জুন ২০২০
কবিতা
কবিতা
গল্প
স্বাধীনতার
সুখ
সব্যসাচী বসু
বর্ধমান, পঃ বাংলা
কটা প্রকাণ্ড ছাতা। লাল-নীল-সবুজ। যেন মেলা বসেছে রঙের। পেছনে হেলানো। সামনে স্থির ফতনাটার দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে বসে আছে অন্তুজেঠু। কখন একটুখানি নড়েচড়ে উঠবে তারই প্রতীক্ষায়। যেন রঙচঙে মাছরাঙা পুঁটিমাছের ভেসে ওঠার অপেক্ষায়। জামপুকুরের শান্ত জলে ভেসে রয়েছে সাদা ফতনাটা। স্বচ্ছ-শীতল জলের নীচে বহু গভীরে কোথায় লুকিয়ে আছে মাছটা! যার জন্যে অধীর আগ্রহে বসে আছে অন্তুজেঠু।
পুকুরে তো মাছ কত থাকে। তাহলে জেঠু কেন বলে, “আজ বড় কাতলাটা ধরবো যার লেজটা ভেঙে দিয়েছিলাম আগের বছর!” ঐ মাছটাই যে ধরা পড়বে ছিপে তার কি কোনো মানে আছে! অন্তুজেঠুকে প্রশ্ন করলে জেঠু বলে, “এ যে ভক্তের সাথে ভগবানের সম্পর্ক রে। কান টানলে যেমন মাথা আসে তেমনি আমি ডাকলে ও ও আসবে; দেখিস। তবে ডাকাটা আন্তরিক হওয়া চাই।”
এসব কথা ওর মাথায় ঢোকে না। ও কেবল চেয়ে থাকে ফতনাটার দিকে। তবে বেশিক্ষণ চুপ করে থাকা ওর স্বভাব বিরুদ্ধ। একটা প্রশ্ন ওর মনে বারবার উঁকি দেয়। সেটাই করে ফেলে।
“প্রতিবছর এই দিনেই তুমি আসো কেন,জেঠু?” শীতের সাতসকালের আলগা রোদ্দুরের মতো এক মিষ্টি হাসি খেলে যায় অন্তুজেঠুর নিখুঁত গালে।
“ছুটি থাকে বলে? বছরে তো আরো ছুটি থাকে। না কি এই সময় মাছেরা তোমার কথা শোনে?” উত্তরে সেই নীরব হাসি।
সত্যিই ভেবে পায় না ও। দুর্গাপুজোর ছুটিটা না হয় বাদই গেল। শহরের পুজোর জাঁকজমকই আলাদা। কালীপুজোতেও হবে না। নৈহাটির কালী বিখ্যাত। বড়দিনে নয় কেন! শীতের আমেজে রোদে হেলান দিয়ে তো জমিয়ে মাছ ধরা যাবে। সকালের উষ্ণ রোদ্দুর গায়ে মাখতে মাছটা ভুস্ করে ভেসে উঠবে। মুখের সামনে কেঁচো দেখে হাঁ করে খেতে আসবে। সারারাত ঘুমের পর জেগে উঠেই চাঁচাঁ খিদে। আর তখনই ঘনিয়ে আসবে মরণঘুম।
তা না করে এই ঘোর বর্ষায় এক হাঁটু কাদা ভেঙে সেই তিন কিলোমিটার দূরের বাসস্টান্ড থেকে কেনই বা হেঁটে আসে অন্তুজেঠু! সারাদিন থাকতে রাতের অন্ধকারে কেন আসতে পছন্দ করে তাও বোঝে না ও। আবার প্রশ্ন করলে উত্তরের বদলে ঐ নীরব হাসি। তাই ও উঠে পরে।
পায়ে পায়ে এগিয়ে আসে জলের ধারে। হাঁটুজলে খেলা করছে বেশ ক’টা তেচোখা মাছ। কে যেন বলেছিল নামটা। ওদের কি তিনটে চোখ! ওরা কি দেবী দুর্গার সন্তান! তাই দেবীর ত্রিনয়ন ওদের মাথায় বসেছে!
