
প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা

এপ্রিল
২০২৩

প্রচ্ছদঃ সুরজিত সিনহা
লেখক/লেখিকাবৃন্দ

গল্প
“লয়ন, ও লয়ন উঠবি নি! সূয্যি ঠাকুর উঠি পড়তিছে যে! উঠরে বাপ, মাঝির তাড়া খাবি যে। ”ফুলমনি ব্যস্ত হয়ে ছিঁটাবেড়া ঘেঁরা তাদের ছোট উঠানে কুঁচিকাঠির ঝাঁটা চালায় আর গজগজ করে নিজের মনে-
“কবে যে বিলের কুঁচির ঝোড়ে যাওয়া হবেক! আগে বুঢ়াডা গাঁও মাঝির গাই গুলান চরাতে যেত – গাঁয়ের বাইরের মজা বিলের ধারে বেড়ে ওঠা কুঁচির গোছা লয়ন লিয়ে আসতো। এখুনতো বুঢ়াডারে ঘরে একা ফেলে যেতি হবি। পাইকারবাবু তাড়া দেয়। কথা মতন পচাশটা ঝাঁটা না দিলে, দাদনের ট্যাকা ফিরাতে হবেক। কি যে করি!“
নয়ন ছেঁড়া চাটায়ে শুয়ে আছে চোখ মেলে। ওপরের খাপরা চালের অজস্র ফুটফাটায় কাক ভোর আকাশের টুকরো দেখে সে। দিনের নতুন আলোয় গাঁ’বুঢ়ার মোরগগুলা ডাক পেড়েছে – কু- ক্রুর-কু। উঠেই পড়ে নয়ন। না! আজ বিল থেকে কুঁচি নিয়ে আসতেই হবে।
মা’র আগের রাতে গুছিয়ে রাখা গামছায় বাঁধা মুড়ি আর ডেলা খানেক গুড় নিয়ে বেরিয়ে পড়ে নয়ন। তাদের আসনপানি গ্রাম মাঝির গরু চরায় সে এখন। আজ বেশ কয়েক মাস বাপ কাজে যেতে পারে না। বাপটা কি যে ব্যায়রাম বাধিয়েছে মারাংবুরু দেওতাই জানেন। মোড়লের গরু না চরালে, মাসের শেষে যে’কটা ট্যাকা পাওয়া যায় তাও বন্ধ হয়ে যাবে। তাই এই কয়েক মাস ওই দূরের ধূমল নীল পাহাড় আর জঙ্গলে ভরা হাতির মাথার মত গজ ডুংরীগুলোর মাঝ দিয়ে আঁকাবাঁকা বয়ে যাওয়া সরু লদী সাতগুরুঙের ধারে আকাশমণির জঙ্গলে গ্রাম মাঝির গরু গুলোকে চরা’তে নিয়ে যায় নয়ন।
গাঁ’এর শেষ মাথায়, বড় তেঁতুল গাছের ছাওয়ায় অড়লফুল ঝোড়ের মাঝে খোলা জায়গার পাঠশালাটায় নয়ন আর যেতে পারে না। নয়নের ভালোই লাগতো পড়তে যেতে, পড়ার শেষে পেট ভরে ভাত ডাল খাওয়ায়। গাঁ’এর কুড়ি বাইশটা ছেলেমেয়ে সচরাচর কামাই করে না ওই পেট ভরে খাওয়ার লোভে।
গ্রামের মধ্যে দিয়ে কাদা জমে শক্ত হওয়া ধূসর রাস্তাটা চলে গেছে সোজা সেই তেঁতুল গাছের পাশ দিয়ে গ্রামের বাইরে। তারপরই রাস্তাটা লাল নুড়ি মাটির, গরুর গাড়ির চলাচলে পিঠে কুঁজ নিয়ে ওঠা নামা রাস্তাটা এঁকে বেঁকো চলে গেছে সেই দূরের নীল পাহাড় পানে। মাথায় জঙ্গল নিয়ে দাঁড়িয়ে প্রথম গজ ডুংরীটা পেরলেই সাতগুরুং লদী। মারাংবুরু পাহাড় থেকে নেমে আসা সাতটা ঝোরা লদী হয়ে বয়ে চলছে কতদূর্ কে জানে, নয়ন জানে না। গ্রাম মাঝিবুঢ়াও বলতে পারেনি। তবে বলেছিল গাই ছাগল চরাতে বা কেঁদু পাতা তুলতে কখনই যেন সাত ঝোরা পাহাড়ে কেউ না যায়। ওখানে নাইহার বোংগা থানা গেড়ে আছে। ওর বাপও মানা করেছিল যেদিন নয়ন প্রথম গাই চরাতে যায়।
নয়ন এখন চলেছে পনেরো কুড়িটা গাই, বকনার পিছনে। বাঁশের ছিপটি আস্ফালনে তাদের লাল মাটির পথের বাইরে যেতে দেয় না। পথের দু ধারে ভুট্টার ক্ষেতি। রেতেরবেলা গাঁয়ের ছেলে বুঢ়াগুলান পালা করে ক্ষেতি পাহারা দেয় নইলে পাশের বনের হরিণরা এসে খেয়ে যাবে সব, ক্ষিদের জ্বালায় হাতিরাও আসে যখন ফসলে ধরে সোনার রঙ। নয়নকেও পাহারায় যেতে হয় মাঝে মাঝে।সাদার ওপর কালো ছোপ ছোপ বুধিয়া গাই তার খুব প্রিয়। বুধিয়া জানে লদীর ধারে কোথায় সরেস ঘাস আছে অন্য গাইদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলে সে। নয়ন একবার দেখে নেয় তার হাঁটুর ওপর তুলে পরা ধুতির গেঁজে নিজের বানানো মূলি বাঁশের আড় বাঁশীটা ঠিকঠাক আছে কি না। সাতগুরুং লদীর ধারে আছে আকাশমণির জঙ্গল। গাছের ছাওয়া বসে বাঁশী বাজায় নয়ন। গাইগুলান চরে বেড়ায় সাতগুরুং এর পারে। লম্বা লম্বা পা’য়ে ধোক পাখির জোড় পোকার খোঁজে ঘোরেফেরে গাইগুলার পায় পায়ে। বাঁশীর সুর লদীর ধারের আকাশমণির জঙ্গল, ওপারে এক ফালি রুখুসুখু জমি ঘেঁসা মৌউলের বন, বনবাবু বলে তমাল বন, ওই ঘন বন ছুঁয়ে ভেসে যায় দূর নীল পাহাড়ের চুড়ায় চুড়ায়। বুধিয়া তার পাশে বসে শিং নেড়ে ঘাস পোকা তাড়ায় আর আনমনে আড় বাঁশীর সুর শোনে নয়না। নয়নের মামার বাড়ির গাঁও মেঘদহ। তার মা ফুলমণির সই’য়ের মেয়ে নয়না। সে তাদের ছাগলগুলো চরাতে নিয়ে আসে নদীর ধারে। দু ফালি সরু সবুজ পাড়ের ফ্যাকাশে সাদা থান কাপড়ের ‘ফাতা’য় মোড়া রোগাসোগা শরীর, রুলি পরা দুটো চিকন কালো হাত বেরিয়ে আছে গাছ কোমরে পরা কাপড়ের ফাঁক দিয়ে। এক ঢাল রুখু চুলের বেণী লতিয়ে আছে তার পিঠের পরে। কানে লোহার তারের মাকড়ি। নাকে পুঁতির নাকছাবি। শুকনো লাল আবির রঙা ধুলোয় মাখা পা’য়ের গোছ। সূয্যি ঠাকুর মাথার উপর উঠলে, গাছের ছাওয়া জড় হয় আকাশমণির গুঁড়ির চারপাশে। আকাশমণির জঙ্গলে গাই ছাগলের চরে বেড়ানোয় দৃষ্টি রেখে নয়না বসে থাকে তার পাশে, তার নানা কথা শুনতে হয় নয়নকে।
মাঝে মাঝেই নয়না বলে ফেলে তার মনের অনেক কথা। মা’র কথায় নিয়ম মত গাঁয়ের যোগমাঝির সাথে তাকে যেতে হয়েছে টুসুর মেলায় বরের খোঁজে। কাছে পিঠের গাঁও থেকে মেয়েরা আসে কত সেজেগুজে। মাথায় তাদের লাল পলাশ, হাতে রঙ বেরঙের রেশমী চুড়ি, গলায় দোলে পলাশ বীজের মালা, গাছ কোমরে পরা হরেক রঙের শাড়ি, পায়ে রুপালী মল। তারা দল বেঁধে নাচে। মরদ গুলানের পরনে হলুদ ছোপানো নতুন ধুতি। ধামসা-মাদলের ছন্দে দুলে ওঠে শরীর ও মন, মরদগুলার তেল চুকচুকে চুলের গোছা নাচের তালে তালে ঝাঁপিয়ে পড়ে চোখেমুখে। মেয়ে মরদের দল যেন হাওয়ায় ভাসে – গানের সুরে, ধামসার তালে তালে। ধীরে ধীরে মুখোমুখি হয়ে, আবার পিছিয়ে আসে। নয়না বরাবর থেকে যায় নাচের দলের বাইরে। সে দূর থেকে দেখে কিন্তু এগিয়ে যেতে পারে না। এবার সে তার বাঁ’পা টা দেখায় নয়নকে। ওই পা টা যেন শুকিয়ে যাওয়া বুনো শিয়াকুলের ডাল। ছোটবেলায় গাঁ’এর সোরেন হাড়াম জবাব দিয়েছিল। নয়নার বাপ ধার কর্জ করে তাকে নিয়ে গেছিল বাঘমুড়ির সরকারের হাসপাতালে। কিন্তু কাজ হয় নি। নয়না তাই জোর পায় না বাঁ পায়ে। একে একে মনের মত বর পেয়েছে তার অনেক সই। যোগ মাঝি আশা ছেড়ে দিয়েছে সেই কবে। কথার শেষে নয়নার উদাস চোখ আকাশমণির ডালপালার ফাঁকের নীল আকাশের জাফরির থেকে সরে গেছিল লদীর ওপারে মৌউল বনের গভীর ঘন সবুজে।
নিঝুম দুপুর, দূর থেকে ভেসে আসা তিলা ঘুঘুর একটানা ডাক, দুপুরের নির্জনতা ঘন করে তোলে। লদীর ধারের আকাশমণির ডালপালার ফাঁকে নীল আকাশে নয়ানার উদাস চোখ। গাঁয়ের মাঝির মেয়ের বাপলা বিয়ের আসরে শোনা গানগুলি নয়নের মনে গেঁথে আছে। নিজের মনে গানের কথা উল্টেপাল্টে নিজের সুরে বাঁশী বাজায় নয়ন। শোনে তার মা ফুলমনি আর শোনে বুধিয়া গাই আর নয়না যখন তারা সাতগুরুঙের ধারে গাই বকনা চরাতে যায়।
নয়ন আড়বাঁশীতে গানের সুর তোলে।
“কালো জলে কুচলা তলে ডুব দেয় আসনপানির লয়ন
আজ সারা না, কাল সারা না পাই যে দরসন৷
লদীধারে আকাশমণি, মৌউলির বন –
বঁধু মিছাই কর আস
ঝিরিহিরি আঁকাবাঁকা সাতগুরুং বইছে বারমাস..........”
পা’য়ের পাতা ডোবা নদীর জলে ছড়ানো পাথরগুলো কালো কুচকুচে কাছিমের পিঠের মত জেগে আছে ইতিউতি। নিথর দুপুর, আকাশের নীল ছায়া জমা নিস্তরঙ্গ জলে খেলে বেড়ায় ছোট ছোট রুপোলী কুচো মাছের দল। নয়ন গামছায় মাছ ধরে, নয়না অবাক চোখে দ্যাখে। নদীর ধারে বেড়ে ওটা কচু পাতায় রাখা মাছ নয়নার সাথে ভাগাভাগি করে নেয় নয়ন।
সূয্যি ডোবার আগে ফিরতে হয় গাঁয়ে। আঁধার নামলে পথে হুড়ার, বন শুয়োরের ভয়, দল ছাড়া হাতিও কখনো পথ জুড়ে দাঁড়ায়। নয়না কুড়িয়ে রাখা কেঁদু পাতার গোছা ছাগলের পিঠে রেখে, ফেরে তার গ্রামে।
অস্তগামী সূর্যের কমলা আলো ছড়িয়ে পড়ে গরুর ক্ষুরে ওড়া ধুলোয়, সেই রেশ নয়নার কাজল
কালো হরিণ চোখে ফোটায় মায়াবী আলো। নয়নের কিশোর মনে সেই আলো কোন অজানা দিশার সন্ধান নিয়ে আসে। বুধিয়া গাই পথ দেখিয়ে নিয়ে চলে গাঁয়ের পথে – নয়নার ছাগলের দল মিশে যায় গরুর পালে। নয়ন তার আড় বাঁশীতে আবার গানের কথার সুর তোলে –
“বাঁশুরিয়া বাঁশী ফুঁকে মাদ্যোল্যা মাদল
পাহাড়িয়া লদী শুধু
বহে কল কল
আমার মনের বাগে
ফাগুনের আগুন
তোলপাড়া করে মন
হিয়া থর থর
সাঁজ বেলি রঙ মাখ্যে
গগনে মগনে
বাঁশী শুন্যে মজে মন
-----“
খুঁড়িয়ে চলা অলস পায়ে নয়নের পাশে পাশে এগিয়ে চলে নয়না। আর কয়েক কদম এগিয়েই তারা আলাদা হয়ে যাবে যে যার গাঁ’য়ের পথে।
গ্রাম মাঝির গোয়ালে গরু তুলে, ধুনো দিয়ে, দিন মজুরের খোরাকি এক সাঁনকি লাল মেটে চাল, দুটি চুরকা-আলু আর কাগজে মোড়া খানিকটা নুন হাতে তুলে দেয় মাঝি বউ। তার আগে মাঝির উঠানে উড়ে আসা পাতা, ডাল পালাও ঝেঁটিয়ে দিয়ে ছুটি পায় নয়ন। সাঁজের আলো নিভে গিয়ে অন্ধকার নেমে আসে গাঁয়ে, আশেপাশের জঙ্গলে, কাছের গজ ডুংরির গায়ে। গোয়ালের বাতার ফাঁকে গামছায় বেঁধে রাখা কচু পাতায় মোড়া কুচো মাছগুলো নিয়ে অন্ধকারে ঘরের পানে হাঁটা দেয় নয়ন।
খাপরা চালের ছিঁটাবেড়া দেওয়া গিরিমাটি লেপা মেটে ঘর নয়নদের। দূরে রাতের আলোয় দেখতে পায় ঘরের পাশে ঝোপড়া বুনো জাম গাছটার জমাট বাঁধা অন্ধকার ঝুঁকে পড়েছে তাদের খাপরার চালে। এগিয়ে চলে নয়ন। কানে আসে ঘরের পাশের ডোবায় বুনো জামের পাতা পচা জলে একটানা ব্যাঙের ডাক।
ঘরের দাওয়ায় রাখা কাঠের ডেঁড়কোয় রেড়ির তেলের কুপি। রাতের বাতাসে কাঁপা কাঁপা হলুদ আলো ছড়িয়ে আছে গোবর নিকনো ছিটা বেড়া ঘেরা ছোট্ট উঠানে। ঘরের ভেতর থেকে ভেসে আসে হ হ হ– কাশির দমক। বাপটার জন্য বুকে মোচড় লাগে নয়নের। এবার মাসের ট্যাকা পেলে বাপটারে নিয়ে যেতে হবে বাগমুড়ির সরকারি হাসপাতালে।
দাওয়ার চালার নিচে, মাটি খোঁড়া চুলার খোঁদলে শুকনো ডালপালা গুঁজে দিচ্ছে ফুলমনি। পাট কাঠির ফুঁ তে ঝলকে ওঠা লক লকে আগুনের শিখায় মা’র ঘাম তেলা মুখ লালচে দেখায়। রাতপোকার দল কুপির আলোর চারপাশে গুনগুনায়। নয়নার দুখী হরিণ চোখ ভেসে ওঠে লক্ষ তারায় মোড়া রাতের আকাশে। নয়ন দাওয়ার দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বাঁশীতে সুর তোলে –
“একটু ঠিকর করে লাচরে ভাবের মার্যানী,
একটু গিদার করে লাচরে ভাবের মাল্যানী।
তোরে আম বাগানের আম খাওয়াবো এখুনি
তোরে জাম বাগানের জাম খাওয়াবো এখুনি।“
রাতের কালো নিথর আকাশে ভেসে বেড়ায় আড় বাঁশীর মিঠে সুর।
গাঁ’য়ের ওধারে ভুট্টার ক্ষেতি থেকে হঠাৎ ভেসে আসে একটানা মাদলের শব্দ সাথে হরেক স্বরে হো হো হো আওয়াজ। মশালের আলোয় ওদিকের এক ফালি আকাশ আগুন রাঙা। আজ হাতি ঢুকেছে বোধহয়। কাল নয়নের পাহারা দেওয়ার পালা। পাহারায় গেলে রেতে ভাত জোটে না। তবে নতুন কিছুর স্বাদ চিনিয়েছে পাশের দুয়ারসিনি গাঁয়ের পালান কিস্কু। ওদের গাঁয়ের আশ পাশের বন জঙ্গলে শহর বাবুরা ঘুরতে আসে। বন বাবুরা পালানকে বাবুদের বনজঙ্গল ঘোরানোর কাজে লাগিয়েছে। সে তাদের জঙ্গল চেনায় আর নিজে শেখে অন্যকিছু। রেত পাহারায় পালান গামছায় বেঁধে নিয়ে আসে লম্বা বোতলে ভরা ভাত পচাই। লুকিয়ে রাখে ক্ষেতি পাহারার মাচার নিচে। পাহারা দলের গাঁ বুঢ়ারা রেতের দিকে ঝিমোতে থাকে, কারুর হাতে শাল পাতার চুট্টার আগুন বিন্দু ধিকি ধিকি জ্বলে। সে নয়নকে মাচার নিচে নিয়ে এসে হাতে তুলে দেয় পচাই এর বোতল। নয়ন এখন বোঝে ভাত পচাই প্যাটের খিদে মেটায় আবার নেশাও ধরায়। পালান বলে –
“তুকে লিয়ে যাব’রে বনবাবুর কাছে। জঙ্গলের গাছে গাছে লম্বর দাগাতে হবে। মাসকাবারি মজুরি পাবি বটেক আর উপরিও আছে’রে লয়ন। শহরবাবু গুলানের হাতে গজ্ গজ করে ট্যাকা। হুই তো সেদিন এক বাবু বলে এক বোতল ভাত পচাই লিয়ে আয়। ঘরে ছিল বাপের এক বোতল, মুর মাতা খারাপ হলো রে লয়ন – বাবুটা মোরে দিয়ে দিল কর্ করে এক পচাশ ট্যাকার লোট!“
হা হা হাসে পালান পচাই এর নেশায়।
চুলায় উথলে ওঠা গরম মেঠে লাল ভাতের সোঁদা মাটির গন্ধে প্যাটের খিদে চনমনায়। নাদা ভরে মেঠে ভাত, কুচো মাছের লঙ্কা হলুদের ঝোল আর আলু সানায় দিন শেষের খিদে মেটায় নয়ন। রাত পাখির ডাক রাতটারে করে তোলে গভীর -
নয়নার চোখ দুটো ভাসে তারার আলোয়, ঘরের দাওয়া এসে তুলে নেয় তার আড় বাঁশী, সুর ওঠে –
“জংলি মোরগ ডেকেছে দূর নীল পাহাড়ে
ডুংরীর ধারে গভীর বনে কেকাধ্বনি
মৌউলি বনে খরগোশ, ঠেলুর তেড়াহুড়ি
শিকার হবে, শিকার হবে,
আসনপানি কাঁপছে যেন ঢেঁকির পাড়
রেগড়া টামাক বাজে
কেন বাজ কেন বাজে-----“
নয়ন দাওয়ায় বসে ভাবে পরের বোশেখী পূর্ণিমায় সে যাবে দিসুম সেঁদরা পরবে। বাপের বেতের ধনু আর মরচে ধরা তির নিয়ে দলের সঙ্গে যাবে শিকার লাচে।
বনমোরগ, খরগোশ শিকারেই নয়ন মরদ হবে। টুসুর মেলায় সেও যাবে কনের খোঁজে। সাজো মাটি ঘসা চুলে জড়ানো পলাশ, গলায় পলাশ বীজের মালা, হরিণ চোখ নয়না কে বেছে নেবে নয়ন। যোগ মাঝি পাকা করবে তাদের বাপলা বিয়ে।
দাওয়ায় বসে দেখা যায় বুনো জামের ঝুপসী অন্ধকারের ওপরে তারায় ভরা মখমলি আকাশ, ডোবার জাম পাতা পচা জলে একটানা ব্যাঙের ডাক, দূরের আকাশে ক্ষেতি পাহারার মশালের কাঁপা কাঁপা আলো, মাঝে মাঝে ঘরের ভেতরে বাপের দমকা কাশির হ হ হ।
আকাশে এক টুকরো পেঁজা তুলোর মেঘে নয়ন ভাসিয়ে দেয় তার বাঁশীর সুর। রাতের আঁধারে পেঁজা মেঘের সাথে নয়নের সুর ভেসে যাবে মেঘদহ গাঁয়ে ঘুমিয়ে থাকা নয়নার স্বপনে –
রাত আরো গভীর হয়। পালান কিস্কু স্বপ্ন ধরিয়েছে নয়নের মনে। নয়নার লজ্জানত হরিণ চোখ ভাসে রাতের আলোয়। মনে ভাসে আসানপানির হাড়াম মাঝির বাপলা বিয়ার মন্ত্র –
“আজ থেকে তুরে দিয়া হল লয়নার ভার।
শিকারে গেলে তুই খাবি আধেক, ঘরে আনবি আধেক।
রোগে শোকে, সুখে দুখে তুরা সঙ্গী সাথী হয়ে থাকবি।
আজ লয়নার পেরান মন সবই তুরে দিয়া হল।“
খুশির রেশ মাখা ঘুম জড়িয়ে আসে নয়নের চোখ।
কবিতা
মৌ চক্রবর্তী
ভুবনবালার চিরকুট
তুলো জমাট লালবুক
একচিত্তির উঠোনে রোদ খাচ্ছে সাত থেকে সত্তর বা আশি কিংবা নব্বইয়ের লেপ আজ
দেখেইনি কেউ কত কত জন্ম
লেপে লেপ্টে স্মৃতিসব গায়ে দেয় ভুবনবালা শুধুই কি লেপখানা
বুকে যার একশ হাজার খাঁজ
রোদ খাইয়ে যতনে
তুলে রাখে নেই যা
আপনজন গন্ধ
পরানে ছুঁয়ে নেয় চুঁয়ে
শরীর জুড়ে শেকড় যত
লাল ওড়নায় নববধূটি সলাজ
সুখে দু'পা
যেমন হাত ডানা মেলে
বিছিয়ে প্রজাপতিরঙ কিংবা
নীলে ভিজে
বেলাসাজে কে এঁকে যায় আলোর কারুকাজ

