top of page

প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা ​

সূচীপত্র
holi.JPG
এপ্রিল
২০২৩
srikrishna.jpg

প্রচ্ছদঃ সুরজিত সিনহা

লেখক/লেখিকাবৃন্দ

নয়নের দিন রাত্রি
village.jpg

গল্প

 এপ্রিল ২০২৩ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

য়ন, ও লয়ন উঠবি নি! সূয্যি ঠাকুর উঠি পড়তিছে যে! উঠরে বাপ, মাঝির তাড়া খাবি যে। ”ফুলমনি ব্যস্ত হয়ে ছিঁটাবেড়া ঘেঁরা তাদের ছোট উঠানে কুঁচিকাঠির ঝাঁটা চালায় আর গজগজ করে নিজের মনে-
“কবে যে বিলের কুঁচির ঝোড়ে যাওয়া হবেক! আগে বুঢ়াডা গাঁও মাঝির গাই গুলান চরাতে যেত – গাঁয়ের বাইরের মজা বিলের ধারে বেড়ে ওঠা কুঁচির গোছা লয়ন লিয়ে আসতো। এখুনতো বুঢ়াডারে ঘরে একা ফেলে যেতি হবি। পাইকারবাবু তাড়া দেয়। কথা মতন পচাশটা ঝাঁটা না দিলে, দাদনের ট্যাকা ফিরাতে হবেক। কি যে করি!“ 
নয়ন ছেঁড়া চাটায়ে শুয়ে আছে চোখ মেলে। ওপরের খাপরা চালের অজস্র ফুটফাটায় কাক ভোর আকাশের টুকরো দেখে সে। দিনের নতুন আলোয় গাঁ’বুঢ়ার মোরগগুলা ডাক পেড়েছে – কু- ক্রুর-কু। উঠেই পড়ে নয়ন। না! আজ বিল থেকে কুঁচি নিয়ে আসতেই হবে।
মা’র আগের রাতে গুছিয়ে রাখা গামছায় বাঁধা মুড়ি আর ডেলা খানেক গুড় নিয়ে বেরিয়ে পড়ে নয়ন। তাদের আসনপানি গ্রাম মাঝির গরু চরায় সে এখন। আজ বেশ কয়েক মাস বাপ কাজে যেতে পারে না। বাপটা কি যে ব্যায়রাম বাধিয়েছে মারাংবুরু দেওতাই জানেন। মোড়লের গরু না চরালে, মাসের শেষে যে’কটা ট্যাকা পাওয়া যায় তাও বন্ধ হয়ে যাবে। তাই এই কয়েক মাস ওই দূরের ধূমল নীল পাহাড় আর জঙ্গলে ভরা হাতির মাথার মত গজ ডুংরীগুলোর মাঝ দিয়ে আঁকাবাঁকা বয়ে যাওয়া সরু লদী সাতগুরুঙের ধারে আকাশমণির জঙ্গলে গ্রাম মাঝির গরু গুলোকে চরা’তে নিয়ে যায় নয়ন। 
গাঁ’এর শেষ মাথায়, বড় তেঁতুল গাছের ছাওয়ায় অড়লফুল ঝোড়ের মাঝে খোলা জায়গার পাঠশালাটায় নয়ন আর যেতে পারে না। নয়নের ভালোই লাগতো পড়তে যেতে, পড়ার শেষে পেট ভরে ভাত ডাল খাওয়ায়। গাঁ’এর  কুড়ি বাইশটা ছেলেমেয়ে সচরাচর কামাই করে না ওই পেট ভরে খাওয়ার লোভে।  
গ্রামের মধ্যে দিয়ে কাদা জমে শক্ত হওয়া ধূসর রাস্তাটা চলে গেছে সোজা সেই তেঁতুল গাছের পাশ দিয়ে গ্রামের বাইরে। তারপরই রাস্তাটা লাল নুড়ি মাটির, গরুর গাড়ির চলাচলে পিঠে কুঁজ নিয়ে ওঠা নামা রাস্তাটা এঁকে বেঁকো চলে গেছে সেই দূরের নীল পাহাড় পানে। মাথায় জঙ্গল নিয়ে দাঁড়িয়ে প্রথম গজ ডুংরীটা পেরলেই সাতগুরুং লদী। মারাংবুরু পাহাড় থেকে নেমে আসা সাতটা ঝোরা লদী হয়ে বয়ে চলছে কতদূর্ কে জানে, নয়ন জানে না। গ্রাম মাঝিবুঢ়াও বলতে পারেনি। তবে বলেছিল গাই ছাগল চরাতে বা কেঁদু পাতা তুলতে কখনই যেন সাত ঝোরা পাহাড়ে কেউ না যায়। ওখানে নাইহার বোংগা থানা গেড়ে আছে। ওর বাপও মানা করেছিল যেদিন নয়ন প্রথম গাই চরাতে যায়। 
নয়ন এখন চলেছে পনেরো কুড়িটা গাই, বকনার পিছনে। বাঁশের ছিপটি আস্ফালনে তাদের লাল মাটির পথের বাইরে যেতে দেয় না। পথের দু ধারে ভুট্টার ক্ষেতি। রেতেরবেলা গাঁয়ের ছেলে বুঢ়াগুলান পালা করে ক্ষেতি পাহারা দেয় নইলে পাশের বনের হরিণরা এসে খেয়ে যাবে সব, ক্ষিদের জ্বালায় হাতিরাও আসে যখন ফসলে ধরে সোনার রঙ। নয়নকেও পাহারায় যেতে হয় মাঝে মাঝে।সাদার ওপর কালো ছোপ ছোপ বুধিয়া গাই তার খুব প্রিয়। বুধিয়া জানে লদীর ধারে কোথায় সরেস ঘাস আছে অন্য গাইদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলে সে। নয়ন একবার দেখে নেয় তার হাঁটুর ওপর তুলে পরা ধুতির গেঁজে নিজের বানানো মূলি বাঁশের আড় বাঁশীটা ঠিকঠাক আছে কি না। সাতগুরুং লদীর ধারে আছে আকাশমণির জঙ্গল। গাছের  ছাওয়া বসে বাঁশী বাজায় নয়ন। গাইগুলান চরে বেড়ায় সাতগুরুং এর পারে। লম্বা লম্বা পা’য়ে ধোক পাখির জোড় পোকার খোঁজে ঘোরেফেরে গাইগুলার পায় পায়ে। বাঁশীর সুর লদীর ধারের আকাশমণির জঙ্গল, ওপারে এক ফালি রুখুসুখু জমি ঘেঁসা মৌউলের বন, বনবাবু বলে তমাল বন, ওই ঘন বন ছুঁয়ে ভেসে যায় দূর নীল পাহাড়ের চুড়ায় চুড়ায়। বুধিয়া তার পাশে বসে শিং নেড়ে ঘাস পোকা তাড়ায় আর আনমনে আড় বাঁশীর সুর শোনে নয়না। নয়নের মামার বাড়ির গাঁও মেঘদহ। তার মা ফুলমণির সই’য়ের মেয়ে নয়না। সে তাদের ছাগলগুলো চরাতে নিয়ে আসে নদীর ধারে। দু ফালি সরু সবুজ পাড়ের ফ্যাকাশে সাদা থান কাপড়ের ‘ফাতা’য় মোড়া রোগাসোগা শরীর, রুলি পরা দুটো চিকন কালো হাত বেরিয়ে আছে গাছ কোমরে পরা কাপড়ের ফাঁক দিয়ে। এক ঢাল রুখু চুলের বেণী লতিয়ে আছে তার পিঠের পরে। কানে লোহার তারের মাকড়ি। নাকে পুঁতির নাকছাবি। শুকনো লাল আবির রঙা ধুলোয় মাখা পা’য়ের গোছ। সূয্যি ঠাকুর মাথার উপর উঠলে, গাছের ছাওয়া জড় হয় আকাশমণির গুঁড়ির চারপাশে। আকাশমণির জঙ্গলে গাই ছাগলের চরে বেড়ানোয় দৃষ্টি রেখে নয়না বসে থাকে তার পাশে, তার নানা কথা শুনতে হয় নয়নকে। 
মাঝে মাঝেই নয়না বলে ফেলে তার মনের অনেক কথা। মা’র কথায় নিয়ম মত গাঁয়ের যোগমাঝির সাথে তাকে যেতে হয়েছে টুসুর মেলায় বরের খোঁজে। কাছে পিঠের গাঁও থেকে মেয়েরা আসে কত সেজেগুজে। মাথায় তাদের লাল পলাশ, হাতে রঙ বেরঙের রেশমী চুড়ি, গলায় দোলে পলাশ বীজের মালা, গাছ কোমরে পরা হরেক রঙের শাড়ি, পায়ে রুপালী মল। তারা দল বেঁধে নাচে। মরদ গুলানের পরনে হলুদ ছোপানো নতুন ধুতি। ধামসা-মাদলের ছন্দে দুলে ওঠে শরীর ও মন, মরদগুলার তেল চুকচুকে চুলের গোছা নাচের তালে তালে ঝাঁপিয়ে পড়ে চোখেমুখে। মেয়ে মরদের দল যেন হাওয়ায় ভাসে – গানের সুরে, ধামসার তালে তালে। ধীরে ধীরে মুখোমুখি হয়ে, আবার পিছিয়ে আসে। নয়না বরাবর থেকে যায় নাচের দলের বাইরে। সে দূর থেকে দেখে কিন্তু এগিয়ে যেতে পারে না। এবার সে তার বাঁ’পা টা দেখায় নয়নকে। ওই পা টা যেন শুকিয়ে যাওয়া বুনো শিয়াকুলের ডাল। ছোটবেলায় গাঁ’এর সোরেন হাড়াম জবাব দিয়েছিল। নয়নার বাপ ধার কর্জ করে তাকে নিয়ে গেছিল বাঘমুড়ির সরকারের হাসপাতালে। কিন্তু কাজ হয় নি। নয়না তাই জোর পায় না বাঁ পায়ে। একে একে মনের মত বর পেয়েছে তার অনেক সই। যোগ মাঝি আশা ছেড়ে দিয়েছে সেই কবে। কথার শেষে নয়নার উদাস চোখ আকাশমণির ডালপালার ফাঁকের নীল আকাশের জাফরির থেকে সরে গেছিল লদীর ওপারে মৌউল বনের গভীর ঘন সবুজে।
নিঝুম দুপুর, দূর থেকে ভেসে আসা তিলা ঘুঘুর একটানা ডাক, দুপুরের নির্জনতা ঘন করে তোলে। লদীর ধারের আকাশমণির ডালপালার ফাঁকে নীল আকাশে নয়ানার উদাস চোখ। গাঁয়ের মাঝির মেয়ের বাপলা বিয়ের আসরে শোনা গানগুলি নয়নের মনে গেঁথে আছে। নিজের মনে গানের কথা উল্টেপাল্টে নিজের সুরে বাঁশী বাজায় নয়ন। শোনে তার মা ফুলমনি আর শোনে বুধিয়া গাই আর নয়না যখন তারা সাতগুরুঙের ধারে গাই বকনা চরাতে যায়। 

নয়ন আড়বাঁশীতে গানের সুর তোলে।
“কালো জলে কুচলা তলে ডুব দেয় আসনপানির লয়ন
আজ সারা না, কাল সারা না পাই যে দরসন৷
লদীধারে আকাশমণি, মৌউলির  বন – 
বঁধু মিছাই কর আস
ঝিরিহিরি আঁকাবাঁকা সাতগুরুং বইছে বারমাস..........”

পা’য়ের পাতা ডোবা নদীর জলে ছড়ানো পাথরগুলো কালো কুচকুচে কাছিমের পিঠের মত জেগে আছে ইতিউতি। নিথর দুপুর, আকাশের নীল ছায়া জমা নিস্তরঙ্গ জলে খেলে বেড়ায় ছোট ছোট রুপোলী কুচো মাছের দল। নয়ন গামছায় মাছ ধরে, নয়না অবাক চোখে দ্যাখে। নদীর ধারে বেড়ে ওটা কচু পাতায় রাখা মাছ নয়নার সাথে ভাগাভাগি করে নেয় নয়ন।
সূয্যি ডোবার আগে ফিরতে হয় গাঁয়ে। আঁধার নামলে পথে হুড়ার, বন শুয়োরের ভয়, দল ছাড়া হাতিও কখনো পথ জুড়ে দাঁড়ায়। নয়না কুড়িয়ে রাখা কেঁদু পাতার গোছা ছাগলের পিঠে রেখে, ফেরে তার গ্রামে।
অস্তগামী সূর্যের কমলা আলো ছড়িয়ে পড়ে গরুর ক্ষুরে ওড়া ধুলোয়, সেই রেশ নয়নার কাজল

কালো হরিণ চোখে ফোটায় মায়াবী আলো। নয়নের কিশোর মনে সেই আলো কোন অজানা দিশার সন্ধান নিয়ে আসে। বুধিয়া গাই পথ দেখিয়ে নিয়ে চলে গাঁয়ের পথে – নয়নার ছাগলের দল মিশে যায় গরুর পালে। নয়ন তার আড় বাঁশীতে আবার গানের কথার সুর তোলে –

“বাঁশুরিয়া বাঁশী ফুঁকে মাদ্যোল্যা মাদল
পাহাড়িয়া লদী শুধু
বহে কল কল
আমার মনের বাগে
ফাগুনের আগুন
তোলপাড়া করে মন
হিয়া থর থর

সাঁজ বেলি রঙ মাখ্যে
গগনে মগনে
বাঁশী শুন্যে মজে মন
-----“
খুঁড়িয়ে চলা অলস পায়ে নয়নের পাশে পাশে এগিয়ে চলে নয়না। আর কয়েক কদম এগিয়েই তারা আলাদা হয়ে যাবে যে যার গাঁ’য়ের পথে। 
গ্রাম মাঝির গোয়ালে গরু তুলে, ধুনো দিয়ে, দিন মজুরের খোরাকি এক সাঁনকি লাল মেটে চাল, দুটি চুরকা-আলু আর কাগজে মোড়া খানিকটা নুন হাতে তুলে দেয় মাঝি বউ। তার আগে মাঝির উঠানে উড়ে আসা পাতা, ডাল পালাও ঝেঁটিয়ে দিয়ে ছুটি পায় নয়ন। সাঁজের আলো নিভে গিয়ে অন্ধকার নেমে আসে গাঁয়ে, আশেপাশের জঙ্গলে, কাছের গজ ডুংরির গায়ে। গোয়ালের বাতার ফাঁকে গামছায় বেঁধে রাখা কচু পাতায় মোড়া কুচো মাছগুলো নিয়ে অন্ধকারে ঘরের পানে হাঁটা দেয় নয়ন।  
খাপরা চালের ছিঁটাবেড়া দেওয়া গিরিমাটি লেপা মেটে ঘর নয়নদের। দূরে রাতের আলোয় দেখতে পায় ঘরের পাশে ঝোপড়া বুনো জাম গাছটার জমাট বাঁধা অন্ধকার ঝুঁকে পড়েছে তাদের খাপরার চালে। এগিয়ে চলে নয়ন। কানে আসে ঘরের পাশের ডোবায় বুনো জামের পাতা পচা জলে একটানা ব্যাঙের ডাক। 
ঘরের দাওয়ায় রাখা কাঠের ডেঁড়কোয় রেড়ির তেলের কুপি। রাতের বাতাসে কাঁপা কাঁপা হলুদ আলো ছড়িয়ে আছে গোবর নিকনো ছিটা বেড়া ঘেরা ছোট্ট উঠানে। ঘরের ভেতর থেকে ভেসে আসে হ হ হ– কাশির দমক। বাপটার জন্য বুকে মোচড় লাগে নয়নের। এবার মাসের ট্যাকা পেলে বাপটারে নিয়ে যেতে হবে বাগমুড়ির সরকারি হাসপাতালে।
দাওয়ার চালার নিচে, মাটি খোঁড়া চুলার খোঁদলে শুকনো ডালপালা গুঁজে দিচ্ছে ফুলমনি। পাট কাঠির ফুঁ তে ঝলকে ওঠা লক লকে আগুনের শিখায় মা’র ঘাম তেলা মুখ লালচে দেখায়। রাতপোকার দল কুপির আলোর চারপাশে গুনগুনায়। নয়নার দুখী হরিণ চোখ ভেসে ওঠে লক্ষ তারায় মোড়া রাতের আকাশে। নয়ন দাওয়ার দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বাঁশীতে সুর তোলে –  
“একটু ঠিকর করে লাচরে ভাবের মার‌্যানী,
একটু গিদার করে লাচরে ভাবের মাল্যানী।
তোরে আম বাগানের আম খাওয়াবো এখুনি
তোরে জাম বাগানের জাম খাওয়াবো এখুনি।“ 

রাতের কালো নিথর আকাশে ভেসে বেড়ায় আড় বাঁশীর মিঠে সুর।

গাঁ’য়ের ওধারে ভুট্টার ক্ষেতি থেকে হঠাৎ ভেসে আসে একটানা মাদলের শব্দ সাথে হরেক স্বরে হো হো হো আওয়াজ। মশালের আলোয় ওদিকের এক ফালি আকাশ আগুন রাঙা। আজ হাতি ঢুকেছে বোধহয়। কাল নয়নের পাহারা দেওয়ার পালা। পাহারায় গেলে রেতে ভাত জোটে না। তবে নতুন কিছুর স্বাদ চিনিয়েছে পাশের দুয়ারসিনি গাঁয়ের পালান কিস্কু। ওদের গাঁয়ের আশ পাশের বন জঙ্গলে শহর বাবুরা ঘুরতে আসে। বন বাবুরা পালানকে বাবুদের বনজঙ্গল ঘোরানোর কাজে লাগিয়েছে। সে তাদের জঙ্গল চেনায় আর নিজে শেখে অন্যকিছু। রেত পাহারায় পালান গামছায় বেঁধে নিয়ে আসে লম্বা বোতলে ভরা ভাত পচাই। লুকিয়ে রাখে ক্ষেতি পাহারার মাচার নিচে। পাহারা দলের গাঁ বুঢ়ারা রেতের দিকে ঝিমোতে থাকে, কারুর হাতে শাল পাতার চুট্টার আগুন বিন্দু ধিকি ধিকি জ্বলে। সে নয়নকে মাচার নিচে নিয়ে এসে হাতে তুলে দেয় পচাই এর বোতল। নয়ন এখন বোঝে ভাত পচাই প্যাটের খিদে মেটায় আবার নেশাও ধরায়। পালান বলে – 
“তুকে লিয়ে যাব’রে বনবাবুর কাছে। জঙ্গলের গাছে গাছে লম্বর দাগাতে হবে। মাসকাবারি মজুরি পাবি বটেক আর উপরিও আছে’রে লয়ন। শহরবাবু গুলানের হাতে গজ্ গজ করে ট্যাকা। হুই তো সেদিন এক বাবু বলে এক বোতল ভাত পচাই লিয়ে আয়। ঘরে ছিল বাপের এক বোতল, মুর মাতা খারাপ হলো রে লয়ন – বাবুটা মোরে দিয়ে দিল কর্ করে এক পচাশ ট্যাকার লোট!“ 
হা হা হাসে পালান পচাই এর নেশায়।
চুলায় উথলে ওঠা গরম মেঠে লাল ভাতের সোঁদা মাটির গন্ধে প্যাটের খিদে চনমনায়। নাদা ভরে মেঠে ভাত, কুচো মাছের লঙ্কা হলুদের ঝোল আর আলু সানায় দিন শেষের খিদে মেটায় নয়ন। রাত পাখির ডাক রাতটারে করে তোলে গভীর -
নয়নার চোখ দুটো ভাসে তারার আলোয়, ঘরের দাওয়া এসে তুলে নেয় তার আড় বাঁশী, সুর ওঠে  –
“জংলি মোরগ ডেকেছে দূর নীল পাহাড়ে
ডুংরীর ধারে গভীর বনে কেকাধ্বনি
মৌউলি বনে খরগোশ, ঠেলুর তেড়াহুড়ি
শিকার হবে, শিকার হবে,
আসনপানি কাঁপছে যেন ঢেঁকির পাড়
রেগড়া টামাক বাজে
কেন বাজ কেন বাজে-----“

নয়ন দাওয়ায় বসে ভাবে পরের বোশেখী পূর্ণিমায় সে যাবে দিসুম সেঁদরা পরবে। বাপের বেতের ধনু আর মরচে ধরা তির নিয়ে দলের সঙ্গে যাবে শিকার লাচে।
বনমোরগ, খরগোশ শিকারেই নয়ন মরদ হবে। টুসুর মেলায় সেও যাবে কনের খোঁজে। সাজো মাটি ঘসা চুলে জড়ানো পলাশ, গলায় পলাশ বীজের মালা, হরিণ চোখ নয়না কে বেছে নেবে নয়ন। যোগ মাঝি পাকা করবে তাদের বাপলা বিয়ে।
দাওয়ায় বসে দেখা যায় বুনো জামের ঝুপসী অন্ধকারের ওপরে তারায় ভরা মখমলি আকাশ, ডোবার জাম পাতা পচা জলে একটানা ব্যাঙের ডাক, দূরের আকাশে ক্ষেতি পাহারার মশালের কাঁপা কাঁপা আলো, মাঝে মাঝে ঘরের ভেতরে বাপের দমকা কাশির হ হ হ। 
আকাশে এক টুকরো পেঁজা তুলোর মেঘে নয়ন ভাসিয়ে দেয় তার বাঁশীর সুর। রাতের আঁধারে পেঁজা মেঘের সাথে নয়নের সুর ভেসে যাবে মেঘদহ গাঁয়ে ঘুমিয়ে থাকা নয়নার স্বপনে –
রাত আরো গভীর হয়। পালান কিস্কু স্বপ্ন ধরিয়েছে নয়নের মনে। নয়নার লজ্জানত হরিণ চোখ ভাসে রাতের আলোয়। মনে ভাসে আসানপানির হাড়াম মাঝির বাপলা বিয়ার মন্ত্র –
“আজ থেকে তুরে  দিয়া হল লয়নার ভার। 
শিকারে গেলে তুই খাবি আধেক, ঘরে আনবি আধেক। 
রোগে শোকে, সুখে দুখে তুরা সঙ্গী সাথী হয়ে থাকবি। 
আজ লয়নার পেরান মন সবই তুরে দিয়া হল।“ 

খুশির রেশ মাখা ঘুম জড়িয়ে আসে নয়নের চোখ।  

কবিতাঃ মৌ চক্রবর্তী

কবিতা

মৌ চক্রবর্তী

ভুবনবালার চিরকুট

    

তুলো জমাট লালবুক 

 একচিত্তির উঠোনে রোদ খাচ্ছে সাত থেকে সত্তর বা আশি কিংবা নব্বইয়ের লেপ আজ 

 

দেখেইনি কেউ কত কত জন্ম

লেপে লেপ্টে স্মৃতিসব গায়ে দেয় ভুবনবালা শুধুই কি লেপখানা

বুকে যার একশ হাজার খাঁজ 

 

রোদ খাইয়ে যতনে 

তুলে রাখে নেই যা 

আপনজন গন্ধ 

পরানে ছুঁয়ে নেয় চুঁয়ে 

শরীর জুড়ে শেকড় যত 

লাল ওড়নায় নববধূটি সলাজ 

 

সুখে দু'পা 

যেমন হাত ডানা মেলে  

বিছিয়ে প্রজাপতিরঙ কিংবা 

নীলে ভিজে

বেলাসাজে কে এঁকে যায় আলোর কারুকাজ  

nupur1.jpg

 এপ্রিল ২০২৩ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

কবিতাঃ সুকান্ত পাল

পদব্রজের নেহা 
 

ঘুমঘোরে অচেতনে দেখি পিয়া মুখ
অন্তর মাঝেতে জাগে কি অদ্ভুত সুখ!
কত মধু আছে বঁধুর অধর কমলে
অধরে অধর পান করি মধু ফলে। 
আঁখি হতে কেবা নিদ লইল হরিয়া
এ রজনী গোঙাইলে যাইব মরিয়া। 
কিছুতে না নিবারয়ে নয়নের আশ
যামিনী বাড়য়ে মোর বাড়য়ে পিয়াস। 
বৈশাখী বহে ঝড় ভিতর বাহিরে
অঙ্গের লাগিয়া অঙ্গ পাশ নাহি ফিরে। 
পরাণ বঁধুয়া মুই দেহি আর দেহা
অশোকানন্দন ভনে এ ব্রজের নেহা। 

কবিতা

সুকান্ত পাল

জিতপুর, মুর্শিদাবাদ

himadri2.jpg

 এপ্রিল ২০২৩ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

Chandrashekar.jpg

কবিতা

চন্দ্রশেখর ভট্টাচার্য

নিউটাউন, কলকাতা

জন্ম: ১৬ই সেপ্টেম্বর, ১৯৮০ সাল। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলায়। দারিদ্রতার মধ্য দিয়ে বড় হয়ে ওঠা। বর্তমানে কলকাতা নিউটাউনের বাসিন্দা। নিজেকে মূর্খ বলতেই ভালোবাসেন। ভালোবাসেন অবসরে গীটার বাজাতে। কিশোর বয়সে কবিতা লেখার শুরু। প্রথম প্রকাশিত কবিতা 'অভিমানী' সৃষ্টিসন্ধান নামক পত্রিকাতে। তারপর 'সোনাঝুরি', 'মেঘদূত', 'সংবাদ প্রবাহ', 'অ', 'সৃষ্টি', ''বাংলালাইভ', 'মৈত্রেয়ী' প্রভৃতি পত্রিকাতে প্রকাশিত হয়েছে বেশ কিছু কবিতা। যা ইতিমধ্যে পাঠকদের মন জয় করেছে। প্রকৃতি ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা থেকে জন্ম নিয়েছে প্রথম প্রেমের কাব্যগ্রন্থ 'তোমাকে এবং তোমাকে'।

বসন্ত নয় পুড়ছে ফাগুন

ঙুলে আঙুল ঘষে
পাথরে পাথর ঘষে
তোকে খুঁজি, তুই কই?
তোর জন্য সূর্য ওঠে
ডুবেও যায়
তোকে হারিয়ে ফেলি
অন্ধকারেই।
আঙুলে আঙুল মানে
এ-মুখে ও মুখ,
তোর জন্য আজ আমার
মন খারাপ, ভীষণ অসুখ।
আঙুলে আঙুল ঘষি
যদি জ্বলে যায় হঠাৎ আগুন
আসমানে ধোঁয়া দেখে দৌড়ে আসিস,
দেখে যাস -
বসন্ত নয়, পুড়ছে ফাগুন।

maple1.jpg
কবিতাঃ চন্দ্রশখর ভট্টাচার্য্য

 এপ্রিল ২০২৩ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

কবিতা

তানভি সান্যাল (সাহেব সেখ) 

মুর্শিদাবাদ, প: বঙ্গ

কবিতাঃ তানভি সান্যাল


বাগান শূণ্য করিয়া,
তুমি চলে গেলে ও মালী।
পুষ্পকে একা ছাড়িয়া,
তুমি করিলে তার কোল খালি?

