জুন ২০২০
কবিতা
কবিতা
গল্প
স্বাধীনতার
সুখ
সব্যসাচী বসু
বর্ধমান, পঃ বাংলা
কটা প্রকাণ্ড ছাতা। লাল-নীল-সবুজ। যেন মেলা বসেছে রঙের। পেছনে হেলানো। সামনে স্থির ফতনাটার দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে বসে আছে অন্তুজেঠু। কখন একটুখানি নড়েচড়ে উঠবে তারই প্রতীক্ষায়। যেন রঙচঙে মাছরাঙা পুঁটিমাছের ভেসে ওঠার অপেক্ষায়। জামপুকুরের শান্ত জলে ভেসে রয়েছে সাদা ফতনাটা। স্বচ্ছ-শীতল জলের নীচে বহু গভীরে কোথায় লুকিয়ে আছে মাছটা! যার জন্যে অধীর আগ্রহে বসে আছে অন্তুজেঠু।
পুকুরে তো মাছ কত থাকে। তাহলে জেঠু কেন বলে, “আজ বড় কাতলাটা ধরবো যার লেজটা ভেঙে দিয়েছিলাম আগের বছর!” ঐ মাছটাই যে ধরা পড়বে ছিপে তার কি কোনো মানে আছে! অন্তুজেঠুকে প্রশ্ন করলে জেঠু বলে, “এ যে ভক্তের সাথে ভগবানের সম্পর্ক রে। কান টানলে যেমন মাথা আসে তেমনি আমি ডাকলে ও ও আসবে; দেখিস। তবে ডাকাটা আন্তরিক হওয়া চাই।”
এসব কথা ওর মাথায় ঢোকে না। ও কেবল চেয়ে থাকে ফতনাটার দিকে। তবে বেশিক্ষণ চুপ করে থাকা ওর স্বভাব বিরুদ্ধ। একটা প্রশ্ন ওর মনে বারবার উঁকি দেয়। সেটাই করে ফেলে।
“প্রতিবছর এই দিনেই তুমি আসো কেন,জেঠু?” শীতের সাতসকালের আলগা রোদ্দুরের মতো এক মিষ্টি হাসি খেলে যায় অন্তুজেঠুর নিখুঁত গালে।
“ছুটি থাকে বলে? বছরে তো আরো ছুটি থাকে। না কি এই সময় মাছেরা তোমার কথা শোনে?” উত্তরে সেই নীরব হাসি।
সত্যিই ভেবে পায় না ও। দুর্গাপুজোর ছুটিটা না হয় বাদই গেল। শহরের পুজোর জাঁকজমকই আলাদা। কালীপুজোতেও হবে না। নৈহাটির কালী বিখ্যাত। বড়দিনে নয় কেন! শীতের আমেজে রোদে হেলান দিয়ে তো জমিয়ে মাছ ধরা যাবে। সকালের উষ্ণ রোদ্দুর গায়ে মাখতে মাছটা ভুস্ করে ভেসে উঠবে। মুখের সামনে কেঁচো দেখে হাঁ করে খেতে আসবে। সারারাত ঘুমের পর জেগে উঠেই চাঁচাঁ খিদে। আর তখনই ঘনিয়ে আসবে মরণঘুম।
তা না করে এই ঘোর বর্ষায় এক হাঁটু কাদা ভেঙে সেই তিন কিলোমিটার দূরের বাসস্টান্ড থেকে কেনই বা হেঁটে আসে অন্তুজেঠু! সারাদিন থাকতে রাতের অন্ধকারে কেন আসতে পছন্দ করে তাও বোঝে না ও। আবার প্রশ্ন করলে উত্তরের বদলে ঐ নীরব হাসি। তাই ও উঠে পরে।
পায়ে পায়ে এগিয়ে আসে জলের ধারে। হাঁটুজলে খেলা করছে বেশ ক’টা তেচোখা মাছ। কে যেন বলেছিল নামটা। ওদের কি তিনটে চোখ! ওরা কি দেবী দুর্গার সন্তান! তাই দেবীর ত্রিনয়ন ওদের মাথায় বসেছে!
না, ওকে আজ ছেলেমানুষীতে পেয়েছে। অবশ্য ওতো ছেলেমানুষই। কতই বা বয়স ওর! মনের বয়স তার চেয়েও কম।
বেশ লাগে এই মাছেদের খেলা। আসলে খেলা নয়-ওরা খাবারের খোঁজে হয়রান। খুব ছোট ছোট পোকা খায় ওরা। তাতো খাবেই। ওরাই বা কতটুকু! ওর কড়ে আঙুলটার মতো হবে বড়জোর।
একটু দূরে বাঁদিকে শালুক ফুটেছে কত! সাদা আর গোলাপি-দুরকমের। অন্যসময় দেখেছে সাঁওতাল পাড়ার ছেলেদের ফুল তুলতে। কি করে ওরা এতো ফুল নিয়ে!
ডানদিকে অশথ গাছটার তলায় রাখালেরা বসে আছে। অবাক হয়ে দেখছে রঙবেরঙের ছাতা আর তর নীচে বসে থাকা রঙিন মানুষটাকে।
রঙিনই বটে! সিন্থেটিক রঙিন চকমকে লুঙ্গি। অথচ খালি গা! ফরসা টকটকে রঙ। বাবুটিকে বেশ লাগে ওদের। বছরের এই সময়ই তো দেখা হয়। ওরা কখন জানি পায়ে পায়ে এগিয়ে এসেছে।
“কিরে ভানু, গোপলা, আসরফ, হারু-ভালো আছিস তোরা? সকলে হাসে। মাথা নেড়ে জানায় তারা ভাল আছে।
“আপনি ভালো আছেন জেঠু? হিন্দোলের জেঠু মানে তো তাদেরও জেঠু। তারা মানে ভানু পাল,গোপাল সোরেন, আসরফ আলি আর হারু দফাদার।
“আজ আর মাছ পড়বে নেগো জেঠু-উঠে পড়েন।”
“ও সব অলুক্ষুনে কথা বলিস না তো গোপলা”, আসরফ বাধা দেয়।
“জেঠুকে দেখেছিস কোনোদিন খালি হাতে ফিরতে?”, ফুট্ কাটে হারু।
আর ঠিক তখনই ফতনাটা নড়ে ওঠে। আচমকা ডুবেও যায়।
“খেয়েছে-খেয়েছে”, একসাথে বলে ওঠে ওরা।
“পেছন থেকে সরে যা”, চাপাস্বরে নির্দেশ দেয় অন্তুজেুঠু। একটা হেঁচকা টান লাগায় মাছটা। সুতো ছাড়তে থাকে অন্তুজেঠু। ছাতা গড়াগড়ি দিচ্ছে পাড়ে। লুঙ্গিটার খুঁট একদিকের কোমরে গোঁজা। ও এগিয়ে যায়। ততক্ষণে মাছটা বহুদূরে চলে গেছে। সারা শক্তি দিয়ে লড়ছে। এ নিয়মটা এতবছরে জেনে গেছে ও। এটাও খেলা। আহত মাছটা ছুটিয়ে ক্লান্ত করে করে একসময়ে পড়ে তুলবে। তখন সুতো গুঁটোবে হুইলের। পোড়খাওয়া হাতে একটা টান। জলের মাছ ডাঙায় আছড়ে পড়বে। ছুট্টে যাবে ছেলেগুলো। জেঠু সাবধানে মাছের রক্তাক্ত ঠোঁট থেকে বঁড়শিটা খুলে নেবে। মাছটাকে ভরে ফেলবে ব্যাগে।
এমনই হয় ফি-বছর। আগস্টের চোদ্দই সন্ধ্যেয় সদর দরজাটা পার হয় সেই চেনা চেহারাটা-রঙিন পাঞ্জাবী, দূরের বাসস্ট্যাণ্ডেই পাল্টে নেওয়া প্যান্টের বদলে রঙচঙে লুঙ্গি; একহাঁটু
কাদা, কাঁধে ঢাউস সাইডব্যাগ। মুখে সেই চেনা মিষ্টি হাসিটা। পেছনে দুটো বড়ো চটের ব্যাগ হাতে বাবা। একটায় সবজী। আরেকটায় মুরগী। জ্যান্ত। পরের দিন - স্বাধীনতা দিবসে আত্মবলিদানের জন্যে।
“বৌমা—” সেই চেনা হাঁক। মাথায় আঁচল দিয়ে মায়ের প্রণাম।
“তোমাকে এতবার বলেছি ঘোমটা দিতে হবে না। তা ভালো আছো তো তোমরা?”
