top of page
srikrishna.jpg
জুন ২০২০
sea1.jpg
সূচীপত্র
স্বাধীনতার সুখ

জুন ২০২০ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

গল্প

স্বাধীনতার

সুখ

সব্যসাচী বসু

বর্ধমান, পঃ বাংলা

oldman2.jpg

টা প্রকাণ্ড ছাতা। লাল-নীল-সবুজ। যেন মেলা বসেছে রঙের। পেছনে হেলানো। সামনে ‍‍‍স্থির ফতনাটার দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে বসে আছে অন্তুজেঠু। কখন একটুখানি নড়েচড়ে উঠবে তারই প্রতীক্ষায়। যেন রঙচঙে মাছরাঙা পুঁটিমাছের ভেসে ওঠার অপেক্ষায়। জামপুকুরের শান্ত জলে ভেসে রয়েছে সাদা ফতনাটা। স্বচ্ছ-শীতল জলের নীচে বহু গভীরে কোথায় লুকিয়ে আছে মাছটা! যার জন্যে অধীর আগ্রহে বসে আছে অন্তুজেঠু।

পুকুরে তো মাছ কত থাকে। তাহলে জেঠু কেন বলে, “আজ বড় কাতলাটা ধরবো যার লেজটা ভেঙে দিয়েছিলাম আগের বছর!” ঐ মাছটাই যে ধরা পড়বে ছিপে তার কি কোনো মানে আছে! অন্তুজেঠুকে প্রশ্ন করলে জেঠু বলে, “এ যে ভক্তের সাথে ভগবানের সম্পর্ক রে। কান টানলে যেমন মাথা আসে তেমনি আমি ডাকলে ও ও আসবে; দেখিস। তবে ডাকাটা আন্তরিক হওয়া চাই।”

এসব কথা ওর মাথায় ঢোকে না। ও কেবল চেয়ে থাকে ফতনাটার দিকে। তবে বেশিক্ষণ চুপ করে থাকা ওর স্বভাব বিরুদ্ধ। একটা প্রশ্ন ওর মনে বারবার উঁকি দেয়। সেটাই করে ফেলে।

“প্রতিবছর এই দিনেই তুমি আসো কেন,জেঠু?” শীতের সাতসকালের আলগা রোদ্দুরের মতো এক মিষ্টি হাসি খেলে যায় অন্তুজেঠুর নিখুঁত গালে।

“ছুটি থাকে বলে? বছরে তো আরো ছুটি থাকে। না কি এই সময় মাছেরা তোমার কথা শোনে?” উত্তরে সেই নীরব হাসি।

সত্যিই ভেবে পায় না ও। দুর্গাপুজোর ছুটিটা না হয় বাদই গেল। শহরের পুজোর জাঁকজমকই আলাদা। কালীপুজোতেও হবে না। নৈহাটির কালী বিখ্যাত। বড়দিনে নয় কেন! শীতের আমেজে রোদে হেলান দিয়ে তো জমিয়ে মাছ ধরা যাবে। সকালের উষ্ণ রোদ্দুর গায়ে মাখতে মাছটা ভুস্‌ করে ভেসে উঠবে। মুখের সামনে কেঁচো দেখে হাঁ করে খেতে আসবে। সারারাত ঘুমের পর জেগে উঠেই চাঁচাঁ খিদে। আর তখনই ঘনিয়ে আসবে মরণঘুম।

তা না করে এই ঘোর বর্ষায় এক হাঁটু কাদা ভেঙে সেই তিন কিলোমিটার দূরের বাসস্টান্ড থেকে কেনই বা হেঁটে আসে অন্তুজেঠু! সারাদিন থাকতে রাতের অন্ধকারে কেন আসতে পছন্দ করে তাও বোঝে না ও। আবার প্রশ্ন করলে উত্তরের বদলে ঐ নীরব হাসি। তাই ও উঠে পরে।

পায়ে পায়ে এগিয়ে আসে জলের ধারে। হাঁটুজলে খেলা করছে বেশ ক’টা তেচোখা মাছ। কে যেন বলেছিল নামটা। ওদের কি তিনটে চোখ! ওরা কি দেবী দুর্গার সন্তান! তাই দেবীর ত্রিনয়ন ওদের মাথায় বসেছে!

না, ওকে আজ ছেলেমানুষীতে পেয়েছে। অবশ্য ওতো ছেলেমানুষই। কতই বা বয়স ওর! মনের বয়স তার চেয়েও কম।

বেশ লাগে এই মাছেদের খেলা। আসলে খেলা নয়-ওরা খাবারের খোঁজে হয়রান। খুব ছোট ছোট পোকা খায় ওরা। তাতো খাবেই। ওরাই বা কতটুকু! ওর কড়ে আঙুলটার মতো হবে বড়জোর।

একটু দূরে বাঁদিকে শালুক ফুটেছে কত! সাদা আর গোলাপি-দুরকমের। অন্যসময় দেখেছে সাঁওতাল পাড়ার ছেলেদের ফুল তুলতে। কি করে ওরা এতো ফুল নিয়ে!

ডানদিকে অশথ গাছটার তলায় রাখালেরা বসে আছে। অবাক হয়ে দেখছে রঙবেরঙের ছাতা আর তর নীচে বসে থাকা রঙিন মানুষটাকে।

রঙিনই বটে! সিন্থেটিক রঙিন চকমকে লুঙ্গি। অথচ খালি গা! ফরসা টকটকে রঙ। বাবুটিকে বেশ লাগে ওদের। বছরের এই সময়ই তো দেখা হয়। ওরা কখন জানি পায়ে পায়ে এগিয়ে এসেছে।

“কিরে ভানু, গোপলা, আসরফ, হারু-ভালো আছিস তোরা? সকলে হাসে। মাথা নেড়ে জানায় তারা ভাল আছে।

“আপনি ভালো আছেন জেঠু? হিন্দোলের জেঠু মানে তো তাদেরও জেঠু। তারা মানে ভানু পাল,গোপাল সোরেন, আসরফ আলি আর হারু দফাদার।

“আজ আর মাছ পড়বে নেগো জেঠু-উঠে পড়েন।”

“ও সব অলুক্ষুনে কথা বলিস না তো গোপলা”, আসরফ বাধা দেয়।

“জেঠুকে দেখেছিস কোনোদিন খালি হাতে ফিরতে?”, ফুট্‌ কাটে হারু।

আর ঠিক তখনই ফতনাটা নড়ে ওঠে। আচমকা ডুবেও যায়।

“খেয়েছে-খেয়েছে”, একসাথে বলে ওঠে ওরা।

“পেছন থেকে সরে যা”, চাপাস্বরে নির্দেশ দেয় অন্তুজেুঠু। একটা হেঁচকা টান লাগায় মাছটা। সুতো ছাড়তে থাকে অন্তুজেঠু। ছাতা গড়াগড়ি দিচ্ছে পাড়ে। লুঙ্গিটার খুঁট একদিকের কোমরে গোঁজা। ও এগিয়ে যায়। ততক্ষণে মাছটা বহুদূরে চলে গেছে। সারা শক্তি দিয়ে লড়ছে। এ নিয়মটা এতবছরে জেনে গেছে ও। এটাও খেলা। আহত মাছটা ছুটিয়ে ক্লান্ত করে করে একসময়ে পড়ে তুলবে। তখন সুতো গুঁটোবে হুইলের। পোড়খাওয়া হাতে একটা টান। জলের মাছ ডাঙায় আছড়ে পড়বে। ছুট্টে যাবে ছেলেগুলো। জেঠু সাবধানে মাছের রক্তাক্ত ঠোঁট থেকে বঁড়শিটা খুলে নেবে। মাছটাকে ভরে ফেলবে ব্যাগে।

এমনই হয় ফি-বছর। আগস্টের চোদ্দই সন্ধ্যেয় সদর দরজাটা পার হয় সেই চেনা চেহারাটা-রঙিন পাঞ্জাবী, দূরের বাসস্ট্যাণ্ডেই পাল্টে নেওয়া প্যান্টের বদলে রঙচঙে লুঙ্গি; একহাঁটু

কাদা, কাঁধে ঢাউস সাইডব্যাগ। মুখে সেই চেনা মিষ্টি হাসিটা। পেছনে দুটো বড়ো চটের ব্যাগ হাতে বাবা। একটায় সবজী। আরেকটায় মুরগী। জ্যান্ত। পরের দিন - স্বাধীনতা দিবসে আত্মবলিদানের জন্যে।

“বৌমা—” সেই চেনা হাঁক। মাথায় আঁচল দিয়ে মায়ের প্রণাম।

“তোমাকে এতবার বলেছি ঘোমটা দিতে হবে না। তা ভালো আছো তো তোমরা?”

“জেঠু কই আমার?”

এই প্রশ্নটার জন্যেই অপেক্ষা করে থাকে ও। সারাবছর। এই দুদিন আর লেখাপড়া নয়। লেখাপড়া যে ভাল লাগে না তা নয়। আসলে অন্তুজেঠু মানেই দেশবিদেশের ভ্রমণকাহিনী আর ইংরেজি সিনেমার গল্প। ক্যামেরায় ছবি তোলা শেখা। খাওয়াদাওয়া। মজা। পরদিন স্বাধীনতা দিবসে সাতসকালে উঠোনে পতাকা তোলা। কবিতা বলা, টেপরেকর্ডারে গান বাজানো। আর মাছধরা। স্বাধীনতার অন্য একটা মানে ও খুঁজে পায় এই দিনক’টায়। এইরকমই হয়ে আসছে শৈশব থেকে কৈশোর। সন্ধ্যেয় টকমিষ্টি চানাচুর আর আমতেল মাখা ফোলা ফোলা মুড়ি খেতে খেতে জমিয়ে গল্প।

“সত্যি তোদের বর্ধমানের মুড়ি যেন অমৃত। এই মুড়ির জন্যেই যে এক’শ বছর বাঁচতে ইচ্ছে করে রে।”

“জেঠু সেই গল্পটা বলো না -রুদ্রপ্রয়াগের চিতাবাঘ। সেই জিম করবেট যেটাকে মেরেছিল। ”সময়টা পিছিয়ে যায় বিশ শতকের গোড়ায়। শিকারী জিম করবেট যখন ঘুরে বেড়ান একা রাইফেল হাতে এক দৈবিক ক্ষমতাওয়ালা চিতাবাঘের পেছনে। কখনও বাঘ জেতে। কখনও তিনি। অবশেষে সেই প্রতীক্ষিত দিন এলো। এলো মুহূর্ত। মাত্র একটা গুলি। সব আতঙ্কের অবসান। কোথায় যেন হারিয়ে গেলো ও।

“তুমি ঐ জায়গাটা দেখেছো?”

“হ্যাঁ রে। ওখানে একটা স্মৃতিস্তম্ভ করা আছে।”

ও অন্তুজেঠুর গা ঘেঁষে বসে। শীতল একটা স্পর্শ অনুভব করে ও। অন্তুজেঠু প্রচুর পান খায়। জর্দা দিয়ে। কেমন একটা মিষ্টি মিষ্টি গন্ধ বের হচ্ছে অন্তুজেঠুর গা থেকে। জেঠুর কাছেই শোনা কস্তুরীমৃগের নাভির সুবাসের মতো। বিরল।

“তোদের দেখা আন্দামান আর কি আছে রে”, বাবাকে আক্ষেপ করে অন্তুজেঠু,“ একবার জাহাজে আর একবার প্লেনে গেছি – তখন প্লেন ডাইরেক্ট যেতো না। রেঙ্গুন হয়ে যেতো। অমলিন সবুজ দ্বীপ আজ গাড়ির ধোঁয়ায় ঢেকে যাচ্ছে।”

ওর বাবার সহোদর দাদা নয়, কোন তুতো দাদাও নয়-এক তুতোদাদার তুতো ভাই এই অন্তুজেঠু। হি ন্দোলের সবচেয়ে কাছের মানুষ।

“এই দ্যাখ,সেই কাতলা মাছটাই উঠেছে”, বড়শি থেকে মাছটা ছাড়াতে ছাড়াতে বলে অন্তুজেঠু,“ ভালই হয়েছে। গরম গরম ভাজা খাওয়া হবে। কি বল্?”

ঘাড় নাড়ে ও। জীবনে বহু মাছের মৃত্যুর কারণ হয়েছি। না রে ছেড়েই দি- একজন অন্তত থাক, যে আমায় মনে রাখবে। ও আমার পোষ্য হয়ে গেছে। রামের পোষা মাছদুটোর মতো। ওদের নাম মনে আছে তোর?”

“কার্তিক-গণেশ”

“ঠিক বলেছিস”

পরম যত্নে মাছটাকে হাতে ধরে দেখে জেঠু। ও লক্ষ্য করে অন্তুজেঠুর চোখে জল। মাছটাকে জলের কাছে নিয়ে যায়- স্বচ্ছ জলে নামিয়ে দেয়। কুতকুতে চোখে বেশ অবাক হয়ে তাকায় কাতলাটা। অন্তুজেঠু ওর দিকে হাত নাড়ে। মাছটাও তার ভাঙা লেজ নাড়িয়ে যেন বিদায় জানায় তার মুক্তিদাতাকে। তারপর খলবলিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়। ওরা হাততালি দিয়ে ওঠে। ভানু, গোপলা, আসরফ আর হারু। ও..ও হাততালি দিতে গিয়ে থমকে দাঁড়ায়। জেঠুর দিকে নজর পড়ে। শেষ শ্রাবণের মধ্যাহ্নে অন্তুজেঠুর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। সারা গা পিচ্ছিল হয়ে উঠেছে। গামছাটা কোমর থেকে খুলে মোছে জেঠু।

“আজ আর মাছ ধরবো না, জানিস, শরীরটা ভাল লাগছে না। চারের ব্যাগটা নে।” ওরা উঠে পড়ে।

“জানিস জেঠু, কেন মাছ ধরি, কেন তোদের এখানে বছরে এসময় আসি!” মাথা নাড়ে ও।

“সারাবছর নানা কাজের চাপে ক্লান্ত হয়ে পড়ি। তাই এই বর্ষাকালে তোদের এখানে এসে ক্লান্তিটা কাটাই। আবার চাঙ্গা হয়ে নি বাকি বছরটার জন্যে। এটাই আমার স্বাধীনতার সুখ রে জেঠু, বুঝলি?”

সন্ধ্যেতেই ঘটনাটা ঘটল। হঠাৎই বুকে ব্যথা শুরু হয়। গ্রামের হাতুড়ে ডাক্তারের মতে হার্ট অ্যাটাক। বর্ধমানের এই প্রত্যন্ত গ্রামে অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া যায় না। একটা অ্যাম্বাসাডার ছুটে চলেছে রাতের নিকষকালো আঁধার ভেদ করে-দুর্গাপুর এক্সপ্রেস ওয়ে বেয়ে-ঝড়ের গতিতে। হু হু করে ছুট্টে পালাচ্ছে রাস্তার পাশের ধানক্ষেত, জলা আর তীব্র হাওয়া। অন্তুজেঠু শুয়ে আছে ওর কোলে মাথা রেখে। এখনও কানে বাজছে মাকে বলা জেঠুর শেষ কথা - “আর বোধহয় আসা হবে না…”

তখনও পতাকাটা নামানো হয়নি। এখনও উড়ে চলেছে সে, রাতের আঁধারে উঠোনের কোণে, অন্তুজেঠুর একমুঠো স্বাধীনতার সুখ হয়ে।

জুন ২০২০ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

কবিতা

অভিষেক চন্দ

ঠাকুরপুকুর, কোলকাতা

কবিতাঃ অভিষেক চন্দ

মেঘ-বৃষ্টি
                              

মেঘ নেমেছে যখন, বৃষ্টি তখনও 
                 মাইল খানেক দূরে। 
হাতের রেখায় অল্প অল্প করে,
তাকে এঁকেছি কলম বন্ধ রেখে
                   অনেক যত্ন করে।
মেঘলা বিকেল তখন,
                 ছিল বড্ড আনমনা।
আলোকে দিয়ে ফাঁকি, বোধহয়
       হয় তোমারই আনাগোনা
                   নিঃশব্দে...
বৃষ্টি আসে তোমার পায়ের কাছে,
ক্রমাগত সে মুছতে থাকে আবছা ছায়াটাকে।
সে তো জানেনা
কেন বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যেবেলা আসে,
কেনই বা হাজার শব্দ মুখ ফিরিয়ে হাসে...
সে শুধু বোঝে
কালির কলম্ থামে, লেখা থমকে গেলে।
বাইরে বিকেল নিয়েছে ছুটি।
সন্ধ্যে এসেছে পা টিপে টিপে
             বৃষ্টির হাত ধরে।।

fisherman.jfif
কবিতাঃ শক্তিপ্রসাদ ঘোষ

জুন ২০২০ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

কবিতা

শক্তিপ্রসাদ ঘোষ

নিউটাউন কোচবিহার

কবিতাঃ বিধান জানা

ফ্যাকাসে স্বপ্ন
                              

নীল রাত্রি নিগরে দুঃখিততম কবিতা

পৃথিবী কাঁপে অতর্কিতে করাল আঘাতে

গর্জে উঠে আঘাত

জ্বলে উঠে উন্মত্ততা

ফ্যাকাসে অন্ধকারে

নেমে আসে শীতল মুহূর্তের নির্ঘণ্ট

প্রতিটি শরীর ভয়ার্ত মূর্তি

দূরত্ব বজায় রেখে গড়ে উঠে

নূতন সামাজিক নকশা

ঘণ্টার গলাভাঙা আওয়াজে

বেদনায় মুমূর্ষু, বীভৎস দাবানলে জ্বলছে চিতা

সবুজ মাঠে

মণি আভা ফ্যাকাসে স্বপ্ন গোনে।          
       

morning.jpg

জুন ২০২০ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

কবিতা

বিধান জানা

শ্রীরামপুর, হুগলী

খাত

ফুল ফোটে গাছে গাছে আকাশেতে তারা

ঘরে ঘরে মেমসাব স্বপ্নের পাড়া

গাড়ি ছোটে সাঁই সাঁই ঢাকা কাঁচ কালো

ল্যাম্প পোস্ট জেগে আছে ঘুমিয়েছে আলো

হাত কাটা গেঞ্জিতে আধখোলা বুক

ঘুম নেই গাঢ় রাতে অলীক অসুখ

হাড় ভাঙা সারাদিন রাত ঘন কালো

ড্রেনে বয় কালো জল সময় ঘোরালো

কয়েকটা ভাই বোন টুকরো বিছানা

ট্রলিব্যাগ বড় লাগে ঘর একখানা

আকাশেতে চাঁদ জাগে জেগে থাকে চোখ

বাবা জাগে কেশে কেশে বুকে ক্ষয়রোগ

ওপারেতে দোতলায় পরী জেগে ওঠে

রাত পোশাকের নিচে জোড়া চাঁদ ফোটে

সারাদিন গেটে খাড়া কখনো বা টুল

বুকে শালা টাই ঝোলে এপ্রিলফুল

তলপেটে চিনচিন রক্তেতে ঝড়

ঝাঁপাবে বাঘের মত দেবেই কামড়

বাইরে ঠান্ডা হাওয়া ঝিমিয়েছে রাত

হাইড্রেন মাঝখানে মারিয়ানা খাত।

touch.jpg
কবিতাঃ তন্বী চক্রবর্তী

কবিতা

তন্বী চক্রবর্তী

জুন ২০২০ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

জাহাজডুবির গল্প

রীরে বল্কল ছিল, আভরণ-উদ্বেলিত ছন্দ,
চাঁদের স্তিমিত আলোয় ছুঁয়ে ছিলাম তোমার ক্র্যানবেরি-ভেজানো ঠোঁট,
নেশা-পথ প্রশস্ত, রাত-নিরালায় তখন চলছিলো পাপ-স্খলনের উন্মাদনা,
একাগ্রতা একেই বলে? বলো?

ভালোবাসায় ছুঁয়ে থাকা স্তব্ধ পায়রার তুলতুলে ঠোঁটে আলপনা এঁকে দিয়েছিলে তোমার বিমূর্ত প্রণয়াকাঙ্খার,
জলে ভরা নৌকো দাঁড় টেনে গিয়েছিলো ছলাৎ ছলাৎ,
আঁকড়ে ছিলাম শেষ পারানির কড়ি, আর পাটাতন-বালিয়াড়িতে হিসেব কষে আছড়ে পড়েছিলো পরিপ্লবের রংমিলান্তি,
থমকে ছিলো লুব্ধ-চাঁদের সময়, ধোঁয়া, চিকন-হদিশ নাগকেশরের ফুল
আর অবাঞ্ছিত ছাদনাতলায় হিন্দোলিত-বাদন,
বলো ভালোবাসাকে থামতে বলিনি আমি?
উপচে-পড়া দুধের সফেন,

সামুদ্রিক রিকিঝিকিমিকির প্রজাপতি-পাখায় তুমি আলতো করে স্পর্শ করেছিলে
তুষারাবৃত ফেনিল-শিখর আর চাঁদ মিশে গিয়েছিলো চাঁদের গভীর উত্তাপে
কোনো এক ফ্লেমিংগো-দেশের আনাচেকানাচে,

ঠোঁট দিয়ে তুলে আনছিলো অদৃশ্য রূপকথার রাজকুমারীর মৃগতৃষ্ণা।

কেমন আছো আফরোজ?

কেমন আছো আফরোজ? অফিসের তাড়ায়,

টাই বাঁধার বিপন্নতায় আজ কেমন আছো আফরোজ?
সময়ের ভ্রুকুটি না-মানা আফরোজ, মনোরঙ্গিণীর মন-মাতানো বিহ্বল বাতাসে আমার শেষ চুম্বন নিয়ে আজ কি ভালো আছো একটুও?
গল্পটা তো সরল ছিলো; তোমার অস্থিরতার জল-নিকোনো উঠোন-দেশ,

তোমার কাঁধের কোনে ছোট্ট একটা তিল,
শরীর জুড়ে আশাবরী স্বপ্ন, 
আফরোজ তুমি তো জানতে চেয়েছিলে বন্দুকের ট্রিগার আর জটিলতার ম্যানিফেস্টো বাদ দিয়ে কিভাবে শরীরে নকশা খোঁজা যায় 
কেমন আছো আজ? আফরোজ? শুনতে পাচ্ছো শব্দের শিথিলতা? 
দেখতে পাও আজও এরোড্রোমের নিচে চাপা পড়া কালচে,

শুকনো রক্তের ফোঁটা?
তুমি কি সত্যিই ভালো আছো আফরোজ?

তোমার ক্যানভাসে আজও রয়ে গেছে আমার ছেড়ে আসা নীলঘূর্ণি আর বসন্তবৌরির ধুকপুকানি?
রডোডেন্ড্রনের পাপড়ি-মেলা স্নিগ্ধ বিস্ময়ে,

জাহাজের বন্দর ছাড়ার বুক-চাপা কান্নায়,
আমাদের সুহানা সফরের দিন-ক্ষণ-পুঁজি-পুঁথি-মুখশ্রীর শূন্য শস্যাগারে ঢেউ খেলে যায় অপাংক্তেয় বাক্য-বিনিময় 
পথচলতি ট্রাম-রিক্সা-দুপুর-ফেরিওয়ালা আর ঘামে-ভেজা উষ্ণ প্রস্রবণ... 
ভালো থেকো আফরোজ, যদি পারো, 
ভালোবেসো।

কবিতাঃ অরুনাভ সর

জুন ২০২০ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

কবিতা

অরুনাভ সর 

strom.jpg

যান্ত্রিক

শিক্ষার কোনো শেষ নেই, দুঃখের নাই রেশ
দুঃখ আজ কোনোভাবেই ভালো লাগছে না বেশ
পেশা চলে গেছে শুধু ঘরে শুই উঠি বার দশেক জেগে
ভাবা হয় না কিছুই,

আবার শুয়ে পড়ি রেগে
যন্ত্রের ভরসায় পড়ে আছে যারা ভাবনা নেই আর
কত কিছুই আছে চুপচাপ ঘরে বসে করার
ঘরে বসে লিখছি এটা ভাবতে পারো কি তা!! 
যন্ত্রের মাঝে ঢুকে গেছে আজ তোমায় বলাই বৃথা

কবিতাঃ সাইদুর রহমান

জুন ২০২০ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

কবিতা

সাইদুর রহমান সাঈদ

masjid.jpeg

ঈদ মোবারাক

ঠলো চাঁদ গগনমাঝে
ধরা সাজে নতুন সাজে,
পশ্চিমে দেখো ঢলল শশী
সবার মুখে রাঙল হাসি।

হাসছে আকাশ হাসছে বাতাস
হাসছে নিখিল দূর-মহাকাশ!
হাসল মরু হাসল তরু
আপনমনে চপল-চারু
দিচ্ছে দোল মায়ের কোলে
শোন খোশঢাক শোন বিহ্বলে!

আসল ঈদ-খোশ-সওগাত,
ধরাকোলে সুখ হল মাৎ!
তাকধিনাধিন ধিন তিকতাক
সবাইকে জানাই ঈদ মোবারাক!!

এই দুর্যোগে, মহামারিতে-

যত কবিতা লেখা হল

বোনা হল যত গল্প।

তত ত্রান পৌঁছল কি
ক্ষুধার্থ জঠরে?

দেওয়ালে দেওয়ালে -
রক্তাক্ত যত ক্ষত
বাতাসে দীর্ঘশ্বাস।
তত স্নেহার্দ্র হাত
ছুঁয়েছে কপালে?

রক্তবীজের মতো-
অনিঃশেষ সহমর্মিতা
আর শোক মিছিল।
পৌঁচ্ছে ছিল কি
দুঃখীর ঠিকানায়?

নাকি সবটুকু আয়োজন-
গল্প, কবিতারা
দুঃখ বিলাসীতা নিয়ে
নেমেছিল পথে
কপট লোকাচারে!

কবিতা

পার্থ সরকার

কবিতাঃ পার্থ সরকার

জুন ২০২০ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

জিরো আওয়ারে, জিরো বাল্বে

ঝিমিয়ে আসে মশাল পালকের

জিরো আওয়ারে, জিরো বাল্বে

বিভ্রান্ত মাছ খালেবিলে পাদুকাবেলার শব্দে

ডেকেই চলে কাকে জনান্তিকে সঘন ভিক্ষুক

আছে পড়ে আটকে বেতালা গান

কান খাঁড়া করে শোনে সে কথা ময়ূর

অথচ কবেই গেছে মরে বর্ষামঙ্গল

কবেই সুরক্ষার নবোদিত দঙ্গল


পড়ে আছে বাতাস এক চিলতে

ঘরের ভিতর

এক চিলতে সোহাগ তাপের ভিতর

বাকি সব

যাওয়ার ভিতর যাওয়া

শূন্য মাঠে ভরা

ভরা শূন্য কায়া ।

jail.jpg

কবিতা

দেবযানী পাল

দেবযানী পাল

জুন ২০২০ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

করোনা
 

বিশ্ববিজয়ী করোনা
তোমার দ্রুত পদক্ষেপে 
বসুন্ধরা আতঙ্কিত 
স্বর্গ, মর্ত, পাতাল উত্কন্ঠিত
তোমার নেই কোনোও করুণা।

সারা বিশ্ব স্তম্ভিত শঙ্কিত 
প্রিয়জন বন্ধুজনের বিদায়ে 
সীমাহীন শোকে আপ্লুত 
অভাবিত, অশান্ত ভাবনায় ভীত।

তোমার থেকে আকাঙ্ক্ষিত নিষ্কৃতি হল ব্যবধান 
কি আশ্চর্য সে মানুষেরই অবদান 
ধনী-দরিদ্র, দেশ-জাতি-প্রজাতির

চীর-ভেদাভেদ অনন্তকাল বিদ্যমান।
প্রার্থনা করি তোমার অন্তিম বিদায় গ্রহণ 
বিশ্বজনের ভেদাভেদের শাশ্বত সমাপন 
বৈচিত্র্যময়, ঐতিহ্যময় অখণ্ড মানবতার স্থিতি চিরন্তন।

800px-SARS-CoV-2_without_background.png

জুন ২০২০ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

দেবদাস ভট্টাচার্য্য

কবিতা

দেবদাস ভট্টাচার্য্য

ডালাস, টেক্সাস

DebdasBhattacharya.jpg

মা  


দিন শুরু হয়নি তখনো, 
পূব দিকে আধো অন্ধকারে -  
একফালি আলোর আভাষ, 
মশারির দড়ি খুলে 
কে যেন নিঃশব্দে 
পূবের জানালা দিল ঠেলে,  
অমনি দামাল শিশুর মত 
এক ঝলক পূবালী বাতাস 
হুটোপুটি করে গেল রাতের ক্লান্তিতে 
ভাঙ্গা ন্যাতানো শরীরে। 
চোখের উপরে নেমে আসা চুলে 
কারো হাত খেলে গেল,
সরে গেল আলতো আঙ্গুলে।
কপালের ঠিক মাঝখানে
কেউ যেন চুমু খেল,
চেনা গন্ধে ঘর ভরপুর – 
ঊষার আলোয়, পূবালী বাতাসে 
টের পাই তার উপস্থিতি – 

ভারী মিষ্টি ভারী মায়াময় 
ঠিক যেন ভৈরবীর সুর। 

রোজ সকালে ঘুম ভাঙ্গে 

দিনের রুটিন, কিছু পাখি চেঁচামেচি করে 

ঘুম থেকে তোলে। 

বাইরে আসি, বুক ভরে শ্বাস নিই, 

গন্ধ পাই তার – 

সেকি রয়েছে ওই বুনো জুঁই, বেদানার ফুলে?  
স্বচ্ছ নীলাকাশ, ছেঁড়াখোঁড়া মেঘেদের সারি 
ভেসে চলে মন্থর অলস, 
ঠিক যেন আমার অতীত 
চেয়ে দেখি প্রতিটি মেঘের বুকে ছোট্ট মুখ 
চেয়ে আছে নির্নিমেষে 
দিঘির জলের মত টলটলে 
মাতৃস্নেহে ভরা যেন পূর্ণ কলস।

প্রশ্নেরা ভীড় করে – 
জীবনের এই উত্তরণ 
জানি না এ সফলতা কিনা, 
কে দেবে উত্তর, শুধুই জিজ্ঞাসা চিহ্ন – 
শুধু জানি এটাই বাস্তব, 

ধ্রুব সত্য, নিষ্ঠুর নির্মম। 

চোখ বুজে দেখি – 
সেও দাঁড়িয়ে আছে 
ঠিক আমারই মত 
পূবের জানালা খুলে

শিক দুটি ধরা কোনমতে -  

ভাঙ্গা গালে নবার্কের রক্তরাগ,

মন তার ধেয়ে আসে সাগর পর্বত মেরু ভেঙ্গে কে ঠেকাবে তাকে, 

সে আসছে ছেলের কাছে অরুণের সপ্তাশ্ব রথে। 

আমি ঠিক আছি, ঠিক থাকি,তবু কখনো কখনো অবুঝ শিশুর মত কেঁদে ওঠে, দেখি তাকে সে আসছে আলুথালু টলোমলো পায় -

ছোট্ট মেয়েটির মত, সে রয়েছে কাছে,

ধানের শিষের বুকে হেমন্তের শিশিরের মত,

সে আমার প্রতি রোমকূপে, 

সে আমার রক্তকণিকায়। 

জুন ২০২০ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

গল্প

ইন্টারভিউ

ইন্টারভিউ

অভিষেক চন্দ

ঠাকুরপুকুর, কলকাতা

offce1.jpg

ন্ধ্যে সাড়ে সাতটা। রাসবিহারীর মোড়ে জ্যামে আটকাল ট্যাক্সিটা। হাল্কা হাল্কা বৃষ্টিতে রাস্তার ওপর স্ট্রিট লাইটের আলোয় লেখা ছোট গল্পরা শহরের ছায়াতেই লুকিয়ে পড়ে। ট্যাক্সির পেছনের সিটে বসে কাঁচটা তুলে দিল মহেন্দ্র। বয়স ষাটোর্ধ। রঙ ফর্সা। দোহারা চেহারায় মেদের স্থান কিঞ্চিৎ। সময় আর ত্রিশ বছর পশ্চিমে গেলে এখন হয়তো ট্যাক্সি থেকেই নেমে যেত ও। হাল্কা বৃষ্টিতে ভিজে যেত মাথার চুল। জামার বুকের দুটো বোতাম খুলে হেঁটে যেত পর্বতের চূড়া ছুঁয়ে থাকা মেঘলা মেঘেদের কবিতার শব্দের ছন্দে। হ্যাঁ, মহেন্দ্র কবি। ও কবিতা লিখতো। যথেষ্ট খ্যাতনামা। তবে এখন শুধু ওই নামটুকুই বাকি। শব্দরা বড় একটা তার কাছে ঘেঁষে না। সেও খুব একটা খোঁজেনা আর। বোধহয়  বড্ড দেরী হয়ে গেছে।

আজকের দিনটা বড্ডই অদ্ভুত, ভীষণই প্রাসঙ্গিক মহেন্দ্রর কাছে। আজ থেকে ঠিক একবছর আগে, না! চারদিন কম একবছর আগে, দুপুর তিনটে কুড়িতে সমস্ত সমারোহের মাঝেই চিরবিদায় জানায় একজন। ফিরে গেছে তার সবটুকু, সবকিছুই ছেড়ে। হারিয়েছে সবার থেকেই। নাম অবিনাশ চক্রবর্তী। চিত্রকরদের জগৎ অবশ্য এই নাম জানেনা। চেনে এক অন্য নামে। অবিন। জন্মেছিল বিজয়ার দিন। আর চলে গেছে বোধনের দুপুরেই। মহালয়া আজ।

অবিনের মৃত্যুবার্ষিকীতে এক টিভি চ্যানেলের বিশেষ অনুষ্ঠানে একান্ত সাক্ষাৎকার দিয়ে বাড়ি ফিরছে মহেন্দ্র। যদিও আসল তারিখটা আজ নয়, তবে যেহেতু মহালয়া, তাই অনুষ্ঠানটা হয়েছে আজই। মেজাজটা বশে নেই। হঠাৎ একটা বিচ্ছিরি শব্দে ট্যাক্সিটা স্টার্ট নিলো। মহেন্দ্র ঘড়ি দেখল। প্রায় আটটা বাজতে চলেছে। জানলার কাঁচটা একবার হাতে করে মুছে দিল ও। ভেতরের বাষ্পে বাইরেটা ঝাপসা ছিল। মুছল খানিক। এরমাঝেই একটা কথা কানে এল ওর। বাইরে কে যেন ফোনে কাউকে বলল, “আমি তো আর রামকৃষ্ণ নই যে… ”। বেশ একটা ব্যঙ্গার্থক সুরেই কথাটা বলা। হঠাৎ মহেন্দ্রর মনে হল, হয়তো অবিন থাকলে বলত, “কেন?”। ভেবে একটু নিজের মনেই বলল, “না রে, তোর না থাকাটাই ভাল হয়েছে! কেউ বুঝতো না তোকে। আমিও তো ভুলই বুঝলাম রে! শুধুই ভুল বুঝলাম!” বড্ড অস্থির লাগছে মহেন্দ্রর। জানলাটা একটু নামাল।

“দাদা, সিটটা পুরো ভিজে যাবে যে! খুব বৃষ্টি তো!” ড্রাইভার একটু পেছন ফিরে বলল মহেন্দ্রকে।

“আরে আর কিছুটা তো রাস্তা, কিচ্ছু হবেনা। বেশি খুলিনি।” জানলাটার দিকে ইশারা করে বলল মহেন্দ্র।

সেই কথা শুনে আর কথা বাড়াল না ড্রাইভার। আসলে পাড়ারই লোক। তাই চুপ করে গেল। বাইরের দিকে চেয়ে রইল মহেন্দ্র। অনিমিখে।

গতকাল বিকেলেই ফোনটা আসে মহেন্দ্রর কাছে এই ইন্টারভিউটার ব্যাপারে। সবে মাত্র ও তখন নিজেরই পুরনো একটা কবিতার বই খুলে পড়তে বসেছিল। লেখারা আর আসেনা। তাই ধরে রাখার চেষ্টা। আর মাঝে মাঝে সেগুলো দেখেই নিজেকে আবার করে খোঁজা।

“হ্যালো”

“আমি কি মিস্টার মহেন্দ্র বসুর সাথে একটু কথা বলতে পারি?” এক পুরুষ কণ্ঠ। শুনে মনে হল মাঝবয়সী। বছর চল্লিশেক হবে।

“তার সাথেই কথা বলছেন আপনি। কি ব্যাপার সেটা বলুন।” একটু মজার স্বরেই কথাটা বলেছিল ও।

“নমস্কার স্যার, আমি সৌরভ দত্ত, ‘সুর ও ছন্দ’ চ্যানেল থেকে কথা বলছি।”

“হ্যাঁ বলুন কি করতে পারি?” এরকম ফোন খুব চেনা মহেন্দ্রর কাছে। অনেক সময় এখনও নানান ইন্টারভিউ এর জন্য ওর কাছে সময় চায় অনেক টিভি চ্যানেল। ও সাধারণত এখন ‘না’ করেই থাকে এগুলি। তবে এবারের ব্যাপারটা পারেনি এড়িয়ে যেতে।

“স্যার, কালকে আমাদের একটা বিশেষ অনুষ্ঠান হতে চলেছে। আর আমরা আপনাকে আমাদের গেস্ট হিসেবে কালকে পেলে খুব খুশি হবো!”

“সে তো বুঝলাম, কিন্তু আমি তো আর কোন চ্যানেলে এখন মুখ দেখাতে যাইনা! আমায় মাফ করুন।” বলেই ফোনটা রেখে দিতে যাচ্ছিল মহেন্দ্র।

“স্যার, প্লিজ ফোনটা রাখবেন না, একটু শুনুন!” ছেলেটার গলাটা একটু ভীত শোনাল।

“বলুন।”

“স্যার, কালকের প্রোগ্রামটা অবিনবাবুকে নিয়ে, মহালয়া কাল।...”

এটুকু শুনেই একটা ধাক্কা খেয়েছিল মহেন্দ্র। একটা আলপিন যেন বুকটা মুহূর্তে ফুটো করে দিল। ছেলেটা বলতে থাকলো,

“আমরা সবাই জানি যে উনি আপনার স্নেহধন্য ছিলেন। আপনি যদি আসেন আমাদের অনুষ্ঠানে, তাহলে আমাদের কালকের অনুষ্ঠান বলতে গেলে সত্যিকারের পূর্ণতা পাবে। একটা ইন্টারভিউ স্যার, প্লিজ!”

একমুহূর্ত থমকেছিল ও। তারপর সামলে নিয়ে বলল,

“ঠিক আছে, যাব।” খুব আস্তে বলেছিলো কথাটা।

“ধন্যবাদ স্যার, অজস্র ধন্যবাদ! আমি আপনার মেলে বাকি ডিটেলস পাঠিয়ে দিচ্ছি এক্ষুনি। ধন্যবাদ স্যার আপনার সময় দেওয়ার জন্য।” বলে ফোনটা রেখেছিল ছেলেটা। মহেন্দ্রও ফোন রেখে নিজের চেয়ারে বসে ব্যাল্কনি থেকে তাকিয়ে ছিল।

“কি হল? কে ফোন করেছিল?” বিছানায় শুয়েই প্রশ্ন করেছিল মিতালি। মিতালি বসু। মহেন্দ্রর স্ত্রী। আগে ছিল মজুমদার। একসুতোয় বাঁধা হয়ে যাওয়ার পর সেটা বিসর্জিত। মানুষটাও বোধহয়। এক কলেজে পড়াশোনা, সেই সূত্রেই আলাপ। মহেন্দ্রর কবিতায় প্রেম, তারপর বিয়ে। তারপর সেই একজন স্ত্রী, একজন মা, একজন পিসি, মাসি, আরও কত কি! আগে ছবি আঁকতো, সেটাও এখন বন্ধ!

“ঐ একটা টিভি চ্যানেল থেকে, একটা ইন্টারভিউ এর জন্য। কালকে।”

“ও!, যাবে?” ‘না’ উত্তরটা পাবেই ধরে নিয়েছিল মিতালি। ওকে চমকে দিয়ে মহেন্দ্র বলেছিল,

“হ্যাঁ, যাব। কালকের অনুষ্ঠানটায় যাব।” অন্য দিকে চেয়ে উত্তরটা দিয়েছিল মহেন্দ্র।

মিতালি অবাক হয়েছিল যথেষ্ট!

“তুমি যাবে? বাবাহ! কি এমন ব্যাপার গো যে তুমি রাজি হয়ে গেলে যেতে?”

“কাল দেখো টিভিতে, তাহলেই বুঝতে পারবে।” ছোট্ট করে প্রশ্নটা এড়িয়েছিল ও। মিতালিও আর কিছু জিজ্ঞেস করেনি।

সন্ধ্যের দিকে ছাদে চলে গেছিল মহেন্দ্র। অবিন। অবিনাশ। যার বিনাশ নেই। যে শেষ হয়না। কথাগুলো মাথাটাকে পুরো ঘেঁটে দিচ্ছিল ওর। ছেলেটার সাথে ওর প্রথম দেখা বেশ অনেক বছর আগে। বইমেলায়। মহেন্দ্র তখন যথেষ্ট নামি কবি। ওর একটা নতুন বইয়ের উদ্বোধন ছিল সেইদিন। সমস্ত কাজ মিটিয়ে যখন একটু ফাঁকা সময় পেয়েছিল ও, তখন প্রায় মেলার শেষ লগ্ন উপস্থিত ছিল। একটু চারপাশটা ঘুরে দেখতে দেখতে প্রথম চোখে পড়ে একটা কমবয়সী চিত্রকরকে, পোর্ট্রেট আঁকছিল মানুষের। একের পর এক ছবি এঁকেই চলেছিল। একটু খেয়াল করে বুঝেছিল মহেন্দ্র, যে ওর আঁকার স্টাইলটা একটু আলাদা। ছবি তো অনেকেই আঁকে, পোর্ট্রেট আর্টিস্ট অনেক দেখেছে ও। ওরা সবাই ভীষণ পারফেক্ট। তবে এই ছেলেটা পারফেকশনের ধার ধারে না। স্মুথ এবং এফর্টলেস পেনসিল স্ট্রোক। মানুষগুলোর মুখের শুধু আদলটা ও স্কেচ করছিল। বাকিটা ছিল ওর ব্রেন-চাইল্ড। ব্যাকগ্রাউন্ড কালার করছিল এক একজনের এক এক রকম! কারুরটা নীল, তো কারুরটা উজ্জ্বল কালোর ওপর অফ হোয়াইট এর স্প্রে পেইন্ট। মহেন্দ্র পেরিয়ে গেছিল ছেলেটাকে আরও অনেকের আঁকা দেখেছিল সেদিন। তবে ওরা ভীষণ পারফেক্ট!

চোখ-নাক-মুখ সব অসাধারণ, নিখুঁত। তবে কিছু যেন মিসিং ছিল। হয়তো একটু ইম্পারফেকশন, হয়তো শিল্পীর কল্পনার ব্যাপ্তি। ও আবার ফিরে গেছিল সেই ছেলেটার কাছেই। তখনও ছেলেটা আঁকছিল।

“আমার একটা পোর্ট্রেট এঁকে দেবে?” মহেন্দ্র প্রশ্ন করেছিল। জবাবে মাথা নেড়ে ছেলেটা বলেছিল,

“দেব স্যার, এইটা শেষ করেই দিচ্ছি।” বলেই আবার আঁকতে লেগেছিল ছেলেটা। শেষ হতেই ও বলেছিল,

“এবার আপনার পালা!” মহেন্দ্র সবে ছেলেটার সামনে গিয়ে বসবে, ঠিক এই সময়েই ছেলেটা বলেছিল, “ আসতে হবেনা আমার সামনে, ঐখানেই বসুন।” মহেন্দ্র বসেছিল ছেলেটার ডান পাশে, একটু কোন করে। ওর কথা শুনে একটু অবাকই হয়েছিল মহেন্দ্র। তবে কথাটা শুনেছিল।

ছেলেটা এঁকেছিল। পেস্তা রঙের ব্যাকগ্রাউন্ডে একটা স্প্রে পোর্ট্রেট। ঐ একটু মুখের পাশটাই। মহেন্দ্র ছবিটা দেখে খুশি যতটা হয়েছিলো, অবাক হয়েছিল আরও অনেক বেশি।

“তোমার নাম কি?” টাকা দিতে গিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল মহেন্দ্র।

“আমার নাম অবিন। অবিনাশ চক্রবর্তী। কেন স্যার?” ছেলেটার চোখে মুখে এক অদ্ভুত সারল্য লক্ষ্য করেছিল মহেন্দ্র।

“না, কিছুনা। কি করা হয়? শুধুই ছবি আঁকা হয়, নাকি অন্য কিছুও কর?”

“আর কিছু করিনা স্যার, কেন?”

“চাকরি করবে? ভাল জায়গায়। করবে?” প্রশ্নটা ইচ্ছে করেই করেছিল ও।

“না স্যার। করব না। আটকে যাব।” উত্তরটা শুনে আরও খুশি হয়েছিল মহেন্দ্র। সেই থেকেই অবিনের সাথে আলাপ। ছেলেটার বাবা-মা দুজনেই চাকুরীজীবী। ভাল পরিবার। ওরা ছিল দু’ভাই। ও ছোট। ওর দাদা তখন পি.এইচ.ডি. করছিল দিল্লী ইউনিভার্সিটি থেকে। আর ও ছিল বাড়ির যাকে বলে ব্ল্যাক শিপ! পড়াশোনায় মন বসেনি। কোন রকমে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে শুধুই নিয়ম ভাঙার খেলাতে মশগুল থাকতো ও। ছবি আঁকা ছিল ওর কাছে একটা গবেষণার মত। এক্সপেরিমেন্টের মত। কোন নির্দিষ্ট পথে ও যেত না। কনট্রাস্ট জানত, বুঝত। তবে খুব একটা মানত না। পারফেকশন থেকে ছিল অনেক দূরে। ওকে যিনি শেখাতেন, তিনি নাকি ওকে সবসময় বলতেন,

“‘টাচ অফ্‌ ইমোশন অ্যান্ড ইম্যাজিনেশন’ ছাড়া ছবি শুধুই একটা পিস অফ্‌ পেপার ফিল্ড উইথ্‌ লাইনস্‌ অ্যান্ড কালার্স।” তিনি গত হয়েছেন, তবে অবিনকে দিয়ে গেছিলেন তাঁর স্বপ্ন দেখার চোখ।

মহেন্দ্রর পরিচয় জানার পর অবিন একদিন বলেছিল,

“তার মানে আপনি আর আমি এক কাজই করি! ”

“কিভাবে? ” মহেন্দ্র উত্তরটা আঁচ করেই প্রশ্নটা করেছিল।

“স্যার, দুজনেই স্বপ্ন দেখাই, আমি রং দিয়ে, আর আপনি শব্দ দিয়ে! এটুকুই পার্থক্য শুধু।” বলে চোখে হেসেছিল অবিন। অবিন স্বপ্ন দেখত, দেখতে জানত। হয়তো বিশ্বাস করত যে সেটাও হতে পারে সত্যি! এটাই ছিল ওর সাথে বাকিদের তফাৎ! ওর ছবি কথা বলতো। ও শুধু পেইন্টার ছিল না, হি ওয়াজ্‌ এন আর্টিস্ট!  

পরে একদিন সকালে মহেন্দ্রের ফোনে অবিনের ঘুম ভাঙে,

“হ্যালো স্যার, বলুন কি হয়েছে?”

“প্রথমে এই স্যার বলাটা থামাতো! হাজার বার বলেছি, আমায় কাকু বলবি, নাহলে দাদাই বলবি, তবে স্যার না!” একটু রেগেই বলেছিল কথাটা। তবে আদর মেশানো ছিল।

“হা হা হা হা!! ঠিক আছে, আর ভুল হবেনা। এবার বলুন কি হয়েছে?”

“বলছি, আমি তোর ছবির একটা এক্সিবিশন করতে চাই। তুই কি রাজি? মানে তোর যত ভাল ভাল ছবি আছে, আমি চাই সেগুলো সবার সামনে আসুক!”

“অ্যাঁ! আপনি সত্যি বলছেন? আমার ছবির এক্সিবিশন?” গলাটা হঠাৎ যেন একটু ভারী শুনিয়েছিল অবিনের।

“হ্যাঁ রে বাবা! তুই যদি রাজি থাকিস, তাহলেই।”

“রাজি দাদা! টাকাপয়সা...”

“ওসব কথা থাক, বাকি ব্যাপারগুলো আমি সামলে নিচ্ছি। শোন অবিন, তোকে ভাল আঁকতেই হবে, তোর বহু কিছু দেওয়ার আছে। এটুকু মনে রাখিস্‌। রাখছি রে।”

“দাদা,” বলে থেমেছিল ও।

“বল, কিছু বলবি?”

“আপনি আমাকে এতো বড় সুযোগ দিচ্ছেন, তার মর্যাদা রাখতে পারব তো?”

“পারবি। আমি আছি তো! ঘাবড়াস না।” বলে ফোনটা রেখেছিল ওরা। অবিন পেরেছিল।

আরও অনেক কথাই উঁকি দিয়েছিল রাতে। যখন সবাই ঘুমায়, তখন। রাতটা কেটেছিল গোপনে, স্মৃতিতে যেন জোনাকির দল ফসফরাসের আলো লাগিয়ে গেছিল। যত অন্ধকার, ততই প্রকট। সকাল হতেই মিতালি জিজ্ঞেস করেছিল,

“ কি গো, কখন তোমার ইন্টারভিউ?”

“ এই দুপুর নাগাদ বেরবো।“ বলে বাথরুমের দিকে এগিয়েছিল মহেন্দ্র।

“ওঃ, তার মানে খেয়েই যাবে। ঠিক আছে।” বলে মিতালিও চলে গেছিল রান্নাঘরের দিকে।

 দুপুরে ভাত খেয়েই একটা নাগাদ বেরিয়ে গেছিল মহেন্দ্র। মিতালি জিজ্ঞেস করেছিল,

“কোন চ্যানেলে এটা দেখাবে?”

“‘সুর ও ছন্দ’ না কি একটা চ্যানেল আছে, তাতে। বিকেল পাঁচটা থেকে। পারলে দেখো।”

এই বলে একটা ট্যাক্সি ধরে সোজা রওনা হয়েছিল টিভি চ্যানেলের ইন্টারভিউয়ের জন্য। সকাল থেকেই আকাশের মুখটা ভার। একদল কালো কালো মেঘেরা যেন তাদের দু’হাত দিয়ে গোটা আকাশটাকে মুড়ে দিয়েছিল। হাল্কা হাল্কা বৃষ্টিও শুরু হয়েছিল। রাস্তার দূরত্ব বেশি নয়, তবে পুজোর সময় প্রতি পদক্ষেপেই জ্যাম, তাই পৌঁছাতে বেজেছিল প্রায় তিনটে। মহেন্দ্রকে দেখেই একটা মাঝবয়সী ছেলে হাত জোড়া করে এগিয়ে এসেছিল। বলল,

“আসুন স্যার, আমি সৌরভ। আমিই আপনাকে কাল ফোন করেছিলাম।”

মহেন্দ্র বুঝেছিল তার অনুমান নিতান্তই সঠিক, চল্লিশের ধারে কাছেই হবে ওর বয়স। সে নিজেও হাত জোড়া করে নমস্কার জানিয়ে বলেছিল,

“দেরী করে ফেললাম না তো?”

“না না স্যার, এখন সবে তো তিনটে বাজে, আমাদের স্যুট পাঁচটা থেকে। আপনি লাউঞ্জে বসুন স্যার। আমরা চা আর স্ন্যাক্স পাঠাচ্ছি।” মহেন্দ্র লাউঞ্জে বসেছিল। জায়গাটা খুব সুন্দর। পুরো জানলাটাই কাঁচের, এবং কোন পার্টিশন নেই। অর্থাৎ পুরো প্যানারমিক ভিউ! ও গিয়ে বসেছিল একদম জানলার ধারের সোফাটায়। আটতলার ওপরে অফিস, তাই বৃষ্টিতে ভেজা গোটা শহরটাই ছিল ওর সামনে হাজির। বড্ড ক্লান্তি লাগছিল ওর। এদিক ওদিক দেখতে দেখতে যে কখন চোখ লেগে এসেছিল, মনেই নেই মহেন্দ্রর। চোখ খুলেছিল সেই সৌরভের ডাকে।

“স্যার, শুটিং-এর সময় হয়ে গেছে। আসুন স্যার, আর আপনার ঘুম ভাঙিয়ে দিলাম, তার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী।” হেসে বলেছিল ছেলেটা। মহেন্দ্র নিজের ঘড়িটা দেখেছিল। পৌনে পাঁচটা। মানে প্রায় দু’ঘণ্টা ও দিবা নিদ্রা দিয়েছিল। উঠে একবার ওয়াশরুমে গিয়ে সোজা পৌঁছল ইন্টারভিউ রুমে। সেট প্রস্তুত। দুটো চেয়ার, মোটা গদি দেওয়া। দুদিকে দুটো ফুলের ভাস্‌, নানা রকম ফুল

দিয়ে সাজানো। সুন্দর লাগছে। আর সেটটার ঠিক ফোকাস পয়েন্টে একটা পুরনো ছবি, ল্যামিনেট করা। অবিনের। হাসি মুখটা। ছবিটাতে মালা দেয়া হচ্ছে তখন। মহেন্দ্রকে দেখে সৌরভ বলেছিল,

“স্যার, আপনি ঐ ডানদিকের চেয়ারটায় গিয়ে বসে পড়ুন। ”

“আচ্ছা। আর শুনুন, এই ইন্টারভিউটা কতক্ষণের বলতে পারেন?” মহেন্দ্র জিজ্ঞেস করেছিল।

“এই মোটামুটি আধঘণ্টা মতন। স্যার, আপনার ইন্টারভিউ নেবেন অমিত স্যার, আপনি বসুন, উনি আসছেন।” এই বলে চলে গেছিল সৌরভ। মহেন্দ্র গিয়ে বসেছিল চেয়ারে। ছবিটা ততক্ষণে মালায় জড়ানো। মহেন্দ্র একবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। অপরাধবোধ বোধহয়। ঠিক পাঁচটাতেই শুরু হয়েছিল ইন্টারভিউ। অমিত এসে নমস্কার জানিয়ে নিজের চেয়ারে বসে প্রশ্নের তালিকাটা মিলিয়ে নিচ্ছিল। একটু চাপা গায়ের রং, তবে সুন্দর ব্যক্তিত্ব ছেলেটার। কিউ দেওয়া শুরু হল। দশ থেকে একে এলে শুরু হল শুটিং।

“নমস্কার। সুর ও ছন্দ চ্যানেলের পক্ষ থেকে সবাইকে জানাই মহালয়ার একরাশ ভালবাসা এবং শুভেচ্ছা।...” অনুষ্ঠান শুরু।

“আজকের আমাদের অনুষ্ঠানটা অবশ্য একটু অন্যরকম, হয়তো ভিন্ন স্বাদের বলতে পারেন। কারণ, আজ মহালয়া। আর যারা ছবি আঁকা পছন্দ করেন বা আঁকেন তাদেরকে বোধহয় নতুন করে মনে করিয়ে দিতে হবেনা আজকের দিনটা। গতবছর ঠিক মহালয়ার দিনে আমাদের মাঝখান থেকে বিদায় নেন একজন তরুণ নক্ষত্র। আমাদের প্রত্যেকের চোখে দিয়ে কান্না, তিনি ফিরে গেছিলেন। অবিন। ভাল নাম অবিনাশ চক্রবর্তী।“ বড্ড সুন্দর করে কথাগুলো বলছিল অমিত।

“আমাদের আলোচনা আজ তাঁকে ঘিরেই। আমাদের সঙ্গে আজ উপস্থিত আছেন প্রখ্যাত কবি মহেন্দ্র বসু।” মহেন্দ্র হেসে নমস্কার জানালে অমিত বলতে থাকে,

“মহেন্দ্র বাবু, আজ আপনাকে পেয়ে আমরা ভীষণ সৌভাগ্যবান। আমরা সবাই জানি যে অবিন আপনার খুব কাছের ছিলেন। বইমেলায় আলাপ, তারপর দাদা-ভাই সম্পর্ক। শিল্পী হিসেবে তো ওনার সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার নেই, মানুষ হিসেবে উনি কেমন ছিলেন যদি একটু বলেন।” হেসেই প্রশ্নটা করেছিল অমিত।

“প্রথমেই সমস্ত দর্শকবৃন্দকে জানাই মহালয়া এবং দুর্গাপূজার আগাম শুভেচ্ছা।” ছবিটার দিকে একবার তাকিয়ে মহেন্দ্র বলেছিল,

“এবার অবিনের কথায় আসি। মানুষ হিসেবে ওকে বিশ্লেষণ করার যোগ্যতা বোধহয় আমার নেই। শিল্পী হিসাবেই ওকে ব্যাখ্যা করাটা আমার জন্য ধৃষ্টতা। শুধু এটুকু বলতে পারি, ও ছিল ওর আঁকা ছবিগুলোর মতই বাঁধনছাড়া। ওকে আটকানো যায়নি। শেষেও গেল না।” কথাগুলো ভীষণ আস্তে আস্তে বলেছিল ও। বিশেষ করে শেষের কথাটা।

“‘বাঁধনছাড়া’ তো সব শিল্পীদেরই বিশেষত্ব, তাই নয় কি? আপনিও কবি, আপনার লেখাও আমাদের বাঁধন ভুলতেই বলে। তাহলে ওনার সাথে যদি সবার পার্থক্যটা একটু বলেন।” প্রশ্নটা অদ্ভুত।

মহেন্দ্র একটু থেমেছিল। তারপর তখন বলেছিল,

“সেটা ঠিক। নিয়মে আটকে পড়লে বোধহয় আর যাই হোক, শিল্পী হওয়া যায়না। তবে একটা জিনিস বলা দরকার। আমরা কিন্তু সবাই, মানে যারা কবিতা, গল্প লিখি বা ছবি আঁকি, বা যে কোনো ক্রিয়েটিভ কাজ-কর্ম করে থাকি, তারা কিন্তু কাজের জন্য নিয়ম ভাঙি। বাস্তবে আমরা একটু আটকেই পড়ি সেসব অচেনা রাস্তা দিয়ে চলতে। অবিন পারত নিয়ম ভাঙতে। পেরেছিল ভাঙতে। তাই ও ছিল আর্টিস্ট! আর আমি শুধু কবিতেই আটকা রইলাম। শিল্পী হওয়া হল না।”  

একটু দম নিয়েছিল ও। সত্যিটা স্বীকার করতে অসুবিধে নেই আজ। মানুষটাই তো আর নেই! মালা দেয়া ছবিটা দেখেছিল মহেন্দ্র। দুচোখ ভর্তি স্বপ্ন হঠাৎ যেন থমকে গেল।

“আপনার সাথে সম্পর্ক কেমন ছিল? মানে আপনাদের আলোচনা কি কোন গণ্ডি মানতো? নাকি সেটাও ছিল বাঁধনছাড়া? বিষয় কি শুধুই ছিল শিল্প? নাকি অন্য কিছুও ছিল রসদ?” প্রশ্নটা যেন একটু বেসুরো শুনিয়েছিল মহেন্দ্রর কানে। ও হয়তো আঁচ করতে পারছিল যে আস্তে আস্তে কোন দিকে এগোচ্ছিল কথোপকথন। মাথা ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টা করে উত্তর দিয়েছিল,

“আমাদের মধ্যে যে ঠিক কি কথা হতো, কিরকম আলোচনা হতো, সেটা বোধহয় ঠিক বোঝাতে পারবোনা আমি। এটা আমার সীমাবদ্ধতা বলতে পারেন। তবে এটা ঠিক, যে ওর সাথে আমি অনেক সময় কাটিয়েছি বটে, তবে ওকে ঠিক মতন বুঝে উঠতে পারিনি। ছবি আঁকা, কবিতা, গান সব কিছু নিয়েই কথা হতো আমাদের। আমার থেকে বয়সে অনেক কাঁচা ছিল ও, তবে বাকি সবকিছুতেই আমায় টেক্কা দিতো। এক কথায় বলতে গেলে, ওর কিছু কমেনি, বরং ওর সাথে কথা বলে আমিই ঋদ্ধ হয়েছি।”

“ব্যাস? আর কিছু না?” ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করেছিল অমিত।

“মানে?” মহেন্দ্র একটু একটু করে আভাস পাচ্ছিল কি আসতে চলেছে।

“না, কিছু না। আচ্ছা, এবার আপনার স্ত্রী, মানে মিতালিদেবীর কথায় আসি। উনি তো অবিনবাবুর কাছে আঁকা শিখেছিলেন কিছুদিন। জানতে চাইবো যে উনি একজন শিক্ষক হিসেবে কিরকম ছিলেন।” প্রশ্নটা এমনভাবে করেছিল অমিত, যেন এই একটা প্রশ্নের জন্যই সমস্ত ইন্টারভিউটা। আর কিছু বুঝতে বাকি ছিলনা ওর।

“ও শেখানোর ব্যাপারে সত্যিই খুব একটা ভাল ছিল না। তবে যেহেতু মিতালি আগেই আঁকা শিখেছিল, তাই ওর খুব কিছু অসুবিধা হয়নি শিখতে।”

“বাঁধনছাড়া হতেও কি শিখিয়েছিলেন অবিন?” প্রশ্নটা শুনে একবার ও তাকিয়েছিল অমিতের দিকে। অমিত তৈরি হয়েই এসেছিল। তীরের মতন প্রশ্নগুলো ধেয়ে আসছিল মহেন্দ্রর দিকে। এক অবোধ, সঙ্কীর্ণ  পৃথিবী চেয়েছিল ওর দিকে।

“বুঝলাম না! একটু স্পষ্ট করবেন ঠিক কি বলতে চাইছেন?” মেজাজ হারাচ্ছিল মহেন্দ্র। বোধহয় চ্যানেলের টিআরপি ঊর্ধমুখী হচ্ছিল একইসাথে।

“না, তেমন কিছু না। আচ্ছা মহেন্দ্রবাবু, আপনার সাথে অবিনবাবুর শেষ দেখা কবে?”

“বছর তিনেক আগে। তারপর আর দেখা হয়নি।”

“হঠাৎ এরকম দূরত্ব কিভাবে তৈরি হল যদি একটু বলেন।” একটার পর একটা চাল চেলে চলেছে অমিত। মহেন্দ্র বুঝেও বেরোতে পারছিল না।

“ব্যপারটা একটু ব্যক্তিগত। নাহলে না বলার কিছু নেই।”

“ও আচ্ছা। তবে আপনার কথায় আমরা এটুকু বুঝতে পারছি, যে যাই হয়ে থাক, সেটার দায় নিতে হয়েছিল আপনাদের সম্পর্কটাকে। সেই অধ্যায় বন্ধই থাক তাহলে।” এই কথাগুলো অমিত একটু ইঙ্গিতপূর্ণভাবেই বলেছিল। ঠোঁটে ছিল অস্পষ্ট জয়ের অহংকার! মহেন্দ্র চুপ করেছিল। শুধু তাকিয়েছিল একবার অমিতের দিকে। একটু হেসে বলেছিল,

“হ্যাঁ, ঐ অধ্যায়টা বাক্সবন্দীই থাক।” তারপর একটু থেমে বলেছিল, “কারণ সেটা আমি বোধহয় বোঝাতে পারবো না, আর বাকিরা বুঝতে পারবেন না।”

ট্যাক্সিটা আবার আটকাল জ্যামে। স্টুডিও থেকে ফেরার সময় নিজের পাড়ারই একটা ট্যাক্সি পেয়ে গেছে ও। রাস্তা কম, তবু যেন কমছে না কিছুতেই। পুজোর বাজারের শেষ মুহূর্তের তড়িঘড়িতে অভিমানী শহর শুধু তাকিয়েই থাকে মুখ বুজে। বাইরে বৃষ্টিটা একটু ধরেছে। পুরো জানলাটাই নামিয়ে দিলো মহেন্দ্র। কালো রাস্তাটা জলে ভিজে যেন এক আত্মসমালোচনার মঞ্চ হয়ে উপস্থিত। কিছু কথা মনে আঁচড়  কাটতে থাকে ওর।

“কিরে, নতুন ছাত্রী কেমন শিখছে?”

মহেন্দ্রর প্রশ্নে একটু অদ্ভুত হেসে অবিন বলেছিল,

“কি যে বলেন না আপনি! উনি তো আঁকতে জানেন। আর আমি নিজে কি জানি যে শেখাবো?” তারপর একমুহূর্ত চুপ থাকার পর বলেছিল,“ বরং একভাবে ভাবলে, ব্যপারটা উল্টো!“

“উল্টো মানে?”

“উল্টো মানে, আমি নিজেই বোধহয় নতুন করে আঁকা শিখছি আমার ছাত্রীর কাছে!”

“তুই নতুন করে আঁকা শিখছিস? তাও আবার মিতালির কাছে? কি যে বলিস না তুই!” মুখ বেঁকিয়ে কথাটা বলেছিল মহেন্দ্র। ভেবেছিল অবিন হয়তো মজা করছে। অবিন একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেছিল। তারপর বলেছিল,  

“দাদা, আপনার লেখারা কি সবাই মুক্ত? সবাই আকাশ পেয়েছে?”

“মানে? মুক্ত বলেই তো ওরা কবিতা হয়েছে রে।” কথাটা শুনে অবিন মাথাটা হাল্কা নাড়িয়ে বলেছিল,

“না, আমি ঠিক সেটা বলছি না। বলছি যে, আপনার সব লেখাই কি সেই আকাশের ঠিকানা পেয়েছে যেখানে কবির লেখা আকাশও ছায়া খুঁজেছে?” অবিনের কথায় যেন এক অন্য পৃথিবী আত্মপ্রকাশ করছিল।

“দ্যাখ অবিন, আমার লেখারা মুক্তি খোঁজে পাঠকদের কাছে। তারাই সেই আকাশ, যার হদিশ আমার কবিতা করে চলে অনবরত।”

“পেয়েছে হদিশ?”

একটু অপ্রস্তুত হয়েছিল মহেন্দ্র। কথাগুলো যেন একটু অদ্ভুত ছিল। এরকম প্রশ্নের সম্মুখীন এর আগে কখনও হয়নি ও। মহেন্দ্র ঘুরিয়ে বলেছিল,

“হয়তো পেয়েছে। কেন রে তোর ছবি কি আকাশ খোঁজে না? তারা কি ঠিকানা পেয়েছে?”

