top of page
সূচীপত্র
Saraswati3.jpg
জুলাই ২০২১
girl.JPG

লেখক ও লেখিকাবৃন্দ

প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা

জুলাই ২০২১ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

কবিতাঃ উজ্জ্বল মিশ্র

কবিতা

ডাঃ উজ্জ্বল মিশ্র

আসানসোল, পঃ বাংলা

উপোসী আগুন
                        

বালিশে গুঁজেছে মুখ উপোসী আগুন,
রূপসী চাঁদের আলো বিছানা ভাসায়।
কথা যে রাখে নি জানে ব্যর্থ ফাগুন,
তবু নিত্য আয়োজন মিথ্যে আশায়।

নিত্য যে দহনজ্বালা শরীরে ও মনে,
অব্যক্ত ব্যথার বিষ অন্তঃপুরময়।
রাতের চাদর ঢেকে অতি সংগোপনে
নিজেকে উজাড় করে নগ্ন সময়।

লক্ষ প্রতীক্ষার পরে উপেক্ষার জ্বালা
বুকময় দাগ নিয়ে চন্দ্রমাও জানে।
বালিশে মুখ গুঁজে যতো অবহেলা
চাদরে কুঁকড়ে খোঁজে জীবনের মানে।

কতদিন বাঁচতে ভুলেছো 

 

তোদিন মাখো নি গায়ে যুবতী চাঁদের থেকে

চুঁইয়ে পড়া লুটোপুটি আলো।

শ্রাবণের রিমঝিম গানে মাতোয়ারা

বেহিসেবি উচ্ছ্বাসে

কতদিন মাতো নি বলো

অবিরাম বরিষণ স্নানে।

বিস্তীর্ণ সবুজ ঘাসে ঘাসে

সঞ্চিত বিন্দু বিন্দু হিমেল শিশিরে
কতদিন ভেজাও নি পা,
পৌষের কোনো এক ভোরে।
কতদিন হয় নি দেখা
কুয়াশার জাল ছিঁড়ে 
কমলা সূর্যোদয় নদীর ওপারে।
অকারণ পুলকে কতদিন
গলা ছেড়ে হয় নি গাওয়া গান,
অরণ্যে পাহাড়ে রহস্যময়
নীরবতা খান খান ভেঙে।
জ্যোৎস্না রাতে মাঝ গাঙে
হাল ছেড়ে নৌকায় পাল তুলে
নিরুদ্বেগ ভেসে থাকা 
হয় নি কতদিন।
কতদিন কারণে অকারণে 
হাসতে ভুলেছো প্রাণ খুলে।
যতো কাজ পিছুটান 
সব কিছু ভুলে অখণ্ড অলসতায়
ঠাঁই বসে বসে দেখা
গাছেদের ডালে ডালে পাতায় পাতায়
জানা অজানা পাখিদের নাচ
ভুলে গেছো কতদিন।

কতদিন কত যুগ 
বুক ভরে বাঁচতে ভুলেছো।

কেমন হতো
          

কেমন হতো হঠাৎ যদি 
হারিয়ে যেতাম
ভোঁকাট্টা ঘুড়ির মতো।
বন্ধ দুয়ার দরাজ খুলে
সটান পা বাড়িয়ে দিতাম 
নিরুদ্দেশে, ঠুনকো যতো
মান অভিমান, মিথ্যে মায়া,
সব পিছুটান পেছনে ফেলে।
কেমন হতো হঠাৎ যদি
চেনা পাড়া, চেনা বাড়ি,
যতো চেনা গণ্ডিগুলো
বিস্মরণের খামে ভরে
উড়িয়ে দিতাম।
কিম্বা যদি হঠাৎ করে        
চেনা সুর, চেনা মুখ,
চেনা চেনা সুখ ও দুখ
চেনা যতো গল্পকথার
নটে গাছটি মুড়িয়ে দিতাম।
ফুরিয়ে যেতো নিত্যদিনের মিথ্যে নাটক।

মিথ্যে যতো কান্না হাসি,

মেকি উৎসব সাঙ্গ হতো।

কেমন হতো হঠাৎ যদি দমবন্ধ 
বৃত্তটাকে ছাড়িয়ে যেতাম।

কেমন হতো সত্যি যদি
নিরুদ্দেশেই হারিয়ে যেতাম।

কবিতা

সৃজিতা ধর

কবিতাঃ সৃজিতা ধর

জুলাই ২০২১ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

মুখোশ সরলেই...

 

মুখোশ শব্দের অর্থ হল মুখ লুকিয়ে রাখার জন্য কৃত্রিম মুখ। আমরা জীবনের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই 'নকল' মুখের ব্যবহার করি, বা বলা ভালো ব্যবহারের দরকার হয়।

এই করোনা কালে বাড়িতে থাকার জন্য আরও বেশী মুখোশের দরকার হয়ে পড়েছে।

সত্যি বলতে কি, করোনা না হলে হয়তো জানতেই পারতাম না পরিবারের মানুষগুলোর কৃত্রিম আর আসল চেহারার পার্থক্য। একটানা প্রায় ৬ মাস এভাবে বাড়িতে থাকার কথা স্বপ্নেও ভাবিনি।

একদম প্রথম দিন মনে হয়েছিল, বাড়ির কাছের মানুষগুলোর সাথে সবসময় লেগে থাকতে পারবো।

আড্ডা দিতে পারবো।

একসাথে খাবার টেবিলে বসে এঁটো হাতে বাজার,

রাজনীতি নিয়ে দারুণ জমজমাট আসর বসাতে পারবো। 

কিন্তু, না- খুব ভুল ছিলাম।

আসলে সবাই সবার কৃত্রিম মুখগুলোকেই চিনতাম,

করোনা আসল মুখগুলো সামনে নিয়ে এলো।

নাহ্, এতটা ধাক্কা বোধহয় নিজের ব্রেকআপের সময়ও পায়নি।

বুঝতে পারলাম নিজের মানুষগুলোর আসল মানসিকতা।

আর ঠিক তখনই আবার দরকার পড়লো 'মুখোশ' এর। 

করোনা হয়তো বাড়ির বাইরে চলার পথে মাস্ক পড়তে শিখিয়েছে, কিন্তু ঘরের মানুষের স্বার্থপরতার মুখোশ টেনে খুলে দিয়েছে।

সত্যিই হয়তো এতটা 'আসল' চেহারা দেখতে হবে কোনোদিন মাথায় আসেনি।

আজ ভীষণভাবে মনে হচ্ছে,

মুখোশ সরলেই যদি কাছের মানুষগুলোর কদর্য চেহারা দেখতে হয়,

তবে আমি সারাজীবন মাস্ক পড়তে রাজি।

Big Wave
অনুপম

প্রবন্ধ - কল্পবিজ্ঞান

জুলাই ২০২১ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

অনুপম

কুমকুম বৈদ্য 

কলকাতা

Big Wave

সাল ২০২৫, সময় সন্ধ্যা ৭ টা, কলকাতা শহর। একটা ওভাল শেপের ল্যাবরেটরি থেকে বেরিয়ে আসছেন প্রফেসার চক্রবর্তী। চোখে মুখে আলোর দ্যুতি। আজ তিনি নিজের ফ্ল্যাটের মুখার্জীবাবুকে যে রোবট চাকরটা দিয়েছেন ল্যাব থেকে তার মাথাতে একটা থট রিডার প্রোগ্রামিং আর কিছু আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স পুরে দিয়েছেন সবার অজান্তে। এটা তার নিজস্ব গবেষণা লব্ধ অ্য়াল্গোরিদিম। তাই তিনি আজ খুব এক্সাইটেড। ষাট ঊর্ধ্ব মুখার্জীবাবুর বাড়িতে তিনি আর তার গিন্নি। একমাত্র মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে, সে ও কাছেরই একটা ফ্ল্যাটে থাকে। পাঁচ বছরের নাতনী প্রায় প্রতিদিনই দাদু দিদার সাথে খেলতে আসে। এখন কাজের লোকের যা ডিম্যান্ড, গ্রাচুইটি, পেনশনের টাকা দিতে হবে, তারপর হাতে গোনা কাজ, সবদিক ভেবে চিন্তে মুখার্জীবাবু ২৪ ঘণ্টার রোবট চাকরই নেওয়া ঠিক করলেন। শুধু দিনে ১ ঘন্টা চার্জ দিলেই হবে আর কোনো হ্যাপা নেই। আর পড়শি চক্রবর্তীবাবু জ্ঞানী মানুষ, আর ওনার দৌলতে ২% ডিসকাউন্ট ও পাওয়া গেল। এতদিনে গিন্নির সব সমস্যার সমাধান হবে।
মুখার্জীবাবুর রোবট চাকরের নাম হল অনুপম। ভালো করে চার্জ দিয়ে মুখার্জীবাবু চালু করলেন অনুপমকে। অনুপম - বাবা একটু চা করে আন তো। অনুপম জিজ্ঞেস করল বাবার অ্যাড্রেসটা দেবেন। মুখার্জীবাবু ঢোক গিলে বললেন মানে আমাকে এক কাপ চা করে খাওয়াতে বলছিলাম। অনুপম রান্নাঘরে চলে গেল, সে  নিজেই লোকেশন ডিটেক্ট করতে পারে, ইনগ্রেডিয়েন্ট ও নিয়ে নিল। চা এর সসপ্য়ান এ হাত দিয়ে খানিক হিস্ট্রি রিড করে নিল অনুপম কত কাপ জলে কত কাপ চিনি আর চা আর দুধ দিয়ে করা হয় চা। দেখল চিনি দেওয়া হয় না চা তে, আবার মাঝে মধ্যে আদা পড়ে। অনুপম খানিক ডেটা অ্য়ানালিসিস করে চা বানিয়ে আনল। গিন্নি এখন বাড়ি নেই, অনুপম সুন্দর আদা এলাচ দিয়ে চা বানিয়ে দিয়েছে গিন্নির মতই প্রায়। মুখার্জীবাবু পুরো দিলখুস। গিন্নি বাড়ি নেই, এলে খুশি করে দেবার ব্যবস্থা করতে অনুপমকে বললেন - ঘরদোরগুলো গুছিয়ে

রাখো তো বাপু। অনুপম চট করে তাকে বাপুজি রচনা শুনিয়ে দিল। মুখার্জীবাবু তো থ। না মানে বলছি কি ঘরটা একটু গুছিয়ে ফেলো। অনুপম আধ ঘন্টা পরে ঘর একদম গিন্নি যেখানে যা রাখে ফিটফাট হয়ে গেল। অনুপমকে বলে রাখলেন, গিন্নি ফিরলেই যেন চা করে দেওয়া হয়। খানিক পরে ডিং ডং, গিন্নি ফিরলেন। দেখো নিউ ইয়ারে তোমার গিফট, তোমার সব কাজ একদম তোমার মতো করে করে দবে অনুপম. দেখো কেমন ঘর গুছিয়েছে।গিন্নি হুম বলে দুম দুম করে পা ফেলে বাথরুমে ঢুকলেন, বাথরুম থেকে বেরিয়ে অনুপমের হাতের এককাপ চা খেতে খেতে গিন্নির মুখে কালো মেঘ দেখা দিল। অনুপমের থার্ড আই তাকে এলার্ট দিল গিন্নিমা তার মত কাজ করতে পারাটা ভালো মনে নিচ্ছেন না।রাতের খাবারে তরকারিতে  নুন সামান্য কম হল, ভাতটা ও একটু বেশি গলা হল. গিন্নি ঘোষণা করলেন কাল থেকে তিনি অনুপমকে রান্না শিখিয়ে দেবেন। পরের দিন থেকে অনুপম মুখার্জী গিন্নির ন্য়াওটা হয়ে উঠল। গিন্নি মনে কিছু ভাবলেই অনুপমের থট রিডারে তা ধরে নিয়ে অনুপম সুন্দর ব্যবস্থা করে আর মুখার্জী গিন্নির ভোকাবুলারি ও কদিনেই রপ্ত করে নিল অনুপম বেশ চলছিল দিন কিন্তু গোল বাঁধালো ওই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের অ্য়ালগোরিদিম। অনুপম আস্তে আস্তে মুখার্জী গিন্নির মায়া মমতা আর ভালোবাসার অনুভূতি নিজের মধ্যে রেপ্লিকেট করে নিল।ফলে মুখার্জীবাবুর শরীর খারাপ হলে অনুপমের ও একই রকম মন খারাপ হতে লাগল এবং অনুপম শুকনো মুখে মেয়েদের তো অভিমানী পায়ে সারা বাড়ি ঘুরতে লাগল এবং সন্ধ্যাবেলা ঠাকুরের কাছে কষে প্রেয়ার করল। যদি ও অনুপমের শরীরে হরমোনের কোনো প্রভাব থাকা সম্ভব নয় কিন্তু তা ও অনুপমের একটা মন জন্ম নিল, আর তার ঠেলায় মুখার্জী দম্পতি নাস্তানাবুত। তার থেকে ও মুশকিল যেটা হল দেখতে ছেলেদের মত রোবট অনুপম মনে মনে মেয়ে। অবস্থা বেগতিক দেখে শেষমেশ মুখার্জীবাবু অনুপমকে ল্যাব এ ফিরিয়ে দিয়ে এলেন। প্রফেসার চক্রবর্তী সব মন দিয়ে শুনে অনুপমকে ফিরিয়ে নিয়ে আবার শুরু করলেন তার কাজ।

