top of page

প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা ​

সূচীপত্র
srikrishna.jpg
 জানুয়ারী
২০২৩
Village2.jpg

প্রচ্ছদঃ সুরজিত সিনহা

লেখক/লেখিকাবৃন্দ

মানবিক মূল্যবোধ
birds.jpg

মানবিক মুল্যবোধের চরম অবক্ষয়

মিজানুর রহমান মিজান

বিশ্বনাথ, সিলেট, বাংলাদেশ

প্রবন্ধ

Mijanur Rahman.jpg

কল প্রশংসা এক মাত্র বিশ্বপ্রভু মহান আল্লাহর প্রাপ্য। যিনি এ জগত সংসারের যাবতীয় বস্তুর সৃষ্টিকর্তা, হেফাজতকারী, পরিচালনাকারী ও সর্বশেষ মৃত্যুদাতা। কারণ ‘জগতের সকল প্রাণী মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে’। তিনি এক, অদ্বিতীয়, তাঁর সমতুল কেহ নেই। সর্বশ্রেষ্ঠ, শেষ নবী হযরত মোহাম্মদ (স:) আল্লাহর প্রেরিত নবী। হাজার হাজার সালাম ও দরুদ পেশ করি হযরত মোহাম্মদ (স:)’র নামে। মানুষকে আল্লাহ আশরাফুল মাখলুকাত নামে অভিহিত করেছেন সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব বলে। কারণ মানুষের মধ্যে রয়েছে বিবেক, জ্ঞান, বুদ্ধি, বিবেচনাসহ সচেতনতাবোধ সম্পন্নতা।আল্লাহ মানুষের জন্য দিক নির্দেশনা দিয়েছেন কিভাবে জীবনযাত্রা পরিচালিত হবে। এ সমস্ত বোধ শক্তি থাকার মুল মন্ত্র হল সৎ, সত্য সঠিক পথে পরিচালিত হওয়া, হারাম–হালাল, বৈধ-অবৈধ বুঝে হালাল ও বৈধ আয়ের মাধ্যমে জীবন পরিচালনা করা। অত:পর নীতি নৈতিকতা, ভদ্র, নম্র আচার আচরণের মাধ্যমে জীবন নামক তরী বেয়ে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌছানো। প্রত্যেক মানুষের পিছনে মৃত্যু দূত সব সময় রয়েছেন। নির্দিষ্ট ও নির্ধারিত সময়ে সবাইকে চলে যেতে হবে। এক মিনিট আগেও না, এক মিনিট পরেও না। পশু পশু হয়ে জন্মায়। তাকে পশুত্ব অর্জন করতে হয় না। কিন্তু মানুষকে মনুষ্যত্ব অর্জন করতে হয়। মনুষ্যত্বের মুলে রয়েছে নীতি, নৈতিকতা, মানবিক, হালাল, বৈধ পন্থা অনুসরণ করে অভীষ্ট গন্তব্যে পৌঁছানো। সুতরাং তা অর্জন করতে অনেক কঠিন, কঠোর ও বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে ঈপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছানো প্রত্যেক নরনারীর ঐকান্তিক কামনা ও বাসনা থাকা চাই। কিন্তু আমরা বর্তমানে কতটুকু মানবিক ও মনুষ্যত্ব সম্পন্ন মানুষের পরিচয় দিচ্ছি? তাই জিজ্ঞাস্য?
বর্তমানে সামান্য স্বার্থের লোভে আমরা যে পরিচয় দিচ্ছি তা কতটুকু নৈতিক, মানবিক ও মনুষ্যত্ব নির্ভর? দু’একটি উদাহরণ দিলেই তা স্বচ্ছ আয়নায় পরিস্ফুটিত হবে সহজে। এইতো গতকল্য একটি ভিডিও দেখে হলাম আশ্চর্যান্বিত। কুমিল্লা জেলার এম এ জলিল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক স্কুলের নিকটেই তিনির বাসা। সে বাসায় স্কুল থেকে বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়ে তিনি চলছেন।আরো টিনের নির্মিত ছয়টি কক্ষ রয়েছে, তাতেও প্রধান শিক্ষকের রোম থেকে সংযোগ দেয়া হয়েছে। একজন শিক্ষকের বেতন বর্তমানে ৩০/৪০ হাজার। এতো টাকা পেয়েও তিনি অবৈধ, অনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িত। প্রাপ্ত বেতনে যদি শিক্ষকের জীবন যাপন কঠিন হয়।তবে একজন মসজিদের ইমাম, শ্রমিক, কৃষক মাত্র ৪/৫ হাজার টাকায় এবং একজন কৃষক কত অমানবিক পরিশ্রম করে ৬/৭ হাজার টাকায় তাঁদের জীবন চলে। শিক্ষক মহোদয় কি খান? কোথায়, কিভাবে ব্যয় করেন? তিনি কি সোনা রুপা খেয়ে ফেলেন? আর শ্রমিক, কৃষকের, ইমামের জীবন যদি অল্প বেতনে সংকুলান সম্ভব হয়। তবে কেন শিক্ষকের উচ্চ বেতন পেয়েও সংকুলান হয় না। উপজেলা নির্বাহী অফিসারের জবাবে তিনি বলেছেন ৭/৮ বৎসর যাবত এভাবে চলছেন। কিন্তু অন্যান্যরা বলেছেন আরো দীর্ঘ দিন থেকে ব্যবহারের কথা। আমি আমার মুরব্বিয়ানদের মুখ থেকে প্রায়ই শুনতাম একটি প্রবাদসম বাক্য। যা হচ্ছে “বৈধ, হালাল উপার্জনে রয়েছে বরকত(মুরাদ)”। অবৈধ ও হারাম উপার্জনে বরকত (মুরাদ) শব্দটির অনুপস্থিতি। শাক-সবজি খেয়ে কৃষক, শ্রমিক অনেক বলবান, অপরদিকে বিরিয়ানি খেয়ে হচ্ছেন ডায়াবেটিস, কোলেস্টেরল সমৃদ্ধ। খানা খাদ্যে নিষেধাজ্ঞা সমৃদ্ধ। শিক্ষক মানুষ গড়ার কারিগর, সম্মানী ব্যক্তি। কিন্তু কাজকর্ম নিন্দিত। (সব নয়) একজন শিক্ষক সত্য ও সততার হবেন প্রতীকী। বিগত ১২জানুয়ারি ২০২১ দৈনিক সিলেটের ডাক পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত “৬ বছর অনুপস্থিত থেকে নিয়মিত বেতন-ভাতা নিচ্ছেন প্রধান শিক্ষক” এবং সুরমা নিউজ টুয়েন্টিফোর ডট কম’র ১০ সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখের প্রকাশিত সংবাদ “থাকেন আমেরিকায়, করেন সিলেটে প্রধান শিক্ষিকার চাকুরী” শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদ পাঠে জানা যায়, হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার বৈরাগিপুঞ্জি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আমেনা খাতুন স্কুলে ৬ বছর যাবত অনুপস্থিত থেকে নিয়মিত বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা নিচ্ছেন। অভিভাবকরা বিষয়টি লিখিতভাবে প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের সিলেট বিভাগীয় পরিচালককে জানালে অভিযোগের সত্যতা তদন্ত পূর্বক একটি বিভাগীয় মামলা করা হয় এবং মামলায় তার দুই বছরের বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি স্থগিত করা হয়। ঐ শিক্ষকের কর্মকান্ডে ছাত্ররা বা সন্তানরা কি শিখবেন? তা পাঠকের বিবেচ্য! ঐ শিক্ষকদ্বয়ের এ জাতীয় মন মানসিকতা কি

সত্যিকার নৈতিকতা ও মানবতাবোধের? আমরা কোথায় চলেছি, আকাশে না পাতালে? অবক্ষয়ের মাধ্যমে হচিছ বঞ্চিত প্রকৃত বাস্তবতা থেকে? ব্যক্তি, গোষ্ঠী, সমাজ, জাতি যাচ্ছি রসাতলে। 

আরেকটি কাহিনী সে দিন আমি আমার এক বন্ধুর মুখ থেকে শুনে হতবাক হয়ে গেলাম। আমাদের সমাজে অধিকাংশ ক্ষেত্রে যৌথ সম্পত্তি। খুব কম সংখ্যক বাটোয়ারা দলিল হয়ে থাকে। মৌখিক ভাবে চিহ্নিত করে সকলেই ভোগ করতে অভ্যস্ত। এক সময় ছিল একজন তার অংশের ভূমি বিক্রি করতে চাইলে অন্য শরিকান সাক্ষী হিসাবে দলিলে স্বাক্ষর দেবার প্রচলন। তাই ভাতিজা তার অংশের জমি বিক্রি করবে। এখন অন্য শরিকানের সাক্ষী প্রদান আবশ্যক। সেহেতু ভাতিজা বলছে চাচাকে সাক্ষী প্রদান করতে। জমির তার অংশের বিক্রির কথা স্পষ্ট করে বলেছে চাচাকে। চাচা সাক্ষী দিয়াছেন বিশ্বাস করেই দলিল না দেখে। এখানে একটি কথা উল্লেখ করতেই হয়। কবরস্থান কিন্তু যৌথই থাকে। কারণ সেখানে কবরস্থ হবেন সবাই। কিন্তু আমাদের উল্লেখিত ভাতিজা মিথ্যা ও প্রতারণার আশ্রয় নেয়। চাচা তা ঘুণাক্ষরে ও টের পাননি। ভাতিজার অংশের আংশিক ভূমিসহ কবরস্থানের দুই তৃতীয়াংশ দলিলে লিখে সাক্ষীর কলামে চাচার স্বাক্ষর নেয়। আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা অতীব প্রয়োজন। ক্রেতা ঐ বংশেরই একজন। উভয়ে চক্রান্ত করে তা বাস্তবায়ন করছে লোভ দেখিয়ে ক্রেতা বিক্রেতাকে। গোপনে তাদের মধ্যে আঁতাত, শলা পরামর্শে কাজটি করা হয়েছে। দিন যায় কথা থাকে। চাচা কবরস্থ ভূমির অংশ বিক্রি করেননি তিনির সত্যে অটল। অপরদিকে বিক্রেতা ক্রেতা এক সময় গোপন আঁতাতে ধরে ফাটল। বের হয়ে আসে গোপন কথা জনসমক্ষে। তখন কিন্তু নদীর জল অনেক বয়ে গেছে। বিক্রেতা দলিল দ্বারা টাকার বিনিময়ে তার নামে কবরের দুই অংশ রেকর্ড করে নেয় টাকা ও শক্তির প্রভাবে। চাচা তাদের সাথে পেরে উঠতে পারছেন না দুর্বল বলে। কিন্তু ভূমিটুকু কবরস্থান বলেই রেকর্ড হয়। এখন কথা হল কবরস্থান বিক্রি হয় না তা বিজ্ঞজন মাত্রই জ্ঞাত। তারপরও হয়ে যায়, যাচ্ছে। সাক্ষী দেবার কারণে চাচার কবরের অংশটুকু থেকে তিনি হলেন বঞ্চিত। সর্বশেষ কথা হল এ ক্ষেত্রে কবরস্থান নিয়েও মানুষ প্রতারণা, প্রবঞ্চনা, ঠকানোর ধান্ধায় লিপ্ত। আর বাকি কি রয়েছে? প্রতারকও তো কবরস্থানে যাবেন শেষ পর্যন্ত। তা থেকে তো কোন ক্রমেই রেহাই নেই। সুতরাং মানুষের মনুষ্যত্ব, মানবিকতা, নীতি-নৈতিকতা কোথায়, কোন অবস্থায় কি ভাব দাঁড়িয়েছে। সম্মানিত পাঠক ও বিজ্ঞজনের আর ব্যাখ্যা করে দেখাবার প্রয়োজন নেই। যে কেহ অতি সহজে অবশ্যই বুঝে নিতে কষ্ট হবার কথা নয়। আরো তদন্ত করলে যে বের হবে না তা কি নিশ্চয়তা দিয়ে বলা যাবে? শুধু শিক্ষকদের কথা নয়। দেশের প্রতিটি সেক্টরে অনুরুপ দায়িত্বহীনতার ভুরিভুরি প্রমাণ মিলবে। দু’একজনের জন্য কেন হবে ঐ সমাজ কলঙ্কিত?
যে কোন কাজে ব্যক্তির চারিত্রিক সংশোধন সর্বাগ্রে প্রয়োজন। ব্যক্তি সংশোধিত না হলে সামগ্রিক কাজ সুষ্ঠু ভাবে সম্পন্ন অসম্ভব। আবার ব্যক্তি সংশোধিত হলেই চলবে না। প্রয়োজন সমষ্টি। কারণ পৃথিবীর কোন কিছুই সংঘবদ্ধ ব্যবস্থাপনা ব্যতিরেকে উন্নতির শিখরে পৌছতে পারে নাই, পারবে না। সুতরাং সম্মিলিত শক্তির গুরুত্ব অপরিসীম। তারপরও কথা থেকে যায়। কোন কিছুতেই কিছু হবে না। যতক্ষণ মানুষকে সঠিক অর্থে সঠিক মানবতা, নৈতিক গুণাবলী সমৃদ্ধ ও মানবিক মানুষ বানানো যাবে না। এ দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে ঘুষ, দুর্নীতি মারাত্মক ব্যাধি রূপে আক্রান্ত সমাজ।এ থেকে পরিত্রাণের আবশ্যকতা অত্যন্ত জরুরী। নৈতিকতা ছাড়া যেমন কেহ ভাল হতে পারেন না,তদ্রুপ মানবিক এবং সামাজিক মুল্যবোধের অভাবে পূর্ণতায় আসা সম্ভব নয়। মুল্যবোধের অবক্ষয় যাতে না ঘটে সেদিকে আমাদেরকে সজাগ, সুদৃষ্টি ও লক্ষ্য রাখতেই হবে। তাহলে হয়ত আমরা পেতে পারি সুন্দর ও সঠিক সমাজ ব্যবস্থা। পরিশেষে এ প্রত্যাশা সর্বাত্মকরণে প্রতিটি ক্ষেত্রে অবক্ষয় থেকে উটে আসার। তথা দায়িত্বশীল, কর্তব্যপরায়ণ ও নৈতিকতাবোধে কাজ করার, দায়িত্ব পালন করার।তা না হলে কবির ভাষায় বলতে হবে আক্ষেপের সুরে, “রাত পোহাবার কত দেরী, পাঞ্জেরী”।

 জানুয়ারী ২০২৩ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

কবিতাঃ সাহেব শেখ

কবিতা

সাহেব সেখ

মুর্শিদাবাদ, পঃ বাংলা

 জানুয়ারী ২০২৩ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

essaylogo1.jpg

আমি দিয়াছি মোক তোমারে


মি দিয়াছি মোক তোমারে,
আমি দিয়াছি দুহাত ভরে।
আমি পেয়েছি তোমারি দর্শন,
মনেরও অন্দরে, মনেরও অন্দরে।

অশ্রুসজল নয়নে,
চেয়ে রয়েছি গগনে।
আমি একা এই মহাপাবনে,
পুড়িতেছি ক্ষণে ক্ষণে।

আমি দিয়াছি মোক তোমারে,
আমি দিয়াছি দুহাত ভরে।
আমি পেয়েছি তোমারি দর্শন,
মনেরও অন্দরে, মনেরও অন্দরে।

প্রেমেরও আগুনে পুড়ে,

প্রভু কাঁদে মাঝি কাঁদে।

দাঁড় যে চলে যায় বয়ে,

দূর থেকে দূরে, দূর থেকে দূরে।

আমি দিয়াছি মোক তোমারে,
আমি দিয়াছি দুহাত ভরে।
আমি পেয়েছি তোমারি দর্শন,
মনেরও অন্দরে, মনেরও অন্দরে।

বাগান শূন্য করে,
ফুল যায় মালিকের সঙ্গে।
মালী তুই ফেলিস অশ্রু ওরে,
কেউ নেই পৃথিবীতে, কেউ নেই পৃথিবীতে।

আমি দিয়াছি মোক তোমারে,
আমি দিয়াছি দুহাত ভরে।
আমি পেয়েছি তোমারি দর্শন,
মনেরও অন্দরে, মনেরও অন্দরে।

 জানুয়ারী ২০২৩ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

কবিতাঃ সুকান্ত পাল

তোর জন্য

সারাদিন মন করে উড়ু উড়ু সেই তো তোরই জন্য
এলো চুল মেলে টোল ফেলে গালে হাসলেই তুই অনন্য। 
তোর জন্যই শব্দ চয়ন স্বপ্নেও খুঁজি তোকে
স্বপ্নেই দিই চুম্বন এঁকে তোর ঠোঁটে গালে চোখে। 
শুধু একবার আড়চোখে তুই চাইলেই আমি ধন্য
সারাদিন মন করে উড়ু উড়ু সেই তো তোরই জন্য। 


পড়ার টেবিলে আনমন আমি সেও তো তোরই জন্য
তোকে মন দিতে এতটুকু আমি করিনিকো কার্পণ্য। 
সাইরেন বাজে বুকেতে আমার নিশ্বাসে  নিকোটিন
ক্যানভাস জুড়ে একটাই ছবি আঁকি আমি সারাদিন। 
তোর পিছে পিছে স্টীমবোট আমি নাই কাজ কিছু অন্য
ফাঁকি দিই ক্লাস আমি বারোমাস সেও তো তোরই জন্য। 

গীতিকবিতাঃতোমার দান

যে কর্মভার করেছো দান করতে যেন পারি

কর্মমুখর এই যে ভুবন সবই তো তোমারি। 

         দাও হে শক্তি মনের মাঝে

           সদাই যেন থাকি কাজে

তোমার দেওয়া কর্মে যেন না হই অহংকারী 

যে কর্মভার করেছো দান করতে যেন পারি। 

তোমার কাজের যোগ্য করে

        নাও না তুমি আমায় গড়ে—

তোমার কর্মযজ্ঞে যেন সামিল  হতে পারি

যে কর্মভার করেছো দান করতে যেন পারি। 

ভুবনভরা সৃষ্টি তোমার সারি সারি

বিশ্বময় কর্ম তোমার রকমারি 

তোমার আশিষ ইচ্ছা বিনা করতে কিছুই নারি

যে কর্মভার করেছো দান করতে যেন পারি। 

তোমারই জন্য

তোমারই জন্য শিউলি শরৎ তোমরই জন্য কবিতা

এতো ভালোলাগে গান ও গল্প তোমরই জন্য সবিতা। 

তোমারই জন্য পূর্ণিমা চাঁদ রূপালী জ্যোৎস্না ধারা

তোমারই জন্য সবিতা আমি সারাদিন দিশাহারা।

তুমি আছো  তাই ঘরেতে অভাব

তবু আমি কত সুখী 

ক্ষণিকের তরে অন্তরে কভু হই নিতো জানো দুখী।

রাংতায়ে মোড়া এ জীবন মোর  

কত যে রংঙের মেলা

তোমারই জন্য সবিতা আমার রঙিন ফাগুন বেলা। 

তোমারই জন্য বাজে গো বাঁশরী বুক ভরা তার সুর

রিনিঝিনি রিনিঝিনি বাজে তোমার পায়ে নূপুর। 

বুকেতে আমার দিলে যে ছন্দ তাই হল কবিতা

আমার সকল কবিতায় তুমি ধরা দিলে সবিতা। 

কামনাবহ্নি

প্রেম নয়, প্রেম নাই— মনে হয় ভুল
শুধু ভালোবাসি আমি কামনার ফুল। 
আকাঙ্ক্ষার ধন তুমি, উদগ্র বাসনার
দেহহীন প্রেম কভু ছিল না আমার। 
নীল চাঁদ জোছনায় নীল নদীকূল
নীল রাত নির্জনে কামিনী মুকুল
ছড়াক সুরভি তার চঞ্চলি প্রাণ
প্রতি রাতে পাই যেন তারই আঘ্রাণ। 
অমৃত সুধারস দেহভান্ড ভরে
আকন্ঠ করি পান তৃষিত অন্তরে। 
চাই না বৈরাগ্য সাধন মোক্ষ মুক্তি আর
জ্বলুক জ্বলুক শিখা বহ্নি কামনার।

কবিতা

সুকান্ত পাল

জিতপুর, মুর্শিদাবাদ

himadri2.jpg
nupur1.jpg

 জানুয়ারী ২০২৩ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

Rajashri Bhattacharya.jpg

কবিতা

রাজর্ষি চট্টোপাধ্যায়

উত্তরপাড়া, হুগলী, পঃ বাংলা

কবিতাঃ রাজর্ষি চট্টোপাধ্যায়

নারী

 

পুরুষ তুমি যতই মারো,

মরবো কিন্তু লড়বো আরো৷

বুটের নিচে দাবিয়ে রেখে,

পারবেনা কো দমিয়ে রেখে৷

পুরুষ তুমি যতই মারো,

মরবো কিন্তু লড়বো আরো৷

যতই তুমি শাসিয়ে রাখো,

জন্ম দেবো লাখো লাখো৷

পুরুষ তুমি যতই বাড়ো,

জন্ম নাহি দিতে পারো৷

ধর্ষণের বর্ষণেতে যতই ভাবো জিতলে তুমি,

নারী ছাড়া ধরিত্রী তো হবেই হবে মরুভূমি৷

দুর্বল বলে তকমা দিয়ে,

তাচ্ছিল্য তো করতেই পারো৷

পুরুষ তুমি যতই মারো,

লাখো নারী লড়বে আরো৷

পুরুষ তুমি যতই মারো,

সংঘবদ্ধ হচ্ছি আরো৷

মা-বোন বলে ভুলিয়ে রেখে,

পারবেনা কো থামিয়ে দিতে৷

মারবে গুলি ফাটবে খুলি,

যন্ত্রণাতো দিতেই পারো।

পুরুষ তুমি যতই মারো,

জেনে রেখো লড়বো আরো৷
 

ইরাবতী তোমাকে
 

রাবতী ইরাবতী পড়ে কি আমায় তোমার মনে
ফাল্গুনের দিবালোকে দেখা তোমার সনে
মনে পড়ে ফাগুন বেলায় অপূর্ব সেই আলো?
কিশোরীর কাজল আঁখি লেগেছিলো বড়ই ভালো
ইরাবতী ইরাবতী তুমি জীবন্ত নদী 
একবারটি দেখতে পাবো সুযোগ হয় যদি
ইরাবতী ফিরতে কি চাও ফেলে আসা দিনে?
স্মৃতি বড় বেদনার
ফিরে আসে ক্ষণে ক্ষণে
তোমার সাথে শেষ বার যদি দেখা করতে চাই 
জীবন যদি সুযোগ দেয় শেষের কথা বলব তাই 
ইরাবতী দুই দশক বাদে যদি তাকাও একবারটি ফিরে
ফিরে যাবো অতীত দেশে ফেলে আসা দিনের তীরে 
ফিরেবে না আর ফিরবে না যে বাসন্তী অতীত আমার
বয়েস বেড়ে দিনগুলো রোজ আজ ফ্যাকাসে ধুসর বারবার

d2dd669cd332f54bf7950a1155f0b079.jpg

 জানুয়ারী ২০২৩ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

প্রতিষ্ঠা প্রতিদানের সংগ্রহশালার

নিঃসঙ্গ তারবার্তা 
ভেঙে পড়া শিশু 
পড়শি সন্দেহজনক যন্ত্রীর 
ব্যথার দিনে হাওয়া বদলের হাতছানি 
প্রতীক হারিয়ে ফেলে কেনাকাটার মুর্খামি 
আবদার পাতা ওলটানোর 

তবু 
প্রতিষ্ঠা 
প্রতিদানের সংগ্রহশালার 
নামজাদা শৃঙ্খলের 
পুনশ্চ কলাকৌশলের 
কেউ ছাড়তে রাজি নয় বিবিধ জমি 
পৃথিবী জানে ছিঁড়ে যায় একাকার বাঁধনে 
প্রসাদের দাবী 

আবিষ্কারের গোড়াতেই আইনঅমান্য আন্দোলন 
শূন্য কাহিনী নিস্তরঙ্গ। 

কবিতাঃ পার্থ সরকার
art1.jpg

কবিতা

পার্থ সরকার 

 জানুয়ারী ২০২৩ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

নারী

হে নারী, তোমার দাবিটা কী শুনি!
শুনি তোমার কিসের চাহিদা।
অল্পতে যা পেয়েছ,
তাতে কী আশ মেটে না?

ওহে নারী, তুমি ইস্কুলে যাবে?
লেখাপড়া ধরলে, বিয়েটা কী আর হবে?
ঘুরে দেখতে চাও এই জগতটাকে?
সাহস তো দেখছি কম নয়!
অসময়ে বাড়ির বাইরে বেরোবার
অনুমতি তোমায় কে দেয়?

নারী গো, তুমি ঘরের লক্ষ্মী 
ঘরেই তোমায় মানায়,
যখন তখন বাইরে বেরলে 

women.jpg
 কবিতাঃ অর্কপ্রভ চৌধুরী

প্রতিবেশীরা কি মেনে নেয়?
অনেক তো হল বয়স 
এখনও ছেলেমানুষী, সেকি?
খেলাধুলো ছেড়ে এবার 
একটু খুন্তি নাড়ো দেখি।

ওহে নারী, তুমি কি স্বপ্ন দেখ?
তবে তা দেখার কি কোনো মানে হয়?
তুমি তো আর পুরুষ নও 
তাই স্বপ্নের কথা ভুলে যাও।
নারী তোমার দাবি শুনলাম বটে,
তবে অস্বাভাবিক চাহিদা শুনিয়ে লাভ কি হল তাতে?

কবিতা

অর্কপ্রভ চৌধুরী

 জানুয়ারী ২০২৩ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

এলোমেলো

দৃশ্যটা এখন পেপার ওয়েট

চশমা ব্যতিত আর কিছু নেই কাছে।

 

এলোমেলো হাওয়া চাপা পড়ে থাক

কাগজের স্তুপ খোলা চোখ 

কাছটাকে বেশ ভালো দেখে।

 

দূরে দেখার ইচ্ছে নেই

ঘটে কম, তার বেশিটাই রটে।

 

হাতের কাছে কলম কালি

দোয়াত গিয়েছি ভুলে -----

চাপা পড়া কথাদের মতো

বেহিসেবে --------

 

খালি চোখ দেখছে ভালো 

বিশ্বাস গুটিসুটি বুকের ভেতর

গুনগুন বাজে ----- বেঁচে থাক

বেজে যাক্ কুয়াশার এই রোদে!

touch.jpg
 কবিতাঃ নারায়ণ চন্দ্র মিস্ত্রি
Narayan Mistry.jpg

কবিতা

নারায়ণ চন্দ্র মিস্ত্রি 

 জানুয়ারী ২০২৩ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

ল্টলেকে বইমেলা, খুঁজে আর পাইনে!
ফরমেশি তালিকাঃ দাঁড়িয়েছি লাইনে।
ফাস্ট ফুড স্টল ফেলে,
বাঁয়ে গিয়ে “রবি” পেলে-- 
কবিদের আড্ডাটা খুঁজে পাবে ডাইনে!

 

bigmarket.jpg
কবিতাঃ রুদ্রজিৎ পাল

কলকাতা বইমেলাঃ লিমেরিক

ডাঃ রুদ্রজিৎ পাল

কসবা, কলকাতা

 জানুয়ারী ২০২৩ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

নিরঞ্জন

দীর কাছে এসো,
কান পেতে দেখো ওই,
জল তরঙ্গের সুরমালা ভেসে আসে;
অপার্থিব সৌন্দর্যের মাঝে,
দেবীর আগমনের প্রাক্কালে,
ক্লান্ত কৃষকের দেহখানি পড়ে থাকে পাশে।
 
অশ্রুজলে সিক্ত মাটি,
বয়সের ভারে জর্জরিত মুখমণ্ডল,

 

art1.jpg
কবিতাঃ মন্থনকুমার দাশ

কবিতা

ডঃ মন্থনকুমার দাস

লক্ষ্ণৌ, উত্তরপ্রদেশ

ক্লান্ত দেহাবশেষের প্রতিটি অঙ্গে স্বপ্ন ভাঙার হতাশা;
ধনী মহাজনের লালসার অগ্নি,
খাজনা ও ঋণের দুর্বিষহ ভ্রুকুটি,
দেবীপক্ষের শারদ প্রাতে সমাধিস্থ এই রাগচন্দন, কৃষ্ণবর্ণ চাষা।
 
শরতের নীল আকাশের ওপর পারে,
রাশি রাশি মেঘমালার কোণে,
নারদের বীণায় বাজে যখন কোমল গান্ধার;
এই ধরিত্রীর বুকে চিতায় তখন,
কঠিন বাস্তবতার লেলিহান শিখা স্বর্গমুখী,
তার মাঝেই নিঃসহায়তার কলরব

"মা, আসছে বছর এসো আবার.."।

মাতাল

গল্প

মাতাল

কৃষ্ণতরু বর্মন

ডালাস, টেক্সাস

thief.jpg

 জানুয়ারী ২০২৩ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

মাতাল। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের একটি খুবই পরিচিত শব্দ। জড়িয়ে আছে হাজার রকমের নানান কাহিনী। কোনটা মজার, আবার কোনটার আড়ালে থেকে যায় এক কঠিন বাস্তব। আর সব কাহিনীই যে সব সময় খুব মজার হয় তা কিন্তু নয়।
বড় হয়েছি দক্ষিণ কলকাতার কাছাকাছি। তখনকার দিনে এখনকার মত অত কংক্রিটের জঙ্গল ছিল না। বেশ ফাঁকা ফাঁকা জায়গা জুড়ে বাগান সমেত সব বাড়ি। মস্ত খেলার মাঠ পেরিয়ে আম, জাম আর সবেদার বাগান। পুরোনো আমলের কিছু বাড়ি, একটা মন্দিরও চোখে পড়ত। বেশ নির্জন ছিল চারপাশ। গাড়ি-ঘোড়ার দৈনন্দিন যানজট, অহেতুক ঝুটঝামেলা, মানুষের ভিড় এসব একেবারেই ছিল না। খোলা পরিবেশে সবুজ রঙটা তখনও বেঁচে, আকাশ ছিল গাঢ় নীল। শীতের ভোরে দূর্বাঘাসের মাথায় শিশিরের স্নিগ্ধতা টাটকা থাকত অনেকক্ষণ। প্রকৃতির সবুজ কোলে মাথা রেখে খোলা আকাশের নিচে একেবারে নির্ঝঞ্ঝাটে আমাদের বড় হওয়া। প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নেওয়ার জায়গা ছিল অনেক। আজ হয়ত আর পাওয়া যায় না। সে যাই হোক, তখনকার দিনেও এই অল্প সংখ্যক মানুষের মধ্যেই কেউ কেউ আবার সন্ধ্যা গড়াতে না গড়াতেই একটু আধটু খেয়ে রাস্তা চওড়া করে বেড়াতেন। কথাবার্তা একটু আধটু লাগামছাড়া হলেও ওদের নিয়ে আমাদের যে একটা বিশাল ঝামেলায় পড়তে হত তা কিন্তু নয়। পাড়াতে উৎপলদা ছিলেন এমনই একজন চরিত্র।     
তখন শহরে খুব লোডশেডিং। আর রোজ হত বলেই ব্যাপারটা গা সওয়া হয়ে গিয়েছিল। দিনের বেলাটা মোটামুটি কেটে গেলেও সমস্যা ছিল সন্ধ্যার পর। একে তো সরু রাস্তা, তার ওপর অন্ধকারে কে কোথা দিয়ে হুড়মুড় করে এসে ঘাড়ে পড়বে কে বলতে পারে? রাস্তায় হাজার হাজার গাড্ডা, বৃষ্টির কথা ছেড়ে দিলুম...অসভ্য গরুগুলো একটু ইয়ে করলেই ব্যাস, পিচ উধাও। পড়তে পড়তে বেঁচে গেছি কতবার। গরমের সময় সব বাড়িতেই গরমে হাত পাখা টানার চলন ছিল। দিদা, ঠাকুমা কিম্বা মায়েদের ঘুমতে ঘুমতে হাত পাখা টানার কনসেপ্টটা আজও অবাক করে। তবে মা আবার ওটাকে আরেকটা বিশেষ কাজে ব্যবহার করতেন। প্রয়োজনে পিঠের ওপর ডুগডুগি বাজানোর সময়ও কাজে লাগত এই শখের কারুকাজ করা তালপাতার পাখাটি।

যাক সে সব কথা। তা সেদিনও পাড়ায় যথারীতি লোডশেডিং। অক্টোবরের শেষের দিকে বাতাসে শীতের ছোঁয়া। ফিরতে একটু দেরীই হয়েছিল। রাতের অন্ধকারে বাসস্ট্যান্ড প্রায় খাঁ খাঁ করছে। মাফলার দিয়ে নাক মুখ ঢেকে এগোতেই কানে এল গোঙানির শব্দ। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছি, এ উৎপলদাই হবে...রোজকার মতই আজও মাল টেনে টাল হয়ে আছে। কাত মেরে পড়ে আছে বেকায়দায়। একটু এগোই... আছে না গেছে? অন্ধকারে বডি তো দেখছি, কিন্তু মুণ্ডটা কোথায়? হাত ধরে টান মারতেই মুণ্ডুটা বেরিয়ে এল। যাক, একদম ঠিক জায়গাতেই এখন এটি শুধু কাজ করলেই হয়। কথায় বলে মাল খেলে নাকি হুঁশ থাকে না, কে বলল? এ বাবাজীর জ্ঞান একেবারে টনটনে। হ্যাঁচকা টান পড়তেই খেঁকিয়ে উঠলেন –

‘টান মারলি কেন? তোকে কে টান মারতে বলেছে, যদি পড়ে যেতাম।'

যাত্তেরি! হাসবো না কাঁদবো, যে বাছাধন পড়েই আছে সে আবার নতুন করে পড়বে কি? বলে উঠলাম,

- ‘আরে ও উৎপলদা, যাও না, এবার বাড়ি যাও অনেক রাত হয়েছে’ আমি তো বলেই খালাস। কিন্তু যাবে কি করে? আর এই শীতের রাতে রাস্তায় তো কোন রিক্সা টিক্সাও দেখছি না। যাই বল বাবা আমার একার পক্ষে এটাকে বয়ে নিয়ে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া... এ তো মহা মুস্কিল! এদিকে বিড়বিড় করতে করতে উৎপলদা কোন রকমে উঠে বসেছে। আমার দিকে তাকিয়ে একেবারে খ্যাঁক খ্যাঁক করে বলে উঠল,

- ‘তুই এত রাতে কি করছিস, আড্ডা মেরে ফিরছিস? দাঁড়া না, কাল কাকুর সঙ্গে একবার দেখা হোক’। আ মলো যা... শা... মাল খেলে কি হবে জ্ঞান বেশ টনটনে। আরে আমিই টেনে তুললাম আবার আমাকেই শাসানি। এইজন্য বলে কারোর উপকার করতে নেই, বিশেষ করে মাতালদের তো একদমই নয়। এত টেনেছে যে কাছে যাওয়াই মুস্কিল। শেষমেশ একটা রিক্সাতে অনেক বলে কয়ে তুলে বিদায় করে দিই। সে যাই হোক শীতের রাতে ঐ রিক্সাওয়ালাকেই সেদিন দেবদূতের মত মনে হচ্ছিল। তবে দেবদূত বাবাজীও একটু বেসামাল। রতনে রতন চেনে। যাক গে, একজন তো পাওয়া গেল যে ওর দুঃখ কষ্ট বোঝে। পরেও যে উৎপলদাকে নিয়ে যে আমার মত অনেককেই ঝামেলাতে পোহাতে হয়েছে, তা বলাই বাহুল্য।
গোরার বাবা একটু নেশা ভাং করতেন। সেটা আমরা পাড়ার চ্যাংড়া ছেলেরা অনেকেই জানতাম। তবে খুব বেশী নাটকীয় ভূমিকায় উনি এর আগে কখনো অবতীর্ণ হন নি। একদিন বিকেলে ক্লাবের বারান্দায় বসে আড্ডা মারছি। সেদিন বোধহয় ওনার একটু চড়েই গিয়েছিল। একটা ম্যাটাডোর ভ্যান গেছে রাস্তায় আটকে। তাকিয়ে দেখি সামনে গোরার বাবা। নট নড়ন চরণ। উত্তমকুমার স্টাইল। হাত দুটো তোলা। নেশাতুর গলায় গাইছেন – ‘যাব বলে তো আসি নি’। কাতর মুখে ড্রাইভার যতবার বলছে – ‘ও দাদা, একটু সরে দাঁড়ান না।’ ঠিক ততবারই কাকুর ঐ এক স্টাইল – ‘যাব বলে তো আসি নি।’ গানের কথাতেই বুঝিয়ে দিচ্ছেন যে উনি সরার পাত্তর নন। 'ওগো বঁধু সুন্দরী' ছবিতে কিশোরদার গানের দ্বিতীয় সংস্করণ আর কি! তবে এই গানের স্টাইল দেখলে বাপীদা যে তার ভারী শরীর নিয়ে ভিমরি খেতেন, তা আমি হলফ করে বলতে পারি। পরে অনেক কষ্টে ওনাকে বাগে আনা হয়েছিল। সত্যি কথা বলতে কি কাকুকে প্রায় একপ্রকার চ্যাংদোলা করেই...সে এক যা তা অবস্থা!
বয়স তখন অল্প। এন্টারটেইনমেন্টের লিমিটেড অপশন বলতে চূড়ান্ত আড্ডা আর খেলা। পাড়ার মাঠে ফুটবলটাই বেশি হত। নানা ধরণের টুর্নামেন্ট লেগেই থাকত সারা বছর। বিভিন্ন জায়গা থেকে নামী দামী খেলোয়াড়রা অংশ নিতেন। আমাদের আশেপাশের টিম নিয়ে চলত ফুটবল লীগ। বেশ কাটত দিনগুলো। আর ফাইনাল খেলার দিন, পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে নিয়ে আসা হত ইষ্টবেঙ্গল কিম্বা মোহনবাগান দলের নামী খেলোয়াড়দের। আমার মনে পড়ে মানস ভট্টাচার্য, কৃষ্ণেন্দু রায়, জেভিয়ার পায়াস, তপন দাস, গৌতম সরকার, তরুন দে, শিবাজী ব্যানার্জী,

ভাস্কর গাঙ্গুলীর মত সব নামী খেলোয়াড়রা কোন না কোন সময় প্রধান অতিথি হয়ে আমাদের মাঠে উপস্থিত ছিলেন। খেলা শেষ হবার পর সব মিটে গেলে শুরু হত ক্লাবের সামনে বনভোজনের আয়োজন। সে এক বিচিত্র উন্মাদনা! বড় বড় ডেচকিতে চলছে হাবিজাবি রান্না আর হুলুস্থুল। ওপেন টু অল। কচিকাঁচা, বাচ্চা, বুড়ো সব্বাই হাজির। চেঁচামেচি, হৈ চৈ, এক জমজমাট সন্ধ্যা। সে একটা সময় গেছে, আজকাল যেন সব কিছুই বড্ড যান্ত্রিক। মনের সঙ্গে যোগাযোগ কম। পরিবেশও গেছে পালটে। সব ছোট ছোট গ্রুপ, লবি। পছন্দ অপছন্দের অজস্র সুক্ষ দেওয়াল। ইনভিজিবল কাঠিতন্ত্র। মানুষকে ছোট করেই মানুষের আনন্দ। আর তাছাড়া সর্ষের মধ্যেই ভূত। হাজার সর্ষে ছুঁড়ে মারলেও ভুতেরা খিলখিলিয়ে হাসে। উল্টে ভূতের সংখ্যাই বাড়ে। তাই চারদিকেই ওদেরই রাজত্ব। যাক গে যেটা বলছিলাম। সব খাওয়া দাওয়া মিটে গেলে তখনই হত সমস্যা। এত রাতে এই বড় বড় ডেকচি, থালা, হাতা, খুন্তি ধোবে কে। ঠিক হত সকালে যা করার করা যাবে। একটা রাতের তো ব্যাপার। পরের দিন সকালে যেটা করা হত, সেটা মোটেই ঠিক ছিল না। রাস্তা দিয়ে কোন মাতাল গেলেই ‘সাত সকালে মাল খেয়েছিস কেন?’ বলে ধরে আনা হত। ‘ছেড়ে দিন না দাদা, এই কান মুলছি আর খাব নি, এই উঠবোস করছি’ বলে উঠবোস করলেও ছাড়া হত না কারণ ওকে দিয়েই এঁটো বাসনগুলো ধুইয়ে নেওয়া হত। তবে দু-একজন একেবারে যে হাত লাগাত না তা নয়। একবার এক মাতাল ইয়া একটা ডেচকি ধুতে ধুতে বলল –

- 'আমি হাফ ধুচ্ছি, তুমি হাফ ধুয়ে নাও’। অবাক হয়ে বললাম,

– ‘ধুর এই ভাবে হয় নাকি। একটা ডেকচির আবার হাফ-ফুল ধোয়া যায় নাকি! যত্তসব! তাহলে তুমি সকালে হাফ চান কর আর বাকিটা বিকেলে...’