“বোধহয় পেয়েছে। সেই একটা আশ্রয়, যেখানে আমার আঁকা ছবিগুলো আমারই টানা দাগের সীমানা ছাড়িয়ে মিশেছে গোটা আকাশটায়। মুক্তি পেয়েছে সেইখানে।”

মহেন্দ্রর দিকে তাকিয়েছিল অবিন, বলেছিল, “সেই আকাশেরই আমি ছাত্র।”  

কথাগুলো অবিন বলেছিল অদ্ভুতভাবে। এই আকাশ যে কে, সেটা বুঝতেও খুব কিছু অসুবিধা হয়নি মহেন্দ্রর। হঠাৎ করে এক অধিকারবোধ বুকে থাবা বসিয়েছিল ওর। সেদিন কিছু বলেনি মহেন্দ্র। অবিন ফিরে গেছিল। মহেন্দ্র বাড়ি ফিরতেই মিতালি হাতে একটা ছবি নিয়ে ওকে বলেছিল,

“এই শুনছো, এই ছবিটা দেখো! এটা অবিন এঁকে আমাকে দিয়েছে। সুন্দর না?” ছবিটায় একটা মেয়ের মুখ কালো ব্যাকগ্রাউন্ডে। ডানহাতটা ঠিক বাঁ চোখের নিচে। চোখ দুটো বোজা। দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ছে হাত বেঁয়ে। আর একটা ছেলে, আকারে ছোট, সেই জলের ফোঁটায় যত্ন করে প্রদীপ জ্বালাচ্ছে নিজের হাতের তুলি দিয়ে। ছবিটা দেখে কিছুই বলেনি মহেন্দ্র। চুপ করে ছাদে চলে গেছিল। এক লহমায় তীব্র অধিকারবোধ শিল্পীসত্ত্বাকে গ্রাস করেছিল সেদিন। এরপর হঠাৎ একদিন মহেন্দ্র অবিনকে বারণ করে দেয় মিতালিকে আঁকা শেখানোর জন্য। কিছু না বুঝেই অবিন জিজ্ঞেস করেছিল,

“কেন দাদা, আমি কি কিছু ভুল শেখাচ্ছি?” প্রশ্নটার কোনরকম উত্তর না দিয়েই চলে যাচ্ছিল মহেন্দ্র। অবিন আবার একই প্রশ্ন করায় মহেন্দ্র বলেছিল,

“যেটুকু বলেছি, শুধু সেটুকুই কর। আমি চলি। ভালো থাকিস।” কথাগুলো অবিনের কাছে অচেনা ছিল। ও বোঝেনি সেদিন তার দাদা তাঁর শিল্পীসত্ত্বাকে ভাসিয়ে দিয়ে এসেছিল সীমাবদ্ধতার বাঁধানো ঘাটে।

“ভালো থাকবো মানে? আপনি কোথায় যাচ্ছেন আমায় একা ফেলে? আমি কি করেছি মহেন্দ্রদা?” মহেন্দ্রর হাতটা চেপে ধরেছিল ও। মহেন্দ্র অবিনের হাতটা একঝটকায় ছাড়িয়ে দিয়ে বলেছিল,

“তুই কি করেছিস, সেটা বোধহয় আমায় নতুন করে বলে দিতে হবেনা, কি বলিস? আর এখন তুই যথেষ্ট বিখ্যাত। আমায় আর দরকার হবে না তোর। চলি।” অবিন খানিক চুপ করে গেছিল। তারপর কিছু একটা আঁচ করতে পেরে বলেছিল,

“দাদা, আপনি ভুল বুঝছেন। মিতালি ...” কথাটা শেষ করতেই দেয়নি মহেন্দ্র। অন্যদিকে তাকিয়ে বলেছিল,

আমি কিছু জানতে চাইনা।”

সেদিন আর কোন কথা হয়নি ওদের। সেই শেষ কথা ছিল ওদের। শেষ দেখাও বটে। ফিরে গেছিল মহেন্দ্র। অবিন দাঁড়িয়েছিল কিছুক্ষণ। ওর দুটো চোখ ছিল জলে ভরা। তাকিয়েছিল মহেন্দ্রর হেঁটে চলে যাওয়ার পথটার দিকে।। আর কখনও যোগাযোগের চেষ্টাও করেনি ও। শিল্পী ছিল। অভিমানটা ছিল ওর বড্ড দামী। হয়তো, ওর নিজের থেকেও।

ট্যাক্সিটা থামল ওর ফ্লাটের তলাতেই। নেমে ট্যাক্সি ভাড়া দিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে থাকলো মহেন্দ্র। লিফ্‌ট নিলো না। ছেলেটা মরে গেছে প্রায় একটা বছর পেরিয়ে গেল। ব্রেনস্ট্রোক হয়েছিল হঠাৎ। মহেন্দ্র খবরটা পেয়েছিল পরেরদিন কাগজে। একটা অপরাধবোধও যেন হঠাৎ কুঁড়ে কুঁড়ে খেতে শুরু করেছিল ওকে। মহেন্দ্র বোঝেনি কখন যে সে এক সঙ্কীর্ণতার গণ্ডিতে একজন শিল্পীকে বাঁধতে চেয়েছিল। ভেবেছিল আর পাঁচজনের মতন হয়তো অবিনেরও কল্পনার বিস্তৃতি একটা অতিসাধারণ মাপকাঠি দিয়ে মাপা যায়। তবে ভাবনাটা ভুল ছিল। নিজের কাছেই আজ প্রমাণিত, বোধহয় ও নিজেই ঐ পাঁচজনের মধ্যে একজন। তার বাইরের নয়। বোঝে নি, কখন ও নিজেই মিতালির আঁকা কবিতাগুলো মুছে দিয়েছে। নিজের হাতেই। আকাশ! অবিন মিতালিকে আকাশ ভাবতো। যেখানে ওর কল্পনার রং পেতো পূর্ণতা, আঁকা ছবিগুলো হয়তো পেয়েছিল সীমাহীন আশ্রয়। সত্যিই, অবিনকে ছুঁতেই পারেনি ও! নিজের ফ্ল্যাটের সামনে এসে কলিংবেলে চাপ দিলো মহেন্দ্র। কাজের মেয়েটা দরজা খুললে ও ভেতরে ঢুকলো। খেয়াল করলো, দুচোখ নিচু করে ঘরে বসে আছে মিতালি। চোখে চোখ পড়তেই মহেন্দ্র বুঝল, বৃষ্টি হয়েছে। কথা বললো না কেউই। অস্থির। অস্থিরতা ধীরে ধীরে গ্রাস করছে ওকে। নিজের মনের ভেতরে জড়ো হওয়া অদ্ভুত একটা কিছু ক্রমাগত ধিক্কার জানাচ্ছে মহেন্দ্রকে।

“তুমি নাকি শিল্পী?” প্রশ্নটা বড্ড বিঁধছে ওকে। রক্তাক্ত। মুখে চোখে জল দিয়ে নিজের ঘরে গেল মহেন্দ্র। আলো জ্বালালো না। ‘শিল্পীরা বাঁধনছাড়া হয়’- কথাটা লিখতে বা বলতে ভালো লাগে। তবে মানতে পেরেছে কি মহেন্দ্র? কান্না আসছে না, কথা আসছেনা। স্তব্ধতাও যেন পথ হারিয়েছে। জানলার সামনে গিয়ে নিজের টেবিলে বসলো মহেন্দ্র। কাঁচটা আটকানো। বাইরে কালো ভেজা আকাশটা দেখা যাচ্ছে। বৃষ্টিটা থেমেছিল। এখন আবার হচ্ছে আস্তে আস্তে। জানলার কাঁচটায় একবার হাত বোলাল ও। মনে একবার বললো, “আর আসবে না কক্ষনো? ক্ষমা কি আমি আর পাব না কোনদিন?” গলাটা একটু বুজে আসছে ওর। হঠাৎ কি মনে হলো, দিলো জানলাটা খুলে একঝটকায়। শুরু হলো ঝড়বৃষ্টি। চমকালো বিদ্যুৎ! ভেজা বৃষ্টির ছাঁটের মতো তারা ঢুকে এল অন্ধকার ঘরটায়। এপাশ-ওপাশ থেকে এসে একসাথে ভিড় করলো মহেন্দ্রর সামনে। একঝাঁক ফেলে আসা রূপকথার মতো বললো, “এসেছি আবার। আর ফিরিয়ো না! আমাদের আর ফিরিয়ো না।” নির্বাক মহেন্দ্র চুপ করে চেয়ে রইল এক মুহূর্ত। চোখের সামনে একদল অভিমানী শব্দ, যারা অনেক আগে তাদের কবির থেকে মুখ ফিরিয়েছিল, আজ বৃষ্টিতে আপাদমস্তক ভিজে উপস্থিত তারই ঘরের ভেতর। মহেন্দ্র খাতা খুললো। কলম ধরে আস্তে আস্তে তাদের সাজাতে থাকলো নিজের মতন করে। নতুনের কবিতা লিখছে ও। আজ বহু বছর পর, হারানো শব্দরা নতুন করে খুঁজে পেল আশ্রয়, তাদের পুরনো কবির কলমে।

ভয়

জুন ২০২০ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

গল্প

ভয়

কল্যান সেনগুপ্ত

নেতাজীনগর, কলকাতা

office.jpg

স্যার, আপনাকে অভিক রায় ডেকেছেন। ফ্লোরের পিয়ন এসে দাঁড়ায়।

-কে অভিক রায়? অনির্বাণের আজ প্রথম দিন নতুন অফিসে, ড্রয়িং হলে বসে একটু নিজের বইপত্র গুছিয়ে রাখছে, এমন সময় পিয়ন এসেছে।

আজ্ঞে সামনের চেম্বারে উনি বসেন। মালিকের ভাগ্নে।

-গেল তাহলে। এনার কাছেও কি ইন্টারভিউ দিতে হবে? ভিতরটা গুড়গুড় করে ওঠে। কেমন লোক হবে কে জানে? পাশের টেবিলে বসা ছেলেটি বলে- বেশি কিছু বলবেন না। শুধু শুনবেন। যান দেখে আসুন উনি কি বলেন। লোক খারাপ না।

ঢুকতেই অনির্বাণ দেখে অন্তত ছয় ফুট কয়েক ইঞ্চি লম্বা একটা মধ্য বয়েসি মানুষ টেবিলের ওপারে বসে আছে। ফরসা টিকলো নাক, এক মাথা কাল চুল পিছন দিকে উল্টানো। মুখে একটা পাইপ। এককথায় খাঁটি বাংলা সাহেব। গলাটাও বেশ ভারিক্কি। গলায় টাই, চেয়ারের পিছনে কোটটা ঝুলচ্ছে। চেম্বারে এদেরকেই মানায়। পিছনের তাকে অগুনতি মোটা মোটা বই। টেবিলে গাদাগুচ্ছের বই, কোড, খাতা, খুব মনোযোগ দিয়ে কিছু দেখছিলেন। অনির্বাণ দরজা ঠেলে ঢোকাতে সব থামিয়ে একগাল হাসি ঝুলিয়ে সাহেবি কায়দায় হাত বাড়িয়ে দিলেন। অভিক রায়। ওয়েলকাম টু আওয়ার অফিস। বসুন বসুন।

অনির্বাণ বসে পরে। চেহারায় আর উপস্থিতিতে একটা প্রছন্ন আভিজাত্য। দেখে বুঝতে পারে খুব গম্ভীর কোন সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত। আলাপ হয়। অভিক রায় হাল্কা হেসে বলেন- কেমন লাগছে? তেমন কিছু নয়, আপনি আজ জয়েন করেছেন শুনলাম তাই স্রেফ আলাপ করার জন্যে। এর আগে কোথায় ছিলেন?

অনির্বাণ উত্তর দেয়। সব সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এর বই চারিদিকে।

- নিশ্চয়ই আপনিও সিভিল ইঞ্জিনিয়ার?

অভিক রায় একটু ঘার বাঁকিয়ে বলে - ঠিক ধরেছেন। খাসা বিষয় কিন্তু। জানেন ত এ হল মাদার অফ ইঞ্জিনিয়ারিং?

মাথা নাড়ে অনির্বাণ।

এত নতুন নতুন কোম্পানি থাকতে এইখানে কি ভেবে?

অনির্বাণ বলে - অনেকদিনের ইচ্ছে ছিল এখানে জয়েন করবার। শুনেছি প্রচুর শেখবার আছে এখানে। আপনাদের লাইব্রেরিটা দেখলাম। দারুণ কালেকশন।

হ্যাঁ। সেটা ঠিক। ওনার মুখটা কঠিন হয়ে যায়। জানবেন, সব জানবেন, এসেছেন যখন। মালিকের সঙ্গে দেখা হয়েছে?

না। শুনেছি উনি এখানে নেই।

কিছুদিন যাক। এখন বাইরে গেছেন আসলে দেখা হবে।

মুখটা কাছে এনে বলে- ভীষণ কৃপণ লোক মশায়। মাইনে বাড়াতেই চায় না। বলে হাসতে থাকেন – ঠাট্টা করছিলাম। কিন্তু দেখবেন এরা সব সময় আপনাকে ভয়ে আর টেনশনে রাখবে।

কিরকম? অবাক হয়। ভয় কেন? কিসের ভয়? অনির্বাণ কিছুটা আশ্চর্য হয়। মালিকের সঙ্গে দেখা হয়নি কিন্তু শুনেছে উন্নীতও ভালই লোক।

- দেখবেন দেখবেন। ড্রয়িং ছাড়ার তাড়া, এস্টিমেসন এর তাড়া, ডিজাইন এর তাড়া, সবাই দেখবেন দৌড়াচ্ছে। না হলেই আর বছরে মাইনে বাড়বে না। কেউ সব সময় আপনার কাজ খেয়াল করে যাচ্ছে। কেমন ভাবে করছে আপনি জানেন না। বাইরে থেকে অনেক কিছু মনে হয়।

অনির্বাণ অবাক হয় তাই নাকি?

রাগ প্রকাশ করে ফ্যালেন। বুঝলেন, অনেকদিন ত আছি। আমাকে কেউ চিনল না। জানেন ত আপনাদের মালিক আমার মামা হন। উঠে পরে হাঁটতে থাকেন ঘরের মধ্যে। এই মামাই আমার বারটা বাজিয়ে দিয়েছে। আমার লাইফ বরবাদ করে দিল। অনির্বাণ কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। অভিক রায় একটার পর একটা সিগারেট খেয়ে যাচ্ছে। ভীষণ অস্থির। ঘরে চোখ বোলাতে বোলাতে অনির্বাণ দেখে ক্রিকেটের প্যাড, গ্লাভস পরে আছে।কথা ঘোরাবার জন্যে বলে- এগুলো এখানে? আপনি কি রেগুলার ক্রিকেট খেলেন?

ফিরে এসে নিজের জায়গায় বসেন। একটা স্নেহের হাসি হাসে অভিক রায়- তাই মনে হচ্ছে বুঝি? ওটা হচ্ছে প্রোটেকশনের জন্যে। ক্রিকেটের জন্যে নয়।

কি রকম?

জানেন ত মানুষ যা কিছু কাজ করে তার পিছনে কোথাও না কোথাও একটা ভয় কাজ করে? স্রেফ ভয়ে মশাই, ভয়ে।

কাকে ভয়- কিসের ভয় অনির্বাণ বোঝে না।

এবার রহস্য ভাঙ্গেন –মোটর সাইকেল কিনেছি মশায় বাড়ি আসা যাওয়ার জন্যে।

তার সঙ্গে ক্রিকেটের এগুলো? ঠিক বুঝতে পারলাম না।

বোঝেন নি ত? বাড়িতে অফিসে সবাই বলেছে এতে খুব রিস্ক রাস্তাঘাটে। খুব অ্যাকসিডেন্ট হয়। ব্যাস ভেবে বার করে ফেললাম উপায়। আমাকে কাত করা অত সোজা নয়।

কে ওনাকে কাত করতে চায়?। নতুন অফিসে এসে কি মুশকিল হল?

অনির্বাণ আস্তে করে জিজ্ঞাসা করে- কিরকম? কে কাত করবে আপনাকে?

অনেক শত্রু মশাই। কাউকে বিশ্বাস করা মুশকিল। না, না, আপনাকে বলছি না। কি করেছি জানেন? বলুন দেখি?

দেখুন আমি কেমন করে জানব। আপনিই বলুন।

সাদা খাতার পাতায় হিজিবিজি কাটতে কাটতে বলেন- হু! হু! একজন ড্রাইভার রেখেছি। সে চালায় আর আমি হেলমেট, প্যাড আর গ্লাভস পরে পিছনে। একদম নিশ্চিন্ত। বলুন কেমন দিয়েছি? মুচকি মুচকি হাসতে থাকেন অভিক রায়। কেন বলুন ত? সেই ভয়। অ্যাকসিডেন্টের ভয়। আঘাত লাগার ভয়। এখন আর আমার ভয় নেই। আয় কত অ্যাকসিডেন্ট হবি।

আর আপনার ড্রাইভার কিছু লাগিয়ে দিলে?

হেলমেট, প্যাড আর গ্লাভস এইগুলিই বাঁচিয়ে দেবে তখন।

অনির্বাণ চেয়ে থাকে লোকটাকে দেখেই ভয় লাগতে থাকে। একি স্বাভাবিক আচরণ? কে জানে? হঠাৎ মনে পড়ে ফ্লোর ম্যানেজার আস্তে বলেছিল। উঠে পড়ে। আজ আসি পরে দেখা হবে। হ্যাঁ, হ্যাঁ আসুন। নিজেই উঠে এগিয়ে দেয়। পরে কথা হবে। 

সময় যায়। আস্তে আস্তে অনির্বাণ বুঝতে পারে অভিক রায়কে অফিসে কোন কাজই করেন না। সবাই মালিকের ভাগ্নে বলে একটু দূরে দূরে থাকে। কাজও দিতে চায় না। মাঝে মাঝে ওনার ডিপ্রেশন হয় তখন মানুষটা ভীষণ গম্ভীর হয়ে থাকেন, মাঝে মাঝে কারণে অকারণে রেগে যান। আর রাগটা ওনার মামার ওপরই বেশি। কিন্তু সবাই বলে ওনার মামা ওনাকে আর ছোট বোনকে ভীষণই ভালবাসেন। এইরকম লোককে কে রাখবে? তাই উনি এখানেই এনে রেখেছেন নিজের চোখের সামনে। ডিপ্রেশনের সময় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া। বেশি বাড়াবাড়ি হলে সামাল দিতে নাকি মামাই করেন। কিন্তু মানুষটা অদ্ভুত। একটা অদ্ভুত জগতে থাকেন। অফিস এর লোকেরা বলাবলি করে অনির্বাণকে অভিক রায়ের খুব পছন্দ।

অভিক রায়ের দৃষ্টি ঘোলাটে হলেই অনির্বাণের মুশকিল। যখন তখন নতুন, নতুন বুদ্ধি নিয়ে হাজির হবেন। এই সেদিন, বস দিনের শুরুতে বলে গেছে আজ প্লান্ট রোডের ড্রয়িং ছাড়তেই হবে যে করেই হোক। সবে ড্রয়িং খুলে বসেছে অনির্বাণ, অনেক কিছু কাজ বাকি, কিকরে যাবে আজ ড্রয়িং কে জানে। সামনে এ্যানুয়াল ইঙ্ক্রিমেন্ট, আজ ড্রয়িং না গেলে গেল সব মান সম্মান। মালিকের ভাগ্নে বলে কথা। তারপর আবার মানসিক দিকে মাঝে মাঝেই আবার গন্ডগোলের। শুধু অনির্বাণকে উনি পছন্দ করেন বলে যত নতুন নতুন চিন্তা ভাবনাগুলো, ওকেই বলেন। মাঝেমাঝে যখন উদ্বেলিত হয় মন, যখন মনে হয় ওনাকে কেউ চাইছে না, যখন ঘুম কম হয়, ঘুমের ওষুধ খেতে হয় তখন মাঝে মাঝেই সামান্য কারণেই রেগে ওঠেন। অফিসের বেশিরভাগ লোকে তখন এড়িয়েই চলতে পছন্দ করে। ঠিক এমনি এক অভিশপ্ত দিনেই সকাল বেলা দরজা খুলে যায়।

আসতে পারি? চেম্বার এর দরজায় অভিক রায়ের হাসি হাসি মুখ।

আসুন, আসুন। মনে ভয় ঘনাতে থাকে অনির্বাণের। আবার কি গল্প নিয়ে এল কে জানে।

বুঝলেন-বলে হাতের সিগারেট বাক্সটা টেবিলের ওপর রেখে অদ্ভুত ঘোলাটে দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন। তারপর হেসে বললেন- কি ভাবে আসেন?

এই রহস্য বোঝা মুশকিল- মানে? কোথায়? অফিস? বাসে।

অভিক মুচকি হাসে। মাথায় একটা দারুণ প্ল্যান এসেছে। আপনাকে বলতে পারি যদি কথা দেন আপনি এখুনি কাউকে না বলবেন না। যদিও রিপোর্ট জমা হলে অবশ্য লোকে জানবেই।

অনির্বাণ বুঝতে পারেনা এবার আবার কি প্লান নিয়ে এলেন। ডিপ্রেশনের রোগী, মাথায় নানা রকম উদ্ভাবনী প্ল্যান নিয়ে ঘোরেন। যারা চাকরী করে এখানে তারা সময় করে ওনার কথা শুনতে হয়। না শুনলে চাকরীর ভয়। উনি কিছু করেন না কিন্তু অন্যদের অফিসের কাজ ঠিক সময় না করলে বিপদ।

মুখে বলে-বলুন, বলুন। আমি আর কাকে বলব?

এই ধরুন শহীদ মিনার, ওই ইন্সপিরেশন টাওয়ার, সাউথসিটি টাওয়ার, হাইল্যান্ড টাওয়ার, আরো আছে। এগুলোকে বুঝলেন শুধু শুধু দাঁড়িয়ে থাকলেই ত হবে না।

কি করতে চান? ছুঁড়ে দ্যায় অনির্বাণ। এইবার খোলসা করে –এই যে আপনারা এত কষ্ট করে দক্ষিণ থেকে উত্তর যাতায়াত করেন এর একটা সহজ সুন্দর উপায় বার করেছি বাস ট্রাম কে বাদ দিয়ে।

সেকি? চমৎকৃত অনির্বাণ নড়েচড়ে বসে। শুনি শুনি।

এই উঁচু উঁচু বাড়ীগুলোকে কাজে লাগিয়ে যাতায়াতের একটা আকাশপথ বার করেছি। বলেন কি মশায়? কি ভাবে?

সে আবার কোন যান্ত্রিক সাহায্য ছাড়াই। এইটুকু বলেই কেমন দিয়েছি দেখ মতন একটা অপার্থিব দৃষ্টি মেলে ধরে আঙ্গুল দিয়ে টরেটক্কা করে টেবিল বাজাতে থাকেন অভিক রায়।

বলেন কি? তাহলে এত তেল খরচা, এত পরিবেশ দূষণ, এমন কি এই ঝুলে ঝুলে বাসে ট্রামে যাওয়া সব শেষ?

অফিস যাওয়াটা মশাই হবে কেবল কারে বেড়াতে যাওয়ার মত নির্মল বাতাস খেতে খেতে। অনির্বাণ এবার আর থাকতে পারে না। রহস্য করবেন না মশাই। জানি আপনি অনেক কিছু ভাবতে পারেন যা আমরা পারিনা। তাই বলে এই রকম? করেছেন কি? করতে পারলে ত মশাই নোবেল আপনার পকেটে। এই শতকের শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার। শুনি শুনি খুলে বলুন দেখি। মুচকি মুচকি হাসতে থাকেন অভিক রায়। একটা রিপোর্ট আকারে জমা দেব সরকারের ঘরে। তার আগে শুধু আপনাকেই বললাম।

একটু খুলে।

এই ধরুন কপিকল দেখেছেন? তেমনি আপনি শহরের বিভিন্ন উঁচু বাড়ীর ছাদে উঠবেন একটা বাকেটে করে আর উল্টো দিকে আরেকদিকে আরেকটা বাকেটে লোকে নামবে ছাদ থেকে মাটিতে। শুধু নামার দিকের বাকেটটা একটু বেশি ভারী হবে। নামার ওজনই নিচের বাকেট কে ওপরে ঠেলে তুলবে। বলুন বুদ্ধিটা কেমন?

আর তারপর?

এই ছাদ থেকে দুরের অন্য টাওয়ারের নিচে গিয়ে কেবল কার গিয়ে নামিয়ে লোক পৌঁছে দেবে উত্তর থেকে দক্ষিণে বাস। কোন মোটর নেই, কোন বিদ্যুৎতের ব্যবহার নেই, যান্ত্রিক সুবিধা শুধু দিয়ে যাতায়াত ওঠাপড়া।

অনির্বাণ রূপকথার জগতে পৌঁছে যায় বলে- তাহলে শুরুতে প্রথম বাকেট উঠবে কি করে? উঠবে, উঠবে বন্ধু। মুচকি হেসে অভিক অনির্বাণের কাঁধে হাত রাখেন। - হয় কিছু লোক একবারের জন্যে লিফটে করে ওপরে গিয়ে চেন এর ওপর দিকে ওজন বাড়িয়ে নেমে আসবে আর অন্য দিকের বাকেটকে ওপরে তুলে দেবে আর সেখান থেকে নিজেদের ইচ্ছে মত দিকে কেবল কারে চড়ে চলে যেতে পারবেন। আমি দু একটা স্কেচও করেছি সুন্দর করে বোঝানর জন্যে।

অনির্বাণ দুহাতে হাততালি দিয়ে ওঠে। এত সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার। তাহলে বাস ট্রাম ত রায়মশাই লাগবেই না ।কি বলেন?

অভিক রায় – কিছুটা গম্ভীর হয়ে যান। ঠিকই বলেছেন। এরপর ভাবছি মাটিতে অনেক গাছপালা লাগিয়ে সবুজায়ন করে শহরটা বাঁচানোর চেষ্টা করব।

অনির্বাণ অভিক রায়ের বুদ্ধির তারিফ না করে পারেন না। আজকের দিনটা যখন গেছেই তখন একটু খুঁচিয়ে তোলে অভিক রায়কে। চিড়িয়াখানার পশুদের তাহলে ময়দানের মাঠে ছেড়ে দিলে কেমন হয়? ওরাও হেসে খেলে চড়ে বেড়াতে পারে। আগামী প্রজন্ম জঙ্গল সাফারি করতে পারবে। আর কেব্‌ল কারে করে যেতে যেতে নীচে সব জীবজন্তু দেখতে দেখতে মানুষ যাবে। বলুন কেমন জমে যাবে?

অভিক রায় একটু সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে অনির্বাণকে দেখেন। একটু গম্ভীর হয়ে যান, বলেন-বলছেন যখন ভেবে দেখি। সেরকম হলে দ্বিতীয় পর্যায় রিপোর্টে জমা দেবার সময় ভাবব। চলি বুঝলেন, আমার নাওয়া খাওয়ার সময় নেই। মুখের সামনে পরে থাকা চুলগুলো আঙ্গুল দিয়ে সড়াতে সড়াতে উঠে পড়েন আর বসেন না, অনির্বাণ ছাড়া পেয়ে ড্রয়িং দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

দুদিন অভিক রায়ের দেখা নেই অফিসে। আবার একদিন দরজা খুলে যায়- আসতে পারি? ঢুকেই চুপ করে কিছুক্ষণ বসে থাকেন। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করেন- বলুন ত আপনার কখনো মনে হয়েছে আপনাকে কেউ অনুসরণ করছে?

ড্রয়িং থেকে মাথা তুলে অনির্বাণ হাসে- না তো। সেরকম কোনদিন তো মনে হয়নি।

কেন বলুন ত?

আমার ত মনে হচ্ছে সব সময়ে।

ব্যাপারটা একটু গম্ভীর মনে হয়। – একটু খুলে বলবেন? কেউ কি আপনাকে ফলো করছে?

অভিক বলে- আমি কিন্তু সম্পূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থায় বলছি। আপনি বিশ্বাস করবেন কিনা জানিনা। কিছুদিন যাবদ রাস্তায়, দোকানে বেরোলেই মাঝে মাঝে পিছন ঘুরে দেখি। মনে হয় সবসময় আমার কেউ পিছু নিয়েছে ।

আপনি তাকে দেখেছেন কখনো ?

না।

একটা কথা জিজ্ঞাসা করব?

বলুন।

কেন আপনাকে ফলো করবে কেউ? এটা ভেবেছেন কি? কি স্বার্থ তার?

চোখের কোনে কালি, ঘোলাটে চাহনি, একটা চাপা গর্ব মুখে। এখনো বোঝেন নি? রিপোর্ট মশাই, ওটা হাতিয়ে নেবার জন্যে?

কোন রিপোর্ট?

মাথা ঝাঁকাতে থাকে অভিক রায়। ইসস এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলে চলবে? ওই যে বলেছিলাম আপনাকে আমার কলকাতার আগামী দিনের যানবাহন নিয়ে চিন্তাধারাটা? রোজ বাড়ী ফিরে আলমারি খুলে একবার দেখে নেই আছে কিনা? চুরি যাবার খুব সম্ভাবনা।

অনির্বাণ ভাবতে থাকে - সর্বনাশ। এবার বোধহয় অসুস্থতাটা বেশীই হয়েছে। ওকে কেন কেউ ফলো করবে?

আর কয়েকদিন পরেই জমা দেব। মনে হয় আপনি ছাড়া আর কেউ ব্যাপারটা জানতে পেরেছে। আপনি কাউকে বলেছেন নাকি? ওটার জন্যে যে কেউ লড়ে যাবে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন অভিক রায়।

অনির্বাণের গলা শুকিয়ে আসে, তোতলে যায়, বলে আমি তো কাউকে কিছু বলিনি। 

– কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম, ঠান্ডা ঘরেও ভিতরের জামা ভিজে ওঠে। কিছুটা সময়ের জন্যে চোখের দৃষ্টিতে অবিশ্বাস এসেই আবার মিলিয়ে যায়।

অভিক রায় গলা নামিয়ে মুখ এগিয়ে বলে- আপনি ও সাবধানে থাকবেন। উঠে গিয়ে ঘরের দরজাটা বন্ধ করে ফিরে আসে। কাউক বলবেন না। চারিদিকে খেয়াল রাখবেন। রাস্তা দিয়ে যাবার সময় মাঝে মাঝে পিছন ফিরে দেখবেন। আমার ধারণা কারুর উপস্থিতি টের পাবেন।

আপাতত বাড়ি খালি। রাখী ওর মেয়ে ঝিনুককে নিয়ে বাপের বাড়ি গেছে। ড্রাইভার ও দেশে গেছে। অফিস যেতে একটা উবের ডেকে নেয় অনির্বাণ। ওদের কাছে টাকা গচ্ছিত আছে পকেট থেকে টাকা দিতে হয়না।অফিসে এসে বাড়ির ট্যাক্স, মেয়ের স্কুলের এর ফিস, ইলেকট্রিক বিল দিয়েছে। প্রথম বেলা কেটে যায় শুধু মিটিং করে। দুপুরে অর্ডার করে খাবার আনিয়েছে। সন্ধ্যেবেলা বেড়িয়ে প্রথম রাখীর ওষুধ, তারপর মানস এর সঙ্গে দেখা কফি শপে বসে আড্ডা, তারপর উবের ডেকে বাড়ি ফিরে আসে। রাত্রে খেতে বসে মনে হয় দিনকাল কত এগিয়ে গেছে। আজকাল টাকা পয়সা না থাকলেও দিব্বি সারাদিনের কাজকর্ম করে বাড়ি ফিরে আসা যায়। যেমন আজ মানিব্যাগটা রাখতে গিয়ে মনে হল আজ পকেট থেকে কোন ক্যাশ দিতেই হয়নি। রাখী ফোন করে-খেয়েছ? কোথায় কি রাখা আছে বলে দেয়। রাখী অন্য কথায় যায়। অ্যাই শোন বাবা বলছে ব্যাঙ্কের সব পাসওয়ার্ডগুলো পালটে ফেল।

চমকে ওঠে, সেকি? কেন? সে তো ভীষণ ব্যাপার। পরে করা যাবে এখন। তাড়া আছে কি? রাখীর বাবা পুলিশে চাকরী করেন। খবর রাখেন অনেক কিছু।

রাখী বলে। জান আজ আমাকে একটা অভূত ফোন এসেছিল। প্রথমে বলে সে ব্যাংক থেকে বলছে। তারপর বলছে আমাদের যে স্টেটব্যাংক এর এটিএম কার্ড আছে সেটা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ওরা সেটা চালু করবে তাই পাসওয়ার্ডটা দিতে হবে।

এ্যাঁ! তারপর তুমি কি বললে?

আরে আমাদের ত স্টেটব্যাংকের এটিএম কার্ডই নেই। যেই বললাম ওটা আমাদের নেই সঙ্গে সঙ্গে ছেড়ে দিল। তাই বাবা বলছিল যেহেতু সব জয়েন্ট একাউন্ট তাই পালটে ফেলাই ভাল। আর জানিতো এরকম কিছু আজেবাজে লোক পাসওয়ার্ড জেনে টাকা তুলে নিচ্ছে।

অনির্বাণ একটু নিশ্চিন্ত হয়। বলে-যাক বাঁচালে। এরপর এরকম ফোন এলে আমাকে ফোন করতে বল।

বাবা বলছিল আমাদের সামনের দাসবাবুর এইভাবে অনেক টাকা মার গেছে। শেষে ব্যাংক একাউন্ট বন্ধ করে বাঁচে। ঠিক আছে আমি ব্যাংকেরটা আমি আজই পালটে দেব। রাখীর সঙ্গে ফোনে কথা বলে খেয়ে উঠে মোবাইলটা নিয়ে বসে। মেলবক্সে দিকে তাকিয়ে দেখে অনেক প্রাইভেট মেল এসে রয়েছে। প্রথমটা উবেরের সকালে অফিস যাবার, এর রসিদ, পরেরটা মেয়ের স্কুল এর মাইনে জমা দেবার রসিদ, তারপর খাবার এর, ওষুধের, কফির এবং আবার বাড়ি ফেরার উবেরের রসিদ। তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে হয় তাহলে রসিদগুলো থেকে কিন্তু বোঝা যাচ্ছে সকালে কখন ও কোথায় কখন গেছে, কোথা থেকে কি খেয়েছে, কোথা থেকে ওষুধ কিনেছে, কি কিনেছে, কোথা থেকে কফি খেয়েছে, কখন বাড়ি ফিরেছে। তাহলে তো মোবাইল সার্ভারের ঘরে ওর সারাদিনের গতিবিধি লুকিয়ে আছে, ওর ব্যাংক এর ডিটেল লুকিয়ে আছে। বুকের মধ্যে হঠাৎ ঠাণ্ডা শিরশিরানি অনুভব হয়। এরপর মনের অন্য দরজা খুলে যায় তাহলে তো ওর ব্যাংক একাউন্টও কারুর কাছে খোলা খাতার মত। যে ওর এক নবের আঁচড়ে টাকা এখান থেকে ওখানে পাঠিয়ে দিচ্ছে সে নিশ্চয় ওর জমানো টাকার ফিক্সড ডিপোজিট আর মিউচুয়াল ফান্ডের সব হদিস জানে। জানবে ত বটেই, মনে পড়ে মিউচুয়াল ফান্ডের মাসিক জমানো তো ওর অজান্তেই কেটে নেয় ব্যাঙ্ক। ব্যাংক থেকে সার্ভার হয়ে তার কাছে মেসেজ আসে। অনেকেই তার একাউন্ট দেখতে পায়। তাহলে যেকোনো দিন একাউন্ট খালি হয়ে গেলে কাকে ধরবে অনির্বাণ? গলা শুকিয়ে আসে। ঠাণ্ডা ঘরের মধ্যেই কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে থাকে। অনেকদিন থেকেই তো এই ভাবে চলছে কোনদিন তো এমন করে মনে হয়নি। খালি বাড়িতে নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগতে থাকে। এদিক ওদিক অনির্বাণ তাকাতে থাকে। পাশের ঘরে মনেহয় কেউ ঘোরাঘুরি করছে। তাহলে তো ওর চলাফেরা, কেনাকাটা, খাওয়াদাওয়া, সবই কারুর নজরে এর মধ্যে আছে? কে সে? যে সব দেখছে দূর থেকে মেঘনাদের মত।

অভিক রায়ের কথা মনে পরে যায়। কেউ আপনাকে ফলো করছে। যার হাত থেকে আমাদের মুক্তি নেই। লুকোবার কিছু নেই। দম বন্ধ হয়ে আসছে, বারান্দায় এসে দাঁড়ায় অনির্বাণ জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে থাকে। মনে হতে থাকে দূরে ফুটপাতে কেউ যেন দাঁড়িয়ে ওকে দেখছে।

বেঁচে থাকার গান

জুন ২০২০ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

গল্প

বেঁচে

থাকার গান

সুশোভন দাশ

ফিনল্যান্ড

misc.jpeg

ভার-ব্রিজের নীচে এক তাল দলা পাকানো কাদার মতো শুয়ে আছে প্রায় জনা পঞ্চাশেক শ্রমিক। তাদের দেহে স্পন্দনের নূন্যতম আন্দোলনটুকুও যেন হারিয়ে গেছে। অনেকের খালি গা আবার অনেকের গায়ে জামা বা গেঞ্জি জাতীয় কিছু আছে। কিন্তু দূর থেকে তাদের জামা ও গায়ের রঙ মাটির সাথে একেবারে মিশে গিয়ে আলাদা করার এতোটুকুও সুযোগ রাখেনি। স্ট্রীট ল্যাম্পের আলো সরাসরি তাদেরকে ছুঁতে পারেনি। আবছা অন্ধকারে বহুদিন চাপা পড়ে থাকা ঘাসের মতো ফ্যাকাশে আবরণ তাদেরকে ঢেকে রেখেছে। মাটিতে কান পাতলে অনেক দুরের শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। এখানেও তার অন্যথা হল না কিন্তু যে শব্দ শুনতে পাওয়া গেল তা সেই ঘুমন্ত শ্রমিকদের সম্মিলিত হৃদস্পন্দন নয়। তা তাদের আগামী দিনের চিন্তার; না না, দুশ্চিন্তার চিৎকার। সেই চিৎকারে নেই কোনো বাহুল্যতা, নেই কোনো সুবিধাবাদীদের সুযোগ বাড়ানোর অজুহাত, নেই কোনো স্বপ্ন পূরণের স্বার্থপরতা। শুধু আছে বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে মানুষের আদিম চাহিদা খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থানের লড়াই।

ভোরের আলো পূব আকাশের অন্ধকার চিরে বেরিয়ে আসতেই সেই কাদার তালে লেগে গেল এক ক্ষিপ্র চঞ্চলতা। ক্ষণকালের জন্য কিছুটা বিক্ষিপ্ত ভাবে ছড়িয়ে পড়ে আবার তারা একজায়গায় জড়ো হয়ে বসল। ফাগুনের আগুন এখনো অতোটা তীব্র হয় নি। কিন্তু ভোরের আলোয় তাদের গা থেকে চুঁইয়ে পড়া পোড়া তামাটে রঙ অনেক আগুনের সাক্ষ্য প্রমাণ দিচ্ছে। নিষ্পলক চোখে একটা অজানা আশঙ্কা জমাট বেঁধে থমকে গেছে ঠিক যেমন ঝড়ের আগের নিষ্প্রাণ নীরবতা। ভোরের আলো লিখে দেয় এক নতুন দিনের সূচনা, এঁকে দেয় আশায় ভরা জলছবি। কিন্তু এখানে নতুন দিনে সূচনায় কে যেন থাবা বসিয়েছে জলছবিতে। আঁচড়গুলো এতটাই গভীর যে ভবিষ্যতের দিনের উপরেও তার দাগ রাখতে উদ্ধত। কপালের প্রতিটা ভাঁজে ভাঁজে তাদের একটাই প্রশ্ন-বেঁচে থাকার লড়াইয়ে এবার কি হাতিয়ার ফেলে আত্মসমর্পণ করতে হবে?

সকাল সাতটায় গির্জার ঘণ্টা বাজার একটু পরেই প্যান্ট-শার্ট পড়া এক ভদ্রলোক মুখ-নাক একটা মাস্কে ঢেকে শ্রমিকদের থেকে প্রায় দশ হাত দূরে দাঁড়িয়ে যা বললেন তা আক্ষরিক অর্থে- ‘করোনা নামক এক সংক্রামিত রোগের কারণে এখানের কাজ আপাতত এক মাসের জন্য স্থগিত থাকবে। তবে পরিস্থিতি দেখে এর মেয়াদ আরো দীর্ঘায়ীত হতে পারে। তোমাদের যা পাওনা তা অফিস রুমে এসে নিয়ে যাও।‘

একটা গুঞ্জন ধীরে ধীরে বাড়তে থাকল। তাদের মাঝ থেকে এক যুবক দাঁড়িয়ে প্রতিবাদী ভঙ্গিতে জিজ্ঞাসা করল,- ‘কিন্তু আমাদের এখানে আনা হয়েছিল ছ’মাসের কাজ আছে বলে। তিন মাসও হল না তার মধ্যে আমাদের এমন ভাবে কাজ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে কেন?’

ভদ্রলোকটি এবার মুখ থেকে মাস্কটা সরিয়ে বললেন,- ‘এখানে কাজ বন্ধ থাকবে। কাউকে কাজ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে না। কিন্তু যদি কাজটাই না থাকে তাহলে তোমাদের মুখ দেখে তো আর কেউ টাকা দেবে না। আর কাজটা কোম্পানি বন্ধ করছে না, একেবারে প্রধানমন্ত্রী-মুখ্যমন্ত্রী থেকে অর্ডার এসেছে।‘ কথাগুলো বলেই ভদ্রলোক মাস্কটা আবার মুখে আটকে নিয়ে উল্টো দিকে হাঁটা দিলেন। গুঞ্জনটা একটা সোরগোলে পরিণত হল আর একে একে তা একটা লাইন করে অফিসের দিকে এগোল।

প্রায় আড়াই হাজার টাকা পেল সুধীর। খুচরোগুলো জামার পকেটে রেখে দুটো কড়কড়ে দু-হাজার টাকার নোট সঞ্চিত টাকার বান্ডিলে মুড়ে চোরা পকেটে চালান করে দিল। টাকা নিয়ে সবাই এদিক-ওদিক ছড়িয়ে পড়ল। বাঁধাধরা এক চায়ের দোকানের দোকানী অনেকটা বেলা করেই তার দোকান খুলল আজ। অন্যান্য দিন কাজের তাড়া আর ওভার টাইমের জন্য বলে সুধীর খুব বেশি সময় কাটায়নি এখানে। আজ আর কাজের কোনো তাড়া নেই তাই সকালের জল-খাবারের জন্যেও দোকানীকে বলল। কয়েক মিনিট পর দুটো সেঁকা পাঁউরুটি আর এক কাপ চা প্লেটে করে এগিয়ে দিল তার দিকে। সুধীরের সাথে আরো অনেকেই সেখানে খেতে এসে গল্প করছিল, কিন্তু টিভির সংবাদ দেখে তারা সবাই হঠাৎ চুপ করে গেল। সারা দেশে লকডাউন। বাস-ট্রেন কিছুই চলবে না। অন্যান্য দেশের মানুষের মুখে মাস্ক ঠিক যেমনটা আজ সকালে ওই ভদ্রলোকের মুখে ছিল। অনেক মানুষ মরে যাচ্ছে। বিশ্বের তাবড় তাবড় দেশের মাথারাও খুব আতঙ্কে আছে। তাদের মধ্যে চীন ও ইতালির নাম বার বার করে বলছে। আর যে কথাটা সব থেকে বেশি বার শুনল তা হল করোনা ভাইরাস।

চা-খাবার শেষ করে সবাই বাস স্টপে এলো। অন্যান্য দিন রাস্তায় বাস-লরির অভাব হয় না কিন্তু আজ কিছু খাম-খেয়ালী ট্যাক্সি আর বাইক ছাড়া অন্যকিছু চোখে পড়ল না। একটা ট্যাক্সিকে দাঁড় করিয়ে সুধীর হাওড়া যাওয়ার কথা বলতে ড্রাইভার বলল,- ‘হাওড়া প্রায় আট-দশ ঘন্টার রাস্তা। এই বন্ধের বাজারে একেবারেই না। পাঁচ-দশ কিমির মধ্যে হলে বলুন নিয়ে যেতে পারি।’ সুধীর আর কথা বাড়াল না। মনে মনে ভাবল,- ‘পাঁচ-দশ কিমি হলে আমি নিজেই হেঁটে চলে যেতাম।‘ এলাকার দেড়-দু কিলোমিটারের মধ্যে একটা বড় বাস টার্মিনাল আছে। সবাই সেই বাস স্টপের দিকে হাঁটা দিল। এখানে অনেক মানুষ ভিড় করে আছে টিকিট কাউন্টারের সামনে। চেঁচামেচি করছে তাদের টিকিট নিয়ে। কিন্তু একটা বাসও আজ ছাড়ছে না। একটা টিভি দোকানের বাইরে দাঁড়িয়ে দেখল কলকাতায় পুলিশ নামিয়েছে। লোকজন বাইরে বেরোলেই পুলিশ লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছে আর তাড়া করছে। সারা রাজ্যেই নাকি এমন পুলিশ নামিয়ে দেবে। টিভিতে এমন পরিস্থিতি দেখে তার সবাই একে অন্যের মুখের দিকে তাকাল। কয়েক জন বলে উঠল, - এখানে আটকে গেলে থেকে যাব এখানে। বাড়ির বাইরে থাকা, এ আর নতুন কিছু নয় আমাদের কাছে।‘

সুধীর এখানে চুপ করে সবার কথা শুনল আর মনে মনে বেশ প্রমাদ গুনলো। সে প্রতি মাসে একদিন ছুটি নিয়ে বাড়ি আসে টাকা দিতে। বাড়িতে তার মা বৌ ও চার মাসের মেয়ে। বৌয়ের পক্ষে এখন অন্যের বাড়িতে কাজ করা একেবারেই অসম্ভব। তাই টাকা তাদের হাতে না দিলে তারা না খেয়েই মারা যাবে। যে ভাবেই হোক হাওড়া পৌঁছাতে পারলে বাড়ি ফেরার একটা আশা থাকে। না হলে যে কি হবে, তা তার চিন্তার বাইরে। অনেকে ঠিক করল হাইওয়ে ধরে হাঁটা দেবে বাড়ির উদ্দেশ্যে। কিন্তু সবাই একমত হল না। বাস-লরির অপেক্ষায় কিছুজন বাস টার্মিনালে থেকে গেল আর বাকিরা হাঁটা শুরু করল হাইওয়ে ধরে। সুধীরও হাঁটা দিল তাদের সাথে। একটু পরেই সূর্য মাঝ আকাশে এলো। অনেকেই এর মধ্যে ক্লান্ত হয়ে হাঁটার সিদ্ধান্ত থেকে সরে গিয়ে আবার বাস টার্মিনালে ফিরে যাওয়ার কথা ভাবছে। তিন কিলোমিটার পথও হেঁটে আসেনি এখনো আর এর মধ্যেই সব উল্টো সুরে গান ধরেছে দেখে সুধীরের বেশ রাগ হল। কয়েকবার একটু জোর গলায়,- ‘না না বাড়ি ফিরতেই হবে থামলে হবে না’ বলায় অনেকেই তাকে পাল্টা মেজাজ দেখিয়ে বলল,- ‘তোর এতোই যদি দম থাকে তাহলে না হেঁটে তুই দৌড়ে বাড়ি যা। আমরা ভাবছি বাস টার্মিনালেই ফিরে যাব’।

রাস্তার পাশে একটা ছোটো ধাবা দেখে সবাই সেখানে ঢুকলো একটু কিছু খেয়ে নেওয়ার জন্য। সুধীর একটু ইতঃস্তত করে ধাবার পাশের দোকান থেকে এক প্যাকেট মুড়ি কিনে গলার গামছার সাথে বেঁধে নিল। সবাই অল্প-বিস্তর কিছু খাবারের অর্ডার দিয়েছে ধাবায়। কিন্তু সুধীর কিছু অর্ডার না দিয়ে খাটিয়ার ধারে চুপ করে পা ঝুলিয়ে বসে আছে। তাদেরই দলের একজন বয়স্ক মানুষ সুধীরকে বলল,- ‘একটু কিছু খেয়ে নে। না হলে হেঁটে বাস টার্মিনালেও ফিরতে পারবি না।’

সুধীর মুখ নীচু করেই ঘাড় নাড়তে নাড়তে বলল,- ‘আমি বাস টার্মিনালে ফিরে যাব না।‘ ইতি মধ্যে এক ট্রাক ড্রাইভার ও তার সঙ্গী ভালো করে খেয়ে লুঙ্গিতে হাত মুছতে মুছতে নিজেদের মাল বোঝাই করা লরির দিকে গেল। ধাবার সামনের খোলা জায়গায় একরাশ ধুলো উড়িয়ে চারদিক অন্ধকার করে বড় রাস্তায় উঠল। ছোটো গাড়িগুলো পাকা রাস্তা পেলেই গতি বাড়িয়ে দেয় কিন্তু মাল বোঝাই করা এতো বড় লরি পাকা রাস্তাতেও বেশ ধুঁকিয়ে ধুঁকিয়ে চলতে লাগল। ধাবার সবাই সেদিকে লক্ষ্য না দিয়ে নিজের নিজের কাজ ও গল্পে মেতে রইল। কিন্তু এর মাঝেই হঠাৎই একটা ঘটনা ঘটে গেল। পাকা রাস্তা ধরে লরিটা একটু এগোতেই সুধীর দৌড়ে গিয়ে লরির পিছনে মাল বেঁধে রাখা দড়ির সাথে ঝুলে গেল। তারপর ধীরে ধীরে দড়ি ধরে একেবারে লরির উপরে গিয়ে শুয়ে পড়ল। যে বয়স্ক লোকটা সুধীরকে খাওয়ার কথা বলছিল সে হতভম্ব হয়ে ‘সুধীর চলে গেল চলে গেল’ বলে চিৎকার করে উঠল। তার চিৎকারে সবাই এদিক-ওদিক দেখে বুঝল সুধীর নেই। তারপর লোকটার কাছে সুধীরের দৌড়ে লরির পিছনে উঠে যাওয়ার কথা শুনে সবাই রাস্তার ধারে এসে লরিটাকে দেখার চেষ্টা করল। ততক্ষণে লরি বাঁক পার হয়ে হাইওয়ে ধরে নিয়েছে। আর দূর থেকে লরির মাথায় কেউ আছে তা বোঝাই গেল না।

লরির গতি খুব একটা বেশি না হলেও ফাঁকা মাথার উপর হাওয়া সুধীরকে বেশ নাজেহাল করে দিল। মাথার উপর সূর্যের তাপ প্রখর তবু সে নিজের শরীরে খুব ঠান্ডা অনুভব করল। দুপুরে কিছু খাওয়া হয়নি তার তাই খিদেটাও বেশ জোরে লেগেছে। ধাবায় বয়স্ক লোকটার কথা তার খুব মনে পড়ল। একটু কিছু খেয়ে নিলে তখন ভালই হত। কিন্তু খেতে গেলে এই লরিটা আর ধরা যেত না। তার ব্যাগের ভিতর মুড়ি আছে কিন্তু লরির ছাদে শুয়ে শুয়ে কি ভাবে খাবে তা বুঝে পেল না। এই অবস্থায় মুড়ি বের করলে হাওয়ায় উড়ে যাবে সবটাই। পেটে কিছুই যাবে না। খাওয়ার চিন্তা বাদ দিয়ে বাড়ির কথা ভাবতেই সকালের খবরের দৃশ্যগুলো তার চোখের সামনে ভেসে উঠল। মাথা তুলে রাস্তার দিকে তাকিয়ে সে কিছুই বুঝল না। লরি হাইওয়ে ধরে ছুটে চলেছে। আশে-পাশে দোকান-প্রসারী বলতে কিছুই নেই। দু-একটা গাড়ি হুস-হুস শব্দ করে তার পাশ দিয়ে চলে গেল। তাড়াতাড়ি করে সে মাথা নামিয়ে নিল। সময় যত কাটছে তার ততই ঠান্ডা লাগছে। নিজের ব্যাগ থেকে চাদরটা কোনো ভাবে বের করে মাথা-গলার সাথে খুব ভাল করে বেঁধে নিল ঠান্ডা হাওয়া আটকানোর জন্য। কিন্তু পেটের খিদে তার শরীরকে ক্রমশ আরো ঠান্ডা করে দিচ্ছে।

হঠাৎ করে লরিটা একটা জায়গায় থেমে গেল। উঁকি মেরে সে দেখল জায়গাটা একেবারে ফাঁকা। কোনো টোল ট্যাক্স বা পুলিশের রাস্তা আটকানো নয়। এই সময় লরির ড্রাইভার ও খালাসী লরি থেকে নেমে রাস্তার ধারে খালের কাছে নেমে গেল। মিনিট দু-তিন পর তারা আবার লরিতে ফিরে এলো। এই অল্প সময়টুকুর মধ্যে সুধীর তাড়াতাড়ি করে নিজের ব্যাগ থেকে মুড়ি বের করে গোগ্রাসে যতটা পারল খেয়ে জলের বোতল থেকে একটু জল নিয়ে গলাটা ভিজিয়ে নিল। অনেকটা সুস্থ বোধ করছে সে এখন। বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা নেমেছে। লরির ছাদে শুয়ে শুয়ে ভাবল- এইভাবে হাওড়া পর্যন্ত চলে গেলে মাঝ রাতের মধ্যে সে বাড়ি ঢুকে যাবে। এমন সময় সে বুঝল লরি এবার ধীরে ধীরে গতি কমিয়ে দিয়ে খুব ধীরে ধীরে এগোচ্ছে। মাথা তুলে দেখল সামনে টোল ট্যাক্স। এখানে ক্যামেরা থাকে। যদি ধরা পড়ে তাহলে এখুনি তাকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে। একবার ভাবল সে লরি থেকে নেমে হেঁটে রাস্তার পাশ দিয়ে টোল ট্যাক্স পার হয়ে যাবে। পরক্ষণেই ভাবল একবার যদি লরি থেকে নামে তাহলে আর সে লরিতে উঠতে পারবে না। সাত-পাঁচ ভেবে সে নিজের চাদরটা দিয়ে আপাদমস্তক ঢেকে একেবারে মড়ার মতো শুয়ে রইল। কতক্ষণ সে এভাবে ছিল জানে না। লরির গতি যখন আবার বাড়ল তখন সে মুখের উপর থেকে চাদর সরিয়ে আকাশের তারা দেখতে পেল।

টোল ট্যাক্স পেরিয়ে একটু সময় যেতে না যেতেই লরি হাইওয়ে থেকে নেমে একটা ধাবার সামনে দাঁড়াল। ড্রাইভার ও খালাসী যথারীতি একসাথে নেমে ধাবায় ঢুকলো খাবারের জন্য। একটু সুযোগ বুঝে সুধীর লরি থেকে নেমে বোতলে জল ভরতে এলো। ধাবার টিভিতে এবার খবর দেখে তার হাত-পা অসাড় হয়ে গেল। পুলিশ নেমেছে সব জায়গায়। একটা শ্রমিকের দলকে আটক করে তাদের উপর কীটনাশক ছড়ানো হচ্ছে। এক পলকে সেই শ্রমিকের দল দেখে সুধীরের চিনতে ভুল হল না। এই দলটা থেকেই সে সকালে ছিটকে বেরিয়ে এসেছে। জল ভরে নিয়ে লরির পিছনের অন্ধকারে গা ঢাকা দিল সে। সেখানেই সে আরো কিছুটা মুড়ি আর জল খেয়ে লরির উপর খুব সাবধানে উঠে শুয়ে পড়ল। টিভির সংবাদ, বাড়ির চিন্তা আর সারাদিনের ক্লান্তিতে কখন যে তার চোখ বুজে এসেছিল তা সে টের পায়নি। কতক্ষণ সময় কেটে গেছে তার কোনো হদিস ছিল না তার। হঠাৎ লরি চলা শুরু করার ঝাঁকুনিতে তার ঘুম ভাঙল। দু-হাত দিয়ে দড়ি শক্ত করে ধরল। ঝাঁকুনি আর ঠান্ডা হাওয়ায় তার ঘুম কেটে গেল। আর বেশি পথ বাকি নেই। টিভিতে পুলিশের কর্মক্ষমতা দেখে সে বুঝে গেছে হাওড়ায় নামা যাবে না। তাকে সুযোগ বুঝে আগে নেমে পুলিশের নজর বাঁচিয়ে বাড়ির পথ ধরতে হবে। লরি হাইওয়ে ছেড়ে শহরের রাস্তায় ঢুকেছে। জায়গাগুলো তার সব চেনা। ফাঁকা রাস্তা তাই লরি ভালো গতিতেই লিলুয়া পেরিয়ে গেল। সালকিয়া মার্কেট পেরিয়ে একটা বাঁকের মাথায় লরিটা একটু আস্তে হতেই সুধীর লাফিয়ে নেমে পড়ল। পথ-ঘাট সব শূন্য। এমন কিছু রাত হয়নি কিন্তু জনমানব হীন রাস্তার অস্বস্তিকর নীরবতা তার মনে একটা ভয়ের সঞ্চার ঘটাল।

মানসিংহপুর এখান থেকে অনেক দূর। রাস্তার নির্জনতা দেখে গাড়ি পাবে সে আশা তার একেবারেই মরে গেল। কিন্তু বাড়ি তাকে যেতেই হবে। কোমরে গামছাটা ভাল করে বেঁধে নিয়ে চাদরটা খুব শক্ত করে জড়িয়ে নিল। তারপর রাস্তা ছেড়ে গলি পথ ধরে একেবারে রেল লাইনের ধারে। রেললাইন পার হওয়ার সময় কয়েকজন পুলিশের নজর পড়ে তার উপর। তারা টর্চের আলো ফেলতেই সুধীর দৌড় দিল। তাড়াতাড়ি রেললাইন পার হয়ে নেমে এলো জলা-জমির উপর। পুলিশের দল কিছুটা তার পিছনে ধাওয়া করে হাল ছেড়ে দিল। দূরে রাস্তার আলোর দিকে চোখ রেখে সুধীর এগিয়ে যেতে লাগল। অসময়ে বৃষ্টির জমা জল-কাদায় কয়েকবার পড়ে গিয়েও সে এগিয়ে যেতে থাকল। তার সারা শরীরে কাদার ছিটে। কোমর থেকে পা একেবারে কাদায় মাখামাখি। একবার সে রাস্তার ধারে উঠে এসেছিল রাস্তা দিয়ে হাঁটবে বলে, কিন্তু সেখানেও পুলিশের গাড়ি যাতায়াত করছে দেখে আবার জলাজমিতে নেমে এলো। প্রায় অবচেতন ভাবে কতক্ষণ যে হেঁটেছে তার ঠিক নেই। একটা সময় সে দেখল আকাশ একটু একটু করে পরিষ্কার হয়ে আসছে। পাখির দল কিচিরমিচির করতে করতে উড়ে যাচ্ছে। দূর থেকে নিজেদের গ্রামের সীমানা দেখে সে লাফিয়ে উঠল। তাড়াতাড়ি করে সে জমির আল ধরে ছুটতে থাকল। কিছুটা যেতে না যেতেই সে হাঁপিয়ে গিয়ে গতি কমিয়ে হাঁটতে লাগল। দিনের আলো বাড়তেই দূর থেকে কয়েকজনের দেখা পেল। কাল রাত থেকে পুলিশের পর এই প্রথম সে কোনো সাধারণ মানুষের দেখা পেল। জলা-জমি পেরিয়ে মাঠের এক প্রান্তে শুরু হয়েছে বাজার। মাঠ পেরিয়ে যখন সে বাজারে ঢুকলো তখন প্রায় সাতটা বাজতে চলেছে। বাজারের দু-এক জন তাকে দেখে চিনতে পেরে তার ফেরার খবর জানতে চাইল। সুধীরের মুখ থেকে ‘এইতো কাজ থেকেই ফিরছি’ শুনে অনেকে তার দিকে সন্দেহের দৃষ্টি দিল। সবার মুখে মাস্ক শুধু মাত্র সে বাদে। তাই একটা গন্ডগোলের আভাস পেতেই আর কথা না বারিয়ে সে তাড়াতাড়ি বাড়ির পথ ধরল। মোড় মাথায় আসতেই দু-টো মাস্ক পরা পুলিশ হঠাৎ করে একেবারে তার দশ হাতের মধ্যে চলে এলো। তার কাদা মাখা পোশাক আর মুখে মাস্ক নেই দেখে পুলিশ দুটো তার দিকে এগোতে থাকল। সুধীর তাড়াতাড়ি করে দৌড় দিল বাড়ির দিকে। কাল থেকে সারাদিন সে টিভিতে যা খবর দেখেছে তাতে সে এটা বুঝে গেছে যে মাস্ক ছাড়া বাড়ির বাইরে বেরলে পুলিশের মার অবধারিত আর বাইরে থেকে কেউ ফিরলে তাকে চিকিৎসার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে, না হলে এই অজানা রোগ পরিবারের সবাইকে ধরবে।

বাড়ির একেবারে কাছে এসে সুধীর খুব জোরে জোরে মা আর বৌকে ডাকতে থাকল। সকাল সকাল এমন ডাকাডাকি শুনে তার মা বেরিয়ে এলো বাড়ির সামনে। পিছন পিছন তার বৌ ও এলো চার মাসের মেয়েকে কোলে নিয়ে। নিজের পরিবারকে দেখে সুধীরের মন আনন্দে ভরে গেল। খুব ইচ্ছা করল তার মেয়েকে সে কোলে নিয়ে একটু আদর করবে। কিন্তু সে বাঁশের বেড়ার কাছে এসে থেমে গেল। পুলিশ দু-টো তখন দৌড়ে আসছে তার দিকে। হঠাৎ সুধীর ঘুরে দাঁড়িয়ে তাদের দিকে হাত তুলে জোর গলায় বলল,- ‘দাঁড়াও। আমি তোমাদের কাছে আসছি এখুনি।‘ আচমকা এমন কথা শুনে পুলিশ দু-টো থমকে দাঁড়িয়ে গেল সেখানেই। কালবিলম্ব না করে সুধীর নিজের চোরা পকেট আর জামার পকেট থেকে সব টাকা বের করে বেড়ার মাথার উপর রেখে দিয়ে মা কে বলল,- ‘এগুলো ভালো করে ধুয়ে শুকনো করে তারপর ব্যবহার করবে। আমি দিন পনেরো পরে ফিরব। ভয়ঙ্কর রোগ হচ্ছে সবার। খুব সাবধানে থাকবে।’ কথা গুলো বলেই সুধীর পুলিশদের দিকে এগিয়ে গেল।

সুধীরের বৌ উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞাসা করল,-‘ তুমি চললে কোথায়? বাড়ি আসবে না?’

সুধীর হাসতে হাসতে বলল,- ‘জেলে যাচ্ছি না রে। ডাক্তারখানায় যাচ্ছি। বাইরে থেকে আসলে ডাক্তার দেখিয়ে তবেই ঘরে ঢুকতে পারব। টাই এখন নিয়ম।‘

একটা পুলিশ তার লাঠির দিয়ে সুধীরের পেটে খোঁচা মেরে বলল,- ‘তোর জ্ঞান বেশ টনটনে তবে আমাদের দেখে ছুটলি কেন?’

সুধীর হাত জড়ো করে বলল,- ‘বাবু আমার এদিক-ওদিক করে ঠিক চলে যাবে কিন্তু ওদের টাকা না দিলে যে ওরা না খেতে পেয়ে মারা যাবে। চার মাসের মেয়ে আমার। ওদের খাবারের যোগাড় না করে আপনাদের সাথে যাওয়াটা কি ঠিক হবে বলুন?’

সুধীরের কথায় পুলিশ কর্মচারী দু-জন তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বলল,- ‘চল এবার তোকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই।’

কাশীরামের কাশি

জুন ২০২০ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

গল্প

কাশীরামের

কাশি

শুভম দাস বিশ্বাস

বোল্পুর, শান্তিনিকেতন, পঃ বাংলা

sadhu.jpg

বুড়ো শিবপুর গাঁয়ে কারুর অ্যালার্মের দরকার পড়ে না। বহুযুগ ধরে গ্রামের মোরগশ্রেণী এই দায়িত্বটা পালন করে এলেও ইদানিং মানে বছর তিনেক ধরে কাশীরাম প্রামাণিক অতি যত্নসহকারে এই কাজটি করে আসছে। কাশীরামের ঘুম ভাঙে ঠিক ভোর তিনটে-সাড়ে তিনটে নাগাদ। উঠতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু এই ভোর রাত থেকে এমন কাশির বেগ উঠতে থাকে যে বিছানায় শুয়ে থাকা যায় না। তাই উঠে পড়তে হয়।

এই সময়টাতে তার কাশির চোটে ঘুম ভাঙে তার এবং আশেপাশের তিন-চারটে বাড়ির। এরপর যখন সে প্রাতঃকৃত্যের জন্য নদীর পাড়ে যায় তখন এক এক করে রাস্তার ধারের সবকটি বাড়িতেই তার কাশির আওয়াজ ভোরের সূচনা করে।

দু দিন আগে ওপাড়ার ব্রজখুড়ো কাশীরামকে পাকড়াও করে। ‘বলছি বাবা কাল ভোরে একটু ওপাড়া দিয়ে যেতে হবে যে। মানে ওই যখন নদীর পাড়ে যাবে তখন।’

কাশীরাম ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে ছিল ব্রজখুড়োর দিকে। এতে খুড়ো একগাল হেসে তিন-চার পিস অবশিষ্ট দাঁত বের করে বলেছিল, ‘আসলে কাল একবার শহরে যাব। তাই ভোর চারটের ফার্স্ট ট্রেনটা ধরতেই হবে। তাই বলছিলাম কাল যখন নদীতে যাবে, একটু কষ্ট করে যদি ওপাড়া হয়ে যাও খুব উপকার হয় বাবা।’

কাশীরাম গত চার বছর ধরে নয় নয় করেও তিনশ ছাপান্নটা ডাক্তার, শ’দেড়েক কবিরাজ আর ডজন খানেক হাকিম দেখিয়েছে। এমনকি ওঝা, কাপালিক, মা মনসা, মঙ্গলচণ্ডী, বিপত্তারিনী করতেও ছাড়ে নি। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। কাশি যে কে সেই।

কি না করেনি সে। বিধু ডাক্তারের কথামতো বেলা বারোটার সময় খাঁ খাঁ রোদে ঝাড়া দু ঘন্টা সূর্যের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে ছিল। মাথাঘুরে পড়ে ভিরমি গিয়েছিল কিন্তু কাশি যায় নি।

সত্য ওঝার কথায় মায়ের মন্ত্রপূত ফুল মুখে নিয়ে, দাঁতে দাঁত চেপে মুখ বুজে হাজার এক বার মায়ের নাম জপ করেছিল। কাশির দমকে বুকে হাতুড়ির বাড়ি অনুভব করলেও মুখফুটে একবারও কাশে নি।সব সহ্য করে নাম কমপ্লিট করেছিল। কিন্তু লাভ কি হল! নাম শেষ হবার পর, এতক্ষণ ধরে চেপে রাখা কাশিগুলো একজোট হয়ে যে মোক্ষম কাশির জন্ম দিল তাতে তার মুখ দিয়ে মায়ের মন্ত্রপড়া ফুলের সাথে, উপরের পাটির নড়বড়ে দাঁতটা সুদ্ধ উপড়ে এসে দুহাত দূরে পড়েছিল।

কাশির চোটে কোনো কাজকম্মও করতে পারে না সে। এতগুলো ডাক্তার দেখানোর ফলে ডাক্তারি সম্পর্কে মোটামুটি একটা আইডিয়া চলে এসেছিল। তাই সনাতন ডাক্তারের কাছে কম্পাউন্ডারির চাকরিতে ঢুকেছিল একবার। কিন্তু কপালে সইল না। কেষ্টখুড়োকে কড়াডোজের ইঞ্জেকশন দিচ্ছিল কাশী। কিন্তু ওই। চরমতম মুহূর্তে এল কাশির বেগ। আর ইঞ্জেকশন গিয়ে বসল কেষ্টখুড়োর গিন্নির কোমরে। সাতদিন ধরে বিছানায় পড়ে গোঁ গোঁ করেছিলেন কেষ্টগিন্নি। সে যাত্রায় বেঁচে গেছিলেন। কিন্তু এখনো পর্যন্ত কাশীকে দেখলে ভিরমি যান। বিকেলবেলা নিধু চক্কোত্তির দাওয়ায় বসে নিজের দুঃখের কথা বলছিল কাশী। ‘কি না করলাম খুড়ো। কিচ্ছু লাভ হল না। এই কাশিই কাশীরামের কাল হয়ে দাঁড়াল। খুড়ো গো, একটা বাপও তার মেয়ে দিলে না।

লোকে দেখলে পরে ভয়ে পালিয়ে যায়। ভাবে কি না যেন রোগ নিয়ে ঘুরছি। বাড়ির লোক অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। না খুড়ো। এ জীবন আর রেখে লাভ নেই।’

নিধু চক্কোত্তির এসব শুনে শুনে মুখস্থ হয়ে গেছে। তাই তিনি এদিকে কান না দিয়ে কি যেন চিন্তা করছিলেন। কাশীরাম তার রেকর্ড থামালে বললেন, ’আমার সাথে একটিবার গোরুমারাচর গাঁয়ে চল কাশী। গতকাল মুখুজ্জেদের বৈঠকখানায় গিয়ে শুনলাম ওখানে নাকি এক মহাপুরুষের আবির্ভাব হয়েছে। ভৈরবানন্দ মহারাজ। সাক্ষাৎ ভৈরব। একবার তার চরণে আশ্রয় নিয়ে শেষবারের মতো একটা চেষ্টা করে দেখ না।’ কাশী কোনো আগ্রহ দেখায়নি। কেবল উদাসভাবে বলেছিল, ’তাই চলো। এত কিছু যখন করলাম তখন এটাই বা কেন বাদ রাখি।’ শুভদিন দেখে কাশীরাম ও

নিধুখুড়ো হাজির হল বাবা ভৈরবজীর আখড়ায়। অন্য সাধুদের থেকে কিছুমাত্র আলাদা না বাবাজী। ঘন্টা দেড়েক অপেক্ষার পর কাশীর নম্বর এল। হ্যাঁ, এইখানে একটু নতুনত্ব। ভিড় কন্ট্রোল করতে বাবা আগত ভক্তদের নম্বর লেখা টোকেন দেন। সেই নম্বর অনুযায়ী ডাক পরে ভক্তদের।

‘বল। কী সমস্যা?’ বাবা চোখ বুজেই বললেন। কাশীরাম সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে উঠে বসে কড়জোড়ে বাবাকে তার সমস্যার কথা বলল। শুনে বাবা কিছুক্ষণ চোখ বুজেই রইলেন। তার পর ধীরে ধীরে চোখ খুললেন।

‘কাশি গেছিস কখনো?’