না, ওকে আজ ছেলেমানুষীতে পেয়েছে। অবশ্য ওতো ছেলেমানুষই। কতই বা বয়স ওর! মনের বয়স তার চেয়েও কম।
বেশ লাগে এই মাছেদের খেলা। আসলে খেলা নয়-ওরা খাবারের খোঁজে হয়রান। খুব ছোট ছোট পোকা খায় ওরা। তাতো খাবেই। ওরাই বা কতটুকু! ওর কড়ে আঙুলটার মতো হবে বড়জোর।
একটু দূরে বাঁদিকে শালুক ফুটেছে কত! সাদা আর গোলাপি-দুরকমের। অন্যসময় দেখেছে সাঁওতাল পাড়ার ছেলেদের ফুল তুলতে। কি করে ওরা এতো ফুল নিয়ে!
ডানদিকে অশথ গাছটার তলায় রাখালেরা বসে আছে। অবাক হয়ে দেখছে রঙবেরঙের ছাতা আর তর নীচে বসে থাকা রঙিন মানুষটাকে।
রঙিনই বটে! সিন্থেটিক রঙিন চকমকে লুঙ্গি। অথচ খালি গা! ফরসা টকটকে রঙ। বাবুটিকে বেশ লাগে ওদের। বছরের এই সময়ই তো দেখা হয়। ওরা কখন জানি পায়ে পায়ে এগিয়ে এসেছে।
“কিরে ভানু, গোপলা, আসরফ, হারু-ভালো আছিস তোরা? সকলে হাসে। মাথা নেড়ে জানায় তারা ভাল আছে।
“আপনি ভালো আছেন জেঠু? হিন্দোলের জেঠু মানে তো তাদেরও জেঠু। তারা মানে ভানু পাল,গোপাল সোরেন, আসরফ আলি আর হারু দফাদার।
“আজ আর মাছ পড়বে নেগো জেঠু-উঠে পড়েন।”
“ও সব অলুক্ষুনে কথা বলিস না তো গোপলা”, আসরফ বাধা দেয়।
“জেঠুকে দেখেছিস কোনোদিন খালি হাতে ফিরতে?”, ফুট্ কাটে হারু।
আর ঠিক তখনই ফতনাটা নড়ে ওঠে। আচমকা ডুবেও যায়।
“খেয়েছে-খেয়েছে”, একসাথে বলে ওঠে ওরা।
“পেছন থেকে সরে যা”, চাপাস্বরে নির্দেশ দেয় অন্তুজেুঠু। একটা হেঁচকা টান লাগায় মাছটা। সুতো ছাড়তে থাকে অন্তুজেঠু। ছাতা গড়াগড়ি দিচ্ছে পাড়ে। লুঙ্গিটার খুঁট একদিকের কোমরে গোঁজা। ও এগিয়ে যায়। ততক্ষণে মাছটা বহুদূরে চলে গেছে। সারা শক্তি দিয়ে লড়ছে। এ নিয়মটা এতবছরে জেনে গেছে ও। এটাও খেলা। আহত মাছটা ছুটিয়ে ক্লান্ত করে করে একসময়ে পড়ে তুলবে। তখন সুতো গুঁটোবে হুইলের। পোড়খাওয়া হাতে একটা টান। জলের মাছ ডাঙায় আছড়ে পড়বে। ছুট্টে যাবে ছেলেগুলো। জেঠু সাবধানে মাছের রক্তাক্ত ঠোঁট থেকে বঁড়শিটা খুলে নেবে। মাছটাকে ভরে ফেলবে ব্যাগে।
এমনই হয় ফি-বছর। আগস্টের চোদ্দই সন্ধ্যেয় সদর দরজাটা পার হয় সেই চেনা চেহারাটা-রঙিন পাঞ্জাবী, দূরের বাসস্ট্যাণ্ডেই পাল্টে নেওয়া প্যান্টের বদলে রঙচঙে লুঙ্গি; একহাঁটু
কাদা, কাঁধে ঢাউস সাইডব্যাগ। মুখে সেই চেনা মিষ্টি হাসিটা। পেছনে দুটো বড়ো চটের ব্যাগ হাতে বাবা। একটায় সবজী। আরেকটায় মুরগী। জ্যান্ত। পরের দিন - স্বাধীনতা দিবসে আত্মবলিদানের জন্যে।
“বৌমা—” সেই চেনা হাঁক। মাথায় আঁচল দিয়ে মায়ের প্রণাম।
“তোমাকে এতবার বলেছি ঘোমটা দিতে হবে না। তা ভালো আছো তো তোমরা?”
