নজরুলের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস মৃত্যু-ক্ষুধা; বস্তিবাসীর প্রকৃত ছবি এর আগে অন্য কোনো উপন্যাসে পাওয়া যায়নি। নজরুলের উপন্যাসে যে মানবপ্রেমী দৃষ্টিকোণ যুক্ত হয়েছে তা তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতারই ফসল। অসাম্প্রদায়িকতা, হিন্দু মুসলমানের মিলন, সমাজের নিচুতলার মানুষের উত্থান এসবই নজরুলের মানবিকতার অংশ। নজরুল মনে প্রাণে ব্রিটিশের উচ্ছেদ কামনা করেছেন। ইংরেজদের বিরুদ্ধে নজরুলের উচ্চারণে একতিল খাদ ছিল না। নজরুল শেষ পর্যন্ত ইংরেজ নয়-ছিলেন সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। তিনি লক্ষ্য করেছেন, মানুষ চিরকাল মানুষের ওপর অত্যাচার করে এসেছে, তা পশুদের পক্ষেও অসম্ভব। নজরুল জীবনভর লাঞ্ছিত মানুষেরই জাগরণ কামনা করেছেন। নজরুলের কবিতার ক্ষেত্রে দৃষ্টি দিলে দেখি বহু আয়তনে বিস্তৃত তাঁর কবিতা। ব্যক্তি জীবনের উদার মানবিকতার চর্চাই নজরুলের সাহিত্যিক জীবনে প্রতিফলিত হয়েছিল। ক্রোধ, ধার্মিকতা, আধ্যাত্মিকতা, সমাজ, রাজনীতি, বাস্তব ও স্বপ্ন মিলে কখনো দেখা গেছে গভীর বিষাদে মগ্ন থেকে কবি কাজ করেছেন মাত্র দুই যুগ। সুস্থাবস্থার সময় মাইকেল মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ দাস এই কবিদের চেয়ে অনেক কম পেয়েছেন কবি নজরুল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে কবি নজরুল চলে যান করাচিতে। কিন্তু সেখানে বেশি দিন ধরে রাখতে পারেনি করাচির মাটি। তিনি চলে এলেন কলকাতায়, কমরেড মুজাফফর আহমদের সঙ্গে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিসে এক সঙ্গ বাস করতে থাকেন। ১৯২০ সালে নজরুল ইসলাম ও মুজাফফর আহমদ দৈনিক ‘নবযুগ’ প্রকাশ করেন। এ কে ফজলুল হক ছিলেন প্রধান পরিচালক। মুজাফফর আহমদ মার্কসবাদের প্রতি আকৃষ্ট হলে নজরুল সম্পাদিত অর্ধ সাপ্তাহিক ‘ধূমকেতু’ বের করেন। তারপর সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘লাঙল ‘প্রকাশিত হয়। লাঙল পত্রিকার প্রথম সংখ্যাতেই বিদ্রোহী কবির সাম্যবাদী চরিত্র প্রকাশিত হয়। তখনই ঘোষিত হলো মানবতার জয়গান। অপরূপা কবির সম্বন্ধে বলে, ১৯২৫ সালে প্রকাশিত সাম্যবাদী কবিতাগ্রন্থ সমাজতন্ত্রী বাংলা কবিতার দরজা খুলে দিল। ৩০ ও ৪০-এর দশকে সাম্যবাদী কবিতার যে প্রবাহ, তার পথিকৃত কাজী নজরুল ইসলাম। চৌদ্দশো বছরের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে নজরুল ইসলামই হিন্দু মুসলমান মিলনের শ্রেষ্ঠ প্রবক্তা। শত শত বছর ধরে হিন্দু মুসলমান পাশাপাশি বাস করলে ও সাহিত্যে তা আদৌ যথাযথ ভাবে প্রতিফলিত হয়নি। ব্যক্তি জীবনেও নজরুল তাঁর ব্যবধান রাখেননি। বিয়ে করলেন হিন্দু মেয়ে। তাঁর পুত্রদের নাম রাখলেন হিন্দু মুসলিম ঐতিহ্যকে সমান করে। নজরুল হিন্দু ও মুসলমান ধর্মের আচার থেকে অন্তর আত্মা অবধি ব্যবহার করেছেন। শুধু কবিতায় নয় গল্পে, উপন্যাসে, নাটকে, প্রবন্ধে, গানে সব ক্ষেত্রে তাঁর পারদর্শিতার পরিচয় মেলে। পৃথিবীর যেখানে বাংলাভাষী রূপে যারা বাস করেন তিনি তাদের আত্মার আত্মীয়, পরমাত্মীয় এবং স্মরণীয় কবিরূপে সম্মানীত। অপরূপার বক্তব্যের পরে সভার সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়। তারপর নরনারায়ণ ভোজনের ব্যবস্থা করা হয়। সভার পাশে রান্না হত খিচুড়ি, তরকারি আর টক। পূর্ব বর্ধমান জেলার লোকেরা টক খুব ভালবাসেন।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, "ভজন পূজন সাধন আরাধনা সমস্ত থাক পরে, রুদ্ধদ্বারে দেবালয়ের কোণে কেন আছিস ওরে"। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, "বহুরূপে সম্মুখে তোমার ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর, জীবে প্রেম করে যেইজন সেইজন সেবিছে ঈশ্বর"। এখানে দেখা যাচ্ছে দুই মহাপুরুষের একই বক্তব্য। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন ভজন পূজন সাধন আরাধনা বাদ দিয়ে যেখানে সমস্ত শ্রমিক কাজ করছেন তাদের মধ্যেই ঈশ্বরের বাসস্থান। আবারও স্বামীজী বলেছেন শ্রমিক, খেটেখাওয়া মানুষের মাঝে ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে। বহুরূপে, মানুষের মাঝে ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিদ্যমান। ধর্ম জীবনেরই অংশ বলা হয়ে থাকে। অবশ্য পাশ্চাত্ত্য দেশে ধর্ম শব্দটি দ্বারা বর্তমানে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মচর্চার বাইরের অনেক কিছুকে বোঝানো হয়ে থাকে। যেমন, ‘ধ্যান’ অধ্যাত্মসাধনার অংশ হলেও এর দ্বারা