পদব্রজের নেহা
ঘুমঘোরে অচেতনে দেখি পিয়া মুখ
অন্তর মাঝেতে জাগে কি অদ্ভুত সুখ!
কত মধু আছে বঁধুর অধর কমলে
অধরে অধর পান করি মধু ফলে।
আঁখি হতে কেবা নিদ লইল হরিয়া
এ রজনী গোঙাইলে যাইব মরিয়া।
কিছুতে না নিবারয়ে নয়নের আশ
যামিনী বাড়য়ে মোর বাড়য়ে পিয়াস।
বৈশাখী বহে ঝড় ভিতর বাহিরে
অঙ্গের লাগিয়া অঙ্গ পাশ নাহি ফিরে।
পরাণ বঁধুয়া মুই দেহি আর দেহা
অশোকানন্দন ভনে এ ব্রজের নেহা।
কবিতা
সুকান্ত পাল
জিতপুর, মুর্শিদাবাদ


কবিতা
চন্দ্রশেখর ভট্টাচার্য
নিউটাউন, কলকাতা
জন্ম: ১৬ই সেপ্টেম্বর, ১৯৮০ সাল। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলায়। দারিদ্রতার মধ্য দিয়ে বড় হয়ে ওঠা। বর্তমানে কলকাতা নিউটাউনের বাসিন্দা। নিজেকে মূর্খ বলতেই ভালোবাসেন। ভালোবাসেন অবসরে গীটার বাজাতে। কিশোর বয়সে কবিতা লেখার শুরু। প্রথম প্রকাশিত কবিতা 'অভিমানী' সৃষ্টিসন্ধান নামক পত্রিকাতে। তারপর 'সোনাঝুরি', 'মেঘদূত', 'সংবাদ প্রবাহ', 'অ', 'সৃষ্টি', ''বাংলালাইভ', 'মৈত্রেয়ী' প্রভৃতি পত্রিকাতে প্রকাশিত হয়েছে বেশ কিছু কবিতা। যা ইতিমধ্যে পাঠকদের মন জয় করেছে। প্রকৃতি ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা থেকে জন্ম নিয়েছে প্রথম প্রেমের কাব্যগ্রন্থ 'তোমাকে এবং তোমাকে'।
বসন্ত নয় পুড়ছে ফাগুন
আঙুলে আঙুল ঘষে
পাথরে পাথর ঘষে
তোকে খুঁজি, তুই কই?
তোর জন্য সূর্য ওঠে
ডুবেও যায়
তোকে হারিয়ে ফেলি
অন্ধকারেই।
আঙুলে আঙুল মানে
এ-মুখে ও মুখ,
তোর জন্য আজ আমার
মন খারাপ, ভীষণ অসুখ।
আঙুলে আঙুল ঘষি
যদি জ্বলে যায় হঠাৎ আগুন
আসমানে ধোঁয়া দেখে দৌড়ে আসিস,
দেখে যাস -
বসন্ত নয়, পুড়ছে ফাগুন।

কবিতা
তানভি সান্যাল (সাহেব সেখ)
মুর্শিদাবাদ, প: বঙ্গ
বাগান শূণ্য করিয়া,
তুমি চলে গেলে ও মালী।
পুষ্পকে একা ছাড়িয়া,
তুমি করিলে তার কোল খালি?
কেন তুমি ছিঁড়িলে তাঁর?
রয়ে গেলো ফাঁকা তানপুরা।
সুর যে উঠিবেনা আর,
বাজিবেনা ভক্তির ঝঙ্কার।
প্রভু তুমি প্রত্যাগমন করিলে,
ফেলে সকল কিছু পাছে।
সবুজ ডানায় উড়িলে নীল দিগন্তে,
এতে মোক কী করার আছে?
মোর হৃদয় বীণা বাজিবে,
ঠিক আগেরই তালে তালে।
তোমায় এ সেবক ভক্তিবে,
যতক্ষণ প্রাণ থাকিবে এ ধড়ে।
"বিরহ বেদনা"
মহাপ্রভু, মহাকাল,
তোমা তেজের আলোক রশ্মিতে,
হইয়াছে আলোকিত চিরকাল।
তোমা সন্নিকটে পাইয়াছে,
এ ধরা সকল চেতনা,
প্রশমিত হইয়াছে সকল বেদনা।
বইয়াছে তোমা ভক্তি মেলা,
তবু কেনো হৃদয়ে এ যন্ত্রণা?
ক্ষণিকের দর্শনে পাইলাম,
তোমারে,আপন করিলাম।
জানিলাম তোমা ভক্তি, বসাইলাম,
হৃদয় পানে, উৎসর্গ করিলাম,
মোক,পূজার ফুল হইলো অর্পণ।
তোমায় নৈবেদ্য দিলাম,
মোক, বুকের রক্তে ভরালাম মন ।
অশ্রুজলে প্রবাহিত করিলাম।
অবস্থান
ঠিক কতটা বিশ্বাসের পর
আনতে হবে অবিশ্বাসের ছোঁয়া!
হাতের থেকে হাত সরাব
কাঁধের থেকে কাঁধ!
ঠিক কতটা পথ প্রশ্নবিহীন
আদেশ মেনে চলা,
কখন থেকে বুঝতে হবে, একি
এ যে চক্রান্তের জটিল আঁকিবুঁকি!
মাথার উপর মুখোশ ধারী গাছ!
মুখের পেছন ঐ যে সব মুখোশ
চিনতে হবে কতটা পথের পর?
কি করে আনব অবিশ্বাসের ছোঁয়া?
বিশ্বাস যে আমার মজ্জ্বাময়!

