পুজো বার্ষিকী
১৪২৬
শিল্পী - মেঘমল্লার (ডালাস, টেক্সাস)
লেখক/লেখিকাবৃন্দ
প্রবন্ধ
বাঙ্গালী আর মানুষ
হইবে কি?
ভাস্কর সিন্হা
দোহা, কাতার
উপরোক্ত শিরোনামায় জনৈক শুভাভিলাষী বিদ্বজন শঙ্কায়- আশঙ্কায় রবীন্দ্রস্মরণ করলে, ওনাকে আশ্বত্ত্ব করা গেল এই বলে যে, রবীন্দ্রনাথ তো বাঙ্গালীর ভাবের, চিত্তের এবং গানের জগতের মেঘমালায় চিরকালীন। তাই প্ল্য়ানচেটবিলাসী, যদিও তিনি আজ স্বর্গগগনবিহারী, তিনি প্রায়শঃই এসে থাকেন আমাদের দিবানিশির আলোচনায়। শুধু তিনি-ই বা কেন, আরও অনেক গুণীও তো আসবেন আমাদের আলোচনায়।
হ্য়াঁ বাজার এখন সরগরম, মৌসুমী বায়ু এখন প্রবেশিত। নির্বাচন আসন্ন। ঘূর্ণি আবর্তে নিম্নচাপে সব ইঁট- পাটকেল জড়ো এক জায়গায়। নির্বাচনী প্লাবনে ভাষার তোড় কোনো বাঁধাই মানে না। আ মরি বাঙ্গলা ভাষা! তা রাজনীতির উৎসবে কবেই বা ভাষণ লৌহকপাটের কারার অন্তর্বতী ছিলো? তবে গুটিকতক ঘোষিত দলবাহী সংবাদ মাধ্য়ম ব্য়তীত- যাদের কর্মই আপনার ঢাক- বাদন, বাকি সংবাদমাধ্য়মের শিরোনামাগুলি দেখলেও অত্য়ন্ত হতাশার উপলব্ধি হয়। শাসক, শাসিত, বিরোধী পক্ষের সম্বন্ধে ব্য়ঙ্গ-বিদ্রূপের সুরারোপণের মূর্ছনায় মূর্ছাপ্রাপ্তি অবশ্য়ম্ভাবী। নিতান্ত সহজেই পাঠকের নিশানায়, এবং আরও অনায়াসসাধ্য় সহজিয়া শরবিদ্ধ মৃগ। এ ভাষার তো হেথায় তুরে মানাইছে না গো অবস্থা।
এখানেই বাঙ্গালীর অস্বাতন্ত্র্য! উড়ে, বিহারী, মারোয়াড়ী, পাঁইয়া, গুজ্জু, মাদ্রাসী, কাটা ইত্য়াদি- ইত্য়াদি সবাই তরল উপহাসের পাত্র। মহামহিম বাঙ্গালী বিদ্বজ্জনের সামনে সকলেই অর্বাচীন, উজবুকের দল। কথাবার্তার শালীনতা, সুষ্ঠু আচরণ, জনপরিসরে ভদ্রতা, সর্বপোরি এক সহমানুষের প্রতি সহমর্মিতার বড়ই অভাব ঘটেছে বাঙ্গালী মানসে ও জীবনে। হয়তো শুধু বাঙ্গালী নয়, সমগ্র ভারতবর্ষেই। যেহেতু বাঙ্গালীই এখানে আলোচনার বিষয়, তাই বাকিদের কথা অন্য় সময়ে হবে। বাঙ্গালী বুঝতেই পারেনা যে অন্য়রা কতো শতপথে অগ্রবর্তীমান। বাঙ্গালী তো বাঙ্গালী-ই। খালি যুক্তিবিহীন একপেষে হিসাব। সুভাষ তো সুভাষ-ই। সেখানে বাঙ্গালীর কাছে স্বয়ং গাঁন্ধীও অতি অবহেলার পাত্র। বাঙ্গালী জানার প্রয়োজনবোধও করেনা নেতাদের মধ্য়ে যে পারস্পরিক সৌজন্য়বোধ ছিলো তাকে। সংঘাত ছিলো সর্বদাই তাত্ত্বিক। আত্মিক পারস্পরিক যোগাযোগের হিসাব সাধারণ বাঙ্গালীর কাছে নেই। যেখানে সুভাষও নিজেই গাঁন্ধী, নেহেরু, আজাদ ইত্য়াদি বিগ্রেড বানিয়েছিলেন। গুরুদেব আর মহাত্মা পরস্পর পরস্পরের পূণ্য় নামকরণ করেছিলেন। নেহেরু কন্য়াকে গুরুদেবের শরণে পাঠিয়ে ছিলেন কিছু দিনের জন্য়। বাঙ্গালীর আজি নিজেকে অন্তরের মধ্য়ে দেখিবার বড়ই প্রয়োজন বোধ হয়ে পড়েছে। অন্তরে আজি আলোক নাহিরে হলে ভীষণই মুশকিল, কুমঙ্গল। হতভাগা অপরকে অবহেলায় পারদর্শী বাঙ্গালী বেমালুম ভুলে যায় যে রবীন্দ্রনাথের ইয়েট্স বা পিয়ার্সন সাহচর্য। বিশ্বভারতী গঠনকল্পে মারোয়াড়ী ব্য়বসায়ীদের যোগদান। স্বামীজির বিদেশযাত্রায় খেতরীরাজার অসীম অবদান। স্বামীজির মহাজীবনে এই খেতরীর রাজারও কম ভূমিকা নেই রামকৃষ্ণের থেকে। রামমোহনের জীবনরক্ষায় এক তিব্বতীনির সুমহান ভূমিকা
