top of page
সূচীপত্র
Saraswati3.jpg
মার্চ ২০২১
girl.JPG

মার্চ ২০২১ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

দেবাশিস পট্টানায়েক - কবিতা
Debashis Pattanakye.jpg

কবিতা

দেবাশিস পট্টনায়েক

জন্ম ১৯৬৭ সালে মেদিনীপুর জেলার (বর্তমান পূর্ব মেদিনীপুর) তমলুক মহকুমায়। চাকরি সূত্রে দিল্লী নিবাসী, গবেষণা ও অধ্যাপনায় নিযুক্ত। কবিতা লেখা শখ।

ভাটিয়ালি গান


পাশাপাশি, জলের ধারে, খুব কাছে -
নদীর দিকে মুখ করে তুমি, তোমার দিকে তাকিয়ে আমি।
ভেসে আসছে তোমার থেকে বেলফুলের গন্ধ,
আর খুব চেনা প্রেম-পর্যায়ের একটা রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুর।
নেচে বেড়াচ্ছে গাছের উপর পাগল দুটি পাখি,
মনের রঙ চুরি করে অকারণে ঝরে পড়ছে কৃষ্ণচূড়া।
আটকে পড়া ফুলের দলকে সরিয়ে দেওয়ার অছিলায়
খেলছে খোলা চুল নিয়ে আমার পথহারা আঙুল.
মনের তরঙ্গের দোলাতে থমকে দাঁড়ানো গানের কলি,
নদীর জলে, কুন্তলে রোদের ছটা, নত মুখে অস্ফুট হাসি।
এলোমেলো হয়ে উড়ছে কথা মনের ঝোড়ো হাওয়ায়,
সময়ের ধারা বয়ে চলেছে নীরবতার দাঁড় টেনে।
লোভীর মতো জোয়ারের জল ছুঁতে চাইছে তোমার পা,
ছুঁড়ে মারলাম এক টুকরো পাথর প্রতিদ্বন্দ্বীর উদ্দেশ্যে,
নদী এমনি বয়ে গেল, ঢেউ উঠল আমার মনে।
সাহসের দেউড়ি পেরিয়ে রাখলাম হাত তোমার হাতে,
সলাজ অনুমতি মুখ ঘুরিয়ে আরক্ত চোখের উপর চোখ রেখে,
হারিয়ে গেল দৃষ্টি ওপারের ঘন সবুজ আভায়।
জলের কুল-কুল, ঝাউয়ের শনশন, মৌমাছির গুনগুন -
বকুলের গন্ধে মাদক চৈতালী হাওয়া;
খেয়ার নৌকা মুখর অচেনা যাত্রীর কলরোলে।
মন্দিরে পূজার ঘণ্টায় কি যেন আকুল মিনতি -
ঢেকে যাক রুষ্ট রোদ, থেমে যাক চঞ্চল বেলা,
নীল আকাশে উড়ন্ত গাংচিলের সোনালী ডানায়।

সারথী

মেলেনি ক্লেশিত ডানার অধিকার,
বহু শত বছরের উপেক্ষা,
রক্ত শোষণ,
উপেক্ষিত সাম্যের দাবি,
পেষিত বিবর্তনের চাকায়;
বহুরূপী চায়নি রাজার কাছে
দুপা জমি ওদের জন্য।
চিনতে পারিনি অবতারের রূপ 
ধূলার মাঝে।
সেই কবে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে
দুর্গম মরুভূমি অতিক্রম করে
বাঁধা পড়েছিলাম শস্যের বাঁধনে,
ধীরে ধীরে অনুশাসনের শৃঙ্খলে,
অবশেষে আবদ্ধ 
ধূসর পিঞ্জরের মায়াজালে।
হারিয়ে ফেলেছি সংগ্রামের মনোবল,
শরীর শুধু ব্যস্ত
আগুন নেভানোর কাজে।
তবুও থামতে দেয়নি রথের গতি,
অসংবেদনশীল সাথীকে নিয়ে
মাথা নিচু করে আত্মগোপনের ছলনায়
দক্ষ নিপুণ হাতে 
লাগাম ধরে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল 
সভ্যতার রথ, রণভূমির মধ্য দিয়ে
মহাকালের দিগন্ত রেখার পানে।
 

আজ যখন ঝড় উঠল,
ডমরু বাজিয়ে শুরু হল
মহারুদ্রের প্রলয় নাচন,
অদৃশ্য আণুবীক্ষণিক শক্তিশেল
আঘাত হানল জীবন দ্বারে -
নেচে উঠল উষ্ণ শোণিত
ঘনশ্যামের শিরায় শিরায়,
বাজিয়ে পঞ্চাজন্য
রথ ছেড়ে নেমে দাঁড়াল পথে,
রুদ্রের নাচের তালে তাল মিলিয়ে
সকল বাধা বিপত্তি উপেক্ষা করে
পদক্ষেপ পিছন পানে।
দৃঢ় প্রতিজ্ঞা,
কোদাল কাস্তের ছোঁয়ায়
আবার আঁকতে হবে সবুজের ছায়া,
ধরিত্রীর জঠরে।
চয়ন করতে হবে বিশল্যকরনি,
লাগাতে হবে প্রলেপ 
মানবতার ক্ষতস্থানে।
দুখের মেঘ ভেদ করে
উদিত হবে আসার সূর্য;
মানব গঙ্গাধারা
উচ্ছল কলস্রোতে রবে প্রবহমান;
উড়িয়ে জয়ধ্বজা
স্থাবর বিবর্তনের রথ
আবার গতিশীল হবে
হয়তোবা নূতন পথ ধরে।

বাণিজ্য

লিখব একগুচ্ছ প্রেমের কবিতা
মনে জোয়ার এনে,
তোমার সান্নিধ্য, তোমার ছোঁয়া,
যদি থাকে দিনে রাতে।
যদি দাও যুদ্ধের সাজ,
কেড়ে নাও ভয় আলো হারানোর,
বন্দুকের বাণীতে শত্রু শোণিতে
লিখে দেব প্রেমের জয়।
বৈশাখের রোদ শরীরে মেখে,
শ্রাবণের ধারা বুকে পেতে,
হাল কষবো -ছড়াব ফসলের বীজ,
তুলির ছোঁয়ায় আঁকব
নীল আকাশ -ঘন সবুজ বন,
ঝরিয়ে দাও যদি
শুকনো পাতা ঝড়ের হাওয়ায়।
সাজাবো মনের রঙে,
দেব আভরণ সকল সঞ্জয়ের,
যদি এঁকে দাও স্নেহ চুম্বন
তপ্ত কপালে আমার।
ভাটার টানে পাল তুলে,
ভাটিয়ালি গান গেয়ে
যেতে পারি সঙ্গমে,
ভরিয়ে দাও যদি
আমার ছোট্ট ভেলা 
শুধু সাদা ফুলে।
হাত ধরে নিয়ে যাও যদি
দূর আদিগন্ত ফেনিল সলিলে,
শোনাও যদি ঘুম পাড়ানি গান,
চার বেহারা পালকির সুর,
হাসব বিজয়ীর হাসি
সব হারানোর গর্বে।

 

মানসী

তুমি আমার -
বকুল ছায়ে নিদাঘ দুপুর,
নিশীথ রাতে নিদ্রাহারা
অচিন পাখি বেদনা মুখর।

তুমি আমার -
সুরঞ্জনা মনের সাদা খাতায়,
রুদ্ধ দুয়ার, ঘূর্ণি আবেগ,
নীরব বাণীর দীর্ঘশ্বাস কবিতায়।

তুমি আমার -
গোপন চিঠি, অলখ ব্যথা,
নিঝুম রাতে স্বল্প আলোয়
আশ না মিটা চোখের ক্ষুধা।

তুমি আমার -
একলা পথের গুনগুন
পাঁপড়ি বোজা গানের কলি,
চৈতী হাওয়ায় মনের দোলন।

তুমি আমার -

সুরভি ভরা কুহেলী সকাল,
শিশির ভেজা স্নিগ্ধ মলয়
হিন্দোলিত দোলন চাঁপা ফুল।

তুমি আমার -
তপ্ত মরু শরীর পরে 
নীলাঞ্জনা বাদল ছায়া,
বিন্দু বারি চাতক নীড়ে।

তুমি আমার -
পদ্মদীঘি অতল গহীন,
বুকের মাঝে সাঁতার কাটা 
ইচ্ছা কোরক অসিত গোপন।


তুমি আমার -
কাজল আঁখি অশ্রু মেদুর,
মুক্ত কবরী অভিমানী মেঘ
অবুঝ নীরব বৃষ্টি অঝোর।

তুমি আমার -
যাত্রা বেলায় থমকে যাওয়া 
কি যেন হায় ভুল,
দুয়ার থেকে ফিরে আসা -

মৃদুল চুম্বন প্রেমের।

সবুজ দ্বীপের আহ্বান


বন্ধু রে-
তোর মনের ফাগুনি হাওয়ায় 
আশার পাল উড়াইলাম
উথাল -পাথাল জীবন দরিয়ায়।
ভাঙা আমার পারের তরী
আঁধার ঘেরা দুই কিনারা 
দিতে হবে পাড়ি স্মরি ভবের কান্ডারী।


ও বন্ধু  রে -
মনের খামে যখন হে নূতন দিলি নিমন্ত্রণ 
দেহের বীণার প্রতিটি তারে তারে
উঠল বেজে মধুর মধুর ভাটিয়ালি গান।
ছিন্ন পালে লাগল বুঝি রঙের ছোঁয়া 
মাঝি হেঁই সামালো, হেঁই সামালো
কালস্রোতে এই অবেলায় তরী বাওয়া।


ও বন্ধু রে -
অতল সাগর আবেগ জোয়ার, 
বারে বারে দেয় যে হানা
রাশি রাশি ঊর্মি অলীক ব্যথার,
টলমল এ ছোট্ট তরী,
যত অলখ স্বপন তোর লাগিয়া 
সে যে হাল, সে মোর পারের কড়ি।


ও বন্ধু রে
তোর মুখের অরূপ হাসি
তিমির মন আকাশে 
জোছনা হয়ে সদাই পরকাশি।
কাজল কালো চোখের পারা
মমতা মাখা অমিয় ভরা
হিয়ার মাঝে ভাসে হয়ে নীল ধ্রুবতারা।


ও বন্ধু রে
ছড়িয়ে দে তোর মনের সুবাস
উড়িয়ে দে তোর প্রেমের আঁচল 
লাগুক প্রাণে তোর সুরেরই পরশ।
জীবন নদে খুশির দোলা 
মরমে মরমে মায়ার বাঁধন 
বাঁধুক নগর আমার ভেলা -

