জুলাই
২০২৪
প্রচ্ছদঃ সুরজিত সিনহা
লেখক/লেখিকাবৃন্দ
প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা
গল্প
পিসেমশাই বাবাকে বললে "না, না, পিন্টুদা কত কি জানার কত কি বোঝার আছে বিয়ে না করলে জানতেই পারতাম না"। বাবা মুচকি হেসে বললে "কি কি জানলে?"
- "খুব সিম্পল, যে আমি কিছুই জানিনা সেটাই তো জানতাম না। মাথায় গোবর পোড়া। মা আমাদের ঠিকমত মানুষই করেনি। এমন কি জানো দাঁত মাজা ও নাকি শেখায় নি।" বলতে বলতে গলা ভারী হয়ে আসে পিসেমশাইর।
বাবা মুখে অসাংবিধানিক কথা বলে না। বেকায়দায় পড়লে আছি অথচ নেই টাইপ হাসি দিয়ে ম্যানেজ করে। বাবা সেরকম ই হাসি দিলে ঠোঁট চেপে।
মেজকা ঘরে ঢুকেই ক্যাঁচটা লুফে নিল।
- "ঠিক বলেছ সুভাষ। আমরা কেউই মানুষ হইনি। কোন এটিকেট সেন্স নেই। শব্দ করে চা খাই, বোতল থেকে গলায় ঢেলে ধক ধক করে জল খাই। কচ কচ করে গাজর চিবিয়ে খাই। জোরে জোরে কথা বলি। লুঙ্গি পড়ি বাড়িতে। পুরো প্রিমিটিভ ব্যাপার স্যাপার। কোনো ব্যাটা সভ্য এটা করে না। সব অসভ্য ব্যাটা চাকরি, ব্যবসা করে খাচ্ছে। দেশের উন্নতি করছে।
পিসেমশাই চারিদিক তাকিয়ে গলা নামিয়ে প্রায় ফিসফিস করে বললে "সভ্য হল বউ। উনি যা যা করেন সেটাই সভ্যতা। বাকি সব বুঝতেই পারছেন।
মা চা নিয়ে ঢুকে দাড়িয়ে পিসেমশাই এর কথা শুনে ফেলেছে। চা এর ট্রেটা রেখে মা হাসতে হাসতে বললে "দাড়ান, ছোড়দি কে বলছি"।
পিসেমশাই ভীতু মানুষ। মুখ কাঁচুমাচু হয়ে গেল "এই দেখো বৌদি, আমি তো ইয়ার্কি করছিলাম।"
বাবা, মেজকা ঘর কাঁপিয়ে হাসতে লাগল। বাবা বললে
- "সুভাষ ভয় পেয়েছে। তোমার নামের সঙ্গে ভয় কিন্তু মানায় না"। পিসেমশাই প্রথম একটু হাসব কি হাসব না ভেবে তারপর সবার সাথে মিলে হাসতে থাকলে।
রবিবারের সকালবেলা ছোট পিসি আর পিসে মশাই চলে এসেছে। আমাদের বসার ঘর জমজমাট। পিশেমশাই এমন মানুষ যে এলে বেশ একটা হালকা হাসির হাওয়া বয়ে যায়। ছোট বড় সবার সঙ্গেই সমান আড্ডা চালাতে পারে। একটা সহজিয়া ব্যাপার আছে পিসেমশাইয়ের মধ্যে। মা, মেজ কাকিমা খুব পছন্দ করে পিসেমশাইকে। গোবেচারা সরকারি অফিসে চাকরি করে। বাবা যে বাবা সে ও দুচার বার মুচকি মুচকি হেসে ফেলে। প্রশ্রয় ও আছে তাতে, মজাও আছে তাতে।
মেজ কাকা এই ব্যাপারে বেশ মজা পেয়ে বললে "দাদা থাকলে হয়ত কেনিয়া বা ঘানার পুরুষরা কি ভাবে বিয়ের পর নিজেকে নতুন করে জানত সেটা জানা হত"।
বাবা বললে "কি আর করা, দাদার মিশন স্কুলের গরমের ছুটি অনেক দেরী"।
আজ ছুটির দিন। ঠাকুমা তার ভাইয়ের বাড়ি গেছে দুপুরের পর ফিরবে তাই মুরগির মাংস হবে বাবা ডিক্লেয়ার করে দিয়েছে গতকাল রাত্রেই। ছোট পিসি খুব মুরগি ভালো বাসে।
চা খেতে খেতে মেজকা ঘোষণা করে দিলে আজ উনি ওনার শিল্প কর্ম দেখাবেন। আমি শিউরে আছি। কি হয়, কি হয়। পিসেমশাই একবার আবদার তুলে ছিল উনি নাকি দারুন একটা চিকেনের পদ শিখেছেন আজ রেঁধে তাক লাগিয়ে দেবেন। মেজকা ঠাকুমার অনুপস্থিতির সুযোগ ছাড়তে নারাজ। কাকিমাকে হুকুম করলে আমার রান্না করার ড্রেস টা নিয়ে এস।
কাকিমা চোখ গুল্লু গুল্লু করে বললে "কেন? ওটা কিসের জন্যে লাগবে? তুমি আবার নাটক করবে নাকি? ওটা তো তোমার নাটকের ড্রেস ছিল। তাহলে তো আমাদের দুপুরের খাওয়া আর হলো না"।
মেজকা বললে "উঁহু, আজ আসল রান্না হবে। ওটা নাহলে চলবে না। যে কাজ করব সেটাই সুন্দর করে করা চাই। মা এই সুযোগে বলে দিয়েছে "যা খুশি কর। কিন্তু রান্না হলে রান্না ঘরের সব কিছু গুছিয়ে, ধুয়ে রাখতে হবে। যেমন তেমন ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখলে চলবে না। তাহলে কাল রান্না করতে গিয়ে আমাদের কাল ঘাম ছুটে যাবে।
সে যাই হোক। মেজকা একটা জম্পেশ তেলে ঝোলে মাখা মাখা কালো ব্রাউন একটা কিছু রান্না করেছে। মা জিজ্ঞাসা করলে "কি আইটেম করলে ঝন্টু?"
খুঁন্তি নাড়তে নাড়তে উত্তর এল "চিকেন ঝিনচাক"
- "এ্যাঁ, কি বললে? মার হেঁচকি ওঠার মত অবস্থা।
- "চিকেনের ধিন তাক? একি তবলার বোল নাকি?"
- "বৌদি? মেজকা হতাশ। এটা হচ্ছে চিকেন ঝিন চাক"।
বাবা ও কেমন নার্ভাস হয়ে গেল "খাওয়া যাবে তো"?
একটু নুন কম ছিল। একটু ঝাল ঝাল পানসে তবু মেজকার মুখে যুদ্ধ জয়ের আনন্দ। দেখলে তো সবই ছেলেরা পারে। আসলে ছেলেরা পারে না এমন কিছু হয় না।মেজ বৌদি তেমন কিছু বললে না। কারণ মেজকা শুনবো না।
বিকেল অবধি পুরুষ রা সব পারের জয়ধ্বনি উড়িয়ে তিনজনে পুরুষ তান্ত্রিক সমাজের খুঁটি যখন পুঁতে ফেলেছে তখন প্রায় ক্লান্ত হয়ে ঠাকুমা ফিরলে। ঘরে ঢুকেই মেজকা, বাবা আর পিসে মশাইয়ের সবজান্তা ভাব দেখে কিছুক্ষণ চুপ করে দেখলে তারপর আর থাকতে পারলে না ।ঠাকুমা বললে "তোরা বলছিস রান্না জানিস।"
- "হ্যা, জানি তো।" মেজকা অকুতোভয়। ঠাকুমা বললে
- "তাহলে এক কাম কইরা দ্যাখা। কাল রান্না কইরা খাওয়া তালের বড়া, চিতই পিঠে, চিতল মাছের মুঠ্যা, তেঁতর ডাল লাউ দিয়া,বাবা প্রতিবাদ করে উঠলে "ওসব স্পেশাল রান্না বাদ দাও। রোজকার যা মন চায় বল।" মেজ কাকিমা এতক্ষণে একটু বুকে বল পেয়েছে, বললে
- "কেন? ওগুলো তোমাদের আমরা রান্না করে খাওয়াই না? কর, করে খাওয়াও"। ঠাকুমা বললে
- "ছাড়ান দে"। বলে বাবাকে বললে
- "তোর জামাখান দে।" বাবা অবাক।
- "কেন কি করবে?"