ছিলো। শরৎচন্দ্রের মানসিপটভূমি তৈরীতে বর্মাদেশীয়দের সোৎসাহ। মহান নেতার অন্তর্ধানে অবাঙ্গালীভাষীদের সক্রিয়তা এবং যারপরনাই তৎপরতা। অর্বাচীন বাঙ্গালীর এহেন ভূমিকায় নিদারুণ ক্ষুব্ধ বিদ্য়াসাগর শেষজীবন অতিবাহিত করেন কর্মাটারে, অবাঙ্গালী আদিবাসীদের সাথে। যাহোক একপেষে বাঙ্গালীর একবগ্গার রোগ চিরকালের। স্বয়ং বীর সন্ন্য়াসী প্রথমে বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি বিরাগভাজন ছিলেন। যদিও পরবর্তীকালে কিছু অধ্য়য়নের পরে তাঁর বিরাগ কিয়ৎ হ্রাস পায়। বৌদ্ধ ধর্মের মঝ্ঝিম পন্থা মানবজীবনের এক অতুল অবদান। মাঝামাঝি পথে চলে উগ্রতার আর হিংস্রতার মানবিকরণ করা তো যেতেই পারে। দরকার সদ্দিচ্ছার আর জীবনকে দুই চক্ষে পূর্ণরূপে দেখা। নইলে একচক্ষু হরিণের ন্য়ায় একদিকে থাকে শুধুই আঁধার। সবাইকেই আসন ছেড়ে যেতে হয়। ভারত বা বাঙ্গলায় সেই নিয়ম অবশ্য় খাটে না। আমেরিকার মতো দেশে সর্বাধিক দুই বারের জন্য় রাস্ট্রপতির আসনপ্রাপ্তি আছে, তার বেশী নয়। এখানে চিরকালীন। যেতে নাহি দিব। শরীর, মন না চাইলেও, দল যে চাইবে শেষ দিন পর্যন্ত। রাজনীতি আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে ঢুকে গিয়েছে। পৃথিবীর যাবৎ চাকুরি বা কর্মে প্রবেশগত যোগ্য়তার প্রয়োজন। প্রবেশ যোগ্য়তা যে শুধু ছাঁকনির কাজ করে তাই নয়, মানুষকে ঐ কর্মের জন্য় পারদর্শী হতে উৎসাহিত করে এবং ঐ কর্মে সফল হবার প্রয়োজনীয় মানের সক্ষমতার অর্জনের বোধ জাগায়। অবশ্য় রাজনীতিতে প্রবেশ যোগ্য়তার কোনো প্রয়োজন নেই, তাই মাপকাঠিরও কোনো ব্য়াপার নেই। নেতা হতে হলে বংশপরিচয় আর যোগাযোগটাই জরুরী। এমতাবস্থায় আমরা রাজনৈতিক ব্য়ক্তিসমূহের কাছ হতে কি-ই বা প্রত্য়াশা করতে পারি? এদিকে রাজনীতি সম্পদ আনার আর জোগানোর মূল শক্তি। কিছু স্বার্থান্বেষী মানবের হাতে পড়ে রাজনীতি আর দেশের হয়েছে দফারফা। স্বাধীনতার আমলের সংগ্রামী রাজনীতি আর আজকের রাজনীতি অবশ্য়ই আলাদা আলাদ বিষয়। আজকের রাজনীতি ক্ষমতাপ্রাপ্তি আর ক্ষমতার কুক্ষিগততার কাহিনী বিশেষ। কিন্তু মানদন্ডহীনতায় এই রাজনীতি মাৎসন্য়ায়ের মতো পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটিয়েছে। বাঙ্গালী হিসাব কষে: তুমি ভালো না খারাপ? তুমি কোন দলের? ঘটনাচক্রে তুমি সহমতের না হলে, বিপদ অবশ্য়ম্ভাবী। দলের আর বাহুবলীদের আস্ফালন চলবে তোমার শরশয্য়া বা কঙ্কটশয্য়ায় পতন না হওয়া পর্যন্ত। এই অভিমুখের অবশ্য় পরিবর্তন আশু কর্তব্য়। মাঝামাঝি কেউ থাকতেই পারেন। তোমার সর্বকর্মে আমার উৎসাহ- উদ্দীপনার অবকাশ নাও থাকতে পারে। এমতবস্থায় আমি তোমার বন্ধু না হলেও, অমিত্রও না হতে পারি। কিছু তো মানদন্ডের মানবসমাজের সর্ব ক্ষেত্রেই মান্য়তা থাকা উচিত। নইলে অন্য় অবোলা প্রাণীকুল হতে আমরা তথাকথিত সভ্য় কিসে? অপার বুদ্ধির অধিকারী কিসে? আত্মনিরীক্ষণ আর বুদ্ধের মঝ্ঝিম পন্থায় বাঙ্গালীমনে শান্তির অবকাশ আনবে। উগ্রতা, রূঢ়তায় ঠান্ডার প্রলেপ দেবে। আমরা একই জাতি, সবাই অমৃত্য়স পুত্রাঃ! ধংসাত্মক ভূমিকা ছেড়ে, গঠনাত্মক ভূমিকার দিকে বাঙ্গালীর সুষম মনোনিবেশ অত্য়ন্ত জরুরি।
প্রবন্ধ
সাচ্চা-ঝুটা
শাশ্বতী ভট্টাচার্য
ম্যাডিসন, উইস্কন্সিন
লেখক পরিচিতিঃ - যাদবপুর ইউনিভার্সিটি থেকে রসায়নে মাস্টার্স করে CSIR এর Indian Institute of Chemical Biology তে গবেষণা করেন এবং যাদবপুর ইউনিভার্সিটি থেকে Ph.D ডিগ্রী অর্জন করেন। আমেরিকার National Institute of Health এর অন্তর্বতী National Cancer Institute এ কিছুদিন পোস্টডকের কাজ করার পর এখন ইউনিভার্সিটি অফ উইস্কসিন ইন ম্যাডিসনে ডিপার্টমেন্টের অফ মেডিসিনের সায়ান্টিস্ট। স্বামী ও কন্যা সহ ওঁনার বাস উইস্কন্সিনের শহর ম্যাডিসনে। পেশায় বিজ্ঞানী শাশ্বতী বাংলা ভাষায় লিখতে ও পড়তে ভালোবাসেন।
প্রথম দেখি অফিসের মিটিংয়ে। পিঁজা আর তার সাথে ডায়েট কোক। কি ব্যাপার? না হেলদী। এমনি কোকে তো অনেক চিনি, তাই ডায়েট কোক। শূন্য ক্যালোরি। হেলদী, স্বাস্থ্যকর।
- সিরিয়াসলী ?