কবিতা
পূর্বিতা পুরকায়স্থ

অদৃশ্য যুদ্ধ
যুদ্ধের কথা বলছিলেন না?
সব যুদ্ধ কি দেখা যায়?
যদি যেত, তাহলে,
ওই যে ন' মাসের পোয়াতিকে,
পেটে লাথি মেরে চলে গেছিল,
স্বামী নামের জানোয়ারটা,
আর সারা সমাজের আঙ্গুল’টা,
এর কারণ নির্দিষ্ট করেছিল,
সেই অভাগীরই উদ্দেশ্যে,
তখন তার লড়াইটাই ছিল,
আমার দেখা সেরা যুদ্ধ।
পচাগলা সমাজের বিরুদ্ধে,

কবিতা
নূপুর রায়চৌধুরী
ছোবল উদ্যত মৃত্যুর সঙ্গে,
দিন দিন, বার বার।
ও, হ্যাঁ, আরেকটা কথা:
শেষ হাসিটা সে'ই হেসেছিল,
দাঁত দাঁত চেপে কন্যা সন্তানকে,
পৃথিবীর আলো দেখিয়েছিল।
এই যুদ্ধজয়ের কোনো শঙ্খনিনাদ,
কিন্তু কোত্থাও ঘোষিত হয়নি,
অবশ্য, তার ভারী বয়েই গেছে,
যুদ্ধটা তো শেষ অব্দি
সে একাই জিতে নিয়েছে।
গল্প
সবিতার সত্য
সংসার কথা
অঞ্জলি দে নন্দী
মোহন গার্ডেন, উত্তমনগর, নতুন দিল্লী

কলকাতার বিধান সরণীর বিরাট চারতলা বাড়ির মেয়ে। বাবার বড় বাজারে দুটি ব্যবসা চলছে। একটিতে সেলাই মেশিন তৈরি হয়। আরেকটিতে যাবতীয় দর্জি কাজের জিনিস পাওয়া যায়। ব্যবসার বাড়িটিও চারতলা বিশাল।
পাত্রী সবিতা দেখতে খুবই সুন্দরী। তেইশ বছর বয়সে বিয়ে হল। পাত্র দেবীপ্রসাদ কলকাতার বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে বি. কম. পাস। কলেজ স্ট্রীটে প্রাইভেট ফার্মে জব করে। হাওড়ার সালকিয়াতে বউকে নিয়ে ভাড়া থাকে। হুগলীর চৈতন্যবাটী গ্রামে প্রচুর জমি, সম্পত্তি আছে। সেখানেই তার পরিবারের সদস্যরা থাকে।
বিয়ের এক বছর পর সবিতা ও দেবীপ্রসাদের এক কন্যা জন্ম নিল। এর যখন তিন বছর বয়স হল তখন তাদের আরেক পুত্র সন্তান জন্ম নিল। ছেলের পাঁচ মাস বয়সে অন্নপ্রাশন করার জন্য তারা মেয়ে ও ছেলেকে নিয়ে গ্রামে গেল। সেই যে গেল আর মা, মেয়ে ও ছেলে শহরে এল না। বাবা সালকিয়াতে একাই থাকে। কলেজ স্ট্রীটে চাকরী করে। প্রতি শনিবার রাতে গ্রামে যায় এবং রবিবার বিকেলে আবার শহরে চলে আসে। ওখানে যখন ছেলের তিন বছর বয়স হল তখন আরেক মেয়ের জন্ম হল।
এদিকে গ্রাম থেকে তখন এক ভাই এসে দাদার কাছে রইল। সে হাওড়ার এক কলেজে বি. এস. সি. পড়ল। এ আসার পাঁচ বছর পর আরেক ভাই এল। সে বেলুর রামকৃষ্ণ মিশনে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিপ্লোমা করতে লাগল। আগের ভাই পাস করে টিউশনি পড়ায় ও সরকারী চাকরীর পরীক্ষা দেয়। বহু বছর পর সে রেলে চাকরী পেল। এর কয়েক বছর পর অন্য ভাই পাস করে কয়েকমাস টিউশনি পড়ায়। তারপর সরকারী চাকরী পেয়ে বোম্বে চলে গেল। দাদা দুভাইকে নিজের খরচায় পড়ালেখা শেখাল। রোজ সকালে ও রাতে নিজের খরচায়, আপন হাতে রেঁধে খাইয়ে রেখেছিল। দাদা তার ত্রিশ বছর বয়সে বিয়ে দিল। সে বিয়ে করে বউকে নিয়ে সালকিয়াতে থাকল। দাদাকে বলেছিল যে আলাদা ঘর খুঁজে দিতে যেখানে ওরা দুজন থাকবে। দাদা ভাইকে সালকিয়াতেই নিজের বাসা থেকে খানিক দূরে ঘর জোগাড় করে দিল। সেখানে দাদার কিন্তু ঠাঁই হল না। দাদা একাই থাকে। এরপর আরেক ভাই যখন একত্রিশ বছরের হল তখন দাদা তারও বিয়ে দিল। সে বউকে নিয়ে বোম্বেতে থাকে।
এদিকে ওরা তিন জন গ্রামের স্কুলে পড়ে। খুব ভালো রেজাল্ট করে সবাই টেন পাস ও টুয়েলভ পাস করল। বড় মেয়েকে এনে বাবা কলকাতার কলেজে বি. এস. সি. পড়াল। সে গার্লস হোস্টেলে থাকে। পাস করার পর তাকে বিয়ে দিয়ে দিল। জামাই হুগলীরই - তাদের বাড়ি থেকে অনেক দূরের এক গ্রামের ত্রিশ বছরের এক ছেলে। কিন্তু দিল্লীতে সরকারী জব করে। তাই মেয়ে ও জামাই দিল্লীতে থাকে।
ছেলে আশিস নন্দী গ্রাম থেকে রোজ সাইকেলে ও ট্রেনে করে যাওয়া এবং আসা করে হুগলীর উত্তরপাড়া কলেজ থেকে ফার্ষ্ট ক্লাস পেয়ে পাস করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম. কম. পড়ল। একই সঙ্গে আই. সি. ডব্লিউ. এ. পড়ল। এম. কম. পাস করল। আই. সি. ডব্লিউ. এ. পড়া চলল।
ছোট মেয়ে শেওড়াফুলিতে থেকে শ্রীরামপুর কলেজ থেকে বি. এস. সি. পাস করল। এরপর কলকাতার রেলে চাকরী করা এক পাত্রের সঙ্গে বিয়ে হয়ে সে কলকাতার বাসিন্দা হল।
হঠাৎ করে আশিসের সাইনাস হল। কলকাতার এক নার্সিং হোমে অপারেশন হল। তার এক বছর পর তার নার্ভের রোগ হল। পড়া ছেড়ে দিল। প্রচুর দাওয়াই খায় রোজ। ওর যখন ত্রিশ বছর হল
তখন নিজের শোবার ঘরে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়ল। সেদিন ছিল থার্ড জুন, ২০০১, রবিবার। বাবা তাই সালকিয়া থেকে চৈতন্যবাটী এসে আছে। রোজ আশিস বিকেলে ঘুম থেকে উঠে এসে মায়ের কাছে বিকেলে দুধ খায়। সেদিন আসছে না দেখে মস ছেলের ঘরে গিয়ে দেখল যে দরজায় খিল দেওয়া। ডাকল। ধাক্কা দিল। সারা শব্দ নেই। বাবাকে ডাকল। সেও এসে ডাকাডাকি, ধাক্কাধাক্কি করল। তারপর দরজা ভাঙল। মা ও বাবা দেখল যে ওদের ছয় ফিট লম্বা, ফর্সা, সুন্দর ছেলের মুখ থেকে জিভটা বেরিয়ে এসেছে। ও করি থেকে ঝুলছে। পুরোনো আমলের করি, বর্গার বাড়ি। বাড়ির ভিটাতেই তিনশ বছর ধরে পঞ্চ বাস্তু দেব ও দেবীর নিত্য পূজো হয়। সেই ভিটাতেই এই আত্মহত্যা। মা পাথরের মূর্তি। বাবা দড়ি কেটে নামাল। মা তার মাথাটা কোলে নিয়ে তাল পাতার পাখায় করে নিজের হাতে হাওয়া করতে লাগল। মৃত ছেলের যেন গরম না করে, তাই। কলকাতার মেয়ে যে হাত পাখা কখনোই বাপের বাড়িতে দেখেই নি সে-ই যখন গ্রামের মা হয়েছে, তখন বিদ্যুৎ না পৌঁছনো বাড়িতে হাত পাখার হাওয়ায় সন্তানদের রাতে গরম থেকে আরাম দিয়ে ঘুমোতে দিয়েছে। নিজে না ঘুমিয়ে রাত কাটাত। সকাল থেকে শাশুড়ির, শ্বশুর, তিন ননদের (যতদিন না ওদের বিয়ে হয়েছে) সব কাজ করে দুপুরে ঘুমোত। আবার ঘুম থেকে উঠে সংসারের কাজ। এখনও তাই সেই একই অভ্যাসে মা পুত্রকে পাখার বাতাস করে চলেছে।
এরপর বাবা নিজের কাঁধে করে ছেলেকে শ্মশানে নিয়ে গেল। আপন হাতে শৈশবে যে বাবা পুত্রকে কোলে বসিয়ে কচি মুখে সন্দেশ খাইয়েছে আজ সেই পিতাই নিজের হাতে যুবক পুত্রের মুখে আগুন দিল। দেহ জ্বলে শেষ হল। বৃদ্ধ বাবা শূন্য বুকে, খালি ঘরে ফিরে এল। বাড়িতে মা রইল। বাবা এক সপ্তাহ পর আবার কলকাতার অফিসে কাজ করতে লাগল আগের মতোই। থাকল সালকিয়ায়। মা চৈতন্যবাটীতে একাই থাকে। পঞ্চ বাস্তু দেব ও দেবীর সেবা করে ঠিক আগেরই মত। বাবা শনিবার রাতে আসে আর রবিবার বিকেলে চলে যায়।
আশিসের মৃত্যুর সাত বছর পর দেবীপ্রসাদের ক্যান্সার হল। শ্রীরামপুরের নার্সিং হোমে মারা গেল। বিধবা সবিতা একাই গ্রামে আছে। বড় মেয়ে বলল তার দিল্লীতে থাকতে। ছোট মেয়ে বলল তার কলকাতায় থাকতে। সে কোথাওই থাকল না। নিজের ছেলের নিত্য ব্যবহৃত হাওয়াই চটিতে রোজ সকালে ও সন্ধ্যায় গঙ্গা জল দিয়ে পূজো করে। তাকে রোজ চার বেলা যেমন বেঁচে থাকতে দিত সেরকমই কাঁসারের থালায় সাজিয়ে খেতে দেয়। তা কিছু পরে নিয়ে গিয়ে পুকুরের জলে ঢেলে দেয়। এভাবে চলতে থাকে। আশিসের মৃত্যুর দশ বছর পর সবিতার ক্যান্সার হল। সেও ঐ শ্রীরামপুরের নার্সিং হোমে মারা গেল।
আশিসের গ্রাজুয়েশন করার সময় যে টাকা স্কলারশিপ পেয়েছিল (বি. কম. পাস করে) সেই টাকা ও নিজের ব্যবসা করার টাকা সব সে আত্মহত্যা করার আগে মায়ের নামেই নোমিনি করে গিয়েছিল। দেবীপ্রসাদ আবার আশিসের, সবিতার ও নিজের নামেও অনেক টাকা ব্যাংকে রেখে গিয়েছিল। সবার সব টাকা দুজনে - বড় ও ছোট মেয়ে পেল। আর সব জমি ও সম্পত্তি দু কাকা নিল।
আজও যদি পারো ভারতের, পশ্চিম বঙ্গের, হুগলীর, চৈতন্যবাটী গ্রামের নন্দী বাড়িতে গিয়ে ওদের আত্মার উদ্দেশ্যে কয়েক ফোঁটা চোখের জল ফেলো! আমি আশিসের বড় দিদি অঞ্জলি। আর আশিসের ছোট বোন মনীষা। আমরা বেঁচে অপেক্ষা করছি কবে যে তাদের কাছে স্বর্গে পৌঁছব.........
সায়াহ্ন
পূর্বিতা পু্রকায়স্থ