- "দে। খুইলা দে।" বাবা বিরক্ত হয়ে জামা খুললে । ঠাকুমা উঠে আলমারি খুলে সূঁচ সুতো বার করে দিলে। দেখা গেল বাবার পাঞ্জাবির একটা বোতাম নেই। ঠাকুমা কি করতে চাইছে ঠিক বুঝতে পারছি না। বোধহয় লাগিয়ে দেবে বোতাম। ঠাকুমা সে পথে গেল না। বললে
- "শুধু সূঁচে সুতো ভইরা দে। তারপর কথা ক। দেখি তোদের দৌড়"। মেজকা হাঁ, হাঁ করে অবহেলার হাসি দিয়ে বলল
- "মা, তুমি কি আমাদের কচি খোকা পেয়েছ? আমি এটা ছোটবেলা থেকেই জানি। এত জলের মত সোজা। এমন কি এটা যে সোনা মুখী সূঁচ সেটাও জানি। আগে বাবার শার্টের বোতাম সেলাই করার সময় কে ভরে দিয়েছে মনে নেই?" ঠাকুমা মুচকি মুচকি হাসছে। মেজকার আর তোর সইছে না, বাবা কে বললে "দে, দে, দাদা দে"। বাবা বললে
- "আমাকে দিয়েছে, আমিই ভরে দেখিয়ে দিচ্ছি। মা তুমি আরেকটু কঠিন কিছু দিলে পারতে"। এই বলে অবহেলা ভরে সূঁচটা বাবা এদিক ওদিক দেখলে। সুতোর রিম থেকে সুতো বার করে বললে
- "এই দেখো এমনি করে ধরবে আর আসতে করে ফুঁটো দিয়ে সুতোর মুখটা ঢুকিয়ে দেবে ব্যস কাজ শেষ"। এবার বাবার মুখটা একটু ত্যারছা হল।
- "ও হয় নি? এই তো। অনেকদিনের প্র্যাক্টিস নেই তাই। ঠিক আছে, এই দেখো" বলে বাবা আবার সুতোটা ঠেললে। দেখলাম সুতোটা ফুটোর মুখে গিয়ে ধাক্কা খেয়ে পাশ দিয়ে চলে গেল। এবার বাবা একটু সিরিয়াস। ও মনে পড়েছে, বলে সুতোর মুখটা মুখ দিয়ে ভিজিয়ে নিল। হাতে নিয়ে ঠেলতে ঠেলতে বললে
- "অনেকদিন বাদে তো তাই প্রথম মনে পড়ছিল না।" এবারও কিন্তু ঢুকলে না । ঠাকুমা দূরে হাত পাখার হওয়া খাচ্ছে। আর মুচকি মুচকি হাসছে। এবার বাবার চোখের মণি দুটো কাছাকাছি চলে এল। বেশ গম্ভীর লাগছে যেন মন দিয়ে দড়ির গিঁট খুলছে। পিসেমশাই একবার বললে
- "পিন্টুদা এটা আমাকে দিন। অতি সহজ ট্রিক আছে। বাবা নাছোড়। আবার নতুন করে সুতো মুখে ভিজিয়ে সরু করে গভীর মনোযোগ দিয়ে সুতোটা ঢোকালে। এবার দিব্যি সুতোটা ভিতর দিয়ে চলে গেল। বাবা মুখ সরিয়ে তাচ্ছিল্য দেখিয়ে বললে
- "এই নাও মা। এত সোজা কাজ আমায় দিয়া দাবায়ে রাখতে পারবা না। বাবা অতি উৎসাহে ঠাকুমার সঙ্গে বাঙাল ভাষায় কথা বলে। কিন্তু পর মুহূর্তে বাবার মুখ শুকিয়ে গেল। সুতোর মধ্যে সূঁচ নেই। কি ষড়যন্ত্রে সূঁচ আলাদা সুতো আলাদা। মেজকা বললে
- "দেখলি তো ওত কনফিডেন্স ভালো নয়। তুই ভাবছিস হয়ে গেছে কিন্তু দেখ হয় নি"। এবার ঠাকুমার দিকে চেয়ে বললে
- "মা এটা কেমন ঠাট্টা হল? আমাদের আর কোন কাজ নেই? এসব কাজ মেয়েরা করে। কিন্তু আমরাও জানি। কোন ব্যাপার নয়। তুমি অন্য কিছু দাও। দেখছো দাদার চোখের পাওয়ার বেড়ে যাচ্ছে"। বাবা এক ধমক দিল,
- "ঝন্টু, বড্ড বার বেড়েছিস। আমি তো তোকে চিনি। তুই এসব কোন দিনই পারবি না।"
ঠাকুমা হাত পাখা নাড়িয়েই যাচ্ছে আর মিটিমিটি হাসছে। পিসেমশাই বললে,
- "আমাকে দিন পিন্টুদা। এটা কোন ব্যাপার নয়। আগে যত রকমের ঘুড়ির কল করা, পায়জামার দড়ি ভরা সব সুক্ষ কাজ আমিই করতাম"। বাবা কোন চান্সই পেল না। পিসেমশাই সূঁচ আর সুতো হাতে নিয়ে বললে,
- "এই দেখো, এই তুমি সুতো নিলে। তারপর হাত দিয়ে সুতোটাকে সরু করে নিলে। চাইলে ভিজিয়ে নিতে পারো।" যেন স্কুলের বিজ্ঞান টিচার পড়াচ্ছে। মেজকা আর ধৈর্য রাখতে পারলে না।
- "তারপর তারপর? আগে বারো"। পিসেমশাই বললে,
- "সূঁচটা সোজা করে ধরতে হবে। ঠিক এইভাবে। সুঁচের ওপরের দিকে গর্ত তার মধ্যে দিয়ে অবলীলায় তোমাকে বেরোতে হবে। ঐটাই তোমার টার্গেট। ভালো করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে দেখতে হবে যেন তুমি অর্জুন। সূঁচ শুধ্ব সুতো পরালে তবেই দ্রৌপদীকে পাবে। কোন তাড়াহুড়ো নয়। আসতে আসতে লক্ষ্যের দিকে সুতোর মুখ চেপে ধরে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে"। বাবা দূরে বসা ঠাকুমার দিকে তাকিয়ে পিসেমশাইকে বললে,
- "কি তুমি কি খেলার ধারাবিবরণী দিচ্ছ?"। এরপরটা খুব গৌরবের হল না। তিন চার বার গোত্তা খেয়ে সুতো সূঁচএর গা বেয়ে কোন বার পাশ দিয়ে কোন বার নীচের দিকে চলে গেল। পিসেমশাই চারিদিকে হতাশ চাহনি দিয়ে বললে এরকম আলো কম হলে কি করে চলবে? মা এটা তো ষড়যন্ত্র"। মাঠে আলো কমের অ্যাপিল করলে। ঠাকুমা দুর থেকে হেসে জামাইকে বললে,
- "আমি ভইরা দেই?" মেজকা অপমানে লাল হয়ে উঠলে।
- "মা তুমি সবাইকে ঠকাতে পারলেও আমাকে পারবে না"। বলে পিসেমশাই এর হাত থেকে ঝপাত করে সূঁচ সুতো নিয়ে নিলে। বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললে,
- "আমি এতক্ষণ সবাইকে দেখছিলাম কি করে। এইবার বল মা সুতো পরালে কি দেবে?" মা মেজ কাকিমা হৈ, হৈ করে উঠলে।
"মা ওরা কিছু করলে কেন প্রাইজ চায়? আমরা তো রোজদিন এই করছি। এই সামান্য সুঁচে সুতো পড়াতে পারছে না আবার পরালে প্রাইজ চাইছে। এসব চলবে না"। ঠাকুমা আজ পণ করেছে বাবা, কাকা, পিসেমশাইকে ল্যাজে গোবরে করবেই। ঠাকুমা কোন উত্তর দিলে না, বললে
- "দেখি ঝন্টুর ক্যারামতি। মেজকা পিসেমশাই আর বাবাকে বললে "তোমরা সূঁচএর গর্তটাই ঠিক মত দেখতে পাওনি। আমি আর বিশেষ কিছু বলব না। করে দেখিয়ে দিচ্ছি তাহলে তো শান্তি হবে? ঠাকুমা ফোঁকলা দাঁত বার করে খিক খিক হাসতে লাগল। মেজকা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে সামনের চুলগুলো পিছনে ফিরিয়ে দিল।তেল চক চকে নাকটা মুছে এবার সূঁচ সুতো হাতে নিয়ে মেজকা প্রথম যেটা করলে পাঞ্জাবির হাতাটা গুটিয়ে ফেললে। বাবা ফোরণ কাটলে।
- "হাতা গোটাচ্ছিস? মারবি নাকি? মেজকা তীব্র দৃষ্টিতে সূঁচএর দিকে তাকিয়ে বললে,
- "ওটা একাগ্রতার জন্যে লাগে। এবার দেখ আমার কামাল"। কাকিমা, মা কাছে এসে ঝুঁকে পড়েছে। আমি অপারেশনটা দেখতে মার ঘাড় সরিয়ে তাকিয়ে আছি নিস্পলক কি হয় কি হয়। এতক্ষনে শেষ হবে ঠাকুরমার টাস্ক। ঠাকুমা খানিক দূরে খাটে হাত পাখা দিয়ে বাতাস করে যাচ্ছে।কোন হেলদোল নেই। কোন উত্তেজনা নেই। মিটিমিটি হাসছে। হাতা গুটিয়ে বললে
- "ইসস এই কয়দিন আগেই ফেস বুকে এসেছিল। কেন যে সেভ করে রাখলাম না কে জানে। পিসেমশাই উৎসাহ দিলে "সুতোটা পরিয়ে দিন তারপর জমিয়ে চা আর মুড়ি খাব। কাকিমা ফুট কাটলে" চা আর মুড়িটা খেয়ে নিলেই ভালো করতে। দেখুন খাওয়া হয় কিনা"। মেজ কাকা এর মধ্যে তুলে নিয়েছে সুতো আর সূঁচ। মেজকার দুটোকে সামনে নিয়ে এসেছে। বাবা, আমি পিসে মশাই জানি এবার ঠিক পারবে ঝন্টু। এরপর মেজ কার মুখটা একটা হল বটে। বেশি কনসেন্ট্রেশন করতে গিয়ে মুখ টা ছুঁচলো হয়ে গেছে। জিভটা বেড়িয়ে এসেছে কোন দিয়ে। দুই ভুরু প্রায় লেগে যায় আরকি। যেন ঘড়ির মেকানিক। চোখ দুটো কুঁচকে ছোট হয়ে এসেছে। একটু একটু করে নিয়ে এসে ঢোকালে। কিন্তু বেমালুম বেড়িয়ে গেল পাশ দিয়ে। আজ কি হল কে জানে। আমার মোবাইল নেই তাই তুলে রাখতে পারলাম না সেই জোকারের মতন মেজকার মুখ। ঠাকুমা বললে
- "হইসে তোদের? আর কবি মেয়েরা যা পারে তোরাও তাই পারিস? মেজকা একটু নরম হয়ে বললে
- "অনেকদিন প্র্যাকটিস নেই। আরেকটু সময় দাও ঠিক করে দেব। মাথা চুলকে একটা যুক্তি খাড়া করে বললে" সত্যিই আলোটা বড় কম। আগে তো আমি তোমায় করে দিয়েছি। এটা মা তুমি ঠিক করো নি। সকালে করলে দেখে নিতাম তোমার চ্যালেঞ্জ"। ঠাকুমা বললে
- "আমার সন্ধার পুজো হয় নাই। আমি উঠলাম। তোরা লইরা যা"। সে এক বিশ্রী করুন দৃশ্য। এত বড় বড় বিরাট দেশ উদ্বার করা, বুলি আওড়ানো মানুষগুলো ল্যাজে গোবরে মাখামাখি অবস্থা। বুলি সব শেষ। শুধু সুতো নিয়ে গুঁতোগুঁতি চলছে তো চলছেই। ছেড়ে পালিয়েও যেতে পারছে না। রাত বাড়ছে, রাগ বাড়ছে। চেষ্টা চলছে তো চলছে। এমন সময় মা এসে বললে চিও বই গুছিয়ে রাখ, তুমি খেয়ে নাও, কাল সকালে স্কুল আছে। বুঝলাম মা হাল ছেড়ে দিয়েছে। খেয়েদেয়ে ওপরে চলে গেছি। মেজকা, বাবা, পিসেমশাই লড়ে যাচ্ছে। আমার ভোর বেলা স্কুল। ছয়টার সময় নীচে নেমে বেরোচ্ছি দেখি মাটিতে টানা ঢালা বিছানায় বাবারা তিন মূর্তি চিৎপাত হয়ে নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে। তিন রকম অদ্ভুত ঘড় ঘড় শব্দ ঘর কাঁপাচ্ছে। গতকাল খুব পরিশ্রম গেছে। সামনে টেবিলে সূঁচ আর সুতোটা আলাদা আলাদা পড়ে আছে। ওদের সারারাতেও এক করা যায় নি।
