

জুলাই ২০২১

লেখক ও লেখিকাবৃন্দ
প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা
কবিতা
ডাঃ উজ্জ্বল মিশ্র
আসানসোল, পঃ বাংলা
উপোসী আগুন
বালিশে গুঁজেছে মুখ উপোসী আগুন,
রূপসী চাঁদের আলো বিছানা ভাসায়।
কথা যে রাখে নি জানে ব্যর্থ ফাগুন,
তবু নিত্য আয়োজন মিথ্যে আশায়।
নিত্য যে দহনজ্বালা শরীরে ও মনে,
অব্যক্ত ব্যথার বিষ অন্তঃপুরময়।
রাতের চাদর ঢেকে অতি সংগোপনে
নিজেকে উজাড় করে নগ্ন সময়।
লক্ষ প্রতীক্ষার পরে উপেক্ষার জ্বালা
বুকময় দাগ নিয়ে চন্দ্রমাও জানে।
বালিশে মুখ গুঁজে যতো অবহেলা
চাদরে কুঁকড়ে খোঁজে জীবনের মানে।
কতদিন বাঁচতে ভুলেছো
কতোদিন মাখো নি গায়ে যুবতী চাঁদের থেকে
চুঁইয়ে পড়া লুটোপুটি আলো।
শ্রাবণের রিমঝিম গানে মাতোয়ারা
বেহিসেবি উচ্ছ্বাসে
কতদিন মাতো নি বলো
অবিরাম বরিষণ স্নানে।
বিস্তীর্ণ সবুজ ঘাসে ঘাসে
সঞ্চিত বিন্দু বিন্দু হিমেল শিশিরে
কতদিন ভেজাও নি পা,
পৌষের কোনো এক ভোরে।
কতদিন হয় নি দেখা
কুয়াশার জাল ছিঁড়ে
কমলা সূর্যোদয় নদীর ওপারে।
অকারণ পুলকে কতদিন
গলা ছেড়ে হয় নি গাওয়া গান,
অরণ্যে পাহাড়ে রহস্যময়
নীরবতা খান খান ভেঙে।
জ্যোৎস্না রাতে মাঝ গাঙে
হাল ছেড়ে নৌকায় পাল তুলে
নিরুদ্বেগ ভেসে থাকা
হয় নি কতদিন।
কতদিন কারণে অকারণে
হাসতে ভুলেছো প্রাণ খুলে।
যতো কাজ পিছুটান
সব কিছু ভুলে অখণ্ড অলসতায়
ঠাঁই বসে বসে দেখা
গাছেদের ডালে ডালে পাতায় পাতায়
জানা অজানা পাখিদের নাচ
ভুলে গেছো কতদিন।
কতদিন কত যুগ
বুক ভরে বাঁচতে ভুলেছো।
কেমন হতো
কেমন হতো হঠাৎ যদি
হারিয়ে যেতাম
ভোঁকাট্টা ঘুড়ির মতো।
বন্ধ দুয়ার দরাজ খুলে
সটান পা বাড়িয়ে দিতাম
নিরুদ্দেশে, ঠুনকো যতো
মান অভিমান, মিথ্যে মায়া,
সব পিছুটান পেছনে ফেলে।
কেমন হতো হঠাৎ যদি
চেনা পাড়া, চেনা বাড়ি,
যতো চেনা গণ্ডিগুলো
বিস্মরণের খামে ভরে
উড়িয়ে দিতাম।
কিম্বা যদি হঠাৎ করে
চেনা সুর, চেনা মুখ,
চেনা চেনা সুখ ও দুখ
চেনা যতো গল্পকথার
নটে গাছটি মুড়িয়ে দিতাম।
ফুরিয়ে যেতো নিত্যদিনের মিথ্যে নাটক।
মিথ্যে যতো কান্না হাসি,
মেকি উৎসব সাঙ্গ হতো।
কেমন হতো হঠাৎ যদি দমবন্ধ
বৃত্তটাকে ছাড়িয়ে যেতাম।
কেমন হতো সত্যি যদি
নিরুদ্দেশেই হারিয়ে যেতাম।
কবিতা
সৃজিতা ধর
মুখোশ সরলেই...