মুখটা একটু কাঁচুমাচু করে বলল,

– ‘তোমরা সারারাত খেলে আর আমাকে দিয়ে এই এঁটো ডেচকিগুলো...’। মৃদু ধমক দিয়ে বললাম – ‘ধ্যাত্তারি, থাকলে কি আর তোমায় দিতাম না? দেখলে তো আর নেই। ভাল করে ধোয় তো দেখি, দেখো আবার যেন লেগে না থাকে।’ ব্যাজার মুখে বাবাজী আবার কাজে লেগে পড়ত। তবে চলে যাওয়ার আগে কয়েকটা টাকা ভাঁজ করে বুক পকেটে গুঁজে দিতেই ছোপ পড়া কেলো দাঁতে আবার মিলিয়ন ডলার হাসি। কত অল্পে যে মানুষ সন্তুষ্ট হত আজ সত্যি ভাবতে অবাক লাগে। চাহিদা আর লোভের চোরাবালিতে আজ আমরা এতটাই নিমজ্জিত যে কিছুতেই আমরা সন্তুষ্ট হই না। সত্যি কথা বলতে কি এই অল্প বয়েসে এই ধরনের কিছু দুষ্টুমি করলেও কাউকে দিয়ে আমরা ফ্রিতে কিছু করাতাম না।

মাতালদের কান্ডকারখানা নিয়ে কথা বলতে গেলে অনেক কথাই বলা যায়। আবার অনেক ঘটনাই আজ আর মনে পড়ে না। তবে মাঝে মাঝে মনের ক্যানভাসে ভেসে উঠে কিছু কিছু চেনা মুখ আর তার সঙ্গে জুড়ে থাকা নানা বিচিত্র কান্ডকারখানা। তখনকার দিনে মাঠে প্যান্ডেল করে যাত্রাপালার চল ছিল। প্যান্ডেল বলতে প্রথমে বাঁশ পুঁতে তার ওপর ত্রিপল। প্রচুর মানুষ আসতেন এই যাত্রাপালা দেখতে। কলকাতার প্রায় সব নামী যাত্রা সংস্থাগুলোই বেশ কয়েকবার আমারদের পাড়ায় যাত্রা করে গেছে। তা একবার মনে আছে এক মাতাল যাত্রা শুরু হওয়ার পরেই মাঠের কোনের দিকের একটু অন্ধকার দেখে ত্রিপল ফাঁক করে বেশ কিছু বিনা টিকিটের দর্শকদের ঢুকিয়ে দিয়েছিল। তারপর স্বেচ্ছা সেবকদের নজরে পড়ায় বেচারা পালিয়ে বাঁচে। কে বলে ওদের নাকি হুঁশ থাকে না? দিব্বি পালিয়েছিল ধরা পড়ার আগেই। পরের দিন ক্লাবে সালিশি ডেকে কান ধরে উঠ-বোস একেবারে বউএর সামনে। বউ একেবারে লতা কন্ঠী, কাই কাই করে সবার মাথা খেয়েছিল। একবার অভিনেতা অনুপকুমার আমাদের পাড়ায় নাটক করতে এসেছিলেন। সঙ্গে ছিলেন ওনার স্ত্রী অলকা গাঙ্গুলী। বেশ মজার নাটক।  মজার মজার ডায়লগ, দর্শকদের ঘন ঘন হাততালি আর হাসির মাঝে অনুপকুমারের অসাধারণ অভিনয়। হঠাৎ তাল গেল কেটে, সব চুপচাপ। স্টেজে তৃতীয় ব্যাক্তির আগমন। অনুপকুমার, অলকাদেবী দু-জনেই একটু থমকে গেছেন। নেশার ঘোরে একটা মাতাল কোন ফাঁকে স্টেজে উঠে একেবারে অনুপকুমারের সামনে। তাকে আবার নামিয়ে তবেই নাটক শুরু। এ রকম কত ঘটনাই না ঘটেছে।

আর একটা ঘটনা বলি। কার্তিকদা খুব নেশা করতেন। সারাদিন কাজ করে এসে আকণ্ঠ না গিল্লে তার চলত না। বউ ভেগে গিয়েছিল আগেই। প্রাণের সাথী বলতে ঐ একটা নেড়ি কুকুর। নিরীহ এই প্রভুভক্ত প্রাণীটি কিন্তু প্রায়ই তার প্রভুর হাতে উত্তম মধ্যম খেত। তবে তার একটা কারণও ছিল। এই সারমেয়টি যা কিছু কুড়িয়ে পেত মুখে করে এনে সোজা কার্তিকদার ঘরে। পাড়াতে যার যেটা হারাতো প্রথমেই খোঁজ নিত কার্তিকদার বাড়িতে। আর শুনেছি সেখানে পাওয়াও যেত। আমি একবার স্ব-চক্ষে একটা খুন্তি মুখে ব্যাটাকে দৌড়তে দেখেছি। কিন্তু ফেলুদা -  খুন্তি তো আর রাস্তায় পরে থাকে না, তাহলে ও পেল কি করে। তুমি ভাব ফেলুদা - আমি বলছি - ও ব্যাটা নির্ঘাত চুরি করেছিল। আমি শুনেছি অনেকেরই হাত-টান আছে কিন্তু কুকুরেরও যে মুখ-টান তা না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। প্রায় প্রতিটি সন্ধ্যায় এই হাজার হাজার অভিযোগ আর নেশার ঘোরে যত তবলার চাঁটি কার্তিকদা কুকুরটার ওপরই বাজাত। তবে অসম্ভব ভালোও বাসত। একটু চোখের আড়াল হলেই খোঁজ খোঁজ। খুঁজে পেলে কোলের মধ্যে নিয়ে ওটাকে বকতে বকতে ফিরত। তা এই কুকুরটা মরে যাবার পর কার্তিকদার কান্না দেখতে পাশের পাড়ার লোকও এসে হাজির। বলাবাহুল্য তারপর পাড়ার লোকের আর কারোর কিছু হারাতো না।
সময় বড় নির্মম, দ্রুত চলে যায়। স্কুল কলেজ পেরোতে না পেরোতেই হঠাৎ যে কবে দুম করে চুলে পাক ধরে গেল কে জানে। সংসার জীবনের এটা ওটা সেটার মধ্যেই প্রত্যাশিত প্রেশার কিম্বা সুগার। কিছু না কিছু আছে। রাজ্যের বড়ি গেলো। ম্যারাথন রেসের বাতিল ঘোড়াগুলোও দেখে ফিঁক করে হাসে। একটাই বাঁচোয়া যে স্মৃতিগুলো কিন্তু দুম করে ছেড়ে চলে যায় না। এখনো চোখ বুঝলে চোখের পাতায় এসে বসে, একটু নিরিবিলিতে। কিছুটা সময় সম্পূর্ণ নিজের মত করে ভাবতে থাকি, আর সেটার বিষয়বস্তু যদি 'মাতাল'ই হয় তো হোক না ক্ষতি কি? আর ভিতরের হাসিটা ভিতরেই থাক, বাইরে থেকে তো আর কেউ দেখছে না।

 জানুয়ারী ২০২৩ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

প্রবন্ধ

গোপনীয়েষু

অপর্ণা চক্রবর্তী

টালিগঞ্জ, কলকাতা 

rangasthalam2.jpg
গোপনীয়েষু
aparnachakroborty.jpg

"মার একলা আকাশ থমকে গেছে

রাতের স্রোতে ভেসে

শুধু তোমায় ভালবেসে"

দু-এক মুঠো শান্তি ছাড়া এখনও জমাতে পারিনি বিশেষ কিছুই। খরুচে বদনাম আছে। শোধ করার ক্ষমতাও নেই। তবু আপনার কাছে ধার চেয়ে লিখতে বসলাম। হ্যাঁ, লিখছি আপনাকেই...

আপনার ওই জানলাটা - আমাকে ধার দেবেন কবি ? অমন একটা জানলা পেতে বড় লোভ হয়।

রোদ উঁকি দেওয়া সকালের জানলা, ছুটির দুপুরে অলস জানলা, মন খারাপের উদাস জানলা, কাশ ফুলের দোলার জানলা, জোনাকির আলোয় রাত জাগা জানলা, ভালোবাসায় ভাসতে ভাসতে খোলা আকাশ দেখার একলা উদাস ওই জানলাটা - আমাকে ধার দেবেন?

আমার নিজস্ব যেটুকু পৃথিবী আছে, সেখানে আমি বাউন্ডুলে। আমার নিজস্ব যেটুকু আকাশ আছে, সেখানে আমি স্বাধীন। সেই স্বাধীন ডানায় ভর করে একদিন আপনার কাছে উড়ে যেতে পারি ওই জানলার জন্য। ঠোঁটে বয়ে নিয়ে যেতে পারি - ঘর বাঁধার খড়কুটো। তারপর বেলাশেষে জানলার পাশে বসে ভাগ করে নিতে পারি বিষন্নতা।

বলুন - ধার দেবেন জানলাটা?

"ভেবেছিনু মনে মনে দূরে দূরে থাকি"

কেন জানি না সবুজ দেখলে শুধু আপনাকেই মনে পড়ে কবি। শহর পেরিয়ে বহুদূর সবুজের ঘেরাটোপে যেখানে আপনার বারান্দা, নিজের সাথে যেখানে আপনার খেলনা বাটির সংসার, জানলার বাইরে হাত রাখলে যেখানে ইলশেগুঁড়ি‌ স্পর্শ করা যায়, আমি আপনার সেই ঘরখানি কল্পনা করি প্রতিদিন।

প্রতিদিন আমার শহুরে চানঘরে একলা হলেই চারপাশে শুকনো পাতা ঝরার শব্দ পাই। সেই শব্দ আমাদের আলাপের মতোই স্নিগ্ধ, নরম, প্রত্যাশাহীন। আমার মনের ভিতর যে পথ ধরে আপনার চলাচল, সন্ধ্যা হলেই সেই পথের পাশে আমি প্রদীপ জ্বালি।

গাঢ় অন্ধকারে বন্ধ একটি দরজার ওপাশে আমার অজস্র না বলা কথা ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে বহুদিন আগে। ওদের ঘুম ভাঙিয়ে আপনাকে উপহার দেব কোনোদিন।

নিদ্রাহীন রাতে- খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে- জ্যোৎস্নার গায়ে লিখে রেখেছি আমার সমস্ত সমর্পণের কথা। পাখির মতো লালিত অনুভূতির পালক দিয়ে চিঠি লিখেছি শুধু আপনাকেই।

আমার প্রতি আপনার ঔদাসীন্য আমাকে ব্যথিত করেনি কখনও। কারণ - এ পূজা আমার একান্ত নিজস্ব। জীবন বড় কম সময়ের সম্পদ, নিজেকে আর একটিও অপ্রেমের দিন দেব না, এইটুকুই প্রতিশ্রুতি।

"কোন্‌ গোপনবাসীর কান্নাহাসির

গোপন কথা শুনিবারে--বারে বারে

কান পেতে রই ..."

======================

দূরে থাকলেও বুঝতে পারি আপনি বাড়ি ফিরলেন কিনা, ফেরার পথে দূরের দীগন্তরেখাটি বিষন্ন ছিল কিনা, আকাশ মেঘলা কিনা। বুঝতে পারি লিখতে বসলেন কিনা, জল খেলেন কিনা, আনমনে কিশোর কুমার গুনগুন করলেন কিনা। আপনি গায়ক হিসেবে তেমন ভালো নন। উচ্চারণেও থতমত। তবু গানই তো! আর তা নিজের জন্যই যখন গাওয়া...

এক এক দিন আপনার মুখ কিছুতেই মনে পড়ে না। কাজের মাঝেও এমন হয়। কিছুতেই মনে করতে পারি না আপনাকে। ভাত মাখা হাতে বা কীবোর্ড থেকে চোখ সরিয়ে তক্ষুনি ফোনটা দেখে নিতে ইচ্ছে হয়। সম্ভব হয়না বলে অস্থির লাগে। মন চাইছে একবার দেখে নিই, একবারই তো দেখবো, দেখি একটিবার, এইটুকু তো দেখতে চাওয়ার ইচ্ছা...

আমার এই অস্থির সময়েই ঠিক বুঝতে পারি - আপনার খাওয়া শেষ হয়েছে, কাজ শেষ হয়েছে।

আপনি ঠিক এই সময় আমার মতো ব্যস্ত নন, অস্থির নন, শান্ত চোখদুটো বন্ধ হয়ে আছে আবেশে। বুকের ওপর খোলা পাতায় উপুড় হয়ে আছে বনলতা সেন, নীরা, নন্দিনী বা মানসী। আসলে বুঝতে পারাটা একটা অভ্যাস। নিরব থাকলে সেই অভ্যাস আরও তীব্রতর হয়। কখনও কথা হয়নি আমাদের। আপনার ফোনটা আমি ইচ্ছা করেই ধরিনি। নিরবতায় আপনার সঙ্গ করতে বড় ভালবাসি। আমি একদিন ঠিক আপনার বুকের ওপর ওই কবিতার খোলা বইটা হয়ে যাব। তারপর কান পেতে জেনে নেব সমস্ত গোপনীয় কথা...

ছায়া পড়ে আছে একলা নদীর জলে,

ছুঁয়ে দিলে জেনো দুহাতেই থেকে যাব।

আমি হেমন্তে পাতা ঝরা লিখে রাখি,

তুমি তো তাকেই আমার চিঠি ভাবো।

"সন্ধ্যার মেঘে করিবো দুকূল,

ইন্দ্রধনুরে চন্দ্রহার।

তারায় করিবো কর্ণের দুল,

জড়াবো গায়েতে অন্ধকার।"

আপনি যেদিন শহরের রাস্তায় পড়ে থাকা পলাশ কুড়িয়ে অফিস টেবিলে রেখে ছবি তুলেছিলেন, সেদিন আমিও ওই ছবি দেখে একটা বেমানান স্বপ্ন বুনেছিলাম। আজ সেকথাই আপনাকে লিখতে ইচ্ছে হচ্ছে।

ধান ক্ষেত, কলাবাগান, জোড়া বটতলা, বাঁশ গাছের আড়াল দেওয়া সবুজ জলের পুকুর ঘাট পেড়িয়ে, বুড়োশিব মন্দিরের পাশ দিয়ে সরু রাস্তা ধরে আর একটু এগিয়ে একটা একচালা বসতবাড়ি। দেড় দু'খানা ঘর, লম্বা বারান্দা, উঠোনের একপাশে হাঁসমুরগি, তুলসী মঞ্চ, কুলুঙ্গিতে গুছিয়ে রাখা টুকিটাকি সাধ।

রান্না ঘরে মাটির উনুন। কঞ্চিবেড়ার ফাঁক গলে সকালের আলো উপুড় হয়ে পড়েছে সংসারের হাঁড়ি পাতিল আর শিল-নোড়ার ওপর। চুড়ি পরা দুটো হাতের ঝুনঝুন ধ্বনির সাথে মিলেমিশে যাচ্ছে মশলা বাটার শব্দ। শিল ধুয়ে জিরা-আদার জলটুকু সে ঢেলে দিচ্ছে ফুটন্ত তরকারির ওপর। আপনার কাচা জামা কাপড়ের সাথে ডুরেপাড় ভেজা তাঁতের শাড়িটা মেলে দিচ্ছে রোদে। মাদুরের ওপর বাংলা বই আর সেলাইয়ের বাক্স খুলে রেখে, চুল শুকচ্ছে দুপুরবেলা।

বেলা গড়িয়ে দীগন্তরেখা বরাবর সোনালী রঙ ধরেছে। হাঁস-মুরগি গুলো সদ্য খোঁয়ারে ঢুকেছে । তুলসী মঞ্চ আলো করেছে মাটির প্রদীপ। অন্ধকারে দু'একটা জোনাকি টুপটাপ ফুটতে শুরু করেছে।

ঠিক তখনই - সরু কাঁচা রাস্তায় সাইকেলটা এসে পড়ে ঝংঝং আওয়াজ করে, ঘন্টি বাজে টিংক্রিং। দূর থেকে এই শব্দ শোনার জন্যই সে উৎকর্ণ থাকে সারাবেলা। তার অপেক্ষা শেষ হয়। সান্ধ্যকালীন ঈশ্বর বন্দনায় আর তার মন বসে না। চুড়ি পরা হাত দুখানি তাড়াহুড়োয় নমস্কার সেরে উঠে পড়ে। এরপর একে একে এগিয়ে দেয় আপনার হাত-পা ধোয়ার জল, গামছা, মুড়ির বাটি, গরম চা। রাত বাড়লে পরম মমতায় গরম ভাতের ওপর ঝোল ঢেলে দেয়। প্রয়োজন মতো হাতে হাতে এগিয়ে দেয় একটা কাঁচা লঙ্কা, জলের গ্লাস, পাখার বাতাস। খাওয়া শেষে এনে দেয় যত্ন করে কাটা দু'টুকরো কুঁচো সুপারি বা মৌরি দানা। তারপর অন্ধকার বারান্দায় গা ঘেঁষে বসে - আপনার সাথে ঝিঁঝিঁর ডাক শোনে, জোনাকির আলো দেখে। গৃহস্থালির ফাটল বেয়ে চাঁদের আলো চুঁইয়ে পড়ে আপনাদের গায়ে।

জীবনে কিছুটা অভাব, কিছুটা মান-অভিমান, অল্প চাহিদা, অনেকটা অপ্রাপ্তি, বেশ কয়েকটা সরু ফাটল আর চোখ ভর্তি স্বপ্ন থাকার প্রয়োজন খুব বেশী। এইসব রঙীন পাথর বুকের ভেতর নড়াচড়া করলেই জীবন উপলব্ধির ঐশ্বর্যে পরিপূর্ণ হয়।

চোখের সামনে আমার মোবাইল স্ক্রীন একটু একটু করে ঝাপসা হচ্ছে জলে। পলাশ ফুল ধরে রাখা আপনার শুভ্র করতলের ছবিটা ফেড আউট হতে শুরু করেছে। ফোনের আলো বন্ধ হয়ে অটোলক্ হবার আগে আপনাকে বলেছিলাম -

ওভাবে নরম আগুন ছুঁতে নেই কবি...

 জানুয়ারী ২০২৩ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

গল্প

অনুগল্প

রাজর্ষি চট্টোপাধ্যায়

উত্তরপাড়া, হুগলী, পঃ বাংলা

nupur1.jpg
অনুগল্প
Rajashri Bhattacharya.jpg

বাউটি

 

জ সকাল থেকেই সুমিতার মেজাজ আগুন হয়ে আছে। শাশুড়ির বাউটিগুলো খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। শাশুড়ির আলমারি তে নেই। বাড়িতে লোক বলতে নিজেরা চারজন ও লক্ষীকান্ত পুর থেকে আসা ১২ বছরের রাত দিনের কাজের মেয়ে মালতি। তারমধ্যে নিজের মেয়ে মেঘমা  ব্যাঙ্গালুরুতে ইঞ্জিনারিং পড়ে। অনেক দিন আসেনি। সন্দেহের তীর প্রথমেই মালতির দিকে। ধমকেছে বল নিয়েছিস কিনা। নাগো আমি নিইনি। জানা আছে তোদের, শাসাতে থাকে। বল এখনো সময় আছে বার করে দে। নাগো আমি নিইনি। কাঁদছে ছোটো মেয়েটা। স্বামী রঞ্জন বলে ভালো করে খুঁজে দেখ। সব খুঁজেছি কোথাও নেই। বাড়িতে থমথমে পরিবেশ বৃদ্ধা শাশুড়ি সুমিতার ভয়েই কাঁটা। সুমিতার যা উগ্র মেজাজ। সুমিতা শাশুড়িকে এবার সন্দেহ করবে। সুমিতার মেয়ে হয়েছিল  বলে শাশুড়ির দুঃখ আছেই। মেয়ের দিকে দুটো ছেলে। ওদের প্রতি টান বেশি

সুমিতা সবসময় সেটাই মনে করে। নিশ্চই ওখানে পাচার করেছে বলে দোষ দেবে। রঞ্জন বলে এসব করে লাভ নেই পুলিশ এ খবর দিই। পুলিশ কি করবে, আজ পর্যন্ত ওরা কিছু করতে পেরেছে? শুধু টাকা খাবার ধান্দা। যা করবার আমি করবো জানি কি করে বার করতে হয়। বলেই মালতির চুলের মুঠি ধরে মাটিতে ফেলে মারতে থাকে। মেয়েটা আছাড়ি পিছাড়ি করে আর্ত নাদ করছে। আওয়াজ পেয়ে পাশের তাপসের বাড়ির লোকেরা ছুটে আসে। কি করছো মরে যাবে। একে ছোটো মেয়ে, শিশু শ্রমিক রাখা বেআইনি  তারপর.....। রঞ্জন থানায় যাও। রঞ্জন বুজতে পারে থানায় না গেলে সুমিতা একটা খুনোখুনি বাঁধাবে। আর দেরি না করে থানায় ডাইরি করে আসে। যা করার পুলিশ করবে। সন্ধ্যেবেলায় পুলিশ আসে সবাইকে জিগ্যেস শুরু করেছে। এক এক করে সবার পালা কাউকেই পুলিশ বিশ্বাস করে না। সুমিতার দিকে পুলিশই শীতল কঠিন নির্মম চাহনিতে তাকাতেই সুমিতার বুক ঢিপ ঢিপের শব্দ নিজেই শুনতে পাচ্ছে জিভ গলা শুকিয়ে যেতে আরম্ভ করেছে ......

প্রবন্ধ

মহাজীবনের

মণিকথা

সুদীপ ঘোষাল 

নন্দনপাড়া, পূর্ব বর্ধমান

nazrul.jpg
Sudip Ghosal.jpg

 জানুয়ারী ২০২৩ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

মহাজীবন
robi.jpg
vivek.jpg
Kumud.jpg
satyajit.jpg
sukumar-roy.jpg
upendrakishore.jpg
sukanta.jpg