কেন তুমি ছিঁড়িলে তাঁর?
রয়ে গেলো ফাঁকা তানপুরা।
সুর যে উঠিবেনা আর,
বাজিবেনা ভক্তির ঝঙ্কার।

প্রভু তুমি প্রত্যাগমন করিলে,
ফেলে সকল কিছু পাছে।
সবুজ ডানায় উড়িলে নীল দিগন্তে,
এতে মোক কী করার আছে?

মোর হৃদয় বীণা বাজিবে,
ঠিক আগেরই তালে তালে।
তোমায় এ সেবক ভক্তিবে,
যতক্ষণ প্রাণ থাকিবে এ ধড়ে।

"বিরহ বেদনা"


হাপ্রভু, মহাকাল,
তোমা তেজের আলোক রশ্মিতে,
হইয়াছে আলোকিত চিরকাল।
তোমা সন্নিকটে পাইয়াছে,

এ ধরা সকল চেতনা,
প্রশমিত হইয়াছে সকল বেদনা।
বইয়াছে তোমা ভক্তি মেলা,
তবু কেনো হৃদয়ে এ যন্ত্রণা?

ক্ষণিকের দর্শনে পাইলাম,
তোমারে,আপন করিলাম।
জানিলাম তোমা ভক্তি, বসাইলাম,
হৃদয় পানে, উৎসর্গ করিলাম,

মোক,পূজার ফুল হইলো অর্পণ।
তোমায় নৈবেদ্য দিলাম,
মোক, বুকের রক্তে ভরালাম মন ।
অশ্রুজলে প্রবাহিত করিলাম।

অবস্থান  
    

ঠিক কতটা বিশ্বাসের পর
আনতে হবে অবিশ্বাসের ছোঁয়া!
হাতের থেকে হাত সরাব
কাঁধের থেকে কাঁধ!
ঠিক কতটা পথ প্রশ্নবিহীন 
আদেশ মেনে চলা, 
কখন থেকে বুঝতে হবে, একি 
এ যে চক্রান্তের জটিল আঁকিবুঁকি!
মাথার উপর মুখোশ ধারী গাছ!
মুখের পেছন ঐ যে সব মুখোশ
চিনতে হবে কতটা পথের পর?
কি করে আনব অবিশ্বাসের ছোঁয়া?
বিশ্বাস যে আমার মজ্জ্বাময়!

কবিতাঃ পূর্বিতা পুরকায়স্থ
art1.jpg

কবিতা

পূর্বিতা পুরকায়স্থ

maple.jpg

 এপ্রিল ২০২৩ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

 এপ্রিল ২০২৩ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

 কবিতাঃ নূপুর রায়চৌধুরী

অদৃশ্য যুদ্ধ

 

যুদ্ধের কথা বলছিলেন না?

সব যুদ্ধ কি দেখা যায়?

যদি যেত, তাহলে,

ওই যে ন' মাসের পোয়াতিকে, 

পেটে লাথি মেরে চলে গেছিল,

স্বামী নামের জানোয়ারটা, 

আর সারা সমাজের আঙ্গুল’টা, 

এর কারণ নির্দিষ্ট করেছিল, 

সেই অভাগীরই উদ্দেশ্যে, 

তখন তার লড়াইটাই ছিল,

আমার দেখা সেরা যুদ্ধ।

পচাগলা সমাজের বিরুদ্ধে,

touch.jpg

কবিতা

নূপুর রায়চৌধুরী

ছোবল উদ্যত মৃত্যুর সঙ্গে,

দিন দিন, বার বার। 

ও, হ্যাঁ, আরেকটা কথা:

শেষ হাসিটা সে'ই হেসেছিল,

দাঁত দাঁত চেপে কন্যা সন্তানকে, 

পৃথিবীর আলো দেখিয়েছিল।

এই যুদ্ধজয়ের কোনো শঙ্খনিনাদ, 

কিন্তু কোত্থাও ঘোষিত হয়নি, 

অবশ্য, তার ভারী বয়েই গেছে,

যুদ্ধটা তো শেষ অব্দি 

সে একাই জিতে নিয়েছে।

 এপ্রিল ২০২৩ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

সবিতার সত্য

গল্প

সবিতার সত্য

সংসার কথা

অঞ্জলি দে নন্দী

মোহন গার্ডেন, উত্তমনগর, নতুন দিল্লী

thief.jpg

 এপ্রিল ২০২৩ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

লকাতার বিধান সরণীর বিরাট চারতলা বাড়ির মেয়ে। বাবার বড় বাজারে দুটি ব্যবসা চলছে। একটিতে সেলাই মেশিন তৈরি হয়। আরেকটিতে যাবতীয় দর্জি কাজের জিনিস পাওয়া যায়। ব্যবসার বাড়িটিও চারতলা বিশাল। 
পাত্রী সবিতা দেখতে খুবই সুন্দরী। তেইশ বছর বয়সে বিয়ে হল। পাত্র দেবী
প্রসাদ কলকাতার বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে বি. কম. পাস। কলেজ স্ট্রীটে প্রাইভেট ফার্মে জব করে। হাওড়ার সালকিয়াতে বউকে নিয়ে ভাড়া থাকে। হুগলীর চৈতন্যবাটী গ্রামে প্রচুর জমি, সম্পত্তি আছে। সেখানেই তার পরিবারের সদস্যরা থাকে। 
বিয়ের এক বছর পর সবিতা ও দেবীপ্রসাদের এক কন্যা জন্ম নিল। এর যখন তিন বছর বয়স হল তখন তাদের আরেক পুত্র সন্তান জন্ম নিল। ছেলের পাঁচ মাস বয়সে অন্নপ্রাশন করার জন্য তারা মেয়ে ও ছেলেকে নিয়ে গ্রামে গেল। সেই যে গেল আর মা, মেয়ে ও ছেলে শহরে এল না। বাবা সালকিয়াতে একাই থাকে। কলেজ স্ট্রীটে চাকরী করে। প্রতি শনিবার রাতে গ্রামে যায় এবং রবিবার বিকেলে আবার শহরে চলে আসে। ওখানে যখন ছেলের তিন বছর বয়স হল তখন আরেক মেয়ের জন্ম হল। 
এদিকে গ্রাম থেকে তখন এক ভাই এসে দাদার কাছে রইল। সে হাওড়ার এক কলেজে বি. এস. সি. পড়ল। এ আসার পাঁচ বছর পর আরেক ভাই এল। সে বেলুর রামকৃষ্ণ মিশনে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিপ্লোমা করতে লাগল। আগের ভাই পাস করে টিউশনি পড়ায় ও সরকারী চাকরীর পরীক্ষা দেয়। বহু বছর পর সে রেলে চাকরী পেল। এর কয়েক বছর পর অন্য ভাই পাস করে কয়েকমাস টিউশনি পড়ায়। তারপর সরকারী চাকরী পেয়ে বোম্বে চলে গেল। দাদা দুভাইকে নিজের খরচায় পড়ালেখা শেখাল। রোজ সকালে ও রাতে নিজের খরচায়, আপন হাতে রেঁধে খাইয়ে রেখেছিল। দাদা তার ত্রিশ বছর বয়সে বিয়ে দিল। সে বিয়ে করে বউকে নিয়ে সালকিয়াতে থাকল। দাদাকে বলেছিল যে আলাদা ঘর খুঁজে দিতে যেখানে ওরা দুজন থাকবে। দাদা ভাইকে সালকিয়াতেই নিজের বাসা থেকে খানিক দূরে ঘর জোগাড় করে দিল। সেখানে দাদার কিন্তু ঠাঁই হল না। দাদা একাই থাকে। 
এরপর আরেক ভাই যখন একত্রিশ বছরের হল তখন দাদা তারও বিয়ে দিল। সে বউকে নিয়ে বোম্বেতে থাকে। 
এদিকে ওরা তিন জন গ্রামের স্কুলে পড়ে। খুব ভালো রেজাল্ট করে সবাই টেন পাস ও টুয়েলভ পাস করল। বড় মেয়েকে এনে বাবা কলকাতার কলেজে বি. এস. সি. পড়াল। সে গার্লস হোস্টেলে থাকে। পাস করার পর তাকে বিয়ে দিয়ে দিল। জামাই হুগলীরই - তাদের বাড়ি থেকে অনেক দূরের এক গ্রামের ত্রিশ বছরের এক ছেলে। কিন্তু দিল্লীতে সরকারী জব করে। তাই মেয়ে ও জামাই দিল্লীতে থাকে। 
ছেলে আশিস নন্দী গ্রাম থেকে রোজ সাইকেলে ও ট্রেনে করে যাওয়া এবং আসা করে হুগলীর উত্তরপাড়া কলেজ থেকে ফার্ষ্ট ক্লাস পেয়ে পাস করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম. কম. পড়ল। একই সঙ্গে আই. সি. ডব্লিউ. এ. পড়ল। এম. কম. পাস করল। আই. সি. ডব্লিউ. এ. পড়া চলল।
ছোট মেয়ে শেওড়াফুলিতে থেকে শ্রীরামপুর কলেজ থেকে বি. এস. সি. পাস করল। এরপর কলকাতার রেলে চাকরী করা এক পাত্রের সঙ্গে বিয়ে হয়ে সে কলকাতার বাসিন্দা হল। 
হঠাৎ করে আশিসের সাইনাস হল। কলকাতার এক নার্সিং হোমে অপারেশন হল। তার এক বছর পর তার নার্ভের রোগ হল। পড়া ছেড়ে দিল। প্রচুর দাওয়াই খায় রোজ। ওর যখন ত্রিশ বছর
 হল

তখন নিজের শোবার ঘরে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়ল। সেদিন ছিল থার্ড জুন, ২০০১, রবিবার। বাবা তাই সালকিয়া থেকে চৈতন্যবাটী এসে আছে। রোজ আশিস বিকেলে ঘুম থেকে উঠে এসে মায়ের কাছে বিকেলে দুধ খায়। সেদিন আসছে না দেখে মস ছেলের ঘরে গিয়ে দেখল যে দরজায় খিল দেওয়া। ডাকল। ধাক্কা দিল। সারা শব্দ নেই। বাবাকে ডাকল। সেও এসে ডাকাডাকি, ধাক্কাধাক্কি করল। তারপর দরজা ভাঙল। মা ও বাবা দেখল যে ওদের ছয় ফিট লম্বা, ফর্সা, সুন্দর ছেলের মুখ থেকে জিভটা বেরিয়ে এসেছে। ও করি থেকে ঝুলছে। পুরোনো আমলের করি, বর্গার বাড়ি। বাড়ির ভিটাতেই তিনশ বছর ধরে পঞ্চ বাস্তু দেব ও দেবীর নিত্য পূজো হয়। সেই ভিটাতেই এই আত্মহত্যা। মা পাথরের মূর্তি। বাবা দড়ি কেটে নামাল। মা তার মাথাটা কোলে নিয়ে তাল পাতার পাখায় করে নিজের হাতে হাওয়া করতে লাগল। মৃত ছেলের যেন গরম না করে, তাই। কলকাতার মেয়ে যে হাত পাখা কখনোই বাপের বাড়িতে দেখেই নি সে-ই যখন গ্রামের মা হয়েছে, তখন বিদ্যুৎ না পৌঁছনো বাড়িতে হাত পাখার হাওয়ায় সন্তানদের রাতে গরম থেকে আরাম দিয়ে ঘুমোতে দিয়েছে। নিজে না ঘুমিয়ে রাত কাটাত। সকাল থেকে শাশুড়ির, শ্বশুর, তিন ননদের (যতদিন না ওদের বিয়ে হয়েছে) সব কাজ করে দুপুরে ঘুমোত। আবার ঘুম থেকে উঠে সংসারের কাজ। এখনও তাই সেই একই অভ্যাসে মা পুত্রকে পাখার বাতাস করে চলেছে। 
এরপর বাবা নিজের কাঁধে করে ছেলেকে শ্মশানে নিয়ে গেল। আপন হাতে শৈশবে যে বাবা পুত্রকে কোলে বসিয়ে কচি মুখে সন্দেশ খাইয়েছে আজ সেই পিতাই নিজের হাতে যুবক পুত্রের মুখে আগুন দিল। দেহ জ্বলে শেষ হল। বৃদ্ধ বাবা শূন্য বুকে, খালি ঘরে ফিরে এল। বাড়িতে মা রইল। বাবা এক সপ্তাহ পর আবার কলকাতার অফিসে কাজ করতে লাগল আগের মতোই। থাকল সালকিয়ায়। মা চৈতন্যবাটীতে একাই থাকে। পঞ্চ বাস্তু দেব ও দেবীর সেবা করে ঠিক আগেরই মত। বাবা শনিবার রাতে আসে আর রবিবার বিকেলে চলে যায়।
আশিসের মৃত্যুর সাত বছর পর দেবীপ্রসাদের ক্যান্সার হল। শ্রীরামপুরের নার্সিং হোমে মারা গেল। বিধবা সবিতা একাই গ্রামে আছে। বড় মেয়ে বলল তার দিল্লীতে থাকতে। ছোট মেয়ে বলল তার কলকাতায় থাকতে। সে কোথাওই থাকল না। নিজের ছেলের নিত্য ব্যবহৃত হাওয়াই চটিতে রোজ সকালে ও সন্ধ্যায় গঙ্গা জল দিয়ে পূজো করে। তাকে রোজ চার বেলা যেমন বেঁচে থাকতে দিত সেরকমই কাঁসারের থালায় সাজিয়ে খেতে দেয়। তা কিছু পরে নিয়ে গিয়ে পুকুরের জলে ঢেলে দেয়। এভাবে চলতে থাকে। আশিসের মৃত্যুর দশ বছর পর সবিতার ক্যান্সার হল। সেও ঐ শ্রীরামপুরের নার্সিং হোমে মারা গেল। 
আশিসের গ্রাজুয়েশন করার সময় যে টাকা স্কলারশিপ পেয়েছিল (বি. কম. পাস করে) সেই টাকা ও নিজের ব্যবসা করার টাকা সব সে আত্মহত্যা করার আগে মায়ের নামেই নোমিনি করে গিয়েছিল। দেবীপ্রসাদ আবার আশিসের, সবিতার ও নিজের নামেও অনেক টাকা ব্যাংকে রেখে গিয়েছিল। সবার সব টাকা দুজনে - বড় ও ছোট মেয়ে পেল। আর সব জমি ও সম্পত্তি দু কাকা নিল।
আজও যদি পারো ভারতের, পশ্চিম বঙ্গের, হুগলীর, চৈতন্যবাটী গ্রামের নন্দী বাড়িতে গিয়ে ওদের আত্মার উদ্দেশ্যে কয়েক ফোঁটা চোখের জল ফেলো! আমি আশিসের বড় দিদি অঞ্জলি। আর আশিসের ছোট বোন মনীষা। আমরা বেঁচে অপেক্ষা করছি কবে যে তাদের কাছে স্বর্গে পৌঁছব.........

সায়াহ্ন

পূর্বিতা পু্রকায়স্থ

girl1.jpg
সায়াহ্ন

গল্প

 এপ্রিল ২০২৩ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

ষ্টেশন থেকে সুনন্দা অটোতে যাচ্ছিলেন। রাস্তার দুপাশে তাকাতে তাকাতে। পুরোপুরি পল্লীগাঁ। রাস্তা সেই তুলনায় বেশ ভাল। রাস্তার দুপাশে কখনও মাঠের মধ্যে ঘরবাড়ি কখনও বা শুধুই ক্ষেত। বেশিরভাগ ঘরবাড়ি একচালা। কোনটা কোনটা আবার মাটির দোতলা। সুনন্দার মনে পড়ে মাটির দোতলা বাড়ি উনি প্রথম দেখেছিলেন শ্বশুরবাড়িতে। এর আগে দেখা তো দূরের কথা শোনেনই নি যে মাটির বাড়ি দোতলাও  হয়। সাদা ফটফটে মাটির দোতলা বাড়ি দেখতে ভালই লাগে।
এভাবে চারদিক দেখতে দেখতে আর এটা ওটা ভাবতে ভাবতে হঠাৎই অটোটা রাস্তা ছেড়ে মাঠের মধ্যে নেমে পড়ল।
- 'স্কুল কি এসে গেছে?' সুনন্দা জিজ্ঞেস করলেন।
- 'হ্যাঁ ম্যাডাম, ঐ যে। সোজা তাকান।'
সুনন্দা দেখতে পেলেন দূরে বিশাল জায়গা জুড়ে একটা বিল্ডিং দাঁড়িয়ে আছে। চারপাশ ফাঁকা ফাঁকা। ওঁর মনটা কেমন উদাস হয়ে গেল। চিরকাল জনবহুল জায়গায় থেকে অভ্যস্ত। চলে তো এলেন। কি জানি থাকতে পারবেন কি না। তবে আজ রোববার দেখে হয়ত বেশি নিস্তব্ধ। অন্য দিনগুলোর চিত্র হয়ত একটু আলাদা হয়।
অটো স্কুলের গেটে এসে থামল। ভাড়া মিটিয়ে দেবার পর মালপত্র নামিয়ে দিয়ে অটোর ড্রাইভার একটু দাঁড়াল। হয়ত সুনন্দাকে ঠিক জায়গায় এনে পৌঁছে দিয়েছে কিনা সেটা আঁচ করতে চাইছিল। সুনন্দা সিকিউরিটির সাথে কথা বলে এপোয়েন্টমেন্ট লেটার দেখালেন। সিকিউরিটি তা দেখে সুনন্দার জন্যে গেটটা খুলে দিল। ভেতরে ঢোকার আগে সুনন্দা পেছন ফিরে ড্রাইভারকে ধন্যবাদ জানালেন।
শুরু হল সুনন্দা বোসের জীবনের আরেকটা অধ্যায় হয়ত বা শেষ অধ্যায়।
গেট দিয়ে ঢুকে হাতের বাঁ পাশে সিকিউরিটির স্টাফেদের ঘর। আরেকটু এগিয়ে গিয়ে দু পাশে দুটো দোতলা বিল্ডিং। মাঝখানে বড় গোলাকৃতি মাঠ। আর মাঠের ওপারে আরেকটা তিনতলা বিল্ডিং। সেটাই সম্ভবত হস্টেল। পুরোটা এলাকাকে ঘিরে রেখেছে প্রায় শ বারো ফুট উঁচু দেয়াল। সুনন্দার আগে আগে ওর মালপত্র নিয়ে একজন যাচ্ছিল। হয়ত হস্টেলে কাজ করে। সিকিউরিটির লোক মোবাইলে ওকে ডেকে নিয়েছিল। সেটা দেখে সুনন্দা আশ্বস্ত হয়েছিলেন এই জেনে যে মোবাইলের টাওয়ারটা আছে! 
হস্টেলে ঢুকেই একটা রিসেপশন রুম। রুমে একটা টেবিল চেয়ার। দু পাশে দুটো থ্রি সিটার সোফা। এখানেই হয়ত গার্জিয়ানরা মেয়েদের সাথে মিট করে। এখনও অব্দি ও যা দেখল তা তে মনে হচ্ছে ব্যবস্থা ভালই। রিসেপশনে তখন কেউ না থাকায় ছেলেটা ওকে বসতে বলে কাকে যেন ডাকতে গেল। একটু পর ফিরে এল সাথে একজনকে নিয়ে। একজন মধ্যবয়েসী মহিলা। সাধারণ চেহারার কিন্তু হাসি হাসি মুখ। সহজেই আপন করে নেবার মত ব্যক্তিত্ব। 
সুনন্দা দেখেই উঠে দাঁড়ালেন।
- 'আরে বসুন বসুন। আপনি সুনন্দা বোস তাই না? আমি মাধুরী। মাধুরী চক্রবর্তী। আপনার এপোয়েন্টমেন্টের খবর আমরা গতকালই পেয়েছি।' একনিঃশ্বাসে ভদ্রমহিলা কথাগুলো বলে থামলেন।
সুনন্দা এপোয়েন্টমেন্টের চিঠিটা এগিয়ে দিলেন। অফিসিয়াল কাজকর্ম সেরে মাধুরী ছেলেটাকে চাবি দিয়ে বললেন,

- 'বিমল ম্যাডামকে ওঁর ঘরে নিয়ে যাও।' আর সুনন্দার দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন,

- 'বিকেলে আমার ঘরে চলে আসুন। দুজনে একসাথে চা খাব।'
- 'নিশ্চয়ই আসব', বলে সুনন্দা বিমলকে অনুসরণ করলেন।
ঘরটা দশ বাই বারো হবে। এটাচড্ বাথরুম। ঘরে একটা ছয় ফিট বাই পাঁচ ফিট খাট। একটা চেয়ার টেবিল আর একটা ওয়ারড্রোব। 
বিমল ওয়ারড্রোব থেকে চটপট তোষক, বালিশ, বেড শিট বার করে খাটের ওপর পেতে দিল। তারপর সুনন্দার দিকে তাকিয়ে বলল,