‘আজ্ঞে?’ কাশী ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়।

‘বলছি কাশি, মানে বাবা বিশ্বনাথের কাছে গেছিস কোনদিন?’

‘আজ্ঞে না বাবা। বাপের জন্মে কখনো কাশি যায়নি।’

‘হুম।’ বাবা আবার চোখ বুজলেন। বিড়বিড় করে কিছু বললেন। তারপর হঠাৎ চোখ খুলে কটমট করে চাইলেন কাশীর দিকে,’ বাপের জন্মে না। তোর আগের জন্মে গেছিলিস।’

বাবাজী আবার চুপ।

‘ঘোর পাপ। ঘোর পাপ করেছিলিস। বাবার মাথায় তুই জল মেশানো দুধ ঢেলেছিলিস। অভিশাপ। হুঁ হুঁ বাবা, যাবে কোথায়! বাবা বিশ্বনাথের অভিশাপ।’

‘মুক্তি লাভের উপায় বাবা? ‘

‘যজ্ঞে আহুতি দিতে হবে। তারপর সেই যজ্ঞের ছাই মাদুলিতে পুরে শনিবার মধ্যাহ্নে কালো ষাঁড়ের গলায় পড়াতে হবে। আর মাদুলি পড়ানোর পর ষাঁড়ের শিং ধরে তিনবার বাবা বিশ্বনাথের নাম নিলেই মুক্তি। মোট ১০০১ টাকা খরচ।’

শনিবার বেলা বারোটার সময় মাদুলি হাতে কাশী ঘোষবাবুদের মাঠে এসে হাজির হল। এখানেই ঘোষবাড়ির বিখ্যাত ষাঁড়, কালো কুচকুচে নন্দী চড়ে বেড়ায়। সাক্ষাৎ বাবা বিশ্বনাথের এই বাহনটিকে সাড়া বুড়োশিবপুর ডরায়। ঘোষেদের রাখাল ছাড়া আর কেউ নন্দীর ছায়া মাড়ানোর সাহস পাই না।

কাশী বাবা বিশ্বনাথের নাম নিয়ে কাঁপতে কাঁপতে নন্দীর কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। নন্দী আপনমনে ঘাস চিবোচ্ছিল। কাশীকে বিশেষ পাত্তা দিল না। কাশী হাতে করে একটা আস্ত লাউ নিয়ে এসেছিল। সেটা নন্দীর দিকে বাড়িয়ে দিতে নন্দী মুখ তুলে চাইল। অনেকক্ষণ ধরে ঘাস চিবিয়ে মুখটা কেমনযেন ভোঁতা হয়ে গেছিল নন্দীর। তাই কচি লাউ দেখে চোখটা চকচক করে উঠল। দুবার শুঁকে লাউ এ মুখ লাগাল সে। এই সুযোগে কাশীরাম খুব সাবধানে মাদুলিটা নন্দীর গলায় পড়িয়ে দিল। লাউটা বেশ সরেস। তাই নন্দীও বিশেষ আপত্তি করল না। কিন্তু তারপরেই ঘটল অঘটন।

মাদুলি পড়ানোর পর যেই না কাশী নন্দীর শিং এ হাত রাখল, নন্দীর সেটা মোটেও পছন্দ হল না। প্রথমে কাশীর পেটে মারল এক মোক্ষম গুঁতো। তারপর পিছন ফিরে ল্যাজে করে কাশীর গলায় এক বাড়ি। এটুকুই যথেষ্ট ছিল।

‘আঁক’ করে কয়েক হাত দূরে ছিটকে পড়ল কাশী। দুবার ওঠার চেষ্টা করল। মাথা ভনভন করছে। কান শনশন করছে। গলাটা কি আদেও শরীরের সাথে লেগে আছে! দুবার কথা বলার চেষ্টা করল সে। ঘর্ঘর আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই বের করতে পারল না। বুঝতে পারল জ্ঞান হারাচ্ছে। ঝাপসা চোখে দেখল নন্দী তার দিকে ফিরে আপনমনে লাউ খাচ্ছে। একবার তার দিকে চেয়ে ফিঁক করে হাসল বলেও মনে হল। তারপর ধীরে ধীরে কাশীর চোখ বুজে এল।

ওই ‘আঁক’ টাই ছিল কাশীরামের মুখের শেষ কথা। যদিও ‘আঁক’ টাকে আক্ষরিক অর্থে কথা বলা চলে কি না এ নিয়েও যথেষ্ট সংশয় আছে। না, কাশী বেঁচে আছে। কথা বের হয়না মুখ দিয়ে। কেবল ঘর্ঘর আর ঘর্ঘর। নন্দীর ল্যাজের বাড়ি তার বাকশক্তি চিরকালের মতো কেড়ে নিয়েছে। যদিও ঘোষেরা এখনো চেষ্টা করে যাচ্ছে। অনেক ডাক্তারও দেখিয়েছে। অনেকে আশাও দিয়েছে। কিন্তু হ্যাঁ। বাবাজীর কৃপা নাকি বাবা বিশ্বনাথের লীলা জানা নেই, নন্দীর ল্যাজের বাড়িতে কথার সাথে সাথে কাশিও লোপ পেয়েছিল কাশীর।

ছুটি

জুন ২০২০ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

গল্প

ছুটি

চৈতালি সরকার

girl1.jpg

ভিমানী চোখ জলে ভরে এল। এখুনি বৃষ্টি নামবে। চন্দন চিবুক ছুঁয়ে আদরের ভঙ্গিতে বলল, 'আমার খুকি বড্ড ছেলেমানুষ!' তবুও জলেরধারা গড়িয়ে পড়ল দুগাল বেয়ে, ভিজে উঠল বিছানা। একেবারে স্যাঁতস্যাঁতে বালিশ, বিছানার চাদর ।

ধড়ফড় করে উঠে বসল মল্লিকা। কপাল জুড়ে বিন্দু বিন্দু ঘাম। তাকিয়ে দেখল ডান পাশের বালিশ ফাঁকা। না, চন্দন কোত্থাও নেই। কি করেই বা থাকবে! মোবাইলে সুইচ অন করে দেখে নিল, রাত তিনটে। আগামী কাল তিনমাস দশ দিন পূর্ণ হবে।

দিনটা ভোলবার নয় বলেই হয়তো কত স্মৃতি ভেসে ওঠে চোখের পর্দায়। কত কথা হাবুডুবু খায় বুকের ভেতর।

সকাল থেকেই চন্দনের শরীর ভালো ছিল না। মল্লিকা বারণ করেছিল অফিসে যেতে। কিন্তু চন্দনের সাফ কথা, জরুরী মিটিং যেতেই হবে। মান্তু বড্ড দুষ্টু হয়েছে। দুবছর কে বলবে! আদোমুখের পাকা পাকা কথায় ভরিয়ে রাখে সারাদিন। বাবার ডাক অনুকরণ করে মল্লিকাকে 'মলি' বলে ডাকে। মা বলতে বললেই দুষ্টু মুখ খিলখিল করে ওঠে।

সবে বিকেল পাঁচটা, মান্তু ধাক্কা দিয়ে বলল, 'মলি ওঠো। আমি চা খাবো।' মল্লিকার থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে এবার চেঁচিয়ে বলল,' ওঠো না মলি, আমি চা খাবো।' মাঝে মাঝে একদম বাবার মতো করে মান্তু কথা বলে। অগত্যা মল্লিকাকে উঠতে হয়। ক্লান্তির হাই তুলে ছেলের হাত ধরে।

হঠাৎই জোর ধাক্কা, এক ঝটকায় জানালাটা খুলে গেল। তবে কি আলগা করে লাগানো ছিল! অজানা আশঙ্কায় বুকের কাছটা দপ করে ওঠে। মল্লিকা জানলার কাছে গিয়ে দেখে বাইরের আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গেছে। কুন্ডলী পাকিয়ে ঝোড়ো বাতাস ছুটে আসছে। বৈশাখ মাস তো নয়, তবে কিসের এই আয়োজন! আজ আকাশ বাতাস সব কেমন বেপরোয়া। কোনো রাক্ষুসে খবরের আগামবার্তা নয় তো! এমনসময় কলিং বেল বেজে উঠল। দরজা খুলতেই ঝোড়ো হাওয়ার মতো ছুটে এল চন্দন। ঝপ করে বসে পড়ল সোফায়। নিজের ভার বহনের ক্ষমতা নেই। ঠিক বুকের কাছে চাপা কষ্ট, মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে। মল্লিকার হাজারো প্রশ্নের মাঝে নিজেকে এলিয়ে দিয়ে বলল, 'একগ্লাস জল।' মান্তু তখন ঘরময় চক্কর কাটছে। বাবা আসার আনন্দের বহিঃপ্রকাশ আর কি! নিজের বাহাদুরী দেখাতে মান্তু বলল, বাবা দেখো না। কোনো সাড়া নেই। ও অধৈর্য হয়ে জোরে ধাক্কা দিতেই চন্দন নুইয়ে পড়ল সোফায়। চোখ দুটো বোজা। ডাক্তার ডাকার সময় পেল না কেউ। মান্তু তখনও ঘরময় চক্কর কাটছে। ভাবনার আকাশ থেকে মল্লিকা হুমড়ি খেয়ে পড়ল মাটিতে। এখন প্রায়ই মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়। আর ঘুম আসতে চায় না। ঘামে ভিজে গেছে শরীর। নিজেকে হাওয়ায় এলিয়ে দিতে মল্লিকা ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াল। পুবের আকাশে লালচে আভা। কিছুক্ষণের মধ্যে অন্ধকার কেটে যাবে। শুরু হবে একটা নতুন দিন।

ছোট্ট বাড়িটা বড্ড অগোছালো, ছন্নছাড়া নাকি সুরের কান্না চারিধারে। মল্লিকার দম বন্ধ হয়ে আসে। ছোট্ট ছেলেটার দস্যিপনাও আজকাল কেমন নেতিয়ে গেছে। রান্নাঘরে সকালের ধুম

নেই। ছাদের গাছগুলো শুঁকিয়ে হলদেটে। কোনো কাজেই তেমন জোর পায় না মল্লিকা। সবাই বলে বাঁচাতে হবে। সত্যিই তো বাঁচতে হবে! আনার সামনে বসে মল্লিকা নিজেকে সাজিয়ে নেয়। আগেই কেয়াকে ফোন করেছে। না আর দেরী নয়। ও রাস্তায় বেড়িয়ে একটা ট্যাক্সি ধরে নিল। গড়িয়া থেকে বাঘাযতীন বেশি দূরে নয়। মোড়ের রেস্টুরেন্টেই কেয়া অপেক্ষা করবে।

অনেকদিন আগেই অফারটা পেয়েছিল মল্লিকা। বাধা দেয়নি চন্দন। অভিনয়ের কথা শুনে শুধু হেসেছিল। ওর হাসির মধ্যে কোনো স্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল না।

টিভি সিরিয়ালে অভিনয়ের জন্য নতুন মুখ চাইছে পরিচালক। ছোট থেকেই অভিনয়ের ভীষণ শখ মল্লিকার। নাচ গান সবই শিখেছিল। তাইতো কেয়া কথাটা বলতেই প্রদীপের মতো দপ করেই নিভে গিয়েছিল মল্লিকা। ওর সেদিন নিজের কথা ভাববার সময় কোথায়! অফিস ফেরত স্বামীর উত্তাপ ছিল মল্লিকা। ছোট্ট মান্তুর অভ্যাস ছিল মল্লিকা।

চন্দনের অফিস থেকে চাকরির একটা সুযোগ এসেছে। মল্লিকার মায়ের ইচ্ছে মলি সেখানে জয়েন করুক। চন্দনের আপনজনেরাও তাই চান।

মল্লিকার অভিনয়ের ব্যাপারটা কেউই তেমন মানতে পারছেন না। চন্দনের সেজকাকিমা বলেই ফেললেন এইসময় মুখে মেকআপ নিয়ে অভিনয় করলে লোকে কি বলবে?

বাঘাযতীনের দিকে ট্যাক্সি চলেছে। গাড়িতে বসে অনেক কথা মনে পড়ছে। মল্লিকার সামনে ফুরফুরে বাতাসের মতো ভেসে বেড়াচ্ছে একগুচ্ছ মুখ। চেনা-অচেনা, আত্মীয়-অনাত্মীয়। বারবার মনে হচ্ছে মুখগুলো আড়ালে টিপ্পনী কাটছে। হো হো করে হেসে বলছে, এই তোমার ভালোবাসা! তুমি না মান্তুর মা! সেজকাকিমা বারবার বলছেন লোকে কি বলবে!

গাড়ির জোর ধাক্কায় মল্লিকার ঘোর ভাঙল। নিজেকে সামলে নিল কিছুটা। মন দুর্বল করলে চলবে না। মল্লিকার চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠল। ক্লান্ত চোখ ক্রমশ জড়িয়ে আসছে। অস্পষ্টভাবে তাকিয়ে দেখল, পাশে বসে চন্দন। আলতো ঠোঁটে মাথা ছুঁয়ে চন্দন বলছে, "এবার তোমার ছুটি!"

ছুটি, এবার কি সত্যিই ছুটি! অজস্র প্রশ্নের মাঝে ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছে মল্লিকা। স্মৃতির আলো কি ক্ষীণ হয়ে আসছে! এবার তাহলে নিজের মতো বাঁচা! লেভেল ক্রসিং পাড় হয়ে গাড়িটা দুরন্ত গতিতে ছুটে চলেছে। আজ সকাল থেকেই সূর্যের দেখা নেই। কেমন মেঘলা মেঘলা ভাব। হঠাৎ মল্লিকার মান্তুর জন্য বুকের কাছটা কামড়ে উঠল। মেকআপের আবরণে মাকে কি ওর বড্ড অচেনা লাগবে! তবু মনে হল শুধু মা হয়ে বেঁচে থাকবে কেন? ওর এতোদিনের ইচ্ছের কি কোনো দাম নেই! মাথাটা ঝিমঝিম করছে। সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। চন্দনের কথা মনে হল ছুটি, ছুটি, ছুটি ......!

একসময় সংস্কারের পর্দা ছিঁড়ে বেরিয়ে এল মল্লিকা। কেঁচোর মতো প্রশ্নগুলোকে সরিয়ে ভাবল শুরু হোক না নতুন একটা অধ্যায়। এবার না হয় নিজের জন্য একটু বাঁচবে।

বাইরের আকাশেও মেঘলা চাদর সরে গেছে। সূর্যের প্রথম আলো ফুটে উঠছে।

প্রবন্ধ

সখী ভালবাসা

জুন ২০২০ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

SaswatiBhattachrya.png

সখী, ভালোবাসা

করে কয়?

শাশ্বতী ভট্টাচার্য

puri.jpg

তাই তোমার আনন্দ আমার 'পর, তুমি তাই এসেছ নীচে। আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর, তোমার প্রেম হত যে মিছে’। কি অনায়াসে এই কথাগুলো বলা হলো! কোথায় আমি নশ্বর এক মানুষ, আর কোথায় ত্রিভুবনেশ্বর, কোথায় প্রেম আর কোথায় আনন্দ? কি সম্পর্ক এই দুইটি সত্তার? কি সম্পর্ক এই দুইটি অনুভূতির? সেই যবে থেকে জ্ঞান হয়েছে, সেই কোন ছোটবেলা থেকেই আমরা হরদম ‘প্রেমে’ পড়ছি। সিনেমার নায়ক, গায়ক, খেলোয়াড়, কিম্বা ক্লাসের লাজুক ছেলেটার প্রেমে পড়ার জন্য মুখিয়ে আছি। কখনও সেই ‘প্রেম একবারই এসেছিলো জীবনে’ বলে দুঃখ প্রকাশ করি, আবার কখনও সদর্পে রেলা নিই, ‘মেরেছো কলসীর কানা তা বলে কি প্রেম দেবো না?’ রবিঠাকুর তো মাতিয়ে দিয়েছেন। তাঁর গানে, কবিতায়, প্রবন্ধে প্রেম-পুজো মিলে মিশে এক হয়ে গেছে; স্বর্গীয়-সুধা আস্বাদন করার সৌভাগ্য হয়েছে বাংলা-ভাষা জানা সমজদারের। মনে হয় কবিগুরুর মনেও সংশয় একটু ছিল, তা না হলে কেন তাঁর লেখনী থেকে উঠে আসবে তাঁর সেই অবিনশ্বর প্রশ্ন, ‘সখী ভালোবাসা করে কয়?’ ভালোবাসাকে ‘কেবলি যাতনাময়’ বলাতে ঘোরতর আপত্তি প্রকাশ করেছেন তিনি, জানিয়েছেন, ‘আমার চোখে তো সকলই শোভন’। তা হতেই পারে, তবে বিজ্ঞানীও বসে নেই, বিজ্ঞানের পটভূমিকায় ‘ভালোবাসা করে কয়’ এর উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেছে, এবং সেই আলোচনাই আজকের এই প্রবন্ধের বিষয় বস্তু, কেন (কি ভাবে) মানুষ প্রেমে পড়ে? স্টোনীব্রুক ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞানী আর্থার এ্যরনকে এই ভাবনা ভাবিয়েছে গত পঞ্চাশ বছর ধরে। গবেষণাগারে প্রায় ছত্রিশটি প্রশ্ন-উত্তরের নিরিখে আর্থার এ্যরন এর একটা জবাব ঠাহর করেছেন। ওঁনার বক্তব্য একমাত্র প্রেমে পড়ার মাধ্যমেই আমরা নিজেদের সর্বাঙ্গীন প্রসার করার অবকাশ পাই, এর জন্য তিনটে শর্ত পূর্ণ হতে হবে। দুটো নাম ধরা যাক, স্থির এবং ধীর। শর্ত অনুযায়ী, স্থির যাচাই করবে, ধীর তার উপযুক্ত কি না, ধীর তার প্রতি আকৃষ্ট কি না এবং সেও সমভাবে ধীরের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করছে কি না। এই পারস্পারিক আকর্ষণের অনুভূতিই আমাদের মধ্যে জাগরিত করে সেই তথাকথিত চিঁটেগুড়ের মধ্যে পড়ে যাওয়া পিঁপড়ের বিপর্যয়। বাউল কবি গেয়ে ওঠেন ‘গোলেমালে গোলেমালে পিরীত কইরো না’। এইবারে দেখা যাক এই আকর্ষিত হওয়ার ব্যপারটা মানুষ জানবে কি করে? আর্থার এ্যরনই তাঁর গবেষণাগারের ছাত্র-ছাত্রীদের আচরণের ভিত্তিতে এর উত্তর দিয়েছেন। পরষ্পরের চোখ থেকে। ফিরে আসি, আগের মতো দুটি কল্পিত নামে। দিবস এবং সন্ধ্যা। এদের দুজনকে নিভৃতে একে ওপরের সঙ্গে ‘আত্ম-আলোচনা’ করতে হবে। সময় সীমা? এই দেড় ঘন্টা খানেক! কথোপকথনের সময় দিবস এবং সন্ধ্যাকে একে ওপরের দিকে ন্যুনতম চার মিনিট তাকিয়ে থাকতে হবে। হ্যাঁ, পুরোপুরি চার মিনিট। চোখে চোখ রেখে। তাহলেই নাকি দিবস এবং সন্ধ্যা যাচাই করে নিতে পারবে ওরা পরষ্পরের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করছে কি না। মনে পড়ে যায়, কিশোর কুমারের সেই বিখ্যাত গানের লাইন ‘এই সেই কৃষ্ণচূড়া, যার নীচে দাড়িয়ে হাতে হাত, চোখে চোখ। নাঃ, হাতের ব্যাপারে আর্থারবাবু কিছু বলেন নি। কৃষ্ণ চূড়া? নাঃ, যেখানে এই গবেষণাটি হয় সেখানে কৃষ্ণচূড়া গাছের কথা সম্ভবত কেউ জানে না। অতএব বাঙালীর প্রিয় গানের লাইন থেকে টুকে রিসার্চ হয়েছে এমন কথা ভাবার প্রয়োজন নেই । প্রেম-রসের আলোচনায় রসায়নকে না আনলে চলে কি করে? উনিভার্সিটি অফ বাফেলোর সাইকোলজির প্রফেসর মার্ক বি ক্রিস্টাল সেই তথাকথিত ত্র্যহস্পর্শ, অর্থাৎ স্থান-কাল-পাত্রের যথাযথ সমাহারের উল্লেখ করেছেন। ওঁনার বক্তব্য, প্রেমে পড়তে জন্য অন্তর এবং বাইরের রাসায়নিক সামঞ্জস্য হওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন। প্রথমে তো চোখের দেখা আছেই, দ্বিতীয়ত একজনের উপস্থিতিতে অন্যজনের শরীর থেকে নিঃসৃত হতে হবে ফেরোমোন নামক রাসায়নিক দ্রব্য এবং অন্যজনকে তার নিজের অজান্তে তাতে সাড়া দিতে হবে। সাড়া দেওয়াটা কি রকমের? একটা ভালো লাগা একটা গলে যাওয়া গলে যাওয়া ভাব অনুভূত হতে হবে। সেই যে কোন হিন্দী সিনেমার লাইন ‘কুছকুছ হোতা হ্যাঁয়’ সেই রকম আর কি। ফেরোমোন অনেকটা হরমোনের মাসতুতো ভাইয়ের মতো, শরীরের নানা কাজে হরমোনের উপস্থিতি বেশ ভালো টের পাওয়া যায়,

ভালো ভাবে বেঁচে থাকার জন্য হরমোন অপরিহার্য। এমনকি ক্ষিদে পাওয়ার এবং পেট ভর্তির অনুভূতির জন্যেও দরকার যথাক্রমে ঘ্রেলিন ও লেপটিন নামক দুইটি হরমোন। কিন্তু ফেরোমোন? তার কাজ সম্বন্ধে নয়তো একটা আন্দাজ পাওয়া গেলো, কিন্তু এই রাসায়নিক দ্রব্যের নাম কি? বাজারে কিনতে পাওয়া যায়? ল্যাবোরেটরীতে তৈরী করা যায়? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়ার চেষ্টা না ক রাই ভালো, কেন না এইখানে বিজ্ঞান একটু থমকে গেছে। একটা খটকা এসে উপস্থিত হয়েছে। মানুষের শরীর থেকে যে ফেরোমোন আদৌ ক্ষরিত হয় কিনা, এই নিয়ে এখনও কিছুটা সংশয় রয়ে গেছে। গবেষণার ভিত্তিতে যদিও ঘুরপথে, অপ্রত্যক্ষে ফেরোমোন অস্তিত্ব মেনে নিয়েছেন কিছু বিজ্ঞানী, আজও এই ২০১৯ সালে, রসায়ানাগারে এই বস্তুটিকে হাতের মুঠোয় পুরেফেলতে পারেননি কেউ। অথচ, প্রায় চল্লিশ বছর আগে ১৯৫৯ সালে, জার্মানীর এডলফ বুটেনান্দট সিল্ক-মথ থেকে বম্বাইকল নামে ফেরোমোন আবিষ্কার করে ফেলেন। (উল্লেখযোগ্য, নোবেল পুরস্কার বিজয়ী এই ভদ্রলোক ১৯৩৪ সালে গুরুত্বপূর্ণ তিন তিনটে মানবীয় হরমোন ইস্ট্রোজেন, প্রজেস্ট্রেরণ কিম্বা টেস্টোস্টেরণও আবিষ্কার করেন।) ফেরোমোনে বিশ্বাসী বিজ্ঞানীর বক্তব্য সাধারণ পোকা-মাকড় যদি ফেরোমোন নিঃসরণ করে খবরের আদান-প্রদান করতে পারে, অসাধারণ মনুষ্য প্রজাতিও যে ফেরোমোনের মাধ্যমে প্রেমানুভূতি জ্ঞাপন করে থাকে, সেটা মেনে নিতে আপত্তি কি? বাকি রইলো মস্তিষ্ক ওরফে ব্রেন ।

সবার উপরে ব্রেন সত্য তাহার উপরে নাই! ব্রেন আমাদের শরীরের সেই রাজধানী, রিমোট কন্ট্রোলে শরীরের যাবতীয় সব কিছু পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে বসে আছে। বলা বাহুল্য, প্রেম সংক্রান্ত বিষয়ে এই মুখ্য অঙ্গটির অবদান প্রচুর। ব্রেনের প্রায় মধ্যস্থলে একটা বেশ বড়ো এলাকা জুড়ে বসে আছে ভেন্ট্রাল-টেগমেনটাল-এরিয়া (ভিটিএ)। এই ভিটিএ থেকে শত-শত নিউরন (ব্রেন-কোষ) মস্তিষ্কের বিভিন্ন অঞ্চলে ডাক হরকরার মতো খবর নিয়ে যাওয়ার কাজে ব্যস্ত। ভিটিএকে প্রেমের ‘সৃষ্টি, স্থিতি, বিনাশং শক্তিভূতে সনাতনী’ কেন্দ্র বলেও অভিহিত করা চলে। আনন্দের মাধ্যমে ডোপামিন, ভ্যাসোপ্রেসিন এবং অক্সিটোসিন নামক তিনটে নামী দামী অণুর সাহায্যে প্রেমের অনুভূতি সৃষ্টি নয়তো হলো, কিন্তু তাকে তো বজায় রাখতে হবে তো? অতএব স্থিতির কাজে আবার ডাক পরে এই অণুগুলোর। প্রিয় মানুষটির সাহচর্যে নিজের অজান্তে শরীরে বয়ে যায় আনন্দানুভূতি। প্রেমের অনুভূতিটি বজায় থাকে। আশ্চর্যজনকভাবে প্রেমাস্পদ মানুষটি বেগড়বাই করলে তাকে সমূলে নিধন করার যে প্রেরণা তার জন্যও আছে ভিটিএর অঙ্গুলি (নাকি নিউরন) চালন। শুধু প্রেম সংক্রান্ত বিষয়েই নয়, আরো নানা অনুভূতির কেন্দ্রে এই এলাকাটি। পাঠক বিচলিত হবেন না, কতোগুলি রসায়ন দিয়েই জীব এবং জীবনের সারমর্ম জানা যায় এমন দাবী কোন বিজ্ঞান কিম্বা কোনো বিজ্ঞানী করছে না। কেন মানুষ প্রেম এবং পুজোকে এক এবং অদ্বিতীয় বলে প্রকাশ করে ফেলে, বিজ্ঞান তার একটা কারণ দেখানোর চেষ্টা করছে মাত্র। ১৯৬৫ সালে খান্দান সিনেমায়, নায়ককে সামনে দাঁড় করিয়ে নায়িকা গেয়ে যাচ্ছে, ‘তুমহি মেরে মন্দির, তুমহি মেরে পূজা, তুমহি দেওতা হো’। বিজ্ঞান আন্দাজ করছে, নায়িকার এই অনুভূতির জন্য দায়ী বেশ কিছু রাসায়নিক পদার্থ এবং ভিটিএর সক্রিয়তা, নায়িকার মাথায় ইলেক্ট্রোড বসিয়ে ব্রেন স্ক্যান করলেই তার প্রমাণ মিলতো। কিন্তু নটে গাছটি এখানেই মুড়োয় না, হতে পারে প্রেম এমন একটা অনুভূতি যা মানুষকে সর্বাঙ্গীন আত্মপ্রসারের সুযোগ করে দেয়, হতে পারে সেই অনুভূতি এমন যা তাকে লতা-পাতায় জড়িয়ে সেই আনন্দানুভূতির উপসেবক, আসক্ত করে তোলে, কিন্তু কথা এইখানেই শেষ হয় না, পূর্বোক্ত গবেষক আর্থার এ্যরন গবেষণাগারের পরীক্ষায় দেখিয়েছেন, এই আনন্দানুভূতি শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছানোর জন্য প্রয়োজন একে অপরের প্রতি উদারতা, কৃপা এবং দয়া। এবং রীতিমতো অনুশীলনের দ্বারাই এই গুণটি অধিগত করা যায়। হ্যাঁ, এই কাজটির জন্য একটা ব্রেনে আরেকটি কেন্দ্র আছে, চর্চার মাধ্যমে তাকে শাণ দেওয়া যায়। কেননা ‘দয়া দিয়ে হবে গো মোর জীবন ধুতে, নইলে কি আর পারবো তোমার চরণ ছুঁতে?।’

অন্তরালে

প্রবন্ধ

জুন ২০২০ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

অন্তরালে

পৃথা কুণ্ডু

kolkatas1.jpg

নসমুদ্রের এক প্রান্তে উদ্ভ্রান্তের মত দাঁড়িয়ে থাকা ভদ্রমহিলাকে অনেকক্ষণ থেকেই দেখছিল স্বপ্নিল। এত চেনা চেনা লাগছে কেন? ভাল করে দেখার পর খেয়াল হল, আরে – একে তো সে দেখেছিল বছর কয়েক আগে, বাঁকুড়ার দিকে কোন একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। গান শুনতে শুনতে গায়কের দিকে একদৃষ্টে চেয়েছিলেন। মাঝে মাঝেই চোখে আঁচল চেপে ধরে কান্না সামলানোর চেষ্টা করছিলেন। অথচ যে গানগুলো চলছিল তখন - খুব জনপ্রিয় হলেও কান্নাকাটির মত কিছু ছিল না তাতে। স্বপ্নিলের মনে হয়েছিল, বেশ ইন্টারেস্টিং সাবজেক্ট তো। এই অনুষ্ঠানের রিভিউ করার কথা ছিল তার। ভদ্রমহিলার আবেগকে পুঁজি করে বেশ কয়েকটা মনছোঁয়া শব্দ লেখা যেত। একটু কথা বলবে ভেবেছিল, কিন্তু পরে আর তাঁকে খুঁজে পায়নি। ভদ্রমহিলাকে দেখে মনে হয় এখন ষাটের কাছাকাছি বয়স। আজকের শোক মিছিলে রোদ, গরম, শারীরিক অস্বস্তি, শ্রান্তি সব কিছুকে হার মানিয়ে নানা বয়সের, নানা স্তরের বহু মানুষ ছুটে এসেছেন - প্রিয় শিল্পীকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে। তার মধ্যে এই মহিলাকে আলাদা করে চোখে পড়ার কথা ছিল না। তবু স্বপ্নিলের চোখে পড়ল। আগে দেখেছিল বলেই হয়তো। শ্মশানে সব কাজ মিটতে মিটতে বিকেল গড়িয়ে গোধূলি। শহরে অবশ্য গোধূলি বোঝা যায় না তেমন। ফেরার পথে ভিড়টা অনেক আলগা - যে যার বাড়ির পথে। ভদ্রমহিলাকে আবার দেখল স্বপ্নিল। ক্লান্তিতে যেন ভেঙে পড়ছেন, আর পা চলছে না। মাঝে মাঝেই আঁচলের খুঁটে বাঁধা কিছু একটা হাতের মুঠোয় চেপে ধরছেন। এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন। স্বপ্নিল সাংবাদিক। বাস্তবের আড়াল থেকে 'স্টোরি' খুঁজে বের করাই তার কাজ। আজ আবার ভদ্রমহিলাকে দেখতে পেয়ে মনে হচ্ছে তার, একটা ভাল স্টোরি লেখার সুবর্ণ সুযোগ আবার তার হাতের সামনে। তাঁর সেদিনের সেই কান্না, আর আজকের এই আঁচলের আড়ালে ঢেকে রাখা রহস্যের মাঝে কোন যোগসূত্র আছে কি? কোন গোপন সম্পর্কের ইঙ্গিত? এঁকে তো নজরছাড়া করা যাবে না। স্বপ্নিল এগিয়ে আসে, ‘মাসিমা, আপনার কি খুব কষ্ট হচ্ছে? জল খাবেন?’ ভদ্রমহিলা ক্লান্ত চোখে তাকান তার দিকে। ‘জল?... কোথায় পাব… হ্যাঁ গলাটা কেমন শুকনো লাগছে…’ যেন মনে না করিয়ে দিলে তেষ্টার অনুভূতিটাও ভুলে গিয়েছিলেন তিনি।

‘আমার কাছে আছে, আপনি খেতে পারেন।’ একটু যেন ধাতস্থ হয়ে মাথা নাড়েন ভদ্রমহিলা, স্বপ্নিলের কাছ থেকে জল নিয়ে গলা ভেজান।

‘অনেক ধন্যবাদ বাবা…’

‘না না এটুকু তো মানুষকে করতেই হয়’, মিষ্টি করে হাসে স্বপ্নিল, ‘আপনার সঙ্গে কেউ নেই? মনে হচ্ছে অনেক দূর থেকে এসেছেন...বাড়ি ফিরবেন কী করে?’  ‘ঠিক ধরেছ, আমি কলকাতার লোক নই...ফিরতে তো হবেই। আচ্ছা, তোমাকেই জিগ্যেস করছি, গঙ্গার একটা নিরিবিলি ঘাট পাব কোনদিকে? তারপর সেখান থেকে হাওড়া স্টেশন যাব কীভাবে?’ ‘আপনি চিন্তা করবেন না, আমি আপনাকে ঘাট দেখিয়ে দিচ্ছি, বাসের নম্বরও বলে দেব। কিন্তু তার আগে আপনি একটু কোথাও বসে বিশ্রাম করে নিন। আসুন আমার সাথে।’  ‘না বাবা, তার দরকার নেই ... তুমি আমায় পথটা দেখিয়ে দাও তাহলেই হবে।’ এত সহজে ছাড়া যায় নাকি? স্বপ্নিল কাজের স্বার্থে অভিনয় করতে পারে একটু আধটু। গলায় খানিক আবেগ এনে বলে, ‘দেখুন আপনি আমার মায়ের বয়সী। আপনার শরীরের কথা ভেবেই বলছি মাসিমা, একটু বসে যান। আমার হাতে জল খেলেন, বাবা বলে ডাকলেন - দরকার হলে আমি স্টেশনে গিয়েই আপনাকে ...

‘কি... বললে তুমি? বাবা বলে ডাকলাম তাই – না না, সবাই যদি এরকম বলে – এ হয় না, হয় না ...’ ভদ্রমহিলার চোখ দিয়ে জল গড়ায় যেন বাঁধ ভেঙে। স্বপ্নিল কোনভাবে ওঁকে শান্ত করে একটা ফাঁকা জায়গায় এনে বসায়। ঘাটের কাছেই। কেন ঘাট খুঁজছেন - আত্মহত্যা-টত্যা করার তালে আছেন নাকি? না, কাছে বসতে হবে তাকেও। ভদ্রমহিলা বসে আছেন তো আছেনই। স্বপ্নিল খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে নিজেই কথা শুরু করে, আজ যে ঘটনা নিয়ে সবাই কথা বলছে – সেই বিষয়েই। ‘আজ আমারও আর বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছে না। সকালে খবরটা পেয়েই মনখারাপ। এ তো একটা মানুষের চলে যাওয়া নয়, একটা যুগের অবসান...’

‘ হ্যাঁ, ... তা তো বটেই। তুমিও যখন এভাবে বলছ,... একালের ছেলে!’ 

উৎসাহ পেয়ে স্বপ্নিল বলতে থাকে, ‘ওঁর ভক্তদের মধ্যে তো আর বয়সের বাছবিচার নেই। এই দেখুন আপনি বাইরে থেকে ছুটে এসেছেন, আমিও আজ অফিস না গিয়ে সারাদিন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরলাম। ছোট থেকে দেখেছি, আমার ঠাকুমা সন্ধ্যেবেলায় ওঁর গাওয়া ভজন, কীর্তনাঙ্গের গান, স্তোত্র বাজিয়ে শুনতেন।’ কথাটা মিথ্যে নয়। সত্যি সে আজ অফিসের কাজেই রাস্তায় ঘুরেছে, শোকযাত্রা ‘কভার’ করার জন্যই। আর দেবায়ন বসুর গান এমনিতে ভালই লাগে। বাড়াবাড়ি রকমের আবেগ কিছু নেই অবশ্য তার। তবে খবরটা শুনে একটু দুঃখ হয়েছিল সে কথাও অস্বীকার করার নয়। ঠাকুমার ব্যাপারটাও সত্যি। ভদ্রমহিলা আবার চোখের জল মোছেন। স্বপ্নিল বলতে থাকে, ‘অনেকেই বলেন, ওঁর গাওয়া এক একটা গান কেমন করে যেন তাঁদের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। যেমন আমার ঠাকুমা চলে যাবার কদিন আগে ‘আমি অকৃতী অধম’ শুনতে চেয়েছিলেন। আমার বাবা কিন্তু এমনিতে গানটান তেমন শোনেন না, কিন্তু এখনও কোথাও এটা বাজতে শুনলেই ইমোশনাল হয়ে যান, আসলে ওই স্মৃতিটা মনে পড়ে।’ একটু উদাসী ছোঁয়া লাগে তার গলায়।

‘ঠিকই বলেছ।’

‘মাসিমা, একটা কথা বলব? যদি কিছু মনে না করেন।’ একটু একটু করে ঘনিষ্ঠ হবার চেষ্টা করে স্বপ্নিল, ‘আপনার জীবনে এমন কোন স্মৃতি আছে নাকি? আজকের দিনে এভাবে আলাপ হল যখন, জানতে খুব...’ ভদ্রমহিলা একটা অদ্ভুত হাসি দেন তার দিকে তাকিয়ে। ‘তুমি হয়তো বুঝবে...’ আলোটা জ্বেলে লীনা বলেন, ‘ঘরটা মনে পড়ছে?’ দরজাটা খাটো। মাথা নিচু করে ঢুকে মানুষটি বললেন, ‘হ্যাঁ... সেবার এখানেই তো শুয়েছিলাম।’

‘শুতে আর হল কোথায়!’ লীনা বড় করে শ্বাস ফেলেন। সতেরো বছর আগে – এই দিনটাতেই রাত একটা নাগাদ - জলসার শেষে এই মানুষটিকে নিয়ে এসেছিলেন তাঁর স্বামী প্রবাল। এত রাতে কারও বাড়িতে এসে ‘বিব্রত করা’র ব্যাপারে যথেষ্ট আপত্তি করেছিলেন তিনি। প্রবালকে শেষে বলতে হয়েছিল, ‘আপনাকে না নিয়ে গেলে আমার বউ আমায় আজ বাড়ি ঢুকতে দেবে না, দয়া করে চলুন!’ প্রবালদের সাংস্কৃতিক চক্র থেকেই গত কয়েক বছর ধরে একটা বড় বিচিত্রানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়, বাইরে থেকে শিল্পীরা আসেন। সেবার অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল জলসা শেষ হতে, তাই যাঁদের অনুষ্ঠান একেবারে শেষের দিকে ছিল, উদ্যোক্তাদের কারও কারও বাড়িতেই তাঁদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। বাচ্চাদুটো আগেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। অতিথির শোবার ব্যবস্থা করে নিজেদের ঘরে এসে প্রবাল জানতে চেয়েছিলেন, ‘বলতে পারলে না?’ -‘এখন... ক্লান্ত হয়ে এসেছেন, হাতমুখ ধোবার জলটল দিতে দিতে আর কতটুকুই কথা বলা যায়!’ - ‘জানতাম, পারবে না। তোমার দ্বারা কিছুই হবে না। কাল ভোরেই কিন্তু চলে যাবেন, তখন হাত কামড়িও না... নাও সরো, আমারও অনেক খাটনি গেছে আজ, একটু শান্তিতে ঘুমোই’ - বলে একপাশে শুয়ে পড়েছিলেন প্রবাল। সেই শুয়ে পড়াটা যে এমন শান্তির হবে, কে জানত! ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই বুকে ব্যথা শুরু হয়েছিল প্রবালের; বাথরুমে যেতে গিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন। লীনার চিৎকারে উঠে পড়েছিল বাচ্চাদুটো; পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন অতিথিও। লোকজন, ডাক্তার ডাকতে ডাকতেই সব শেষ। এই বিপর্যয় দেখে পরদিন ভোরে ফিরে যাওয়া বাতিল করেছিলেন অতিথি। পাশে ছিলেন অন্ত্যেষ্টি পর্যন্ত। সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করেছিলেন – যে কোন সংবেদনশীল মানুষ যা করে থাকে এ অবস্থায়। কিন্তু তারপর... কাঁদতে কাঁদতে লীনা বলে ফেলেছিলেন, ‘আমার যে সব শেষ হয়ে গেল, দাদা!’ সেই প্রথম সরাসরি সম্বোধন। আগের রাতে দুচারটে কথা – বিহ্বলতার মধ্যে কেবল ‘আপনি আজ্ঞে’ করেই সারা হয়েছিল। মানুষটি এক মুহূর্ত স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়েছিলেন সদ্য স্বামীহারা যুবতীর মুখের দিকে। তারপর বলেছিলেন, ‘দাদা বলে ডাকলে যখন, দাদার কর্তব্য করতে দিয়ো।’ আজও সেই বাড়িতে

সেই অতিথি, সেই গৃহিণী - শুধু গৃহকর্তা নেই। লীনা নিজেকে সামলে নিয়ে, বিছানাটা ঠিকঠাক করে সরে দাঁড়ান সসম্ভ্রমে, ‘আসুন, হয়ে গেছে।’ বিছানায় এসে বসেন মানুষটি। বলেন, ‘এত পরিপাটি সব, একা হাতে...’

‘আমার সাহায্য করার লোক আছে। এত বছর পরে এলেন, এটুকু করব না?... ভেবেছিলাম এবছরও ‘না’ করে দেবেন কি না!’ প্রবাল চলে যাওয়ার পর থেকে দেবায়ন আর আসতেন না এখানকার অনুষ্ঠানে। বলতেন – ‘সেবার অমন একটা ঘটনা ঘটে গেল... আর তাছাড়া আপনারা প্রতিবার একই আর্টিস্টকে ডাকবেন কেন? লোকে ভাববে, আর কাউকে পান না বোধহয়। আমি বলে দিচ্ছি অমুককে – খুব ভাল গাইছে, নিয়ে যান।’

দু-এক বছর এরকম হবার পর উদ্যোক্তারাও আর বলতেন না তাঁকে। লীনার সঙ্গে কিন্তু যোগাযোগটা ছিলই। প্রত্যেক মাসে একটা খাম চলে আসত। বোনের প্রতি দাদার কর্তব্য। লীনা কয়েকবার চিঠিতে অনুরোধ করেছেন, এরকম না করতে। তিনি তো স্বামীর অফিসে একটা ছোট চাকরি পেয়েছেন।

উত্তর এসেছে, ‘ছেলেমেয়েরা বড় হোক, তারপর দেখা যাবে।’ বাইরের কেউই জানত না বিষয়টা। লীনাও ঘন ঘন চিঠি দিতেন না, ওই বিজয়া-নববর্ষে যেটুকু। এখানকার অনুষ্ঠানে এলে, লীনার বাড়িতে থাকা ভাল দেখায় না। আবার না থাকলেও তাঁকে কষ্ট দেওয়া হবে। তাই বোধহয় না আসার সিদ্ধান্ত। লীনা নিজের মত করে এরকম একটা ব্যাখা ভেবে নিয়েছিলেন মানুষটির সামগ্রিক আচরণের।

‘এবার কেন এলাম, জানো?’

‘আমার চিঠি ...পেয়েছিলেন?’ উত্তরের বদলে প্রশ্নই করেন লীনা। 

এবারে প্রবালদের সাংস্কৃতিক চক্রের রজতজয়ন্তী। পাড়ায় অনেকেই ভালবাসত প্রবালকে, লীনাকেও তারা সহানুভূতির চোখে দেখে। এখন নতুন অনেক সদস্য এসেছে, তবু এবারের মিটিং-এ ঠিক হয়েছিল – যারা প্রথম থেকে এই চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন, তাঁদের উপদেষ্টা হিসেবে রাখা হবে। প্রবালের অবর্তমানে লীনাকেই বলতে এসেছিল ক্লাবের ছেলেরা। তখনই তিনি কথাটা পাড়েন, দেবায়ন বসুকে আনা যায় না?

‘উনি কি আসবেন বৌদি? তাছাড়া এখন বয়সও হয়েছে ওনার, অ্যাদ্দূরে কি আর... ’

‘দেখ না, যদি আসেন। এবার তো রজতজয়ন্তী। বড় কেউ না এলে হয়?’ ছেলেগুলোকে পাঠিয়েছিলেন লীনাই। সেই সঙ্গে আলাদা করে একটা চিঠি। আশ্চর্যের ব্যাপার, এবার আর আপত্তি করেন নি দেবায়ন। লীনারও সংকোচ ছিল না। ছেলেমেয়েরা এখন বাইরে। বয়স হচ্ছে, তাই নিজের কাছে ইদানীং রেখেছেন একজন মহিলাকে। সে ছোট ছেলেকে নিয়ে বাড়ির একটা ঘরে থাকে। এ অবস্থায় অতিথি এলে কার কী বলার আছে? দেবায়ন একটু থেমে গম্ভীর মুখে বলেন, ‘চিঠিটা না দিলেও আসতাম। তোমার সাথে বোঝাপড়া আছে।’

‘সে কি!’ অবাক হন লীনা।

‘কাছে এসো।’ লীনা পায়ে পায়ে এগিয়ে আসেন। দেবায়ন একটা কাগজে মোড়া বাণ্ডিল বুকপকেট থেকে বের করেন, ‘এবারের অনুষ্ঠানের ওয়ান থার্ড খরচ নাকি তুমি দিয়েছ?’ ‘...আপনাকে... মানে, কে বলল?’

‘হ্যাঁ কি না বল।’

‘হ্যাঁ, উনি যেদিন চলে গেছিলেন,... এবারও সেই তারিখে অনুষ্ঠান – ওনার স্মৃতিতে...’

‘জানি। ছেলেগুলো কথায় কথায় বলছিল। সে যাই হোক, আমি এটা নিতে পারি না। রাখো।’ ‘না না দাদা, এটা তো ...’ লীনার হাতে একরকম জোর করেই গুঁজে দেন তিনি বাণ্ডিলটা। ‘একটাও কথা না। আর দাদা বলে ডাকবেও না। এইজন্য ডেকেছিলে আমায়!’

‘আমাকে ভুল বুঝবেন না দাদা, আমি... আচ্ছা ক্ষমা চাইছি, এভাবে রাগ করে থাকবেন? আজকের দিনটা...’

‘ঠিক আছে, যাও ওটা সাবধানে তুলে রাখো। শুয়ে পড়।’ জল খেয়ে আলো নেভাতে যাচ্ছিলেন দেবায়ন, আবার দরজার কাছে ফিরে আসেন লীনা। ‘দাদা, এতে তো বেশি আছে।’

‘ঠিকই আছে।’

‘না, এই তো...’

‘দরজায় না, ভেতরে এস’, ডাকেন দেবায়ন। ‘...আমার ভগ্নীপতির স্মৃতিতে অনুষ্ঠানের খরচ দিয়েছ তুমি। সেখানে আমার কিছু কন্ট্রিবিউশন থাকতে পারে না?... চিঠিতে এত কথা লিখলে, ছেলের চাকরি হয়েছে, মেয়ে ইউনিভার্সিটিতে হস্টেল পেয়েছে...আর এটা তো লিখলে না যে এবারে তুমি এত আয়োজন করছ?’ লীনা আর কিছু বলতে পারেন না। চোখে জল। 

‘কেঁদো না লীনা। জানি আজ তোমার মন এমনিতেই খারাপ। দেখলাম, তখনও তুমি অনুষ্ঠান শেষ হবার আগেই উঠে চলে গেলে...’

‘আমি আর পারছিলাম না দাদা। সব আছে, শুধু সেই মানুষটা নেই – আর আপনি ওনার প্রিয় গানগুলোই গাইছিলেন। আমার খালি মনে হচ্ছিল, এত লোকের মধ্যেও আমি বড় একা ...’

‘এভাবে বোল না। তুমি তো ছেলেমেয়েদের মানুষ করেছ। তখন কতটুকু বয়স ছিল তোমার? সেখান থেকে আজ - তুমি হেরে যাওনি, এটাই বড় কথা।’

‘জানেন, উনি সবসময় বলতেন, তোমার দ্বারা কিছুই হবে না। কিছুই পার না...’  ‘পেরেছ তো।’

‘সে আপনি ছিলেন বলে। আমায় হেরে যেতে দেননি।... আর একটা ব্যাপারে আমায় জিতিয়ে দেবেন, দাদা?’

‘কি ব্যাপার?’ লীনার গলায় যেন কিশোরীবেলার আবেশ, ‘আপনাকে নিয়ে... পাগলামি করতাম রীতিমত। আমার সঙ্গে অনেকটাই বয়সের তফাৎ ছিল ওনার... উনি শুনে ছেলেমানুষি বলে খ্যাপাতেন। আমার একটা স্বপ্ন ছিল, আপনাকে রাখি পরাব, আপনি আমায় – ‘তুই’ বলে ডাকবেন। উনি বলতেন, সামনে পেলে বলতে পারবে এসব? না হাঁ হয়ে থাকবে? বলেছিলাম... নিয়ে এসো দেখি তোমাদের ফাংশনে, কেন বলতে পারব না! এই নিয়ে বাজি হয়েছিল আমাদের মধ্যে। সেই আপনি এলেন, অথচ সেদিনই...’ গলা কাঁপতে থাকে তাঁর, ‘আর বলা হয়ে উঠল না। আজ অ্যাদ্দিন পরে বলছি... জানিনা আপনি কী ভাবছেন!

‘কই, দেখি।’

‘ক-কী?’ একটু থমকে যান লীনা।

‘রাখি। এনেছিস?’ খুব শান্ত, স্বাভাবিক স্বরে কথাগুলো বলে, ডানহাতটা বাড়িয়ে দেন তিনি। লীনা প্রায় ছুটে এসে সে হাতটা আঁকড়ে ধরেন নিজের দুহাত দিয়ে। ‘দাদা...!’ সে রাতে আরও অনেকক্ষণ জেগে ছিলেন দুজনে। বোনকে একান্তে একটা গান শুনিয়েছিলেন দাদা। খুব গভীর আর নিচু গলায়, যেন স্পর্শ করছেন অনাহত নাদকে – ‘চিরপিপাসিত বাসনা বেদনা বাঁচাও তাহারে মারিয়া শেষ জয়ে যেন হয় সে বিজয়ী তোমারি কাছেতে হারিয়া...’ টেবিলে রাখা প্রবালের ছবিটা হাসছিল। বাজি হেরে যাবার আনন্দে। ‘পরদিন সকাল সকাল চান করে, তাঁকে রাখিটা পরিয়েছিলাম। সতেরো বছর ধরে তুলে রাখা। যাবার আগে আবার খুলেও দিয়েছিলেন... আমারই আবদারে। বলেছিলাম, আপনি তো ফিরে গিয়ে খুলে রাখবেনই, কোথায় পড়ে থাকবে - তার চেয়ে আমার কাছেই থাক।... কিন্তু উনি তো শেষ কথাটা রাখলেন না। বলেছিলেন, সবসময় আমার পাশে থাকবেন।... তাই ভেবেছিলাম, এটা গঙ্গায় ভাসিয়ে দিয়ে যাব।’

আঁচলের খুঁটটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে থাকেন ভদ্রমহিলা। চুপ করে শুনছিল স্বপ্নিল। এতক্ষণে কথা বলল, ‘রাখিটা... আপনি ফেলবেন না মাসিমা। আজ হয়তো আবেগের বশে আপনার এরকম মনে হচ্ছে। পরে খারাপ লাগবে।...চলুন, আপনাকে বাসে তুলে দিই।’ বাড়ি ফেরার পথে স্বপ্নিল ভাবছিল, সাধারণ একটা প্রতিবেদনই লিখতে হবে তাকে। এই ‘স্টোরি’টা লিখতে সে পারবে না। অতখানি কলমের জোর নেই তার।

বিদ্যুৎ বিভ্রাট

প্রবন্ধ

জুন ২০২০ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

বিমানবন্দরে

বিদ্যুৎ বিভ্রাট

সূর্য বন্দোপাধ্যায়

পোর্টল্যান্ড, অরিগন

airport.jpg

র্যটকদের প্রিয় শহর পোর্টল্যান্ড। আমেরিকার উত্তর পূর্ব অঞ্চলে মেইন রাজ্যে অবস্থিত এই শহরটি একদিকে সামুদ্রিক খাবার, অন্য দিকে Acadia ন্যাশনাল পার্কের দ্বারদেশ হিসেবে পরিচিত। তাই হঠাৎ যখন অফিসের কাজ নিয়ে দুদিন পোর্টল্যান্ড যেতে হবে শুনলাম, মনে মনে অত্যন্ত পুলকিত হয়ে উঠলাম। দুদিন ধরে সামুদ্রিক খাবার খাবো আর সেই সঙ্গে পাহাড় ও সমুদ্রের ধারে ঘুরে ঘুরে ছবি তুলবো ভেবেই "সুদূরের পিয়াসী" মনটা বেশ "চঞ্চল" হয়ে উঠলো। প্রথম দুদিন মনের আনন্দে বিভিন্ন প্রকার এর গলদা চিংড়ি আর কাঁকড়া খেয়ে কাটালাম। পোর্টল্যান্ড অফিসের লোকজন ও দেখলাম খুবই আন্তরিক। প্রথম দেখাতেই ওনারা বিখ্যাত সব স্থানীয় খাবার আর রেস্তোরার সন্ধান দিলেন। তারপর থেকে নিয়মিত ভাবে ওনারা খোঁজ নিতেন সেই সব খাবার খেয়েছি কিনা। যদিও ঘুরে বেড়ানোর পরিকল্পনাটি সফল হলো না। প্রথম দিন ভীষণ ঠান্ডা এবং দ্বিতীয় দিন থেকে বৃষ্টি যোগ হওয়ায় আমি হোটেল এর নিরাপদ আশ্রয়ে থাকাটাই বুদ্ধিমানের কাজ মনে করেছিলাম। এয়ারপোর্ট যাওয়ার পথে দেখলাম ঝোড়ো আবহাওয়া, সঙ্গে বৃষ্টি। ভাড়া গাড়িতে তেল ভরার জন্য নামতে হলো, আর মুহূর্তে ভিজে গেলাম। ওই  ঠান্ডাতে ভেজা জ্যাকেট টুপি আর সোয়েটার পড়ে আধ ঘন্টা গাড়ি চালানোটা মনে হয়েছিল চরম দুর্গতি। কিন্তু পরে বুঝেছিলাম যে আগামী কিছু ঘন্টার তুলনায় এই আধ ঘন্টা কিছুই নয়। এয়ারপোর্ট ঢুকে মনে হলো যেন কোনো মৃত্যুপুরীতে প্রবেশ করছি। চারদিকে একটা গা ছমছম করা অন্ধকার। গাড়ি ফেরত দেয়ার কাউন্টারে গিয়ে শুনলাম যে একটা ট্রাক নাকি ঝড়ের মধ্যে দিকভ্রষ্ট হয়ে একটা ইলেকট্রিক পোলে ধাক্কা মেরেছে। তার ফলস্বরূপ সমস্ত এলাকায় বিদ্যুৎ বিপর্যয় ঘটেছে। ছোটবেলায় কলকাতায় বড়ো হয়েছি। লোডশেডিং এর অনেক স্মৃতি আছে ছোটবেলা থেকেই। বিদ্যুৎ বিভ্রাট মানেই ছিল পড়াশোনা থেকে ছুটি, বারান্দা বা ছাদ এ বসে রাতের সৌন্দর্য্য বা চাঁদের আলো দেখে মুগ্ধ হওয়া। কিন্তু দেখলাম এয়ারপোর্ট এ বিদ্যুৎ বিভ্রাট মোটেই এরকম সুখকর কিছু নয়। ভাড়া গাড়ি ফেরত দেয়ার সময় জানতে পারলাম যে কম্পিউটার চলছে না, তাই ওনারা আমায় রশিদ দিতে পারবেন না । কোম্পানির কাজে এসেছি তাই রশিদ ছাড়া টাকা পাবো না ভেবে মন ব্যাকুল হয়ে উঠলো। কাউন্টার এর ভদ্রলোক জানালেন যে আমি যদি কারেন্ট আসা অবধি অপেক্ষা করি তাহলে অতি আনন্দের সঙ্গেই উনি আমায় রশিদ দেবেন। ভেবে দেখলাম যে রশিদ এর জন্য প্লেন ছেড়ে দেয়া যায় না।  তাই রশিদ এর মায়া ত্যাগ করে চেক ইন করতে অগ্রসর হলাম। চেক ইন কাউন্টার এ দেখি একই অবস্থা। কোনো কম্পিউটার কাজ হচ্ছে না। এমার্জেন্সি সিস্টেমে শুধু এয়ারপোর্ট এর কনভেয়র বেল্ট, কন্ট্রোল রুম কন্ট্রোল টাওয়ার এর লাইট ইত্যাদি চলছে। আর সেই সঙ্গে গুটিকতক সিলিং এর লাইট জ্বলছে। আজকাল আমরা যেরকম মেশিন এ ক্রেডিট কার্ড বা নাম দিয়ে বোর্ডিং পাস প্রিন্ট করি সেই রাস্তা বন্ধ। লোকজন এক এক করে কাউন্টার এ যাচ্ছে, কাউন্টার এর মহিলা ফোন করে হেড অফিস থেকে জেনে নিচ্ছেন সেই যাত্রীর কত নম্বর সিট। তারপরে সাদা কাগজে সেই যাত্রীর নাম আর সিট নম্বর লিখে মহিলা সই করে স্ট্যাম্প মারছেন। একদম যেন ত্রিশ বছর আগের অবস্থা। বলাই বাহুল্য যে এই চেক ইন পদ্ধতি ৫ গুণ বেশি সময় নিচ্ছে। তাই সমস্ত এয়ারপোর্টেই প্রচুর ভীড়, প্রচুর লাইন, আর সেই সঙ্গে লোকজনের প্রচুর বিরক্তি। বিরক্তির আরেকটা কারণ এমার্জেন্সি পাওয়ার এ এসি মেশিন চলছে না। তাই যাত্রীগণ অনেকেই এই গুমোট আবহাওয়ায় ঘামছেন, এবং আরো বিরক্ত হচ্ছেন। চেক ইন কাউন্টার এর সংকীর্ণ জায়গায় প্রচুর যাত্রীর এই ঘর্মাক্ত পরিস্থিতি, পুরো জায়গাটাকে আরো বিরক্তিকর করে তুলছে। সিকিউরিটি চেক এর অবস্থাও দেখলাম বিশেষ ভালো নয়। পাসপোর্ট বা ড্রাইভিং লাইসেন্স স্ক্যান করে সমস্ত ঠিকুজি কুষ্ঠি বার করে ফেলা মেশিনগুলো আজ অচল। একজন বৃদ্ধ সিকিউরিটি অফিসার দুতিন রকম নীল বেগুনি আলোর টর্চ নিয়ে সবার পাসপোর্ট বা ড্রাইভিং লাইসেন্স পরীক্ষা করছেন। ওনার মুখে গর্ব ও তৃপ্তি মিশ্রিত অভিব্যক্তি। আধুনিক যুগের মেশিন এর সঙ্গে আধুনিক যুগের সিকিউরিটি অফিসার গণও এই বিদ্যুৎ বিপর্যয়ে অচল হয়ে গেছেন। সবাই দল বেঁধে ওই বৃদ্ধ সিকিউরিটি অফিসার এর পেছনে দাঁড়িয়ে শিখছেন কিভাবে মেশিন ছাড়াও জাল পাসপোর্ট বা জাল ড্রাইভিং লাইসেন্স ধরা যায়।

যাই হোক প্রায় দুঘন্টা ভেজা জামাকাপড় পড়েছিলাম। সিকিউরিটি চেক এর পরে ভাবলাম বাথরুম এ কাপড় বদলে নেবো। সেখানেও দেখি ঘোর বিপদ। বাথরুমের অল্প আলোতে দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়া এড়াতে কর্তৃপক্ষ বেশিরভাগ বাথরুম বন্ধ রেখেছেন। শুধুমাত্র একটি বাথরুম এমার্জেন্সি আলোতে উদ্ভাসিত। বলাইবাহুল্য সেখানে বিশাল  লাইন। হতাশ হয়ে এয়ারপোর্টের একটা কোনায় গিয়ে ব্যাগ খুলে পোশাক বদল করা শুরু করলাম। হঠাৎ করে সেই অন্ধকারের মধ্যেও দুজন এয়ারপোর্ট কর্মী এসে আমায় শাসিয়ে গেলেন যে আমি যেন পাবলিক জায়গায় এরকম অসভ্যতা না করি। আমি বিনীত হয়ে জানালাম যে আমি শুধুমাত্র পাবলিক জায়গায় নিউমোনিয়া থেকে বাঁচার চেষ্টা করছিলাম। ওনারা জবাবে আমাকে কফি খাবার উপদেশ দিয়ে চলে গেলেন| এমনিতে আমি খুব একটা কফি ভক্ত নই, কিন্তু এই প্রস্তাবটা ভালোই লাগলো। এমনিতেই ঠান্ডা লাগছিল, পেটের আনাচে-কানাচে খিদেরা উঁকি দিচ্ছিলো। আমার ৫:৩০ এর ফ্লাইট ও শুনলাম ৭:০০ ছাড়বে। এয়ারপোর্ট এর একটা রেস্টুরেন্ট এ ঢুকে পড়লাম। রেস্টুরেন্ট এর সুন্দরী একগাল হেসে এমনভাবে অভ্যর্থনা জানালেন যেন এতদিন উনি আমারই পথ চেয়ে বসে ছিলেন। আমি ওনাকে অনুরোধ করলাম অবিলম্বে গলদাচিংড়ির সূপ আর কাঁকড়ার বড়া দিয়ে যেতে। উনি দুঃখের সঙ্গে জানালেন যে বৈদ্যুতিক চুল্লি বন্ধ থাকায় ওনারা কিছুই রান্না করতে পারবেন না। বাধ্য হয়ে কফি চা ইত্যাদির খোঁজ করলাম। বলাই বাহুল্য, আবার নিরাশ হলাম। মরিয়া হয়ে আমি আমার দুর্দশার  কথা বিশদভাবে ব্যক্ত করলাম। উনি আমায় ব্র্যান্ডি খাবার পরামর্শ দিলেন - কারণ মদ্যপান করতে বৈদ্যুতিক সহযোগিতা লাগে না। আমি একটু দুশ্চিন্তা প্রকাশ করলাম, ব্র্যান্ডি খেয়ে ফ্লাইট এ ওঠা কি ঠিক হবে? যদি নেশা হয়ে যায়? মহিলা আমায় আশ্বাস দিলেন যে পোর্টল্যান্ড এ মানুষদের তিন রকম এর নেশা হয়। কারোর হয় সামুদ্রিক খাবারের নেশা, কারোর হয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের নেশা। কেউকেউ আবার পোর্টল্যান্ডের সুন্দরী মহিলাদের কটাক্ষের নেশায় নেশাচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। কিন্তু পোর্টল্যান্ড শহরে কাউকে মদ্যপান করে নেশাছন্ন হতে কখনো উনি শোনেন নি। আমার মুখের সন্দিহান ভাব দেখে ওনার মনে হলো আমি হয়তো কথাটা পুরোপুরি বিশ্বাস করিনি। তাই শেষমেশ উনি এটাও বললেন যে নেশা হলেও চিন্তার কোনো কারণ নেই, কারণ প্লেন চালানোর জন্য পাইলট আছে, আমাকে প্লেন চালাতে হবে না। ব্র্যান্ডি বা যেকোনো ধরণের মদ্যপান এর অর্ডার এর সঙ্গে যে এক প্লেট বাদাম ভাজা ফ্রিতে দেয়া হয়, একথাও উনি জানাতে ভুললেন না। এতক্ষণে ওনার চেষ্টা সফল হলো। আমরা হাজার হলেও ভারতীয় কনসিউমার। যে কোনো জিনিস এ ফ্রি অফার