“জেঠু কই আমার?”
এই প্রশ্নটার জন্যেই অপেক্ষা করে থাকে ও। সারাবছর। এই দুদিন আর লেখাপড়া নয়। লেখাপড়া যে ভাল লাগে না তা নয়। আসলে অন্তুজেঠু মানেই দেশবিদেশের ভ্রমণকাহিনী আর ইংরেজি সিনেমার গল্প। ক্যামেরায় ছবি তোলা শেখা। খাওয়াদাওয়া। মজা। পরদিন স্বাধীনতা দিবসে সাতসকালে উঠোনে পতাকা তোলা। কবিতা বলা, টেপরেকর্ডারে গান বাজানো। আর মাছধরা। স্বাধীনতার অন্য একটা মানে ও খুঁজে পায় এই দিনক’টায়। এইরকমই হয়ে আসছে শৈশব থেকে কৈশোর। সন্ধ্যেয় টকমিষ্টি চানাচুর আর আমতেল মাখা ফোলা ফোলা মুড়ি খেতে খেতে জমিয়ে গল্প।
“সত্যি তোদের বর্ধমানের মুড়ি যেন অমৃত। এই মুড়ির জন্যেই যে এক’শ বছর বাঁচতে ইচ্ছে করে রে।”
“জেঠু সেই গল্পটা বলো না -রুদ্রপ্রয়াগের চিতাবাঘ। সেই জিম করবেট যেটাকে মেরেছিল। ”সময়টা পিছিয়ে যায় বিশ শতকের গোড়ায়। শিকারী জিম করবেট যখন ঘুরে বেড়ান একা রাইফেল হাতে এক দৈবিক ক্ষমতাওয়ালা চিতাবাঘের পেছনে। কখনও বাঘ জেতে। কখনও তিনি। অবশেষে সেই প্রতীক্ষিত দিন এলো। এলো মুহূর্ত। মাত্র একটা গুলি। সব আতঙ্কের অবসান। কোথায় যেন হারিয়ে গেলো ও।
“তুমি ঐ জায়গাটা দেখেছো?”
“হ্যাঁ রে। ওখানে একটা স্মৃতিস্তম্ভ করা আছে।”
ও অন্তুজেঠুর গা ঘেঁষে বসে। শীতল একটা স্পর্শ অনুভব করে ও। অন্তুজেঠু প্রচুর পান খায়। জর্দা দিয়ে। কেমন একটা মিষ্টি মিষ্টি গন্ধ বের হচ্ছে অন্তুজেঠুর গা থেকে। জেঠুর কাছেই শোনা কস্তুরীমৃগের নাভির সুবাসের মতো। বিরল।
“তোদের দেখা আন্দামান আর কি আছে রে”, বাবাকে আক্ষেপ করে অন্তুজেঠু,“ একবার জাহাজে আর একবার প্লেনে গেছি – তখন প্লেন ডাইরেক্ট যেতো না। রেঙ্গুন হয়ে যেতো। অমলিন সবুজ দ্বীপ আজ গাড়ির ধোঁয়ায় ঢেকে যাচ্ছে।”
ওর বাবার সহোদর দাদা নয়, কোন তুতো দাদাও নয়-এক তুতোদাদার তুতো ভাই এই অন্তুজেঠু। হি ন্দোলের সবচেয়ে কাছের মানুষ।
“এই দ্যাখ,সেই কাতলা মাছটাই উঠেছে”, বড়শি থেকে মাছটা ছাড়াতে ছাড়াতে বলে অন্তুজেঠু,“ ভালই হয়েছে। গরম গরম ভাজা খাওয়া হবে। কি বল্?”
ঘাড় নাড়ে ও। জীবনে বহু মাছের মৃত্যুর কারণ হয়েছি। না রে ছেড়েই দি- একজন অন্তত থাক, যে আমায় মনে রাখবে। ও আমার পোষ্য হয়ে গেছে। রামের পোষা মাছদুটোর মতো। ওদের নাম মনে আছে তোর?”
“কার্তিক-গণেশ”
“ঠিক বলেছিস”
পরম যত্নে মাছটাকে হাতে ধরে দেখে জেঠু। ও লক্ষ্য করে অন্তুজেঠুর চোখে জল। মাছটাকে জলের কাছে নিয়ে যায়- স্বচ্ছ জলে নামিয়ে দেয়। কুতকুতে চোখে বেশ অবাক হয়ে তাকায় কাতলাটা। অন্তুজেঠু ওর দিকে হাত নাড়ে। মাছটাও তার ভাঙা লেজ নাড়িয়ে যেন বিদায় জানায় তার মুক্তিদাতাকে। তারপর খলবলিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়। ওরা হাততালি দিয়ে ওঠে। ভানু, গোপলা, আসরফ আর হারু। ও..ও হাততালি দিতে গিয়ে থমকে দাঁড়ায়। জেঠুর দিকে নজর পড়ে। শেষ শ্রাবণের মধ্যাহ্নে অন্তুজেঠুর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। সারা গা পিচ্ছিল হয়ে উঠেছে। গামছাটা কোমর থেকে খুলে মোছে জেঠু।
“আজ আর মাছ ধরবো না, জানিস, শরীরটা ভাল লাগছে না। চারের ব্যাগটা নে।” ওরা উঠে পড়ে।
“জানিস জেঠু, কেন মাছ ধরি, কেন তোদের এখানে বছরে এসময় আসি!” মাথা নাড়ে ও।
“সারাবছর নানা কাজের চাপে ক্লান্ত হয়ে পড়ি। তাই এই বর্ষাকালে তোদের এখানে এসে ক্লান্তিটা কাটাই। আবার চাঙ্গা হয়ে নি বাকি বছরটার জন্যে। এটাই আমার স্বাধীনতার সুখ রে জেঠু, বুঝলি?”