বি নজরুল বন্ধুদের আড্ডায় ধূমকেতুর মতো আবির্ভূত হতেন আর সুরের অপূর্ব কন্ঠ নিয়ে তিনি মানুষকে আজীবন ভালবেসে গেছেন। যৌবন ধর্মের অতিরেকে সারা দেশটাকে চষে বেড়াতেন আনন্দের হিন্দোলে।বিদ্রোহী কবিতা ও গান লিখে তিনি বিদ্রোহী উপাধি পান দেশের জনগণের কাছে। কবিগুরু যৌবন মূর্তি নজরুলকে অতিশয় স্নেহ করতেন এখন পাঠকসমাজের নয়নতারা স্বরূপ গণ্য হয়েছিলেন। বিদেশি সরকারের রক্তচক্ষু অবহেলা করে দুরন্ত কবি, কবিতা গান ও প্রবন্ধের সাময়িকপত্রে আগুনের ফুলকি ছড়াতে লাগলেন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড শুরু হতে পারত তার লেখনীর গুণে। এর জন্য কিছু কলকাতায় কারারুদ্ধ থাকতে হয়েছিল বোধ হয় রাজনৈতিক চেতনার ক্ষেত্রে ইদানিং আর কোন কবি ও লেখক এতটা উদ্দীপনার সঞ্চার করতে পারেননি। তাঁর কাব্য ও গানে  জাতি সম্প্রদায়ের উপলব্ধি ব্রিটিশ বিদ্বেষী মনোভাব সৃষ্টি করেছে। যে কবিতাসমূহ বিদ্রোহীর অস্থিরতা বোধ করে, সর্ববিধ শাসক, যৌবনকে বরমাল্য দিয়েছে তার সঙ্গে তার কবিতাকে। হিন্দু-মুসলমানের জাত বিচারকে অবহেলা করে উপেক্ষা করে তাদের মিলনের এক ছাতার তলায় এনেছিলেন। কবি নজরুলের অগ্নিবীণা ও হয়তো সেই ভাঙ্গার গান বিষের বাঁশি প্রভৃতি কাব্যসংগ্রহ সংগীত সংকলনের প্রচুর রসের আমদানি করা হয়েছে। বাবু বলে, বিংশ শতাব্দীর বাংলা মননে কাজী নজরুল ইসলামের মর্যাদা ও গুরুত্ব অপরিসীম। তার জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী বিশেষ মর্যাদার সঙ্গে উভয় বাংলাতে প্রতি বৎসর উদযাপিত হয়ে থাকে। আমরা তাঁকে প্রণাম জানাই। এই বলে মাষ্টারমশাই চুপ করলেন। তারপর বিরাজুল আমাদের শোনায় কবির গল্প। কবি নজরুল এক দরিদ্র মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার প্রাথমিক শিক্ষা ছিল ধর্মীয়। কৈশোরে বিভিন্ন লেটো দলের সাথে কাজ করতে করতে তিনি কবিতা এবং সাহিত্য সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান লাভ করেন। সেনাবিভাগে কিছুদিন কাজ করার পর তিনি সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। এসময় তিনি কলকাতায় থাকতেন। এসময় তিনি ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। প্রকাশ করেন বিদ্রোহী এবং ভাঙার গানের মতো কবিতা; ধূমকেতুর মতো সাময়িকী। জেলে বন্দী হলে পর লেখেন জবানবন্দী, এই সব সাহিত্যকর্মে শোষক বিরোধিতা ছিল সুস্পষ্ট। ধার্মিক মুসলিম সমাজ এবং অবহেলিত ভারতীয় জনগণের সাথে তার বিশেষ সম্পর্ক ছিল। তার সাহিত্যকর্মে প্রাধান্য পেয়েছে ভালোবাসা, মুক্তি এবং বিদ্রোহ। ধর্মীয় লিঙ্গভেদের বিরুদ্ধেও তিনি লিখেছেন। ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক লিখলেও তিনি মূলত কবি হিসেবেই বেশি পরিচিত। বাংলা কাব্যে তিনি এক নতুন ধারার জন্ম দেন। গজল, এর পাশাপাশি তিনি অনেক উৎকৃষ্ট মুক্তিগীতিও রচনা করেন। নজরুল গান রচনা এবং অধিকাংশে সুরারোপ করেছেন যেগুলো এখন "নজরুল গীতি" নামে পরিচিত এবং বিশেষ জনপ্রিয়ও পরিচিত হন।চা-রুটির দোকানে চাকরি করার সময় আসানসোলের দারোগা রফিজউল্লার সঙ্গে নজরুলের পরিচয় হয় এবং তাঁর সুবাদেই নজরুল ১৯১৪ সালে ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের দরিরামপুর স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন। রমেন আলোচনায় অংশ নেয়। সে বলে, এক বছর পর তিনি পুনরায় নিজের গ্রামে ফিরে যান এবং ১৯১৫ সালে আবার রানীগঞ্জ সিয়ারসোল রাজস্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হন। এ স্কুলে নজরুল একটানা অষ্টম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনা করেন। প্রিটেস্ট পরীক্ষার সময় ১৯১৭ সালের শেষদিকে নজরুল সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ছাত্রজীবনের শেষ বছরগুলিতে নজরুল সিয়ারসোল স্কুলের চারজন শিক্ষক দ্বারা নানাভাবে প্রভাবিত হন। তাঁরা হলেন উচ্চাঙ্গসঙ্গীতে সতীশচন্দ্র কাঞ্জিলাল, বিপ্লবী ভাবধারায় নিবারণচন্দ্র ঘটক, ফারসি সাহিত্যে হাফিজ নুরুন্নবী এবং সাহিত্যচর্চায় নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯১৭ সালের শেষদিক থেকে ১৯২০ সালের মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় আড়াই বছর নজরুলের সামরিক জীবনের পরিধি। এ সময়ের মধ্যে তিনি ৪৯ বেঙ্গলি রেজিমেন্টের একজন সাধারণ সৈনিক থেকে ব্যাটেলিয়ন কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার পর্যন্ত হয়েছিলেন। রেজিমেন্টের পাঞ্জাবি মৌলবির নিকট তিনি ফারসি ভাষা শেখেন, সঙ্গীতানুরাগী সহসৈনিকদের সঙ্গে দেশি-বিদেশি বাদ্যযন্ত্র সহযোগে সঙ্গীতচর্চা করেন এবং একই সঙ্গে সমভাবে গদ্যে-পদ্যে সাহিত্যচর্চা করেন। করাচি সেনানিবাসে বসে রচিত এবং কলকাতার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত নজরুলের রচনাবলীর মধ্যে রয়েছে ‘বাউন্ডুলের আত্মকাহিনী’ নামক প্রথম গদ্য রচনা, প্রথম প্রকাশিত কবিতা ‘মুক্তি, এবং অন্যান্য রচনা: গল্প ‘হেনা’, ‘ব্যথার দান’, ‘মেহের নেগার’, ‘ঘুমের ঘোরে’; কবিতা ‘আশায়’, ‘কবিতা সমাধি’ প্রভৃতি। উল্লেখযোগ্য যে, করাচি সেনানিবাসে থেকেও তিনি কলকাতার বিভিন্ন সাহিত্যপত্রিকা, যেমন:  প্রবাসী,  ভারতবর্ষ,  ভারতী,  মানসী, মর্ম্মবাণী, সবুজপত্র, সওগাত ও বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার গ্রাহক ছিলেন। তাছাড়া তাঁর কাছে রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, এমনকি ফারসি কবি হাফিজেরও কিছু গ্রন্থ ছিল। প্রকৃতপক্ষে নজরুলের আনুষ্ঠানিক সাহিত্যচর্চার শুরু করাচির সেনানিবাসে থাকাবস্থায়ই। আমরা এখন আলোচনায় মগ্ন জোয়ার সংস্থার নির্দিষ্ট ক্লাবঘরে।এখানে লাইব্রেরীও আছে। বিশু আবার বলে, প্রথম মহাযুদ্ধ শেষে ১৯২০ সালের মার্চ মাসে নজরুল দেশে ফিরে কলকাতায় সাহিত্যিক-সাংবাদিক জীবন শুরু করেন। কলকাতায় তাঁর প্রথম আশ্রয় ছিল ৩২নং কলেজ স্ট্রীটে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিসে সমিতির অন্যতম কর্মকর্তা মুজফ্ফর আহমদের সঙ্গে। শুরুতেই মোসলেম ভারত, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, উপাসনা প্রভৃতি পত্রিকায় তাঁর সদ্যোরচিত বাঁধন-হারা ও আরও নানা কবিতা প্রকাশিত হলে বাংলা সাহিত্য ক্ষেত্রে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। বাংলা সাহিত্যের এ নবীন প্রতিভার প্রতি সাহিত্যানুরাগীদের দৃষ্টি পড়ে। কবি-সমালোচক মোহিতলাল মজুমদার মোসলেম ভারত পত্রিকায় প্রকাশিত এক পত্রের মাধ্যমে নজরুলের ‘খেয়া-পারের তরণী’ এবং ‘বাদল প্রাতের শরাব’ কবিতাদুটির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন এবং বাংলার সারস্বত সমাজে তাঁকে স্বাগত জানান। নজরুল বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিসে মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক, সমকালীন মুসলমান সাহিত্যিকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হন। অপরদিকে কলকাতার তৎকালীন জমজমাট দুটি সাহিত্যিক আসর ‘গজেনদার আড্ডা’ ও ‘ভারতীয় আড্ডা’য় অতুলপ্রসাদ সেন, দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, ওস্তাদ করমতুল্লা খাঁ, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, শিশিরকুমার ভাদুড়ী, হেমেন্দ্রকুমার রায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, নির্মলেন্দু লাহিড়ী, ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ বাংলার সমকালীন শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীত ও নাট্যজগতের দিকপালদের সঙ্গে পরিচিত ও ঘনিষ্ঠ হবার সুযোগ পান। নজরুল ১৯২১ সালের অক্টোবর মাসে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন; তখন থেকে ১৯৪১ পর্যন্ত দু দশক বাংলার দু প্রধান কবির মধ্যে যোগাযোগ ও ঘনিষ্ঠতা অক্ষুণ্ণ ছিল।এ.কে ফজলুল হকের সম্পাদনায় অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ১৯২০ সালের ১২ জুলাই সান্ধ্য দৈনিক নবযুগ প্রকাশিত হলে তার মাধ্যমেই নজরুলের সাংবাদিক জীবনের সূত্রপাত ঘটে। নভেম্বর মাসে নজরুল আবার কুমিল্লা যান। ২১ নভেম্বর ভারতব্যাপী হরতাল ছিল। নজরুল পুনরায় পথে নামেন এবং অসহযোগ মিছিলের সঙ্গে শহর প্রদক্ষিণ করে গাইলেন: ‘ভিক্ষা দাও! ভিক্ষা দাও! ফিরে চাও ওগো পুরবাসী।’ এ সময় তুরস্কে মধ্যযুগীয় সামন্ত শাসন টিকিয়ে রাখার জন্য ভারতে মুসলমানরা খিলাফত আন্দোলন করছিল। মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে অসহযোগ আর মওলানা মোহাম্মদ আলী ও শওকত আলীর নেতৃত্বে খিলাফত আন্দোলনের দর্শনে নজরুল আস্থাশীল ছিলেন না। স্বদেশে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে স্বরাজ বা স্বাধীনতা অর্জন আর মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে তুরস্কের সালতানাত উচ্ছেদকারী নব্য তুর্কি আন্দোলনের প্রতি নজরুলের সমর্থন ছিল; তথাপি ভারতের হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের সম্মিলিত সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের জন্যই তিনি ওই দুটি আন্দোলনে যোগদান করেন। বিশু বলে যায়, এবার শোনো সকলে মন দিয়ে কবির গল্প। ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে কুমিল্লা থেকে কলকাতা ফেরার পর নজরুলের দুটি ঐতিহাসিক ও বৈপ্লবিক সৃষ্টিকর্ম হচ্ছে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ও ‘ভাঙার গান’ সঙ্গীত। এ দুটি রচনা বাংলা কবিতা ও গানের ধারাকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছিল; ‘বিদ্রোহী’ কবিতার জন্য নজরুল বিপুল খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। ১৯২১ সালের শেষদিকে নজরুল আরেকটি বিখ্যাত কবিতা ‘কামাল পাশা’ রচনা করেন, যার মাধ্যমে তাঁর সমকালীন আন্তর্জাতিক ইতিহাস-চেতনা এবং ভারতীয় মুসলমানদের খিলাফত আন্দোলনের অসারতার পরিচয় পাওয়া যায়। নজরুল তাঁর রাষ্ট্রীয় ধ্যান-ধারণায় সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছিলেন মোস্তফা কামাল পাশার নেতৃত্ব দ্বারা, কারণ তিনি সামন্ততান্ত্রিক খিলাফত বা তুরস্কের সুলতানকে উচ্ছেদ করে তুরস্ককে একটি আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতন্ত্রে রূপান্তরিত করেছিলেন। তুরস্কের সমাজজীবন থেকে মোস্তফা কামাল যে মৌলবাদ ও পর্দাপ্রথা দূর করেছিলেন, তা নজরুলকে বেশি অনুপ্রাণিত করেছিল। তিনি ভেবেছিলেন, তুরস্কে যা সম্ভবপর, ভারত ও বাংলায় তা সম্ভবপর নয় কেন? বস্তুত, গোঁড়ামি, রক্ষণশীলতা, ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার ও আচারসর্বস্বতা থেকে দেশবাসী, বিশেষত স্বধর্মীদের মুক্তির জন্য নজরুল আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। ১৯১৭ সালের রুশ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবও নজরুলকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছিল। নজরুলের  লাঙল ও গণবাণী পত্রিকায় প্রকাশিত ‘সাম্যবাদী’ ও ‘সর্বহারা’ কবিতাগুচ্ছ এবং কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল-এর অনুবাদ ‘জাগ অনশন বন্দী ওঠ রে যত’ এবং ‘রেড ফ্লাগ’ অবলম্বনে রক্তপতাকার গান এর প্রমাণ।১৯২২ সালে নজরুলের যেসব সাহিত্যকর্ম প্রকাশিত হয় সেসবের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল গল্প-সংকলন ব্যথার দান, কবিতা-সংকলন অগ্নি-বীণা ও প্রবন্ধ-সংকলন যুগবাণী। বাংলা কবিতার পালাবদলকারী কাব্য অগ্নি-বীণা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে এর প্রথম সংস্করণ শেষ হয়ে যায় এবং পরপর কয়েকটি নতুন সংস্করণ প্রকাশ করতে হয়; কারণ এ কাব্যে নজরুলের ‘প্রলয়োল্লাস’, ‘কামাল পাশা’ প্রভৃতি বাংলা সাহিত্যে সাড়া জাগানো এবং বাংলা কবিতার মোড় ফেরানো কবিতা সংকলিত হয়েছিল। নজরুলের অপর বিপ্লবী উদ্যম হলো ধূমকেতু পত্রিকার প্রকাশ। পত্রিকাটি সপ্তাহে দুবার প্রকাশিত হতো। বিশের দশকে অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলনের ব্যর্থতার পর সশস্ত্র বিপ্লববাদের পুনরাবির্ভাবে ধূমকেতু পত্রিকার তাৎপর্যপূর্ণ অবদান ছিল। এক অর্থে এ পত্রিকা হয়ে উঠেছিল সশস্ত্র বিপ্লবীদের মুখপত্র। পত্রিকাটি প্রকাশিত হতো ‘কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু, আয় চলে আয়রে ধূমকেতু। আধাঁরে বাঁধ অগ্নিসেতু, দুর্দিনের এ দুর্গশিরে উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।’ রবীন্দ্রনাথের এ আশীর্বাণী শীর্ষে ধারণ করে। ধূমকেতুর ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯২২ সংখ্যায় নজরুলের প্রচ্ছন্ন রাজনৈতিক কবিতা ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ প্রকাশিত হলে ৮ নভেম্বর পত্রিকার ওই সংখ্যাটি নিষিদ্ধ করা হয়। নজরুলের প্রবন্ধগ্রন্থ যুগবাণী বাজেয়াপ্ত হয় ২৩ নভেম্বর ১৯২২সালে তিনি সপরিবারে বাংলাদেশে আসেন। এসময় তাকে বাংলাদেশের জাতীয়তা প্রদান করা হয়। এখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।"হিন্দু না ওরা মুসলিম ঐ জিজ্ঞাসে কোন জন কাণ্ডারি বল ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মা'র" তাঁর লেখা এই লাইনে প্রকাশিত হয়েছে মানবপ্রেম। সমস্ত জাতিভেদ ভুলে একতার বাণী শুনিয়ে ছিলেন এই বিদ্রোহী কবি। "ঐ নতুনের কেতন ওড়ে কাল বোশেখির ঝড়।’ "আমার কৈফিয়ৎ নামে নজরুলের প্রথম কবিতা ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হয় ১৯১৯ সালে। এর আগে তিনি তীক্ষ্ম হীরকখণ্ডের মতো ‘বিদ্রোহী’ কবিতা লিখেছেন। ‘খেয়াপারের তরণী’র মতো ইসলাম সম্পৃক্ত কবিতা লিখেছেন, প্রেমের কবিতা লিখেছেন, ‘সর্বনাশের ঘণ্টা’র মতো কবিতা লিখেছেন—এতেই বোঝা যায় নজরুল বহুভাবে বিপরীত দিকে ধাবিত হয়েছেন। নজরুলের অনেক কবিতা যেমন-বিদ্রোহী, দারিদ্র্য, আমার কৈফিয়ৎ অনেক গতিশীল কবিতা। প্রথমেই কবি নিজেকে বর্তমানের কবি বলে আখ্যায়িত করেছেন। প্রার্থনা করো যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস, যেন লেখা হয় আমার রক্তে তাদের সর্বনাশ; ’কবিতার স্তবকে বর্তমানের কবি কথাটার বিশদ বিবরণ লক্ষণীয়। অন্যায়, অবিচার, অসাম্য, শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে চির বিদ্রোহী কবি নজরুলের সমগ্র সাহিত্যে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠেছে। এর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছেন মানবপ্রেমিক নজরুল। মানুষের অফুরন্ত ভালোবাসা, মানুষের বেদনা, যাতনা, পীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। এক কথায় মানবপ্রেম।আমি জানি, নজরুলের ছোটগল্পে এক নতুন ভাবধারা সৃষ্টি হয়েছে। তাঁর ‘বাউন্ডুলের আত্মকাহিনি’ গল্পে যেভাবে নিচতলার জীবনের কথা উঠে এসেছে তেমন রূপায়ণ বাংলা সাহিত্য ছোটগল্পে ছিল না। নজরুলের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস মৃত্যু-ক্ষুধা; বস্তিবাসীর প্রকৃত ছবি এর আগে অন্য কোনো উপন্যাসে পাওয়া যায়নি। নজরুলের উপন্যাসে যে মানবপ্রেমী দৃষ্টিকোণ যুক্ত হয়েছে তা তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতারই ফসল। অসাম্প্রদায়িকতা, হিন্দু মুসলমানের মিলন, সমাজের নিচুতলার মানুষের উত্থান এসবই নজরুলের মানবিকতার অংশ। নজরুল মনে প্রাণে ব্রিটিশের উচ্ছেদ কামনা করেছেন। ইংরেজদের বিরুদ্ধে নজরুলের উচ্চারণে একতিল খাদ ছিল না। নজরুল শেষ পর্যন্ত ইংরেজ নয়-ছিলেন সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। তিনি লক্ষ্য করেছেন, মানুষ চিরকাল মানুষের ওপর অত্যাচার করে এসেছে, তা পশুদের পক্ষেও অসম্ভব। নজরুল জীবনভর লাঞ্ছিত মানুষেরই জাগরণ কামনা করেছেন। নজরুলের কবিতার ক্ষেত্রে দৃষ্টি দিলে দেখি বহু আয়তনে বিস্তৃত তাঁর কবিতা। ব্যক্তি জীবনের উদার মানবিকতার চর্চাই নজরুলের সাহিত্যিক জীবনে প্রতিফলিত হয়েছিল। ক্রোধ, ধার্মিকতা, আধ্যাত্মিকতা, সমাজ, রাজনীতি, বাস্তব ও স্বপ্ন মিলে কখনো দেখা গেছে গভীর বিষাদে মগ্ন থেকে কবি কাজ করেছেন মাত্র দুই যুগ। সুস্থাবস্থার সময় মাইকেল মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ দাস এই কবিদের চেয়ে অনেক কম পেয়েছেন কবি নজরুল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে কবি নজরুল চলে যান করাচিতে। কিন্তু সেখানে বেশি দিন ধরে রাখতে পারেনি করাচির মাটি। তিনি চলে এলেন কলকাতায়, কমরেড মুজাফফর আহমদের সঙ্গে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিসে এক সঙ্গ বাস করতে থাকেন। ১৯২০ সালে নজরুল ইসলাম ও মুজাফফর আহমদ দৈনিক ‘নবযুগ’ প্রকাশ করেন। এ কে ফজলুল হক ছিলেন প্রধান পরিচালক। মুজাফফর আহমদ মার্কসবাদের প্রতি আকৃষ্ট হলে নজরুল সম্পাদিত অর্ধ সাপ্তাহিক ‘ধূমকেতু’ বের করেন। তারপর সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘লাঙল ‘প্রকাশিত হয়। লাঙল পত্রিকার প্রথম সংখ্যাতেই বিদ্রোহী কবির সাম্যবাদী চরিত্র প্রকাশিত হয়। তখনই ঘোষিত হলো মানবতার জয়গান। অপরূপা কবির সম্বন্ধে বলে, ১৯২৫ সালে প্রকাশিত সাম্যবাদী কবিতাগ্রন্থ সমাজতন্ত্রী বাংলা কবিতার দরজা খুলে দিল। ৩০ ও ৪০-এর দশকে সাম্যবাদী কবিতার যে প্রবাহ, তার পথিকৃত কাজী নজরুল ইসলাম। চৌদ্দশো বছরের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে নজরুল ইসলামই হিন্দু মুসলমান মিলনের শ্রেষ্ঠ প্রবক্তা। শত শত বছর ধরে হিন্দু মুসলমান পাশাপাশি বাস করলে ও সাহিত্যে তা আদৌ যথাযথ ভাবে প্রতিফলিত হয়নি। ব্যক্তি জীবনেও নজরুল তাঁর ব্যবধান রাখেননি। বিয়ে করলেন হিন্দু মেয়ে। তাঁর পুত্রদের নাম রাখলেন হিন্দু মুসলিম ঐতিহ্যকে সমান করে। নজরুল হিন্দু ও মুসলমান ধর্মের আচার থেকে অন্তর আত্মা অবধি ব্যবহার করেছেন। শুধু কবিতায় নয় গল্পে, উপন্যাসে, নাটকে, প্রবন্ধে, গানে সব ক্ষেত্রে তাঁর পারদর্শিতার পরিচয় মেলে। পৃথিবীর যেখানে বাংলাভাষী রূপে যারা বাস করেন তিনি তাদের আত্মার আত্মীয়, পরমাত্মীয় এবং স্মরণীয় কবিরূপে সম্মানীত। অপরূপার বক্তব্যের পরে সভার সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়। তারপর নরনারায়ণ ভোজনের ব্যবস্থা করা হয়। সভার পাশে রান্না হত খিচুড়ি, তরকারি আর টক। পূর্ব বর্ধমান জেলার লোকেরা টক খুব ভালবাসেন।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, "ভজন পূজন সাধন আরাধনা সমস্ত থাক পরে, রুদ্ধদ্বারে দেবালয়ের কোণে কেন আছিস ওরে"। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, "বহুরূপে সম্মুখে তোমার ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর, জীবে প্রেম করে যেইজন সেইজন সেবিছে ঈশ্বর"। এখানে দেখা যাচ্ছে দুই মহাপুরুষের একই বক্তব্য। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন ভজন পূজন সাধন আরাধনা বাদ দিয়ে যেখানে সমস্ত শ্রমিক কাজ করছেন তাদের মধ্যেই ঈশ্বরের বাসস্থান। আবারও স্বামীজী বলেছেন শ্রমিক, খেটেখাওয়া মানুষের মাঝে ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে। বহুরূপে, মানুষের মাঝে ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিদ্যমান। ধর্ম জীবনেরই অংশ বলা হয়ে থাকে। অবশ্য পাশ্চাত্ত্য দেশে ধর্ম শব্দটি দ্বারা বর্তমানে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মচর্চার বাইরের অনেক কিছুকে বোঝানো হয়ে থাকে। যেমন, ‘ধ্যান’ অধ্যাত্মসাধনার অংশ হলেও এর দ্বারা শরীরের সুস্থতার ধারণা যুক্ত হয়েছে। একাগ্রতার কথা বলা হয়েছে। ঈশ্বর বিশ্বাসী কিংবা অবিশ্বাসী যে কোনো ব্যক্তি ধ্যানের মাধ্যমে শরীরের সুস্থতা বজায় রাখতে পারেন। এ ধরনের দৃষ্টিকোণে ধর্ম বিশ্লেষণে গুরুত্ব পায় মানবতাবাদ, প্রেম, সমবেদনা, ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, ক্ষমা, পরিতৃপ্তি, দায়িত্ব, সংগতি, অপরের সুবিধা-অসুবিধার প্রতি দৃষ্টি রাখা প্রভৃতি। কেউ অস্বীকার করবে না এই যুগে যুবসমাজ জ্ঞানী ও কর্মে অনেক অগ্রসর। কিন্তু তাদের মূল্যবোধের অভাব নিয়ম-শৃঙ্খলা প্রতি অবজ্ঞা তাদের ভবিষ্যৎ কি অন্ধকার আচ্ছন্ন করে রেখেছে। কে তাদের সতর্ক করে দেবে কেউ দেবে না। কারণ কেউ তাদের আত্মীয় হতে চায় না কি বাড়ির অভিভাবক শিক্ষক সংবাদপত্র কেউ সবাই নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য যুব শক্তিকে কাজে লাগাতে ব্যস্ত। যুব শক্তিকে কাজে লাগানোর জন্য স্বামী বিবেকানন্দের এবং তার কর্মময় জীবন তার প্রমাণ রেখেছে। স্বামীজি দেশপ্রেমিক ছিলেন এটুকু বললে তাকে ছোট করা হবে।। তিনি তো সন্ন্যাসী ছিলেন। সন্ন্যাসী হিসেবে তার আবার দেশকি? সমাজ কি সন্ন্যাসী তো দেশকালের ঊর্ধ্বে বস্তুত তিনি ভালবাসতেন মানুষকে। মানুষের মধ্যেই তিনি ঈশ্বরকে দেখেছিলেন সব দেশের মানুষকে শ্রদ্ধা করতেন যারা দুর্বল অক্ষম নিপীড়িত তারাই ছিল তার বিশেষ প্রীতিভাজন। যে দেশের মানুষ তারা হোক। নিগ্রো মনে করে আমেরিকার এক হোটেলে তাঁকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। কিন্তু তিনি বলেন নি যে তিনি নিগ্রো নন। প্রতিটি নিগ্রো, কালো, অসুন্দর মানুষ তার ভাই। মিশরের তথা বিশ্বের না খেতে পাওয়া, কষ্ট পাওয়া প্রতিটি পতিতা তার বোন।

অনেকে মনে করেন এসব বিবেচনা কোনো ঐশ্বরিক বা স্বর্গীয় ধারণার সঙ্গে যুক্ত নয়, বরং পৃথিবীর প্রতিদিনকার বাস্তবতার সঙ্গে সম্পৃক্ত। পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করতে হচ্ছে। মানুষকে খেটে খেতে হয়। নানা ঝামেলার মাঝে প্রতিদিনের কাজের সঙ্গে প্রার্থনা ও ধ্যানের মাধ্যমে ঈশ্বরকে স্মরণ করছি আমরা মানুষ। যে বিশ্বে আমরা বাস করি তার আশ্চর্য ক্রিয়াকাণ্ড দেখে অভিভূত হই। আমরা কেন এখানে কিংবা আমাদের মৃত্যুর পরে কী হবে, এসব ভাবনাই অধ্যাত্মতত্ত্বের অংশ। আমরা তখনই আধ্যাত্মিক মানুষ হিসেবে পরিচিত হই যখন সুন্দর, প্রেম অথবা সৃষ্টিশীলতায় নিজেকে খুঁজে পাই। বাস্তব পৃথিবীতে জীবন পরিচালনায় আমাদের প্রত্যাশা প্রকাশিত হয় সূক্ষ্ম সম্পর্কের সুতোয়। সেই সম্পর্কের মধ্যে পরমার্থ-জীবন আমাদের প্রশান্তি দান করে। আধ্যাত্মিক জীবনের পথ বিচিত্র। ঈশ্বরের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য নিজেকে তৈরি করা, নিজের জ্ঞান ও বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে সৃষ্টি জগতের সঙ্গে মিলতে চাওয়ার জন্য সুশৃঙ্খলভাবে ধ্যান, প্রার্থনা, নৈতিকতার উন্নতি সাধন, ধর্মীয় গ্রন্থে নিমগ্ন হওয়াকে চিহ্নিত করা হয় এর অন্যতম পথ হিসেবে। এসবই অনেক সময় একজন ধর্মতাত্ত্বিকের মাধ্যমেও সম্পন্ন হতে পারে। আধ্যাত্মিকতার লক্ষ্য হচ্ছে ভেতরের জীবন ও বাইরের জীবনের উন্নতি। প্রেম ও করুণা ধারায় সিক্ত হলে আধ্যাত্মিক জীবনের উন্নতি ঘটে।

ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতার যোগাযোগটা কী রকমের? পরমের সন্ধানে নিয়োজিত আধ্যাত্মিকতার উদ্দেশ্য পরমের সন্ধান। তবে আমাদের মতে আধ্যাত্মিকতা ধর্মেরই একটি অংশ। ধর্মের বাইরে একজন ব্যক্তি তার আধ্যাত্মিক জীবন খুঁজে পেতে পারেন। শূদ্রের সেবার জন্য এক লক্ষ যুবককে স্বামীজি চেয়ে ছিলেন। তারা সমস্ত শক্তি নিয়ে দেশের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে এই ছিল তার আশা। কিন্তু সর্বাগ্রে চেয়েছিলেন তারা মানুষের মত মানুষ হবে, বুদ্ধির উদয় কর্মশক্তি এবং তার সঙ্গে নিঃস্বার্থ সেবার মনোভাব নিয়ে তারা কুটিরে কুটিরে গিয়ে মানুষকে উজ্জীবিত করবে। এই সেবা পেতে নিশ্চিতভাবে, শিবজ্ঞানে জীব সেবা বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন এই হচ্ছে যুগধর্ম এর মধ্যে আমি নেই। তুমি শুধু তুমি আছো। অর্থাৎ ঈশ্বরের প্রতি শ্রদ্ধা ও প্রীতি, স্মৃতি নিয়ে সেবা। সেবা বুদ্ধি না থাকলে ক্ষমতার অপব্যবহার অবশ্যম্ভাবী। তাই বারবার বলেছিলেন দেশ স্বাধীন হবেই। কিন্তু জাতি স্বার্থান্বেষীরা ক্ষমতার অপব্যবহার করতে না পারে সেজন্য আমাদের কর্তব্য, ধর্মের উচ্চতম চিন্তা দিয়ে সে সময় একটা প্লাবন ঘটানো উচিত এতে চিন্তার একটা  প্রভাব পড়বে। কিন্তু যিশু খ্রিস্টের জীবনের প্রসঙ্গ আলোচনা করলে ধর্ম ও মানবতা একই জিনিস মনে হওয়াই স্বাভাবিক। অপরের জন্য নিজেকে আত্মোৎসর্গ করা, নিজের শান্তি, নিজের তৃপ্তি, সুখী হওয়ার প্রচেষ্টায় দান-ধ্যান-প্রার্থনায় নিয়োজিত থাকা এসবই আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে বিজড়িত থাকলে নিজের ভালো লাগে। এ ক্ষেত্রে নিজের অন্তরের উপলব্ধি গুরুত্বপূর্ণ। মানসিক স্বাস্থ্যের সঙ্গেও জড়িত অপরের উপকার প্রসঙ্গ। সমাজবিজ্ঞানীরা বলেছেন অন্তরের আকুতি ও নিবেদিত নৈবেদ্যের মধ্যে সেই ভালোলাগা লুকিয়ে থাকতে পারে। অন্যদিকে সার্বজনীন চেতনার সঙ্গে জড়িত রয়েছে সামাজিক উপকারের বিষয়টি। সর্বধর্মের দৃষ্টিতে সমগ্র মানব সমাজ এবং সৃষ্টির সব কিছু ঈশ্বরের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তিনি সকল মানুষের প্রতিপালক। তিনি সকলকে ভালোবাসেন। মানবতার দিশারি হিসেবে ভগবান বুদ্ধ, যিশু, রসুল আল্লা আমাদের পরিত্রাণকর্তা। মানবাত্মা সম্পর্কে ধারণা একটি মানবিক ধারণা। বিশ্বজুড়ে মানুষে মানুষে সাংস্কৃতিক ভিন্নতা, বহুত্ববাদী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আধ্যাত্মিক সত্যকে বারবার প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এসব থেকে মুক্তির জন্য সার্বজনীন চেতনার গুরুত্ব অপরিসীম। মানুষে মানুষে মৈত্রী, সাম্য, ঐক্য ও পারস্পরিক বিশ্বাস এই চেতনার প্রধান দিক। স্বামী বিবেকানন্দ শুধু বাঙালির জীবনের এক আদর্শ মহামানবই নন, তিনি যুগাবতার। তাঁর দেখানো আদর্শের রাস্তা যুক্তিবোধের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায় মানুষকে। আধ্যত্মকে এক অন্য পর্যায়ে উন্নতি করে স্বামীজী সকলের জীবনকে আরও বেশি করে আলোর দিকে ঠেলে দিয়েছেন। নেতিবাচক ভাবনার অন্ধকার দিকটির পর্দা সরিয়ে তিনি বাঙালির জীবনবোধকে আরও বেশি করে অনুপ্রাণিত করেছেন। উদ্বুদ্ধ হয়েছে যুব সমাজ, আর সেজন্যই তার জন্মদিন ১২ই জানুয়ারি যুব দিবস বলে খ্যাত। স্বামীজির কিছু অমর বাণী মনে দাগ কাটে। স্বামী বিবেকানন্দ বলতেন তোমরা হৃদয়বান হও প্রেমিক হও। তোমরা কি প্রাণে প্রাণে বুঝেছ যে কোটি কোটি দেবর্ষির বংশধর পশুর মত হয়ে দাঁড়িয়েছে। তোমরা কি প্রাণে প্রাণে অনুভব করেছো, কোটি কোটি লোক অনাহারে মরছে। কোটি কোটি লোক শতাব্দী ধরে অনেক আছে, তোমরা কি মনে প্রাণে বুঝেছ অজ্ঞতার কালোমেঘ ভারতবর্ষকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। এই সব ভাবনা কি তোমাদের অস্থির করে তুলেছে তোমাদের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। তিনি বলেছেন আমি বিশ্বাস রাখি আধুনিক যুব সমাজের উপর আমার কর্মীরা তাদের মধ্য থেকেই আসবে। সিংহের মত যে তারা দেশের সব সমস্যাগুলির সমাধান করবে। গীতা পড়ার থেকে ফুটবল খেললে ঈশ্বরের সন্ধান তাড়াতাড়ি পাওয়া যায়। একথা তিনি বলেছেন যুবদের। তিনি বলতেন তোরা মানুষ হ। তিনি বলতেন আমি এমন মানুষ চাই যাদের মাংস পেশি লোহা দিয়ে তৈরি। আর এই দেহের মধ্যে এমন মন থাকবে যা নরম উপাদানে গঠিত। অনেকে আমিষ, নিরামিষ খাওয়া নিয়ে খুব গর্ব করতেন তিনি বলতেন আমার ছেলেরা যত খুশি আমিষ খাবে। পাপ আমার হোক। কারণ তিনি চাইতেন দেশের ছেলেমেয়েরা বলিষ্ঠ ও দৃঢ় হোক। শুধু দেহ শক্ত হলে হয়না। মন শক্ত হওয়া চাই। সর্বাগ্রে চাই আত্মবিশ্বাস। যাকে তিনি শ্রদ্ধা বলতেন, কে নাস্তিক? স্বামীজি বলতেন পুরোনো মতে যাদের ঈশ্বরে বিশ্বাস নেই তারা নাস্তিক। কিন্তু আধুনিক মতে যাদের নিজেদের উপর বিশ্বাস নেই তাই নাস্তিক। স্বামীজি পাশ্চাত্যে সংঘ শক্তি দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন এই সংঘ শক্তি আমাদের দেশে আসুক আর সঙ্গে সঙ্গে আসুক পাশ্চাত্যের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিদ্যার সহায়তায় আমরা নতুন ভারত গড়ো কিন্তু তা বলে আমাদের আর্থিক সম্পদ হারাবো না সামাজিক নেতৃত্বে আমাদের দেশের তরুণরা নতুন ভারত এগিয়ে আসুক এই আশার আলো জর্জরিত ভারতের জনসাধারণ অপেক্ষা করছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ভারতের প্রাচীন আদর্শ অনুশাসনের প্রতি ছিলেন পরম নিষ্ঠাবান। এমনকি চল্লিশ বছর অবধি তিনি ভারতবর্ষের সনাতন সারল্য, স্নিগ্ধতা ও অনাড়ম্বর পুজো আচরণের প্রতি ছিলেন অনুরক্ত। সংযম, বিশ্বাস, ধ্যান, মৃত্যুভয়হীন, আত্মসমাহিত শক্তি, কোমলতা ও স্বধর্ম রক্ষায় দৃঢ়তা এবং শান্তির মর্মগত বিষয়ে তিনি ছিলেন প্রাচীন বিশ্বাসী। দীর্ঘদিনের প্রথাগত সংস্কার-বিশ্বাস ও শিক্ষায় বেড়ে ওঠা হিন্দুসমাজে জন্মেছিলেন বলে কবি তার যা কিছু শ্রেষ্ঠ তাকে সমস্ত সমাজের বলে ভেবেছেন। তবে যে ধর্মসমাজে তার জন্ম তার অতিরিক্ত অর্জন আছে তাঁর পরমার্থচেতনায়। জন্মগত আর বংশগত ধর্ম তাঁর শিক্ষাদীক্ষা সংস্কৃতি ও চিন্তার ভেতর দিয়ে বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে রূপান্তরিত হয়েছে; পেয়েছে পরিপূর্ণতা। তিনি একসময় হিন্দু সম্প্রদায় ও হিন্দু আদর্শ নিয়ে প্রশস্তি গেয়েছেন (যেমন, ১৩২৪ সালে ‘আত্মপরিচয়’ রচনায়)। পরে আবার এর বিপরীত কথাও বলেছেন (যেমন, ১৩৩৯ সালে ‘কালান্তর’ গ্রন্থে)। হয়ে উঠেছেন ‘গোরা’ উপন্যাসের গোরা চরিত্রের মতো ভারতবর্ষের দেবতার পূজারি।

রবীন্দ্রনাথ উদার বিশ্বমানবিকতার কবি। বিশ্বমানব ও বিশ্বপ্রকৃতির প্রতি তাঁর অনুরাগ ছিল সংস্কারমুক্ত ও ভেদাভেদশূন্য। প্রথমদিকে সমাজ ও ধর্মের সংস্কার ও বিশ্বাসের বেড়াজাল সৃষ্টি হলেও সেই উচ্ছ্বাস ও আবেগ থেকে তিনি মুক্ত হয়ে মানবিক সত্যের মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়েছেন। তিনি যেমন ব্রাহ্মণের মিথ্যা গরিমাকে ধূলায় মিশিয়ে দিয়েছেন তেমনি হিন্দুদের দ্বারা কথিত ম্লেচ্ছ মুসলমানকে সম্মান করেছেন। কাহিনী কাব্যের ‘সতী’ কবিতায় আছে:
‘বৃথা আচার বিচার। সমাজের চেয়ে
হৃদয়ের নিত্য ধর্ম সত্য চিরদিন।’

মানুষের জয়গান ছত্রে-ছত্রে। সংস্কারমুক্ত কবি সাম্প্রদায়িক জাতিভেদের ভেদবুদ্ধিকে পরিহার করেছেন। জাতপাতের বিরুদ্ধে উঠে তাঁর কণ্ঠস্বর তীব্র হয়েছে। পত্রপুট কাব্যের পনের সংখ্যক কবিতায়। যেখানে গরীব, সমাজের নিচুতলার পক্ষে কবির চেতনা। তিনি সহজ ভক্তির আলোকে দেবতাকে পেতে চেয়েছেন। আচার সংস্কার মন্ত্র ও মন্দিরের ভেতরে নয়। এ জন্য গীতাঞ্জলির অসংখ্য কবিতায় দেখা যায় দেবতা বদ্ধ ঘরে নেই, তিনি আছেন রৌদ্র ধূলায় চাষা আর শ্রমিকের মাঝে। অবজ্ঞাত, হীন, পতিত অন্ত্যজের মধ্যে কবি দেবতা খুঁজেছেন। গীতাঞ্জলির কবিতায় কবি সব হারাদের মাঝে দেবতাকে পেয়েছেন আমরা দেখতে পাই।

"যেথায় থাকে সবার অধম দীনের হতে দীন

সেইখানে যে চরণ তোমার বাজে

সবার পিছে, সবার নিচে

সব হারাদের মাঝে।"

কবিগুরু সকল গণ্ডি, সমস্ত সম্প্রদায় বিভেদ বৈষম্যের ঊর্ধ্বে মানুষের ঈশ্বরের সাধনা করেছেন, আরাধনা করেছেন। মানুষের মাঝে দেবতাকে পেয়েছেন। ‘মানুষের ধর্ম’ প্রবন্ধে নিজের সাধনা সম্পর্কে বলেছেন, ‘আমার মন যে সাধনাকে স্বীকার করে তার কথাটা হচ্ছে এই যে, আপনাকে ত্যাগ না করে আপনার মধ্যেই সেই মহান পুরুষকে উপলব্ধি করবার ক্ষেত্র আছে, তিনি নিখিল মানবের আত্মা। এই বিশ্ব মানবের আত্মাকে উপলব্ধি করার সাধনাই কবির ধর্মসাধনার পরিণাম। মানবের আত্মার স্বরূপ হচ্ছে সর্বজনীন মানব বা পরম পুরুষ। যিনি সব মানুষের হৃদয়ে সন্নিবিষ্ট থেকে মহত্ত্বের শ্রেয়োবোধের প্রেরণা দিচ্ছেন। চিত্রার ‘এবার ফিরাও মোরে’ কবিতায় তার পরিচয় আছে।
‘কে সে? জানি না কে? চিনি নাই তারে
শুধু এইটুকু জানি— তারি লাগি রাত্রি-অন্ধকারে
চলেছে মানবযাত্রী যুগ হতে যুগান্তর-পানে
ঝড়ঝঞ্ঝা বজ্রপাতে জ্বালায়ে ধরিয়া সাবধানে
অন্তরপ্রদীপখানি।... মানুষের অন্তরে এক মহামানবত্বের প্রেরণা, যা তাকে অনুপ্রাণিত করে মহত্ত্বের পথে নিয়ে যায় তাকে অনুভব করেন কবি। তবে মহামানবের কর্ণে তার আহ্বান পৌঁছায় সবার আগে। তাঁরা সংসারের সীমা ছেড়ে ছুটে আসেন। নতুন নতুন ত্যাগ ও দুঃখ বোধ প্রকাশিত হয়। মানুষের অন্তর্নিবিষ্ট মহামানবই কবির ‘সদা জনানাং হৃদয়ে আছে। মহামানবকে লাভ করার সাধনাই কবির ধর্ম সাধনা। এর নাম মানবধর্ম। কবিগুরুর আত্মদর্শন  বিভিন্ন কবিতায় রূপায়িত হয়েছে। গীতমাল্যের  কবিতায় মহামানবকে লাভ করার জন্য ত্যাগ ও দুঃখবরণ করে মানবাত্মার অভিসারের কথা বলা হয়েছে। দুঃখকে আত্মসাৎ করার আনন্দের কথা ‘আত্মপরিচয়ে’ বলেছেন তিনি। দুঃখের মধ্য দিয়ে সুন্দরের পরমসত্তার আবির্ভাব ঘটে। মানবাত্মা পরিশুদ্ধ হয়। গীতবিতানের পূজা পর্যায়ের গানে আছে, "দুঃখ যদি না পাবে তো দুঃখ তোমার ঘুচবে কবে। / বিষকে বিষের দাহ দিয়ে দহন করে মারতে হবে। ...মরতে মরতে মরণটারে শেষ করে দে একেবারে/ তার পরে সেই জীবন এসে আপন আসন আপনি লবে।" কবির দেবতা রুদ্র, শান্ত, শিবম। দুঃখ আঘাতে তাঁকে পাওয়া যায়। খেয়ার ‘আগমন’-এ আছে সেই রুদ্র রূপ। ‘এই করেছ ভালো নিঠুর’/ কিংবা ‘আরো কি বাণ তোমার তুণে আছে’- দুঃখকে আহ্বান করার গান। দুঃখ ও কঠোর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে মহামানবের সাধনা পূর্ণ হয়। তবে তাঁর সাহচর্য কখনো কখনো আনন্দময়। বিভিন্ন কবিতায় ব্যক্ত ‘খেলার সঙ্গিনী’, ‘নর্মসহচরী’, ‘মানসসুন্দরী’ কবির জীবনের নিয়ন্ত্রণকর্ত্রী জীবনদেবতায় পরিণত। চিত্রা কাব্যের জীবনদেবতা, রাজা, অরূপরতন নাটকের রাজা এবং খেয়া কাব্যের দুঃখরাতের রাজা ও রাজার দুলাল একই সত্তার ভিন্ন রূপ। একই দেবতা বিচিত্র রূপে কবির কাছে দেখা দিয়েছে। গীতাঞ্জলির গানে আছে প্রকৃতির নিবিড় সাহচর্যে কবি তার অমৃত স্পর্শ লাভ করেছেন। হৃদয়দেবতার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বভুবনের প্রতি কবির ছিল বিস্ময়। গীতাঞ্জলির গানে আছে ‘সীমার মাঝে অসীম তুমি/বাজাও আপন সুর/আমার মধ্যে তোমার প্রকাশ/তাই এত মধুর।’ জগতের সামান্য বস্তুর মধ্যেও অপরিমেয়তার অশেষ ব্যঞ্জনা আছে। কবি বিশ্বপ্রকৃতিতে নিসর্গ সৌন্দর্যে মানব সম্বন্ধের মধ্য দিয়ে সীমাহীন অনির্বচনীয়তা লক্ষ্য করেছেন। অনন্ত অসীম পরম রহস্যময় প্রকাশ, ‘যা দেখেছি যা পেয়েছি তুলনা তার নাই।’ গীতাঞ্জলির ৩০ নম্বরে সৃষ্টির সকল আনন্দময় প্রকাশ আছে।  অন্তর অনুভূতির গভীর আকুতি মিশেে আছেে, 

