মার্চ ২০২২
কবিতা
লেখক ও লেখিকাবৃন্দ
প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা
বাউল
একলা বেশ তো আছি, একলা থাকাই ভালো
দুপুরে ডিস্কো নাচি, রাতে পাই চাঁদের আলো।
কোনো এক নিঝুম দুপুর, কিংবা গভীর রাতে
মনে আর পড়েই না তো, টান দিই গঞ্জিকাতে।
পরোয়া করব কেন? সমাজটা দিচ্ছে বা কী?
ছোট্ট জীবন আমার, তাইতো নাচতে থাকি।
পলকা এই জীবনে, কী হবে দুঃখ এনে?
চল্ না উড়াই ঘুড়ি, সুতোতে মাঞ্জা টেনে।
লাফিয়ে পাহাড় চড়ে, সাঁতরে নদীর বুকে
কবিতা দু'এক কলি আসলে রাখছি টুকে।
এভাবে কাটছে তো দিন, তোমাকে আর কী খুঁজি?
জানিনা কোথায় তুমি, আমাকে ভাবছো বুঝি?
ভাবলে কী হবে আর, নদীতে জল গড়ালে
চাঁদটা বন্ধু আমার, গভীর এই রাত্রিকালে
গাছেরা আগলে রাখে, পাখিরা গাইতে থাকে
ঘরে আর যায় কী ফেরা? ওই যে বাউল ডাকে !
জল
সেতু? হ্যাঁ গো, সেতুই পাতো তোমার আমার বুকে
চিরটাকাল ভালবাসা থাক না বাঁধা সুখে।
সুখের বাঁধন আলগা হলেই নামব আবার জলে
জলে জন্ম, জলে মৃত্যু, জলেই বাঁচতে বলে।
জল হয়ে তাই তোমার পাশে যেই না আমি নামি
ভালবাসার অতলতলে যাই তলিয়ে আমি!
জল তো মুছে ফেলে সবই সাঁতরে যাবার পরে
তাই বিরহ দেয় না উঁকি জলের কোনও স্তরে।
ভুলে যাওয়া বরং ভালো, ভুলতে কি আর জানি?
তাইতো শুধু হৃদয় সেঁচে দুঃখ তুলে আনি।
বিপ্রলব্ধ
ত্রাহ্যস্পর্শে তিথিক্ষয়ে চাঁদের দেখা নেই
মঞ্জুষাতে লক্ষ্মীকে নয়, চাইছি তোমাকেই।
তামরসের মতোই তুমি, মুগ্ধ হয়ে থাকি
ধৈবতহীন আরোহণে তিলক কামোদ রাখি।
অনিকেত শব্দচাষী বন-পাহাড়ে ঘুরি
স্মিত হাসির ময়ূখছটায় মন করেছ চুরি।
ভৈরবের ওই বিরহী সুর পাখির ডাকে ঝরে
বিপ্রলব্ধ, বিহানবেলায় বড্ড মনে পড়ে।
শব্দার্থ
তিথিক্ষয় ~ একদিনে দুই তিথির ক্ষয় হয়ে তৃতীয় তিথির সংযোগ; ত্রাহ্যস্পর্শ; অমাবস্যা।
মঞ্জুষা ~ লক্ষ্মীর ঝাঁপি।
তামরস ~ পদ্ম।
তিলক কামোদ হল একটা রাগ।
এই রাগে অবরোহণে সাতটি সুর থাকলেও আরোহণে ধা বা ধৈবত সুরটি থাকে না।
অনিকেত ~ গৃহহীন পথিক।
শব্দচাষী ~ কবি।
ময়ূখ ~ রশ্মি।
ভৈরব হল প্রভাতকালীন একটা রাগ।ভোর বেলা গাওয়া হয় এই রাগ।
বিপ্রলব্ধ অর্থ বঞ্চিত বা প্রতারিত।
বিহানবেলা মানে সকালবেলা।
জলছবি
বেঁচেই আছি বাঁচছি বেশ
চশমা এঁটে পক্ক কেশ।
জীবনটা কী? জানি কী কেউ?
মিথ্যে শুধু গুনছি ঢেউ।
বাড়ছে যত বাঁচার আশা
যাচ্ছে বেড়ে ক্ষুৎপিপাসা ।
কীসের খোঁজে ইঁদুর দৌড়
ছুটছে লোকে ছুটছে জোর।
দিনটা আসে দিনটা যায়
চমকে খসা ঝরাপাতায়
কলকলানো নদীর পাশে
চুপটি করে মৃত্যু আসে।
দ্বন্দ্ব
জল আগে না পানি?
আমরা কী তা জানি?
ওসব জানতে গেলে আগে
পেতে হয় জলপানি।
গড বড় না আল্লা?
কার যে ভারি পাল্লা?
পরনে তাদের হ্যাট-কোট-বুট
না কি আলখাল্লা?
হিন্দু না মুসলিম?
উচ্ছে না কী নিম?
মরার পরের ভয় না পেয়ে
বাঁচ্ না ভীতুর ডিম।
আল্লা হরির ভক্ত?
এদের মেলা শক্ত?
কাটলে পরেই দেখতে পাবে
লাল দুটোরই রক্ত।
কাঁটাতার
আমরা পাখিরা উড়ে যাই কতদূরে
কত দেশ-গ্রাম ইয়ত্তা নেই তার
মানুষেরা শুধু ঝগড়া-বিবাদ করে
মানুষের শুধু দেশভাগ কাঁটাতার।
আমরা নদীরা বয়ে যাই কত দূরে
পাহাড়ের থেকে দূর সাগরের পার
মানুষেরা শুধু দ্বন্দ্ব-বিবাদ করে
মানুষের শুধু দেশভাগ কাঁটাতার।
আমরা আলোরা সূর্যের থেকে এসে
ভেদাভেদ ভুলে ঘোচাই অন্ধকার
মানুষেরা শুধু দ্বন্দ্ব-বিবাদ করে
মানুষের শুধু দেশভাগ কাঁটাতার।
আমরা মেঘেরা হাওয়ার ডানায় ভেসে
কত পথ চলি হিসেব থাকে না তার
মানুষেরা শুধু দ্বন্দ্ব-বিবাদ করে
মানুষের শুধু দেশভাগ কাঁটাতার।
মানুষেরা কেন কাঁটাতার ভালোবাসে?
হিংসা বা দ্বেষে কেন যে বিবাদমান!
কেন যে শেখেনি ভালোবেসে বেঁচে থাকা,
নদী বা বাতাস, মেঘ-পাখিদের গান।
কবিতা
পার্থ সরকার
বড় বেশি শব উৎসবে
বড় বেশি শব উৎসবে
নাকচ হয়ে যায় প্রধান শব্দসমূহ
ক্ষরণ অফুরান
আনাচেকানাচে লোলুপ স্তাবকতা
কোথাও ঘৃণার সরু রেখা
অগ্নিনদ!
হয়তো
হয়তো নয়
তবু, একদিন শেষ
উৎসবে
শবের আনাগোনা
একদিন সত্যই শেফালী
একদিন সত্যই কাশ
আমি
যতটা পারি
গঠনে আছি
গৈরিক মাটিতে
এক সড়ক
তোমার জন্য...।
ক্লান্ত প্রচ্ছদ গল্পের
ক্লান্ত প্রচ্ছদ গল্পের
আচ্ছাদন সরিয়ে ঘরে আসে
অলীক খাসমহল
ব্যবধানে ধ্বস্ত মরুৎ
মরুতেজ
অবধারিত বিতাড়িত বায়স...
প্রণম্য এই বিষাদ কেন ?
হয়তো জানে মেরুক্ষেত
হয়তো বিশদে আছে আরো খেদ
তবু...
পুনশ্চ...
যদি কোনদিন
শস্যের অন্য কারুকাজে...
তবে...
গল্পের ক্লান্ত প্রচ্ছদ
হোক...
আজ সারাবেলা আমার কাজের শেষ নেই।
ভাবি, এক চক্কর দিলেই
ভাবি, এক চক্কর দিলেই তোমার আমার
সোনালি ডানা... আর প্রতিবারেই ভাবনার
মাঝপথে জলসত্রের আধখানা বাড়ি আর
প্রতিবারেই মুখ থুবড়ে পড়ে একগোছা প্রজাপতি।
প্রবন্ধ
এক নিভৃতচারী সমাজ সেবক
সংগঠক জনাব আব্দুল হান্নান
মিজানুর রহমান মিজান
এ পৃথিবীর বুকে আমাদের তথা মানব সমাজের আগমনের সহিত মৃত্যুর আলিঙ্গন রয়েছে মিতালী সমতায়। অর্থাৎ জন্মিলে মৃত্যু অবধারিত। একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। মহান রাব্বুল আলামিন আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন তিনির গুণ গান, তিনির প্রদত্ত নেয়ামতের শুকরিয়া আদায়, ভাল কাজের প্রতি মনোযোগী হওয়া, মন্দ বা নিষিদ্ধ কাজকর্ম পরিহার করে সুন্দর ও ভাল কাজে নিজকে উৎসর্গিত করা। আমরা পথ ভুলা হয়ে গেলে আলো ছড়াতে, সঠিক পথে চলতে, দিকনির্দেশনার নিমিত্তে পাঠিয়েছেন নবী ও রাসুল যুগে যুগে। ক্ষণস্থায়ী এ জীবনে আমরা যতটুকু সম্ভব ভাল কাজ করা উচিত বলে মনে করি। কারণ পৃথিবীতে অমরত্ব লাভ কেহই করতে পারেননি, পারবেনও না। তবে অমরত্ব লাভের সুযোগ রয়েছে ভাল কাজ করে যেতে পারলে। কাজের মধ্যেই রয়েছে অমরত্বের সুযোগ। “মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য” এ বাক্যের অন্তর্নিহিত মর্মবাণীতে। মানুষের কল্যাণ করতে পারলে মানুষ চিরদিন কর্মকে মূল্যায়ন করে। অমরত্বের সুযোগ সৃষ্টি হয়। মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নেয়া সম্ভব হয়। অপরদিকে কিছু কিছু কাজ রয়েছে তা করতে হলে চিত্তের সহিত বিত্তের প্রয়োজনীয়তা অবশ্যম্ভাবী। কারণ হিসাবে এখানে উল্লেখ করতে চাই, কোন কোন সময় দেখা যায় অনেকের টাকা আছে। কিন্তু ভাল কাজ করার মন মানসিকতার অভাব। কারো মন মানসিকতা ভাল কাজ করার ইচ্ছা থাকলেও অর্থের অভাবে সম্ভব হয়ে উঠে না। তাই শুধু চিত্ত বা বিত্ত হলেই সম্ভব নয় অনেক ক্ষেত্রে। সেক্ষেত্রে চিত্ত-বিত্তের সমন্বয় অপরিহার্য।
একটি আদর্শ, সুন্দর ও সুষ্ঠু সমাজ গঠন করতে হলে সহানুভূতি, সহমর্মিতা একে অন্যের প্রতি ভালবাসার সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্কের বিকল্প নেই। পরস্পর সহানুভূতি ও সহমর্মিতা সৃষ্টির লক্ষ্যে সকল সৃষ্টি কুলের অধিকার সংরক্ষণ অবশ্যম্ভাবী। “মহান রাব্বুল আলামীন ন্যায়পরায়ণতা, সদাচরণ এবং আত্মীয়-স্বজনকে দান করার আদেশ দিয়েছেন এবং তিনি অশ্লীলতা, অসঙ্গত কাজ এবং অবাধ্যতা করতে বারণ করেছেন”। হিংসা-বিদ্বেষ সমাজের সুন্দর ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশের মারাত্মক অন্তরায়। সমাজে জ্বলে উঠে অশান্তির আগুন। পানির অপর নাম জীবন। পানির দ্বারা শুধু মানুষ পিপাসা নিভৃত করে না, জীবন-ধারণ করে অন্যান্য জীব-জন্তু, পশু পাখিও। ফসল ফলাতেও পানির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। আবার অধিক পরিমাণে পানি হলে বন্যা হয়ে যায়। তাতে সকল দিকে ক্ষতির সমূহ কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ভাসিয়ে যেমন নেয়, পচাতেও সাহায্য করে। সুতরাং সমতা, সুষ্ঠু, সুষম ও পরিমিত পরিমাণ ব্যবহার একান্ত প্রয়োজন। প্রত্যেক মানুষের উপার্জিত বৈধ অর্থ বৈধ খাতে ব্যয় করার মধ্যে রয়েছে আলাদা তৃপ্তি, মনের প্রশান্তি। পরিবার পরিজনের ব্যয় নির্বাহিত করে উদ্ধৃতাংশ থেকে সমাজের অসহায় বঞ্চিত মানুষের কল্যাণে ব্যয় করা ও সমাজের কল্যাণার্থে ব্যয় করার তাগিদ রয়েছে ইসলামিক দিক থেকে যেমন, তেমনি সামাজিক ও সামাজিকতার দিক থেকেও। অপব্যয় করা, কৃপণতা করা নিষিদ্ধের অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।সর্বক্ষেত্রে মধ্যম পন্থা অবলম্বন বাঞ্ছনীয়। একজন মানুষ এ সকল চিন্তায় সামান্যতম প্রভাবিত হলেই তিনি হয়ে উঠেন অনায়াসে হৃদয়জ মানুষ হিসাবে। যে মানুষের হৃদয়ে মানুষের নির্মল ভালবাসায় কিঞ্চিৎ পরিমাণ হলেও মানুষের কল্যাণ কামনা করেন বা জাগ্রত হয়, সে মানুষ অল্প বিস্তর হলেও মানুষ, সমাজ ও সামাজিকতা অনুধাবন করে থাকেন যদিও তার পরিমাণ কম বেশী হয়। আমার আজকের লিখার শেষের দিকে এ কথাগুলি বলার কারণ অবশ্যই আমি ব্যাখ্যা করব সবিস্তারে।
