জুন ২০২২
লেখক ও লেখিকাবৃন্দ
প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা
কবিতা
পার্থ সরকার
ব্যস্ততার মধ্যরাত
ব্যস্ততার মধ্যরাত
গভীর নক্ষত্রস্বেদ শ্রমে
স্ফুট শব্দে মহাকাব্য পড়ে পেচক
যাযাবর ইচ্ছা উত্তরণের দোরগোড়ায়
সমাপতনে ভোর আসবে বলে
বুলবুলির ল্যাজ মধ্যরাতে
জবরদখল থাকবে না শশব্যস্ত রহস্যে
এই আশা সুনিশ্চিত।
ধূমপান নিষেধ মধ্যরাতে
পবিত্র জলোচ্ছ্বাস সারারাত
(লিখিত মদ্যপান নয়)
পবিত্র ধূম উদ্গীরণ সারারাত
(লিখিত দূষণ নয়)
বেছে নেয় সংবাদ নক্ষত্র পবিত্র উচ্চারণে
পুনশ্চ উদ্ভাসিত হবে বলে
যজ্ঞ মহাজাগতিক সারারাত
সারারাত কোন রোগ নয় মনুষ্যবাহিত
সারারাত ধূমপান নিষেধ
ধূমপান নিষেধ মধ্যরাতে।
অপ্রধান স্বাক্ষর, পাথরে সূচীকর্ম
মাঝামাঝি ফুলের মরশুম
ধুমধাম লৌকিক পর্ব
অলৌকিক সান্ত্বনায় পীতনদীতে দুর্বলতা
ঢেউ উঠছে সড়কে
সড়কে অবলুপ্ত ডাকপিয়ন
তবু কেউ কড়া নাড়ছে
অসুখী স্থবিরতা?
হয়তো হরিণ
হয়তো
সখেদে মুখ ফেরানো সুখী
হয়তো
অপ্রধান স্বাক্ষর
পাথরে সূচীকর্ম
ছিটকে পড়ে পাথরকুচির সম্মেলন
ফিরে আসে নামঞ্জুর ধোয়া তুলসীপাতা
জলসেচে হাত পুড়িয়ে বাড়ি ফিরে খোলা হাওয়া
কিংবা
‘আলাপ আলোচনায় বধিরতা বাড়ে’ শহুরে প্রবাদ।
কবিতা
শান্তাপ্রসাদ রায়
কলকাতা
শেষ ঘুমের আগে
আমার একটা রোবট চাই
সকাল বেলায় ঘুম ভাঙাবে,
অ্যালার্ম ক্লকে হবে না...
পায়ের শব্দ চাই রান্না ঘর, বিছানায়,
চুলে হাতের আঙ্গুল, অভ্যাস কথা বলার
সে হোক না একপেশে
আমার চাই
আমার একটা কথা বলা রোবট চাই
যে আমায় ঘুম পাড়াবে
শেষ ঘুমের আগে।
ধারাপাত
সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি
কাল যত ঘুড়ি ছিল আকাশে উধাও,
ব্যান্ডউইথ খাচ্ছে কচি কাঁচা
স্কুল ড্রেস এ সার্কাস আর বাবা মা পরীক্ষা দিয়ে ক্লান্ত
সন্ধ্যে বেলায় ছাদে উঠে স্পষ্ট গোঙানি শুনি
গলা টিপে ধরেছে ওদের,
এখন আর সুর শোনা যায় না
এখন আর কেউ নামতা পড়ে না।
কবিতা
গৌতম দাস
বাখারপুর, মেদিনীপুর
আমি পশ্চিমবঙ্গ মেদিনীপুর জেলার অন্তর্গত বাখারপুর গ্রামে অবস্থিত অখণ্ড শ্রী ক্রিয়া যোগ সাধন মন্দির সেবাশ্রম এর একজন সেবক। এই আশ্রমেই আমি থাকি। স্কুল জীবন থেকেই কবিতা লিখতাম। এখনো লিখি।
বাঁশিওয়ালা
শূন্য তোমার ওই দু চোখ, কালো মুখখানা
প্রাণের সুরে বাজাও বাঁশি, যায় সে ধ্বনি শোনা
মনের মাঝে তোমায় ধরি, ছেড়ে দেবো না।।
কোথায় পেলে এমন সুর, মনকে উদাস করে
ডানা মেলে যায় সে উড়ে, সুদূর তেপান্তরে।
যদি চায় আসতে ফিরে, করি তারে মানা,
মনের মাঝে তোমায় ধরি, ছেড়ে দেবো না।।
আশুথ গাছের ছায়াতলে বাজাও তোমার বাঁশি
কী অকরুণ মায়ার বাঁধন, বড্ড ভালোবাসি।
প্রথম শেষের আলাপ মাঝে, হয়তো দেখা হবে না
মনের মাঝে তোমায় ধরি, ছেড়ে দেবো না।।
সুরের মাঝে অসুর আমি, মন খুশিতে ভরে
ও বাঁশিওয়ালা! তোমারও কী মন খারাপ করে?