সন্ধ্যেতেই ঘটনাটা ঘটল। হঠাৎই বুকে ব্যথা শুরু হয়। গ্রামের হাতুড়ে ডাক্তারের মতে হার্ট অ্যাটাক। বর্ধমানের এই প্রত্যন্ত গ্রামে অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া যায় না। একটা অ্যাম্বাসাডার ছুটে চলেছে রাতের নিকষকালো আঁধার ভেদ করে-দুর্গাপুর এক্সপ্রেস ওয়ে বেয়ে-ঝড়ের গতিতে। হু হু করে ছুট্টে পালাচ্ছে রাস্তার পাশের ধানক্ষেত, জলা আর তীব্র হাওয়া। অন্তুজেঠু শুয়ে আছে ওর কোলে মাথা রেখে। এখনও কানে বাজছে মাকে বলা জেঠুর শেষ কথা - “আর বোধহয় আসা হবে না…”
তখনও পতাকাটা নামানো হয়নি। এখনও উড়ে চলেছে সে, রাতের আঁধারে উঠোনের কোণে, অন্তুজেঠুর একমুঠো স্বাধীনতার সুখ হয়ে।
কবিতা
অভিষেক চন্দ
ঠাকুরপুকুর, কোলকাতা
মেঘ-বৃষ্টি
মেঘ নেমেছে যখন, বৃষ্টি তখনও
মাইল খানেক দূরে।
হাতের রেখায় অল্প অল্প করে,
তাকে এঁকেছি কলম বন্ধ রেখে
অনেক যত্ন করে।
মেঘলা বিকেল তখন,
ছিল বড্ড আনমনা।
আলোকে দিয়ে ফাঁকি, বোধহয়
হয় তোমারই আনাগোনা
নিঃশব্দে...
বৃষ্টি আসে তোমার পায়ের কাছে,
ক্রমাগত সে মুছতে থাকে আবছা ছায়াটাকে।
সে তো জানেনা
কেন বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যেবেলা আসে,
কেনই বা হাজার শব্দ মুখ ফিরিয়ে হাসে...
সে শুধু বোঝে
কালির কলম্ থামে, লেখা থমকে গেলে।
বাইরে বিকেল নিয়েছে ছুটি।
সন্ধ্যে এসেছে পা টিপে টিপে
বৃষ্টির হাত ধরে।।
কবিতা
শক্তিপ্রসাদ ঘোষ
নিউটাউন কোচবিহার
ফ্যাকাসে স্বপ্ন
নীল রাত্রি নিগরে দুঃখিততম কবিতা
পৃথিবী কাঁপে অতর্কিতে করাল আঘাতে
গর্জে উঠে আঘাত
জ্বলে উঠে উন্মত্ততা
ফ্যাকাসে অন্ধকারে
নেমে আসে শীতল মুহূর্তের নির্ঘণ্ট
প্রতিটি শরীর ভয়ার্ত মূর্তি
দূরত্ব বজায় রেখে গড়ে উঠে
নূতন সামাজিক নকশা
ঘণ্টার গলাভাঙা আওয়াজে
বেদনায় মুমূর্ষু, বীভৎস দাবানলে জ্বলছে চিতা
সবুজ মাঠে
মণি আভা ফ্যাকাসে স্বপ্ন গোনে।
কবিতা
বিধান জানা
শ্রীরামপুর, হুগলী
খাত
ফুল ফোটে গাছে গাছে আকাশেতে তারা
ঘরে ঘরে মেমসাব স্বপ্নের পাড়া
গাড়ি ছোটে সাঁই সাঁই ঢাকা কাঁচ কালো
ল্যাম্প পোস্ট জেগে আছে ঘুমিয়েছে আলো
হাত কাটা গেঞ্জিতে আধখোলা বুক
ঘুম নেই গাঢ় রাতে অলীক অসুখ
হাড় ভাঙা সারাদিন রাত ঘন কালো
ড্রেনে বয় কালো জল সময় ঘোরালো
কয়েকটা ভাই বোন টুকরো বিছানা
ট্রলিব্যাগ বড় লাগে ঘর একখানা
আকাশেতে চাঁদ জাগে জেগে থাকে চোখ
বাবা জাগে কেশে কেশে বুকে ক্ষয়রোগ
ওপারেতে দোতলায় পরী জেগে ওঠে
রাত পোশাকের নিচে জোড়া চাঁদ ফোটে
সারাদিন গেটে খাড়া কখনো বা টুল
বুকে শালা টাই ঝোলে এপ্রিলফুল
তলপেটে চিনচিন রক্তেতে ঝড়
ঝাঁপাবে বাঘের মত দেবেই কামড়
বাইরে ঠান্ডা হাওয়া ঝিমিয়েছে রাত
হাইড্রেন মাঝখানে মারিয়ানা খাত।
কবিতা
তন্বী চক্রবর্তী
জাহাজডুবির গল্প
শরীরে বল্কল ছিল, আভরণ-উদ্বেলিত ছন্দ,
চাঁদের স্তিমিত আলোয় ছুঁয়ে ছিলাম তোমার ক্র্যানবেরি-ভেজানো ঠোঁট,
নেশা-পথ প্রশস্ত, রাত-নিরালায় তখন চলছিলো পাপ-স্খলনের উন্মাদনা,
একাগ্রতা একেই বলে? বলো?
ভালোবাসায় ছুঁয়ে থাকা স্তব্ধ পায়রার তুলতুলে ঠোঁটে আলপনা এঁকে দিয়েছিলে তোমার বিমূর্ত প্রণয়াকাঙ্খার,
জলে ভরা নৌকো দাঁড় টেনে গিয়েছিলো ছলাৎ ছলাৎ,
আঁকড়ে ছিলাম শেষ পারানির কড়ি, আর পাটাতন-বালিয়াড়িতে হিসেব কষে আছড়ে পড়েছিলো পরিপ্লবের রংমিলান্তি,
থমকে ছিলো লুব্ধ-চাঁদের সময়, ধোঁয়া, চিকন-হদিশ নাগকেশরের ফুল
আর অবাঞ্ছিত ছাদনাতলায় হিন্দোলিত-বাদন,
বলো ভালোবাসাকে থামতে বলিনি আমি?
উপচে-পড়া দুধের সফেন,
সামুদ্রিক রিকিঝিকিমিকির প্রজাপতি-পাখায় তুমি আলতো করে স্পর্শ করেছিলে
তুষারাবৃত ফেনিল-শিখর আর চাঁদ মিশে গিয়েছিলো চাঁদের গভীর উত্তাপে
কোনো এক ফ্লেমিংগো-দেশের আনাচেকানাচে,
ঠোঁট দিয়ে তুলে আনছিলো অদৃশ্য রূপকথার রাজকুমারীর মৃগতৃষ্ণা।
কেমন আছো আফরোজ?