- 'এবার আমি আসি ম্যাডাম। দরকার হলে ডাকবেন। আমার নাম্বারটা নিয়ে নিন।' মোবাইল নাম্বারটা দিয়ে নমস্কার করে চলে গেল ।
সুনন্দা চেয়ারে বসলেন। সেই কখন বেরিয়েছিলেন বাড়ি থেকে। একটু একটু ক্ষিদের বোধ হচ্ছে। কিন্তু ক্ষিদেকে ছাপিয়ে উঠছে একটা মনখারাপ। যা উপেক্ষিত হবার আর সঞ্চিত ধন ছেড়ে চলে আসার মিলিত কষ্ট। সুনন্দা অস্তিত্ব রহিত হয়ে আছে। মনে হচ্ছে যেন ওর কোন অতীত নেই। ওর

কোন ইতিহাস নেই। সুনন্দা বোস যেন চিরকাল ধরে এই মারান্ডি হায়ার সেকেন্ডারী গার্লস স্কুলের হস্টেল সুপার। একটা কথা ওর হৃদয়ের তন্ত্রীতে বেজেছে। বড্ড বেজেছে। এমনভাবে বেজেছে যে তিল তিল করে গড়ে তোলা সংসার ছেড়ে এত সহজে উনি বেরিয়ে এলেন। অনেকদিন ধরে মেয়ের কিছু অস্বাভাবিক ব্যবহার, জীবন যাত্রা সুনন্দা লক্ষ্য করছিলেন। জীবনের মূল স্রোত থেকে ও যেন ক্রমেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। কাজ কর্ম সব প্রায় বন্ধ হয়ে যেতে বসেছে। মেয়ে আর্কিটেকচারে ফ্রি ল্যান্সার। জনসংযোগ না থাকলে কাজ পাওয়া মুশকিল। তাই মেয়ের অনিয়মিত জীবনযাপন দেখে সুনন্দার মনে হতাশা বাসা বাঁধতে শুরু করেছে। কারণ কি ভাবে ওকে আবার জীবনে ফেরাবেন? কে ও এমন করছে? এই সব প্রশ্নের উত্তর কোনটাই ওঁর কাছে ছিল না। চাকরী থাকাকালীন একা হাতে সংসার সামলে কি করে অফিস করতে পেরেছেন তা এখন ওঁর নিজের কাছেই এক বিস্ময়। পেছন ফিরে দেখলে ওঁর মনে হয় ও ই কি সেই মহিলা যে পেরেছিল এত কিছু করতে! তখন যেন একটা ঘোড়ার ওপর সওয়ার হয়ে ছিলেন। একটাই লক্ষ্য সংসারের উন্নতি। আর কিচ্ছু ভাবার সময় নেই। একবগ্গা ঘোড়া! যার ফল হচ্ছে আজকের সুনন্দা। অজস্র অসুখের ঘেরাটোপে বন্দী আজকের সুনন্দা। ছেলেমেয়ে যত বড় হতে লাগল ক্রমে ক্রমে সবকিছুই হাতের বাইরে চলে যেতে লাগল। সুনন্দা ধীরে ধীরে মানিয়ে নিচ্ছিলেন। মেনে নিয়েছিলেন সময়ের ধর্ম বলে। কিন্তু তাই বলে সন্তানের কষ্ট হলে তা মনে দাগ কাটবে না সেটা তো হয় না। মেয়ের জন্য সুনন্দার একটা বুকচাপা কষ্ট হয়। শুধু ভাবেন ওর এই অস্বাভাবিক আচরণের কারণটা কি। অনেক চেষ্টা করেছেন এই রহস্য ভেদ করার। কিন্তু পারেন নি। তাতে কষ্ট আরো বেড়েছে। শুধু ভাবছেন কোথায় ভুল ছিল ওঁর শিক্ষায় যে আজ মেয়ে বাধা অতিক্রম করে জীবনের স্রোতে ফিরে আসতে পারছে না। এত কষ্ট বুকে চেপে সুনন্দা ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে উঠেছেন। সেটারই বহিঃপ্রকাশ হয়ে গেল এক সকালের চায়ের টেবিলে। 

- 'কি একটা দমবন্ধ পরিবেশ হয়ে আছে বল তো বাড়িতে।'
- 'কেন? কি হয়েছে?'
- 'বাঃ। তুমি কিছুই বুঝতে পারছ না!'
- 'বুঝতে পারব না কেন? তুমি মুন্নির কথা বলছ তো?'
- 'হ্যাঁ। তুমি তো দিব্যি আছ! মেয়েটার জন্য তোমার চিন্তা হয় না? সারাজীবন শুধু নিজেরটা নিয়েই ব্যস্ত রইলে'।
- 'তুমি কি ভেবেছ, তুমি দুঃখে থাকলে আমাকেও দুঃখে থাকতে হবে!'
আসলে যেটাতে আমার কোন কথা চলবে না সেটা নিয়ে আমি ভাবিনা। ভাল থাকতে জানতে হয় বুঝলে। তুমি তা জান না আমি তা জানি। তার মানে এই নয় যে আমি শুধু নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। 
- 'কথা চলবে না বলে কি মনটাকে কন্ট্রোল করা যায়? মন কি মেশিন? যে সুইচ টিপলেই যা চাইব তাই পাওয়া যায়?'
সুনন্দা থমকে যান। এর পর আর কি কোন কথা চলে? অশোকের সাথে গত পঁচিশ বছরের জীবনে অগুনতি ওঠা পড়ায় সুনন্দা ছায়ার মত ছিলেন। মন খারাপ দেখলেই, কি অসুবিধে আমাকে বল বলে সেধে সেধে সাহায্যের জন্য এগিয়ে গেছেন। সবার অমতে বিয়ে করেছিলেন বলে এই সম্পর্ক কে খুব যত্ন করে বজায় রেখেছেন। আত্মীয়স্বজন, সহকর্মী অনেকেরই ওদের বিয়ে নিয়ে ভবিষ্যৎ বাণী কে ভুল প্রমাণিত করা যেন সুনন্দার আরেকটা তপস্যা ছিল সন্তানদের মানুষ করার পাশাপাশি।
আজ সুনন্দা যেন দেখতে পান সংসার সমুদ্র থেকে যেন উঠে আসছে ক্ষয়াটে শরীরের সুনন্দা। তার কোমলতা হারিয়ে সে এখন রুক্ষ। সংসারের নোনা জলে তার মিষ্টি শোভন মুখ আজ বলিরেখায় আকীর্ণ। তার সরলতা সংসারের ঢেউয়ের টালমাটালে পথ হারিয়ে নিঃস্ব। নিজের ধ্বংসাবশেষ দেখে ভেতরে ভেতরে কি জানি ঝরে! সেটা অশ্রূরূপী রক্ত নাকি রক্তরূপী অশ্রূ তা তিনি জানেন না। শুধু ঝরাটা অনুভব করেন।
আজ তাই একটাই কথা বার বার মনে হচ্ছে এই জীবন সায়াহ্নে  এসে যদি একে অন্যের সাথে সুখ দুঃখ ভাগ করা না যায় তবে কেন একসাথে থাকা? তার চেয়ে এই ভাল। 
অনেক ভেবে সুনন্দা এই পথ বেছে নিয়েছেন। প্রথম ভেবেছিলেন বৃদ্ধাশ্রমে যাবেন। মন সায় দেয় নি। ওঁর মনে হয়েছে ওখানে বসে শুধুই মৃত্যুর অপেক্ষা! এর চাইতে এখানে এই ছাত্রীদেরদের সাথে অন্তত প্রগাঢ় ভাবে জীবনের উষ্ণ স্পর্শে থাকতে পারবেন। তরতাজা জীবনের ছায়ায় থেকে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করবেন।

গল্প

অনুগল্প

ডাঃ রুদ্রজিৎ পাল

কসবা, কলকাতা

nupur1.jpg
অনুগল্প-১

 এপ্রিল ২০২৩ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

যাওয়ার আগে
মা, দরজাটা বন্ধ করে দাও।” বেরোনোর আগে রেশমি ডাক দিল। হুইলচেয়ারে করে এগিয়ে এলেন রেশমির মা। হাতে জলের বোতল। মেয়ের হাতে তুলে দিয়ে বললেন,
“সাবধানে যাস। বেশি তাড়াহুড়ো করবি না।”
“দেখছ তো আধঘণ্টা দেরি হয়ে গেছে। আর কথা বাড়িও না।” মাকে অল্প করে বকে দিয়ে রেশমি জুতো পরতে শুরু করে, “আর আমার যা যা অনলাইন ডেলিভারি আসার, সব এসে গেছে। কেউ আর আসার নেই। সেদিনের মত অচেনা কাউকে দরজা খুলবে না!”
“না, সেদিন তো----------”

মাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই রেশমি আবার বলে,

“ওষুধ ওই নীল খামে রাখা আছে।ভুলবে না। আর গ্যাস জ্বালাবে না। সেদিন গ্যাস জ্বালিয়ে নেভাতে ভুলে গিয়েছিলে!”

মা চুপ করে শোনেন। মেয়ে এখন বাসে করে যাবে স্টেশনে। তারপর ভিড় ট্রেনে করে সেইমেদিনীপুর। সেখানে রাত আটটা অবধি ডিউটি। অফিসে আবার ফোনের টাওয়ার থাকে না।রেশমি দরজাটা টেনে দিতে দিতে বলে,

“বারান্দার জবা গাছটাতে একটু জল দিও। কালকেওজল দিতে ভুলে গেছি, আজকেও……”

সেফটি পিন

ন্দ্রনাথবাবু অফিস থেকে ফেরার পর তার হাত দেখে স্ত্রী আবার চীৎকার করে উঠলেন, “আজকে আবার সেই কাঁটা গাছে হাত লাগিয়েছ?” 
চন্দ্রনাথবাবুর বাঁ হাতের কব্জির কাছে একটা কিছু ফুটে যাওয়ার দাগ। একটু ছড়েও গেছে। লাল হয়ে আছে। উনি একটু অপ্রস্তুত হয়ে হেসে বললেন,

“আসলে বেরোনোর দরজার মুখেই রেলিঙয়ের ধারে গাছটা। একটু অসাবধানে হাত চলে গেলেই কাঁটা বিঁধে যায়।”

স্ত্রী ডেটল দিয়ে জায়গাটা ধুয়ে দিলেন, “সাবধানে চলাফেরা করবে। আর কাউকে বল গাছটা ছেঁটে দিতে।”
“দেখি, বলব--------------”
তিনদিন পর চন্দ্রনাথবাবু অফিস থেকে বেরিয়ে বাসে উঠেছেন। তাঁর রোজকার বাঁধাধরা বিকেল পাঁচটা সাইত্রিশের বাস। একটাই সীট খালি ছিল। এক কলেজপড়ুয়া তরুণীর পাশে। উনি বসে রুমাল দিয়ে মুখ মুছলেন। এখন এক ঘণ্টা লাগবে। চন্দ্রনাথবাবু মোবাইলে একটা সিনেমা দেখতে শুরু করলেন। দেখতে দেখতে যাদবপুর এসে গেল। সেই তরুণী উঠে পড়লেন। “দেখি একটু। নামব।”
“হ্যাঁ মা।”
চন্দ্রনাথবাবু ঘুরে বসে তরুণীকে নামার রাস্তা করে দিলেন। তারপরেই তাঁর মুখ থেকে একটা আওয়াজ বেরোল, “উঃ!”
পেছনের সীটের একজন বললেন, “কী হল দাদা?”
“এই সীটের পেছনে একটা কাঠের খোঁচা বেরিয়ে আছে। হাতে লাগল।”
সবাই দেখলেন, চন্দ্রনাথবাবুর হাতে একটা কিছু ফুটে যাওয়ার দাগ। অন্য একজন বলে উঠল, “সত্যি, এখন বাসে কেউ কিছু মেইন্টেনেন্স করে না।”
বাস আবার চলতে শুরু করল।
------------------------------------------------------------------------------
সেই তরুণী বাস থেকে নেমে হাতের সেফটি পিনটা ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখল। এই লোকটা এর আগেও পাশে বসে হাত চালিয়েছে। আজকে ও তৈরি হয়েই ছিল। যেই হাতটা সাপের মতন লকলক করে এগিয়ে এসেছে, সঙ্গে সঙ্গে ফুটিয়ে দিয়েছে সেফটি পিন। 
তরুণী সাবধানে সেফটি পিনটা ব্যাগের সামনের চেনে রেখে দিল। আবার কবে কাজে লাগে কে জানে!!  

গল্প

অনুগল্প

অদ্রিজা মুখার্জী

তানভী সান্যাল

লেকটাউন, কলকাতা 

nupur1.jpg
অনুগল্প ২

 এপ্রিল ২০২৩ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

বাসরের ফুল

তানভী একটা পিঙ্ক এন্ড গ্রীন COMBINED সুন্দর শাড়ী মাথায় গোলাপ ফুল সাজানো খোঁপা করা। কপালে লাল টিপ আর হালকা করা চন্দনের ফোঁটা, ঠোঁটে লাল LIP GLOSS, গলায় একটা হীরের মঙ্গলসূত্র আর একটা সোনার সরু লম্বা সীতা হার, হাতে গোলাপি চূড়া, আগ্নুলে প্ল্যাটিনাম এর হাতফুল আর কোমরে একটা পাতলা কোমরবন্ধ পরে বসে আছে।
তানভী বসে বসে তার জীবন সঙ্গীর অপেক্ষায় । রাত তখন ১ টা বাজে। ননদ বৌদি আর বন্ধুরা তার হাতে দুধের গ্লাস আর মিষ্টি দিয়ে বলে গেছে অর্জুনকে খাইয়ে দিতে। তানভী লজ্জায় লাল হয়ে মুখ নিচু করে সম্মতি জানায় ।
তানভী: কি সুন্দর ঘরটা! কি সুন্দর সাজিয়েছে!
ডেকোরেশন টা দারুণ!

গোলাপের পাপড়ি ছড়ানো জলের ওপরে ক্যান্ডলেস চারিদিকে যেন একটা স্বপ্নের আবহাওয়া।  
কিন্তু অর্জুনকে তো আমি চিনিনা।  
আজকে চিনে নেব।  
(তার ভেতরটা হঠাৎ ভয়ে কেঁপে উঠলো, সে দেখলো টেবিলের ওপর রাখা একটা ছবি যেখানে একজন তারই মতন মেয়ে তারই মতন নতুন বৌয়ের মতন সেজে আছে)তানভী: এটা কার ছবি? অর্জুনের ঘরে এইরকম পোশাক এ এইরকম সাজে একটা মেয়ের ছবি কেন রাখা?

তার মনে প্রশ্ন জাগলো। সেটাই তো স্বাভাবিক তাইনা? সে নতুন জীবনে পা রেখেছে, আজকে সে তার জীব সঙ্গীকে নতুন ভাবে চেনার অপেক্ষায় সময় গুনছিল ।  
তানভী আর অর্জুনের ARRANGE MARRIAGE কিন্তু বিয়ের আগে থেকেই ওদের মধ্যে ভালোবাসার একটা বাঁধন একটু একটু করে শক্ত হচ্ছিল।   তানভী আর অর্জুনের প্রথম দেখা হয়েছিল যখন অর্জুন তার বাড়িতে আসে গত বছর পয়লা বৈশাখে । একদেখাতেই তানভীর পছন্দ হয়েছিল অর্জুনকে । 
লম্বা চওড়া চেহারার স্মার্ট ছেলে । গায়ের রং ফর্সা। সল্ট লেক এ একটা বেসরকারি কোম্পানিতে ম্যানেজার অর্জুন। কিন্তু হঠাৎ আজকে এই ছবিটার মধ্যে কি যেন একটা অদ্ভুত সংকেত দিচ্ছিল। তানভীর মনে হলো যে তাদের জীবনের শুরুটা কি শেষএ পরিণত হয়ে যাবে নাতো?

ও।” বেরোনোর আগে রেশমি ডাক দিল। হুইলচেয়ারে করে এগিয়ে এলেন রেশমির মা। হাতে জলের বোতল। মেয়ের হাতে তুলে দিয়ে বললেন,
“সাবধানে যাস। বেশি তাড়াহুড়ো করবি না।”
“দেখছ তো আধঘণ্টা দেরি হয়ে গেছে। আর কথা বাড়িও না।” মাকে অল্প করে বকে দিয়ে
রেশমি জুতো পরতে শুরু করে, “আর আমার যা যা অনলাইন ডেলিভারি আসার, সব এসে
গেছে। কেউ আর আসার নেই। সেদিনের মত অচেনা কাউকে দরজা খুলবে না!”
“না, সেদিন তো----------”

প্রবন্ধ

চূর্ণী এক চুরি করা জলের নদী:

জনশ্রুতি আর

সত্যের সন্ধানে

ডঃ বলাই চন্দ্র দাশ

নদীয়া, পঃ বঙ্গ 

চূর্ণী
fisherman.jfif

 এপ্রিল ২০২৩ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

লেখকের কথায়...

মাধুকরী পত্রিকাতে প্রকাশের জন্য আমি একটি প্রবন্ধ রচনা করেছি। প্রবন্ধটির শিরোনাম 'চূর্ণী এক চুরি করা জলের নদী: জনশ্রুতি আর সত্যের সন্ধানে'। স্থানীয় সাহিত্য, ইতিহাস এমনকি ভূগোলের একটি গবেষণা পত্রেও চূর্ণী নদীকে কৃত্রিম খাল হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। আরও বলা হয় যে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র ইছামতি নদীর জল প্রবাহের একটি অংশ দখল করে এই কৃত্রিম খালটি তৈরি করেছিলেন। কৃত্রিম নদীটি ইছামতি নদী থেকে জল দখল করার কারণে, নামকরণ করা হয়েছে ‘চূর্ণী’ যার অর্থ 'মহিলা চোর'। যদি এ কথা সত্য হয় যে নদীটি একটি কৃত্রিম খাল। আমার প্রবন্ধটি সত্য অনুসন্ধানের - চূর্ণী একটি কৃত্রিম খাল নাকি প্রাকৃতিক নদী? এই সত্য অনুসন্ধানের প্রয়োজনে, এতাবৎ প্রকাশিত ও প্রাপ্ত রচনার পুনর্বিশ্লেষণ ও নদী বিজ্ঞানের কতকগুলি সাধারণ নীতিকে ব্যবহার করা হয়েছে।

 

এক যে আছে নদী:

সে নদীকে নিয়ে অপকথার হরেক জনশ্রুতি। সে নদীর নামেও রয়েছে কলঙ্ক। সে নদীর নাম চুর্ণী।চুর্ণী শব্দের অর্থ মহিলা চোর বা স্ত্রী চোর (সূত্র ১ ও ২)এ নদীর জন্ম এবং কলঙ্কিত নামের পেছনে রয়েছে এক রাজকীয় গল্প। সে গল্প শোনার আগে আমরা জেনে নিই নদীটির বাকি পরিচয়।
ব্রিটিশ আমলে ভাগীরথী, জলঙ্গি ও মা
থাভাঙা নদীত্রয়কে একত্রে 'নদীয়ার নদী' (Nadia Rivers) (সূত্রঃ ৩,৪,৫,৬ বা) 'কৃষ্ণনগরীয় নদীদল' (Kishnaghur Group of Rivers - সূত্র ৭) বলা হ’তো। এদের মধ্যে ভাগীরথী নদীটি মুর্শিদাবাদ, বর্ধমান ও নদীয়া জেলার ভেতর দিয়ে অথবা সীমানা ছুঁয়ে বইছে। সে নদীকে কেন যে ‘নদীয়ার নদী’ বা ‘কৃষ্ণনগরীয় নদীদল’ এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল বুঝিনে। তেমনি মাথাভাঙা নদী। সে নদী অবশ্য বৃটিশ শাসনকালে নদীয়ার নদীই ছিল। যদিও এর শাখা নদী ইছামতী বয়ে গেছে নদীয়া ও চব্বিশ পরগনার বুকের ওপর দিয়ে। ১৯৪৭ সালের পর থেকে সে নদী তো আন্তর্জাতিক হয়ে গেছে। একমাত্র জলঙ্গি নদীর  উৎস থেকে সঙ্গম পর্যন্ত গোটা প্রবাহ পথই নদীয়া জেলার ভেতর দিয়ে অথবা নদীয়া জেলার সীমানা ছুঁয়ে। সে কারণে, এ তিন নদীর মধ্যে একমাত্র জলঙ্গি নদীই আক্ষরিক অর্থেই নদীয়ার নদী। তবুও মূলত প্রশাসনিক কারণেই এই তিন নদীকে 'নদীয়ার নদী' বলা হতো।

**সূত্র 

১- সাহিত্য সংসদ (২০০০ )সংসদ বাংলা অভিধান, কোলকাতা, ISBN 81-86806-92-X
২-
 দাস, (২০০৩) বাংলা ভাষার অভিধান, সাহিত্য সংসদ, কোলকাতা, ISBN 81-85626-08-1
৩- Hunter W
W (1875). A Statistical account of Bengal. Vol. II. Trubner & Co. London. P: 18-33
৪- Garrett JHE (1910). Bengal District gazetteers. Nadia. Bengal Secretariat Book Depot. Calcutta. P: 1-21 

৫- Basu SR and Chakraborty SC (1972). Some considerations on the decay of the Bhagirathi Drainage System. In Bagchi KG (1972). The Bhagirathi-Hooghly Basin. Proceedings of the Interdisciplinary Symposium. Calcutta University. P: 59-77
৬- Moore et al. (1919). Report on the Hooghly River and its Head-Waters. Vol. I. Calcutta.  West Bengal Secretariat Book Depot. In Biswas KR (2001). Rivers of Bengal.  

Vol. II. Government of West Bengal.  Kolkata. p: 27,49
৭- Ferguson, J. (1912). On recent changes in the delta of the Ganges, Pub-Calcutta, Bengal Secretariat PressReprinted from the Quarterly Journal of the Geological Society of London, Vol-XIX, 1863. Edited by Biswas K.R. 2001, Rivers of Bengal. Vol. I. pp. 177–230.