তোর সবুজ মনের চরে।।

 

স্মৃতি  ও নীড় 

লো আঁধারী সকাল,
হাওয়ার গলা জড়িয়ে 
আবেশে নিদ্রামগ্ন শীতলতা।
আকাশে সাদা রেখা -
বক পঙক্তি নীড় ছেড়ে 
অনির্দেশ্য খাল বিলের পানে।
সুর সাধার আগে
গলা ভিজিয়ে নিচ্ছে কোকিল 
পাকা বকুলের রসে।
পুকুর ঘাটে আনমনে 
ছাই দিয়ে বাসন মাজছে
খড়ের লুটি হাতে
এলোকেশে নবোঢ়া বধূ।
পোষা হাঁস মুনিয়া
চরে বেড়াচ্ছে আপন মনে।
খাঁচায় বাঁধা হাঁস দুটো
ব্যথায় ছটপট।
লাঙ্গল ধরা কড়া পড়া হাত,
সারাদিনের জমে থাকা আগুন,
রাতে হ্যারিকেনের আলো নিভতেই
দপ করে জ্বলে উঠে।
ঝলসে যাওয়া শরীরে 
ঘামের জ্বালা ঘুম চাতক চোখে
খুলে দেয় স্মৃতির জানালা।

‘চৈ চৈ, মুনিয়া, আয় আয়’ -
হাঁস ধরার নামে খালের ধারে
বকুল তলায় সন্ধেবেলা;
সযত্নে গাঁথা হিজল ফুলের মালা,
নীরব প্রত্যয় ভরা চোখ;
দুটি কম্পিত হাত অন্ধকারে 
খুঁজে বেড়ায় ভীত কোমল হাঁস।
তড়িৎ শিখা -
উন্মুক্ত আবেগের গিরিমুখ,
অনাবিল সুখের আবেশে
থর থর শরীর 
ডানা মেলে মেঘের দেশে।
'পোড়ামুখী, ওলাউঠি,
নম করবি না হরি মন্দিরে?!'
মুনিয়াকে জড়িয়ে ধরে
লজ্জা জড়ানো পা,
মনে শিহরন,
মন্দিরে সন্ধ্যা আরতির ঘণ্টা।
উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ,
বিধির বিধান  -
এক রাস্তা কারখানার কড়িকাঠে,
অন্য রাস্তায় হলুদের ছিটে।
গোধূলি বেলায় নীরব দীর্ঘশ্বাস 
বকুলের পাতায় পাতায়।

ধান সেদ্ধ করার হাঁড়ি
সামনেই জলে ডোবানো,
কোমরে জড়ানো গামছা -
হাতে মুনিয়ার ছোঁয়া, 
ব্যথার মলম।
চোখের জলে সিক্ত হাত
করুন বেদনায় মুনিয়ার গায়ে।
প্যঁক প্যঁক -
'এই যাস কুথায়!'
লেজ নাড়িয়ে মুনিয়া
দূরের ঘাটের পানে
নূতন বন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে।
গাছের ফাঁকে আলোর উঁকি,
পাতার আড়ে বৌ কথা কও।
ধোয়া বাসন হাতে
রাস্তায় বিছানো হিজল ফুল মাড়িয়ে 
ঘোমটা টেনে
ঘরের পানে বধূ।

গান্ধারীর প্রতি পত্রালিকা 

জানতে ইচ্ছে করে 
কেমন লেগেছিল 
স্বেচ্ছা অন্ধত্ব?
ঘন তমিশ্রায়
দীর্ঘ বন্ধুর পথ
অতিক্রম করা!
মনে কি হয়নি 
এ যেন একাকী পথ হাঁটা
ঘন জঙ্গলের রাস্তায়!
প্রতিটি পদক্ষেপে
ওঠেনি কি বুক গুমরে -
এই বুঝি ঝাঁপিয়ে পড়ল
তীক্ষ্ণ দন্তক হিংস্র শ্বাপদ
ডাইনে, বাঁয়ে, সামনে,
বা পেছন থেকে!
কি করে অতিক্রম করলে
এ দূর্গম জীবনপথ
মাথা উঁচু করে হেঁটে?

তোমার মত 
আমিও অন্ধকারের পথিক;
অন্ধকার বরণ করেছিলে তুমি,
আমি নিক্ষেপিত অন্ধকূপে।
চার দিগন্তে অন্ধকারের কালি,
নেই কোন আলোর রেখা
চোখের সামনে।
জীবন নদের চরে
পথহারা পথিক,
যেতে হবে মোহনার বাঁকে।
হাতড়ে হাতড়ে হোঁচট খেয়ে 
অনির্দিষ্ট পথে চলতে চলতে 
মনে হয় যেন কোন
মায়াবিনী মরীচিকার মোহে
পথভ্রষ্ট ঘুরপাক খাচ্ছি
একই বৃত্ত পথে।
সময়ের জালের ফাঁকে
রঙিন প্রজাপতিরা
পাখনায় মেখে ফাগের রঙ 
কখন হারিয়ে গেছে চুপিচুপি!
বর্ষণ শেষে 
সোনালী আলোয় ঝিকিমিকি মুক্তো
কদম্বের বুক থেকে 
ঝরে গেল বুঝি একে একে!
ঝাউয়ের পাতায় 
দীর্ঘশ্বাসের ঢেউ 
তুফান হানে বুকে,
হাবুডুবু খাই
চাঁদ সওদাগরের মত।
সকল সঞ্চয় হারানোর ব্যথা,
তার থেকে বেশি 
না হারিয়ে যেতে পারার ব্যথা
উত্তাল বিশাল অন্ধকার 
সমুদ্রের মাঝে।
উড়ে আসা সুবাসের পানে
হাত বাড়াতে গিয়ে 
সংশয়ে থমকে যাই -
আত্মগোপন করে নেইতো
বিষধর কাল সর্প
ভেসে আসা শতদলে!

পশ্চিমের ঝঞ্ঝাকে 
সমাহিত করে মনে
জ্বলালে ত্যাগের দিব্য জ্যোতি;
যুগ, কাল অতিক্রম করে
তার স্নিগ্ধ শিখা 
ভারতের ঘরে ঘরে
আজও নীরবে জ্বলে 
অদৃশ্য কালো কাপড়ে বাঁধা
ভাষাহীন আঁখির পলে।
ইচ্ছা, অনিচ্ছা, ত্যাগের 
সূক্ষ্ম গন্ডির  বাইরে 
শুষ্ক, নিরুপায়, অপলক
মনের আয়নার হিম শীতলতায়
মাথা কুটে মরে
স্বপ্নের আগুন।
তোমার মত কি তারা পারেনা 
একবার, শুধু একবার
চোখ খুলে তাকাতে!
স্নেহ কাতর মায়ের 
কল্যাণ প্রলেপ আঁকতে নয়;
বিদ্যুতের আঘাত হানতে,
উড়িয়ে দিতে কালো কুয়াশা,
জ্বালিয়ে দিতে 
ওই ছদ্মবেশীদের,
যারা খেলা করে
অন্যের ভাগ্য নিয়ে
দেবতার দোহাই দিয়ে।


নিশীথ  অভিসারিণী

ঝিলের নীলে         চাঁদনি খেলে,
শশীর খেয়া          ইন্দুলেখা,
মৃদুলা গামিনী        কুহকী যামিনী।
মৌমিতা ঝুমে        মহুয়া চুমে,
কানন দোলে         হাওয়ার তালে।
ডাকিছে ডাহুক,     কাঁদিছে চাতক,
মত্ত দাদুরী,           মদির বিভাবরী।
তুলির ছোঁয়া          অলীক কায়া,
কুহেলী কবিতা      নিশীথ ঈশিতা ।
বসি একাকিনী      ভীরু কামিনী
হিজল কোলে       ঝিলের নীলে ।
নীলাঞ্জনা,            মৃগ নয়না,
কাহার দুহিতা       চম্পক শোভিতা!
কুঞ্জিত কুন্তল,      কুমুদ কুন্ডল,
কুমকুম চর্চিতা     তনু ললিতা,
সুচন্দ্র্রা,             মৌন পারমিতা ।
মন কস্তুরী           হয়েছে অভিসারী,
আঁখির কাজল     ছড়ায় আঁচল,
কাহার লাগি         আজ বিবাগী!
মঞ্জু চাঁদ,          চাঁদনি দূত 
যাচিছে প্রেম,        জোছনা কুসুম 
লাজুক কপোলে    ঝিলের নীলে।


ইচ্ছা প্রজাপতি


পাগল মনের চাওয়া
হয়ে বাদল হাওয়া,
মিথ্যা খেয়ায় শ্রাবণ ছায়া আনে
হরিণ আঁখি কাজলা দীঘির উপর অকারণে।
রাতুল অধর, চোখে  সৌদামিনী,
তপ্ত কায়া মরুতে যাচ্ছে বারে বারে হানি।
রিমঝিম রিমঝিম তানে কুন্ডলিত কানে
মন্দ্র মধুর ভাষ - আজ নিভৃত গোপন বরিষণে।
অভিমানীর মৃণাল বাহুর পাশে,
লতায়িত দিঘল কেশের সুবাসে,
মাদল রাগ গোপন অভিসারে
দেহের শিরায় শিরায় নাচবে চুপিসাড়ে।
জানি বৃষ্টি থেমে যাবে,
মেঘের ফাঁকে চাঁদ হাসবে,
আকাশে নয়, বঁধুর কাজল ধোয়া চোখের
তারায় জোছনা শত খুশির !
রামধনুগো তোমার সাতরঙা রঙ ছড়িয়ে দাওনা,
হৃদয় কাননে ফুলের কোরক মেলুক পাখনা।

মার্চ ২০২১ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

উজ্জ্বল মিশ্র - কবিতা

কবিতা

ডাঃ উজ্জ্বল মিশ্র

আসানসোল, পঃ বঙ্গ

ভাস্বতী মন্ডল

অজানা অসুখবোধ
                              

পিঠময় খোলা চুল কোমর ছুঁয়েছে,
পৌষের বিকেলের শীতমাখা রোদ
জানালার আলপনা পিঠেতে এঁকেছে।
হাঁটুতে রেখেছো মুখ, যতো দুঃখ বোধ।

সে বিষাদ ছড়িয়েছে পৃথিবীর বুকে,
বাতাসেরও নিশ্বাসে, অদ্ভুত সময়।
যে আলো মাখানো ওই আকাশের মুখে -
প্রভাহীন, নিষ্প্রাণ কী বিষাদময়।

সে আলো মেখেছো গায়ে, মননে ও বোধে।
‘ভালো নেই’ অনুভূতির সংক্রামক জ্বরে -
ভেঙে চুরে বসে আছো বিকেলের রোদে।
অজানা অসুখবোধ গভীর শিকড়ে।
          
       

Watercolor Butterfly 6

কবিতা

ভাস্বতী মন্ডল

সোনারপুর, কলকাতা

মার্চ ২০২১ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

Illustrated Scenery

দূষণ 

রাধীন হচ্ছে মনন–
বাড়ছে স্বৈরী রিপুর শাসন;
জঞ্জালের কায়েমে মানসপুরী:
দুর্গন্ধে বন্দী মনুষ্যত্ব
হারাচ্ছে মানবিকতায় কর্তৃত্ব;
মানসিকতা কুড়চ্ছে কলুষের নুড়ি।

ধরছে ফাটল মানসপুরীর প্রাচীরে,

উপচে পড়া আবর্জনার ভীড়ে–ওই ছুটে আসছে ওরা, আলেয়ার দল!


