
প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা

পুজো বার্ষিকী
১৪৩১


রবীন্দ্রচেতনায় বিজ্ঞান - অনিশা দও
প্রচ্ছদঃ সুরজিত সিনহা
লেখক/লেখিকাবৃন্দ
উপন্যাস


এক
স্বামী চলে যাওয়ার পরে একদম একা হয়ে পড়েছিলেন, কবিতা। মনে পড়তো ফুলশয্যা, আদর। কি করে যে একটা একটা করে রাত, দিন পার হয়ে যায়, বোঝাই যায় না। তবু বুঝতে হয়, মেনে নিতে হয়। একটা ঘুঘু পাখি তার স্বামী মরে যাওয়ার পর থেকেই এ বাড়িতে আসে। আম গাছের ডালে বসে আপন মনে কত কথা বলে। ঘুঘুর ঘু, ঘুঘুর ঘু। কবিতাদেবীর সঙ্গে পাখিটার খুব ভাব।তার মনে হয় স্বামী, ঘুঘুর রূপ ধরে আসেন। তিনি আম গাছের তলায় খুদকুঁড়ো ছিটিয়ে দেন। ঘুঘু পাখিটা খায় আর গলা তুলে কবিতাকে দেখে। কিছু বলতে চায়। তিনি বোঝেন। আর আপনমনেই পাখিটার সঙ্গে বকবক করেন। পুরোনো দিনের কথা বলেন। ছেলের বৌ বলে, বুড়িটা পাগলী হয়ে গেছে। প্রতিবেশীরা অতশত বোঝে না। হাসাহাসি করে। শুধু তার ছেলে বোঝে মায়ের অন্তরের কথা, ব্যথা। ঘুঘু পাখিটা সারাদিন ডেকে চলে। এবার আয়, এবার আয়। কবিতার বয়স হল আটত্রিশ। বিধবা হলে কবিতার উপর নজর পড়লো তাদের গুরুদেবের। গুরুদেব বললেন, যা হবার হয়েছে বুঝলে কবিতা। আমি তো আছি। স্বামীর অভাব বুঝতে দেব না। প্রথমে গুরুদেবের আসা যাওয়া ভালো না লাগলেও একদিন তা অভ্যাসে পরিণত হল।
কবিতার একমাত্র ছেলে রাজু বামুন পাড়ার ছেলে। পৈতে হয়েছে বৈশাখ মাসে। উপনয়নের পর উপবীত ধারণ করতে হয়। এই উপবীতের চলতি নাম পৈতে। পৈতে কথাটি সমাজে বহুপ্রচলিত।বাহুতে গুরুদেব বেঁধে দিয়েছেন কবচ। রাজুদের বংশের গুরুদেব বলেছেন, সমস্ত বিপদ আপদ থেকে রক্ষা করবে এই কবচ আর পৈতে। সব কাজে সফল হবে নিশ্চিতভাবে আর সারাজীবন রক্ষাকবচের মত আগলে রাখবে জীবন।
রাজু গরীব বামুনের ছেলে। দুবিঘে জমি, দুটো গরু আর গোটা দশেক ছাগল তাদের সম্পত্তি। রাজুর পৈতেটা একটু দেরী করেই হয়েছে। তার ফলে গুরুদেবের আদেশ অনুযায়ী প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়েছে তার ফর্দ মত। তার ফলে খরচ অনেকটা বেড়ে গেছে।
এখন তার বয়স উনিশ। বাবা মরে গেছেন অনেক আগেই। তার মা ঐ গুরুদেবের কথামত সংসার চালান। পুজো, উপবাসে মেতে থাকেন মা। আর গুরুদেবের ফলাহার রাজু তাকিয়ে দেখে। মা গুরুদেবের খাওয়ার শেষে তার উচ্ছিষ্ট খান। এটাই মায়ের গুরুর প্রসাদ। গুরুদেব মাঝে মাঝে রাতে রাজুদের বাড়িতে থাকেন। রাজু বোঝে সবকিছু কিন্তু চুপ করে থাকে। গুরুদেব মাকে বলেন, আমার কথামত চললে তোমাদের ভাল হবে। এই ভাল হওয়ার লোভে রাজুর মা গুরুদেবের সব কথা মেনে নেন। রাজুর মায়ের মিথ্যে রক্ষাকবচ হলেন গুরুদেব। এক অদৃশ্য দেওয়া নেওয়ার খেলা তিনি খেলেন নিষ্ঠুর হৃদয়ে।
রাজু সকালবেলা মাঠে যায়। সে বামুন হলেও লাঙল ধ'রে চাষ করে। ছোট থেকেই করে আসছে। বেশ গাঁট্টাগোঁট্টা চেহারা তার। সকলে বেশ সমীহ করে চলে তাকে। পড়াশুনা বেশিদূর গড়ায় নি। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছে কোনরকমে। বাবা মরে যাওয়ার পর থেকে সংসারের দায়িত্ব তার উপরেই ন্যস্ত।
সকালে গরু ছাগল নিয়ে মাঠে যায়। হাতে পাঁচন গলায় গামছা। লুঙ্গি পরে আলের উপর বসে থাকে। গরু ছাগল পালিয়ে গেলে ডাকিয়ে নিয়ে আসে ঘাসের বনে। পরের ফসল খেলে লোকে ছাড়বে না। এ নিয়ে অনেকবার ঝগড়া হয়েছে রাজুর সঙ্গে জমির মালিকদের। একদিন রমেন মোড়ল লাঠি নিয়ে এসে বলল, তোর ছাগলে আমার জমির ফসল খেয়েছে। খবরদার বলছি আমি কিন্তু ছাড়ব না। এই লাঠি মেরে মাথা ফাটিয়ে দেব। রাজু বললো, বেশ কাকা আর হবে না এই ভুল। আমি নজর রাখব। সঙ্গে সঙ্গে মোড়ল নরম সুরে বলল, তোমরা হলে গিয়ে বামুনের ছেলে। বলতে খারাপ লাগে। বুঝলে তোমার বাবাকে আমি দাদা বলে ডাকতাম। রাজু বলল, মায়ের কাছে শুনেছি সব। তবে আপনার ফসলের ক্ষতি হলে তো রাগ হবেই। আমি এবার ভাল করে লক্ষ্য রাখব। মোড়ল বললেন, বেশ বাবা বেশ। বেঁচে থাক। রাজু ভাবে ফসলের মাঠে গরু, ছাগল চড়ানো খুব কঠিন। কখন যে কার মাঠে নেমে যায় বোঝা মুস্কিল। সে ভাবল, কাল থেকে অই পাকা রাস্তার ধার ঘেঁষে বারান্দা গ্রামের কাছাকাছি জঙ্গলে যাবে গরু চড়াতে। ওখানে ফসলের জমি নাই। নিশ্চিন্তে বসতে পারবে। মাকে বলে, জলখাবার সঙ্গে নিয়ে যাবে।
পরের দিন রাজুর মা সকাল থেকে আলু ভেজে দিল আখের গুড় দিল আর এক জামবাটি ভরতি করে মুড়ি দিল। রাজু গামছায় বেঁধে গরু, ছাগলের দড়ি খুলে পাঁচন হাতে চলে গেল জঙ্গলে। সেখানে গিয়ে দেখল ঘাস আছে পাতা আছে। আর ভিড় কম। পাশে ক্যানেলের পরিষ্কার জল। সেখানে মাছ ধরছে হাজরাদের একটা মেয়ে। রাজু ভাবল, কি সুন্দর দেখতে মেয়েটা। উবু হয়ে মাছ ধরছে। মেয়েটা রাজুকে দেখতে পায় নি। একটু পরে রাজু ডাকল, ও মেয়ে, তোর নাম শ্যামলী নয়? শ্যামলী বলল - হুঁ।
- তুই রোজ এখানে আসিস মাছ ধরতে?
- হুঁ
- আমাকে চিনিস?
- হুঁ
- আয় এখানে আয়। দুজনে মুড়ি খাই। তোর মাছ নেব না। আয়।
শ্যামলী হাত, পা ভাল করে ধুয়ে চলে এল রাজুর কাছে। রাজু গামছায় মুড়ি ঢেলে দিল। দুজনে গল্প করতে করতে খেল। তারপর দুপুর হলে দুজনে চলে এল নিজের বাড়ি।
রাজু গোয়ালে গরু বেঁধে, হাত পা ধুয়ে স্নান সেরে নিল। তারপর দরজার কাছে এসে দেখল দরজা বন্ধ। দরজায় একটা ফুটো আছে। চোখ লাগিয়ে দেখল, গুরুদেব মা কে নিজের উলঙ্গ দেহ দিয়ে ঢেকে ফেলেছে। মাকে দেখা যাচ্ছে না। তাহলে কি মাকে বশ করেছে কবচ পরিয়ে? আমাকেও দিয়েছে কবচ। রাজুর রাগ হল। কিন্তু কোন আওয়াজ না করে চলে গেল গোয়ালে।
প্রায় কুড়ি মিনিট পরে রাজুর মা রাজুকে দেখতে গোয়ালে এল। রাজুর মা বলল - আমি তোকে না দেখে একটু শুয়েছিলাম। আজকে তোর দেরী হল কেন? রাজু বলল, মা আমার খিদে পেয়েছে। খেতে দাও। আমি এখানে বসে খাব। তারপর বর্ষা এল। নদী, পুকুর, খাল, বিল সব কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গেল। শুধু পূর্ণ হল না রাজুর মন। গুরুদেবের প্রতি ঘৃণায় তার মন খারাপ ছিল। কিন্তু এখনও সেই ঘটনা ঘটে চলেছে। রাজু জানে, মানুষের জীবনে কিছু ঘটনা মনের কোণে থেকে যায়। তার প্রতিকার হয় না কোনোদিন। রাজু এবার চাষ করেছিল সময়ে। কিন্তু বন্যায় ধানের চারা ডুবে থাকল দশদিন। সব পচে গেল। পচে গেল সমস্ত কৃষকের আশা আকাঙ্ক্ষা সবকিছু। আর কদিন পরেই শরৎকালের দুর্গাপুজো। সবাই নতুন জামা, কাপড় কিনবে। কিন্তু এই গ্রামের লোকগুলো খালি গায়ে গামছা কাঁধে ঘুরবে। রাজু শ্যামলীকে এইসব কথা বলে। রাজু বলে - তোকে একটা শাড়ি দেব ভেবেছিলাম, কিন্তু কি করে দেব?
শ্যামলী বলে - দিতে হবে না গো। তুমি শুধু এমনি করে আমাকে জড়িয়ে থেকো।
রাজু আর শ্যামলী দুজনে দুজনকে ভালবাসে। তারা বিয়ে করবে। কিন্তু বামুনের সঙ্গে হাজরা বা হাড়ি জাতের বিয়ে সমাজের সেনাপতিরা মেনে নেবে না। ওরা ঠিক করল, পালিয়ে গিয়ে ওরা বিয়ে করবে পরে। ততদিনে রাজু ভাবে, একটু গুছিয়ে নেব নিজেকে। টাকা, পয়সা জমিয়ে রাখব। তারপর বিয়ে, সংসার।
প্রায় দুবছর পরে রাজু আর শ্যামলী ঠিক করল দুদিন পরে তারা শিবলুন স্টেশনে ট্রেন ধরবে। তারপর বহরমপুরে চলে যাবে। ওখানে নিশ্চয় কাজ পেয়ে যাবে। তা না হলে কুলিগিরি করবে। ওদের ঠিক চলে যাবে।
রাজু আজ বাড়ি গিয়ে গুরুদেব আর মা কে দেখতে পেল। গুরুদেবের দয়ায় মায়ের খাওয়া পরার অভাব নেই। মেয়ের বয়সী রাজুর মা। গুরুদেব এই মেয়ের বয়সী অসহায় বিধবার সঙ্গে যে খারাপ দৃষ্টি দিতে পারে, এই ধারণা গ্রামের সরল মানুষের ছিল না। আর রাজুর দেখা সেদিনের ঘটনা একমাত্র শ্যামলী বিশ্বাস করে। আর কাকে বলবে সে। এই ঘটনার সঙ্গে যে মা জড়িত। মা যদি লজ্জায় গলায় দড়ি দিয়ে বসে তাহলে রাজু তো মাতৃহারা হবে। তাই নিজের পায়ে কোপ রাজু মারতে চায় না। নিজের মত করে পরবর্তী জীবন সে আনন্দে কাটাতে চায়। হঠাৎ একদিন গুরুদেব রাজুকে কাছে বসালেন। বললেন - তুই নিজেকে খুব চালাক মনে করিস নয়? রাজুর মা বললেন - কেন কি করেছে রাজু?
গুরুদেব বললেন - তোমার ছেলে হাড়িদের মেয়ের সঙ্গে ঘোরে। মাখামাখি করে। ওদের পাড়ার অনেকে দেখেছে। আমাকে বলেছে। রাজু বলল - হ্যাঁ, আমি ওকে বিয়ে করতে চাই।
গুরুদেব বললেন - আমি হতে দেব না। তুই বামুনদের ছেলে। সমাজ মানবি তো হতভাগা। রাজু বলল - আপনার মুখোশপরা সমাজ আমি মানি না। আমি জাতপাত মানি না। এই বিয়ে হবেই। কোনো শক্তি এই বিয়ে আটকাতে পারবে না। প্রয়োজনে প্রাণ দিয়ে দেব।
রাজুর মা চিৎকার করে বললেন - কাকে কি বলছিস তুই? এই বিয়ে হলে আমার মরা মুখ দেখবি। আমি গলায় দড়ি দেব।
গুরুদেব বললেন - ছি ছি রাজু। মায়ের কথা চিন্তা না করে তুই দেহের কথা চিন্তা করছিস। ছি ছি।
রাজু মাকে বলল - মা হয়ে তুমি ছেলেকে সাজা দেবে?
রাজু ছুটতে ছুটতে নতুন পুকুরের পাড়ে গেল। রাজুর মা ও ছেলেকে ডাকছেন - রাজু ফিরে আয়। রাজু ফিরে আয়। রাজু দূর থেকে দেখল শ্যামলী ছুটতে ছুটতে শিবলুন স্টেশনে যাচ্ছে। এখন তাকে কোনো বাধা আটকাতে পারবে না। আজ তাদের পালিয়ে বিয়ে করার দিন। রাজু অবাক চোখে দেখে, শ্যামলী খোলা মাঠে হৃদয় মেলে আনন্দে মেঘ হয়ে ভাসছে। রাজু ভাবল, এই আনন্দ ম্লান হয়ে যেতে পারে না। সে ও হাওয়ায় উড়তে চায়।
রাজু অসহায়। সে ভেবে পাচ্ছে না কি করবে? একদিকে শ্যামলী তার প্রাণের বাঁশি আর একদিকে মা, রাজুর শ্রেষ্ঠ দেবী।
গুরুদেবের সমস্ত মিথ্যা কথা রাজুর মনে পড়ছে। কবচ পরলে নিশ্চিতভাবে সকল কাজে সফল হওয়া যায়। পৈতে থাকলে সিদ্ধিলাভ হয়। কই রাজুর জীবন তাহলে ব্যর্থতায় ভরা কেন? রাজু ভাবে, এই সব কিছু গুরুদেবের বানানো কথা। শাস্ত্র কখনও জাতিগত ভেদাভেদ করে নি। পৃথিবীর কোন ধর্ম কোন মানুষকে ছোট করে নি। শুধুমাত্র গুরুদেবের মত স্বার্থপর লোকেরা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য এইসব নিয়ম চালু রাখেন সমাজে। রাজু এই মুখোশ একা খুলতে পারবে না। তবু নিজের জীবনে তো নিজের ইচ্ছেমত থাকতে পারবে। সে মা কে বুঝিয়ে বলবে। মা নিশ্চয়ই বুঝবে। রাজু অনেক আশা নিয়ে পৈতে খুলে ফেলল। কবচ খুলে ফেলল। দুটো বিষফলের মত, কুসংস্কারের বোঝা ছুঁড়ে ফেলে দিল পুকুরের জলে। আর কখনও বিষফল দুটো রাজুর ভাবনার বাধা হতে পারবে না। রাজুর মনটা হাল্কা হল। তারপর দৃপ্ত পদক্ষেপে হাঁটা শুরু করল মানুষের মনের কুসংস্কার মুছে ফেলার সংকল্প নিয়ে।
রাজু দৌড়তে শুরু করল। তারপর সে উড়তে শুরু করল। সমস্ত বাধাকে জয় করতে পারলে বোধহয় এইরকমই অনুভূতি হয়, সে ভাবল, আকাশে ওড়া শ্যামলীকে এবার ও নিজেও উড়তে উড়তে ধরবে। শ্যামলীকে ভালবেসে আকাশে ওড়াটা সে ভালভাবেই রপ্ত করেছে..
****
গণিতের শিক্ষকমশাই বলতেন, যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ জীবনের ক্ষেত্রেও মেনে চলবি। যত দুঃখ, ব্যথা বিয়োগ করবি। আনন্দ যোগ করে খুশি গুণ করবি। আর খাবার ভাগ করে খাবি। একা খেলে, বেশি খেলে রোগ বেড়ে যাবে। মজার মধ্যেও কত বড় শিক্ষা তিনি আমাদের দিয়েছিলেন আজ বুঝতে পারি। আদর্শ শিক্ষক বোধহয় এই রকম হন। ফোচন বললো। ফোচনের বোন ফোড়োনকে মাস্টারমশাই মশলা বলে ডাকতেন। ফোড়োন খুব রেগে যেতো। কারণ বন্ধুরাও তাকে মশলা বলেই ডাকতো। একদিন স্যারের কাছে ফোড়ন বললো, আপনি মশলা নামে ডাকেন বলে সবাই ডাকে। মাস্টারমশাই বলেছিলেন, আদর করে দেওয়া নাম কোনোদিন ফেলবি না। রাগ করবি না। দেখবি একদিন যখন তোর বন্ধু, বান্ধবীরা দূরে চলে যাবে তখন এই নাম তোর মুখে হাসি ফোটাবে। সংসারের সমস্ত দুঃখ ভুলিয়ে দেবে আদরের পরশে। ফোড়োনের জীবনে সত্য হয়েছিলো এই কথা। একদিন বিয়ের পরে রমেশের সঙ্গে দেখা হলো তার। রমেশ বললো, কেমন আছিস ফোড়োন। ফোড়োন বললো, একবার মশলা বলে ডাক। তা না হলে আমি তোর প্রশ্নের উত্তর দেবো না। রমেশ তারপর ওকে মশলা বলে ডেকেছিলো। মশলা সেবার খুশি হয়ে রমেশকে ফুচকা খাইয়েছিলো।
দুই
গ্রামে থাকতেই প্রাইমারী স্কুলে যেতাম। মাষ্টারমশাই আমাদের পড়াতেন। পরের দিন আমরা দুই ভাই স্কুলে ভর্তি হতে গেলাম। বড়দা গ্রামে কাকার কাছে আর ছোটো ভাই বাবু একদম ছোটো। স্কুলে মীরা দিদিমণি সহজ পাঠের প্রথম পাতা খুলে বললেন, এটা কি? আমি বললাম অ য়ে, অজগর আসছে ধেয়ে। আবার বই বন্ধ করলেন। তারপর আবার ওই পাতাটা খুলে বললেন, এটা কি?
আমি ভাবলাম, আমি তো বললাম এখনি। চুপ করে আছি। ঘাবড়ে গেছি। দিদি বাবাকে বললেন, এবছর ওকে ভর্তি করা যাবে না।
ছোড়দা ভর্তি হয়ে গেলো। তারপর বাসা বাড়িতে জীবন যাপন। সুবিধা অসুবিধার মাঝে বড়ো হতে লাগলাম। আমাদের খেলার সঙ্গী ছিলো অনেক। ধীরে ধীরে আমরা বড়ো হয়ে টি, আর, জি, আর, খেমকা হাই স্কুলে ভর্তি হলাম। তখন লাইনের পাশ দিয়ে যাওয়া আসা করার রাস্তা ছিলো না। লাইনের কাঠের পাটাতনের উপর দিয়ে হেঁটে যেতাম। কতজন ট্রেনে কাটা পরে যেত তার হিসাব নেই। তারপর ওয়াগন ব্রেকাররা মালগাড়ি এলেই চুরি করতো রেলের সম্পত্তি। কঠিন পরিস্থিতি সামলে চলতো আমাদের লেখাপড়া।
এখন পরিস্থিতি অনেক ভালো। পাশে রাস্তা আছে। ওয়াগান ব্রেকারদের অত্যাচার নেই। মনে আছে ক্লাস সেভেন অবধি লিলুয়ায় পড়েছি। তারপর গ্রামে কাকাবাবু মরে গেলেন অল্প বয়সে। বাবা অবসর নিলেন চাকরী থেকে। বড়দা ও ছোড়দা রয়ে গেলো লিলুয়ায়। বাবা, মা ও আমাদের দুই ভাইকে নিয়ে এলেন বড় পুরুলিয়া গ্রামে।
গ্রামে কাকীমা ও দুই বোন। রত্না ও স্বপ্না। আমরা চারজন। মোট সাতজন সদস্য। শুরু হলো গ্রামের জীবন। আবার বিল্বেশ্বর হাই স্কুলে ভর্তি হতে গেলাম বাবার সঙ্গে। ভর্তির পরীক্ষা হলো। হেড মাষ্টারমশাই বললেন - বাঃ, ভালো পত্রলিখন করেছে। বিজয়া প্রণামের আগে চন্দ্রবিন্দু দিয়েছে। কজনে জানে। আমি প্রণাম করলাম স্যারকে। ভর্তি হয়ে গেলাম।
সংসারে সং সেজে দিবারাতি নিজেকে ঠকিয়ে কোন ঠিকানায় ঠাঁই হবে আমার। নিজেকে নিজের প্রশ্ন কুরে কুরে কবর দেয় আমার অন্তরের গোপন স্বপ্ন। জানি রাত শেষ হলেই ভোরের পাখিদের আনাগোনা আরম্ভ হয় খোলা আকাশে। আমার টোনা মাসিকে টোন কেটে অনেকে অভিশাপ দিতো । আমি দেখেছি ধৈর্য্য কাকে বলে। আজকালের কাঠগোড়ায় তিনি রাজলক্ষ্মী প্রমাণিত হয়েছেন। কালের বিচারক কোনোদিন ঘুষ খান না। তাই তাঁর বিচারের আশায় দিন গোনে শিশুর শব, সব অবিচার, অনাচার কড়ায় গন্ডায় বুঝে নেবে আগামী পৃথিবীর ভাবি শিশু প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি। অপেক্ষায় প্রহর গোনে নিজের অন্তরের প্রদীপ শিখা জ্বালিয়ে। সাবধান খুনির দল, একবার হলেও অন্তত নিজের সন্তানের জন্য শান্ত পৃথিবী রেখে যা। ঋতু পরিবর্তন কিন্তু তোর হত্যালীলায় বন্ধ হবে না নির্বোধ। শান্ত হোক হত্যার শাণিত তরবারি। নেমে আসুক শান্তির অবিরল ধারা। রক্ত রঙের রাত শেষে আলো রঙের নতুন পৃথিবী আগামী অঙ্কুরের অপেক্ষায়।
শিউলি শরতের ঘ্রাণে শিহরিত শরীর। শিউলি নামের শিউলি কুড়োনো মেয়েটি আমার শৈশব ফিরিয়ে দেয়। মনে পড়ে পিসির বাড়ির শিউলি গাছটার তলায় অপেক্ষা করতো ঝরা ফুলের দল। সে জানত ফুল ঝরে গেলেও তার কদর হয় ভাবি প্রজন্মের হাতে। সে আমাদের ফুল জীবনের পাঠ শেখায়। মানুষও একদিন ফুলের মত ঝরে যায়। শুধু সুন্দর হৃদয় ফুলের কদর হয়। বিদেশে ষাট বছরেও মানুষ স্বপ্ন দেখে। নিজেকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরখ করার সুযোগ মেলে। কিন্তু আমাদের কয়েকজন বন্ধু লোক ব্যাঙ্গের সুরে বলে - বুড়ো ঢ্যামনার ভীমরতি হয়েছে। সখ দেখো এখনও রঙিন জামা পড়ে। ব্যায়াম করে। মেয়েদের সঙ্গে কতা বলে।
একটু হাসি ঠাট্টা করলে বলবে - মিনসে, ঘাটের মরা এখনও দুধ তোলা রোগ গেলো না।
সব স্বপ্ন দেখা বন্ধ রেখে বুড়ো সেজে থাকলেই সম্মান পাওয়া যায় বেশি। নিজের মনে গুমরে ওঠে যত স্মৃতি। শেয়ার করার কেউ নেই। তারপর মরে যাওয়ার পড়ে অন্তিম কাজ, নির্লজ্জ ভুরিভোজ। তবু সব কিছুর মাঝেই ঋতু জুড়ে আনন্দের পসরা সাজাতে ভোলে না প্রকৃতি। সংসারের মাঝেও সাধু লোকের অভাব নেই। তারা মানুষকে ভালোবাসেন বলেই জগৎ সুন্দর আকাশ মোহময়ী, বলেন আমার মা।সব কিছুর মাঝেও সকলের আনন্দে সকলের মন মেতে ওঠে। সকলকে নিয়ে একসাথে জীবন কাটানোর মহান আদর্শে আমার দেশই আদর্শ।
সত্য শিব সুন্দরের আলো আমার দেশ থেকেই সমগ্র পৃথিবীকে আলোকিত করুক।
আমার দুই বোন। তিন ভাইঝি। বোনেদের নাম রত্না স্বপ্না। রত্না হলো কন্যারত্ন। সব অভাব অভিযোগ তার কাছে এসে থমকে পড়ে অনায়াসে। আর অপরের উপকার করতে স্বপ্নার তুলনা মেলা ভার। ভাইঝিরা তনুশ্রী, দেবশ্রী, জয়শ্রী। এরা বড়দার মেয়ে আর মেজদার মেয়ে পৃথা, ছেলে ইন্দ্র। এরা সকলেই আমার খুব প্রিয়। বাবুর মেয়ে তিন্নি আমার ছেলে সৈকত।
রূপসী বাংলার রূপে ছুটে যাই। কিন্তু আমার চেনা পৃথিবীর সবটা হয়ে যায় অচেনা বলয়, মাকড়সার জালের মতো জটিল। সবাই এত অচেনা অজানা রহস্যময়। বুকটা ধকধক করছে, হয়তো মরে যাবো, যাবো সুন্দরের কাছে, চিন্তার সুতো ছিঁড়ে কবির ফোন এলো। এক আকাশ স্বপ্ন নিয়ে, অভয়বাণী মিলেমিশে সৃষ্টি করলো আশা। আর আমি একা নই, কবির ছায়া তাঁর মায়া আমাকে পথ দেখায়...
আমার মায়ের বাবার নাম ছিল মন্মথ রায়। মনমতো পছন্দের দাদু আমাদের খুব প্রিয় ছিলেন। যখন মামার বাড়ি যেতাম মায়ের সঙ্গে তখন দাদু আমাদের দেখেই মামিমাকে মাছ, ডিম, মাংস রান্না করতে বলতেন। কখনও সখনও দেখেছি মামিমা নিজে ডেঙা পাড়া, সাঁওতাল পাড়া থেকে হাঁসের ডিম জোগাড় করে নিয়ে আসতেন। তখন এখনকার মতো ব্রয়লার মুরগি ছিলো না। দেশি মুরগির বদলে চাল, ডাল, মুড়ি নিয়ে যেতো মুরগির মালিক। নগদ টাকার টানাটানি ছিলো। চাষের জমি থেকে চাল, ডাল, গুড় পাওয়া যেতো। মুড়ি নিজেই ভেজে নিতেন মামিমা। আবার কি চাই। সামনেই শালগোরে। সেখানে দাদু নিজেই জাল ফেলে তুলে ফেলতেন বড়ো বড়ো রুই, কাতলা, মৃগেল। তারপর বিরাট গোয়ালে কুড়িটি গাইগরু। গল্প মনে হচ্ছে। মোটেও না। এখনও আমার সঙ্গে গেলে প্রমাণ হিসাবে পুকুর, গোয়াল সব দেখাতে পারি। আহমদপুর স্টেশনে নেমে জুঁইতা গ্রাম। লাল মাটি। উঁচু উঁচু ঢিবি। আমি পূর্ব বর্ধমানের ছেলে। সমতলের বাসিন্দা। আর বীরভূমে লাল উঁচু নিচু ঢিবি দেখে ভালো লাগতো। আমাদের মাটি লাল নয়। কি বৈচিত্র্য। ভূগোল জানতাম না। জানতাম শুধু মামার বাড়ি। মজার সারি। দুপুরবেলা ঘুম বাদ দিয় শুধু খেলা। আর ওই সময়ে দাদু শুয়ে থাকতেন। ডিস্টার্ব হতো। একদিন ভয় দেখানোর জন্যে বাড়ির মুনিষকে মজার পদ্ধতি শিখিয়ে দিয়েছিলেন। তখন ছেলেধরার গুজব উঠেছিলো। আমরা দুপুরে খেলছি। দাদু বারবার বারণ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আজ কিন্তু ছেলেধরা আসতে পারে। আমি খুব ভীতু ছিলাম। আমার মামার ছেলে বাঁটুলদা, হোবলো, ক্যাবলা, লেবু। সবাইকে বললাম। তখন বারো থেকে পনেরো বছরের পালোয়ান আমরা। সকলের ভয় হলো। দাদু কোনোদিন মিথ্যা বলেন না। কথার মধ্যে কনফিডেন্স না থাকলে তিনি রাগ করতেন। একবার আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, এই অঙ্কটা পারবি। পড়ে দেখ। আমি বললাম, বোধহয় পারবো। তিনি রেগে বললেন, বোধহয় কি? হয় বল না, কিংবা হ্যাঁ। নো অর ইয়েস। ধমকের চোটে কেঁদে ফেলেছিলাম। এই সেই দাদু বলেছেন, আজ ছেলেধরা আসবে। সাবধান। সবাই ঘুমোবি। দুপুরের রোদে বেরোবি না। বাধ্য হয়ে শুলাম। দাদুর নাক ডাকা শুরু হলেই সবাই দে ছুট। একেবারে বাদাম তলায়। চিনে বাদামের একটা গাছ ছিলো। ঢিল মেরে পারছি। এমন সময়ে মুখ বেঁধে ছেলেধরা হাজির। হাতে বস্তা। বস্তা ছুঁড়ে ঢাকা দিতে চাইছে আমাদের। আমরা সকলেই প্রাণপণে বক্রেশ্বর নদীর ধারে ধারে গিয়ে মাঝিপাড়ায় গিয়ে বলতেই বিষ মাখানো তীর আর ধনুক কাঁধে বেড়িয়ে পড়লো। বীর মুর্মু। সাঁওতাল বন্ধু। ছেলেধরা তখন পগার পাড়। আর দেখা নেই। বড়ো হয়ে সত্য কথাগুলি জানতে পেরেছি। দাদু ওই সাঁওতাল বন্ধুকে বকেছিলেন, ছেলেগুলোকে ভয় দেখাতে নাটক করছিলাম। আর তুই এক নম্বরের বোকা। একবারে অস্ত্র হাতে। যদি মরে যেতো ছেলেটা। বন্ধু বললো, আমাকে অত বোকা ভাবিস নি। তোর মুনিষটো আমাকে আগেই বলেছে তোর লাটকের কথা। আমি অভিনয়টো কেমন করেছিলাম বল একবার। দাদু ওদের খুব ভালোবাসতেন। ওদের অসময়ের বন্ধু ছিলেন দাদু। দাদুকে আমরা বলতাম টাইগার বাম বা বিপদের বন্ধু। ওষুধ মলমের স্পর্শে যেমন ফোঁড়া ভালো হয়ে যায়। তেমনি বিপদের সময় দাদুর উপস্থিতি সকল সমস্যার সমাধান করে দিতো। একবার ডেঙা পাড়ায় ডাকাত পড়েছিলো। জমিদার বাড়িতে। তখন ফোন ছিলো না। জানাবার উপায় নেই। পাশের বাড়ির একজন দাদুকে ডাকতে এসেছিলো। দাদু ঘুম থেকে উঠেই লাঠি হাতে লোকজন ডেকে সিধে চলে গিয়েছিলেন। তখন লাঠিই প্রধান অস্ত্র। লাঠিখেলায় দাদুর সমকক্ষ কেউ ছিলো না। চারজন বাছা বাছা তরুণকে বললেন, আমার মাথায় লাঠি মারতে দিবি না। তারপর শুরু হলো লড়াই। পঁচিশজন ডাকাত সব কিছু ফেলে লাগালো ছুট। জমিদার দাদুকে বললেন, আপনার জন্যই আজকে বাঁচলাম। ভগবান আপনার ভালো করবেন। বাড়ির মহিলারা দাদুকে মিষ্টি জল খাইয়ে তবে ছাড়লেন। বাকি লোকেরাও খেলেন। দাদুর লাঠি খেলার দলের কথা আশেপাশে সবাই জানতো। দাদুর মুখেই শুনেছি হাটবারে ডাকাত সর্দার হাটে এসেছিলো। বলেছিলো, আপনার মায়ের দুধের জোর বটে। আপনাকে পেন্নাম। সাহসকে বলিহারি জানাই। আপনি ওই গ্রামে থাকতে আর কোনোদিন ডাকাতি করবো না। দাদু বলেছিলে, ছেড়ে দে ডাকাতি। তোকে জমিদার বাড়িতে ভালো কাজ দেবো। শেষে ওই ডাকাতদল জমিদারের লাঠিয়াল হয়েছিলো। ডাকাতি করা ছেড়ে দিয়েছিলো। এখন চোর ডাকাতগুলো চরিত্রহীন, দূর্বল, নির্গুণ। সেই ডাকাত সর্দার সন্ধ্যা হলেই দাদু আর জমিদারকে শ্যামাসংগীত শোনাতো।
সম্পর্কে দাদু হলেই তো আর বুড়ো হয়ে যায় না। দাদুর যখন চল্লিশ বছরের তখন মায়ের বিয়ে হয়েছিলো। দাদু আঠারো বছরেই মায়ের বিয়ে দিয়েছিলেন। মায়ের মুখ থেকে শোনা কথা। বিয়ের পরেও আমার মা তালবোনা পুকুরে তাল পড়লেই সাঁতার কেটে সবার আগে তাল কুড়িয়ে আনতেন। দাদু আমার মা, বড়মা সবাইকে সব বিষয়ে পারদর্শী করে তুলেছিলেন। আর আমার মামা শান্ত লোক। গাঁয়ের মাসি বলতেন, একটা ব্যাটা। দুটি বিটি। তাই ঠাকুমার আদরে দাদা ঝুট ঝামেলা থেকে দূরে থাকতেন। জুঁইতা গ্রামটা ছিলো একটা ঘরের মতো। গ্রামের বাসিন্দারা সেই ঘরের লোক। কোনোদিন বুঝতে পারিনি, কে আপন, কেই বা পর। গ্রাম না দেখলে ভারতবর্ষকে চেনা অসম্ভব। মামার বাড়ি গেলেই গ্রামে ঢুকতেই স্কুল। তারপর মামার বাড়ি আসতে অনেক সময় লেগে যেতো। আমার বড়দাকে ওখানে সবাই মিনু বলে ডাকতো। মাকে বলতো গীতু। হাঁটছি হঠাৎ এক মামা বললেন, কিরে গীতু ভালো আছিস, আই মিনে আয়। সুদপে, রিলপে আয়। আমাদের নাম ওখানে আদরের আতিশয্যে বিকৃত হয়ে যেতো। আবার কোনো মাসি বলতেন, আয় গীতু কতদিন পরে এলি, একটু মিষ্টিমুখ করে যা, জল খা। কোন পাষন্ড এই আদরের ডাক উপেক্ষা করবে। কার সাধ্য আছে। ফলে দেরি হতো অনেক। ইতিমধ্যে গীতু, মিনেদের দলবেঁধে আসার খবর রানার পৌঁছে দিয়েছে আগেই। তাই দেখা হয়ে যেতো মামির সঙ্গে কোনো এক বাড়িতে। আঁচলে ডিম আর হাতে মাছ নিয়ে হাসিমুখে হাজির। আরও অনেক কথা হারিয়ে গেছে স্মৃতির গভীরে।
তারপর সংসারের টানা পোড়েন। রাগ, হিংসা, ক্রোধের সংমিশ্রণে সংসার স্রোতে ভাসতে ভাসতে জীবন প্রবাহ এগিয়ে চলে। হয়তো এর ফলেই দাদুর শেষ জীবনে সেবার সুযোগ পেয়েছিলাম আমরা। আমি নিয়ম করে দাদুকে গীতাপাঠ করে শোনাতাম। দাদু কত গল্প বলতেন। কোনোদিন হা পিত্যেশ করতে দেখিনি। আমার সময় কাটতো দাদুর কাছেই বেশি। পড়াশোনার ফাঁকে চলতো গীতাপাঠ। আমি জিজ্ঞেস করতাম, দাদু মরণের পরে আমরা কোথায় যাই? দাদু বলতেন, জানি না ভাই। তবে, মরণের পরে যদি যোগাযোগ করা যায়, তাহলে আমি তোকে নিশ্চয় জানাবো। দাদু বলতেন, আমি যখন শেষ বিছানায় শোবো,তখন আমি ইশারা করবো হাত নেড়ে। তখন তুই গীতার কর্মযোগ অধ্যায় পড়ে শোনাবি। তোর মঙ্গল হবে। আমিও শান্তিতে যেতে পারবো। হয়েছিলো তাই। কর্মযোগ পাঠ করা শেষ হতেই দাদুর হাত মাটিতে ধপাস করে পরে গেলো। দাদু ওপারে চলে গেলেন হেলতে দুলতে চারজনের কাঁধে চেপে। মাথাটা দুই বাঁশের ফাঁক গলে বেরিয়ে ঝুলছিলো। আমি বলে উঠলাম, ওগো দাঁড়াও দাদুর লাগবে। মাথাটা ঠিক কর বালিশে দি। কেঁধো বললেন, মরে গেয়েছে। ছেড়ে দে। আমি বললাম, না ঠিক করো। তারপর ঠিক করলো দাদাভাই, দাদুর মাথাটা বালিশে দিয়ে।
অনেক বছর অপেক্ষা করেছি, দাদুর কথা শুনবো ওপার থেকে। যোগাযোগের উপায় থাকলে নিশ্চয় করতেন। কিন্তু কোনোদিন স্বপ্ন পর্যন্ত দেখিনি। কথা শোনা তো দূর অস্ত।
আমরা ছোটোবেলায় মোবাইল পাই নি। কিন্তু আমরা যেসব আনন্দের অংশীদার ছিলাম সেসব আনন্দ এখনকার ছেলেরা আর পায় না। ইতিহাসের বাইরে চলে গেছে ভুলোলাগা বামুন। তিনি ঝোলা হাতে মাথায় গামছা জড়িয়ে আসতেন শিল্পকর্ম দেখিয়ে রোজগার করতে। তিনি আমাদের বাড়িতে এসে শুরু করতেন নিজের কথা বা শিল্পকর্ম। নাটকের অভিনয়ের ভঙ্গিমায় বলতেন, আর বলো না বাবা। তোমাদের গ্রামে আসতে গিয়ে চলে গেলাম ভুলকুড়ি ভুল করে। তারপর মেলে, কোপা, বিল্বেশ্বর, চুরপুনি, সুড্ডো ঘুরে কোমডাঙ্গা। তারপর কেতুগ্রাম, কেউগুঁড়ি হয়ে গুড়ি গুড়ি পায়ে হেঁটে পোশলা, নঁগা, খাটুন্দি, পাঁচুন্দি হয়ে তৈপুর, পাড়গাঁ, বাকলসা, পাঁচুন্দি, মুরুন্দি, সেরান্দি, খাটুন্দি পার করে কাঁদরের গাবায় গাবায় হেঁটে এই তোমাদের গ্রামে।
আমরা জিজ্ঞেস করতাম, এতটা পথ হাঁটলে কি করে দাদু। তিনি বলতেন, সব ভূতের কারসাজি। তেনারা ভুলো লাগিয়ে দেন। ভর করে দেহে। তাই এতটা পথ হাঁটতে পারি। তারপর চালটা, কলাটা, মুলোটা দিতেন তার ঝোলায় আমার মা বা পিসি। ভুলোলাগা বামুন এলেই সেই দিনটা আমাদের খুব ভালো লাগতো। তার পিছু পিছু মন্ত্রমুগ্ধের মতো ঘুরে বেড়াতাম ভুলো লাগা বালক হয়ে।
বৃষ্টির পরেই রাম ধনু দেখা যায়। দুঃখ শেষে আনন্দ। আমার পাগলামি যে ভালোবাসে সেই শোভন । দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে মানুষকে ভালোবাসার নামই জীবন। নর জীবনে নারী ছাড়া জীবন অচল। তবু কেন এত অন্যায় অত্যাচার নারীর উপর। সাধুবেশে নারীদের বিশ্বাস অর্জন করে ন্যায় অন্যায় জলাঞ্জলি দিয়ে কেন তাদের বিশ্বাস হত্যা করা হয়। তারা যে মায়ের, মাসির আদরের আঁচল। তাদের রক্ষা করার জন্য তৈরি হোক সমস্ত মানবহৃদয়।
যতবার আমি বিপদে পড়েছি রক্ষা পেয়েছি নারী হৃদয়ের কমনীয়তার গুণে। ভীষণ বন্যায় ভেসে চলেছিলাম স্রোতের তোড়ে। রক্ষা পেয়েছি সর্দার দিদির বলিষ্ঠ হাতের আশ্রয়ে। জীবনে জ্বর হয় বারে বারে। সেবা পেয়েছি স্বপ্না বোনের শাসনে। বারে বারে জীবনযুদ্ধে যখন হেরে যাই ভালোবাসার আড়ালে মায়াচাদর জড়িয়ে রাখেন আমার বড় সাধের সহধর্মিণী। আর আমার মা সুখে দুখে শোকের নিত্যদিনের সঙ্গী। পুরো জীবনটাই ঘিরে থাকে নারীরূপী দেবির রক্ষাকবচ। সমগ্র পুরুষ সমাজ আমার মতোই নারীর কাছে ঋণী। তবে কোন লজ্জায় পুরুষ কেড়ে নেয় নারীর লজ্জাভূষণ । পুরুষদের মধ্যেই অনেকে আছেন তাদের শ্রদ্ধা করেন। তাদের রক্ষায় জীবন দান করেন। তারা অবশ্যই প্রণম্য। তাদের জীবন সার্থক। এই পৃথিবী সকলের স্বাধীনভাবে বিচরণের স্থান হোক। হিংসা ভুলে পৃথিবীর বাতাস ভালোবাসা ভরুক।
আমরা চার বন্ধু। রমেন, জীবন, বিশু আর আমি। যেখানেই যেতাম একসাথে থাকতাম। বিশু ছিলো আমাদের দলের অলিখিত নেতা। নেতা তো এমনি এমনি হয় না। তার কাজ, দল চালানোর কৌশল তাকে নেতা বানিয়েছিলো। একদিন দুপুরবেলায় সে আমাদের ডাক দিলো তার বাঁশি বাজিয়ে। বাঁশির ডাক শুনেই মন চঞ্চল হয়ে উঠতো। ঠিক যেনো রাধার পোড়া বাঁশির ডাক। চুপিচুপি বাড়ি থেকে বেড়িয়ে বটতলায়। আমাদের মিলন অফিস ছিলো এই বটতলা। চারজন ছুটে চলে যেতাম মাঠে। সেখানে বিশু বলতো, দাড়া কয়েকটা তাল কাঁকড়া ধরি। ভেজে খাওয়া যাবে। বলেই হাত ভরে দিলো সোজা ধানের জমির গর্তে। একটা মাগুর ধরেছি, বলেই মাথা টিপে হাত বের করতেই দেখা গেলো মাছ নয়, একটা বড় কালো কেউটে সাপ। বিশু সাপটাকে সাঁ সাঁ করে ঘুরিয়ে সহজেই ছুঁড়ে দিলো দূরে। তারপর তাল কাঁকড়া ধরে ভেজে খাওয়া হলো মাঠে। ভাজার সমস্ত সরঞ্জাম বিশু লুকিয়ে রাখতো একটা পোড়ো বাড়িতে। সাঁতার কাটতে যেতাম নতুন পুকুরে। একবার ডুবে যাওয়ার হাত থেকে রেহাই পেয়েছিলাম তার প্রখর বুদ্ধির জোরে। মাথার চুল ধরে টেনে তুলেছিলো ডাঙায়।
গ্রীষ্ম অবকাশে বট গাছের ডালে পা ভাঁজ করে বাদুড়ঝোলা খেলতাম বিশুর নেতৃত্বে। তারপর ঝোল ঝাপটি। উঁচু ডাল থেকে লাফিয়ে পড়তাম খড়ের গাদায়। এসব খেলা বিশুর আবিষ্কার। তারপর সন্ধ্যা হলেই গ্রামের বদমাশ লোকটিকে ভয় দেখাত বিশু। সুদখোর সুরেশ মহাজন বটগাছের ডাল থেকে শুনলো, কি রে বেটা খুব তো চলেছিস হনহনিয়ে। আয় তোকে গাছে ঝোলাই। সুদখোর অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলো। তারপর থেকে ও পথে যেত না মহাজন। সাদা চুলো গান্ধিবুড়িকে রোজ সন্ধ্যাবেলা নিজের মুড়ি খাইয়ে আসতো অতি আদরে। বিশু বলতো, আমি তো রাতে খাবো। বুড়ির কেউ নেই, আমি আছি তো। শ্রদ্ধায় মাথা নত হত নেতার হাসিতে।
একবার বন্যার সময় স্কুল যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন আমাদের নেতা। কোথাও সাঁতার জল কোথাও বুক অবধি জল। একটা সাপ বিশুর হাতে জড়িয়ে ধরেছে। বিশু এক ঝটকায় ঝেরে ফেলে দিলো সাপটা। স্কুল আমাদের যেতেই হবে। সাঁতার কাটতে কাটতে আমাদের সে কি উল্লাস। যে কোনো কঠিন কাজের সামনাসামনি বুক চিতিয়ে সমাধান করার মতো মানসিকতা বিশুর ছিলো। সে সামনে আর আমরা চলেছি তার পিছুপিছু। শেষ অবধি পৌঁছে গেলাম স্কুল। হেড মাষ্টারমশাই খুব বাহবা দিলেন স্কুলে আসার জন্য। তিনি বললেন, ইচ্ছা থাকলে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়।
টিফিনের সময় ছুটি হয়ে গেলো। আসার সময় একটা নৌকো পাওয়া গেলো। মাঝি বললেন, আমার বয়স হয়েছে আমি একা অতদূর নৌকা বাইতে পারবো নি বাবু। তাছাড়া আমার এখনও খাওয়া হয় নি।
বিশু সঙ্গে সঙ্গে নিজের টিফিন বের করে দিলো। আমরাও মন্ত্রমুগ্ধের মতো টিফিন বের করে দিলাম। মাঝি ভাই বললেন, এসো সবাই এক হয়ে খেয়ে লি। তারপর নৌকার কাণ্ডারি হলো বিশু। আর আমরা সবাই মুড়ি মাখিয়ে খেতে শুরু করলাম। মাঝি ভাই ও বিশু খেলো। ধীরে ধীরে পৌঁছে গেলাম গ্রামে। মাঝি ভাইকে পারিশ্রমিক দিয়ে বিদায় জানালাম।
পরের দিন রবিবার। রঙিন সকাল। আকাশে মেঘের আনাগোনা। কাশের কারসাজি নদীর তীর জুড়ে। বন্যার জল নেমে গিয়েছে। পুজো পুজো ভাব। বিশু কাশফুলের ভিড়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে। কয়েকদিন হলো তাকে দেখা যাচ্ছে না।
আমি ঘুরতে ঘুরতে পুজো বাড়ির ঠাকুর দেখতে গেলাম। সেখানে দেখি বিশু হাতে কাদা মেখে শিল্পীকে সাহায্য করছে। তিন দিন ধরে এখানেই তার ডেরা। এখন তার মনে বাজছে ঢাকের ঢ্যামকুড়াকুড়। মন মন্দিরে তার দুর্গা গ্রামদেশ ছাড়িয়ে অভাবি বাতাসে বাতাসে। পুজো বাড়িতে আমাকে দেখেও কোনো কথা না বলে হাঁটতে হাঁটতে বাইরে চলে গেলো।
আমি জানি সে এখন চাল, ডাল নিয়ে সর্দার বুড়িকে রেঁধে খাওয়াবে। সে বলে, ওর যে কেউ নেই। ও খাবে কি? বিশুর বাবা বছরে একবার বাড়ি আসেন। তিনি ভারতীয় সৈন্য বিভাগে কাজ করেন। বাড়িতে এলেই বিশুর হাতে হাতখরচ বাবদ তিনি বেশ কিছু টাকা দিয়ে যান। সেই টাকা বিশু লোকের উপকারে কাজে লাগায়। বড়ো অবাক হয়ে ভাবি, ছোটো বয়সে এতবড় মন সে পেল কোথা থেকে?