গল্প
ষ্টেশন থেকে সুনন্দা অটোতে যাচ্ছিলেন। রাস্তার দুপাশে তাকাতে তাকাতে। পুরোপুরি পল্লীগাঁ। রাস্তা সেই তুলনায় বেশ ভাল। রাস্তার দুপাশে কখনও মাঠের মধ্যে ঘরবাড়ি কখনও বা শুধুই ক্ষেত। বেশিরভাগ ঘরবাড়ি একচালা। কোনটা কোনটা আবার মাটির দোতলা। সুনন্দার মনে পড়ে মাটির দোতলা বাড়ি উনি প্রথম দেখেছিলেন শ্বশুরবাড়িতে। এর আগে দেখা তো দূরের কথা শোনেনই নি যে মাটির বাড়ি দোতলাও হয়। সাদা ফটফটে মাটির দোতলা বাড়ি দেখতে ভালই লাগে।
এভাবে চারদিক দেখতে দেখতে আর এটা ওটা ভাবতে ভাবতে হঠাৎই অটোটা রাস্তা ছেড়ে মাঠের মধ্যে নেমে পড়ল।
- 'স্কুল কি এসে গেছে?' সুনন্দা জিজ্ঞেস করলেন।
- 'হ্যাঁ ম্যাডাম, ঐ যে। সোজা তাকান।'
সুনন্দা দেখতে পেলেন দূরে বিশাল জায়গা জুড়ে একটা বিল্ডিং দাঁড়িয়ে আছে। চারপাশ ফাঁকা ফাঁকা। ওঁর মনটা কেমন উদাস হয়ে গেল। চিরকাল জনবহুল জায়গায় থেকে অভ্যস্ত। চলে তো এলেন। কি জানি থাকতে পারবেন কি না। তবে আজ রোববার দেখে হয়ত বেশি নিস্তব্ধ। অন্য দিনগুলোর চিত্র হয়ত একটু আলাদা হয়।
অটো স্কুলের গেটে এসে থামল। ভাড়া মিটিয়ে দেবার পর মালপত্র নামিয়ে দিয়ে অটোর ড্রাইভার একটু দাঁড়াল। হয়ত সুনন্দাকে ঠিক জায়গায় এনে পৌঁছে দিয়েছে কিনা সেটা আঁচ করতে চাইছিল। সুনন্দা সিকিউরিটির সাথে কথা বলে এপোয়েন্টমেন্ট লেটার দেখালেন। সিকিউরিটি তা দেখে সুনন্দার জন্যে গেটটা খুলে দিল। ভেতরে ঢোকার আগে সুনন্দা পেছন ফিরে ড্রাইভারকে ধন্যবাদ জানালেন।
শুরু হল সুনন্দা বোসের জীবনের আরেকটা অধ্যায় হয়ত বা শেষ অধ্যায়।
গেট দিয়ে ঢুকে হাতের বাঁ পাশে সিকিউরিটির স্টাফেদের ঘর। আরেকটু এগিয়ে গিয়ে দু পাশে দুটো দোতলা বিল্ডিং। মাঝখানে বড় গোলাকৃতি মাঠ। আর মাঠের ওপারে আরেকটা তিনতলা বিল্ডিং। সেটাই সম্ভবত হস্টেল। পুরোটা এলাকাকে ঘিরে রেখেছে প্রায় শ বারো ফুট উঁচু দেয়াল। সুনন্দার আগে আগে ওর মালপত্র নিয়ে একজন যাচ্ছিল। হয়ত হস্টেলে কাজ করে। সিকিউরিটির লোক মোবাইলে ওকে ডেকে নিয়েছিল। সেটা দেখে সুনন্দা আশ্বস্ত হয়েছিলেন এই জেনে যে মোবাইলের টাওয়ারটা আছে!
হস্টেলে ঢুকেই একটা রিসেপশন রুম। রুমে একটা টেবিল চেয়ার। দু পাশে দুটো থ্রি সিটার সোফা। এখানেই হয়ত গার্জিয়ানরা মেয়েদের সাথে মিট করে। এখনও অব্দি ও যা দেখল তা তে মনে হচ্ছে ব্যবস্থা ভালই। রিসেপশনে তখন কেউ না থাকায় ছেলেটা ওকে বসতে বলে কাকে যেন ডাকতে গেল। একটু পর ফিরে এল সাথে একজনকে নিয়ে। একজন মধ্যবয়েসী মহিলা। সাধারণ চেহারার কিন্তু হাসি হাসি মুখ। সহজেই আপন করে নেবার মত ব্যক্তিত্ব।
সুনন্দা দেখেই উঠে দাঁড়ালেন।
- 'আরে বসুন বসুন। আপনি সুনন্দা বোস তাই না? আমি মাধুরী। মাধুরী চক্রবর্তী। আপনার এপোয়েন্টমেন্টের খবর আমরা গতকালই পেয়েছি।' একনিঃশ্বাসে ভদ্রমহিলা কথাগুলো বলে থামলেন।
সুনন্দা এপোয়েন্টমেন্টের চিঠিটা এগিয়ে দিলেন। অফিসিয়াল কাজকর্ম সেরে মাধুরী ছেলেটাকে চাবি দিয়ে বললেন,
- 'বিমল ম্যাডামকে ওঁর ঘরে নিয়ে যাও।' আর সুনন্দার দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন,
- 'বিকেলে আমার ঘরে চলে আসুন। দুজনে একসাথে চা খাব।'
- 'নিশ্চয়ই আসব', বলে সুনন্দা বিমলকে অনুসরণ করলেন।
ঘরটা দশ বাই বারো হবে। এটাচড্ বাথরুম। ঘরে একটা ছয় ফিট বাই পাঁচ ফিট খাট। একটা চেয়ার টেবিল আর একটা ওয়ারড্রোব।
বিমল ওয়ারড্রোব থেকে চটপট তোষক, বালিশ, বেড শিট বার করে খাটের ওপর পেতে দিল। তারপর সুনন্দার দিকে তাকিয়ে বলল,
- 'এবার আমি আসি ম্যাডাম। দরকার হলে ডাকবেন। আমার নাম্বারটা নিয়ে নিন।' মোবাইল নাম্বারটা দিয়ে নমস্কার করে চলে গেল ।
সুনন্দা চেয়ারে বসলেন। সেই কখন বেরিয়েছিলেন বাড়ি থেকে। একটু একটু ক্ষিদের বোধ হচ্ছে। কিন্তু ক্ষিদেকে ছাপিয়ে উঠছে একটা মনখারাপ। যা উপেক্ষিত হবার আর সঞ্চিত ধন ছেড়ে চলে আসার মিলিত কষ্ট। সুনন্দা অস্তিত্ব রহিত হয়ে আছে। মনে হচ্ছে যেন ওর কোন অতীত নেই। ওর
কোন ইতিহাস নেই। সুনন্দা বোস যেন চিরকাল ধরে এই মারান্ডি হায়ার সেকেন্ডারী গার্লস স্কুলের হস্টেল সুপার। একটা কথা ওর হৃদয়ের তন্ত্রীতে বেজেছে। বড্ড বেজেছে। এমনভাবে বেজেছে যে তিল তিল করে গড়ে তোলা সংসার ছেড়ে এত সহজে উনি বেরিয়ে এলেন। অনেকদিন ধরে মেয়ের কিছু অস্বাভাবিক ব্যবহার, জীবন যাত্রা সুনন্দা লক্ষ্য করছিলেন। জীবনের মূল স্রোত থেকে ও যেন ক্রমেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। কাজ কর্ম সব প্রায় বন্ধ হয়ে যেতে বসেছে। মেয়ে আর্কিটেকচারে ফ্রি ল্যান্সার। জনসংযোগ না থাকলে কাজ পাওয়া মুশকিল। তাই মেয়ের অনিয়মিত জীবনযাপন দেখে সুনন্দার মনে হতাশা বাসা বাঁধতে শুরু করেছে। কারণ কি ভাবে ওকে আবার জীবনে ফেরাবেন? কে ও এমন করছে? এই সব প্রশ্নের উত্তর কোনটাই ওঁর কাছে ছিল না। চাকরী থাকাকালীন একা হাতে সংসার সামলে কি করে অফিস করতে পেরেছেন তা এখন ওঁর নিজের কাছেই এক বিস্ময়। পেছন ফিরে দেখলে ওঁর মনে হয় ও ই কি সেই মহিলা যে পেরেছিল এত কিছু করতে! তখন যেন একটা ঘোড়ার ওপর সওয়ার হয়ে ছিলেন। একটাই লক্ষ্য সংসারের উন্নতি। আর কিচ্ছু ভাবার সময় নেই। একবগ্গা ঘোড়া! যার ফল হচ্ছে আজকের সুনন্দা। অজস্র অসুখের ঘেরাটোপে বন্দী আজকের সুনন্দা। ছেলেমেয়ে যত বড় হতে লাগল ক্রমে ক্রমে সবকিছুই হাতের বাইরে চলে যেতে লাগল। সুনন্দা ধীরে ধীরে মানিয়ে নিচ্ছিলেন। মেনে নিয়েছিলেন সময়ের ধর্ম বলে। কিন্তু তাই বলে সন্তানের কষ্ট হলে তা মনে দাগ কাটবে না সেটা তো হয় না। মেয়ের জন্য সুনন্দার একটা বুকচাপা কষ্ট হয়। শুধু ভাবেন ওর এই অস্বাভাবিক আচরণের কারণটা কি। অনেক চেষ্টা করেছেন এই রহস্য ভেদ করার। কিন্তু পারেন নি। তাতে কষ্ট আরো বেড়েছে। শুধু ভাবছেন কোথায় ভুল ছিল ওঁর শিক্ষায় যে আজ মেয়ে বাধা অতিক্রম করে জীবনের স্রোতে ফিরে আসতে পারছে না। এত কষ্ট বুকে চেপে সুনন্দা ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে উঠেছেন। সেটারই বহিঃপ্রকাশ হয়ে গেল এক সকালের চায়ের টেবিলে।
- 'কি একটা দমবন্ধ পরিবেশ হয়ে আছে বল তো বাড়িতে।'
- 'কেন? কি হয়েছে?'
- 'বাঃ। তুমি কিছুই বুঝতে পারছ না!'
- 'বুঝতে পারব না কেন? তুমি মুন্নির কথা বলছ তো?'
- 'হ্যাঁ। তুমি তো দিব্যি আছ! মেয়েটার জন্য তোমার চিন্তা হয় না? সারাজীবন শুধু নিজেরটা নিয়েই ব্যস্ত রইলে'।
- 'তুমি কি ভেবেছ, তুমি দুঃখে থাকলে আমাকেও দুঃখে থাকতে হবে!'
আসলে যেটাতে আমার কোন কথা চলবে না সেটা নিয়ে আমি ভাবিনা। ভাল থাকতে জানতে হয় বুঝলে। তুমি তা জান না আমি তা জানি। তার মানে এই নয় যে আমি শুধু নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত।
- 'কথা চলবে না বলে কি মনটাকে কন্ট্রোল করা যায়? মন কি মেশিন? যে সুইচ টিপলেই যা চাইব তাই পাওয়া যায়?'
সুনন্দা থমকে যান। এর পর আর কি কোন কথা চলে? অশোকের সাথে গত পঁচিশ বছরের জীবনে অগুনতি ওঠা পড়ায় সুনন্দা ছায়ার মত ছিলেন। মন খারাপ দেখলেই, কি অসুবিধে আমাকে বল বলে সেধে সেধে সাহায্যের জন্য এগিয়ে গেছেন। সবার অমতে বিয়ে করেছিলেন বলে এই সম্পর্ক কে খুব যত্ন করে বজায় রেখেছেন। আত্মীয়স্বজন, সহকর্মী অনেকেরই ওদের বিয়ে নিয়ে ভবিষ্যৎ বাণী কে ভুল প্রমাণিত করা যেন সুনন্দার আরেকটা তপস্যা ছিল সন্তানদের মানুষ করার পাশাপাশি।
আজ সুনন্দা যেন দেখতে পান সংসার সমুদ্র থেকে যেন উঠে আসছে ক্ষয়াটে শরীরের সুনন্দা। তার কোমলতা হারিয়ে সে এখন রুক্ষ। সংসারের নোনা জলে তার মিষ্টি শোভন মুখ আজ বলিরেখায় আকীর্ণ। তার সরলতা সংসারের ঢেউয়ের টালমাটালে পথ হারিয়ে নিঃস্ব। নিজের ধ্বংসাবশেষ দেখে ভেতরে ভেতরে কি জানি ঝরে! সেটা অশ্রূরূপী রক্ত নাকি রক্তরূপী অশ্রূ তা তিনি জানেন না। শুধু ঝরাটা অনুভব করেন।
আজ তাই একটাই কথা বার বার মনে হচ্ছে এই জীবন সায়াহ্নে এসে যদি একে অন্যের সাথে সুখ দুঃখ ভাগ করা না যায় তবে কেন একসাথে থাকা? তার চেয়ে এই ভাল।
অনেক ভেবে সুনন্দা এই পথ বেছে নিয়েছেন। প্রথম ভেবেছিলেন বৃদ্ধাশ্রমে যাবেন। মন সায় দেয় নি। ওঁর মনে হয়েছে ওখানে বসে শুধুই মৃত্যুর অপেক্ষা! এর চাইতে এখানে এই ছাত্রীদেরদের সাথে অন্তত প্রগাঢ় ভাবে জীবনের উষ্ণ স্পর্শে থাকতে পারবেন। তরতাজা জীবনের ছায়ায় থেকে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করবেন।
গল্প

