এপ্রিল ২০২০
কবিতা
কবিতা
শিল্পী - মেঘমল্লার (ডালাস, টেক্সাস)
লেখক/লেখিকাবৃন্দ
গল্প
শয়তানের
হাসি
সুশোভন দাস
অল্টো ইউনিভার্সিটি, ফিনল্যান্ড
অঝোরে বৃষ্টি ঝরছে বাইরে। মাঝে মাঝে দমকা হাওয়া শহরটাকে যেন মাটিতে মিশিয়ে ফেলতে চায়। আজ সন্ধ্যা থেকেই প্রকৃতি রুষ্ট হয়েছিল। যত রাত বাড়ছে সেই রাগের অগ্নিকুণ্ডে কে যেন আরো বেশি করে আহুতি দিচ্ছে। বিশ তলার উপর থেকে নীচে তাকালে মনে হচ্ছে গোটা শহরটা যেন এক ঘন মেঘের চাদরে ঢাকা পড়েছে। স্ট্রিট ল্যাম্প থেকে কয়েকটা আলোক ধারা সেই মেঘের বুক চিরে বেরিয়ে আসার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। কিন্তু প্রকৃতি যেন আজ তাদেরকেও নিষ্প্রভ করে দিতে চায়। এমন ভয়াবহ দূর্যোগ এর আগে কখনো হয়েছে বলে মনে পড়ে না। বিছানার পায়ের দিকের জানলাটা খুলে গেছে দমকা হাওয়ায়। বৃষ্টির ঝাপটায় জানলার পর্দাটা একেবারে ভিজে এক পাশে ঝুলছে। ভেজা পর্দা থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল মেঝেতে পড়ে একটা সরু জলধারা সৃষ্টি করে টেবিলের দিকে এগিয়ে গেছে। ঝড়ের দাপটে বৃষ্টির ঝাপটা বেশ কয়েকবার আমার বিছানা পর্যন্ত ছুটে আসে। কিছুটা আগেই ঘুম ভেঙেছে তবু উঠে জানলাটা বন্ধ না করে বিছানায় শুয়ে রইলাম। প্রকৃতির এই রুদ্র রূপ মনের ভিতর একটা চাপা আতঙ্ক সৃষ্টি করলেও বিছানায় শুয়ে শুয়ে জানলা দিয়ে তা দেখতে বেশ ভালোই লাগছিল। কিন্তু মনে করতে পারলাম না কাল রাতে ঘুমানোর আগে জানলাটা বন্ধ করেছিলাম না এমন খোলা রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। এখন রাত ক'টা বাজে সেটাও ঠিক আন্দাজ করতে পারলাম না। টেবিলের উপর রাখা মোবাইলের নোটিফিকেশন লাইটটা পর্যায়ক্রমে জ্বলছে ও নিভছে। সেই ক্ষীণ আলো ঘরের নিকষ অন্ধকারের সাথে অসম প্রতিদ্বন্দ্বীতা করে নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। দমকা হওয়াটা যেন হঠাৎ করেই থেমে গেল। ঝমঝম করে অবিরত বৃষ্টির শব্দের মাঝে ঘরের দেওয়াল ঘড়িটার টিক্ টিক্ শব্দ হঠাৎ করেই বেশ জোরে শোনা যাচ্ছে। এমনকি জালনার পর্দা থেকে মেঝেতে পড়া জলের ফোঁটার শব্দও পরিষ্কার কানে ভেসে আসছে। জানলা দিয়ে বাইরের অন্ধকারটা ঘরের মধ্যের অন্ধকারের মতো এতো গাঢ় মনে হল না। হালকা ফ্যাকাশে ভাব একটা আছে সেখানে। কিন্তু তাতে রাস্তার উল্টোদিকের বাড়ি দেখতে পাওয়া যায় না। উল্টো দিকের বাড়ির ছাদের আলোটা দু-একবার জ্বলা-নেভা করে শেষমেশ জ্বলে উঠল। সাথে সাথে এক রাশ আলো আমার ঘরে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল। একটু বিরক্তি লাগল। এমন নিবিড় অন্ধকার রাতে প্রকৃতির ভিন্ন রূপ দেখায় হঠাৎ বাধা পড়ল। নিজের মনেই বললাম - ''বাধা যখন পড়েছে তখন জানলা বন্ধ করে ভালো করে ঘুমানো যাক বাকি রাতটুকু।''
বিছানা ছেড়ে উঠতেই মাথাটা হালকা ঘুরে আবার বিছানায় বসে পড়লাম। নাঃ। নেশাটা এখনো মাথা থেকে নামেনি। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বিছানা ধরে ধরে জানলার কাছে এলাম। জানলার পাল্লা দুটো বন্ধ করতে যাব ঠিক তখনি উল্টোদিকের বাড়ির ছাদে এক জন এসে দাঁড়ায় ঠিক একটু আগে জ্বলে ওঠা আলোটার নীচে। উল্টোদিকের বাড়িটাও বিশ তলা। কিন্তু আমার বিল্ডিং থেকে প্রায় মিটার পঞ্চাশ দূরে। মাঝে রয়েছে তিনটে হাইওয়ে। বৃষ্টির মাঝে ল্যাম্পের আলোয় তার মুখ বোঝা যাচ্ছে না। পরনে সাদা শার্ট আর জিন্স। বৃষ্টিতে ভিজে জামাটা একেবারে আটকে আছে শরীরের সাথে। রোগা চেহারার অবয়ব ফুটে উঠেছে আলো-অন্ধকারের মাঝে। অনেকটা আমারই মতো কিন্তু নারী না পুরুষ সেটা বুঝতে পারলাম না। খুব চেনা চেনা লাগছে কিন্তু নিশ্চিতভাবে কিছু বুঝলাম না। কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম সেইদিকে। কিছু ভেবে পেলাম না কি কারণে এতো রাতে একা একা সে ছাদে এসে বৃষ্টিতে ভিজছে। আমি তাকে হাত নেড়ে কিছু বলতে যাব এমন সময় সে ল্যাম্পপোস্টের সাহায্যে ছাদের রেলিং-এর উপর উঠে দাঁড়াল। আমি এক মুহূর্তের জন্য আঁতকে উঠলাম। পরক্ষণেই বিদ্যুতের মতো আমার মনে পড়ে গেল তনিমার কথা। গত সন্ধ্যায় আমরা দুজনে এক ড্রেস পড়ে পার্টিতে গিয়েছিলাম।
তনিমার সাথে আমার সম্পর্ক গত পাঁচ বছর ধরে। যদিও আমরা ছোটবেলা থেকেই একে অপরকে চিনতাম। আমরা যখন সাত বছর বয়স তখন তনিমার বাবা বদলি হয়ে আমাদের এলাকায় আসেন সাব-ইন্সপেক্টর হিসাবে। স্কুল যাওয়া, খেলাধুলা করা, সাঁতার শেখা সব কিছু একসাথেই করতাম। পড়াশুনায় ভালো ছিলাম বলে কাকু-কাকিমা আমায় বেশ পছন্দ করত। স্কুলের পর প্রায় প্রতিদিনই তনিমাদের বাড়ি আসতাম। এমনকি মাঝে মাঝে আমি তনিমার সাথে খেলতে খেলতে ওদের বাড়িতেই ঘুমিয়ে পড়তাম। তারপর কখন মা-বাবা আমাকে বাড়ি নিয়ে আসতো আমি টেরও পেতাম না। কিন্তু এমন ভালো দিন খুব বেশি দীর্ঘস্থায়ী হল না। বছর চারেক পর কাকু আবার বদলি হয়ে অন্য জায়গায় চলে যান। তারপর অনেক বছর তনিমার সাথে খুব একটা যোগাযোগ ছিল না। বাবা মাঝে মাঝে কাকুকে ফোনে করলে তখন দুয়েকটা কথা হত তার সাথে। ক্লাস টুয়েলভের পর সৌভাগ্যবশত: দুজনে একই ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হলাম। তনিমার ছিল আই-টি আর আমার কম্পিউটার সায়েন্স। বাড়ি থেকে কলেজ অনেক দূর। তাই আমাকে হোস্টেলে থাকতে হল। তনিমা কিন্তু রোজ যাতায়াত করতো। কাকু-কাকিমার স্নেহভাজন হওয়ায় ছুটির দিনে মাঝে মাঝে আমায় বাড়ি ডেকে পাঠাতেন। হোস্টেলের একঘেঁয়ে খাবারের মাঝে বাড়ির রান্না অগ্রাহ্য করার দুঃসাহস আমার ছিল না। শনি-রবিবারগুলো নিজের বাড়ি না ফিরলে হয় তনিমাদের বাড়ি না হলে শহর থেকে কিছুটা দূরে খামখেয়ালি ঘুরে বেড়ানোই ছিল আমার ছুটি কাটানোর