তিন
স্কুলের দূরত্ব অনেক বেশি হওয়ায় আমাদের চার বন্ধুর বাড়ির গার্জেনরা শলা পরামর্শ করে হোষ্টেলে থাকার কথা বললেন। দায়িত্ব নিলো বিশু। কিন্তু হেডমাষ্টারমশাই বললেন, সেশনের মাঝে হোষ্টেল পাবি না। ঘর ভাড়া নিয়ে চারজনে থাক। পরীক্ষা এসে গেছে। কাছাকাছি থাকিস তিনটি মাস।রেজাল্ট ভালো হবে। ঘুরে ঘুরে অবশেষে ভাড়া ঘর পেলাম। কিন্তু বাড়িওয়ালার পাশের প্রতিবেশী বললেন, সাবধান ওই বাড়িতে ভূত আছে। আমরা ভয় পেয়ে তিনজনে বলে উঠলাম, তাহলে অন্য ঘর দেখি চল।
বিশু বললো, টাকা দেওয়া হয়ে গেছে। ভূতের বাড়িতেই থাকবো। বিশু যখন সঙ্গে আছে, ভয় কি তোদের। তার অভয় বাণী ভরসা করে আমরা মালপত্তর নিয়ে ঢুকে পড়লাম লড়াইয়ের কোর্টে।ক্যাপটেন বিশু বাড়িটা এক চক্কর পাক দিয়ে হাতে একটা লাঠি নিয়ে বললো, চলে আয় ভূতের বাচ্চা। আমরা ওর সাহস দেখে অবাক হতাম। রমেন বলে উঠলো, ভূতের শেষ দেখে ছাড়বো।জীবনের মরণের ভয় একটু বেশি। সে কাঁপা গলায় বলে উঠলো, যদি গলা টিপে ধরে ভূত। বিশু বললো, ভয় নেই, আমি একাই একশো। তোর কিছু হবে না। হলে আমার হবে।
এই বাড়ির নিচু তলায় কিছু অসামাজিক লোকের কাজকর্ম বিশু এক সপ্তাহের মধ্যেই টের পেয়ে গেলো। তারাই এই ভূতের ভয় দেখায়। একদিন জীবন বাথরুম গেছে এমন সময় নাকি সুরে একজন বলে উঠলো, এঁখান থেকে পাঁলা। ঘাড় মটকে দেবো। আবার একদিন রমেন ভয় পেলো।ঠিক সেই বাথরুমে। বিশু তদন্ত করে দেখলো বাথরুমের ভেন্টিলেটার ভেঙ্গে একটা সরু দড়ি ঢোকানো হয়েছে। বাইরে গিয়ে দেখলো দড়িটা নিচের ঘরের বারান্দায় শেষ হয়েছে। বাথরুমে ভাঙ্গা কাঁচে টান পড়লে বিকট আওয়াজ হয়। আর মুখ বাড়িয়ে মুখোশ পড়ে নাকি সুরের কথায় সকলেই ভয় পাবে। বিশু বললো সবাই তৈরি থাকিস। আজ রাতেই ভূত ধরবো।
আজ আর কেউ স্কুল গেলাম না। একটা উত্তেজনা রাতে জাগিয়ে রেখেছে। এবার সেই বিকট শব্দ। বিশু বাঘের মতো লাফিয়ে লাঠি হাতে নিচের তলায় গিয়ে জলজ্যান্ত ভূতের পাছায় লাঠির আঘাতে ভূতকে কাবু করে ফেললো। ভূত বাবাজি জোড় হাতে বলছে, ছেড়ে দাও বাবা আমি আর ওসব করবো না। ভূতের সঙ্গীরা সব পালিয়েছে, আমাদের হাতে লাঠি দেখে। বিশু বললো, যাও, যেখানে বিশু আছে সেখানে চালাকি করার চেষ্টা কোরো না। বিপদে পড়বে। তারপর থেকে আর কোনোদিন ভূতের উপদ্রব হয়নি সেই বাড়িতে।
বিশুর বাহাদুরি দেখেই আমরা সাহসী হয়ে উঠেছিলাম। বিশুর সঙ্গে আমরা বেরোলে সকলের চোখেমুখে একটা সাহসের, শান্তির ছাপ ফুটে উঠতো। পাড়ার কোনো মানুষ বিপদে পড়লে বিপদের বন্ধু এই টাইগার বিশুকেই স্মরণ করতো। তার সঙ্গে আমরা তো থাকতাম অবশ্যই। রমেন, জীবন, বিশু, আমি একবার বন্যার সময় নৌকা করে মানুষের খাবার জোগাড় করতে চড়খী গ্রামে গিয়েছিলাম। হেলিকপ্টার থেকে চিড়ের বস্তা, গুড়ের বস্তা ফেলছে চড়খীর ব্রীজে যার আসল নাম কাশীরাম দাস সেতু। সেখান থেকে আমরা চিড়ে, গুড়ের পাটালি নৌকায় তুললাম। রমেন পেটুক। বললো, একটু টেষ্ট করলে হয় না। বিশু বললো, এখন এটা সকলের সম্পত্তি। যা হবে সকলের সামনে হবে। কেউ হাত দিবি না। এখন তাড়াতাড়ি চল। বান বাড়ছে। বিশু দাঁড় টানে আর আমরা সবাই সাহায্য করে নৌ্কা ও খাবার নিয়ে চলে এলাম নতুন পুকুরের পাড়ে। সেখানে বাড়ি বাড়ি সকলকে সমানভাবে খাবার ভাগ করে দিলো বিশু। তারপর আমরা বাড়ি এসে জীবনের মায়ের হাতের রান্না, গরম খিচুড়ি আর পেঁপের তরকারি খেলাম। অমৃতের স্বাদ। বিশু বললো, কাকীমা অনেক পেঁপে গাছ পড়ে গেছে বন্যার স্রোতে। আমরা আপনাকে অনেক পেঁপে এনে দেবো। সেবার বন্যায় পেঁপে, গ্রামের লোকের প্রাণ বাঁচিয়েছিলো। আমাদের গ্রাম অজয় নদীর ধারে।গ্রামগুলিও খুব নীচুস্থানে অবস্থিত। নদীর নাব্যতা বা গভীরতা অল্প। ফলে বন্যা প্রায় প্রতি বছর দেখা দিয়ে যেত। জল যখন কমে যেতো তখন তোতনের মা ও পাড়ার মা বোনেরা মাঠে মাছ ধরার জন্য যেত। নানারকমের শাক, ঢোল কলমি, শুশুনি তুলতো। খুব ভালো লাগতো নানারকমের মাছ ভাজা খেতে। আমি দেখলাম, তোতনের মা মাঠ থেকে দুই তিন রকমের শাক তুলেছে। ওরা ভিটামিন বোঝে না, শরীরচর্চ্চাও বোঝে না। ওরা জানে খাটবো, রোজগার করবো আর খাবো পেট ভরে। মাঠেই পাওয়া যেত বেশির ভাগ শাক, সব্জী, খলসে, ও আরও নানারকমের মাছ মাঠের জলে সাঁতার কেটে বেড়াতো। বেলে, চোখো, চ্যাঙ, ছিঙুরি, গচিমাছ ছাড়াও ছোটো কাঁকড়া, তাল কাঁকড়া পাওয়া যেত। গর্তে হাত ঢুকিয়ে বিশু অনরকবার তো আল কাঁকড়া বের করে আমাদের দেখিয়েছে।পাঁকাল, গুঁতে, কৈ, মাগুর, ল্যাটা প্রভৃতি অসংখ্য মাছ। বিত্তি পেতে দিতো স্রোতের মুখে। বিশু বলছে, খাল কেটে মাঝখানে বিত্তি পেতে জল যাওয়ার নালা কেটে দিতো। মাছ লাফিয়ে ওই গর্তে পড়তো। টানা জাল,পাতা জাল দিয়ে মাছ ধরতো। এখন তোতনের মায়ের জায়গায বৌমা মাঠে যায়। কিন্তু কৃষিকাজে সার, ওষুধ প্রয়োগ করার ফলে সেইসব মাছ ইতিহাসের পাতায় চলে গেছে। শাকপাতাও পায় না মা বোনেরা। এখন সব বাজারমুখী। তখন শাক আঁচলে করে নিয়ে গিয়ে বাউরী বউ মুড়ি নিয় আসতো চাষি বাড়ি থেকে। মাঠের টাটকা শাক সবাই নিত জলের দরে। আজ আর টাটকা কিছু পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশুর কথা একশো শতাংশ সত্য। এখন আমরা বড় হয়ে গেছি। কিন্তু, স্বর্ণযুগের সেইসব স্মৃতি মনের মণিকোঠায় চিরদিন স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। আমার মা বলতেন, ছোটো থাকাই ভালো রে, সংসার অসার। মা বলতেন, এখন সংসাররূপ চিতায় জ্বলে মরছি। মরণের পরে প্রকৃত চিতায় পুড়ে যাবে আদরের দেহ...
স্বজন বন্ধুরা বলবে আর কত সময় লাগবে শেষ হতে...একটু দ্রুত করো ভাই...তবে কিসের এত অহংকার... কেন এত লোভ ... ভালোবাসায় কৃপণতা ... কে ধনী... টাকায় চিতা সাজালেও পরিণতি একই...
কৃষ্ণধনে ধনী যেজন
নিজ ধামে ফেরে সেজন...
লক্ষ্মীপুজো এলেই মা বলতেন কোজাগরীর অর্থ। তিনি বলতেন, কোজাগরী লক্ষীপুজোয় পুজো করার পরে যে গৃহস্থ রাত্রি জাগরণ করে রাত কাটাবে তার ঘরে লক্ষী স্বয়ং বিরাজ করেন। কোন অভাব, অনটন তাকে স্পর্শ করতে পারবে না। স্বার্থ নিয়েই মানুষ পুজো করে। কারণ সে সংসারী। ছেলে, মেয়ে, বাবা,মা, ঠাকুমা, দাদু সকলকে নিয়ে এই সংসার। তাদের মঙ্গল কামনা করেই মানুষের এই পুজো পার্বণ। বাজারে দরদাম করে ঠাকুর কেনার পরে পুজোর ফলমূল, দশকর্মার জিনিসপত্র কিনে বাড়িতে আলপনা এঁকে ঠাকুরের প্রতিষ্ঠা হয়। তারপর পুরোহিতের পৌরোহিত্যে গৃহস্থের মঙ্গলসাধন। লৌকিক আচার, আচরণে বিশ্বাস জড়িয়ে থাকে। আর বিশ্বাসে মিলায় বস্তু। পুজোর প্রতিটি পর্যায়ে শিল্প ভাবনা বিরাজ করে। তার ফলে পুজো আরো আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে।দুর্গাপুজোয় ঢাক বাজে। প্যান্ডেলে কোটি কোটি টাকা খরচ করে কোনো কিছুর আদলে মন্দির বানানো হয়। যেমন, তাজমহল, খাজুরাহো, কোণারক প্রভৃতি। নানারকম বাদ্যযন্ত্র পুজেকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে। মা আমাদের নিয়ে, কাটোয়ার কার্তিক লড়াই, চন্দননগরে জগদ্ধাত্রী পুজো, কাগ্রামের জগদ্ধাত্রী পুজো, শিবলুনের মেলা, উদ্ধারণেরপুরের মেলা দেখাতে নিয়ে যেতেন। পুজো এলেই মায়ের লক্ষ্মীর ঝাঁপি উন্মুক্ত হয়ে যেত। কোজাগরীর রাতে মা কম করে তিনশো লোকের খাওয়ার ব্যবস্থা করতেন। মাজা নীচু করে আসনে বসা মানুষদের প্রসাদ বিতরণ করতাম আমরা ভাই বোনেরা। পরের দিনও খিচুড়ির ব্যবস্থা থাকতো। ডোমপাড়ার সকলে এসে নিয়ে যেতো আনন্দে। সর্দার বুড়ি বেসকাদি, মঙ্গলীদি সবাই আসতো। ছোটো পিসি, মানা, বড়পিসী, সন্ধ্যা, রুনু, শঙ্করী সকলে আসতো। মায়ের ঘর পূর্ণ হয়ে উঠতো অতিথি সমাগমে। গম্গম্ করতো বাড়ি। মানুষই যে লক্ষ্মী তা আবার প্রমাণ হয়ে যেতো চিরকালের সত্য সুরে।
পুজোর বেশ কিছুদিন পরে মেয়েরা সকলে এক হয়ে মাংস, ভাতের ফিষ্টি করতো। মনে আছে আমার, খেতে এসে বিশাখাদি বলেছিলো, আমি বিধবা মাংস খবো কি করে? আমার মাসতুতো দিদি বলেছিলো, বিধবা আবার কি কথা? তোর স্বামী মরে গেছে। দুঃখের কথা। তার সঙ্গে মাংসের কি সম্পর্ক। আচ্ছা কেউ মনে কর মাংস খেলো না। আর মনে মনে স্বামীকে দোষ দিলো। সমাজপতিরা, সমাজের সেনাপতিরা মনের নাগাল কি করে পাবে? ওদের হাত ওই মাংস অবধি। অতএব, নো চিন্তা, ডু ফুর্তি।
বিশাখাদি আনন্দে মাংস খেয়েছিলো। সমস্ত কিছুতেই চিরকাল কিছু মহিলার সংস্কারমুক্ত মনের জন্য পৃথিবী এত সুন্দর। উন্মুক্ত সমাজ আমাদের সর্দার পাড়ার। সেখানে সমাজের কোনো সেনাপতি বিধি আরোপ করে না। যে যার ইচ্ছে মতো খেটে খায়। কেউ মুনিষ খাটে, কেউ মাছ ধরে, কেউ কেরালাতে সোনার দোকানে কাজ করে। বুড়ো বয়সে তারা ছেলে মেয়েদের রোজগারে খায়। ওদের কাউকে বৃদ্ধাশ্রমে যেতে হয় না। কার কৃপায় ওরা বুড়ো বুড়ি হয় না? শক্ত সমর্থ থাকতেই পরকালের ডাকে ওপারে চলে যায়। কাজই হলো আসল লক্ষ্মী।
কদতলার মাঠে এসে ঢিল মেরে পেরে নিতাম কাঁচা কদবেল। কামড়ে কচ কচ শব্দে সাবাড় করতাম কদ। বুড়ো বলতো, কদ খেয়েছিস। আর খাবি। কই তখন তো গলা জ্বলতো না। এখন শুধু ওষুধ। ভক্ত, ভব, ভম্বল, বাবু, বুলা, রিলীফ সবাই তখন আমরা আমড়া তলায় গিয়ে পাকা আমড়া খেতাম। জাম, তাল, বেল, কুল, শসা, কলা, নারকেল কিছুই বাদ রাখতাম না। নারকেল গাছে উঠতে পারতো গজানন। শুধু দুহাতের একটা দড়ি। তাকে পায়ের সঙ্গে ফাঁদের মতো পরে নিতো গজানন। তারপর কিছুক্ষণের মধ্যেই নারকেল গাছের পাতা সরিয়ে ধপাধপ নিচে ফেলতো। আমরা কুড়িয়ে বস্তায় ভরে সোজা মাঠে। বাবা দেখলেই বকবেন। তারপর দাঁত দিয়ে ছাড়িয়ে আছাড় মেরে ভেঙ্গে মাঠেই খেয়ে নিতাম নারকেল। একদম বাস্তব। মনগড়া গল্প নয়। তারপর গাজনের রাতে স্বাধীন আমরা। সারা রাত বোলান গান শুনতাম। সারা রাত নাচতাম বাজনার তালে তালে।
শীতকালে খেজুর গাছের রস। গাছের কামান হতো হেঁসো দিয়ে। মাথার মেথি বার করে কাঠি পুঁতে দিতো গুড় ব্যাবসায়ী। আমাদের ভয় দেখাতো, ধুতরা ফুলের বীজ দিয়ে রাকবো। রস খেলেই মরবে সে। চুরি করা কাকে বলে জানতাম না। এক রাতে বাহাদুর বিশুর পাল্লায় পরে রাতে রস খেতে গেছিলাম। বিশু বললো, তোরা বসে থাক। কেউ এলে বলবি। আমি গাছে উঠে রস পেড়ে আনি। তারপর গাছে উঠে হাত ডুবিয়ে ধুতরো ফুলের বীজ আছে কিনা দেখতো। পেড়ে আনতো নিচে। তারপর মাটির হাঁড়ি থেকে রস ঢেলে নিতাম আমাদের ঘটিতে। গাছে উঠে আবার হাঁড়ি টাঙিয়ে দিয়ে আসতো বিশু। সকালে হাড়ি রসে ভরে যেতো। ভোরবেলা ব্যবসায়ীর কাছে গিয়ে বলতাম, রস দাও, বাড়ির সবাইকে দোবো। বুক ঢিপঢিপ চাঁদের গর্ত। দেবে কি দেবে না, জানিনা। অবশেষে প্রাপ্তিযোগ। যেদিন রস পেতাম না তখন মাথায় কুবুদ্ধির পোকা নড়তো। তাতে ক্ষতি কারো হতো না। বিশু ভালো মিষ্টি রস হলে বলতো, এটা জিরেন কাঠের রস। মানে চারদিন হাড়ি না বাঁধলে রস মিষ্টি হতো। জানি না। আমরা গাছে নিচে গিয়ে হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকতাম। রস পড়তো জিভে টুপ টাপ। কতদিন ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে গেছে রসাস্বাদনে। মোবাইল ছিলো না, ফেসবুক ছিল না। কোন পাকামি ছিল না। সহজ সরল হাওয়া ছিলো। ভালোবাসা ছিলো। আনন্দ ছিলো জীবনে। ব্লউ হোয়েলের বাপ পর্যন্ত আমাদের সমীহ করে চলতো। কোনদিন বাল্যকালে আত্মহত্যার খবর শুনিনি। সময় কোথায় তখন ছেলেপিলের। যম পর্যন্ত চিন্তায় পড়ে যেতো বালকদের আচরণে, কর্ম দক্ষতায়।
আমাদের একটা বন্ধু দল ছিল। পুজোর সময় রাত জেগে ঘুরতুম কোলকাতার অলিগলি। হাওড়া ব্রিজ থেকে শিয়ালদহ। পায়ে হেঁটে। গোল হয়ে প্রাচী পেরিয়ে হাঁটার নেশায় চলে আসতাম আবার কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে সোজা কলেজ স্কোয়ার। জীবনের তিরিশটা বছর তিল তিল করে খরচ করেছি আনন্দের খোঁজে। অসীম বলে সীমাহীন আনন্দের ছেলেটা গান গাইতো সুন্দর। বিচ্ছু বলে বন্ধুটা ভালোবাসতো অপলক মায়া জড়ানো চোখের সুন্দরীকে। তাকে দেখলেই বিচ্ছু ওথেলো হয়ে যেতো। অমিত রান্না করতো খুব ভালো। পুরী আর দীঘাতে ওর হাতের রান্না খেয়ে আনন্দিত আমরা ওকে একটা জামা উপহার দিয়েছিলাম। ও শেফ হতে চেয়েছিলো। অনিন্দিতা বলে বান্ধবীটা আমাদের মানুষ হওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছিলো। কিন্তু সব স্বপ্নগুলো বিস্ফারিত চোখের কাছে থমকে গিয়েছিলো।
ঐ বন্ধুরা একত্রে সমাজ সেবার প্রচেষ্টায় আছে। রাস্তার অভুক্ত মানুষের মুখে একটু নুনভাত জোগানোর জন্য ওরা ভিক্ষা করে, জীবনমুখী গান শুনিয়ে। অসীম গান করে, বিচ্ছু একতারা বাজায়। অমিত আর অনিন্দিতা সুরে সুর মিলিয়ে স্বপ্ন দেখে। ওরা এখনও স্বপ্ন দেখে। হয়তো চিরকাল দেখে যাবে থমকা লাগা স্ট্যাচুর পলক..
ছোটোবেলার রায়পুকুরের রাধা চূড়ার ডালটা আজও আমায় আহ্বান করে হাত বাড়িয়ে। এই ডাল ধরেই এলোপাথারি হাত পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে সাঁতার শিখেছি আদরের পরশে। ডুবন্ত জলে যখন জল খেয়ে ফেলতাম আনাড়ি চুমুকে, দম শেষ হয়ে আসতো তখন এই ডাল তার শক্তি দিয়ে ভালোবাসা দিয়ে জড়িয়ে ধরতো অক্লেশে। হয়তো পূর্ব জন্মে আমার দিদি হয়ে যত্ন আদর করতো এই ডালটা। কোনদিন তাকে গাছ মনে করিনি আমি। এখনও জল ছুঁয়ে আদরের ডাক শুনতে পাই পুকুরের ধারে গেলে। রাধা নামের মায়াচাদর জড়ানো তার সবুজ অঙ্গে। ভালো থেকো বাল্য অনুভব। চিরন্তন প্রকৃতির শিক্ষা অঙ্গনে নাম লিখে যাক নব নবীন শিক্ষার্থী প্রবাহ।
আমার স্বপ্নের সুন্দর গ্রামের রাস্তা বাস থেকে নেমেই লাল মোড়াম দিয়ে শুরু। দুদিকে বড় বড় ইউক্যালিপ্টাস রাস্তায় পরম আদরে ছায়া দিয়ে ঘিরে রেখেছে। কত রকমের পাখি স্বাগত জানাচ্ছে পথিককে। রাস্তা পারাপারে ব্যস্ত বেজী, শেয়াল আরও অনেক রকমের জীবজন্তু। চেনা আত্মীয়র মতো অতিথির কাছাকাছি তাদের আনাগোনা। হাঁটতে হাঁটতে এসে যাবে কদতলার মাঠ। তারপর গোকুল পুকুরের জমি, চাঁপপুকুর, সর্দার পাড়া, বেনেপুকুর। ক্রমশ চলে আসবে নতুন পুকুর, ডেঙাপাড়া, পুজোবাড়ি, দরজা ঘাট, কালী তলা। এখানেই আমার চোদ্দপুরুষের ভিটে। তারপর ষষ্টিতলা, মঙ্গলচন্ডীর উঠোন, দুর্গাতলার নাটমন্দির। এদিকে গোপালের মন্দির, মহেন্দ্র বিদ্যাপীঠ, তামালের দোকান, সুব্রতর দোকান পেরিয়ে ষষ্ঠী গোরে, রাধা মাধবতলা। গোস্বামী বাড়ি পেরিয়ে মন্ডপতলা। এই মন্ডপতলায় ছোটোবেলায় গাজনের সময় রাক্ষস দেখে ভয় পেয়েছিলাম। সেইসব হারিয়ে যাওয়া রাক্ষস আর ফিরে আসবে না। কেঁয়াপুকুর, কেষ্টপুকুরের পাড়। তারপর বাজারে পাড়া, শিব তলা পেরিয়ে নাপিত পাড়া। এখন নাপিত পাড়াগুলো সেলুনে চলে গেছে। সাতন জেঠু দুপায়ের ফাঁকে হাঁটু দিয়ে চেপে ধরতেন মাথা, তারপর চুল বাটি ছাঁটে ফাঁকা। কত আদর আর আব্দারে ভরা থাকতো চুল কাটার বেলা। এখন সব কিছুই যান্ত্রিক। মাঝে মাঝে কিছু কমবয়সী ছেলেমেয়েকে রোবোট মনে হয়। মুখে হাসি নেই। বেশ জেঠু জেঠু ভাব। সর্বশেষে বড়পুকুর পেরিয়ে পাকা রাস্তা ধরে ভুলকুড়ি। আর মন্ডপতলার পর রাস্তা চলে গেছে খাঁ পাড়া, কাঁদরের ধার ধরে রায়পাড়া। সেখানেও আছে চন্ডীমন্ডপতলা, কলা বা গান, দুর্গাতলার নাটমন্দির সব কিছুই। পুজোবাড়িতে গোলা পায়রা দেখতে গেলে হাততালি দিই। শয়ে শয়ে দেশি পায়রার দল উড়ে এসে উৎসব লাগিয়ে দেয়। পুরোনো দিনের বাড়িগুলি এই গ্রামের প্রাণ। এই গ্রামেই আমার সবকিছু, আমার ভালোবাসা, আমার গান।
ছোটোবেলার সরস্বতী পুজো বেশ ঘটা করেই ঘটতো। পুজোর দুদিন আগে থেকেই প্রতিমার বায়নাস্বরূপ কিছু টাকা দিয়ে আসা হত শিল্পীকে। তারপর প্যান্ডেলের জোগাড়। বন্ধুদের সকলের বাড়ি থেকে মা ও দিদিদের কাপড় জোগাড় করে বানানো হত স্বপ্নের সুন্দর প্যান্ডেল। তার একপাশে বানানো হত আমাদের বসার ঘর। পুজোর আগের রাত আমরা জেগেই কাটাতাম কয়েকজন বন্ধু মিলে। কোনো কাজ বাকি নেই তবু সবাই খুব ব্যস্ত। একটা ভীষণ সিরিয়াস মনোভাব। তারপর সেই ছোট্ট কাপড়ের পাখির নিড়ে কে কখন যে ঘুমিয়ে পড়তাম তা কেউ জানতে পারতাম না। মশার কামড়ও সেই নিশ্চিন্ত নিদ্রা ভাঙাতে পাড়তো না। তবু সকালে উঠেই মচকানো বাঁশের মত ব্যস্ততার আনন্দ। মা বাবার সাবধান বাণী, ডেঙ্গু জ্বরের ভয় কোনো কিছুই আমাদের আনন্দের বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে নি। হড়কা বানে যেমন সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে সমুদ্রে ফেলে, আমাদের আনন্দ ঠিক আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যেত মহানন্দের জগতে। এরপরে সকাল সকাল স্নান সেরে ফলমূল কাটতে বসে পড়তাম বাড়ি থেকে নিরামিষ বঁটি এনে। পুরোহিত এসে পড়তেন ইতিমধ্যে। মন্ত্র তন্ত্র কিছুই বুঝতাম না। শুধুমাত্র বুঝতাম মায়ের কাছে চাইলে মা না করতে পারেন না। পুষ্পাঞ্জলি দিতাম একসঙ্গে সবাই। জোরে জোরে পুরোহিত মন্ত্র বলতেন। মন্ত্র বলা ফাঁকি দিয়ে ফুল দিতাম মায়ের চরণে ভক্তিভরে। তারপরে প্রসাদ বিতরণের চরম পুলকে আমরা বন্ধুরা সকলেই পুলকিত হতাম। প্রসাদ খেতাম সকলকে বিতরণ করার পরে। আমাদের সবার প্রসাদে ভক্তি বেশি হয়ে যেত, ফলে দুপুরে বাড়িতে ভাত খেতাম কম। সন্ধ্যাবেলায় প্রদীপ, ধূপ জ্বেলে প্যান্ডেলের ঘরে সময় কাটাতাম। পরের দিন দধিকর্মা। খই আর দই। পুজো হওয়ার অপেক্ষায় জিভে জল। তারপর প্রসাদ বিতরণ করে নিজেদের পেটপুজো সাঙ্গ হত সাড়ম্বরে।
এরপরের দৃশ্য প্রতিমা বিসর্জন। কাছেই একটা পুকুর। রাত হলে সিদ্ধিলাভে (দামীটা না) আনন্দিত হয়ে নাচতে নাচতে অবশেষে শেষের বাজনা বেজে উঠতো। মা তুই থাকবি কতক্ষণ, তুই যাবি বিসর্জন। তার সাথে আমাদের মনটাও বিসর্জনের।
সুমন্ত ভট্টাচার্য শুধু একজন যোগ্য বিজ্ঞানী নন। তিনি একাধারে চিকিৎসক, সন্ধানী গোয়েন্দা আবার কিশোর মনোবিজ্ঞান পত্রিকার সহ সম্পাদক। তিনি এক বনেদী পরিবারের সন্তান। পূর্ব বর্ধমান জেলায় পূর্বপুরুষরা বাস করতেন। ঐ বংশের একাংশ আবার জলপাইগুড়িতে বাস করতেন । কিন্তু কালের প্রবাহে কোনো কিছুই স্থির নয়। এখন কে কোথায় ছিটকে পৃথিবীর কোন জায়গায় আছেন তার সন্ধান করা সহজ কাজ নয়। জয়ন্তদা বসে বসে এইসব ভাবছেন আর মনে মনে প্রার্থনা করছেন, যে যেখানেই থাকুন, তারা যেন সবাই সুখে শান্তিতে থাকেন।
হঠাৎ রত্নাদির ডাকে সুমন্তদার লুপ্ত চেতনা ফিরে এলো। দাদা বললেন - বসো বসো আমি একটু আসছি।
তারপর দুই কাপ চা এনে বললেন - দিদি চা খাও।
- দাদা চা খুব ভালো করেন।
দিদি বললেন - দাদা চা খুব ভালো হয়েছে।
দাদা বললেন - ধন্যবাদ। তারপর কি খবর বলো।
দিদি বললেন - গতকাল এক ভদ্রলোক ফোন করেছিলেন বেড়াতে যাওয়ার জন্য।
- কোথায়?
বীরভূম জেলার সাঁইথিয়ার কাছে মথুরাপুর গ্রামে। দাদা নতুন জায়গা দেখতে ভালোবাসেন। ব্যাগ পত্তর গুছিয়ে পরের দিন দুজনে হাওড়া রামপুর হাট এক্সপ্রেস ট্রেনে চেপে বসলেন। ট্রেনে বসে জানালা দিয়ে দৃশ্যাবলী দেখতে দেখতে যাওয়া অন্তরে এক অদ্ভূত অনুভূতির সৃষ্টি করে। এ রসে যে বঞ্চিত তাকে বোঝানো কঠিন। দাদা ও দিদিকে এই কথাগুলি বলছিলেন। দিদি বললেন, সত্য কথা। ট্রেন জার্নির স্বাদ আলাদা।
তারপর বারোটার সময় ওনারা মথুরাপুর গ্রামে এসে গেলেন। পরেশবাবু ফোনে খবর পেয়ে আগে থেকেই তৈরি ছিলেন। জলটল খাওয়ার পর পরেশবাবু দাদাও দিদিকে নিয়ে ময়ুরাক্ষী নদী দেখাতে নিয়ে গেলেন। নদীতে এখন বেশি জল নেই। পায়ে হেঁটে ওনারা নদীর ওপারে গেলেন। পরেশবাবুর ব্যবহার দেখে দাদা ও দিদি খুব মুগ্ধ হলেন। তারপর খাওয়া দাওয়া করে দুপুরে একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার বিকালে গ্রাম ঘোরার পালা। কত কিছু দেখার আছে আমাদের দেশের গ্রামে। গাছপালা নদীনালা এই নিয়েই আমাদের গ্রাম। কবিগুরু তাই বলেছিলেন, "দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া ... একটি ঘাসের শিষের উপর একটি শিশির বিন্দু"। আমরা আজীবন ঘুরে বেড়াই, আনন্দের খোঁজে। আর এই আনন্দ হলো জীবনের আসল খোঁজ। কথাগুলি জয়ন্তদা বললেন।
দিদি পরেশবাবুকে অনেক কথা জিজ্ঞাসা করলেন। পরেশবাবুও কথা বলে খুব আনন্দ পেলেন।
তারপর রাতে খাওয়া বেশ ভালোই হলো। পরেশবাবুর বিরাট জায়গা জুড়ে বাগান। অনেক হিম সাগর আম। গাছের টাটকা আম। আর সাঁকিরের পাড় থেকে আনা দৈ আর রসগোল্লা। রসিক মানুষ জয়ন্তদা। বললেন - পরেশবাবু কব্জি ডুবিয়ে ভালোই খেলাম।
পরেশবাবু বললেন - আপনাদের খাওয়াতে পেরে আমি খুব খুশি।
ভোরবেলা তখন চারটে বাজে। জয়ন্তদার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। পরেশবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন - কি ব্যাপার এত কল রব কেন?
পরেশবাবু বললেন - আর বলবেন না। আমার বাগানে অনেক জবা গাছ আছে নানা জাতের। কোনোটা লঙ্কাজবা, পঞ্চমুখী, গণেশজবা, সাদাজবা, ঝুমকোজবা, খয়েরীজবা, লাল, ঘিয়েজবা প্রভৃতি। এখন একটা লাল জবা গাছে ঘিয়ে জবা হয়েছে। সবাই তাই ভোরবেলা পুজো দেয়। বলে, ঠাকুরের দয়া। তাই এক গাছে দুই রকমের ফুল। দিদি দেখছেন প্রচুর মহিলা চান করে কাচা কাপড় পরে পুজো দিতে এসেছেন।
দাদা বললেন - এদের বোঝাতে হবে। এটা বিজ্ঞান নির্ভর ব্যাপার।
দিদি বললেন - আপনারা শুনুন, এটা বিজ্ঞানের ব্যাপার।
তখন মহিলাদের একজন বললেন - একথা বলবেন না দিদি। পাপ হবে।
দিদি বললেন - পরাগ মিলনের ফলে লাল গাছের পরাগ রেণু ঘিয়ে গাছের পরাগ রেণুর সঙ্গে মিলিত হয়। এই কাজটি করে পতঙ্গরা। সংকারয়নের ফলে জটিল পদ্ধতি পার করে এইসব ব্যাপারগুলো হয়। সেসব বুঝতে গেলে আরও পড়াশুনা করতে হবে। আরেকজন মহিলা বললেন - কই আর কোনো গাছে তো হয় নি।
দিদি বললেন - এত বড় বাগান ঘুরে দেখুন। নিশ্চিত দেখা যাবে। দাদা জানেন সবাই প্রমাণ চায়। প্রমাণ ছাড়া এদের কুসংস্কার মন থেকে যাবে না। দাদা ডাকলেন - আপনারা এদিকে আসুন। দেখুন এখানেও দুটি গাছে ঐ একই ঘটনা ঘটেছে। সবাই ওখানে গিয়ে দেখলেন, সত্য কথা তাই হয়েছে। লাল গাছে ঘিয়ে জবা। দাদা বললেন, মনে রাখবেন বিজ্ঞান অসম্ভবকে সম্ভব করে। বিজ্ঞান এর দৃষ্টি দিয়েই আমাদের সবকিছু বিচার করতে হবে। সবাই বুঝতে পারলেন এবং খুশি হয়ে বাড়ি চলে গেলেন। পরেশবাবু বললেন - এবার আপনাদের জন্য কফি নিয়ে আসি।
বর্ধমান জেলার সিঙ্গি গ্রামে কবি কাশীরাম দাসের জন্মস্থান। ঐ গ্রামে আমার এক আত্মীয় বাড়িতে ক্ষেত্রপাল পুজোর সময় বেড়াতে গেছিলাম। এই পুজোর সময় এই গ্রামে খুব ধূমধাম হয়। রতন আমার থেকে বয়সে একটু ছোটো হলেও বন্ধুর মতোই ভালোবাসি। যেখানে যাই আমরা দুজন একসাথে যাই। আমার অনেক দিনের ইচ্ছা কিশোর মনোবিজ্ঞানের সহ সম্পাদক সুমন্ত ভট্টাচার্য ও সহ সম্পাদনা সচিব রত্না রায়কে এই সিঙ্গিগ্রামের পুজো দেখাবো। রতনকে আগেই বলে রেখেছি। দাদা ও দিদিকেও একমাস আগে বলে রেখেছি। আজ তাঁরা আসবেন।
আমরা ক্ষেত্রপালতলায় ঢাকের তালে মত্ত। হঠাৎ একটি ছোট ছেলে ছুটতে ছুটতে এসে সবাইকে বলছে, সবাই দেখে এসো মিত্র বাড়িতে ঠাকুর এসেছে। আমরা ছেলেটির কথা শুনে কৌতূহল বশত মিত্র বাড়িতে গিয়ে দেখি লোকে লোকারণ্য। -----কি হয়েছে রে, একটি মেয়েকে জিজ্ঞাসা করলাম । মেয়েটি বললো - জগন্নাথ মন্দিরের ভিতর স্বয়ং জগন্নাথ ঠাকুর এসেছেন। ভিড় ঠেলে এগিয়ে গিয়ে দেখলাম, একটি বড় পোকা ঠিক জগন্নাথ ঠাকুরের মত সব কিছু। খুব আশ্চর্য হওয়ার কথা।
এদিকে দাদা ও দিদি এসে গেছেন। ওনাদের বন্ধুর বাড়ি নিয়ে গোলাম। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়া হলে গ্রামের সব কিছু ঘুরে দেখলেন। পাশের গ্রামে অনেক ভেড়া, ছাগল জাতীয় পশুদের বলি দেওয়া হচ্ছে দেখে দাদা ও দিদির খুব রাগ হলো।
ওনারা বললেন - এই সুযোগে বলি প্রথা বন্ধ করতে পারলে ভালো হয়। দেখা যাক এই নিরীহ পশু দের যদি বাঁচানো যায়। তার জন্য একটু মিথ্যার আশ্রয় নিতে হলে নিতে হবে। যাই হোক গ্রাম ঘুরে বেশ ভালো লাগলো ওনাদের। রাত্রিবেলা সোরগোল। জগন্নাথ ঠাকুরের প্রসাদ খেয়ে অনেকেই অসুস্থ। তারা সবাই কাটোয়া হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। দাদা মন্দিরের ভিতর ঢুকে বললেন - এত পশুর বলি দান দেওয়া হচ্ছে এই বিপদ ঐ কারণেই হয়েছে। গ্রামের সবাই যদি প্রতিজ্ঞা করে, বলি প্রথা বন্ধ করবে, তাহলে সবাই সুস্থ হবে। সবাই ঠাকুরের সামনে তাই বললো। আর কিছু করার নেই । বলি বন্ধ হলেই হবে। অনেক কিশোর কিশোরী ,বুড়ো বুড়ি এই সিদ্ধান্তে খুব খুশি। গ্রামের বেশির ভাগ লোক পশু বলি চায় না। কিন্তু অভিশাপের ভয়ে কেউ মুখ খোলে না।
হাসপাতাল থেকে সবাই সুস্থ হয়ে ফিরে এলে দিদি বললেন, এই পোকাটি জগন্নাথ ঠাকুরের মত দেখতে। কিন্তু এটি একটি বিষাক্ত পোকা। গভীর জঙ্গলে ওরা থাকে। রাতে প্রাসাদের আঢাকা থালার মধ্যে যাওয়া আসা করার ফলে বিষাক্ত ফ্লুয়িড খাবারে লেগে যায়। সেই প্রসাদ সকালে খাওয়া হয়, আবার তারপরে বলি প্রথার পাপের ফল। এই দুয়ে মিশে আমাদের গ্রামের অনেকেই অসুস্থ।বিজ্ঞানের যুক্তি দিয়ে সব কিছু বিশ্লেষণ করলেই সব পরিষ্কার হয়ে যায় জলের মতো। দাদা বললেন - মনে রাখতে হবে, আমরা মানুষ, পশু নই। তাই আমরা নিজেরা বাঁচার পাশাপাশি আর বাকি সবাইকে বাঁচতো দেবো। তবেই আমরা সুন্দর এক পৃথিবী সৃষ্টি করতে পারবো।
কেতুগ্রাম থানার ভুলকুড়ি গ্রামে সন্ধ্যা ছ'টার পর আর কেউ বাইরে বেরোয় না। একমাস যাবৎ এই অঞ্চলে ভূতের অত্যাচার খুব বেড়ে গেছে। গ্রামের শিক্ষিত ছেলে বাবু ছুটতে ছুটতে এসে আমাকে বললো, জানো দাদা জবাদের দোতলা ঘরে জবা শুয়েছিলো। ঠিক বারোটার সময় জানলা দিয়ে হাত গলিয়ে জবার মাথার চুল ছিঁড়ে নিয়েছে।
- কবে রে বাবু
- গতকাল রাতে
- এখন কেমন আছে
- এখনি ডাক্তার খানা নিয়ে যাবে বলছে
আমি কয়েকদিন ধরে এইরকম কথা শুনছি। ভাবছি কি করা যায়। আমার বাড়িতেও তো এইরকম আক্রমণ হতে পারে। আজকে রাতে রাস্তায় কেউ নেই। আমি দোতলার বারান্দায় রাত বারোটা অবধি জেগে থাকলাম। কিন্তু, কাকস্য পরিবেদনা। কেউ নেই। একটু ভয় ভয় লাগছে। তারপর রাত্রির অপরূপ রূপে মগ্ন হয়ে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালবেলা পেপার আর চা নিয়ে কোকিলের ডাক শুনছিলাম। হঠাৎ মন্ডল পাড়ার স্বদেশ এসে আমেজটা নষ্ট করে দিলো।
- দাদা, কালকে আমাদের পাড়ায় ভূতটা ঘুরছিলো। প্রায় দশ ফুট লম্বা, বড়ো হাত আর কালো রঙ।ভয়ে আমার বাবা অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলো।
- এখন ভালো আছেন ?
- না না, এখনও বু বু করছে।
আমি আবার চিন্তার মধ্যে ডুবে গেলাম। কি করা যায়, এই সমস্যা সহজে সমাধান করা খুব কঠিন।প্রকৃতির নিয়মে আবার রাত হলো। গ্রামের সহজ সরল মানুষ এই সব বিপদের দিন অসহায় হয়ে যায়। রাতে শুয়ে চিন্তা করলাম মুস্কিল আসান করার জন্য কিশোর মনোবিজ্ঞানের সুমন্ত ভট্টাচার্য মহাশয়কে খবর দিতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে মোবাইলে চড়খীর অমলকে ফোন করলাম। আমার মনে আছে অদৃশ্য নাথ সেই ভয়ংকর বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছিলো জয়ন্তদা ও হৈমন্তীদির জন্য।
অমল ফোন করে সুমন্ত ভট্টাচার্য মহাশয়ের আসার সমস্ত ব্যবস্থা করে দিলো। সঙ্গে আসছেন কিশোর মনোবিজ্ঞানের সহ সম্পাদনা সচিব রত্না দিদি। তিনি বিখ্যাত পরিবেশ বিজ্ঞানী। আমার একটু সাহস বাড়লো। ওদের সাথে আমার বন্ধু অমলকেও আসতে বললাম। সেই রাত কাটলো ভয়ে ভয়ে। সকালে উঠে শুনলাম ব্রাহ্মণ পাড়ার দীপক বাইরে বসে গান করছিলো আর ভূতে তাকে পিটিয়ে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছো। শুনে আমার খুব রাগ হলো। ভাবলাম, দাঁড়া আজকের রাতে তোদের ব্যবস্থা হচ্ছে। দাদা ও দিদি ঠিক বারোটার মধ্যে অমলকে সঙ্গে নিয়ে আমার বাড়িতে চলে এলেন। তাদের দেখে আমার বুকের ছাতি চল্লিশ ইঞ্চি হয়ে গেলো মনে হচ্ছে।
ঠিক চারটের সময় মঙ্গল চন্ডীর উঠোনে গ্রামবাসীরা হাজির হয়ে গেলো। জয়ন্তদা বলতে শুরু করলেন, আজ আমরা সবাই রাতে জেগে থাকব। কে বা কারা এই কুকর্ম করছে আমাদের জানা দরকার। একজন বলে উঠলেন, ভূতের সঙ্গে লড়াই করে কি পারা যাবে। দিদি বললেন, ভূত বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই। তারপর তিনি আরও কিছু কথা বললেন গ্রামবাসীদের সাহসী করার জন্য। আবার একজন বললেন, তাহলে আগুন জ্বলে উঠছে কেমন করে। দাদা বললেন, এসব কিছু বিজ্ঞান বিষয়ের ব্যাপার। আগে ধরা হোক অপরাধীকে তারপর সব বোঝা যাবে।
এখন রাত দশটা বাজে। গ্রামের সবাই জেগে আছে। ঠিক রাত বারোটার সময় একটা দশ ফুটের লোক হেঁটে আসছে গ্রামের দিকে। দাদা থানায় ফোন করে দুজন বন্দুকধারী পুলিশ আনিয়েছেন।সাধারণ লোকের বুদ্ধির সঙ্গে এখানেই দাদার পার্থক্য। কখন যে সমস্ত ব্যবস্থা করে রেখেছেন কেউ জানি না। ভূত কাছাকাছি আসা মাত্র পুলিশ দু রাউন্ড গুলি চালালো ফাঁকা আকাশে। গুলির আওয়াজ শোনা মাত্র ভূতটি ভয়ে মাটিতে পড়ে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের সাহসী ছেলেরা বিকট চিৎকার করে ধরে ফেললো ভূত বাবাজিকে। বেচারা তখন জোড়া হাতে ক্ষমা চাইছে।
তাকে বিচারের জন্য ফাঁকা জায়গায় আনা হলো। সবাই বসে পড়লেন। এবার দাদা বলতে শুরু করলেন, দেখুন সবাই এই চোরটি রণ পা ব্যবহার করেছে লম্বা হওয়ার জন্য। রণ পা টি বাঁশের তৈরী নয়। একজন বললো, তাহলে ও ছোটো বড় কি করে হতো। দিদি বললেন, রণ পা টি বিশেষ ধরণের। এর মাঝে একটি শক্ত স্প্রিং আছে। যার ফলে এ যখন লাফ দি তো তখন এটি ছোটো বড়ো হতো।
আর একজন বললো, তাহলে মুখ দিয়ে আগুন বেরোতো কি করে। দিদি বললেন, এটা তো সহজ ব্যাপার। সার্কাসে আপনারা দেখে থাকবেন মুখের মধ্যে পেট্রোলিয়াম বা কেরোসিন জাতীয় দাহ্য পদার্থ ব্যবহার করে এরা মানুষকে অবাক করে দেন। এই চোরটিও তাই করেছে। দাদা এবার চোরটিকে ধমক দিয়ে বললেন, তুমি জঘন্য অপরাধ কেন করছো জবাব দাও।
এবার চোরটি উঠে জোড় হাতে বললো, আমরা মাদক দ্রব্য চোরাপথে চালান করি। তাই ভূতের ভয় দেখিয়ে আমরা মানুষকে বাড়িতে ঢুকিয়ে রাখি। এর ফলে আমাদের চোরা চালানে সুবিধা হয়।তারপর থেকে আর ভূূতের উপদ্রব হয় নি।
চার
কানি নদীর পাড়ে মালিহা গ্রাম। হারুদাদু বলতেন - এই গ্রামে পাঁচশো বছর আগে এক রাজা এসে বড় অট্টালিকা করেছিলেন এক সুন্দরীকে ভালোবেসে। সেইসব আর নাই। কালের প্রবাহে ভেসে গেছে। গ্রামে দুইশত পরিবারের বাস। বেশিরভাগই মাটির বাড়ি। সন্তুদেরও মাটির বাড়ি। চারচালা টিনের চাল।
সন্তু ছোটো থেকেই মায়ের নেওটা। মা ছাড়া সে কিছু বোঝে না, চেনে না। ফলে মায়ের স্নেহছায়া একটু বেশি পেতো সে। মা জানতেন এই ছেলে আমার, অবর্তমানে অন্য ছেলেমেয়েদের দেখবে। সন্তুর বাবা ছিলেন সরকারী কর্মচারী। তিন ছেলে আর দুই মেয়েকে পড়াশোনা শেখাতে সমস্ত ব্যবস্থা করেছেন। খাওয়া পরার কোনো অসুবিধা নেই। বেশ চলছিলো বটগাছের ছায়ায় সাতটি জীবন। কিন্তু মহাকালের বিচার মানতেই হবে। হঠাৎ মারা গেলেন সন্তুর বাবা।
তখন সন্তুর বয়স একুশ। মেট্রিক পাশ করে আই,টি,আই এ ভর্তি হয়েছিলো। কিন্তু অর্ধপথে পড়া থেমে গেলো। সংসারের সমস্ত দায়ীত্ব কাঁধে তুলে নিলো সন্তু। বাবার চাকরীটা সরকার বাহাদুর দিলেন সন্তুকে। এবার ভাই, বোনদের পড়াশোনা, মাকে যত্ন করা সব অই সন্তুর সামান্য মাইনের টাকায়। নতুন চাকরী তাই মাইনে কম। ট্রান্সফারেবল্ জব। আজ হাওড়া তো কাল শিলিগুড়ি। শিলিগুড়ি থাকাকালীন ছুটির দিনে ঘুরতো সন্তু একা। একবার দার্জিলিং গিয়েছিলো। পাহাড় তাকে ডাকতো। ভালোবাসা ধরে রাখতো সবুজ প্রকৃতির মাঝে।
সে সমতলের ছেলে। আর পাহাড়ি ছবি তার মনে শান্তি আনতো। মন খারাপ হলেই পাহাড়ের ডাকে বেরিয়ে পরতো বারে বারে।
একরাতে বাসা বাড়িতে খাবার নেই। মাইনের টাকা গ্রামে মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে। সামান্য কটা টাকা আছে। সন্তু জানে মাস চালাতে হবে। রাত বেশি হওয়ায় দোকানগুলো বন্ধ। একগ্লাস জল ঢকঢক করে পান করলো। অমৃতের স্বাদ। কিন্তু পোড়া পেট মানে না বারণ। চুঁই চুঁই করছে। তবু লেপ মুরি দিয়ে শুয়ে পড়লো। গুরুর জপ শেষ করে ঘুমোয় সন্তু। জপ করার সময় শুনতে পেলো ঠক ঠক আওয়াজ। তাড়াতাড়ি জপ শেষ করে বললো, কে?
- আমি, দরজাটা খুলুন।
- জগতে সবাই তো আমি। নাম বলুন।
- আমি পাপিয়া, আপনার বাড়িওলার একমাত্র মেয়ে।
- এত রাতে কেন? কি প্রয়োজন বল?