তোমার দেওয়া মন খারাপ, ভুলতে পারা যায় না
মনের মাঝে তোমায় ধরি, ছেড়ে দেবো না।।
থাকে সে জন আমার কাছে, আমার পাশাপাশি
প্রাণে মনে মিলন হলে, সেও বাজায় বাঁশি
ছয়ের ঘরে সুর তোলে সে, হয়ে আপনমনা
মনের মাঝে তোমায় ধরি, ছেড়ে দেবো না।।
তোমার মাঝেও দেখি তারে, সে জন কৃষ্ণ কালো
তার সুরেতেই তোমার বাঁশি, অন্ধেরে দেয় আলো।
দুয়ে মিলে এক হয়ে যায়, পাই যে কাঁচাসোনা
হৃদয় মাঝে তোমরা দুজন, ছেড়ে দেবো না।।
কবিতা
মৌ চক্রবর্তী
নব নবীনের নতুন রূপ
বোশেখ ভোরের আলো গায়ে
কেউ আলপনা
কেউ পুষ্পপত্র
কেউ হাতে হাতে মিলছে
কেউবা কবিতায়
কয়েকছত্র
দিনভর উৎসব মিষ্টিমুখ
মিষ্টান্ন মুখর
বাঙলার পয়লা বোশেখ
যে আছ যেখানে যত দূর
যে ছিল অথচ ছিল না
যে কঠিন যেখানেই যার ব্যথা
যে অসীম প্রভাত লেখে সন্ধ্যাগাঁথা
ছুঁয়ে দিক আজ ছুঁয়ে নিক দিবালোকে
প্রসন্ন আলো আলোময়
অমল
সহস্র টগর মাধবীলতায়
সাজুক জীবন দোঁহায়
নববর্ষের শোভাযাত্রা
কবিতা
সায়নী আচার্য্য
গ্রীষ্মের দুপুর
নদীর পাড়ে জলের কাছে,
নিজের মুখ জলে ভাসে
গাছের ছায়ায় শান্ত বাতাস,
পড়েই চলে দীর্ঘশ্বাস।
উঠতে গিয়ে পা পিছলোয়
মুখটা যেন বিকৃত হয়,
গল্প থেকে স্বল্প করে
গল্প টল্প অনেক করে।
নদীর জলে ডুব দিয়ে সে
মুখ তুলে খালি মিষ্টি হাসে,
গাছের ছায়ায় রোদের তাপে
শুকোয় জল গরম মাপে।
হেলতে দুলতে এগোয় তারা
হাসির রোল ওঠায় যারা,
বাড়ির দিকে এগোতেই যেন
গরম হাওয়া এগোয় কেন।
গরম হাওয়ায় বকা খাওয়া
বেড়েই চলে গরম হাওয়া,
দুপুর গ্রীষ্মে ভাতের স্পর্শে
খিদের জ্বালা বাড়ায় জোরসে।
ঘুমের গান গাইছে কারা
ঘুম পেয়েছে ঘুমিয়ে পড়া।
সকাল সন্ধ্যে শান্ত পরিবেশ
শান্ত পুরীতে প্রবেশ নিষেধ,
গল্পের গান ছন্দ মেলায়
সমাপ্তির সময় এসে চলে যায়।
কবিতা
শুকদেব দে
বাঁকুড়া, পঃ বাংলা
সাময়িক
শ্বাসরোধ করে মেরেছি প্রেমিকাকে—
এক ডালিভরা শিউলিফুল তার মুখ৷
টেনে টেনে দাহ করেছি অজান্তেই,
নদীর তীরে পাতা ছিল চাঁদ-বুক৷
অনেক ভাঁজে গুটিয়ে রেখেছি মেঘ৷
হিসেব রাখিনি ক' বার উঠেছে ঢেউ৷
কবে জ্বলেছিল শেষ কথা নিভে গেছে,
সে ধ্বনির এপারে সাক্ষী থাকেনি কেউ!
আমারও দেহ মমি ছাড়া কিছু নয়
স্তব্ধ জীবন, পিরামিড-কোনেই বাসা৷
উড়ে গেছে, তবু ঝরেছে পালক শুধু,
প্রেম তবে কী? ত্যাগেরই আজব নেশা?
কবিতা
মনোরঞ্জন দাস
সারসত্যে সম্পক্তlয়ন এই প্রত্যয়, এই মাধুকরি.
বেলা শেষে তাৎপর্যে কিছু প্রাপ্তি, পরম্পরায়ন --
পরিবেশে পথ থেকে পথ, বাড়ি বাড়ি এবং...
উপস্থাপনে স্থিতি, অতীব সংবাহন, এভাবেই।।
গল্প
মধ্য রাতের
অতিথি
চন্দন চ্যাটার্জি
এটা সবাই মানবেন চেয়ে যে লেখালিখি করার জন্য একটু নিরিবিলি জায়গা প্রয়োজন, সঙ্গে একটু অবকাশ এবং একটু আরামও জরুরী, তাহলেই মনের ভিতরের কথাগুলো কলমের মাধ্যমে কাগজে ফুটে উঠবে, আর সেটা পড়ে পাঠককুল সমৃদ্ধি ও পরিতিপ্ত হবেন ।
গল্প পড়া, গান শোনা যে কোনো জায়গায় হতে পারে, যেমন অফিস যাবার সময় গাড়িতে বসে মোবাইল বা ট্যাবলেটে বা প্রিন্টেড বই হাতে নিয়ে পড়া যায় বা কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শোনা যায়। কিন্তু এই গান, গল্প, কবিতা লিখতে গেলে অনেক ধৈর্য, অধ্যবসায়, জ্ঞান এবং সর্বোপরি চিন্তা করার শক্তি ও পরিবেশ অবশ্যই প্রয়োজন। সকালে বাস ঠেঙ্গিয়ে অফিসে গিয়ে, সারাদিন হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে, সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে এসে, স্ত্রীর সঙ্গে বাক্য যুদ্ধ ও শান্তি স্থাপনের মধ্যে দিয়ে যখন একটু নিরিবিলি ঘরের কোন পাওয়া যায়, তখন ঘুম ছাড়া মাথার মধ্যে আর কিছুই আসে না।