“জেঠু কই আমার?”
এই প্রশ্নটার জন্যেই অপেক্ষা করে থাকে ও। সারাবছর। এই দুদিন আর লেখাপড়া নয়। লেখাপড়া যে ভাল লাগে না তা নয়। আসলে অন্তুজেঠু মানেই দেশবিদেশের ভ্রমণকাহিনী আর ইংরেজি সিনেমার গল্প। ক্যামেরায় ছবি তোলা শেখা। খাওয়াদাওয়া। মজা। পরদিন স্বাধীনতা দিবসে সাতসকালে উঠোনে পতাকা তোলা। কবিতা বলা, টেপরেকর্ডারে গান বাজানো। আর মাছধরা। স্বাধীনতার অন্য একটা মানে ও খুঁজে পায় এই দিনক’টায়। এইরকমই হয়ে আসছে শৈশব থেকে কৈশোর। সন্ধ্যেয় টকমিষ্টি চানাচুর আর আমতেল মাখা ফোলা ফোলা মুড়ি খেতে খেতে জমিয়ে গল্প।
“সত্যি তোদের বর্ধমানের মুড়ি যেন অমৃত। এই মুড়ির জন্যেই যে এক’শ বছর বাঁচতে ইচ্ছে করে রে।”
“জেঠু সেই গল্পটা বলো না -রুদ্রপ্রয়াগের চিতাবাঘ। সেই জিম করবেট যেটাকে মেরেছিল। ”সময়টা পিছিয়ে যায় বিশ শতকের গোড়ায়। শিকারী জিম করবেট যখন ঘুরে বেড়ান একা রাইফেল হাতে এক দৈবিক ক্ষমতাওয়ালা চিতাবাঘের পেছনে। কখনও বাঘ জেতে। কখনও তিনি। অবশেষে সেই প্রতীক্ষিত দিন এলো। এলো মুহূর্ত। মাত্র একটা গুলি। সব আতঙ্কের অবসান। কোথায় যেন হারিয়ে গেলো ও।
“তুমি ঐ জায়গাটা দেখেছো?”
“হ্যাঁ রে। ওখানে একটা স্মৃতিস্তম্ভ করা আছে।”
ও অন্তুজেঠুর গা ঘেঁষে বসে। শীতল একটা স্পর্শ অনুভব করে ও। অন্তুজেঠু প্রচুর পান খায়। জর্দা দিয়ে। কেমন একটা মিষ্টি মিষ্টি গন্ধ বের হচ্ছে অন্তুজেঠুর গা থেকে। জেঠুর কাছেই শোনা কস্তুরীমৃগের নাভির সুবাসের মতো। বিরল।
“তোদের দেখা আন্দামান আর কি আছে রে”, বাবাকে আক্ষেপ করে অন্তুজেঠু,“ একবার জাহাজে আর একবার প্লেনে গেছি – তখন প্লেন ডাইরেক্ট যেতো না। রেঙ্গুন হয়ে যেতো। অমলিন সবুজ দ্বীপ আজ গাড়ির ধোঁয়ায় ঢেকে যাচ্ছে।”
ওর বাবার সহোদর দাদা নয়, কোন তুতো দাদাও নয়-এক তুতোদাদার তুতো ভাই এই অন্তুজেঠু। হি ন্দোলের সবচেয়ে কাছের মানুষ।
“এই দ্যাখ,সেই কাতলা মাছটাই উঠেছে”, বড়শি থেকে মাছটা ছাড়াতে ছাড়াতে বলে অন্তুজেঠু,“ ভালই হয়েছে। গরম গরম ভাজা খাওয়া হবে। কি বল্?”