যাওয়ার আগে
“মা, দরজাটা বন্ধ করে দাও।” বেরোনোর আগে রেশমি ডাক দিল। হুইলচেয়ারে করে এগিয়ে এলেন রেশমির মা। হাতে জলের বোতল। মেয়ের হাতে তুলে দিয়ে বললেন,
“সাবধানে যাস। বেশি তাড়াহুড়ো করবি না।”
“দেখছ তো আধঘণ্টা দেরি হয়ে গেছে। আর কথা বাড়িও না।” মাকে অল্প করে বকে দিয়ে রেশমি জুতো পরতে শুরু করে, “আর আমার যা যা অনলাইন ডেলিভারি আসার, সব এসে গেছে। কেউ আর আসার নেই। সেদিনের মত অচেনা কাউকে দরজা খুলবে না!”
“না, সেদিন তো----------”
মাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই রেশমি আবার বলে,
“ওষুধ ওই নীল খামে রাখা আছে।ভুলবে না। আর গ্যাস জ্বালাবে না। সেদিন গ্যাস জ্বালিয়ে নেভাতে ভুলে গিয়েছিলে!”
মা চুপ করে শোনেন। মেয়ে এখন বাসে করে যাবে স্টেশনে। তারপর ভিড় ট্রেনে করে সেইমেদিনীপুর। সেখানে রাত আটটা অবধি ডিউটি। অফিসে আবার ফোনের টাওয়ার থাকে না।রেশমি দরজাটা টেনে দিতে দিতে বলে,
“বারান্দার জবা গাছটাতে একটু জল দিও। কালকেওজল দিতে ভুলে গেছি, আজকেও……”
সেফটি পিন
চন্দ্রনাথবাবু অফিস থেকে ফেরার পর তার হাত দেখে স্ত্রী আবার চীৎকার করে উঠলেন, “আজকে আবার সেই কাঁটা গাছে হাত লাগিয়েছ?”
চন্দ্রনাথবাবুর বাঁ হাতের কব্জির কাছে একটা কিছু ফুটে যাওয়ার দাগ। একটু ছড়েও গেছে। লাল হয়ে আছে। উনি একটু অপ্রস্তুত হয়ে হেসে বললেন,
“আসলে বেরোনোর দরজার মুখেই রেলিঙয়ের ধারে গাছটা। একটু অসাবধানে হাত চলে গেলেই কাঁটা বিঁধে যায়।”
স্ত্রী ডেটল দিয়ে জায়গাটা ধুয়ে দিলেন, “সাবধানে চলাফেরা করবে। আর কাউকে বল গাছটা ছেঁটে দিতে।”
“দেখি, বলব--------------”
তিনদিন পর চন্দ্রনাথবাবু অফিস থেকে বেরিয়ে বাসে উঠেছেন। তাঁর রোজকার বাঁধাধরা বিকেল পাঁচটা সাইত্রিশের বাস। একটাই সীট খালি ছিল। এক কলেজপড়ুয়া তরুণীর পাশে। উনি বসে রুমাল দিয়ে মুখ মুছলেন। এখন এক ঘণ্টা লাগবে। চন্দ্রনাথবাবু মোবাইলে একটা সিনেমা দেখতে শুরু করলেন। দেখতে দেখতে যাদবপুর এসে গেল। সেই তরুণী উঠে পড়লেন। “দেখি একটু। নামব।”
“হ্যাঁ মা।”
চন্দ্রনাথবাবু ঘুরে বসে তরুণীকে নামার রাস্তা করে দিলেন। তারপরেই তাঁর মুখ থেকে একটা আওয়াজ বেরোল, “উঃ!”
পেছনের সীটের একজন বললেন, “কী হল দাদা?”
“এই সীটের পেছনে একটা কাঠের খোঁচা বেরিয়ে আছে। হাতে লাগল।”
সবাই দেখলেন, চন্দ্রনাথবাবুর হাতে একটা কিছু ফুটে যাওয়ার দাগ। অন্য একজন বলে উঠল, “সত্যি, এখন বাসে কেউ কিছু মেইন্টেনেন্স করে না।”
বাস আবার চলতে শুরু করল।
------------------------------------------------------------------------------
সেই তরুণী বাস থেকে নেমে হাতের সেফটি পিনটা ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখল। এই লোকটা এর আগেও পাশে বসে হাত চালিয়েছে। আজকে ও তৈরি হয়েই ছিল। যেই হাতটা সাপের মতন লকলক করে এগিয়ে এসেছে, সঙ্গে সঙ্গে ফুটিয়ে দিয়েছে সেফটি পিন।
তরুণী সাবধানে সেফটি পিনটা ব্যাগের সামনের চেনে রেখে দিল। আবার কবে কাজে লাগে কে জানে!!
গল্প

বাসরের ফুল
তানভী একটা পিঙ্ক এন্ড গ্রীন COMBINED সুন্দর শাড়ী মাথায় গোলাপ ফুল সাজানো খোঁপা করা। কপালে লাল টিপ আর হালকা করা চন্দনের ফোঁটা, ঠোঁটে লাল LIP GLOSS, গলায় একটা হীরের মঙ্গলসূত্র আর একটা সোনার সরু লম্বা সীতা হার, হাতে গোলাপি চূড়া, আগ্নুলে প্ল্যাটিনাম এর হাতফুল আর কোমরে একটা পাতলা কোমরবন্ধ পরে বসে আছে।
তানভী বসে বসে তার জীবন সঙ্গীর অপেক্ষায় । রাত তখন ১ টা বাজে। ননদ বৌদি আর বন্ধুরা তার হাতে দুধের গ্লাস আর মিষ্টি দিয়ে বলে গেছে অর্জুনকে খাইয়ে দিতে। তানভী লজ্জায় লাল হয়ে মুখ নিচু করে সম্মতি জানায় ।
তানভী: কি সুন্দর ঘরটা! কি সুন্দর সাজিয়েছে!
ডেকোরেশন টা দারুণ!
গোলাপের পাপড়ি ছড়ানো জলের ওপরে ক্যান্ডলেস চারিদিকে যেন একটা স্বপ্নের আবহাওয়া।
কিন্তু অর্জুনকে তো আমি চিনিনা।
আজকে চিনে নেব।
(তার ভেতরটা হঠাৎ ভয়ে কেঁপে উঠলো, সে দেখলো টেবিলের ওপর রাখা একটা ছবি যেখানে একজন তারই মতন মেয়ে তারই মতন নতুন বৌয়ের মতন সেজে আছে)তানভী: এটা কার ছবি? অর্জুনের ঘরে এইরকম পোশাক এ এইরকম সাজে একটা মেয়ের ছবি কেন রাখা?
তার মনে প্রশ্ন জাগলো। সেটাই তো স্বাভাবিক তাইনা? সে নতুন জীবনে পা রেখেছে, আজকে সে তার জীব সঙ্গীকে নতুন ভাবে চেনার অপেক্ষায় সময় গুনছিল ।
তানভী আর অর্জুনের ARRANGE MARRIAGE কিন্তু বিয়ের আগে থেকেই ওদের মধ্যে ভালোবাসার একটা বাঁধন একটু একটু করে শক্ত হচ্ছিল। তানভী আর অর্জুনের প্রথম দেখা হয়েছিল যখন অর্জুন তার বাড়িতে আসে গত বছর পয়লা বৈশাখে । একদেখাতেই তানভীর পছন্দ হয়েছিল অর্জুনকে ।
লম্বা চওড়া চেহারার স্মার্ট ছেলে । গায়ের রং ফর্সা। সল্ট লেক এ একটা বেসরকারি কোম্পানিতে ম্যানেজার অর্জুন। কিন্তু হঠাৎ আজকে এই ছবিটার মধ্যে কি যেন একটা অদ্ভুত সংকেত দিচ্ছিল। তানভীর মনে হলো যে তাদের জীবনের শুরুটা কি শেষএ পরিণত হয়ে যাবে নাতো?
ও।” বেরোনোর আগে রেশমি ডাক দিল। হুইলচেয়ারে করে এগিয়ে এলেন রেশমির মা। হাতে জলের বোতল। মেয়ের হাতে তুলে দিয়ে বললেন,
“সাবধানে যাস। বেশি তাড়াহুড়ো করবি না।”
“দেখছ তো আধঘণ্টা দেরি হয়ে গেছে। আর কথা বাড়িও না।” মাকে অল্প করে বকে দিয়ে
রেশমি জুতো পরতে শুরু করে, “আর আমার যা যা অনলাইন ডেলিভারি আসার, সব এসে
গেছে। কেউ আর আসার নেই। সেদিনের মত অচেনা কাউকে দরজা খুলবে না!”
“না, সেদিন তো----------”
প্রবন্ধ
চূর্ণী এক চুরি করা জলের নদী:
জনশ্রুতি আর
সত্যের সন্ধানে
ডঃ বলাই চন্দ্র দাশ
নদীয়া, পঃ বঙ্গ

লেখকের কথায়...
মাধুকরী পত্রিকাতে প্রকাশের জন্য আমি একটি প্রবন্ধ রচনা করেছি। প্রবন্ধটির শিরোনাম 'চূর্ণী এক চুরি করা জলের নদী: জনশ্রুতি আর সত্যের সন্ধানে'। স্থানীয় সাহিত্য, ইতিহাস এমনকি ভূগোলের একটি গবেষণা পত্রেও চূর্ণী নদীকে কৃত্রিম খাল হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। আরও বলা হয় যে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র ইছামতি নদীর জল প্রবাহের একটি অংশ দখল করে এই কৃত্রিম খালটি তৈরি করেছিলেন। কৃত্রিম নদীটি ইছামতি নদী থেকে জল দখল করার কারণে, নামকরণ করা হয়েছে ‘চূর্ণী’ যার অর্থ 'মহিলা চোর'। যদি এ কথা সত্য হয় যে নদীটি একটি কৃত্রিম খাল। আমার প্রবন্ধটি সত্য অনুসন্ধানের - চূর্ণী একটি কৃত্রিম খাল নাকি প্রাকৃতিক নদী? এই সত্য অনুসন্ধানের প্রয়োজনে, এতাবৎ প্রকাশিত ও প্রাপ্ত রচনার পুনর্বিশ্লেষণ ও নদী বিজ্ঞানের কতকগুলি সাধারণ নীতিকে ব্যবহার করা হয়েছে।
এক যে আছে নদী:
সে নদীকে নিয়ে অপকথার হরেক জনশ্রুতি। সে নদীর নামেও রয়েছে কলঙ্ক। সে নদীর নাম চুর্ণী।চুর্ণী শব্দের অর্থ মহিলা চোর বা স্ত্রী চোর (সূত্র ১ ও ২)। এ নদীর জন্ম এবং কলঙ্কিত নামের পেছনে রয়েছে এক রাজকীয় গল্প। সে গল্প শোনার আগে আমরা জেনে নিই নদীটির বাকি পরিচয়।
ব্রিটিশ আমলে ভাগীরথী, জলঙ্গি ও মাথাভাঙা নদীত্রয়কে একত্রে 'নদীয়ার নদী' (Nadia Rivers) (সূত্রঃ ৩,৪,৫,৬ বা) 'কৃষ্ণনগরীয় নদীদল' (Kishnaghur Group of Rivers - সূত্র ৭) বলা হ’তো। এদের মধ্যে ভাগীরথী নদীটি মুর্শিদাবাদ, বর্ধমান ও নদীয়া জেলার ভেতর দিয়ে অথবা সীমানা ছুঁয়ে বইছে। সে নদীকে কেন যে ‘নদীয়ার নদী’ বা ‘কৃষ্ণনগরীয় নদীদল’ এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল বুঝিনে। তেমনি মাথাভাঙা নদী। সে নদী অবশ্য বৃটিশ শাসনকালে নদীয়ার নদীই ছিল। যদিও এর শাখা নদী ইছামতী বয়ে গেছে নদীয়া ও চব্বিশ পরগনার বুকের ওপর দিয়ে। ১৯৪৭ সালের পর থেকে সে নদী তো আন্তর্জাতিক হয়ে গেছে। একমাত্র জলঙ্গি নদীর উৎস থেকে সঙ্গম পর্যন্ত গোটা প্রবাহ পথই নদীয়া জেলার ভেতর দিয়ে অথবা নদীয়া জেলার সীমানা ছুঁয়ে। সে কারণে, এ তিন নদীর মধ্যে একমাত্র জলঙ্গি নদীই আক্ষরিক অর্থেই নদীয়ার নদী। তবুও মূলত প্রশাসনিক কারণেই এই তিন নদীকে 'নদীয়ার নদী' বলা হতো।
**সূত্র
১- সাহিত্য সংসদ (২০০০ )সংসদ বাংলা অভিধান, কোলকাতা, ISBN 81-86806-92-X
২- দাস, (২০০৩) বাংলা ভাষার অভিধান, সাহিত্য সংসদ, কোলকাতা, ISBN 81-85626-08-1
৩- Hunter WW (1875). A Statistical account of Bengal. Vol. II. Trubner & Co. London. P: 18-33
৪- Garrett JHE (1910). Bengal District gazetteers. Nadia. Bengal Secretariat Book Depot. Calcutta. P: 1-21
৫- Basu SR and Chakraborty SC (1972). Some considerations on the decay of the Bhagirathi Drainage System. In Bagchi KG (1972). The Bhagirathi-Hooghly Basin. Proceedings of the Interdisciplinary Symposium. Calcutta University. P: 59-77
৬- Moore et al. (1919). Report on the Hooghly River and its Head-Waters. Vol. I. Calcutta. West Bengal Secretariat Book Depot. In Biswas KR (2001). Rivers of Bengal.
Vol. II. Government of West Bengal. Kolkata. p: 27,49
৭- Ferguson, J. (1912). On recent changes in the delta of the Ganges, Pub-Calcutta, Bengal Secretariat PressReprinted from the Quarterly Journal of the Geological Society of London, Vol-XIX, 1863. Edited by Biswas K.R. 2001, Rivers of Bengal. Vol. I. pp. 177–230.
সে নদী যে পথে চলে:
চর-মধুগরী গ্রামের পূর্বদিকে চর-মহিষকুণ্ডি গ্রামটি করিমপুর-১ নম্বর ব্লকের উত্তর-পূর্ব সীমান্তে অবস্থিত। চর মহিষকুণ্ডির সীমান্ত বেড়ার পূর্ব দিকে বাংলাদেশের পদ্মা নদীর একটি সরু বাইপাস চ্যানেল থেকে একটি নদীর সৃষ্টি হয়েছে (সূত্র ৮)। সে নদীর নাম মাথাভাঙ্গা। হ্যাঁ, এটি মাথাভাঙ্গা, কারণ বর্ষার দু-এক মাস বাদে পদ্মার জল এ নদীতে ঢুকতে পারে না। পদ্মা থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন। উৎসমুখের বাম তীরে বাংলাদেশের গ্রাম ‘জামালপুর’। পদ্মা থেকে যাত্রা শুরুর পরমাথাভাঙ্গা নদী দক্ষিণদিকে করিমপুর-১ নম্বর ব্লকের মধুগরী-চরমেঘনা-শিকারপুর-দর্পনারায়ণ গ্রামের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পূর্বদিকে বাঁক নিয়ে বাংলাদেশের কাজীপাড়া-হাটবোয়ালিয়া-মুন্সিগঞ্জবাজার-চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুর-দর্শনা প্রভৃতি স্থান দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। সেখান থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে সর্পিল পথে গেদের কাছে পুনরায় ভারতে প্রবেশ করেবিজয়পুর-গোবিন্দপুর-বানপুর-মাজদিয়ার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে। ‘মাথাভাঙ্গা’ নামটি মাজদিয়াতে (পাবাখালি) শেষ হয়ে ইছামতি এবং চূর্ণী নদীতে বিভক্ত হয়েছে। উৎস থেকে পাবাখালিতে দ্বিধাবিন্দু পর্যন্ত মাথাভাঙ্গার দৈর্ঘ্য ১৯৬.৪০ কিলোমিটার।
**সূত্র
৮- Sarkar B, Islam A and Das BC (2021). Anthropo-Footprints on Churni River: A River of Stolen Water. https://doi.org/10.1201/9781003032373
Figure-1: চুর্ণী নদীর অবস্থান