কবিতা
মিজানুর রহমান মিজান
বিশ্বনাথ, সিলেট, বাংলাদেশ
ভাবিয়া আপন
তরে ভাবিয়া আপন
রাখলাম করে যতন
এ দেহ পিঞ্জরায়।।
আশ্বাসে ভর করিয়া
বুকে বিশ্বাস রাখিয়া
জীবন যাত্রা বাহিয়া
আসা যাওয়া তোমার ইচ্ছায়।।
যাবার যদি ছিলো ধান্ধা
করালে কেন মায়ায় বান্ধা
এ পিরিতের জালে কান্দা
পদে পদে বিপদ ঘনায়।।
আদর সোহাগে ছিলো না কমতি
তবুও ভালবাসায় বসালে যতি
ফিরে না চাইলে একরত্তি
বুকের পাঁজর ভাঙ্গে ব্যথায়।।
চলে যাওয়ায় হারালাম হুস-
জ্ঞানশূন্য পিঞ্জিরা নাহি সেথা প্রাণ
লাশ বলে সবাই নিয়ে যান
অন্ধকার মাটির ঘরে রাখার দায়।।
নীতি আছে মুখে
নীতি আছে মুখে, কাগজে
রীতি শুধু অমান্য কাজে
নাই নীতির ধারা এ সময়ে।।
কোন আশার আশে
মন স্বপ্ন দেখে ভাল সাজে
প্রীতিহীন নীতি,দু:খ বুকে লয়ে।।
মন মানে না বাঁধা
নির্বাসনে ভক্তি শ্রদ্ধা
বিষাদে ঘুরে গুরু হয়ে।।
নীরব রাতে ঘুম ঘুম প্রাতে
ভাবি নিরলে হারালাম সাথে
রীতি নীতির কথা ক্ষয়ে।।
আর কি হবে না সুপ্রভাত
আচরণে নাকি দীপ্তির আঘাত
চিত্তে বোধ শ্রদ্ধা হারিয়ে।।
কবিতা
সুকান্ত দেবনাথ
বিদ্যাসাগর পল্লী, দুর্গাপুর
নিশিকান্ত ও একটি স্থির ছবি
আমি জানি মুখোমুখি বৃষ্টির থাকলে আর ফ্রাস্টেশনের কথা মাথায় থাকে না
রাত তার নিজস্ব অক্টপাস নিয়ে তখন বেহেস্ত উদার
ফ্যানায় ভাসে দেহ আর
ঊর্মির খুলে রাখা অ্যাবসার্ড রঙের ব্রা থেকে যে গন্ধ ছড়ায়
তার কাছে নিশিকান্ত ওঃ
পরিণত হয় হাইব্রিড অন্ধকারে
আলো পিছন থেকে আপ্রাণ ডাকতে থাকে দাঁড়াও দাঁড়াও আমি
এই তো সেদিন কারখানা ফেরত এক কয়লা চোরের কাছে
সংক্রমিত কঙ্কালে পেয়েছি
সে বলেছে তার নামও নিশিকান্ত ছিল
লুকিয়ে অন্ধকারে তাকে বুঝিয়ে বলেছি
পরাবাস্তব ছিল সে আলো যে পোশাক ভেদ করেছিল
নিশিকান্ত অযথাই মাঝে পড়ে গেল
এক প্যাসিভ দৃষ্টিকোণ যদিও সে জানে
নিশিকান্ত ছেলে কোলে করে হেঁটে যায় অচেনা প্রান্তরে
প্রান্তর বেজন্মা রতি-হীন লবণাক্ত জলে ডুবে থাকা অবসেশন দ্যাখে
ভেতরে ডাকবেন না ----
ঊর্মি সেই বিষাদ রঙের জামা পরে আছে
ঝুলে আছে বিগত রাত আর আগামী রাত্রির মাঝের তফাৎ
আমি বলেছি
এই সব দলাদলি আর বিষ মাখানো ঠোঁট
নিশিকান্ত পাঁচিল টপকে দেখে ছিল
কয়েকজন শ্রমিক নেতা দাঁড়িয়ে আছে
মুখে জটিল গন্ধ
নিশিকান্ত সে গন্ধ চেনে তার পকেট ভর্তি বিষ
সায়ানাইডের ফাইল সে সঙ্গে করে ঘোরে
তারপর না টাকায় না দারিদ্রে না মদে না শরীরে
শুয়ে থেকে ভাবে উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর কি হতে পারে
এই ঘর, অহেতুক স্বপ্ন পতনের শব্দ
সেদিন এক ভিখারি এসেছিলে
তাকে দেখেও না দেখার ভান করে চলে গেছে, চায়নি
উচ্চাকাঙ্ক্ষা কি হতে পারে
কারখানা ফেরত যে কামিনকে সে ডেকে ছিল
সেও তো তার বুকের ছেলেকে পাশে রেখে দেখিয়েছে
কর্মঠ মানুষের অসাধারণ পারফর্মেন্স
আঃ সেকি করাপশন, অস্থির পাগল পারা
দেখেছি
শহরের নিচে দিয়ে বয়ে যাচ্ছে ঊর্মি১ ঊর্মি২ ঊর্মি৩ ঊর্মি৪ --
শূন্যতায় স্পার্ক
অশরীরী হাত বাড়াচ্ছে তুলে নেব কোলে নাকি
তুমি তুমি তুমি একাত্ম হয়ে তাকিয়ে দেখছ বৃষ্টির মাঝে যে মাঠ
ভরে উঠেছে জলে তার মাঝে এক সরলতা স্কুল ছুটির পরেও
একা দাঁড়িয়ে আছে
তার খেলার সাথী নেই
ভিজে যাচ্ছে একটানা, রেখে যাচ্ছে বিষণ্ণ এক ফুটবল
ফেলে যাচ্ছে তাকে মাঠের মাঝে
কেউ খেলার নেই
একটা স্থির ছবি আছে কোথাও
একটি মাঠ একটি ছেলে আর একটি বল
কবিতা
পার্থ সরকার
অকল্পনীয় ঘরে ফেরা
চাঁদের ওপর জলকণা
রাত্রি নামে হাতে
করুণা শেষে
ঘরে ফিরেছে কথা,
ব্যথার পরে ধ্বস্ত রূপকথা?
ছেঁড়া প্রহেলিকা
জলবিভাজিকায় কথকতা
সাধনার ওপর রেখেছে হাত শব
কতদূর যাবে রহস্য
ঘর বন্ধের চাবিহাতে?
সীমান্ত নেই
তাই কথা নেই
থই থই উঠানে
একাই সাঁতার কাটে মেঘ।
এক সোজা হওয়া পথে
এক সোজা হওয়া পথে
ভেঙে
নুইয়ে পড়ে আছে রোদ
মঠের মধ্যপদতলে
উড়ে যায়
ভয়ে ভয়ে
ঘুম ঘুম ক্ষয়রোগের দিকে
তাপের অস্ফুট উড়ান
বিবিধ ঘনত্ব নিয়ে গভীর ঘণ্টাধ্বনির দিকে সান্ধ্য পদক্ষেপ
নাছোড় শূন্য লগ্নিপথে
পড়ে থাকে
এক বান্দা
কারোর কথা না শোনার।
কবিতা
সুকান্ত পাল
জিতপুর, মুর্শিদাবাদ
তুমি কি বন্ধু!
তুমি কি বন্ধু পেরেছো আমার সবটুকু নিতে কেড়ে
আঁখি হতে মোর কান্নাটুকু পারো নি তো নিতে পেড়ে।
রেখে গেছো ভুলে স্বরলিপি তুমি ব্যথার আখরে লেখা
মুছতে চেয়েও পারো নি মুছতে নয়নে স্মৃতির রেখা।
প্রেমের পুতলি তাও রেখে গেলে এ বুকে কবর গেড়ে
আঁখি হতে মোর কান্নাটুকু পারো নি তো নিতে পেড়ে।
প্রেমের পূজার দেবতা তুমি তোমার চরণ তলে
অঞ্জলি মোর দিয়েছি আমার দুই নয়নের জলে।
বিরহ তাপিত বেদনা আমার এই যে কাঁটার মালা
বিধি হয়ে তুমি লিখেছো ললাটে কত যে যাতনা জ্বালা।
বন্দীশালার শিকল ছিঁড়ে যাওনি আমারে ছেড়ে
আঁখি হতে মোর কান্নাটুকু পারো নি তো নিতে কেড়ে।
আজকের পুজো
প্রাচীন শরৎ নতুন হল, স্বর্নালী ওই কাশের বনে
ইউটিউবে বিশ্বজুড়ে মহালয়ার বোধন শোনে।
স্ক্রীনসেভারে ত্রিনয়নী, ওয়ালপেপারে সিংহবাহন
পাসওয়ার্ড-এ দুর্গানামে আগমনীর নিশিযাপন।
বাদল মেঘ বিদায় নিল, নীল আকাশে বকের সারি
থিমের দেশে, সাবেক বেশে, গণেশ যাবে মামার বাড়ি।
সাইকেডেলিক আলোর খেলা, রাত্রি জাগা চিকেন রোলে
কার্নিভালে পা মিলিয়ে, বন্ধুরা সব সেলফি তোলে।
পড়ছে ছায়া কাশের গোছার, কূল ছাপানো নদীর জলে
হঠাৎ করেই শীতের আমেজ, পাতা ঝরা গাছের তলে।
অনলাইনে আড্ডা জমে, উপচে পড়ে ফোনের স্ক্রীন,
প্রাচীন প্রথা যাক না মুছে, উৎসব হোক চিরকালীন।
কবিতা
রুদ্রজিৎ পাল
কসবা, কলকাতা
নতুন বছর বলল হেসে
থাকছে সারপ্রাইজ!
মুলোয়-পাতায় জব্বর মিল
ব্রাইট সানরাইজ।
ধনে মানে বাড়বাড়ন্ত
থাকবে না টেনশন।
দুখ্খু টুখ্খু বে়চতে পার
ডব্বল রিডাকশন।
কারবার আর ব্যবসাপত্রে
বৃহস্পতি তুঙ্গে।
বিদ্যে বোঝাই ভিড়বে জাহাজ।
সরস্বতীর সঙ্গে।
মদ্দা কথা ইনভারম্যান্ট
ফুলেল বসন্ত।
আঙুল চাপে উঠবে হেসে
কুসুম ফুটন্ত।
কবিতা
সনোজ চক্রবর্তী
পূর্ব মেদিনীপুর, পঃ বঙ্গ
ঘাস ফুল হোক ছোট্ট খাটো
চাষী নয় এলেবেলে।
পাঁকের গোড়ায় মস্ত পদ্ম
দলটা বদল হলে।
বাংলা দেখো জগৎ মাঝে
হবেই বড় মস্ত।
দেশ গঠনের সোনার চেয়ার
পাছায় পেলে আস্ত।
এসব শুনে "নোটা- বোতাম"
ছোট্ট আলপিন-
ফুল বাবুদের নরম পাছায়
ফুটিয়ে বলল সেদিন--
"হারামজাদা নতুন বছর
সোনার পাথর বাটি!
নির্বাচনের ইস্তেহারে
মিথ্যে মিছিল হাঁটি।
কবিতা
সাহেব সেখ
মুর্শিদাবাদ, প: বঙ্গ
শৈশব হারিয়ে গেছে
শৈশব হারিয়ে গেছে, দারিদ্রের অন্ধকারে,
সময়ের যাঁতাকলে, মানুষের জীবন ঘোরে।
শৈশব হারিয়ে গেছে, দারিদ্রের অন্ধকারে,
সময়ের যাঁতাকলে, মানুষের জীবন ঘোরে
শুধু একটি আশা, রয়ে যায় মনের ভেতর,
সেই আশায় মানুষ বাঁচে, খুলে যায় খুশির দোর।
শুধু একটি আশা, রয়ে যায় মনের ভেতর,
সেই আশায় মানুষ বাঁচে, খুলে যায় খুশির দোর।
দারিদ্রের কষ্টে মানব, নিজের আবেগ করে দান,
নাপাওয়ার বেদনায় সরব, চোখের জলে সব ভাসান।
একটু একটু করে মানুষ, ক্ষুধার আগুনে পোড়ে।
জীবনটা তীর বিহীণ ধনুষ, সেটাকে সম্পূর্ণ বোঝে।
শৈশব হারিয়ে গেছে, দারিদ্রের অন্ধকারে,
সময়ের যাঁতাকলে, মানুষের জীবন ঘোরে।
শুধু একটি আশা, রয়ে যায় মনের ভেতর,
সেই আশায় মানুষ বাঁচে, খুলে যায় খুশির দোর।
কবিতা
রাজর্ষি চট্টোপাধ্যায়
স্বপ্ন দেখা
আমি ভেঙে চুরে শুরু করলাম আবার স্বপ্ন দেখা
অনেক বিষাদ যন্ত্রণা আছে স্মৃতি পটে লেখা
আগুনএ পুড়িয়েছি আমার প্রতিচ্ছবি
স্বপ্ন গুলো ঢেউ খেলে যায় যখন অস্তাচলে রবি
প্রতিচ্ছবি প্রতিচ্ছবি তুমি থেকেও তবু নেই
ফিরে ফিরে আসে স্মৃতি বিষণ্ণ হয় কবি
তবু ভেঙে চুরে শুরু করলাম আবার স্বপ্ন দেখা
স্বপ্ন আসে স্বপ্ন ভাসে মন ছবিতে লেখা
আমি আবার ভেঙে চুরে শুরু করলাম নতুন স্বপ্ন দেখা
দুঃসপ্ন গুলো হাত ছানি দেয় স্মৃতি পটে একা।
দাঁত তুলতে গিয়ে
চণ্ডীচরণ ষাট বছরের পা দিল আজ ভোরে
সারাটা দিন ঘুরে ঘুরে কাজ করে রোদ্দুরে।
শরীর টরীর সব ঠিক আছে শুধু দুটি দাঁত
পোকায় খেয়ে পোকার বংশ করছে বাজিমাত।
ডাক্তার বলে- "এত্দিন পর এলেন আপনি কেন?"
