এপ্রিল
২০২৪
প্রচ্ছদঃ সুরজিত সিনহা
লেখক/লেখিকাবৃন্দ
প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা
গল্প
রুদ্র ক্রমশই ধৈর্য হারিয়ে ফেলছিল। আজ ভীষণ দেরী করছে সাফারির গাড়িটা আসতে। বাবা-মা হোটেলের বারান্দায় বসে প্রথম কাপ চা শেষ করে দ্বিতীয় কাপটাও প্রায় শেষ করে ফেলেছে তাও গাড়ির দেখা নেই। এর আগে ডিসেম্বর মাসের রাজস্থানের প্রবল শীত অগ্রাহ্য করে ভোর পাঁচটায় উঠে ওরা তিনজন তৈরি হয়ে হোটেলের বারান্দায় জঙ্গল সাফারির গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিল।
একে মঙ্গলবার তার উপর ডিসেম্বরের মাঝামাঝি রাজস্থানের প্রচণ্ড শীত তাই বেশি টুরিস্ট নেই। অবশ্য শনি-রবিবার একটু বেশী ভিড় হয়। আজ আর একটি মাত্র বিদেশী টুরিস্ট পরিবার গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিল। কয়েক মিনিট আগে ওদের গাড়ি এসে যাওয়ায় ওরাও চলে গেল। রুদ্রর হতাশা আরও বেড়ে গিয়েছিল, বাবা অমিতাভর দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল,
- 'বাবা আমাদের গাড়ি আসবে তো?'
এবার অমিতাভেরও ধৈর্যচ্যুতি ঘটলো। চায়ের কাপটা পাশে রেখে পকেট থেকে ফোন বের করে গাড়ির ড্রাইভার এর সঙ্গে যোগাযোগ করলো।
- 'আপনারা কোথায়? আলো ফুটে গেলে আজ আর সাইটিং হবে না! ড্রাইভার এর উত্তর শোনা গেল না।' তবে ফোন রেখে অমিতাভ বলল,
- 'আমাদের জঙ্গলে ঢোকার টিকিটে একটু গলদ ছিল ওরা সেটা মিটিয়ে আসছে। এখুনি হোটেলে এসে পড়বে।' কথা শেষ হবার আগেই কিছু দূরে একটি গাড়ির হেডলাইটও দেখা গেল।
এক বহুজাতিক তথ্য-প্রযুক্তি সংস্থার কর্তা অমিতাভর দুটো নেশা এক জঙ্গল ভ্রমণ, দ্বিতীয় ছবি তোলা। প্রথম প্রথম স্ত্রী কেকার, অমিতাভর সঙ্গে জঙ্গলে ঘুরতে একদম ভালো লাগতো না। কিন্তু আস্তে আস্তে কেকারও জঙ্গল ভালো লাগতে আরম্ভ করেছে। একমাত্র বার বছরের ছেলে রুদ্রনীল ওরফে রুদ্র্র একদম বাবার মত; অনেক জঙ্গলের বইও পড়ে ফেলছে।
অমিতাভের মতে প্রকৃতির আসল রূপ দেখতে হলে জঙ্গলে আসতে হবে। সৃষ্টিকর্তা প্রাণমন ঢেলে সাজিয়েছেন প্রতিটি জঙ্গল আর তার বসবাসকারী প্রতিটি প্রাণীকে। এই সৌন্দর্য অনির্বচনীয়, আর ক্যামেরাতে ধরে রাখার মতো তো বটেই। ব্যাঙ্গালোর থেকে ওরা প্লেনে রবিবার জয়পুর এসে। সেখান থেকে গাড়িতে সোমবার সকালে রনথম্ভুর এসে হাজির হয়েছিল। গতকাল বিকেলের সাফারিতে যদিও বাঘের দেখা পায়নি কিন্তু এক নম্বর জোনের সৌন্দর্য অমিতাভর যথেষ্ট ভালো লেগেছিল।
ভারতের সংরক্ষিত জঙ্গলের মধ্যে রনথম্ভুর একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে রয়েছে। প্রায় ১৩৩৪ বর্গ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে প্রায় খান পঁচিশেক বাঘের বাসস্থান এই জঙ্গল। এই জঙ্গলের বেশিরভাগ গাছই বছরে একবার তাদের পাতা পাল্টায়। তাই এদের পর্ণমোচী বলা হয়। এই সময় সেই পাতাঝড়ার পর্ব চলছে। সারা জঙ্গলে পাতা পড়ে পড়ে একদম গালিচার মত চেহারা হয়েছে। রনথম্ভুর জঙ্গল অনেকখানি রুক্ষ আর পাথুরে। জায়গায় জায়গায় ঝোপঝাড়। ঘন জঙ্গল না হবার জন্য, অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। সাইটিং বা বাঘ দেখার জন্য এটা একটি লোভনীয় ব্যাপার। গতকাল অমিতাভরা প্রচুর সাম্বার হরিণ, আর পাল পাল চিতল হরিণও দেখেছে। এছাড়া দেখেছে নানা রকমের পাখি। তবে যে জঙ্গলে বাঘ থাকে সেখানে সবাই বাঘই দেখতে চায়। অর্থাৎ এই জঙ্গলে বাঘই প্রধান আকর্ষণ। সেটা দেখতে না পাওয়াতে অমিতাভের পরিবার কাল একটু হতাশই হয়েছিল।
যাই হোক আজ ঠিক সাতটায় ওদের গাড়ি জঙ্গলে ঢুকে পড়ল। এখনো দিনের আলো ভালো করে ফোটেনি। আর গাড়িটা বেশি জোরেই চলছিল জঙ্গলের এবরো-খেবড়ো রাস্তায়। মিনিট দশেকেই একপাল হরিণ আর সেই সঙ্গে একজোড়া নীলগাই দেখা দিল। সকালের নরম আলোয় আর আধা
অন্ধকারে ওদের দেখতে ভারী সুন্দর লাগছিল। অমিতাভ ক্যামেরা বের করে ছবি তুলতে উদ্যোগী,
- সাব, এই সমস্ত জন্তু সারা জঙ্গলে আছে এবং পরেও আপনি প্রাণভরে ছবি তুলতে পারবেন। আগে আমরা বাঘের খোঁজ করে নেই।
ওদের কাছে খবর আছে। যে জঙ্গলের এই অংশে নুরী (টি-১০৫ নম্বর বাঘ) ছাড়াও আরেকটি পুরুষ-বাঘও এখন রয়েছে। ওরা এখন তারই খোঁজে চলেছে। একটু একটু করে সকাল হচ্ছে। তবে যেখানে ঘন জঙ্গল। সেখানে এখনো আলো-আঁধারি-ভাব রয়েছে। সেই রকম এক জায়গায় হঠাৎ মাথায় বিশাল পাগড়ী আর গায়ে কালো কম্বল জড়ানো একটি লোকের দেখা পাওয়া গেল। মনে হল লোকটি যেন হঠাৎ মাটি ফুঁড়ে সামনে এসে হাজির হলো। রামচরন গাড়ির গতি কমিয়ে কিরকম ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল লোকটির দিকে। লোকটা মৃদুস্বরে রাজস্থানি ভাষায় বলল।
- বাঘ দেখতে চাও তো লেকের পাশে পাথুরে জায়গায় যাও।
হতচকিত রামচরণ মৃদুস্বরে বলল আমরাই জায়গাটা ছেড়ে এসেছি, গাড়ি ঘোরাতে হবে।
অমিতাভর কানে ওর গলাটা একটু অস্বাভাবিক মনে হল। যাইহোক গাড়ি ঘুরিয়ে লেকের দিকে রওনা হল। তবে ওই কালো কম্বল জড়ানো লোকটাকে আর দেখা গেল না। সে যেমন মাটি ফুটে এসেছিল বোধহয় তেমনি উবে গেল। মিনিট দশের পর লেকের পাশে ওই পাথরের জায়গায় গিয়ে সবার অবাক হওয়ার পালা। এক বড়সড় পাথরের উপর সম্রাজ্ঞীর ভঙ্গিতে নুরী (টি-১০৫ নম্বর বাঘ) বসে আছে। সকালের মিষ্টি রোদ ওর গায়ে পড়ে হলুদ আর কালো ডোরা অপূর্ব লাগছিল। একটার পর একটা ছবি তুলেও অমিতাভর আশ মিটছিল না। একটু পরে নুরী পাথরের আসন থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করল। সে হাঁটাও দেখার মত। কিছুক্ষণের মধ্যেই পাশের ঝোপ থেকে দুটো ব্যাঘ্র শাবক বেরিয়ে এসে নুরীর আশেপাশে ঘুরে বেড়াতে লাগলো। এখন নুরী আর এই জঙ্গলের সম্রাজ্ঞী নয় এক মমতাময়ী মা।
অমিতাভ পরিবারের কারোরই আর চোখের পলক পর্যন্ত পড়ছিল না। সবাই রাজ পরিবারের দর্শনে মুগ্ধ। কিছু পরে নুরী সপরিবারে গভীর জঙ্গলে ঢুকে গেল।
আরও কিছুক্ষণ জঙ্গলে ঘোরাঘুরি করে পুরুষ বাঘের খোঁজ করেও দেখা পাওয়া গেল না। তবে অমিতাভরা খুব তৃপ্ত। অসাধারণ বাঘের দর্শন হয়েছে। এত ভালোভাবে খুব কম লোকই বাঘ এবং তার বাচ্চাদের দেখতে পায়।
হোটেলে ফিরে প্রাতরাশ বা ব্রেকফাস্ট এর জন্য অমিতাভরা রেস্টুরেন্টে হাজির হল। সেখানে পৌঁছতেই দর্শনের সঙ্গে দেখা। মাঝ বয়সি এই ছেলেটির মুখে এক গাল হাসি লেগে রয়েছে সব সময়। গতকাল থেকে দর্শন অমিতাভদের খুব যত্ন সহকারে খাওয়া-দাওয়া দেখাশোনা করছিল। নিজের হাতে বাড়ির লোকের মত পরিবেশন করছিল। আর রুদ্ররও বন্ধু হয়ে গেছিল, দর্শন। এখন এক গাল হেসে জিজ্ঞেস করল।
- রুদ্রবাবুর কি আজ বাঘ দেখা হলো?