উপায়। বাইরে ঘুরতে গেলে তনিমা বেশিরভাগ দিনই যোগ দিত তবে অনেক কাঠ-খড় পোড়ানোর পর। তবে আমার এমন খামখেয়ালি ঘুরে বেড়ানোর জন্য মাঝে মাঝে খুব রাগ করতো আমার উপর। দিন তিন-চার আমার সাথে কথাই বলত না তখন। এমন ভাবেই কলেজের দিনগুলো কেটে গিয়েছিল। এরপর এলো চাকরী পাওয়ার তোড়জোড়। পড়াশুনাতে দুজনেই ভালো ছিলাম তাই ক্যাম্পাসিং-এ প্রথম কোম্পানিতেই দুজনের চাকরী হয়ে গেল। দেখতে গেলে মাথার উপর থেকে বিশাল বড় একটা চাপ এক নিমেষে উবে গেল। চাকরী পাওয়ার পর শেষ ছয়টা মাস খুব আনন্দ করেই কেটে গেল। কলেজ ছাড়ার একেবারে শেষ প্রান্তে এসে তনিমার প্রতি আমার অনুভূতির কথা জানাই। আমার অনুভূতির কথায় চোখে জল এনে বুকে জড়িয়ে একসাথে পথ চলার কথা জানায়। কিন্তু তার আগে এতো দিন পর নিজের মনের কথা জানানোর জন্য আমার গালে তার ভালোবাসার পাঁচ আঙুলের ছাপ এঁকে দিল। সেদিন বুঝেছিলাম প্রেম কাঁঠালের আঠা হলেও প্রেম নিবেদন আসলে শাঁখের করাত।
কলেজ ছাড়ার দু-মাসের মধ্যে আমাদের চাকরীতে ঢুকতে হল। পোস্টিং এক জায়গায় হলেও এবার দুজনকেই ছাড়তে হল নিজেদের শহর। অন্য শহরে এসে দুজনে একসাথেই থাকতে শুরু করলাম। দুজনের বাড়ি থেকে আমাদের সম্পর্কের কথা শুনে খুবই খুশি, তাই বিয়ে নিয়ে কারোর বাড়ি থেকেই কিছু চাপ ছিল না। একসাথে ভালো কাজের সুবাদে দুজনেরই ভালো প্রোমোশন হতে থাকে। প্রতিটা প্রোমোশনের সাথে সাথে আমাদের ফ্ল্যাটের ফ্লোরও উপরে উঠতে থাকে। উপর থেকে শহর দেখার ইচ্ছা তনিমার অনেকদিনের। তাই দেখতে দেখতে আমার এই বিশ তলা বিল্ডিঙের একেবারে উপরে উঠে এলাম। কর্ম ব্যস্ততার মাঝে সময় যে কিভাবে পেরিয়ে যায় তা বোঝার উপায় থাকে না। যদিও দুজনে একসাথে থাকি, একই অফিসের একই প্রজেক্টে কাজ করছি, সব সময়ই দুজন দুজনের মুখ দেখছি কিন্তু কোথাও যেন এই দেখা-দেখির মাঝে দেখেও না দেখার একটা অবজ্ঞা ভাব অদৃশ্যভাবে আমাদের মাঝে ফুটে উঠেছে।
উপরে ওঠার ইচ্ছাটা কখন যে রক্তে মিশে গিয়েছিল তা নিজেরাও টের পাই নি। বস্তুগত চাহিদাগুলো এতটাই মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল যে ব্যক্তিগত সুখ বস্তু ছাড়া অধরা মনে হতে লাগল। সামনের মানুষটা, যে একটা সময় গোটা মন জুড়ে আধিপত্য চালিয়েছে, বস্তুগত চাহিদার করাল গ্রাসে সেই সাম্রাজ্য প্রায় নিশ্চিহ্ন হতে চলেছে। কর্পোরেট ওয়ার্ল্ডের দৌলতে একটা পোশাকি ভালোবাসা আমাদের দুজনেকে একটা আলগা সুতোর বাঁধনে বেঁধে রেখে ছিল। অন্তঃসার শূন্য হয়ে যাওয়া একটা সম্পর্ক যেখানে ঠুনকো আঘাতে চুরমার হয়ে যেতে পারে সেখানে পোশাকি ভালোবাসার ভার দিনে দিনে এক অসহনীয় বেদনার উদ্রেক শুরু করে। কিন্তু যতদিনে তা বুঝলাম তখন আমরা নিজেরাই নিজেদের উপর অধীনতা হারিয়ে ফেলেছি। ফিরে যাওয়ার সব রাস্তাই তখন এতটাই সংকীর্ণ ও দুর্গম যে নিজেদের ক্ষত-বিক্ষত করে সে পথের পথিক হওয়ার সাহস বা মানসিকতা কোনটাই এলো না। তাই পোশাকি ভালোবাসার মায়াবী ছায়ায় মনকে ভুলিয়ে একই ছাদের নীচে দুজনে দুজনের মতো আলাদা দুটো পৃথিবী গড়ে নিলাম। কিন্তু যেদিন পোশাকি ভালোবাসাটুকুও খসে পড়বে সেদিন কিভাবে, তার আতঙ্ক দুজনের ভিতরেই জমাট বেঁধেছে। গত বুধবার তনিমার জন্মদিন গেছে কিন্তু সপ্তাহের মাঝে বলে সেলিব্রেশন পার্টি শুক্রবার রাতেই রাখা
হল। সকাল থেকে একটা আনন্দ - উত্তেজনার ঝলক তার চেহারায় ফুটে উঠেছে। এতটা প্রাণোচ্ছলতা তনিমার মধ্যে অনেকদিন দেখি নি। তাই তার উৎফুল্ল মনের জলতরঙ্গ ভাবনার শরিক হয়ে গেলাম। ঠিক হল আজ একই পোশাক পরে অফিস করব তারপর পার্টি। তনিমার পছন্দ অনুযায়ী সাদা শার্ট আর গাঢ় নীল জিন্স তার উপর কোট। অফিসে ঢোকার সাথে সাথে দুজনের এক পোশাক দেখে সবাই খুব তারিফ করল, অনেকে 'মানিকজোড়' বলে আখ্যাও দিল। সন্ধ্যায় অফিস কলিগদের নিয়ে কেক কাটার মধ্যে দিয়ে শুরু হল আমাদের পার্টি। তারপর অফিস থেকে বেরিয়ে নাইট ক্লাবে জমে উঠল আসর। ইদানিং বিলাতি মদ সহ নারী সঙ্গ যেন এই পার্টিগুলোর এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। একটার পর একটা মদের গ্লাস খালি করতে লাগলাম। কোনও হিসাব ছিল না আজ, ছিল না কোনও মাত্রা জ্ঞানের বাধ্যতা। নেশাগ্রস্থ চোখে লাস্যময়ী নারীদের নৃত্য কিছু অতৃপ্ত বাসনাকে হঠাৎ করেই উদ্দীপিত করে তোলে। তাদের কটিদেশ থেকে খামখেয়ালি তরঙ্গায়িত উত্তেজনা গ্রীবা স্পর্শ করে তৃষ্ণার্ত ওষ্ঠে রূপান্তরিত অদম্য আবেদনকে অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা আমার মধ্যে ছিল না। ছুটে গিয়েছিলাম সেই আবেদনের ডাকে, ছুঁতে চেয়েছিলাম সেই তৃষ্ণার্ত ওষ্ঠ, মেটাতে চেয়েছিলাম অতৃপ্ত বাসনার একাংশ। বাসনার সাগরে একটু একটু করে ডুব দিতে দিতে চোখে ভেসে উঠল তনিমার মুখ। আলো-আঁধারের ঘেরা একরাশ ধোঁয়ার মাঝে তার ঠোঁটও খুঁজে নিয়েছিল অন্য এক আশ্রয়। সময় যেন থমকে গেছে তার নিমীলিত নয়নে। স্বপ্ন পূরণ হওয়ার এক আশার আলোক ছড়িয়ে পড়েছে তার মুখে। আমার পৃথিবী হঠাৎ করে থমকে দাঁড়িয়ে গেছে তনিমাকে দেখে। এক-ধাক্কায় আমার নেশাগ্রস্থ অবস্থার অবসান হল। দৌড়ে এলাম তনিমার কাছে। নিজেকে সামলাতে না পেরে এক মুষ্টি ছুঁড়ে দিলাম ছেলেটার উদ্দেশ্যে। আচমকা আমার আক্রমণের প্রত্যুত্তরে তনিমা আমাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিল। এমন প্রতিঘাত আমি কল্পনাতেও ভাবিনি। মেঝে থেকে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে বুঝলাম নেশার ঘোর আবার মাথায় চেপে বসেছে। কিছু কোলাহল আর উৎসুক চোখ আমাকে ঘিরে রইল কিছুক্ষণ। সেই উৎসুক চোখগুলোর মাঝে তনিমার ঘৃণা ভরা চোখ যেন আমাকে সমূলে উৎখাত করতে চায়। নীরবে বিক্ষিপ্ত পদক্ষেপে আমি ক্লাব ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। বুঝলাম, পোশাকি ভালোবাসাটুকুও আজ খসে গেছে। বাইরের আকাশে তখন দুর্যোগের ঘনঘটা। বৃষ্টির মাঝেই রাস্তার ধারে বসে পড়লাম কিছুটা শান্তির আশায়। মনে মনে ভাবলাম - ভিতর থেকে তনিমাকে নিয়ে আসি। আবার হয়তো নতুন করে শুরু করি। কিন্তু তনিমাও কি তা চায়? আজ সে ধাক্কা মেরে মেঝেতে ফেলে দিয়েছে। হয়তো অনেকদিন আগেই মন থেকে মুছে ফেলেছে। তবু কি যায় না অস্পষ্ট হয়ে যাওয়া ডাইরির পাতাগুলোকে সযত্নে রেখে তাতে নতুন কালিতে পুরানো গল্পকে পুনর্জীবন দেওয়া? হঠাৎ করে একেবারে একলা হয়ে যাওয়ার অনুভূতি বাস্তবের সাথে নিজের মিল ও অমিলগুলোকে আরও স্বচ্ছ করে তোলে। স্ট্রিটল্যাম্পগুলোও সব একা একা দাঁড়িয়ে আছে। একের আলো অন্যের সাথে কথা বলে না। শুধু দেখে আর নিজের জায়গায় স্থির থাকে নিজের মতন করে। হাতঘড়িটার দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম কত রাত হয়েছে। কিন্তু ঝাপসা চোখে সেটাও বুঝতে পারলাম না। কড় কড় শব্দ করে আকাশের বুক চিরে নেমে এলো এক বিদ্যুতের ঝলক। ক্লাবের গ্রাউন্ড ফ্লোর থেকে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম বাড়ি ফেরার জন্য। ফেরার পথে অনেক অন্য কথা ভাবার চেষ্টা করলাম কিন্তু মাথা থেকে তনিমার আবেগে ভেসে যাওয়া আর ঘৃণা ভরা দৃষ্টি কিছুতেই সরাতে পারলাম না। নেশার প্রভাব অনেকটা কমে গেলেও মাথার মধ্যে এক ভয়ঙ্কর যন্ত্রণা সারা শরীরকে অবশ করে দিচ্ছে। যন্ত্রণার প্রকোপ আরো প্রবল হচ্ছে যখনি তনিমার কথা মনে পড়ছে। কখন কিভাবে নিজের ফ্ল্যাটে এসেছি আর কিভাবে বিশ তলায় নিজের রুমে এসে বিছানা নিয়েছি তা আর কিছু মনে নেই।
জানলার বাইরে মুখ বাড়িয়ে তনিমার নাম ধরে আমি চিৎকার করে উঠলাম। প্রাণপণে দু-হাত নাড়িয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু এই অন্ধকারের মধ্যে আদৌ কি সে আমায় দেখতে পাবে? সঙ্গে সঙ্গে মাথায় এলো মোবাইলের আলো দেখলে হয়তো সে বুঝতে পারবে। ঝুঁকে পড়লাম টেবিলের উপর মোবাইলটা নেওয়ার জন্য। কিন্তু ততক্ষণে সেটা অফ হয়ে গেছে। হাতের সামনে কিছু না পেয়ে বাধ্য হয়ে আরো জোরে চিৎকার করতে লাগলাম। কিন্তু হঠাৎ মনে হল আমার চিৎকার আমি নিজেই শুনতে পাচ্ছি না। খুব অবাক লাগল নিজেকে। সন্দেহ হল নিজের উপর - তবে কি আমি স্বপ্ন দেখছি? কিন্তু না। স্বপ্নই যদি হবে তাহলে এমন জানলার সামনে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজে যেতাম না। জানলা থেকে শরীরের প্রায় অর্ধেকটা বের করে দু-হাত ছুঁড়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলাম। একটা সময় মনে হল সে যেন আমাকে দেখতে পেয়েছে। এক নির্মল হাসি ফুটে উঠেছে তার ঠোঁটে। এতো দূর থেকে হাসির স্পষ্ট অনুভূতি যেন নিজেই নিজের দিকে তাকিয়ে হাসলাম। তার ডান হাত কনুই থেকে উপরে উঠে এলো। আমার দিকে তাকিয়ে অল্প অল্প করে সে হাত নাড়াতে লাগল। মন্ত্র মুগ্ধের মতো আমার ডান হাতও উঠে এলো। আমিও তার দিকে হাত নাড়িয়ে সারা দিলাম। তারপর দু-হাত ছড়িয়ে বৃষ্টিকে বুকে নিয়ে সে মাথা তুলে আকাশের দিকে তাকাল। একটা জোরালো বিদ্যুতের ঝলক কালো মেঘের বুক চিরে আকাশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছড়িয়ে ক্ষণিকের জন্য সমস্ত অন্ধকারকে দূর করে দিল। সেই তীব্র চোখ ধাঁধানো আলোর সামনে আমি চোখ বন্ধ করে নিলাম। চোখ খোলার আগেই ভেসে এলো এক কর্ণ বিদারী বজ্রপাতের শব্দ। কানে হাত চাপা দিয়ে আমি জানলার ধরে বসে পড়লাম। শব্দ থামতে উঠে দাঁড়িয়ে আর কিছুই দেখতে পেলাম না। ছাদের আলোটা আবার নিভে গেছে। আমার ঘরটা আবার নিকষ অন্ধকারে ডুবে গেছে। মনে মনে ভাবলাম - ছাদে যে ছিল সে কি তনিমা নাকি অন্য কেউ? কেন এসেছিল ছাদে কোথায় গেল? কিছু অমীমাংসিত প্রশ্নের কোলাহলে মাথার যন্ত্রণাটা আবার ফিরে এলো। মাথায় হাত দিয়ে বুঝলাম মাথার পিছনের দিকটায় খুব ব্যথা। কোথাও হয়তো খুব জোরে ধাক্কা খেয়েছি বা মেঝেতে পরে যাওয়ার সময় হয়তো লেগেছে। অন্ধকারের মাঝে মাথা ধরে কোনও রকমে বিছানায় এসে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই জানালার বাইরে চোখ গেল। বৃষ্টি থেমে গেছে কিন্তু মেঘলা হয়ে আছে। রাতের ঘটনাটা মনে পড়তেই রুম থেকে বেরিয়ে সামনের ফ্ল্যাটে যাওয়ার জন্য দৌড় দিলাম। রাস্তাঘাটে লোকজন বিশেষ নেই। সারারাত তনিমার কোনও খবর নেই তাই তাড়াতাড়ি করে একটা বুথ দেখে তনিমার নম্বরে ফোন করল। রিং হয়ে কেটে গেল কিন্তু কেউ ফোন তুললো না। রাতের ঘটনা মনের মধ্যে যেন একটু একটু করে সত্যি হতে লাগল। তাড়াতাড়ি রাস্তা পেরিয়ে সামনের ফ্ল্যাটে এসে কোনও কোলাহল বা মানুষের জটলা না দেখে খুব আস্বস্থ হলাম। তাহলে তনিমার কিছু হয় নি। বাড়ি ফিরতে ফিরতে বিষয়টা নিয়ে ভাবতে ভাবতে মনে হল - তনিমার এই বিল্ডিংয়ে আসার কোনও কারণ থাকতে পারে না। তাহলে কাল রাতে যাকে ছাদের উপর দেখেছি সেটা পুরোটাই কি একটা ভ্রম? আকাশ-পাতাল ভাবতে ভাবতে নিজের বিলিডংয়ের সামনে আসতেই একটা ছোট্ট জটলা চোখে পড়ল। বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় এই দিকটা লক্ষ্য করিনি। আমি এগিয়ে গেলাম সেই দিকে। এক অজানা আতঙ্ক আমায় ঘিরে ধরল। বৃষ্টি ভেজা শহরের স্যাঁতসেঁতে গন্ধে মাথার ব্যথাটা আবার জেগে উঠল। যত এগিয়ে গেলাম সেই ভিড়ের দিকে মাথার যন্ত্রণা যেন তত বেশি তীব্র হতে লাগল। দু-হাত দিয়ে নিজের মাথাটা চেপে ধরে সেদিকে এগিয়ে গেলাম। কিছু লোক সেইদিক থেকে সরে আসছে আবার কিছু লোক সেখানে জড়ো হচ্ছে। কিন্তু কেউ আমায় লক্ষ্যও করছে না। দু-একজনের চোখের দিকে সরাসরি তাকানোর পর তাদের মুখের ভাব দেখে মনে হল তারা যেন কেউ আমায় দেখতেই পাচ্ছে না। আমি এগিয়ে গেলাম আরো একটু। কিছু শুনে বোঝার চেষ্টা করলাম কিন্তু কিছুই শুনতে পেলাম না। এতোগুলো লোক জড়ো হয়েছে অথচ সবাই নীরব- এটাও কি সম্ভব? আমি সাহস ভরে ভিড় ঠেলে একেবারে সামনে এসে দাঁড়ালাম। নীল জিন্স আর সাদা শার্ট পড়া এক মানুষের সেখানে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে আর প্রচন্ড আঘাতে তার মাথার পিছনের দিক থেঁতলে গিয়ে একটা রক্তের ধারা বৃষ্টির জলের সাথে মিশে অনেকটা দূর পর্যন্ত লাল দাগ কেটে গেছে। লোকটার মুখের উপর চোখ পড়তেই আমি আঁতকে উঠে দু-পা পিছিয়ে এলাম। শুয়ে থাকা মানুষটা আর কেউ নয় আমি নিজে। মাথার ভিতরের যন্ত্রণাটা ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। কিছু ভাবার আগেই সামনের জানলার কাঁচে নিজের প্রতিচ্ছবির দিকে তাকাতে দেখতে পেলাম আমার প্রতিচ্ছবি কাল রাতের মতো আমার দিকে তাকিয়ে ডান হাত নাড়াচ্ছে সাথে তার ঠোঁটে লেগে আছে এক অপার্থিব শান্তির নির্মল হাসি।
গল্প
ইসমাইল
অপর্ণা চক্রবর্তী
টালিগঞ্জ, কলকাতা
সেই ছোট থেকে রিকশা চালায় ইসমাইল। তখন তার বার কি তের বছর বয়স। মধ্যবয়সে এসেও- সে রিকশাওয়ালা। এক বগ্গা ঘোড়ার মতো তেজী ইসমাইলের রিকশা। চেন-চাকা-প্যাডেল-সিট সব কিছু ঝকঝক করছে। একঘেঁয়ে প্যাকপ্যাক হর্নটাও একটা বিশেষ তালে বাজায় সে। রিকশাটা তার নিজের নয়। মালিককে রোজ রিকশা বাবদ পঞ্চাশ টাকা ভাড়া গুনতে হয়।
রোজ সকালে আজান সেরে, রিকশা নিয়ে স্ট্যান্ডে আসে ইসমাইল। সিটের পিছনে অ্যালুমিনিয়াম পাতের ওপর ফুলকারি নকশায় নাম লেখা "চেতক"। তেল ঘষা স্টিলের চাকায় সকালের আলো পড়ে, চকচক করে ওঠে।
জুতো বিহীন চওড়া পা- প্যাডেলে চাপ ফেললেই, চেতকের শরীরে প্রাণ সঞ্চার হয়। চালকের আসন থেকে ইসমাইলের কোমর উঠে যায়। ডান পা- বাঁ-পায়ের অবিরত ঘূর্ণনে, চেতকের গতি ক্রমে বাড়তে থাকে।
বড় রাস্তায় - ব্রীজের ঢাল থেকে নামার সময় - দু'হাতে হাতল চেপে ধরে, প্যাডেলের ওপর দু'পায়ে সোজা দাঁড়িয়ে পড়ে ইসমাইল। তীরের বেগে ঢাল বেয়ে রিকশা আপনি নামতে থাকে। চেন -চাকা- টায়ারের অবিরত ঘর্ষণ পিচের রাস্তায়- খ্যাস্-খ্যাসে একটা যান্ত্রিক শব্দ তৈরী হয়। দ্রুত গতির জন্য - ইসমাইলের চুল হাওয়ায় উড়তে থাকে; তখন তাকে ঠিক চেতকের পিঠে সওয়ার রাণা প্রতাপের মতোই মনে হয়।
এই সময়- পিছনে সিটে বসে, তার আব্বুকে অবাক হয়ে দেখে মোমিনা। গতির সঙ্গে শরীরের ভারসাম্য রাখতে - প্রাণপণে নিজেকে চেপে বসিয়ে রাখে আসনে। ছাউনির শিকগুলো ছোট্টো হাতে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে। তবু একবারও বলে না ----- আব্বুউউউ আস্তে চলো।-----
পড়ন্ত বিকেলের হলুদ আলোয় আব্বুকে দেখতে বড় ভালো লাগে মোমিনার। তার আব্বুর তেলহীন - রুক্ষ - উড়ন্ত চুল দেখলে বুকের মধ্যে কিসের একটা অচেনা কষ্ট জমা হয়! ঠিক বুঝতে পারে না মেয়েটা, কেন এমন হয়!
ঈদের দিন বড় পীরের দরগায় নামাজ পড়া হয়ে গেলে, বাপ মেয়েতে বেরিয়ে পড়ে চেতক কে সঙ্গে নিয়ে। মসজিদের মাঠে আজ ঘুড়ির প্যাঁচে লড়াই হবে। দু'চোখে রোদ আড়াল করে, আকাশে উড়ন্ত লাল নীল হলুদ সবুজ গোলাপী রঙ দেখবে মেয়েটা। আর বাবা দেখবে তার মেয়ের মুখে পরীর হাসি। আজ, ইসমাইলের 'জন্নত' নেমে আসবে মসজিদের মাঠে। সেই কোন ছেলেবেলায় রুজি রোজগারের পথে নেমেছে ইসমাইল। যে বয়সে তার মাঠে ঘাটে ছুটে বেড়ানোর কথা, সেই বয়স থেকে সে রিকশা ছুটিয়েছে। ছোট ছোট আহ্লাদগুলো তুচ্ছ করে, উড়িয়ে দিয়েছে অনায়াসে। কিন্তু, ঘুড়ি আর ওড়ানো হয়নি কোনদিন। ইসমাইল ঘুড়ি ওড়াতে শেখেনি।
মোমিনার খুব ইচ্ছা হয়, তার আব্বুও বড় মসজিদের মাঠে সবার সাথে ঘুড়ি উড়াক। এবার ঈদে মেয়ের ইচ্ছা মত ঘুড়ি- লাইট - মাঞ্জা - সুতো সবকিছু কেনা হলো। সুতোয় বাঁধা ঘুড়ির দুই প্রান্ত ধরে, মাথার ওপর ঘষে চেত্তা দিল মোমিনা। তারপর হুশ করে যতটা সম্ভব উঁচুতে উড়িয়ে দিল ঘুড়িটাকে। অনধিকে ইসমাইল আপ্রাণ চেষ্টায় সুতোয় এলোমেলো টান দিচ্ছে। হাওয়ার সঙ্গে কিছুতেই ঘুড়ির তাল মেলাতে পারছে না। বারবার মাটিতে মুখ থুবড়ে গোত্তা খাচ্ছে ঘুড়ি। একবার - দুবার - আরও অনেকবারের প্রচেষ্টাতেও ঘুড়ি বাতাস কেটে আকাশে উড়ল না।
ব্যর্থ হয়ে, চল্লিশোর্ধ ইসমাইল শিশুর মতো অবোধ অসহায় হাসি হাসি মুখ করে, মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইল। আব্বুর এই অসহায় মুখ দেখলেই সেই অচেনা কষ্টটা আবার বুকের মধ্যে টের পায় মোমিনা। মনে হয় যেন - আব্বুকে সে অনেক দিন দেখতে পাবে না। আব্বু দূরে কোথাও চলে যাবে।
ঘুড়ি ওড়ানোর ব্যর্থ প্রচেষ্টার পর, মেয়ের দিকে তাকিয়ে ইসমাইল দেখল -- মা মরা মেয়েটা কেমন দু্ঃখী আনমনা হয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। তখন হঠাৎই - লাটাইটাকে দু'হাতে আঁকড়ে, মাথার ওপর তুলে বনবন দৌড়াতে লাগল সে। লাটাইয়ের সুতোয় বাঁধা ঘুড়িটা ফরফর করে উড়তে শুরু করল। হাওয়া কেটে কেটে সারা মাঠ দৌড়াচ্ছে ইসমাইল। ঘামে ভিজে- জামাটা লেপ্টে যাচ্ছে রোগা শরীরে, বুকের ভিতরে নিঃশ্বাসের হাপর পড়ছে। আর ঘুড়িটা যেন ওকে তাড়া করে করে উড়ছে মাথার পিছনে।
হঠাৎ, আব্বুর এমন কান্ড দেখে, অবাক হল মোমিনা। হাসিও পেল। আব্বু বুড়ো হয়ে যাবে, তবুও ঘুড়ি আর ওড়াতে শিখবে না!! নিজের থেকে আব্বুকে কমবয়সী লাগে মাঝে মাঝে। মা চলে যাবার পর, তাকে ভোলাতে, মাঝে মাঝেই এমনি সব কান্ড করে তার আব্বু। সব বোঝে সে। ছোট থেকেই মেয়েটা রুগ্ন। জ্বরটা কিছু দিন পর পর ঘুরে ফিরে আসে। মা মারা যাওয়ার পর মেয়েটাও আনমনা থাকে খুব। জ্বরের ঘোরে মাকে কাছে ডাকে। মা ভেবে কতবার আব্বুকেই ছোট্ট হাত দুটো দিয়ে জড়িয়ে ধরেছে!
