পুজো বার্ষিকী
১৪২৭
যখন সে
ফিরে আসে
স্বরূপ ঘোষ
কলকাতা
গল্প
"অধিক জ্ঞান লাভ করা আমার মত ক্ষুদ্র মস্তিষ্কের মানুষের পক্ষে দুঃসাধ্য। অতি ক্ষুদ্র জ্ঞানের অতি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ আরোহণ করে তা সঠিকভাবে বিতরণ করা বোধহয় আরোই দুঃসাধ্য। বস্তুত জ্ঞান অর্জন ও সেই জ্ঞান সঠিকভাবে বিতরণের মধ্যে এক বিস্তর ফারাক আছে। প্রকৃতপক্ষে যিনি সঠিক জ্ঞান প্রদান করতে পারেন, তাহারই শিক্ষালাভ সম্পূর্ণ হয়েছে বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে। প্রাচীনকাল থেকে এরূপ রীতি ও ভাবনা চলে আসছে, তা শিক্ষক মহাশয়দের কাছে বহুবার শুনেছি। যদিও বহুবার এই শিক্ষিত সমাজ দ্বারাই বিজ্ঞান ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, তথাপি বিজ্ঞানের ছাত্র হয়ে এইটুকু ধারণা জন্মেছে যে সঠিক জ্ঞান অর্জনকারী ব্যক্তি দ্বারা বিজ্ঞান নামক বিষয়টির এই সমাজে একটি অনস্বীকার্য গুরুত্ব আছে। আর সেই গুরুত্বের সন্ধান করতে গিয়েই আজ যে প্রকার আনন্দের সম্মুখীন হয়েছি তা বোধ করি জীবনের সমস্ত ধ্বংসের মাঝেও এক অনাবিল চিরনতুনের ডাক।" কথাগুলো একমনে বলে থামল পবিত্র। এতক্ষণ যিনি শুনছিলেন, তিনি সুচন্দ্রিমা। পাঁচ বছর আগে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যাওয়া পবিত্রর স্ত্রী। তারই ছবির দিকে তাকিয়ে চোখ জলে ভরে উঠেছিল পবিত্রর। রাত তখন গভীর। সমগ্র পৃথিবী যেন চিরনিদ্রায় শায়িত।
পবিত্র মৌলিক, বয়স বিয়াল্লিশ। মাঝারি গড়ন, ছিমছাম, সাদামাটা, সাতে-পাঁচে না থাকা মানুষ। বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে আজ বছর পনেরো হল তিনি ভারতবর্ষের একটি বিখ্যাত গবেষণা কেন্দ্রে বিজ্ঞান চর্চায় নিযুক্ত। একটু ভুল হল। নিযুক্ত ছিলেন। কিন্তু আজ এক বছর হল সেই বিজ্ঞান সংস্থা থেকে তিনি প্রত্যাখ্যান হয়েছেন। পবিত্র নিঝঞ্ঝাট মানুষ ছিলেন। বিজ্ঞান ও স্ত্রী এই দুটো জিনিসেই তার ভালোবাসা ছিল অগাধ। পরোপকারী ও ছাত্র দরদী এই মানুষটি কোনদিন অজান্তেও কারও ক্ষতি করেছেন শুনলে অনেকেই অবাক হতে পারেন। তবুও কি এমন হয়েছিল যে তাকে একদিন বিতাড়িত হতে হল তার কর্মস্থল থেকে।
স্ত্রী মারা যাবার পর থেকেই পবিত্র বেশ একা হয়ে পড়েছিল। সময়টাই যেন থমকে গেছিল তার কাছে। কোন কাজেই মন বসতো না ঠিক করে। আর সেটা হবে নাই বা কেন বলুন। পতি-পত্নীর ভালোবাসা যেন একই আত্মারই পৃথক রূপ মাত্র। পুরুষ ও প্রকৃতির এই নিরভিমান মহাযজ্ঞের গাঁথা নিরবিছিন্ন রূপে বহমান। স্ত্রীর মৃত্যুর পরেও নিজের কাজ ও ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে সবকিছু ভুলে থাকতে চেয়েছিল সে, কিন্তু সে আর হল কই! মহাকালের অমোঘ নিয়মে সবকিছুই যেন অপ্রকাশিত। পবিত্রর গবেষণার বিষয় ছিল কোয়ান্টাম মেকানিক্স ও কোয়ান্টাম কম্পুটেশন। গবেষক হিসেবে এখনো সে সেইভাবে খ্যাতি অর্জন না করলেও, একজন ভালো শিক্ষক ও নিপাট ভালমানুষ হিসেবে তার যথেষ্ট খ্যাতি ছিল। কিন্তু সেও এক বছর আগের কথা।
হঠাৎ যদি কম্পুটার টা কথা বলে ওঠে। হঠাৎ যদি তার সচল স্ক্রিনটা বলে ওঠে 'কেমন আছো?' তাহলে কেমন হয়? তেমনি হয়েছে আজ পবিত্রর ঘরের ছোট্ট টেবিলে রাখা কম্পুটারে। কথা বলছে তার স্ত্রী সুচন্দ্রিমা। না, একথা কোন রেকর্ড করে রাখা শব্দ নয়, একথা যেন জীবন্ত, সময়ের ও ভাবের সাথে পরিবর্তনশীল দৈনিক কথাবার্তা। পবিত্রর কম্পুটার থেকে বেড়িয়ে আসছে সুচন্দ্রিমার বলা কথা। সুচন্দ্রিমার বলা নিত্যদিনের কথাগুলো প্রোগ্রামিঙের মাধ্যমে তৈরি করেছে পবিত্র। যেন জীবন্ত তার স্ত্রী। স্ত্রীর একাকীত্ব কিছুটা হলেও কাটিয়ে উঠবে সে। শুধু এইটুকু হলেও হয়তো ঠিক ছিল, কিন্তু সেইদিন পবিত্রর সামনে থাকা একটি জায়ান্ট স্ক্রিনে ভেসে উঠেছিল সুচন্দ্রিমার মুখ। না এ কোন পুরানো ছবি বা ভিডিও নয়, এ যে পবিত্রর নিজের হাতে তৈরি সুচন্দ্রিমার সচল প্রতিরূপ। মৃত্যুর পর সুচন্দ্রিমার দেহ থেকে বিকিরিত শক্তি কে পার্টিকেলের বিপরীত অ্যান্টিপার্টিকেলে রূপান্তরিত করে সেই অ্যান্টিপার্টিকেল কে উচ্চ শক্তিসম্পন্ন চৌম্বকক্ষেত্র বা ম্যাগনেটিক ফিল্ডে চালনা করে তার থেকে বিচ্ছুরিত দৃশ্যমান আলোর বর্ণালী আজ স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে। হ্যাঁ, নির্ভুল এ সুচন্দ্রিমার মুখ। ডাকছে পবিত্রকে। নিজের আবিষ্কারে নিজেই হতবাক হয়ে গেছিল পবিত্র। বিশ্বাস করতে পারেনি। সময় লেগেছিল তার সম্বিত ফিরতে। কিন্তু এখন সে রোজ কথা বলে সুচন্দ্রিমার সাথে। সুচন্দ্রিমা হারিয়ে যায়নি, সে আছে তার কাছেই।
গল্পটা এই অবধি থাকলেই বোধহয় সুন্দর হত। কিন্তু নিয়তির অস্ফুট পরিহাসে তা আর হল না। পরমাত্মার পরিকল্পনা হয়তো অন্য কিছু ছিল। তার এই আবিষ্কারের উচ্ছ্বাস সংবরণ করতে পারেনি পবিত্র। এই অভূতপূর্ব কাজের কথা সে জানিয়েছিল তার সহকর্মী প্রফেসর সেন কে। প্রথমটায় সেনবাবু বিশ্বাস করতে চায়নি পবিত্রর কথা। যতই হোক, পদমর্যাদা ও সামাজিক সম্মানে তিনি পবিত্রর থেকে অনেক উপরে। বৈজ্ঞানিক মহলেও তার প্রভাব প্রতিপত্তি কম নয়। বিদেশ থেকে পাশ করা বৈজ্ঞানিক বলে কথা। সেখানে পবিত্র কোলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি.এইচ.ডি। তাই তিনি মানবেন কেন পবিত্রর মত এক সাধারণ বিজ্ঞানীর কথা। কিন্তু পবিত্রর আবিষ্কার দেখে নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারেননি প্রফেসর সেন। প্রথম দিকে হতবাক
হলেও, পরে নিজেকে সামলে নিয়ে 'ব্রাভো' শব্দটুকু উচ্চারণ করে সেখান থেকে বিদায় নিয়েছিলেন তিনি। এই ঘটনার কিছুদিন পরেই ঐ বিজ্ঞান সংস্থা পবিত্রর বিরুদ্ধে জরুরী অবস্থা জারি করে। অভিযোগ সে নাকি কিছু নিষিদ্ধ বেসরকারি ও বিদেশী সংস্থার সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেছে এবং কিছু বৈজ্ঞানিক গবেষণার ব্লু – প্রিন্ট কম্পুটার প্রোগ্রামিঙের কোডিং এর সাহায্যে সে তাদের প্রদান করেছে। ঘটনার আকস্মিকতায় বিস্মিত হয় পবিত্র। তার উপর আগামী সাতদিনের মধ্যে তাকে এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানাতে বলা হলে, সাদামাটা আপনভোলা মানুষটি তা জানাতে ব্যর্থ হলে তাকে বরখাস্ত এবং তার বৈজ্ঞানিক কার্যকলাপের উপর সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা জারি হয়।
আজ ইকুয়েশনগুলো কিউবিটের মধ্যে দিয়ে দ্রুত সমাধান হয়ে গেছে। আগামীকালের কাজগুলোর পরিকল্পনা করে এক নতুন স্বপ্ন নিয়ে ঘুমোতে যায় পবিত্র।
"ভোর হল, দোর খোল ..." কথাগুলো শুনে চমকে উঠল পবিত্র। চায়ের কাপ হাতে সশরীরে উপস্থিত সুচন্দ্রিমা। প্রথমে ভেবেছিল সে স্বপ্ন দেখছে, কিন্তু চোখ কচলিয়ে বুঝতে পারল স্বপ্ন নয় বাস্তব। বিস্ময়ে হতবাক পবিত্র সুচন্দ্রিমাকে স্পর্শ করতে গিয়ে এক প্রবল ঝটকায় মূর্ছা গেল। যখন জ্ঞান ফিরল, দেখল সুচন্দ্রিমা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। কিছুক্ষণ লাগল পবিত্রর সেই ভ্রম কাটতে। কিন্তু পরক্ষনেই সে বুঝল এই অত্যাশ্চর্য ঘটনার কারণ। অতি উচ্চ চৌম্বকক্ষেত্র বা ম্যাগনেটিক ফিল্ডে অ্যান্টিপার্টিকেলগুলো নিজেদের সজ্জিত করে সুচন্দ্রিমার মানবী রূপ ধারণ করেছে। না, এ কোন ক্লোন নয়। এ হল অ্যান্টিপার্টিকেলের সজ্জা। পবিত্রর মূর্ছা যাবার কারণ এবং এখন সুচন্দ্রিমার স্পর্শে ঐরূপ কোন আঘাত অনুভব না হওয়ার কারণও এখন তার কাছে স্পষ্ট। উচ্চ শক্তির চৌম্বকক্ষেত্রে আবেশিত হওয়া তড়িৎ প্রবাহ এবং পরমুহূর্তে অ্যান্টিপার্টিকেলগুলোর নিজে থেকেই ঐ তড়িৎ প্রবাহকে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া, পবিত্রর আজ সকালের সমগ্র উত্তেজনার কারণ। সুচন্দ্রিমা কথা বলছে তারই তৈরি করা কথায় কিন্তু নিজের মুখে। এ এক অদ্ভুত জগৎ। এক নিরবিচ্ছিন্ন অনাবিল আনন্দ অনুভব করতে থাকে পবিত্র। আজ বহু বছর পর সেই স্পর্শ সেই অনুভূতি উপলব্ধি করল পবিত্র। এ যেন এক সমুদ্রতীরের দৃপ্ত আবাহন। জীবনের সমস্ত অসত্যের মাঝে এক সুগভীর সত্যের ছোঁয়া। কিন্তু পরমুহূর্তেই সুখ ও ভ্রমের অবসান হয় পবিত্রর। বুঝতে পারে, এ সশরীরি সুচন্দ্রিমার দেহ ধারণ করলেও তা সুচন্দ্রিমা নয় এবং এই শরীরের স্থায়িত্বও খুব বেশী দিনের নয়। কোন এক অজানা আতঙ্কে ধ্বংসের প্রহর গুনতে থাকে পবিত্র। এতদিন ঘরে থেকেও সে মানসিক ভাবে দৃঢ় ছিল। কিন্তু আজ কৃত্তিম সুচন্দ্রিমার মানবী রূপ, তার কথা বলা ইত্যাদি পবিত্রর সমস্ত প্রফুল্লতায় জল ঢেলে দিয়েছে। কোন এক সিঁদুরে মেঘের আশঙ্কায় শিউরে ওঠে সে।
দিনটা ছিল বৈশাখ মাসের কোন এক দিন। সকাল থেকে তীব্র দাবদাহের শেষে অপরাহ্ণের কালবৈশাখী। অঝোর ধারায় বৃষ্টি হয়ে চলেছে, সাথে ঝড় ও বজ্রপাতের উচ্চ কণ্ঠের গীত যেন সমগ্র প্রকৃতির বুকে প্রলয় নৃত্য করছে। সুচন্দ্রিমা বিকেলের চা করে এনে দিয়েছে পবিত্রকে। একটা নিয়মিত আলেখ্যের মত আবার সবকিছু ভুলে পবিত্র যেন এক নতুন জীবনের স্বাদ পেয়েছে। সুচন্দ্রিমার টানে সে যেন ভুলে গেছে বাস্তব ও রূপকথার দ্বন্দ্বকে, ভুলে গেছে তার সেই দুঃসাধ্য কালজয়ী আবিষ্কারকে। ভুলে গেছে সে তার পূর্বপরিচিত মানুষগুলোকে। কৃত্রিম সুচন্দ্রিমা তার মস্তিষ্কে যেন এক নতুন জীবনের, নতুন সময়ের রূপরেখা রচনা করে দিয়েছে। যার গন্তব্য যেন তারই অন্তিম যাত্রাপথে সমর্পিত।
রাত তখন দশটা বেজে দশ। বৃষ্টি থেমে গেছে। গাছের পাতা গুলো দিয়ে টুপটুপ করে জল পড়ছে। সবুজ পাতা গুলো জলে ভিজে আরও সবুজ হয়ে গেছে। হঠাৎ কলিং বেলটা বেজে উঠল। প্রকৃতির এই নৈসর্গিক সৌন্দর্যের মায়া কাটিয়ে চেতনা ফিরল পবিত্রর। আজ বহুদিন হল ওদের কাছে কেউ আসে না। সুচন্দ্রিমা আর ও, এই দুজনের একান্ত আপন পৃথিবী। তাই কলিং বেলের শব্দ এবং বিশেষত: ঘড়ির কাঁটার অবস্থান আরও কিছুটা বিস্মিত করল তাকে। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে দরজাটা খুলে দেয় পবিত্র। দরজার ও প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটিকে দেখে হাড় হিম হয়ে যায় তার। দরজার ওপাড়ে উষ্কখুষ্ক চুলে দাঁড়িয়ে আছে সুচন্দ্রিমা। তার রক্তাভ চোখ দুটো যেন শোণিত করছে পবিত্রকে। ঘরে থাকা সুচন্দ্রিমা ততক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে পবিত্রর পিছনে। হাতে তার রাতের খাবার। দুই মানবীর মুখেই এবার ফুটে উঠল হাসি। এগিয়ে আসতে থাকে দুজন দুজনের দিকে। ওদের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা পবিত্রর বাহ্যজ্ঞান লোপ পায়। দুই সুচন্দ্রিমা দুজনের কাছে পৌঁছতেই এক ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে গোটা বাড়ি। ছিটকে পড়ে যায় পবিত্র। ঘোলাটে দৃষ্টিতেও সে দেখতে পায় সেই ভয়ঙ্কর প্রলয়ের দৃশ্য এবং একই সাথে কানে ভেসে আসে এক তীব্র ভৎসনা ও বিদ্রূপের হাসি। প্রফেসর সেন হেসে চলেছেন এক পৈশাচিক হাসি। প্রাণের শেষ স্পন্দনেও পবিত্র শুনতে পায় কোথায় যেন বেজে চলেছে - "আমার যাবার সময় হল, আমায় কেন রাখিস ধরে। ................."
গল্প
ক্যামেলিয়া
চৈতালী সরকার
কলকাতা
ভারতের উত্তরে হিমালয় পর্বত। হিমালয়ের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্ট। এর উচ্চতা ৮৮৪৮ মিটার।' হেলেদুলে বই পড়ছে রিঙ্কা। এইবার কিছুতেই কম পেলে চলবে না। মা বলেছে, 'একশোর মধ্যে নব্বই কোনো নম্বরই নয়।' আরও আরও ছুটতে হবে। ট্রাকের পেছনে সবাইকে ফেলে শুধু ছোটা!
পিছনে কখন তন্বী এসে দাঁড়িয়েছে, সেদিকে না তাকিয়ে রিঙ্কা পড়ে চলে ভূগোলের ভূপ্রকৃতি। তন্বী মুখে বিকট আওয়াজ করতেই চমকে ওঠল রিঙ্কা।
নিজের বুকের কাছটা চেপে ধরে বলল, 'ভয় দেখাছিস কেন?'
'আর কত পড়বি? চল না একটু খেলা করি। ছাদে কিংবা আমাদের বাড়ি!' তন্বী কথাগুলো বেশ আস্তে আস্তে বলল। রিঙ্কার মা শুনলে আর রক্ষে নেই। একেবারে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার, না না রয়্যাল বেঙ্গল টাইগ্রেস বলে ডাকে রিঙ্কার মাকে ওর বন্ধুরা।
একবার রিঙ্কার হরিণ চোখ চারিধার দেখে নিল।
মা বোধহয় দুপুরে ভাত ঘুম দিচ্ছে। এইসময় একটু খেলা যেতেই পারে। একটা উষ্ণ ঢেউ খেলে গেল বুকের মধ্যে। তারপর বেরিয়ে পড়ল দুজনে।
ভরদুপুরে রাস্তায় লোকজন বেশি নেই। একজন ফেরিওয়ালা সাইকেল করে প্লাস্টিকের বালতি, মগ বিক্রি করছে। এরা জামাকাপড়ের বিনিময়ে জিনিষ দেয়। কিছুদিন আগে রিঙ্কার মা দুটো পুরোনো কাপড়ে জোরজবরদস্তি করে একজোড়া বালতি নিয়েছিল।
রিঙ্কা জানে, মাকে কেউ ঠকাতে পারবে না।
মায়ের কথা মনে পড়তে বুকটা কেমন কেঁপে উঠল রিঙ্কার। এইভাবে চলে আসা তবে কি ঠিক হয়নি!
'দ্যাখ কেমন হনুমানটা কলা খাচ্ছে। আবার আমাদের দিকে তাকিয়ে মুখ ভেংচি করল। ' তন্বী আঙুল তুলে দেখাল রিঙ্কাকে। রিঙ্কা ভয়ে তন্বীর হাত চেপে বলল,' যদি কামড়ে দেয়? 'দূর বোকা, দেখছিস না ও কেমন কলা খাচ্ছে। কি সুন্দর একটা বাচ্চা দেখেছিস?' হনুমানের বাচ্চাটা হনুমানের গা ছুঁয়ে বসে আছে। নিশ্চয় ও মা হনুমান। কলার খোসা ছাড়িয়ে বাচ্চাটাকে দিচ্ছে।মায়েরা এরকমই হয়।
একবার রিঙ্কার মনে আছে মায়ের হাত থেকে একটা হনুমান কিভাবে বাঁধাকপি নিয়ে গিয়েছিল, মা একটুও ভয় পায় নি। পরে এর প্রতিশোধ নিতে অন্য একটা হনুমানকে লাঠির ঘা পর্যন্ত মেরেছিল।
কেন বারবার মায়ের কথা মনে পড়ছে রিঙ্কার! তবে কি না বলে আসাটা সত্যিই অন্যায় হয়েছে। এই প্রথমবার মাকে না বলে রিঙ্কা এতোটা পথ এসেছে।
তন্বীর বাড়ি থেকে রিঙ্কার বাড়ি যেতে হেঁটে দশ মিনিট লাগে। তন্বীর একা চলার অভ্যেস আছে। ইংরেজি পড়তে তন্বীকে অনেক দূর যেতে হয়। প্রথমবার তন্বীর মা সঙ্গে গিয়েছিল। তারপর থেকে তন্বী একাই যায়।
পিঠে বস্তা নিয়ে মাঝবয়সী একটা লোক ওদের দিকে আসছে। লোকটির দৃষ্টি রাস্তার দুধারে নোংরা আবর্জনার দিকে। রিঙ্কা ভাবল ও নিশ্চয় ছেলেধরা। রিঙ্কা শুনেছে নির্জন পথে এইরকম ছেলেধরা বস্তা নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। একা ছোটো ছেলেমেয়েদের ধরে নিয়ে যায়। তারপর হাতপা কেটে দিয়ে পঙ্গু করে মেলায় মেলায় ভিক্ষা করতে বসিয়ে দেয়। রিঙ্কা, তন্বীর বয়স কতই হবে! সবে দশ পেরিয়েছে, সেই হিসেবে ওরাও বেশ ছোটো। যদি ওদের ধরে নিয়ে যায়।
ঐ তো ছেলেধরাটা রিঙ্কাদের দিকে আসছে। রিঙ্কার স্থির বিশ্বাস এক্ষুনি ওদের বস্তায় পুড়বে। তারপর নির্ঘাত ভিক্ষা করতে হবে। রিঙ্কার বেশ ভয় ভয় করছে। এদিকে তন্বীর কোনো হেলদোল নেই। এইরকম বস্তা কাঁধে লোক ও প্রায়ই দেখে। রিঙ্কাকে অন্যমনস্ক দেখে তন্বী বলল, 'তাড়াতাড়ি চল। অনেক খেলব।'
একটু এগোতেই দেখল ছেলেধরা লোকটা পাশের গলিতে চলে গেল। এবার বেশ নিশ্চিন্ত লাগছে রিঙ্কার।
খবরের কাগজে আজকাল বড্ড একঘেয়ে খবর বেরোয়। রাজনীতির তর্জা না হয় বিজ্ঞাপনে ভরে থাকে পাতার পর পাতা। তবু দুপুরবেলা কাজ সেরে কাগজে মুখ গুঁজে পড়ে থাকে মৈত্রেয়ী। পাশে মোবাইলে চলতে থাকে মিষ্টি রবীন্দ্রসঙ্গীত। মৈত্রেয়ী কখনো গুন গুন করে ওঠে। শ্যামল এইসময় অফিসে থাকে। বেশিরভাগ ভাগ দিন বেশ রাত করে ফেরে।
বিয়ের প্রথম প্রথম অভিমান হত মৈত্রেয়ীর। তন্বী আসার পর সেসব কেটে গেছে। ছোটোবেলায় তন্বীকে অনেকটা সময় দিতে হত। কিন্তু বড়ো হওয়ার সাথে সাথে তন্বী বেশ স্বাবলম্বী হয়ে উঠছে। এখন নিজের সব কাজ একা করে। স্কুল, প্রাইভেট টিউশনি সব জায়গায় একাই যেতে পারে। মাঝে মাঝে মৈত্রেয়ীর চিন্তা হয়।
মফঃস্বল শহরে গাড়ি অনেক বেড়ে গেছে। রাস্তাঘাটও আর আগের মতো সেফ নয়। গোলাপ, লাল, হলুদ গোলাপী, সাদা। রিঙ্কা এতো ফুল দেখে অবাক হয়ে বলল, 'এত গাছ কে লাগিয়েছে? কি সুন্দর লাগছে।' তণ্বী রিঙ্কাকে সব দেখাতে দেখাতে বলল, 'সব মা লাগিয়েছে। মা রোজ জল দেয়। সার দেয়। আরও কত কি!'