ঘাড় নাড়ে ও। জীবনে বহু মাছের মৃত্যুর কারণ হয়েছি। না রে ছেড়েই দি- একজন অন্তত থাক, যে আমায় মনে রাখবে। ও আমার পোষ্য হয়ে গেছে। রামের পোষা মাছদুটোর মতো। ওদের নাম মনে আছে তোর?”
“কার্তিক-গণেশ”
“ঠিক বলেছিস”
পরম যত্নে মাছটাকে হাতে ধরে দেখে জেঠু। ও লক্ষ্য করে অন্তুজেঠুর চোখে জল। মাছটাকে জলের কাছে নিয়ে যায়- স্বচ্ছ জলে নামিয়ে দেয়। কুতকুতে চোখে বেশ অবাক হয়ে তাকায় কাতলাটা। অন্তুজেঠু ওর দিকে হাত নাড়ে। মাছটাও তার ভাঙা লেজ নাড়িয়ে যেন বিদায় জানায় তার মুক্তিদাতাকে। তারপর খলবলিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়। ওরা হাততালি দিয়ে ওঠে। ভানু, গোপলা, আসরফ আর হারু। ও..ও হাততালি দিতে গিয়ে থমকে দাঁড়ায়। জেঠুর দিকে নজর পড়ে। শেষ শ্রাবণের মধ্যাহ্নে অন্তুজেঠুর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। সারা গা পিচ্ছিল হয়ে উঠেছে। গামছাটা কোমর থেকে খুলে মোছে জেঠু।
“আজ আর মাছ ধরবো না, জানিস, শরীরটা ভাল লাগছে না। চারের ব্যাগটা নে।” ওরা উঠে পড়ে।
“জানিস জেঠু, কেন মাছ ধরি, কেন তোদের এখানে বছরে এসময় আসি!” মাথা নাড়ে ও।
“সারাবছর নানা কাজের চাপে ক্লান্ত হয়ে পড়ি। তাই এই বর্ষাকালে তোদের এখানে এসে ক্লান্তিটা কাটাই। আবার চাঙ্গা হয়ে নি বাকি বছরটার জন্যে। এটাই আমার স্বাধীনতার সুখ রে জেঠু, বুঝলি?”
সন্ধ্যেতেই ঘটনাটা ঘটল। হঠাৎই বুকে ব্যথা শুরু হয়। গ্রামের হাতুড়ে ডাক্তারের মতে হার্ট অ্যাটাক। বর্ধমানের এই প্রত্যন্ত গ্রামে অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া যায় না। একটা অ্যাম্বাসাডার ছুটে চলেছে রাতের নিকষকালো আঁধার ভেদ করে-দুর্গাপুর এক্সপ্রেস ওয়ে বেয়ে-ঝড়ের গতিতে। হু হু করে ছুট্টে পালাচ্ছে রাস্তার পাশের ধানক্ষেত, জলা আর তীব্র হাওয়া। অন্তুজেঠু শুয়ে আছে ওর কোলে মাথা রেখে। এখনও কানে বাজছে মাকে বলা জেঠুর শেষ কথা - “আর বোধহয় আসা হবে না…”
তখনও পতাকাটা নামানো হয়নি। এখনও উড়ে চলেছে সে, রাতের আঁধারে উঠোনের কোণে, অন্তুজেঠুর একমুঠো স্বাধীনতার সুখ হয়ে।
কবিতা
অভিষেক চন্দ
ঠাকুরপুকুর, কোলকাতা
মেঘ-বৃষ্টি
মেঘ নেমেছে যখন, বৃষ্টি তখনও
মাইল খানেক দূরে।
হাতের রেখায় অল্প অল্প করে,
তাকে এঁকেছি কলম বন্ধ রেখে
অনেক যত্ন করে।
মেঘলা বিকেল তখন,
ছিল বড্ড আনমনা।
আলোকে দিয়ে ফাঁকি, বোধহয়
হয় তোমারই আনাগোনা
নিঃশব্দে...