ছোঁয়াচে রোগ, ছড়াচ্ছে ওদের উল্লাসে;
নামছে ত্রাস সমাজের চারপাশে!
সংসার শীর্ণ হচ্ছে, হারাচ্ছে বল।

জমছে পাঁক পৃথিবী জুড়ে;
উঠে আসছে কীট পাতাল ফুঁড়ে–
মর্ত্যে পড়ছে নরকের ছায়া!
অসুস্থ আবহ, বিষাক্ত দংশনে;
মুকুলেই নষ্ট পঙ্কজ, মালিন্যের বারণে;
দুনিয়া দমিয়ে বাড়ছে দূষণের দানবীয় কায়া!

সপ্তর্ষি গাঙ্গুলী

কবিতা

সপ্তর্ষি গাঙ্গুলী

খড়দা, কলকাতা

FB_IMG_1603447196421.jpg

মার্চ ২০২১ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

প্রেম প্রতীতি


নের কোণে আসে করে ভিড়
কুয়াশালিঙ্গনে আবিষ্ট শীতের সেই মনোহর প্রভাতগুলি।
যখন দুজনার অনাবৃত চরণপটে 
অবিরত বুলিয়ে যেত কুহেলিসিক্ত তৃণদল এক স্নেহের তুলি।
বর্ণাঢ্য এক জীবনকক্ষে ছিল হর্ষালোকের অবাধ আনাগোনা,
বিষাদের আঁধার কেমনে তারে করল গ্রাস থাক সে উপাখ্যান সকলের অজানা।
কার ছিলো ভুল!? দিলো কে মাশুল!?
মেলেনি কভু সেই সমাধান।
কি নাম দেবে!? ঠুনকো প্রণয়,
পাবে না খুঁজে প্রেমের কোনো অভিধান।
আপন প্রেম পরিহারে অনভিলাষী
যে ছিল এক স্বার্থপর —
অমাবস্যার এক রজনীতে সে 
তার ভালোবাসার মাল্যটি করল অন্যের পাত্রে দান।
দিলো তার হৃদয়ে রচিত 
স্নিগ্ধ ভালোবাসার অপরূপ রূপের নিঠুর বলিদান।
সুখাবশিষ্টের আচ্ছাদনে ভালোবাসাকে সযতনে মুড়িয়ে শেষ বিদায় জানিয়ে সেদিন সে হয়ে উঠল প্রথম 'পরার্থপর'।
একদিন সহসা মনের অলিন্দে
অগোচরে ঢুকে খুলে দিলে তুমি 
অনেকদিনের রুদ্ধ এক বাতায়ন।
তোমার হাতের কোমল পরশে
আজ এক নবীনালোকে সেজে উঠল
আমার তমসাচ্ছন্ন হৃদয়প্রাঙ্গন।
মৃদুল পবন উড়িয়ে জীমূত
ঠিক যেমন ভাঙায় গগনের সুপ্তি
কেশপুঞ্জের অন্তরাল সরিয়ে তোমার
নিদ্রাতুর আনন দর্শন এ যেন এক পরম প্রাপ্তি।

Plumeria Flower

প্রাণের দোসর 
                              

চাওয়া পাওয়ার দীর্ঘ যোজন মাঝে,
প্রত্যাশার এই বেহালার তারে বিষাদের সুর বাজে,
হৃদয়ে আজ জমেছে তোমার অনুরাগের এক বালুচর,
বিভেদের মাঝে বলো তবে দেখি কে আপন আর কে পর!
উথাল পাথাল জীবন জোয়ারে ভাসিয়ে দিয়ে কল্পনারে,
একদিন ঠিক পাড়ি দেবে মন উজ্জ্বল এক আলোকমিনারে।
সেই আলোকে ঘুচে যাবে জেনো তোমার অতীতের সকল আঁধার,
অভিমানী হৃদয়কে জিগায়েই দেখোনা তুমি বৈ আমি অন্য কাহার!?
সংকোচের বেড়াজাল সরিয়ে; করি তবে চলো প্রণয়পুরী বিচরণ,
চলার পথে কুড়োবো তোমার সকল হারানো মর্যাদার আভরণ।
একে অপরের পাশে থেকে তিলে তিলে গড়ি ভালোবাসার এক অটুট পাহাড়,
সব ব্যবধান মুছে একসুরে তবে গাই  'তুমি আমার, আমি তোমার'।।

স্নেহময়ী মা 
                              

টুকরো টুকরো শৈশব স্মৃতিগুলি আজ ভিড় করে আসে মনের ফ্রেমে
পাই না ভেবে ব্যস্ত কর্মসূচীতে তারে কেমনে বন্দী করব পর্যায়ক্রমে! 
ভাগ্যতটিনীর প্রবহমান ধারায় ভেসে যেতে যেতে পেয়েছিলাম গিয়ে তোমার গর্ভে নিরাপদ ঠাঁই
ধরিত্রীর আলোয় বিস্মিত নয়ন মেলে প্রথম যারে দেখেছিলাম সে আর কেউ নয়, আমার 'মা'-ই।
বক্ষমাঝের শীতল ছায়ায় রেখেছিলে মোরে আগলে অপার স্নেহসুখে
দিবানিশি তখন‌ হতে না কি ব্যাকুল প্রথম 'মা' বুলিটা শুনতে আমার মুখে!? 
সুমিষ্ট এই বুলির মাধুর্যে একদিন হয়ে উঠল এই বসুধা আলোময়ী 
জানি না কেমনে শুধিব তোমার অগণিত ঋণ ওগো মমতাময়ী!
সংসার ধর্মপালনে নিবৃত্ত তোমারে প্রত্যহ দেখেছি দিবাশেষে বড় ক্লান্ত
তবু্‌ কতিপয় পরিজন প্রত্যাশা আর চাহিদার কণ্টকে তোমারে বিঁধতে হয়নি কভু এতটুক ক্ষান্ত।
জীবনে তোমার সকল অবদান ভুলে যেন আজ তোমার‌ই সুখদুঃখের ভাগীদার না হবার হাজারো ছল
অথচ জীবনের ঘোর দুর্দিনেও জানি জীবনসংগ্রামে জয়ী হবার এই 'মা' ডাকটাই একমেবাদ্বিতীয়ম বল।


          
       

বিত্তদনুজ
                              

হৃদয় নীরবে সইবে কত 
সযতনে তোমাদের নিক্ষেপিত লাঞ্ছনার বাণ যত!
পথের ধার ধরে খসে পড়ে থাকা ফুলের যত পাঁপড়ি
হাতে তুলে ধরে লালন করে দেয় কি বলো কেউ আজ তাদের হারানো প্রাপ্য স্বীকৃতি?
অর্থস্তূপের উদ্ধত আস্ফালনে প্রতিনিয়ত নিষ্পেষিত হতে থাকা
আমারও ন্যায় এমন অগণিত সব জীবন চেয়ে দেখো নিরন্তর চাইছে কেবল একটু নিষ্কৃতি।
অর্থসম্পদমাপক দাঁড়িপাল্লায় শ্রেষ্ঠত্ব নির্ণায়ক প্রতিযোগীতায় সকলের চোখের তারা যেন আজ হয়েছে এসে স্থির ঐ পাল্লা কার তরফে রয়েছে‌ ঝুঁকে!?
সেই ভীড়ে মাথা খুঁজে পাবে না কেউ আমার ; আমি আপনসৃষ্টি হরণের ভয়ে সন্তর্পণে ঘরের এককোণে বসে আঁকড়ে তারে রেখেছি ধরে নিজেরই বুকে।
যতই করো হেয়; না হয় আমারে এভাবেই দমিয়ে রাখতে চেয়ো,
বিষবিত্তের এই চাবুক বিজলির মতন ঘুরিয়ে যত করবে অন্তরে আমার নির্মম প্রহার
জেনে রাখা শ্রেয় ; সইবে না আর অন্তরাত্মা তোমাদের এই আঘাত,
নীরব প্রতিবাদের ভাষাস্বরূপ বলিষ্ঠ লেখনীতে ততই হতে থাকবে আমার এই অমূল্য কলমটি ক্ষুরধার।

সুব্রত মিত্র - কবিতা

কবিতা

সুব্রত মিত্র 

মার্চ ২০২১ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

অনুকম্পপ্রবণ পরিধেয়

গোছালো প্রাপ্তি আর অপ্রাপ্তির মাঝে

তোমাকে মিলিয়ে নিতে পারিনি এখনো,

শতবছর পর পৃথিবীর বয়স বেড়ে যাবে

আমি অনীহার প্রকট মাখা

কোন দুর্নিবারের আচ্ছাদনে তোমাকে ঢাকব না কখনো। 

 

পিছিয়ে আসা বালুচর সমুদ্রের কাছে ঋণী থাকে আজীবন

ঋণী থাকে আকাশ মেঘের কাছে প্রাণপণ;

পরিশ্রান্ত পৃথিবীর আমি এক ক্লান্ত পথিক

দুটি মাপকাঠির সমরেখার প্রান্ত হতে

ভিন্ন সমরেখার পাইনি নাগাল; তাই তোমায় পারিনি ছুঁতে 

 

পরিপাটি বলে কিছু নেই আমাতে এখন

এখন নেহাৎ জীবন যাপন সঙ্গ হয় নিত্য

গহীন জলের তলানিতে গিয়েও তৃষ্ণা গ্রহণ অসহ্য 

 