থাকলে সেগুলো আমরা ছাড়তে পারিনা। অবিলম্বে ব্র্যান্ডি অর্ডার করে পকেট থেকে ক্রেডিট কার্ড বের করে দিলাম। কিন্তু ক্রেডিট কার্ড দেখে সুন্দরীর মুখভঙ্গি অনেকটা কলকাতার বাস কন্ডাক্টরদের মতো হয়ে গেলো। ক্রেডিট কার্ড এর মেশিন ও যে অচল। খুচরো ক্যাশ ছাড়া গতি নেই। কিন্তু যাই হোক এই মহিলার কন্ডাক্ট বাস কন্ডাক্টরদের থেকে ভালোই ছিল। উনি দয়া পরবশতঃ আমাকে ফ্রি বাদাম ভাজা থেকে বঞ্চিত করেন নি। সঙ্গে কফি মেশিন থেকে প্রায় ঠান্ডা ঈষদুষ্ণ এক কাপ কফি ও খাইয়েছিলেন। শুনেছিলাম বাদাম খেলে নাকি বুদ্ধি বাড়ে। দেখলাম, বাদাম ভাজা খেয়ে মনে নানারকম সুবুদ্ধির উদয় হলো। প্রথমে মনে হলো গিন্নিকে অন্তত খবর দেয়া উচিত যে বাড়ি ফিরতে দেরি হবে। ঐদিন আবার মহাকালী পুজো, ভেবেছিলাম সপরিবারে ও সবান্ধবে মাঝরাতে কালীমন্দির এ গিয়ে পুজো দেখবো। কিন্তু এয়ারপোর্ট এ যা অবস্থা দেখলাম, তাতে হয়তো পৌঁছাতে দেরি হবে এই আভাস গিন্নিকে জানিয়ে রাখলাম। ইতিমধ্যে সেই বন্ধুরাও ফোন এ যোগাযোগ করা শুরু করে দিয়েছে, তাদের সবাইকেও জানাতে হলো আমার এই দূর্দশার কথা। এইসব দূর্দশার খবর দিতে গিয়ে লক্ষ্য করলাম নতুন আরেকটি দূর্দশা ঘনিয়ে এসেছে। মোবাইল ফোন এ মাত্র কুড়ি% চার্জ আছে। সমস্ত এয়ারপোর্টেই আজকাল ফোন চার্জ দেয়ার ব্যবস্থা থাকে বলে আমি নিশ্চিন্ত ছিলাম। কে জানতো যে এয়ারপোর্ট এইরকম বিদ্যুৎ বিভ্রাট এর শিকার হবে, আর আমাকে মোবাইল হীনতার আশংকায় ভুগতে হবে! ক্রমশ আসে পাশে তাকিয়ে "বিগ পিকচার" টা কিছুটা বোঝার চেষ্টা করলাম। এমার্জেন্সি পাওয়ার এ কন্ট্রোল রুম, কন্ট্রোল টাওয়ার ইত্যাদি তো চলছে, তাহলে সব ফ্লাইট এ এতো দেরি কেন? এতো ভীড় কেন? যা বুঝলাম, এমার্জেন্সি পাওয়ার এ jetway (যেই টিউব গুলো দিয়ে যাত্রীরা হেটে হেটে এয়ারপোর্ট টার্মিনাল থেকে প্লেন এর পেটের ভেতর ঢুকে পরে) গুলো চলছে না। তাই যাত্রীদেরকে সিঁড়ি দিয়ে হেঁটে টার্মিনাল থেকে মাটিতে নামতে হচ্ছে, এবং তারপরে সিঁড়ি দিয়ে হেঁটে প্লেন এ উঠতে হচ্ছে। ঠিক যেমন আমরা কুড়ি তিরিশ বছর আগের সিনেমা বা ছবিতে দেখতাম। টার্মিনাল এর ১৬টা গেট এর মধ্যে মাত্র দুটো গেট এই সিঁড়ি আছে, তাই সমস্ত ফ্লাইট এই দুটো গেট দিয়েই ছাড়ছে। সেইজন্যই এতো দেরি। বোর্ড এর দিকে তাকিয়ে অনুধাবন করলাম যে আমার ফ্লাইটটা এতক্ষণে পিছিয়ে ৭:৩০ হয়ে গিয়েছে, এবং ও দেখলাম যে দুপুর ৩:০০ এর ফিলাডেলফিয়ার ফ্লাইটটা এই সন্ধ্যে ৬:৩০ নাগাদ ছাড়বে। ভাবলাম চেষ্টা করে দেখা যাক আগের ফ্লাইট এ কোনো সিট ফাঁকা পাওয়া যায় কিনা, তাহলে ১ ঘন্টা আগেই বাড়ি যেতে পারবো। একটা আঠেরো মিনিটের ফোন কল, পঁচিশ ডলার আর ফোনের বাকি চার্জ এর পুরোটা খরচ করে ১ ঘন্টা আগের ফ্লাইট এ সিট বুক করে নিলাম। এবং নিজের এই বুদ্ধিতে নিজেই চমৎকৃত হয়ে গেলাম। ইতিমধ্যে আরো কিছু সময় কেটে গেলো। আমার মোবাইল ও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এর মধ্যে ৬:৩০ আর ৭:৩০ এর ফ্লাইটগুলো যথা ক্রমে পিছিয়ে ৭:০০ আর ৮:০০ হয়ে গিয়েছে। জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম যে ৬:৩০ এর ফ্লাইট অন্ধকার রানওয়েতে ল্যান্ড করতে গিয়ে বেকায়দায় গুঁতো খেয়ে সামনের চাকাটি ফাটিয়ে ফেলেছেন। চাকা বদল করার জন্য এই তিরিশ মিনিটের বাড়তি বিলম্ব। যাই হোক, এই ঠান্ডার মধ্যে সিঁড়ি দিয়ে নেমে, আরেকদফা বৃষ্টিতে ভিজে প্লেন এ গিয়ে চড়লাম। সমস্ত যাত্রীরা বসলেন, দরজা বন্ধ হলো, কিন্তু প্লেন আর এগোয় না। মিনিট কুড়ি পড়ে ঘোষণা হলো যে আমাদের আবার এয়ারপোর্ট টার্মিনাল এ ফিরে যেতে হবে। চাকার সঙ্গে এক্সেলে আরো কিছু ক্ষতি হয়েছে, যেজন্য প্লেনটি মেরামত না করে উড়ান এ যেতে পারবে না। সমস্ত যাত্রীরা বিরক্ত হয়ে গজগজ করতে করতে টার্মিনাল এ ফিরে এলেন। আমার বিরক্তির কারণ আরো বেশি ছিল, কারণ এই দুবার বৃষ্টি ভিজে এই ফ্লাইট এ ওঠানামা করার জন্য আমায় আঠেরো মিনিটের ফোন কল, পঁচিশ ডলার আর মোবাইল ফোনের চার্জ এর পুরোটা খরচ করতে হয়েছিল।

এয়ারপোর্ট কর্তৃপক্ষ এবার জানালেন যে এই বিকল হয়ে যাওয়া ফ্লাইটের সমস্ত যাত্রীরাও এক ঘন্টা পরের ফ্লাইটেই ফিরবেন। সেই ব্যবস্থা করা হচ্ছে। কিন্তু এই দুটি ফ্লাইটের যাত্রীদের একসঙ্গে নেয়ার জন্য আরো বড় বিমানের প্রয়োজন। তাই আমাদের পরিত্রাণের জন্য ওয়াশিংটন থেকে আরেকটি বড়সড় বিমানকে উড়িয়ে আনা হচ্ছে। এই কারণে আমাদের ৮:০০ টার ফ্লাইট এবার ৮:৩০ এ ছাড়বে। যাত্রীদের হতাশা ও বিরক্তি দূর করতে বিকল হয়ে যাওয়া বিমানের সমস্ত খাদ্য (যেমন চিপস, কোল্ড ড্রিংক আর জুস) বিলিয়ে দেয়া হলো যাত্রীদের মধ্যে। চার প্যাকেট চিপস হজম করে সত্যি একটু চাঙ্গা বোধ করলাম। মানসিক অবস্থার সঙ্গে দেখলাম ভাগ্য কিছুটা উন্নতি হলো। নতুন বিমান নির্ধারিত সময়ে এসে পৌঁছল। আমিও একটি খুব লোভনীয় আসন লাভ করলাম - কারণ - আমার পাশের সিট এর সহযাত্রিনী একটি পাওয়ার ব্যাঙ্ক নিয়ে ঘুরছিলেন। প্লেন ছাড়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই ওনার সঙ্গে আলাপ জমিয়ে নিয়ে আমি ওনার পাওয়ার ব্যাঙ্ক এর সাহায্যে আমার মৃত মোবাইলকে আবার পুনর্জন্ম দান করলাম। নির্ধারিত দেড় ঘন্টার জায়গায় আমাদের আড়াই ঘন্টা লাগলো ফিলাডেলফিয়া পৌঁছাতে। শুনলাম যে ওয়াশিংটন থেকে আসার পথে নাকি ঝোড়ো আবহাওয়ায় এই বিমান এর একটি ইঞ্জিন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। তাই আমাদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে পাইলট সাহেব একটি ইঞ্জিন এর সাহায্যেই আমাদের উড়িয়ে এনেছেন। তাই একটু ধীর গতিতে উনি বিমান উড়িয়েছেন। না না, আমাদের দুশ্চিন্তার কোনো কারণ ছিল না। কারণ দুটি ইঞ্জিন বিকল হলেও নাকি অক্সিলারি ইঞ্জিনের এর সাহায্যে বিমান যেকোনো নিকটবর্তী এয়ারপোর্ট এ নামতে পারে। তাই আমরা খুবই নিরাপদেই এসে পৌঁছেছি, আমাদের বিন্দুমাত্র বিপদের আশংকা ছিল না।

মনে মনে ঈশ্বরকে অশেষ ধন্যবাদ দিয়ে এয়ারপোর্ট থেকে বেরোলাম, এবং বাড়ির দিকে রওনা হলাম। প্রায় ৪ ঘন্টা কোনো রকম ফোন এর সংযোগ না থাকায় গিন্নি খুবই উৎকণ্ঠায় ছিলেন। ওনাকে ফোন করে আস্বস্ত করলাম। বলাই বাহুল্য যে সেই রাতে আর মন্দিরে গিয়ে কালীপুজো দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি। আমার কিছু বন্ধুর ধারণা, আমি মহা গুলবাজ, আমার কোনো কথাতেই ভরসা করা যায়না। আমি মন্দির এ পুজো দেখবো না বলে এরকম একটা মনগড়া গল্প তৈরী করেছিলাম। আবার কিছু বন্ধুর ধারণা যে আমি এতই অলস যে আমি সময়মতো এয়ারপোর্ট পৌঁছাতে পারিনি আর তাই নির্ধারিত সময়ে ফ্লাইট ধরতে পারিনি, এবং পরের ফ্লাইট এ ফিরেছি।

আমেরিকার মতো দেশে যে এয়ারপোর্ট এ বিদ্যুৎ বিভ্রাট ঘটা সম্ভব, এটা বিশ্বাস করা সত্যি খুব কঠিন। এই কঠিন কাজটি সহজ করার জন্য আমি সংবাদ মাধ্যমের ওয়েবসাইট এ প্রকাশ হওয়া এই ঘটনার বিবরণটিও আপনাদের সামনে তুলে ধরলাম  :

http://www.mainebiz.biz/article/20181107/NEWS0101/181109963/jetport-flights-delayed-after-traffic-accident-knocks-out-power

ভ্রমণ

সুন্দর শহর ইয়াংজাও

জুন ২০২০ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

AG image (2).jpg

সুন্দর শহর

ইয়াংজাও

অরুন্ধতী ঘোষ

পিটস্‌বার্গ, ইউ এস এ

yungzao4.png

গ্র্যান্ড ক্যানালের ধারে (বেইজিং-হ্যাংজাও ক্যানাল), মধ্য চিনে অবস্থিত এই শহরটি। আমরা এই শহরে এসেছি নিমন্ত্রিত হয়ে ইয়াংজাও বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে কাছেই একটি খুব ভালো হোটেলে। আমার স্বামীর পূর্বতন পোষ্ট-ডক্টরাল ফেলো এবং আমার পূর্ব -সহকর্মী ডাঃ জিয়াংজং জু এখন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। তার একান্ত ইচ্ছায় এবং নিমন্ত্রণে আমরা এখানে এসেছি তার ডিপার্টমেন্ট ও ল্যাবরেটরী ঘুরে দেখব এবং আমার স্বামী এখানে একটি ভাষণ দেবেন  তার কাজের বিষয়ে। আমরা পৌঁছলাম সকাল ৭টায় ইয়াংজাও। আগের দিন রাতে বেইজিং থেকে স্লিপার ট্রেন ধরে এসেছি। স্টেশনে জিয়াংজং অপেক্ষা করছিল। তাকে এই অজানা অচেনা শহরে দেখে মনে হল পরম আত্মীয়। সে আমাদের নিয়ে গেল নিকটবর্তী ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে। হোটেলে যাবার পথে বেশ  ভালো লাগল শহরটি। বেশ ছিমছাম, পরিষ্কার। রাস্তায় গাড়ির যান-জট তখনো শুরু হয় নি। হোটেলে স্নান, জলখাবার সেরে আমরা পাড়ি দিলাম ইয়াংজাও বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে। ক্যাম্পাসে প্রচুর গাছ, মাঝখান দিয়ে রাস্তা চলে গেছে। 
এখানে বলে রাখি চিন হল কৃষিপ্রধান দেশ। কাজেই কৃষিবিদ্যা পড়াশুনার এখানে খুব চল রয়েছে। এছাড়াও পশুচিকিৎসা বিদ্যা নিয়ে পড়াশুনাও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। চিনে গরু, শূকর, ভেড়া, ছাগল, মুরগী, হাঁস ইত্যাদি সবই খাওয়া হয়। কাজেই এদের পালন করা ও অসুখ-বিসুখের চিকিৎসার জন্য পশুর চিকিৎসক প্রয়োজন। প্রচুর জৈবপ্রযুক্তি সংস্থা রয়েছে এই কৃষিবিদ্যা ও পশু চিকিৎসা সংক্রান্ত গবেষণা ও পণ্যদ্রব্য তৈরী করার জন্য। এছাড়াও রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে কৃষিকার্য ও পশুদের ক্ষতি করে এমন জীবাণুদের নিয়ে রিসার্চের ব্যবস্থা। ডাঃ জিয়াংজং পশুদের ভাইরাসের ওপর কাজ করেন। দেখলাম  অন্যান্য অধ্যাপক ছাড়াও অনেক ছাত্র-ছাত্রীরা এসেছে সেমিনার শুনতে। এরা অনেকে মাষ্টার্স করতে এসেছে। এদের মাষ্টার্স ডিগ্রী পাবার জন্য কিছুদিন গবেষণা করে গবেষণাপত্র জমা দিতে হয়। এরা সবাই গবেষণা করছে পশুচিকিৎসাবিদ্যা নিয়ে। সেমিনার শেষে আমরা ডিপার্টমেন্ট ঘুরে দেখলাম। বেশ ভালো ব্যবস্থা। বড় বড় ল্যাবরেটরী, রিসার্চ করার যাবতীয় যন্ত্রপাতি, ভালো মাইক্রোস্কোপ ইত্যাদি কিছুর কমতি নেই। দুপরে লাঞ্চের ব্যবস্থা হয়েছে অধ্যাপকদের ক্লাবে- এখানে সব অধ্যাপকরা দুপুরে লাঞ্চ করেন। বেশ ভালো ব্যবস্থা। প্রচুর খাবার। আমরা ছিলাম বেশ কয়েকজন। খাবার পড়ে রইল না। এখানে বলে রাখি চিনের মানুষরা খেতে জানে এবং ভালোই খেতে পারে। অনেক রকম মাছ, মাংস, সবজি, টোফু (বিন-কার্ড) টক-ঝাল; নানা রকমের পিকল্‌ (আচার বললাম না কারণ আমাদের আচারের সঙ্গে আকাশ-পাতাল তফাৎ)। এরা কিছু পিকল্‌ খায় মুখের স্বাদ বদলানোর জন্য (এক খাবার থেকে আরেক খাবারে যেতে) (palate cleanser) আর কিছু পিকল্‌ ব্যাবহার করে মুখের স্বাদ বাড়ানোর জন্য (Palate enhancer/stimulator)। বেশ ইন্টারেষ্টিং! তাই না! আমাদের-ও তাই মনে হয়েছে। অনেক রকম মূল, গাছের কান্ড এবং পাতা সেদ্ধ খায় (জলখাবারে ও অন্যান্য সময়ে)। ফলের মধ্যে চোখে পড়ল বিভিন্ন ধরণের মেলন, ক্যান্টালোপ, আর ড্রাগন ফ্রুট (এই ফলটি এই অঞ্চলে খুব প্রচলিত)। ইচ্ছা আছে ভবিষ্যতে একবার শুধু চিনে যাব এদের বিভিন্ন ধরণের খাবার নিয়ে রিসার্চ করার জন্য। তবে এখানে বলে রাখি চিনকে ভালোভাবে জানতে যদি চিনে যেতে চান তবে সঙ্গে একজন ম্যান্ডারিন চাইনিজভাষী বিশ্বাসযোগ্য লোক দরকার। কারণটা খুব সহজ। এখানে দূর্নীতি আছে যথেষ্ট। বিশেষ করে যেখানে সেখানে ক্রেডিট কার্ড মোটেও ব্যাবহার করবেন না। আর ভাষা জানা থাকলে যে কোনো জায়গায় আন্তরিক ব্যাবহার পাওয়া যায়।

গ্যালারী - ২

এবারে এই শহরের ইতিহাস নিয়ে কিছু বলি। ঐতিহাসিক গ্র্যান্ড ক্যানালের (Jinghang Canal) ও ইয়াংজাও নদীর সন্ধিস্থলে অবস্থিত এই শহরটি। এই ক্যানাল বা নালাটি বেশ বড়, দেখলে নদী বলে ভ্রম হবে। তবে এই নালাটির তৈরী শুরু হয়েছিল খৃষ্টপূর্ব ৪৮৬ সালে এবং বিভিন্ন অংশে সম্পূর্ণ হয়েছিল পরবর্তী ১০০০ বছর ধরে। নালাটি ইয়াংজি নদীর সঙ্গে পীত নদীকে (Yellow River) যুক্ত করে। নালাটি তৈরী হয়েছিল জনবহুল উত্তর চিনের সঙ্গে শষ্যবহুল দক্ষিণ চিনকে যুক্ত করার জন্য।একসময় এই নালার খুবই ব্যাবহার ছিল রাজকীয় চিনে (Imperial China)। খুবই ভালো উদ্দেশ্য নিয়ে তৈরী হলেও পরবর্তী কালে রেলপথ তৈরী হবার পর এই নালার ব্যাবহার অনেক কমে গেছে। শোনা যায়, প্রায় ৫০ লক্ষ শ্রমিক (বয়স ১৫-৫৫ বছর) লেগেছিল এই নালা তৈরী করতে। এবার শহরের কথায় আসি। শহরটি বেশ বর্ধিষ্ণু, সংস্কৃতি ও খাবারের জন্য এর খ্যাতি আছে। সং সাম্রাজ্যের পতনের পর এই শহরের অবনতি হয় এবং পুনর্বার খ্যাতি বাড়ে মিং সাম্রাজ্যের উত্থান ও উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে। প্রশ্ন জাগে মনে কেন এরকমটা হল? কারণ, দেশের নানা দিক দিয়ে সিল্ক, ধান ও নুনের আমদানী হত দেশের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। রাজকীয় ইন্সপেকশন ট্যুরের অনেক শহরের মধ্যে ইয়াংজাও ছিল একটি বিশিষ্ট শহর। ক্রমে ক্রমে ১৮শ শতাব্দীতে বড় বড় নুনের ব্যবসায়ীরা তাদের প্রাসাদ গড়ে তুলেছিল। এখানে অনেক সুন্দর সুন্দর বাগান আছে।

গ্যালারী - ১

শাও সি হু (Shou Xi Hu)ঃ দুপুরে লাঞ্চের পর জিয়াংজং আমাদের নিয়ে এল এ। ই পার্কে আমাদের জন্য একটি গাইডের ব্যবস্থা করেছিল। তার সঙ্গে আমরা পার্কটি ঘুরতে শুরু করলাম। পার্কটি অসংখ্য উইলো গাছে ঢাকা। এখানকার বিখ্যাত পশ্চিম লেক (West Lake) ঘিরে এই মনোরম পার্কটির অবস্থান। লেকের পাশ দিয়ে যেতে যেতে অনেক ছোট ছোট ব্রিজ, প্যাভিলিয়ন পেরোলাম। একটি পাঁচতলা প্যাগোডাওলা ব্রিজ আছে। এছাড়াও আছে একটি সাদা রঙের প্যাগোডা। তৈরী হয়েছিল সম্রাট কুইনলং এর আগমনের জন্য।শোনা যায় সম্রাটের আগমনের জন্য নুনের ব্যবসায়ীরা রাতারাতি নুন দিয়ে এই প্যাগোডা তৈরী করেছিল সম্রাটকে দেখাবার জন্য। সম্রাট দুর থেকে এই প্যাগোডা দেখে সত্যিকারের ভেবেছিলেন এবং তুষ্ট হয়েছিলেন। ভাগ্যিস এই নকল প্যাগোডার কাছে যেতে চান নি! পরবর্তীকালে নকলের জায়গায় আসল প্যাগোডা তৈরী হয়, সাদা রঙের। লেকের প্রেক্ষাপটে এই প্যাগোডা দেখতে ভালো লাগল। 

আমাদের গাইড আমাদের দুজনকে নানা জায়গায় দাঁড় করিয়ে ফটো তুলতে খুব উদগ্রীব। আমরাও তার মডেল হয়ে বেশ কিছু ছবি তুললাম। লেকের পাশ দিয়ে যেতে যেতে দেখলাম এক বিশেষ ধরণের  রাজহাঁস ও ছোটো হাঁস ভেসে বেড়াচ্ছে। কয়েকটি ছাউনি দেওয়া ভেলা দেখলাম ভাসছে। গাইডের কাছে জানলাম যে ওই ভেলাগুলি রাজহাঁস দম্পতিদের বাসা। একেকটি দম্পতি একেকটি ভেলায় বাসা বাঁধে। লেকের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে দেখলাম একটি ভেলার ছাউনির ভিতরে একটি ছোট খড়ের বাসার উপর বসে মা রাজহাঁস ডিমে তা দিচ্ছে। অবশেষে এসে পড়লাম পার্কের শেষে। এই শান্তিপূর্ণ, সুন্দর ছবির মতো পার্কটিকে বিদায় জানিয়ে আমরা আমাদের ভাড়া করা গাড়িতে উঠে বসলাম। এবার যাত্রা পরবর্তী গন্তব্যস্থলের দিকে। ইয়াংজাও মিউসিয়ামঃ এরপর গেলাম এই মিউজিয়ামটিতে। এখানে নানা ধরণের হস্তশিল্প সাজানো আছে। এই মিউজিয়ামটি না দেখলে চিনে বেড়ানো অসমাপ্ত থেকে যেত। এখানের অন্যতম কুটিরশিল্প হল ল্যাকারের তৈরী জিনিস (Lacquerware)। কাঠের বড় বা ছোট প্যানেলের ওপর নানা জিনিস বানানো মূলত: চিত্রকলা। এবারে কিভাবে পুরো জিনিসটি বানানো হয় বলছি। প্রথমে যে প্যানেলের ওপর বানানো হবে সেটির ওপরে দৃশ্যটির একটি প্রতিরূপ বানিয়ে নেওয়া হয়। এবার সেটিকে প্যানেলের ওপর বসিয়ে খোদাই করে দৃশ্যটি আঁকা হয় কাঠের ওপর। এবার ভরাট করার কাজ। বিভিন্ন রঙ, সোনালী রাংতা, নানারকমের ফেলে দেওয়া কাপড়ের বা কাগজের টুকরো ও অন্যান্য জিনিস ব্যাবহার করা হয় এই ভরাট করার কাজে। এই শিল্পের তৈরীর ছয়টি বিভাগ আছে, কার্ভিং (খোদাই করা), শোভেলিং (খোঁড়া বা কোরা), লিউটিং (ভরাট করা), মেকিং (তৈরী  করা), পেস্টিং (জোড়া দেওয়া বা আঠা দিয়ে লাগানো), স্প্রিঙ্কলিং (ছিটানো বা ছড়ানো)। চিত্রকলাটি বানানো হয় কোনো ঐতিহ্যগত দৃশ্য বা আধুনিক বিমূর্ত শিল্পের ওপর।

এই ধরণের ছবি তৈরীর পদ্ধতি শুরু হয়েছিল অনেক বছর আগে চিন সাম্রাজ্য। আমরা দেখলাম কয়েকটি অপূর্ব সুন্দর ছবি, জেড পাথর ও ঝিনুক খোদাই করে করা। এই ধরনের নানাপ্রকার পাথর খোদাই করে ল্যাকার চিত্রকলার শুরু হয়েছিল তাং সাম্রাজ্যে। এরপর মিং ও কিং সাম্রাজ্য আরো অন্যান্য মূল্যবান পাথর বা রত্নখচিত ল্যাকার চিত্রকলা শুরু হয়। পান্না, অ্যাগেট, অ্যাজুরাইট, সাদা জেড, প্রবাল, জ্যাস্‌পার, মুক্তো ইত্যাদি খচিত চিত্রকলা স্থান পেয়েছে অনেক মিউজিয়ামে। এছাড়াও আমরা দেখলাম অন্যান্য চিত্রকলা। সাদা কাগজ বিভিন্ন ভাবে কেটে, প্যানেলের ওপর সাজিয়ে দৃশ্যপট তৈরী করা হয়েছে। সবশেষে দেখলাম হাতের সূচিকর্ম। নানারঙের সুতো দিয়ে খুব সূক্ষ কাপড়ের ওপর অপূর্ব সব দৃশ্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে যা একদম ক্যামেরায় তোলা ছবির মতোই জীবন্ত। নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস হয় না যে আমরা ফটো না, সূচিকর্ম দেখছি! ছবির পাশে রাখা লেখা পড়ে জানলাম এখানকার শিল্পীরা একটি সুতোকে আটভাগে ভাগ করে সেটি দিয়ে সেলাই করে ছবির মতোই জীবন্ত এইরকম সূচিকর্ম তৈরী করেন। এই মিউজিয়ামটি সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় চলে। এদের একটি নিজস্ব দোকান আছে। সেখানে সবরকমের শিল্পকর্ম বিক্রি হয়। আমরা কিনলাম একটি ছোট কাঠের প্যানেলে সবুজ ও গোলাপী জেডপাথর খচিত ল্যাকারের চিত্রকলা। এটি প্যাকিং-এর পর আর আমাদের ছোট সুটকেসে আঁটলো না। কিন্তু আমার স্বামী অতি যত্ন-সহকারে নিজে হাতে করে নিয়ে এলেন আমাদের বাড়িতে। এখনো আমাদের ফায়ারপ্লেসের ওপরে রাখা এই শিল্পকর্মটি আমাদের এই মিউজিয়ামটি দেখার অভিজ্ঞতার কথা মনে করিয়ে দেয়। পরেরদিন সকালে হোটেল থেকে বেরিয়ে আমাদের জন্য নির্ধারিত গাড়িতে উঠে বসলাম সাঙ্ঘাই-এর পথে। আমাদের ফেরার প্লেন ধরতে হবে ওখান থেকে। গাড়ি মসৃণ ন্যানজিং-ন্যানটং এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে এগিয়ে চলল ইয়াংজাওকে পিছনে ফেলে। প্রায় আড়াই ঘন্টা বাদে আমাদের পৌঁছে দিল সাঙ্ঘাই এয়ারপোর্টে। এযাত্রায় সাঙ্ঘাই দেখা হল না। ফেরার তাড়া আছে। মনে রয়ে গেল চিনে বেড়ানোর বিভিন্ন মুহূর্তের কোলাজ।

জুন ২০২০ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

গল্প

অন্তরণের বিজ্ঞাপণ

অন্তরণের বিজ্ঞাপন

শুভম তালুকদার

village2.jpg

সালটা ১৯৪৯, শরৎকাল। কালশিরা হত্যাকাণ্ড তখনও হয়নি। কিন্তু, জন্মাষ্টমীর শোভাযাত্রায় আক্রমণ এনেছিল ‘আনসারের দল'। এই দুই বছর ধামরাই রথযাত্রা পালন করতে দেওয়া হলো না সুকুমারদের। দুর্গাপূজাতেও যে একটা গোল বাঁধবেতা পূর্ব-পাকিস্তান রাইফেল বাহিনীদের' কনভয় দেখেই বোঝা যেতে লাগলো। ১৯৪৬ সালে যে গ্রামগুলিতে নোয়াখালি জেনোসাইড বা দাঙ্গা হয়েছিল, সুকুমার সেখানের বাসিন্দা। রামগঞ্জ, বেগমগঞ্জ, রায়পুর- পরের গ্রাম লক্ষীপুর, যা টিপ্পেরহ জেলার চৌদ্দগ্রাম থানা থেকে দু-ঘণ্টার হাঁটা পথ। পুরো গ্রামটা ২,০০০ বর্গ মাইল-এর থেকে বড় নয়।
'রহমতখালী ফেরি ঘাটে' নেমে একটু এগিয়েই মজু চৌধুরী হাটে এসে সুকুমার একটি দোকানের গায়ে স্বাধীন অক্ষরে বাংলাদেশ লেখাটা দেখল। লেখাটা দেখে সে উপলব্ধি করল যে মানুষেরা নিঃশ্বাস নিয়েই বেঁচে থাকে আর, সে এতক্ষণ নিঃশ্বাসই ফেলছিল। 
লেখাটা দেখে যেমন তার গর্ববোধ হলো, স্বাভাবিকভাবে কিছুটা কষ্ট হলো ঠিকই। সে বাংলাদেশ লেখাটা আবার দেখে এবং আরো একবার বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে নেয়। সে মনে-মনে ভাবে 'জমি-জেলাকে তো কাঁটাতার দিয়ে ভাগ করা যায় কিন্তু, আকাশকে ভাগ করা যায় কি করে? এপার বাংলা ওপার বাংলা এক হলেও এখানকার সবুজের অন্তরঙ্গতাটা যেন একটু বেশীই।' ইংরেজ শাসকেরা এই পরিবেশ দেখেও কি করে বন্দুক-গুলি ফেলে না দিয়ে, এই দেশের মানুষদের তাদের নিজের ভাই না মনে করে এদের উপর অত্যাচার চালিয়েছিল সেটা ভেবে পায়না সুকুমার। মেঘের মধ্যে যেন সারাক্ষণ একটা খুনসুটি চলছে। বাতাসের মধ্যে মলিন গন্ধ যা গাছের সাথে মিশে একটি অপরূপ সৌন্দর্য সৃষ্টি করে।
এমনই অপরূপ ছিল সুকুমারের বাল্যকালের প্রেম শিউলি। এমনি উভচরী নাম ছিল সেই মেয়ের, কিন্তু জাতে ছিল সে মুসলমান। তার বাংলাদেশে আসার মূলত দুটি কারণ, থুড়ি, একটি। আমি অন্তত বলবো অনেক কটি রেখা একটি বিন্দুতে এসে অবতীর্ণ হয়েছে। বাইশ বছর পর ভারত থেকে বাংলাদেশে ফিরে এসেছে সুকুমার। তার কাছে বাংলাদেশের স্মৃতি মানেই শিউলি, আর শিউলিকে ছেড়ে চলে যাবার কারণ হলো এই দেশভাগ।
‘বাংলাদেশে চলে তো এলাম ঠিকই কিন্তু, এখন শিউলিকে খুঁজে পাবো কি করে? এখনো লক্ষীপুরের বাড়িতে গেলে কি ওদের পরিবারের কাউকে খুঁজে পাবো? কাউকে খুঁজে পেলে তারা কি আমাকে চিনতে পারবে? - এতগুলো আবেগপূর্ণ, পার্শ্ববর্তী প্রশ্নের পর এখনকার বস্তুত, জিনিস এর দিকে একটু বুদ্ধি ব্যয় করার চেষ্টা করে। 
'কাউকে একটু জিজ্ঞেস করলে ভালো হতো যে এখান থেকে লক্ষীপুর কোথায়, আর কতটা’।
একটি সবজির দোকানে একটি লোককে টমেটোর দর করতে দেখে জিজ্ঞেস করে - 'এই যে দাদা শুনছেন, এখান থেকে লক্ষীপুর... একি! নূর?' লোকটি সুকুমারের দিকে নিরভঙ্গিমায় তাকিয়ে থাকে, অর্থাৎ অনুমান করে ও সুকুমারকে চিনতে পারেনি। একবার সে বোর্ডে মাস্টার এর লেখা মুছে নিজের নাম বড় হরফে লিখেছিলো। তার জন্যে মার ও বকাও খেতে হয়েছিল। এখন সে পার্টির দেওয়াল লেখে। ‘আমাকে চিনতে পারিসনি? আমি সুকুমার, তোর বাল্যকালের বন্ধু’। নূর তার ছোটবেলাকার বন্ধুকে চিনতে পারলেও যেন মনে করলো এই জীবনে তার আবার বাংলাদেশে ফিরে আসার কোন দরকার ছিল না। কিছুটা অপ্রস্তুত ভাবে বলল ‘তুই এত্তো  দিন পরে এডা আসলি যে?’
সে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলেও তার মেকি আনন্দ দেখাতে অক্ষম হয়।
‘একটা কারণ আছে, তুই এখনো লক্ষ্মীপুরে থাকিস তো? যেতে-যেতে বলছি। কিন্তু তোর মুখের একই অবস্থা? এত চাপ দাড়ি, মোটা গোঁফ, আর যুগ্ম ভুর তো ছোট থেকেই।
আচ্ছা, নবিহা মাসির বিয়ে হয়েছে? বাসুকি খুড়োর হাঁসগুলো এখনো রোজ সকালে ডিম দেয়? হরিণ বাড়ির মেয়েরা এখনো রোজ সকালে গলা সাধে?’, সুকুমার এত বছরের মনের ভিতর জমে থাকা প্রশ্নগুলো আর ধরে রাখতে পারে না। শুনলে মনে হবে সুকুমার যেন এই কালকের খবর নিচ্ছে। সে ভুলে গেছে বাইশটা বছর পেরিয়ে গিয়েছে। ‘তুই এখনো আবু তাহের মাঠে বল খেলিস? আচ্ছা, ডেঙ্গারা এখনো ষোলজন মিলে ফুটবল খেলে?’ এতক্ষণে একটু চুপ করে এবং নূরের থেকে উত্তরগুলি জানতে চায়। এতগুলো প্রশ্ন একসাথে করে ফেলায় মনে মনে লজ্জিত বোধ করে সে। যেন তার আবার এও মনে হয় নূরের কাছে লজ্জা কিসের? এত বছর পর দেখা হলেও সে তো তার বন্ধুই তো। সুকুমার জানেনা সময় যেমন বদলায় সময়ের সাথে সাথে বদলায় মানুষও। ‘ইখনত আর খেলতে জাউয়া হয়না। কিন্তু তুই বৈললে এখন একটু পায়ে গোলা ছোঁয়াতে পারি। আর বাকি সব প্রশ্নের উত্তর দিমু কিন্তু আপাতত তুই আমার বাসায় চল’ রাস্তায় চলা শুরু করতে না করতেই একটা ধুলোর ঝড় ওঠে। সামনে দিয়ে কিছু উড়তি ছেলে, ভ্যানে করে মা দুর্গার মূর্তি নিয়ে চলেছে| দাদাদের পাশে হাঁটতে-হাঁটতে চলেছে কাঁসর ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে। তাদের পেছনে আরেকটি ছোট্ট ছেলে ভ্যান এর পেছনে ঘুড়ি হাতে নিয়ে  দৌড়োচ্ছে, যাকে অন্যরা কেউ পাত্তা দিচ্ছে না।

পুজোতে হয়তো তার একটাও জামা হবে না। কিছুক্ষণের জন্যে নাপিত কমানো বন্ধ করে দোকানের বাইরে বেরিয়ে প্রতিমাটিকে দেখে। রাস্তার চারিধারে গাছগুলি মাথা নাড়তে থাকে যেন মা দুর্গার এই ভিনদেশে আগমনীকে তারা আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। ঘুড়ি হাতে ছোট্ট ছেলেটা একমাত্র সুকুমারের দিকে চায় এবং তার সামনে এসে দাড়ায়, আবার ঠাকুরের পিছনে দৌড়াতে থাকে। সুকুমার একটি মিষ্টির দোকানে দাঁড়ায় এবং দুই বাক্স ক্ষীরমোহন কেনে। নূর বলতে থাকে 'আহা ইসবের আবার কি দরকার সিলো?''তোকে দেখে আমার খুব লোভ হচ্ছে। কলকাতায় থাকতে থাকতে আমার কথা বলার মধ্যে বরিশালের টানটা একেবারেই চলে গেছে। আচ্ছা এখন এখানে দুর্গা পুজো হয়?'

'ইখান থেকে ঠাকুর বানায় লিয়ে যায়।রহমান সাহেবের প্রশ্রয়ে অনেক বাড় বাড়সে ইরা'।

'মুসলমানেরা পুজোতে যোগদান করে না? এখনও এই ভেদাভেদ চলে আসছে?'

'ঝগড়াণ করে যদি নবমীর দিন ভোগ খাওয়ায়। আর ঝড়ি ভেদাভেদের কথা করিস তাহলে শোন - এডা এখনো কোন মুসলিম নাপিত ভাই কোন হিন্দুর গোফ কামায় লা'।

চলতে চলতে, রাস্তায়ে আরো বাল্যকালের কোথা এসে পড়লো। তার পরেই সোজা রাস্তা যেখানে ডান দিকে বাঁক নিলো, নূর বা দিকের তৃতীয় বাড়িটা দেখিয়ে বলো - ‘এডা আমগো বাসা'।

নূর বাইশ বছর আগে এখানেই থাকতো কিনা সুকুমার মনে করতে পারেনা। বাড়ির সামনে কুয়াটা ভীষণ-ই বিকট দেখাচ্ছে। বাড়ির প্রধান দরজাটা দো পাল্লার। পাল্লাগুলি নতুন করে সবুজ রং করা হয়েছে।

‘কি নূর ভাই, আজকে এরশাদ সাহেব এর মিটিংয়ে যাবেন না?’ হেঁকে একটি লোক সাইকেলে করে চলে যায়। বাইশ বছর আগে সেও হয়েতো ছোট ছিল এবং সুকুমার-এর সাথে খেলেছে কখনো।

নূর আস্তে গলায় সাড়া দেয় ‘জামু’। পরক্ষণে, নূর তার বাড়ির দেরাজে কড়া নাড়ে এবং তার মেয়ের উদ্দেশে বলে ‘কৈ ঝুমুর মা, দেরাজ খান খোল '

একটি ছোট্ট, ছিপ-ছিপে, ফর্সা মেয়ে দরজা খোলে। তার চোখ, ঠোঁট এবং চোখের ওপরের ভুরুগুলি তার অনেক দিনেরই চেনা। ঝুমুরকে দেখে সুকুমারের মনে হলো সে যেন শিউলির খুব কছেই আছে। শিউলিকে খুঁজে পেতে তার আর বেশি দেরি নেই।

সুকুমারকে ভেতরের ঘরে একটি ছোট্ট টুলে বসতে দেয় নূর। সে বলে তার বউ ‘গোচোর’ করে এক্ষুনি আসছে। সুকুমার এক দৃষ্টিতে ঘুমুর এর দিক চেয়ে থাকে। তার মনে পরে যায় কিভাবে শিউলি তারে খেলা থমিয়া দিয়া, মোরে ওপারে হাথ ধরে নিয়ে গিয়ে খুব কেঁদেছিল আর বলেছিল ‘তুমি সত্যিই চলে যাচ্ছ?’ কোনো প্রতিশ্রুতি সেদিন শিউলির মনে ধরেনি। কিন্তু সুকুমারকে সে নিয়ে গিয়েছিল শিউলির পুরোনো বাগান বাড়ির ছাদে এবং সুকুমারের হাথের ওপরে নিজের হাথ রেখে ঠিক অঞ্জোলির ফুল নেবার মতন তুলে ধরেছিল আকাশে, ঠিক চন্দ্রর কুলুঙ্গি। সুকুমার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সে ফিরে আসবেই। দশ-কুড়ি বছর পেরিয়ে গেলেও শিউলি তো বলেছিল সে প্রতিক্ষা করে থাকবে।

নূর-এর বাড়িটা নেহাতই ছোট। নূর এর স্ত্রী তার মাথার চুল মুছতে-মুছতে ঘরে প্রবেশ করলে। সুকুমার একটি মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে দেবে বলে উঠে দাঁড়ালো। সুকুমার-এর দৃষ্টি নূরের স্ত্রীর দিকে যেতেই হিম হয়ে গেল। শিউলি এখানে? শিউলি তার মানে নূরের স্ত্রী?

‘শিউলি আমাকে চিনতে পারছো না?’ এই প্রশ্নটাই সুকুমারের মনে বারবার ঘুরতে থাকলো। শিউলি তারে দিকেই তাকিয়েছিল। হাত থেকে প্যাকেট খানা নিয়ে বললো -

‘আপনি ওর বাল্যকালের বন্ধু শুনলাম। তা, আপনি লখিপুরে থাকতেন?’, এতো বছর পরেও তার গলার স্বর একই আছে। সত্যিই শিউলি সুকুমারকে চিন্তে পারেনি।

সুকুমার কিছু একটা বলার চেষ্টা করল, হয়তো সে বলতো ‘মেয়েতো তোমার মতন-ই দেখতে হয়েছে’ 'কিন্তু একটা শব্দও বেরোলো না। সুকুমার তৎক্ষণাৎ অন্য মিষ্টির প্যাকেটটা নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো। দুটি মিষ্টির প্যাকেট যে সে একই ঘরের জন্যেই আনছে সে মিষ্টি কেনবার সময় জানতো না। তার-ই মতন প্যাকেটগুলি একটি স্থানে এসে অবতীর্ণ হয়েছে আজ।

কোন কথা বাড়াতে চায়না সুকুমার। কোনো জিনিসের স্থান বরাবরের জন্যে পরিবর্তন করতে গেলে যদি বাইরে থেকে জোর দিয়ে প্রবাহিত করতে হয় তাহলে তাকে না ছোঁয়াই উচিৎ। সে সেখানেই থাকুক। আর কোনো চলন্ত বস্তুকেও আজ থেকে থামবে না সুকুমার। বাইশ বছর আগের সেই মধুর সন্ধ্যা আজকে যেন একটা স্বপ্ন মনে হয়। ‘তাহলে শিউলি কি সেদিন অপেক্ষা করে থাকবে বলেনি? সেটা কি শুধুই কল্পনা?’ গলাটা ভীষণ যন্ত্রনা করছে যেন। হঠাৎ কেউ তার জামা ধরে টান মারলো, হ্যাঁ, সেই বাচ্চা ছেলেটা যে ঘুড়ি হাথে নিয়ে ঠাকুরের মুর্তির পিছনে দৌড়াচ্ছিলো। তারে হাথে শুধুই লাটাই আছে শুধু। ঘুড়ি নেই। সে বলে - ‘বাবু পুজোর সময়, কিছু দিন'।

সুকুমার অন্য মিষ্টির প্যাকেটটা বাচ্চাটার হাতে দিয়ে বলে ‘এটা খেয়ো'।

আমেরিকার দূর্গাপুজো

জুন ২০২০ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

গল্প

আমেরিকার দুর্গাপূজা

সূর্য বন্দোপাধ্যায়

পোর্টল্যান্ড, অরিগন

durga-sketch.png

বি ঠাকুর লিখেছিলেন যে আমরা বাঙালিরা চঞ্চল এবং সুদূরের পিয়াসী। শুধু যে আমরা সুদূরেই যাই, তা নয়, সুদূরে যাওয়ার সময় আমরা আমাদের বাঙালি সংস্কৃতিও আমাদের সঙ্গে নিয়ে যাই। তাই তো সাবর্ণ রায়চৌধুরীর দুর্গাপূজা কলকাতা ছাড়িয়ে ভারতের সমস্ত বড় শহর, এমনকি ইউরোপ আমেরিকা অস্ট্রেলিয়া ইত্যাদি দেশের বিভিন্ন শহরেও উদযাপিত হয়। আমেরিকায় আসার সময় এরকমটাই শুনেছিলাম। তাই ২০০৬ সালে, আমার আমেরিকার প্রথম দুর্গাপূজার একমাস আগে থেকেই খোঁজ খবর শুরু করে দিলাম যে কাছাকাছি কোথায় পূজা হয়, এবং আমার অফিস থেকে মিনিট চল্লিশেকের দূরত্বেই একটা বাঙালি পুজোর খোঁজ পেয়ে গেলাম। ছোটবেলায় দেখতাম যে পুজোর প্যান্ডেলে বাঁশ পড়ছে মানেই স্কুল কলেজ ছুটি। আমেরিকায় কিন্তু উল্টো ব্যবস্থা, মানে স্কুল বিল্ডিং এর ভেতরেই সব পুজো হয়। যাই হোক, আমেরিকার মাটিতে, স্কুল এর ভেতরে মা দূর্গার দর্শন পেয়ে খুব ভালো লাগলো। প্রথম আবেগ এর ধাক্কাটা সামলে উঠে তারপরে চেষ্টা শুরু করলাম কার কার সঙ্গে আলাপ করা যায়। সোমক নামের একটি ছেলের সঙ্গে আলাপ জমে গেলো, সাউথ কলকাতার ছেলে, আমার থেকে বছর পাঁচেক এর বড় হবে। ওর কাছ থেকে অনেক কিছু জানতেও পারলাম। আর ঘন্টাখানেক এর মধ্যেই দেখলাম দশ পনেরোজন লোক এসে আমায় জিজ্ঞেস করে গেলো যে আমেরিকায় প্রথম পুজো কেমন লাগছে। সৌজন্য বিনিময়ের ফাঁকে জানতে চাইলাম "আচ্ছা সোমকদা, সবাই কি করে বুঝে যাচ্ছে যে আমেরিকায় এটা আমার প্রথম পুজো? এখানে কি সবাই সবাইকে চেনে?" সোমকদা বোঝালো "ভালো করে আসে পাশে দেখ, পোশাক দেখে বুঝেছে" এতক্ষণ ভালো করে লোকজনকে দেখিনি। এবারে ভালো করে দেখলাম যে ছেলেরা সবাই ধুতি পাঞ্জাবি বা শেরওয়ানি পরে এসেছে, মেয়েরা সবাই খুব জমকালো শাড়ী পরিহিতা। আমি একমাত্র নতুন জিনস আর নতুন টিশার্ট পরে 'হংস মাঝে বক যথা' হয়ে বসে আছি। সোমকদাকে জিজ্ঞেস করলাম "আমেরিকায় এসে কি লোকজন বেশি বাঙালি হয়ে যায়? কলকাতার পুজোয় তো দেখতাম যে লোকজন যত পারছে ওয়েস্টার্ন জামাকাপড় পরে ঠাকুর দেখতে বেরোচ্ছে। অষ্টমীর অঞ্জলি ছাড়া তরুণীদের কখনো শাড়ী পড়তে দেখিনি কলকাতার পুজোয়।" সোমকদা উদাসীন হয়ে বললো "না রে, বাঙালিরা বাঙালি থাকে চিরকাল। কলকাতায় ওরা ওয়েস্টার্ন পরে স্টাইল দেখায়, আর ওয়েস্টার্ন দেশ এ এসে এরা সব ইন্ডিয়ান জামাকাপড় এর কম্পিটিশন করে" তারপরে আরো যোগ করলো "আর তাছাড়া ভেবে দেখ, দেশে থাকলে মহিলারা গয়না আর শাড়ী দেখানোর জন্য বিয়েবাড়ি, অন্নপ্রাশন ইত্যাদি সুযোগ পায়। এখানে পুজো ছাড়া কোথায় এইসব কম্পিটিশন করবে?" হঠাৎ করে সোমকদা একজন তরুণীর সঙ্গে গল্প করতে ব্যস্ত হয়ে গেলো। পরে জানলাম ওর নাম কৃষ্ণা, আগে একসঙ্গে চাকরি করতো ওরা। শুনলাম সোমকদা বলছে "বঙ্গ সম্মেলন এ তোর নাচের প্রোগ্রামটা দেখলাম, খুব সুন্দর হয়েছে"। কৃষ্ণা খুব খুশি কিন্তু বিনয় করে বললো "ওই আর কি, দেশ ছাড়ার পরে তো আর চর্চা হয় না, কোনো মতে উৎরে গেছে"। সোমকদা নাছোড়বান্দা "না রে, খুব ভালো হয়েছে, চালিয়ে যা। চর্চা ছাড়িস না"। কৃষ্ণা আরো বিনয় আর হতাশা মিশিয়ে বললো "কোথায় আর সুযোগ পাই বোলো। পরের বছর বঙ্গ সম্মেলন তো কানাডাতে হচ্ছে, এদিকে ফেরত আসবে আবার ৬ বছর পরে"। সোমকদা বললো "তুই কি বঙ্গ সম্মেলন ছাড়া নাচতে পারিস না নাকি? এইতো আমাদের পুজো হচ্ছে, এখানেকরছিস না কেন?"। কৃষ্ণা মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করলো "তুমি এবছর আমাদের পুজোর ফোটোগ্রাফি করছো না কেন?"। সোমকদা একটু গম্ভীর হয়ে বললো "ওই আগের বছর ইন্দ্রানীদির ছবির ব্যাপারটা হয়েছিল না? তাই এবছর রক্তিমদা আমাকে ফটোগ্রাফির ডিউটি দেয়নি"। কৃষ্ণা ও একটু হাসি দিয়ে বললো "আমার ও ওই জন্মদিনের ব্যাপারটা হয়েছিল না? তাই আমিও এবার কালচারাল প্রোগ্রাম থেকে বাদ"। কৃষ্ণা চলে যাওয়ার পরে চেপে ধরলাম। "এই সোমকদা, এই ইন্দ্রানীদি আর রক্তিমদা, এরা করা? আর কি এমন আপত্তিজনক ছবি তুলেছিলে তুমি যে তোমাকে ফোটোগ্রাফি থেকে বাদ দিলো?" সোমকদা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বললো। "রক্তিমদা হচ্ছে আঁখিদির হাসব্যান্ড।

আঁখিদি আর ইন্দ্রানীদি কেউ কাউকে সহ্য করতে পারে না। আগেরবার ইন্দ্রানীদির একটা খুব ভালো ফটো তুলেছিলাম। প্রচুর লাইক এসেছিলো ওই ছবিতে। আঁখিদির ফটোতে অতগুলো লাইক আসেনি। সেই রাগে রক্তিমদা আমায় বাতিল করলো" একটু অবাক লাগলো, তাও জিজ্ঞেস করলাম "আর ওই জন্মদিনের কেসটা কি?" সোমকদা একটা মুচকি হাসি দিলো। "কৃষ্ণার ছেলের ১ম জন্মদিন ছিল, মনে হয় অগাস্ট এর শেষের দিকে একটা মঙ্গলবারে। আঁখিদি অনেকবার করে বলেছিলো জন্মদিনের পার্টিটা পিছিয়ে দিয়ে সেপ্টেম্বর এর একটা রবিবারে করতে"। আরো অবাক লাগলো "কেন? জন্মদিন পিছিয়ে দিতে বললো কেন?"। "মঙ্গলবার করে আঁখিদির মেয়ের নাচের ক্লাস থাকে। তাই মঙ্গলবার হলে আঁখিদি আসতে পারবে না। তার পরের দুটো উইকেন্ড ও আঁখিদির অন্য নেমন্তন্ন ছিল। তাই পিছোতে বলেছিলো"। আসতে আসতে ব্যাপারটা বোধগম্য হচ্ছিলো "বুঝলাম, আর কৃষ্ণা নিশ্চয়ই ছেলের ১ম জন্মদিনটা দিনের দিনেই করেছে?" "ঠিক তাই। আঁখিদি ছাড়া বাকি সব মহিলারা সেখানে গেছে, হৈহৈ করেছে। সেইজন্যই এবার কৃষ্ণাকে কোথাও নাচ করতে দেয়া হয়নি"। এইসব পলিটিক্স ঠিক মাথায় ঢুকছিল না। "কিন্তু এই রক্তিমদা আর আঁখিদি দুজনে মিলে কি করে সব কিছু decide করে? কখনো কোনো কমিটিতে তো এক ফ্যামিলি থেকে দুজনকে রাখতে দেয়া হয়না। এটাতো সোসাইটি এক্ট বা কমিটি এক্ট এর বেসিক নিয়ম"। সোমকদা একটা তাচ্ছিল্যের সুরে বললো "ধুর কোন জগতে যে তোরা থাকিস! রক্তিমদা বড়োসড়ো বাড়ি কিনেছে, পুজোর পরে রক্তিমদার বেসমেন্ট এ প্রতিমা থাকে। তাই রক্তিমদার কথাই এখানে ফাইনাল। ছোটবেলায় মনে নেই, পাড়ার ক্রিকেট খেলা? যে ব্যাট নিয়ে আসে সেই ক্যাপ্টেন হয়, তাকে আগে ব্যাট করতে দেয়া হয়, তাকে দুতিনবার আউট না হলে কেউ আউট বলে না? ধরে নে অনেকটা সেইরকম ব্যাপার"। ক্রিকেট এর লজিকটা মাথায় ঢুকলো, অবাক ও লাগলো। কিন্তু এখানে যে প্রতিমা বিসর্জন হয় না, বেসমেন্ট বন্দি হয়, সেটা জেনে আরো অবাক লাগলো। আরো অনেক নতুন নতুন জিনিস দেখে অবাক হতেই থাকলাম। হাজার হোক, আমেরিকার প্রথম পুজো বলে কথা। দেখলাম এখানে কলকাতার মতো ঠাকুর দেখার তাড়া নেই। দুদিন ধরে সবাই বসে আড্ডা গল্প দিয়ে খাওয়া দাওয়া করে নাচ গান ইত্যাদি অনুষ্ঠান দেখে পুজো পালন করে। আড্ডা ব্যাপারটাও খুব কৌতুকময় লাগলো। দুদিন ধরে বেশিরভাগ ছেলেদের আড্ডার বিষয় দেখা গেলো "সৌরভ গাঙ্গুলি টিমে কবে ফিরবে", "দ্রাবিড়ের ক্যাপ্টেন্সি বেশিদিন টিকবে নাকি কংগ্রেস সরকার বেশিদিন টিকবে" এই সমস্ত বিষয় নিয়ে। এছাড়া সবাই দেখলাম RECESSION বলে একটা শব্দ নিয়ে খুব চিন্তিত। চিন্তার প্রধান বিষয় যে "RECESSION হলে দেশে ডলার পাঠালে বেশি টাকা পাওয়া যাবে নাকি কম টাকা পাওয়া যাবে", আর "RECESSION হলে আমেরিকায় ইলিশ মাছ আর স্কচ এর দাম বাড়বে নাকি কমবে" এই সব নিয়ে। মেয়েদের আড্ডার বিষয় দেখা গেলো অপেক্ষাকৃত সহজ। প্রথমত যেই বান্ধবীরা অনুষ্ঠানে উপস্থিত আছে, সেই বান্ধবীদের ও তাদের সাজ পোশাক গয়না, স্বামী আর সন্তানদের প্রশংসা করা। দ্বিতীয়ত যেই বান্ধবীরা উপস্থিত নেই, কিংবা পুজোয় আসেনি, সেই বান্ধবীদের ও তাদের সাজ পোশাক গয়না, স্বামী আর সন্তানদের নিন্দা করা। পুজোর শেষে মেয়েদের সিঁদুর খেলা এবং ছেলেদের কোলাকুলির সঙ্গে একে অপরকে জ্ঞান দেয়ার পর্ব চলতে থাকে। রক্তিমদার মতো কয়েকজন গৃহস্বামী বাকিদের বলে "কি রে, আর কতদিন এইরকম বাড়ি ভাড়া গুনবি, এবারে একটা বাড়ি কিনে ফেল" এই ভাড়াটেরা আবার বাকিদের জ্ঞান দেয় "আর কতদিন দেশি কোম্পানিতে কাজ করবি? এবারে একটা লোকাল প্রোডাক্ট কোম্পানিতে ঢুকে যা" দেশি কোম্পানির কর্মচারীরা আরো নতুনদের জ্ঞান দেয় "কি করছিস? গ্রীনকার্ডটা এপলাই কর এবারে, আর কতদিন ভিসা নিয়ে বসে থাকবি?" ভিসাওলারা আর কি করে? আরো আনকোরাদের ডেকে বলছে যে "আর কতদিন বাস এ করে ঘুরবি? লাইসেন্সটা কর, গাড়ি কেন একটা" আমি তো সবচেয়ে নতুন, আমার কিছুই বলার নেই। আমি তাই মা দুর্গার সামনে গিয়ে হাত জোর করে বললাম "মা গো, এইসব কি আসছে বছর আবার হবে?"

ডিমাপুর

ভ্রমণ

জুন ২০২০ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

sanjay.jpg

ডিমাপুর..

গ্লাটোনাসদের স্বর্গ রাজ্য/

লেইমারাম(মণিপুর) এর পথে

সঞ্জয় গোষ্মামী

dimapur1.jpg

গ্যালারী - ১: ডিমাপুর

ডিমাপুর..  গ্লাটোনাসদের স্বর্গ রাজ্য

ধানসিঁড়ি (Dong siri - Ravine of peaceful habitation) নদীর তীরের শহর ডিমাপুর মাংস প্রেমিকদের হোলিল্যান্ড বলা যায়।। ইতিহাসে কথিত আছে একদা ডিমাপুর শহরের বাইরে কাছারি রাজবংশ বিশাল প্রাচীর তুলে রেখেছিল বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে বাঁচতে (চার ফুট চওড়া এবং প্রায় ষোল ফুট উঁচু) তাই অনেক ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ ডিমাপুরকে ব্রিক সিটি রূপেও নামকরণ করেছিলেন।

ডিমাপুর এর খাদ্য সংস্কৃতি এত বৈচিত্রময় হওয়ার মুল কারণ এর ডেমগ্রাফিক ভ্যারিয়েশন। নাগা, জৈন (মুলতঃ শেঠি সম্প্রদায়, যারা কোহিমা থেকে সরে চলে এসেছিলেন), তামিল, বাংলাদেশি মুসলিম, কেরালাইট, রাজস্থানি কি নেই....... অনেকে মজা করে বলেন 'মিনি ইন্ডিয়া'.... ফলে বুঝতেই পারছেন বাজারগুলি ঘুরলে টের পাবেন হরেক সব্জি থেকে মাংস। চটের ব্যাগে ছুঁচোর মাংস থেকে গরু, ভেড়া, মুরগী, ছাগল, কুকুর হরেক মাংসের পসরা। বাজার থেকে বেরিয়ে একটু গলি বেয়ে এগোলে রান্না করা মাংস ও পেতে পারেন।ফলে গ্ল্যাটোনাসদের জন্য ডিমাপুর সব পেয়েছির দেশ। ফুডি লোকজনের কাছে যেন চোখ ধাঁধানো ব্যাপার স্যাপার। আমি নিজে পকেটে জেলুসিল সিরাপ নিয়ে গান্ডে পিন্ডে গিলেছি হরেক মাংস এবং বাজারে বিক্রি হওয়া মশলাদার খাবার। বাজারগুলির দোকানে আরামসে বাংলা বলতে পারেন, বেশিরভাগই বাংলাদেশি অরিজিন, অনেকের তো টান টাও যায়নি। শহরটা ইম্ফলের মত পরিচ্ছন্ন বা সাজানো গোছানো নয় ফলে আপনার মনে দাগ কাটা অসম্ভব।। উত্তরের রাজ্য ফলে ভোর পাঁচটা থেকেই রাস্তায় ব্যস্ততা আবার রাত ন'টার মধ্যে সব জনশূণ্য প্রায়।

Kachari ruins of Dimapur..

ডিমাপুর শহরের প্রাণকেন্দ্রের এক আকর্ষণ কাছারি রাজবংশের মোনোলিথ রুইনস। মুলত উপজাতীয় মানুষদের হারিয়ে সেই জয় কে স্মরণীয় রাখতে কাছারি রাজা (কথিত আছে তারা ঘটোৎকচের বংশধর) এই মনোলিথগুলি বানিয়েছিলেন। Dimapur নামটাও এসেছে কাছারি ভাষা

থেকেই৷ Di - river/ water, Ma - big, Pur - City. যার অর্থ দাঁড়ায় Big river city, more precisely ডিমাপুর হল রিভার ভ্যালী শহর (Dhansiri river)। কাছারি রাজাদের পরাস্ত করে পরে অহম ডাইন্যাস্টি এলেও, শহরের প্রাণকেন্দ্রে এই মোনোলিথগুলি আজও যেন ইতিহাস বয়ে নিয়ে চলেছে। ASI নেওয়ার পর কিছুটা যত্ন ফিরলেও, ণ ছাপ সুস্পষ্ট।

লেইমারাম(মণিপুর) এর পথে

ইরাং ভ্যালির পিচ কালো রাস্তা ধরে প্রায় ৩০ কিমি যাওয়ার পর সবুজ পাহাড়গুলির "নিশিডাক" শুরু। কোলে মেঘ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়ের ঢেউগুলির অমোঘ আকর্ষণকে অস্বীকার করা প্রায় অসম্ভব। Moiram District পার হতেই শুরু Bishnupur district যার ছোট্ট গ্রাম লেইমারাম, হয়ত মণিপুরের সবচেয়ে সুন্দরী গ্রাম। সারপেনটাইন সরু রাস্তা চলেছে পাহাড় অভিমুখে, চারিদিকে সবুজের সমুদ্র আর নীল ঢেউ পাহাড়ের। ঢেউ এর গায়ে মেঘের ফেনিল উপস্থিতি, এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে দোল খাচ্ছে, এত রোমান্টিক রাস্তা খুব কম দেখেছি। কিছুটা যাওয়ার পরেই রাস্তার ধারে লোকাল মদের পসরা সাজিয়ে ঘরণীরা বসে, লাল, হলুদ, সবুজ তাদের রঙের মেলা। যদিও খাওয়া হয়নি কিন্তু রঙের সমারোহ মনে বেশ একটা দোলা দিয়ে যাচ্ছিল কিন্তু কড়া অনুশাসন এর চোটে শালা টেরিয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই সম্ভব ছিল না। তবে এ রাস্তার রোমান্টিকতায় আঘাত হেনেছে কমল মিত্তির রূপে টোল ট্যাক্স..... প্রায় ১০০ টাকা কম বেশি কমলবাবুদের দিয়ে অবশেষে গন্তব্যের ঠিকানা। গন্তব্য সাদু চিরু জলপ্রপাত।

সাদু চিরুর প্রবেশ পথেই অনেক দোকান, বিশেষ করে হরেক সব্জী, অনেক দেখা অনেক অদেখা। আধা ভাঙা সিড়ি বেয়ে, সবুজের বাসভূমিতে সতর্ক পদচারণ এর পর ঝরণার ধারে। উফফ কি মায়াবী পরিবেশ! প্রায় ২০০ মিটার উঁচু থেকে তিরতির করে নেমে ভিজিয়ে দিল সাদু চিরু। সাদু চিরু আমায় মুগ্ধ করল।

গ্যালারী - ১ঃ মনিপুর

রিইউনিয়ন

গল্প

জুন ২০২০ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

রিইউনিয়ন

সুপ্রিয় চক্রবর্তী

coffeehouse.jpeg

নেরো বছর হয়ে গেছে পাশ করেছে সবাই, কিন্তু সবাই এখনো সেই সব দিন, মুহূর্ত ভুলতে পারেনি। সকলে প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়তো, স্নাতক স্তরে। এখন সবাই নিজ নিজ যায়গায় প্রতিষ্ঠিত।

পাঁচ বন্ধু, প্রীতম, শ্রী, দেবাশিস, দীপ্ত এবং সুশান্ত একসাথে রিউনিওন করার পরিকল্পনা করলো। সাথে যাবে সুশান্তর স্ত্রী শ্রুতি। পরিকল্পনা অনুযায়ী স্থির হল পাহাড়ি কোন গ্রামে যাওয়া হবে। সুশান্ত গত মাসে একটি বাংলো কিনেছে একটি পাহাড়ি গ্রামে। গ্রামটির নাম মিরিক, দার্জিলিং থেকে মাত্র দুই ঘণ্টা লাগে ওর বাংলোতে পৌঁছতে তবে এরা সবাই যাবে গাড়িতে, সরাসরি নিউ জলপাইগুড়ি থেকে, সময় তাও কম লাগবে, মাত্র আড়াই ঘণ্টা।

(প্রীতম এবং শ্রী স্বামী-স্ত্রী। কলেজের পরে তারা বিয়ে করে। শ্রী একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের প্রোফেসর। প্রীতম ব্যবসা করে, নিজের সফটওয়ার কোম্পানি খুলেছে।) (দেবাশিস একটি বেসরকারি কোম্পানিতে বেশ উঁচু পোষ্ট এ কাজ করে। সদ্য নিজের বাড়ি কিনেছে রাজারহাটে।)

(দীপ্ত একমাত্র সরকারী চাকরি করে। সাথে তার নিজের ব্যবসা করে। একবছর আগে নিজের পাবলিশিং হাউস খুলেছে। দেবাশিস ও দীপ্ত অবিবাহিত।)

 

বাংলো বাড়ির সামনের সাজানো বাগান। সুশান্তর কথাতে, ওর বাংলোর কেয়ারটেকার সুব্বা কিছু চেয়ার আর দুটো টেবিল বাগানে পেতে দিয়েছে। সবাই মিলে একসাথে সন্ধ্যেবেলা আড্ডা মারছে।

প্রীতমঃ জায়গাটা বেশ ভালো, নির্জন, চারিদিকে জঙ্গল আর পাহাড়। কিন্তু কোনো Infrastructure নেই। ভাবছি এখানে একটা হোটেল খুললে কেমন হয়? থ্রী-স্টার হোটেল, সাথে সুইমিংপুল, প্লে-গ্রাউন্ড, ফ্রী-ইন্টারনেট..