- আমরা আজ খুব ভালোভাবে নূরী আর তার দুই বাচ্চাকে অনেকক্ষণ ধরে দেখেছি।
রুদ্রর চোখে মুখে প্রচন্ড উত্তেজনার ছাপ। সে দর্শনকে সবিস্তারে সেই কম্বল জড়ানো লোকটার কথাও বলল। হঠাৎ দর্শনের মুখ কেমন যেন ভাবলেশহীন হয়ে গেল।
- বাবু আপনাদের যে পথ দেখিয়েছে সে রক্তমাংসের মানুষ নয়। এখানকার লোকেরা বলে এক প্রেত আত্মা। জঙ্গলে কাঠ কাটতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছে লোকটি বছর পাঁচেক হল। বোধহয় বাঘের শিকার হয়েছিল। এখন মাঝে মাঝে কেউ কেউ ওর দেখা পায়। তবে ও কারুর কোনো ক্ষতি করেনি আজ পর্যন্ত। অমিতাভর পরিবারের সবারই খাওয়া প্রায় বন্ধ হয়ে গেল।
কবিতা
ডক্টর সুব্রত ভট্টাচার্য্য
সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
দ্বিরাগমন
মনে পড়ে,
দ্বিরাগমনের দিনটির কথা?
জ্যোৎস্নার সেই পরশনের কথা?
প্রাক গোধূলিলগ্নে,
দুর্যোগ ভরা অবিশ্রান্ত বৃষ্টির খানিক বিরতিতে,
দোরগোড়া থেকে রিকশায় চড়ে গলি দিয়ে রাস্তার মোড়ে যাওয়ার পথে
বর্ষিত হয়েছিল প্রতিবেশীদের -
ছাদ থেকে,
বারান্দা থেকে,
উন্মুক্ত জানালা থেকে,
এবং অর্ধ উন্মুক্ত ঘোমটাবৃত সম্মুখ দরজা থেকে,
নানান উচ্চারণে,
নানান ভঙ্গীতে,
কত না কৌতূহলমিশ্রিত ভালোবাসা,
আর পাগল করা আশীর্বাদ!
সেইসময় -
বৈবাহিক কার্যাদি সমাপনান্তে
ছাদের কার্নিশ আর বারান্দার রেলিংএর কিছু স্থান হতে
তখনও চুঁইয়ে পড়া বৃষ্টির জলের ফোঁটাগুলো
খুব ছোট থেকে ধীরে ধীরে প্রস্ফুরণ ঘটিয়ে বড় গোলাকৃতি ধারণ করে
ঝরে পড়বার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত
ছোট ছোট রামধনু সৃষ্টি করছিলোl
উঁকি দেওয়া অস্তগামী সূর্যের কোমল রশ্মি ও দ্রুতগতির মেঘের
লুকোচুরি খেলা আলো-আঁধারিতে
আর্দ্র স্যাঁতসেঁতে কিঞ্চিৎ ভারী সমীরণে দোদুল্যমান
অনতিদূরের সুবৃহৎ নারিকেল বৃক্ষের
এলোমেলো হতে থাকা আপাত: ফ্যাকাসে সবুজ পত্রাবলী হতে
নির্গত হওয়া
বৃষ্টিতে আশ্রয় নেওয়া
সদ্য বাসা ভাঙা কয়েকটি সাদা বক,
আর
গঙ্গাপাড়ের ইতিহাসসাক্ষী সুবৃহৎ বটবৃক্ষগুলো হতে
শিকারীর তাড়া খেয়ে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে আর্তনাদ করতে করতে
শামুকখোল পাখিরা,
দক্ষিণ -পূর্বাকাশে ক্রমশ: পুঞ্জীভূত হতে থাকা কালো মেঘের নীচ দিয়ে
নিরাপদ উচ্চতায়
বিভ্রান্ত অবস্থায় এদিক সেদিক উড়ছিলোl
পরিস্থিতি অনুযায়ী
আপন আস্তানা হতে বহির্গমন নিমিত্ত তাৎক্ষণিক পরিবেশ কিঞ্চিৎ অনুকূল মনে হলেও,
সারমেয়কুল কিন্তু তখনও বৃষ্টিকালীন নিরাপদ আশ্রয় ছেড়েপথে নেমে স্ব এলাকা নিয়ে সদর্পে বিতন্ডা শুরু করেনি l
উপচে পড়া বাঁশপুকুর থেকে জলের তোড়ে ভেসে আসাছোট ছোট তেচোখো, তেলাপিয়া, এবং পুঁটির লাগি দোরগোড়ার সিঁড়ির নীচে,
কংক্রিটের আড়ালে, বৃষ্টিপ্লাবিত পয়:প্রণালীর খাঁজে আশ্রয় নেওয়া জলঢোড়া সার্পটি
প্রকাশ্যে আসেনিl
সুড়সুড়ি পিঁপড়েরা রিক্সাতে আচমকা উপস্থিত হয়ে নব দম্পতির সঞ্চারিত আবেগের ছন্দভঙ্গ করেনিl
মধুপেরা মধু সংগ্রহে বাহির হয়নি।
নব নব বিকশিত কিশলয় ভক্ষণ নিমিত্ত সদ্য আগত হনুমানেরা
সুবৃহৎ বৃক্ষগুলি হতে হাঁকডাক করা তো দূরের কথা,
এমনকি, লম্ফঝম্ফ করে শাবক বুকে নিয়েও
সামনে এসে দাঁড়ায়নি।
তবে ভুলি কেমনে,
পাশের বাড়ির সাদা -বাদামী ছোপওয়ালা বিড়াল ছানাগুলো
কি মিষ্টি ভঙ্গীতে পাঁচিলের উপরে
তাদের মায়ের পাশে গুটিসুটি হয়ে বসে
কীট পতঙ্গ শিকারের লাগি তাকিয়ে থেকেছিলো!
আর,
সংকীর্ণ বর্ষণস্নাত: খানাখন্দ পথ ধরে
আমাদের রিকশা সন্তর্পণে এগুনোর সাথে সাথে
যেন পেখম মেলে
নৃত্যের ভঙ্গীতে
ডানপার্শ্বের বাড়ির ছাদের কার্নিশ দিয়ে
ক্রমান্বয়ে সম্মুখ আর পশ্চাদপানে মাথা নাড়াতে নাড়াতে
ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে
বকবকম করতে করতে
মদনবানে বিদ্ধ হয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলো
পোষা একজোড়া
সাদা ধবধবে গোলা পায়রা।
কর্মোদ্দেশ্যে ঘর ছাড়বার পূর্বাবধি
আজন্ম লালন পালনের মধ্যে কাটানো
আমার পাড়া ওটি।
সবাই ভালোবেসেছে আমাকে,
এবং
ওখানকার বাতাসে,
ধূলোকনায়,
মিশে রয়েছি আমি।
সেদিন ওরা সকলে বুঝিয়ে দিয়েছে যে
বধূ হিসাবে পাড়াতে স্বাগত তুমি,
গৃহীত তুমি সেথায়
আন্তরিকতা আর
সম্মানের সাথে।
এরপর রাস্তার মোড়ে পৌঁছে
রিকশা থেকে নেমে
মখমল আচ্ছাদিত নান্দনিক যন্ত্র বাহনে আসীন হয়ে
তব পিতৃ -মাতৃলয় উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার সময়
না জানি কত আশংকায় ছিলে তুমি -
'পাছে সেই ঘোর ভেঙে যায়!
বেপাড়া দিয়ে অগ্রসর হওয়ার পথে
পাছে কোথাও দেখতে হয়
চলন্ত গাড়ির উদ্দেশ্যে নিক্ষিপ্ত কোনো উষ্ণ চুম্বন,
কিংবা কোনো কুটিল চোখের ইশারা!'
হয়তো তাই চোখ বুজে ছিলে তুমি,
যাতে না দেখতে হয় অনাকাঙ্খিত ঐ সকল
রঙিন কাঁচের মধ্য দিয়ে।
খানিক পরে,
গোধূলি অন্তে,
বড় রাস্তার মায়াবী আলো আঁধারিতে দেখেছিলে
দুপাশ দিয়ে একের পর এক চলে যাওয়া
সান্ধ্যকালীন কুটিল ছায়াগুলো,
দন্তবিকশিত সব দানবগুলো;
যেন ওগুলো ছিল
চলে যেতে থাকা নানান প্রেতাত্মা!