শরীরের সুস্থতার ধারণা যুক্ত হয়েছে। একাগ্রতার কথা বলা হয়েছে। ঈশ্বর বিশ্বাসী কিংবা অবিশ্বাসী যে কোনো ব্যক্তি ধ্যানের মাধ্যমে শরীরের সুস্থতা বজায় রাখতে পারেন। এ ধরনের দৃষ্টিকোণে ধর্ম বিশ্লেষণে গুরুত্ব পায় মানবতাবাদ, প্রেম, সমবেদনা, ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, ক্ষমা, পরিতৃপ্তি, দায়িত্ব, সংগতি, অপরের সুবিধা-অসুবিধার প্রতি দৃষ্টি রাখা প্রভৃতি। কেউ অস্বীকার করবে না এই যুগে যুবসমাজ জ্ঞানী ও কর্মে অনেক অগ্রসর। কিন্তু তাদের মূল্যবোধের অভাব নিয়ম-শৃঙ্খলা প্রতি অবজ্ঞা তাদের ভবিষ্যৎ কি অন্ধকার আচ্ছন্ন করে রেখেছে। কে তাদের সতর্ক করে দেবে কেউ দেবে না। কারণ কেউ তাদের আত্মীয় হতে চায় না কি বাড়ির অভিভাবক শিক্ষক সংবাদপত্র কেউ সবাই নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য যুব শক্তিকে কাজে লাগাতে ব্যস্ত। যুব শক্তিকে কাজে লাগানোর জন্য স্বামী বিবেকানন্দের এবং তার কর্মময় জীবন তার প্রমাণ রেখেছে। স্বামীজি দেশপ্রেমিক ছিলেন এটুকু বললে তাকে ছোট করা হবে।। তিনি তো সন্ন্যাসী ছিলেন। সন্ন্যাসী হিসেবে তার আবার দেশকি? সমাজ কি সন্ন্যাসী তো দেশকালের ঊর্ধ্বে বস্তুত তিনি ভালবাসতেন মানুষকে। মানুষের মধ্যেই তিনি ঈশ্বরকে দেখেছিলেন সব দেশের মানুষকে শ্রদ্ধা করতেন যারা দুর্বল অক্ষম নিপীড়িত তারাই ছিল তার বিশেষ প্রীতিভাজন। যে দেশের মানুষ তারা হোক। নিগ্রো মনে করে আমেরিকার এক হোটেলে তাঁকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। কিন্তু তিনি বলেন নি যে তিনি নিগ্রো নন। প্রতিটি নিগ্রো, কালো, অসুন্দর মানুষ তার ভাই। মিশরের তথা বিশ্বের না খেতে পাওয়া, কষ্ট পাওয়া প্রতিটি পতিতা তার বোন।
অনেকে মনে করেন এসব বিবেচনা কোনো ঐশ্বরিক বা স্বর্গীয় ধারণার সঙ্গে যুক্ত নয়, বরং পৃথিবীর প্রতিদিনকার বাস্তবতার সঙ্গে সম্পৃক্ত। পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করতে হচ্ছে। মানুষকে খেটে খেতে হয়। নানা ঝামেলার মাঝে প্রতিদিনের কাজের সঙ্গে প্রার্থনা ও ধ্যানের মাধ্যমে ঈশ্বরকে স্মরণ করছি আমরা মানুষ। যে বিশ্বে আমরা বাস করি তার আশ্চর্য ক্রিয়াকাণ্ড দেখে অভিভূত হই। আমরা কেন এখানে কিংবা আমাদের মৃত্যুর পরে কী হবে, এসব ভাবনাই অধ্যাত্মতত্ত্বের অংশ। আমরা তখনই আধ্যাত্মিক মানুষ হিসেবে পরিচিত হই যখন সুন্দর, প্রেম অথবা সৃষ্টিশীলতায় নিজেকে খুঁজে পাই। বাস্তব পৃথিবীতে জীবন পরিচালনায় আমাদের প্রত্যাশা প্রকাশিত হয় সূক্ষ্ম সম্পর্কের সুতোয়। সেই সম্পর্কের মধ্যে পরমার্থ-জীবন আমাদের প্রশান্তি দান করে। আধ্যাত্মিক জীবনের পথ বিচিত্র। ঈশ্বরের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য নিজেকে তৈরি করা, নিজের জ্ঞান ও বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে সৃষ্টি জগতের সঙ্গে মিলতে চাওয়ার জন্য সুশৃঙ্খলভাবে ধ্যান, প্রার্থনা, নৈতিকতার উন্নতি সাধন, ধর্মীয় গ্রন্থে নিমগ্ন হওয়াকে চিহ্নিত করা হয় এর অন্যতম পথ হিসেবে। এসবই অনেক সময় একজন ধর্মতাত্ত্বিকের মাধ্যমেও সম্পন্ন হতে পারে। আধ্যাত্মিকতার লক্ষ্য হচ্ছে ভেতরের জীবন ও বাইরের জীবনের উন্নতি। প্রেম ও করুণা ধারায় সিক্ত হলে আধ্যাত্মিক জীবনের উন্নতি ঘটে।
ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতার যোগাযোগটা কী রকমের? পরমের সন্ধানে নিয়োজিত আধ্যাত্মিকতার উদ্দেশ্য পরমের সন্ধান। তবে আমাদের মতে আধ্যাত্মিকতা ধর্মেরই একটি অংশ। ধর্মের বাইরে একজন ব্যক্তি তার আধ্যাত্মিক জীবন খুঁজে পেতে পারেন। শূদ্রের সেবার জন্য এক লক্ষ যুবককে স্বামীজি চেয়ে ছিলেন। তারা সমস্ত শক্তি নিয়ে দেশের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে এই ছিল তার আশা। কিন্তু সর্বাগ্রে চেয়েছিলেন তারা মানুষের মত মানুষ হবে, বুদ্ধির উদয় কর্মশক্তি এবং তার সঙ্গে নিঃস্বার্থ সেবার মনোভাব নিয়ে তারা কুটিরে কুটিরে গিয়ে মানুষকে উজ্জীবিত করবে। এই সেবা পেতে নিশ্চিতভাবে, শিবজ্ঞানে জীব সেবা বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন এই হচ্ছে যুগধর্ম এর মধ্যে আমি নেই। তুমি শুধু তুমি আছো। অর্থাৎ ঈশ্বরের প্রতি শ্রদ্ধা ও প্রীতি, স্মৃতি নিয়ে সেবা। সেবা বুদ্ধি না থাকলে ক্ষমতার অপব্যবহার অবশ্যম্ভাবী। তাই বারবার বলেছিলেন দেশ স্বাধীন হবেই। কিন্তু জাতি স্বার্থান্বেষীরা ক্ষমতার অপব্যবহার করতে না পারে সেজন্য আমাদের কর্তব্য, ধর্মের উচ্চতম চিন্তা দিয়ে সে সময় একটা প্লাবন ঘটানো উচিত এতে চিন্তার একটা প্রভাব পড়বে। কিন্তু