দীপ্তঃ থাম থাম, অনেক হয়েছে। এই শুরু, যেখানে যাবি কোনো না কোনো ব্যবসা করার কথা বলবি। আরে দুদিন ছুটি কাটাতে এসেছিস, খাওয়া-দাওয়া কর, প্রেম কর, এই পরিবেশটাকে উপভোগ কর।

শ্রীঃ দীপ্ত একদম ঠিক বলেছে। সব জায়গায় গিয়ে শুধু ব্যবসা, আর টাকার চিন্তা। কলেজে পড়াকালীন এরকম ছিল না জানিস দীপ্ত। মনে আছে তোদের, আমাদের মধ্যে, ও আর অরিজিৎ কীরকম সারাদিন বিপ্লবের কথা বলতো? একদিন বিপ্লব আসবে, সমাজতন্ত্র পরিকাঠামো তৈরি হবে, যে সমাজে গরীব মানুষ বলে কিছু থাকবে না। সাম্যবাদ, গণতন্ত্র...

দেবাশিসঃ ওসব দিয়ে কি হবে? কোন সমাজের কথা বলছিস শ্রী? তুই তো নিজেই নিজেকে বিক্রি করে দিয়েছিস কর্পোরেট কোম্পানীর কাছে। সকাল বিকেল হাজিরা দিস, গুচ্ছ গুচ্ছ টাকা আর কাঁচের দেওয়ালে নিজেকে বন্দী করে রেখেছিস।

শ্রীঃ জানি। আমাদের মধ্যে কেউ কি কথা রাখতে পেরেছে? আমি এখন এক গভীর নিদ্রায় স্বপ্ন দেখতে চাই। একাকী, নির্জনতায়, নদীর মতো কাঁদতে চাই, আমি অন্ধকারাচ্ছন্ন হতে চাই, ঘুমোতে চাই প্রাচীন অজৈব রাত্রির মতো।

প্রীতমঃ Elegia by Pablo Neruda, দেবাশিস এখন আমার কাছে টাকাই সব। কেন জানিস? কারণ টাকা দিয়ে সব কেনা যায়। টাকা ছাড়া স্বপ্ন দেখা যায় না, টাকা ছাড়া মানুষ চেনা যায় না, আর টাকা না থাকলে সমাজ তোকে অস্বীকার করবে, ছুঁড়ে ফেলে দেবে কোন অন্ধকার আস্তাকুরে।

দেবাশিসঃ কথাটা ভুল বলিসনি। কিন্তু আমরা নিজ ধর্ম বিসর্জন দিয়েছি। টাকার পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে নিজেদের অস্তিত্বকে বিসর্জন দিয়েছি। অরিজিৎ কিন্তু সেটা করতে পারেনি। তাই ওকে সমাজ ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে গভীর অন্ধকারে।

দীপ্তঃ তোরা কেউ অরিজিৎ এর কোনো খবর জানিস?

দেবাশিসঃ শেষ তিনমাস আগে পেপারে পরলাম ওকে নাকি বিহার পুলিশ এরেস্ট করেছে। ওর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা চলছে। ছাড়া পাওয়া মুশকিল।

শ্রীঃ জানিস গতমাসে নতুন নিয়ম চালু হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে কোন ছাত্র ছাত্রীর সাথে কথা বলা যাবে না, দশ মিনিট লেট হলে তোমাকে জবাবদিহি করতে হবে। প্রোফেসররা নাকি ছাত্রদের উস্কানিমুলক কথা বলেছে। কর্তৃপক্ষের নানাবিধ নিয়মে সবাই জর্জরিত। তবুও কেউ মুখ খুলবে না, সবার টাকার দরকার। মাঝে মাঝে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। বাইরের আকাশটা কালো কাঁচে ঢাকা থাকে সারাদিন, আমার নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়...

দীপ্তঃ তুই চাকরিটা ছেড়ে দে শ্রী। প্রীতম তো এখন ভালো টাকা রোজগার করছে। তুই বরং ফিকশন লেখা শুরু কর। তোর এক সময় স্বপ্ন ছিলো বড় লেখক হওয়ার। লেখা শুরু কর আবার।

প্রীতমঃ এখন কেউ ফিকশন পরে না। তোকে নতুন কিছু লিখতে হবে, যেটা বাজারে আলু পটলের মতো বিক্রি হবে।

দেবাশিসঃ কয়েকদিন আগে একটা বই পড়া শুরু করলাম। দু পাতা পড়ার পর বন্ধ করে দিলাম। শুধু গালাগালি, প্রেম, অবৈধ সম্পর্ক আর নতুন নতুন শব্দ। কোনো অভিধানে সেই শব্দ তোরা খুঁজে পাবিনা।

দীপ্তঃ যেমন? বই প্রকাশ করার আগে সব প্রকাশক এডিট করে।

দেবাশিসঃ তোরা কেউ Lolz, Tyt, Brb মানে জানিস?

প্রীতমঃ Tyt, Brb মানে জানি। take your time and be right back

শ্রীঃ laughed out loud. Lolz is an acronym and its one of the most common slang terms in electronic communications.

(সবাই মিলে হেসে ওঠে। সুশান্ত এবং শ্রুতি প্রবেশ করে। ওরা বাইরে গিয়েছিলো বাজারের কাজে। এখানে বেশি কিছু পাওয়া মুশকিল। নীচের বাজারে বিকেলে কিছু সবজি বসে, সাথে একটা মাংসের দোকান।)

সুশান্তঃ (হাতে বাজারের ব্যাগ, হন্তদন্ত হয়ে ঢুকে) সুব্বা, আরে এই সুব্বা... বাজারের ব্যাগ টা নিয়ে যাও। কি অদ্ভুত যায়গা মাইরি, কিছু পাওয়া যায়না। ধুর এর থেকে শহরে একটা ফ্ল্যাট কিনলে কাজে দিতো। 

শ্রুতিঃ আমি বার বার বারণ করেছিলাম যে এখানে বাড়ি কিনো না। কে শোনে আমার কথা। কতবার বললাম, রাজারহাটে বাবা নতুন ফ্ল্যাট দেখেছে। সব আছে, সাথে টুয়েন্টি ফোর আওয়ারস সিকুরিটি। বাবুর পাহাড়ে প্রেম জন্মেছে। পাহাড়েই মরতে চায়। নাও মরো এবার...

সুশান্তঃ আরে ছাড়ো তো তোমার বাবার কথা। পাহাড়ের প্রেম তোমার বাবা কি বুঝবে?

শ্রীঃ আরে কি অদ্ভুত তোরা আবার ঝামেলা শুরু করলি?

প্রীতমঃ অনেক হয়েছে। শান্ত হয়ে বস এবার। শহরের মানুষদের high altitude এ একটু অসুবিধে হয়।

দেবাশিসঃ কি হোলো, সুব্বা আবার কোথায় গেলো?

দীপ্তঃ আরে জানিস না? পাহাড়ের মানুষরা সন্ধ্যের পর লোকাল রাম খেয়ে পরে থাকে।

দেবাশিসঃ লোকাল রাম আবার কি?

প্রীতমঃ just like বাংলা অ্যান্ড চুল্লু। দীপ্ত একবার দেখতো সুব্বা কোথায় গেলো? রাত্রের খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে, না হলে আমাদের কেও রাত্রে লোকাল রাম খেতে হবে।

দীপ্তঃ ঠিক আছে, দাঁড়া আমি দেখছি।

সুশান্তঃ দীপ্ত একটু ব্যাগটা নিয়ে যা। আর ওকে খুঁজে পেলে বল, মাংসটা রান্না করার আগে কিছুটা কষিয়ে এখানে দিয়ে যেতে। এদের কাবাব বানাতে বললে, মুরগিগুলো কাঁদবে। বলবে, হায় রে যখন কাটলি, তখন একটু ভালো করে রান্না করতে পারলি না...।

(দীপ্ত ব্যাগ নিয়ে হাসতে হাসতে বেরিয়ে যায়)

শ্রীঃ জায়গাটা কিন্তু বেশ ভালো বেছেছিস। এখানে এলে শহরে ফিরতে ইচ্ছা করে না। মনে হয় সারাদিন পাহাড়ের কোলে বসে মেঘের আলপনা দেখি। আর রাত্রে পাহাড়গুলো কেমন নিস্তব্ধতার চাদরে মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ে। যেন হিমবাহেরও ঠাণ্ডা লাগে।

প্রীতমঃ যদি তুমি প্রকৃতিকে ভালোবাসো তাহলে তুমি সব জায়গায় প্রকৃতিকে খুঁজে পাবে, কারণ প্রকৃতি সব জায়গায় আছে। শুধু তাদের রঙ, গন্ধ, স্বাদ আর রূপ আলাদা।

দেবাশিসঃ বাবা, কবি হলি কবে? এবার তুইও বই ছাপা। এখনকার বাজারে ছাইপাঁশ লিখলে ভালো চলে, শুধু দরকার প্রপার মার্কেটিং।

সুশান্তঃ তোরা কাকে নিয়ে আলোচনা করছিলি?

দেবাশিসঃ সেরকম কিছু না। প্রীতম অরিজিতের কথা বলছিলো। তুই কোনো খবর জানিস?

সুশান্তঃ না, বিশেষ কিছু জানি না। তবে কয়েক মাস আগে পেপারে পরেছিলাম।

শ্রীঃ থাক, ওসব কথা আর বলিস না। শ্রুতি এসব কিছুই জানে না। অন্য প্রসঙ্গে কথা বল।

শ্রুতিঃ কি ব্যাপার? কে অরিজিৎ?

দেবাশিসঃ অরিজিৎ আমাদের বন্ধু। কমরেড অরিজিৎ। ছেলেটা খুব ভালো ছিল। আমরা একসাথে পার্টি করতাম। স্বপ্ন দেখতাম, বরং বলা যায় অরিজিৎ স্বপ্ন দেখাতো অন্যদের...

প্রীতমঃ আমরা এখনো স্বপ্ন দেখাই, কিন্তু সেগুলো লাভের স্বপ্ন। বলতে পারিস আমারা এখন স্বপ্ন কেনাবেচা করি।

সুশান্তঃ দুর শালা, আমি এখনো স্বপ্ন দেখি। কিন্তু কোন বাজারে সেগুলো কিনতে পাওয়া যায় জানিনা।

দেবাশিসঃ সবই জানিস। কেন এইতো পাহাড়ের কোলে অচেনা বাজারে কি সুন্দর একটা বাড়ি কিনলি। আর শালা বলে কিনা স্বপ্ন বিক্রির বাজার জানে না...

সুশান্তঃ আরে এটা তো সখ, স্বপ্ন কোথায়? অদ্ভুত কথা বলিস তুই। দেখছিস এখন বাড়িটা কিনে নিজে ফেঁসে গেছি। বাজার নেই, খাওয়ার নেই, মোবাইল কানেকশন চলে যায়, আর একটা ভৃত্য পেলাম সেটাও শালা হাইব্রিড মাল...

শ্রীঃ বাজে কথা রাখতো। শহরে থেকে থেকে তোরা ক্যাপিটালিস্ট হয়ে গেছিস। মেটিরিলিস্টিক চিন্তা ভাবনা ছাড়া থাকতে পারিস না।

প্রীতমঃ কিন্তু এত ভালো বাংলা-বলা নেপালি ভৃত্য পাওয়া কিন্তু ভাগ্যের ব্যাপার।

দেবাশিসঃ ঠিক বলেছিস। সুব্বা কিন্তু দারুন বাংলা বলে।

শ্রুতিঃ আরে সুব্বা তো হাফ বাঙালি। ওর মা বাঙালি।

দেবাশিসঃ কি বলছিস রে?

সুশান্তঃ আরে সেই জন্যই তো বললাম যে সুব্বা একটা হাইব্রিড মাল। বাবা নেপালি, বাঙালি মেয়ের প্রেমে পড়ে বিয়ে করে...

(দীপ্তর প্রবেশ)

দীপ্তঃ আরে শোন সুব্বা বললো রাতের ডিনার রেডি। আর মাংস কষা নিয়ে আসছে। পনেরো মিনিট অপেক্ষা করতে বললো...

শ্রুতিঃ আরে কি রান্না করলো এর মধ্যে? যাই আমি গিয়ে দেখি একবার। হাফ বাঙালি হলেও বিশ্বাস নেই। হয়তো মাংস সিদ্ধ করে বললো মোমো রেডি...

(সবাই হেসে উঠলো, আর দেবাশিস ওর খালি গ্লাসটায় হুইস্কি ঢালতে শুরু করলো)

সুশান্তঃ দাঁড়া দাঁড়া তোদের জন্য একটা সারপ্রাইস আছে। পাহাড়ের কোলে তোদের শান্তিনিকেতনের ছাতিম ফুলের গন্ধ শোঁকাবো|

শ্রীঃ কি বাজে বকছিস? এখানে ছাতিম গাছ থাকতেই পারে না। ছাতিম গরমের গাছ। নিছে রৌদ্র শুষে নিয়ে, আগন্তুকদের আশ্রয় দেয়।

দেবাশিসঃ তোর চড়ে গেছে। যা বৌয়ের সাথে গিয়ে রান্নায় হাত লাগা...

সুশান্তঃ দাঁড়া দাঁড়া ফোন করছি। তোরা গল্প কর, আমি আসছি একটু পর। (সুশান্ত ফোন করতে করতে বেরিয়ে যায়।)

দীপ্তঃ ঠাণ্ডাটা বেশ জাঁকিয়ে বসেছে কিন্তু। উফ তোরা এই শীতে কি মরতে মিরিক আসার প্ল্যান করলি বলতো? এখন রাজস্থান যাওয়ার সময়, তা না করে ডিসেম্বরে মিরিক...

দেবাশিসঃ শহরের পরিবেশে নিজেকে পুরো মেরে ফেলেছিস। মনে আছে তোদের, সেই শীতকালে সন্ধ্যেবেলা পি. এল. টি তে মিটিং? উফ সেই সব কি দিন গেছে। চরম শীতেও শমীকদার কালজয়ী ভাষণ।

প্রীতমঃ আমাদের লড়াই সরকারের সাথে না, আমাদের লড়াই পুঁজিবাদের সঙ্গে। সমাজের সব কিছু খারাব না, কিন্তু আমাদের শ্রেণীদ্বন্দ্বের ইতিহাস ভুলে গেলে চলবে না। আমাদের পরণে গরম জামা, আর আমাদের পরিবারের সদস্যদের পেটের জ্বালায় রাতের ঘুম। এই সমাজ আমাদের পরিবার, আর সবাই আমাদের পরিবারের সদস্য।

শ্রীঃ শহরের গরম কি এক রকম? তার অনেক রকম আছে। মিটিং-মিছিলের গরম, শীত ভাঙ্গা শহরের কোলে বেড়ে ওঠা অট্টালিকার গরম, টাকার গরম...

দীপ্তঃ আমি কিছু ভুলিনি। কিন্তু আমাকে সব ভুলে থাকতে হয়। দাসত্ব প্রথার অবলুপ্তির কথা বলতে বলতে কখন যে নিজেকে দাস বানিয়ে ফেললাম, বুঝতে পারলাম না।

দেবাশিসঃ আমরা সবাই দাস। কেউ টাকার দাস, আবার কেউ ক্ষমতার দাস। আসলে কি জানিস, আমাদের দাস বানিয়েছে আমাদের খিদে।

শ্রীঃ সহনশীলতার কথা আমরা সবাই বলি, কিন্তু নিজেদের সহনশীল করার জন্য আমাদের কি কি করতে হয় তা আমরা কোনোদিন ভেবে দেখি?

প্রীতমঃ ভাগ্যিস আমাদের ভাবার শক্তিগুলোকে মেরে ফেলেছি। আমাদের ইন্দ্রিয় আছে স্বাদ গ্রহণের জন্য। কিন্তু তার বিচার করার দায়িত্ব আমাদের নেই।

শ্রীঃ বঞ্চিতদের বঞ্চনা আমরা গ্রহণ করতে পারি না। কিন্তু ক্ষমতার অলিন্দে থাকা লোকজনদের সাথে খঞ্জনী বাজাতে আমরা ভালই পারি...

(সুশান্তর এবং রঙ্গিতের প্রবেশ। রঙ্গিতের বয়স উনিশ, বিশ্বভারতীতে আর্ট নিয়ে গ্র্যাজুয়েশন করছে।)

সুশান্তঃ দেখ কাকে এনেছি। মিরিকে এক টুকরো শান্তিনিকেতন। ওর নাম রঙ্গিত, পাশের Glenburn tea estate এর ম্যানেজারের ছেলে।

দেবাশিসঃ বেশ ভালো, বসো বসো। আরে সুব্বাকে বল মাংসটা দিয়ে যেতে, সাথে একটু কফি দিতে বল ওর জন্য।

রঙ্গিতঃ আরে ওসব কিছুর দরকার নেই। আমি বাড়ি থেকে জলখাওয়ার খেয়ে বেরিয়েছি...

শ্রীঃ আরে বস তো। এই ঠাণ্ডায় দুবার কেন, এক ঘণ্টা পর পর কফি খাওয়া উচিত।

প্রীতমঃ ব্যস, দিদিমণির আদেশ অমান্য করা চলবে না। (হাসি)

সুশান্তঃ দাঁড়া, আমি দেখছি, মাংসটা নিয়ে আসি।

(শ্রুতির প্রবেশ, হাতে ট্রে, মাংস আর জলের বোতল রাখা)

শ্রুতিঃ কোথাও যেতে হবে না। আমি এসে গেছি। এই নাও মাংস রেডি। আরে রঙ্গিত! কখন এলি?

রঙ্গিতঃ এখুনি এলাম...মানে সুশান্তদা বার বার বলেছিলো একবার সন্ধ্যেবেলা আসার জন্য...

সুশান্তঃ আরে ওর জন্য একটু কফি বানাতে হবে।

শ্রুতিঃ ঠিক আছে, আমি সুব্বাকে বলছি...

রঙ্গিতঃ আরে শ্রুতিদি লাগবে না, আমার এতেই হবে...

প্রীতমঃ কি নিয়ে পড়ছিস এখন? তুই বলতে পারি তো?

রঙ্গিতঃ একদম, কোন অসুবিধা নেই। তোমরা আমার থেকে অনেক বড়।

দেবাশিসঃ বাঃ এইতো, সহজেই আমাদের দলে মিশে গেলো।

রঙ্গিতঃ আমি ফাইন আর্ট নিয়ে পড়ছি।

সুশান্তঃ আরে বাকি কথাটা বল, জানিস প্রীতম ও দারুন গান গায়। অসাধারণ গানের গলা ছেলেটার।

রঙ্গিতঃ (লজ্জা পেয়ে ) না না, সেরকম কিছু না। ওই শান্তিনিকেতনে থাকি তাই একজন প্রসিদ্ধ বাউলের কাছে গান শিখেছি...

শ্রীঃ বাঃ বেশ ভালো, ক্যানভাসে রঙ ছড়ানোর জন্য নিয়মের বাইরে গিয়ে সুরের মূর্ছনা খুব দরকার...

সুশান্তঃ তোদের বলেছিলাম না, যে মিরিকের পাহাড়ে বাউলের আড্ডা দেখাবো। এবার দেখ, আমি রঙ্গিতের কথাই বলছিলাম। ও যে এখানে এসেছে আমি জানতাম না, বিকেলে বাজারে গিয়ে দেখা। ওর বাবা আমাকে এই বাড়িটা কেনার সময় খুব হেল্প করেছে। সেই থেকেই ওর সাথে আলাপ। আগেও আমি আর শ্রুতি ওর গান শুনেছি। তাই আর সুযোগ হাতছাড়া করলাম না। আজকে রাত্রে ও আমাদের এখানে ডিনার করবে। আমি ওর বাবাকে বলে দিয়েছি, ওকে রাত্রে আমি আর প্রীতম বাড়ি ছেড়ে দিয়ে আসবো।

শ্রীঃ আমরাও অনেকবার শান্তিনিকেতন গিয়েছি| খোয়াইয়ের ধারে এখনো সেই হাটটা বসে?

রঙ্গিতঃ না, এখন ছোট করে একটা বাজার বসে, তবে সেটাকে হাট বলা চলে না।

দেবাশিসঃ তুই তরুণ মামা কে চিনিস?

রঙ্গিতঃ কে তরুণ মামা?

দেবাশিসঃ তরুণ ক্ষ্যাপা।

রঙ্গিতঃ হ্যাঁ, চিনিতো, এখনো কি গানের গলা, মনে হয় আকাশের মেঘ যেন মাথার উপর ঘুরছে...

দেবাশিসঃ তরুণ মামা আগে একটি ব্যাঙ্কে চাকরি করতো। হঠাৎ করে একদিন সব ছেড়ে দিয়ে বাউল হয়ে গেলো। আমাদের সাথে এক সময় বেশ ভালো পরিচয় ছিল। অনেক দিন যাওয়া হয় না, আর ওনার ফোন নম্বরটাও নেই আমার কাছে।

প্রীতমঃ এবার একটু গান শুরু হোক।

দীপ্তঃ অনেক রাত্রি হয়ে গেলো। এখানে এত রাতে গান-বাজনা করলে আবার কেউ আপত্তি জানাবে না তো?

প্রীতমঃ আরে দুর, চারপাশে, শেয়াল-কুকুর ছাড়া আর কেউ নেই। আর ওরা আপত্তি করবে না, ওদের তো একটু আনন্দ করতে মন চায়, না কি?

দেবাশিসঃ এবার শুরু কর রঙ্গিত, দেখি তোর গান শুনে পাহাড়ের পাখিদের সমাবেশ হয় কিনা?

শ্রুতিঃ রঙ্গিত, আজকে একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত দিয়ে শুরু কর।

রঙ্গিত গান শুরু করে।

আছ অন্তরে চিরদিন, তবু কেন কাঁদি?

তবু কেন হেরি না তোমার জ্যোতি,

কেন দিশাহারা অন্ধকারে?।

অকূলের কূল তুমি আমার,

তবু কেন ভেসে যাই মরণের পারাবারে?

আনন্দঘন বিভু, তুমি যার স্বামী

সে কেন ফিরে পথে দ্বারে দ্বারে?।

শ্রীঃ Five years have past; five summers, with the length

Of five long winters! and again I hear

These waters, rolling from their mountain-springs

বাইরে একজনের দৌড়ানোর শব্দ শোনা যায়|দৌড়াতে দৌড়াতে অরিজিৎ প্রবেশ করে। অরিজিৎ কে প্রথমে কেউ চিনতে পারেনা। অনেক দিনের না-কাটা দাড়িতে অরিজিতের মুখ চেনা দুষ্কর। গায়ে একটা শাল জড়ানো, কাঁধে ঝোলা ব্যাগ। পায়ে নোংরা চামড়ার চটি আর মাথার একটা যায়গায় অল্প রক্ত জমাট বেধে আছে)

(আরিজিতের অস্বাভাবিক প্রবেশে সবাই চমকে ওঠে এবং শ্রী হঠাৎ করে চিৎকার করে ওঠে)

দেবাশিসঃ কে? কে আপনি? এরকম পারমিশন না নিয়ে ঢুকলেন কি করে?

দীপ্তঃ সুব্বা, সুব্বা, তাড়াতাড়ি এসো...

প্রীতমঃ কে আপনি? বেরিয়ে যান, বলছি বেরোন, নাহলে পুলিশ ডাকবো,

সুশান্তঃ দারা প্রীতম, আমি পুলিসে কল করছি...(বলে ফোনটা পকেট থেকে বার করতে জায়)

অরিজিৎঃ (কোমরে গোঁজা পিস্তল বের করে সুশান্তর দিকে তাক করে।) একচুল নড়লে এখানেই লাশ ফেলে দেবো। শালা ফুর্তি করতে এসেছেন? গান-বাজনা করছেন?

প্রীতমঃ তাতে আপনার কি? কে আপনি?

অরিজিৎঃ (পিস্তল প্রীতমের দিকে ঘোরায়) আমি কে সেটা আপনাদের জেনে লাভ নেই। আমি কিছুক্ষণ এখানে থাকবো। পুলিশ আমার পেছনে, আপনারা আমাকে শেল্টার দেবেন...

শ্রীঃ কি আশ্চর্য? তার মানে আপনি আসামী?

অরিজিৎঃ না, আমি বিপ্লবী।

দেবাশিসঃ (অবাক হয়ে) স্বাধীন দেশে বিপ্লবী? সন্ধ্যেবেলা কি নেশাটা বেশি করে ফেলেছেন?

দীপ্তঃ আমরা আপনাকে কোন শেল্টার দিতে পারব না। আপনি এখুনি এখান থেকে বেরিয়ে যান|

রঙ্গিতঃ বেরোন, বেরোন বলছি...(বলতে বলতে আরিজিতের দিকে এগিয়ে যায়)

অরিজিৎঃ (রঙ্গিতের মাথায় পিস্তল দিয়ে আঘাত করে) সোজা কথা কানে যায় না ছোকরা? চুপচাপ বস এখানে, এক পা এগোলে মেরে ফেলবো...(রঙ্গিত মাথায় গুরুতর আঘাত পেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পরে)

প্রীতমঃ এটা কি করলেন আপনি? দীপ্ত, দেবাশিস, সুশান্ত কিছু একটা কর। রঙ্গিতকে এক্ষুনি হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে...

(দীপ্ত এবং দেবাশিস রঙ্গিতের দিকে এগোতে জায়, কিন্তু অরিজিৎ চিৎকার করে তাদের পিছনে সরতে বলে)

অরিজিৎঃ এক পা এগোবেন না, ওর বাপের ফল ওকে ভুগতে হয়েছে। বিষফল সেবন করা যায় না, বিষবৃক্ষ বেড়ে ওঠার আগে তাকে ছেঁটে ফেলা উচিৎ।

শ্রীঃ আপনি চুপ করুন। You are a criminal, you should be hanged till death, I will call the police immediately…

অরিজিৎঃ চুপ করুন। আপনারা কি জানেন ওর ব্যাপারে? টি-এস্টেটের ম্যানেজারের একমাত্র ছেলে। ওর বাবার জ্বালায় শত শত শ্রমিক দিনের পর পর মারা গেছে, একটা শ্রমিক মরলে তাকে শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয় না, ওষুধ নেই, ডাক্তার নেই, পেটে দুবেলা দুমুঠো ভাত পড়ে না, শিশুরা জন্মাবার পরে দুধের বদলে ভাতের ফ্যান খায়, সময় বিশেষে সেটাও ওদের বাবা-মা দিতে পারে না, কারণ ভাত ফোটানোর গন্ধ সেইসব গ্রামে এক বিরল দৃশ্য ...।

প্রীতমঃ আপনি নিজেকে বিপ্লবী বলে দাবী করেন, আর একজন সাধারণ নাগরিকের মাথায় আঘাত করতে আপনার হাত কাঁপে না!

দীপ্তঃ স্বাধীন দেশে বিপ্লব কিসের জন্য?

দেবাশিসঃ ঠিক বলেছিস, আমারা নিজেরা নিজেদের বিরুদ্ধে লড়াই করবো, যাদেরকে আপনারা শত্রু বলে মনে করছেন, তারাও তো আমাদের পরিবারের সদস্য...

অরিজিৎঃ পরিবারের কোন সদস্য যদি শ্রেণীশত্রুতে পরিণত হয়, তাহলে তাদেরকে আর ভালবাসা যায়না, তাদেরকে উচিৎ শিক্ষা দেওয়াটা আমাদের কর্তব্য...

প্রীতমঃ আপনি উচিৎ শিক্ষা দেওয়ার কে?

শ্রীঃ ভালবাসা দিয়ে কোনো মানুষকে পরিবর্তন করা যায়, তার জন্য বন্দুকের নলের প্রয়োজন হয় না।

অরিজিৎঃ সত্যি? পনেরো বছর আগে আপনাকে ভালবাসা দিয়ে কেউ পরিবর্তন করার চেষ্টা করেছিলো?

শ্রীঃ কে আপনি?

অরিজিৎঃ দেবাশিস আপনি খুব ভালো করে জানেন যে, ভালবাসার অস্তিত্ব আমাদের সমাজে নেই, নাহলে পনেরো বছর আগে আপনাকে suicide attempt করতে হতো না।

দেবাশিসঃ আপনি কে? আমাদের সম্পর্কে এত কিছু আপনি জানেন কি করে?

দীপ্তঃ আপনি কি কোন পলিটিকাল এজেন্ট?

অরিজিৎঃ না দীপ্ত, আমি আপনার মতো সিস্টেমের দাস নই।

প্রীতমঃ অনেক হয়েছে, আপনি কে, কি উদ্দেশ্য আপনার?

অরিজিৎঃ (অট্টহাসি) তুই অনেক বড় হয়ে গেছিস প্রীতম। বরং আমার মনে হয় আরো ছোট হয়ে গেছিস। কলেজ স্ট্রিটের রাস্তায় ট্রাম আটকে শ্লোগান লাগানো প্রীতম, পুলিশের চোখে ধুলো দেওয়ার জন্য তুখোড় রনকৌশল বানানো কমরেড প্রীতম...

প্রীতমঃ কে তুই?

অরিজিৎঃ এখন আমাকে চিনতে এতো অসুবিধে হচ্ছে প্রীতম? চশমার পাওয়ার বেড়েছে তোর? না কি আমার মুখের আদল এতটাই পরিবর্তন হয়েছে যে আমাকে তোরা চিনতে পারছিস না... নাকি তোরা চেনার চেষ্টা করছিস না...

সুশান্তঃ (অরিজিতের দিকে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে) অরিজিৎ?

শ্রীঃ অসম্ভব, উনি অরিজিৎ কিছুতেই হতে পারেন না...অরিজিৎ কে আমি চিনতে পারবো না, এটা হতেই পারে না...

অরিজিৎঃ পনেরো বছর আগেও তো তুই আমাকে চিনতে অস্বীকার করেছিলি...আমার ভালবাসা কে প্রত্যাখ্যান করেছিলি শুধুমাত্র ক্ষমতার লোভে...

শ্রুতিঃ উনি তোমাদের বন্ধু?

দীপ্তঃ কমরেড অরিজিৎ...

প্রীতমঃ (অরিজিতের দিকে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে) অরিজিৎ, তুই এতো নিচে নেমে গেছিস? তোর এতো অধঃপতন যে, তুই আমাদের উপর বন্দুক তাক করে দাঁড়িয়ে আছিস?

অরিজিৎঃ একই কথা তো আমিও বলতে পারি প্রীতম, যে তোরা এত নিচে নেমে গেছিস যে সমাজের অন্ধকার দিকগুলোকে অবলীলায় অস্বীকার করছিস...

দেবাশিসঃ তুই তো এরকম ছিলিস না, তুই খুব bright student ছিলি, তোর একটা bright career আছে...

শ্রীঃ অরিজিৎ তুই মূলস্রোতে ফিরে আয়...অনেক হয়েছে, এসব অলীক কল্পনা বন্ধ কর...

অরিজিৎঃ তোরা মূলস্রোতে ফিরে আয়...আমি পথ ভুল করিনি, তোরা করেছিস...কোন মূলস্রোতের কথা বলছিস শ্রী? আমিতো আমার মূল ছাড়িনি, আমি আমার শিকড়ের কাছেই আছি...

প্রীতমঃ তুই যা করছিস ভুল করছিস...

অরিজিৎঃ কোন ভুলের কথা বলছিস?

দেবাশিসঃ তুই নিজেকে অপরাধী বানিয়েছিস, নিজেকে শেষ করে দিয়েছিস...

অরিজিৎঃ অপরাধী আমি? না তোরা?

দীপ্তঃ আমাদের অপরাধ কি? স্বাভাবিক জীবনযাপন করাটা অপরাধ?

আরিজিৎঃ কোনটা স্বাভাবিক? তোদের কাছে যেটা স্বাভাবিক, আমার কাছে সেটা ভীরুতা। ভৃত্যর মতো জীবনযাপন করাটা তোদের কাছে স্বাভাবিক?

প্রীতমঃ অরিজিৎ তুই বাজে কথা বলছিস। তুই জানতিস না? যে আমাদের সবাইকে একদিন সমাজের মূলস্রোতে ফিরতে হবে? কলেজে পুতুল খেলাটাকে তুই জীবনের পথ চলার আদর্শ করে ফেলেছিস।

অরিজিৎঃ কোনটা পুতুল খেলা ছিলো প্রীতম? বইয়ের পাশে, ম্যাক্সিম গোরকির মা শুয়ে থাকতো, বুকের কাছে চে-র সবুজ নোটবুক, একসাথে দিরোজিও হলে The Motorcycle Diaries দেখা...

দীপ্তঃ যৌবনের রক্তে অনেক বিষ থাকে, পরে সেই বিষ ধুয়ে ফেলতে হয় অরিজিৎ...

অরিজিৎঃ বিষ তোদের রক্তে ছিলো না, বিষ ছিলো তোদের মনে...

দেবাশিসঃ এবার পিস্তলটা ফেলে দে অরিজিৎ, আমরা তোর বন্ধু্‌...আমাদের উপর পিস্তল তাক করা তোর শোভা পায় না...

(অরিজিৎ পিস্তলটা কোমরে গুঁজে নেয়।)

অরিজিৎঃ তোরা এখানে কি করছিস?

প্রীতমঃ ঘুরতে এসেছি। সুশান্ত এই বাড়িটা কিনেছে।

অরিজিৎঃ বাঃ বেশ ভালো। অনেক উন্নতি করেছিস সুশান্ত। গ্রামের ছেলে আজ লাখপতি হয়েছে।

সুশান্তঃ সেটাও আমার দোষ।

অরিজিৎঃ না, দোষ কিসের। তবে নিজের চোখটা বন্ধ করে রেখেছিস, তাই নীচের গ্রামগুলোকে দেখতে পারছিস না।

শ্রীঃ অরিজিৎ তোর কপালে রক্ত জমাট বেঁধে আছে।

অরিজিৎঃ রক্তের রঙটা কীরকম দেখছিস? লাল না কালচে লাল।

দেবাশিসঃ বিজ্ঞানের ছাত্র হয়ে তোর এটা জানার কথা, যে রক্ত জমাট বাঁধলে সেটা কালচে লাল হয়ে যায়...

অরিজিৎঃ ঠিক বলেছিস, লাল রঙ অনেক সময় একা পড়ে থাকলে কালো হয়ে জায়। (অরিজিৎ টেবিলের দিকে এগিয়ে যায়, ওয়াইনের গ্লাসটা হাতে নেয়)...শ্রী, একটা সময় তো অশোকদার লাল চা খেতিস, এখন তোর হাতে ওয়াইনের গ্লাস? (কটাক্ষ)

শ্রীঃ সময় মানুষ কে পরিবর্তন করে, মানুষের অভ্যাস পরিবর্তন হয়...

অরিজিৎঃ তবে রঙটা তো পরিবর্তন হয়নি। ভালবাসার রঙ লাল, রক্তের রঙ লাল, বিপ্লবের রঙ লাল আর দাসত্বের রঙও লাল...

শ্রীঃ তোর মাথায় গণ্ডগোল দেখা দিয়েছে। তুই পাগলের প্রলাপ বকছিস...

অরিজিৎঃ পনেরো বছর আগেও কি আমি পাগলের প্রলাপ বকতাম? Time was not passing; it was turning in a circle

শ্রীঃ there is always something left to love...

অরিজিৎঃ (অবাক হয়ে) তুই কি আমাকে এখনো ঘেন্না করিস?

শ্রীঃ জানি না কেন ভাব তুমি,

সৈনিক, যে তোমাকে ঘৃণা করি আমি,

যদি একই পথের যাত্রী হই আমরা, আমি...তুমি...

অরিজিৎঃ তুমি জন্ম দিচ্ছিলে চুম্বনের এবং হত্যা করেছিলে পিঁপড়েদের,

তুমি বিলাপ করছিলে ভালো থাকার,

পেঁয়াজ আর প্রজাপতি নিয়ে,

জ্বলন্ত বর্ণমালা নিয়ে...

(শ্রী মাথা নিচু করে চেয়ারে বসে পড়ে)

প্রীতমঃ অরিজিৎ, তুই বাড়াবাড়ি করছিস। অনেক হয়েছে, তুই আত্মসমর্পণ কর সরকারের কাছে।

দীপ্তঃ আমি কথা দিচ্ছি তোকে, তোর কোন অসুবিধে হবে না। আমি আমার সব চ্যানেল লাগাবো তোকে বাঁচানোর জন্য।

দেবাশিসঃ তুই আমার সাথে চল। আমি পুলিশ যা বলার বলবো।

অরিজিৎঃ (অট্টহাসি) হায়রে, এই অবুঝ শহর, যারা নৈরাশ্যের গান গাইতো, তারা এখন এক লম্বা সবুজ সরীসৃপ। তোরা নিজেরা কি করে বাঁচবি সেটাই জানিস না, আমাকে বাঁচাবি কি করে?

দীপ্তঃ তুই কি বলতে চাইছিস? তুই কি আমাদের মেরে ফেলার ফন্দি করছিস?

অরিজিৎঃ আমরা মানুষদের বাঁচার পথ দেখাই দীপ্ত, মেরে ফেলার পথ না।

প্রীতমঃ তুই কি মনে করিস, মানুষ হত্যা করে বিপ্লব করা যায়?

অরিজিৎঃ না, মানুষদের বাঁচানোর পথ দেখিয়ে বিপ্লব করা যায় না।

প্রীতমঃ স্বাধীন দেশে, পরাধীনতার জীবনযাপন করে নিজেকে কষ্ট দেওয়াটাকে মূর্খতা বলে। সেটাকে বিপ্লব বলে না।

অরিজিৎঃ কষ্ট আমাকে স্পর্শ করে না, তোদের জ্বালা, কষ্ট, আনন্দ আছে, আমার জীবনে এসবের কোন মূল্য নেই।

দেবাশিসঃ এই জীবন বাছার জন্য তুই নিজেই দায়ী।

অরিজিৎঃ তোদের জীবনে কি আছে তোরা বলতে পারিস?

দীপ্তঃ টাকা আছে, ক্ষমতা আছে,

অরিজিৎঃ ভালবাসা আছে? অনুভূতি আছে?

প্রীতমঃ আছে, সব আছে আমাদের। কিন্তু তুই আজ নিঃস্ব।

অরিজিৎঃ (অট্টহাসি) ঠিক বলেছিস, আমি নিঃস্ব। শহরের পাখিগুলো ছাড়া আমার কোন বন্ধু নেই, আকাশটা ছাড়া আমার কোন ছাদ নেই। কিন্তু আমি যে গভীর প্রশ্বাস নিতে পারি, সেটা তোরা পারিস? তোদের দম বন্ধ হয়ে আসে না?

প্রীতমঃ না, আসে না। আমাদের প্রশ্বাসের দাম আছে। তোর কোন দাম নেই এই সমাজে।

অরিজিৎঃ কিসের সমাজ? সমাজ, রাষ্ট্র এগোল সব শোষণের যন্ত্র।

প্রীতমঃ একটা মানুষকে দেখাতে পারবি যে এই যন্ত্রের অংশীদার না?

অরিজিৎঃ তাহলে মানছিস, যে তোরা সবাই যন্ত্রের দ্বারা পরিচালিত?

প্রীতমঃ তোদের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের কমরেডদের দ্বারা পরিচালিত ছাত্রসমাজ, আর ওদের কাঁচা মাথা চিবিয়ে খাওয়ার অভ্যাস আমাদের অজানা না। তোরা রেড স্কোয়াড তৈরি করতে চাইছিস, আমরা সেটা কিছুতেই হতে দেবো না।

অরিজিৎঃ আবার দুটো শ্রেণী বিভাজন, আমারা আর তোরা। আমাদের মধ্যে শ্রেণীদ্বন্দ্ব অবশ্যম্ভাবী...প্রীতম তোদের মনে পরে না সেই কলেজের দিনগুলি, পনেরো বছর আগের সেই ১৪ই আগস্টের রাত, যেদিন পি. এল. টি তে কমরেড শমীক আমাদের বলেছিলো, “আমরা ভোটের রাজনীতিতে বিশ্বাস করিনা, আমাদের দ্বন্দ্ব বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে। আমাদের দাবী মেঘের আড়ালে সূর্যকে লুকিয়ে রাখা না, সূর্যের আলোয় সবাইকে আলোকিত করা”। আর তুই সেদিন তুমুল তর্ক করেছিলি, চিৎকার করে বলে উঠেছিলি...

(মঞ্চের সব আলো নিভে আসে। মঞ্চের সামনে শুধু দুটো আলো অরিজিৎ আর প্রীতমের উপর পরে। পনেরো বছর আগের পি, এল, টি রুমের আদল ভেসে ওঠে মঞ্চের সামনে)

প্রীতমঃ কমরেড, সূর্যের আলোয় আমাদের কাজ করা শোভা পায়না। আমাদের কাজ রাতের অন্ধকারে। আপনি কোন আলোর কথা বলছেন? চোখ মেলে দেখুন, রাস্তায় আজ হ্যাজাকের আলোর বদলে শত শত পাওয়ারের জোরালো আলোয় মানুষের মুখ পুড়ে যাছে, সেই ছাই আমাদের প্রশ্বাসের মধ্যে দিয়ে অতিক্রান্ত করছে। সাধারণ মানুষ আমাদের পাগল বলে, বাবা ধমক দেয় বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার, মা আঁচলের আড়ালে কেঁদে যায়...আমরা আমাদের বাড়ির কাছের মানুষদের ভরসা দিতে পারিনা, সেখানে কি ভাবে আমরা সমাজ পরিবর্তন করবো? জবাব দিন কমরেড, জবাব দিন (প্রীতমের চোখ লাল হয়ে ওঠে, হাত কাঁপতে থাকে রাগে, গলার শিরা বেরিয়ে আসে)

আরিজৎঃ চুপ কর প্রীতম, তুই চুপ কর। কি করছিস এসব?

প্রীতমঃ না অরিজিৎ, আমাকে আজ বলতেই হবে। আমরা সবার অসংখ্য প্রশ্নের সম্মুখীন হই, আর আমাদের যারা স্বপ্ন দেখায়... তাদের প্রশ্ন করা আমাদের অধিকার...ওনাকে আজ জবাব দিতেই হবে......জবাব দিন কমরেড শমীক...জবাব দিন...

শমীক: শান্ত হোন কমরেড, শান্ত হোন। আমাদের লড়াই এই ক্ষুদ্র পরিবাবের সাথে নয়। আমাদের লড়াই বৃহত্তর পরিবারের স্বার্থে। বিপ্লবের সংজ্ঞা জানেন?

প্রীতমঃ কি কমরেড?

শমীক: আমরা হলাম চাষি, আর বিপ্লব হল ধানের শিস। চাষ করে, অক্লান্ত পরিশ্রম করে, মাটি কুপিয়ে, লাঙ্গল টেনে আমাদের শস্য ফলাতে হবে। যখন পুরো মাঠ সোনালি শিসে ভরে উঠবে, তখন সেই ধান কেটে, ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে হবে।

প্রীতমঃ তাহলে আমাদের শিক্ষা, কলেজের ডিগ্রি নিয়ে কি লাভ? মাঠে গিয়ে চাষ করলেই তো হয়!

শমীক: শিক্ষা বলতে আপনি কি বোঝেন? আপনার মনে হয়, যে এইসব ডিগ্রি আপনার গুনের বিচার করতে সক্ষম? আমাদের দেশে শিক্ষা চাষ হয়, খোলা বাজারে বিক্রি হয়..শিক্ষা হলো আপনার পরিচয়। রেশনের দোকানের লাইনে দাঁড়িয়ে যে শিক্ষা পাওয়া যায়, সেটা আপনাদের কোন বইতে পাওয়া যায় না। ফালানস্টোরি, হোম কলোনি অথবা ছোট আইকেরিয়া স্থাপন করার লক্ষ্য আমাদের নয়, আমাদের কাজ পুরো পৃথিবী জুড়ে…

(বাইরে পুলিশের গাড়ির আওয়াজ শোনা যায়| হুড়মুড়িয়ে কিছু পুলিশ এসে কমরেড শমীক এবং অরিজিৎকে এরেস্ট করে। প্রীতম পালিয়ে যায় সভা ছেড়ে, সে ধরা পরে না) মঞ্চের সব আলো আবার জ্বলে ওঠে, আবার মিরিকের বাগানবাড়ি ফুটে ওঠে মঞ্চে| রঙ্গিতের পাশে বসে সুশান্ত, আর শ্রুতি ওর মাথার রক্ত মুছে দিছে.

অরিজিৎঃ তুই সেদিন কেন পালালি প্রীতম? তুই চলে যাওয়ার পর আমাদের পুলিশ এরেস্ট করলো। তিন মাস জেল, কমরেড শমীকের সশ্রম কারাদণ্ড...সে কি ভয়ানক যন্ত্রণা...

প্রীতমঃ আমি যে স্বাভাবিক জীবন চেয়েছিলাম। আমার জেল হলে আমার বাবা-মা সমাজে মুখ দেখাতে পারতো না...

অরিজিৎঃ আমার বাবা-মা, ভাই-বোন সব ছিলো প্রীতম, কিন্তু আমার মধ্যে যে আগুন ছিলো, সেটা আমি ভুলে যায়নি।

দেবাশিসঃ তুই কি বলতে চাইছিস? আমরা সারাজীবন তোর মতো এরকম ভিখারি হয়ে থাকতাম।

দীপ্তঃ আমাদের জীবনে অনেক স্বপ্ন ছিল, সেগুলো পূরণ করার জন্য আমাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরতেই হতো। তাছাড়া আমরা তো কোন বন্ডে সাইন করিনি, যে আমাদের সারাজীবন আন্দোলনের সাথে যুক্ত থাকতে হবে?

অরিজিৎঃ ঠিক বলেছিস, আমাদের মানসিক কোন বন্ড ছিলো না। আর আমি সত্যি ভিখারি| কিন্তু তোদের কি আছে বলতে পারিস? তোরা ভিখারি না?

দেবাশিসঃ আমরা ভিখারি? (কটাক্ষ) আমার ব্যাঙ্কে যা ব্যাল্যান্স আছে, সেটা দিয়ে তোর চোদ্দপুরুষ বসে খেতে পারে। টাকা, গাড়ি, বাড়ি...কি নেই আমাদের?

অরিজিৎঃ বাড়িতে কোনো আয়না আছে?

দেবাশিসঃ (হেসে) অবশ্যই, একদিন আয় আমার বাড়িতে, তোকে দেখিয়ে দেবো কি কি আছে। গত সপ্তাহে একটা নতুন জাকুজি বসালাম, শীতকালে খুব কষ্ট হয় চান করতে, তার ওপর আমার আবার সাইনাস ধরা পড়েছে...

অরিজিৎঃ দিনে কতবার নিজের মুখ দেখিস আয়নাটায়?

দেবাশিসঃ কি অদ্ভুত প্রশ্ন? নিজের বাড়ি, নিজের আয়না, আমি যতবার খুশী ইয়েস করতে পারি...

অরিজিৎঃ পনেরো বছর আগের দেবাশিসকে খুঁজে পাস? যাকে আমরা দেবু বলে চিনতাম। যেই ছেলেটার একমাত্র সখ ছিলো...

দীপ্তঃ চুপ কর অরিজিৎ। অনেক হয়েছে...

অরিজিৎঃ তুই চুপ কর। শালা ভেড়ুয়া, আস্তিনের সাপ...

শ্রীঃ কি বলছিস এসব?

অরিজিৎঃ ঠিক বলেছি। এই শালা দীপ্তই, সেইদিন পুলিশে খবর দিয়েছিলো। (সবাই দীপ্তর দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে)

শ্রীঃ দীপ্ত তুই? কেন এরকম করলি তুই?

প্রীতমঃ দীপ্ত, তোকে আমরা সবাই বিশ্বাস করেছিলাম। জানতাম তুই আমাদের সংগঠনকে সহ্য করতে পারতিস না। সেই জন্য তুই এরকমভাবে প্রতিশোধ নিবি?

দীপ্তঃ (মাথা নিচু করে, মুখে দুই হাত চাপা দিয়ে বসে পড়ে।) আমি ভয় পেয়েছিলাম। ওরা আমাকে বলেছিলো, যে তোদের ঠিকানা না বললে ওরা আমাকে গ্রেফতার করবে। আমাকে ক্ষমা কর অরিজিৎ, আমাকে ক্ষমা কর...

শ্রীঃ অরিজিৎ অনেক হয়েছে। আর না, এবার তুই ফিরে আয়। স্বাভাবিক জীবনযাপন কর। আমাদের মতো হয়ে ওঠ, আমরা তোকে সাহায্য করবো, বিশ্বাস কর...

দেবাশিসঃ শ্রী ঠিক বলেছে অরিজিৎ, যা হয়েছে ভুলে যা, আবার নতুন করে জীবন শুরু কর, আমরা তোর পাশে আছি...

অরিজিৎঃ কি করে ফিরব বলতো? আমি এখন সমাজের চোখে আসামী...আমাকে পুলিশ ধরার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছে...

প্রীতমঃ আমি দেখছি কি করা যায়| তোর কোনো চিন্তা নেই, তোর বন্ধুরা এখনো বেঁচে আছে অরিজিৎ...।

অরিজিৎঃ প্রীতম সেটা আর সম্ভব না, মৃত্যু আমার ভবিতব্য, সংগ্রাম আমার রাস্তা, স্বাধীন দেশকে বুর্জোয়াদের কবল থেকে আমাকে বাঁচাতেই হবে...আমার যে অনেক কাজ এখনো বাকি...(অরিজিৎ কাশতে কাশতে বসে পরে, ওর মুখ দিয়ে রক্ত ঝরে পড়তে থাকে, প্রীতম দৌড়ে গিয়ে নিজের শালটা অরিজিতের গায়ে পরিয়ে দেয়)

(পুলিশ ঢুকে আসে মিরিকের বাগান বাড়িতে, অরিজিৎকে দেখে পিস্তল তাক করে।)

পুলিশঃ you are under arrest Mr. Arijit. Don’t move, আমি আপনাকে request করছি আত্মসমর্পণ করতে, নাহলে আমি গুলি চালাতে বাধ্য হবো।

প্রীতমঃ অফিসার, এরকম করবেন না। ও আত্মসমর্পণ করবে, একটু অপেক্ষা করুন প্লিস...

অরিজিৎঃ (শালের আড়াল থেকে নিজের পিস্তলটা বের করে প্রীতম এর মাথায় ধরে) অফিসার আমাকে ধরা এতো সহজ নয়। বন্দুকটা ফেলে দিন, নাহলে আমি ওকে গুলি করবো, আমি মরলে, এরা সবাই মরবে...

শ্রীঃ এটা তুই কি করছিস অরিজিৎ?

দেবাশিসঃ অরিজিৎ পিস্তলটা ফেলে দে। নিজের বন্ধুকে তুই গুলি করবি?

দীপ্তঃ অরিজিৎ এসব ছাড়, আত্মসমর্পণ কর। আমরা আছি তোর সাথে...

অরিজিৎঃ (চিৎকার করে)চুপ কর তোরা, আমার তোদেরকে দরকার নেই, কিন্তু সাধারণ মানুষদের আমাকে দরকার, আমার কাজ এখনো শেষ হয়নি...আমাকে যেতেই হবে...

(অরিজিৎ আস্তে আস্তে প্রীতমকে নিয়ে বাইরে যায়, শেষে প্রীতমকে ধাক্কা দিয়ে, নিজে মঞ্চ থেকে প্রস্থান করে)

অফিসারঃ ফলো হিম, এরেস্ট হিম ওর শুট হিম...

দেবাশিসঃ অফিসার, প্লিস ওয়েট, আমাদের কথাটা শুনুন...

অফিসারঃ অন ডিউটি পুলিশের কাজে বাধা দিলে আমি আপনাদের এরেস্ট করতে বাধ্য হবো। (অফিসার দৌড়ে মঞ্চ থেকে বেরিয়ে জায়, আরিজিতের পিছু করে)

পাহাড়ের ঢালু জায়গা দিয়ে অফিসার অরিজিৎ কে তাড়া করতে থাকে। সন্ধ্যেবেলা হালকা আলোয় অরিজিৎকে আর অফিসারকে দুটো ছায়া মূর্তির মতো দেখায়। হঠাৎ করে তিনটে পর পর গুলির আওয়াজ শোনা যায়। রাতের অন্ধকারে, পাহাড়ের আঁকাবাঁকা রাস্তার জন্য, অফিসারের গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়, পায়ের বদলে, তিনটে গুলি অরিজিৎকে বিদ্ধ করে কোমরে আর পিঠে| লুটিয়ে পড়ে কমরেড অরিজিৎ, বিপ্লবের নাস্তি হয়না, শুধু শরীরটা ভেসে যায় গভীর খাদে|

পাহাড়ের উপর থেকে এই দৃশ্য দেখে শ্রী কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে, সকলে ছুটে যায় বাগানের ধারে নিথর শরীরটা অন্ধকারে এক ঝলক দেখার জন্য। মঞ্চের উপর থেকে গভীর আর্তনাদ ভেসে আসে প্রীতমের গলা থেকে।  শেষ কথাঃ অরিজিৎ মরেনি। অরিজিৎ বেঁচে আছে সবার মধ্যে। যখনি আপনারা কোন অন্যায়ের প্রতিবাদ করবেন, স্বপ্ন দেখবেন, ধানের শিস পৌঁছে দেবেন ঘরে ঘরে, তখনি এক একটা নতুন অরিজিৎ জন্ম নেবে এই পৃথিবীর বুকে।

গল্পঃ শিবাশু মুখোপাধ্যায়

গল্প

জুন ২০২০ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

এক পাটি চটি...

বাঙ্গালা ভাষায় লকডাউন এফেক্ট...

অবশেষ...

গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব... 

শিবাংশু মুখোপাধ্যায়

kolkata.jpeg

এক পাটি চটি

টাটকা ধ্বংসস্তুপ। ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে ঘরের চাল, বাঁশের খুঁটি, বিছানার চাদর, বাসনপত্র, মেয়েদের হাতের চুড়ি, চটি-জুতো, মা লক্ষ্মীর ছবি আঁটা ভেঙে চুরমার হয়ে যাওয়া ফ্রেম, ভাঙা চশমা, ছেলেমেয়েদের স্কুলের বই খাতা, স্লেট, দরমার বেড়ার অংশ বিশেষ, ছেঁড়া চটের টুকরো, এরকম অজস্র জিনিস। সমুদ্রের জল এসে জিনিসগুলোকে কখনো টেনে নিয়ে যাচ্ছে, কখনো ফিরিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। 

একা দাঁড়িয়ে আছে কৃষ্ণা। তার পায়ের পাতাও সমুদ্রের ওই আসা-যাওয়ার সাক্ষী। তার কাপড় ভিজে। গায়ে ব্লাউজ নেই। ভিজে কাপড়েই সর্বাঙ্গ শক্ত করে বাঁধা। কৃষ্ণা ওই ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জিনিসের মধ্যে থেকে যেগুলো এখনও অক্ষত রয়েছে - সেগুলো কুড়িয়ে নেবে বলে সমুদ্রের দিকে পেছন করে, সমুদ্রের উলটো দিকে ঝুঁকে পড়েছে। সে প্রথমেই, দুটো কাঁচের চুড়ি পেয়ে হাতে পরে নিল। এরপর কুড়িয়ে পেল একটা ভাঙা আয়না। সেটা কুড়িয়ে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল সে। দেখল, আয়নায় নিজের মুখের যে ছবিটা পড়েছে সেই ছবিটা অসংখ্য ভাঙা ভাঙা টুকরো। অনেকগুলো মুখ তার। কয়েকটা মুখ স্পষ্ট কয়েকটা অস্পষ্ট। 

কৃষ্ণা দেখে এসেছে এগারো মাসের বাচ্চাটা জড়ো করা ভিজে ন্যাতার ওপর ঘুমিয়ে আছে। তার ঘরের দুটো বাঁশের খুঁটি তখনও দাঁড়িয়ে। সে ভোর রাত্রে ফিরে এসে একটা টিনের চাল জোগাড় করে সেই খুঁটিদুটোর গায়ে দাঁড় করিয়েছে। দেওয়ালের মতো সেটা বাচ্চাটাকে আড়াল করে আছে। এখনও রোদ ওঠেনি। এখনও মেঘ বেশ ঘন, ঘোর করে আছে চারদিক। এখনও বুকের দুধ খায়, এমন পাজি! চিন্তা হয়, যদি সে হঠাৎ উঠে পড়ে! 

কুড়িয়ে পাওয়া আস্ত আস্ত জিনিসগুলো সে কাপড়ের ঝোলার মধ্যে রাখছিল। সেখানে ভাঙা আয়নাটাও রাখল। তারপর মুখ ফিরিয়ে এগিয়ে গেল সমুদ্রের দিকে, যেখানে ঢেউ এসে ফিরি দিয়ে যাচ্ছিল আরও অনেক জিনিস। সেই নতুন জিনিসগুলোর মধ্যে এক পাটি চেনা চটিও ছিল। চটিটা হাতে তুলে নিল কৃষ্ণা। তারপর হাঁটু মুড়ে জলের ওপরেই বসে পড়ল বজ্রাসনে। সর্বাঙ্গ ভিজে। কেবল মরুভূমির মতো শুকনো তার চোখদুটো।  

 

বাঙ্গালা ভাষায় লকডাউন এফেক্ট

০২০ খ্রীষ্টাব্দে সমগ্র মানবজাতি এক কঠিন ব্যাধির রক্তচক্ষুতে গ্রস্ত হইয়া পড়িয়াছিল। সেই ব্যাধি দেশ হইতে দেশান্তরে ছুটিয়া বেড়াইতেছিল এবং মনুষ্যগণ তাহার অত্যাচারে বিভ্রান্ত, তঠস্থ ও বিপন্ন বোধ করিয়া রাষ্ট্রের শরণাপন্ন হইয়াছিল। তদানীন্তন রাষ্ট্র-পরিচালকগণ নানাবিধ বিধান প্রণয়ন করিয়া এবং সেই বিধানসমূহের মধ্যে মনুষ্যজাতিকে বাঁধিয়া রাখিয়া সেই ব্যাধির প্রকোপ হইতে সেদিনকার মতো সেই অসহায় মনুষ্যকুলকে রক্ষা করিয়াছিলেন। সেইসব বিধানের মধ্যে, “সামাজিক দূরত্ব” রাখিবার বিধান যে সর্বাপেক্ষা গভীরতর ছিল - তা বোধ করি আজ আর বলিবার অপেক্ষা রাখে না। 

কিন্তু সেই প্রমিত বিধানসমূহের মধ্যে নানাবিধ অকিঞ্চিৎকর বিধানও ছিল, যাহাদিগের কথা মনুষ্যকুলশিরোমণি বাঙ্গালী জাতি আজ আর মনে রাখে নাই। তাহাদের অভ্যাস এমনভাবে বদলাইয়া গিয়াছে যে তাহারা আজ আর সেইসব ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র নিয়মাবলীর কথা মনে রাখিবার প্রয়োজনটুকুও বোধ করে না। রাষ্ট্র, বাণিজ্য ও অন্যান্য নানাবিধ সংগঠন ব্যবস্থাপনায় সৌজন্য রক্ষা করিবার নিমিত্ত সর্বাধিক ব্যবহৃত তৎকালীন বাঙ্গালা শব্দ “গণতন্ত্র”-এর “সামাজিক দূরত্ব”-য় পর্যবসিত হইবার ঘটনাটুকু তাহারা কেবল মনে রাখিয়াছে।   

অকিঞ্চিৎকর বিধানগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল, ভাষায় শ্বাসাঘাতাদি স্বরক্ষেপের ব্যবহার নিষিদ্ধ হইয়া যাওয়া। তখন যে নীতিমালার পুস্তিকা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক প্রকাশিত হইয়াছিল, এবং তাহার যেরূপ বঙ্গানুবাদ আমাদিগের হস্তে আসিয়া পড়িয়াছিল তাহাতে স্পষ্টই লিখিত ছিল: ২০২০ খ্রীষ্টাব্দের পয়লা মে অর্থাৎ শ্রমিক দিবস হইতে বাঙ্গালী জাতিকে আর বাঙ্গালা ভাষায় শ্বাসাঘাতাদি স্বরক্ষেপের ব্যবহার করিবার শ্রম করিতে হইবে না। “করিতে হইবে না” যখন সরকার বাহাদুরের হাত ঘুরিয়া জনতা জনার্দনের হাতে আসিল তখন তাহা হইয়া উঠিল, “করিতে পারিবে না।” বাঙ্গালীর কথা বলিবার কালে শ্বাসাঘাতাদি স্বরক্ষেপজনিত উচ্চারণে যেহেতু মুখনিঃসৃত স্রাব ছিটকাইয়া বাহির হইতে থাকে সেহেতু তাহা ওই ব্যাধি সংক্রমণের কারণ হিসেবে বিবেচিত হইবে। বিধান অগ্রাহ্য করিলে বাঙ্গালী নাগরিককে কঠোরতা শাস্তি পাইতে হইবে। হে শিশুগণ, তোমাদের কীরূপে বুঝাইব, তাহার আগে পর্যন্ত ছিল বাঙ্গালা ভাষার বড় আরামের দিন। যথেচ্ছ কেচ্ছা করিবার ইচ্ছা পোষণ করিবার দিন।

সেই দিন হইতে অদ্যাবধি, বাঙ্গালী আর কোনো কালে - পদমধ্যস্থিত, ত্ত, জ্ঝ, চ্চ, চ্ছ, দ্ব, স্য, শ্য, ষ্য, ইত্যাদি নানা বিধ যুক্ত ব্যঞ্জন, রেফ-রেফাদি শব্দ, মহাপ্রাণ ধ্বনি, ইত্যাদি উচ্চারণ করিতে পারে নাই। এখন বাঙ্গালা ভাষার সুর পালটাইয়া গিয়াছে। তার আর যৌবনের সেই তেজ নাই। তৎকালীন বাঙ্গালা ভাষা হইলে তোমরা নিশ্চয় বুঝিতে পারিতে, পরস্পরকে “শুয়োরের বাচ্ছা” বলিয়া সম্বোধনের মধ্যে যে অনির্বচনীয় আত্মপ্রসাদ উদ্রেককারী আনন্দ আছে, তাহা “বরাহ নন্দন”-এর মধ্যে নাই। এখন লিখিতেছি বলিয়া পুরাতন অভ্যাসের কথা স্মরণ করিয়া - মনে করিতেছি “সাত খুন মাপ হইবে”। তাহা না হইলে, হুঁজুরদিগের কাছে হাত জোড় করিয়া বলিতে হইবে: “উঁজুর এবারের মতো কমা করিয়া আমায় বাদিত করুন। প্লিজ!”  

 

 

অবশেষ

রের ভেতরটা গাঢ় অন্ধকার। বন্ধ দরজার বাইরে কান পাতলে মেয়েলি গোঙানির আওয়াজ শোনা যায়। আর নির্বোধ তৃপ্তির পৌরুষ। বেশ খানিকক্ষণ সম্পূর্ণ পৃথক এই দুই ভাষায় সংলাপ চলে। কেউ কারুর ভাষা বোঝে না। কোনো দোভাষী নেই, অথচ সংলাপ চলে। তারপর একসময়, কিছুক্ষণ, বাইরের অন্ধকারের সঙ্গে মিশে যায় ঘরের অন্ধকার। তাদের মধ্যে কী দেওয়া-নেওয়া চলে কেউ জানে না। দিন পার হয়ে আসে আরেক দিন। তার মধ্যিখানে হয়তো, একবার অন্তত, দুই অন্ধকারকে ছিঁড়ে দেয় কোনো অচেনা আলো। ঘরের ভেতরটা মুহূর্তের মধ্যে টাঙস্টেনের অহংকারে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। দেখা যায়, একজন মানুষ বটে!  দোমড়ানো মোচড়ানো অবস্থায় বিছানায় পড়ে আছে জড়ের মতন। বুক অবধি ঢাকা সাদা চাদরে। পাশ ফিরে আর্ত হাঁটু দুটো বুকের কাছে গোটানো। হাতদুটোও ভাঁজ করে কুঁকড়ে বুকের মধ্যে রাখা। যেন হেমন্তের শুকনো ঝরা পাতা মাড়িয়ে চলে গেছে কোনো উদ্ধত জয়ী মিলিটারির বুট। যেন একটা শান্ত জলের চাদর

কোনো বুনো হাঁস বেমানান সাঁতরে এফোঁড়-ওফোঁড়, তছনছ করে দিয়ে গেছে। যেন কীটবিদ্ধস্ত পচা খাবারের অবশেষ। মাস পার হয়ে আরেক মাস। বছরের পর বছর।

শূন্যগর্ভ সংলাপ চলে। 

তারপর...   