বৃষ্টি আসে তোমার পায়ের কাছে,
ক্রমাগত সে মুছতে থাকে আবছা ছায়াটাকে।
সে তো জানেনা
কেন বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যেবেলা আসে,
কেনই বা হাজার শব্দ মুখ ফিরিয়ে হাসে...
সে শুধু বোঝে
কালির কলম্ থামে, লেখা থমকে গেলে।
বাইরে বিকেল নিয়েছে ছুটি।
সন্ধ্যে এসেছে পা টিপে টিপে
বৃষ্টির হাত ধরে।।
কবিতা
শক্তিপ্রসাদ ঘোষ
নিউটাউন কোচবিহার
ফ্যাকাসে স্বপ্ন
নীল রাত্রি নিগরে দুঃখিততম কবিতা
পৃথিবী কাঁপে অতর্কিতে করাল আঘাতে
গর্জে উঠে আঘাত
জ্বলে উঠে উন্মত্ততা
ফ্যাকাসে অন্ধকারে
নেমে আসে শীতল মুহূর্তের নির্ঘণ্ট
প্রতিটি শরীর ভয়ার্ত মূর্তি
দূরত্ব বজায় রেখে গড়ে উঠে
নূতন সামাজিক নকশা
ঘণ্টার গলাভাঙা আওয়াজে
বেদনায় মুমূর্ষু, বীভৎস দাবানলে জ্বলছে চিতা
সবুজ মাঠে
মণি আভা ফ্যাকাসে স্বপ্ন গোনে।
কবিতা
বিধান জানা
শ্রীরামপুর, হুগলী
খাত
ফুল ফোটে গাছে গাছে আকাশেতে তারা
ঘরে ঘরে মেমসাব স্বপ্নের পাড়া
গাড়ি ছোটে সাঁই সাঁই ঢাকা কাঁচ কালো
ল্যাম্প পোস্ট জেগে আছে ঘুমিয়েছে আলো
হাত কাটা গেঞ্জিতে আধখোলা বুক
ঘুম নেই গাঢ় রাতে অলীক অসুখ
হাড় ভাঙা সারাদিন রাত ঘন কালো
ড্রেনে বয় কালো জল সময় ঘোরালো
কয়েকটা ভাই বোন টুকরো বিছানা
ট্রলিব্যাগ বড় লাগে ঘর একখানা
আকাশেতে চাঁদ জাগে জেগে থাকে চোখ
বাবা জাগে কেশে কেশে বুকে ক্ষয়রোগ
ওপারেতে দোতলায় পরী জেগে ওঠে
রাত পোশাকের নিচে জোড়া চাঁদ ফোটে
সারাদিন গেটে খাড়া কখনো বা টুল
বুকে শালা টাই ঝোলে এপ্রিলফুল
তলপেটে চিনচিন রক্তেতে ঝড়
ঝাঁপাবে বাঘের মত দেবেই কামড়
বাইরে ঠান্ডা হাওয়া ঝিমিয়েছে রাত
হাইড্রেন মাঝখানে মারিয়ানা খাত।
কবিতা
তন্বী চক্রবর্তী
জাহাজডুবির গল্প
শরীরে বল্কল ছিল, আভরণ-উদ্বেলিত ছন্দ,
চাঁদের স্তিমিত আলোয় ছুঁয়ে ছিলাম তোমার ক্র্যানবেরি-ভেজানো ঠোঁট,
নেশা-পথ প্রশস্ত, রাত-নিরালায় তখন চলছিলো পাপ-স্খলনের উন্মাদনা,
একাগ্রতা একেই বলে? বলো?