কেমন আছো আফরোজ? অফিসের তাড়ায়,
টাই বাঁধার বিপন্নতায় আজ কেমন আছো আফরোজ?
সময়ের ভ্রুকুটি না-মানা আফরোজ, মনোরঙ্গিণীর মন-মাতানো বিহ্বল বাতাসে আমার শেষ চুম্বন নিয়ে আজ কি ভালো আছো একটুও?
গল্পটা তো সরল ছিলো; তোমার অস্থিরতার জল-নিকোনো উঠোন-দেশ,
তোমার কাঁধের কোনে ছোট্ট একটা তিল,
শরীর জুড়ে আশাবরী স্বপ্ন,
আফরোজ তুমি তো জানতে চেয়েছিলে বন্দুকের ট্রিগার আর জটিলতার ম্যানিফেস্টো বাদ দিয়ে কিভাবে শরীরে নকশা খোঁজা যায়
কেমন আছো আজ? আফরোজ? শুনতে পাচ্ছো শব্দের শিথিলতা?
দেখতে পাও আজও এরোড্রোমের নিচে চাপা পড়া কালচে,
শুকনো রক্তের ফোঁটা?
তুমি কি সত্যিই ভালো আছো আফরোজ?
তোমার ক্যানভাসে আজও রয়ে গেছে আমার ছেড়ে আসা নীলঘূর্ণি আর বসন্তবৌরির ধুকপুকানি?
রডোডেন্ড্রনের পাপড়ি-মেলা স্নিগ্ধ বিস্ময়ে,
জাহাজের বন্দর ছাড়ার বুক-চাপা কান্নায়,
আমাদের সুহানা সফরের দিন-ক্ষণ-পুঁজি-পুঁথি-মুখশ্রীর শূন্য শস্যাগারে ঢেউ খেলে যায় অপাংক্তেয় বাক্য-বিনিময়
পথচলতি ট্রাম-রিক্সা-দুপুর-ফেরিওয়ালা আর ঘামে-ভেজা উষ্ণ প্রস্রবণ...
ভালো থেকো আফরোজ, যদি পারো,
ভালোবেসো।
কবিতা
অরুনাভ সর
যান্ত্রিক
শিক্ষার কোনো শেষ নেই, দুঃখের নাই রেশ
দুঃখ আজ কোনোভাবেই ভালো লাগছে না বেশ
পেশা চলে গেছে শুধু ঘরে শুই উঠি বার দশেক জেগে
ভাবা হয় না কিছুই,
আবার শুয়ে পড়ি রেগে
যন্ত্রের ভরসায় পড়ে আছে যারা ভাবনা নেই আর
কত কিছুই আছে চুপচাপ ঘরে বসে করার
ঘরে বসে লিখছি এটা ভাবতে পারো কি তা!!
যন্ত্রের মাঝে ঢুকে গেছে আজ তোমায় বলাই বৃথা
কবিতা
সাইদুর রহমান সাঈদ
ঈদ মোবারাক
উঠলো চাঁদ গগনমাঝে
ধরা সাজে নতুন সাজে,
পশ্চিমে দেখো ঢলল শশী
সবার মুখে রাঙল হাসি।
হাসছে আকাশ হাসছে বাতাস
হাসছে নিখিল দূর-মহাকাশ!
হাসল মরু হাসল তরু
আপনমনে চপল-চারু
দিচ্ছে দোল মায়ের কোলে
শোন খোশঢাক শোন বিহ্বলে!
আসল ঈদ-খোশ-সওগাত,
ধরাকোলে সুখ হল মাৎ!
তাকধিনাধিন ধিন তিকতাক
সবাইকে জানাই ঈদ মোবারাক!!
এই দুর্যোগে, মহামারিতে-
যত কবিতা লেখা হল
বোনা হল যত গল্প।
তত ত্রান পৌঁছল কি
ক্ষুধার্থ জঠরে?
দেওয়ালে দেওয়ালে -
রক্তাক্ত যত ক্ষত
বাতাসে দীর্ঘশ্বাস।
তত স্নেহার্দ্র হাত
ছুঁয়েছে কপালে?
রক্তবীজের মতো-
অনিঃশেষ সহমর্মিতা
আর শোক মিছিল।
পৌঁচ্ছে ছিল কি
দুঃখীর ঠিকানায়?
নাকি সবটুকু আয়োজন-
গল্প, কবিতারা
দুঃখ বিলাসীতা নিয়ে
নেমেছিল পথে
কপট লোকাচারে!
কবিতা
পার্থ সরকার
জিরো আওয়ারে, জিরো বাল্বে
ঝিমিয়ে আসে মশাল পালকের
জিরো আওয়ারে, জিরো বাল্বে
বিভ্রান্ত মাছ খালেবিলে পাদুকাবেলার শব্দে
ডেকেই চলে কাকে জনান্তিকে সঘন ভিক্ষুক
আছে পড়ে আটকে বেতালা গান
কান খাঁড়া করে শোনে সে কথা ময়ূর
অথচ কবেই গেছে মরে বর্ষামঙ্গল
কবেই সুরক্ষার নবোদিত দঙ্গল
পড়ে আছে বাতাস এক চিলতে
ঘরের ভিতর
এক চিলতে সোহাগ তাপের ভিতর
বাকি সব
যাওয়ার ভিতর যাওয়া
শূন্য মাঠে ভরা
ভরা শূন্য কায়া ।
কবিতা
দেবযানী পাল
করোনা
বিশ্ববিজয়ী করোনা
তোমার দ্রুত পদক্ষেপে
বসুন্ধরা আতঙ্কিত
স্বর্গ, মর্ত, পাতাল উত্কন্ঠিত
তোমার নেই কোনোও করুণা।
সারা বিশ্ব স্তম্ভিত শঙ্কিত
প্রিয়জন বন্ধুজনের বিদায়ে
সীমাহীন শোকে আপ্লুত
অভাবিত, অশান্ত ভাবনায় ভীত।
তোমার থেকে আকাঙ্ক্ষিত নিষ্কৃতি হল ব্যবধান
কি আশ্চর্য সে মানুষেরই অবদান
ধনী-দরিদ্র, দেশ-জাতি-প্রজাতির
চীর-ভেদাভেদ অনন্তকাল বিদ্যমান।
প্রার্থনা করি তোমার অন্তিম বিদায় গ্রহণ
বিশ্বজনের ভেদাভেদের শাশ্বত সমাপন
বৈচিত্র্যময়, ঐতিহ্যময় অখণ্ড মানবতার স্থিতি চিরন্তন।
কবিতা
দেবদাস ভট্টাচার্য্য
ডালাস, টেক্সাস
মা
দিন শুরু হয়নি তখনো,
পূব দিকে আধো অন্ধকারে -
একফালি আলোর আভাষ,
মশারির দড়ি খুলে
কে যেন নিঃশব্দে
পূবের জানালা দিল ঠেলে,
অমনি দামাল শিশুর মত
এক ঝলক পূবালী বাতাস
হুটোপুটি করে গেল রাতের ক্লান্তিতে
ভাঙ্গা ন্যাতানো শরীরে।
চোখের উপরে নেমে আসা চুলে
কারো হাত খেলে গেল,
সরে গেল আলতো আঙ্গুলে।
কপালের ঠিক মাঝখানে
কেউ যেন চুমু খেল,
চেনা গন্ধে ঘর ভরপুর –
ঊষার আলোয়, পূবালী বাতাসে
টের পাই তার উপস্থিতি –
ভারী মিষ্টি ভারী মায়াময়
ঠিক যেন ভৈরবীর সুর।
রোজ সকালে ঘুম ভাঙ্গে
দিনের রুটিন, কিছু পাখি চেঁচামেচি করে
ঘুম থেকে তোলে।
বাইরে আসি, বুক ভরে শ্বাস নিই,
গন্ধ পাই তার –
সেকি রয়েছে ওই বুনো জুঁই, বেদানার ফুলে?