--- "ডাক্তারবাবু ইয়ে মানে লজ্জা লাগে যেন।
না না ডাক্তারবাবু হাত দেবেন না দাঁতে
যন্ত্রপাতি দেখলে আমার ব্যথা বাড়ে ক্ষতে।
তার চেয়ে বরং এমন বেডে শুয়ে খানিক থাকি
ঘন্টাখানেক শুয়ে থাকলে অসুবিধা নাকি ?
মনকে তবু প্রবোধ দেব দাঁত তুলতে গিয়ে
ফিরে এলাম ডাক্তারবাবুর সুপরামর্শ নিয়ে।"
কবিতা
দিলীপ কুমার মধু
পূর্ব বর্ধমান, পঃ বঙ্গ
কবিতা
সঞ্জীব হালদার
গড়িয়া, কলকাতা
(জন্মস্থান- কলিকাতা, শিক্ষকতা পেশায় নিযুক্ত। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর। প্রথম কবিতা “বসন্তের দুপুর” প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯২ সালে।)
আমাদের হারাবার কিছু নেই
আমাদের হারাবার কিছু নেই
শৈশবের খেলনা হারানো কান্না নেই
আমাদের হারাবার কিছু নেই
স্কুল কলেজের পরীক্ষায় পাস নম্বর হারানো নেই
আমাদের হারাবার কিছু নেই
নেই বেকারত্বে প্রেম হারানোর ভয়
আমাদের হারাবার কিছু নেই
নেই সংসার হারানোর ভয়
আমাদের হারাবার কিছু নেই
নেই অলি-গলি, রাস্তা-রাজপথ হারানোর ভয়
আমাদের হারাবার কিছু নেই
নেই উত্তরসূরি হারানোর ভয়
আমাদের হারাবার কিছু নেই
পার হয়ে গেছে আজ অর্ধেকটা জীবন!
কিছুই কি হারাবার নেই?
সবই কি প্রাপ্ত হয় জীবনে?
আছে ভয় মূল্যবোধ হারানোর
আছে ভয় মনুষ্যত্ব হারানোর।
হয়তো
হয়তো, মন ভালো নেই
হয়তো, কাজে আছ ব্যস্ত,
হয়তো, দিচ্ছে না শরীর—
এই সতত্ সংঘাতে।
হয়তো, আমার দুঃখ কমার পাত্রপূর্ণ,
হয়তো, তোমার দুঃখ ভরার পাত্র খালি।
হয়তো, সব-ই ভুল
হয়তো, কিছু ঠিক।
হয়তো, বিরক্ত হবে পরে
হয়তো, অর্থহীন কিছু পেয়ে—
হবে খুশী—
হয়তো, অনন্ত এই পথচলায়, ডেকে বলবে
‘একটু ছায়ায় বসি’।
কবিতা
রথীন্দ্রনাথ বড়াল
কলিকাতা
অশ্রুলিখিত
বারণ বলে বলিনি, এ-কথা ভেবোনা।
নিষেধ না মানা আমার দুইহাতই জানে গন্তব্য কঠিন, কন্টকপূর্ণ, রহস্য-অন্ধকারের পথ।
অভাবী বোনের কথা শুনতে শুনতে, অভাবী ভাইয়ের, হাঁ করে তাকিয়ে থাকার দিকে আমার দু'চোখ অশ্রু লিখিত।
ধানক্ষেতে, নতুন ফুটে ওঠা ভাতের কথা ভাবতে ভাবতে, উনুনের আঁচ এসে পড়ে রোদে।
খিদে আসে।
আরও খিদে, তারা আসবে-কি-আসবেনা এই গুনতে গুনতে, জল খেয়ে ভরে নিই পেট, খানিক রোদ ও হাওয়া। আর খুব সকালে উঠে দেখি, একটা সুন্দর কবিতা গজিয়ে উঠে বসে আছে, উদরে, নতুন পৃথিবী জুড়ে আমার।
কবিতা
সুপ্রভাত মেট্যা
তমলুক, পূর্ব মেদিনীপুর, পঃ বঙ্গ
গল্প
ভাই বোনেরা চলে যেতেই ধুম করে দরজা বন্ধ করল দিমা। বন্ধ করার মধ্যেই একটা রাগ ফুঁটে বেরোচ্ছে। নভেম্বর এর কলকাতা। হালকা শীতের আগমনকে ঠেকিয়ে মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। কিছুটা গুমোট হয়ে আছে। একদুবার দূরে আকাশে সামান্য ঝিলিক দিয়েছে। অকাল বৃষ্টি হলেও হতে পারে। নীচের প্যান্ডেলের আলোগুলো খুলছে ইলেকট্রিশিয়ান। দুচারটে ডেকরেটর এর বাসনের শব্দ ভেসে আসছে। ওপরের তলায় বাসর ঘরে পিছন ফিরে সাত্যক ঘড়িটা খুলতে খুলতে ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় দেখলে দিমা ফুলের মালাটা পড়ার টেবিলে গোল করে নামিয়ে রাখছে। মুখ বেশ গম্ভীর সেই যেমন সারাদিন ছিল। সেই শুভ দৃষ্টি থেকেই পাঁচের মত মুখ করে আছে। বিয়ে থেকে বৌভাত তেমন সুযোগ হয় নি কথা বলার। তবে বেদম চটে আছে সেটা জানা। মাথার গোঁজা কাঁটা গুলো খুলে রাখছে। দেয়ালে, খাটে, টেবিলে ফুলের সমারোহ। বেশ লাগছে ওকে। নতুন গয়নার রিন রিন শব্দ এখন ঘরময়। খাটের চার কোণে রজনী গন্ধা থেকে আর খাটে ছড়ানো গোলাপের পাপড়ি যেন ফুলের গালিচা, এক অদ্ভুত গন্ধ ছড়িয়ে দিয়েছে। শুধু রজনীগন্ধা নয়, তার সঙ্গে কিছু বেলী ফুল ও আছে। পাঞ্জাবির পকেট থেকে বেশ কিছু কার্ড, কাগজ চিরকুট বেরোলো। দু একজন বন্ধুর বিজনেস কার্ড। কাল সকালে উঠে সব ডেকরেটর, লাইট, টাকা নিতে আসবে। বাসন নিতে আসবে ঠাকুর। খাটের এক ধারে বসে এতক্ষণে মনে হল আজ ফুলশয্যা। দিমা ধড়াচূড়া ছেড়ে ছুড়ে বিরক্ত হয়ে বললে "আপনার ঘরে র সাথে এটাচড বাথ নেই? আশ্চর্য্য"।
"আছে তো। পর্দার জন্যে দেখতে পান নি। এই যে" বলে দেখিয়ে দিলে। ঠাকুরদার করা দোতলা বাড়ি। দরজা জানালা আধুনিক নয় কিন্তু সব শাল আর সেগুন কাঠের। বড় বড় উঁচু ঘর।
এরপরই এদিকওদিক তাকিয়ে দিমা বললে " আপনার রিমোটটা কোথায়?"
সাত্যক মুচকি হাসল "আমার রিমোট"?
দিমার এক মাথা কালো চুলের কয়েকটা মুখের ওপর চলে এসেছে। গরমে হাঁসফাঁস অবস্থায় মুখ ঘুরিয়ে ক্লান্ত এক হাসি দিল "আপাতত এসির হলেই চলবে"। সাত্যক খেয়াল করলে দিমাকে হাসলে ভারী সুন্দরী লাগে। হাসলেই এক মুহূর্তে বয়সটা হুস করে পাঁচ সাত বছর কমে যায়। বড় বড় চোখ দুটো ও হাসতে থাকে। দাঁতগুলো ঝকঝক করছে সুন্দর গঠন সাজানো। পান পাতার মতন ফর্সা মুখে দু গেল হালকা টোল পড়ে।
সাত্যক নতুন শ্বশুর বাড়ি থেকে আসা ড্রেসিং টেবিলের ওপর রাখা রিমোটটা তুলে দিলে।
দিমা র একটা বেশ সহজ ব্যাপার আছে যেটা খুব আকর্ষণীয়। দু পা দোলাতে দোলাতে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলাতেই বললে "আমার কিছু কথা আছে। আপনার শোনা খুব দরকার।"
সাত্যক খুব সহজ ভাবে বললে "বলুন"। শোনবার জন্যে তো বসেই আছি"।
দিমা চুড়ি, বালা, হার খুলতে খুলতে একবার স্থির দৃষ্টিতে দেখলে। তারপর প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল "আমি আপনাকে অনুরোধ করেছিলাম আপনি বিয়েটা ভেঙে দিন? বলেছিলাম কিনা আমার তরফ থেকে অসুবিধা আছে ভাঙার?
সাত্যক এর মুখে হাসি হাসি মুখটা দেখে মাথাটা আরো গরম হয়ে গেল দিমার। মুখটা বেঁকিয়ে তেড়ে ওঠে
"চুপ কেন? যেন কিছুই জানেন না? বলেছিলাম কিনা? আমাকে দেখতে এসে বুঝেছেন নিশ্চয়ই যে আমি একদম ন্যাকামি পছন্দ করিনা। লজ্জা ব্যাপারটা আমার বেশ কম"।
পাঞ্জাবিটা খুলতে খুলতে বলে -
"হ্যাঁ সেতো দেখেইছি। আমার মা, পিসি, কাকা, ভাই আমি এসেছিলাম দেখতে। সেখানে যা দেখালেন সেটা দেখে আমি কেন আমার বাড়ির সবাই তো তাজ্জব। এরকম লজ্জাহীন মেয়ে দেখতে হবে বোধহয় কেউ আসেনি"।
"তাহলে দিলেন না কেন ভেস্তে?"
"আপনার অসুবিধাটা কি?"
এবার দু পা তুলে বাবু হয়ে বসে দিমা। হাত তুলে মেজাজে বলে "দুর ওসব ছাড়ুন তো। আমি তো দিদি আর মাকে বলেই দিয়েছিলাম আমি যাবো না জ্যাঠার বাড়ি। নেহাত শেষ মুহূর্তে জ্যাঠা ডেকে পাঠালেন তাই আসতে হল"।
"হ্যাঁ, এরকম কেউ মেয়ে দেখেছে কিনা সন্দেহ। আপনি এলেন অনেকক্ষণ পর একটা বাড়িতে পড়া সাধারণ শাড়ি পড়ে। ঘরে ঢুকলেন শাড়িতে হাত মুছতে মুছতে। যাই বলুন বেশ মজা লেগেছিল"।
"আপনার মজা লাগতেই পারে কিন্তু ঐযে ন্যাকামি করে হাত গুটিয়ে সবাই মিষ্টি সামনে নিয়ে বসে ছিলেন ,সেটা খুব অন্যায়। একেই এটা জ্যাঠার বাড়ি ,তারপর এতজন এক সাথে চলে এসেছেন।মেয়ে দেখার খুব মজা তাই তো? এতকিছু মিষ্টি চা অ্যারেঞ্জ করা কি কম কথা? আপনাদের কি কোনো কান্ড জ্ঞান নেই? তারপর আবার হাত গুটিয়ে বসে আছেন? আমি কি খাইয়ে দেব ভেবেছিলেন?"
সাত্যক হেসে মাথা নাড়িয়ে হাত নাড়িয়ে বলে "কেউ অচেনা লোকের বাড়িতে মিষ্টি দিলেই গপাগপ মুখে ঢোকালে কি ভালো দেখাত? সবাই ভাবত ছেলের বাড়ি কোনো ভদ্রতা জানে না। তবে আপনি ঢুকে যে রকম ধমক দিলেন তাড়াতাড়ি খাবার শেষ করার জন্যে সেটা কিন্তু বেশ লা জবাব"।
"আমি তো ভেবেছিলাম ওতেই ভেঙে যাবে সম্বন্ধটা।"
"কিন্তু ভাঙল না, তাইতো?"