জ্বরের তাপে মেয়ের মুখটা লাল হয়ে থাকে। বন্ধ চোখের পাতা দুটো কাঁপে। ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে, সাদা দাঁতগুলো অল্প দেখা যায়। মোমিনাকে বড় সুন্দর দেখতে লাগে এই সময়। ইসমাইল তাকিয়ে থাকে মেয়ের মুখের দিকে। ভয় লাগে আজকাল। জ্বর হলেই মেয়েটা এতো সুন্দর হয়ে যায় কেন! এই রূপ সে দেখতে চায়না। এই মুখ তার ভালো লাগে না। জ্বর ছাড়ার পর মেয়ের ওই শীর্ণ ক্লান্ত মুখটা দেখার জন্যই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে ইসমাইল।
জ্বরের সময় চোখের সামনে আম্মুর জংলা ছাপা শাড়ির আঁচল দেখতে পায় মোমিনা। একটানা
চুড়ির আওয়াজ ভেসে আসে কানে। আব্বুর ঘামে ভেজা মুখ, চেতকের সিটে বসা আবছা নিজেকেও দেখেছে অনেকবার। কিন্তু, কোন রাস্তা ধরে যে তার আব্বু তাকে সওয়ারি করে নিয়ে যায়, ঘোরের মধ্যে ঠিক চিনতে পারে না। আর একটা স্বপ্ন দেখে মোমিনা -- আব্বুর ঘুড়িটা উড়তে চাইছে। ছটফট করছে সুতো ছিঁড়ে ফেলার জন্য। কিন্তু আব্বু কিছুতেই সুতোয় ঢিলা দিচ্ছে না। আব্বু লাটাই বুকে চেপে দৌড়চ্ছে। লাটাই ছেড়ে দিলেই সব সুতো নিয়ে ঘুড়ি একা একা উড়ে যাবে এক্ষুনি।
সন্ধ্যার আজান সেরে এসে ঘরের আলোটা জ্বালিয়ে দিল ইসমাইল। হলদে বাল্বের ম্লান আলো ছড়িয়ে আছে তার দৈন্য সংসারে। তেলচিটে বিছানার একপাশে কুঁকড়ে শুয়ে আছে মেয়েটা। দু'দিন চোখ খোলে নি। এবারের জ্বরটা কিছুতেই ছাড়তে চাইছে না। মেয়ের শীর্ণ, দূর্বল চেহারার দিকে তাকাতে পারে না ইসমাইল। কোন ওষুধই ঠিক মতো কাজ করছে না। সদর হাসপাতালে ডাক্তার বাবুর ওষুধেও জ্বর নামছে না ঠিক মতো। মেয়ের গায়ে চাদর টা টেনে দিয়ে, মাথার কাছে বসল ইসমাইল। আজ সারারাত সে দোয়া পাঠ করবে, পরম করুনাময়ের এর কাছে।
বন্ধ চোখের সামনে হলদে সবুজ আলোর ফুলকি দেখতে পাচ্ছে মোমিনা। আব্বু ডাকছে তাকে। আব্বুর গলার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে সে -- একটানা দোয়া পাঠ শুনতে পাচ্ছে মৌমিনা।
------"লা ইলাহা ইল্লাল্লাহুল হালীমুল হাকীম, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু রাব্বুল আরশিল আজীম, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু রাব্বুস সামাওয়াতি ওয়াল আরদি- ওয়া রাব্বুল আরশিল কারীম।" ------ পরম করুণাময়ের স্তুতি করছে আব্বু।
হালকা হয়ে আসছে মোমিনার শরীর। শীত করছে খুব। দূরে থেকে ভেসে আসা ডানার ঝটফট্ শুনতে পাচ্ছে মোমিনা। বড় মসজিদের ওপর থেকে সব পায়রাগুলোকে একসাথে কেউ ফরফরিয়ে উড়িয়ে দিলো হয়তো। বন্ধ চোখের সামনে হলদে সবুজ আলোর ফুলকিও সরে সরে যাচ্ছে ক্রমশ। এখন শুধুই সাদা আলোয় ভরা আকাশ দেখছে সে। আর সেই আকাশে দূরে অনেক দূরে উড়ছে আব্বুর ঘুড়িটা। আজ খুব খুশি মোমিনা। একবার চিৎকার করে আব্বুকে জানাতে চাইল ---- আব্বু দেখেছ, ঘুড়িটা উড়ছে, অনেক উঁচুতে, আমি দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু, গলা বুঝে আসছে তার। আব্বুর গলার আওয়াজও দূরে চলে যাচ্ছে, ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে।
তার কানে তালা লেগে যাচ্ছে কেন! আর কোন কিছুই শোনা যাচ্ছে না কেন! একটানা পিঁ-পিঁ-পিঁ শব্দ কিসের! চোখ খুলতে চাইল মোমিনা। একবার আব্বুকে দেখতে চেষ্টা করল। আব্বু দূরে চলে যাচ্ছে। আর হয়তো দেখা হবে না কখনো।
ইসমাইলের দোয়া কবুল হয়নি। তিন চার দিনের একটানা জ্বরে, চলে গেল মোমিনা। যাবার সময়ও মেয়েটা একবার পরীর মতো হেসেছিল, তার আব্বুর জন্য।
কবরে শেষ মাটি দিয়ে, চেতকের সঙ্গে একা ফিরে এল ইসমাইল। সিটে মাথা রেখে পাদানীতেই ঘুমিয়ে পড়ল কখন। রোজের মতো ভোরের আজানেই ঘুম ভাঙল তার। চেতক কে সঙ্গে নিয়ে আবার স্ট্যান্ডের দিকে চলল সে।
জীবন তো আর থেমে থাকে না!