অবশেষ।

গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব 

কজন বলল, “একবার শুধু বলুন স্যার। নদীর চড়ায় সবকটাকে পুঁতে দিয়ে আসি। আগে বাঁধবো, তারপর গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দেব। তারপর পুড়ে ছাই হয়ে গেলে পুঁতে ফেলব বালিতে। কাল জোয়ারের জলে সব ধুয়ে যাবে।”
দ্বিতীয় লোকটা বলল, “তোর কি মাথা খারাপ! একসঙ্গে অতগুলো মানুষ...” 
প্রথমজন বলল, “কত জন হবে তাও?”
তৃতীয় একজন বলল, “জনা সত্তর। পিন্টু দেখে এসেছে। বাচ্চা, বুড়ো, মেয়েছেলে, সবমিলিয়ে। বাচ্চা আর মেয়েছেলেগুলোকে ঠাণ্ডা করার দায়িত্ব আমাদের দে। আমরা তো দশ-বারোজন রয়েছি। আমি হাঁক দিলে আরও জুটে যাবে। আমি, পিন্টু, কার্তিক, তপন... সব, আর খানকির ছেলেদের তোরা সামলে নিস!”
প্রথমজন বলল, “অত সোজা না ভাই! পারবি সামলাতে? তোদের গ্রুপে ক’টা মেশিন আছে রে? সবাই জুটে যাবে – এরকম ভাববারও কারণ নেই।” বলে দ্বিতীয়জনের দিকে তাকালো।
তৃতীয়জন আবার বলল, “পারব পারব। মেশিনের কথা সিধুরা বলতে পারবে, ওতে আমি হাত দিই না। আমার এই-ই যথেষ্ট।” এই বলে, কোমর থেকে একখানা ধারালো ভোজালি বের করল সে। সেই ভোজালিটার গায়ে চাঁদের আলো পড়ে পিছলে যেতে লাগল।  
প্রথমজন “জনা সত্তর” শুনে একটু দমে গেল যেন! “তাহলে? কিছু বলুন না স্যার!”
কালো জ্যাকেট পরা, গলায় সাদা মাফলার জড়ানো, স্যার চাপা গলায় বলল, “দাঁড়া দাঁড়া, একটু ভাবতে দে। আর ওই সব কোমরেই গুঁজে রাখ। যখন তখন বার করিস না।” 
চাপা গলার মিটিং-এর মধ্যে হঠাৎ ঢুকে পড়ল একটা সাদা-কালো কুকুর। প্রবল বেগে ল্যাজ নাড়তে নাড়তে সে দ্বিতীয় লোকটার কাছে গেল। গিয়ে প্রথমে তার পায়ের কাছে গড়াগড়ি খেল, তারপর তার কোমর অবধি দাঁড়িয়ে উঠে তাকে আঁচড়াতে শুরু করল। দ্বিতীয় লোকটা ওর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে জিজ্ঞেস করল, “কী রে চটাই?”
চটাই আরও উত্তেজিত হয়ে, কালো কান দুটো পেছনের দিকে করে, জোরে জোরে কুঁই কুঁই করে কাঁদতে লাগল। দ্বিতীয় লোকটা হঠাৎ বলে বসল, “ভাবাভাবি যাই করুন, আমি এর মধ্যে নেই।” “কেন? হঠাৎ কী হল তোর?” স্যার বলল। 
দ্বিতীয় লোকটা বলল, “আমি অকারণে কাউকে মারি না।”
আবার স্যার বলল, “অকারণে? আজকে হঠাৎ, মার্ডারের কারণ খুঁজছিস, কী ব্যাপার! ওরা-যে রোগটা ছড়ালো, আর তাতে যে আমাদের নিরীহ লোকগুলো মরে গেল, তার কী হবে!...ঠিক আছে, তোর মতটাও শুনি, বল।” 
“মতামতের কিছু নেই। প্রথম থেকেই আমার আপত্তি ছিল। শুধু শুধু এতগুলো নিরীহ লোককে মারব কেন? তার মধ্যে অতগুলো শিশু, মহিলা! একটা তো কারণ থাকতে হবে। ওরা আমাদের তো কোনো ক্ষতি করে নি! আর কেন ভুল বোঝাচ্ছেন বলুন তো সকলকে। রোগ তো ওরা ছড়ায় নি। ওদেরও তো লোক মরেছে এই একই রোগে!”
“আলবাৎ ছড়িয়েছে। ওরাই রোগটা ছড়িয়েছে। ওদের অভ্যাসগুলোই নোংরা। গা ঘিনঘিন করে। আর তুই যে এত বড় বড় কথা বলছিস, এতদিন যতগুলো খতম করেছিস সবেতেই কারণ ছিল?” তখন স্যার বেশ উত্তেজিত।
“ছিল।”
“কী কারণ?”
“টাকা”
প্রথম লোকটা আবার কথা বলে উঠল, “তুই থামলি! ওদের জন্যই তো আমাদের এতগুলো লোক মরে গেল।”
দ্বিতীয়জন বলল, “তোরা সব অন্ধ! ভালো করে ভেবে দেখেছিস কখনো কেন এই ঝামেলা করানো হচ্ছে আমাদের দিয়ে!” প্রথমজন বলল, “ঝামেলা আবার কী! ওরা আমাদের দেশে থাকতে পারবে না। চিরকাল ওরা আমাদের দাবিয়ে রেখেছে। আমার বাবাকে মেরেছিল ওরা। আমার মায়ের ইজ্জত নিয়েছে ওরাই। ওদের আমি ঘেন্না করি। আজও ওরাই আমাদের মধ্যে অসুখ ছড়িয়ে দিয়েছে, ইচ্ছে করে। এমনিতে আমাদের সঙ্গে পেরে উঠবে না তাই রোগ ছড়িয়ে আমাদের মারতে চাইছে। আমাদের ক্ষতি করা ছাড়া ওদের আর কোনো কাজ নেই। এখন আমাদের পালা। কী বলেন স্যার!”স্যার সম্মতিসূচক মুচকি হেসে দ্বিতীয়জনের দিকে তাকালো। দ্বিতীয়জন প্রথমজনের দিকে ফিরে বলল, “গাধাই রয়ে গেলি চিরকাল। কিচ্ছু জানিস না, কেবল পরের কথায় নাচিস। এত ঘেন্না তোর আসে কোথা থেকে! যা-খুশি কর, আমি চললাম।”  সাদা-কালো কুকুরটা একদৃষ্টে স্যারের দিকে তাকিয়ে ছিল। একটু গোঁ গোঁ আওয়াজও বের করছিল মুখ দিয়ে। সেটা কেউ খেয়াল করে নি। এখন দ্বিতীয়জন মিটিং থেকে বেরিয়ে যেতেই সেও তার পিছু নিল। 

এক যুবকের মৃতদেহ পড়ে আছে কালীকিঙ্করপুর ফেরিঘাটের লাগোয়া অংশে, বুড়ি নিম গাছটার তলায়। সঙ্গে একটা সাদা-কালো কুকুরও মরে পড়ে আছে। তার গলার নলিটা কাটা। উপুড় হয়ে শুয়ে আছে যুবক। পিঠে তখনও ভোজালিটা গোঁজা। রক্ত জমাট বেঁধে কালো ছোপ পড়ে গেছে জামার পিঠে। সবে সূর্যের আলো ফুটেছে নদীর ওপার থেকে। সেই আলো পড়ে শরীর থেকে বেরিয়ে থাকা ভোজালির ধাতব অংশটা চকচক করছে। একজন কালো জ্যাকেট পরা লোক, গলায় সাদা মাফলার জড়ানো, চিৎকার করে লোক জড়ো করছে: “আমরা অনেক সহ্য করেছি, আর নয়! আমাদেরই জায়গা দখল করে থাকবে, আমাদেরই খাবে আর আমাদের লোককেই মারবে! সুভাষকে আমি ছোট ভাইয়ের মতো ভালোবাসতাম। ওকে বারণ করেছিলাম, ওই এলাকায় যাস না, ওদের মায়া-মমতা বলে কিস্যু নেই। যখন তখন মেরে দিতে পারে! কথা শোনে নি। তবে আমরাও চুপ করে বসে থাকব না। সুভাষের হত্যার বদলা আমরা নেবই।

আজ একসপ্তাহ হয়ে গেল: কালীকিঙ্করপুরে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ। খবরের কাগজে কেবল বেরিয়েছিল একটা তিন চার লাইনের ছোট্ট খবর: গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরে কালীকিঙ্করপুরে এক যুবকের হত্যা। কীসের গোষ্ঠী, কাদের গোষ্ঠী – সেসব তদন্ত করে দেখছে পুলিশ! কালীকিঙ্করপুরের লোকেরাও মরা কুকুরটার কথা ভুলে গিয়েছিল, এই ক’দিনে। 

বুড়িটা

গল্প

জুন ২০২০ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

বুড়িটা

অদিতি সুর

Project 118.jpg

বৈশাখ মাসের প্রায় মাঝামাঝি হতে চললো, কালবৈশাখীর কোন পাত্তা নেই। সূর্যের তাপে, গরমের জ্বালায় সকলের প্রাণ ওষ্ঠাগত। খুব দরকার না থাকলে গৃস্থের ঘরের থেকে ভর দুপুরবেলা পারতপক্ষে কেউ বাড়ির বাইরে বের হয় না। ব্যতিক্রম এই নির্মলাদেবী। এই ভর দুপুরেও তার এই সাধের বাগানের আম গাছের দিকে চোখ লাগিয়ে পশ্চিমের বারান্দার রোদ্দুরে চেয়ার নিয়ে বসে আছেন। এই দুপুরে এ পাড়ার ছেলেপিলেরা আম চুরি করতে আসে তার বাগানে। তারপর একটু চোখের আড়াল হয়েছে কি গাছ থেকে টপাটপ আম পেড়ে নিয়ে ছুট দেয়। নির্মলাদেবী শাপ শাপন্ত করেন, তাতে তারা থোড়াই কেয়ার করে। এই পাড়ায় নির্মলাদেবীর বসতি অনেক দিনের। সেই কবে তার জন্মের আগে তার বাবা মেদিনীপুর থেকে উত্তর চব্বিশ পরগনার বারাসাত অঞ্চলের বটতলা এলাকায় জমি কিনে বাড়ি করে আসেন। তার কিছুকাল পর নির্মলাদেবীর জন্ম। চার ভাইবোনের মেজো তিনি। বড়ো দাদা বিয়ে করে অনেক কাল আগে গড়িয়াতে ফ্ল্যাট কিনে চলে গেছেন। ছোটো বোনকে বাবা বিয়ে দিয়ে গেছেন। বসিরহাটে এখন তার ভরা সংসার। নির্মলাদেবীর আর বিয়ে করা হয়ে ওঠেনি বাবার সংসার সামলে। আসলে ওনার মা অনেক অল্প বয়েসেই পরলোক বাসি হয়েছিলেন। ছোটো ভাইটাও বিয়ে করেনি নির্মলাদেবীর। সে লেবার কন্ট্রাক্টর এর কাজ করে। ভাইবোন দুজনের ভালোভাবেই কেটে যায়, বাবার রেখে যাওয়া কিছু সম্পত্তির দেখভাল করে।

নির্মলাদেবীর বাবা সাত কাঠা জমির তিন কাঠাতে বাড়ি করেছিলেন আর চার কাঠাতে বেশ কিছু ফলের গাছ লাগান। সেসব স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে ভালোই টাকা আসে ভাইবোনের সংসারে। জামরুল, নোনা, আতা, সবেদা, সুপুরি, নারকেল, লিচু, পেয়ারা গাছ তো আছেই বাগানে সাথে আছে একটা বড়ো আম গাছ। এই আম গাছটা জাতে হিমসাগর, বারো বছর আগে বাজার থেকে কেনা আমের আঁটি থেকে গাছটা জন্মেছিল। ফল আসতে বেশ কিছু বছর দেরি হয়েছে। নির্মলা দেবীর ভাই নিরুপমবাবু একসময় রাগ করে গাছটা কেটে ফেলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মায়া করে নির্মলাদেবী সেটা কাটতে দেন নি।

এই বছর গাছটায় ভরে আমের ফলন হয়েছে। নির্মলাদেবী খুব খুশি আমের ফলন দেখে সাথে তার আজকাল রাতের ঘুমের ও বারোটা বেজেছে। যবে থেকে আমের মুকুল এসেছে তবে থেকে পাড়ার ছেলেপুলের নজর তার গাছের ওপর। আমের চিন্তায় শান্তিতে দু মুঠো খেতেও পারেন না তিনি। কোন রকমে দুপুরে ভাত গলধঃকরণ করে গাছের ওপর নজরদারি চালান। এই তো সেদিন দুপুরে চোখ দুটো ঘুমে বুজে এসেছিল চেয়ারে বসে আম পাহারা দিতে দিতে। আর ঠিক তখনই পাড়ার ছেলেরা সুযোগ বুঝে আম চুরি করতে এসেছিল, দেখতে পেয়েই কি শাপ শাপান্ত করলেন তিনি। অশ্লীল গালিগালাজ শুনে প্রতিবেশীরা কানে হাত চাপা দিয়েছিল। আজকাল বয়েস হয়েছে ঠিকই নির্মলাদেবীর কিন্তু মুখের ধার এখনও কমেনি। আড়ালে পাড়ার সবাই বলে বুড়ির হাত থেকে একটা আম ও সরে না। যে ওর গাছ থেকে চুরি করবে সে ওর গালি খেতে খেতে মরবে। ওই বুড়ির মুখ না যেন পচা ডোবা।

নির্মলাদেবীর বধ্য ধারণা সবাই ওর গাছের আমের দিকে নজর দিয়ে রেখেছে, তাই আজকাল উনি পাড়ার কারুর সাথে রাগে কথা বলেন না। নিজেকে একটু গুটিয়ে রাখেন।

দুপুরে চেয়ারে বসে গাছের হাওয়ার সাথে নির্মলাদেবী গুটি কতক আম কেটে খাচ্ছিলেন নিজের গাছের, তখনই নিরুপমবাবু ঘরে ফেরেন হন্তদন্ত হয়ে। একটু অবাক হন নির্মলাদেবী, এই সময় তার আদরের নীরু কখনো বাড়িতে ফেরে না। হাত এর আমের বাটিটা নামিয়ে রেখে ভাইকে জিজ্ঞেস করেন তার এত তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার কারণ। নিরুপমবাবু উদ্বিগ্ন মুখে বলেন "টিভিতে দেখো কি অবস্থা, কাল দুপুর নাগাদ ঘূর্ণিঝড় আসছে, সবাইকে বাড়ির মধ্যে থাকতে বলছে। লেবারদের তাই ছুটি দিয়ে দিলাম।"

"কি বলিস নীরু!" কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে নির্মলাদেবীর।

"এত আম হয়েছে গাছে এবার। কী করে একদিনের মধ্যে পারব? লোক ও তো পাব না যে আমগুলো পেড়ে দেবে। বড্ডো দুশ্চিন্তা হচ্ছে রে!"

দিদির কথা শুনে ভারী অদ্ভুত লাগে নিরুপমবাবুর, ঝড়ে উড়ে যাবেন কিনা তার ঠিক নেই,তাতে আবার ওনার আমের চিন্তা। ঘূর্ণঝড়টি নাকি একশো কুড়ি কিলোমিটার বেগে আসছে। "উনি বিরক্ত প্রকাশ করে বলেন "আহ্ দিদি, বাঁচবো কী করে তাই ভাবো, তোমার আবার আমের চিন্তা, বাড়িটা অনেক বছরের পুরনো, ভেঙে না পড়ে, কোথায়ে সেসব চিন্তা করবে তা না করে উটকো চিন্তা করছো।"

"হ্যা রে আমি তো উটকো চিন্তাই করি। সব আম বিক্রির টাকা তো নিজের শ্রাদ্ধের জন্য রাখছি। অদ্ভুত চিন্তাভাবনা তোর।" মহা বিরক্ত হয়ে নিজের মনে গজগজ করতে করতে বারান্দায় চলে যান নির্মলাদেবী।

রাতে ভালো করে খেতেও পারেন না শান্তিতে। দুশ্চিন্তাতে সারারাত ঘুম হয় না তার। বারবার বিছানা থেকে উঠে বারান্দায় গিয়ে গাছটা দেখতে থাকেন তিনি। সারারাত এভাবেই ঘর আর বারান্দা ঘোরাফেরা করেই কেটে যায়। 

ভোর রাত থেকেই ঝোড়ো হাওয়া বইতে শুরু করে। শান্ত প্রকৃতির ধীরে ধীরে রূপ বদলাতে থাকে। সকালবেলা এক চোট ঝগড়া বেঁধে যায় নির্মলাদেবীর তার ভাইয়ের সাথে।

"দিদি যত তোমার বয়েস বাড়ছে তত তুমি আরো সংসারের মায়াতে জড়িয়ে পড়চো ।"

"হ্যা সবসময় আমাকেই দুষতে থাক তুই, এই বাড়ি বাগান কম ঝামেলা, সব সামলাই আমি, তুই নিজের কাজ আড্ডা বন্ধুবান্ধব এইসব নিয়ে ব্যস্ত থাকিস। তোদের এসব দেখভালের জন্য বিয়েটাও করিনি। আর এখন এসব শুনতে হয় আমাকে।

এসব নিয়ে কি আমি সোগ্গে যাবো। এই মাগীর মৃত্যুর পর তো বাতি দেওয়ার ও কেউ নেই।" কাঁদতে

কাঁদতে নিজের বাপের ছবিখানার সামনে গিয়ে বসেন নির্মলাদেবী। তাকে ওরকম করতে দেখে নিরুপমবাবু জোড় গলাতে দিদির দিকে তাকিয়ে বলে ওঠেন "একটু রান্না পর্যন্ত করো না সকাল থেকে, সেই যে শুনেচো ঝড় আসবে দুপুরের পর থেকে, ঐখানে আম গাছের সামনে গিয়ে হত্যে দিয়ে পড়ে আছো। মুড়ি কটা বাতাসা দিয়ে কোন সকালে খেয়েছিলাম, এখন দুপুর একটা বাজতে যায়, স্নান করে বসে আছি, পেটে একটা ভাতের দানা পড়েনি।"

রাগ দেখিয়ে নিরুপমবাবু আবার রান্নাঘরে মুড়ি খেতে চলে যান। দিদির হাবভাব দেখে বুঝেই গেছেন আজ ভাত জুটবে না তিনবেলা মুড়ি দিয়েই খুন্নিবৃত্তি করতে হবে।

বেলা যত বাড়তে থাকে তত হাওয়ার গতি তীব্র হতে থাকে, সেই সাথে নির্মলাদেবীর হৃদয় এর গতি ও পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে। সকাল থেকে মুড়ি জল খেয়েছেন শুধু তাতেও তেমন খিদে লাগছে না তার। গাছটার চিন্তায় নড়তে পারছেন না একচুল বারান্দা থেকে তিনি। বেলা চারটে নাগাদ প্রবল বেগে ঝড় বইতে শুরু করে। চারদিকে শো শো আওয়াজ হতে থাকে হাওয়ার। দমকা হাওয়া বইতে শুরু করে দিশাহীনভাবে। আকাশ কালো করে আসে। বারান্দার গ্রীলে হাত দিয়ে আম গাছের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকেন নির্মলাদেবী। কিছু সময় পরে ঝেঁপে বৃষ্টি আসে আকাশ কাঁপিয়ে সাথে ঝড়ের গর্জন বাড়তে থাকে। নির্মলাদেবীর সাধের আম গাছের থেকে হাওয়ার ঝাপটায়ে আম ঝরে পড়তে থাকে বাগানে। গাছটা ঝড়ের দাপটে ক্রমশঃ রাস্তার দিকে হেলে দুলে পড়ে সাথে টুপটাপ আম রাস্তায় গড়িয়ে যায়। নির্মলাদেবী কষ্টে ককিয়েঁ ওঠেন তার সাধের আমগুলোর স্থান চ্যুতি ঘটতে দেখে।

"নীরু ও নীরু শিগগির এদিকে আয়ে ভাই আমার।"

চিৎকার করে ডাকেন নির্মলাদেবী। দিদির আর্ত চিৎকারে নিরুপমবাবু ভেতরের ঘর থেকে ছুটে আসেন।" চেঁচাচ্ছো কেন? এই ঝড়বৃষ্টির মধ্যে বাইরে না থেকে ভেতরে চলো দিদি।"

"ও নীরু ভাই আমার যা না ছাতা মাথায় দিয়ে রাস্তার আমগুলো একটু কুড়িয়ে আন। এই পাড়ার ছেলেপুলেগুলোকে জানিস তো সব শকুনের নজর। ঝড় কমলেই শালা হারামিগুলো সব কুড়িয়ে নিয়ে যাবে। যা না বাপ।"

"তুমি পারো বটে দিদি! এই ঝড়ে আম আনতে পারবো না আমি। তোমার যুত থাকলে যাও।"

নিরুপমবাবু আর কথা না বাড়িয়ে ঘরের ভিতর চলে যান। এর মিনিট দশেকের মধ্যে সারা পাড়ার বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। অন্ধকারে ভরে যায় চারিদিক। ঝড়ের গতি আরো তীব্র তর হতে থাকে। তার মধ্যেই ছাতা মাথায় দিয়ে প্রবল বজ্র বিদ্যুৎ এর ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে নির্মলাদেবী রাস্তার দিকে এগিয়ে চলেন আম কুড়ানোর জন্য। ঝমঝম এ বৃষ্টির মধ্যে আম কুড়াতে গিয়ে ভিজে জবজবে হয়ে যান তিনি। তবুও বৃষ্টিতে ভিজে ব্যাগের মধ্যে রাস্তায় পড়ে যাওয়া আমগুলো রাখতে থাকেন। ওনাকে দেখে নিরুপমবাবু চিৎকার করে ঘরে আসতে বলেন। ভাইয়ের কথার কর্ণপাত না করে নির্মলাদেবী নিজের কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। কিছুটা আম কুড়ানোর পর হাঁপিয়ে গিয়ে ঘরে ঢোকেন তিনি। আসলে এই বয়েসে কোমরে বাতের ব্যথার জন্য ঝুঁকে কাজ করতে কষ্ট হয়। 

নিরুপমবাবু অন্ধকারে হাতরে হাতরে মোমবাতি খুঁজে বের করে জ্বালিয়ে দেন, তারপর নিজের দিদিকে এই দুর্যোগের মধ্যে বাইরে বেরোনোর জন্য খুব কথা শোনাতে থাকেন। নির্মলাদেবী কোন কথা গায়ে না লাগিয়ে একটা ঝুড়ির মধ্যে আমগুলো গুনে গুনে রাখতে থাকেন। তিতিবিরক্ত হয়ে নিরুপমবাবু অন্য ঘরে চলে যান।

নির্মলাদেবী আবার বারান্দায় টর্চ হাতে নিয়ে দাড়িয়ে এক দৃষ্টিতে আম গাছটার দিকে তাকিয়ে থাকেন। ঝড়ে হাওয়ার দাপটে আম পড়লেই দৌড়ে চলে যান রাস্তায় কখনো বাগানের মধ্যে আম কুড়িয়ে আনার জন্য। দিদির অবস্থা দেখে নিরুপমবাবু রাগে গজগজ করতে থাকেন নিজের ঘরে বসে। সেই রাত্রে ঘর দুর্যোগের মধ্যে বিদ্যুতের আসার সম্ভাবনা না দেখে সামান্য দুধ মুড়ি খেয়ে শুয়ে পড়েন নিরুপমবাবু। মাঝ রাতে হঠাৎ দিদির একটা আর্তনাদ কানে আসে তার। ঘুমের ঘোরে সেটা ঠিকমতো ঠাওর করতে পারেন না তিনি। ভোরের দিকে দুর্যোগ শেষ হয়। ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড় তার দাপটের চিহ্ন চারিদিকে রেখে যায়।নিরুপমবাবু ঘুম থেকে উঠে নিজেদের বাগানের ক্ষয় ক্ষতির হিসাব করতে বাগানে যান। বাগানে যেতে গিয়ে দেখেন বাড়ির সামনের পাঁচিলটার অনেকটা ভেঙে পড়েছে। পাঁচিলের জবা আর শিউলি গাছটার অবস্থা শোচনীয়। বাগানের জামরুল গাছটা একদিকে শুয়ে পড়েছে শুধু তাই নয় তার দিদির সাধের আমগাছ টাও একদিকে শুয়ে পড়েছে,আর চতুরদিকে ছড়িয়ে পড়েছে আম।গাছটা শিকড় সমেত গোড়া থেকে ভেঙে পড়েছে। নিরুপমবাবু গাছের মোটা ডালের নিচে দেখতে পান ওনার দিদির শাড়ির আঁচল এর কিছুটা অংশ। বড়ো বড়ো পা ফেলে উনি ডালটার কাছে প্রায় দৌড়ে আসেন। কাছে এসে দেখেন নির্মলাদেবী গাছের মোটা ডালটার নিচে চাপা পড়ে উপুড় হয়ে পড়ে আছেন। সারা শরীর ফ্যাকাশে সাদা, বিদ্যুতের তার ওনার গায়ের সাথে পেঁচিয়ে রয়েছে। উনি দৃশ্য দেখে আঁতকে ওঠেন, বুঝতে আর বাকি থাকে না কি অঘটন ঘটে গেছে কাল রাতে। মাথা চেপে ধরে ওখানেই হাঁটু মুড়ে বসে পড়েন তিনি।

পাশের বাড়ির প্রতিবেশী সুমনবাবু ওনার বারান্দায় দাড়িয়ে এই ভয়ংকর দৃশ্য দেখে চিৎকার করে পাড়ার লোক জড়ো করেন। মুহূর্তের মধ্যে পাড়ার লোক ভিড় করে আসে নির্মলাদেবীর বাড়িতে। পুলিশে খবর দেওয়া হয়। সারারাত বাগানের জমা জলে পড়ে থাকার জন্য নির্মলাদেবীর শরীরটা ফুলে গেছে অনেকটা। পুলিশ এসে লাশ উদ্ধার করে। তখনও দেখা যায় নির্মলাদেবীর শাড়ির কোঁচড়ে আমের রাশি। দৃশ্য দেখে পাড়ার দুষ্টু ছেলেপুলেদের চোখেও জল এসে যায়। স্ট্রেচারে করে নির্মলাদেবীর লাশ যখন নিয়ে যাওয়া হচ্ছে নিরুপমবাবু ফ্যালফ্যাল করে আম গাছটার দিকে তাকিয়ে থাকেন। গাছটা থেকে হঠাৎ কিছু পাতা ঝড়ে পড়ে। মুক গাছটাও যেন নির্মলাদেবীর মৃত্যুর শোকে চোখ থেকে দু ফোঁটা জল ফেলে। আসলে গাছেরও তো প্রাণ আছে কিন্তু কথা বলে অনুভূতি ব্যক্ত করার ক্ষমতা থাকে না।

প্রবন্ধ

বাউল

জুন ২০২০ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

বাউলতত্ত্বের মর্মকথা ও বাংলাদেশে

বাউলগানের ভবিষ্যৎ

মোঃ সোলায়মান মিয়া
বাংলাদেশ

baul_pi95_l.jpg

বাউল” শব্দটি ‍শুনলে বা কোন বাউল দেখলে সাধারণভাবে আমাদের মনে হয়, কোনো ঘরছাড়া উদাসী সাধকের কথা, কিংবা কোনো এক বিশেষ দর্শনের কথা অথবা কোনো মরমী গানের কথা। সত্যিকার অর্থে বাউল হলো এসকল অর্থের বিচারে যে কোন একটি এবং একই সাথে সকল অর্থের সমাহার। বাউলের ভিত্তি হলো বহুবিধ ধর্ম-দর্শনে সৃষ্ট “বাউলতত্ত্ব”। এই তত্ত্বকে মান্য করে যে বা যারা স্বতন্ত্র জীবনযাপনের পথ বেছে নেন, তিনি বাউল বা বাউল সাধক। এই তত্ত্বকে যখন বিশেষ সুরে গানের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়, তখন তা হয়ে উঠে বাউল গান। বাউলগণ একদিকে গানের মাধ্যমে সাধনার তত্ত্ব প্রচার করেন, অপরদিকে তাঁরা গানের মাধ্যমেই “মনের মানুষ”, “প্রাণের মানুষ” অর্থাৎ ঈশ্বর-আল্লাহ-ভগবানকে খুঁজেন। বাউল তত্ত্বে বা আদর্শে দীক্ষিত না হলে কারো পক্ষে বাউল গানের নিগূঢ় তত্ত্ব উপলব্ধি করা সম্ভব না। যেমন মহাত্মা লালনের একটি গান:

চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে, আমরা ভেবে করবো কি
ঝিয়ের পেটে মায়ের জন্ম, তারে তোমরা বলবে কি?
তিন মাসের এক কণ্যা ছিল, নয় মাসে তার গর্ভ হল
এগার মাসে তিনটি সন্তান, কে বা করবে ফকিরি?
ঘর আছে তার দুয়ার নাই রে, লোক আছে তার বাক্য নাই রে
কে বা তারে আহার জোগায়, কে বা দেয় সন্ধ্যাবাতি?
ফকির লালন ভেবে বলে, ছেলে মরে মাকে ছুঁলে
এই তিন কথার অর্থ না জানলে, তার হবে না ফকিরি।।

বাউল সাধনার শীর্ষস্তরে না গিয়ে কারো পক্ষে কি এই গানে কি বলা হয়েছে তা বুঝা সম্ভব? তবুও আমরা নিজেদের মতো করে এরকম গানগুলোর একটা মানে দাঁড় করিয়ে নিই। সেই মানেটা কতটা গভীরে যেতে পারে বা কতটা নিগূঢ়তাকে স্পর্শ করতে পারে তা কেবল প্রকৃত বাউলগণই বলতে পারবেন। আবার এখানেও প্রতিবন্ধকতা আছে, কেননা প্রকৃত বাউল হলে তাঁর কর্তৃক নিগূঢ় তত্ত্ব ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ পূর্বক বিতরণ করাও যথেষ্ট কঠিন। কারণ বাউলতত্ত্বের সাধকরা বেদ, বাইবেল বা কোরানের মত মান্য করা যায় - এমন কোন গ্রন্থ রচনা করেন নি। বাউলদের কাছে ধর্মগ্রন্থের চেয়ে গুরু বা মুর্শিদ বড়। বাউল সাধকরা কোনো অলৌকিক গল্পকথা দ্বারা তাঁদের দর্শনকে মহিমান্বিত করার চেষ্টা করেন নি। বাউল সাধকদের ভাবনা গ্রন্থাকারে প্রচারের পরিবর্তে শিষ্যদের মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। সে কথাও আবার সবার জন্য হয়ে উঠে নি। কারণ গুরুর বারণ - “আপন সাধনার কথা, না বলিও যথা তথা”। তাই বাউলতত্ত্ব পরিণত হয়েছে গুপ্তবিদ্যায়। এ বিদ্যার পারিভাষিক শব্দাবলির গভীরে লুকিয়ে আছে তাত্ত্বিক রহস্যময়তা। মনে হতে পারে বাউল গুরুরা নিজেরাই নিজেদের কথা রাখেন নি। কারণ তাঁরা তাঁদের গানে গানে সর্বজনের কাছে বাউলতত্ত্বের গোপন কথা প্রচার করেছেন। কিন্তু ভাবসন্ধানের বিচারে সে গান কি সকলের বোধগম্য হয়ে উঠেছে? নিতান্তই শ্রোতা হিসেবে যাঁরা সুরের মোহে বাউল গানে মুগ্ধ হন, ভাবসন্ধানে এসে তাঁরাই অসহায় বোধ করেন। গানের সুরে বাউল গান কাছে টানে, আর ভাবের সুরে বাউলতত্ত্বের মর্মের গভীরে টেনে নিয়ে যায়। বাউল গানের সুর লোকজ। বাংলা লোকগানের প্রধান চারটি ধারার সুরের ভিতরে বাউল সুর একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। তবে সুরের কাঠামোগত রূপের ভিতরে পাওয়া যায় পূর্ববঙ্গের ভাটিয়ালি এবং পশ্চিমবঙ্গের কীর্তনের প্রভাব। উদ্দীপনামূলক গানে রয়েছে চঞ্চল গতি। আনন্দ প্রকাশের অংশ হিসেবে গানের সাথে এঁরা নাচে। এঁদের নাচ ধরা-বাঁধা ছকে আবদ্ধ নয়। এ নাচে বন্ধনের আড়ষ্ঠতা নেই, আছে মুক্তির আনন্দ। বাউল নিজে নাচে যত, শ্রোতাকে নাচায় তাঁর চেয়ে বেশি। বাউল ভাবের ঘোরে নাচে, আর শ্রোতা সে নাচে উদ্বেলিত হয়। বাউলের গানে তাল নেই, আছে ছন্দ। তালটা যান্ত্রিক বলে, তাতে আনন্দ কম। ছন্দ হলো নান্দনিক, তাই ছন্দ আনন্দময়।

ইতিহাসবিদদের মতে, সতেরো শতকে বাংলাদেশে বাউল মতের উদ্ভব হয়। এ মতের প্রবর্তক হলেন আউল চাঁদ ও মাধববিবি। সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত বাংলা ভাষায় “বাউল” শব্দের দ্বারা বুঝানো হয়েছে বাহ্যজ্ঞানহীন, উন্মাদ, স্বাভাবিক চেতনাশূণ্য, ক্ষ্যাপা ইত্যাদি। যাঁরা বাউল ধর্মের প্রতি অশ্রদ্ধা দেখিয়েছেন এবং যাঁরা প্রথাগত ধর্মমতের বাইরে এসে ভিন্নমতকে গ্রহণ করতে পারেন নি মূলত তাঁরাই এই নামগুলো দিয়েছিলেন। এরূপ ধারণার পিছনে বাউলদের জীবনযাত্রার ধরণই দায়ী ছিল। কারো মতে সংস্কৃত “বায়ু” শব্দটি থেকে বাউল শব্দটির উৎপত্তি। সংস্কৃত বায়ু = বাংলা “বাউ” শব্দের সাথে “ল” প্রত্যয়যোগে বাউল শব্দটির উৎপত্তি, অর্থাৎ বাংলার যে সব লোক “বায়ু” অর্থাৎ শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়ার সাহায্যে সাধনার মাধ্যমে আত্মিক শক্তি লাভ করার চেষ্টা করেন, তাঁরাই বাউল। কারো মতে যে সব লোক প্রকৃতই পাগল, তাই তাঁরা কোনো সামাজিক বা ধর্মের কোনো বিধিনিষেধ মানে না, তাঁরাই বাউল। আবার কেউ কেউ বাউল শব্দটিকে মুসলমান সাধক অর্থে আরবি “অলী” শব্দের বহুবচন “আউলিয়া” শব্দ হতে “ইয়া” প্রত্যয়ের পতনে উৎপত্তি বলে মনে করে থাকেন। তাঁদের মতে বাংলার যে সব লোক মুসলমান দরবেশদের মতো লম্বা আলখেল্লা পরে, তাঁদের বাণী ও বিশ্বাসে আস্থাপরায়ণ হয়ে দেশে দেশে ঘুরে বেড়ায়, তাঁরাই বাউল। এই জন্যই নাকি বাউল-সন্ন্যাসীদের “ফকির” বলা হয়। সর্বোপরি বাউলেরা নিজেরা যেহেতু নিজেদের বাউল নামটি দেন নি, সেহেতু “বাউল” শব্দটির উৎপত্তি ও ব্যাখ্যা নিয়ে নানা ধরনের মত প্রচলিত রয়েছে, কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবে বাউল মতের মর্মকথা অনুধাবন করা অত্যন্ত দুরুহ ব্যাপার। 

বাউল গানে নিতান্তই প্রেম বা প্রকৃতির গান নেই। এদের গানের একমাত্র বিষয় বাউল ভাবনা কেন্দ্রিক তত্ত্বকথা। বাউলতত্ত্বের সাধকগণ বাউল গানে প্রথাগত রাগরীতিকে অনুসরণ করেন নি। শাস্ত্রীয় বা নাগরিক গানের তালের পরিবর্তে, তাঁরা ভাবের দোলায় আপন ছন্দে গান বেঁধেছেন। এদের গানে নানা ধরনের রূপক শব্দ পাওয়া যায়। যা ভাব প্রকাশের সহায়ক হলেও এর বাণী সাধারণ মানুষের কাছে সহজে ধরা দেয় না। বাউল গানের বাণী চর্যাপদের মতই “সন্ধ্যাভাষা”। যেখানে বাইরে এক কথা থাকে কিন্তু ভিতরে অন্য ভাব থাকে।

এই গানের বাণীতে পাওয়া যায় প্রশান্ত ভাব, যা আধ্যাত্মিক দর্শনকে প্রকাশ করার জন্য অত্যন্ত উপযোগী। এ গানের বাইরের রূপ প্রতীকী; ভিতরের কথাটাই আসল। লালন যখন বলেন, “খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়।” তখন আক্ষরিক অর্থে ”খাঁচা” এবং ”পাখি” মূল তত্ত্বকে প্রকাশ করে না। কিন্তু প্রতীকী ”খাঁচা” শব্দের মূল অর্থ যখন হয় ”দেহ” আর “পাখি”র অর্থ হয় “প্রাণ” বা “মন”, তখন ভাবের ঘরে নতুন চৈতন্যের উদয় হয়। বহুদিন ধরে অজস্র বাউল গানের ভিতর দিয়ে বাউল দর্শন বর্ণিত হয়েছে। এ দর্শন এমনি প্রতীকী মোড়কে আবদ্ধ। গুরুর কাছে বসে শিষ্যরা বাউলতত্ত্বের গোপন অর্থ আয়ত্ত্ব করেন সযত্নে।

কেবল বাউল গান হয় না। তার ভিতরে বাউল দর্শনও থাকা আবশ্যক। বর্তমানে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, হিন্দুধর্ম থেকে আগত বাউলগণ নামের শেষে “দাস” ও “বাউল” এবং মুসলিম ধর্ম থেকে আগত বাউলগণ নামের শেষে “শাহ্”, “ফকির” ও “বাউল” যুক্ত করে দেশ-বিদেশ

সফর করছেন এবং প্রচুর অর্থ উপার্জন করছেন। মানুষের সামনে বিভিন্ন রং-এর বাহারি তালি দেয়া পোষাক পরিধাণ করলেও তাদের বেশিরভাগেরই যাপিত জীবন কিন্তু বেশ আয়েশি। অপরদিকে সমাজের বিভিন্ন অংশের চাপ সামলাতে সামলাতে বাউল সাধনা-তত্ত্ব বিলুপ্ত প্রায়। হাটে-মাঠে-গঞ্জে-আখড়ায় বাউল হিসেবে আমরা যাদের দেখি, তাদের অধিকাংশই কর্মে ভীত একশ্রেণির মানুষ, কিংবা বাউল বেশ ধারণ করে নানাধরণের অপকর্মে লিপ্ত। বাউলরা আজ দারুনভাবে পণ্যে পরিণত হয়েছে। কিন্তু একটা সময়ে বাউলতত্ত্ব ও সাধনা ধর্মাশ্রয়ীদের বেশ বিপদেই ফেলে দিয়েছিলো। শাস্ত্র-কিতাবের বাইরে গিয়ে এবং সকল প্রকার জাত-পাতকে পিষ্ঠ করে বাউলগণ মানুষকে ঈশ্বরজ্ঞান করেছেন এবং মানুষের মধ্যে ঈশ্বর খুঁজেছেন। তাঁদের সাধনায় ঈশ্বর ছিলোনা, বর্ণ-ধর্ম ছিলোনা, ধনী-গরীব ছিলো না । কিন্তু তাঁদের গুরু ছিলেন, মুরশিদ ছিলেন।

বাউলদের জ্ঞান আহরণের জন্য তা ছেঁকে নিতে হবে মারফতের মাধ্যমে। মারফত জানতে হয় মুর্শিদের মাধ্যমে। মুর্শিদ হলো সেই শক্তির আঁধার, যিনি শিষ্যকে সরল-গরল, ভালো-মন্দের ভেদ-প্রভেদ বুঝিয়ে দেন। মুর্শিদ শিষ্যকে বাউলের গোপনীয় গুহ্যতত্ত্ব সম্পর্কে ধারণা দেন। বাউলেরা সাধনার আশ্রয় হিসেবে দেহকে অবলম্বন করে থাকেন এবং দেহ-ঘরের মধ্যে তাঁরা সৃষ্টি-স্রষ্টার অবস্থান পর্যবেক্ষণ করেন, আর গুরু-শিষ্য পরম্পরায় বাউলেরা সাধনার ধারা অব্যাহত রাখেন। এক্ষেত্রে গুরুকে তাঁরা স্রষ্টার সমতুল্য বিবেচনা করেন। তাঁরা মনে করেন গুরু বা মুর্শিদকে ভজনা করার ভেতর দিয়ে স্রষ্টার সাথে সাক্ষাৎ করা যায়। দেহের আধারে যে চেতনা বিরাজ করছে, সে-ই আত্মা। এই আত্মার খোঁজ বা সন্ধানই হচ্ছে বাউল মতবাদের প্রধান লক্ষ্য। বাউলরা আল্লাহ, ঈশ্বর কিংবা সৃষ্টিকর্তাকে নিরাকার মানতে নারাজ। ঈশ্বর নামক শক্তিকে তারা সাকার হিসেবেই মানেন। যেমন ভাটির বাউল শাহ আব্দুল করিম বলেছেন; "আমি কখনোই আসমানি খোদাকে মান্য করি না। মানুষের মধ্যে যে খোদা বিরাজ করে আমি তার চরণেই পূজো দেই।” বাউল করিমের এ কথায় স্পষ্ট ভাবেই প্রকাশ হয় যে বাউলরা নিরাকার সৃষ্টিকর্তা মানতে নারাজ। বাউলদের বিশ্বাস মানুষের মধ্যে সৃষ্টিকর্তা আসীন, তাই মানুষ ভজলেই ঈশ্বরের নৈকট্য সম্ভব। এ প্রসঙ্গে ড. আহমেদ শরিফ তার বাউলতত্ত্ব গ্রন্থে লিখেছেন ”বিভিন্ন মতবাদের মিশ্রণে গড়ে উঠেছে বাউল মত। হিন্দু-মুসলমানের মিলনে হয়েছে বাউল সম্প্রদায়। তাই পরমত সহিষ্ণুতা, অসাম্প্রদায়িকতা, গ্রহণশীলতা, বোধের বিচিত্রতা, মনে ব্যাপকতা ও উদার সদাশয়তা এদের বৈশিষ্ট্য।” তাই মুসলমান বাউলদের হিন্দু গুরু বা হিন্দু বাউলদের মুসলমান গুরু এমন প্রায়শই দেখা যায়। বাউলতত্ত্বের আদর্শসমূহ হলো - গুরুবাদ, শাস্ত্রহীন সাধনা, দেহতত্ত্ব, মনের মানুষ, রুপ-স্বরূপ তত্ত্ব ইত্যাদি। বাংলাদেশের বাউলেরা এভাবেই অকাট্য যুক্তির আলোকে শরিয়তি গ্রন্থকে সামনে রেখেই গুরুবাদী ধারার সাধনচর্চাকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। শুধু তাই নয়, মানুষ-গুরু ভজনা এবং মানুষকে সেজদার যোগ্য বিবেচনা করে, তার ভেতর দিয়েই যে স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ ইবাদত সম্ভব; বাংলার বাউল-সাধকেরা সেকথা ব্যক্ত করতেও দ্বিধা করেন নি। 

বাংলার বাউল-সাধক পদকর্তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের দাবীদার হলেন ফকির লালন সাঁই। লালন সাঁই তাঁর সমগ্রজীবন ব্যয় করেছেন বাউল-সাধনার স্থায়ী ও একটি গানগত রূপ দিতে, তাঁর গানে বাউল-সাধনার করণ-কার্যের নানাবিধ নির্দেশনা আছে। তিনি দৈন হতে শুরু করে গোষ্ঠ, গৌর, আত্মতত্ত্ব, আদমতত্ত্ব, নবীতত্ত্ব, সৃষ্টিতত্ত্ব, সাধনতত্ত্ব, দেহতত্ত্ব ইত্যাদি পর্বের গানের পাশাপাশি সমাজ-সংস্কারমূলক মানবিকতার উদ্বোধনমূলক গান রচনা করেছেন। বাউল-সাধনার গুরু-শিষ্য পরম্পরার লালন প্রবর্তিত ধারাটি অদ্যাবধি বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গে অত্যন্ত বেগবান রয়েছে। লালনপন্থী সাধকদের মধ্যে পদ রচনায় অন্যান্য যাঁরা শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছেন তাঁদের মধ্যে দুদ্দু শাহ, খোদাবক্স শাহ, বেহাল শাহ, মকছেদ আলী সাঁই, মহিন শাহ প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশ ও ভারতের বাউল-সাধক, পদকর্তা ও সংগীতশিল্পী হিসেবে যাঁদের স্বীকৃতি রয়েছে, তাঁরা হলেন যাদু বিন্দু, দ্বিজ দাস ঠাকুর, পাঞ্জু শাহ, গোসাই গোপাল, হাসন রাজা, আলফু শাহ, জালালউদ্দিন খাঁ, রশিদ উদ্দিন, উকিল ‍মুন্সি, পাগল বিজয়, দূরবীন শাহ, আলাউদ্দিন শাহ, খালেক দেওয়ান, মালেক দেওয়ান, ভবা পাগলা, রজ্জব আলী দেওয়ান, মাতাল রাজ্জাক দেওয়ান, নবনী দাস বাউল, পূর্ণদাস বাউল, শাহ আবদুল করিম প্রমুখ। যুগে যুগে কালে কালে শত সহস্র বাউলেরা পূর্বে যেমন এই সাধনা ও গানের ধারা চর্চা করেছেন, বর্তমান কালেও অগণিত বাউল-সাধক-ভক্তগণ এই ধারা অব্যাহত রেখে চলেছেন। বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে গেলে এখনও বাউলের দেখা মেলে, এমনকি চলতে পথে রাস্তায়, ট্রেনে, বাসে বা শহরাঞ্চলেও বাউল শিল্পীদের প্রসার চোখ এড়িয়ে যায় না, কেননা তাদের কণ্ঠে থাকে সুমধুর গান আর ভাবের বিস্তার।

২০০৫ সালে “ইউনেস্কো” বিশ্বের মৌখিক ও দৃশ্যমান ঐতিহ্যসমূহের মধ্যে বাউল সঙ্গীতকে অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ হিসেবে ঘোষনা করেছে। বাংলাদেশের গ্রামীণ সৃজনশীল সাধকদের মধ্যে “বাউল সম্প্রদায়” অত্যন্ত প্রসিদ্ধ। বাউলদের রচিত সঙ্গীতে ভাবের গভীরতা, সুরের মাধুর্য, বাণীর সার্বজনীন মানবিক আবেদন বিশ্ববাসীকে যেন এক মহামিলনের মন্ত্রে আহ্বান করে। আবার, ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে ইউনেস্কো বাংলার বাউল সঙ্গীতকে ”দ্যা রিপ্রেজেন্টেটিভ অব দ্যা ইন্ট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটি”র তালিকাভুক্ত করেছে। অবশ্য তারও আগেই বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশ-ষাটের দশক হতেই যেন ইউরোপ-আমেরিকার নানা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে বাউলগান ও বাউলদের সাধনপদ্ধতি নিয়ে নানা ধরণের গবেষণা কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। পাশাপাশি এই বাংলার বাউলগান পরিবেশন করতে গ্রামের বাউল-সাধক শিল্পীগণ বিভিন্ন দেশ-বিদেশেও ভ্রমণ করেছেন। তবে, জাতীয় পর্যায়ে ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাউলদের সাধনা কিংবা সঙ্গীত সম্পর্কে আগ্রহের সূচনা হয়ে ছিল প্রাথমিক পর্যায়ে কাঙাল হরিনাথ মজুমদার, ইন্দিরা দেবী, সরলা দেবী অথবা নবকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের তৎপরতায়। পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর “বাংলার বাউল” সম্পর্কে বিশেষভাবে বিশ্ববাসীকে দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়ে ছিলেন, এমনকি তিনি তাঁর নিজের রচনাতেও ভাবসম্পদ হিসেবে বাউলগানের ভাবাদর্শ গ্রহণ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি” এর সুরও গৃহীত হয়েছে বাউল গগন হরকরার গান হতে। বর্তমানে “গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার” আবহমান বাউলগান সংরক্ষণের জন্য পদক্ষেপ নিচ্ছেন। গত ২২ জানুয়ারি, ২০২০ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে বলেছেন, “এখন সরকার বাউল গানকে বিশ্ব-ঐতিহ্য করার জন্য উদ্যোগ নিচ্ছে। তাই অনুরোধ করব, বাউল গানে সম্পৃক্তরা যেন এমন কোন কাজ না করেন, যাতে বিশ্ব-ঐতিহ্য বাউল গান প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে।” বাউল শিল্পীরা আশা করছেন,  বাংলাদেশে বাউল গান এবং বাউল তত্ত্বের ধারা খুব সহসাই বিলুপ্ত হবে না, বরং বাউল গানের প্রচার ও প্রসার আরও ব্যাপক আকারে হবে এবং বাউল শিল্পীরা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিজেদের যোগ্যতায় পরিচিত হতে পারবেন।
 

অনুগল্পঃ সনোজ চক্রবর্তী

প্রবন্ধ

জুন ২০২০ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

SanojCharaborty.jpg

সনোজ চক্রবর্তীর 

অনুগল্প সমগ্র 

সনোজ চক্রবর্তী 
পুঃ মেদিনীপুর, পঃ বাংলা 

village1.jpg

১)

 

কবার ঘাটাল থেকে ফিরছি বাসে, পথে এক মহিলা উঠলেন ছেলে নিয়ে। ভদ্রমহিলা শুধু সুন্দরী নন একেবারে ডানা কাটা পরী। ঈশ্বরের কারখানায় তৈরি হওয়া সেই সব রূপবতীদের মধ্যে ইনিও নির্ঘাত একজন যার প্রতি বোধহয় কামার্ত হয়েছিল দেবকুলও। অবশ্য ছেলেটি মায়ের দিকে যায় নি। না বল্লে বোঝা মুশকিল এই মায়ের এই ছেলে! ভদ্রমহিলার শরীর যেন কুমারটুলিতে গড়া। রূপ যৌবনে যেন তাজা ভিসুভিয়াস! সন্তান হওয়ার পর শরীরের খালাখন্দ ভরে যতটা গোলগাল হলে পরিপাটি দেখায় সেই সীমারেখায় থমকে গেছে স্নেহ-সঞ্চয়। তুলনায় বছর চার পাঁচেকের ছেলেটি পাশ বালিশের মতো গোল। মহিলা ছেলেকে নিয়ে জানালার ধারে বসতে চাইলেন। অনিচ্ছা নিয়েও ছেড়ে দিলাম। বাসে ঘাটে সুন্দরীরা কেবল বাড়তি কিছু সুবিধাই পায় না, অত্যাচারও করে যথেষ্ট।
শুরুতে ভদ্রমহিলার ব্যাগ পত্তর বাঙ্কে তোলা। শক্ত শাটারটাকে হাত নোংরা করে একটু বেশি পিছনের দিকে ঠেলতে গিয়ে পেছনে বসা যাত্রীর সঙ্গে বচসা এসব তো হলই। কিছু সময় পর ছেলেটা খাবে তার প্রস্তুতি শুরু হল। আমার বাম হাতে ফ্লাস্ক আর ডান হাতে খাওয়ারের বাটি। অবস্থা অনেকটা পুরানো দিনের সিনেমার চাকর জহর রায়ের মতো। উপরি এটুকুই বাবু সোনার খাওয়া শেষে লাস্য মাখানো ধন্যবাদ। অনেক হয়েছে। অনেকটা আলগা হয়েছি।
এবার সুতো গোটানো উচিত। ভাবা মাত্র মুখটা একটু শক্ত করে, মানে রাশ ভারি রাশ ভারি ভারিক্কি নিয়ে মোবাইল খুলে বসলাম। বাস জার্নির একঘেয়েমি কাটাতে ফেসবুকের জবাব নেই। ফেসবুক খুলেছি সবে, পাশ বালিশ এলিয়ে পড়ল গায়ে। আমি তো দেখেছি আমার সন্তান তার মাকে জড়িয়ে শোয়। এ আপদ তো সেদিক মাড়ালই না, ঘনঘন গুঁতাতে থাকল আমাকে। ভদ্রমহিলা তুন থেকে আবারও সেই বাণটি তুলে নিলেন সযত্নে। লাস্য মিশিয়ে বললেন--
"কিছু যদি মনে না করেন, আসলে অনেক ভোর থেকে উঠতে হয়েছে তো, তাই ওর ঘুমটা ঠিক হয় নি। যদি একটু হেল্প করেন..."
আমার রাশ ভারি মুখটা তখন গলে যাওয়া আইসক্রীমের মতো ভেঙে চুরে একাকার।

"না না এভাবে বলার কি আছে...."
আমার কথা শেষ হওয়ার ফুরসত পেল না, ভদ্রমহিলা থ্রি সিট জুড়ে তার আদরের দুলালটিকে শেয়ানোর বন্দোবস্ত করে ফেলেলেন। লম্বা শুয়ে গেল পাশ বালিশ। মায়ের দিকে মাথা আর পা জোড়া বিষ্ণুর চরণ তুল্য স্থান নিল আমার কোলে। সে এক বিরক্তি আর অস্বস্তির মহাভারত। এর মধ্যেই ঘটল সেই অভূতপূর্ব ঘটনাটি।
আমার কলেজ কালের এক জুনিয়র, যে প্রয়োজনের তুলনায় আমাকে একটু বেশিই খোশামোদ করেছে বরাবর। বাসের মধ্যে আমাকে দেখে খুশিতে এক্কেরে গদগদ। ভিড় ঠেলে দূরত্ব ঘোচাতে গিয়ে তুমুল বচসা। কাছে এসে ভালবেসে তার উৎচকিত উচ্চারণ--
"সনোজ'দা কোত্থেকে? "
আমাকে আর উত্তরের সুযোগটি না দিয়েই আবার প্রগলভ হয়ে উঠল সে।
"ঘাটাল থেকে? কত দিন পর দেখা। ভাল আছ তো? বৌ'দি আপনি? ভালো তো? আমরা এক কলেজে পড়তাম। ছেলে তো একদম তোমার উপর দিয়ে গেছে দাদা। বেশ সুন্দর হয়েছে। সনোজ'দা বৌ'দিকে নিয়ে কিন্তু আসতেই হবে আমাদের বাড়ি। খুব গল্প হবে মজা হবে। আসি তা হলে দাদা। বৌ'দি ভাল থাকবেন। আসছি তা হলে। নামতে হবে আমায়।"
এইসব কথা বার্তার মাঝে আড়চোখে মাপতে চাইলাম ভদ্রমহিলাকে। মেকআপ সৌন্দর্য সব মিথ্যা করে ভেঙে পড়তে চাইছে ভদ্রমহিলার ঢলঢলে মুখটি। বন্ধুটি নেমে যাওয়ায় পর মহিলা পাশ বালিশের পিঠে দিলেন কষিয়ে এক চড়। দাঁত দাঁত দিয়ে বললেন--
"বাসে উঠলেই ঘুম! কুম্ভকর্ণ জুটেছে আমার কপালে।"

বেচারা কিছু বুঝে ওঠার আগেই সারা বাস মাতিয়ে উঠল কঁকিয়ে কেঁদে। ইদানিং আমার এক নতুন বাতিক হয়েছে- ছবি তোলা। এদিক ওদিক চলে যাই যা পাই তাই ফ্রেম বন্দী করি। না ছবি তোলার কোনো প্রথাগত শিক্ষা নেই আমার। গোপনে একটা কথা জানিয়ে রাখি- এ্যাপারচার, সাটার স্পীড, আইএসও এসব খুব একটা বুঝিও না।
দোহাই আপনাদের এ যেন পাঁচ কান না হয়। যাই হোক নিজের তোলা ছবি নিজেই দেখি আর বুকের ভেতরটায় হাজার প্রদীপ জ্বলে উঠে, থালা বাজার শব্দ শুনতে পাই। দিন কয়েক আগে একটা ছবি তুলে ছিলাম। পোট্রের্ট। মন করল সে ছবি আপনাদেরও দেখাই। আর সে জন্যই এতো বায়নাক্কা এতো বাহানা।

ইনিয়ে বিনিয়ে আগে ভাগে গল্প ফেঁদে রাখা-- অচেনা মুখটি দেখে যেন কেউ বোকার মতো না বলে বসেন --- এ বাব্বা কি মিষ্টি! কখন? কবে?

২)

দাও ফিরে সে অরণ্য লাও এ নগর.... আজ গলা ফাটিয়ে এসব বলে-- কাল থেকে আবার আয় রে কুড়ুল করাত নিয়ে পোড়া বরাত নিয়ে জঙ্গলে জঙ্গলে আয় রে কাটি কাঠ.... কাটি কাঠ... পোড়া বরাতের দোহাই দিয়ে আর কত কাল! পোড়া বরাত তো গাছ গাছালির। আপনাকে বৃক্ষমিত্র হতে হবে না ঝাঝরি হাতে হতে হবে না অরণ্যমিতা কিম্বা তরু সাধক। গাছপাগলা বা বৃক্ষক্ষেপা না থাকলেও চলবে দস্তুর..... শুধু উন্মুক্ত উন্মত্ত বৃক্ষ নিধন বন্ধ হোক। প্রকৃতি আপনা হতে আপন হাতে সাজিয়ে নেবে গাছেদের বাড়ি---- প্রকৃতির খেয়ালে বটের শরীরে জায়গা করে নিয়েছে তাল। তারই আশ্রয়ে ঘন হয়েছে ছায়া। মুক্ত মেঘে হাত পা ছড়িয়ে এ যেন আনন্দের প্রকাশ।

৩) শ্মশানচারী

রাত বারোটা নাগাদ ঘুম ঘুম চোখে ঢুলতে ঢুলতে শোয়ার ঘরের দরজায় দাঁড়ায় বাণেশ্বর। দরজার কাছে মুখটা নিয়ে গিয়ে আস্তে আস্তে বলে-- "শুনছো? এ্যাই শুনতে পাচ্ছ? "
বাণেশ্বরের ক্ষীণ কন্ঠ দরজা ভেদ করে ওপারে মাহেশ্বরীর কানে পৌঁছায় না।

চারপাশটা ভাল করে আর একবার দেখে নেয় বাণেশ্বর। অমরেশবাবুর বাড়িতে এখনো আলো জ্বলচ্ছে।
"কি গো শুনতে পাচ্ছ? ঘুমিয়ে পড়লে নাকি?" দরজায় আলতো ধাক্কা দেয় বাণেশ্বর।
সবে তন্দ্রা তন্দ্রা এসেছিল, হাকাহাকিতে চোখ মেলেন মাহেশ্বরী।

ঘুম জড়ানো গলায় বলেন-- কি হল আবার!
-- ঘুম আসছে না।
-- একটা ঘুমের ট্যাবলেট জল দিয়ে...
-- খেয়েছি, তবু আসছে না।
-- তাহলে আর একটা নাও, ডোজ বাড়াও।
-- গন্ধ!
-- গন্ধ? ট্যাবলেটে!
-- গোবর গন্ধ, আর কি মশা!
-- তা একটু হবে সোনা, আর তো মাত্র কটা দিন। পরিযায়ী স্বামী হয়ে গোয়াল ঘরে কাটিয়ে দাও প্লীজ। ঘরের আলো নিভিয়ে পাশবালিশ বুকের কাছে টেনে নেন মাহেশ্বরী। বারান্দায় স্থির দাঁড়িয়ে থাকেন বাণেশ্বর। এতোক্ষণ অমরেশবাবু হাতে একরাশ এঁটো বাসন পত্তর নিয়ে জানালা দিয়ে লক্ষ্য করছিলেন সব। চোখাচোখি হতেই সরিয়ে নেন নিজেকে।
রাতের নিরবতা ভেঙে অমরেশবাবুর জলকল থেকে কলকল শব্দে পড়ছে জল। শোনা যাচ্ছে
বাসনকোসনের ঠুং ঠাং। করোনার সংক্রমণে সব স্বামীই কাবু। যন্ত্রণা যে তার একার নয় এটা ভেবে নিজেকে সান্ত্বনা দেয় বাণেশ্বর। ফিরে যায় তার হোম কোয়ারান্টাইন - গোয়াল ঘরে গোয়াল ঘরের দেওয়ালে ঝোলানো ক্যালেন্ডারের পাতায় টর্চ জ্বালেন। আজ তিন তারিখ, এখনো এগারো দিন পরিযায়ী স্বামী হয়ে তাকে থাকতে হবে গোয়াল ঘরে। তিন দিন হল সে এসেছে চেন্নাই থেকে। চর্চের আলো উপরের দিকে সরে যেতেই বাণেশ্বর দেখতে পেলেন ক্যালেন্ডার জুড়ে ছাই ভস্ম মেখে আদুল গায়ে তার দিকে তাকিয়ে হাসছে দেবাদিদেব মহেশ্বর।

৪) ঊষর

হাওয়ার গতি একটু বাড়তেই নিভে গেল পথ বাতি। এ অঞ্চলে লোডশেডিং বেশি সময় স্থায়ী হয় না। সত্যি বলতে কি লোডশেডিং এক প্রকার হয় না বললেই চলে। শুধু ঝড়ের পূর্বাভাস থাকায় হতে পারে এটা প্রিকশনারি আউটেজ। আজ মাসের তিন তারিখ, অনিমিখের বাবার বেতন হয়ে যায় মাসের শুরুতেই। তা না হলে ঝড় জলের সম্ভাবনা মাথায় নিয়ে টিউশন বেরাতো না পলাশ। তাছাড়া আজ অনিমিখের ডেটও নয়। ফি মাসেই শুরুর দিকে এরকম একটা বাড়তি ডেট পেয়ে যায় অনিমিখ। আসলে গেল মাসে বাড়তি কিছু খরচের জন্য মাস শেষের দিন সাত-আট আগেই পকেট গড়ের মাঠ। ইতিহাসে এম এ- পলাশ। হতে তো চেয়েছিল অনেক কিছুই। আটকে গেল যা হতে চায় নি তার মধ্যে। টুকটাক টিউশন করে কি আর সংসারের সুরাহা হয়! দাদা বৌদির সংসারে অনেক বাহুল্যের মধ্যে সেও একটি। উচ্চশিক্ষিত পলাশ অনেকটা বনসাই এর মতো। কাজে আসে না, ওজন বাড়ায়। রাস্তা ঘাটে পরিচিত কারো মুখোমুখি হলেই

"এদ্দিনেও একটা কিছু করে উঠতে পারলি না!" - এ খেদোক্তি এখন আর এমন কিছু বিব্রত করে না পলাশকে।
লোডশেডিং-এ পথ বাতি নিভে যেতে পিছুটান নিয়েছিল পলাশ, পরক্ষণেই পকেটের কথা মনে হতে আবার অনিমিখদের বাড়ির পথে গতি বাড়াল সে। অন্য অনেক সুগন্ধের সঙ্গে পেট্রলের গন্ধ বেশ পচ্ছন্দ পলাশের ক্রমশ বাড়ছে গন্ধটা। যত্ন করে গভীর ভাবে গন্ধটা নিল পলাশ। গন্ধটার খোঁজে চারপাশে ফিরল তার চোখ।
অনিমিখ বলল - "লোডশেডিং -এর জন্য আমাদের ইমারজেন্সির থেকে পেট্রল গন্ধ পাচ্ছেন স্যার।" অনিমিখের বাবা পলাশের দাদার সঙ্গে এক ব্যাচের গ্র্যাজুয়েট। দুজনেরই ট্রেজারিতে চাকরি। অনিমিখের বাবার দু'হাতে রোজগার। সারা বাড়িতে বৈভবের ছড়াছড়ি। লোডশেডিং-এ যখন প্রায় সারা পাড়া মানিয়ে নিয়েছে অন্ধকারে তখন অনিমিখদের বাড়িতে ঝকঝকে আলো। পলাশের আজ ঠিক পড়ানোর ইচ্ছে নেই। তার চোখ বারবার চলে যাচ্ছিল দরজায়।
এ এক অস্থির অপেক্ষা কখন সাদা খামটা হাতে আসে। "আচ্ছা টাকাটার কথা অনিমিখের বাবা ভুলে যান নিতো?"
চিন্তাটা মাথায় আসতেই দিকবিদিক ভুলে চায়ের কাপে লম্বা চুমুক দিয়ে ফেলল পলাশ। গরম চায়ের ছ্যাকা লাগল জিভে ঠোঁটে। নিজেকে সামলে, অনুৎসাহী গলায় বলল-
"আজ আমরা খানিক মানসাঙ্ক নিয়েই থাকব।" অঙ্ক অনিমিখের মন্দ লাগে না। সে সম্মতি দিয়ে ঘাড় দোলাল।

"আসলে কি জান অনি, প্রতিটি অঙ্কের মধ্যে একটা গল্প থাকে।"

অনিমিখকে একমাত্র পলাশই অনি বলে ডাকে। বাড়ির অন্যরা বলে মিখ। অনিমিখের অবশ্য অনিটাই বেশি পচ্ছন্দ।

"অঙ্কে গল্প?" এ যেন অনিমিখের জিজ্ঞাসা নয় বিষ্ময়!
"ঠিক তাই, গল্প। সব অঙ্কেরই নিজস্ব একটা গল্প হয়। মজার বিষয় হল যদি তুমি গল্পটা রিডিং করতে পার,মানে ধরতে পারো তবে তুমি সহজেই পৌঁচ্ছে যাবে উত্তরে।"
অঙ্ক নিয়ে আজ এ এক অদ্ভুৎ নতুন কথা শুনছে অনিমিখ। এদ্দিন সে জানত অঙ্ক একটা সমস্যা, অঙ্ক কতকগুলো সংখ্যার মারপ্যাঁচ। বুদ্ধি দিয়ে তাকে ছুঁতে হয়। "একটা গাছে বারোটি পাখি ছিল। পুরুষ পাখি ছিল সাতটি। মেয়ে পাখি চারটা ডিম দিল, ডিম থেকে হল বাচ্চা। দুটি পুরুষ পাখি উড়ে গেল গাছ থেকে। এখন গাছে কটি পাখি রইল?' মন থেকে অঙ্কটা তৈরি করে বলল পলাশ। অঙ্কটা শুনে কেমন যেন আনমনা হয়ে গেল অনিমিখ। ধীর পায়ে উঠে গেল জানালায়। একটু দূরে অন্ধকারে ডালপালা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে পুরানো বট। জানালা ভেঙে ছড়িয়ে পড়া আলোয় ফুটে উঠেছে তার অস্পষ্ট অবয়ব। গাছটার আশেপাশের ঘরগুলোতে টিমটিম করছে বাতি। জানালার গরাদ ধরে সেদিকে স্থির তাকিয়ে থাকে অনিমিখ। ভেজা ভেজা গলায় বলে--
"পাঁচটা স্ত্রী পাখির মধ্যে একটা স্ত্রী পাখির বড় কষ্ট। তার বাচ্চা না হওয়ায় পুরুষ পাখি তাকে মারে। ঝগড়া করে সারাদিন। অন্য স্ত্রী পাখিগুলোও আড়ালে আবডালে তাকে নিয়ে নানা কথা বলে। পাখিটা সব সময় বাসায় লুকিয়ে বসে থাকে। তার ভয় করে বাসার বাইরে যেতে, সেখানেও যে তাকে আড় চোখে দেখে সবাই। ছোট বড় কোনো পাখিরই এতোটুকুও ভালবাসা নেই তার জন্য। পাখিটার মাঝেমাঝে ইচ্ছে হয় সে উড়ে যায় দূরে, অন্য আকাশে।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে ঐ কষ্টের মধ্যেই থেকে যেতে হয়-দূরে উড়তে গেলেই ডানা দুটি অবশ হয়ে আসে তার!"
অনিমিখকে কেমন যেন অস্বাভাবিক লাগে। ভয় পেয়ে পলাশ উঠে যায় তার কাছে। মাথায় হাত রাখে। তখনও অনিমিখ তাকিয়ে আছে দূর অন্ধকারে। যেখান থেকে রোজদিনের মতো আজও শোনা যাচ্ছে বৌটার চিৎকার আর কান্না। বিয়ের দশ বছরেও মা হতে পারে নি ও বাড়ির বৌ। স্বামীটা মদ গিলে রোজদিন উৎপাত করে। পড়ার লোকেরা এড়িয়ে চলে বৌটাকে। লোকে বলে "শুভ কাজে বাঁজা মেয়ের মুখ দেখতে নেই।" বাঁজা কথাটা মনে হতেই বিদ্যুৎ বয়ে গেল পলাশের সারা শরীরে। হাজার কন্ঠে আত্মীয়-পরিজন, পরিচিতরা বলছে- "এদ্দিনেও একটা কিছু করে উঠতে পারলি না!"