যিশু খ্রিস্টের জীবনের প্রসঙ্গ আলোচনা করলে ধর্ম ও মানবতা একই জিনিস মনে হওয়াই স্বাভাবিক। অপরের জন্য নিজেকে আত্মোৎসর্গ করা, নিজের শান্তি, নিজের তৃপ্তি, সুখী হওয়ার প্রচেষ্টায় দান-ধ্যান-প্রার্থনায় নিয়োজিত থাকা এসবই আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে বিজড়িত থাকলে নিজের ভালো লাগে। এ ক্ষেত্রে নিজের অন্তরের উপলব্ধি গুরুত্বপূর্ণ। মানসিক স্বাস্থ্যের সঙ্গেও জড়িত অপরের উপকার প্রসঙ্গ। সমাজবিজ্ঞানীরা বলেছেন অন্তরের আকুতি ও নিবেদিত নৈবেদ্যের মধ্যে সেই ভালোলাগা লুকিয়ে থাকতে পারে। অন্যদিকে সার্বজনীন চেতনার সঙ্গে জড়িত রয়েছে সামাজিক উপকারের বিষয়টি। সর্বধর্মের দৃষ্টিতে সমগ্র মানব সমাজ এবং সৃষ্টির সব কিছু ঈশ্বরের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তিনি সকল মানুষের প্রতিপালক। তিনি সকলকে ভালোবাসেন। মানবতার দিশারি হিসেবে ভগবান বুদ্ধ, যিশু, রসুল আল্লা আমাদের পরিত্রাণকর্তা। মানবাত্মা সম্পর্কে ধারণা একটি মানবিক ধারণা। বিশ্বজুড়ে মানুষে মানুষে সাংস্কৃতিক ভিন্নতা, বহুত্ববাদী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আধ্যাত্মিক সত্যকে বারবার প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এসব থেকে মুক্তির জন্য সার্বজনীন চেতনার গুরুত্ব অপরিসীম। মানুষে মানুষে মৈত্রী, সাম্য, ঐক্য ও পারস্পরিক বিশ্বাস এই চেতনার প্রধান দিক। স্বামী বিবেকানন্দ শুধু বাঙালির জীবনের এক আদর্শ মহামানবই নন, তিনি যুগাবতার। তাঁর দেখানো আদর্শের রাস্তা যুক্তিবোধের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায় মানুষকে। আধ্যত্মকে এক অন্য পর্যায়ে উন্নতি করে স্বামীজী সকলের জীবনকে আরও বেশি করে আলোর দিকে ঠেলে দিয়েছেন। নেতিবাচক ভাবনার অন্ধকার দিকটির পর্দা সরিয়ে তিনি বাঙালির জীবনবোধকে আরও বেশি করে অনুপ্রাণিত করেছেন। উদ্বুদ্ধ হয়েছে যুব সমাজ, আর সেজন্যই তার জন্মদিন ১২ই জানুয়ারি যুব দিবস বলে খ্যাত। স্বামীজির কিছু অমর বাণী মনে দাগ কাটে। স্বামী বিবেকানন্দ বলতেন তোমরা হৃদয়বান হও প্রেমিক হও। তোমরা কি প্রাণে প্রাণে বুঝেছ যে কোটি কোটি দেবর্ষির বংশধর পশুর মত হয়ে দাঁড়িয়েছে। তোমরা কি প্রাণে প্রাণে অনুভব করেছো, কোটি কোটি লোক অনাহারে মরছে। কোটি কোটি লোক শতাব্দী ধরে অনেক আছে, তোমরা কি মনে প্রাণে বুঝেছ অজ্ঞতার কালোমেঘ ভারতবর্ষকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। এই সব ভাবনা কি তোমাদের অস্থির করে তুলেছে তোমাদের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। তিনি বলেছেন আমি বিশ্বাস রাখি আধুনিক যুব সমাজের উপর আমার কর্মীরা তাদের মধ্য থেকেই আসবে। সিংহের মত যে তারা দেশের সব সমস্যাগুলির সমাধান করবে। গীতা পড়ার থেকে ফুটবল খেললে ঈশ্বরের সন্ধান তাড়াতাড়ি পাওয়া যায়। একথা তিনি বলেছেন যুবদের। তিনি বলতেন তোরা মানুষ হ। তিনি বলতেন আমি এমন মানুষ চাই যাদের মাংস পেশি লোহা দিয়ে তৈরি। আর এই দেহের মধ্যে এমন মন থাকবে যা নরম উপাদানে গঠিত। অনেকে আমিষ, নিরামিষ খাওয়া নিয়ে খুব গর্ব করতেন তিনি বলতেন আমার ছেলেরা যত খুশি আমিষ খাবে। পাপ আমার হোক। কারণ তিনি চাইতেন দেশের ছেলেমেয়েরা বলিষ্ঠ ও দৃঢ় হোক। শুধু দেহ শক্ত হলে হয়না। মন শক্ত হওয়া চাই। সর্বাগ্রে চাই আত্মবিশ্বাস। যাকে তিনি শ্রদ্ধা বলতেন, কে নাস্তিক? স্বামীজি বলতেন পুরোনো মতে যাদের ঈশ্বরে বিশ্বাস নেই তারা নাস্তিক। কিন্তু আধুনিক মতে যাদের নিজেদের উপর বিশ্বাস নেই তাই নাস্তিক। স্বামীজি পাশ্চাত্যে সংঘ শক্তি দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন এই সংঘ শক্তি আমাদের দেশে আসুক আর সঙ্গে সঙ্গে আসুক পাশ্চাত্যের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিদ্যার সহায়তায় আমরা নতুন ভারত গড়ো কিন্তু তা বলে আমাদের আর্থিক সম্পদ হারাবো না সামাজিক নেতৃত্বে আমাদের দেশের তরুণরা নতুন ভারত এগিয়ে আসুক এই আশার আলো জর্জরিত ভারতের জনসাধারণ অপেক্ষা করছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ভারতের প্রাচীন আদর্শ অনুশাসনের প্রতি ছিলেন পরম নিষ্ঠাবান। এমনকি চল্লিশ বছর অবধি তিনি ভারতবর্ষের সনাতন সারল্য, স্নিগ্ধতা ও অনাড়ম্বর পুজো আচরণের প্রতি ছিলেন অনুরক্ত। সংযম, বিশ্বাস, ধ্যান, মৃত্যুভয়হীন, আত্মসমাহিত শক্তি, কোমলতা ও স্বধর্ম রক্ষায় দৃঢ়তা এবং শান্তির মর্মগত বিষয়ে তিনি ছিলেন প্রাচীন বিশ্বাসী। দীর্ঘদিনের প্রথাগত সংস্কার-বিশ্বাস ও শিক্ষায় বেড়ে ওঠা হিন্দুসমাজে