এরপরে এই শূন্য বা কম ক্যালোরির খাবার সব জায়গায় দেখতে শুরু করলাম। সভা-সমিতি, জলসা-ঘরে, বিবাহবাসরে। হোটেল-রেস্তোরায় তো বটেই।
সত্তরের দশকে যার স্থান ছিল মেডিসিন ক্যাবিনেটে তা ছড়িয়ে পড়লো রান্নাঘরে, এমনকি পানীয় জল খাবার কুঁজোতেও। আমার ডায়াবেটিক দিদা চায়ে স্যাকারীন মিশিয়ে খেতেন, তাই ওই কেমিক্যালটিকে আমার মা ঘরে মজুত রাখতেন, অবশ্যই তা থাকত আমাদের নাগালের বাইরে, ডেটল, বার্ণল আর এ্যনাসিনের সাথে। তবুও শান্তি ছিল, সেটা তখনও পূর্নবয়স্কদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।
তারপর একদিন ওই শূন্য ক্যালোরিকে দেখলাম শিশুদের ব্যবহার্য খাদ্যদ্রব্যে। প্রিয় বন্ধুর রান্নাঘরে দুধ, ডিম, ময়দা, তেল, ইস্টের পাশে পাতার পর পাতার কৃত্রিম চিনির স্যাচেট। শুধু তাই নয়, কেকের সমারোহ বৃ্দ্ধি করার নানা রং-বেরঙএর আইসিং, ফ্রস্টিংয়ের যে সমাহার, তার উপরেও কালো কালির বড়ো হরফে লেখা শূন্য ক্যালোরি কথাটা চোখে পড়লো।
- 'এইখানে এইগুলো কি রে? তোর ছেলে তো সবে দুই, আর মেয়েটা এই সেদিন থেকে স্কুলে যাচ্ছে? ওরা কি ডায়া...? বলতে বলতে থেমে গিয়েছি। এই রকম একটা অশুভ প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা আমার একান্তই অনুচিত নয় কি?
- 'আরে বলিস কেন? আমার মেয়ের খুব রান্নার সখ বুঝলি? এই বয়সেই ও যা রান্না করে না! নির্ঘাত এমেরিল লাগাসের ঠাকুরমা ছিল গতজন্মে। দেখ না দেখ, এই কুকি, এই কেক, এই প্যস্ট্রি বানিয়ে চলেছে। তারপর উইক-এন্ড হলো কি না, আসে পাশের গাদাগুচ্ছের সাদা কালো সব বন্ধুবান্ধবকে ঘরে ডাকবে..., ওই সব ডেসার্ট বানাবে, খাবে আর ঘরে বসে ভিডিও গেম খেলবে।আসলে ওর বাবারও তো ভিডিও গেমের শখ, তাই আমাদের বাড়িতে ভালো স্টক আছে। হই হই করে কথাগুলো বলে বন্ধু আমার দিকে তাকায়, সম্ভবত কিছু পড়েছে আমার ভ্রকুঞ্চনে, ... চিন্তা করিস না, ওগুলো সব জিরো ক্যলোরী। ভিডিও গেম খেলাটাতে তো তেমন কোন এক্সারসাইজ নেই! বুঝলি না? এক ঢিলে দুই পাখি।
- 'না। বুঝলাম না বন্ধু। কোনটা সত্যি কোনটা মিথ্যা, সাচ্চা-ঝুটা ঝুটা-সাচ্চা সব কি আমরা গুলিয়ে ফেলছি? এতো ঠিক মঙ্গলময় বার্তা নয়। আমি দীর্ঘশ্বাস গোপন করি। জিভকে নকল মিষ্টির স্বাদ পাইয়ে নয় তো ফাঁকি দেওয়া গেল, কিন্তু এই মিষ্টির ব্যপারটা জিভেই শেষ হয় কি? জিভ থেকে যে বার্তাটা মগজ মানে, যাকে আমরা ইংরাজীতে ব্রেন বলি তার কথা মনে রেখেছো তো বন্ধু? বার্তাটা পাওয়ার পর শরীরে অন্তত এক প্রকারের হরমোনের ক্ষরণ হতে পারে তার কথাটা মনে রেখেছো তো বন্ধু? সেদিন বলতে পারিনি।
মাধুকরীতে আমার এই লেখাটা আজ তাই বন্ধু, তোমায় দিলাম।
বাজারে আরো তো চারটে স্বাদ আছে, তবে কেন মিষ্টির প্রতি এই আকর্ষণ? ব্যপারটা জটিল নয়, যদি মেনে নিতে পারি যে “মিষ্টি” শুধু মাত্র একটা স্বাদই নয়। কেন মিষ্টির দিকে আমাদের এই অপ্রতিরোধ্য ঝোঁক, তা বোঝার জন্য বেশী দূর নয়, মাত্র কয়েক মিলিয়ন বছর আগের কথা ভাবলেই চলবে।
জীবাশ্ম বিজ্ঞান অনু্যায়ী প্রায় ২.৬ মিলিয়ন খৃষ্টাব্দে মানুষের পূর্বসূরী Hominids এর দেখা পাওয়া যায়। যদিও Neolithic (New Stone age, আনুমানিক খৃষ্টাব্দ ১০,২০০ সাল) যুগকে মনুষ্য সভ্যতার শুরুর যুগ বলা যেতে পারে, বুঝতে হবে, তারও প্রায় ১৯০ হাজার বছর আগের Paleolithic (Old-Stone age) যুগে আজকের মানুষ বা Homosapien এর আবির্ভাবকাল। সবে বন্য জন্তু জানোয়ারের কবল থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য পাথরের ব্যবহার সে শিখেছে বটে, কিন্তু অন্য সমস্ত জীবিত প্রাণীর মতো নিছক প্রাণ ধারণের জন্য মানুষেরও দরকার ছিল খাদ্যের।
