top of page
সূচীপত্র
Saraswati3.jpg
মার্চ ২০২২
girl.JPG

লেখক ও লেখিকাবৃন্দ

প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা

 মার্চ ২০২২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

Sudipta-Biswas.jpg
কবিতাঃ সুদীপ্ত বিশ্বাস
touch.jpg

বাউল

 

কলা বেশ তো আছি, একলা থাকাই ভালো
দুপুরে ডিস্কো নাচি, রাতে পাই চাঁদের আলো।
কোনো এক নিঝুম দুপুর, কিংবা গভীর রাতে
মনে আর পড়েই না তো, টান দিই গঞ্জিকাতে।
পরোয়া করব কেন? সমাজটা দিচ্ছে বা কী?
ছোট্ট জীবন আমার, তাইতো নাচতে থাকি।
পলকা এই জীবনে, কী হবে দুঃখ এনে?
চল্ না উড়াই ঘুড়ি, সুতোতে মাঞ্জা টেনে।
লাফিয়ে পাহাড় চড়ে, সাঁতরে নদীর বুকে
কবিতা দু'এক কলি আসলে রাখছি টুকে।
এভাবে কাটছে তো দিন, তোমাকে আর কী খুঁজি?
জানিনা কোথায় তুমি, আমাকে ভাবছো বুঝি?
ভাবলে কী হবে আর, নদীতে জল গড়ালে
চাঁদটা বন্ধু আমার, গভীর এই রাত্রিকালে 
গাছেরা আগলে রাখে, পাখিরা গাইতে থাকে
ঘরে আর যায় কী ফেরা? ওই যে বাউল ডাকে !

 

 

জল


সেতু? হ্যাঁ গো, সেতুই পাতো তোমার আমার বুকে
চিরটাকাল ভালবাসা থাক না বাঁধা সুখে।
সুখের বাঁধন আলগা হলেই নামব আবার জলে
জলে জন্ম, জলে মৃত্যু, জলেই বাঁচতে বলে।
জল হয়ে তাই তোমার পাশে যেই না আমি নামি
ভালবাসার অতলতলে যাই তলিয়ে আমি!
জল তো মুছে ফেলে সবই সাঁতরে যাবার পরে
তাই বিরহ দেয় না উঁকি জলের কোনও স্তরে।
ভুলে যাওয়া বরং ভালো, ভুলতে কি আর জানি?
তাইতো শুধু হৃদয় সেঁচে দুঃখ তুলে আনি।

বিপ্রলব্ধ

ত্রাহ্যস্পর্শে তিথিক্ষয়ে চাঁদের দেখা নেই
মঞ্জুষাতে লক্ষ্মীকে নয়, চাইছি তোমাকেই।
তামরসের মতোই তুমি, মুগ্ধ হয়ে থাকি
ধৈবতহীন আরোহণে তিলক কামোদ রাখি।
অনিকেত শব্দচাষী বন-পাহাড়ে ঘুরি
স্মিত হাসির ময়ূখছটায় মন করেছ চুরি।
ভৈরবের ওই বিরহী সুর পাখির ডাকে ঝরে
বিপ্রলব্ধ, বিহানবেলায় বড্ড মনে পড়ে।

শব্দার্থ


তিথিক্ষয় ~ একদিনে দুই তিথির ক্ষয় হয়ে তৃতীয় তিথির সংযোগ; ত্রাহ্যস্পর্শ; অমাবস্যা।
মঞ্জুষা ~ লক্ষ্মীর ঝাঁপি।
তামরস ~ পদ্ম।
তিলক কামোদ হল একটা রাগ।

এই রাগে অবরোহণে সাতটি সুর থাকলেও আরোহণে ধা বা ধৈবত সুরটি থাকে না।
অনিকেত ~ গৃহহীন পথিক।
শব্দচাষী ~ কবি।
ময়ূখ ~ রশ্মি।
ভৈরব হল প্রভাতকালীন একটা রাগ।ভোর বেলা গাওয়া হয় এই রাগ।
বিপ্রলব্ধ অর্থ বঞ্চিত বা প্রতারিত।
বিহানবেলা মানে সকালবেলা।

 


জলছবি

 

বেঁচেই আছি    বাঁচছি বেশ
চশমা এঁটে     পক্ক কেশ।
জীবনটা কী?   জানি কী কেউ?
মিথ্যে শুধু      গুনছি ঢেউ।
বাড়ছে যত      বাঁচার আশা
যাচ্ছে বেড়ে    ক্ষুৎপিপাসা ।
কীসের খোঁজে  ইঁদুর দৌড় 
ছুটছে লোকে   ছুটছে জোর।
দিনটা আসে    দিনটা যায়
চমকে খসা     ঝরাপাতায়
কলকলানো    নদীর পাশে
চুপটি করে      মৃত্যু আসে।

দ্বন্দ্ব


ল আগে না পানি?
আমরা কী তা জানি?
ওসব জানতে গেলে আগে
পেতে হয় জলপানি।

গড বড় না আল্লা?
কার যে ভারি পাল্লা?
পরনে তাদের হ্যাট-কোট-বুট
না কি আলখাল্লা?

হিন্দু না মুসলিম?
উচ্ছে না কী নিম?
মরার পরের ভয় না পেয়ে
বাঁচ্ না ভীতুর ডিম।

আল্লা হরির ভক্ত?
এদের মেলা শক্ত?
কাটলে পরেই দেখতে পাবে
লাল দুটোরই রক্ত।

 


কাঁটাতার


মরা পাখিরা উড়ে যাই কতদূরে
কত দেশ-গ্রাম ইয়ত্তা নেই তার
মানুষেরা শুধু ঝগড়া-বিবাদ করে
মানুষের শুধু দেশভাগ কাঁটাতার।

আমরা নদীরা বয়ে যাই কত দূরে
পাহাড়ের থেকে দূর সাগরের পার
মানুষেরা শুধু দ্বন্দ্ব-বিবাদ করে
মানুষের শুধু দেশভাগ কাঁটাতার।

আমরা আলোরা সূর্যের থেকে এসে
ভেদাভেদ ভুলে ঘোচাই অন্ধকার
মানুষেরা শুধু দ্বন্দ্ব-বিবাদ করে
মানুষের শুধু দেশভাগ কাঁটাতার।

আমরা মেঘেরা হাওয়ার ডানায় ভেসে
কত পথ চলি হিসেব থাকে না তার
মানুষেরা শুধু দ্বন্দ্ব-বিবাদ করে
মানুষের শুধু দেশভাগ কাঁটাতার।

মানুষেরা কেন কাঁটাতার ভালোবাসে?
হিংসা বা দ্বেষে কেন যে বিবাদমান!
কেন যে শেখেনি ভালোবেসে বেঁচে থাকা,
নদী বা বাতাস, মেঘ-পাখিদের গান।

 

কবিতা

পার্থ সরকার 

কবিতাঃ পার্থ সরকার

 মার্চ ২০২২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

বড় বেশি শব উৎসবে

 

ড় বেশি শব উৎসবে 

নাকচ হয়ে যায় প্রধান শব্দসমূহ 

ক্ষরণ অফুরান 

আনাচেকানাচে লোলুপ স্তাবকতা 

কোথাও ঘৃণার সরু রেখা 

অগ্নিনদ! 

হয়তো 

হয়তো নয় 

তবু, একদিন শেষ 

উৎসবে 

শবের আনাগোনা 

একদিন সত্যই শেফালী 

একদিন সত্যই  কাশ 

 

আমি 

যতটা পারি 

গঠনে আছি 

গৈরিক মাটিতে 

এক সড়ক 

 

তোমার জন্য...। 

ক্লান্ত প্রচ্ছদ  গল্পের

ক্লান্ত প্রচ্ছদ গল্পের  
আচ্ছাদন সরিয়ে ঘরে আসে 
অলীক খাসমহল 
ব্যবধানে ধ্বস্ত মরুৎ 
মরুতেজ 
অবধারিত বিতাড়িত বায়স... 
 
প্রণম্য এই বিষাদ কেন ? 
হয়তো জানে মেরুক্ষেত 
হয়তো বিশদে আছে আরো খেদ 
তবু... 
পুনশ্চ... 
যদি কোনদিন 
শস্যের অন্য কারুকাজে... 
তবে... 

গল্পের ক্লান্ত প্রচ্ছদ 

হোক... 

আজ সারাবেলা আমার কাজের শেষ নেই। 

women.jpg

ভাবি, এক চক্কর দিলেই

ভাবি, এক চক্কর দিলেই তোমার আমার 

সোনালি ডানা... আর প্রতিবারেই ভাবনার 

মাঝপথে জলসত্রের আধখানা বাড়ি আর 

প্রতিবারেই মুখ থুবড়ে পড়ে একগোছা প্রজাপতি।   

এক নিভৃতচারী

প্রবন্ধ

 মার্চ ২০২২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

Mijanur Rahman.jpg

এক নিভৃতচারী সমাজ সেবক

সংগঠক জনাব আব্দুল হান্নান

মিজানুর রহমান মিজান 

village3.jpg

পৃথিবীর বুকে আমাদের তথা মানব সমাজের আগমনের সহিত মৃত্যুর আলিঙ্গন রয়েছে মিতালী সমতায়। অর্থাৎ জন্মিলে মৃত্যু অবধারিত। একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। মহান রাব্বুল আলামিন আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন তিনির গুণ গান, তিনির প্রদত্ত নেয়ামতের শুকরিয়া আদায়, ভাল কাজের প্রতি মনোযোগী হওয়া, মন্দ বা নিষিদ্ধ কাজকর্ম পরিহার করে সুন্দর ও ভাল কাজে নিজকে উৎসর্গিত করা। আমরা পথ ভুলা হয়ে গেলে আলো ছড়াতে, সঠিক পথে চলতে, দিকনির্দেশনার নিমিত্তে পাঠিয়েছেন নবী ও রাসুল যুগে যুগে। ক্ষণস্থায়ী এ জীবনে আমরা যতটুকু সম্ভব ভাল কাজ করা উচিত বলে মনে করি। কারণ পৃথিবীতে অমরত্ব লাভ কেহই করতে পারেননি, পারবেনও না। তবে অমরত্ব লাভের সুযোগ রয়েছে ভাল কাজ করে যেতে পারলে। কাজের মধ্যেই রয়েছে অমরত্বের সুযোগ। “মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য” এ বাক্যের অন্তর্নিহিত মর্মবাণীতে। মানুষের কল্যাণ করতে পারলে মানুষ চিরদিন কর্মকে মূল্যায়ন করে। অমরত্বের সুযোগ সৃষ্টি হয়। মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নেয়া সম্ভব হয়। অপরদিকে কিছু কিছু কাজ রয়েছে তা করতে হলে চিত্তের সহিত বিত্তের প্রয়োজনীয়তা অবশ্যম্ভাবী। কারণ হিসাবে এখানে উল্লেখ করতে চাই, কোন কোন সময় দেখা যায় অনেকের টাকা আছে। কিন্তু ভাল কাজ করার মন মানসিকতার অভাব। কারো মন মানসিকতা ভাল কাজ করার ইচ্ছা থাকলেও অর্থের অভাবে সম্ভব হয়ে উঠে না। তাই শুধু চিত্ত বা বিত্ত হলেই সম্ভব নয় অনেক ক্ষেত্রে। সেক্ষেত্রে চিত্ত-বিত্তের সমন্বয় অপরিহার্য। 

একটি আদর্শ, সুন্দর ও সুষ্ঠু সমাজ গঠন করতে হলে সহানুভূতি, সহমর্মিতা একে অন্যের প্রতি ভালবাসার সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্কের বিকল্প নেই। পরস্পর সহানুভূতি ও সহমর্মিতা সৃষ্টির লক্ষ্যে সকল সৃষ্টি কুলের অধিকার সংরক্ষণ অবশ্যম্ভাবী। “মহান রাব্বুল আলামীন ন্যায়পরায়ণতা, সদাচরণ এবং আত্মীয়-স্বজনকে দান করার আদেশ দিয়েছেন এবং তিনি অশ্লীলতা, অসঙ্গত কাজ এবং অবাধ্যতা করতে বারণ করেছেন”। হিংসা-বিদ্বেষ সমাজের সুন্দর ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশের মারাত্মক অন্তরায়। সমাজে জ্বলে উঠে অশান্তির আগুন। পানির অপর নাম জীবন। পানির দ্বারা শুধু মানুষ পিপাসা নিভৃত করে না, জীবন-ধারণ করে অন্যান্য জীব-জন্তু, পশু পাখিও। ফসল ফলাতেও পানির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। আবার অধিক পরিমাণে পানি হলে বন্যা হয়ে যায়। তাতে সকল দিকে ক্ষতির সমূহ কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ভাসিয়ে যেমন নেয়, পচাতেও সাহায্য করে। সুতরাং সমতা, সুষ্ঠু, সুষম ও পরিমিত পরিমাণ ব্যবহার একান্ত প্রয়োজন। প্রত্যেক মানুষের উপার্জিত বৈধ অর্থ বৈধ খাতে ব্যয় করার মধ্যে রয়েছে আলাদা তৃপ্তি, মনের প্রশান্তি। পরিবার পরিজনের ব্যয় নির্বাহিত করে উদ্ধৃতাংশ থেকে সমাজের অসহায় বঞ্চিত মানুষের কল্যাণে ব্যয় করা ও সমাজের কল্যাণার্থে ব্যয় করার তাগিদ রয়েছে ইসলামিক দিক থেকে যেমন, তেমনি সামাজিক ও সামাজিকতার দিক থেকেও। অপব্যয় করা, কৃপণতা করা নিষিদ্ধের অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।সর্বক্ষেত্রে মধ্যম পন্থা অবলম্বন বাঞ্ছনীয়। একজন মানুষ এ সকল চিন্তায় সামান্যতম প্রভাবিত হলেই তিনি হয়ে উঠেন অনায়াসে হৃদয়জ মানুষ হিসাবে। যে মানুষের হৃদয়ে মানুষের নির্মল ভালবাসায় কিঞ্চিৎ পরিমাণ হলেও মানুষের কল্যাণ কামনা করেন বা জাগ্রত হয়, সে মানুষ অল্প বিস্তর হলেও মানুষ, সমাজ ও সামাজিকতা অনুধাবন করে থাকেন যদিও তার পরিমাণ কম বেশী হয়। আমার আজকের লিখার শেষের দিকে এ কথাগুলি বলার কারণ অবশ্যই আমি ব্যাখ্যা করব সবিস্তারে। 

সকল প্রশংসা মহান রাব্বুল আলামিনের যিনি আমি/আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এবং মানুষকে শ্রেষ্ঠ বলে ঘোষণা দিয়েছেন এ পৃথিবীর বুকে। আল্লাহর অপার দয়ামায়া, করুণার মাধ্যমে আমাদেরকে হেদায়েতের ও আলো দেখিয়েছেন সর্বশেষ, সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হযরত মোহাম্মদ (স:)এর মাধ্যমে। পথহারা মানুষ পেয়েছে পথের দিশা, হয়েছেন আলোর দিশারী।গড়ে উঠেছে আদর্শ পরিবার, সুষ্ঠু সমাজ, সুষম অর্থনীতি। আমাদের মধ্যে ভুলের পরিমাণ থাকা স্বাভাবিক। তারপর ও আমাদের আন্তরিকতা যদি থাকে তবে শুধু টাকা পয়সা দিয়ে মানুষ বা সমাজের উন্নয়ন সাধন হয় না বা করা যায় না। মানুষ এবং সমাজের উন্নয়ন বা কল্যাণার্থে কাজ করার রয়েছে বহুবিধ পন্থা। অনেক সময় কথা দিয়ে, আচার আচরণ ইত্যাদি দিয়েও কল্যাণ করা সম্ভব। প্রয়োজন আন্তরিকতা, ভালবাসা, মন মানসিকতার। আমি সম্পূর্ণ নির্ভরশীল মহান আল্লাহ তওফিক দিলে এ লেখাটি সম্পূর্ণ করার। আল্লাহ সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। 

ধনে-জনে আলোকিত (সিলেটের) বিশ্বনাথ উপজেলার খাজাঞ্চী ইউনিয়ন একটি ঐতিহ্যবাহী কৌড়িয়া পরগণার অন্তর্ভুক্ত ইউনিয়ন। যেখানে জন্ম নিয়েছেন অনেক কীর্তিমান মানুষ। যাঁদের মধ্যে কয়েকজনের নাম না নিলে কৃপণতার সামিল হয়ে যাবে। অথবা একটা দায়বদ্ধ ঋদ্ধতার অনুশোচনায় পড়ে যাচ্ছি বলে মনে হচ্ছে। সুতরাং আমি চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি আমার একেকটি লেখায় সকল গুণীজনের নাম স্মরণ করতে। এখানে উল্লেখ করতেই হয়, অবসর প্রাপ্ত কর্ণেল মরহুম তৈয়বুর রহমান পাখিচিরী, মরহুম মাওলানা আব্দুল বারী ইসলামাবাদ, মরহুম মাওলানা ওলিউর রহমান (র:) তেলিকুনা, সাবেক চেয়ারম্যান মরহুম আব্দুল মজিদ ইসলামাবাদ (যিনি খাজাঞ্চী ইউনিয়ন পরিষদ সংলগ্ন স্থানেই পোষ্ট অফিসের ভূমি দাতা এবং পোষ্ট অফিসের নামকরণ করেন ইসলামাবাদ, (এ বিষয়ে অন্য লেখায় আলোচনা করার প্রত্যয়ী প্রত্যাশা রাখি), অবসর প্রাপ্ত সাবেক অধ্যক্ষ মাওলানা শফিকুর রহমান পাখিচিরী, আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে সুপরিচিত মরহুম ডা: আবুল লেইছ ইসলামাবাদ, সালিশ জগতের ব্যক্তিত্বময় ব্যক্তি মরহুম সাবেক চেয়ারম্যান পীর লিয়াকত হোসেন হোসেন পুর, শিক্ষাবিদ ও সাউথ-ইস্ট ব্যাংকের ডিজি মরহুম আলতাফুর রহমান ঘাসিগাঁও প্রমুখ খাজাঞ্চীবাসীর আলোকবর্তিকা। এবার মুল বক্তব্যে যাবার চেষ্টায় হচ্ছি নিমজ্জিত। 

খাজাঞ্চী ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডের অন্তর্গত হোসেন পুর একটি গ্রাম। যে গ্রামে ১৯৪০ সালের সাত ডিসেম্বর পিতামৃত আবরু মিয়া ও মাতামৃত পাখি বিবি দম্পতির কোল আলোকিত করে মোল্লাবাড়ি খ্যাত বাড়িতে জন্ম গ্রহণ করেন পিতামাতার তৃতীয় সন্তান আলহাজ আব্দুল হান্নান। অত্যন্ত আদর যত্নে শিশুকাল অতিবাহিত করেন নিজ বাড়িতে পারিবারিক সুদৃঢ় বন্ধনের মধ্য দিয়ে।কিন্তু ১৯৪৭ সালের পূর্বে অত্রাঞ্চলের মানুষ লন্ডন, আমেরিকার মত চাকুরী, অর্থনৈতিক উন্নয়নের নিমিত্তে চলে যেতেন কলিকাতা। তখন গ্রামের মানুষের মুখে মুখে ছিল কলিকাতার অপর নাম কালিমাটি। কালিমাটি থেকে কেহ ফিরে আসলে তিনিকে দেখার জন্য মানুষের ভীড় লেগে যেত। চাকুরী সূত্রে জনাব আব্দুল হান্নানের চাচা হাজী আছলম আলী ছিলেন কলিকাতার বাসিন্দা। তাই আদরের ভাতিজা আব্দুল হান্নানকে কলিকাতা নিয়ে যান চাচা আছলম আলী লেখাপড়া করানোর জন্য।সেখানে কলিকাতার জামসেদ পুর জেলার গুলমুরি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করেন। প্রায় দু’বৎসর আব্দুল হান্নান সেখানে থেকে চলে আসেন নিজ বাড়িতে। অত:পর তিনি ভর্তি হন স্থানীয় ফুলচন্ডি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। পাঠশালার লেখাপড়া সমাপন করে তিনি কৃষিকাজে আত্মনিয়োগ করেন। এক সময়ে তিনি ব্যবসাকে ভালবেসে মুফতির বাজারে রাইছ মিল স্থাপন করেন। কিছুদিন তা পরিচালনা করে ১৯৭০ সালে সিলেট শহরের হাছন মার্কেটে ব্যবসা শুরু করেন। সে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তিনির ভাই কর্তৃক দীর্ঘদিন হয়েছে পরিচালিত। বর্তমানে ভাই অসুস্থতাজনিত কারণে ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন। 

১৯৫৪ সালে রাজনীতির সহিত সম্পৃক্ত হন যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনকালীন সময়ে। ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আসেন সিলেটের রেজিস্টারি মাঠে এক জনসভায়। শেখ মুজিবের ঐদিনের

ভাষণ শুনে হান্নান সাহেব অভিভূত হয়ে যোগ দেন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে। হয়ে উঠেন আওয়ামীলীগের একজন দক্ষ সংগঠক, কর্মী ও সমর্থক হিসাবে। আসে ১৯৭০ সালের নির্বাচন। বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ নৌকা প্রতীক নিয়ে একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন করলেও পাকিস্তানের ইয়াহিয়া-ভুট্রো শেখ মুজিবের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর না করে বিভিন্ন কুট-কৌশলের আশ্রয় নেয়। বাঙ্গালীর ন্যায্য দাবীকে দমিয়ে রাখার আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালায়। তাই ২৫শে মার্চ রাতে সশ্রস্ত্র ও সুসজ্জিত একটি বাহিনীকে অতর্কিতে নিরস্ত্র বাঙ্গালীর উপর লেলিয়ে দেয়। ওরা নির্বিচারে গণহত্যা চালায়। কি বিভীষিকাময় পরিবেশ! সারা দেশ জুড়ে আতংক, হতাশা ও শঙ্কায় শঙ্কিত পুরো জাতি। যে যেভাবে পারে শুরু হয় প্রতিরোধ। পাকবাহিনী শুরু করে ধরপাকড়, অত্যাচার, নির্মম নির্যাতন। এপ্রিলের প্রথমার্ধে পাকবাহিনী কর্তৃক খাজাঞ্চি রেলওয়ে ব্রীজের পূর্ব তীরে আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল হান্নান, মরহুম লিলু মিয়া, মরহুম ডা: আব্দুল করিম, মরহুম তোয়াহিদ মিয়া গং আরো লোকজনের মাধ্যমে খনন করাতে থাকে ব্যাংকার। পশ্চিম তীরেও অনুরূপ ব্যাংকার, বাঁশ আনয়ন ও ব্রীজকে সুরক্ষিত রাখতে বাঁশের বেড়া দিতে অর্ডার করে প্রত্যেক গ্রামের প্রতিটি পরিবার আস্ত বাঁশ প্রদান করতে। দেয়া হয় নির্দেশ। মত না দিলে মেরে ফেলার ভয়। তাছাড়া চতুর্পাশ্বস্থ গ্রামের মানুষ দিয়ে পালাক্রমে ব্রীজ পাহারা দেয়ানো হত। একদিন রাতের বেলা দুই ঘটিকার সময় হানা দেয় পাকবাহিনী কিছু সংখ্যক রাজাকার সঙ্গে নিয়ে হোসেন পুর গ্রামে। খুঁজতে থাকে আব্দুল হান্নান, পীর লিয়াকত হোসেন গং আওয়ামীলীগ নেতা, কর্মী ব্যক্তিবর্গকে। ঐদিন ঘর থেকে লুকিয়ে বের হয়ে একত্রিত হন আব্দুল হান্নান, পীর লিয়াকত হোসেন ও বরই কান্দির রইছ আলী হোসেন পুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নিকটে। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে প্রাণ বাঁচাতে যে যেদিকে পারেন বিচ্ছিন্ন হয়ে দৌড়াতে থাকেন। আব্দুল হান্নান ও রহিম পুর নিবাসী জহুর আলী কাটা-খালি গোরস্তানে আশ্রয় নিয়ে রাত কাটান। গোরস্তানে থেকে ফজরের নামাজের পর পরই শুনতে পান দু’টি গুলির শব্দ। পাক সেনারা চলে গেলে এসে দেখেন হোসেন পুর গ্রামের খলিল উল্লাকে (পিতা রসিদ আলী) মসজিদের প্রস্রাব খানায় বসা অবস্থায় এবং ছোরাব আলীকে (পিতা কটু মিয়া) ধরে নিয়ে খাজাঞ্চী রেলস্টেশন সংলগ্ন স্থানে স্থাপিত টিউবওয়েলের নিকটে বুকে গুলি চালিয়ে হত্যা করে। ছোরাব আলী ছিলেন হাজী মকরম আলীর গৃহে চাকুরীতে। অন্য একদিন রমজান মাসে দুপুরবেলা আব্দুল হান্নানের ৬নং ভাই আব্দুল ছমদকে রেলস্টেশনে ধরে মারপিট করে। তখন সাবেক চেয়ারম্যান (খাজাঞ্চী ইউ/পি) আছকির মিয়া, কারী ইছাক আলী, তাদের বড় ভাই আব্দুল মন্নান অনেক কাকুতি মিনতি করে ছাড়িয়ে আনেন। অপর একদিন পীর লিয়াকত হোসেনসহ আরো দুই ভাইকে ধরে নিয়ে যায় সিলেট ক্যাডেট কলেজে। পীর লিয়াকত হোসেনের বড় ভাই ছিদ্দেক আলী ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ছিলেন। অনেক প্রচেষ্টার মাধ্যমে এ যাত্রায় ও রক্ষা পান। ঐদিন পাকসেনারা জনাব আব্দুল মন্নানকে বলে যায়, আব্দুল হান্নান সাহেব সিলেট সার্কিট হাউজে যাবার জন্য। নতুবা তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হবে। তাদের কথামত পরদিন সিলেট সার্কিট হাউজে যান, সারেন্ডার করেন ও রাজাকারদের সহযোগিতা করার কথা বলে দেয়া হয়। এক্ষেত্রে তারা মিয়া নামক একজন ব্যক্তির সহযোগিতায় মুক্তি পান। এ ঘটনার কয়েকদিন পর লিলু মিয়া, আলহাজ ছমরু মিয়া, মজমিল আলী, ডা: আব্দুল করিম ও রন দাসকে ধরে নিয়ে যায়। এখানে উল্লেখ করা আবশ্যক যে ঐদিন অনেক মানুষকে ধরেছিল। এখানে ঘাসি গাঁও এর ছাদ মিয়াও (আলতাফুর রহমান) ধৃত ছিলেন। কিন্তু ছাদ মিয়ার স্কুল, কলেজের সকল কাগজপত্রে আলতাফুর রহমান নাম থাকায় তিনিকে ছেড়ে দেয়। এরূপ বিভিন্ন উপলক্ষ্য দেখিয়ে পাঁচজন ব্যতীত সবাই ছাড়া পান। বিজয় দিবসের কয়েকদিন পূর্বে লামাকাজী থেকে পাকসেনা এবং ভুলাগঞ্জ গ্রাম থেকে মুক্তিবাহিনী উভয়দলের গুলি ছুড়াছুড়ি সন্ধ্যার সাথে সাথে আরম্ভ হলে ভুলাগঞ্জ গ্রামের সাবেক মেম্বার মন্তাজ আলীর স্ত্রী উরুতে গুলিবিদ্ধ হন।৩/৪ মাস পর তিনি মারা যান। অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার পর ১৬ই ডিসেম্বর আমাদের কাঙ্ক্ষিত বিজয় অর্জন হয়। 

হান্নান সাহেবের প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া কম হলেও তিনি স্বশিক্ষিত। হোসেন পুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকালে এ পরিবার থেকে ১৮ শতক ভূমি প্রদান করা হয় এবং বাকি ১২ শতক ভূমি দান করেন মরহুম আলহাজ মখরম আলী। তাছাড়া আধুনিক শিক্ষার সাথে সমন্বয় রেখে সৎ ও দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার লক্ষে এবং উদ্দেশ্য নিয়ে ২০০৪ সালের ১ লা জানুয়ারি বর্তমান ভূমি দাতা মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক আলহাজ্ব আব্দুল হান্নানের নিজ বাড়িতে খাজাঞ্চি একাডেমীর আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়। পরবর্তীতে উক্ত প্রতিষ্ঠান ২০০৫ সালে তার নিজস্ব ভূমিতে এসে শিক্ষাকার্য পরিচালনা করে আজ অবধি সফলতার সাথে শিক্ষা বিস্তারে কাজ করে যাচ্ছেন। ২০০৯ খ্রীষ্টাব্দে খাজাঞ্চী একাডেমী জুনিয়র স্কুলের মর্যাদা লাভে সক্ষম হয় লেখাপড়ার মানোন্নয়ন ও প্রতি বৎসর কৃতিত্ব পূর্ণ ফলাফলের কারণে। ২০১২ সালে প্রথম এসএসসি পরীক্ষায় শতভাগ সফলতা অর্জিত হয়। প্রতিষ্ঠাতা ও ভুমিদাতা জনাব আব্দুল হান্নানের একক উদ্যোগ ও উদ্যমে অর্থাৎ অর্থায়নে ৫০ জন গরিব, অসহায় ছাত্র-ছাত্রী সম্পূর্ণ বিনা বেতনে পড়ার ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন। 

২০১২ সালে প্রথম এসএসসি পরীক্ষায় শতভাগ সফলতা অর্জিত হয়। শুরু থেকে এ পর্যন্ত সবক’টি পরীক্ষায় শতভাগ সফলতা অর্জন করে দেশ বিদেশে সুনাম অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে খাজাঞ্চি একাডেমী এন্ড উচ্চ বিদ্যালয়। স্কুলটি কলেজে উন্নীত হলে এলাকার শিক্ষা বিস্তারে অবদান রাখতে পারবে বলে বিজ্ঞজনদের ভাবনা। সুতরাং কলেজে উন্নীত করতে জনাব আব্দুল হান্নান ও তিনির বড় ছেলে যুক্তরাজ্য প্রবাসী আব্দুল শহিদ আপ্রাণ প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। তাছাড়া এ পরিবার থেকে বিভিন্ন সময় গরীব ও অসহায় মানুষ বিভিন্ন প্রকার সাহায্য, সহযোগিতা পেয়ে থাকেন। তিনির প্রবাসী ছেলেরা শিক্ষানুরাগী হয়ে গড়ে উঠেছেন পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে। যার প্রত্যক্ষ প্রমাণ আমরা পেয়েছি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করার মধ্য দিয়ে। অপরদিকে তিনির প্রতিষ্ঠিত খাজাঞ্চী একাডেমী এন্ড উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকালীন নামকরণের ক্ষেত্রে জনাব আব্দুল হান্নান মহৎ ও উদার হৃদয়ের আরেকটি পরিচয় তিনির নামে বা কারো নামে নামকরণ না করে তিনি খাজাঞ্চী ইউনিয়নের নামে নামকরণ করে তা প্রতিষ্ঠিত করতে। তিনি পারতেন ব্যক্তি বা অন্য কোন নামকরণ করতে। অত্যন্ত সহজ, সরল, মহৎ, সৎ, উদার, নৈতিকতাবোধ সম্পন্ন একজন মানুষ।আমি তিনির সম্পর্কে একটু অধিক সময় ও সান্নিধ্য পেয়েছি বিভিন্ন রূপে পরিচিত থাকার ফলে। কারণ আমি যখন উত্তর বিশ্বনাথ উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত ছিলাম। তখন তিনির বড় ছেলে জনাব আব্দুস শহিদ ছিলেন সে স্কুলের ছাত্র। যে কারণে তিনি স্কুলে যেতেন বিভিন্ন সময়ে। অপরদিকে আমি মদন মোহন কলেজে লেখাপড়া করতে ট্রেন যোগে যেতাম প্রতিদিন খাজাঞ্চী স্টেশন থেকে যাত্রী হয়ে। সিলেট যেতে এক মাত্র রাস্তা ছিল সিলেট-ছাতক রেললাইনের ট্রেন। প্রায়ই তিনিকে পেতাম ট্রেন যাত্রী রূপে। তিনির সান্নিধ্য এবং দুর থেকে দেখার সুমিষ্ট ফলাফল অত্যন্ত হৃদয়জ অনুভূতি পূর্ণ ছিল এবং রয়েছে। আমি বরাবরই তিনির আচার আচরণে পেয়েছি হৃদ্যতা, প্রীতি, স্নেহ, আদর ও ভালবাসার অতুলনীয়তা। 

আমি মহান আল্লাহর দরবারে তিনির সুস্থতা ও দীর্ঘায়ু কামনা করি বিনয়াবনত চিত্তে। সেই সাথে তিনির পরিবার পরিজনকেও আল্লাহ সুখ, শান্তিতে রাখুন এবং শিক্ষা বিস্তারে অবদান রেখে খাজাঞ্চীবাসীর আলোকবর্তিকা রূপে চির জাগরূক থাকুক প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানগুলি। 
 

গল্প

হালদারদের হানাবাড়ি

 মার্চ ২০২২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

হালদারদের

হানা বাড়ি

চন্দন চ্যাটার্জি

banglow.jpg

শ্চিমবঙ্গে মুর্শিদাবাদ জেলার একদম শেষ প্রান্তে রেলস্টেশন আছে যার নাম ধুলিয়ানগঙ্গা। এখানে উত্তরবঙ্গগামী কোন এক্সপ্রেস ট্রেন খুব একটা থামে না, তবে সাহেবগঞ্জগামী এবং মালদাগামী লোকাল ট্রেন কিছু থামে। ধুলিয়ান মুলত বিড়ি শিল্পে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছে। বিড়ি শিল্পের বাদশা যে কোম্পানি, “পতাকাবিড়ি” তার অনেক কারখানা এখানে আছে। তাছাড়া ছোট-বড় অনেক বিড়ি কোম্পানির কারখানা এখানে আছে।
এলাকাটি মুলত মুসলিম অধ্যুষিত গ্রাম, এই গ্রামের এক পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ভাগীরথী নদী এবং তার ওপারে বাংলাদেশ। অন্যদিকে ন্যাশনাল হাইওয়ে, এনএইচ ১২। ধুলিয়ান বাস স্ট্যান্ড এই হাইওয়ের উপরে। ধর্মতলা থেকে উত্তরবঙ্গ যাবার সমস্ত বাস এখানে থামে। এছাড়া অটো, টোটো ও আর একটা যান এখানে খুব বিখ্যাত সেটা হল ঘোড়ারগাড়ি। ঘোড়ারগাড়িতে ভাড়া কম, তবে ঝাকুনি বেশি। আমি একবার লালগোলা থেকে এখানে গিয়েছিলাম সেই অভিজ্ঞতার কথাই বলব।আগেই বলেছি আমি একজন আমি কলকাতার একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে আভ্যন্তরীণ হিসাব পরীক্ষক হিসাবে কাজ করতাম। এই কোম্পানির কলকাতার বাইরে অনেক জায়গায় শাখা অফিস ছিল। এই শাখা অফিসে আমাকে মাঝে মধ্যে ফিজিক্যাল স্টক ভেরিফিকেশনে যেতে হত। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এটা সঠিকভাবে না করতে পারলে কোম্পানীর অনেক ক্ষতি হতে পারে, বিশেষ করে এফ.এম.সি. কোম্পানিগুলোতে। 
যাইহোক, মঙ্গলবার ২৫শে জুলাই অফিসের পর শিয়ালদা স্টেশন থেকে লালগোলা প্যাসেঞ্জার ট্রেন ধরে লালগোলার উদ্দেশ্যে রওনা হই। বিকাল ৩.৪৫ মিনিটের গাড়ি ছাড়লো পাঁচটায়। শিয়ালদা থেকে লালগোলার দূরত্ব প্রায় ২৩৪ কিলোমিটার, সময় লাগে ৫ ঘণ্টা ৫০ মিনিট। প্রায় এগারোটা কুড়ি মিনিটে ট্রেনটি লালগোলায় পৌঁছাল। এইটি একটি সীমান্ত স্টেশন এরপর রেললাইন নেই। এখান থেকে ধুলিয়ান যেতে হলে বাই রোড যেতে হবে, কোন ট্রেন লাইন নেই। আমার লালগোলাতে আসবাব কারণ হলো ধুলিয়ানের অফিসের ম্যানেজার এর বাড়ি লালগোলায়, আমি তার সঙ্গে মোটর সাইকেলে করে চলে যেতে পারবো । 
যাইহোক ৫/৬ ঘণ্টা ট্রেন যাত্রা করে আমি খুব ক্লান্ত ছিলাম। ‘হোটেল প্রিয়াঙ্কা’ আগে থেকেই বুকিং ছিল তাই চেক ইন করে একবারে খাবারের অর্ডার দিয়ে নিজের রুমে চলে গেলাম। কিছুক্ষণ পরে স্নান করে এসে দেখলাম রুম বয় খাবার দিয়ে গেছে। খাবার খেয়ে শুয়ে পড়লাম। পরের দিন, ধুলিয়ানের ব্রাঞ্চ ম্যানেজার বিশ্বনাথ দাস সকালবেলায় হোটেলে এল, এবং আমি তার মোটর সাইকেলে চড়ে ধুলিয়ানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। লালগোলা থেকে ধুলিয়ান প্রায় ৫৫ কিলো মিটার রাস্তা, যেটা  জঙ্গিপুর রঘুনাথগঞ্জ হয়ে এন এইচ ১২ সঙ্গে মেশে। কিন্তু একটা শর্টকাট রাস্তা আছে গ্রামের মধ্যে দিয়ে যেটা জঙ্গিপুর হয়ে অরঙ্গবাদ, সুতি, আয়রন ব্রিজে উঠবে, তারপর মালদার দিকে কিছুক্ষণ গেলে ধুলিয়ান বাস স্টেশন পড়বে। এটা মুলত গ্রামের রাস্তা। আমরা এই গ্রামের রাস্তাটা ধরেছিলাম। প্রথমত দূরত্ব কিছুটা কম হবে এবং গ্রামের রাস্তা বলে ট্রাফিক অনেক কম হবে।
আমরা সকাল আটটায় বের হয়ে প্রায় ১০টা ৩০ মিনিটে ধুলিয়ান অফিসে পৌঁছালাম। সারাদিন অফিসের কাজ করে দুপুরবেলা একটা হোটেলে লাঞ্চ করলাম এবং গঙ্গার ধারে একবার ঘুরেও আসলাম। বিশাল বড় গঙ্গা, এপার অপার দেখা যায় না। তারপর আবার বিশ্বনাথের মোটর সাইকেলে চেপে বিকেল পাঁচটা নাগাদ ধুলিয়ান থেকে লালগোলার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। জুলাই মাস, বেলা বড়, তাই কোন অসুবিধা নাই। ধুলিয়ান থেকে অরঙ্গাবাদ, নিমতিতা পার হয়ে যখন সাজিনা পাড়ায় ঢুকলাম এমন সময় প্রচন্ড বৃষ্টি শুরু হল। যদিও আমরা গ্রামের রাস্তা ধরেছিলাম তথাপি এই এলাকায় লোকবসতি খুবই কম। কারণ এখানে খুব বেশি আফিং চাষ হয়। যদিও আফিং চাষ করা বেআইনি তথাপি লুকিয়ে চুরিয়ে অনেক জায়গাতে এখনও তার চাষ হয়। এই আফিং গাছে যে ফল হয় তার ওপরের আবরণটা আফিং বা লোকাল ভাষায় ডেড়ি ফল এবং তার বীজ থেকে তৈরি হয় পোস্ত। 
যাইহোক, আমরা যে গ্রাম্য রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম, তার আসে পাশে কোন দাঁড়াবার জায়গা ছিল না, তাই মোটর সাইকেলে চেপে ভিজতে ভিজতে যাচ্ছিলাম। বৃষ্টিতে আমার চশমা ঝাপসা হয়ে গেল তাই সেটা খুলে পকেটে পুরলাম।
খানিক বাদে বিশ্বনাথ বলল, “দূরে একটা বাড়ি দেখা যাচ্ছে ওখানে গিয়ে একটু দাঁড়াব, বৃষ্টিতে আর মোটর  সাইকেল চালান যাচ্ছে না”। 
আমি বললাম, “ঠিক আছে চল ওখানে একটু দাঁড়ানো যাক তারপর আবার যাওয়া যাবে”।
সেই মতো বিশ্বনাথ মোটর সাইকেলটাকে আস্তে আস্তে বাড়ির কাছে নিয়ে এসে থামালো। আমরা মোটর সাইকেল থেকে নেবে বাড়ির কাছে এসে দেখলাম এটা আসলে একটা ভাঙ্গাবাড়ি। বাড়ির সামনে একটা দরজা আছে। সেটা অল্প চাপ দিতেই খুলে গেল। আমরা আস্তে আস্তে ভিতরে ঢুকলাম। দোতলাবাড়ি, গেটের পর একটু বাগান, নানান গাছ আছে বটে, কিন্তু তা আগাছায় ভরে গেছে, যত্নের অভাব। পথ চলার রাস্তাটাও ঘাসে ভর্তি। নিচে সম্ভবত দুটি ঘর আছে। সামনে একটা বড় দালান আছে, উপরে দুটো ঘর আছে, একটা ঝুল বারান্দা আছে বাইরের দিকে। আমরা আস্তে আস্তে সিঁড়ি দিয়ে দালানে উঠে দাঁড়ালাম। আমি চশমাটা পকেট থেকে বার করে মুছে সেটা আবার পরলাম। বিশ্বনাথ রুমাল বার করে মাথা, মুখ মুছতে লাগল। 
এমন সময় ভেতর থেকে একটা বয়স্ক লোকের আওয়াজ এল, “কে”?
আমি বললাম, “আজ্ঞে আমরা ধুলিয়ান থেকে আসছি, যাবো লালগোলা। রাস্তায় বৃষ্টি এসেছে তাই এখানে এসেছি। একটু বৃষ্টি কমলে আমরা চলে যাব”। 
ভেতর থেকে আবার উত্তর আসলো, “ঠিক আছে, ভেতরে আসুন, কোনো অসুবিধে নেই”। 
আমি বললাম, “না ঠিক আছে, এখানে দাঁড়াই”। 
আবার উত্তর আসলো, “আসুন না এখানে একটু বসতে পারবেন, বাইরে ঝাপটা দিচ্ছে ভিজে যাবেন”।
আমি বিশ্বনাথকে বললাম, “কথাটা ঠিক, একে আধভেজা হয়েছি, এখানে দাঁড়ালে পুরো ভিজে যাব। চল ভিতরে গিয়ে বসি”। কোন উপায়ন্তার না দেখে বিশ্বনাথ আমার পিছু পিছু এল। ভেতরে ঢুকে দেখলাম ঘরটি প্রায় অন্ধকার, কোন আলো নেই। পিছন দিকে একটা জানলা খোলা আছে সেটা দিয়ে অল্প আলো ভেতরে আসছে। তাতে দেখা যাচ্ছে ঘরের কোনে একটা চৌকিতে একজন শুয়ে আছে, মনে হয় তিনি অসুস্থ। আপাদ মস্তক কালো কম্বলে ঢাকা। আর একজন ভদ্রলোক একটা চেয়ারে বসে আছেন। সামনে একটা ভাঙা টেবিল তাতে কিছু প্লেট গ্লাস। একদিকে একটা ফটো ফ্রেম তাতে একজন ভদ্রমহিলার ছবি বাঁধানো আছে খুব সম্ভবত বিয়ের সময়কার ফটো, আবছা ধুলোয় ভর্তি আর একটা পুরান আমলের পেন্ডুলাম ঘড়ি বন্ধ হয়ে আছে। ঘরের ভেতরে কিছু আসবাবপত্র আছে এদিক ওদিক। ভদ্রলোক আমাদের দুটো মোড়া দিয়ে বসতে বললেন। আমরা সেখানে বসলাম। 

আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “আপনি এখানে একাই থাকেন আশে পাশে তো কোন বাড়ি দেখছি না” ভদ্রলোক একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে খানিকটা আক্ষেপের সুরে বললেন তার নাম সৌমেন হালদার। পূর্ববঙ্গে তাদের বাড়ি ছিল। দেশভাগের পর তারা এখানে চলে আসেন। চৌকিতে যিনি শুয়ে আছেন, তিনি তার স্ত্রী। তার দুটো ছেলে আছে তারা বহরমপুরে থাকে। আমি বললাম, ”তাহলে তো আপনাদের বহরমপুরে থাকলে ভালো কারণ এখানে এইভাবে সমস্ত কাজ তো নিজেকেই করতে হয়। ছেলেদের কাছে থাকলে সুবিধে”। ভদ্রলোক বললেন, “এখানে কিছু জমি আছে তা একজন ভাগে চাষ করে, সেখান থেকে যা আয় হয় তাতেই আমাদের চলে যায়। নিজের হাতের গড়া বাড়ি তাই ছেড়ে যেতে পারছি না। ছেলেরা অনেকবার আমাদের নিয়ে যেতে চেষ্টা করে ছিল আমরা যায় নি”। এ ছাড়াও তিনি আরো কিছু নিজের কথা বলতে লাগলেন। আমরা আন মনে শুনছিলাম কিন্তু মনটা পড়েছিল বাইরে বৃষ্টির দিকে। কখন বৃষ্টি থামবে তারপর আমরা বের হতে পারব। কারণ ঘরের আবহাওয়াটা এত গুমোট লাগছিল যে এখানে কিভাবে দুজন জীবন্ত প্রাণী বসবাস করে সেইটা আমার একটু আশ্চর্য লাগছিল। এমন সময় বিশ্বনাথ বলল, “স্যার একটু চা হলে ভালো

হতো” পাছে ভদ্রলোক শুনতে পেয়ে আমাদের জন্য চা বানাতে বসেন তাই আমি বললাম, “চুপ করো এখানে চা কোথায় পাবে বাহিরে দোকানে থেকে চা খাব”। ভদ্রলোক কিন্তু আমাদের কথা শুনতে পেয়েছেন। তিনি বললেন, “চা তো আমি দিতে পারবো না তবে লেবুর সরবত খেতে চান তো দিতে পারি। আমাদের উঠানে যে লেবুর গাছ আছে সেটা আমি বাংলাদেশ থেকে এনে বসিয়ে ছিলাম এখনো ফল দিচ্ছে”।
আমি বললাম, ”না না তার দরকার নেই,  আপনি ব্যস্ত হবেন না”।
উনি বললেন, ”ঠিক আছে কোন অসুবিধে নেই, আপনারা বসুন, আমি লেবু তুলে আনছি”।
আমি দেখলাম ভদ্রলোক আমাদের সামনে দিয়ে আস্তে আস্তে উঠে বারান্দা দিয়ে বাইরের দিকে গেলেন লেবু আনতে। এখানে একটা কথা বলা দরকার ঘরের ভিতর ধুলোর মধ্যে আমাদের পায়ের ভিজে জুতোর ছাপ পড়ছে। কিন্তু ভদ্রলোকের পায়ের ছাপ পড়লো না, অথচ তিনি আমাদের সামনে দিয়ে হেঁটে গেলেন। এটা বিশ্বনাথ না লক্ষ্য করলেও আমি লক্ষ্য করেছি তাতেই আমার একটু সন্দেহ হল, কিন্তু বিশ্বনাথকে কিছু বললাম না।
প্রায় এক মিনিটেরও কম সময়ে মধ্যে ভদ্রলোক চলে এলেন হাতে তিনটে চারটে লেবু। তারপরে একটা ছুরি দিয়ে সেই লেবু কেটে একটা বড় ঘটিতে দিলেন। তারপর তাতে নুন চিনি দিয়ে গুলিয়ে দুটো গ্লাসে ভর্তি করে আমাদের দিলেন।
যখনই আমি গ্লাসটা মুখের কাছে তুললাম তখনই একটা বিকট পচা গন্ধ লাগলো, মনে হল গ্লাসের ভেতরে পচা ডিম ছিল, বা গ্লাসটা ডিমের অমলেট বানানোর জন্য ব্যবহার করা হতো এবং ভালো করে ধোয়া  হয় নি, তাই গন্ধ ছাড়ছে। আমি একটুও খেতে পারলাম না। কিন্তু বিশ্বনাথ একটুখানি মুখে দিল তারপরে আবার গ্লাসটা রেখে দিল। ভদ্রলোক দুটো লেবু আমাদের হাতে দিলে দিয়ে বললেন এগুলো আপনারা নিয়ে যান বাড়িতে গিয়ে সরবত খাবেন। আমাদের গাছের লেবুতে অনেক রস আছে। এইটা আমার মনে ধরল দুটোই আমি নিয়ে প্যান্টের পকেটে রাখলাম। 
এতক্ষণে আস্তে আস্তে বৃষ্টি কমেছে আর আমাদের যেতে হবে এখনও অনেকটা পথ। তাই বিশ্বনাথ বলল,” স্যার চলুন আর দেরী করা ঠিক হবে না”।
আমিও তাই ভাবছিলাম, অতএব ভদ্রলোককে ধন্যবাদ জানিয়ে আমরা মোটরসাইকেলে চেপে লালগোলার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। জঙ্গিপুরে পোঁছে একটা চায়ের দোকান দেখতে পেয়ে আমি বিশ্বনাথকে বললাম, ”তুমি চা খাবে বলছিলে সামনের চায়ের দোকানে দাঁড়াও”।
আমরা চায়ের দোকানে ঢুকে বেঞ্চিতে বসে দোকানদারকে বললাম, “দুটো চা দেবেন”।
দোকানদার দুটোকে গেলাসকে ভালো করে গরম জলে ধুয়ে তাতে চা দিয়ে আমাদের দিলেন। বাহিরে বৃষ্টি  থামলেও ঠাণ্ডা আমেজটা আছে। তাই গরম চা টা বেশ তৃপ্তি লাগলো। আমি বিশ্বনাথকে বললাম, ”হালদারবাবু যে লেবু দিয়েছে তা তোমার কাছে রাখো আমি হোটেলে থাকব আমার দরকার নেই”। এই বলে পকেটে হাত দিয়ে দেখলাম লেবু নেই। এ পকেট, ও পকেট, ব্যাগ সব দেখলাম কোথায় লেবু পেলাম না। বিশ্বনাথ বলল, “বোধহয় রাস্তায় পড়ে গেছে”।
হঠাৎ দোকানদার আমাদের কথা শুনতে পেয়ে জিজ্ঞাসা করল, “আপনারা কোন হালদারবাবুর কথা বলছেন”।
আমি বললাম, ”এই একটু দূরে মাঠের মাঝখানে একটা বাড়ি আছে, ওইখানে আমরা গিয়েছিলাম। বৃষ্টি পড়ছিল তাই  আমরা অল্প সময়ের জন্য দাঁড়িয়েছিলাম”।
দোকানদার বলল, ”আপনারা কি বাড়ির মধ্যে গিয়েছেন”।
আমি বললাম, ”হ্যাঁ গিয়েছিলাম। ওখানে সৌমেন হালদার বলে এক বয়স্ক ভদ্রলোক আছেন, তার স্ত্রী ও আছেন। তারা আমাদের লেবু শরবত খেতে দিয়েছিলে। এছাড়া গোটা দুটো লেবু আমাকে দিয়েছিলেন বাড়িতে নিয়ে যাবার জন্য। সেই দুটো রাস্তায় পরে গেছে বোধহয়”।
ভদ্রলোক বললেন, “আপনারা কি লেবুর জল খেয়েছেন?”
আমি কিছুটা ইতঃস্তত করে বললাম, ”হ্যাঁ মানে, গেলাস খুব পচা গন্ধ ছাড়ছিল বলে আমি খাইনি, কিন্তু আমার সহকর্মী বিশ্বনাথ একটু খেয়েছে”।
তখন ভদ্রলোক একটু মাথা চুলকে বললেন, ”বসুন”।
এইবলে তিনি দুটো কাগজে একটু করে নুন নিয়ে তাতে মন্ত্র বলে তিনি আমাদের দিয়ে বললেন এটা আগে খেয়ে নিন, তারপর জল খাবেন। তারপরে চা খাবেন।
আমি বললাম, “কেন কি হয়েছে?”
সে বলল, ”আপনি আগে এটা করুন তারপর আপনাকে বলছি পুরো ঘটনা”।
পেট খারাপ হলে আমার মা মাঝে মধ্যে আমাকে জোয়ান আর নুন মিশিয়ে খেতে দিতেন। এটা আমি জানি পেটের গোলমালের খুব ভালো ওষুধ নুন আর জোয়ান। তাই এটা খেতে আমার আপত্তি হল না, আমি খেলাম, তাই দেখে বিশ্বনাথ ও খেলো।
একটু পরে ভদ্রলোক একটু নিছু স্বরে আমাদের বললেন, “আপনারা যেখানে গিয়েছিলেন সেটা হালদারের বাড়ি ঠিকই, কিন্তু ওটা হানাবাড়ি, বসতবাড়ি নয়। ওখানে কেউ জীবিত থাকে না। যে সৌমেন হালদার আপনাদের লেবুর জল দিয়েছিল সে মারা গিয়েছে আজকে পাঁচ  বছর হল। তার দুজন ছেলে আছে ঠিকই তারা বহরমপুরে থাকে, ব্যবসা করে। এখানে কেউ আসে না। এই বাড়িটা এলাকার লোকের কাছে হানাবাড়ি হিসেবেই খ্যাত। এখানে দিনের বেলাতেও কেউ যায় না। অনেকেই নাকি রাত্রিবেলায় ওই ভদ্রলোককে সাদা কাপড় মুড়ি দিয়ে লেবু গাছ থেকে লেবু তুলতে দেখেছে। সৌমেনবাবুর স্ত্রী মারা যায় এক অজানা জ্বরে। তারপর ছেলেরা অনেকবার বাবাকে নিজেদের কাছে রাখতে চেয়ে ছিল, কিন্তু তিনি যান নি। স্ত্রী বিয়োগের ছয় মাসের মধ্যে তিনি মারা যান। ছেলেরা বাড়ীটা ভাড়া দেবার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু কোন ভাড়াটে পুরো একমাস থাকেনি। সবাই বলত রাত্রিবেলায় কে যেন পুরো বাড়ি দাপাদাপি করে বেড়াচ্ছে। মাঝে মধ্যে ঘরের জিনিসপত্র এদিক ওদিক সরে যায়। “
খানিকটা দম নিয়ে ভদ্রলোক আবার বললেন, “আমি গুণিন ভুতের উপস্থিতি বুঝতে পারি। আপনাদের দেখে আমার মনে হয়েছে কোন কালো ছায়া আপনাদের পিছে পিছে আসছে। তাই আমি নুন পরা দিয়েছি ও কোন ক্ষতি করতে পারবে না।“
আমি দোকানদার ভদ্রলোককে সমর্থন করে বললাম, “এটা হতে পারে, কারণ দুটো বিষয়ে আমার সন্দেহ হয়েছিল। প্রথমত ঘরে কোন আলো নেই কেন, এত অন্ধকারের মধ্যে লোক থাকে কি করে, এবং ঘরটা ভীষণ স্যাঁতসেঁতে। কোন রোগীর পক্ষে এই রকম ঘর ভালো নয়।
দ্বিতীয়তঃ যখন আমাদের সামনে দিয়ে ভদ্রলোক লেবু তুলতে গেলে তখন তার পায়ের ছাপ কিন্তু মাটিতে পরছিল না। অথচ আমরা যখন ঘরে ঢুকি তখন আমাদের পায়ের ছাপ এদিকে-ওদিকে ছিল”। 
বিশ্বনাথ বলল, “আপনি এটা দেখেছেন কিন্তু আমাকে বলেননি”।
আমি বললাম, ”আমার অডিটরের চোখ কাজেই কোন কিছুই আমার চোখে ফাঁকি দেওয়া যায় না। তাছাড়া ঘর থেকে বারান্দায় বেরিয়ে তারপর উঠনের লেবু গাছ থেকে লেবু তুলে ফিরে আসতে প্রায় তিন মিনিট সময় লাগার কথা। অথচ ভদ্রলোক এক মিনিটেরও কম সময়ের মধ্যে ফিরে এলেন কি করে, তখনই আমার সন্দেহ হয়েছিল”।
দোকানদার ভদ্রলোক বললো, “তাহলে আপনাদের সাহস আছে বলতে হবে আপনারা জেনে শুনে ওর কাছ থেকে লেবুর সরবত খেয়েছিলে। তবে ভয় নেই আমি নুন পোরা দিয়ে দিয়েছি আপনাদের কোন ক্ষতি হবে না”। এর পর আমরা চায়ের কাপটা রেখে পয়সা দিয়ে আবার মোটর সাইকেলে উঠে পড়লাম। যখন হোটেলে পৌছালাম তখন রাত্রি সাতটা।
আমি বিশ্বনাথকে বললাম, ”তুমি রাত্রি দশটা-এগারোটা নাগাদ একবার আমাকে ফোন করবে কিরকম আছো তা জানাবে। তোমাদের বাড়িতে এ বিষয়ে কোন কথা না বলাই ভালো “। 
ও ঠিক সাড়ে দশটায় আমাকে ফোন করেছিল। আমরা দুজনেই ভালো আছি, কোন অসুবিধা হয়নি।  এরপরে দুদিন পরে আমি আমার কাজ শেষ করে কলকাতায় আবার ফিরে আসি। এটা আমার জীবনের একটা ঘটনা।

চিত্তদহন

গল্প

 মার্চ ২০২২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

চিত্তদহন

অভিজিৎ দাস

girl1.jpg

মলুক রেলওয়ে স্টেশান থেকে কুন্তল একা-একা হেঁটে চলল অয়নের বাড়ির উদ্দেশ্যে। স্টেশান থেকে অয়নের বাড়ি পায়ে হেঁটে পনেরো-কুড়ি মিনিট লাগে। এর আগে কুন্তল বহু বার এসেছে অয়নের বাড়ি; তাই এখানকার পথ- ঘাট সব কুন্তলের চেনা। কুন্তলের যত দূর মনে পড়ে সে তার বন্ধু অয়নের বাড়িতে শেষ বার এসেছিল প্রায় তিন বছর আগে। তারপর তার আর আসা হয়নি। কারণ, অয়ন জার্মানে একটা চাকরি নিয়ে ওখানেই সেটেল হয়েছে। তিন বছর বাদে অয়ন দেশে ফিরেছে; জন্মভূমিতে দিন কয়েক কাটিয়ে আবার সে ফিরে যাবে জার্মানে। যাইহোক, ফুরফুরে বাতাস গায়ে মেখে হাঁটতে কুন্তলের বেশ ভালোই লাগছিল। হঠাৎ তার মনের সাগরে ভেসে ওঠে জয়তির মুখ। কুন্তল হেঁটে চলেছে, হেঁটেই চলেছে! আর তার সঙ্গে রয়েছে জয়তির স্মৃতি। কেমন আছে ও? ভালো আছে তো? ও কি এখন আর গান গায়? কুন্তল যে অয়নের বাড়িতে আগে প্রায় আসতো, সে তো শুধু জয়তির গান শোনার টানে। কী সুমধুর কণ্ঠ জয়তির! ওর গান শুনলে মনে হয় জীবনের যত সংঘর্ষ, দুঃখ, যন্ত্রণা সব যেন এক নিমেষেই দূরে সরে যায়। জয়তির বাড়ি অয়নদের গ্রামেই। অয়ন একবার কুন্তলকে জয়তির সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়ে দিয়েছিল। সেই থেকে কুন্তল প্রায় যেত জয়তির বাড়িতে। যখনই সে অয়নের বাড়িতে আসতো, তখনই জয়তির কণ্ঠ নিঃসৃত গানের সুর তাকে পাগলের মত আকর্ষণ করত। তাইতো সে বার-বার ছুটে যেত জয়তির বাড়ি! কোনো-কোনো সময় তো অয়ন সঙ্গেই যেত না, কুন্তল একাই যেত। জয়তি একদিন কুন্তলকে বলেছিল, "বাবু, আমাকে কোথাও একটা গান গাওয়ার সুযোগ করে দেবেন? দুটো পয়সা ঘরে আনবো! আমরা খুব গরীব, সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরায়! মা সেই কবে মরে গিয়েছে! আর বাবা--- বাবা এখন অসুস্থ, কাজে বেরোতে পারছে না!"
কথাগুলো বলতে বলতে ঝর-ঝর করে কেঁদে উঠেছিল জয়তি। সেদিন কুন্তল মনে খুব ব্যথা পেয়েছিল জয়তির দুর্দশার জন্য! জয়তির হাতে দু-শ টাকা গুঁজে দিয়ে কুন্তল বলেছিল, "দেখো জয়তি, সংগীত মহলে আমারতো তেমন কেউ জানা- শোনা নেই। তবে আমি চেষ্টা করে দেখবো একবার। আপাতত এই টাকাটা রাখো।"
জয়তি কোনো মতে টাকা নিতে চাইছিল না; কুন্তল এক প্রকার বাধ্য হয়েই বলেছিল, "তুমি যে আমায় গান শোনালে, তার পারিশ্রমিক হিসেবে রাখো না হয়।"
এই রকম নানান কথা ভাবতে ভাবতে কুন্তল হেঁটেই চলল। এরই মধ্যে কখন যে বিকেল গড়িয়ে ঝপ্ করে সন্ধ্যে নামল, কুন্তল টেরই পেল না।

হাঁটতে হাঁটতে কুন্তল ভাবছিল কত দিন পর অয়নের সাথে আজ তার দেখা হবে--- আঃ! কী মজাটাই না হবে! কিন্তু তারপর আবার তাকে জয়তির স্মৃতিগুলো আঁকড়ে ধরল। সে মনে-মনে স্থির করল অয়নকে সঙ্গে নিয়ে সে একবার যাবে জয়িতর বাড়িতে। তিন বছর পর কুন্তল আবার জয়তির গান শুনবে। ভাবতেই তার মনে কেমন যেন একটা রোমাঞ্চ জেগে উঠল। কিন্তু, জয়তির যদি বিয়ে হয়ে থাকে, তবে তো তার শ্বশুরবাড়িতে থাকার কথা। জয়তির সঙ্গে কি দেখা হবে? আচ্ছা, সে কি নিজের অজান্তে জয়তিকে ভালোবেসে ফেলেছিল! না শুধুই গানের টানে সে বার-বার ছুটে যেত জয়তির কাছে! এ যদি গানের আকর্ষণ হয়, তবে কেন জয়তির মায়া মাখানো মুখ খানা বার-বার ফুটে ওঠে তার মনের দর্পণে! কেন সে তার হৃদয়ের অন্তঃপটে ব্যথা অনুভব করে! সে ভাবে তার বড্ড ভুল হয়ে গেছে! কারণ, সেদিন সে জয়তির আবছা উদ্গ্রীব আবেদনে সাড়া দেয়নি। সেদিন জয়তি অশ্রু ভেজা চোখে কুন্তলকে বলেছিল, "বাবু, আমাকে নিয়ে যাবেন আপনার বাড়ি? আমি সব কাজ করে দেবো। ঘর মোছা, বাসন মাজা, রান্না-বান্না, সব পারি আমি!"
হঠাৎ দোটানার মধ্যে পড়ে গিয়ে কুন্তল বলেছিল, "আমি বাড়িতে কথা বলে দেখি; পরে তোমায় জানবো।"
সেদিন কুন্তল জয়তির মনের ভাষা বুঝতে পারেনি। শুধু পকেট থেকে তিনশ টাকা বের করে জয়তিকে দিয়ে বলেছিল,- "এটা তোমার কাছে রেখে দাও জয়তি।"
জয়তি বলেছিল, "বারবার আমি আপনার কাছে টাকা নেব কেন? আমার বুঝি অন্তরে বাধে না!"
"সে কী, অন্তরে বাধবে কেন। এই যে আমি তোমার বাড়িতে এলে, তুমি সমস্ত কাজ-কর্ম ফেলে রেখে আমায় গান শোনাও, তা কি এমনি-এমনি। বলি তোমারও তো সময়ের দাম আছে, না কি ? সেইজন্য ভালোবেসে আমি যদি কিছু টাকা দিই, তাতে ক্ষতিটা কী।"
"বেশ, নিলুম না হয়, ঐ যা! কথায়- কথায় অনেক রাত হয়ে গেল, বাবাকে খাওয়ার দিতে হবে।"
"আমাকেও ফিরতে হবে। আজ যাই, আবার পরে আসবো।"
"এতক্ষণ যখন রইলেন, আর কিছুক্ষণ থাকুন। খেয়ে যাবেন।"
কুন্তল সেদিন জয়তির কথা ফেলে দিতে পারেনি। এক অসীম তৃপ্তির অনুভূতিতে সেদিন সে শাক-ভাত খেতে বসে পড়েছিল জয়তির বাড়িতে।

কুন্তল অয়নের বাড়ির প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছিল। আর মিনিট পাঁচেক হাঁটলেই সে পৌঁছে যাবে অয়নের বাড়ি। পূর্ব দিগন্তের চাঁদ তার কিরণ দিয়ে চারিদিক ভরিয়ে তুলেছিল; তাই কুন্তলের চোখ অনেক দূর পর্যন্ত প্রাকৃতিক শোভা উপভোগ করতে সক্ষম হয়েছিল। তিন-চারটা মোটর বাইক তাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। একটা টোটোকেও সে দেখতে পেল। টোটোটা স্টেশানের দিক থেকে এসে অয়নের বাড়ির দিকে চলে গেল। ইচ্ছে করলেই সে টোটোতে চড়ে বসতে পারত; কিন্তু সে তা করল না। হাঁটতে তার ভালোই লাগছিল। কুন্তল হনহন করে এগিয়ে চলল। হঠাৎ তার কানে ঠেকল একটা অতি পরিচিত কণ্ঠস্বর। জয়তি গান গাইছে! কিন্তু জয়তির বাড়িতো এদিকে নয়। তাহলে, তার কণ্ঠ এখানে ভেসে আসছে কী করে। এই রকম সাত-পাঁচ ভেবে কুন্তল একটু থমকে দাঁড়াল। তারপর সে মেইন রাস্তা থেকে নেমে গানটা যেদিক থেকে ভেসে আসছিল, সেই দিকে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর সে একটা পুকুর পাড়ে পৌঁছাল। পুকুরটার চার পাশে ছোট-বড় নানা রকম গাছ মৃদুমন্দ বাতাসে মাথা দোলাচ্ছে। কুন্তল দেখল পুকুর পাড়ে অনতি দূরে একটা গাছের তলায় বসে একজন রমণী আপন খেয়ালে গান গেয়ে চলেছে। কুন্তল ধীরে-ধীরে গাছটার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই, রমণীটি তার গান থামিয়ে বলল, "আপনি এসেছেন বাবু?

"কুন্তল অতিশয় বিস্ময় প্রকাশ করে বলল, "জয়তি, তুমি এখানে!" 

"একটা কাজে গিয়েছিলাম, ফেরার পথে এখানেই একটু বসে পড়লাম। এই চন্দ্রালোকিত মনোরম পরিবেশ --- এমন নির্জন স্থানে আমি অসীম শান্তি খুঁজে পাই!"

"কেমন আছো, জয়তি?"

"ভালোই আছি। আপনি ভালো আছেন তো? বিয়ে করেছেন বুঝি? ছেলে-পুলে হয়েছে নিশ্চয়?"

"আমি এখনো বিয়ে করিনি, জয়তি।"

"কেন, করেননি কেন? মনের মত মেয়ে পাননি বুঝি?"

"না, বিষয়টা ঠিক তা নয়। নানা রকম ঝামেলা এবং কাজের চাপে বিয়ের কথা ভাবারই সময় পাইনি! তবে, এখন ভাবছি বিয়েটা করেই ফেলব।"

কয়েক মুহূর্ত উভয়েই চুপ-চাপ রইল। কুন্তল লক্ষ্য করল জয়তির মধ্যে আগের মত আর ইচ্ছা-শক্তি নেই, আশা-আনন্দের আলোড়ন নেই, সে যেন নির্বিকার। জয়তি চাঞ্চল্যহীন কণ্ঠে বলল,

"গান গাইতে পারে এমন মেয়েকে বিয়ে করবেন কিন্তু। আপনার তো আবার গান শোনার শখ।"

"একটা কথা বলবো, জয়তি?"

"কী কথা, বলুন।"

"আমি মনে মনে তোমায় ভালোবেসে ফেলেছি! তুমি যাবে আমার বাড়ি?"

"বড্ড দেরী হয়ে গেছে বাবু! আজ থেকে তিন বছর আগে আমি আপনার সঙ্গে যেতে চেয়েছিলাম; কিন্তু আপনি বুঝতে পারেননি!"

"আমার খুব ভুল হয়েছে জয়তি! এখন আমি তোমায় কাছে পেতে চাই। তুমি না কর না জয়তি!"

"এখন তা আর সম্ভব নয় বাবু!"

"কেন, সম্ভব নয় কেন? তোমার কি বিয়ে হয়ে গেছে?"

"হ্যাঁ। অনেক দিন আগে, আকাশের সঙ্গে!"

কুন্তল মনে খুব আঘাত পেল; অত্যন্ত নিম্ন স্বরে সে বলল,

"ও--- খুব সুখের সংসার বুঝি!"

জয়তি একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,

"খুব সুখের !"

দুজনের মধ্যে আর বিশেষ কিছু কথা হল না। পুকুরের পাড় ঘেঁষা একটা সরু পথ ধরে জয়তি চলে গেল। আর প্রকান্ড একটা দুঃখের উপত্যকাকে বুকের মাঝে ধারণ করে কুন্তল সেখানেই কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইল। নিজের অজান্তে তার চোখ থেকে কখন যে দু-ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে টপ্ করে শুকনো পাতার ওপর পড়ল, সে বুঝতেই পারল না।

অবশেষে কুন্তল যখন অয়নের বাড়িতে পৌঁছালো, তখন রাত প্রায় আটটা। বহু দিন পরে দুই বন্ধুর দেখা; তাই, অয়ন সোল্লাসে ফেটে পড়ে জড়িয়ে ধরল কুন্তলকে। তারপর অয়নের মায়ের আয়োজন করা নানা রকম জল-খাবার সহযোগে দুই বন্ধুর মধ্যে বিভিন্ন স্বাদের কথাবার্তা চলছিল। অয়ন বলতে থাকে তার জার্মানে থাকাকালীন ছোট-বড় নানা রকম তিন বছরের অভিজ্ঞতা। কুন্তলও কিছু কম যায় না। সেও বলতে থাকে সুখ- দুঃখ মিলিয়ে তার জীবনে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা। কথায়-কথায় অয়ন বলল, "হ্যাঁ রে, তোর এত দেরী হল কেন?" কুন্তল প্রথমটা কেমন হকচকিয়ে গেল। জয়তির সঙ্গে দেখা হওয়ার ঘটনাটা বলবে কি বলবে না, এই নিয়ে সে দোটানার মধ্যে পড়ে গেল। তারপর, জয়তির বিষয়টাকে সম্পূর্ণ চেপে গিয়ে কুন্তল বলল, "স্টেশানে একটু রেস্ট নিয়ে হেঁটে-হেঁটে এসেছি তো, তাই।"

"কেন, হেঁটে এলি কেন ? একটা টোটো ধরে নিলেই পারতিস।"

"হ্যাঁ, তা হত--- চন্দ্রালোকিত রাত্রি আর মৃদুমন্দ বাতাস; তাই হাঁটতে ভালোই লাগছিল।" তারপর, কুন্তল আর অয়ন বাড়ির ছাদে গেল। প্রকৃতির বাতাস উপভোগ করতে-করতে আরও নানা রকম গল্প করছিল তারা। এই ভাবে রাত দশটা পেরিয়ে গেল। বাড়ির সকলের সঙ্গে বসে কুন্তল পেট পুরে ডিনার করল; তারপর সে অয়নের সাথে ঘরের পশ্চিম দিকের একটা রুমে শুতে গেল। বড় একটা পালঙ্কের উপর পরিপাটি করে বিছানা পাতা ছিল, তাতেই দুই বন্ধু শুয়ে পড়ল। রুমের পশ্চিম দিকের একটা জানালা খোলা ছিল, যার মধ্য দিয়ে জ্যোৎস্না এসে রুমের বেশ কিছুটা অংশকে আলোকিত করে তুলেছিল। একে ট্রেন জার্নি, তার ওপর পায়ে হাঁটা--- ক্লান্তি অনুভব করছিল কুন্তল। তার দুচোখের পাতা জড়িয়ে এল। এরই মধ্যে কুন্তল মনে মনে স্থির করে নিল যে কাল সকালে সে একবার জয়তির সঙ্গে দেখা করবে।

এক ধরণের অস্বাভাবিক অনুভূতিতে আচমকা কুন্তলের ঘুম ভেঙে গেল! মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখল রাত তিনটে বাজে। তারপর জানালার দিকে তাকাতেই তার মাথাটা ঝাঁ করে ঘুরে গেল! জ্যোৎস্নার আলোতে সে স্পষ্ট দেখতে পেল জানালার বাইরে একজন মহিলার ছায়ামূর্তি! তারপর তার মনে হল যেন জয়তি দাঁড়িয়ে রয়েছে। ধড়মড় করে সে বিছানাতে উঠে বসল! আর সঙ্গে-সঙ্গে ছায়ামূর্তিটা জানালার কাছ থেকে সরে গেল! অয়ন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন; মাঝে-মাঝে সে নাক ডেকে চলেছে। কুন্তল ভাবল অয়নকে কি সে একবার ডাকবে ? না, সে ডাকলনা অয়নকে। অয়ন ঘুমাচ্ছে ঘুমাক। মনে সাহস এনে কুন্তল ধীরে ধীরে রুমের বাইরে বেরিয়ে এল। সে দেখল ঘরের বারান্দায় একটা টিমটিমে নাইট বাল্ব জ্বলছে। সে অতি সন্তর্পণে ঘরের মেইন গেট খুলে বাইরে বেরিয়ে এল। তারপর ঘরের পশ্চিম দিকের সেই জানালাটার দিকে এগিয়ে গেল। হঠাৎ তার লক্ষ্যে পড়ল জানালা থেকে অনতি দূরে একটা গাছের তলায় দাঁড়িয়ে রয়েছে জয়তি। কুন্তলকে দেখতে পেয়ে জয়তি অতি দ্রুত পায়ে পালিয়ে যেতে থাকে। কুন্তলও দৌড়াতে থাকে জয়তির পেছন-পেছন। সামান্য উচ্চ স্বরে কুন্তলের কণ্ঠে ফুটে ওঠে ব্যাকুল মিনতি, "যেও না জয়তি, দাঁড়াও! দাঁড়াও বলছি! আমার কথাটা একবার শোনো!" অনেক দূরে গিয়ে জয়তি দাঁড়িয়ে পড়ল। কুন্তল জয়তির কাছে গিয়ে বলল, "জয়তি, তুমি এত রাতে ঐ জানালার পাশে কী করছিলে?" জয়তি কয়েক মুহূর্ত নীরব রইল; তারপর রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল, "বদলা! আমি বদলা চাই!"

"বদলা! কিসের বদলা? কার ওপর বদলা নিতে চাও?"

"আপনার বন্ধু অয়ন গোস্বামীর ওপর প্রতিশোধ নিতে চাই আমি!"

"কেন, অয়ন কী করেছে?"

"আমার চরিত্রকে কলুষিত করেছে! আমার সারা দেহ ও মনে কলঙ্ক লেপে দিয়ে নিজের লাম্পট্য এবং লালসাকে চরিতার্থ করেছে!"

বিষয়টা কুন্তলের বুঝতে আর বাকি থাকল না। সে সবিস্ময়ে বলল, "সে কী! কবে হল এরকম অনাচার!"

"আজ থেকে প্রায় দেড় বছর আগে।"

"বলছো কী জয়তি! অয়নতো তিন বছর বাদে জার্মান থেকে বাড়ি ফিরল!"

"না, দেড় বছর আগে একবার আপনার বন্ধু অয়ন গোস্বামী বাড়ি এসেছিল। একদিন সন্ধায়

ও আমাকে ওর বাড়িতে ডেকেছিল; বলেছিল যে আমি যদি ওকে গান শোনাই, তাহলে ও আমাকে অনেক টাকা দেবে। আপনিতো জানেন আমরা খুব গরীব; প্রতিদিন খাবার জোটে না! তাই, আমি সেই সন্ধ্যায় গিয়েছিলাম অয়ন গোস্বামীর বাড়ি। আমার অসহায়তার সুযোগ নিয়ে রাতের অন্ধকারে নিজের লালসা মিটিয়ে অয়ন গোস্বামী পরের দিন ফিরে যায় জার্মানে; ওর কুকর্মের কথা কাক-পক্ষীও টের পেল না! এর সাথে অয়ন গোস্বামীর বাবা- মাও জড়িত আছে!"