"ওসব বাজে কথা রাখুন। আপনি তো আমার কথা শোনেন নি। এরকম খ্যা, খ্যা করে হাসবেন না। এখন এটাও জেনে রাখুন আপনার সাথে বৈবাহিক জীবন রাখা আমার পক্ষে রাখা সম্ভব নয়। কি করবেন আপনি ভেবে নিন। আমি চাইনি এ বিয়ে হোক তবু আপনি....।"
সাত্যক সেই মুচকি হাসি ঝুলিয়ে রাখে "আমি দেখলাম খেয়াল করে যে আপনার রাগী রাগী মুখটাই বেশি সুন্দর হাসি মুখের চেয়ে।"
"কি বলতে চাইছেন? কিছুটা গলা তুলে বলে দিমা। সাত্যক দু হাত জোড় করে ইশারায় গলা নামাতে বলে" ঠিক আছে কোনো চাপ নেই। জানতে পারি আপনি কেন বিয়ে করতে। চাইছিলেন না? আমি কি পাত্র হিসেবে খারাপ? আপনার কোন প্রেমিক?"
মাথা নাড়ে "আপাতত ওর অসুবিধা আছে বিয়ে করতে। মা দিদির আর তর সইছে না তারপর জ্যাঠা ও জেঠিমার তাগাদা। একটু থেমে বলে "আপনি তো মশাই ভয়ানক খারাপ লোক। এতবার বলা স্বত্বেও বিয়েটা না করলেন না। কারণটা কি? জানতে পারি কি? আপনার অন্য কোনো অন্য উদ্দেশ্য আছে নাকি? নাহলে জেনে শুনে। বেচে দেবার ধান্দা করছেন নাকি? কথা আর শেষ করেনা। চেয়ে থাকে সাত্যকএর মুখের দিকে।
সাত্যক মাথা নাড়ায় "আজ থাক। আজ ফুলশয্যা ।কাল পরশু এক সময় বলব না হয়।"
ফুল শয্যা? মুখ বেঁকিয়ে হাসে দিমা। মাই ফুট।
কি ভেবেছেন কি?"
একেবারেই পাত্তা দেয় না সাত্যক। কথা ঘুরিয়ে বলে
"আপনার এই দিমা নামটা কিন্তু বেশ। জানেন তো আমি আমার দিদিমা কে দিমা বলে ডাকতাম"।
"বাসর ঘরে কথার কি ছিরি"। লোকটা বোকা না বদমাইশ বোঝা যাচ্ছে না। কিছু তো একটা এই বিয়ের পিছনে উদ্দেশ্য আছে। ব্যাপারটা বোঝা যাচ্ছে না।
দিমা বললে "আমাকে কিন্তু পরশু থেকে অফিসে এ জয়েন করতে হবে"।
সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে সাত্যক বলে "আমি বলি কি আপনি আরো কিছুদিন ছুটিতে থাকুন। অনেক আত্মীয়স্বজন যারা বৌভাতে আসতে পারেনি যেমন পিসিমা, দিদিমা এরা আসবে আপনি না থাকলে কেমন দেখায়?"
"ওসব জানি না। অফিসে আমাকে পরশু যেতেই হবে"।
কিছুক্ষণ সাত্যক চেয়ে রইল। তারপর বললে "এই অফিসটা মনে হয় ছেড়ে দিলেই ভালো।"
"মানে? মেজাজ সপ্তমে ওঠে দিমার" ঠিক এইটাই ভাবছিলাম কখন বলেন। আপনি আমাকে কি পেয়েছেন? যাবো যখন বলেছি যাবোই"।
সাত্যক চুপ করে যায়। পাঞ্জাবিটা খুলে, ফুলগুলো সরিয়ে এক পাশ করে খাটে শুয়ে পড়ে। দিমা অনেকক্ষণ প্রত্যুত্তরের অপেক্ষা করে তারপর খাটের ওপর পাশে গা এলালো।
শুয়ে মনে হল মা, দিদি কি করছে কে জানে? বাড়িতে মামা মাসী মামা তো ভাই, বোনেরা ভর্তি।শুধু ওকেই এই খতরনাক লোকটার সঙ্গে বনবাসে পাঠিয়ে দিল। এমন একটা আস্ত বদমাইশ লোকের সঙ্গে খোঁজ খবর নিয়ে বিয়ে দিলে? লোকটা সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট এ কি একটা ভালো চাকরি করে ব্যস। সেখানে খোঁজ নিলে কি করে হবে? কোথায় কোথায় যায় কাদের সঙ্গে মেশে জানা খুব দরকার না তো কি? এই লোকটার আসল রূপ ফাঁস করে তবে বেড়িয়ে যাবে এখান থেকে।
আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে দিমার চোখটা বুজে এসেছিল। হঠাৎ কি একটা প্রচন্ড শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। চোখ খুলে একটা নতুন বালিশ, খাট তোষক অচেনা একটা ঘর। ওহ! মনে পড়ল আজ তো ফুলশয্যা। বদমাইশ লোকটা উল্টো দিকে ফিরে হাঁটু মুড়ে অনেকটা দূরে শুয়ে ঘুমাচ্ছে। ঘরে একটা হালকা আলো জ্বলছে। পাশে জানলার পর্দা ভেদ করে রাস্তার আলোর ছটা এসে পড়েছে ঘরে। ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। দিমা উঠে বসলে। এমন একটা পরপুরুষ শুয়ে আছে একই খাটে। হঠাৎ ভীষণ অস্বস্তি হল। কেন শেষ মুহূর্তে কেন না করতে পারলে না যখন সাত্যক বিয়েটা কাঁচিয়ে দিলে না? এবার শব্দটা বোঝা গেল একটা নীল আলোর ঝলকানি ঘরের মধ্যে আর সঙ্গে কর, কর, করাত করে সামনে কোথাও বাজ পড়ল। ঝড় বৃষ্টি বাজ পড়া এগুলো দিমা একদম সহ্য করতে পারেনা। "ওরে বাবারে", চিৎকার করে দিমা সাত্যকএর গায়ের ওপর গিয়ে পড়লে। সারাদিনের প্রচুর পরিশ্রম এর পড়ে ঘুমটা জাঁকিয়ে এসেছিল। হঠাৎ এরকম আচমকা গায়ের ওপর পড়াতে হুড়মুড় করে উঠে বসে সাত্যক। "কে? কে? দিমাকে দেখে কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞাসা করে "কি হয়েছে? কিছু কি ভেঙে পড়েছে। কোন বিপদ?"
দিমা এই সুযোগে নিজেকে দূরে সরিয়ে নেয়। "দুর মশাই। কোথায় থাকেন? দুম দারাক্কা যখন তখন বাজ পড়ছে আপনাদের এখানে আর আপনার ঘুম হচ্ছে? কালা নাকি আপনি?" মনে মনে বিড়বিড় করলে এটাতো চেক করেনি মা জ্যাঠামশাই।
একেই ধাক্কা ধাক্কি তে কাঁচা ঘুম ভেঙে গেছে তারপর আবার উল্টোপাল্টা অনুযোগ। গুম হয়ে ভাবল এখন কথা কাটাকাটি, রাগারাগি করলে ঘুমটা চটে যাবে। তার থেকে চুপচাপ পাশ ফিরে বাকি ঘুমটা শেষ করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। সাত্যক দিমার রাগত মুখটা এক ঝলক দেখে আবার ওপাশ ফেরে।
মেঘের গর্জন কমেছে। বৃষ্টি কিন্তু অঝোরে পড়েই যাচ্ছে। জোর ক্রমশ বাড়ছে, সঙ্গে হাওয়া। আগামী দুদিন সাত্যক এর সঙ্গেই ওর বাড়িতে শাশুড়ি, ননদ, ও দেওরের সাথে কাটাতে হবে। ভাবতে ভাবতে আবার চোখ বুজে এল। ফুলশয্যা একটা কাটল বটে।
মালবিকার ফোন এল ফুল শয্যার পরের দিন দুপুরে। "কিরে কেমন কাটছে? বর, শ্বশুর বাড়ী কেমন রে?
সাত্যক খেতে বসে শুনল। মুখ চেপে, নীচু গলায় দিমা বললে
"গিয়ে বলব। অনেক কথা আছে। এখন রাখছি। সাত্যক মোবাইল দেখতে দেখতে খাচ্ছিল। দিমার কথা শুনে মুখ তুলে তাকাল। ননদ মুখ চিপে হাসল কথা শুনে। দিমা অফিসে যাবেই। এই মালবিকাটা কে?
দুপুরে খেয়ে উঠে শোবার ঘরে এসে দিমা বললে "বিকেলে আমি একটু বেরোব কিছুক্ষণের জন্যে।"
"কিন্তু পিসেমশাই পিসিমা আসবেন বলেছেন বউ দেখতে"।
দিমা চুপ করে গেল তারপর বললে" কখন আসবেন ওনারা?"
"সাতটা সাড়ে সাতটা হবে মনে হয়। পিসেমশাই অফিসে থেকে ফিরে আসবেন"।
চট করে ভেবে বললে "ওকে আমি তার আগেই ফিরে আসবো"।
সাত্যক বিশেষ কিছু বললে না। উদাস হয়ে সিগারেট ধরালে। মনে মনে একটা অপরাধ বোধ হচ্ছিল যে সিগারেট এর ধোঁয়ায় হয়ত আপত্তি হতে পারে দিমার। কিন্তু প্যাকেটটা ঢোকাতে গিয়ে আটকে গেল।"
কি ব্র্যান্ড? একটা হবে? অনেকদিনের নেশা। কেউ সামনে খেলে আরো ...."। সাত্যক কিছুটা অবাক হয়েই এগিয়ে দিল প্যাকেটটা। শুধু তাকিয়ে বললে "পুরনো দিনের লোক সব। সবার সামনে খেলে ওদের একটু খারাপ লাগতে পারে।
...,......................
মালবিকা সবটা শুনে বললে" লোকটা কিন্তু ভয়ানক ধূর্ত"।
দি মা গলা মিলালে" সে আর বলতে? দিমা হাতের পেন্সিলটা এদিক ওদিক করে বললে "তৃতীয় রাতে জোর চেপে ধরাতে হাসতে হাসতে কি বলল জানিস? বললে
"আপনি না করাতে তো আমার সুবিধা হয়ে গেল"।
অবাক, বললাম "কেন? কি সুবিধা হল?"
"আরে। আমিই তো বলতে যেতাম আপনাকে বিয়েটা ভেঙে দিতে। তারপর আপনি যখন বললেন ভেঙে দিতে তখন আমার মাথায় বুদ্ধিটা এল। আপনি চান না আমিও চাইনা। সুতরাং বিয়েটা হলে দুজনেই বেঁচে যাবো"।
"মানেটা কি? কি করে বাঁচবো? মাথাটা গেছে নাকি? আর অনির্বাণ তো বসে আছে আমার জন্যে"।
"ছাড়ুন তো। অনির্বাণ কে? আপনার প্রেমিক?"