মুখোশ শব্দের অর্থ হল মুখ লুকিয়ে রাখার জন্য কৃত্রিম মুখ। আমরা জীবনের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই 'নকল' মুখের ব্যবহার করি, বা বলা ভালো ব্যবহারের দরকার হয়।
এই করোনা কালে বাড়িতে থাকার জন্য আরও বেশী মুখোশের দরকার হয়ে পড়েছে।
সত্যি বলতে কি, করোনা না হলে হয়তো জানতেই পারতাম না পরিবারের মানুষগুলোর কৃত্রিম আর আসল চেহারার পার্থক্য। একটানা প্রায় ৬ মাস এভাবে বাড়িতে থাকার কথা স্বপ্নেও ভাবিনি।
একদম প্রথম দিন মনে হয়েছিল, বাড়ির কাছের মানুষগুলোর সাথে সবসময় লেগে থাকতে পারবো।
আড্ডা দিতে পারবো।
একসাথে খাবার টেবিলে বসে এঁটো হাতে বাজার,
রাজনীতি নিয়ে দারুণ জমজমাট আসর বসাতে পারবো।
কিন্তু, না- খুব ভুল ছিলাম।
আসলে সবাই সবার কৃত্রিম মুখগুলোকেই চিনতাম,
করোনা আসল মুখগুলো সামনে নিয়ে এলো।
নাহ্, এতটা ধাক্কা বোধহয় নিজের ব্রেকআপের সময়ও পায়নি।
বুঝতে পারলাম নিজের মানুষগুলোর আসল মানসিকতা।
আর ঠিক তখনই আবার দরকার পড়লো 'মুখোশ' এর।
করোনা হয়তো বাড়ির বাইরে চলার পথে মাস্ক পড়তে শিখিয়েছে, কিন্তু ঘরের মানুষের স্বার্থপরতার মুখোশ টেনে খুলে দিয়েছে।
সত্যিই হয়তো এতটা 'আসল' চেহারা দেখতে হবে কোনোদিন মাথায় আসেনি।
আজ ভীষণভাবে মনে হচ্ছে,
মুখোশ সরলেই যদি কাছের মানুষগুলোর কদর্য চেহারা দেখতে হয়,
তবে আমি সারাজীবন মাস্ক পড়তে রাজি।

প্রবন্ধ - কল্পবিজ্ঞান

সাল ২০২৫, সময় সন্ধ্যা ৭ টা, কলকাতা শহর। একটা ওভাল শেপের ল্যাবরেটরি থেকে বেরিয়ে আসছেন প্রফেসার চক্রবর্তী। চোখে মুখে আলোর দ্যুতি। আজ তিনি নিজের ফ্ল্যাটের মুখার্জীবাবুকে যে রোবট চাকরটা দিয়েছেন ল্যাব থেকে তার মাথাতে একটা থট রিডার প্রোগ্রামিং আর কিছু আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স পুরে দিয়েছেন সবার অজান্তে। এটা তার নিজস্ব গবেষণা লব্ধ অ্য়াল্গোরিদিম। তাই তিনি আজ খুব এক্সাইটেড। ষাট ঊর্ধ্ব মুখার্জীবাবুর বাড়িতে তিনি আর তার গিন্নি। একমাত্র মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে, সে ও কাছেরই একটা ফ্ল্যাটে থাকে। পাঁচ বছরের নাতনী প্রায় প্রতিদিনই দাদু দিদার সাথে খেলতে আসে। এখন কাজের লোকের যা ডিম্যান্ড, গ্রাচুইটি, পেনশনের টাকা দিতে হবে, তারপর হাতে গোনা কাজ, সবদিক ভেবে চিন্তে মুখার্জীবাবু ২৪ ঘণ্টার রোবট চাকরই নেওয়া ঠিক করলেন। শুধু দিনে ১ ঘন্টা চার্জ দিলেই হবে আর কোনো হ্যাপা নেই। আর পড়শি চক্রবর্তীবাবু জ্ঞানী মানুষ, আর ওনার দৌলতে ২% ডিসকাউন্ট ও পাওয়া গেল। এতদিনে গিন্নির সব সমস্যার সমাধান হবে।