"কী! কাকু আর কাকীমাও জানেন!"
"হ্যাঁ, ঐ শয়তান আর শয়তানীও জড়িত আছে! আমি বদলা চাই! মেরে ফেলব ঐ অয়ন গোস্বামীকে"।
"আমি বলছিলাম কি জয়তি, আইন নিজের হাতে তুলে না নিয়ে চলো না কাল সকালে একবার থানাতে গিয়ে বিষয়টা জানিয়ে আসি। অয়ন তো এখন কয়েক দিন ইন্ডিয়াতে থাকবে।"
"কিচ্ছু লাভ হবে না, ও আবার পালিয়ে যাবে জার্মানে!"
"আচ্ছা আমি তোমায় কথা দিচ্ছি জয়তি, অয়ন গোস্বামীকে আমি জেলের ঘানি টানাবই! কিন্তু কিছু একটা প্রমাণ..."
কুন্তলের কথা শেষ হল না, জয়তি একটু উত্তেজিত কণ্ঠে বলল,--
"প্রমাণ! প্রমাণ তো আছে!"
"হোয়াট! প্রমাণ আছে! কোথায়?"
"ওদের রান্নাঘরের পাশের রুমে একবার ঢুকে দেখবেন; তাহলেই সব বুঝে যাবেন!"
এই বলে জয়তি দ্রুত পায়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল। কুন্তল সেখানেই কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। তার মনে প্রবল একটা ঝড় উঠেছে! সে কী করবে ভেবে পাচ্ছিল না; তারপর মনস্থির করেই ফেলল।

ভোরের আলো প্রায় ফুটে উঠেছিল। কুন্তল ধীর পায়ে গিয়ে জয়তির বাড়ির সামনে দাঁড়াল। জয়তির নাম ধরে দু-তিন বার ডাকতেই ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন জয়তির বাবা। উনি কুন্তলের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলেন। কুন্তল বলল, "মেসোমশাই, আপনার শরীর কেমন আছে ?"
"খুব একটা ভালো নয় বাবা। মাঝে মাঝে বুকের বাম দিকটা যন্ত্রণা হয়। কখন চলে যাবো টুক করে!"
"এরকম করে বলতে নেই মেসোমশাই! যাইহোক, আমি একবার জয়তির সঙ্গে দেখা করতে চাই। আর আকাশ এখন কোথায় ? এখানেই আছে, না..."
কুন্তলের কথা শেষ হল না, জয়তির বাবা অতিশয় অবাক হয়ে বললেন,- 
"আকাশ! কে আকাশ?"
"আকাশ, মানে জয়তির স্বামী, আচ্ছা আপনি জয়তিকে ডেকে দিন।"
জয়তির বাবা কাঁপা-কাঁপা গলায় বললেন, "দেখো বাবা, জয়তি যে আকাশ নামের কাউকে বিয়ে করেছে, সেটাই তো আমি জানি না। তাছাড়া, মেয়েটা যে এখন কোথায় আছে, কেমন আছে, তাও আমি জানি না!"
"সে কী! জয়তি এখানে নেই! তা কী করে সম্ভব!"
জয়তির বাবা কাঁদতে-কাঁদতে বলতে থাকেন, "আমি সত্যি বলছি বাবা! আজ থেকে বছর দেড়েক আগে হঠাৎ করে মেয়েটা যে কোথায় চলে গেল, আর ফিরে এল না! গাঁয়ের সবাই বলে কুলটা, দুশ্চরিত্রা মেয়ে কোনো ছেলের সঙ্গে পালিয়েছে!"
সঙ্গে-সঙ্গে কুন্তল দারুণ এক বিস্ময়ের ঘোরে পড়ে গেল! এই কিছুক্ষণ আগে যে সে জয়তির সঙ্গে কথা বলেছে! গতকাল সন্ধ্যায় যে তাকে জয়তি বলেছিল আকাশের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে! জয়তি কি তবে...! রক্ত হিম করা একটা আশঙ্কা কুন্তলকে পেয়ে বসল! বিষয়টা বুঝতে তার আর বাকি রইল না! আকাশের সঙ্গে জয়তির বিয়ে--- মানে আকাশে, বাতাসে ঘুরে বেড়ায় জয়তির অতৃপ্ত আত্মা! হ্যাঁ, তার মানে ঐ রাতে অয়ন গোস্বামী জয়তিকে খুন করেছে! কুন্তলের মানসিক অবস্থা এখন ভয় এবং দুঃখের মিশ্রণে এক অদ্ভুত অনুভূতির শিকার। অনেক কষ্ট করে কণ্ঠে আওয়াজ এনে কুন্তল জয়তির বাবাকে ভাঙা ভাঙা স্বরে বলল,--
"মেসোমশাই, জয়তি দুশ্চরিত্রা ছিল না!"
এই বলে কুন্তল পকেট থেকে রুমাল খানা বের করে নিজের চোখের জল মুছল।

পূর্ব দিগন্তে উদীয়মান সূর্যের আলো কুন্তলের করুণ মুখটাকে আরো করুণ করে তুলেছিল। সে দ্রুত গতিতে হেঁটে চলল অয়নের বাড়ির উদ্দেশ্যে। কুন্তলের দৃঢ় প্রতিজ্ঞ মন যেন তাকে বলে উঠল,--
"অয়ন গোস্বামীর শাস্তি চাই! ওকে সাজা পেতেই হবে!"
তাকে কী কী করতে হবে, সবই সে হাঁটতে হাঁটতে স্থির করে ফেলল। তারপর কয়েক মিনিটের মধ্যেই সে অয়নের বাড়ি পৌঁছাতেই অয়ন বলল,

"কী রে, ভোর থেকে উঠে তুই কোথায় গিয়েছিলি?"
কুন্তল পুরো বিষয়টা চেপে গিয়ে বলল, "একটু মর্নিং ওয়াকে বেরিয়ে ছিলাম।"
"আচ্ছা বেশ, তুই এখন মুখ-হাতটা ধুয়ে আয়। জল-খাবার খেয়ে গ্রামের পথে-ঘাটে একটু ঘুরে বেড়াবো।"
এই বলে অয়ন নিজের রুমে চলে গেল। কুন্তল লক্ষ্য করল অয়নের বাবা বাড়ির বারান্দায় একটা সোফাতে কী সব কাগজ-পত্র নিয়ে বসেছে। কুন্তল ধীরে ধীরে বাথরুমের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। বাথ রুম থেকে রান্না ঘরটা খুব কাছে; তাই সে একটু উঁকি দিয়ে দেখল অয়নের মা রান্না ঘরে ব্যস্ত রয়েছে। কুন্তল আরো দেখল যে রান্না ঘরের পাশের রুমে তালা বন্ধ নেই, শুধু শিকল তুলা রয়েছে। কুন্তল আস্তে- আস্তে করে গিয়ে রুমটার সামনে দাঁড়াল। তারপর খুব সতর্কতার সঙ্গে দরজা খুলে সে ঢুকে পড়ল রুমের মধ্যে। রুমটাতে সব ভাঙা-চোরা আসবাব পত্র ভর্তি রয়েছে। কুন্তল ঘরের চারিদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সব কিছু দেখতে থাকল। মেঝেতে পড়ে থাকা একটা ভাঙা চেয়ারের দিকে তাকাতেই হঠাৎ একটা বিষয় তার নজরে পড়ল। তার মস্তিষ্কে বিদ্যুতের মত ঝিলিক দিয়ে উঠল একটা ধারণা! সঙ্গে সঙ্গে সে পুরো বিষয়টা বুঝে গেল। আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা না করে কুন্তল রুমের বাইরে বেরিয়ে এল এবং সোজা চলে গেল বাড়ির ছাদের ওপর। ছাদটা খুব নিরিবিলি, তার কণ্ঠস্বর কেউ শুনতে পাবে না। ছাদের ওপর উপযুক্ত একটা স্থানে দাঁড়িয়ে সে পকেট থেকে মোবাইলটা বের করল; মনের মধ্যে অদম্য শক্তি সঞ্চয় করে স্থানীয় পুলিশ স্টেশানে একটা কল করল। তারপর কুন্তল অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে ছাদ থেকে নেমে এসে মুখ হাত ধুয়ে যথা সময়ে অয়নের সাথে জল-খাবারের টেবিলে যোগ দিল। জল-খাবার খেতে খেতে কুন্তল ইচ্ছে করেই বলল, "এই বেলা একবার জয়তির গান শুনতে যেতে হবে, অনেক দিন ওর গান শুনিনি।"
হঠাৎ করে অয়ন বলে উঠল,--
"কিন্তু, জয়তি তো মারা গেছে।"
কথাটা বলেই অয়ন কেমন যেন হকচকিয়ে গেল। কুন্তল বলল,--
"তুই জানলি কী করে যে জয়তি মারা গেছে?"
অয়ন আমতা-আমতা করে বলল,--
"না, মানে -- আমি শুনেছি দেড় বছর আগে নাকি জয়তি হঠাৎ করে এক রাতে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়; তাই সকলের ধারণা যে ও আর বেঁচে নেই।"
"জয়তি যে রাতের বেলায় নিরুদ্দেশ হয়েছিল, সেটা তুই কার কাছে শুনলি?"
"কার কাছে আবার, লোকের মুখে শুনেছি।"
"কে সেই লোক? তুই তার নাম জানিস?"
"নাম দিয়ে কী হবে? তুই কি তদন্ত শুরু করেছিস নাকি?"
অয়নের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে কুন্তল বলল, "পাড়া-প্রতিবেশীর কাছে শুনলাম তুই নাকি দেড় বছর আগে একবার বাড়ি এসেছিলি?"
হঠাৎ করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে অয়ন অত্যন্ত উত্তেজিত কন্ঠে বলল, "হোয়াট ডু ইউ মিন, কুন্তল! তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে! এক্ষুনি তুই আমার বাড়ি ছেড়ে চলে যা!"
অয়নের মা সম্ভবত আড়াল থেকে ওদের কথবার্তা শুনে ফেলেছিল; তাই সে দ্রুত এসে দাঁড়াল কুন্তলের সামনে; চোখ পাকিয়ে বলল,
"দেখো কুন্তল, তুমি বন্ধুর বাড়িতে এসেছ, বন্ধুর মতই থাকো! অন্য কোনো কিছুতে নাক গলানোর চেষ্টা করবে না!"
কুন্তল একটু মুচকি হেসে বলল,
"কাকীমা, আপনিও কম যান না!"
আর কোনো কথা না বলে অয়ন তার মায়ের সঙ্গে অন্য রুমে চলে গেল।

কুন্তল অয়নের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য প্রস্তুত হল; স্থির করল রাস্তার কোনো এক স্থানে দাঁড়িয়ে থাকবে সে। তারপর, পুলিশ এলে, পুলিশের সঙ্গে সে আবার ফিরে আসবে অয়নের বাড়িতে। এই সময় পাশের একটা রুম থেকে চাপা স্বরের কিছু কথাবার্তা তার কানে ঠেকল। অস্পষ্টভাবে সে শুনতে পেলো অয়ন আর তার মায়ের কথাবার্তা। সে অয়নকে বলতে শুনল, "কুন্তল সব টের পেয়ে গেছে! এখন কী হবে!"
অয়নের মা বলল - "তুই এক্ষুণি গিয়ে কুন্তলকে আটকে রাখ! ওকে আর কোনো মতে বাঁচতে দেওয়া চলে না!"
শিউরে উঠল কুন্তল! এ যে তাকেই হত্যা করার ষড়যন্ত্র চলছে! সে আর এক মুহূর্তও সেখানে দাঁড়াল না, দৌড়ে গেল মেইন গেটের দিকে। সে খুব তাড়াতাড়ি গেটটা খুলে ফেলল, আর সঙ্গে-সঙ্গে তাকে পেছন থেকে জাপটে ধরল অয়ন! অয়নের মা একটা বড় দড়ি দিয়ে কুন্তলের হাতে পায়ে বাঁধার চেষ্টা করছে! কুন্তল লক্ষ্য করল অয়নের বাবাও এসে ওদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে! অবশেষে তিনজন মিলে কুন্তলের হাতে-পায়ে দড়ি বেঁধে ফেলল। একটা হিংস্র মুচকি হাসি হেসে অয়নের বাবা বলল - "তোমাকে তো পালাতে দেওয়া যাবে না কুন্তল! তাতে আমরাই বিপদে পড়ব! রান্না ঘরের পাশের রুম থেকে তোমাকে যখনই বেরোতে দেখেছি, তখনই আমার সন্দেহ হয়েছিল।"
কুন্তল ভাবল তার বোধহয় আর বাঁচা হল না! সে 'বাঁচাও-বাঁচাও' বলে চিৎকার করতে শুরু করল, আর সঙ্গে সঙ্গে অয়ন তার মুখে একটা বড় রুমাল গুঁজে দিল। অয়নের বাবা মেইন গেটটা বন্ধ করতে যাবে, ঠিক এমন সময় কয়েকজন পুলিশ হুড়মুড় করে ভেতরে প্রবেশ করলেন। দুজন পুলিশ কুন্তলের হাতে-পায়ের দড়ি খুলে দিলেন এবং মুখ থেকে রুমালটা টেনে বের করলেন। একজন পুলিশ অফিসার বললেন,--
"এখানে এই সব কী হচ্ছিল?"
কুন্তল হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,--
"অ্যাটেমট টু মার্ডার! স্যার, এরা সবাই মিলে আমাকে হত্যা করার চেষ্টা করেছিল! এদেরকে ছাড়বেন না স্যার!"
"আচ্ছা, কুন্তল বসাক কে?"
কুন্তল বলল - "আজ্ঞে আমি কুন্তল বসাক। আমিই থানাতে ফোন করেছিলাম। আপনারা আসুন আমার সঙ্গে।"
এই বলে কয়েকজন পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে কুন্তল সোজা গিয়ে রান্না ঘরের পাশের রুমে প্রবেশ করল। একজন পুলিশ বললেন - "এখানে কী আছে?"
কুন্তল রুমের মেঝের দিকে একটা আঙ্গুল দেখিয়ে বলল - "এখানে খোঁড়ার ব্যবস্থা করুন।"
পুলিশ অফিসারের মনে হল মেঝেতে বসানো টাইলসগুলোর মধ্যে দুটো টাইলস কেমন যেন অসমতল। তাই, উনি টাইলসগুলো সরিয়ে মেঝে খুঁড়ে ফেলার হুকুম দিলেন এবং প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে তিন জন কনস্টেবল কাজে লেগে পড়লেন। প্রায় ছ-সাত ফুট খোঁড়ার পর সকলের লক্ষ্যে পড়ল একটা নর কঙ্কাল! কঙ্কালের দুহাতে কয়েকটা চুড়ি রয়েছে। কুন্তলের আর বুঝতে বাকি রইলো না যে এটা জয়তির কঙ্কাল!
ভারাক্রান্ত মন নিয়ে কুন্তল হেঁটে চলেছে। অবশেষে নিরুপায় হয়ে অয়ন আর তার বাবা-মা সমস্ত দোষ স্বীকার করেছে। ওদের জবান বন্দী অনুযায়ী আজ থেকে দেড় বছর আগে এক সন্ধ্যায় অয়ন গোস্বামী নিজের লালসা চরিতার্থ করে জয়তিকে গলা টিপে খুন করে। ওর বাবা-মা যখন বিষয়টা জানতে পারে, তখন পুলিশের হাত থেকে বাঁচার জন্য উপায় খুঁজতে থাকে। তারপর তিনজনে মিলে লাশটাকে ঘরের মেঝের তলায় পুঁতে ফেলে। যাই হোক, কুন্তলের কাজ শেষ; সে হেঁটে চলেছে স্টেশানের উদ্দেশ্যে। সন্ধ্যে নামার আগে তাকে বাড়ি ফিরতে হবে। পরের দিন থেকে আবার কাজে মন দেবে সে। এখানে আর তার কোনো দিনও আসা হবে না! কুন্তল এই রকম নানান কথা ভাবছে, এমন সময় তার মনে হল যেন জয়তি তার পেছন-পেছন চলেছে। কুন্তল পেছন ঘুরে তাকাল। না, কাউকে দেখতে পেলনা সে! সূর্যের আলোতে তার চোখের অশ্রু চক্ চক্ করে উঠল। পকেট থেকে রুমালটা বের করে অশ্রু মুছে কুন্তল আবার এগিয়ে চলল স্টেশানের দিকে। সহসা তার মনে হল জয়তি যেন তার কানে কানে বলে গেল,-- "বাবু, আমি আপনাকেই ভালোবাসি!"

কবিতা

সুকান্ত পাল

জিতপুর, মুর্শিদাবাদ

কবিতাঃ সুকান্ত পাল

 মার্চ ২০২২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

একাকিত্ব কখনো গ্রাস করেনি।


কাকিত্ব কখনো আমাকে গ্রাস করে নি
বৈশাখী ঝোড়ো হাওয়া—
আষাঢ়ী বৃষ্টি কিম্বা নিঃসঙ্গ রাত
সব কিছুই মানিয়ে নিয়েছিলাম
একাকী আমি—তাই হয়তো
একাকিত্ব কখনো আমাকে গ্রাস করেনি। 

ঘরের দরজা ধরে আমার জন্য
কেউ কখনো অপেক্ষা করে না—
চায়ের টেবিলে একলা বসি
খবরের কাগজখানা হাতে নিয়ে
অথচ বাজারের ব্যাগ এগিয়ে দিতে
কোনোদিন কেউ আসেনি। 

রান্নার তাগাদা নাই 
হইচই নাই —

জেদ অভিমান—না কিচ্ছুটি নাই। 
একলা বারান্দায় দুপুর কাটে -তবু
একাকিত্ব কখনো আমাকে গ্রাস করেনি। 

সন্ধ্যা নামে—রাত্রি গভীর হয়
অথচ ঘরে ফেরার তাড়া নাই। 
জনহীন পথে একাই হেঁটে চলেছি 
এ হাঁটার শেষ নাই—সীমা নাই। 
হাঁটতে হাঁটতেই এগিয়ে যেতে হয়
তাই আমিও হাঁটছি —আর এগিয়ে যাচ্ছি
তবু এগিয়ে যাওয়ার শেষ নাই। 
অতীতকে পাশে রেখে 
ভবিষ্যৎকে ধ্রুবতারা করে
বর্তমানের পথ ধরে গুটিগুটি পায়ে
চলতে চলতে ক্লান্ত হয়েছি বটে—তবু
একাকিত্ব কখনো আমাকে গ্রাস করেনি। 

চিরবসন্তের গান

তুমি আছো তাই প্রতিটি দিনই আমার গোলাপ-ডে
গোলাপী আদরে আলিঙ্গনের আসে রোজ হাগ-ডে। 
চকোলেট-ডে নতুন করে ভাবিনিতো কোনোদিন
তুমি আছো তাই চকোলেট-ডে আমাদের প্রতিদিন। 
কিস-ডে সে তো আসে প্রতিদিন একদিন নয় মোটে
প্রতিটি  সকাল চুম্বন আঁকা গালে-বুকে-মুখে-ঠোঁটে। 
প্রতি প্রশ্বাস তোমাকেই খোঁজে নাই কোনো মিস-ডে
জীবনের যত অবশেষ দিন সবই তো প্রমিস-ডে। 
টেডি-ডে সেও তো আসে হাররোজ পুতুল পুতুল দিন
আলতো ছোঁয়ার উষ্ণ পরশ হৃদয়ে বাজায় বীন। 
তুমি আছো তাই এত ভালোবাসা রোজ রোজ লাভ-ডে
তোমারই জন্য প্রতিদিন আমার ভ্যালেনটাইন্স-ডে। 
তাইতো তোমার আমার হৃদয় চিরবসন্তময়
পলাশের কুঁড়ি প্রেম হয়ে ফুটে সদা সুরভিত রয়। 

 

কবিতা

সুব্রত মিত্র

কবিতাঃ সুব্রত মিত্র

 মার্চ ২০২২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

সবাই যেন নিগূঢ় প্রতিনিধি


বাই কেমন দুরে চলে যায় 
আমি পারি না যেতে।

সবাই কেমন 
সুন্দর স্মৃতিগুলো সুন্দর করে ভুলে যায়
আমি পারি না ভুলে যেতে
সবাই কেমন
সবকিছু দেখেও না দেখার ভান করে আকাশ দেখে
আমি পারিনা সেই ভান করিতে।
সবাই কেমন
স্বার্থ ত্বরান্বিত করতে নিজের প্রকৃত পরিচয়কে লুকিয়ে রাখে
সবাই কেমন আরও কিছু পাব পাব বলে
হঠাৎ করে নিজের জাতি গোত্রকে নকল করে ঢেকে রাখে,
আমি পারি না তাহা করিতে।

সবাই কেমন-
দেশকে ভালোবাসার নাম করে দেশটাকেই দখল করে
সবাই কেমন 
হতে গিয়ে ঝান্ডার তলায় নিজের আশ্রয় খুঁজে নেয়
আমি এগুলোর কোনটাই পারিনা করিতে।

সবাই কেমন ফুটপাত দখল করে বসে পড়ে রাস্তার ধারে
সবাই কেমন অপরিচিত হয়ে ওঠে
সবাই কেমন অকৃতজ্ঞ হয়ে ওঠে
সবাই কেমন প্রাপ্তিস্বীকার করতে ভুলে যায়
আমি পারিনা এভাবে ভুলে যেতে। 

ন্যায্য দাবির বিদ্রোহ
 

কালবেলা স্নান খাওয়া-দাওয়া সেরে কাজে বেরোলাম
পাটুলি হয়ে যাদবপুর, যাদবপুর থেকে যোধপুর পার্ক আমার গন্তব্য স্থল
গন্তব্য স্থলে যেতে-যেতে মাঝপথে যাদবপুর ইউনিভার্সিটির সামনে রাস্তা অবরোধ
পাঁচ মিনিট;দশ মিনিট; কুড়ি মিনিট; প্রায় আধ ঘন্টা দাড়িয়ে--
তিত বিরক্ত হয়ে যাচ্ছিলাম ঐ আন্দোলনকারী যুবক যুবতীদের ওপরে। 

ওরা চিৎকার করে বলছে --  --   --  --
আমাদের কর্ম চাই,
আমাদের ধর্ম চাই।
আমাদের অধিকার চাই,
আমাদের প্রতিবাদ করার স্বাধীনতা চাই।
আওয়াজগুলো আমার কর্ণপাত হওয়া মাত্রই আমার শত বিরক্তি থেমে গেল,
আমি শত ব্যস্ততার মাঝেও হঠাৎ করে শক্ত বরফের মতো শীতল পাথরে পরিণত হলাম।

ভাবলাম; হ্যাঁ ওরা তো ঠিকই বলছে,
যে কথা আমি এবং আমরা বলছি না,
যে কথা আমরা কেউই সাহস করে বলতে পারছি না
সেই কথাই ওরা বলছে।

যে কথা বাধ্য হয়ে মুখ বুজে থাকা শিশু শ্রমিক

বলতে পারছে না,

যে কথা বিধবা মায়ের দুর্দশা মোছাতে চায়

যে কথা রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে বদলাতে চায়ওরা সেই কথাগুলিই বলতে চায়।

এতক্ষণে আমি--------------
যাদবপুর ইউনিভার্সিটির তিন নম্বর গেটের সামনে।
স্লোগান আরও জোরদার,
মাঝরাস্তায় বড় বড় নেতাদের কুশপুত্তলিকা জ্বলছে দাউ দাউ করে।
আমি মাথা নিচু করে একজন স্বার্থপর মানুষের মত
সবকিছু না দেখার ভান করে সামনের দিকে এগিয়ে যাই।

সামনেও রক্তাক্ত অবস্থায় আন্দোলনকারী----
বেশ কয়েকজন যুবক আহত অবস্থায় খোঁড়াচ্ছে।
কেউ কেউ আবার যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে।
পেছন থেকে কয়েকজন সাদা পোশাকের পুলিশ আহত আন্দোলনকারী যুবকদের সাহায্য করার চেষ্টা করতে এগিয়ে আসছে।
পুলিশের চোখেও সেদিন আমি লেখা দেখেছি দয়ার অক্ষরমালা।

এই বঙ্গ দ্বেষ

 

ই বঙ্গে অনেক বুদ্ধিজীবীদের দেখতে পাই।

এই বঙ্গে অনেক মহাকবিদের দেখতে পাই।

এই বঙ্গে অনেক সম্প্রীতির বার্তা বাহককে দেখতে পাই।

এই বঙ্গে রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে কথা বলার মত-- অনেক মুখরোচক নেতাদের দেখতে পাই।

যা দেখেছি সব ভুয়ো বাতাস, সব নিঃস্বতায় পোড়া এক রত্তি ছাই।

 

এই বঙ্গে অন্যায়ের প্রাতিবাদ না করে শুধু সম্মান হারানোর ভয়ে-----

লেজ গুঁটিয়ে পালানোর মত অনেক মহাপুরুষদের দেখতে পাই।

আমি খুব ছোটখাটো মানুষ অথচ আমি মস্ত বড় ছোটলোক হয়েও------

উনাদের দেখে বড় কষ্ট পাই, ওনাদের দেখে বড় লজ্জা পাই।

 

এই বঙ্গে ঝুলিয়ে সম্প্রীতির মালা

শালারা মা-বোনের ইজ্জত বেচে দেয়---

তারাই আবার দেশপ্রেমের উন্মুক্ত চেতনার ভাষণে মঞ্চ আওড়ায়।

এই বঙ্গে ঐ কান্ডারীর দল কেড়ে নেয় ইমোশন; ফাঁটকাবাজের শক্তিমান হয়ে পকেটে ভরে প্রমোশন,

সম্প্রীতির নামে নিজের স্বার্থে এখানে-----

ভেসে যায় আমার মা-বোনের সম্ভ্রম।

এই বঙ্গে ভাইয়ে-ভাইয়ে,

বাবা-কাকায় হয়ে যায় কত হানাহানি

এই বঙ্গেই আমি দেখি;

সব জেনেশুনেও জনস্বার্থে নেতারা করেনা কানাকানি,

শুধু বলে; "সম্প্রীতি, সম্প্রীতি, সম্প্রীতি"।

আমি যদি বলি ওহে নেতা,

কেন হচ্ছে তবে সমাজের এত অবনতি?

 

স্বাধীনতার এত বছর পরেও এই বঙ্গের হয়েছে কি সংস্কার?

চারিদিকে হিংসার দুর্বার,

এই বঙ্গ ঐ বঙ্গ ভেঙে হচ্ছে ছারখার

কি প্রয়োজন হয়েছিল ওদের আজ হিন্দুদের ঘরবাড়ি;

মন্দির পোড়াবার?

 

তোমরা নাকি মুসলমান;

তোমাদেরওতো ধর্মের আছে অনেক মান সম্মান

তবে কেন অন্য ধর্মের ক্ষতি করে নিজের ধর্মকে করো অপমান?

আমি বিগ্রহ চিত্তে মালা ছিড়ে ফেলি সব নেতাদের সব রাজনৈতিক দলের------------------

সব হিংস্রতার; সব নোংরা মানসিকতার।

 

আর যে সকল কবি সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীরা------

বুদ্ধির ঢেঁকি মাথায় নিয়ে চুপটি করে তামাশা দেখে--

তোমাদের আক্কেল হওয়া চাই, 

তোমাদেরও আছে মা বোন, আছে ভাই।

 

তবে আজ তোমাদের কলম কোথায়?

 

হে কবি, হে বুদ্ধির ঢেঁকিওয়ালা বুদ্ধিজীবী .. ....  ...  ..

তোমাদের মানবিকতাও বিক্রি হয়েছে নাকি ঐ নেতাদের গোপন পকেটে?

নাকি তোমার ধর্মটাও বিক্রি হয়ে গেছে স্বার্থের হাটে?

তুমি জানো কি?

আমাদের জাতিটাও আজ ভেসে যেতে বসেছে সস্তার ঘাটে।

 

শুনে রাখ, শুনে রাখ, সকল বুদ্ধিজীবীগণ.......

সকল জাতির জাতীয়তাবাদ, সকল ধর্মের ধর্ম প্রবাদ

সকল দেশের দেশাত্বতা, সকল মনের মহানুভবতা

সকল মনের কামনা-বাসনায়; স্পর্শতা থাকুক স্বাধীনতায়।

 

আমাদের দুই বঙ্গের আপন সিন্ধু সেই তো মোদের বঙ্গবন্ধু

তারেই বলি মোরা জাতির জনক,

সেতো আজ হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি মোদের অহংকারের মাইলফলক।

সে যে শিখিয়ে গেছেন একই ভাষায় দুই বঙ্গের আলিঙ্গন

শিখিয়েছেন ভালবাসতে; শিখিয়েছেন কাছে আসা আসি

সেই তো মোদের রবীন্দ্রনাথের কন্ঠকে জাতীয় সংগীতে স্থাপন করেছেন--

"আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি"।

জাগো; জাগো; জাগো;.. ..    ... জাগো মহাবীর

এই বঙ্গমাতার নিঃস্ব খাতায়-------

রাখিবো আবার অটুট ছবি আমার বঙ্গের সংস্কৃতির।

কবিতা

তাপস কুমার বর

কৃষ্ণনগর,  দঃ ২৪ পরগনা

কবিতাঃ তাপস কুমা বর

 মার্চ ২০২২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

নতুন বছর

তুন বছর মানে,
একটা স্বপ্নগড়া ইতিহাস।
নতুন বছর মানে,
মানবতার জয়-জয়কার।
নতুন বছর মানে,
সুরক্ষিত ভবিষ্যতের সন্ধান।
দেখো বন্ধু প্রিয়জন,
আজও ওরা ও কি সুখী?
ওদের থালায় জোটেনা ভাত,
ওরা যে ফুটপাত!
যাক সব মলিনতার অন্ধকার,
মুছে সাফ হোক সকল সন্ত্রাস।
এখনো স্মৃতির মন্দিরে দুঃখের আঘাত....
ওই দেখো কত শত মৃত্যুর চিৎকার।

নতুন বছর মানে,
একটা সুরক্ষিত সমাজ।
নতুন বছর মানে,
সুস্থভাবে বেঁচে থাকার সম্মান।
নতুন বছর মানে,
ধর্ষিতা নারীর অধিকার।
ওই দেখো শিক্ষার অধিকার,
হাজার হাজার ধর্না দেওয়া রাজপথে।
দেনার দায়ে কত শ্রমিক কৃষক আজও মরে,
এখনো একমুখো ভাত জোটেনি ওদের ঘরে।
এখনো কি মা-বোন সুরক্ষিত আছে?
কাগজের হেটলাইনে দিনে দিনে কত ধর্ষিতা মরে।
ভেবে দেখেছো কি সকলে...?
হারিয়ে যাচ্ছে যুবসমাজ একে একে করে।

independence1.jpg

নতুন বছর মানে,
কত মহান স্মরণীয় সভা।
নতুন বছর মানে,
ধর্মে ধর্মে এক মানবতার জোয়ার।
নতুন বছর মানে,
তোমার আমার বাঁচার অধিকার।
আমি সেই দিন পেতে চাই ফিরে,
মানবতার নতুন সূর্যোদয়ে....
দেশের বাহু হবে মজবুত কংক্রিটে।
অধিকারের মুক্ত দরজা,
শাশ্বত হয়ে বিরাজ থাকবে।
সব জাত-পাত যাক না মুছে,
একটা শক্ত মেরুদন্ডের মানবতার মুক্ত আকাশে।

হয়তো সেদিন....
প্রাণভরা হাসি নিয়ে বলবে,
আবার নতুন বছর এসেছে!

যিশু
 

মানব রূপী ঈশ্বর হয়ে...
মর্ত্যে এসেছে যিশু।
দুখিনী মেরি মা কাঁদছে আজও..
কোথায় আমার সন্তান যিশু?
সত্য আজও ক্রশবিদ্ধ হয়ে,
তোমরা বাঁচাও আমার যিশু।

আমার যিশুর ও অভুক্ত ঘরে,
আজও মরছে কত শিশু।
ভিক্ষার ঝুলি ঝুলছে আজও,
যন্ত্রণার অভুক্ত দোরে।
শরীর থেকে রক্ত ঝরে,

ক্রশবিদ্ধ আমার যিশু।
জোসেফ মেরি কাঁদছে আজও,
তোমরা বাঁচাও আমার যিশু।

হাজার হাজার অভুক্তের চিৎকারে...
মরছে কত শিশু।
দুখিনীর ঘরে দুখিনী মা,
বাঁচাতে পারেনি তাঁর যিশু।
বড়দিন আজও বড়দিন কি..?
হতে পেরেছে অভুক্ত শিশু।
ফুটপাতে ওরা দিন-রাত ঘোরে,
ওদের বড়দিন আসেনা কিছু।

ঈশ্বর যিশু কাঁদছে আজও,
শরীরের রক্তঝরা ক্রুশে।
আমার যিশু ও অভুক্ত হয়ে...
ধুঁকে ধুঁকে মরে ফুটপাতে।
বড়দিন হয়তো সেদিন হবে,
যেদিন অনাহারের জ্বালা মিটবে!
দেখো শান্তির বাতাস আকাশে বাতাসে,
প্রাণ খোলা একটা প্রাঙ্গণে।
অশ্রু সেদিন নিপাত যাবে..
কত জোসেফ মেরির দুখিনীর ঘরে।

কবিতাঃ মিজানুর রহমান
Mijanur Rahman.jpg

কবিতা

মিজানুর রহমান মিজান

বিশ্বনাথ, সিলেট, বাংলাদেশ

 মার্চ ২০২২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

ভাইবোন বন্ধুরা তোমাদেরকে বলি
ভাল মানুষ হবে সন্তান দেখো চোখ খুলি।।
আদর সোহাগ যত্ন নিবেন সচেতনতায়
ফাঁকি দিলে বুঝান তারে নির্জন নিরালায়।।
রোজ সকালে উঠার অভ্যাস দেন শিখিয়ে
মিথ্যা বলা মহাপাপ বলুন বুঝিয়ে ।।
নজর রাখুন ভাল বন্ধুর হয় যেন সহচর
দুষ্টুদের কাছ থেকে ফিরান তারে অতি সত্তর।।
অহংকার লোভ পতনের মুল এ কথাটি সত্য
হিংসা নিন্দা পরিহারে থাকে যেন সর্বদা মত্ত।
অলসতায় দারিদ্রতা পরিশ্রমে ধন
সঙ্গ ভাল নির্বাচনে যদি হয় সুজন।।

independence1.jpg
কবিতাঃ পবিত্রজ্যোতি মন্ডল

কবিতা

পবিত্রজ্যোতি মণ্ডল

 মার্চ ২০২২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

farmer.png

কেমন জব্দ 

লাঙ্গল টানার কাজ করেছি
জোয়াল কাঁধে নিয়ে।
সকাল-সন্ধ্যে দুধ দিয়েছি
বাছুরকে না দিয়ে।
খেতে কিছুই দাওনি তেমন
খড়-বিচালি ছাড়া।
চলতে ফিরতে যখন তখন
পাঁচন দিয়ে মারা !

মোট বয়েছি মুখটি বুজে
বর্ষা-জলে ভিজে।
শীতের রাতে বস্তা গায়ে
সব সয়েছি নিজে।
গোয়াল থেকে বাইরে গেলেই
পরিয়ে দিতে ঠুঁসি।
গ্রীষ্মকালে ডোবার পানি
কেমন করে শুষি?
হাম্বা ছাড়া 'রা' কাড়িনি
যতই কাঁপি রাগে।
ঠুঁসির মতো মাস্ক পরেছ
এখন কেমন লাগে?

কবিতাঃ শক্তিপ্রসাদ ঘোষ

 মার্চ ২০২২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

কবিতা

শক্তিপ্রসাদ ঘোষ 

রবীন্দ্রনগর, নিউটাউন, কোচবিহার

ঘর

রের ভিতরে ঘরটির তালা বেশির ভাগই বন্ধ থাকে 
সপ্তাহ অন্তে বাবা বাড়ি এলে মা আঁচলে 
লুকোন চাবি দিয়ে তলাটা খুলতো 
আমরা উঁকি মেরে দেখতে চেষ্টা করতাম 
ঘরের ভেতর কি কি আছে ঠিক দেখতে পেতাম না 
তবে ঘর মাঝে মাঝে উজ্জ্বল আলোয় ভরে উঠতো 
কখনো ঘুটঘুটে ঘরের ভেতর টা 
এখনো আজানাই রয়ে গেছে 
এখনো ঘরের ভেতর আছি ঘরটি নেই।

village.jpg
কবিতাঃ মৌ চক্রবর্তী

 মার্চ ২০২২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

কবিতা

মৌ চক্রবর্তী

দেবী সিরিজ ১৩

সূর্যের সঙ্গে প্রথম দেখা যখন
মনে মনে জানি তেপান্তরের রানী আমি 
গেছোফুল গোত্রে  গুচ্ছলগ্ন 
কলকাতার দেশে দেশের মতন এখানে ছাদঘর
চাঁদ উপড়ে দেয়  আলো
আলাপ তো আগেই ছিল 
কলকাতার রাস্তায় হারিয়ে অনেকক্ষণ

ফের দেখা দিনালোকে 
মায়ের মুখের তেজ গড়গড়িয়ে যেন
পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছে
চোখে চোখ
হাতে হাত
মন পাগলেরা
  মনের ইতিহাস লিখবে সূর্যরঙের কালিতে
ওই রঙ শাড়ি মায়েরও তো 
দেবীর মতন মা আর মা দেবী হতে হতে পাথর প্রতিমা কোনও
যার গায়ে আলো গেলে জ্বলে প্রদীপমন

 

দেবী সিরিজ ১৪
 

মেঘ পেরিয়ে কতবার বেরিয়ে আসছে 
           চাঁদের রুপোলি সবজে শান্ত মেঘালো
মায়ের গায়ের ওরকম রঙ হয়  
যখন মা মাঝরাতের উঠোনে সবজি কাটে
যখন মা নানা রঙের সুতোয় সেলাই করে নকশা

মায়ের গায়ের ওরকম রঙ স্বপ্নদেখা আলো
এমনটি নয় মা আমার 
ছবিতে মিশে থাকে শেষ সারিতে 
কেবলই পুরনো গল্প বলা ঝাঁপি খুলে
 
আলপনার মতন দুঃখের দুয়ারে চোখের জলে তুলো
ভিজিয়ে মা  _ মনে মনে সাজ সারে
বারে বারে মাজে বেহায়া দাগ 
মায়ের আঙুল সেতার ছুঁলে 

বেদনা ভুলে কড়াইতে সাঁতলায় নুন হলুদ মিশে যায় মন্দভাল 
কেউই ডাকেনি তাকে কোনোদিন 
দিনের কাছে মা ঘোমটায় ঢাকা
আমার মায়ের রঙ কালো যেন সে পরী 
                          যেন সে সাজে রাততারার ফুলে 


দেবী সিরিজ ১৭
 

কালিমতী মেয়ে বসেছে লালমাটির দাওয়ায়

হাঁটুময় সন্ধ্যা
কুয়াশা তার এলোচুলে 
                  রাতের অপেক্ষায় 

হলদেফুল ডাগর চোখে চোখ রেখে 
জনমভর ভজে 
চেনা সুর মনালাপ গায়

তারপর 
মাঠ পেরিয়ে  লুটিয়ে থাকে 
কোন নিরাকার সাধনায়

 


দেবী সিরিজ ২১
 

সুড়ঙ্গ থেকে ঠিকরে আসা আলোয় 
দেবী লাগছে মাকে
মুখ মাটির লেপে
চোখ দ্বীপপুঞ্জের মতন
ঠোঁট ব্যথা সয়ে সন্ন্যাসী
হাত বাউলের দোতারা
এমন সময় ডাকি, শুনছ মা  ...
একি মা রুমি পড়নি তুমি
মা বলে, ছেঁচে জল রাতভর জেগেছি সামান্য সেই মেয়ের মতন রুগ্ন ছেলের জ্বর 
সন্তান স্তবে কেটে গেছে প্রথম বেলা 
বই ফেলে
কোল পেতে রেখেছি যেভাবে বট অশ্বথ পুরনো বাড়ির পাশে ছায়া
বই সরিয়ে রাঁধতে রাঁধতে দুপুর 
শেষ রোদে ধুয়েছি এঁটো বাসনকোসন 

বই সরে গেছে যেদিকে শেকড় খুব 
রুমি আমাকে বলে গেছিল,  পালাচ্ছি  সবুজালি ছুঁয়ে শপথ কর বলবি না
তিন সত্যি করতে করতেই বলি, পালাসনি রুমি লড়াই কর 
যেমন মা ঠাকুমায় 
যেমন তারও মায়ের লড়াই ছিল  

এখন বেলা চড়ছে রোদ গাছে গাছে 
মায়ের শরীর ভরে রোদ্দুর মাকে দেবী নাকি 
জলপরী 
না না  __ মাকে মনে হচ্ছে  শুধুই  নারী 

 

দেবী সিরিজ ২২

ই তো মুখর দিনেদুপুরে

এই তো মুখর রাতে

এক পা থাকে মনের ভেতর

এক পা হাঁটে চেনা অতীতে

তার নামে চিঠি আসে না কখনও

কখনও
লগন আসে না
পরব ছুটি নেই 

 এমনই দিন যায় বাগানের মালি হয়ে মা সাজায় 
শ্রীমতী মন কোজাগরী আল্পনা লেপে দুয়ার সজ্জায়

আগামীর তরে 
ঋতু আসে
সে ছুঁয়ে দেখে হাওয়া

পুজোর ছুটি ছুটি ছুটি ছিল সব্বার

মায়েরই হয়নি কোথাও যাওয়া
 

দেবী সিরিজ ২৪


সেজেছে দুয়ার চালের গন্ধে ভরে উঠছে চারপাশ যেন
আল্পনা 

ধানের গোছা 
চৌকাঠ পেরিয়ে ধূপগন্ধ 
আঁচল পেরিয়ে 
মঙ্গলকামনায়
পঞ্চ প্রদীপ_ব্যঞ্জন
   মুখরিত কেউ বা কারা আজ যেন সবাই স্বজন

তারই মধ্যে আলোর ফুলে ফুলে দুঃখ আসে পাঁচিলে 
ছুটি নেই__ হবে না ঘরে ফেরা
মনের কান্না কন্যারূপে মা ঢেলে দেয় শাঁখ ফুঁইয়ে
দুলে ওঠে বুঝি একলা মনখানি তার _ বহুকাল আগে ফেলে আসা ঘোর 
পুতুলপারুল সংসার 
না হল বলা না হল চলাচল

পাথরমানবী মা 

এত ঐশ্বর্যে মা
গৃহসম্ভার ভূষিতা মা শক্তিমত্তা মা তবুও কেন অসম্পূর্ণা

 

কবিতা

ঋতুরাজ হালদার

জি এস বোস রোড, কলকাতা 

কবিতাঃ ঋতুরাজ হালদার

 মার্চ ২০২২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

রেভেরি


ফিল্টার অবধি খাওয়া
সিগারেট,
শুকনো চায়ের কাপ।
রাস্তায় রিস্কাওয়ালার
রেডিওতে গান,
   "আপ যেসা কই
   মেরে জিন্দেগী মে আয়
   তো বাত বান যায়।"

আকাশ ভরা মেঘ
গুরু-গুরু করছে
থেকে থেকে,
আসবে হয়ত তুমি...
বৃষ্টি বৃষ্টি আর বৃষ্টি।

থমকে থাকি সময়ের 
মত,
আয়নায় থাকা ছেলেটি
তাকিয়ে থাকে আমার দিকে,
বলতে চায় সে অনেক কথা,
কিন্তু দুর্ভাগ্য!
আমি যে বোবা...