বেগুনকোদার রেলওয়ে স্টেশন

গল্প 

জুলাই ২০২১ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

বেগুনকোদার

রেলওয়ে স্টেশন

চন্দন চ্যাটার্জি

begun.JPG

দি ইন্টারনেটে পৃথিবীর দশটি ভুতুরে রেলওয়ে স্টেশনের নাম খোঁজ করা যায় তবে পুরুলিয়ার এই বেগুনকোদার রেলওয়ে স্টেশনের নাম অবশ্যই আসবে। এই স্টেশনটি পড়ে পুরুলিয়া জেলায়, ঝালদা এবং কোট শিতা স্টেশনের মাঝখানে। এটি একটি হল্ট স্টেশন, এখানে কোন এক্সপ্রেস গাড়ি থামে না। শুধু কিছু প্যাসেঞ্জার গাড়ি থামে। 
একবার আমার এই স্টেশনে রাত কাটানোর অভিজ্ঞতা হয়েছিল সেটাই আমি এখন বলব।আমি একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে আভ্যন্তরীণ হিসাব পরীক্ষক হিসাবে কাজ করতাম। এই কোম্পানির হেডঅফিস ছিল কলকাতায়, লেলিন সরণির কমলয়া সেন্টারে। সারা পশ্চিমবাংলা জুড়ে তার বাইশটি শাখা অফিস ছিল। এর মধ্যে একটি  শাখা অফিস হল পুরুলিয়া শহরে। আমি অফিসের অডিটিং কাজের জন্য গিয়েছিলাম তখনই অভিজ্ঞতা হয়।
সেবার দূর্গাপুজো পড়েছিল অক্টোবর মাসের শেষের দিকে, কাজেই দেওয়ালী পড়েছিল প্রায় নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি। দেওয়ালীর ছুটি কাটিয়ে যখন অফিসে যাই তখন আমার এক উচ্চপদস্থ কর্তা বলেন পুরুলিয়ার অফিস খোলা হয়েছে প্রায় ছয় মাস হল এখনো একবার অডিটিং হয়নি কাজেই ওখানে একবার আমার যাবার প্রয়োজন রয়েছে এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য, আমার কাজটা শুধুমাত্র অডিটিং নয়, কিছুটা শাখার কর্মীদের প্রশিক্ষণ করতে হয় অর্থাৎ কিভাবে হিসাব রাখা উচিত, ক্যাশবুক কিভাবে লিখতে হয়, ভাউচার কিভাবে তৈরি করতে হয়,  কিভাবে আপলোড করতে হয়, ভেরিফাই করতে হয়।  এছাড়াও প্রতিদিন হেড অফিসে একটা রিপোর্ট পাঠাতে হয় এটা সম্বন্ধে প্রশিক্ষণ দিতে হয়। 
নভেম্বর মাসের  মাঝামাঝি  কলকাতা শহরে  শীত অনুভূত না হলেও গ্রামে গঞ্জে এই সময় শীতের ভালো আমেজ পাওয়া যায় আর পাহাড়ী এলাকা হলে তো কথাই নেই। বিকালের পর থেকেই শীতের পোশাক জরুরী হয়ে যায়। আমি ২৫শে নভেম্বর হাওড়া থেকে পুরুলিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হই, পাঁশকুড়া, খড়গপুর, টাটানগর, হয়ে পুরুলিয়া যেতে হয়। ট্রেনটি হাওড়া থেকে ছাড়লো সকাল ১০.১৫ মিনিটে। যখন টাটানগর পৌঁছল তখন সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়েছে। শীতকালে গ্রাম অঞ্চলে দেখা যায় বিকেলের পরেই ধোয়াগুলো একটা মেঘের মতো আকার নিয়ে মাটি থেকে কিছুটা উপরে থেকে এক সরলরেখায় অবস্থান করে, সূর্যের আলো কমতে কমতে একসময় অন্ধকার নেমে আসে। নভেম্বর মাসে দিন রাতের ফারাক বিস্তর। এখন দিনের তুলনায় রাত অনেক বেশি। ট্রেন যখন ঝালদা স্টেশন পাস করল তখন রাত্রি সাড়ে আটটা। যেহেতু এক্সপ্রেস ট্রেন তাই এই স্টেশনে থামে না, এর প্রায় ৩ মিনিট পর আমি দেখলাম ট্রেনটি বেগুনকোদর স্টেশন ছাড়িয়ে চলে যাচ্ছে। আমি ছিলাম শীততাপ কন্টোল্ড কামরায়। এটা ইঞ্জিন থেকে  চারটি  কামরা  পিছনে। আমার মনে হয় ট্রেনের শেষ কামরাটি বেগুনকোদর স্টেশন  ছাড়িয়েছে এমন সময় ট্রেনের গতি  কমতে শুরু করে শেষ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে গেল। পরের স্টেশন কোটশিতা প্রায় ৬ কিলোমিটার দূরে, সবাই ভাবল সিগনাল নেই তাই  দাঁড়িয়েছে। 
এইভাবে প্রায় ৪/৫ মিনিট কাটলো, আমি জানালা দিয়ে দেখলাম দূরের সিগন্যাল কিন্তু সবুজ আছে অথচ গাড়ি যাচ্ছে না। ব্যাপারটা কি বোঝার জন্য আমি ট্রেনের দরজার কাছে এসে দেখতে লাগলাম। আমার মতই অনেকেই বিভিন্ন কামরা থেকে মুখ বাড়িয়ে দেখছে। কেউ কেউ আবার ট্রেন থেকে নেবে প্রাকৃতিক কর্ম সারছে। আমিও নেবে একটু দূরে গিয়ে প্রাকৃতিক কর্ম করার জন্য যখন প্যান্টের চেইন খুলেছি ঠিক তখনই হর্ন বাঁচিয়ে ট্রেন চালু হয়ে গেল আমিও যত সম্ভব তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করে প্যান্টের চেইন টানতে টানতে চলন্ত ট্রেনটাকে ধরবো বলে ছুটতে লাগালাম। যারা ট্রেন থেকে নেমে ছিল সবাই ছুটতে ছুটতে ট্রেন ধরে ফেলল। আমার শরীর কিছুটা স্থুল। তাই আমি বেশি জোরে দৌড়াতে পারলাম না। তবুও যতটা সম্ভব জোরে ছুটতে গিয়ে একটা বড় পাথরে হোঁচট খেয়ে আছড়ে পড়লাম আর আমার সামনে দিয়ে ট্রেনটি সশব্দে চলে গেল। একটু পরে যখন ধাতস্থ হলাম তখন দেখলাম যারা ট্রেন থেকে নেবে ছিল তারা সবাই উঠে পড়েছে। কেবলমাত্র একজন আমার পিছন দিক থেকে রেল লাইন ধরে হেঁটে আসছে, অন্ধকারে ভালোভাবে দেখা যাচ্ছে না তা হলেও বোঝা যাচ্ছে ভদ্রলোক বয়স্ক, স্থূল শরীর, সুগার আছে, চাকুরীজীবী। 
সুগার আছে, এটা প্রমাণ হয় এই বয়সে ও এই শরীরে কেউ স্টেশন ছাড়া নাবে না, আর চাকুরীজীবী কারণ শনিবারে এই সময় এইসব এক্সপ্রেস গাড়িতে সংরক্ষিত কামরায় সংরক্ষিত যাত্রী ছাড়াও অনেক অফিস ফেরত যাত্রী ওঠে। ভদ্রলোককে দেখে  আমি  একটু  দাঁড়ালাম, পরে কাছে আসতে জিজ্ঞাসা করলাম আপনিও কি এই ট্রেনে আসছিলেন। ভদ্রলোক  একটু গলা খ্যাঁকরে মোটা আওয়াজে উত্তর দিলেন আওয়াজে, “আজ্ঞে হ্যাঁ“
আমি বললাম, “আপনি কি পুরুলিয়া যাবেন?”
উত্তর এল, “আমার বাড়ি শিমুলতলা গ্রামে, পুরুলিয়া থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে। এই প্রথম আমি লক্ষ্য করলাম তার আওয়াজ আসছে অনেক দূর থেকে যেন আওয়াজটা ভেসে ভেসে আসছে, অথচ তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন আমার অদূরে। 
একটু পরে ভদ্রলোক বললেন, “আপনাকে দেখে তো এখানকার লোক বলে মনে হচ্ছে না, তা আপনার আসা হচ্ছে কোথা থেকে?”  আমি বললাম, “কলকাতা, যাব পুরুলিয়া”
ভদ্রলোক -  “পুরুলিয়াতে কাউকে চেনেন?”
আমি - “ না, কিন্তু যে কোম্পানিতে যাব তার ব্রাঞ্চ ম্যানেজারকে জানি। সে স্টেশনে এসে দাঁড়িয়ে থাকবে, এই গাড়িতে যাব বলেছিলাম”
ভদ্রলোক কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “আপনি আমার সঙ্গে স্টেশনে চলুন মাঝরাতে একটা গাড়ি আছে সেটা যদি থামে তাহলে পুরুলিয়া পৌঁছাতে পারবেন”।
অন্য কোন উপায় না দেখে আমি ভদ্রলোকের সঙ্গে বেগুনকোদর স্টেশনের দিকে চললাম। স্টেশনের কাছাকাছি আসতে অল্প আলোয় ওকে দেখলাম একটা মোটা চাদর আপাদ-মস্তক ঢাকা, মাথায় হনুমান টুপি, চোখের পুরু ফ্রেমের চশমা ও মোটা কাচ, হাতে দস্তানা, পায়ের মোজা  ও রাবারের জুতো তাই চলার সময় কোন আওয়াজ হচ্ছে  না। 

স্টেশনে এসে দেখলাম একটা টিকিট কাউন্টার তাতে একজন লোক বসে ঝিমচ্ছে। প্ল্যাটফর্মের দুদিকে দুটো লাইট জ্বলছে। প্ল্যাটফর্মের শেষ প্রান্তে একটা ফলকে তাতে হলদে ওপর কালো কালিতে লেখা আছে বেগুনকোদর হালট স্টেশন। বাংলা, ইংরেজি ও হিন্দি ভাষায়। সমুদ্রতল থেকে ৩৬০ মিটার উঁচুতে, দক্ষিণ পূর্ব রেলওয়ে রাঁচি ডিভিশন। এটা সবাই জানে স্টেশন কখনো বন্ধ হয় না, কারণ রাত্রির গাড়িকে সবুজ সংকেত দেখানোর জন্য একজন লোক থাকা অবশ্যই দরকার। ছোট ছোট স্টেশনে এক ব্যক্তি একাধিক কাজ করে থাকেন যেমন কাউন্টার সামলানো, সিগন্যাল দেওয়া, আবার প্রয়োজন হলে অফিস সাফাই ও করতে হয়। আমার মনে হয় এই স্টেশনের এই ব্যক্তিটি এই একই কাজ করে থাকে। প্লাটফর্মে একটা বসার জায়গা আছে, সেখানে আমাকে বসতে বলে ভদ্রলোক চলে গেলেন ভেতর থেকে পরবর্তী ট্রেনের সময় জানতে। আমি যেখানটায় বসেছিলাম সেখান থেকে আবছা হলেও টিকিট কাউন্টার দেখা যাচ্ছিল। আমি দেখলাম ভদ্রলোক টিকিট কাউন্টারের সামনে দাঁড়ালো অথচ কাউন্টারের ভিতরের ভদ্রলোক যেমন ঝিমোচ্ছিল

তেমনি রইল, তাহলে কাউন্টারের ভদ্রলোক একবার মাথা তুলে কার সঙ্গে কথা বলছে সেটা দেখবার প্রয়োজন মনে করল না। একটু পরে আমার সাথী ভদ্রলোকটি এসে বলল, “পুরুলিয়া ইন্টারসিটি আসবে মাঝরাতের পর”।

আমি বললাম , “ইন্টারসিটি গভীর রাত্রি নয়”। 
সে বলল, “ট্রেন লেট করেছে তাই রাত্রি পৌঁছাবে”
অগত্যা কি করা যায় আমি বসে রইলাম কিছুক্ষণ পরে ভদ্রলোক বললেন, “একটু জল হবে ?”
আমি বললাম, “জল – খাবার সব আমার ব্যাগে ছিলো সেটা তো এখন আর পাওয়া যাবে বলে মনে হচ্ছে না“। 
ভদ্রলোক, “আপনার কি রিজার্ভেশন ছিল?”
আমি, “বি-৩, ২৮ সাইড লোয়ার”।
ভদ্রলোক, “আচ্ছা “
এরপর প্রায় এক ঘন্টা কেটে গেছে, ইতিমধ্যে আমি প্ল্যাটফর্মের বাইরে গিয়ে একটু চা খেয়ে এসেছি মাত্র। ভদ্রলোক কোথাও দেখছিলাম না, বসে বসে ঝিমুনি ও এসেছে, এমন সময় একটা ঠান্ডা স্পর্শে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল, দেখলাম সেই ভদ্রলোকটি আমাকে ডাকছেন।
ভদ্রলোক, ”আপনার ব্যাগটি পাওয়া গেছে”
আমি , “কি করে?”
ভদ্রলোক, “আমার এক পরিচিত আপনার কামরায় সফর করছিল সে আপনাকে নামতে দেখে আপনার ব্যাগটি নিয়ে পুরুলিয়া স্টেশনে নেমেছিল, তার বাড়ি এই স্টেশনের উল্টোদিকেই, বাইরে আমার সঙ্গে দেখা হলো, কথায় কথায় আমি আপনার কথা বললাম তখন সে  আপনার ব্যাগটি আমাকে দিয়ে চলে গেল”। 
আমি মনে মনে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিলাম এবং এমন একটা সংযোগও যে হতে পারে সে বিষয়ে ভাবতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পরে ভদ্রলোক বললো, “দেখুন আপনার গে সব ঠিকঠাক আছে তো“। আমি ব্যাগের চেইন খুলে দেখলাম আমার ল্যাপটপ, জলের বোতল, টিফিন, অফিসের কাগজপত্র ইত্যাদি সবই আছে। 
আমি বললাম, “আপনি জল খাবেন বলেছিলেন”। এই বলে জলের বোতলটা তার দিকে এগিয়ে  দিলাম। ভদ্রলোক বললেন, “না দরকার নেই আমি বাইরে দোকান থেকে খেয়েছি”। রাত অনেক হয়েছে তাই আমি টিফিন বার করে খেয়ে, জল খেয়ে, আবার বসলাম। আমার একটু পানের নেশা আছে। রাত্রে খাবার পর খয়ের ছাড়া ১২০ জর্দা দিয়ে একটা পান দরকার হয়।   
আমি বললাম, “আপনি বসুন আমি দেখি বাইরে একটা পান পাওয়া যায় কিনা”। 
ভদ্রলোক বললেন, ”আমার কাছে আছে“ এই বলে একটা কাগজের মোড়ক আমার হাতে দিলেন। সেটা হাতে নিতে বুঝতে পারলাম এটা বরফের মত ঠান্ডা । 
আমি বললাম, “এত ঠান্ডা কেন?”। 
উত্তর এলো, “এটা আমার পকেটে ছিল তাই“।
মনে মনে ভাবলাম পকেটে থাকলে তো গরম হওয়ার কথা, আর একটা কথা আমার মনে ঘুরপাক খাচ্ছে যখন যেটা প্রয়োজন সবই এর কাছে আছে কেন, এই সব নানা কথা ভাবছি।
যাই হোক, আমি যে রকম পান খাই এটা ঠিক সেই রকমই। পানটি গালেপুরে চিবুতে চিবুতে তাকে একটা ধন্যবাদ জানালাম, এবং জিজ্ঞাসা করলাম, “দুঃখিত আপনার নামটা জানা হয়নি, আজ আপনি এত উপকার করলেন তার জন্য অজস্র ধন্যবাদ। বাই দি ওয়ে আমার নাম চন্দন চট্টোপাধ্যায়”।
ভদ্রলোক উত্তর দিলেন তার নাম বিকাশ চক্রবর্তী। এরপরে বললেন, “একটা এক্সপ্রেস গাড়ি আসছে ডাউনে”।
আমি বললাম, “ ডাউন এর গাড়ি তো আমার লাগবে না যদি আপে হয় তো ভালো, তাও আবার যদি এখানে দাঁড়ায় তো“।
হ্যাঁ  ঠিক বটে খানিকক্ষণ পরে সত্যিই একটা ট্রেনের শব্দ শুনতে পেলাম এবং অনেক দূরে ট্রেনের আবছা আলো দেখা যাচ্ছে। ক্রমে আলোটা উজ্জ্বল হতে লাগলো, আবছা স্টেশন অনেকটা আলোকিত হতে লাগলো। আমি একটু এগিয়ে গিয়ে লাইনের ধারে দেখতে গেলাম কি ট্রেন আসছে । 
আমাকে যেতে দেখে লোকটি উঠে দাঁড়ালো এবং কর্কশ আওয়াজে আদেশের সুরে বলল,    “লাইনের ধারে যাবেন না মারা পড়বেন”।   
“আমি কি ১০ বছরের শিশু যে মারা পড়বো, ট্রেনের হওয়া আমাকে টেনে নেবে“, এই কথা বলে আমি যেমনি আমি ভদ্রলোকের দিকে তাকালাম ট্রেনের আলোয় পরিষ্কার দেখতে পেলাম ভদ্রলোকের মুখ বলে কিছুই নেই, শুধু দুটি জ্বলন্ত চোখ যেন আমাকে গিলে খেতে চাইছে। এইরকম দৃশ্য দেখার পর আমি একটা বিকট চিৎকার করে টিকিট কাউন্টারের দিকে ছুটলাম একটু  দৌঁড়াতে একটা পাথরে হোঁচট খেয়ে জ্ঞান হারালাম। 
যখন জ্ঞান ফিরলো তখন আমি নিজেকে আবিষ্কার করলাম একটা হাসপাতালে বেডে। একটু সম্বিত ফিরে পেয়ে ডাক্তারবাবুকে বললাম, “আমি এখানে কি করে এলাম”।