এই অব্যক্ত ভাষার ব্যাপ্তি যদি হয় সমাপ্তি

আমি শিহরণ জাগানো পৃথিবী রেখে যাবো

তলদেশের তলায় চির অপরিণত ভাষায়

মাপবো নিরবধি তোমার মুক্ত বাসনার তৃপ্তি 

ক্ষমা করো;ক্ষমা করো; ক্ষমা করো বনলতা,

প্রকাশের পাহাড় এসেও ঠোঁটে

তবু তুমি রয়েছ যতনে হৃদয় কোণে

পৃথিবীর মানুষ বোঝেনি; জানতে চায়নি মোটে, 

 

কলহের সমারোহে কাল হতে কালান্তরে

অস্পৃশ্য দেবতার মতো করে তোমার স্মরণ হয় বারেবারে

আমি কৌতুহল ভেঙে দিলেও প্রশ্নরা ছুটে আসে ঝাঁকে ঝাঁকে

প্রকৃতির সাথে যেন প্রকৃতির মায়া-লতা চলমান জীবনের ঘূর্ণি পথের বাঁকে 

 

দেখি সেই বনলতা নামক দেবতার অনুভূতিটাকে

এভাবেই হয়ে সুপ্ত থেকো লিপ্ত

আত্মবিলীন পথের সাথী আমিই সেই অভিন্ন প্রদীপ্ত।

Big Wave

মার্চ ২০২১ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

Mijanur Rahman.jpg

কবিতা

মিজানুর রহমান মিজান

বিশ্বনাথ, সিলেট, বাংলাদেশ

মিজানুর রহমান মিজান

নির্মল স্মৃতি 
 

নুতাপের মালা কণ্ঠে পরে     
কত নিশি ভিজে শিশিরে 
ভাঙ্গিলাম অনুরাগের প্রাচীর। 
দু’হাতে মুছিলাম আঁখি জল 
অষ্ট প্রহর ভাবনার ফল 
হিসাব মিলাতে গন্ডগোল সুগভীর। 
অবিশ্রান্ত কত না কেঁদেছি 
আপন করতে শত চেষ্টা করেছি 
চেষ্টা বিফল প্রতিফল পাতায় স্মৃতির। 
স্বপ্নের জাল বুনি অবিরত 
বাস্তবে রূপ দানে মগ্ন সতত 
ব্যথার কাটা উপড়ে ফেলে নিষ্ফলা আবির। 
জয়ের মালা হল না পরা 
শূণ্যতার বইছে শ্রাবন্তী খরা 
ভাবান্তর উদাসী স্তূপীকৃত নির্মল স্মৃতির। 

অহংকার পতনের মুল 


বুঝে না বুঝে নারে ভাই কথার মর্মার্থ 
বুঝে বুঝে বুঝেরে ভাই সে-ই যথার্থ। 
বুঝে নাতো গাধা, খায় পানি মিশিয়ে কাদা 
রসবিহীন যেমন আদা, ফল অনর্থ। 

যৌবনে বাহাদুর, রূপের ঝলক সুর 
শক্তি কিছুদূর, ক্ষমতা অচিনপুর 
সময়ান্তে নেই কোন অর্থ।। 
জোয়ার এল, ভাটা হল 
ক্ষমতার দাপট গেল, কদ‌র্যতা র’ল 
অবশেষ ফলাফল নেই সতীর্থ।। 
অহংকার পতনের মুল 
ভেবে দেখ নহে ভুল 
ঝরে পড়ে বাসি ফুল 
বিষণ্ণতায় করে কান্না মর্ত্য। 

বিষে অঙ্গ জ্বলে 

ষ্টের বুকে ভাসি জলে 
বারে বারে দাও গো টেলে 
আর যাব কই ছেড়ে দিলে। 
তুমি বিনে নাহি আশ্রয় 
বিন্দু জলে পাথরও ক্ষয় 
অন্যত্রতো নেই যে অভয় 
সর্বত্র বিরাজ দেখি চক্ষু মেলে। 
ধরার যথাতথা তোমারই একক রাজত্ব 
খেয়ে পরে দেখে শুনে সবই সত্য 
দুর্বল মারে, অসহায়ের নেই গুরুত্ব 
দেখে সহ্য করি দু’হাত তোলে। 

লোভ হিংসা স্বার্থের ধান্ধায় 
অহরহ নির্মম মিথ্যা নির্যাতন চালায় 
বল তুমি ভাল করতে, তবু জলে হিংসায় 
নিন্দার কাটা অবিরত বিষে অঙ্গ জ্বলে। 
তুমিতো সবারই মালিক 
নাম রেখেছ প্রচারে খালিক 
তবে কেন ঘুরাও দিক-বিদিক 
যতই হোক আশায় আছি আশ্রয় তলে। 

স্বপ্নাশা 

র তো নাই কোন আশা 
শুধু চাই তোমার ভালবাসা। 
দুর করে মনের কালিমা 
বাজাতে চাইলাম দামামা 
প্রতারণায় ছাড়ায় সীমা 
জুলুমে বানায় বেদিশা। 
দাও করে মানুষ 
ফিরে আসুক হুশ 
কিবা ছিল তাতে দোষ 
বুঝার তওফিক হারাল বেদিশা। 
যাবার ইচ্ছা অনেক দুর 
পথের বাঁধায় উঠে না রোদ্দুর 
হয়ে দাঁড়ায় মহিসুর 
মনের সুখে গাইতে গান স্বপ্নাশা। 

 

সমুদ্রমন্থন

ভ্রমণ

মার্চ ২০২১ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

সমুদ্রমন্থন

সৌমেন্দ্র দরবার

বাগুইআটি, কলকাতা

Samudra4.JPG
Samudra9.JPG
Samudra7.JPG

র্মব্যস্ত জীবন। একটু বিরতি হলে মন্দ হয় না। রোজকার অফিসের দিনগত পাপক্ষয়, বসের লাল চোখ, সংসারের প্রাণান্তকর ব্যস্ততা কিংবা পড়শির পি এন পি সি। কি দুর্বিসহ জীবন। মন চায় একটু ছুটি, একটু বিরতি ----- দু - তিন দিন! বনানীর সবুজ, আকাশের নীল আর উত্তাল ঢেউ। সমুদ্র আলিঙ্গন করে বলে "এসো মোর কাছে, একান্ত নিভৃতে", সবুজ ঝাউ হাত নেড়ে বলে "অবগাহন করো মোর রূপ", নির্মল আকাশ ডাক দেয়" ডানা মেলো খোলা হাওয়ায়, হে পথিক"।সবুজের মধ্যে দিয়ে আঁকা বাঁকা রাস্তায় পায়ে পায়ে যেতে যেতে মনে পড়বে ছোট্টবেলার দিনগুলো। রাস্তার দুপাশে প্রজাপতি, মথ শরীর ছুঁয়ে অভিবাদন জানাবে। তাদের কত রং, কি বাহার। 
গাছের ডালে নাম না জানা পাখির কুজন মন কে নিয়ে যাবে কল্পলোকে। এরই মধ্যে হঠাৎ পায়ের সামনে কাঠবেড়ালি প্রণাম ঠুকলে বুকটা ভোরে যাবে গর্বে।
দূরে ভোঁ বাজিয়ে ট্রলারেরা পাড়ি দেয় অতল সমুদ্রে। অন্বেষণ শেষ হলে ফিরে আসে রুপোলী মাছের ডালি নিয়ে। 
স্থানীয় জেলেদের সরলতা সত্যি মন কেড়ে নেয়। সমুদ্রে গা ভেজানোর আগে সবুজ ডাবের মিষ্টি জল তৃষ্ণা আরো বাড়িয়ে দেবে বই কমবে না।  
সমুদ্রতটে ছোটদের বালিয়াড়ি আর ঝিনুক সংগ্রহ মনকে শৈশবে নিয়ে যেতে বাধ্য। বালির ওপর অতি যত্নে লেখা নিজের অথবা প্রিয় মানুষটির নামকে সমুদ্র ভরিয়ে দিয়ে যায় ওষ্ঠের চুম্বনে। সমুদ্রগাহনে পায়ের তোলার ছোট্ট ছোট্ট নুড়িগুলো এঁকে দেয় আদরের রেখা। আদুল গায়ে লেগে থাকে নোনতা তরল, সাক্ষী থাকে উন্মুক্ত আকাশ আর একরাশ ঝাউ। 
মৎস্যবন্দরের অবিরাম কর্মব্যস্ততা, দুপুর রোদে মাঠের ধরে জেলেদের জালবোনা কিমবা সমুদ্রে নৌকা বাওয়া আর জাল টেনে তটে তোলা - সে যেন এক অন্য জগৎ। কুলিং টাওয়ারের অবিরাম জলধারায় সূর্যের আলোয় তৈরি রামধনু থেকে চোখ ফেরানো ভার। 
ভোরের আবছা আলো আঁধারিতে সমুদ্র থেকে সুয্যিমামার উত্থান অথবা রঙিন বিকেলে সূর্যের বাড়ি ফেরা তুলতে তুলতে ক্যামেরার স্টোরেজ ফুল হয় যাওয়া। পড়ন্ত বিকেলে লাল পাথরের ওপর বসে সাদা ক্যানভাসে পেন্সিল ড্রয়িং নতুবা ডাইরির পাতায় দু কলম কবিতা লিখতে মন্দ লাগবে না!