ঊর্ধ্বে তুমি

রাজভোগেরও ঊর্ধ্বে 
তোমার ঠোঁটের স্বাদ
শত চেষ্টায়েও পারি না বুঝতে
তোমার মনের বিষাদ।

মরাল প্রতিম তীক্ষ্ণ চোখে
কাজল ভরা অন্ধকার 
নিয়ে থাকো,
ওরম ভাবে মেঘের আড়ালে
আমায় ফেলে যেও নাকো।

পায়ে তোমার পদ্ম ফোটে 
বুকে তোমার সূর্য ওঠে 
রাতের মত কালো চুলে
জ্যোৎস্না ভাসে জটে জটে।

তোমার সুরে ঠাই দিও মোরে 
দিও মোরে ছন্দের আলো,
মর্ত্য হতে অনেক দূরে 
স্বর্গের সীমা পেড়িয়ে 
পদ্মার আসনে বসলে তোমায়
মানাবে বড়ো ভালো।।
অঝোর সুর

ছন্দে মধুর
অঝোর সুর
অমৃত ধারা
আজ বাঁধনহারা।

দিগন্ত হতে ভেসে আসে
অশনির ডাক,
প্রান্ত জুড়ে 
আসক্ত মেঘ
করছে আজ বিরাজ।

পুলকিত কেয়া


পন ঘোরে মগ্ন
আজ বাস্তব তার
অকলুষিত স্বপ্ন।
ঐশী মধুর
অক্লান্ত বর্ষণ।
অখল ছন্দে মাতোয়ারা 
আজ জল কন্যা সীতা।

ছন্দে মধুর
অঝোর সুর
অমৃত ধারা
আজ বাঁধনহারা।।
রাতের গান

নিস্তব্ধ অন্ধকারে 
ঝিঁঝিঁর ডাক 
রাতের গান গায়ে।
নীলাভ আভায়
জ্যোৎস্না মিশে
মায়া মোহনার তীর গড়ে।

সেই তীরের চাতক আমি,
অভাগা মুনি।
তারার চাদর মুড়ে
অসীমের প্রহর গুনি।
চিত্তে বয়ে
নিরন্তর খেয়ালের স্রোত।
মেঘের ভেলায় ভেসে
অগস্ত্য যাত্রার
স্বপ্ন বুনি।

দিগন্ত হতে আলো ফোঁটে
শিশির বিন্দু আমার দেহে
বাসা বাধে।
রাতের গান স্তব্ধ হয়।
আমি আবার আমার
নিদ্রায় ফিরে যাই।
অন্ধকারে,
তোমায় দেখতে পাই।

 

প্রবন্ধ

প্রাচীন ভারতে
art1.jpg

 মার্চ ২০২২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

প্রাচীন ভারতে জ্যোতির্বিদ্যার

পরিচয়

প্রোজ্জ্বল মণ্ডল

images.png

প্রাচীন ভারতের বৈদিক মুনি-ঋষিরা ধ্যান যোগ বলে তাদের মতাদর্শ বেদ, নক্ষত্রকল্প, শাস্ত্র ইত্যাদি গ্রন্থে মহাবিশ্বের মহাজাগতিক‌ শক্তি যেমন সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত, জোয়ার-ভাটা, আবর্তন-পরিক্রমণ গতি ইত্যাদি সম্বন্ধে লিখে রেখে গেছেন, যা ছিল পাশ্চাত্য দেশের বিভিন্ন বিজ্ঞানীদের ধারণা দেওয়ার বহু পূর্বেই।
বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে ও সংস্কৃতির চর্চার অভাবে সেই সব জ্ঞান বিলুপ্ত হয়ে গেছে। যার ফলে পাশ্চাত্য দেশগুলোর থেকে ভারত পিছিয়ে পড়েছে। এইসব সংশোধন হওয়া প্রয়োজন। এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করছি -

*বেদে সূর্যগ্রহণের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা :-*
যত্ ত্বা সূর্য স্বর্ভানু স্তমবিধ্যদাসুরঃ।
অক্ষেত্রবিদ যথা মুগ্ধ ভুবনান্যদীধয়ুঃ।।
              - ঋগবেদ ০৫/৪০/০৫

*অর্থ :-* হে সূর্য, যাকে (চাঁদ) তুমি তোমার নিজ আলো উপহার স্বরূপ প্রদান করেছ, তাঁর (চাঁদের) দ্বারা যখন তুমি আচ্ছাদিত হও, তখন আকস্মিক অন্ধকারে পৃথিবী ভীত হয়।

*সূর্যকে সমস্ত গ্রহ পরিক্রমণ করে, বেদে তার প্রমাণ:-*
“পঞ্চারচে পরিবর্তমানে তস্মিন্নাতস্থর্ভুবনানি বিশ্বা।“
               - ঋগবেদ ১/১৬৪/১৩
*অর্থ :-* পৃথিবীসহ সমস্ত গ্রহ নিজ অক্ষের চারিদিকে এবং সূর্যকে কেন্দ্র করে আবর্তন করে।

*হনুমানচল্লীসা তে পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব:-*
    অনেকেই জানেন যে হনুমানচল্লীসাতে একটি লাইনে বলা আছে..
     “যুগ সহস্র যোজন পর ভানু ।
     লীল্যো তাই মধুর ফল জানু ।।
       ১ যুগ= ১২০০০ বছর ।
       ১ সহস্র = ১০০০
       ১ যোজন = ৮ মাইল ।
যুগ × সহস্র × যোজন = এক ভানু
১২০০০ × ১০০০ × ৮ = ৯৬০০০০০০ মাইল
      ১ মাইল = ১.৬ কিমি
            ⁂ ৯৬০০০০০০ মাইল
            = ৯৬০০০০০০ × ১.৬ কিমি
              = ১৫৩৬০০০০০ কিমি।
এটিই হল পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব। নাসা (NASA) বলেছে এটাই পৃথিবী থেকে সূর্যের প্রকৃত দূরত্ব। যা প্রমাণ করে।
ভগবান বীর হনুমান ছোটোবেলায় সূর্যকে মধুর ফল ভেবে খাবার জন্য লাফ দিয়েছিল। এটি আশ্চর্যজনক মনে হলেও অর্থবহ দিক থেকে বর্তমান যুগেও সত্য।

*বেদে উল্লেখিত সূর্যের নিজ অক্ষের উপর আবর্তন ও পরিক্রমণ*
যজুর্বেদে ৩৩/৪৩ নং মন্ত্রে উল্লেখ আছে - 
সূর্য তার গ্রহদের নিয়ে (ছিন্ন অংশ) মাধ্যাকর্ষণ শক্তিতে প্রদক্ষিণরত অবস্থায় নিজ কক্ষপথে ও নিজের অক্ষে প্রদক্ষিণ করে।

চন্দ্র ও সূর্যের গ্রহণ, নক্ষত্রবৃত্ত, রাশিচক্র, জোয়ারভাটাদি তত্ত্ব, তিথি-বার ইত্যাদির ব্যবস্থাচক্র প্রভৃতি আর্য্যঋষিরাই প্রথমে আবিষ্কার করেছিলেন। পৃথিবী যে গোলাকার তাহা আর্য্যঋষিগণ ইংরেজরা এদেশে আসার বহুপূর্ব্বে আবিষ্কার করেছিলেন যথা-
      “কপিথ – ফলবৎ বিশ্বং
       দক্ষিণোত্তরয়োঃ সমম্ ।” – নক্ষত্রকল্প
অর্থাৎ, পৃথিবী কপিথফল অর্থাৎ কোয়াতবেলের ন্যায় গোলাকার এবং উত্তর ও দক্ষিণে কিঞ্চিৎ চাপা। “সৰ্ব্বতঃ পর্ব্বতারাম-গ্রাম-চৈত্যচয়ৈশ্চিতঃ।
কদম্ব-কেশরগ্রন্থিকেশর-প্রসবৈরিব।।” 
                     - সিদ্ধান্ত শিরোমণি
অর্থাৎ, কদম্ব যেমন গোলাকার ও খেসরসমূহে পরিবেষ্টিত, সেইরূপ এই পৃথিবীও গোলাকার এবং সর্ব্বদিকেই গ্রাম, বৃক্ষ, পৰ্ব্বত, নদ-নদী, সমুদ্র ইত্যাদির দ্বারা পরিবেষ্টিত।
পৃথিবীর যে গতি আছে তাহা গ্রীসদেশীয় পণ্ডিত পিথাগোরাসের জন্মের বহু পূর্বে এবং ইটালি দেশীয় কোপারনিকাসেরও বহুপুর্ব্বে আর্যভট্ট বলে গিয়েছিলেন- 
    “চলা পৃথ্বী স্থিরা ভাতি।” - আৰ্য্যভট্ট 
অর্থাৎ, পৃথিবী চলছে, কিন্তু মনে হচ্ছে যেন স্থির রয়েছে।
ভপঞ্জরঃ স্থিরো ভুরেবাবৃত্ত্যা-বৃত্ত্যা-প্রতিদৈবসিকৌ।
উদয়াস্তময়ৌ সম্পাদয়তি নক্ষত্ৰ গ্ৰহানাম্॥
                    -আৰ্য্যভট্ট –ভপঞ্জর 

অর্থাৎ নক্ষত্রমণ্ডল, রাশিচক্র স্থির আছে। কিন্তু পৃথিবী বারংবার আবৃত্তি বা পরিভ্রমণ দ্বারা গ্রহ নক্ষত্রাদির প্রাত্যহিক উদয়াস্ত সম্পাদন করছে।   

এই গতিবিচার দ্বারা সূর্যের উদয়াস্ত সম্বন্ধে ভিন্ন ভিন্ন দেশে যে সময়ের তারতম্য হয় তাও পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের বহু পুর্ব্বে ভারতীয় ঋষিগণ আবিষ্কার করেছিলেন—
    “লঙ্কাপুরেঽকস্য যদোদয় : স্যাৎ
     তদা দিনাৰ্দ্ধং যমকোটি-পুৰ্য্যাম্।
     অধন্তদা সিদ্ধপুরেঽস্তকালঃ
     স্যাৎ - রোমকে রাত্রিদলং তদৈব॥” 
অর্থাৎ -- লঙ্কায় যখন সূর্যের উদয় হয়, তখন যমকোটিপুরীতে দ্বিপ্রহরবেলা, আর যখন লঙ্কার অধোভাগে সিদ্ধপুরে সূর্য অস্তগমনোন্মুখী তখন রোমদেশে রাত্রিকাল।

পৃথিবী যে শূন্যমণ্ডলে অবস্থিত এবং পৃথিবীর যে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি আছে তা স্যার আইজাক নিউটন জন্মগ্রহণ করিবার বহু পূর্ব্বে ভারতীয় ঋষিগণ আবিষ্কার করেছিলেন।
*সূৰ্য্যসিদ্ধান্ত লিখেছেন-* 
        “ভূগোলো ব্যোম্নি তিষ্ঠতি।”
*অর্থাৎ* গোলাকার পৃথিবী শূন্যমণ্ডলে অবস্থান করছে।

*ভাস্করাচার্য্য তাহার সিদ্ধান্ত শিরোমণিতে লিখেছিলেন-*
“নান্যাধারং স্বশক্ত্যা বিয়তি চ নিয়তং তিষ্ঠতীহাস্য পৃষ্ঠে। নিষ্ঠং বিশ্বঞ্চ শশ্বৎ সদনুজমনুজা-দিত্যদৈত্যং সমন্ত্যং।।“ 
*অর্থাৎ* পৃথিবী বিনা আধারে স্বীয় শক্তিদ্বারা আকাশমণ্ডলীতে অবস্থান করছে। এরই পৃষ্ঠে চতুৰ্দ্দিকে দেব, দানব, মানবাদি সমস্ত বসবাস করছে

*মাধ্যাকর্ষণ সম্বন্ধে ভাস্করাচার্য্য তাহার বিখ্যাত“ গোলাধ্যায়”-এ লিখেছিলেন—*
      “আকৃষ্ট শক্তিশ্চ মহী তয়া যত্
       খস্থং গুরু স্বাভিমুর্খং স্বশক্ত্যা।
        আকৃষ্যতে তৎ পততীব ভাতি
         সমে সমন্তাৎ ক্ব পতত্বিয়ংখে॥”
*অর্থাৎ* পৃথিবী আকর্ষণ শক্তি-বিশিষ্টা। কারণ কোন গুরুভার বস্তু আকাশে নিক্ষেপ করিলে পৃথিবী নিজ শক্তি দিয়ে তাকে নিজের দিকে আকর্ষণ করে। কিন্তু আমরা মনে করি যেন তা পতিত হয়। চারিদিকেই সমান আকাশ, কাজেই পৃথিবী ছাড়া পড়বে কোথায়?

*আর্যভট্টও লিখেছিলেন—*
       “আকৃষ্ট শক্তিশ্চ মহি যৎ তয়া
        প্রক্ষিপ্যতে তৎ তয়া ধাৰ্য্যতে।” 
*অর্থাৎ* পৃথিবী আকর্ষণ-শক্তি বিশিষ্টা। কারণ যাহা কিছু ঊর্দ্ধে প্রক্ষিপ্ত হয় তাহাই আকর্ষণশক্তি দ্বারা পৃথিবী ধারণ করে।

শাস্ত্রের গুহ্য মর্ম্ম বুঝতে না পেরে আমরা অনেকে রাহু কেতুকে দৈত্য মনে করি এবং এই দৈত্যদ্বয় চন্দ্র – সূৰ্য্যকে মাঝে মাঝে গ্রাস করে এবং সেই জন্যই সূর্য্য ও চন্দ্রগ্রহণ হয় বলে অনেকে মনে করেন।  কিন্তু ঋষিগণ ব্রহ্মপুরাণে বহুপূর্ব্বে লিখেছিলেন-
        “পৰ্ব্বকালে তু সংপ্রাপ্তে
                   চন্দ্রার্কো ছাদয়িস্যসি।
          ভূমিচ্ছায়াগতশ্চন্দ্ৰং
                     চন্দ্ৰগোঽকং কদাচন।”
                                        —পৰ্ব্বকালে
*অর্থাৎ* পূর্ণিমা ও প্রতিপদের সন্ধিকালে এবং অমাবস্যা ও প্রতিপদের সন্ধিকালে রাহুরূপ ছায়া চন্দ্র সূর্যকে আচ্ছাদন করে। সেই জন্যই সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণ হয়।

*সূৰ্য্যসিদ্ধান্ত গ্রন্থে বলেছেন—*
           “ছাদকো ভাস্করস্যেন্দু
                    -অধঃস্থো ঘনবস্তুবেৎ।
          ভূচ্ছায়াং প্রাঙ্মুখশ্চন্দ্রো
                   বিশত্যস্য ভবেদসৌ॥”
                        -সূৰ্য্যসিদ্ধান্ত , ৪।৯

*জোয়ারভাটা সম্বন্ধে বিষ্ণুপুরাণে উল্লেখ আছে—* 
   “স্থালীস্থমগ্নিসংযোগাৎ - উদ্ৰেকি সলিলং যথা।
  তমেন্দুবৃদ্ধৌ সলিলমপ্তোধৌ মুনিসত্তম।।৯০
ন ন্যুনা নাতিরিক্তাশ্চ বর্দ্ধন্ত্যাপো হ্রসন্তি চ।
উদয়াস্ত ময়েম্বিন্দোঃ পক্ষয়ো শুক্ল কৃষ্ণয়োঃ॥৯১ 
      -বিষ্ণুপুরাণ ২।৪।৯০-৯১
*অর্থ :-* জোয়ারভাটায় প্রকৃত পক্ষে জলের হ্রাস – বৃদ্ধি হয় না। হাঁড়ীতে জল চড়িয়ে অগ্নির উত্তাপ দিলে জল যেমন ফেঁপে উপরের দিকে ওঠে , সেইরকম শুক্ল ও কৃষ্ণ পক্ষে চন্দ্রের কলার হাস ও বদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্র – জলেরও হ্রাস বৃদ্ধি হয়ে থাকে।

উপরোক্ত উল্লেখিত বিভিন্ন গ্রন্থের আলোচিত বিষয় থেকে প্রমাণ পাই শিক্ষা-দীক্ষা, সংস্কার-সংস্কৃতি দিক থেকে প্রাচীন ভারতের বৈদিক সভ্যতা ছিল অনেক বেশি উন্নত। আমরা চাই এইসব বৈদিক জ্ঞান আবার বিশ্বসংসারে ছড়িয়ে পড়ুক।

গল্প 

ঠেলার নাম বাবজী

 মার্চ ২০২২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

ঠেলার

নাম বাবাজী

চন্দন চ্যাটার্জি

oldman2.jpg

টনাটি ছোট, কারণটি তার থেকেও ছোট।  
সকালবেলায় পরেশবাবু তার স্ত্রীকে বললেন “একটু চা দেবে”। 
ব্যাস, জ্বলন্ত আগুনে ঘি পড়লে যেরকম জোয়ালা ওঠে ঠিক সেইরকম জ্বলে উঠলেন কাদম্বরী দেবী। 
“আমাকে কি মন্দিরের ঘন্টা পেয়েছো যখন খুশি বাজাবে, আমাকে কি বিনা মাইনের চাকর পেয়েছো যখন যা বলবে তখন তাই করতে হবে, আমি কি আলাউদ্দিনের আশ্চর্য প্রদীপের জিন একবার ঘষলেই নিজের ইচ্ছে মত জিনিস চেয়ে বসবে, আমাকে কি সান্তাক্রুজ পেয়েছ তোমার সব ইচ্ছে পূরণ করব”।
পরেশবাবু বাধা দিয়ে বললেন “এবার থামো, কারণ বৌদ্ধ, শিখ, বা জৈন মতে ইচ্ছাপূরণ করার জন্য যে ব্যক্তি বা চরিত্র আছে তা আমার জানা নেই। কাজেই তুমি ভুল বলছো ঠিক বলছো তা আমি বুঝতে পারবো না“।
কাদম্বরীদেবী ততোধিক উচ্চস্বরে বলে উঠলেন, “রাখো তো তোমার ঠাট্টা, ইয়ার্কি, অফিসে গিয়ে চা খাবে, ব্রেকফাস্ট করে দিয়েছি তাড়াতাড়ি গিলে অফিস যাও। আজ আমার বাবা-মা ও ভাই আসবে”। 
এটা ঠিক কোন ব্যক্তির কাছে যদি টাটা বিড়লা এর থেকেও বেশি সম্পত্তি থাকে তবুও স্ত্রীর চোখে তার বাবা হল একমাত্র সফল ব্যক্তি, তার ভাই হল দুনিয়ার সবথেকে সুখী, আর দুনিয়ার সব থেকে হতভাগ্য নিস্কর্মা অসফল ব্যক্তি হল তার স্বামী। এইজন্য সে নিজে দুনিয়ার সবথেকে দুঃখী মহিলা। 
পরেশবাবু, সংসার জীবনের এই মূলমন্ত্র বিয়ের পরেই বুঝতে পেরেছিলে তাই সকালে উঠে স্ত্রীর বাক্যবাণে বিদ্ধ এবং রাত্রে শুতে যাওয়ার আগে সন্ধিস্থাপন এই ছিল তার প্রায় নিত্যনৈমিত্তিক কাজ।
পরেশবাবুর বাড়ি উত্তর কলকাতায়, কাশিপুরে, চাকরি করেন হাওড়া গ্রামীণ ব্যাংকে, কেরানী পদে, হাওড়ার দাশনগর শাখায়। মোটা গোলগাল চেহারা, মাথা জুড়ে টাক, পরণে পাজামা পাঞ্জাবি, চোখে চশমা তা অবশ্য লেখাপড়া সংক্রান্ত কাজ কর্ম করার জন্য, না হলে খালি চোখে তিনি সবকিছু দেখতে পান। বাড়িতে উনি ওনার স্ত্রী ও একপুত্র থাকে। পুত্র লেখাপড়া ভালোভাবে করতে পারে নি, তাই কাশিপুর বাজারে একটা দোকান করে দিয়েছেন। সম্প্রতি তার বিবাহের কথাবার্তা চলছে। 
পরেশবাবুর শ্বশুরবাড়ি নবদ্বীপ শান্তিপুর। শান্তিপুরের রাস মেলা বিখ্যাত, তাই ওই সময় তিনি সপরিবারে শান্তিপুরে যান। তাও বছরে একবার। এখন তার শ্বশুরমশাই অসুস্থ তাই কলকাতার কোঠারি হসপিটাল এ তাকে দেখাতে আসবে, কথাটা তিনি অবশ্য কালকেই শুনেছিলেন। তাই আজ থেকে তার কথাবার্তা, খাওয়া-দাওয়া, ওঠাবসা সবকিছু নিয়ন্ত্রিত, কারণ মা পার্বতীর সামনে যখন স্বয়ং ভোলানাথের চলে না, তিনি তো কোন ছাড়। 
দেখতে দেখতে পরেশবাবুর চাকরিজীবন প্রায় শেষ প্রান্তে এসে উপস্থিত। সামনের দুই হাজার কুড়ি সালের জানুয়ারিতে তিনি রিটায়ার করবেন, অর্থাৎ হাতে আর মাত্র এক বছর সময়। এই সময় চাকরিতে অহেতুক ছুটি নেওয়া তার অর্থনৈতিক, শারীরিক ও মানসিক সবদিক থেকেই ক্ষতিকর। অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ তো বোঝা যায়, শারীরিক ও মানসিক ক্ষতিকর কি ভাবে তাই বলছি, ছুটি নিলে তিনি ঘরে বসে থাকবেন। ঘরেতে থাকলে স্ত্রীর কথা শুনতে হবে আর সেটা থেকে এড়ানোর জন্য যদি তিনি পাড়ার চায়ের দোকানে গিয়ে বসেন তবে আলুর চপ, বেগুনি, পিয়াজি দেখে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না, আর এই বয়সে এক-একটা তেলেভাজা যেন এক-একটা বৃশ্চিক দংশনের সমান, সেটা বুঝতে পারবে মাঝরাতের পর। 
এইসব কথা ভাবতে ভাবতে তিনি অফিসে যাচ্ছিলেন। আজ তিনি এমন অন্যমনস্ক যে তার অফিস সেকেন্ড ফ্লোরে তিনি লিফটে করে থার্ড ফ্লোর পর্যন্ত উঠে পড়েছিলেন। আবার একটা ফ্লোর তিনি হেঁটে নিচে নেবে আসেন, আর সেইটা অফিসের পিয়ন রামকরণ দেখতে পায়। রামকরণ আসলে বিবিসি নিউজ, তাই এই খবরটা ছড়াতে বেশি সময় লাগে না। 
লাঞ্চের সময় অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার দীপকদা তো বলেই ফেলল, ”পরেশদা কিছুদিন ছুটি নিয়ে কোথাও বেরিয়ে আসুন শরীর ও মন দুটোই হালকা হবে”।
পরেশবাবুর সামনের টেবিলে বসেন সমরেশ রায়। তারা প্রায় সমবয়সী, কিন্তু তার রিটায়ার হতে আরো তিন বছর বাকি। ছুটির পর সমরেশ, পরেশবাবুকে ধর্মতলায় নিয়ে আসলো, ওখানে দত্ত কেবিনে চিকেন কবিরাজি ও টোস্ট খাইয়ে তারপর তাকে কাশীপুরের বাসে তুলে দিল। অফিসে পরেশবাবুর একমাত্র বন্ধু এবং শুভাকাঙ্খী হল এই সমরেশ। এ বেশ সুখেই আছে, বিয়ে সাদি করেনি, দাদার কাছে থাকে, খায়, মাসান্তে কিছু টাকা বউদির হাতে দিলেই হল। বাজার দোকান করা নেই, ছেলেপুলের ঝামেলা নেই, একদম মুক্ত ও সুখী পুরুষ।  
বছরে একবার ছুটি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে কখনো কেদারনাথ, বদ্রিনাথ, ঋষিকেশ বৃন্দাবন বা পুরী, দীঘা তো লেগেই আছে। একদিন অফিসে পরেশবাবুকে বেশ বিষণ্ণ দেখাচ্ছিলো। তাই দেখে সমরেশ বলল “কি হয়েছে পরেশদা বৌদির সঙ্গে আবার ঝগড়া”।
পরেশবাবু বললেন “আর বলিস না ভাই বউ তো নয় যেন এক শাণিত দুমুখো তলোয়ার, আসতে যেতে দুই দিকেই কাটে। জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা ধরে গেছে, ভাবছি কোন সাধু সন্ন্যাসী হয়ে হিমালয় চলে যাব। তুই তো প্রায়ই পাহাড়ে যাস কোন একটা গুহা ভাড়া পাওয়া যায় না কি দেখিস তো আমি চলে যাব”। সমাবেশ বলল “দাদা সাধু হওয়া অত সোজা নয়”।
পরেশবাবু “আরে কি সহজ নয়? কোন একটা মাল-দার পার্টিকে শিষ্য করে তার বাড়ীতে থেকে যাব। দিনরাত খাবো দাব, হরিনাম করব। অন্য সব সাধুদের দেখিস নি, ওদের কিসের চিন্তা? মস্ত জীবন”।
সমরেশ, ”একটা কথা বলব পরেশদা রাগ করবেন না। তুমি বরং একবার সাধু সাজো। মেকাপের ভার আমার, একটু প্রচার করে দেব এবং বৌদিকে গিয়ে আমি ম্যানেজ করে দেব এই একঘেয়ে জীবন থেকে বৈচিত্র আসবে তুমি জগৎটাকে নতুন চোখে দেখতে পাবে”। 
পরেশবাবু কিছু না বলে চুপ করে থাকেন, আসলে সমরেশ মন্দ বলেননি বাড়ি থেকে পালিয়ে বউকে জব্দ করার একটা সুযোগ আছে। আর যদি ধরা পড়ে যায় তাহলে সত্যি কথা বলে দেবো। 
এরপর আবার একমাস কেটে গেছে দুর্গা পুজোর কিছু আগে, পুজোর জামা কাপড় কেনা নিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে তুমুল গন্ডগোল শেষ মেশ তিনি অফিসে যাবার সময় বলে গেলেন, ”ধুরতারি! সংসারের মাথায় মারো ঝাড়ু, আমি যাচ্ছি আর আসবো না সন্ন্যাসী হয়ে হিমালয় চলে যাব ইত্যাদি।“
আজ শনিবার তাই অর্ধ দিবস অফিস হবে। বেলা একটার সময় দুই বন্ধু হাওড়া ময়দান এর কাছে একটা রেস্টুরেন্টে বসে খানিক চিন্তা-ভাবনা করলেন। তারপর সমরেশ কিভাবে সাধু হওয়া যায় সেই সম্বন্ধে একটা ছোটখাটো লেকচার দিল, এই একটা সুযোগ এসেছে বউকে জব্দ করতে হবে একটা শিক্ষা দিতেই হবে, না হলে এরপরে বাকি জীবনটা কাটানো মুশকিল হবে। 

সমরেশের বাড়ি বরানগর মঠের কাছে, রাত্রি পরেশবাবু, সমরেশের বাড়িতে ছিলেন। ভোরবেলা থেকে অ্যাকশন শুরু হবে। ইতিমধ্যে রাত্রি পরেশবাবু না ফেরায় কাদম্বরী দেবী বেশ চিন্তিত, প্রথমটা  অভিমান, দুঃখ, কিন্তু  রাত যত বাড়তে থাকে ততই দুঃখটি দুশ্চিন্তায় পরিণত হয়। একবার অফিসে ফোন করলেন কিন্তু তা রিং বেজে গেল কারণ শনিবার ব্যাংক বন্ধ হয় সাড়ে বারোটায়। পাড়ার দু একজন মহিলা এসে জুটল, যাদের সঙ্গে কাদম্বরীদেবী দুপুরে পান খেতে খেতে, পরচর্চা ও পরনিন্দা করেন। তাদের একজন যুক্তি দিল থানাতে খবর দিতে এবং কাগজে নিরুদ্দেশ সংক্রান্ত বিজ্ঞাপন দিতে। কাদম্বরীদেবীর স্বামীর সঙ্গে যতই ঝগড়া করুক, থানা পুলিশের নাম শুনে একটু চুপ করে রইলেন কারণ থানা পুলিশে তার বড় ভয়। হঠাৎ তার ছেলে বলল সমরেশকাকুকে ফোন করবো। সমরেশ, পরেশবাবুর বাড়িতে অনেকবার গিয়েছিলেন তাই সবাই তাকে চেনে। ছেলেটা সমরেশকে ফোন করতেই সমরেশ বলল ”ছুটি তো আমাদের সাড়ে বারোটায় হয়ে গেছে তোমার বাবা তো এতোক্ষণ পৌঁছে যাবার কথা আমি তো বলতে পারছি না ভাই”। ছেলেটা বলল, ”তবে কি একবার থানায় খবর দেবো” সমরেশ তাড়াতাড়ি বলে উঠলো “না না থানায় জানাবার দরকার নেই হয়তো রাগ করে কোন আত্মীয়র বাড়িতে গেছে দু-একদিনের মধ্যে ফিরে আসবে তোমরা কোন চিন্তা করো না আমি কাল সকাল বেলায় তোমাদের বাড়ি যাবো”।

ক্রমে ক্রমে রাত বাড়তে লাগলো কাদম্বরীদেবী না খেয়ে শুয়ে পড়লেন। পরের দিন খুব ভোরবেলায় সমরেশ, পরেশবাবুর বাড়িতে গিয়ে ভালো করে বুঝিয়ে আসলো এবং থানা পুলিশ করতে মানা করলো কারণ রিটায়ারমেন্ট বেনিফিট পেতে সমস্যা হবে।

কেবলমাত্র আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে একটু খোঁজখবর নিতে বলল। কাদম্বরী দেবীর দুই ননদ, একজনের আরামবাগে বিয়ে হয়েছে অন্যজন আসানসোলে। ছেলেটা দোকান বন্ধ রেখে বাবার খোঁজে বের হলো। একদিনে দুই জায়গা যাওয়া সম্ভব নয়। তাই তার ফিরে আসতে তিন চার দিন সময় লাগবে এই কথা সে মাকে বলে গেল। 
কাদম্বরীদেবী একা বাড়িতে আছেন অনেকটাই খালি খালি লাগছে বিশেষ করে সন্ধ্যের পর থেকে। আসলে স্বামীর সঙ্গে ঝগড়াটা একটা হজমীগুলির মতো হয়ে গেছে এটা না হলে যেন তার দুপুরের ভাত হজম হয় না। 
রবিবার দুপুরে সমরেশ সবে খেয়েদেয়ে আজকের রবিবাসরীয়টা নিয়ে একটা গল্প পড়ার উপক্রম করছে এমন সময় তাদের বাড়ির দরজায় এক সাধু আসলো গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, মাথায় লম্বা লম্বা জটা, পরনে গেরুয়া পোশাক, হাতে কমন্ডুল, কাঁধে ঝোলা, কপালে সিঁদুরের টিপ, পায়ে খড়ম, দেখলে যেন ভক্তিতে মাথা নত হয়ে আসে। 
সমরেশের বৌদি ভিক্ষার সামগ্রী নিয়ে সাধুবাবাকে দেবার উপক্রম করছে, এমন সময় সমরেশ এসে সাধু বাবাকে দেখেই চিনতে পারল, বৌদিকে বলল আমি যখন কেদারনাথে গিয়েছিলাম তখন একবার এনার আশ্রমে গিয়েছিলাম। উনি খুবই মস্ত বড় সাধু, একবারে বাক সিদ্ধ পুরুষ, যাকে যা বলেন তাই হয়ে যায়। 
সাধারণ লোক বিশেষ করে স্ত্রীলোক সাধুসন্তদের বেশি সম্মান করে কারণ তারা ভাবে তাদের প্রকৃত মনের কথা একমাত্র সাধুবাবারা বুঝতে পারবে এবং তা সমস্যা সমাধানের উপায় বাতলে দেবে তাই সাধুবাবাকে সম্মানের সঙ্গে ভেতরে নিয়ে গেলেন, খড়ম খুলে পা ধুয়ে গামছা দিয়ে মুছিয়ে দিল। নিচে একটা বড় কম্বলের আসন পেতে দিল বসার জন্য। খানিক পরে জল, দুধ, ফলমূল আহারের জন্য দিল। 
সাধুবাবা কিছু ফল মূল গ্রহণ করলেন, কিছু উপদেশ দিলেন, এইভাবে দেখতে দেখতে সন্ধ্যে হয়ে গেল। তার কিছুক্ষণ পর সমরেশের দাদা সমরেশকে জিজ্ঞেস করল “হ্যাঁ রে সাধুবাবা কোথায় থাকবেন আমাদের ঠাকুরঘরে”। 
যদিও সাধুবাবার থাকার জায়গা আগে থেকেই ঠিক করা ছিল, তথাপি সমরেশ বলল, ”হ্যাঁ ঠাকুর ঘরে থাকতে পারেন, কিন্তু ইনি অত্যন্ত সিদ্ধপুরুষ কাল থেকে বোধকরি অনেক লোক আসতে শুরু করবে। তাই আমার মনে হয় অগ্রদূত ক্লাব এর পাশে যে ঘর আছে যেখানে বাসন্তী পূজা হয় ওখানে সাধু বাবার থাকার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি, তা হলে অনেক লোক দর্শন করতে পারবে”।
সন্ধ্যেবেলায় সমরেশ সাধুবাবাকে নিয়ে ক্লাব ঘরের দিকে গেল এবং ওনার থাকার ব্যবস্থা করে দিল। পরেরদিন সকাল হতে না হতেই রটে গেল অগ্রদূত ক্লাবে একজন মহাসিদ্ধ পুরুষ হিমালয় থেকে এসেছেন। একটা সিঙ্গেল খাটিয়া ছিল তার ওপর সুসজ্জিতভাবে বসে সাধুবাবা দর্শন দিচ্ছেন, কাউকে আশীর্বাদস্বরূপ একটা ফুল দিচ্ছেন বা কিছু মাদুলি দিচ্ছেন যে কেউ আসছে তারা সাধু বাবার জন্য ফলমূল মিষ্টান্ন ধুপ এইসব নিয়ে আসছেন। ক্লাবের একজন ছেলে সেগুলি এক জায়গায় গুছিয়ে রাখছে অপর কয়েকজন ছেলে লাইন নিয়ন্ত্রিত করছে যাতে করে সবাই সাধু বাবার দর্শন লাভ করতে পারে। 
সেই সকাল থেকে শুরু হয়েছে একজন একজন করে অনেক লোক আছে তাদের অভাব-অভিযোগ দুঃখ দারিদ্রতা শোকতাপ সবকিছুই বাবাকে জানাচ্ছে। বাবা প্রয়োজনমতো উপদেশ দিচ্ছেন ও প্রসাদী ফুল দিচ্ছেন। 
এইভাবে তিন দিন কাটল, বাবা রোজ সকালে স্নান করে তৈরি হয়ে বসেন, তারপর দর্শন চলে রাত্রি পর্যন্ত। মাঝখানে দুপুরে সময় এক ঘন্টা বিশ্রাম বাবা পান। বাবা যাকে যা বলছেন কারুর মিলেছে, কারুর মেলেনি কিন্তু তাই নিয়ে কোন অভিযোগ নেই। কারণ মানুষের মধ্যে একটা বিশ্বাস আছে যদি কোন খারাপ হয় তাহলে সেটাও ভগবানের ইচ্ছা, হয়তো এরপর তাঁর আশীর্বাদে আরো ভালো হবে, এখন তিনি ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছেন। বাস্তবিকপক্ষে ভবিষ্যৎ ভালো হবে উজ্জল হবে এই আশাতেই মানুষ বর্তমানে কাজ করে। 
দিন চারেক কাটার পর সাধুবাবার বেশ অসুবিধে হচ্ছে। এক ভাবে বসে থাকতে থাকতে তার কোমরে স্পন্ডালাইসিস হয়ে যাবার জোগাড়। ওদিকে চায়ের বদলে দুধ, তা আবার পেটে গ্যাস হয়। দুপুরবেলায় আতপ চালের ভাত ঘি এবং সেদ্ধ আলু। আমিষ খাবারের আস্বাদ তিনি প্রায় ভুলেই গেছেন, চিকেন কষা, ডিমের অমলেট কিরকম খেতে তা ভুলে গেছেন। রাত্রিতে মাঝেমধ্যে তিনি স্বপ্নে দেখেন ধর্মতলায় দত্ত কেবিনে বসে চিকেন কবিরাজি, চিকেন রোল খাছেন, বা হাওড়া ময়দানে ফ্রাই রাইস, চিলি চিকেন বা নিদেন পক্ষে পাড়ার মোড়ে চায়ের দোকানে তেলেভাজা বেগুনি এইসব খাচ্ছেন। এইসব চিন্তা করতে করতে রাত্রি তার ঘুম হয় না। খালি পেটে দুধ খেলে তার গ্যাস হয়ে যায়, তাই এই চার দিনে তার প্রায় দশ কেজি ওজন বেড়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে। খড়ম পরা তার অভ্যাস নয় তাই চলতে ভীষণ অসুবিধা হয়। এক ভক্ত আবার পায়েতে আলতা লাগিয়ে দিয়েছে, সকালবেলা চান করার সময় সেটা ঘষে ঘষে তুলতে গিয়ে ছাল উঠে গেছে, জ্বালা করছে, কিন্তু কাউকে কিছু বলতেও পারছেন না। এই কদিন ভগবানের নামের পরিবর্তে অফিস ও সংসারের কথা বেশি করে মনে হচ্ছে। এখন তিনি হাড়েহাড়ে বুঝতে পারছেন সাধু হওয়া কোনো সহজ কাজ নয়। যাদের জীবনে ত্যাগ নেই তারা সাধু হতে পারবে না।  
ওদিকে সপ্তা খানেক পরে পরেশবাবুর ছেলে এসে তার মাকে জানালো পিসিদের বাড়িতে বাবা যায়নি। আর শ্বশুরবাড়িতে তো কখনো একা যান না তাহলে কোথায় গেছে সেটা এখন কাদম্বরীদেবীর মনে চিন্তার ছাপ ফেলেছে। এদিকে বরানগরে এক সিদ্ধ পুরুষ এসেছেন হিমালয় থেকে সেটা কাদম্বরীদেবীর কানে পৌঁছেছে। তিনি নাকি অন্তর্যামী ভূত-ভবিষ্যৎ সব দেখতে পান একবার তার স্বামী কোথায় গেছে কেমন আছে তা জানার জন্য বরানগরে গেলে কেমন হয়। এই কথা মনে করতেই ছেলেটাকে তিনি সমরেশকাকুর সঙ্গে যোগাযোগ করতে বললেন।  
সমরেশ বললো, ”ঠিক আছে তোমার মাকে নিয়ে কালকে আসো আমি দেখছি কি করা যায়”। 
যথারীতি কাদম্বরীদেবী ও তার ছেলে সকালবেলায় বাবাজির দর্শনে আসল, সঙ্গে কাশীপুরে বিখ্যাত কাঁচাগোল্লা ও একটা চাঁপাফুলের গন্ধওলা ধুপ নিয়ে আসল। কিন্তু ভিড় থাকায় তারা বাবাজির সামনে আসতে প্রায় দুপুর হয়ে গেল আর দু একজনের সঙ্গে কথা বলে বাবাকে বিশ্রাম নেবেন। 
কাদম্বরীদেবীকে দেখেই বাবাজি বললেন “তুই তোর স্বামীর সঙ্গে এত ঝগড়া করিস কেন? তাই সে বাড়ি থেকে চলে গেছে”। কাদম্বরীদেবী কাঁদ কাঁদ স্বরে বললেন “বাবা খুব অন্যায় হয়ে গেছে, মা কালীর নামে দিব্যি করছি আজ থেকে আর ঝগড়া করবো না। আমার স্বামী যেন ফিরে আসে, কোথায় আছে, কেমন আছে সেটা যদি বলে দেন”।
সাধুবাবা বললেন “মায়ের নাম নিয়ে শপথ করেছিস কিন্তু মনে রাখিস আবার ঝগড়া করলে সে চলে যাবে আর ফিরে আসবে না”। 
কাদম্বরীদেবীর বললেন “না বাবা এই নাক মুলছি, এই কান মুলছি আর ঝগড়া করবো না আমার স্বামীকে ফিরিয়ে এনে দিন”।
বাবাজি তার হাতে মন্ত্রপুত ফুল দিলে দিয়ে বললেন” এইটা রাখ, কালকের মধ্যেই তোর স্বামী ফিরে আসবে”।
কাদম্বরী দেবী অত্যন্ত খুশি মনে বাবাজিকে প্রণাম করে চলে গেলেন।