সকল প্রশংসা মহান রাব্বুল আলামিনের যিনি আমি/আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এবং মানুষকে শ্রেষ্ঠ বলে ঘোষণা দিয়েছেন এ পৃথিবীর বুকে। আল্লাহর অপার দয়ামায়া, করুণার মাধ্যমে আমাদেরকে হেদায়েতের ও আলো দেখিয়েছেন সর্বশেষ, সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হযরত মোহাম্মদ (স:)এর মাধ্যমে। পথহারা মানুষ পেয়েছে পথের দিশা, হয়েছেন আলোর দিশারী।গড়ে উঠেছে আদর্শ পরিবার, সুষ্ঠু সমাজ, সুষম অর্থনীতি। আমাদের মধ্যে ভুলের পরিমাণ থাকা স্বাভাবিক। তারপর ও আমাদের আন্তরিকতা যদি থাকে তবে শুধু টাকা পয়সা দিয়ে মানুষ বা সমাজের উন্নয়ন সাধন হয় না বা করা যায় না। মানুষ এবং সমাজের উন্নয়ন বা কল্যাণার্থে কাজ করার রয়েছে বহুবিধ পন্থা। অনেক সময় কথা দিয়ে, আচার আচরণ ইত্যাদি দিয়েও কল্যাণ করা সম্ভব। প্রয়োজন আন্তরিকতা, ভালবাসা, মন মানসিকতার। আমি সম্পূর্ণ নির্ভরশীল মহান আল্লাহ তওফিক দিলে এ লেখাটি সম্পূর্ণ করার। আল্লাহ সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী।
ধনে-জনে আলোকিত (সিলেটের) বিশ্বনাথ উপজেলার খাজাঞ্চী ইউনিয়ন একটি ঐতিহ্যবাহী কৌড়িয়া পরগণার অন্তর্ভুক্ত ইউনিয়ন। যেখানে জন্ম নিয়েছেন অনেক কীর্তিমান মানুষ। যাঁদের মধ্যে কয়েকজনের নাম না নিলে কৃপণতার সামিল হয়ে যাবে। অথবা একটা দায়বদ্ধ ঋদ্ধতার অনুশোচনায় পড়ে যাচ্ছি বলে মনে হচ্ছে। সুতরাং আমি চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি আমার একেকটি লেখায় সকল গুণীজনের নাম স্মরণ করতে। এখানে উল্লেখ করতেই হয়, অবসর প্রাপ্ত কর্ণেল মরহুম তৈয়বুর রহমান পাখিচিরী, মরহুম মাওলানা আব্দুল বারী ইসলামাবাদ, মরহুম মাওলানা ওলিউর রহমান (র:) তেলিকুনা, সাবেক চেয়ারম্যান মরহুম আব্দুল মজিদ ইসলামাবাদ (যিনি খাজাঞ্চী ইউনিয়ন পরিষদ সংলগ্ন স্থানেই পোষ্ট অফিসের ভূমি দাতা এবং পোষ্ট অফিসের নামকরণ করেন ইসলামাবাদ, (এ বিষয়ে অন্য লেখায় আলোচনা করার প্রত্যয়ী প্রত্যাশা রাখি), অবসর প্রাপ্ত সাবেক অধ্যক্ষ মাওলানা শফিকুর রহমান পাখিচিরী, আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে সুপরিচিত মরহুম ডা: আবুল লেইছ ইসলামাবাদ, সালিশ জগতের ব্যক্তিত্বময় ব্যক্তি মরহুম সাবেক চেয়ারম্যান পীর লিয়াকত হোসেন হোসেন পুর, শিক্ষাবিদ ও সাউথ-ইস্ট ব্যাংকের ডিজি মরহুম আলতাফুর রহমান ঘাসিগাঁও প্রমুখ খাজাঞ্চীবাসীর আলোকবর্তিকা। এবার মুল বক্তব্যে যাবার চেষ্টায় হচ্ছি নিমজ্জিত।
খাজাঞ্চী ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডের অন্তর্গত হোসেন পুর একটি গ্রাম। যে গ্রামে ১৯৪০ সালের সাত ডিসেম্বর পিতামৃত আবরু মিয়া ও মাতামৃত পাখি বিবি দম্পতির কোল আলোকিত করে মোল্লাবাড়ি খ্যাত বাড়িতে জন্ম গ্রহণ করেন পিতামাতার তৃতীয় সন্তান আলহাজ আব্দুল হান্নান। অত্যন্ত আদর যত্নে শিশুকাল অতিবাহিত করেন নিজ বাড়িতে পারিবারিক সুদৃঢ় বন্ধনের মধ্য দিয়ে।কিন্তু ১৯৪৭ সালের পূর্বে অত্রাঞ্চলের মানুষ লন্ডন, আমেরিকার মত চাকুরী, অর্থনৈতিক উন্নয়নের নিমিত্তে চলে যেতেন কলিকাতা। তখন গ্রামের মানুষের মুখে মুখে ছিল কলিকাতার অপর নাম কালিমাটি। কালিমাটি থেকে কেহ ফিরে আসলে তিনিকে দেখার জন্য মানুষের ভীড় লেগে যেত। চাকুরী সূত্রে জনাব আব্দুল হান্নানের চাচা হাজী আছলম আলী ছিলেন কলিকাতার বাসিন্দা। তাই আদরের ভাতিজা আব্দুল হান্নানকে কলিকাতা নিয়ে যান চাচা আছলম আলী লেখাপড়া করানোর জন্য।সেখানে কলিকাতার জামসেদ পুর জেলার গুলমুরি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করেন। প্রায় দু’বৎসর আব্দুল হান্নান সেখানে থেকে চলে আসেন নিজ বাড়িতে। অত:পর তিনি ভর্তি হন স্থানীয় ফুলচন্ডি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। পাঠশালার লেখাপড়া সমাপন করে তিনি কৃষিকাজে আত্মনিয়োগ করেন। এক সময়ে তিনি ব্যবসাকে ভালবেসে মুফতির বাজারে রাইছ মিল স্থাপন করেন। কিছুদিন তা পরিচালনা করে ১৯৭০ সালে সিলেট শহরের হাছন মার্কেটে ব্যবসা শুরু করেন। সে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তিনির ভাই কর্তৃক দীর্ঘদিন হয়েছে পরিচালিত। বর্তমানে ভাই অসুস্থতাজনিত কারণে ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন।
১৯৫৪ সালে রাজনীতির সহিত সম্পৃক্ত হন যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনকালীন সময়ে। ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আসেন সিলেটের রেজিস্টারি মাঠে এক জনসভায়। শেখ মুজিবের ঐদিনের
ভাষণ শুনে হান্নান সাহেব অভিভূত হয়ে যোগ দেন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে। হয়ে উঠেন আওয়ামীলীগের একজন দক্ষ সংগঠক, কর্মী ও সমর্থক হিসাবে। আসে ১৯৭০ সালের নির্বাচন। বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ নৌকা প্রতীক নিয়ে একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন করলেও পাকিস্তানের ইয়াহিয়া-ভুট্রো শেখ মুজিবের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর না করে বিভিন্ন কুট-কৌশলের আশ্রয় নেয়। বাঙ্গালীর ন্যায্য দাবীকে দমিয়ে রাখার আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালায়। তাই ২৫শে মার্চ রাতে সশ্রস্ত্র ও সুসজ্জিত একটি বাহিনীকে অতর্কিতে নিরস্ত্র বাঙ্গালীর উপর লেলিয়ে দেয়। ওরা নির্বিচারে গণহত্যা চালায়। কি বিভীষিকাময় পরিবেশ! সারা দেশ জুড়ে আতংক, হতাশা ও শঙ্কায় শঙ্কিত পুরো জাতি। যে যেভাবে পারে শুরু হয় প্রতিরোধ। পাকবাহিনী শুরু করে ধরপাকড়, অত্যাচার, নির্মম নির্যাতন। এপ্রিলের প্রথমার্ধে পাকবাহিনী কর্তৃক খাজাঞ্চি রেলওয়ে ব্রীজের পূর্ব তীরে আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল হান্নান, মরহুম লিলু মিয়া, মরহুম ডা: আব্দুল করিম, মরহুম তোয়াহিদ মিয়া গং আরো লোকজনের মাধ্যমে খনন করাতে থাকে ব্যাংকার। পশ্চিম তীরেও অনুরূপ ব্যাংকার, বাঁশ আনয়ন ও ব্রীজকে সুরক্ষিত রাখতে বাঁশের বেড়া দিতে অর্ডার করে প্রত্যেক গ্রামের প্রতিটি পরিবার আস্ত বাঁশ প্রদান করতে। দেয়া হয় নির্দেশ। মত না দিলে মেরে ফেলার ভয়। তাছাড়া চতুর্পাশ্বস্থ গ্রামের মানুষ দিয়ে পালাক্রমে ব্রীজ পাহারা দেয়ানো হত। একদিন রাতের বেলা দুই ঘটিকার সময় হানা দেয় পাকবাহিনী কিছু সংখ্যক রাজাকার সঙ্গে নিয়ে হোসেন পুর গ্রামে। খুঁজতে থাকে আব্দুল হান্নান, পীর লিয়াকত হোসেন গং আওয়ামীলীগ নেতা, কর্মী ব্যক্তিবর্গকে। ঐদিন ঘর থেকে লুকিয়ে বের হয়ে একত্রিত হন আব্দুল হান্নান, পীর লিয়াকত হোসেন ও বরই কান্দির রইছ আলী হোসেন পুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নিকটে। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে প্রাণ বাঁচাতে যে যেদিকে পারেন বিচ্ছিন্ন হয়ে দৌড়াতে থাকেন। আব্দুল হান্নান ও রহিম পুর নিবাসী জহুর আলী কাটা-খালি গোরস্তানে আশ্রয় নিয়ে রাত কাটান। গোরস্তানে থেকে ফজরের নামাজের পর পরই শুনতে পান দু’টি গুলির শব্দ। পাক সেনারা চলে গেলে এসে দেখেন হোসেন পুর গ্রামের খলিল উল্লাকে (পিতা রসিদ আলী) মসজিদের প্রস্রাব খানায় বসা অবস্থায় এবং ছোরাব আলীকে (পিতা কটু মিয়া) ধরে নিয়ে খাজাঞ্চী রেলস্টেশন সংলগ্ন স্থানে স্থাপিত টিউবওয়েলের নিকটে বুকে গুলি চালিয়ে হত্যা করে। ছোরাব আলী ছিলেন হাজী মকরম আলীর গৃহে চাকুরীতে। অন্য একদিন রমজান মাসে দুপুরবেলা আব্দুল হান্নানের ৬নং ভাই আব্দুল ছমদকে রেলস্টেশনে ধরে মারপিট করে। তখন সাবেক চেয়ারম্যান (খাজাঞ্চী ইউ/পি) আছকির মিয়া, কারী ইছাক আলী, তাদের বড় ভাই আব্দুল মন্নান অনেক কাকুতি মিনতি করে ছাড়িয়ে আনেন। অপর একদিন পীর লিয়াকত হোসেনসহ আরো দুই ভাইকে ধরে নিয়ে যায় সিলেট ক্যাডেট কলেজে। পীর লিয়াকত হোসেনের বড় ভাই ছিদ্দেক আলী ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ছিলেন। অনেক প্রচেষ্টার মাধ্যমে এ যাত্রায় ও রক্ষা পান। ঐদিন পাকসেনারা জনাব আব্দুল মন্নানকে বলে যায়, আব্দুল হান্নান সাহেব সিলেট সার্কিট হাউজে যাবার জন্য। নতুবা তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হবে। তাদের কথামত পরদিন সিলেট সার্কিট হাউজে যান, সারেন্ডার করেন ও রাজাকারদের সহযোগিতা করার কথা বলে দেয়া হয়। এক্ষেত্রে তারা মিয়া নামক একজন ব্যক্তির সহযোগিতায় মুক্তি পান। এ ঘটনার কয়েকদিন পর লিলু মিয়া, আলহাজ ছমরু মিয়া, মজমিল আলী, ডা: আব্দুল করিম ও রন দাসকে ধরে নিয়ে যায়। এখানে উল্লেখ করা আবশ্যক যে ঐদিন অনেক মানুষকে ধরেছিল। এখানে ঘাসি গাঁও এর ছাদ মিয়াও (আলতাফুর রহমান) ধৃত ছিলেন। কিন্তু ছাদ মিয়ার স্কুল, কলেজের সকল কাগজপত্রে আলতাফুর রহমান নাম থাকায় তিনিকে ছেড়ে দেয়। এরূপ বিভিন্ন উপলক্ষ্য দেখিয়ে পাঁচজন ব্যতীত সবাই ছাড়া পান। বিজয় দিবসের কয়েকদিন পূর্বে লামাকাজী থেকে পাকসেনা এবং ভুলাগঞ্জ গ্রাম থেকে মুক্তিবাহিনী উভয়দলের গুলি ছুড়াছুড়ি সন্ধ্যার সাথে সাথে আরম্ভ হলে ভুলাগঞ্জ গ্রামের সাবেক মেম্বার মন্তাজ আলীর স্ত্রী উরুতে গুলিবিদ্ধ হন।৩/৪ মাস পর তিনি মারা যান। অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার পর ১৬ই ডিসেম্বর আমাদের কাঙ্ক্ষিত বিজয় অর্জন হয়।