এইজন্যে সমীর মাঝেমধ্যে শহর ছেড়ে তার গ্রামের বাড়ি উত্তরবঙ্গ সেবক রোডে কাছে চালসা গ্রামে চলে যায়। সমীর দেবনাথ বর্ধমান হাই স্কুলের ইকোনমিক্স এর টিচার, থাকে স্কুলের কাছে একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে, গরমের ও পুজোর ছুটিতে দেশের বাড়ি যায়। যদিও সে ইকোনোমিক্সের টিচার তাহলেও সাহিত্যের প্রতি তার বেশ আকর্ষণ আছে। ছোটগল্প, প্রবন্ধ এইসব লেখালেখি করে তার লেখা দু-একটা গল্প স্থানীয় পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। সম্প্রতি হেমেন্দ্রকুমার রায়ের কিছু ভৌতিক গল্প পড়ে তার একটা ভূতের গল্প লেখার ইচ্ছা হয়। কোন বিষয়ে কিছু লিখতে হলে তার সম্বন্ধে একটু জ্ঞান থাকা প্রয়োজন, যেমন যদি কোন ব্যক্তি বিজ্ঞান বিষয়ক গল্প লিখতে চান তবে তাঁকে বিজ্ঞান সম্বন্ধে বিশদে জানতে হবে। যেমন তিনি যদি লেখেন জলের কেমিক্যাল কম্পাউন্ড এইচ টু এস ও ফোর (H2so4) তাহলে এসিডে জল নয়, জলে এসিড ঢালা হয়ে যাবে।
তাহলে পাঠকদের মনে হতে পারে ভৌতিক গল্প লিখার জন্য কি ভূতের সাক্ষাৎ পাওয়া দরকার, তা যদি করতে হয় তাহলে তো মুশকিল। কারণ ভূতের কোথায়, কবে, কখন, দর্শন হবে তা তো তার জানা নেই, এমন কি তার পরিচিত কেউ জানে বলে মনে হয় না। আর অন্য লোককে যে জিজ্ঞেস করবে তাহলে তাকে পাগল বলে ভাববে। অতএব কল্পনার আশ্রয় তাকে নিতে হবে। এবার দুর্গাপূজার ছুটির সময় বাড়ি গিয়ে সে দু-তিনটে ভূতের গল্প লিখবে স্থির করলো। মহাষষ্ঠীর দিন স্কুল করে রাত্তিরে উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেস ট্রেন ধরে পরের দিন সকালে বাড়ি পৌঁছায়। তার বাড়ি হল চালসা গ্রামে। এই গ্রামটা পরে মাল জংশন ও সেবক রোডের মধ্যে। ছবির মতো সুন্দর গ্রাম, একদিকে চা বাগান দূরদূরান্ত পর্যন্ত দেখা যায় সবুজ গাছ সার দিয়ে রয়েছে, অন্যদিকে তিস্তা নদী।
তিস্তা নদীর ওপারে জঙ্গল, ওয়াইল্ডলাইফ ফরেস্ট। এখানে অনেক কোম্পানির চা বাগান আছে, তার মধ্যে চালসা টি গার্ডেন বেশ বড়। এই চা বাগানের ধারে একটা মডার্ন কলোনি আছে ওখানে তার বাড়ি। বাবা, মা মারা গেছেন, এখন আছে শুধু দূর সম্পর্কের কাকা বাড়িতে থাকে ও দেখাশোনা করে। সমীরের এখনো বিয়ে হয়নি, তার স্কুলের ইতিহাস শিক্ষিকাকে বেশ পছন্দ কিন্তু মুখ ফুটে সে কথা বলতে পারে নি আজ পর্যন্ত। এহেন ব্যক্তি কিভাবে ভৌতিক গল্প লিখবেন তা কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়।
যাই হোক তাকে দেখেই তার কাকা বেশ খুশি, সমীরকে বলল “যা বাবু একটু বিশ্রাম করে চান করে নে আমি তোর জন্য ভালো তিস্তার তেলাপিয়া মাছ নিয়ে এসেছি বাজার থেকে, রান্না করবো“। ট্রেনে সমীরের ভালো ঘুম হয় না তাই তেলাপিয়ার ঝাল দিয়ে গরম গরম ভাত খেয়ে সমীর একটা লম্বা দিবানিদ্রা দিল। ঘুম থেকে যখন উঠল তখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে গেছে । তাদের পাড়ায় কোন দুর্গাপূজা হয় না, কিন্তু মাল বাজারে বড় পূজা হয় সেটা কালকে দেখতে যাবে ঠিক করল। পুজো আসলেই প্রকৃতিতে একটা আলাদা আমেজ আসে, সেটা সে ছোটবেলা থেকে দেখে আসছে। বর্ষা গড়িয়ে শরৎ আসে, তাই চারদিকে সবুজের সমারোহ, বনজঙ্গল এখন একটু বেশি ঘন ও সবুজ দেখায়, তিস্তা নদীতে এখন বেশ জল, সন্ধ্যের সময় একটা ফুলের গন্ধ বাতাসে ভাসে, অনেকটা এলাচের মত, সমীর এটার নাম দিয়েছে এলাচ ফুল এটা দুর্গাপুজোর সময় ফোটে। দূর থেকে ভেসে আসছে মাইকের গান, সবমিলিয়ে সত্যিই একটা উৎসবের আমেজ। সমীরের বাড়িটা কলোনির একদম শেষ প্রান্তে, এর পরেই চা বাগান শুরু, দোতলা বাড়ি, ওপর-নিচে দুটো করে ঘর। ওপরের ঘরে একটাতে সমীর থাকে খালি, অন্যটা খালি। নীচের ঘরে একটা রান্না ও খাওয়া-দাওয়া হয় অন্যটাতে কাকা থাকে।