পরদিন দুপুরবেলায় দরজায় ঠক ঠক আওয়াজ, ছেলে এসে দরজা খুলে চমকে গেল এবং চেঁচিয়ে বলল “মা বাবা এসেছে”। কাদম্বরীদেবীর রান্নাঘর থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলেন। ছোট ছেলেকে মা যেমন হাত ধরে নিয়ে যায় সেই রকম তিনি পরেশবাবুর হাত ধরে আস্তে আস্তে নিয়ে যেতে লাগলেন। 
সোফার ওপর নিয়ে গিয়ে বসিয়ে জিজ্ঞেস করলেন “এ কদিন কোথায় ছিলে, কোথায় গিয়েছিলে,কি করছিলে”।
পরেশবাবু “সে অনেক কথা পরে বলব এখন চান করছি, খেতে দাও” কাঁধের ব্যাগটা সোফার ওপর রেখে তিনি চান করতে যাবার জন্য বাথরুমের দিকে গেলেন।
ওদিকে কাদম্বরী দেবী, পরেশবাবুর ব্যাগ থেকে একটা কাশীপুরের দোকানে মিষ্টির প্যাকেট একটা চাঁপা ফুলের গন্ধওলা ধুপের প্যাকেট বের করলেন। পরেশবাবু সেই দিকে একবার আড় চোখে তাকিয়ে একটু মুচকি হেসে চলে গেলেন, না তাকাবার ভান করে। আর ওদিকে কাদম্বরীদেবীর মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে রান্না ঘরে চলে গেলেন। 
বলাবাহুল্য পরেশবাবু জীবিত ছিলেন ৭২ বছর এই সময় তাদের মধ্যে আর ঝগড়া হয়নি।

দি লাস্ট বাস

গল্প 

 মার্চ ২০২২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

দা লাস্ট বাস
মূলঃ ডার্সি কোটস 

ভাষান্তর: অরূপ ঘোষ

bus driver.jpg

রাজের কপাল বাস টাইম টেবিলটাতে প্রায় লেগে গেলো যখন সে বাসের চলার পথগুলি দেখছিল। ছাব্বিশ, আটাশ আর চল্লিশ নাম্বার ওখানে থামে, কিন্তু ওখানে এটা লেখা নেই, যে এদের মধ্যে কোনটা, ক্যালগ্যারিতে যায়!
সে একপলকে রাস্তার দুপাশের বাড়িগুলির দিকে তাকিয়ে নিলো। সেখানকার বাসিন্দারা ওর দিকে তাকিয়ে আছে, তার কনফিউশন দেখে হাসছে, এই আইডিয়াটা তার পছন্দ হল না! পরিচিত অপমানের অনুভূতিটা ওর পেটের ভেতর পাকিয়ে উঠতে চাইলো, কিন্তু ও জোর করে ঠেলে সেটাকে নিচে পাঠিয়ে দিলো।
এই পাড়াতে তোমার লজ্জিত হবার কিছুই নেই, এটা একটা বস্তি থেকে মাত্র কয়েক কদম দূরে; এখানকার বাসিন্দাদের অর্ধেকের বেশিই হয়ত লেখাপড়া জানেই না!
একটা টায়ারের আর্তনাদ রাজকে বিরক্ত করল এবার। ও ঘুরে তাকাল, আর বিস্ময়ের সাথে আবিষ্কার করলো, একটা বাস এসে ওর পাশে দাঁড়িয়েছে, আশ্চর্য! আমি তো এটা আসতেই শুনিনি!     
সে বাসের সামনে দিক নিদর্শন বা কোন নাম্বার দেখার আশাতে তাকাল, কিন্তু ওটার সেরকম কিছুই ছিল না! দরজাগুলি বিকট ‘হুশ’ শব্দ করে খুলে গেল।
“হেই” রাজ ডাকল, আর ড্রাইভার, মোটাসোটা মধ্যবয়সী লোক, মুখে বিনয়ী হাসি ঝোলানো, ওর দিকে ঝুঁকে এলো “তোমরা কোথায় যাচ্ছ?”
মানুষটি হাসল “সব ধরনের জায়গায়, ছেলে! তুমি কোথায় যেতে চাও?”
রাজ ওর চারপাশের জরাজীর্ণ বাড়িগুলির দিকে তাকাল, সে এ ধরণের জায়গাতে ওই ধরণের বাস মোটেও আশা করেনি, ড্রাইভারটাকে দেখে মনে হয় সে আরামদায়ক মধ্যবিত্ত বা উচ্চ মধ্যবিত্ত শহরতলীতে থেকে অভ্যস্ত, একটা প্রাইভেট স্কুলের বাস চালায় বড়জোর।
“আহ!” রাজ পেছনে ম্যাপটার দিকে তাকাল, তার ক্যালগ্যারিতে যাওয়ার রাস্তা সম্পর্কে খুব অস্পষ্ট ধারণা ছিল, যেখানে তার ভাইয়ের বন্ধু থাকে। কিন্তু সে যে কোন মূল্যে এই পাড়া থেকে বেরোতে চাইছিল। 
“তোমরা কি ক্যালগ্যারির আশপাশ দিয়ে যাবে?” শুধালো সে।
“অবশ্যই” ড্রাইভারটা বলল রাজকে বাসে উঠতে ইশারা করতে করতে “আমরা আরও কিছু শহরতলী ঢুঁ মারবো, তাই এটা একটা লম্বা ভ্রমণ হবে, চলবে?”
রাজ ইতস্তত করতে লাগলো, এক পা বাসের ভেতর, লম্বা ভ্রমণ মানে বেশি পয়সা, সেটা তার কাছে নেই “কত দিতে হবে?”
বাস ড্রাইভারটি ওর দিকে মূল্যায়নের দৃষ্টিতে তাকাল, ওর নীল চোখগুলি রাজের দাগ পড়া হুডি আর ছেঁড়া জিন্সের ওপর ঘুরে এলো। “ছেলে, আমার মনে হয় এটা বলা উচিত হচ্ছে না, কিন্তু আমার মনে হয় তুমি কিছু সমস্যাতে আছো!” একজন মদ্যপ আর বদমেজাজি বাপকে যদি সমস্যা ধরা হয়, তাহলে রাজ গভীর সমস্যাতেই আছে। সে অসহায়ভাবে কাঁধ ঝাঁকাল শুধু একবার।
“হেই” ড্রাইভার বলল উষ্ণ হাসি হেসে “আমাদের সবারই কোন না কোন সময় উপরে উঠার জন্য হাতের প্রয়োজন হয়, টিকেট আমার পয়সায়, উঠে পড়!”
রাজ হতবাক হয়ে গেল, বিড়বিড় করে ধন্যবাদ জানিয়ে বাসে উঠে পড়ল, পেছনে দরজা বন্ধ হয়ে যাবার পর সে সিটের খোঁজে এদিক সেদিক তাকাল। বাসটাতে বিভিন্ন ধরণের যাত্রী সমাবেশ দেখা গেলো, সামনের দিকে এক সুন্দরী অল্পবয়সী মহিলাকে দেখা গেলো নীল ডাই করা চুল আর নাকে ছিদ্র করে রিং পরা। তিন রো পরে এক ব্যবসায়ী বসে ছিল হাতের চারপাশে নেতানো খবরের কাগজ মুড়ে, আরেকটু পেছনে এক অল্পবয়সী ছেলে বসে ছিল যার বয়স রাজের চাইতেও অনেক কম। ওর ফ্যাকাসে মুখ আর সঙ্গী যাত্রীদের দিকে সন্দেহাকুল দৃষ্টিতে তাকানো দেখে রাজ সন্দেহ করল, ব্যাটা মনে হয় নেশা করেছে ভালোই! এক গৃহহীন দেখতে লোক আরেকটা জানালার পাশে শুয়ে ঘুমাচ্ছিল। অন্যপাশে দুই মধ্যবয়সী মহিলা বসে ছিলেন, শেষদিকে, কিছু একটা বুনছিলেন। গাঢ় করে চোখে মাস্কারা দেয়া আরেক মেয়ে জানলা দিয়ে বাইরে গভীর মনোযোগের সাথে দেখছিল।
রাজ প্রথম দিকে বসা সুন্দরী মহিলার পেছনের সিটে বসল আর আরাম করে সিটে হেলান দিলো, মহিলা ওনাকে পার হবার সময় উজ্জ্বল হাসি দিলো একটা, রাজ ওনাকে তার সেরা হাসিটা উপহার দিলো। “সবাই বসেছে?” ড্রাইভার বলল গিয়ার বদলাতে বদলাতে।
রাজ আচমকা একটা শক টের পেলো নিজের ওপর, যখন এতক্ষণ ওরা কথা বলছিল, ড্রাইভারের হাত দুটো কোলের ওপর রাখা ছিল, সেগুলো রাজ দেখতে পায়নি তাই। এখন সেগুলো যখন স্টিয়ারিং হুইলে ফেরত গেল, রাজ দেখতে পেল দশটা লম্বা ঘন হলুদ নখ! এটা ওই ফিটফাট দেখতে ড্রাইভারের জন্য এতোটাই বেমানান আর উদ্ভট ছিল যে, রাজ ওর চোখ সরাতে পারলো না। নখগুলি ছিল কমপক্ষে তিন ফুট লম্বা, আর মাথার দিকে বেশ ছুঁচালো! “খারাপ দিন?” হাস্কি একটা কণ্ঠ জিজ্ঞেস করল, রাজ চমকে উঠে সুন্দরী মহিলাটির দিকে তাকাল। “কি ---- ??” রাজ তোতলাতে শুরু করেও থেমে গেল।

“তোমাকে বেশ ভালোই চিন্তিত দেখাচ্ছিল” মহিলা বলল, ওনার স্বর রাজ যা আশা করেছিল তার থেকেও নিচু, আর অবাক হয়ে আবিষ্কার করল যে সে এটা পছন্দই করছে!” একটা ইতস্তত হাসিতে ভরে যাচ্ছিল রাজের মুখ, কিন্তু দ্রুত সেটা মুছে ফেলে সে বলল “ওয়েল, সবচেয়ে সেরা না, আম্মম্মম ......”“হেই” পেছন থেকে একটা কণ্ঠ ঘেউ করে উঠলো “এটা তো হাইড স্ট্রিটে যাওয়ার রাস্তা না! রাজ পেছন ফিরে দেখল, নেশা করা ছেলেটা কথা বলে উঠেছে, তাকে বেশ উত্তেজিত দেখাচ্ছিল, সিটে মোচড়ামুচড়ি করছিলো আর বার বার চোরা চোখে বিপরীত দিকে কিছু একটা বুনন রত দুই মহিলার দিকে তাকাচ্ছিল ! 
বাস ড্রাইভারটা রিয়ার ভিউ মিররে তাকাল, একটা উজ্জ্বল হাসিতে ভরে গেল তার মুখ “তুমি ঠিক বলেছ!” তারপর বাসের বাকিদের উদ্দেশে বলল “কি মনে হয়, আমাদের জন্য যথেষ্ট হয়েছে না?”
সম্মিলিত কণ্ঠে আওয়াজ এলো
“ইয়াহ!”
“আমার জন্য চলবে!”
“চলো কাজটা সেরে ফেলি!”
ড্রাইভার একটা শার্প টার্ন নিয়ে স্পিড বাড়িয়ে দিলো, বাসটাকে চালিয়ে নিয়ে চলল আরও কিছু অন্ধকারাচ্ছন্ন, কম ব্যাবহার করা অলি গলি দিয়ে। রাজ ওর পেটের ভেতর একটা অস্বস্তিকর সুড়সুড়ি টের পাচ্ছিল। সে সুন্দরী মহিলাটির দিকে তাকাল, যে রাজের দিকে ফেরার জন্য সিটে ঘুরে বসেছে। মহিলার বড় কালো চোখগুলি নিঃশব্দ হাসিতে কুঁচকে গেল। ওনাকে দেখে মনে হচ্ছিল উনি কোন কিছুরই পরোয়া করেন না!
রাজ পেছনে বাসের বাকিদের দিকে তাকাল, বুনন করতে থাকা মহিলারা আর ব্যবসায়ীটাকে দেখে কিচ্ছু বোঝা যাচ্ছে না! শুধু নেশাখোর ছেলেটা, গাঢ় মাস্কারা দেয়া মেয়েটা আর গৃহহীন লোকটা, যে এইমাত্র ঘুমের দেশ থেকে ফেরত এসেছে, ওদেরকেই বেশ বিচলিত মনে হল।
“এখানে কি হচ্ছে?” রাজ ড্রাইভারের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল। যে এলাকাতে গাড়িটা ঢুকেছে সেটা সে চেনে না, কিন্তু ওটা দেখতে শিল্প এলাকার মতো লাগছিল। ওয়্যারহাউজগুলি লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, আর রাস্তাতে আর কোন গাড়িই দেখা যাচ্ছিল না। 
“একটু অপেক্ষা করো” ড্রাইভার বলল “বুঝতে পারবে!”
রাজ বুঝতে চায়না, সে শুধু চায় এই বালের বাস থেকে নেমে যেতে, ওই ......ওই ভয়ঙ্কর যাত্রী, ওই বড় নখ অলা ড্রাইভার থেকে দূরে চলে যেতে চায়!
“তোমার হাতে কি সমস্যা?” নেশাখোর ছেলেটার কণ্ঠ শোনা গেলো আবার, রাজ ঘুরলো। ওই ছেলেটা বুনন করতে থাকা মহিলা দুটির দিকে জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে ছিল, কিন্তু ওনারা অমায়িক হাসি নিয়ে তাকালেন এদিকে। রাজ আরেকটু ঝুঁকে ভালো করে দেখার চেষ্টা করল, কিন্তু মহিলা দুজন বুনন করা স্কার্ফগুলি দিয়ে ওনাদের হাত ঢেকে রেখেছিলেন। 
রাজ অনুভব করল, যে লুকানো আঙ্গুল খুব খারাপ ইঙ্গিত বহন করে, ও বাসের বাকিদের হাতের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাতে লাগলো। নেশাখোর, গৃহহীন, মাস্কারা দেয়া মেয়ে আর ওর নিজের হাত দৃশ্যমান ছিল। কিন্তু বুনন করা মহিলারা স্কার্ফ দিয়ে, ব্যবসায়ী পেপার দিয়ে আর ওর নিজের সামনে বসা সুন্দরী মহিলা নিজেরগুলি পকেটে ঢুকিয়ে রেখেছিলেন।
“কিহ ???!!” সে শুরু করতে যেতেই বাসটা হঠাৎ থেমে গেলো। 
ওখানে কোন স্ট্রিট লাইট, কোন বাড়িঘর, কোন গাড়িঘোড়া কিছুই ছিলো না। রাজ দাঁড়িয়ে গেলো দরজা দিয়ে বের হয়ে যাবে বলে, কিন্তু ড্রাইভারটা একটা বোতামে চাপ দিতেই মৃদু শব্দ করে দরজাগুলি লক হয়ে গেলো।
“চলো খাই!” বাস ড্রাইভার বলল স্বাভাবিকভাবে! এবং হঠাৎ করেই, লুকিয়ে রাখা হাতগুলি বেরিয়ে এলো স্কার্ফ, পকেট আর পেপারের আড়াল ছেড়ে। 
রাজ গলার গভীরে একটা চিৎকার তৈরি হচ্ছে টের পেলো, কিন্তু সে জানতো কেউ ওকে শুনতে পাবে না! জন্তুগুলো তাদের লম্বা হলুদ নখগুলি নিয়ে শ্বাপদের ক্ষিপ্রতায় নড়ে উঠলো। বুনন কারী মহিলা দুজন ঝাঁপিয়ে পড়ল নেশাখোরের ওপর, ওদের চোয়ালগুলি এমনভাবে খুলে গেলো, কোন মানুষের চোয়াল ওভাবে খুলতে পারেনা, ভেতরে দেখা গেলো হাঙ্গরের মতো তীক্ষ্ণ আর ছুঁচালো দাঁত! ওরা এত দ্রুত নড়াচড়া করছিলো যে রাজ খালি চোখে ওদের ফলো করতে পারছিল না, কিন্তু নিষ্ফল, গড়গড়া করার মতো চিৎকার রক্তের স্প্রেতে ভেসে যাওয়া ঠিকই দেখতে পেলো। স্যুট পরা ব্যবসায়ী পেপার ফেলে দিয়ে ঘুরে সিটের ওপর দিয়ে লাফিয়ে পড়ল পেছনের গৃহহীন লোকটার ওপর! বাস ড্রাইভার লাফিয়ে রাজকে ফেলে এগিয়ে গেলো ভীতসন্ত্রস্ত টিনেজ মেয়েটির দিকে। রাজের চিবুকে রক্তের ছিটে এসে লাগলো, আর ও ঘুরে সভয়ে দেখল সুন্দরী মহিলাটির কালো চোখগুলি ওর মুখ থেকে মাত্র এক ইঞ্চি দূরে!
“সরি” মহিলাটা হাসছিল, কিন্তু ওর নিশ্বাস কোন অসুস্থ আর পচা জিনিস দিয়ে দূষিত মনে হল যখন সে তার হলুদ বড় বড় নখগুলি রাজের দিকে বাড়িয়ে ধরল “আজকের দিনটা তোমার জন্য আরও জঘন্য আর ভয়ঙ্কর হয়ে দেখা দেবে!”

গল্প 

 মার্চ ২০২২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

অনাহুত বরযাত্রী

অনাহুত

বরযাত্রী

পার্থ বোস

ব্যাঙ্গালুরু

wedding_priests2.jpg

তকাল ছিয়ানব্বই বছর বয়সে আমাদের গোটা পরিবারকে গভীর শোকের মধ্যে রেখে চলে গেলেন সাহেব দাদু। জন্মের সময় বাচ্চার গায়ের রং ছিল টুকটুকে ফর্সা।  তাই দেখে বাবা মা আদর করে নাম রেখেছিলেন ‘সাহেব’। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন এই সাহেব দাদু। চাকরি জীবনে সরকারি অনেক বড় বড় পোষ্ট দক্ষতার সঙ্গে সামলেছেন। ফলে আদব-কায়দার মধ্যেও একটা সাহেব সুলভ আচরণ তার ছিল। কিন্তু রিটায়ার করার পর তার স্বভাবে বেশ কিছু পরিবর্তন দেখা যায়। চাকরি জীবনে উনি যতটা  ডিসিপ্লিন  মেনে চলতেন, অবসর নেবার পর সেই ডিসিপ্লিনকে ভঙ্গ করার ইচ্ছা ততটাই প্রবল হয়ে ওঠে।
কিন্তু ইচ্ছা করলেই তো সেটা প্রশ্রয় দেওয়া যায় না। বিশেষত সাহেব ঠাম্মির মত জাঁদরেল একজন প্রশাসক যখন আছেন। এক কথায় অবসরপ্রাপ্ত জীবনে সাহেব দাদু ছিলেন সম্পূর্ণভাবে সাহেব ঠাম্মির তত্ত্বাবধানে। কিন্তু সুযোগ পেলেই সাহেব দাদু বাধা নিয়মগুলো ভাঙ্গার তীব্র প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতেন।
আমার নিজের ঠাকুরদা ঠাকুরমা মারা যাবার পর ঠাকুরদার এই ছোট ভাই অর্থাৎ সাহেব দাদুই ছিলেন আমাদের গোটা পরিবারের অভিভাবক। সত্যি বলতে তিনি ছিলেন যথার্থই অভিভাবক। তার অভিভাবকত্বে আমাদের গোটা পরিবার তার কাছে ঋণী। তার বহু কীর্তির সাক্ষী আমাদের এই পরিবার। তাই আজ এই গভীর শোকের মধ্যে আজ থেকে ছাব্বিশ বছর আগে ঘটে যাওয়া এক কাহিনীর কথা বার বার মনে পড়ছে। আজ আপনাদের সেই কাহিনীটাই শোনাব।
সালটা ছিল উনিশ পঁচানব্বই। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে আমার বাবা ছিলেন দ্বিতীয়। আমরা থাকতাম দক্ষিণ কলকাতার হাজরাতে। বাবার বড় দাদা মানে আমার জেঠু তার পরিবার এবং অবিবাহিত ছোট দুই ভাই মানে আমার মেজো আর ছোট কাকাকে নিয়ে থাকতেন আমাদের পৈত্রিক বাড়ী হাওড়ার সাঁতরাগাছিতে। আর  বাবার ঠিক পরের ভাই মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার বড়ো কাকা পরিবার নিয়ে থাকতেন রাউরকেল্লায়।
অবিবাহিত দুই কাকার মধ্যে মেজ কাকা বিয়ে করতে একেবারেই রাজি ছিলেন না। কলেজ জীবনে কারোর কাছে আঘাত পেয়ে সারা জীবন অবিবাহিত থাকার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে ছিলেন। দাদু ঠাম্মি গত হয়েছে বেশ কয়েক বছর হল। কিন্তু বাকি ভাইরা মেজ কাকাকে হাজার বুঝিয়েও কোন লাভ হয় নি। আত্মীয়-স্বজন পাড়া-প্রতিবেশীরাও চেষ্টার ত্রুটি রাখিনি। কিন্তু লাভের লাভ কিছু হয় নি। কিন্তু এতে ছোট কাকার বিয়ের আয়োজনে বিলম্ব হয়ে যাচ্ছিল। তাতে ছোট কাকা যে মনে মনে ভীষণ রুষ্ট ছিলেন সেটা বলাই বাহুল্য।
শেষে নিপীড়িত ছোট কাকা নিজেই নিজের বিয়ে ঠিক করে বসলেন। আমাদের গোটা পরিবারই পণপ্রথা আর জাতপাতের ঘোর বিরোধী। ফলে ছোট কাকার পছন্দ করা পাত্রীকে মেনে নিতে কারোই কোন সমস্যা হল না। এক কথায় সবাই রাজী। রৈ রৈ করে বিয়ের আয়োজনে মেতে উঠল সবাই।
অনেকদিন পর আমাদের সেই পৈত্রিক বাড়িতে বিয়ে। তাই ছোট কাকার বিয়ে নিয়ে আমরা সবাই খুব উল্লাসিত। আমি,মা আর বাবা পোঁছালাম বিয়ের আগের দিন রাতে। কারণ ওই দিনই আমার মাধ্যমিকের শেষ পরীক্ষাটা ছিল।
বাড়িতে পৌঁছে দেখলাম আমরা বাদে সবাই চলে এসেছে। কাছের দুরের আত্মীয় স্বজন মিলিয়ে বিয়ে বাড়ী জমজমাট। ততক্ষণে রাতের খাবারের সময় হয়ে গেছিল। ঢুকতেই জেঠু বললেন “হাত মুখ ধুয়ে খেতে বসে যাও, তারপর শুনব পরীক্ষা কেমন হোল”। 
খাবারের জন্য আমি সন্ধ্যে থেকেই প্রস্তুত ছিলাম। তাই বসতে আর বিলম্ব করলাম না। জায়গা পেলাম - ঠিক সাহেব দাদুর পাশে। 
বয়স সত্তর অতিক্রম করা ব্যক্তির রাতের খাবারের বহর দেখে আমি তো অবাক। শুনেছিলাম উনি খেতে ভালোবাসেন। তাই বলে এত? কমপক্ষে চল্লিশটা লুচি তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চিকেন কসা।
একটা কথা বলা হয়নি। উনি কিছুদিন আগে ওনার ছেলের কাছে আমেরিকা গেছিলেন। ওখান থেকে উনি ওনার দাঁতগুলো বাঁধিয়ে এসেছেন। শুনেছি নকল দাঁতের পাটিটা এতটাই অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে বানানো যে এটা পড়লে যুবা বয়সে যা চেবানো সম্ভব ছিল না, তাও চেবানো যায়। সেই শোনা কথাটা যে একশ শতাংশ সত্যি তা তো আমি নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছি। শুধু এটাই বুঝতে পারছি না - এই দাঁত কি খিদে আর হজম শক্তিকেও বাড়ীয়ে দেয়? হয়ত হবে, নইলে এই বয়সে চল্লিশটা লুচি কেজি খানেক চিকেন কসা সহকারে রাতের খাবার সম্ভব নয়। আমি তো পনেরটার পরেই হাল ছেঁড়ে দিয়েছি।
মনে মনে সাহেব ঠাম্মি খুব রেগে যাচ্ছিলেন। কিন্তু সবার মাঝে দাদুকে শাসন করাটা অশোভন দেখাবে ভেবেই চুপ করে ছিলেন। সাহেব দাদুও সেই সুযোগ্যার সদ্ব্যবহার করছিলেন।
খাওয়া চলতেই চলতেই সাহেব ঠাম্মি দু’দুবার এসে সাহেব দাদুকে বলেছেন “রাত করে বেশী খেও না”। প্রতিবারই সাহেব দাদু উত্তর দিয়েছেন “না না আমি বেশী খাচ্ছি না। পুর পেট ভরে খাচ্ছি না। তোমাকে অতো চিন্তা করতে হবে না। আমি বুঝেই খাচ্ছি।” আমি শুধু অবাক হয়ে ভাবছি লোকটা পেট ভরে খেলে কতটা খেত।
পরের দিন খুব সকাল সকাল সবাই উঠে পড়লাম। রৈ রৈ করে দধিমঙ্গল, গায়ে হলুদ কাটিয়ে পৌঁছেগেলাম বিকালে। আমার বাবা আর সাহেব ঠাম্মি ছোটকাকাকে নিয়ে বরের গাড়িতে বেরিয়ে গেল। সাহেব দাদুরই যাবার কথা ছিল। কিন্তু তিনি দুপুরের খাওয়া খেয়ে আর বেরতে চাইলেন না। আসলে খাওয়াটা একটু বেশী হয়ে গেছিল। তাই না ঘুমিয়ে বেরতে চাইছিলেন না। কনে মানে হবু কাকিমার বাড়ী সেই উত্তর চব্বিশ পরগনার বেড়াচাঁপাতে। সাঁতরাগাছি থেকে বেড়াচাঁপা যেতে প্রায় তিন ঘণ্টা সময় লাগবে। বিয়ের লগ্ন সন্ধ্যেতে হওয়ায় বরের গাড়ী দুপুর তিনটের আগেই বেড়িয়ে গেছে। জেঠু তারা দিচ্ছিলেন যাতে বরযাত্রীর গাড়ীও বিকাল পাঁচটার মধ্যে বেরতে পারে। 

আমারা সবাই বেশ ব্যস্ত হয়েই সাজগোজ করছি। জেঠু আর জেঠিমা আমাদের সাথে যাবেন না, বাড়ীতেই থাকবেন। জেঠুর নারায়ণ শিলা আছে। আজ আবার পূর্ণিমা। এমনিতেই নারায়ণকে দুবেলা ভোগ না দিয়ে, সান্ধ্যা আহ্নিক না করে জেঠু কিছু খান না। আর তাছাড়া প্যান্ডেলের কাজ পুরো শেষ হয় নি। জেঠু দাঁড়িয়ে থেকে সেই কাজটা শেষ করাবে। এদিকে আমাদের সাজগোজ সম্পূর্ণ শেষ। ঘড়ীতেও পাঁচটা বেজে গেছে। কিন্তু বরযাত্রীর গাড়ী এখনও আসে নি। জেঠু খুব অস্থির হয়ে উঠেছেন। প্রায় সারে পাঁচটার সময় গাড়ীটা এলো। লাল রঙের বেশ বিলাসবহুল সুন্দর একটা বাস। কিন্তু গাড়ীর ড্রাইভারকে দেখে জেঠু ভীষণ রেগে গেলেন। “পাঁচু তুই কেন? মন্টু কোথায়? আর এত দেরিই বা হল কেন?” রোগা ছিপ ছিপে বেঁটে খাটো আমার থেকে তিন চার বছরের বড় পাঁচু চিরুনি দিয়ে তার ঝাঁকড়া চুলগুলো আছড়াতে আছড়াতে উত্তর দিল “মন্টুদার পেট খারাপ। বার বার বাথরুম যেতে হচ্ছে। তাই আমাকে পাঠাল। আমি সঙ্গে কোন হেল্পার পাচ্ছিলাম না বলে দেরি হচ্ছিল।” জেঠু বিস্ময়ে প্রশ্ন করলেন “কিন্তু তুই পারবি ঠিকঠাক চালাতে?” পাঁচু দৃঢ়তার সঙ্গে উত্তর দিল ”কেন পারব না? আমি তো এখন ফুল ড্রাইভার। লাইসেন্সও পেয়ে গেছি।” এই পাঁচু হল মন্টুদার হেল্পার। মন্টুদাই ওকে নিজের হাতে গাড়ী চালান শিখিয়েছে। মন্টুদা খুব ছোট থেকে ড্রাইভারই করছে। আমাদের এ বাড়ীর সঙ্গে ওর খুব ভাল সম্পর্ক। মাঝে মাঝে জেঠুর কোথাও যাবার হলে ওকে খবর দিলে ও এসে জেঠুর অ্যাম্বাসাডরটা চালায়। পাকা কথার দিন জেঠু আর বাবাকে মন্টুদাই অ্যাম্বাসাডরেই নিয়ে গেছিল বেড়াচাঁপাতে। বরযাত্রী গাড়ী মন্টুদাই জোগাড় করে নিজেই চালাবে বলে ছিল। তাই জেঠুও নিশ্চিন্তে ছিলেন। কারণ কন্যাপক্ষের বাড়ী ছোটকাকা ছাড়া জেঠু ,বাবা আর এই মন্টুদাই চিনত। তাই জেঠু পাঁচুকে আবার প্রশ্ন করলেন “তুই ঠিকঠাক চিনে যেতে পারবি?” পাঁচু মাথা ঝাঁকিয়ে উত্তর দিলে “হ্যাঁ হ্যাঁ, মন্টুদা আমাকে পুরো ছবি একে বুঝিয়ে দিয়েছে। এই দেখুন না।” সে পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে দেখাল। জেঠু দেখে বেশ খুশি হলেন। পাঁচু আরও বলল “রাস্তাটা এক দম সোজা। বেড়াচাঁপা বাজার থেকে ডান দিকে বেঁকে সোজা পুব দিকে। প্রাইমারী ইস্কুলের অপোজিটে-বিরাট উঠানয়ালা তিনতলা বাড়ী।” পাঁচুর কথায় আশ্বস্ত হয়ে জেঠু গাড়ি ছাড়ার পারমিশন দিলেন। বাস ছাড়ার পর বড় কাকা একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন “পৌছাতে পৌছাতে কটা বাজবে কে জানে?” গাড়ী ছাড়ার সাথে সাথেতেই বড় কাকা বাসের ভিডিও সেট এ হিন্দি সিনেমার গান চালিয়ে দিল। আমরা সবাই মজা করে দেখতে দেখতে চলেছি। কিন্তু কোনা এক্সপ্রেস আর এম-জি রোড এত জ্যাম ছিল যে গাড়ী প্রায় নড়তেই চায়না। তিন ঘণ্টা লাগল ওই দুটো রোড পেরতেই। এয়ারপোর্ট পর্যন্ত জ্যাম পিছু ছাড়ল না। তারপর জ্যাম কমলেও রাস্তার অবস্থা ভালো না হওয়ায় বাস স্পিড তুলতে পারল না। এগারোটা বেজে যাবার পর আমাদের সকলের মধ্যেই একটা ঝিঁমুনি ভাব চলে এসেছিল। সবার মুখে চোখে একটা ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি গোছের অভিব্যক্তি। “পাঁচু আর কতক্ষণ? তোর মন্টুদার ম্যাপ কি বলছে?” বিরক্তি ও ক্লান্তি মেশানো গলায় প্রশ্ন করলেন বড়কাকা। রাস্তার দিকে মুখ রেখেই পাঁচু উত্তর দিল “মাপ বলছে একটু পরই একটা বাজার পরবে আর সেটা থেকেই ডান দিক বেঁকে যেতে হবে। তারপর সোজা রাস্তা। একটা স্কুল পরবে তার পাশেই বিয়ে বাড়ী।” কথাটা শুনেই আমরা চল্লিশ জন বরযাত্রী জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে রাস্তার সামনে দেখতে দেখতে চললাম। কিছুক্ষণ পর একটু আলো ঝলমলে একটু জনবহুল একটা এলাকা আসতেই পাঁচু বলল “এই তো বাজার চলে এসছে। এই বার ডান দিক।” বাস ডান দিকে ঢুকে সোজা রাস্তায় চলতে শুরু করল। রাস্তার শুরুর দিকে কিছু বাড়ীতে আলো থাকলেও কিছুটা পর থেকে শুরু হল অন্ধকার। এখানে কি তবে লোডশেডিং চলছে। কিন্তু সেই স্কুল কোথায়? অন্ধকারে কি করে বুঝব? ঘড়িতে তখন পৌনে বারোটা। আরও খানিকটা যাবার পর দুরে দেখতে পেলাম একটা আলো ঝলমলে অনুষ্ঠান বাড়ী। “মনে হচ্ছে ঐ বাড়িটাই হবে।” হাসি হাসি মুখ করে বললেন বড় কাকিমা। বাস কাছাকাছি পৌছাতেই দেখলাম অনুষ্ঠান বাড়ীর লোকজন রাস্তা উপড়েই দাঁড়িয়ে আছে। ওরা হাত দেখিয়ে বাসটাকে পাশের মাঠের মধ্যে ঢুকতে বলল। আমরা খুব খুশি। যাক বাবা একটু দেরি হলেও অবশেষে পৌঁছলাম।

কনে পক্ষের একজন মোটা চেহারার সাদা চুলওয়ালা বয়স্ক লোকটি বলল “যখনই শুনলাম কল্যাণীতে একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে, তখনি ভেবেছিলাম আপনাদের দেরি হবে। আপনারা খুব জ্যাম পেয়েছেন তো?” বড় কাকা বললেন “সে আর বলতে।” কিন্তু সাহেব দাদু বিরক্তি নিয়ে বললেন “কি আশ্চর্য? কল্যাণীতে এক্সিডেন্ট হয়েছে বলে কোনা এক্সপ্রেসে জ্যাম? এই দেশটার কোন দিন উন্নতি হবে না।” সত্যি আমাদের কাছেও ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগছিল। বিয়ে বাড়ি ঢোকার মুখেই কনে পক্ষের সবাই আমাদের বলছে ব্যাচ ফাঁকা আছে আমরা যেন আগেই খেতে বসে যাই। রাত বারোটায় ব্যাচ ফাঁকা থাকাটাই স্বাভাবিক। এদিকে কিছুক্ষণ আগে কনে নাকি হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। বিয়ে এখন স্থগিত আছে। তাই বিয়ে শুরু হতে সময় লাগবে। তাই আমাদের খেতে বসে যাওয়াই ভাল। আমার মা সেই বয়স্ক লোকটির কাছে বাবা আর সাহেব ঠাম্মির খোঁজ করছিলেন। সেই লোকটি একটু আমতা আমতা করে বলল “বরের সাথে যারা এসেছিল, তাদের খাওয়া হয়ে গেছে।” সেই শুনে আমরা বিয়ের বাড়ীতে না ঢুকে মাঠের যে দিকে খাওয়া জন্য প্যান্ডেল করা হয়েছিল সেই দিকেই চললাম। বলাই বাহুল্য আমাদের প্রত্যেকের পেটেই ছুঁচোয় ডন মারছিল। তাই শুরুতেই সরাসরি খাওয়ার আমন্ত্রণে আমারা প্রত্যেকেই বেশ খুশী হলাম। বেশ আরাম করেই আমাদের খাওয়া দাওয়া চলছিল। কনে পক্ষ খুব যত্ন নিয়েই আমাদের পরিবেশন করছিলেন। পরিবেশক সবাই কনের আত্মীয় সজন বলেই মনে হল। পোশাকের উপর গামছা পরে হাতে বালতি নিয়ে পরিবেশন করছিলেন। খাবারের মেনু খুবই সাদামাটা। আমাদের সবার মনের মধ্যে একটা খটকা লাগছিল। শুনেছিলাম কনে বাড়ির আর্থিক অবস্থা খুবই উচ্চ প্রকৃতির। কিন্তু এই প্যান্ডেল, পরিবেশনের লোকজন এবং খাবারে মেনু কোনটাই আর্থিক প্রাচুর্যের পরিচায়ক ছিল না। মুরগি কিংবা পাঁঠা কোন প্রকারের মাংসই ছিল না। বলতে শুধুই কাতলা মাছ। সাহেব দাদু কিন্তু সব খাবারই খুব তৃপ্তি করে এক মনে খেয়ে চলেছেন। বলাবাহুল্য পাশে সাহেব ঠাম্মি না থাকায় খাবারের পরিমাণও বেড়ে চলেছে। এমন সময় একটা লোক একটা বড় থালায় রান্না করা একটা প্রকাণ্ড মাছের মাথা নিয়ে হাজির। বাবার সঙ্গে আমি প্রায়ই লেক মার্কেটে যেতাম। কিন্তু কোন দিন এত বড় মাছের মাথা দেখিনি। মাথাটা খুব কম হলেও তিন কেজি হবে। কনেপক্ষের সেই লোকটিই বলল “এটা আমাদের পাড়ার পুকুরের আজকের ধরা সব চেয়ে বড় মাছের। মাছটা বারো কেজি ওজনের। এটা শুধু মাত্র রান্না করা হয়েছে আপনাদের জন্য। কে খাবেন বলুন?” আমরা প্রায় সবাই এক সাথেই ঘাড় নেড়ে জানিয়ে দিলাম না আমরা কেউ খাব না। কিন্তু আমাদের এই সমবেত নায়ের মাঝে আর একটা গলার স্বর প্রকট হল “এটা কি জ্যান্ত মাছের মাথা?” ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি মাছের মাথাটার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছেন সাহেব দাদু। প্রশ্নটা উনিই করেছেন। কনে পক্ষের লোকটা বলল “এক দম জ্যান্ত মাছের। আমি নিজের হাতে ধরেছি। আপনি খান?”