যেতে যেতে সন্ধ্যা পার হলে,
অত:পর সুবৃহৎ বৃক্ষরাজি আর
দুই পার্শ্বের নবীন শস্যক্ষেত্রময়,
অন্ধকারময়,
জনবিহীন পথে পৌঁছে
একসময় অনুভব করেছিলে
কেউ যেন তোমার গালে সুড়সুড়ি দিচ্ছিলোl
অনেক যত্নে পাগলা গোছের একটা মাকড়সা যেন
তোমার ঘাড়ের ওপর দিয়ে ছুটে যাচ্ছিলো।
তখন সলজ্জে মস্তক নুইয়ে
ক্ষীণস্বরে বলেছিলে
“ধরো ওটাকে”।
আঁধারে ব্যস্ত তখন
অনুসন্ধিৎসু মন।
খুঁজিতে সেই প্রাণীটিরে
থামিয়ে পথিপার্শ্বে যন্ত্রবাহন
রয়েছিলাম আমরা সেথায়
বেশ কিছুক্ষণ।
বাহনচালক তড়িঘড়ি চলে গিয়েছিলো নিরাপদ আড়ালে,
প্রকৃতির আজ্ঞায়।
ছিলাম আমরা তখন দুজনে
সেই নির্জনে
তার প্রত্যাবর্তনের প্রতীক্ষায়।
সেখানে তখন বর্ষার নতুন জলে
খুশিতে মাতোয়ারা কোলা ব্যাঙেরা।
ব্যাঙ ব্যাঙানির বিয়েতে ব্যাঙেদের ঘরে আনন্দের ধুম।
উজ্জ্বল হলুদ শাড়িপরিহিতা তাদের গানের আসরে
ঝিঁ ঝিঁ পোকারা তানপুরার সুর বেঁধেছিলো।
আকাশের তারাগুলো তো বহুদূরে,
জীবন স্পর্শ করতে পারে না;
তখন ওই থই থই অন্ধকারে দেখেছিলাম
ক্ষণে ক্ষণে
যেন তারা-দেরই মতন মিটমিট করে জ্বলে উঠে
ক্ষুদ্র বুকে প্রেমের আলোকে দীপ্তিমান হয়ে
কর্দমাক্ত আঁকাবাঁকা সংকীর্ণ মেঠো পথে
থোকা থোকা জোনাকিরা
আরতির মতন নৃত্যের ছন্দে
মিছিল করে পথ দেখানো গ্রাম পরিক্রমা করেছিল।
বামপার্শ্বের এক শালবৃক্ষে
নিরাপদ -উচ্চ ডালে
একনাগাড়ে বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়া বাসায়
শুকনো স্থানের সংকুলানে
তা দিয়ে ডিমগুলোকে গরম রাখতে
পাখিদের জায়গা পরিবর্তন করার সময়
মচ মচ শব্দ,
এবং ডানা ঝাপটানোর সময় বাতাসে ধাক্কা জনিত
ত্বরিত গতির ছন্দময় মসৃণ শব্দের সঙ্গে সঙ্গে
ডানার পালকের সঙ্গে বাসার ঘর্ষণজনিত খর খর শব্দও ভেসে এসেছিলো।
প্রাকৃতিক দুর্যোগে আপন কৃষিজমি পরিদর্শন শেষে কয়েকজন চাষী বগলদাবা করে
খানিক আগে বৃষ্টিতে ব্যবহার করা তালপাতার মাথাল,
আর
প্রজ্বলিত কেরোসিনের ধোঁয়ায় কালো হয়ে যাওয়া কাঁচের লণ্ঠন হাতে,
উচ্চস্বরে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে ঘরে ফিরছিলো।
সহসা ঐ পূর্ণিমার নিশীথে
উতল হাওয়ায় পুঞ্জীভূত মেঘ
কিছুক্ষণের জন্য উড়ে যাওয়ার পর,
পূর্বাকাশে নবীন চন্দ্রের স্নিগ্ধ -কোমল রূপ
সৌরভময় কদম, ছাতিম, আর হাসনাহানা পুষ্পশোভিত
বৃক্ষরাজির মধ্য দিয়ে
চিরুনির মত অগুনতি সংকীর্ণ পথে
রজতধারায় ঝরনার মতাে ঝরে
কুয়াশার মতন চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়লে,
ক্রমশ:ই যেন অবগাহন করেছিলাম
এক গভীর উপলব্ধির অতলে।
আবেগমথিত সেই মায়াবী জ্যোৎস্নালোকে ভাসতে ভাসতে
দুজনে একাত্ম হয়ে
পাড়ি জমিয়েছিলাম এক স্বপ্নলোকে।
বাহনচালকের বিলম্বিত প্রত্যাগমনে বিন্দুমাত্র বিরক্ত না হয়ে
তোমাকে বলেছিলাম -
তাড়া কিসের
হোক না খানিক দূর,
এটা কি কম মধুর?
চলেছি আমি আবার
এ শহর, এ দেশ ছেড়ে
মানুষ হতে দূর থেকে দূরে।
ঘুমিয়ে আছে মানুষ
প্রাণহীন এ শহরে।
ঢাকা চারিধার শুধু
ইট-কাঠ আর পাথরে।
মরেছি আমি বহুবার
এ দেশে, এ শহরে।
নবজন্মের পর চলেছি আবার
কল্পনার রথে চড়ে।
গিয়েছি আমি বারে বারে
মানুষ হতে দূর থেকে দূরে সরে।
কবিতা
সঞ্জীব হালদার
কলকাতা
লেখক পরিচিতিঃ থাকেন কলকাতায়। শিক্ষকতা পেশায় নিযুক্ত। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর। প্রথম কবিতা “বসন্তের দুপুর” প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯২ সালে।
এই শহর এই দেশ
কতশত দেশে চলেছি আমি
কল্পনার রথে চড়ে।
গিয়েছি আমি বারে বারে সরে
মানুষ হতে দূরে।
দেখেছি আমি কোলাহল মাঝে
হিংসামত্ত আমার এ দেশ,
মৃত্যু মিছিলে আমার এ শহর।
না-এ আমার শহর নয়,
এ নগর আমার দেশ নয়।
কবিতা
মো:সাইদুর রহমান সাঈদ
পটুয়াখালি,বাংলাদেশ
যজ্ঞ-মন্ত্র
হে মহা-রুদ্র!
আমার চিত্তের তিক্ত-আত্মাকে
আবার জাগিয়ে তোলো!
কণ্ঠে ঢালো শূল-বাণী,
আবার করো আমায় ত্রিশূলপাণিনী!
বহাও রক্তাগ্নিস্রোত!!
মম ভালে জ্বেলে দাও পুনঃ রণনৃত্যের কাপালিক-টীকা!
চক্ষে চির-জ্বালাময়ী অগ্নি-বহ্নি-শিখা
ফিরিয়ে দাও!
জ্বালিয়ে দাও!
দুঃসহ-দাহনে আবার ভস্ম করি সব__সব!
দাও হে-ভীম ডম্বরু-রব,যাহা মম নীরব
ভেঙে যাক!টুটে যাক!
আমার গহীনের কৈলাশ হতে
জাগিয়ে তোলো বিনিদ্রিত শিবকে,
ভৈরব-শবখেলায় নেচে উঠি আমি আবার!
আনি কাল-প্রলয়ংকর-যামিনী!!
জাগাও!পিয়াও মোরে সে-ই নীল-হলাহল-পানি!
তাথিয়া-তাথিয়া নেচে উঠি আবার সে-ই ভৈরবী নাচ,
প্রলয়-ঝংকার বেজে উঠুক
তন্দ্রাচ্ছন্ন এই বাতাসে!
রুষে উঠুক ঘুম-যাওয়া অগ্নিগিরির অশান্ত রক্ত-নার!
গগন বিদারি উঠুক চির-ভৈরব-কোলাহলঃ
তিমির রাত্রি বিদারণ,
জাগে যাত্রী সংশয়-সংহার!
শংকর_শংকর!
ভীম-রুদ্র-ভয়ংকর!!
আল্লা--হু--আকবার!!!
কবিতা
রাহুল রাজ
মুর্শিদাবাদ, প: বঙ্গ
যেদিন তুমি চলে গেলে
যেদিন তুমি চলে গেলে-
সেদিন-
আকাশ ভরা বৃষ্টি ছিল,
বৃষ্টি ছিল দৃষ্টিতে।
বুকের ভিতর কষ্ট ছিল,
হাহাকারের সৃষ্টিতে।
চোখের ভিতর স্বপ্ন ছিল
মনে ভিতর কষ্ট।
সেদিন থেকে এই আমি
আমার থেকে নষ্ট।
কবিত্ব
চাঁদের গায়ে জোৎসনা ছিলো-
জোৎসনা ছিল তার রূপে,
কবির আজ বাঁধ ভেঙেছে
আগুন জ্বলে চুপে চুপে।
কবির মনে প্রেম জেগেছে-
প্রেম জেগেছে কবিতায়।
কবির আজ সাধ জেগেছে
ফুলের ভ্রমর হতে চায়
মেয়েটি ইদানিং বড় হয়েছে-
সে সম্প্রতি আবিষ্কার করেছে
কেন তার সাথে শুধু তাদেরই দেখা হয়?