ভালোবাসায় ছুঁয়ে থাকা স্তব্ধ পায়রার তুলতুলে ঠোঁটে আলপনা এঁকে দিয়েছিলে তোমার বিমূর্ত প্রণয়াকাঙ্খার,
জলে ভরা নৌকো দাঁড় টেনে গিয়েছিলো ছলাৎ ছলাৎ,
আঁকড়ে ছিলাম শেষ পারানির কড়ি, আর পাটাতন-বালিয়াড়িতে হিসেব কষে আছড়ে পড়েছিলো পরিপ্লবের রংমিলান্তি,
থমকে ছিলো লুব্ধ-চাঁদের সময়, ধোঁয়া, চিকন-হদিশ নাগকেশরের ফুল
আর অবাঞ্ছিত ছাদনাতলায় হিন্দোলিত-বাদন,
বলো ভালোবাসাকে থামতে বলিনি আমি?
উপচে-পড়া দুধের সফেন,
সামুদ্রিক রিকিঝিকিমিকির প্রজাপতি-পাখায় তুমি আলতো করে স্পর্শ করেছিলে
তুষারাবৃত ফেনিল-শিখর আর চাঁদ মিশে গিয়েছিলো চাঁদের গভীর উত্তাপে
কোনো এক ফ্লেমিংগো-দেশের আনাচেকানাচে,
ঠোঁট দিয়ে তুলে আনছিলো অদৃশ্য রূপকথার রাজকুমারীর মৃগতৃষ্ণা।
কেমন আছো আফরোজ?
কেমন আছো আফরোজ? অফিসের তাড়ায়,
টাই বাঁধার বিপন্নতায় আজ কেমন আছো আফরোজ?
সময়ের ভ্রুকুটি না-মানা আফরোজ, মনোরঙ্গিণীর মন-মাতানো বিহ্বল বাতাসে আমার শেষ চুম্বন নিয়ে আজ কি ভালো আছো একটুও?
গল্পটা তো সরল ছিলো; তোমার অস্থিরতার জল-নিকোনো উঠোন-দেশ,
তোমার কাঁধের কোনে ছোট্ট একটা তিল,
শরীর জুড়ে আশাবরী স্বপ্ন,
আফরোজ তুমি তো জানতে চেয়েছিলে বন্দুকের ট্রিগার আর জটিলতার ম্যানিফেস্টো বাদ দিয়ে কিভাবে শরীরে নকশা খোঁজা যায়
কেমন আছো আজ? আফরোজ? শুনতে পাচ্ছো শব্দের শিথিলতা?
দেখতে পাও আজও এরোড্রোমের নিচে চাপা পড়া কালচে,
শুকনো রক্তের ফোঁটা?
তুমি কি সত্যিই ভালো আছো আফরোজ?
তোমার ক্যানভাসে আজও রয়ে গেছে আমার ছেড়ে আসা নীলঘূর্ণি আর বসন্তবৌরির ধুকপুকানি?
রডোডেন্ড্রনের পাপড়ি-মেলা স্নিগ্ধ বিস্ময়ে,
জাহাজের বন্দর ছাড়ার বুক-চাপা কান্নায়,
আমাদের সুহানা সফরের দিন-ক্ষণ-পুঁজি-পুঁথি-মুখশ্রীর শূন্য শস্যাগারে ঢেউ খেলে যায় অপাংক্তেয় বাক্য-বিনিময়
পথচলতি ট্রাম-রিক্সা-দুপুর-ফেরিওয়ালা আর ঘামে-ভেজা উষ্ণ প্রস্রবণ...