সাত্যক একটু থেমে বললে "দেখুন বিয়ে হয়ে গেল। সবাই নিশ্চিন্ত। এবার আপনার আর আমার কোনো নিজের কাজ নিয়ে আর ঝামেলা রইল না। আপনিও আপনার বন্ধুবান্ধব নিয়ে থাকুন আর আমি আমার। কেউ কাউকে ঝামেলায় না ফেললেই হল"।
"কি সাংঘাতিক লোক দেখ। অন্য কোনো ধান্দা আছে সিওর"। মালবিকা বললে।
তারপর হিসেবের সব খাতাগুলো এগিয়ে দেয় "একবার দেখে নে। আর হ্যাঁ, তুই ডিভোর্স করে দে। মার কাছে ফিরে যা। লোকটা তোকে অবধারিত বিপদে ফেলবে। প্ল্যান করছে"।
দিমা বললে "এমনিতে তো ভাব দেখায় ভীষণ ভদ্র। গুছিয়ে কথা বার্তা বলে, আমার বাড়ি ওনার বাড়ির সবাই খুব ব্যাপারটা স্বাভাবিক ভাবছে। ডিভোর্স এখুনি বললে আমি খুব চাপে পড়ে যাব। ও ব্যাটা সাধু সেজে আছে ওকে আগে এক্সপোজ করতে হবে"।
"খুব দুখ্যের কথা। কিন্তু একই ঘরে দিনের পর দিন কাটানো ও তো মুশকিল"।
মালবিকা বললে "দিমা, একটা খারাপ খবর আছে। আমাদের এনজিওর এবার আগামী সব ইউএসএ এর হেল্প মিশনগুলো অ্যাপ্রভাল এজেন্ট এর মিস্টার এস ব্যানার্জী আটকে রেখেছেন"।
দিমা অবাক হয়। "কেন আটকে দিয়েছে? কোন কারণ?"
"বোঝা যাচ্ছে না। তুই ভালো কথা বলতে পারিস। একবার যা গিয়ে কথা বলে বোঝ কি অসুবিধা?"
"আমাদের হিসেব তো সব অডিট করানো আছে"।
"ঠিক আছে। কাল ঠিকানাটা দিয়ে দিও। আমি কথা বলব। এরকম হলে বাচ্চাদের পড়াশুনা আটকে যাবে হোমগুলোতে।
দিমা যায় কিন্তু দেখা করতে পারে না। মিস্টার ব্যানার্জী ভীষণ কড়া ধাঁচের মানুষ। ওনার এসিস্ট্যান্ট বললে পরের দিন অডিট রিপোর্ট নিয়ে আসতে। লোকটা গভর্নমেন্ট এর রিপ্রেজেন্টেটিভ এই থার্ড পার্টি অডির টীম এর।
অফিসে থেকে বেড়িয়ে আসার সময় দিমার মনে হয় মিস্টার ব্যানার্জীর অন্য কোন উদ্দেশ্য নেই তো? ঘুষ? এখন ঘোরাচ্ছে পড়ে মুখ খুলবে। এরকম ও শুনেছে অনেক ক্ষেত্রে। কিন্তু লোকটার অফিসে বলছে লোকটা ভীষণ সৎ এবং কড়া ধাঁচের।
তিন রাত্রির দিন ঘরের দরজা বন্ধ করে দিমা রাগে ফেটে পড়লে।
"আমি তোমার সঙ্গে থাকব না। কিছুতেই না। কাল আমাকে অফিসে যেতেই হবে। আমি কোনো কথা শুনব না"। একটু থেমে গলা তুলে বলে
"আপনার সাহস দেখে আমি অবাক হচ্ছি। খাবার টেবিলে কি করে আপনি বললেন কে আমরা কাল মাইথন যাচ্ছি? কে আপনাকে এই ক্ষমতা দিয়েছে?"
সাত্যক চুপ করে সিগারেট ধরালো।
দিমা বললে "আমি কাল অফিসে যাবই। কেউ আমাকে রুখতে পারবে না।"
সাত্যক বারান্দা থেকে ভিতরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে বলে "একটু শান্ত হোন। আমার কথা শুনুন কাল যাবেন না অফিসে"।
"কেন যাবো না? আমি অফিসে ছুটি নেইনি। আর আপনার সাথে যাবার কথা একবারও আপনি আগে বলেছেন? অসম্ভব। কেন যাবো আমি?"
সাত্যক সেই রহস্যময় হাসিটা ঝুলিয়ে রাখে "শুনুন কাল অফিসে গেলে আপনি বিপদে পড়তে পারেন। তাই যাবেন না দয়া করে। ক্ষমা চাইছি আগে মাইথন যাবার কথা বলিনি বলে।"
লোকটা কি চায়? যা ইচ্ছে তাই নিজে নিজে ঠিক করছে। গা জ্বালা করছে।
"শুনুন আপনি যে মিস্টার ব্যানার্জীকে খুঁজতে গিয়েছিলেন তিনি আমার জুনিয়র। খুবই বন্ধু। একই জায়গায় চাকরি করি। ও ই বলেছে এখন দুদিন যাবেন না। আপনার বিপদ হতে পারে"।
দিমার মুখটা বিকৃত হয়।" খুব দর বাড়াচ্ছেন বুঝি?"
"আপনি একটা বিপদের মধ্যে আছেন"।
"কিসের বিপদ? আপনাকে আমি বিশ্বাস করি না।"
"করতে হবে না। পুরোটা শুনুন। আপনি জানেন আপনাদের এনজিও তে টাকা নয় ছয় হয়?"
নয় ছয় হতেই পারে না। সমস্ত রিপোর্ট। থেমে যায় "এনাকে কেন বলছি? এরা হতেই পারে না।"
এবার সাত্যক গম্ভীর হয়।
"আগামীকাল সকালে বা রাত্রে আপনাদের ওখানে এনফোর্সমেন্ট থেকে রেড হবে আপনি জানেন"?
"কি আজে বাজে কথা বলছেন? কেন হবে? একটা এনজিও যারা গরীব দুস্থ ছেলে মেয়েদের পড়াশুনা থাকার ব্যবস্থা করে। যাদের সব হিসেব রীতিমত অডিট হয় সেখানে কেন রেড হবে? যা খুশি বলবেন আর মেনে নেব?
সাত্যক এর ধৈর্য্য ভেঙে যায়। বলে
"আপনি কিছুই জানেন না। আপনি কি জানেন আপনাদের কোম্পানিতে বাইরের মুদ্রায় সাহায্য আসে তার অনেকটা অংশ ড্রেন আউট হয়ে যায়? বেশ কিছু ব্যবসায়ীর হাতে। তারা এটা কে ইউজ করে টাকা লেনদেনের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে"।
"আপনি কি করে বলছেন এসব? আমি এতদিন তো সেরকম কিছু দেখিনি"। রাগে ফেটে পড়ে
দিমা।
"শুনুন, রেগে যাবেন না। মাথা ঠাণ্ডা করে শুনুন।
আচ্ছা ঠিক আছে শুনতে হবে না"। মুহূর্তে রাগটা প্রশমিত করে বলে
"কাল চলুন সকালে মাইথন ঘুরে আসি। আমার ওখানে একটা পুজো দেবার ব্যাপার আছে"।
"কেন যাবো?"
"ধরে নিন এটা আমার অনুরোধ।"
প্রতি মুহূর্তে লোকটা নতুন নতুন মিথ্যে বলছে। কিন্তু শ্বশুরবাড়িতে কি বলবে? সাত্যক বাড়িতে বলেই ফেলেছে পুজো দিতে যাবার ব্যাপারটা।
প্রবল অনিচ্ছা স্বত্বেও পরদিন সকালে ওরা ট্রেনে চাপে। একদিন যাবে পুজো দেবে, একদিন থেকে কাছাকাছি কিছু ড্যাম দেখে পরদিন সকালে চলে আসবে ।
যে লোকটা কে পছন্দ নয় তার সাথে কোথাও বেড়াতে যাওয়াটা যে কি বিরক্তিকর সেটা দিমা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারে।
ঘুম ভাঙ্গার পর মনে পড়ল দিমার আরে! মনেই ছিল না এটাতো মাইথন এর গেস্ট হাউস। সাত্যক ঘরে নেই। উঠে বসে ভাবলে পুজো তো কাল দেওয়া হয়েই গেছে। আজ দুপুর খেয়ে দেয়ে ট্রেন ধরে মার ওখানে ফিরে যাবে। নিকুচি করেছে আজ বেড়ানো, নিকুচি করেছে হানিমুন। এমন সময় মূর্তিমান ফিরল কাগজ নিয়ে। কাগজটা খুব ঠাণ্ডা মাথায় খাটের ওপর রাখল। শুধু বললে
"দেখুন পড়ে। কাগজ খুলতেই চক্ষু চড়কগাছ। গতকাল রাত্রিবেলা দিমার এনজিওতে এনফোর্সমেন্ট থেকে রেড হয়েছে। অফিসে সিল করে দিয়েছে মালকিন হৈমন্তী রায় কে, হিসেব রক্ষক মালবিকা সান্যালকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে ওদের অফিসে এ নিয়ে গেছে। রেডটা হয়েছে রাত ট টা। তখন দিমারা দ্যামের ধারে রেস্টুরেন্ট এ। কোন রিং শুনতে পায় নি। তাড়াতাড়ি ফোনটা নিয়ে খুলল। মালবিকার ফোন তিনবার। ঠিক আটটার সময়। দিমার মুখ থেকে সব রক্ত যেন নিমেষে শুষে নিয়েছে কেউ। এটা কি করে হল? কোনো রকম এনজিও তে এদিকওদিক চোখে পড়েনি। এই লোকটা তাহলে কি পুলিশের বা গোয়েন্দার লোক? চুপ করে বসে ভাবল। তাহলে এই জন্যেই ওকে নিয়ে চলে এসেছিল সাত্যক? সত্যি লোকটা ভীষণ খারাপ। ওপর থেকে দেখে কিছুই বোঝা যায় না।
মন্দিরে পুজো দিয়ে ফিরে ড্যাম দেখতে গিয়েছিল। এখন কলকাতায় থাকলে প্রচুর ডাকাডাকি হত। দিমার অনেকদিনের যোগাযোগ ওদের সঙ্গে। আশ্চর্য্য, কিছুই বোঝেনি।
কাগজ খুঁটিয়ে পড়েছে। টিভিতে বলেছে অনেক বিদেশী মুদ্রার নয়ছয় হয়েছে। আশ্চর্য, দিমা জানত না।
মাইথন থেকে ফিরবার আগের দিন রাতে দিমাকে কথা বলতেই হল। লোকটা ও কেমন গম্ভীর হয়ে আছে। খেতে বসে হঠাৎ জিজ্ঞেস করলে "একটা কথা জিজ্ঞেস করব?"
"বলুন" গম্ভীর ভাবে উত্তর দিলে সাত্যক।
"আপনি এটা কি ভাবে জানলেন?
কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললে "বিয়ের ব্যাপার শুনে আমার জুনিয়র সেই বন্ধু বললে চাকরিরটা মোটেই ভালো জায়গা নয়। এরা অনেক বিদেশী টাকা এদিক ওদিক করে। বিয়ে হলে চাকরিটা ছাড়িয়ে দিস।"
"তারপর ও আপনি এগুলেন? ভয় করল না?"
"ভয় কেন করবে? বরং মনে হল আপনাকে জানিয়ে দেওয়া দরকার। আমি একবার চেষ্টাও করেছিলাম। কিন্তু ইউ denied টু মিট"।
"তারপর?"
"বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না। মনে হল আপনাকে বাঁচানো দরকার। বলতে গেলে আরো ক্ষেপে যাবেন"।
"কেন আমাকে বাঁচান দরকার? আপনার সাথে তো আমার কোন সম্পর্কই নেই। তাই বিয়ে করে বাঁচানোর প্ল্যান করলেন? মোস্ট ফানি। মিলছে না। আপনার বিয়ের আসল উদ্দেশ্যটা কিন্তু এখনও বলেন নি"।
"এরপর একদিন আপনি এসেছিলেন আমার অফিসে এ। আমার পদ সম্পর্কে খোঁজ না নিয়েই এসেছিলেন বলতে কে আপনাদের এনজিওর টাকা স্যাংশন যেন বন্ধ না করি। কি ঠিক বলছি তো?"