স্বচ্ছ নীলাকাশ, ছেঁড়াখোঁড়া মেঘেদের সারি
ভেসে চলে মন্থর অলস,
ঠিক যেন আমার অতীত
চেয়ে দেখি প্রতিটি মেঘের বুকে ছোট্ট মুখ
চেয়ে আছে নির্নিমেষে
দিঘির জলের মত টলটলে
মাতৃস্নেহে ভরা যেন পূর্ণ কলস।
প্রশ্নেরা ভীড় করে –
জীবনের এই উত্তরণ
জানি না এ সফলতা কিনা,
কে দেবে উত্তর, শুধুই জিজ্ঞাসা চিহ্ন –
শুধু জানি এটাই বাস্তব,
ধ্রুব সত্য, নিষ্ঠুর নির্মম।
চোখ বুজে দেখি –
সেও দাঁড়িয়ে আছে
ঠিক আমারই মত
পূবের জানালা খুলে
শিক দুটি ধরা কোনমতে -
ভাঙ্গা গালে নবার্কের রক্তরাগ,
মন তার ধেয়ে আসে সাগর পর্বত মেরু ভেঙ্গে কে ঠেকাবে তাকে,
সে আসছে ছেলের কাছে অরুণের সপ্তাশ্ব রথে।
আমি ঠিক আছি, ঠিক থাকি,তবু কখনো কখনো অবুঝ শিশুর মত কেঁদে ওঠে, দেখি তাকে সে আসছে আলুথালু টলোমলো পায় -
ছোট্ট মেয়েটির মত, সে রয়েছে কাছে,
ধানের শিষের বুকে হেমন্তের শিশিরের মত,
সে আমার প্রতি রোমকূপে,
সে আমার রক্তকণিকায়।
গল্প
ইন্টারভিউ
অভিষেক চন্দ
ঠাকুরপুকুর, কলকাতা
সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা। রাসবিহারীর মোড়ে জ্যামে আটকাল ট্যাক্সিটা। হাল্কা হাল্কা বৃষ্টিতে রাস্তার ওপর স্ট্রিট লাইটের আলোয় লেখা ছোট গল্পরা শহরের ছায়াতেই লুকিয়ে পড়ে। ট্যাক্সির পেছনের সিটে বসে কাঁচটা তুলে দিল মহেন্দ্র। বয়স ষাটোর্ধ। রঙ ফর্সা। দোহারা চেহারায় মেদের স্থান কিঞ্চিৎ। সময় আর ত্রিশ বছর পশ্চিমে গেলে এখন হয়তো ট্যাক্সি থেকেই নেমে যেত ও। হাল্কা বৃষ্টিতে ভিজে যেত মাথার চুল। জামার বুকের দুটো বোতাম খুলে হেঁটে যেত পর্বতের চূড়া ছুঁয়ে থাকা মেঘলা মেঘেদের কবিতার শব্দের ছন্দে। হ্যাঁ, মহেন্দ্র কবি। ও কবিতা লিখতো। যথেষ্ট খ্যাতনামা। তবে এখন শুধু ওই নামটুকুই বাকি। শব্দরা বড় একটা তার কাছে ঘেঁষে না। সেও খুব একটা খোঁজেনা আর। বোধহয় বড্ড দেরী হয়ে গেছে।
আজকের দিনটা বড্ডই অদ্ভুত, ভীষণই প্রাসঙ্গিক মহেন্দ্রর কাছে। আজ থেকে ঠিক একবছর আগে, না! চারদিন কম একবছর আগে, দুপুর তিনটে কুড়িতে সমস্ত সমারোহের মাঝেই চিরবিদায় জানায় একজন। ফিরে গেছে তার সবটুকু, সবকিছুই ছেড়ে। হারিয়েছে সবার থেকেই। নাম অবিনাশ চক্রবর্তী। চিত্রকরদের জগৎ অবশ্য এই নাম জানেনা। চেনে এক অন্য নামে। অবিন। জন্মেছিল বিজয়ার দিন। আর চলে গেছে বোধনের দুপুরেই। মহালয়া আজ।
অবিনের মৃত্যুবার্ষিকীতে এক টিভি চ্যানেলের বিশেষ অনুষ্ঠানে একান্ত সাক্ষাৎকার দিয়ে বাড়ি ফিরছে মহেন্দ্র। যদিও আসল তারিখটা আজ নয়, তবে যেহেতু মহালয়া, তাই অনুষ্ঠানটা হয়েছে আজই। মেজাজটা বশে নেই। হঠাৎ একটা বিচ্ছিরি শব্দে ট্যাক্সিটা স্টার্ট নিলো। মহেন্দ্র ঘড়ি দেখল। প্রায় আটটা বাজতে চলেছে। জানলার কাঁচটা একবার হাতে করে মুছে দিল ও। ভেতরের বাষ্পে বাইরেটা ঝাপসা ছিল। মুছল খানিক। এরমাঝেই একটা কথা কানে এল ওর। বাইরে কে যেন ফোনে কাউকে বলল, “আমি তো আর রামকৃষ্ণ নই যে… ”। বেশ একটা ব্যঙ্গার্থক সুরেই কথাটা বলা। হঠাৎ মহেন্দ্রর মনে হল, হয়তো অবিন থাকলে বলত, “কেন?”। ভেবে একটু নিজের মনেই বলল, “না রে, তোর না থাকাটাই ভাল হয়েছে! কেউ বুঝতো না তোকে। আমিও তো ভুলই বুঝলাম রে! শুধুই ভুল বুঝলাম!” বড্ড অস্থির লাগছে মহেন্দ্রর। জানলাটা একটু নামাল।
“দাদা, সিটটা পুরো ভিজে যাবে যে! খুব বৃষ্টি তো!” ড্রাইভার একটু পেছন ফিরে বলল মহেন্দ্রকে।
“আরে আর কিছুটা তো রাস্তা, কিচ্ছু হবেনা। বেশি খুলিনি।” জানলাটার দিকে ইশারা করে বলল মহেন্দ্র।
সেই কথা শুনে আর কথা বাড়াল না ড্রাইভার। আসলে পাড়ারই লোক। তাই চুপ করে গেল। বাইরের দিকে চেয়ে রইল মহেন্দ্র। অনিমিখে।
গতকাল বিকেলেই ফোনটা আসে মহেন্দ্রর কাছে এই ইন্টারভিউটার ব্যাপারে। সবে মাত্র ও তখন নিজেরই পুরনো একটা কবিতার বই খুলে পড়তে বসেছিল। লেখারা আর আসেনা। তাই ধরে রাখার চেষ্টা। আর মাঝে মাঝে সেগুলো দেখেই নিজেকে আবার করে খোঁজা।
“হ্যালো”
“আমি কি মিস্টার মহেন্দ্র বসুর সাথে একটু কথা বলতে পারি?” এক পুরুষ কণ্ঠ। শুনে মনে হল মাঝবয়সী। বছর চল্লিশেক হবে।
“তার সাথেই কথা বলছেন আপনি। কি ব্যাপার সেটা বলুন।” একটু মজার স্বরেই কথাটা বলেছিল ও।
“নমস্কার স্যার, আমি সৌরভ দত্ত, ‘সুর ও ছন্দ’ চ্যানেল থেকে কথা বলছি।”
“হ্যাঁ বলুন কি করতে পারি?” এরকম ফোন খুব চেনা মহেন্দ্রর কাছে। অনেক সময় এখনও নানান ইন্টারভিউ এর জন্য ওর কাছে সময় চায় অনেক টিভি চ্যানেল। ও সাধারণত এখন ‘না’ করেই থাকে এগুলি। তবে এবারের ব্যাপারটা পারেনি এড়িয়ে যেতে।
“স্যার, কালকে আমাদের একটা বিশেষ অনুষ্ঠান হতে চলেছে। আর আমরা আপনাকে আমাদের গেস্ট হিসেবে কালকে পেলে খুব খুশি হবো!”