মাথাভাঙ্গা নদীর ডান শাখাটি ‘চূর্ণীনদী’ নাম নিয়ে শিবনিবাস-বেনালী-বাপুজিনগর-ব্যাসপুর-আড়ংঘাটা-কালীনারায়ণপুর-রানাঘাট-আনন্দধাম হয়ে শিবপুরে হুগলী নদীতে পড়েছে। পাবাখালিতে উৎসস্থল থেকে শিবপুরে হুগলী নদীতে সঙ্গমস্থল পর্যন্ত চূর্ণী নদীর দৈর্ঘ্য ৫৩ কিলোমিটার, যদিও কেউ বলেছেন ৫৬ কিলোমিটার (সূত্র ৯)।
**সূত্র
৯- Sarkar, B., & Islam, A. (2019). https://doi.org/10.1007/s12517-019-4827-9
তাকে নিয়ে জনশ্রুতি:
প্রচলিত জনশ্রুতি, সংবাদপত্রের কলাম (সূত্র ১০,১১), স্থানীয় সাহিত্য (সূত্র ১২), ইতিহাস (সূত্র ১৩,১৪), এমনকি ভূগোলের একটি গবেষণা পত্রেও (সূত্র ১৫) চূর্ণী নদীকে কৃত্রিম খাল হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয় যে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের দ্বারা ইছামতি নদীর প্রবাহের একটি অংশ দখল করে এই কৃত্রিম খালটি তৈরি করার কারণে, নামকরণ করা হয়েছে ‘চূর্ণী’ (মহিলা চোর) (সূত্র ১৬,১৭)। যদি কথাটি সত্য হয়, তবে এটি এই অঞ্চলের ভূমিরূপ বিদ্যায় সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য ঘটনা এবং বৃহত্তম নৃতাত্ত্বিক স্বাক্ষর।
শম্পা গাঙ্গুলি (সূত্র ১৮) লিখেছেন-
“নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় সপ্তদশ শতকের শেষের দিকে বর্গি আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তিনি তাঁর রাজধানী কৃষ্ণনগর থেকে মাজদিয়ার শিব নিবাসে স্থানান্তরিত করেন। এই রাজধানী স্থানান্তর করণের বিষয়ে ঐতিহাসিকদের বিভিন্ন মতবাদ পাওয়া যায়। কেউ কেউ মনে করেন, রাজা কৃষ্ণচন্দ্র তাঁর রাজধানীর সুরক্ষার জন্য রাজধানীর চারিদিকে পরিখা খনন করে দেন। এই পরিখাটি হাওলি নদীর মাথা থেকে তৈরি করা হয়। যেহেতু এই খালটি হাওলি নদীর মাথা চূর্ণ করে খনন করা হয়েছিল, তাই এই খালটির নাম দেন ‘চূর্ণী’। ……… ১৭৮০ সালের পর থেকেই নাকি এই খাল চূর্ণী নদী নামে পরিচিতি লাভ করে” ।
**সূত্র
১০- শম্পা গাঙ্গুলি (১৪.০৭.২০২১)। চূর্ণী নদীর তীরে…। আর্টিকেল -পার্টিকেল। সাহিত্য।https://www.mysepik.com/on-the-banks-of-the-river-churni-sampa-ganguly-ranaghat-wb/retrieved on 12.01.2022
১১- সুদেব দাস, বর্তমান, সংবাদপত্র, বুধবার ১২ জানুয়ারি ২০২২, ২৭ পৌষ ১৪২৮, https://bartamanpatrika.com/detailNews.php?cID=17&nID=150321&P=3
১২- চট্টপাধ্যায় সঞ্জীব(২০০৭) মহারাজেন্দ্র বাহাদুর কৃষ্ণচন্দ্র, দেজ প্রকাশন, কলকাতা -৩,,পৃষ্ঠা-৫২,৫৩
১৩- ঠাকুর, স্বপনকুমার (২০১৯ )বর্গি হাঙ্গামা ও সমকালীন রাজা জমিদার, ‘মুদ্রা’ মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র ও সমকাল, নবপর্যায়, তৃতীয় বর্ষ, সম্পাদক- শৈবাল সরকার, কৃষ্ণনগর, পৃষ্ঠা -১৭৩-১৯৮
১৪- কর্মকার, সুপ্রতিম (২০১৯)একটি রাজবংশ ও জলবৃত্তান্ত, ‘মুদ্রা’ মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র ও সমকাল, নব পর্যায়, তৃতীয় বর্ষ, সম্পাদক- শৈবাল সরকার, কৃষ্ণনগর, পৃষ্ঠা -৩৬৭-৩৭৮
১৫- Chatterjee, Mitrajit. (2017). An Enquiry in to The Evolution and Impact of Human Interference on The Churni River of Nadia District, West Bengal. International Journal of Current Research, 5(5), 1088-1092
১৬- সাহিত্য সংসদ (২০০০) সংসদ বাংলা অভিধান, কোলকাতা, ISBN 81-86806-92-X
১৭- দাস, জ্ঞানেন্দ্রমোহন (২০০৩) বাংলা ভাষার অভিধান, সাহিত্য সংসদ, কোলকাতা, ISBN 81-85626-08-1
১৮- শম্পা গাঙ্গুলি (১৪.০৭.২০২১)। চূর্ণী নদীর তীরে…। আর্টিকেল - পার্টিকেল। সাহিত্য।https://www.mysepik.com/on-the-banks-of-the-river-churni-sampa-ganguly-ranaghat-wb/retrieved on 12.01.2022
আরও একটি অনুরূপ গল্প এমন-
“এই নদীটার নাম ছিল হাউলি। অনেকে আবার ডাকত পাঙ্গাসি বা পাংশি বলেও। কারণ গ্রীষ্মকালে নদীতে জল এতটাই কম থাকত পাংশি নৌকা ছাড়া অন্য কোনও নৌকা নদীতে চলাচল করতে পারত না। …. সময়টা সপ্তদশ শতকের শেষের দিক। নদীয়ার সিংহাসনে তখন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র। বর্গী আক্রমণের হাত থেকে বাঁচার জন্য তিনি তাঁর রাজধানীকে কৃষ্ণনগর থেকে শিবনিবাসে স্থানান্তরিত করেন। ….. তাই রাতারাতি কৃষ্ণচন্দ্র হাউলি নদী থেকে একটা খাল কেটে এনে শিবনিবাসকে বেড় দেন। আর সেখান থেকে আর একটি খাল কেটে অঞ্জনা নদীর সঙ্গে জুড়ে দেন। হাউলি নদীর মাথা ভেঙে আরও একটি খাল তৈরি হল বলে নদীটা পরিচিতি লাভ করে মাথাভাঙা নদী হিসেবে। আর কাটা খালটা যেহেতু হাউলি নদীর মাথা চূর্ণ করে তৈরি হল, তাই রাজা কৃষ্ণচন্দ্র এই খালটির নাম দেন চূর্ণী। কাটা খাল চূর্ণী ১৭৮০ সালের পর থেকে চূর্ণী নদী হিসেবে পরিচিতি লাভ করে” (সূত্র ১৯)।
উপরোক্ত দুটি লেখার বক্তব্য একই রকম। বলা হয়েছে-
সপ্তদশ শতকের শেষের দিকে পদ্মাজাতা হাউলি নদীর মাথা ভেঙ্গে বা চূর্ণ করে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র একটি খাল খনন করান। ফলে মাথা ভেঙ্গে দেওয়ার জন্য হাউলি নদীর নাম হয় ‘মাথাভাঙ্গা’। আর হাউলি নদীর মাথা চূর্ণ করে যে খাল খনিত হয়, রাজা কৃষ্ণচন্দ্র সেই খালটির নাম দেন ‘চূর্ণী’। এ ক্ষেত্রে যে প্রশ্নগুলি এসে যায় তা হল, প্রথমতঃ বর্গী আক্রমণ হয় ১৭৪১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৭৫১ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এবং মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র শিবনিবাসে রাজধানী স্থানান্তর করেন ১৭৪২ সালে। ফলে সময়টা সপ্তদশ শতকের শেষ দিক নয়, বরং অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি। দ্বিতীয়তঃ হাউলি নদীর নাম পাঙ্গাসি ছিল, এমন তথ্য কোথাও পাওয়া যায়নি। বরং হাউলি নদীর বাম তীরস্থ এক শাখা নদীর নাম পাঙ্গাসি (সূত্র ২০,২১)। স্টিভেনসন মুর কমিটির রিপোর্টে বলা হয়েছে যে ভৈরব, নবগঙ্গা, চিত্রা, কপতাক্ষ, হরিহর ও ভদ্রা নদীগুলিতে পূর্বে মাথাভাঙা নদীর মধ্যমে জল আসত। ঐ রিপোর্টে হান্টারকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে- ------ ‘the Chitra river was artificially disconnected from the Nabaganga whence it formerly received its spill supply by an embankment which an indigo planter threw across its head about 1830. According to the same authority the connection of the Kobadak with the Matabhanga was severed through the action of Mr. Shakespeare, a former Magistrate of Nadia, who cut a channel across the neck of a bend of the Matabhanga at the Kobadak offtake’.
**সূত্র
১৯- কর্মকার সুপ্রতিম, আমাদের এই নদীর নামটি..., আজকাল, সংবাদ, রবিবার ৭এপ্রিল, ২০১৯, https://aajkaal.in/news/robibasar/river-ach1retrieved on ১২.০১.২০২২
২০- Reaks, H.G. (1919) ‘Report on The Physical and Hydraulic Characteristics of The Rivers of The Delta’ In Stevenson Moore (1919), P-50
২১- https://en.wikipedia.org/wiki/Mathabhanga_River
কুমার নদীটিও মাথাভাঙা নদীর বাম তীরের শাখা নদী। পাঙ্গাসি নদী আসলে কুমার নদীর আর একটি উৎস মুখ, যা মাথাভাঙ্গা নদী থেকে কুমার নদীতে জলের যোগান দিত। কুমার নদী কুস্টিয়া জেলার হাট বোয়ালিয়ায় মাথাভাঙা থেকে বেরিয়ে বর্তমান বাংলাদেশের নবগঙ্গা নদিতে মিশেছে। ১৮১৯-২০ সালে মিস্টার কে সি রবিনসন সাহেবকে মাথাভাঙা নদীর সুপারিনটেন্ড ও কালেক্টর নিযুক্ত করা হয় এবং ঐ সময়েই তৈরী হয় 'নদিয়া রিভার ডিভিসন'। ঐ সময় পদ্মা থেকে যত জল মাথাভাঙা নদীতে ঢুকত, তার ৮৩.৪% কুমার নদী দিয়ে চলে যেত। কুমার নদীতে জল ঢোকা বন্ধ করার জন্য রবিনসনের নেতৃত্বে ব্যর্থ উদ্যগ নেওয়া হয়েছিল (সূত্র ২২)। ১৮২১ সালেও মাথাভাঙার ৭৫% জল কুমার নদী দিয়ে প্রবাহিত হত। সেজন্য মিস্টার মে কুমার নদীর মুখে একটি বড় বজরা ও বেশ কয়েকটি নৌকা মাটি ভরাট করে ডুবিয়ে দেন। এর ফলে কুমার নদীতে জল ঢোকা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল এবং মাথাভাঙা-চুর্ণী নদীতে সারাবছর নূন্যতম তিন ফুট জল ছিল। এ ছাড়াও কুমার নদীতে জল ঢোকা বন্ধ করার জন্য কুমার নদীর উৎসস্থলে মাথাভাঙা নদীর একটি বাঁকে ১৫৪০ গজ দৈর্ঘ্যের খাল কাটা হয়। ১৮২৪ সালে পাঙ্গাসি মুখের ভাঁটি থেকে মাথাভাঙা প্রায় শুকিয়ে যায় এবং ১৮৫০ সাল পর্যন্ত কখনও নাব্য হয় নি (সূত্র ২৩)।
যেহেতু মাথাভাঙা নদীর জলের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ পাঙ্গাসি নদী পথে কুমার নদীতে চলে যেত, সেজন্য হয়তোবা কেউ কেউ গোটা মাথাভাঙা নদীটিকেই কুমার অথবা পাঙ্গাসি বলে উল্লেখ করে থাকবেন (যদিও তেমন তথ্য পাওয়া যায় নি)। সাম্প্রতিককালে মুর্শিদাবাদ জেলার আখড়িগঞ্জ থেকে ভেলানগর পর্যন্ত ভৈরব নদীকে অনেকে জলঙ্গি নদী বলেন। এমনকি গুগল ইমেজেও ভৈরব নদীর নাম জলঙ্গি লেখা হয়েছে। আসলে বর্তমানে ভৈরব নদীর মাধ্যমেই পদ্মার জল জলঙ্গিতে আসে।
মাথাভাঙা নদীর অপর নাম হাউলি নদী, সে কথা বিভিন্ন লেখায় দেখা যায় (সূত্র ২৪)। কিন্তু ওপরের গল্প দুটিতে পাঙ্গাসি ও মাথাভাঙা নদীর নাম করণের ক্ষেত্রে যে গল্প বলা হয়েছে, তার কোনো নির্ভর যোগ্য তথ্য পাওয়া যায় না।
**সূত্র
২২- Moore et al. (1919).p: 27,49
২৩- Moore et al. (1919). p: P-50
২৪- Garrett JHE (1910). P: 6
চুর্ণী নদীর নামকরণের বিষয়ে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে জড়িয়ে বেশ একটি প্রচলিত গল্প আছে। এখানে গল্পকারেরা প্রচলিত গল্পে নতুন মাত্রা যোগ করেছেন। হাউলি নদীর মাথা চুর্ণ করে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র নতুন নদী তৈরী করলেন, তাই সে নদীর নাম হল 'চুর্ণী'! কিন্তু এসব গল্প লেখকদের অপুর্ব কল্পনা শক্তির প্রকাশ হলেও, ইতিহাস রচনায় তথ্য ও সত্যের যে দ্বায় থাকে, তা এখানে নেই। সাহিত্যে যদিও সত্যের দ্বায় আবশ্যিক নয়। চুর্ণী নামের পেছনে এসব গল্পের কোন প্রামাণ্য সূত্র পাওয়া যায়নি। গল্পে আরও বলা হয়েছে যে ১৭৮০ সালের পর থেকে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র কতৃক কাটা খালটির ‘চুর্ণী’ নামকরণ করা হয়। আবার বলা হয়েছে যে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র নদীটির নাম দেন চুর্ণী! তথ্য ও সত্যের দ্বায় না থাকলে খুব স্বাভাবিকভাবেই গল্প যথেচ্ছগামী হয়। মহারাজা খালটি খনন করান ১৭৪২ সালে এবং সেই খালের নামকরণ করেন ৩৮ বছর পর ১৭৮০ সালে? নামকরণে এই বিলম্বের কারণ এবং এই তথ্যের উৎস কি, সে কথা অবশ্য গল্পকারেরা জানান নি।
ঠাকুর, স্বপনকুমার (২০১৯) তাঁর প্রবন্ধে (সূত্র ২৫) লিখেছেন-