দুইদিন বেশ কাটলো ঠাকুর দেখা, খাওয়া-দাওয়া, ঘোরাঘুরি এতেই চলে গেল, ভৌতিক গল্প লেখার কথা সে প্রায় ভুলেই বসেছে। আজ দশমী, মায়ের বিসর্জনের দিন। সকাল থেকেই আকাশটা কি রকম মুখ ভার করে আছে, বোধহয় মা চলে যাবে তাই ওর মন ভালো নেই। সন্ধ্যে হতে না হতেই কালো মেঘে চতুর্দিক ছেয়ে গেল এবং অল্প কিছুক্ষণ পরেই তুমুল বৃষ্টি ও তার সঙ্গে বজ্রপাত শুরু হলো। মনে হচ্ছে যেন মহাপ্রলয় আজকেই শুরু হবে। পাঁজিতে লেখা ছিল দেবী দুর্গার আগমন হাতিতে, গমন নৌকায়। কিন্তু মায়ের নৌকা চালাতে কতজন লাগবে তা বোঝা যাচ্ছে না। এই দুর্যোগে বাইরে কোথাও যাবার তো প্রশ্নই নেই, যদি কেউ ভুলে বাইরে গিয়ে থেকে থাকে তবে সেও ঘরের অভিমুখে তাড়াতাড়ি যাচ্ছে। একের দুর্যোগের রাত, তারপর ঘরে কোন কাজ নেই, তাই রাত ন'টার মধ্যে খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ল । এত সকাল-সকাল তার অভ্যাস নেই, তাই সে উসখুস করতে লাগলো, তারপর কখন ঘুমিয়ে পড়েছে তার খেয়াল নেই। রাত তখন কটা হবে কে জানে এমন সময় বাইরের দরজায় একটা আওয়াজ। সমীর ভাবল, কাকা এসেছে তাই জিজ্ঞাসা করল, “কে?“
বাইরে থেকে আওয়াজ আসলো, “মহাশয় আমি বিকাশ, দরজাটা একটু খুলবেন, খুব বিপদে পড়েছি তাই আশ্রয় চাইছি। চোর ডাকাত নই সে সম্বন্ধে নিশ্চিত হতে পারেন।”
আওয়াজ শুনে সমীর তাড়াতাড়ি নিচে দরজা খুলে দেখল এক বয়স্ক ব্যক্তি মাথায় ছাতা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন কিন্তু বৃষ্টি তোরে তিনি পুরো ভিজে গেছে। বৃষ্টি তখনও পরছে তাই সমীর বলল, “ তাড়াতাড়ি ভেতরে আসুন।“
ভদ্রলোক বাড়ির ভিতরে আসলে সমীর গেট বন্ধ করে তাকে উপরে নিয়ে আসলো। ভদ্রলোক একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, “মাফ করবেন, এত রাত্রে আপনাকে বিব্রত করার জন্য আমি সত্যিই খুব লজ্জিত, আসলে আমি যাচ্ছিলাম শিলিগুড়ি থেকে আলিপুরদুয়ার লোকাল ট্রেনে করে। চালসা স্টেশনে এসে বলল ট্রেন আর যাবে না, তিস্তা নদীর উপর রেললাইনে ফাটল দেখা দিয়েছে মেরামত করে তারপর যাবে। এখন ছুটির সময় তারপর এই দুর্যোগের রাত তাই কামরায় খুব কমই লোক ছিল, যারা ছিল তারাও আস্তে আস্তে সব নেবে চলে গেল। আমার বাড়ি আলিপুরদুয়ার কাছে, এখানে কোন আত্মীয়-পরিজন নেই, তাই আর কার কাছে যাবো আমিও ট্রেন থেকে নেবে হাঁটতে লাগলাম। এই চা বাগান ধরে হাঁটতে হাঁটতে আপনার বাড়িটা প্রথমে পরায় আমি আশ্রয় চাইলাম।“
সমীর বলল, ”ঠিক আছে কোনো অসুবিধে নেই আমার পাশের ঘর খালি আছে আপনি শুতে পারবেন। আপনার খাওয়া দাওয়া হয়েছে?” ভদ্রলোক বলল, “ব্যস্ত হবেন না আমি ট্রেনে খেয়েছি তাছাড়া আমার কাছে ফ্লাক্সে চা ও বিস্কুট আছে, আমার কোনো অসুবিধে হবে না“। সমীর বলল, “ঠিক আছে আপনি বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে নিন, আমি আমার একটা পাঞ্জাবী ও লুঙ্গি দিচ্ছি পরবেন”। ভদ্রলোক ফ্রেশ হয়ে এসে পাঞ্জাবি লুঙ্গি পরে বিছানায় বসলো। সমীর জিজ্ঞাসা করল, “আপনার নাম কি জানতে পারি“। ভদ্রলোক, “নিশ্চয়ই, আমার নাম বিকাশ রায়, আলিপুরদুয়ারে বাড়ি, ওখানে একটা দোকান আছে, শিলিগুড়ি পাইকারি বাজার থেকে মাল কিনে নিয়ে যে ওখানে বিক্রি করি“। কথা বলতে বলতেই ভদ্রলোক চায়ের ফ্লাক্সটি ব্যাগ থেকে বার করে সমীরকে এক কাপ চা অফার করলেন। তারপর দুইজনে দুকাপ চা নিয়ে বসল, মাঝেমধ্যে এ ওকে কিছু প্রশ্ন করে আবার ও একে কিছু প্রশ্ন করে, এইভাবে পাঁচ মিনিট যাওয়ার পর, কথায় কথায় সমীর ভৌতিক গল্প লেখা প্রসঙ্গ তুলল। বিকাশবাবু বললেন, ”সেটা তো ভালো কথা”। সমীর, ”ভালো তো বটে কিন্তু ভৌতিক গল্প কিভাবে শুরু করব সেটাই বুঝতে পারছি না”। বিকাশবাবু বললেন, “আপনার হাতে যদি খানিকটা সময় থাকে তাহলে আমার সত্যিকারের ভূত দেখার অভিজ্ঞতার কথা বলতে পারি। সমীর চিয়ারে আরেকটু নড়েচড়ে বসলো, বাইরে তখনোও ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পরছে, জানলার ওপরের পাল্লাটা খোলা আছে, তাই একটা ঠান্ডা হওয়ার ঘরে আসছে, বাইরে একটা ঝিঁঝিঁ পোকা এবং কোলা ব্যাঙের ঐক্যতান শোনা যাচ্ছে, এটাই হল ভূতের গল্প শোনার আসল পরিবেশ। সমীর মোবাইলেতে দেখল রাত্রি একটা কুড়ি মিনিট অর্থাৎ দশমী শেষ, একাদশী শুরু। বিকাশবাবু শুরু করলেন, ”আমার বাবা মারা যান খুব ছোটবেলায় কাজেই সংসারের হাল আমাকে ছোটবেলা থেকেই ধরতে হয়। মায়ের কাছে শুনেছিলাম আমাদের আদি বাড়ি ছিল হাসিমারায়, কি একটা কারণে বাবা ওখানকার সমস্ত পাঠ চুকিয়ে