- আরে খুলুন না ছাই।
দরজা খুলে দেখলো বাড়িওয়ালার সুন্দরী অষ্টাদশী মেয়েটা। হাতে একটা বাটি। বললো, আজকে আমাদের সত্যনারায়ণ পুজো ছিলো, মা তাই প্রসাদ পাঠালেন। খেয়ে জল খাবেন। প্রসাদ খেয়ে জল খেতে হয়। জল খাবেন। এখন কি ঢাকা দিয়ে রেখে দেব।
সন্তু বলল, তাই দাও। আমি পরে খেয়ে নেব।
পাপিয়া বলল, আমি বসব। আপনার সঙ্গে গল্প করব।
- কিন্তু মেসোমশাই রাগ করবেন। রাতে গল্প।
- বকবে না। বাবাকে বলে, তারপর এসেছি। বলেছি সন্তুদা প্রসাদ খাবে। তারপর বাটি নিয়ে আসতে দেরী হবে।
- কত আর দেরী হবে খেতে।
- কিচ্ছু বলবে না, বলছি না। বাবা আমাকে বকে না। একমাত্র আদরের মেয়ে আমি।
পাপিয়া বলল, এবার তোমার গ্রামের গল্প বলো। আমি কিন্তু তোমাকে, তুমি তুমি বলব সন্তুদা। তুমি বেশী কথা বল না কেন? কথা বলবে এখন। আমি শুনব।
সন্তু বলেছিল, নিশ্চয় বলবো। কথা বলব না কেন? আমি তো একাই থাকি। বল, কি বলবে।
সন্তুর মনেও একটা কোণে পাপিয়া ডাকত। কিন্তু বড় সংসারের দায়ীত্ব তার কাঁধে। মায়া কাটাতে হবে। বাউলের মন হয়ে যায় সন্তুর। সে ভাবে, এসব প্রেমের বিলাসিতা কি আমার সাজে? সন্তু ভাবে, বারবার ভাবে পাপিয়ার কথা। কিন্তু ভালবাসা সহজে কেউ পায় না আর কেউ কেউ বাউল সাধক। মানুষের মাঝেই তাঁর বাসা। উদাস ভালবাসা। হঠাৎ পাপিয়ার ডাকে সন্তু চেতনা ফিরে পেলো। পাপিয়া বলল, তুমি সবসময় বাউল মনে ঘুরে বেড়াও কেন। কোকিলের মত তোমার কি বাসাবোনার ইচ্ছে নেই। সন্তু উত্তর দেয় না। পাপিয়া আবার বায়না করে, একটা গল্প বলো না সন্তুদা। তোমার গ্রামের গল্প। তোমার মায়ের কথা, বাড়ির কথা, আনন্দের কথা। সব শুনব আমি।
সন্তু বলল, শোনো তাহলে। বলি তোমাকে শীতকালে মেলা যাওয়ার কথা। আমার আবেগের কথা।গোরুর গাড়ি চেপে উদ্ধারণপুরের মেলা যাচ্ছি। পিছনে বাঁধা রান্না করার সরঞ্জাম। মেলা গিয়ে রান্না হবে। বনভোজন। সঙ্গে মুড়ি আছে। বড়দা বললেন, গিয়ে প্রথমে মেলা ঘোরা হবে। তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা। মা বললেন, তোরা ঘুরবি আমি আর মানা রান্নাবান্না করবো। তারপর দুপুরে মেলা ঘুরবো। গাড়ি চলেছে ক্যাঁচর ক্যাঁচর শব্দে। গোপাল কাকা বললেন - আরে, দেখ দেখ জিম চলে এসেছে। বড়দার ভয়ে ব্যাটা গাড়ির তলায় হাঁটছে।
জিম নেড়ি কুকুর হলেও, আমরা ওকে জিম বলেই ডাকি। কুকুর ভাবি না। অনেক মানুষের থেকেও ওর ভব্যতা অনেক বেশি।
পঞ্চাননতলার মেলা যেতে একটা আল রাস্তা ছিলো। আমরা ছোটোবেলায় বারবার ওই রাস্তা ধরে আসা যাওয়া করতাম। দুপাশে কাদা ভর্তি ধানের জমি। কি করে কাউকে ওই কাদায় ফেলা যায়, এই কুবুদ্ধি আমাদের মাথায় খেলা করতো। আর তাই হতো। ধপাধপ কাদায় পরে যেতো অনেকেই। আর আমরা কি মজা, কি মজা করে চিৎকার করতাম। মার খেয়েছি খুব। বদ বুদ্ধির জন্য।
গোরুর গাড়ি একবার থামলো। তামালদা আর আমি জমি দিয়ে হেঁটে গেলাম। দেখলাম আখের জমি। বললাম, একটা আখ খাবো। তামালদা বললো - না পরের জমি।
- একটা তো, কিছু হবে না।
- যাও, তাড়াতাড়ি আসবা।
তারপর একগাছা সরালো আখ ভেঙ্গে খেতে খেতে চলে এলাম। গোরুর গাড়ি আবার চলতে শুরু করলো। দিগি দিগি, পা পা, করে গোরুর সঙ্গে কথা বলে চলেছে প্রিয় তামালদা। মন্থর গতিতে পৌঁছে গেলাম সকালের টাটকা মেলায়। ভোরবেলায় বেরিয়েছি বাড়ি থেকে। প্রায় কুড়ি কিমি রাস্তা চার ঘন্টা লাগলো। তবু ক্লান্তি নেই। মা বললেন - প্রথমে জল এনে এই ড্রাম ভরে ফেল।
জল ভরার পরে আমরা মেলা ঘুরতে চলে গেলাম। কাঁচের চুড়ির দোকান পার করে নাগরদোল্লা। চাপলাম। ভয় নেই। মনে মজা। তারপর ঘুরে ঘুরে দেখার পালা। একই জিনিস ঘুরে এসে দেখে নতুন লাগছে। চির নতুন। কেউ বিরক্ত নয়। সবাই অনুরক্ত মানুষের ভিড়ে। এই প্রবাহ পুরোনো হবে না কোনোকালে। বড়দা বললেন, অনেক হয়েছে। এবার খাবে চলো। মায়ের কাছে গিয়ে দেখলাম, মুড়ি, তেলেভাজা, আর রসগোল্লা রেডি। ঘুরে ঘুরে খিদে পেয়েছে। খেয়ে নিলাম। জল খেয়ে ধড়ে প্রাণ এলো। এলো আনন্দ। মানা পিসি বললেন, চল আমি আর তুই একবার মেলা ঘুরে আসি। পিসি প্রথমেই চিতার কাছে গিয়ে বললেন, সব থেকে সত্য, এই চিতা। পিসি খুব তাড়াতাড়ি এই সত্যের সন্ধান কিছুদিন পরেই পেয়ে গিয়েছিলেন।
তামালদা মাকে বললো - দিদিমুণি, ত্যাল দিন তো। আর ওই খোলের বাটিটা। গরুগোলাকে খেতে দি ভালো করে। ত্যাল মাকিয়ে দোবো। ওরাও তো মেলায় এয়েচে। অবিচার করলে হবে না। মা বললেন, যাও, দাও গা। ভালো করে খেতে দাও। মা রান্না সারার পরে একবার মেলায় গেলেন। আমার ঘুরে ঘুরে পায়ের ডিমিতে লাগছে তবু মেলা না দেখে মন মানছে না। ক্লান্তি ভুলে অবাক চোখ চালানো সারা মেলা জুড়ে। কোনো কিছু দেখা বাকি থাকলো না তো? তাহলে বন্ধুদের কাছে হেরে যাবো। বন্ধুরা বলবে, কেমন মেলা দেখলি। আমরা সব দেখেছি।
ঘুরে ঘুরে লেখক অবধূতের আবক্ষ মূর্তি দেখলাম। শ্মশান দেখলাম। গঙ্গার ঘাট দেখলাম। আর দেখলাম মানুষের আবেগের রঙীন খেলা। কেউ নাগরদোল্লায়। কেউ খাবার দোকানে। আর অনেকে শুধু ভবঘুরের মতো চরকী পাক খাচ্ছে ভিড়ের মাঝে। মেলায় মিলন মানুষে মানুষে। জাতিতে জাতিতে, বললেন গোপাল কাকা। এই উদ্ধারণপুরের মেলায় গঙ্গা এক প্রধান আকর্ষণ। তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে জন্ম মৃত্যুর অনেক ছবি। আমার ঈশ্বর, আমার অনুভব, ভালোবাসা একান্তই নিজস্ব অনুভূতি। আমার জ্যান্ত ঈশ্বরের পরম করুণাময়ের সঙ্গে মিলিত হবার শেষ আয়োজনের শুরু হয়েছে। মনে পড়ছে, আমার সামনে থেকেও রকেটের দাগের মতো মিলিয়ে গেলো বন্ধু। গঙ্গার জলে ডুব দিয়ে আর উঠলো না নীলমণি। রোজ আকাশে ধ্রুবতারা হয়ে জ্বল জ্বল করে আমার অশ্রু আয়নায়। হাওয়ায় ওড়া আমার বেহিসাবী মন আজও দেখতে পায় অনন্ত আকাশে তার বিচরণ।
দুপুর ঠিক দুটোর সময় মা খাওয়ার জন্য ডাকলেন। মা বললেন, থালাগুলো জল বুলিয়ে নিয়ে এসো সবাই। তারপর গোল হয়ে সবাই বসে পড়লাম খেতে। মাটিতে বসে খেতে শুরু করলাম। আমি কলাপাতায় খেতে ভালোবাসি। এতো খাওয়া নয়, স্বপ্ন জগতে বিচরণ। এই ভালোলাগা বারবার আসে না। অকৃত্রিম আনন্দের জগৎ এই মেলা।
সবার খাওয়া হয়ে গেলে মা ও মানা পিসি বসলেন খেতে। সবাইকে প্রথমে খাইয়ে তারপর নিজের খাওয়া। তাই ভারতমাতার সন্তানরা দেশের দশের জন্য সব ত্যাগ করতেও কুন্ঠিত হয় না। মায়ের কাছে এই শিক্ষা তারা পায় ছোটো থেকেই। তারপর বাড়ি ফেরার পালা। অনেক মৃতদেহ আসছে শ্মশানে। বলো হরি, হরিবোল ধ্বনিতে আকাশ বাতাস মুখরিত। তারা ফিরছে আপন ঘরে। আমরা ফিরছি গ্রীনরুমে।
সন্ধ্যা হয়ে আসছে। মা চিন্তা করছেন। তামালদাকে বললেন - তাড়াতাড়ি ডাকাও। গোরু দুটোকে তামালদা বলছে, হুট্ হুট্, চ,চ দিগি দিগি। গোরু দুটো ছুটতে শুরু করলো। খুব তাড়াতাড়ি চললাম। টর্চের আলোয় রাস্তা দেখছি সবাই। হঠাৎ রে রে করে দশজন ডাকাত পথ আগলে দাঁড়ালো। দে যা আছে বার কর। হাতে তাদের বড় বড় লাঠি। মা বললেন - বললাম তাড়াতাড়ি করে বাড়ি চলে যায় চ, তোরা শুনলি না আমার কথা।
হঠাৎ তামালদা আর বড়দা নেমে লাঠি কেড়ে নিয়ে বনবন করে ঘোরাতে লাগলো। আমরা গাড়িতে বসেই দেখতে লাগলাম লাঠির ঘায়ে ডাকাতগুলোর মাথা ফেটে রক্ত পড়ছে। সবগুলো শুয়ে পড়ে হাত জোড়া করে ক্ষমা চাইছে। মা বললেন - ছেড়ে দে। উচিত শিক্ষা পেয়েছে বাঁদরগুলো। খেটে খাগা যা, পালা।
তারপর তামালদা ও বড়দা লাঠি দুটো নিয়ে সামনে বসলো। বড়দা বলছে, আয় কে আসবি আয়। সেই কেড়ে নেওয়া লাঠি আজও আছে। মা বলতেন, অন্যায় করবি না, আর অন্যায়ের সাথে আপোষও করবি না। এই বলে মা দাদুর গল্প শোনাতে শুরু করলেন। আজও মনে আছে আমার সেইসব কথা। কোনোদিন ভুলতে পারব না।
পাপিয়া বলে - খুব সুন্দর গল্প। সন্তুদা আমাকে কোনোদিন ভুলবে না তো?
সন্তু বলে, তোমার দেওয়া প্রসাদ খেয়ে নি। ঢাকা পড়ে আছে অনেকক্ষণ। সেই প্রসাদ খেয়ে সন্তু ঘুমিয়েছিলো। প্রসাদ এত মিষ্টি হতে পারে সন্তুর জানা ছিল না। হয়ত পাপিয়া ভালবাসা মিশে ছিল। সন্তু ভাবে একথা কিন্তু পাপিয়াকে ঘুরিয়ে বলল, তোমার বাটিটা ধুয়ে দি।
- আমাকে দিন। আমি ধুয়ে নেব। এইকথা বলে সে চলে গেল।
সন্তু ভাবে, কোন কারিগর বানিয়েছেন মেয়েদের মন। তার মন দিলে আর ফেরাতে পারে না, ভুলতে পারে না প্রিয়জন।
বাড়িওয়ালার মেয়ে পাপিয়া দেখতো, সন্তু সকালে বেরিয়ে যায় আর রাতে ঢোকে। তার মানে হোটেলে খায়। কোনোদিন বেশি কথা বলে না। শুধু বলে, ভালো আছেন। আর ভাড়া দিতে এলে বলে, বাবা আছে। পাপিয়া মা আর বাবাকে বললো, আমি সন্তুদার কাছে ইংরাজীটা দেখিয়ে নেবো। বাবা খুব কিপটে। বিনা পয়সায় পড়ানোতে আপত্তি নেই। মা বললেন, ছেলেটা ভালো। যাবি প্রয়োজন হলে।
রাতে সন্তু এলে পাপিয়া বই নিয়ে ওর ঘরে গেলো। লুঙ্গি পরে তক্তায় সন্তু বসেছিলো। সন্তু বললো, কিছু বলবে।
- হূঁ,একটু ইংরাজীটা দেখিয়ে দেবেন?
- কই দেখি, আমি পড়তে ভালোবাসি।
- আর পড়াতে।
- দুজনে আলোচনা করবো। ইংলিশ আমার বেস্ট সাবজেক্ট ছিলো।
- তাই,তাহলে ভালোই হলো।
সন্তু দেখছে পাপিয়ার পড়াশোনায় মন নাই। শুধু কথা বলছে। বলছে, আপনি এত অগোছালো কেন? তারপর সন্তু দেখলো পাপিয়া সব কিছু গোছাতে শুরু করেছে। সন্তু বললো,তুমি বড়লোকের একমাত্র কন্যা আমার কাজ করবে কেন?
- আমি এসব দেখতে পারি না। আপনি চুপ করে বসুন। আর আমি একবার করে আপনার কাছে গল্প করতে আসবো। তাড়িয়ে দেবেন না তো?
- না, না আমিও তো একাই থাকি। কথা বলার সঙ্গী পাবো।
- বাবাকে বলবেন, আমি খুব পড়ি।
- মিথ্যা বলতে নেই। যা বলার তুমি বলবে। আমি কিছু বলবো না।
- ঠিক আছে, আপনি ক্যাবলার মতো এসব বলবেন না। বিছানায় বসেছি বা কাজ করেছি।
- আমি এসব ভালোবাসি না।
সন্তু ভাবে মেয়েটা কি চায়? আমার মাথার ওপর বড়ো সংসারের দায়িত্ব। আমাকে সাবধানে চলতে হবে। একবার ভালোবাসাকে প্রশ্রয় দিলে বেড়ে যাবে কুমড়ো লতার মত। আমাকে শিঁকড়ে ঘা দিতেই হবে। আমার যে হাতে পা বাঁধা, আমার মন পাপিয়া। সংসারের কাছে বেইমান আমি হতে পারবে না আমার মন।
পাঁচ
পুজোর ছুটিতে সন্তু বাড়ি এসেছে। মায়ের জন্য সাদা তাঁতের শাড়ি। দুই ভায়ের জন্য জামা,প্যান্ট একই কালারের। বোনেদের চুড়িদার এনেছে। বাড়িতে দুর্গাপুজোর পালা। আগের দিন রাত থেকে সব্জি বনানো, কুটনো কাটা শুরু হলো। অনেক লোকজন বাড়িতে তাদের খাওয়ার ব্যবস্থা। বড়ো বড়ো গামলায় রেখে সব্জি সব উঠোনে নামানো হলো। কাল সকালবেলা রান্না হবে। সন্তুকে ওর মা বলে, এবার বিয়ে করে নিবি। আমি দোনাগ্রামে মেয়ে দেখে রেখেছি। কথাও বলেছি। মায়ের কথা ফেলতে পারে না সন্তু। সে সম্মতি দিলো। তা না হলে মা দুঃখ পাবেন।
পুজোর ছুটি ফুরিয়ে গেলে সন্তু ফিরে এলো শিলিগুড়ি। এসেই দেখলো, পাপিয়া হাতে একটা চিঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সন্তু বললো, কি এটা।
- পুজোতে তোমার জন্য লিখেছি।
- থাক, তোমার কাছে থাক। আমার আবার ট্রান্সফারের অর্ডার এসেছে। কাল মোবাইলে মেসেজ পেয়েছি। আজকে নোটিশ পাবো অফিসে।
- কিন্তু আমি যে অনেক কিছু দিয়েছি তোমাকে। আমার মন, প্রাণ সবকিছু।
সন্তু দরজা খোলামাত্র পাপিয়া জড়িয়ে ধরলো তাকে। চোখের জলে তার জামা ভিজিয়ে দিলো। আর সন্তু তো কাঁদতে পারছে না। পাপিয়ার জন্য তার মন পাপিয়া কতবার যে ডাক দিয়ে গেছে তার ইয়ত্তা নাই। সন্তুর বাসা বাড়ির টালির চাল। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলো, চাঁদ আজ ঢেকে গেছে অন্ধকারে।
ছয়
সমবেত সুধীজনের হাততালিতে ভরে উঠল সভাপ্রাঙ্গণ। এবার একটি সংগীত গাইছে একজন কিশোর। ইতিমধ্যে রােমাঞ্চিত হল। এতবড় একজন পণ্ডিত মানুষ আমার পাশে। বলল - অংশুমান দেখি আমার পাশে ত্রিপলে মাটির মানুষ ডঃ স্বপন ঠাকুর। আমার দেই আদিত্যকে। আদিত্য বলল - “অবাক হচ্ছেন কেন? পৃথিবীতে যারা বড় তার এইরকমই হন। এটাই স্বাভাবিক। আমি মঞ্চে উপবিষ্ট মানেই আমি সব। এসব নিচু মানসিকতার লক্ষণ। আদিত্য আবার আলাদা। এই ধারণা শুনিলে প্রাণপাগল করা সেই গান- যারা সুজন নাইয়া, উজান বাইয়া বােকাই করে মাল স্বদেশে ফিরে গেছেন তারা, থাকিতে সকাল, থাকিতে সকাল রে, থাকিতে সকাল। এমনি কত গান পাগল আদিত্য, অংশুমানের পাড়ার ভাই। বার্তাসূচী সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক শ্ৰী দেবাশীষ রায়ের সঙ্গে আশুমানের এখানেই পরিচয়। আদিত্য অংশুমানকে বলল - “বার্তাসূচীর সম্পাদক মহাশয়কে লেখা দেবেন। আপনার লেখা ছাপা হবে।" সম্পাদককে বলে দেখে অংশুমান। শ্রী দেবাশীষ রায় সমস্ত লেখককেই সম্মান দেন। তার পত্রিকা এখন বাজারে বেশ নাম করেছে। পত্রিকাটিতে সম্পাদকের ভাবনার ছাপ স্পষ্ট। আত্যি এখন সরস্বতী পূজার প্রস্তুতি নিয়ে খুব ব্যস্ত। প্রখ্যাত জি, খ্যাত কবি অসীম সরকারকে নিয়ে আসছে আদিত্য। প্রায় দশহাজার লোক জমায়েত হয় এই কবির গান শােনার জন্য। যুবকদের সঙ্গে থেকে আদিত্য এইসব অনুষ্ঠান পরিচালনা করে থাকে। আদিত্য অংশুমান বলল - এবার সরস্বতী পুজোর সময় কবি অসীম সরকারকে দেখতে আসবেন, দেখবেন ভালো লাগবে। এবার অনেকদিন পর কাটোয়ায় অংশুমানের বাড়িতে এল। সঙ্গে পরেশ তার মাসীর ছেলে। অংশুমান ও পরেশ ছােটো থেকেই বন্ধুর মতাে। ওরা একসঙ্গেই থাকত কোনাে বিয়ে বা অনুষ্ঠান বাড়িতে। অংশুমানের পিসির ছেলে কালীচরণ ও বড়পিসির ছেলে অপু। ওরা সবাই সমবয়সী। যখন কোনাে বিয়েবাড়িতে ওরা একসাথে থাকে তখন বিয়েবাড়িও যেন আলাদা একটা মাত্রা পেয়ে যায়।। বাবু পরেশকে সঙ্গে এনেছে কারণ পরেশের ছােট দিদির ছেলের জন্য এক পাত্রী প্রয়ােজন। বিয়ে দিতে হবে। ছােট দিদির ছেলে রমেশ। কিন্তু পছন্দ মতো মেয়ে পাওয়া যাচ্ছে না— বলল পরেশ। পরেশকে বলল - “চলাে অংশুমানের বাড়ি ঘুরে একবার ছােট মামীর বাড়ি গিয়ে বলে দেখি।" পরেশ বলল - “হ্যা, যা করেই হােক এক বছরের মধ্যে বিয়ে দিয়ে দিতে হবে। পরেশ সাঁইথিয়া হোমিওপ্যাথি দোকানের মালিক। খুব সৎ, সত্যবান ও পরিশ্রমী। ফুটবল খেলতাে ভালো। এখন বিয়ে করে সংসারী হয়েছে। পরেশ বলে - কত, জানিস অংশুমান জীবনে লােভে আদর্শ ভ্রষ্ট হয় নি। আমি আমার আদর্শ নিয়ে সঠিক এ জীবনে পরেশ কারাের সাথে খারাপ ব্যবহার কোনোদিন করেনি। সবাই তাকে সৎ, সাহসী ছেলে বলেই জানে। ওদের এ ডাকাতের উপদ্রব। রাত্রি হলেই সবাই ভয়ে ভয়ে কাটাতে। এই হয়-এরকম ভাব। পরেশ ও তার বন্ধুরা নিয়ম করে লাঠিসোঁটা নিয়ে রাত পাহারা দিয়ে চিৎকার করে সমস্যার শুরু করল। ওরা হাঁক দিত, ‘ও-ও-ও হ্যাৎ'-চিৎকার করে। কিছুদিনের মধ্যেই ডাকাতদের অত্যাচার কমে গেল। সবাই ঘুমতে পারল। অংশুমান মাসির বাড়ি গেলেই পরেশের সঙ্গে ময়ূরাক্ষী নদীর তীরে যেত। ওখানে বালির চরে ফুটবল খেলা হত। অংশুমান বলত, পরেশ তােদের এখানেই থেকে যাবাে। পরেশ বলত, “নিশ্চয়ই থাকবি।” সেসব ছােটবেলাকার কথা মনে পড়ে আর ভালাে লাগে—অংশুমান বলল দেবীকে। সব ছােটবেলার কথা অংশুমান তার ছেলে সৈকতকে বলে। সৈকতের এসব শুনে শুনে মুখস্থ হয়ে গেছে। সৈকত আজ মন দিয়ে বাংলা পড়ছিল। বাংলা বইয়ে ভালাে ভালাে লেখকের গল্প-কবিতা আছে। লালন ফকিরের একটা কবিতা আছে, ওটাই সৈকত পড়ছে, “বাড়ির কাছে আরশিনগর, ও এক পড়শি বসত করে।” অংশুমান সৈকতকে থামিয়ে বলল, এর অর্থটা জেনে নিস। শেষে অংশুমান নিজেই বলল, আরশি হল আত্মদর্শনের এক মাধ্যম অর্থাৎ যা নিজেকে দেখা যায়। তাই আরশি' হল মানুষের মন। আর 'পড়শি বলতে এ বােঝানাে হয়েছে প্রত্যেক মানুষের মধ্যে বাস করা আর এক মানুষ বা ঈশ্বর বা মনের মানুষ। যাকে অন্য গানে লালন অধর মানুষ, সহজ মানুষ। অলখ সাঁই ইত্যাদি বলেছেন। সৈকতের খুব ভালাে লাগে বাবার কথা।
অংশুমানের ক্লাসমেট সুলেখক ডা রবীন্দ্ররনাথ মণ্ডল খুব ভালোবাসে তাকে। তার কাছে অনেক প্রয়োজনে অংশুমান উপকার পেয়েছে। কিছু লোক যদি এইরকম হৃদয়বান হতেন, তাহলে মানুষের উপকার হত। সুলেখিকা সুজাতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে অংশুমান লেখা পড়ে অনেক অনা তথ্য জানতে পেরেছে। বিবেকানন্দবাবু ও আরও লােকজনের সঙ্গে দেখা হয়। টিফিনে বাড়িতেই থাকে। মানুষ কেন খাওয়া-খাওয়া করে। আর মাসে যতটুকু পারে সাহায্য করে। বড়দার হাতে দেয়, মায়ের ওষুধ দেয়। আজ কবি বলছেন সভায় "গুরুজনদের প্রণাম। সবাইকে যথাযােগ্য সম্মান জানিয়ে আমি দু-চারটে কথা বলব। ধর্ম কথার অর্থ। ধারণ করে থাকে। সমাজের শান্তি, সুস্থ মন ও কর্ম হচ্ছে ধর্মের ফল। কথাটি সন্ধিবিচ্ছেদ করলে অন্যের কথা আসে। কিন্তু সেই নিয়ম। সুস্থ নিয়ম পালন পুর্বক আমরা যদি প্রত্যেক কর্ম করি, তাহলে ধরে সেটা হল সনাতন ধন অনুশাসন সার্থক হয়। সনাতন ধর্ম। ধর্ম একটাই। সেটা হল সনাতন আর বাকিগুলাে হল সম্প্রদায় বা গােষ্ঠী। এক-একটি গােষ্ঠি করে চলতে ভালােবাসে। আমরা একদম প্রাচীন যুগে যদি চলে যখন মানুষের সৃষ্টি হয় নাই, তাহলে দেখা যাবে, এককোষী প্রাণী থেকে ধীরে ধীরে বিবর্তনের মাধ্যমে মানুষ এসেছে। আর একজন মানুষ পিতা থেকে আমাদের সৃষ্টি। একজন পিতা আর একজন মাতা থেকেই ধীরে ধীরে এই বিশ্বের মানুষরা এসেছেন। অনেকে বলেন এই পিতামাতার নাম আদম ও ঈভ। তাহলে প্রশ্ন আমরা মানুষ হয়ে তাহলে আলাদা ধর্মের হতে পারি কি করে? আমরা লড়াই করি কেন? এসব প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য আমাদের। শিক্ষার মাধ্যমে নিজেদের উন্নত করতে হবে। অংশুমান বলছে, আমি অনেক কথা বলেছি। আর কিছু বলব না। আপনারা সকলেই বুদ্ধিমান। সবাই আমার প্রণাম নেবেন- এই বলে অংশুমান সভা থেকে নিচে নামল। চা-বিস্কুট খেলাে তারপর সভা শেষ হলে বাড়ি ফিরল। তখন প্রায় দশটা বাজে। পরের দিন স্কুল আছে। তাড়াতাড়ি খেয়ে শােয় অংশুমান। মা ও ছেলে তখনও টিভি দেখছে। দু-দিন পরে ডঃ স্বপনকুমার ঠাকুর, আদিত্য ও অংশুমান একটি গ্রামে যাবে ঠিক করল। ডঃ ঠাকুর প্রত্নগবেষক। তিনি বললেন - “ভারতবর্ষ নদীমাতৃ দেশ। বড় বড় নদীর ধারে বড় বড় বসতি তৈরি হয়েছে। আমরা যেখানে যাব সেই গ্রামটিতে গঙ্গা নদীর নিকটবর্তী গ্রাম। আদিত্য বলল - “শুনেছি ওই গ্রামে একটা পুরােনাে বাড়ি আছে। ওখানে অনেক ঐতিহাসিক নিদর্শন আছে। আমরা তার ছবি তুলে নিয়ে বললাম - "তাই হবে। এই পুরােনাে বাড়িতে রাজরাজেশ্বরীর মূর্তি আছে। আবার ওখানে একটি পরিবার বাস করেন। তারা বলেন - এইটি পাঁচশাে বছর আগেকার বাড়ি।”
শঙ্কর বললেন - “তথ্য থাকলে তবেই এসব কথা বিশ্বাস করা যাবে। ঠাকুর বললেন, কথা দিয়ে উপন্যাসের মতাে এইসব কথা বলা যায় না। তার জন্য উপযুক্ত তথ্যপ্রমাণাদি প্রয়োজন।”
ওরা সবাই গিয়ে একবার গ্রামে ঘুরে আসার মনস্থির করল। অংশুমান আবার আদিত্যর কাছে গেল। আদিত্য খুব ভালাে গান করে। “নির্মল বাংলা' নিয়ে একটি গান লিখেছে খুব সুন্দর। অংশুমান গান গাইতে জানে। তবু একবার গানটি গাইবার চেষ্টা করল। অংশুমানকে উৎসাহ দেয় সবাই খুব। গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাস লিখতে বলে। অংশুমান উৎসাহ পেয়ে বাড়ি এসে অনেক পড়াশােনাও করে। বর্তমানে দেশে যে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে তার বর্ণনা করতে গেলে খুন, ধর্ষণ লেগেই আছে। সংবাদপত্র খুললেই শুধু রক্তারক্তির খবর। মানুষে মানুষে হানাহানির খবর। অংশুমানের ভালাে লাগে না। দেশে শান্তি আসবে। সবাই সুস্থভাবে খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকবে। বাঁচো এবং অন্যকে বাঁচতে দাও'—এই আদর্শ নিয়ে সবাই চলবে। তবে হবে সুস্থ। দেশের সুস্থ নাগরিক। অংশুমান জানে সেই দিন নিশ্চয়ই আসবে। এখনও শাসকদলে অনেক ভালাে লোক আছেন। তারাই একদিন ছাত্র-যুব সবাইকে এক ছাতার তলায় এনে একতার গান গাইবেন। আজ অংশুমান পুরুলেতে এসেছে। বড়দা দিলীপ বলল - “সৈকত আর বৌমাকে একদিন পাঠিয়ে দিস। অনেকদিন আসেনি ওরা।" অংশুমান বলল - "ঠিক আছে।"
রিলিফ লিলুয়া থেকে স্ত্রী-পুত্র-কন্যাসহ পুরুলে এসেছে। অংশুমানের স্কুল। বড়দা মাঝে মাঝেই সৈকতকে যেতে বলে। এইসময় পাঠালে বরদার সঙ্গেই দেখা হয়ে যাবে। অংশুমান দেবীকে বলল - “যাও তুমি আর সৈকত একবার পুরুলে থেকে ঘুরে এসে।" সে বলল, "তাহলে তুমি চলে যেও না ঘর ফাঁকা রেখে। যা চোরের উৎপাত” অংশুমান বলল - “না না, আমি বাড়ি থেকে বেরােব না। দু-দিন সবাই যাও তােমরা ঘুরে এসো। তারপর সৈকত সকালবেলা বেরিয়ে পড়ল। অংশুমান নিশ্চিন্ত হল, আর নয় এখন বেড়াতে যেতে পারে না। যখন মায়াপুর গেছি তখন মনে আছে, নজনেই গেছিল। তখন একটা ঘরে ছিল তিনজন। এখন যা হােক দুটো-একটা জিনিস হয়েছে। চোর এসে নিয়ে তাহলে আর বােধহয় অংশুমান ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। পুুরুলেতে গিয়ে সৈকত আর ইন্দ্র দু-দিন খুব ঘুরে বেড়ালাে। সেই নতুনপুকুর, হাড়ি পাড়া, পুজো বাড়ি, হাইস্কুল আর দক্ষিণের খােলা মাঠ। সেখানে। গিয়ে কি করে যে সময় কেটে যায় পাখির গান শুনে, বাতাসের শিহরনে। তা ওরা বুকতেই পারল না। সৈকত আর ইন্দ্র যেন অংশুমান আর বিডি ছােটবেলার ছবি। তারা যেভাবে যীতলায় বেলগাছের ডালে উঠে খদের গায়ে লাফ মারত। সৈকত আর ইন্দ্র আরও অন্যান্য বন্ধুদের সঙ্গে একইরকমভাবে খেলে বেড়াচ্ছে। সেই ছোটবেলা, ছোলামুড়ি আর লুকোচুরি খেলার দিন ফিরে এসেছে। ঘেঁটুফুল, ঘাসফড়িং সবকিছুই নতুন করে চেনা এক ধারাবাহিক পদ্ধতি। এত শিশু আসে আর এক শিশু বড় হয়ে যায়। আবার তার জায়গায় আর এত শিশু এসে ফনি ধরে, লুকোচুরি খেলে, ডিগবাজি খায়, হাওয়াতে দোলে। এ-এক চিরন্তন প্রবাহ জেগে ছিল, জেগে আছে, জেগে থাকবে। এক অসীম নিরবছিন্ন খেলা। দু-দিন পরে আবার ওরা কাটোয়াতে ফিরে এল। কাটোয়াতে এসে প্রায় দু-দিন ধরে সৈকত বলছে - “বাবা, ঠাকুমার জন্যে মন খারাপ করছে, ইন্দ্র জন্যে, বাড়ির সবার জন্যে, ষষ্ঠীতলার জন্যে, নতুন পুকুরের জন্যে মন খারাপ করছে?" অংশুমান বললাে - “মন খারাপ কোরাে না। আবার সুযােগ পেলে ওখানে চলে যাবে। অংশুমান বাবার চাকরিসূত্রে বিভিন্ন জায়গায় কাটিয়েছে। অংশুমান ও তার বন্ধুরা অনেক জায়গায় ঘােরাঘুরি করেছে। পুরী, দার্জিলিং, দিঘার সব জায়গায় গেছে। এখন ঘরে বসে অবসর সময়ে এইসব কথা লেখে। একটা জীবন একটা উপন্যাসের মতাে।
অনিলদার বাড়ি। অনিলদা বলেন - "চলো অংশুমান, আজ আয়ের সাহিত্য আসর। চলো ঘুরে আসি। অংশুমান বলল - "চলুন ভালােই হবে, একটা কবিতা পাঠ করব। আজয়ের আসরে গিয়ে ওরা দু-জনে কবিতা পাঠ করল। তারকেশ্বর বাবু বললেন - “পরবর্তী মাসের আসর কাটোয়া মহুকুমা মন্দিরে অনুষ্ঠিত হবে। সাহিত্য আসরেই পরবর্তী মাসের আসরের দিন ঘোষণা করা হয়। আবার মাসের প্রথম শনিবার বিজ্ঞান পরিষদে অনিল ঠাকুর সাহিত্য আসরে গিয়ে অনুগল্প পাঠ করল। অনিল ঠাকুর বললেন, আমরা একসঙ্গে বাড়ি যাবাে। তুমি চলে যেও না।" অনুষ্ঠান শেষে ওরা বাড়ি এল, কবি ও গবেষক অনিল ঠাকুর সতিই খুব গুণী মানুষ।
অংশুমান কথা বলে মোবাইল রেখে দিল। তারপর দেবীকে বলল - পুরুলেতে জেঠুমা মারা গেছেন। এই দশ মিনিট আগে।” তখনও খিচুড়ি, ডিমভাজা, আলুভাজা খাওয়া হয়নি। সব কুকুরকে খাওয়ানো হল। সঙ্গে সঙ্গে তিনজনেই রওনা হল পুরুলে গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে। প্রায় দু-ঘন্টা পরে ওরা পুরুলে পৌছে গেল। পাশের বাড়িতে জেঠিমা থাকতেন। দুই ছেলে বুড়ো আর ভােম্বল। ভবদেব মারা গেছে আগে। ওরা মোট তিন এক বোন। বড়দা, বাবু, অংশুমান সবাই কাটোয়ার শানে যাওয়ার নিল। রিলিফদাকে ফোন করে দেওয়া হয়েছে। রিলিফদা বলল, "আ বোলপুর এসেছি। রাস্তায় ঠিক দেখা করে নেব।" বাবা মারা যাওয়ার সময় সব ভাইরা একত্রে শাক পালন করেছেন। আবার জ্যাঠাইমা মারা যাওয়াতে সবাই এক হল। দাহকার্য সমাপ্ত করে সবাই গঙ্গাস্নান করার পর সাদা কাপড়। পড়শীরা যারা এসেছিলেন সবাই গঙ্গাস্নান করে নিলেন। বাবু, বাবন, মলয়, নিতাইদা, গোপালদা, প্রশান্ত ও আরও অনেকে এসেছেন। এইভাবে কথাবার্তা চলছে। এদিকে দেবী, বড় বোন মামণি, ছােটো বােন পপন ও তাদের ছেলেমেয়েরা, জামাইরা সবাই এসেছে। ঘর মানেই তো মানুষের সমাহার। যে ঘরের মানুষ যত ভালো, সেই ঘর ততটাই সুন্দর। সবাই একসাথে এখন থাকবে দু-চারদিন। কারণ চলে গেলে আবার যে লেগে যাবে। শ্মশানে গিয়ে অনেকক্ষণ হরিনাম হয়েছিল। হরিনামের মল যে ছিল ভইা। কাটোয়া শ্মশান গঙ্গার প্রায় কাছাকাছি। তখন ইংলফটিক In tv না। কাঠের আগুনে বা কয়লার আগুনে দাহকার্য সমাপ্ত এ। ভবা পাগলার সেই বিখ্যাত গান মাইকেে বাজছে। ”ও আমার ব্যথা এভাবে চলে গেলেন তা নয়, যেতে হবে আমাদের আমরা শুধু আমার আমার করেই কাটিয়ে দিই সময়। বৈরাগ্য হলেই তো হবে না। এমন আবেগ আমাদের, মানুষদের করা হল হিংসা, লোভ পাপ করে সতিকারে মানুষ এখন। আর কিছু হতে না পারি এক এ কারও মাথা নেই। ফলে থেকে সবাই যে যার চলে গেল। পুরুলেতে থাকল বাকি সংসার পরিজন। অংশুমান নিজের পরিবার। শহরে চলে এল। দেবী তাে ঘরে এসেই ঝুল ঝাড়া, ঝাট দেওয়া করতে লাগল। সৈকত একটা গল্পের বই নিয়ে বিছানায় পড়তে গেল। অংশুমান বাজারে গেল কিছু বাজার করে আনার জন্য। ঠিকঠাক করে রেডি হতে প্রায় বেলা দুটো বেজে গেল। দেবী বলল - "সৈকত আয় খাবি আয়। সৈকত ডাকল বাবাকে। খাওয়া দাওয়া হয়ে গেল। দুপুরে একটু শুয়ে সকলে বিশ্রাম করে নিল। বিকেলবেলায় দেখি ও অংশুমান হাঁটতে বেরােয় আর সৈকত খেলতে যায়। প্রতিবেশীরা সকলে খুব ভালােবাসে। তারা বলে, “আপনারা সকলে বেড়িয়ে যাবেন না। একজন ঘরে থাকবেন।"
তার সাথে আমাদের মনটাও বিসর্জনের বাজনা শুনতো পড়ার ঘরে বেশ কিছুদিন ধরে... যে স্কুলে পড়তাম, দীর্ঘ কুড়িবছর পরে সেই স্কুলের সিঁড়িতে দেখলাম স্মৃতিগুলো থমকে আছে অতীতের থাম ধরে। আমার কাঁচাপাকা চুল সহসা কালো হয়ে ফুটে উঠল। কি করি, কোনটা আগে দেখি পড়িমড়ি করে ছুটলাম রসায়নাগারে। এখানে লাফিং গ্যাসের বোতল খুলে গেছে, আমরা সকলে হাসছি, এমনকি শিক্ষকমহাশয় পর্যন্ত হাসছেন। তারপর, গ্রন্থাগারের দরজা খুলে মৌন হলাম। সারি সারি বই সাজানো, আব্দুল স্যার গম্ভীর হয়ে পড়ছেন। মায়ামাখানো অপূর্ব দৃষ্টিতে তিনি তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। ঘন্টা পড়তেই চমকে দেখি কেষ্টদা বলছেন, কেমন আছিস বাছা। অনেকদিন পরে এলি। এতদিন কি করছিলি, তোর নাম মনে পড়ে না তবে মুখটা ভুলিনি। আসবি প্রতিবার স্কুলে প্রাক্তন ছাত্রদের নিয়ে 'ফিরে দেখা 'হয়।
আমি কি করব ভেবে পাচ্ছি না। আমার ক্লাসের বন্ধুরা ক্লাসে ছোটাছুটি করছে টিফিনের সময়ে। তারপর ভূগোল শিক্ষক মহিমবাবুর ক্লাস। দেখে দেখে পড়া বলা, আড়ালে গল্পের বই পড়া। আড়াল করতাম স্টিলের বাক্স দিয়ে। তখন আমরা ব্যাগের বদলে স্টিলের বাক্স ব্যবহার করতাম। আবার ঘন্টার ঢং শব্দে চমকে উঠি। ফিরে আসি বাস্তবের মাটিতে। সেই বটগাছতলা, সেই স্কুল আছে। শুধু নেই আমার পুরোনো শিক্ষকমহাশয়রা। চাকরির নিয়মে তারা প্রাক্তন হয়েছেন। তবু এই স্কুলের ইঁট, কাঠ, পাথর কত চেনা কত আপন। পুরোনো স্মৃতির মোড়কে, নব নব সুরে আমি আপ্লুত।
লিলুয়ার পটুয়াপাড়ায় আমরা ঘরভাড়া নিয়ে থাকতাম বাবার চাকরিসূত্রে। ভাড়া বাড়ির সামনে একটা কুলগাছ ছিল। টালির চাল। তখন চোর ডাকাতের উপদ্রব ছিল খুব। আমার বাবা সন্ধ্যে হলেই দরজা জানলা বন্ধ করে দিতেন। আমরা চার ভাই। কিন্তু বড়দা গ্রামের বাড়িতে কাকাবাবুর কাছে থাকতেন। বাবার কাছে থাকতাম আমরা তিনভাই। বিশ্বকর্মা পুজোতে ঘুড়ি ওড়াতাম। দোলে রঙ মাখতাম উল্লাসে। তখন আকাশ এত খোলা ছিল, পুকুর ছিল। শীতকালে পুকুরের জল শুকিয়ে গেলে আমরা মাঠ তৈরি করে খেলতাম। ঝুড়ি, কোদাল নিয়ে পুকুরের তলা সমান করে ক্রিকেট খেলার পিচ বানাতাম। কবাডির কোর্ট বানাতাম দাগ দিয়ে। সকালে ছুটির দিনে কবাডি খেলতাম ছেলেমেয়ে একসাথে। একটা মেয়ের তনু নাম ছিল। তার সঙ্গে আমি কবাডি খেলতে পারতাম না। কত বন্ধু। তাদের সঙ্গে পড়াশুনোয় চলত কম্পিটিশন। কিন্তু বাইরে বন্ধু। বিকেলে ক্রিকেট খেলতাম। শটিবনের জঙ্গল ছিল পুকুরের পাড়জুড়ে। সেখানে লুকোচুরি খেলতাম।
সৈকত তার স্কুলবেলায় বিজ্ঞানের স্যারকে খুব ভালবাসত। সৈকতের অন্য বন্ধুরা বলত পাগলা স্যার। সৈকতের খুব রাগ হত। সে বলত, এইরকম পাগল হাজার হাজার প্রয়োজন আমাদের শিক্ষার জন্য। বিজ্ঞান স্যারের নাম ছিল পাই স্যার। মার্চ মাসে বিজ্ঞানী আইন স্টাইনের জন্ম। এই বিজ্ঞানীর জন্মদিনে খুব মজা করে বিজ্ঞান বোঝাতেন স্যার। তিনি একবার বলেছিলেন, ছোটবেলায় আমরা সৌরজগতের গ্রহগুলোকে সূর্যের থেকে কত দূরে শিখেছিলাম। পৃথিবীর থেকে সূর্য পনেরো কোটি কিলোমিটার দূরে। কিন্তু মুশকিল হল এই‘ পনেরো কোটি কিলোমিটার’–টা কতদূর তার ধারণা আছে নাকি আমাদের? তোমার স্কুল আর মামার বাড়ির দূরত্ব কত, বলতো সৈকত।
সৈকত বলল, স্যার তিন’ কিলোমিটার হেঁটে স্কুল যেতে মিনিট কুড়ি লাগে। একশো কিলোমিটার দূরে মামার বাড়ি যেতে বাসে ঘন্টাখানেক লেগে যায়। অমর বলল, আমার মামা দিল্লিতে থাকেন। কলকাতা থেকে দিল্লীর দূরত্ব দেড় হাজার কিলোমিটার – প্লেনে যেতে লাগে ঘন্টা দেড়েক কি দুয়েক। স্যার বললেন, তাহলে দেখ, এই একশো কিলোমিটার বা দেড় হাজার কিলোমিটার দূরত্বের সাথে আমাদের অভিজ্ঞতা দিয়ে একটা সম্পর্ক তৈরি হল। কিন্তু পনের কোটি? সেটা কত বড় সংখ্যা তা বুঝি নাকি? সুতরাং, সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্ব আমাদের কাছে একটা মুখস্থ করার সংখ্যা হিসেবেই রয়ে গেল, অনুভূতি বা‘ইনটুইশন’–এ সাথে যুক্ত হল না। আবার এই দূরত্বের সাপেক্ষে পৃথিবী কত বড়, সূর্যই বা কত বড়, তাও মনের মধ্যে ছবি হয়ে রইল না! এই ধরণের নতুন তথ্যকে আমাদের অনুভূতির সাথে যুক্ত করা যায় অনেকভাবে। যেমন, একটা উড়োজাহাজ যার কলকাতা থেকে দিল্লী যেতে এক-দেড় ঘন্টা লাগে, তার কতক্ষণ লাগবে একই বেগে পৃথিবী থেকে সূর্য যেতে? উত্তরটা সহজেই দূরত্বকে গতিবেগ দিয়ে ভাগ করে পাওয়া যাবে – প্রায় সতের বছর! আবার ব্যাপারটাকে অন্যভাবেও ভাবা যায়। ধরা যাক, পৃথিবীর সাইজ একখানা পাঁচ সেন্টিমিটার ব্যাসের রাজভোগ কি রসগোল্লার মত। তাহলে এই স্কেলে সূর্য কত বড় আর কত দূরে হবে? অমর বলল, অঙ্কটা চট করে কষতে পারব ঐকিক নিয়ম লাগিয়ে। স্যার বললেন, হ্যাঁ পৃথিবীর ব্যাস মোটামুটি ১২,৮০০ কিলোমিটার, সেটাকে ছোট করে ৫ সেন্টিমিটার করে নাও। তাহলে পনেরো কোটি কিলোমিটার হবে ‘৫ সেন্টিমিটার X ১৫ কোটি / ১২,৮০০’ সমান প্রায় ৬০০ মিটার। এবার কিন্তু সৌরজগত সম্বন্ধে আমাদের একটা ধারণা তৈরি হল। মনে মনে একটা ছবি বানিয়ে নিলাম যে আমার টেবিলের উপরের রসগোল্লাটা পৃথিবী, আর মিনিট পাঁচ–ছয় হেঁটে গেলে সূর্যকে পাব। কিন্তু সূর্য তো বিন্দু নয়! তার ব্যাস প্রায় চোদ্দ লাখ কিলোমিটার। তাহলে আবার ঐকিক নিয়মে দেখে নেব যে আমাদের উদাহরণে সূর্য হবে প্রায় সাড়ে পাঁচ মিটার মানে মোটামুটি একখানা বড়সড় ঘরের মত। ঘরের মত চৌকো নয় অবশ্য, মোটামুটি গোলাকার।এইভাবে তিনি বিজ্ঞান বোঝাতেন সহজ করে। তারপর যখন বারো ক্লাসে পড়ি তখন স্যার একবার স্কুল ল্যাবরেটরিতে ক্লাস নিলেন। স্যার সিরিয়াস হয়ে পড়াচ্ছেন। প্রায় কুড়ি মিনিট পরে ক্লাসে সকলেই হাসতে শুরু করেছে। সৈকত ও তার বন্ধুরা তো হাসছেই। তার সঙ্গে হাসছেন, পাই স্যার। আমরা অবাক হয়ে হাসছি। হাসির কলরবের শব্দ পৌঁছে গেল হেড মাষ্টারমশাইয়ের ঘরে। তিনি একটি শক্ত লাঠি নিয়ে এলেন মারার জন্য। তিনি চিৎকার করছেন আর বলছেন, বাঁদরামি হচ্ছে। এটা স্কুল। স্কুলে হাসি। ঘরে ঢুকে পড়ে হেড মাষ্টারমশাই ও হাসতে লাগলেন। সৈকতরা অবাক। কি ব্যাপার হলো। এদিকে পাই স্যার হাসতে হাসতে এগিয়ে চলেছেন একটা মোটা কাঁচের বোতলের দিকে। তিনি দেখলেন বোতলের মুখ খোলা। লেখা আছে বোতলের গায়ে নাইট্রাস অক্সাইড। স্যার বন্ধ করলেন ঢাকনা। তারপর দশ মিনিট পরে হেডস্যারকে বললেন, স্যার লাফিং গ্যাসের বোতল খুলে ফেলেছে কেউ। তার ফলে এই হাসি। অমর বললো, স্যার হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে গেছে। কে যে বোতলটা খুলেছিলেন তা আজ পর্যন্ত জানা যায় নি...
পাই স্যারের বাড়ি গেলেই তিনি পরাণের পান্তুয়া খাওয়াতেন। তিনি আমাদের বাড়িতেও পড়াতেন। তিনি আমাকে বলতেন, তোর কি পাখির পেট নাকি। খা পরাণের পান্তুয়া। আরও দুটো নে। আমি বলতাম, না না আর নেব না। প্রত্যেকদিন তিনি আমাদের পান্তুয়া খাওয়াতেন। মনে পড়ে আজও লিলুয়ার কথা। এটা শহর নয়। গ্রামের মতই। জায়গাটার নাম পটুয়াপাড়া। এই পাড়ায় মাটির পুতুল বিখ্যাত ছিল। দুটো পুতুল কিনলেই মাসি বলতেন, নে নে আর একটা নে। এটার দাম লাগবে না। মাটির পুতুল নিয়ে আনন্দে ঝুলন সাজাতাম। পুজো দিতাম। পরাণদার পান্তুয়া ছিল প্রসাদ। তার লোভেই আমরা ঝুলন সাজাতাম প্রতিবার। আমরা ছোটোবেলায় মোবাইল পাই নি। কিন্তু আমরা যেসব আনন্দের অংশীদার ছিলাম সেসব আনন্দ এখনকার ছেলেরা আর পায় বলে মনে হয় না। ইতিহাসের বাইরে চলে গেছে ভুলোলাগা বামুন। তিনি ঝোলা হাতে মাথায় গামছা জড়িয়ে আসতেন শিল্পকর্ম দেখিয়ে রোজগার করতে। তিনি আমাদের বাড়িতে এসে শুরু করতেন নিজের কথা বা শিল্পকর্ম। নাটকের অভিনয়ের ভঙ্গিমায় বলতেন, আর বলো না বাবা। তোমাদের গ্রামে আসতে গিয়ে চলে গেলাম ভুলকুড়ি ভুল করে। তারপর মেলে, কোপা, বিল্বেশ্বর, চুরপুনি, সুড্ডো ঘুরে কোমডাঙ্গা। তারপর কেতুগ্রাম, কেউগুঁড়ি হয়ে গুড়িগুড়ি পায়ে হেঁটে পোশলা, নঁগা, খাটুন্দি, পাঁচুন্দি হয়ে তৈপুর, পাড়গাঁ, বাকলসা, পাঁচুন্দি, মুরুন্দি, সেরান্দি, খাটুন্দি পার করে কাঁদরের গাবায় গাবায় হেঁটে এই তোমাদের গ্রামে। আমরা জিজ্ঞেস করতাম, এতটা পথ হাঁটলে কি করে দাদু। তিনি বলতেন, সব ভূতের কারসাজি। তেনারা ভুলো লাগিয়ে দেন। ভর করে দেহে। তাই এতটা পথ হাঁটতে পারি। তারপর চালটা, কলাটা, মুলোটা দিতেন তার ঝোলায় আমার মা বা পিসি। ভুলোলাগা বামুন এলেই সেই দিনটা আমাদের খুব ভালো লাগতো। তার পিছু পিছু মন্ত্রমুগ্ধের মতো ঘুরে বেড়াতাম ভুলো লাগা বালক হয়ে। বৃষ্টির পরেই রাম ধনু দেখা যায়। দুঃখ শেষে আনন্দ। আমার পাগলামি যে ভালোবাসে সেই শোভন। দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে মানুষকে ভালোবাসার নামই জীবন। নর জীবনে নারী ছাড়া জীবন অচল। তবু কেন এত অন্যায় অত্যাচার নারীর উপর। সাধুবেশে নারীদের বিশ্বাস অর্জন করে ন্যায় অন্যায় জলাঞ্জলি দিয়ে কেন তাদের বিশ্বাস হত্যা করা হয়। তারা যে মায়ের, মাসির আদরের আঁচল। তাদের রক্ষা করার জন্য তৈরি হোক সমস্ত মানবহৃদয়। তারপর যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি তখন কাকাবাবু মরে গেলেন অকালে। বাবা হতাশ হয়ে পড়লেন। ভাই অন্ত প্রাণ। বাবা বললেন, আর লিলুয়ায় থাকব না। গ্রামে গিয়ে জমিজমা দেখভাল করব। চাষ করব। বাবারা দুই ভাই দুই বোন। পিসিদের বিয়ে হয়ে গেছে অনেকদিন। তারপর চলে এলাম গ্রামে। গ্রামে এসে নতুন পরিবেশে মিশতে সময় লাগল। কিন্তু টাইম ইস দ্য বেষ্ট হিলার। সময়ের প্রলেপে খাপ খাইয়ে নিলাম নিজেকে। তারপর অজয়ের বন্যায় মাটির বাড়ি ভেঙ্গে গেল। ভেসে যাচ্ছিলাম বন্যার জলে। চিৎকার করলাম, আমাকে বাঁচাও... যতবার আমি বিপদে পড়েছি রক্ষা পেয়েছি নারী হৃদয়ের কমনীয়তার গুণে। ভীষণ বন্যায় ভেসে চলেছিলাম স্রোতের তোড়ে। রক্ষা পেয়েছি সর্দার দিদির বলিষ্ঠ হাতের আশ্রয়ে। জীবনে জ্বর হয় বারে বারে। সেবা পেয়েছি স্বপ্না বোনের শাসনে। বারে বারে জীবনযুদ্ধে যখন হেরে যাই ভালোবাসা র আড়ালে মায়াচাদর জড়িয়ে রাখেন আমার বড় সাধের সহধর্মিণী। আর আমার মা সুখে দুখে শোকের নিত্যদিনের সঙ্গী। পুরো জীবনটাই ঘিরে থাকে নারীরূপী দেবির রক্ষাকবচ। সমগ্র পুরুষ সমাজ আমার মতোই নারীর কাছে ঋণী। তবে কোন লজ্জায় পুরুষ কেড়ে নেয় নারীর লজ্জাভূষণ। পুরুষদের মধ্যেই অনেকে আছেন তাদের শ্রদ্ধা করেন। তাদের রক্ষায় জীবন দান করেন। তারা অবশ্যই প্রণম্য। তাদের জীবন সার্থক। এই পৃথিবী সকলের স্বাধীন ভাবে বিচরণের স্থান হোক। হিংসা ভুলে পৃথিবীর বাতাস ভালোবাসা ভরুক দুর্বল মানসিকতায়।
বিল্বেশ্বর স্কুলের হেড টিচার অম্বুজাক্ষবাবু বলতেন, যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ জীবনের ক্ষেত্রেও মেনে চলবি। যত দুঃখ, ব্যথা বিয়োগ করবি। আনন্দ যোগ করে খুশি গুণ করবি। আর খাবার ভাগ করে খাবি। একা খেলে, বেশি খেলে রোগ বেড়ে যাবে। মজার মধ্যেও কতবড় শিক্ষা তিনি আমাদের দিয়েছিলেন আজ বুঝতে পারি। আদর্শ শিক্ষক বোধহয় এই রকম হন। ফোচন বললো। ফোচনের বোন ফোড়োনকে মাস্টারমশাই মশলা বলে ডাকতেন। ফোড়োন খুব রেগে যেতো। কারণ বন্ধুরাও তাকে মশলা বলেই ডাকতো। একদিন স্যারের কাছে ফোড়ন বললো, আপনি মশলা নামে ডাকেন বলে সবাই ডাকে। মাস্টারমশাই বলেছিলেন, আদর করে দেওয়া নাম কোনোদিন ফেলবি না। রাগ করবি না। দেখবি একদিন যখন তোর বন্ধু, বান্ধবীরা দূরে চলে যাবে তখন এই নাম তোর মুখে হাসি ফোটাবে। সংসারের সমস্ত দুঃখ ভুলিয়ে দেবে আদরের পরশে। ফোড়োনের জীবনে সত্য হয়েছিলো এই কথা। একদিন বিয়ের পরে রমেশের সঙ্গে দেখা হলো তার। রমেশ বললো, কেমন আছিস ফোড়োন। ফোড়োন বললো, একবার মশলা বলে ডাক। তা না হলে আমি তোর প্রশ্নের উত্তর দেবো না। রমেশ তারপর ওকে মশলা বলে ডেকেছিলো। মশলা সেবার খুশি হয়ে রমেশকে ফুচকা খাইয়েছিলো। তারপর বিয়ে হল বন্ধু রমেশের। প্রায় কুড়ি বছর পরে ২০২০ সালে করোনা রোগ এল বিশ্বজুড়ে। রমেশের ছেলের জ্বর হল। কোনমতেই ছাড়ে না। ছেলে চোদ্দদিন পরে বলে, আমাকে হাসপাতালে নিয়ে চল বাবা। টোল ফ্রি নাম্বারে ফোন কর। তোমাকে যেতে হবে না। রমেশ বলল, তুই আমার একমাত্র ছেলে। তোকে যদি করোনা ভাইরাস আ্যাটাক করে আমি হাসপাতালে পাঠাব না। আইসোলেশনে রাখার পরে তুই যদি আর ঘরে না ফিরিস।
-তাহলে কি হবে। আমি একা মরে যাব। আর হাসপাতালে না পাঠালে তুমি আর মাও মরে যাবে। আমার শরীরে অসুবিধা হচ্ছে। তুমি আমাকে হাসপাতালে পাঠাও।
- তা হোক শরীর খারাপ হলে কাউকে বলার দরকার নেই। ওষুধ খেলেই ভালো হয়ে যাবি।
- না বাবা। তা হয় না। আমি যদি পজিটিভ হই আমাকে হাসপাতালে দেওয়াই ভাল।
বাবা ভাবেন ছেলেটা সমাজের মুখ তাকিয়ে ঠিক বলছে। সমাজে এ রোগ ছড়িয়ে গেলে আরও অনেক লোক মরে যাবে। কিন্তু ছেলেটা তো বাবা হয় নি। ও কি করে জানবে বাবার দৃষ্টিকোণ। আমি কি ওর মায়ের অন্তর দেখতে পাচ্ছি। মেয়েদের বুক ফাটে মুখ ফোটে না। ছেলে হারাবার ভয়ে বা স্বামীকে হারাবার ভয়ে সে করোনা রোগের নাম করে না।
ওর মা বলে - বড্ড অপয়া রোগ। একজনকে গ্রাস করলে সারা বলয় গিলতে চায়।
বাবা ভাবেন - এখনও এই উন্নত যুগে মানুষ কত অসহায়। মিথ্যে ক্ষমতা আর টাকার বড়াই। কোনো কিছুই মৃত্যুকে আটকাতে পারে না। ছেলে আইসোলেশন ক্যাম্পে চলে গেলো। করোনা পজিটিভ। চিকিৎসায় কোন ফল হলো না।
ছেলেটা চলে গেল...রমেশ আর তার বউ কেমন যেন হয়ে গেল। কারও সাথে আর কথা বলে না। তারপর পৃথিবীর সব রোগ সেরে গেল দুমাস পরে। সংসার সহজভাবে চলতে থাকল। সে ত থামতে জানে না।আমি সুরেন্দ্রনাথ কলেজে আইন পড়তে ভর্তি হলাম। বড়দা বাবার মত ঘর ভাড়া নিয়ে থাকেন চাকরিসূত্রেই। লিলুয়ায় বড়দার বাসায় থাকতাম। ফিরে ফিরে দেখতাম ছোটবেলার পুকুরটাকে। বন্ধুরা সব বড় হয়ে গেছে। কেউ আর পাত্তা দেয় না। সেই পাই স্যার, সৈকত, বিশ্বকর্মা
পুজো আমার মনে বিষাদের বাজনা বাজায়। পরাণদার বাড়ির সামনে মিষ্টির দোকানে গেলাম।
সেখানে পান্তুয়ার দোকানের বদলে মোমোর দোকান দিয়েছে পরাণদার ছেলে। পরাণদা বুড়ো হয়েছেন এখন। আমাকে দেখে বললেন -
কে তুমি চিনতে পারলাম না তো। আমি পরিচয় দিলে তিনি আমাকে আনন্দে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন আমাকে -
পাই স্যার নেই তো কি হয়েছে, আমি তোমাকে পান্তুয়া খাওয়াব। আমি বললাম,
না তুমি এখন বুড়ো হয়েছ। আর তোমাকে কাজ করতে হবে না। পরাণদাকে প্রাণভরা ভালবাসা জানিয়ে চোখে জল নিয়ে বাইরে এলাম। এখনকার ছেলেরা কেউ আমাকে চেনে না। পরের দিন বিকেলবেলা পরাণদা তার বাড়িতে আমাকে ডাকলেন। থালায় চারটে পান্তুয়া। খেলাম তৃপ্তি করে। শেষে তিনি কাগজের ঠোঙায় অনেকগুলো পান্তুয়া হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন
- এটা তুমি বাসায় গিয়ে খেও। আমার আনন্দ হবে। ইতস্তত হয়ে আমি ঠোঙা হাতে ধরে একশ টাকার নোট বের করলাম। পরাণদা বললেন
- ভালবাসায় টাকাপয়সার স্থান নেই। আমার এখন টাকার অভাব নেই। তোমাকে পান্তুয়া খাইয়ে আমি যে কতটা আনন্দ পেলাম তা আমি ছাড়া কেউ বুঝবে না। পরাণদার এই কথা শুনে আমি আর কথা বলতে পারলাম না। গলা ধরা গলায় বললাম, আসছি।
এখনও পটুয়াপাড়ায় আমি সময় পেলেই চলে যাই পুকুরের পাড়ে। বসে থাকি শটিবনের ধারে। জঙ্গলের এক বুনো গন্ধে পরাণদার কথা মনে পড়ে। এই পুকুরে খেলার সঙ্গিদের মনে পড়ে। বুকটা চিন চিন করে ওঠে। মন উদাস হয়। অতিতের এই পুকুর পাড়ে আমার বয়স, আমার স্মৃতি থমকে রয়েছে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের চিরন্তন খেলায়। আমি পুকুড়ের পাড়ে বসে আমার ছোটবেলার খেলা খেলি আপনমনে হাতে একটা ময়লপড়া ঝোলা হাতে শিলকোটানি হেঁকে চলত, শিল কোটাবে গো শিল, শিল কোটাও গো শিল...