হঠাৎ একটা গাছে চোখ পড়ল রিঙ্কার। এই ফুলগুলো কখনও দেখেনি রিঙ্কা। তণ্বীর কাছে জানতে পারল, ফুলের নাম ক্যামেলিয়া। এগুলোকে শীতের গোলাপ বলে, খুব যত্ন করতে হয়।
রিঙ্কা ভাবে, ওদের বাড়ির ছাদ তো আরো বড়। একটা ফুলবাগান করা যেতেই পারত! মায়ের ওপর খুব রাগ হল, কেন যে গাছ লাগায় না!
রিঙ্কা অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ দেখে তণ্বীর মা এক প্লেট পাপড় নিয়ে কখন পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন। রিঙ্কা অবাক চোখে দেখল তণ্বীর মাকে। কি সুন্দর দেখতে! ক্যালেন্ডলারের দুর্গা ঠাকুরের মতো। রিঙ্কার মনে হল তণ্বীর থেকেও ওর মা সুন্দর। আচ্ছা উনি কি করে জানলেন ও পাপড় খেতে ভালোবাসে। মায়েরা কি সব কথা জানে! কই ওর মা তো বোঝে না। ওর পড়তে না ইচ্ছে করলেও মা কেমন জোর করে পড়ায়। খেলতে চাইলে বলে এখন খেলা নয়।
রিঙ্কার তো মন চায় এক্কা দোক্কা খেলতে, তণ্বীর মতো রাস্তা চিনে বাড়ি ফিরতে। একদম একা একা!
'কি এতো ভাবছ রিঙ্কা? 'তণ্বীর মা খুব কাছে এসে আদর সুরে বললেন। কতদিন তণ্বী বলেছে তোমাকে এখানে আনবে। ও তো তোমাদের বাড়ি কতবার গেছে। ভালোই হল তোমরা অনেক খেলা করতে পারবে। এবার থেকে মাঝে মাঝে চলে আসবে কেমন?
কি মিষ্টি করে কথা বলছেন তণ্বীর মা। মনে হয় সব কথা শুনি। রিঙ্কার মনে পড়ল, একবার তণ্বীর সাথে ওর মা খুব খারাপ ব্যবহার করেছিল। মায়ের ধারণা তণ্বীর জন্যই নাকি রিঙ্কা এবার ফার্স্ট হতে পারেনি। ইস তণ্বীর মায়ের মতো ওর মা যদি হতো!
আফশোসের তীর বুকে এসে বিঁধল। সেপটিপিনের খোঁচার মতো কষ্টটা চেপে নিল রিঙ্কা।
খেলতে খেলতে বিকেল হয়ে গেল। রিঙ্কা বাড়ি যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠল। কেন যে তণ্বীর ফিরতে দেরী হচ্ছে? রিঙ্কাকে ছাদে রেখে তণ্বী তো অনেকক্ষণ ঘরে গেছে। মা ঘুম থেকে উঠে ওকে না দেখে নিশ্চয় খুব চেঁচামেচি করছে! মা রেগে গেলে তো কুরুক্ষেত্র কান্ড করে। কুুরুক্ষেত্রের সঙ্গে মায়ের রাগ কতটা মেলে রিঙ্কা বোঝে না। তবে বাবা প্রায়ই এই কথাটা বলেন।
না আর ধৈর্য রাখতে পারছে না রিঙ্কা। একবার ঘরে গিয়ে দেখবে! ঘরের কাছে যেতেই বেরিয়ে এল তণ্বী। 'এতো দেরী হল কেন, এবার আমাকে বাড়ি যেতে হবে।' রিঙ্কা উদ্বেগের সঙ্গে বলল। আজ নির্ঘাত পিঠে মার পড়বে। মনে মনে নিজেকে কিছুটা গুছিয়ে নিল রিঙ্কা। কথার কোনো তল পাচ্ছে না। সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে! বাড়ির যত কাছে আসছে তত ভয় বাড়তে লাগল। রিঙ্কা ঠিক করল আর কোনো দিন না বলে কোথাও যাবে না।
বাড়ির সামনে এসে তণ্বী বলল, 'আমি বাড়ি গেলাম। তোর মা যা রাগী নিশ্চয় আমাকেও পেটাবেন।' কথা শেষ না হতেই চড়ুই পাখির মতো পালিয়ে গেল তণ্বী। এবার রণাঙ্গনে একা রিঙ্কা।
বেল বাজাতেই রিঙ্কার বাবা দরজা খুলে দিলেন। রিঙ্কা চুপি চুপি ঘরে ডুকে দেখে, মা বিছানায় শুয়ে আছে। মা তো কখনই শুয়ে থাকে না। আর এত তাড়াতাড়ি বাবাও তো বাড়ি ফেরেন না। রিঙ্কার বেশ ভয় করছে। বাবা ফোনে কার সাথে যেন কথা বলছেন। ডাক্তার মনে হল। কেন? মার কি শরীর খারাপ। কই দুপুরে তো ঠিক ছিল। মনের মধ্যে নানা কথা উঁকি মারছে, কাউকে বলতে পারছে না রিঙ্কা। বাবা কেন এতো গম্ভীর? কই ওকে তো কিছুই বললেন না। মনে হচ্ছে না বলে বাড়ির থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা বাবা জানেন না। একটু ভয়ে ভয়ে রিঙ্কা মায়ের কাছে দাঁড়াল। তখন ভেতরটা তোলপাড় করছে।
'প্রেশার থেকেই অজ্ঞান হয়েছেন মনে হয়। হঠাৎ প্রেশার নেমে গেছে আর কি। টেনশন করবেন না। ভয়ের কিছু নেই।' ডাক্তারী ভঙ্গিতে বেশ গম্ভীর গলায় ডাক্তারবাবু বলে চললেন।বাবা রিঙ্কার কাছে এসে আস্তে আস্তে বললেন, 'তুই কোথায় ছিলি? ভাগ্যিস বাণ্টির মা আমার অফিসে ফোন করেছিলেন!' রিঙ্কা কোনো কথা না বলে মায়ের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইল।চোখ বুজে আছে মা। আজ মাকে সবচেয়ে সুন্দর লাগছে। ঠিক ক্যামেলিয়া ফুলের মতো। রিঙ্কা এই প্রথম অনুভব করল ওর মা সবচেয়ে সুন্দর, সবার থেকে ভালো। রিঙ্কার চোখ জলে ভরে এল।
কিছুক্ষণ পরে রিঙ্কার মা চোখ খুললেন। রিঙ্কাকে দেখে তাঁর চোখদুটো চিকচিক করে উঠল। সেই চোখে কোনো রাগ নেই। আছে গভীর ভালোবাসা, উৎকণ্ঠা। রিঙ্কা মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, 'আর কক্ষনও তোমাকে না বলে কোত্থাও যাবো না।'
মা রিঙ্কার মাথায় ছোট্ট একটা চুমু খেলেন। মা মেয়ের সম্পর্ক স্নিগ্ধ ঢেউয়ের মতো ছড়িয়ে পড়ল বিছানায় ..... বাড়িময়।
গল্প
মাতৃজা
অধীর সিনহা
ডায়মন্ড সিটি, যশোর রোড, কলকাতা
ইউ এস এ থেকে মিঃ আর মিসেস স্মিথ কাল রাতেই এসে উঠেছেন হায়াতে। ডাঃ অরুনা মিত্র তাদের জন্য হোটেলের লাউনজে অপেক্ষা করছিলেন। তাঁরা আসতেই ম্যাডাম উঠে দাঁড়িয়ে হ্যান্ডশেক করলেন ‘ওয়েলকাম টু কলকাতা, আই এম ডাঃ অরুনা মিত্র, ম্যানেজিং ডাইরেক্টর অফ আই ভি এফ ফার্টিলিটি ক্লিনিক।’
‘গ্লাড টু মিট ইউ, উই আর ডিলাইটেড টু বি ইন কোলকাতা।’
‘ফর সারোগেট মাদার উ হ্যাভ সিলেক্টেড কোলকাতা ওভার গুজরাট এন্ড মুম্বাই, থ্যাং উ ফর ইয়োর সাপোর্ট।’
‘উ আর মোস্ট ওয়েলকাম, দা রিজন ইজ লেডিজ হিয়ার আর ন্যাচারালি বিউটিফুল।’ মিসেস স্মিথ হাসি মুখে উত্তর দিলেন। ম্যাডাম মিত্র মনে মনে জানেন যে কলকাতা পছন্দের আর একটা বড় কারণ খরচ; গুজরাট আর মুম্বাই থেকে অনেক কম খরচে এখানে সারোগেট পাওয়া যায় আর পাবলিসিটি কম হওয়ার জন্যে লোক জানাজানি বেশি হয়না।
তাদের নিয়ে ম্যাডাম হোটেল থেকে সোজা তার ক্লিনিকের অবব্জারভেশন রুমে নিয়ে এলেন। সেখানে ওয়ান ওয়ে ভিউ কাঁচের জানলা, রত্না উদ্বিগ্ন চিত্তে বসে উল্টো দিকে।
ডাঃ মিত্র বললেন, ‘দেয়ার ইজ ইউর সারোগেট, বেঙ্গলি লেডি ইন হার ফরটিজ, সিটিং ইন আ ব্লু সাড়ি।
শি উইল বি সারোগেট ফর ইউর চাইল্ড।’ স্মিথ দম্পতি খুশি হলেন রত্না কে দেখে।
‘উই হোপ শি উইল বি আ ভেরি গুড মাদার অফ প্রেশাস চাইল্ড। ইউ মে নট বি নোইং হাউ ডিপ্রেশড উই ওয়ার হয়েন মাই ওয়াইফ ক্যান্ট কন্সিভ, সো উই আর ভেরি ইগার টু হাব আওয়ার চাইল্ড, হি উইল ইনহেরিট আস।’
‘সো নাইস,ইউ উইল গেট দ্য কন্ট্রাক্ট এন্ড আ ডোসিয়ার অন হুইচ উ উইল গেট আল ইনফরমেশনস, ফটো অফ সারোগেট। ’ম্যাডাম মিত্র তাদের বোঝালেন। তিরিশ হাজার ডলারে চুক্তি হল, শর্ত অনুযায়ী পনেরো হাজার ডলার পেমেন্ট নিলেন ম্যাডাম মিত্র।
কিছুক্ষণ পরে ম্যাডাম রত্নাকে ডেকে পাঠালেন। রত্না কেবিনে আসতেই ম্যাডাম রত্নাকে বললেন, ‘রত্না কংগ্রাচুলেশনস, তোমাকে ওদের পছন্দ হয়েছে। দি ডিল ইজ অন। কি খাবে বলো? ইউ ডির্জাভ এ ট্রিট, আর কাল এসে কাগজপত্রে সাইন করে দু লাখ টাকার চেক নিয়ে যেও। ইন ফাক্ট ইউ আর আ গোল্ড মাইন। পেট ভাড়া দিয়ে পেট ভরিয়ে যাও।’ রত্নাকে বসিয়ে ম্যাডাম ভরপেট খাওয়ালেন আর দুপ্যাকেট ভর্তি খাবার নিখিল আর শুভর জন্যে দিলেন।
রত্না ম্যাডামকে প্রণাম করলো। খুশির আনন্দে রত্না যখনই উচ্ছল হয়ে উঠছে তক্ষুনি একটা অজানা ভয় তার মনের মধ্যে উঁকি মারতে থাকে, তাকে মা হতে হবে এক অজানা উপায়ে— আর প্রসবের পর শিশুর ওপর কোন তার অধিকার থাকবে না।
‘কি হয়েছে রত্না? তোমাকে এরকম লাগছে কেন? হাতে কিসের প্যাকেট?’ নিখিল ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল।
‘ওরা আমাকে পছন্দ করে নিয়েছে, আর ম্যাডাম দু লাখের চেক দিয়েছে! আমাদের খাওয়া থাকার জন্য আর কোন চিন্তা নেই।’
‘কারা?’নিখিল ঠিক বুঝতে পারেনি।
‘ঐ যে ম্যাডামের আমেরিকার লোকজন।’
‘তুমি এখন নার্সিংহোম থেকে এলে?’
‘হ্যাঁ ম্যাডাম ডেকেছিল, এই সব খাবার আর চেক দিয়েছে।’ রত্না খুব আনন্দের সাথে বললেও কি রকম একটা ভয়ের ছায়া নিখিল দেখতে পেল।
‘এ সব কথা তো অনেক দিন থেকে কথা হচ্ছে। তা তোমাকে এরকম কেন লাগছে?’
‘আমার ভীষণ ভয় করছে, আমি আবার মা হবো। আমি পারবো?’ রত্নাকে খুব অসহায় লাগল।
‘কেন পারবে না, ম্যাডাম যখন সব ব্যবস্থা করছেন তিনি নিশ্চয়ই সব দিক ভেবেই করছেন। কাল আমি আরও জেনে নেব। তুমি ভয় করো না, তোমাকে যে পারতেই হবে। শুভর কথা, আমাদের সংসারের কথা ভেবে; কতো টাকা পাওয়া যাবে। আমি গার্ডের কাজ ছেড়ে ছোট্ট একটা ব্যবসা করবো, শুভকে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করবো আর একটা টিভি কিনবো। তোমাকে আর বাড়ি বাড়ি কাজ করতে হবে না।’
রত্না নিখিলের হাতটা চেপে ধরল, ‘টাকার লোভে আমরা ভুল বা খারাপ কিছু করতে যাচ্ছি না তো?আর দশ মাস পেটে ধরার পর, যে আসবে তাকে চিরদিনের জন্য আর দেখতে পাব না।’
‘ম্যাডাম তো বললেন ভারতের অন্য জায়গায়ও তো এইরকম অনেকেই করছে, আসলে ওরা তোমার পেটটা ভাড়া নেবে। এই আমরা যেমন ভাড়া বাড়িতে থাকি।’
নার্সিং হোমে ডঃ মিত্র নিজে রত্নার জঠরে আই ভি এফ পদ্ধতির মাধ্যমে মিঃ আর মিসেস স্মিথের স্পার্ম ইনসার্ট করলেন। দেখতে দেখতে সাত মাস কেটে গেল। মাতৃত্বের সব লক্ষণ রত্নার দেহে ফুটে উঠল। তলপেটের উঁচু ভাব আর উজ্জ্বল মুখে এ যেন আর এক রত্না। রাত্রে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে সে পেটে হাত দিয়ে বোঝার চেষ্টা করতো ভিতরের ছটপটানি।গুণ গুণ করে গান গাইত তখন রত্না। ভিতরের ছট পটানি ধীরে ধীরে কম হয়ে আসত। যে দিন গানের পরেও ছটপ্টানি বন্ধ হোত না,সেদিন রত্না ছড়া শোনাত।
ওদিকে ম্যাডামের নির্দেশ আট মাস থেকে রত্নাকে নার্সিং হোমে থাকতে হবে।
ম্যাডাম এম্বুল্যান্স পাঠীয়ে রত্নাকে নার্সিং হোমে ভর্তি করে দিলেন। মিঃ স্মিথ বার বার ফোন করছেন তারা ইণ্ডিয়ায় কবে আসবেন? রত্নার শারীরিক অবস্থা এক জন আদর্শ মায়ের মতো, তাই সব দিক দেখে ম্যাডাম ন্যাচারাল ডেলিভারির কথাই ভাবলেন এবং সেই মতো স্মিথ পরিবারকে আসতে বলা হল।
দশ মাসের মাথায় রত্না একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দিলেন। প্রসবের পর রত্নার মনে হতো তার চারিদিকে কেমন যেন খালি খালি ভাব। দেহে, মনে চারিদিকে যেন একটা শুন্যতা তাকে ঘিরে রেখেছে। যে আত্মা এতো দিন তার আত্মার অঙ্গ ছিল, সে আজ তার আত্মাকে পরিত্যাগ করে কোন দূর দেশে পাড়ি দিয়েছে। ওকে যদি একবার তাকে কোলের মধ্যে দেয় তাহলে প্রাণ ভরে তাকে বুকের দুধ দেবে। কিন্তু অনেকবার বলেও কেউ শোনেনি। চুক্তি মতো রত্নার আর কোন অধিকার নেই তার উপর। সাত দিন পরেই রত্নাকে নার্সিং হোম থেকে ছেড়ে দিলো।
অটো থেকে যখন নিখিল রত্নাকে নিয়ে নামলো তখন বেশি বেলা হয়নি আর রবিবার থাকার জন্যে রাস্তা মোটামুটি ফাঁকাই ছিল।শুভো ছুটে এল, ‘মা বোনু কই?’