তিনি বললেন, “বিকাশ চক্রবর্তী বলে কেউ আপনার পরিচিত আপনাকে লাইনের ধারে অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে উঠিয়ে নিয়ে এসে এখানে ভর্তি করে দেয়। এখন কেমন বোধ করছেন”।
বললাম, “ভালো“
একটু পরে সিনেমার ফ্ল্যাশব্যাকের মত আমার সব কথা মনে পড়ে গেল।  ট্রেন থেকে নামা, হোঁচট খাওয়া, এক ভদ্রলোক সঙ্গে পরিচয় হওয়া, আমার ব্যাগ ফিরে পাওয়া, পান খাওয়া, শেষে ডাউন ট্রেনের আলোতে এক জ্বলন্ত চোখ দেখা এবং জ্ঞান হারানো। আমি দেখলাম আমার ব্যাগটি মাথার কাছেই আছে। খানিক পরে ডাক্তারবাবু আমাকে প্রাথমিক চিকিৎসা করে ছেড়ে দিলেন।  
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “একবার হাসপাতালের ভিজিটার বুকটা দেখতে পারি”।
ডাক্তারবাবু বললেন, “হ্যাঁ” এই বলে তিনি আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে রিসেপশনে ভিজিটর বুকটা দেখালেন। তাতে সই আছে বি. চক্রবর্তী। 
হঠাৎ আমার মনে হলো হাসপাতালের লোক যদি তাকে দেখে থাকে, তাহলে হাসপাতালে সিসিটিভি ক্যামেরাতে নিশ্চয়ই তার ফটো উঠবে। আমি হাসপাতালে সুপারের কাছে গিয়ে সব কথা খুলে বললাম এবং সিসিটিভি ক্যামেরা ক্লিপিংস দেখতে চাইলাম। তাতে দেখা গেল আমি স্ট্রেচারের উপর শুয়ে আছি, রিসেপশনিস্ট কথা বলছে, কিন্তু সামনে যে ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলছে তাকে দেখা যাচ্ছে না। কলমটা যেন নিজে থেকে উঠে ভিজিটের বুকে সই করছে, আমার ব্যাগটা যেন শূন্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এটা দেখে, হাসপাতালের সুপারও সিসিটিভি অপারেটর দুজনেরই জ্ঞান হারাবার অবস্থা।

প্রবন্ধ

প্রেমধর্ম

জুলাই ২০২১ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

‘মার খেয়েছি না হয় আরও খাব।

তাই বলে কি প্রেম দিব না?’

প্রেমধর্ম-রবীন্দ্র সাহিত্যে

ও চৈতন্য চরিতামৃতে
ইন্দ্রজিৎ সেনগুপ্ত

chaitanya.jfif

শ্রীচৈতন্য বলেছেন কলিযুগে ভগবানের দিব্য নাম কীর্তন করা ছাড়া আর কোন ধর্ম নেই। এই দিব্য নাম হচ্ছে বৈদিক মন্ত্রের সার।

চৈতন্যদেব প্রবর্তিত নাম কীর্তনের কথা বলতে গেলে যেমন আসে, -
“হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে”
তেমনি রবীন্দ্রনাথের ভাবনাতেও নামের মাহাত্ম্য স্বীকৃতি পেয়েছে, -
“তোমারি নাম বলব নানা ছলে,
বলব একা বসে আপন মনের ছায়াতলে॥
বলব বিনা ভাষায়, বলব বিনা আশায়,
বলব মুখের হাসি দিয়ে, বলব চোখের জলে॥
বিনা প্রয়োজনের ডাকে ডাকব তোমার নাম,
সেই ডাকে মোর শুধু শুধুই পূরবে মনস্কাম”।
চৈতন্যদেবের আবির্ভাবে ধর্মে, সাহিত্যে সর্বোপরি নাম-সংকীর্তনের মাধ্যমে একসময় বাঙালি জাতির মধ্যে যে মহাভাব জেগে উঠেছিল, রবীন্দ্রনাথ আশা প্রকাশ করে লেখেন, - “তাই আশা হইতেছে- আর একদিন হয়তো আমরা একই মত্ততায় পাগল হইয়া সহসা একজাতি হইয়া উঠিতে পারিব, বৈঠকখানার আসবাব ছাড়িয়া সকলে মিলিয়া রাজপথে বাহির হইতে পারিব, বৈঠকি ধ্রুপদ খেয়াল ছাড়িয়া রাজপথী কীর্তন গাহিতে পারিব”। 
শ্রীচৈতন্যদেবের দৃঢ় ব্যক্তিত্ব এবং জীবনাদর্শে রবীন্দ্রনাথ কতটা মুগ্ধ ছিলেন তা বোঝা যায় ‘বিদ্যাসাগর চরিত’ প্রবন্ধে শ্রীচৈতন্যদেব সম্পর্কে তাঁর মন্তব্যে। এই প্রবন্ধে শ্রীচৈতন্যদেবের গৌরবময় কর্মকুশলতা স্মরণ করে তিনি লেখেন, - 

“বহুকাল পূর্বে একদা নবদ্বীপের শচীমাতার এক প্রবল দুরন্ত ছেলে এই আশা পূর্ণ করিয়াছিলেন”। 
চৈতন্যদেব যেমন আপন তেজে বঙ্গবাসীকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন – এই তেজ আত্মশক্তিজাত। রবীন্দ্রনাথও তেমনি আপন তেজে বঙ্গবাসীকে কূপমণ্ডুকতা থেকে বেরিয়ে মননচর্চায় যোগ দিতে উৎসাহ দিয়েছিলেন।
মহাপ্রভু আর বিশ্বকবি। দুই মহাপুরুষের জীবনেও কি আশ্চর্য মিল। অপূর্ব দেহকান্তি নিয়ে গৌরাঙ্গ বিশ্বম্ভর জন্মগ্রহণ করেন সেকালের কলকাতা নবদ্বীপে। আর রবির আলোর মত উজ্জ্বল রবীন্দ্রনাথের জন্ম একালের জোড়াসাঁকোর কলকাতায়। দুজনেরই আদি নিবাস বর্তমান বাংলাদেশে। চৈতন্যদেবের আয়ুষ্কাল ৪৮ বছর। তার অর্ধাংশ কেটেছে বাংলাদেশে। বাকি অর্ধাংশ অন্যত্র। ২৪ বছর বয়সে তিনি নবদ্বীপ ছেড়ে পুরি শ্রীক্ষেত্রকে নতুন কর্মক্ষেত্র করে তোলেন। রবীন্দ্রনাথ বেঁচে ছিলেন আশি বছর। তিনিও জীবনের ঠিক অর্ধাংশ কলকাতায় কাটিয়ে ঠিক ৪০ বছর বয়সে নতুন কর্মযজ্ঞ শুরু করেন শান্তিনিকেতনে। চৈতন্যদেব নিজে সাহিত্যস্রষ্টা না হয়েও বাংলা সাহিত্যে নতুন জোয়ার আনেন তাঁর মহিমান্বিত প্রভাবে। তাঁর জীবন অবলম্বন করে গড়ে ওঠে বিশাল জীবনী সাহিত্য, বৈষ্ণব পদাবলী পায় নতুন প্রেরণা। তাঁর আবির্ভাবের পরেই বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে গৌরবের সূচনা। ঐশ্বর্যবান বাংলা সাহিত্য সম্ভারের গৌরচন্দ্রিকা সেই সুসময়েই। রবীন্দ্রনাথেরই ভাষায়, “চৈতন্য বঙ্গভাষায় তাঁহার প্রেমাবেগ সর্বসাধারণের অন্তরে সঞ্চারিত করিয়া দিয়াছিলেন” (শিক্ষার হেরফের)।
সেকালের বাংলা সাহিত্য যেমন চৈতন্যদেবের প্রেমভক্তিরসে আপ্লুত, একালের বাংলাসাহিত্য তেমনি রবিকরোজ্বল। সাহিত্যের পর সঙ্গীত। চৈতন্যদেব আর রবীন্দ্রনাথ আমাদের উপহার দিয়েছেন দুটি সম্পদ – কীর্তন আর রবীন্দ্রসঙ্গীত। বাঙালি জাতির সবচেয়ে গর্ব এই দুটি জিনিস নিয়ে। দুটিই বাংলার প্রাণ। তাছাড়া, দুজনেই উপলব্ধি করেছিলেন, সঙ্গীত যেখানে নিঃশেষ, সেখানের শুরু নৃত্যের। ভাষাহীন সুরহীন নৃত্য-ছন্দ স্বর্গের সুষমা আনে। দুজনেই যেন বলেছেন, “নৃত্যরস চিত্ত মম উচ্ছল হয়ে বাজে”। তাই বারবার দেখি মহাপ্রভু কৃষ্ণনাম করতে করতে ভাবাবেশে নৃত্য শুরু করেছেন এবং রবীন্দ্রনাথও অন্ধ বাউল বা ঠাকুরদার ভূমিকায় নেমে গানের সুরের সঙ্গে মঞ্চে হঠাৎ নৃত্যের ছন্দ তোলেন। নাচকে এমন মর্যাদা চৈতন্যদেব আর রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আর কেউ দেননি।
চৈতন্যদেব ব্রাহ্মণ হয়েও ব্রাহ্মণ্যধর্মের বিরুদ্ধে সংগ্রামে নামেন পতিত উদ্ধারিতে, নামগান প্রচার করেন সবার অধম সবহারাদের মাঝে। রবীন্দ্রনাথও জন্মগতভাবে উপবীতধারী বাহ্মণ, তবু অনায়াসে ঘোষণা করেন, ‘আমি ব্রাত্য, আমি মন্ত্রহীন’। দুজনেই মধুর রসের পথিক, কিন্তু বলিষ্ঠ মতের প্রচারক। দুজনেই ছিলেন দীর্ঘদেহী গৌরাঙ্গ। দু’জন দুই পথের পথিক হয়েও দুইভাবে বিপ্লবী। এই বিপ্লব প্রচলিত সংজ্ঞা অনুযায়ী না হয়েও সুদূরপ্রসারী। আনন্দময় উৎসবকে দুজনেই প্রাধান্য দিয়েছেন জীবনে। তাঁর মধ্যে বসন্ত ঋতুর প্রতি পক্ষপাতিত্ব দুজনের। একজন বলেন দোললীলা, আরেকজন বলেন বসন্তোৎসব। দুজনেরই যিনি উপাস্য, তাঁর বর্ণ শ্যামল। একজনের শ্যামল কৃষ্ণ, আরেকজনের শ্যামল প্রকৃতি।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভুর দিব্যজীবন এবং তাঁর বৈষ্ণবদর্শন প্রবলভাবে প্রভাবিত করেছিল রবীন্দ্রনাথকে। অনেকের ধারণা, রবীন্দ্রনাথের ধ্যান-ধারণা যেন শুধু উপনিষদ কেন্দ্রিক। উপনিষদ নিশ্চয়ই তাঁর প্রেরণার অন্যতম উৎস, কিন্তু বৈষ্ণব দর্শন ও সাহিত্য যে তাঁকে কতটা প্রেরণা দিয়েছিল, সেই সম্পর্কে অনেকেই অবহিত নন। তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন, উপনিষদ আর বৈষ্ণব সাহিত্যের প্রতি তাঁর ঋণের কথা। ১৯২১ সালে বন্ধু ব্রজেন্দ্রনাথ শীলকে লেখা এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, - “বৈষ্ণব সাহিত্য এবং উপনিষদ বিমিশ্রিত হইয়া আমার মনের হাওয়া তৈরি করিয়াছে। নাইট্রোজেন এবং অক্সিজেন যেমন মিশে তেমনি করিয়া তাহারা মিশিয়াছে”। 
শ্রীচৈতন্যের জীবনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় সেই বাল্যকাল থেকে। বিভিন্ন সময়ে তিনি চৈতন্যদেবের জীবনী পরম আগ্রহে বারবার পড়েছেন। ১৯১০ সালে লেখা একটি চিঠিতে বলছেন, - 