বাড়ির বৌ-ঝিরা ত্রস্ত হয়ে বেরিয়ে আসত বাইরে। বাইরে এসে বলত, এসো গো আমার দ্বারে আমার শিল একবার কোটাতে হবে। শিলকোটানি লোকটা ময়লা ঝোলা থেকে বের করত ছেনি, হাতুড়ি। তারপর পাথরের শিলের উপর নক্সা ফুটিয়ে তুলতো ঠকঠক শব্দে। আশেপাশে কচিকাঁচা ছাড়াও প্রতিবেশিদের বৌরা দেখত আগ্রগভরে এই শিলকোটা। কিভাবে ধীরে ধীরে ফুটে উঠছে নক্সা হাত ও হাতুড়ির যুগলবন্দীতে।
তারপর একজনের দেখে প্রতিবেশিদের দশজন কুটিয়ে নিত শিল। পাশের বাড়ির অনিতা বললো, আমাদের বাঁটনা বাঁটা শিলটাও কেমন সমান হয়ে গেছে। ফুটো ফুটো না থাকলে মশলা ভালো করে বাঁটা যায় না।
শিলকোটানি লোকটা বলে, নিয়ে এসো গো মা। কুটে দিই শিলটা। আবার কবে আসব জানা নাই।
তারপর দশ বারোটা শিল কুটে রোজগার করে শিলকোটানি চলে আসত তার বাড়ি। ছেনি, হাতুড়ির সব সময় ঠিক রাখত। অনেকে পাথরের শিল মাথায় করে নিয়ে আসত তার কাছে। কত যত্নে সে শিল কুটতো। তখন তার শিল্পীহৃদয় নিয়ে যেত কল্পনার জগতে। সেখানে রঙ আর রঙীন মেঘের আনাগোনা। সেই মেঘের আশীর্বাদ পেয়ে সে বোধহয় এই কাজ পেয়েছে। সে এই কাজ পেয়ে খুব খুশি।
অবসর সময়ে বাগানে গাছ লাগাতেন। আবার সকাল হলেই বেরিয়ে পড়তেন শিকোটানোর কাজে। এখন আর শিলকোটানোর যুগ নেই। মিক্সির চাপে পেশাই হয়ে গেছে প্রচলিত এই পেশা। সেই শিলকোটানোর লোকটির বাড়িতে এখন নাতিদের মিক্সির বাজার। হারিয়ে গেছে পুরোনো সেই শিলের কথা।
আর এক সম্প্রদায়ের মানুষ ছিল তারা হাবু গান গাইতো সাথে লাঠি দিয়ে পিঠে আঘাত করত। এইসব আঘাত দেখে সহ্য করতে না পেরে বেশি টাকা দিয়ে তাদের এই খেলা দেখাতে বারণ করত। এইভাবে হাবুগান চলত কিন্তু তার প্রচলন এখনো দু-এক জায়গায় রয়ে গেছে। হাবু গানে প্রচলিত গানগুলো ছাড়াও কাউকে ব্যঙ্গ করে বা কোন সমাজের অত্যাচারকে ব্যঙ্গ করে গান গাওয়া হতো।
বীরভূম থেকে বহুরূপী সম্প্রদায় এখানে এসে অন্যরকম সাজে অভিনয় করে দেখাতো বহুরূপী রাম সীতা হনুমান এইভাবে তারা বিভিন্ন রকম সাজে সজ্জিত হয়ে আনন্দিত এবং তার বদলে টাকা-পয়সা উপার্জন করে তাদের সংসার চলত। বহুরূপী সম্প্রদায় এখনো অনেক জায়গায় আছে শহরের বিভিন্ন জায়গায় মাঝে মাঝে দেখা যায় হনুমান সেজে কেউ ঘুরে বেড়াচ্ছে কেউ রাবণ সেজে এসে ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং তারা বিভিন্ন জায়গায় ভান করে বা মজার ছড়া বলে না কিছু উপার্জন করছে এবং এই উপার্জিত টাকা পয়সা তাদের জীবন নির্বাহ হয়। প্রচণ্ড গরমে তারা সারা দেহে রং মেখে এইভাবে পরিশ্রান্ত হয়ে দিনের পর দিন অর্থ উপার্জন করে এবং দিন চলে গেলে তখন তাদের আর কাজ থাকেনা তখন তারা অন্য কাজ করে।
আমরা ছোটবেলায় দেখেছি ভুলো লাগা ব্রাহ্মণ এসে বাড়ি বাড়ি ঘুরতে তারা ছড়ার মত করে বলতো না বিভিন্ন গ্রামের নাম করত এবং বলতো যেসব গ্রাম ঘুরে এসে শেষে আপনাদের বাড়ি এলাম। হয়তো গ্রামগুলো আশপাশের গ্রামগুলোর নাম বলতো, মেলে পোশলা কোপা ভুলকুরি হয়ে তারপর মুলগ্রাম শিবলুন তাড়াতাড়ি হয়ে তারপর আমাদের গ্রামে এসেছে। দিক দিয়ে ভুলো লাগা ভূত নাকি তাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে শেষে এইগ্রামে এনেছে। তারপর ঘুরতে ঘুরতে রাস্তা ধরে প্রচন্ড গরমে মালিকের বাড়িতে এলাম বাড়িতে এসে দাঁড়াতেই কথা বলতেন একথা শুনে শিশু থেকে বৃদ্ধ এবং তাকে বসিয়ে হয়তো তার উপার্জিত অর্থ দিয়ে সংসার চলতো সংসার চলত।
তারপর এক ধরনের ব্যবসাদার ছিল তারাও সরু লিকলিকে বাসের উপর সেই বোম্বে মিঠাই মিঠাই নানান রঙের মিঠাছড়ি এনে বাচ্চাদের বিভিন্ন রকম পুতুল তৈরি করে দিতে হতো বলতো আমাকে সাপ তৈরি করেছে মিঠাই মিঠাই দিয়ে তৈরি করে দিত আর আমাকে পুতুল বানিয়ে দাও বিভিন্ন নতুন নতুন ছোটদের মনভোলানো আর দেখা যায় না এর অর্থ উপার্জন করত। এই বোম্বাই লাঠি বানানোর জন্য প্রথমে নিজেকে ফুটিয়ে ফুটিয়ে হাজারের মতো তৈরি করা হতো আটা লেগে গেলে বিভিন্ন রঙে রঙিন করা হলুদ নীল সবুজের জরিনা জরিনা হতো প্রথমে তারপর যদি না হতো এবং তাতে প্লাস্টিক জড়িয়ে রাখো ধুলোবালি যাতে না পড়ে তারপর শিশুদের চাহিদামত পুতুল তৈরি করা হতো।
তাছাড়া একটা টিনের বাক্স নিয়ে শনপাপড়ি বিক্রেতা শোনপাপড়ি বিক্রি করত। তারা একটা চাকা ঘোরাতো টিনের বাক্সের মধ্যে থাকা এবং তাতে চিনির জল বিভিন্ন রং মিশিয়ে চাকা ঘুরিয়ে দিলে মাকড়সার জালের মত মিঠাই তৈরি হত। সেটাকে এক জায়গায় করে শোনপাপড়ি বিক্রি হতো। এক টাকায় হয়তো একটা দেখা গেল একটা বড় ফুটবলের মত শোনপাপড়ি। অনেকে এর নাম দিয়েছিল দিল্লিকা লাড্ডু। এখনো অনেক জায়গায় দেখা যায় ঘটিগরম বলে একটা জিনিস যেটা ভুজিয়া জাতীয় জিনিস দিয়ে মিশিয়ে দেওয়া হয়। সেই হাতেধরা জায়গায় থাকে একটা উনুুন এবং সেই উনুনে গরম করে পিঁয়াজ ও নানারকম মশলা মিশিয়ে ঘটিগরম তৈরি করা হয়।
নিজের বাড়ি থেকে অশান্তির চাপে দীনেশ চলে এল শহরে। সে বিবাহিত। ঘর নেই, চাকরি নেই অথচ একটা সন্তান আছে বৌ আছে। বউকে কয়েকদিনের জন্য বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দিল। নিজে একা শহরে থেকে ছাত্র পড়ানো শুরু করল। নিজেই রান্নাবান্না করে। বাসা বাড়িটা ট্রেনের কামরার মত। সেখানে একটা জলের বোতল আর একটা স্টোভ। হোটেলে খাওয়াদাওয়া করে। আর অবসরে চা খেতে মন হলে স্টোভে চা করে খায়। অন্য ভাড়াটে যারা তারা বলে - দীনেশ তুমি তো ট্রেনের যাত্রী। একটা বোতলে জল থাকে আর একটা প্যান্ট জামা পরে থাক সবসময়। দীনেশ হাসে আর মনে মনে ভাবে, আমরা সকলেই কিছু সময়ের জন্য ট্রেনের যাত্রী। স্টেশন এলেই নেমে যেতে হবে। আমরা দুদিনের সহযাত্রী। অতএব তোমার কোটি টাকা থাকলেও সব ছেড়ে একদিন চলে যেতে হবে স্থায়ী ঠিকানায়।
এইভাবে দীনেশের দিন যায়। এখন ছাত্র নেই। তাই ভাড়া ঘর ছেড়ে দীনেশ চলে গেল গঙ্গার ধারে একটা আশ্রমে। সাইকেলে সংসারের সমস্ত জিনিস নিয়ে চলে এল আশ্রমের ঘরে। মশারি টাঙিয়ে রাতে শোয় সে। গঙ্গার ধারে শবদেহ দাহ হয়। দীনেশ দেখে কি করে একটা মানুষ পুড়ে শেষ হয়ে যায়। আশ্রমে টাকা পয়সা লাগে না। আশ্রমের প্রধান দীনেশকে ভালবাসেন। খাওয়াদাওয়া ফ্রিতে হয়ে যায়। শুধু আশ্রমের দরজা ভোরবেলা খুলতে হয়। তারপর মন্দিরের বারান্দা জল দিয়ে ধুতে হয়। তারপর সারাদিন অখন্ড অবসর। আশ্রমের প্রধান বলেন, যা, মায়ের কাছে বোস। একটু জপ কর। তোর দুর্দিন কেটে যাবে। দীনেশ তাই করে। তারও বিশ্বাস আছে একদিন নিশ্চয় দুঃখের অবসান ঘটবে।
তারপর দীনেশ আশ্রম থেকে ফিরে আবার ঘর ভাড়া নিল। নতুন সেশন। ছাত্রছাত্রী জুটল অনেক। নব উদ্যমে শুরু করল পড়ানো। এক ছাত্রী একদিন বলল - দাদা, বৌদিকে কাছে নিয়ে এস। দূরে থাকলে মায়া কেটে যাবে। দীনেশ বলল,এলে কষ্ট পাবে। ছেলেটা আছে। আর একজন বড় ছাত্র বলল, আপনি কষ্ট করছেন ওরাও করবে। একসঙ্গে থাকবেন।
দীনেশ বউ বাচ্চা নিয়ে এল বাসা বাড়িতে। এখন রোজগার ভাল। কিছু টাকা জমেছে। বউ বলল, পরপর বাসা পাল্টে বিরক্ত হয়ে গেলাম দুবছরে। আমার গহনা নাও। বিক্রি করে আর কিছু টাকা লাগিয়ে একটা জায়গা কিনে বাড়ি কর নিজের। দীনেশ খোঁজ করল জায়গার। পেয়ে গেল দুকাঠা জায়গা। জায়গা কিনে একটা ঘর বারেন্দা করল। তারপর বাঁশের বেড়া দিল জায়গা জুড়ে। পরিবার নিয়ে মাঝমাঠে বসবাস শুরু করল। তবু শান্তি। নিজের বাড়ি তো। আশ্রমে থেকে মায়ের ইচ্ছায় বাড়ি হল নিজের। ছাত্র পড়ানো শুরু করল চুটিয়ে। বেশ চলতে লাগল পানসি নৌকো।
মাঝমাঠ। চারিদিকে ধানচাষ হয়েছে। বর্ষাকাল। চন্দ্রবোড়া, কেউটে, কালাচ, গোখরো কত রকমের সাপ। ঘরে ঢুকে পড়েছে একদিন গোখরো সাপ। ঘরে আছে দীনেশ। বউকে ডেকে তুলে বাইরে আসে তারা। ভেতরে সাপের দখলাতি। ঘরে ঢুকবে তার উপায় নেই। ফণা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে গোখরো। দীনেশ ভাবে, প্রবাদ আছে, বাড়ি গাড়ি আর নারী, দেখেশুনে নিতে হয়। কিন্তু দেখতে গেলে টাকার এলেম চাই। গাড়ি কিনতে গিয়ে খুচরো গুণলে হবে না। নোট চাই নোট। দীনেশ পাশের গ্রাম থেকে সাপ ধরার লোক ডেকে আনল। কিন্তু সে খুব ভীতু। সাপ দেখে আর ধরতে পারছে না। শেষে দীনেশ তার হাত থেকে বড় সাঁড়াশি নিয়ে নিজেই ধরল সাপটা। তারপর জঙ্গলে ছেড়ে দিল।
আর একদিন রাতে চোর এসে কল খুলে নিয়ে চলে গেলো। দীনেশের ইনকাম কম। আবার কি করে জলের কল বসাবে চিন্তা করতে লাগল। কয়েকমাস দূর থেকে জল আনতে হত। সে কি কষ্ট। দূর থেকে জল এনে যে খেয়েছে সেই জানে।
বাঁশের বেড়া। চারদিক খোলা। কোন বাড়ি নেই। শুধু মাঠে চাষিরা এলে একটু আধটু কথা হয়। চাষিরা তাদের কথা বলে। খরচ করে, পরিশ্রম করে চাষ করেও ন্যায্য মূল্য পাওয়া যায় না। গরীব আরও গরীব হয়। ধনীর প্রাসাদ ভরে ওঠে প্রাচুর্যে, গরীবের রক্তের বিনিময়ে। এ কেমন নীতি চাষিরা বোঝে না। তারা মুখ বুজে আজীবন পরিশ্রম করতে করতে একদিন বুড়ো হয়ে যায়। অবস্থার পরিবর্তন হয় না। সমস্ত রক্ত জমা হয় মাথায়। দেশের সুস্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে।
সতেরো বছর কেটে যায়। একই অবস্থা সেই চাষ। কোন বাড়িঘর হয় না। দু-একটা বাড়িঘর হয়তো দূরে দূরে দেখা যায়। কিন্তু রাস্তা নেই ঘাট নেই। ঘরে সাপ ঢুকে পড়ে। এই অবস্থায় দিনের পর দিন ভগবানের সুবিচারের আশায় পড়ে থাকে দীনেশ।
দীনেশের ছেলে দিনেন গ্রাজুয়েট হয়। করোনার অতিমারিতে পৃথিবী অসুস্থ হয়ে পড়ে। দীনেশের বউ ঝুমা বলে - এবার এ বাড়ি বিক্রি করে গ্রামে ফিরে যাই চলো। দীনেশ বাড়ি কেনাবেচার দালালদের বলে বাড়ি বিক্রির কথা। শেষে কুড়ি লাখ টাকায় বিক্রি হয় দীনেশের বাড়ি।
দীনেশ ভাবে, গ্রামে বসে থাকলে সে কুড়ি লাখ টাকার মালিক কোনোদিন হতে পারত না। ঈশ্বরের ইচ্ছে হয় তো তাই। তাই এত কষ্টের মধ্যে থেকে দীনেশের বাস মাঝমাঠে। আশ্রমের কথা মনে পড়ে দীনেশের। সেখানে সে মাকে মনের কথা বলেছিল বারে বারে।
দীনেশ এত কষ্টের ফাঁকে লিখে যেত নিজের জীবনকাহিনী। অনেক কথা সঞ্চিত হয়ে বুক ফেটে বেরিয়ে আসত কথামালা। কথামালাগুলো জড়ো হয়ে সৃষ্টি হয় এক বৃহৎ উপন্যাস।
এখন লকডাউনের সময় দীনেশ বাইরে বেরোতে পারে না। লেখালেখির অখন্ড অবসর। সঠিকভাবে লকডাউন না পালনের ফলে দিন দিন বাড়াতে হচ্ছে বারবার। বিশ্বব্যাপী এই কোভিদ নাইন-টেনের আক্রমণে মানুষ এখন দিশেহারা। কি করে করো না কে রুখে দেওয়া যায় তার জন্য বৈজ্ঞানিকরা গবেষণা শুরু করেছেন। কিন্তু সময় তো লাগবে মিনিমাম ১২ থেকে ১৪ মাস সেই সময়টা অন্তত লকডাউন এর মাধ্যমে মানুষকে ঘরে বেঁচে থাকতে হবে আর যত সুন্দর ভাবে লালন পালন করা হবে ততো তাড়াতাড়ি আমরাই করোনা ভাইরাস থেকে মুক্তি পেতে পারবো। কিন্তু কিছু না ছাড় লোক আছে তারা কোনমতেই বারণ শোনে না। ইতালি এবং আমেরিকায় সঠিকভাবে লালন পালন না করার জন্য বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে গেছে থেকে প্রথমে শুরু হয় সেই করোনা রোগ ছড়ানোর কারণ প্রথম থেকেই ধীরে ধীরে সমস্ত বিশ্বে ছড়িয়ে যায়। সঠিকভাবে লকডাউন পালন করলে এই রোগকে সহজেই আটকানো যেত কিন্তু কে শোনে কার কথা। ঠিকমত পালন না করা হলে এর ব্যপ্তি চারিদিকে বেড়ে গেল। তারপর সরকার থেকে স্টেপ নেওয়া হল পুলিশি হস্তক্ষেপে হয়তো কিছুটা কমলেও কিন্তু তবুও লুকিয়ে জোরে জঙ্গলের মধ্যে মশারি টাঙিয়ে কেউ তাস খেলে কেউ আড়ালে চার-পাঁচজন গিয়ে গাঁজা টানে এইভাবে তারা সংক্রমিত হতে লাগল এবং নিজের সংক্রমিত হয়ে অন্যকে সংক্রমিত করল। এরূপ বড্ড ছোঁয়াচে একজনের হলেও সমাজের প্রত্যেকের হয়ে যাবে যে আসবে তার সংস্পর্শে আসবে প্রত্যেকের হবে তাই প্রথমেই এই রোগের নিয়ম হচ্ছে হাঁচি-কাশিতে ঢেকে রাখতে হবে এবং সেই ঢেকে রাখা না একা একা ঢাকনাওয়ালা বালতিতে ফেলতে হবে এবং কোনমতেই খোলা জায়গায় হাঁচি-কাশি করা যাবে না।। বার বার সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে দু ঘন্টা অন্তর অন্তর অথবা করতে হবে নিজের হাতকে এবং সরকার থেকে স্প্রে করে যে পাড়ায় যে কাজে নেমেছে তাও খুব প্রশংসার যোগ্য। মোটকথা প্রত্যেককে সচেতন হতে হবে এবং নিজে নিজে সচেতন হলেই তো প্রজ্ঞা অনেকটা প্রশমিত করা যায় কিন্তু সচেতনতা যতদিন না পারছে এই রোগ বাড়তেই থাকবে এবং মৃত্যুহারও বাড়তে থাকবে। মহারাষ্ট্র মুম্বাই কেরালা থেকে প্রচুর পরিযায়ী শ্রমিক বাংলায় প্রবেশ করছে বা অন্যান্য প্রদেশের প্রবেশ করছে এবং তাদের মধ্যে কিছু যৌন সংক্রমিত তাদের প্রথমে সে হাসপাতালে দেখা করতে হচ্ছে এবং হাসপাতালে টেস্ট করে তাদের পেপার দিলেই তবে তারা বাড়ি আসতে পারছে। পাড়ায় এসে যদি ধরা পড়ছে তখন রোগ ছড়িয়ে যাচ্ছে এবং গোষ্ঠী সংক্রমণের ভয় থাকে যাচ্ছে তাই বারবার সরকার থেকে ঘোষণা করা হচ্ছে পরিযায়ী যারা যারা বাইরে থেকে আসবে পরিযায়ী শ্রমিক তারা যেন প্রথমেই হাসপাতালে দেখা করে এবং হাসপাতালে নিজেদের পরীক্ষা করিয়ে তারপর বাড়িতে ঢুকে এতে কোনো বিপদ থাকবে না সুখে থাকতে পারবে বাড়িতে। লকডাউন এর ফলেই পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্ভোগের সীমা নেই। তারা কতদিন বাড়ি আসতে পারেনি। ফুটপাতে, রাস্তায্ পুকুরের পাড়ে তারা সময় কাটিয়েছে এবং কেউ পায়ে হেঁটে কাউকে কাঁধে করে তারা মাইলের পর মাইল হেঁটে গেছে। কিন্তু সরকারের তো কিছু করার নেই এখন তো লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। ট্রেন বাস সব বন্ধ আবার যদি ঘোষণা করা হয় তিনবার। সচল হবে তাহলে দেখা যাবে গোষ্ঠী সংক্রমণের ভয় বেড়ে যাচ্ছে উভয় সংকটের মধ্যে তবু কিছু ট্রেন চালু করা হলো পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য। সব প্রদেশেই শ্রমিকরা নিজের বাড়ি যেতে পারছে সরকার থেকে ট্রেন চালানোর ফলে। প্রথমে গিয়ে তারা হাসপাতালে দেখা করে নিজেদের পরীক্ষা করিয়ে তারপর সঠিক সিদ্ধান্তে তারা বাড়ি পৌঁছে যাচ্ছে এবং বাড়িতে গিয়ে নিশ্চিন্তে থাকতে পারছে। মানুষের সভ্য সমাজে চলাফেরা এখন অন্যরকম হয়ে গেল। মুখে মাক্স হাতে গ্লাভস আর জুতো পড়ে বাইরে বেরোতে হবে। সেই জামা প্যান্টের মত নিয়মিত পোশাক হয়ে গেল। তিন মাস পরে কিছু কিছু অফিস-আদালত খোলা হয়েছে থার্টি পার্সেন্ট লোক হয়তো কাজে যোগ দিচ্ছে। এবার ধীরে ধীরে সচল হচ্ছে পৃথিবী কিন্তু সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে যথেষ্ট। একটু অসাবধান হলেই কিন্তু বিপদ ওৎ পেতে। এখনো স্কুল খোলা হয়নি। স্কুলের ছোট ছোট কচিকাঁচারা যাতে রোগে আক্রান্ত না হয় সেই জন্য সরকারের সিদ্ধান্ত। ডাক্তার নার্স আর পুলিশরা নিজের জীবন বিপন্ন করে জনগনের সেবায় দিনরাত বাইরে কাজ করছে। সঠিক সাবধানতা অবলম্বন করে তারা মানুষ বাঁচানোর জন্য নিজেদের প্রাণ তুচ্ছ করে নিজেদের সংসার ছেড়ে বাইরে আছে। দিনের-পর-দিন মাসের-পর-মাস তাদের কত কষ্ট। তারা শান্তিতে ঘুমোতে পর্যন্ত পারছে না।
ছোটো থেকেই পড়তে ভালো লাগতো পড়ার বাইরের বই। বাবা, বড়দা বই এনে দিতেন প্রচুর।সংবাদপত্র আসতো নিয়মিত বাড়িতে। পড়ার একটা পরিবেশ গড়ে উঠেছিলো। ফলে লেখার ইচ্ছে হলো একদিন। স্কুলের ম্যাগাজিনে প্রথম লেখা। আমার প্রথম উপন্যাস ১৯৮৪ সালে লেখা। নামটা হলো, মিলনের পথে। জীবনের অনুভবের প্রয়োজন আছে নিশ্চয় লেখার জন্য। যে জীবন ব্যর্থ হয়নি, কষ্ট পায় নি, অভাব বোঝে নি সে জীবন তো মরুভূমি। সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ তো বলেই গিয়েছেন এ কথা। তাই সকল ব্যথার অনুভূতি থেকে উৎসারিত হয় লেখার আলো।
বাংলা ভাষাকে উন্নত করার জন্য, সর্বপ্রথম এই ভাষাকে জানতে হবে সঠিকভাবে। ভবিষ্যত প্রজন্মকে তার মাতৃভাষার প্রতি আগ্রহী করে তুলতে হবে। বাকিটা তাদের উপরেই ন্যস্ত থাক।
ইদানিং হৃদকথন, বাংলা ক্যানভাস, সংবাদ পত্রিকা, তথ্যকেন্দ্র, আরম্ভ, শব্দসাঁকো, অক্ষরসংলাপ, আলো, কাটোয়ার কথা, ধুলামন্দির, কৃতি এখন, ইসক্রা, কবি ও কবিতা, আমাদের কফি হাউস ও আরও বহু পত্র পত্রিকায় লিখি। বাংলা ক্যানভাসে শারদীয়া সংখ্যায় এবার একটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। নামটি হলো, মধু বাঁশির দেশ।
ভবিষ্যতে ফেসবুকের প্রয়োজনীয়তা বাড়বে বলেই মনে করি। ওয়েবজিনই ম্যাগাজিন ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছে পাঠকের কাছে। কবিতা ভালো লিখতে গেলে পড়াশুনার প্রয়োজন আছে। জয় গোস্বামীর গোঁসাইবাগান, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কবিতার বই ও আরও আধুনিক সব কবির কবিতা পড়া উচিত। একটা ভালো কবিতা পড়লে ভালো কবিতা লেখা যায়।
তবে একটা কথা বলি, কবিতা কিন্তু অনুভবের উপর নির্ভর করে। পড়াশোনা জানেন না এমন কবির সংখ্যা কম নয়। বলে কয়ে প্রেম হয় না আর চেষ্টা করে কবিতা হয় না। এটা প্রতিভার উপর নির্ভরশীল নয় শুধু। অনুভূতির মাধ্যমে কবিতা হয়ে যায় কখনও সখনও। কবির সংখ্যা কম। কবিতা লেখক বেশি।
লেখকের জীবনাভূতি অনন্য হওয়া চাই। পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়নের সঙ্গে পড়াশোনা করতে হয় ভালোবেসে। দায়সারা হলে ভালো লেখক হওয়া যায় না।
বর্তমানে আমি উপন্যাস লিখছি। দুটি উপন্যাস লেখার অনুরোধ এসেছে। এছাড়া গল্প, কবিতাও লিখছি সময় হলে। ভালো লেখার সংজ্ঞা বলা কঠিন। বাজাতে বাজাতে বায়েন, গাইতে গাইতে গায়েন। লেগে থাকতে হবে। লেগে থাকলেই হবে। ফেসবুকের লেখাই তো আধুনিক যুব সমাজ পড়ছে। তবে সব লেখা তো সফল মানের হয় না। এখন ফেসবুকে লিখে কিছু লাইক পেলেই কবি মনে করে নিজেকে। কিন্তু এত সহজ নয়। তাই লেখা চিনতে হবে। বেছে পড়তে হবে। সারাজীবন দশভূজার আদরে বাঁচি। প্রথম দশভূজা আমাদের মা। ছোট থেকে বড় করে সংসার গড়ে তুলে দেন আর এক দশভূজার হাতে। তিনি আমাদের সংসারের গৃহিণী।
ঘরে আমার ঝগড়া করার সাথী সকাল থেকে ঘটি বাটি আর রান্নাঘরের ঝুলে তার বকম বকম চলতেই থাকে। একা সব কষ্ট বাঁধে হৃদয়ে, ছেলে আর স্বামীকে পালঙ্কে বসায়। বসে বসে তারা দেখে কেমন করে চাঁদ ওঠে মাঝে অমাবস্যায় ভরে যায় দুপুর, তারা খসে পরে দুঃখের বাজার থেকে ঝুলিয়ে আনে আশার ঝুলি সব কাজ দশভূজার হাতে ভিড় করে আসে একে একে তারা ফোটে যখন, তখনও রান্নাঘরে খাওয়ার জোগাড়ে ব্যস্ত ঝগরাটে বউটা বাপের বাড়ি গেলে ঘরে আঁধার ঘনায়। আশার তারাগুলো ফুলের মত ঝরে পড়ে লেখার কথা মাথায় আসে না। স্বার্থপর এক অসহায় লোক, অধির হয়ে শুনি, গতকাল তার বলা অমৃত বাণী, আমাকে বাঁচিয়ে রাখে, আশার আলো দেখায়। ঝগড়াটে রোগা বউটা কষ্টগুলো জমিয়ে রাখে মনের সিন্দুকে। এখন দুজনে একটা জাহাজবাড়ি কিনেছি। কল্পনার জলে তরতরিয়ে ভাসে জাহাজ ঝগরাটে বউটা বলে, আমি গভীরতা মাপি তুমি আকাশ হও, আমি জাহাজের গতি মন্থর করি তুমি জীবনে আলো আনো অনেক প্রাণে আমরা কি জানি সমস্ত মনজুড়ে সারাজীবন আলো হয়ে থাকে আমাদের দুই দশভূজার আশীর্বাদ।
সাত
রাজু বিয়ে করার পর ভাবলো এবার তো চাকরি-বাকরি করতে হবে আর বাড়ি ফিরে যাওয়ার উপায় নেই। সেখানে গুরুদেব আছে সে কোন মতেই বাড়ি ঢুকতে দেবে না মাকে বশ করে নিয়েছে। সে বিধবা মায়ের আর কোন উপায় নেই সে গুরুদেবের কথামতো ওঠাবসা করে। রাজু আর শ্যামলী ঠিক করল তারা কেরালা যাবে। সেখানে গিয়ে প্রথমে তারা একটা ঘর ভাড়া করল। কিছু রান্নার সরঞ্জামাদি কিনল। একটা কাজ জুটিয়ে নিল রাজু। সোনার দোকানে। ভালোবাসায় চলে যাাচ্ছিলো তাদের জীবন। ধীরে ধীরে তারা সংসারের সমস্ত নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে নিল। সোনার দোকানের মালিক রাজুকে খুব ভালোবাসতো রাজুকাকা যে কোন পাখি ছিল না সে মন দিয়ে কাজ করতো। মালিকের সমস্ত কথাবার্তা শুনতো। যেন মালিক তাকে খুব ভালবাসত। এক্সট্রা টিফিনের পয়সা জমিয়ে রাখত শ্যামলীর জন্য। ছুটির দিনে শ্যামলীকে নিয়ে বাজার করতে যেত সেখানে এসে কিনে দিবো কাচের চুড়ি। কাচের চুড়ি পেয়ে আনন্দ আর সোহাগ উথলে পড়ত শ্যামলীর।রাজু বলল, আমি তো বেশি আয় করি না আমি তোমাকে সোনার গহনা দিতে পারব না শ্যামলী বলল, সোনার গহনা আমার প্রয়োজন নেই। এ কাচের চুড়ি আমার বেঁচে থাক সোহাগরূপে।
তারপর দুঃখ শোকে সবকিছু মিলিয়ে তারা বছর পাঁচেক কাটিয়ে দিল কিন্তু তারা কোন সন্তান এখনো পর্যন্ত নেয় নি। রাজু ভাবে বেশ কিছু পয়সা আয় করে বাড়ি ফিরে গিয়ে নিচে জায়গা কিনে ঘর করে তারপর সন্তান নেবে। শ্যামলী বলে তাই হবে। মানুষ ভাবে এক আর হয় আরেক মানুষের চিন্তাধারা সঙ্গে বাস্তব জগতের কোনো মিল নেই এখানেও তাই হল রাজু পড়ে গেল মহাবিপদে।
এক বিশাল যুদ্ধ বেধে গেল বিশ্বজুড়ে সে যুদ্ধ অস্ত্রের যুদ্ধ নয়। মারণ রোগ ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বময় তার নাম নাকি করো না রাজু বলল এই করোনা ভাইরাস পৃথিবীর সমস্ত প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে মানুষ মরে যাচ্ছে লাখে লাখে।
শ্যামলী বলল চলো আমরা আমাদের গ্রামে ফিরে যাই আমাদের গ্রামে ফিরে গেলে আমরা হয়তো এই রোগ থেকে রক্ষা পাবো। রাজু বলল আরো কিছুদিন থাকি দেখি পরিস্থিতি কি হয় ১২ এখন প্রধানমন্ত্রী ২১ দিনের লকডাউন ঘোষণা করেছে এখন তো যাওয়া যাবে না তাহলে কি করে কোন যানবাহন নেই কি করে যাবে স্বামী বলল আমরা প্রয়োজনে হেঁটে যাবো।
রাজু আর শ্যামলী দুজনেই উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেছিল কোন রকমে। তারা তাই সংবাদপত্রের সব খবর রাখে। তারা সংবাদপত্র পড়ে। আর বসে বসে ঘরে দিন কাটায়। রাজুকে এখন কাজ থেকে ছেড়ে দিয়েছে মালিক। ঘর ভাড়া দেওয়া খুব মুশকিল হয়ে যাবে। সামান্য কটা টাকা আছে সেই টাকা থেকে কিছু চাল-ডাল কিনে তারা ঘরে অপেক্ষায় বসে ঘরে বসে অপেক্ষা করতে লাগলো।
বাড়িওয়ালা দুর থেকে খবর নেন। বলেন, রাজু তুমি কি আর কাজে যাও না?