আলিপুরদুয়ার চলে যান। ওখানে একটা দোকান করেন, নিচে দোকান উপরে আমাদের থাকার ঘর ছিল। সব ঠিকই চলছিল, তারপর হঠাৎ বাবার মৃত্যু হওয়ায় আমি দোকানের দায়িত্ব নিলাম। ধীরে ধীরে আমার বয়স ও বুদ্ধি দুটোই বারতে লাগলো। তারপর আমি ঠিক করলাম এখানকার পাইকারি বাজার থেকে কিনে খুচরো বিক্রি করলে লাভ খুবই কম হয়, কিন্তু এই মালটাই যদি শিলিগুড়ি পাইকারি বাজার থেকে কেনা যায় তাহলে কিন্তু লাভ অনেক বেশি হবে, কারণ শিলিগুড়ি পাইকারি বাজারে দাম এখানকার পাইকারি বাজারের দামের থেকে অনেক কম। তাই প্রতি মাসে একদিন করে শিলিগুড়ি বাজার থেকে
মাল কিনে নিয়ে যেতাম এবং আমার দোকানে বিক্রি করতাম। আস্তে আস্তে এইভাবে ব্যবসাটাকে সাজাতে লাগলাম যেদিন আমি শিলিগুড়ি আসতাম সেদিন আমার মা অথবা স্ত্রী দোকানে বসত। সকালের গাড়িতে শিলিগুড়ি আসতাম আর মাল কিনে রাত্তিরে ফিরে যেতাম। যখন ব্যবসা আরো একটু বড় হল তখন আমি মাল ট্রান্সপোর্ট এর কাছে দিয়ে দিতাম, ওরা আলিপুরদুয়ারে আমাকে ডেলিভারি দিয়ে দিত।এইরকম একদিন শিলিগুড়ি থেকে সওদা করে শেষ ট্রেনে বাড়ি যাচ্ছি, ট্রেনটি যখন আলিপুরদুয়ারে পৌঁছল তখন বাজে রাত্রি সাড়ে বারোটা। আপনি এদিককার লোক কাজেই জানবেন এদিকে সিঙ্গেল লাইন, একটা ট্রেন যদি উল্টোদিক থেকে এসে যায় তাহলে তাকে সাইড দেবার জন্য অন্য ট্রেনকে স্টেশনে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। এইভাবে যেতে যেতেই আমার রাত্রি গভীর হয়ে যেত। এত রাত্তিরে রিক্সা থাকে না তাই আমি পায়ে হেঁটে যেতে লাগলাম। আমাদের বাড়ি স্টেশন থেকে নেবে প্রায় ১০-১২ মিনিটের হাঁটা পথ। গ্রামের মেঠো রাস্তা তারপর রাস্তায় আলো নেই। স্টেশন ছাড়িয়ে খানিকটা গেছি, এমন সময় মনে হলো কেউ আমার পিছু পিছু আসছে, এত রাত্তিরে কেউ কোথাও নেই তাই মনে একটু ভয় করতে লাগলো। মনে হল একটা ঘুঙরুর আওয়াজ আসছে। যেন সেটা আমার সঙ্গে সমান তালে পা ফেলে ফেলে যাচ্ছে। একবার আমি ইচ্ছে করে থেমে গেলাম দেখলাম আওয়াজটাও থেমে গেল। এবার আমার সত্যি ভয় হতে লাগল। খানিকবাদে দেখলাম চারদিকে একটা পচা গন্ধ ছাড়ছে মনে হল যেন মাংস পচে চারদিকে ছড়ানো রয়েছে। আমি যেখানটায় দাঁড়িয়ে ছিলাম তার হাত দশ বারো দূরে একটা শিমুল গাছ ছিল, ঠিক তার নীচে দপ করে একটা নীল রঙের আলো জ্বলে উঠেই নিভে গেল। তারপর একটা আপাদ-মস্তক সাদা কাপড় মুড়ি দেওয়া ছায়ামূর্তি লক্ষ্য করলাম। মূর্তিটা ছোট থেকে আস্তে আস্তে বড় হতে লাগলো, লম্বা হয়ে উপর দিকে উঠতে লাগল। সাদা কাপড়ের মধ্যে যেন দুটো জ্বলন্ত চোখ আমার দিকে তাকিয়ে আছে, তারপর তার দুটো হাত আমার দিকে প্রসারিত করতে লাগলো । অন্ধকার হলেও একটু বুঝতে পারলাম যে এটা হাত নয় কঙ্কাল, এমতাবস্থায় রাম নাম নেওয়া ছাড়া অন্য কোন উপায় আমার মাথায় এলো না। আমি পিছনের দিকে যে ফিরে আসব তার উপায় নেই কারণ সামনের দিক দিয়েই আমাকে বাড়ি যেতে হবে।
আমার হাতে সবসময় একটা ছাতা থাকতো, সেইটাই খুলে আমি ঢাল হিসাবে ব্যবহার করব ঠিক করছিলাম এমন সময় একটা স্ত্রী কণ্ঠ ভেসে আসল বিকু ভয় নেই আমি তোর কোন ক্ষতি করব না অপঘাতে মরেছি, গয়ায় পিণ্ডি দিয়ে আসবি আমার নামে, না হলে এ জ্বালা আমি সহ্য করতে পারছি না। আমার পাঁচ-পাঁচটা ছেলে কেউ আমায় ভাত দেয় না।
এতক্ষণে আমার সম্বিৎ ফিরে এল। আমাকে বিকু বলে ডাকত দেবুর মা। দেবু মানে দেবশংকর পন্ডিত, তারা পাঁচ ভাই রমাশংকর, উমাশঙ্কর, রবিশঙ্কর, উদয়শংকর। দেবু আমার সমবয়স্ক তার ভাইয়েরা সবাই বড় এবং প্রতিষ্ঠিত। আমাদের এলাকায় পন্ডিত পরিবারের খুব নাম, সবাই জানে, চেনে আমি অনেকবার তার বাড়িতে গেছি, তার মাকে আমি বড়মা বলে ডাকতাম। বড়মা আমাকে মাঝেমধ্যেই আচার, সিঙরা, নিমকি মোরব্বা ইত্যাদি দিতেন। স্কুলে পড়ার অনেকবার টিফিন করার জন্য আমাকে টাকা ও দিতেন। তিনি অসুস্থ ছিলেন সেটা শুনেছিলাম, কিন্তু অপঘাতে মারা গেছেন সেটা জানি না। জিজ্ঞাসা করলাম, “কবে মারা গেছ”?