‘না বাবা, বোনকে এখন আনা যাবেনা। ওকে হাসপাতালে রেখেছে।’
‘ভ্যাগিস ওর ছবি তুলে নিয়েছিলাম - কবে আসবে?’ শরীরটা বেশ খারাপ লাগছিলো রত্নার। কিছু বলার আগেই নিখিল একটু ধমকের সুরে শুভোকে বলল, ‘শুভ তুমি এখন বড়ো হয়েছো, দেখছ তো মার শরীর ভালো নেই। পরে তুমি সব জানবে। এখন মাকে নিয়ে ভেতরে যাও আমি অটোর ভাড়া দিয়ে, ওষুধ নিয়ে আসছি।’
দশ বছর পর চিকাগো শহরে স্মিথ দম্পতির বাসস্থান;
‘শি টকস ইন হার স্লিপ এন্ড স্পিকস এ ডিফারেন্ট লাঙ্গোয়েজ।’ সাইক্রিয়াটিকরা অনেক চিন্তা ভাবনা করে বুঝতে পারল না এঞ্জেল ঘুমের ঘোরে ভাঙ্গা ভাঙ্গা কি ভাষায় কথা বলে। কি করে তারাই বা বুঝবে, মাতৃজঠরে থাকার সময় সে বাংলা ভাষা শুনে পৃথিবীতে আসার জন্য তৈরি হয়েছিল। এঞ্জেল নিজেও বুঝে পেত না ঘুমের মধ্যে মাঝে মধ্যে সে যেন এক অজনা জগতে চলে যায় আর হালকা সুরে গান শুনতে পায়।
‘মম ক্যান আই কল ইউ মা?’ ‘মা? ওহ নাইস - ইফ দ্যাট সুটস ইউ, মে কল মি মা।’ সেদিন হটাৎ এঞ্জেল হাতে পেল কলকাতার আই ভি ফার্টিলিটি হাসপাতালের ফাইল, যাতে লেখা সারোগেট মাদার রত্না দাস, ওয়াইফ অফ নিখিল দাস, ডেলিভারড এক গার্ল চাইল্ড অ্যাট কোলকাতা অন থার্ড ফেবরুইয়ারী ২০০০। ভেতরে এক মহিলার আলাদা ছবি, তার মা বাবার ছবি-তাদের কোলে একটি শিশু। বারবার জিজ্ঞাসা করেও এঞ্জেল মম বা ড্যাড কারো কাছ থেকেই কোন সদউত্তর পেল না এই বিষয়ে। প্রতি বছর থার্ড ফেব ঘটা করে তার জন্মদিন হয়, কেক কাটা হয় — আর সেই দিনে মম ড্যাড কলকাতা - ইন্ডিয়াতে কাকে কোলে ছবি তুলেছিল। তবে ছবির ওই ছোট্ট শিশু কি সে নিজে? কে আর এক জন মহিলা? এঞ্জেল হাই স্কুল পাস করল - সে এখন বিশ বছরের তরুণী। কিন্তু কোলকাতার অজানা মহিলার ছবি, বাচ্চা কোলে তার নিজের মা বাবার স্মৃতি সে ভুলতে পারেনি। মাঝে মাঝেই ঘুমের মধ্যে সে মা মা বলে ডাকে। ডাক্তারের নির্দেশে মিঃ আর মিসেস স্মিথ বাধ্য হলেন এঞ্জেলকে তার জন্ম কাহিনী বলতে। সব শোনার পর এঞ্জেল বলল, ‘মম আই ওয়ান্ট টু মিট মাই সারোগেট মম।’
‘হোয়াই? শি হাজ নো রাইট ওভার ইউ এজ পার কনট্রাক্ট।’ ‘মম আই এম হোপফুলি নট পার্ট অফ কনট্রাকট? আই শুড মিট মাই মা।’ মেয়ের কথা শুনে মিসেস স্মিথ হ্যাঁ, না কিছু বলতে পারলেন না। ‘শুধু বললেন আস্ক ইউর ড্যাড।’ মিঃ স্মিথ মেয়েকে খুব বোঝালেন ,‘ইটস অ্যা পুওর কান্ট্রি এন্ড সিটি — দ্যা লেডি মে নট বি স্টিল এলাইভ।’ শেষ চেষ্টা করলেন এঞ্জেলের ডি এন এ রিপোর্ট দেখিয়ে। তিনি দেখালেন সেখানে স্পষ্ট করে লেখা আছে এঞ্জেল স্মিথের ডি এন এ চেনে কেবল দুটি সুতো আছে, একটি মিঃ স্মিথের আর অন্যটি মিসেস স্মিথের। এঞ্জেল উত্তর দিল ‘মাই মম ইজ মাই
বাইওলজিক্যাল মাদার —হোয়ার আজ দ্যা আননোন লেডি বোর মি ফর টেন মান্থস এন্ড স মি দ্যা লাইট অফ দ্যা ডে, ইজ মাই মা। আই মাষ্ট মিট মাই মা।’ ‘ইউ লুজ রাইট ওভার আওয়ার প্রর্পাটি ইফ ইউ গো টু ইন্ডিয়া’
‘আই ডোন্ট কেয়ার, বাই ড্যাড।’
এঞ্জেল চিকাগোতে বিবেকান্দ মিশনে গেল, সে শুনেছে দ্যা গ্রেট সেণ্ট ওয়াজ বর্ন ইন কোলকাতা। স্বামীজির তাকে সানন্দে তাদের মিশনের সদস্য করে নিলেন। স্বামীজির কাছ থেকে, আর লাইব্রেরি থেকে বই পড়ে এঞ্জেল ভারত,কলকাতা আর স্বামী বিবেকানন্দ সম্বন্ধে অনেক কিছু জানতে পারল। বাংলা ভাষা এখানে এসে অনেক শিখে গেল অঞ্জলি - এখন সে বাংলায় বই পড়া শুরু করল। এঞ্জেলের মনের কালো কুয়াশা আলোর রোশনাইয়ে ঝল মল করে উঠল। স্বামীজি তাকে নতুন নামে দীক্ষিত করলেন, “অঞ্জলি”। ইন্ডিয়া যাবার সুযোগ এসে গেল, আমফান ঘূর্ণি ঝড়ে বিধ্বস্ত অঞ্চলে ত্রাণ শিবিরে কাজ করার জন্য অঞ্জলি ভারত সেবাশ্রমের হয়ে সেখানে গেল। দিল্লি হয়ে কলকাতায় পৌঁছল অঞ্জলি, সেখান থেকে সঙ্ঘের জিপে বাসন্তী পৌঁছল - মুল ত্রাণ শিবির সেখানেই চলছিল। দুর্গাপুজার আর বেশি দেরী নেই; ত্রাণ শিবিরের কাজ কমে আসতেই অঞ্জলি বেলুড়ে স্বামী নিত্যানন্দ মহারাজের সঙ্গে দেখা করতে গেল পরবর্তী এসাইনমেণ্টের জন্য। অবশ্য কিছু দিনের ছুটি নেবার খুব ইচ্ছে ছিলো। মহারাজ তার মনের কথা বুঝে তাকে আগে থেকেই দু সপ্তাহের ছুটি মঞ্জুর করে রেখেছিলেন। ‘থ্যাঙ্ক ইউ স্বামীজি আই অয়ান্ট টু ট্রেস মাই বার্থ মাদার এন্ড স্পেন্ড হলিডে উইথ মাই মা। আমায় যিনি জন্ম দিয়েছেন তাকে যেন খুঁজে পাই এই আর্শিবাদ করুন।’ ‘নিশ্চিই মা, জগজনণী মা আসছেন, তিনি তো বিশ্বাত্মা। তার ভেতর থেকে তুমি যার আত্মজা তাকে তিনি নিশ্চই তোমার কাছে ফিরিয়ে দেবেন। ইউ উইল গেট দ্যা ব্লেসিংস অফ উনিভারসাল মাদার — গডেস দুর্গা।’ অঞ্জলি স্বামীজিকে প্রণাম করে কিছুক্ষণের মধ্যেই তার ব্যাগ গুছিয়ে রওনা দিল।
এঞ্জেল প্রথমে আই ভি এফ ফার্টালিটি ক্লিনিকে পৌঁছল। অনেক চেষ্টার পর ম্যাডাম অরুনার সঙ্গে দেখা করতে পারল।
‘সো ইউ আর এঞ্জেল স্মিথ? হোয়াই অন আর্থ, কেন তুমি তোমার কেনা মায়ের খোঁজ করছ? ইন ফাকট, মিঃ স্মিথ ফোন করছিলেন, আমরা যেন তোমাকে তোমার সারোগেট মাদারের এড্রেস না দি।’ এঞ্জেল ম্যাডামের হাত ধরে অনুরোধ করল,‘ম্যাডাম, হ্যাভ পিটি অন মি — দয়া করে আমার গর্ভ ধারিণী মায়ের সঙ্গে আমায় মিলিয়ে দেন।’
অঞ্জলির চোখ ভিজে উঠল,অরুনা ম্যাডাম বললেন, ‘যত দুর মনে পরে তোমাকে ফেরত পাওয়ার জন্য তোমার মা বেশ কিছুদিন এখানে এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকত আর আমকে বলত মেয়েকে ফিরিয়ে দেবার জন্য। কিছুতেই বিশ্বাস করত না যে তোমাকে নিয়ে তোমার বাবা মা আমেরিকায় চলে গেছে। এনি ওয়ে আমি এক কাজ করছি, এজ আই কান্ট রিভিল হার এড্রেস, আমি তোমার বাবা, কি যেন নাম – হিয়ার ইট ইজ, নিখিল দাসকে ফোন করছি। জানিনা এতদিন বাদে এই নাম্বার কাজ করবে কিনা।’ সৌভাগ্য বসতঃ ফোনে নিখিল কে পাওয়া গেল এবং কিছুক্ষণের মধ্যে সে এল।
‘ম্যাডাম কেন ডাকলেন এতদিন পর?’
‘মিঃ দাস, দেখ এনাকে চিনতে পার?’ নিখিল অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকল-মনের কোনে হাতড়ে হাতড়ে সুদুর অতীতের হদিস পেতে চেষ্টা করল।
‘বাবা আমি অঞ্জলি স্মিথ, মিঃ আর মিসেস স্মিথের মেয়ে। আমি কলকাতায় আমার মায়ের পেটে জন্মেছিলাম।’ অঞ্জলি বাবাকে প্রণাম করল। ‘এত দিন পরে তুই কি করে খোঁজ পেলি মা? তোর বাবা, মা কই?’
‘আমি একাই এসেছি বাবা, আমাকে আমার মার কাছে নিয়ে চল।’
রত্নাকে ধরে শুভো বাইরে এসে দাঁড়িয়ে ছিলো। নিখিল আগেই ঘরে শুভোকে ফোন করেছিল। ট্যাক্সি থেকে নেমেই অঞ্জলি দেখল একটি যুবক একজন বয়স্ক মহিলাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে। নিখিল সেদিকে এগিয়ে যেতেই অঞ্জলি মা বলে রত্নার বুকে ঝাঁপিয়ে এলো।
‘কেমন আছিস মা আমার, কতো বড় হয়েছিস; কোথায় আছিস, কবে এসেছিস?’
‘সব বলবো মা। এতদিন আমি তোমায় খুঁজেছি স্বপ্নে - আজ আমার স্বপ্ন সত্যি হল।’
‘কিন্তু একি রঙের সাড়ি পড়েছিস।’
‘কেন মা? এটা আমাদের মিশনের শাড়ি, আমরা এটাই পড়ি। আমি এখন থেকে কলকাতায় থাকব — রামকৃষ্ণ মন্ত্রে দিক্ষা নিয়েছি।’
‘আর কোথাও যেতে হবে না। তুই এখানেই থাকবি, আর কোথাও যাবি না।’ রত্না মেয়েকে আঁকড়ে ধরলেন। নিখিল ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে এগিয়ে এলো, ‘থাক না ওসব কথা, তোমরা ভেতরে চলো।’
পাড়া পড়শিদের কিছু ভিড় জমেছিল তাদের চলে যাওয়া মেয়েকে দেখতে, কিন্তু গেরুয়া বসন দেখে কেউ আর কাছে এলনা। দুর থেকেই প্রশ্ন এলো, ‘এই কি সেই সাহেব মেয়ে?’ অঞ্জলি এগিয়ে গিয়ে তাদের কাছে দাঁড়ালো, ‘কাকিমা, আমিই সেই সাহেব মেয়ে এঞ্জেল আর এখন সন্ন্যাসিনী অঞ্জলি।’
‘তা বাছা সন্ন্যাসিনী হলে কি দুঃখে, তা আবার সাহেবদের দেশে গিয়ে?’
‘সন্ন্যাস নেবার জন্যে কি দেশ বিদেশ বলে কিছু আছে কি? আর দুঃখের মধ্যে না দাঁড়ালে জগজননীকে অনুভব কি করে করা যায়? আমি এসেছি সেই মায়ের খোঁজে, এবং তাঁকে পেয়েছি।’ শুভো বোনকে হাত ধরে ঘরে নিয়ে এল, দেখ তোর ছবি।’ দেওয়ালে একটি ছোট ছবি, রত্নার কোলে শিশু পুত্র। শুভ ব্যাপারটা খোলসা করল,’ আমি মোবাইলে তুলে নিয়েছিলাম লুকিয়ে।’
রত্না একটা তাঁতের শাড়ি এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘এবার বার যা তো, মুখ হাত ধুয়ে শাড়িটা চেঞ্জ করে আয়।’ অঞ্জলি শাড়ি বদলে এল।
‘এই তো আমাদের মেয়ে, ওই যোগিনী শাড়ি আর পড়িস না।’
‘ঠিক আছে মা, আমি তোমার ইচ্ছামতো এখানে যদ্দিন আছি গেরুয়া পড়বো না। এবার কিন্তু আমি চা বিস্কুট খাবো।’ শুভো দোকানে গেল চায়ের দুধ আনতে। রত্না তক্তা পোষে অঞ্জলিকে বসিয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। ‘বিয়ে থা করবি ত? আমরা খুব ভালো ঘরে তোকে বিয়ে দেব।’
‘কিন্তু মা আমি তো সন্ন্যাসিনী, আমি কিভাবে ঘর বাঁধতে পারি?’
‘অঞ্জলি মা আমার, ছোটবেলায় তোকে একবার হারিয়েছি, অনেক চেষ্টা করেও তোকে কাছে রাখতে পারিনি। আজ আবার কাছে এসে তুই এই ভাবে সন্ন্যাসী হয়ে হারিয়ে যাবি? ঘর সংসার করবিনা?’
‘মা আমি তো আর এঞ্জেল স্মিথ নেই, আমি এখন বেদান্ত মিশনের মা অঞ্জলি আর তোমাদের জন্য অঞ্জলি দাস। আর আমার তো বিশাল বড় ঘর। অনেকটা ঐ গ্লোবের মতো। যখন যেখানে থাকবো সেটাই আমার ঘর আর সেখানকার লোকেরাই আমার সংসার। আমি আমেরিকায় আমার সম্পর্কের বাবা মা, বিষয় আশয় সব ছেড়ে এসেছি। আমাকে এই ছোট্ট গণ্ডির ভেতরে আটকে দিওনা প্লিজ। আমি ত তোমার কাছে কাছেই থাকব-কখনো বেলুড়ে, কখনো এখানে।’ অঞ্জলি প্রসঙ্গ হাল্কা করার চেষ্টা করলো,‘আমার খুব খিদে পেয়েছে। আমি কিন্তু ধোঁকার ডালনা দিয়ে ভাত খাবো। আর খেয়ে তোমার কোলে মাথা রেখে ঘুমাব। তুমি আমায় গুণ গুণ করে গান শুনিয়ে ঘুম পাড়াবে। ’
‘আচ্ছা বাবা তাই হবে, তবে ঘুম পাড়াব রাতে — এখন অনেক কথা শোনা বাকি।’
রাত্রে খাওয়ার পর অঞ্জলি মার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ল, ‘মা তুমি এবার সেই ছোট বেলার গান শোনাও?’
‘ছোটবেলায়? তখন তুই আমেরিকায়!’
মা, আমি গানের সুর বলছি — কথা জানি না!’ অঞ্জলি ঘুমের মধ্যে যে সুর শুনত সেটা গুণ গুণ করল।
‘ও এই গান? এটা তুই পেটে থাকতে আমি শোনাতাম। যখন তুই খুব ছট পট করতিস এই গান করতাম — তুই চুপ করে যেতিস! খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ল, বর্গি এল দেশে…।’ অঞ্জলি চোখ স্বর্গীয় আরামে বুঝে এল — প্রথম এত নির্ভানায় সে ঘুমিয়ে পড়ল।
আনন্দেরকটা দিন কেটে গেল। শুভ মুম্বাইতে চাকরী করে, ‘বোনটি একবার মুম্বাই আয়।’ শুভ মুম্বাই ফেরত গেল, যাবার আগে অঞ্জলির মাথায় হাত দিয়ে বললো, ‘তোমার মন যা চায় তুমি তাই করো, কিন্তু ভাই ফোঁটা থেকে যেন আমাকে বঞ্চিত করো না।’
‘না দাদা আমি যেখানেই থাকি না কেন, ফোঁটা তোমাকে আমি দেবই, আর সঙ্গে চাই ভালো শাড়ী।’ শুভ হেসে উত্তর দিল, ‘আই প্রমিস মাই সিস।’
রত্না ও নিখিল অঞ্জলির ইচ্ছাকেই স্বীকার করে নেবার জন্যে মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে লাগলো, কিন্তু যাবার দিন সকালে যখন অঞ্জলি গেরুয়া শাড়ি পরে সুটকেস গোছাচ্ছে রত্নার চোখ জলে ভরে এলো। এতো দিন ধরে লড়াই করেও মেয়ে কে সে ধরে রাখতে পারলোনা।
অঞ্জলি মার চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলল, ‘মা যাবার সময় চোখের জল মুছে আমায় আশীর্বাদ করো, না হলে এই বিরাট সংসারের দায়িত্ব আমি কি ভাবে সামলাবো?’
‘অঞ্জলি তুমি আমাদের চোখে ওই দূর আকাশের তারা, তুমি ওখান থেকে সবাইকে তোমার আলো দিও; আমরা তাতেই খুশি থাকবো। যখন সময় পাবে কথা বোলো আর বেলুড়ে থাকলে দেখা কোরো।’
‘নিশ্চই মা, আমি যখনই সময় পাবো, ছুট্টে তোমার কোলে চলে আসবো’। অঞ্জলি মা, বাবার পা ছুঁয়ে প্রণাম করল।
গল্প
অন্তিম
শ্বাস সুন্দর
সুশোভন দাস
ফিনল্যান্ড
পর্ব: ১
- ”হ্যাঁ গো, আর কবে আমার বটি-ছুরিগুলোতে ধার দিয়ে দেবে? এগুলো দিয়ে সবজি কেনো, চোরের কানও কাটা যাবে না। সবার ছুরি-কাটারি একেবারে চকচকে করে দিচ্ছ আর নিজের ঘরের গুলো দেখো - যেন দাঁত-ভাঙা আশি বছরের বুড়ো। আজ যদি ধার না দাও তাহলে তোমার ওই কোদাল মার্কা দাঁত দিয়ে কুটনো কুটে খেও।”
এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে একটা চটের ব্যাগ উপুড় করে ধরল কাজল। ঝনঝন শব্দ করে কয়েকটা ছুরি, দুটো বোঁটি, জং ধরা দুটো কাটারি এক সাথে একটার উপর আরেকটা পড়ল। হাঁপরে টান দিতে দিতে অজিত বলল, - ”ঠিক আছে রেখে যা। আমি দুপুরে বাড়ি ফেরার সময় সব গুলো ধার দিয়ে নিয়ে যাবো।”
হাপরের আগুনের মতো দপ করে জ্বলে উঠে বলল, - ”তা দুপুরে গিয়ে কি খাবে? আমার মাথা? এগুলো এখনি না করে দিলে রান্নাটা করব কি করে শুনি?”
কাজলের ভাবমূর্তি দেখে অজিত আর কিছু বলল না। হাঁপর ছেড়ে উঠে এসে শান দেওয়ার পাথরটায় দু-হাতে আঁচলা করে জল তুলে ভিজিয়ে নিল। একটা ছোটো টুলের উপর বসে একে একে শান দিতে শুরু করল।
অজিত মুখ বুজে তার ছুরি-কাটারিতেই হাত দিয়েছে দেখে কাজল আর রাগ দেখাল না। ”তুমি এগুলো করে রাখো আমি বাজার সেরে ফেরার পথে নিয়ে যাবো”- বলে বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে বাজারে চলে গেল।
নিতাই কাকা গ্রামের একজন নাম করা কামার। বলতে গেলে এই অঞ্চলে কামারের দোকান একমাত্র নিতাই কাকার। নিতাই কাকার একমাত্র মেয়ে কাজল। খুব ছোটবেলায় মাকে হারায় কাজল। তাই ছোটবেলা থেকেই সংসারের কাজে সে বাবার সাথে হাত লাগায়। পেন্সিল ধরার বয়সে সে হাতে ধরেছিল খুন্তি। স্কুল জীবন বলতে তার যতদিন স্কুলে খিচুড়ি পাওয়া যেত ততদিন। গ্রামের একমাত্র দোকান হলেও তাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায়। বাপ-ঠাকুরদার আমলের দোকান, তাই কাগজ-পত্র বলতে কি বোঝায় সেটাই নিতাই কাকার জানাছিল না। আর সেই অজুহাতে কখনো পুলিশ বা কখনো রাজনৈতিক দলের লোক এসে টাকা আদায় করে নিয়ে যেত। দোকানের সব কাজ একা হাতে করাও যায় না তাই একটা কর্মচারীর খোঁজ করছিল। ক্লাবের ছেলেরাই তার একটা বিহিত করে। অল্প মাইনেতে একটা আনাড়ি ছেলেকে দোকানে ঢুকিয়ে দেয়। কিন্তু একদিন সুযোগ বুঝে সেই কর্মচারী দোকান থেকে সব টাকা নিয়ে কেটে পড়ে। ক্লাবের ছেলেদের কাছে সাহায্য চাইতে গিয়েছিল নিতাই কাকা। কিন্তু তারা বেমালুম সব দোষ নিতাই কাকার ঘাড়ে দেয় আর বলে- ”কর্মচারী খুঁজে দেওয়ার কথা বলেছিলে খুঁজে দিয়েছি। এবার সে কি করবে সেটা তার আর তোমার ব্যাপার। শুনেছি তুমি তাকে মাইনে দিতে না, রাত-দিন ওই আগুনের সামনে বসিয়ে রাখতে। তাকে তুমি রাখতে পারনি। তাই সে পালিয়েছে। তার জন্য আমাদের দায়ী করে কোনো লাভ হবে না। যাও পুলিশে গিয়ে কমপ্লেন করো।”
পুলিশের কাছে গেলে কি হবে তা নিতাই কাকা খুব ভালো ভাবে জানত। তাই মুখ বুজে নিজের মরা দোকান নিয়েই রইল।
নিতাই কাকার বাড়ির লাগোয়া বাড়ি হল অজিতদের। নিতাই কাকার সাথে তাদের সম্পর্ক খুব ভালো ছিল। অজিতের বাবা বিপিন রাজনীতি করত আর সুযোগ পেলেই ’বিপিন বাবুর কারণ সুধা’ খেয়ে উল্টে থাকত। অজিতের মা সুধা বেশির ভাগ সময় তাকে সামনের জলা-জমি থেকে উদ্ধার করে আনত। একদিন সন্ধ্যায় বিনা মেঘে বজ্রপাত নেমে আসে তাদের ঘরে। সেই রাতের মধ্যেই অজিত নিজের বাবা-মাকে হারায়। সাথে খুনির ছেলের তকমা লেগে যায় তার কপালে। গ্রামের মানুষের আক্রোশের মুখে নিজের ভিটে বাড়িটাও ধুলোয় মিশে যায়। তাই চাইতে বা না চাইতে অজিতের দায়িত্ব এসে পড়ে নিতাই কাকার উপর। তবে পড়াশুনার থেকে অজিতের লোহার কাজের উপর আগ্রহ দেখে স্কুল ছাড়িয়ে তাকে হাতে ধরে কাজ শেখায়। দোকানের কাজে অজিত অল্প বয়সে বেশ পারদর্শী হয়ে উঠল। একটা বিশ্বাসযোগ্য হাত পেয়ে নিতাইকাকা মনে ভরসা পেল। দোকানও ধীরে ধীরে প্রাণ ফিরে পেল।
বাড়ির বোঁটি-কাটারিতে শান দিয়ে ব্যাগে ভরে আবার হাঁপরের কাছে ফিরে গেল অজিত। কিছুক্ষণের মধ্যে কাজল ফিরে এল। ব্যাগ থেকে একটা ছুরি বের করে মুখের সামনে ধরল।
বেশ অবাক হয়ে চোখ বড় বড় করে ছুরির ফলায় নিজের মুখ দেখতে দেখতে বলল,- ”এইতো কত ভাল ধার হয়েছে এখন। আর গায়ে একটুও জং নেই। একেবারে পরিষ্কার। এটা দিয়ে এখন এক বছর চলে যাবে বলো।”
অজিত মুখ নিচু করেই বলল, - ”এ-গুলো কাঁচা লোহার। জল লাগিয়ে না মুছে রাখলে দু-দিনেই আবার দাঁত ভাঙা আশি বছরের বুড়ো হয়ে যাবে।”
হাতের ছুরিটা ব্যাগে ঢুকিয়ে একটু লাজুক গলায় কাজল বলল, - ”তা তুমি কয়েকটা ভালো ছুরি বানিয়ে দিতে পারতো বাড়ির জন্য। তাহলে আর তোমাকে কাজের মাঝে জ্বালাতে হয় না।
হাঁপর ছেড়ে উঠে নিজের বসার জায়গার তলা থেকে কাঠের বাক্স বার করে সেটা কাজলের হাতে দিয়ে বলল, - ”এটা তৈরি হতে আর কিছু দিন বাকি। সামনের জন্মদিনে এটাই তোমায় দেব।”
বাক্সটা খুলতেই একেবারে সূর্যের আলোয় চকচক করে উঠল একটা সরু ছুরির ফলা। ছুরিটার ফলা এতটাই সুন্দর যে প্রায় মিনিট দুই সেটার দিকে নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইল কাজল। ছুরির একেবারে গোড়ার দিকে নজর পড়তে সে দেখল খুব ছোটো অক্ষরে কিছু লেখা। ছুরি সমেত বাক্সটা আরো একটু কাছে নিয়ে ভালো করে দেখল প্রথম শব্দ ’রিপন’।
সাথে সাথে ছুরি থেকে চোখ সরিয়ে কাজল বলল, - ”রিপন? রিপন কে? এ তুমি কোন রিপনের কথা বলছো? ”কাজলের চোখ ছোটো হয়ে এলো। কপাল কুঁচকে ভ্রূ-দুটো একে অপরকে ছুঁতে চাইছে। কপালের প্রতিটা ভাঁজে হাজার হাজার প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে তার।
অজিত শান্ত ভাবে কাছে এগিয়ে গেল। তার ঠোঁট দু-দিকে প্রসারিত হয়ে একটা হালকা হাসি সৃষ্টি করল যা শুধু মাত্র তার ঠোঁটেই সীমাবদ্ধ রইল। বাক্সটার ঢাকনা বন্ধ করতে করতে বলল, - ”এখনো অনেকটা কাজ বাকি। সব শেষ করে তবেই তোমায় দেবো এই উপহার।”
পর্ব : ২
হাঁপাতে হাঁপাতে কনস্টেবল দুলাল থানায় ঢুকল। থানার বড়বাবু সবে গরম চায়ে চুমুক দিতে যাবেন কিন্তু সামনে কাক ভেজা দুলালকে দেখে চায়ের গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে বললেন, - ”খেয়ে একটু গা-গরম করে নাও। তারপর কি হয়েছে বল।”
দুলাল চায়ের কথায় কান না দিয়ে ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে বলল, - ”স্যার, কাল রাত থেকে গ্রামের পাঁচ জনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।”
বড়বাবু চায়ের গ্লাসে চুমুক দিয়ে চেয়ারে শরীর এলিয়ে দিয়ে বললেন, - ”আজ না হয় কাল খুঁজে পাওয়া যাবে। এ আর এমন কি বড় কথা। এই গ্রামে আমি একাই মানুষ লোপাট করি। আমার অনুমতি ছাড়া কেউ নিখোঁজ হতে পারবে? কি বল হে রাম-দুলাল?”