দিমা মাথা নাড়ে। "কিন্তু আপনি ছিলেন না"।
"আমার বন্ধু ব্যানার্জী ছিল না। আমি ওর ঘরে ঢুকতে গিয়ে দুর থেকে আপনাকে দেখতে পেয়ে দারোয়ানকে দিয়ে বলে পাঠাই ও অফিসে এ নেই"।
"বাহ! চমৎকার। চমৎকার। জেনেশুনে আপনি সামনে এলেন না"।
"হ্যাঁ। আসিনি। আপনার নেচার দেখে বুঝেছিলাম আপনাকে সত্যিটা বলে কিছু হবে না"।
"তাই বিয়ে করে আমাকে বাঁচাতে এগিয়ে এলেন?" বাহ, বাহ, হাততালি দিয়ে ওঠে দিমা।
যাইহোক আমি কাল সকালেই ফিরে যাবো। কোন কথা শুনতে চাই না।" বলে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে দিমা।
সেদিন ও মাঝ রাতে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল। মেঘের ডাক আর বাজের শব্দ ঘুমটা ভাঙিয়ে দিলে। একমাত্র এই বাজ পড়ার শব্দতেই দিমা কাত। শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল। সাত্যক যথারীতি ওপাশ ফিরে ঘুমাচ্ছে। উঠে বসে ভাবছিল লোকটা কেমন? আজ কলকাতায় থাকলে ওকে নিয়ে টানাটানি হত এনফোর্সমেন্ট থেকে। কারণ এনজিও র হিসেবপত্রও ও কিছুটা তো জানে। কিন্তু ডলারের নয়ছয়টা তো কখনো শোনে নি। লোকটা ভীষণ খারাপ। কিছুই বলেনি। এতদিন ধরে খেয়াল রেখেছে। অনেকগুলো খারাপ কথা বলে ফেলেছে। অবশ্য এগুলো ওর প্রাপ্য। এমন সময় ঘর একটা নীলচে আলোয় ভরে গেল ঘর। সঙ্গে সঙ্গে আকাশ পাতাল কাঁপিয়ে বাজ পড়ল সামনে কোথায়। দু হাত দিয়ে দু কান বন্ধ করে চোখ কুঁচকিয়ে চিকার করলে
"ওরে বাবারে! কি মানুষ একটা। এই যে, এই যে। আঙ্গুল দিয়ে ঠেলতে থাকে সাত্যককে। ধড়মড় করে উঠে বসে
"কি কি হয়েছে? চারিদিক তাকিয়ে বললে
"ঘুমিয়ে দু জন বন্ধ করে শুতে পড়ুন দেখবেন কমে গেছে কিছুক্ষণ পরে। বলতে বলতেই আবার ঘর কাঁপিয়ে বাজ পড়ে। দিমা সোজা "আঃ, আঃ করে সাত্যকএর ওপর পড়ে।
"কি করছেন কি করছেন?"
"দিমা গলাটা জড়িয়ে ধরে গভীর স্বরে বলে
"আপনি ভীষণ খারাপ লোক মশাই। ভীষণ খারাপ। দু মুঠো দিয়ে সাত্যকএর বুকে মারতে থাকে। ঝম ঝম করে বৃষ্টি নামে আকাশ ভেঙে। সাত্যক হেসে ফেলে
"যাক চিনতে ভুল হয়নি। ঘুমিয়ে পড়ুন কাল সকালে ফিরবার ট্রেন ধরতে হবে"।
"না। আপনার কি কোন মন বলে কিছু নেই? আমি বললাম কাল ফিরে যাবো আর আপনি বোকার মত কিছু না বলে ঘুমিয়ে পড়লেন? ভগবান কি মাথায় কি কিছুই দেয়নি? আমাদের বেড়ানো তো এখনও বাকি আছে। কাল আমি যাবই না"।
সাত্যক হেসে ফেলে" এই খারাপ লোকটার সঙ্গে বেড়ানো যাবে? ভয় লাগবে না তো?"
গুমগুম করে আরো দুটো কিল বসিয়ে দেয় দিমা সাত্যকএর বুকে।
"তাহলে টিকিট দুটো?"
"যাক গে। আমি যাবো না ব্যস"।
বৃষ্টির শব্দ চালে একটা ঝিম ধরানো শব্দ করছে। দিমার খারাপ লোকটার আর কোন উদ্দেশ্য আছে কিনা জানে না। থাকলে থাকুক। আর কিছু শুনতে চায় না ও। জানলায় ছাট এসে ধাক্কা লাগছে।
বৃষ্টির ধারার শব্দে চাপা পড়ে যায় সাত্যক এর কথা ।
'নয়না নীর বহা, সখী বিন মোরা জিয়া তরসায়ে'-
পথ থেকে প্রান্তরে
শ্রীতন্বী চক্রবর্তী
প্রবন্ধ
একেকটা বারান্দায় বসে থেকে থেকে সময় কেটে যায় বেলায়, অবেলায়। পেশক চা-বাগান সবুজ আঁচল বিছিয়ে রাখে রাতভর, চা-পাতার ডগায় সূর্যের আস্তরণ মেখে শিশিরবিন্দু বন্ধু হয়ে ওঠে ময়ূরের, ময়ূরপঙ্খী, বন্য সবুজ আভরণে বন্ধু হয়ে ওঠে বাঁশকাঠি-দোকানের স্বপ্ন-পোশাক বিক্রেতাও - 'পাহাড়ি জামা নেবে? পাহাড়ি মেয়ের মত ছবি তুলবে?' বারান্দার সামনে পায়ে-হাঁটা গালিচা রাস্তা বৃষ্টিতে হঠকারী, মেঘের নাদে চুঁইয়ে পড়ে কাদম্বিনী মধু, রাধা সেজে বিস্মৃত অতীত থেকে তুলে আনি আঁখিপল্লব-ছোঁয়া চামর, পাইনের ঝিরঝিরে পাতা কখন না জানি অবিচ্ছেদ্য হয়ে পড়ে সন্ধ্যারাগের সন্নিকটে। বারান্দার অন্যদিকে আঙুল বরাবর রাধারাণীর নাকছাবি হীরের দ্যুতি হয়ে ছড়িয়ে পড়ে কালিম্পঙে, আবেগবিহ্বল হয়ে পরিজন খুঁজে চলি আমি আর অনন্যসহায় মার্জারটি, পিঙ্গল বাহারে তিস্তার হৃৎকম্প সে বুঝি বা জানতে পেরে যায়।
আনীল আকাশ রাত বাড়লে পরিযায়ী পাখির মর্মর কলতানে উচ্চকিত হয় না। অক্ষাংশের প্রাগৈতিহাসিক প্রান্তে কোথা থেকে মন্দ্রমুগ্ধ স্বরে গান জেগে ওঠে - 'আজ রাধা ব্রিজ কো চলি', নুপুরের ছন্দ থামে না, গারলাং স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে ঘুরে ঘুরে আলতা-পা নুপুরের ছন্দ ছাড়ে না, সে যদি কখনো কাউকে ভালোবেসে থাকে, তাহলে সেইক্ষণ বিধ্বংসী বিনয়ে উপস্থিত হয় তার সামনে আজ আবার। দ্রাক্ষাসবুজ বন্দরে আজও অপেক্ষায় থাকে তার নাবিক, রূপকথার রাজপুত্র বেসাতি করে ফিরে আসে, চা-বাগানের শীতলপাটি পেতে নিবিড় আলিঙ্গনে রাধা আবদ্ধ হয়,
সরোদের মূর্ছনায় মনের তন্ত্রীতে বাজতে থাকে - 'সাজনা, বরষে হ্যায় কিঁউ আঁখিয়া', মেঘ কাকে গিয়ে গিয়ে বলবে, মন কেন থেকে থেকে কেঁদে ওঠে? শূন্য পথের কাঁটাপ্রান্তরে চন্দ্রজোছন সাক্ষী থাকে তাদের আলিঙ্গনের। আরো দূরের পাহাড়ে উপোষী রাত গভীর হয়, ভরন্তযৌবনা রমিতেধারা ছন্দ, অলংকার, শব্দ, বাক্যবিন্যাসের বাঁকে বাঁকে ঝরো ঝরো হয়ে ঝরে পড়ে স্তব্ধ পাথরের বুকে, বন্দরত্যাগী নাবিক রাধার অশ্রুসজল চোখে চেয়ে গেয়ে ওঠে - 'নয়না নীর বহা, সখী বিন মোরা জিয়া তরসায়ে।'রুক্ষ পাহাড় বিরূপাক্ষ, সহস্র শতাব্দী ধরে চিন্তার কোলাহল শুনে মরমে মরসুমি ভালোবাসার উদ্গীরণ জাগায়, বাসন্তী-সম্মেলনে রাধার অনুনয় পুষ্পস্তবক হয়ে উপহার হয় নাবিকের বক্ষে, সে ব্যাকুল হয়ে পাপড়ির ঠোঁটে ছুঁয়ে দেয় ঠোঁট, বিদ্যুদ্দীপ্তির বর্ণিল আভা প্রবেশ করে দুজনের রন্ধ্রে, রন্ধ্রে। কেন? এত আকুল কেন হয় রাধা? স্খলিত আশা-নিরাশার পরিব্যাপ্তি ত্যাগ, তিতিক্ষায় এসে শেষ হয় না, নাবিক ক্লান্ত হয়, বিদীর্ণ হয় সংযমের চিরপাপিষ্ঠ বন্ধন, তবু নাবিক হাল ছাড়ে না, উদাত্তকণ্ঠে ব্যক্ত করে কামনার পরিতৃপ্তি, রাধাকে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর চুম্বন করে, রাতভর, অক্লেশে, যতক্ষণ না রক্তাভ বৃষ্টিভোর বনবিহারী-রাধের বক্ষবিভাজিকায় প্রবেশ করে শারঙ্গীস্বরূপ, তার গতি হয় মন্থর, চন্দনপত্র আর গুরাসকুঞ্জের শীতলতায় শরীর এলিয়ে দেয় বৃষ্টিভোর, অপেক্ষা করে, ঘুম ভেঙে উদাত্ত কণ্ঠে রাধাকৃষ্ণ-স্বর ধাবিত হয় চারদিকে- 'ধনী ধনি বনি অভিসারে / সঙ্গিনী রঙ্গিনী প্রেম-তরঙ্গিণী সাজলি শ্যাম-বিহারে।'
প্রবন্ধ
একটা সময় ছিল যখন আমি স্কুলের পড়ার ফাঁকে সময় পেলেই ফেলুদার বইতে মুখ ডুবিয়ে থাকতাম। আমার জীবনে ফেলুদা এসেছে ব্যোমকেশের পরে। আমাদের বাড়িতে আগে থেকেই শরদিন্দুর রচনাবলী ছিল। ফলে ব্যোমকেশের সাথে পরিচয় হয়েছে প্রথমে। কিন্তু একটু দেরি করে পেলেও ফেলুদার ম্যাজিকে মন মজে যেতে বেশিক্ষণ লাগেনি। এখনও মনে আছে, প্রথম ফেলুদার বই, গড়িয়াহাটের “জ্ঞান সঞ্চয়ন” দোকান থেকে কেনা, ছিল “গোরস্থানে সাবধান”! প্রথম কয়েকটা পাতা উল্টেই মনে কেমন একটা আলোড়ন হয়ে গেল। ব্যোমকেশ ১৯২০ সালের বাঙালির প্রতিনিধি। কিন্তু সেই বই পড়ে একবারও ১৯৯৫ সালের আমার ব্যোমকেশকে বাড়ির দাদা মনে হয়নি। কিন্তু এই বই পড়ে এক মুহূর্তেই যেন মনে হল আমার পাশের বাড়ির কেউ এইসব গোয়েন্দাগিরি করছে। ফেলুদার সব কিছু খুব চেনা। আর সেই সাথে আছে দারুণ ছবি। ব্যোমকেশের বইয়ে ছবি ছিল না।