“দাও দেখি” লজ্জা লজ্জা মুখে বললেন সাহেব দাদু। সাহেব দাদুর খাবারের এই রকম নমুনা দেখে আমরা সবাই বেশ চিন্তিত। আমার মা আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললেন "বাড়ির ভেতরে গিয়ে তোর সাহেব ঠাম্মিকে গিয়ে ডেকে নিয়ে আয় তাড়াতাড়ি। উনি ছাড়া সাহেব কাকাকে আটকানো মুস্কিল। সত্তর বছরে এই রকম খেয়ে বাসে এতোটা জার্নি করলে অবধারিত অসুস্থ হবেন। তখন বউভাতটাই মাটি হবে।" আমি ছুটলাম বাড়ির ভিতরে। কিন্তু কি আশ্চর্য বাবা বা সাহেব ঠাম্মি কাউকেই খুঁজে পেলাম না। সব চেয়ে অবাক হলাম বরের পোশাকে যে বসে আছে সে আমার ছোটকাকা নয়। কি যে হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার খুব ভয় করতে শুরু করেছে। কথাগুলো মাকে বলতেই মা বললেন “কেলেঙ্কারি কান্ড। তাড়াতাড়ি তোর বড় কাকাকে ডাক“। ইতি মধ্যে সাহেব দাদু বাদে সকলের খাওয়া হয়ে গেছিল। বড় কাকাকে পাওয়া গেল প্যান্ডেলের পিছনে হাত মুখ ধোয়ার জায়গায়। 

আমরা কিছু বলার আগেই দেখি পাঁচু বড় কাকাকে ডাকছে। সে আমাদের সঙ্গে খেতে বসে নি। সিগারেট ফুঁকতে গেছিল। পাঁচুর সঙ্গে একজন স্থানীয় লোক। বড় কাকা কাছে আসতেই পাঁচু বলল “কাকা, বিরাট একটা ভুল হয়ে গেছে। বারাসাতে আমি টাকি রোডে ঢুকতে গিয়ে ব্যারাকপুর রোডে ঢুকে গেছিলাম। আর বেড়াচাঁপা ভেবে নীলগঞ্জে ঢুকে গেছি। এটা না অন্য বাড়ি। আপনারা যে বাড়ি যাবেন এটা সেটা নয়।” স্থানীয় লোকটাকে দেখিয়ে পাঁচু আরও বলল “এই দাদার পাশেই মুদিখানা দোকান। উনি বললেন এদের বরযাত্রী কৃষ্ণনগর থেকে আসার কথা।

আসলে কল্যাণীতে বিরাট এক্সিডেন্ট হয়েছে তো - তাই হয়ত ওদের গাড়ী আসতে পারছে না। আমি রাস্তাটা পুরো বুঝে নিয়েছি। আপনারা গাড়ীতে উঠে পড়ুন। আমি এবার ঠিকঠাক নিয়ে যাব।” 
এতক্ষণ পর আমার সব কিছু একে একে দুই হল। বড় কাকা বললেন “ইশ, কি বিশ্রী ব্যাপার। চল্লিশটা প্লেট কি কম কথা? লজ্জায় ওদের সামনে যেতে পারব না।"
সেই পাড়ার লোকটি বলল "সত্যি বিশ্রী ব্যাপার। কারণ যখন এদের অ্যাকচুয়াল বরযাত্রী আসবে তখন এরা খেতে দেবে কি? একেই এনার মানে কনের বাবার আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। এই বিয়েটাই তো আমরা পাড়ার সবাই চাঁদা তুলে দিচ্ছি। এদিকে বরপক্ষ তো ত্রিশ হাজার টাকা পণ চেয়েছে। সে টাকা এখনও জোগাড় হয় নি।"
লোকটির কথা শুনে আমার প্রত্যেকের মন দুঃখে ভরে উঠল। আমি ছুটলাম সাহেব দাদুর কাছে। গিয়ে দেখি উনি তখনও সেই বিরাট সাইজের মাছের মাথাটাকে বাগে আনার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আমি কানের কাছে গিয়ে বললাম "দাদু, পাঁচু আমাদের ভুল করে অন্য বাড়িতে নিয়ে এসেছে। "
দাদু নির্বিকার চিত্তে বললেন "সেটা আমি খেতে বসেই বুঝেছি। কিন্তু এতো খিদে পেয়েছিল তাই আর মুখ খুলিনি। বুজলে ওরা মানুষ খুব ভালো। কি যত্ন করে খেতে বসাল। তাই আর ওদের কষ্ট দিতে মন চাইল না। " 
আমি বললাম "কিন্তু এখন যদি অ্যাকচুয়াল বরযাত্রী এসে পড়ে?"
উনি একটু বিরক্ত হয়ে বললেন "ওদের বেড়াচাপার নাম ঠিকানা দিয়ে ওখানে পাঠিয়ে দেব। আমাদের খাওয়াটা না হয় ওরাই খাক। "
এমন সময় বিয়ের আসর থেকে একটা কান্নার শব্দ শুনতে পেলাম। সঙ্গে খুব চেঁচামেচিও হচ্ছে।
সেটা শুনে দাদু বললেন "তুমি গিয়ে দেখত কি হচ্ছে। আমি মুড়োটা শেষ করে আসছি। আমাকে মুড়োটাকে একটু তৃপ্তি করে খেতে দাও।"
আমি আর কি বলব? আমি এবং আমাদের বাকি সবাই ছুটে গেলাম বিয়ের আসরের দিকে। পাঁচুর সঙ্গের পাড়ার লোকটি ঠিকই বলেছিল। কনের বাবার আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। দেখলাম মাটির ভিতওয়ালা একটা বেড়ার বাড়ীর উঠানে বড় একটা চাঁদোয়া টাঙিয়ে বিয়ের আসর বসেছে। 
আসরের ঠিক মাঝখানে একটা মোটা গোঁফওয়ালা লোক চোখ দুটো জবা ফুলের মতো লাল করে উপস্থিত জনতার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করছেন। আর মনে মনে গজগজ করে চলেছেন। ওনার সামনে একটা বয়স্ক লোক এবং একজন মহিলা হাঁটু গেঁড়ে হাত জোড় করে ওনার কৃপা পাওয়ার আসায় বসে আছে। মহিলাটি হাউহাউ করে কেঁদে চলেছেন।
দুতিন মিনিট দাঁড়ানর পর উপস্থিত জনতার ফিসফিস কথাবার্তায় এই ঘটমান নাটকের কাহিনী বোধগম্য হল। হাঁটু গেঁড়ে বসে থাকা মানুষ দুটি কনের বাবা ও মা। আর ঐ গুঁফো লোকটা পাত্রের বাবা।
পাত্রপক্ষ ত্রিশ হাজার টাকা পণ চেয়েছিল। কিন্তু কন্যাপক্ষ বিশ হাজার জোগাড় করতে পেরেছে। কিন্তু বাকি দশ হাজার বলেছে সামনের এক বছরের মধ্যে শোধ করে দেবে। এতেই পাত্রের বাবা ভীষণ রেগে গেছেন। তিনি এখনই পাত্রকে নিয়ে চলে যাবেন। মেয়ের বাবা মা আত্মীয় সজন এমনকি পাড়া প্রতিবেশীরাও ক্রমাগত অনুরোধ করেছে বিয়েটা সম্পন্ন করতে। কিন্তু পাত্র এবং পাত্রের বাবা দুজনেই তাদের সিদ্ধান্তে অনড়। 
পাত্রের বাবা হুঙ্কার দিয়ে বলল  "এখন একটা বাজে। রাত দুটোয় একটা লগ্ন আছে। এই এক ঘন্টার মধ্যে যদি দশ হাজার টাকা জোগাড় করতে পারেন তো ঐ লগনে মেয়ের বিয়ে হবে। নইলে নয়। এটাই আপনাদের লাস্ট চান্স। নয়ত আমি ছেলে নিয়ে চলে যাবো। আর কোন চান্স দেব না। "
ক্লাস নাইনে আমাদের সিলেবাসে রবীন্দ্রনাথের দেনাপাওনা ছিল। প্রতিবার পড়লেই মনটা কষ্টে ভরে উঠত। নিজের মনকে সান্ত্বনা দিয়ে বলতাম। বাস্তবে এতো নিষ্ঠুর কোন ছেলের বাড়ীর লোক হবে না। সাহিত্যের খাতিরে হয়ত রবীন্দ্রনাথ একটু রং চড়িয়ে লিখেছেন। আজ এই খানে দাঁড়িয়ে নিজের মনকে দেওয়া সেই সান্ত্বনা কর্পূরের মতো উবে গেল। তাও তো দেনাপাওনায় অন্তত পাত্র বিয়ে করতে রাজি হয়েছিল। এই ক্ষেত্রে তো সেটাও নয়। 
কাঁদো কাঁদো গলায় কনের বাবা বলল "এক ঘণ্টায় অতো টাকা কোথায় পাব তালোয় মশাই। একটু মেয়েটার কথা ভাবুন। আপনি বিয়েটা করিয়ে দিন। আমি যত তাড়াতাড়ি পারি টাকাটা শোধ করে দেব। "
পাত্রের বাবা হাত নেড়ে, শরীর ঝাঁকিয়ে বলল "ওসব ধার বাকির মধ্যে আমি নেই। আমি এক কথার মানুষ। টাকা ফেললে বিয়ে হবে। নইলে হবে না।"
"আপনি এতো নিষ্ঠুর কেন বলুন তো। ছেলে কি আপনার ব্যবসার জিনিস যে দর দাম করছেন।" যিনি এই কথাগুলো বললেন তার গলার স্বর শুনে আমাদের পক্ষের সবাই বেশ হতচকিত হয়ে উঠল। কারণ কথাগুলো বলেছেন সাহেব দাদু। 
পাত্রের বাবা তো বটেই সেই সঙ্গে কনের বাবা মাও হতচকিত হয়ে উঠল।
পাত্রের বাবা কর্কশ গলায় বলল "কে আপনি? এতো জ্ঞান মারছেন কেন?"
আমার শান্ত স্বভাবের মেজো কাকু পাত্রের বাবার এই রকম অভদ্র আচরণে তীব্র রেগে তেড়ে গিয়ে বললেন "মুখ সামলে কথা বলবেন।"
সাহেব দাদু মেজো কাকাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন - "শুনুন মশাই। আমার জ্ঞান আছে তাই মারছি। আপনার মতো অজ্ঞানী নির্লজ্জ নই। আমি কনের দূরসম্পর্কের জ্যাঠা। আপনার টাকা আমি দিচ্ছি।"
সাহেব দাদু নিজের পাঞ্জাবির গলা থেকে সোনার চারটি বোতাম খুলে পাত্রের বাবার হাতে দিয়ে বললেন "এর দাম বিশ হাজার টাকার বেশী হবে। নিন এবার বিয়েটা শুরু করান।"
পাত্রের বাবা সেই একই রকম কর্কশ গলায় বলল "আমাকে কি বোকা পেয়েছেন। এসব ইমিটেসন নিয়ে আমি বিয়ে করাতে রাজি হয়ে যাবো?"
মেজো কাকু আবার রেগে বললেন "কাকে কি বলছেন আপনি জানেন? এগুলো ইমিটেসন কেন হতে যাবে। পিওর গোল্ড।"
পাত্রের বাবা বলল "আমি ক্যাশ চাই। নইলে আমরা যাচ্ছি।"
সাহেব দাদু এবার খুব রেগে গেলেন। কনের বাবার দিকে তাকিয়ে বললেন "এই রকম কসাইকে কোথা থেকে জোটালেন আপনারা। এরা তো আপনার মেয়েকে নিয়ে গিয়েও শান্তিতে রাখবে না।"
ভিড়ের মধ্যে থেকে কয়েক জন দাদুকে সায় দিয়ে বলল "ঠিকই বলেছেন। নিয়ে গিয়ে কারণে অকারণে বাপের বাড়ী থেকে টাকা আনার জন্য আবার চাপ দেবে।"
অন্যরা বলল "হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক। সেটাই করবে।"
এসব শুনে পাত্রের বাবা রেগে বলল "আমারা এতো খারাপ হলে আমরা তাহলে চলে যাচ্ছি?"
ভিড়ের মধ্যে থেকে সেই মোটা সোটা চেহারার সাদা চুলওয়ালা বৃদ্ধ লোকটি বলল "শুধু মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে আমরা আপনার এই বেয়াদপি সহ্য করছি। নইলে অনেক আগেই আপনার চলে যাবার ব্যবস্থা করে দিতাম। এক্ষণিই হাতের কাছে একটা ভালো ছেলে পেলে আপনার বেয়াদপির যোগ্য জবাব দিয়ে দিতাম।" 
বৃদ্ধ লোকটি সাহেব দাদুর দিকে তাকিয়ে বলল "বুঝলেন মশাই মেয়েটার গায়ের রং একটু চাপা আর গরিব ব্রাহ্মণ ফ্যামিলি। তাই সহজে পাত্র খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। শেষে এরা রাজি হওয়াতে আমরা গ্রামের সবাই চাঁদা তুলে মেয়েটার বিয়ের ব্যবস্থা করছিলাম। আর এই সুযোগে এই লোকটি কসাইয়ের মতো ব্যবহার করে চলেছে।"
সাহেব দাদু মেজো কাকার দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন "বিজন বাবা, আর বৈরাগী হয়ে থাকিস না। এই দুঃখী মেয়েটাকে এই কসাইদের হাত থেকে তুই বাঁচা। আজ এই অভাগা মেয়েটাকে তুই উদ্ধার কর।"
এই রকম আচমকা অনুরোধে মেজো কাকা কেমন থতমত খেয়ে বললেন "আমি কি করব?"
আমার মা আর বড়ো কাকিমা এগিয়ে এসে বললেন "হ্যাঁ হ্যাঁ তুমিই পারবে। রাজি হয়ে যাও ঠাকুরপো। আর অমত কর না। এই মেয়েটার কথা ভাবো।"
ইতিমধ্যে বড়ো কাকা বরের মাথা থেকে টোপরটা খুলে মেজো কাকার মাথায় পড়িয়ে দিয়ে বললেন "এই তো বেশ মানিয়েছে।" 
উপস্থিত সবাই তীব্র কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে আছে এই সমস্ত কর্মকাণ্ডের দিকে। সাহেব দাদু তখন আমাদের বিস্তারিত পরিচয় দিয়ে, পাঁচুর দিকভ্রান্ত হয়ে এই বাড়িতে এসে পড়ার পুরো কাহিনী বর্ণনা করলেন। 
সাহেব দাদুর এই মেজো কাকাকে পাত্র করার প্রস্তাবে কনের বাবা- মা আনন্দে দাদুর সামনে কেঁদে ফেললেন।
আপনারা হয়তো ভাবছেন গল্পটা এখানেই একটা হ্যাপি এন্ডিং হয়ে গল্পের নটে গাছটি এখানেই মুড়িয়ে গেল। না, একেবারেই সেটা হল না। কেন হল না সেটাই এবার বলছি। 
আমরা বেশ আনন্দে ছিলাম অবশেষে মেজো কাকার আইবুড়ো নাম ঘুচলো। একটা নির্ভেজাল আনন্দের আবেশে আমারা সবাই বেশ মজেছিলাম। 
হঠাৎ বিদ্রোহীর ভঙ্গিতে মেজো কাকা বললেন "তোমরা মেয়েটির মতামত নিচ্ছ না। এক তরফা ডিসিশন নিচ্ছ। এটা খুব অন্যায় হচ্ছে। আমি মেয়েটির সঙ্গে কথা বলতে চাই।"
সাহেব দাদুও দেখলাম তাতে সায় দিলেন। বললেন "হ্যাঁ, বিজন ঠিকই বলেছে। আমিও মেয়েটির সাথে কথা বলতে চাই।"
অমনি কনের মা-বাবা দুজনেই তড়িঘড়ি  বলল "ওর মতামত মানে আমাদের মতামতই। মেয়ে আমার বড় বাধ্য।"
সাহেব দাদু বললেন "তবু মেয়ের সাথে একবার কথা হওয়া দরকার।"
সবাই তখন চলল কনে অসুস্থ হয়ে যে ঘরে ছিল সেই ঘরের দিকে। ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। 
কয়েকজন পাড়া প্রতিবেশী দরজায় ঠকঠক করে ডাকতে লাগল "এই মিনা, মিনা"।
এত কোলাহলের মধ্যে একটা জিনিসই খারাপ লাগলো। হঠাৎ কনের মা আমার কানের কাছে এসে জিজ্ঞাসা করল- "বাবা, তোমার দাদু বললেন তোমাদের টাইটেল রায়। তা তোমরা কি ব্রাহ্মণ না কায়স্ত?”
আমরা ব্রাহ্মণ জেনে ভদ্রমহিলা খুব স্বস্তি পেলেন। কিন্তু ওদিকে কনের ঘরের সামনে বেশ ভিড় জমে গেছে। অনেক ডাকাডাকির পরেও কনে কিন্তু দরজা খুলল না। উপস্থিত সকলের মুখে চোখে তখন এক অজানা আশঙ্কার ছাপ। 
সাহেব দাদু বললেন "ব্যাপারটা ভালো ঠেকছে না। দরজা ভেঙ্গে ফেলুন।"
সঙ্গে সঙ্গে কিছু লোকজন সম্মিলিত ভাবে দরজায় গুরুতর রকমের ধাক্কাধাক্কি করে দরজা ভেঙ্গে ফেলল। দরজা ভেঙে ঢুকতেই এক মর্মান্তিক দৃশ্য আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠলো। কণে অচৈতন্য অবস্থায় পরে আছে। তার মুখ থেকে সাদা ফেনার মতো কিছু বেরিয়ে আসছিল। 
তীব্র আশঙ্কায় সাহেব দাদু চেঁচিয়ে উঠলেন "এ তো বিষ খেয়েছে মনে হচ্ছে। এখনি হসপিটাল নিয়ে যেতে হবে।"
ঘটনার আকস্মিকতায় উপস্থিত সকলে দিশেহারা হয়ে পড়ল। কণের বাবা-মা "ওরে মিনা, এ তুই কি করলি" বলে তীব্র কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। 
পাড়ার কিছু লোক কনেকে নিয়ে হসপিটালে ছুটল। পিছন পিছন আমরাও ছুটলাম।
এদিকে বরপক্ষের বাড়ির লোকদের অবস্থা খুব খারাপ। পাড়ার লোক তাদের এই মারে তো সেই মারে। সাহেব দাদু বললেন "এদেরকে ধরে রাখুন। আগে মেয়েটার চিকিৎসার ব্যবস্থা করে আসি। তারপরে এদের পুলিশে দেবার ব্যবস্থা করছি।"
সেদিনের অবশিষ্ট রাতটুকু আমাদের হসপিটালের সামনেই কাটল। হসপিটালে পৌঁছাতেই ডাক্তার বাবুরা কনের মুখ দিয়ে পাম্প করে সমস্ত পাকস্থলী ওয়াশ করল। সমান তালে চলল স্যালাইন আর ইনজেকশন। শেষে ভোরের দিকে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হল। কনেকে ভর্তি করে নেয়া হল। কিন্তু কনে তখনও অচৈতন্য। ডাক্তার বাবুরা বলল "বিষক্রিয়া কাটলেই জ্ঞান ফিরবে।"
কনের জ্ঞান ফিরে আসার প্রতীক্ষায় প্রায় শ'দুয়েক লোক হসপিটালের চাতালে বসে রইলাম। পাড়া প্রতিবেশীদের নিজস্ব কথোপকথনে জানতে পারলাম আরও এক করুণ কাহিনী।
মেয়েটি একটি ছেলেকে ভালবাসত। সে নিচু জাত হওয়াতে তাকে বাড়ির লোক মেনে নেয়নি। এমনকি প্রেমিক ছেলেটিকে বিশ্রীভাবে অপমান করে পাড়া থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে কনের বাবা-মা এবং তাদের বেশ কিছু ক্ষমতাবান আত্মীয় স্বজন।
সেই মোটা সোটা চেহারার সাদা চুলওয়ালা বৃদ্ধ লোকটি সাহেব দাদুকে জানাল - 

"একে তো মেয়েটির এই বিয়েতে মত ছিল না। তার উপর সকলের সামনে পাত্রপক্ষের এই অপমান - মেয়েটা নিতে পারেনি। ওর মা বাবা যদি এই সব জাতপাত না নেমে যদি ওই ছেলেটির সঙ্গে বিয়ে দিত - তাহলে হয়ত মেয়েটা সুখীই হত। "
কথাগুলো শুনে সাহেব দাদু খুবই কষ্ট পেলেন। উনি নিজে গিয়ে কনের মা বাবকে অনেক করে বোঝালেন। শেষে ওনারা সাহেব দাদুকে কথা দিল - মেয়ে সুস্থ হয়ে উঠলে ওনারা মেয়ের সেই প্রেমিকের সাথেই বিয়ে দেবে।ৎ
সাহেব দাদু বললেন "তবে আর শুভ কাজে দেরি কেন? ছেলেটিকে ডেকে আনুন। এই মণ্ডপেই শুভ কাজ সম্পন্ন করে তবেই আমরা এখান থেকে বিদায় নেব।"
পাড়া-প্রতিবেশীরাও সাহেব দাদুর কথায় খুব খুশী হল। তারাই সেই প্রেমিককে খুঁজে বার করে হসপিটালে নিয়ে এলো।
ওদিকে বর এবং তাঁর বাবা দুজনেরই সুমতি ফিরেছে। তারাও এখন পনের অবশিষ্ট টাকা ছাড়াই মেয়েটিকে বিয়ে করতে রাজী।
আমি মেজো কাকার দিকে তাকিয়ে দেখলাম - তিনিও বেশ চিন্তিত। কিন্তু হঠাৎ নার্স এক ভয়ঙ্কর খবর দিয়ে গেল। কনের বাড়ীর লোককে ডাক্তার ডেকে পাঠিয়েছে - হঠাৎ করে কনের ব্লাড প্রেশার নামতে শুরু করেছে। পালস রেটও কমে যাচ্ছে ক্রমশ। 
আমরা সবাই খুবই উদ্বিগ্ন। সবাই মনে মনে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করছিল। কিন্তু কনের শারীরিক অবস্থা ক্রমাগত খারাপের দিকে এগোতে লাগলো। শেষে বেলা এগারটা নাগাদ আমাদের সবাইকে নিদারুণ কষ্টের মধ্যে রেখে মেয়েটি আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে গেল।
একটা সমবেত কান্নার রোল উঠল হাসপাতাল চত্বরে। আমরা এদের কাউকে চিনতাম না। কিন্তু এই কয়েক ঘণ্টার আলাপেই মেয়েটির মৃত্যুতে আমাদের মন একটা স্বজন হারানোর বেদনায় শোকার্ত হয়ে উঠল। 
আমার মা বললেন "ভাগ্যের কি পরিহাস না? কাল রাতে মেয়েটাকে বিয়ে দেবার জন্য কতো কাকুতি নিমতি। আর আজ তিন তিনটে ছেলে মেয়েটাকে বিয়ে করতে রাজী। অথচ মেয়েটাই নেই।"
মেয়েটিকে শেষ যাত্রায় বিদায় করে আমারা যখন বাসে উঠলাম সূর্য তখন অস্তাচলে। 

প্রবন্ধ

বিবেক চেতনায়

 মার্চ ২০২২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

বিবেক চেতনায়

জাগ্রত মন

মনোরঞ্জন সাঁতরা 

swamibibek.jpg

স্বামী বিবেকানন্দ ভারতের সুপ্ত চেতনাকে তার শান্তি ও ভ্রাতৃত্বের বাণী দিয়ে জাগ্রত করেছিলেন। তিনিই প্রথম ভারতীয় যিনি বেদান্ত ও যোগ দর্শন পাশ্চাত্যে প্রচার করেন। উত্তর কলকাতার সিমলা এলাকার দত্ত পরিবারের ছেলে নরেন্দ্র নাথ দত্তই হয়েছিলেন পরবর্তী জীবনে স্বামী বিবেকানন্দ।
তার জন্ম ১৮৬৩ সালের ১২ই জানুয়ারি। মা ভুবনেশ্বরী দেবী এবং বাবা বিশ্বনাথ দত্ত দুজনেরই যথেষ্ট প্রভাব ছিল তাঁর জীবনে।

কলকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজে কিছুদিন পড়াশোনা করার পর স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে স্নাতক পাশ করেন তিনি। পাশ করার ঠিক দুবছর আগে আঠারো বছর বয়সে তিনি যোগসাধক ও দার্শনিক রামকৃষ্ণ পরমহংসের সান্নিধ্যে আসেন। স্বামী প্রভানন্দ কথায়  খুব অল্প বয়স থেকেই বিবেকানন্দের কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য দেখা গিয়েছিল।রামকৃষ্ণ পরমহংসের সান্নিধ্য বিবেকানন্দের জীবন দর্শনকে পুরোপুরি বদলে দেয়। এর মধ্যে কিছু ছিল তাঁর জন্মলব্ধ আর কিছু তিনি যে পরিবেশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তার অবদান। কিন্তু তাঁর জীবনে সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন এনেছিলেন রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব।

বিবেকানন্দের সঙ্গে রামকৃষ্ণের যোগাযোগের সময়কাল ছিল মাত্র পাঁচ বছর।

প্রথমদিকে নরেন্দ্রনাথ রামকৃষ্ণ পরমহংসকে গুরু বলে মেনে নিতে অস্বীকার করেছিলেন। এমনকি তার চিন্তাভাবনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ প্রকাশও করেছিলেন। কিন্তু রামকৃষ্ণ পরমহংসের ব্যক্তিত্বের প্রতি পরে তিনি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হন ও তাঁকে গুরু হিসাবে মেনে নেন।

স্বামী প্রভানন্দ বলেছেন এই অল্প সময়ে গুরু শিষ্যের মধ্যে যেরকম সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, সেটা ছিল খুবই বিরল: "দুজন দুজনকে নানাভাবে যাচাই করে দেখেছেন।"
রামকৃষ্ণের মৃত্যুর পর ব্রিটিশ ভারতের আর্থ সামাজিক অবস্থা দেখার জন্য স্বামী বিবেকানন্দ প্রায় পাঁচ বছর সারা ভারত ঘুরে বেড়ান।
তাঁর ভারত ভ্রমণের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তিনি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরেছিলেন এবং সেসব জায়গায় শিক্ষিত, অশিক্ষিত, ধনী, নির্ধন সর্ব শ্রেণীর মানুষের সঙ্গে মিশেছিলেন। যার ফলে তাঁর চরিত্রে অসাধারণ কিছু গুণ এসেছিল। তাঁর জীবনদর্শন পরিপুষ্টতা লাভ করেছিল। এই সব কিছু নিয়েই গড়ে উঠেছিলেন বিবেকানন্দ।

তাঁর ভারত ভ্রমণের সময় বিবেকানন্দ সন্ন্যাসীর মত প্রধানত ভিক্ষা করে জীবনধারণ করতেন এবং মূলত পায়ে হেঁটে, আর কখনও বা অনুরাগীদের কেটে দেওয়া টিকিটে রেলপথে ভ্রমণ করতেন।বিবেকানন্দ সারা জীবন ভারতীয় সঙ্গীতের একান্ত অনুরাগী ছিলেন। নিজে গান গাইতেনও ভাল।

মাত্র ২৩ বছর বয়সে তিনি সন্ন্যাসী হবার সঙ্কল্প গ্রহণ করেন। বিবেকানন্দ শিকাগো ধর্মসভায় তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ যখন দেন তাঁর বয়স তখন তিরিশ। ১৮৯৩ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর ওই বিশ্ব ধর্ম মহাসভায় তিনি ভারত ও হিন্দুধর্মের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। শিকাগো ধর্মসভায় তাঁর বক্তৃতা ব্যাপক সাড়া ফেলে দেয়। এরপর তিনি আমেরিকা, ইংল্যাণ্ড ও ইউরোপে হিন্দু দর্শনের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে অসংখ্য সাধারণ ও ঘরোয়া বক্তৃতা দেন এবং ক্লাস নেন।

দু-বার তিনি ইংল্যাণ্ড ভ্রমণ করেন ১৮৯৫ এবং ১৮৯৬ সালে এবং সেখানে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় এক আইরিশ নারী মিস মার্গারেট নোবেলের, যিনি পরে পরিচিত হন ভগিনী নিবেদিতা নামে। বছর দুয়েকের মধ্যে তিনি কলকাতায় চলে আসেন স্থায়ীভাবে এবং স্বামী বিবেকানন্দের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।
বিবেকানন্দ ১৮৯৭ সালের পয়লা মে আনুষ্ঠানিকভাবে রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠা করেন। শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিস্তার এবং চিকিৎসা ও দাতব্যকাজের মধ্যে দিয়ে জনগণের সেবার লক্ষ্য নিয়ে তৈরি হয়েছিল এই সামাজিক-ধর্মীয় আন্দোলন।
লেখক ও গবেষক, অধ্যাপক শঙ্করীপ্রসাদ বসুর মতে স্বামী বিবেকানন্দ শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছিলেন শুধু বাংলায় বা ভারতবর্ষে নয়, সারা পৃথিবীতে।
ত্যাগে, তপস্যায়, আনন্দে, যন্ত্রণায়, মানুষের প্রতি ভালবাসায় তিনি উন্মোথিত ছিলেন। ভারতবর্ষের ইতিহাসে তিনি বেদান্ত ভিত্তিক সেবাধর্মের প্রবর্তন করেন। সেবা হয়ে আসছে অনেকদিন ধরে। কিন্তু মানবসেবাকে একটা ধর্মসত্য রূপে উপস্থিত করেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ।
"তাঁর বিখ্যাত উক্তি ছিল -বহুরূপে সম্মুখে তোমার, ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর, জীবে প্রেম করে যেইজন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর।"
বিবেকানন্দ ভারতের সর্বব্যাপী দারিদ্রের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছিলেন, এই দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্যই ভারতে জাতীয় নবজাগরণের প্রয়োজন আছে।
স্বামী বিবেকানন্দকে নিয়ে গবেষণা করেছেন সাহিত্যিক শঙ্কর। বিবেকানন্দের উচ্চ চিন্তাধারা, আধ্যাত্মিক জ্ঞান ও সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতা অনেক মানুষের জন্য প্রেরণা হিসাবে কাজ করেছে বলে তিনি মনে করেন।
বিবেকানন্দের জীবন আমার মনে হয় আমাদের মত সাধারণ মানুষের জন্যে বেঁচে থাকার একটা ওষুধ। সমস্ত প্রতিকূল অবস্থার বিরুদ্ধে কী করে আত্মপ্রকাশ এবং আত্মবিকাশের চেষ্টা করা যায় তা তিনি দেখিয়ে গেছেন। মাত্র উনচল্লিশ বছরে তাঁর জীবনাবসান হয় ১৯০২ সালের চৌঠা জুলাই।

ঘন্টাকর্ণ

গল্প

 মার্চ ২০২২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

ঘন্টাকর্ণ
চন্দন চ্যাটার্জি

thief.jpg

তার আসল নাম ঘন্টেশ্বর দাস। কিন্তু লোকে তাকে ঘন্টাকর্ণ বলে বেশি জানে। মোটা গোলগাল চেহারা, গায়ের রঙ কাল, থাকে বাগবাজার এলাকায়। বাগবাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পাঠ শেষ করে, শ্যামবাজার এস. ভী. ইন্সটিটিউশন থেকে উচ্চমাধ্যমিক পড়েছে। তার বাবা ব্যাঙ্কশাল কোটের মুহুরী। আসলে কোটের সামনে ঢুকতে গেলে কিছু লোক আছে যারা চারদিক থেকে ঘিরে ধরে, এবং বিভিন্ন প্রশ্নের বাণে জর্জরিত করে, যেমন কি দরকার আছে এভিডেভীট করবেন? স্ট্যাম্প পেপার লাগবে? নোটারি করার আছে? তা হলে আমার সঙ্গে আসুন। ঘন্টেশ্বরের পিতা হচ্ছে এদের মধ্যে একজন। কাজেই তার যে রোজগার খুব একটা বেশি নয় সেটা বলাবাহুল্য বাড়িটা নিজেদের তাই কোনরকমে খাওয়া পরা চলে যায়। বাড়িতে ও তার বাবা-মা থাকে। স্কুল স্পোর্টসে সে প্রায় সব ইভেন্টে নাম দিতো। ১০০ মিটার রেসেতে সবাই যখন কমপ্লিট করত ও তখন অর্ধেক রাস্তা পার করতে পারে না। এটা  তার ভারী  শরীর যেমন একটা কারণ তেমনি শ্বাস প্রশ্বাসের সমস্যাও একটা কারণ। ঘণ্টাকর্ণ কখনোই নিশ্বাস প্রশ্বাসকে বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারে না। একবার তো ওয়েট লিফটিংএর সময় পিছন থেকে তার প্যান্ট ছিড়ে যায় তাও সকলের সামনে সে বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। অবশ্য তখন সে ক্লাস সিক্সে পড়তো। যদি কেউ ওকে বলতো তুই তো কোন বছর কোন স্পোর্টস ইভেন্টে কোন রেঙ্ক করতে পারিস না, তা হলে সব ইভেন্টে নাম দিস কেন। তখন সে একটা খুব সুন্দর জবাব দিত ইভেন্টে অংশ নেওয়াটাই বড় কথা, হারি জিতি সেটা বড় কথা নয়, আজ হারছি কিন্তু অন্যদিন হয়তো জিতবো। হ্যাঁ এটাকেই বলে স্পোর্টসম্যান স্প্রিরিট।
এত সবের মধ্যে তার অংকের মাথা ছিল অত্যন্ত পরিষ্কার। 
ক্লাসের ছেলেরা যখন সাতের নামতা মুখস্ত বলতে হোঁচট খায় ও তখন সতেরও আঠারও এমনকি কুড়ি পর্যন্ত নামতা এক নাগাড়ে বলে যেতে পারত। এইজন্যে অংকের টিচার বাসুদেববাবুর খুব প্রিয় ছাত্র ছিল। ও যখন ক্লাস এইটে পড়ত তখন ক্লাস নাইনের অংক করতে পারত। ওর মনে হতো যেন অংকের বই দরকার আর অন্যসব বইয়ের কোন দরকারই নেই, বিশেষ করে ইতিহাস। ইতিহাস বইটা তার কাছে একটা জঞ্জাল ছাড়া কিছু নয়। কে কোন খ্রিস্টাব্দে কি কাজ করেছে তার ফল কি হয়েছে সেইটা আজকে জেনে কি লাভ আছে। আমরা তো সামনের দিকে এগোছি। তাহলে ইতিহাস পড়ে পিছনের দিকে তাকাবার কি দরকার। এ বিষয়ে সে তো একবার ইতিহাস স্যারকে প্রশ্ন করেছিল। স্যার বলেছিলেন তোকে যদি নম্বর পেতে হয় তাহলে এটা তোকে জানতে হবে। তাছাড়া ইতিহাস পড়লে তুই পূর্বপুরুষদের কথা তাদের ধ্যানধারণা, চিন্তাধারা এগুলো জানতে পারবি। এটা না জানলে তুই ভবিষ্যতে চলবি কি করে। যাইহোক এইকথা তার কিন্তু মনে ধরে নি। 
অংক দিয়ে সে অনেক সময় অনেককে বোকা বানিয়ে দিয়েছে। তার দু একটা উদাহরণ বলতে পারি। একবার সায়েন্স টিচার আসার আগে সে ব্ল্যাকবোর্ডে দুটো সমীকরণ করে রেখে ছিল কতকটা এইরকমঃ
যদি      0  =  0                                          বা,  1   =  1 X 4
বা,    1 X 0   =  1 X 0                                বা,   1  =  4
বা,   1 X (2-2)   =  1 X (4-4)                    এইটা কি ঠিক  ?
বা,   1 X (2-2)   = 1 X { (2)2 - (2)2}         আর একটা ছিল
বা,   1 X (2-2)   = 1 X (2-2)(2+2)            যদি -2 > -3
                 1 X (2-2)(2+2)                     বা, -2 X-2 > -3 X-2
বা,    1  = ---------------                          বা, 4 >6
                      (2-2)
বা,   1   =   1 X (2+2)                               এইটা কি ঠ

বিজ্ঞানের টিচার  তো এটা দেখে প্রথমে রেগে গেলেন পরে ঘণ্টাকর্ণের বুদ্ধির তারিফ করে ছিলেন।আরেকবার একটা চায়ের দোকানে বসে, বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা দিছিল সে একটা প্রবলেম তৈরি করে সেটা সকলকে জানাল।
সেইটা এরকম কোন একটা রেস্টুরেন্টে খাবারের জন্য তিন বন্ধু ঢুকলো খাওয়ার শেষে ওয়েটার তাদের বিল দিল। তিরিশ টাকা হয়েছে। প্রত্যেকে দশ টাকা করে ওয়েটারকে দিল। ওয়েটার তিরিশ টাকা ম্যানেজারবাবুকে দিল। ম্যানেজারবাবু একটু দেখে বললেন আরে ভুল হয়ে গেছে এতে পঁচিশ টাকার বিল হবে। তখন তিনি পাঁচ টাকা ফেরত দিয়ে দিলেন ওয়েটারকে। ওয়েটার ভাবল পাঁচ টাকা কিভাবে তিন জনের মধ্যে কিভাবে ভাগ করব। তার থেকে আমি দুই টাকা নি, বাকি তিন টাকা ওদেরকে ফেরত দি। ওরা এক টাকা করে পাবে।এখন প্রশ্নটা হল তিনজন লোক এক টাকা করে ফেরত পেয়েছে। তাহলে তারা নয় (9) টাকা করে দিয়েছে। নয় গুনিতক তিন হল সাতাশ টাকা, তার কাছে আছে দুই টাকা তাহলে উনতিরিশ টাকা। কিন্তু বিল ছিল তিরিশ টাকার। তাহলে এক টাকা গেল কোথায়।
এটা যখন চায়ের দোকানে সবাইকে বলেছিল তখন অনেকেই মাথা চুলকে ছিল, লোকে বলেছিল অংকটা ভুল আর কেউ নানা রকমের উত্তর দিয়ে ছিল। এইরকম ছিল তার বুদ্ধি।
কিন্তু বর্তমান যুগে কোন একটা সাবজেক্টে বেশি নাম্বার পেলে ফার্স্ট হওয়া যাবে না, অনান্য সাবজেক্ট গুলো সমানভাবে পড়তে হবে এবং ভালো নাম্বার তুলতে হবে। তবেই ফার্স্ট হতে পারবে। সেইজন্য সে কখনোই ফার্স্ট হতে পারে নি তবে প্রথম দশ জনের মধ্যে তার নাম থাকত। তার বাবার রোজগার ভালো নয় তাই সে মাধ্যমিক পরীক্ষার পর থেকেই প্রাইভেট টিউশনি করত। ছোট ছোট ছেলেদের অংক শেখাত। এইভাবে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র কলেজে আর্টস নিয়ে ভর্তি হয়। কিন্তু সে গনিতকে স্পেশাল সাবজেক্টে রাখল। কারণ যদি গণিতের কারণে সে কোনরকমে গ্রাজুয়েট পাশ হয়ে যায়। দু বছর পর সে গ্রাজুয়েট হয়ে, এদিক ওদিক চাকরির চেষ্টা করতে লাগলো। কারণ তার মনে হয়েছে চাকরিটা তার একান্ত জরুরী তাহলে সংসারের হাল কিছুটা এড়ানো সম্ভব। সৌভাগ্যক্রমে তার একটা চাকরি জুটে গেল। তার বাবার বন্ধু অ্যাডভোকেট হরনাথচক্রবর্তী কেল্ভিন জুট মিলের লিগ্যাল এডভাইসার। একদিন তিনি বাবাকে বললেন এই কোম্পানির টিটাগড় ফ্যাক্টরিতে একটা পদে চাকরি খালি আছে তোমার ছেলে যদি ইন্টারেস্টেড থাকে তাহলে চাকরিটা হতে পারে। আমি একটা সুপারিশ পত্র লিখে দিচ্ছি ওটা নিয়ে ওখানের ম্যানেজারবাবুকে দেখালে চাকরি হবে। ম্যানেজারবাবুকে আমি একটা ফোন করেও জানিয়ে দেব। বুধবার রাত্তিরে তার বাবা সেই চিঠিটা নিয়ে আসল। আর বৃহস্পতিবার সকালে ঘন্টাকর্ণ টিটাগড়ের উদ্দেশ্যে রওনা হলো।
প্রথমেই বাগবাজার থেকে বাসে করে শিয়ালদা তারপর ট্রেনে করে টিটাগড়। শিয়ালদা থেকে প্রায় ২০-২৫ কিলোমিটার রাস্তা মাঝখানে ১০-১১ টি স্টেশন আছে। প্রায় আধঘন্টা ছাড়াই নানা লোকাল ট্রেনআছে। দমদম, বরানগর,পানিহাটি, খড়দহ হয়ে টিটাগড় যাওয়া যায়। স্টেশন থেকে ১০ মিনিট হাঁটা পথ, পার হলেই কেল্ভিন জুট মিলের বড় ফ্যাক্টরি গঙ্গার ধারে, সামনে বিরাট বড় গেট। ভেতরে ঢুকে ম্যানেজারবাবুকে এডভোকেট চক্রবর্তীর লেটারটা দেখাতেই চাকুরী হল। 