এবার দুলাল বড়বাবুর টেবিলের উপর ঝুঁকে পড়ে গলার স্বর ভারি করে বলল, - ”না স্যার। অমিত, বাপ্পা, সজল, রিপন আর মঙ্গল। এরা কাল রাত থেকে গায়েব। বিকাশবাবু খুব চিন্তিত। তাড়াতাড়ি আপনাকে খবর দিতে বলল।”
বড়বাবু এবার মুখ ঝামটা দিয়ে বললেন, - ”সকাল সকাল বিকাশবাবুর বাড়ি টাকা গিলতে গেছো নিশ্চয়ই। না হলে বিকাশবাবু ভালো মত জানেন তাঁর গুণধর পুত্র কেমন। এক রাত কেন, এক মাস বাড়ি না ফিরলেও কিচ্ছু যায় আসে না।”
দুলাল হাল না ছেড়ে গলা আরো একটু ভারি করে বলল, - ”স্যার, মোবাইলেও ধরা যাচ্ছে না কাল রাত থেকে।”
টেবিলের উপর রাখা পেন তুলে নিয়ে কান খোঁচাতে খোঁচাতে বড়বাবু বললেন, - ”সে তো কাল রাত থেকে আমি বৌকে মোবাইলে পাচ্ছি না। আজ রাতের মধ্যে না পেলে আমার নামেই কেস ঠুকে দেবে। জানিস তো তোর বৌদিকে, যখন তখন ফোন করে খোঁজ নেয় কোনো মেয়ের সাথে চক্কর চালাচ্ছি কিনা সেটা জানতে। তুমি বলতো দুলাল, এই পুলিশের চাকরীতে অন্য মেয়ে আসবে কোথা থেকে?”
এবার দুলাল অনেকটা দমে গিয়ে মাথা নিচু করে বলল, - ”বিকাশবাবু কিন্তু বেশ চিন্তিত। আমায় খুব জোর দিয়ে বলেছেন।”
”আরে ধুর, তুমি থাম। বিকাশবাবু নিজে এসে যতক্ষণ না বলবেন ততক্ষণ কিছু করবো না। ওনার আর ওনার সুপুত্রের কেস চাপা দিতে দিতে মাথার চুল উঠে গেল, অথচ জল-পানি ছাড়ার কথা বললেই একটাই কথা- ’সময় মতো পাঠিয়ে দেব।’ তা তুমি যে সাত-সকালে হাজিরা দিলে সেখানে, মাল-কড়ি কিছু দিল না কথা শুনিয়ে ছেড়ে দিল?”
দুলাল মাথা নিচু করে ঘাড় নাড়ল।
বড়বাবু মুখটা বেজার করে বেললেন, - ”জানতাম। ওই ঘণ্টা দেবে। দাঁড়া, একবার সুযোগ পাই ওর হাতে আমি হ্যারিকেন ধরিয়ে দেব।”
দুলাল কিছু না বলে ঘর থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে যাচ্ছে তখনই বড়বাবু পিছন থেকে ডেকে বললেন, -”বুঝলে দুলাল চাপটা আমারও লাগছে। গত দু-বছর ধরে যা দেখছি, মালগুলো কিছুদিনের জন্য গায়েব হয়ে যখনই ফিরে এসেছে বড়সড় কিছু কেস নিয়ে আমার ঘাড়ে চেপেছে। তাড়াতাড়ি যদি ওদের খোঁজ পেয়ে যাই তাহলে আমার চাপ কম হবে।”
এতক্ষণে বড়বাবু তার কথা শুনেছে ভেবে দুলাল বেশ উৎসাহিত হয়ে বলল, - ”একদম ঠিক বলেছেন স্যার। ওরা নিশ্চয়ই কিছু কেস পাকাচ্ছে।” একটু সময় থেকে দুলাল মাথা চুলকে জিজ্ঞাসা করল, - ”কিন্তু স্যার, খুঁজবেন কি ভাবে? কাউকে কিছু বলে যায় নি।”
নিজের চেয়ারে ফিরে যেতে যেতে বড়বাবু বললেন, - ”আপাতত ফোন রেকর্ড চেয়ে পাঠাও। তারপর দেখছি।”
চায়ের কাপে এক চামচ চিনি তুলে নিয়ে অধীরবাবু বললেন, - ”বিকাশদা, ছেলেগুলো তিনদিন হল কোনো খবর নেই। আপনি কিছু খবর পেয়েছেন? মঙ্গল সেদিন সকালে ওর মায়ের সাথে বেশ ঝগড়া করে আমার কাছে টাকা চাইতে এসেছিল। এতদিন কখনো মোবাইল বন্ধ রাখে না। এই প্রথমবার। রোজই আমার ওয়াইফ সকাল-বিকাল মাথা খাচ্ছে। না জানি কোথায় কি অঘটন ঘটাচ্ছে।”
অবিনাশবাবু বললেন, -”সজল ঘরে ফোনটা পর্যন্ত ফেলে গেছে। ওর মায়ের কাছে শুনলাম বৃষ্টির মধ্যে কে ডাকলো আর ওমনি দৌড়ে বেরিয়ে গেল। পরদিন সকালে ফোনটা দেখি গ্যারাজের কাছে পড়ে আছে। লাস্ট কল দেখলাম রিপনের।” কথা শেষে আড়-চোখে একবার তিনি বিকাশবাবুর দিকে তাকালেন।
খুব বিরক্ত সহকারে চেয়ার ছেড়ে উঠে পায়চারী করতে করতে রঞ্জনবাবু বললেন, -” এতো বড় সোনার কারবারের দায়িত্ব সবে একটু একটু করে অমিতকে বুঝিয়ে দেওয়া শুরু করেছি আর তখনই একেবারে হাওয়া। দু-সপ্তাহও হয়নি অনেক বুঝিয়ে একটু কারবারে মন এসেছিল আর ওমনি হাওয়া। তিন দিন হয়ে গেল এখনও পর্যন্ত বাপ্পার কোনো খবর দিতে পারলোনা থানার বড়বাবু। দু-দিন ছাড়া ওই চেলা দুলালটাকে পাঠায় জলপানির জন্য। কিন্তু কাজের নামে অষ্টরম্ভা”
সকালের শান্ত মেজাজে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বিকাশবাবু বললেন, - ”আপনারা এতো চিন্তা করবেন না। সবাই ঠিক আছে।”
ক্ষণিকের জন্য একটা অস্বাভাবিক নীরবতা নেমে এলো। সবাই একসাথে বিকাশবাবুর পরবর্তী কথার জন্য শ্বাসরোধ করে অপেক্ষা করতে থাকল।
বিকাশবাবুর দিকে তাকিয়ে নীরবতা ভঙ্গ করে নির্মলবাবু স্বভাবসিদ্ধ ভারি গলায় বললেন, -”ও মশাই, আপনি সত্যি কিছু খোঁজ পেয়েছেন নাকি? আমার প্রথম বৌ যাওয়ার আগে আমায় শুধু খুনের হুমকি দিয়েছিল, কিন্তু অমিতের যদি এতটুকুও কিছু হয় তাহলে দ্বিতীয় বৌ সত্যি সত্যি খুন করে ফেলবে আমায়। কিছু জানতে পেলেন নাকি রিপনের কাছ থেকে?”
নিজের মোবাইলটা পকেট থেকে বের করে হোয়াটস্যাপ থেকে রিপনের মেসেজ বক্স খুলে টেবিলের উপর রাখলেন। তাড়াতাড়ি করে মোবাইলটা তুলে নিয়ে অবিনাশবাবু জোরে জোরে শেষ মেসেজটা দেখলেন। একটা পাহাড়ী জঙ্গলের ছবি গত কাল দুপুরের দিকে রিপন পাঠিয়েছিল। তার নীচে যা লেখা ছিল সেটা হল ’জলদাপাড়া ঘুরতে চলে এলাম হঠাৎ করে। এখানের নেটওয়ার্ক খুব খারাপ। আমরা সবাই ভালো আছি। দিন পনেরো জঙ্গলে থেকে তারপর ফিরবো।’
অধীরবাবু একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে বললেন, - ”এখন ব্যাপারটা পরিষ্কার হল। মঙ্গল কেন সেদিন আমার থেকে বিশ হাজার টাকা ক্যাস নিল।”
”এই দুলাল, দুলাল, এমন ভয়ঙ্কর নাক ডাকার আওয়াজ কোথা থেকে আসছে? দুপুরে একটু যোগনিদ্রা দেওয়ারও উপায় নেই দেখছি।” - নিজের চেয়ারের ভিতরে আরও কিছুটা ডুবে যেতে যেতে একটা বিরক্তির সাথে কথাগুলো ছুড়ে দিলেন বড়বাবু।
ঘড়ির কাঁটা তিনটের ঘর পেড়িয়ে গেছে। থানার পাশেই বাদলের দোকান থেকে চা চলে এসেছে। হরি আদা দেওয়া লিকার চায়ের গ্লাসটা ধীরে ধীরে বড়বাবুর টেবিলে নামিয়ে রেখে বলল, - ”স্যার, আপনার চা।”
টেবিলের উপর তুলে দেওয়া দু-পায়ের মাঝখান দিয়ে বাঁ চোখটা হালকা ফাঁকা করে হরির মুখটা দেখে বলল, - ”দুলাল কোথায়? সেকি খেয়ে ফেরেনি এখনও?”
হরি বলল, - ”স্যার, সে তো কখন খেয়ে ফিরে পড়েছিল। ফেরার পথে ওই মোড় মাথায় কারা মাল খেয়ে ভর দুপুরে মারামারি করছিল, তাদেরকে ধরে এনে লকআপে পুরেছে। তারপর বেরিয়ে গেছে। শুধু বেরোনোর আগে বলে গেল যে ফিরতে দেরি হবে।”
বড়বাবু টেবিল থেকে পা নামিয়ে চেয়ারের উপর সোজা হয়ে বসলেন চায়ের গ্লাস নিয়ে সশব্দে চুমুক দেওয়ার সাথে সাথে এক বিকট গর্জন এলো পাশের ঘর থেকে। এক মুহূর্তের জন্য চমকে উঠলেন তিনি। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে ধমকে হরিকে বললেন, - ”যা ওই অপোগণ্ডগুলোকে বনে ছেড়ে দিয়ে আয়। থানাটা যেন মামার বাড়ি পেয়েছে। বুনো শুয়োরের মতো নাক ডেকে ঘুম দিচ্ছে মহা আরামে।”
হরি বড়বাবুর মেজাজ দেখে তাড়াতাড়ি পাশের ঘরে গিয়ে লোকদুটোকে ডান্ডা মেরে ঘুম থেকে তুলল। তারপর প্রায় টানতে টানতে তাদেরকে কোনো রকমে থানার বাইরে নিয়ে এলো। এক মাতাল তখন অন্য মাতালকে বলল, - ”ইশ কেমন বাইরে বের করে দিল দেখ। যেন ওর বাপের বাড়িতে ঘুমাচ্ছিলাম।”
তা শুনে অন্য মাতাল বলল, - ”চল তবে আবার মারামারি করি। তাহলে আবার ভিতরে নিয়ে যাবে।”
কথাটা শুনে হরি ভয়ানক রেগে গেল। পাগলের মতো হাতের লাঠিটা ঘোরাতে থাকল। দু-একটা লাঠির ঘা খেয়ে মাতাল দুটো পড়ি কি মরি করে একেবারে থানার গেটের বাইরে চলে গেল। এই সময় বাইকে করে দুলাল থানায় ফিরে এলো। হরির এমন বেখাপ্পা মেজাজ আর থানার বাইরে মাতাল দুটোকে দেখে অবাক হয়ে বলল, - ”কি হয়েছে? এগুলোকে ছেড়ে দিলি কেন?”
হরি লাঠি থামিয়ে বলল, - ”বড়বাবুর অর্ডার। আর যা নাক ডাকছিল যেন কুম্ভকর্ণ, আর একটু হলে থানা ভেঙে যেত।”
দুলাল বিশেষ কথা না বাড়িয়ে একেবারে বড়বাবুর কাছে এলো। দুলালকে দেখেই বড়বাবু হেঁয়ালি করে বললেন,- ”কি সংবাদ আনিয়াছো, হে নারদ। কহ তব মনবাসনা।”
দুলাল বলল,- ”ওই স্যার একটু রঞ্জনবাবু আর বিকাশবাবু একটু ডেকেছিলেন। সামনে ভোট আসছে তাই কোথায় কোথায় পুলিশ লাগবে সেটাই একটু বলছিলেন।”
চোখ ছোটো করে একটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে দুলালের দিকে তাকিয়ে বড়বাবু বললেন, - ”আর কিছু না?”
দুলাল এবার একটু লজ্জা লজ্জা করে বলল, - ”ওই স্যার বৌয়ের জন্মদিন বলতে একটু জলপানি দিল। এই আর কি।”
বড়বাবু রেগে গিয়ে বললেন, - ”ব্যাস, জলপানি নিয়ে কেটে পড়লে। ভিতরের কোনো খবর নেই নাকি তুমি কান দাও নি?”
বড়বাবুর কাছে একথা শুনে দুলাল একটু বোঝার চেষ্টা করল বড়বাবু আসলে কি বলতে চাইছেন সেটা বোঝার। দশ-পনেরো সেকেন্ড চুপ থেকে সে বলল, - ”ও, হ্যাঁ স্যার। ওই পাঁচ জনের খোঁজ পাওয়া গেছে। ওরা হঠাৎ করে জলদাপাড়া ঘুরতে গেছে। দিন পনেরো পর ফিরে আসবে। নেটওয়ার্ক নেই তাই কাউকেই ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। বিকাশবাবু বললেন যে ওদের খোঁজায় সময় নষ্ট না করতে। তাই আমাদেরও আর খুঁজতে হবে না।”
নিজের টেবিলের চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে টেবিলের উপর এক কোণায় বসে পড়লেন বড়বাবু। পেপারওয়েট ঘোরাতে ঘোরাতে বললেন, - ”খুঁজতে হবে না সে বুঝলাম। জলদাপাড়া ঘুরতে গেছে সেটাও আজ সকালে জেনে গিয়েছিলাম অধীরবাবুর কাছে। কিন্তু আসল কথা হল, খবরটা জানার পর আমি জলদাপাড়া পুলিশ স্টেশনের সাথে কথা বলেছি। তার বলছে একপাল বুনো হাতির জন্য গত সপ্তাহ থেকে পুরো জায়গা ব্লক। কাউকে এখানে আসতে দেওয়া হয়নি।”
পর্ব : ৩
সময়টা তখন আশির দশক। সমগ্র বাংলার প্রচলিত রাজনীতিকে উপড়ে ফেলার তাগিদে রাস্তায় নেমেছে শত-সহস্র ছাত্রদল। তরুণ রক্তে ভিজেছে বাংলার ওলি-গলি। এই উত্তাল রাজনীতির আগুনে ঝাঁপ দিয়েছিল বিকাশও। রায়-পরিবার তথা সূর্য্যকান্তবাবু প্রচলিত রাজনীতির এক অন্যতম বাহক। কিন্তু পরিবারের একমাত্র সন্তান যখন নতুন পথ বেছে নেয়, রাজনীতির আগুন তখন সংসার পুড়িয়ে দেওয়ার হুঙ্কার দেয়। গ্রামের জমিদার সূর্য্যকান্তবাবু পরিবার বাঁচানোর তাগিদে প্রকাশ্য রাজনীতি থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তাঁর অভুত রাজনৈতিক শক্তি ও ঐশ্বর্যের প্রাচুর্য নিয়ে নতুন দলের এক উদীয়মান যুবনেতা হিসাবে মানুষের সামনে আসে বিকাশ রায়। অন্য রাজনৈতিক মতাদর্শে প্রভাবিত হয়েও সূর্য্যকান্তবাবু রাজনীতির খুঁটিনাটি বিষয়ে সর্বদাই বিকাশকে সাহায্য করে গেছেন। অচিরেই সূর্য্যকান্তবাবুর থেকেও অনেক বেশি প্রভাবশালী হয়ে ওঠে যুবনেতা বিকাশ রায়। নব্বুইয়ের দশকে এসে বিকাশবাবু বিয়ে করেন বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু তথা প্রভাবশালী নেতার একমাত্র কন্যা নয়নতারাকে। জমিদার বিকাশ রায় তখন একাধারে সংসার ও রাজনীতির মানদণ্ড মুষ্টিবদ্ধ করেন। বংশের এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য বিকাশবাবুর ইচ্ছা রিপনকেও এই পথে নিয়ে আসার। কিন্তু কখনই চাননি নিজের শৈশব ও কৈশোর জীবনের মতো রিপনের জীবন ধারা হোক। তাই কখনো রিপনকে চোখের নজরের দূরে হতে দেননি। আজ তিন-চার দিনে রিপনের মাত্র একটা মেসেজ পেয়ে বিকাশবাবু বাইরে যতটা স্বাভাবিক দেখাচ্ছেন ভিতরে তা একেবারেই বিপরীত। নিজের খেয়ালেই একটু নির্জনতায় রিপনের সাথে নিজের ফেলে আসা জীবনে মিলিয়ে দেখলেন।
ছোটোবেলা থেকেই বিকাশের খেলার সঙ্গী হিসাবে বিপিন সব সময় থাকতো। বিপিন সারাদিন বিকাশের সাথে জমিদার বাড়িতেই খেলা করত। এমন কি মাঝে মাঝে খাওয়া-দাওয়া করে দু-জনে একসাথে সেখানেই ঘুমিয়ে যেত। সন্ধ্যায় বিপিনের মা বিমলাদেবী তাকে কোলে করে বাড়ি ফিরিয়ে আনতো। জমিদার বাড়ি থেকে বিপিনকে নিয়ে আসতে দেরি হলে সূর্য্যকান্তের স্ত্রী বিভাবরীদেবী প্রায়ই বলতেন, - ”ছেলে মানুষ ঘুমিয়ে পড়েছে যখন আর ডেকে তুলে কি হবে। একেবারে কাল সকালেই বাড়ি ফিরে যাবে।”
বিমলাদেবী তবু মানতেন না। বলতেন, - ”ওর বাবা কারখানা থেকে ফিরে এসে ছেলেকে না দেখতে পেলে আমার উপর খুব রেগে যাবে। মাঝে মাঝে উনি বলেন যে একটা মাত্র ছেলে তবু তাকে সামলাতে পারছো না। অনেকগুলো হলে কি করতে? আমি খুব হেসে ফেলি তখন। বলি, একটাই একশোটার সমান।”
গ্রামের পাঠশালায় দুজনের মিলিত অত্যাচারে সবাই অতিষ্ঠ হয়ে উঠে। বাড়িতে রিপোর্ট করার কথা ভাবলেও সেই রিপোর্ট বাড়ি পর্যন্ত আসতো না। একবার তাদের অন্যায়ের কথা সূর্য্যকান্ত বাবুর কানে তোলেন স্কুলের হেডমাস্টার। সূর্য্যকান্তবাবু হেসে জবাব দেন,-” বাচ্চারাই এমন করবে এটাই নিয়ম। দু-দিন পর বড় হয়ে গেলে দেখবেন একেবারে শান্ত হয়ে গেছে। তাছাড়া স্কুলে যদি কেউ অন্যায় না করে তাহলে আপনারা কাকে শাস্তি দেবেন বলুনতো?”