ঝাউয়ের দোলায় দোল খেতে খেতে নির্জন সৈকতে ভ্রমণকালে গলায় গুনগুন করে উঠতেই পারে "আমি দূর হতে তোমারেই দেখেছি, আর মুগ্ধ হয়ে শুধু চেয়ে থেকেছি"। সন্ধ্যার আলো ঝলমল সমুদ্রতটে উষ্ণ চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিতে দিতে সান্ধ্য ভ্রমণ আর ক্লান্ত হয়ে পাড়ে বসে শুক্লপক্ষের চাঁদের আলোয় রুপোলী ঢেউয়ের অবিরাম আস্ফালন। রাত আহারের পর নির্জন সমুদ্রসৈকতে সমুদ্র গর্জন মন ভালো করার আর এক নৈবেদ্য। মৎস্যবিলাসীদের রসনায় এখানের সমুদ্র জীবেরা সদা দণ্ডায়মান। স্থানীয় মানুষদের সরলতা আর আন্তরিকতায় দু তিন দিন কোথা দিয়ে চলে যাবে বোঝাই যায় না। অমৃত না উঠলেও এ ভ্রমণের স্বাদ মনের তৃষ্ণা মিটিয়ে দেবে। না এবার বলেই ফেলি গন্তব্য কলকাতার খুব কাছে মাত্র ১৬৬ কিলোমিটার দূরের সমুদ্রতট শঙ্করপুর আপনারই পথ চেয়ে। মনস্থির করে ব্যাগ গুছিয়ে চলুন পাড়ি জমাই দুদিনের নিশ্চিন্ত অবকাশে। সাধ্যের মধ্যে স্বপ্নপূরণ।

পথের ঠিকানা:

দিঘাগামী যে কোনো বাসে বা গাড়িতে ১৪ মাইল। সেখান থেকে বাঁ দিকে ৪ কিলোমিটার। ট্রেনে রামনগর স্টেশন থেকে গাড়িতে, অটোতে বা টোটোতে ১৫-২০ মিনিট।

গৃহের ঠিকানা:

পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বেনফিশএর অথিতি নিবাস কিনারা ও তটিনী। ছিমছাম এ সি অথবা নন এ সি ঘর সাধ্যের মধ্যে। অনলাইন বুকিং করে নেওয়াই ভালো। দূরভাষ - ০৩২২০ ২৬৪ ৫৭৭। আর আছে পশ্চিমবঙ্গ মৎস্য দপ্তরের অথিতি নিবাস মৎস্যগন্ধা। এখানেও এ সি অথবা নন এ সি ঘর সাধ্যের মধ্যে। দূরভাষ - ৮৭৫৯৬২০৩৬৭ বিলাসবহুল থাকতে আছে হোটেল নেস্ট। এছাড়া নিউ শঙ্করপুরে বেশ কয়েকটি সমুদ্র লাগোয়া হোটেল আছে।

রাসনাবিলাস:

ইলিশ, চিংড়ি, পমফ্লেট, পার্শে, ভেটকি - টাটকা তাজা খেতে মজা। চাইলে খেতে পারেন কাঁকড়ার কষা।

কেনাকাটা:

বেশকিছু দোকান আছে সামুদ্রিক গিফট আইটেমের। পকেট পারমিট করলে মন খুলে কেনাকাটা করুন। 

ভ্রমণকাল:

সারাবছর

Samudra1.JPG
Samudra6.JPG

গল্প

গ্রস্তপ্রকাশনী

মার্চ ২০২১ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

গ্রস্তপ্রকাশনী

দেবার্ঘ্য মুখার্জী

office.jpg

রে রাখুন মশাই, এমন লেখা রোজ রোজ কত মানুষ যে নিয়ে আসে আমাদের কাছে, তার মনে তো এটা নয় লেখা আনলেই সেটা ছেপে বের করতে হবে, আরে বাবা বাজার খাবে তবে না, মোদ্দা কথা হলো বাজারে বই এর কাটতি কেমন সেটাই বড়ো কথা। আর আজকাল তেমন ইন্টেলেক্টওলা লেখাটেখা মানুষ এতো পড়ে না মশাই। এই তো ধরুন না সেদিন সাইফুল হকের এত বড়ো একটা আর্টিকেল আমরা বের করলাম আমাদের মাসিক পত্রিকাতে তা লেখাটা কটা মানুষ পড়েছে শুনি? হাঃ? ওনার নাম আছে তাই ছাপতে হয়, তাই বলে সব্বারটা নাকি? প্রকাশকের ঘরের পুরনো পাখাটা খটাস খটাস শব্দ করে ঘুরছিলো, সামনের মানুষটার কথাগুলো নাকি ওই পাখার শব্দ কোনটা কানে বেশি লাগছিলো, তাই রবীন্দ্রনাথবাবু বুঝতে পারছিলেন না, শেষের কথাটা যেন, একটু বেশিই কানে লাগলো, শুরুর দিকে লেখক কবিদের কপালে সম্মান-তোম্মান বিশেষ যে জোটেনা সেটা তিনি জানেন, তাবলে এভাবে পত্রপাঠ অপমান করে বের করাটা মেনে নিতে পারলেন না, একটা তীব্র অভিমান আর চোখ ফেটে বেরিয়ে আসা কান্নাটা চেপে অস্ফুট হাসি দিলেন, চ্যানেল ফাইলে বাংলা হরফে কাল রাতে ডিটিপি করা লেখাটা হাতে তুলে শুকনো নমস্কার জানালেন। 
প্রকাশকমশাই সরু সোনালী ফ্রেমের চশমার ওপর থেকে তাকিয়ে দেখে বললেন, “ও মশাই, এই দেখো, আপনি তো আবার রাগ করে ফেললেন দেখছি”, আর এই কথাটাতে নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না রবীন্দ্রবাবু, বললেন, “কি করবো বলুন আমার নাম রবীন্দ্রনাথ সরকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তো নয়, তাই এত ভালো প্রবন্ধটা শুধু প্রথম অংশটুকু পড়েই আপনি রিজেক্ট-এর খাতায় ফেলে দিলেন”। 
এবার মুচকি হাসলেন প্রকাশক, আরে না না, ব্যাপারটা তেমন নয়, রবিঠাকুর হতে হবে না, আমি বলি কি সামান্য কিছু খরচাপাতি করুন, একটা দুটো বই আমরাই বের করে দেব, একটু এ স্টল ও স্টল বলে শোকেসের সামনের দিকে সাজিয়ে রাখলেই কেল্লা ফতে, তখন দেখবেন আপনার ঘরে আমার মতো কত প্রকাশক লাইন দিয়েছে এমন সব লেখার বায়না নিয়ে। হেহে করে হেসে উঠলেন তিনি।
“ও বুঝলাম”, উত্তর দিলেন রবীন্দ্রনাথ, আচ্ছা দেখি।
আরে দেখা-টেখার দিন শেষ, সামনের বইমেলার জন্য কিছু লিখে ফেলুন না, আমরা তো ৪-টে স্টল দি ফি বছর, কোনো একটার সাইড এ আপনার লেখার ফেস্টুন ঝুলিয়ে দেবখনে।
 আসলে ব্যাপারখানা হলো, বই আজকাল কেও তেমন পড়ে না, বুঝলেন না, বই কেও পড়েনা, সবাই সাইজ মতো খাপে খাপ বসিয়ে রাখে। 
এমা ছি কিসব কথাবার্তা, বলে ওঠে রবীন্দ্রনাথ;
মুখ থেকে কেমন একটা চুকচুক শব্দ বের করে প্রকাশক মশাই বলেন, ধুস, ওসব না, শুনুন বুঝিয়ে বলি ব্যাপারটা। ধরুন বালিগঞ্জ প্লেসের ওপর ১২০০ স্কোয়ার ফুট এর ফ্লাট, সাইড এ রাখা আছে বুকশেলফ, অল্প জায়গা। সেখানটা বই দিয়ে সাজাতে হবে। তো কি বই কিনবো, কি বই কিনবো, ভাবনা নেই, মাপ দেখে নিয়ে, বুক স্টল গিয়ে, মনের মতো কালার ম্যাচ করে কিছু কিনে নাও। তবে এসব ক্ষেত্রে বিদেশী বই বেশি জায়গা করেছে। কারণটা বুঝতে পারছেন তো, বাঙালি তো, তাই সব সময় নিজের সাহিত্য বাদ দিয়ে অন্যের সাহিত্য পড়েছি, এটা যদি বন্ধুবান্ধবদের দেখাতে পারে, অনেক বেশি মান-ইজ্জত বাড়বে, এই আরকি।
মুখের হাঁ টা আরো বড়ো হলো রবীন্দ্রনাথের, বললেন, এমন হয় নাকি আবার?
আলবাত হয়, হচ্ছে তো এটাই, ওই যে বলে, "যো দিখতা হয় ও বিকতা হায়" তাই তো আমাদের প্রতিটা বইয়ের প্রচ্ছদটা ঝাঁ চকচকে করা থাকে, খদ্দের দেখলেই কিনে সাজিয়ে রাখবে। আমি তো আলাদা করে গ্রাফিক্স সাইকোলজিস্ট দিয়ে কালার সিলেকশন করাই মশাই, এখন কম্পিউটার এ সব কালার পাওয়া যায়, এটার পাশে ওটা বসিয়ে দারুণ ডিজাইন করে দেয় ওরা।
আর কথা না বাড়িয়ে প্রকাশক এর অফিস থেকে বেরিয়ে পড়লেন রবিবাবু, বাইরে লেখা আছে রেবতী প্রকাশনী সাইড এ আবার ক্যাপশন আছে "মানে গুনে সবার সেরা ", মনে মনে ভাবলেন, হা সেরাই বটে, গুনে গুনে পয়সা নিতে সেরা, মান গুণ চুলোয় গেছে, যত্তসব।
যতীন আরো ৩-৪ টা প্রকাশকের ঠিকানা দিয়েছে বটে, এই আসে পাশেই হবে কোথাও। এগিয়ে যাচ্ছিলেন হঠাৎ চোখে পড়লো, "বর্ণহীন প্রকাশনী", মনে মনে ভাবলেন, নামেই যারা বর্ণহীন, হয়তো বা তার মতো সাদা কালো নতুন লেখককে পাত্তা দিলেও দিতে পারে, ঠাকুর নাম করে ঢুকে পড়লেন, কাঁচের দরজা ঠেলে।
সামনের চেয়ার এ বসে আছে একটি কম বয়েসের ছেলে, এগিয়ে গিয়ে রবিবাবু নিজের আসার হেতু জানাতেই, ছেলেটি বললেন, ওই সোফাতে বসুন, একটু পরেই স্যার একজন একজন করে ডাকবেন। সোফায় বসে এদিক ওদিক দেখে বুঝলেন, এই আশপাশের ছেলে ছোকরা তার মতোই প্রকাশকমশাই এর কাছে এসেছে, তা ভালো দশটা মানুষ আসছে যখন এদের কাজ কর্মও হয় ভালো নিশ্চয়ই।
বসে থেকে থেকে কিছু ঢুলুনি এসে গেছিলো রবিবাবুর, ছেলেটি বললো, এবার আপনি যেতে পারেন। বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে ঘুম ভাবটা তাড়িয়ে নিলেন তিনি, তারপর সোজা পাশের চেম্বারে এসে ঢুকলেন।
সামনের চেয়ার অলংকৃত করে বসে আছেন, বিশাল বপু পঞ্চাশ ঊর্ধ্ব প্রকাশকমশাই। পাশেই একটি সুন্দরী মেয়ে, হয় তো ওনার সেক্রেটারি। অফিসের দেওয়াল সু-সজ্জিত, এদের বিক্রিবাটা ভালোই হয় বেশ বোঝা যাচ্ছে।
ভদ্রলোক কোনো কথা বলছেন না, মেয়েটি সব কথা বলছে, ছোট ছোট চোখ করে রবিবাবুকে শুধু ওয়াচ করছেন ভদ্রলোক। একটু অস্বস্তি হচ্ছিলো বটে ওনার, কিন্তু মানিয়ে নিচ্ছিলেন।
সব লেখা মেয়েটি খাপছাড়া ভাবে পড়লো। তারপর বললো আপনি কি আমাদের প্রকাশনীর আগের কিছু লেখা পড়েছেন বা শুনেছেন?
না সেভাবে পড়া হয়নি, বললেন রবিবাবু।
মেয়েটি সাইড ড্রয়ারের থেকে বের করে দিলো ৪-৫ টা বই।
আর বললো, এগুলো আমাদের লেটেস্ট এডিশন, আমাদের বইমেলার স্টল এর সামনে পুলিশ রেখে ভিড় কন্ট্রোল করতে হয়, মেলা শেষ হবার আগেই, বই শেষ হয়ে যায়, তবে আমরা এখন তো অনলাইন অর্ডার নিচ্ছি, তাই আমাদের ক্রেতাদের তেমন অসুবিধা হয় না, আপনি একটু পড়ে দেখুন, যদি এমন লেখা কিছু থাকে, আমরা কিনে নেবো।
প্রথম বইএর মলাটে অতি স্বল্প পোশাক পরা একটি মেয়ে শুয়ে আছে, আর টাইটেল আছে "নিষিদ্ধি রজনীর সুবাস"। এই একটা বই দেখেই রবিবাবু বুঝে গেলেন, এ জায়গা তার জন্য না।
বইগুলি মেয়েটির দিকে সামান্য এগিয়ে দিয়ে বললেন, না থাক ম্যাডাম, আমি এরকম লেখা তো ঠিক লিখি না।
ঠোঁটের কোনে ফিঁক করে হেসে মেয়েটি বললো চেষ্টা করেই দেখুন না, আপনার মতো বয়েসের কত মানুষ আমাদের সাথে রেগুলার কাজ করেন, শুরুতে একটু অসুবিধা হলেও ধীরে ধীরে দেখবেন, লেখার ফ্লো এসে যাবে। 
এবার মুখ খুললেন প্রকাশক ভদ্রলোক, আপনারা হলেন, গুণী মানুষ, এসব লেখা তো জলভাত আপনাদের কাছে, বাংলাদেশে খুব ডিমান্ড এসব লেখার, জানেন তো। আর কাঁচা পয়সা আছে, ভেবে দেখুন। আমাদের সাথে কাজ করলেন, টাকা এল, পরে না হয়, আমার বন্ধুকে দিয়ে কিছু কবিতা গল্প যা বলবেন তেমন বই ছাপিয়ে দেব। প্রেস মিটিং করবেন, সভাঘরে লোক হাততালি দেবে, আপনিও খুশি আমরাও খুশি।
মাথাটা গুলিয়ে যাচ্ছিলো রবিবাবুর।
মেয়েটা চামড়ার চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে ওনার দিকে তাকিয়ে হাসছিলো মিটিমিটি, রবিবাবুর শরীরে অস্বস্তি লাগছিলো, উঠে পড়তে পারলে বাঁচেন। নমস্কার জানিয়ে উঠে বললেন, একটু ভেবে দেখি।
বাইরে বেরিয়ে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। বাপরে বাপ্!
বাড়ি এসে শান্তি করে এক কাপ চা খেয়ে নিজের ছোট্ট সাজানো বাগানটাতে বসে থাকলেন বেশ কিছুক্ষণ। নিজের মনকে  প্রশ্ন করতে লাগলেন, এই যে সবাই বলে গেছে "চেষ্টা করে যাও ফলের আসা না করে, ফল ঠিক আসবেই" কথাটা কতটা সত্যি? শালা, চেষ্টার কোনো ত্রুটি রেখেছি? হাঁটুর বয়েসী ছোকরা প্রকাশককে স্যার স্যার করে তেল দেওয়া থেকে লিটল ম্যাগাজিনের ইন্টেলেক্চুয়াল প্রকাশক এর সস্তা বুর্জোয়া সমাজ শত্রুর আসরে গল্প শোনা, চা খাওয়ানো সবই তো করলেন, ফল কি মিললো? আর আজকের অভিজ্ঞতা তো কহতব্য না। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় বেঁচে থাকলে তার টেনিদার ভাষাতে বলতেই পারতেন তোমার কেসটা পুড়িছেরী।