রাজু বলে,না মালিক আমাকে ছাড়িয়ে দিয়েছেন।
এই মুহূর্তে আমাদের বাইরে বেরোনো উচিত নয় মালিক বলেন, তোমার চিন্তা নেই ঘর ভাড়া লাগবে না। ঘর ভাড়া তোমাদের দিতে হবে না তোমরা কোনরকম এখন গ্রামের বাড়ি চলে যাও।
শ্যামলী বলে কাকু আমাদের আর এক সপ্তাহ থাকতে দিন তারপর আমরা ঘর ছেড়ে চলে যাব।
রাজু এই এক সপ্তাহ সময়ে তার লকডাউন এর দিনলিপি লিখে রাখে তার জীবনের খাতায়। সে দিনলিপি লেখে দিনরাত। শ্যামলী তাকে উৎসাহ দেয়। আজ রাজু লেখে, করোনা আতঙ্কে ২০২০ সালের ২২ শে মার্চ রবিবার প্রথম লক ডাউন ঘোষণা করলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদী। তারপর কিছু সময় কেনাকাটি, বাজার করার পরে টানা একত্রিশে মার্চ অবধি টানা লকডাউন শুরু হয়ে গেল। বেশিরভাগ মানুষ সচেতন কিন্তু অনেকেই বাহাদুরি করে বাইরে যাচ্ছেন। চীনদেশ, ইতালি এরাও প্রথমে গুরুত্ব না দেওয়ার ফলে করোনা ভাইরাস কোভিড ১৯ ছড়িয়ে পরে সারা পৃথিবীতে। পুলিশ, প্রশাসন কড়া হয়েছেন। কিছু পাবলিক লাথখোড়। তার কিছুতেই নিয়ম মানতে চাইছে না। মুরগির মাংস কিনতে, মাছ কিনতে, মদ খেতে, জুয়া খেলতে বেরিয়ে পড়ছে বাড়ির বাইরে। সোম, মঙ্গল, বুধ পেরিয়ে গেল। এখনও লকডাউন চলছে। কতদিন চলবে কেউ জানে না। আজ একটা খবরের কাগজে পড়লাম বর্তমান পরিস্থিতি বাংলার। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আলাদা করে তৈরি করা হচ্ছে ‘করোনা চিকিৎসা কেন্দ্র’। ৩ হাজার শয্যার করা হতে পারে এই চিকিৎসা কেন্দ্র। নোভেল করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের আলাদা আলাদা জায়গায় নয়, একই হাসপাতালে চিকিৎসা করা হবে। করোনা মোকাবিলায় নতুন এই সিদ্ধান্ত নিতে পারে রাজ্য সরকার। এখন সুপারস্পেশ্যালিটি ব্লকে ৩০০ শয্যা নিয়ে তৈরি করা হচ্ছে করোনা–আক্রান্ত এবং সন্দেহভাজনদের চিকিৎসা পরিষেবার ব্যবস্থা। স্বাস্থ্য ভবন সূত্রে খবর, গোটা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালকেই করোনার চিকিৎসার জন্য নির্দিষ্ট করে বিশেষভাবে প্রস্তুত করার উদ্যোগ নেওয়া হতে পারে। তবে এদিন বিকেল পর্যন্ত লিখিত কোনও নির্দেশিকা আসেনি। নির্দেশিকা দ্রুত জারি হবে বলে স্বাস্থ্য দপ্তর সূত্রে খবর। সম্পূর্ণ একটি হাসপাতাল যদি শুধুমাত্র করোনা চিকিৎসার জন্য করার ভাবনা–চিন্তা সত্যিই হয় তাহলে রাজ্যে এটি নজিরবিহীন হবে মনে করছেন চিকিৎসকেরা। সূত্রের খবর, সোমবার দুপুর থেকেই নতুন করে রোগী ভর্তি নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে কলকাতা মেডিক্যাল। এখন ৩০০ শয্যা নিয়ে তৈরি করা হচ্ছে করোনা–আক্রান্ত এবং সন্দেহভাজনদের চিকিৎসা কেন্দ্র। হাসপাতালের ৯ তলার যে সুপারস্পেশ্যালিটি ব্লক রয়েছে সেখানে দুটি তলা রাখা হচ্ছে করোনায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য। বাকি ৭টি তলায় করোনা সন্দেহভাজনদের চিকিৎসা করা হবে। নতুন হস্টেলও বর্তমানে ফাঁকা রয়েছে। এদিন মেডিক্যাল কলেজের সমস্ত বিভাগীয় প্রধানদের নিয়ে জরুরি বিভাগ ডাকা হয়। এই সপ্তাহেই সুপারস্পেশ্যালিটি ব্লকে এই পরিষেবা শুরু হয়ে যাবে বলে জানা গেছে। করোনা সংক্রান্ত সব ধরনের চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। কলকাতা মেডিক্যালের উপাধ্যক্ষ ডাঃ ইন্দ্রনীল বিশ্বাস জানিয়েছেন, ‘করোনা–আক্রান্ত বা সন্দেহভাজন রোগীর সংখ্যা বাড়লে আমাদের চিকিৎসা দিতে হবে। তাই নতুন রোগী ভর্তি নেওয়া কমাতে হবে। না হলে করোনা–আক্রান্ত রোগীদের জায়গা দেওয়া মুশকিল হবে। আপাতত ৩০০ শয্যার সুপারস্পেশ্যালিটি ব্লকে চিকিৎসা দেওয়া হবে। তবে শুধুমাত্র করোনা রোগীর চিকিৎসা হবে বলে গোটা হাসপাতাল খালি করতে হবে এরকম কোনও লিখিত নির্দেশনামা আমাদের কাছে এখনও আসেনি। যদি নির্দেশ আসে তখন সেইভাবে প্রস্তুতি নেওয়া হবে।’ এখন ২,২০০টি শয্যা রয়েছে মেডিক্যালে। সেটি বাড়িয়ে ৩,০০০ করার পরিকল্পনা। স্বাস্থ্য দপ্তরের নির্দেশিকা অনুযায়ী সব হাসপাতালেই পেডিয়াট্রিক, চেস্ট, কমিউনিটি ও জেনারেল মেডিসিন, ইএনটি এবং মাইক্রোবায়োলজিস্ট, ক্রিটিক্যাল কেয়ার স্পেশ্যালিস্টদের নিয়ে মেডিক্যাল বোর্ড করতে হবে। সেই অনুযায়ী এখানেও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা রয়েছেন। তবে এখন অন্য অনেক রোগী ভর্তি রয়েছেন যাঁদের চিকিৎসা চলছে এখানে। শয্যা খালি করার জন্য সেই চিকিৎসাধীন রোগীদের দ্রুত অন্য হাসপাতালে স্থানান্তরের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আজও অনেকে বাইরে বেরিয়েছে। কোন বিজ্ঞানসম্মত বারণ মানতে চাইছে না। যদি কাউকে মানা করা হচ্ছে সে তার উত্তরে খিল্লি করছে, হাসছে পাগলের মত। আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বাড়িতে বসে যতটা পারছি ফেসবুকে সাবধানতার পোষ্ট দিচ্ছি। কবিতা, গল্প পোষ্ট করছি। শীর্ষেন্দু বাবুর গল্পের লিঙ্ক পেয়েছি। গল্প পড়ছি। এখন পড়ছি, মনোজদের অদ্ভূত বাড়ি, গল্পটা। ছেলেটা মোবাইলে ব্যস্ত। মাঝে মাঝে বলছে, ভয়ঙ্কর অবস্থা, কি হবে বাবা? ওর মা ছেলেকে বকছেন, টেনশন করবি না। সাবধানে থাকবি। হাত, মুখ সাবান দিয়ে ধুবি। চান করবি। তাহলে কিছুই হবে না। বাড়িতে বসে বসে পড়। বাইরে একদম বেরোবি না। ছেলে খুব সচেতন। সে মা কে বলে, মা তুমি কিন্তু হাত কম ধুচ্ছ। রান্না করার আগে হাত ধোও সাবান জলে। আমি জানি, আমাদের এইটুকুই জ্ঞান। আর বেশি কিছু জানি না। তবে বাবা বলতেন, সাবধানের মার নেই। পাশের বাড়িতে জমি জায়গা নিয়ে ঝগড়া চলছে এক চাষীর। চাষী তার গরু উঠিয়ে আল ভেঙ্গে দেয়। আমি জানলা থেকে মুখ বাড়িয়ে থামতে বললাম, বেঁচে থাকলে অনেক বাড়ি হতে পারে। এখন ঝগড়া করার সময় নয়। একজন আমাকে মেসেঞ্জার বক্সে একটা ভিডিও পাঠিয়েছিল। আমার কথা বলা হয়নি তার সঙ্গে। তাই সে রেগে আমাকে ব্লক করে দিল। সব ঝগড়ার সূত্র সেই ভুল বোঝাবুঝি। যাইহোক মেসেঞ্জার কয়েকদিনের জন্য আনইন্সটল করে দিলাম। এখন একটাই চিন্তা পৃথিবীর এই কঠিন রোগ। ভাইরাস আ্যাটাকে সারা বিশ্ব রোগগ্রস্ত। এখন দূরে দূরে থাকার সময়। দূরে থাকলে বাঁচব আর একত্রে সমাবেশ করলে মরব। ভাইরাস মানুষের হাতে হাতে ছড়িয়ে যাচ্ছে চেনের মত। এই চেনকে ভাঙ্গার জন্য লকডাউন।
প্রকৃতি শুদ্ধ হচ্ছে। লকডাউন করার ফলে দূষণ কমছে ব্যাপকহারে। এবার প্রধানমন্ত্রী একুশ দিনের লক ডাউন ঘোষণা করলেন। সচেতনতা প্রয়োজন মানুষের। গ্রামে গঞ্জে কেরালা, মুম্বাই থেকে কাজ করে ফেরা লোকগুলো যত্রতত্র ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ফলে সংক্রমণ ক্রমশ উর্ধ্বমুখি। আমলা থেকে সাধারণ মানুষের ছেলেপুলে সব একই অবস্থা। রাস্তায় বেরিয়ে সেলফি তুলছে। প্রশাসন কঠোরভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু কিছু করার নেই। মানুষের চেতনা জাগ্রত না হলে ধ্বংস হবে সভ্যতা। এখন বাংলায় বসন্তকাল চলছে। পাখি ডাকছে, ফুল ফুটছে। পাখিরা পশুরা উন্মুক্ত আকাশের নিচে আর মানুষ ঘরবন্দি। মানুষ শক্তিশালী প্রাণী। কিন্তু প্রকৃতির বিচার নিরপেক্ষ। তাই আজ উল্টোচিত্র। প্রকৃতি কি হাসছে। জানি না তবু এটুকু বলতে পারি, ভাবার সময় এসেছে। কল কারখানা, ধোঁয়া আবর্জনায় পৃথিবী কলুষিত। তাই আজ এই প্রতিশোধ।চারিদিক নিস্তব্ধ। খাওয়া আর ঘুমানো ছাড়া কোন কাজ নেই। বাজার করা, মাছ কেনা, স্কুল যাওয়া সব বন্ধ। একটা কোকিল গান শুনিয়ে চলেছে। ফিঙেটা ইলেকট্রিক তারে বসে ডাকছে। ওরা মানুষের মত স্বার্থপর নয়। তাই হয়ত গান শুনিয়ে চলেছে এই দুর্দিনে। আজকের খবরে শুনলাম, করোনাভাইরাসের জেরে ধাক্কা লেগেছে অর্থনীতিতে। লকডাউনের জেরে উৎপাদন বন্ধ হয়েছে ছোট থেকে বড় সংস্থায়। এই পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়াতে এগিয়ে এসে তহবিল ঘোষণা করল দেশের বৃহত্তম রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া (এসবিআই)।
এসবিআই সূত্রে খবর, চলতি ২০১৯–২০ আর্থিক বছরে মুনাফার ০.২৫ শতাংশ কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা খাতে করোনা প্রাদুর্ভাবের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ব্যয় করা হবে। কেন্দ্রীয় সরকার প্রতিটি বৃহত্তম সংস্থাকে নিজেদের কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা খাত থেকে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে ব্যয় করার পরামর্শ দেয় কিছুদিন আগে। এবার তা পালন করতে চলল এসবিআই।
এসবিআইয়ের চেয়ারম্যান রজনীশ কুমার জানান, ‘এই তহবিলটি মূলত স্বাস্থ্য পরিষেবার সঙ্গে জড়িত। দরিদ্র মানুষের চিকিৎসা সংক্রান্ত খাতে ব্যবহার করা হবে। এসবিআই ভারতে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একটি বৃহত্তর পদক্ষেপ নিয়েছে। এই তহবিলটি মূলত সুবিধা থেকে বঞ্চিত মানুষকে স্বাস্থ্যপরিষেবা পৌঁছে দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত হবে।’
তিনি অন্যান্য কর্পোরেট সংস্থার কাছেও এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে টুইটারে লিখেছেন, গোটা দেশ একটা কঠিন সময়ের মধ্যে যাচ্ছে। মানুষের চরম আর্থিক সংকটের মধ্যে পড়েছেন। সতর্কতামূলক এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি দেশবাসীকে উদারভাবে সহযোগিতা করার আহ্বান জানাই।ভরসা পেলাম। খাবারের জোগানও অব্যাহত থাকবে। রাজ্যসরকার থেকে দিন আনা দিন খাওয়া লোকেদের জন্য সাহায্যের ব্যবস্থাও করা হয়েছে। সরকার সবদিক ভাবছেন। মানুষই একমাত্র মানুষকে বাঁচাতে পারে। ডাক্তার, নার্স, আয়া, পুলিশ সকলে জীবনকে বাজি রেখে মানুষ তথা পৃথিবীকে বাঁচানোর কাজে লেগে পড়েছেন। এ এক আশার কথা। ভালো লাগছে এই কথা ভেবে যে সকলে রাজনৈতিক জীবনের উর্ধে উঠে মনেপ্রাণে এক হয়ে কাজ করছে। এই অপূর্ব মিলনের বার্তা একমাত্র ভারতবর্ষ দিতে পারে। সকলে তাকিয়ে আছে আমাদের দেশের দিকে। সারা পৃথিবী মিলিত হোক মানবতার মহান জগতে। পৃথিবী ভাল থেক। পৃথবী নিরোগ হও।আজ একটা সংবাদপত্রে পড়লাম, করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়া নিয়ে এবার সরাসরি চীনের দিকে আঙুল তুলল আমেরিকা। আর এই আঙুল তুলেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। আগাম বিপদ সম্পর্কে চীন সতর্ক করলে এই পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হতো না। বেজিংকে সরাসরি এই ভাষাতেই বিঁধলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এমনকী তিনি এই বিষয়ে সামান্য বিরক্ত বলেও মন্তব্য করেছেন। আমেরিকার চিকিৎসকদের সেখানে পরিদর্শনে যেতে দেওয়া হয়নি বলেও অভিযোগ করেছেন ট্রাম্প।এদিকে ট্রাম্প প্রশাসন দেশের যে তিনটি জায়গাকে সংক্রমণের আঁতুড়ঘর হিসেবে চিহ্নিত করতে পেরেছে, সেগুলো হল নিউ ইয়র্ক, ক্যালিফোর্নিয়া এবং ওয়াশিংটন। তালিকার প্রথমেই আছে নিউ ইয়র্ক। সেখানে ১৫ হাজার নিশ্চিত সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। তার মধ্যে ৫৪১৮টি সংক্রমণ ঘটেছে গত ২৪ ঘণ্টায়। এখনও পর্যন্ত ১১৪ জন মারা গিয়েছেন। একদিনেই প্রাণ গেছে ৫৮ জনের। গোটা আমেরিকায় করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ৩৫ হাজারের বেশি। মারা গিয়েছেন সাড়ে চারশো।আমি ভাবি দেশের কথা, পৃথিবীর কথা।এখন দোষারোপের কথা বাদ দিয়ে পৃথিবীকে বাঁচাই। সকলের সমবেত চেষ্টায় রোগমুক্তি ঘটুক পৃথিবীর। কারাবাসে যেমন বন্দি থাকা হয় এই গৃহাবাস কিন্তু ততটা বিরক্তিকর নয়। সংসারের মাঝে থেকে একটু একা একা থাকা। একটু রামকৃষ্ণ পড়ি, একটু রবীন্দ্রনাথ পড়ি, একটু জীবনানন্দ বা বিভূতিভূষণ পড়ি। সময় কেটে যাবে আরামসে। দেরাজে রাখা বইগুলো একটু পরিষ্কার করে রাখি। রান্নায় সাহায্য করি স্ত্রীকে। দূরে থেকে সকলকে বাঁচিয়ে চলতে পারলেই জীবনের খোঁজ পাওয়া যাবে। "অসদো মা সদগময়, ত্বমসো মা জ্যোতির্গময় " এই মন্ত্রে এগিয়ে চলি নিশ্চিন্তে।আবার খবরের কাগজে দেখলাম কি মারাত্মক পরিস্থিতি সারা বিশ্বের। নাকানিচোবানি খাচ্ছে গোটা দুনিয়া। প্রায় সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়েছে করোনাভাইরাস। মারণ ভাইরাস সংক্রমণে বিশ্বে মৃত ১৭,২৩৫ জন। এ–পর্যন্ত মোট আক্রান্ত ৩,৯৫,৮১২। ইতালি এখন মৃত্যুভূমি। গত ২৪ ঘণ্টায় সেখানে ৬০২ জনের মৃত্যু হয়েছে। সব মিলিয়ে ইতালিতে এখনও পর্যন্ত মৃত ৬,০৭৮। আক্রান্ত ৬৩, ৯২৭। ইতালির লম্বার্ডির অবস্থা ভয়াবহ। ইতালির মোট মৃতের প্রায় অর্ধেক লম্বার্ডির বাসিন্দা। সেখানে মৃত্যু হয়েছে ৩,৭৭৬ জনের, আক্রান্ত ২৮,৭৬১। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, লকডাউনের সিদ্ধান্ত নিতে দেরির কারণেই ইতালির এই অবস্থা। শুধু প্রবীণদেরই নয়, ইতালিতে ৩০–৪০ বছরের কোঠায় যাদের বয়স, তাদের কাবু করছে করোনা। নাজেহাল গ্রেট ব্রিটেন, ফ্রান্স, স্পেন— সব দেশেই। স্পেনের অবস্থা এখন ভয়াবহ। গত ২৪ ঘণ্টায় সেখানে মারা গেছেন ৫১৪ জন। মোট মৃত ২,৬৯৬। আক্রান্ত ৩৯,৬৩৭। মৃতদেহ রাখার জায়গা অমিল। অনেক জায়গায় বাড়িতেই পড়ে আছে মরদেহ। স্বাস্থ্যকর্মীরা জানান, মৃতদেহ হিমঘরে রাখা যায়, কিন্তু করোনায় মৃত্যু শুনলে কেউ মৃতদেহ স্পর্শ করছে না। অন্ত্যেষ্টির কাজে নিযুক্ত কর্মীরা পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন। অবস্থা মোকাবিলায় নেমেছে সেনাবাহিনী।ওদিকে ফ্রান্সও নাজেহাল। সেখানে মৃত ৮৬০, আক্রান্ত ১৯,৮৫৬। রাজধানী প্যারিসের রাস্তা এখন খাঁ খাঁ করছে। প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ। কাফে, রেস্তরার ঝাঁপ বন্ধ। লোকজনের দেখা নেই। নিঃশ্বাস ফেলতেও যেন ভয়। কে জানে কখন ভাইরাস ঢুকে পড়ে শরীরে! আতঙ্কে মানুষ ঘরবন্দি। ব্রিটেনেও ক্রমেই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে পরিস্থিতি। সেখানে মৃত ৩৩৫। আক্রান্ত ৬,৬৫০। প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন দেশে তিন সপ্তাহ লকডাউনের ঘোষণা করেছেন। দেশবাসীকে ঘরবন্দি থাকতে বলেছেন। দু’জনের বেশি জমায়েত নিষিদ্ধ। আমোদপ্রমোদের জন্য সপ্তাহ শেষে কেউ পার্ক বা অন্য কোথাও জড়ো হলে নেওয়া হবে কড়া ব্যবস্থা। ওষুধ আর অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের দোকান খোলা। বাকি সব বন্ধ। বিয়ে আর ব্যাপটাইজেশনও বন্ধ থাকবে।
এদিকে কানাডায় করোনায় মৃত ২০। আক্রান্ত ১,৪৭৪। সংক্রমণ মোকাবিলায় ৩৪০ কোটি ডলার বরাদ্দ করেছে কানাডা সরকার। সংক্রমণ এড়াতে সকলকেই ঘরবন্দি থাকতে বলছেন। কিন্তু কেউ কেউ আইসোলেশনের তোয়াক্কা করছেন না। তাতেই চটেছেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। বলেন, ‘অনলাইনে আমরা অনেক লোকজনের ছবি দেখছি। তঁারা ভাবছেন তঁাদের কেউ দেখতে পাচ্ছেন না। ভাল, তবে আপনাদের দেখা যাচ্ছে। যথেষ্ট হয়েছে। বাড়িতে যান, ঘরেই থাকুন। আমরা নিয়ম মানতে বাধ্য করব। তা লোকজনকে সচেতন করেই হোক বা জোর করেই হোক।’
আমেরিকায় উদ্বেগ তুঙ্গে। মৃত ৫৮২ জন। এ অবস্থায় লক ডাউনে থেকে করোনার চেন ভাঙ্গতে হবে। অন্য কোন উপায় নেই। গ্রাম থেকে শহরের প্রত্যেকটি মানুষকে সচেতন হতে হবে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে করোনা মোকাবিলায় কলকাতা পৌরসভার উদ্যোগে জোর কদমে চলছে শহর স্যানিটাইজ করার কাজ। কিভাবে গাড়ি করে সকলের বাড়ির সামনে এসে নিঃশব্দে কাজ করে চলেছে সুন্দর।
বাড়িতে যথেষ্ট খাবার মজুত নেই। ছাড় দেওয়া আছে মুদিখানা, সব্জিবাজারকে। একজন করে পরিবার পিছু ভিড় না করে বাজার করা নিয়ম। কিন্তু এটা একশ চল্লিশ কোটির দেশ। ভিড় হয়ে যাচ্ছে যেখানে সেখানে। পুলিশের টহল চলছে। আমার স্ত্রী পাড়ার দোকান থেকে চাল, ডাল কিনে আনলেন। আমরা তিনজন। গ্রামের বাড়িতে অন্যান্য সদস্যরা আছেন। তাদের খবর রাখছি মোবাইল ফোনে, হোয়াটস আ্যপে। তাছাড়া উপায় নেই।এক একজন ধনীলোক প্রচুর খাবার মজুত করছেন বাড়িতে। এর ফলে খাবারের অভাব হতে পারে। এক সব্জীব্যবসায়ী বললেন, যার দরকার আড়াইশ আদা তিনি নিয়ে নিচ্ছেন আড়াই কেজি। চড়া দাম দিতে তারা প্রস্তুত। এ এক অদ্ভূত মানসিকতা। তারা বলছেন, নিজে বাঁচলে বাপের নাম থাকবে। তবু সবাইকে নিয়ে চলতে হয়। জীবনের চরম মুহূর্তের কথা তারা ভুলে যায়। কত রাজার ধনে মরচে পরেছে ইয়ত্তা নেই। শিক্ষা নিতে হয় অতীতের কাছে। আমার পাশের বাড়ির সকলেই কিছু খাবার কিনলেন। একুশ দিন যাওয়ার মত। কম খেতে হবে। প্রকৃতি তার হারানো ছন্দ খুঁজে পাচ্ছে জেনে আনন্দ হল। পাঁচশ বছর আগে পৃথিবীর জলবায়ু যেমন ছিলো সেরকম হতে চলেছে পৃথিবী। প্রকৃতি সব দিক দিয়ে মারেন না। একদিক ভাঙ্গলে আর একদিক গড়ে দেয়। আশার অনেক কিছু আছে। "আশায় বাঁচে চাষা। "
আমার স্ত্রী বাজারে গেছিলেন আজ। দোকানে দড়ি দিয়ে মেপে এক মিটার দূরে ইঁট পাতা আছে।লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন গ্রাহকরা। পুলিশ পর্যবেক্ষণ করছেন বাজার, রাস্তা। জরুরি অবস্থায় সকলে চিন্তিত। কি করে একুশ দিন কাটবে। কাটবে ঠিকই। আবার ফুটবে ফুল। আবার হাসবে শিশু পৃথিবী।
আজ ঘুম থেকে একটু দেরি করে উঠলাম। এখন সকাল নয়টা বাজে ঘড়িতে। চা মুড়ি আর প্রেশারের ওষুধটা খেলাম। সাবান দিয়ে হাত ধুয়েছি অবশ্যই। খবরের কাগজ পেলাম। হেডিং -ভালবাসার দেশ কিউবা।
করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাহায্য করতে ইতালিতে একটি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদল পাঠিয়েছে কিউবা। দেশটি জানিয়েছে, ইতালির অনুরোধে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও নার্সের একটি ব্রিগেড রওনা হয়ে গেছে। করোনায় জর্জরিত ইতালির লমবার্দি অঞ্চলে কাজ করবে তারা। ১৯৫৯ সালে কমিউনিস্ট বিপ্লবের পর থেকেই বিশ্বজুড়ে বিশেষ করে দরিদ্র দেশগুলোর দুর্যোগ মোকাবেলায় কমিউনিস্টশাসিত কিউবা প্রায়ই তাদের ‘সাদা পোশাকের বাহিনী’ পাঠিয়ে আসছে। এর আগে হাইতিতে কলেরা এবং পশ্চিম আফ্রিকায় ইবোলার বিরুদ্ধে লড়াইয়েও দেশটির চিকিৎসকরা সামনের কাতারে ছিলেন। এবারই প্রথম কিউবা বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশ ইতালিতে ৫২ সদস্যের শক্তিশালী একটি দল পাঠাচ্ছে; যার মাধ্যমে দেশটি তাদের ‘চিকিৎসা কূটনীতির’ বড় ধরনের নজিরও স্থাপন করতে যাচ্ছে। নভেল করোনাভাইরাস মোকাবেলায় এ নিয়ে কিউবার ষষ্ঠ মেডিকেল ব্রিগেড অন্য কোনো দেশের উদ্দেশে রওনা হলো। দেশটি এর আগে তাদের সমাজতান্ত্রিক মিত্র ভেনিজুয়েলা, নিকারাগুয়ার পাশাপাশি জ্যামাইকা, সুরিনাম ও গ্রেনাদাতেও চিকিৎসকদল পাঠিয়েছে। শনিবার ইতালির উদ্দেশে রওনা হওয়ার আগে চিকিৎসকদলের সদস্য ৬৮ বছর বয়সী লিওনার্দো ফার্নান্দেজ বলেন, ‘আমরা সবাই বেশ ভীত, কিন্তু আমাদের বিপ্লবী দায়িত্ব আছে, তাই আমরা আমাদের ভয়কে একপাশে সরিয়ে রেখেছি।
আট
এদিকে চিনের অবস্থাও ভাল নয়। আমার কাটোয়া শহরে করোনা আক্রান্ত রোগী এখনও অবধি একটাও পাওয়া যায়নি। পুলিশ তৎপর আছে। বাইরে বেরোলেই পিটুনি খাচ্ছে আনাড়ির দল। ঘরে বসে ছেলেটা বই পড়ছে। আরণ্যক।আমিও মাঝে মাঝে পুরোনো স্মৃতি ঝালিয়ে নিচ্ছি। শীতের পোশাকগুলো গুছিয়ে রাখলাম। বসন্ত কেমন ম্লান হয়ে রয়েছে। একটা সবুজ ছোট্ট পাখি শিউলি গাছে বসে আছে। স্ত্রী রুটি বেলছে। জলখাবারের জন্য। এতদিন তো ঘরে বসে থাকার সুযোগ পাই না। বেশ লাগছে সপরিবারে একসঙ্গে থেকে। দোকানপাট যা করার লকডাউনের আগেই করা হয়েছে। সরকার থেকে খাবার বিতরণের কাজ শুরু হবে। ভবঘুরের দল ব্লক অফিস আর স্কুলগুলোতে ঠাঁই পেয়েছে। দুদিনের ঘর। তারপর তাদের ঘর ছেড়ে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়াতে হবে।
প্রতি বছর রথ যাত্রার ঠিক আগে ভগবান জগন্নাথ স্বয়ং অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁর জ্বর এবং সর্দি কাশি হয়; অসুস্থতার এমন পরিস্থিতিতে তাঁকে Quarantine করা হয় যেটাকে মন্দিরের ভাষায় অনাসর বলে। ভগবানকে ১৪ দিন পর্যন্ত একা বাস মানে isolation এ রাখা হয়। হ্যাঁ, ঠিক ১৪ দিন। এই সময় ভগবানের দর্শন বন্ধ থাকে এবং ভগবানকে জড়িবুটি আর জল খাবার দেওয়া হয় মানে Patients Diet, আর এই পরম্পরা হাজারাে বছর থেকে চলে আসছে।আর এখন ২০ শতাব্দীতেও বলা হলো isolation & Quarantine এর সময় ১৪ দিন! আগের সেই বিজ্ঞান ভিত্তিক জীবন কৌশল যা আজও বিশ্বকে পথ দেখাচ্ছে!..১৪ দিন জগতের প্রভু জগন্নাথ যদি মানেন Isolation / Quarantine / light diet আমাদের কেন তা মানায় অসুবিধা? ভগবানকে মেনে, চাহিদা কমিয়ে এই ক'দিন আমরা তাঁর দেখানো পথে একটু চলিইনা! কিন্তু কিছু লোক আড়ালে মশারি টাঙিয়ে তাস খেলছে। জুয়ো খেলছে। কোন আইন মানতে চাইছে না। একজন মহাপুরুষ বলেছিলেন, আমাদের দেশে কম করে দুবছর মিলিটারি শাসনের প্রয়োজন আছে। তার কথাই ঠিক। তবে যদি এরা কিছু নিয়ম শেখে তাহলে দেশের দশের উপকার।
ভারতবর্ষ ত্যাগের দেশ। আজ খবরে জানলাম, শিক্ষকরা যে যেমন পারছেন দান করছেন। এক শিখ মহাজন কয়েকলক্ষ টাকা দান করেছেন পাঞ্জাবের পিড়িতদের জন্যে। বাংলায় এক গ্রামের ধনী কয়েকলক্ষ টাকা দান করলেন পিড়িতদের কল্যাণে। খবরে প্রকাশ, রাজ্যে আক্রান্ত বেড়ে ১০। কলকাতার নয়াবাদের এক প্রৌঢ়ের শরীরে মিলল করোনার নমুনা। আশঙ্কা, কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের।
গত ২৪ ঘণ্টায় রাজ্যে একটিও করোনা আক্রান্তের সংবাদ না আসায় একটু স্বস্তিতে ছিল বাংলার মানুষ। কিন্তু বুধবার রাতেই সেই স্বস্তিতে জল পড়ল। ৬৬ বছরের ওই বৃদ্ধ সোমবার হাসপাতালে ভর্তি হন। বুধবার রাতে রিপোর্ট মেলে। তাঁর বিদেশ ভ্রমণের কোনও খবর এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তাঁর পরিবারের কেউ সম্প্রতি দেশের বাইরে গিয়েছিলেন বলেও জানা যায়নি। রাজ্যে আশঙ্কা বাড়ল। এটি তৃতীয় পর্যায়ের শুরু কিনা ভেবে। এখনও পর্যন্ত কোনও সিদ্ধান্তে আসা যাচ্ছে না। জিজ্ঞাসাবাদ চলবে বলে সূত্রের খবর।
একের পর এক বাড়তেই থাকবে নাকি রোগীর সংখ্যা। কিছু বোঝা যাচ্ছে না। পরিস্থিতির উপর নজর রাখছি ঘরে থেকে।
আমি কাটোয়া পৌরসভার কুড়ি নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা। পৌরসভা থেকে বারবার মাইকিং করা হচ্ছে। সবরকম সাহায্য করার পাশাপাশি সচেতনাতামূলক প্রচারও চলছে। কাটোয়া পৌরসভা, কাটোয়া হাসপাতাল, পুলিশ ও প্রশাসন সবাই নিজেদের সাধ্যমতো চেষ্টা চালাচ্ছেন যাতে করোনা মহামারী রুখে দেওয়া যায়।মাইকে ঘোষণা হচ্ছে, কাটোয়ার সর্বস্তরের জনসাধারণ আমাদের যে ভাবে সাহায্য করছেন তাতে আমরা আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। এতো দিন গৃহবন্দী থাকা যথেষ্ট কষ্টকর এটা আমরা বুঝি। কিন্তু এই মারনব্যাধি থেকে মানবসভ্যতাকে রক্ষা করার এটাই এক ও একমাত্র উপায়।আপনাদের প্রতি আমাদের বিনীত আবেদন - বাজার করা অথবা মুদি / রেশন / ওষুধের দোকানে কিছু কিনতে যাবার সময় প্রত্যেকে প্রত্যেকের থেকে অন্তত ৬ (ছয়) ফুট দুরত্ব বজায় রাখুন। খুব প্রয়োজন না থাকলে বাড়ির বাইরে বেরোবেন না। অন্যথায়, অন্যের থেকে সংক্রমন আপনার তথা আপনার প্রিয়জনের মধ্যে ছড়াতে বেশি সময় নেবে না। রাস্তায় একসাথে জড়ো হবেন না। ডাক্তারবাবুর পরামর্শ ছাড়া ওষুধ খাবেন না। সর্বোপরি, নিজে সুস্থ থাকুন, নিজের পরিবারকে ভালো রাখুন তাহলেই সমাজ ব্যাপকার্থে মানব সভ্যতা রক্ষা পাবে।
কেউ শুনছে কেউবা শুনছে না। মাছ, মাংস খাওয়ার লোভে অনেকে বেরিয়ে পড়ছেন বাইরে। এটা সংযমের সময়। সংযত হয়ে চলার সময়। এটা ভাবতে পারলেই সমস্যার সমাধান হয়।
আজ খবরে পড়লাম আবার একই বিষয়ে। করোনা। করোনা। করোনা। খবরের কাগজ আর ফেসবুকের খবর ছাড়া বাইরে বেরিয়ে খবর নেওয়া উচিত নয়। তাহলে এত পরিশ্রম বৃথা যাবে। আজকের খবরে প্রকাশ, ইতিমধ্যেই করোনা আতঙ্কে জেরবার দেশের মানুষ। করোনা আতঙ্ককে সাথে নিয়ে দেশের পরিস্থিতি রীতিমতো উদ্বেগজনক। সারা দেশবাসীর কাছে এখন একটাই লক্ষ্য, কিভাবে করোনার হাত থেকে পরিত্রাণ পাবেন তাঁরা? দেশের প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা একযোগে করোনার সংক্রমণকে মহামারী হওয়া থেকে আটকাতে শুরু করেছে লকডাউন। সরকারিভাবে নোটিশ জারি করা হয়েছে এই মুহূর্তে দেশের কেউ যেন কোন রকম জমায়েতে শামিল না হন।
করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হয়েছিল চীন থেকে। সেখান থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে যায়। যার মধ্যে ভারত অন্যতম। অন্যদিকে, এই মুহূর্তে বিজ্ঞানীরা আশার কথা শোনাচ্ছেন ভারতকে নিয়ে। এই মুহূর্তে একদিক দিয়ে যেমন ভারতে করোনা সংক্রমণ বাড়ছে, সেরকম অন্যদিক দিয়ে করোনায় আক্রান্ত হয়েও সুস্থ হয়ে উঠছেন বেশ কিছু জন। যদিও সে সংখ্যা আক্রান্তের তুলনায় অত্যন্ত কম। কিন্তু তা সত্বেও সুস্থ হওয়ার খবর নিঃসন্দেহে খুশির বলেই মনে করা হচ্ছে।
এখনো পর্যন্ত ভারতে 37 জন সুস্থ হয়ে উঠেছেন বলে স্বাস্থ্যমহল সূত্রে জানা গেছে। ভারতে আক্রান্ত হয়েছেন 492 জন। তার মধ্যে মারা গেছেন এখনো পর্যন্ত ন জন। করোনা সংক্রমণের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া 37 জনের মধ্যে 11 জন ইতালীয় পর্যটক রয়েছেন। যাঁদের সুস্থ হওয়ার পর ইতালীয় দূতাবাসের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। অন্যদিকে, চীনের পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে বলে খবর। তবে সাংবাদিক সূত্রে জানা গেছে, করোনা সংক্রমণ এর মধ্য দিয়ে চিনে আসিম্পটোমেটিক রোগী ধরা পড়ছে। নাও ঠেলা। এক রোগে নিস্তার নেই আবার শঙ্করাকে ডাকে। অন্য আর একটি রোগ যেটি ইঁদুরবাহিত ক্রমশ ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়ছে জানালো চিন সরকার।
আজকে একটা ভাল খবর শুনলাম, নবান্নে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী জানান, শহরের একাকী থাকা বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের যাতে কোন অসুবিধা না হয় সে খেয়াল আমাদেরকেই রাখতে হবে। কোন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা খেতে পারছে না বা প্রয়োজনীয় ওষুধ পাচ্ছে না জানতে পারলে সেই হাউসিং কম্প্লেক্সকে তিনি সঙ্গে সঙ্গে জেলাশাসক মহকুমা শাসক বা পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করার আবেদন জানান। প্রশাসন প্রয়োজনীয় চাল ডাল থেকে শুরু করে ওষুধ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছে পৌঁছে দেবেন। পাশাপাশি এই পরিস্থিতিতে সকলকে মানবিক থাকার অনুরোধ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। জানিয়েছেন, “কারোর জ্বর হলে তাকে সামাজিকভাবে বয়কট করবেন না। প্রয়োজনে স্থানীয় থানায় খবর দিন পুলিশ অসুস্থ ব্যক্তির চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে”অন্যদিকে ভবঘুরেদের উদ্দেশ্যে নাইট শেল্টারে তাদের থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। সেই ভবঘুরেদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন তারা যেন কর্পোরেশনের স্কুল এবং কমিউনিটি হল গুলোতে যেখানে ব্যবস্থা করা হয়েছে সেখানে থাকেন। খাবারের ব্যবস্থা পুলিশ এবং কর্পোরেশগুলি, করে দেবে। শুনে মনটা একটু হাল্কা হল। কত অসহায় ভবঘুরে পাগল মানুষ থাকে রাস্তায়। তারাও ভাল থাকুক। ভাল থাকুক ভালবাসা। রাস্তায় যখন যেতাম এই রোগ আসার আগে। তখন দেখতাম কত গোসাপ, সাপ, শেয়াল, কুকুর চাপা পড়ে মরে আছে মানুষের দাপাদাপিতে। এখন আর তারা চাপা পড়বে না একুশ দিন। শান্তিতে ঘুরতে পারবে। আমরা ভুলে যাই তারাও এ পৃথিবীর অংশিদার। তাদের ঠকিয়েছি আমরা। তার মাশুল গুণছে মানুষ।
ক্রিকেটার সৌরভ থেকে আমজনতার অনেকেই মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে দান করছেন অভুক্ত মানুষের কথা ভেবে। সব স্তরের মানুষ মিলেমিশে এক হয়ে গেছে। জ্বালা যন্ত্রণা অত্যাচার বেড়ে গেলে ফিরে ফিরে আসে সমোচ্চশীলতার ধর্ম। সে যে রূপেই হোক। কখন রোগ মহামারী বা প্রলয়। তার বিচারের কাছে গরীব ধনী নেই। তার বিচারের কাছে শিক্ষিত অশিক্ষিত নেই। সব সমান করে নবরূপে তৈরি করেন প্রকৃতির প্রতিমা। আজকে একটা খবর পড়লাম, করোনা ভাইরাসের কারনে পৃথিবীর প্রায় ৭৫% ছোট বড় ইন্ডাস্ট্রিজ বন্ধ হয়েছে। আকাশ পথে বিমান চলাচল বন্ধ হয়েছে। পৃথিবীর প্রায় ৮০% যানবহন চলাচল বন্ধ হয়েছে।ভারী অস্ত্রের মহড়া বন্ধ হয়েছে। পৃথিবীজুড়ে লকডাউন আইনের কারনে মানব সৃষ্ট দূষণ বন্ধ হয়েছে।হাঁচি, কাশি ঠান্ডাজনিত রোগ থেকে দুরে থাকতে সবাই এয়ার কন্ডিশন চালানো বন্ধ রেখেছে। করোনা থেকে বাচঁতে নিজের শরীর থেকে শুরু করে বাড়ির আশে পাশের আঙ্গিনা পরিষ্কার রাখছে। যত্রতত্র বিশেষ করে পলিথিন বা প্লাস্টিকের ব্যবহার কমে এসেছে।এ সব কিছুর ফলে নাসার দেয়া তথ্যমতে পৃথিবীজুড়ে নাইট্রোজেন গ্যাস ও কার্বন এমিশনের মাত্রা ২৫% কমে এসেছে।
ফলে প্রকৃতি তার নতুনরূপে সাজতে বসেছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা কমে এসেছে। গ্রীনল্যান্ড ও এন্টার্কটিকায় গলে যাওয়া বরফ আবার জমতে শুরু করেছে।যেখানে নিজের ঘরের মানুষকে আটকিয়ে রাখা যায় না। সেখানে ৭০০ কোটি মানুষকে কিভাবে সম্ভব? হয়তো সৃষ্টিকর্তা করোনার অছিলায় ৭০০ কোটি মানুষকে আবদ্ধ করে প্রকৃতি মেরামত করে দিচ্ছেন। হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ পৃথিবী কে একটু একটু করে ধ্বংস করে যাচ্ছিলো।করোনায় সৃষ্ট মহামারীতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পরবে বিশ্ব অর্থনীতিতে। কিছু কিছু দেশে দুর্ভিক্ষের ন্যায় আঘাত হানবে।
আজ আমাদের প্রতিটি সরকারের প্রতি আনুগত্য দেখানোর সময়। তারা আমাদের ভাল চাইছেন। বিশ্ববাসি প্রত্যের মঙ্গলের জন্য ঘরবন্দি থাকাটা কোন ব্যাপার নয়। এই ফাঁকে যে যার শখের কাজগুলি মন দিয়ে করতে পারবেন। ভাঙ্গা মচকা কুচটপড়া সম্পর্কগুলো মেরামত করে নিতে পারবেন। বিপদের বন্ধু প্রকৃতির সঙ্গে ভাব জমিয়ে 'অমলের' মত জানালা দিয়ে পাখি আর গাছের সঙ্গে মিত্রতা করলে দেখবেন কখন অজান্তে সময় উধাও হয়ে গেছে আনন্দে। এখন আর কান্নার সময় নয়। মন মিলিয়ে দূরত্বে থাকার সময়। মনের মিল থাক ফোনে, হোয়াটস আ্যপে আর মেসেঞ্জারে। দেহের দূরত্ব বজায় থাক। মশা মাছি থেকে নিজেকে বাঁচান। আর কত দিন বলে হা হুতাশ না করে ভাল থাকুন।
রাজ্যে লকডাউনের তৃতীয় দিন এবং দেশে প্রথম দিনে পরিস্থিতি কলকাতাসহ গোটা রাজ্যে একইরকম। তবে, কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় এবং লাগোয়া জেলাতে বিক্ষিপ্তভাবে কিছু কিছু মানুষ লকডাউনের নিয়ম ভেঙেছেন। পুলিশ কঠোর হাতে তা দমন করেছে। অনেক জায়গাতেই বাইক নিয়ে ঘোরাঘুরির জন্য পুলিশ তাড়া করেছে। এখনও পর্যন্ত কলকাতা পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে ১৩০২ জনকে। এর মধ্যে ৬৪০ জন গ্রেপ্তার হয়েছে মাতলামোর জন্য। এবং লকডাউন ভাঙার জন্য ৬৬২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কলকাতার নগরপাল অনুজ শর্মা জানিয়েছেন, প্রত্যেককে অনুরোধ করা হচ্ছে বাড়িতে থাকুন। এবং প্রশাসনকে সাহায্য করুন।
কলকাতায় শৃঙ্খলার চিত্রও দেখা গেছে। বেলেঘাটা, উল্টোডাঙা, গুরুদাশ দত্ত গার্ডেন লেনে বহু মানুষ রাস্তায় এঁকে দেওয়া বৃত্তের মধ্যে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেছেন। সহনাগরিকের থেকে দূরত্বে দাঁড়িয়ে ওষুধপত্র, বাজারহাট সবই করেছেন। ওষুধের দোকানগুলিতে প্রচুর ভিড় দেখা গেছে। বেশি টাকার ওষুধ কিনলে যে ছাড় পাওয়া যেত, এখন তা দেওয়া হচ্ছে না। অড়েক জায়গায় চাহিদামতো ওষুধও নেই। হাওড়া ব্রিজে এদিন অন্য চিত্র দেখা গেল। ব্রিজের একটা দিক দিয়েই গাড়ি যাতায়াত করবে। বাকি অংশ আটকে রাখা হয়েছে। ব্রিজের দুপারেই পুলিশ মাস্ক পরে দাঁড়িয়ে। গাড়ি নিয়ে কেউ গেলেই, থামিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। বড়বাজারের ক্যানিং স্ট্রিটের ছবিও একইরকম। সমস্ত বড় বড় ব্যবসায়িক কেন্দ্রগুলোর মূল ফটকে তালা। নিয়মশৃঙ্খলা ঠিক রাখার জন্য কয়েক জায়গায় র্যাফ টহল দিচ্ছে। ধর্মতলা জনহীন। শিয়ালদা স্টেশনের ছবিও এক। তবে কয়েক জায়গায় দেখা গেল দু’একটি সরকারি বাস চলছে। সাইকেল চালিয়ে কাজে যোগ দিতে চলেছেন অনেকে। টিভি আর মোবাইলে চিত্রগুলি দেখতে পাচ্ছি।বাইরে না বেরিয়ে বাইরের খবর জানতে পারা এক সুন্দর ব্যাপার। বেশ লাগছে। অনেকে ফোন করে খবর নিচ্ছেন। এক দাদা বললেন, মানুষ এত পাপ করছে যে সবকিছু গোলমাল হয়ে যাচ্ছে।ধর্ষণ,খুন বেড়েই চলেছে। অথচ এই কয়েকদিনের গৃহবন্দি অবস্থায় সব পাপ কমে গেছে। পুলিশ, প্রশাসন রাস্তায় মাস্ক পড়ে টহল দেওয়ার সুফল মিলছে। এর ভাল দিক আছে অনেক।
অন্যায়ের বিরুদ্ধে মহাভারতে আঠারোদিন যুুুদ্ধ চলেছিল আজ করোনা রোগের বিরুদ্ধে 21 দিনের যুদ্ধ চলবে। এ যুদ্ধে আমাদের জিততেই হবে। মানুষ চেষ্টা করলে সব পারে 21 দিন কেন 21 মাস হলেেও প্রয়োজনে ঘরে থাকবে। তা না হলে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। অনেকেই চাল-ডাল মালমশলা সবজিতেে ঘর ভরে নিচ্ছেন কিন্তু এতটা স্টক করা একজনের পক্ষে ঠিক না।সবাইকে বাঁচতে হবে সকলের জন্য চিন্তা করতে হবে তবেই" ধন্য রাজার পূণ্য দেশ" ।
নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন, অর্থনীতিকে এর মাসুল গুনতে হতে পারে। আর ব্রিটিশ ব্রোকারেজ সংস্থা বার্কলেজ় সমীক্ষায় জানাল, সম্ভাব্য সেই ক্ষতির অঙ্ক প্রায় বারো লক্ষ কোটি টাকা।
গরীব ভ্যানচালক, রিক্সাচালক সকলের কথা চিন্তা করছেন সরকার। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে কাজ করছেন সরকার বাহাদুর। এ এমনএক সময় যখন সঠিকভাবে কিছু বলা যায় না। শুধু নজর রাখা আর অনুশাসন মান্য করাই ভারতবাসী তথা দেশবাসীর কর্তব্য।
কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য এবং পরিবার কল্যাণ মন্ত্রকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী-ভারতে আজ দুপুর পর্যন্ত করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ৭৩। তাঁদের মধ্যে বিদেশি নাগরিকও রয়েছেন। দিল্লিতে সংক্রমিত ৬ জন, হরিয়ানায় ১৪ জন (প্রত্যেকেই বিদেশি নাগরিক), কেরলে ১৭ জন, রাজস্থানে ৩ জন (একজন ভারতীয় নাগরিক এবং দু’জন বিদেশি নাগরিক), তেলেঙ্গানায় আক্রান্ত একজন, উত্তর প্রদেশে ১১ জন (১০ জন ভারতীয় নাগরিক এবং একজন বিদেশি নাগরিক), কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল লাদাখে আক্রান্ত ৩ জন, তামিলনাড়ুতে একজন, জম্মু ও কাশ্মীরে একজন সংক্রমিত, পাঞ্জাবে আক্রান্ত একজন এবং কর্ণাটকে করোনায় সংক্রমিত ৪ জন। এইভাবে বাড়তে থাকলে তৃতীয় সপ্তাহে দ্বিগুণহারে বাড়তে থাকবে রোগীর সংখ্যা।অনেকে এটাকে আমল না দেওয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। ইতালির কাছ থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত সকলের। ওরাও প্রথমে বাড়ির বাইরে বেরোনো বন্ধ করেনি।
সবথেকে আনন্দের খবর পশুপাখিরা আনন্দে বিচরণ করছে। দূষণের পরিমাণ কমে গিয়ে অনেক রকম পাখির আনাগোনা বেড়ে গেছে আশ্চর্যভাবে। আমরা যদি মাসে একদিন লকডাউন করে যাই নিয়মিত তাহলে হয়ত পৃথিবীর পরমায়ু বেড়ে যাবে। এ এক আশার বার্তা।
এখন অফুরন্ত সময়। পড়ছি, শুনছি ফেসবুকে পোষ্ট দিচ্ছি জনসচেতনতামূলক।খবরের কাগজ আছে। আমি আর কতটুকু জানি। তবু জানার ইচ্ছে, পিঠে কুঁজ নিয়ে চিত হয়ে শোওয়ার বাসনা। করোনা ভাইরাসে আতঙ্কিত গোটা বিশ্ব। ভারতেও তা মহামারির আকার নিচ্ছে। রাজ্যে যাতে করোনা ভয়াবহ আকার ধারণ না করতে পারে, তার জন্য জনগণকে প্রতিদিন সতর্ক করে যাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। রাজ্য সরকার করোনা ঠেকাতে একাধিক পদক্ষেপ নিয়েছে। লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে অনেকদিন। করোনা মোকাবিলায় জরুরী ত্রাণ তহবিল গঠন করা হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে রাজ্যের শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী, প্যারাটিচার, পার্টটাইম টিচার সহ শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত সবাইকে ত্রাণ তহবিলে মুক্তহস্তে দান করার জন্য আবেদন করলেন রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ও তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চ্যাটার্জি। তিনি বলেছেন, ‘আর্থিক বিষয়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। যা পরিস্থিতি তাতে আগামীদিনে আর্থিক অভাব ঘটবে। আমাদের এই আর্থিক সঙ্কটের মোকাবিলা করতে হবে। এই পরিস্থিতিতে আমরা একজোট হয়ে মুখ্যমন্ত্রীর পাশে দাঁড়াব।’ পাশাপাশি তিনি দলের বিধায়কদের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনাদের যতটুকু সামর্থ্য, সেই অনুযায়ী এই ত্রাণ তহবিলে সাহায্য করুন। বিধানসভা থেকে যে ভাতা পান, তার কিয়দংশ অনুদান ত্রাণ তহবিলে দিন। আপনারা যা ভাল বুঝবেন, তাই করুন। যেভাবেই হোক করোনার সঙ্গে আমাদের মোকাবিলা করতে হবে। মমতার পাশে দাঁড়ান।’ পাশাপাশি তৃণমূলের শিক্ষা সেল ও গণ সংগঠন এবং বামপন্থীদের কাছেও পার্থ চ্যাটার্জি সাহায্য করার জন্য অনুরোধ করেছেন।
সকলের সমবেত প্রচেষ্টায় পৃথিবীর এই গভীরতম অসুখ সেরে যাবে একদিন।
" একদিন ঝড় থেমে যাবে
একদিন পৃথিবী শান্ত হবে "।
এক সপ্তাহ পরে রাজু আর শ্যামলী রাস্তায় নামল। রাস্তায় নেমে তারা দেখলো কোনও যানবাহন নেই পুরো রাস্তা ফাঁকা এদিকে ঘরছাড়া হয়ে গেছে ঘর ভাড়া দিয়ে তাকে জবাব দিয়ে আসা হয়েছে সেখানেও ফিরে যাওয়ার কোন উপায় নেই এখন তারা কি করবে তারা বসে পড়লো রাস্তার ফুটপাতের উপর দূরে। তাদের অসহায়ত্ব ভিখারি ভেবে পুলিশ তাদের হাতে খাবারের প্যাকেট তুলে তুলে দিল তারা আনন্দে খেলো কিন্তু খাওয়া-দাওয়া পর ভাবলো কি করে গ্রামে ফিরবে এখনতো বাস-ট্রেন কিছুই নেই তারা কেন যে ঘরটা ছাড়লো এতটা বুঝতে পারেনি রাজু বলল আগে যদি বাইরে বেরিয়ে একটু দেখে নিতাম শ্যামলী বলল বাইরে বেরোবে কি করে কোন কারন ছাড়া তো বাইরে বেরোনো যাবে না।
রাজু বলল যদি কোন রকমে আমরা গ্রামে যাই তাহলে বাড়িটা কোথায় করব। শ্যামলী বলল অত চিন্তা করো না। গ্রামে ফিরে আমরা এটাও তো দেখতে পারি যে হয়তো গুরুদেব মরে গেছে। তোমার মা একা। সেখানে হয়তো আমরা গেলে অসহায়ের সহায় হবো। আমরা তোমার বিধবা মাকে দেখাশোনা করতে পারবো।
রাজু দেখল তাদের অদূরেই একজন সাধুবাবা বসে আছে তার লম্বা লম্বা দাড়ি। আর বগলে গেরুয়া রঙের কাপড় পড়ে বসে আছে। শ্যামলী আঙ্গুল দেখিয়ে বলল ওনার সঙ্গে একটু কথা বললে হয় না। উনিও তো আমাদের মত অসহায়।
রাজু তিন ফুট দূরত্ব রেখে বলল - ও সাধু বাবা আপনি কোথায় যাবেন এখানে বসে কেন? সাধুবাবা উত্তর দিল - আমিও পশ্চিমবাংলায় যাব কিন্তু কোন বাস বা ট্রেন পাচ্ছি না। রাজু বলল - আমরাও তো পশ্চিম বাংলার লোক কিন্তু যানবাহন না পাওয়ায় আমরা এখানে বসে আছি আর কতদিন বসে থাকবে চলো হাঁটতে শুরু করি।
সাধুবাবা পথ চলতে শুরু করল। রাজু আর শ্যামলী তার পিছনে সাধুবাবা সাধুবাবা জিজ্ঞেস করল - তোমার নাম কি রাজু? বলল - আমার নাম রাজু। শ্যামলী বলল - আমার নাম শ্যামলী। শ্যামলী- বাবা আপনার নাম কি? - আমার নাম ছিল এখন আর নেই। আমার নাম ছিল সন্তু আমি একটা সরকারি চাকরি করতাম কিন্তু আমার সারা দেশ দেখার শখ মিটলো আজ আমি ঘুরে ফিরে এসে কেরালাতে আশ্রয় নিয়েছি আজ দুই মাস হল এখন আতঙ্কে সমস্ত বন্ধ হওয়ায় আমার গ্রামে যাওয়ার পথে যতদূর চোখ যায় আমরা হেঁটে যেতে পারবো।
সাধু বাবা ও রাজু কথা বলতে বলতে এগিয়ে চলল। কথা বলছে শ্যামলী। কাঁধে একটা ব্যাগ। রাজুর কাঁধে একটা ব্যাগ আর সাধুবাবার বগলের ঝোলা। তিনজনেই হেঁটে চলেছে। হাঁটছে তো হাঁটছেই। পথের কোনো শেষ নেই। হেঁটে কি কেরালা থেকে পশ্চিমবাংলা যাওয়া চাট্টিখানি কথা। বিরাট কঠিন ব্যাপার। তারা প্রায় ১০-১২ মাইল হেঁটে তারপর আবার বসলো তখন সন্ধ্যা প্রায়। আর পুলিশ রা জিজ্ঞেস করছে নানা প্রশ্ন। দেখুন আমরা একসাথে এসেছি কোনো যানবাহন না পাওয়ায় আমরা হেঁটে চলেছি। আমরা এখানে একটু বিশ্রাম নেব।
সেদিনের মত রাত তো তারা সেই ফুটপাতে শুয়ে কাটিয়ে দিলো তারপরে সকাল থেকে আবার হাঁটতে শুরু করলো। রাতে কোন খাবার নেই। শুকনো খাবার কিছু বিস্কুট ছিল কিন্তু বিস্কুট খেয়ে কি আর কতদিন চলবে। সাধু বাবার কাছে কিছু কাজুবাদাম কিশমিশ ছিল সেগুলোও ফুরিয়ে গেল। তারা হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে পড়ল। রাজু শ্যামলীকে কাঁধে নিয়ে হাঁটতে শুরু করল। সাধু বাবা দেখে তো অবাক।
সাধু বাবা বলল - এতটা পথ তুমি একে কাঁধে নিয়ে যেতে পারবে। রাজু বলল কি করবো সাধুবাবা। একে তো কোন হাসপাতালে দেওয়ার উপায় নেই। হাসপাতলে এখনতো করোনা চিকিৎসাতেই ব্যস্ত। সবাই দেখছেন তো হাসপাতালের লাইন। খবরের কাগজে আমি খবর রাখি। সবাই চলে যেতে পারে না অকারণে হাসপাতালে। সাধু বলেন, চলো যাওয়া যাক।
রাজু হাঁটতে হাঁটতেই বলে - সাধুবাবা আপনাকে একটা প্রশ্ন করি আপনি কেন সাধু হয়েছেন? সাধুদের আমি দেখতে পারি না আমার এক গ্রামে গুরুদেব আছে সেই স্বাধীন নামে অসাধারণ কাজ করে সে আমার মাকে বশ করে রেখেছে সে আমাদের সমস্ত সম্পত্তি নিয়ে নেবার ধান্দা তার। তার জন্যই আমি কেরালায় চলে এসেছি।
সাধু এবার আসল কথা বলল। সাধু বললো - আমাকে সাধু বাবা বলে ডাকবে না আমাকে সন্তুদা বলবে। দাড়ি আর জটের তার জন্য তুমি আমাকে সাধু মনে করো না। আমি দেশ ভ্রমণ করতে ভালোবাসি। আমি ঘুরে বেড়াতে ভালবাসি। তাই আমি ঘুরে ঘুরে বেড়াই। দেশ ভ্রমণ করি। আমি সাধু নয়। তবে হ্যাঁ আমি অন্যায় কোন কাজকে প্রশ্রয় দিই না।
তারপর বিকেলের আলো থাকতেই সাধুবাবা বলেন আমরা বসি। চলো আজ থেকে তুমি আমাকে সাধুবাবা বলবেনা সন্তুদা বলবে। তারপর ব্যাগ থেকে একটা ক্ষুর বের করে রাজুর হাতে দিলেন। বললেন আমার মাথা ন্যাড়া করে দাও আর দাড়ি কামিয়ে দাও। আজ থেকে আমি তোমার মত সাধারণ মানুষ হতে চাই।
রাজু সন্তু তার কথামতো তাই করল ইতিমধ্যে একটা পুলিশের গাড়ি চলে এসেছে। পুলিশের গাড়ি থেকে দু'জন পুলিশ নেমে বেধড়ক পেটাতে শুরু করেছে সন্তুদা আর রাজুকে। তারা বলছে শুনুন শুনুন আমাদের কথা -শুনবো না কেন তোমরা কাছাকাছি বসে আছো
তোমরা যাও তফাত যাও তফাত যাও তাড়াতাড়ি দূরে সরে তারা কথা বলতে শুরু করল। তারা পুরো বর্ণনা দেওয়ার পর পুলিশ বলল, চলো আমাদের সঙ্গে তোমরা। তোমাদের থানার কাছে থাকতে হবে একমাস। তারপরে তোমরা দেশে ফিরবে। এখান থেকে পশ্চিমবাংলা যাওয়া যায় ট্রেনে, বাসে।পায়ে হেঁটে নয়। সন্তুদা বলল- যার কেউ নেই তার ভগবান আছে। দেখলে মার খেয়েও একটা উপায় হলো। এবার তুমি তোমার স্ত্রী শ্যামলীকে ডাক্তার দেখাতে পারবে। আর আমাদের থাকার একটা বন্দোবস্ত হলো। আমরা দু'বেলা খেতেও পারবো। আর আমরা থানার সামনে, পুলিশের নজরে আছি। আমাদের বিপদের কোন ভয় নেই। শ্যামলীর পায়ে প্লাষ্টার হল। সন্তুদা বলল, এখন শুধু খাওয়া আর গল্প করার সময়। রাজু বলল, আপনি তো অনেক জায়গা ঘুরেছেন। বলুন আমাদের সেইসব গল্প।
সন্তুদা বললেন- আমি যেমন এখন তোমাদের সঙ্গে মিশে গেছি। ঠিক এভাবেই মিশেছিলাম লক্ষদ্বীপে। আমার যেতে মনে হলো লাক্ষাদ্বীপ। লাক্ষাদ্বীপে কিছুদিন কাটিয়ে এলে মন্দ হয়না। ভাবাও যা কাজ শুরু হলো আর শুরু হল তোড়জোড়। দমদম এয়ারপোর্টে টিকিট বুকিং করে কয়েকদিন পরে কলকাতা থেকে সরাসরি উড়ানে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে পৌঁছে গেলাম কোচি বিমানবন্দর। যেহেতু আমরা উড়ানে গেলাম তাই সময়টা কম লাগলো। তা না হলে হয়তো থেকে জলজাহাজে ১৬ ঘন্টা লাগে। আমি বিয়ে করেছিলাম একজন গরীব মেয়েকে। আমরা চারজন একসাথে আছি। আমি আলাদা। ওরা স্বামী স্ত্রী। আমি পাশের ভদ্রলোককে বললাম, চলুন। আমি আমার বন্ধু রতন আর আমার স্ত্রী এবং রতনের স্ত্রী। চারজনের চারটে লাগেজ। সঙ্গে টাকা পয়সা কিছু আছে এটিএম কার্ড আছে। ওখানে প্রয়োজনমতো সব কিছু কিনে নেওয়া যাবে। রতনের সঙ্গে রাস্তায় পরিচয়।
প্রথমেই বিপত্তি একটা লাগেজ চুরি হয়ে গেছে বিমানবন্দর থেকে। থানায় একটা রিপোর্ট করে আমরা এগিয়ে চললাম। ব্যাগে অনেক টাকা পয়সা আছে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আছে। ফিরে না পেলে খুবই অসুবিধা। থানায় আমরা পৌঁছানোর আগেই আমাদের পুলিশ আমাদের সমস্ত জিনিসপত্র দিয়ে গেলেন। চুরি নয় আমরাই হারিয়ে ফেলেছিলাম ব্যাগটা। একজন পুলিশ বললেন, নামতে গিয়ে মিস করেছেন লাগজটি। যাইহোক পাওয়া গেছে আফটার অল। এর আগে দিঘা পুরীতে সমুদ্র দেখেছি কিন্তু এখানকার সমুদ্র একদম অন্যরকম। নীল সমুদ্রের জলের সঙ্গে নীল আকাশ যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। নীলে নীলে নীলাম্বর...সরকার অনুমোদিত সংস্থার সঙ্গে আমরা এসেছি। সেজন্য লজের কোন অসুবিধা হয়নি রাত কাটালাম নিরাপদে। লজে ছিল কুয়ার আমিন, বলে একজন গাইড।
গাইড আমাদের সঙ্গে গেলেন এবং তিনি ইতিহাস বোঝাতে বোঝাতে আমাদের সব জায়গায় ঘোরাতে লাগলেন। ১৫৫৫ সালের কেরালা এখানকার রাজা ঘোষণা করেন প্রসাদ নির্মানের। প্রাসাদটি কিন্তু তারপরেও তাড়াতাড়ি নষ্ট করে দেয় হানাদস্যুরা। শতাব্দীর শেষের দিকে যখন অন্য রাজা এদিকে আসেন তখন এই প্রাসাদটি পুনর্নির্মাণ করে তারা। এরপর ক্লকটাওয়ার। তারপরে ১৭৬০ সালে তৈরি ৪৫ ফুট লম্বা চারমুখী ঘড়ি দেখলাম গাইডকে জিজ্ঞাসা করলাম এখানে প্রবাল পাওয়া যায় অনেক না। গাইড বলল পাওয়া যায় প্রবাল পাওয়া যায় প্রত্যেকটা দিকেই কিন্তু কোনটাই নিয়ে যাওয়া যায়না। দু-একটা লুকিয়ে-চুরিয়ে নিয়ে যেতে পারেন। তারপর কেরলের বিখ্যাত মসলা বাজারে ঢুকলাম সেখানে আমার স্ত্রী এবং বন্ধু স্ত্রী খুব কেনাকাটি শুরু করলেন। আমি বললাম এত মসলা দিয়ে ব্যাগ ভরে যাবে, এত মশলা নিয়ে কি করবে? বন্ধুর স্ত্রী বলেন আপনারা কি বুঝবেন। এসব ব্যাপার আপনার নাক গলাবেন না। বাড়িতে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিতে হবে তো। এতদূর বেড়াতে এসেছি আর বারবার আসা হবে?