৫) স্বৈরাচারী রাজা ও পিঁপড়েদের লাইন আর শিরদাঁড়ার গল্প

হু হু করে নেমে আসছিল বড় চাঙড়টা। আছড়ে পড়ার আগেই কোনো রকমে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছিল ওরা। সবাই যে সরে আসতে পেরেছিল তা নয়। কেউ কেউ সপরিবার চাপা পড়েছিল মাটির তলায়। মাটি ফুঁড়ে মাথা তোলার প্রাণান্তকর চেষ্টার মধ্যে নেমে এসেছিল চালার পর চালা। মুহূর্তে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রাণ। ঘটনার আকস্মিকতা তো ছিলই, ছিল সামর্থের ঘাটতি ফলে মাথা তুলতেই পারে নি প্রতিরোধ। ওরা দল বেঁধে এসেছিল খাওয়ারের খোঁজে। অনেক চেষ্টায় খাওয়ারও জুটেছিল কিছু। হঠাৎ ওদের তৈরি করা জমিতে যখন মালিক নাঙল নামাল তখন ওরা বুঝে গেল আর নয়। এবার ফিরতে হবে। না, ফেরা ছাড়া আর কিচ্ছু চায় নি ওরা। শুধু ফিরতেই চেয়েছিল ঘরে। কিন্তু হঠাৎ করে এমন আঁটকে ধরে মারবে, তা স্বপ্নের সীমানায় ছিল না! যারা সুযোগ বুঝে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছিল তার দল বেঁধে বাড়ি ফেরার পথ ধরেছিল পরদিন। যেমন ভাবে দল বেঁধে ফেরে ওরা। ফিরছিল নিয়ম মেনে সারিবদ্ধভাবেই।
ওরা তো জানত না ওদের ফেরার নিরাপদ পথ তো দূর,ওদের জন্য নিদিষ্ট কোনো পথই নেই। তাই একসময় ভুল করে ওদের পথটা চলে আসে মানুষের পথে। রাজপথে। দীর্ঘ সর্পিল রেখা হয়ে এগোচ্ছিল ওরা। ক্ষুধা তৃষ্ণা উপেক্ষা করে উজ্জ্বল হচ্ছিল ঘরে ফেরার আনন্দ। আচমকা উটকো বিপদ হুমড়ি খেয়ে পড়ল ওদের উপর। অজানা পথ তার উপর দীর্ঘ পথ অতিক্রমের ক্লান্তি। বুড়ো আঙুলের চাপে, গোড়ালির চাপে সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে যায় অনেকেই। কেউ কেউ ছিটকে যায়। কপাল জোরে পায়ের পাতার ফাঁকে যারা রয়ে গিয়েছিল তাদের অনেকেই বেঁচে ফেরে। এর মধ্যে বিপত্তি ঘটিয়ে ফেলে শক্ত মেরুদন্ডের একজন। সে আঙুলের ফাঁকে ঢুকে, সুযোগ বুঝে কামড়ে ধরে। সামান্য ক্ষমতা নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে স্বৈরাচারী মালিকটার উপর। ঐ লোকটাই তো হঠাৎ করে আচমকা নাঙল নামিয়ে দেয়েছিল মাঠে। পিষে দিয়েছিল নিরিহ পিঁপড়েগুলোকে। বেঘোরে প্রাণ হারিয়েছিল কত শত। স্বৈরাচারীরা বরাবাই একক আক্রমণকে দমন করেছে প্রবল হাতে। লোকটা খুঁজে বের করে আনে বিদ্রোহী পিঁপড়েটাকে। দু'আঙুলে চেপে মেরে দেয় নৃশংস। জলের মগ থেকে জল কামানের মতো প্রহার নেমে আসে পিঁপড়েদের লাইনে। ভেসে যায় সহায় সম্বলহীনের দল আজ না হয় একটা পিঁপড়ের প্রতিরোধকে নস্যাৎ করা গেল। আগামীতে একটা নয়, শত শত পিঁপড়ে শিরদাঁড়া শক্ত করে প্রতিরোধের জন্য তৈরি হচ্ছে। সাবধান স্বৈরাচারী সেদিন একজনকে পিষে দেওয়ার জন্য হাত বাড়ালে হাতে, আঙুলে আঙুলের ফাঁকে কামড়ে দেবে অন্য জন।সেদিন কিন্তু পালাবার পথ পাবে না তুমি।

৬) প্রক্সি

রে ঢোকা মাত্র পুষণের হাত থেকে ব্যাগটা ছোঁ মেরে নিয়ে নিল পিয়ালি। বারান্দায় দাঁড়িয়ে জুতোর সুতো আলগা করতে করতে পুষণের গলায় বিদ্রুপ-- "দিনের পর দিন তুমি যেন ছোট খুকিটি হয়ে যাচ্ছ!" চেনটা দ্রুত টেনে, ব্যাগ হাতড়াতে হাতড়াতে পিয়ালি বলল--
"ভালই তো, বয়স কমলে ঘুর পথে লাভটা তো তোমারই।" ব্যাগটা পিয়ালির হাত থেকে ফিরিয়ে নিল পুষণ। ব্যাগের চেনটা ক'দিন হল ঠিকমতো কাজ করছে না। চেনটা বারকয়েক এদিক ওদিক করল সে। বিরক্তি নিয়ে বলল - "আমার লাভ?"

"নয় তো কি, কঁচি বউয়ের জন্য গব্ব হবে না তোমার?" টাইটাকে আলগা করতে করতে পুষণ বলল  - "আমি কিন্তু কঁচি খুকি বলেছি।"

"তাহলে তো হয়েই গেল, যখন যা বোঝাবে যেমন ভাবে বোঝাবে বুঝে নিতে হবে সোনা মেয়ে হয়ে।" আঁচল খুঁটতে খুঁটতে কথাগুলো বলে পিয়ালি। কথাগুলো নিরিহ শোনালেও কোথায় যেন একটা অভিমান লুকিয়ে ছিল। পিয়ালি আর পুষণের ভালবাসার বিয়ে। পিয়ালির বাপের বংশে সকলেই ডাক্তার। তাই ডক্টর পুষণ শিকদারকে প্রথম দেখাতেই ভাল লেগেছিল পিয়ালির। পুষণরা যেহেতু ব্রাহ্মণ নয়, তাই বিয়ের আগে বাড়িতে কিচ্ছুটি প্রকাশ করে নি পিয়ালি। লুকিয়ে বাড়ি পালিয়ে বিয়ে। তারপর থেকেই বাপের বাড়ির সঙ্গে সব যোগাযোগ শেষ।

"বুঝছ কোথায়, বারবার করে বলেছি হসপিটাল থেকে বাড়ি ফিরলে ডিসট্যান্স মেন্টেন করতে। কে কার কথা শোনে! আসা মাত্র ব্যাগটা নিয়ে পড়লে! আরে বাবা কটাতো মাত্র দিন, ইনফেকশনটা কমলে তখন তো সব আগের মতো। দেখো আমরা হেল্থ লাইনের লোকেরা যদি না বুঝি তবে সাধারণ মানুষদের কি ভাবে বোঝাব?" পুষণের কথায় মুখটা থমথমে হয়ে যায় পিয়ালির। ব্যাগ থেকে সুন্দর একটা প্যাকেট বের করে পিয়ালির হাতে দেয় পুষণ। প্যাকেটটা পাওয়া মাত্র পিয়ালির চোখ মুখ খুশিতে ভরে যায়। প্যাকেটটা নাকের কাছে এনে সুন্দর গন্ধটা বার তিন লম্বা শ্বাসে নেয় পিয়ালি।

"গন্ধটা কি ভালো, কি আছে গো?" পিয়ালির গলায় আদর।

"কিছু একটা খাওয়ার হবে, মিষ্টি টিষ্টি কিছু, ডক্টর সেনগুপ্ত দিলেন। আমি বারণ করলাম কিন্তু কিছুতেই শুনলেন না। জোর করে দিলেন ব্যাগে ঢুকিয়ে।"

"যাই বলো ডক্টর সেনগুপ্ত কিন্তু তোমাকে একটু বেশিই পচ্ছন্দ করেন।"

"যাদের এমন কঁচি বউ থাকে তাদের অনেক ডক্টর সেন শর্মাই কারণ ছাড়াই প্রশ্রয় করে থাকেন।"
রসিকতা করে বলল পুষণ। সত্যি পিয়ালির রূপ এখনও টলিয়ে দিতে পারে যে কোন বিশ্বামিত্রের তপস্যা। বরং চার বছর বাড়তি বয়স নিয়ে পুষণ অনেক বুড়িয়ে গেল। "ডাক্তারবাবুর অনেকগুলো খরচ হল বলো।" কথাটায় সামান্য দুঃখ মিশিয়ে দেয় পিয়ালি।

"অতটা দুঃখ পাওয়ার কিছুই হয় নি, ডক্টর সেনগুপ্তকে পেশেন্ট পার্টি ডাকাত বলে। গাঁটের কড়ি খরচ করে প্যাকেট দেবেন উনি! একটা পেশেন্ট পার্টি সুস্থ হয়ে ফিরল আজ প্যাকেট সহ আরো কত কি দিয়ে গেল।" 

দীর্ঘশ্বাস ফেলল পিয়ালি, বলল
"স্নান সেরে, খাবে এসো, অনেক রাত হল।"

"হ্যাঁ তাড়াতাড়ি উঠতে হবে। কাল থেকে আবার মরনিং। "
টাওয়াল নিয়ে বাথরুমে ঢুকল পুষণ। খাওয়ার টেবিলে মুখোমুখি দুটো চেয়ার। আট বছরের সংসারে মেম্বার দুই ই রয়ে গেল। বাড়ল না। চেষ্টার খামতি রাখে নি পুষণ, শহরের বড় গাইনো সাজেষ্ট করেছিল ইসু না নিতে। নিলে হয়তো মাকে টেকানো যেত না। জীবনে অনেক চাওয়া, না-পাওয়ার সঙ্গে দুজনই বেশ মানিয়ে নিয়েছে ধীরে ধীরে। পুষণের পাতে মাছের পেটিটা দিতে দিতে পিয়ালি বলল "এরপর কি হবে গো?"

"কি হবে মানে?"
মুখে ভাত নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বিষম খেল পুষণ, পিয়ালি দ্রুত বাড়িয়ে দিল জলের গ্লাস।
ধাতস্ত হতে সময় লাগল খানিক। তারপর আবার দুজনের ডানহাত চলল।

"বলছিলাম কি, কিছু দিন পর তো আর এই বাড়তি রোজগারটা থাকবে না..."
একটু হলেও চিন্তিত দেখাল পিয়ালিকে।

"আবার যেমন কে তেমন। অন্তত পিপিই-এর দৌলতে তোমার একটা সাধ মিটল।"
হাসতে হাসতে কথাটা বলল পুষণ "সুযোগ পেলেই খোঁচা দেওয়ার স্বভাবটা এতকালেও তোমার গেল না, যদি সামান্যতম অতৃপ্তি থাকত তবে কবেই চলে যেতাম, তুমি ছাড়া পিছুটানের মতো কিছুই তো নেই এ সংসারে আট বছরে......"
শেষটায় আবেগে থেমে গেল পিয়ালির গলা। খাওয়ার থালা ছেড়ে উঠে গেল সে। পুষণ বুঝতে পেরেছে মজা করতে গিয়ে পিয়ালির সবচেয়ে বেশি কষ্টের জায়গায় আঘাত করে ফেলেছে সে। সম্পর্কের শুরুতে নিজেকে লুকিয়েছিল পুষণ, মিথ্যে করে বলেছিল সে ডাক্তার।
বিয়ের পর পর যখন পিয়ালি বুঝে ফেলে- পুষণ একটা বেসরকারি হাসপাতালের রেডিওলজি বিভাগের এ্যাসিসট্যান্ট, তখন আর মাথা নিচু করে ফিরতে চায় নি বাপের ঘরে। একটু একটু করে মানিয়ে নিয়েছিল পুষণের সংসারে। পরিস্থিতি আয়ত্বে আনতে পিয়ালির মাথায় হাত রাখল পুষণ।
আদর করতে করতে বলল "ব্যাপারটাকে নিয়ন্ত্রণে না আনতে পারলে হাসপাতালটাই এক সময় বন্ধ হয়ে যাবে পিয়ালি। হ্যাঁ হয়তো চিরকালের জন্য নয়। হয়তো তিন মাস, চার মাস হয়তো আরো একটু বেশি সাত আট....."
একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে পুষণ আবার বলতে থাকে "ভেবে দেখো রোজগার নেই, সঞ্চয় কমতে কমতে তলানিতে... এমনি করে মাসের পর মাস কিভাবে চলত সংসার! তাই আর দ্বিতীয়বার ভাবি নি, ম্যানেজম্যান্টের প্রস্তাবটায় রাজি হয়ে যাই। তুমি হয়তো ভাবছ তোমাকে খুশি করার জন্য কিম্বা খোঁচা দেওয়ার জন্য, না পিয়ালি একদমই তা নয়। আসলে এ রোগটায় ডাক্তারদের তো খুব একটা করার কিছুই নেই। তাই তাদের নির্দেশ মতো পিপিই-এর আড়ালে আমরাই এখন ডাক্তার। অন্তত অন্য পেশেন্টদের জন্য তাঁদের সামান্য নিরাপত্তা দেওয়া গেল। ডাক্তারবাবুরা অসুস্থ হলে পরিসেবাটাই তো একটা সময় থমকে যাবে। হ্যাঁ ঝুঁকি হয়তো আছে কিন্তু উপরি আছে তার জন্য। সবচেয়ে বড় কথা কি জানো একবার যদি একজন ডাক্তারের থেকে সংক্রমণটা অন্য বিভাগে পৌচ্ছে যায় তবে পুরো হসপিটালটাই সিল। রেপুটেশন যাবে মাটিতে মিশে। ভয়ে আর কোনো পেশেন্ট আসবে না হসপিটালে।
কাজ হারিয়ে তখন খাব কি?" ম্যানেজম্যান্টের পক্ষে যুক্তি সাজিয়ে কথাগুলো কেটে কেটে বলে গেল পুষণ।

"কিন্তু সংক্রমণের ভয়তো তোমাদেরও, তোমার একটা কিছু হলে আমি কোথায় যাব বলতো?" নরম গলায় কথাটা বলল পিয়ালি।
"ম্যানেজম্যান্টের কাছে শুধু ডাক্তাররাই ভ্যালুয়েবল, তোমাদের কোন দাম নেই!" পরক্ষণেই ফেটে পড়ল রাগে। 

"কটা তো মাত্র দিন, একটু সাবধানে চললে সব ঠিক হয়ে যাবে।" ততক্ষণে পুষণের আদর অসাবধানী হয়ে নিবিড় করে নিয়েছে পিয়ালিকে। রাত বাতির নরম আলো ছড়িয়ে পড়েছে সারা ঘরটায়। লকডাউন রাতের নিঃস্তব্ধতাকে এগিয়ে নিয়ে গেছে আর প্রস্থ। পুষণের নিঃশ্বাস ঘন হয়ে নেমে আসছে পিয়ালির শরীরী উপত্যকায়। পিয়ালির মুখের কাছে মুখ নিয়ে গেল পুষণ। বালিশ দিয়ে নিজেকে আড়াল করে পিয়ালি বলল-
"উহু... না... না ডক্টর শিকদার, অনেক রাত হয়েছে। না একদম নয়.... একদম নয়.... কাল মরনিং আছে কি... ন... তু..."

পুনশ্চঃ পুরোটাই কাল্পনিক প্যানডেমিকের সঙ্গে কোনো যোগ নেই।

৭)

খন রেড জোনেও বাজার সবুজ। অঢেল সবজি। দামও গুরুপাক নয়। আসলে ফোঁড়ে, পাইকার- মাঝের এই মানুষগুলো উধাও। মাটির মানুষেরাই সাজিয়ে বসেছে নিজের পসরা। চাঁপা নোটে, পুই, লাউশাক যেন ঘন সবুজ মাঠখানা উঠে এসেছে রাজপথের দু'ধারে। সবুজ সতেজ ফসলের মধ্যে বুড়িয়ে যাওয়া শুকিয়ে যাওয়া মানুষগুলো হাসি মুখে বসে থাকে বিকি-কিনির অপেক্ষায়। ছবির সঙ্গে আঁকিয়েকে, নাটকের সঙ্গে নাট্যকারকে, কবিতার সঙ্গে কবিকে, চলচিত্রের সঙ্গে চিত্রপরিচালককে-- কথা-বার্তায়, পোশাকে-আশাকে, শরীরী বিভঙ্গে ঠিক যতখানি মানায়, ফসল আর চাষিতে বেমানান হয় তার চেয়ে ঢের কিছু বেশি।
তাত্ত্বিকরা হয়তো বলবেন প্রথমটা যে সৃষ্টি অন্যটা উৎপাদন। এ কূট তর্ক চলতেই থাকবে...
আসলে "চাষিরা বরাবরই শস্যে, শ্যামলে.... সরসতা-সতেজতা ঢেলে দিতে দিতে নিজেরাই শুকিয়ে যায় নিজেদের অজান্তে। নাকি জেনে বুঝেই নিংড়ে দেয় নিজেদের কে জানে!"

চারপাশে ছড়ানো সবুজের মধ্যে তরমুজ আর কাঁচালঙ্কা নিয়ে বসেছে এক ষাট ছুঁই ছুঁই। রুক্ষ শরীর। পরনের গেঞ্জিটা আর মেরামতি না হলেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। তেল চিটে লুঙ্গি দড়ির মতো পাক খেয়ে উঠে গেছে হাঁটুর উপর। বর্ণময় তাঁর সম্ভার.... কালোসবুজ তরমুজ আর তার পাশেই সবুজ লঙ্কায় কোথাও কোথাও মিশে গেছে এক চিলতে লাল। সৃষ্টিশীল মানুষ বলবে- এ এক অদ্ভুত সমাপতন... লঙ্কটাই ওর তরমুজের বিজ্ঞাপন। ব্যাপার খানা আদতেও তা না। গড়বেতায় অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে তরমুজ আর লঙ্কা ফলে ভাল। তাই পসরায় তরমুজ আর লঙ্কা। তরমুজের হাত ধরে লঙ্কা না কি লঙ্কার অনুসারী তরমুজ, সেকথা জানা হয় নি গড়বেতা থেকে আসা লোকটির থেকে। তবে লোকটি ভরসা দিয়ে বলেছিল" গড়বেতার লঙ্কায় রাগ খুব বেশি।" লঙ্কা খুব ঝাল তা জেনেই এক'শ নিতে চাইলাম। পরে যখন জানা গেল এক'শ বেশ সস্তা-- মাত্র পাঁচ টাকা। সস্তার সুযোগ নিয়ে বাড়িয়ে নিলাম আর শ'খানেক। লোকটা তরমুজ দিতে চাইলে--
বললাম "ভেতরটা লাল হবে?"

দু'তালুতে তরমুজ খানা ফেলে, চেপে, কানের কাছে তরমুজটা এনে সে একটা কিছু শব্দ শুনতে চাইল। তার চোখ দুটো দেখে মনে হল খুব নিবিড় পর্যবেক্ষণে সে স্থির। তারপর তরমুজটা চাপড়ে অভয় দিল--
"একদম ঠকবেন নি বাবু, লিয়ে লিন।" পাল্লায় তরমুজটা তোলার পরও ভরসাটা কোথায় যেন টাল খেয়ে গেল। "ঠকিয়ে দেওয়াটা যখানে একটা খেলা, সেখানে ঠকে যাওয়া মন সারাতে সময় লাগে অনেক।" নিলাম না তরমুজ। বাজারের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ঘুরে ঘুরে দাম দস্তুর করে সব কিছু কিনে ফেরার পথ নেব, এমন সময় মনে হল-কুমড়ো, পুই শাক, কু্ঁচো চিংড়ি সবই হল সজনেডাঁটা তো নেওয়া হল না!
হাঁটু গেড়ে বসলাম সজনেডাঁটা কোমলতা পরখ করতে। "কঁচি তো?" টাক মাথায় এক ফোটা জল পড়ল! "বৃষ্টি পড়ল কি?" ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি গড়বেতার সেই তরমুজওয়ালা। তারই কপাল থেকে বৃষ্টির মতো ঘাম ফোঁটা নেমে এসেছে আমার মাথায়। রুমালে ঘামটা সরিয়ে নিতে গিয়ে মনে হল- আমি কি লঙ্কার দাম দিতে ভুলে গেলাম! ততক্ষণে লঙ্কার পলিথিনটা আমার দিকে বাড়িয়ে, অপরাধ অপরাধ মুখ করে লোকটা বলল-- "তরমুজ নিয়ে ঝামেলার মধ্যে লঙ্কাটা দিতে ভুলে গেছি বাবু।" আমি লোকটার মুখের দিকে ভাবলেশহীন তাকিয়ে রইলাম। কপালে একটুও জায়গা ফাঁক নেই যেখানে আর এক টুকরো ঘাম বসিয়ে দেওয়া যায়। কত সময় ধরে এখানে ওখানে খুৃৃৃঁজেছে কে জানে! নিশ্চিত ভাবেই বেশ কিছু টাকার বিক্রিতো ফোস্কে গেল এই দশ টাকার লঙ্কার জন্যে।
"না না এখানে আপনার কোনো দোষ নেই...." কথাটা বলব তার আগেই লঙ্কাটা হাতে ধরিয়ে হনহন করে ফিরে গেল লোকটা। এই মানুষগুলোর বাইরেরটা শুকনো, রুক্ষ কিন্তু ভেতরে ভেতরে সতেজ প্রাণের অফুরন্ত ধারা.... লক্ষ মানুষের তৃষ্ণা মেটানোর সঞ্চয়। আর আমি! আমরা সভ্য-ভব্য মানুষের দল বুকের ভেতর মরুভূমি নিয়ে বসে আছি। বাইরের সবটুকুই লোক দেখানো। উপর থেকে যতই প্রাণময় দেখাক ভিতরটা সন্দেহ, ঈর্ষা, কপটতার নির্ভয় আশ্রয়।

অভ্যাস বশত সেই কদর্যতা বেরিয়ে পড়ল আগল ভেঙে...লঙ্কাটাকে ব্যাগে ঢোকানোর আগে, আঙুলে ঝুলিয়ে পরখ করে নিতে চাইলাম--দু'শই আছে তো।

৮) 

ঠাৎ করে এভাবে দেখা হয়ে যাবে ভাবি নি। মুখোমুখি হয়ে জ্বলে উঠেছিল মুখ দুটো। শেষ বার দেখা হয়েছিল বছর চার পাঁচ আগে, তমলুকের পুরানো ঠিকানায়। টানা বছর তিন-চারের সম্পর্কে কমা নয়, একেবারে পাকাপাকি দাঁড়ি, কেতাবি কথায় পূর্ণচ্ছেদ। তিন কামরার মেস। নিয়মিত যাতায়াতে আপত্তি ছিল মেস মালিকের। দু'কথা শুনিয়েছিল ওকে। খুব সিরিয়াসলি বলেছিল--
"জানিস তোর এখানে আসাতে মালিক আপত্তি করে!" শুনে মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। আসা যাওয়ায় আপত্তি! চুপসে গিয়েছিল মুখ। তারপর 'হাঃ হাঃ হাঃ' কি তার হাসি! মালিকের নামে মিথ্যে

বলে ভড়কে দিয়েছিল আমাকে। আলাপ হয়েছিল বিএড পড়তে গিয়ে। সেদিন তমলুক বিএড কলেজে স্টুডেন্ট ইউনিয়ন তৈরি হচ্ছিল। স্ট্রাকচারটা তৈরি করেছিলাম আমরা পাঁচমিশালি পান্ডব। তৈরি হয়েছিল রাজনীতি নিরপেক্ষ। ডান বাম সবই ছিল সে স্ট্রাকচারে। সিনিয়র স্টুডে ন্ট(এস.এস.) ঠিক করা হয়েছিল একজন প্রবীন শিক্ষককে। সম্ভবত তার অবসরের খুব একটা বাকিও ছিল না। ঐ শিক্ষক সে সময়ের একটি প্রভাবশালী শিক্ষক সংগঠনের সক্রিয় ও বরিষ্ঠ সদস্য ছিলেন। হঠাৎ কলেজ ইউনিয়ন থেকে একদল ছাত্র এসে গন্ডগোল শুরু করে। শুরুতে বারান্দা থেকে হট্টগোল করলেও পরে সামনের দরজা দিয়ে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ে ক্লাসরুমে। ওদের একজন, সেই ছিল নেতা, বিপ্লবী বিপ্লবী মেজাজ, চোখে মুখে ঝরছে আগুন এক লাফে উঠে আসে ডায়াসে। অধ্যাপকের দিকে আঙুল উঁচিয়ে যখন ঐ আগুনখেঁকো থামিয়ে দিচ্ছিল অধ্যাপককে, ঠিক তখন অন্য একজন সামনের দরজাটা লাগিয়ে তুলে দেয় শিকল। সে যেন জতুগৃহে পান্ডবদের একহাত নেওয়ার চেষ্টা। ধাক্কাধাক্কিতে মাটিতে পড়ে যান প্রবীন শিক্ষক, যার নাম সদ্য প্রস্তাবিত হয়েছিল সিনিয়র স্টুডেন্ট হিসাবে। সমস্ত প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে প্রায় দেড়শ জনের ক্লাসরুম দাপাচ্ছিল ওরা।
আর দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল ওদের শ্লোগান। সবচেয়ে ভয় পেয়েছিল মেয়েরা। চিৎকার করছিল থেকে থেকে। এসবের মাঝে আচমকা প্রতিরোধ গড়ে তোলে মাঝারি গড়ন একটু চাপা চাপা গায়ের রং ছেলেটি। যাকে এতোদিনে নজরেই পড়ে নি কখনো। যে ছিল ভিড়ের একজন সে হঠাৎ বিকর্ণ নাকি কৃষ্ণ হয়ে উঠল কোন সাহসে ভর করে! ছেলেটাকে ধাক্কা দিতে দিতে মারমুখি ছাত্ররা এগিয়ে আসতে থাকে ক্রমশ। মুহূর্তে বুঝে ফেলি টার্গেট আমি। আমি তখন নিশ্চিত, মার খাচ্ছি আমি। এমন সময় অপরিচিত দুটি মুখ আমাকে একপ্রকার পাজাকোলা করে বের করে নিয়ে যায়। ওরা একটা কথাই বলেছিল-- "ভয় নেই,আমরা আপনার বন্ধু।"
নতুন একটা পথে হাঁটতে হাঁটতে হাজির হয়েছিলাম মানিকতলায়। সেদিনের মারপিট না হলে ও পথ আমার জানাই হতো না। তারপর থেকে অনেক খুঁজেও সেই দুটি মুখের দেখা পাই নি কোনদিন। অনেক অনুরোধ উপরোধেও সেই প্রবীন শিক্ষককে এস এস হতে রাজী করানো যায় নি। এমনকি বিপ্লবীরাও চেষ্টা করে নড়াতে পারেন নি স্যারকে। কারো কারো আত্মসম্মানবোধ হয়তো অতটাই প্রবল হয়!
সামগ্রিক ভাবে ঘটনাপ্রবাহে আমার সঙ্গে দুটি মানুষের ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। নতুন এস এস। হলদিয়ার একটি স্কুলের কমার্সের শিক্ষক আর প্রসেন, প্রসেনজিৎ মন্ডল। সেও আমার মতো ফ্রেশার্স হিসাবে পড়তে এসেছিল বিএড। সেদিন আমার বদলে বেয়াড়া মার খেয়েছিল প্রসেনজিৎ। এতোটাই মেরেছিল ওরা, দিন কয়েক কলেজ আসতে পারে নি সে। আমি তার মেসে গিয়েছিলাম খোঁজ নিতে। তখনও সে আঃ উঃ নিয়ে শুয়ে ছিল বিছানায়। সেই যাতায়াতের শুরু। তারপর বিএড শেষেও সে ধারা থেকে গিয়েছিল নিয়মিত। মেসে থাকত ওরা দুই ভাই আর ওদের সম বয়সী এক মামা- তপন। প্রসেনজিৎ এর দাদা অভিজিতদা ছিল পড়াশুনায় তুখোড়। ইংরাজীতে দারুণ সড়গড়। ব্যাঙ্ক পি ও এর প্রস্তুতি চলছিল তার।প্রতিযোগিতামুলক পরীক্ষার খুঁটিনাটির খবর পাওয়া যেত তার থেকে। সপ্তাহে একদিন কি দুদিন যেতাম তমলুক। টানা চর্চা হত স্কুল সার্ভিস নিয়ে। কোনো কোনো দিন এক মেডিকেল পড়ুয়া মোটা মোটা বই নিয়ে হাজির হত মেসে। সেদিন লেখাপড়া লাটে উঠত।
কম বয়সি সে ছোকরার থেকে জানা যেত কত কি। কবিতা, আড্ডা, সিনেমার গল্প, গান, চা আর সিগারেটের ধোয়া সে এক নরক গুলজার অবস্থা। সে ছোকরা ছিল প্রসেনজিৎ এর ছোটো মামা। পরে পরে ফেসবুকে কাটা আঙুল জোড়া লাগানো ডাক্তারের গল্প দেখি। মুখটা কেমন যেন চেনা চেনা মনে হয়। স্মৃতি হাতড়ে উঠে আসে মেসের সে সব দিন। সেই ছোকরাই আজকের নামকরা ডাক্তার ডঃ পবন মন্ডল এটা বুকের ভেতর আকাশ ছাপানো আলো জ্বেলে দেয়। হঠাৎ দেখার আকস্মিকতায় সত্যিই কথা হারিয়ে ছিলাম আমরা। তারপর বাঁধ ভেঙে হু হু করে ঢুকতে থাকে স্মৃতিরা। একে একে তারা সব র‍্যাম্পে হাঁটার মতো হেলেদুলে ফিরে আসে স্মৃতিতে।আমার আর প্রসেনের সেই সব অগোছালো উসকোখুসকো আটপৌরে দিনগুলোর পাতা খুলে যায় ফরফর। হঠাৎ মেসে পৌঁচ্ছে একটা মিলকে দুটো করে খাওয়া। ভীষণ গরম টানা লোডশেডিং চলছে। পাশাপাশি শুয়ে ছাতে। চোখের সামনে খোলা আকাশ। তারারা জ্বালিয়ে রেখেছে নিজেদের। কত কথা হচ্ছে নিজেদের মধ্যে। রাত গভীর থেকে গভীর হচ্ছে। কারো চোখে ঘুম নেই। সিগারেটও শেষ হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। শেষে এ্যাসট্রে থেকে পোড়া সিগারেট খুঁটে নেশা। দোকানে এটা ওটা খেয়ে দুজনের পকেট মিলিয়ে দাম মেটানো। বি এড এর টুর.... পলাশ না কার যেন প্রেম পত্র। চন্ডিপুরের সেই শ্যামলা মেয়েটা... সে হয়তো আর কোনো দিন লুডোই খেলল না। ঝাড়গ্রামের জয়ন্ত... শান্তনু, বিভাস। সেই লাস্যময়ী সুন্দরী যে এলে পোড়া গন্ধে ভরে যেত আমাদের মতো যুবকদের হৃদয়। আরো কত কি! এর মধ্যেই আমি এড়িয়ে গেছি, আমার চাকরি পাওয়ার খবর। কি করে জানাই সাত মাস আগে স্কুলে জয়েন করেছি আমি!
এক বছর আগের খবর ওর কিছু হয় নি। না চাকরি বাকরি নিয়ে কোনো প্রশ্ন করে নি প্রসেনজিৎ। সেও এড়িয়ে গেছে সযত্নে। তবে কি ও জেনে গেছে আমার চাকরির খবর! হতে পারে শান্তনু বা বিভাস কারো থেকে।
"আমি তো অনেক বার খোঁজ নিয়েছি তোদের পুরানো মেসে।" এ জিজ্ঞাসায় অপরাধের হাসি হাসে প্রসেন।
"তোকে জানানো হয় নি আমরা বছর দুই ফিরে গেছি নিজেদের গ্রামে।" সিগারেট ধরাই। ওকেও দিতে চাই। নেয় না। অনিচ্ছা নিয়ে শেষ পর্যন্ত টান দেয় আমারটায়। "সিগারেট কি ছেড়ে দিলি?"
"এক রকম।" কাসিটা সামলে উত্তর দেয় প্রসেন।
"তা এখন কি ময়না ফিরবি, মানে বাড়ি?" মুখটা কেমন যেন অসহায় মতো লাগে প্রসেনের। অনেকটা সেই মেসের মার খাওয়া কষ্ট পাওয়া মুখ। কিছু একটা লুকানোর চেষ্টা শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারে না প্রসেন। অনেকগুলো যদি কিন্তু মিশিয়ে বলে-
"আমি আমার স্কুলের হেড স্যারের বাড়ি যাচ্ছি।"
"হেড স্যার! তোর স্কুল তো সুন্দরবনের দিকে!"
"না সে স্কুল নয়। আসলে আমি চার মাস হল পাশ ক্যাটাগরিতে..." কথাটা শেষ কারার আগেই পিঠ বেঁকে গেল প্রসেনের। পিঠ চাপড়ে বললাম-- "শালা এতো সময় এতো ভাল খবর বলিস নি কেন!"
"কি করে বলি, দুহাজারে তোর মাস্টারিটা হলে আজ প্রায় আট বছর হয়ে যেতো তোর। তোর সেই কষ্টের দিনগুলো তো নিজের চোখে দেখেছি।" বুকের উপর থেকে মস্ত বড় ওজনের পাথরটা হঠাৎ করেই নেমে যায়। হাসি পেয়ে যায়। দুজন দুজনকে লুকাচ্ছিলাম পাছে কষ্ট দেওয়া হয় এই আশংকায়। হাত ধরে হিড়হিড় করে প্রসেনকে টেনে নিয়ে গেলাম মিষ্টি দোকানে "পরে যাবি তোর স্যারের কাছে, আগে চল মিষ্টি খাই।" মিষ্টির দাম দেওয়া নিয়ে সে এক কান্ড। মোটেই দাম দিতে দেয় না প্রসেন। শেষে বললাম
"পাশের স্কেলের থেকে তো পোষ্ট গ্রাজুয়েশন স্কেল বেশি না কি?"
"মানে?"
পার্স থেকে টাকা বের করতে করতে বলি "আমি মার্চে জয়েন করেছি হলদিয়ার একটা স্কুলে।"
"শালা এতোক্ষণ খেলা হচ্ছে!"
"ঐ যে তুই যে কারণে সুযোগ পেয়েও গোল দিতে চাস নি।"
"দে একটা সিগারেট দে খাই।"
এই বলে প্রসেন নিজেই আমার পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা নিল তুলে।
আমি বললাম-- "তোর স্যারের বাড়ি?"
"কে স্যার?"
"ঐ যে যেখানে যাচ্ছিলি, হেড স্যার।"
"ঐ দেখ একদম ভুলে গেছি। কোন গাড়ি ধরি বলতো?" সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বললাম
"তার আমি কি জানি।" তারপর "হাঃ হাঃ হাঃ" কি তার হাসি।
"ধুর, জানি নাকি তার বাড়ি! ওটা তো ছিল সত্যটা জানানোর বাহানা।"

৯) 

মাদের হাত আছে, আছে দশটা আঙুল। আমাদের সাধ্য আছে, স্বপ্ন আছে, তার মধ্যেও কিছু একটা নেই। যেটা নেই সেটা এক 'মস্ত বড় নেই'। কিম্বা যেটা আছে সেটা এতোটাই 'মস্ত বড়' যা পেরানো বা উপেক্ষা করা গেল পঁচিশটা বসন্তেও। উল্টো মুখে শোয়া স্বামী-স্ত্রী র মধ্যে পড়ে থাকা পাশ বালিশের মতো সেই 'মস্ত বড়' কিছুকে সরাতে পারলাম না আমরা কেউই। আমাদের অনেক কিছু করার ছিল কিন্তু কিছুই করা হয়ে ওঠে নি। কেন যে হয়ে ওঠে নি সে নিয়ে বসা হয় নি এমন নয়। হয়েছে, অনেক অনেকবার বসা হয়েছে। আলোচনা হয়েছে। বচসা হয়েছে। কেন যে হয় নি তা নিয়ে আমরা যতবার বসেছি ততবারই যতজন বসেছি আলোচনা শেষে কারন পেয়েছি তারও বেশি। সব আলোচনাই শেষ পর্যন্ত আটকা পড়েছে ব্যক্তিগত টানাপোড়েনে নাকি সেই 'মস্ত বড়' কিছুর চক্করে। তাই আর এগিয়ে যাওয়া হয় নি। অথচ এককালে সম্ভ্রম সমীহ কোনোটারই অভাব ছিল না। ব্যক্তিমানুষের জীবনকালের সবটুকু তো আর সম্ভ্রম জাগানো হয় না।
একটা অধ্যায়কে নিয়েই বাঁচে মানুষ। ঐ সোনা রঙের দিনগুলো নাড়াচাড়া করতে করতে এগিয়ে চলে। এমন তো নয় তারুণ্য বা মধ্য বয়সের ঝকঝকে দিন পেরিয়ে থমকে যায় মানুষ।mআত্মহত্যার পথ নেয়। বরং এটাই দস্তুর অতীতের স্মৃতি-সুখ ভরিয়ে তোলে ভবিষ্যতের আনাচ কানাচ। আমি তো হেলাফেলার নই। আমার তো কিছু নেই তা নয়। আমার আছে গর্বের উত্তরাধীকার-- এ নিয়েও বেঁচে বর্তে থাকা যায়। আমাদের যা কিছু সে প্রথম পঁচিশের। তারপর সেই 'মস্ত বড়' কিছুটার জন্য নাকি অন্য কোনো কিছুতে আমরা আটকে গেছি তার স্থির নির্ধারণ হয় নি। পঁচিশ বছরের মেহগনি, পলাশ, বকুল, ইউক্যালিপটাস লাট খেয়ে পড়ে আছে মাটিতে। ইতিহাসকে ধরার জন্য রজতজয়ন্তীতে বোনা হল চারা, দেওয়া হল জল, ক্রমে পল্লবিত হল মেহগনি, পলাশ, বকুল, ইউক্যালিপটাসের দল। ২০ এর তান্ডবে শুয়ে গেছে সে সব। নাকি তান্ডব চলছিল ভিতর ভিতর। আদালত আমাদের পক্ষে রায় দিলেও হিসেব মতো জিতে গেছে সেই লোকটা।
কোট- তারিখ-সমন- হাজিরা-কাঠগড়া এসবের চক্করে ধারে কাছে আসে নি কেউ প্রবল দুঃসাহসে। এখনো লাট খেয়ে শুয়ে আছে ইতিহাসের স্মারক। আর ভগ্নস্তূপের আশে পাশে খ্যাঁক খ্যাঁক হাসি।

১০)

বাপ কাকার ভাগাভগিতে বাপ পেয়েছিল ইঁটের দেওয়াল টালির ছাউনি দুটো রুম আর ফুট পঁচিশেক লম্বা টালির ছাউনি মাটির দেওয়ালের একটা ঘর। আমরা ইঁটের দেওয়ালের ঘরটাকে পাকা বাড়িই বলতাম। সেই পাকা ঘরের রুমগুলোকে রুম না বলে স্কুল ঘর বল্লে অত্যুক্তি হয় না। দিব্যি একটা রুমকে ভেঙে দুটো রুম বানিয়ে নেওয়া যায় প্রমাণ সাইজে।
বছর ষাটেক আগে পিচ রাস্তার পাশে বাড়ি বানিয়েছিল ঠাকুরদা। আসলে আমরা কুকড়াহাটীর ভূমিপুত্র নই। কুকড়াহাটী থেকে পশ্চিমে আরো আট দশটা গ্রাম সরে ছিল ঠাকুরদার পৈতৃক ভিটে।
শিক্ষকতার সুবাদেই ঐ অভিবাসন। পাকা ঘরটা ছিল, দু'কামরার একতলা বাড়ি। মাথায় টালির ছাউনি। খাঁড়াই সিঁড়ির নিচে রড নয়, ছিল তালের কাঠামো। দশ ইঞ্চির দেওয়াল, শক্তপোক্ত ভিতেও ভারি যানবাহন গেলে কেঁপে উঠত বাড়িটা। পাশের মাটির লম্বা হল ঘরে ভাগাভাগি করে হেঁসেল আর গোয়াল। ছেলেবেলা থেকেই তেমন কোন বড় ঝড় সামলাতে হয় নি আমাকে। মাথার উপর তিন দিদির আড়াল ছিল। এই যে দানবটা সবকিছু তছনছ করে গেল, ঘটনাক্রমে আমি রইলাম তুলনামুলক নিরাপদ দূরত্বে ঘাটলে। ঝড়টা ঘাটাল যদি একের নামতা হয় তবে কুকড়াহাটীতে বয়ে গেল তিনের নামতা হয়ে। শুরুতে একবার ফোনে পেয়েছিলাম দিদিদের। তখনও পরিস্থিতি খারাপ হয় নি। বললাম "পরে আবার করব।"দিদি বলল "হোয়াটস অ্যাপে নজর রাখিস, ডিটেলে লিখে দেব সব।" কিছু সময় পর ফোন করলাম, সুইচড অফ! ঘাটালে অনেক আগে থেকেই লোডসেডিং ফলে টিভির খবর থেকেও কিছু জানা যাচ্ছে না। সাড়ে তিনটে নাগাদ কুকড়াহাটীর ঝড়ের একটা আন্দাজ পেলাম, অস্থির লাগল বেশ। ভয় পেয়ে গেলাম ফেসবুকে সাত্যকি (পাশের বাড়ির ভাই)র লাইভ দেখে।তারপর চেষ্টার পর চেষ্টা, লাগাতার লেগে থাকা- না, বাড়ির কোনো খবর নেই!
থেকে থেকে হোটাস অ্যাপ যাচ্ছি, সেখানেও নতুন কোনো ম্যাসেজ নেই! দাদা, শংকরদা, মানা, কাল্টুকাকু, অভি, ধুলা, সাত্যকি, শ্রীদেবদা, সুজন, তীর্থকাকু, পবিত্রকাকু। বাড়ির আশেপাশের পরিচিতদের চেষ্টা করলাম। শুরুতে খুঁট খুঁট খু্ঁট শব্দ তারপর এক কথা হয় সুইচড অফ নয়তো পরিসেবা সীমার বাইরে। ছেলেবেলার সেই টালি উড়ে যাওয়ার ভয়টা ফিরে এল।
ছেলেবেলাকার শনশন ঝড়, ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি, চোখ ধাঁধানো বিদ্যুৎ চমক আর কান এফোঁড় ওফোঁড় করা বাজের তীব্র শব্দ মনের দরজায় ফিরে চোখ রাঙাতে লাগল। তবে খুব ছোটবেলায় ঝড়-জলে বেশ মজা ছিল, কারণ ঝড় জলের দিনে পড়তে হত না। বাড়িতে তো নয়ই এমন কি স্কুলও ছুটি হয়ে যেত। যেদিন থেকে টালি উড়ে যাওয়াটা বুঝতে শিখলাম। সেদিন থেকেই ঝড় জলের সঙ্গে আমার পাকাপাকি শত্রুতা হয়ে গেল। এই প্রথম এতো বড় বিপর্যয়ে বাড়ি নেই আমি। শনশন ঝড় বইছে আমরা ভাই বোনেরা জড়ো হয়েছি উপর ঘরের একটা তক্তোপোশে।
জল পড়ছে, জল ঝরছে টালি চুইয়ে, টালি ভেদ করে আর জায়গাটা ছোট হতে হতে ক্রমশ একে অপরের নিশ্বাস ছোঁয়ার বৃত্তে এসে দাঁড়িয়েছে। নিচের থেকে হাঁকছে মা-
"নেমে আয় না, একটা কিছু বিপদ ঘটিয়ে ছাড়বি?" আজ আর ডাক দেওয়ার কেউ নেই।মা-বাবা দু'জনেই চলে গেছে পিঠাপিঠি প্রবল ঝড়ে বুক ভেঙে দিয়ে। আমাদের পাড়ায় সব থেকে পরে আলো পেয়েছিলাম আমরা। চারপাশে বিদ্যুত বাতির কুলীন উজ্জ্বল্যের মধ্যে আমাদের অভাবের সংসার বেশ মানিয়ে গিয়েছিল কুপিতে, লন্ঠনে, হারিকেনে। ঝড়ের সে দিনগুলোতে হাতের লন্ঠন নিভে গেলেও টালি ফেঁড়ে, জানালা টপকে, বারান্দা ভাসিয়ে বিদ্যুতের তীব্র ঝলকানিতে স্পষ্ট ছিল সিঁড়ি ভাঙার অভ্যস্ত পথ। নিচের বড় ঘরে বসে আছি বাড়ির সবাই। ভাই মায়ের কোলে। ছোট বোন মেজদির গা ঘেষে। বসে আছি অস্পষ্ট, হাওয়ায় নিভে গেছে বাতি। কেবল থেকে থেকে বিদ্যুতের আলোয় একে অপরকে দেখে সাহসে বুক বাঁধছি। জানলা ভেঙে বাতাস ঢুকছে। জলের ঝাট, গুড়েগুড়ো জলের বিন্দু মিশে যাচ্ছে বাতাসে। ভিজছে জামাকাপড়,বইপত্তর সংসারের টুকিটাকি সবকিছুই।
সব থেকে সমস্যা হত চালের বস্তা নিয়ে। এ কোন থেকে ও কোন, এদিক থেকে ওদিক--
কোথায় যে বস্তাগুলো নিরাপদ সে ঠিক হতে হতে বৃষ্টি যেত থেমে। পরস্পর কথা বলে দেখেছি ছেলেবেলায় আমাদের ভাই বোনদের কোনো ঋতুই পচ্ছন্দ হতো না। বাংলা পরীক্ষায় বানিয়ে বানিয়ে লিখতাম বর্ষা আমার প্রিয়। তারপর ভিজে, আ হাঁটু কাদা নিয়ে বাড়ি ফিরে ধুম জ্বর। জ্বরের ঘোরে কখনও অঙ্ক পরীক্ষায় নিজের নাম লিখি নি তো কখনও ইতিহাসে আলেকজান্ডারের কাছে পুরুর হেরে যাওয়ায় কান্না আর বেঘোর ভুল বকে যাওয়া। নাক ভর্তি মোটা জমাট সর্দিতে দম নিতে হাসফাস, কপালে মায়ের জল পট্টি। গ্রীষ্মে কালবৈশাখির তান্ডব, বর্ষার প্লাবন, শীতপোশাকের অভাবে কাঁমড়ানো শীত কাউকেই ভালবাসতে পারি নি ছেলেবেলায়। এমন কি ঝকঝকে শরৎকেও পুজো পোশাকের খামতিতে অস্বস্তি হত খুব। ঝড়জলের আগে খড়ের গাদায় বাঁশের গোজ কিংবা পলিথিনের খু্ঁটে খুঁটে আদলা বা গোটা ইঁট বেঁধে খড় গাদাকে ইগলু বানিয়ে বাঁচানোর চেষ্টার মধ্যে এসে পড়ত ঝড় বৃষ্টি।
মেজদি প্রায় একাই সব সামল দিত মাথা খাটিয়ে। আমরা শুধু ফাইফরমাস খাটতাম। গরুর গায়ে চাপত চট। ইচ্ছে থাকলে উপায় হয় কথাটা আমার বাবা মায়ের ক্ষেত্রে একেবারে ভিন্ন ধারার ছিল। সঞ্চয়ের ইচ্ছে থাকলেও সংসারের মস্ত হাঁ আর সঞ্চয় অপ্রতুল আয়ের কারনে বাবার সঞ্চয় ছিল শুন্য। মা বর্ষার জন্য একটু একটু করে সরিয়ে রাখত চাল, ডাল, তেল,ঘুঁটে এমন কি বর্ষা নামার আগে আগে ছাই সঞ্চয় থাকত যথেষ্ট। বর্ষা শেষে এখানে ওখানে গোয়ালে ছাই ছড়ানো হতো ঝুড়ি ঝুড়ি। প্রবল সে সব ঝড়ের রাতে উড়তে থাকা ক্যালেন্ডারের শিব, কালি আর সব দেবতাদের শক্তিতে আস্থা রাখা ছাড়া আর বিশেষ কোনো উপায় ছিল না। ভাই বোন মিলে ওদের বারবার ডাকতাম আর বলতাম--
"ভগবান আমাদের অন্য সব কষ্ট আরো কিছুটা বাড়িয়ে দাও, অভাবের যন্ত্রনা আরো একটু বেশি সইতে পারবো, সকালে খেয়ে রাতে না খেয়েও থাকবো না হয়, শুধু বিনিময়ে তুমি ঝড়টাকে থামিয়ে দাও।" ঝড় এলেই মনে হতো টালির চালটা এই বুঝি উড়ে গেল মাথা থেকে। তখন রাত সাড়ে সাত বা আট ফোনে পেয়ে গেলাম পবিত্রকাকুকে। ক্ষয়ক্ষতির কথা তো সেই মুহূর্তে বলা যায় না। বুঝতে পারলাম কি চলছে। পবিত্রকাকু এমনিতেই খুব স্থিতধী মানুষ। দুম করে উত্তেজনা দেখানোর লোক নয়। বলল "আমার পয়ষট্টি বছর বয়সে এমনটা দেখিনি! আমরা এখানে তো সবকিছু থেকেই বিচ্ছিন্ন কারো সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। তুমি কি কোনো ভাবে জানাতে পারবে আর কতক্ষণ চলবে এই তান্ডব?" বুঝলাম যন্ত্রনা কতটা গভীর হলে মানুষ জানতে চায় কখন মুক্তি মিলবে। সময়টা যাই হোক এক ঘন্টা বা দুই কিম্বা তিন, নিদিষ্ট করে জানতে পারলে যেন স্বস্তি।
চুড়ান্ত উৎকন্ঠার মধ্যে ঐ সময়টাই খড়কুটো ওটাই সাহস, ব্যাস আর এক বা দুই বা তিন ঘন্টা পরে কমবে তান্ডব। পবিত্রকাকুদের জন্য চেষ্টা শুরু করলাম, দেখলাম নেটের যা অবস্থা নিদিষ্ট তথ্য পেতে বেগ পেতে হবে বেশ। না আমার হাতে অতো সময় নেই। সত্যিই নেই। বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ হয় নি যে। এখন গুগুল করার চেয়ে বাড়িতে বারবার ফোন করাটা দরকার, যদি লেগে যায়। পেয়েও গেলাম। তবে কথা হল একটাই।
"ভাইরে টালিগুলো যেন ফরফর করে পাতার মতো উড়ে গেল" তারপর সব চুপ।
ভাবলাম দিদি হয়তো কথা বলতে পারছে না কষ্টে। আমি নানা ভাবে স্বান্তনা দিতে রইলাম।
ওদিকে গভীর স্তব্ধতা। না ফোন কেটে গেছে অনেক আগে। সেই যে ফোন কাটল আর পাওয়া গেল না। ফেসবুকে পোষ্ট করলাম আপডেট পাওয়ার জন্য। আরিফবাবু, ডাঃ দয়াল বন্ধু মজুমদার, অনুপম, অমিত ব্যানার্জী বাবুর থেকে কিছুটা আন্দাজ পেলাম। নটা নাগাদ একটু হলেও স্বস্তি মিলবে। পবিত্রকাকুকে ম্যাসেজ করলাম। মোবাইলে তখন ১৩% চার্জ। না এর পর মোবাইল খোলা রাখলে সকালে বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ হবে না। বন্ধ করলাম মোবাইল। তারপরই শুরু হল বিনিদ্র রাত। ঘুম আসছে না, মোবাইল খোলা যাচ্ছে না সে এক অদ্ভুৎ অবস্থা। সকাল থেকে কুকড়াহাটী যোগাযোগের বাইরে। গুজরাট থেকে সুব্রত মাইতি (বাপি)র পোষ্ট কোন যোগাযোগ হচ্ছে না। চিন্তায় শেষ হয়ে যাচ্ছি। দুপুর একটা নাগাদ অভি সঙ্গে কথা হল। অভি বাড়ি গিয়ে কথা বলাল। শুনলাম সব। হেঁসেলের টালির চাল নেই,আম, জাম, পেয়ারা, নারকেল সব গাছ শেষ। মেজদিকে বললাম "কাল বাড়ি ফিরছি।"
ওদিক থেকে মেজদি শান্ত গলায় বলল "যেখানে আছিস সেখানেই থাক, আমি সামলে নিচ্ছি সব।"
জানি না ফিরতে পারব কিনা তবে এটা জানি সবটা সামলে নেবে ও যেমন বাকি ঝড়গুলো সামলেছে এতোদিন। পুনশ্চঃ আমাদের বড় কোনো ক্ষতি হয় নি।আসলে মাটির লম্বা ঘরটা ফেলে দু'কামরার পাকা বাড়ি হয়েছে বারো বছর আগে,তার পাশেই ইটের দেওয়াল টালি চালা হেঁসেল। দুবছর আগে ঠাকুরদার তৈরি বাড়ির টালির চাল বদলে নিয়েছিলাম কংক্রীটের ছাদে তাই বেঁচে গেছি এ যাত্রায়।

১১) লটারি

নিয়ম মেনেই সব কাজ হচ্ছিল। দাউ দাউ জ্বলছিল হোমের আগুন। পুরোহিতের ফর্দে কোনো কার্পণ্য রাখেনি ভুদেব। রীতিমত পাঁচ সের ঘি পুড়বে ভুদেবের ভিটায়। একটা দোতলা পাকা বাড়ির সাধ, তার অনেক কালের। হঠাৎ করে সবটা এতো দ্রুত বদলে যাবে, এতো সহজ হয়ে যাবে জীবন, শুরুতে বিশ্বাসই হয় নি ভুদেবের। একটা টিকিটেই পাল্টে গেল তার জীবনের গতি। অবশ্য এমনটাই তো হওয়ার কথা ছিল। এটাই তো সে চাইত প্রথম থেকেই।
বাড়ির সামনে তৈরি হয়েছে নতুন মন্দির, পাথর বাঁধানো। মন্দিরে কুলদেবতা রঘুনাথের সঙ্গে স্থান পেয়েছে কল্পেশ্বরী মা। কল্পেশ্বরী এই এলাকার জাগ্রত দেবী। প্রচলিত রীতি মেনে মাসে একদিনই পুজো- প্রসাদ গ্রহণ করেন মা। মাসের একাদশীর প্রত্যুষে একটি বারের জন্য মন্দিরের দরজা খোলেন ঠাকুরমশাই। একাদশী ছাড়া অন্য সব দিন বন্ধ থাকে মন্দিরের দরজা। ঐ দিন মায়ের কাছে মন থেকে কিছু চাইলে, মা তাকে ফেরান না। বাস্তু পুজোর আগে একাদশী তিথি মেনে কল্পেশ্বরী দেবীর মন্দিরে ঘটা করে পুজো দিয়েছে ভুদেব।
সাতচল্লিশ বছরের নাস্তিক ভুদেব পান, মাস চার হল বিশ্বাস করতে শুরু করেছে দৈবে। মানে যখন থেকে ভুদেবের মাথাটা একটু বেশি রকম বিগড়ে গেল তখন থেকেই ব্বহুদেবের বিশ্বাস একটু একটু করে পোক্ত হতে শুরু করে ঠাকুর দেবতায়। রেকাব ভর্তি লুচি, পায়েস, ক্ষীর নিয়ে ব্যস্ত পায়ে মন্দিরে ঢুকল ভুদেবের স্ত্রী হৈমবতী।
গলায় আঁচল দিয়ে আভূমি প্রণাম করল কুলদেবতাকে। কল্পেশ্বরী মায়ের পায়ে প্রণাম সেরে, ঢেলে দিল এক কৌটা সিঁদুর। খালি কৌটাটা রাখল বেদীতে, পুজো শেষে মায়ের পা থেকে সিঁদুর তুলে নেবে ফের। মায়ের ঐ প্রসাদী সিঁদুরের জোরে দীর্ঘ এয়ো হতে চায় হৈমবতী। রঘুনাথ তাকে অনেক দিয়েছে, অতোগুলো টাকা, নাতি নাতনি নিয়ে ভরা সংসার, মন্দির থেকে মুখ ফেরানো নাস্তিক স্বামীর মতি ফিরেছে ঈশ্বরে এর চেয়ে আর বেশি কি বা চাওয়ার আছে হৈমবতীর! হঠাৎই কাজের মেয়ে কমলার চিৎকার--
"বৌদিমনি দেখ দেখ পাগলটার কারবার খানা দেখ! কাজের বাড়িতে একটা কিছু অলক্ষুণে কান্ড না ঘটে!"

পাশ বালিটা বগলদাবায় চাপা, মাথায় আরো একটা বালিশ, কাঁধ থেকে নেমে এসেছে বিছানার অন্য সব সাজ, গেট পেরিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে ভুদেবের বেডরুমের দিকে হনহনিয়ে এগোচ্ছিল ভুদেবের। বাড়ি ভর্তি আত্মীয় স্বজনের চোখ ছানা বড়া। হোম কুন্ডে নজর যেতেই মাঝপথে বিছানাপত্তর ফেলে ধপ ধপ পা ফেলে সটান চলে গেল সেখানে।বসে পড়ল পুরোহিতের পাশে। চকিতে বেলপাতা তুলে, বেলপাতা সহ হাতটা ডুবিয়ে দিল ঘি-পাত্রে। পুরোহিত রাগে চিৎকার করলেন-- "হচ্ছেটা কি? সবকিছুই যে অপবিত্র হয়ে গেল!"
"আমি যযমান, আমার আবার শুদ্ধ অশুদ্ধ! একটা কানাকড়ি দক্ষিণা হবে না, উঠ উঠ বলছি। পুরোহিত জাতটাই গাছ ঢ্যামনা। কানেও কি কম শুনিস না কি?... উঠ...উঠ এক্ষুনি।"
এই বলে ভুদেব পুরোহিতদের নামাবলী টেনে, সে এক অস্থির অবস্থা। ততক্ষণে দুজন ষন্ডা গন্ডা লোক বাহুমূল ধরে হ্যাঁচকা টানে ভূদেবকে উঠিয়ে নিয়েছে বেদী থেকে। পা ছড়িয়ে চোখ পাকিয়ে ভূদেব বলছে-- "ছাড় ছাড় বলছি আমাকে, আমার বাড়ি, আমার হোম, আমি ঘি পোড়াব না! এ্যাই এ্যাই লাগছে রে, ছাড় ছাড় না আমাকে।'

ভূদেব এগিয়ে এসে ভূদেবের মাথায় হাত রাখে। গোঙাতে গোঙাতে একটু সময়ে স্থির হয়ে যায় ভূদেব। আনন্দ করে থালা ভর্তি লুচি ছোলার ডাল আর মিস্টি খেতে থাকে। লম্বা বেগুন ভাজা তার বড্ড পচ্ছন্দের। তেল চপচপে বেগুন ভাজার বোখাটা ধরে দোলাতে থাকে সে। ঘড়ির পেন্ডুলামের মতো ভাজা বেগুনটা দুলতে দুলতে একসময় খসে পড়ে মাটিতে। বেগুন ভাজা আর খাওয়া হয় না তার। ভুদেব পানের বিছানায় বালিশ নিয়ে এদিক থেকে ওদিক গড়াগড়ি যায় সে। আপন মনে হাসে। তারপর হঠাৎই হাতের কাছে পাওয়া কুশনটাকে ছুঁড়ে দেয় দেওয়ালে ঝোলানো টিভিটার দিকে। ভুদেব পালের এই পাগলামো আজেকের নয়। ভুদেব পানের লটারি পাওয়ার পর থেকে দ্রুত পাল্টে যেতে থাকে ভুদেব পাল। একসময় দুই ভূদেব ছিল হরিহর আত্মা। নাস্তিক ভুদেব পান আর আস্তিক ভুদেব পালের বন্ধুত্বের শুরু লটারি দিয়েই। দুজনের ছিল লটারীর পোকা। একবার টিকিট নিতে গিয়ে দেখে, সব টিকিট শেষ, রয়েছে মাত্র একটি। দুই ভূদেবে শেয়ারে কিনেছিল সে টিকিট।
বন্ধুত্বের সেই শুরু। তারপর মাসের পর মাস, বছরের পর বছর রাজ্য লটারি, রথ যাত্রা স্পেশাল, পুজো বাম্পার কোনো টিকিটই কপাল ফেরাতে পারে নি ভুদেবদের। লটারির টাকায় সোনির ঐ এলইডি টিভিটা যেদিন বাড়ি নিয়ে আসছিল ভুদেব পান সেদিন প্রথম পথ আগলে দাঁড়ায় ভূদেব পাল। টিভিটা ছিনিয়ে নেওয়ার জোর চেষ্টা চালায়। শেষ পর্যন্ত ভুদেব পানের বড় ছেলে রনজয়ের চেষ্টায় উদ্ধার পায় টিভি। তারপর থেকে বহুবার ঝামেলা করেছে ভুদেব। কখনে কেড়ে নিয়েছে বাজার ভার্তি থলে, কখনো মিষ্টির প্যাকেট।
বারবার দাবী করেছে ও টাকা নাকি তারই। লটারির পুরোটাই তার প্রাপ্য। এ কথায় অন্যরা হাসলেও ভূদেব পান বুঝতে পারে তার বন্ধুর কষ্টটা। লটারির পর লটারিতে তার বন্ধুও তো উড়িয়েছে টাকা.... প্রতিবারই মনে হয়েছে এর পরেরটা নিশ্চিত কিন্তু কাগজ কাগজ থেকে গেছে টাকা হয়ে উঠে নি পোড়া কপালে। ভুদেব একবার হাজার কুড়ি টাকা দিতেও চেয়েছিল বন্ধুকে। কিন্তু ভূদেব পালের এক জেদ, লটারির পুরো টাকাই চাই তার। নতুন ঘর বাড়ি সমেত ঐ চল্লিশ লক্ষের পুরোটাই তার। ছয় মাসের মধ্যে একটা ভালো মানুষ লটারি লটারি করে এখন আস্ত উন্মাদ। নাকি যারা লটারি কাটে তারা আগা গোড়াই উন্মাদ হয়! কে জানে! তবে এলাকার সবাই জানে কল্পেশ্বরীর ঠাকুর মশাই পালিয়েছে ভুদেব পাগলের ভয়ে।
ভুদেব নাকি মাঝেমাঝে কল্পেশ্বরীর বন্ধ দরজার মাথা ঠুকে আর বলে "আমার টাকা ওকে দিয়ে দিলি মা!" মাস ছয় আাগের ঘটনা, প্রতিবাররের মতো সেবারও দু'ভুদেবই চল্লিশ লক্ষের টিকিট কিনেছিল একটা করে। একাদশীর সকালে ভূদেব মা কল্পেশ্বরীকে পুজো দিয়ে, মাকে প্রণাম করে বলেছিল--- "মা গো আর কিচ্ছু চাই না, একটা বার মুখ তুলে চা মা, চল্লিশ লাখের রাজ্য লটারিটা নামিয়ে দে মা।" মাটির ভাড়ে বাতাসা সন্দেস সহ টিকিটাও দিয়েছিল মায়ের চরণে। ঠাকুর মশাই জানতে চেয়েছিলেন "কি নামে পুজো হবে?"

ভুদেব বলেছিল---"ভুদেব পাল,  শান্ডেল্য গোত্র" ঠাকুর মশাই ভাড়ের গায়ে নাম লেখেন "ভুদেব পান,শান্ডেল্য গোত্র"।

১২)

ষ্টমুদির জলে ভেঙে যাচ্ছে দিন শেষের আলো। অনতিবিলম্বে দিননাথ নিদ্রা যাবেন পশ্চিমদেশে। চতুর্থ প্রহরান্তে পুনঃরায় প্রত্যাবর্তনের নিশ্চয়তায় পশ্চিমদেশে বিনির্মিত হচ্ছে শয্যা খেজুর আর তালের ছায়ায় ক্রমশ ঘন হচ্ছে অন্ধকার। বজরায় অস্থির পায়চারি করছেন মহারাজ। পশ্চাতে গৃহমন্ত্রী সর্বক্ষণের সঙ্গী। দীন দুঃখী প্রজাদের জন্য মহারাজের চিত্ত হয়েছে ব্যাকুল। অনৃত হয়ছে বিলাস-ব্যসন সহ সকল রাজসুখ যুদ্ধ যাত্রায় এখন অনীহা অসুখ। দুশ্চিন্তা এমন এক ব্যধি পক্ষকালেই যুবাকেও বয়োবৃদ্ধ দেখায় নিরবধি।
পরিত্রানের উপায় সন্ধানে.... পাত্র-মিত্র- মন্ত্রী- সান্ত্রী ব্যস্ত সর্বজনে। অষ্টমুদির জলে এই যে অস্থায়ী দরবার- এ হল বিদুষকের কারবার। সেই তো প্রারম্ভে পথ-দর্শায়-
"উপায় উদ্ভাবনে,
মস্তিষ্ক সাড়া দেয় মুক্ত বায়ু সেবনে।"
সেই মতো রাজধানী থেকে শত ক্রোশ দূরে নিত্য বসছে সভা অতল নীলাম্বুতে। পলকে রক্ষীদের সকল সতর্কতা অতিক্রম করে, বিহঙ্গের দল ক্লান্ত পাখায় ফিরে যায় নীড়ে। মহারাজ নিস্প্রভ নেত্রে তাকিয়ে থাকেন সেই প্রত্যাবর্তনে। কার্যত বিমর্ষ দেখায় মহারাজকে।
রক্ষামন্ত্রী তিরোস্কার করেন রক্ষী সহ পাত্র, মিত্র, অমাত্য সকল রাজানুগ্রাহীদের। ভৎসনা করেন তীব্র নাদে...
"রাজ চিত্ত সিক্ত হয় এমন দৃশ্য উন্মোচনের অবকাশ আর যেন না ঘটে।"

ইত্যবসরে গৃহমন্ত্রীর বিকচ শিরদেশ হিরক দ্যুতির ন্যায় চমকাইল বেশ।
উল্লসিত স্বরে কহিলেন
"জয় শ্রীরাম, জয় শ্রীরাম.... ধর্ম নয়, নয় রাজনীতি। উপায় নির্দেশে রামায়নই অগতির গতি।" সাগ্রহে মহারাজ কহিলেন-- " সাধে কি পক্ষপাত করি তোমায় সর্বক্ষণে।"

গৃহমন্ত্রী বললেন- "মহারাজ অদূরেই মালাবার উপকুল দেশ, সেখানেই আছে কোল্লাম প্রদেশ।" রক্ষামত্রী বললেন - "রামায়নের সঙ্গে তার কি যোগ?" "আছে আছে, রামায়নের অরণ্য কান্ড। কোল্লামের ইতিহাস জটায়ু সম্পাতির বসবাসের জন্য।"

বিদূষক বিজ্ঞ বিজ্ঞ বলে--
"সূর্যের সারথি অরুন তার দুই পুত্র,
মস্ত বড় পক্ষী, ডানা মস্ত বড়...
তাদের নিয়ে উপায় কি কর?"

গৃহমন্ত্রী পরামর্শ দিলেন--
"মহারাজ সত্ত্বর পাঠান নির্দেশ...
শোনা হবে না কোনো বাহানা।
ঐ দুই পক্ষী বিশেষ
অভিবাসী শ্রমিকের পিঠে
সেলাই করে দিক ডানা।
বিনা ব্যয়ে ফিরতে স্বদেশে
থাকবে নাকো মানা।"

রক্ষামত্রী বললেন--
"খবর দাও থানায় থানায়
শ্রমিকরা যেন ইমেলে সব জানায়।"

বিদূষক বললেন--
"সাধু সাধু....
প্রস্তাবটি বেশ...
এ যাত্রায় হোক অভাগার  বিমানের আবেশ।"

জুন ২০২০ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

গল্প

বস
Pijushkanti-Das.jpg

বস

পীযূষ কান্তি দাস

মেদিনীপুর
 

village.jpg

জন্ম -অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রাম। ইচ্ছা ছিলো সাহিত্য নিয়ে পড়াশুনা করে শিক্ষকতাকে পেশা হিসাবে নেওয়া। কিন্তু বাস্তবতা আর নিয়তি টেনে নিয়ে গেল অন্যপথে আর পেশা হল স্বাস্থ্যকর্মী। দীর্ঘ চল্লিশ বছর পেশার চাপে সব রকমের সাহিত্য থেকে বহুৎ দূরে। পরে একটু অবসর পেয়ে ভার্চুয়াল বন্ধ. 