জন্মেছিলেন বলে কবি তার যা কিছু শ্রেষ্ঠ তাকে সমস্ত সমাজের বলে ভেবেছেন। তবে যে ধর্মসমাজে তার জন্ম তার অতিরিক্ত অর্জন আছে তাঁর পরমার্থচেতনায়। জন্মগত আর বংশগত ধর্ম তাঁর শিক্ষাদীক্ষা সংস্কৃতি ও চিন্তার ভেতর দিয়ে বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে রূপান্তরিত হয়েছে; পেয়েছে পরিপূর্ণতা। তিনি একসময় হিন্দু সম্প্রদায় ও হিন্দু আদর্শ নিয়ে প্রশস্তি গেয়েছেন (যেমন, ১৩২৪ সালে ‘আত্মপরিচয়’ রচনায়)। পরে আবার এর বিপরীত কথাও বলেছেন (যেমন, ১৩৩৯ সালে ‘কালান্তর’ গ্রন্থে)। হয়ে উঠেছেন ‘গোরা’ উপন্যাসের গোরা চরিত্রের মতো ভারতবর্ষের দেবতার পূজারি।
রবীন্দ্রনাথ উদার বিশ্বমানবিকতার কবি। বিশ্বমানব ও বিশ্বপ্রকৃতির প্রতি তাঁর অনুরাগ ছিল সংস্কারমুক্ত ও ভেদাভেদশূন্য। প্রথমদিকে সমাজ ও ধর্মের সংস্কার ও বিশ্বাসের বেড়াজাল সৃষ্টি হলেও সেই উচ্ছ্বাস ও আবেগ থেকে তিনি মুক্ত হয়ে মানবিক সত্যের মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়েছেন। তিনি যেমন ব্রাহ্মণের মিথ্যা গরিমাকে ধূলায় মিশিয়ে দিয়েছেন তেমনি হিন্দুদের দ্বারা কথিত ম্লেচ্ছ মুসলমানকে সম্মান করেছেন। কাহিনী কাব্যের ‘সতী’ কবিতায় আছে:
‘বৃথা আচার বিচার। সমাজের চেয়ে
হৃদয়ের নিত্য ধর্ম সত্য চিরদিন।’
মানুষের জয়গান ছত্রে-ছত্রে। সংস্কারমুক্ত কবি সাম্প্রদায়িক জাতিভেদের ভেদবুদ্ধিকে পরিহার করেছেন। জাতপাতের বিরুদ্ধে উঠে তাঁর কণ্ঠস্বর তীব্র হয়েছে। পত্রপুট কাব্যের পনের সংখ্যক কবিতায়। যেখানে গরীব, সমাজের নিচুতলার পক্ষে কবির চেতনা। তিনি সহজ ভক্তির আলোকে দেবতাকে পেতে চেয়েছেন। আচার সংস্কার মন্ত্র ও মন্দিরের ভেতরে নয়। এ জন্য গীতাঞ্জলির অসংখ্য কবিতায় দেখা যায় দেবতা বদ্ধ ঘরে নেই, তিনি আছেন রৌদ্র ধূলায় চাষা আর শ্রমিকের মাঝে। অবজ্ঞাত, হীন, পতিত অন্ত্যজের মধ্যে কবি দেবতা খুঁজেছেন। গীতাঞ্জলির কবিতায় কবি সব হারাদের মাঝে দেবতাকে পেয়েছেন আমরা দেখতে পাই।
"যেথায় থাকে সবার অধম দীনের হতে দীন
সেইখানে যে চরণ তোমার বাজে
সবার পিছে, সবার নিচে
সব হারাদের মাঝে।"
কবিগুরু সকল গণ্ডি, সমস্ত সম্প্রদায় বিভেদ বৈষম্যের ঊর্ধ্বে মানুষের ঈশ্বরের সাধনা করেছেন, আরাধনা করেছেন। মানুষের মাঝে দেবতাকে পেয়েছেন। ‘মানুষের ধর্ম’ প্রবন্ধে নিজের সাধনা সম্পর্কে বলেছেন, ‘আমার মন যে সাধনাকে স্বীকার করে তার কথাটা হচ্ছে এই যে, আপনাকে ত্যাগ না করে আপনার মধ্যেই সেই মহান পুরুষকে উপলব্ধি করবার ক্ষেত্র আছে, তিনি নিখিল মানবের আত্মা। এই বিশ্ব মানবের আত্মাকে উপলব্ধি করার সাধনাই কবির ধর্মসাধনার পরিণাম। মানবের আত্মার স্বরূপ হচ্ছে সর্বজনীন মানব বা পরম পুরুষ। যিনি সব মানুষের হৃদয়ে সন্নিবিষ্ট থেকে মহত্ত্বের শ্রেয়োবোধের প্রেরণা দিচ্ছেন। চিত্রার ‘এবার ফিরাও মোরে’ কবিতায় তার পরিচয় আছে।
‘কে সে? জানি না কে? চিনি নাই তারে
শুধু এইটুকু জানি— তারি লাগি রাত্রি-অন্ধকারে
চলেছে মানবযাত্রী যুগ হতে যুগান্তর-পানে
ঝড়ঝঞ্ঝা বজ্রপাতে জ্বালায়ে ধরিয়া সাবধানে
অন্তরপ্রদীপখানি।... মানুষের অন্তরে এক মহামানবত্বের প্রেরণা, যা তাকে অনুপ্রাণিত করে মহত্ত্বের পথে নিয়ে যায় তাকে অনুভব করেন কবি। তবে মহামানবের কর্ণে তার আহ্বান পৌঁছায় সবার আগে। তাঁরা সংসারের সীমা ছেড়ে ছুটে আসেন। নতুন নতুন ত্যাগ ও দুঃখ বোধ প্রকাশিত হয়। মানুষের অন্তর্নিবিষ্ট মহামানবই কবির ‘সদা জনানাং হৃদয়ে আছে। মহামানবকে লাভ করার সাধনাই কবির ধর্ম সাধনা। এর নাম মানবধর্ম। কবিগুরুর আত্মদর্শন বিভিন্ন কবিতায় রূপায়িত হয়েছে। গীতমাল্যের কবিতায় মহামানবকে লাভ করার জন্য ত্যাগ ও দুঃখবরণ করে মানবাত্মার অভিসারের কথা বলা হয়েছে। দুঃখকে আত্মসাৎ করার আনন্দের কথা ‘আত্মপরিচয়ে’ বলেছেন তিনি। দুঃখের মধ্য দিয়ে সুন্দরের পরমসত্তার আবির্ভাব ঘটে। মানবাত্মা পরিশুদ্ধ হয়। গীতবিতানের পূজা পর্যায়ের গানে আছে, "দুঃখ যদি না পাবে তো দুঃখ তোমার ঘুচবে কবে। / বিষকে বিষের দাহ দিয়ে দহন করে মারতে হবে। ...