এরমধ্য একটা অঘটন ঘটে গিয়েছে। অন্যমনস্ক হয়ে দলছাড়া হয়েছে রতন। রতনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। গাইড বলল, আমাকে না জানিয়ে কোথায় গেল? বন্ধুর বৌ কান্না শুরু করল। আমি সবাইকে বুঝিয়ে লজে নিয়ে এলাম।
বৌকে বললাম, তোমরা ফিরে যাও। আমি রতনকে নিয়ে ফিরব। বন্ধুর বৌ বলল, আমি যাব না। আমার স্বামীকে ফিরিয়ে নিয়ে যাব। রতনের বৌ রেখা আমার সঙ্গে থাকল। চলে গেল আমার স্ত্রী। বাড়িতে তা না হলে সবাই চিন্তা করবে।পৌছে দিলাম বন্দরে টিকিট কেটে। সময় বেশি লাগবে। কিছু করার নেই।
রেখা আর আমি খোঁজ শুরু করলাম তার পরের দিন সকাল থেকে। রেখা খুব স্মার্ট আর চালাক। ক্যারাটে কুংফু শিখেছে অনেকদিন। আমাদের গাইড অন্য খদ্দের পেয়ে চলে গেছে। লজের মালিককে বলে সরকারি সংস্থাকে সব জানিয়ে রাখলাম। তারা বললেন, আমরা থানায় জানিয়ে রাখব। আপনারা সবরকমের সহায়তা পাবেন।
এখানে কেরলের শুধু নারকেলের বন নারকেলের বাগান সুন্দর সবুজ বনানী। আর নীল আকাশ আমাদের মন মুগ্ধ করল। কিন্তু বন্ধু হারিয়ে যাওয়ায় আমাদের আনন্দের মাত্রা কমে গেল। এখন আমাদের খোঁজ শুরু হল নব উদ্যমে। শুরু করলাম প্রথম থেকে। মসলা বাজারে যেখানে বন্ধু নিখোঁজ হয়েছিল সেখান থেকে। হাঁটা শুরু করলাম। হাঁটতে হাঁটতে একটা গলিপথ পেলাম।
সেই গলিপথ পেয়ে একটু দূরে গিয়ে দেখতে পেলাম সমুদ্র। সমুদ্রের ধারে মোটা চেনের সঙ্গে বাধা জাহাজগুলো। সমুদ্রের ধার বরাবর আমরা এগোতে লাগলাম আমাদের উদ্দেশ্য স্থানীয় লোকদের সঙ্গে মেলামেশা করে তাদের বুঝিয়ে, আমাদের বিপদের কথা বলা। এত লোকেরা মাঝে যখন আমরা জাহাজে উঠতে পারলাম তখন বেলা প্রায় বারোটা। জাহাজে উঠে খোঁজ শুরু করলাম। গাইড বলেছিল, জাহাজে করে এরা চোরাপথে কারবার করে আবার জাহাজের ঘর ভাড়া দেয় যখন মাসখানেক দাঁড়িয়ে থাকে। জাহাজ তো বাসের মত সহজে যাওয়া আসা করে না। নিয়ম তাদের আলাদা। লাক্ষা দ্বীপের লক্ষ দ্বীপের কথা বলা হয়। কিন্তু পাঁচটি দ্বীপে শুদ্ধমাত্র যাওয়া আসা করা যায়। বাকিগুলো সব নিষিদ্ধ। চোর ডাকাতরা নিষিদ্ধ দ্বীপেই ডেরা নেয়।
আমার বন্ধু কোথায় হারিয়ে গেলো খুঁজতে খুঁজতে আমরা হয়রান। বন্ধুর বউ রেখা খুব স্মার্ট এবং চালাক সে বলল কোন ভয় নেই আমরা তাকে খুঁজে বার করবোই। কেরলে প্রবাল রাজ্যের হাতছানি। এখানে লাল-নীল-সবুজ কত রকমের প্রবাল পাওয়া যায় তার ইয়ত্তা নেই।
এখানকার স্থানীয় লোকজনর সঙ্গে পরিচয় হলো। ইশারায় তারা সব ভাষা বোঝে। তবু তারা হাতের আংটি দেখিয়ে বলল যে এর ব্যবসা চলে রমরমিয়ে। সেখানে লোকের প্রয়োজন হয় অনেক। আমার আশা জাগল, তাহলে এখানেই রতনের খোঁজ পাব। স্থানীয় লোকটির নাম জিজ্ঞেস করলাম। সে বলল জিন্দালা আলু আলু। আমাদের সঙ্গে থেকে নিয়ে গেল ঝাল মিষ্টি পকরার দোকানে। চা খাওয়ালেন রেখা। স্থানীয় দাদা দিদিরা বসে আছেন দোকানে। ভাষার সমস্যার জন্য কারো সঙ্গে দুদন্ড কথা বলা গেল না।
জিন্দালার সঙ্গে আমরা চলে এলাম এক জঙ্গলে। মনে পড়লো বিভূতিভূষণের আরণ্যক। আমি রেখাকে বললাম, এই বিপদের মাঝে মনে পড়ছে, 'আরণ্যক'। এটা কি সত্যিই কল্পনা-লোকের বিবরণ বা বানানো গল্প হতে পারে? তাহলে সেই প্রিয় চরিত্রগুলো এতো বাস্তব কেন মনে হয়?এখানকার জঙ্গল দেখে মনে পড়ে গেলো সব কথা।
যদি বিভূতিভূষণের ঠিক পরবর্তী প্রজন্মের লোক হতাম, তাহলে নিশ্চয়ই বিহারে যেতাম। লবটুলিয়া, ফুলকিয়া বইহার, সরস্বতী কুণ্ডী, মোহনপুরা অরণ্য, মহালিখারূপ ও ধন্ঝরি পাহাড় খুঁজে বেড়াতাম।সেই প্রিয় চরিত্রগুলো সত্যিই কি আছে? খোঁজখবর নিতাম। রাজু পাঁড়ে, গনোরী তিওয়ারি, মুসম্মত কুন্তা, ভানুমতী প্রভৃতি সাধারণ লোকদের না পেলেও অন্ততপক্ষে নন্দলাল ওঝা, রাসবিহারী সিংএর মতো বিত্তবান ব্যক্তিদের সন্ধান পেতে অসুবিধে হত না। তবে এখন এতো বৎসর পরে কোনোভাবেই এই পরিকল্পনা করা যায় না। সম্বিৎ ফিরে এল। রেখা বলল, এখন রাত হয়ে গেছে আর ফেরার উপায় নেই রাতেই সে একটা পাতার ছাউনি দেওয়া ঘর দেখিয়ে দিল সেই ঘরে গিয়ে আমরা দুজনে ঢুকলাম খাবার-দাবারে কোন অসুবিধা হয়নি কিন্তু শোবার বেলায় খুব অসুবিধা। কোনমতে রেখা আমার সাথে শুতে চাইছেন সে নিচে শুয়েছে হঠাৎ মাঝ রাতে বারোটার সময় একটা বল্লম। দেখে আমাকে জড়িয়ে ধরেছে। আমি বললাম, রেখা তুমি কি ক্ষেপে গেলে? তোমার কি মাথা খারাপ হল? ছেড়ে দাও।
কি হলো? রেখা বলল-একটা বল্লমের ডগায় রক্ত দেখলাম।
আমি বললাম, তাহলে আমাদের সন্ধান কেউ পেয়েছে। নিষিদ্ধ এলাকায় আমরা আছি। পুলিশ খুঁজেও পাবে না আমাদের লাশ। আমি চিৎকার করে ডাকলাম, জিন্দালা।
জিন্দালা এল। ঈশারায় বলল, ভয় নেই। আমি আছি। ওদের আঁটঘাঁট সব চেনা। তাই ওরা ভয় পায় না। কী গভীর ভালোবাসায় আমাদের জন্য ও রাত জেগে পাহারা দিচ্ছে। চিৎকারে আমাদের ঘুম ভেঙে গেল। কাছে গিয়ে দেখলাম, কেউ একজন তাকে খুন করে রেখে চলে গেছে। জঙ্গলে আশেপাশে এসব লোক ভিড় করে চলে এসেছে তার চিৎকারে। সকলের চোখে মুখে একই জিজ্ঞাসা কে মারল তাকে? এখানে তার শত্রু বলতে কেউ নেই। শত্রু হয়তো আমাদের থাকতে পারে। হয়ত আমাদের সাহায্য করার পরিণতি এটা।
কিন্তু সে আড়ালেই আছে। আমি আর রেখা খুব সাবধান হয়ে গেলাম। আমি গেলাম দুজন স্থানীয় লোক লক্ষ্য করে, আমরা বললাম আমাদের বিপদের কথা। তারা ইশারায় সবকিছু বুঝে নিল। বিপদ আমাদেরও ঘনিয়ে আসছে এখন রাত্রি দুটো। এখনো রাত শেষ হতে প্রায় ৪ ঘণ্টা বাকি। ছয়টা বাজলে আমরা বেরিয়ে পড়বো রকমে জেগে রাত কাটিয়ে দিলাম ঘরের ভেতর। খিদে পেয়েছে। কিন্তু কোন খাবার নেই। ছটা বাজতেই আমরা স্থানীয় লোকেদের বলে বেরিয়ে পড়লাম। আর ওদের সঙ্গে নিলাম না।
এবার আমাদের নিজেদের শক্ত হতে হবে। আর কারো সাহায্যের আশা করলে হবে না। তার কারণ হচ্ছে কতজন আমাদের জন্য প্রাণ দেবে। আমরা এরকম মনে করে, আমরা বেরিয়ে পড়লাম দুজনে। সরকারি স্পর্শিয়ায় আমরা খবর পাঠাইনি। তারা জানেনা আমরা কোথায়। তারা হয়তো খোঁজ করছে। কিন্তু আমাদের যে বন্ধু রতনকে খুঁজে বার করতেই হবে।
সৈকতের ধার বরাবর এগোতে এগোতে আমরা চলে এলাম এক চেইন বাধা জাহাজের কাছে। সেখানে একটি পানসি নৌকা। অনেক ভেতরে চলে গেলাম। কিন্তু মাঝ নদীর সমুদ্র বরাবর। রেখা ধারে ধারে যায়। পানসি ধারে ধারে গিয়ে আমরা আরো ঘন জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করলাম। আশেপাশে কেউ আমাদের ফলো করছে নাকি। আমরা লক্ষ্য করলাম। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারলাম না। হঠাৎ আমরা একটা নেকড়ের সামনে পড়ে গেলাম। পানসি ছেড়ে ছুটতে শুরু করলাম জঙ্গলের ভিতরে। নেকড়ে আমাদের দিকে তেড়ে এল আমরা ফাটা বাঁশে আওয়াজ করতেই দুমদুম করে সে পালিয়ে গেল। বাঁশটা পড়ে ছিল বনে। সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় লোক কিছু ভিড় করে চলে এল। আমরা ইশারায় তাদের কথা বললাম। পেটে হাত দিয়ে আমরা তাদের কথা বললাম। তারা আমাদের খেতে ফলমূল দিল। ফলমুলাহার করে, জল খেয়ে যাক আমাদের ধড়ে প্রাণ এলো। এবার আমরা ইশারায় তাদের আমাদের বিপদে কথা বোঝাতে লাগলাম। আমরাএ ও বোঝালাম আমাদের বন্ধু রতন হারিয়ে গেছে। আমরা তাকে খুঁজতে এসেছি। তারা কোনরকমে বুঝল কিন্তু তারা আমাদের ভাষা বোঝে না। ইশারা করে কষ্ট করে তাদের বোঝাতে হলো। আমাদের অভিযান শুরু হলো আরও দুর্গম পথে। স্থানীয় লোকদের সাহায্যে এত কাণ্ডের পর লোহার মই বেয়ে যখন আমরা জাহাজে উঠতে পারলাম। তখন বেলা প্রায় বারোটা। এলাম চারতলায় আজ থেকে চার দিন আমাদের ঠিকানায় কাভারাত্তি। ৪০৬ নম্বর কেবিনে ঢুকে অবাক ওরে বাবা এইতো চকচকে ঝকঝকে ঘর শুধু বিছানার চেয়ার টেবিল সাজানো।। ওকে টি আমাদের পয়সার অভাব নেই কিন্তু এত সুন্দর ব্যবস্থা হোটেলের মতো সবকিছুই এখানে সহজলভ্য এটাচ বাথ গরম জল ঠান্ডা ঘর দেয়াল জড়ায় না সবকিছু এখানে আছে। ভাড়া মিটিয়ে দিলাম। জাহাজে রতন নেই। এই জাহাজে করে পাচার করা হয় মানুষ, প্রবাল ও অরণ্য সম্পদ। বিশেষ করে জঙ্গলের কস্তুরী মৃগ এদের সবথেকে লোভনীয় ব্যবসা। এদের লম্বা হাত। পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে চলে এই ব্যবসা। লোকাল পুলিশ আমাদের সাবধান করে দিয়েছিল। এবার দেখলাম নিজের চোখে। জাহাজের ঘরগুলি প্রায় বন্ধ। মাংস পচা গন্ধ আসছে।
স্থানীয়রা এতক্ষণ জঙ্গলে চলে গেছে তারা নেই এখন আমরা দুজনে আছি সকলের সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলে পরিচয় করলাম। পরিচয় করে তারা একটা ঘর দেখিয়ে দিল। সেই ঘরে আমরা চারদিন থাকলাম।
লোকজন উঠছে মালপত্র উঠছে। ক্যাপ্টেনের সঙ্গে তিনি সারারাত কাজ করে নিচ্ছেন সব ব্যবস্থা ঠিকঠাক আছে নাকি দেখতে। তারপর থেকে একটু বিশ্রাম নিচ্ছি। বেশ ভাল লাগল না। রতনকে এখনও পেলাম না। ক্যাপটেন বলল, চারদিন হো গয়া। এখন আপনারা নেবে যান। জাহাজ ছাড়ব দুঘণ্টা পরে। তার আগেই, হঠাৎ করে ঘোষণা শুরু হলো এবং ইংরেজিতে ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু আমরা জাহাজে তো যাব না।
আমরা এখানে বন্ধুর খোঁজ নেব। তাই কাভারাত্তিতে নেমে জেটির উপর দিয়ে একটু ঘুরিয়ে সৈকতে এসে পৌঁছাতেই হাতে হাতে মিলিয়া বড়া খেলাম। বড় ডাক্তার নেই। রেখার জ্বর। পরবর্তী দিনগুলোতে দেখলাম ডা দীপেন আমার সঙ্গে একরকম ব্যবস্থা করেছেন চিকিৎসার।
সব লোক স্থানীয়। লোকদের। দেখে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে মন প্রাণ জুড়িয়ে গেল। কিন্তু বন্ধু যদি সঙ্গে থাকত এই আনন্দ দ্বিগুণ হতো। স্থানীয়রা বলল-এখানে প্রবাল রাজ্যের হাতছানি এখানে নানান রকম প্রবাল লাল, নীল সবুজ সব রকমের ব্যবসা রমরমিয়ে চলে। চোরাচালান পথে চলে তার জন্য অনেক লোকের প্রয়োজন হয়। হয়ত এরা এরজন্য লোক এমনকি মহিলা পর্যন্ত চুরি করতে পিছুপা হয় না। এবার আমাদেরও আশা একটু বাড়লো হয়তো এই প্রবালের ব্যবসাদারদের কাছেই আমরা বন্ধুর খোঁজ পাব। স্থানীয়রা ইশারায় তারা বলল, আমরা সঙ্গে আছি। মহাবিপদ, কি হলো হঠাৎ আমাদের তাড়া করলো দুটো অ্যালসেশিয়ান কুকুর। লেলিয়ে দিলো কে। আমরা সমুদ্রের জলে এসে পড়লাম। অমূলকভাবে শান্ত আরব সাগরে স্নান করার মজাটাই হলো আলাদা।
এই বিপদে,সময় সুযোগে আমাদের সমুদ্র স্নান করে নিলাম।
রেখার এক্সপার্ট কিন্তু এর প্রমাণ কোনরকমে হাতের ব্যাগ একজনের কাছে জমা করে ঝাপিয়ে পড়লাম জলে। সাঁতার কাটলাম মহানন্দে। স্থানীয় লোকদের ডাকাডাকি। শুরু হয়ে গেল খবর।কুকুরদুটো আর নেই। রহস্যজনকভাবে এল আবার জলে না নেমে চলেও গেল।
ভিজে জামাকাপড়েই আমরা এগিয়ে চললাম বন্ধুর খোঁজে। স্থানীয়রা প্রত্যেক লোককে জিজ্ঞেস করে করে দেখছে। এই নামের কোন বন্ধু আছে নাকি। কোন লোক এখানে নতুন এসেছে নাকি।
একজন খবর দিল। খবর দিল, হ্যায় ইখানে একটা নতুন লোক এসেছে। লোক কোথায় আছে তা জিজ্ঞেস করতেই লোকটি বললো, ইশারায় বলল, আঙ্গুল দিয়ে সেই ঘরটি দেখিয়ে দিল।
সাহসে ভর করে আমরা ঘরের ভেতর ঢুকে গেলাম অন্ধকার ঘরে হঠাৎ আমাদের পিঠে ধপাস করে আঘাত। লাঠির আঘাত। নাও এবার বন্দি হয়ে গেলাম আমরাও তাদের জালে। আর কিছুক্ষণ পরেই তাদের দলের সর্দার এল। এসে বলল যে তোমাদের সাহস তো মন্দ নয়। ইংরেজিতে বলল। এখানে এলে আর ফিরে যাওয়া যায় না। তোমার বন্ধু এই ঘরেই আছে। এই দেখো এটা কি তোমার বন্ধু?
দেখলাম হ্যাঁ রতন ই বটে। রতন তো আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করল। সেরা রুটি আর নারকেলের কিছু সব দিয়ে তারা চলে গেল। আমরা ঘরে বন্দি হয়ে রইলাম।
কি করে এই ঘর থেকে বেরোনো যায় পরিকল্পনা করতে শুরু করলাম। কিন্তু কোথাও জানালা নেই। দরজা আছে। দরজা একটামাত্র। দরজাটা তালা দেওয়া।
তাহলে বেরনো যাবে কি করে?
আমরা বন্ধ হয়ে গেলাম অন্ধকার জেলে। আর চারিদিকে সশস্ত্র প্রহরী। জামা কাপড় পাল্টানোর জন্য আমাদের জামা কাপড় দেয়া হয়েছিল। আমরা সেই জামাকাপড় পরে নিলাম। যেন কাঁদিয়ে কয়েদির পোশাক যাওয়ার জন্য লাইন দিতে হলো। কিন্তু কোন উপায় নেই এই ঘর থেকে আমরা মুক্তি পাব কি করে। নৌকা দুশমনরা আমাদের চোখ বেঁধে দিল। সেই সবুজ, নীল নীল সমুদ্রের জল আমাদের চোখে ভাসছে। আমরা যে ঘরে বন্দি হয়ে আছি সেই ঘরে একটিমাত্র দরজা। সেই দরজায় কি ফুটো আছে ফুটোয় চোখ রেখে রেখা দেখল, কত রকমের প্রবাল।
তারা প্রবালগুলো নিয়ে ঘষাঘষি করে তৈরি করছে আংটি। আর মজুরদের দরকার হলে প্রয়োজনে ধমক দিচ্ছে। এমন কি মারছো। মধ্যযুগের বর্বরতা। কি করে আমরা এদের হাত থেকে পরিত্রাণ পাব। এই নিয়ে আমরা চিন্তাভাবনা শুরু করলাম। কিন্তু হা হতোস্মি। কোন দিক দিয়ে পালাবো আমরা।
আমাদের পালাবার পথ বন্ধ হয়তো সারা জীবনই এই ঘরের মধ্যে আমাদের তিনজনের কেটে যাবে। ওরা যা খেতে দেবে তাই খেতে হবে। যা কাজ করাবে তাই সেই কাজই করতে হবে কোথায় চালান করে দেবে জাহাজে তাও জানিনা। এই ভাবনায় বাড়ির কথা মনে পড়তে লাগলো মনে পরতে লাগলো মা বাবার কথা আমার স্ত্রীর কথা। আর এখানে ধরে কাঁদতে শুরু করলো কি করে আমরা কি আর বাড়ি ফিরে যেতে পারবো না কোনদিনই কোনদিনই বাড়ি যেতে পারব না। এই ছোট্ট ঘরে মধ্যে আমাদের কাটাতে হবে। দ্বিতীয় রাত কেটে গেল তবু আমাদের কোন উপায় হলো না। কোনো রকমে খেয়ে একটু জল খেয়ে বেঁচে আছি।
এবার হয়তো ওরা আমাদের কোথাও পাচার করে দেবে আমাদের পোশাক পাল্টানোর জন্য তারা পোশাক দিয়ে গেছে। এবার কি আমাদের নিয়ে যাবে আমাদের চিন্তা হলো তাহলে সরকারি সংস্থা থেকে আমাদের তো নিয়ে এসেছে।
তারা কি পুলিশ থানায় খবর দেয় নি। মোবাইল কেড়ে নিয়েছে। তারা নিশ্চয়ই খোঁজ করতে করতে এখানে আসবে। সেই মনে পড়ছে নারকেল গাছের নিচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে আড্ডা শুরু করেছিলাম। সেই সময়টিতে নামল বৃষ্টি এখানে সমুদ্রের মজাটাও পাওয়া গেল না যতদূর হলে হাটু গেড়ে বসে পড়তে পড়তে আমাদের কখন যে ঘুম এসে গেল। আমরা সকলে ঘুমিয়ে পড়লাম।
আর পরদিন সকালে আমাদের তিনজনকে নিয়ে একটা জাহাজে উঠলো। জাহাজে উঠে আমরা চিনতে পারলাম সে ক্যাপ্টেনকে। ক্যাপ্টেন ইশারায় একটুখানি হাসি হাসলো কিন্তু কিছু কোন কথা বললো না। আমরা এখন কি জাহাজে চেপে থাকতে পেরেছি। হ্যাঁ ঠিক তাই ক্যাপ্টেন সামনে।
এতক্ষণ তো কেউ ছিলনা থেকে নিঃশব্দে আমাদের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। আমাদের কোলে তুলে নেবে বলে। কিন্তু আমাদের তো যাওয়ার সময় হয়নি। এমন সময়ে বিভিন্ন রকম কায়দা করতে শুরু করলো। তারপর আমরা দেখলাম তারা বেশি করে নিয়েছে প্রবাল ও কস্তুরী। সুগন্ধি কস্তুরীর গন্ধে আমরা পাগল। তাও বস্তায় প্যাকেট করা আছে। জাহাজ আমাদের তিনজনকে নিয়ে চলে এলো গেঞ্জি কারখানায়। সেখানে দেখলাম খুব ভালো সুতোর টি-শার্ট। আর কি কম দাম উপহারের জন্য অনেকে কিনে নিচ্ছে। ইশারায় আমাদের বলা হলো এখানেই তোমাদের কাজ করতে হবে। আজীবন। এখানেই তোমরা থাকবে আমাদের বন্দিদশা এখনো ঘোচেনি।
ঘুরে চা পান শেষে আবার তারা ফিরে গেল। আবার আগের ঠিকানায়। এই ঠিকানায় তারা আজ শেষ রাতে এসেছে।
নয়
কাল সকালেই হয়তো পৌঁছে যাবে কোচিতে। আমাদের মন কেমন যেন হয়ে গিয়েছে আর এই আছে তারা কর্মীরা আমাদের ভয় করতে মানা করলো তারা বলল একটা উপায় কিছু হবেই। আপনারা নিশ্চিন্তে থাকুন। তারপরে তারা চলে গেল। বদমাশরা চলে গেলে এদের কাছে অনেক কিছু জানতে পারলাম। এর মধ্যে একজন এগিয়ে এল। বদমাশ রহিম শেখের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করল। এখন বাধা দেয়াতেই চাবুক আলা ২৭৬০ নং কয়েদী রতনের পিঠে চাবুক মারল।
রতনের বিরক্ত হতে শুরু করলো। কিন্তু রেখা তো থেমে থাকার পাত্র নয়। সে মার্শাল আর্টে কাবু করে ফেলল যাকে তাকে একদম ধরাশায়ী করে ফেললো মেঝেতে। বদমাশ লোকটি শুয়ে পড়ল মাটিতে আহত হয়ে।
সকলে হাততালি দিয়ে উঠল। আর মালিকেরা মালিকদের লোকজন এখন কেউ নেই ওরা হয়তো পাশের ঘরে আছে। শুনতে পায়নি। আমরা পুলিশের আশায় বসে আছি। অবৈধ প্রবাল পাচারকারী দলের নেতা সহ ১০ জন আমাদের ঘরে ঢুকলো এবার তারা অত্যাচার শুরু করবে। তাদের কাছে আমরা শুনেছিলাম তারা প্রত্যেকদিন এইভাবে মারধর করে এবং ভয় দেখিয়ে রাখে যাতে ভালো কাজ পায়। কাজে ফাঁকি তারা বরদাস্ত করে না।
এইভাবে তারা ভয় দেখিয়ে কাজ বাগিয়ে নেয়। মোটা লাঠি দিয়ে ওরা সবাইকে পেটাতে শুরু করল।
রক্তাক্ত হয়ে গেল মেঝে। কিন্তু ওদের মায়া দয়া নেই। ওরা পৈশাচিক। আনন্দে মশগুল। এমন সময় হঠাৎ সদলবলে পুলিশ বাহিনীর আবির্ভাবে আমরা নিঃশ্বাস ছেড়ে বাঁচলাম। এবার তাহলে একটা উপায় হবে। হ্যাঁ ঠিক আমাদের খুঁজতেই তারা এসেছেন।
তারা আমাদের সরকারি সংস্থার মাধ্যমে সেই স্পোর্টস থানায় রিপোর্ট করাতে তারা আমাদের এখানেও চলে এসেছেন। এবার আমরা নিশ্চিন্ত। নিশ্চয়ই একটা বিহিত হবে। আমাদের তিনজনকে মুক্ত করতে এসে মুক্তি পেয়ে গেল ৩০ জন বন্দি। আমাদের খুব আনন্দ হল। সবাই একসাথে বেরিয়ে পড়লাম বাইরে।
কি সুন্দর প্রকৃতির হাওয়া সবুজ নির্মল পরিবেশে মন জুড়িয়ে গেল আর কদিনের আকাশ দেখা মন খারাপের দিনগুলো যেন উধাও হয়ে গেল। পুলিশের আই সি বললেন আপনারা বেড়াতে এসেছিলেন। আপনারা এইদিকে কিছু স্থান দেখে তারপরে কোচি। কোচি থেকে আপনারা ফিরে যাবেন কলকাতা। পুলিশের আইসি বললেন আপনাদের তিনজনের দৌলতে ধরা পড়ে গেল বড় চোরাকারবারী দল। এরা গেঞ্জি কারখানা কাপড়ের কারখানা দেখিয়ে প্রবালগুলো গোপন পথে চোরাচালানে বিক্রি করে প্রচুর টাকা লাভ করে।
এদের ধরতে আমাদের হিমশিম খেতে হয় কিন্তু আপনাদের খুঁজতে এসে আজ আমরা আমরাই ধরতে পারলাম। পুলিশের লোকটির নাম মদনলাল খুরানা। ইনি বললেন, এই দলটা শুধু প্রবাল নয়। এখানকার জঙ্গলের সম্পদ নষ্ট করে চোরাচালান করে। গোসাপের চামড়া চালান করে। হাতির দাঁত কেটে নেয়। নিরীহ হরিণ হত্যা করে। আরও বললেন, আমরা জেনেছি বিশেষ সূত্রে বা বই পড়ে যে, কস্তুরী খুব দামী সুগন্ধি, যা মোঘলরা ব্যবহার করত বলে জানা যায়৷
বর্তমানে এক গ্রাম কস্তুরীর মূল্য প্রায় ৫৫,০০০ টাকার কাছাকাছি!! এই কস্তুরী চোরাচালান করে চোরাকারবারির দল নির্বিচারে হরিণ হত্যা করে চলেছে। পাপ শব্দটা এদের অভিধানে নেই। রতন বলল, কস্তুরী কি এবং কোথায় পাওয়া যায়, বুঝিয়ে আমাদের বলুন।
মদনলাল বললেন, বই পড়ে যেটুকু জেনেছি তাই বলছি আপনাদের। হরিণের দশ বছর বয়সে নাভির গ্রন্থি পরিপক্ব হয়। এ সময় হরিণটিকে হত্যা করে নাভি থেকে তুলে নেওয়া হয় পুরো গ্রন্থিটি। তারপর রোদে শুকানো হয়। একটা পূর্ণাঙ্গ কস্তুরী গ্রন্থির ওজন প্রায় ৪০ গ্রাম। এটি বিশেষ ধরনের প্রাণিজ সুগন্ধি। হরিণের নাভি থেকে পাওয়া যায় এই কস্তুরী, যা মহামূল্যবান সুগন্ধি হিসেবে পরিচিত। অনেকে নিশ্চয় নাম শুনেছেন। রেখা বলল, আমিও পড়েছি, বহু গুণসম্পন্ন এবং বহু নামসম্পন্ন, এর ঘ্রাণ যোজনগন্ধা বললে কম বলা হয়। কস্তুরীর এক তিল পরিমাণ কোন বাড়িতে ফেললে বহু বছর সেখানে এর ঘ্রাণ থাকে। তিন হাজার ভাগ নির্গন্ধ পদার্থের সঙ্গে এর এক ভাগ মেশালে সমস্ত পদার্থই সুবাসিত হয় কস্তুরীর ঘ্রাণে। চোরাকারবারি এগুলিকে বিদেশে পাচার করে মোটা ডলার পায়। মদনলাল বললেন, কস্তুরী সংগ্রহকারীরা এই সুগন্ধিকে প্রায় প্রকৃত অবস্থায় রাখেন না।
সচরাচর অন্য পদার্থের সঙ্গে মিশিয়ে বিক্রি করেন। অন্য পদার্থের মধ্যে রক্ত বিশেষ একটি উপাদান। শুকিয়ে যাওয়া রক্তের সঙ্গে কস্তুরীর বিশেষ সাদৃশ্য আছে । কস্তুরীর সুবাসেও আছে বৈচিত্র্য। সুগন্ধি ফুলের মতোই যুগ যুগ ধরে মানুষের দৃষ্টি কেড়েছে কস্তুরী মৃগ। এই মৃগ অর্থাৎ হরিণ এক প্রজাতির পুরুষ হরিণ। ইংরেজি নাম ‘মাস্ক ডিয়ার’। এরা খুব লাজুক স্বভাবের। তাই নিরিবিলি বাস করে। বিচরণ করে একান্ত নির্জনে।
রতন বলল, হিমালয় পর্বতমালার উচ্চ পার্বত্য অঞ্চলেও উৎকৃষ্ট কস্তুরীমৃগ পাওয়া যায়। ওই অঞ্চলে একপ্রকার ছোট আকারের হরিণ আছে, তারা ছাগলের চেয়ে বড় নয় কিন্তু দেখতে অত্যন্ত সুন্দর। এদের পা অতি সরু, মাথা সুন্দর এবং চোখ চমৎকার উজ্জ্বল। এই হরিণ অন্য হরিণ থেকে আলাদা নয়। অত্যন্ত শীতল পার্বত্য পরিবেশে বাস করায় এদের লোম সরু না হয়ে অত্যন্ত মোটা ও পালকের মতো হয়। এ ছাড়া পামির মালভূমির গ্রন্থি পর্বতমালায় তৃণভূমি সমৃদ্ধ উপত্যকায় এই হরিণ পাওয়া যায়। এখানেও চোরাকারবারির অভাব নেই।
মদনলাল আবার বলতে শুরু করলেন, কস্তুরী মৃগের ওপরের মাড়ি থেকে গজদন্তের মতো দুটি দাঁত ছোট আকারে বের হয়। এ ধরনের দাঁত সব প্রজাতির হরিণের ক্ষেত্রে দেখা যায় না। এই দেখেই কস্তুরী মৃগ সনাক্ত করা হয়।
এই প্রজাতির হরিণ আত্মরক্ষায় পটু। কিন্তু তারা নিজেদের লুকিয়ে রাখতে পারে না, কারণ এদের দেহের তীব্র ঘ্রাণ। এই ঘ্রাণ অনুসরণ করে শিকারি ঠিকই এদের সন্ধান পেয়ে যায়। এই হরিণের নাভি থেকেই মূলত এই সুগন্ধি দ্রব্য সংগ্রহ করা হয়।
পুরুষ হরিণের নাভি মুখের গ্রন্থিতে এক বিশেষ ধরনের কোষের জন্ম হয়। এই কোষ যখন পূর্ণতা লাভ করে তখন এ থেকেই সুঘ্রাণ বের হতে থাকে। হরিণের ১০ বছর বয়সে সুগন্ধি কোষ পূর্ণতা লাভ করে। তবে মজার ব্যাপার হলো, যে হরিণটির নাভিতে এই কোষের জন্ম, সে নিজে কিছুই বুঝতে পারে না। তার নাকে যখন এই সুগন্ধ এসে লাগে তখন সে পাগলের মতো ছুটতে থাকে এই সুঘ্রাণের উৎসের সন্ধানে। অথচ সে বুঝতে পারে না যে, সুঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ছে তার নিজের দেহ থেকেই।
বাইরের দিকটায় থাকে এলোমেলো কিছু লোম। সেগুলো ছাড়িয়ে শুকনো কোষটিকে যখন জলেতে ভেজানো হয়, তখন পরিষ্কার কস্তুরী বেরিয়ে আসে। কোনো কোনো হরিণের মধ্যে পাওয়া যায় খুব কম পরিমাণে কস্তুরী। অপরদিকে এই প্রজাতির সকল হরিণের নাভিতে একই পরিমাণে কস্তুরী উৎপন্ন হয় না; হরিণের বয়স এবং পরিবেশভেদে কস্তুরীর পরিমাণের তারতম্য হয় ।
দেখা গেছে, এক কিলোগ্রাম কস্তুরী পাওয়ার জন্য প্রায় দুই হাজার হরিণ শিকার করতে হয়। রতন বলল, পচা মাংসও এরা রপ্তানি করে। কিছুই ফেলে না। জাহাজে আমরা পচা গন্ধ পেয়েছি। কস্তুরী যখন সংগ্রহ করা হয় তখন এর গন্ধ এত উগ্র থাকে যে হরিণের নাভিকোষ কেটে নেওয়ার সময় শিকারিরা মোটা কাপড় দিয়ে নিজেদের নাক বেঁধে নেয়। অনেক সময় এ গন্ধ সহ্য করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। কারো কারো চোখ, নাক থেকে জল ও মুখ থেকে লালা ঝরা শুরু হয়। এমনকি জীবনহানিও ঘটে। এইসবই আমার বিভিন্ন গ্রন্থ পড়ে জানা। তবে এই লক্ষদ্বীপের আনাচে কানাচে রহস্য লুকিয়ে আছে। তাই এখানে দশটি দ্বীপ ছাড়া অন্য দ্বীপে যাওয়ার পারমিশন নেই। তবু চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনী।
মদনলাল এবার বিদায় নেবেন। সমুদ্রের ঢেউ একের পর এক দ্বীপকে ভিজিয়ে চলেছে নিশিদিন। আমরা ভেসে চলেছি অজানা কে জানার নেশায় যাযাবরের মত।
রাজু বলল, আপনি স্ত্রীকে পাঠিয়ে দিয়েছেন কিন্তু আপনার খবর তো পায় নি। সন্তুদা বলল, আমি ওকে বিয়ে করেছি। ওর সঙ্গে আমার পরিচয়ও ছিল না। গরীব একা মেয়ে দেখে বিয়ে করেছি। ওর বাবা, মা কেউ নেই। আমার মোবাইল ফোনে সে আমার খবর পায়।
শ্যামলী বলে, এবার সন্তুদা বাড়িতেই থাকবেন। আপনি ধনী লোক। সরকারি চাকরি করতেন। আপনার অভাব নেই। সন্তু বললো, আমি খেয়াল হলে হাওয়াই জাহাজে চড়ি আবার পয়দলেও স্বচ্ছন্দ। দেশে দেশে আমার ভালবাসা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এবার আমরা বাড়ি যাব। তোমরাও বাড়ি যাবে। নিজের বাড়ি ছেড়ে আর কোথাও যাবে না। চাষ করবে, ফসল ফলাবে। প্রয়োজনে আমাকে ডাকবে। আমিও রাজুর মত শ্রমিকের কাজ করেছি। কুলিগিরি করেছি। কোন কাজই ছোট নয়। আমরা কৃষিকাজে এবার মন দেব সবাই। তাহলে দেখবে কাউকে আর গ্রাম ছাড়তে হবে না।
শ্যামলী বলল, সন্তুদা তোমার তো অভাব ছিল না। বিয়ে হয়েছে। মা বাবা ছিল। তাও তুমি ঘরছাড়া কেন হলে?
সন্তু বলল, আমার বিয়ের পরে বৃন্দাবনে গেছিলাম। তারপর লাক্ষা দ্বীপও ঘুরেছি। ফোনে বাবা জানিয়েছিলেন, একটি গ্রামের ছেলেকে নিয়ে আমার বউ ঘর ছেড়ে পালিয়েছে কামের তাড়নায়। আর আমি বৃন্দাবনের দেখা মেয়েকে আবার দেখতে গেছিলাম। তার কেউ নেই। আমি তাকে ভালবেসেছিলাম। সেই আমাকে গেরুয়া পরিধান করিয়েছে। আমাদের প্রেম দেহের উর্ধে। মনের সেতুবন্ধন। রাজু বলল, আমাদের বলুন বৃন্দাবনের কথা। সন্তু শুরু করল বৃন্দাবনের কাহিনীর কথা।
দুজনে ভেবে ভেবে ঠিক করলাম বৃন্দাবনে যাবো। রমার সঙ্গে পরিচয় আগে ছিল না। বিবাহসূত্রে পরিচিত হয়েছে। এখনো পরিচয়পর্ব অনেক বাকি আছে। কেউ কাউকে চিনতাম না। বাড়ি থেকে দেখাশোনা করে বিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এবার নিজেদের মধ্যে পরিচিতি বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন সময় গল্প-গুজব করি আমরা। সময় কাটাতে আবার কাজের ফাঁকে ফাঁকে বেড়াতে যাওয়ার কথাও চিন্তা করতাম। ঠিক ভেবে ভেবে তাদের সময় পেরিয়ে বৈশাখ মাস থেকে জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ় শ্রাবণ, ভাদ্র পেরিয়ে আশ্বিন মাস হল।পুজোর ছুটিতে ঠিক করলাম বৃন্দাবনে যাবো। শুরু হল তোড়জোড়। প্রয়োজনের কিছু জিনিস নিলাম। বাকিটা কিনে নেওয়া যাবে। আমি জানি নগদ টাকা পয়সার সঙ্গে এ টি এম কার্ডটাও রাখতে হবে।
কলকাতা থেকে দিল্লি আগ্রা হাইওয়ে ধরে ১৩৫ কিলোমিটার দক্ষিণে গেলেই বৃন্দাবন। বৃন্দাবনও মথুরায় মন্দির কম করে হলেও ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় তিন হাজার প্রায়। মন্দিরগুলি যার বেশিরভাগই কৃষ্ণ, রাধা কৃষ্ণর সঙ্গে কোন না কোন ভাবে সম্পর্কিত। বৃন্দাবনে গিয়ে তারা প্রথমে ঠিক করল বাসা। একটি লজ পছন্দ হয়েছে। লজের নাম রাধা ভবন।
সেই রাধা ভবনে তারা আশ্রয় নিল। ভাড়া মিটিয়ে চাবি নিয়ে ঘরে ঢুকল। এখানে নিরামিষ খাওয়ার ব্যবস্থাও আছে। রমা ও অনুপের পছন্দের খাবার এখানে আছে। লজের সামনে একটা বেশ সুন্দর রাধাকৃষ্ণের ছবি। আর কৃষ্ণের হাতে বাঁশি। স্বয়ং কৃষ্ণ যেন সাক্ষাৎ দাঁড়িয়ে একদম বাঁশি বাজাচ্ছেন। অনুপ আর রমা খুব সুন্দর ভাবে খাওয়া দাওয়া করার পর দুপুরের দিকে বেরিয়ে পড়ল বৃন্দাবন ঘোরার জন্য। বেড়াতে এসে তো আর শুয়ে পড়ে সময় কাটানো ভালো লাগে না। তাই ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম একটার পর একটা মন্দিরের অভাব নেই। এখানে এসে এখনো মনে হয় যার মনে হয় যেন হাজার বছর আগে থেমে আছে। উত্তরপ্রদেশের এই প্রাচীন ভূখণ্ডটি শহর হয়ে ওঠে। শহরে নেই পাঁচতারা হোটেলের ঝলক। শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত শপিং প্লাজার স্মার্টনেস কিংবা মাল্টিপ্লেক্সের উত্তরাধুনিকতা কিছুই যেন ছুঁয়ে যায়নি ব্রজভূমিকে।
সরু গলি কাচা-পাকা রাস্তা সাইকেল রিকশা মলিন স্কুল ইউনিফর্ম পরা দল মন মাতিয়ে চলে। রাস্তায় কেবলই গেরুয়া বসনধারীর সংকীর্তন ধ্বনি। কেমন লাগছে তোমার রমা। অনুপ বলল।আমার বউ রমা বলল, সব দেখে খুব ভালো লাগছে। দেখো কুমোরপাড়ায় মাটির কারুকাজ। এদের আর কোন আলাদা ইষ্ট নেই, শ্রীকৃষ্ণ চরণের এই ভূমিতে। মাটির তৈরী রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহ বিস্ময় জাগায় অনুপের মনে প্রাণে। এখানে একটা দোকানে শ্রীকৃষ্ণের প্রচুর ছবি বিক্রি হচ্ছে। সেই ছবি বিক্রি করছে একজন সুন্দরী মহিলা। তার বিয়ে হয়নি কি বিধবা বুঝতে পারছে না অনুপ। কেবল তার ডাগর রূপ মনে এক অদ্ভুত সুর তোলে ক্ষণে ক্ষণে। অনুপ ভাবে, ভাগ্যিস মনের রূপ দেখা যায় না চোখে। তা না হলে কত হৃদয় যে ভেঙ্গে যেত মুহূর্ত প্রেমে। সে এতো সুন্দরী যে তাকে তাকে দেখতে মনে হয় অনেক বার। বারবার ঘুরে ফিরে তার দিকে চোখ দিয়ে ফেলছে।
স্ত্রী রাগ করে বলছে তুমি ওদিকে বারবার তাকাচ্ছ কেন। কী মনে করবেন উনি। অনুপ কিন্তু দৃষ্টি সংযম করতে পারছে না।
সুন্দরী মেয়েটি বলল, নিন বাবু দুটো ছবি নিন শ্রীকৃষ্ণের ছবি বাড়িতে থাকা খুব মঙ্গলের। এই ছবি থাকলে কোন বিপদ-আপদ আপনাদের জীবনে নেমে আসবে না। রোজ দুবেলা এই শ্রীকৃষ্ণের ছবিতে ধূপ দেখাবেন। বাতি দেখাবেন। তাহলে দেখবেন কোন বিপদ আপনাকে ছুঁতে পারবে না।
আমি বললাম দুটো নয়, আমাদের চারটে ছবি দিন। আমরা চারটে ঘরে চারটে ছবি টাঙিয়ে রাখবো।আর মনে মনে ভাবল তোমার স্মৃতি ও এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকবে। দাও চারটে শ্রীকৃষ্ণের ছবি দাও।
রমা বললো চারটে প্রয়োজন নেই। একটাই নাও।
- না একটা নিলেই তো হয় না।
- ঠিকমতো ধুপ বাতি দেখালেই তো একটা ফটোতে ভক্তি হবে। ভক্তি দেখানোর জন্য অত ছবি নেওয়ার প্রয়োজন নেই।
আমি বললাম, তুমি বাধা দিও না প্লিজ। না চারটিই থাক। আমি সুন্দরী মেয়েটিকে বললাম, আপনাকে কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে পারি? সুন্দরী মেয়েটি বলল হ্যাঁ নিশ্চয়ই পারেন।
- আপনার নাম কি জানতে পারি। মেয়েটি বলল হ্যাঁ নিশ্চয়ই, আমার নাম লেখা।
- আপনি এখানে আপনি এখানে এলেন কি করে।
মেয়েটি বলল আমি বিধবা হওয়ার পর এখানে এসেছি। তারপরে আমি নিঃসন্তান। তাই একাই আমি এই ব্যবসা করি আর বৃন্দাবন ধামের প্রসাদ গ্রহণ করি। এইভাবেই আমার জীবন চলে যায় রাধামাধবের দয়ায়। জয় রাধে জয় রাধে।
রমার মনে এইবার মায়া জেগে উঠলো সে বললো আহা এত অল্প বয়সে তুমি বিধবা হয়ে গেছো আমি শুনে খুব দুঃখ পেলাম। জয় রাধে।
আমি বললাম - এই বৃন্দাবনে বেড়াতে আসার উৎকৃষ্ট সময় কোনটা বলতে পারেন? লেখা বলল, বৃন্দাবনে বেড়াতে আসতে হলে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ থেকে নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে শ্রেষ্ঠ সময়। সে আরও বলল, বৃন্দাবনে গোবিন্দজী মন্দিরটি অসাধারণ দেখবেন। দেখবেন পুরোটা লাল পাথরে তৈরি। প্রায় হাজারখানেক কারিগর নাকি পাঁচ বছর ধরে মূর্তি তৈরি করেন।
আমরা শুনেছি তবে এই বিষয়ে একটা কথা বলা ভালো আপনার বিশ্বাস থাক আর না থাক বেড়াতে গিয়ে সমস্ত সন্দেহ সরিয়ে রাখবেন। আপনার সন্দেহ জড়িয়ে না থাকাই রাখাই ভালো।
রমা এবার বলল - আপনাকে দেখে তো শিক্ষিত মনে হচ্ছে আপনি তো অনেক খবর রাখেন। লেখা বলল - হ্যাঁ আমি নরসিংহ দত্ত কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন করেছি। পড়াশুনা করি বৃন্দাবনের ইতিহাস নিয়ে। অনেক বই পাবেন বাংলা, হিন্দী বা ইংরাজীতে লেখা। এই বৃন্দাবনের পৌরাণিক ইতিহাস।
লেখাও বলল, আমার বরাবরই এই বৃন্দাবন ধামের প্রতি একটা আকর্ষণ ছিল। ঈশ্বর শ্রীকৃষ্ণ যেন আমার সেই আশাই পূর্ণ করে দিয়েছেন। জয় রাধে।
আমি বললাম - তাহলে আপনার দেবতা কৃষ্ণ। শুধু কৃষ্ণ। আহারে কৃষ্ণ প্রেমের কারণে আপনি এখানে এসেছেন।
লেখা বলল, হ্যাঁ ঠিক তাই। ঠিক তাই। ঠিকই ধরেছেন আপনি। এই একটাই দেবতাকে ভজনা করি। তবে শুধু কৃষ্ণ প্রেমের কারণে নয় ভাস্কর্যশিল্পের দিক থেকেও মথুরা অত্যন্ত আকর্ষণীয়।
আমি বললাম তাহলে কৃষ্ণ প্রেমই আপনাকেই বৃন্দাবনে টেনে এনেছে।আর তার সৌন্দর্য আপনাকে মুগ্ধ করে।
লেখা বলল - হ্যাঁ এটা বলতে পারেন। আমার জীবনে ইচ্ছে ছিল এই শ্রীবৃন্দাবনে এসে শেষ দিন কাটানো। ঈশ্বর যেন সেই আশাই পূর্ণ করলেন। আবার বলল লেখা, তবে শুধু কৃষ্ণ প্রেমের কারণে নয় ভাস্কর শিল্পের দিক থেকেও দেখবেন এই কাছের মথুরা অত্যন্ত আকর্ষণীয়। মিউজিয়ামে প্রায় ২০০০ বছর আগে বুদ্ধের মূর্তি অপূর্ব সুন্দর দেখবেন। আপনারা থাকুন কিছুদিন এখানে। শুধু পাথরের মূর্তি সংগ্রহ প্রায় ৫ হাজারের মত। ভাল লাগবে দেখে।
রমা বললো - দুদিন দোকান বন্ধ রেখে আমাদের সঙ্গে ঘোরাঘুরি করুন না। আপনাকে নিয়ে দেখলে সব কিছু জানা যাবে। আপনার আর্থিক কোনো ক্ষতি হবে না। আমরা আপনাকে পারিশ্রমিক দিয়ে দেব।
লেখা বলল, ঠিক আছে আমার আপত্তি নেই। আমি আপনাদের এই কৌতুহল মেটাতে রাজি।
আমি ভাবলাম, মানুষ অজান্তে খাল কেটে কুমির আনে জীবনে। হয়ত এটাই ভবিতব্য। তারপরের দিন থেকে লেখাকে নিয়ে শুরু হলো মথুরা ভ্রমণ। মথুরা জুড়ে ২,৫২৫টি ঘাট আছে। বিশ্রাম ঘাটের সৌন্দর্য সবাইকে মুগ্ধ করে। লেখা কথাগুলো বলে চলেছে আমরা শুনে চলেছি। লেখা আরো বলছে, কথিত আছে কংস বধের পরে শ্রীকৃষ্ণদেব এই ঘাটে বিশ্রামে ছিলেন। এই ঘাটে তাকে ঘিরে রয়েছে অসংখ্য মন্দির। বিশ্রাম ঘাটে সন্ধারতি এক অনন্য অভিজ্ঞতা। কোন পর্যটক এটা মিস করেন না। লেখা বলল, আমাদের বিয়ের পরও আমরা প্রথম হানিমুনে বৃন্দাবনে এসেছিলাম। আমার মনে পড়ে আমরা ওই লজেই থেকেছি। আপনারাও রাধা ভবনে আছেন।
ওই রাধা ভবনে যে আমরাও ছিলাম আজ থেকে পাঁচ বছর আগে। কিন্তু আমাদের বিবাহ জীবন সুখের হলো না। স্বামী এক পথ দুর্ঘটনায় মারা গেলেন। জয় রাধে। আমার স্বামী ছিলেন কবি, বাউল। সংসারে তার মনযোগ ছিল না। মালিহা গ্রামে তাদের বাড়ি ছিল। খুব আনন্দে থাকত আমার স্বামী। সে আমাকে তার জীবনের গল্প বলেছিল। স্বামীর নাম ছিল সন্তু। আসুন আমরা বিশ্রামঘাটে বসে তার গল্প বলি।
সে বলেছিল আমাকে, কিন্তু বড় সংসারের দায়ীত্ব তার কাঁধে। মায়া কাটাতে হবে। বাউলের মন হয়ে যায় সন্তুর। সে ভাবে, এসব প্রেমের বিলাসিতা কি আমার সাজে? সন্তু ভাবে,বারবার ভাবে পাপিয়ার কথা। কিন্তু ভালবাসা সহজে কেউ পায় না আর কেউ কেউ বাউল সাধক। মানুষের মাঝেই তাঁর বাসা। উদাস ভালবাসা। বৃন্দাবনের শান্তি বারিতেই যেন বিশ্বের মানুষ ভালোভাবে বেঁচে আছেন। সমস্ত দুঃখ তাপ জন্ম থেকে মুছে গেল মুহূর্তে। রমা বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে দেখল আমি জোড়হাতে বিছানায় বসে আছি। রমা জিজ্ঞেস করল কি হল তোমার তুমি কি রাধার রাগে মগ্ন আমি বললাম, হ্যাঁ আমি আমি রাধাভাবে আচ্ছন্ন। এখন রাধার প্রেমে আমি মাতোয়ারা। জানো শ্রীকৃষ্ণ রাধা কৃষ্ণের দর্শন আমার এই ঘরে বসেই হয়ে গেল। আমি মগ্ন হয়ে থাকলাম কিছুক্ষন শ্রীরাধাভাবে মানবদেহের রাধাভাব এর মধ্যে দেখতে পেল লেখাকে।
লেখার সুন্দর মুখখানি ভেসে উঠেছে। সেই সেই মুখে কোনো ব্যথা নেই যন্ত্রণা নেই শুধু আলো আর আলো।
আমরা কয়েকদিন এসেছি। কিন্তু এই কদিন এসে আমাদের শারীরিক মিলন কিন্তু একবারও হয়নি।
কেমন যেন আচ্ছন্ন হয়েছি আমি। রমা খুব অবাক হল কি হল। সে ভাবল, আমার স্বামীর এ কি হল। সে ভাবল যে শ্রী কৃষ্ণ ভক্তিতে সে হয়তো এগুলো করতে চাইছে না। এখন বাড়ি গেলে হয়ত সব ঠিক হয়ে যাবে। পরের দিন আবার শুরু হলো বৃন্দাবনের দর্শনীয় স্থানগুলো দেখার জন্য। লেখা সুন্দরী এসে গেছেন অমোঘ আকর্ষণে। অনুপ মনে মনে ভাবল এই কথা। হয়ত আমাদের ভালবাসা হয়ে গেছে প্রথম দর্শনে। লেখা বলল-এখানে দর্শনীয় স্থানের অভাব নেই যুগল ঘাঁটি সেবাকুঞ্জ ও কালিয়া ঘাটাল শ্রী কুঞ্জ গোবিন্দ কুণ্ডু শিলঘাটা মদনমোহন বাঁকে বিহারী রাধাবল্লব যুগলকিশোর রাজি দামোদর গোবিন্দ গোবিন্দ। এগুলো আমাদের দেখাও লেখা।
আমি বললাম, আমরা একে একে সব দর্শনীয় স্থান ঘুরবো তবে প্রথমে বৃন্দাবন মন্দিরটা একবার দেখাও। লেখা বলল চলুন আজ আমরা বিদ্যামন্দিরে যাই। সেখানে এক বিরাট আকর্ষণ অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। লেখা বলল মদনমোহন মন্দিরটি কালীঘাটের কাছে মথুরা থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে এই মন্দিরগুলো বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে আছে। রমা জিজ্ঞাসা করল আচ্ছা মুলতানি কাপুর কি এই মন্দিরটি নির্মাণ করেন? লেখা বলল, এটিই বৃন্দাবনের সবচেয়ে পুরনো মন্দির। বাঁকে বিহারী মন্দির, জয়পুর মন্দির, রাধাবল্লব মন্দিরটি তৈরি হয়েছিল ১৮৭৬ সালে।অন্যতম আকর্ষণ রাধাকৃষ্ণের বহু মূল্যবান অলঙ্কারসমূহ। এগুলো ভারতবর্ষের সম্পদ।
আমি বললাম আপনি এত কিছু জানলেন কি করে? লেখা বলল আমার এখানে প্রায় দশ বছর থাকা হয়ে গেল। আর বৃন্দাবন ভ্রমণ বৃত্তান্ত, বইয়ে পাবেন এসব কথা। এখানে বই কিনতেও পারেন।তাছাড়া বাইরের অনেক বই আছে। জানার ইচ্ছেটাই আসল। রমা ঘুরতে ঘুরতে লেখা আর আমার দৃষ্টির বাইরে চলে গেল। সে হয়তো অন্য কোথাও ঘুরতে গেছে।
চলে আসবে চিন্তা করবেন না। এখানে চলে আসবে। আর না হলে আমার তো সব জানা জায়গা। আমি খুঁজে নিয়ে আসবো। আমি বললাম এখন ওকে দরকার নেই। এখন আমার তোমাকে দরকার।তাই আমরা হয়ত সুযোগ পেলাম বিধির বিধানে।
তোমাকে একটা গোপন কথা বলতে চাই। লেখা বলল, বলুন আমিও বলবো একটা কথা কিন্তু আমি কি করলাম আর কি, লেখাকে জড়িয়ে ধরে দীর্ঘ চুম্বনের রত হলাম। এটাই চাইছিল লেখা। তার শরীর কেঁপে উঠল। মনে মনে তৃপ্ত হল। এর মধ্যে রমা চলে এসেছে।
তখন রমা দেখল আমি আর লেখা গল্প করতেই ব্যস্ত।
দশ
আমি বললাম আমরা সারা জীবন যদি এখানে থাকতে পারতাম তাহলে খুব ভালো হতো। রমা বললো তাহলে ঘর-সংসার ছেলে চলো দুজনেই আমরা এখানে সন্ন্যাসী হয়ে থেকে যাই।
তারপর, আহা তারপর দুজনে মিলে এখানে সারা জীবন কাটিয়ে দিই। লেখা বলল, তাহলে আজ এই অবধি থাক। এখন রাত্রি নটা বেজে গেছে এখন আপনারা বাড়ি যান। এই বলে লেখা নিজের গন্তব্যের দিকে রওনা দিল। লজে এসে রহমান নিরামিষ খাওয়া দাওয়া দিয়ে গেল। আহার করে তারা বিছানায় শুয়ে পড়ল। তারপর রমার সঙ্গে সঙ্গমে রত হলাম।
আজ এত ভালো লাগছে কেন রমা বুঝতে পারলো না। রমাকে আসলে লেখা ভেবে অনুপ আদর করতে শুরু করলাম।
তার মধ্যে লেখার ভাব পরিস্ফুট হতে দেখল। লেখাকে আমি আদরে আদরে পাগল করে তুললাম।রমা বলল আমি কোনোদিন এতক্ষণ এত আনন্দ পাইনি। তুমি আজকে আমাকে খুব আনন্দ দিলে।আমি বললাম, রমা তুমি কি শুনতে পাচ্ছ চারিদিকে বাঁশির আওয়াজ। কি মিষ্টি শ্রীকৃষ্ণের বাঁশির আওয়াজ ভেসে আসছে।
তুমি কি শুনতে পাচ্ছ বাঁশির আওয়াজ।এই বাঁশির আওয়াজ আমি শুনে এত আনন্দ হচ্ছে কেন।রমা বলল,কই আমি তো বাঁশির আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি না পাচ্ছি না। তুমি কি পাগল হয়ে গেলে।
আমি বললাম, আমি বোধহয় ভুল শুনছি নাকি। ঠিক শুনছি। এই তুমি কি পেতে শোনো দেখো বাঁশির আওয়াজ ভেসে আসছে চারিদিক থেকে। এমন সময় রমার মোবাইল ফোনটা বেজে উঠলো। এতদিন লেখার সঙ্গে যোগাযোগ রমার সঙ্গে কথাবার্তা সব মোবাইল ফোনেই হয়েছে। লেখার মোবাইল ফোন আছে। ফোনে রমাকে জিজ্ঞেস করল, আপনি কি বাঁশির আওয়াজ শুনতে পাচ্ছেন?