হান্নান সাহেবের প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া কম হলেও তিনি স্বশিক্ষিত। হোসেন পুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকালে এ পরিবার থেকে ১৮ শতক ভূমি প্রদান করা হয় এবং বাকি ১২ শতক ভূমি দান করেন মরহুম আলহাজ মখরম আলী। তাছাড়া আধুনিক শিক্ষার সাথে সমন্বয় রেখে সৎ ও দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার লক্ষে এবং উদ্দেশ্য নিয়ে ২০০৪ সালের ১ লা জানুয়ারি বর্তমান ভূমি দাতা মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক আলহাজ্ব আব্দুল হান্নানের নিজ বাড়িতে খাজাঞ্চি একাডেমীর আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়। পরবর্তীতে উক্ত প্রতিষ্ঠান ২০০৫ সালে তার নিজস্ব ভূমিতে এসে শিক্ষাকার্য পরিচালনা করে আজ অবধি সফলতার সাথে শিক্ষা বিস্তারে কাজ করে যাচ্ছেন। ২০০৯ খ্রীষ্টাব্দে খাজাঞ্চী একাডেমী জুনিয়র স্কুলের মর্যাদা লাভে সক্ষম হয় লেখাপড়ার মানোন্নয়ন ও প্রতি বৎসর কৃতিত্ব পূর্ণ ফলাফলের কারণে। ২০১২ সালে প্রথম এসএসসি পরীক্ষায় শতভাগ সফলতা অর্জিত হয়। প্রতিষ্ঠাতা ও ভুমিদাতা জনাব আব্দুল হান্নানের একক উদ্যোগ ও উদ্যমে অর্থাৎ অর্থায়নে ৫০ জন গরিব, অসহায় ছাত্র-ছাত্রী সম্পূর্ণ বিনা বেতনে পড়ার ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন।
২০১২ সালে প্রথম এসএসসি পরীক্ষায় শতভাগ সফলতা অর্জিত হয়। শুরু থেকে এ পর্যন্ত সবক’টি পরীক্ষায় শতভাগ সফলতা অর্জন করে দেশ বিদেশে সুনাম অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে খাজাঞ্চি একাডেমী এন্ড উচ্চ বিদ্যালয়। স্কুলটি কলেজে উন্নীত হলে এলাকার শিক্ষা বিস্তারে অবদান রাখতে পারবে বলে বিজ্ঞজনদের ভাবনা। সুতরাং কলেজে উন্নীত করতে জনাব আব্দুল হান্নান ও তিনির বড় ছেলে যুক্তরাজ্য প্রবাসী আব্দুল শহিদ আপ্রাণ প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। তাছাড়া এ পরিবার থেকে বিভিন্ন সময় গরীব ও অসহায় মানুষ বিভিন্ন প্রকার সাহায্য, সহযোগিতা পেয়ে থাকেন। তিনির প্রবাসী ছেলেরা শিক্ষানুরাগী হয়ে গড়ে উঠেছেন পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে। যার প্রত্যক্ষ প্রমাণ আমরা পেয়েছি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করার মধ্য দিয়ে। অপরদিকে তিনির প্রতিষ্ঠিত খাজাঞ্চী একাডেমী এন্ড উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকালীন নামকরণের ক্ষেত্রে জনাব আব্দুল হান্নান মহৎ ও উদার হৃদয়ের আরেকটি পরিচয় তিনির নামে বা কারো নামে নামকরণ না করে তিনি খাজাঞ্চী ইউনিয়নের নামে নামকরণ করে তা প্রতিষ্ঠিত করতে। তিনি পারতেন ব্যক্তি বা অন্য কোন নামকরণ করতে। অত্যন্ত সহজ, সরল, মহৎ, সৎ, উদার, নৈতিকতাবোধ সম্পন্ন একজন মানুষ।আমি তিনির সম্পর্কে একটু অধিক সময় ও সান্নিধ্য পেয়েছি বিভিন্ন রূপে পরিচিত থাকার ফলে। কারণ আমি যখন উত্তর বিশ্বনাথ উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত ছিলাম। তখন তিনির বড় ছেলে জনাব আব্দুস শহিদ ছিলেন সে স্কুলের ছাত্র। যে কারণে তিনি স্কুলে যেতেন বিভিন্ন সময়ে। অপরদিকে আমি মদন মোহন কলেজে লেখাপড়া করতে ট্রেন যোগে যেতাম প্রতিদিন খাজাঞ্চী স্টেশন থেকে যাত্রী হয়ে। সিলেট যেতে এক মাত্র রাস্তা ছিল সিলেট-ছাতক রেললাইনের ট্রেন। প্রায়ই তিনিকে পেতাম ট্রেন যাত্রী রূপে। তিনির সান্নিধ্য এবং দুর থেকে দেখার সুমিষ্ট ফলাফল অত্যন্ত হৃদয়জ অনুভূতি পূর্ণ ছিল এবং রয়েছে। আমি বরাবরই তিনির আচার আচরণে পেয়েছি হৃদ্যতা, প্রীতি, স্নেহ, আদর ও ভালবাসার অতুলনীয়তা।
আমি মহান আল্লাহর দরবারে তিনির সুস্থতা ও দীর্ঘায়ু কামনা করি বিনয়াবনত চিত্তে। সেই সাথে তিনির পরিবার পরিজনকেও আল্লাহ সুখ, শান্তিতে রাখুন এবং শিক্ষা বিস্তারে অবদান রেখে খাজাঞ্চীবাসীর আলোকবর্তিকা রূপে চির জাগরূক থাকুক প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানগুলি।
গল্প
হালদারদের
হানা বাড়ি
চন্দন চ্যাটার্জি
পশ্চিমবঙ্গে মুর্শিদাবাদ জেলার একদম শেষ প্রান্তে রেলস্টেশন আছে যার নাম ধুলিয়ানগঙ্গা। এখানে উত্তরবঙ্গগামী কোন এক্সপ্রেস ট্রেন খুব একটা থামে না, তবে সাহেবগঞ্জগামী এবং মালদাগামী লোকাল ট্রেন কিছু থামে। ধুলিয়ান মুলত বিড়ি শিল্পে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছে। বিড়ি শিল্পের বাদশা যে কোম্পানি, “পতাকাবিড়ি” তার অনেক কারখানা এখানে আছে। তাছাড়া ছোট-বড় অনেক বিড়ি কোম্পানির কারখানা এখানে আছে।
এলাকাটি মুলত মুসলিম অধ্যুষিত গ্রাম, এই গ্রামের এক পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ভাগীরথী নদী এবং তার ওপারে বাংলাদেশ। অন্যদিকে ন্যাশনাল হাইওয়ে, এনএইচ ১২। ধুলিয়ান বাস স্ট্যান্ড এই হাইওয়ের উপরে। ধর্মতলা থেকে উত্তরবঙ্গ যাবার সমস্ত বাস এখানে থামে। এছাড়া অটো, টোটো ও আর একটা যান এখানে খুব বিখ্যাত সেটা হল ঘোড়ারগাড়ি। ঘোড়ারগাড়িতে ভাড়া কম, তবে ঝাকুনি বেশি। আমি একবার লালগোলা থেকে এখানে গিয়েছিলাম সেই অভিজ্ঞতার কথাই বলব।আগেই বলেছি আমি একজন আমি কলকাতার একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে আভ্যন্তরীণ হিসাব পরীক্ষক হিসাবে কাজ করতাম। এই কোম্পানির কলকাতার বাইরে অনেক জায়গায় শাখা অফিস ছিল। এই শাখা অফিসে আমাকে মাঝে মধ্যে ফিজিক্যাল স্টক ভেরিফিকেশনে যেতে হত। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এটা সঠিকভাবে না করতে পারলে কোম্পানীর অনেক ক্ষতি হতে পারে, বিশেষ করে এফ.এম.সি. কোম্পানিগুলোতে।
যাইহোক, মঙ্গলবার ২৫শে জুলাই অফিসের পর শিয়ালদা স্টেশন থেকে লালগোলা প্যাসেঞ্জার ট্রেন ধরে লালগোলার উদ্দেশ্যে রওনা হই। বিকাল ৩.৪৫ মিনিটের গাড়ি ছাড়লো পাঁচটায়। শিয়ালদা থেকে লালগোলার দূরত্ব প্রায় ২৩৪ কিলোমিটার, সময় লাগে ৫ ঘণ্টা ৫০ মিনিট। প্রায় এগারোটা কুড়ি মিনিটে ট্রেনটি লালগোলায় পৌঁছাল। এইটি একটি সীমান্ত স্টেশন এরপর রেললাইন নেই। এখান থেকে ধুলিয়ান যেতে হলে বাই রোড যেতে হবে, কোন ট্রেন লাইন নেই। আমার লালগোলাতে আসবাব কারণ হলো ধুলিয়ানের অফিসের ম্যানেজার এর বাড়ি লালগোলায়, আমি তার সঙ্গে মোটর সাইকেলে করে চলে যেতে পারবো ।
যাইহোক ৫/৬ ঘণ্টা ট্রেন যাত্রা করে আমি খুব ক্লান্ত ছিলাম। ‘হোটেল প্রিয়াঙ্কা’ আগে থেকেই বুকিং ছিল তাই চেক ইন করে একবারে খাবারের অর্ডার দিয়ে নিজের রুমে চলে গেলাম। কিছুক্ষণ পরে স্নান করে এসে দেখলাম রুম বয় খাবার দিয়ে গেছে। খাবার খেয়ে শুয়ে পড়লাম। পরের দিন, ধুলিয়ানের ব্রাঞ্চ ম্যানেজার বিশ্বনাথ দাস সকালবেলায় হোটেলে এল, এবং আমি তার মোটর সাইকেলে চড়ে ধুলিয়ানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। লালগোলা থেকে ধুলিয়ান প্রায় ৫৫ কিলো মিটার রাস্তা, যেটা জঙ্গিপুর রঘুনাথগঞ্জ হয়ে এন এইচ ১২ সঙ্গে মেশে। কিন্তু একটা শর্টকাট রাস্তা আছে গ্রামের মধ্যে দিয়ে যেটা জঙ্গিপুর হয়ে অরঙ্গবাদ, সুতি, আয়রন ব্রিজে উঠবে, তারপর মালদার দিকে কিছুক্ষণ গেলে ধুলিয়ান বাস স্টেশন পড়বে। এটা মুলত গ্রামের রাস্তা। আমরা এই গ্রামের রাস্তাটা ধরেছিলাম। প্রথমত দূরত্ব কিছুটা কম হবে এবং গ্রামের রাস্তা বলে ট্রাফিক অনেক কম হবে।
আমরা সকাল আটটায় বের হয়ে প্রায় ১০টা ৩০ মিনিটে ধুলিয়ান অফিসে পৌঁছালাম। সারাদিন অফিসের কাজ করে দুপুরবেলা একটা হোটেলে লাঞ্চ করলাম এবং গঙ্গার ধারে একবার ঘুরেও আসলাম। বিশাল বড় গঙ্গা, এপার অপার দেখা যায় না। তারপর আবার বিশ্বনাথের মোটর সাইকেলে চেপে বিকেল পাঁচটা নাগাদ ধুলিয়ান থেকে লালগোলার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। জুলাই মাস, বেলা বড়, তাই কোন অসুবিধা নাই। ধুলিয়ান থেকে অরঙ্গাবাদ, নিমতিতা পার হয়ে যখন সাজিনা পাড়ায় ঢুকলাম এমন সময় প্রচন্ড বৃষ্টি শুরু হল। যদিও আমরা গ্রামের রাস্তা ধরেছিলাম তথাপি এই এলাকায় লোকবসতি খুবই কম। কারণ এখানে খুব বেশি আফিং চাষ হয়। যদিও আফিং চাষ করা বেআইনি তথাপি লুকিয়ে চুরিয়ে অনেক জায়গাতে এখনও তার চাষ হয়। এই আফিং গাছে যে ফল হয় তার ওপরের আবরণটা আফিং বা লোকাল ভাষায় ডেড়ি ফল এবং তার বীজ থেকে তৈরি হয় পোস্ত।
যাইহোক, আমরা যে গ্রাম্য রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম, তার আসে পাশে কোন দাঁড়াবার জায়গা ছিল না, তাই মোটর সাইকেলে চেপে ভিজতে ভিজতে যাচ্ছিলাম। বৃষ্টিতে আমার চশমা ঝাপসা হয়ে গেল তাই সেটা খুলে পকেটে পুরলাম।
খানিক বাদে বিশ্বনাথ বলল, “দূরে একটা বাড়ি দেখা যাচ্ছে ওখানে গিয়ে একটু দাঁড়াব, বৃষ্টিতে আর মোটর সাইকেল চালান যাচ্ছে না”।
আমি বললাম, “ঠিক আছে চল ওখানে একটু দাঁড়ানো যাক তারপর আবার যাওয়া যাবে”।
সেই মতো বিশ্বনাথ মোটর সাইকেলটাকে আস্তে আস্তে বাড়ির কাছে নিয়ে এসে থামালো। আমরা মোটর সাইকেল থেকে নেবে বাড়ির কাছে এসে দেখলাম এটা আসলে একটা ভাঙ্গাবাড়ি। বাড়ির সামনে একটা দরজা আছে। সেটা অল্প চাপ দিতেই খুলে গেল। আমরা আস্তে আস্তে ভিতরে ঢুকলাম। দোতলাবাড়ি, গেটের পর একটু বাগান, নানান গাছ আছে বটে, কিন্তু তা আগাছায় ভরে গেছে, যত্নের অভাব। পথ চলার রাস্তাটাও ঘাসে ভর্তি। নিচে সম্ভবত দুটি ঘর আছে। সামনে একটা বড় দালান আছে, উপরে দুটো ঘর আছে, একটা ঝুল বারান্দা আছে বাইরের দিকে। আমরা আস্তে আস্তে সিঁড়ি দিয়ে দালানে উঠে দাঁড়ালাম। আমি চশমাটা পকেট থেকে বার করে মুছে সেটা আবার পরলাম। বিশ্বনাথ রুমাল বার করে মাথা, মুখ মুছতে লাগল।
এমন সময় ভেতর থেকে একটা বয়স্ক লোকের আওয়াজ এল, “কে”?