সে নদী যে পথে চলে:
চর-মধুগরী গ্রামের পূর্বদিকে চর-মহিষকুণ্ডি গ্রামটি করিমপুর-১ নম্বর ব্লকের উত্তর-পূর্ব সীমান্তে অবস্থিত। চর মহিষকুণ্ডির সীমান্ত বেড়ার পূর্ব দিকে বাংলাদেশের পদ্মা নদীর একটি সরু বাইপাস চ্যানেল থেকে একটি নদীর সৃষ্টি হয়েছে
(সূত্র ৮) সে নদীর নাম মাথাভাঙ্গা। হ্যাঁ, এটি মাথাভাঙ্গা, কারণ বর্ষার দু-এক মাস বাদে পদ্মার জল এ নদীতে ঢুকতে পারে না। পদ্মা থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন। উৎসমুখের বাম তীরে বাংলাদেশের গ্রাম ‘জামালপুর’। পদ্মা থেকে যাত্রা শুরুর পরমাথাভাঙ্গা নদী দক্ষিণদিকে করিমপুর-১ নম্বর ব্লকের মধুগরী-চরমেঘনা-শিকারপুর-দর্পনারায়ণ গ্রামের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পূর্বদিকে বাঁক নিয়ে বাংলাদেশের কাজীপাড়া-হাটবোয়ালিয়া-মুন্সিগঞ্জবাজার-চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুর-দর্শনা প্রভৃতি স্থান দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। সেখান থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে সর্পিল পথে গেদের কাছে পুনরায় ভারতে প্রবেশ করেবিজয়পুর-গোবিন্দপুর-বানপুর-মাজদিয়ার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে। ‘মাথাভাঙ্গা’ নামটি মাজদিয়াতে (পাবাখালি) শেষ হয়ে ইছামতি এবং চূর্ণী নদীতে বিভক্ত হয়েছে। উৎস থেকে পাবাখালিতে দ্বিধাবিন্দু পর্যন্ত মাথাভাঙ্গার দৈর্ঘ্য ১৯৬.৪০ কিলোমিটার।

**সূত্র 

৮- Sarkar B, Islam A and Das BC (2021). Anthropo-Footprints on Churni River: A River of Stolen Water. https://doi.org/10.1201/9781003032373

Figure-1: চুর্ণী নদীর অবস্থান 

Churni.jpg

মাথাভাঙ্গা নদীর ডান শাখাটি ‘চূর্ণীনদী’ নাম নিয়ে শিবনিবাস-বেনালী-বাপুজিনগর-ব্যাসপুর-আড়ংঘাটা-কালীনারায়ণপুর-রানাঘাট-আনন্দধাম হয়ে শিবপুরে হুগলী নদীতে পড়েছে। পাবাখালিতে উৎসস্থল থেকে শিবপুরে হুগলী নদীতে সঙ্গমস্থল পর্যন্ত চূর্ণী নদীর দৈর্ঘ্য ৫৩ কিলোমিটার, যদিও কেউ বলেছেন ৫৬ কিলোমিটার (সূত্র ৯)

**সূত্র  

৯- Sarkar, B., & Islam, A. (2019). https://doi.org/10.1007/s12517-019-4827-9


তাকে নিয়ে জনশ্রুতি:
প্রচলিত জনশ্রুতি, সংবাদপত্রের কলাম
 (সূত্র ১০,১১), স্থানীয় সাহিত্য (সূত্র ১২), ইতিহাস (সূত্র ১৩,১৪), এমনকি ভূগোলের একটি গবেষণা পত্রেও (সূত্র ১৫) চূর্ণী নদীকে কৃত্রিম খাল হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয় যে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের দ্বারা ইছামতি নদীর প্রবাহের একটি অংশ দখল করে এই কৃত্রিম খালটি তৈরি করার কারণে, নামকরণ করা হয়েছে ‘চূর্ণী’ (মহিলা চোর) (সূত্র ১৬,১৭)। যদি কথাটি সত্য হয়, তবে এটি এই অঞ্চলের ভূমিরূপ বিদ্যায় সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য ঘটনা এবং বৃহত্তম নৃতাত্ত্বিক স্বাক্ষর। 
শম্পা গাঙ্গুলি (সূত্র ১৮) লিখেছেন- 
“নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় সপ্তদশ শতকের শেষের দিকে বর্গি আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তিনি তাঁর রাজধানী কৃষ্ণনগর থেকে মাজদিয়ার শিব নিবাসে স্থানান্তরিত করেন। এই রাজধানী স্থানান্তর করণের বিষয়ে ঐতিহাসিকদের বিভিন্ন মতবাদ পাওয়া যায়। কেউ কেউ মনে করেন, রাজা কৃষ্ণচন্দ্র তাঁর রাজধানীর সুরক্ষার জন্য রাজধানীর চারিদিকে পরিখা খনন করে দেন। এই পরিখাটি হাওলি নদীর মাথা থেকে তৈরি করা হয়। যেহেতু এই খালটি হাওলি নদীর মাথা চূর্ণ করে খনন করা হয়েছিল, তাই এই খালটির নাম দেন ‘চূর্ণী’। ……… ১৭৮০ সালের পর থেকেই নাকি এই খাল চূর্ণী নদী নামে পরিচিতি লাভ করে” ।  

**সূত্র 

১০- শম্পা গাঙ্গুলি (১৪.০৭.২০২১)। চূর্ণী নদীর তীরে…। আর্টিকেল -পার্টিকেল। সাহিত্যhttps://www.mysepik.com/on-the-banks-of-the-river-churni-sampa-ganguly-ranaghat-wb/retrieved on 12.01.2022

১১- সুদেব দাস, বর্তমান, সংবাদপত্র, বুধবার ১২ জানুয়ারি ২০২২, ২৭ পৌষ ১৪২৮, https://bartamanpatrika.com/detailNews.php?cID=17&nID=150321&P=3

১২-  চট্টপাধ্যায় সঞ্জীব(২০০৭) মহারাজেন্দ্র বাহাদুর কৃষ্ণচন্দ্র, দেজ প্রকাশন, কলকাতা -৩,,পৃষ্ঠা-৫২,৫৩

১৩- ঠাকুর, স্বপনকুমার (২০১৯ )বর্গি হাঙ্গামা ও সমকালীন রাজা জমিদার,  ‘মুদ্রা’ মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র ও সমকাল, নবপর্যায়, তৃতীয় বর্ষ, সম্পাদক- শৈবাল সরকার, কৃষ্ণনগর, পৃষ্ঠা -১৭৩-১৯৮

১৪- কর্মকার, সুপ্রতিম (২০১৯)একটি রাজবংশ ও জলবৃত্তান্ত, ‘মুদ্রা’ মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র ও সমকাল, নব পর্যায়, তৃতীয় বর্ষ, সম্পাদক- শৈবাল সরকার, কৃষ্ণনগর, পৃষ্ঠা -৩৬৭-৩৭৮

১৫- Chatterjee, Mitrajit. (2017). An Enquiry in to The Evolution and Impact of Human Interference on The Churni River of Nadia District, West Bengal. International Journal of Current Research, 5(5), 1088-1092

১৬- সাহিত্য সংসদ (২০০০) সংসদ বাংলা অভিধান, কোলকাতা, ISBN 81-86806-92-X

১৭- দাস, জ্ঞানেন্দ্রমোহন (২০০৩) বাংলা ভাষার অভিধান, সাহিত্য সংসদ, কোলকাতা, ISBN 81-85626-08-1

১৮- শম্পা গাঙ্গুলি (১৪.০৭.২০২১)। চূর্ণী নদীর তীরে…। আর্টিকেল - পার্টিকেল। সাহিত্যhttps://www.mysepik.com/on-the-banks-of-the-river-churni-sampa-ganguly-ranaghat-wb/retrieved on 12.01.2022


আরও একটি অনুরূপ গল্প এমন-
“এই নদীটার নাম ছিল হাউলি। অনেকে আবার ডাকত পাঙ্গাসি বা পাংশি বলেও। কারণ গ্রীষ্মকালে নদীতে জল এতটাই কম থাকত পাংশি নৌকা ছাড়া অন্য কোনও নৌকা নদীতে চলাচল করতে পারত না। …. সময়টা সপ্তদশ শতকের শেষের দিক। নদীয়ার সিংহাসনে তখন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র। বর্গী আক্রমণের হাত থেকে বাঁচার জন্য তিনি তাঁর রাজধানীকে কৃষ্ণনগর থেকে শিবনিবাসে স্থানান্তরিত করেন। ….. তাই রাতারাতি কৃষ্ণচন্দ্র হাউলি নদী থেকে একটা খাল কেটে এনে শিবনিবাসকে বেড় দেন। আর সেখান থেকে আর একটি খাল কেটে অঞ্জনা নদীর সঙ্গে জুড়ে দেন। হাউলি নদীর মাথা ভেঙে আরও একটি খাল তৈরি হল বলে নদীটা পরিচিতি লাভ করে মাথাভাঙা নদী হিসেবে। আর কাটা খালটা যেহেতু হাউলি নদীর মাথা চূর্ণ করে তৈরি হল, তাই রাজা কৃষ্ণচন্দ্র এই খালটির নাম দেন চূর্ণী। কাটা খাল চূর্ণী ১৭৮০ সালের পর থেকে চূর্ণী নদী হিসেবে পরিচিতি লাভ করে” (সূত্র ১৯)
উপরোক্ত দুটি লেখার বক্তব্য একই রকম। বলা হয়েছে- 
সপ্তদশ শতকের শেষের দিকে পদ্মাজাতা হাউলি নদীর মাথা ভেঙ্গে বা চূর্ণ করে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র একটি খাল খনন করান। ফলে মাথা ভেঙ্গে দেওয়ার জন্য হাউলি নদীর নাম হয় ‘মাথাভাঙ্গা’। আর হাউলি নদীর মাথা চূর্ণ করে যে খাল খনিত হয়, রাজা কৃষ্ণচন্দ্র সেই খালটির নাম দেন ‘চূর্ণী’। এ ক্ষেত্রে যে প্রশ্নগুলি এসে যায় তা হল, প্রথমতঃ বর্গী আক্রমণ হয় ১৭৪১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৭৫১ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এবং মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র শিবনিবাসে রাজধানী স্থানান্তর করেন ১৭৪২ সালে। ফলে সময়টা সপ্তদশ শতকের শেষ দিক নয়, বরং অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি। দ্বিতীয়তঃ হাউলি নদীর নাম পাঙ্গাসি ছিল, এমন তথ্য কোথাও পাওয়া যায়নি। বরং হাউলি নদীর বাম তীরস্থ এক শাখা নদীর নাম পাঙ্গাসি
(সূত্র ২০,২১)। স্টিভেনসন মুর কমিটির রিপোর্টে বলা হয়েছে যে ভৈরব, নবগঙ্গা, চিত্রা, কপতাক্ষ, হরিহর ও ভদ্রা নদীগুলিতে পূর্বে মাথাভাঙা নদীর মধ্যমে জল আসত। ঐ রিপোর্টে হান্টারকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে- ------ ‘the  Chitra river was artificially disconnected from the Nabaganga whence it formerly received its spill supply by an embankment which an indigo planter threw across its head about 1830. According to the same authority the connection of the Kobadak with the Matabhanga was severed through the action of Mr. Shakespeare, a former Magistrate of Nadia, who cut a channel across the neck of a bend of the Matabhanga at the Kobadak offtake’.

**সূত্র 

১৯- কর্মকার সুপ্রতিম, আমাদের এই নদীর নামটি.‌.‌.‌, আজকাল, সংবাদ, রবিবার ৭এপ্রিল, ২০১৯, https://aajkaal.in/news/robibasar/river-ach1retrieved on ১২.০১.২০২২

২০- Reaks, H.G. (1919) ‘Report on The Physical and Hydraulic Characteristics of The Rivers of The Delta’ In Stevenson Moore (1919), P-50

২১- https://en.wikipedia.org/wiki/Mathabhanga_River


কুমার নদীটিও মাথাভাঙা নদীর বাম তীরের শাখা নদী। পাঙ্গাসি নদী আসলে কুমার নদীর আর একটি উৎস মুখ, যা মাথাভাঙ্গা নদী থেকে কুমার নদীতে জলের যোগান দিত। কুমার নদী কুস্টিয়া জেলার হাট বোয়ালিয়ায় মাথাভাঙা  থেকে বেরিয়ে বর্তমান বাংলাদেশের নবগঙ্গা নদিতে মিশেছে। ১৮১৯-২০ সালে মিস্টার কে সি রবিনসন সাহেবকে মাথাভাঙা নদীর সুপারিনটেন্ড ও কালেক্টর নিযুক্ত করা হয় এবং ঐ সময়েই তৈরী হয় 'নদিয়া রিভার ডিভিসন'। ঐ সময় পদ্মা থেকে যত জল মাথাভাঙা নদীতে ঢুকত, তার ৮৩.৪% কুমার নদী দিয়ে চলে যেত। কুমার নদীতে জল ঢোকা বন্ধ করার জন্য রবিনসনের নেতৃত্বে ব্যর্থ উদ্যগ নেওয়া হয়েছিল (সূত্র ২২)১৮২১ সালেও মাথাভাঙার ৭৫% জল কুমার নদী দিয়ে প্রবাহিত হত। সেজন্য মিস্টার মে কুমার নদীর মুখে একটি বড় বজরা ও বেশ কয়েকটি নৌকা মাটি ভরাট করে ডুবিয়ে দেন। এর ফলে কুমার নদীতে জল ঢোকা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল এবং মাথাভাঙা-চুর্ণী নদীতে সারাবছর নূন্যতম তিন ফুট জল ছিল। এ ছাড়াও কুমার নদীতে জল ঢোকা বন্ধ করার জন্য কুমার নদীর উৎসস্থলে মাথাভাঙা নদীর একটি বাঁকে ১৫৪০ গজ দৈর্ঘ্যের খাল কাটা হয়। ১৮২৪ সালে পাঙ্গাসি মুখের ভাঁটি থেকে মাথাভাঙা প্রায় শুকিয়ে যায় এবং ১৮৫০ সাল পর্যন্ত কখনও নাব্য হয় নি (সূত্র ২৩)। 
যেহেতু মাথাভাঙা নদীর জলের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ পাঙ্গাসি নদী পথে কুমার নদীতে চলে যেত, সেজন্য হয়তোবা কেউ কেউ গোটা মাথাভাঙা নদীটিকেই কুমার অথবা পাঙ্গাসি বলে উল্লেখ করে থাকবেন (যদিও তেমন তথ্য পাওয়া যায় নি)। সাম্প্রতিককালে মুর্শিদাবাদ জেলার আখড়িগঞ্জ থেকে ভেলানগর পর্যন্ত ভৈরব নদীকে অনেকে জলঙ্গি নদী বলেন। এমনকি গুগল ইমেজেও ভৈরব  নদীর নাম জলঙ্গি লেখা হয়েছে। আসলে বর্তমানে ভৈরব নদীর মাধ্যমেই পদ্মার জল জলঙ্গিতে আসে।
মাথাভাঙা নদীর অপর নাম হাউলি নদী, সে কথা বিভিন্ন লেখায় দেখা যায় (সূত্র ২৪)। কিন্তু ওপরের গল্প দুটিতে পাঙ্গাসি ও মাথাভাঙা নদীর নাম করণের ক্ষেত্রে যে গল্প বলা হয়েছে, তার কোনো নির্ভর যোগ্য তথ্য পাওয়া যায় না।

 

**সূত্র 

২২- Moore et al. (1919).p: 27,49

২৩- Moore et al. (1919). p: P-50

২৪- Garrett JHE (1910). P: 6


চুর্ণী নদীর নামকরণের বিষয়ে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে জড়িয়ে বেশ একটি প্রচলিত গল্প আছে। এখানে গল্পকারেরা প্রচলিত গল্পে নতুন মাত্রা যোগ করেছেন। হাউলি নদীর মাথা চুর্ণ করে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র নতুন নদী তৈরী করলেন, তাই সে নদীর নাম হল 'চুর্ণী'! কিন্তু এসব গল্প লেখকদের অপুর্ব কল্পনা শক্তির প্রকাশ হলেও, ইতিহাস রচনায় তথ্য ও সত্যের যে দ্বায় থাকে, তা এখানে নেই। সাহিত্যে যদিও সত্যের দ্বায় আবশ্যিক নয়। চুর্ণী নামের পেছনে এসব গল্পের কোন প্রামাণ্য সূত্র পাওয়া যায়নি। গল্পে আরও বলা হয়েছে যে ১৭৮০ সালের পর থেকে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র কতৃক কাটা খালটির ‘চুর্ণী’ নামকরণ করা হয়। আবার বলা হয়েছে যে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র নদীটির নাম দেন চুর্ণী! তথ্য ও সত্যের দ্বায় না থাকলে খুব স্বাভাবিকভাবেই গল্প যথেচ্ছগামী হয়। মহারাজা খালটি খনন করান ১৭৪২ সালে এবং সেই খালের নামকরণ করেন ৩৮ বছর পর ১৭৮০ সালে? নামকরণে এই বিলম্বের কারণ এবং এই তথ্যের উৎস কি, সে কথা অবশ্য গল্পকারেরা জানান নি।
ঠাকুর, স্বপনকুমার (২০১৯) তাঁর প্রবন্ধে (
সূত্র ২৫) লিখেছেন-
“শিবনিবাস আসলে চুর্ণি নদীর গর্ভোত্থিত চড়াতে গড়ে ওঠা জনপদ। এর তিন দিকটাই চুর্ণি নদী দ্বারা ঘেরা ছিল। ......... মাথাভাঙ্গা নদী এখানে ত্রিধা বিভক্ত হয়ে প্রবাহিত হয়েছে। একটি শাখা বর্তমান শিবনিবাসের পশ্চিম, উত্তর ও দক্ষিণ দিকে কঙ্কন আকারে প্রবাহিত হয়েছিল। এরই নাম চুর্ণি নদী। ……………রাজা কৃষ্ণচন্দ্র পূর্বদিকে মাথাভাঙ্গা নদী থেকে একটি গড়খাত কেটে শিবনিবাসের পাশ দিয়ে প্রবাহিত করে শিবনিবাসের কাছে চন্দননগর নামক গ্রামে মূল চুর্ণির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছিলেন। ফলে শিবনিবাসের চারিদিকেই নদী বাহিত হয়েছিল একসময়। বর্তমানে এই কাটা খালটিকে লোকে চুর্ণি নদী মনে করে”।
অন্যান্য লেখকের মতোই, শ্রী ঠাকুরও জানাননি কোন উৎস থেকে অথবা কিভাবে জানা গেল যে ‘বর্তমানে এই কাটা খালটিকে লোকে চুর্ণি নদী মনে করে?’। তাছাড়া তথ্যের স্ববিরোধিতাও বেশ লক্ষ্যনীয়। একবার লিখলেন, শিবনিবাস আসলে চুর্ণি নদীর গর্ভোত্থিত চড়াতে গড়ে ওঠা জনপদ। অর্থাৎ শিবনিবাস স্থাপনের আগেই চুর্ণী নদী ছিল এবং তার গর্ভজাত চড়াতেই শিবনিবাস গড়ে ওঠে। আবার লিখলেন, মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের নির্দেশে কাটা খালটিকে বর্তমানে লোকে চুর্ণি নদী মনে করে। অবশ্য একটি বিষয় ঠিক যে, মাথাভাঙ্গা-চুর্ণি নদীর একটি শাখা বর্তমান শিবনিবাসের পশ্চিম, উত্তর ও দক্ষিণ দিকে কঙ্কন আকারে প্রবাহিত হয়েছিল। এ বক্তব্যের প্রমান এখনও স্থানীয় ভূমিরূপে খোঁদাই করা রয়েছে অশ্বক্ষুরাকৃতির বিল ও নদীবাঁকের দাগ (meander scar) হিসাবে। 
সুপ্রতিম কর্মকারের (২০১৯) গল্পগুলিও (
সূত্র ২৬) প্রায় একই রকম-
“সেই জায়গাটা ছিল ঘন অরণ্যময় ও জল বেষ্টিত। সেখানে থাকতেন নসরৎ খাঁ নামের একজন ব্যক্তি। রাজা ওই স্থানে বন শূন্য করে নগর স্থাপন করেন। …… রঘুনন্দন পরামর্শ দিলেন। আর তার পরামর্শ মতনই রাজা নির্মাণ করলেন নতুন নগরকে ঘিরে কঙ্কনের মত পরিখা। … কঙ্কণের আকারে শিবনিবাস নগর পরিবেষ্টিত জলস্রোতের নাম হল ‘কঙ্কনা নদী’। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র এবার একশো হাত পরিমাণ একটি খাল কেটে ইচ্ছামতীর সঙ্গে জুড়ে দেন। আর পশ্চিম দিকে প্রায় তিন মাইল আর একটি খাল কেটে হাঁসখালির উত্তর দিকে অঞ্জনা নদীর সঙ্গে মিলিয়ে দেন। ……… রাজা কৃষ্ণচন্দ্র চূর্ণী নদীর যে পথ তৈরী করে গেছেন তা প্রায় ৩০০ বছরের বেশি সময় বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিপর্যয় যেমন বন্যার মধ্য দিয়ে গেলেও নদীটার কোন রকমের অবস্থানগত পরিবর্তন হয়নি। প্রায় একই রকম ভাবেই রয়েছে। …… রেনেল সাহেবের ম্যাপ প্রকাশিত হবার পর দেখা গেল সেখানে চূর্ণী নদীর উৎসমুখ ইছামতি নদীর সঙ্গে সংযুক্ত নয়। রেনেল কেন এই নদীর সংযোগটাকে  দেখালেন না সেই প্রশ্নের কোন সদুত্তর পাওয়া যায় না”।

**সূত্র 

২৫-ঠাকুর, স্বপনকুমার (২০১৯ )বর্গি হাঙ্গামা ও সমকালীন রাজা জমিদার,  ‘মুদ্রা’ মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র ও সমকাল, নবপর্যায়, তৃতীয় বর্ষ, সম্পাদক- শৈবাল সরকার, কৃষ্ণনগর, পৃষ্ঠা -১৭৩-১৯৮

২৬-কর্মকার সুপ্রতিম, আমাদের এই নদীর নামটি.‌.‌.‌, আজকাল, সংবাদ, রবিবার ৭এপ্রিল, ২০১৯, https://aajkaal.in/news/robibasar/river-ach1retrieved on ১২.০১.২০২২

এ গল্পেও বলা হয়েছে, যে স্থানে শিবনিবাস প্যালেস স্থাপন করা হয়েছিল, সেই স্থানটি আগের থেকেই ঘন অরণ্যময় ও জল বেষ্টিত ছিল। অথচ এখানেও দ্বিধাহীন ভাবে বলা হল যে রাজা নির্মাণ করলেন নতুন নগরকে ঘিরে কঙ্কনের মত পরিখা এবং কঙ্কণের আকারে শিবনিবাস নগর পরিবেষ্টিত জলস্রোতের নাম হল ‘কঙ্কনা নদী’। প্রশ্ন থেকেই গেল- ‘সেই জায়গাটা’ (শিবনিবাস) পূর্বেই জল বেষ্টিত ছিল, নাকি “রাজা নির্মাণ করলেন নতুন নগরকে ঘিরে কঙ্কনের মত পরিখা’? নাকি দুটি বক্তব্যই আংশিক ভাবে সত্য? তাছাড়া একই গল্পকারের পূর্বোক্ত গল্প (সূত্র ২৭) বর্তমান গল্প থেকে আংশিক আলাদা (সূত্র ২৮)। পশ্চিম দিকে‘ তিন ক্রোশের’ পরিবর্তে ‘ প্রায় তিন মাইল আর একটি খাল’ কাটার উল্লেখ রয়েছে। 

**সূত্র 

২৭-কর্মকার, সুপ্রতিম (২০১৯) একটি রাজবংশ ও জলবৃত্তান্ত, ‘মুদ্রা’ মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র ও সমকাল, নবপর্যায়, তৃতীয়বর্ষ, সম্পাদক- শৈবাল সরকার, কৃষ্ণনগর, পৃষ্ঠা -৩৬৭-৩৭৮

২৮-কর্মকার, সুপ্রতিম (২০১৯) একটি রাজবংশ ও জলবৃত্তান্ত, ‘মুদ্রা’ মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র ও সমকাল, নব পর্যায়, তৃতীয় বর্ষ, সম্পাদক- শৈবাল সরকার, কৃষ্ণনগর, পৃষ্ঠা -৩৬৭-৩৭৮

মিত্রজিৎ চ্যাটার্জী (সূত্র ২৯)(২০১৭) তাঁর গবেষণাপত্রে লিখেছেন “It has been opined that the Churni is most probably an artificial canal, not a true river. Local history says, during the 17th century the river Churni was dug by the orders of Maharajah Krishna Chandra, the King of Nadia as a moat against the Bargees of Maharashtra”. কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে ‘চূর্ণী নদী একটি কাটাখাল’ ‘true river’ নয়, সেইমত কে কবে কোথায় দিয়েছেন এমন কোন তথ্যসূত্র শ্রী চ্যাটার্জী জানান নাই। দ্বিতীয়তঃ সপ্তদশ শতাব্দীতে চূর্ণী খাল কাটা হয়েছিল মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের নির্দেশে- এই বক্তব্যও সঠিক নয়। কারণ মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র ১৭৪২ খ্রিস্টাব্দে রাজধানী স্থানান্তর করেন - সপ্তদশ নয়, অষ্টদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে।

সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় (সূত্র ৩০)(২০০৭) ‘মহারাজেন্দ্র বাহাদুর কৃষ্ণচন্দ্র’ বইতে লিখেছেন যে বর্গী আক্রমণের ভয়ে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র কৃষ্ণনগরের ছ'ক্রোশ দুরে ইছামতীর তীরে এক নিরাপদ স্থানে রাজধানী স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নেন। “….বন জঙ্গল ঘেরা জলবেষ্টিত একটি গ্রাম। একসময় নসরৎ খাঁ নামে একজন ফকির ওই জায়গায় বাস করতেন। সেই কারণে স্থানটির নাম নসরৎ খাঁর বেড়।… জলবেষ্টিত এলাকা। চারিদিকেই খাল পরিখার কাজ করবে। পুব দিকের খালটিকে আরো এক হাজার হাত বাড়িয়ে ইছামতির সঙ্গে যুক্ত করে দিলেন। পশ্চিম দিকের খালটিকে প্রায় তিন ক্রোশ বাড়িয়ে হাঁসখালির উত্তরে অঞ্জনা নদীর মোহনার সঙ্গে মিলিয়ে দিলেন। ফলে হল কি, পুব আর পশ্চিমের এই খাল দুটি ছোট আকারের নদী হয়ে গেল। প্রবাহ বিশিষ্ট একটি গোল কঙ্কণের  আকার ধারণ করায় কৃষ্ণচন্দ্র নাম দিলেন ‘কঙ্গনা’। আর নগরটির নাম রাখলেন শিব নিবাস”। এ গল্পও স্ববিরোধে পূর্ণ। প্রথমতঃ খাল দুটি ‘ছোট আকারের নদী হয়ে গেল’ কৃষ্ণচন্দ্র যার নাম দিলেন ‘কঙ্গনা’ বলতে লেখক কি বোঝাতে চেয়েছেন তা পরিস্কার নয়। হাঁসখালি থেকে পাবাখালি পর্যন্ত অংশের নাম কঙ্কনা নদী? কিন্তু এমন তথ্য কোথাও পাওয়া যায় না। আবার বাস্তবে স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যেও এমন কোনও জনশ্রুতি নেই। বরং এমন তথ্য এবং জনশ্রুতিও পাওয়া যায় যে, শিবনিবাসের চতুর্দিকে যে প্রায়-বৃত্তাকার জলাশয় ছিল, তার নাম ‘কঙ্কণা’। দ্বিতিয়তঃ ঐ একই বইয়ের ৫৩ নম্বরপৃষ্ঠাতে লিখেছেন “শিবনিবাস  থেকে শিবপুর পর্যন্ত একটি নদী আছে কৃষ্ণচন্দ্র সেই নদীর সুন্দর একটি কাব্যিক নাম দিলেন – চূর্ণী”। একই নদীর ভিন্ন ভিন্ন অংশের নাম আলাদা – এমন উদাহারণ প্রচুর আছে। পাবাখালি থেকে শিবপুর পর্যন্ত নদীর প্রায় গোটা অংশের নাম ‘চূর্ণী’ এবং উজানের সামান্য অংশের নাম ‘কঙ্কনা’? শ্রী চট্টোপাধ্যায় সাহিত্য রচনা করেছেন। সেখানে ভূগোলের সত্যের চেয়ে রাজ-পরিবার নির্ভর সাহিত্যটাই প্রধান বিবেচ্য। সম্ভবতঃ সে কারণেই স্থানীয় ভূগোলকে তিনি বিশেষ গুরুত্ব দেন নি। 

**সূত্র 

২৯-Chatterjee, Mitrajit. (2017). An Enquiry in to The Evolution and Impact of Human Interference on The Churni River of Nadia District, West Bengal. International Journal of Current Research, 5(5), 1088-1092

৩০- চট্টপাধ্যায় সঞ্জীব(২০০৭) মহারাজেন্দ্র বাহাদুর কৃষ্ণচন্দ্র, দেজ প্রকাশন, কলকাতা -৩,,পৃষ্ঠা-৫৩

দিলীপ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় (সূত্র ৩১)(২০০৭) ‘বাংলার নদ নদী’ বইতে লিখেছেন চূর্ণী নদী “শিবনিবাস, হাঁসখালি, বীরনগর হয়ে দক্ষিণমুখে প্রবাহিত। চূর্ণী মাথাভাঙা নাম নিয়ে জলঙ্গী নদীর উৎস থেকে আরও ২৫ মাইল পূর্বে পদ্মা থেকে নির্গত হয়ে ক্রমশ দক্ষিণে নেমে মাঝদিয়া শহরে এসে দ্বিধা বিভক্ত হয়েছে”। কিন্তু জলঙ্গী নদীর উৎস থেকে চূর্ণী নদীর উৎস স্থলের দূরত্ব ২৫ মাইল নয় বরং ৩.৭ মাইল বা ৫.৯৭ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমদিকে। তিনি লিখেছেন “চূর্ণী নাম নিয়ে রানাঘাট এসে পশ্চিম মুখী হয়ে চাকদহের কাছে গৌড় নগরে ভাগীরথীতে পড়েছে”। আসলে ‘গৌরনগর’ নয় বরং শিবপুরে ভাগীরথীতে পড়েছে। তথ্যসূত্রের উল্লেখ না করেই তিনি লিখেছেন “অনেকে বলেন কয়েক শতাব্দি আগেও চূর্ণী নদীর অস্তিত্বের কথা জানা ছিল না। এটি আসলে একটি কাটাখাল। শোনা যায় নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের নির্দেশে কৃষ্ণগঞ্জ থেকে শিব নিবাস পর্যন্ত একটি খাল কেটে মাথাভাঙ্গা নদীর সঙ্গে যুক্ত করা হয়, যাতে বর্গীদের আক্রমণ থেকে প্রজাদের রক্ষা করা যায়। একই সঙ্গে হাঁসখালিতে যুক্ত করা হয় অঞ্জনা নদীর সাথে”। প্রশ্ন হচ্ছে, শ্রীবন্দ্যোপাধ্যায় কোথাও জানাননি কোন তথ্য বা নদী-বিজ্ঞানের বিশ্লেষণের দ্বারা এই সিদ্ধান্তে এলেন যে, চূর্ণী নদী ‘আসলে একটি কাটাখাল’?
তিনি লিখেছেন ‘কৃষ্ণনগর বাস স্ট্যান্ড থেকে ১০ মিনিটের পায়ে হাঁটা দূরত্বে রয়েছে চূর্ণীর খেয়াঘাট’ যে কথা মোটেই ঠিক নয়। তবে এমন হতে পারে যে, মুদ্রণ দোষে ‘কৃষ্ণগঞ্জের’ পরিবর্তে ‘কৃষ্ণনগর’ হয়ে গেছে। তাছাড়া শ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা যেহেতু সমীক্ষা-নির্ভরনয় তাই লিখেছেন অঞ্জনা নদী থেকে একটি শাখা বেরিয়ে এসে ইছামতিতে মিশেছে যাত্রাপুরের কাছে। প্রসঙ্গত বলে রাখি যাত্রাপুরে অঞ্জনা-ইছামতি সঙ্গম বা অন্য কোন নদী-সঙ্গমও নেই। 

**সূত্র 

৩১ -বন্দ্যোপাধ্যায় দিলীপকুমার (২০০৭) বাংলার নদ নদী, দে’জ প্রকাশনা, কলকাতা -৩,পৃষ্ঠা-৬৬,৬৭

মল্লিক, কুমুদনাথ (১৩১৭ বঙ্গাব্দ, ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দ) লিখেছেন -“মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র নসরত খাঁ নামক একজন দুর্দান্ত দস্যুকে তাহার রাজ্য মধ্য উৎপাত করিতে দেখিয়া চূর্ণী নদীর পূর্বকূলে এক গভীর অরণ্যে তাহার আড্ডার সন্ধান পাইয়া তাকে শাসনার্থ উপযুক্ত সজ্জায় আসিয়া শিবির সন্নিবেশ করেন। দস্যু দমন করিয়া তিনি একরাত্রি তথায় বাস করেন। পরদিন প্রাতঃকালে তিনি যখন নদীর

churni1.jpg

Figure-2: চুর্ণী নদীর তীরে শিবনিবাস ও পার্শ্ববর্তি অশ্বক্ষুরাকৃতির হ্রদ ও নদী-বাঁক-চিহ্ন সমুহ  

 

কূলে বসিয়া মুখ প্রক্ষালন করিতেছিলেন ….. রাজাও তখন বর্গীর উৎপাত হইতে আত্মরক্ষার্থ এইরূপ একটি নিরাপদ স্থান অনুসন্ধান করিতেছিলেন।  এক্ষণে এই স্থানটী সকলে মনোনীত করলে তিনি উক্ত স্থানটিকে কঙ্কন আকারে নদীবেষ্টিত করিয়া স্বীয় দেওয়ান রঘুনন্দনের মতানুযায়ী এক সুন্দর পুরী নির্মাণ করলেন ও আপনার বাসভবন ও দুইটি বৃহৎ শিব মন্দির স্থাপন করিয়া দুইটি দুর্জয় শিবলিঙ্গ ও অপর মন্দিরে রাম সীতা স্থাপনা করিলেন” (সূত্র ৩২)

**সূত্র 

৩২- মল্লিক কুমুদনাথ (১৩১৭বঙ্গাব্দ, 1919), নদীয়া কাহিনী, রানাঘাট, পৃষ্ঠা-২৪১

নদীয়া কাহিনী’র বর্ণনায় যে বিষয়গুলি দেখা যাচ্ছে, তা হ’ল- ১. চূর্ণী নদীর পূর্বকূলে এক গভীর অরণ্যে দস্যু নসরত খাঁ’র আড্ডা ছিল। ২. দস্যু দমন করার পরদিন সকালে তিনি এক স্থানে নদীর কূলে বসে মুখ প্রক্ষালন করছিলেন এবং ৩. ঐ স্থানটিকে কঙ্কন আকারে নদীবেষ্টিত ক’রে রাজধানী স্থাপন করেন। প্রশ্ন হচ্ছে, যে নদীতে মহারাজা মুখ ধুচ্ছিলেন, সে কি চূর্ণী নদী? নাকি ইছামতি? নাকি গভীর অরণ্যে দস্যু নসরত খাঁ’র আড্ডার চতুর্দিকের মজে যাওয়া অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ? মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র কি রাজধানির চতুর্দিকে নতুন করে পরিখা খনন করান? নাকি স্থানটির চতুর্দিকে পূর্বেই যে জলবেষ্টন ছিল তাকে সংস্কার ক’রে পরিখার রূপ দেন? যেমন তাঁর পূর্ববর্তি লেখক কার্তিকেয় চন্দ্র রায় (১৮৭৬), ও শ্রীযুক্ত রাজীব লোচন মুখোপাধ্যায়ের (১৮১১) লেখায় উল্লেখ রয়েছে যে ‘ঐ স্থান অরন্যময় ও জলবেষ্টিত ছিল’। ‘চূর্ণী কাটা খাল’ এমন সিদ্ধান্তে আসার আগে এসব প্রশ্নের উত্তর উত্তর খোঁজা নিতান্ত জরুরী। অবশ্য ‘নদীয়া কাহিনী'তে পরিস্কার লেখা রয়েছে ‘চূর্ণী নদীর পূর্বকূলে এক গভীর অরণ্যে তাহার আড্ডার সন্ধান পাইয়া’। তবে কি শিবনিবাস স্থাপনের পূর্বেই চূর্ণী নদীর অস্তিত্ব ছিল? 
কার্তিকেয় চন্দ্র রায় (১৮৭৬) শিবনিবাস ও কঙ্কনা নামকরনের বিষয়ে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের নাম উল্লেখ করলেও, মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র কতৃক চূর্ণী নদীর নামকরনের বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। তিনি লিখেছেন-
“অনেক বিবেচনার পর কৃষ্ণনগরের অন্তরে ইচ্ছামতী নদীর নিকটস্থ একটি স্থান মনোনীত করিলেন। ঐ স্থান অরন্যময় ও জলবেষ্টিত ছিল। নসরৎ খাঁ নামক একজন ফকির তথায় বাস করিত বলিয়া ওই স্থানের নাম নসরৎ খাঁর বেড় রাখিয়াছিল। রাজা ঐ স্থান বনশূন্য করিয়া তাহাতে নগর পত্তন করিলেন। চতুর্দিকে যে জলাশয় ছিল তাহার পূর্ব দিক হইতে দীর্ঘে সহস্র হস্ত এক খাল কাটাইয়া  ইচ্ছামতী নদীর সঙ্গে এবং পশ্চিম দিক হইতে প্রায় তিন ক্রোশ  আর এক খাত কাটাইয়া হাঁসখালির উত্তরে অঞ্জনা নদীর মোহনার সহিত মিলাইয়া দিলেন। এই উভয় নদীর সহিত মিলিত হওয়াতে ঐ জলাশয় প্রবাহবিশিষ্ট হইল। কঙ্কন সদৃশ গোলাকার ছিল বলিয়া রাজা তাহার নাম কঙ্কনা রাখিলেন। নগরের নাম শিবনিবাস দিলেন”
 (সূত্র ৩৩)

**সূত্র 

৩৩- কার্তিকেয় চন্দ্ররায় (১৮৭৬) ক্ষিতীশ বংশাবলী চরিত, নতুন সংস্কৃত যন্ত্র, কোলকাতা, পৃষ্ঠা-১০৭-১০৯


কার্তিকেয় চন্দ্র রায় পরিস্কার জানিয়েছেন, স্থানটি ‘অরণ্যময় ও জলবেষ্টিত ছিল‘। জলবেষ্টিত থাকার একটিই মাত্র অর্থ হল অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদের দ্বারা বেষ্টিত থাকা। অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদের যেহেতু নদীর সাথে সংযোগ থাকে না, তাই তাতে কোনো স্রোত থাকে না। শিবনিবাসের চতুর্দিকের ঐ জলাশযয়েও  কোন প্রবাহ ছিল না। তাকে প্রবাহ বিশিষ্ট করার জন্য পূর্ব ও পশ্চিমে খাল কাটানো হয়েছিল। যেহেতু সেখানে অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ ছিল, নিশ্চয়ই সেখানে নদীও ছিল। হয় তো সে নদী নিতান্ত স্থবির এক মজে যাওয়া নদী। সে জন্যই বিচক্ষণ দেওয়ান রঘুনন্দন এই মজে যাওয়া নদীর পশ্চিম দিকে ৩ ক্রোশ (৯.৬৬ কিলোমিটার) ও পূর্ব দিকে ১০০০ হাত (৪৫৭.২ মিটার ) সংস্কার করে ইছামতী নদীর সাথে যুক্ত ক’রে পরিখাকে (কঙ্কনা) দুর্লঙ্ঘ করে তোলেন। প্রশ্ন আসতে পারে, সেই অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ তো মাথাভাঙ্গা নদী থেকেও সৃষ্টি হতে পারে? ‘'নদী বিজ্ঞানের কষ্টি পাথর’ অংশে বিশ্লেষণ করে দেখানো হয়েছে, কেন শিবনিবাস সন্নিহিত অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদগুলি মাথাভাঙ্গা-জাত নয়, চূর্ণী-জাত। 
শ্রী রায় কখনও উল্লেখ করেননি যে, কৃষ্ণচন্দ্র কাটা খালটির ‘কঙ্কনা’ বা ‘চূর্ণী’ নাম দিয়েছিলেন। বরং স্পষ্ট লিখেছেন, পরিখার নাম রেখেছিলেন ‘কঙ্কনা’। আরও একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, হরধাম থেকে শিবপুরের দুরত্ব অর্ধ ক্রোশ বা ১.৬১ কিলোমিটার। এই অংশেও মাহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র খাল কাটান। এক্ষেত্রেও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, তবে কি মাজদিয়া থেকে হাঁসখালির উত্তরে অঞ্জনা নদীর মোহনা পর্যন্তঅংশ কাটা খাল? হাঁসখালি থেকে শিবপুরে চূর্ণী-হুগলী নদীর সঙ্গম পর্যন্ত অংশ অঞ্জনা নদীর প্রাচীন খাত? এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা রয়েছে ‘নদী বিজ্ঞানের কষ্টি পাথর’ ও ‘অঞ্জনা তত্ত্ব’ পরিচ্ছেদে।
কার্তিকেয় চন্দ্র রায় আবার লিখেছেন ‘হরধাম হইতে শিবপুরের সমীপস্থ ভাগীরথী অধিক দূরবর্তী ছিলনা; এ কারণ কৃষ্ণচন্দ্র গঙ্গা স্নানের সুগমের নিমিত্ত, হরধাম হইতে শিবপুর পর্যন্ত এক খাল কাটাইয়া দেন, তাহাতেই শিবপুরের সন্নিহিত ত্রিমোহিনীর সৃষ্টি হয়। শিবনিবাস হইতে শিবপুর পর্যন্ত যে নদী আছে, তাহার চূর্ণী নাম রাজা কৃষ্ণচন্দ্র দেন, কি এই নদীর যে অংশ পূর্বে ছিল তাহার এই নাম থাকে, তাহা নিশ্চয় জানিতে পারা যায় নাই’। এখানে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলি হল- ১. মাহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র হরধাম হইতে শিবপুর পর্যন্ত এক খাল কাটাইয়া দেন, এবং ২. শিবপুর পর্যন্ত যে নদী আছে, তাহার চূর্ণী নাম রাজা কৃষ্ণচন্দ্র দেন, কি এই নদীর যে অংশ পূর্বে ছিল তাহার এই নাম থাকে, তাহা নিশ্চয় জানিতে পারা যায় নাই’।
ভাববার বিষয় এই যে কৃষ্ণচন্দ্র হরধাম হইতে শিবপুর পর্যন্ত চূর্ণী-হুগলী নদীর সঙ্গমের কাছে অর্ধ ক্রোশ বা ১.৬১ কিলোমিটার নতুন খাল কাটান নাকি পূর্বের মজে যাওয়া নদী সংস্কার করান? কারন ঠিক পরের লাইনে লিখেছেন, ‘এই নদীর যে অংশ পূর্বে ছিল তাহার এই নাম থাকে, তাহা নিশ্চয় জানিতে পারা যায় নাই’। অর্থাৎ কৃষ্ণচন্দ্রের খাল কাটানোর পূর্বেই সেখানে একটি নদী ছিল। দ্বিতীয় বিষয় টি হল এই যে, ‘চূর্ণী নদী’ নাম রাজা কৃষ্ণচন্দ্র দেন কি আগে থেকেই ‘চূর্ণী নদী’ নাম ছিল, সে বিষয়ে কার্তিকেয় চন্দ্র রায় নিশ্চিত ছিলেন না। তবে এটা নিশ্চয় করে বলা যায় যে, ১৮৭৬ সালেই ‘চূর্ণী নদী’ নামকরন বিষয়ে কৃষ্ণচন্দ্রের নাম জরিয়ে গল্প প্রচলিত ছিল এবং সে বিষয়ে কার্তিকেয় চন্দ্র রায় অনুসন্ধানও করেছিলেন, কিন্তু এমন কোনও তথ্যই  পাননি, যা থেকে নিশ্চিত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়। 

শ্রীযুক্ত রাজীব লোচন মুখোপাধ্যায় (সূত্র ৩৪) (১৮১১) লিখেছেন, মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র ‘একস্থানে উপনীত হইয়া দেখেন অতিরম্যস্থান চারিদিগে  নদী মধ্যে এক ক্ষুদ্র দ্বীপ এবং স্থানে২ অনেক পশু পক্ষী আছে’। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের নির্দেশে পাত্র সেখানে রাজপুরী নির্মাণ করলেন। আর ‘চারিদিগে যে নদী আছে সেই গড় হইল। দক্ষিণ দিগের নদী বন্ধন করিয়া প্রধান পথ করিলেন এবং সৈন্যের থাকনের স্থান করিলেন’।
রাজীব লোচন মুখোপাধ্যায়ের রচনায় যে বিষয়গুলি বিশেষভাবে বিশ্লেষণ করার প্রয়োজন রয়েছে, সেগুলি হ’ল- 
১. চারিদিকে  নদী মধ্যে এক ক্ষুদ্র দ্বীপ, ২. চারিদিকে 
যে নদী আছে সেই গড় হইল, ৩. দক্ষিণ দিকের নদী বন্ধন করিয়া প্রধান পথ করিলেন। 
অর্থাৎ, যেখানে শিবনিবাস রাজধানী স্থাপন হয়েছিল, সেই স্থানটি আগে থেকেই নদী (?) বেষ্টিত ছিল এবং সেই নদীকেই রাজধানীর চতুর্দিকের গড়ে রূপান্তরিত করা হয়েছিল। প্রশ্ন হচ্ছে, চারিদিকে কি আদৌ নদী ছিল? প্রধান পথ করার জন্য দক্ষিণ দিকের প্রবাহমান একটি নদীকে বন্ধন করা কি আদৌ সম্ভব? 2 নম্বর চিত্রে দেখা যাচ্ছে ঐ অঞ্চলে অনেকগুলি পরিত্যক্ত ‘অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ’ ও ‘মিয়েন্ডার স্কার’ রয়েছে যেগুলো ঐ অঞ্চলে নদীর প্রাচীন প্রবাহকে নির্দেশ করে। সম্ভবত এমনই এক অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদকে সংস্কার করে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র শিবনিবাসের চতুর্দিকে পরিখা নির্মাণ করেছিলেন। 
এ প্রসঙ্গে আরও উল্লেখযোগ্য, রাজীব লোচন মুখো
পাধ্যায় তাঁর লেখাতে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের নির্দেশে ‘কঙ্কনা’ থেকে ইছামতী নদী ও অঞ্জনা নদীর মোহনা পর্যন্ত খাল কাটার গল্পটি অনুপস্থিত। মনে রাখতে হবে, রাজীব লোচন মুখোপাধ্যায়ের ‘শ্রী মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়স্য চরিতং’, গ্রন্থটি শিবনিবাস ও চূর্ণী নদী সংক্রান্ত প্রাচীনতম রচনা!