তার সেই অস্থায়ী যাযাবরের জীবনে না ছিল কোন বাসস্থান, না ছিল কোন নির্দিষ্ট খাবারের সরবরাহ, না ছিল বিশেষ একটা বাছ-বিচার করার পরিস্থিতি। তার বেঁচে থাকা, অথবা না-থাকা প্রধানতঃ কার্বোহাইড্রেট তথা গ্লুকোজের ওপর নির্ভর-শীল। নানা প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় সেই গ্লুকোজের রূপান্তরিত হয়ে তৈরী হবে এটিপি নামক এক অণু। যাবতীয় কাজ করার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তির মুদ্রা (Currency) এই অণুটি।
অতএব, বিবর্তনের সহজাত কর্ষণে মানুষ বুঝতে শিখেছে কিভাবে পরিশ্রমকে এক রেখে বেশী গ্লুকোজ তথা এটিপি পাওয়া যেতে পারে। মিষ্টি পাকা ফলটা তাই, কাঁচাটার থেকে অনেক বেশী বাঞ্ছনীয়। এইভাবেই সদ্য জাত শিশুর প্রথম খাদ্য মায়ের দুধে মিষ্টি এবং তা উপভোগ করার জন্য যেমন জিভে তার উপযোগী স্বাদ-কলিকা, ব্রেনেও তেমনি, চিনির সরসতায় নির্দিষ্ট আনন্দানুভূতি এসেছে। এর অন্য প্রান্তে অদূর ভবিষ্যতে অনাহারের সম্ভাবনায় যতটা প্রয়োজন ঠিক ততখানি খরচা করে বাড়তি গ্লুকোজকে ফ্যাটের আকারে গড়ে মজুত করে রাখার আয়োজন হয়েছে।
বন্ধু, বলা বাহুল্য এই ভাঙ্গা আর গড়ার কাজগুলি করার জন্য যার অবদান অপরিহার্য, তিনিই সেই সুপ্রসিদ্ধ ইনসুলিন হরমোন জগতের Swish army knife, কিম্বা সর্ব-ঘটের কদলী বৃন্ত। প্রাণী জগতে এই ভদ্রলোক ইনসুলিনটি বাবুটির আবির্ভাবকাল নিয়ে নানা গবেষণা থেকে বলা যায়, ইনি অতিবৃদ্ধ।
অন্তত পক্ষে মিলিয়ন বছর আগে তো বটেই, কেউ কেউ বলেন তার চেয়েও আরও আগে!আজকাল দেখেছি অনেকে সাদা চাল, ওরফে ভাত পাউরুটি ইত্যাদি কার্বোহাইড্রেটকে শুধু কার্ব বলে ডাকেন (এবং বেশ ছিঃ ছিঃ কারও করেন)। ভুললে চলবে না চাল যেমন কার্বোহাইড্রেট, যে কোন ফল, সবজি, ডাল, দুধ, আলু, ভুট্টা, ওটমিল সব কিন্তু সেই একই। কার্বোহাইড্রেট এক ধরণের অণুর বংশগত নাম। গ্লুকোজ এই কার্বোহাইড্রেটের গোত্রের সব থেকে সিধাসাদা সদস্য, এবং এই প্রবন্ধে একেই আমি সুগার, কিম্বা মাঝে মাঝে চিনি বলি ডেকেছি। নানা বিপর্যয় থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রেখে, বনে জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে কার্বোহাইড্রেট আহরণ করার জন্য এবং তাকে ঠিক মতো ব্যবহার করার এই যে রীতিমতো এটা অখণ্ড (ফেল প্রুফ) একটা সিস্টেমের উদ্ভাবন হয়েছে প্রকৃতিতে, ভাবলে অবাক হতে হয়। অতএব পাঠক, পাকা আমটি মুখে দিয়ে যে সুখ, সেই সুখ এক-দুই দিনের মামলা নয়, বিগত কয়েক শত হাজারের বছরের বিবর্তনের আমদানি। মিষ্টির আকর্ষণ তো শুধু মাত্র
জিভেই সীমাবদ্ধ নেই, লাল টুক-টুকে স্ট্রবেরীটিকে তাই চোখে দেখেও সুখ! ওটা মুখে পড়লে ব্রেন যে “আহা আহ্ আহা” বলে জানান দিয়ে উঠবে। তুমি আমি বন্ধু তো নশ্বর মানুষ, মেরে কেটে একশো বছরের আয়ু।
কৌতূহলী পাঠকের জন্য জানাই, পৃথিবীর যাবতীয় প্রাণীর যাবতীয় দৃশ্য বা অদৃশ্য কাজ করার জন্য প্রয়োজন এটিপির। সাধারণতঃ গ্লুকোজ (তথা অযৌগিক কার্বোহাইড্রেট) থেকে এটিপি উৎপাদন হয় বটে, তবে ফ্যাট এবং সবিশেষ প্রয়োজনে আমাদের শরীর প্রোটিন থেকেও এটিপি উৎপাদন করে, (তার আগে কিন্তু সেই প্রোটিন থেকে কোন প্রকারে গ্লুকোজ বানাতে হয়) তবে সেটা কেন ঠিক অভিপ্রেত নয় আজকের প্রবন্ধে সেই আলোচনায় যাবো না। মিষ্টি শুধু খেতেই নয়, মিষ্টি নিয়ে লিখতেও সুখ। হ্যাঁ, আধুনিক মনুষ্য-সমাজ ঠিক এই রকম পরিস্থিতির কবলে। বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে, রাসায়নিক পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে, আঁখ থেকে হোক, বা ভুট্টা দানা থেকে হোক, আমরা চিনিকে ঘনীভূত করতে শিখেছি। আর যেই না তা পেরেছি, আমাদের চেনা প্রায় সমস্ত খাদ্যে আমরা মিষ্টি দিতে শিখেছি, মুখে দেওয়ার মতো কিছু হলেই হলো, রুটি, পাউরুটি, ভাত, ডাল, মাংস, মায় ওষুধ...। A spoonful of sugar helps the medicine go down, in the most delightful way!