চারিদিক থেকে বাঁশির আওয়াজ ভেসে ভেসে অন্তর ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে প্রেম সুন্দরের কাছে। সুন্দর বাঁশির আওয়াজ ভেসে আসছে আসছে রমাদি। রমাদি আপনি শুনছেন। সন্তুদা কি শুনতে পেয়েছেন বাঁশির ইশারা। রমা নিরুত্তর হয়ে বসে রইল। হারিয়ে যাওয়ার ভয় চেপে ধরল রমার অন্তর। সে বলল, না আর নয়, এবার ফিরতে হবে। আমি বললাম,ফিরতে পারব কি? ফেরা যে কঠিন হল মরমিয়া।
রমা অনুপের কথায় হেঁয়ালির সুর খোঁজে। বাঁশির সুর তার কানে বাজে নি। সে জানে না, এখনও এখানে বাঁশি বাজে। সারা পৃথিবী জুড়ে বাঁশির খেলা চলেছে নিশিদিন। মোবাইলের ও প্রান্ত থেকে শোনা গেল লেখার গলায় বাঁশির করুণ সুর, রমার মোবাইলে সাউন্ড হাই থাকায়। হ্যালো হ্যালো হ্যালো, আমি শুনছি বাঁশির সুর। এসুরে আমি মাতোয়ারা। এ সুর ভালবাসার...
তারপর বাড়ি চলে গেলাম কিন্তু মন পড়ে রইল বৃন্দাবনের লেখার খাতায়। আবার বাড়ি ছাড়লাম। লেখা শিখিয়ে দিল দেহ ছাড়া প্রেম। সে বৃন্দাবনের আশ্রম ছেড়ে এল না আমার সঙ্গে। আমার আর খেদ নেইন। দেখেছি পরম পুরুষের ঈশারা। আমি গ্রামে যাব। চাষ করব। আর কোন তরুণ যেন গ্রাম ছেড়ে বাইরে না যায়। আমি তোমাদের সাহায্য চাই।
রাজু বলল,আমরাও চাষ করব। আর কোথাও যাব না। আমরাও অন্য তরুণদের উদ্বুদ্ধ করব। এখন থেকে এটাই হবে আমাদের মন্ত্র। আজ সকালে উঠে থানার আই সির পারমিশন নিয়ে তারা ট্রেনে চেপে বসলন এক মাস পরে। আর কোন বাধা নেই। নতুন পৃথিবী গড়বে এবার নব উদ্যমে।
কিশোর
উপন্যাস


এক
ডাঃ হরেনবাবু হোমিওপ্যাথির ডাক্তার। তার ডাক্তারখানায় ঝোলানো কঙ্কালে হাত দিতে ভয় লাগত। সর্দিকাশি, পেটখারাপ বা অন্যকোন রোগ হলেই আমাদের আশ্রয় ছিল হরেনবাবুর চেম্বার। হরেনবাবু এক ডোজ ওষুধ খাইয়ে দিতেন প্রথমে তারপর কাগজ কেটে কাঁচের শিশিতে আঠা দিয়ে সাটিয়ে দিয়ে রোজকার ওষুধের পরিমাণ, নির্দিষ্ট করে দিতেন। হোমিওপ্যাথি ওষুধ খেতে আমার মত সব কিশোর কিশোরীর মন্দ লাগে না। বেশ মিষ্টি, মিষ্টি। ছোট ছোট সাবুদানার মত দেখতে।
আমি, রতন, হারু, বিনয় আরও অনেক বন্ধু একসঙ্গে থাকতাম। একই স্কুলে পড়ি। একই মাঠে খেলি। ডাক্তারবাবু খুব কড়া মেজাজের লোক হলেও আমাদের ক্রিকেট দলকে খুব ভালোবাসতেন। প্রয়োজনে তিনি ব্যাট, বল কিনে দিতেন। উৎসাহ দিয়ে বলতেন, যারা খেলা করে তাদের কোন রোগ সহজে কাবু করতে পারে না। খেলবি, দূরদূরান্তে গাঁয়ের নাম ছড়িয়ে দিবি ম্যাচ জিতে শিল্ড এনে। একদিন আমরা সকল বন্ধু একসঙ্গে খেলা দেখার জন্য, ট্রেন ধরে চলে গেলাম কুমোরপুর হাটতলা হল্ট। মনে করলাম, তাড়াতাড়ি চলে আসব, দুপুরের আগে। পরীক্ষা হয়ে গেছে। বাড়িতে শাসনের দড়িটা একটু ঢিলে হয়েছে। মা বলেছেন, খাওয়ার সময় যেন ডাকাডাকি করতে হয় না। আর সবসময় স্বাধীন এই কটা দিন। বন্ধুরা ডাকল ক্রিকেট খেলা দেখার জন্য। আমাদের ফুল টিম খেলা দেখতে চলে এলাম কুমোরপুর হল্টে বিনা টিকিটে। ভাবলাম খাওয়ার সময়ের আগে বেলা দুটোর সময় হাজির হয়ে যাব মায়ের কাছে। কিন্তু সব উল্টোপাল্টা হয়ে গেল।
একটা টিম খেলতে আসে নি। এত আয়োজন ব্যর্থ হয়ে যাবে ভেবে আমরা কমিটির কাছে একশ টাকা দিয়ে আবেদন করলাম। কমিটি রাজি হল। আমরা মাঠে নামলাম ফুল টিম নিয়ে।পরপর অনেক টিমকে হারিয়ে আমরা ফাইনালে উঠলাম। ফাইনাল খেলা শুরু হবে বিকেল তিনটের সময়। এখন দুটো বাজে। মায়ের মুখটা মনে পড়ছে। ভাতের থালা সাজিয়ে বসে আছেন নিজে না খেয়ে। যেতে পারলাম না বাড়ি। খিদে লেগেছে খুব পাশের বাড়ির কাকিমা মাঠের ধারেই বাড়ি। কাকু, কাকিমা দুজনে এসে বললেন, তোমাদের খেলা দেখে ভাল লেগেছে আমাদের। আমরা তোমাদের সাপোর্টারস। এই নাও এক থালা পিঠে তোমরা খাও। আমরা ভালোবেসে বানিয়েছি। আহা খিদে পেটে অই পিঠে একদম অমৃত। পেট ভরে খেলাম। আমার ভাই বাবু বলল, দাদা আজ বাবা চামড়া তুলবে পিটিয়ে। আমি বললাম, কি আর করা যাবে। অন্যায় করলে তো কেউ ছাড়বে না।
তারপর ফাইনালে জিতে শিল্ড নিয়ে আমরা ট্রেনে চেপে বাড়ি ফিরলাম। আমাদের বিজয় নাচ দেখতে হাজির হল গ্রামের লোকজন। ডাক্তার হরেনবাবুকেও ভিড়ে দেখলাম, হাত নাড়ছেন হাসিমুখে।
বাবা, লাঠি হাতে চিৎকার করছিলেন। খেলায় জেতা, বড় শিল্ড দেখে চুপ করে গেলেন। মাকে ডেকে দিয়ে নিজে চলে গেলেন ছাদে।
তারপর বাড়ি ঢুকলাম সন্ধ্যাবেলায়। মা তখনও উপোষী। একসঙ্গে খেলাম পিঠে আর খেজুর গুড়। মা পিঠে হাত বুলিয়ে বললেন, তোদের বাবা খুব খুশি। আমাকে ডেকে দিয়ে বললেন - যাও দেখ গিয়ে গ্রামের ছেলেরা খেলে শিল্ড এনেছে। গর্বের খবর গো। তারপর থেকে বাবা আমাদের আর কোনদিন গায়ে হাত দেন নি।
দুই
প্রথমে হাঁটু মোড়ল রাস্তার ধারে গাছ লাগাত কোন লাভের প্রত্যাশা না করেই। পৈতৃকসূত্রে তার দুবিঘে জমি আছে। একদিন হাঁটুর স্ত্রী বললেন, ওসব কাজ করে তো পেট ভরবে না। গাছ লাগানোর ফাঁকে জমি দুবিঘায় সবজির চাষ কর। তারপর হাটবারে বিক্রি করে আসবা। হাঁটু ভাবে, বউটা কথাটা মন্দ বলে নি। চাষ না করলে খাব কি? তারপর থেকে হাঁটু মোড়ল সবজি চাষ করে আর বিক্রি করে আসে হাটবারে।
সপ্তাহে দুদিন হাট বসে ভুলকুড়ি গ্রামের বাসস্ট্যান্ডে। প্রায় দশ বারোটা গ্রামের খরিদ্দার এই হাটে আসেন সবজি, মাছ ও আরও নানারকম জিনিস কিনতে। হাঁটু মোড়ল সবজি চাষী। তাঁর বেলুন গ্রামে, বাড়ি। তিনিও সবজি নিয়ে বসেন হাটবারে। তিনি বলেন - আমি জমিতে কোন রাসায়নিক সার বা কীটনাশক প্রয়োগ করি না, কারণ বন্ধুপোকা না বাঁচলে মাটির উর্বরতা কমে যাবে।
হাঁটু বলেন - খরিদ্দাররা পছন্দ করে লকলকে লাউশাক, পালংশাক বা বড় ফুলকপি। হাঁটু মোড়ল জানে ওইসব হাইব্রিড ফসলের কোন মিষ্টতা নেই। দেখতেই সুন্দর খেতে ভাল নয়। কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে তার ক্ষেতের সবজি দেখতে সেরকম না হলেও খেতে সুস্বাদু। কিছু বাঁধা খদ্দের হাঁটুর আছে। তারা, তার কাছেই সবজি নেয়।
হাঁটু মোড়লের কাছে একজন শিক্ষিত লোক আসেন। তিনি তার কাছেই সবজি কেনেন। তিনি বলেন কীটনাশক প্রয়োগ না করা সবজিই আমার পছন্দ। হাঁটু মোড়ল বলেন - সবাই তো তাই খায়। আমার সবজি বিক্রি হয় কম। আপনি একটু বুঝায়ে বলুন দেকি, কি কি ক্ষতি হয় কীটনাশক প্রয়োগ করলে।
শিক্ষিত ভদ্রলোক বললেন - সবজিতে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের ফলে কিডনি ও যকৃতে সমস্যা দেখা দিচ্ছে। কৃষি বিভাগের নিয়মানুযায়ী সহনীয় পর্যায়ে কীটনাশক প্রয়োগ করা উচিত, তাহলে তা পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতি বয়ে আনবে না।
টমেটোর গাছে অধিক ফলনের জন্য বেশি পরিমাণে রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও ছত্রাক নাশক প্রয়োগ করতে হচ্ছে। হাইব্রিড টমেটো চাষাবাদের কারণে অধিক পরিমাণে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের প্রয়োজন হয়। চলতি মৌসুমে কৃষকেরা খেতে সিতারা ও সিক্সআর জাতের বিষাক্ত কীটনাশক চার-পাঁচ দিন পরপর প্রয়োগ করছেন। কীটনাশক প্রয়োগ করলে খেতের আশপাশের নদী, ছড়া, নালা এমনকি জলাভূমিতে তা ছড়িয়ে পড়ে উদ্ভিদ, সাপ, ব্যাঙ, মাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির জলজ প্রাণী মারা যায়।
বাজারের চকচক করা টমেটো বা সবজি কিনে না খাওয়াই উত্তম। এমনকি এগুলো কেউ বিনা মূল্যে দিলেও নেওয়া ঠিক হবে না। এ ছাড়া এ সময় তাঁরা কীটনাশকের দুর্গন্ধও পেয়েছেন। এগুলো মুছতে না মুছতে আবারও কীটনাশক প্রয়োগ করা হয়। কৃষি বিভাগ থেকে নিয়মিত কৃষকদের সহনীয় পর্যায়ে সার ও ছত্রাক নাশক প্রয়োগের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। কৃষকদের কীটনাশক ব্যবহারের পরিবর্তে জৈব সার, ফেরোমোন বড়ি এবং হাত দিয়ে পোকা দমনসহ যান্ত্রিক পদ্ধতি ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
হাটুমোড়ল খুব মন দিয়ে কথাগুলো শুনে বলল - মাটি হচ্ছে মা। মা কে বিষ খাইয়ে মেরে দিলে পাপ হবে। ছেলেমেয়েরা আর শুদ্ধ মাটি পাবে না। বিষাক্ত, কালো হয়ে যাবে মাটি।
শিক্ষিত না হয়েও হাঁটু মোড়লের কৃষি জ্ঞান দেখে সকলে অবাক হয়ে যান।
কয়েক বছরের মধ্যেই রাস্তার ধারে লাগানো গাছগুলো বেশ বড় আর সবুজ হয়ে উঠেছে। হাটে যাওয়ার পথে হাঁটু দেখল, গাছগুলোতে গজাল ঠুকে লেখা হচ্ছে, বেলুন পঞ্চায়েতে ঢুকুন, সবুজ উপভোগ করুন। গজালগুলো হাঁটুর বুকেও আঘাত হানল। হাঁটু বলল,ছোট গাছে গজাল ঠুকো না, ওদের ব্যথা লাগবে। লোকটা হেসে উত্তর দিল - তোমার না লাগলেই হল, হাঁটু মোড়ল। নিজের কাজে যাও। হাঁটু আর কথা না বাড়িয়ে হাট থেকে ফিরে ফাঁকা রাস্তা দেখে আবার গাছ লাগাতে শুরু করে।
তিন
গ্রামের বাড়িতে আমাদের মাটির দোতলা বাড়ি ছিলো। সন্ধ্যাবেলা হলেই হ্যারিকেন নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে যেতাম দোতলার ঘরে। আমরা ভাই বোন একসাথে পড়ছি, এমন সময়ে কালোদার গলা শুনতে পেলাম। পড়ার থেকে গল্প হত আমাদের বেশি। বড়দা সবাইকে চুপ করতে বললো, কিসের চিৎকার হচ্ছে। শুনলাম নিচে হৈ হট্টগোলে সবাই ছোটাছুটি করছে। কালোদা আমাদের বাড়ির লোকাল গার্জেন। তিনি নিচে থেকে বলছেন - ওপরে যারা আছো, কেউ নিচে নামবে না। বড়দা জিজ্ঞাসা করলো - কেন কালো দা? কালোদা জোরে চেঁচিয়ে বললেন - গোলার তলায় গুলবাঘ ঢুকেছে। সাবধান। ওরা মানুষের রক্ত খায়। বড়দা বললো - গুলবাঘ আবার কি? কালোদা বললো - বাঘের মত দেখতে। কিন্তু বাঘ নয়। সাইজে একটু ছোটো। ঠিক হায়েনার মত। ওরা খুব হিংস্র।
বাড়িতে সবাই আতঙ্কিত। সকলে ঘরে ঢুকে খিল দিয়ে বসে আছে। উঠোন একদম ফাঁকা। আমার বড়দার ভালো নাম দিলীপ। কিন্তু বড় শ্রদ্ধায় ডাকনাম আমরা দিয়েছি, বাহাদুর বিশু।বাহাদুর বিশু পরোপকারী, বুদ্ধিমান, দরদী এবং সাহসী যুবক। বিশুর কাহিনী আমার স্মৃতিকথা, সাদা পাতায় জীবনরেখা গল্পে বিস্তারিত বর্ণনায় পাবেন। যাইহোক বিশু বললো - আর পারা যাচ্ছে না। গুলবাঘ গোলার তলায় ঢুকে আছে। বের হচ্ছে না। দেখি খুঁচিয়ে বের করি। এই বলে একটা গিঁট তোলা লাঠি নিয়ে নিচে নেমে এলো বিশু। একহাতে তিন ব্যাটারীর টর্চ আর এক হাতে লাঠি। সকলে চিৎকার করে উঠলো, যাস না হতভাগা। কিন্তু বিশু মনস্থির করে ফেলেছে।তার বুদ্ধিতে সে বুঝতে পারছে এটা ভয়ংকর কিছু নয়। কিন্তু বিশু লাঠি দিয়ে খোঁচা মারার সঙ্গে সঙ্গে গুলবাঘ বিশুর কাছে চলে এলো।সে দেখলো, একটা ভোঁতা মাথা। টর্চ রেখে বিশু মারলো চার লাঠি। কিন্তু একটাও গুলবাঘের শরীরে পড়লো না। জন্তুটা লাফিয়ে উঠছে তিন ফুট।তারপর বিশু মাথা ঠান্ডা করে অপেক্ষা করলো কিছুক্ষণ। সে দেখলো, জন্তুটা বসে আছে আর মাথাটা নাড়াচ্ছে। তিন ব্যাটারীর টর্চের আলোয় দেখলো বিশু, ওটা মাথা নয়। একটা ঘটি। জলের ঘটি। ঐ চারটে ট্যাংরা মাছ বিশু ছিপে ধরে রেখে ভুলে গেছে বাড়িতে বলতে। বিশু ঘটিটা হাত দিয়ে ধরে টান মারতেই খুলে গেলো। একটা বিড়াল মাছ খেতে গিয়ে ঘটিতে মাথা আটকে যাওয়ায় এই বিপত্তি। বিশু লাঠি রেখে বিড়ালটাকে ধরে আদর করলো। সবাই বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। কালোদা বললো - শালা বিড়ালের লোভ আর যাবে না। মারো শালাকে। বিড়ালটা আদরে আবদারে ডেকে উঠলো - ম্যাঁও।
চার
তখন গ্রামে চোর ডাকাতের উপদ্রব ছিল খুব। আমার বাবা সন্ধ্যে হলেই দরজা জানলা বন্ধ করে দিতেন। আমরা চার ভাই গ্রামের বাড়িতে থাকতাম। বাবা, মা, কাকিমা, দুইবোন সকলে একসাথে থাকতাম। বিশ্বকর্মা, সরস্বতী পুজোতে ঘুড়ি ওড়াতাম। দোলে রঙ মাখতাম উল্লাসে। তখন আকাশ এত খোলা ছিল, পুকুর ছিল। শীতকালে পুকুরের জল শুকিয়ে গেলে আমরা মাঠ তৈরি করে খেলতাম। ঝুড়ি, কোদাল নিয়ে পুকুরের তলা সমান করে ক্রিকেট খেলার পিচ বানাতাম। কবাডির কোর্ট বানাতাম দাগ দিয়ে। সকালে ছুটির দিনে কবাডি খেলতাম ছেলেমেয়ে একসাথে। একটা মেয়ের তনু নাম ছিল। তার সঙ্গে আমি কবাডি খেলতে পারতাম না। কত বন্ধু। তাদের সঙ্গে পড়াশুনোয় চলত কম্পিটিশন। কিন্তু বাইরে বন্ধু। বিকেলে ক্রিকেট খেলতাম। শটিবনের জঙ্গল ছিল পুকুরের পাড় জুড়ে। সেখানে লুকোচুরি খেলতাম।
সৈকত তার স্কুলবেলায় বিজ্ঞানের স্যারকে খুব ভালবাসত। সৈকতের অন্য বন্ধুরা বলত পাগলা স্যার। সৈকতের খুব রাগ হত। সে বলত, এইরকম পাগল হাজার হাজার প্রয়োজন আমাদের শিক্ষার জন্য। বিজ্ঞান স্যারের নাম ছিল পাই স্যার। মার্চ মাসে বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের জন্ম। এই বিজ্ঞানীর জন্মদিনে খুব মজা করে বিজ্ঞান বোঝাতেন স্যার। তিনি একবার বলেছিলেন, ছোটবেলায় আমরা সৌরজগতের গ্রহগুলো কে সূর্যের থেকে কত দূরে শিখেছিলাম। পৃথিবীর থেকে সূর্য পনেরো কোটি কিলোমিটার দূরে। কিন্তু মুশকিল হল এই‘পনেরো কোটি কিলোমিটার’–টা কতদূর তার ধারণা আছে নাকি আমাদের? তোমার স্কুল আর মামার বাড়ির দূরত্ব কত, বলতো সৈকত।
সৈকত বলল - স্যার তিন কিলোমিটার হেঁটে স্কুল যেতে মিনিট কুড়ি লাগে। একশো কিলোমিটার দূরে মামার বাড়ি যেতে বাসে ঘন্টাখানেক লেগে যায়। অমর বলল - আমার মামা দিল্লিতে থাকেন। কলকাতা থেকে দিল্লীর দূরত্ব দেড় হাজার কিলোমিটার – প্লেনে যেতে লাগে ঘন্টা দেড়েক কি দুয়েক। স্যার বললেন - তাহলে দেখ, এই একশো কিলোমিটার বা দেড় হাজার কিলোমিটার দূরত্বের সাথে আমাদের অভিজ্ঞতা দিয়ে একটা সম্পর্ক তৈরি হল। কিন্তু পনের কোটি? সেটা কত বড় সংখ্যা তা বুঝি নাকি? সুতরাং, সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্ব আমাদের কাছে একটা মুখস্থ করার সংখ্যা হিসেবেই রয়ে গেল, অনুভূতি বা ‘ইনটুইশন’–এ সাথে যুক্ত হল না। আবার এই দূরত্বের সাপেক্ষে পৃথিবী কত বড়, সূর্যই বা কত বড়, তাও মনের মধ্যে ছবি হয়ে রইল না! এই ধরণের নতুন তথ্যকে আমাদের অনুভূতির সাথে যুক্ত করা যায় অনেকভাবে। যেমন, একটা উড়োজাহাজ যার কলকাতা থেকে দিল্লী যেতে এক-দেড় ঘন্টা লাগে, তার কতক্ষণ লাগবে একই বেগে পৃথিবী থেকে সূর্য যেতে? উত্তরটা সহজেই দূরত্বকে গতিবেগ দিয়ে ভাগ করে পাওয়া যাবে – প্রায় সতের বছর! আবার ব্যাপারটাকে অন্যভাবেও ভাবা যায়। ধরা যাক, পৃথিবীর সাইজ একখানা পাঁচ সেন্টিমিটার ব্যাসের রাজভোগ কি রসগোল্লার মত। তাহলে এই স্কেলে সূর্য কত বড় আর কত দূরে হবে? অমর বলল - অঙ্কটা চট করে কষতে পারব ঐকিক নিয়ম লাগিয়ে। স্যার বললেন - হ্যাঁ পৃথিবীর ব্যাস মোটামুটি ১২,৮০০ কিলোমিটার, সেটাকে ছোট করে ৫ সেন্টিমিটার করে নাও। তাহলে পনেরো কোটি কিলোমিটার হবে ‘৫ সেন্টিমিটার X ১৫ কোটি / ১২,৮০০’ সমান প্রায় ৬০০ মিটার। এবার কিন্তু সৌরজগত সম্বন্ধে আমাদের একটা ধারণা তৈরি হল। মনে মনে একটা ছবি বানিয়ে নিলাম যে আমার টেবিলের উপরের রসগোল্লাটা পৃথিবী, আর মিনিট পাঁচ–ছয় হেঁটে গেলে সূর্যকে পাব। কিন্তু সূর্য তো বিন্দু নয়! তার ব্যাস প্রায় চোদ্দ লাখ কিলোমিটার। তাহলে আবার ঐকিক নিয়মে দেখে নেব যে আমাদের উদাহরণে সূর্য হবে প্রায় সাড়ে পাঁচ মিটার মানে মোটামুটি একখানা বড়সড় ঘরের মত। ঘরের মত চৌকো নয় অবশ্য, মোটামুটি গোলাকার।এইভাবে তিনি বিজ্ঞান বোঝাতেন সহজ করে। তারপর যখন বারো ক্লাসে পড়ি তখন স্যার একবার স্কুল ল্যাবরেটরিতে ক্লাস নিলেন। স্যার সিরিয়াস হয়ে পড়াচ্ছেন। প্রায় কুড়ি মিনিট পরে ক্লাসে সকলেই হাসতে শুরু করেছে। সৈকত ও তার বন্ধুরা তো হাসছেই। তার সঙ্গে হাসছেন, পাই স্যার। আমরা অবাক হয়ে হাসছি। হাসির কলরবের শব্দ পৌঁছে গেল হেড মাস্টারমশাইয়ের ঘরে। তিনি একটি শক্ত লাঠি নিয়ে এলেন মারার জন্য। তিনি চিৎকার করছেন আর বলছেন, বাঁদরামি হচ্ছে। এটা স্কুল। স্কুলে হাসি। ঘরে ঢুকে পড়ে হেডমাষ্টারমশাই ও হাসতে লাগলেন। সৈকতরা অবাক। কি ব্যাপার হলো। এদিকে পাই স্যার হাসতে হাসতে এগিয়ে চলেছেন একটা মোটা কাঁচের বোতলের দিকে। তিনি দেখলেন বোতলের মুখ খোলা। লেখা আছে বোতলের গায়ে নাইট্রাস অক্সাইড। স্যার বন্ধ করলেন ঢাকনা। তারপর দশ মিনিট পরে হেডস্যারকে বললেন, স্যার লাফিং গ্যাসের বোতল খুলে ফেলেছে কেউ। তার ফলে এই হাসি।অমর বললো, স্যার হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে গেছে। কে যে বোতলটা খুলেছিলেন তা আজ পর্যন্ত জানা যায় নি...
পাই স্যারের বাড়ি গেলেই তিনি পরাণের পান্তুয়া খাওয়াতেন। তিনি আমাদের বাড়িতেও পড়াতেন। তিনি আমাকে বলতেন, তোর কি পাখির পেট নাকি। খা পরাণের পান্তুয়া। আরও দুটো নে। আমি বলতাম, না না আর নেব না। প্রত্যেকদিন তিনি আমাদের পান্তুয়া খাওয়াতেন। মনে পড়ে আজও লিলুয়ার কথা। এটা শহর নয়। গ্রামের মতই। জায়গাটার নাম পটুয়াপাড়া। এই পাড়ায় মাটির পুতুল বিখ্যাত ছিল। দুটো পুতুল কিনলেই মাসি বলতেন, নে নে আর একটা নে। এটার দাম লাগবে না। মাটির পুতুল নিয়ে আনন্দে ঝুলন সাজাতাম। পুজো দিতাম। পরাণদার পান্তুয়া ছিল প্রসাদ। তার লোভেই আমরা ঝুলন সাজাতাম প্রতিবার। আমরা ছোটোবেলায় মোবাইল পাই নি। কিন্তু আমরা যেসব আনন্দের অংশীদার ছিলাম সে সব আনন্দ এখনকার ছেলেরা আর পায় বলে মনে হয় না। ইতিহাসের বাইরে চলে গেছে ভুলোলাগা বামুন। তিনি ঝোলা হাতে মাথায় গামছা জড়িয়ে আসতেন শিল্পকর্ম দেখিয়ে রোজগার করতে। তিনি আমাদের বাড়িতে এসে শুরু করতেন নিজের কথা বা শিল্পকর্ম। নাটকের অভিনয়ের ভঙ্গিমায় বলতেন - আর বলো না বাবা। তোমাদের গ্রামে আসতে গিয়ে চলে গেলাম ভুলকুড়ি ভুল করে। তারপর মেলে, কোপা, বিল্বেশ্বর, চুরপুনি, সুড্ডো ঘুরে কোমডাঙ্গা। তারপর কেতুগ্রাম, কেউগুঁড়ি হয়ে গুড়ি গুড়ি পায়ে হেঁটে পোশলা, নঁগা, খাটুন্দি, পাঁচুন্দি হয়ে তৈপুর, পাড়গাঁ, বাকলসা, পাঁচুন্দি, মুরুন্দি, সেরান্দি, খাটুন্দি পার করে কাঁদরের গাবায় গাবায় হেঁটে এই তোমাদের গ্রামে। আমরা জিজ্ঞেস করতাম, এতটা পথ হাঁটলে কি করে দাদু। তিনি বলতেন, সব ভূতের কারসাজি। তেনারা ভুলো লাগিয়ে দেন। ভর করে দেহে। তাই এতটা পথ হাঁটতে পারি। তারপর চালটা, কলাটা, মুলোটা দিতেন তার ঝোলায় আমার মা।
পাঁচ
গণিতের শিক্ষকমশাই বলতেন, যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ জীবনের ক্ষেত্রেও মেনে চলবি। যত দুঃখ, ব্যথা বিয়োগ করবি। আনন্দ যোগ করে খুশি গুণ করবি। আর খাবার ভাগ করে খাবি। একা খেলে, বেশি খেলে রোগ বেড়ে যাবে। মজার মধ্যেও কতবড় শিক্ষা তিনি আমাদের দিয়েছিলেন আজ বুঝতে পারি। আদর্শ শিক্ষক বোধহয় এইরকম হন। ফোচন বললো। ফোচনের বোন ফোড়োনকে মাস্টারমশাই মশলা বলে ডাকতেন। ফোড়োন খুব রেগে যেতো। কারণ বন্ধুরাও তাকে মশলা বলেই ডাকতো। একদিন স্যারের কাছে ফোড়ন বললো, আপনি মশলা নামে ডাকেন বলে সবাই ডাকে। মাস্টারমশাই বলেছিলেন - আদর করে দেওয়া নাম কোনোদিন ফেলবি না। রাগ করবি না। দেখবি একদিন যখন তোর বন্ধু, বান্ধবীরা দূরে চলে যাবে তখন এই নাম তোর মুখে হাসি ফোটাবে। সংসারের সমস্ত দুঃখ ভুলিয়ে দেবে আদরের পরশে। ফোড়োনের জীবনে সত্য হয়েছিলো এই কথা। একদিন বিয়ের পরে রমেশের সঙ্গে দেখা হলো তার। রমেশ বললো - কেমন আছিস ফোড়োন। ফোড়োন বললো - একবার মশলা বলে ডাক। তা না হলে আমি তোর প্রশ্নের উত্তর দেবো না। রমেশ তারপর ওকে মশলা বলে ডেকেছিলো। মশলা সেবার খুশি হয়ে রমেশকে ফুচকা খাইয়েছিলো। গ্রামে থাকতেই প্রাইমারী স্কুলে যেতাম।
মাষ্টারমশাই আমাদের পড়াতেন। পরের দিন আমরা দুই ভাই স্কুলে ভর্তি হতে গেলাম। বড়দা গ্রামে কাকার কাছে আর ছোটো ভাই বাবু একদম ছোটো। স্কুলে মীরা দিদিমণি সহজ পাঠের প্রথম পাতা খুলে বললেন - এটা কি? আমি বললাম অ য়ে, অজগর আসছে ধেয়ে। আবার বই বন্ধ করলেন। তারপর আবার ওই পাতাটা খুলে বললেন - এটা কি?
আমি ভাবলাম - আমি তো বললাম এখনি। চুপ করে আছি। ঘাবড়ে গেছি। দিদি বাবাকে বললেন - এবছর ওকে ভরতি করা যাবে না।
ছোড়দা ভরতি হয়ে গেলো। তারপর বাসা বাড়িতে জীবন যাপন। সুবিধা অসুবিধার মাঝে বড়ো হতে লাগলাম। আমাদের খেলার সঙ্গী ছিলো অনেক। ধীরে ধীরে আমরা বড়ো হয়ে টি, আর, জি, আর, খেমকা হাই স্কুলে ভর্তি হলাম। তখন লাইনের পাশ দিয়ে যাওয়া আসা করার রাস্তা ছিলো না। লাইনের কাঠের পাটাতনের উপর দিয়ে হেঁটে যেতাম। কতজন ট্রেনে কাটা পরে যেত তার হিসাব নেই। তারপর ওয়াগন ব্রেকাররা মালগাড়ি এলেই চুরি করতো রেলের সম্পত্তি। কঠিন পরিস্থিতি সামলে চলতো আমাদের লেখাপড়া। এখন পরিস্থিতি অনেক ভালো। পাশে রাস্তা আছে। ওয়াগান ব্রেকারদের অত্যাচার নেই। মনে আছে ক্লাস সেভেন অবধি লিলুয়ায় পড়েছি। তারপর গ্রামে কাকাবাবু মরে গেলেন অল্প বয়সে। বাবা অবসর নিলেন চাকরী থেকে। বড়দা ও ছোড়দা রয়ে গেলো লিলুয়ায়। বাবা, মা ও আমাদের দুই ভাইকে নিয়ে এলেন বড় পুরুলিয়া গ্রামে। গ্রামে কাকীমা ও দুই বোন। রত্না ও স্বপ্না। আমরা চারজন। মোট সাতজন সদস্য। শুরু হলো গ্রামের জীবন। আবার বিল্বেশ্বর হাই স্কুলে ভর্তি হতে গেলাম বাবার সঙ্গে। ভর্তির পরীক্ষা হলো। হেডমাষ্টারমশাই বললেন - বাঃ, ভালো পত্রলিখন করেছে। বিজয়া প্রণামের আগে চন্দ্রবিন্দু দিয়েছে। কজনে জানে। আমি প্রণাম করলাম স্যারকে। ভর্তি হয়ে গেলাম।
স্কুলে আজ বাংলার স্যার দুটো ক্লাস একসঙ্গে নিলেন। কবি বিহারীলাল ও অক্ষয়কুমার বড়াল সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করলেন। স্যার সুদীর্ঘ বক্তব্য রাখলেন তিনি বললেন - কবি বিহারীলাল বাংলা ভাষার কবি। বাংলা সাহিত্যের প্রথম গীতি-কবি হিসেবে তিনি সুপরিচিত। কবিগুরু তাকে বাঙলা গীতি কাব্য-ধারার 'ভোরের পাখি' বলে আখ্যায়িত করেন। তার সব কাব্যই বিশুদ্ধ গীতিকাব্য। মনোবীণার নিভৃত ঝংকারে তার কাব্যের সৃষ্টি। বাঙালি কবি মানসের বহির্মুখী দৃষ্টিকে অন্তর্মুখী করার ক্ষেত্রে তার অবদান অনস্বীকার্য। অতি অল্পকালের ভিতরে তিনি বাংলা কবিতার প্রচলিত ধারার পরিবর্তন ঘটিয়ে নিবিড় অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যমে গীতিকবিতার ধারা চালু করেন। এ বিষয়ে তিনি সংস্কৃত ও ইংরেজি সাহিত্যের মাধ্যমে গভীরভাবে প্রভাবিত হন।
ছয়
মনমতো পছন্দের দাদু আমাদের খুব প্রিয় ছিলেন। যখন মামার বাড়ি যেতাম মায়ের সঙ্গে তখন দাদু আমাদের দেখেই মামিমাকে মাছ,ডিম,মাংস রান্না করতে বলতেন। কখনও সখনও দেখেছি মামিমা নিজে ডেঙা পাড়া,সাঁওতাল পাড়া থেকে হাঁসের ডিম জোগাড় করে নিয়ে আসতেন। তখন এখনকার মতো ব্রয়লার মুরগি ছিলো না। দেশি মুরগির বদলে চাল,ডাল,মুড়ি নিয়ে যেতো মুরগির মালিক। নগদ টাকর টানাটানি ছিলো। চাষের জমি থেকে চাল,ডাল,গুড় পাওয়া যেতো। মুড়ি নিজেই ভেজে নিতেন মামিমা। আবার কি চাই। সামনেই শালগোরে। সেখানে দাদু নিজেই জাল ফেলে তুলে ফেলতেন বড়ো বড়ো রুই, কাতলা,মৃগেল। তারপর বিরাট গোয়ালে কুড়িটি গাইগরু। গল্প মনে হচ্ছে। মোটেও না। এখনও আমার সঙ্গে গেলে প্রমাণ হিসাবে পুকুর,গোয়াল সব দেখাতে পারি। আহমদপুর স্টেশনে নেমে জুঁইতা গ্রাম। লাল মাটি। উঁচু উঁচু ঢিবি। আমি পূর্ব বর্ধমানের ছেলে। সমতলের বাসিন্দা। আর বীরভূমে লাল উঁচু নিচু ঢিবি দেখে ভালো লাগতো।আমাদের মাটি লাল নয়। কি বৈচিত্র্য। ভূগোল জানতাম না। জানতাম শুধু মামার বাড়ি। মজার সারি। দুপুর বেলা ঘুম বাদ দিয় শুধু খেলা। আর ওই সময়ে দাদু শুয়ে থাকতেন। ডিস্টার্ব হতো।একদিন ভয় দেখানোর জন্যে বাড়ির মুনিষকে মজার পদ্ধতি শিখিয়ে দিয়েছিলেন। তখন ছেলেধরার গুজব উঠেছিলো। আমরা দুপুরে খেলছি। দাদু বার বার বারণ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন,আজ কিন্তু ছেলেধরা আসতে পারে। আমি খুব ভিতু ছিলাম। আমার মামার ছেলে বাঁটুলদা,হোবলো,ক্যাবলা,লেবু। সবাইকে বললাম। তখন বারো থেকে পনেরো বছরের পালোয়ান আমরা। সকলের ভয় হলো। দাদু কোনোদিন মিথ্যা বলেন না। কথার মধ্যে কনফিডেন্স না থাকলে তিনি রাগ করতেন। একবার আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন,এই অঙ্কটা পারবি। পড়ে দেখ। আমি বললাম,বোধহয় পারবো। তিনি রেগে বললেন, বোধহয় কি? হয় বল না, কিংবা হ্যাঁ। নো অর ইয়েস। ধমকের চোটে কেঁদে ফেলেছিলাম। এই সেই দাদু বলেছেন, আজ ছেলেধরা আসবে। সাবধান। সবাই ঘুমোবি। দুপুরের রোদে বেরোবি না। বাধ্য হয়ে শুলাম। দাদুর নাক ডাকা শুরু হলেই সবাই দে ছুট। একেবারে বাদাম তলায়। চিনে বাদামের একটা গাছ ছিলো। ঢিল মেরে পারছি। এমন সময়ে মুখ বেঁধে ছেলেধরা হাজির। হাতে বস্তা। বস্তা ছুড়ে ঢাকা দিতে চাইছে আমাদের । আমরা সকলেই প্রাণপণে বক্রেশ্বর নদীর ধারে ধারে গিয়ে মাঝিপাড়ায় গিয়ে বলতেই বিষ মাখানো তীর আর ধনুক কাঁধে বেড়িয়ে পড়লো। বীর মুর্মু। সাঁওতাল বন্ধু। ছেলেধরা তখন পগার পাড়। আর দেখা নেই। বড়ো হয়ে সত্য কথাগুলি জানতে পেরেছি। দাদু ওই সাঁওতাল বন্ধুকে বকেছিলেন,ছেলেগুলোকে ভয় দেখাতে নাটক করছিলাম। আর তুই এক নম্বরের বোঙা। একবারে অস্ত্র হাতে। যদি মরে যেতো ছেলেটা। বন্ধু বললো,আমাকে অত বোঙা ভাবিস নি। তোর মুনিষটো আমাকে আগেই বলেছে তোর লাটকের কথা। আমি অভিনয়টো কেমন করেছিলাম বল একবার। দাদু ওদের খুব ভালোবাসতেন। ওদের অসময়ের বন্ধু ছিলেন দাদু। দাদুকে আমরা বলতাম টাইগার বাম বা বিপদের বন্ধু। ওষুধ মলমের স্পর্শে যেমন ফোড়া ভালো হয়ে যায়। তেমনি বিপদের সময় দাদুর উপস্থিতি সকল সমস্যার সমাধান করে দিতো। একবার ডেঙা পাড়ায় ডাকাত পড়েছিলো। জমিদার বাড়িতে। তখন ফোন ছিলো না। জানাবার উপায় নেই। পাশের বাড়ির একজন দাদুকে ডাকতে এসেছিলো। দাদু ঘুম থেকে উঠেই লাঠি হাতে লোকজন ডেকে সিধে চলে গিয়েছিলেন। তখন লাঠিই প্রধান অস্ত্র। লাঠিখেলায় দাদুর সমকক্ষ কেউ ছিলো না। চারজন বাছা বাছা তরুণকে বললেন,আমার মাথায় লাঠি মারতে দিবি না। তারপর শুরু হলো লড়াই। পঁচিশজন ডাকাত সবকিছু ফেলে পালালো ছুট। জমিদার দাদুকে বললেন,আপনার জন্যই আজকে বাঁচলাম। ভগবান আপনার ভালো করবেন। বাড়ির মহিলারা দাদুকে মিষ্টি জল খাইয়ে তবে ছাড়লেন। বাকি লোকেরাও খেলেন। দাদুর লাঠি খেলার দলের কথা আশেপাশে সবাই জানতো। দাদুর মুখেই শুনেছি হাটবারে ডাকাত সর্দার হাটে এসেছিলো। বলেছিলো,আপনার মায়ের দুধের জোর বটে। আপনাকে পেন্নাম।সাহসকে বলিহারি জানাই। আপনি ওই গ্রামে থাকতে আর কোনোদিন ডাকাতি করবো না। দাদু বলেছিলে, ছেড়ে দে ডাকাতি। তোকে জমিদার বাড়িতে ভালো কাজ দেবো। শেষে ওই ডাকাতদল জমিদারের লাঠিয়াল হয়েছিলো। ডাকাতি করা ছেড়ে দিয়েছিলো। এখন চোর ডাকাতগুলো চরিত্রহীন, দুর্বল,নির্গুণ। সেই ডাকাত সর্দার সন্ধ্যা হলেই দাদু আর জমিদারকে শ্যামাসংগীত শোনাতো। সম্পর্কে দাদু হলেই তো আর বুড়ো হয়ে যায় না। দাদুর যখন চল্লিশ বছরের তখন মায়ের বিয়ে হয়েছিলো। দাদু আঠারো বছরেই মায়ের বিয়ে দিয়েছিলেন। মায়ের মুখ থেকে শোনা কথা। বিয়ের পরেও আমার মা তালবোনা পুকুরে তাল পরলেই সাঁতার কেটে সবার আগে তাল কুড়িয়ে আনতেন। দাদু আমার মা,বড়মা সবাইকে সব বিষয়ে পারদর্শী করে তুলেছিলেন। আর আমার মামা শান্ত লোক।গাঁয়ের মাসি বলতেন, একটা ব্যাটা। দুটি বিটি। তাই ঠাকুমার আদরে দাদা ঝুট ঝামেলা থেকে দূরে থাকতেন। জুঁইতা গ্রামটা ছিলো একটা ঘরের মতো। গ্রামের বাসিন্দারা সেই ঘরের লোক। কোনোদিন বুঝতে পারিনি, কে আপন, কেই বা পর। গ্রাম না দেখলে ভারতবর্ষকে চেনা অসম্ভব। মামার বাড়ি গেলেই
গ্রামে ঢুকতেই স্কুল। তারপর মামার বাড়ি আসতে অনেক সময় লেগে যেতো। আমার বড়দাকে ওখানে সবাই মিনু বলে ডাকতো। মাকে বলতো গীতু। হাঁটছি হঠাৎ এক মামা বললেন, কি রে গীতু ভালো আছিস, আই মিনে আয়। সুদপে, রিলপে আয়। আমাদের নাম ওখানে আদরের আতিশয্যে বিকৃত হয়ে যেতো। আবার কোনো মাসি বলতেন,আয় গীতু কতদিন পরে এলি, একটু মিষ্টিমুখ করে যা, জল খা। কোন পাষন্ড এই আদরের ডাক উপেক্ষা করবে। কার সাধ্য আছে। ফলে দেরি হতো অনেক। ইতিমধ্যে গীতু,মিনে দের দলবেঁধে আসার খবর রানার পৌঁছে দিয়েছে আগেই। তাই দেখা হয়ে যেতো মামির সঙ্গে কোনো এক বাড়িতে। আঁচলে ডিম আর হাতে মাছ নিয়ে হাসিমুখে হাজির। আরও অনেক কথা হারিয়ে গেছে স্মৃতির গভীরে।
সাত
তারপর সংসারের টানা পোড়েন। রাগ, হিংসা, ক্রোধের সংমিশ্রণে সংসার স্রোতে ভাসতে ভাসতে জীবন প্রবাহ এগিয়ে চলে। হয়তো এর ফলেই দাদুর শেষজীবনে সেবার সুযোগ পেয়েছিলাম আমরা। আমি নিয়ম করে দাদুকে গীতা পাঠ করে শোনাতাম। দাদু কত গল্প বলতেন। কোনোদিন হা পিত্যেশ করতে দেখিনি। আমার সময় কাটতো দাদুর কাছেই বেশি। পড়াশোনার ফাঁকে চলতো গীতা পাঠ। আমি জিজ্ঞেস করতাম - দাদু মরণের পরে আমরা কোথায় যাই? দাদু বলতেন - জানি না ভাই। তবে। মরণের পরে যদি যোগাযোগ করা যায়, তাহলে আমি তোকে নিশ্চয় জানাবো। দাদু বলতেন - আমি যখন শেষ বিছানায় শোবো, তখন আমি ঈশারা করবো হাত নেড়ে। তখন তুই গীতার কর্মযোগ অধ্যায় পড়ে শোনাবি। তোর মঙ্গল হবে। আমিও শান্তিতে যেতে পারবো। হয়েছিলো তাই। কর্মযোগ পাঠ করা শেষ হতেই দাদুর হাত মাটিতে ধপাস করে পরে গেলো। দাদু ওপারে চলে গেলেন হেলতে দুলতে চারজনের কাঁধে চেপে। মাথাটা দুই বাঁশের ফাঁক গলে বেরিয়ে ঝুলছিলো। আমি বলে উঠলাম - ওগো দাঁড়াও দাদুর লাগবে। মাথাটা ঠিক কর বালিশে দি। কেঁধো বললেন - মরে গেয়েচে। ছেড়ে দে। আমি বললাম - না ঠিক করো। তারপর ঠিক করলো দাদাভাই, দাদুর মাথাটা বালিশে দিয়ে। অনেক বছর অপেক্ষা করেছি, দাদুর কথা শুনবো ওপার থেকে। যোগাযোগের উপায় থাকলে নিশ্চয় করতেন। কিন্তু কোনোদিন স্বপ্ন পর্যন্ত দেখিনি। কথা শোনা তো দূর অস্ত। আমরা ছোটোবেলায় মোবাইল পাই নি। কিন্তু আমরা যেসব আনন্দের অংশীদার ছিলাম সেসব আনন্দ এখনকার ছেলেরা আর পায় না। ইতিহাসের বাইরে চলে গেছে ভুলোলাগা বামুন। তিনি ঝোলা হাতে মাথায় গামছা জড়িয়ে আসতেন শিল্পকর্ম দেখিয়ে রোজগার করতে। তিনি আমাদের বাড়িতে এসে শুরু করতেন নিজের কথা বা শিল্পকর্ম। নাটকের অভিনয়ের ভঙ্গিমায় বলতেন, আর বলো না বাবা। তোমাদের গ্রামে আসতে গিয়ে চলে গেলাম ভুলকুড়ি ভুল করে। তারপর মেলে, কোপা, বিল্বেশ্বর, চুরপুনি, সুড্ডো ঘুরে কোমডাঙ্গা। তারপর কেতু গ্রাম, কেউগুঁড়ি হয়ে গুড়ি গুড়ি পায়ে হেঁটে পোশলা, নঁগা, খাটুন্দি, পাঁচুন্দি হয়ে তৈপুর, পাড়গাঁ, বাকলসা, পাঁচুন্দি, মুরুন্দি, সেরান্দি, খাটুন্দি পার করে কাঁদরের গাবায় গাবায় হেঁটে এই তোমাদের গ্রামে। আমরা জিজ্ঞেস করতাম, এতটা পথ হাঁটলে কি করে দাদু। তিনি বলতেন, সব ভূতের কারসাজি। তেনারা ভুলো লাগিয়ে দেন। ভর করে দেহে। তাই এতটা পথ হাঁটতে পারি। তারপর চালটা, কলাটা, মুলোটা দিতেন তার ঝোলায় আমার মা বা পিসি। ভুলোলাগা বামুন এলেই সেই দিনটা আমাদের খুব ভালো লাগতো। তার পিছু পিছু মন্ত্রমুগ্ধের মতো ঘুরে বেড়াতাম ভুলো লাগা বালক হয়ে। বৃষ্টির পরেই রাম ধনু দেখা যায়। দুঃখ শেষে আনন্দ। আমার পাগলামি যে ভালোবাসে সেই শোভন। দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে মানুষকে ভালোবাসার নামই জীবন। নর জীবনে নারী ছাড়া জীবন অচল। তবু কেন এত অন্যায় অত্যাচার নারীর উপর। সাধুবেশে নারীদের বিশ্বাস অর্জন করে ন্যায় অন্যায় জলাঞ্জলি দিয়ে কেন তাদের বিশ্বাস হত্যা করা হয়। তারা যে মায়ের, মাসির আদরের আঁচল। তাদের রক্ষা করার জন্য তৈরি হোক সমস্ত মানবহৃদয়। যতবার আমি বিপদে পড়েছি রক্ষা পেয়েছি নারী হৃদয়ের কমনীয়তার গুণে। ভীষণ বন্যায় ভেসে চলেছিলাম স্রোতের তোড়ে। রক্ষা পেয়েছি সর্দার দিদির বলিষ্ঠ হাতের আশ্রয়ে। জীবনে জ্বর হয় বারে বারে। সেবা পেয়েছি স্বপ্না বোনের শাসনে। বারে বারে জীবন যুদ্ধে যখন হেরে যাই ভালোবাসার আড়ালে মায়াচাদর জড়িয়ে রাখেন আমার বড় সাধের সহধর্মিণী। আর আমার মা সুখে দুখে শোকের নিত্যদিনের সঙ্গী। পুরো জীবনটাই ঘিরে থাকে নারী রূপী দেবীর রক্ষাকবচ। সমগ্র পুরুষ সমাজ আমার মতোই নারীর কাছে ঋণী। তবে কোন লজ্জায় পুরুষ কেড়ে নেয় নারীর লজ্জা ভূষণ। পুরুষদের মধ্যেই অনেকে আছেন তাদের শ্রদ্ধা করেন। তাদের রক্ষায় জীবন দান করেন। তারা অবশ্যই প্রণম্য। তাদের জীবন সার্থক। এই পৃথিবী সকলের স্বাধীনভাবে বিচরণের স্থান হোক। হিংসা ভুলে পৃথিবীর বাতাস ভালোবাসা ভরুক। আমরা চার বন্ধু। রমেন, জীবন, বিশু আর আমি। যেখানেই যেতাম একসাথে থাকতাম। বিশু ছিলো আমাদের দলের অলিখিত নেতা। নেতা তো এমনি এমনি হয় না। তার কাজ, দল চালানোর কৌশল তাকে নেতা নিয়েছিলো। একদিন দুপুর বেলায় সে আমাদের ডাক দিলো তার বাঁশি বাজিয়ে। বাঁশির ডাক শুনেই মন চঞ্চল হয়ে উঠতো। ঠিক যেন রাধার পোড়া বাঁশির ডাক। চুপিচুপি বাড়ি থেকে বেড়িয়ে বটতলায়। আমাদের মিলন অফিস ছিলো এই বটতলা। চারজন ছুটে চলে যেতাম মাঠে। সেখানে বিশু বলতো - দাড়া কয়েকটা তাল কাঁকড়া ধরি। ভেজে খাওয়া যাবে।
আট
বলেই হাত ভরে দিলো সোজা ধানের জমির গর্তে। একটা মাগুর ধরেছি, বলেই মাথা টিপে হাত বের করতেই দেখা গেলো মাছ নয় একটা বড় কালো কেউটে সাপ। বিশু সাপটাকে সাঁ সাঁ করে ঘুরিয়ে সহজেই ছুঁড়ে দিলো দূরে। তারপর তাল কাঁকড়া ধরে ভেজে খাওয়া হলো মাঠে। ভাজার সমস্ত সরঞ্জাম বিশু লুকিয়ে রাখতো একটা পোড়ো বাড়িতে। সাঁতার কাটতে যেতাম নতুন পুকুরে। একবার ডুবে যাওয়ার হাত থেকে রেহাই পেয়েছিলাম তার প্রখর বুদ্ধির জোরে। মাথার চুল ধরে টেনে তুলেছিলো ডাঙায়। গ্রীষ্ম অবকাশে বট গাছের ডালে পা ভাঁজ করে বাদুড়ঝোলা খেলতাম বিশুর নেতৃত্বে। তারপর ঝোল ঝাপটি। উঁচু ডাল থেকে লাফিয়ে পড়তাম খড়ের গাদায়। এসব খেলা বিশুর আবিষ্কার। তারপর সন্ধ্যা হলেই গ্রামের বদমাশ লোকটিকে ভয় দেখাত বিশু। সুদখোর সুরেশ মহাজন বটগাছের ডাল থেকে শুনলো, কি রে বেটা খুব তো চলেছিস হনহনিয়ে। আয় তোকে গাছে ঝোলাই। সুদখোর অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলো। তারপর থেকে ও পথে যেত না মহাজন। সাদা চুলো গান্ধিবুড়িকে রোজ সন্ধ্যাবেলা নিজের মুড়ি খাইয়ে আসতো অতি আদরে। বিশু বলতো - আমি তো রাতে খাবো। বুড়ির কেউ নেই, আমি আছি তো। শ্রদ্ধায় মাথা নত হত নেতার হাসিতে। একবার বন্যার সময় স্কুল যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন আমাদের নেতা। কোথাও সাঁতার জল কোথাও বুক অবধি জল। একটা সাপ বিশুর হাতে জড়িয়ে ধরেছে। বিশু এক ঝটকায় ঝেরে ফেলে দিলো সাপটা। স্কুল আমাদের যেতেই হবে। সাঁতার কাটতে কাটতে আমাদের সে কি উল্লাস। যে কোনো কঠিন কাজের সামনাসামনি বুক চিতিয়ে সমাধান করার মতো মানসিকতা বিশুর ছিলো। সে সামনে আর আমরা চলেছি তার পিছুপিছু। শেষ অবধি পৌঁছে গেলাম স্কুল। হেডমাষ্টারমশাই খুব বাহবা দিলেন স্কুলে আসার জন্য। তিনি বললেন - ইচ্ছা থাকলে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। টিফিনের সময় ছুটি হয়ে গেলো। আসার সময় একটা নৌকো পাওয়া গেলো। মাঝি বললেন - আমার বয়স হয়েছে আমি একা অতদূর নৌকা বাইতে পারবো নি বাবু। তাছাড়া আমার এখনও খাওয়া হয় নি। বিশু সঙ্গে সঙ্গে নিজের টিফিন বের করে দিলো। আমরাও মন্ত্রমুগ্ধের মতো টিফিন বের করে দিলাম। মাঝি ভাই বললেন - এসো সবাই এক হয়ে খেয়ে লি। তারপর নৌকার কান্ডারি হলো বিশু। আর আমরা সবাই মুড়ি মাখিয়ে খেতে শুরু করলাম। মাঝি ভাই ও বিশু খেলো। ধীরে ধীরে পৌঁছে গেলাম গ্রামে। মাঝি ভাইকে পারিশ্রমিক দিয়ে বিদায় জানালাম। পরেরদিন রবিবার। রঙিন সকাল। আকাশে মেঘের আনাগোনা। কাশের কারসাজি নদীর তীর জুড়ে। বন্যার জল নেমে গিয়েছে। পুজো পুজো ভাব। বিশু কাশফুলের ভিড়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে। কয়েকদিন হলো তাকে দেখা যাচ্ছে না। আমি ঘুরতে ঘুরতে পুজো বাড়ির ঠাকুর দেখতে গেলাম। সেখানে দেখি বিশু হাতে কাদা মেখে শিল্পীকে সাহায্য করছে। তিন দিন ধরে এখানেই তার ডেরা। এখন তার মনে বাজছে ঢাকের ঢ্যামকুড়াকুড়। মন মন্দিরে তার দুর্গা গ্রাম দেশ ছাড়িয়ে অভাবী বাতাসে বাতাসে। পুজো বাড়িতে আমাকে দেখেও কোনো কথা না বলে হাঁটতে হাঁটতে বাইরে চলে গেলো। আমি জানি সে এখন চাল, ডাল নিয়ে সর্দার বুড়িকে রেঁধে খাওয়াবে। সে বলে, ওর যে কেউ নেই। ও খাবে কি? বিশুর বাবা বছরে একবার বাড়ি আসেন। তিনি ভারতীয় সৈন্য বিভাগে কাজ করেন। বাড়িতে এলেই বিশুর হাতে হাতখরচ বাবদ তিনি বেশ কিছু টাকা দিয়ে যান। সেই টাকা বিশু লোকের উপকারে কাজে লাগায়। বড়ো অবাক হয়ে ভাবি, ছোটো বয়সে এত বড় মন সে পেল কোথা থেকে?