 

**সূত্র

৩৪- মুখোপাধ্যায় শ্রীযুত রাজীব লোচন (১৮১১) শ্রীমহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়স্যচরিতং, লন্ডন, পৃষ্ঠা- 30 - 33


অঞ্জনা তত্ত্ব:
এই তত্ত্বের মূল বক্তব্য হল- হাঁসখালি থেকে ভাঁটিতে শিবপুরে চূর্ণী-হুগলী সঙ্গম পর্যন্তচূর্ণী নদীর অংশটি পূর্বে অঞ্জনা নদী ছিল। পরবর্তী কালে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র যখন ইছামতী থেকে চূর্ণীখাল কেটে শিবনিবাস রাজবাড়ির পরিখার সাথে মিশিয়ে হাঁসখালি পর্যন্ত প্রসারিত করলেন, তখন
থেকে অথবা ১৭৮০ সালের পর থেকে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র কতৃক কাটা খালটির ‘চুর্ণী’ নামকরণ করা হয়।অঞ্জনা তত্ত্ব বিষয়ে কতকগুলি বিষয় ভাববার রয়েছে। প্রথমতঃ এই তত্ত্বের উৎপত্তি কোথায় এবং কোন লেখায় কিভাবে এই তত্ত্বের উল্লেখ রয়েছে? দ্বিতীয়তঃ এই তত্ত্বের সম্ভাব্যতা কতটা?

churni2.jpg

Figure-3: হাঁসখালি থেকে চুর্ণী নদীর নিম্ন প্রবাহ ও অঞ্জনা নদী 


অঞ্জনা নদী সম্পর্কে কার্তিকেয় চন্দ্র রায় লিখেছেন ‘এই স্রোতস্বতী জলঙ্গী নদীর একটি শাখা। ইহা কৃষ্ণনগরের পশ্চিম দিয়া দক্ষিণাভিমুখে গমন পূর্বক যাত্রাপুর গ্রামের অনতিদূরে দ্বিধারা হয়। এক ধারা, জয়পুর, জালালখালি, ধর্মদা, বাদকুল্লা প্রভৃতি গ্রামের নিকট দিয়া আরংঘাটা সন্নিহিত মামজোয়ান গ্রামের নিকট যাইয়া দক্ষিণ বাহিনী হয়; অপর ধারা যাত্রাপুর ও বেৎনা প্রভৃতি কতিপয় গ্রামের নিকট দিয়া, হাঁসখালি গ্রামের সমীপস্থ  হয়, এবং তদনন্তর, দক্ষিণ মুখে মামজোয়ানের নিকট যাইয়া পূর্ব ধারার সহিত মিলিত হইয়া যায়’। ……… ‘ওই নদী শেষে হরধামের উত্তর দিয়া গিয়া চাকদহের নিকট গঙ্গার সহিত মিলিত হয় (সূত্র ৩৫)’। 

**সূত্র

৩৫- কার্তিকেয় চন্দ্ররায় (১৮৭৬) ক্ষিতীশ বংশাবলী চরিত, নতুন সংস্কৃতযন্ত্র, কোলকাতা, পৃষ্ঠা-৮৫, ১০৯

 

কিন্তু চূর্ণী নদীর বিষয়ে ‘ক্ষিতীশ বংশাবলী চরিত’-এ আরও যে সব উল্লেখ রয়েছে, সেগুলির বিশ্লেষণেরও প্রয়োজন রয়েছে। প্রথমতঃ ‘কি এই নদীর যে অংশ পূর্বে ছিল তাহার এই নাম থাকে’ এইশব্দ বন্ধ থেকে বোঝা যায় যে শিবনিবাস থেকে শিবপুর অবধি নদীটির কিছু অংশ কৃষ্ণচন্দ্রের শিবনিবাসে রাজধানী স্থানান্তরের পূর্বেই ছিল। দ্বিতিয়তঃ শিবনিবাস স্থাপনের পূর্ব থেকেই সে নদীর নাম ‘চূর্ণী’ ছিল কিনা, সে বিষয়ে কার্তিকেয় চন্দ্র রায় সংশয়বিদ্ধ ছিলেন। তৃতীয়তঃ যেহেতু শিবনিবাসে রাজধানী স্থানান্তরের পূর্বেই স্থানটি অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদের দ্বারা বেষ্টিত ছিল এবং যেহেতু সেখানে নদীও ছিল, সেহেতু সে নদীর নিম্নপ্রবাহের খাতও ছিল। চতুর্থতঃ কার্তিকেয় চন্দ্র রায় লিখেছেন, ‘পশ্চিম দিক হইতে প্রায় তিন ক্রোশ  আর এক খাত কাটাইয়া হাঁসখালির উত্তরে অঞ্জনা নদীর মোহনার সহিত মিলাইয়া দিলেন’। এই বাক্যে ‘মোহনা’ শব্দটি গুরুত্বপূর্ণ। নদী বিজ্ঞানে নদী-মোহনা ও নদী-সঙ্গম দুটি পৃথক শব্দ। নদী-মোহনা কথার অর্থ  হল নদী ও সমুদ্রের মিলন স্থল এবং নদী-সঙ্গম হল দুটি নদীর মিলন স্থল। কার্তিকেয় চন্দ্র রায় মোহনা বলতে অঞ্জনা নদী ও সমুদ্রের মিলন স্থল নিশ্চয় বোঝাতে চান নি! তিনি মোহনা ও সঙ্গম সমার্থে ব্যবহার করেছেন। তাই সম্ভবত অঞ্জনার সাথে অন্য কোন নদীর মিলন স্থলকে বুঝিয়েছেন। সেই অন্য নদীটি তবে কি চূর্ণী হওয়ার সম্ভাবনাই প্রবল নয়? যা তখন ভীষণ ভাবে মজে গেছে। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র যাকে সংস্কার করে পুনরুদ্ধার করেন?
অনেকেই কার্তিকেয় চন্দ্র রায়ের অনুসরণে হাঁসখালি থেকে চূর্ণী নদীর নিম্ন প্রবাহকে প্রাচীন অঞ্জনা খাত বলে উল্লেখ করেছেন (সূত্র ৩৬,৩৭)। কিন্তু যে বিষয় গুলি অনুসন্ধানে উঠে আসে, তা হ’ল- ১. হাঁসখালির ভাঁটিতে চূর্ণী নদীর তীরে যে সব জনপদ রয়েছে, সেখানে চূর্ণী নদীর কোন অংশ কোনদিন ‘অঞ্জনা’ অথবা ‘কঙ্কনা’ নামে পরিচিত ছিল না, বা এখনও নেই; ২. অঞ্জনা নদী খাতের গড় প্রশস্ততা এবং পাড়-শীর্ষ থেকে গড় গভীরতা (১.৯৬ মিটার), চূর্ণী নদীর গড় প্রশস্ততা এবং পাড়-শীর্ষ থেকে গড় গভীরতার (৪.৫ মিটার) চেয়ে অনেক কম। চূর্ণী নদীর গভীরতা, অঞ্জনা নদীর গভীরতার তিন থেকে চার গুণ, যা অঞ্জনা তত্ত্বের বিপরীতে সাক্ষ্য দেয়; ৩. অঞ্জনা অববাহিকার ভুমির সাধারণ ঢাল দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে। তাহলে অঞ্জনা নদীর মত একটি ছোট নদী কেন ভুমি-ঢালের বিপরীতে প্রথমে  উত্তর দিকে এবং পরে পূর্ব দিকে হাঁসখালি পর্যন্ত প্রবাহিত হল, তাঁর কোনো সদুত্তর পূর্বোক্ত লেখা গুলিতে নেই। এ প্রসঙ্গে একটি কথা বলা প্রয়োজন যে, যাত্রাপুর থেকে অঞ্জনা নদীর বাম ধারাটিকে হেলের ‘খাল’ বলা হয়। ‘খাল’ বিষয়টিও ভাববার।৪. পূর্বেই বলা হয়েছে, যেহেতু শিবনিবাসে রাজধানী স্থানান্তরের পূর্বেই ঐ স্থানটি অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদের দ্বারা বেষ্টিত ছিল, সেহেতু সেখানে নদীও ছিল। আবার যেহেতু শিবনিবাস অঞ্চলে নদীটির উচ্চ প্রবাহ ছিল, সেহেতু সে নদীর নিম্নপ্রবাহের খাতও নিশ্চয়ই ছিল। এবং রঘুনন্দনের মত একজন বিচক্ষণ দেওয়ান খুব সম্ভবতঃ খরচ কমানোর জন্য এবং নদীর দীর্ঘ আয়ুস্কালের প্রত্যাশায় সেই মজে যাওয়া খাত বরাবরই সংস্কার করেছিলেন।

 

**সূত্র

৩৬- চট্টপাধ্যায় সঞ্জীব(২০০৭) মহারাজেন্দ্র বাহাদুর কৃষ্ণচন্দ্র, দেজ প্রকাশন, কলকাতা -৩,,পৃষ্ঠা-৫৩

৩৭- কর্মকার, সুপ্রতিম (২০১৯)একটি রাজবংশ ও জলবৃত্তান্ত, ‘মুদ্রা’ মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র ও সমকাল, নব পর্যায়, তৃতীয় বর্ষ, সম্পাদক- শৈবাল সরকার, কৃষ্ণনগর, পৃষ্ঠা -৩৬৭-৩৭৮


নদী বিজ্ঞানের কষ্টি পাথর:
১. গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা ব-দ্বীপাঞ্চলের প্রতিটি নদী স্থানীয় ভাবে অদ্বিতীয় হলেও তাদের মধ্যে কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট লক্ষ্য করা যায়, যার জন্য তাদেরকে কৃত্রিম খাল থেকে পৃথক ভাবে চিনতে পারা যায়। যেহেতু নদী গুলি খুব মৃদু ঢালের সহজেই সামঞ্জস্যযোগ্য (easily adjustable) পলি গঠিত ভুমির ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়, তাই এদের নদী খাত সর্পিল হয়। ভাগিরথী, জলঙ্গি ও চূর্ণী নদীর সর্পিলতার ‘বক্রতা সুচক’ এবং ব-দ্বীপীয় নদীর কয়েকটি বৈশিষ্টের তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা গেছে চূর্ণী নদীর বক্রতা সুচক (১.৩০) (সূত্র ৩৮) ভাগীরথী (২.৯৬) (সূত্র ৩৯), ও জলঙ্গির (২.৬৭) (সূত্র ৪০) তুলনায় যথেষ্ট কম। এ প্রসঙ্গে দিলীপ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন যে, চূর্ণী নদী চ্যুতি রেখা বরাবর প্রবাহিত হওয়ার কারণে বেশী আঁকাবাঁকা নয় (সূত্র ৪১)। তাছাড়াও সমীক্ষাতে দেখা গেছে চূর্ণী নদীর অববাহিকার মাটি ভাগীরথী নদী ও জলঙ্গি নদীর  অববাহিকার মাটির তুলনায় অনেকটা আঠালো। সে জন্য নদী বেশী সর্পিল হতে পারে না। 
২. নদী তীরবর্তী অঞ্চলে ‘অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ’ ও ‘মিয়েন্ডার স্কার’ থাকাও এই অঞ্চলের নদীর আর এক বৈশিষ্ট। চূর্ণী নদীর উভয় তীরে, পাবাখালি থেকে চৌগাঁছা অঞ্চলের মধ্যে নুন্যতম পাঁচটি অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ ও মিয়েন্ডার স্কার রয়েছে। এছাড়াও ময়ুরহাট-তারকনগরের পূর্ব দিকে; মামজোয়ানের পূর্বদিকে; এবং পারুয়া অঞ্চলে বেশ কয়েকটি মিয়েন্ডার স্কার রয়েছে। সুতরাং এ ক্ষেত্রেও কোন অস্বাভাবিকতা না থাকায়, চূর্ণী নদীর প্রাকৃতিক-জন্ম ও বিকাশই সমর্থিত হচ্ছে। 
৩. চূর্ণী নদীর পাশে যে সব ‘অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ’ রয়েছে, সেগুলিচূর্ণী নদী থেকেই জন্মেছে কিনা, সে সন্দেহের মাত্রাও বিচার করা হয়েছে। পাবাখালি থেকে চৌগাঁছা অঞ্চলের মধ্যে যে অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ ও মিয়েন্ডার স্কার রয়েছে, সেগুলির সন্দেহ-মাত্রা ১০% -র কম। অর্থাৎ ৯০% সম্ভাবনা রয়েছে যে, ঐ অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ ও মিয়েন্ডার স্কারগুলি চূর্ণী নদী থেকেই জন্মেছে। 
৪. নদীখাতের প্রস্থচ্ছেদের অসমতা (channel asymmetry) প্রাকৃতিক নদীর এক অবিচ্ছেদ্য বৈশিষ্ট্য। অর্থাৎ প্রাকৃতিক নদীর খাত কখনই সমাকৃতির (symmetrical) হয় না। ভাগীরথী (± ০.২১ থেকে ± ০.৬২) ও জলঙ্গি (± ০.১২ থেকে ± ০.৩৩ ) নদীর তুলনায় চূর্ণী নদীখাতের অসমতা (± ০.০১ থেকে ±০.৪৮) কম। তবুও কৃত্রিম খালের মত সমাকৃতির নয়। এখানে আরও একটি বিষয় মনে রাখা দরকার যে, জোয়ার-ভাঁটা যুক্ত নদীতে অসমতার মাত্রা কম হয়। চূর্ণী নদীখাতের নিম্ন প্রবাহ জোয়ার-ভাঁটা প্রভাবিত। সুতরাং অসমতার মাত্রা কম হওয়াই স্বাভাবিক।
৫. ব-দ্বীপীয় নদীর আর এক বৈশিষ্ট, নদীখাতের স্থান পরিবর্তন। এ কথা ঠিক যে, চূর্ণী নদীখাতের স্থান পরিবর্তনের ঘটনা ভাগীরথী এবং জলঙ্গির তুলনায় অনেক কম। তবুও রানাঘাটের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে ‘দক্ষিণ-মাজদিয়া’ গ্রামের পাশে, চূর্ণী নদীখাত সর্বাধিক ৬৭১ মিটার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে সরে গেছে।

 

**সূত্র

৩৮- Sarkar, B. (2021). Decaying of River Churni and its Impact on Ecology, Economy and Society. PhD thesis, Aliah University, Kolkata

৩৯- Islam (2018, 2019, 2020)

৪০-Das BC (2013). Changes and Deterioration of The Course of River Jalangi And Its Impact on The People Living on Its Banks, Nadia, West Bengal. Ph.D. Thesis. University of Calcutta.

৪১-বন্দ্যোপাধ্যায় দিলীপকুমার (২০০৭) বাংলার নদনদী, দে’জ প্রকাশনা, কলকাতা -৩,পৃষ্ঠা-৬৬,৬৭

churni3.jpg

Figure-4: রানাঘাটের দক্ষিণ-পূর্বে দখিন-মাজদিয়াতে চুর্ণীর নদী-বাঁকের স্থান পরিবর্তন 


সুতরাং উপরোক্ত নদী-বিজ্ঞান ভিত্তিক বিশ্লেষণেও প্রমানিত যে, চূর্ণী এক প্রাকৃতিক নদী, কৃত্রিম খাল নয়।
কল্যান রুদ্র (সূত্র ৪২) (২০১০) ‘বাংলার নদীকথা’ বইতে ৩৯ পৃষ্ঠায় লিখেছেন ‘রেনেলের সময় চূর্ণীর সঙ্গে মাথাভাঙ্গার কোনো সংযোগ ছিল না। চূর্ণী তখন একটি ছোট নদী। কবে মাথাভাঙার সঙ্গে চূর্ণী যুক্ত হয়েছিল তা বলা কঠিন। সম্ভবত ঊনবিংশ শতাব্দীতে কোন এক বন্যার সময় মাথাভাঙার একটি স্রোত দক্ষিণ-পশ্চিমে এগিয়ে এসে চূর্ণীর সঙ্গে মিশে যায়’। অর্থাৎ ১৭৬৪ সাল থেকে ১৭৭৭ সাল পর্যন্ত জরিপকালে চূর্ণী নদীর অস্তিত্ব ছিল তবে মাথাভাঙ্গা নদী থেকে চূর্ণীতে জল আসতো না।  শিবনিবাসের চতুর্দিকে জল অথবা নদী ঘেরা স্থানের বর্ণনা থেকে অনুমান করা যায় যে ১৭৪২ সালে শিবনিবাসে  রাজধানী তৈরীর আগে থেকেই ওই অঞ্চলে কোন নদী ছিল, যার মজে যাওয়া খাতই শিবনিবাসের চতুর্দিকের পরিখা। অনেক আগে থেকেই মজে যাওয়া ওই নদী কৃষ্ণচন্দ্র রাজা ১৭৪২ সালে সংস্কার করার পর, মাত্র ২০ - ২২ বছরের ব্যবধানে পুনরায় মাথাভাঙ্গা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া চূর্ণী নদীকে রেনেল প্রত্যক্ষ করেন। 
মুর কমিটির রিপোর্টেও লেখা হয়েছে- ‘The Jalangi and Matabhanga-Churni are comparatively new rivers, the modern Churni having opened out since Rennell’s time at the end of the 18th century’ (সূত্র ৪৩)। মুর তাঁর রিপোর্টে ‘মডার্ন চূর্ণী’ শব্দটি ব্যবহার করায় সহজেই অনুমান করা যায় যে ১৮ শতকের শেষ দিকে ‘মডার্ন চূর্ণী’ খাত তৈরি হলেও পূর্বে ‘প্রাচীনচূর্ণী’ নদী ছিল। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র সম্ভবত সেই প্রাচীন চূর্ণী খাতকে সংস্কার করেছিলেন। ঐ রিপোর্টের ফুট নোটে লেখা হয়েছে - ‘Rennell shows the Churni as a small branch of the Ichhamati …..’.

**সূত্র

৪২- কল্যান রুদ্র (২০১০) বাংলার নদী কথা, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, ISBN 97881-7955-141-5, পৃষ্ঠা ৩৯

৪৩- Moore et al (1919). p-35


একটি হিসাব:
মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র যদি সম্পূর্ণ নতুন একটি খাল খনন করে চূর্ণী নদী তৈরি করেন তবে তা সরল রৈখিক হওয়ার  কথা। আঁকাবাঁকা নয়। যাইহোক, যদি চুর্ণী ন
দীর গড় প্রশস্ততা ৭০ মিটার এবং গড় গভিরতা ৪.৫ মিটার ধরি তবে এবার হিসাব করুন এত মাটি কাটার জন্য কতজন শ্রমিক কত দিন ধরে কাজ করেছিল।
একজন শ্রমিক দিনে ১০০ ঘনফুট মাটি কাটলে, এবং সে মাটি নদী পাড়ে বয়ে নিয়ে যেতে দুই জন শ্রমিক লাগলে হাঁসখালি থেকে হরধাম পর্যন্ত অংশ বাদ দিলেও মোট শ্রমিক লেগেছিল= {(৭০৩৬৬৫৪৫ ÷ ১০০)X৩} = ২১১০৯৯৬ জন। এবং প্রতিদিন ৩০০ = (১০০+২০০) জন শ্রমিক মাটি কাটলে সময় লেগেছিল = ৭০৩৭ দিন বা ১৯ বছর ৪ মাস প্রায়!
গোটা নদীর দৈর্ঘ্য ৫৩ কিলোমিটার। সে হিসাবে মাটি কাটা হয়েছিল ২১০৫৩১৪২০ ঘনফুট। মাটি কাটার জন্য মোট শ্রমিক লেগেছিল = ৬৩,১৫,৯৪৩ জন। এবং প্রতিদিন ৩০০ = (১০০+২০০) জন শ্রমিক মাটি কাটলে সময় লেগেছিল = ২১০৫৩ দিন = ৫৭ বছর ৭ মাস প্রায়! যদি প্রতিদিনের শ্রমিক সংখ্যা দশ গুন বাড়িয়ে ৩০০০ জন করা হয়, তবুও সময় লেগেছিল ২১০৫ দিন বা ৫ বছর ৯ মাসের অধিক!!
এতবড় অপ্রয়োজনীয় সময়, শ্রম ও অর্থ খরচের কি আদৌ কোন প্রয়োজন ছিল?  নাকি এমন কোন সিদ্ধান্ত রঘুনন্দনের মত এক জন বিচক্ষন দেওয়ান আদৌ নিয়েছিলেন বলে মনে হয়?


শেষ কথাটি:
যুক্তিহীন মিথ্যা গল্পকে জলজ্যান্ত সত্যের মতো উপস্থাপন করা এক ধরনের আর্ট। কিছু মানুষের এ দক্ষতা সহজাত। কিন্তু এক্ষেত্রে শ্রোতার ভূমিকাও কম নয়। শ্রোতারাও কিছু কিছু মিথ্যা, অলৌকিক ও অসম্ভবকে বিশ্বাস করতে ভালোবাসেন। সেজন্য যিনি যুক্তিহীন মিথ্যাকে সত্যরূপে উপস্থাপন করেন, তার কাছে কাজটি সহজতর হয়ে ওঠে। আসলে যুক্তি এবং বিচার মাঝে মাঝেই সমাজকে বেঢপ, অপ্রিয় এবং অস্বস্তিকর সত্যের সামনে দাড় করায়। প্রাকৃতিক উপায়ে সৃষ্ট এবং মজে যাওয়া একটি নদীকে খনন করে পুনরুদ্ধার করার মধ্যে কোনও রাজকীয়তা নেই, নিতান্তই আটপৌরে ম্যাড়মেড়ে গল্প। বরং খাল কেটে একটা গোটা নদী সৃষ্টি করার মধ্যে একটা রাজকীয়তা রয়েছে, যা বিশ্বাস করতে মনের আশকারা থাকে। তাছাড়া অতীত-গৌরব নিয়ে অতি-গৌরবের প্রবৃত্তি তো মানুষের সহজাত। সম্ভবত সেজন্যই প্রকৃত সত্যকে অতিকথনের মশলায় জারিত করে বেশ মুখরোচক ও জনপ্রিয় করে তোলা হয়েছে। পূর্ববর্তী লেখকেরা প্রায় সকলেই স্বীকার করেছেন, যে স্থানে শিবনিবাস প্যালেস স্থাপিত হয়েছে, সেই স্থানটি পূর্ব থেকেই জলাশয় (অশ্বক্ষুরাকৃতির হ্রদ)দ্বারা ঘেরা ছিল। তাহলে তো খুব স্বাভাবিক ভাবেই সেখানে একটি নদীও ছিল। অথচ, চূর্ণীনদীর উৎপত্তি বিষয়ে গল্প বলার সময় শিবনিবাস ঘিরে থাকা সেই আদি জলাশয়টি এবং সম্ভাব্য নদীটির কথা কেউ মাথায় রাখেন নি। এমন নয় যে সবাই সচেতন ভাবে বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন। বরং অবচেতনেই সমস্ত যুক্তি ও বিশ্লেষণ গল্পের থ্রিল ও রাজকীয়তার কাছে হার মেনেছে।

অনুগল্প

সনোজ চক্রবর্তী

পূর্ব মেদিনীপুর, পঃ বাংলা

গল্প/প্রবন্ধ

oldman1.jpg
SanojCharaborty.jpg
অনুগল্প-সনোজ চক্রবর্তী

 এপ্রিল ২০২৩ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট

দিন হল ঠান্ডাটা বেশ জাকিয়ে পড়েছে। বেলা দশ'টা তবুও ঘন কুয়াশায় নিকটও অস্পষ্ট। সুলতা গোল গলা সয়েটারটা হাতে নিয়ে চুপটি করে বসে ছিল। সয়েটারটার রঙ যেমন ছিল তেমনটিই রয়েছে,একটুও ফিকে হয় নি। কেবল সতনু সয়েটারটার চেয়ে অনেকটা বড় হয়ে গেছে আজ।

সতনুর বয়স যখন সাত, সে সময় সয়েটারটা নিজেই বানিয়েছিল সুলতা,।

"এখন ওখানে টেম্পারেচার কত গো?"

সয়েটারটায় হাত বোলাতে বোলাতে উদ্বিগ্ন হল সুলতা। মোবাইলে একমনে কিছু একটা করছিল বিপিন। সুলতা ফের বলল--

"কি গো? ওখানের টেম্পারেচার? "

টেম্পারেচার এ্যাপসে কানাডা টাইপ করতে করতে বিপিন বলল--

"কানাডার শীতে তোমার ঐ সয়েটার কাজে আসবে না সুলতা- যদিও আজ ছেলের জন্মদিন তবুও প্রচন্ড শীতে কাঁপতে কাঁপতে তোমার ছেলে পরিযায়ী পাখি হয়ে এবেলা আর বাড়ি ফিরবে না। মিছেমিছি মন খারাপ করো না। তুমি মন খারাপ করলে আজকাল আমার মনটা বড্ড অস্থির হয়।"

আঁচল মুখে গুঁজেও কান্নাটা আটকাতে পারল না সুলতা। বিপিন দ্রুত সয়েটারটা কেড়ে নিল সুলতার হাত থেকে।তারপর চোখের জল মুছিয়ে বলল--

"একদম কান্না নয়, এই দেখ, দেখ, ছেলে পাঠিয়েছে জন্মদিনের গিফ্ট।"

সুলতা কান্না সামলে বলল--

"গিফ্ট!"