ভালো থেকো আফরোজ, যদি পারো,
ভালোবেসো।
কবিতা
অরুনাভ সর
যান্ত্রিক
শিক্ষার কোনো শেষ নেই, দুঃখের নাই রেশ
দুঃখ আজ কোনোভাবেই ভালো লাগছে না বেশ
পেশা চলে গেছে শুধু ঘরে শুই উঠি বার দশেক জেগে
ভাবা হয় না কিছুই,
আবার শুয়ে পড়ি রেগে
যন্ত্রের ভরসায় পড়ে আছে যারা ভাবনা নেই আর
কত কিছুই আছে চুপচাপ ঘরে বসে করার
ঘরে বসে লিখছি এটা ভাবতে পারো কি তা!!
যন্ত্রের মাঝে ঢুকে গেছে আজ তোমায় বলাই বৃথা
কবিতা
সাইদুর রহমান সাঈদ
ঈদ মোবারাক
উঠলো চাঁদ গগনমাঝে
ধরা সাজে নতুন সাজে,
পশ্চিমে দেখো ঢলল শশী
সবার মুখে রাঙল হাসি।
হাসছে আকাশ হাসছে বাতাস
হাসছে নিখিল দূর-মহাকাশ!
হাসল মরু হাসল তরু
আপনমনে চপল-চারু
দিচ্ছে দোল মায়ের কোলে
শোন খোশঢাক শোন বিহ্বলে!
আসল ঈদ-খোশ-সওগাত,
ধরাকোলে সুখ হল মাৎ!
তাকধিনাধিন ধিন তিকতাক
সবাইকে জানাই ঈদ মোবারাক!!
এই দুর্যোগে, মহামারিতে-
যত কবিতা লেখা হল
বোনা হল যত গল্প।
তত ত্রান পৌঁছল কি
ক্ষুধার্থ জঠরে?
দেওয়ালে দেওয়ালে -
রক্তাক্ত যত ক্ষত
বাতাসে দীর্ঘশ্বাস।
তত স্নেহার্দ্র হাত
ছুঁয়েছে কপালে?
রক্তবীজের মতো-
অনিঃশেষ সহমর্মিতা
আর শোক মিছিল।
পৌঁচ্ছে ছিল কি
দুঃখীর ঠিকানায়?
নাকি সবটুকু আয়োজন-
গল্প, কবিতারা
দুঃখ বিলাসীতা নিয়ে
নেমেছিল পথে
কপট লোকাচারে!
কবিতা
পার্থ সরকার
জিরো আওয়ারে, জিরো বাল্বে
ঝিমিয়ে আসে মশাল পালকের
জিরো আওয়ারে, জিরো বাল্বে
বিভ্রান্ত মাছ খালেবিলে পাদুকাবেলার শব্দে
ডেকেই চলে কাকে জনান্তিকে সঘন ভিক্ষুক
আছে পড়ে আটকে বেতালা গান
কান খাঁড়া করে শোনে সে কথা ময়ূর
অথচ কবেই গেছে মরে বর্ষামঙ্গল
কবেই সুরক্ষার নবোদিত দঙ্গল
পড়ে আছে বাতাস এক চিলতে
ঘরের ভিতর
এক চিলতে সোহাগ তাপের ভিতর
বাকি সব
যাওয়ার ভিতর যাওয়া
শূন্য মাঠে ভরা
ভরা শূন্য কায়া ।
কবিতা
দেবযানী পাল
করোনা
বিশ্ববিজয়ী করোনা
তোমার দ্রুত পদক্ষেপে
বসুন্ধরা আতঙ্কিত
স্বর্গ, মর্ত, পাতাল উত্কন্ঠিত
তোমার নেই কোনোও করুণা।
সারা বিশ্ব স্তম্ভিত শঙ্কিত
প্রিয়জন বন্ধুজনের বিদায়ে
সীমাহীন শোকে আপ্লুত
অভাবিত, অশান্ত ভাবনায় ভীত।