ভালো সরকারি অফিসার ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, স্ত্রীর অসুস্থতাতে ভি.র.স. নিয়ে নিলেন, যা ছিল সবটাই ডাক্তার আর হাসপাতালে চলে গেল, তাও বাঁচাতে পারলেন না স্ত্রী মাধবীকে, সন্তানাদিও নেই, তাই একদম একা হয়ে গেলেন, আর সঙ্গী হলো সাহিত্য, কিন্তু তাতেই আর সাফল্য কোথায়! রোজই প্রকাশক এর দোরে দোরে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে পড়েন, আরে বাবা নিজের টাকাতে বই ছাপাবার সামর্থ্য থাকলে তোদের আমি তেল দিতাম!!, কবে বের হয়ে যেত আমার বই। লেখা লেখির অভ্যাসটা ছোটবেলাতে ছিল। স্কুল কলেজের নানা পাত্র-পত্রিকাতে ওনার লেখা বেরোতো, তারপর যা হয়, সংসার সামলে কটা বাঙালি আর লাইফ এ যা হতে চেয়েছিলো সেটা হতে পারে। সেইদিক থেকে বাপু সাহেবগুলো আমাদের থেকে এগিয়ে, এই তো সেদিন কোন এক সাহেবের কথা পড়ছিলেন যেন কাগজে, ৯০ বছর বয়েসে কি এক নাটক না নভেল লিখে খুব বিখ্যাত হয়েছেন, আগে নাকি কেও তাকে চিনতো না, তারপর যতীন বলছিলো, কি এক KFC না কি আছে, তার মালিক নাকি অনেক বুড়ো বয়েসে এসে কোটিপতি হয়েছে। তা সে কোটিপতি হবার শখ ওনার নেই। বিধু চৌধুরী লেনের এই পৈতৃক বাড়িতে তিনি সুখেই আছেন, অত টাকার শখ ওনার কোনো কালেই ছিল না, নাহলে কত কোটি টাকার টেন্ডার পাস হয়েছে যার হাত থেকে, একটা পয়সা ঘুষ নিতেন না বলে আজ সামান্য বই ছাপাবেন সেই সামর্থ্য হচ্ছে না। রবিবাবুর ছোটবেলাটা কেটেছে, গ্রামের বাড়িতে। বাবা ছিলেন প্রাইমারি স্কুলএর হেডমাস্টার। সংসারে অভাব ছিলনা কোনো কালেই, বাবার কাছেই বাংলাটা পড়েছেন ছোটবেলাতে। ছোটবেলার কথা মাঝেমাঝেই মনে পড়ে ওনার। বাবা বলতেন, নিজের ভাষাটা না শিখতে পারলে, নিজের শিকড়কে চেনা যায়না। কতই না সুন্দর ছিল সেসব দিনগুলো, তারপর বড় হলেন, চাকরি নিয়ে চলে এলেন কলকাতা শহরে, ধীরে ধীরে এই শহরের কত রূপ এর রং পাল্টাতে নিজের চোখে দেখলেন। বাবা নিজেই আর থাকতে চাইতেন না গ্রামের বাড়িতে, নিজের টাকাতে, এই বাড়িটা করলেন। আশেপাশে কত ফাঁকা জায়গা ছিল তখন। বাড়ির সামনের এই বাগানটা তো বাবার উৎসাহেই করা। বিয়ের পর মাধবী অনেকটা সামলে দিয়েছে। স্ত্রী মাধবীর অভাবটা কেমন যেন তাড়িয়ে বেড়ায় ওনাকে। কথা বলার মানুষ টানেই। তাই ভেবেছিলেন, মনের কথাগুলো কাগজের পাতায় লিখে লোকের সাথে মনের ভাবের আদানপ্রদান করবেন। এখন মাঝে মাঝে মনে হয়, এসব না করে, ধর্মচর্চাতে মন দিলেই হতো। সেদিনও মিত্তিরমশাই বলছিলো, রবি, আসতে পারো তো আমাদের ধর্মপাঠের আসরে। যাবো ভেবেও গেলেন না। আসলে ধর্ম নিয়ে কোনোদিনও সেভাবে মাথা ঘামান নি উনি, ধর্মের পরিবর্তে কর্মকেই প্রাধান্য দিয়েছেন । এমন সময় কলিং বেল বাজলো, শ্রীমান যতীন উপস্থিত। যতীন হলো রবিবাবুর শালা, নানান ধরণের ব্যবসা আছে, আর হালফিলে ধরেছে কনসাল্টেন্সি ব্যবসা। কোনোটাতেই তেমন সুবিধা করতে না পারলেও, উৎসাহের খামতি নেই কিছুতে, এক কথায় যতীনই তাকে এই লেখালেখিতে উৎসাহ দিয়ে শুরু করিয়েছে। "দেখুন জামাইবাবু, সময় কিছুর জন্য থেমে থাকে না, দিদি নেই, আমাদের সব্বারই খুব কষ্ট, কিন্তু এভাবে একা একা কি করে বাঁচবেন! কিছু একটা করুন, কিছু শিখতেও পারেন" বলেছিলো যতীন "শিখবো? এই বুড়ো বয়েসে কি শিখবো? না না বাবা, ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের ভিড়ে শিখতে গেলেই বলবে, বুড়োটা শিঙ ভেঙে বাছুরের দলে নাম লিখিয়েছে রে" উত্তর দিয়েছিলেন রবিবাবু তখন অনেক ভেবে চিনতে এই লেখালেখির পালা শুরু হয়। তবে মন্দ তিনি লেখেন না। ওনাদের পাড়ায় বেশ কয়েকবার কবি সংবর্ধনাতে কবির জন্য সম্মান পত্র লিখে দিয়েছেন, একবার ওনারই লেখা ছোটদের নাটক নিয়ে কত হই হই হলো বিজয়া সম্মিলনীতে। কিন্তু সব লেখকের ইচ্ছা থাকে, তার বই বের হোক, দশটা লোক পড়ুক, চিঠি দিক, মুখোমুখি হলে বলুক, আপনার অমুক লেখাটা পড়লাম, বা আমি আপনার ফ্যান। তাই সেই চেষ্টাটাই চালাচ্ছেন কটা দিন ধরে। "তুই কি চা খাবি?" যতীনকে বলেন রবিবাবু। তবে করে নিয়ে আয়, আমি এই ফিরে এসে বসলাম। না না, খাবো না, এই তো ঝুলঝুনওয়ালার অফিস থেকে এক পেট খেয়ে এলাম, শোনো না রবিদা, এই প্রজেক্টটা যদি পেয়ে যাই, তোমার বই আমি ছাপাবো, কোনো প্রকাশককে আর তেলাতে হবে না। আমি তো ভাবছিলাম ছোট করে একটা পাবলিকেশন বিসনেস খুললে কেমন হয়, এই যেমন ধরো, কলেজ স্ট্রিট চত্বরে, ৪০০ স্কোয়ারফুট ...“থাক”, থামালেন রবিবাবু। তোর এই গাছে কাঁঠাল আর গোঁফে তেল স্বভাব গেলো না।আগে টাকাটা পা, আগে থেকেই এত কিছু না ভাবলেও চলবে, কোথায় কিছু নেই পাবলিকেশনের ব্যবসা করবে, কি বুঝিস তুই এই ব্যবসার!