“বৈষ্ণবকাব্য এবং চৈতন্যমঙ্গল প্রভৃতি কাব্য অবলম্বন করে চৈতন্যের জীবনী আমি অনেক বয়স পর্যন্ত বিশেষ উৎসাহের সঙ্গে আলোচনা করেছি”। ১৯৩৬ সালে হেমন্তবালা দেবীকে আর একখানা চিঠিতে লিখেছেন, - 
“কল্যাণীয়াসু, প্রথম বয়সে বৈষ্ণবসাহিত্যে আমি ছিলুম নিমগ্ন, সেটা যৌবনচাঞ্চল্যের আন্দোলনবশত নয়, কিছু উত্তেজনা ছিল না এমন কথা বলা যায় না। কিন্তু ওর আন্তরিক রসমাধুর্য্যের গভীরতায় আমি প্রবেশ করেছি। চৈতন্যমঙ্গল চৈতন্যভাগবত পড়েছি বারবার। পদকৰ্ত্তাদের সঙ্গে ছিল আমার ঘনিষ্ঠ পরিচয়। অসীমের আনন্দ এবং আহ্বান যে বিশ্বপ্রকৃতির সৌন্দর্য্যে ও মানবপ্রকৃতির বিচিত্র মধুরতায় আমাদের অন্তরবাসিনী রাধিকাকে কুলত্যাগিনী করে উতলা করছে প্রতিনিয়ত, তার তত্ত্ব আমাকে বিস্মিত করেছে।

কিন্তু আমার কাছে এই তত্ত্ব ছিল নিখিল দেশকালের— কোনো বিশেষ দেশে বিশেষ কালে বিশেষ পাত্রে কতকগুলি বিশেষ আখ্যায়িকায় আবদ্ধ করে একে আমি সঙ্কীর্ণ ও অবিশ্বাস্য করে তুলতে পারিনি”।
তাই আমরা দেখতে পাই প্রেমিক চৈতন্য, বিপ্লবী চৈতন্য, মানবদরদী চৈতন্য এবং বাঙালি জাতির ভাষার ও সাহিত্যের উদ্বোধক চৈতন্য মহাপ্রভুর প্রতি রবীন্দ্রনাথ এত শ্রদ্ধাশীল।
রবীন্দ্রনাথ চৈতন্যদেবকে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করেছেন। প্রচলিত কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, আইন অমান্য আন্দোলন, বিক্ষোভ মিছিলের সংগঠন, আপামর জনসাধারণকে পরম স্নেহে বুকে তুলে নেওয়া, প্রেমধর্মের প্রচার ইত্যাদি রবীন্দ্রনাথকে আকৃষ্ট করেছিল। তাঁর রচনাবলীতে মহাপ্রভু সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, 
“আমাদের আশ্বাসের কারণও আছে। আমাদের বাঙালির মধ্য হইতেই তো চৈতন্য জন্মিয়াছিলেন। তিনি তো বিঘা কাঠার মধ্যেই বাস করিতেন না, তিনি তো সমস্ত মানবকে আপনার করিয়াছিলেন। তিনি বিস্তৃত মানবপ্রেমে বঙ্গভূমিকে জ্যোতির্ময়ী করিয়া তুলিয়াছিলেন। তখন তো বাংলা পৃথিবীর এক প্রান্তভাগে ছিল, তখন তো সাম্য ভ্রাতৃভাব প্রভৃতি কথাগুলোর সৃষ্টি হয় নাই, সকলেই আপন-আপন আহ্নিক তর্পণ ও চণ্ডীমণ্ডপটি লইয়া ছিল-তখন এমন কথা কী করিয়া বাহির হইল।
‘মার খেয়েছি নাহয় আরও খাব।
তাই বলে কি প্রেম দিব না? আয়। '
এ কথা ব্যাপ্ত হইল কী করিয়া? সকলের মুখ দিয়া বাহির হইল কী করিয়া? আপন-আপন বাঁশবাগানের পার্শ্বস্থ ভদ্রাসনবাটীর মনসা-সিজের বেড়া ডিঙাইয়া পৃথিবীর মাঝখানে আসিতে কে আহ্বান করিল এবং সে আহ্বানে সকলে সাড়া দিল কী করিয়া? একদিন তো বাংলাদেশে ইহাও সম্ভব হইয়াছিল। একজন বাঙালি আসিয়া একদিন বাংলাদেশকে তো পথে বাহির করিয়াছিল। একজন বাঙালি তো একদিন সমস্ত পৃথিবীকে পাগল করিবার জন্য ষড়যন্ত্র করিয়াছিল এবং বাঙালিরা সেই ষড়যন্ত্রে তো যোগ দিয়াছিল। বাংলার সে এক গৌরবের দিন। তখন বাংলা স্বাধীনই থাকুক আর অধীনই থাকুক, মুসলমান নবাবের হাতেই থাকুক আর স্বদেশীয় রাজার হাতেই থাকুক, তাহার পক্ষে সে একই কথা। সে আপন তেজে আপনি তেজস্বী হইয়া উঠিয়াছিল”।
চৈতন্যদেবের সংগ্রাম ছিল সমস্ত ভেদবুদ্ধির বিরুদ্ধে। তাঁর অস্ত্র ছিল প্রেমধর্ম। সাম্য ও ভক্তির মিশ্রণে গঠিত তাঁর প্রেমধর্ম হরিনাম সংকীর্তনের সন্মোহনী শক্তিতে আকৃষ্ট করেছিল সর্বশ্রেণীর, বিশেষ করে পতিত অবহেলিত সমাজের লোকদের। এই বলিষ্ঠ অথচ প্রেমময় ভাববন্যার বিশ্লেষণ করে রবীন্দ্রনাথ বলেন, 
“আসল কথা, বাংলায় সেই একদিন সমস্ত একাকার হইবার জো হইয়াছিল। তাই কতকগুলো লোক খেপিয়া চৈতন্যকে কলসীর কানা ছুঁড়িয়া মারিয়াছিল। কিন্তু কিছুই করিতে পারিল না। কলসীর কানা ভাসিয়া গেল। দেখিতে দেখিতে এমনি একাকার হইল যে, জাতি রহিল না, কুল রহিল না, হিন্দু-মুসলমানেও প্রভেদ রহিল না। তখন তো আর্যকুলতিলকেরা জাতিভেদ লইয়া তর্ক তুলে নাই। আমি তো বলি, তর্ক করিলেই তর্ক উঠে। বৃহৎ ভাব যখন অগ্রসর হইতে থাকে তখন তর্কবিতর্ক খুঁটিনাটি সমস্তই অচিরাৎ আপন-আপন গর্তের মধ্যে সুড়্‌সুড়্‌ করিয়া প্রবেশ করে। কারণ, মরার বাড়া আর গাল নাই। বৃহৎ ভাব আসিয়া বলে, সুবিধা-অসুবিধার কথা হইতেছে না, আমার জন্য সকলকে মরিতে হইবে। লোকেও তাহার আদেশ শুনিয়া মরিতে বসে। মরিবার সময় খুঁটিনাটি লইয়া তর্ক করে কে বলো”।
প্রেমধর্মের আদর্শনিষ্ঠা ও তাঁর বহুমুখী আবেদন রবীন্দ্রনাথকে সারাজীবন মুগ্ধ রেখেছিল। ‘সমূহ’ গ্রন্থের ‘দেশহিত’ প্রবন্ধ বাংলাদেশের স্বাদেশিকতার আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি চৈতন্যদেবের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, - 
“চৈতন্যদেব একদিন বাংলাদেশে প্রেমের ধর্ম প্রচার করিয়াছিলেন। কাম-জিনিসটা অতি সহজেই প্রেমের ছদ্মবেশ ধরিয়া দলে ভিড়িয়া পড়ে এইজন্য চৈতন্য যে কিরূপ একান্ত সতর্ক ছিলেন তাহা তাহার অনুগত শিষ্য হরিদাসের প্রতি অত্যন্ত কঠোর ব্যবহারে প্রমাণিত হইয়াছে । ইহাতে বুঝা যায় চৈতন্যের মনে যে প্রেমধর্মের আদর্শ ছিল তাহ কত উচ্চ, তাহা কিরূপ নিষ্কলঙ্ক । তাহার কোথাও লেশমাত্র কালিমাপাতের আশঙ্কায় তাহাকে কিরূপ অসহিষ্ণু ও কঠিন করিয়াছিল। নিজের দলের লোকের প্রতি দুর্বল মমতাকে তিনি মনে স্থান দেন নাই—-ধর্মের উজ্জ্বলতাকে সর্বতোভাবে রক্ষা করার প্রতিই তাহার একমাত্র লক্ষ্য ছিল”। 
চৈতন্য বাঙালি জাতিকে সংযুক্ত করেছিলেন বিশ্বচেতনার সঙ্গে। অখণ্ড ভারতবোধ জাগ্রত করার পশ্চাতেও তাঁর দান অনেক। তিনি দক্ষিণভারত ও উত্তরভারতকে যুক্ত করেছিলেন পূর্ব ভারতের সঙ্গে। কোনও রাষ্ট্রীয় শক্তির সাহায্যে নয়, প্রেমধর্মের মাধ্যমে। সাম্য, মৈত্রী ও ভালবাসা ছিল তাঁর প্রেমধর্মের মূলমন্ত্র। রবীন্দ্রনাথ তাই লেখেন, “চৈতন্য যখন পথে বাহির হইলেন তখন বাংলা দেশের গানের সুর পর্যন্ত ফিরিয়া গেল। তখন এককণ্ঠবিহারী বৈঠকি সুরগুলো কোথায় ভাসিয়া গেল? তখন সহস্র হৃদয়ের তরঙ্গ-হিল্লোল সহস্র কণ্ঠ উচ্ছ্বসিত করিয়া নূতন সুরে আকাশে ব্যাপ্ত হইতে লাগিল। তখন রাগরাগিণী ঘর ছাড়িয়া পথে বাহির হইল, একজনকে ছাড়িয়া সহস্রজনকে বরণ করিল। বিশ্বকে পাগল করিবার জন্য কীর্তন বলিয়া এক নূতন কীর্তন উঠিল। যেমন ভাব, তেমনি তাহার কণ্ঠস্বর - অশ্রুজলে ভাসাইয়া সমস্ত একাকার করিবার জন্য ক্ৰন্দনধ্বনি”।
১৯১১ সালের ১৪ই মার্চ চৈতন্যদেবের আবির্ভাব তিথি উপলক্ষে একটি ভাষণ দেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯১৬ সালে পুত্র রথীন্দ্রনাথকে লেখা এক চিঠিতে তিনি বলেন, -

“একদিন চৈতন্য আমাদের বৈষ্ণব করেছিলেন। সে বৈষ্ণবের জাত নেই কূল নেই। আর একদিন রামমোহন রায় আমাদের ব্রহ্মলোকে উদ্বোধিত করেছেন। সেই ব্রহ্মলোকেও জাত নেই দেশ নেই”।
আর সেই বৈষ্ণব সাহিত্যের প্রতি রবীন্দ্রনাথের আকর্ষণ ছোটবেলা থেকেই। বয়স তখন বারো, তেরো, তখন থেকেই পদাবলী তাঁর প্রাণ। সেই কারণেই অলস, অন্যমনে কিশোর কবি হঠাৎ লিখে ফেলেন, “গহনকুসুম কুঞ্জমাঝে”। সেই হঠাৎ রচনা থেকেই সৃষ্টি ‘ভানুসিংহের পদাবলী’। যে দুটি বৈষ্ণব পদে তিনি সুর দিয়েছেন, তাও বিদ্যাপতি এবং গোবিন্দদাসের। ‘এ ভরা বাদর মাহ ভাদর’ এবং ‘সুন্দরী রাধে আওয়ে বনি’।

জ্ঞানদাসের “রজনী শাঙন ঘন, ঘন দেয়া গরজন” পদটি সাহিত্য আলোচনায় বহুবার দৃষ্টান্ত হিসাবে ব্যবহার করেছেন। শুধু তাই নয়, তার অনুকরণে সোনার তরীর ‘বর্ষাযাপন’ এবং সানাই গ্রন্থের ‘মানসী’ কবিতাটাও লিখেছেন। বিদ্যাপতি ও চন্ডীদাসের পদাবলী সম্পর্কে তার ব্যাখ্যা তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্য সমালোচনা।

তিনি লেখেন - “বিদ্যাপতি সুখের কবি, চণ্ডিদাস দুঃখের কবি। বিদ্যাপতি বিরহে কাতর হইয়া পড়েন, চণ্ডিদাসের মিলনেও সুখ নাই। বিদ্যাপতি জগতের মধ্যে প্রেমকে সার বলিয়া জানিয়াছেন, চণ্ডিদাস প্রেমকেই জগৎ বলিয়া জানিয়াছেন। বিদ্যাপতি ভোগ করিবার কবি, চণ্ডিদাস সহ্য করিবার