মরতে মরতে মরণটারে শেষ করে দে একেবারে/ তার পরে সেই জীবন এসে আপন আসন আপনি লবে।" কবির দেবতা রুদ্র, শান্ত, শিবম। দুঃখ আঘাতে তাঁকে পাওয়া যায়। খেয়ার ‘আগমন’-এ আছে সেই রুদ্র রূপ। ‘এই করেছ ভালো নিঠুর’/ কিংবা ‘আরো কি বাণ তোমার তুণে আছে’- দুঃখকে আহ্বান করার গান। দুঃখ ও কঠোর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে মহামানবের সাধনা পূর্ণ হয়। তবে তাঁর সাহচর্য কখনো কখনো আনন্দময়। বিভিন্ন কবিতায় ব্যক্ত ‘খেলার সঙ্গিনী’, ‘নর্মসহচরী’, ‘মানসসুন্দরী’ কবির জীবনের নিয়ন্ত্রণকর্ত্রী জীবনদেবতায় পরিণত। চিত্রা কাব্যের জীবনদেবতা, রাজা, অরূপরতন নাটকের রাজা এবং খেয়া কাব্যের দুঃখরাতের রাজা ও রাজার দুলাল একই সত্তার ভিন্ন রূপ। একই দেবতা বিচিত্র রূপে কবির কাছে দেখা দিয়েছে। গীতাঞ্জলির গানে আছে প্রকৃতির নিবিড় সাহচর্যে কবি তার অমৃত স্পর্শ লাভ করেছেন। হৃদয়দেবতার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বভুবনের প্রতি কবির ছিল বিস্ময়। গীতাঞ্জলির গানে আছে ‘সীমার মাঝে অসীম তুমি/বাজাও আপন সুর/আমার মধ্যে তোমার প্রকাশ/তাই এত মধুর।’ জগতের সামান্য বস্তুর মধ্যেও অপরিমেয়তার অশেষ ব্যঞ্জনা আছে। কবি বিশ্বপ্রকৃতিতে নিসর্গ সৌন্দর্যে মানব সম্বন্ধের মধ্য দিয়ে সীমাহীন অনির্বচনীয়তা লক্ষ্য করেছেন। অনন্ত অসীম পরম রহস্যময় প্রকাশ, ‘যা দেখেছি যা পেয়েছি তুলনা তার নাই।’ গীতাঞ্জলির ৩০ নম্বরে সৃষ্টির সকল আনন্দময় প্রকাশ আছে। অন্তর অনুভূতির গভীর আকুতি মিশেে আছেে,
"এই তো তোমার প্রেম ওগো
হৃদয় হরণ
এই যে পাতায় আলো নাচে
সোনার বরণ।।
এই যে মধুর আলস বরে
মেঘ ভেসে যায় আকাশ পরে
এই যে বাতাস দেহে করে
অমৃত ক্ষরণ।।"
মানুষ ও মানব সংসারের মধ্য দিয়ে কবি তাঁর পরমেশ্বরের আনন্দরূপ দেখেছেন। কবিতায় তিনি অমৃতময় ভূমাকে পরমানন্দময় জীবনদেবতাকে লাভ করেছেন।
‘এই বসুধার
মৃত্তিকার পাত্রখানি ভরি বারম্বার
তোমার অমৃত ঢালি দিবে অবিরত
নানাবর্ণগন্ধময়।...
যে-কিছু আনন্দ আছে দৃশ্যে গন্ধে গানে
তোমার আনন্দ রবে তার মাঝখানে।’
"তিনি গেছেন সেথায়, যেথায় করছে চাষা চাষ পাথর ভেঙে কাটছে যারা পথ খাটছে বারোমাস, রৌদ্রে জলে আছেন সবার সাথে ধুলা তাহার লেগেছে দুই হাতে, তারি মতন শুচি বসন ছাড়ি, আয়রে ধুলার 'পরে"।
আবার তিনি বলেছেন কবিতায়, "মুক্তি ওরে মুক্তি কোথায় পাবি, মুক্তি কোথায় আছে, আপনি প্রভু সৃষ্টি বাঁধন 'পরে বাঁধা সবার কাছে"।
আবার স্বামী বিবেকান্দ বলেছেন, 'কেবল শারীরিক সাহায্য দ্বারা জগতের দুঃখ দূর করা যায় না। যতদিন না মানুষের প্রকৃতি পরিবর্তিত হইতেছে, ততদিন এই শারীরিক অভাবগুলি সর্বদাই আসিবে এবং দুঃখ অনুভূত হইবেই হইবে। যতই শারীরিক সাহায্য কর না কেন, কোনমতেই দুঃখ একেবারে দূর হইবে না। জগতের এই দুঃখ-সমস্যার একমাত্র সমাধান মানবজাতিকে শুদ্ধ ও পবিত্র করা। আমরা জগতে যাহা কিছু দুঃখকষ্ট ও অশুভ দেখিতে পাই, সবই অজ্ঞান বা অবিদ্যা হইতে প্রসূত। মানুষকে জ্ঞানালোক দাও, সকল মানুষ পবিত্র আধ্যাত্মিক-বলসম্পন্ন ও শিক্ষিত হউক, কেবল তখনই জগৎ হইতে দুঃখ নিবৃত্ত হইবে, তাহার পূর্বে নয়। দেশে প্রত্যেকটি গৃহকে আমরা দাতব্য আশ্রমে পরিণত করিতে পারি, হাসপাতালে দেশ ছাইয়া ফেলিতে পারি, কিন্তু যতদিন না মানুষের স্বভাব বদলাইতেছে, ততদিন দুঃখ-কষ্ট থাকিবেই থাকিবে।'
স্বামীজি বলতেন ভারতের জাতীয় অপরাধ সে তার জনসাধারণকে অবজ্ঞা করে এসেছে। এই পাপের ফলে ভারত এত দুর্বল। বারবার বিদেশি শক্তির কাছে পদানত হয়েছে। জনসাধারণের বৃহত্তর অংশ হচ্ছে শূদ্র। খেটে খাওয়া মানুষ যারা মাঠে চাষ করে কলকারখানায় হাতুড়ি পেটায়। এরা দেশ গড়ে কিন্তু এরা সে ধন থেকে বঞ্চিত। আবার কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একই কথা বলেছেন তিনি বলেছেন যারা মাঠে ঘাটে খাটে তারাই তো আসল দেবতা। তাদের মধ্যেই দেবতা বিরাজ করে। তুমি রুদ্ধদ্বারে দেবালয়ের কোণে কেন ভগবানকে খোঁজো। সেখানে ঈশ্বর নেই। সেখানে ঈশ্বর নেই, যেখানে শুধু ধর্মের আড়ালে ক্ষমতার বড়াই করে গরীবের ঘাম কেড়ে খাওয়া লোভি হায়েনার দল। তাহলে দেখা যাচ্ছে, গ্রেট মেন থিংকস আ্যালাইক। যারা বিদ্বজ্জন যারা মহাপুরুষ, জ্ঞানী তারা একই রকম চিন্তা করে থাকেন এটাই আমাদের প্রবন্ধের মূল বক্তব্য। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর স্বামী বিবেকানন্দের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে একই সুরে সুর মিলে যায়। তারা মানুষের জয়গান করেছেন চিরকাল। মানুষের জয়গান করেছেন ভগবান যিশু, বুদ্ধ সকলে। আমরা তো সামান্য লোক।তাই তাঁদের পথ ধরে চিরকাল অনুসরণ করে যাই আলোপথ। কবির ভাষায় বলি, "মহাজ্ঞানী মহাজন, যে পথে করে গমন, হয়েছেন চিরস্মরণীয়, সেই পথ লক্ষ্য করে স্বীয় কীর্তি ধ্বজা ধরে আমরাও হব বরণীয়"।
নানা প্রতিকূলতার মধ্যে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী এমন ভূমি তৈরি করেছিলেন যে ভূমিতে পরপর তৈরি হয়েছে নানান সাহিত্যিক। তখনকার দিনে ছাপাখানা অত সহজ ছিল না উপেন্দ্রকিশোর নানা বাধা অতিক্রম করে এই ছাপাখানা বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেন এবং তিনি নিজের হাতেই প্রচ্ছদ নির্মাণ এবং এর যাবতীয় ছবি আঁকা সবকিছু নিজের হাতেই করতেন।