আমি বললাম, “আজ্ঞে আমরা ধুলিয়ান থেকে আসছি, যাবো লালগোলা। রাস্তায় বৃষ্টি এসেছে তাই এখানে এসেছি। একটু বৃষ্টি কমলে আমরা চলে যাব”।
ভেতর থেকে আবার উত্তর আসলো, “ঠিক আছে, ভেতরে আসুন, কোনো অসুবিধে নেই”।
আমি বললাম, “না ঠিক আছে, এখানে দাঁড়াই”।
আবার উত্তর আসলো, “আসুন না এখানে একটু বসতে পারবেন, বাইরে ঝাপটা দিচ্ছে ভিজে যাবেন”।
আমি বিশ্বনাথকে বললাম, “কথাটা ঠিক, একে আধভেজা হয়েছি, এখানে দাঁড়ালে পুরো ভিজে যাব। চল ভিতরে গিয়ে বসি”। কোন উপায়ন্তার না দেখে বিশ্বনাথ আমার পিছু পিছু এল। ভেতরে ঢুকে দেখলাম ঘরটি প্রায় অন্ধকার, কোন আলো নেই। পিছন দিকে একটা জানলা খোলা আছে সেটা দিয়ে অল্প আলো ভেতরে আসছে। তাতে দেখা যাচ্ছে ঘরের কোনে একটা চৌকিতে একজন শুয়ে আছে, মনে হয় তিনি অসুস্থ। আপাদ মস্তক কালো কম্বলে ঢাকা। আর একজন ভদ্রলোক একটা চেয়ারে বসে আছেন। সামনে একটা ভাঙা টেবিল তাতে কিছু প্লেট গ্লাস। একদিকে একটা ফটো ফ্রেম তাতে একজন ভদ্রমহিলার ছবি বাঁধানো আছে খুব সম্ভবত বিয়ের সময়কার ফটো, আবছা ধুলোয় ভর্তি আর একটা পুরান আমলের পেন্ডুলাম ঘড়ি বন্ধ হয়ে আছে। ঘরের ভেতরে কিছু আসবাবপত্র আছে এদিক ওদিক। ভদ্রলোক আমাদের দুটো মোড়া দিয়ে বসতে বললেন। আমরা সেখানে বসলাম।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “আপনি এখানে একাই থাকেন আশে পাশে তো কোন বাড়ি দেখছি না” ভদ্রলোক একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে খানিকটা আক্ষেপের সুরে বললেন তার নাম সৌমেন হালদার। পূর্ববঙ্গে তাদের বাড়ি ছিল। দেশভাগের পর তারা এখানে চলে আসেন। চৌকিতে যিনি শুয়ে আছেন, তিনি তার স্ত্রী। তার দুটো ছেলে আছে তারা বহরমপুরে থাকে। আমি বললাম, ”তাহলে তো আপনাদের বহরমপুরে থাকলে ভালো কারণ এখানে এইভাবে সমস্ত কাজ তো নিজেকেই করতে হয়। ছেলেদের কাছে থাকলে সুবিধে”। ভদ্রলোক বললেন, “এখানে কিছু জমি আছে তা একজন ভাগে চাষ করে, সেখান থেকে যা আয় হয় তাতেই আমাদের চলে যায়। নিজের হাতের গড়া বাড়ি তাই ছেড়ে যেতে পারছি না। ছেলেরা অনেকবার আমাদের নিয়ে যেতে চেষ্টা করে ছিল আমরা যায় নি”। এ ছাড়াও তিনি আরো কিছু নিজের কথা বলতে লাগলেন। আমরা আন মনে শুনছিলাম কিন্তু মনটা পড়েছিল বাইরে বৃষ্টির দিকে। কখন বৃষ্টি থামবে তারপর আমরা বের হতে পারব। কারণ ঘরের আবহাওয়াটা এত গুমোট লাগছিল যে এখানে কিভাবে দুজন জীবন্ত প্রাণী বসবাস করে সেইটা আমার একটু আশ্চর্য লাগছিল। এমন সময় বিশ্বনাথ বলল, “স্যার একটু চা হলে ভালো
হতো” পাছে ভদ্রলোক শুনতে পেয়ে আমাদের জন্য চা বানাতে বসেন তাই আমি বললাম, “চুপ করো এখানে চা কোথায় পাবে বাহিরে দোকানে থেকে চা খাব”। ভদ্রলোক কিন্তু আমাদের কথা শুনতে পেয়েছেন। তিনি বললেন, “চা তো আমি দিতে পারবো না তবে লেবুর সরবত খেতে চান তো দিতে পারি। আমাদের উঠানে যে লেবুর গাছ আছে সেটা আমি বাংলাদেশ থেকে এনে বসিয়ে ছিলাম এখনো ফল দিচ্ছে”।
আমি বললাম, ”না না তার দরকার নেই, আপনি ব্যস্ত হবেন না”।
উনি বললেন, ”ঠিক আছে কোন অসুবিধে নেই, আপনারা বসুন, আমি লেবু তুলে আনছি”।
আমি দেখলাম ভদ্রলোক আমাদের সামনে দিয়ে আস্তে আস্তে উঠে বারান্দা দিয়ে বাইরের দিকে গেলেন লেবু আনতে। এখানে একটা কথা বলা দরকার ঘরের ভিতর ধুলোর মধ্যে আমাদের পায়ের ভিজে জুতোর ছাপ পড়ছে। কিন্তু ভদ্রলোকের পায়ের ছাপ পড়লো না, অথচ তিনি আমাদের সামনে দিয়ে হেঁটে গেলেন। এটা বিশ্বনাথ না লক্ষ্য করলেও আমি লক্ষ্য করেছি তাতেই আমার একটু সন্দেহ হল, কিন্তু বিশ্বনাথকে কিছু বললাম না।
প্রায় এক মিনিটেরও কম সময়ে মধ্যে ভদ্রলোক চলে এলেন হাতে তিনটে চারটে লেবু। তারপরে একটা ছুরি দিয়ে সেই লেবু কেটে একটা বড় ঘটিতে দিলেন। তারপর তাতে নুন চিনি দিয়ে গুলিয়ে দুটো গ্লাসে ভর্তি করে আমাদের দিলেন।
যখনই আমি গ্লাসটা মুখের কাছে তুললাম তখনই একটা বিকট পচা গন্ধ লাগলো, মনে হল গ্লাসের ভেতরে পচা ডিম ছিল, বা গ্লাসটা ডিমের অমলেট বানানোর জন্য ব্যবহার করা হতো এবং ভালো করে ধোয়া হয় নি, তাই গন্ধ ছাড়ছে। আমি একটুও খেতে পারলাম না। কিন্তু বিশ্বনাথ একটুখানি মুখে দিল তারপরে আবার গ্লাসটা রেখে দিল। ভদ্রলোক দুটো লেবু আমাদের হাতে দিলে দিয়ে বললেন এগুলো আপনারা নিয়ে যান বাড়িতে গিয়ে সরবত খাবেন। আমাদের গাছের লেবুতে অনেক রস আছে। এইটা আমার মনে ধরল দুটোই আমি নিয়ে প্যান্টের পকেটে রাখলাম।
এতক্ষণে আস্তে আস্তে বৃষ্টি কমেছে আর আমাদের যেতে হবে এখনও অনেকটা পথ। তাই বিশ্বনাথ বলল,” স্যার চলুন আর দেরী করা ঠিক হবে না”।
আমিও তাই ভাবছিলাম, অতএব ভদ্রলোককে ধন্যবাদ জানিয়ে আমরা মোটরসাইকেলে চেপে লালগোলার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। জঙ্গিপুরে পোঁছে একটা চায়ের দোকান দেখতে পেয়ে আমি বিশ্বনাথকে বললাম, ”তুমি চা খাবে বলছিলে সামনের চায়ের দোকানে দাঁড়াও”।
আমরা চায়ের দোকানে ঢুকে বেঞ্চিতে বসে দোকানদারকে বললাম, “দুটো চা দেবেন”।
দোকানদার দুটোকে গেলাসকে ভালো করে গরম জলে ধুয়ে তাতে চা দিয়ে আমাদের দিলেন। বাহিরে বৃষ্টি থামলেও ঠাণ্ডা আমেজটা আছে। তাই গরম চা টা বেশ তৃপ্তি লাগলো। আমি বিশ্বনাথকে বললাম, ”হালদারবাবু যে লেবু দিয়েছে তা তোমার কাছে রাখো আমি হোটেলে থাকব আমার দরকার নেই”। এই বলে পকেটে হাত দিয়ে দেখলাম লেবু নেই। এ পকেট, ও পকেট, ব্যাগ সব দেখলাম কোথায় লেবু পেলাম না। বিশ্বনাথ বলল, “বোধহয় রাস্তায় পড়ে গেছে”।
হঠাৎ দোকানদার আমাদের কথা শুনতে পেয়ে জিজ্ঞাসা করল, “আপনারা কোন হালদারবাবুর কথা বলছেন”।
আমি বললাম, ”এই একটু দূরে মাঠের মাঝখানে একটা বাড়ি আছে, ওইখানে আমরা গিয়েছিলাম। বৃষ্টি পড়ছিল তাই আমরা অল্প সময়ের জন্য দাঁড়িয়েছিলাম”।
দোকানদার বলল, ”আপনারা কি বাড়ির মধ্যে গিয়েছেন”।
আমি বললাম, ”হ্যাঁ গিয়েছিলাম। ওখানে সৌমেন হালদার বলে এক বয়স্ক ভদ্রলোক আছেন, তার স্ত্রী ও আছেন। তারা আমাদের লেবু শরবত খেতে দিয়েছিলে। এছাড়া গোটা দুটো লেবু আমাকে দিয়েছিলেন বাড়িতে নিয়ে যাবার জন্য। সেই দুটো রাস্তায় পরে গেছে বোধহয়”।
ভদ্রলোক বললেন, “আপনারা কি লেবুর জল খেয়েছেন?”
আমি কিছুটা ইতঃস্তত করে বললাম, ”হ্যাঁ মানে, গেলাস খুব পচা গন্ধ ছাড়ছিল বলে আমি খাইনি, কিন্তু আমার সহকর্মী বিশ্বনাথ একটু খেয়েছে”।
তখন ভদ্রলোক একটু মাথা চুলকে বললেন, ”বসুন”।
এইবলে তিনি দুটো কাগজে একটু করে নুন নিয়ে তাতে মন্ত্র বলে তিনি আমাদের দিয়ে বললেন এটা আগে খেয়ে নিন, তারপর জল খাবেন। তারপরে চা খাবেন।
আমি বললাম, “কেন কি হয়েছে?”