পাটশিল্প হল লেবার ইনটেনসিভ বিজনেস এখানে মেশিনের থেকে শ্রমিকের সংখ্যা অনেক বেশি। র’ জুট থেকে ফিনিশড প্রডাক্ট তৈরি করতে অনেক লম্বা প্রসেস। অনেক ধাপ পেরিয়ে তবেই তৈরি হয় চটের থলে, ব্যাগ, দড়ি ইত্যাদি। তাই বর্তমান যুগে কেউই আর নতুনকরে পাটশিল্প নিয়ে বিশেষ ভাবনা চিন্তা করছে না। পাটের পরিবর্তে অন্য অনেক কিছু বেরিয়ে গেছে সেইগুলোই বেশি ব্যবহার করা হয়। তাছাড়া পাট শিল্পে প্রচুর জলের দরকার, তাই প্রত্যেকটি কারখানা বড় কোন নদীর ধারে হয়ে থাকে। পশ্চিমবঙ্গে মূলত গঙ্গা নদীর ধারে পাটশিল্প বেশি দেখা যায়। এই কেল্ভিন জুট মিলে প্রায় সাড়ে তিন হাজার শ্রমিক আছে। ঘণ্টাকর্ণ জয়েন করাতে আরো একজন বাড়ল। এই কারখানাটি তিনটে শিফটে চলে। তার মানে ২৪ ঘণ্টা কারখানা চলে। এই শিল্পের আরেকটা অসুবিধা হল বছরের বেশ কয়েক মাস কাঁচামালের অভাব হয় তখন কারখানা বন্ধ রাখতে হয়। আমরা কাগজে প্রায়ই দেখি অমুক জুটমিল বন্ধ হয়ে গেছে। আসলে কাঁচামালের অভাবে তাদের ফ্যাক্টরি বন্ধ রাখতে হয়েছে। কারণ কোন কোম্পানি বসিয়ে বসিয়ে ৩ – ৪ হাজার শ্রমিককে মাইনে দেবে না। এই ফ্যাক্টরিতে জয়েন করার সময় সকাল সাড়ে ছ’টা। তাহলে ঘণ্টাকর্ণের পক্ষে বাগবাজার টু টিটাগড় রোজ ডেলি প্যাসেঞ্জারই করা সম্ভব নয়। তাই ওখানে একটা ঘর ভাড়া নিতে হল। সেখানে সে একাই থাকে, শনিবার অর্ধদিবস অফিস করে বাড়ি চলে যায়। আবার সোমবার ভোরবেলায় গিয়ে অফিসে জয়েন করে। সে বাড়িভাড়া নিয়েছে গঙ্গার ধারে প্রতিদিন ভোর বেলা উঠে সে গঙ্গা স্নান করে। তারপর ব্রেক ফাস্ট করে অফিস যায়। আর দুপুরে দেড় ঘণ্টা লাঞ্চ ব্রেক থাকে, তাই দুপুরে রান্না-বান্না করে খাওয়া-দাওয়া করে আবার অফিসে যায়, এবং বিকেল পাঁচটায় ছুটি হয়। এইভাবে বেশ আনন্দেই দিন কাট ছিল তার। অফিসে সবার সাথে তার সৎভাব। মোটা বলে অনেক আড়ালে আবডালে কিছু বললেও, কিন্তু তার সামনে কেউ কিছু বলে না। ঘন্টাকর্ণ বসে লেবার ডিপার্টমেন্টে। ঠিক তার সামনের চেয়ারে বসে বিল্টূ । বিল্টূ (অর্থাৎ বীরেশ্বর ঘোষ) দুজনের বন্ধুত্ব খুব বেশী। জীবনের নানা কথা শেয়ার করে। ছুটির পর একসঙ্গে বেরিয়ে পচাদার দোকানে চা খেয়ে তবে যে যার বাড়ি যায়।সম্প্রতি একটা অদ্ভুত জিনিস হচ্ছে ঘণ্টা কর্ণের সঙ্গে। রোজ ভোরবেলায় সে টিটাগড় ঘাটে গঙ্গা স্নান করে। সিঁড়িতে তোয়ালে সাবান রেখে শুধু একটা গামছা পড়ে সে নদীতে ডুব দেয়। ৫ সেকেন্ড পরে সে উঠে পরে এইভাবে পর পর তিনটি  ডুব দেয়। সাধারণত কোন ব্যক্তি যখন জলে ডুব দেয় তখন চোখ নাক বন্ধ করে যাতে করে জল না ঢুকে যায়। আগে  সে তাই করত সম্প্রতি তার এক নতুন দৃশ্য দেখার বাসনা হয়েছে। নদীর ভেতরে কি আছে তা দেখতে হবে। তাই সে নাক বন্ধ করলেও চোখ খোলা রাখে। প্রথমদিন সে কিছুই দেখতে পায় না। শুধুই ঘোলা জল।

এইভাবে দুটো তিনটে দিন যাবার পর, একদিন সে দেখতে পেল একটা মুখের আকৃতি। যেহেতু সে নিঃশ্বাসকে বেশীক্ষণ ধরে রাখতে পারে না তাই ১০ সেকেন্ডের মধেই জলের বাহিরে এল। প্রথম ডুবটাতে মুখের আকৃতিটি আবছা। দ্বিতীয় ডুবে সেটা আরও পরিস্কার হলো। আর তৃতীয় ডুবে সেই মূর্তি যেন চোখের ইশারায় তাকে ডাকছে জলের ভেতরে। মুখের আকৃতিটি কার সেটা সে বুঝতে পারল না।  তিনটি ডুব দিয়ে সে গঙ্গা থেকে উঠে পরে। প্রথম প্রথম সে ভেবেছিল এটা মনের ভুল। তাই উড়িয়ে দিল।

এরপর দ্বিতীয়দিন, তৃতীয়দিন একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলো। চতুর্থদিনে এক কাণ্ড হল, ডিপার্টমেন্টের বড়কর্তা একটা নতুন গাড়ি কিনেছেন তাই সবাইকে তিনি লাড্ডূ খাওয়াচ্ছেন। বিল্টূতাকে জিজ্ঞাসা করল কোথা থেকে কিনেছেন। তার উত্তরে তিনি আজকের খবরের

কাগজটি এগিয়ে দিয়ে বললেন শেষের পাতা নিচের দিকে একটা বিজ্ঞাপন ছাপা হয়েছে দেখ। ওখান থেকে কিনেছি, খুব কম কিস্তিতে। আমাদের টিটাগড়ে এই কোম্পানির একটা শোরুম আছে। কাগজটা নিয়ে বিল্টূ ঘণ্টাকর্ণকে দেখায়। ঘণ্টাকর্ণ পুরো কাগজটা খুলে হতবাক হয়ে গেল। আসলে গাড়ির শোরুমের বিজ্ঞাপনের পরিবর্তে অন্য একটা খবর তার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। গতকাল ভারতে একজন বিখ্যাত হকি খেলোয়াড় মারা গিয়েছেন। বিল্টূ কিন্তু কিছুতেই বুঝতে পারল না এই খবরটার প্রতি তার এত আকর্ষণ কেন। ছুটির পরে পচাদার চায়ের দোকানে চা খেতে খেতে ঘণ্টাকর্ণ বিষয়টি খোলসা  করল। আসলে ক’দিন ধরে গঙ্গায় ডুব দিয়ে সে একব্যক্তির মুখের আকৃতি প্রত্যক্ষ করছিল, এই সেই ব্যক্তি। 
এই কথা শুনে বিল্টূ হাসিতে ফেটে পরে বলল, ”আরে পাগল লোকে চোখ নাক বন্ধ করে জলে ডুব দেয়, তুই কি চোখ খোলা রেখে জলে ডুব দিয়েছিল।"
সে বলল,” আগে আমি তাই করতাম সম্প্রতি জলের ভেতরের পরিবেশটা দেখার ইচ্ছা হয় তাই চোখ খোলা রেখে জলে ডুব দি। গত তিন চার দিন ধরে আমি এই ব্যক্তির মুখের আকৃতি জলের ভেতরে দেখতে পাচ্ছি। ও আমাকে চোখের ইশারায় জলের ভেতরে ডাক ছিল”। বিল্টূ মজা করে বলল, “তাহলে এই ব্যক্তি নয় কোন জল পরী তোকে ডাকছে, সাবধান যাবি না কিন্তু”। 
বিল্টূ যতই হাসি ঠাট্টা করুক ঘণ্টাকর্ণের মন কিন্তু মানতে পারল না। পরেরদিন আবার চান করতে গেল কিন্তু কিছুই দেখতে পেল না। তারপর আবার দু চার  দিন বেশ নিরুপদ্রেব কাটল। তারপর একদিন অন্য একটা মুখ দেখতে পেল। এটা ঘন্টাকর্ণের পরিচিত, এক চলচ্চিত্র অভিনেতা নাম করা। 
এই চলচ্চিত্র অভিনেতার অনেক সিনেমা ঘন্টাকর্ণ দেখেছে। কাজই অফিসে এসে তাড়াতাড়ি সে বিল্টূকে ঘটনাটি বলল। বিল্টূ বলল, “চুপ কর এইরকম সন্দেহজনক ভিত্তিহীন কথাবার্তা ছড়ালে পুলিশ তোকে ধরবে”।  সে চুপ করে গেল।
এর মধ্যে বিল্টূ একটা যুক্তি দিল তুই একটা কাজ কর তুই ঘরে স্নান কর, বা নদীতে যদি স্নান করতেই হয় তাহলে ঘটি করে জল তুলে মাথায়  ঢাল। ডুব না দিলেই তো হল, তা হলে তুই কোন ছবি দেখতে পাবি না। কথাটা ঘণ্টাকর্ণের মনে ধরেছে, তাই সে ঘঠিতে করে জল তুলে মাথায় দিতে লাগলো। কাজেই সে কোন মূর্তি দেখতে পেল না। কিন্তু মনের মধ্যে একটা অজানা আশঙ্কা তার সবসময় কাজ করছে। এত বড় নামি অভিনেতার কি খুব শীঘ্রই মৃত্যু হবে। 
প্রতি শনিবার ঘণ্টাকর্ণ অফিস শেষ করে দুপুর সাড়ে বারোটার মধ্যে বেরিয়ে পরে, বাড়ি যাবার জন্য। তার বাবা মা এই দেড় দিনের জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকে। তাই শনিবার সে বাসা থেকে রেডি হয়ে, বড় ব্যাগ নিয়ে বের হয়। অফিস করে সোজা টিটাগড় স্টেশন তারপর ওখান থেকে ট্রেন ধরে শিয়ালদা। তারপর শিয়ালদা থেকে বাগবাজার। সোমবার বাড়ি থেকে সোজা অফিস তারপর বিকালে বাসায় যায়। তার রোজকার রুটিন এই ভাবে বাঁধা। আজ শনিবার তাই সে তাড়াতাড়ি তার হাতের কাজ গুছিয়ে টেবিল পরিষ্কার করতে ব্যস্ত। কারণ সাড়ে বারোটার মধ্যে সে বের হবে। ইতিমধ্যে বিল্টূ এসে খবর দিল সেই অভিনেতা একটা অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছেন। রেডিওর খবরে এখুনি বলল, বিল্টূর কথা শুনে একে অপরের দিকে নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। 
খানিক্ষন পরে বিল্টূ বলল,” তাহলে তুই যা দেখ ছিস তা কাকতালীয় নয়, সত্যি”। 
ঘণ্টাকর্ণ, “না আমার ও তো তাই মনে হচ্ছে”। এর পর ঘন্টাকর্ণ খুব মনমরা ভাবে আজকে বাড়িতে গেল। সে ভাবলো একবার কথাটা বাবা-মাকে শোনাবে তার পর ভাবলো না এই বয়সে উনাদের আর  ফালতু চিন্তার মধ্যে জড়াতে চাই না।
রবিবার সকাল বেলা সে ঠনঠনিয়া কালী মন্দিরে গেল। যথা উপাচারে পূজাদিয়ে, মাকে ভালো ভাবে সব কথা জানাল এবং কিভাবে এটা দূর হয় সেটাও তাকে জানাতে বলল। ফের সোমবার আবার পুরানো রুটিন অনুযায়ী ভোরবেলা বেরিয়ে গেল, সকালবেলায় অফিসে পৌঁছালো। সারাদিন কাজ করে সন্ধ্যেবেলায় আবার বাসায় ফিরে গেল। প্রায় দু সপ্তাহ এভাবে কেটে গেলো, ঘণ্টাকর্ণ আর জলের ভেতরে কাউকে দেখছে না। ইতিমধ্যে একদিন বিল্টূ জিজ্ঞাসা করল আর কোন জলপরী ডাকছে কিনা। 
সে উত্তরে জানিয়ে ছিল না। ঘন্টাকর্ণ অফিসে জয়েন করেছে আজ প্রায় ছ'মাস হতে চলল। এখন আষাঢ়ের শেষ রথযাত্রা হয়ে গেছে। টিটাগড়ের স্কুল মাঠে রথযাত্রা উপলক্ষে একটা বড়মেলা হয়। তারা দুজনে একদিন ছুটির পর মেলা দেখতে গিয়েছিল। সে দিন মঙ্গলবার বিল্টূ অফিসে বসে কাজ করছে, এমন সময় ঘন্টাকর্ণ হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বলল,” ভাই আজ খুব গন্ডগোল হয়ে গেছে”। ইতিমধ্যে বিভিন্ন ধরনের কাজের মধ্যে বিল্টূ এই ব্যাপারটা প্রায় ভুলেই গিয়েছিল। তাই সে জিজ্ঞাসা করলো, “কি হয়েছে“
ঘন্টাকর্ণ একটু দম নিয়ে নিচু গলায় এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল, ”আমাদের বড়বাবুর মুখায়ব আজ আমি গঙ্গার মধ্যে দেখেছি”। বিল্টূ ও নিচু গলায় বলল, ”এখন তো একদমই চুপ করে থাক বড়বাবু মৃত্যুর খবর তার জীবিত অবস্থায় তাকে জানালে তোকে এক্ষুনি চাকরি থেকে দূর করে দেবে”।
অগত্যা ঘণ্টাকর্ণ নিজের জায়গায় গিয়ে বসে কাজ করতে লাগল। কিন্তু মনটা ভীষন ছটফট করতে লাগলো। তার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বিল্টূ বলল, “দাঁড়া আমি একটা কোন কাজ নিয়ে বড়বাবুর কাছে গিয়ে দেখি তার হালচাল কি রকম”। এই বলে ছুটির এপ্লিকেশনের ফাইলটা নিয়ে সে বড়বাবুর কাছে গেল, কাদের ক্যাজুয়াল লিভ দেয়া হবে আর কাদের উইথ আউট পে করা হবে সেইটা জানতে। বিল্টূ গিয়ে দেখল তিনি বেশ হাসি খুশি মেজাজে আছেন, মনে মনে গুনগুন করে গান করছেন। বিল্টূকে দেখে তিনি বললেন, “এস বিল্টু বাবু কি খবর”। বিল্টূ যে কাজ নিয়ে এসেছিল সেটা বলল। 
তার উত্তরে তিনি বললেন, ”আজ তো সবে মাসের কুড়ি তারিখ, মাস শেষ হতে আরো দিন দশেক বাকি। এরমধ্যে যদি কোন লিভ এপ্লিকেশন পরে সেগুলো দেখে নাও সামনের মাসের দু তারিখকে আমি বলে দেবো কাদের উইথ  আউট পে হবে”। 
দুর্ভাগ্যক্রমে বড়বাবু এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া আর হয়ে ওঠে নি। সাতাশ তারিখে রাত্রে ঘুমের মধ্যে তিনি ইহলোক ত্যাগ করে পরলোকে যাত্রা করেছিলেন। আটাশ তারিখে সকাল দশটার সময় ম্যানেজারবাবুকে ফোন করে জানান বড়বাবুর ছেলে। অতএব সঙ্গে সঙ্গে ফ্যাক্টরিতে সাইরেন বেজে গেল, এবং আজকের মত সমস্ত কাজ বন্ধ হয়ে যায়। ম্যানেজারবাবুও অন্যান্য কিছু সিনিয়ার স্টাফ বড়বাবুর বাড়িতে গেলে তাকে শ্রদ্ধা জানাবার জন্য। বিল্টূ ও ঘন্টাকর্ণ দুজনেই গিয়েছিল। মৃতব্যক্তির মুখ দেখে ঘণ্টাকর্ণের মনে হয়েছিল যেন বড়বাবু তাকে বলছেন তুমি যদি আমাকে আগে থেকে সাবধান করতে তাহলে আমি এই বয়সে আর অতো গুলো লুচি খেতাম না। বড়বাবুর ছেলে ম্যানেজারবাবুকেবলে,” বাবা অফিস থেকে ফিরেছিলেন সুস্থভাবে, রাত্রিরে ডিনার করে শুতে যান, তখনও সুস্থ ছিলেন। কিন্তু রাত্তিরে বোধ হয় ঘুমের মধ্যেই হয়তো স্ট্রোক হয়ে গেছে, আমরা জানতে পারিনি”। খুবই মনমরা ভাবে তারা ফিরে আসল।
তারপর দিন পনের ঠিক ভাবে কাটলো। ইতিমধ্যে শ্রাবণ মাসের মাঝামাঝি হয়ে গেছে, যাকে বলে ভরা শ্রাবণ। গঙ্গা নদী এখন বৃষ্টির ও জোয়ারের জলে ভর্তি। একুল ওকুল প্রায় দেখাই যায় না। 
কয়েক দিন ধরেই বিল্টূ লক্ষ্য করলো ঘণ্টাকর্ণের মধ্যে বেশ পরিবর্তন হয়েছে। অফিসে আসে লেট করে। রোজই প্রায় পনের বিশ মিনিট লেট হয়ে যায়। যেহেতু বড়বাবু নেই তাই বাঁচোয়া। নতুন বড়বাবু কবে নিয়োগ হবে তা জানা নেই।  বিকালে আর পচাদার দোকানে চা খায় না। ছুটির পর সোজা বাড়ি চলে যায়। আজ শনিবার ঘণ্টাকর্ণের সাপ্তাহিক ছুটিতে বাড়ি যাবার দিন। কিন্তু আজ সে বড় ব্যাগ নিয়ে আসে নি। তাই দেখে বিল্টূ একটু আশ্চর্য হয়ে বলল,”কিরে আজ বাড়ি যাবি না” সে সংক্ষেপে উত্তর দিল, “না”।
যেহেতু শনিবার অর্ধদিবস তাই বেলা একটার মধ্যে ছুটি হয়। ছুটির পর অফিসের বাইরে বেরিয়ে বিল্টূ বলল, ”চল চা খাবি”। সে বলল, “না বরঞ্চ চল একটু গঙ্গার ধার দিয়ে উত্তর দিকে খানিকটা বেরিয়ে আসি”। বিল্টূ বলল, “ ঠিক আছে চল”। প্রায় আধঘন্টা ধরে তারা হেঁটে গেছে গঙ্গার পাড় ধরে। এখন নদীতে ভরা জোয়ার, মাঝে মাঝে দু-একটা নৌকা বাইছে। টিটাগড়ের ঘাট পেরিয়ে তারা প্রায় কাকীনাড়ার ঘাটে পৌঁছে গেছে। ওপারে চন্দননগর সেটাও, প্রায় আবছা হয়ে আসছে, কারণ মেঘ করেছে। এইরকম খানিকটা যেতে যেতে এক জায়গায় তারা দেখতে পেল বেশ কিছু লোকের জটলা।
বিল্টূ বলল,” চল দেখে আসি ওখানে কি হয়েছে”। 
ঘণ্টাকর্ণ বলল, “তুই দেখে আয় আমি এই গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছি”। বিল্টূ গিয়ে দেখল গঙ্গার পারে একটা নৌকা দাঁড়িয়ে আছে। তার থেকে  দুজন জেলে  একটা মোটা ব্যক্তির লাশ নৌকা থেকে নাবাচ্ছে।  লাশটাকে তারা গঙ্গার পাড়ে উপুড় করে শোয়ালো। একজন বললো জেলেদের জালে এই লাশটা উঠেছে। বডির মধ্যে অনেক জল ঢুকে গেছে তাই ফুলে উঠেছে। দেখে তো মনে হচ্ছে দু-তিনদিন আগে ব্যক্তিটা জলে ডুবে মারা গেছেন। 
বিল্টূ জিজ্ঞাসা করল, “ব্যক্তিটি কে সেটা জানা গেছে”। ভিড়ের ভেতর থেকে একজন বলল,”না তবে পুলিশে খবর দেওয়া হয়েছে, আসলে পরে হয়তো জানা যেতে পারে”। লাশের পরনে শুধু একটা গামছা শরীরের উপরের অংশ খালি। একজন ব্যক্তি জেলেকে বলল বডিটা সোজা করুন মুখটা দেখলে হয়তো চেনা যেতে পারে। এই এলাকার ব্যক্তি কি অন্য কোথাকার। দুজন জেলে মিলে তাকে সোজা করলো। মুখটা দেখেই বিল্টূ চমকে উঠলো এবং আস্তে আস্তে পিছু হটতে হটতে ভিড়ের বাইরে চলে এলো। আরে এ যে ঘন্টাকর্ণ। তাড়াতাড়ি সে গাছ তলায় গেল, কিন্তু ঘন্টাকর্ণকে কোথাও দেখতে পেল না। এদিক ওদিক  চারিদিকে খুঁজল শেষে বিষণ্ণমনে বাড়ী ফিরে এল। 
রাত্তিরে সে স্বপ্ন দেখল যেন ঘন্টাকর্ণ তাকে বলছে ভাই গত কয়েকদিন ধরে আমি গঙ্গার মধ্যে যে মুখটা দেখতে পেয়েছিলাম সেটা আমারই। তোকে কিছু বলিনি। দুদিন আগে চান করতে এসে হঠাৎ আমি পা পিছলে গভীর জলে পরে যাই। তখন ভরা জোয়ার, তাই আর নিজেকে বাঁচাতে পারি নি। কাল তোর অফিসের ড্রয়ারে একটা চাবি ও একটা চিঠি পাবি। চিঠিতে আমি তোকে অথোরাইজড করে দিয়েছি আমার সমস্ত পাওনা টাকা তুলে আমার বাড়িতে পৌঁছে দিবি। আর চাবিটা আমার বাসা বাড়ির, কালকে তুই আমার জিনিসপত্র গুলো বাড়িতে পৌঁছে দিবে এবং বাড়িওয়ালাকে ঘরটা খালি করে দিবি। 
পরের দিন সকালে বিল্টূ প্রায় এক ঘণ্টা আগে অফিসে এসে হাজির। প্রথমে ড্রয়ার খুলে দেখল একটা চাবি একটা লেটার আছে। এই দুটো দেখে তার চোখ জলে ভরে গেল।

প্রবন্ধ

উপনিষদ

 মার্চ ২০২২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

উপনিষদ

প্রোজ্জ্বল মণ্ডল

uponishad.JPG

হিন্দুশাস্ত্রে বেদের পরেই উপনিষদের স্থান। প্রকৃতপক্ষে উপনিষৎ বেদই। বেদের জ্ঞানকাণ্ড বা শ্রেষ্ঠ অংশের নাম উপনিষৎ বা বেদান্ত। শ্রদ্ধালু শিষ্য শ্রীগুরুসমীপে উপস্থিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন— “ হে ভগবান, এই জগতে কোন বস্তুটি জানিতে পারিলে সমস্ত কিছুই জানিতে পারা যায়?” উত্তরে গুরুদেব বলিলেন — এই জগতে দুইটি বিদ্যা জানিবার আছে -পরা বিদ্যা ও অপরা বিদ্যা। 

“কম্মি ভগবো বিজ্ঞাতে সৰ্বমিদং বিজ্ঞাতং ভবতীতি। তস্মৈ স হোবাচ — দ্ধে বিদ্যে বেদিতব্যে ইতি হ স্মযদ্ব্রহ্মবিদো বদন্তি — পরা চৈবাপরা চ ৷৷ ” -মুণ্ডক , ১/১/৩-৪ 
অপরা বিদ্যা হইতেছে জাগতিক বিদ্যা — যাহা দ্বারা ঐহিক এবং পারলৌকিক কল্যাণ সাধিত হয়। আর পরা বিদ্যা তাহাই — যাহার দ্বারা অক্ষর পরব্রহ্মের জ্ঞান হয়। “ক্ষরত্ত্ববিদ্যা হ্যমৃতং তু বিদ্যা। ” — শ্বেতাশ্বতর .৫/১ 

এই পরা বিদ্যা বা ব্রহ্মবিদ্যাই উপনিষদে ব্যাখ্যাত হইয়াছে।
মানব জীবনের লক্ষ্য কি? —মহামুক্তি, আত্মতত্ত্বোপলব্ধি; আর এই মহামুক্তি লাভের উপায় কি (ধর্ম কি?) - ত্যাগ, সংযম, সত্য, ব্রহ্মচর্য্য। এই মহামুক্তিলাভ অথবা আত্মতত্ত্ব উপলব্ধি কিরূপে করিতে হয় উপনিষদে তাহা বিশদভাবে বলা হইয়াছে।

সত্যেন লভ্যস্তপসা হেষ আত্মা সম্যগ জ্ঞানেন ব্রহ্মচর্য্যেণ নিত্যম। 
-মুণ্ডক, ৩/১/৫
অর্থাৎ সেই আত্মজ্ঞান লাভ হয় — অবিচল সত্য, অবিরাম তপস্যা অর্থাৎ সংযম ( মনসশ্চিন্দ্রিয়াণাং চৈকাগ্রং তপ উচ্যতে’ - মন ও ইন্দ্রিয় সমূহের যে সংযম বা একাগ্রতা তাহাই প্রকৃত তপস্যা) অটুট ব্রহ্মচর্য এবং সম্যক্ জ্ঞান অর্থাৎ সদসৎ বিচার দ্বারা মনপ্রাণে বৈরাগ্য বা ত্যাগভাব আনয়ন। এর দ্বারাই আত্মজ্ঞান লাভ বা আত্মতত্ত্বোপলব্ধি হয়।
বেদ ও উপনিষদের উপরেই হিন্দুধর্মের ভিত্তি। অন্য হইতে মৃত্যু পর্যন্ত যতকিছু ধর্মকর্মাদি করা হয় এবং যে ভাবধারা অবলম্বনে হিন্দুর জীবন পরিচালিত হয় তার মূলে আছে বেদ ও উপনিষদ। বস্তুতঃ যিনি বেদের প্রামাণ্য স্বীকার করেন না, তিনি হিন্দুধর্মাবলম্বী বলিয়া পরিচিত হইতে পারেন না। 

উপনিষদ প্রতিপাদ্য ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করিলেই মানুষের জীবন ধন্য ও কৃতার্থ 

“ইহ চেদবেদীদথ সত্যমস্তি 

ন চেদিহাবেদীৎ মহতী বিনষ্টি।” — কেন, ২৫ ঈশ, কঠ, মুণ্ডক, শ্বেতাশ্বতর — এই চারিখানা পদ্যাত্মক উপনিষদ সেই প্রাচীন যুগ হইতে নিত্যপাঠ্য স্বাধ্যায় ছিল। 

“যতো বা ইমানি ভূতানি জায়ন্তে। যেন জাতানি জীবন্তি। যৎ প্রয়ম্ভভিসংবিশন্তি। দ্বিজিজ্ঞাস । তন্দ্রহ্মেতি।” 
-তৈত্তিরীয় , ৩/১ 
অর্থাৎ, যাহা হইতে এই নিখিল প্রাণিবর্গ উৎপন্ন হয়, উৎপন্ন হইয়া যাহার দ্বারা বতি হয়, বিনাশকালে যাহাতে গমন করে এবং যাহাতেই বিলীন হয় — তাহাই ব্রহ্ম। তাহাকেই জানিবার জন্য তুমি তপস্যা কর। ভৃগু অনেক তপস্যা করিয়া শেষে জানিতে পারিলেন -আনন্দই ব্ৰহ্ম, ব্ৰহ্ম সচ্চিদানন্দ - ঘনস্বরূপ।
মুণ্ডক উপনিষদে বলা হইয়াছে যথোর্ণনাভিঃ সৃজতে গৃহূতে চ যথা পৃথিব্যামশোধয়ঃ সম্ভবন্তি। যথা সতঃ পুরুষাৎ কেশলোমানি তথাহক্ষরাৎ সম্ভবতীহ বিশ্বম্। -মুণ্ডক , ১/১/৭ — অর্থাৎ মাকড়সা যেরূপ কারণান্তর - নিরপেক্ষ হইয়া নিজ শরীর হইতে সূতা উৎপাদন করে ও আত্মসাৎ করে, পৃথিবীতে যেরূপ তদনতিরিক্ত ওষধি সমূহ জাত হয়, সজীব পুরুষশরীর হইতে যেরূপ

বিজাতীয় কেশ ও ললামসমূহ নির্গত হয়, সেইরূপ অক্ষর পরব্রহ্ম হইতে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যাবতীয় বস্তু উৎপন্ন হয়।
বেদাহমেতং পুরুষং মহান আদিত্যবং তমসঃ পরাৎ। তমেব বিদিত্বীহতি মৃত্যুমেতি নান্য পন্থা বিদ্যতেহয়নায়। ” -শ্বেতাশ্বতর , ২/৫ , ৩/৮ - 
“হে বিশ্ববাসী অমৃতের সন্তানগণ, তোমরা শোনো। শুধু তাই নয়। হে দিব্যধাম স্বর্গের অমরবৃন্দ, তোমরাও শোনো আমি সেই মহান পুরুষকে জেনেছি, যিনি সমস্ত অজ্ঞানান্ধকারের অতীত ও দিব্যজ্যোতির্ময়। তাহাকে জানিলেই মাত্র এই মৃত্যুময় সংসার অতিক্রম করা যায়; ইহা ভিন্ন দ্বিতীয় কোন পথ নাই।”
এই ভাবে উপদেশ দিয়া সৰ্বশেষে ঋষি বলিতেছেন যস্য দেবে পরা ভক্তিৰ্যথা দেবে তথা গুরৌ । তস্যৈতে কথিতা হ্যর্থাঃ প্রকাশন্তে মহাত্মনঃ। -শ্বেতাশ্বতর, ৬/২৩ অর্থাৎ, যাঁহার দেবতার উপর পরম ভক্তি আছে এবং দেবতার উপর যেরূপ ভক্তি, শ্রীগুরুদেবের উপরেও সেইরূপ ভক্তি আছে, সেই মহাত্মার নিকটেই উপনিষদে উক্ত এই ব্রহ্মজ্ঞান প্রতিভাত হয়। 

চতুৰ্ব্বেদে চারিটি মূল উপদেশ আছে। তাহাদের বলে “মহাবাক্য।” এইগুলি হইল—
( ১ ) প্রজ্ঞানং ব্রহ্ম — ঐতরেয় ৩/১/৩ - ঋগ্বেদ
( 2 ) অহং ব্রহ্মাস্মি — বৃহদারণ্যক , ১/৪/১০ - যজুৰ্বেদ 
( ৩ ) তত্ত্বমসি — ছান্দোগ্য , ৬/৮/৭ - সামবেদ 
( ৪ ) অয়মাত্মা ব্রহ্ম — মাণ্ডুক্য , ১/২ — অথৰ্ব্ববেদ 
সমস্ত বেদবিদ্যা শিক্ষা দিবার পর আচাৰ্য্য শিষ্যকে উপদেশ দিতেছেন “সত্যং বদ। ধর্মং চর । স্বাধ্যায়াম্মা প্রমদঃ। সত্যান্ন প্রমদিব্যম। ধৰ্মান্ন প্ৰমদিতব্য। কুশলান্ন প্ৰমদিতব্য। ভূত্যৈ ন প্রমদিতব্য। স্বাধ্যায় - প্রবচনাভ্যাং ন প্রমদিতব্য। 

দেবপিতৃকাৰ্য্যাভ্যাং ন প্রমদিতব্য। মাতৃদেবো ভব। পিতৃদেবো ভব। আচাৰ্য্যদেবো ভব। অতিথিদেবো ভব। যন্যনবদ্যানি কৰ্ম্মাণি। তানি সেবিতব্যানি। নো ইতরাণি। যান্যস্মাকং সুচরিতানি। তানি ত্বয়োপাস্যানি। 

নো ইতরাণি।.... শ্রদ্ধয়া দেয়ম। অশ্রদ্ধয়াহদেয়ম। শ্রিয়া দেয়। হ্রিয়া দেয়। ভিয়া দেয়। সংবিদা দেয়। 

এষ আদেশঃ। এষ উপদেশ। এষা বেদোপনিষৎ। এতদনুশাসন। এবমুপাসিতব্য। এবমুচৈতদুপাস্যম। 

–তৈত্তিরীয় , ১।১১।১-৪
অর্থাৎ, সদা সত্য কথা বলিবে। সৰ্ব্বদা ধৰ্ম আচরণ করিবে। স্বাধ্যায় অর্থাৎ শাস্ত্রপাঠ হইতে বিরত হইবে না। সত্য হইতে কখনও বিচ্যুত হইবে না। ধর্ম হইতে বিচ্যুত হইবে না। আত্মরক্ষা বিষয়ে অনবহিত হইবে না। সম্পদলভার্থে মঙ্গলজনক কাৰ্যে প্ৰমাদগ্রস্ত হইবে না । স্বাধ্যায় ও অধ্যাপনা বিষয়ে অনবহিত হইবে না। 

দেবকার্য্যে ও পিতৃকার্য্যে কখনও অবহেলা করিবে না। তাকে দেবতাজ্ঞানে ভক্তি করিবে। পিতাকে দেবতার মত ভক্তি করিবে। আচাৰ্য্য বা গুরুদেবকে দেয়ার মত ভক্তি করিবে। অতিথিকে দেবতার মত সম্মান করিবে। যে সকল কৰ্ম্ম অনিন্দিত তাহাই অনুষ্ঠান করিবে, অন্যগুলি নহে। আমাদের যাহা সদাচার তাহাই তোমাদের অনুষ্ঠেয়, অপরগুলি নহে। 

শ্রদ্ধাপূৰ্ব্বক দান করিবে। অশ্রদ্ধার সঙ্গে করিবে না। সামর্থ্য অনুসারে দান করিবে; সলজ্জভাবে দান করিবে। সভয়ে দান করিবে। মিষ্টব্যবহার সহকারে দান করিবে — ইহাই আদেশ, ইহা উপদেশ, ইহাই বেদের রহস্য, ইহাই ঈশ্বরের আদেশ। এই প্রকারেই সমস্ত অনুষ্ঠান করিবে। তবেই জগতে শান্তি ও কল্যাণ লাভ করিতে পারিবে।

অণুগল্প

অণু-গল্প

 মার্চ ২০২২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

SanojCharaborty.jpg

অনুগল্প

সনোজ চক্রবর্তী
মেদিনীপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর

village.jpg

ল্পের গরু গাছে তোলার ক্ষমতা আমার নেই। তখন দুপুর দুটো হবে। সবে খিচুড়ি, আলু ভাজা আর টমাটোর চাটনি সাটিয়ে বিছানায় কাত হয়েছি। তখন আর কত! ক্লাস ফাইভ হবে হয়তো। সরস্বতী পুজো মানে যে স্কুলে স্কুলে ঘোরা... পাড়ায় পাড়ায় সাইকেল নিয়ে টো টো.... এসব বোঝার জ্ঞান-কেশ তখনও গজায় নি.. মানে মাথা থেকে নামা শুরু করে নি।
উঠোনে মায়ের সঙ্গে মায়ের ভক্তদের(আমার মার নয় সরস্বতী মায়ের) তুমুল বাদ বিসংবাদ।
মা তো কিছুতেই এন্ট্রি নিতে দেবে না। মা আমার খুবই ছুত মার্গ। অবস্থা এমনই পারলে সপ্তাহে সে আট দিন উপবাস করে। আচার নিষ্ঠ ব্রাহ্মণ বংশের মেয়ে আমার মা। একশ বিশ ঘর যজমান ছিল দাদুর।  
মায়ের অবস্থান খুবই স্পষ্ট --এ অনাচার তার পক্ষে কোনো ভাবেই মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।
এদিকে ভক্তরা সংখ্যায় বাড়ছে। বড়দের সঙ্গে মিশে থাকা শুকিয়ে যাওয়া কচি মুখগুলো দেখলে মায়া হবে যে কারো। মা আমার আচার নিষ্ঠ ব্রাহ্মণ বংশের সন্ততি তাই এসবে তার নেই কোনো হেলদোল। মা বরাবরই পুজো আচ্চায় শালগ্রাম শিলার মতো খাঁটি। ভক্তদের পুরোহিত আসে নি তখনও, আসার সম্ভাবনাও দূর-অস্ত। ঠাকুরকে ফুল না দিয়ে কচি-কাঁচাগুলো দাঁতে কিছু কাটবে না। পড়ুয়াদের কাছে মা সরস্বতী হেড স্যারেরও হেড স্যার। সব সার্টিফিকেট নাকি গচ্ছিত থাকে মায়ের জিম্মায়।
একই পাড়ায় থাকার সুবাদে আগত ভক্তদের কাউকে কাউকে পানা পুকুরে ভাসতে থাকা হাসকেও গড় ঠুকতে দেখেছি। স্কুল,কলেজ, আপিস,কাচারি, স্বর্গ, মর্ত সব জায়গাতেই একই বিধিবন্দোবস্ত  -- চ্যালাকে ধরে উপরে যেতে হয়। মার দুর্বল প্রতিরোধ ডিঙিয়ে স্রোতের মতো ভিড়টা ঢুকে পড়ল ঘরে। বিছানা থেকে আমি এক প্রকার চ্যাঙ দোলা হয়ে চালান হয়ে গেলাম ভিড়টার মাথায়। মা পেছন থেকে চিৎকার করছে...
"ওরে ও মুখপোড়ার দল... ওর যে এখনো পৈতে হয় নি রে হারামজাদারা... এ অনাচার সইবে না দেবী। তোদেরও আর পাশ দেওয়া হবে না আর আমার ছেলেটাও ক্লাস ফাইভ ডিঙাতে পারবে না.… ওরে ছেড়ে দে রে ওকে ছেড়ে দে.….." কে কার কথা শোনে।
তখন তারা ট্রফি পেয়েছে যেন। উন্মত্ত উল্লাসে আমাকে চাগিয়ে দে ছুট। ভিড়ের থেকে কেউ যেন চিৎকার করে জানিয়েছিল... " এতো আর ইচ্ছাকৃত ত্রুটি নয়। এ যে নাচারে পড়ে পরিত্রাণের চেষ্টা। মা অতো নির্দয় হবেন না। সন্তানের এ অনিচ্ছাকৃত অপরাধের দোষ ধরবেন না মা"।
ভক্তের দল বাড়ি ছাড়ার আগে সুযোগ মতো আলনা থেকে বাবার একটা ধুতি নিয়েছিল হাতিয়ে। মন্ডপে আগে থেকে আনা ছিল পৈতের সুতো। আমার দু হাঁটুতে পাক খেয়ে তৈরি হল পৈতে।পুজো শেষে দক্ষিণা হিসাবে জুটল দশ টাকার একটা নোট। সে দক্ষিণায় সেদিন আনন্দ পেলেও পরে বুঝেছিলাম পৈতে হীন পুরোহিত বলে দক্ষিণায় একটা সমঝতা ছিল।
বাড়ি ফিরে জীবনের প্রথম রোজগার গামছার পুটুলি ভরা কেজি দেড়েক আতপ চাল গোটা কতক আলু আর কাঁচকলা সহ খান সাত আটেক সিকি পয়সা মায়ের কাছে রাখতেই মা ছুঁড়ে ফেলে দিলেন সে সব। মায়ের হাতে ঘা কতক জুটল বকশিস হিসাবে।
রাতে বাবা ফিরে সব শুনে হাসলেন। আর তাতেই মায়ের রাগের পারদ চড়ল আরো। তারই রেশ রইল, দিন তিনেক মা আর কথা বলল না আমার সঙ্গে। তবে সে ঘটনার বছর ঘুরতে না ঘুরতে মেজ পিসি অনেক খরচ পাতি করে আমার গলায় দিলেন সত্যি কারের ধবধবে সাদা একখান পৈতে।

******

#ঋত্বিক- রা 
ক'বছর আগের-- '"কিসসু হবে না তোর।" কথাটাই ঠাঁটিয়ে এক থাপ্পড় কষাল আমার গালে।
কোওপারেটিভের হিসাব করতে করতে আনমনা হয়ে যাচ্ছিলাম থেকে থেকে। স্টাফরুম থেকে সহ শিক্ষকের বাইট কানে আসছিল। কিছু সময় আগে ছেলেটা আমাকে নিয়ে কাজ করেছে। একটা ডকুমেন্টারি বানাতে চায় ছেলে। বিষয়টাই অন্য রকম! আসলে আমরা সকলেই একটা বয়সে এসে, নিজের স্কুলে ফিরতে চাই- ফিরতে চাই শৈশব বা কৈশোরের স্মৃতিতে। যে পারে সে লজ্জা সরিয়ে স্কুল চলাকালীন পৌঁচ্ছে যায়।  প্রায় সমবয়সী শিক্ষক শিক্ষিকাদের বলে -- " এই ক্লাসরুম একদিন একান্ত ভাবে আমাদের ছিল। ঐ দাওয়ায় কতদিন নীলডাউন হতে হয়েছে!"
যে পারে না, যার লজ্জা বোধ পেয়ে বসে-- সে হয়তো কোন এক ছুটির দুপুরে পায়ে পায়ে স্কুলের দাওয়ায় গিয়ে বসে। তখন এক সঙ্গে লেখাপড়া করা গোপাল, হরেন মালতীদের কথা মনে হয়, মনে পড়ে অঙ্কের স্যারের বকুনি পন্ডিত স্যারের শ্লোক কিম্বা বাংলা স্যারের 'ছাত্রধারা' কবিতা। ঝিম ধরা দুপুর বুদ হয়ে যায় অতীত ডুবে। আর যাদের আস্ত স্কুলটাই গিলে খেয়েছে সময়! যাদের স্কুল-বেলাটাই ভিটে ছাড়া! উদ্বাস্তু হয়ে যারা হাতড়াচ্ছে 'শিকড়'! 
যারা ত্রিশঙ্কুর মতো ঝুলে রইল না ঘরকা না ঘাটকা হয়ে! সত্যিই তো ঋত্বিক, সঞ্জয়,বিষ্ণুপদ,বাবলি এদের তো ফেরার কোন দাওয়া নেই! এদের স্কুলটাই তো লোপাট হয়ে গেছে! পছন্দ হয়ে গেল ডকুমেন্টারিটা। ঋত্বিককে না করা গেল না- ফলত সেই ডকুমেন্টারির সুত্রধর হতেই হল আমাকে। বিষয়টা বুঝিয়ে, আমাকে বসিয়ে দেওয়া হল ক্যামেরার সামনে। একবার বললাম।
"স্যার ভাল হচ্ছে, আর একবার।" দ্বিতীয়বার বললাম।
" স্যার চমৎকার হয়েছে আর একবার নেবো।" আবার বললাম।
"স্যার অসাধারণ, আর একবার।" বুঝলাম 'কিসসু' হচ্ছে না।
এগিয়ে গিয়ে বললাম-- "ঠিক কি চাইছিস বলতো?"