কবি”! রবীন্দ্রনাথ বৈষ্ণব পদাবলীতে এত মগ্ন ছিলেন যে, তাঁর যৌবনেই ‘পদরত্নবলী’ সংকলন করেছিলেন। একটি চিঠিতে লিখেছেন, “বৈষ্ণব পদাবলীতে বর্ষার যমুনাবর্ণনা মনে পড়ে। প্রকৃতির অনেক দৃশ্যই আমার মনে বৈষ্ণব কবির ছন্দঝঙ্কার এনে দেয়। তার প্রধান কারণ এই প্রকৃতির সৌন্দর্য্য আমার কাছে শূন্য সৌন্দর্য্য নয়— এর মধ্যে একটি চিরন্তন হৃদয়ের লীলা অভিনীত হচ্ছে—এর মধ্যে অনন্ত বৃন্দাবন। বৈষ্ণব পদাবলীর মৰ্ম্মের ভিতর যে প্রবেশ করেছে, সে সমস্ত প্রকৃতির মধ্যে সে বৈষ্ণৰ কবিতার ধ্বনি শুনতে পায়” । 
শিলাইদহ থেকে আর একটা চিঠিতে দুঃখ করে লিখছেন, - “বরাবর বৈষ্ণব কবি ও সংস্কৃত বই আনি। এবার আনিনি। সেইজন্যে, ঐ দুটোর আবশ্যক বেশি মনে হচ্ছে”।
বৈষ্ণব পদাবলীর প্রেম ও প্রকৃতি বর্ণনার যে অনুভাবনা ধীরে ধীরে কবির মনে দানা বেঁধেছে, তারই স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ দেখা যায় ‘মানসী’-র বেশ কয়েকটি কবিতায়, -
“আজও আছে বৃন্দাবন মানবের মনে।
শরতের পূর্ণিমায়
শ্রাবণের বরিষায়
উঠে বিরহের গাথা বনে উপবনে।
এখনো সে বাঁশি বাজে যমুনার তীরে।
এখনো প্রেমের খেলা
সারা নিশি, সারা বেলা,
এখনো কাঁদিছে রাধা হৃদয়কুটিরে”।
কখনও বলেছেন, “বর্ষাঋতুর মতো মানুষের সমাজে এমন এক-একটা সময় আসে যখন হাওয়ার মধ্যে ভাবের বাষ্প প্রচুররূপে বিচরণ করিতে থাকে। চৈতন্যের পরে বাংলাদেশের সেই অবস্থা আসিয়াছিল। তখন সমস্ত আকাশ প্রেমের রসে আর্দ্র হইয়া ছিল। তাই দেশে সে-সময় যেখানে যত কবির মন মাথা তুলিয়া দাঁড়াইয়া ছিল সকলেই সেই রসের বাষ্পকে ঘন করিয়া কত অপূর্ব ভাষা এবং নূতন ছন্দে কত প্রাচুর্যে এবং প্রবলতায় তাহাকে দিকে দিকে বর্ষণ করিয়াছিল”।
পঞ্চভূত গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ বৈষ্ণব ধর্মের একটা ব্যাখ্যাও করেছেন, বলেছেন, - “বৈষ্ণবধর্ম পৃথিবীর সমস্ত প্রেম-সম্পর্কের মধ্যে ঈশ্বরকে অনুভব করিতে চেষ্টা করিয়াছে। যখন দেখিয়াছে মা আপনার সন্তানের মধ্যে আনন্দের আর অবধি পায় না, সমস্ত হৃদয়খানি মুহূর্তে মুহূর্তে ভাঁজে ভাঁজে খুলিয়া ঐ ক্ষুদ্র মানবাঙ্কুরটিকে সম্পূর্ণ বেষ্টন করিয়া শেষ করিতে পারে না, তখন আপনার সন্তানের মধ্যে আপনার ঈশ্বরকে উপাসনা করিয়াছে”। 
রবীন্দ্রনাথ আর একটু এগিয়ে গিয়ে বলেছেন, - 
“সেদিন রাধিকার ছবির পিছনে
কবির চোখের কাছে
কোন্‌ একটি মেয়ে ছিল,
ভালোবাসার-কুঁড়ি-ধরা তার মন।
মুখচোরা সেই মেয়ে,
চোখে কাজল পরা,
ঘাটের থেকে নীলশাড়ি
"নিঙাড়ি নিঙাড়ি' চলা”। (শ্যামলী: স্বপ্ন)।
সোনার তরী কাব্যগ্রন্থের বৈষ্ণব কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ওই একই কথা আরও স্পষ্ট করে বলেছেন, -
“দেবতারে যাহা দিতে পারি, দিই তাই
প্রিয়জনে-- প্রিয়জনে যাহা দিতে পাই,
তাই দিই দেবতারে; আর পাব কোথা!
দেবতারে প্রিয় করি, প্রিয়েরে দেবতা"।
শুধু ধর্মের ব্যাখ্যা নয়, বৈষ্ণবপদাবলীর ভাব, ভাষা ইত্যাদি নিয়ে রবীন্দ্রনাথ সারাজীবন আলোচনা করেছেন। গোবিন্দদাস ও বিদ্যাপতীর নাম তাঁর কবিতার পঙক্তিতে প্রবেশ করেছে অনেকবার। আবার কীর্ত্তন গান সম্পর্কে ২৯ জুলাই ১৯৩৭ সালে দিলীপ কুমার রায়কে এক চিঠিতে বলেছেন, - “কীর্তনগীত আমি অনেক কাল থেকেই ভালোবাসি। ওর মধ্যে ভাবপ্রকাশের যে নিবিড় ও গভীর নাট্যশক্তি আছে সে আর-কোনো সংগীতে এমন সহজভাবে আছে বলে আমি জানি নে। সাহিত্যের ভূমিতে ওর উৎপত্তি, তার মধ্যেই ওর শিকড়, কিন্তু ও শাখায় প্রশাখায় ফলে ফুলে পল্লবে সংগীতের আকাশে স্বকীয় মহিমা অধিকার করেছে। কীৰ্তন-সংগীতে বাঙালির এই অনন্যতন্ত্র প্রতিভায় আমি গৌরব অনুভব করি”। 
কীর্তনগান ভালো লাগার আরেকটি কারণ আবিষ্কার করেছেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি বলেছেন, - “কীর্তনের আরও একটি বিশিষ্টতা আছে। সেটাও ঐতিহাসিক কারণেই । বাংলায় একদিন বৈষ্ণব ভাবের প্রাবল্যে ধর্মসাধনায় বা ধর্মরসভোগে একটা ডেমোক্রাসির যুগ এল । সেদিন সম্মিলিত চিত্তের আবেগ সম্মিলিত কণ্ঠে প্রকাশ পেতে চেয়েছিল । সে প্রকাশ সভার আসরে নয়, রাস্তায় ঘাটে । বাংলার কীর্তনে সেই জনসাধারণের ভাবোচ্ছসি গলায় মেলাবার খুব একটা প্রশস্ত জায়গা হল”। 
এছাড়া চৈতন্যদেবের প্রভাব সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য করা যায় রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ উপন্যাসের চরিত্র নির্মাণে। প্রথমের চোখে পড়ে উভয়ের দেহসৌষ্ঠবের দিকে। চৈতন্যদেবের বিপুল জনপ্রিয়তার একটি অন্যতম কারণ অবশ্যই তাঁর দেহকান্তি। চৈতন্যচরিত কাব্যগুলি অনুসরণ করলে দেখা যায় শ্রীচৈতন্যদেব ছিলেন ‘সিদ্ধপুরুষের প্রায় পরম-গম্ভীর’। তাঁর ‘সিংহগ্রীব গজস্কন্ধ’, আজানুলম্বিত ভুজ কমল নয়ন সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করত। তাই তো রামানন্দ তাঁকে দেখে বলেছিলেন, -
“সূর্যশত সমকান্তি অরুণ বসন 
সুবলিত প্রকাণ্ড দেহ কমল লোচন”  
আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গোরার রূপের বর্ণনা দিয়েছেন এইভাবে, “তাহার গায়ের রঙটা কিছু উগ্র রকমের সাদা … মাথায় সে প্রায় ছয় ফুট লম্বা, হাড় চওড়া, দুই হাতের মুঠা যেন বাঘের থাবার মতো বড়ো … তাহার মুখের গড়নও অনাবশ্যক রকমের বড়ো এবং অতিরিক্ত রকমের মজবুত; … ওষ্ঠাধর পাতলা এবং চাপা; তাহার উপরে নাকটা খাঁড়ার মতো ঝুঁকিয়া আছে। দুই চোখ ছোটো কিন্তু তীক্ষ্ণ”; …
গোরার দেহসৌষ্ঠব রচনায় অবশ্যই আমরা চৈতন্যদেবের প্রভাব লক্ষ্য করতে পারি। তাই তো গোরার ‘হোমের আগুনের’ মত চেহারা দেখে বিস্মিত হরিমোহিনী বলেছিল, “তোমার কথা অনেক শুনেছি বাবা! তুমিই গৌর? গৌরই বটে! ওই-যে কীর্তনের গান শুনেছি— 
“চাদের অমিয়া-সনে   চন্দন বাটিয়া গো
কে মাজিল গোরার দেহখানি”l
চৈতন্যদেবের মত রবীন্দ্রনাথের চেহারাতেও এমন অমোঘ আকর্ষণ ছিল যাকে এড়িয়ে যাবার সাধ্য কারও ছিল না। প্রত্যক্ষদর্শী রঘুনাথ দাসের কাছে চৈতন্যদেব ‘হেমাদ্রী’ রূপে প্রতিভাত হয়েছিলেন। 'গোরা' উপন্যাসের গৌরমোহনের মতোই রবীন্দ্রনাথের চেহারাও ছিল ‘রজতগিরির মতো’ এবং ‘তাহাকে না দেখিয়া থাকিবার জো নাই, সে সকলের মধ্যে চোখে পড়িবেই’। ১৮৯৪ সালের ২রা সেপ্টেম্বর রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে যাবার সময় একবার নবীনচন্দ্রের আহ্বানে রানাঘাটে নামেন। এই উপলক্ষে নবীনচন্দ্রের ‘আত্মজীবনী’তে বত্রিশ বছর বয়সের রবীন্দ্রনাথের একটি বর্ণনা আছে, “দেখিলাম সেই ১৮৭৬ খৃষ্টাব্দের নবযুবকের আজ পরিণত যৌবন। কি সুন্দর, কি শান্ত, কি প্রতিভান্বিত দীর্ঘাবয়ব। উজ্জ্বল গৌরবর্ণ, স্ফুটনোন্মুখ. পদ্মকোরকের মত দীর্ঘ মুখ, মস্তকের মধ্যভাগে বিভক্ত কুঞ্চিত ও সজ্জিত কেশশোভা… 
সুবর্ণোদর্পণোজ্জ্বল ললাট, ভ্রমরকৃষ্ণ গুম্ফ, শ্মশ্রু শোভান্বিত মুখমন্ডল … দীর্ঘ ও সমুজ্জ্বল চক্ষু; সুন্দর নাসিকায় মার্জিত সুবর্ণের চশমা”। কেবল দৈহিক সৌন্দর্যই নয়, গোরার সঙ্গে গৌরাঙ্গের জীবন ও কর্মধারার সাদৃশ্যও লক্ষ্য করতে পারি। নবদ্বীপের নিমাইয়ের ন্যায় রবীন্দ্রনাথের গোরাও ছোটবেলা থেকে পাড়ায় ও স্কুলে ছেলেদের সর্দারি করত। তার দুরন্তপনায় সকলে অতিষ্ঠ হয়ে উঠত। আবার বয়সকালে যে কোনও সভায় বক্তৃতা দিতে, নিমাইয়ের মত নেতৃত্বদানে এবং প্রতিপক্ষকে যুক্তি-তর্কে পরাস্ত করতে গোরা ছিল সিদ্ধহস্ত।
প্রথম দিকে গোরার মনে জাতপাত নিয়ে গোঁড়ামি ছিল। হিন্দু-সংস্কার, আচার-আচরণ, সে অক্ষরে অক্ষরে পালন করত। কিন্তু গোরা যখন ভ্রমণে বেরিয়ে ভদ্র শিক্ষিত কলকাতা সমাজের বাইরে গ্রামে গ্রামে ঘুরে দেশের প্রকৃত অবস্থা ও মানুষের দুর্দশা প্রত্যক্ষ করল তখন তার যাবতীয় সংস্কার ও ধর্মীয় গোঁড়ামির ঊর্ধ্বে মানুষের স্নেহ-ভালবাসা, আবেগ-অনুভূতি, মানবিকতার গুরুত্ব অনেক বেশি। তাই ক্ষুধা-তৃষ্ণায় নিতান্ত ক্লান্ত হওয়া সত্ত্বেও দুর্বৃত্ত অন্যায়কারী মাধব চাটুজ্জের বাড়িতে গোরা অন্নগ্রহণ, এমনকি জলস্পর্শ পর্যন্ত করেনা। সে চলে যায় সেই নাপিতের বাড়ি, যেখানে পিতৃহারা মুসলমানের ছেলে মানুষ হচ্ছে, যে নাপিত হিন্দুর হরি ও মুসলমানের আল্লার মধ্যে কোনও তফাৎ দেখে না। এইভাবে গোরার মধ্যে প্রকৃত ভারতবোধের উন্মেষ ঘটে।
এ প্রসঙ্গে আমাদের মনে পড়ে যায় শ্রীচৈতন্যদেবের কথা। ষোড়শ শতকে চৈতন্যদেবের মধ্যেই আমরা প্রথম হিন্দু-মুসলমান, ব্রাহ্মণ-পন্ডিত-বৈষ্ণব, উচ্চ-নীচ জাতি সকলকে একত্রিত করার মত নেতৃত্ব দানের শক্তি লক্ষ্য করে থাকি। তাঁর নেতৃত্বেই সেদিন নবদ্বীপের অসংখ্য মানুষ একত্রিত হয়ে কাজীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে বিরাট শোভাযাত্রার আয়োজন করেছিল। যা ছিল ভারতবর্ষের ইতিহাসে প্রথম গণ-আন্দোলন। ঘটনাটা ছিল - মহাপ্রভু যখন প্রবল হরিনাম আন্দোলন শুরু করেছেন কিছু গোঁড়া ব্রাহ্মণ ধর্ম ভয়ে ভীত হয়ে নবদ্বীপের শাসক চাঁদ কাজীর কাছে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। কাজী উচ্চস্বরে নাম-সংকীর্তনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে, মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য সেই নির্দেশ অমান্য করে সংকীর্তন চালিয়ে যেতে থাকেন। কাজী তখন সেই সংকীর্তন বন্ধ করার জন্য তাঁর পেয়াদা পাঠান এবং তাঁরা সেই সংকীর্তনকারীদের কয়েকটি মৃদঙ্গ ভেঙে দেয়। সত্যকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য ভারতে প্রথম আইন অমান্য আন্দোলনের সূচনা এখান থেকেই হয়েছিল। কাজীর আইন অমান্য করে লক্ষ লক্ষ ভক্ত সহযোগে বিশাল শোভাযাত্রা শ্রীচৈতন্যের নেতৃত্বে নবদ্বীপের রাজপথে হরিনাম সংকীর্তন করতে করতে কাজীর বাড়ির দিকে এগিয়ে আসে। ভীতসন্ত্রস্ত কাজী শ্রীচৈতন্যের আশ্বাস পেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলে দু’জনের মধ্যে হিন্দু শাস্ত্র ও কোরান সম্পর্কে আলোচনা হয়। শুধু তাই নয়, সেই সময়ে জগাই-মাধাইকেও কৃষ্ণ নাম দ্বারা উদ্ধার করেন। কাজীদলনের পর নগর ভ্রমণে বেরিয়ে নিমাই সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষ তাঁতী, গোয়ালা, গন্ধবণিক, মালাকার, শঙ্খবণিক, তাম্বুল প্রভৃতি বৃত্তিজীবীদের প্রত্যেকের ঘরে ঘরে গিয়ে অন্তরঙ্গতা স্থাপন করেন।
“নগরে আসিয়া করে বিবিধ বিলাস
সভার সহিত করে হাসিয়া সম্ভাষ”
এমনকি খোলাবেচা শ্রীধরের বাড়িতে তার দুয়ারে পড়ে থাকা লোহার পাত্র থেকে জল পান করেন, -
“নৃত্য করে মহাপ্রভু শ্রীধর অঙ্গণে
জলপূর্ণ পাত্র প্রভু দেখিলা আপনে॥ 
ভক্ত প্রেম বুঝাইতে শ্ৰীশচীনন্দন। 
লৌহপাত্ৰ তুলি লইলেন ততক্ষণ॥ 
জল পিয়ে মহাপ্ৰভু সুখে আপনার। 
কার শক্তি আছে তাহা নয় করিবার”॥
তাই রবীন্দ্রনাথ কাব্যে জানান, “যারে বলে ভালোবাসা, তারে বলে পূজা।” এবং বৈষ্ণবধর্মের উদারতার মন্ত্রে দীক্ষিত রবীন্দ্রনাথ ‘গোরা’ উপন্যাসে ‘গোরা’-র মুখ দিয়ে বলেন, - “আপনি আমাকে আজ সেই দেবতারই মন্ত্র দিন যিনি হিন্দু মুসলমান খ্রিস্টান ব্রাহ্ম সকলেরই, যার মন্দিরের দ্বার কোনো জাতির কাছে, কোনো ব্যক্তির কাছে কোনোদিন অবরুদ্ধ হয় না, যিনি কেবলই হিন্দুর দেবতা নন- যিনি ভারতবর্ষের দেবতা”।
বৈষ্ণব ধর্মে ভালবাসা যেমন মানুষে মানুষে, তেমনি ভগবানে ও মানুষেও। বৈষ্ণবদের মতে ঈশ্বর আনন্দস্বরূপ। তিনি আনন্দময় ভগবানরূপে ভক্তের সঙ্গে লীলা করতে ভালোবাসেন। ভক্ত যেমন ভগবানকে চায়, তেমনি লীলারস আস্বাদনের জন্য ভগবানেরও প্রয়োজন ভক্তকে। এই তত্ত্বটি রবীন্দ্রনাথ তাঁর একটি গানের দুটি পঙক্তিতে নিবেদন করেছেন সরলতম ভাষায়। রবীন্দ্রনাথ যখন বলেন, -
“তাই তোমার আনন্দ আমার 'পর, তুমি তাই এসেছ নীচে।
আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর, তোমার প্রেম হত যে মিছে”।
অনেকে মনে করেন রবীন্দ্রনাথ ও চৈতন্যদেব বিপরীত মনের মানুষ। জীবনের সুখ দুঃখ আনন্দবিরহ ও ঈশ্বরানুভবকে চৈতন্যদেব ভাবোন্মদনায় প্রকাশ করেছেন, রবীন্দ্রনাথ সমজাতীয় অভিজ্ঞতাকে কাব্যে, গানে প্রতীক-প্রতিমানে প্রকাশ করেছেন। চৈতন্যদেব সন্ন্যাস নিয়েছিলেন, আর রবীন্দ্রনাথ তো বলেই দিয়েছেন, ‘বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি সে আমার নয়’, মোহই তাঁর মুক্তি, প্রেমই তাঁর ভক্তি। তাই তো ‘বৈষ্ণব কবিতা’-য় লিখলেন, -
“সত্য করে কহ মোরে হে বৈষ্ণব কবি,
কোথা তুমি পেয়েছিলে এই প্রেমচ্ছবি,
কোথা তুমি শিখেছিলে এই প্রেমগান
বিরহ-তাপিত। হেরি কাহার নয়ান”…
ঋণঃ রবীন্দ্ররচনাবলী। একত্রে রবীন্দ্রনাথ – অমিতাভ চৌধুরি। ইন্টারনেট।