সে বলল, ”আপনি আগে এটা করুন তারপর আপনাকে বলছি পুরো ঘটনা”।
পেট খারাপ হলে আমার মা মাঝে মধ্যে আমাকে জোয়ান আর নুন মিশিয়ে খেতে দিতেন। এটা আমি জানি পেটের গোলমালের খুব ভালো ওষুধ নুন আর জোয়ান। তাই এটা খেতে আমার আপত্তি হল না, আমি খেলাম, তাই দেখে বিশ্বনাথ ও খেলো।
একটু পরে ভদ্রলোক একটু নিছু স্বরে আমাদের বললেন, “আপনারা যেখানে গিয়েছিলেন সেটা হালদারের বাড়ি ঠিকই, কিন্তু ওটা হানাবাড়ি, বসতবাড়ি নয়। ওখানে কেউ জীবিত থাকে না। যে সৌমেন হালদার আপনাদের লেবুর জল দিয়েছিল সে মারা গিয়েছে আজকে পাঁচ বছর হল। তার দুজন ছেলে আছে ঠিকই তারা বহরমপুরে থাকে, ব্যবসা করে। এখানে কেউ আসে না। এই বাড়িটা এলাকার লোকের কাছে হানাবাড়ি হিসেবেই খ্যাত। এখানে দিনের বেলাতেও কেউ যায় না। অনেকেই নাকি রাত্রিবেলায় ওই ভদ্রলোককে সাদা কাপড় মুড়ি দিয়ে লেবু গাছ থেকে লেবু তুলতে দেখেছে। সৌমেনবাবুর স্ত্রী মারা যায় এক অজানা জ্বরে। তারপর ছেলেরা অনেকবার বাবাকে নিজেদের কাছে রাখতে চেয়ে ছিল, কিন্তু তিনি যান নি। স্ত্রী বিয়োগের ছয় মাসের মধ্যে তিনি মারা যান। ছেলেরা বাড়ীটা ভাড়া দেবার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু কোন ভাড়াটে পুরো একমাস থাকেনি। সবাই বলত রাত্রিবেলায় কে যেন পুরো বাড়ি দাপাদাপি করে বেড়াচ্ছে। মাঝে মধ্যে ঘরের জিনিসপত্র এদিক ওদিক সরে যায়। “
খানিকটা দম নিয়ে ভদ্রলোক আবার বললেন, “আমি গুণিন ভুতের উপস্থিতি বুঝতে পারি। আপনাদের দেখে আমার মনে হয়েছে কোন কালো ছায়া আপনাদের পিছে পিছে আসছে। তাই আমি নুন পরা দিয়েছি ও কোন ক্ষতি করতে পারবে না।“
আমি দোকানদার ভদ্রলোককে সমর্থন করে বললাম, “এটা হতে পারে, কারণ দুটো বিষয়ে আমার সন্দেহ হয়েছিল। প্রথমত ঘরে কোন আলো নেই কেন, এত অন্ধকারের মধ্যে লোক থাকে কি করে, এবং ঘরটা ভীষণ স্যাঁতসেঁতে। কোন রোগীর পক্ষে এই রকম ঘর ভালো নয়।
দ্বিতীয়তঃ যখন আমাদের সামনে দিয়ে ভদ্রলোক লেবু তুলতে গেলে তখন তার পায়ের ছাপ কিন্তু মাটিতে পরছিল না। অথচ আমরা যখন ঘরে ঢুকি তখন আমাদের পায়ের ছাপ এদিকে-ওদিকে ছিল”।
বিশ্বনাথ বলল, “আপনি এটা দেখেছেন কিন্তু আমাকে বলেননি”।
আমি বললাম, ”আমার অডিটরের চোখ কাজেই কোন কিছুই আমার চোখে ফাঁকি দেওয়া যায় না। তাছাড়া ঘর থেকে বারান্দায় বেরিয়ে তারপর উঠনের লেবু গাছ থেকে লেবু তুলে ফিরে আসতে প্রায় তিন মিনিট সময় লাগার কথা। অথচ ভদ্রলোক এক মিনিটেরও কম সময়ের মধ্যে ফিরে এলেন কি করে, তখনই আমার সন্দেহ হয়েছিল”।
দোকানদার ভদ্রলোক বললো, “তাহলে আপনাদের সাহস আছে বলতে হবে আপনারা জেনে শুনে ওর কাছ থেকে লেবুর সরবত খেয়েছিলে। তবে ভয় নেই আমি নুন পোরা দিয়ে দিয়েছি আপনাদের কোন ক্ষতি হবে না”। এর পর আমরা চায়ের কাপটা রেখে পয়সা দিয়ে আবার মোটর সাইকেলে উঠে পড়লাম। যখন হোটেলে পৌছালাম তখন রাত্রি সাতটা।
আমি বিশ্বনাথকে বললাম, ”তুমি রাত্রি দশটা-এগারোটা নাগাদ একবার আমাকে ফোন করবে কিরকম আছো তা জানাবে। তোমাদের বাড়িতে এ বিষয়ে কোন কথা না বলাই ভালো “।
ও ঠিক সাড়ে দশটায় আমাকে ফোন করেছিল। আমরা দুজনেই ভালো আছি, কোন অসুবিধা হয়নি। এরপরে দুদিন পরে আমি আমার কাজ শেষ করে কলকাতায় আবার ফিরে আসি। এটা আমার জীবনের একটা ঘটনা।
গল্প
চিত্তদহন
অভিজিৎ দাস
তমলুক রেলওয়ে স্টেশান থেকে কুন্তল একা-একা হেঁটে চলল অয়নের বাড়ির উদ্দেশ্যে। স্টেশান থেকে অয়নের বাড়ি পায়ে হেঁটে পনেরো-কুড়ি মিনিট লাগে। এর আগে কুন্তল বহু বার এসেছে অয়নের বাড়ি; তাই এখানকার পথ- ঘাট সব কুন্তলের চেনা। কুন্তলের যত দূর মনে পড়ে সে তার বন্ধু অয়নের বাড়িতে শেষ বার এসেছিল প্রায় তিন বছর আগে। তারপর তার আর আসা হয়নি। কারণ, অয়ন জার্মানে একটা চাকরি নিয়ে ওখানেই সেটেল হয়েছে। তিন বছর বাদে অয়ন দেশে ফিরেছে; জন্মভূমিতে দিন কয়েক কাটিয়ে আবার সে ফিরে যাবে জার্মানে। যাইহোক, ফুরফুরে বাতাস গায়ে মেখে হাঁটতে কুন্তলের বেশ ভালোই লাগছিল। হঠাৎ তার মনের সাগরে ভেসে ওঠে জয়তির মুখ। কুন্তল হেঁটে চলেছে, হেঁটেই চলেছে! আর তার সঙ্গে রয়েছে জয়তির স্মৃতি। কেমন আছে ও? ভালো আছে তো? ও কি এখন আর গান গায়? কুন্তল যে অয়নের বাড়িতে আগে প্রায় আসতো, সে তো শুধু জয়তির গান শোনার টানে। কী সুমধুর কণ্ঠ জয়তির! ওর গান শুনলে মনে হয় জীবনের যত সংঘর্ষ, দুঃখ, যন্ত্রণা সব যেন এক নিমেষেই দূরে সরে যায়। জয়তির বাড়ি অয়নদের গ্রামেই। অয়ন একবার কুন্তলকে জয়তির সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়ে দিয়েছিল। সেই থেকে কুন্তল প্রায় যেত জয়তির বাড়িতে। যখনই সে অয়নের বাড়িতে আসতো, তখনই জয়তির কণ্ঠ নিঃসৃত গানের সুর তাকে পাগলের মত আকর্ষণ করত। তাইতো সে বার-বার ছুটে যেত জয়তির বাড়ি! কোনো-কোনো সময় তো অয়ন সঙ্গেই যেত না, কুন্তল একাই যেত। জয়তি একদিন কুন্তলকে বলেছিল, "বাবু, আমাকে কোথাও একটা গান গাওয়ার সুযোগ করে দেবেন? দুটো পয়সা ঘরে আনবো! আমরা খুব গরীব, সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরায়! মা সেই কবে মরে গিয়েছে! আর বাবা--- বাবা এখন অসুস্থ, কাজে বেরোতে পারছে না!"
কথাগুলো বলতে বলতে ঝর-ঝর করে কেঁদে উঠেছিল জয়তি। সেদিন কুন্তল মনে খুব ব্যথা পেয়েছিল জয়তির দুর্দশার জন্য! জয়তির হাতে দু-শ টাকা গুঁজে দিয়ে কুন্তল বলেছিল, "দেখো জয়তি, সংগীত মহলে আমারতো তেমন কেউ জানা- শোনা নেই। তবে আমি চেষ্টা করে দেখবো একবার। আপাতত এই টাকাটা রাখো।"
জয়তি কোনো মতে টাকা নিতে চাইছিল না; কুন্তল এক প্রকার বাধ্য হয়েই বলেছিল, "তুমি যে আমায় গান শোনালে, তার পারিশ্রমিক হিসেবে রাখো না হয়।"
এই রকম নানান কথা ভাবতে ভাবতে কুন্তল হেঁটেই চলল। এরই মধ্যে কখন যে বিকেল গড়িয়ে ঝপ্ করে সন্ধ্যে নামল, কুন্তল টেরই পেল না।
হাঁটতে হাঁটতে কুন্তল ভাবছিল কত দিন পর অয়নের সাথে আজ তার দেখা হবে--- আঃ! কী মজাটাই না হবে! কিন্তু তারপর আবার তাকে জয়তির স্মৃতিগুলো আঁকড়ে ধরল। সে মনে-মনে স্থির করল অয়নকে সঙ্গে নিয়ে সে একবার যাবে জয়িতর বাড়িতে। তিন বছর পর কুন্তল আবার জয়তির গান শুনবে। ভাবতেই তার মনে কেমন যেন একটা রোমাঞ্চ জেগে উঠল। কিন্তু, জয়তির যদি বিয়ে হয়ে থাকে, তবে তো তার শ্বশুরবাড়িতে থাকার কথা। জয়তির সঙ্গে কি দেখা হবে? আচ্ছা, সে কি নিজের অজান্তে জয়তিকে ভালোবেসে ফেলেছিল! না শুধুই গানের টানে সে বার-বার ছুটে যেত জয়তির কাছে! এ যদি গানের আকর্ষণ হয়, তবে কেন জয়তির মায়া মাখানো মুখ খানা বার-বার ফুটে ওঠে তার মনের দর্পণে! কেন সে তার হৃদয়ের অন্তঃপটে ব্যথা অনুভব করে! সে ভাবে তার বড্ড ভুল হয়ে গেছে! কারণ, সেদিন সে জয়তির আবছা উদ্গ্রীব আবেদনে সাড়া দেয়নি। সেদিন জয়তি অশ্রু ভেজা চোখে কুন্তলকে বলেছিল, "বাবু, আমাকে নিয়ে যাবেন আপনার বাড়ি? আমি সব কাজ করে দেবো। ঘর মোছা, বাসন মাজা, রান্না-বান্না, সব পারি আমি!"
হঠাৎ দোটানার মধ্যে পড়ে গিয়ে কুন্তল বলেছিল, "আমি বাড়িতে কথা বলে দেখি; পরে তোমায় জানবো।"
সেদিন কুন্তল জয়তির মনের ভাষা বুঝতে পারেনি। শুধু পকেট থেকে তিনশ টাকা বের করে জয়তিকে দিয়ে বলেছিল,- "এটা তোমার কাছে রেখে দাও জয়তি।"
জয়তি বলেছিল, "বারবার আমি আপনার কাছে টাকা নেব কেন? আমার বুঝি অন্তরে বাধে না!"
"সে কী, অন্তরে বাধবে কেন। এই যে আমি তোমার বাড়িতে এলে, তুমি সমস্ত কাজ-কর্ম ফেলে রেখে আমায় গান শোনাও, তা কি এমনি-এমনি। বলি তোমারও তো সময়ের দাম আছে, না কি ? সেইজন্য ভালোবেসে আমি যদি কিছু টাকা দিই, তাতে ক্ষতিটা কী।"
"বেশ, নিলুম না হয়, ঐ যা! কথায়- কথায় অনেক রাত হয়ে গেল, বাবাকে খাওয়ার দিতে হবে।"
"আমাকেও ফিরতে হবে। আজ যাই, আবার পরে আসবো।"
"এতক্ষণ যখন রইলেন, আর কিছুক্ষণ থাকুন। খেয়ে যাবেন।"
কুন্তল সেদিন জয়তির কথা ফেলে দিতে পারেনি। এক অসীম তৃপ্তির অনুভূতিতে সেদিন সে শাক-ভাত খেতে বসে পড়েছিল জয়তির বাড়িতে।
কুন্তল অয়নের বাড়ির প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছিল। আর মিনিট পাঁচেক হাঁটলেই সে পৌঁছে যাবে অয়নের বাড়ি। পূর্ব দিগন্তের চাঁদ তার কিরণ দিয়ে চারিদিক ভরিয়ে তুলেছিল; তাই কুন্তলের চোখ অনেক দূর পর্যন্ত প্রাকৃতিক শোভা উপভোগ করতে সক্ষম হয়েছিল। তিন-চারটা মোটর বাইক তাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। একটা টোটোকেও সে দেখতে পেল। টোটোটা স্টেশানের দিক থেকে এসে অয়নের বাড়ির দিকে চলে গেল। ইচ্ছে করলেই সে টোটোতে চড়ে বসতে পারত; কিন্তু সে তা করল না। হাঁটতে তার ভালোই লাগছিল। কুন্তল হনহন করে এগিয়ে চলল। হঠাৎ তার কানে ঠেকল একটা অতি পরিচিত কণ্ঠস্বর। জয়তি গান গাইছে! কিন্তু জয়তির বাড়িতো এদিকে নয়। তাহলে, তার কণ্ঠ এখানে ভেসে আসছে কী করে। এই রকম সাত-পাঁচ ভেবে কুন্তল একটু থমকে দাঁড়াল। তারপর সে মেইন রাস্তা থেকে নেমে গানটা যেদিক থেকে ভেসে আসছিল, সেই দিকে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর সে একটা পুকুর পাড়ে পৌঁছাল। পুকুরটার চার পাশে ছোট-বড় নানা রকম গাছ মৃদুমন্দ বাতাসে মাথা দোলাচ্ছে। কুন্তল দেখল পুকুর পাড়ে অনতি দূরে একটা গাছের তলায় বসে একজন রমণী আপন খেয়ালে গান গেয়ে চলেছে। কুন্তল ধীরে-ধীরে গাছটার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই, রমণীটি তার গান থামিয়ে বলল, "আপনি এসেছেন বাবু?
"কুন্তল অতিশয় বিস্ময় প্রকাশ করে বলল, "জয়তি, তুমি এখানে!"
"একটা কাজে গিয়েছিলাম, ফেরার পথে এখানেই একটু বসে পড়লাম। এই চন্দ্রালোকিত মনোরম পরিবেশ --- এমন নির্জন স্থানে আমি অসীম শান্তি খুঁজে পাই!"
"কেমন আছো, জয়তি?"
"ভালোই আছি। আপনি ভালো আছেন তো? বিয়ে করেছেন বুঝি? ছেলে-পুলে হয়েছে নিশ্চয়?"
"আমি এখনো বিয়ে করিনি, জয়তি।"
"কেন, করেননি কেন? মনের মত মেয়ে পাননি বুঝি?"
"না, বিষয়টা ঠিক তা নয়। নানা রকম ঝামেলা এবং কাজের চাপে বিয়ের কথা ভাবারই সময় পাইনি! তবে, এখন ভাবছি বিয়েটা করেই ফেলব।"
কয়েক মুহূর্ত উভয়েই চুপ-চাপ রইল। কুন্তল লক্ষ্য করল জয়তির মধ্যে আগের মত আর ইচ্ছা-শক্তি নেই, আশা-আনন্দের আলোড়ন নেই, সে যেন নির্বিকার। জয়তি চাঞ্চল্যহীন কণ্ঠে বলল,
"গান গাইতে পারে এমন মেয়েকে বিয়ে করবেন কিন্তু। আপনার তো আবার গান শোনার শখ।"
"একটা কথা বলবো, জয়তি?"
"কী কথা, বলুন।"
"আমি মনে মনে তোমায় ভালোবেসে ফেলেছি! তুমি যাবে আমার বাড়ি?"
"বড্ড দেরী হয়ে গেছে বাবু! আজ থেকে তিন বছর আগে আমি আপনার সঙ্গে যেতে চেয়েছিলাম; কিন্তু আপনি বুঝতে পারেননি!"
"আমার খুব ভুল হয়েছে জয়তি! এখন আমি তোমায় কাছে পেতে চাই। তুমি না কর না জয়তি!"
"এখন তা আর সম্ভব নয় বাবু!"
"কেন, সম্ভব নয় কেন? তোমার কি বিয়ে হয়ে গেছে?"
"হ্যাঁ। অনেক দিন আগে, আকাশের সঙ্গে!"
কুন্তল মনে খুব আঘাত পেল; অত্যন্ত নিম্ন স্বরে সে বলল,
"ও--- খুব সুখের সংসার বুঝি!"