আর তার ফল? শিকারী খুদ ইহা শিকার হো গয়া!
বেঁচে থাকার তাগিদে যে গ্লুকোজ তথা মিষ্টির দরকার ছিল এবং তাকে ভালো লাগার এবং সংযতভাবে ব্যবহার করার যে উপকরণ বিবর্তনের রাস্তা ধরে আমাদের মস্তিকে, শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গে প্রোথিত হয়েছিল তা আজ এক আশ্চর্য আসক্তি হয়ে বহু মানুষের দূর্বিসহ জীবন এবং ক্ষেত্র-বিশেষে মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মিষ্টি বহু মানুষের কাছে অবিকল সিগারেট বা মদের মতো নেশাকারক এবং জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে সেই নেশায় এনারা আক্রান্ত। বলা বাহুল্য বাড়তি চিনি ইনসুলিনের প্রভাবে ফ্যাট বা বাড়তি ওজনে পরিণত হয়েছে এবং আদমশুমারি অনুযায়ী গত ২০১৫ সালে, সারা পৃথিবীতে বাড়তি ওজন মনুষ্য সভ্যতার প্রায় ৩০ শতাংশকে (২.২ বিলিয়ন) অসুবিধায় ফেলেছে।তা হলে উপায়? নাহ, কোন চিন্তা নেই!
যে বিজ্ঞান গোটা আঁখকে ছিবড়ে করে তার হৃদয় থেকে বার করে এনেছে জমায়িত চিনির স্ফটিক মানিকটিকে, কিম্বা ভুট্টার রস থেকে আমাদের মুখে তুলে দিয়েছে গ্লুকোজের ভাই ফ্রুকটোজকে সেই বিজ্ঞান এবার আমাদের হাতে তুলে দিয়েছে বেশ কয়েক প্রকারের আর্টিফিসিয়াল সুগার, বিগত কয়েক হাজার হাজার বছর ধরে বিবর্তিত হওয়া আমার মগজ যাদের মোটেও চেনে না।
এই ‘অচেনা” চিনিগুলোকে তাদের চরিত্র অনুযায়ী গোষ্ঠীবদ্ধ করলে, যারা এক্কেবারে রাসায়নিক দ্রব্য তারা হলো Sweet'N Low (Saccharin), Equal, NutraSweet (Aspartame), Sweet One (Acesulfame potassium) Neotame (Aspartame বড়ো দাদা)। এর পরে লাইন দিয়ে এলো Erythritol, Isomalt, Lactitol, Maltitol, Mannitol, Sorbitol, Xylitol, Splenda (Sucralose) প্রভৃতি। এরা চিনি কিন্তু চিনি নয়, এরা Sugar alcohol। মোটামুটি চিনির মতো একটা অণু, তার সাথে একটা আরেকটা অণু এমন করে জুড়ে দেওয়া হয়েছে এদের মধ্যে যে আমাদের সেই সুপ্রসিদ্ধ বয়োজ্যেষ্ঠ ইনসুলিন বাবা-জীবন এদের ছোঁবেনও না, এরা মোটামুটি বাহ্য পদার্থ! বহু ক্ষেত্রে জোলাপের মতো এদের আচার ব্যবহার। এর মধ্যে Stevia নামক নকল চিনিটার মধ্যে যদি ও বা একটা প্রাকৃতিক- প্রকৃতিজ ভাব আছে, আসলে কিন্তু ওটিও Stevia rebaudiana নামক এক গুল্ম-ঝাড়ের পাতা থেকে রাসায়নিক পদ্ধতিতে বার করে আনা পদার্থ (stevioside)।
তা হলে কি দাঁড়ালো? ভেবে দেখলে ব্যাপারটা অত্যন্ত সহজ। স্বাদের বিচারে এরা চিনি থেকে বহুতর গুনে মিষ্টি হওয়া সত্বেও বাড়তি চিনি সংক্রান্ত কোন ঝামেলা থাকছে না। কেন না এরা তো মোটেও চিনি নয়, তাই ইনসুলিন নিঃষ্করণ হবে না ধরে নেওয়া যেতে পারে। আর কে না জানে ওই ইনসুলিনটাই তো যত্তো গন্ডগোলের মূলে। এই সে গ্লুকোজকে কোষের কাছে বিলি করে তার থেকে এনার্জি তৈরী করতে সাহায্য করছে, এই সে বাড়তি চিনিকে ফ্যাট তৈরী করে লিভারের কাছে জমা রাখতে এগিয়ে আসছে!
তা হলে তো মুস্কিল আসান? প্রবলেম সল্ভড।
না! ধীরে বন্ধু ধীরে। গবেষণা চলতে চলতে থাকল এবং প্রথম অন্তরায় দেখা গেল...।
যেমনটি ভাবা গিয়েছিল, দেখা গেল তেমনটি ঠিক হচ্ছে না। অচেনা চিনির কয়েকজন সদস্য ইঁদুরের শরীরে ইনসুলিন বাড়িয়ে দিচ্ছে! সত্যি? কৃত্রিম চিনির সপক্ষে যাঁরা তারা বললেন, --বুঝেছি।ইঁদুর ব্যবহার করা হয়েছে না? তাই। মানুষ আর ইঁদুর এক নাকি?