"এই তো তোমার প্রেম ওগো

হৃদয় হরণ 

এই যে পাতায় আলো নাচে

সোনার বরণ।।
এই যে মধুর আলস বরে
মেঘ ভেসে যায় আকাশ পরে
এই যে বাতাস দেহে করে
অমৃত ক্ষরণ।।"

মানুষ ও মানব সংসারের মধ্য দিয়ে কবি তাঁর পরমেশ্বরের আনন্দরূপ দেখেছেন। কবিতায় তিনি অমৃতময় ভূমাকে পরমানন্দময় জীবনদেবতাকে লাভ করেছেন। 

‘এই বসুধার
মৃত্তিকার পাত্রখানি ভরি বারম্বার
তোমার অমৃত ঢালি দিবে অবিরত
নানাবর্ণগন্ধময়।...
যে-কিছু আনন্দ আছে দৃশ্যে গন্ধে গানে
তোমার আনন্দ রবে তার মাঝখানে।’

"তিনি গেছেন সেথায়, যেথায় করছে চাষা চাষ পাথর ভেঙে কাটছে যারা পথ খাটছে বারোমাস, রৌদ্রে জলে আছেন সবার সাথে ধুলা তাহার লেগেছে দুই হাতে, তারি মতন শুচি বসন ছাড়ি, আয়রে ধুলার 'পরে"।  

আবার তিনি বলেছেন কবিতায়, "মুক্তি ওরে মুক্তি কোথায় পাবি, মুক্তি কোথায় আছে, আপনি প্রভু সৃষ্টি বাঁধন 'পরে বাঁধা সবার কাছে"।

আবার স্বামী বিবেকান্দ বলেছেন, 'কেবল শারীরিক সাহায্য দ্বারা জগতের দুঃখ দূর করা যায় না। যতদিন না মানুষের প্রকৃতি পরিবর্তিত হইতেছে, ততদিন এই শারীরিক অভাবগুলি সর্বদাই আসিবে এবং দুঃখ অনুভূত হইবেই হইবে। যতই শারীরিক সাহায্য কর না কেন, কোনমতেই দুঃখ একেবারে দূর হইবে না। জগতের এই দুঃখ-সমস্যার একমাত্র সমাধান মানবজাতিকে শুদ্ধ ও পবিত্র করা। আমরা জগতে যাহা কিছু দুঃখকষ্ট ও অশুভ দেখিতে পাই, সবই অজ্ঞান বা অবিদ্যা হইতে প্রসূত। মানুষকে জ্ঞানালোক দাও, সকল মানুষ পবিত্র আধ্যাত্মিক-বলসম্পন্ন ও শিক্ষিত হউক, কেবল তখনই জগৎ হইতে দুঃখ নিবৃত্ত হইবে, তাহার পূর্বে নয়। দেশে প্রত্যেকটি গৃহকে আমরা দাতব্য আশ্রমে পরিণত করিতে পারি, হাসপাতালে দেশ ছাইয়া ফেলিতে পারি, কিন্তু যতদিন না মানুষের স্বভাব বদলাইতেছে, ততদিন দুঃখ-কষ্ট থাকিবেই থাকিবে।'

স্বামীজি বলতেন ভারতের জাতীয় অপরাধ সে তার জনসাধারণকে অবজ্ঞা করে এসেছে। এই পাপের ফলে ভারত এত দুর্বল। বারবার বিদেশি শক্তির কাছে পদানত হয়েছে। জনসাধারণের বৃহত্তর অংশ হচ্ছে শূদ্র। খেটে খাওয়া মানুষ যারা মাঠে চাষ করে কলকারখানায় হাতুড়ি পেটায়। এরা দেশ গড়ে কিন্তু এরা সে ধন থেকে বঞ্চিত। আবার কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একই কথা বলেছেন তিনি বলেছেন যারা মাঠে ঘাটে খাটে তারাই তো আসল দেবতা। তাদের মধ্যেই দেবতা বিরাজ করে। তুমি রুদ্ধদ্বারে দেবালয়ের কোণে কেন ভগবানকে খোঁজো। সেখানে ঈশ্বর নেই। সেখানে ঈশ্বর নেই, যেখানে শুধু ধর্মের আড়ালে ক্ষমতার বড়াই করে গরীবের ঘাম কেড়ে খাওয়া লোভি হায়েনার দল। তাহলে দেখা যাচ্ছে, গ্রেট মেন থিংকস আ্যালাইক। যারা বিদ্বজ্জন যারা মহাপুরুষ, জ্ঞানী তারা একই রকম চিন্তা করে থাকেন এটাই আমাদের প্রবন্ধের মূল বক্তব্য। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর স্বামী বিবেকানন্দের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে একই সুরে সুর মিলে যায়। তারা মানুষের জয়গান করেছেন চিরকাল। মানুষের জয়গান করেছেন ভগবান যিশু, বুদ্ধ সকলে। আমরা তো সামান্য লোক।তাই তাঁদের পথ ধরে চিরকাল অনুসরণ করে যাই আলোপথ। কবির ভাষায় বলি, "মহাজ্ঞানী মহাজন, যে পথে করে গমন, হয়েছেন চিরস্মরণীয়, সেই পথ লক্ষ্য করে স্বীয় কীর্তি ধ্বজা ধরে আমরাও  হব বরণীয়"।

নানা প্রতিকূলতার মধ্যে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী এমন ভূমি তৈরি করেছিলেন যে ভূমিতে পরপর তৈরি হয়েছে নানান সাহিত্যিক। তখনকার দিনে ছাপাখানা অত সহজ ছিল না উপেন্দ্রকিশোর নানা বাধা অতিক্রম করে এই ছাপাখানা বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেন এবং তিনি নিজের হাতেই প্রচ্ছদ নির্মাণ এবং এর যাবতীয় ছবি আঁকা সবকিছু নিজের হাতেই করতেন। 

একটা চারা গাছ রোপন করে তাকে যত্ন করে তার যোগ্য মাটিতে থাকে পথে তাকে সার দিয়ে বড় করতে হয় তবেই সে বড় হয় এবং ফল-ফুল প্রদান করে। তেমনি একটি সন্তান সুন্দর পরিবেশে সুন্দর পরিবারে জন্মগ্রহণ করে যদি যথোপযুক্ত মাধ্যমে মানুষ হয় সে পৃথিবীতে আপন স্থান করে নেয় স্বমহিমায়। এমনই একটা যোগ্য পরিবার রায় পরিবার যেখানে সন্তানদের মানুষ হবার মতো বিখ্যাত সকল পরিবেশ বিদ্যমান এবং তাদের সেই লড়াকু মনোভাব ও বিদ্যমান। 

প্রসিদ্ধ শিশুসাহিত্যিক, চিত্রশিল্পী, বাংলা মুদ্রণশিল্পের অন্যতম রূপকার, ১৮৬৩ সালের ১০ মে ময়মনসিংহ জেলার মসুয়া গ্রামে উপেন্দ্রকিশোর জন্মগ্রহণ করেন। পিতামাতার আট সন্তানের মধ্যে উপেন্দ্রকিশোর ছিলেন তৃতীয় সন্তান। তাঁর পিতৃদত্ত নাম ছিল কামদারঞ্জন। পাঁচ বছর বয়সের সময় তাঁর পিতা কালীনাথ রায় ওরফে শ্যামসুন্দর মুন্সীর কাছ থেকে নিকট আত্মীয় ময়মনসিংহের জমিদার হরিকিশোর চৌধুরী তাঁকে পোষ্যপুত্র হিসেবে গ্রহণ করে নতুন নাম রাখেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। সুপন্ডিত জমিদার হরিকিশোর রায়চৌধুরীর পৃষ্ঠপোষকতায় উপেন্দ্রকিশোরের শিক্ষাজীবন শুরু হয় এবং ময়মনসিংহ জিলা স্কুল থেকে ১৮৮০ সালে বৃত্তি নিয়ে প্রবেশিকা পরীক্ষা পাস করেন। স্কুল জীবনেই তিনি চিত্রাঙ্কনে দক্ষতা অর্জন করেন। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে কিছুকাল অধ্যয়নের পর কলকাতা মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন এবং ১৮৮৪ সালে সেখান থেকে বিএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এ সময় তিনি ব্রাহ্মসমাজে যোগ দেন এবং প্রখ্যাত সমাজসেবী দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের জ্যেষ্ঠ কন্যা বিধুমুখীর সঙ্গে বিবাহ হয়।

কোনো বাধা কোনো বিপত্তি উপেন্দ্রকিশোরের সামনে দাঁড়াতে পারেনি। সকলকে সকল বাধাকে তুচ্ছ জ্ঞান করে তিনি এগিয়ে চলেছেন সদর্পে। পরিবারকে তিনি এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন যেখানে যে কোন সন্তান জন্ম নিলে সে বড় হবেই এমন একটা পরিবেশ গড়ে তোলা একজনের পক্ষে কতটা কঠিন সে যে করেছে সেই জানে। তারপরে কি হয়েছে, উপেন্দ্রকিশোরে পরবর্তী সন্তান সুকুমার রায় সাহিত্য জগতে এক নক্ষত্র হয়েছেন। তারপর সুকুমার রায় সত্যজিৎ রায় ও নক্ষত্র হয়েছেন এবং সত্যজিৎ রায়ের পুত্র সন্দীপ রায় সাহিত্য আকাশে নক্ষত্র স্থান অধিকার করেছেন তারপরও হয়তো তোকে দেখে যাবেন কোন হীরের টুকরো দেখে যাবেন তার বংশে। 

কিশোর বয়সেই উপেন্দ্রকিশোরের সাহিত্যসৃষ্টির হাতেখড়ি ঘটে এবং তখনকার কিশোরপত্রিকা সখা, বালক, সাথী, সখা ও সাথী, মুকুল ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৮৮৩ সালে ছাত্রাবস্থায় সখা পত্রিকায় তাঁর প্রথম রচনা প্রকাশিত হয়। তাঁর সমগ্র জীবনেই তিনি নিরবচ্ছিন্নভাবে সাহিত্যচর্চা অব্যাহত রাখেন। শিশুকিশোর সাহিত্যের প্রায় সকল শাখায় বিচরণ করে তিনি বাংলা শিশুসাহিত্যের দিকনির্দেশকের ভূমিকা পালন করেন।  চমকপ্রদ নানা চিত্র সংযোজন উপেন্দ্রকিশোরের প্রকাশনার এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল। অপূর্ব দক্ষতায় শিল্পী রায়চৌধুরীর সম্পাদনা করেন ১৯১৩ সালে বিখ্যাত মাসিক পত্রিকা সন্দেশ। প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯১৩ সালে। আজও  কলকাতা থেকে প্রকাশিত একটি জনপ্রিয় শিশুকিশোর সাহিত্য পত্রিকা হল সন্দেশ। দেশবিদেশের গল্প, হাস্যকৌতুক, জ্ঞান বিজ্ঞানের কথা ইত্যাদি লেখার পাশাপাশি নিজের নানা বুদ্ধিদীপ্ত ছবি সংযোজনের মাধ্যমে সন্দেশকে তিনি কিশোর পত্রিকা হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন।

উপেন্দ্রকিশোর কিশোরদের জন্য বহু সাহিত্য পুস্তক রচনা করেছেন, এর মধ্যে উলে­খযোগ্য গ্রন্থ,ছোটদের রামায়ণ, ছোটদের মহাভারত, সেকালের কথা, মহাভারতের গল্প, ছোট্ট রামায়ণ, টুনটুনির বই এবং গুপী গাইন বাঘা বাইন। বইগুলির প্রচ্ছদ এবং ভেতরের ছবিও তিনি নিজেই অঙ্কন করেন। এ ছাড়া বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-এর উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদ এবং রবীন্দ্রনাথের ‘নদী’ কবিতার সঙ্গে সংযোজিত তাঁর অঙ্কন বিশেষ প্রশংসা লাভ করে। চিত্রাঙ্কনে তিনি সচরাচর পাশ্চাত্য প্রথায় তেলরঙ ও কালিকলম ব্যবহার করতেন। জলরঙের ছবিতেও তিনি কুশলী ছিলেন। ‘বলরামের দেহত্যাগ’ তাঁর অঙ্কিত একটি বিখ্যাত চিত্র।উপেন্দ্রকিশোর তাঁর প্রথম বই ছোটদের রামায়ণ।

বিশ্বে তখন রঙীন ছবি প্রযুক্তি প্রারম্ভিক পর্যায়ে মাত্র। গণিতে গভীর ব্যুৎপত্তি এবং সূক্ষ্ম বৈজ্ঞানিক দৃষ্টির সাহায্যে উপেন্দ্রকিশোর এদেশে বসেই এ বিষয়ে অনেক নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। নানা ধরনের ডায়াফ্রাম তৈরি, রে-স্ক্রিন অ্যাডজাস্টার যন্ত্র নির্মাণ, ব্লক নির্মাণের ডায়োটাইপ ও রি-প্রিন্ট পদ্ধতির উদ্ভাবন তাঁর মৌলিক অবদান। পশ্চিমা দেশে তাঁর উদ্ভাবিত প্রযুক্তি ও মুদ্রণ প্রণালীসমূহ বেশ প্রশংসিত হয়। লন্ডন থেকে প্রকাশিত পেনরোজেজ পিকটোরিয়াল অ্যানুয়াল পত্রিকার বিভিন্ন সংখ্যায় এ প্রসঙ্গে তাঁর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধও প্রকাশিত হয়। উপেন্দ্রকিশোর প্রতিষ্ঠিত ‘ইউ রায় অ্যান্ড সন্স’ কোম্পানির মাধ্যমেই ভারতবর্ষে প্রসেস-মুদ্রণ শিল্প বিকাশের সূত্রপাত ঘটে।

বাল্যকাল থেকেই উপেন্দ্রকিশোর সঙ্গীতচর্চার প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। তিনি পাখোয়াজ, হারমোনিয়াম, সেতার, বাঁশি, বেহালা ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র বাদনে দক্ষতা অর্জন করেন। তবে বেহালাই ছিল তাঁর বিশেষ প্রিয়। আদি ব্রাহ্মসমাজের উৎসবসমূহে সঙ্গীতের সঙ্গে তাঁর বেহালার বাজনা ছিল একটি বড় আকর্ষণ। পাশ্চাত্য সঙ্গীত সম্পর্কেও তিনি গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। বেহালা শিক্ষা এবং হার্মোনিয়াম শিক্ষা নামে তাঁর দুটি বই  বিখ্যাত। তাঁর পুত্র সুকুমার রায়ের জন্ম ১৮৮৭ সালের

৩০শে অক্টোবর, কলকাতার এক ব্রাহ্ম পরিবারে। সুকুমারের মা বিধুমুখী দেবী ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের মেয়ে। সুবিনয় রায় ও সুবিমল রায় তাঁর দুই ভাই। এ ছাড়াও তাঁর ছিল তিন বোন। সবরকমের সুবিধা নিয়ে সুন্দর পরিবেশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন উপেন্দ্রকিশোরের সন্তান সুকুমার রায়। উপেন্দ্রকিশোরের তৈরী জমিতে তার সন্তান জন্মেছিলেন। তার ফলে সাহিত্য আকাশে বড় হতে তার খুব বেশি বিলম্ব হয়নি। 

সুকুমার রায় জন্মেছিলেন বাঙালি নবজাগরণের স্বর্ণযুগে। তাঁর পারিবারিক পরিবেশ ছিল সাহিত্যনুরাগী, যা তাঁর মধ্যকার সাহিত্যিক প্রতিভা বিকাশে সহায়ক হয়। পিতা উপেন্দ্রকিশোর ছিলেন শিশুতোষ গল্প ও জনপ্রিয়-বিজ্ঞান লেখক, চিত্রশিল্পী, সুরকার ও শৌখিন জ্যোতির্বিদ। উপেন্দ্রকিশোরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যিনি সুকুমারকে সরাসরি প্রভাবিত করেছিলেন। এ ছাড়াও রায় পরিবারের সাথে জগদীশ চন্দ্র বসু, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় প্রমুখের সম্পর্ক ছিল। উপেন্দ্রকিশোর ছাপার ব্লক তৈরির কৌশল নিয়ে গবেষণা করেন, এ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান এবং মানসম্পন্ন ব্লক তৈরির একটি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। মেসার্স ইউ রয় অ্যান্ড সন্স নামে ঐ প্রতিষ্ঠানের সাথে সুকুমার যুক্ত ছিলেন।

কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৯০৬ সালে রসায়ন ও পদার্থবিদ্যায় বি.এস.সি.(অনার্স) করার পর সুকুমার মুদ্রণবিদ্যায় উচ্চতর শিক্ষার জন্য ১৯১১ সালে বিলেতে যান। সেখানে তিনি আলোকচিত্র ও মুদ্রণ প্রযুক্তির ওপর পড়াশোনা করেন এবং কালক্রমে তিনি ভারতের অগ্রগামী আলোকচিত্রী ও লিথোগ্রাফার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ১৯১৩ সালে সুকুমার কলকাতাতে ফিরে আসেন। সুকুমার ইংল্যান্ডে পড়াকালীন, উপেন্দ্রকিশোর জমি ক্রয় করে, উন্নত-মানের রঙিন হাফটোন ব্লক তৈরি ও মুদ্রণক্ষম একটি ছাপাখানা স্থাপন করেছিলেন। তিনি ছোটদের একটি মাসিক পত্রিকা, 'সন্দেশ', এই সময় প্রকাশনা শুরু করেন। সুকুমারের বিলেত থেকে ফেরার অল্প কিছু দিনের মধ্যেই উপেন্দ্রকিশোরের মৃত্যু হয়। উপেন্দ্রকিশোর জীবিত থাকতে সুকুমার লেখার সংখ্যা কম থাকলেও উপেন্দ্রকিশোরের মৃত্যুর পর সন্দেশ পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব সুকুমার নিজের কাঁধে তুলে নেন। সুকুমার রায় ছিলেন উপেন্দ্রকিশোরের পরবর্তী যোগ্য বংশধর। তিনি বাবার সমস্ত ছাপাখানা, প্রচ্ছদ শৈলী আয়ত্ত করেন অল্পসময়ে। নিজেও তিনি সাহিত্য আকাশে এক স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিগণিত হন। 

শুরু হয় বাংলা শিশুসাহিত্যের এক নতুন অধ্যায়। পিতার মৃত্যুর পর আট বছর ধরে তিনি সন্দেশ ও পারিবারিক ছাপাখানা পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর ছোটভাই এই কাজে তাঁর সহায়ক ছিলেন এবং পরিবারের অনেক সদস্য 'সন্দেশ'-এর জন্য নানাবিধ রচনা করে তাঁদের পাশে দাড়ান।সুকুমার রায়ের স্বল্পস্থায়ী জীবনে তাঁর প্রতিভার শ্রেষ্ঠ বিকাশ লক্ষ করা যায়। সন্দেশ পত্রিকার সম্পাদক থাকাকালীন সময়ে তাঁর লেখা ছড়া, গল্প ও প্রবন্ধ আজও বাংলা শিশুসাহিত্যে মাইলফলক হয়ে আছে। তাঁর বহুমুখী প্রতিভার অনন্য প্রকাশ তাঁর অসাধারণ ননসেন্স ছড়াগুলোতে। তাঁর প্রথম ও একমাত্র ননসেন্স ছড়ার বই আবোল তাবোল শুধু বাংলা সাহিত্যে নয়, বরং বিশ্বসাহিত্যের অঙ্গনে নিজস্ব জায়গার দাবিদার। প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়বার সময় তিনি ননসেন্স ক্লাব নামে একটি সংঘ গড়ে তুলেছিলেন। এর মুখপাত্র ছিল সাড়ে বত্রিশ ভাজা নামের একটি পত্রিকা। সেখানেই তাঁর আবোল তাবোল ছড়ার চর্চা শুরু। পরবর্তীতে ইংল্যান্ড থেকে ফেরার পর মন্ডা ক্লাব (ইংরেজি ভাষা) নামে একই ধরনের আরেকটি ক্লাব খুলেছিলেন তিনি। মন্ডা ক্লাবের সাপ্তাহিক সমাবেশে সদস্যরা 'জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ' পর্যন্ত সব বিষয়েই আলোচনা করতেন। সুকুমার রায় মজার ছড়ার আকারে এই সাপ্তাহিক সভার কয়েকটি আমন্ত্রণপত্র করেছিলেন সেগুলোর বিষয়বস্তু ছিল মুখ্যত উপস্থিতির অনুরোধ এবং বিশেষ সভার ঘোষণা ইত্যাদি। সুকুমার রায়ের মজার ছড়া পড়তে পড়তে কখন যে শিশু কিশোরবেলায় ফিরে যায় মানুষ তা বুঝতেও পারে না। এক অমলিন হাসির আড়ালে কত শিক্ষা যে লুকিয়ে আছে তার ইয়ত্তা নেই। সুকুমার লেখচিত্রী হিসেবে সুনাম অর্জন করেছিলেন। তাঁর প্রযুক্তিবিদের পরিচয় মেলে, নতুন পদ্ধতিতে হাফটোন ব্লক তৈরি আর ইংল্যান্ডের কয়েকটি পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর প্রযুক্তি বিষয়ক রচনাগুলো থেকে। সুকুমার রায়ের সৃষ্টি আজও আমাদের আলোড়িত করে। সেই তালিকায় রয়েছে আবোল তাবোল, পাগলা দাশু, হ য ব র ল, চলচ্চিত্র সহ অসংখ্য মণি। সোনার চামচ মুখে নিয়ে সোনার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন সত্যজিৎ রায়। তাঁর নেশা এবং সাধনা ছিল সিনেমাশিল্প। চলচ্চিত্র পরিচালনায় তাঁর অসাধারণ মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি বাংলা চলচ্চিত্রে একটি নতুন মাত্রা তৈরি করেছিল। এটা বললে ভুল হবে না যে শুধুমাত্র সত্যজিৎ রায়ের কারণেই আজ বাংলা ভাষায় তৈরি চলচ্চিত্র পৃথিবী জুড়ে সম্মানের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়। অনেকেই বলেন সত্যজিৎ রায় তাঁর ছবির মাধ্যমে বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতিকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরেছিলেন। অস্কার পেয়েছেন পথের পাঁচালী সিনেমা থেকে। 

চলচ্চিত্র নির্মাতা, চিত্রনাট্যকার, শিল্প নির্দেশক, সঙ্গীত পরিচালক এবং লেখক সত্যজিৎ রায় বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র নির্মাতাদের একজন হিসেবে বিশ্বে পরিচিতি লাভ করেছিলেন।তাঁর পূর্বপুরুষের ভিটা ছিল তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের কিশোরগঞ্জে উপজেলার মসুয়া গ্রামে। সেসময় তিনি ছিলেন ব্রাহ্ম আন্দোলনের অন্যতম একজন নেতা। তাঁর নিজের একটি ছাপাখানাও ছিল। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় ১৮ বৈশাখ ১৩২৮ বঙ্গাব্দে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম সুকুমার রায়, মাতার নাম সুপ্রভা দেবী। আদি নিবাস ছিল বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ জেলার মসুয়া গ্রামে। প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন তাঁর মায়ের কাছে। ৮ বৎসর বয়সে সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হন। বিগত বংশধরদের মতো সত্যজিৎ রায় ও নানা বিষয়ে পারদর্শী ছিলেন। শুধু চলচ্চিত্র পরিচালক নয় তিনি ছিলেন সাহিত্যিক, তিনি ছিলেন শিল্পী তিনি ছিলেন নানা গুণে গুণান্বিত। 

১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে বিদ্যালয়ের পাঠ শেষে তিনি ভর্তি হন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ প্রেসিডেন্সি কলেজে। পড়াশোনাতে সত্যজিৎ রায় খুব ভালো ছিলেন। তিনি সর্ব বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করতেন। বই পড়তে তার অনীহা ছিল না সব সময় বই পড়তে ভালো লাগতো। বাইরের বই পড়ে পড়ে তিনি অসংখ্য জ্ঞান অর্জন করেন। এই কলেজে প্রথম দু’ বছর বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেন। শেষ বছরে বিষয় পাল্টে তিনি অর্থনীতি পড়েন। ফলে তাঁর লেখাপড়ার সময় দীর্ঘতর হয়ে উঠে। এই সময়ে ইনি পাশ্চাত্য চিরায়ত চলচ্চিত্র এবং সঙ্গীত নিয়ে এতটাই আগ্রহী হয়ে উঠেন যে, তাঁর মূল পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটে। শেষ পর্যন্ত তিনি ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বি.এ (অনার্স) পাশ করেন। মায়ের উৎসাহে সত্যজিৎ ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে শান্তিনিকেতনে যান এবং সেখানকার কলাভবনে ভর্তি হন। এই সূত্রে তিনি বিখ্যাত চিত্রশিল্পী নন্দলাল বসু এবং বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের কাছে শিক্ষালাভের সুযোগ পান। নিয়মানুযায়ী বিশ্বভারতীতে সত্যজিতের পাঁচ বছর পড়াশোনা করার কথা থাকলেও তার আগেই তিনি শান্তিনিকেতন ছেড়ে কলকাতায় চলে আসেন।

১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে ডি জে কেমার নামক ব্রিটিশ বিজ্ঞাপন সংস্থায় 'জুনিয়র ভিজুয়ালাইজার' পদে যোগদান করেন। এখানে তিনি বেতন পেতেন ৮০ টাকা। ইনি প্রথম বিজ্ঞাপনে ভারতীয় ধাঁচের ক্যালিওগ্রাফিক উপাদান ব্যবহার করা শুরু করেন। একই সঙ্গে তিনি অক্ষরশৈলীতে বিশেষ আগ্রাহী হয়ে উঠেন। তাঁর নকশা করা দুটি ফন্ট 'Ray Roman' এবং 'Ray Bizarre' ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত একটি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পুরস্কার লাভ করেছিল।

তারপর তার চলচ্চিত্র বিষয়ে আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। তিনি চলচ্চিত্র বিষয়ে পড়াশোনা আরম্ভ করেন। বিভিন্ন দেশ-বিদেশের বই পড়তে শুরু করেন এবং সঙ্গে সঙ্গে বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালী রুপোর কাজ শুরু করেন। 

এই সময় থেকে খুব আগ্রহ নিয়ে চলচ্চিত্র দেখা শুরু করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি কলকাতায় অবস্থানরত মার্কিন সেনাদের সাথে যোগাযোগ করে নতুন মার্কিন চলচ্চিত্রগুলোর বিষয়ে খবর নিতেন। বিশেষ করে নরম্যান ক্লেয়ার নামের রয়্যাল এয়ারফোর্সের এক কর্মচারী এ বিষয়ে তাঁকে বিশেষ ভাবে সাহায্য করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে কলকাতার প্রেক্ষাগৃহগুলোতে হলিউডে নির্মিত প্রচুর ছবি দেখানো হতো। এই সূত্রে হলিউডের চলচ্চিত্রগুলো কলকাতার চলচ্চিত্র প্রেমিকদের কাছে প্রধান আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠেছিল। ১৯৪৭ সালে সত্যজিৎ এবং বংশী চন্দ্রগুপ্ত কলকাতা ফিল্ম সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন। এই সোসাইটিতে চলচ্চিত্র দেখানো হতো এবং এই বিষয়ে পরে ঘরোয়াভাবে আলোচনার ব্যবস্থা করা হতো। উল্লেখ্য এই সমিতি প্রথম প্রদর্শন করেছিল ‘ব্যাটেলশিপ পটেমকিন’। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে তৈরি নির্বাক চলচ্চিত্র। পরিচালক ছিলেন সোভিয়েত রাশিয়ার সেরগেই আইজেনস্টাইন। সত্যজিৎ রায়ের সুপুত্র সন্দীপ রায় এখন সন্দেশ পত্রিকার সম্পাদক। সন্দীপ রায়ের পরিচালনায় গুপি বাঘা ফিরে এল, চলচ্চিত্র দর্শকমহলে সমাদৃত হয়েছে। সন্দীপ রায় হয়ত আবার রেখে যাবেন কোন হীরের টুকরো, রায় পরিবারের যোগ্য উত্তরসূরী।

বর্তমান পূর্ব বর্ধমান জেলা অনেক কবি সাহিত্যিকের পীঠস্থান। কবি কাশীরাম দাস থেকে শুরু করে কবিশেখর কালিদাস রায়, কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিক ইত্যাদি। আজ আমি কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিকের জীবনী ও সাহিত্য সম্পর্কে দু চার কথা বলব। উনবিংশ শতকে সমগ্র বাংলা সাহিত্য জগত যখন কবি গুরু রবীন্দ্রনাথের কাব্যগাথার ছটায় উদ্ভাসিত, ঠিক সেই সময় নিজের স্বতন্ত্র লেখনী প্রতিভা নিয়ে কাব্য জগতে আবির্ভূত হলেন কবি কুমুদ রঞ্জন মল্লিক। তিনি ১৮৮৩ সনের ৩রা মার্চ অবিভক্ত বাংলার, বর্ধমান জেলার কোগ্রাম নামক গ্রামে এক বৈদ্য ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ছাত্র হিসাবে তিনি খুবই মেধাবী ছিলেন। ১৯০৫ সনে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হন এবং বঙ্কিম চন্দ্র স্বর্ণ পদকে ভূষিত হন।

পরবর্তীকালে বর্ধমানের মাথ্রন নবীনচন্দ্র বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার কাজে যোগ দেন এবং এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার আলোকেই পরবর্তীকালে বাংলার আর এক স্বনামধন্য কবি বিদ্রোহী কবি রূপে আত্মপ্রকাশ করেন ।কথিত আছে তাঁর গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া অজয় ও কুনুর নদীই তাঁর কবিতার মুখ্য প্রেরণা। তাঁর কবিতা মুখ্যত বৈষ্ণব ভাবনায় সম্পৃক্ত হলেও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও গ্রাম বাংলার প্রতি ভালবাসা তাঁর কবিতাগুলিকে করেছে এক অনবদ্য সৃষ্টির আধার। তাঁর কবিতায় ধর্মের উপস্থিতি থাকলেও তা ছিল ধর্মীয় সংকীর্ণতার উরদ্ধে। তাঁর রচিতউল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলি হল উজানী (১৯১১), বনতুলসী (১৯১১), অজয় (১৯২৭), স্বর্ণ সন্ধ্যা (১৯৪৮) প্রভৃতি। তবে তিনি তাঁর সাহিত্যকর্মকে কাব্য জগতে আবদ্ধ না রেখে নাট্য রচনার দিকেও প্রসারিত করেছিলেন। তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য নাটক হল দ্বারাবতী (১৯২০)। তিনি জগত্তারিণী স্বর্ণ পদক এবং স্বাধীনতার পর ভারত সরকার দ্বারা পদ্মশ্রী পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন।
কুমুদরঞ্জন ১৯০১ সালে এন্ট্রান্স, ১৯০৩ সালে রিপন কলেজ থেকে এফএ এবং ১৯০৫ সালে বঙ্গবাসী কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। পরে বর্ধমানের মাথরুন উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন এবং সেখান থেকেই ১৯৩৮ সালে প্রধান শিক্ষকরূপে অবসর গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য যে, কাজী নজরুল ইসলাম ওই স্কুলে তাঁর ছাত্র ছিলেন। কুমুদরঞ্জনের কবিত্বশক্তির বিকাশ ঘটে বাল্যকালেই। পল্লীর মানুষ ও প্রকৃতি তাঁর কাব্যের প্রধান বিষয়। তাঁর কবিতায় নির্জন গ্রামজীবনের সহজ-সরল রূপ চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। পল্লী-প্রবণতার সঙ্গে বৈষ্ণবভাবুকতা যুক্ত হয়ে তাঁর কবিতার ভাব ও ভাষাকে স্নিগ্ধতা ও মাধুর্য দান করেছে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘কুমুদরঞ্জনের কবিতা পড়লে বাঙলার গ্রামের তুলসীমঞ্চ, সন্ধ্যাপ্রদীপ, মঙ্গলশঙ্খের কথা মনে পড়ে।’ তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনা: উজানী (১৯১১), বনতুলসী (১৯১১), শতদল (১৯১১), একতারা (১৯১৪), বনমল্লিকা (১৯১৮), নূপুর (১৯২০), রজনীগন্ধা (১৯২১), অজয় (১৯২৭), তূণীর (১৯২৮), স্বর্ণসন্ধ্যা (১৯৪৮) ইত্যাদি।শিক্ষাবিদ, কবি। ১৮৮৩ সালের ১ মার্চ পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার কোগ্রামে মাতুলালয়ে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস একই জেলার শ্রীখন্ড গ্রামে। পিতা পূর্ণচন্দ্র মল্লিক ছিলেন কাশ্মীর রাজসরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। কুমুদরঞ্জন ১৯০১ সালে এন্ট্রান্স, ১৯০৩ সালে রিপন কলেজ থেকে এফএ এবং ১৯০৫ সালে বঙ্গবাসী কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। পরে বর্ধমানের মাথরুন উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন এবং সেখান থেকেই ১৯৩৮ সালে প্রধান শিক্ষকরূপে অবসর গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য যে, কবি নজরুল ওই স্কুলে তাঁর ছাত্র ছিলেন। কুমুদরঞ্জনের কবিত্বশক্তির বিকাশ ঘটে বাল্যকালেই। পল্লীর মানুষ ও প্রকৃতি তাঁর কাব্যের প্রধান বিষয়। তাঁর কবিতায় নির্জন গ্রামজীবনের সহজ-সরল রূপ চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। পল্লী-প্রবণতার সঙ্গে বৈষ্ণবভাবুকতা যুক্ত হয়ে তাঁর কবিতার ভাব ও ভাষাকে স্নিগ্ধতা ও মাধুর্য দান করেছে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘কুমুদরঞ্জনের কবিতা পড়লে বাঙলার গ্রামের তুলসীমঞ্চ, সন্ধ্যাপ্রদীপ, মঙ্গলশঙ্খের কথা মনে পড়ে।’ তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনা: উজানী (১৯১১), বনতুলসী (১৯১১), শতদল (১৯১১), একতারা (১৯১৪), বনমল্লিকা (১৯১৮), নূপুর (১৯২০), রজনীগন্ধা (১৯২১), অজয় (১৯২৭), তূণীর (১৯২৮), স্বর্ণসন্ধ্যা (১৯৪৮) ইত্যাদি। কুমুদরঞ্জন বাংলার কবি-সাহিত্যিকদের প্রতিষ্ঠান সাহিত্যতীর্থের ‘তীর্থপতি’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি কলকাতা ইউনিভার্সিটি কর্তৃক ‘বঙ্কিমচন্দ্র স্বর্ণপদক’ (১৯০৫) ও ‘জগত্তারিণী স্বর্ণপদক’ এবং ভারত সরকার কর্তৃক ‘পদ্মশ্রী’ উপাধিতে ভূষিত হন। ১৯৭০ সালের ১৪ ডিসেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়। বর্ধমান জেলার মাথরুন নবীনচন্দ্র বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকরূপে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে অবসর গ্রহণ করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখনীয় এই যে, বাংলার বিদ্রোহী কবি নজরুল ওই স্কুলে তাঁর ছাত্র ছিলেন।