জয়তি একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
"খুব সুখের !"
দুজনের মধ্যে আর বিশেষ কিছু কথা হল না। পুকুরের পাড় ঘেঁষা একটা সরু পথ ধরে জয়তি চলে গেল। আর প্রকান্ড একটা দুঃখের উপত্যকাকে বুকের মাঝে ধারণ করে কুন্তল সেখানেই কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইল। নিজের অজান্তে তার চোখ থেকে কখন যে দু-ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে টপ্ করে শুকনো পাতার ওপর পড়ল, সে বুঝতেই পারল না।
অবশেষে কুন্তল যখন অয়নের বাড়িতে পৌঁছালো, তখন রাত প্রায় আটটা। বহু দিন পরে দুই বন্ধুর দেখা; তাই, অয়ন সোল্লাসে ফেটে পড়ে জড়িয়ে ধরল কুন্তলকে। তারপর অয়নের মায়ের আয়োজন করা নানা রকম জল-খাবার সহযোগে দুই বন্ধুর মধ্যে বিভিন্ন স্বাদের কথাবার্তা চলছিল। অয়ন বলতে থাকে তার জার্মানে থাকাকালীন ছোট-বড় নানা রকম তিন বছরের অভিজ্ঞতা। কুন্তলও কিছু কম যায় না। সেও বলতে থাকে সুখ- দুঃখ মিলিয়ে তার জীবনে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা। কথায়-কথায় অয়ন বলল, "হ্যাঁ রে, তোর এত দেরী হল কেন?" কুন্তল প্রথমটা কেমন হকচকিয়ে গেল। জয়তির সঙ্গে দেখা হওয়ার ঘটনাটা বলবে কি বলবে না, এই নিয়ে সে দোটানার মধ্যে পড়ে গেল। তারপর, জয়তির বিষয়টাকে সম্পূর্ণ চেপে গিয়ে কুন্তল বলল, "স্টেশানে একটু রেস্ট নিয়ে হেঁটে-হেঁটে এসেছি তো, তাই।"
"কেন, হেঁটে এলি কেন ? একটা টোটো ধরে নিলেই পারতিস।"
"হ্যাঁ, তা হত--- চন্দ্রালোকিত রাত্রি আর মৃদুমন্দ বাতাস; তাই হাঁটতে ভালোই লাগছিল।" তারপর, কুন্তল আর অয়ন বাড়ির ছাদে গেল। প্রকৃতির বাতাস উপভোগ করতে-করতে আরও নানা রকম গল্প করছিল তারা। এই ভাবে রাত দশটা পেরিয়ে গেল। বাড়ির সকলের সঙ্গে বসে কুন্তল পেট পুরে ডিনার করল; তারপর সে অয়নের সাথে ঘরের পশ্চিম দিকের একটা রুমে শুতে গেল। বড় একটা পালঙ্কের উপর পরিপাটি করে বিছানা পাতা ছিল, তাতেই দুই বন্ধু শুয়ে পড়ল। রুমের পশ্চিম দিকের একটা জানালা খোলা ছিল, যার মধ্য দিয়ে জ্যোৎস্না এসে রুমের বেশ কিছুটা অংশকে আলোকিত করে তুলেছিল। একে ট্রেন জার্নি, তার ওপর পায়ে হাঁটা--- ক্লান্তি অনুভব করছিল কুন্তল। তার দুচোখের পাতা জড়িয়ে এল। এরই মধ্যে কুন্তল মনে মনে স্থির করে নিল যে কাল সকালে সে একবার জয়তির সঙ্গে দেখা করবে।
এক ধরণের অস্বাভাবিক অনুভূতিতে আচমকা কুন্তলের ঘুম ভেঙে গেল! মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখল রাত তিনটে বাজে। তারপর জানালার দিকে তাকাতেই তার মাথাটা ঝাঁ করে ঘুরে গেল! জ্যোৎস্নার আলোতে সে স্পষ্ট দেখতে পেল জানালার বাইরে একজন মহিলার ছায়ামূর্তি! তারপর তার মনে হল যেন জয়তি দাঁড়িয়ে রয়েছে। ধড়মড় করে সে বিছানাতে উঠে বসল! আর সঙ্গে-সঙ্গে ছায়ামূর্তিটা জানালার কাছ থেকে সরে গেল! অয়ন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন; মাঝে-মাঝে সে নাক ডেকে চলেছে। কুন্তল ভাবল অয়নকে কি সে একবার ডাকবে ? না, সে ডাকলনা অয়নকে। অয়ন ঘুমাচ্ছে ঘুমাক। মনে সাহস এনে কুন্তল ধীরে ধীরে রুমের বাইরে বেরিয়ে এল। সে দেখল ঘরের বারান্দায় একটা টিমটিমে নাইট বাল্ব জ্বলছে। সে অতি সন্তর্পণে ঘরের মেইন গেট খুলে বাইরে বেরিয়ে এল। তারপর ঘরের পশ্চিম দিকের সেই জানালাটার দিকে এগিয়ে গেল। হঠাৎ তার লক্ষ্যে পড়ল জানালা থেকে অনতি দূরে একটা গাছের তলায় দাঁড়িয়ে রয়েছে জয়তি। কুন্তলকে দেখতে পেয়ে জয়তি অতি দ্রুত পায়ে পালিয়ে যেতে থাকে। কুন্তলও দৌড়াতে থাকে জয়তির পেছন-পেছন। সামান্য উচ্চ স্বরে কুন্তলের কণ্ঠে ফুটে ওঠে ব্যাকুল মিনতি, "যেও না জয়তি, দাঁড়াও! দাঁড়াও বলছি! আমার কথাটা একবার শোনো!" অনেক দূরে গিয়ে জয়তি দাঁড়িয়ে পড়ল। কুন্তল জয়তির কাছে গিয়ে বলল, "জয়তি, তুমি এত রাতে ঐ জানালার পাশে কী করছিলে?" জয়তি কয়েক মুহূর্ত নীরব রইল; তারপর রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল, "বদলা! আমি বদলা চাই!"
"বদলা! কিসের বদলা? কার ওপর বদলা নিতে চাও?"
"আপনার বন্ধু অয়ন গোস্বামীর ওপর প্রতিশোধ নিতে চাই আমি!"
"কেন, অয়ন কী করেছে?"
"আমার চরিত্রকে কলুষিত করেছে! আমার সারা দেহ ও মনে কলঙ্ক লেপে দিয়ে নিজের লাম্পট্য এবং লালসাকে চরিতার্থ করেছে!"
বিষয়টা কুন্তলের বুঝতে আর বাকি থাকল না। সে সবিস্ময়ে বলল, "সে কী! কবে হল এরকম অনাচার!"
"আজ থেকে প্রায় দেড় বছর আগে।"
"বলছো কী জয়তি! অয়নতো তিন বছর বাদে জার্মান থেকে বাড়ি ফিরল!"
"না, দেড় বছর আগে একবার আপনার বন্ধু অয়ন গোস্বামী বাড়ি এসেছিল। একদিন সন্ধায়
ও আমাকে ওর বাড়িতে ডেকেছিল; বলেছিল যে আমি যদি ওকে গান শোনাই, তাহলে ও আমাকে অনেক টাকা দেবে। আপনিতো জানেন আমরা খুব গরীব; প্রতিদিন খাবার জোটে না! তাই, আমি সেই সন্ধ্যায় গিয়েছিলাম অয়ন গোস্বামীর বাড়ি। আমার অসহায়তার সুযোগ নিয়ে রাতের অন্ধকারে নিজের লালসা মিটিয়ে অয়ন গোস্বামী পরের দিন ফিরে যায় জার্মানে; ওর কুকর্মের কথা কাক-পক্ষীও টের পেল না! এর সাথে অয়ন গোস্বামীর বাবা- মাও জড়িত আছে!"
"কী! কাকু আর কাকীমাও জানেন!"
"হ্যাঁ, ঐ শয়তান আর শয়তানীও জড়িত আছে! আমি বদলা চাই! মেরে ফেলব ঐ অয়ন গোস্বামীকে"।
"আমি বলছিলাম কি জয়তি, আইন নিজের হাতে তুলে না নিয়ে চলো না কাল সকালে একবার থানাতে গিয়ে বিষয়টা জানিয়ে আসি। অয়ন তো এখন কয়েক দিন ইন্ডিয়াতে থাকবে।"
"কিচ্ছু লাভ হবে না, ও আবার পালিয়ে যাবে জার্মানে!"
"আচ্ছা আমি তোমায় কথা দিচ্ছি জয়তি, অয়ন গোস্বামীকে আমি জেলের ঘানি টানাবই! কিন্তু কিছু একটা প্রমাণ..."
কুন্তলের কথা শেষ হল না, জয়তি একটু উত্তেজিত কণ্ঠে বলল,--
"প্রমাণ! প্রমাণ তো আছে!"
"হোয়াট! প্রমাণ আছে! কোথায়?"
"ওদের রান্নাঘরের পাশের রুমে একবার ঢুকে দেখবেন; তাহলেই সব বুঝে যাবেন!"
এই বলে জয়তি দ্রুত পায়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল। কুন্তল সেখানেই কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। তার মনে প্রবল একটা ঝড় উঠেছে! সে কী করবে ভেবে পাচ্ছিল না; তারপর মনস্থির করেই ফেলল।
ভোরের আলো প্রায় ফুটে উঠেছিল। কুন্তল ধীর পায়ে গিয়ে জয়তির বাড়ির সামনে দাঁড়াল। জয়তির নাম ধরে দু-তিন বার ডাকতেই ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন জয়তির বাবা। উনি কুন্তলের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলেন। কুন্তল বলল, "মেসোমশাই, আপনার শরীর কেমন আছে ?"
"খুব একটা ভালো নয় বাবা। মাঝে মাঝে বুকের বাম দিকটা যন্ত্রণা হয়। কখন চলে যাবো টুক করে!"
"এরকম করে বলতে নেই মেসোমশাই! যাইহোক, আমি একবার জয়তির সঙ্গে দেখা করতে চাই। আর আকাশ এখন কোথায় ? এখানেই আছে, না..."
কুন্তলের কথা শেষ হল না, জয়তির বাবা অতিশয় অবাক হয়ে বললেন,-
"আকাশ! কে আকাশ?"
"আকাশ, মানে জয়তির স্বামী, আচ্ছা আপনি জয়তিকে ডেকে দিন।"
জয়তির বাবা কাঁপা-কাঁপা গলায় বললেন, "দেখো বাবা, জয়তি যে আকাশ নামের কাউকে বিয়ে করেছে, সেটাই তো আমি জানি না। তাছাড়া, মেয়েটা যে এখন কোথায় আছে, কেমন আছে, তাও আমি জানি না!"
"সে কী! জয়তি এখানে নেই! তা কী করে সম্ভব!"
জয়তির বাবা কাঁদতে-কাঁদতে বলতে থাকেন, "আমি সত্যি বলছি বাবা! আজ থেকে বছর দেড়েক আগে হঠাৎ করে মেয়েটা যে কোথায় চলে গেল, আর ফিরে এল না! গাঁয়ের সবাই বলে কুলটা, দুশ্চরিত্রা মেয়ে কোনো ছেলের সঙ্গে পালিয়েছে!"
সঙ্গে-সঙ্গে কুন্তল দারুণ এক বিস্ময়ের ঘোরে পড়ে গেল! এই কিছুক্ষণ আগে যে সে জয়তির সঙ্গে কথা বলেছে! গতকাল সন্ধ্যায় যে তাকে জয়তি বলেছিল আকাশের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে! জয়তি কি তবে...! রক্ত হিম করা একটা আশঙ্কা কুন্তলকে পেয়ে বসল! বিষয়টা বুঝতে তার আর বাকি রইল না! আকাশের সঙ্গে জয়তির বিয়ে--- মানে আকাশে, বাতাসে ঘুরে বেড়ায় জয়তির অতৃপ্ত আত্মা! হ্যাঁ, তার মানে ঐ রাতে অয়ন গোস্বামী জয়তিকে খুন করেছে! কুন্তলের মানসিক অবস্থা এখন ভয় এবং দুঃখের মিশ্রণে এক অদ্ভুত অনুভূতির শিকার। অনেক কষ্ট করে কণ্ঠে আওয়াজ এনে কুন্তল জয়তির বাবাকে ভাঙা ভাঙা স্বরে বলল,--
"মেসোমশাই, জয়তি দুশ্চরিত্রা ছিল না!"
এই বলে কুন্তল পকেট থেকে রুমাল খানা বের করে নিজের চোখের জল মুছল।
পূর্ব দিগন্তে উদীয়মান সূর্যের আলো কুন্তলের করুণ মুখটাকে আরো করুণ করে তুলেছিল। সে দ্রুত গতিতে হেঁটে চলল অয়নের বাড়ির উদ্দেশ্যে। কুন্তলের দৃঢ় প্রতিজ্ঞ মন যেন তাকে বলে উঠল,--
"অয়ন গোস্বামীর শাস্তি চাই! ওকে সাজা পেতেই হবে!"
তাকে কী কী করতে হবে, সবই সে হাঁটতে হাঁটতে স্থির করে ফেলল। তারপর কয়েক মিনিটের মধ্যেই সে অয়নের বাড়ি পৌঁছাতেই অয়ন বলল,
"কী রে, ভোর থেকে উঠে তুই কোথায় গিয়েছিলি?"