“শিবনিবাস আসলে চুর্ণি নদীর গর্ভোত্থিত চড়াতে গড়ে ওঠা জনপদ। এর তিন দিকটাই চুর্ণি নদী দ্বারা ঘেরা ছিল। ......... মাথাভাঙ্গা নদী এখানে ত্রিধা বিভক্ত হয়ে প্রবাহিত হয়েছে। একটি শাখা বর্তমান শিবনিবাসের পশ্চিম, উত্তর ও দক্ষিণ দিকে কঙ্কন আকারে প্রবাহিত হয়েছিল। এরই নাম চুর্ণি নদী। ……………রাজা কৃষ্ণচন্দ্র পূর্বদিকে মাথাভাঙ্গা নদী থেকে একটি গড়খাত কেটে শিবনিবাসের পাশ দিয়ে প্রবাহিত করে শিবনিবাসের কাছে চন্দননগর নামক গ্রামে মূল চুর্ণির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছিলেন। ফলে শিবনিবাসের চারিদিকেই নদী বাহিত হয়েছিল একসময়। বর্তমানে এই কাটা খালটিকে লোকে চুর্ণি নদী মনে করে”।
অন্যান্য লেখকের মতোই, শ্রী ঠাকুরও জানাননি কোন উৎস থেকে অথবা কিভাবে জানা গেল যে ‘বর্তমানে এই কাটা খালটিকে লোকে চুর্ণি নদী মনে করে?’। তাছাড়া তথ্যের স্ববিরোধিতাও বেশ লক্ষ্যনীয়। একবার লিখলেন, শিবনিবাস আসলে চুর্ণি নদীর গর্ভোত্থিত চড়াতে গড়ে ওঠা জনপদ। অর্থাৎ শিবনিবাস স্থাপনের আগেই চুর্ণী নদী ছিল এবং তার গর্ভজাত চড়াতেই শিবনিবাস গড়ে ওঠে। আবার লিখলেন, মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের নির্দেশে কাটা খালটিকে বর্তমানে লোকে চুর্ণি নদী মনে করে। অবশ্য একটি বিষয় ঠিক যে, মাথাভাঙ্গা-চুর্ণি নদীর একটি শাখা বর্তমান শিবনিবাসের পশ্চিম, উত্তর ও দক্ষিণ দিকে কঙ্কন আকারে প্রবাহিত হয়েছিল। এ বক্তব্যের প্রমান এখনও স্থানীয় ভূমিরূপে খোঁদাই করা রয়েছে অশ্বক্ষুরাকৃতির বিল ও নদীবাঁকের দাগ (meander scar) হিসাবে।
সুপ্রতিম কর্মকারের (২০১৯) গল্পগুলিও (সূত্র ২৬) প্রায় একই রকম-
“সেই জায়গাটা ছিল ঘন অরণ্যময় ও জল বেষ্টিত। সেখানে থাকতেন নসরৎ খাঁ নামের একজন ব্যক্তি। রাজা ওই স্থানে বন শূন্য করে নগর স্থাপন করেন। …… রঘুনন্দন পরামর্শ দিলেন। আর তার পরামর্শ মতনই রাজা নির্মাণ করলেন নতুন নগরকে ঘিরে কঙ্কনের মত পরিখা। … কঙ্কণের আকারে শিবনিবাস নগর পরিবেষ্টিত জলস্রোতের নাম হল ‘কঙ্কনা নদী’। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র এবার একশো হাত পরিমাণ একটি খাল কেটে ইচ্ছামতীর সঙ্গে জুড়ে দেন। আর পশ্চিম দিকে প্রায় তিন মাইল আর একটি খাল কেটে হাঁসখালির উত্তর দিকে অঞ্জনা নদীর সঙ্গে মিলিয়ে দেন। ……… রাজা কৃষ্ণচন্দ্র চূর্ণী নদীর যে পথ তৈরী করে গেছেন তা প্রায় ৩০০ বছরের বেশি সময় বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিপর্যয় যেমন বন্যার মধ্য দিয়ে গেলেও নদীটার কোন রকমের অবস্থানগত পরিবর্তন হয়নি। প্রায় একই রকম ভাবেই রয়েছে। …… রেনেল সাহেবের ম্যাপ প্রকাশিত হবার পর দেখা গেল সেখানে চূর্ণী নদীর উৎসমুখ ইছামতি নদীর সঙ্গে সংযুক্ত নয়। রেনেল কেন এই নদীর সংযোগটাকে দেখালেন না সেই প্রশ্নের কোন সদুত্তর পাওয়া যায় না”।
**সূত্র
২৫-ঠাকুর, স্বপনকুমার (২০১৯ )বর্গি হাঙ্গামা ও সমকালীন রাজা জমিদার, ‘মুদ্রা’ মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র ও সমকাল, নবপর্যায়, তৃতীয় বর্ষ, সম্পাদক- শৈবাল সরকার, কৃষ্ণনগর, পৃষ্ঠা -১৭৩-১৯৮
২৬-কর্মকার সুপ্রতিম, আমাদের এই নদীর নামটি..., আজকাল, সংবাদ, রবিবার ৭এপ্রিল, ২০১৯, https://aajkaal.in/news/robibasar/river-ach1retrieved on ১২.০১.২০২২
এ গল্পেও বলা হয়েছে, যে স্থানে শিবনিবাস প্যালেস স্থাপন করা হয়েছিল, সেই স্থানটি আগের থেকেই ঘন অরণ্যময় ও জল বেষ্টিত ছিল। অথচ এখানেও দ্বিধাহীন ভাবে বলা হল যে রাজা নির্মাণ করলেন নতুন নগরকে ঘিরে কঙ্কনের মত পরিখা এবং কঙ্কণের আকারে শিবনিবাস নগর পরিবেষ্টিত জলস্রোতের নাম হল ‘কঙ্কনা নদী’। প্রশ্ন থেকেই গেল- ‘সেই জায়গাটা’ (শিবনিবাস) পূর্বেই জল বেষ্টিত ছিল, নাকি “রাজা নির্মাণ করলেন নতুন নগরকে ঘিরে কঙ্কনের মত পরিখা’? নাকি দুটি বক্তব্যই আংশিক ভাবে সত্য? তাছাড়া একই গল্পকারের পূর্বোক্ত গল্প (সূত্র ২৭) বর্তমান গল্প থেকে আংশিক আলাদা (সূত্র ২৮)। পশ্চিম দিকে‘ তিন ক্রোশের’ পরিবর্তে ‘ প্রায় তিন মাইল আর একটি খাল’ কাটার উল্লেখ রয়েছে।
**সূত্র
২৭-কর্মকার, সুপ্রতিম (২০১৯) একটি রাজবংশ ও জলবৃত্তান্ত, ‘মুদ্রা’ মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র ও সমকাল, নবপর্যায়, তৃতীয়বর্ষ, সম্পাদক- শৈবাল সরকার, কৃষ্ণনগর, পৃষ্ঠা -৩৬৭-৩৭৮
২৮-কর্মকার, সুপ্রতিম (২০১৯) একটি রাজবংশ ও জলবৃত্তান্ত, ‘মুদ্রা’ মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র ও সমকাল, নব পর্যায়, তৃতীয় বর্ষ, সম্পাদক- শৈবাল সরকার, কৃষ্ণনগর, পৃষ্ঠা -৩৬৭-৩৭৮
মিত্রজিৎ চ্যাটার্জী (সূত্র ২৯)(২০১৭) তাঁর গবেষণাপত্রে লিখেছেন “It has been opined that the Churni is most probably an artificial canal, not a true river. Local history says, during the 17th century the river Churni was dug by the orders of Maharajah Krishna Chandra, the King of Nadia as a moat against the Bargees of Maharashtra”. কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে ‘চূর্ণী নদী একটি কাটাখাল’ ‘true river’ নয়, সেইমত কে কবে কোথায় দিয়েছেন এমন কোন তথ্যসূত্র শ্রী চ্যাটার্জী জানান নাই। দ্বিতীয়তঃ সপ্তদশ শতাব্দীতে চূর্ণী খাল কাটা হয়েছিল মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের নির্দেশে- এই বক্তব্যও সঠিক নয়। কারণ মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র ১৭৪২ খ্রিস্টাব্দে রাজধানী স্থানান্তর করেন - সপ্তদশ নয়, অষ্টদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে।
সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় (সূত্র ৩০)(২০০৭) ‘মহারাজেন্দ্র বাহাদুর কৃষ্ণচন্দ্র’ বইতে লিখেছেন যে বর্গী আক্রমণের ভয়ে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র কৃষ্ণনগরের ছ'ক্রোশ দুরে ইছামতীর তীরে এক নিরাপদ স্থানে রাজধানী স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নেন। “….বন জঙ্গল ঘেরা জলবেষ্টিত একটি গ্রাম। একসময় নসরৎ খাঁ নামে একজন ফকির ওই জায়গায় বাস করতেন। সেই কারণে স্থানটির নাম নসরৎ খাঁর বেড়।… জলবেষ্টিত এলাকা। চারিদিকেই খাল পরিখার কাজ করবে। পুব দিকের খালটিকে আরো এক হাজার হাত বাড়িয়ে ইছামতির সঙ্গে যুক্ত করে দিলেন। পশ্চিম দিকের খালটিকে প্রায় তিন ক্রোশ বাড়িয়ে হাঁসখালির উত্তরে অঞ্জনা নদীর মোহনার সঙ্গে মিলিয়ে দিলেন। ফলে হল কি, পুব আর পশ্চিমের এই খাল দুটি ছোট আকারের নদী হয়ে গেল। প্রবাহ বিশিষ্ট একটি গোল কঙ্কণের আকার ধারণ করায় কৃষ্ণচন্দ্র নাম দিলেন ‘কঙ্গনা’। আর নগরটির নাম রাখলেন শিব নিবাস”। এ গল্পও স্ববিরোধে পূর্ণ। প্রথমতঃ খাল দুটি ‘ছোট আকারের নদী হয়ে গেল’ কৃষ্ণচন্দ্র যার নাম দিলেন ‘কঙ্গনা’ বলতে লেখক কি বোঝাতে চেয়েছেন তা পরিস্কার নয়। হাঁসখালি থেকে পাবাখালি পর্যন্ত অংশের নাম কঙ্কনা নদী? কিন্তু এমন তথ্য কোথাও পাওয়া যায় না। আবার বাস্তবে স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যেও এমন কোনও জনশ্রুতি নেই। বরং এমন তথ্য এবং জনশ্রুতিও পাওয়া যায় যে, শিবনিবাসের চতুর্দিকে যে প্রায়-বৃত্তাকার জলাশয় ছিল, তার নাম ‘কঙ্কণা’। দ্বিতিয়তঃ ঐ একই বইয়ের ৫৩ নম্বরপৃষ্ঠাতে লিখেছেন “শিবনিবাস থেকে শিবপুর পর্যন্ত একটি নদী আছে কৃষ্ণচন্দ্র সেই নদীর সুন্দর একটি কাব্যিক নাম দিলেন – চূর্ণী”। একই নদীর ভিন্ন ভিন্ন অংশের নাম আলাদা – এমন উদাহারণ প্রচুর আছে। পাবাখালি থেকে শিবপুর পর্যন্ত নদীর প্রায় গোটা অংশের নাম ‘চূর্ণী’ এবং উজানের সামান্য অংশের নাম ‘কঙ্কনা’? শ্রী চট্টোপাধ্যায় সাহিত্য রচনা করেছেন। সেখানে ভূগোলের সত্যের চেয়ে রাজ-পরিবার নির্ভর সাহিত্যটাই প্রধান বিবেচ্য। সম্ভবতঃ সে কারণেই স্থানীয় ভূগোলকে তিনি বিশেষ গুরুত্ব দেন নি।
**সূত্র
২৯-Chatterjee, Mitrajit. (2017). An Enquiry in to The Evolution and Impact of Human Interference on The Churni River of Nadia District, West Bengal. International Journal of Current Research, 5(5), 1088-1092
৩০- চট্টপাধ্যায় সঞ্জীব(২০০৭) মহারাজেন্দ্র বাহাদুর কৃষ্ণচন্দ্র, দেজ প্রকাশন, কলকাতা -৩,,পৃষ্ঠা-৫৩
দিলীপ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় (সূত্র ৩১)(২০০৭) ‘বাংলার নদ নদী’ বইতে লিখেছেন চূর্ণী নদী “শিবনিবাস, হাঁসখালি, বীরনগর হয়ে দক্ষিণমুখে প্রবাহিত। চূর্ণী মাথাভাঙা নাম নিয়ে জলঙ্গী নদীর উৎস থেকে আরও ২৫ মাইল পূর্বে পদ্মা থেকে নির্গত হয়ে ক্রমশ দক্ষিণে নেমে মাঝদিয়া শহরে এসে দ্বিধা বিভক্ত হয়েছে”। কিন্তু জলঙ্গী নদীর উৎস থেকে চূর্ণী নদীর উৎস স্থলের দূরত্ব ২৫ মাইল নয় বরং ৩.৭ মাইল বা ৫.৯৭ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমদিকে। তিনি লিখেছেন “চূর্ণী নাম নিয়ে রানাঘাট এসে পশ্চিম মুখী হয়ে চাকদহের কাছে গৌড় নগরে ভাগীরথীতে পড়েছে”। আসলে ‘গৌরনগর’ নয় বরং শিবপুরে ভাগীরথীতে পড়েছে। তথ্যসূত্রের উল্লেখ না করেই তিনি লিখেছেন “অনেকে বলেন কয়েক শতাব্দি আগেও চূর্ণী নদীর অস্তিত্বের কথা জানা ছিল না। এটি আসলে একটি কাটাখাল। শোনা যায় নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের নির্দেশে কৃষ্ণগঞ্জ থেকে শিব নিবাস পর্যন্ত একটি খাল কেটে মাথাভাঙ্গা নদীর সঙ্গে যুক্ত করা হয়, যাতে বর্গীদের আক্রমণ থেকে প্রজাদের রক্ষা করা যায়। একই সঙ্গে হাঁসখালিতে যুক্ত করা হয় অঞ্জনা নদীর সাথে”। প্রশ্ন হচ্ছে, শ্রীবন্দ্যোপাধ্যায় কোথাও জানাননি কোন তথ্য বা নদী-বিজ্ঞানের বিশ্লেষণের দ্বারা এই সিদ্ধান্তে এলেন যে, চূর্ণী নদী ‘আসলে একটি কাটাখাল’?
তিনি লিখেছেন ‘কৃষ্ণনগর বাস স্ট্যান্ড থেকে ১০ মিনিটের পায়ে হাঁটা দূরত্বে রয়েছে চূর্ণীর খেয়াঘাট’ যে কথা মোটেই ঠিক নয়। তবে এমন হতে পারে যে, মুদ্রণ দোষে ‘কৃষ্ণগঞ্জের’ পরিবর্তে ‘কৃষ্ণনগর’ হয়ে গেছে। তাছাড়া শ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা যেহেতু সমীক্ষা-নির্ভরনয় তাই লিখেছেন অঞ্জনা নদী থেকে একটি শাখা বেরিয়ে এসে ইছামতিতে মিশেছে যাত্রাপুরের কাছে। প্রসঙ্গত বলে রাখি যাত্রাপুরে অঞ্জনা-ইছামতি সঙ্গম বা অন্য কোন নদী-সঙ্গমও নেই।
**সূত্র
৩১ -বন্দ্যোপাধ্যায় দিলীপকুমার (২০০৭) বাংলার নদ নদী, দে’জ প্রকাশনা, কলকাতা -৩,পৃষ্ঠা-৬৬,৬৭
মল্লিক, কুমুদনাথ (১৩১৭ বঙ্গাব্দ, ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দ) লিখেছেন -“মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র নসরত খাঁ নামক একজন দুর্দান্ত দস্যুকে তাহার রাজ্য মধ্য উৎপাত করিতে দেখিয়া চূর্ণী নদীর পূর্বকূলে এক গভীর অরণ্যে তাহার আড্ডার সন্ধান পাইয়া তাকে শাসনার্থ উপযুক্ত সজ্জায় আসিয়া শিবির সন্নিবেশ করেন। দস্যু দমন করিয়া তিনি একরাত্রি তথায় বাস করেন। পরদিন প্রাতঃকালে তিনি যখন নদীর