আসতে থাকল, ‘এই কৃত্রিম চিনিটা ওই নকলটার থেকে ভালো’র বিবৃতি, এবং একের পর এক নকল চিনিতে বাজার ছেয়ে যেতে লাগলো।
এই সব ক্ষেত্রে যা হয়ে থাকে, সেই চাপান উতোর চলতেই থাকল, আর অন্য দিকে, ১৯৮০ থেকে আজকের ২০১৮ সাল অবধি, বাজারে এতো প্রকারের কৃত্রিম চিনি এবং তাদের বিক্রি পুরো মাত্রায় বজায় থাকা সত্ত্বেও থেকে জন-সাধারণের ওজন বাড়তেই থাকল।
কেন? কোথায় বাঁধলও গন্ডগোলটা? উত্তরের আশায় গবেষণা এবং কারণের খোঁজে জল ঘোলা হতেই থাকল।
জানা গেল, কিছু কিছু নকল চিনি খাওয়ার পর মানুষের শরীরেও ইনসুলিনের ক্ষরণ হয়। তখন সে প্রথমে খোঁজে তার অতি পরিচিত আসল গ্লুকোজটিকে (তারপরে হাত বাড়ায় ফ্যাট কিম্বা প্রোটিনের ওপর)। ফলাফল সরূপ- রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কম, এবং মগজে ক্ষুধানুভূতির বার্তা। খিদে পেয়েছে! খাবার কই? খাবার চাই! এখুনি চাই। ফলাফল সরূপ-অতিভোজন।
জানা গেল, নকল মিষ্টি স্যাকারিন কোকেনের মতো বহুপ্রসিদ্ধ নেশার জিনিষের চাইতে বেশি আকর্ষণীয় এবং নেশাকারক, অন্তত গবেষণাগারের কতগুলি ইঁদুর কাছে। ২০১৭ সালে মার্চ এবং ডিসেম্বরে প্রকাশিত হওয়া সুস্থ মানুষ নিয়ে করা দুটি প্রবন্ধের (Physiol Behav. 2017, 182:17-26, এবং International Journal of Obesity, 2017 41, 450–457) কথা উল্লেখ করবো।
এই দুটোতেই বক্তব্য যদিও বা সেই ‘আরো গবেষণার প্রয়োজন’ ভাবনাটা আছে, দুটোতেই গবেষকেরা কৃত্রিম চিনির কোন উপকারীতা দেখতে পারেন নি। উল্টে নিয়মিত কৃত্রিম চিনি সেবন যে পৃথুলতা বা ডায়াবেটিস নামক রোগের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিতে পারে এমন একটা স্টাডির (CMAJ. 2017;189:E929-E939) কথা বলা আছে একটি প্রবন্ধে।
আমি নকল মিষ্টির সপক্ষে নই এটা হয়তো এতক্ষণে বোঝাতে পেরেছি। আর রসগোল্লার বদলে যদি আপেল কিম্বা আমে মিষ্টি রসনা তৃপ্ত হয়, সেই চেষ্টাটাও তো করে দেখা যাক না বন্ধু। জলের মতো পানীয় আর হয় না কি?
বন্ধু, শেষ পর্যন্ত মানুষ অভ্যাসের দাস, কুকির বদলে কতগুলো ব্লুবেরী বা আঙ্গুর মুখে ফেলে দেখলে হয় না? হয়তো কয়দিনেই সেটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যেতে পারে।
কথায় বলে না “Prevention is better than cure”?
পরিশেষে বলি, পাঠক, মিষ্টি খেতে ইচ্ছা হলে মিষ্টিই খান না! আপনি নেশাগ্রস্থ কিনা সেটা আপনারই বিচার। ভালো থাকুন, রসে বশে থাকুন।
কবিতাঃ সুদীপ্ত বিশ্বাস
রাণাঘাট, নদীয়া, পঃ বাংলা
নদী ও প্রেমিক
পাহাড়ের বুক চিরে ঝর্ণাটা নামে
অনেক না বলা কথা আছে নীল খামে।
ঝর্ণারা মিলেমিশে হয়ে যায় নদী
শুনবে নদীর গান, কান পাতো যদি।
ও নদী কোথায় যাও? ছল ছল তানে?
দাও নদী দাও বলে জীবনের মানে।
ঘন্টার ঠুন ঠুন, আজানের সুর
নদী জলে মিশে যায় সোনা রোদ্দুর।
ছোট ছোট ঢেউ তুলে নেচে নেচে যায়
সব মেয়ে তাই বুঝি নদী হতে চায়?
ও নদী চলেছ বয়ে, নদী তুমি কার?
প্রেমিকটা প্রাণপণ কাটছে সাঁতার।
সাঁতরে সাঁতরে আরো কতদূর যাবে?
কতটা গভীরে গেলে তবে তল পাবে?
নদীটা যেই না গিয়ে সাগরেতে মেশে,
প্রেমিক ঘুমিয়ে পড়ে সঙ্গম শেষে...
আয় বৃষ্টি ঝেঁপে
বৃষ্টি রে তুই আয় না ঝেঁপে আমাদের এই গাঁয়ে
দে ছুঁয়ে দে মিষ্টি ছোঁয়া রাঙা মাটির পায়ে।
ওই যে মাটি, মাটির ভিতর শিকড় খোঁজে জল
বল না বৃষ্টি ওদের সঙ্গে খুশির কথা বল।
টিনের চালে অল্প আলোয় যখন ঝরিস তুই
পুকুর ভরে শালুক ফোটে বাগান জুড়ে জুঁই ।
আকাশ তখন সাত রঙেতে রামধনুটা আঁকে
সেই খুশিতে টুনটুনিটা টুটুর টুটুর ডাকে।
রামধনুর ওই সাতটি রঙে মন হারিয়ে যায়
অনেক দূরে তারার দেশে মেঘের সীমানায়।
মাছের খোঁজে পানকৌড়ি ওই তো দিল ডুব
বৃষ্টি নামুক বৃষ্টি নামুক টাপুর টুপুর টুপ...