বেশ কিছুদিন হল -- কানাঘুষো শুনছিল ইসমাইল। রিকশা মালিক নাকি তার সব রিকশা, স্ট্যান্ড থেকে তুলে নেবে। বাজার চলতি নতুন দুটো ব্যাটারী টোটো কিনেছে মালিক।
লাভ-ক্ষতির পাটিগণিত ঠাসা মগজে হিসাব নিকাশ করে - রিকশা মালিক একদিন ইসমাইলকে জানিয়ে দিল -
---- "রিকশায় আর তেমন লাভ দেখছি না রে ইসমাইল। ঈদের পরে রিকশা জমা দিয়ে - তুই অন্য ভাড়া খুঁজে নিস।"
এ' অঞ্চলের রিকশা মালিকরা সবাই চেনে ইসমাইলকে। নতুন ভাড়া পেতে একদিনও সময় লাগবে না তার। কিন্তু, এতো দিনের সুখ দুঃখের সঙ্গী চেতককে আর কিছুদিন পরেই ছেড়ে দিতে হবে! তার মোমিনার বড় প্রিয় ছিল চেতক। মেয়ের স্মৃতি জড়িয়ে আছে চেতকের সিটে- চাকায়। মালিকের কাছে ওটা তো শুধুমাত্র একটা রিকশা। যা সারাদিনে মাত্র পঞ্চাশ টাকা রোজগার দেয়।
কবরের পাশে শুয়ে আছে ইসমাইল। চেতকও তিন পায়ে দাঁড়িয়ে আছে মোমিনার কবরের কাছেই। হয়তো শেষ বারের মতো। আজ খুশির ঈদ। কাল চেতককে রেখে আসতে হবে তার আসল মালিকের জিম্মায়।
একটা ভালো চাদর মেয়ের কবরের জন্য এনেছে ইসমাইল। কিছু ফুল, আর লাটাইয়ে বাঁধা লাল ঘুড়ি।
চিত হয়ে শুয়ে, আকাশ দেখছে ইসমাইল। বড় মসজিদের মাঠে ঘুড়ি উড়ছে; আলোময় আকাশ জুড়ে - লাল নীল সবুজ পেটকাটি চাঁদিয়ালের মেলা। একভাবে অপলক সেই দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে, চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে তার। তবু পলক পড়ছে না। বুক ছেঁচা জল চোখের ধার বেয়ে - কানের পাশ হয়ে- গড়িয়ে পড়ছে কবরের পাশে মাটিতে।
ছোটবেলার মতো এখনো তাকে হাতছানি দেয় উড়ন্ত ঘুড়ির ঝাঁক। ওই আকাশেই মিশে আছে তার মোমিনার শেষ ইচ্ছা। মেয়ের ইচ্ছা পূরণ করতে পারেনি ইসমাইল। আকাশের কোণে বিন্দু হয়ে কখনো ওড়েনি তার ঘুড়ি। লাটাইয়ের সুতোয় ঘুড়িটাকে বেঁধে নিয়ে, ফুল ছড়ানো মেয়ের কবরের চারপাশে -আজ আবার বনবন দৌড়াচ্ছে ইসমাইল।
গল্প
একটি
পাখির প্রেম
সন্দীপ চ্যাটার্জী
ধরত্রিগ্রাম, বর্ধ্মান
আজ হঠাৎ ইচ্ছা হল তোকে কিছু বলতে, শুনবি? শুনবি আমার কথা?
আমি? কে আমি?
আমি হলাম একটি পাখি, কোন দেশের তা জানি না। কিন্তু আমি উড়ে এসেছিলাম তোর দেশে, তোর শহরে, তোর পাড়ায়। ওই যে সেদিন দুপুরবেলায় বসেছিলাম তোর জানালায়, তুই আমায় দেখে হেসেছিলি, ভালবেসেছিলি আমায়। আমি যে ঠিক কখন তোকে ভালবেসেছিলাম তা বলতে পারব না।
কিন্তু....কিন্তু যখন আমার খুব খিদে পেলো আমি খিদের জালায় জোরে জোরে ডাকছিলাম, তখন তুই আমার দিকে সেই রুটির টুকরোটা ছুঁড়েছিলি। তোর ভাষা তো আমি জানি না, তাই তোকে আমি বলতে পারি নি, খাবার চাইতে পারি নি তোর কাছে। কিন্তু তবু তুই কেমন আমার মনের চাওয়াটা বুঝেছিলি। ঠিক তক্ষনি আমি তোকে আমার মনটা দিয়ে দিয়েছিলাম.... তোকে বড্ড ভাল লেগেছিল আমার। কিন্তু কিভাবে তোকে বলবো বুঝতে পারিনি, আর তাইতো তাইতো আমি তোর হাতে ঠক্কর মেরেছিলাম। তোর খুব ব্যাথা লেগেছিল না রে? অভিমান হয়েছিল আমার ওপর? তাই তুই আমায় ওভাবে সেদিন তাড়িয়ে দিয়েছিলি তোর জানালা থেকে? জানিস আমি কিন্তু একটুও কষ্ট হয়নি সেদিন। তোর বকুনিটা আমায় তোর প্রতি আমার ভালোবাসার গভীরতা বোঝাতে সাহায্য করেছিল। যখন তুই আমায় তাড়িয়ে দিলি তখন বুঝেছিলাম তোকে ছেড়ে যাবার ব্যাথাটা। জানিস তারপর থেকে রোজ তোর জানালায় আসি, তোকে দুর থেকে দেখি, খুব ভাল লাগে তোকে দেখতে।
তুই হয়তো আর আমায় লক্ষ্য করিস না, আমি কিন্তু রোজ তোর জন্য একটা গোলাপ পাতা তোর জানালায় রেখে আসি। তুই দেখিস রে? দেখিস না?
হয়তো তুই দেখার আগেই বাতাস তোকে দেওয়া আমার সেই উপহারটি উড়িয়ে দেয়। আমি কিন্তু কোনোদিন তাই ভেবে তোকে গোলাপ পাতা দিতে ভুলি না। আমি জানি বাতাস-ও একদিন আমার ভালোবাসার কাছে হেরে যাবে, সেদিন আমার উপহারটি ঠিক তোর কাছে পৌঁছবে।
আচ্ছা তোকে সেদিন অত মানুষ মিলে কোথায় নিয়ে যাচ্ছিলো রে? তুই ঘুমাচ্ছিলি, তোর খাটটা কি সুন্দর ফুল দিয়ে সাজানো ছিল। তোকে কি সুন্দর লাগছিলো। সেদিনও আমার বড্ড খিদে পেয়েছিল, তুই বুঝতে পেরেছিলি না রে? তাই তুই সবাইকে বলেছিলি আমায় খেতে দিতে? সবাই রাস্তায় খই ছড়িয়ে দিল, আর ওই খই খেতে গিয়েই তোর দিকে তাকাতে পারিনি কিছুক্ষণ। সেই ফাঁকেই সবাই তোকে কোথায় একটা নিয়ে চলে গেল। আর তো দেখতে পেলাম না।
জানিস আজও আমি তোর জানালায় আসি। কিন্তু সেদিনের পর থেকে আর তো তোকে ঘরে দেখি না। আজ দুটি বসন্ত পার হয়েছে, তোর কথা খুব মনে পড়ে। তুই কোথায় রে? তোকে আর আমি দেখিনা কেন? তুই কি আমার ওপর রাগ করেছিস তাই আমায় দেখা দিচ্ছিস না?
কি জানি তুই কোথায়।
জানিস আজ আমার খুব ইচ্ছা হয় একটিবারের জন্য যদি মানুষ হতাম কত ভালো হত, মানুষের মতো কথা বলতে পারতাম। দেখতিস কাউকে সুধীয়ে ঠিক পৌঁছে যেতাম তোর নতুন জানালায়।
প্রবন্ধ
রবীন্দ্রানুরাগী
রামচন্দ্রন
দিলীপ মজুমদার
পর্নশ্রী, বেহালা, কলকাতা
আজ থেকে একশো বছর আগে দক্ষিণ ভারত থেকে একটি তরুণ এসেছিলেন শান্তিনিকেতনে। রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনো করতে। সেই তরুণটির নাম গি রামচন্দ্রন। কেরলের পেরুমাথান্নিতে ১৯০৪ সালে তাঁর জন্ম। এই তরুণটির জীবনের ধ্রুবতারা হলেন এ দেশের দুই মনীষী - রবীন্দ্রনাথ আর গান্ধীজি।