একটা চারা গাছ রোপন করে তাকে যত্ন করে তার যোগ্য মাটিতে থাকে পথে তাকে সার দিয়ে বড় করতে হয় তবেই সে বড় হয় এবং ফল-ফুল প্রদান করে। তেমনি একটি সন্তান সুন্দর পরিবেশে সুন্দর পরিবারে জন্মগ্রহণ করে যদি যথোপযুক্ত মাধ্যমে মানুষ হয় সে পৃথিবীতে আপন স্থান করে নেয় স্বমহিমায়। এমনই একটা যোগ্য পরিবার রায় পরিবার যেখানে সন্তানদের মানুষ হবার মতো বিখ্যাত সকল পরিবেশ বিদ্যমান এবং তাদের সেই লড়াকু মনোভাব ও বিদ্যমান।
প্রসিদ্ধ শিশুসাহিত্যিক, চিত্রশিল্পী, বাংলা মুদ্রণশিল্পের অন্যতম রূপকার, ১৮৬৩ সালের ১০ মে ময়মনসিংহ জেলার মসুয়া গ্রামে উপেন্দ্রকিশোর জন্মগ্রহণ করেন। পিতামাতার আট সন্তানের মধ্যে উপেন্দ্রকিশোর ছিলেন তৃতীয় সন্তান। তাঁর পিতৃদত্ত নাম ছিল কামদারঞ্জন। পাঁচ বছর বয়সের সময় তাঁর পিতা কালীনাথ রায় ওরফে শ্যামসুন্দর মুন্সীর কাছ থেকে নিকট আত্মীয় ময়মনসিংহের জমিদার হরিকিশোর চৌধুরী তাঁকে পোষ্যপুত্র হিসেবে গ্রহণ করে নতুন নাম রাখেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। সুপন্ডিত জমিদার হরিকিশোর রায়চৌধুরীর পৃষ্ঠপোষকতায় উপেন্দ্রকিশোরের শিক্ষাজীবন শুরু হয় এবং ময়মনসিংহ জিলা স্কুল থেকে ১৮৮০ সালে বৃত্তি নিয়ে প্রবেশিকা পরীক্ষা পাস করেন। স্কুল জীবনেই তিনি চিত্রাঙ্কনে দক্ষতা অর্জন করেন। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে কিছুকাল অধ্যয়নের পর কলকাতা মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন এবং ১৮৮৪ সালে সেখান থেকে বিএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এ সময় তিনি ব্রাহ্মসমাজে যোগ দেন এবং প্রখ্যাত সমাজসেবী দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের জ্যেষ্ঠ কন্যা বিধুমুখীর সঙ্গে বিবাহ হয়।
কোনো বাধা কোনো বিপত্তি উপেন্দ্রকিশোরের সামনে দাঁড়াতে পারেনি। সকলকে সকল বাধাকে তুচ্ছ জ্ঞান করে তিনি এগিয়ে চলেছেন সদর্পে। পরিবারকে তিনি এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন যেখানে যে কোন সন্তান জন্ম নিলে সে বড় হবেই এমন একটা পরিবেশ গড়ে তোলা একজনের পক্ষে কতটা কঠিন সে যে করেছে সেই জানে। তারপরে কি হয়েছে, উপেন্দ্রকিশোরে পরবর্তী সন্তান সুকুমার রায় সাহিত্য জগতে এক নক্ষত্র হয়েছেন। তারপর সুকুমার রায় সত্যজিৎ রায় ও নক্ষত্র হয়েছেন এবং সত্যজিৎ রায়ের পুত্র সন্দীপ রায় সাহিত্য আকাশে নক্ষত্র স্থান অধিকার করেছেন তারপরও হয়তো তোকে দেখে যাবেন কোন হীরের টুকরো দেখে যাবেন তার বংশে।
কিশোর বয়সেই উপেন্দ্রকিশোরের সাহিত্যসৃষ্টির হাতেখড়ি ঘটে এবং তখনকার কিশোরপত্রিকা সখা, বালক, সাথী, সখা ও সাথী, মুকুল ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৮৮৩ সালে ছাত্রাবস্থায় সখা পত্রিকায় তাঁর প্রথম রচনা প্রকাশিত হয়। তাঁর সমগ্র জীবনেই তিনি নিরবচ্ছিন্নভাবে সাহিত্যচর্চা অব্যাহত রাখেন। শিশুকিশোর সাহিত্যের প্রায় সকল শাখায় বিচরণ করে তিনি বাংলা শিশুসাহিত্যের দিকনির্দেশকের ভূমিকা পালন করেন। চমকপ্রদ নানা চিত্র সংযোজন উপেন্দ্রকিশোরের প্রকাশনার এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল। অপূর্ব দক্ষতায় শিল্পী রায়চৌধুরীর সম্পাদনা করেন ১৯১৩ সালে বিখ্যাত মাসিক পত্রিকা সন্দেশ। প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯১৩ সালে। আজও কলকাতা থেকে প্রকাশিত একটি জনপ্রিয় শিশুকিশোর সাহিত্য পত্রিকা হল সন্দেশ। দেশবিদেশের গল্প, হাস্যকৌতুক, জ্ঞান বিজ্ঞানের কথা ইত্যাদি লেখার পাশাপাশি নিজের নানা বুদ্ধিদীপ্ত ছবি সংযোজনের মাধ্যমে সন্দেশকে তিনি কিশোর পত্রিকা হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন।
উপেন্দ্রকিশোর কিশোরদের জন্য বহু সাহিত্য পুস্তক রচনা করেছেন, এর মধ্যে উলেখযোগ্য গ্রন্থ,ছোটদের রামায়ণ, ছোটদের মহাভারত, সেকালের কথা, মহাভারতের গল্প, ছোট্ট রামায়ণ, টুনটুনির বই এবং গুপী গাইন বাঘা বাইন। বইগুলির প্রচ্ছদ এবং ভেতরের ছবিও তিনি নিজেই অঙ্কন করেন। এ ছাড়া বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-এর উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদ এবং রবীন্দ্রনাথের ‘নদী’ কবিতার সঙ্গে সংযোজিত তাঁর অঙ্কন বিশেষ প্রশংসা লাভ করে। চিত্রাঙ্কনে তিনি সচরাচর পাশ্চাত্য প্রথায় তেলরঙ ও কালিকলম ব্যবহার করতেন। জলরঙের ছবিতেও তিনি কুশলী ছিলেন। ‘বলরামের দেহত্যাগ’ তাঁর অঙ্কিত একটি বিখ্যাত চিত্র।উপেন্দ্রকিশোর তাঁর প্রথম বই ছোটদের রামায়ণ।