উত্তর এলো কবে কি রে হতভাগা, এখনো আমার শরীরটা এই গাছের উপরে ঝুলছে। তুই এক কাজ কর, আমাদের বাড়িতে যা ওখানে গিয়ে সব কথা বল, তারপর ওরা যেন আমার শরীরটাকে নিচে নাবায়।
এই কথা বলার পর সাদা কাপড় জড়ানো ছায়ামূর্তি গায়েব হয়ে গেল। আমি উপরের দিকে তাকিয়ে দেখলাম একটা সাদা কাপড় জড়ানো কিছু তো ঝুলছে, কিন্তু কে বা কি তা পরিষ্কার হলো না। আমার ভয় পাচ্ছিল তাই আর নিজে রিস্ক নিলাম না। তাড়াতাড়ি পন্ডিতবাড়ির দিকে ছুটলাম। প্রথমে দেবুর কাছে গিয়ে সব কথা বললাম। সে বলল, ”আজ থেকে একমাস মা আমার বাড়ি থেকে উমাদা বাড়িতে গিয়ে থাকবে বলেছিল”।
আমি বললাম “চল তবে উমাদার বাড়িতে যাই”।
উমাদা চোখ রগড়াতে রগড়াতে দরজা খুলে বলল “এত রাতে কি ব্যাপার”।
দেবু তাকে সব কথা খুলে বলল। তারপর একে একে পাঁচ ভাই এবং পাড়ার আরো কয়েকজন মিলে আলো, লাঠি, শাবল, দড়ি ইত্যাদি নিয়ে সেই শিমুল গাছের নিচে আসলো । সেই সাদা মূর্তির মুখের উপর আলো পড়তেই আমি চমকে উঠলাম। গাছের একটা ডালে দড়ি বাধা আর বড়মা গলায় দড়ির আর অপর প্রান্তটা বাধা, তার দুই হাতের মুঠো খোলা এবং সোজা, চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে গেছে, জিবটা মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছে প্রায় বুক পর্যন্ত এবং তার থেকে রক্তের ফোঁটা ঝরছে। এই রকম বীভৎস দৃশ্য আমি আগে কক্ষনো দেখিনি। আমরা বড়মার শেষ পরিণতি যে এত ভয়ঙ্কর হবে এটা আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি। দু তিনজন মিলে আস্তে আস্তে বডিটাকে নিচে নাবাল।
তারপর পুলিশে খবর দিল, পুলিশ এসে বডিটা নিয়ে গেল পোস্টমর্টেম করার জন্য।
এর একদিন পরে পাঁচ ছেলে মিলে মাকে দাহ করল। জীবিত অবস্থায় যাকে দু মুঠো ভাতের জন্য ছেলেদের দ্বারে যেতে হত, মৃত্যুর পর অবশ্য পাঁচ ছেলে মিলে মায়ের শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান বেশ বড় করেছিল।
এই পর্যন্ত বলে বিকাশবাবু থামলেন। সমীর বলল, ”তাহলে এই ঘটনাটাকে লেখা যেতে পারে ? আপনি কি বলেন, হ্যাঁ আরেকটা কথা, আপনি আপনার বড়মার গয়ায় পিন্ডি দিয়েছিলেন”। ভদ্রলোক বললেন, “হ্যাঁ, এই ঘটনার মাসখানেকের মধ্যেই আমি গয়ায় গিয়ে উনার পারলৌকিক কর্ম সেরে আসি” ।
ঠিক আছে আপনি শুয়ে পড়ো কালকে আবার কথা হবে রাত অনেক হলো এই কথা বলে সমীর নিজের ঘরে চলে গেল। খাটে শুয়ে ভাবতে লাগল গল্পটা সত্যি কিনা জানিনা কিন্তু ভদ্রলোক বলেছেন বেশ গুছিয়ে এইটাকে যদি আরেকটু রং দিয়ে লেখা যায় তবে একটা সুন্দর ভৌতিক গল্প হতে পারে। এইসব কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ল ঠিক নেই। তখন সকাল ন'টা বাজে, কাকা ডাকছে, “সমীর বেলা হল চা খাবি তো“।
সমীর ধড়মড় করে উঠে বসল একটু পরেই তার মনে হলো পাশের ঘরে বিকাশবাবু আছেন । সে কাকাকে বলল, “কাকা তিন কাপ চা কর”।
কাকা, ”কেন তুই দু কাপ চা খাবি নাকি?“
সমীর ”আরে আমি নয় পাশের ঘরে এক ভদ্রলোক আছেন তার জন্য"।
“ভদ্রলোক, কোথা থেকে এল” কাকা একটু বিস্ময়ের সুরে জিজ্ঞাসা করল।
সমীর একটু বিরক্ত হয়ে “কাল রাতিরে এসেছেন সে অনেক কথা আমি তোমাকে পরে বলব ”।
কাকা বলল, ”পাশের ঘরে তো কেউ নেই তাহলে নিশ্চয়ই চোর এসেছিল, কিছু চুরি করে নিয়ে পালিয়েছে, বোধহয়”।
কাকার কথা শুনে সমীর কিছুটা আশ্চর্য হল, তারপর দুজনে মিলে সারাবাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজে নিশ্চিন্ত হল যে কোন জিনিস চুরি যায়নি সব জিনিসই নিজ নিজ স্থানে বিদ্যমান। এমনকি সেই ভদ্রলোককে পরার জন্য যে লুঙ্গি ও পাঞ্জাবি দিয়েছিল সেটা সমীর নিজেই পরে আছে।
সমীর জিজ্ঞাসা করল, ”কাকা তুমি যখন বাইরের দরজা খুলে ছিলে তখন তা ঠিকভাবে বন্ধ ছিল”।
কাকা বলল, ”হ্যাঁ সদর দরজা তো আমি তালা দিয়েছি রাত্রি এবং সকালে আমি খুলেছি। চাবি তো আমার ঘরে থাকে”।
সমীর ভাবল তাহলে সে স্বপ্ন দেখেছে বোধহয়। তাই এটাকে আস্তে আস্তে মন থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করতে লাগলো।
ঘন্টাখানেক পরে বাজারের থলি হাতে নিয়ে, সমীর কাকাকে বলল, ”কাকা আমি একটু বাজার থেকে ঘুরে আসি। স্টেশন রোডের বাজারে যাবো দেখি ওখানে তিস্তার মাছ পাওয়া যায় কিনা”।
স্টেশন রোডের বাজারটা লাইনের ওপারে। তাইলে তাকে রেল লাইন পার করে যেতে হবে। লাইনের ধারে এসে সমীর দেখল এক জায়গায় কয়েকজন লোক জমায়েত হয়েছে। কাছে গিয়ে দেখল সাদা চাদর দিয়ে ঢাকা আছে একটা বডি। একজনকে জিজ্ঞাসা করায় সে বলল কালকে এক ব্যক্তি লাইন পার হওয়ার সময় বিপরীত দিক থেকে আসা এক্সপ্রেস গাড়ি এসে তাকে কেটে দেয়। এক ব্যক্তির মৃতদেহের মুখের ওপরের সাদা চাদরটা সরালো। মৃত ব্যক্তি চেহারা দেখে সমীরের আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হবার উপক্রম, তার মাথা ঘুরে গেল, বাজারের ব্যাগ হাত থেকে পরে গেল আরে এ তো বিকাশবাবু। এক রেলের অফিসার দাঁড়িয়ে ছিল, সে সমীরের অবস্থা দেখে জিজ্ঞাসা করল আপনি একে চেনেন। সমীর কালকের রাত্রের সব ঘটনা বলল। এই ব্যক্তির পকেটে একটা শিলিগুড়ি টু আলিপুরদুয়ারের টিকিট পাওয়া যায়। অফিসার আলিপুরদুয়ার জংশনে যোগাযোগ করল এবং এখান থেকে বডি পাঠাবার ব্যবস্থা করল।
ঘরে এসে সমীর কাকাকে সব কথা খুলে বলল।
কাকা বলল, ”তুই ক’দিন থেকে যে ভূতের গল্প লিখতে চাইছিলি তাই স্বয়ং ভুতই তার অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে গেছে”।
বলাবাহুল্য এর পর সমীরের আর ভূতের গল্প লেখা হয়নি।
অন্য এক পথ
এক অজানা স্টেশন ছেড়ে যাচ্ছি আমি।
এ বোধহয় অন্য এক পথ।
তবু মনে হচ্ছে এ পথে হেঁটেছি আমি।
ওই দুই পাহাড় এর ধারে,
প্রকৃতির গন্ধ আমার চেনা।
এই বৃষ্টি আর উষ্ণতা আমার
শরীর ছুঁয়েছে বহুবার।
কবিতা
শ্রীকান্ত দাস
এই লাবণ্য চাওয়া পাওয়াকে বিদীর্ণ করেছিলও সেদিন।
হাড়হীম দেহে আগুন জ্বলেছিল
এমন এক পথের আঁকে বাঁকেই।
নিস্তব্ধতায় শুনেছিলাম ...