শুধু হেডমাস্টার নন গ্রামের সবাই জানত, কার ঘাড়ে দুটো মাথা আছে যে বিকাশকে শাস্তি দেবে? গ্রামে স্কুলের গন্ডি পার হয়ে শহরে চলে আসে বিকাশ। কিন্তু বিপিন থেকে যায় নিজের গ্রামেই। এই প্রথম জ্ঞানত বিকাশ ও বিপিনের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়। তবে বিপিন জমিদারবাড়ি ছাড়েনি। সংসারের অবস্থা খারাপ দেখে বিপিন পড়াশুনার পাঠ চুকিয়ে রাজনীতিতে নেমে পড়ে। প্রথমে দলের হয়ে তারপর সূর্য্যকান্তবাবুর খুব কাছের একজন বিশ্বস্ত মানুষ হয়ে কাজ শুরু করে। সংসারে বিপিনের হাত ধরে কিছু টাকা আসায় মোটামুটি স্বচ্ছলতা আসে তাদের জীবনে।
বয়স পঁচিশের গন্ডি পার হতেই বিমলাদেবী ঠিক করলেন বিপিনের বিয়ে দেবেন। পাত্রীও ঠিক করে ফেললেন - পাশের গ্রামের রমেন তাঁতির মেয়ে সুধারানী। পুরুত ডেকে দিন ঠিক করে ফেলেন বৈশাখের একুশে। বিপিনের বিয়েতে তাদের নিজেদের বাড়ির থেকে অনেক বেশি আনন্দ লেগে গেল রায়-পরিবারে, যেন সেই বাড়ির ছেলেরই বিয়ে হবে নতুন বছরের শুরুতেই। বিভাবরীদেবী নিজে বিমলাদেবীকে নিয়ে শহর থেকে হবু বৌমার জন্য শাড়ি-গহনা কিনে আনেন। এমনকি বিবাহ অনুষ্ঠানের জন্য নিজেদের বাড়ির পিছনের জমিটায় মণ্ডপ তৈরির আদেশ দেন।
বিমলাদেবী একটু বিব্রত বোধ করে বলেন, - ”দিদি, আমার ছেলের বিয়েতে আপনি সব করছেন। আমায় একটু কিছু করতে দিন। বিয়েটা আমাদের বাড়ির সামনের মাঠে করলে হত না? ওই মন্ডলদের বলেছি মাঠটা দু-দিনের জন্য ভাড়া দিতে। ওরা রাজিও হয়ে গেছে পাঁচশ টাকায়।”
বিভাবরীদেবী বিমলাদেবীর হাত ধরে বললেন, - ”দেখো বিমলা, বিপিনকে সেই ছোটোবেলা থেকে দেখে আসছি। আমাদের ঘরে খেলা করতে করতে বড় হল। ও আমার ছেলের থেকে কোনো অংশে কম নয়। এই ডামাডোলে বিকাশ এখন প্রাণ বাঁচিয়ে পালাচ্ছে। বিয়ে দূরের কথা, ভয় হয় কোন দিন দেখব প্রাণহীন দেহটা বাড়ির চৌকাঠে এসে ঠেকেছে। তার উপর আমার যা অবস্থা আজ আছি তো কাল নেই। কমপক্ষে এক ছেলের বিয়েতে নিজের মতো করে আনন্দ করে নিই।”
একথা শোনার পর বিমলাদেবী আর কিছু বলতে পারেননি। মন্ডলদের থেকে আর মাঠ ভাড়া নিতে হল না। বিয়ের প্রস্তুতিতে দুই পরিবারের মা মিলে সব দায়িত্ব নিজেদের মধ্যে ভাগকরে নিলেন।
নিজের ছেলের বিয়ের দিনগুলোতে বাড়ি থাকার জন্য শিবনাথবাবু বাজির কারখানায় ওভার টাইম শুরু করেন। বিয়ের আর মাত্র দুই-পক্ষও বাকি নেই। এমনি একদিন সন্ধ্যায় কারখানা থেকে বেরনোর একটু আগে হঠাৎ শর্টসার্কিট হয়ে কারখানায় আগুন লেগে যায়। নিমেষের মধ্যে সেই আগুন আকাশ ছুঁয়ে ফেলে। খবরটা যখন টিভিতে প্রচার হয় তখন বিমলাদেবী জমিদার বাড়িতে ছিলেন। শিবনাথের চিন্তায় তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। খবর পেয়ে বিপিন তাড়াতাড়ি ফিরে আসে জমিদার বাড়িতে। বিমলাদেবী কারখানায় যাওয়ার জন্য ব্যকুল হয়ে ওঠায় সূর্য্যকান্তবাবুর তত্ত্বাবধানে একটা গাড়ি নিয়ে তৎক্ষণাৎ মায়ের সাথে বেরিয়ে পড়ে বিপিন।
খবরে জানালো- শর্টসার্কিট হয়ে কারখানায় আগুন লেগে দশ জন শ্রমিক একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। আহতের সংখ্যা চল্লিশ।
ভোরের আলো ফুটতে আর কিছুটা বাকি তেমন সময় বিপিন ফিরে আসে মাকে নিয়ে। বিমলাদেবীর প্রায় অবচেতন অবস্থা। চোখের দৃষ্টি একেবারে স্থির। অবিশ্রান্ত সরু জলধারা চোখের কোণ বেয়ে শুকনো গালের উপর এসে পড়ছে। অনেক সময় পরপর একবার চোখের পলক বুজে চোখ ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। গাড়ি থেকে নামিয়ে বিপিন মাকে ঘরের ভিতর নিয়ে যাওয়ার সময় বিমলাদেবী হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেলেন। বিপিনের হাত চেপে ধরে বললেন, - ”বাবা, একটু দেখ না সামনে এগিয়ে গিয়ে। তোর বাবা ফিরতে কখনো এতো দেরি করে না। ওই বড় রাস্তার কাছে যাবি বাবা একবার? আচ্ছা বড় রাস্তা না হয় ওই পাশের পুকুর পাড়ে যা, ওখান থেকে বড় রাস্তা পরিষ্কার দেখা যায়। দেখ না বাবা একটু এগিয়ে, লোকটা কেন এখনো ফিরছে না।”
মায়ের অমন অবস্থা দেখে বিপিন কিছু বলতে পারেনি, শুধু ঘাড় নেড়ে মাকে আশ্বাস দিয়েছিল। বিছানায় মাকে শুইয়ে দিয়ে গাড়িটা ফেরত দিতে যায়। জমিদার বাড়িতে আজ কারোর চোখে ঘুম নেই। সবাই জেগে আছে শুধু বিপিনের পথ চেয়ে। বিপিন আসতে বিভাবরীদেবী তাকে জড়িয়ে কেঁদে উঠলেন। সূর্য্যকান্তবাবু জানতে চাইলে বিপিন কান্না চেপে শুধু বলল, - ”কিছু খুঁজে পাই নি জ্যেঠু। একেবারে ছাই।”
ভোরের আলো ফুটে গেছে ততোক্ষণে। বাড়ি ফিরে মাকে বিছানায় না দেখতে পেয়ে বিপিন খুব ভয় পেয়ে যায়। বাড়ি থেকে বেরিয়ে চিৎকার করে ডাকতে থাকে মাকে। বিপিনের চিৎকার শুনে আসেপাশের লোকজন ছুটে আসে। সবাই মিলে বিমলাদেবীকে খুঁজতে থাকে। একটু পরেই পাওয়া গেল বিমলাদেবীকে বাড়ির উত্তর দিকের ধান জমির পাশের পুকুর পাড়ে। বিমলাদেবীর পা পুকুর পাড়ে একটা লতা গাছের সাথে আটকে আছে কিন্তু বাকি শরীর পুকুরের জলে উপুড় হয়ে ভাসছে। তাঁর ডান-পায়ের গোড়ালির এক ইঞ্চি উপরে স্পষ্ট দুটো লাল বিন্দু থেকে তখনও চুঁইয়ে চুঁইয়ে রক্ত পড়ছে।
এই দৃশ্য দেখার সাথে সাথে বিপিন অজ্ঞান হয়ে সেখানেই পড়ে গেল। চোখ খুলে দেখল সে নিজের বাড়ির বিছানায়। বিছানার পাশে একটা চেয়ারে বিভাবরীদেবী বসে আছেন। অন্য দিকে চোখ ঘোরাতেই দেখতে পেল টেবিলের উপর থাকা বাবা-মায়ের ছবি। গত বছর সবাই শহরে গিয়ে ছবিটা তুলে বাঁধিয়ে এনেছিল সে। ফটোফ্রেমের পাশেই রয়েছে তার বিয়ের একতোড়া নিমন্ত্রণ পত্র।
পর্ব : ৪
বৈশাখের এক রাতের কালবৈশাখী ঝড়ে বিপিন খড়-কুটোর মতো উড়ে যায়। কালরাত্রির থেকেও আরো ভয়াবহ সেই রাতের কথা মনে পড়লে বিপিন নিজের চিন্তা শক্তি হারায়। নিথর পাথর হয়ে যায় ক্ষণিকের জন্য। জীবনের প্রতি আসক্তি যেন হঠাৎ করে বাঁক নিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায় অন্ধকারে। জমিদার বাড়িতে যাওয়া অনেক কমে গেছে বিপিনের। কিন্তু সূর্য্যকান্তবাবু লোক পাঠিয়ে বিপিনকে ডেকে এনে আবার কাজের মধ্যে ডুবিয়ে রাখে। তবে মাঝে মাঝেই গ্রামের লোকজন সময়-অসময়ে বিপিনকে সেই পুকুরের আশে-পাশে মাতাল অবস্থায় দেখতে পায়। বিপিনের এমন অবস্থা থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য বিভাবরীদেবী স্থগিত হয়ে যাওয়া বিয়ে শীতের শুরুতেই একরকম জোর করেই সম্পন্ন করেন। জীবনে সুধা আসার পর বিপিন নতুন করে জীবন গুছিয়ে নিতে শুরু করে, স্থিরতা আসে তার কাজে। বিবাহিত জীবনে পুরানো অনেক কিছু ছাড়লেও কালরাত্রির পিছু ধরে মদও একটা অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী হয়ে যায়। তবে তা শুধুই দুঃখ ভোলার জন্য।
বিপিনের বিয়ে খুব-একটা জাঁকজমক করে হয়নি। কিছু পাড়া-প্রতিবেশী ও বিপিনের বন্ধু-বান্ধব ও জমিদার পরিবার নিয়েই বিবাহ সম্পন্ন হয়। বিপিনের বিয়েতে বিকাশ আসতে পারেনি। আর আসবেই বা কি করে? বিদ্রোহের আগুনে ঝাঁপ দিয়ে পুলিশের হাত থেকে নিজের প্রাণ বাঁচিয়ে ফিরছে। কানাঘুষো শোনা যায় যা বিকাশ একদিন খুব ভোররাতের দিকে বাড়ি এসেছিল কিছুক্ষণের জন্য। শুধু মায়ের সাথে দেখা করে চলে গেছে। পরে এটা সূর্য্যকান্তবাবু জানতে পেরে খুবই দুশ্চিন্তায় পড়েন। ক্ষমতার পক্ষে থেকেও বার-কয়েক পুলিশ বাড়িতে এসে তাঁকে সাবধান করে দিয়ে গেছেন। এরপর থেকে সরাসরি বাড়ির সাথে যোগাযোগ রাখা বিকাশের সম্ভব হয়নি। তবে মাঝে মাঝে বিপিনের বাড়ি এসে কিছু সময় গা-ঢাকা দিতো কখনো একা আবার কখনো কোনো বিপ্লবী সাথে থাকতো। বিমলাদেবী অনেক খাবার তাদের সাথে পুঁটলি করে দিয়ে দিতেন। আর সেখানেই বিভাবরীদেবীর সাথে একটু দেখা করে ফিরে যেত। তবে বিপিনের মা-বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে বিকাশের কোনো খবর সে পায়নি। বিভাবরীদেবী ভিতরে ভিতরে উতলা হয়ে উঠলেও বিপিনকে তা নিয়ে কখনো কিছু বলেননি।
বিয়ের প্রায় মাস-দুই কেটে গেছে। মাঘ মাসের মাঝামাঝি সময়। গ্রামের দিকে এখন বিকালের পর ঝুপ করে রাত নেমে আসে। সন্ধ্যা বলে প্রায় কিছুরই অস্তিত্ব নেই। ঠান্ডাও বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে। এমনই একদিন সূর্য্যকান্তবাবুর পার্টি অফিস থেকে বাড়ি ফিরে দেখে সুধা খুব ভয় পেয়ে একেবারে জড়োসড়ো হয়ে বিছানার উপর বসে আছে। বিপিন কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই সুধা লেপের তলা থেকে কাঁপা কাঁপা হাত বের করে টেবিলের দিকে ইঙ্গিত করল। টেবিলের উপর একটা ছোট্টো চার-ভাঁজ করা চিরকুট। বিপিন এই চিরকুটের মানে আগে থেকেই জানতো। কিন্তু সুধাকে এই নিয়ে কখনো কিছু বলেনি। তাড়াতাড়ি চিরকুটটা তুলে নিয়ে ভাঁজ খুলে মেলে ধরল চোখের সামনে। সেখানে শুধু একটা ক্রস আঁকা। তাড়াতাড়ি সন্ধ্যার প্রদীপের আগুনে চিরকুটটা পুড়িয়ে ফেলে সুধার কাছে এসে বলল,- ”ভয়ের কিছু নেই। আজ রাতে জমিদার বাড়ির ছেলে বিকাশ আমাদের বাড়ি আসবে। আর এই খবরটা আমায় এখনি বিভাবরীদেবীকে দিতে হবে।”
সুধা মুখে কিছু বলল না কিন্তু তার কপালের প্রতিটা ফুটে ওঠা ভাঁজ ও কুঁচকে যাওয়া ভ্রূ বিপিনের দিকে সহস্র প্রশ্নবাণ নিক্ষেপ করল। বুকের মাঝে সুধাকে জড়িয়ে ধরে বলল,- ”ভয় পেও না। তোমায় সব কিছু বলবো। তার আগে দৌড়ে খবরটা বড়মা কে দিয়ে আসি। আজ প্রায় দশ মাসের উপর হয়ে গেল বিকাশের কোনো খবর পাননি। অনেকদিন পর আজ একটু তিনি শান্তি পাবেন।”
সুধার কপালের ভাঁজ তখনও স্পষ্ট। খুব নরম স্বরে জিজ্ঞাসা করল, - ”আচ্ছা, ও বাড়ির আর কেউ কি জানে না?”
বিপিন ঘাড় নেড়ে বলল, - ”না। বড়মা ছাড়া আর কেউ জানে না।”
তাড়াতাড়ি করে নিজের বাইক নিয়ে সে বেড়িয়ে গেল জমিদার বাড়ির উদ্দেশ্যে। বাইকের শব্দ যতক্ষণ কানে আসে সুধা সেই দিকে কান পেতে রইল। অল্প সময় পরেই শীতের শন শনে হাওয়ার শব্দে চাপা পড়ে গেল বিপিনের বাইকের শব্দ।
বিপিনের কাছে খবর শুনে বিভাবরীদেবী আনন্দে বিপিনকে জড়িয়ে কেঁদে ফেললেন। পরক্ষণেই কেউ দেখে না ফেলে তাই তাড়াতাড়ি আঁচল দিয়ে চোখ মুছে বিপিনকে বললেন,- ”বাবা, তুই আজ বারোটা নাগাদ পিছনের গেটের সামনে চলে আসিস কেমন।”
বিপিন একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল,- ”বড়মা, এতো দেরি কেন? আগে তো এগারোটায় নিতে আসতাম।”
বিভাবরীদেবী একটু বিরক্ত হয়ে বললেন,- ”আরে ওর বাবা জন্য তো। আজকাল খুব দেরি করে ঘুমাতে যান। সাড়ে দশটা পৌনে এগারোটা বাজায় শুধু খেয়ে উঠতে। তারপর ঘুমাতে যাবে সোয়া এগারোটার দিকে।”
বিপিন আর কথা না বাড়িয়ে বলল,- ”ঠিক আছে বড়মা, আমি এখন যাই। বৌটা একা ঘরে আছে। একটু ভয় পেয়েছে। আমি বারোটাতেই চলে আসবো।”
বিভাবরীদেবী একটু সন্ত্রস্ত হয়ে বললেন,- ”বাবা, বৌমা কে ভালো করে বুঝিয়ে বলিস। দেখিস যেন পাঁচ কান না করে। তাহলে আমার ছেলেকে আর হয়তো দেখতে পাবো না।”
তাঁর কথায় সম্মতি জানিয়ে বিপিন ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে আসবে তখনই পিছন থেকে তিনি ডেকে বললেন,- ”বাবা বিপিন, তখন হয়তো সব খাবার একসাথে নিয়ে যেতে পারবো না। শুকনো খাবারের পুঁটলিটা এখনি নিয়ে চলে যা।”
বিপিন কিছু সাড়া না করে পিছন পিছন রান্নাঘরের দিকে এলো। বিভাবরীদেবী একটা বড় ব্যাগ অনেক শুকনো খাবার প্যাকেট করে ভরে বিপিনের হাতে দিলেন। বিপিন আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে ব্যাগ নিয়ে বাড়ি চলে এলো।
সুধা তখনও বিছানায় বসে আকাশ পাতাল ভেবে চলেছে। শনশন বাতাসের মাঝে আবার বাইকের শব্দ স্পষ্ট হয়ে উঠল। শব্দটা একেবারে তার বাড়ির দোরগোড়ায় এসে বন্ধ হল। সুধা বিছানা থেকে নেমে বাইরে এলো। বিপিনের হাতে অতো বড় ব্যাগ ভর্তি খাবার দেখে তার কপালের ভাঁজ আরো গভীর হল।
দরজার পাশে ঘরের কোণায় ব্যাগটা রেখে সুধাকে খাবার দিতে বলল। দু-জনে খাবার খেতে খেতে বিপিন একেবারে ছোটো বেলা থেকে আজ পর্যন্ত বিকাশের জীবনে যা হয়েছে তা বিশদ ভাবে বলল।
পরিশেষে বলল,- ”বিকাশ একজন বিপ্লবী। সমাজের কিছু ভালোর জন্যই বিপ্লব করছে পরিবার পরিজন ছেড়ে। আজ আসবে খাবার নিতে আর বড়মার সাথে দেখা করবে। নিজের বাড়িতে যেতে পারবে না। ধরা পড়ে যাবে। আর ধরা পড়লে কি হবে তা তো তোমায় বলেছি। তবে বিকাশ যে আমাদের বাড়ি আসে তা আমি আর বড়মা ছাড়া এই তুমি জানলে। তবে এটা ঘুণাক্ষরেও যেন আর কেউ জানতে না পারে।”
রাত বারোটার কিছু আগেই বিপিন জমিদারবাড়ি চলে গেল। বারোটা বাজার পর পরই সে ফিরে এলো বিভাবরীদেবীকে সাথে নিয়ে। একটা-দুটো কথা তিনি সুধার সাথে বললেন। এই ঠান্ডাতেও একটা চাপা উত্তেজনায় বিভাবরীদেবীর কপালে বিন্দু বিন্দু জল জমতে শুরু করেছে। ঘরের মধ্যে এক কোণায় শুধু একটা মোমবাতি জ্বলছে। ঘরের আলো আঁধারীর সাথে শ্বাসরোধ করা নীরবতা ঘরের বাতাসকে আরো ঘন করে তুলেছে।
নীরবতা ভঙ্গ করে জানলায় হালকা তিনটে খট-খট শব্দ ঘরের মধ্যে প্রতিধ্বনি তুলল। বিপিন ঘরের দরজা খুলে দিতেই চাদরে আপাদমস্তক মোড়া একজন ঘরে ঢুকল। খাওয়া-দাওয়ার পর সুধা সেই যে ভয়ে বিছানায় উঠেছে আর সে নামেনি। ছায়া মূর্তির পাশে বিপিন দাঁড়িয়ে সুধার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল,- ”আমার স্ত্রী, সুধা।” সুধা সে দিকে তাকাতেই দেখল মোমবাতির আলোয় চাদরের ভিতর দিয়ে জ্বলে ওঠা দুটো চোখ তার দিকে শুধু একবার দৃষ্টিপাত করে চাদরের অন্ধকারে বুজে গেল। আসার সময় বিভাবরীদেবী নিজের সাথে কিছু খাবার তৈরী করে এনেছিলেন। বিকাশ ঘরে ঢুকতেই অন্ধকারের মাঝে মেঝেতে সব খাবার থালায় সাজিয়ে দিলেন। সুধা দেখল একটা হাত থালা থেকে খাবার তুলছে আর তা চাদরের কাছে এসেই অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। তাদের মধ্যে কি কথা হল তার কিছুই সুধার কানে গেল না। শুধু খাবার চেবানোর শব্দ ও মাঝে মাঝে বিভাবরীদেবীর চাপা ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজ অন্ধকার ছিঁড়ে তার কানে আসলো। একটা সময় খাবার চেবানোর শব্দ থেমে থালার উপর জলের আওয়াজ এলো। চাদরে ঢাকা ছায়া মূর্তি উঠে দাঁড়াতেই বিভাবরীদেবী জড়িয়ে ধরলেন। কান্নার সুর একটু উপরে উঠে আবার নেমে গেল। আলো ছায়ার মাঝে আরও একবার জ্বলে উঠল চোখ দুটো। দরজার পাশে রাখা খাবার ভর্তি ব্যাগ হাতে তুলে দরজার বাইরের অন্ধকারে মিলিয়ে গেল সেই ছায়ামূর্তি। দরজা থেকেই বিপিনের গলায় ভেসে এলো,- ”একটু অপেক্ষা করো, আমি বড়মাকে পৌঁছে দিয়ে আসছি।”
বেরিয়ে যাওয়ার সময় বিপিন ঘরের আলো জ্বেলে দরজা বন্ধ করে দিল। হঠাৎ এক ঝাঁক আলোয় সুধার চোখ ধাঁধিয়ে গেল। তবু আলো দেখে তার হৃদপিণ্ডের ধুকপুকুনি কিছুটা স্বাভাবিক হল। ”তাড়াতাড়ি ফিরে এসো।” - বলে একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো।
প্রায় আধা ঘণ্টা পর বিপিন ফিরে এলো। বাইকের ইঞ্জিন বন্ধ করতে করতে সে দেখল ঘরের দরজা খোলা আর ভিতরে কোনো আলো জ্বলছে না। পরক্ষণেই ঘরের ভিতর থেকে সুধার গোঙানি আওয়াজ ভেসে এলো। বাইক থেকে নামতে নামতে সে দেখল ঘরের ভিতর থেকে চাদরে মোড়া এক ছায়ামূর্তি দৌড়ে বেরিয়ে এক পলকের জন্য থমকে লাফিয়ে বারান্দা পেরিয়ে মাঠের অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। বিপিন তাড়াতাড়ি করে ঘরে ঢুকে আলো জ্বালিয়ে দেখল মেঝেতে ছড়িয়ে আছে কাঁচের চুড়ির সাথে শাঁখা-পলার টুকরো। সুধার দুই-হাতের কাঁধের কাছে আঁচোড় কাটা রক্তের দাগ ফুলে ফুলে উঠছে। অবশ হাতে এলোমেলো বিছানার উপর থেকে কোনো রকমে লেপ টেনে নিজেকে চাপা দিল। চোখ ফেটে বেরিয়ে আসছে তার অবিশ্রান্ত জলধারা। শুধু বিপিনকে সামনে দেখে সে কণ্ঠ রোধ করে নিয়েছে। ঘরের সামনে বাইকের একঝলক আলোয় ভেসে ওঠা সেই মুখ বিপিনের চিনতে ভুল হয় নি। চাদরের আড়ালে থাকা মুখ যাকে সে বিপ্লবী বলে জানত আজ তাকে নরখাদক রূপে চিনেছে। সে আর কেউ নয় জমিদার বাড়ির একমাত্র বংশধর, তার ছোটোবেলার বন্ধু বিকাশ।
পর্ব : ৫
সেই রাতের ঘটনার পর বিপিন জমিদার বাড়ির প্রতি বিমুখ হয়ে পড়ে। বিভাবরীদেবীর কথা ভেবে সুধা ও বিপিন দু-জনেই সে-কথা চেপে যায়। জমিদার বাড়ির সাথে আপাত মৌখিক সম্পর্ক বজায় রাখলেও পারিবারিক আন্তরিকতা থেকে নিজেদেরকে ধীরে ধীরে সরিয়ে নিতে থাকে। সকলের নজরে দুই পরিবারের সম্পর্ক আগের মতোই থাকলেও বিভাবরীদেবীর নজরে এই দূরত্ব খুবই স্পষ্ট তবুও সদ্য বিকাশের সাথে দেখা করার আনন্দে তিনি তা উপেক্ষা করে গেলেন। রাজনৈতিক আবহাওয়ার আমূল পরিবর্তন ও ক্ষমতার হস্তান্তর যে অবশ্যম্ভাবী তা বিপিনের বুঝতে দেরি হল না। শুধু পার্টি করে নিজের সংসার চালানো যাবে না তা বুঝতে পেরে, বাবার কারখানায় সে কাজে ঢুকে যায়। আর পার্টির কাজের জন্য বেছে নেয় কারখানা থেকে ফিরে সন্ধ্যার সময়।