কোলকাতার কালীঘাট অঞ্চলের ৪৩ নং মহিম হালদার স্ট্রীট। জনপূর্ণ এলাকা। সবাই ব্যস্ত। সুনীতি দেবী এসেছেন বাপের বাড়ি। তিনি সন্তানসম্ভবা। দ্বিতীয় সন্তান হবে। তখনকার দিনে বাড়িতে ধাত্রীমাতা আসতেন বাড়িতে। তিনি এসে বললেন, আর দেরী নেই। রাতের মধ্যেই বাচ্চা প্রসব হবে। তখন ফোন এত ছিল না। অফিসে আদালতে ফোন থাকত। এদিকে সুনীতির স্বামী চিন্তায় মগ্ন। ফরিদপুরে উনশিয়া গ্রামে থাকেন। কোলকাতা থেকে অনেকদূর। বড়ছেলেকে নিয়ে খুব চিন্তায় আছেন। তারপর মাসখানেক পরে খবর পেলেন আবার পুত্রসন্তান প্রসব করেছেন তার স্ত্রী। নিবারণ ভট্টাচার্য গ্রামের সকলকে মিষ্টিমুখ করালেন। তার রানীদি ভাইয়ের নাম দিলেন সুকান্ত। তখন ১৯২৬ সাল। পরাধীন ভারতবর্ষে ব্রিটিশ রাজ চলছে। অত্যাচার আর অবিচারে বিপ্লবীদের ফাঁসি দিচ্ছে সরকার একের পর এক। সুনীতি দেবির মোট সন্তান ছিল ছয়জন। তিনি স্বামীকে বললেন, আর নয়। এবার ছেলেদের মানুষের মত মানুষ করতে হবে। তারপর ফরিদপুরে স্কুলে ভরতি হলেন সুকান্ত। তাঁর ছয় ভাইয়ের মধ্যে ছিলেন দ্বিতীয়। তাঁর ভাইদের নাম যথাক্রমে - মনমোহন, সুশীল, প্রশান্ত, বিভাষ, অশোক এবং অমীয় ছিলো। তিনি তাঁর বড় দাদা মনমোহন এবং বৌদি সরজু দেবীর বড় আদরের ছিলেন। তাঁর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ ছিলেন রানীদি।সেইসময়ের বিখ্যাত কথা সাহিত্যিক মনিন্দ্রলাল বসুর “সুকান্ত” গল্পটি পড়ে, তিনি তাঁর নাম রেখেছিলেন সুকান্ত। জানা যায়, তাঁর প্রিয় রানীদির জন্যই নাকি তিনি সাহিত্যকর্মের প্রতি আকৃষ্ট হন। রানীদি বললেন, তোর খাতায় লেখা কবিতা আমি দেখেছি। তুই কবিতা লেখ। একদিন তুই অনেক বড় হবি। তোর নাম ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়বে। সুকান্ত বললেন, তুমি কি করে জানলে আমি বড় কবি হব। ও কথা বোলো না। আমার লজ্জা লাগে দিদি। রানীদি বললেন, আমার কথা ফেলিস না ভাই। সুকান্ত বলেছিল, চেষ্টা করব তোমার কথা মেনে চলার। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তাঁর রানীদি তাঁর কোনো সাহিত্যকর্মই দেখে যেতে পারেননি, এর প্রধান কারণ তিনি খুব তাড়াতাড়ি মারা যান। তারপর দিদির মারা যাওয়ার কিছুদিন পরেই আবার তাঁর মা সুনীতিদেবীও পরলোক গমন করেন। পরপর চোখের সামনে দুটো মৃত্যু, সুকান্তকে ভীষণ শোকাহত এবং মর্মাহত করে তোলে, যারফলে তাঁর মানসিক অবস্থা পুরোপুরি বিদ্ধস্ত হয়ে যায় বেশ কিছুদিন। এই চরম শোকের মূহুর্তেই তিনি রচনা করে অনেক কবিতা। নিঃসঙ্গতার সময় সেইসব কবিতাই ছিলো তাঁর একমাত্র সঙ্গী। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের বাল্যশিক্ষা শুরু হয় কোলকাতার কমলা বিদ্যামন্দির থেকে। এখানেই তাঁর লেখা প্রথম ছোটগল্প প্রকাশিত হয় স্কুলেরই নিজেস্ব পত্রিকা “সঞ্চয়ে”। সেই স্কুলে তিনি বেশ কিছুবছর পড়াশোনা করেন, এবং তারপর তিনি ভর্তি হন বেলেঘাটা দেশবন্ধু হাইস্কুলে। এরপর ১৯৪৫ সালে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষা দেন কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তিনি সেই পরীক্ষায় ফেল করেন।বাড়িতে তার বাবা বললেন, ফেল করেছিস তো কি হয়েছে। মনে রাখবি এটা সাফল্যের এক একটা স্তম্ভ। সুকান্ত বলল, আমার স্কুলে যেতে লজ্জা করছে। তার বাবা বললেন, স্কুলে তুমি যাও। এবার দেখ তুমি পাশ করবে। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই কবি সুকান্ত বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত ছিলেন। এই সময় ছাত্র আন্দোলন ও বামপন্থী রাজনৈতিক কাজের সাথে যুক্ত হওয়ায জন্য, তাঁর পড়াশোনার পরিসমাপ্তি ঘটে। ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও অনৈতিক ব্রিটিশ শাসন প্রভৃতির বিরুদ্ধে তিনি ও তাঁর দল ভীষণভাবে সোচ্চার হন। তিনি তাঁর সীমিত জীবনকালে যা কিছু সাহিত্যসৃষ্টি করে গেছেন তা সত্যিই এক কথায় অনবদ্য। তিনি মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, মন্বন্তর, ফ্যাসিবাদ আগ্রাসন ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রভৃতির বিরুদ্ধে সেইসময় কলম ধরেছিলেন। তাঁর সমস্ত সাহিত্যকর্ম আজও প্রত্যেক বাঙালী পাঠকদের সমানভাবে মাতিয়ে রাখে। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই কবি সুকান্ত বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত ছিলেন। এই সময় ছাত্র আন্দোলন ও বামপন্থী রাজনৈতিক কাজের সাথে যুক্ত হওয়ায জন্য, তাঁর পড়াশোনার পরিসমাপ্তি ঘটে। ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন,  সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও অনৈতিক ব্রিটিশ শাসন প্রভৃতির বিরুদ্ধে তিনি ও তাঁর দল ভীষণভাবে সোচ্চার হন। ১৯৪৪ সালে তিনি এরপর ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন। সেই বছরই “আকাল” নামক একটি সংকলনগ্রন্থ তিনি সম্পাদনাও করেন এবং সেখানেই শোষিত মানুষের কর্ম জীবন, ভবিষ্যৎ পৃথিবীর জন্য সংগ্রাম, সমাজের দুর্দশাজনিত বেদনা এবং শোষণ মুক্ত স্বাধীন সমাজের স্বপ্ন প্রভৃতি বিষয় নিয়ে কবিতা লিখতে থাকেন। তাঁর সেই কবিতা সংকলন মানুষকে ভীষণভাবে সাহস ও অনুপ্রেরণা যোগায় রাজনৈতিক কর্মকান্ডে লিপ্ত হওয়ার জন্য ১৯৪১ সালে সুকান্ত ভট্টাচার্য কোলকাতা রেডিও আয়জিত “গল্পদাদুর আসর” নামক এক অনুষ্ঠানে যোগদান করেন। 

সেখানে তিনি প্রথমে রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি করতেন। যখন রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু হয়, তখন সেই আসরেই তিনি নিজের লেখা কবিতা পাঠ করে তাঁকে শ্রদ্ধাও জানান। মঞ্চে এক প্রাবন্ধিক তার বক্তব্যে বলেছিলেন, তুমি যদি এটা ভেবে থাকো যে সুকান্ত ভট্টাচার্য শুধু একজন কবি ছাড়া আর কিছুই ছিলেন না, তাহলে তোমার সেই ভাবনা একেবারে ভুল। কারণ তিনি কবিতা লেখার সাথেই সাথেই বিভিন্ন গান, গল্প, নাটক এবং প্রবন্ধও রচনা করেছিলেন। মাত্র এগারো বছর বয়সে তিনি “রাখাল ছেলে” নামে একটি গীতিনাট্য রচনা করেছিলেন, যেটা পরে “হরতাল” নামক বইতে সংকলিত হয়েছিলো। তাঁর সমস্ত রচনাবলীর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো - ছাড়পত্র (১৯৪৭), গীতিগুচ্ছ (১৯৬৫), পূর্বাভাস (১৯৫০), মিঠেকড়া (১৯৫১), অভিযান (১৯৫৩), ঘুম নেই (১৯৫৪), হরতাল (১৯৬২), প্রভৃতি। পরবর্তীকালে উভয় বাংলা থেকেই “সুকান্ত সমগ্র” নামে তাঁর রচনাবলী প্রকাশিত হয়। জীবনের প্রতিটি অংশেই সুকান্ত যেন অনিয়মকেই তাঁর জীবনের অঙ্গ করে তুলেছিলেন। কবি সুকান্ত তার বন্ধুদের বলতেন, আমার যেমন পার্টির কাজ, তেমনই অন্যদিকে সাহিত্যকর্ম, অভাব ও অনটন। এইসব কিছুর ধকল আমার শীর্ণ শরীর আর মানতে পারছে না। বন্ধুরা তাকে সাহায্য করতেন অর্থ দিয়ে। তারা বলতেন, শরীরের যত্ন নে। তা নাহলে তোর বিপদ হবে। তবুও কবি লিখে যেতেন কষ্ট করে। অত্যধিক পরিশ্রমের ফলে নিজের শরীরের উপর যে অত্যাচারটুকু তিনি করেন তাতে তাঁর শরীরে প্রথমে ম্যালেরিয়া ও পরে দুরারোগ্য যক্ষারোগ এসে হানা দেয়। বন্ধুরা তাঁকে দেখতে আসতেন আর সাবধানবাণী শোনাতেন। কবি মুচকি হেসে বলতেন, দেখবি একদিন পালিয়ে যাব ফাঁকি দিয়ে। এই ম্যালেরিয়া আর যক্ষার আদরে আমি জর্জরিত। এক কবিসভায় কোনো এক কবিবন্ধু তাঁকে পাল্কি করে নিয়ে গেছিলেন। সেই সভায় বন্ধুটি কবির সম্বন্ধে দু চার কথা লিখেছিলেন। তিনি কবির সামনেই সেই লেখা পাঠ করেছিলেন। তিনি সভায় সকলকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আট-নয় বছর বয়স থেকেই সুকান্ত লিখতে শুরু করেন। তিনি আমার বন্ধুসম। তাঁর কাছেই শোনা কথাগুলি আমি বর্ণনা করছি। কবি তো প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি বললেন আমাকে আগে এই কথা বললে না। আমার সামনে আমারই স্তুতি নিবেদন করবে তুমি। এ যে ভীষণ লজ্জার। বন্ধু বলেছিলেন, আগে বললে উনি তো অনুমতি দিতেন না ভাই। তাই বলছি। আমাকে ক্ষমা কোরো। সমবেত সকলে হাততালি দিয়ে জয়ধ্বনি করলেন। তারপর তাঁর বন্ধু বলতে শুরু করলেন, আমি আমার বন্ধুর সাহিত্যকর্ম বিষয়ে কয়েকটি সংবাদ পরিবেশন করব। স্কুলের হাতে লেখা পত্রিকা ‘সঞ্চয়ে’ একটি ছোট্ট হাসির গল্প লিখে আত্মপ্রকাশ করেন। তার দিনকতক পরে বিজন গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘শিখা’ কাগজে প্রথম ছাপার মুখ দেখে তার লেখা বিবেকান্দের জীবনী। মাত্র এগার বছর বয়সে ‘রাখাল ছেলে’ নামে একটি গীতিনাট্য রচনা করেন। এটি পরে তার ‘হরতাল’ বইতে সংকলিত হয়। বলে রাখা ভালো, পাঠশালাতে পড়বার কালেই ‘ধ্রুব’ নাটিকার নাম ভূমিকাতে অভিনয় করেছিলেন সুকান্ত। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় বাল্য বন্ধু লেখক অরুণাচল বসুর সঙ্গে মিলে আরেকটি হাতে লেখা কাগজ ‘সপ্তমিকা’ সম্পাদনা করেন। অরুণাচল তার আমৃত্যু বন্ধু ছিলেন। মার্কসবাদী চেতনায় আস্থাশীল কবি হিসেবে সুকান্ত কবিতা লিখে বাংলা সাহিত্যে স্বতন্ত্র স্থান করে নেন। সুকান্তকে বলা হয় গণমানুষের কবি। অসহায়-নিপীড়িত সর্বহারা মানুষের সুখ, দুঃখ তার কবিতার প্রধান বিষয়। অবহেলিত মানুষের অধিকার আদায়ের স্বার্থে ধনী মহাজন অত্যাচারী প্রভুদের বিরুদ্ধে নজরুলের মতো সুকান্তও ছিলেন সক্রিয়। যাবতীয় শোষণ-বঞ্চনার বিপক্ষে সুকান্তের ছিল দৃঢ় অবস্থান। তিনি তার কবিতার নিপুণ কর্মে দূর করতে চেয়েছেন শ্রেণী বৈষম্য। মানবতার জয়ের জন্য তিনি লড়াকু ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। অসুস্থতা অর্থাভাব তাকে কখনো দমিয়ে দেয়নি। মানুষের কল্যাণের জন্য সুকান্ত নিরন্তর নিবেদিত থেকেছেন। তিনি মানবিক চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে বিদ্রোহের ডাক দিয়েছেন। তার অগ্নিদীপ্ত সৃষ্টি প্রণোদনা দিয়ে সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করতে প্রয়াসী ছিলেন। মানবিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য বাংলা কাব্যধারার প্রচলিত প্রেক্ষাপটকে আমূল বদলে দিতে পেরেছিলেন। সুকান্ত কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা দৈনিক স্বাধীনতার (১৯৪৫) ‘কিশোর সভা’ বিভাগ সম্পাদনা করতেন। মার্কসবাদী চেতনায় আস্থাশীল কবি হিসেবে সুকান্ত কবিতা লিখে বাংলা সাহিত্যে স্বতন্ত্র স্থান করে নেন।তার কবিতায় অনাচার ও বৈষ্যমের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ পাঠকদের সংকচিত করে তোলে। গণমানুষের প্রতি গভীর মমতায় প্রকাশ ঘটেছে তার কবিতায়। তার রচনাবলির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো:  পূর্বাভাস (১৯৫০), মিঠেকড়া (১৯৫১), অভিযান (১৯৫৩), ঘুম নেই (১৯৫৪), হরতাল (১৯৬২), গীতিগুচ্ছ (১৯৬৫) প্রভৃতি। পরবর্তীকালে উভয় বাংলা থেকে সুকান্ত সমগ্র নামে তার রচনাবলি প্রকাশিত হয়। সুকান্ত ফ্যাসিবাদবিরোধী লেখক ও শিল্পিসঙ্ঘের পক্ষে আকাল (১৯৪৪) নামে একটি কাব্যগ্রন্থ সম্পাদনা করেন। সুকান্তের কবিতা বিষয়বৈচিত্র্যে ও লৈখিক দক্ষতায় অনন্য। সাধারণ বস্তুকেও সুকান্ত কবিতার বিষয় করেছেন। বাড়ির রেলিং ভাঙা সিঁড়ি উঠে এসেছে তার কবিতায়। সুকান্তের কবিতা সব ধরনের বাধা-বিপত্তিকে জয় করতে শেখায়। যাপিত জীবনের দুঃখ-যন্ত্রণাকে মোকাবেলা করার সাহস সুকান্তের কবিতা থেকে পাওয়া যায়। তারুণ্যের শক্তি দিয়ে উন্নত শিরে মানুষের মর্যাদার জন্য মানুষকে প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান সুকান্তের কবিতায় লক্ষণীয়। সুকান্তের কবিতা সাহসী করে, উদ্দীপ্ত করে। তার বক্তব্যপ্রধান সাম্যবাদী রচনা মানুষকে জীবনের সন্ধান বলে দেয়। স্বল্প সময়ের জীবনে তিনি বাংলা সাহিত্যকে অনেক কিছু দিয়ে গেছেন। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, দিজেন্দ্রলাল রায়, জীবনানন্দ দাশসহ সে সময়ের বড় বড় কবির ভিড়ে তিনি হারিয়ে যাননি। নিজের যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখে গেছেন নিজ প্রতিভা, মেধা ও মননে। সুকান্ত তার বয়সিক সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করেছেন তার পরিণত ভাবনায়। ভাবনাগত দিকে সুকান্ত তার বয়স থেকে অনেক বেশি এগিয়ে ছিলেন। এখন তিনি ম্যালেরিয়া ও যক্ষা রোগে আক্রান্ত। আপনাদের সাহায্য চাই। সকলের সমবেত প্রচেষ্টায় প্রিয় কবিকে রেড এড কিওর হোমে ভরতি করা হয়। কিন্তু তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে। যার ফলে ১৯৪৭ সালের ১৩ই মে তারিখে কোলকাতার ১১৯ নম্বর লাউডট ট্রিষ্ট্রের অন্তর্গত “রেড এড কিওর হোমে” তিনি অবশেষে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর সময় তার বয়স ছিল মাত্র একুশ। স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেও তিনি স্বাধীন দেশের আনন্দ আস্বাদন করার সুযোগ পাননি। আদি শঙ্কর বাংলার রাজ্যের এক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।তিনি সারা ভারত পর্যটন করে অন্যান্য দার্শনিকদের সঙ্গে আলোচনা ও বিতর্কে অংশগ্রহণের মাধ্যমে নিজের দার্শনিক মতটি প্রচার করেন। তিনি চারটি মঠ প্রতিষ্ঠা করেন। এই মঠগুলি অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের ঐতিহাসিক বিকাশ, পুনর্জাগরণ ও প্রসারের জন্য বহুলাংশে দায়ী। শঙ্কর নিজে অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের প্রধান প্রবক্তা হিসেবে খ্যাত। এছাড়া তিনি হিন্দু সন্ন্যাসীদের ও হিন্দুদের পূজার নামক পদ্ধতির প্রবর্তক।সংস্কৃতে লেখা আদি শঙ্করের রচনাবলির প্রধান লক্ষ্য ছিল তত্ত্বের প্রতিষ্ঠা। সেযুগে হিন্দু দর্শনের শাখাটি অতিরিক্ত আনুষ্ঠানিকতার উপর জোর দিত এবং সন্ন্যাসের আদর্শকে উপহাস করত। আদি শঙ্কর পুরোনো তত্ত্ব অবলম্বনে সন্ন্যাসের গুরুত্ব তুলে ধরেন। তিনি উপনিষদ্‌, ব্রহ্মসূত্র ও ভাষ্যও রচনা করেন। এই সব বইতে তিনি তার প্রধান প্রতিপক্ষ মীমাংসা শাখার পাশাপাশি হিন্দু দর্শনের  শাখা ও বৌদ্ধ দর্শনের মতও খণ্ডন করেন। তিনি একটি গ্রন্থ রচনা করেন তালপাতায়। পরে পুস্তকরূেপে আত্মপ্রকাশ করে। এরপর আর এক সাধু, বারানসীর পঞ্চগঙ্গার প্রাচীনঘাটের নিকটে মহাকায় উলঙ্গ সাধু পদ্মাসনে চোখ বন্ধ করে বসে আছেন। তার সামনে হাজার নর-নারী সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে। একজন একজন করে সাধুর পায়ে মাথা ঠেকিয়ে স্থান ত্যাগ করছে। তারা বিভিন্ন বর চাইছে। এরা সবাই সন্ধ্যাকালীন স্নান শেষে সাধুকে প্রণাম করে হৃষ্ট মনে আপন নিবাসে ফেরত যাচ্ছে। কিন্তু নির্বিকার ধ্যানগম্ভীর সাধুর এতে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। বারানসীর আপামর জনতার কাছে উলঙ্গ, মৌন সাধক তৈলঙ্গস্বামী নামে পরিচিত। ভক্তরা তাকে ভালবেসে বাবা মহাদেব বলেও সম্ভাষণ করেন। শ্রীতৈলঙ্গনাথ স্বামীজির জন্মসাল নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তবে সপ্তদশ শতকের প্রথম দিকেই তার জন্ম বলে বেশিরভাগ ইতিহাসবিদের দাবি। প্রচলিত আছে, অন্ধ্রদেশের ভিজিয়ানা গ্রামের হোলিয়া নামক অঞ্চলে তার জন্ম। তার জন্মদাতার নাম নরসিংহ রাও এবং মাতার নাম বিদ্যাবতী রাও। নরসিংহ রাও এ অঞ্চলে ধনবান ব্যক্তি ছিলেন। ধার্মিকতা আর সততার জন্য জনপ্রিয় ছিলেন হোলিয়া জনগণের কাছে। তার স্ত্রী বিদ্যাবতীরও ভক্তিমতী, সাধিকা হিসেবে সুনাম ছিল যথেষ্ট। নরসিংহ রাও তার স্ত্রী বিদ্যাবতীর সাথে অনেকদিন যাবত ঘর করার পরেও সন্তানসুখ লাভ করছিলেন না। বংশরক্ষার তাগিদে নরসিংহ রাও পুনরায় বিয়ে করতে বাধ্য হন। কিন্তু কয়েকমাসের মধ্যে বিদ্যাবতী সবাইকে অবাক করে অন্তঃসত্ত্বা হন। প্রচলিত আছে, তিনি রাতদিন নিজ গৃহে প্রতিষ্ঠিত শিবলিঙ্গের পূজাতেই মগ্ন থাকতেন এবং অসুস্থ অসহায় মানুষের সেবাতে নিজেকে নিয়োজিত করেন। তার ভক্তি আর সেবার গুণে মুগ্ধ হয়ে দেবাধিদেব তার ওপর কৃপাধারা বর্ষিত করেন। মহাযোগী শ্রীশ্রী তৈলঙ্গস্বামী ২৬শে ডিসেম্বর আসেন নশ্বর জগতেে। একশত পঞ্চাশ বছরের বারাণসী নিবাসী একদিন গঙ্গা থেকে জল বিহার করে সুস্থ দেহে ফিরে আসেন ৮০ বৎসরের আবাসস্থল মঙ্গল দাস ঠাকুরের বাড়ীতে। তখন মঙ্গল দাস ঠাকুর ও অন্যান্য আরো কয়েকজন ভক্ত উপস্থিত ছিল। তিনি ভক্তদেরকে ডেকে বলেন এবার তোরা আমায় বিদায় দে। আমি ঠিক করেছি সমাধিযোগে আজই দেহত্যাগ করবো। ভক্তরা কথাটি শুনে কান্নায় ভেঙ্গে পরেন। শেষ পর্যন্ত ভক্তদের বিশেষ অনুরোধে আশ্রমে মূর্তি নির্মাণ সহ ভক্তদের অন্যান্য ইচ্ছা পূরণের জন্য তিনি দেহরক্ষার দিন এক মাস পিছিয়ে মহা-সমাধির দিন ধার্য করে দেন। সেই অনুসারে তিনি ২৬শে ডিসেম্বর ১৮৮৭ সালে সোমবার পৌষ মাসের শুক্লা একাদশীর বিকেলে মহা-যোগে বারাণসীর পঞ্চগঙ্গা ঘাটের নিকটে মঙ্গল দাসের বাড়ীতে দেহরক্ষা  করেন। তাঁর ইচ্ছে তাঁর দেহটি যেন একটি কাঠের বাক্সে ঢুকিয়ে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়। অসি ঘাট থেকে যাত্রা করে বরণা পর্যন্ত পরিক্রম শেষে পঞ্চগঙ্গা ঘাটের অদূরে গঙ্গায় বিসর্জন দেওয়া হয়। সেই অনুসারে ভক্তগণ একটি চন্দনকাঠের বাক্স তৈরী করেন। বাক্সের মধ্যে বিছানা পাতা হয়। মহাযোগীর মহাপ্রয়ানের পর দেহটি সেই বাক্সে ঢুকিয়ে সেটি তালাবদ্ধ করা হয়। ঘাট থেকে বরণা ঘাট পর্যন্ত পরিক্রমা শেষে বাক্সটি পঞ্চগঙ্গা ঘাটের অদূরে গঙ্গায় বিসর্জন দেওয়া হয়। বিসর্জনের পর বাক্সটি না ডুবে ভাসতে থাকে। বাক্সটি মাঝ গঙ্গায় গেলে এর ভিতর থেকে এক জ্যোতির্ময় রশ্মি বাহির হয়ে আসে। ভাসতে ভাসতে বাক্সটি উজানের দিকে চলে যায়। লক্ষ লক্ষ মানুষ ঐদিন গঙ্গার পাড়ে উপস্থিত থেকে তাঁর সমাধির দৃশ্য অবলোকন করেন। তাঁর দেহটি একটি চন্দন কাঠের বাক্সে ঢুকিয়ে তালাবদ্ধ করে একটি নৌকায় তোলা হয়। অসি ঘাট থেকে যাত্রা করে বরনা ঘাট পর্যন্ত পরিক্রম শেষে পঞ্চগঙ্গা ঘাটের অদূরে গঙ্গায় বিসর্জন দেওয়া হয়। এবার গুরুকে বাদ দিয়ে তাঁরা দু’জনে পদযাত্রায় আবার দেশভ্রমণ শুরু করেন। প্রথমে আফগানিস্তান, পারস্য, আরব, মক্কা-মদীনা, মক্কেশ্বর তীর্থস্থান, তুরস্ক, ইতালি, গ্রিস, সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স, ইউরোপ-সহ বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করে দেশে ফিরে আসেন এবং পরে দেশের ভিতর হরিদ্বার, হিমালয় তীর্থ, বদ্রীনাথ, সুমেরু পর্বত, কাশীধাম ও কাবুল পরিদর্শন করেন। দিনে দিনে গুরুর বয়স একশ বছর ও শিষ্যদের বয়স পঞ্চাশ বছর হলো।গুরুদেব ভগবান গাঙ্গুলী শিষ্য দু’জনকে শ্রীতৈলঙ্গস্বামীর (হিতলাল নামে যিনি পরিচিত) হাতে তুলে দিয়ে পরলোক গমন করেন। একবার নারায়ণগঞ্জের বারদীর জমিদার নাগ মহাশয় লোকনাথের কথা শুনে তাঁর জন্য জমি দান করেন এবং সেখানে মহা ধুম-ধামের সঙ্গে আশ্রম স্থাপন করা হয়। লোকনাথ ব্রহ্মচারীর আশ্রমের কথা শুনে দেশ-দেশান্তর হতে বহু ভক্ত এসে ভিড় জমাতে থাকেন। অল্প সময়ের ব্যবধানেই বাবার আশ্রম তীর্থভূমিতে পরিণত হয়। কোনো এক সময় ভাওয়ালের মহারাজ তাঁর ফটো তুলে রাখেন। যে ফটো বর্তমানে ঘরে ঘরে পূজিত হয়। সেদিন ছিল ১৯শে জৈষ্ঠ, রবিবার। বাবা নিজেই বললেন তার প্রয়াণের কথা। বহু মানুষ আসেন তাঁকে শেষ দর্শন করার জন্য। কথিত আছে একসময় লোকনাথ মহাযোগে বসেন। সবাই নির্বাক হয়ে অশ্রুসজল চোখে এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন কখন বাবার মহাযোগ ভাঙ্গবে। কিন্তু ঐ মহাযোগ আর ভাঙেনি। শেষ পর্যন্ত ১১.৪৫ মিনিটে দেহ স্পর্শ করা হলে দেহ মাটিতে পড়ে যায়। ত্রিকালদর্শী বাবা লোকনাথ বলেছেন, ‘প্রতিদিন রাতে শোবার সময় সারাদিনের কাজের হিসাব-নিকাশ করবি অর্থাৎ ভাল কাজ কী কী করেছিস আর খারাপ কাজ কী কী করেছিস? যে সকল কাজ খারাপ বলে বিবেচনা করলি সে সকল কাজ আর যাতে না করতে হয় সেদিকে খেয়াল রাখবি।’ আবার তিনি বলেছেন, ‘সূর্য উঠলে যেমন আঁধার পালিয়ে যায়। গৃহস্থের ঘুম ভেঙে গেলে যেমন চোর পালিয়ে যায়, ঠিক তেমনি বার-বার বিচার করলে খারাপ কাজ করবার প্রবৃত্তি পালিয়ে যাবে।’ ক্রমে তিনি তারাপীঠের প্রধান ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন। ভক্তরা বিশ্বাস করত তার অলৌকিক ক্ষমতা আছে। তাই তারা রোগারোগ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনে তার কাছে আসত। তাঁর ভক্তরা তাঁঁর জীবনীগ্রন্থ রচনা করেন। শোনা যায় বাবার শরীর পরিবর্তন করতে পারতেন তিনি একবার বাঘরূপে প্রকাশিত হয়েছিলেন। একবার কুকুর রূপে প্রকাশিত হয়েছিলেন। 