চেনা নিঃশ্বাস এর শব্দ।
আর মাটির সে গন্ধে সেদিনও
জুড়িয়েছিলাম প্রাণ।
ফিরতে পারবনা জানি সেই পথে,
অভিমানের বনে হারিয়েছে সে পথ।
তাই অজানা স্টেশন ছেড়ে যাচ্ছি আমি।
এ বোধহয় অন্য এক পথ।
কবিতা
সুকান্ত পাল
জিতপুর, মুর্শিদাবাদ
মরাচাঁদ
দিবসের শেষে
মরা চাঁদ হেসে
দিয়েছে জোছনা মেলে আকাশের গায়ে।
শীতল সমীর ঢেউ
হয়তো ফকির কেউ
দিবসের শেষ গান গায় বুঝি তমালের ছায়ে।
তবু অঞ্জনা
মন আনমনা
বাসনা ব্যাকুল হয় আঁধারের ঝিল্লির ডাকে
প্রদীপের বুক জ্বলে
সুরার পেয়ালা তলে
খুন হয় লাখো লাশ ভোর হয় দুহাতের ফাঁকে।
রাঙা বৌ
অ বাজায় ডুগডুগিটা ঢোলক বাজায়
আ গান ধরেছে ই-তে তাইরে নাইরে না।
ঈ আর উ ঊ ঘুঙুর বেঁধে পায়ে
কেমন মজার নৃত্য করে ঘুরে ডানে বাঁয়ে।
সুর ধরেছে ঋ ৯ সা রে গা মা পা
সারছে গলা এ ঐ আআ আআ আ।
তালে তালে হাতে তালি দেয় ও ঔ
চেয়ে দেখো পালকিতে ওই আসছে রাঙা বৌ।
কবিতা
সুব্রত মিত্র
মধ্য রাতের শেষে
ওরা সবাই চলে গেছে পড়ে আছি আমি একা
হবে কি? হবে কি আর বনলতা তোর সাথে দেখা?
চোরাবালির স্রোতের মতো-------
স্মৃতির কথা গুলো ভেঙে ভেঙে তলিয়ে যাচ্ছে যেন
তবু তোকে স্বপ্নে দেখি বলতো কেন?
চোখের কোণে জন্ম নেওয়া কালশিটে আবরণ
দিচ্ছে জানান বার্ধক্যের বাতাবরণ
যৌথ সমন্বয়ের বিগ্রহ চিত্ত ভেঙে গেছে কবে কোথায়
অদল বদল হয় ঋতুদের হাওয়া চক্র
এই জড়তার ভিড়ে তবু ভালোবাসা প্রাণ পায়,
শুভ প্রনয়ের ঝঞ্ঝা বিচলিত করে আজ তবু
যায় ডুবে ভাবনার সাগরে
ভিড়ের মাঝে যায় না মুছে বনলতা কভু,
একে একে চলে গেছে সবাই;
বয়ে গেছে জীবনের ঢের সময়
আগন্তুক পথের পথিক জেগে আছে মধ্যরাতের শূন্য গগনে
নিস্তব্ধ রাতের কোন আঁধারের আকাশে ভাসমান চাঁদ অতীন্দ্রিয় প্রহরায়,সজাগ ভোরের মিশ্রিত কোলাহলে মোহনায় ডুবে শেষ ফেরি ডাকছে আমায়।
আকুল প্রার্থনায় স্মৃতিতে মোড়া নীল খাম শোনায় তাহার নাম
এই ভোর ভোর নয়;
এ যে স্বপ্নের ঘোর,
নামের পাশেই আছে লেখা দেখো সেই চির বদনাম। যাক চলে সবাই রব পড়ে আমি,
জানি বনলতা গেছো চলে তুমিও;
তবু তুমি কাছে মোর খুব যে দামী।
কবিতা
দুর্গেশ রঞ্জন দে
কৃষ্ণনগর, দঃ ২৪ পরগণা
জ্বলন্ত অঙ্গার
এ রাজ্য ক্ষুধার
তাইতো হেথাকার মানুষজন
কুৎসিত কদাকার।
অস্থিচর্মসার।
জীবনের প্রতিটি কানায় কানায় পূর্ণ
অর্ধাহার অনাহার
জীবন তাহাদের ভার।
অবশিষ্ট থাকে শুধু হাহাকার।
যোগ বিয়োগ পূরণ- ভাগ সকল
ভাজ্য ভাজক ভাগফল,
ভাগ্য রাশি ফল,
বিড়ম্বিত হয় নিষ্ফল।
তাদের ওরসে নবজাতকের জন্মলাভ,
সঙ্গে নিয়া আসে, আজন্ম পাপ-তাপ।
তাদের অক্লান্ত শ্রম দান,
গড়িয়া উঠে বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান।
তাহারা একান্তই নগণ্য,
তাদের জন্য,
বিত্ত বানরা দেশে-বিদেশে,
প্রচুর বৈভবে হইতেছে ধন্য।
এখানে হা-হুতাশ,দীর্ঘশ্বাস,
নাই আনন্দ -উল্লাস,
নিত্য ক্ষুণ্ণই বইতটির ত্রাস,
জীবনকে করিয়াছে গ্রাস।
এখানে জঠরের যাতনা,
অবারিত নিত্য আনা-গুনা,
আনন্দ উল্লাস উদ্দীপনা,
আসিতে রহিয়াছে মানা।
এখানে হাজার কষ্ট বেদনা,
তাইত আনন্দ আসিতে পারে না।
এখানে হরেক রকম,
অপুষ্টির বিচিত্র বাহার,
চুপসানো জীর্ণ-শীর্ণ চেহারা সবার।
তাদের মনের কোন আগ্রহ,
শুনিতে বুঝিতে ও দেখিতে,
চাহে না কেহ?