কুন্তল পুরো বিষয়টা চেপে গিয়ে বলল, "একটু মর্নিং ওয়াকে বেরিয়ে ছিলাম।"
"আচ্ছা বেশ, তুই এখন মুখ-হাতটা ধুয়ে আয়। জল-খাবার খেয়ে গ্রামের পথে-ঘাটে একটু ঘুরে বেড়াবো।"
এই বলে অয়ন নিজের রুমে চলে গেল। কুন্তল লক্ষ্য করল অয়নের বাবা বাড়ির বারান্দায় একটা সোফাতে কী সব কাগজ-পত্র নিয়ে বসেছে। কুন্তল ধীরে ধীরে বাথরুমের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। বাথ রুম থেকে রান্না ঘরটা খুব কাছে; তাই সে একটু উঁকি দিয়ে দেখল অয়নের মা রান্না ঘরে ব্যস্ত রয়েছে। কুন্তল আরো দেখল যে রান্না ঘরের পাশের রুমে তালা বন্ধ নেই, শুধু শিকল তুলা রয়েছে। কুন্তল আস্তে- আস্তে করে গিয়ে রুমটার সামনে দাঁড়াল। তারপর খুব সতর্কতার সঙ্গে দরজা খুলে সে ঢুকে পড়ল রুমের মধ্যে। রুমটাতে সব ভাঙা-চোরা আসবাব পত্র ভর্তি রয়েছে। কুন্তল ঘরের চারিদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সব কিছু দেখতে থাকল। মেঝেতে পড়ে থাকা একটা ভাঙা চেয়ারের দিকে তাকাতেই হঠাৎ একটা বিষয় তার নজরে পড়ল। তার মস্তিষ্কে বিদ্যুতের মত ঝিলিক দিয়ে উঠল একটা ধারণা! সঙ্গে সঙ্গে সে পুরো বিষয়টা বুঝে গেল। আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা না করে কুন্তল রুমের বাইরে বেরিয়ে এল এবং সোজা চলে গেল বাড়ির ছাদের ওপর। ছাদটা খুব নিরিবিলি, তার কণ্ঠস্বর কেউ শুনতে পাবে না। ছাদের ওপর উপযুক্ত একটা স্থানে দাঁড়িয়ে সে পকেট থেকে মোবাইলটা বের করল; মনের মধ্যে অদম্য শক্তি সঞ্চয় করে স্থানীয় পুলিশ স্টেশানে একটা কল করল। তারপর কুন্তল অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে ছাদ থেকে নেমে এসে মুখ হাত ধুয়ে যথা সময়ে অয়নের সাথে জল-খাবারের টেবিলে যোগ দিল। জল-খাবার খেতে খেতে কুন্তল ইচ্ছে করেই বলল, "এই বেলা একবার জয়তির গান শুনতে যেতে হবে, অনেক দিন ওর গান শুনিনি।"
হঠাৎ করে অয়ন বলে উঠল,--
"কিন্তু, জয়তি তো মারা গেছে।"
কথাটা বলেই অয়ন কেমন যেন হকচকিয়ে গেল। কুন্তল বলল,--
"তুই জানলি কী করে যে জয়তি মারা গেছে?"
অয়ন আমতা-আমতা করে বলল,--
"না, মানে -- আমি শুনেছি দেড় বছর আগে নাকি জয়তি হঠাৎ করে এক রাতে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়; তাই সকলের ধারণা যে ও আর বেঁচে নেই।"
"জয়তি যে রাতের বেলায় নিরুদ্দেশ হয়েছিল, সেটা তুই কার কাছে শুনলি?"
"কার কাছে আবার, লোকের মুখে শুনেছি।"
"কে সেই লোক? তুই তার নাম জানিস?"
"নাম দিয়ে কী হবে? তুই কি তদন্ত শুরু করেছিস নাকি?"
অয়নের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে কুন্তল বলল, "পাড়া-প্রতিবেশীর কাছে শুনলাম তুই নাকি দেড় বছর আগে একবার বাড়ি এসেছিলি?"
হঠাৎ করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে অয়ন অত্যন্ত উত্তেজিত কন্ঠে বলল, "হোয়াট ডু ইউ মিন, কুন্তল! তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে! এক্ষুনি তুই আমার বাড়ি ছেড়ে চলে যা!"
অয়নের মা সম্ভবত আড়াল থেকে ওদের কথবার্তা শুনে ফেলেছিল; তাই সে দ্রুত এসে দাঁড়াল কুন্তলের সামনে; চোখ পাকিয়ে বলল,
"দেখো কুন্তল, তুমি বন্ধুর বাড়িতে এসেছ, বন্ধুর মতই থাকো! অন্য কোনো কিছুতে নাক গলানোর চেষ্টা করবে না!"
কুন্তল একটু মুচকি হেসে বলল,
"কাকীমা, আপনিও কম যান না!"
আর কোনো কথা না বলে অয়ন তার মায়ের সঙ্গে অন্য রুমে চলে গেল।
কুন্তল অয়নের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য প্রস্তুত হল; স্থির করল রাস্তার কোনো এক স্থানে দাঁড়িয়ে থাকবে সে। তারপর, পুলিশ এলে, পুলিশের সঙ্গে সে আবার ফিরে আসবে অয়নের বাড়িতে। এই সময় পাশের একটা রুম থেকে চাপা স্বরের কিছু কথাবার্তা তার কানে ঠেকল। অস্পষ্টভাবে সে শুনতে পেলো অয়ন আর তার মায়ের কথাবার্তা। সে অয়নকে বলতে শুনল, "কুন্তল সব টের পেয়ে গেছে! এখন কী হবে!"
অয়নের মা বলল - "তুই এক্ষুণি গিয়ে কুন্তলকে আটকে রাখ! ওকে আর কোনো মতে বাঁচতে দেওয়া চলে না!"
শিউরে উঠল কুন্তল! এ যে তাকেই হত্যা করার ষড়যন্ত্র চলছে! সে আর এক মুহূর্তও সেখানে দাঁড়াল না, দৌড়ে গেল মেইন গেটের দিকে। সে খুব তাড়াতাড়ি গেটটা খুলে ফেলল, আর সঙ্গে-সঙ্গে তাকে পেছন থেকে জাপটে ধরল অয়ন! অয়নের মা একটা বড় দড়ি দিয়ে কুন্তলের হাতে পায়ে বাঁধার চেষ্টা করছে! কুন্তল লক্ষ্য করল অয়নের বাবাও এসে ওদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে! অবশেষে তিনজন মিলে কুন্তলের হাতে-পায়ে দড়ি বেঁধে ফেলল। একটা হিংস্র মুচকি হাসি হেসে অয়নের বাবা বলল - "তোমাকে তো পালাতে দেওয়া যাবে না কুন্তল! তাতে আমরাই বিপদে পড়ব! রান্না ঘরের পাশের রুম থেকে তোমাকে যখনই বেরোতে দেখেছি, তখনই আমার সন্দেহ হয়েছিল।"
কুন্তল ভাবল তার বোধহয় আর বাঁচা হল না! সে 'বাঁচাও-বাঁচাও' বলে চিৎকার করতে শুরু করল, আর সঙ্গে সঙ্গে অয়ন তার মুখে একটা বড় রুমাল গুঁজে দিল। অয়নের বাবা মেইন গেটটা বন্ধ করতে যাবে, ঠিক এমন সময় কয়েকজন পুলিশ হুড়মুড় করে ভেতরে প্রবেশ করলেন। দুজন পুলিশ কুন্তলের হাতে-পায়ের দড়ি খুলে দিলেন এবং মুখ থেকে রুমালটা টেনে বের করলেন। একজন পুলিশ অফিসার বললেন,--
"এখানে এই সব কী হচ্ছিল?"
কুন্তল হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,--
"অ্যাটেমট টু মার্ডার! স্যার, এরা সবাই মিলে আমাকে হত্যা করার চেষ্টা করেছিল! এদেরকে ছাড়বেন না স্যার!"
"আচ্ছা, কুন্তল বসাক কে?"
কুন্তল বলল - "আজ্ঞে আমি কুন্তল বসাক। আমিই থানাতে ফোন করেছিলাম। আপনারা আসুন আমার সঙ্গে।"
এই বলে কয়েকজন পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে কুন্তল সোজা গিয়ে রান্না ঘরের পাশের রুমে প্রবেশ করল। একজন পুলিশ বললেন - "এখানে কী আছে?"
কুন্তল রুমের মেঝের দিকে একটা আঙ্গুল দেখিয়ে বলল - "এখানে খোঁড়ার ব্যবস্থা করুন।"
পুলিশ অফিসারের মনে হল মেঝেতে বসানো টাইলসগুলোর মধ্যে দুটো টাইলস কেমন যেন অসমতল। তাই, উনি টাইলসগুলো সরিয়ে মেঝে খুঁড়ে ফেলার হুকুম দিলেন এবং প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে তিন জন কনস্টেবল কাজে লেগে পড়লেন। প্রায় ছ-সাত ফুট খোঁড়ার পর সকলের লক্ষ্যে পড়ল একটা নর কঙ্কাল! কঙ্কালের দুহাতে কয়েকটা চুড়ি রয়েছে। কুন্তলের আর বুঝতে বাকি রইলো না যে এটা জয়তির কঙ্কাল!
ভারাক্রান্ত মন নিয়ে কুন্তল হেঁটে চলেছে। অবশেষে নিরুপায় হয়ে অয়ন আর তার বাবা-মা সমস্ত দোষ স্বীকার করেছে। ওদের জবান বন্দী অনুযায়ী আজ থেকে দেড় বছর আগে এক সন্ধ্যায় অয়ন গোস্বামী নিজের লালসা চরিতার্থ করে জয়তিকে গলা টিপে খুন করে। ওর বাবা-মা যখন বিষয়টা জানতে পারে, তখন পুলিশের হাত থেকে বাঁচার জন্য উপায় খুঁজতে থাকে। তারপর তিনজনে মিলে লাশটাকে ঘরের মেঝের তলায় পুঁতে ফেলে। যাই হোক, কুন্তলের কাজ শেষ; সে হেঁটে চলেছে স্টেশানের উদ্দেশ্যে। সন্ধ্যে নামার আগে তাকে বাড়ি ফিরতে হবে। পরের দিন থেকে আবার কাজে মন দেবে সে। এখানে আর তার কোনো দিনও আসা হবে না! কুন্তল এই রকম নানান কথা ভাবছে, এমন সময় তার মনে হল যেন জয়তি তার পেছন-পেছন চলেছে। কুন্তল পেছন ঘুরে তাকাল। না, কাউকে দেখতে পেলনা সে! সূর্যের আলোতে তার চোখের অশ্রু চক্ চক্ করে উঠল। পকেট থেকে রুমালটা বের করে অশ্রু মুছে কুন্তল আবার এগিয়ে চলল স্টেশানের দিকে। সহসা তার মনে হল জয়তি যেন তার কানে কানে বলে গেল,-- "বাবু, আমি আপনাকেই ভালোবাসি!"