বামাক্ষ্যাপা মন্দিরের নিয়মকানুন মানতেন না। এমনকি দেবতার থালা থেকেই নৈবেদ্য তুলে খেয়ে নিতেন। কথিত আছে, মহারানীকে স্বপ্নে দেবী তারার প্রত্যাদেশ পান যে, দেবীপুত্র বলে বামাক্ষ্যাপাকে যেন আগে খাওয়ানো হয়। এরপর থেকে মন্দিরে পূজার আগেই বামাক্ষ্যাপাকে নৈবেদ্য প্রদান এবং তাকে অবাধে মন্দিরে বিচরণ করতে দেওয়া হত। আরও কথিত আছে, দেবী তারা ভয়ংকর বেশে বামাক্ষ্যাপাকে দর্শন দিয়েছিলেন এবং পরে মাতৃবেশে কোলে তুলে নিয়েছিলেন। তারাপীঠ শ্মশানে ও দুমকা জেলার মালুটি গ্রামের তার স্মৃতিমন্দির আছে। রামকৃষ্ণ পরমহংস গ্রামীণ পশ্চিমবঙ্গের এক দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পৌরোহিত্য গ্রহণের পর বঙ্গীয় তথা ভারতীয় শক্তিবাদের প্রভাবে তিনি আরাধনা শুরু করেন। তার প্রথম গুরু তন্ত্র ও বৈষ্ণবীয় ভক্তিতত্ত্বজ্ঞা এক সাধিকা। পরবর্তীকালে মতে সাধনা করে লাভ করেন রামকৃষ্ণ। অন্যান্য ধর্মীয় মতে, বিশেষত ও মতে সাধনা তাকে “যত মত, তত পথ” উপলব্ধির জগতে উন্নীত করে।পশ্চিমবঙ্গের আঞ্চলিক গ্রামীণ উপভাষায় ছোটো ছোটো গল্পের মাধ্যমে প্রদত্ত তার ধর্মীয় শিক্ষা সাধারণ জনমানসে বিরাট প্রভাব বিস্তার করে। প্রথাগত দৃষ্টিভঙ্গিতে অশিক্ষিত হলেও রামকৃষ্ণ বাঙালি বিদ্বজ্জন সমাজ ও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের সম্ভ্রম অর্জনে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৮৭০-এর দশকের মধ্যভাগ থেকে পাশ্চাত্যশিক্ষায় শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীদের নিকট তিনি হয়ে ওঠেন হিন্দু পুনর্জাগরণের কেন্দ্রীয় চরিত্র। তৎসঙ্গে সংগঠিত করেন একদল অনুগামী। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভূ ১৪৮৬ খৃষ্টাব্দে  ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমায় নবদ্বীপে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম জগন্নাথ মিশ্র এবং মাতার নাম শচীদেবী। জগন্নাথ মিশ্র পূর্বে শ্রীহট্টে বাস করতেন। পরে তিনি গঙ্গাবাসের উদ্দেশ্যে নবদ্বীপে বাস করা শুরম্ন করেন। অল্প বয়সেই চৈতন্যদেব পিতাকে হারান। তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা বিশ্বরূপ পিতার মৃত্যুর পূর্বেই সন্ন্যাস গ্রহণ করে গৃহত্যাগ করেন। শ্রীচৈতন্যবাল্যে নিমাই নামে পরিচিত ছিলেন। নিমাই গঙ্গাদাস পণ্ডিতের পাঠশালায় কৃষ্ণানন্দ, কমলাকান্ত, মুরারী গুপ্ত প্রভৃতি সহপাঠীদের সাথে শিক্ষা অর্জন করেন। তিনি নবদ্বীপের বিশিষ্ট ব্রাহ্মণ বল্লভাচার্যের মেয়ে লক্ষ্মীদেবীকে বিয়ে করেন। তিনি বুদ্ধি ও স্মৃতিশক্তির জোড়ে ক্রমান্বয়ে নবদ্বীপের শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত হয়ে ওঠেন এবং নবদ্বীপে অধ্যাপনা শুরু করেন। নিমাই পিতা জগন্নাথ মিশ্রের পিতৃভূমি পূর্ববঙ্গের শ্রীহট্ট ভ্রমণকালে তাঁর স্ত্রী সর্পদংশনে মৃত্যুবরণ করেন। তারপর তাঁকে রাজপণ্ডিত সনাতনের মেয়ে বিষ্ণুপ্রিয়ার সাথে বিবাহ দেয়া হয়। গয়ায় পিতৃদেবের পিণ্ড দিতে গিয়ে মাধবেন্দ্রপুরির শিষ্য ঈশ্বরপুরির নিকট দীক্ষাগ্রহণ করে ফিরে আসেন। দীক্ষাগ্রহণের পর থেকে নিমাইয়ের অনেক পরবর্তন লক্ষ্য করা গেল। ধীরে ধীরে নিমাই টোলের অধ্যাপক থেকে কৃষ্ণপ্রেমীক হতে শুরু করলেন। ২৪ বছর বয়সে নিমাই মাতা ও স্ত্রীকে ত্যাগ করে কাঠোয়াতে এসে সন্ন্যাসী কেশব ভারতীর নিকট সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। তখন তার নাম হয় শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য। সন্ন্যাস নেয়ার পর চৈতন্যদেব একবার নবদ্বীপের কাছে শান্তিপুরে অদ্বৈতের বাড়িতে এসেছিলেন। সেখানে তিনি মাতা শচীদেবীর সাথে সাক্ষাৎ করেন। কিন্তু সন্ন্যাসীদের স্ত্রী-সাক্ষৎ নিষিদ্ধ বলে বিষ্ণুপ্রিয়া চৈতন্যদেবকে দর্শন করতে পারেন নি। শান্তিপুর থেকে চৈতন্যদেব পুরীতে গমন করেন। পরেও আরেক বার তিনি নবদ্বীপে এসে মায়ের সাথে দেখা করেছিলেন এবং তখন বিষ্ণুপ্রিয়াকে পাদুকা দান করেছিলেন। কাটোয়ায় মস্তক মুন্ডন করেন। এরপর তিনি বৃন্দাবন, প্রয়াগ, কাশী প্রভৃতি তীর্থ ভ্রমণ করেন। নিত্যানন্দ, অদ্বৈত, গদাধর, শ্রীনিবাস, রামানন্দ, হরিদাস, প্রভৃতি বৈষ্ণবগণ ছিল তাঁর প্রিয় অদ্বৈত ও নিত্যানন্দকে চৈতন্যের দুই অঙ্গ স্বরূপ কল্পনা করা হয়। নিত্যানন্দ চৈতন্যের খুবই প্রিয়ভাজন ছিলেন। নিত্যানন্দ একবার জগাই ও মাধাই নামক নদীয়ার দুই পাপিষ্ঠ ব্রাহ্মণকুমারকে উদ্ধার করতে চাইলেন। সে লক্ষ্যে তিনি অনেক ভক্তদের সাথে নিয়ে নাম-কীর্তন করতে করতে জগাই-মাধাইয়ের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। জগাই-মাধাই মদ পান করে ঘুমাচ্ছিলেন। নাম-কীর্তন শুনে তাদের ঘুম ভাঙায় তারা খুব বিরক্ত হলেন। নিত্যানন্দ বারংবার তাদের হরিনাম করার অনুরোধ করলেন। মাধাই তখন ক্রোধান্বিত হয়ে নিকটস্থ একটি ভাঙ্গা কলসির টুকরা দ্বারা নিত্যানন্দকে আঘাত করল। ফলে নিত্যানন্দের কপাল কেটে রক্ত ঝরতে লাগল। চৈতন্যদেব খবর পেয়ে ঐ স্থানে ছুটে আসলেন। তিনি জগাই-মাধাই শাস্তি দেয়ার জন্য সুদর্শন চক্রকে স্মরণ করলেন। কিন্তু নিত্যানন্দ তাঁকে নিরস্ত করলেন। শত্রু কর্তৃক আঘাত পেয়েও শত্রুকে ক্ষমা করার মত উদারতা আর কি হতে পারে? নিত্যানন্দের উদারতা ও মহত্ব দেখে জগাই-মাধাইয়ের বোধোদয় হয়। অবশেষে গৌর-নিতাইয়ের পরশে জগাই-মাধাই শুদ্ধ বৈষ্ণবভক্তে পরিণত হয়। বৈষ্ণবদের মতে শ্রীচৈতন্য রাধা ও কৃষ্ণের মিলিত রূপ, নিত্যানন্দ বলরাম, অদ্বৈত সদাশিব, শচীদেবী যশোদা এবং জগন্নাথ মিশ্র নন্দ। চৈতন্যদেবের অনুসারী ছয় জন গোস্বামী ছিলেন যারা অনেক বৈষ্ণবশাস্ত্র রচনা করে গিয়েছেন। সে ছয় জন গোস্বামী হলেন রূপ, সনাতন, জীব, রঘুনাথ ভট্ট, রাঘনাথ দাস এবং গোপাল ভট্ট। এছাড়াও চৈতন্যদেবের অনুসারী আটজন কবিরাজ ও চৌষট্টিজন মহন্ত ছিলেন। সন্ন্যাস নেবার পর চৈতন্যদেব ছয় বছর মথুরায় অবস্থান করেন। তিনি পুরুষোত্তম ক্ষেত্র সহ নানা স্থান পর্যটন করে বৈষ্ণব মত প্রচার করেন এবং শিষ্য সংগ্রহ করেন। তারপর তিনি রূপ ও সনাতনকে মথুরায় এবং অদ্বৈত ও নিত্যানন্দকে বাংলায় প্রচারকার্যে নিযুক্ত করে নীলাচলে গমন করেন। নীলাচলে মহাপ্রভূ জীবনের শেষ ১৮ বছর জগন্নাথের সেবায় রত ছিলেন। শেষদিকে তিনি ভাবে উন্মত্ত হয়ে থাকতেন। কথিত আছে যে, তিনি সমুদ্রকে যমুনা ভেবে এবং শ্রীকৃষ্ণ সে যমুনার জলে গোপীকাদের সাথে ক্রিড়া করছেন এমন উপলব্ধি করে ঐ সমুদ্রের জলে সেখানে ঝাপ দিয়েছিলেন। এটাই প্রেমভক্তির চূড়ান্ত স্তর। ভাবের এ চূড়ামত্ম সত্মরে উপনীত হলে সর্বত্রই প্রেমাস্পদের দর্শন মেলে। মহাপ্রভূ ১৫৩৪ খৃষ্টাব্দে ইহলীলা সংবরণ করেন। মহাপ্রভূ শিষ্যদের উপদেশ দিয়েছেন, তৃণ হতেও নীচ (নম্র) হবে, তরু হতেও সহিষ্ণু হবে, অহংকারশূন্য হয়ে সকলকে সম্মান করবে এবং সব সময় হরিনাম করবে। চৈতন্যদেব ভক্তদের শিক্ষার জন্য আটটি শ্লোক রচনা করে গিয়েছিলেন যা শিক্ষাষ্টক নামে পরিচিত। সাধক তুলসীদাস ছিলেন একজন রামভক্ত। তিনি গৃহস্থ-আশ্রমে থাকাকালে স্ত্রীকে খুব ভালবাসতেন। একদিন তিনি গৃহের বাইরে থাকাকালে তাঁর স্ত্রী পিতৃ-গৃহে গমন করেন। তিনি গৃহে ফিরে স্ত্রীকে দেখতে না পেয়ে প্রণয়বশত শ্বশুরবাড়ি গিয়ে স্ত্রীর নিকট উপস্থিত হন। স্ত্রী তাঁর এ নির্লজ্জ স্বভাবের জন্য তাঁকে তিরষ্কার করেন। স্ত্রীর ভৎর্সনা শুনে তাঁর মনে তীব্র বৈরাগ্য আসে এবং তিনি গৃহ ত্যাগ করে শ্রীরামচন্দ্রের উপাসনা শুরু করেন। কথিত আছে তিনি চিত্রকুটে হনুমানজীর দর্শন পান। তাঁর হিন্দী ভাষায় অনুদিত রামায়ণের নাম রামচরিতমানস। এ রামচরিতমানস গ্রন্থই তাঁর অমর কীর্তি।
রামকৃষ্ণের প্রয়াণের পর সন্ন্যাস গ্রহণ করে তার কাজ চালিয়ে যান। এঁদেরই নেতা ছিলেন বিবেকানন্দজী। ১৮৯৩ সালে বিবেকানন্দ তার ধর্মীয় চিন্তাধারাকে পাশ্চাত্যের জনসমক্ষে উপনীত করেন। বিবেকানন্দ যে বিশ্বমানবতাবাদের বার্তা প্রেরণ করে তা সর্বত্র সমাদৃত হয় এবং তিনিও সকল সমাজের সমর্থন অর্জন করেন। হিন্দু দর্শনের সার্বজনীন সত্য প্রচারের উদ্দেশ্যে তিনি এরপর মঠ প্রতিষ্ঠা করেন এবং ভারতে রামকৃষ্ণের ধর্মীয় সমন্বয়বাদ ও “শিবজ্ঞানে জীবসেবা”র আদর্শ বাস্তবায়িত করার জন্য স্থাপনা করেন নামে একটি ধর্মীয় সংস্থা। রামকৃষ্ণ আন্দোলন ভারতের অন্যতম নবজাগরণ আন্দোলনরূপে বিবেচিত হয়। ২০০৮ সালে ভারত ও বহির্ভারতে রামকৃষ্ণ মিশনের মোট ১৬৬টি শাখাকেন্দ্র বিদ্যমান। এই সংস্থার প্রধান কার্যালয় পশ্চিমবঙ্গের অবস্থিত। স্বামী বিবেকানন্দ এক উচ্চবিত্ত হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ছোটোবেলা থেকেই আধ্যাত্মিকতার প্রতি তিনি আকর্ষিত হতেন। তার গুরু রামকৃষ্ণ দেবের কাছ থেকে তিনি শেখেন, সকল জীবই ঈশ্বরের প্রতিভূ; তাই মানুষের সেবা করলেই ঈশ্বরের সেবা করা হয়। রামকৃষ্ণের মৃত্যুর পর বিবেকানন্দ ভারত ভালোভাবে ঘুরে আর্থ-সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে প্রত্যক্ষ জ্ঞান অর্জন করেন। পরে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দের বিশ্ব ধর্ম মহাসভায় ভারত ও হিন্দুধর্মের প্রতিনিধিত্ব করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ও তিনি বিভিন্ন দিক সম্পর্কে অসংখ্য সাধারণ ও ঘরোয়া বক্তৃতা দিয়েছিলেন এবং ক্লাস নিয়েছিলেন। তার রচিত গ্রন্থগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য চিকাগো বক্তৃতা, ইত্যাদি। বিবেকানন্দ ছিলেন সংগীতজ্ঞ ও গায়ক। তার রচিত কয়েকটি বিখ্যাত কবিতা। "সখার প্রতি" কবিতার অন্তিম দুইটি চরণ – “বহুরূপে সম্মুখে তোমার ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর? / জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।" – বিবেকানন্দের সর্বাধিক উদ্ধৃত একটি উক্তি। ভারতে বিবেকানন্দকে বীর সন্ন্যাসী নামে অভিহিত করা হয় এবং তার জন্মদিনটি ভারতে যুব দিবস হিসেবে পালিত হয়।

 জানুয়ারী ২০২৩ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

অনুগল্প

সনোজ চক্রবর্তী

পূর্ব মেদিনীপুর, পঃ বাংলা

গল্প/প্রবন্ধ

oldman1.jpg
SanojCharaborty.jpg
অনুগল্প-সনোজ চক্রবর্তী

বিশু ফরিদুল ও ছন্নছাড়ারা
বার একটা ম্যাসেজ ঢুকল টুং টাং শব্দে। বাংলা হরফে লেখা অদ্রিশের ম্যাসেজ---
"আচার্যদেব ভবঃ।"
সকাল নয়টা পঁয়ত্রিশ, মানে এসময় ম্যানহাটনে প্রায় রাত বারোটা দশ পনেরো হবে। ওদেশের ক্যালেন্ডারে পাঁচই সেপ্টেম্বর শুরু হচ্ছে সবে। মতিনস্যারের মুখে আশ্চর্য এক খুশির আলো এসে লাগে। গর্বে ফুলে উঠে বুকটা-- "ছেলে নয় খাঁটি  গিনি!"
ম্যানহাটনে প্রোজেক্ট অ্যাসিস্ট্যান্ট অদ্রিশ। মস্ত বড় পোষ্ট, কত বড় দায়িত্ব মাথার উপর এতোসবের মধ্যেও ফিপথ্ সেপ্টেম্বরটা ঠিক মনে রেখেছে ছেলে। নস্টালজিক হয়ে যান মতিনস্যার।
ক্ষেত্রমোহন ইন্সটিটিউট, ইন্সটিটিউটের স্যাঁতা পড়া দেওয়াল, ক্ষয়াটে দালান, বিকেলের নরম আলো, স্কুল শেষে অদ্রিশ, দেবারতি আর অত্রিদের বাড়তি জিজ্ঞাসার আবদার....
টোটোতে বসেই মতিনস্যার নব্বুই থেকে সাতানব্বুই আট বছরের স্মৃতি হাতড়াতে থাকেন আহ্লাদে।হঠাৎ টোটোর ঝাঁকুনিতে 'আহ্লাদে' ছেদ পড়ে। ঝাঁকুনি আর বাজারের ব্যাগ সামলে দ্রুত  মোবাইলে চোখ রাখেন মতিনস্যার।
কাঁপা কাঁপা আঙুল মোবাইলের আলো ছোঁয়--ইনবক্সে মাস পয়লা পেনশনের ম্যাসেজগুলোই পড়ে আছে কেবল। আর কোনো ম্যাসেজ নেই। নতুন করে কত কাল কোনো ম্যাসেজ আসে নি! ম্যাসেজ আসে না!
মন খারাপ হয়ে যায় মতিনস্যারের। এতটুকু সময়ে বোকা বোকা কতকিছু ভেবে ফেলেছেন!
"স্যার, বাড়ি এসে পড়েছি।"
ছোকরার কথায় নিজেকে সামলে নেন মতিনস্যার।

"তোমার টোটো তো আজ এরোপ্লেনের মতো ছুটল হে!" ছোকরা মতিনস্যারের দিকে তাকিয়ে হাসে। স্যার পাঞ্জাবির বুক পকেট হাতড়ে দু'শ টাকার নোট ছোকরার দিকে বাড়িয়ে বলেন--
"আজ কিন্তু খুচরো নেই, বাজার করতেই সব ফুরিয়েছে।" হেঁটে বাজার এলেও মতিনস্যার বাজার নিয়ে ফেরেন টোটোতে। বেলা বাড়লে রোদও বাড়ে, এ বয়সে সে আর সহ্য হয় না। তার উপর সবজি-মাছ- মুদির ভার। বাজার নিয়ে ফেরার সময় ছোকরা রোজ অপেক্ষা করে স্যারের জন্য। ভারী ব্যাগ নিজেই গুছিয়ে তোলে টোটোতে। সুরাহাটা শুধু স্যারের হয় ঠিক তা নয়, সকাল সকাল বাঁধা একটা ভাড়াও  জুটে যায় ছোকরার। স্যার টোটো থেকে নামলে, সবজির ব্যাগটা স্যারের হাতে দেয় ছোকরা-- 
"আজ ভাড়া লাগবে না স্যার, প্রতিদিনই তো দেন। আজ ফিরি।"
আন্তরিকতা মিশে যায় ছোকরার চোখে মুখে। মতিনস্যার রাগ দেখিয়ে বলেন--
"তা হবে না বাপু, আজ খুচরো নেই কাল নিও। চালাও তো টোটো। ফ্রি আবার কিসের!"
ছোকরা ঠক করে প্রণাম ঠুকে বলে--
"আজ শিক্ষকদিবস যে...." দু'হাতে বাজারের ভার নিয়ে মতিনস্যার চিত্রার্পিত তাকিয়ে থাকেন ছোকরার মুখে। ক্ষেত্রমোহন ইন্সটিটিউটের ব্যাক বেঞ্চার বিশু, রঘু, সাধন, ফরিদুলদের মনে পড়ে যায় মতিনস্যারের। নিজের স্কুলেতো বটেই এলাকার বিভিন্ন স্কুলের মেধাবীদের বাড়ি বাড়ি ছুটতেন মতিনস্যার। অভিভাবকদের বোঝাতেন মেধাটাই আসল। বলতেন---
"মেধা চাই, মেধা। মেধা ছাড়া দেশ, সমাজ গড়া যায় না।"
ছোকরার মাথায় হাত রাখেন মতিনস্যার। দু'চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। এই প্রথম শিক্ষকদিবসের দিনে নিজেকে ব্যর্থ বলে মনে হয় তাঁর। বিশু, ফরিদুল, রঘু, সাধনদের অবহেলার অপরাধে বুকটা ভার হয়ে আসে।

দেশপ্রেম যে এক সংক্রামিত ব্যাধি তা ব্রিটিশ প্রশাসন ধরেছিল নির্ভুলভাবে। তাই দেশবাসীর থেকে দেশদ্রোহীদের( ব্রিটিশের বিচারে) অনেক দূরে সরিয়ে দিতে চেয়েছিল তারা। দেশ মাতৃকার বীর সন্তানদের প্রভাব, তাঁদের ত্যাগ দেশটাকে উত্তাল করে তুলতে পারে, নাড়িয়ে দিতে পারে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ভিত-- সেটা নিখুঁত অনুমান করেছিল তৎকালীন শাসক। সেই সময়ের রাজদ্রোহীদের নির্বাসনের জন্য ১৮৯৬ সালে শুরু হয় সেলুলার জেল নির্মাণ।
পাঁচ লক্ষ টাকার অধিক খরচে ৬৯৬ সেল বিশিষ্ট সেলুলার জেলের নির্মাণ শেষ হয় ১৯০৬ সালে।শুধু স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জন বিচ্ছিন্ন করা নয় কালাপানির ভয়ংকর আতঙ্ক জনমানসে ছড়িয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনকে ঠাণ্ডা ঘরে পাঠাতে চেয়েছিল ব্রিটিশ। আসলে সিপাহি বিদ্রোহের পর পর ব্রিটিশ বিরোধী শক্তিকে গরাদের পেছনে আটকে দিতে বদ্ধপরিকর হয়ে উঠে ব্রিটিশ শাসক।
১৮৫৭ সাল ও তার পরবর্তী সময়ে একে একে নির্মাণ হয় মাদ্রাজ সেন্ট্রাল জেল, বোম্বে সেন্ট্রাল জেল, আলিপুর সেন্ট্রাল জেল, বেনারস, ফতেহগড়, লখনউ-- সেন্ট্রাল জেল।
১৯৩০ এ হিজলি ডিটেনশনক্যাম্প।
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্টের মধ্য রাত্রে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল  নেহেরুর - ট্রিটস উইথ ডেসটিনি.....
"সারা বিশ্ব যখন ঘুমাচ্ছে,  এই মধ্য রাত্রে সূর্য উঠছে ভারতের, জাগছে ভারতভূমি।" একে একে ব্রিটিশ ভারতের অন্যায় কারাগার মুক্ত করা হল। দেশপ্রেমিকেরা বেরিয়ে এলেন ব্রিটিশের কারাগার থেকে। গভীর অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এলেন আলোকময় মানুষগুলো। সদ্যমুক্ত ভারতমাতার সুসন্তানদের অনেকেই সেদিন ব্রিটিশের অত্যাচারে হয় পঙ্গু নয় অথর্ব নয়তো উন্মাদ। সেই মধ্য রাত থেকে শুরু হল 'নতুন ভারত বেরুক'।
শুরু হল----  'ভারত নির্মাণ'। আজও চলছে--- এর মধ্যে পনেরো জন প্রধানমন্ত্রী পেয়েছে দেশ।আমরা সহনাগরিকরা তাঁদের সঙ্গে দেশ নির্মাণে ব্রতী থেকেছি-- ঋতবদ্ধ- আদর্শনিষ্ঠ- আন্তরিক নিবেদনে। সেলুলার জেল সহ পরাধীন দেশের জেলগুলো এখন

স্বাধীন ভারতে আজকে কারাগারের সংখ্যা কত?৷ ১৩৫০টি।
যার মধ্যে ১৪৪টি সেন্ট্রাল জেল
৪১০টি জেলা জেল
৬১৭টি সাব জেল
৮৬টি মুক্ত জেল
বিশেষ জেল ৪১টি
নারী জেল ৩১টি
বোষ্টাল জেল ১৯ টি
ও অন্যান্য ২।
সহজেই বোঝা যাচ্ছে আমরা ঠিক কতখানি নিয়মনিষ্ঠ হয়ে ভারত নির্মাণে ব্রতী হয়েছি। এতো সবের মধ্যে একটা আশার কথা-- নেদারল্যান্ডের রাজা রানী ভারত ঘুরে গেছেন ২০১৯ এ। ৯ এপ্রিল ২০২১ -এ ভারত নেদারল্যান্ড ভার্চুয়াল সম্মেলন আশা জাগাচ্ছে। আগামীদিনে হয়তো আর নতুন কারাগার তৈরি হবে না এদেশে। হবে না, কারণ নেদারল্যান্ডস বর্তমানে অপরাধ মুক্ত দেশ। নেদারল্যান্ডসের কারাগারগুলো খাঁ খাঁ করছে। সেদেশের ঝাঁ চকচকে কারগারগুলোর আধুনিক ব্যবস্থা সচল রাখতে সে দেশ নাকি কারাগারগুলো ভাড়া দিচ্ছে। আসুন স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসবে মেতে উঠি। বাড়ির ছাদে পতাকা টাঙাই।গুগুল করে জাতীয় সঙ্গীত গাই।

 জানুয়ারী ২০২৩ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

গল্প

morning1.jpg
খাল কেটে কুমির
Chandan Chatterjee_edited.jpg

সেটা ছিল ২০২২ সাল,  গত দু'বছর বাঙালির প্রিয় দুর্গোৎসব হয়নি, মানে সেই ভাবে পালন করা যায় নি, করোনা মহামারীর জন্য। ২০২১ সালের মাঝামাঝি করোনা ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয়। প্রথম ডোজ, দ্বিতীয় ডোজ শেষে বুস্টার ডোজ। ২০২২ এর দুর্গা পুজোর আগেই পশ্চিমবাংলার তথা ভারতের অনেকেই এই তিনটি ডোজ নিয়ে নিয়েছেন। আমারও হয়ে গেছে, তাই এখন করোনা আমার আর কিছুই করতে পারবে না, এইরকম একটা বেপরোয়াভাব আমার মধ্যে এসেছে। তাই স্থির করলাম এ বছর পুজোয় খুব ঘোরাঘুরি করব, গত দু'বছরের না পাওয়া, এই বছরে মেটাবো।কিন্তু বিধি বাম। বাড়িতে মাকে এই কথা বলায় তিনি বললেন, “সাবধানতা অবলম্বন করা এখনও জরুরী। এখানে পুজোর সময় অনেক ভিড় হবে, তাই তুই গ্রামের বাড়িতে চলে যা। দেখে আয় সেখানের অবস্থা কিরকম, বাড়ি ঘর কি অবস্থায় আছে, বাগানের অবস্থা কি”। 
আমাদের দেশের বাড়ি হাওড়া জেলার উদয়নারায়ণপুর গ্রামে। এটা হাওড়া জেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম, দামোদর নদী, এই গ্রামের বুক চিরে বয়ে গেছে। এই নদীতে প্রতি বছর বন্যা হয়, আর আমাদের বাড়িতেও জল ঢোকে, দু-তিন দিন থাকে, তারপর আবার বেরিয়ে যায়। এইজন্য বাবা গ্রামে দোতলা বাড়ি তৈরি করেছিলেন। কিন্তু প্রাকৃতিক দৃশ্য এখানকার অতি মনোরম। দোতলার ছাদের উপর উঠলে খুব সুন্দর দৃশ্য দেখা যায়, ছবির মত। বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে গেছে কানা-নদী যাকে বলে মজা-দামোদর, তারপর দিগন্ত বিস্তৃত খোলা মাঠ। দক্ষিণে চাষীদের খেত, তারপর চাষীপাড়া, পশ্চিমে আমাদের একটা ছোট পুকুর আছে, তারপর একটা বড় দীঘির মতো আছে। লোকে বলে কালীর- দ, পূর্বে লাল মাটির রাস্তা চলে গেছে বাজার-বাস স্ট্যান্ড- থানা-বিডিও অফিস সব পর পর আছে। 
আমার ছেলেবেলা এই গ্রামে বাড়িতে কাটে। তাই শহরের বাসিন্দা হলেও মাঝেমধ্যে গ্রামের বাড়িতে ছুটে যাই, মাটির টানে, শিকড়ের টানে। মায়ের আদেশ পাবার পর ভাবলাম একা কেন যাই কিংকরকেও সঙ্গে নিই। কিংকর আমার বন্ধু, বাড়ি শিবপুর মন্দিরতলায়, পেশায় প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর, স্বাধীন ব্যবসা। আমি অবশ্য কলকাতার একটা বেসরকারি কোম্পানির একাউন্টস ম্যানেজার। কিঙ্করের সঙ্গে অনেক কেসের সহযোগী। আমি কিঙ্করকে বলতে ও এক কথায় রাজি হল, কারণ এখন ওর হাতে তেমন কোনো ব্যস্ততা নেই, তাছাড়া সর্বত্র এখন পুজোর মেজাজ। ঠিক হলো আমরা মহালয়ার দিন গিয়ে দশমীর দিন আসবো, মোটামুটি আট-দশ দিনের ট্যুর। 
মহালয়ার দিন ভোর বেলায় উঠে, রেডিওতে চণ্ডীপাঠ শুনে, বেলা দশটা নাগাদ উদয়নারায়ণপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। আমার একটা মোটর সাইকেল আছে, আমি সেইটা নিয়ে যাব ঠিক করেছিলাম, কিন্তু কিংকরের বাবার বাধা দিয়ে বললেন কতদূর রাস্তা তোমরা বাসে যাও। অগত্যা দুজনে ব্যাগ হাতে নিয়ে প্রথমে হাওড়ায় গেলাম, ওখান থেকে উদয়নারায়ণপুরের বাসে উঠলাম। হাওড়া বাসস্ট্যান্ড থেকে প্রায় আড়াই ঘন্টার মত লাগে, যদিও খুব বেশি দূর নয়, মাত্র ৪৫ কিলোমিটার। কিন্তু বাস লোক তুলতে তুলতে দাঁড়াতে দাঁড়াতে যায়, তাই সময় লাগে। উদয়নারায়ণপুর বাস স্ট্যান্ড থেকে আমাদের বাড়ি হাঁটাপথে ১০ মিনিট লাগে। বাসস্ট্যান্ড থেকে সোজা পশ্চিমে হাঁটলে রাস্তার দুই পাশে অনেক সারিবদ্ধ দোকান, শেষে হাওড়া কো-অপারেটিভ ব্যাংক তারপর স্কুলের খেলার মাঠ, তারপর এই রাস্তাটা সোজা বিডিও অফিসে গিয়ে ধাক্কা খাবে। সেখান থেকে দুদিকে দুটো রাস্তায় বেরিয়ে গেছে, বাঁ দিক দিয়ে চলে গেলে কয়েকটি দোকান, থানা, উদয়নারায়ণপুর এস সি ইনস্টিটিউশন, স্কুল-পুকুর, বাজার, রথতলা ইত্যাদি আর ডান দিক দিয়ে গেলে পোস্ট অফিস তারপর জমিদারবাড়ি তারপর খানিকটা হাঁটলে আমাদের বাড়ি, কানা নদীর পাশে। 
যখন আমরা বাড়ি পৌঁছলাম তখন বেলা প্রায় দুটো বাজে, মা আমাদের লাঞ্চ প্যাক করে দিয়েছিলেন। আমি চাবি দিয়ে বাড়ির খিড়কী দরজা খুললাম, তারপর বারান্দার দরজা খুলে সোজা উপরে উঠলাম। সেখানে খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে তারপর চান করতে বাথরুমে ঢুকেছি, ইতিমধ্যেই কিঙ্কর আমাদের পুরো বাড়িটা একটা ময়না করছে। আমি যখন চান করে বাইরে বেরিয়ে আসলাম তখন ও বলল, “তোদের কলাবাগান থেকে একটা পাকা কলার কাঁদি আজ সকালে কেউ কেটে নিয়ে গেছে”।
আমি, ”শুধু কলা কেন, আমাদের জামরুল, লিচু, আম, কাঁঠাল গাছ আছে কিন্তু আমাদের কিছুই ভোগে আসে না, সব পাড়ার লোক ভোগ করে, বাই দ্যা ওয়ে তুই কি করে বুঝলি কলার কাঁদি আজ সকালে কেটেছে”?
কিঙ্কর, “কলাগাছটা নুয়ে পরেছে এবং কাটা জায়গা থেকে রস পড়ছে”।
আমি, “আচ্ছা”।
তারপর একটু চমকে বললাম, “পাকা কলা তোকে কে বলেছে”।
কিংকর, “কাঁচা কলার কাঁদি সবুজ রঙের হয় কিন্তু এটা হালকা হলুদ রঙের তাই মনে করা যায় কলা আগেই পেকে গেছে। তবে চোর বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি, কারণ এখানে যা পাখি ও কাঠবেড়ালি গাছে গাছে তারাই অর্ধেক খেয়ে নিয়েছে  বোধ হয়“।
যাই হোক এরপর আমরা খেয়েদেয়ে খানিক বিশ্রাম নিয়ে সন্ধ্যার দিকে বাজারে বের হলাম। পথে তপনদার সঙ্গে দেখা, তার একটা টেলারিং শপ রয়েছে বাজারে। আজকালকার ছেলেরা রেডিমেড জামা প্যান্ট পড়ে কিন্তু আমি যখন ছোট ছিলাম তখন জামাপ্যান্ট এমন কি জুতো তৈরি করা পরতাম, শরীরের সঙ্গে ঠিক ঠিক মাপের। এখানে সাধারণত বিশ্বকর্মা পুজোর পর থেকে মহালয়া পর্যন্ত যত টেলারিং শপ আছে সবাই অর্ডার নেয়, তারপর অর্ডার ক্লোজ করে দেয়,  কারণ পুজোর আগেই সব মাল ডেলিভারি করতে হয়। কেউ এসে খালি হাতে ফিরে যেতে রাজি নয়। 
আমি তপনদাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ”এত তাড়াতাড়ি বাড়ি যাচ্ছ? এই সময় তো তোমরা সারারাত জেগে কাজ কর। সারা বছরের রোজগার এই পুজোর সময় তো হয়”।
তপনদা একটু হেসে উত্তর দিলো, ”গত দু'বছর মন্দা ছিল তাই কারিগর সব চলে গেছে। এবছর বাজার একটু ভালো দুজন মুসলমান কারিগর পেয়েছি, ওরা সন্ধ্যেবেলায় আসে সারারাত কাজ করে ভোরবেলায় দোকান বন্ধ করে চলে যায়। আমি ওদের কাছে একটা দোকানের ডুপ্লিকেট চাবি তৈরি করে দিয়েছি। আমি  সকাল বেলায় এসে দোকান খুলি”। 
কিঙ্কর একটু আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল, “মুসলমান কারিগর?”
আমি তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম, ”তাকে কি হয়েছে এখানে হিন্দু-মুসলমান এত ভেদ নেই, সবাই দুবেলা খাবারের সংস্থান করতে ব্যস্ত। ধর্ম নিয়ে হানাহানি এখানে হয় না”।
কিঙ্কর একটু গম্ভীর হলো।
পরের দিন বাজারে গিয়ে আমি কিংকরকে তপনদার দোকান দেখালাম। বি ডি ও অফিসের ঠিক উল্টোদিকে সারিবদ্ধ ভাবে চার-পাঁচটি দোকান আছে তার মধ্যে তিন নম্বর দোকানটি তপনদার। সেখানে যথা রীতি অর্ডার ক্লোজ নোটিশ ঝুলছে। তারপর  আরও দুটি দোকান তারপর একটা গলি তারপর থানা। থানার পাশেই স্কুল পুকুর। বর্তমানে সেটার সংস্কার করা হচ্ছে। পাঁকে প্রায় পুকুরটা বুজে গিয়েছিল। সেই পাঁক তুলে রাস্তার ধারে রাখা আছে। কালো কালো পাঁকে রাস্তার পশ্চিম পাড় ভর্তি।
আমরা বাজারে গিয়ে কিছু বাজার করে, তারপর চপ মুড়ি খেতে খেতে বাড়ি ফিরলাম। জমিদার বাড়িতে দুর্গাপূজা এবং শ্রীজগন্নাথের রথযাত্রা হয়। এখানকার জমিদার ছিলেন স্বর্গতঃ বিশ্বনাথ চট্টোপাধ্যায়, বর্তমানে অবশ্য সবই  শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনকে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। তারাই সব দেখাশোনা করে এবং পালা-পার্বণ করে। একবার সেখানে ঢুকলাম পুরাতন আমলে জমিদার বাড়ি, মোটা মোটা গোল গোল থাম, সদর দরজা দিয়ে ঢুকে সামনে দুর্গা দালান, ঠাকুর তৈরি হচ্ছে, দোমেটে হয়ে গেছে, রং বাকি। এখানে পুজো খুবই নিষ্ঠা সহকারে  নিয়ম মেনে হয়। বাইরে একটা বেল গাছ আছে সেখানে ষষ্ঠীর দিন নবপত্রিকা প্রবেশ হয়।
বেলা দশটা নাগাদ আমরা বাড়ি ফিরলাম তারপর চান করে খেয়ে দেয়ে কিছু বিশ্রাম নিয়ে বিকালে আবার বাজারের দিকে গেলাম। রান্না আমিই করতাম। এখানকার পুকুরে জ্যান্ত মাছের ঝোল, কোন দিন বা মুরগি, খাসি  এই সব খেয়ে ৪-৫ দিনে মনে হচ্ছে যেন দু কেজি ওজন বেড়ে গেছে। 
আজ মহাপঞ্চমী। সব দোকানে ভিড় লক্ষ্য করা যাচ্ছে, বিশেষ করে জামা কাপড়ের দোকানে লোকের পুজোর কেনাকাটা অন্তিম পর্বে। আমরা যথারীতি সকাল নটার সময় বাজারে গেলাম। তপনদার দোকানের সামনে কিছু লোকের জটলা, আমি কাছে গিয়ে ব্যাপারটা বুঝলাম যারা জামা প্যান্ট তৈরি করতে দিয়েছিল তারা নিতে এসে দেখছে তাদের পোশাক এখনো তৈরি হয়নি। কাল পুজো কি হবে তাই সবাই এসে চেঁচামেচি করছে, তপনদা তাদের কিছু বোঝাবার চেষ্টা করছে। ইতি মধ্যে কিঙ্কর দেখি সবাইকে পাশ কাটিয়ে কখন দোকানের ভেতরে ঢুকে গেছে। সেখানে গিয়ে আলমারি, সেলাই মেশিন, কাটা কাপড়ের পরে থাকা স্তূপ ইত্যাদি দেখছে। তার দেখাদেখি আমিও তার কাছে গেলাম কিন্তু কিছুই বুঝতে পারলাম না। হঠাৎ ও বাইরে বেরিয়ে এসে বলল,

“চল থানায়”। আমি বললাম,

“কেন এ তো সামান্য ব্যাপার, তাছাড়া এটা তপনদার ব্যাপার, আমাদের নাক গলাবার আবার কিছু নেই”।
কিঙ্কর, ”না"।

কেবলমাত্র তপনদার নয় একটা সাংঘাতিক ঘটনার সূত্রপাত হতে চলেছে”। আমি বোকার মত চলতে লাগলাম থানাতে গিয়ে ও নিজের ভিজিটিং কার্ড বার করে অফিসারের সামনে রাখলো। তারপর  যা বলল  তা শুনে তো আমি অবাক। উদয়নারায়ণপুরের মত অজ পাড়াগাঁয়ে এত বুদ্ধি করে চুরি করার মতো কে আছে? আর কিইবা আছে? অফিসারের নাম সোমনাথ কুমার তিনি প্রথমে আমাদের কথায় বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করলেন না। তখন কিংকর বললো বহরমপুরের ডিএসপি সোমেশ্বর রায়কে ফোন করতে। সোমেশ্বর কিঙ্করের বন্ধু। বহরমপুরের একটা কেসে, কিঙ্কর তাকে সাহায্য করেছিল। সোমেশ্বর, সোমনাথবাবুকে ভালো করে বুঝিয়ে দিলেন এবং কিঙ্করের উপর ভরসা রাখতে এবং সাহায্য করতে নির্দেশ দিলেন। এরপর বাজার করা শিকেয় উঠলো। কিঙ্কর তপনদার দোকানটাকে ঘিরে পুরো আশপাশ এলাকা তল্লাশি করছে। ঘন্টা দুয়েক পরে আমরা ফিরে এসে দেখলাম তপনদার দোকানে ভিড় অনেকটাই কমে গেছে। তপনদা নিজে সেলাই মেশিন চালাচ্ছে ছেলে দুটো ছিট কাটছে। এই পর্যন্ত দেখে আমরা বাড়ি ফিরে এলাম। দুপুরে ট্যাংরা মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেয়ে কিঙ্কর একটা লম্বা ঘুম দিল। আমি নীচের ঘরে টিভিতে একটা হিন্দি কমেডি সিরিয়াল দেখছিলাম। বিকাল পাঁচটার সময় আবার বাজারে গেলাম। স্কুল মাঠের ওপারে যে কো-অপারেটিভ ব্যাংক আছে আমরা সেখানে গেলাম। কিঙ্কর দাড়োয়ানের হাতে তার একটা ভিজিটিং কার্ড দিয়ে ম্যানেজার সাহেবের সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা প্রকাশ করল। ব্যাংকের ম্যানেজার হেমন্ত পাত্র, আমার সঙ্গে ছোটবেলায় পড়তো। আমাকে দেখে খুশি হলো। কিঙ্কর  তাকে জিজ্ঞাস করল -

“আপনার ব্যাংকে ডিপোজিট কত আছে”।

হেমন্ত, “এখন হাজার দশেক টাকা, কারণ পুজোর ছুটি, ৫-৬ দিন ব্যাংক বন্ধ থাকবে। সব টাকা হেডঅফিসে পাঠিয়ে দিয়েছি“।

কিংকর আবার জিজ্ঞেস করল, “ভল্টে কোনো দামি জিনিস আছে?”