কবিতা

সপ্তর্ষি গাঙ্গুলী

খড়দা, কলকাতা

কবিতাঃ সপ্তর্ষি গাঙ্গুলী
FB_IMG_1603447196421.jpg

জুলাই ২০২১ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

প্রণয় মরমিয়া

 

যে আঁখিতে রেখে আঁখি তব পলক নাহি পড়ে,

সেই আঁখিপটে বারিধারা নীরবে কেমনে সহিতে পারে!

হৃদয়াম্বরে চলে অনুক্ষণ এক অদ্ভুত মেঘরোদ্দুর খেলা,

অনেক কথাই তব আঁখিপানে চেয়ে‌ থেকে গেল অবলা।

ঘনিয়ে এল সহসা এ কোন্ গহীন আঁধার রাতি!

মম হৃদয়প্রাঙ্গনে নিভিয়ে তব ভালোবাসার উজ্জ্বল বাতি।

সেই আঁধারে না হেরি তোমায় এক লহমা তিষ্ঠতে না পারি,

বয়ে যাক এমন‌ই যেমনি চলেছে বয়ে  ভালোবাসার নিষ্কলুষ বারি।

ব্যাকুল হৃদয়; আকুল চিত্ত নিবৃত্ত করত যে যাদুস্পর্শ,

সে যাদু আজ যেন কোথায় গিয়েছে হারিয়ে! এ বড় বেদনাতুর অচেনা স্পর্শ।                             

প্রণয় কুহক

 

জানি না এ কোন্ অজানা ঝটিকা বয়ে গেল মম জীবনে!?

যে ঝড় নিশান রেখে গেল মোর জীবনভর রোদনে।

কিসের‌ও প্রতীক্ষায় থাকি বসে তব পাষাণ হৃদয়দুয়ারে!?

যে দুয়ার মোরে দিয়েছে ফিরায়ে নিদারুণ অনাদরে।

কল্পনার তরণী ভেসে চলে তবু প্রেমের সিন্ধু বেয়ে,

জানি না কোথায় থামবে মম স্বপ্ন‌উড়ান গিয়ে!?

অলীক স্বপ্ন;

তবু যে মগ্ন,

যেন কোনো তপতী করল ভগ্ন।

স্বপ্নভঙ্গে না হেরি তারে;

অঞ্চলছায়া হাতছানি দিয়ে ডাকে।

ইহলোকের অতৃপ্ত প্রেম স্বপ্নে তার স্নেহালিঙ্গনে পাড়ি দিতে চায় বাস্তবের নবজন্মালোকে।

স্নেহ পরশে ব্যথিত সে হৃদয় আকুল হয়ে হাহাকার করে কাঁদে।

বলে ওঠে যেন না পড়ি আর আমি কার‌ও নিপুণ প্রেমাভিনয়ের ফাঁদে।

parjayee.jpg

হায় রে পরিযায়ী

লাখো লাখো মাথা ঐ হয়েছে সামিল পদব্রজে রাজপথে,

বাসা ফেরবার অঙ্গীকারে অসাধ্যকে যেন তারা করবেই সাধন।

দৃঢ় প্রত্যয় পুঁজি নিয়ে তারা সকল ঝঞ্ঝা করবে লঙ্ঘন,

করবে না পরোয়া যাত্রাপথে আগত আর কোনো অদৃশ বাধন।

ওদের চোখের তারায় ক্ষণে ক্ষণে যেন স্ফুলিঙ্গের মত উঠছে জ্বলে প্রবঞ্চনার অনল।

পরিবার পরিজনেরা সব কাটাচ্ছে বসে উদ্বেগের প্রহর;

সেবন করে অধীর প্রতীক্ষার গরল।

বাজি রেখে বিধাতার নিকট তাদের ভালোবাসা,

নিরন্তর ওদের ভার্যারা যেন চেলে যাচ্ছে পতির মৃত্যুঞ্জয়ী পাশা।

ফিরে যদি আসে সকল বাধাবিপত্তি জয় করে একবারের জন্যও,

করবে পরশ প্রাণনাথের কায়া; পূর্ণ হবে চিত্তের একমাত্র নিবিড় আশা।

ওরা বহুদূর দেবে পাড়ি; মনে ক্ষীণ আশা বাসা ফিরে পাবে দেখতে সন্তানের আনন

নাই বা থাক মুক্তগগনে বিহঙ্গের ন্যায় উন্মীলিত করার মতন ওদের পেলব ডানা;

তা বলে কি আর ওদের নেই এটুক অধিকার যে

নিজ মুলুকেই প্রদেশ হতে প্রদেশান্তরে থাকবে না

ওদের অবাধ আনাগোনা! 

মাইলের পর মাইল অতিক্রমণ করে

ওদের শ্রান্ত চরণযুগল ক্ষান্ত হয়ে

যখন খুঁজে নিচ্ছে বিশ্রামের জন্য একটু নির্বিদ্ম আশ্রয়

এই সড়কেই,

তখনই পণ্যবাহী কিছু শকট ঘানির মত যাত্রাপথে অক্লেশে ওদের পরিশ্রান্ত তন্বী

ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে ভূতলে পিষে বিলীন করে দিয়ে যাচ্ছে পলকেই।

দিবানিশি একযোগে জনসাধারণের পায়ের নীচের ভিত যারা করছে সুদৃঢ় ;

আবার তুলছে গড়ে মাথার ওপর সুরক্ষিত এক ছাত।

অত্যাশ্চর্যভাবেই সমাজের এই বিশ্বকর্মাদের দেহক্ষরিত 

নির্ঝর রক্তপাত দেখেও থেকে যায় নির্বিকার;

স্বার্থান্বেষী এই মানবজাত। 

জনহিতে সমর্পিত অকালে ঝরে যাওয়া ওদের অমূল্য জীবনের সন্দেশ আর রাখে না 

মূক এ সমাজ; শুধু আঙুল তুলে বলে ওদের করুণ এই পরিণতির জন্য আর কেউ নয়;

ওদের হঠকারী গৃহযাত্রাই কেবল দায়ী।

আসলে যে ওদের নেই কোনো নাম; নেই কোনো জাত; ওড়বার পাখনা না থাকলেই বা!

ওদের কেবল একটিই পরিচয় সমাজের সেঁটে দেওয়া সংকীর্ণ তকমা "পরিযায়ী"।

প্রেমচরিত মানস

লাজে নত আজ তোমার আঁখি আমার হৃদয়ের যে কথাটি শ্রবণে,

জানো কি হৃদয়কাননে কতকাল আমি তারে রেখেছি এত যতনে!?

রঙিন বসন্ত রাঙিয়ে দিয়ে যায় চলে কামনার সকল গোলাপ, হোক নয় লাজে!

তুমি বৈ আর কেই বা শুনবে আমার অন্তরাত্মার অবুঝ প্রলাপ?

তোমার মধুর‌‌‌ পরশে মনের গোপন কথাটি র‌ইল না আর সঙ্গোপন,

অন্তরে তোমার নিভৃতে করল আমার নিগূঢ় ভালোবাসার বীজ বপন।

লাজের অন্তরালে তোমার অমলিন হাসি;

দেয় যেন মোরে এক পরম তৃপ্তি‌,

কলাপ জড়ানো তোমার কেশবিন্যাসের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারে সোনালি এক আলোকদীপ্তি।

দখিনা বাতাস আসে নিয়ে বয়ে তোমার চিরন্তন প্রেমের অরূপ বাণী,

স্নেহচুম্বনে আপন করে আজ এ কোন ঋণে তুমি করলে আমায় ঋণী!?