মুখার্জীবাবুর রোবট চাকরের নাম হল অনুপম। ভালো করে চার্জ দিয়ে মুখার্জীবাবু চালু করলেন অনুপমকে। অনুপম - বাবা একটু চা করে আন তো। অনুপম জিজ্ঞেস করল বাবার অ্যাড্রেসটা দেবেন। মুখার্জীবাবু ঢোক গিলে বললেন মানে আমাকে এক কাপ চা করে খাওয়াতে বলছিলাম। অনুপম রান্নাঘরে চলে গেল, সে নিজেই লোকেশন ডিটেক্ট করতে পারে, ইনগ্রেডিয়েন্ট ও নিয়ে নিল। চা এর সসপ্য়ান এ হাত দিয়ে খানিক হিস্ট্রি রিড করে নিল অনুপম কত কাপ জলে কত কাপ চিনি আর চা আর দুধ দিয়ে করা হয় চা। দেখল চিনি দেওয়া হয় না চা তে, আবার মাঝে মধ্যে আদা পড়ে। অনুপম খানিক ডেটা অ্য়ানালিসিস করে চা বানিয়ে আনল। গিন্নি এখন বাড়ি নেই, অনুপম সুন্দর আদা এলাচ দিয়ে চা বানিয়ে দিয়েছে গিন্নির মতই প্রায়। মুখার্জীবাবু পুরো দিলখুস। গিন্নি বাড়ি নেই, এলে খুশি করে দেবার ব্যবস্থা করতে অনুপমকে বললেন - ঘরদোরগুলো গুছিয়ে
রাখো তো বাপু। অনুপম চট করে তাকে বাপুজি রচনা শুনিয়ে দিল। মুখার্জীবাবু তো থ। না মানে বলছি কি ঘরটা একটু গুছিয়ে ফেলো। অনুপম আধ ঘন্টা পরে ঘর একদম গিন্নি যেখানে যা রাখে ফিটফাট হয়ে গেল। অনুপমকে বলে রাখলেন, গিন্নি ফিরলেই যেন চা করে দেওয়া হয়। খানিক পরে ডিং ডং, গিন্নি ফিরলেন। দেখো নিউ ইয়ারে তোমার গিফট, তোমার সব কাজ একদম তোমার মতো করে করে দবে অনুপম. দেখো কেমন ঘর গুছিয়েছে।গিন্নি হুম বলে দুম দুম করে পা ফেলে বাথরুমে ঢুকলেন, বাথরুম থেকে বেরিয়ে অনুপমের হাতের এককাপ চা খেতে খেতে গিন্নির মুখে কালো মেঘ দেখা দিল। অনুপমের থার্ড আই তাকে এলার্ট দিল গিন্নিমা তার মত কাজ করতে পারাটা ভালো মনে নিচ্ছেন না।রাতের খাবারে তরকারিতে নুন সামান্য কম হল, ভাতটা ও একটু বেশি গলা হল. গিন্নি ঘোষণা করলেন কাল থেকে তিনি অনুপমকে রান্না শিখিয়ে দেবেন। পরের দিন থেকে অনুপম মুখার্জী গিন্নির ন্য়াওটা হয়ে উঠল। গিন্নি মনে কিছু ভাবলেই অনুপমের থট রিডারে তা ধরে নিয়ে অনুপম সুন্দর ব্যবস্থা করে আর মুখার্জী গিন্নির ভোকাবুলারি ও কদিনেই রপ্ত করে নিল অনুপম বেশ চলছিল দিন কিন্তু গোল বাঁধালো ওই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের অ্য়ালগোরিদিম। অনুপম আস্তে আস্তে মুখার্জী গিন্নির মায়া মমতা আর ভালোবাসার অনুভূতি নিজের মধ্যে রেপ্লিকেট করে নিল।ফলে মুখার্জীবাবুর শরীর খারাপ হলে অনুপমের ও একই রকম মন খারাপ হতে লাগল এবং অনুপম শুকনো মুখে মেয়েদের তো অভিমানী পায়ে সারা বাড়ি ঘুরতে লাগল এবং সন্ধ্যাবেলা ঠাকুরের কাছে কষে প্রেয়ার করল। যদি ও অনুপমের শরীরে হরমোনের কোনো প্রভাব থাকা সম্ভব নয় কিন্তু তা ও অনুপমের একটা মন জন্ম নিল, আর তার ঠেলায় মুখার্জী দম্পতি নাস্তানাবুত। তার থেকে ও মুশকিল যেটা হল দেখতে ছেলেদের মত রোবট অনুপম মনে মনে মেয়ে। অবস্থা বেগতিক দেখে শেষমেশ মুখার্জীবাবু অনুপমকে ল্যাব এ ফিরিয়ে দিয়ে এলেন। প্রফেসার চক্রবর্তী সব মন দিয়ে শুনে অনুপমকে ফিরিয়ে নিয়ে আবার শুরু করলেন তার কাজ।
গল্প