টিফিনের টাইম। গেট থেকে বেরিয়েছে অনেকেই। কেউ কেউ অবশ্য ভেতরেই বসে বাড়ির থেকে আনা ডাল ভাত শাক চচ্চড়ি খাচ্ছে। অনন্ত একটুকরো ভেলি গুড় দিয়ে আর নকুল শীতের পাঁচমিশেলি সব্জি দিয়ে রুটি সাঁটাচ্ছে। হিন্দুস্তানী দারোয়ানটা ইয়াবড় ভুঁড়ি নিয়ে গেটের পাশে টুলের উপর বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে খৈনি ডলছে। একটা নেড়ি কুকুর গেটের বাইরে লেজ মুড়ে কুন্ডলী পাকিয়ে শুয়ে। গেটের সামনে রাস্তা বিশ ফুটের মতো চওড়া। সেই রাস্তার যেদিকে কারখানার গেট ঠিক তার বিপরীত দিকে একটা ময়লার ভ্যাট। কি নাই সেই ভ্যাটে? মাছের আঁশ, কলার খোসা, টকসে যাওয়া তরকারি, ছেঁড়া জুতো, শুকিয়ে যাওয়া ফুলের মালা, মরা ইঁদুর, কাগজে মোড়া ইউজড কন্ডম মায় রক্তে ভেজা মেয়েদের স্যানিটারি ন্যাপকিন ইত্যাদি ইত্যাদি। গতবছর তো একটা আট ন মাসের বাচ্চার আধখাওয়া লাশও ভ্যাটের বাইরে পড়েছিল। তাই না দেখে খুব চেঁচামেচি! কে যেন ফোন করে খবর দিল আর তার মিনিট পনেরর মধ্যেই থানা থেকে পেটমোটা বিশু দারোগা জিপে চেপে হাজির। এসেই তার সে কি হম্বিতম্বি! কোথা থেকে এল এ সব? কোন খানকি পেট খসিয়ে এখানে এসব ফেলে গেল? 

কারুর কাছে কোন উত্তর না পেয়ে শেষে সেই যে পাগলাটা যে পাশেই বাসস্ট্যান্ডের টিনের শেডের তলায় শুয়ে থাকে, কুকুরের সাথে লড়াই করে ভ্যাট থেকে খাবার খুঁজে খায় তাকেই চালান করে আর কি! পথচলতি মানুষ যারা ভিড় দেখে দাঁড়িয়ে গেছিল, ভেবেছিল কোন তামাশা হচ্ছে তারাই প্রতিবাদ করে। শেষে কাউন্সিলরের চামচা কালু এসে বিশু দারোগাকে একদিকে ডেকে কানে কানে কি যেন বললে। আর সাথে সাথে বিশু দারোগাও পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে থানায় ফোন করল। কিছুক্ষণ পরেই একটা মোটর সাইকেলে চেপে থানার ধ্যাঙড়কে নিয়ে এক কনিষ্ঠগোপাল এল এবং একটা ছোট চটের বস্তায় সেই লাশ উঠিয়ে নিয়ে চলে গেল। ভিড়ও অমনি পাতলা।   

সুরভীর দেওয়া আলুপোস্ত আর বিউলির ডাল ভাত খেয়ে আমিও বেরিয়েছি। ইচ্ছা একটা বিড়ি খাই। বিবেকদার পানের দোকানের সামনে গিয়ে বলি বিবেকদা এক প্যাকেট লক্ষ্মী বিড়ি। ঠিক সেই সময় পিছন থেকে কে যেন বললে দাদা একটা তিনশ পান হবে। গলাটা কেমন চেনা চেনা মনে হল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি সাইকেলের হ্যান্ডেল ধরে শমীক। আমি বললাম কিরে শমীক কোথ্থেকে? 

দাঁত বের করে একগাল হেসে শমীক বললে আরে অনিকদা তুমি? তা তুমি এখানে? আমি বললাম আরে ওইতো আমাদের কারখানা বলে আঙুল তুলে দোকানের উল্টোদিকের সাইনবোর্ডটা দেখাই। 

সাইনবোর্ড বলতে গেটের উপর রঙচটে যাওয়া একটা লেখা "বিশ্বকর্মা ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস"।

সাইনবোর্ডের হাল দেখলে যে কেউ সহজেই বুঝে নেবে তার বর্তমান হাল হকিকত। 

আমি বললাম - 'তুইতো বললি না কোথ্থেকে ফিরছিস?

- 'সে পরে বলব'খন' শমীক উত্তর দেয়। 

আমি প্যাকেট কেটে বিড়ি বের করি। একটা বিড়ি এগিয়ে দিয়ে বলি - 'ঠিক আছে। সে পরে শুনব'খন। নে বিড়িটা নে।'

শমীককে একটা বিড়ি দিয়ে আমিও একটা বিড়ি নিয়ে কানের কাছে নিয়ে গিয়ে আঙুল দিয়ে ঘুরিয়ে মুখে নিই। পকেট থেকে দেশলাইটা বের করে ধরাতে গিয়ে দেখি একটাও কাঠি নাই। অগত্যা বিবেকদাকে বলি বিবেকদা, একটু ম্যাচিসটা হবে। পান সাজতে সাজতে বিবেকদা আঙুল দিয়ে দোকানের পাশে ঝোলানো লাইটারটা দেখিয়ে দিল। আমি বিড়ি ধরানোর পর শমীককে বিড়িটা এগিয়ে দিলাম। শমীক বিড়ির আগুনে বিড়ি ধরিয়ে আমায় ফেরৎ দিল। দুজনে দোকান থেকে একটু সরে গিয়ে আরাম করে সবে দুটো টান দিয়েছি এমন সময়, একটা লাক্সারি কার এসে কারখানার গেটে থামল। এরকম গাড়ি বাপের জন্মে দেখিনি!  আমি শমীককে বললাম - 'দ্যাখ দ্যাখ কি সুন্দর গাড়ি!  কত দাম হবে বলতো?' 

শমীক কারটার দিকে তাকিয়ে বলল - কি জানি!  তা বিশ-ত্রিশ লাখ হবে নিশ্চয়! 

বলিস কিরে বিশ-ত্রিশ লাখ আমি অবাক হয়ে বললাম! একটা গাড়ির অত দাম! 

আমার কথা শুনে শমীক হি হি করে হাসল। দোক্তা পান আর বিড়ি খেয়ে খেয়ে তার দাঁতের যা রঙ তা আর কহতব্য নয়। 

এমন সময় খট্ করে একটা আওয়াজ হল। ড্রাইভারের দিকের গেট খুলল। তারপর যা দেখলাম তাতে করে আমার আর শমীকের দুজনের চোখই আকাশে ওঠার জোগাড়। দেখলাম এক কুড়ি -বাইশ বছরের সুন্দরী, না না শুধু সুন্দরী নয় ছম্মক ছল্লু রকমের সুন্দরী পায়ে হাইহিল সু, হাঁটু অবধি পিংক কালারের স্কার্ট, চোখে রে ব্যানের সানগ্লাস গেটের সামনে গিয়ে সাইনবোর্ডের দিকে তাকাল। তারপর গটগটিয়ে ফ্যক্টরির গেট দিয়ে ঢুকে সোজা মালিক অবনীবাবুর রুমের দিকে হাঁটা লাগাল। হিন্দুস্থানী দারোয়ান প্রথমে ভ্যাবাচ্যাকা খেলেও তার বিশাল ভুঁড়ি নিয়ে পিছনে পিছনে ছুটল। আর ঠিক যখন সে  কাছে যাব যাব করছে ততক্ষণে রঙ্গিলার ঊর্মিলা অবনীবাবুর সামনে। 

টিফিনের পর সব লেবার, সুপারভাইজার সহ সব কর্মচারীকে ডাকা হল অবনীবাবুর চেম্বারে। অবনীবাবু বললেন শুনুন আপনারা। ইনি হলেন মিস মুখার্জী। লণ্ডন থেকে এম.বি.এ করে এসেছেন। আজ থেকে এই ফ্যাক্টরির মালিক।

গত সপ্তাহে আমি এই ফ্যাক্টরি ওনাকে বেঁচে দিয়েছি। উনি কথা দিয়েছেন কোন কর্মচারীকে ছাটাই করবেন না। আশাকরি আপনারা সব্বাই ভালো থাকবেন।

আমি বাবা বিশ্বকর্মাকে মনে মনে প্রণাম করে বললাম হে বাবা! মালকিনের মতো আমাদের ফ্যাক্টরির চেহারাটাও বদলে দাও। আর কৃপা করে দেখো মাসের শেষে বেতনটা যেন ঠিক মতো পাই।

Sudipta-Biswas.jpg

কবিতা

সুদীপ্ত বিশ্বাস

রানাঘাট, নদীয়া, পঃবাংলা 

কবিতাঃ সুদীপ্ত বিশ্বাস

জুন ২০২০ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

জন্ম নদীয়ার রানাঘাটে।

কবিতা লিখছেন ১৯৯২ সাল থেকে। কবির কবিতা প্রকাশিত হয়েছে  শুকতারা, নবকল্লোল, উদ্বোধন, বসুমতী, কবিসম্মেলন, চির সবুজ লেখা, তথ্যকেন্দ্র, প্রসাদ, দৃষ্টান্ত, গণশক্তি ইত্যাদি বাণিজ্যিক পত্রিকা ও অজস্র লিটিল ম্যাগাজিনে। কবিতার আবৃত্তি হয়েছে আকাশবাণী কলকাতা রেডিওতে। ঝিনুক জীবন কবির প্রথম বই। ২০১০ এ প্রকাশিত হয়। এরপর মেঘের মেয়ে, ছড়ার দেশে, পানকৌড়ির ডুব, হৃদি ছুঁয়ে যায়, Oyster Life বইগুলো এক এক করে প্রকাশিত হয়েছে। দিগন্তপ্রিয় নামে একটা পত্রিকা সম্পাদনা করেন। কবি পেশাতে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। নদিয়া জেলার রানাঘাটের বাসিন্দা। শিক্ষাগত যোগ্যতা বি ই, এম বি এ, ইউ জি সি নেট। স্বরবৃত্ত, অক্ষরবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্ত তিন ছন্দেই কবিতা লেখেন। বড়দের কবিতার পাশাপাশি ছোটদের জন্যও কবিতা লেখেন।

লক্ষ্যভ্রষ্ট

থিক আমি, পথের কাছে কথা আমার দেওয়াই আছে

ঠিক যে ভাবে ছোট্ট নদী ছুটতে-ছুটতে দারুণ বাঁচে!

মাধুকরী করেই আমি পাহাড় দেখে ঝর্ণাতলে

সেই যেখানে অরণ্য-বন ভালবাসার কথাই বলে;

সেই সে দেশে যেই না গেছি ছুটতে ছুটতে হন্যে হয়ে

নদীও দেখি দারুণ খুশি, আমার জন্যে যাচ্ছে বয়ে।

টুনটুনিটার মতই সরল, আমার হাতে রাখল সে হাত

তারপরে তো আপন হল, নদীর সে গান, জলপ্রপাত।

ছপ-ছপা-ছপ সাঁতরে শুধু ডুব-সাঁতারে, চিৎ-সাঁতারে

যাচ্ছি ডুবে উঠছি ভেসে কুল না পেয়ে সেই পাথারে।

এরপরে তো হঠাৎ করে সেই ফোয়ারা উথলে ওঠে

এমনি করেই ঝলমলিয়ে বাগানজুড়ে গোলাপ ফোটে।

গেলাম ভুলে পথের কাছে কথা আমার দেওয়াই আছে

বন্দী আমি আটকে গেছি, আটকে গেছি তোমার কাছে!


 

ভালবাসা যদি ফিরে পাই

ভালবাসা যদি ফিরে পাই

তবে তো নাচবো ভাই

তাধিন তাধিন...

 

পোড়া বিড়ি দেব ছুঁড়ে ফেলে।

ফেলে দেব তামাকের শিশি

ছেড়ে দেব সব ছাইপাঁশ

তেতো জল, বিলিতি বা দিশি।

ভালবাসা যদি ফিরে পাই

তবে তো গাইবো ভাই

গলা ছেড়ে যা আসবে মনে

বাতাসকে বলে দেব আমি কত সুখি

আকাশকে বলে দেব আমি কত সুখি

পাহাড়কে বলে দেব আমি কত সুখি

তারাদের বলে দেব আমি কত সুখি।

ভালবাসা যদি ফিরে পাই

তাহলে তো ভাই

হয়ে যাব ফুল, পাখি, নদী।

ভালবাসা ফিরে পাই যদি -

নরম পালক নিয়ে

রামধনু রঙ মেখে এসে

বয়ে যাব তির-তির,

পাহাড়ের দেশে।

ভালবাসা যদি ফিরে পাই

তবে তো বাঁচবো ভাই

সমস্ত জীবন।

প্রতিটা মুহূর্ত বেঁচে বেঁচে

প্রতিটা শরৎ বেঁচে বেঁচে

প্রতিটা বছর বেঁচে বেঁচে

প্রতিটা দশক বেঁচে বেঁচে

তবুও তো ভরবে না মন।

বলে যাব, 'বড় ছোট এ জীবন।'


ঈশ্বর কাঁদছে

পৃথিবী মারা গেছে, তার প্রাচীন খোলসে

লেগে নেই কোনো জন্মদাগ।

ধু-ধু প্রান্তরে শুধু নীরস পাথর।

নিস্তব্ধ বাজনা বাজছে ফাঁকা হাওয়ার বুকে।

একদিন নদী ছিল,পাখিদের গান ছিল,

সোনালী প্রভাত ছিল, ফুলে প্রজাপতি ছিল।

পাতায় পাতায় ছিল সবুজের ছাপ,

মানুষের ইট, কাঠ, জঙ্গলও ছিল তার বুকে।


চুপচাপ সব কিছু মুছে গেছে।

মৃত্যুর গভীর থেকে উঠে আসছে বিষাক্ত নিশ্বাস।

নক্ষত্রের ফ্যাকাশে আলোরা

শুরু করতে পারছে না নতুন কোনও গান।

প্রেতপুরীতে একলা দাঁড়িয়ে রয়েছেন ঈশ্বর।

আশেপাশে কেউ নেই যে হাত রাখবে তার কাঁধে।

ঈশ্বর কাঁদছে, তার জমাট কান্নারা সৃষ্টি করছে নতুন নদীর!


 

অভিলাষ

তুমি যখন নদী হলে

আমার চোখে আলো

সাঁতরে ভাঙি উথালপাথাল ঢেউ

অনভ্যস্ত গহীন গাঙে

আনাড়ি এই মাঝি

তুমিই জানো, আর কি জানে কেউ?

ঠিক সে সময় ঝাপুরঝুপুর

বৃষ্টি যদি নামে

আকাশ জুড়ে গলতে থাকে মেঘ

সুখ সাঁতারে শ্রান্ত আমি

ঘুমিয়ে যদি পড়ি

জানবে আমার কেটেছে উদ্বেগ।

ঘুম ঘুম ঘুম ঘুমের দেশে

স্বপ্নমাখা চোখে

দুহাত দিয়ে জাপটে ধরি নদী

বাঁচতে রাজি অযুত বছর

আলোকবর্ষ পারে

ভালবাসা, তোমায় পাই গো যদি।

সহজ তুমি সহজ হয়েই

থেক আমার পাশে

গ্রীষ্ম দিনে, দারুণ মরুঝড়ে

বুকের পাশে নরম ওমের

পালক হয়ে থেক

শীতের রাতে বরফ যদি পড়ে।
 

আগামী দিনের ধর্ম

মন দিনও আসবে যখন কোনও ধর্মই থাকবে না

মানুষ তখন গড-ভগবান কাউকে মনে রাখবে না।

মানুষ হবে মুক্তমনা বুদ্ধি জ্ঞানে দীপ্ত

ধর্ম নামের খুড়োর-কলে হবে না তাই ক্ষিপ্ত।

আগামীতে সেই মানুষই বিশ্বজুড়ে বাঁচবে

তারায়-তারায়, গ্যালাক্সিতে মনের সুখে নাচবে।

স্বপ্নমাখা ডাগর চোখে করবে মানুষ কর্ম

ধর্ম হবে মানবতা, বিবেক হবে ধর্ম।

এমন দিনও আসবে যখন কোনও ধর্মই থাকবে না

ধর্ম নামের কালো চশমা অন্ধ করে রাখবে না।

ফেরা

হমান স্রোতধারা পথ নেই, পরিচয় নেই

পাগলের মত শুধু ছুটে ছুটে মরে...

আমিও ছুটেছি কত শ্মশানে মশানে

মৃত্যুর গভীরে গিয়ে খুঁজেছি স্ফটিক!

বিষাদেরা জমে জমে হয়েছে পাথর

অন্ধকূপের গভীরে আজীবন...

আজীবন এক কূপের গভীরে

লোফালুফি করে গেছি একটা পাথর

জানি তুমি ফিরবে না

ফিরতে পারো না

তবুও তো মনে হয়,স্মৃতির গভীরে

অশ্বত্থের ডালে অবেলায়

প্রাচীন পেঁচার মত

কোনোদিন হাউমাউ ফিরে আসতে পারো...


ভাল না বাসলে

ভাল না বাসলে যাহোক তাহোক

বেঁচেই যেতাম, বেঁচেই যেতাম।

জোড়াতালি আর তাপ্পি মেরে

নুনের সাথে পান্তা খেয়ে,

চিংড়ি ইলিশ না জুটলেও

যাহোক তাহোক, বেঁচেই যেতাম ।

এখন দুপুর নীরস লাগে

সকাল বিকেল নিমের পাঁচন,

রাত্তিরেতেও ঘুম আসে না, ঘুম আসে না।

সব পেয়েছির সে দেশ ঘুরে

সর্বহারা ফকির হয়ে

ছেঁড়া মলিন হৃদয় নিয়ে

দগ্ধে দগ্ধে বাঁচার কষ্টে

ঘুম আসে না, ঘুম আসে না।

ভাল না বাসলে পাহাড়-নদী

কিংবা খুশির ঝর্ণা দেখে

ভোরবেলাতে পাখির গানে

বেঁচেই যেতাম বেঁচেই যেতাম।

এখন বড়ই একলা একা

থমকে থাকে রাত দিন সব

আর সেতারে সুর লাগে না, সুর লাগে না।

পথিক

থিক আমি আপন মনে পথ চলেছি পথের টানে,

হিসেব নিকেশ সব ভুলেছি ঝর্ণা তলে পাখির গানে।

নদীর রূপে বিভোর হয়ে কলকলিয়ে চলছি ভেসে

দীপ জ্বালিয়ে আকাশটা রোজ পাগল করে এক নিমেষে ।

নীল পরি ও লাল পরিরা,তারার দেশে- অ্যান্ড্রোমিডায়,

ফিসফিসানো হাতছানিতে রোজ এসে রোজ খোঁজ নিয়ে যায়।

সে ডাক শুনে কেউ কখনো আর কি ঘরে থাকতে পারে ?

উদাস বাউল শাপলা শালুক একলা খোঁজে নদীর পাড়ে।

অনেকটা পথ পেরিয়ে তবু, ডাগর দুচোখ স্বপ্ন মাখা;

নাম না জানা ফুলের উপর প্রজাপতির রঙিন পাখা!

মাঠের পরে মাঠ পেরিয়ে সবুজ মেখে চলছে নদী,

ছলাৎ ছলাৎ ছন্দ তুলে গান ধরেছে সপ্তপদী!

বেশ তো ছিলাম, হঠাৎ কেন বাউল বাতাস লাগল প্রাণে!

পথিক আমি আপন মনে পথ চলেছি পথের টানে...


ফেরা

মেঘ চাইতেই জল আসে না জীবন বড় শুখা

অসম্ভবও চাইনি কিছু আমি।

যা ছিল তাও হারিয়ে গেল হঠাৎ মরুঝড়ে

এখন চোখে স্বপ্নও নেই দামি।

অতীত এখন আকাশকুসুম মন খারাপের খাতা

বর্তমানও দেয়াল হয়ে খাড়া,

অন্ধকূপে বন্দী হয়ে মিথ্যে ছুটে মরি

হাজার ডেকেও পাই না কারও সাড়া।

মুখোশধারী বন্ধুরা সব ট্রিগার দিল টিপে

বন্ধুতো নয়, বন্দুক সব আজ।

স্বার্থ লোভের হিংস্র থাবায় মানুষ এখন পশু,

এখন মানুষ বড়ই ধাপ্পাবাজ।

চাইতে চাইতে পাথর হয়ে চাই না রে আর কিছু

ভুলেই গেছি চেয়েছিলাম কি যে!

ঘুরতে ঘুরতে হন্যে হয়ে আর ঘুরি না আমি

ফিরেও গেছি নিজের কাছে নিজে।


কালবেলা

মুখোশের মাঝে মুখটা হারিয়ে গেলে

মানুষে-মানুষে যবনিকা নেমে আসে,

উজানের স্রোতে অনেক সাঁতারু ছিল

অকুল পাথারে একজনও নেই পাশে।

বন্ধুর বুকে বন্ধু বসালে ছুরি,

ভাইয়ের রক্তে দুহাত রাঙালে ভাই;

মনের আগুনে প্রতিদিন পুড়ে-পুড়ে

চিতার জন্য পড়ে থাকে শুধু ছাই।

ধর্মের নামে অন্ধেরা উন্মাদ

রক্তে-রক্তে রাঙিয়ে নিচ্ছে হাত;

মৃতের মিছিলে কত অসহায় মুখ

প্রশ্ন করছে, মৃত্যুর আছে জাত?

খুনের মিছিলে এ কেমন সভ্যতা?

প্রতিবাদ? তুমি প্রতিবাদী ভাষা শেখো;

ধর্মের-কল আগুনে পুড়িয়ে দিয়ে

মানুষে-মানুষে ভালবাসা লিখে রেখো।


 

village.jpg

আজকাল

বিপদেরা চুপচাপ ওত পেতে থাকে,

নদীর প্রতিটি বাঁকে-বাঁকে।

সাবধান! সাবধান মাঝি

শ্বাপদের চেয়ে হিংস্র মানুষের কারসাজি।

মুখোশের আড়ালেতে ঢাকা সব মুখ

ঠকাতে শেখেনি যে, সে উজবুক।

আলো নেই,

চারিদিকে জমেছে আঁধার চাপচাপ

মানুষকে ভালবাসা ভুল নয়, পাপ।


 

বৃষ্টি এলে

বৃষ্টি এলে বুকের ভিতর গোলাপ কুঁড়ি ফোটে

বৃষ্টি এলে মনটা বড় উদাস হয়ে ওঠে।

বৃষ্টি এলে শিউলিতলায়, ছাতিমগাছের ডালে

মনটা বড় কেমন করে বৃষ্টি-ঝরা কালে।

এখন তুমি অনেকদূরে না জানি কোনখানে,

ভিজছো কিংবা গুনগুনিয়ে সুর তুলেছো গানে।

তোমার গানের সেই সুরটাই বৃষ্টি হয়ে এসে

টাপুরটুপুর পড়ছে ঝরে মেঘকে ভালবেসে।

মেঘ বিরহী,কান্নাটা তার বৃষ্টি হয়ে ঝরে

তোমার বুঝি মেঘ দেখলেই আমায় মনে পড়ে?


পূর্বরাগ


যেই গিয়েছি তোমায় ছুঁতে তুমি বললে, 'না-না'

তোমার ছোঁয়ায় স্বপ্নগুলো ঝটপটাল ডানা।

ফাগুন এসে আগুন দিল কৃষ্ণচূড়ার বনে,

সেই আলোতে সুখপাখিটা বাঁধল বাসা মনে।

অলস দুপুর, নিঝুম বিকেল একলা বসে আছি,

স্বপ্নগুলো বাঁধ মানে না, করছে নাচানাচি।

স্তব্ধ ? হ্যাঁ গো, স্তব্ধ হয়েই ছিলাম বছর-মাস;

পায়ের তলায় সরছে মাটি, চরম সর্বনাশ!

ডানায়-ডানায় উড়তে হবে পথ যে অনেক বাকি;

সেসব ভুলে অবুঝ আমি, বিভোর হয়ে থাকি!


কালচিত্র

দিনকে ফাঁকি দিতে পারলেও

রাতের কাছে হেরে যাই রোজ!

স্বপ্নেরা সব মুখ থুবড়ে পড়ে

চোখের জলে বালিস ভিজতে থাকে।


তারপর খুব ক্লান্ত হলে,

গভীর ঘুমে পাই মৃত্যুর স্বাদ।

সারারাত জ্বলতে-জ্বলতে

রাতের তারার সলতে ফুরিয়ে যায়।

আবার একটা দিন...

আবার ছোটা শুরু...


 

কিছু কথা

কিছু কথা না শোনাই ভাল

ভুলে যাওয়া ভাল কিছু কথা,

কিছু কথা শুধু ভেসে যায়

দাগ কাটে কিছু নিরবতা।

কিছু কথা যায় না তো ভোলা

কিছু কথা বেমালুম ভুলি,

কিছু কথা শুনে সুখ পাই

কিছু কথা বলে কান মুলি।


কিছু কথা, মানে নেই কোনও

কিছু কথা বড়ই ভাবায়,

কিছু কথা দেয় দূরে ঠেলে

কিছু কথা ডাকে, আয় আয়...


কিছু কথা, যেন পেঁজা তুলো

এদিক ওদিক যাক উড়ে,

কিছু কথা চড়ুক চিতায়

ছাই হয়ে যাক জ্বলে পুড়ে।

কিছু কথা, যাক থেমে যাক

কিছু কথা বল তুমি প্রিয়,

কিছু কথা ডাস্টবিনে রেখে

কিছু কথা বুকে তুলে নিও...


মুক্তি


গুন? হ্যাঁ গো আগুনই বেশ ভাল

আগুনেই তো পোড়ায়, করে ছাই

দুঃসহ সেই স্মৃতির দহন থেকে

মুক্তি পেতে আগুন তোকেই চাই।

একলা ঘরে ডুকরে কাঁদার পরে

বাষ্প হয়ে ওড়ে অশ্রুকণা

ভুলে যাওয়া? সেটাই বরং ভাল

ভুলে যেতে জানে গো ক’জনা?

একলা আমি একাই হাঁটতে পারি

চাইনা আমি চাইনা কারও ছায়া

একটুখানি ভুলে থাকতে গেলেই

আগুন না গো, পোড়ায় আমায় মায়া।

টুনটুনি

গল্প

জুন ২০২০ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

টুনটুনি

অপরাজিতা চিত্রলেখা ঘোষ  

বেলঘোরিয়া, কলকাতা 
 

girl1.jpg

বেশ ভোরে ঘুম ভাঙল অয়নিকার। সুশোভনের গায়ে চাদরটা টেনেটুনে দিয়ে সে দক্ষিণের জানলার সামনে এসে দেখলো ধূসর ক্যানভাসের মত আকাশ। চোখের পলক ফেলার আগেই বৃষ্টি নেমে এলো ঝমঝমিয়ে। সঙ্গে সঙ্গে অয়নিকার মাথায় হুড়মুড়িয়ে এলো চিন্তা, “এই বৃষ্টিতে টুনির মা আসবে তো!!” ভাবতে ভাবতেই ডোরবেলের আওয়াজ। অয়নিকা এগিয়ে গিয়ে আইহোলে চোখ রাখতেই হুস করে তার বুকের বোঝা নেমে গেল। দরজা খুলে হাসলো অয়নিকা, “ভাবলাম এই বৃষ্টিতে তোরা বুঝি এলিই না”। টুনির মা নয়, টুনি এসেছে। ভেতরে ঢুকে ভেজা ছাতাটা দরজার পাশে রাখতে রাখতে বললো টুনি, “ভালোই বৃষ্টি হচ্ছে গো মামী, রাস্তায় এই এতখানি জল জমে গেছে”। 
“তোর মা এলোনা আজ?”
টুনি মাথা নাড়ল, “না গো মামী, কাল সন্দে থেকে ছোট ভাইটার গায়ে জ্বর। মা কদিন আসবে না। আমায় একলাকেই এই কটাদিন সব বাড়ি কাজ সামলাতে হবে”। 

টুনির মা অনেকদিন ধরেই কাজ করছে এ বাড়িতে। প্রায় বছর ছয়েক। টুনটুনির বয়স তখন এগারো কি বারো। সাত-আট বছরের বোন আর কোলের ভাইটাকে নিয়ে টুনি রোজ আসতো মায়ের জলখাবার নিতে। ভাই-বোনকে একটা জায়গায় বসিয়ে মায়ের হাতে হাতে কাজ করে দিত। টুনির বাপ্ টা একটু কুড়ে গোছের। গায়ে গতরে খাটতে চায় না। বৌ-মেয়ে মূলত ঝি এর কাজ করেই চার-পাঁচটা পেটের খাবার যোগাড় করে। চার নম্বর লাইনের বস্তিতে একটা এক কামরার ঘুপচি ঘরে থাকে ওরা। আটশো টাকা ভাড়া। ক্যানিং এর কাছাকাছি কোনো একটা গ্রামে ওদের “দেশ”। দুটো মাটির ঘর আর একচিলতে ধানি জমি আছে সেখানে।  মাসে একবার করে চার- পাঁচ দিনের জন্য ওরা “দেশে” যায়। টুনি ওরফে টুনটুনি এখন ষোল-সতেরো বছরের তরুণী। পুঁইলতার ডগার মতন শ্যামলা, চিকন্, বাড়ন্ত। লোকের বাড়িতে এঁটো বাসন মাজলেও তার সাজপোশাকের ভারি বাহার। অয়নিকার পাশের বাড়ির যে মহিলা জামাকাপড়ের ব্যবসা করেন, টুনি তার কাছে সারা বছর পছন্দমত জামাকাপড় কেনে, ইনস্টলমেন্টে। অর্থাৎ মাসে মাসে দু-একশো করে দ্যায় আর কি। এছাড়া কাছেপিঠে এ মেলা ও মেলা সে মেলায় ঘুরে ঘুরে টিপ, কাজল, বাহারি চুড়ি তো আছেই। অয়নিকার কাছ থেকেও টুকটুক করে জামা, চুড়িদার, ছোট হয়ে যাওয়া কারুকাজ করা ব্লাউজ, ভ্যানিটি ব্যাগ ইত্যাদি উপরি পাওনা সারা বছর। টুনির এহেন শৌখিনতা অয়নিকা বেশ পছন্দ করে মনে মনে। সে নিজেও আগাগোড়া শৌখিন এবং রুচিশীল। সুশোভনও যথেষ্ট স্নেহ করে টুনিকে। চার নম্বর রেল গেট থেকে শুরু করে অয়নিকাদের পাড়া, রানীপার্ক--- যেখানে যেখানে ওদের যাতায়াত, সর্বত্র এই হাসি খুশি কাজের মেয়েটি টুনটুনি বা টুনি নামে খ্যাত। ওর আসল নাম রহিমা, রহিমা খাতুন। 

টুনটুনির কাছে একটা ভাঙাচোরা স্ক্রিন টাচ ফোন আছে। থার্ড কিংবা ফোর্থ হ্যান্ড হবে। ফোন টা কোমরে ওড়নার সঙ্গে কায়দা করে বেঁধে নিয়ে কাজে আসে ও। এসেই আগে কোনো কথা না বলে অয়নিকার চার্জারে নিজের ফোন টা চার্জএ বসায়। এটা এ বাড়িতে ওর প্রথম কাজ। তারপর কাজে হাত দ্যায়। আধ ঘণ্টা-পঁয়তাল্লিশ মিনিট চার্জ হতে না হতেই শুরু হয় টুনির ফ্যানদের ফোন, মেসেজ আসার পালা। একটা করে ফোন কিংবা মেসেজ আসে আর অমনি টুনি কাজ ফেলে ছুটে ছুটে দেখতে আসে কার ফোন বা কি মেসেজ এলো! অয়নিকার একটু আধটু বিরক্তি লাগলেও সে মুখে কিছু বলে না। টুনিকে সে সত্যিই স্নেহ করে। তাছাড়া এমন পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন বিশ্বস্ত কাজের লোক পাওয়া আজকাল যে বেশ সমস্যা তা অয়নিকা খুব ভালো করে বোঝে। তা সেই টুনি একদিন সকালে এসে বললো “মামী, আজ একটু তাড়াতাড়ি ছুটি নোবো”।
অয়নিকা জিজ্ঞাসা করলো “কেন রে? কি ব্যাপার?”
টুনি একগাল হেসে বললো “বন্ধুদের সাতে সিনিমা যাব গো মামী, শারুপ খানের বই দিয়েছে”।
অয়নিকাও হা হা করে হেসে ফেলল টুনির শাহরুখ খান উচ্চারণ শুনে। তারপর বললো “আচ্ছা যাবি’খন। তবে বিকেলের আগেই ফিরে আসিস”। অয়নিকার কথামতো বিকেল নাগাদই ফিরে এলো টুনি। খুব হাসি খুশি। অয়নিকার সঙ্গে দেখা করে বাড়ি চলে গেল। দিন পনেরো পর আবার একদিন বললো কামারহাটিতে নাকি কিছু একটা মেলা বসেছে। বন্ধুদের সঙ্গে দেখতে যাবে।
সপ্তাহখানেকের মধ্যেই আবার সেই এক গল্প। এবার বলল “মামী, তোমার একটা শাড়ি দাও না। প’রে যাব। বন্ধুর জন্মদিন আছে”।
অয়নিকা শিক্ষিতা ও আধুনিকা হলেও একটু সহজ সরল এবং স্নেহপ্রবণ। আলমারি খুলে বছর পাঁচেক আগে পুজোয় কেনা কালোর ওপর জরির কাজ করা একটা সিল্ক বের করে দিলো টুনিকে। টুনি বললো “মামী বাসন এখন মাজবো না। ফিরে এসে মাজবো। বিকেলের আগেই ফিরে আসবো”। কিন্তু এলো না। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে গেল। সন্ধ্যে পেরিয়ে রাত। তাও টুনটুনি এলো না। অয়নিকা মনে মনে ভেবে নিলো ‘হয়তো বন্ধুর বাড়ি থেকে ফিরতে দেরি হয়ে গেছে দেখে বাড়ি ফিরে গেছে। এখানে আর আসে নি’। এঁটো বাসন গামলায় যেমন ডাঁই করে রাখা ছিলো, তেমনি পড়ে রইল। সকালে টুনি এসে মাজবে-এই আশায়। পরদিন ভোর পাঁচটা নাগাদ বেল বাজলো। “উঃ! এত ভোরে আবার কে এলো!” ঘুম জড়ানো চোখে দরজা খুলতে উঠলো অয়নিকা। দরজা খুলতেই হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকে পড়লো টুনির মা। তারপর মেঝেতে ধপাস করে বসে পড়ে কান্না জুড়ে দিল। “দিদি গোওওও কাল সারারাত্তির টুনি বাড়ি ফিরে নিইইইই”। টুনির বাবা দাঁড়িয়ে ছিলো দরজার পাশে গুটিশুটি মেরে। চোখ থেকে তখনো ঘুম ছাড়েনি অয়নিকার। আগের দিন খাটুনিটাও বেশি হয়ে গেছে। প্রথমটায় বুঝতে পারলো না সে। তবে  কিছু একটা বিপদ হয়েছে আন্দাজ করে জিজ্ঞাসা করলো “কাঁদছো কেন? কি হয়েছে?”। কান্না কান্না গলায় টুনটুনির মা পুনরাবৃত্তি করলো “আমার সব্বোনাশ হয়ে গেছে দিদি গো---------" শোনা মাত্র অয়নিকাও হতভম্ব হয়ে ধপ্ করে বসে পড়ল সোফায়। প্রথমেই তার মনে এলো, ”কি হবে এখন! এতগুলো বাসন কে মাজবে?” তারপরেই মনে হলো “কোথায় গেলো টুনি! কোনো বিপদে পড়লো না তো?” টুনির ফোন নম্বর ছিলো অয়নিকার কাছে। কিন্তু যতবারই নম্বরটা টিপে কানে দিলো, ততবারই এক কথা, “সুইচড অফ”। সুশোভন সবকিছু শুনে অয়নিকাকেই দোষারোপ করে বললো “এই ঘটনাটা ঘটার জন্য তুমি কিছুটা হলেও দায়ী। তুমি মেয়েটাকে এখান ওখান ছেড়ে দিতে”। অয়নিকা অবাক হয়ে বললো “ও মা, কি কথা বলছো তুমি? ছেলেমানুষ, একটু আধটু সিনেমা দেখতে যেতে চাইলে, মেলায় যেতে চাইলে, যেতে দেব না? ওর কি কোনো শখ আহ্লাদ নেই? শুধু লোকের বাড়ি কাজ করে করেই মরবে? সুশোভন বিরক্তি নিয়ে বললো,”শখ আহ্লাদ! ভালোই শখ আহ্লাদ করতে গেছে। ঠেলা

সামলাও এবার” সারাদিনটা খুবই বাজে কাটলো অয়নিকার। কাজের লোক এর ভাবনাটা যদিও গেছে। কাল থেকে টুনির মা নিজেই আবার কাজ করবে বলেছে। কিন্তু টুনটুনির ভাবনাটা কিছুতেই মন থেকে ঝেড়ে ফেলে দিতে পারছে না অয়নিকা। ফোনটা এলো রাত সাড়ে ন’টার সময়। অয়নিকা তখন মুখ ব্যাজার করে রুটি করছে। ফোনে রিং টোনএর শব্দ পেয়ে গ্যাস জ্বালিয়েই চলে এলো অয়নিকা ফোনটা ধরতে। অচেনা নম্বর। অয়নিকা ফোনটা রিসিভ করে হ্যালো বলতেই ওপার থেকে ভেসে এলো “হ্যালো মামী, আমি বিয়ে করেছি। মাকে বোলো আমি ভালো আছি। আমার জন্যে চিন্তা না করতে। আমার বর আমাকে খুব ভালবাসে”।
অয়নিকা শুধু জিজ্ঞাসা করলো, “কোথায় আছিস তুই?”।
টুনি বললো, “জায়গাটা চিনতে পারছি না। তবে কিষ্ণনগরের কাছাকাছি কোথাও হবে। কিষ্ণনগর লোকালএ এসেছি।“ তারপর বললো “ফোনে চার্জ কম। তোমার সঙ্গে পরে কথা বলবো। এখন রাখছি”। অয়নিকা আর কিছু বলার আগেই ফোনটা কেটে গেল। তারপরের দিন টুনি আবার ফোন করলো। এবার জানালো, সে একটা হিন্দুদের ছেলেকে বিয়ে করেছে। সিঁথিতে সিঁদুর পরেছে। হাতে শাঁখা পলা। মামীর কালো শাড়িটা পরে ওকে এত ভালো দেখতে লাগছিল যে সব্বাই বৌ দেখে খুব প্রসংশা করেছে।
অয়নিকার জিজ্ঞাসা করলো “ওখানে সবাই জানে তোর পরিচয়?”
টুনি বললো, “না এখানে সবাই আমাকে মীনা বলে ডাকে। বর ছাড়া আর কেউ জানে না যে আমি মুসলমান”।
অয়নিকার বুকের ভেতরে ভাললাগার সুশীতল বাতাস বয়ে গেল। মানুষে মানুষে ভালবাসার কাছে কত তুচ্ছ জাত-ধর্মের বিভেদ। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে অয়নিকা জানতে চাইল, “তোর বর কি করে?” টুনি জানালো ওখানেই কোনো একটা ছোটখাটো মিষ্টির দোকানে কাজ করে। তারপর থেকে দুদিন কাটলো, তিনদিন কাটলো, চারদিন কাটলো, টুনি আর ফোন করলো না। দৈনন্দিন জীবন প্রবাহে আস্তে আস্তে কমে এলো টুনির চর্চা। তবে অয়নিকার খাটুনি এখন একটু বেশি, টুনির অভাবে। টুনির মা একবেলা এসে শুধু বাসনটা মেজে দিয়ে যায়। অয়নিকা গুণে দ্যাখে প্রায় একমাস হতে চললো টুনি গেছে। যাক্ বাবা, বিয়ে করেই ফেলেছে যখন, যেখানেই থাক্ ভালো থাক্। অয়নিকা মনে মনে আশীর্বাদ করে। কিন্তু বিধাতা বোধহয় অন্য কিছু লিখে রেখেছিলেন টুনির কপালে। একমাস চারদিনের মাথায় ফিরে এলো টুনি। সিঁথির সিঁদুর মুছে, হাতের শাঁখা-পলা খুলে। টুনির শ্বশুরবাড়ির লোকজন ও পাড়ার লোকজন যেভাবেই হোক জানতে পেরে গিয়েছিল, টুনি হিন্দু নয়, মুসলমানের মেয়ে। অথচ ও বাড়িতে রাধা-কৃষ্ণের মূর্তি আছে, আর টুনি সেখানে রোজ সন্ধ্যে প্রদীপ জ্বালায়। একদিন গ্রামের  প্রধান বেশ কিছু লোকজন নিয়ে হাজির হলেন টুনিদের বাড়ি। বললেন টুনির বর যদি টুনিকে না পরিত্যাগ করে, তাহলে সে ঐ পরিবার, প্রতিবেশী বা আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে পারবে না। ঐ বাড়ি এবং ওদের সম্পত্তি থেকে তাকে বঞ্চিত করা হবে। এছাড়াও ওরা ঐ গ্রামেই থাকতে পারবে না এবং জীবনে কোনোদিন ঐ গ্রামের ত্রিসীমানায় আসতে পারবে না। পাড়ার লোক এবং পঞ্চায়েত স্পষ্ট জানিয়ে দিলো যে টুনিকে রাখলে ওদের পরিবারকেও একঘরে করা হবে। ফোন করে ওরা ডেকে পাঠালো টুনির বাবা মাকে। টুনির বাবা মা পৌঁছলে, টুনিকে উঠোনে দাঁড় করিয়ে গ্রামসুদ্ধু লোকের সামনে টুনির বর টুনির মাথায় এক বালতি জল ঢেলে সিঁদুর ধুয়ে  দিলো। খুলে নিলো টুনির হাতের শাঁখা পলা। টুনি কাঁদলো না। দাঁড়িয়ে রইলো পাথরের মতো। তারপর ভিজে কাপড়টা ছেড়ে একটা শুকনো কাপড় পরে বেরিয়ে এলো বাড়ি থেকে। টুনি আবার ফিরে এলো তার মায়ের সংসারে। পরের দিন থেকে আবারও লেগে গেল পরের বাড়ির কাজে, বাসন মাজা, কাপড় কাচা, ঘর মোছা ----

টুনটুনি অনেক বদলে গেছে। অয়নিকা ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলো, টুনটু্নির মধ্যে সেই চেনা টুনটুনিটা আর নেই। কাজ করছে অথচ কোনো কাজে মন নেই। সবসময় অন্যমনস্ক। বাসন মাজলে বাসনে এঁটো লেগে থাকে। ঘর মোছে, যেখানকার নোংরা সেখানেই পড়ে থাকে। মা ডাকছে, ও বসে আছে তো বসেই আছে। উঠতে বসতে ওর মা গালিগালাজ শাপশাপান্ত করে চলেছে। টুনি যেন শুনেও শুনছে না। অয়নিকা কিছু বলে না। মনে মনে ভাবে, কটা দিন যাক, আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। তবে বেশিদিন কাটলো না। পঁচিশ-ছাব্বিশ দিনের মাথায় টুনি আবার পালিয়ে গেল। পরের দিন ওর মা কাজ করতে এসে জানালো, এবার টুনি যার সঙ্গে গেছে সেই ছেলেটা নাকি ওর আগের বরেরই বন্ধু। তবে তার থেকে বয়সে অনেকটা বড়। সে টুনিকে কথা দিয়েছে বিয়ে করবে। টুনটুনির মা এবার আর কোনো কান্নাকাটি করলো না। অয়নিকাও সেরকম কোনো দুঃখ পেল না। বরং সেদিন সন্ধ্যেবেলা চা খেতে খেতে সুশোভনের সঙ্গে টুনটুনি প্রসঙ্গ আলোচনার সময় মন্তব্য করলো, “মেয়েটার স্বভাবটাই খারাপ হয়ে গেছে”।

টুনটুনি বসে আছে কাঁচরাপাড়া স্টেশনে। তিন দিন আগে সে পালিয়ে এসেছে বাবুরাম এর সঙ্গে। আজ ওদের বিয়ে করার কথা। টুনিকে স্টেশন এ একটা ফাঁকা জায়গায় বসিয়ে খাবার কিনতে গেছে বাবুরাম। তা সে গেছে তো গেছে। টুনি বসে অপেক্ষা করছে টানা তিন চার ঘণ্টা। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল। তাও বাবুরামের পাত্তা নেই। টুনির খুব কান্না পাচ্ছে তবু সে জোর করে কান্না চেপে রেখেছে। কোথায় যাবে এখন সে! এ পথ তো সে নিজেই বেছে নিয়েছে। শীতের বেলা। সন্ধ্যে নেমে আসছে ঝপ করে। প্রায় সন্ধ্যের মুখে টুনটুনির সামনে এসে দাঁড়ালো একটা কালো মত ষণ্ডামার্কা ছেলে। পানের কালচে ছোপ ধরা দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বললো, “আমাকে বাবুরাম পাঠিয়েচে তোমায় নিয়ে যেতে। এখন থেকে তুমি আমার কাচে থাকবে। বাবুরাম পরে এসে তোমাকে নিয়ে যাবে”। টুনি অনুভব করলো খুব তাড়াতাড়ি অন্ধকার নেমে আসছে তার চারপাশে। তার খুব শীত শীত লাগছিলো। শরীরে মনে কোথাও তার আর এতটুকু শক্তি নেই। সে হাত বাড়িয়ে ষণ্ডামার্কার একটা হাত ধরলো তারপর যন্ত্রের মত তার সঙ্গে হাঁটতে শুরু করলো। কয়েক পা হেঁটে একটা এঁদো গলির মুখে একটা নোংরা হতশ্রী এক কামরার ঘরে এসে ঢুকলো। ষণ্ডামার্কার সঙ্গে টুনি থাকলো আট দশ দিন। ষণ্ডামার্কার শখ মিটতে সে টুনিকে নিয়ে গেলো একদিন মোতি মিঞার কাছে। মোতি মিঞার জহুরির চোখ। টুনটুনিকে দেখে সে বললো, “বয়সটা অল্প, জৌলুসও আছে। রোজগার পাতি ভালোই হবে, কি বলিস?” মোতি মিঞার কথায় ষণ্ডামার্কা হেসে উঠলো খ্যাকখ্যাক করে। মোতি মিঞা নিজের কাছে টুনিকে তিনদিন রেখে চার দিনের দিন তুলে দিলো সৌদি আরব গামী জাহাজে। ভোর চারটেয় ছাড়লো জাহাজ। শীতের ভোর তখনো ঘুম ভাঙায়নি সূর্যের। টুনটুনির পরিশ্রম ক্লান্ত মা তখনো ওঠেনি ঘুম থেকে। বেলঘরিয়ার বাড়িতে সুশোভন আর অয়নিকাও তখন ঘুমোচ্ছে অঘোরে।     

করোনা

প্রবন্ধ

জুন ২০২০ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

AG image (2).jpg

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে করোনা ভাইরাস

অরুন্ধতী ঘোষ

পিটস্‌বার্গ, ইউ এস এ

800px-SARS-CoV-2_without_background.png

ডাঃ এন্টনি ফাউচি (ন্যাসন্যাল ইন্সটিটিউট অফ আলার্জী ও ইনফেক্‌সাস্‌ ডিসিস্‌ এর ডিরেক্টার) দেশের সরকারকে সাবধান করে দিয়েছিলেন প্রথমেই। সবকিছু বন্ধ করে দিয়ে এই রোগের সংক্রমণ রোধ করতে বলেছিলেন। অবশেষে সরকার বাধ্য হয় লকডাউন ঘোষনা করতে। প্রেস মিটিং করে ওয়াইট হাউস থেকে সোস্যাল ডিস্‌ট্যান্সিং এর কথা বলা হয়। জনসাধারণকে সাবধান করে দেওয়া হয় বারংবার। ইতিমধ্যে সব স্কুল কলেজ বন্ধ হতে শুরু করেছে মার্চ মাসের প্রথমে।

 

০১৯ এর ডিসেম্বর মাসে চিনের হুবেই প্রভিন্সের উহান শহরে কিছু লোক অসুস্থ হয়ে পড়ে এক বিশেষ ধরণের নিউমোনিয়ায়। অনেকের তখন প্রায় প্রাণসংশয়। ঘটনাটি বিশেষভাবে দেখতে সরকারী চিকিৎসক ও নার্সের দল উহানে এসে পৌছায়।। তারা সবকিছু দেখে মতামত জানায় যে এক বিশেষ ধরণের ভাইরাসের সংক্রমণ এই রোগের কারণ এবং এটি বেশ ছোঁয়াচে। এই খবরটি চিন সরকার তখনকার মতো চেপে দিয়ে এই ভাইরাসটি নিয়ে গবেষণা শুরু করে দেয় জোরকদমে। এদিকে ততদিনে আরো অনেকের এই অসুখটি ধরা পড়েছে। স্থানীয় হাসপাতালে অনেক লোক ভর্তি হয়েছে, কিছু লোকের প্রায় মরণাপন্ন অবস্থা। এর কারণ হল এই ভাইরাসের আক্রমণে প্রথমে শরীরে ফ্লু -এর মতো অসুস্থতা হয়, ক্রমে ফুসফুস আক্রান্ত হয় এবং নিউমোনিয়া দেখা দেয়। নিউমোনিয়া যখন ধরা পড়ে তখন রোগীর শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে গেছে, ভেন্টিলেটার ছাড়া নিঃশ্বাস নেওয়া প্রায় অসম্ভব। এই অবস্থা থেকে কিছু রোগী সুস্থ হয়ে ফিরে আসেন, আর কিছু মারা যান। এই ফেরা নির্ভর করছে রোগীর শরীরে প্রতিরক্ষার ক্ষমতার ওপরে। এবার প্রশ্ন হল এই ভাইরাসটি এল কোথা থেকে? চিন সরকারের গবেষণা থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী এটি একটি নতুন করোনাভাইরাস, এসেছে প্রথমে বাদুরের থেকে সম্ভবতঃ প্যাঙ্গোলিন জাতীয় প্রাণীর শরীরে এবং সেখান থেকে মানুষের শরীরে। বাদুর এবং প্যাঙ্গোলিনের সংগে মানুষের বিশেষ যোগাযোগ নেই। এদের কোনোটিই গৃহপালিত পশু নয়।  উহানে কিছু বাজার আছে যেখানে নানান ধরণের জংলি প্রাণী বিক্রী হয়। এখানে নিষিদ্ধ প্যাঙ্গোলিন বিক্রি হয় কারণ প্যাঙ্গোলিনের গায়ের আঁশ ব্যাবহার হয় চৈনিক ওষুধে। সেখান থেকে মানুষের শরীরে এসেছে। তবে এত তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে পড়ল কিভাবে? সেই সময়ে ছিল চিনের নতুন বছরের উৎসব। প্রচুর লোক বেরিয়েছিল আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করতে বিভিন্ন অঞ্চলে। উহানেও প্রচুর লোক এসেছিল এবং উহান থেকেও লোকজন বেরিয়েছিল নতুন বছরের উৎসবে। এইভাবেই সংক্রমন ঘটেছে চিনের অন্যান্য অঞ্চলে। এরপর ১৫ই জানুয়ারী চিন সরকার উহান পুরোপুরি বন্ধ করে দিল সংক্রমণ বন্ধ করার জন্য। এর মানে বাইরের জগতের সঙ্গে উহানের আর কোনো যোগাযোগ রইল না কিন্তু তার আগেই ভাইরাস নানান মানুষের শরীরে আশ্রয় নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে চিন থেকে হংকং, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর, ইটালী প্রভৃতি জায়গায়। ততদিনে তার নাম হয়েছে সার্স-কোভ ২। এটি সার্স ও মার্স ভাইরাসের আত্মীয় এবং ছোঁয়াচে। মানুষের শরীরে ভর করে ভাইরাসটি চলে এল মার্কিন যুক্ত্ররাষ্টে। দোশরা ফেব্রুয়ারী বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সার্স-কোভ ২ ভাইরাসের আক্রমণে হওয়া এই রোগটির নামকরণ নামকরণ করলেন কোভিড -১৯। প্রথমে বিশেষ পাত্তা না দিলেও অবশেষে এদেশের সরকার ব্যাপারটার গুরুত্ব বুঝে বিশেষ ব্যাবস্থা নিতে বাধ্য হলেন। কিন্তু এদেশ ঠিক এই ধরণের ছোঁয়াচে অসুখের সঙ্গে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত ছিল না। তবে পরিস্থিতির প্রভাবে আস্তে আস্তে নিজেকে মানিয়ে নিচ্ছে। আপাততঃ এদেশে এই ভাইরাসে আক্রান্ত লোকের সংখ্যা প্রায় ১৭ লক্ষের ওপর এবং ১ লক্ষ লোকের মৃত্যু হয়েছে। অনেকে সেরে উঠেছেন। সারা পৃথিবীতে প্রায় ৫৬ লক্ষ লোক আক্রান্ত হয়েছে এবং প্রায় ৩ লক্ষ লোক মৃত। এবার এদেশে এই অসুখ মানুষের জীবনে কিরকম প্রভাব ফেলেছে সেই আলোচনায় আসি।

আগেই বলাছি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তুত ছিলনা এই রকম মারাত্মক ছোঁয়াচে রোগের সঙ্গে যুঝতে। শুধু এদেশ কেন, কোনো দেশই প্রস্তুত থাকে না এই রকম সংক্রামক রোগের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য। যত রোগীর সংখ্যা বাড়তে লাগল, শুরু হয়ে গেল নানান জিনিসের অভাব। হাসপাতালে যথেষ্ট পরিমানে সার্জিক্যাল মাস্ক নেই, গ্লাভ্‌স নেই, গাউন নেই রেস্পিরেটার নেই। আর জনসাধারণের এই রোগের সঙ্গে যুঝবার জন্য হাত পরিস্কারের স্যানিটাইজার, হাত ধোবার তরল সাবান (অ্যান্টি- ব্যাকটেরিয়াল) নেই দোকানে, মাস্ক ও গ্লাভ্‌স তো ছেড়েই দিলাম। সার্জিক্যাল মাস্ক আসে চিন থেকে এবং সেখান থেকে আমদানী বন্ধ। এদেশে অবশ্য থ্রী এম কম্পানী মাস্ক বানাচ্ছে। তবে প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয়। এখন চেষ্টা চলছে অন্য দেশ থেকে মাস্ক বানিয়ে আনবার জন্য। হাসপাতাল কর্মীরা কোনোরকমে প্রাণ হাতে করে কাজ করছেন। এছাড়াও প্রয়োজন শরীরে এই ভাইরাস আছে কিনা দেখার জন্য পরীক্ষা করবার টেষ্ট। যখন চাহিদা বাড়বে, তখন টেষ্ট কিট প্রয়োজন অনুযায়ী থাকতে হবে। প্রথম এইরকম করোনা টেষ্ট কিট তৈরী করে সেন্টার ফর ডিসিস্‌ কন্ট্রোল (সি ডি সি), কিন্তু প্রয়োজন অনুযায়ী সাপ্লাই দিতে না পারায় অবশেষে প্রাইভেট কম্পানী এগিয়ে আসে।প্রথম দুটি প্রাইভেট কম্পানীর তৈরী টেষ্ট কিট ১) ল্যাবরেটরী করপোরেশন অফ আমেরিকা (ল্যাবকরপ), নাম কোভিড-১৯ আর টি- পি সি আর কিট; ২) থার্মো ফিসার, নাম ট্যাক পাথ কোভিড-১৯ কম্বো কিট। দুটিকেই এখানকার খাদ্য ও ওষুধ সংস্থা (এফ ডি এ) অনুমোদন করেছে। এছাড়াও চলেছে যারা আক্রান্ত হয়েছে তাদের শরীরে অ্যান্টিবডি মাপার জন্য টেষ্ট-কিট তৈরী করার প্রচেষ্টা। কিছু বেরিয়েছে, আরো তৈরী করার প্রচেষ্টা চলছে। অনেকেই হয়ত কোভিডে আক্রান্ত হয়েছেন, কিন্তু অল্পদিনের মধ্যে সেরে উঠেছেন এবং জানেন না যে তাদের এই অসুখটি হয়েছে। এটি টেষ্টটি করলে এই অসুখের জন্য শরীরে কি রকম প্রতিরক্ষা তৈরী হয় সে সম্বন্ধে জানা যাবে। এবার আসি কোভিডের ওষুধের কথায়। ভ্যাকসিন বা প্রতিষেধক হল শেষ কথা। এদেশে এবং সারা বিশ্বে অনেক বায়োটেক কম্পানী প্রতিষেধক তৈরী করার জোরদার চেষ্টা চালিয়ে

যাচ্ছেন। শুধু তৈরী নয়, তার সঙ্গে রয়েছে মানুষের ওপর প্রয়োগ করে এর উপযোগিতা দেখা, কাজ করলে সারা বিশ্বের মানুষের জন্য বানানো এবং যোগান দেওয়া। মনে হয় এই একটা ব্যাপারে সারা বিশ্বের বৈজ্ঞানিকরা একত্র হয়ে কাজ করবেন। আপাততঃ প্রতিষেধকের বদলে অন্য কিছু ওষুধ ব্যবহার হচ্ছে। ১) ক্লোরোকুইন ও হাইড্রক্সি ক্লোরোকুইন। ম্যালেরিয়ার চিকিৎসায় ব্যাবহৃত এই ওষুধ কিন্তু অন্য গুণ আছে। এটি ব্যাবহৃত হয় একটি বিশেষ ধরণের বাতের (রিউমাটয়েড আর্থারাইটিস) ওষুধ হিসেবে। আবার দেখা গেছে কোভিডে আক্রান্ত রোগীদের শ্বাসকষ্ট কিছুটা কমে এই ওষুধে। তবে দীর্ঘদিন ব্যাবহার করা যাবে না। ২) রাইবাভিরিন ইনজেক্সন, এটি সাধারণতঃ ফুসফুসের ভাইরাসের সংক্রমণ হলে ব্যাবহৃত হয়। ৩) রিটোনাভির, এই ওষুধটি ব্যাবহৃত হয় এইচ আই ভি ভাইরাসের সংক্রমণ হলে। দেখা গেছে এডস্‌ পেশেন্টদের নানাবিধ অসুখের একটু প্রশমন হয়। ৪) রেমডেসিভির ইনজেক্সন, এটি শ্বাসনালী ও ফুসফুস সংক্রমনকারী ভাইরাসের প্রশমনে ব্যাবহার হয়। দেখা গেছে এই ওষুধ ব্যাবহারের ১০ দিনের মধ্যে কোভিড-১৯ রোগীদের অবস্থার একটু উন্নতি হয়।এই চারটি ওষুধ এখন পরীক্ষামূলক ভাবে ব্যাবহার করা হচ্ছে কোভিড রোগীদের তাদের উপসর্গ একটু কমানোর জন্য। সাধারণ মানুষের এই ওষুধ ব্যাবহার করা উচিত নয় ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া। কারণ এদের নিরাপত্তা সন্দেহাতীত নয়।

ডাঃ এন্টনি ফাউচি (ন্যাসন্যাল ইন্সটিটিউট অফ আলার্জী ও ইনফেক্‌সাস্‌ ডিসিস্‌ এর ডিরেক্টার) দেশের সরকারকে সাবধান করে দিয়েছিলেন প্রথমেই। সবকিছু বন্ধ করে দিয়ে এই রোগের সংক্রমন রোধ করতে বলেছিলেন। অবশেষে সরকার বাধ্য হয় লকডাউন ঘোষনা করতে। প্রেস মিটিং করে ওয়াইট হাউস থেকে সোস্যাল ডিস্‌ট্যান্সিং এর কথা বলা হয়। জনসাধারণকে সাবধান করে দেওয়া হয় বারংবার। ইতিমধ্যে সব স্কুল কলেজ বন্ধ হতে শুরু করেছে মার্চ মাসের প্রথমে। সব শিক্ষাকেন্দ্র অন্‌লাইন শিক্ষার ব্যাবস্থা শুরু করল। সবই চলতে লাগল। কিন্তু ক্ষতি হতে লাগল ছোটো ব্যবসাগুলির। তাদের ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেল। অনেক লোকের চাকরী চলে গেল, কারণ কম্পানী ক্ষতিতে চলছে। প্লেন বন্ধ, কাজেই এয়ারলাইনগুলিও ক্ষতিতে চলছে। তারাও লোক ছাটাই করতে শুরু করল। যারা দৈনিক কাজের ভিত্তিতে রোজকার করে, তাদের রুজি-রোজকার বন্ধ। এখন পর্যন্ত ৩০ লক্ষ লোকের চাকরী নেই।

জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে তেলের দাম ভীষণ কমে গেছে। সারা বিশ্বেই জ্বালানীর প্রয়োজনীয়তা সাময়িকভাবে কমে গেছে। রিফাইন্যারীগুলি পেট্রোলিয়াম থেকে গ্যাসোলিন, ডিসেল ও অন্যান্য জিনিষ তৈরী করতে চাইছে না কারণ খুব কম লোক বেরোচ্ছে বাড়ি থেকে। বড় বড় কম্পানীর স্টকের দাম পড়ে গেছে। সবদিকেই ক্ষতি। সরকার থেকে চাকরী হারা ও ছোট ব্যাবসায়ীদের ব্যাবসার জন্য সাময়িক অর্থ অনুমোদন হয়েছে। এতে বেশ কিছু মানুষের উপকার হবে।

নার্সিংহোমগুলির খারাপ অবস্থা। এখানে বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা থাকেন যাদের একা থাকা সম্ভব নয়। এদের বিশেষভাবে সাবধানে থেকে প্রয়োজন কারণ বয়স হলে শরীরে প্রতিরক্ষা ক্ষমতা কমে যায়। এদের সঙ্গে বাইরের লোক (মানে আত্মীয়-পরিজন) দেখা করতে আসতে পারছেন না। কাজেই এদের মানসিক অবস্থার অবনতি ঘটছে। এদের জন্য অন্য ব্যবস্থা নিতে হচ্ছে। নতুন রেসিডেন্ট আসা বন্ধ হয়ে গেছে, তাই ব্যবসার ক্ষতি হচ্ছে।

এবার আসি এদেশের সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের কথায়। সামাজিক দূরত্ব এক নতুন অভিজ্ঞতা। তবে এর ফলে মানুষের বন্ধুদের সঙ্গে, আত্মীয়-পরিজনদের সঙ্গে কথা বলা বেড়ে গেছে, ফোনের মাধ্যমে। অনেকে ভিডিও কল করে দেশে বিদেশে পরিচিত মানুষদের সঙ্গে কথা বলছেন। বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলছেন। প্রতিবেশীরা দূরে দাঁড়িয়ে একে অপরের খবরাখবর নিচ্ছেন। যে সব কাজ সচরাচর দৈনন্দিন জীবনে করা হয়ে ওঠে না, সেগুলি করছে মানুষ। সোস্যাল মিডিয়ায় যাওয়া মানুষের বেড়ে গেছে। কোভিডে আক্রান্ত মানুষের পরিবারকে মনে ভরসা দেবার জন্য, তাদের প্রিয়জনকে সাময়িকভাবে ও চিরকালের মতো না দেখতে পাবার মানসিক বেদনার উপসমের জন্য অনেক সংস্থা জুম ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে নানা ধরনের বিশেষজ্ঞকে এনে আলোচনার ব্যাবস্থা করেছে, মানুষের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে সোস্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে। এটা আমার মনে হয় খুব ভালো উদ্যোগ কারণ কারো পরিবারের কেউ কোভিডে মারা গেলে, তার শরীর আত্মীয়স্বজন পাবে না শেষকৃত্যের জন্য। অনেকে নানাভাবে ফান্ড রেজিং করছেন কোভিড পেসেন্টদের জন্য বা গরীব মানুষদের জন্য। কেউ গানের অনুষ্ঠান করছেন দেশে-বিদেশের শিল্পীদের দিয়ে, আবার কোনো কোনো সংস্থা আধ্যাত্মিক লেকচারের ব্যাবস্থা করেছেন ভিডিও কনফারেন্স এর মাধ্যমে। এত কিছুর মধ্যে একটি কম্পানী লাভের মুখ দেখেছে।

নেটফ্লিক্স দেখা মানুষের বেড়ে গেছে। জানুয়ারি-মার্চ মাসে প্রায় ৮৭ লক্ষ লোক নেটফ্লিক্স নিয়েছেন (সাব্‌স্ক্রাইব করেছেন)। আরেকটি চিন্তার বিষয় হল অনেক লোক দেশের বাইরে গিয়ে আর ফিরতে পারছেন না, কারণ ফেরার উপায় নেই। আশা করা যায় লক ডাউন উঠে গেলে তারা এদেশে ফিরতে পারবেন। এদেশ থেকে বিশেষ প্লেনের ব্যাবস্থা করে নাগরিকদের নিয়ে আসার ব্যাবস্থা হয়েছে। বেশ কিছু মানুষ ফিরে এসেছেন। কিন্তু আরো অনেক মানুষ এখনো আটকে আছেন। তাদেরও অনেক ক্ষতি হয়েছে এবং হচ্ছে।  

কিছু কথা লিখলাম কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্বন্ধে। হয়ত কিছু কথা না বলা রয়ে গেল। ব্যাপারটা দুঃখের হলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আবার সারা পৃথিবীর মানুষ এক বিপর্যয়ের সন্মুখিন যার এখনো পর্যন্ত কোন সমাধান নেই। এদিকে ক্ষতির পরিমান বেড়েই চলেছে। আশা করা যায় আর বছর খানেকের মধ্যে অনেকে প্রতিষেধক নিয়ে সুস্থ থাকবেন, অনেকে এই অসুখ থেকে শরীরে নিজের প্রতিরক্ষা নিজেই গড়ে তুলবেন। এই সময়ের মধ্যে আমরা হারাবো আরো বেশ কিছু মানুষকে। আশা করি এই ঘটনা মানুষকে নতুন করে ভাবনা-চিন্তা করতে শেখাবে। মানুষের চাহিদা কমে যাবে। বেঁচে থাকার জন্য মানুষ নিজেকে ধন্যবাদ দেবে।

জুন ২০২০ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

মতামত

Please mention the "name of the article and the author" you would like to comment in the following box... Thank you.

bottom of page