“সে তো বুঝলাম, কিন্তু আমি তো আর কোন চ্যানেলে এখন মুখ দেখাতে যাইনা! আমায় মাফ করুন।” বলেই ফোনটা রেখে দিতে যাচ্ছিল মহেন্দ্র।
“স্যার, প্লিজ ফোনটা রাখবেন না, একটু শুনুন!” ছেলেটার গলাটা একটু ভীত শোনাল।
“বলুন।”
“স্যার, কালকের প্রোগ্রামটা অবিনবাবুকে নিয়ে, মহালয়া কাল।...”
এটুকু শুনেই একটা ধাক্কা খেয়েছিল মহেন্দ্র। একটা আলপিন যেন বুকটা মুহূর্তে ফুটো করে দিল। ছেলেটা বলতে থাকলো,
“আমরা সবাই জানি যে উনি আপনার স্নেহধন্য ছিলেন। আপনি যদি আসেন আমাদের অনুষ্ঠানে, তাহলে আমাদের কালকের অনুষ্ঠান বলতে গেলে সত্যিকারের পূর্ণতা পাবে। একটা ইন্টারভিউ স্যার, প্লিজ!”
একমুহূর্ত থমকেছিল ও। তারপর সামলে নিয়ে বলল,
“ঠিক আছে, যাব।” খুব আস্তে বলেছিলো কথাটা।
“ধন্যবাদ স্যার, অজস্র ধন্যবাদ! আমি আপনার মেলে বাকি ডিটেলস পাঠিয়ে দিচ্ছি এক্ষুনি। ধন্যবাদ স্যার আপনার সময় দেওয়ার জন্য।” বলে ফোনটা রেখেছিল ছেলেটা। মহেন্দ্রও ফোন রেখে নিজের চেয়ারে বসে ব্যাল্কনি থেকে তাকিয়ে ছিল।
“কি হল? কে ফোন করেছিল?” বিছানায় শুয়েই প্রশ্ন করেছিল মিতালি। মিতালি বসু। মহেন্দ্রর স্ত্রী। আগে ছিল মজুমদার। একসুতোয় বাঁধা হয়ে যাওয়ার পর সেটা বিসর্জিত। মানুষটাও বোধহয়। এক কলেজে পড়াশোনা, সেই সূত্রেই আলাপ। মহেন্দ্রর কবিতায় প্রেম, তারপর বিয়ে। তারপর সেই একজন স্ত্রী, একজন মা, একজন পিসি, মাসি, আরও কত কি! আগে ছবি আঁকতো, সেটাও এখন বন্ধ!
“ঐ একটা টিভি চ্যানেল থেকে, একটা ইন্টারভিউ এর জন্য। কালকে।”
“ও!, যাবে?” ‘না’ উত্তরটা পাবেই ধরে নিয়েছিল মিতালি। ওকে চমকে দিয়ে মহেন্দ্র বলেছিল,
“হ্যাঁ, যাব। কালকের অনুষ্ঠানটায় যাব।” অন্য দিকে চেয়ে উত্তরটা দিয়েছিল মহেন্দ্র।
মিতালি অবাক হয়েছিল যথেষ্ট!
“তুমি যাবে? বাবাহ! কি এমন ব্যাপার গো যে তুমি রাজি হয়ে গেলে যেতে?”
“কাল দেখো টিভিতে, তাহলেই বুঝতে পারবে।” ছোট্ট করে প্রশ্নটা এড়িয়েছিল ও। মিতালিও আর কিছু জিজ্ঞেস করেনি।
সন্ধ্যের দিকে ছাদে চলে গেছিল মহেন্দ্র। অবিন। অবিনাশ। যার বিনাশ নেই। যে শেষ হয়না। কথাগুলো মাথাটাকে পুরো ঘেঁটে দিচ্ছিল ওর। ছেলেটার সাথে ওর প্রথম দেখা বেশ অনেক বছর আগে। বইমেলায়। মহেন্দ্র তখন যথেষ্ট নামি কবি। ওর একটা নতুন বইয়ের উদ্বোধন ছিল সেইদিন। সমস্ত কাজ মিটিয়ে যখন একটু ফাঁকা সময় পেয়েছিল ও, তখন প্রায় মেলার শেষ লগ্ন উপস্থিত ছিল। একটু চারপাশটা ঘুরে দেখতে দেখতে প্রথম চোখে পড়ে একটা কমবয়সী চিত্রকরকে, পোর্ট্রেট আঁকছিল মানুষের। একের পর এক ছবি এঁকেই চলেছিল। একটু খেয়াল করে বুঝেছিল মহেন্দ্র, যে ওর আঁকার স্টাইলটা একটু আলাদা। ছবি তো অনেকেই আঁকে, পোর্ট্রেট আর্টিস্ট অনেক দেখেছে ও। ওরা সবাই ভীষণ পারফেক্ট। তবে এই ছেলেটা পারফেকশনের ধার ধারে না। স্মুথ এবং এফর্টলেস পেনসিল স্ট্রোক। মানুষগুলোর মুখের শুধু আদলটা ও স্কেচ করছিল। বাকিটা ছিল ওর ব্রেন-চাইল্ড। ব্যাকগ্রাউন্ড কালার করছিল এক একজনের এক এক রকম! কারুরটা নীল, তো কারুরটা উজ্জ্বল কালোর ওপর অফ হোয়াইট এর স্প্রে পেইন্ট। মহেন্দ্র পেরিয়ে গেছিল ছেলেটাকে আরও অনেকের আঁকা দেখেছিল সেদিন। তবে ওরা ভীষণ পারফেক্ট!