বিশ্বে তখন রঙীন ছবি প্রযুক্তি প্রারম্ভিক পর্যায়ে মাত্র। গণিতে গভীর ব্যুৎপত্তি এবং সূক্ষ্ম বৈজ্ঞানিক দৃষ্টির সাহায্যে উপেন্দ্রকিশোর এদেশে বসেই এ বিষয়ে অনেক নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। নানা ধরনের ডায়াফ্রাম তৈরি, রে-স্ক্রিন অ্যাডজাস্টার যন্ত্র নির্মাণ, ব্লক নির্মাণের ডায়োটাইপ ও রি-প্রিন্ট পদ্ধতির উদ্ভাবন তাঁর মৌলিক অবদান। পশ্চিমা দেশে তাঁর উদ্ভাবিত প্রযুক্তি ও মুদ্রণ প্রণালীসমূহ বেশ প্রশংসিত হয়। লন্ডন থেকে প্রকাশিত পেনরোজেজ পিকটোরিয়াল অ্যানুয়াল পত্রিকার বিভিন্ন সংখ্যায় এ প্রসঙ্গে তাঁর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধও প্রকাশিত হয়। উপেন্দ্রকিশোর প্রতিষ্ঠিত ‘ইউ রায় অ্যান্ড সন্স’ কোম্পানির মাধ্যমেই ভারতবর্ষে প্রসেস-মুদ্রণ শিল্প বিকাশের সূত্রপাত ঘটে।
বাল্যকাল থেকেই উপেন্দ্রকিশোর সঙ্গীতচর্চার প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। তিনি পাখোয়াজ, হারমোনিয়াম, সেতার, বাঁশি, বেহালা ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র বাদনে দক্ষতা অর্জন করেন। তবে বেহালাই ছিল তাঁর বিশেষ প্রিয়। আদি ব্রাহ্মসমাজের উৎসবসমূহে সঙ্গীতের সঙ্গে তাঁর বেহালার বাজনা ছিল একটি বড় আকর্ষণ। পাশ্চাত্য সঙ্গীত সম্পর্কেও তিনি গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। বেহালা শিক্ষা এবং হার্মোনিয়াম শিক্ষা নামে তাঁর দুটি বই বিখ্যাত। তাঁর পুত্র সুকুমার রায়ের জন্ম ১৮৮৭ সালের
৩০শে অক্টোবর, কলকাতার এক ব্রাহ্ম পরিবারে। সুকুমারের মা বিধুমুখী দেবী ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের মেয়ে। সুবিনয় রায় ও সুবিমল রায় তাঁর দুই ভাই। এ ছাড়াও তাঁর ছিল তিন বোন। সবরকমের সুবিধা নিয়ে সুন্দর পরিবেশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন উপেন্দ্রকিশোরের সন্তান সুকুমার রায়। উপেন্দ্রকিশোরের তৈরী জমিতে তার সন্তান জন্মেছিলেন। তার ফলে সাহিত্য আকাশে বড় হতে তার খুব বেশি বিলম্ব হয়নি।
সুকুমার রায় জন্মেছিলেন বাঙালি নবজাগরণের স্বর্ণযুগে। তাঁর পারিবারিক পরিবেশ ছিল সাহিত্যনুরাগী, যা তাঁর মধ্যকার সাহিত্যিক প্রতিভা বিকাশে সহায়ক হয়। পিতা উপেন্দ্রকিশোর ছিলেন শিশুতোষ গল্প ও জনপ্রিয়-বিজ্ঞান লেখক, চিত্রশিল্পী, সুরকার ও শৌখিন জ্যোতির্বিদ। উপেন্দ্রকিশোরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যিনি সুকুমারকে সরাসরি প্রভাবিত করেছিলেন। এ ছাড়াও রায় পরিবারের সাথে জগদীশ চন্দ্র বসু, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় প্রমুখের সম্পর্ক ছিল। উপেন্দ্রকিশোর ছাপার ব্লক তৈরির কৌশল নিয়ে গবেষণা করেন, এ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান এবং মানসম্পন্ন ব্লক তৈরির একটি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। মেসার্স ইউ রয় অ্যান্ড সন্স নামে ঐ প্রতিষ্ঠানের সাথে সুকুমার যুক্ত ছিলেন।
কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৯০৬ সালে রসায়ন ও পদার্থবিদ্যায় বি.এস.সি.(অনার্স) করার পর সুকুমার মুদ্রণবিদ্যায় উচ্চতর শিক্ষার জন্য ১৯১১ সালে বিলেতে যান। সেখানে তিনি আলোকচিত্র ও মুদ্রণ প্রযুক্তির ওপর পড়াশোনা করেন এবং কালক্রমে তিনি ভারতের অগ্রগামী আলোকচিত্রী ও লিথোগ্রাফার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ১৯১৩ সালে সুকুমার কলকাতাতে ফিরে আসেন। সুকুমার ইংল্যান্ডে পড়াকালীন, উপেন্দ্রকিশোর জমি ক্রয় করে, উন্নত-মানের রঙিন হাফটোন ব্লক তৈরি ও মুদ্রণক্ষম একটি ছাপাখানা স্থাপন করেছিলেন। তিনি ছোটদের একটি মাসিক পত্রিকা, 'সন্দেশ', এই সময় প্রকাশনা শুরু করেন। সুকুমারের বিলেত থেকে ফেরার অল্প কিছু দিনের মধ্যেই উপেন্দ্রকিশোরের মৃত্যু হয়। উপেন্দ্রকিশোর জীবিত থাকতে সুকুমার লেখার সংখ্যা কম থাকলেও উপেন্দ্রকিশোরের মৃত্যুর পর সন্দেশ পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব সুকুমার নিজের কাঁধে তুলে নেন। সুকুমার রায় ছিলেন উপেন্দ্রকিশোরের পরবর্তী যোগ্য বংশধর। তিনি বাবার সমস্ত ছাপাখানা, প্রচ্ছদ শৈলী আয়ত্ত করেন অল্পসময়ে। নিজেও তিনি সাহিত্য আকাশে এক স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিগণিত হন।