আগডুম বাগডুম
আগডুম বাগডুম ওই ঘোড়া ছুটল
ভোরবেলা চুপিচুপি ফুলটাও ফুটল।
বাগানেতে টুনটুনি টুই-টুই ডাকছে
গুনগুন মৌমাছি ফুলে মধু চাখছে।
ছপছপ দাঁড় টেনে নৌকারা চলছে
ছলছল কলকল নদী কথা বলছে।
আকাশের মগডালে ওই চিল উড়ছে
চিকচিক রোদ্দুরে পিঠ তার পুড়ছে।
চুপিচুপি মেঘ এসে সূর্যকে ঢাকল
তারপর রেগে-মেগে গুরগুর হাঁকল।
কড়কড় বাজ ফেলে মেঘ যেই থামল
টুপটাপ ঝিরঝির বৃষ্টিটা নামল...
নগ্নতা
রাতের কাছে নগ্ন হতে লজ্জা তো নেই
বরং ও রাত ঘন কালো চাদর মুড়ে
ঢেকে রাখে আমার যত নগ্নতা সব।
ওই আকাশে নগ্ন হতে লজ্জা তো নেই
বরং আকাশ ছাতার মত মাথার উপর
মুড়ে রাখে সবকিছু তার বুকের ভিতর।
জল বাতাসে নগ্ন হতে লজ্জা তো নেই
তারা বরং একটু বেশি খুশি হয়েই
ফিসফিসিয়ে বলে কিছু বাড়তি কথা।
নদীর কাছেও নগ্ন হতে লজ্জা তো নেই
বরং নদী ছলাত-ছলাত ছন্দ তুলে
নগ্ন হয়েই আমায় শুধু নাইতে বলে।
বন-পাহাড়ে নগ্ন হতে লজ্জা তো নেই
বরং তারা খুব খুশিতে দুজনেই চায়
আমি যেন খালি পায়ে যাই হেঁটে যাই।
পশুপাখিওদের কাছেও লজ্জা তো নেই
বরং তারা বন্দুক আর চশমা-টুপি
এসব ছাড়াই সত্যি কোনও বন্ধুকে চায়।
এই পৃথিবীর সত্য যারা তাদের কাছে
নগ্ন হতে লজ্জা তো নেই,লজ্জা তো নেই
কারণ সত্য নগ্ন হতে লজ্জা পায় না।
মানুষ দেখে নগ্ন হতে লজ্জা করে
মানুষগুলো লুকিয়ে রাখে নিজের মুখও
তার শুধুই মিথ্যে বলে, মুখোশ পরে।
এই সমাজে নগ্ন হতে লজ্জা করে
গোটা সমাজ মিথ্যেবাদী, ভ্রষ্টাচারী
নগ্নতা আর সরলতার সুযোগ খোঁজে।
ভালবাসা যদি ফিরে পাই
তবে তো নাচবো ভাই
তাধিন তাধিন...
পোড়া বিড়ি দেব ছুঁড়ে ফেলে।
ফেলে দেব তামাকের শিশি
ছেড়ে দেব সব ছাইপাঁশ
তেতো জল, বিলিতি বা দিশি।
ভালবাসা যদি ফিরে পাই
তবে তো গাইবো ভাই
গলা ছেড়ে যা আসবে মনে
বাতাসকে বলে দেব আমি কত সুখি
আকাশকে বলে দেব আমি কত সুখি
পাহাড়কে বলে দেব আমি কত সুখি
তারাদের বলে দেব আমি কত সুখি।
ভালবাসা যদি ফিরে পাই
তাহলে তো ভাই
হয়ে যাব ফুল, পাখি, নদী।
ভালবাসা ফিরে পাই যদি -
নরম পালক নিয়ে
রামধনু রঙ মেখে এসে
বয়ে যাব তির-তির,
পাহাড়ের দেশে।
ভালবাসা যদি ফিরে পাই
তবে তো বাঁচবো ভাই
সমস্ত জীবন।
প্রতিটা মুহূর্ত বেঁচে বেঁচে
প্রতিটা শরৎ বেঁচে বেঁচে
প্রতিটা বছর বেঁচে বেঁচে
প্রতিটা দশক বেঁচে বেঁচে
তবুও তো ভরবে না মন।
বলে যাব, 'বড় ছোট এ জীবন।'
বাক্যহারা
অবলা কথারা আটকে রয়েছে চোখে
অবুঝ মনের বোবা কান্নার মত
আজকে এখন পাথর চোখেতে শুধু
হারানো আবেগ পুরানো দিনের ক্ষত।
বুঝলে না কিছু বুঝতে চাওনি বলে
সুরের ইশারা সুরকার শুধু জানে
দূরের বাতাস দূরে চলে যায় আরও
মন শুধু বোঝে হারানো গানের মানে।
এসেছিল যেটা একদিন নিঃশব্দে
বাতাসেও ছিল চুপিচুপি আসা যাওয়া
রূপকথা দেশে হারানো বিকেলগুলো
সবটাই যেন মিথ্যে অলীক মায়া।
জীবনের খাতা ভাসানোর পর পর
দুচোখ ভেজায় অঝোর অশ্রুধারা
অল্প দুঃখে সশব্দে কেঁদে ওঠে
গভীর দুঃখে ঠোঁটেরা বাক্যহারা
কবিতাঃ প্রসেঞ্জিত ঘোষ
"আমি আর লিখতে পারি না"
আমি আর লিখতে পারি না মণি!
তোর জন্য ভালো ভালো কবিতা-
আর আসেনা আমার কলমে।
জানি তুই আমার কবিতা ভালোবাসতিস
এলোমেলো যাই লিখি না কেনো।
ঘুম চোখে ও বারবার পড়ে
ঠিক ভুলটা ধরিয়ে দিতিস।
আর সে সব হয় না এখন।
জানিস আমিও খুব মিস্ করি
সেইসব দিনগুলো...