চোখ-নাক-মুখ সব অসাধারণ, নিখুঁত। তবে কিছু যেন মিসিং ছিল। হয়তো একটু ইম্পারফেকশন, হয়তো শিল্পীর কল্পনার ব্যাপ্তি। ও আবার ফিরে গেছিল সেই ছেলেটার কাছেই। তখনও ছেলেটা আঁকছিল।
“আমার একটা পোর্ট্রেট এঁকে দেবে?” মহেন্দ্র প্রশ্ন করেছিল। জবাবে মাথা নেড়ে ছেলেটা বলেছিল,
“দেব স্যার, এইটা শেষ করেই দিচ্ছি।” বলেই আবার আঁকতে লেগেছিল ছেলেটা। শেষ হতেই ও বলেছিল,
“এবার আপনার পালা!” মহেন্দ্র সবে ছেলেটার সামনে গিয়ে বসবে, ঠিক এই সময়েই ছেলেটা বলেছিল, “ আসতে হবেনা আমার সামনে, ঐখানেই বসুন।” মহেন্দ্র বসেছিল ছেলেটার ডান পাশে, একটু কোন করে। ওর কথা শুনে একটু অবাকই হয়েছিল মহেন্দ্র। তবে কথাটা শুনেছিল।
ছেলেটা এঁকেছিল। পেস্তা রঙের ব্যাকগ্রাউন্ডে একটা স্প্রে পোর্ট্রেট। ঐ একটু মুখের পাশটাই। মহেন্দ্র ছবিটা দেখে খুশি যতটা হয়েছিলো, অবাক হয়েছিল আরও অনেক বেশি।
“তোমার নাম কি?” টাকা দিতে গিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল মহেন্দ্র।
“আমার নাম অবিন। অবিনাশ চক্রবর্তী। কেন স্যার?” ছেলেটার চোখে মুখে এক অদ্ভুত সারল্য লক্ষ্য করেছিল মহেন্দ্র।
“না, কিছুনা। কি করা হয়? শুধুই ছবি আঁকা হয়, নাকি অন্য কিছুও কর?”
“আর কিছু করিনা স্যার, কেন?”
“চাকরি করবে? ভাল জায়গায়। করবে?” প্রশ্নটা ইচ্ছে করেই করেছিল ও।
“না স্যার। করব না। আটকে যাব।” উত্তরটা শুনে আরও খুশি হয়েছিল মহেন্দ্র। সেই থেকেই অবিনের সাথে আলাপ। ছেলেটার বাবা-মা দুজনেই চাকুরীজীবী। ভাল পরিবার। ওরা ছিল দু’ভাই। ও ছোট। ওর দাদা তখন পি.এইচ.ডি. করছিল দিল্লী ইউনিভার্সিটি থেকে। আর ও ছিল বাড়ির যাকে বলে ব্ল্যাক শিপ! পড়াশোনায় মন বসেনি। কোন রকমে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে শুধুই নিয়ম ভাঙার খেলাতে মশগুল থাকতো ও। ছবি আঁকা ছিল ওর কাছে একটা গবেষণার মত। এক্সপেরিমেন্টের মত। কোন নির্দিষ্ট পথে ও যেত না। কনট্রাস্ট জানত, বুঝত। তবে খুব একটা মানত না। পারফেকশন থেকে ছিল অনেক দূরে। ওকে যিনি শেখাতেন, তিনি নাকি ওকে সবসময় বলতেন,
“‘টাচ অফ্ ইমোশন অ্যান্ড ইম্যাজিনেশন’ ছাড়া ছবি শুধুই একটা পিস অফ্ পেপার ফিল্ড উইথ্ লাইনস্ অ্যান্ড কালার্স।” তিনি গত হয়েছেন, তবে অবিনকে দিয়ে গেছিলেন তাঁর স্বপ্ন দেখার চোখ।
মহেন্দ্রর পরিচয় জানার পর অবিন একদিন বলেছিল,
“তার মানে আপনি আর আমি এক কাজই করি! ”
“কিভাবে? ” মহেন্দ্র উত্তরটা আঁচ করেই প্রশ্নটা করেছিল।
“স্যার, দুজনেই স্বপ্ন দেখাই, আমি রং দিয়ে, আর আপনি শব্দ দিয়ে! এটুকুই পার্থক্য শুধু।” বলে চোখে হেসেছিল অবিন। অবিন স্বপ্ন দেখত, দেখতে জানত। হয়তো বিশ্বাস করত যে সেটাও হতে পারে সত্যি! এটাই ছিল ওর সাথে বাকিদের তফাৎ! ওর ছবি কথা বলতো। ও শুধু পেইন্টার ছিল না, হি ওয়াজ্ এন আর্টিস্ট!
পরে একদিন সকালে মহেন্দ্রের ফোনে অবিনের ঘুম ভাঙে,
“হ্যালো স্যার, বলুন কি হয়েছে?”
“প্রথমে এই স্যার বলাটা থামাতো! হাজার বার বলেছি, আমায় কাকু বলবি, নাহলে দাদাই বলবি, তবে স্যার না!” একটু রেগেই বলেছিল কথাটা। তবে আদর মেশানো ছিল।
“হা হা হা হা!! ঠিক আছে, আর ভুল হবেনা। এবার বলুন কি হয়েছে?”
“বলছি, আমি তোর ছবির একটা এক্সিবিশন করতে চাই। তুই কি রাজি? মানে তোর যত ভাল ভাল ছবি আছে, আমি চাই সেগুলো সবার সামনে আসুক!”
“অ্যাঁ! আপনি সত্যি বলছেন? আমার ছবির এক্সিবিশন?” গলাটা হঠাৎ যেন একটু ভারী শুনিয়েছিল অবিনের।
“হ্যাঁ রে বাবা! তুই যদি রাজি থাকিস, তাহলেই।”
“রাজি দাদা! টাকাপয়সা...”
“ওসব কথা থাক, বাকি ব্যাপারগুলো আমি সামলে নিচ্ছি। শোন অবিন, তোকে ভাল আঁকতেই হবে, তোর বহু কিছু দেওয়ার আছে। এটুকু মনে রাখিস্। রাখছি রে।”
“দাদা,” বলে থেমেছিল ও।
“বল, কিছু বলবি?”
“আপনি আমাকে এতো বড় সুযোগ দিচ্ছেন, তার মর্যাদা রাখতে পারব তো?”