১৯২০ সালে রবীন্দ্রনাথ ত্রিবান্দ্রমে গিয়েছিলেন। সঙ্গে ছিলেন ভারতবন্ধু সি এফ এন্ড্রুজ রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে রামচন্দ্রনের পরোক্ষ পরিচয় হয়েছিল সেন্ট জোশেপ স্কুলে। সে স্কুলের প্রধান শিক্ষক কুলন্দি স্বামী ছিলেন রবীন্দ্রভক্ত। তাঁর কাছেই রামচন্দ্রন শোনেন রবীন্দ্রনাথের কবিতা। সেসব কবিতা শুনে তাঁর ‘হৃদয় আজি মোর কেমনে গেল খুলি’। এন্ড্রূজের সঙ্গে পরিচয় ছিল রামচন্দ্রনের। এন্ড্রুজ রামচন্দ্রকে পরিচয় করিয়ে দিলেন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে। জানালেন রামচন্দ্র পড়তে চায় বিশ্বভারতীতে। এত দূরে গিয়ে পড়াশুনোর ব্যাপারে তাঁর বাবার মত ছিল না। কিন্তু নাছোড়বান্দা রামচন্দ্রন। শেষপর্যন্ত রাজি হতে হল বাবাকে। দাদা রঘুবীরনকে সঙ্গে নিয়ে রামচন্দ্রন ১৯২০ সালের ডিসেম্বর মাসের এক শীতের সকালে হাজির হলেন শান্তিনিকেতনে।
বৃক্ষলতায় ঘেরা শান্তিনিকেতন তাঁর হৃদয়হরণ করে নিল কয়েকদিনের মধ্যে। দেখলেন সুন্দর এক ছন্দে বাঁধা এখানকার আশ্রমজীবন। ভোর সকালে উঠে পড়তে হয় ছাত্রদের। সূর্য ওঠার আগে। তারপরে গান গাইতে গাইতে প্রভাত ফেরি। রবীন্দ্রনাথের লেখা প্রকৃতি বন্দনামূলক গান। তারপরে প্রার্থনা। সে প্রার্থনা গীতি রবীন্দ্রনাথেরই লেখা। জাতি-ধর্ম-বর্ণের কোন স্পর্শ সে প্রার্থনা গীতিতে ছিল না। প্রাতঃরাশের পরে সকাল সাড়ে সাতটায় শুরু হত ক্লাশ। মাঝে কিছু সময়ের বিরতি। পরের ক্লাশ শুরু হত আড়াইটেতে। তার সময়সীমা ২ ঘন্টা। তারপরে খেলাধুলো। সন্ধ্যের সময় কোনদিন ছাত্রদের সভা, কোনদিন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। অলস বা নিশ্চল থাকতে পারে না ছাত্ররা। আবার এই শ্রম তাদের গায়েও লাগে না, কারণ এর মধ্যে একঘেয়েমি নেই।
আরও একটা জিনিস অভিভূত করল রামচন্দ্রনকে। শ্রীনিকেতনে তিনি দেখলেন অন্য এক দৃশ্য। আমাদের পল্লিজীবনের বাস্তবতার পাঠ নিলেন তিনি অধ্যাপক পিয়ার্সনের কাছে। দেখলেন পল্লি পুনর্গঠনের কাজ। পরবর্তী জীবনে এই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে তিনি তৈরি করেছিলেন ‘গান্ধী গ্রাম’। বুঝলেন কৃষিকে দিতে হবে প্রাথমিক গুরুত্ব। তারপরে নজর দিতে হবে পল্লির কুটিরশিল্পের দিকে। এভাবে পল্লির মানুষ হতে পারবে স্বাবলম্বী।
বিশ্বভারতীতে সাহিত্য, দর্শন, সমাজতত্ত্ব অধ্যয়নের সঙ্গে সঙ্গে সমাজসেবা তথা দেশসেবার পাঠ নিতে লাগলেন তিনি। বিশ্বভারতীর আদর্শ তাঁর তরুণ মনেকে প্লাবিত করছিল। সে আদর্শ যথার্থ মানবতার আদর্শ। সে আদর্শ মনের মুক্তি ও স্বাধীনতার আদর্শ। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন:
প্রথমে আমি শান্তিনিকেতনে বিদ্যালয় স্থাপন করে এই উদ্দেশ্যে ছেলেদের এখানে এনেছিলুম যে, বিশ্বপ্রকৃতির উদার ক্ষেত্রে আমি এদের মুক্তি দেব। কিন্তু ক্রমশ আমার মনে হল যে, মানুষে মানুষে যে ভীষণ ব্যবধান আছে তাকে অপসারিত করে মানুষকে সর্বমানবের বিরাট লোকে মুক্তি দিতে হবে। আমার বিদ্যালয়ের পরিণতির ইতিহাসের সঙ্গে সেই আন্তরিক আকাঙ্ক্ষাটি অভিব্যক্ত হয়েছিল। কারণ বিশ্বভারতী নামে যে প্রতিষ্ঠান তা এই আহ্বান নিয়ে স্থাপিত হয়েছিল যে, মানুষ শুধু প্রকৃতির ক্ষেত্রে নয়, কিন্তু মানুষের মধ্যে মুক্তি দিতে হবে। রামচন্দ্রনের মনে গুনগুন করে বাজে রবীন্দ্রনাথের কত কবিতার পঙক্তি। যে সব কবিতায় কবি মানুষের মনের মুক্তির কথা বলেছেন। আবিষ্টচিত্তে রামচন্দ্রন আবৃত্তি করতে থাকেন: চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির/জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর/আপন প্রাঙ্গনতলে দিবসশর্বরী/বসুধারে রাখে নাই খণ্ড ক্ষুদ্র করি/যেথা বাক্য হৃদয়ের উৎসমুখ হতে/উচ্ছ্বসিয়া উঠে............. রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে গান্ধীজিরও গভীর প্রভাব পড়ছিল রামচন্দ্রনের মনে। তিনি লক্ষ্য করছিলেন রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধীজি পরস্পরকে শ্রদ্ধা করেন, কিন্তু নানা ক্ষেত্রে তাঁদের মতের মিল ছিল না। শান্তিনিকেতনে এইরকম এক বিতর্কের সূত্রপাত
হল। রামচন্দ্রন তার প্রত্যক্ষদর্শী। তখন শুরু হয়েছে অসহযোগ আন্দোলন। রবীন্দ্রনাথ ‘মডার্ন রিভিউ’ কাগজে সে আন্দোলনের সমালোচনা করছেন। সমালোচনা করছেন চরকা নিয়ে। শান্তিনিকেতনের একদল ছাত্র তখন সে সব আন্দোলনে মেতে উঠেছে। রামচন্দ্রনও তাদের একজন। তিনি তখন ছাত্র সংগঠনের সম্পাদক। রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধীর মতামত নিয়ে তিনি আয়োজন করলেন এক বিতর্কসভার। সে সভার বিষয়: ‘In this controversy in regard to the immediate tasks to be accomplished in India Mahatma Gandhi’s programme is the only right programme’. বিতর্কসভায় রামচন্দ্রন জোরালো ভাষায় খন্ডন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের মত।
খবরটা রবীন্দ্রনাথের কানে গেল। তিনি ডেকে পাঠালেন রামচন্দ্রনকে। ডাক পেয়ে রামচন্দ্রন একটু দ্বিধাগ্রস্ত ও ভীত হলেন। গুরুদেবের প্রতিষ্ঠানের ছাত্র তিনি, অথচ সেই গুরুদেবের মতামতের বিরুদ্ধতা করছেন তিনি। কি বলবেন গুরুদেব? বিতর্কসভার পরের দিনই রামচন্দ্রন গেলেন রবীন্দ্রনাথের কাছে। মৃদু হেসে তাঁকে অভ্যর্থনা করলেন রবীন্দ্রনাথ। অবাক রামচন্দ্রন। ক্রোধ বা বিরক্তির চিহ্নমাত্র নেই গুরুদেবের মুখে। বললেন, ‘কালকের বিতর্কসভার কথা শুনেছি। তোমরা যে সাহসের সঙ্গে নিজের মতামত প্রকাশ করেছ সেজন্য আমি আনন্দিত।’ হতবাক রামচন্দ্রন। এতটা ভাবেন নি তিনি। গুরুদেব আরও বললেন, ‘তোমরা কি আরও একটা সভার আয়োজন করতে পারবে? সেখানে আমি আমার কথা আরও একটু খোলসা করে বলতে পারব তোমাদের কাছে?’