যেদিন প্রথম তোর জন্য কবিতা লিখেছিলাম,
খুব মনে আছে.. একদম বাজে হয়েছিল।
তবুও একমাত্র তুই ই প্রশংসা করেছিলিস
খুব বাজে হয়েছিল জেনেও।
জানিস মণি আজ খুব মিস্ করি তোকে
যখন ই একা থাকি।
কেও আর আজ তোর মতো
সারাদিন বকবক করে না
প্রতি সপ্তাহে ঘুরতে যাওয়ার ও আর কেউ নেই।
আমি এখন দামোদর এর পাশে
পড়ে থাকি একা হয়ে।
সময় ও কাটে ... মলিন হয়ে।
আর স্মৃতিগুলো জড়িয়ে ধরে
আস্টেপিস্টে।
কাজের ফাঁকে গোধূলি বেলায়
নানান জিনিস মাথায় আসে
কখন কখন খুব ই ইচ্ছে করে
আবার তোর জন্য কবিতা লিখি
কিন্তু সত্যি আর আমি লিখতে পারি না
তোর জন্য...
মণি আমি আর লিখতে পারি না।।।
কবিতাঃ সৌমিলি ঘোষাল
বছর দশেক পর
বছর দশেক পর
আমি ঠিক এমনই একটা দিনের কথা ভেবেছিলাম,
যেদিন বাতাসে ভেসেছিল আম্রমুকুলের মৃদু সুবাস,
কুসুম বনে উঠেছিল ঢেউ,
নবজাতকের আগমনের তীব্র উন্মাদনা ছিল মনে,
উথাল পাথাল ছিল -
দখিন দুয়ারে দাঁড়িয়ে থাকা আমার আঁচল,
আমি ঠিক এমনই একটা দিনের কথা ভেবেছিলাম
যেদিন ছিল তোমার আসার কথা।
তারপর হয়ে গেলো বছর দশ - বারো,
মাঝে তিস্তা তোর্সা দিয়ে বয়ে গেছে অনেক জল,
ধূসর স্মৃতিতে লেগেছে সময়ের প্রলেপ,
কষ্ট ধুয়ে জমেছে একরাশ অভিমান,
কিন্তু ফিরে আসার কথা ভাবনি তুমি।।
মন
ওই সুদূরে যায় হারিয়ে
বিস্তৃত বালুরাশি
ওই আকাশে ঐ ছুয়ে যায়
একটু নীলের আভা
হাত বাড়িয়ে যেই ছুঁতে যাই
বাঁধন হারা ওই সীমানা
অমনি সেথা যায় হারিয়ে
এক নিমেষে ছড়িয়ে ধুলো
মেঘের ফাঁকে ফাঁকে
জন্ম যেথা মৃত্যু সেথা
যুগান্তরে যায়না বৃথা
সেই সীমাতে নিমেষ হারা
পাগল পারা মন।।
বন্ধু তুই
তুই-ই আমার মনের কথা,
কান্না হাসির গান
তুই -ই আমার সুজন মাঝি ,
কুহুদের কলতান
তুই- ই আমার চাঁদের আলো,
জোৎস্না মাখা প্রহর
তুই -ই আমার অতলান্ত,
অনুভূতির অবসর।
অসমাপ্ত
আমি বেসেছি ভালো ওই নীলদিগন্তের, রামধনু মাখা ওই স্বপ্নগুলোকে।
আমি বেসেছি ভালো ওই একরাশ ধুলো মাখা স্মৃতিগুলোকে,
আমি থাকতে চেয়েছি একা -
হৃদয়ের আঁকাবাঁকা
গোলক ধাঁধার ওই শুকনো গলিতে
আমি স্পষ্ট দেখেছি ওই
সেতারের সুরে বাজে
মলিন যন্ত্রণার নীরব প্রকাশ।
তাই এসেছি ফিরে আমি
তবু বারে বারে এই
জীবনের খাতায় গল্প লিখবো বলে
হয়ত থাকবো একা
দাঁড়িয়ে থাকবো তবু,
দেখবো আমায় ফেলে
এগিয়ে যাচ্ছে সব
চোখ মেলে তবু আমি
দেখবো দুচোখ ভরে
নতুন পৃথিবীটা নতুন করে।
কবিতাঃ যশমন ব্যানার্জী
উইনচেস্টার, ভার্জিনিয়া
দার্জিলিং
কুয়াশায় নির্জন বাঁকা পথ
হাজার বাঁক ঘুরে ঘুরে
জড়িয়ে ধরে ঘোলাটে সবুজ পাহাড়
ভোরে চান করে ঠান্ডা তুষার কনায়
ধোঁয়া ধোঁয়া মেঘ চোখে মুখে ছুটে আসে
কথা বলা নিশ্বাস সেই ধোঁয়াতেই শান্ত
অল্প অল্প করে বেরিয়ে আসে মানুষ বাড়ি ঘর
কেমন যেন অচেনা স্বপ্ন কেটে গেল শোরগোলে
হোল্ডঅল নিয়ে স্টেশনে গরম চা
এবার দেখব নতুন স্বপ্ন কিছুদিন
তুমিও কি বদলেছ? দার্জিলিং?
কখনও রবীন্দ্রনাথ
একটা মেটে রোদ জড়িয়ে আছে শহর
ধোঁয়ায়, শব্দে ভরে গেছে উপেক্ষিত সূর্যাস্ত
ধুঁকতে ধুঁকতে চলেছে হাজার কলেবর
এদিক থেকে ওদিক দিকভ্রানত উদ্দেশ্যহীন
অপ্রয়োজনের জীবন এখন জীবনমুখী সাজে
প্রিয়জন আর প্রয়োজন নেই ব্যস্ততায়
নিজের জন্যেই টিঁকে থাকার তাগিদে
ধুঁকতে ধুঁকতে চলেছে হাজার কলেবর
এসবের মাঝে ভুল করে চোখে পড়ে
ফুল আকাশ আর কখন রবীন্দ্রনাথ