“পারবি। আমি আছি তো! ঘাবড়াস না।” বলে ফোনটা রেখেছিল ওরা। অবিন পেরেছিল।
আরও অনেক কথাই উঁকি দিয়েছিল রাতে। যখন সবাই ঘুমায়, তখন। রাতটা কেটেছিল গোপনে, স্মৃতিতে যেন জোনাকির দল ফসফরাসের আলো লাগিয়ে গেছিল। যত অন্ধকার, ততই প্রকট। সকাল হতেই মিতালি জিজ্ঞেস করেছিল,
“ কি গো, কখন তোমার ইন্টারভিউ?”
“ এই দুপুর নাগাদ বেরবো।“ বলে বাথরুমের দিকে এগিয়েছিল মহেন্দ্র।
“ওঃ, তার মানে খেয়েই যাবে। ঠিক আছে।” বলে মিতালিও চলে গেছিল রান্নাঘরের দিকে।
দুপুরে ভাত খেয়েই একটা নাগাদ বেরিয়ে গেছিল মহেন্দ্র। মিতালি জিজ্ঞেস করেছিল,
“কোন চ্যানেলে এটা দেখাবে?”
“‘সুর ও ছন্দ’ না কি একটা চ্যানেল আছে, তাতে। বিকেল পাঁচটা থেকে। পারলে দেখো।”
এই বলে একটা ট্যাক্সি ধরে সোজা রওনা হয়েছিল টিভি চ্যানেলের ইন্টারভিউয়ের জন্য। সকাল থেকেই আকাশের মুখটা ভার। একদল কালো কালো মেঘেরা যেন তাদের দু’হাত দিয়ে গোটা আকাশটাকে মুড়ে দিয়েছিল। হাল্কা হাল্কা বৃষ্টিও শুরু হয়েছিল। রাস্তার দূরত্ব বেশি নয়, তবে পুজোর সময় প্রতি পদক্ষেপেই জ্যাম, তাই পৌঁছাতে বেজেছিল প্রায় তিনটে। মহেন্দ্রকে দেখেই একটা মাঝবয়সী ছেলে হাত জোড়া করে এগিয়ে এসেছিল। বলল,
“আসুন স্যার, আমি সৌরভ। আমিই আপনাকে কাল ফোন করেছিলাম।”
মহেন্দ্র বুঝেছিল তার অনুমান নিতান্তই সঠিক, চল্লিশের ধারে কাছেই হবে ওর বয়স। সে নিজেও হাত জোড়া করে নমস্কার জানিয়ে বলেছিল,
“দেরী করে ফেললাম না তো?”
“না না স্যার, এখন সবে তো তিনটে বাজে, আমাদের স্যুট পাঁচটা থেকে। আপনি লাউঞ্জে বসুন স্যার। আমরা চা আর স্ন্যাক্স পাঠাচ্ছি।” মহেন্দ্র লাউঞ্জে বসেছিল। জায়গাটা খুব সুন্দর। পুরো জানলাটাই কাঁচের, এবং কোন পার্টিশন নেই। অর্থাৎ পুরো প্যানারমিক ভিউ! ও গিয়ে বসেছিল একদম জানলার ধারের সোফাটায়। আটতলার ওপরে অফিস, তাই বৃষ্টিতে ভেজা গোটা শহরটাই ছিল ওর সামনে হাজির। বড্ড ক্লান্তি লাগছিল ওর। এদিক ওদিক দেখতে দেখতে যে কখন চোখ লেগে এসেছিল, মনেই নেই মহেন্দ্রর। চোখ খুলেছিল সেই সৌরভের ডাকে।
“স্যার, শুটিং-এর সময় হয়ে গেছে। আসুন স্যার, আর আপনার ঘুম ভাঙিয়ে দিলাম, তার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী।” হেসে বলেছিল ছেলেটা। মহেন্দ্র নিজের ঘড়িটা দেখেছিল। পৌনে পাঁচটা। মানে প্রায় দু’ঘণ্টা ও দিবা নিদ্রা দিয়েছিল। উঠে একবার ওয়াশরুমে গিয়ে সোজা পৌঁছল ইন্টারভিউ রুমে। সেট প্রস্তুত। দুটো চেয়ার, মোটা গদি দেওয়া। দুদিকে দুটো ফুলের ভাস্, নানা রকম ফুল
দিয়ে সাজানো। সুন্দর লাগছে। আর সেটটার ঠিক ফোকাস পয়েন্টে একটা পুরনো ছবি, ল্যামিনেট করা। অবিনের। হাসি মুখটা। ছবিটাতে মালা দেয়া হচ্ছে তখন। মহেন্দ্রকে দেখে সৌরভ বলেছিল,
“স্যার, আপনি ঐ ডানদিকের চেয়ারটায় গিয়ে বসে পড়ুন। ”
“আচ্ছা। আর শুনুন, এই ইন্টারভিউটা কতক্ষণের বলতে পারেন?” মহেন্দ্র জিজ্ঞেস করেছিল।
“এই মোটামুটি আধঘণ্টা মতন। স্যার, আপনার ইন্টারভিউ নেবেন অমিত স্যার, আপনি বসুন, উনি আসছেন।” এই বলে চলে গেছিল সৌরভ। মহেন্দ্র গিয়ে বসেছিল চেয়ারে। ছবিটা ততক্ষণে মালায় জড়ানো। মহেন্দ্র একবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। অপরাধবোধ বোধহয়। ঠিক পাঁচটাতেই শুরু হয়েছিল ইন্টারভিউ। অমিত এসে নমস্কার জানিয়ে নিজের চেয়ারে বসে প্রশ্নের তালিকাটা মিলিয়ে নিচ্ছিল। একটু চাপা গায়ের রং, তবে সুন্দর ব্যক্তিত্ব ছেলেটার। কিউ দেওয়া শুরু হল। দশ থেকে একে এলে শুরু হল শুটিং।
“নমস্কার। সুর ও ছন্দ চ্যানেলের পক্ষ থেকে সবাইকে জানাই মহালয়ার একরাশ ভালবাসা এবং শুভেচ্ছা।...” অনুষ্ঠান শুরু।
“আজকের আমাদের অনুষ্ঠানটা অবশ্য একটু অন্যরকম, হয়তো ভিন্ন স্বাদের বলতে পারেন। কারণ, আজ মহালয়া। আর যারা ছবি আঁকা পছন্দ করেন বা আঁকেন তাদেরকে বোধহয় নতুন করে মনে করিয়ে দিতে হবেনা আজকের দিনটা। গতবছর ঠিক মহালয়ার দিনে আমাদের মাঝখান থেকে বিদায় নেন একজন তরুণ নক্ষত্র। আমাদের প্রত্যেকের চোখে দিয়ে কান্না, তিনি ফিরে গেছিলেন। অবিন। ভাল নাম অবিনাশ চক্রবর্তী।“ বড্ড সুন্দর করে কথাগুলো বলছিল অমিত।
“আমাদের আলোচনা আজ তাঁকে ঘিরেই। আমাদের সঙ্গে আজ উপস্থিত আছেন প্রখ্যাত কবি মহেন্দ্র বসু।” মহেন্দ্র হেসে নমস্কার জানালে অম