শুরু হয় বাংলা শিশুসাহিত্যের এক নতুন অধ্যায়। পিতার মৃত্যুর পর আট বছর ধরে তিনি সন্দেশ ও পারিবারিক ছাপাখানা পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর ছোটভাই এই কাজে তাঁর সহায়ক ছিলেন এবং পরিবারের অনেক সদস্য 'সন্দেশ'-এর জন্য নানাবিধ রচনা করে তাঁদের পাশে দাড়ান।সুকুমার রায়ের স্বল্পস্থায়ী জীবনে তাঁর প্রতিভার শ্রেষ্ঠ বিকাশ লক্ষ করা যায়। সন্দেশ পত্রিকার সম্পাদক থাকাকালীন সময়ে তাঁর লেখা ছড়া, গল্প ও প্রবন্ধ আজও বাংলা শিশুসাহিত্যে মাইলফলক হয়ে আছে। তাঁর বহুমুখী প্রতিভার অনন্য প্রকাশ তাঁর অসাধারণ ননসেন্স ছড়াগুলোতে। তাঁর প্রথম ও একমাত্র ননসেন্স ছড়ার বই আবোল তাবোল শুধু বাংলা সাহিত্যে নয়, বরং বিশ্বসাহিত্যের অঙ্গনে নিজস্ব জায়গার দাবিদার। প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়বার সময় তিনি ননসেন্স ক্লাব নামে একটি সংঘ গড়ে তুলেছিলেন। এর মুখপাত্র ছিল সাড়ে বত্রিশ ভাজা নামের একটি পত্রিকা। সেখানেই তাঁর আবোল তাবোল ছড়ার চর্চা শুরু। পরবর্তীতে ইংল্যান্ড থেকে ফেরার পর মন্ডা ক্লাব (ইংরেজি ভাষা) নামে একই ধরনের আরেকটি ক্লাব খুলেছিলেন তিনি। মন্ডা ক্লাবের সাপ্তাহিক সমাবেশে সদস্যরা 'জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ' পর্যন্ত সব বিষয়েই আলোচনা করতেন। সুকুমার রায় মজার ছড়ার আকারে এই সাপ্তাহিক সভার কয়েকটি আমন্ত্রণপত্র করেছিলেন সেগুলোর বিষয়বস্তু ছিল মুখ্যত উপস্থিতির অনুরোধ এবং বিশেষ সভার ঘোষণা ইত্যাদি। সুকুমার রায়ের মজার ছড়া পড়তে পড়তে কখন যে শিশু কিশোরবেলায় ফিরে যায় মানুষ তা বুঝতেও পারে না। এক অমলিন হাসির আড়ালে কত শিক্ষা যে লুকিয়ে আছে তার ইয়ত্তা নেই। সুকুমার লেখচিত্রী হিসেবে সুনাম অর্জন করেছিলেন। তাঁর প্রযুক্তিবিদের পরিচয় মেলে, নতুন পদ্ধতিতে হাফটোন ব্লক তৈরি আর ইংল্যান্ডের কয়েকটি পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর প্রযুক্তি বিষয়ক রচনাগুলো থেকে। সুকুমার রায়ের সৃষ্টি আজও আমাদের আলোড়িত করে। সেই তালিকায় রয়েছে আবোল তাবোল, পাগলা দাশু, হ য ব র ল, চলচ্চিত্র সহ অসংখ্য মণি। সোনার চামচ মুখে নিয়ে সোনার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন সত্যজিৎ রায়। তাঁর নেশা এবং সাধনা ছিল সিনেমাশিল্প। চলচ্চিত্র পরিচালনায় তাঁর অসাধারণ মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি বাংলা চলচ্চিত্রে একটি নতুন মাত্রা তৈরি করেছিল। এটা বললে ভুল হবে না যে শুধুমাত্র সত্যজিৎ রায়ের কারণেই আজ বাংলা ভাষায় তৈরি চলচ্চিত্র পৃথিবী জুড়ে সম্মানের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়। অনেকেই বলেন সত্যজিৎ রায় তাঁর ছবির মাধ্যমে বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতিকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরেছিলেন। অস্কার পেয়েছেন পথের পাঁচালী সিনেমা থেকে।
চলচ্চিত্র নির্মাতা, চিত্রনাট্যকার, শিল্প নির্দেশক, সঙ্গীত পরিচালক এবং লেখক সত্যজিৎ রায় বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র নির্মাতাদের একজন হিসেবে বিশ্বে পরিচিতি লাভ করেছিলেন।তাঁর পূর্বপুরুষের ভিটা ছিল তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের কিশোরগঞ্জে উপজেলার মসুয়া গ্রামে। সেসময় তিনি ছিলেন ব্রাহ্ম আন্দোলনের অন্যতম একজন নেতা। তাঁর নিজের একটি ছাপাখানাও ছিল। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় ১৮ বৈশাখ ১৩২৮ বঙ্গাব্দে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম সুকুমার রায়, মাতার নাম সুপ্রভা দেবী। আদি নিবাস ছিল বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ জেলার মসুয়া গ্রামে। প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন তাঁর মায়ের কাছে। ৮ বৎসর বয়সে সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হন। বিগত বংশধরদের মতো সত্যজিৎ রায় ও নানা বিষয়ে পারদর্শী ছিলেন। শুধু চলচ্চিত্র পরিচালক নয় তিনি ছিলেন সাহিত্যিক, তিনি ছিলেন শিল্পী তিনি ছিলেন নানা গুণে গুণান্বিত।
১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে বিদ্যালয়ের পাঠ শেষে তিনি ভর্তি হন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ প্রেসিডেন্সি কলেজে। পড়াশোনাতে সত্যজিৎ রায় খুব ভালো ছিলেন। তিনি সর্ব বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করতেন। বই পড়তে তার অনীহা ছিল না সব সময় বই পড়তে ভালো লাগতো। বাইরের বই পড়ে পড়ে তিনি অসংখ্য জ্ঞান অর্জন করেন। এই কলেজে প্রথম দু’ বছর বিজ্ঞা