মাস ছয়েক কাটতে না কাটতেই বিপিনের আশঙ্কা বাস্তবের মাটিতে এসে দাঁড়ালো। ক্ষমতার হস্তান্তরের সাথে সমাজে একটা শান্তি-শৃঙ্খলার পরিবেশ সৃষ্টি হল। অন্যদিকে ক্ষমতা হারানোর জন্য সূর্য্যকান্তবাবু ও তাঁর মতো অনেকেই নিজের দল ছেড়ে বেড়িয়ে এলেন। এমতো অবস্থায় পুলিশের হাতে বিকাশের ধরা পড়া ক্ষণিকের জন্য তাঁকে বিব্রত করলেও তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও প্রভাব কাজে লাগিয়ে দু-সপ্তাহের মধ্যে পুলিশের হাত থেকে ছাড়িয়ে বাড়ি ফিরিয়ে আনলেন বিকাশকে। সংসারে মন বাঁধার জন্য কালবিলম্ব না করে সুর্য্যকান্তবাবু তাঁর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও রাজনৈতিক ক্ষমতায় আসীন দেবনারায়নবাবুর একমাত্র মেয়ে নয়নতারার সাথে বিকাশের বিয়ের ঘোষণা করলেন।
বিকাশের ফিরে আসা ও তার বিয়েকে ঘিরে জমিদারবাড়িতে চার চাঁদ লেগে গেল। সেই চাঁদের আলোয় সারা গ্রাম ভেসে গেলেও বিপিন ও সুধার মনকে আন্দোলিত করতে পারেনি। বরং তাদের মনে কিছুটা অন্ধকার নেমে আসে যখন বিকাশের বিয়ের নিমন্ত্রণ পত্র তাদের বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছায় না। যদিও ওই বাড়িতে যাওয়ার ইচ্ছা তাদের কারোরই নেই। বিয়ের পর বিকাশ ক্ষমতার রাজনীতিতে যোগ দিল। পাঁচ বছরের বিপ্লবী জীবনের পর বিকাশ প্রকাশ্য রাজনীতিতে আসতেই দল তাকে উষ্ণ আলিঙ্গনে যুবনেতার মুকুট পড়িয়ে দিল। ক্ষমতা বাড়ার সাথে সাথে বিকাশ নিজের অস্তিত্ব পাকা করতে চার পুরানো বন্ধু রঞ্জন, অবিনাশ, নির্মল, অধীরকে একেবারে কাছে টেনে নেয় যারা তাকে অর্থ, লোকবল ও আইনি পরামর্শ দিবে আর পরিবর্তে বিকাশের রাজনৈতিক হাত হবে তাদের ছত্রছায়া। এদের মধ্যে অন্যতম হলেন রঞ্জনবাবু যিনি সামনে জুয়েলারী দোকান খুলে রেখে পিছনে সোনা ও কাঁচাটাকার লেনদেন করেন। পার্টি ফান্ডিং-এর একটা বিশাল অঙ্ক ইনি সামলান। অবিনাশবাবু পেশায় একজন উকিল তবে এনার হাতে এখনও অবধি কোন কেস শেষ পর্যন্ত যায় নি। আইন এনার কাছে যমদন্ড, যার দিকে ছুঁড়বেন তার যমদর্শন অবশ্যম্ভাবী। তাই ইনি কোর্ট রুমের ভিতরের থেকে বাইরে কেস মিটিয়ে নিতে বেশী পছন্দ করেন। নির্মলবাবু শুধুই নামে নির্মল, প্রোমটারির সাথে একটা দল চালান যা লোক জড়ো করতে বা উৎখাত করতে সিদ্ধহস্ত। সাধারণ খবরের কাগজের চাকরী দিয়ে শুরু করে এখন সে টিভি নিউজ রিপোর্টার। বিকাশ তাকে নিজের চ্যানেল খুলতে সাহায্য করবে আর সেখানে বিকাশের শুধুই গুণগান হবে।
আপাত ভিন্ন রাজনৈতিক ভাবাদর্শ ও সূর্য্যকান্তবাবুর অখণ্ড সমর্থনের জোরে বিকাশ কয়েকদিনের মধ্যেই প্রভূত প্রভাবশালী নেতা হয়ে দাঁড়াল। কিন্তু প্রতিটা ক্ষমতা সম্পন্ন নেতার একজন খুব বিশ্বস্ত কাছের লোক দরকার যাকে সময়-অসময়ে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করা যাবে। এতদিন সূর্য্যকান্তবাবুর কাছের মানুষ হিসাবে বিপিন সেই বিশ্বাস অর্জন করেছিল। তাই বিপিনকে সূর্য্যকান্তবাবু স্বয়ং একদিন বিকাশের দলের হয়ে কাজ করার প্রস্তাব দেন। যেহেতু তিনি সব ঘটনা জানেন না তাই সরাসরি তাঁর প্রস্তাব অগ্রাহ্য করা বিপিনের পক্ষে সম্ভব হল না। বিপিনের নীরবতাকে সম্মতির লক্ষণ ভেবে তিনি পুরানো দলের সম্পর্কে যা মন্তব্য করলেন তা শোনার পর সূর্য্যকান্তবাবুর জন্য যে তিলার্ধ সম্মান বিপিনের বুকে ছিল তা একেবারেই অদৃশ্য হয়ে গেল। একটা সময় পরিবার-পরিজনের ঊর্ধ্বে যে সুর্য্যকান্তবাবুর কথা ও আদর্শ শিরোধার্য করেছিল আজ ছেলের জন্য স্বয়ং তিনি নিজের আদর্শ থেকে সরে গিয়ে বিপিনকে জীবনের এক চরম শিক্ষা দিয়ে গেলেন। মুখ নীচু করে বিপিন বলেছিল, - ”আমি আমার দলের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারব না। তাছাড়া আমি রাজনীতিতে তেমন ভাবে আর সক্রিয় নই।” সূর্য্যকান্তবাবু টাকার লোভ দেখাতেও পিছুপা হননি, কিন্তু বিপিনকে ফেরাতে পারলেন না। নিজ ব্যর্থতার আস্ফালন ঢাকতে অত্যন্ত রেগে গিয়ে তিনি বললেন, - ”এতদিন ধরে তোকে কাছে রেখে ছেলের মতো দেখলাম আর আজ তুই আমায় ফিরিয়ে দিলি। তোর এতো দম্ভের ফল তুই পাবি।” সত্যিই বিপিন সূর্য্যকান্তবাবুর কাছে কৃতজ্ঞ তাঁর অবদানের জন্য। তাই তাঁর রাগে এতটুকুও বিরক্ত না হয়ে চুপ করে সব শুনে গেছে। কিন্তু সূর্য্যকান্তবাবু সেখান থেকে চলে যাওয়ার পর সে মনে মনে বলল,-”আপনি যদি সব ঘটনা জানতেন তাহলে এমন প্রস্তাব আমার কাছে কখনই আনতেননা।”
মাস কয়েক পরেই সুধা বিপিনকে জানায় যে সংসারে নতুন মানুষ আসতে চলেছে। এই খবর পেয়ে বিপিন সব ভুলে একেবারে সংসারী হয়ে গেল। পার্টি অফিসের সাথে তার যোগাযোগ শুধু পূর্ণিমা-অমাবস্যায়। কারখানাতে সে এখন মাঝে মাঝেই ওভারটাইম করে বেশী টাকার আশায়। বিপিন নিজের জীবনের অনেক হেরে যাওয়া গল্পের মাঝে পুত্র সন্তানের পিতা হয়ে খুব গর্বের সাথে নাম রাখল ’অজিত’।
সুখে শান্তিতে পাঁচটা বছর তাদের সংসার বেশ ভালো ভাবেই কেটে যাচ্ছিল। একদিন সকালে কারখানা যাওয়ার পথে সে খবর পেল রান্না ঘরের গ্যাস সিলিন্ডার ফেটে বিভাবরীদেবী মারা গেছেন। খবরটা পাওয়া মাত্রই বিপিন বাড়ি ফিরে অজিত ও সুধাকে নিয়ে জমিদারবাড়ি যায় শেষ বারের মতো দেখে আসতে। চুপ চাপ বিভাবরীদেবীকে প্রণাম করেই তারা চলে আসে। বিভাবরীদেবীর প্রয়াণের পর বিকাশ এতোটাই অর্থ ও ক্ষমতা পিপাসু হয়ে গেল যে ন্যায়-অন্যায়ের সীমারেখা তার জীবন থেকে মুছে গেল। তবে বিপিন ও সুধা যথা সম্ভব তাদের থেকে দূরত্ব বজায় রেখেই চলল। কিন্তু একদিন কারখানায় ওভারটাইম করার সময় কিছু খুব পুরনো কারখানার কর্মচারীর থেকে এখানে আগুন লাগার ঘটনার বিবরণে বিকাশের নাম শুনলো। সেদিন সন্ধ্যায় বিকাশ ও তার দল বারুদ লুঠ করতে এসে প্রথমে দুই জন গার্ডকে গুলি করে কারখানার পাওয়ার কেটে দেয়। তারপর ভিতর থেকে যা পেরেছে নিজেদের সাথে নিয়ে সালফার ট্যাঙ্কে গুলি করে কারখানার ভিতরে ও বাইরে বেরিয়ে ট্রান্সফরমারে গুলি করে বাইরে থেকে আগুন ধরায়। যারা তাদের দেখেছিল তারা যদি মুখ খোলে তাহলে তাদের পরিবার শেষ করে দেবে এমন হুমকি দিয়ে যায়। তাই পুরো ব্যপারটা শর্ট সার্কিটের উপর দিয়ে চালানো হয়।
অনেকদিন পর সেদিন আবার বিপিন মদ খেয়ে চূড় হয়। বিপিনের হঠাৎ করে এমন অস্বাভাবিক আচরণ সুধাকে রীতিমত ভাবিয়ে তোলে। মাঝে মধ্যে সে মদ খেতো ঠিকই কিন্তু আজ সে সব মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। বারান্দার সিঁড়িতে বসে বিপিন ঢক ঢক করে গলায় মদ ঢেলে যাচ্ছে আর বিকাশের নামে গালাগালি দিচ্ছে।
সুধা অনেক শান্ত করার চেষ্টা করলেও কিছুতেই কিছু পরিবর্তন হয় না বিপিনের। তার এমন আগ্রাসী ও প্রতিশোধ পরায়ণ মনোভাব সে কখনো দেখেনি। ভয়ে কিছুটা পিছিয়ে এসে সুধা এমন করার কারণ জিজ্ঞাসা করায় বিপিন বলল,-”ওই বিকাশ সেদিন আমার বাবার কারখানা লুট করে বারুদ নিতে গিয়ে কারখানায় আগুন লাগিয়ে দেয়। আমার বাবা সেদিন ওই আগুনে মারা যায়। আমি আমার বাবাকে শেষ বারের মতো দেখতে পর্যন্ত পাইনি। আর ওই দিন ভোররাতে আমার মাও মারা যায় সাপের কামড়ে। ওই – ওই পুকুর পাড়ে মাকে উপুড় হয়ে পড়ে থাকতে দেখেছি। সব- সব কিছু পিছনে ওই বিকাশ হারামজাদা। অনেক কিছু ভেবে আমি এতোদিন চুপ ছিলাম। এমন বিষাক্ত জাতের সাপকে একটা সময় বন্ধু ভেবেছিলাম আর আজ তার ফল ভুগতে হচ্ছে। ওর মৃত্যু কামনা করি ঠাকুর, ওর মৃত্যু হোক।”
বিপিনের মুখে কথাগুলো শুনে সুধার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে যায়। প্রায় টানতে টানতে বিপিন কে ঘরে এনে মেঝেতেই শুইয়ে দেয়।
বাবার অমন অবস্থা দেখে ছোটো অজিত অনেক ভয় পেয়ে যায়। অজিতের তখন খেলার সঙ্গী বলতে তার বাবা আর পাশের বাড়ি নিতাই কাকার মেয়ে কাজল। দুজনেই প্রায় সমবয়সী। তাই বাবার অবর্তমানে কাজলের সাথে তার খেলা যেমন হত তেমন ঝগড়াও। সেই রাতে বিপিনের অমন মাতলামি শুনে নিতাই কাকা ও কাজল এসেছিল রাতে। তারা আসতে বিপিন একটু চুপ হয়েছিল। না হলে হয়তো সারারাত এমনটাই করে যেত।
অনেকক্ষণ পর বিপিন নিজের মনে বকতে বকতে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘরের মধ্যে অজিত বাবার মুখে সব কথা শুনে সুধাকে জিজ্ঞাসা করে - ”মা, বিকাশ কে? ওই জমিদারবাবু বুঝি?”
সুধা খুব গম্ভীর গলায় হুম করে বলল, - ”বাবু, এই নিয়ে তুমি আর একটাও কথা কাউকে বলবে না আর জিজ্ঞাসাও করবে না। মনে থাকবে?”
ছোটো অজিত ভয়ে ভয়ে ঘাড় নেড়ে মায়ের কথায় সম্মতি জানালো।
নিজের বাবার মৃত্যুর জন্যও যে বিকাশ দায়ী তা সে কোনদিন কল্পনায় আনতে পারে নি বিপিন। তাই ঠিক করে এই সব কিছু তথ্য সে পার্টি অফিসে জানিয়ে সামনের ভোটের প্রচারে বিকাশ ও সূর্য্যকান্তবাবুর আসল চেহারা সবার সামনে আনবে। কিন্তু বিপিন যে কারখানায় আগুন লাগার আসল কারণ জেনে গেছে তা বিকাশের কানে উঠতে বেশী সময় লাগলো না। পরদিন সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার পথে বিপিন দেখল হঠাৎ করে রাস্তার মাঝে একটা সাদা গাড়ি একেবারে তার গায়ের কাছে এসে দাঁড়ালো। বিপিন থমকে রাস্তার ধারেই দাঁড়িয়ে পড়ল। গাড়ি থেকে বিকাশ নেমে একেবারে বিপিনের সামনে এসে দাঁড়ায়। নিজের বামহাত বিপিনের ডান কাঁধে রেখে কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে খুব আসতে আসতে বলল, - ”যা জেনেছিস নিজের কাছেই চাপা রাখ। সেদিন রাতের সিনেমাটায় ইন্টারভ্যাল হয়ে থমকে আছে। বলিস তো বাকি সিনেমাটা দেখিয়ে দিতে আমার কোনো আপত্তি নেই। এবার তুই ঠিক কর সিনেমা দেখবি না যেমন আছিস তেমনই থাকবি?”
কথা গুলো শুনে বিপিনের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। চোখ গুলো একেবারে রক্ত জবার মতো লাল হয়ে গেল। তার সারা শরীর দিয়ে একটা শীতল সাপ যেন হিলহিল করে খেলে যাচ্ছে। দুই হাতের মুষ্টি শক্ত করে পাকিয়ে ধরে যথা সম্ভব নিজের রাগ সংবরণ করলো। বিকাশের চলে যাওয়ার পথের দিকে অনেকক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। প্রতিশোধের আগুনটা তার যেন হঠাৎ করে খুবই নিজের ব্যক্তিগত মনে হল।
পর্ব : ৬
শুধু রাজনৈতিক দিক থেকে নয়, ব্যক্তিগত দিক থেকেও বিকাশের সাথে দ্বন্দ্বে একেবারে মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো বিপিন। সে বিকাশের সম্পর্কে আরো তথ্য সংগ্রহে মন দিল। সাথে সাথে নিজের দলের হাতে সংগৃহীত তথ্য তুলে বিকাশের মানবদরদী চেহারার মুখোশ ছিঁড়ে ফেলে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গেল। একটা সময় বিভাবরীদেবীর কাছে সব কিছু গোপন করে যাওয়ার আফসোস এখন তাকে মাঝে মাঝেই বিব্রত করে তোলে। ফেলে আসা সময়ে যদি সরব হতো তাহলে বিকাশের রূপ হয়তো এতোটা কদর্য হতো না। কারখানায় বিকাশ ও তার ছত্রছায়ায় পালিত বন্ধুদের সম্পর্কে এমন অনেক তথ্য বিপিন জানতে পারলো যা তার সাথে ঘটে যাওয়া সেই রাতের ঘটনার থেকে সহস্র গুণে মর্মান্তিক। বাড়ি লুট করা ও বাধা পেয়ে সদ্যজাত সন্তান সহ মহিলার গায়ে আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে মারার মতো নৃশংস কাজ করতেও তাদের হাত কাঁপেনি।
বিপিনের কাছে সমস্ত ঘটনা শুনে সুধা রীতিমতো ভয় পেয়ে গেল। তারপর একটা সময় সে বলল, - ”সূর্য্যকান্তবাবু এখনো অনেক ক্ষমতা রাখেন। তাঁর কাছে সব কিছু বলে দেখ না যদি বিকাশকে কিছুটা হলেও আটকানো যায়।”
সুধার কথা বিপিনকে একটু ভাবায়। তারপর সে মেনে নেয়। কিন্তু একটা সন্দেহ তার মনে থেকে যায় - সূর্য্যকান্তবাবু আদৌ তার কথা শুনে বিশ্বাস করবেন তো? শেষবার তাঁর কথা না মানায় তিনি বিশ্বাসঘাতক বলে গেছেন। তবে যাই হোক একবার সূর্য্যকান্তবাবুকে কথা গুলো বলা দরকার। জানা দরকার তাঁর ছেলে আদতে রাজনীতির নামে কি করে যাচ্ছে। সন্দেহটা আরো বেড়ে যায় যখন ভাবে সূর্য্যকান্তবাবু নিজে পাল্টে গেছেন। নিজের দল থেকে বেরিয়ে এসেছেন।
এইসব অনেক সাত-পাঁচ ভেবে বিপিন একেবারে সকাল সকাল সূর্য্যকান্তবাবুর চায়ের প্রথম চুমুকের সাথে হাজির হল জমিদারবাড়ির দরজায়। বাগানে বসে সূর্য্যকান্তবাবু চা খেতে খেতে বিপিনকে দেখেই তাকে হাত নেড়ে ভিতরে আসতে বললেন। তাঁর হাতের ইশারায় দারোয়ান দরজা খুলে দিল। সূর্য্যকান্তবাবুকে প্রণাম করে সে সামনের চেয়ারে বসে ধীরে ধীরে সব কথা বলল। নিজের ছেলের সম্পর্কে কোনো পিতা কখনই কুখ্যাতি শুনতে পছন্দ করেন না। এখানেও তার অন্যথা হল না। তবে বিপিন যখন কারখানার ঘটনার সাথে সে-রাতের ঘটনা ও কিছুদিন আগে বিকাশের হুমকির দেওয়ার কথা বলে তখন সূর্যকান্তবাবু বিপিনের কথায় একটু বিশ্বাস করা শুরু করেন । ফিরে আসার সময় বিপিন হাত জড়ো করে অনুরোধ করে বলে,-”আপনার হাত ধরেই রাজনীতি শিখেছি। কিন্তু সেখানে কখনই কারোর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে টানাটানি করিনি। সামনেই ভোট। প্রস্তুতি সবাই নিচ্ছে। বিকাশের সাথে যা রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব আছে তা থাকুক কিন্তু সে যেন আমার পরিবারের উপর কোনো আঘাত না হানে।”
সূর্য্যকান্তবাবু খুব গম্ভীর ভাবে ”হুম। আমি দেখছি।”- বলে বিপিনকে বিদায় দিল। বাড়ির দোতলার বারান্দা থেকে বিপিনের জমিদারবাড়িতে আসা থেকে চলে যাওয়া কোনোটাই বিকাশের চোখ এড়াই নি।
বিপিন চলে যাওয়ার পর সূর্য্যকান্তবাবুর ও বিকাশবাবুর মাঝে বেশ কিছুদিন ধরে একটা গরম হাওয়া চলতে থাকে। কানাঘুষো শোনা যায় যা, বিকাশের কাজের উপর অনেক বেশি নজর রাখছেন সূর্য্যকান্তবাবু এবং সাথে সাথে তার অনেক কিছুতে বাধাও দিচ্ছেন। বিপিন ভেবেছিল বিকাশ সূর্য্যকান্তবাবুর কথা শুনে একটু হলেও নিজের উপর রাশ টানবে। কিন্তু সে ভুলে গিয়েছিল সাপের লেজে পা দিলে সাপ ছোবল মারবেই।
জমিদার বাড়ি থেকে ফিরে আসার কয়েক সপ্তাহ পর একদিন কারখানা থেকে ফিরে দেখে ঘরের একটাও আলো জ্বলছে না। সুধাকেও দেখতে পাচ্ছে না। বার-কয়েক সুধার নাম ধরে ডাকতে অবশেষে সুধা ঘরের ভিতর থেকে সাড়া দিল। বাড়ির বারান্দার আলো জ্বালাতে সুধা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে টেবিলের উপর রাখা একটা রঙিন কাগজের বাক্সের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, - ”সন্ধ্যায় ক্লাবের দু-টো ছেলে এসে এটা দিয়ে গেল আর বলল বিকাশদা পাঠিয়েছে। আমি ভয়ে ওটা খোলার সাহস পাই নি। আর বাবুকেও ওটার ধারে কাছে যেতে দিই নি।”
খুব সন্তর্পণে বাক্সটা খুলতে একটা সাদা কাঁচের বোতল বেরিয়ে এলো। বোতলটা দেখে বিপিনের চিন্তে ভুল হল না- এটা বাংলা মদের একটা বোতল। বোতলটা স্বচ্ছ তরলে ভর্তি। তবে গায়ে একটা কাগজ লাগানো। সাধারণত বাংলা মদের বোতলের গায়ে কোনো কাগজ থাকে না। কাগজের ভিতরের দিয়ে কিছু একটা লেখা আছে। ভিতরের তরলটা নড়ছে বলে তা পরিষ্কার করে বোঝা যাচ্ছে না। টেবিলের উপর বোতলটা রাখতেই স্থির তরলের ভিতর দিয়ে লেখাটা বড় বড় করে ফুটে উঠল - ” আজ রাতেই হয়ে যাক সিনেমার শেষাংশ। মদটা তোর জন্য। রাতটা খালের ধারে
কাটাস।” লেখাগুলো সুধা ও বিপিন একসাথেই পড়ল। বিপিন তৎক্ষণাৎ রেগে গিয়ে বোতলটা উঠোনের মাঝে আছাড় মেরে গুঁড়ো গুঁড়ো করে ফেলে। রাগে গজ গজ করতে করতে ”আজ বিকাশের একদিন কি আমার একদিন” - বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। পরিস্থিতি বুঝে উঠতে বেশ কিছুটা সময় লেগে যায় সুধার। তারপর তাড়াতাড়ি অজিতকে নিতাই কাকার বাড়ি রেখে বিপিনের পিছু নেয়।
জমিদার বাড়িতে আজ তেমন একটা আলো জ্বলছে না। বাড়ির ভিতরে একটা – দুটো আলো নিতান্তই না জ্বললে নয় সেই রকম ভাবে জ্বলছে। লোকজনেরও কোনো ভিড় নেই। ভোটের প্রস্তুতির সময়ে জমিদার বাড়িতে এমন অস্বাভাবিক নির্জনতা সুধার খুব একটা ভালো ঠেকলো না। অনেক দূরে থেকে সে বিপিনের ছায়ামূর্তি দেখতে পেল। তীর বেগে হেঁটে জমিদার বাড়ির দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকে অদৃশ্য হয়ে গেল বিপিন। অনেকক্ষণ জমিদার বাড়ির বাইরে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে ভিতরে কি হচ্ছে তা বোঝার ও শোনার চেষ্টা করল কিন্তু কিছুই লাভ হল না। হঠাৎ করে বিপিনের তীক্ষ্ণ চিৎকার আর সাথে সাথে আবার নীরবতা সুধাকে ভিতর থেকে কাঁপিয়ে দিল এক অশনি সংকেত। তাড়াতাড়ি করে সে শব্দের উৎসস্থল স্মরণ করে দৌড় দিল জমিদার বাড়ির ভিতর।
দোতলায় উঠে ডান দিকে তাকাতেই বারান্দার অল্প আলোয় সে দেখল বিকাশ একটা চকচকে ছুরি হাতে ধরে বিপিনের উপুড় হয়ে পরে থাকা দেহটার পাশে হাঁটু গেঁড়ে বসে আছে। বিকাশের একেবারে ডান হাতের কাছে মাটিতে রাখা আছে একটা বন্দুক। এই ভয়াবহ দৃশ্য দেখে সুধার গলা দিয়ে চিৎকার বেড়িয়ে এল কিন্তু পরক্ষণেই নিঃশব্দে একটা গুলি তার দুই চোখের মাঝ বরাবর মাথা ফুটো করে তাকে চিরতরে নীরব করে দিল।
- হ্যালো, পুলিশ ষ্টেশন?