এক একটা বই যে কতবার পড়েছি, ঠিক নেই। তবে সবকটা বই বা গল্প অন্তত পঞ্চাশ বার তো হবেই। মনে আছে, ফেলুদার বইয়ের প্রথম দিকের পাতায়, যেখানে গল্প শুরুর আগে প্রকাশকের নাম ইত্যাদি থাকে, সেখানে ফেলুদার সবকটা বইয়ের নাম দেওয়া থাকত। আমি সেখানে টিক দিয়ে দিয়ে বই কিনতাম। সত্যজিৎ রায় মারা যাওয়ার বেশ কিছুদিন পর ফেলুদার নতুন একটা উপন্যাস প্রকাশ হয়ঃ রবার্টসনের রুবি। সেটা প্রকাশের কয়েক দিনের মধ্যেই মাকে দিয়ে কিনিয়েছিলাম, একটা বাংলা নববর্ষের সময়ে। আর তারও বেশ কিছুদিন পর, আমি যখন অনেকটা বড়, তখন প্রকাশিত হয় “ইন্দ্রজাল রহস্য”। সেটাও খবর পেয়েই কিনেছিলাম। তখন গড়িয়াহাটে দুটো বইয়ের দোকান ছিলঃ জ্ঞান সঞ্চয়ন আর আইডিয়াল বুক স্টোর্স। এই দুটোর সামনে দিয়ে গেলেই ফেলুদার বই কেনার ইচ্ছে হত। আর যেসব গল্প কোনও সংকলনে থাকত, যেমন “সেরা সত্যজিৎ”, সেগুলো কারুর বাড়ি গেলে ফাঁক পেয়ে পড়ে নিয়েছিলাম।
আমার ছোটবেলায় আনন্দমেলা পত্রিকায় ফেলুদা নিয়ে অনেক কিছু প্রায়ই প্রকাশিত হত। মনে আছে, একবার বিশ্বের অন্যান্য গোয়েন্দার সাথে একটা তুলনা করে লেখা হয়েছিল যে শার্লক হোমস্ এর থেকেও ফেলুদার গল্প অনেক বেশি সেরেব্রাল। সেই সময়টা আমার কাছে ছিল আইকন খোঁজার। ফলে ফেলুদা সেই বয়সে ছিল আমার আইকন। বিশ্ব সাহিত্যের সাথে তখন পরিচয় কোথায়? শার্লক হোমস পড়েছি কিছুটা। আগাথা ক্রিস্টি বা নিরো উলফ তখনও অনেক দূর। আর জেফ্রি ডিভার নামই শুনিনি। ফলে তখন যদি পত্রিকার পাতায় দেখি যে ফেলুদার গল্প পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ, সেই বয়সে সেটাই বেদবাক্য বলে মেনে নেওয়া স্বাভাবিক।
সোনার কেল্লা সিনেমাটা প্রথম দেখি দূরদর্শনে “ছুটি ছুটি” বলে গরমের ছুটিতে যে প্রোগ্রাম হত, সেখানে। তারপর আরও অনেকবার। এছাড়া “জয় বাবা ফেলুনাথ” তো বটেই। আমার ছোটবেলায় দূরদর্শন ছিল বাইরের জগতের একমাত্র দরজা। সেখানে এই দুটো সিনেমা ছাড়াও ওই যে ছোট ছোট টেলিফিল্ম হয়েছিল, যেমন “ঘুরঘুটিয়ার ঘটনা” সেটাও বাদ দিইনি। অবশ্য এ কথাও মনে রাখতে হবে যে হিন্দিতে যে ব্যোমকেশ বক্সী তখন হচ্ছিল, সেটাও যে বাদ দিচ্ছিলাম, তা নয়।
ফেলুদার বইয়ের সবকিছুই ছিল, যাকে বলে, আমার আদর্শ। সেই বেড়াতে যাওয়ার বর্ণনা পড়ে বেড়াতে যাওয়ার আগে একটা জায়গা নিয়ে গবেষণা করার অভ্যাস হয়েছিল আমার। এমনকি একটা সময় এরকমও ছিল যে অচেনা লোক দেখলে তার পোশাক, হাত নাড়া, মুদ্রাদোষ ইত্যাদি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা অভ্যাস ছিল আমার, যাতে সেই লোক সম্পর্কে না বলতেই অনেক কিছু আন্দাজ করতে পারি। বোম্বাইএর বোম্বেটে পড়ে সেই কল্লোলের ফাইভ মিক্স সুইটস খাওয়ার ইচ্ছে হয়েছিল আমার। যদিও সেটার কোনও অস্তিত্ব আর আমার ছোটবেলায় ছিল না। ফেলুদার বইতে পড়া জায়গাগুলোতে সব বেড়াতে যেতে হবে, এরকম একটা লক্ষ্য ছিল আমার মনে। রবার্টসনের রুবি পড়ে আমি খোঁজ করেছিলাম যে শান্তিনিকেতন যেতে সত্যিই ওরকম বিলাসবহুল ট্রেনের কামরা আছে কিনা। কিন্তু সেটা আর তখন ছিল না। এমনকি ফেলুদার বইয়ে পড়ে একটা সময়ে খবরের কাগজের খবরের কাটিং একটা খাতায় সেঁটে রাখাও শুরু করেছিলাম।
এরপর কলেজেও সেই মুগ্ধতা ছিল। বইগুলো মাঝে মাঝেই উল্টে পাল্টে পড়তাম। কলেজে ওঠার পরেই রিলিজ হল “বোম্বাইএর বোম্বেটে”। অবশ্যই দেখলাম ফার্স্ট ডে ফার্স্ট শো। সেইদিন প্রিয়া সিনেমায় সব্যসাচী চক্রবর্তী শোএর আগে এসেছিলেন। তাঁর সাথে হ্যান্ডশেক করলাম। তারপরেও কৈলাসে কেলেঙ্কারি ইত্যাদি সিনেমা বেরোলেই সোজা হলে। ইতিমধ্যে নানা জায়গায় ফেলুদা নিয়ে প্রবন্ধ পড়ি। এর থেকে ভালো গোয়েন্দা যে আর পৃথিবীতে নেই, সেই বিশ্বাস আমার মনে দৃঢ় হয়েছে। তখন বয়েস বেশ খানিকটা বেড়েছে, কিন্তু আমার মন পড়ে আছে সেই ফেলুদার জগতেই। এমনকি যখন লন্ডনে গেলাম, তখন “লন্ডনে ফেলুদা” বই থেকে লিস্ট করে নিলাম যে কোন কোন জায়গার কথা সেখানে আছে। সেই জায়গা গুলো দেখতেই হবে যে। সেই অক্সফোর্ড স্ট্রীটের সেলফ্রিজেস, সেই ২২১বি বেকার স্ট্রিট ইত্যাদি। সেগুলো একদম লিস্ট করেই দেখেছিলাম এবং সেটা নিয়ে ফেসবুকে পোস্টও দিয়েছিলাম।
এরপর কাজের চাপ বাড়ল। ফেলুদার বই ভালো করে মলাট দিয়ে (সেটাও কোন একটা উপন্যাস থেকেই শেখা) আলমারিতে তুলে রাখলাম। এগুলো আমার নিজস্ব ধনরত্ন। কাউকে দেওয়া যাবে না। এগুলো আমার সঙ্গে সারাজীবন থাকবে। এরকম একটা দৃঢ় ধারণা তখন মনে। চারিদিকে দেখি ফেলুদা নিয়ে আরও অনেক সিনেমা হয়। যদিও সেগুলো আর দেখার সময় হয় না। বয়স হয়ে গেছে। আনন্দমেলা আর কিনিনা। কিন্তু মনের মধ্যে ফেলুদার নাম থাকেই। গল্পগুলোর নাম তো সব মুখস্ত। সেই ছবিগুলোও ইন্টারনেটএ মাঝে মাঝেই দেখা যায়। আর ইউটিউবে আছে সব সিনেমা। পুরো সিনেমা দেখার সময় আর নেই। কিন্তু ক্লিপ তো দেখাই যায়।
দশ-পনেরো বছর চলে গেল। এর মধ্যে নিজের জীবনে অনেক পরিবর্তন ঘটে গেছে। অনেক নতুন অভিজ্ঞতা হয়েছে আস্তে আস্তে। নানা জায়গা থেকে অনেক নতুন বইয়ের সন্ধান পেয়েছি। অনেক নতুন লেখকের সাথে পরিচয় হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, একবিংশ শতকের বিশ্বের বিভিন্ন লেখকের বই পড়তে শুরু করেছি। এইরকম একটা সময়ে, বহু বহু দিন পর হাতে এল একটা ফেলুদার বই। সেই ছোটবেলার অভ্যাসবশেই হাতে তুলে খুলে দেখলাম। এইসব বইয়ের পাতায় পাতায় ধরা আছে আমার ছোটবেলার অনেকটা সময়। দশ-বারো-পনেরো বছরের আমির জীবনে বাইরের জগতের ভূমিকা যতটা, ঠিক ততটাই ভূমিকা রয়েছে এইসব বইয়ের।
কিন্তু এই এখন বই খুলে একপাতা-দুপাতা পড়েই কেমন একটা অস্বস্তি শুরু হল। প্রথমে ঠিক বলে বোঝাতে পারলাম না। বইয়ের পাতা উল্টে যাচ্ছি ঠিকই, কিন্তু কোথায়? সেই আমেজ তো নেই! পড়তে যেন কেমন কেমন লাগছে। সেই ডায়ালগ, সেই জায়গার বর্ণনা, সবই একরকম আছে, কিন্তু আমার তো আর সেই চুম্বকের মত আকর্ষণ নেই। চার পাঁচ পাতা পড়ে আর ভালোই লাগল না। বই বন্ধ করে রেখে দিলাম। মনে হল, আজকে খুব ক্লান্ত। তাই এরকম হচ্ছে। এর পর সময় পেলে আবার পড়ব।
এরপর সময় পেলাম আবার। কিন্তু পাশে ফেলুদার বই থাকলেও আর সেটা হাতে তুলে নিতে ইচ্ছে হল না। বরং হাতে তুলে নিলাম অন্য একটা আধুনিক লেখকের লেখা বই। সেটাতেই মন ডুবে গেল। এরপর সেই ফেলুদার বই টেবিলে থেকে ধুলো জমতে শুরু করল। আমার আর পড়া হয় না। অবশেষে একদিন জোর করেই বইটা খুললাম। মনকে বোঝালাম, পড়ার অভ্যাস চলে গেছে। এটা ভালো না। এইসব বই চিরকালীন। কিন্তু আবার সেই এক অনুভূতি। কিছুতেই আর মন বসে না। মাঝখান থেকে পড়লাম। সব বইয়ের ভিলেন মুখস্ত ছিল আগেই। কিন্তু একটা সময় রহস্যের সমাধান জেনেও তো বারবার পড়েছি এইসব বই। কিন্তু এখন দুপাতার বেশি চোখ আর চলছে না। বরং, মনে কয়েকটা বেয়াড়া প্রশ্ন আসছে যে। এর আগে যখন পড়েছি, তখন এরকম প্রশ্ন করার মন ছিল না। কী কী প্রশ্ন?
প্রথমেই যেটা এখন চোখে লাগছে, সেটা হল, এইসব বইয়ে নারী চরিত্র কোথায়? দুজন যুবক কলকাতায় বসে কাজ করছে, এত লোকের সাথে রোজ দেখা হচ্ছে, এর মধ্যে মহিলা কোথায়? তোপসে চরিত্রের মা দু-একবার দেখা দিয়েছেন, এই পর্যন্ত। কিন্তু সেটা নেহাত অলঙ্কার। প্লটের প্রয়োজনে নয়। এই যে এ