Figure-2: চুর্ণী নদীর তীরে শিবনিবাস ও পার্শ্ববর্তি অশ্বক্ষুরাকৃতির হ্রদ ও নদী-বাঁক-চিহ্ন সমুহ
কূলে বসিয়া মুখ প্রক্ষালন করিতেছিলেন ….. রাজাও তখন বর্গীর উৎপাত হইতে আত্মরক্ষার্থ এইরূপ একটি নিরাপদ স্থান অনুসন্ধান করিতেছিলেন। এক্ষণে এই স্থানটী সকলে মনোনীত করলে তিনি উক্ত স্থানটিকে কঙ্কন আকারে নদীবেষ্টিত করিয়া স্বীয় দেওয়ান রঘুনন্দনের মতানুযায়ী এক সুন্দর পুরী নির্মাণ করলেন ও আপনার বাসভবন ও দুইটি বৃহৎ শিব মন্দির স্থাপন করিয়া দুইটি দুর্জয় শিবলিঙ্গ ও অপর মন্দিরে রাম সীতা স্থাপনা করিলেন” (সূত্র ৩২)।
**সূত্র
৩২- মল্লিক কুমুদনাথ (১৩১৭বঙ্গাব্দ, 1919), নদীয়া কাহিনী, রানাঘাট, পৃষ্ঠা-২৪১
‘নদীয়া কাহিনী’র বর্ণনায় যে বিষয়গুলি দেখা যাচ্ছে, তা হ’ল- ১. চূর্ণী নদীর পূর্বকূলে এক গভীর অরণ্যে দস্যু নসরত খাঁ’র আড্ডা ছিল। ২. দস্যু দমন করার পরদিন সকালে তিনি এক স্থানে নদীর কূলে বসে মুখ প্রক্ষালন করছিলেন এবং ৩. ঐ স্থানটিকে কঙ্কন আকারে নদীবেষ্টিত ক’রে রাজধানী স্থাপন করেন। প্রশ্ন হচ্ছে, যে নদীতে মহারাজা মুখ ধুচ্ছিলেন, সে কি চূর্ণী নদী? নাকি ইছামতি? নাকি গভীর অরণ্যে দস্যু নসরত খাঁ’র আড্ডার চতুর্দিকের মজে যাওয়া অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ? মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র কি রাজধানির চতুর্দিকে নতুন করে পরিখা খনন করান? নাকি স্থানটির চতুর্দিকে পূর্বেই যে জলবেষ্টন ছিল তাকে সংস্কার ক’রে পরিখার রূপ দেন? যেমন তাঁর পূর্ববর্তি লেখক কার্তিকেয় চন্দ্র রায় (১৮৭৬), ও শ্রীযুক্ত রাজীব লোচন মুখোপাধ্যায়ের (১৮১১) লেখায় উল্লেখ রয়েছে যে ‘ঐ স্থান অরন্যময় ও জলবেষ্টিত ছিল’। ‘চূর্ণী কাটা খাল’ এমন সিদ্ধান্তে আসার আগে এসব প্রশ্নের উত্তর উত্তর খোঁজা নিতান্ত জরুরী। অবশ্য ‘নদীয়া কাহিনী'তে পরিস্কার লেখা রয়েছে ‘চূর্ণী নদীর পূর্বকূলে এক গভীর অরণ্যে তাহার আড্ডার সন্ধান পাইয়া’। তবে কি শিবনিবাস স্থাপনের পূর্বেই চূর্ণী নদীর অস্তিত্ব ছিল?
কার্তিকেয় চন্দ্র রায় (১৮৭৬) শিবনিবাস ও কঙ্কনা নামকরনের বিষয়ে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের নাম উল্লেখ করলেও, মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র কতৃক চূর্ণী নদীর নামকরনের বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। তিনি লিখেছেন-
“অনেক বিবেচনার পর কৃষ্ণনগরের অন্তরে ইচ্ছামতী নদীর নিকটস্থ একটি স্থান মনোনীত করিলেন। ঐ স্থান অরন্যময় ও জলবেষ্টিত ছিল। নসরৎ খাঁ নামক একজন ফকির তথায় বাস করিত বলিয়া ওই স্থানের নাম নসরৎ খাঁর বেড় রাখিয়াছিল। রাজা ঐ স্থান বনশূন্য করিয়া তাহাতে নগর পত্তন করিলেন। চতুর্দিকে যে জলাশয় ছিল তাহার পূর্ব দিক হইতে দীর্ঘে সহস্র হস্ত এক খাল কাটাইয়া ইচ্ছামতী নদীর সঙ্গে এবং পশ্চিম দিক হইতে প্রায় তিন ক্রোশ আর এক খাত কাটাইয়া হাঁসখালির উত্তরে অঞ্জনা নদীর মোহনার সহিত মিলাইয়া দিলেন। এই উভয় নদীর সহিত মিলিত হওয়াতে ঐ জলাশয় প্রবাহবিশিষ্ট হইল। কঙ্কন সদৃশ গোলাকার ছিল বলিয়া রাজা তাহার নাম কঙ্কনা রাখিলেন। নগরের নাম শিবনিবাস দিলেন” (সূত্র ৩৩)।
**সূত্র
৩৩- কার্তিকেয় চন্দ্ররায় (১৮৭৬) ক্ষিতীশ বংশাবলী চরিত, নতুন সংস্কৃত যন্ত্র, কোলকাতা, পৃষ্ঠা-১০৭-১০৯
কার্তিকেয় চন্দ্র রায় পরিস্কার জানিয়েছেন, স্থানটি ‘অরণ্যময় ও জলবেষ্টিত ছিল‘। জলবেষ্টিত থাকার একটিই মাত্র অর্থ হল অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদের দ্বারা বেষ্টিত থাকা। অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদের যেহেতু নদীর সাথে সংযোগ থাকে না, তাই তাতে কোনো স্রোত থাকে না। শিবনিবাসের চতুর্দিকের ঐ জলাশযয়েও কোন প্রবাহ ছিল না। তাকে প্রবাহ বিশিষ্ট করার জন্য পূর্ব ও পশ্চিমে খাল কাটানো হয়েছিল। যেহেতু সেখানে অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ ছিল, নিশ্চয়ই সেখানে নদীও ছিল। হয় তো সে নদী নিতান্ত স্থবির এক মজে যাওয়া নদী। সে জন্যই বিচক্ষণ দেওয়ান রঘুনন্দন এই মজে যাওয়া নদীর পশ্চিম দিকে ৩ ক্রোশ (৯.৬৬ কিলোমিটার) ও পূর্ব দিকে ১০০০ হাত (৪৫৭.২ মিটার ) সংস্কার করে ইছামতী নদীর সাথে যুক্ত ক’রে পরিখাকে (কঙ্কনা) দুর্লঙ্ঘ করে তোলেন। প্রশ্ন আসতে পারে, সেই অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ তো মাথাভাঙ্গা নদী থেকেও সৃষ্টি হতে পারে? ‘'নদী বিজ্ঞানের কষ্টি পাথর’ অংশে বিশ্লেষণ করে দেখানো হয়েছে, কেন শিবনিবাস সন্নিহিত অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদগুলি মাথাভাঙ্গা-জাত নয়, চূর্ণী-জাত।
শ্রী রায় কখনও উল্লেখ করেননি যে, কৃষ্ণচন্দ্র কাটা খালটির ‘কঙ্কনা’ বা ‘চূর্ণী’ নাম দিয়েছিলেন। বরং স্পষ্ট লিখেছেন, পরিখার নাম রেখেছিলেন ‘কঙ্কনা’। আরও একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, হরধাম থেকে শিবপুরের দুরত্ব অর্ধ ক্রোশ বা ১.৬১ কিলোমিটার। এই অংশেও মাহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র খাল কাটান। এক্ষেত্রেও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, তবে কি মাজদিয়া থেকে হাঁসখালির উত্তরে অঞ্জনা নদীর মোহনা পর্যন্তঅংশ কাটা খাল? হাঁসখালি থেকে শিবপুরে চূর্ণী-হুগলী নদীর সঙ্গম পর্যন্ত অংশ অঞ্জনা