আর পাবলিকেশনের যা অবস্থা দেখে এলাম আজ। আরে ওসব নিয়ে কিছু ভেবো না, "Be positive" সব ব্যবসার টাল-মাটাল আছে, হয় তো তুমি যাদের পাবলিকেশন দেখে এসেছো, ওদের খারাপ সময় চলছে, টা বলে তো আর সবার এমন হাল না। বললো যতীন খারাপ হাল? না না মোটেও না, বেশ ফুলে ফেঁপে উঠছে ওদের ব্যবসা, তবে কি জানিস সাহিত্যটাই হারিয়ে যাচ্ছে, একজন বললো চকমকে কভারের মাপ মতো বই লিখুন, আর একজন তো বাংলা পর্নোগ্রাফির বই লিখতে বললো রে। 
ছ্যা, ছ্যা, কি বলবো তোকে, বছর ২২ বয়সের একটা মেয়ে, আমার হাঁটুর বয়েস, সে আমাকে চিবিয়ে চিবিয়ে ওসব কথা বললো, মুখে বাঁধলো না এতটুকু'।
যতীন ফিঁক করে হেসে বললো, রবিদা, টাকা আর শরীর দুটোই এখন ট্রেডিং ট্রেন্ড।
ক্ষমা কর ভাই, ওসব উত্পটাং কিছু লিখে আমি বই ছাপাতে পারবো না। বিরক্ত স্বরে বলেন রবিবাবু।
আচ্ছা শোনো না, আমি আজ আরও কয়েকটা ঠিকানা পেয়েছি, দেখো একটু কথা বলে।
হুম, কাল যাবো না হয়, আমি উঠলাম দাদা, গুড নাইট, যতীন উঠে পড়লো।
পরদিন সকালে আবারও নিজের ব্যাগপত্তর নিয়ে বেরোলেন, যাবার আগে স্ত্রী মাধবীকে ছবির মধ্যে থেকে বলে গেলেন, তুমি মনে হয়তো ঐ পারে বসে আমার পাগলামো দেখে হাসছো বলো! কিন্তু মনে প্রাণে বড়ো একা লাগে গো, তাই বেরিয়ে পড়ি।
ওনার কাজের মাসি লক্ষীদি এসে গেছে ততক্ষণে, ঘড়িটা একবার দেখে নিয়ে বললেন, রাতে বাড়ির ফেরার সময় একটিবার এস দিদি, তোমার এই মাসের টাকাটা নিয়ে যেও, আর তালাটা দেখে লাগিও, ডুপ্লিকেট চাবি আমার কাছে আছে, বলেই বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে যতীনের দেওয়া ঠিকানাগুলি দেখে দেখে সব কটায় ভিজিট হয়ে গেলো তার। শেষ জনের থেকে বেরিয়ে ঘড়িতে দেখলেন, ১২টা ০৫ বাজে। মনে মনে ভাবলেন, হা আজকের মতো তার বারোটা বেজেছে, এবার বাড়ি ফিরলেই হয়। 
কলেজ স্কোয়ার থেকে একটু এগিয়ে বাম দিকে যে চা-এর দোকানটা আছে, ওখানে বসে চিনি ছাড়া চা এর অর্ডার দিয়ে, লোকের যাওয়া আসা দেখছিলেন তিনি। এই এক স্বভাব তার, লোক দেখা, অনেক ছোটবেলাতে, কেও তাকে বলেছিলো, প্রতিটা মানুষের জীবন একটা করে আলাদা আলাদা গল্প। তাই লোক দেখেন তিনি, বুঝতে চান, হাসি মুখে যে মানুষটা হাঁটছে, সে হয়তো অফিসে বসের থেকে গালি খেয়ে বাড়ি ফিরছে, কিমবা বউটার অসুখ, কারো বা শরীরে মরণ রোগ বাসা বেঁধেছে, সে জানে বা জেনেও না জানার ভান করে হাঁটছে।
“বাবু চা” ,দোকানের ছেলেটা কাঠের টেবিলে চায়ের কাপটা রেখে বললো। ভাবনায় বাধা পড়ে তার।
গরম চাতে চুমুক দিতে দিতে লক্ষ্য করলেন, হালকা শ্যাম বরণ রোগা পাতলা একজন মানুষ ওনার দিকেই তাকিয়ে আছে, চোখে চোখ পড়তেই হেসে উঠলেন, 
ভদ্রতার খাতিরে রবি বাবুও হাসলেন, মনে মনে ভাবছিলেন, এর আবার কি মতলব কে জানে, কলকাতা মানেই তো মতলববাজদের আড্ডাখানা, হয় ইন্সুরেন্সের দালাল আর নাহলে নেটওয়ার্ক মার্কেটিং করতে বলবে, লোকটি উঠে এসে বললেন, একটু বসি আপনার পাশে?
ঈষৎ সরে এলেন, রবিবাবু, বুঝিয়ে দিলেন, বসলেও তার আপত্তি নেই।
কিছু সময়, চুপচাপ। লোকটি নিজেই তারপর বললেন "যাক বাঙালি তাহলে আজ কাল ইন্টেলেক্চুয়াল নিবন্ধ লিখতে পারে," পাশের ওই লোকটির কেমন একটা মেয়েলি টাইপ পুরুষ কণ্ঠ, চা এর দোকান এর বেঞ্চ এ তার ফেলে রাখা লেখাটার দিকে তাকিয়ে কথাটা বলছিলো। "আমাকে কিছু বললেন?" প্রশ্ন করলেন রবীন্দ্রনাথ, উত্তর এল হা, বেশ কিছুটা চুপ থেকে ব্যক্তিটি আবার ও প্রশ্ন করলেন "ছাপছে না বুঝি?", বিরক্ত স্বরে রবীন্দ্রনাথ এর জবাব এল, না। 
ছাপবে কি করে, এসব লেখা এর মর্ম বোঝে যারা তাদের কাছে পৌঁছতো হবে, তবে না। ঘাড়টা ঘুরিয়ে রবীন্দ্রনাথ লোকটিকে একটা শ্লেষ জড়িয়ে বললেন “তারা কারা শুনি? ইহ জগৎ না অন্য জগৎ এর কোনো কেও?” মুচকি হেসে এবার আগুন্তুক বললেন, “১৩ নম্বর বনমালী এভিনিউ এ যান একবার, গিয়ে বলবেন দিগন্ত সান্যাল পাঠিয়েছে,"।
প্রকাশনীর নাম "গ্রস্ত"।
গ্রস্ত? এটা তো শুনিনি, কেমন লেখা নেন ওনারা? আগের দিনের তিক্ত অভিজ্ঞতার স্মৃতি এখনো ভোলেননি রবিবাবু তাই আজ আর রিস্ক নিতে পারছেন না।
লোকটি জানায়, নতুন পুরানো সব লেখাই ছাপায় ওনারা, পয়সাওয়ালা মানুষ মশাই, বইয়ের কাটতি নিয়ে মাথা ঘামান না, প্রকাশকের কথা হলো সাহিত্য সৃষ্টিটাই মূল, পয়সা দিয়ে তার বিচার হয়না। আমি বলি কি যান একবার।
কথাটা মনে ধরলো রবিবাবুর। ভদ্রলোককে ধন্যবাদ জানিয়ে ঠিকানাটা আরো একবার ভালো করে জেনে নিয়ে চলে এলেন প্রকাশকের ঠিকানাতে।
হা ১৩ন তো এটাই, কিন্তু এটা তো বাড়ি মনে হচ্ছে, ঠিক তখনই খেয়াল করলেন, পাশেই "গ্রস্ত প্রকাশনী" লেখা  সাইনবোর্ড। গেট খুলে ভিতরে এসে, ডান দিকের অফিস রুমের দিকে চললেন। কাঁচের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে দেখলেন একজন বসে আছেন, রবিবাবুকে দেখেই নমস্কার জানিয়ে সামনের চেয়ারে বসতে বললেন। 
আমাকে দিগন্ত সান্যাল আপনার ঠিকানা দিয়েছে। ওই কলেজ স্ট্রিট এ ওনার সাথে দেখা হয়েছিল, বললেন, আপনি নতুন লেখকদেরকেও সুযোগ দেন। 
'হা নিশ্চই, লেখার আবার নতুন পুরানো কি, আমি শুধু দেখি লেখার মান। আর সেটা যদি ঠিক থাকে, আমার তা ছাপার কোনো আপত্তি নেই। দেখি আপনি কি লিখেছেন।
বর্তমান যুব সমাজ আর চাকুরিমুখী শিক্ষার ওপর রবিবাবুর লেখা প্রবন্ধটি, প্রকাশককে বাড়িয়ে দিলেন উনি।
বেশ বেশ, বলে মন দিয়ে লেখাটি শুরু থেকে পড়তে লাগলেন প্রকাশক মশাই ,ডান হাতটি চেয়ারের হাতলে রেখে, কপালের একদিকে চাপ দিয়ে পড়ছিলেন, আর মাঝে মাঝে সম্মতি মুলুক কিমবা প্রশংসা মূলক মাথা নাড়ছিলেন, এটা দেখে রবিবাবুর বুকে যেন একটু ভরসা এল। ছাপা হোক বা না হোক, মন দিয়ে লেখাটা পড়েছেন তো অন্তত।
মিনিট ২০ পরে বললেন, লেখার মান নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই কিন্তু আমাদের সিলেকশন কমিটিকে একবার দেখিয়ে নিতে চাই আমি লেখাটা।
“অবশ্যই” রবিবাবু সম্মতি মুলুক মাথা নেড়ে জানালেন।
তবে আপনি এটার জেরক্স কপি রেখে যান, বললেন প্রকাশক। আপনি এটাই রেখেদিন, আর কপি নেই, আপনাকে দেখে ভরসা আছে আমার, বলে উঠে পড়লেন রবিবাবু।
আজ বাড়ি ফিরে বেশ একটা স্বস্তি অনুভব করছেন তিনি। দিনের পর দিন যে অবহেলা নিয়ে বাড়িতে ফেরেন, সেটার অভাব আজ, বরং কিছুটা হলেও আশার আলো লেগে আছে মনে।