হেমন্ত, ”আমার ব্রাঞ্চ ছোট এখানে কোন সেফটি ভল্ট নেই”। কিঙ্কর একটু আশ্চর্যান্বিত হয়ে আমার দিকে তাকাল তারপর ঠিক আছে ধন্যবাদ বলে আমরা উঠলাম। রাস্তায় সে আমাকে জিজ্ঞেস করল শহরে ঠাকুর দেখার জন্য সারারাত মানুষের ঢল রাস্তায় থাকে এখানে কি সেইরকম হয় কি না।
আমি বললাম, “না, না এখানে কটা আর দুর্গাপুজো হয়। জমিদার বাড়ি, উদয়নারায়ণপুর বাজার সমিতি, পল্লীমঙ্গল ক্লাব, আরো দক্ষিণে গেলে শিবপুর বারোয়ারী মাঠ। তাই বড়জোর রাত্রি ১০টা কি ১১টা পর্যন্ত লোকের আনাগোনা হতে পারে। তারপর আর নয়, বরং কালীপুজো এখানে ভালো করে হয়। এই স্কুল মাঠে  পাঁচটা পুজো হয় তারপর …“
ও আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল , “আজ রাত্রি জাগতে হবে কিন্তু” তারপর আবার আমরা থানায় চললাম। সেখানে সোমনাথবাবুর সঙ্গে কথা বলল তারপর কি করতে হবে তার একটা একশন ব্লু প্রিন্ট তৈরি করল ।
সন্ধ্যেবেলা আমরা ডিনার সেরে রাত্রি সাড়ে দশটা নাগাদ আবার থানায় গেলাম। সব বাড়ির লাইট বন্ধ,  শুধুমাত্র রাস্তার স্ট্রীট লাইট জ্বলছে। এটা শরৎকাল, তাই একটা হালকা কুয়াশার চাদর পুরো গ্রামকে ঢেকে ফেলেছে এবং একটা হালকা শীত অনুভূত হচ্ছে। রাস্তার ধারে কুকুরগুলো কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে। আমাদের উপস্থিতি তাদের ঘুমের ব্যাঘাত করায়, তারা মাঝে মধ্যে ডেকে উঠছে। একটা নিশাচর পাখি আমার মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেল। এই সব দেখেশুনে আমার উত্তেজনা থেকে ভয়ের উদ্রেক বেশি হচ্ছে। এখন
কিঙ্কর মুখ বুজে চলেছে, তবে তার চলার ভঙ্গি ও হাতের অঙ্গুলীহেলন দেখে অনুমান করা যায় ও কোন বিশাল ষড়যন্ত্রের আভাস পেয়েছে ।
আমি একটু ঘুম কাতুরে, ৯ ঘন্টার নিচে ঘুম হলে পরের দিন আমার বিছানা থেকে ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করে না। এই সব না করে ভালো হতো যদি টেংরা মাছের ঝোল দিয়ে গরম ভাত খেয়ে রাত্রিতে একটা মস্ত ঘুম দিতাম। 
আমার মনোভাব ও বুঝতে পেরে বলল, ”এই জন্যই তোকে রাত্রে রুটি খাইয়েছি, ভাত খেলে তোকে বিছানা থেকে উঠাতে পারতাম না“। 
আমি বললাম, ”তুই কি মাইন্ড রিডিং করছিস নাকি“?

কিঙ্কর একটু হেসে উত্তর দিল, “এর জন্য মাইন্ড রিডিং এর দরকার নেই। তোর চলন, মনোভাব প্রকাশ করছে। পায়ে রাবারের জুতো পরা সত্বেও এত পা ঠুকে চলছিস যে রাস্তার কুকুরের ঘুম ভাঙছে এবং অহেতুক হাতের টর্চ লাইট জ্বালাচ্ছিস আর নেভাচ্ছিস”।
আমরা গিয়ে সোমনাথবাবুর সঙ্গে দেখা করলাম। তিনি তিন-চারজন পুলিশকে একটা প্রাথমিক ট্রেনিং দিচ্ছিলেন যে রাতে তাদের কি করতে হবে। আমরা সবাই কালো পোশাক পড়েছি, যাতে অন্ধকারের সহজেই মিশে যেতে পারি। তখন বাজে রাত্রি বারোটা থানার সব লাইট বন্ধ। স্ট্রিট লাইট বন্ধ। আমরা তপনদার দোকানকে কেন্দ্র করে আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে লুকিয়ে আছি। প্রায় আরও আধ ঘন্টা কেটে গেছে হঠাৎ দেখি বাসস্ট্যান্ডের দিক থেকে দুটি ছায়ামূর্তি আসছে। তারা বার বার এদিকে ওদিকে তাকাচ্ছে। তারা এসে তপনদার দোকানের শাটার খুলে ভেতরে ঢুকলো তারপর তারা ভেতর থেকে শাটার নামিয়ে দিল।
এটা নিশ্চিত যে তারা তপনদার দোকানে চুরি করতে এসেছে। তাহলে এই রাস্তা দিয়ে তাদের বের হতে হবে। কিন্তু তার জন্য এত আয়োজন কেন, চাট্টি জামা প্যান্টের ছিট, কিছু টেলারিং যন্ত্রপাতি আর ক্যাশ  বাক্সে খুব বেশি হলে হাজার দুয়েক টাকা। এর জন্য এত তাম-ঝাম। বর্তমান যুগে এর কোন মূল্যই নেই। এইসব নানান কথা ভাবছি। ভাবতে ভাবতে কখন প্রায় এক ঘন্টা পার হয়ে গেছে, ইতিমধ্যে পঞ্চমী শেষ রাতের চাঁদ আলো দিতে শুরু করেছে। আমরা সবাই দোকানের দিকে তাকিয়ে বসে আছি অপলক দৃষ্টিতে। হঠাৎ ঘড়্‌ ঘড়্‌ আওয়াজ, দোকানের শাটার উঠল, বেরিয়ে এল সাত জন লোক। আমি তো অবাক। ঢুকল দু জন বের হল সাত জন, এই অতিরিক্ত পাঁচ জন লোক এল কোত্থেকে। এরা কি লোক চুরি করতে এসেছিল। এরপর শাটার বন্ধ হল, আর তারপরের মুহূর্তে কিঙ্কর ও সোমনাথবাবু একইসঙ্গে সিটি বাজালেন আর সঙ্গে সঙ্গে আমরা সবাই গিয়ে তাদের সাতজনকে পাকড়াও করলাম। তপনদার দোকানের সামনে দুজন পুলিশ পোস্টিং করা হলো। তারপরে সবাইকে থানাতে নিয়ে আসা হল। এদের মধ্যে তিনজন মুখোশ পরা ছিল, বাকিরা একটা গামছা মুখে জড়ানো ছিল। সকলের মুখ থেকে আবরণ উন্মোচন করতে আমরা তো অবাক। এদের দুজনকে আমি চিনি তপনদার কর্মচারী। সোমনাথবাবুর কথায় বাকিরা এই থানার চোর। কিন্তু তারা নিছকই ছিঁচকে চোর, সবাই এক, দেড় বছরের মধ্যে ছাড়া পাবে। এদেরকে ছাড়ানোর পিছনে কি উদ্দেশ্য থাকতে পারে সেটা আমাদের বোধগম্য হচ্ছে না। এর মধ্যে একজন তো প্রায় আসা-যাওয়া করতেই থাকে। 
হঠাৎ
কিঙ্কর, সোমনাথবাবুকে একটা কাগজ পেন চাইল, তারপর পাঁচজনকে নিজ নিজ লিখতে বলল, এর মধ্যে দু'জন বাংলায় লিখলো, দুজন লেখাপড়া জানে না টিপ ছাপ, একজন উর্দুতে লিখলো। যে উর্দুতে নাম লিখল তাকে ছেড়ে বাকি চারজনকে আবার জেলে পাঠিয়ে দিল। এই লোকটাকে একটা টুলে বসিয়ে, কিঙ্কর তার সাথে আলাপ জুড়ে দিলো। এটা আমার বুঝতে অসুবিধা হলো না কিঙ্কর কথা বার করার চেষ্টা করছে আর মাঝেমধ্যে মোবাইল নিয়ে কি যেন করছে। 
প্রায় এক ঘন্টা কথা বলার পর
কিঙ্কর সোমনাথবাবুকে উদ্দেশ্য করে শুরু করলো পুরো ঘটনার বিবরণ। সোমনাথবাবু নিজ চিয়ারে বসে, তার টেবিলের চারপাশে আমরা বসে, আর এই তিনজন একটা বেঞ্চিতে বসে।
আপনাদের মনে আছে গত কয়েক মাস আগে দিল্লি থেকে একটা এনো আই এ -এর দল এই বাংলায় এসেছিল, মুর্শিদাবাদ-এর ডোমকল থেকে জঙ্গি সন্দেহে কয়েকজনকে ধরে নিয়ে যায়। তারপর কিছুদিন পরেই তাদের মধ্যে দুজনকে ছেড়ে দেয়। তাদের মধ্যে একজন হলেন এই ব্যক্তি শেখ নিজাম উদ্দিন লস্কর। এর অপরাধ হয়তো তখন এত বেশি ছিল না, তাই এনো আই এ ছেড়ে দিয়েছিল। ছাড়া পাবার পর ও প্রথমে যায় ডোমকলে, সেখানে পাড়া-প্রতিবেশী থেকে নানা প্রকার বিদ্বেষপূর্ণ কথা শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়, তারপর গ্রাম ত্যাগ করে সোজা চলে যায় মালদায় সেখানে বেশ কিছুদিন থাকে, মালদায় এদের সংগঠনের কোন শাখা অফিসে। তারপর নিজাম এখানে আসে, মূল উদ্দেশ্য একটাই, শান্ত গ্রামবাংলার নিরীহ যুবকদের ধরে উত্তেজিত করে ধর্মের নামে হানাহানি করানো। এখানে এ বাসা ভাড়া নেয় টোকাপুর নামে কোন পাড়ায়।
আমি বললাম, “টোকাপুর গ্রাম আছে সেখানে বেশিরভাগই মুসলমান পরিবার। তবে তারা এইসব ব্যাপারে বেশি উৎসাহিত নয় বলেই শুনেছিলাম”। 

কিঙ্কর বলল, “হ্যাঁ সেইজন্যই এখানে নিজাম বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি মাত্র এই দুজনকে খানিকটা বশীভূত করেছে। এদিকে টাকাপয়সা যা ছিল সবই প্রায় শেষ হয়ে গেছে তাই চুরির পথ। একজনের গলার হার ছিনতাই করতে গিয়ে ধরা পড়ে যায় নিজাম। নিজাম জেলে যাবার পর এরা দুজন একলা হয়ে যায়। এদিকে নিজাম এদের মোবাইলের সাহায্যে মালদায় বসের কাছে খবর পাঠায়। সেই বসই যুক্তি দেয় মাটির নিচ দিয়ে সুড়ঙ্গ করে বের হতে”।
এক জন অফিসার বলল, “ হ্যাঁ এই ছেলে দুটো দু-এক বার নিজামের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল  বটে “।

কিঙ্কর আবার শুরু করল, “এরা কিভাবে সুরঙ্গ খোলা হবে তাই নিয়ে চিন্তা করছিল, এমন সময় তপনদার লোকের দরকার হয়, আর এরা একটু আধটু টেলারিং এর কাজ জানত, তাই এরা  রাত্রিতে কাজ করবে এই মর্মে তপনদার কাছে কাজ নিল “
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তোর প্রথমে কিসে সন্দেহ হল যে এরা মাটিতে সুড়ঙ্গ খুঁড়ছে“।

কিঙ্কর, “আমি তপনদার কাছ থেকে জেনেছিলাম একটা জামা তৈরি করতে তিন থেকে সাড়ে তিন ঘন্টা লাগে, আর একটা প্যান্ট তৈরি করতে সাড়ে তিন থেকে চার ঘণ্টা লাগে ওরা যদি রাতে ৮ ঘন্টা কাজ করে তবে এক থেকে দেড়টি জামা-প্যান্টের সেট তৈরি করতে পারবে, দুজনে মোটামুটি তিনটি সেট করতে পারবে প্রতিদিন।  বিশ্বকর্মা পূজা ১৭ সেপ্টেম্বর আর মহাপঞ্চমী ২রা অক্টোবর, এই ১৫ দিনে কমপক্ষে ৪৫ টি সেট হয়ে যাবার কথা। কিন্তু কুড়িটি সেট হয়েছে ও সঠিকভাবে তৈরি হয়নি। এর মানে একজন কাজ করছিল তাহলে আরেকজন কি করছিল। সেটা জানার জন্য আমি দোকানের ভেতরটা ময়নাতদন্ত করি। দোকানের কোণে যে কালো কাপড়ে ঢাকা পুরাতন সেলাই মেশিন আছে তাতে মাটির দাগ, এবং কোণের কার্পেট একটু তুলতেই মাটি খোঁড়ার দাগ স্পষ্ট। টেলারিং শপ সাধারণত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকে, কারণ এখানে নতুন জামা কাপড় নিয়ে ব্যবসা, জামা কাপড়ে দাগ লেগে গেলে কেউ ছেড়ে কথা বলবে না। তাই মাটি এলো কোথা থেকে সেইটা আমাকে বিশেষভাবে চিন্তিত করেছিল। এটা আরও কনফার্ম হয় স্কুল পুকুরের থেকে যে কালো পাঁক মাটি তোলা হয়েছে তার সঙ্গে কিছু লালমাটি দেখা গেছে যেটা গত চার-পাঁচ দিন আগেও ছিল না“।
আমি কিছু বলতে যাচ্ছিলাম ও বাধা দিয়ে বলল - 'হ্যাঁ এটা হতে পারে অন্য কোথাও খোঁড়া খুঁড়ি করা হচ্ছিল সেই মাটি কিন্তু এখন তো কনফার্ম হলো এদের খোঁড়া সুড়ঙ্গের মাটি যা এরা রাত্রিতে এখানে ডাম্প করে যেত। কিন্তু  সুরঙ্গটা কোথায় গেছে সেটা আমার মাথায় আসেনি। দোকানের সামনের দিকে ইস্কুল সেখানে বইপত্র ছাড়া বিশেষ কিছু দামি জিনিস নেই, পিছনদিকে স্কুল মাঠ তারপরে ব্যাংক, কিন্তু ব্যাংক ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি তার ব্যাংক ও ভাঁড়ে মা ভবানী, দক্ষিণ দিকে পুলিশ স্টেশন, আর উত্তরদিকে সার দিয়ে তিনটি দোকান তাহলে এরা কি চুরির পরিকল্পনা করেছে। তারপর হঠাৎ মাথায় এলো তোর একটা কথা। তুই একবার বলেছিলে আমরা বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া সদর দরজা খুলি না, খিড়কি দরজা দিয়েই যাতায়াত করি, একটা গেট দিয়ে যাতায়াত করলে তালা দেওয়ার কথা মনে থাকবে। তাই দোকানের আশপাশ পরীক্ষা করে দেখলাম এরা যতই গভীর  সুড়ঙ্গ খুঁড়ুক না কেন যা কিছু চুরি করবে তা নিয়ে বেরোবার রাস্তা এইটাই। তাই এই মুখটাতে ঘিরে থাকলে আমাদের কাজ সহজ হবে”।
আমি একটু উসখুস করছি দেখে ও বলল, ”হ্যাঁ আজকে রাত্রে যে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ তার প্রমাণ হলো সকালের চেঁচামেচিতে তপনদা এদের কাছ থেকে ডুপ্লিকেট চাবি নিতে ভুলে গেছে কাল সকালে নিশ্চয়ই তা নিয়ে নেবে। তখন তো  আর বিনা চাবিতে দোকানের শাটার খোলা যাবে না, তাই আজ রাত্তি কাজ শেষ করতে হবে“। 
তারপর সোমনাথবাবুর দিকে তাকিয়ে বলল, ”হ্যাঁ আর একটা কথা  নিজাম ছাড়া বাকি যে চারজন লোক বেরিয়ে আসছিল তারা শুধুমাত্র পালানোর জন্য এদের সঙ্গী হয়েছিল, এদের কাজকর্মের সঙ্গে তাদের কোন যোগ নেই। এদের মোবাইল চেক করে জেনেছি নিজামের প্ল্যান ছিল এখান থেকে বেরিয়ে সোজা ফাস্ট বাসে হাওড়া, সেখান থেকে সকাল ৭.৫০ এর বালুরঘাট এক্সপ্রেসে মালদা”।
এতক্ষণ
কিঙ্কর তার বক্তব্য শেষ করল তারপর নিজামের দিকে তাকাল, তার চোখে তখন একটা শ্রদ্ধাযুক্ত আনুগত্যের ছাপ। থানা থেকে বেরিয়ে আমি বললাম, ”আর নয় আজ মহাষষ্ঠীর দিনে আমি চলেছি মন্দিরতলায় তোর সঙ্গে থাকলে আমার পুজোর ঘোরাঘুরি করাটাই মাটি হবে”।

 জানুয়ারী ২০২৩ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

বিস্মৃত

ভাষা-সৈনিক

সুমন চক্রবর্তী

প্রবন্ধ

21she1.jpg
বিস্মৃত ভাষা-সৈনিক

ভাষা আন্দোলন বলতে যে তারিখটা সবার আগে মাথায় আসে তা হলো ২১শে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২। সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউর নামগুলো ঠকঠক করে মনের দরজা। কিন্তু আরও কত ভাষা-শহীদ, ভাষা সৈনিক, বাংলা ভাষাকে ভালোবেসে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাদের সবাইকে কি আমরা মনে রাখি? বাংলা ভাষার জন্যে কি একটিই আন্দোলন হয়েছিলো? শুধু ঢাকা শহরের রাজপথ-ই কি ঢেকে গিয়েছিলো রক্তে? তা তো নয়। তিনটি ছবিকে একই ফ্রেমে পাশাপাশি বসিয়ে দেখলে তবেই পাওয়া যাবে সম্পূর্ণ ছবিটিকে। ১৯৫২ সালে ঢাকা-সহ পূর্ববঙ্গ, ১৯৫৬ সালে পুরুলিয়া-সহ মানভূম এবং ১৯৬১ সালে অসমের হাইলাকান্দি, করিমগঞ্জ, শিলচর ইত্যাদি শহর। বাংলাদেশের লড়াই অর্জন করে নিয়েছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। শুধু একটি দিনের আবেগ দিয়েই বাংলাদেশ মনে রাখেনি ভাষা আন্দোলনকে। জীবনে-মননে এবং কর্মে তারা ঠাঁই দিয়েছে বাংলা ভাষাকে। তাই ভাষা আন্দোলনের যত আলো, আজ তাদেরই আকাশে। কিন্তু কেন্দ্র থেকে দূরে থাকা ভূখণ্ডের আন্দোলন, লোকসেবক সঙ্ঘের ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠা মানভূমের ভাষা আন্দোলন এবং কাছাড় গণসংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে চালিত অসমের ভাষা আন্দোলন, উপেক্ষিত রয়ে গেছে। অথচ লড়াইয়ে কিন্তু ফাঁকি ছিল না, খাদ ছিল না। মাতৃভাষায় কথা বলার, কাজ করার, লেখাপড়া করার অধিকার চেয়েছিল বাঙালি। যে পুরুলিয়া ছিল বঙ্গভুক্তির লক্ষ্যে মানভূমের ভাষা অন্দোলনের ধাত্রীভূমি, তার ভাষা আন্দোলনের কথা আমরা মনে রাখিনি। ভুলে গেছি সেই আন্দোলনের সৈনিকদের। ভুলে গেছি ভাবিনী মাহাতোকেও।

জন্ম ১৯১৫ সালে বৃটিশ ভারতের মানভূমের এক চাষী পরিবারে। লেখাপড়া শেখেন নি। মাত্র নয় বছর বয়সেই বিয়ে। দাদা পরীক্ষিৎ মাহাতো তখন কংগ্রেসে যোগ দিয়েছেন। 'মানভূম কেশরী' অতুলচন্দ্র ঘোষ ও তাঁর স্ত্রী 'মানভূম জননী' লাবণ্যপ্রভা ঘোষ স্থাপিত, জনকল্যাণকারী সংস্থা 'শিল্পাঞ্চল' ছিল, তৎকালীন সময়ে বিপ্লবীদের ঘাঁটি। কম বয়স থেকেই সেখানে বিপ্লবীদের দেখে হয়ে উঠেছেন দেশ-অন্ত-প্রাণ। তারপর আর মন টেকেনি স্বামীর ঘরে। বেছে নিয়েছেন রাজনীতির কঠিন পথ। ব্রিটিশ বিরোধী সমাবেশে স্লোগান দিয়ে, বিভিন্ন সত্যাগ্রহে অংশ নিয়ে, গ্রেপ্তার হয়েছেন, জেল খেটেছেন বহুবার। জেলে আলাপ হয়েছে 'মা' লাবণ্যপ্রভা ঘোষের সাথে। খুঁজে পেয়েছেন নিজের আদর্শকে।

‘জঙ্গলমহল’ জেলা ভেঙে ১৮৩৩ সালে নির্মিত মানভূম জেলা, ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত ছিল বিহার-ওড়িশা যুক্তপ্রদেশের অধীন। স্বাধীনতার সময় মানভূম ছিল বিহারের অঙ্গ। মানভূমের বাঙালিদের মধ্যে বঙ্গভঙ্গের সময় থেকেই অসন্তোষ দানা বাঁধে। ১৯১২ সালে বাংলা ভাষার উপর, হিন্দির আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টার প্রতিবাদে, মানভূম অঞ্চলে ভাষা আন্দোলনের সূচনা হয়। যদিও তা চল্লিশের দশকের শেষদিকে গভীরতর হয়। প্রতিবাদের নেতৃত্বে ছিলেন জেলা কংগ্রেসের সভাপতি শ্রী অতুল চন্দ্র ঘোষ। ১৯৪৮ সালের ৩০শে এপ্রিল বান্দোয়ান থানার জিতান গ্রামে, প্রদেশ কংগ্রেসের অধিবেশনে উত্থাপিত, আটটি প্রস্তাবের মধ্যে অন্যতম ছিল ভাষা সমস্যা। মাতৃভাষার ভিত্তিতে প্রদেশ পুনর্গঠনের প্রশ্নে কমিটি দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়লে, বাংলা ও হিন্দিভাষীদের মধ্যে বিরোধ চরমে ওঠে। মাসখানেকের মধ্যে পুরুলিয়ার প্রদেশ কংগ্রেস ভেঙে যায়। সভাপতি অতুলচন্দ্র ঘোষ, সম্পাদক বিভূতিভূষণ দাশগুপ্ত-সহ ৩৪ জন ইস্তফা দেন। তাঁদের প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য হয়ে ওঠে মাতৃভাষা রক্ষা। যদিও সব বাংলাভাষীই তাদের পক্ষে ছিল না। ফলতঃ শুরু হয় জাতিভিত্তিক বিভাজন। কিন্তু প্রতি ক্ষেত্রেই হিন্দিভাষা ব্যবহারের জন্য জেলাবাসীরা বাধ্য হতে থাকায়, একটা

বিপুল জনসমর্থন অতুলবাবুদের দিকে চলে আসে। ১৯৪৮ সালের ১৩ জুন ‘লোকসেবক সঙ্ঘ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। ৫০ জনের একটি গান্ধীবাদী জনসংযোগ দল তৈরি হয়। সংঘের নেতৃত্বে আরও দৃঢ় হয় ভাষা আন্দোলন। পঞ্চাশের দশকের শুরুর দিকে আন্দোলন তীব্র আকার নেয়। ‘ভাষাগুলির পূর্ণ উৎকর্ষ লাভ করতে হলে ভাষা অনুসারে প্রদেশগুলির পূর্ণ ব্যবস্থা করা প্রয়োজন’— গান্ধীর এই কথা অনুসারে শুরু হয় ভাষা সত্যাগ্রহ। সংস্কৃতির ধারা ও লোকায়ত মানুষের ভাবনা এই সত্যাগ্রহে মিশে যায়। বহু মানুষ টুসু গান গেয়ে পথে নামেন। আন্দোলনের নাম ‘টুসু সত্যাগ্রহ’ হিসেবে ছড়িয়ে পড়ে। গ্রেফতার না করেও বিশাল জন সত্যাগ্রহে বর্বর পুলিশি আক্রমণ চালানো হয়। কিন্তু লোকসেবক সঙ্ঘের পরিচালনায়, বিভিন্ন স্থানে, বিপুল সংখ্যক মানুষের যোগদানে, সত্যাগ্রহের শক্তি বাড়তে থাকে। লোকের মুখে মুখে ফিরতে থাকে প্রতিবাদী টুসু সংগীত, 'মন মানে না রে হিন্দি সইতে। ভাষা মোদের হরে নিল হিন্দীতে।। মাতৃভাষা হরে যদি আর কি মোদের থাকে রে। (তাই) মধু বলে মাতৃভাষার ধ্বজা হবে বহিতে।।' সত্যাগ্রহীদের উপরে বিহার সরকার ও প্রশাসনের অত্যাচার বেড়ে চলে। ১৯৫৪ সালে বিহার সরকার নিরাপত্তা আইনের অজুহাতে, ভাষা সত্যাগ্রহীদের বিরুদ্ধে মামলা করা শুরু করে। ২২শে জানুয়ারি লাবণ্যপ্রভা দেবী ও ভজহরি মাহাতো এবং ২৫শে জানুয়ারি ভাবিনী মাহাতো, সমরেন্দ্রনাথ ওঝা, কুশধ্বজ মাহাতো ও কালীরাম মাহাতো স্বেচ্ছায় কারাবরণ করেন।

২৩ শে জানুয়ারী ১৯৫৬, বাংলার মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় ও বিহারের মুখ্যমন্ত্রী কৃষ্ণ সিংহ, স্থির করেন যে, বিহার ও পশ্চিমবঙ্গকে মিলিয়ে একটা রাজ্য তৈরি হবে, ”বিহার-পশ্চিমবঙ্গ সংযুক্ত প্রদেশ”। বাংলার মানুষ এর বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে। কলকাতার বুদ্ধিজীবী মহলেও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। সারা পশ্চিমবঙ্গে হরতাল পালিত হয় ২৪শে ফেব্রুয়ারী। মানভূমে হরতাল পালিত হয় আরও একদিন, ১৯শে মার্চ। কিন্তু মানভূমের মানুষ, নেতৃবৃন্দ, তখন আরও এক ধাপ এগিয়ে চিন্তা করছে। ২০শে এপ্রিল মানভূমের পাকবিড়রা গ্রাম থেকে অতুলচন্দ্র ঘোষ ও লাবণ্যপ্রভা ঘোষের নেতৃত্বে প্রতিবাদিনী ভাবিনী মাহাতো ও তার সঙ্গীরা শুরু করলেন ‘লং মার্চ ‘। গ্রীষ্মের দাবদাহ উপেক্ষা করে এগিয়ে চললেন। মুখে তাঁদের ‘বন্দেমাতরম’, 'বাংলার মাটি বাংলার জল’। গন্তব্য কলকাতার ডালহৌসি স্কোয়ার। সুদীর্ঘ সে মিছিলের প্রথম ভাগ কোলকাতায় এসে পৌঁছয় ৬ই মে। পথে অসুস্থ হয়ে পড়া বাকিরা, গন্তব্যে এসে পৌঁছয় ৯ তারিখ। বলাবাহুল্য, এত দিন পর শ্রান্ত দেহে কোলকাতায় পৌঁছলেই, বাংলার পুলিশ প্রতিবাদীদের গ্রেপ্তার করে। তাদের ১১ দিনের জেল হয়। ভয়ঙ্কর দমন-পীড়ন, ভয় দেখানো, জেলে ঢোকানো সত্ত্বেও, আন্দোলনকারীদের মনোবল কমেনি। এ ভাবেই নিয়ত সংগ্রাম ও সুদীর্ঘ পথ পরিক্রমার পর, অবশেষে বিহার-বাংলা সংযুক্তিকরণের সিদ্ধান্ত পরিত্যক্ত হয়। যদিও মানভূম বঙ্গভঙ্গের মতো ভাগ হয়ে যায়। পুরুলিয়া জেলার কিছু অংশ পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভুক্ত হয়, বাকি অংশটা থেকে যায় বিহার অর্থাৎ বর্তমান ঝাড়খণ্ডে। ১৯৫৬ সালের ১লা নভেম্বর, পুরুলিয়া অন্তর্ভুক্ত হয় পশ্চিমবঙ্গের ভূগোলসীমায়।
পরবর্তীকালে মেয়েদের চরকা কাটা শিখিয়েছেন। চাষীর মেয়ে। তাই বারবার জেলে বন্দী হয়েও, জেলে খাবার-জামা-কাপড়ের বিশাল সম্ভার দেখে, তার কাছে জেল ছিল এক রাজকীয় ব্যবস্থা। জেলে বসেই লাবণ্যপ্রভা দেবীর কাছে শিখেছেন বর্ণপরিচয় থেকে চিঠি লেখা, সবকিছুই। প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতার কাজ করেছেন। মেয়েদের স্বাবলম্বী করায় বারবার জোর দিয়েছেন। ২০১৪ সালের ২৪শে জুন, মানবাজারের মাঝিহিডা গ্রামে, নিজের বাড়িতে, তার মৃত্যু হয়। মানুষ মনে না রাখলেও, বাংলা ভাষার প্রতিটা অক্ষর ভাবিনী মাহাতোকে ভুলে যায়নি।

 

 জানুয়ারী ২০২৩ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

ঘরের কাছেই আফ্রিকার

ড্রাগন পাহাড় দেখার অনুভূতি! 

সুদীপ পাকড়াশী

ভ্রমণ

ড্রাগন পাহাড়
Dragon Pahar.jpg

ফ্রিকার ড্রাগন পাহাড় দেখতে গিয়েছেন এরকম কোনও পর্যটক মিল খুঁজে পাবেন। একইরকমের অনুভূতি হবে তার। অথচ ঘরের কাছেই!
জেলার নাম পুরুলিয়া। অনেকবছর ধরেই এই জেলা পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয় অযোধ্যা পাহাড়ের জন্য। সম্প্রতি এই জনপ্রিয়তা আরও বেড়ে গিয়েছে। অযোধ্যা পাহাড় দেখার পাশাপাশি পর্যটকরা যাচ্ছেন গড়পঞ্চকোট দেখতে, খয়রাবেরা ড্যাম দেখতে। বামনি জলপ্রপাত দেখতে। কিন্তু এই স্পটগুলোর মধ্যে লুকিয়ে আছে আরও একটি স্পট। তার নাম মার্বেল লেক।

খুব সম্প্রতি ধীরে ধীরে মার্বেল লেক মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। একটি ছোট্ট হৃদ। ভীষণ শান্ত সেই জল। সেখানে পাতা ফেলাও নিষিদ্ধ। নীল আর সবুজে মেশানো জলের রঙ। সেই হৃদ ঘেরা রয়েছে পাহাড়ে। পাহাড়ের কাছে গেলে দেখা যাবে কত রকমের পাথরের সংমিশ্রণে তার সৃষ্টি! যার মধ্যে অন্যতম মার্বেল! তাই তার নাম হয়েছে মার্বেল লেক। পাহাড়ের ওপরের অংশ কিন্তু সবুজে ঘেরা!