পঁচিশে পদার্পণ মধুর মিলন

 

ই যেন সেইদিন হাতের ওপর হাতটি রাখবার ছলে,

পানপাতাতে মোড়া লাজের অন্তরাল হতে হৃদয়হরণ খেলা চলে।

উত্তুরে হিমেল হাওয়ার মায়াবী আবেশে বাঁধা পড়েছিল সেদিন মনযুগলের যে গাঁটছড়া,

আজ‌ও খুঁজে চলে চপল সে দুই চিত্ত একে অপরের নির্বিদ্ম আশ্রয় হয়ে পাগলপারা।

অগ্নিসাক্ষী রেখে বাধাবিপত্তির দুস্তর পারাবার অতিক্রমণ করে সূচনা হয়েছিল তোমাদের যে পথচলা,

বিরল সে বোঝাপড়ায় অক্লেশে কপোতমিথুনের কেটে গেল পঁচিশটা বছর; নয় এ কাহিনী মিছেবলা।

প্রবহমান কালের দুর্বার স্রোত নিরন্তর বয়ে নিয়ে চলেছে মুহুর্তবিতানভেলা ,

পূবাকাশে প্রদ্যোতিত রবিও আজ সকলের সাথে মেতেছে প্রমোদে ; দেখতে পুণরায় চিরন্তন দুই অন্তরের মিলনমেলা।

মনের মণিকোঠায় আজ‌ও উদ্ভাসিত হয়ে রয়েছে তোমাদের সামীপ্যে অতিবাহিত আমার মধুর স্মৃতিবিজড়িত শৈশব —

মনে কি পড়ে রঙীন সেই সকল দিনগুলিতে ভালোবাসা আর মমতার তুলির টানে আমার মধ্যেই যেন রচেছিলে তোমাদের মানসপুত্রের অবয়ব।

নিজ অগোচরেই কখন‌ও বা তোমাদের করেছি অতিশয় হতাশ;  তবু থাকেনি কখন‌ও এতটুক অপূর্ণ তোমাদের স্নেহাধার,

পূর্ণ হোক চাই আমার নিখাদ এ মনস্কাম — 'সময়ের ডালি প্রেমের আতরে ভরিয়ে নিয়ে জীবনে এমন মধুর পঁচিশ আসুক বারেবার'।

কবিতা

নাজমুল হক

ঢাকা, বাংলাদেশ

কবিতাঃ নাজমুল হক

জুলাই ২০২১ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

touch.jpg

জন্ম: পিরোজপুর জেলায়। বাংলা বিষয়ে স্নাতক সম্মান সহ এমএ পাশ করার পর দীর্ঘ ১৭ বছর শিক্ষকতা পেশায়। বসবাস ঢাকায়।শৈশবের লেখক হওয়ার ইচ্ছা বিসর্জন দিয়ে শুধু জ্ঞান বিতরণে নিজেকে সমর্পণ করেছি। কিন্তু একান্ত নিজের মনের খোরাক এই কবিতার হাত ধরে চলি নিজের জন্য। একান্তে অনুভূতির অনুরণন, উপলব্ধি ও বোধের বিক্ষোভ থেকেই মাঝে মাঝে জন্ম নেয় কিছু ছেলে মানুষী কবিতা। ব্লগে তা প্রকাশিত হলে কেউ কেউ তাদের ভালোলাগার কথা জানায়। তাই পত্রিকায় পাঠানোর সিদ্ধান্ত।

শঙ্খিনী কথন

কোন এক শঙ্খিনী নারীর হৃদয়ের স্পর্শ পাবো বলে
আমি এই পৃথিবীর পথে হেঁটে ছিলাম একদিন।
সমুদ্র মন্থনে মন্থনে চেয়েছিলাম আত্মশুদ্ধি,
থেকেছি তপস্যায় মগ্ন অশ্বত্থের মত,
তবুও মেলেনি বুদ্ধের বোধি লাভ
কিংবা শঙ্খিনীর হৃদয়ের সন্ধান।
একদিন ছিল সব পথ ধাবমান শঙ্খিনী হৃদয়ের পানে
হেঁটেছি আমি পথ পথান্তরে, বিমূর্তের মোহে।
বিমূর্ত তৃষ্ণারা জেগেছিল আত্মার ভেতর।
তবে কি সৃজন তৃষাই ঢের বেশি টানে ?
তবে কি মস্তিষ্কের তন্ত্রীতে কিংবা
বিমূর্ত ভাবলোকে শঙ্খিনী নারীর সৃজন।

নিশিকন্যার কাব্য
 

১.
শুনেছিস  মেয়ে
তোকে বলে কলঙ্কিনী সবে
যারা রাতে মধুর লোভে
ঢিল মারে তোর চাকে।
শুনেছিস মেয়ে
তারাই নাকি দিনের বেলা
সাজে চকচকে পোশাকে।
সুগন্ধি আতর মাখে।
জানিস কি তুই
সভ্য লোকের সমাবেশে
তোকেই অসভ্য ভাষায়
নানান নামে ডাকে।
এরাই আবার রাতের বেলায়
কড়া নেড়ে তোর দরজায়
কেমন করে মধুর স্বরে
প্রাণহরিণী ডাকে।
ভাবছিস মেয়ে
ডুবে গেছিস পাপের পাঁকে
পেটের ক্ষুধা মিটবে বলে
দিচ্ছিস সাড়া ডাকে।
সেই পাঁকেতে ডুব দিয়ে যে
খুঁজছে মনের রত্ন আকর,
পাপ পঙ্কিল বলছে তোরই
পেটের ক্ষুধাটাকে।
হাসিস নে মেয়ে
ঘৃণা চোখে, উপহাস মেখে ঠোঁটে,
সাধু সন্তর লেফাফা জড়ানো
আমার কথা শুনে।
ভাবিস মুখটি মুখোশেই ঢেকে চলি
নিশিকন্যাকে দিনের আলোয় ভুলি।
আবার রাতে  কামনা কুকুর হয়ে পাড়া
জাগাবো আকাশ বিদীর্ণ ডাকে।

২.
দেখ মেয়ে তোর চাউনি বাঁকা
স্বপ্ন আঁকা চোখের কোণে
চাঁদের আলোর ঝলক লাগে।
অন্ধকারে পথের ধারে
কিংবা পার্কে বেঞ্চে বসে
আয়েশ করে বেনুনী নিয়ে
খেলা করিস মগ্নতাতে।
ঠোঁট রাঙানোর সস্তা প্রলেপ
আলগোছে তুই মেখেই চলিস
চোখ এঁকেছিস কাজল দিয়ে
লাল ফিতেতে বেনুনী বাঁধিস।
এমনি করে প্রতিটি রাতে
পসরা সাজাস নিজ শরীরে
দেহের দামে দেহের ক্ষুধা
অপুরুষগুলো নেয় মিটিয়ে।
ডাকে তোকে নিশিরানী
রানীর মতই দানের শরীর।
উপঢৌকন দিচ্ছে তোকে
প্রজারা সব পালা করে।
তোকে নিয়েই কাব্য করি
চাটুকারি নেই ভাড়ারে।
হতে চাই তোর সভা কবি
নিজেকে বিকিয়ে বাজারে।
আমায় দেখে তাইতো হাসিস
এই হাসিটা তোকেই মানায়।
নপুংসক আবেগটা দেখে
বিদ্রূপ হানিস কাব্য কথায়।
 
 

গল্প 

ঘোষালবাবুর প্রত্যাবর্তন

জুলাই ২০২১ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

ঘোষালবাবুর

প্রত্যাবর্তন

গীতাঞ্জলী ঘোষ

oldman1.jpg

১)
-
অ্যাই প্যালা, ঐ ইংরেজি বইগুলো খুঁজলি? 
- কোন ইংরেজি বইগুলো? 
- ক্লাস সেভেনের। 
- ওগুলো এখন কোথায় পাব? ওগুলো তো দুদিন আগেই বিক্রি করে দিলে টিন ভাঙা, লোহা ভাঙাকে। 
- কবে? ও হ্যাঁ, তাই তো। আর কি বিক্রি করেছি বল তো? 
- উফ্ দাদাবাবু, তুমি এত তাড়াতাড়ি ভুলে যাও কি করে? ঐ বড়বাবুর আলমারিতে কি সব পুরনো গল্পের বই,  শেষ হওয়া হোমিওপ্যাথির কাচের শিশি, তারপর ঐ  হরিতকি, বোতাম ভর্তি ছোটো কৌটোগুলো। কালি ফুরিয়ে যাওয়া এক বাক্স পেন সবই তো টেনে বার করলে গো তুমি আর বৌদি মিলে। 
- আবার সব ফেরত আনতে হবে। তুই একটু খোঁজ ঐ টিন-লোহা বিক্রির ছেলেটা যদি আবার পাড়ায় আসে। 
কথাটা বলেই প্যালার প্রত্যুত্তরের আশা না করে রমাপতি ঘোষাল অন্দরমহলে ছুটলেন। ধুলিগড়ের জমিদার হল ঘোষালরা। তাদের পাঁচ পুরুষ আগে দশপতি ঘোষাল ছিলেন একজন দাপুটে জমিদার। তাঁর দাপটে বাঘে, গরুতে একঘাটে জল খেত। দশপতি ঘোষালের জমিদারি শুধু ধুলিগড় নয়, আশে পাশে আরও কয়েকটি গ্রামের ওপর তিনি রাজত্ব করতেন। 
তখন চলছিল ইংরেজ শাসনকাল। পলাশীর যুদ্ধের বিজয়ের পর নতুন করে আরও প্রবল ক্ষমতায় হাজির বাংলায় ইংরেজ শাসন। যে সমস্ত জমিদাররা তখন ইংরেজদের তাবেদারি করে জমিদারি চালাতেন, দশপতি ঘোষাল তাঁদের মধ্যে অন্যতম। গরিব কৃষকদের কাছ থেকে কি ভাবে খাজনা আদায় করা যায়, তা তিনি মোক্ষম জানতেন। কিন্তু ঘোষালদের এই রাজত্ব বেশি পুরুষ টেকেনি। বংশ পরম্পরায় তাদের প্রতিপত্তি, সাম্রাজ্য সবকিছুই সংকুচিত হতে থাকে। কালক্রমে তলানিতে ঠেকে। এখন তাদের উপার্জনের একমাত্র রাস্তা হল ঐ পেল্লাই যৌথ বাড়ি আর কিছু যৌথ সম্পত্তি। এই বাড়ির ষষ্ঠ বংশধর হলেন রমাপতি ঘোষাল। সেই পুরোনো জমিদারি না থাকলেও গ্রামের মানুষ এখনও তাদের এককালীন জমিদার জ্ঞানে সম্মান করে। রমাপতি ঘোষালরা তিন ভাই। রমাপতি ছাড়া বাকি ভাইয়েরা তাদের চাকুরে ছেলের কাছে চলে গেছে। কেউ কলকাতায়, কেউ মুম্বাই আবার কেউ নিউ ইয়র্কে। রমাপতির দুই ছেলে অকর্মণ্য, তারা শুধু বাপ ঠাকুরদার সম্পত্তির ওপর শ্যেন দৃষ্টি হেনে বসে আছে। অবশ্য তাদের বাকি কাকা, জ্যাঠারাও কেউ কম যায় না। দূরে থেকেও সম্পত্তির ভাগ ছাড়তে তারা কেউ রাজি নয়। দুমাস কুড়ি দিন হতে চলল রমাপতি ঘোষালের বাবা উমাপতি ঘোষাল গত হয়েছেন। আর তাঁর শ্রাদ্ধ শান্তি শেষ হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই সম্পত্তি নিয়ে শুরু হয়ে গেছে খণ্ডযুদ্ধ। পারিবারিক উকিলের থেকে জানতে পারা গেছে ঈশ্বর উমাপতি ঘোষাল সম্পত্তি ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে কোনো উইল  করে যাননি। তারপর থেকেই সকলের মাথায় হাত- কি হবে এবার। শ্বশুর মারা যাওয়াতে বাড়ীর তিন জা বেশ মনের সুখে নিজেদের মধ্যে ভাব ভালোবাসা করে ছিলেন, ঠাট্টা হাসি-মজা ভালোই চলছিল। ভেবেছিলেন এই বাড়ি এবার ভাগ হবে। কিন্তু এখন তাদের মধ্যে কথা বন্ধ, একে অপরের দিকে সন্দিগ্ধ দৃষ্টি নিয়ে তাকাচ্ছেন- এই বুঝি কেউ কারোর ভাগটা মেরে দিল। অন্যদিকে ভাইয়েরা সব ফেরার টিকিট ক্যান্সেল করে দিয়েছেন, একটা হেস্তনেস্থ করে তবেই যাবেন সবাই। শেষ কিছুদিনে এত তর্কাতর্কি হয়েছে যে সকলে মিলে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আর তার ফলেই সমগ্র বাড়িতে এখন হুলুস্থুল কাণ্ড চলছে। সেইদিনের সিদ্ধান্তে ঠিক হয়েছে যে একটা প্ল্যানচেটের আয়োজন করা হবে। তাতে স্বর্গবাসী পিতাকে মর্ত্যে ক্ষণিকের জন্য নামিয়ে জিজ্ঞেস করা হবে কার ভাগে কতটা সম্পত্তি পড়া উচিত। রমাপতি ঘোষাল যেহেতু এই বাড়ির দেখাশোনা করেন তাই তাঁর মতে তাঁরই সর্বস্ব প্রাপ্য। তাঁর মাথায় চিন্তা, বাবা এসে যদি নিজের শখের জিনিসগুলো খোঁজেন, তাহলে কি হবে। বাবার শখের সকল জিনিস তিনি তো বিক্রি করে দিয়েছেন। রমাপতি ভাবলেন, তাকে যেহোক করে সব জোগাড় করতে হবে। কোনোভাবে যদি স্বর্গীয় বাবাকে ম্যানেজ করা যায়, তাহলে তো কেল্লা ফতে। 