"হ্যাঁ, এটা তোমার মোবাইল, আমি ফেসবুক ইনস্টল করে দিলাম। এবার ছেলেকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে দিলেই মুশকিল আসান।"

"ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট!"- সুলতা বিপিনের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকল।

"বুঝলে সুলতা সন্তান বড় হয়ে গেলে তার সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশতে হয়। এ আমার কথা নয়, শাস্ত্র বলে-- প্রাপ্তে তু ষোড়শে বর্ষে পুত্র মিত্রবদাচরেৎ।" কথাগুলো বলতে বলতে গলা বুজে এল বিপিনের।

নরানাং মাতুল ক্রম...

স্ত টাক, ছোট্ট একটা ভুঁড়ি নিয়ে আমি নাকি একদম 'হারাধন চক্কত্তি'। 'হারাধন চক্কত্তি' হলেন আমার বড় মামা। গায়ের রং,মুখের আদল সবটাতেই আমি বড় মামা।

খুব ছোটবেলা থেকেই আমি মামার ন্যাওটা। আমরা মামা বাড়িতে গেলেই বড় মামা বাতাড়ি জাল( বাতাড়ি জাল বড় জাল, আসলে প্রিয়জনের জন্য চাওয়াটা সব সময়ই মস্ত হয়) নিয়ে হাঁটা দিত বড় পুকুরে। বালতি হাতে পেছন পেছন আমি।জাল ফেলার আগে মামা পুকুর পাড়ে বিছিয়ে দিত জাল আর আমায় বলত...

"ভমলা নুঙ্কুটা বের করে দে দিখি হিসু করে, দেখি মাছ কেমন জাল ছাড়া হয়।"

ছেলেবেলার সে স্মৃতি বড্ড বেদনার। অধিকাংশ দিন খালি বালতিই ফিরত হাতে দুলতে দুলতে। মন খারাপ হয়ে যেত। আমার চাওয়ার জোর কি এতোটাই কম! আর আমার পেচ্ছাব! মামা বুঝতে পেরে সান্ত্বনা দিত...

"ভরা পুকুর জলে মাছ পাওয়া কি এতোই সহজ কাজ।" তখন পাঁচ কি সাত হব। বাদল খুড়োর কাঁধে চেপে কোনো কোনো দিন পৌঁচ্ছে যেতাম আমাদের টালি-ইট ভাটায়। বাদল কাকুর কাঁধ ছেড়ে দুঃখিরাম কাকু তার থেকে হরেরাম জেঠা তার থেকে বাঘাদা.... মাটিতে পা পড়ত কই!

মালিকের ছেলে বলে কথা। সবাই তখন আমাকে 'ছোটবাবু' বলত। একবছর অকালে প্রবল বৃষ্টি। ছ'মাসের মধ্যে দেনার দায়ে বাবা ভাটা বিক্রি করতে বাধ্য হলেন। আমার জ্ঞানাবধি আমার 'ছোটবাবু' হওয়াটা একবছরও টেকসই হয় নি। বাবা অভাবের চাপে বছর খানেকের মধ্যেই

মালিক থেকে হয়ে গেলেন ম্যানেজার-- অন্যের ভাটায়। মাধ্যমিক পরীক্ষার আগের সরস্বতী পূজায় সরস্বতী মাকে, না খেয়ে, শীত স্নানে কাঁপতে কাঁপতে জানিয়ে ছিলাম...

"কিচ্ছু চাই না মা, শুধ্ধু ফাস্ট ডিভিশন...."

হয় নি।

যে মেয়েটা হাত দুটো হাতে নিয়ে বলেছিল...

"তুমিই আমার সব। "

যৌথ যাপনের গয়া প্রাপ্তি ঘটিয়ে, তিন মাসের মধ্যে তিনি হনিমুনে গিয়েছিলেন গোয়ায়। বুঝেছিলাম জীবনের সমস্ত অঙ্ক নিরিহ হয় না। আসলে জীবনটাই একটা সিঁড়ি ভাঙা অঙ্ক। চাকরিটা হয়তো বছর পাঁচ আগেই জুটে যেত যদি ভাবনাটা দশ মিনিট আগে মাথায় আসত। মারজিন্যাল কস্টিং এর যে অঙ্কটার সমাধান পরীক্ষার হলে হাজার হাতড়েও পেলাম না, হল থেকে বেরিয়ে পেচ্ছাব করতে করতে মুহুর্তে খেলে গেল মাথাটা।

পেচ্ছাবখানার দেওয়ালে মাথা ঠুকতে গিয়েও টাক সামলে পিছু হটলাম। সেদিন পুকুর পাড়ে মামার বেছানো জালে আমার ব্যার্থ পেচ্ছাব মনে পড়ছিল বারবার। আমার বুকে বাবার মাথা। চামচে চামচে তরল খাওয়ার বাবার মুখে দিচ্ছিলাম। গলার পাতলা চামড়ার নিচে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল বাবার ঘোট গেলা। তখনও বুঝতে পারি নি ওটাই বাবার শেষ খাওয়া। আর কয়েক মিনিট পর বাবা আর আমাদের মধ্যে থাকবেন না। শেষ কটা দিন মা হাসপাতালের বিছানায় নিথর নিরব। আমরা ভাই বোন প্রতিদিনিই ভাবছিলাম মা ঠিক কাল চোখ মেলবেন....

ডেকে উঠবেন..." ভমলা।"

আমাদের সব চাওয়াকে মিথ্যে করে বছরের শেষ দিন চলে গেলেন মা। এই তো কদিন আগে- চায়ের দোকানে বসে আছি। ছেলেবেলার এক বন্ধু হেঁটে হেঁটে এ্যাম্বুল্যান্সে উঠল।অসুস্থ। ডাক্তারের কাছে যাচ্ছে। চা ছেড়ে উঠে যাব ভাবলাম। ভাবলাম উঠে গিয়ে বলি...

"কি রে কেমন আছিস এখন?"

তারপর ভাবলাম এখন ডাক্তারের কাছে যাচ্ছে যাক, ফিরলে বাড়িতে যাব। ক'দিন বাদেই শুনি সে বাড়ি ফিরছে গাড়ি করে। শব বাহী গাড়ি। আমার আর তাকে জিজ্ঞেস করাই হল না...

"কি রে কেমন আছিস এখন?"

কালকের দিনটা যেমন করে কাটাতে চাই তা যে ভাবেই চাই না কেন, যত নিখুঁত পরিকল্পনাই করি না কেন শেষ পর্যন্ত তা মেলে না। আশ্চর্যের সঙ্গে একটা আকাশ জমিন তফাৎ ঘটে যায়। যেখানে প্রতিটা মুহুর্ত ভয়ঙ্কর রকম অনিশ্চিত। যেখানে নিজের চাওয়ার সঙ্গে নিজের আগামী কালটাই মেলাতে নিজেরাই অব্যর্থ ব্যর্থ। সেখানে কেবল লৌকিকতার জন্য বলতে হয়....

"আগামী বছরের প্রতিটা মুহুর্ত আপনার আনন্দময় হোক।"

দেনাপাওনা

কটা কুকুর ভোর রাতের পেচ্ছাব সেরে, কুঁইকুঁই করে ফের ঢুকে পড়ল শান বাঁধানো ফুটপাতের চট- বিছানার নিচে। ফলত চট- বিছানা থেকে অনেকটাই বেরিয়ে পড়ল লোকটা। পেরেকের মতো গাঁথছে শীত। ঘন কুয়াশা ঈশ্বরের আশীর্বাদ হয়ে নেমে আসছে সটান। তবুও কোন হেলদোল নেই ।

লোকটা নিথর ঘুমিয়ে শান বাঁধানো ফুটপাতে। গত বৈশাখে ফুটপাত থেকে যতটা উষ্ণতা নিয়েছিল শরীর তার সবটুকুই তাকে যে ফিরিয়ে দিতে হবে এই শীতে।

রো একবার পিছন ফিরে দেখল বিরোচন----

দু'দিক থেকে ঝাপিয়ে পড়া বাঁশে অর্ধবৃত্তকার পথ শেষ হয়েছে বামুন পাড়ার মাঠে। দুপুরের রোদে ঝলসে যাচ্ছে মাঠ-- শ্মশানের অশ্বত্থের ডালে তখনও পেন্ডুলামের মতো দুলছে হলুদ ঘুড়িটা। মাঝ দুপুরের সূর্যও বাঁশ পাতার অলিগলি টপকে ঘোচাতে পারে নি দুপুর পথের আপাত আঁধার। পথের পাশের ডোবায় নুয়ে পড়া বাঁশের ডগে একটা নিবিষ্ট বক ছাড়া আর কিছুই নজরে আসে না বিরোচনের।

অথচ সে স্পষ্ট শুনেছে বাঁশ পাতায় পা ফেলার মচমচ শব্দ। প্রথমটায় আমল না দিলেও সে শব্দ রীতিমতো তাড়া করছে তাকে। এই পথটা শুরু হয়েছে বর্মন পল্লীর নাটমন্দিরে, তারপর সত্যেশ্বর আত্যয়িক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পশ্চিমের দেওয়াল ছুঁয়ে মিতালি সংঘের খেলার মাঠটা বাঁ'হাতে ফেলে ঢুকে পড়েছে হালদারদের বাঁশ বাগানে। নদী যেমন মোহনায় ফুরায়-- তেমনই এ পথ শেষ হয়েছে বর্মন পল্লী আর বামুন পাড়ার মাঝের মাঠে। মাঠটা এতো বড় যেন মনে হয় সূর্যটা বামুন পাড়ায় টুপুস করে ডুবে যায় সন্ধে হলে। বিরোচন প্রায়দিন বাড়ি থেকে পালিয়ে মাঠের ধারে বসে থাকে, শীতের রোদ গায়ে আরাম দেয়। বামুন পাড়ার ঘুড়িগুলো আকাশে পাখির মতো উড়তে থাকে, ঘাড় উঁচিয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকে বিরোচন।

রং বেরং-এর ঘুড়ি সব বামুন পাড়ার আকাশটাকে রঙীন করে দেয়। রঙীন করে দেয় বিরোচনের মনটাকেও। হলুদ রঙের ঘুড়িটায় বড্ড মায়া বিরোচনের, মনে মনে ভাবে ওটা তারই। সবুজ,কমলা, লাল-কালো ঘুড়িগুলোকে হারিয়ে হলুদটা যখন সব্বার উপরে তখন খুব আনন্দ হয় তার। একসময় লাল-কালো ঘুড়িটা কেটে দেয় হলুদ ঘুড়িটাকে-- পাক খেতে খেতে তলিয়ে যেতে থাকে বিরোচনের হলুদ। বামুন পাড়ার শ্মশানে অশ্বত্থ গাছে জড়িয়ে যায় ঘুড়ি- মন খারাপ হয়ে যায়। বিরোচন বাড়ি ফেরার পথ নেয়।খানিকটা এগানোর পরই তার মনে হয়ে-- কে যেন আসছে তার পেছনে পেছনে। শ্মশানের অশ্বত্থে নাকি ভুতেরা বাস করে। খালি চোখে দেখা যায় না অশরীরীদের। তবে কি তার হলুদ ঘুড়িটা একটু হলেও বিরক্ত করল ওদের! হাঁটার গতি বাড়িয়ে দেয় বিরোচন। বাঁশ পাতা মাড়ানোর শব্দটা আরো স্পষ্ট হয় তার কানে। আর একবার পিছন ফিরে দেখবে বলে ভাবে সে কিন্তু সাহসে কুলিয়ে উঠে না।

লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে সামনের দিকে দৌড় লাগায় সে-- যে দৌড়টা ছেলেবেলায় আমি আপনি আমরা অনেকেই দৌড়েছি, নিজের পায়ে বাঁশ পাতা মাড়িয়ে।

সাহিত্যসভার প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি

তকাল আমাদের স্কুলে মেঘবল্লরীর সাহিত্য সভায় প্রকাশিত হল মেঘবল্লরী লৌকিক দেবদেবী সংখ্যা। প্রায় চল্লিশটি লৌকিক দেবদেবীর আবির্ভাব মাহাত্ম্য জায়গা করে নিয়েছে এই সংখ্যায়। পরে কোন দিন সে নিয়ে আলোচনার আসা যাবে।

মেঘবল্লরীর সম্পাদক শ্রী প্রাণনাথ শেঠ আমাদের স্কুলের প্রধাণ শিক্ষক, সেই বিধায় ঐ সভায় উপস্থিত থাকতে পেরেছিলাম। এটা আমার তৃতীয় সাহিত্যসভা। আগের দুটিও প্রাণনাথ স্যারের উদ্যোগে আমাদের স্কুলেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল। আসলে হলদিয়া তল্লাটে যারা চিহ্নিত সাহিত্যকর্মী আমি তাদের দলে পড়ি না, খুব সতর্কভাবে পড়তে চাইও না। আমার লেখালেখি ফেসবুকেই সীমাবদ্ধ আজকের সভায় আমাদের বিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষক শিক্ষিকা শিক্ষাকর্মী সহ উপস্থিত ছিলেন শতাধীক সাহিত্যকর্মী।

গত দুবারের সভার প্রেক্ষিতে এবারের আয়োজন অনেক বেশি বলিষ্ঠ ছিল। প্রাণনাথবাবু আন্তরিক আয়োজন ছিল প্রায় ত্রুটিহীন। স্যারের একটা বিষয় বড় আশ্চর্য করে একজন সংগঠক হয়েও ভীষণ নিবিড়ভাবে জনেজনে আপ্যায়ন। দুই পর্বের সভায় ছিল গান,আবৃত্তি, আলোচনা, পত্রিকা প্রকাশ, সম্মাননা জ্ঞাপন। মাঝে ছিল মধ্যাহ্ন ভোজন। আলোচক গৌতম ভট্টাচার্য বরাবরের মতো টানটান বসিয়ে রাখলেন সকলকে।

আলোচনার বিষয় ছিল-- " সাহিত্যে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি"। স্বেচ্ছাকৃত দুর্বোধ্যতার বাইরে বেরাতে হবে সাহিত্যকে, কেবল আনন্দময় নয় সামাজিক দায়বদ্ধতা থাকবে, সবচেয়ে গোড়ার কথা লেখক হবেন আন্তরিক ও সৎ। অথাৎ তাঁর লেখায় যে আদর্শ, সত্য উঠে আসছে তিনি নিজে তার বিপ্রতীপ অবস্থানে থাকবেন না। এই আলোচনার পরই ছিল মধ্যাহ্ন ভোজনের বিরতি। একেবারে কব্জি ডুবিয়ে না হলেও আলোচনার সঙ্গে সমতা রেখে ভুরিভোজের প্রত্যাশা আর প্রাপ্তিতে খুব একটা হেরফের ঘটে নি। চল্লিশ জনের পঙতিতে প্রথম দফার বসেছিলেন তুলনা মুলক বয়স্ক ও মহিলারা আসলে আমি সাহিত্য সভার সালতামামি করতে বসি নি। আমি মধ্যাহ্ন ভোজে ঘটে যাওয়া একটা ছোট্ট ঘটনা নিয়ে কথা বলতে বসেছি মাত্র। খাওয়া দাওয়ার শুরু থেকেই আমি তদারকিতে ছিলাম। প্রথম দফার খাওয়া শেষ হয়েছে, বাইরে এসে দাঁড়িয়েছি একটু রোদের লোভে।

সাদা পা'জামা পাঞ্জাবির এক ভদ্রলোকের একটা প্রশ্ন কানে এল, চল্লিশ পয়তাল্লিশের এক ছটফটে মানুষকে দেখিয়ে, বললেন

"ইনি কি শিক্ষক?"

যাকে প্রশ্ন করেছিলেন তার উত্তরের অপেক্ষায় না থেকেই প্রশ্নকর্তা আবার শুরু করলেন--

"অসভ্য একটা, আমার বাবা খাওয়া শেষে ঘাটে মুখ ধুচ্ছেন, লোকটা ট্যাপের জলে মুখ ধুয়ে তারমধ্যেই ঘাটে পা ধোয়া শুরু করলেন!"

ভদ্রলোক রাগে ফেঁটে পড়লেন, সেই রাগ ছোট্ট ঐ জটলা পেরিয়ে আরো দু'একজনকে ছুঁয়ে গেল।

বুঝলাম নিতান্ত নিমন্ত্রিত না হলে, আর সাহিত্যসভা না হলে একটা অন্য রকম ঘটনা ঘটে যেত। সাহিত্যসভায় নিজেকে অনেটা নরম নরম রাখাই নিয়ম-পেলবতা দস্তুর। উপযাচক হয়ে সাদা পাঞ্জাবিকে জানালাম আমাদের সমস্ত মাস্টার মশাই প্রথম পঙতি থেকে স্বেচ্ছাকৃত নিজেদের সরিয়ে রেখেছেন। যাতে বয়স্ক ও বহিরাগত আমন্ত্রিতরা আগে খেয়ে নিতে পারেন। আরো নিশ্চিত করে বললাম উনি আমাদের বিদ্যালয়ের শিক্ষক নন। এই ঘটনায় দুটো অভিঘাত আমাকে ভাবিয়েছে।

প্রথমত, অনেককাল ধরেই আমারা শিক্ষককেরা ক্রমশ শ্রেণীশত্রু হয়ে উঠেছি, তা যে নিতান্তই অকারণে( কিছু শিক্ষকের অনৈতিকতা যে আমাদের অনেকেই বিব্রত করে) আত্মপক্ষ সমর্থনে সে উচ্চারণ করব না। এও সত্য সমসাময়িক নিয়োগ দূর্নীতি সেই বিশ্বাসটাকে আরো জরালো করছে।

আমি ভাবছি যিনি লেখেন, যিনি আমরা সাধারণে যতটা দেখি বা দেখতে পাই তার চেয়ে ঢের বেশি দেখেন, যার বিশ্বাস চিন্তা মমনশীলতা সাধারণের থেকে একটু হলেও পৃথকীকৃত, তিনি চটজলদি অবিবেচকের মতো একটা সাধারণ মাপকাঠিকে হাতিয়ার করবেন কেন? কেন ঐ অপরাধের জন্য একজন শিক্ষককেই চিহ্নিত অভিযুক্ত হিসাবে ধরে নেবেন?

অন্য দিকটায়, পরে জেনেছি যিনি পা ধুচ্ছিলেন তিনি ঐ সাহিত্য সভার অন্যতম প্রাবন্ধিক। এই তাঁর যাপন-- অন্তর আর বাহিরে আকাশ জমিন! তাহলে "সাহিত্যে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি" -এ কেবল আমাদের টানটান বসিয়ে রাখে। আলোচনা কেবল সভার অলংকার হয়েই থেকে যায়। ইংরাজীতে Hearing ও listening দু'টোই শোনা কিন্তু একরকম শোনা নয়। এই দুই শোনার তফাৎ অনেক।

প্রথম শোনায় কেবল কান সক্রিয় থাকে অন্য দিকে দ্বিতীয় শোনা, কানের সঙ্গে হৃদয় দিয়ে শোনা।

একজন সাহিত্যকর্মী অনায়াসে সাহিত্যকর্মী হয়ে উঠতে পারেন না। তাঁকে নিরবিচ্ছিন্ন সাহিত্য পাঠ চর্চা ও নির্মাণের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন-

"কেউ দুধের কথা শুনেছে, কেউ দেখেছে, কেউ ছুঁয়েছে, আর কেউ দুধ খেয়ে হজম করেছে। এদের মধ্যে শেষের মানুষ দুধের যা উপকার তা পেয়েছে।"

নীল কোড

ভাস্কর সিনহা

ক্যালিফোর্নিয়া

গল্প

morning1.jpg
নীল কোড
Bhaskar Sinha.jpg

 এপ্রিল ২০২৩ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

"যা হালা, হবি তো হ- সব বিপদই এলো একসাথে।" করোনা মহামারীর আবর্তে পড়ে রজত আটকে এক মহাদেশে, আর তার পরিবার বহুদূরে অন্য এক মহাদেশে। এদিকে একমাত্র সন্তানের তো যাই যাই অবস্থা। সুচরিতা তাকে অনেক দিন আগেই সাবধান করে রেখেছিল। আসলে রুদ্রের জন্ম থেকেই তো সমস্যাটা ছিলো। এবং সব কিছুরই মতো সুচরিতা রজতকেই এই সমস্য়ায় জন্য় দায়ী ঠাউরেছিল। যদিও রজত অনেক ডাক্তারকে ধরেও আসল কারণের সুলুকসন্ধান করে উঠতে পারেনি। বাপ- ছেলের রক্তের গোত্র এক হওয়ায়, রজত কেমন এক ঘোরে থাকত। ভাবত দরকার পড়লে, সেই দিয়ে দেবে। সুচরিতা রজতকে সাবধান করত এই বলে যে রক্তের গোত্রটা এক হওয়াই সব কিছু নয়, আরো একশটা পরীক্ষা যে পড়ে আছে। যাচ্ছি- যাব করে আর পরীক্ষামুখী সে হতে পারেনি। আর মধ্যবিত্তদের দশাই তো এইরকম। ঠ্যালা পড়লে তবেই তো উঠবে বাবাজী।

এখন কি যে করে, কোথায়ই বা যায়? না চলছে উড়োজাহাজ, না চলে গাড়ী- ঘোড়া। অন্য দেশ তো দুরস্থান, এক শহর থেকে অন্য শহরেও যেতে এখন প্রতিবন্ধ লেগেছে। করাল মহামারীর আবর্তে মানবসভ্যতার তো যাই - যাই অবস্থা। পৃথিবীব্যাপী অর্থনীতি চূড়ান্তভাবে ক্ষরিত। মানুষের সমাজবদ্ধতাই এখন বিকট প্রশ্নের সম্মুখীন। জানা বিপদ হতে অজানা বিপদ যে কতো ভয়াল আর ভয়ংকর হতে পারে, তা ঠারে ঠারে বোধগম্য হচ্ছে। একের পর এক আসছে নূতন- নূতন ঢেউ আরো বীভৎস রূপে এবং পরিস্থিতি কবে সুস্থিত হবে বা আদৌ হবে কিনা কারোরই তা ঠিক জানা নেই। প্রাণের চেয়ে মহার্ঘ আর কিছু নেই। সভ্যতার এই সঙ্কটে মানুষ নামক প্রাণীটির প্রাণ আর টিকে থাকে কিনা, এই এখনকার সময়ের সবচেয়ে মূল্যবান প্রশ্ন।

সুচরিতা দূরভাষে করে কান্না-কাটি… এই অ্যাম্বুলেন্স আসে। রুদ্রকে নিয়ে দেয় পাড়ি। অস্ত্রোপচার শুরু হবার আগে সে রজতকে বলে, "ডাকো, ডাকো ঠাকুরকে।" ঠাকুরকে প্রাণপণে ডাকা ছাড়া, আর করারই বা কি আছে এই পরিস্থিতির ঠুঁটো জগন্নাথের। রজত শঙ্খবাবুর ক্লাসে পড়ানো ‘বাবরের প্রার্থনা‘র বিশ্লেষণ আজ অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করে। দুই পিতার এক আশ্চর্য সমাপতন কোথাও যেন হয়ে যায়। যেখানে রাজা-প্রজার আন্তরিক নিবেদন ও প্রার্থনায় কোন অন্তর থাকে না।

একে, একে বাদ পড়ে পিত্ত থলি এবং উপাঙ্গ। যকৃৎ আর অগ্ল্যাশয়ের অবস্থাও তথৈবচ। কিন্তু এগুলি বাদ দিলে তো পরিশিষ্টে কিছুই পড়ে থাকে না। তবে কোথাও, কোথাও স্টেন্ট বসাতে হয়।