লাল গোলাপের সাথে নীল চিঠি কেন আসে।
জানতে পেরেছে,
দুজনার দুজনে
এত কি আকর্ষণ!
মেয়েটি ইদানিং বড় হয়েছে
সে এখন বুঝতে শিখেছে লোকে খারাপ কাকে বলে।
পেটের গভীরে কালো শিশু জন্মানোর
জটিল রহস্য।
মেয়েটি ইদানিং বড় হয়েছে সে এখন
তুমি থেকে আপনি হয়
আবার আপনি থেকে তুমি
দেরিতে বাড়িতে এলে সাজিয়ে গুছিয়ে মিথ্যে বলে।
অনেক কবির কবিতায় জোগায় আলপনা।
মেয়েটি ইদানিং বড় হয়েছে-
খুঁজতে শিখেছে নিজের জগতে কোথায় সে।
আয়নাতে কখন তাকে বেশি সুন্দর লাগে।
পুরুষের দৃষ্টি কেন স্থির নয়।
কিছুই হবে না পৃথিবীর
তোমার আমার মিলন না হলে কিছুই হবে না পৃথিবীর
দুঃখগুলো পুশে রেখে বুকে, দোষ দেব সব নিয়তির।
বুকের ভেতর স্মৃতিগুলো সব যত্নে রাখবো জমা
কিছুই হবে না এই সমাজের, যদি না করি ক্ষমা।
হাজার প্রেম রোজ ভেঙে, চাপা পড়ে ইতিহাসে
কত যুগলের মন ভারি হয় হতাশার নিঃশ্বাসে।
তোমার আমার মায়ার টান আবেগের সুতোয় বাঁধা
আমাদের প্রেম আমরা বুঝি, পৃথিবীর কাছে ধাঁধা।
প্রেম নদীর উল্টো স্রোতে দু’জনের দুই তীর-
তোমার আমার মিলন না হলে কিছুই হবে না পৃথিবীর।
মেয়েটি
মেয়েটি ইদানিং বড় হয়েছে
সে এখন চুপিচুপি কাউকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে
রাজ জেগে অন্তর্জালে স্বপ্ন আঁকে।
সে এখন বুঝতে শিখেছে ভালবাসার মানে।
জানতে পেরেছে ভালবাসার গোপন রহস্য!
মেয়েটি ইদানিং বড় হয়েছে-
সে এখন কায়দা করে সাজসজ্জা করে।
চলার পথে বাঁকা চোখে উৎসুখ চোখগুলো দেখে-
সে ইদানিং বুঝতে শিখেছে কারো জন্য
মায়া লাগার কারণ।
হরষিত চিত মনের সঙ্গোপনে
বাঁধে সবে যেন নিবিড় ঐকতানে
হৃদয়ের আজ সকল দুয়ার খোলা।
ক্ষণ এল ঐ ভক্তেরা মন্ডপে
ফুল বেলপাতা হাতে হাতে হয় বিলি,
দীপের আলোকে, ধূপের সুবাসে
ঘন চারিধার - যেন ঘোর লাগে;
দাঁড়াইনু নিয়ে করপুটে অঞ্জলি।
ভক্ত কণ্ঠে মন্ত্র ধ্বনিতে মুখরিত মণ্ডপ
পুলকিত চিতে কেন ঘোর লাগে শুনি কোন মহারব?
পদপুষ্পিত মাল্যভূষিত সম্মুখে মৃন্ময়
তথাপি মনের গহনেতে পূজা পায় নিজ চিন্ময়।
কবিতা
সোমদেব পাকড়াশী
পূজা
কাঠামোর খড়ে মাটির প্রলেপ পড়ে, সযতনে গড়ে অবয়ব এক তাঁর সজ্জা সাজের বাহারে অলংকারে
নিপুণ কুশলী শিল্পীর রেখাটানে
দেয় রূপ রং অনন্য এ প্রতিমার
সমবেত সবে অধীর ত্বরায়
আসিতেছে কত পূজা উপাচার;
আছে বাকি শুভ ক্ষণের বিচার
জানা না জানা কত লোকাচার শুভদিন ঐ সমাগত প্রায়।
মঙ্গলদিন ঊষার পরশে আসে
খুশীর উচ্ছ্বাস প্রাণমনে দেয় দোলা,
করা যেতেই পারে সংরক্ষণ মমির
করা যেতেই পারে সংরক্ষণ
মমির
অস্পষ্ট আলমগীরের
আলমারির চাবির
প্রক্রিয়া তিলধারণের
নাকছাবি সন্ধ্যার
উড়িয়ে দাও ক্রোধ
সুতোর সমস্ত দুর্গন্ধ
জ্বলেই চলেছে
দাউদাউ ধুলো
একাদিক্রমে
একাকী রজঃস্বলা।
কবিতা
পার্থ সরকার
তেইশ সালটা হাড়বজ্জাত
আগা গোড়াই ফাঁকি
বারোটা মাস চলেই গেল
সব টার্গেট বাকি!
ডিএ-এর খবর মামলা হয়ে
ঝুলছে এখন কোর্টে।
গভর্নমেন্টের মস্ত সাফাই
"মাইনেটা তো জোটে"।
প্রশ্ন করা, খাতা দেখা
মিড ডে মিলের তেল নুন-
মাস্টারি আজ মাল্টি ম্যাটার
সব্যসাচীর তিন গুন।
এরই মধ্যে টিউশনিটা
টুরের খরচ সামলায়।
কবিতা
সনোজ চক্রবর্তী
পূর্ব মেদিনীপুর, পঃ বঙ্গ
তেইশ সালের 'কু-নজরে'
'সে- উপরি' মামলায়।
ঐ-একটিই সহজ কাজ
রিটার্ন তবু জব্বর-
পুরানো-নোট্স্ জেরক্স গুনে
ঝকঝকে আর ভদ্দর।
নতুন বছর আর টিউশন
নিক্তির দুই পাল্লা-
ব্যাকডেট আর মান্ধাতাদের
ঢাকল আলখাল্লা।
নতুন বছর বলল হেসে
ঠিক বুঝেছ সোনা।
তেইশ সালের জেরক্স নিয়েই
চব্বিশ কল্পনা।
তুলনা নাই
এখন পাতাঝরার মরশুম -
শীতার্ত বাতাস বয় হাড় হিম করে,
যে পথে হাঁটা শুরু হয়েছিল অনেক কাল আগে -
তিনের দুই পেরিয়ে গেছি তার
আরো কিছু পথ চলা হয়তো বাকী এখন ও
ফুল শুকিয়ে গেলে মূল্য থাকে নাকি কখনও?
শুনি কারা যেন বলে সময় নেই
পাততাড়ি গুটোও
এবারকার মতো "বন্দরের কাল হলো শেষ" -
মন কিন্তু দেয় না সায় বলে না তো বেশ বেশ।
একটা কম বয়েসী মন উঁকি মারে
এই বলি রেখাঙ্কিত শরীরের ভেতর -
সে দেখে না পাঙ্গাস বরণ কিছু
সে দেখে রক্তলাল কৃষ্ণচূড়ার হাসি,
সে হয় মাতাল মহুয়া ফুলের গন্ধে
মাঝে মাঝে তাই সে পড়ে বড্ড বেশী ধন্ধে।
বার্দ্ধক্যের খোলসে এখনও কেন
একটা সতেজ মন?