(২)
মাথার ওপর দুপুরের চড়চড়ে কড়া রোদ। জ্যৈষ্ঠের হাঁসফাঁস গরম। মাথা থেকে দরদর করে ঘাম বয়ে চলেছে পা অবধি। প্যালা তাও থামছে না। সে সাইকেলটা যতটা জোরে পারা যায় প্যাডেল করছে। বাড়িতে গিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব খবরটা তাকে  দিতে হবে। আজ সকাল সকাল সে ছুটেছিল পুরনো বইয়ের দোকান, পুরনো লাল হয়ে আসা পাতার বই চাই। উমাপতি ঘোষাল লাল হয়ে আসা পুরনো বইয়ের সোঁদা গন্ধ ভালোবাসতেন। তাই এখন সেই খোঁজ চলছে। প্যালা ঘোষাল ফটকের সামনে এসে সাইকেলের ব্রেকটা কষল। দেওয়ালে সাইকেলটা ঠেসিয়ে হাওয়াই চটির শব্দ তুলে ঘরে ঢুকল। চারপাশটা একবার দেখে নিয়ে বৈঠক খানায় গিয়ে উঁকি দিল। রমাপতি বাবু চেয়ারে বসে ঢুলছেন। 
দাদাবাবু, 
কে? অ তুই। এত তাড়াতাড়ি চলে এলি। কি হল? আর খালি হাত কেন? বইগুলো কই?
আরে বই আনব কি করে। গিয়ে যা দেখলাম। 
কী দেখলি?
বলছি বলছি, প্যালা গলার স্বরটা আরও নামিয়ে বলল। গিয়ে দেখলাম মেজোবাবু আর ছোটোবাবুও হাজির। 
মানে? ওরা জানল কী করে? 
সে আমি কি জানি। আমি যখন বইয়ের দোকানে কালুদা বলে জোরে চেঁচাতে যাব, মানে গলা দিয়ে ডাকটা বেরোতে যাচ্ছিল, ঠিক তখন দেখি ঐ ওদের দোকানের ঠিক পাশটায় যেখানে পুরনো বই বাছাই হয়, ওখানে মেজবাবু আর ছোটবাবু দাড়িয়ে আছে। আমি তো ওদের দেখেই চুপচাপ কেটে পড়লাম। দিয়ে তাড়াতাড়ি করে আসছি খবরটা তোমায় দেব বলে। যা গরম পড়েছে, পুরো গ্রামটা মনে হচ্ছে আগুনের কুন্ডে ঢুকে পড়েছে। উফফ!
বলে প্যালা তার কাঁধে রাখা রংচটা গামছা নিয়ে মাথার কাছে হাওয়া করতে লাগল। কথা গুলো শুনতে শুনতে রমাপতি ঘোষালের মুখটা কেমন শুকিয়ে  গেল। চোখ দুটো ছোটো ছোটো করে তিনি চুলচেরা বিশ্লেষণের দৃষ্টিতে খুঁজতে লাগলেন তাঁর ভাবনাটা কি করে জানল মেজো আর ছোটো। তিনি তো কাউকে বলেননি।
যাই হোক, তোকে আর কিছু করতে হবে না। আজ রাতে ঝন্টু বাবা আসবেন, তাঁর সাহায্যে আগে আমরা বাবামশায়কে নামাই, তারপর দেখা যাবে। কথাটা বলে দুহাত জোর করে মাথায় ঠেকালেন। 
এদিকে সমগ্র বাড়ি জুড়ে তোড়জোড় চলছে স্বর্গীয় পিতাশ্রিকে মর্ত্যে আহ্বানের। তিনি কি খেতে ভালোবাসেন, তাঁর হুকো, কলকে সব এনে হাজির করা হয়েছে। জমিদারি শেষ হয়ে গেলেও স্বর্গীয় উমাপতী ঘোষালের জমিদারীয়ানা ছিল বহাল তবিয়তে। তাই সবকিছুর আয়োজনই চলছে। এখন চিন্তা একটাই। ওপর থেকে নেমে তিনি এই বাড়িতে কতদিন থাকবেন কে জানে। থাকলেই তিনি গোটা বাড়ি ঘুরে সব ঘেঁটেঘুঁটে দেখবেন। বিক্রি করে দেওয়া জিনিসপত্রের খোঁজ করলেই ভয়। 


(৩)
বৈঠক খানার দেওয়াল ঘড়িতে ঢং ঢং করে রাত বারোটার ঘন্টা পড়ল। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। এই ঘরেই যে আরও মানুষ আছে বোঝার উপায় নেই। বাড়ির মহিলারা সব ঘরের বাইরে উঁকি দিয়ে বসে আছেন। পারিবারিক সদস্যদের বাইরেও আছেন ঝন্টু বাবা। তিনি একজন সিদ্ধ তান্ত্রিক। তিনিই প্ল্যানচেটের রাস্তা দেখাবেন সকলকে। ক্ষণে ক্ষণে  ব্যম ভলে উচ্চারণে জানান দিচ্ছেন এই অন্ধকারেও তিনি আছেন। আর আছে পারিবারিক উকিল খগেন চাটুজ্জে। তাঁকেও রাখা হয়েছে যদি বাবা সম্পত্তি ভাগের কাজকর্ম নেমেই শুরু করে দেন। প্যালা তো আছেই, বসে বসে ঢুলছে। ঘরের মেঝেতে গোল হয়ে বসেছে তিন ভাই। মধ্যিখানে ধরানো হয়েছে একটা মোমবাতি। তার শিখা হাল্কা নড়ছে। সেই আধো অন্ধকারে বেশ এক ভৌতিক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। ঘরের কোণায় জ্বলছে চন্দনের ধূপ। ঝন্টু বাবা আদেশ করলেন, সবাই একে অপরের হাত ধরে একমনে নিজেদের বাবাকে স্মরণ করুন। ব্যম্ ভোলে। সকলে তার কথামতো তাই করল, চোখ বন্ধ করে এক মনে শুরু হল প্ল্যানচেটের ক্রিয়া। 
পুরো ঘর নিস্তব্ধ, পিন ফেললে আওয়াজ পাওয়া যাবে। গ্রীষ্মের রাতে মৃদু হাওয়া বইছে। কোথাও একটা রাতচরা পাখি ডেকে উঠল। ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় পনেরো মিনিট হতে চলল কোথাও কিছু নেই। রমাপতি বাবু তার মেজ ভাইয়ের কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বললেন, এই নারায়ণ, এতক্ষণ ধরে তো বসে আছি। বাবামশায় কই এলেন? 
কে জানে। কিছু বুঝতে পারছি না দাদা। 
বোম ভোলে। ঝন্টু বাবা চেঁচিয়ে উঠল। পাশ থেকে ছোটো ভাই গণেশপতি বললেন, 
বাবাজি, আপনি ভোলানাথ কে কেন ডাকছেন? আমরা তো ভুত ডাকছি। ভগবানের নাম শুনলে ভুত যে আর আসবে না। 
বলার সাথে সাথে মোমবাতির আলো নিভে গেল। হাওয়ার গতি বেড়ে গেল। বাইরে বোধ হয় কালবৈশাখীর ঝড় উঠেছে। মেঘ ডাকছে গম্ভীর স্বরে। সবাই চোখ খুলে ফেলেছে। কি হল কি হল রব সকলের দৃষ্টিতে। ঝন্টু বাবাও এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন- কি হল রে বাবা। হঠাৎ একটা গুরুগম্ভীর গলা,
আমায় ভুত কে বললি রে? কেউ বুঝতে পারছে না গলাটা কার। সবাই খালি এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। তুমুল ঝড়ে পূর্ব দিকের জানালার একটা পাল্লা খুলে গেল, সাথে সাথে ভিজে হাওয়া হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ল বন্ধ ঘরে। গণেশপতি বাবু উঠে জানালাটা বন্ধ করে মোমবাতিটা আবার জ্বালালেন। ঘরে আবার আলোক দীপ্তি। সেই আধো আলোয় দেখা গেল প্যালার শরীরটা কেমন দুমড়ে মুচড়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগিয়ে এল। এবার স্পষ্ট বোঝা গেল, 
কে ভুত বললি রে আমায়? তুই? বলেই ঝান্টু বাবাকে টুটি টিপে এক হাতে তুলে ধরল। তুই বলেছিস? এত সাহস তোর। জানিস আমি কে? আমি হলাম জমিদার উমাপতি ঘোষাল। তুই বেটা কে? অবস্থা বেগতিক দেখে গণেশপতি বললেন, বাবামশাই, আসলে আমি বুঝতে পারিনি। আপনি উনাকে ছেড়ে দিন। ভুল হয়ে গেছে বাবামশাই। এই কান মুললাম। 
শুনে প্যালার দেহে উমাপতি ঘোষাল ঝন্টু তান্ত্রিককে ছুড়ে ফেললেন মেঝেতে। সে পড়ি কি মরি করে দৌড় দিল। উমাপতি ঘোষাল চেয়ারে নবাবি কায়দায় বসলেন যেমন বসতেন। সকলেই বুঝে গেল, প্যালার শরীরে স্বয়ং তাদের বাবামশায় উপস্থিত। সকলে করজোড়ে প্রণাম করল। পাশের ঘরে বৌমায়েরা মাথায় ঘোমটা দিল। নাইটি পরিহিতা ছোটো বৌমা ওড়না টানল মুখের সামনে। 


(৪)
বোস্টন, অফিসের পশ্চিমদিকের করিডোরে ব্যস্তভাবে পায়চারি করছে নিখিলেশ ঘোষাল। পরনে রাত্রি পোশাক। নিখিলেশ নিজের কাজকে এত ভালবাসে যে সে বাড়ি যায় না তাই আর অফিসের পোশাক পরার দরকার হয় না। নিখিলেশের স্ত্রী মহুয়া আর দু বছরের মেয়ে অ্যানা অফিসেই আসে মাঝে মাঝে দেখা করতে। নিখিলেশ প্যারানর্মাল বিষয় নিয়ে রিসার্চ করে। সে বিভিন্ন ধরনের যন্ত্র আবিষ্কার করেছে যার মাধ্যমে বিভিন্ন আধিভৌতিক ঘটনাবলি বিশ্লেষণ করা যায়। শুধু তাই নয়, তার কাছে এমন এক রাডার আছে যেখানে ধরা পড়ে মানুষ তার জৈবিক দেহ থেকে কোন ফ্রিকোয়েন্সিতে সেকেন্ড ডাইমেনশন অর্থাৎ পারলৌকিক দুনিয়ায় যায়,  দুই প্যারালাল ডাইমেনশনে পপুলেশন ডেনসিটি  কতটা ইত্যাদি আরও আনুষঙ্গিক বিষয়। নিখিলেশের সৃষ্টি করা সন্ধিতরঙ্গ সমগ্র পৃথিবীকে চাঁদোয়ার মতো বেষ্টন করে রয়েছে। যে কোনো প্রাণী যে স্টেটেই যাক না কেন সব ধরা পড়ে যাবে তার ল্যাবের কম্পিউটারে। 
স্যার, স্যার একবার আসুন। জরুরী দরকার। নিখিলেশর অ্যাসিস্ট্যান্ট জোন্স ডাকল। ছুটে গেল নিখিলেশ।
হোয়াট হ্যাপেন্ড জোন্স ? 
স্যার, এই দেখুন সেকেন্ড ডাইমেনশন মানে পারলৌকিক স্তরে পপুলেশন লিমিট ক্রস করে যাচ্ছে। স্ক্রিনের এই জায়গাটা দেখুন কেমন কনজেসটেড। এই ডাইমেনশন থেকে আমাদের ডাইমেনশন মানে মানবস্তরে এবার কিছু আত্মার অনুপ্রবেশ হবে। কিন্তু জৈবিক দেহের যে অভাব স্যার।
মানেটা বুঝলে না জোন্স? এর মানে সেকেন্ড ডাইমেনশনের সূক্ষ্ম শরীর মানব ডাইমেনশনে কোনো জীবন্ত দেহে প্রবেশ করবে। একই জৈবিক দেহে দুটো আত্মা থাকবে। ক্ল্যাশ করবে। 
তাহলে এখন কি করতে হবে স্যার? 

অপেক্ষা। বলে নিখিলেশ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মোবাইলটা বেজে উঠল। ফোনের ওপারে মেয়ে অ্যানার গলা, পাপা, হয়েন ইউ উইল কাম? পাপা, দাদুন ফোন করেছিল। আমরা ইন্ডিয়া যাব পাপা। মেয়ের হাত থেকে ফোনটা নিয়ে মহুয়া বলল, হ্যাঁ, নিখিলেশ। বাবা আর মা ফোন করেছিলেন। একবার গ্রামের বাড়ি যেতে হবে। ঐ যে সেই প্যালা বলে ছেলেটা আছে না সে নাকি কেমন অদ্ভুত আচরণ করছে। তোমার বাবা তো বললেন, যে দাদু নাকি ওর শরীরে চেপেছে। আমি অবশ্য এসব বিশ্বাস করি না তুমি জান। কিন্তু বাড়িতে সবাই তোমার সাথে আলোচনা করতে চায়, তাই একবার যেতে বলছেন। 
প্রসঙ্গত বলে রাখা উচিত, নিখিলেশ ঘোষাল বাড়ির মেজো ছেলে নারায়ণপতি ঘোষালের একমাত্র ছেলে। সব কথা মন দিয়ে শুনে নিখিলেশ ফোনটা ডিসকানেক্ট করল। তার ঠোঁটে বুদ্ধিদীপ্ত হাসি, যেন এটার অপেক্ষাতেই ছিল। জোন্স জিজ্ঞেস করল, কিছু হয়েছে স্যার? 
হ্যাঁ অনেক কিছু। আমাদের ধুলিগড় যেতে হবে।


(৫)
পাঁচদিন হতে চলল প্যালার শরীরে সমগ্র ঘোষাল বাড়িতে উমাপতি ঘোষাল নবাবি চালে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তাঁর ভয়ে সকলে নিশ্চুপ। রমাপতি ঘোষাল যা আশঙ্কা করেছিলেন, তাই হয়েছে। তিনি

এসেই তাঁর পুরনো বই এর খোঁজ করছেন। উমাপতি ঘোষালের নাতি, নাতনিদের পড়ানোর জন্য যে সমস্ত স্কুলের বই কিনে দিয়েছিলেন, তা তিনি যত্ন করে বেঁধে তুলে রেখেছিলেন। তাঁর জমিয়ে রাখা একগাদা কালি শেষ হয়ে যাওয়া পেন, হোমিওপ্যাথির শিশি কিচ্ছু দেখতে না পেয়ে তাঁর মেজাজ সপ্তমে। উঠতে বসতে তিনি সকল ছেলেদের তেজ্য পুত্র করে দেওয়ার কথা বলছেন। তাঁর সব শখের জিনিস খুঁজতে ছেলে, বৌমাদের গলদঘর্ম হয়ে যাচ্ছে।

নারায়ণপতি আর গণেশপতি প্রত্যেকদিন পুরনো বই এর দোকান ছুটছে। শুধু পুরনো বই নয় যা কিছু ফেলে দেওয়া হয়েছে সব পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চলছে। উদ্দেশ্য একটাই যা হোক করে সম্পত্তি ভাগ এবং আইনি উপায়ে নিজেদের নামে করতে হবে। এরই মধ্যে তিনভাই বার পাঁচেক উকিল বাবুর বাড়ি থেকে ঘুরে এসেছেন। নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে কে কোন ভাগটা নেবে তা ঠিক করে সেইমতো আইনি কাগজপত্র তৈরি করতে দেওয়া হয়ে গেছে। এবার সুযোগ বুঝে শুধু সাইনটা করাতে হবে।