স্কুলের দূরত্ব অনেক বেশি হওয়ায় আমাদের চার বন্ধুর বাড়ির গার্জেনরা শলা পরামর্শ করে হোষ্টেলে থাকার কথা বললেন। দায়িত্ব নিলো বিশু। কিন্তু হেডমাষ্টারমশাই বললেন, সেশনের মাঝে হোষ্টেল পাবি না। ঘর ভাড়া নিয়ে চারজনে থাক। পরীক্ষা এসে গেছে। কাছাকাছি থাকিস তিনটি মাস। রেজাল্ট ভালো হবে। ঘুরে ঘুরে অবশেষে ভাড়া ঘর পেলাম। কিন্তু বাড়িওয়ালার পাশের প্রতিবেশী বললেন, সাবধান ওই বাড়িতে ভূত আছে। আমরা ভয় পেয়ে তিনজনে বলে উঠলাম, তাহলে অন্য ঘর দেখি চল। বিশু বললো - টাকা দেওয়া হয়ে গেছে। ভূতের বাড়িতেই থাকবো। বিশু যখন সঙ্গে আছে, ভয় কি তোদের। তার অভয়বাণী ভরসা করে আমরা মালপত্তর নিয়ে ঢুকে পড়লাম লড়াইয়ের কোর্টে। ক্যাপ্টেন বিশু বাড়িটা এক চক্কর পাক দিয়ে হাতে একটা লাঠি নিয়ে বললো, চলে আয় ভূতের বাচ্চা। আমরা ওর সাহস দেখে অবাক হতাম। রমেন বলে উঠলো, ভূতের শেষ দেখে ছাড়বো। জীবনের মরণের ভয় একটু বেশি। সে কাঁপা গলায় বলে উঠলো - যদি গলা টিপে ধরে ভূত। বিশু বললো - ভয় নেই, আমি একাই একশো। তোর কিছু হবে না। হলে আমার হবে।
নয়
এই বাড়ির নিচু তলায় কিছু অসামাজিক লোকের কাজকর্ম বিশু এক সপ্তাহের মধ্যেই টের পেয়ে গেলো। তারাই এই ভূতের ভয় দেখায়। একদিন জীবন বাথরুম গেছে এমন সময় নাকি সুরে একজন বলে উঠলো, এঁখান থেকে পাঁলা। ঘাঁড় মটকে দেবো। আবার একদিন রমেন ভয় পেলো। ঠিক সেই বাথরুমে। বিশু তদন্ত করে দেখলো বাথরুমের ভেন্টিলেটার ভেঙ্গে একটা সরু দড়ি ঢোকানো হয়েছে। বাইরে গিয়ে দেখলো দড়িটা নিচের ঘরের বারান্দায় শেষ হয়েছে। বাথরুমে ভাঙ্গা কাঁচে টান পরলে বিকট আওয়াজ হয়। আর মুখ বাড়িয়ে মুখোশ পড়ে নাকি সুরের কথায় সকলেই ভয় পাবে। বিশু বললো সবাই তৈরি থাকিস। আজ রাতেই ভূত ধরবো। আজ আর কেউ স্কুল গেলাম না। একটা উত্তেজনা রাতে জাগিয়ে রেখেছে। এবার সেই বিকট শব্দ। বিশু বাঘের মতো লাফিয়ে লাঠি হাতে নিচের তলায় গিয়ে জলজ্যান্ত ভূতের পাছায় লাঠির আঘাতে ভূতকে কাবু করে ফেললো। ভূত বাবাজি জোড় হাতে বলছে - ছেড়ে দাও বাবা আমি আর ওসব করবো না। ভূতের সঙ্গীরা সব পালিয়েছে, আমাদের হাতে লাঠি দেখে। বিশু বললো - যাও, যেখানে বিশু আছে সেখানে চালাকি করার চেষ্টা কোরো না। বিপদে পড়বে। তারপর থেকে আর কোনোদিন ভূতের উপদ্রব হয়নি সেই বাড়িতে। বিশুর বাহাদুরি দেখেই আমরা সাহসী হয়ে উঠেছিলাম। বিশুর সঙ্গে আমরা বেরোলে সকলের চোখেমুখে একটা সাহসের, শান্তির ছাপ ফুটে উঠতো। পাড়ার কোনো মানুষ বিপদে পড়লে বিপদের বন্ধু এই টাইগার বিশুকেই স্মরণ করতো। তার সঙ্গে আমরা তো থাকতাম অবশ্যই। রমেন, জীবন, বিশু, আমি একবার বন্যার সময় নৌকা করে মানুষের খাবার জোগাড় করতে চড়খী গ্রামে গিয়েছিলাম। হেলিকপ্টার থেকে চিড়ের বস্তা, গুড়ের বস্তা ফেলছে চড়খীর ব্রীজে যার আসল নাম কাশীরাম দাস সেতু। সেখান থেকে আমরা চিড়ে, গুড়ের পাটালি নৌকায় তুললাম। রমেন পেটুক। বললো, একটু টেষ্ট করলে হয় না। বিশু বললো, এখন এটা সকলের সম্পত্তি। যা হবে সকলের সামনে হবে। কেউ হাত দিবি না। এখন তাড়াতাড়ি চল। বান বাড়ছে। বিশু দাঁড় টানে আর আমরা সবাই সাহায্য করে নৌকা ও খাবার নিয়ে চলে এলাম নতুন পুকুরের পাড়ে। সেখানে বাড়ি বাড়ি সকলকে সমানভাবে খাবার ভাগ করে দিলো বিশু। তারপর আমরা বাড়ি এসে জীবনের মায়ের হাতের রান্না, গরম খিচুড়ি আর পেঁপের তরকারি খেলাম। অমৃতের স্বাদ। বিশু বললো - কাকীমা অনেক পেঁপে গাছ পড়ে গেছে বন্যার স্রোতে। আমরা আপনাকে অনেক পেঁপে এনে দেবো। সেবার বন্যায় পেঁপে, গ্রামের লোকের প্রাণ বাঁচিয়েছিলো। আমাদের গ্রাম অজয় নদীর ধারে। গ্রামগুলিও খুব নীচুস্থানে অবস্থিত। নদীর নাব্যতা বা গভীরতা অল্প। ফলে বন্যা প্রায় প্রতি বছর দেখা দিয়ে যেতো। জল যখন কমে যেতো তখন তোতনের মা ও পাড়ার মা বোনেরা মাঠে মাছ ধরার জন্য যেতো। নানারকমের শাক, ঢোল কলমি, শুশুনি তুলতো। খুব ভালো লাগতো নানারকমের মাছ ভাজা খেতে। আমি দেখলাম, তোতনের মা মাঠ থেকে দুই তিন রকমের শাক তুলেছে। ওরা ভিটামিন বোঝে না, শরীরচর্চ্চাও বোঝে না। ওরা জানে খাটবো, রোজগার করবো আর খাবো পেট ভরে। মাঠেই পাওয়া যেতো বেশির ভাগ শাক, সবজি, খলসে ও আরো নানারকমের মাছ মাঠের জলে সাঁতার কেটে বেড়াতো। বেলে, চোখো, চ্যাঙ, ছিঙুরি, গচিমাছ ছাড়াও ছোটো কাঁকড়া তাল কাঁকড়া পাওয়া যেতো। গর্তে হাত ঢুকিয়ে বিশু অনেকবার তো আল কাঁকড়া বের করে আমাদের দেখিয়েছে। পাঁকাল, গুঁতে, কৈ, মাগুর, ল্যাটা প্রভৃতি অসংখ্য মাছ। বিত্তি পেতে দিতো স্রোতের মুখে। বিশু বলছে, খাল কেটে মাঝখানে বিত্তি পেতে জল যাওয়ার নালা কেটে দিতো। মাছ লাফিয়ে ওই গর্তে পড়তো। টানা জাল, পাতা জাল দিয়ে মাছ ধরতো। এখন তোতনের মায়ের জায়গায় বৌমা মাঠে যায়। কিন্তু কৃষিকাজে সার, ওষুধ প্রয়োগ করার ফলে সেইসব মাছ ইতিহাসের পাতায় চলে গেছে। শাকপাতাও পায় না মা বোনেরা। এখন সব বাজারমুখী। তখন শাক আঁচলে করে নিয়ে গিয়ে বাউরীবউ মুড়ি নিয়ে আসতো চাষি বাড়ি থেকে। মাঠের টাটকা শাক সবাই নিতো জলের দরে। আজ আর টাটকা কিছু পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশুর কথা একশো শতাংশ সত্য। এখন আমরা বড় হয়ে গেছি। কিন্তু, স্বর্ণযুগের সেইসব স্মৃতি মনের মণিকোঠায় চিরদিন স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। আমার মা বলতেন - ছোটো থাকাই ভালো রে, সংসার অসার। মা বলতেন - এখন সংসাররূপ চিতায় জ্বলে মরছি। মরণের পরে প্রকৃত চিতায় পুড়ে যাবে আদরের দেহ...স্বজনবন্ধুরা বলবে... আর কত সময় লাগবে শেষ হতে...একটু দ্রুত করো ভাই...তবে কিসের এত অহংকার... কেন এত লোভ... ভালোবাসায় কৃপণতা। কে ধনী... টাকায় চিতা সাজালেও পরিণতি একই..। কৃষ্ণধনে ধনী যেজন নিজ ধামে ফেরে সেজন..। লক্ষ্মীপুজো এলেই মা বলতেন কোজাগরীর অর্থ।
দশ
তিনি বলতেন, কোজাগরী লক্ষীপুজোয় পুজো করার পরে যে গৃহস্থ রাত্রি জাগরণ করে রাত কাটাবে তার ঘরে লক্ষ্মী স্বয়ং বিরাজ করেন। কোনো অভাব, অনটন তাকে স্পর্শ করতে পারবে না। স্বার্থ নিয়েই মানুষ পুজো করে। কারণ সে সংসারী। ছেলে, মেয়ে, বাবা,মা, ঠাকুমা, দাদু সকলকে নিয়ে এই সংসার। তাদের মঙ্গল কামনা করেই মানুষের এই পুজো পার্বণ। বাজারে দরদাম করে ঠাকুর কেনার পরে পুজোর ফলমূল, দশকর্মার জিনিসপত্র কিনে বাড়িতে আলপনা এঁকে ঠাকুরের প্রতিষ্ঠা হয়। তারপর পুরোহিতের পৌরোহিত্যে গৃহস্থের মঙ্গলসাধন। লৌকিক আচার, আচরণে বিশ্বাস জড়িয়ে থাকে। আর বিশ্বাসে মিলায় বস্তু। পুজোর প্রতিটি পর্যায়ে শিল্প ভাবনা বিরাজ করে। তার ফলে পুজো আরো আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। দুর্গাপুজোয় ঢাক বাজে। প্যান্ডেলে কোটি কোটি টাকা খরচ করে কোনো কিছুর আদলে মন্দির বানানো হয়। যেমন, তাজমহল, খাজুরাহো, কোনারক প্রভৃতি। নানারকম বাদ্যযন্ত্র পুজোকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে। মা আমাদের নিয়ে, কাটোয়ার কার্তিক লড়াই, চন্দননগরে জগদ্ধাত্রী পুজো, কাগ্রামের জগদ্ধাত্রী পুজো, শিবলুনের মেলা, উদ্ধারণেরপুরের মেলা দেখাতে নিয়ে যেতেন। পুজো এলেই মায়ের লক্ষ্মীর ঝাঁপি উন্মুক্ত হয়ে যেতো। কোজাগরীর রাতে মা কম করে তিনশো লোকের খাওয়ার ব্যবস্থা করতেন। মাজা নীচু করে আসনে বসা মানুষদের প্রসাদ বিতরণ করতাম আমরা ভাই বোনেরা। পরের দিনও খিচুড়ির ব্যবস্থা থাকতো। ডোমপাড়ার সকলে এসে নিয়ে যেতো আনন্দে। সর্দার বুড়ি বেসকাদি, মঙ্গলীদি সবাই আসতো। ছোটো পিসি, মানা, বড়পিসী, সন্ধ্যা, রুনু, শঙ্করী সকলে আসতো। মায়ের ঘর পূর্ণ হয়ে উঠতো অতিথি সমাগমে। গম্গম্ করতো বাড়ি। মানুষই যে লক্ষ্মী তা আবার প্রমাণ হয়ে যেতো চিরকালের সত্য সুরে। পুজোর বেশ কিছুদিন পরে মেয়েরা সকলে এক হয়ে মাংস, ভাতের ফিষ্টি করতো। মনে আছে আমার, খেতে এসে বিশাখাদি বলেছিলো, আমি বিধবা মাংস খাবো কি করে? আমার মাসতুতো দিদি বলেছিলো, বিধবা আবার কি কথা? তোর স্বামী মরে গেছে। দুঃখের কথা। তার সঙ্গে মাংসের কি সম্পর্ক। আচ্ছা কেউ মনে কর মাংস খেলো না। আর মনে মনে স্বামীকে দোষ দিলো। সমাজপতিরা, সমাজের সেনাপতিরা মনের নাগাল কি করে পাবে? ওদের হাত ওই মাংস অবধি। অতএব, নো চিন্তা, ডু ফুর্তি। বিশাখাদি আনন্দে মাংস খেয়েছিলো। সমস্ত কিছুতেই চিরকাল কিছু মহিলার সংস্কারমুক্ত মনের জন্য পৃথিবী এত সুন্দর। উন্মুক্ত সমাজ আমাদের সর্দার পাড়ার। সেখানে সমাজের কোনো সেনাপতি বিধি আরোপ করে না। যে যার ইচ্ছেমতো খেটে খায়। কেউ মুনিষ খাটে, কেউ মাছ ধরে, কেউ কেরালা সোনার দোকানে কাজ করে। বুড়ো বয়সে তারা ছেলে মেয়েদের রোজগারে খায়। ওদের কাউকে বৃদ্ধাশ্রমে যেতে হয় না। কার কৃপায় ওরা বুড়ো বুড়ি হয় না? শক্ত সমর্থ থাকতেই পরকালের ডাকে ওপারে চলে যায়। কাজই হলো আসল লক্ষ্মী। কদতলার মাঠে এসে ঢিল মেরে পেরে নিতাম কাঁচা কদবেল। কামড়ে কচ কচ শব্দে সাবাড় করতাম কদ। বুড়ো বলতো, কদ খেয়েছিস। আর খাবি। কই তখন তো গলা জ্বলতো না। এখন শুধু ওষুধ। ভক্ত, ভব, ভম্বল, বাবু বুলা, রিলীফ সবাই তখন আমরা আমড়াতলায় গিয়ে পাকা আমড়া খেতাম। জাম, তাল,বেল, কুল, শসা, কলা, নারকেল কিছুই বাদ রাখতাম না। নারকেল গাছে উঠতে পারতো গজানন। শুধু দুহাতের একটা দড়ি। তাকে পায়ের সঙ্গে ফাঁদের মতো পরে নিতো গজানন। তারপর কিছুক্ষণের মধ্যেই নারকেল গাছের পাতা সরিয়ে ধপাধপ নিচে ফেলতো। আমরা কুড়িয়ে বস্তায় ভরে সোজা মাঠে। বাবা দেখলেই বকবেন। তারপর দাঁত দিয়ে ছাড়িয়ে আছাড় মেরে ভেঙ্গে মাঠেই খেয়ে নিতাম নারকেল। একদম বাস্তব। মনগড়া গল্প নয়। তারপর গাজনের রাতে স্বাধীন আমরা। সারা রাত বোলান গান শুনতাম। সারা রাত নাচতাম বাজনার তালে তালে। শীতকালে খেজুর গাছের রস। গাছের কামান হতো হেঁসো দিয়ে। মাথার মেথি বার করে কাঠি পুঁতে দিতো গুড় ব্যবসায়ী। আমাদের ভয় দেখাতো, ধুতরা ফুলের বীজ দিয়ে রাকবো। রস খেলেই মরবে সে। চুরি করা কাকে বলে জানতাম না। একরাতে বাহাদুর বিশুর পাল্লায় পরে রাতে রস খেতে গেছিলাম। বিশু বললো, তোরা বসে থাক। কেউ এলে বলবি। আমি গাছে উঠে রস পেরে আনি। তারপর গাছে উঠে হাত ডুবিয়ে ধুতরো ফুলের বীজ আছে কিনা দেখতো। পেড়ে আনতো নিচে। তারপর মাটির হাঁড়ি থেকে রস ঢেলে নিতাম আমাদের ঘটিতে। গাছে উঠে আবার হাঁড়ি টাঙিয়ে দিয়ে আসতো বিশু। সকালে হাড়ি রসে ভরে যেতো। ভোরবেলা ব্যবসায়ীর কাছে গিয়ে বলতাম, রস দাও, বাড়ির সবাইকে দেবো। বুক ঢিপঢিপ চাঁদের গর্ত। দেবে কি দেবে না, জানিনা। অবশেষে প্রাপ্তিযোগ। যেদিন রস পেতাম না তখন মাথায় কুবুদ্ধির পোকা নড়তো। তাতে ক্ষতি কারো হতো না। বিশু ভালো মিষ্টি রস হলে বলতো, এটা জিরেন কাঠের রস। মানে চারদিন হাড়ি না বাঁধলে রস মিষ্টি হতো। জানি না। আমরা গাছে নিচে গিয়ে হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকতাম। রস পড়তো জিভে টুপ টাপ। কতদিন ঘনটার পর ঘনটা কেটে গেছে রসাস্বাদনে। মোবাইল ছিলো না। ফেসবুক ছিলো না। কোনো পাকামি ছিলো না। সহজ সরল হাওয়া ছিলো। ভালোবাসা ছিলো। আনন্দ ছিলো জীবনে। ব্লু হোয়েলের বাপ পর্যন্ত আমাদের সমীহ করে চলতো। কোনোদিন বাল্যকালে আত্মহত্যার খবর শুনিনি। সময় কোথায় তখন ছেলেপিলের। যম পর্যন্ত চিন্তায় পরে যেতো বালকদের আচরণে, কর্ম দক্ষতায়। আমাদের একটা বন্ধু দল ছিলো। পুজোর সময় রাত জেগে ঘুরতুম কোলকাতার অলিগলি । হাওড়া ব্রিজ থেকে শিয়ালদহ। পায়ে হেঁটে। গোল হয়ে প্রাচী পেরিয়ে হাঁটার নেশায় চলে আসতাম আবার কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে সোজা কলেজ স্কোয়ার। জীবনের তিরিশটা বছর তিল তিল করে খরচ করেছি আনন্দের খোঁজে। অসীম বলে সীমাহীন আনন্দের ছেলেটা গান গাইতো সুন্দর। বিচ্ছু বলে বন্ধুটা ভালোবাসতো অপলক মায়া জড়ানো চোখের সুন্দরীকে। তাকে দেখলেই বিচ্ছু ওথেলো হয়ে যেতো। অমিত রান্না করতো খুব ভালো। পুরী আর দীঘাতে ওর হাতের রান্না খেয়ে আনন্দিত আমরা ওকে একটা জামা উপহার দিয়েছিলাম। ও শেফ হতে চেয়েছিলো। অনিন্দিতা বলে বান্ধবীটা আমাদের মানুষ হওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছিলো। কিন্তু সব স্বপ্নগুলো বিস্ফারিত চোখের কাছে থমকে গিয়েছিলো। ঐ বন্ধুরা একত্রে সমাজ সেবার প্রচেষ্টায় আছে। রাস্তার অভুক্ত মানুষের মুখে একটু নুনভাত জোগানোর জন্য ওরা ভিক্ষা করে, জীবনমুখী গান শুনিয়ে। অসীম গান করে, বিচ্ছু একতারা বাজায়। অমিত আর অনিন্দিতা সুরে সুর মিলিয়ে স্বপ্ন দেখে। ওরা এখনও স্বপ্ন দেখে। হয়তো চিরকাল দেখে যাবে থমকা লাগা স্ট্যাচুর পলক..
এগারো
ছোটোবেলার রায়পুকুরের রাধা চূড়ার ডালটা আজও আমায় আহ্বান করে হাত বাড়িয়ে। এই ডাল ধরেই এলোপাথারি হাত পা ছুড়তে ছুড়তে সাঁতার শিখেছি আদরের পরশে। ডুবন্ত জলে যখন জল খেয়ে ফেলতাম আনাড়ি চুমুকে, দম শেষ হয়ে আসতো তখন এই ডাল তার শক্তি দিয়ে ভালোবাসা দিয়ে জড়িয়ে ধরতো অক্লেশে। হয়তো পূর্ব জন্মে আমার দিদি হয়ে যত্ন আদর করতো এই ডালটা। কোনোদিন তাকে গাছ মনে করিনি আমি। এখনও জল ছুঁয়ে আদরের ডাক শুনতে পাই পুকুরের ধারে গেলে। রাধা নামের মায়াচাদর জড়ানো তার সবুজ অঙ্গে। ভালো থেকো বাল্য অনুভব। চিরন্তন প্রকৃতির শিক্ষা অঙ্গনে নাম লিখে যাক নব নবীন শিক্ষার্থী প্রবাহ। আমার স্বপ্নের সুন্দর গ্রামের রাস্তা বাস থেকে নেমেই লাল মোড়াম দিয়ে শুরু। দুদিকে বড় বড় ইউক্যালিপ্টাস রাস্তায় পরম আদরে ছায়া দিয়ে ঘিরে রেখেছে। কত রকমের পাখি স্বাগত জানাচ্ছে পথিককে। রাস্তা পারাপারে ব্যস্ত বেজি, শেয়াল আরও অনেক রকমের জীবজন্তু। চেনা আত্মীয়র মতো অতিথির কাছাকাছি তাদের আনাগোনা। হাঁটতে হাঁটতে এসে যাবে কদতলার মাঠ। তারপর গোকুল পুকুরের জমি, চাঁপপুকুর, সর্দার পাড়া, বেনেপুকুর। ক্রমশ চলে আসবে নতুন পুকুর, ডেঙাপাড়া, পুজোবাড়ি, দরজা ঘাট, কালী তলা। এখানেই আমার চোদ্দপুরুষের ভিটে। তারপর ষষ্টিতলা, মঙ্গল চন্ডীর উঠোন, দুর্গা তলার নাটমন্দির। এদিকে গোপালের মন্দির, মহেন্দ্র বিদ্যাপীঠ, তামালের দোকান, সুব্রতর দোকান পেরিয়ে ষষ্ঠী গোরে, রাধা মাধবতলা। গোস্বামী বাড়ি পেরিয়ে মন্ডপতলা। এই মন্ডপতলায় ছোটোবেলায় গাজনের সময় রাক্ষস দেখে ভয় পেয়েছিলাম। সেইসব হারিয়ে যাওয়া রাক্ষস আর ফিরে আসবে না। কেঁয়াপুকুর, কেষ্টপুকুরের পাড়। তারপর বাজারে পাড়া, শিব তলা, পেরিয়ে নাপিত পাড়া। এখন নাপিত পাড়াগুলো সেলুনে চলে গেছে। সাতন জেঠু দুপায়ের ফাঁকে হাঁটু দিয়ে চেপে ধরতেন মাথা, তারপর চুল বাটি ছাঁটে ফাঁকা। কত আদর আর আব্দারে ভরা থাকতো চুল কাটার বেলা। এখন সব কিছুই যান্ত্রিক। মাঝে মাঝে কিছু কমবয়সী ছেলেমেয়েকে রোবোট মনে হয় । মুখে হাসি নেই। বেশ জেঠু জেঠু ভাব। সর্বশেষে বড়পুকুর পেরিয়ে পাকা রাস্তা ধরে ভুলকুড়ি। আর মন্ডপতলার পর রাস্তা চলে গেছে খাঁ পাড়া, কাঁদরের ধার ধরে রায়পাড়া। সেখানেও আছে চন্ডীমন্ডপতলা, কলা বা গান, দুর্গা তলার নাটমন্দির সব কিছুই। পুজোবাড়িতে গোলা পায়রা দেখতে গেলে হাততালি দিই। শয়ে শয়ে দেশি পায়রার দল উড়ে এসে উৎসব লাগিয়ে দেয়। পুরোনো দিনের বাড়িগুলি এই গ্রামের প্রাণ। এই গ্রামেই আমার সবকিছু, আমার ভালোবাসা, আমার গান।ছোটোবেলার সরস্বতী পুজো বেশ ঘটা করেই ঘটতো। পুজোর দুদিন আগে থেকেই প্রতিমার বায়নাস্বরূপ কিছু টাকা দিয়ে আসা হত শিল্পীকে। তারপর প্যান্ডেলের জোগাড়। বন্ধুদের সকলের বাড়ি থেকে মা ও দিদিদের কাপড় জোগাড় করে বানানো হত স্বপ্নের সুন্দর প্যান্ডেল। তার একপাশে বানানো হত আমাদের বসার ঘর। পুজোর আগের রাত আমরা জেগেই কাটাতাম কয়েকজন বন্ধু মিলে। কোনো কাজ বাকি নেই তবু সবাই খুব ব্যস্ত। একটা ভীষণ সিরিয়াস মনোভাব। তারপর সেই ছোট্ট কাপড়ের পাখির নিড়ে কে কখন যে ঘুমিয়ে পড়তাম তা কেউ জানতে পারতাম না। মশার কামড়ও সেই নিশ্চিন্ত নিদ্রা ভাঙাতে পাড়তো না। তবু সকালে উঠেই মচকানো বাঁশের মত ব্যস্ততার আনন্দ। মা বাবার সাবধান বাণী, ডেঙ্গু জ্বরের ভয় কোনো কিছুই আমাদের আনন্দের বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে নি। হড়কা বানে যেমন সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে সমুদ্রে ফেলে, আমাদের আনন্দ ঠিক আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যেত মহানন্দের জগতে। এরপরে সকাল সকাল স্নান সেরে ফলমূল কাটতে বসে পড়তাম বাড়ি থেকে নিরামিষ বঁটি এনে। পুরোহিত এসে পড়তেন ইতিমধ্যে। মন্ত্র তন্ত্র কিছুই বুঝতাম না। শুধুমাত্র বুঝতাম মায়ের কাছে চাইলে মা না করতে পারেন না। পুষ্পাঞ্জলি দিতাম একসঙ্গে সবাই। জোরে জোরে পুরোহিত মন্ত্র বলতেন। মন্ত্র বলা ফাঁকি দিয়ে ফুল দিতাম মায়ের চরণে ভক্তিভরে। তারপরে প্রসাদ বিতরণের চরম পুলকে আমরা বন্ধুরা সকলেই পুলকিত হতাম। প্রসাদ খেতাম সকলকে বিতরণ করার পরে। আমাদের সবার প্রসাদে ভক্তি বেশি হয়ে যেত, ফলে দুপুরে বাড়িতে ভাত খেতাম কম। সন্ধ্যা বেলায় প্রদীপ, ধূপ জ্বেলে প্যান্ডেলের ঘরে সময় কাটাতাম। পরের দিন দধিকর্মা। খই আর দই। পুজো হওয়ার অপেক্ষায় জিভে জল। তারপর প্রসাদ বিতরণ করে নিজেদের পেটপুজো সাঙ্গ হত সাড়ম্বরে।এরপরের দৃশ্য প্রতিমা বিসর্জন। কাছেই একটা পুকুর। রাত হলে সিদ্ধিলাভে (দামীটা না) আনন্দিত হয়ে নাচতে নাচতে অবশেষে শেষের বাজনা বেজে উঠতো। মা তুই থাকবি কতক্ষণ, তুই যাবি বিসর্জন। তার সাথে আমাদের মনটাও বিসর্জনের বাজনা শুনত দুদিন ধরে।
কবিতা
প্রণব কুমার দাস
বিরাটি, কলকাতা

দুই শালিক
পৌষমাস.....
আলস্য মাখা সকাল,
নরম লেপের ওম,
ধোঁয়া ওঠা এক কাপ চা,
জানালায় মন ভাল করা - দুই শালিক,
মিঠে রোদে সেঁকা খবর,
নরম হাতের গরম রুটি-তরকারী,
পড়নে পছন্দের শার্ট, যুতসই ঘড়ি,
ব্যাগে বনলতা সেন, কলম, জল-টিফিন,
পকেটে মানিব্যাগ... আজও খুচরোর অভাব,
স্টেশনে অনাবশ্যক ভিড়,
রেললাইনে গড়ায় চাকা... ঘর্ষণ,
কামরার দুলুনি, হকারের ছড়া,
ঘুম ঘুম মধ্যবিত্ত আবেশ....
সহযাত্রীর বকুনি, গন্তব্যের ঝাঁকুনি,
নেমে রিকশা ....... আমার ইস্কুল।
প্রার্থনার 'আগুনের পরশমণি',
ক্লাস শুরুর ঘন্টা,
শ্রেণী শিক্ষক, সপ্তম শ্রেণী, বিভাগ ‘ক’,
রোল কল শেষে এক মিষ্টি নালিশ .... সমাধান।
তারপর... নদীর ক্ষয়কার্য,
ব্ল্যাকবোর্ডে ভাস্কর্য, ভাল লাগার ক্ষণ,
জীবিত জীবাশ্ম, স্বপ্নের ভারে স্থবির।
তবুও পাশে এক উষ্ণ আবেশ
সম্বিত ফেরে তার ডাকে।
“ঝড়, চৈত্রে কালবৈশাখীর ঝড়
তছনছ করবে সে ...”
ময়দানে ধূলার কুন্ডলী, চারপাশ ঝাপসা, ধূসর।
এই ভাবে কিছুক্ষণ, পাশাপাশি দুজন...বৃষ্টির আশায়।
অতঃপর বৃষ্টি, কাঙ্ক্ষিত বৃষ্টি - সোঁদা আঘ্রাণ।
ভিজে যায় শরীর, শরীরের ধূলা মরে হয় কাদা,
তৃপ্ত ময়দান - মিটিয়েছে তৃষ্ণা, ছাপিয়েছে রাজপথ,
ঘাস এখন আরও সবুজ।
কিন্তু আমার মন তৃষ্ণার্ত, কাতর।
চোখের জল ঢেকেছে আকাশের জল,
তবু আগামীর লক্ষ্যে অবিচল…
বেলা শেষ, দিগন্তে রোদের ঝিলিক,
পুব আকাশে ছেঁড়া রঙধনু ফ্যাকাশে, বেমানান।
এবার ঘরে ফেরার পালা...
তবু ভেজা ঘাসে বসে থাকে এক জোড়া শালিক।
ক্লাস শেষে লাজুক ডাক,
জন্মদিন... এক গোছা গোলাপ,
অফ পিরিয়ডে পায়চারি,
হঠাৎ হাত ধরে টান,
‘ও স্যার আমাদের ক্লাসে এসো '...
নাছোড় ডাক, অবুঝ শৈশব, খিল খিল হাসি।
******
আবারও টান...
হাত ধরে টান, হেঁচকা টান,
জোর বড়ো বেশি!
বুক ধরফর, গাঢ় শ্বাস, ঘার্মাক্ত শরীর - অস্থির,
ভীষণ গরম! আঁতুড়ে গরম, প্রবল সংশয়....
আমি - জীবিত শরীরে মৃত আত্মা,
না কি মৃত দেহের জীবিত সত্তা?
ক্ষণিকের ভ্রান্তি.... বিস্ময়!
ঘুম? ঘোর? না দুরাশা...
আজ ২২ শে চৈত্র, আমি ধর্নায়।
সাথে একদল...
হার না মানা ক্ষয়াটে চেহারা।
রাজপথে কোলাহল, ভারি হট্টগোল,
পশ্চিমে আকাশ বিষণ্ণ, মিশ কালো,
বাতাসে মেদিনীর ভার।
আমি নিশ্চল...
কবিতা
কৃষ্ণতরু বর্মন
ডালাস, টেক্সাস
বয়েই গেছে
বয়েই গেছে..
বৃষ্টি ভেজা মাটি, সদ্য স্নাত নরম ঘাসে পায়ের ছাপ
কিছুটা জল উঠে এসে-
তোমার সকালের নেলপালিশ ভিজিয়ে দিল।
আমার ও...
চটিতে নতুন পেরেকের সোহাগ,
যন্ত্রণা ভুলে অঙ্গে নতুন চামড়ার গন্ধ,
রুগ্ন শরীরে কত আনকোরা কাটাঁছেঁড়া,
শীর্ণ আঙ্গুলের অবিরাম কারসাজি।
আর তো কটা দিন!
করুক শহুরে ধুলো-জলের সাথে আলগা পিরিত...
তাও গিলে নিল এই ক্ষণজন্মা বৃষ্টির সুস্বাদু জল!
***
কাঁধে ঝোলানো ব্যাগে তোমাকে লেখা আধখানা চিঠি,
মাঝদরিয়ায় উঠলো তুফান,
শব্দের টানাটানি, হাহাকার, বিজ্ঞাপনে 'সন্ধান চাই'
মাথামুণ্ডু না বুঝে ধার করা শব্দগুলো
আলগোছে পাশাপাশি, নাম দিয়েছি 'কবিতা'...
অসাধ্য সাধন! তাও শুধু তোমারই জন্য।
কাকভেজা শালিকের ডানা ঝাঁপটানো জলের ফোঁটা
হাওয়া মিশে তোমার চোখের পাতায় খোঁজে আশ্রয়
এক বিষণ্ণ বিকেলের আর্দ্র স্নিগ্ধতায়।
কথা হয় নি কখনও আমাদের, হবেও না।
শুধু তোমার হাতটা ছিল আমার হাতের মুঠোয়...
মনে হচ্ছিল সারা পৃথিবী -
তারপর, জংলা ঘাস, নেল পালিশ, চটির উপাখ্যান ...
কিছুই মনে রাখিনি।
বয়েই গেছে...
সেই সংলাপ
"হ্যাঁ রে, খেয়ে যাস, বলিস কখন খাবি?
বেরোনোর সময় ছাতা নিস, বৃষ্টি হতে পারে"
মেঘের চোখে চোখ রেখে এই দুটো কথাই!
উঠতি বয়স, সময়ের থেকেও দ্রুতগামী,
অগোছালো পদক্ষেপে মন দিয়ে শোনা হয় নি।
দায়সারা উত্তর - 'এসে খাবো' কিম্বা -
'ধুর! ছাতা কে নেবে'।
যেমন বলি যৌবনে, দাম্ভিক উদ্দামতায়।
তারপর আর কিছু মনে নেই, থাকার কথাও নয়।
তবে শুনলে ভাল হত, আজ মনে হয়
জীবনের অপরাহ্ণে...
সেদিন ফেরেছিলাম তাড়াতাড়ি,
কেন জানি না, ফেরার কথাও কিন্তু ছিল না...
না বৃষ্টি আসে নি ঠিকই...তবে...
এরপর আর কখনো ছাতার
কথা মনে আসেনি হাজার বৃষ্টিতেও!!
হয়ত প্রয়োজন পড়ে নি, কিমবা
হয়ত মনে করানোর কেউ ছিল না বলে।
***
চলমান সময়ের ভাঁজে ভাঁজে
মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা ফেলে আসা কিছু মুহূর্ত
ডাইরির মলাট জুড়ে শুধু স্মৃতির ধুলো...
সরাতে গিয়ে তর্জনীতে একরাশ...
ধুলোর আড়ালেই -
মন জমিনের গভীরেই অদৃশ্য প্লেটের ঠোকাঠুকি
নির্গত শক্তি, রেখটার স্কেল! প্রাণহীন, স্থবির, অর্থহীন
আয়না বছর গোনে, রাখে অপর্থিব সময়ের হিসাব
চোখের নিচে বলিরেখা নিয়ে নিদারুণ মস্করা... কিম্বা
চোখের গভীরেই ডুবুরী নামিয়ে
ভ্রু কুঁচকে বয়স যাচাই...
চোখের তারা খোঁজে সত্যের জলছবি,
পালিয়ে আসি আড়ালেই, আচম্বিতে
***
আজ আর অফিস যাই নি
মেঘ নেমে এসে আলতো করে ব্যালকনিতে মুখোমুখি...
আমার ফেলে আসা যৌবন
ছেলেটার উদ্দামতায় বেঁচে,
থাকুক, যত দিন পারে...
হঠাৎই সকালের অযাচিত তাড়াহুড়োয় -
সেই সাবধানী সংলাপ 'ছাতা নিস, বৃষ্টি হতে পারে'
চমকে উঠি! চোখের চমশা স্থানচ্যুত -
এ ও কি সম্ভব, সেই সংলাপ!!
তবে ভাল লাগল, ছেলেটা আমার মত ভুল করে বসেনি
যৌবনে দাম্ভিক উদ্দামতায়! তবে...
আমি অপেক্ষায় ছিলাম ওর ফিরে আসা পর্যন্ত...

এখন দুঃসময়—
এখন দুঃসময়—
পথের সাথীরে নিতে হবে চিনে, পথে হবে পরিচয়
প্রেমের কাব্য কবিতা গানের সময় এ তো নয়।
এখন দুঃসময়—
পথহারা যারা ভ্রান্ত পথিক নিতে হবে সাথে তারে
অসহায় যত আর্তপীড়িত যেতে হবে তারও দ্বারে।
ভাষাহীন মুখে দিতে হবে ভাষা দূর করে সব ভয়
নেমে এসো পথে, পথের বন্ধু, পথে হবে পরিচয়।
এখন দুঃসময়—
যদি বাধা আসে আসুক তবু ও চলবে এ পথ চলা
এসো হে নবীন ডাকছে এ গান গাইবো মিলিয়ে গলা।
দূর করে এসো দ্বিধা ও দ্বন্দ্ব যত মনে সংশয়
মিশে যেতে হবে জনস্রোতে আর কাল বিলম্ব নয়।
এখন দুঃসময়—
ভয় কি মরণে, করব বরণ মরণ আসলে আসুক
এ আঁধার চিরে আগত শিশুকে দেখাবো আলোর মুখ।
আগামী ডাকছে পথে নেমে এসো, পথে হবে পরিচয়
প্রেমের কাব্য কবিতা গানের সময় এ তো নয়।
এখন দুঃসময়—
কবিতা
সুকান্ত পাল
জিতপুর, মুর্শিদাবাদ
পূর্ণিমা রাত - পূর্ণ চাঁদের স্বপ্ন আমার নাই
আধখানা নয়, আস্ত রুটির অধিকার আমি চাই।
নেমে এসো পথে বন্ধু এখন পথে নামবার পালা
আধখানা রুটি কতদিন আর, সইবে ক্ষুধার জ্বালা!
শহর আর গ্রাম হতে হবে এক বাঁচব লড়াই করে
দু’হাতে ক্ষুধার আঁধার ছিঁড়ে পৌঁছে যাবোই ভোরে।
ভীরু নই কেউ, নই কাপুরুষ দাবী শুধু একটাই
আধখানা নয়, আস্ত রুটির অধিকার আমি চাই।
বন্ধ কলের খুলে দাও দ্বার, চলুক অচল কল
কর্মবিহীন অলস বাহুতে জাগুক পূণর্বল।
পায়ের পিছনে শত শত পায়ে নেমে এসো সাথী পথে
বিজয়লক্ষ্মী আগুয়ান হবে আমাদেরই সাথে রথে।
গরম ভাতে নুনের দাবীতে হতে হবে এক ভাই
আধখানা নয়, আস্ত রুটির অধিকার আমি চাই।