কবিতা
বনদেবী রায়
কলকাতা
সেই মন দৌড়ায়, পঞ্চকোট পাহাড়ের কোলে -
ঘুড়ে বেড়ায় দামোদরের চিক্চিকে বালির ওপর
সে কল্পনায় দেখতে পায়, সন্ধ্যেবেলায়
ছোটবেলার সুখী গৃহকোন
শোভে গ্রামোফোন
সে দেখতে পায় থোকায় জোনাক জ্বলে
মফঃস্বলী নিকষ কালো রাত
আর পাহাড়ের ওপরের দাবানল -
পলাশ গাছে ভরা "ভাদুরাণীর" দেশ,
তার সামনে পরীরা খেলা করে
দামোদরের সাদা বালুচরে।
তাদের মুকুটের হীরে করে ঝিক্ মিক্
আনন্দের হাসি তার মুখে করে চিক্ চিক্।
কিছু যায় আসে না বয়স আর বার্দ্ধক্যে ভরা দিন -
কল্পনার আলপনায় মন যদি থাকে রঙিন -
যাবার সময় যাবো নির্বিবাদে
মানবো না পাতা ঝরা মরশুমের
শীর্ণতা রিক্ততার গতি অবাধকে।
যাবার বেলা এই কথাটি বলবো বারবার
যা দেখেছি যা পেয়েছি তুলনা নেই তার।
অনুবাদ
বিশ বছর পর
নুপূর রায়চৌধুরী
ও হেনরীর 'আফটার টুয়েন্টি ইয়ার্স' গল্পের বাংলা অনুবাদ
পুলিশটা রাস্তার পাশে সরে গেল, ওকে দেখাচ্ছে শক্তিশালী এবং হোমরা-চোমরা। এইভাবেই সে সবসময় চলাফেরা করে। তাকে দেখতে কেমন লাগছে, তা নিয়ে সে মাথা ঘামাচ্ছে না। তাকে দেখার লোকও রাস্তায় কম। রাত সবে দশটার কাছাকাছি, কিন্তু ঠান্ডা পড়েছে। এবং তার মধ্যে সামান্য বৃষ্টি সঙ্গে একটি বাতাস বইছিল। সে পথ চলতে চলতে দরজার সামনে থামছিল, নিশ্চিত করার চেষ্টা করছিল যে, প্রতিটি দরজা রাতের মতো বন্ধ করা হয়েছে। বার বার সে ঘুরে ঘুরে রাস্তার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে লক্ষ রাখছিল। সে একজন সুদর্শন পুলিশ, সতর্ক, শান্তিরক্ষাকারী। শহরের এই অংশের মানুষজন তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে যায়। আপনি মাঝে মাঝে কোনো একটা দোকান বা একটা ছোট রেস্টুরেন্টের আলো দেখতে পারেন। তবে বেশিরভাগ দোকানপাটের দরজাই কয়েক ঘণ্টা আগে বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
পুলিশটা হঠাৎই তার হাঁটার গতি কমিয়ে দিল। একটা অন্ধকার দোকানের দরজার কাছে একটা লোক দাঁড়িয়ে ছিল। পুলিশটা তার দিকে এগিয়ে যেতেই লোকটা দ্রুত কথা বলে উঠল।
"সব ঠিক আছে, অফিসার," লোকটা বলল।
"আমি একজন বন্ধুর জন্য অপেক্ষা করছি। বিশ বছর আগে আমরা আজ রাতে এখানে দেখা করতে রাজি হয়েছিলাম। এটা আপনার কাছে খুব অদ্ভুত শোনাচ্ছে, তাই না? আমি আপনাকে বুঝিয়ে বলতে পারি, যদি আপনি নিশ্চিত হতে চান যে সবকিছু ঠিক আছে। প্রায় বিশ বছর আগে এই দোকানে একটা রেস্তোরাঁ ছিল। 'বিগ জো' ব্র্যাডির রেস্তোরাঁ।"
"হ্যাঁ, পাঁচ বছর আগে পর্যন্ত ওটা এখানে ছিল," পুলিশটা বলল।
দরজার কাছে দাঁড়ানো লোকটার মুখ বর্ণহীন, বর্গাকার, চোখদুটো জ্বলজ্বলে, আর তার ডান চোখের কাছে একটা সামান্য সাদা দাগ। তার গলার টাইটাতে একটা বড় রত্ন লাগানো রয়েছে।
"বিশ বছর আগের এক রাতে," লোকটা বলে চলল, "আমি এখানে জিমি ওয়েলসের সাথে ডিনার করেছি। সে আমার সেরা বন্ধু এবং সারা পৃথিবীর মধ্যে সবথেকে ভাল মানুষ। সে এবং আমি এখানে, নিউইয়র্কে দুই ভাইয়ের মতো একসাথে বড়ো হয়েছি। আমার বয়স তখন আঠারো আর জিমির বিশ। পরেরদিন সকাল। পশ্চিমের উদ্দেশ্যে আমার যাত্রা শুরু হওয়ার কথা। আমি একটি কাজ খুঁজতে চলেছিলাম এবং তাতে দারুণ সফল হতে যাচ্ছিলাম। জিমিকে নিউইয়র্ক থেকে বের করে আনার সাধ্য কারুর ছিল না। সে মনে করত পৃথিবীতে এই একটামাত্র জায়গায়ই রয়েছে"।
“সেই রাতে আমরা একমত হয়েছিলাম যে বিশ বছর পর আমরা এখানে আবার দেখা করব। আমরা ভেবেছিলাম যে বিশ বছরের মধ্যে আমরা জানতে পারব কে কেমন ধরণের মানুষ হয়েছি এবং আমাদের জন্য কেমনতরো ভবিষ্যত অপেক্ষা করছে।”
"এটা আকর্ষণীয় শোনাচ্ছে," পুলিশটা বলল।
“সাক্ষাতের জন্য এটা এক দীর্ঘ সময়, আমার মনে হয়। আপনি পশ্চিমে যাওয়ার পর থেকে আপনার বন্ধুর কাছ থেকে কিছু শুনেছেন?”
"হ্যাঁ, কিছু সময়ের জন্য আমরা একে অপরকে লিখেছিলাম", লোকটা বলল। “কিন্তু এক বা দুই বছর পরে, আমরা ক্ষান্তি দিয়েছিলাম। পশ্চিম একটা বড় জায়গা। আমি সর্বত্র ঘুরে বেড়িয়েছি, এবং দ্রুত স্থান পরিবর্তন করেছি। তবে আমি জানি যে, যদি সম্ভব হয় তবে জিমি আমার সাথে এখানে দেখা করবেই। সে পৃথিবীর সত্যবাদী মানুষদের একজন। সে কখনো ভুলে যাবে না। আমি হাজার মাইল পার করে আজ রাতে এখানে অপেক্ষা করতে এসেছি। তবে আমি এতে খুশি হব, যদি আমার পুরনো বন্ধুও আসে।”
অপেক্ষমান লোকটা একটি সুদৃশ্য ঘড়ি বের করল, ছোট ছোট মণি দিয়ে সেটা আবৃত। "দশটা বাজতে তিন মিনিট বাকি আছে," সে বলল।
“সেই রাতে আমরা এখানে রেস্টুরেন্টের দরজায় যখন একে অপরকে বিদায় জানাই তখন ছিল দশটা।"
"আপনি পশ্চিমে বেশ সফল হয়েছিলেন, তাই না?" পুলিশটা জিজ্ঞাসা করল।
"হ্যাঁ, অবশ্যই! আমি আশা করি জিমি অন্তত তার অর্ধেক হাসিল করেছে। ও একটু ধীর গতির ছিল। আমার সাফল্যের জন্য আমাকে লড়াই করতে হয়েছে। নিউইয়র্কে একজন মানুষ খুব একটা বদলায় না। পশ্চিমে আপনি যা পান, তা আদায়ের জন্য আপনি লড়াই করতে শিখে যান।" পুলিশটা দু-এক কদম বাড়াল।
"আমাকে এবার যেতে হবে," সে বলল।
"আমি আশা করি আপনার বন্ধু ঠিকঠাক আছে, যদি সে এখানে দশটায় না আসে, আপনি কি তাহলে চলে যাবেন?"
"আমি যাচ্ছি না!" অন্যজন বলল।
"আমি অন্তত আধ ঘন্টা অপেক্ষা করব। জিমি যদি এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকে, সে ততক্ষণে এখানে আসবেই। শুভ রাত্রি, অফিসার।"
"শুভ রাত্রি," পুলিশটা বলল, এবং সে চলে যেতে যেতে দরজাগুলো পরীক্ষা করতে থাকল ।
এখন ঠান্ডা বৃষ্টি পড়ছে আর বাতাস আরও জোরদার হয়ে উঠেছে। যে অল্প কয়জন মানুষ সেই রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল, তারা তাড়াহুড়ো করছিল, নিজেদের গরম রাখার চেষ্টা করছিল। আর দোকানের দরজায় দাঁড়িয়ে রয়েছিল সেই লোকটা, যে হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে, বন্ধুর সাথে দেখা করতে এসেছে। এরকম একটা বৈঠক নিশ্চিত হতে পারে না। কিন্তু সে তবু অপেক্ষা করছিল। প্রায় মিনিট কুড়ি অপেক্ষা করেছে সে, তখন লম্বা কোট পরা একজন দীর্ঘদেহী লোক রাস্তা পার হয়ে দ্রুত চলে এল। লোকটা সরাসরি অপেক্ষমান ব্যক্তির কাছে আসল।
"তুমি, কি বব?" সে সন্দেহজনকভাবে জিজ্ঞাসা করল।
"তুমি, কি জিমি ওয়েলস?" দরজার কাছে থাকা লোকটা কেঁদে উঠল।
নতুন লোকটা অন্য লোকটার হাত নিজের হাতে নিল।
"তুমি বব! নিঃসন্দেহে তাই। আমি নিশ্চিত ছিলাম যে, তুমি বেঁচে থাকলে আমি তোমাকে এখানে খুঁজে পাবই। বিশ বছর অনেক লম্বা সময়। পুরানো রেস্টুরেন্টটা উঠে গেছে, বব, ইস, যদি ওটা এখানে থাকত, তাহলে আরও একবার আমরা এখানে ডিনার করতে পারতাম। পশ্চিম কি তোমার জন্য ভালো হয়েছে?"
"আমি যা চেয়েছিলাম, তার সবটাই ওই জায়গা আমাকে দিয়েছে। তুমি বদলে গেছো, জিমি। আমি কখনো ভাবিনি তুমি এতটা লম্বা।"
"ওহ, বিশ বছর বয়সের পরে আমি আর একটু লম্বা হয়েছি।"
"তুমি কি নিউইয়র্কে ভালো আছো, জিমি?"