ঘন জঙ্গল, আশাতীতভাবে পুরুলিয়ায় আপনি পেয়ে যাচ্ছেন ডুয়ার্সের ঘন জঙ্গলের স্বাদ! তার সঙ্গে স্তব্ধতা! অপার এক শান্তি। মার্বেল লেকের ধারে বসে থাকার সময় আপনি ভুলে যাবেন যে, জেলাটা পুরুলিয়া। স্থানীয় বাসিন্দারা জানাচ্ছেন এই লেককে পাতাল ড্যামও বলে অনেকে। তাদেরই দেওয়া তথ্য জানাল, এখানে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল অনেক বছর আগে। সেই উদ্যোগে ডাইনামাইট দিয়ে পাহাড় ফাটানোর কাজ শুরু হওয়ার পর হঠাৎ আবিষ্কৃত হয় এই ছোট্ট হৃদটি। তারপর পুরুলিয়া জেলা কর্তৃপক্ষ বিস্ফোরণ ঘটানোর কাজ বন্ধ করে দেয়। শুরু হয় মার্বেল লেককে পর্যটনকেন্দ্রে রূপান্তরিত করার পরিকল্পনা।

একটি ওয়াচ-টাওয়ার তৈরির পরিকল্পনা করা হয়েছে, মার্বেল লেক থেকে বাঘমুণ্ডি পর্বতের প্যানারমিক-ভিউ দেখার জন্য। মার্বেল লেক যেতে হলে পর্যটকদের অবশ্যই গাড়ি ভাড়া করতে হবে। পুরুলিয়া স্টেশনে নেমে তারা অযোধ্যা পাহাড়ের কাছে মুরুগুমা গ্রামে কোনও হোটেলে থাকতে পারেন। সেখান থেকে বামনি জলপ্রপাত যাওয়ার পথে পড়বে মার্বেল লেক। 

 জানুয়ারী ২০২৩ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

গল্প

women.jpg
অন্ধ ভালোবাসা
SwatiDey.jpg
Mijanur Rahman.jpg

নিরুপমা থরথর পায়ে ব্যাংক থেকে বেরিয়ে আসার পথে আর না পেরে সামনের সিঁড়ির উপর পড়ে গেল। এখন প্রায় দুপুর বারোটা বাজে। ব্যাংকের সামনে অনেক লোক, কেউ ঢুকছে আবার কেউ বেরোচ্ছে। তাদেরই কয়েকজন এসে নিরুপমাকে তুলে পাশের চেয়ারটায় বসাল। নিরুপমা শুনতে পেল কেউ একজন ভিড়ের মধ্যে থেকে জিজ্ঞেস করছে, “আপনি ঠিক আছেন, মাসিমা?” 
নিরুপমার কথা বলার মত শক্তি নেই। কোন রকমে হাতের ইশারায় দেখাল একটু জল খাবে। ভিড়ের মধ্যে থেকে একজন একটা জলের বোতল নিয়ে এল নিরুপমার জন্য। হাত বাড়িয়ে জলের বোতলটা নিয়ে চুপ করে বসে রইল নিরুপমা। পাশ থেকে আরেক জন বলে উঠল, “মাসীমা, জলটা খান, একটু ভাল বোধ করবেন।“  
এবার পাশে দাঁড়ান একটি মেয়ে নিরুপমার অবস্থাটা হয়তো বুঝতে পেরে ওর হাত থেকে জলের বোতলটা নিয়ে নিরুপমার মুখের সামনে ধরে জলটা খেতে বলল। নিরুপমা কিছুটা জল খেল। আরো কিছুক্ষণ পর যখন নিরুপমা  একটু ভাল বোধ করল তখন মেয়েটি বলল, “মাসীমা, আপনি কোথায় থাকেন? আপনাকে কি বাড়িতে পৌঁছে দেব?”
“না না, আমাকে একটা অটো রিকশা ডেকে দিলে আমি একাই চলে যেতে পারবো। এখন একটু ভাল লাগছে।“
“ঠিক আছে আমি অটো রিকশা ডেকে দিচ্ছি, আপনি কিন্তু যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একজন ডাক্তার দেখিয়ে নেবেন।“
অটো রিকশাওয়ালাকে নিজের বাড়ির ঠিকানা বুঝিয়ে দিয়ে রিকশায় উঠে বসল নিরুপমা। অটো রিকশায় বসে ভাবল, “ওটা কি সত্যিই আর আমার বাড়ি? বাড়ির এক কোণে একটা ছোট ঘরে এখনও মাথা গোঁজার ঠাই দিয়েছে বটে রূপম, তবে সেটাই বা কতদিন থাকবে কে জানে। ব্যাংকের সব টাকার মত ঘরটাও হয়তো একদিন বেহাত হয়ে যাবে।“
বছর খানেক হল নিরুপমা কোমর ব্যথায় খুব কষ্ট পাচ্ছে। রূপম সারাদিন অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকে। তাই একদিন সব লজ্জা কাটিয়ে বৌমা সৃজনী কে বলেছিল, “আমার কোমরটায় বেশ কিছুদিন হল খুব ব্যথা। রাতে ঘুমাতে পারছি না। আমাকে একটু ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে?“
সৃজনী বিরক্তি মাখা কন্ঠে বলেছিল, “আমার বুঝি আর কোন কাজ নেই? আমাকে তো একা হাতে চাকরি সামলে ঘরের কাজ করা, আপনার দেখাশোনা করা, আপনার ছেলের দেখাশোনা করা সব কিছুই করতে হয়। বরং এত কিছুর চাপে আমি আমার নিজের ছেলের ঠিকমত যত্ন নিতে পারি না। ওর পড়াশুনাতেও একটুও সময় দিতে পারি না।“
আর কিছু কথা না বাড়িয়ে নিরুপমা নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছিল, এমন সময় পিছন থেকে আবার সৃজনীর গলা শুনতে পেল, “আপনি কলকাতায় আপনার ছোট মেয়ের কাছে কয়েক দিনের জন্য গিয়ে থাকলেই তো পারেন। ওখানেই নাহয় নীরা আপনাকে একজন ডাক্তার দেখিয়ে দেবে। ওদের তো আর আপনার কোন দায়িত্ব পালন করতে হয় না। এই টুকু নাহয় করেই দিল।“ 
“ঠিক আছে, ওকে ফোন করে বলব কোন সময়”, বলে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে চেয়ারটা নিয়ে জানালার ধারে বসল। আজ কাল নিরুপমার সময় যেন কাটতেই চায় না। আগে একটু বাইরে গিয়ে হাঁটাহাঁটি করত, আজকাল কোমড় ব্যথাটার জন্য আর সেটাও পারে না। 
নিরুপমার জীবনের প্রায় পুরোটা সময়ই দুর্গাপুরে কেটেছে। পড়াশুনার পাট শেষ করে রমলা দেবী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে শিক্ষিকার কাজ শুরু করে। বাবা-মা দেখেশুনে বিয়ে দেন সরকারি কর্মচারী বিমলেন্দু মিত্রের সাথে। ছেলের বাড়ি বেশ বড় লোক। তাই নিরুপমার বাবাও তার মান রাখতে বেশ খরচা করেই বিয়ে দিয়েছিলেন বিমলেন্দুর সাথে। সময়ের স্রোতে তাদের তিনটে ছেলে মেয়ে হয়। বড় ছেলে রূপম আর দুই মেয়ে মীরা আর নীরা। সময়ের সাথে সাথে বিমলেন্দু আর নিরুপমার চাকরিতে উন্নতি হয়। বড় বাড়ি হয়। ব্যাংক এও টাকা বেশ ফুলে ফেঁপে ওঠে। 
বড় ছেলে রূপম শিবপুর থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে সরকারি চাকরিতে ঢোকে। ছোট বেলা থেকেই মীরার আঁকার হাত খুব ভাল। ছবি আঁকা নিয়েই ও কলকাতায় পড়াশুনা করতে যায়। আর ছোট মেয়ে নীরা বরাবরই একটু ঘরোয়া প্রকৃতির। পড়াশুনায় ওর খুব একটা বেশি মন ছিল না। ঘরের কাজে মাকে সাহায্য করতেই ও বেশি ভাল বাসত। নিরূপমাও ওকে কখনও কোন জোর করে নি কোন ব্যাপারে। কি আর হবে জোর করে। মেয়ে হয়ে জন্মেছে। বিয়ের পর তো সংসারই সামলাতে হবে। ওর বাবা অবশ্য এই ব্যাপারে নিরুপমার সাথে একমত ছিল না। তাই এক রকম জোর করে নীরাকে কলেজে ভর্তি করে দিয়েছে। 
রূপম চাকরি পাবার এক বছরের মধ্যে নিরুপমার স্কুলে একজন নুতন টিচার জয়েন করে। সৃজনীকে প্রথমবার দেখেই নিরুপমার খুব ভাল লেগে যায়। সেদিন বিকেলে বাড়ি ফিরে বিমলেন্দুকে বলে, “দেখ, আমি আমার রূপমের জন্য বউ পছন্দ করে ফেলেছি।“
“মানে? রূপম জানে?
“না। আমি তো আজই দেখলাম মেয়েটাকে। সৃজনী আজই আমাদের স্কুলে জয়েন করেছে। খুব ভাল মেয়ে।“
“একদিন দেখেই তুমি পাত্রী হিসেবে নির্বাচন করে ফেললে? তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে নাকি? তাছাড়া, তোমার পছন্দই যে তোমার ছেলের পছন্দ হবে, সেটাই বা তুমি ভাবলে কি করে?”
“রূপম আমার একমাত্র ছেলে। ও আমাকে সব থেকে বেশি ভাল বাসে। তুমি দেখবে আমার পছন্দই ওর পছন্দ হবে।“
সৃজনীর বাড়ির অবস্থা তেমন ভাল নয়। তাতে কি হয়েছে। নিরুপমা বিমলেন্দু কে বলল, “রূপম আমাদের একমাত্র ছেলে। আমাদের বাড়ি গাড়ি জমানো টাকা সবকিছুর মালিক তো একদিন ওরা দুজনই হবে। তাছাড়া দুজনেই ভাল চাকরি করছে। দেখবে ওরা খুব ভাল থাকবে।“
“সে না হয় বুঝলাম, কিন্তু তুমি মনে হয় একটা কথা ভুলে গেছ।“
“কি, আমি আবার কি ভুলে গেলাম?”
“তুমি ভুলে গেছ যে আমাদের আরো দুটো মেয়েও আছে। আমাদের বাড়ি গাড়ি জমানো টাকা, এই সব কিছুতেই ওদেরও সমান অধিকার আছে।“
“ওদের বিয়ে হয়ে গেলে ওরা নিজেদের সংসারে চলে যাবে। এখানে আমাদের সাথে থাকবে শুধু রূপম আর সৃজনী। তাছাড়া, তোমার ওসব নিয়ে ভাবতে হবে না। ওসব আমি সামলে নেব।“
তারপর ছয় মাসের মধ্যে রূপম আর সৃজনীর বিয়ে হল। সৃজনীর বাপের বাড়ির অবস্থা তেমন ভাল নয় বলে নিরুপমা মোটামুটি নিজের খরচেই জাঁক জমকের সাথে একমাত্র ছেলের বিয়ে দিলেন। 
বাড়িতে সব কিছু ঠিকমতই চলছিল। বড় মেয়ে মীরা কলকাতায় হোস্টেলে থাকে। মাঝে মাঝে ছুটিতে দুর্গাপুরে আসে। এখানে নীরা বাড়ির প্রায় সব কাজেই নিরুপমাকে সাহায্য করে। তাই সৃজনীকে কিছুই করতে হয় না। ও নুতন বউ, ও বাড়ির কাজ করবেই বা কেন। 
কিন্তু আমাদের জীবন তো আর বরাবর এক ভাবে যায় না। সুখ দুঃখ মিলেই যে জীবন। তাই হয়ত এত সুখ নিরূপমার ভাগ্যে সইল না। ছেলের বিয়ের এক বছরের মধ্যে হার্ট অ্যাটাকে বিমলেন্দুর মৃত্যু হয়। তারপরই সংসারের চেহারটাও একটু একটু করে বদলাতে শুরু করে। বিমলেন্দুই এতদিন বাইরের সব কাজ সামলে এসেছে। টাকা পয়সার ব্যাপারে নিরুপমাকে কখনোই কিছু চিন্তা করতে হয়নি। সংসারের কাজ সামলানোই তার দায়িত্ব ছিল। এখন যে ঘর-বার দুটোই দেখতে হচ্ছে। 
এদিকে মীরার আর্ট কলেজের পড়া শেষ হয়ে গেছে। বাড়িতে এসেছে কিছুদিনের জন্য। কলেজে পড়ার সময় রমেশ নামে একটি ছেলের সাথে ওর বন্ধুত্ব হয়। ছেলেটিও খুব ভাল আঁকে। ওরা দুজনেই বিয়ে করে মুম্বাই এ পাকাপাকি ভাবে গিয়ে থাকতে চায়। 
মীরা একদিন নিরুপমাকে বলল, “মা, রমেশের বাবা-মা তোমার সাথে আমাদের বিয়ের ব্যাপারে কথা বলতে চান। কবে উনাদের আসতে বলব?”
“দাড়াও, আমাকে একটু ভাবতে দাও। তাছাড়া এখন তোমার বাবার অবর্তমানে তোমার দাদাই সব সিদ্ধান্ত নেবে। ওর সাথে আগে একটু কথা বলে তোমাকে জানাবো।“
রাতে দাদা নিজের ঘরে মীরাকে ডেকে পাঠাল। মীরা দাদার ঘরে গিয়ে দেখল মা আর বৌদিও আছে। মীরা একটা চেয়ার নিয়ে বসার পরে ওর দাদা বলতে শুরু করলো, “মার কাছে শুনলাম তুই রমেশকে বিয়ে করতে চাস, সেটা তো খুবই ভাল খবর। কিন্তু দেখ, বাবা মারা যাবার পর সংসারের সবকিছু তো আমাকেই সামলাতে হচ্ছে। এই বাড়িটাও তো দেখছিস কি রকম ভাঙা চোরা হয়ে যাচ্ছে। এটাকেও ভেঙে নুতন করে বানাতে হবে। আমি একা হাতে সব কিছু কি করে সামলাব বল?“   
“আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না দাদা, তুই কি বলতে চাইছিস। একটু খুলে বলবি কি?”
নিরুপমা আর সৃজনী এতক্ষণ চুপ করে সব শুনছিল। এবার নিরুপমা বলতে শুরু করলো, “দেখ মীরা, রমেশ কে তো তুই নিজেই পছন্দ করেছিস, আমাদের জন্য তো অপেক্ষা করিস নি যে আমরা বড়লোকের ঘরের ভাল ছেলে দেখে তোর বিয়ে দেব, তাই বলছিলাম কি তুই বরং রমেশের সাথে কথা বলে রেজিস্ট্রি ম্যারেজ করে নে।“
“মা, এসব তুমি কি বলছ? তুমি তো একটা হাই স্কুলের হেড মিসট্রেস। প্রচুর টাকা মাইনা পাও। তাছাড়া, বাবা মারা যাবার পরও অনেক টাকা পেয়েছো। দাদার বিয়ের সময় তো প্রচুর লোক দেখানো উত্সব করেছিলে। আর এখন মেয়ের বেলায় তোমার পয়সা নেই?” কথাগুলো বলেই মীরা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। রাতটা কোন মতে নিজের ঘরে কাটিয়ে সকালে উঠেই কলকাতা ফিরে গেল। সেখানে গিয়ে রমেশের সাথে কথা বলল। 
“আমার বাড়ির লোকজন আমাদের বিয়ের জন্য কোন খরচ করতে পারবে না বলেছে। তুমি এখন কি করতে চাও?”
“যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তোমাকে বিয়ে করে মুম্বাই নিয়ে যেতে চাই।“
“ওখানে গিয়ে আমরা কি খাব? কোথায় থাকবো?”
“সেসব নিয়ে আর তোমাকে ভাবতে হবে না। আমি মুম্বাইতে একটা ভাল চাকরির অফার পেয়েছি। একটা বড় কোম্পানীতে মার্কেটিং বিভাগে। আমাকে ওদের বিজ্ঞাপনের অটিস্টিক দিক গুলো দেখতে হবে। মাইনাও বেশ ভাল দেবে।“
“আর তোমাদের বাড়ির লোক?”
“আমি তোমাকে রেজিস্ট্রি করে বিয়ে করলেও আমার বাবা মার কোন আপত্তি হবে বলে মনে হয় না। ওরা তোমাকে ভালবাসে। তাই বিয়েটা কিভাবে হল সেটা বড় কথা নয়। তুমি ওদের বাড়ির বউ হবে, সেটাই ওদের কাছে বড় কথা।“
এরপর এক মাসের মাথায় মীরা রমেশকে বিয়ে করে মুম্বাই চলে যায়। যাবার আগে শুধু ছোট বোন নীরাকে ফোন করে খবরটা দিয়েছিল। নিরার কাছ থেকেই বাড়ির সবাই খবরটা পায়। ‘নির্ঝঞ্ঝাটে আপদ বিদেয় হয়েছে’, এরকমই একটা ভাব নীরা দেখতে পেয়েছিল ওর দাদা বৌদি, এমনকি মার চোখে মুখে। নীরা মুহূর্তের জন্য ওর নিজের ভবিষ্যতটাও দেখে নিল এদের চোখে মুখে। 
এর ঠিক কয়েকদিন পর রাতে ডিনার টেবিলে খেতে বসে রূপম মা কে বলল, “মা, বাড়িটার অবস্থা তো দেখছ দিন দিন খারাপ হচ্ছে। এসব ঠিক করতে আমার অনেক টাকা খরচ হচ্ছে। তার থেকে বরং এই বাড়িটা ভেঙে নুতন করে একটা দোতলা বাড়ি বানিয়ে নিলে কেমন হয়?”
“সেটা তো খুবই ভাল কথা। কিন্তু তাতে তো খরচও হবে অনেক।“
“তাতো হবেই। সে নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না। আমি সব কিছু ম্যানেজ করে নেব। তুমি শুধু বাড়িটা আমার নামে লিখে দিলেই আমি ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে বাড়ির কাজে হাত দিতে পারবো।“
নিরুপমা একটুও দ্বিধা না করে বলল, “তাই নাকি? এসব বাড়ি-টারি তো আমি সবই তোর জন্যই করেছিলাম। তোর নামে লিখে দিলে যদি তোর লোন পেতে সুবিধা হয় তাহলে তাই দেব। তুই ব্যবস্থা কর।“  
নীরা চুপ করে খাওয়া শেষ করে উঠে গেল। ওর থাকা না থাকা, ওর মতামতের কোন মূল্য এই বাড়িতে কখনও ছিল না। আজই বা থাকবে কেন? মা বা দাদাদের ওর বিয়ে নিয়ে কোন মাথা ব্যথা নেই। নীরা এখন বাড়িতে থাকলেই তো বরং ভাল। বিনে পয়সায় এত ভাল সেবা দাসী কোথায় পাবে ওরা। তার উপর আবার বৌদি এখন সন্তান-সম্ভবা। বাচ্চা হয়ে গেলে সব কাজ করার জন্য তো নীরাকেই প্রয়োজন হবে। 
রূপম কয়েক দিনের মধ্যেই বাড়ির মালিকানা পরিবর্তনের সব কাগজ পত্র মা কে দিয়ে সই সাবুদ করিয়ে নিয়ে চলে গেল। রাতে বাড়ি ফেরার পথে নিরুপমার জন্য এক প্যাকেট মিষ্টি এনে মার হাতে দিয়ে বলল, “মা, তোমার তো দোতলা বাড়িতে খুব থাকার ইচ্ছে ছিল, এবার দেখবে আমি তোমার জন্য কি সুন্দর দোতলা বাড়ি বানাবো। এই নাও, সেই আনন্দে একটু মিষ্টি মুখ কর।“
নিরুপমা আনন্দে উল্লসিত হয়ে ঘরের দেয়ালে ঝোলানো বিমলেন্দুর ছবিটার দিকে তাকিয়ে বলল, “দেখেছ তো আমাদের ছেলে কত ভাল হয়েছে। আমি তোমায় বলেছিলাম না ওকে আমি আমার সর্বস্ব নিশ্চিন্তে দিতে পারি। ওকে নিয়ে আমার কোন চিন্তা নেই।“ 
পাশে দাঁড়িয়ে নীরা মনে মনে ভাবল, “ছবিতে বাবার মুখ দেখে মনে হল বাবা যেন একটু মুচকি হাসল। জানি না সেটা মার দূরদর্শিতায়, নাকি নির্বুদ্ধিতায়। একমাত্র সময়ই সেটা বলতে পারবে।“ 
এরপর সৃজনীর ছেলে হল। নিরুপমা রূপমের বিয়ের মত এবারও রাজকীয় ভাবে একমাত্র নাতি সৃজিতের অন্ন প্রাশনের সব খরচ নিজেই করলো। নিরুপমার সুখ আর ধরে না। এটাই তো

চেয়েছিল নিরুপমা। ছেলে, বৌ আর নাতি নিয়ে সুখে সংসার করবে। সৃজিতের জন্মের এক বছর পর সৃজনী আবার স্কুলের চাকরিতে ফিরে গেল। বাড়িতে সারাদিনের একটা কাজের লোক আছে“কি কথা?“ বটে, তবে তার ভরসায় তো আর নিজের বাচ্চাকে সারাদিনের জন্য ফেলে রেখে যাওয়া যায় না। নীরা আছে, এটাই ভরসা। নীরাও এই প্রথম উপলব্ধি করল এই বাড়িতে ওর গুরুত্ব আর যাই হোক অন্তত কাজের মাসির থেকে উপরে। দেখতে দেখতে সৃজিতের বয়স তিন বছর হল। সামনের বছর থেকে স্কুলে যাবে। তখন আর নীরাকে এ বাড়িতে কারো প্রয়োজন হবে না। তাই নিরুপমা ভাবল, “এবার নীরার একটা বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। রূপমের সাথে একদিন এই নিয়ে কথা বলতে হবে।“ কিছুদিন পর রূপমই কথাটা তুলল, “মা, তোমার সাথে একটা জরুরী কথা ছিল।“

“নীরার তো অনেক বয়স হল, এবার তো ওর বিয়ের কথা ভাবতে হবে। আর তাছাড়া দাদা হিসেবে আমারও তো একটা কর্তব্য আছে।“
“তাই তো, আমিও কয়েকদিন হল এটাই ভাব ছিলাম। কিন্তু পাত্র পাব কোথায়? আর তাছাড়া নীরা তো রূপে গুণে কোন দিকেই আহা মরি কিছু নয়।“
“সে নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। কলকাতায় আমার এক পরিচিত ছেলে আছে। ওর নিজের বলতে কেউ নেই। ছোট বেলায় বাবা-মা কে হারিয়েছে। নিজের একটা ইলেকট্রিকাল গুডস এর দোকান আছে। ছেলেটার বয়সটা নিরার থেকে একটু বেশি। কিন্তু নীরা কে তো আর শ্বশুর শ্বাশুড়ী দেওর ননদ নিয়ে সংসার করতে হবে না। ও ওখানে রাজ-রানী হয়ে থাকবে।“
“দাবি দাওয়ার ব্যাপারে কিছু কথা হয়েছে তোর সাথে?”
“হ্যাঁ, বিনোদের কোন চাহিদা নেই। আমার বোন গৃহ কর্মে নিপুণা শুনে এক কথায় রাজি হয়ে গেছে। বাবা-মা মড়া ছেলে তো, তাই ও চাইছে নিরার মত একটা মেয়ে যে ওর সংসারের হাল ধরবে।“
“তাহলে আর দেরি কেন? তুই বিয়ের দিন ঠিক কর।“
“আসলে বিনোদ বলেছে ওর কাছে বিয়ের জন্য অহেতুক খরচ করার মত টাকা নেই, তাই ও ঘরোয়া ভাবেই নীরা কে বিয়ে করে নিয়ে যেতে চায়।“
“সেটা তো খুবই ভাল কথা। এখান থেকে রেজিস্ট্রি করে, বাড়িতেই একটু খাওয়া দাওয়া মিষ্টি মুখ করে ওকে নিয়ে যাবে।“
পর দিন নিরুপমা নীরাকে নিজের ঘরে ডেকে নিয়ে বললেন, “ছেলে শুধু হাতে তোমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে বলেই তো আর আমি তোমাকে শুধু হাতে পাঠাতে পারি না। দেখ আমি তোমার জন্য কিছু গয়না বের করে রেখেছি”, বলে নিরার হাতে একটা ছোট বাক্স দিল। 
বাক্সটা খুলে নিরার ছোট বেলার অনেক কথা মনে পড়ে গেল। ছোট বেলায় এই গয়না গুলো দেখলেই নিরুপমা রেগে যেত। এগুলো তার বিয়েতে পাওয়া গয়না। নিরুপমার মতে তাদের সব গরীব আত্মীয়রা এগুলো দিয়েছে। এগুলো এত হালকা যে এসব নাকি সভ্য সমাজে পরা যায় না। বাক্সের মধ্যে একটা সরু চেন, দুটো বালা, এক জোড়া কানের রিং আর একটা আংটি। 
নিরুপমা জিজ্ঞেস করলো, “এগুলো পছন্দ হয়েছে তো?”
অনেক কষ্টে নীরা চোখের জল আটকে বলল, “হ্যাঁ, খুব সুন্দর।“
“তাহলে বিকেলে তৈরি থেকো, তোমাকে নিয়ে শাড়ির দোকানে যাবো। তোমার অবশ্য অনেক শাড়ি আছে। ঘরে পড়ে পড়ে সব নষ্ট হচ্ছে। তুমি তো বাইরে কোথাও যাও না। তবুও, আমি তো আর তোমাকে নুতন শাড়ি ছাড়া শ্বশুর বাড়িতে পাঠাতে পারি না।“
“ঠিক আছে”, বলে নীরা কোনমতে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে কাঁদতে লাগলো। মনে মনে ভাবল, “বাবা তুমি খুব স্বার্থপর, তুমি আমাদের ছেড়ে এভাবে চলে গেলে কেন? আজকে তুমি থাকলে আমাদের দুই বোনের এরকম অবস্থা হত না।“
বিকেলে নিরুপমা নীরাকে নিয়ে দোকান থেকে একটা পিওর সিল্ক আর দুটো তাতের শাড়ি কিনে বাড়ি ফিরল। তার ঠিক সাত দিন পর নীরা শ্বশুর-শ্বাশুড়ী হীন শ্বশুর বাড়ির উদ্দেশে যাত্রা করল একজন অচেনা অজানা লোকের হাত ধরে। মনে মনে ভাবল, “জন্মের পর থেকে দেখা এইসব চেনা মানুষ গুলোর থেকে আর কতই বা খারাপ হতে পারে এই অচেনা মানুষটা?”
যাইহোক, নীরা মনে না নিলেও, সময়ের সাথে সব কিছুকে মেনে নিয়ে বিনোদের সংসারের হাল ধরল। বিনোদ মানুষটা বেশ শান্ত স্বভাবের। এই প্রথম কোন মহিলার সাথে এক বাড়িতে এক ঘরে থাকছে বলে প্রথম দিকে একটু অসুবিধা হলেও পড়ে আস্তে আস্তে মানিয়ে নিতে শুরু করেছে। সব কিছুতে নিরার মতামতের গুরুত্ব দেয়। এই প্রথম নিরার নিজেকে একজন মানুষ বলে মনে হল। বাপের বাড়ির সেবা দাসী হয়ে থাকতে থাকতে ও যেন ক্লান্ত হয়ে উঠেছিল।  
এদিকে নিরুপমা স্কুলের হেড মিস্ট্রেসের পদ থেকে বিরতি নিয়েছেন। বাড়িতে সারা দিন প্রায় একাই থাকেন। তবে নীরা চলে যাওয়াতে সৃজনের দেখাশোনার ভারটা এখন নিরুপমার উপরেই এসে পড়েছে। নিরুপমারও বয়স বাড়ছে। সব কাজ নিজে হাতে সামলে উঠতে পারেন না। তাছাড়া কোমরের ব্যথাটাও আজকাল বড় ভোগাচ্ছে। 
রাতে খাবার টেবিলে বসে রূপম বলল, “মা, তুমি তো আজকাল আর বাইরে যাও না। বাজার-ঘাট সব আমাকেই করতে হয়। ব্যাংকের কাজগুলোও আমাকেই করতে হয়। আমাকে বার বার তোমার কাছে সই করাতে আসতে হয়। তাই বলছিলাম কি, চল আমরা দুজন মিলে একটা জয়েন্ট একাউন্ট খুলে নি। সেখানে তোমার টাকাও থাকবে, আমাদের টাকাও থাকবে। প্রয়োজন মত আমরা দুজনেই সেটা ব্যবহার করতে পারবো।“
“তুই যা ভাল বুঝিস কর। আমাকে বলিস কি করতে হবে, কোথায় সই করতে হবে, আমি করে দেব।“
“ঠিক আছে মা, আমি ব্যাংকে কথা বলে তোমাকে জানাবো।“
কিছু দিনের মধ্যেই ব্যাংকে নিরুপমা আর রূপমের জয়েন্ট একাউন্ট হয়ে গেল। নিরুপমাকে আর ব্যাংকে গিয়ে টাকা তোলার জন্য লাইন দিয়ে দাড়িয়ে থাকতে হয় না। নিরুপমা মনে মনে খুশীই হল। খুশি না হয়েই বা কি করবে। তার একমাত্র ছেলে, তার নয়নের মনি কিছু বলেছে আর তিনি সেটা করবেন না, তা কখনও হয়েছে?    
এভাবেই চলছিল। তবে আজকাল সৃজনীর ব্যাবহার দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। সেদিন স্কুলে যাবার আগে বলে গেল, “সারাদিন বাড়িতে বসে বসে অন্ন ধ্বংস করা ছাড়া আর কিছু তো একটু করতে পারেন। ঘর-দুয়ার গুলো একটু গুছিয়ে রাখবেন। আর সৃজিত স্কুল থেকে বাড়ি ফিরলে ওকে একটু পড়াশুনা করাবেন।“
নিরুপমা চুপচাপ সব কথা শুনে চলে। ছেলেকে এসব বলে কোন লাভ হবে না, এ টুকু না বোঝার মত নির্বোধ তিনি নন। 
এর মধ্যে একদিন নীরা ফোন করে জানালো, “দিদি একটু অসুবিধায় আছে। আসলে ওরা একটা ফ্ল্যাট কিনতে চাইছে, কিছু টাকা কম হচ্ছে। আমার কাছেও তো তেমন কোন সঞ্চয় নেই যে ওকে দেব। মা, তোমার কাছে তো অনেক টাকা আছে। তুমি তো ওকে বিয়েতেও কিছু দাও নি। ওকে কি তুমি কিছু টাকা ধার দিতে পারবে? ও তোমাকে সুদ সমেত ফিরিয়ে দেবে।“
“তা এটা তোমার দিদি আমাকে বলতে পারল না ফোন করে?”
“মা, তুমি কি কখনো ফোন করে দিদি বা আমার কোন খোঁজ নিয়েছো?”
“থাক থাক, তোমাদের সাথে কথা বললেই তো এক ঝাঁক অভিযোগ শুনতে হয়। তার থেকে কথা না বলাই ভাল। আমাকে একটু ভেবে দেখার সময় দাও। আমাকে কয়েকদিন পর ফোন কোরো।“
নিরার ফোনটা কেটে দিয়ে নিরুপমা স্নানে গেল। আজ অনেকদিন পর একটু ব্যাংকে যাবে। মনে মনে ভাবল, “সত্যিই তো, মীরাকে কিছু দেওয়া হয় নি। দেখি কিছু টাকা যদি পাঠাতে পারি। তাছাড়া, নীরা তো বলেছে মীরা টাকাটা সুদ সমেত ফিরিয়ে দেবে। ওকে বলব সুদটা না দিলেও চলবে।“
ব্যাংকে গিয়ে নিরুপমা জানতে পারল যে ওর একাউন্ট এ মাত্র কয়েক হাজার টাকা পড়ে আছে। নিরুপমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল। তার অন্ধ বিশ্বাস আর অন্ধ ভালোবাসার সুযোগ নিয়ে আজকে রূপম তাকে এভাবে ঠকাল? নিরুপমা সব কিছু বুঝতে পেরেও যেন বিশ্বাস করতে চাইছে না। 
রাতে রূপমকে টাকার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করাতে রূপম বলল, “মা, আসলে তুমি তো জানো আমি এখানের বাড়িটা তৈরির জন্য লোনের চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু সেটা পেতে একটু দেরি হচ্ছে। তাই ভাবলাম তোমার একাউন্ট এ এত গুলো টাকা এমনি পড়ে আছে, এ গুলো দিয়ে আগে বাড়ির কাজটা শুরু করি। তারপর আমার লোনের টাকা পেয়ে গেলে তোমাকে তোমার টাকা ফিরিয়ে দেব।“
নিরুপমা আর কথা না বাড়িয়ে নিজের ঘরে চলে গেল। পরদিন সকালে রূপম আর সৃজনী বেরিয়ে গেলে নীরাকে ফোন করল। নিরুপমার একটু অস্বস্তি লাগছিল। সত্যিই তো, এত বছর হয়ে গেছে, ও নিজে থেকে কখনো মেয়েদের ফোন করে জিজ্ঞেস করেনি ওরা কেমন আছে। আজও হয়তো করতো না। তবু মনে হল কারো সাথে কথা বললে হয়তো মনটা একটু হালকা লাগবে। 
“হ্যালো, নীরা, আমি মা বলছি। তুই কেমন আছিস।“
“এই প্রথমবার তুমি ফোন করেছ, তাই বলব ভালই আছি। তা হঠাৎ ফোন করলে যে?”
“আসলে কালকে তোর কাছে মীরার কথা শুনে ব্যাংকে গিয়েছিলাম। কিন্তু গিয়ে দেখি ব্যাংকে মাত্র কয়েক হাজার টাকা পড়ে আছে।“
“কেন? বাবা মারা যাবার পর তো তুমি অনেক টাকা পেয়েছিলে? তারপর, তুমি রিটায়ার করার সময়ও অনেক টাকা পেয়েছো? তাছাড়া, বাবা আর তোমার সারা জীবনের সঞ্চয়, এসব কোথায় গেল?“
“আসলে তোর দাদার সাথে আমি জয়েন্ট একাউন্ট খুলেছিলাম। আমি তো আর আজকাল কোমর ব্যথার জন্য ব্যাংকে যেতে পারি না। তাই রূপমই সব কিছু দেখা শোনা করে।“ 
“তা তুমি কি দাদাকে জিজ্ঞেস করেছিলে ও টাকাটা দিয়ে কি করলো?”
“হ্যাঁ, করেছি তো। ও বলল ওর লোনের টাকাটা পেতে একটু দেরি হচ্ছে। তাই এই টাকাটা দিয়ে ও আমাদের বাড়ির কাজটা শুরু করবে। তারপর লোনের টাকাটা পেলে আমাকে আমার টাকাটা ফিরিয়ে দেবে বলেছে।“
“ও, দাদা তোমাকে তাই বলেছে বুঝি? দাদা কয়েকদিন আগে কলকাতায় এসেছিল একটা ফ্ল্যাট কেনার জন্য। ও এখানে এক কোটি বিশ লাখ টাকায় একটা ফ্ল্যাট কিনেছে। আর সেই টাকাটা ও তোমার একাউন্ট থেকেই নিয়েছে। আমি এটা কার কাছ থেকে জেনেছি সেটা জিজ্ঞেস করে নিজেকে আর ছোট কোরো না, মা।“ 
একটু থেমে নীরা আবার বলল, “দিদি কারো কাছে টাকা চায় নি, তাছাড়া কেউ দিলেও ও নেবে না। আমাদের বাড়ির সবার থেকে ওর আত্মসম্মান বোধটা চিরকালই একটু বেশি। আমি সব কিছুই জানতাম। তোমাকে বললে তুমি বিশ্বাস করতে না। তাই তুমি যাতে ব্যাংকে গিয়ে নিজের চোখেই সব দেখতে পারো, সেই জন্য দিদির গল্পটা বানিয়ে বলেছিলাম তোমাকে।“
“আমার নিজের কর্মফলই আজ আমার কাছে বুমেরাং হয়ে ফিরে আসছে। অন্ধ ভালোবাসার মোহে আমার সব কিছু বড় ছেলেকে দিয়ে আমি যে এখন একেবারে নিঃস্ব”, কথাগুলো আপন মনেই ভাবল নিরুপমা। 
এর কিছুদিন পর মাথাটা একটু ঠান্ডা হলে নিরুপমা ছেলেকে বলল, “রূপম, তুই তো আমার বাড়ি, টাকা সব কিছুই নিয়ে নিয়েছিস, এখন থেকে আমার পেনশনের টাকাটা আমি আমার জন্য রাখতে চাই। কখনো কোন অসুখ বিসুখ হলে কাজে লাগবে।“
রূপম কিছু উত্তর দেবার আগেই সৃজনী বলে উঠল, “তাহলে আপনার পিছনে মাসে মাসে যে টাকা খরচ হয় সেটা কোথা থেকে আসবে? আপনার সারাদিনের দেখাশোনার লোক, বাড়ির রান্নার লোক, আপনার ডাক্তার, ওষুধ এসব খরচ কি আপনার মেয়েরা দেবে?”
“আমার মেয়েরা যেমন আমার কাছ থেকে কিছু নেয় নি, আমিও তেমনি ওদের কাছ থেকে কিছু নেব না। আমার যা আছে তোমরা সব নিয়ে নাও”, বলতে বলতে নিরুপমা নিজের ঘরে গেল। 
আজ নিরুপমা ভেবেছিল নিজেই গিয়ে একজন ডাক্তার দেখাবে কোমর ব্যথাটার জন্য। তাই সকালে ব্যাংকে এসেছিল কিছু টাকা তোলার জন্য। ডাক্তারের ফি, বিভিন্ন রকমের টেস্ট, তারপর ওষুধ, সব মিলিয়ে বেশ কিছু টাকা লাগবে। এক ঘণ্টা লাইন এ দাড়িয়ে থাকাতে কোমর ব্যথাটা আরো বেড়ে গেল। তারপর যখন জানতে পারল ব্যাংক একাউন্টে মাত্র এক হাজার টাকা আছে, রূপম ওর পেনশনের টাকাটাও তুলে নিয়েছে, তখন আর নিজেকে সামলাতে পারেনি। মাথা ঘুরে পড়ে যায় ব্যাংকের সামনে। ভাগ্যিস সবাই মিলে ধরাধরি করে উঠাল, নাহলে খুব অসুবিধা হত। 
বাড়ি ফিরে নিরুপমা অটো রিক্সাওয়ালাকে ভাড়ার টাকাটা দিতে গিয়ে একশ টাকা বেশি দিল। মনে মনে ভাবল, “এই প্রথম কাউকে নিঃস্বার্থ ভাবে হয়ত কিছু দিলাম। সারাজীবন তো ছেলে ছেলে করে মরলাম। ভেবেছিলাম আজ ওর জন্য করলে ওই একদিন আমার অন্ধের যষ্ঠি হবে। সেই জন্যই মেয়েদেরও সারা জীবন সব কিছু থেকে বঞ্চিত করেছি। আজ আমাকে এ টুকু শাস্তি তো পেতেই হবে। এটাই আমার কর্মফল।“ 

মতামত

Please mention the "name of the article and the author" you would like to comment in the following box... Thank you.

 জানুয়ারী ২০২৩ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

bottom of page