- হ্যালো। হ্যাঁ। পুলিশ ষ্টেশন।
- আমি বিকাশ রায় বলছি।
- আরে স্যার, আপনি ! আপনি কষ্ট করে ফোন করতে গেছেন কেন? কাউকে দিয়ে ডাকিয়ে নিতে পারতেন।
- আপনি একবার তাড়াতাড়ি আমার বাড়ি চলে আসুন। বিপিন ও তার স্ত্রী আমার বাবাকে খুন করতে এসেছিল। বাবা খুব বাজে ভাবে আহত। আমি ওনাকে নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছি। বিপিন ও তার স্ত্রী বেঁচে আছে কি না জানি না। আপনি এসে বাকিটা সামলান।
- ও কে, আসছি স্যার এখুনি।
বিদ্যুতের বেগে খবর ছড়িয়ে পড়ল। জমিদার বাড়ি লোকজনে ভর্তি হয়ে গেল। নিজের গাড়ি করেই বিকাশ সূর্য্যকান্তবাবুকে নিয়ে হাসপাতালে গেল। খবর পেয়ে বাপের বাড়ি থেকে নয়নতারা সরাসরি হাসপাতালে চলে আসে। তাড়াতাড়ি করে অপারেশন করার ব্যবস্থা করা হলেও এক ঘন্টার মধ্যে ডাক্তার এসে বললেন , - ”সূর্য্যকান্তবাবু আর বেঁচে নেই।”
ডাক্তারের মুখে বাবার মৃত্যু খবর শুনে পকেট থেকে সাদা রুমাল বের করে বিকাশ চোখের কোণ মুছে নিল। নয়নতারা সেখানেই বসে কান্নায় ভেঙে পড়ল।
এদিকে পুলিশ বিপিন ও সুধার মৃতদেহ জমিদার বাড়ি থেকে বের করে সোজা পোস্টমর্টেমের জন্য পাঠিয়ে দেয়। পার্টির ও ক্লাবের লোকজন সূর্য্যকান্তবাবুর হত্যার খবর শুনে বিপিনের বাড়িতে চড়াও হয়ে তাদের ঘর ভেঙে দেয়। অজিতকেও তারা মেরে ফেলবে বলে কিন্তু নিতাই কাকা অনেক আকুতি মিনতি করে তাদের শান্ত করে।
দিন দশেক পর সব রিপোর্ট হাতে নিয়ে পুলিশ তার তদন্ত শেষে জানায়- সেদিন রাতে বিপিন ও সুধা সূর্য্যকান্তবাবুকে হত্যা করতে আসে একটা খুব ধারাল ছুরি নিয়ে। ছুরির হাতলে দুজনেরই ডান হাতের ছাপ পাওয়া যায়। বুকের পাঁজর ভেদ করে ছুরি গিয়ে লাগে একেবারে সূর্য্যকান্তবাবুর হৃদপিণ্ডে। আর তখনই তাঁর মৃত্যু নেমে আসে। বিকাশবাবু তা দেখতে পেয়ে যান। বিকাশবাবুকে দেখে প্রথমে বিপিন ছুরি তুলে নিয়ে তাকে আক্রমণ করতে আসে। উপায় না দেখে বিকাশবাবু নিজের আত্মরক্ষার তাগিদে গুলি চালান। গুলি গিয়ে লাগে একেবারে বিপিনের বুকে। সাথে সাথে বিপিন মাটিতে পড়ে যায়। বিপিনকে মাটিতে পড়ে যেতে দেখে সুধা ছুটে আসে। বিপিনের ডান হাত থেকে সুধা ছুরি নিজের ডান হাতে তুলে নিয়ে এগিয়ে আসতে চাইলে বিকাশবাবু আবার একটি গুলি করেন সুধার দিকে তাক করে। অব্যর্থ নিশানা। গুলি সুধার দুই চোখের মাঝের কপাল ফুঁড়ে মাথায় চলে যায় ও সাথে সাথে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়ে।
পুলিশের বক্তব্য পরদিন খবরের কাগজে সূর্য্যকান্তবাবু, বিপিন, সুধা ও যে ছুরি দিয়ে খুন করা হয়েছে তার ছবি সহযোগে বের হয়। খবরের কাগজে ছুরিটা দেখে ও সংবাদ পড়ে নিতাইকাকার কপালে অজস্র ভাঁজ দেখা দেয়। তারপর ছুরির ছবিটার উপর হাত বোলাতে বোলাতে কপালের ভাঁজ ধীরে ধীরে মিলিয়ে আসে যেমনটা হয় জ্ঞানের আলোয় অন্ধকারের অপসরণ।
পর্ব : ৭
নয়নতারার কাছে শ্বশুর মশাই নাতি-নাতনির মুখ দেখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রিপনের জন্মের তিন দিন পরেই সূর্য্যকান্তবাবুর হঠাৎ মৃত্যু তাঁর শেষ ইচ্ছাটুকুও পূরণ হতে দিল না। নয়নতারা ও তার পরিবার রীতিমত মর্মাহত হন সূর্য্যকান্তবাবুর আকস্মিক মৃত্যুতে। তবে নতুন অতিথি আসায় বাড়িতে শোকের ছায়া অল্প কিছুদিনের মধ্যেই মুছে গিয়ে আনন্দের সুর বেজে ওঠে।
জমিদার বাড়ির উত্তরসূরির পদার্পণে সারা গ্রাম যেমন একদিকে আনন্দে মেতে ওঠে, অন্যদিকে একরাতেই পাঁচ বছরের অজিত বাবা-মা সহ নিজের বাড়িটুকুও হারিয়ে ফেলে। শুধু তাই নয়, কিছু না করেই তার গায়ে তকমা লেগে যায় খুনির ছেলে। গ্রামের স্কুলেও তাকে সবাই একঘরে করে দেয়। বন্ধু বলতে একমাত্র পাশে থাকে কাজল। যদিও নিতাইকাকার আর্থিক অবস্থা একেবারেই মন্দ তবু সে-ই তার এখন একমাত্র আশা ও ভরসা। কিন্তু নিতাইকাকার বাড়িতে থাকার জন্য অজিতের উপর লাগানো লাঞ্ছনার ছিটে কিছুটা কাজলের উপরেও লাগলো। স্কুলে তারও বন্ধু সংখ্যা একেবারেই কমে গেল। যারা শেষমেশ টিকে রইল তারা পর্যন্ত বলল, - ”তোর বাবা খুব ভুল কাজ করছে। ওই খুনির ছেলেকে তোরা বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দে। না হলে কিন্তু দেখবি কোন দিন তোদের বুকে ছুরি মেরে দিয়েছে।” কাজলের খুব খারাপ লাগতো এমন কথা শুনে। অনেকবার সে স্কুল যাবে না বলে কান্না জুড়ে দিত। কিন্তু নিতাইকাকা তখন বুঝিয়ে বলত, - ”স্কুলে না গেলে খিচুড়ি পাবি কি করে? না খেয়ে থাকতে পারবি তো সারাদিন?”
নিতাইকাকার কথায় কাজল যা বুঝতো তার থেকে অনেক বেশী উপলব্ধি করত অজিত নিজে। এতো অল্প বয়সে বাস্তবের মাটিতে আছাড় খেয়ে তার উপলব্ধির পরিধি অনেকগুণ বেড়ে গেছে। সে জোর করে কাজলকে হাত ধরে স্কুলে নিয়ে যেত। বন্ধুহীন স্কুলে দুজনেরই মন টিকলো না। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই স্কুল ছেড়ে অজিত হাতে তুলে নিল নিতাইকাকার কামারশালার হাতুড়ি আর কাজল আঁচলে বাঁধলো সংসারের চাবি।
অজিতের কামারশালার প্রতি আগ্রহ ও কাজ শেখার নেশাকে হাতিয়ার করে নিতাইকাকা তাকে একজন দক্ষ কামার বানিয়ে তুলল। তার হাত দিয়ে লোহা পিটিয়ে সেখানেও যে সোনার গহনার মতোই কারুকার্য করা যায় তা নতুন করে সবাইকে আশ্চর্য করল। ধীরে ধীরে তাদের দোকানের হাল কিছুটা ভালোর পথে আসতে থাকে। কিন্তু সেই ভালো অনেকের চোখে কাঁটার মতো বিঁধতে থাকে। রাজনৈতিক দল ও ক্লাবের অনাবশ্যক চাঁদার জুলুমবাজি বার বার তাদের মাটিতে মিশিয়ে দেয়। এমন ভাবেই কেটে যায় পনেরোটা বছর। পরিবর্তনের মধ্যে অজিত তাদের ভাঙা ঘরের জায়গায় একটা মাটির বাড়ি বানিয়ে সেটাকে বাড়ির চেয়ে বেশী কামারশালায় পরিণত করে। সারাদিন নিতাইকাকার দোকানে আর রাতে নিজের বাড়িতে কাজ করে। তবে বয়সের ধর্ম অনুযায়ী কাজলের মধ্যে প্রভূত শারীরিক পরিবর্তন দেখা যায় যা আশে পাশের অনেক পুরুষের দৈহিক বাসনার উদ্রেক করে। সারাদিনে তার কাজ বলতে দুটো বাড়ি পরিষ্কার করা আর রান্না করা। নিজের তৈরি কোদাল-কুড়ুল বিক্রি করে অজিত তাকে একটা রেডিও কিনে দিয়েছিল তার জন্মদিনে। কাজলের হাজার কাজের মাঝে সেই রেডিওটাই তার সারাক্ষণের সঙ্গী। এমনকি ঘুমানোর সময়ও সেটা একেবারে মাথার কাছে নিয়ে হালকা করে চালিয়ে গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে যায়।
বর্ষা কাল। সারা আকাশ জুড়ে কালো মেঘ দিন রাতের ব্যবধান ঘুচিয়ে দিয়েছে। বর্ষার দিনগুলোতে কাজ খুব আসে। তাই একেবারে দুপুরের খাবার সেরে নিতাইকাকা ও অজিত দোকানে যায়। আজ সকাল থেকে বৃষ্টি হচ্ছে না দেখে নিতাইকাকা দোকানে যায়। অজিত তার মাটির ঘরেই নিজের সূক্ষ্ম হাতের কাজ নিয়ে সকালটা কাটায়। কিন্তু দুপুরের দিকে হঠাৎ করে আকাশ একেবারে ভেঙে পড়ে। নিতাইকাকা অবস্থা দেখে তাড়াহুড়ো করে দোকান বন্ধ করে বাড়ি চলে আসে। খাবার পর দুজনে দোকানে গিয়ে দেখে দোকান জলে জলময়। হাপরের ভিতরেও জল ঢুকে গেছে। পরিষ্কার না করা পর্যন্ত একটা কাজও করা যাবে না। কিছুটা পরিষ্কার করার পর দিনের আলো এতোটাই কমে গেল যে বাধ্য হয়ে একটা টর্চ আনতে অজিত আবার বাড়ি ফিরল। বার-দুই কাজলের নাম ধরে ডাকার পরেও যখন কোনো সাড়া পেল না তখন সে টর্চ নিয়ে বাড়ির চারিদিকে ভালো করে দেখতে লাগল। বাড়ির পিছনে কিছুটা দূরে রাস্তার উপর থেকে রেডিওর কড়কড় শব্দ আসতে অজিত সেদিকে ছুটে গিয়ে দেখল তার দেওয়া রেডিওটা বৃষ্টির জলে ভিজছে। ছাতা ফেলে রুদ্ধশ্বাসে অজিত পিছনের রাস্তা ধরে ছুটলো। ক্লাব ঘরের কাছে আসতে আসতেই সে একেবারে ভিজে গেছে। হালকা ঠান্ডাও লাগছে। ক্লাবের দরজার সামনের বারান্দায় উঠে সে একটু আশ্রয় নিল। অঝরে বৃষ্টি ঝরার শব্দের মাঝে দরজার ফাঁক দিয়ে হালকা গোঙানি শব্দ তার কানে লাগতেই তার মেরুদন্ড দিয়ে এক তীব্র শীতল শিহরণ খেলে গেল। পরক্ষণেই উন্মাদের মতো কাজলের নাম ধরে দরজা চাপড়াতে লাগলো সে। গোঙানির শব্দ এখন কান্নায় পরিণত হয়েছে। হঠাৎ করে দরজাটা খোলার সাথে সাথে তার মাথার উপর একটা শক্ত কাঠের সজোর আঘাত তাকে ধীরে ধীরে অবচেতন করে দিল। ক্লাব ঘরের এক কোণায় ক্যারাম বোর্ডের উপর ল্যাম্পের আলো তখনও দুলছে। অজ্ঞান হওয়ার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত সে দেখল ঘরের এক কোণায় কাজলের নিস্তেজ নগ্ন দেহটা। আলোতে তার মুখের উপর মাছের চোখের মতো নিস্পলক চোখ দুটো জ্বল জ্বল করছে। চোখ দুটো তার দিকেই তাকিয়ে আছে। তাকে দেখে চোখের তারাটা একটু যেন নড়ে উঠল। মেঝের উপর দিয়ে গড়িয়ে সে দিকে যাওয়ার একটু প্রচেষ্টা করতেই তল পেটের কাছে একটা শক্ত জুতোর আঘাত তাকে একেবারে কুঁকড়ে দিল। ক্লাব থেকে একে একে অমিত, বাপ্পা, সজল, রিপন ও মঙ্গলকে বেরিয়ে যেতে দেখল। বাইরে থেকে ক্লাবের দরজা বন্ধ করে তালা লাগানোর শব্দ অজিতের কানে এলো। নিঃশ্বাস বন্ধ করে নিজের যন্ত্রণা উপেক্ষা করে সে হামাগুড়ি দিয়ে কাজলের দিকে এগিয়ে গেল। পাশে পড়ে থাকা ওড়না দিয়ে কাজলকে ঢাকা দিতে দিতে সেখানেই জ্ঞান হারালো।
চোখ খুলে অজিত নিজেকে পেল মাথায় ব্যান্ডেজ সহ সরকারী হাসপাতালের বেডে। সামনেই দু-জন পুলিশ অপেক্ষা করছিল তার চোখ খোলার জন্য। পুলিশ দেখেই অজিত তাড়াতাড়ি করে বলতে গেল- ”স্যার ওরা…”
তার কথা শুরুর আগেই এক পুলিশ ধমক দিয়ে বলল, - ”একেবারে চুপ। একটা সাড়া করবি তো এখানেই গুলি করে দেব। তোর বাপ খুনি আর তুই রেপিস্ট।” জোর করে অজিতের বাঁ-হাতের টিপ সই একটা সাদা কাগজের উপরে নিয়ে নিলো। নার্সও যেন কোনো রকমে তাকে ছেড়ে দিতে পারলে বাঁচে আর সেটাই করল। সরাসরি পুলিশের গাড়িতে করে এসে সে বন্দি হল থানার ভিতরে। থানায় এসে অজিতের সই করা কাগজে থানার বড়বাবু কিছু লিখে যত্ন করে নিজের কাছে রেখে দিলেন। তারপর অজিতের দিকে তাকিয়ে বললেন ,- ”যত দিন কাজলে জ্ঞান না ফিরছে তত দিন তুই এখানেই থাকবি।”
এদিকে কাজল অর্ধচেতন অবস্থায় নিজের বাবা ও পুলিশের সামনে সব কিছু বলল। নিতাইকাকা সঙ্গে সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ জানালো। কিন্তু সরকারী হাসপাতালে প্রায় তিন দিন থাকার পর বড়বাবু অজিতের সই করা কাগজ নিয়ে এলেন কাজল ও নিতাইকাকার সামনে। একটু অনুরোধের সুরে বড়বাবু নিতাইকাকাকে বললেন, - ”আপনি ও আপনার মেয়ে এই অভিযোগ তুলে নিন। নাহলে অজিতের স্বীকারোক্তি তাকে জেলে যেতে বাধ্য করবে।”
অবাক হয়ে নিতাইকাকা বললেন,-”কিন্তু অজিত কিছু করে নি তা জেলে যাবে কেন?”