নাসিরউদ্দিনের একটা ক্লিপিংস্ দেখালো ছেলে। কোওপারেটিভের হিসাব করতে করতে বুঝতে পারছিলাম কত হিসাবই ভুল করে ফেলেছি। আমরা বুঝতেই চাই না-- লেখাপড়ার বাইরে হাজার একটা জগৎ আছে। শুধু ভালোবাসা আর নিষ্ঠা থাকলেই হয়।  বাইট চলছে... বলেই চলেছেন সহ শিক্ষক। বুঝতেই পারছি কথাগুো ঋত্বিকের ভাবনার সাথে যাচ্ছে না। তবুও ঋত্বিক থামাছে না স্যারকে।
বিরক্ত হয়ে বলছে না -- "হচ্ছে না স্যার।"

বকের মতো ধৈর্য নিয়ে অপেক্ষা করছে আসল মুহূর্তটুকুর জন্য।

******

কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুলের মারপিট নিয়ে শিক্ষক সমাজকে কাঠগড়ায় তোলা হয়েছে। স্কুলে পঠন পাঠন চালু হওয়ার একদিন আগে যে হাতাহাতি হয়েছে তা যথেষ্ট নিন্দার। টীকাটিপ্পনীর বিরাম নেই। সেটা নেহাত অসঙ্গতও নয়। দীর্ঘ অচলাবস্থা কাটিয়ে আবার যখন নতুন করে শুরু হচ্ছে স্কুল-  তখন শিক্ষক শিক্ষিকারা কোথায় এতোদিনের খামতি পূরণ করতে মরিয়া হয়ে উঠবে, তা নয় বরং এ যে রীতিমত মল্লযুদ্ধ!  দিনকয়েক আগে শ্যালকের পাত্রী সন্ধানে চন্দ্রকোনা গিয়েছিলাম। সে গল্প অন্য একদিন হবেখন। অনেক কথাবার্তা নিয়ে উপস্থিত মেয়ের পিসেমশাই। তিনি একজন রিটায়ার হেডমাস্টার মশাই। বাঁকুড়ার একটি নামকরা স্কুলে দীর্ঘকাল শিক্ষকতা করেছেন। একথা সেকথায় কোনো রাখঢাক না রেখেই বলে ফেললেন সহ শিক্ষক-শিক্ষিকারা আসলে ফাঁকিবাজ ও বেয়াদপ। ভদ্রলোক হয়তো জানতেন না উপস্থিত আমরা অনেকেই শিক্ষক কিম্বা সব জেনেই একটু ঝাল মেটানো। আমি হাসতে হাসতে বললাম উল্টো পিঠের লোকেরাও কিন্তু হেডমাস্টারদের ভাল ভাবে নেন না। আমাকে সমর্থন করে উনি বললেন-- 'জানি তো, আমাকে মাল বলতো ওরা।'
এরপর ভদ্রলোক কিভাবে কাকে টাইট দিয়েছেন সে গল্পও শোনালেন, শুনতে হল প্রবল অনিচ্ছা নিয়ে। একবার চারজন সহ শিক্ষককে একসাথে বাথরুম থেকে ফিরতে দেখে উনি নাকি বলেছিলেন-- 'একসঙ্গে চারজনের বেগ এল কিভাবে!'
আমি মজা করে বললাম-- 'এ প্রশ্ন শুধু অসংগতই নয়, বোকামিরও--বাঙালীর মুত্রদোষ বহু বিদিত মূদ্রাদোষ।' কথাগুলো বললাম একারণে একজন প্রধান শিক্ষক, তাঁর সহকর্মীদের প্রতি মনোভাবটা কত হীন। অথচ স্কুলটার সুনাম রয়েছে -- ওনার কথা মতো। আচ্ছা এই সুনাম কি একা হেডমাস্টার মশাই এনে দিতে পারেন? এনে দিতে পারেন ফাঁকিবাজ সহ শিক্ষকদের ডিঙিয়ে! 
আসলে প্রায় সমস্ত প্রধান শিক্ষক তাঁর সহকর্মীদের অধস্তনদের সম্পর্কে এমনটাই মনোভাব রাখেন কারণ উপর থেকে সবটাই ছোট দেখায়। অভিজ্ঞতা না বলে উপলব্ধি বলাই ভাল-- উপলব্ধি থেকে বলছি অধিকাংশ প্রধান শিক্ষক তাঁর সহ-শিক্ষকদের তো বটেই এমনকি তাঁর  প্রতিবেশী প্রধান শিক্ষকদের সম্পর্কে কষ্ট করে সামান্যতম প্রশংসা তো করেনই না বরং নিন্দা করে স্বস্তি পান। তবে সহ শিক্ষকরা ধোয়া তুলসীপাতা নন। তবুও আমি দোষ দেখব প্রধান শিক্ষকদের। আর পাঁচটা পেশায় যা চলে শিক্ষকতায় তা চলে না। সামান্য পান থেকে চুন সরলেই গেল গেল রব। এ হেন পেশার  মাথায় যিনি, যিনি শিক্ষকদের অভিভাবক তাঁকে তো অনেক বেশি সংবেদনশীল হতে হয়। তাই তাঁর প্রতিনিয়ত নিজেকে অতিক্রম করে চলতে হয়।

শিক্ষকদের মারপিট নিয়ে বিভাজন স্পষ্ট। কেউ ভুগোলকে দুষছেন কেউ হেড এর মুন্ডুপাত করছেন। আচ্ছা পে-স্লিপের জন্য অবস্থান করা যায়? অন্য কোন উপায় কি ছিল না!
একজন সহ শিক্ষক কি অন্যরা পাশে না থাকলে এতো জোর থাপ্পড় কষাতে পারেন? চড়টার মধ্যে প্রধান শিক্ষকের প্রতি অন্য অনেক শিক্ষকের রাগ কি মিশে গেল? প্রধান শিক্ষক দুর্নীতি পরায়ণ- সহ শিক্ষকদের এ অভিযোগ বহু কালের। আসলে সরকার নির্ধারিত দু'শ চল্লিশের অডিট হয় হাজার টাকা ফি এর সাত'শ ষাটের হিসাব কতজন প্রধান ছাতি ঠুকে স্টাফরুমে ফেলে দেন? তাঁদের সতত মনে হয় আমি বাড়ির কর্তা আমার আবার হিসাব কি! যাইহোক শিক্ষা দফতর কারণ দর্শাতে বলেছেন দু'জনকেই। এর মধ্যে তৃনমূল বিজেপি ঢুকল বলে।
সেসব হয় হোক সে নিয়ে না ভেবে একটু গোড়ার দিকে তাকাই চলুন। ঝকঝকে দিনের আলোয় মিডিয়ার উপস্থিতিতে দুজন হাতাহাতিতে মাতলেন কেন? মানে কারণটা কি কি হতে পারে? দুজনেই বদমেজাজি?  তাই যদি হয় তবে লেখাপড়া সঙ্গে এমন লোকজন এদ্দিন রইলেন কিভাবে! মানে বলতে চাইছি শিশু মনস্তত্ত্বকে ছোঁয়া তো এদের পক্ষে সম্ভব নয়। অর্থাৎ এধরনের শিক্ষকরা শিশুদের মনের ধারে কাছে যেতে পারেন না।
তবুও মাস মাহিনাটা বুঝে নিয়েছেন নিখুঁত! আচ্ছা ব্যাপারটাকে একটু নরম করে দেখা যাক।
ধরা যাক ওনারা বদমেজাজি নন। পরিস্থিতি, পরিবেশ সহ্য সীমার বাইরে চলে গিয়েছিল।
আচ্ছা দু'জন মানুষ পরস্পরের প্রতি কতোটা শ্রদ্ধাহীন হলে এমনটা হয়? সত্যি কি কেবল শ্রদ্ধাহীন হলেই এমনটা সম্ভব ছিল ? না, আদপেই এঘটনা সম্ভব নয়। আসলে দু'জন দু'জনের প্রতি কেবল শ্রদ্ধাহীন নন,  সম্পর্ক ভীষণ রকম তিক্ত না হলে এ ঘটনা ঘটতে পারে না ?প্রবল বিরক্তি, সীমাহীন বীতশ্রদ্ধ থেকেই ঘটে এমন।

এখন প্রশ্ন হল এতোটা বিরক্তি, তিক্ততা, বীতশ্রদ্ধ নিয়ে পাঠদানের মতো মননশীল কাজটা এরা করলেন কেমন করে? করবেন কেমন করে? সোজা কথায় এনারা কি শিক্ষার্থীদের ফাঁকি দেন নি? সমাজকে ঠকান নি এনারা? ঠকিয়েছেন। লাগাতার ঠকিয়ে চলেছেন ।  পুনশ্চঃ কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুলের পরিবর্তে আপনি আপনার স্কুলের নামটা বসিয়ে নিন। ঘটনা হুবুহ এক। শুধু মিডিয়ায় মারামারিটা আসে নি।মাছ ঢাকার সমূহ বন্দোবস্ত হয়েছিল রাতারতি। কিম্বা দাঁতে দাঁত দিয়ে মারামারিটা এড়িয়ে গিয়েছিলেন প্রখর বুদ্ধিমত্তায়।

******

# কমার্স # 
ক কমার্সের মাস্টার মশাই তাঁর ছাত্রকে একদিন জিজ্ঞেস করলেন--

"পৃথিবীটাকে চালাচ্ছে কে?" ছাত্র মাথা চুলকাতে থাকল।

স্যার চশমাটা মুছতে মুছতে বললেন--
-- কোন ভগবান,গড,আল্লহ্ কেউই পৃথিবীটাকে নিয়ন্ত্রণ করেন না। এই গোটা পৃথিবীটাকে   নিয়ন্ত্রণ করে এই পৃথিবীর মানুষ। সারা পৃথিবীর প্রতিটি দিন কিভাবে কাটবে তা ওরাই ঠিক করে দেয়।
ছাত্র চোখ দুটো বড় বড় করে বলল--

-- কারা ওরা?জো বাইডেন? বরিস জনসন্? ভ্লাদিমির পুতিন?ইমানুয়েল মেক্রন? নরেন্দ্র মোদী?
স্যার চশমাটা পরতে পরতে বললেন---- না না এরা কেউ নয়। আসলে এদেরও নিয়ন্ত্রণ করেন তাঁরা। ছাত্র জানতে চাইল--

-- তবে তাঁরা কারা? পাবলিক?
স্যার মুচকি হাসলেন, বললেন-- গভর্নমেন্ট অফ দ্যা পিপুল, ফর দ্যা পিপুল, বাই দ্যা পিপুল--

ও সব অর্থহীন, যাতা বলে গেছেন আব্রাহম লিঙ্কন। বাজে কথা, পাবলিক তো আসলে কথা বলা পুতুল যেমন  বলা শেখানো হয় তেমন বলে। আসলে সারা পৃথিবীটাকে নিয়ন্ত্রণ করছে বিল গেটস্, আমাচিও ওরতেগা, জেফ বেজোস, ইলন মাস্ক, ওয়ারেন বফেট..... 
ছাত্র অবাক হয়ে বলল-- মানে ব্যবসায়ীরা?

স্যার বললেন---- হ্যাঁ, ব্যবসায়ীরা।
ছাত্র আগ্রহ দেখিয়ে বলল-- আমাদের দেশের আম্বানি, আদানি এরা? স্যার চশমাটা নাকের ডোগায় নামিয়ে বললেন-- 

আশ্চর্যের কিছুই নেই আলবাত আছেন দলে আসলে পৃথিবীটাকে এরাও নিয়ন্ত্রণ করছেন না, সারা পৃথিবীটাকে নিয়ন্ত্রণ করছে অর্থনীতি,ব্যবসা,বাণিজ্য--কমার্স। আরো আশ্চর্যের সেই কমার্সটা তোরা মুখস্থ করে শিখতে চাইছিস। নোটস্ শর্টকাট এসব  করে কমার্সকে জানা যায় না রে পাগলা। পুনশ্চঃ পরের দিন ছাত্রের বাবা এসেছিলেন স্যারের কাছে। জানিয়ে দিলেন প্যান্ডামিকে ব্যবসা বাণিজ্য মন্দা যাচ্ছে তাই ছেলে আর পড়তে আসবে না।

******

কালো পাথরে আছড়ে পড়ছে সমুদ্র। উন্মত্ত সেই ঢেউ পাথরে খানখান হয়ে পিছলে গিয়ে মূহুর্তে উত্তুঙ্গ ফণায় ফিরে এসে ছোবল বসিয়ে দিচ্ছে স্থাপত্যে। অর্ণব সাটার স্পীড বাড়িয়ে নিখুঁত ধরল ঢেউটাকে। কিছু আগে স্টিমারটা যখন বেশি রকম দুলে উঠেছিল একটু হলেও ভয় পেয়েছিল অর্ণব। ছবি তোলা তো দুরস্ত হাত-পা ঠান্ডা হয়ে সত্যি হয়ে উঠেছিল মৃত্যু। অথচ একটা মানুষ এই শিলায় তিন রাত তিন দিন ধ্যানস্থ রইলেন! সূর্যের আলোয় ঝকঝক করছে বিবেকানন্দরক মেমোরিয়াল। ক্যামেরার সেটিংসটা ফের একবার দেখল অর্ণব। সাটার হাফ ডাউন করে কম্পোজিশনটা গুছিয়ে নিল নিজের মতো। সৌধের ভেতরে ছবি

তোলা বারণ। অর্ণব বাইর থেকে দরজার ফ্রেমে রাখল দেবমূর্তিকে-- সূর্যের আলো পড়েছে। 
অপার্থিব জ্যোতি বিচ্ছুরিত হচ্ছে পাথরের মূর্তি থেকে।  পুরো কম্পোজিশনে আরও একবার চোখ বোলাতে বোলাতে অর্ণব অস্ফুটে বলে উঠল 'অসাধারণ'। বুকের ভিতর লম্বা শ্বাস নিয়ে সাটার ফুল ডাউন করল সে। আশ্চর্য! সাটার পড়ল না!
অথচ কনটিনিউ স্যুটে রাখা ছিল সেটিংস্ ! বিরক্তি নিয়ে ফিউ ফাউন্ডারে প্যারামিটারগুলো চেক করল অর্ণব। না, সব ঠি আছে। আর একবার সাটার দাবাল সে-- গোঁ গোঁ শব্দে থেমে গেল ক্যামেরা। এবার ঘামতে শুরু করছে অর্ণব। একমাস হল ক্যামেরাটা কিনেছে সে। যদিও ওয়ারেন্টই আছে, ফিরে গিয়ে সবটা সামলে নেওয়া যাবে কিন্তু এই মূহুর্তটা!
এই মূহুর্তটা ফিরে পাবে কি করে? কিভাবে কম্পেনসেট হবে মূহুর্তটা? কন্যাকুমারী ফেরত দেবমূর্তি ছাড়া বাড়ি ফিরতে হবে তাকে! পেছন থেকে কেউ পিঠে হাত রাখতে বিরক্তি নিয়ে ফিরে তাকাল অর্ণব। গেরুয়া বসনের এক সন্ন্যাসী হাসছে তার দিকে তাকিয়ে--
"ছবি হচ্ছে না?" সন্ন্যাসীর কথা শুনে চুপ করে গেল অর্ণব। মনে মনে ভাবল- "এটা তো ওনার জানার কথা নয়।" মাথাটা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানাল অর্ণব। "কত দাম?" ক্যামেরাটার দিকে ইশারা করে দাম জানতে চাইল সন্ন্যাসী।  তারপর উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে ফের প্রশ্ন করল--"বেড়ানোটা বুঝি নেশা?" "হু" - বলে ফের ক্যামেরায় ফিরল অর্ণব।
"কেউ হাওয়া বদলের জন্য বেড়ায়, কেউ ভগ্নস্বাস্থ্য ফেরাতে, কেউবা প্রকৃতি প্রেমে--- সবই ইন্দ্রিয় সুখ।"--কথাগুলো শেষ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন সন্ন্যাসী।
"তিনি বেরিয়েছিলেন মানুষের দুঃখ কষ্ট ছুঁয়ে দেখবেন বলে! পায়ে হেঁটে ফিরেছেন ভারতবর্ষের অলিতে গলিতে।" সন্ন্যাসী এবার অর্ণবের ক্যামেরায় হাত রাখলেন।

"বোকাছেলে, তাঁকে ধরা যায়!" সন্ন্যাসীর গলায় প্রত্যয়। অর্ণব তীব্র বিরক্তিতে ক্যামেরা সহ সরিয়ে নিল নিজেকে। বেড়াতে আসা রঙিন লোকজন ঘুরে বেড়াচ্ছে আনন্দিত -- নিজের ঘর ছেড়ে হুজুগে বাঙালী তার দেবতাকে খুঁজে ফিরছে বিদেশ বিভুইয়ে।  রঙিন লোকজনকে ফ্রেমে নিয়ে সাটার টিপল অর্ণব। হ্যাঁ কাজ করছে, এতক্ষণে ক্যামেরা এ্যাকটিভ হয়েছে। অর্ণব খুশি হয়ে আবার দরজায় ফ্রেমে ক্যামেরা তাক করল। আইএসও... সাটারস্পীড... সব সবই পারফেক্ট... তবুও অর্ণবের আঙুল শিথিল, সে নিশ্চল দাঁড়িয়ে রইল ক্যামেরা নিয়ে। আশ্চর্য! সেই গেরুয়া সন্ন্যাসী ধীরে ধীরে মিশে যাচ্ছে কালো পাথরের মূর্তিতে!
কানের কাছে কে যেন ফিসফিসিয়ে বলছে-- "বোকাছেলে, তাঁকে ধরা যায়!"

******

 

শেঠ মানে একটা বড়সড় ব্যাপার তার উপর প্রাণনাথ! শনিবার ছুটি নেব তারই তদবির করতে ঢুকেছিলাম হেডমাস্টারের চেম্বারে। খেয়াল করি নি তিনি ফোনে ছিলেন,তেমন হলে পরেই যেতাম। যাই হোক আমাকে টেবিল লাগোয়া একটা চেয়ারে বসার ইশারা করে তিনি ফের ফিরলেন ফোনে। আমি হাঁ তাকিয়ে রইলাম তাঁর দিকে। আমি সাধারণত ছুটি নিলে দু-এক দিন আগে জানিয়ে রাখি তাই শনির ছুটির আবেদন বিষুদবারেই।  আমাকে বসিয়ে উনি ফোনে বলেই চলেছেন।  কখনও উদ্বিগ্ন হচ্ছেন আবার মূহুর্তে বকুনি। এর মধ্যে একটা কাগজ বের হল, চোখ বড়বড় করে বুঝলাম ওটা রেজাল্টের কাগজ। আজ টুয়েলভ ক্লাসের টেস্টের রেজাল্ট।
ইনি একবছরও হয় নি আমাদের স্কুলে বদলি নিয়েছেন প্রতিবেশী একটি স্কুল থেকে। ফলত এইধরনের বদলির আগেই বদলির খবর রটে যায় কানে কানে। আর তার সঙ্গেই বিয়ের অব্যবহিত পূর্বে পাত্রী পাশের পাড়ার হলে পাত্রপক্ষের ঠিক যতটা বেশি কৌতূহল বা জেনে ফেলার চেষ্টা থাকে ততটা আগ্রহ নিয়ে খোঁজখবর চলছিল। এসবক্ষেত্রে যেমনটা হয় হয়েছিলও তাই।

উনি এলেন। উনি কবি ছড়াকার আর সেই সূত্রধরে আমার সঙ্গে একটু বেশি সহজ হলেন।বুঝলাম পাত্রী পাশের পাড়ার হলে পাত্রপক্ষের যেমন কানভারী হয় আমাদেরও ঠিক তাই হয়েছে।

কয়েক দিনের মধ্যেই সকলকে চাপমুক্ত করে,হেড মাস্টারের ধড়াচূড়া ফেলে হয়ে গেলেন আত্মীয়। মনে হল ইনি যতটা না হেডমাস্টার তার চেয়ে ঢের বেশি সহমর্মী-সহকর্মী। তাঁর অনেক কিছু নিয়ে লিখতে ইচ্ছে হলেও পারি না,একটা খচখচানি লেগেই থাকে। এই যেমন সেদিন দেখি বারান্দা দিয়ে একপ্রকার ছুটছেন তিনি। পেছনে নির্মল।
নির্মলকে বললাম--"হেডমাস্টারমশাইকে তাড়াচ্ছ কেন?"
জানা গেল স্কুলের একজন সহকর্মী অনেক সকালে এসেছেন কিন্তু  খাওয়ার বন্দোবস্ত থাকলেও তাঁকে সময়ে জানানো হয় নি। হোক বেলা দেড়'টা এই অবেলায়ও যদি অনুরোধ করে ভাতের থালায় বসানো যায়। না এসব কথা লিখতে পারি নি-- উনি যে হেডমাস্টার। 
-- যদি কথাগুলো তোষামোদের মতো মনে হয়, যদি তেল দেওয়া টাইপ ঠাহর হয় কারো, যদি কেউ ইয়ে মানে তল্পিবাহক ভেবে বসে! তাই লিখি লিখি করে লেখা হয় নি।
ভেবে দেখলুম হেডমাস্টার না হোক একটা মানুষকে নিয়ে তো দু'চার কথা লেখা যায়। ভালো ডাক্তার, ভালো মোক্তার, ভালো মাস্টার ভালো যাই কিছু হও না কেন আসলে তো ভালো মানুষ হয়ে উঠতে হয় আগে। এতক্ষণে তিনি ফোন থেকে ফিরলেন। আমি ছুটির আবেদন করার আগেই তাঁর সেই অহেডমাস্টার সুলভ হাসিটা ছড়িয়ে বললেন--
"মেয়েটিকে ছেড়ে দিয়েছে,তবে এখনো বেশ দূর্বল। রেজাল্টটা জানিয়ে দিলাম। একটা টেনশন তো থাকেই-- ক'দিনই বা স্কুলে আসার সুযোগ পেয়েছে বেচারারা! তবে বকুনি দিয়ে বলেছি এবার থেকে যেন পেট ভর্তি খায়।" বুঝলাম এতক্ষণ ঐ বকবকম চলছিল। কাল ভ্যাকসিন নিতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে যায় মনসুরা। এমনিতে সূচ দেখলে ভয় তার উপর সকাল থেকে কিছু না খাওয়া। চোখ উল্টে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছেতাই অবস্থা। স্বাস্থ্য কেন্দ্রের পর্দা সরিয়ে দেখি মনসুরার কপালে ভরসার হাতে রেখেছে মানুষটা। শুধু নামটুকু নয় টাইটেলটাও জব্বর মানিয়ে গেছে মানুষটার সঙ্গে। শেঠ মানে একটা বড়সড় ব্যাপার। আশ্চর্য নাম প্রাণনাথ শেঠ। মনোহরপুর থেকে  বদলি নিয়ে এলেন পরাণচকে। জায়গাগুলোও কেমন যেন একে অপরের চেনা।

 

******


রানাং মাতুল ক্রম... মস্ত টাক, ছোট্ট একটা ভুঁড়ি নিয়ে আমি নাকি একদম 'হারাধন চক্কত্তি'। 'হারাধন চক্কত্তি' হলেন আমার বড় মামা। গায়ের রং,মুখের আদল সবটাতেই আমি বড় মামা। খুব ছোটবেলা থেকেই আমি মামার ন্যাওটা।আমরা মামা বাড়িতে গেলেই বড় মামা বাতাড়ি জাল( বাতাড়ি জাল বড় জাল, আসলে প্রিয়জনের জন্য চাওয়াটা সব সময়ই মস্ত হয়) নিয়ে হাঁটা দিত বড় পুকুরে। বালতি হাতে পেছন পেছন আমি। জাল ফেলার আগে মামা পুকুর পাড়ে বিছিয়ে দিত জাল আর আমায় বলত... 
"ভমলা নুঙ্কুটা বের করে দে দিখি হিসু করে, দেখি মাছ কেমন জাল ছাড়া হয়।" ছেলেবেলার সে স্মৃতি বড্ড বেদনার। অধিকাংশ দিন খালি বালতিই ফিরত হাতে দুলতে দুলতে। মন খারাপ হয়ে যেত। আমার চাওয়ার জোর কি এতোটাই কম! আর আমার পেচ্ছাব! মামা বুঝতে পেরে সান্ত্বনা দিত...
"ভরা পুকুর জলে মাছ পাওয়া কি এতোই সহজ কাজ।"   তখন পাঁচ কি সাত হব। বাদল খুড়োর কাঁধে চেপে কোনো কোনো দিন পৌঁচ্ছে যেতাম আমাদের টালি-ইট ভাটায়। বাদল কাকুর কাঁধ ছেড়ে দুঃখিরাম কাকু তার থেকে হরেরাম জেঠা তার থেকে বাঘাদা....    মাটিতে পা পড়ত কই! মালিকের ছেলে বলে কথা। সবাই তখন আমাকে 'ছোটবাবু' বলত।একবছর অকালে প্রবল বৃষ্টি। ছ'মাসের মধ্যে দেনার দায়ে বাবা ভাটা বিক্রি করতে বাধ্য হলেন। আমার জ্ঞানাবধি আমার 'ছোটবাবু' হওয়াটা একবছরও টেকসই হয় নি। বাবা অভাবের চাপে বছর খানেকের মধ্যেই মালিক থেকে হয়ে গেলেন ম্যানেজার-- অন্যের ভাটায়।
মাধ্যমিক পরীক্ষার আগের সরস্বতী পূজায় সরস্বতী মাকে, না খেয়ে, শীত স্নানে কাঁপতে কাঁপতে জানিয়ে ছিলাম... "কিচ্ছু চাই না মা, শুধ্ধু ফাস্ট ডিভিশন...." হয় নি। যে মেয়েটা হাত দুটো হাতে নিয়ে বলেছিল..."তুমিই আমার সব। "যৌথ যাপনের গয়া প্রাপ্তি ঘটিয়ে, তিন মাসের মধ্যে তিনি হনিমুনে গিয়েছিলেন গোয়ায়। বুঝেছিলাম জীবনের সমস্ত অঙ্ক নিরীহ হয় না। আসলে জীবনটাই একটা সিঁড়ি ভাঙা অঙ্ক। চাকরিটা হয়তো বছর পাঁচ আগেই জুটে যেত যদি ভাবনাটা দশ মিনিট আগে মাথায় আসত।
মারজিন্যাল কস্টিং এর যে অঙ্কটার সমাধান পরীক্ষার হলে হাজার হাতড়েও পেলাম না, হল থেকে বেরিয়ে পেচ্ছাব করতে করতে মুহূর্তে খেলে গেল মাথাটা। পেচ্ছাবখানার দেওয়ালে মাথা ঠুকতে গিয়েও টাক সামলে পিছু হটলাম। সেদিন পুকুর পাড়ে মামার বেছানো জালে আমার বার্থ পেচ্ছাব মনে পড়ছিল বারবার। আমার বুকে বাবার মাথা। চামচে চামচে তরল খাওয়ার বাবার মুখে দিচ্ছিলাম। গলার পাতলা চামড়ার নিচে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল বাবার ঘোট গেলা। তখনও বুঝতে পারি নি ওটাই বাবার শেষ খাওয়া। আর কয়েক মিনিট পর বাবা আর আমাদের মধ্যে থাকবেন না। শেষ কটা দিন মা হাসপাতালের বিছানায় নিথর নীরব। আমরা ভাই বোন প্রতিদিনই ভাবছিলাম মা ঠিক কাল চোখ মেলবেন....
ডেকে উঠবেন..." ভমলা।" আমাদের সব চাওয়াকে মিথ্যে করে বছরের শেষ দিন চলে গেলেন মা।এই তো কদিন আগে- চায়ের দোকানে বসে আছি। ছেলেবেলার এক বন্ধু হেঁটে হেঁটে এ্যাম্বুল্যান্সে উঠল। অসুস্থ।  ডাক্তারের কাছে যাচ্ছে। চা ছেড়ে উঠে যাব ভাবলাম। ভাবলাম উঠে গিয়ে বলি...
"কি রে কেমন আছিস এখন?"
তারপর ভাবলাম এখন ডাক্তারের কাছে যাচ্ছে যাক, ফিরলে বাড়িতে যাব। ক'দিন বাদেই শুনি সে বাড়ি ফিরছে গাড়ি করে। শব বাহী গাড়ি। আমার আর তাকে জিজ্ঞেস করাই হল না...
"কি রে কেমন আছিস এখন?"
কালকের দিনটা যেমন করে কাটাতে চাই তা যে ভাবেই চাই না কেন, যত নিখুঁত পরিকল্পনাই করি না কেন শেষ পর্যন্ত তা মেলে না। আশ্চর্যের সঙ্গে একটা আকাশ জমিন তফাৎ ঘটে যায়। যেখানে প্রতিটা মুহূর্ত ভয়ঙ্কর রকম অনিশ্চিত। যেখানে নিজের চাওয়ার সঙ্গে নিজের আগামী কালটাই মেলাতে নিজেরাই অব্যর্থ ব্যর্থ। সেখানে কেবল লৌকিকতার জন্য বলতে হয়.... "আগামী বছরের প্রতিটা মুহূর্ত আপনার আনন্দময় হোক।"

******

-- দুটো ডিফারেন্ট ফ্লেভার দেই?
-- না না একদম নয়।
-- দুটো একই!
-- একদম।
দোকানটায় পা ফেলার জায়গাটুকু নেই। আনন্দিত লোকজন কেক কিনে উধাও হয়ে যাচ্ছে মুহূর্তে। দোকানটাতে যারা কিনছেন আমার মনে হয় তারা সবাই বাইরের লোক। রেল স্টেশন-রাজ্য সড়ক-জাতীয় সড়ক সবটাই এসে মিশেছে এখানে। তাই এখানে লোকজন স্থিতিশীল নয়। একটা অস্থিরতা সঙ্গে নিয়েই আসে তারা। যেমনটা আমিও। হাঁটার গতির সঙ্গে কেকের প্যাকেট দুলতে রইল হাতে। বাসটা গতি বাড়ানোর আগেই দৌড়ে গিয়ে পা রাখলাম পা-দানিতে। তাড়াটা জবরদস্ত, ছেলে অপেক্ষা করে আছে কেকের জন্য। শীতে মানুষজন অনেক বেশি রঙিন হয়ে যায়। কত রং বেরঙের সোয়েটার-চাদর- মাফলার। সাজ-পোশাকে লোকজন পাল্টেও যায় বেশ।
এই তো দিন দুই আগে টুপি-জ্যাকেটে আমার এক পরিচিতা অনেক চেষ্টাতেও আমাকে উদ্ধার করতে পারে নি। বাসে জানালা তোলা, তবুও কোথা থেকে বাতাস ঢুকছে সূচের মতো। উইন্টার ক্রিমের সুবাস পাক খাচ্ছে সে বাতাসে। উইন্টার ক্রিমে একটা মাদকতা থাকে, থাকে যৌনতাও। কোলের উপর রাখা কেকের গন্ধ ক্রিমের সুবাস ছাপিয়ে নাকে ঢুকছে। চোখের পাতা বন্ধ হতেই বেডসিট পাতা তক্তবসে থরেথরে সাজানো কেক দেখতে পেলাম। দেখতে পেলাম আমার ছেলেবেলার কেকের দোকানটাকে। স্পষ্ট দেখতে পেলাম বাবাকেও, চোখ কুচকে, চোয়াল শক্ত করে কলা গাছের নরম শিকড় চেবাচ্ছে বাবা।
এ্যালুমিনিয়মের জাম বাটি থেকে শিকড় গুলো ধুয়ে ধুয়ে তুলে দিচ্ছে মা। কঠিন শীতও কোনো দিন জব্দ করতে পারে নি মাকে। পরার কাপড়টাকে এমন একটা কায়দায় শরীরে জড়িয়ে নিত মা, যেন ওটা চাদর। শীতের পোশাক বলতে -উলের একটা চাদর ছিল মার আর ফ্যানেলের একটা থ্রি-কোয়াটার ব্লাউজ। চাদরটা রাখা থাকত ট্রাঙ্কে। শীতে বাইরে কোথাও বেরালে বের হত সে চাদর, ন্যাপথালিনের গন্ধ নাগত নাকে। ফ্যানেলের ব্লাউজটা অবশ্য মা পরত বাড়িতেই। ব্লাউজটা আমার এক মাসি দিয়েছিল মাকে। হোক রং চটা তবুও পরলে বেশ মানাত মাকে। বড়দিনে যখন অন্যদের বাড়িতে কেক আসত তখন বড্ড মন খারাপ হয়ে যেত আমাদের। মা বড় দিনে রুটি না বানিয়ে জলরুটি বানাত। খেজুর গুড়ের সঙ্গে সেই জলরুটিই ছিল আমাদের বড়দিনের কেক। সেসব বড়দিনে বড়দিন ছিলাম আমরা।
একবার বাবা রঙিন পলিথিন মোড়া বড়দিনের কেক এনেছিল ছাব্বিশে ডিসেম্বরে। ভাই-বোন হুটোপাটি ফেলে দিয়েছিলাম। বুঝেছিলাম মায়ের জলরুটির চেয়ে আলাদা কিছু ছিল না সেটা। শীতটা বরাবরই বাবার কাছে ছিল বড় কষ্টের। শীতে বাবার দাঁতের সমস্যাটা বাড়ত। ঔষধ কেনার পয়সা ছিল কোথায়, কলা গাছের শিকড় চিবিয়ে উপশম পেত বাবা। একটু আয় উপার্জন করে বাবাকে একটা শাল কিনে দিয়েছিলাম আমি। একটা নয় এক শীতে এক সঙ্গে দু-দুটো শাল পেয়েছিল বাবা। একটা আমি আর অন্যটা দিয়েছিল মেজদি। শাল দুটো পেয়ে বাবার সে কি আনন্দ। সেদিন আমরা কেউ জানতামই না ঐ শীত থেকেই বাইরে বেরানোর শক্তি হারিয়ে ফেলবেন বাবা। আর এক শীতের ডিসেম্বরে হাসপাতাল থেকে মা বাড়ি ফিরলেন। তখন তার শরীর বরফের থেকেও ঠান্ডা। এখন থেকে থেকেই মনে হয়--কেবল একটু আয় উপার্জন বেড়েছে এই যা। সেদিনের মতোই আজও বড় দীন আমরা।
জব্বর জ্যাকেটেও বেশ শীত শীত লাগে।

কবিতা

রীনা  নন্দী 

বিপিন বিহারী গাঙ্গুলী স্ট্রীট, কলকাতা 

কবিতাঃ রীনা নন্দী

 মার্চ ২০২২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

নশ্বর

কদিন হেঁটে যেতে যেতে
ছিটকে যাবই –
অথচ এই মঞ্চ-রূপায়ণ,
টিকিটঘর, বাজার সব থাকবে
লুকনো সঞ্চয়ে থেকে যাওয়া
ধাতব কয়েনও অবিনশ্বর!

সামান্য গন্ধটুকু আমার
রয়ে যাবে এক কোণে
ধুলো জমতে জমতে
একদিন সেটুকুও উবে যাবে
হাওয়ার সাথে সাথে।

ভিড়

কটা ভিড়ে অনেক মানুষ
সকলেরই মোটামুটি দু’টো হাত,
দু’টো পা, একটা মাথা আর হৃদয় ......
অথচ প্রত্যেকেরই পরিস্থিতি,
মন, সঙ্কটের অনেক তারতম্য।
আর সকলেই একটা বিন্দুতে
মিলে যেতে চাইছে প্রাণপণ
একটু, আরো একটু ভালো থাকার জন্য
এগোতে চাইছে ভিড়ের জটলাটা।

maple1.jpg

হয়তো সেদিন

ত দিন পারো কুসুম-রোদ্দুরে 
হাত পা সেঁকে নাও।
কে বলতে পারে
কবে আছে কবে নেই!
সময় বদলালে রোদ যদি
কাঠ ফাটা হয়!
জ্বলন্ত পৃথিবীতে হয়ত একদিন
কুসুম-রোদ্দুর শুধুই গল্পকথা।

হিজল গাছ

তাকে দেখে মনে হোতো
প্রচন্ড দহনে জ্বলে যাওয়া
মাঠের মত; খরা মাঠ
অজন্মা চিরকাল হাত ধরে তার।
একদিন ঝড় এসে পৃথিবীর
সেই মাঠে কিভাবে যেন
উথাল পাথাল ! তার নিজেরই
মাটির ভিতর জমে থাকা
তপ্ত বাতাস জমে জমে
ঘন কালো মেঘ –
সেই মেঘ ভেঙে ভেঙে
হঠাৎই বৃষ্টি এলো
আর ভিজে মাটি
ভেদ করে উঠে এলো
জীবনানন্দের হিজল গাছ।

কবি হিজল গাছটা
তোমাকে উৎসর্গ করলাম 

মতামত

Please mention the "name of the article and the author" you would like to comment in the following box... Thank you.

 মার্চ ২০২২ ।। সূচীপত্র

bottom of page