কবিতা
সুকান্ত পাল
জিতপুর, মুর্শিদাবাদ
একাকিত্ব কখনো গ্রাস করেনি।
একাকিত্ব কখনো আমাকে গ্রাস করে নি
বৈশাখী ঝোড়ো হাওয়া—
আষাঢ়ী বৃষ্টি কিম্বা নিঃসঙ্গ রাত
সব কিছুই মানিয়ে নিয়েছিলাম
একাকী আমি—তাই হয়তো
একাকিত্ব কখনো আমাকে গ্রাস করেনি।
ঘরের দরজা ধরে আমার জন্য
কেউ কখনো অপেক্ষা করে না—
চায়ের টেবিলে একলা বসি
খবরের কাগজখানা হাতে নিয়ে
অথচ বাজারের ব্যাগ এগিয়ে দিতে
কোনোদিন কেউ আসেনি।
রান্নার তাগাদা নাই
হইচই নাই —
জেদ অভিমান—না কিচ্ছুটি নাই।
একলা বারান্দায় দুপুর কাটে -তবু
একাকিত্ব কখনো আমাকে গ্রাস করেনি।
সন্ধ্যা নামে—রাত্রি গভীর হয়
অথচ ঘরে ফেরার তাড়া নাই।
জনহীন পথে একাই হেঁটে চলেছি
এ হাঁটার শেষ নাই—সীমা নাই।
হাঁটতে হাঁটতেই এগিয়ে যেতে হয়
তাই আমিও হাঁটছি —আর এগিয়ে যাচ্ছি
তবু এগিয়ে যাওয়ার শেষ নাই।
অতীতকে পাশে রেখে
ভবিষ্যৎকে ধ্রুবতারা করে
বর্তমানের পথ ধরে গুটিগুটি পায়ে
চলতে চলতে ক্লান্ত হয়েছি বটে—তবু
একাকিত্ব কখনো আমাকে গ্রাস করেনি।
চিরবসন্তের গান
তুমি আছো তাই প্রতিটি দিনই আমার গোলাপ-ডে
গোলাপী আদরে আলিঙ্গনের আসে রোজ হাগ-ডে।
চকোলেট-ডে নতুন করে ভাবিনিতো কোনোদিন
তুমি আছো তাই চকোলেট-ডে আমাদের প্রতিদিন।
কিস-ডে সে তো আসে প্রতিদিন একদিন নয় মোটে
প্রতিটি সকাল চুম্বন আঁকা গালে-বুকে-মুখে-ঠোঁটে।
প্রতি প্রশ্বাস তোমাকেই খোঁজে নাই কোনো মিস-ডে
জীবনের যত অবশেষ দিন সবই তো প্রমিস-ডে।
টেডি-ডে সেও তো আসে হাররোজ পুতুল পুতুল দিন
আলতো ছোঁয়ার উষ্ণ পরশ হৃদয়ে বাজায় বীন।
তুমি আছো তাই এত ভালোবাসা রোজ রোজ লাভ-ডে
তোমারই জন্য প্রতিদিন আমার ভ্যালেনটাইন্স-ডে।
তাইতো তোমার আমার হৃদয় চিরবসন্তময়
পলাশের কুঁড়ি প্রেম হয়ে ফুটে সদা সুরভিত রয়।
কবিতা
সুব্রত মিত্র
সবাই যেন নিগূঢ় প্রতিনিধি
সবাই কেমন দুরে চলে যায়
আমি পারি না যেতে।
সবাই কেমন
সুন্দর স্মৃতিগুলো সুন্দর করে ভুলে যায়
আমি পারি না ভুলে যেতে
সবাই কেমন
সবকিছু দেখেও না দেখার ভান করে আকাশ দেখে
আমি পারিনা সেই ভান করিতে।
সবাই কেমন
স্বার্থ ত্বরান্বিত করতে নিজের প্রকৃত পরিচয়কে লুকিয়ে রাখে
সবাই কেমন আরও কিছু পাব পাব বলে
হঠাৎ করে নিজের জাতি গোত্রকে নকল করে ঢেকে রাখে,
আমি পারি না তাহা করিতে।
সবাই কেমন-
দেশকে ভালোবাসার নাম করে দেশটাকেই দখল করে
সবাই কেমন
হতে গিয়ে ঝান্ডার তলায় নিজের আশ্রয় খুঁজে নেয়
আমি এগুলোর কোনটাই পারিনা করিতে।
সবাই কেমন ফুটপাত দখল করে বসে পড়ে রাস্তার ধারে
সবাই কেমন অপরিচিত হয়ে ওঠে
সবাই কেমন অকৃতজ্ঞ হয়ে ওঠে
সবাই কেমন প্রাপ্তিস্বীকার করতে ভুলে যায়
আমি পারিনা এভাবে ভুলে যেতে।
ন্যায্য দাবির বিদ্রোহ
সকালবেলা স্নান খাওয়া-দাওয়া সেরে কাজে বেরোলাম
পাটুলি হয়ে যাদবপুর, যাদবপুর থেকে যোধপুর পার্ক আমার গন্তব্য স্থল
গন্তব্য স্থলে যেতে-যেতে মাঝপথে যাদবপুর ইউনিভার্সিটির সামনে রাস্তা অবরোধ
পাঁচ মিনিট;দশ মিনিট; কুড়ি মিনিট; প্রায় আধ ঘন্টা দাড়িয়ে--
তিত বিরক্ত হয়ে যাচ্ছিলাম ঐ আন্দোলনকারী যুবক যুবতীদের ওপরে।
ওরা চিৎকার করে বলছে -- -- -- --
আমাদের কর্ম চাই,
আমাদের ধর্ম চাই।
আমাদের অধিকার চাই,
আমাদের প্রতিবাদ করার স্বাধীনতা চাই।
আওয়াজগুলো আমার কর্ণপাত হওয়া মাত্রই আমার শত বিরক্তি থেমে গেল,
আমি শত ব্যস্ততার মাঝেও হঠাৎ করে শক্ত বরফের মতো শীতল পাথরে পরিণত হলাম।
ভাবলাম; হ্যাঁ ওরা তো ঠিকই বলছে,
যে কথা আমি এবং আমরা বলছি না,
যে কথা আমরা কেউই সাহস করে বলতে পারছি না
সেই কথাই ওরা বলছে।
যে কথা বাধ্য হয়ে মুখ বুজে থাকা শিশু শ্রমিক
বলতে পারছে না,
যে কথা বিধবা মায়ের দুর্দশা মোছাতে চায়
যে কথা রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে বদলাতে চায়ওরা সেই কথাগুলিই বলতে চায়।
এতক্ষণে আমি--------------
যাদবপুর ইউনিভার্সিটির তিন নম্বর গেটের সামনে।
স্লোগান আরও জোরদার,
মাঝরাস্তায় বড় বড় নেতাদের কুশপুত্তলিকা জ্বলছে দাউ দাউ করে।
আমি মাথা নিচু করে একজন স্বার্থপর মানুষের মত
সবকিছু না দেখার ভান করে সামনের দিকে এগিয়ে যাই।
সামনেও রক্তাক্ত অবস্থায় আন্দোলনকারী----
বেশ কয়েকজন যুবক আহত অবস্থায় খোঁড়াচ্ছে।
কেউ কেউ আবার যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে।
পেছন থেকে কয়েকজন সাদা পোশাকের পুলিশ আহত আন্দোলনকারী যুবকদের সাহায্য করার চেষ্টা করতে এগিয়ে আসছে।
পুলিশের চোখেও সেদিন আমি লেখা দেখেছি দয়ার অক্ষরমালা।
এই বঙ্গ দ্বেষ
এই বঙ্গে অনেক বুদ্ধিজীবীদের দেখতে পাই।
এই বঙ্গে অনেক মহাকবিদের দেখতে পাই।
এই বঙ্গে অনেক সম্প্রীতির বার্তা বাহককে দেখতে পাই।
এই বঙ্গে রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে কথা বলার মত-- অনেক মুখরোচক নেতাদের দেখতে পাই।
যা দেখেছি সব ভুয়ো বাতাস, সব নিঃস্বতায় পোড়া এক রত্তি ছাই।
এই বঙ্গে অন্যায়ের প্রাতিবাদ না করে শুধু সম্মান হারানোর ভয়ে-----
লেজ গুঁটিয়ে পালানোর মত অনেক মহাপুরুষদের দেখতে পাই।
আমি খুব ছোটখাটো মানুষ অথচ আমি মস্ত বড় ছোটলোক হয়েও------
উনাদের দেখে বড় কষ্ট পাই, ওনাদের দেখে বড় লজ্জা পাই।
এই বঙ্গে ঝুলিয়ে সম্প্রীতির মালা
শালারা মা-বোনের ইজ্জত বেচে দেয়---
তারাই আবার দেশপ্রেমের উন্মুক্ত চেতনার ভাষণে মঞ্চ আওড়ায়।
এই বঙ্গে ঐ কান্ডারীর দল কেড়ে নেয় ইমোশন; ফাঁটকাবাজের শক্তিমান হয়ে পকেটে ভরে প্রমোশন,
সম্প্রীতির নামে নিজের স্বার্থে এখানে-----
ভেসে যায় আমার মা-বোনের সম্ভ্রম।
এই বঙ্গে ভাইয়ে-ভাইয়ে,
বাবা-কাকায় হয়ে যায় কত হানাহানি
এই বঙ্গেই আমি দেখি;
সব জেনেশুনেও জনস্বার্থে নেতারা করেনা কানাকানি,
শুধু বলে; "সম্প্রীতি, সম্প্রীতি, সম্প্রীতি"।
আমি যদি বলি ওহে নেতা,
কেন হচ্ছে তবে সমাজের এত অবনতি?
স্বাধীনতার এত বছর পরেও এই বঙ্গের হয়েছে কি সংস্কার?
চারিদিকে হিংসার দুর্বার,
এই বঙ্গ ঐ বঙ্গ ভেঙে হচ্ছে ছারখার
কি প্রয়োজন হয়েছিল ওদের আজ হিন্দুদের ঘরবাড়ি;
মন্দির পোড়াবার?
তোমরা নাকি মুসলমান;
তোমাদেরওতো ধর্মের আছে অনেক মান সম্মান
তবে কেন অন্য ধর্মের ক্ষতি করে নিজের ধর্মকে করো অপমান?
আমি বিগ্রহ চিত্তে মালা ছিড়ে ফেলি সব নেতাদের সব রাজনৈতিক দলের------------------
সব হিংস্রতার; সব নোংরা মানসিকতার।
আর যে সকল কবি সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীরা------
বুদ্ধির ঢেঁকি মাথায় নিয়ে চুপটি করে তামাশা দেখে--
তোমাদের আক্কেল হওয়া চাই,
তোমাদেরও আছে মা বোন, আছে ভাই।
তবে আজ তোমাদের কলম কোথায়?
হে কবি, হে বুদ্ধির ঢেঁকিওয়ালা বুদ্ধিজীবী .. .... ... ..
তোমাদের মানবিকতাও বিক্রি হয়েছে নাকি ঐ নেতাদের গোপন পকেটে?
নাকি তোমার ধর্মটাও বিক্রি হয়ে গেছে স্বার্থের হাটে?
তুমি জানো কি?
আমাদের জাতিটাও আজ ভেসে যেতে বসেছে সস্তার ঘাটে।
শুনে রাখ, শুনে রাখ, সকল বুদ্ধিজীবীগণ.......
সকল জাতির জাতীয়তাবাদ, সকল ধর্মের ধর্ম প্রবাদ
সকল দেশের দেশাত্বতা, সকল মনের মহানুভবতা
সকল মনের কামনা-বাসনায়; স্পর্শতা থাকুক স্বাধীনতায়।
আমাদের দুই বঙ্গের আপন সিন্ধু সেই তো মোদের বঙ্গবন্ধু
তারেই বলি মোরা জাতির জনক,
সেতো আজ হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি মোদের অহংকারের মাইলফলক।
সে যে শিখিয়ে গেছেন একই ভাষায় দুই বঙ্গের আলিঙ্গন
শিখিয়েছেন ভালবাসতে; শিখিয়েছেন কাছে আসা আসি
সেই তো মোদের রবীন্দ্রনাথের কন্ঠকে জাতীয় সংগীতে স্থাপন করেছেন--
"আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি"।
জাগো; জাগো; জাগো;.. .. ... জাগো মহাবীর
এই বঙ্গমাতার নিঃস্ব খাতায়-------
রাখিবো আবার অটুট ছবি আমার বঙ্গের সংস্কৃতির।
কবিতা
তাপস কুমার বর
কৃষ্ণনগর, দঃ ২৪ পরগনা
নতুন বছর
নতুন বছর মানে,
একটা স্বপ্নগড়া ইতিহাস।
নতুন বছর মানে,
মানবতার জয়-জয়কার।
নতুন বছর মানে,
সুরক্ষিত ভবিষ্যতের সন্ধান।
দেখো বন্ধু প্রিয়জন,
আজও ওরা ও কি সুখী?
ওদের থালায় জোটেনা ভাত,
ওরা যে ফুটপাত!
যাক সব মলিনতার অন্ধকার,
মুছে সাফ হোক সকল সন্ত্রাস।
এখনো স্মৃতির মন্দিরে দুঃখের আঘাত....
ওই দেখো কত শত মৃত্যুর চিৎকার।
নতুন বছর মানে,
একটা সুরক্ষিত সমাজ।
নতুন বছর মানে,
সুস্থভাবে বেঁচে থাকার সম্মান।
নতুন বছর মানে,
ধর্ষিতা নারীর অধিকার।
ওই দেখো শিক্ষার অধিকার,
হাজার হাজার ধর্না দেওয়া রাজপথে।
দেনার দায়ে কত শ্রমিক কৃষক আজও মরে,
এখনো একমুখো ভাত জোটেনি ওদের ঘরে।
এখনো কি মা-বোন সুরক্ষিত আছে?
কাগজের হেটলাইনে দিনে দিনে কত ধর্ষিতা মরে।
ভেবে দেখেছো কি সকলে...?
হারিয়ে যাচ্ছে যুবসমাজ একে একে করে।
নতুন বছর মানে,
কত মহান স্মরণীয় সভা।
নতুন বছর মানে,
ধর্মে ধর্মে এক মানবতার জোয়ার।
নতুন বছর মানে,
তোমার আমার বাঁচার অধিকার।
আমি সেই দিন পেতে চাই ফিরে,
মানবতার নতুন সূর্যোদয়ে....
দেশের বাহু হবে মজবুত কংক্রিটে।
অধিকারের মুক্ত দরজা,
শাশ্বত হয়ে বিরাজ থাকবে।
সব জাত-পাত যাক না মুছে,
একটা শক্ত মেরুদন্ডের মানবতার মুক্ত আকাশে।
হয়তো সেদিন....
প্রাণভরা হাসি নিয়ে বলবে,
আবার নতুন বছর এসেছে!
যিশু
মানব রূপী ঈশ্বর হয়ে...
মর্ত্যে এসেছে যিশু।
দুখিনী মেরি মা কাঁদছে আজও..
কোথায় আমার সন্তান যিশু?
সত্য আজও ক্রশবিদ্ধ হয়ে,
তোমরা বাঁচাও আমার যিশু।
আমার যিশুর ও অভুক্ত ঘরে,
আজও মরছে কত শিশু।
ভিক্ষার ঝুলি ঝুলছে আজও,
যন্ত্রণার অভুক্ত দোরে।
শরীর থেকে রক্ত ঝরে,
ক্রশবিদ্ধ আমার যিশু।
জোসেফ মেরি কাঁদছে আজও,
তোমরা বাঁচাও আমার যিশু।
হাজার হাজার অভুক্তের চিৎকারে...
মরছে কত শিশু।
দুখিনীর ঘরে দুখিনী মা,
বাঁচাতে পারেনি তাঁর যিশু।
বড়দিন আজও বড়দিন কি..?
হতে পেরেছে অভুক্ত শিশু।
ফুটপাতে ওরা দিন-রাত ঘোরে,
ওদের বড়দিন আসেনা কিছু।
ঈশ্বর যিশু কাঁদছে আজও,
শরীরের রক্তঝরা ক্রুশে।
আমার যিশু ও অভুক্ত হয়ে...
ধুঁকে ধুঁকে মরে ফুটপাতে।
বড়দিন হয়তো সেদিন হবে,
যেদিন অনাহারের জ্বালা মিটবে!
দেখো শান্তির বাতাস আকাশে বাতাসে,
প্রাণ খোলা একটা প্রাঙ্গণে।
অশ্রু সেদিন নিপাত যাবে..
কত জোসেফ মেরির দুখিনীর ঘরে।
কবিতা
মিজানুর রহমান মিজান
বিশ্বনাথ, সিলেট, বাংলাদেশ
ভাইবোন বন্ধুরা তোমাদেরকে বলি
ভাল মানুষ হবে সন্তান দেখো চোখ খুলি।।
আদর সোহাগ যত্ন নিবেন সচেতনতায়
ফাঁকি দিলে বুঝান তারে নির্জন নিরালায়।।
রোজ সকালে উঠার অভ্যাস দে