“হ্যাঁ যথেষ্টই। আমি শহরের জন্য কাজ করি। এসো, বব, আমরা আমার পরিচিত একটি জায়গায় যাব, এবং পুরোনো দিন সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনা করব।" হাতে হাত রেখে রাস্তা ধরে চলা শুরু করল দুজন। পশ্চিমের লোকটা তার জীবনের গল্প বলতে শুরু করল।
অন্যজন, তার কোটটা কান পর্যন্ত টেনে এনে, আগ্রহের সাথে শুনতে থাকল।
কোণের দিকে বৈদ্যুতিক আলোয় আলোকিত একটি দোকান দাঁড়িয়ে আছে। সেটার কাছে এসেই ওরা একে অপরের মুখের দিকে তাকাল। পশ্চিমের লোকটা হঠাৎ থেমে গেল এবং তার হাত সরিয়ে নিল।
"তুমি জিমি ওয়েলস নও," সে বলল।
"বিশ বছর অনেক দীর্ঘ সময়, কিন্তু একটা মানুষের নাকের আকৃতি পাল্টে যাবার জন্য যথেষ্ট দীর্ঘ নয়।"
"তবে, এটা কখনও কখনও একজন ভাল মানুষকে খারাপ বানিয়ে দিতে পারে," দীর্ঘদেহী লোকটা বলল।
"আপনি দশ মিনিট যাবৎ ধরা পড়েছেন, বব। শিকাগো পুলিশ ভেবেছিল আপনি হয়তো নিউইয়র্কে আসছেন। তারা আমাদেরকে আপনার উপর নজর রাখতে বলে। আপনি কি চুপচাপ আমার সাথে আসবেন? সেটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। কিন্তু প্রথমে এখানে কিছু একটা আছে, যা আপনাকে দিতে বলা হয়েছে আমায়। আপনি এখানে জানালার কাছে এসে এটা পড়তে পারেন, ওয়েলস নামের একজন পুলিশ এটা দিয়েছে।"
পশ্চিমের লোকটা কাগজের ছোট্ট টুকরোটা খুলল। পড়তে পড়তে তার হাতটা একটু একটু কাঁপতে লাগল।
"বব: আমি সময়মতই সেই জায়গায় ছিলাম। আমি লোকটার মুখ দেখেছি, যাকে শিকাগো পুলিশ খুঁজছিল। আমি নিজের হাতে তোমাকে গ্রেফতার করতে চাইনি। তাই আমি ফেরত গিয়ে, আরেকজন পুলিশকে পাঠালাম কাজটা করার জন্য।
জিমি।"
বীথি পিসির
বাড়ি
সায়ন রায়
গল্প
হারু, পুরো নাম হরেন্দ্র পাল নিজের এক পিসির বাড়ি বেড়াতে যাবে ঠিক করে। দূর এক প্রত্যন্ত গ্রামে তার পিসির বাড়ি, গ্রামের নাম ডালিপুতি। মায়ের মৃত্যুর পর এই সে প্রথম কোথাও বেড়াতে যাচ্ছে, মন খুব দূরে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে! ভালোবাসার দুর্লভ তালিকায় মায়ের পরেই যে বীথি পিসির নাম আসে, তা সে সবসময়ই মেনে এসেছে, অতএব মা চলে যাওয়ার পর সে এই মনের টান যে আরো প্রবলভাবে অনুভব করছে, সেটা খুবই যুক্তিসঙ্গত ও মানবিক ব্যাপার! নির্ধারিত দিনে হরেন্দ্র দুপুরের ট্রেনে উঠে পড়লো, সঙ্গে নিলো দুটো গল্পের বই আর কয়েকটা আরামদায়ক সুতির জামা - গ্রামের খট-খটে রৌদ্র দুপুরে কাজে আসবে বলে।
বিকেল ছটায় হারু যখন ট্রেন থেকে নেমে ডালিপুতি গ্রামে প্রবেশ করলো, তখন প্রায় সন্ধ্যা। সূর্যের শেষ লাল রশ্মিতে জঙ্গল, ক্ষেত, তৃণ-লতা ধিকি ধিকি করে জ্বলছে - দূরের কুঁড়েঘরগুলি সন্ধ্যা-রাতের সন্ধিক্ষণে হারালো প্রায়! ধানক্ষেতের মধ্যে চলে যাওয়া সরু আল-পথটি ধরে হারু এগিয়ে চললো - দুপাশে গাঢ় অন্ধকার অনন্ত কেশের ন্যায় মৃত্তিকা ব্রততির উপর প্লাবিত হচ্ছে, দুচোখ আঁধারে হারিয়ে হারিয়ে আবার নিজের সম্বিৎ ফিরে পায়! আরো কুড়ি মিনিট এভাবে চলার পর হারু একটু থামলো, তারপর সতেরো বছর আগের ছেঁড়া-ছেঁড়া স্মৃতির উপর ভর করে সে ডান দিকে বেঁকে পুকুর-পাড়ের নির্জন রাস্তাটি ধরলো।
রাস্তার পাশে সারি-সারি বটগাছগুলো সেই একই ভাবে দাঁড়িয়ে, জনমানবহীন কাঁচা-মাটির রাস্তা চাঁদের আলোয় স্বপ্নপুরীর খোয়া-গলির মতো দেখায় - স্মৃতি ও বর্তমান এক সাথে হাত ধরে পথ চলতে লাগে! কিছুটা যাওয়ার পর দুটো-একটা মাটির ঘর পাওয়া গেলো, কোনোটায় সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বলছে, কোনোটা পুরোপুরি অন্ধকার। হারু কুটিরগুলোকে পাস কাটিয়ে রাস্তার একেবারে শেষে অবস্থিত বাড়িটার দিকে দ্রুত পায়ে এগিয়ে যেতে লাগলো। পথের এক কোণে পরে থাকা সেই কাঁচা-মাটির বাড়িটা আজও সেই একই ভাবে পথের শেষে পরে আছে- দেওয়ালের লাল হলুদের চিত্রকলা বোঝা যায় না আর! দরজা দিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করতেই হারানো শৈশবের প্রখর স্মৃতিবেদনা দমকা-হাওয়ার মতো হারুকে জাপ্টে ধরলো, মাঝ-উঠোনের সেই তুলসীতলা আজও কত নিখোঁজ স্মৃতির মরীচিকা আঁকড়ে বসে আছে!
কত যুগ, কত সময় কেটে গেছে কিন্তু সময় যেমনি প্রাণের অনুরাগে বন্দিত প্রানগুলিকে একই স্নেহ-বন্ধনে বাঁচিয়ে রাখার প্রচেষ্টায় বাহিত হয়, সেই একই স্নেহ-আবেগের বশে পড়ে হারু বীথি পিসির নাম জোরে ডেকে ফেললো!
আঁধার আবৃত ঠাকুর দালান থেকে এক বৃদ্ধা বেরিয়ে এলেন। ঘোলা চোখের গভীর দৃষ্টি দিয়ে প্রাপ্তবয়স্ক যুবকটিকে অদ্দ-পান্তো অবেক্ষণ করলেন, তারপর আতশ কাঁচের চশমাটি পরে নিয়ে বৃদ্ধা জিজ্ঞেস করলো, ''কে রে হরেন্দ্র নাকি?''
"হা পিসি '' বলে বীথি পিসিকে নমস্কার করতেই বৃদ্ধাও তাকে স্নেহ ভরা হাতে জড়িয়ে ধরলেন। হারু বুঝতে পারলো চিঠিতে মা যে তার বর্ণনা পিসিকে দিয়ে থাকতো, সেটা পিসি ঠিক মনে রেখেছে। আর তা ছাড়া চোখের দৃষ্টি অস্পষ্ট হয়ে গেলেও মনের চোখ তো যার ঝাপসা হয়ে যায় না, সেটা ঠিকই মনের মানুষের চিনে ফেলে -সেটা দিয়েই হয়তো বীথি পিসি তাকে চিনে ফেলেছে।
"এতো দিন পর তুই তাহলে এলি হারু?" কম্পিত কণ্ঠস্বরে বৃদ্ধা বলে উঠলো। "ভেবেছিলাম তুই হয়তো তোর বীথি পিসিকে একবারে ভুলে গেছিস, এই জন্মে আর হয়তো দেখা হলো না!"