আর একটা সভার আয়োজন করার অনুমতি চাইছেন গুরুদেব? অনুমতি চাইছেন ছাত্রের কাছে? এ যে অভাবিত। তার পরের দিন একটা সভার আয়োজন করা হল। রবীন্দ্রনাথ বললেন তাঁর নিজের জীবনের কথা। বললেল কেন তিনি এ ধরনের আশ্রম বিদ্যালয়ের কথা ভাবলেন। ছোটবেলায় স্কুলকে তাঁর জেলখানা মনে হত। শিক্ষার্থীর কোন স্বাধীনতা ছিল না। তার উপর বড়রা বোঝা চাপিয়ে দিতেন। এটা শিক্ষার্থীর আত্মবিকাশের পক্ষে এক প্রবল বাধা।
শিক্ষার্থীর সেই আত্মবিকাশ ও মনের স্বাধীনতার কথা ভেবেই তিনি শান্তিনিকেতনে এরকম বিদ্যালয়ের কথা ভেবেছিলেন। তিনি বললেন গান্ধীজির প্রতি তাঁর নিগূঢ় শ্রদ্ধা আছে, কিন্তু তাঁর কোন কোন মত তিনি মেনে নিতে পারেন নি। তিনি চান আসমুদ্রহিমাচলের মানুষ গান্ধীজিকে অনুসরণ করুক নিজের নিজের বিচারবুদ্ধি দিয়ে, কিন্তু তা যেন কখনও অন্ধ অনুসরণ না হয়। অন্ধ অনুসরণে আত্মার স্বাধীনতা পরাজিত হয়।
রবীন্দ্রনাথের এই কথাগুলি মনে গেঁথে গিয়েছিল রামচন্দ্রনের। শ্রদ্ধাবোধ অক্ষুণ্ণ রেখেও কিভাবে ভিন্নমত প্রকাশ করা যায় সে শিক্ষা তিনি রবীন্দ্রনাথের কাছেই লাভ করেছিলেন। গান্ধী গ্রামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের সময় এ শিক্ষাকে কাজে লাগিয়েছিলেন তিনি। চিত্তকে ভয়শূন্য রেখে, শিরকে উন্নত করেই রামচন্দ্রন পরাধীন ভারতবর্ষের ইংরেজ শাসকের সমালোচনা করতে পেরেছিলেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে।
কস্তুরবা গান্ধীর মৃত্যুর জন্য ব্রিটিশ প্রশাসনকে দায়ী করে তিনি ভাইসরয় লর্ড ওয়েভেলকে বলতে পেরেছিলেন: ‘An Empire afraid of Kasturaba Gandhi was a doomed Empire‘. স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল গান্ধী গ্রামে এলে রামচন্দ্রন পুলিশ বা নিরাপত্তারক্ষীদের প্রতিষ্ঠানের ভেতর প্রবেশ করতে দেন নি। চিন-ভারত সীমান্ত সংঘর্ষের পরে এন সি সি বাধ্যতামূলক করা হয় কিন্তু রামচন্দ্রনের প্রতিষ্ঠানে সে নিয়ম লাগু করা যায় নি।
আত্মার স্বাধীনতার পাঠ তিনি যেমন নিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের কাছে, তেমনি নিয়েছিলেন আন্তর্জাতিকটার শিক্ষা। বুঝেছিলেন ‘জাতিপ্রেম নাম ধরি প্রচণ্ড অন্যায়/ধর্মেরে ভাসাতে চাহে বলের বন্যায়’। রবীন্দ্রনাথের মতো নিখিল মানবের ধ্যান ছিল তাঁর হৃদয়ে। মন্ত্রের মতো হৃদয়ে গুনগুন করত রবীন্দ্রনাথের বাণী: ‘ও আমার দেশের মাটি তোমার পায়ে ঠেকাই মাথা/তোমাতে বিশ্ব মায়ের আঁচল পাতা’।
প্রবন্ধ
ঐতিহ্যের ঠিকানাঃ
নদীয়ার শান্তিপুর
শুভদীপ রায়চৌধুরী
"বন্দে তং শ্রীমদদ্বৈতাচার্য্যমদ্ভুতচেষ্টিতম্।
যস্য প্রসাদাদজ্ঞোহপি তৎস্বরূপং নিরূপয়েৎ।।"
(শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃত)
অর্থাৎ যাঁহার প্রাসাদে অতি অজ্ঞ ব্যক্তিও তাঁহার স্বরূপনিরূপণে সমর্থ হয়, সেই অদ্ভূত লীলাশালী শ্রীমৎ অদ্বৈতাচার্য্য প্রভুকে আমি বন্দনা করি। নদীয়া জেলার শান্তিপুর একটি অত্যন্ত সুপ্রাচীন ও ঐতিহ্যপূর্ণ স্থান, বিশেষত গঙ্গার তীরবর্তী জনপদ। মহাপুরুষ চৈতন্য মহাপ্রভুর শিক্ষাগুরু অদ্বৈত আচার্যের সাধনপীঠ নিকটবর্তী বাবলাগ্রামে।
"শ্রীলদ্বৈত গুরুং বন্দে হরিণাদ্বৈতমেব তং
প্রকাশিত পরম্ ব্রহ্ম যোহবতীর্ণ ক্ষিতৌ হরিং।।
অন্তঃকৃষ্ণ বহিগৌরং কৃষ্ণচৈতন্য সংজ্ঞ কং।
প্রেমাধিবং সচ্চিদানন্দং সর্ব্বশক্তাশ্রয়ং ভজে।।
শ্রীনিত্যানন্দরামহি দয়ালুম্ প্রেম দীপকং।
গদাধরঞ্চ শ্রীবাসং বন্দে রাধেশসেবিনং।।"
শ্রীঅদ্বৈত প্রকাশ গ্রন্থের প্রারম্ভে ঈশান নাগর লিখেছেন- কলিকাল ঘোর পাপচ্ছন্ন, জীবের দূর্দশা দেখে বৈষ্ণব চূড়ামণি শঙ্কর কলির জীবকে উদ্ধারের জন্য যোগমায়ার সঙ্গে পরামর্শ ক’রে কারণ সমুদ্রের তীরে উপনীত হন। সেখানে সাতাশ বছর তপস্যায় জগৎকর্ত্তা মহাবিষ্ণু পঞ্চাননকে দর্শন দিয়ে বলেন- "তুমি আর আমি অভেদ নই। তোমার এবং আমার আত্মা এক, দেহ ভিন্ন।" এই বলে মহাবিষ্ণু পঞ্চাননকে আলিঙ্গন করেন, ফলে দুই দেহ এক হয়ে যায়। এই দৃশ্য দর্শনের সৌভাগ্য যাঁদের হয়েছিল তারা অত্যাশ্চর্য হয়ে যায়। 'শুদ্ধ স্বর্ণ বর্ণ অঙ্গ উজ্জ্বল বরণ' ইহা দর্শন হয়। মহাবিষ্ণু তখন কৃষ্ণ কৃষ্ণ বলে হুঙ্কার ছাড়লেন, সঙ্গে সঙ্গে চমৎকার এক দৈববাণী হয়। "শোন মহাবিষ্ণু তুমি এই মূর্তিতে লাভার গর্ভে অবতীর্ণ হও।"
অদ্বৈতাচার্যের বংশেই জন্ম আরেক বৈষ্ণবসাধক বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী। তাঁরও স্মৃতি মন্দির রয়েছে এই শান্তিপুরে। এছাড়া তন্ত্রসিদ্ধ কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের বংশধর শান্তিপুরে দক্ষিণাকালীমূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন, যা আগমেশ্বরী নামে পরিচিত। এছাড়া বহু প্রাচীন ঐতিহ্যের নিদর্শনও রয়েছে এই অঞ্চলে। তাদের মধ্যে অন্যতম চাঁদুনীমায়ের প্রাচীন ইতিহাস, খাঁ বংশের ইতিহাস, শ্যামচাঁদ মন্দিরের ঐতিহ্য, জলেশ্বর শিবমন্দির, দক্ষিণাকালীর পঞ্চরত্ন মন্দির, প্রাচীন সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দির ইত্যাদি। সেই ইতিহাসের কিছু অংশই গবেষণায় উঠে এল বনেদীয়ানা পরিবারের সদস্যদের হাতে। আজ তাই আলোচনার অন্যতম উদ্দেশ্য। ভবিষ্যৎ-এ আরও প্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্যপূর্ণ তথ্য শান্তিপুর তথা বঙ্গের বহু স্থানের তুলে ধরা হবে।
"জ্ঞান নেত্রং সমাদায় উদ্ধরেদ্ বহ্নিবৎ পরম।
নিস্কলং নিশ্চলং শান্তং তদ্ ব্রহ্মাহ মিতি স্মৃতম।।"
জ্ঞাননেত্র অবলম্বন করে অগিড়বতুল্য পরমজ্যোতি নিয়ে, জ্যোতির্ময় সেই পরমব্রহ্মকে জানতে হবে। অমূল্য নিধির মত সযত্নে তাকে আহরণ করবে। যাঁরা বিদ্বান, তাঁরা সবসময় এই চিন্তাই করবে-"আমিই সেই নিষ্কল(কলাহীন), নিশ্চল(ধ্রুব), শান্ত (নির্বিকার মঙ্গলময়) ব্রহ্ম!"
শান্তিপুর পূণ্যতোয়া ভাগীরথীর তীরস্থ একটি নগর, বৈষ্ণব ও শাক্তের মিলনক্ষেত্র এবং শৈব ধারারও প্রাচীনত্ব দেখা যায় এই অঞ্চলে। শুরুতেই শ্রীশ্যামচাঁদ জীউ- প্রাচীন ইতিহাস।
শ্যামচাঁদ জীউঃ
শান্তিপুরের প্রাচীন মন্দিরের মধ্যে অন্যতম এই শ্যামচাঁদ মন্দির। এই মন্দিরের ইতিহাস বললেন শ্রী অলোক দাস(মন্দির পরিচালন কমিটির সদস্য) এবং শান্তিপুরে বিগ্রহবাড়ি সমন্বয় সমিতির পত্রিকা। অদ্বৈতপ্রভুর দ্বাদশ বছর বয়েসে যখন শান্তিপুরে আসে, সঙ্গে আসেন গোবিন্দ দাস। এই গোবিন্দদাস সহ অন্যান্য ভাইয়েরা অ