বড়বাবু ভালো করে অজিতের টিপসই করা কাগজটা দেখিয়ে বললেন,-”অজিত সব স্বীকার করে নিয়েছে যে সেই এমন কাজ করেছে। তাই আপনারা যদি অভিযোগ করেন তাহলে তা অজিতের উপরেই পড়বে। তাই অভিযোগ তুলে নিলেই আপনাদের মঙ্গল।”
কথা গুলো শুনে কাজল কান্নায় ভেঙে পড়ল। টাকা ও ক্ষমতার জোরের সামনে নিজেরা একেবারে অসহায় হয়ে গেল। বাধ্য হয়ে তারা অভিযোগ তুলে নিল। অজিত ছাড়া পেয়ে সরাসরি হাসপাতালে আসে। কাজলের হাত ধরার সাথে সাথে অজিতের দু-চোখ ভেসে যায়। কাজল নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে বলে, - ”আর একটু দেরি হলে হয়তো আমি আর বেঁচে ফিরতাম না। এতো তাড়াতাড়ি মৃত্যুটা হয়তো ভাগ্যে নেই। তাই সেদিন তুমি ওখানে চলে এসেছিলে।”
অজিত কিছু বলবে ভেবেছিল কিন্তু গলা থেকে তার কোনো শব্দ বেরোল না। কাজলের হাত নিজের হাতের মাঝে নিয়ে কপালে ঠেকালো।
প্রায় দিন সাতেক পর হাসপাতাল থেকে তারা বাড়ি ফেরে। এক ঘরে হয়ে যাওয়ার ভয়টা নিতাইকাকার মধ্যে বেশ কিছুদিন জাঁকিয়ে বসেছে। দোকানের অবস্থা খুবই খারাপ। দিনান্তে একটাও বিক্রি নেই। চাপা ভয় ও উত্তেজনায় নিতাইকাকার শরীর দিন দিন খারাপ হতে থাকে। নিজেই একদিন অজিতে হাত ধরে বললেন, - ”অজিত, আমি চলে গেলে কাজলের তুমি ছাড়া আর কেউ নেই। তাই আমি থাকতে থাকতে তোমাদের বিয়ে দিয়ে যেতে চাই। মেয়েটাকে তোমার হাতে তুলে দিয়ে অন্তত শান্তিতে মরতে পারবো।”
নিতাইকাকার কথায় অজিত রাজি হয়ে যায়। এমনিতেই সে কাজলকে খুব ভালোবাসে। আর কাজলও তাকে চোখে হারায়। তাই একদিন সকাল সকাল মন্দিরে গিয়ে নিতাইকাকা দুজনের বিয়ে দিয়ে দেন। সারাদিন খুব আনন্দে আর হাসিতে মেতে ছিল নিতাইকাকা। তাকে এতো খুশি এর আগে কেও কখনো দেখেনি । কিন্তু রাত পেরোতেই তার নিষ্প্রাণ দেহ অজিতকে দ্বিতীয়বার অনাথ করে। নিজের জীবনে পর পর দুটো ধাক্কা কাজল কিভাবে সামলাবে বুঝে উঠতে পারলোনা। নিষ্প্রাণ দেহেও বাবার মুখে লেগে থাকা গতকালের হাসির দাগ কাজল নিজের কান্নায় ভিজিয়ে দেতে চায় না। তাই বারবার শুধু অতীতের কথা বলে নিজেকেই সান্ত্বনা দিয়ে যাচ্ছে।
বাবার মৃত্যুর পর অজিতের মধ্যে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করল কাজল। অনেকদিনই সকালে সে অজিতকে খুঁজে পায় তার নিজের গড়া মাটির ঘরের মেঝেতে জল-কাদা মাখা ঘুমন্ত অবস্থায়। কাজল জানতে চাইলে শুধু হাসে আর বলে, - ”কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক, কে বলে বহুদূর? মানুষের মাঝে স্বর্গ-নরক, মানুষেতে সুরাসুর।”
পর্ব: ৮
রিপন ও তার চার বন্ধুর দল বেঁধে শিকার করার কথা অনেকেই জেনে গেছে কিন্তু প্রমাণের অভাবের সাথে তাদের টাকা ও রাজনৈতিক ক্ষমতার জোরে সব সময়ই আইনের জাল কেটে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে। কাজল তাদের প্রথম শিকার ছিল। প্রথমবারেই প্রত্যক্ষদর্শী থাকা সত্ত্বেও বিন্দুমাত্র আঁচ না আসার কারণে তাদের সাহস আরো বেড়ে যায়। বছর দুয়েকের মধ্যেই এমন ঘটনার পুনরাবর্তন বেশ কয়েকবার হয় আর প্রতিবারেই তারা অধরা থেকে যায়। তাদের চোখে লেগে থাকা রক্ত-মাংসের নেশা ও চলনে শিকারীর ভঙ্গি শিশু থেকে বৃদ্ধা সবারই মনে আতঙ্কের সৃষ্টি করে। তাই তারা দল বেঁধে বা একা যে কোনো পরিস্থিতিতে লোকসমাজের সামনে এলে সবাই তাদেরকে এড়িয়ে চলে। এমনকি মেয়েরা স্কুলে বা টিউশনিতে গেলে বাড়ির কোনো বড় মানুষ তাদের সাথে থাকতেই হবে এটাই এখন অলিখিত নিয়মের মধ্যে পড়ে গেছে। মেয়েদের বাড়ির বাইরে একা ছেড়ে দেওয়ার আরেক অর্থ নরখাদকের দলকে নিমন্ত্রণ পাঠানো তাদের পিপাসা নিবৃত্তি করার।
শিকারীদের শিকারের তালিকায় যাদের নাম উঠেছে তাদের জন্য সবার চোখেই আছে সহানুভূতি আর মনের ভিতরে একরাশ ভীতি। কিছুটা ভীতি কাটানোর জন্য গ্রামের প্রতিটা ঘর থেকেই দু-একটা করে ধারালো বা ছুঁচালো অস্ত্র তৈরীর অর্ডার অজিতের কাছে খুবই গোপনে আসতে লাগলো। বাড়ির মেয়েদের হাতে সব সময়ের জন্য এই অস্ত্র থাকবে। যে কোনো পরিস্থিতিতে তারা নিজেদের বাঁচানোর জন্য ভিতরে ভিতরে প্রস্তুতি নিচ্ছে। পুলিশ যেখানে নেতাদের ইশারায় নাচা কাঠের পুতুল সেখানে প্রতিটা বাড়ির ভিতরে এক বিদ্রোহী মনোভাবের জন্ম নেওয়াটা এতটুকুও অস্বাভাবিক নয়। আর তাদের হাতেই পেনের মতো দেখতে অথচ ঢাকনা খুললেই তিনটে সূক্ষ্ম ধারালো ফলা জ্বল জ্বল করে ওঠা অস্ত্র তুলে দিচ্ছে অজিত। সে অস্ত্র হাতে নিয়ে মনের মাঝে একটু সাহস এলেও ভীতি সম্পূর্ণ রূপে কাটে না, তা অজিত খুব ভালোভাবেই জানতো। দিনে দিনে পরিস্থিতি আরো জটিল হবে, গ্রামে শিকারের সংখ্যা আরো বাড়তে থাকবে, মনের আগুণ দাউ দাউ করে জ্বলে গগনচুম্বী শিখা উঠবে, তবু ক্ষমতার কাছে মাথা নত করে থাকা ছাড়া সাধারণ মানুষের কাছে আর বেশী কিছু আশা করা যায় না।
অজিত মনে মনে ভাবল, - ”শিকারীদের শিকার এখন ভীত। সেই আনন্দে শিকারীও আত্মসন্তুষ্টিতে নিজেকে সর্বশক্তিমান ভেবে চোখ বন্ধ করবে। শিকারীকে শিকার করার এর থেকে ভালো সময় আর হতে পারে না।” নিজের মনেই একটু হেসে হাপরে টান দিল। পরক্ষণেই তার কপালে রেখা ফুটে মনের মাঝে দুশ্চিন্তার প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল-”কিন্তু শুরু হবে কিভাবে? শিকারীদের আলাদা করবে কি ভাবে? একসাথে থাকলে তাদের ধরা যাবে না। বরং নিজেই শিকার হয়ে যেতে পারে।”
ভাবতে ভাবতে কখন যে বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে গেছে তা অজিত লক্ষ্য করেনি। দোকানের ভিতরের আলোটা পর্যন্ত জ্বালতে সে ভুলে গেছে। হাপরের লাল আগুনেই দোকানের ভিতরটা লাল হয়ে উঠেছে। এমন সময় দোকানের ঝাঁপে সশব্দে চাপড় মেরে এক অর্ধমাতাল কণ্ঠ ধমকের সুরে বলে উঠল, - ”এই অজিত, তুই নাকি সবাইকে পেনের মধ্যে ছুরি বানিয়ে দিচ্ছিস? ভেবেছিস কি আমরা কোনো খবর পাবো না? হারামজাদা! মেয়েগুলো মারা গেলে তোকেই জেলে পাঠাবো দেখিস।”
অজিত হাপর ছেড়ে উঠে এলো। আগুণের লাল আঁচেই চিনল বাপ্পাকে। গলায় তার মোটা পুরু সোনার চেন। সেটা গলা থেকে খুলে নিয়ে বলল, - ”এই সোনার লোভে কত মেয়ে লটকে যায় জানিস? তোর লোহার থেকে হাজার গুনে দামী আমার এই সোনা। তোর এই অস্ত্র তৈরী আজই বন্ধ কর। নাহলে তোর এই দোকান আর কাল সকাল দেখবে না।”
অজিত নিজের মনেই একটু ভাবল। তার কপালের ভাঁজের গভীরতা একটু একটু করে কমে জানান দিল দুশ্চিন্তার অবসান আসন্ন। ঠোঁটের মাঝে বাঁকা হাসি এনে বলল, - ”দোকান ভাঙা তোর একার কর্ম নয়। পারলে তোদের বাকি মাথাগুলোকেও ডাক।”
নিজের পকেট থেকে তাড়াতাড়ি স্মার্টফোনটা বের করে সে মঙ্গলকে কল লাগালো। ফোন লাগানোর সাথে সাথে অজিত কাল বিলম্ব না করে একটা ভারি লোহার হাতল দিয়ে সপাটে বাপ্পার মাথার পিছনে মারল। বাপ্পা সেখানেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল। ফোনটা তাড়াতাড়ি করে তুলে নিয়ে দেখল তখনও মঙ্গল ফোন তোলেনি। আরও বার দুই রিং হওয়ার পর মঙ্গল ফোনটা তুলতেই অজিত একেবারে মুখের কাছে ধরে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলে ফিসফিস করে বলল, - ”তাড়াতাড়ি পাঁচ কান না করে চলে আয় অজিত কামারের দোকানে। খাবার একেবারে গরম। তাড়াতাড়ি।” ফোনটা কেটে অজিত ফোনের শব্দ বন্ধ করে কিছু গান চালিয়ে রাখলো যাতে সেটা লক না হয়ে যায়।
হাপরের কাছে যেখানে সে বসে, সেই জায়গা থেকে টুল ও বস্তা সরিয়ে ফেলল। ম্যানহোলের ঢাকনার মতো একটা ঢাকনা সেখানে একেবারে মেঝের সাথে মিশে আছে। সেটা তুলতেই একটা গর্ত বেরিয়ে পড়ল। বাপ্পার জ্ঞান হীন দেহটা সেই গর্ত দিয়ে নিচে ফেলে দিয়ে একটা মই বেয়ে নিজে নেমে এলো। হাতের আন্দাজে একটা ছোটো আলো জ্বালতেই নিচের অন্ধকার সরে একটা বেশ বড় গোল ঘরের মতো দেখা গেল। মেঝেতে দাঁড়িয়ে ঘরের ছাদে হাত পাওয়া যায়। ঘরে এই একটা আলো ছাড়া আর কোনো আলো নেই। ঘরের মাঝে একটা লোহার মোটা দন্ড মেঝে থেকে একেবারে ছাদ পর্যন্ত ঠেকেছে। তাকে কেন্দ্র করে একটা গোল লোহার বেদী। ঘরের অন্য প্রান্তে দেওয়ালে একটা মাঝারি আকারের গর্ত দেখা যাচ্ছে। তবে সেই গর্তের মুখ একটা বড় ঢাকনা দিয়ে বন্ধ করা। তার পাশেই একটা খুব ছোটো আকারের টেবিল। তার উপর রাখা টেপ ও দড়ি নিয়ে খুব ক্ষিপ্রতার সাথে অজিত বাপ্পাকে লোহার দন্ডের সাথে ভাল করে বেঁধে ফেলল যাতে জ্ঞান ফেরার পরে কোনো শব্দ বা নড়া-চড়া করতে না পারে। বাপ্পার ফোনে বাজতে থাকা গান হালকা হালকা তার কানে আসছে। আলো বন্ধ করে উপরে উঠে এসে গর্তের মুখটা আবার আগের মতো চাপা দিয়ে দিল। প্রায় দশ মিনিট অন্ধকার দোকানে চুপ করে বসে থাকার পর বাইরে জুতোর আওয়াজ পেল। তা শুনে লোহার হাতলটা নিয়ে দোকানের পিছনের দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে একেবারে দেওয়াল ঘেঁসে নিজেকে অন্ধকারে আড়াল করল। মঙ্গল দোকানের সামনে এসে একটু ইতস্তত করে দোকানের পর্দা সরিয়ে মুখ ঢুকিয়ে বাপ্পা বলে ডাকল। একটা হাত পিছন থেকে তার কাঁধ ছুঁয়ে বলল, - ”বাপ্পা এদিকে।” মঙ্গল পিছন ঘুরতে যাবে তখনই অজিত তার মাথা লক্ষ্য করে সজোরে আঘাত করল। মাটিতে ঢলে পরার আগেই তাকে ধরে নিয়ে বাপ্পার পাশে তার মতোই বেঁধে রাখলো। বাপ্পার ফোনে গান থামিয়ে অমিতকে একই ভাবে ফোন করে ডেকে নিল নিজের দোকানে। কিন্তু বিপদ বাঁধল যখন দূর থেকে অমিত আর সজল দু-জনকে একসাথে দোকানের দিকে আসতে দেখলো। দু-জনের হাতে ফোন জ্বলছে আর এদিকে বাপ্পা ও মঙ্গলের ফোনে মাঝে মাঝেই রিং বাজছে। মঙ্গলের ফোনটা বার দুই রিং হওয়ার পর অজিত সেটা তুলে ফিসফিস করে গালি দিয়ে বলল, - ”এমন জ্বালাস কেন বার বার কল করে? চুপচাপ আসতে না পারলে ভোগ পাবি না।” বাপ্পার ফোন না ধরে কেটে দিয়ে বলল,-”বাপ্পা চেটে পুটে খাচ্ছে। তোরা আয় তাড়াতাড়ি না হলে সব শেষ করে দেবে।”
দোকানের বাইরে বেরিয়ে অজিত দেখল, দুই ছায়ামূর্তি একেবারে তার দোকানের কাছে চলে এসেছে। কি করবে কিছু বুঝতে না পেরে পিছনের দরজাটা খুলে রেখেই সামনের দরজার দিকে এগোতে থাকল। অন্ধকারে কথা শুনতে পেল, - ”সজল, তুই বাইরে দাঁড়া। আমি একবার দেখে আসি।”
কথাটা শুনেই অজিত তাড়াতাড়ি পিছন দিয়ে দোকানের ভিতর এসে গা ঢাকা দিল। অমিত অন্ধকারের মধ্যে ফোন জ্বেলে দোকানের ভিতর ফেলতেই দেখল পিছনের দরজা খোলা। কিছু না ভেবেই অমিত সেই দরজা দিয়ে দোকানের বাইরে পা দিতেই তার মাথায় আঘাত করল। কিন্তু তা ফসকে গিয়ে অমিতের কাঁধে লেগে ফোনটা ছিটকে যায়। অজিত কোনো দিকে না তাকিয়ে পর পর বার কয়েক লোহার হাতলটা চালায় অমিতের মাথা লক্ষ্য কর। শব্দ পেয়ে সজল দোকানের ভিতর ঢুকে পড়ে ফোনের আলো জ্বেলে। অজিতকে ওই অবস্থায় দেখে একেবারে হকচকিয়ে যায়। অজিতের মাথায় তখন মৃত্যুর নেশা। সজল কি করবে ভেবে ওঠার আগেই সে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার উপর একেবারে শিকারী বাঘের মতো। নিমেষের মধ্যে সে সজলকে কাবু করে ফেলে। তারপর সজল ও অমিতকে একই ভাবে মাটির নীচের ঘরে বেঁধে ফেলে। নীচের ঘরের আলো নিভিয়ে অজিত সবে মই বেয়ে উপরে উঠবে তখনই সে শুনলো রিপনের গলা। সজল ও অমিতের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে একটা ক্ষীণ আলো সেই গর্তের দিকে এগিয়ে আসছে। অজিত তাড়াতাড়ি নেমে মইয়ের পাশে সরে গেল যাতে গর্তের উপর থেকে তাকে না দেখা যায়। আলোটা সরাসরি গর্তের উপর আসার আগেই সে চাপা গলায় বলে উঠল, - ”কামন, লেটস্ এনজয় হার হোল নাইট।”
কথাটা বলার সাথে সাথে অজিত দেখল আলোটা বন্ধ হয়ে পায়ের শব্দ সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছে। শিকার যখন নিজেই ফাঁদে এসে ধরা দেয় তখন শিকারীকে বেশী কষ্ট করতে হয়ে না। প্রথমে রিপনের কোমরে ও পায়ে তারপর পিঠে লোহার হাতল দিয়ে মেরে বাকিদের সাথে বেঁধে রাখতে বিশেষ বেগ পেতে হল না। সবার ফোন সংগ্রহ করে বন্ধ করে দোকানের এক কোণে অন্য লোহার জিনিস মাঝে প্যাকেটে মুড়ে রেখে দিল। তারপর আলো জ্বেলে দোকান একেবারে আগের মতো স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে এনে বন্ধ করে বাড়ি ফিরে গেল। একটা আংশিক তৃপ্তির হাসি তার মুখে এসেও চিন্তার ভাঁজে তা আড়াল হয়ে গেল। বাঘেদের রাজা যে এখনও অধরা।
পর্ব: ৯
পরদিন অজিত অনেকটা সময় ধরে নিজের মনের মতো লোহা পিটিয়ে একটা ছুরির ফলা তৈরী করল। বাকি সব কাজ ফেলে রেখে সে সারাদিন ধরে ছুরিটায় শান দিয়ে একেবারে আয়নার মতো চকচকে করে ফেলল। ছুরির ধরার জায়গায় নিজের বানানো একটা লোহার হাতল লাগিয়ে তার পূর্ণতা দিল। বাড়ি ফেরার সময় সেটা নিজের সাথে নিয়ে আসে কিছু কারুকার্য করার জন্য। পরদিন সকালে সে ছুরিটা একটা সুন্দর কাঠের বাক্সে রেখে অন্য কাজে হাত দেয়। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে কাজলের উপস্থিতি ও চোখরাঙানিতে বাধ্য হয়ে ছুরির কথা প্রকাশ করে ও বলে, - ”এটার কাজ এখনও কিছুটা বাকি আছে। তোমার জন্মদিনে এটা উপহার দেব। ততদিনে এটার কাজও শেষ হয়ে যাবে।”
প্রতিদিন বাড়ি ফেরার সময় ছুরিটা সে বাড়ি আনে। সমস্ত বাহ্যিক কারুকার্য শেষ করে ফলার একদিকে সেই পাঁচ ছেলের নাম খুব শৌখিন ভাবে লেখে যারা এখন তার দোকানের নীচে বন্দী। ফলার গোড়ার দিকে বিকাশবাবুর নামটা লিখতে গিয়ে থেমে যায়। খুব অস্থির ভাবে ঘরের মধ্যে পায়চারী করে কতক্ষণ তার ঠিক ছিল না। অন্যান্য দিনের থেকে আজ অনেক রাত করে সে কাজলের পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ে। পরদিন সন্ধ্যায় অজিত রিপনকে দিয়ে তার ফোন খুলে বিকাশবাবুকে হোয়াটস্যাপে মেসেজ করে একটা পুরানো পাহাড়-জঙ্গলের ছবির সাথে। মেসেজের বয়ান অনুযায়ী তার হাতে মাত্র দিন পনেরো সময় আছে। কিন্তু এতোদিন অপেক্ষা করা মানে নিজের বিপদ ডেকে আনা। এদিকে কাজলের জন্মদিনও মাত্র চার দিন বাকি। তাই আগামী তিন-চার দিনের মধ্যেই তাকে সব কাজ শেষ করে ফেলতে হবে। তাই এই কটা দিন বিকালের পর থেকে সে বিকাশবাবুর ছায়াসঙ্গী হয়। নানান কাজের ব্যস্ততা দেখিয়ে সে দোকান বন্ধ রেখে হাটে বাজারে একটা ভ্যান ও তার উপর চাপানো একটা বস্তা নিয়ে ঘুরতে থাকে। দু-দিনেই সে বুঝে যায় যে বিকাশবাবু রোজ সন্ধ্যার দিকে মোটামুটি ফাঁকা থাকেন। পার্টি অফিসের কাজ সেরে একাই একটু বাজারের দিকে আসেন তারপর অনেকটা সময় মোড় মাথার চায়ের দোকানে আড্ডা দেন। ঠিক সাড়ে ন’টা নাগাদ গাড়ি আসে তাঁকে নিতে।
পরদিন সন্ধ্যায় সে এক নজর বাজারে এসে দেখে নেয় যে বিকাশবাবু জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছেন। ঠিক সাড়ে ন’টা বাজতেই দূর থেকে বিকাশবাবুর সাদা গাড়িটা আসতে দেখে অজিত রিপনের ফোন থেকে তাঁকে মেসেজ করল - ’গাড়িটা বাড়ি পাঠিয়ে দাও। তোমার সাথে একটু কথা আছে। দাদুকে কি সত্যি সত্যি অজিতের বাবা মেরেছিল?’
নিজের ফোনের শব্দ শুনে তাড়াতাড়ি সেটা দেখে বিকাশবাবু হকচকিয়ে গেলেন। কিছু ভেবে ওঠার আগেই আরো একটা মেসেজ এলো, ’কাউকে জানিও না। জানালে তুমিই ফেঁসে যাবে।’
নিজের ছেলের কাছ থেকে এমন অসময়ে এইসব মেসেজ দেখে তিনি খুব অস্থির হয়ে গেলেন। ড্রাইভার কাছে এসে ডাকতেই তাকে ধমক দিয়ে বললেন, - ”তোর কি সারাদিন কাজ নেই নাকিরে? সারাক্ষণ বাবু চলুন বাবু চলুন করে যাচ্ছিস। যা তুই বাড়ি যা। আমি আজ হেঁটেই ফিরবো।”
বাবুর ধমক খেয়ে ড্রাইভার পিছু ফিরতেই বিকাশবাবু তাড়াতাড়ি করে রিপনকে মেসেজ করে বললেন,-”তুমি না জলদাপাড়া ঘুরতে গেছো। নাকি তুমি আমায় মিথ্যা বলে অন্য কোথাও গেছো?”
সঙ্গে সঙ্গে সেই মেসেজের উত্তর এলো বিকাশবাবুর ফোনে। তাতে লেখা, - ’পুকুরের পাশের বড় রাস্তার ধারে চলে এসো তাড়াতাড়ি। সেখানে সব কথা হ