সেই যে নয় বছর আগে হরেন্দ্রদের বাড়ির কালিপূজার সময় দেখা হয়েছিল, তারপর আবার আজ তাদের দেখা হলো, হারুর মন খুশিতে ভোরে গেলো।
"না না পিসি, তা কি কখনো হয়? মা আর ছেলের সম্পর্কতো জন্ম জন্মান্তরের, সে কি তাকে ভুলতে পারে কখনো! আমি তো তোমার ছেলের মতোই বলো?" হারু এই কথা বলতেই বীথি পিসির চোখ অশ্রুতে ভিজে গেল।
"ওরে হারু, তুই তো আমার ছেলেই হলি, কতদিন পর আজ আবার দেখতে পেলাম তোকে,"
হারু দেখলো খুড়ী পিসির বলি-ভরা মুখটায় আজও সেই মাতৃসুলভ হাসিটা বিদ্যমান, তুলসীতলার হলুদ প্রদীপের আলোয় তার সৌন্দর্য ও মাতৃত্ব আজও অখণ্ড।
'এখানে কিছু দিন থেকে যাবি কিন্তু হারু! আমি তোর কোনো অজুহাত শুনবো না, বলে দিচ্ছি!' পিসি আদর ভরা শাসনের সুরে পরিষ্কার জানিয়ে দিলো।
'হা বীথি পিসি' উত্তর পেতে বৃদ্ধা ভারী খুশি হয়ে হারুর ললাটে একটা চুম্বন খেলো।
‘কতটা পথ হেঁটে এসেছিস, খিদে পেয়েছে নিশ্চই! যা গিয়ে পরিষ্কার হয়ে না, আমি যাই তোর জন্য বরং কিছু নিয়ে আসি’ বলে বৃদ্ধা চলে গেলো।
হারু লণ্ঠনটা হাতে তুলে নিলো, তারপর কলতলায় গিয়ে শীতল-স্বচ্ছ জলে ভালো করে হাত-পা ধুয়ে নিলো, মনে একটা ভাষণ প্রশান্তির অনুভূতি ‘তাহলে এতো বছর পর পিসির সাথে আবার দেখা হলো তার!’ কলতলা থেকে ফিরে আসতে সে দেখলো বীথি পিসি সন্ধ্যার খাবারের সরঞ্জাম নিয়ে বসে আছে। হারু পিসির পাশে গিয়ে বসলো, তারপর মুড়ি-বাতাসা খেতে খেতে মহানন্দে ফেলে আশা দিনের গল্পে করতে লাগল। হারু পিসির কাছে জানতে পারে আজ প্রায় পাঁচ বছর হলো তার পিসিমশাই গিরিশচন্দ্র দাস পরলোক-গমন করেছেন, বীথি পিসির এক মাত্র পুত্র অতয়েব তার শীর্ষেন্দু দাদা বিবাহ করে অন্য গ্রামে চলে গেছে, তারপর সে আর কোনোদিন তার মায়ের কাছে আসেনি, একবার দুবার চিঠি লিখেছে মাত্র। কিন্তু নিয়তির লিখনকে মর্যাদা দিয়ে তার বুড়ো বিধবা পিসি এই ভিটেতে একাই রয়ে গেছে।
প্রাণভরা গল্প-গুজবে কখন যে সময়ে কেটে রাত দশটা বেজে গেলো, হারু বুঝতেই পারলো না। বীথি পিসি নড়বড় পায়ে রান্নাঘরে চলে যেতে হারু উঠোনে পরে থাকা উজ্জ্বল নীলাভ চন্দ্রিমার দিকে তাকিয়ে বসে থাকলো। ঘন কালো আঁধার ভরা রাত্রি, গ্রামের কৃষ্ণবর্ণ গভীর-অন্ধকার তুঁতে আঠার মতো দুচোখের পাতা জুড়ে দেয়। রান্না শেষ হলে পরে পিসি তাকে ডাকতে আসে, তারপর পিসির মাতৃ ছায়ায় বশে হারু তার পছন্দের তরকারি দিয়ে ভাত খায়।
খাওয়া-দাওয়া শেষ করে সে বীথি পিসির পাশের ঘরটিতে শুতে যায়। ঘরে ঢুকতেই হারু বিছানায় উঠে জানালাটাকে হাট করে খুলে দেয় - গ্রীষ্মের রাতে খোলা হওয়ার প্রয়োজন যে কতটা! সেটা আর বলে দিতে হয় না! জানালা খুলতেই দিগ্-দিগন্তের অন্ধকারে অবগাঢ শস্যক্ষেত্রগুলিকে চাঁদের হালকা রোশনাইতে ভারী চমৎকার দেখালো, মৃদুমন্দ বাতাসের তালে-তালে মকাই শ্রেণীগুলো কখনো কখনো দুলে দুলে উঠছে! স্বপ্নস্মৃতির জালে টাঁকা এই দৈবদৃশ্য দেখতে দেখতে কখন হারু নিদ্রালোকে বিলীন হয়ে গেলো, বোঝা গেলো না।
রাত প্রায় আড়াইটে মতো বাজে, একটা খচ-খচ শব্দে হারুর ঘুম ভেঙে গেলো। 'খচ-খচ করে কি একটা কাটার শব্ধ যেন?" হারু চটপট বিছানায় উঠে বসে আওয়াজটির দিক ও উৎস নির্ণয় করতে লাগলো। কিছুক্ষন কান পেতে সোনার পর সে বুঝলো আওয়াজটা আসছে বাড়ির বাইরে থেকে। হারু জানালার দিকে এগিয়ে গিয়ে একবার বাইরে চাইলো, জঙ্গল ও ক্ষেত নিশাচর রাতের নিগূঢ় আঁধারে পুরোপুরি ডুবন্ত, খচ-খচ আওয়াজটা প্রতিধ্বনিত হচ্ছে পুকুর-পার থেকে!
হারু ঘুম-মাখা চোখে চাঁদের ভাষা-ভাষা আলোয় দেখলো কোনো এক বউ পানা-পুকুরের পাড়ে উপুড় হয়ে বসে কিছু সব কাটছে! মাথার উপর তার ঘোমটা টানা, ঝোপ-ঝাড়, কাঁটাগাছে ভরা পুকুর-পারে বসে সেই নারী অবিচলিত ভাবে কি সব পাতা কেটেই চলেছে! আরো দশ মিনিট ধরে জংলী লতা-পাতার গুচ্ছ কাটার পর সে বৌটি নড়া-চড়া বন্ধ করে একেবারে স্থির হয়ে গেলো। নির্জন পুকুর-পারে সেই ঘোমটা পড়া অবয়বকে একভাবে উপুড় হয়ে পড়ে থাকতে দেখে হারুর এবার একটু ভয় হলো! সে আস্তে করে জানালাটা বন্ধ করে দিতে গেলো কিন্তু পড়লো না! সেই বৌটিকে দেখতে দেখতে কি এক উটকো সম্মোহনের বশে পরে গেলো সে - তার দাঁত-মাড়ি, হাত-আঙ্গুল একসাথে জোড়া লেগে গেল, ভয়-ছায়ার কালো জগতে হারিয়ে কান-মাথা ঝিঁঝিঁ করতে লাগলো তার! সঙ্গে সঙ্গে এক বিবর্ণ স্মৃতির সাথে তার সংযোগ বাঁধতে শুরু হলো, যেন কেউ তাকে এক অতি পুরানো কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে? কে বেশ ছিল এখানে? প্রায় আধঘন্টা এক নিশ্চল অচল যন্ত্রণার মধ্যে কাটলো, হারু মনে করেও মনে করতে পারলো না । তারপর হঠাৎ বৌটি উঠে কোথায় চলে গেলো আর তার সাথে সাথেই হারুর ক্লেশপূর্ণ সংযোগটা বিচ্ছন্ন হয়ে গেলো - কষ্টকর শ্বাস প্রশ্বাস ও শক্ত হয়ে ওঠা শরীর আবার স্বাভাবিক স্থিতিতে ফিরে এলো!
হারুর সারা শরীর ও মাথাটা এবার ঝিম-ঝিম করতে শুরু লাগলো, সে কি কোনো স্বপ্ন দেখছিলো? পুকুর-পাড়টা আবার ভালো করে দেখে নিলো সে, না কেউ তো নেই ওখানে! সে তাড়াতাড়ি জানালা বন্ধ করে দিলো। দুঃস্বপ্নের ভয়গ্রস্ত অবস্থায় কি বেশ একটা কথা মনে পড়ছিলো তার? অনেক চেষ্টা করেও হারু মনে করতে পারলো না। অনেক চেষ্টাতেও কোনো কথা মনে না পড়লে, এক বিচিত্র রকমের কষ্টের সৃষ্টি হয়, চিন্তা পীড়ায় দগ্ধ হরেন্দ্র সেই রাতে ঘুমিয়ে পড়লো - মনে তার কিছুই পড়লো না!
পরদিন সকালে হারু আবার পিসির সাথে নানা-প্রকের গল্পে রত হলো কিন্তু শেষ রাতের নিদারুন অভিজ্ঞতার কথা কিছুই জানালো না, পাছে পিসি তাকে এখনো ছেলেমানুষ ভেবে মজা করে!
ঠাকুরের চরণে ফুল দিতে দিতে বীথি পিসি তাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘কিরে হারু কাল রাতে কেমন ঘুম হলো,’
হারু বললো, ‘খুব ভালো পিসি, কোনো অসুবিধা হয়নি’
‘কোনো অসুবিধা হলে আমায় ডাকবি হারু, আমার রাতে আর সেই আগের মতো ঘুম হয় না, আমি জেগেই থাকি’
‘নিশ্চই পিসি’
ছেলেবেলায় যে কতবার ভূতের স্বপ্ন দেখে সে পিসিকে মাঝরাতে জাগিয়ে দিয়েছে, সেটা হারুর ভালোই মনে আছে, ‘পিসি তাকে এখনো সেই ছেলেমানুষ ভাবে’ ভেবে হারু দিয়ালে মাথা ঠেকালো।
দুপুর হতে খাওয়া তাড়াতাড়ি সেড়ে ফেলে হরেন্দ্র বাড়ির বাইরেটা একটু ঘুরতে বেড়োলো।
বাড়ির পিছনের বাগানে হরেক রকমের পেয়ারা, ফুল, লঙ্কা গজিয়ে আছে, বেড়ার পাশে বড় একটা আম গাছ। দুপুরের খট-খটে রোদ্দুরে ক্ষেত, জমি-জমা খাঁ-খাঁ করছে, দূরে দূরে কোনো বট, অশ্বথ্বের ছায়া কালো পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে আছে! মাঠ-ঘাস, প্রকৃতি, সূর্যের আলো তাকে যেন তাকে মায়ের কথা মনে করিয়ে দিলো, সে যেন আছে - তারই সঙ্গে!