তোমার থেকে আকাঙ্ক্ষিত নিষ্কৃতি হল ব্যবধান
কি আশ্চর্য সে মানুষেরই অবদান
ধনী-দরিদ্র, দেশ-জাতি-প্রজাতির
চীর-ভেদাভেদ অনন্তকাল বিদ্যমান।
প্রার্থনা করি তোমার অন্তিম বিদায় গ্রহণ
বিশ্বজনের ভেদাভেদের শাশ্বত সমাপন
বৈচিত্র্যময়, ঐতিহ্যময় অখণ্ড মানবতার স্থিতি চিরন্তন।
কবিতা
দেবদাস ভট্টাচার্য্য
ডালাস, টেক্সাস
মা
দিন শুরু হয়নি তখনো,
পূব দিকে আধো অন্ধকারে -
একফালি আলোর আভাষ,
মশারির দড়ি খুলে
কে যেন নিঃশব্দে
পূবের জানালা দিল ঠেলে,
অমনি দামাল শিশুর মত
এক ঝলক পূবালী বাতাস
হুটোপুটি করে গেল রাতের ক্লান্তিতে
ভাঙ্গা ন্যাতানো শরীরে।
চোখের উপরে নেমে আসা চুলে
কারো হাত খেলে গেল,
সরে গেল আলতো আঙ্গুলে।
কপালের ঠিক মাঝখানে
কেউ যেন চুমু খেল,
চেনা গন্ধে ঘর ভরপুর –
ঊষার আলোয়, পূবালী বাতাসে
টের পাই তার উপস্থিতি –
ভারী মিষ্টি ভারী মায়াময়
ঠিক যেন ভৈরবীর সুর।
রোজ সকালে ঘুম ভাঙ্গে
দিনের রুটিন, কিছু পাখি চেঁচামেচি করে
ঘুম থেকে তোলে।
বাইরে আসি, বুক ভরে শ্বাস নিই,
গন্ধ পাই তার –
সেকি রয়েছে ওই বুনো জুঁই, বেদানার ফুলে?
স্বচ্ছ নীলাকাশ, ছেঁড়াখোঁড়া মেঘেদের সারি
ভেসে চলে মন্থর অলস,
ঠিক যেন আমার অতীত
চেয়ে দেখি প্রতিটি মেঘের বুকে ছোট্ট মুখ
চেয়ে আছে নির্নিমেষে
দিঘির জলের মত টলটলে
মাতৃস্নেহে ভরা যেন পূর্ণ কলস।
প্রশ্নেরা ভীড় করে –
জীবনের এই উত্তরণ
জানি না এ সফলতা কিনা,
কে দেবে উত্তর, শুধুই জিজ্ঞাসা চিহ্ন –
শুধু জানি এটাই বাস্তব,
ধ্রুব সত্য, নিষ্ঠুর নির্মম।
চোখ বুজে দেখি –
সেও দাঁড়িয়ে আছে
ঠিক আমারই মত
পূবের জানালা খুলে
শিক দুটি ধরা কোনমতে -
ভাঙ্গা গালে নবার্কের রক্তরাগ,
মন তার ধেয়ে আসে সাগর পর্বত মেরু ভেঙ্গে কে ঠেকাবে তাকে,
সে আসছে ছেলের কাছে অরুণের সপ্তাশ্ব রথে।
আমি ঠিক আছি, ঠিক থাকি,তবু কখনো কখনো অবুঝ শিশুর মত কেঁদে ওঠে, দেখি তাকে সে আসছে আলুথালু টলোমলো পায় -
ছোট্ট মেয়েটির মত, সে রয়েছে কাছে,
ধানের শিষের বুকে হেমন্তের শিশিরের মত,
সে আমার প্রতি রোমকূপে,
সে আমার রক্তকণিকায়।