যতীন আজ এসেছিলো সন্ধেবেলা, সব কিছু শুনে বললো, হয়ে যাবে সিলেকশন, কি দাদা আপনাকে বলেছিলাম না, একদিন মূল্য পাবেনই আপনি, দেখুন মিললো তো!
বেশ একটা হাসি মুখে বললেন, রোসো ভায়া ওদের কমিটি কি বলে দেখা যাক।
কিছু ভাববেন না বলে যতীন।
পর পর ৩-৪ তে দিন বেশ ভালোই কাটলো, শুধু সামান্য অপেক্ষার উদ্দীপনা লেগেছিলো ওনার মনেতে, তবে যথেষ্ট আশাবাদী ছিলেন মনে মনে তিনি নিজেও।
গত রবিবার ফোন করেছিলেন প্রকাশক, বললেন, লেখাটা কমিটি সিলেকশন করেছে, আর ওনারা চান যে রবিবাবু নিজে একবার আসুন আজ সন্ধেবেলা, প্রতি রবিবার কমিটি মেম্বার ছাড়াও অনেক প্রকাশক আর বাঙালি সাহিত্যের দিকপালরা আসেন ওনার ওখানে, সবার ইচ্ছা একবার লেখাটা পড়ে শোনান রবিবাবু নিজে, এ লেখা সেখানে খুবই সমাদর পাবে প্রকাশক নিজে মনে করেন”। কথাটা শেষ করে,ভদ্রলোক বললেন “এবার তাহলে রাখি?”,
“আপনার নামটা জানা হলো না!! বললেন রবিবাবু। 
“আমার নাম পরিতোষ পাঠক, আমারই বাড়িতে সভাটা বসে, আপনি ওই সন্ধে ৭টা নাগাদ আসুন, আমরা অপেক্ষা করবো”. বলেই ফোনটা রেখে দিলেন ভদ্রলোক।
উফফ সে যে কি আনন্দ, একবার ভাবলেন যতীনের মোবাইলে ফোন করে জানাবেন, তারপর ভাবলেন না, দেখা হলেই বলবেন। 
সকালটা যেন কিছুতেই আর কাটছে না তার, ঠিক বিকাল ৬টা নাগাদ এক কাপ চা আর দুটো বিসকুট খেয়ে রবীন্দ্রনাথ বেরিয়ে পড়লেন, ঠিক সন্ধে ৭টা ১০এ প্রকাশকের বাড়ি পৌঁছে গেলেন, অফিস বন্ধ দেখে সোজা এগিয়ে এসে বাড়ির কলিং বেল বাজাতেই একজন কম বয়েসী ছোকরাচাকর দরজা খুলে দিলো, আর নিয়ে গেল এক প্রকান্ড হল ঘরে, ইতিমধ্যে অনেক মানুষ বসে আছেন, কারোর মুখ ঠিকমতো দেখা যাচ্ছে না, আলো আর অন্ধকারে শুধু অবয়বটি বোঝা যাচ্ছে, তাদের কেউকেই তেমন চেনা লাগছে না তাঁর। একজন মানুষ এর মুখটা একটু শুধু চেনাচেনা লাগছে, তরুণ বয়েস, কবি কবি চেহারা, একজন বেশ লম্বা হালকা দাড়ি আছে সুপুরুষ, আর একজন এর বেশ বলিষ্ঠ চেহারা সরু গোঁফ, ঘরের  আলো খুব কম, একটি করে চেয়ার তার পাশে একটি করে ছোট টেবিল। তারই ওপর রাখা টেবিল ল্যাম্প, কাগজ পেন রাখা, রবীন্দ্রনাথকে চাকরটি একটি টেবিল দেখিয়ে দিলো, কয়েক মিনিটে বসে থাকার পরেই ওই পাশের বড়ো দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকলেন, পরিতোষবাবু। সকলকে নমস্কার করে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় দিলেন, সভা শুরু হলো, সভার শুরুতে, আগামী মাসের পত্রিকাতে কি কি প্রকাশ পাবে, পাঠকরা কি চিঠি দিয়েছে, কোনো অভিযোগ এসেছে কিনা, এসব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হলো| তারপরে শুরু হলো আলোচনা সভা, সেই সভার নিয়ম সহজ, সকলে একটি মাত্র নিজ রচনা পাঠ করতে পারবেন, লেখা পাঠ শেষ হলে অন্যরা সমালোচনা করতে পারবেন। কেও কবিতা পড়ে শোনাচ্ছেন, কেও বা প্রবন্ধ, কেও বা গল্প, পাঠের শেষে, সকলেই মন্তব্য রাখছেন. রবীন্দ্রনাথবাবু তার নিবন্ধটি পাঠ করলেন আর ভূয়সী প্রশংসা পেলেন সকল এর থেকে, একজন তো জানালেন সভা শেষে তিনি যেন তার সাথে কথা বলেন, তিনি তার পত্রিকাতে এমনই কিছু সামাজিক বিষয় নিয়ে লেখা বের করবেন|
সবই ঠিক চলছিল কিন্তু হঠাৎ সেই তরুণ কবিটি, কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য এর কবিতা পড়াশোনাতে লাগলেন, অবাক হলেন রবীন্দ্রনাথ, এত পুরো টুকে দিয়েছে, তার পাঠ শেষ হলে সকলে মন্তব্য করলো প্রশংসাও করলো, আরো অবাক হলেন এরপরের জন এর লেখাটা শুনে "হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে, সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে" এইটুকু বলতেই রবীন্দ্রনাথ আর থাকতে না পেরে বললেন, থামুন মশাই, এ কেমন সভা, বিখ্যাত লেখকদের লেখা নিজের নাম দিয়ে পাঠ করছেন, আর আপনারা কেমন সাহিত্যিক মশাই, কেও কোনো প্রতিবাদ জানাচ্ছেন তো নাই, উল্টে আবার প্রশংসা। সভা সকলে সবাই`চুপ, রবীন্দ্রনাথ বলে চললেন আর পরিতোষবাবু, আপনি আমাকে বললেন এটা নাকি স্বরচিত লেখা পাঠ এর আসর এ তো পুরোটাই টোকা, আমার এখন খেয়াল হচ্ছে, ওই যে উনি যে কবিতা পড়লেন ওটা তো রবিঠাকুর এর লেখা, ওনারটা সুকান্ত ভট্টাচার্য্য আর উনি পাঠ করছেন জীবনানন্দ এর বনলতা সেন, মশাই টোকাটুকির একটা লিমিট থাকে, হাত তুলে থামতে বললেন পরিতোষ পাঠক আর তার পাশের দেওয়ালে ইলেকট্রিকের সুইচ বোর্ড এর আলোটা জ্বেলে দিলেন, সাথে সাথে ভীষণ চমকে গেলেন রবীন্দ্রনাথ, এ তিনি কাদেরকে দেখছেন? কারা বসে আছে সামনে?, প্রতিটা টেবিলের সামনে চেয়ার আলো করে বসে আছেন তরুণ কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যী, তরুণ বয়েসে ররবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনানন্দ, বিভূতিভূষণ আরো কত কত নামি মানুষ, মাথাটা বন্‌বন্‌ করছে, এ তিনি কোথায় এসেছেন, ছুটে বেরিয়ে আসতে গেলেন ঘর থেকে, বাইরের দরজা ঠেলে খোলার চেষ্টা করলেন কিন্তু পারলেন না, কিছুতেই সামনে পিছনে টেনে ঠেলে খোলা যাচ্ছে না, তবে কি দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে রাখা!
“আমি চলে যেতে চাই, খুলে দিন দরজাটা”, চিৎকার করে বললেন রবিবাবু, আমাদের সভায় যিনি একবার আসেন, আর কোনোদিন চলে যেতে পারেনা রবিবাবু, বলেন পরিতোষ পাঠক, আপনি হয়ে গেলেন আজীবনের সদস্য।
না না আমার বই আপনাকে ছাপাতে হবে না শুধু আমাকে যেতে দিন।
শান্ত গলাতে পরিতোষবাবু উত্তর দিলেন কাদের কাছে ফিরতে চাইছেন আপনি? যারা আপনার কাজের মর্যাদা কোনোদিনও দেয়নি? দিনের পর দিন রাত জেগে, কত ভেবে, কত অভিজ্ঞতা দিয়ে লিখেছেন আপনি, কোনো মর্যাদা তো দেয়নি আপনাকে, পরিবর্তে কতকগুলো অপদার্থ মানুষ, নিজেদের নিম্নরুচির পরিচয় দিয়ে অপমান করে বের করে দিয়েছে। তাহলে কিসের জন্যই বা ফিরতে চান, আসুন না, আমাদের সাথে সাহিত্য করবেন, যেখানে একজন গুণীকে তার কাজের জন্য তার সৃষ্টিশীলতার যোগ্য সম্মান দেওয়া হবে। একবার তাকিয়ে দেখুন, আপনি বসে আছেন আপনারই চেয়ারে। রবিবাবু ঘাড়টা ঘুরিয়ে নিজের চেয়ারের দিকে তাকালেন, আর অবাক হয়ে দেখলেন, তিনি বসে আছেন, শুধু ঘাড়টা ইষৎ বাম দিকে হেলানো।
ঘরের অন্য সদস্যরা যেন বলে উঠলো, সুস্বাগতম।

অনুগল্প

গল্প

মার্চ ২০২১ ।। মতামত ।। সূচীপত্র