এবার তার চোখ সেই পুকুর-পাড়টার দিকে পড়লো, আগের রাতের কথা মনে পড়লো আবার। হারু একটা ঢোক গিলে এক পা এক পা করে সেদিকে এগিয়ে চললো। সেখানে পৌঁছে দেখলো অনেক বেগুনি ও সাদা ফুল ফুটে রয়েছে, আসে পাশে কাঁটা গাছ, ব্রততী ভোরে থাকলেও কি এক অজাগতিক শান্তির অস্তিত্ব বর্তমান সেখানে - ভারী মনোরম লাগলো জায়গাটা হারুর! ‘কাকে না কাকে দেখেছিলো সে, কোনো চোর টোর হবে, বা কোনো গ্রামের বৌ হয়তো ফুল নিতে এসেছিলো, সেটা দেখে নাকি সে ভয় পেয়ে গেছিলো, আবার হয়তো সে স্বপ্ন দেখছিলো তাও তো হতে পারে।’ হারুর এসব ভেবে হাসি পেলো, মনটা একটু হালকা হলো. একটা ফাঁকা জায়গায় দেখে সে বসে পড়লো সে, তারপর পুকুরের সবুজ কচুরিপানা, তার মাঝে ফুটে থাকা সাদা গোলাপি পদ্ম ফুলের সমারোহ দেখতে দেখতে গ্রামের নিশ্চুপ একলা দুপুরে হারিয়ে গেলো।
হয়তো একটু তন্দ্রা লেগে গেছিলো, যখন চোখ খুললো তখন সন্ধ্যার আঁধারে সে একলা বসে সেখানে, চারিপাশে কিট-পতঙ্গ, জোনাকির দল ডানা মেলে খেলে বেড়াচ্ছে! হারু তাড়াতাড়ি সেখান থেকে উঠে পড়লো, মশার কামড়ে আর বসতে পারলো না সে। তারপর চাঁদের আলোয় পথ তাহরে বাড়ি ফিরে এলো। বাড়ি ঢুকতেই দেখলো পিসি উঠোনে বসে তার জন্য অপেক্ষা করছে, জিজ্ঞেস করলো 'কি রে হারু? কোথায় চলে গেছিলিস? এতো সময় লাগলো যে তোর আসতে?’
‘অরে না না পিসি, আমি ওই পুকুর-পাড়ে গেছিলাম, ওখানেই বসে ছিলাম’
‘ওই জংলা পুকুর পাড়টায় কি করতে গেছিলিস শুনি? নোংরা জায়গা একখানা’ বৃদ্ধা বিরক্তির স্বরে বললো
‘কোথায় নোংরা? আমার তো বড় ভালোই লাগলো পরিবেশটা, কত ফুল ফুটে আছে ওখানে?’
‘ফুল ফুটেছে? ওখানে?’ বৃদ্ধা অবিশ্বাসের চোখে তার দিকে চাইলো
‘হা গো বীথি পিসি!’
‘জানি না বাবা, হতে পারে, কত দিন যাওয়া হয়নি ওদিকে ’ বলে বৃদ্ধা হেঁশেলে চলে গেলেন।
সেদিন রাতে হারু দরজায় খিল আটকে সব জানালা আঁটো-সাঁটোভাবে বন্ধ করে দিলো। সব ঠিকঠাক ভাবে বন্ধ আছে কি না আবার করে দেখে সে শুয়ে পড়লো। মাঝরাতে হারু আবার সেই খচ-খচ আওয়াজটা পেলো কিন্তু স্বাভাবিক মনোভাব বজায় রাখার চেষ্টা করলো। আরো কিছুক্ষণ আওয়াজটা চলতে থাকলে তার একটু অস্বস্তি বোধ হতে লাগলো! গত রাতের তুলনায় আওয়াজটা যে আরো বেড়ে গেছে, সেটা হারু একেবারে বুঝে গেলো - যেন আওয়াজটা আসছে আরো কাছ থেকে, জোরে জোরে! ভয়ে সে জানালা খুললো না, চোখও খুললো না, পাথরের মতো বিছানায় পরে থাকলো। বিন্দু বিন্দু ঘামে তার কপাল ভোরে উঠলো, শরীরে আবার সেই আড়ষ্টতা ফিরে আসতে লাগলো কিন্তু হারু আত্মপ্রতিজ্ঞা করে নিলো যে বাইরে যেই হোক না কেন, সে জানালা খুলবে না, সে চোখও খুলবে না! বাইরের আওয়াজটা এবার থেমে গেলো কিন্তু তার ভয় কাটলো না, সে যেন চোখ বন্ধ করেও সেই বৌটিকে একভাবে পুকুরপাড়ে উপুড় হয়ে পড়ে থাকতে দেখলো। আতঙ্কে তার চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো, সে বন্ধ চোখের মধ্যে দিয়ে পরিষ্কার ভাবে দেখলো সেই নারীটি ঘাস, ফুলের মাঝে নিশ্চল বস্তুর মতো পড়ে আছে, সে পিসিকে আওয়াজ দিতে গেলো কিন্তু পারলো না - তালাবন্ধ অন্ধকারে কারা যেন ফিস্ ফিস্ করে কথা বলতে লাগলো, ভয়ে হারুর রক্ত হিম হয়ে গেলো! সে দেখলো বৌটি এবার ধীরে ধীরে মাথা তুলে তারই দিকে দৃষ্টিপাত করছে - চোখ খোলার ব্যর্থ প্রচেষ্টায় সে ছটফট করতে লাগলো, কেউ যেন তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার বন্ধ চোখ দুটি টিপে ধরে রেখেছে!! সেই ঘোমটা পড়া বৌটি তারই দিকে চেয়ে রইলো, কারা যেন ফিশ-ফিশ করে কি সব বলে চলেছে তার কানে! তারপর হঠাৎ সেই বৌটি উঠে চলে যেতে তারও আতঙ্কের নাগপাশ থেকে মুক্তি লাভ হলো! সব আবার স্বাভাবিক হয়ে যেতে হারু চোখ খুললো কিন্তু প্রচন্ড ঘুমের রেশে সে আর তাকিয়ে থাকতে পারলো না, আত্মা শরীর নিদ্রা জগতে ফিরে গেলো।
পরদিন সকালে হারুর মাথা যন্ত্রণা করতে লাগলো, বাইরের অগ্নিবৎ রোদ্দুরে সে পা ফেলার দুঃসাহস করলো না - সারাদিন তাকে নিজের ঘরে শুয়ে শুয়ে, বই পড়ে কাটাতে হলো। দুপুরে খেতে বসে সে বীথি পিসির সাথে অনেক গল্প করলো - গ্রামে কি কি উৎসব হয়, কোন ঋতুতে কি রোগ হয়, যাত্রা রাতে কে কি সাজে ইত্যাদি কিন্তু অন্য বিষয়টা নিয়ে কিছুই বললো না। হারু ভাবলো সে তো পরদিনই সেখান থেকে চলে যাবে, পিসিকে আর ওই সব কথা বলে বিব্রত করা ঠিক হবে না! যতই হোক তিনি বুড়ো মানুষ, তাকে এখানে, এই গ্রামে একাই থাকতে হবে, তার মনে কোনো রকমের ভয় ধরানো উচিত কাজ হবে না ।
এবার একটা ব্যাপার হলো, হারুর শেষ-দুপুর থেকে একটু সর্দির উপসর্গ দেখা দিলো। বীথি পিসি চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কি রে হারু, সর্দি বাধিয়ে বসলি না কি?”
হারু জবাব দিলো ‘আমার নতুন জায়গায় মাঝে-মাঝেই এমনি হয়ে থাকে, আবার একটু পরেই ঠিক হয়ে যায়, তুমি চিন্তা করো না পিসি।’
‘জানি না বাবা! তা হলেই মঙ্গল' বলে বৃদ্ধা পিসি চাল বাছতে বসলো।
কিন্তু ক্রমশ ঘন ঘন হাঁচিতে ও কাশিতে হারুর প্রাণ অস্তগত হয়ে গেলো, সন্ধেবেলা ভন-ভন করতে থাকা মাথায় হাত দিয়ে সে বুঝলো তার জ্বর এসেছে। পিসিকে বলতে তিনি বিচলিত হয়ে নিজের ঘর থেকে একটা ওষুধের বাক্স নিয়ে এলো এবং করুণাভরা গলায় বললো, ‘জ্বরে তো গা পুড়ে যাচ্ছে হারু! নে নে ওষুধটা শিগগিরি খেয়ে ফেল দেখি!!’