কেননা তাড়াত গড্ডালিকা প্রবাহ।
তাদের জীবনে নাই ছন্দ -তাল,
তারা ছিন্ন-মূল,ভুখা-নাঙ্গা কাঙ্গাল,
সন্ধ্যা-দুপুর ও সকাল,
বংশ পরম্পরায় চিরকাল।
বিত্তবানের লালসার লোলুপ আগুন,
তাদেরকে জ্বালায় দ্বিগুণ,
জ্বলে জ্বলে হয় অঙ্গার,
তারপরও তাকিতে হয় নির্বিকার।
চাহিতে পারে না প্রতিকার,
কারণ তারা হল-পরিবেশ-পরিস্থিতির শিকার,
তাদের উপর বার বার,
আসিবে নির্যাতনের পাহাড়।
দিন আনে,দিন খায়,
এতেই তারা আনন্দ পায়,
ভূত -ভবিষ্যৎ নিরাশায়,
কাজটাই তাদের অনন্য উপায়।
অতীতকে তারা জানে,
বর্তমানকে তারা মানে,
তাই ছুটেছে তারা বর্তমানের পানে।
আগামীকল্য কোথায় থাকিবে?
কি-খাইবে?কাজ পাইবে কি না?
সে কথা তারা জানিতে চাহে না।
তারা বস্তুই বাসী,মুখে নাই তাদের,
এতটুকু হাসি।
তারা বস্তি বাসী,সমাজে তারা-উচ্ছিষ্ট,
পচা গন্ধময় বাসি।
তারা বস্তি বাসী,তাদের দুঃখ -কষ্ট,
জ্বালা-যন্রনা রাশি -রাশি।
চলছে, চলমান
মানুষ বুদ্ধির এক-
অপরূপ কলা-কৌশলে,
দাবি করিতে চায়-
সর্বস্ব আপনার বলে।
ছলে কিংবা বলে,
কিংবা কলা-কৌশলে।
এ-জগতের সব কিছু-
আনিতে অনন্য নিজ করতলে।
দেশে-দেশে হানা-হানি,
জাতি-ভেদে টানা-টানি,
এ-কোন কাল- ছায়ার
উন্মুক্ত, উলঙ্গ হাতছানি।
জ্ঞান -বিজ্ঞানে ভূতপত্তি লাভ হইয়াছে যখন,
কথায় কথায় মুখে বলি,
আমরা সভ্য এখন।
কিন্তু হায়!
আমাদের আচার-আচরণ, এমন,
নিজ হাতে,
প্রতিনিয়ত সভ্যতার করিতেছি দাফন।
তবু বলি মুখে,
আমরা সভ্য এখন।
কত সহজলভ্য এখন-
মানুষের জীবন -যাপন।
দুরে বহু দুরে-
সাত সমোদ্র তেরো নদীর ওপারে,
নিমিষে ভাবের আদান-প্রদান করে।
কম্পিউটার, সেটে-লাইট, আরও আছে, মোবাইল, ইন্টারনেট।
বাটন চাপিলে, সব কিছু মিলে হাতের নাগালে।
তৎক্ষণাৎ যোগা-যোগ,
একে অন্যে থাকে না-কোন অনুযোগ।
চলার পথে, কাজে বা বিশ্রামে থাকে সাথে,
হাতে আছে একটি মোবাইল ফোন,
টিপ দিয়ে, হ্যালো-তুমি শোন।
স্নেহ, মায়া, মমতা, এ-সব অতীত কথা।
স্বার্থের কি নিদারুণ দান?
এগুলি করিয়াছে প্রস্থান।
স্বার্থের কি দাপট?
প্রত্যেকে আমরা হইয়াছি কপট।
স্বার্থের অদম্য হানা-আমরা স্বার্থে হইয়াছি কানা।
উবিয়া গিয়াছে অন্তরের আবেগ,
বিজ্ঞান দিয়াছে-এক অসাধারণ বেগ।
আমাদের অন্তর এখন, ভাব-লেশ হীন,
আরাম -বেআরাম বিহীন,
চলমান যন্ত্রের মতন, চলে হন-হন।
আমরা বর্তমান, চলছি-চলমান,
হেথা নাই, মান অভিমান।
স্বার্থের মহিমা অপরূপ,
সবার চেহারা হইয়াছে বিরূপ।
স্বার্থের নিদারুণ দান,
বর্তমান থাকিতে পারে নামান-সম্মান।
তবু,আমরা চলমান, চলছি, চলমান।
চলছে বিশ্বায়ন, বিজ্ঞান করিবে, স্বার্থের উন্নয়ন।
স্বার্থের মহা-সাগরে করিয়া অবগাহন,
স্বার্থের জন্য মনন, পঠন ও হনন।
স্বার্থের এ-কঠিন ধারা,হইয়াছি স্বার্থান্ধ, আত্মহারা।
চলছে বিশ্বায়ন,বহিতেছে উষ্ণ আয়ন ।
কবিতা
দেবাশিস পট্টনায়েক
নিউ দিল্লী