দিনকয়েক যমে-মানুষে টানাটানির পরে রুদ্র চোখ মেলে। সুচরিতা যেন প্রাণ ফিরে পায়। রুদ্র তখনও মুচকি হেসে বলে, "তুমি তো আমায় টেনে ফেরালে।" রজত মানসচক্ষে সুগভীর মার্তত্বের বিরাজমান ফল্গুধারা দেখেই চলে। সুপ্রাণা মহীয়সী কোনো কাজের সুসমাপ্তি না দেখে কখনোই চূড়ান্ত ক্ষান্তি দেয় না।

এদিকে ঝিল্লিস্রবণ সত্ত্বর শুরু করা ছাড়া আর কোনো বিকল্পের অবকাশ থাকে না। অপরিশ্রুত রক্ত শরীরের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি শুধু করেনি, জীবনদীপের শিখাও নিভু- নিভু করে তুলেছে।

এই সময়েই যেন দৈবযোগ ঘটে। কখনো- কখনো সাদামাটা জীবনে এমন কিছু ঘটে যা রূপকথাকেও হার মানায়। রজতের জীবনে তেমন দু- একটা রোমাঞ্চকর ঘটনা ঘটে থাকলেও, এমন অভূতপর্ব ঘটনা যে আদৌ ঘটতে পারে, যা কোনো শ্রেষ্ঠ সৃজনশীল লেখকের লেখনীকেও তুচ্ছ করে দেবে, তা সে স্বপ্নকালেও অনুধাবন করে উঠতে পারে নি। কোথা হতে সব এলোমেলো অবস্থার বিন্দুগুলো একে- একে সরলরৈখিক উদ্যোগে যুক্ত হতে শুরু করে। চাকুরির ইস্তফা তো দেওয়াই ছিল। চারদেশের রাষ্ট্রদূতদের মাধ্যমে উড়ানের আগমন, নির্গমন, ইত্যাদির আয়োজন একে একে সম্পূর্ণতা পায়। প্রবল মহামারীর মাঝে এক নিজস্ব উড়ানে রজতের একাকী যাত্রা শুর হলো। সেই প্রথম এবং হয়তো সেই শেষ একক উড়ান। রজত সেই সহৃদয় ব্যক্তির সুবিশাল মন এবং ততোধিক ভারী পকেটের গভীরতা অনুধাবনের প্রচেষ্টায় বিন্দুমাত্র আগ্রহী না হয়ে রুদ্রের ছোটবেলার স্মৃতিতে ডুব দেয়। সত্যয়ই সন্তান হয়ে, ও সুচরিতা এবং রজতের জীবন কানায় কানায় পূর্ণ করে তুলেছে। আবার ছাত্র হিসাবে ওর জুড়ি পাওয়া ভার। শত শারীরিক অক্ষমতাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে রুদ্র সেরা ছাত্রেরা শিরোপাটা অক্ষুণ্ণ রেখেছে। শতকোটি কষ্টের মধ্যয়েও রুদ্রের অপাপবিদ্ধ হাসিমুখই যেন সুচরিতা আর রজতকে এগিয়ে নিয়ে চলে। রজতের কখনও কখনও মনে হয় যে কোথায় যেন রুদ্রের আর স্টিফেন হকিং-এর অশেষ দেহকষ্টের মিলমিশ হয়ে যায়। জীবনকে কখনো স্বাভাবিকভাবে না পাওয়ার আক্ষেপ বোধহয় রুদ্র বই আর তার স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের মধ্যয়েই ডুবে ভুলে থাকতে চায়। সুচরিতা এখন আর এতটুকু অবাক হয় না যখন রুদ্রকে রাতের পর রাত জেগে আন্তর্জাতিক প্রকল্পগুলিকে রূপায়নের জন্য় প্রাণপাত করতে দেখে। রুদ্রের দৃঢ় প্রচেষ্টা আর জ্ঞানার্জনের প্রবল তৃষ্ণা সুচরিতা আর রজতকে পথের পাথেয় যোগায়। এই তপস্যা আর তিতিক্ষাই রুদ্রের পরিচয় হয়ে উঠছে। এই একমুখী একাগ্রতার কাছে কোনো বাধাই আর বাধা নয়। কোনো পথই আর দুর্গম নয়। কোনো বর্মই আর দুর্ভেদ্যয় নয়।
 

দেখতে দেখতে আরব সাগরতীরের সুরম্যয় এক শহরে কিয়ৎক্ষণের জন্য় উড়ান থামে। নাকাবন্দীর কারণে এখানে যে থামতেই হবে। গন্তব্যস্থল সোজাসুজি যাবার উপায় যে নেই। তার কর্মস্থলের শহর আর পরিবারের বাস যে শহরে তাদের মধ্যে মধ্যে ঘোর বিবাদ চলছে যে। দীর্ঘকালীন অবরোধে সরাসরি সব উড়ান বন্ধ। সব ঘুর পথে চলছে। এক- দুটি পথ খোলা আছে, তাই কেবল ভরসা রুদ্রের কাছে পৌঁছানোর।

সুদর্শনা, সুভাষিণী, এক সুসজ্জিতা উড়ান পরিচারিকা জলখাবারের আয়োজন করে। ঢালাও পরিবেশন। অন্য সময় হলে রজত অবশ্যই সেই উপভোগে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করত না। কিন্তু এমত পরিস্থিতিতে সবকিছুই যেন বিস্বাদ লাগে। রজতের চোখে শুধুই রুদ্রের বেদনাতুর মুখ ভেসে ওঠে। সুচরিতা সত্যয়ই দশভূজার মতো সবকিছু সামাল দিচ্ছে। ও তো পাগলই হয়ে যেত, সুচরিতা না থাকলে। সুচরিতা শুধু শিকড়ের আগলে সংসারটিকে টিকিয়ে রেখেছে তা কেবল নয়, তার সুশীতল নীড়ে শান্তি প্রদানের আপ্রাণ চেষ্টাও অবিরত চালিয়ে যাচ্ছে।         

অবশেষে উড়ান থামে গন্তব্যে। অভিবাসনের কাগজপত্রের জরিপ সামলে সত্যয়ই সত্যয়ই ঘরমুখী। ফিরছে সে একা। রিক্ত, ক্লান্ত, অর্থক্লিষ্ট, এবং বেতনহারা...রজত। কি করবে সে? কি-ই বা সে করতে পারে তার প্রাণাধিক সন্তানের জন্য়? সবই এখন যেন ভগবান ভরসা। রজতের কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ ভিন্ন আর কোনো পথ খোলা থাকে না।

কিন্তু কলিযুগেও অদ্ভুত, আশ্চর্যজনক, ও বিস্ময়কর ব্যাপার ঘটে থাকে। রজত সজ্ঞানে তা চাক্ষুষ করল। দেশের প্রধানমন্ত্রী আপনার দূত ও পত্র পাঠালেন,  যখন রুদ্রের উপাচারশালায় অস্ত্রোপচার চলছিল। পত্রটি পড়ে সুচরিতা ঝর ঝর করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন যে রুদ্র এখন জাতীয় সম্পদ আর তার চিকিৎসা করাতে কোনো ত্রুটি থাকবে না। এরপর তো সব স্বপ্নের ব্যাপার। সংবাদপত্র, দূরদর্শন, বেতার ইত্যাদি সব মাধ্যম রজত আর সুচরিতার উদ্ধৃতি নেবার জন্য় অধীরভাবে ব্যগ্র হয়ে উঠল। "বাঁচবে, রুদ্র নিশ্চয়ই বাঁচবে এইবার। আর ভয় নেই এখন," আনন্দে লাফিয়ে ওঠে রজত। সুচরিতার চোখেও আশার ঝিলিক জ্বলে ওঠে। আঁধার ধীরে ধীরে যাচ্ছে কেটে। চারিপাশের আর আলোকোজ্জ্বল হতে বেশী দেরী নেই। সে ইষ্টদেবতাকে ভক্তিভরে প্রণাম জানায়।

ঝিল্লিস্রবণ শুরু হলেও তা শতভাগের দশভাগের বেশী কার্যকরী নয়। বৃক্কদানই এখন একমাত্র উপায়। ক্রমশ চিকিৎসকদের কথাবার্তায় তা পরিস্কার হয়ে উঠতে থাকে। রজত যেন তৈরীই ছিলো। সমৃতদেহ থেকে বৃক্ক পাওয়া তো ভাগ্যের ব্যাপার। কিন্তু তা কবে পাওয়া যাবে কেউ জানে না। একবছর বা একাধিক বৎসর। রজত বা সুচরিতা কেউই অনিশ্চয়তায় বসে থাকতে রাজি ছিলো না। রজত বৃক্কদানের সম্মতি দিয়ে দেয়। এরপর শুরু হয় বৃক্কের ঐ হাজারটা সদৃশ হত্তয়ার পরীক্ষা দুই দেহের মধ্যে, যতই হোক জিনগত মিলের সম্ভাবনা দুই দেহের মধ্যে পঞ্চাশ শতাংশ মাত্র। প্রথমে একটু অনিশ্চয়তা থাকে মধুমেহতার সূত্রপাত নিয়ে। কিন্তু জেদি রজত যেন সামরিক শাসনের বাঁধনে নিজেকে বেঁধে ফেলে। সকাল- সন্ধ্যেয় ব্যায়াম আর ছোটাছুটি যায় বেড়ে। রুদ্রের বাঁচার কোন সুযোগেরই হাতছাড়া হতে দিতে আর রাজি নয় সে। আর দুই মাসের মধ্যয়েই স্থিতিমাপগুলি স্থিতিশীল হয়ে যায়। রজতের বুকের ভার নেমে যায়। এখন আর কোনো বাঁধন থাকে না বৃক্কদানের।

কিন্তু যখন সারা পৃথিবী মহামারীর আবর্তে, রজতের ঘর তার থেকে ছাড়া পায় কি করে? ঝিল্লিস্রবণ চলাকালীন জানা গেল যে করোনা রুদ্রের মধ্যয়েও সংক্রামিত হয়েছে। আবার এক বিশাল পরীক্ষার মুখোমুখি হওয়া। সুচরিতা চলে বাক্স-প্যাঁটরা বেঁধে ডাক্তারের বিধিনিষেধ না মেনে রুদ্রের পরিচর্যা করতে। যে রোগ সম্বন্ধে চিকিৎসাশাস্ত্র এখনও সবকিছু জেনে উঠতে পারেনি, মা হয়ে সে তো সব ছেড়ে দিতে পারে না। অবশেষে মাস-খানেকের বন্ধুর পথপাড়ি শেষে বিজয়ীর অভিজ্ঞান মেলে। যদিও সুদীর্ঘকাল হাসপাতালের নীল কোডের স্মৃতি সুচরিতা আর রুদ্রকে বিচলিত করে রাখে। অত্যন্ত চিন্তিত চিকিৎসকদের দ্রুত ছোটাছুটির দৃশ্য স্বপ্নে বারংবার এসে নিদ্রার ব্যাঘাত ঘটায়। কেঁপে ওঠে বিশ্বচরাচর। আর ভয়ার্ত ছায়াদের আনাগোনা চলে চারিপাশে। দুঃস্বপ্নগুলো ফিরে ফিরে আসতে থাকে বারবার।

এবার আসে বৃক্কদানের পালা। পঞ্চতারাসদৃশ হাসপাতালের শয়নকক্ষ ছেড়ে যাবার পথে রজত শান্ত ঘুমে ঢলে পড়ে। কি হয়েছে, না হয়েছে, তার আর জানা নেই। যখন ঘুমের ঘোর একটু কাটে, তন্দ্রাবেশে বোঝে যে তার বামদিক ভীষণ যন্ত্রণাক্লিষ্ট এবং অবসন্ন। হয়তো বামদিক আর কোনদিনই রজতের কর্মতৎপরতায় সাড়া দেবে না। হাসিমুখে চিকিৎসকেরা জানান যে সব অস্ত্রোপচারই সফল হয়েছে এবং রুদ্রের দেহে তার বৃক্ক পুরোদমে কাজ সুরু করে দিয়েছে।

রজত ভাবে যাক তাহলে হয়তো রুদ্রের এবার কষ্ট কিছুটা লাঘব হবে। গলা শুকনো, তাই ধন্যবাদ জানানোটা ঠিক সজীব হয়ে ওঠে না। ধীরে, ধীরে ঘুমের দেশে ফিরে যায় রজত।

রঙের খেলায় বর্জ্যের ওপর শিল্পসৃষ্টির

নেশায় মগ্ন চিরশ্রীর লক্ষ্য মাটির প্রতিমা সৃষ্টি 

সুদীপ পাকড়াশী

কলকাতা

প্রবন্ধ

চিরশ্রীর লক্ষ্য
chirasree-malik-handicraft.jpg
chirasree-craft-works.jpg

 এপ্রিল ২০২৩ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

ফেলে দেওয়া যে কোনও জিনিস তার হাতের স্পর্শে শেষপর্যন্ত আর বর্জ্য হয়ে ওঠে না! নতুনভাবে প্রাণ পায়। রঙ নিয়ে খেলেন তিনি। রীতিমত পরীক্ষা নিরীক্ষা করেন। তার হাতে উঠে আসে বাংলার প্রাচীন মধুবনী পেন্টিং, মধ্যপ্রদেশের প্রাচীন আদিবাসীদের সৃষ্টি করা গন্ড পেন্টিং। সেই পেন্টিংয়ে ফেলে দেওয়া বোতল, কৌটো ও অন্যান্য বর্জ্য শুধু পুর্নব্যবহারযোগ্যই হয় না, নতুন এক ছবি তৈরি করে দেয়। তিনি শুধু হাতের কাজ করেই ক্ষান্ত থাকেন না, এলাকার পরিবেশকে দূষণের হাত থেকেও বাঁচানোর নিঃশব্দ লড়াই তার চলছে। 
সেই কারণেই তার এলাকায় চিরশ্রী মালিক রীতিমত জনপ্রিয়! ফোনে কথা বলার সময় তার সহাস্য মন্তব্য, "আমার এলাকায় কেউ বাড়িতে ব্যবহার হয়ে যাওয়ার পরও কোনও জিনিস ফেলে দেয় না। আমাকে একবার জিজ্ঞেস করে নেব কি না।" এভাবে এখনও পর্যন্ত কত শিল্প যে তার হাতে সৃষ্টি হয়েছে সেটা ৩১ বছর বয়সী চিরশ্রী মনে করতে পারছিলেন না!  স্কুলে পড়ার সময় থেকেই আঁকা তার সহজাত প্রেম। তখন মূলত গ্রিটিংস কার্ড তৈরি করতেন। তারপর পরিধি আরও বিস্তৃত হল। স্কুলের গণ্ডী পেরিয়ে কলেজে পড়ার সময় থেকেই তার বিষয় ইলেক্ট্রনিকস। কলকাতার পলিটেকনিকে এম-টেক করছেন ইলেক্ট্রনিকস নিয়ে। কিন্তু প্যাশন যে আঁকায়। তাই সমানে চলেছে সেই কাজ। 
 এখনও পর্যন্ত যে কত ফেলে দেওয়া প্লাস্টিক আর অন্যান্য দ্রব্যের ওপর চিরশ্রীর কাজ হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই! অন্তত তিনি মনে করতে পারলেন না। কিন্তু এই কাজের মাধ্যমে যে একইসঙ্গে পরিবেশ দূষণের কাজও হচ্ছে তার জন্য খুশি চিরশ্রী।চিরশ্রীর আঁকার যে প্রধান উপাদান সেই রঙ নিয়েও কিন্তু তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়। তিনি মধুবনী পেইন্টিং করেন। গ্রাম বাংলার

এক প্রাচীন রঙ। যে পাতা ও ফুলের রস দিয়ে দিয়ে এই রঙ তৈরি হয় সেটাও চিরশ্রী তৈরি করেন শিলে বেটে। তারপর তুলি দিয়ে সেই প্রাকৃতিক মধুবনী রঙের সহায়তায় তৈরি হয় চিরশ্রীর সৃষ্টি। এছাড়াও মধ্যপ্রদেশের আদিবাসীদের সৃষ্ট প্রাচীন গন্ড পেন্টিং এবং অ্যাক্রিলিক পেন্টিংও চিরশ্রী করেন। 
বর্জ্যের ওপর আঁকার কাজের বাইরেও চিরশ্রী মাটির কাজও করেন। সেখানে তার ব্যবহৃত প্রধান উপাদান ওয়াল পুট্টি, এয়ার ড্রাই ক্লে। তার মাটির তৈরি রাজহাঁস, গোলাপ ফুল, প্লেটের ওপর দুর্গার ছোট মূর্তি সৃষ্টি জনপ্রিয় হয়েছে। গত তিন বছর ধরে করা এই সৃষ্টিগুলো চিরশ্রী বিক্রি করেন, দামও পান। 
এরপরও সৃষ্টি সুখের উল্লাসে থাকা চিরশ্রীর সন্তুষ্টি নেই! স্বপ্ন দেখেন মাটি দিয়ে একটি পূর্ণ সাইজের প্রতিমা তৈরি করার। মাটি দিয়ে চাবির রিং বানিয়েছেন, টেডি বিয়ার বানিয়েছেন, কিন্তু পূর্ণ দৈর্ঘ্যের প্রতিমা সৃষ্টি হয়নি। সেরকম একটি কাজ করে চিরশ্রীর ইচ্ছে মানুষকে জানানো। কোনও হস্তশিল্প মেলা বা প্রদর্শনীতে সেই কাজটি পাঠানো। 
আর পরিবেশকে দূষণের হাত থেকে বাঁচানোর লড়াই তার মনে প্রতি মূহুর্তে চলছে। না হলে বাড়ির কোনও মলিন, স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে পড়া দেওয়ালে রঙ করে তার মধ্যে আবার প্রাণ ফেরাবেন কেন? কেনই বা বাড়ির গ্যারাজ, বা ছাদের ওপর থাকা জলের রিজার্ভারকে রঙ করে তাদের প্রাণবন্ত করে তুলবেন? আর কেনই বা এই রঙে প্রাধান্য পায় সবুজ! যে সবুজকে প্রকৃতি থেকে, বিশেষত শহরগুলিতে ক্রমশ নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে নিঃশব্দে দূষণের জয়গান করে চলেছে মানবসভ্যতা! 

দে ছুট্‌ 

যজ্ঞেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায় 

সাঁইথিয়া, বীরভূম, পঃ বঙ্গ 

ভ্রমণ

দে ছুট
De Chhut1.jpeg
Jaggeshar Bandhopadhya_edited.jpg

 এপ্রিল ২০২৩ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

De Chhut3.jpeg
De Chhut2.jpeg

প্তাহান্তের ছুটিতে মাঝে মাঝেই বেড়িয়ে পড়তে হয়, মনের তাগিদে। তাই চেপে বসলাম রামপুরহাট জসিডি প্যাসেঞ্জারে, সাথে তিন সফরসঙ্গী। এই লাইনটা চালু হওয়ার পর থেকেই যাবো যাবো ভাবছি কিন্তু হয়ে ওঠেনি। নতুন ট্রেন রুট চালু হলেই অজান্তে কোনো ইঞ্জিন আমাকে নিয়ে চলে সেই পথে। তো শুরুতেই উত্তরবঙ্গের রাস্তাকে পাশে ফেলে পশ্চিমবঙ্গের সীমানা ছাড়িয়ে আমরা ঝাড়খণ্ডের পশ্চিমমুখে শাল, মহুয়া, খেজুর ও পলাশের জঙ্গলে প্রবেশ করলাম। এ যেন ঝাড়গ্রাম থেকে ঘাটশিলা বা রাঁচী ঢোকার আগের পথ, মনে পড়ছিল সেই সব ভ্রমণকথা। অসংখ্য বাঁক নিয়ে ট্রেন চললো, কখনও দূরে পাহাড়ের হাতছানি তো কখনও বা ট্রেন চললো পাহাড় কেটে রাস্তার মধ্যে দিয়ে। এ কোন আদিম জগতে প্রবেশ করলাম, মাঝে মাঝে পাহাড়ি ঝর্ণা আর তাতে স্নানরত সাঁওতাল কিশোর ও রমণী। জঙ্গলের ফাঁকে আদিবাসীদের পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন নীচু টালির ঘর, গাছের ছায়ায় খাঁটিয়া পাতা একটু জিড়োনোর জন্য। একদিন এখানে রাত্রিবাস করতেই হবে, সেদিন সবটাই তাদের মতো করে কাটানো।
দুমকাতে আমাদের যাত্রার ইতি টানলাম, ট্রেন চলে গেলো নিজ গন্তব্যে। রেলস্টেশন শহর থেকে একটু দূরে, আমাদের ফিরতি প্লান বাসে, তবেই না সবটা চাখা যাবে। ভোজপুরী গান শুনতে শুনতে ট্রেকারে মেন বাজার এলাম। ওখানের বিখ্যাত পকোড়ি আর চা, জমে গেল ব্যাপারটা। অর্ডার দিলাম ঠিক এই ভঙ্গিতে 'বড়িয়া সে চা এ বানাও, ভ্যেস কা দুধ দে কে', যেন কিছুক্ষণের জন্য অরণ্যের দিনরাত্রির রবি ঘোষ ভড় করলো আমার মধ্যে। সাথে দুমকার বিখ্যাত শোনপাপড়ি খাওয়া ও বাড়ির জন্য কেনা হলো, সবই পরিবেশিত হচ্ছে কাচা শাল পাতার তৈরি পাত্রে।
ফিরতি পথের বাসযাত্রা, এ যেন এক অন্য জগত। বাসের কেবিনে লোকাল মহিলাদের সংখ্যাধিক্য চোখে ঠেকছে, কেন এমন? আমাদের ওদিকের বাসে তো দেখা যায় না। পরে মনে হলো হয়তো নিরাপত্তার জন্য এই অভিনব পন্থা। বাস জঙ্গলের বুক চিরে চলতে থাকলো ধীর পায়ে। এতো টার্ন, যে কোন নতুন চালক সাবধানে গাড়ি না চালালে দুর্ঘটনা এড়ানো যাবে না, সাথে পাহাড়ের বন্ধুরতা। এভাবেই এসে পড়লাম পাতাবাড়ি, আগে আদিবাসীদের ঘরের ছাদ বা চাল শাল, হোগলা বা কোঁয়া পাতা দিয়ে ছাওয়া হতো বলে এই নামকরণ, এখন অবশ্য কংক্রিট জায়গা করে নিচ্ছে। এরপর এলো মহুলপাহাড়ী, ওখানের খ্রিষ্টান হাসপাতাল আগে খুব জনপ্রিয় ছিল,
বহু মানুষ দূর দূরান্ত

থেকে আসতো চিকিৎসার জন্য, এখন তার পড়তি দশা। পরের শিকারীপাড়াতে ১৫ মিনিট চা পানের বিরতি, নেমেই দেখলাম বাজার বসেছে রাস্তার উপর, সাঁওতাল রমণীরা পসরা সাজিয়ে বসে আছে। ওদের ভাষায় ব্যাঙের ছাতা মানে মাসরুম, জঙ্গলের কাঁঠাল, পেয়ারা, আম নিয়ে, সেটাও কেনা হলো, খাট্টামিঠা।  বাস ছাড়ার পর এলো সারসডাঙা, শুনলাম যে ওখানের এক দিঘিতে সারস পাখির আনাগোনার জন্য এই নাম। মাঝে মাঝেই রাস্তার উপরে পরপর টেম্পোরারি বার, হাড়িয়া নিয়ে বসে দোকানদার। মনে হলো বলি এ বাবু দিবি আধা পওয়া। কোথাও আবার সাঁওতালি বৃদ্ধা টানতে টানতে নিয়ে চললো তার মাতাল মরদকে।
তবে এতো কিছু পাওয়ার মধ্যেও তাল কাটলো, পাহাড়কে ছিন্ন ভিন্ন করে যন্ত্রদানবের আধিপত্য দেখে। হায় রে আধুনিকতা, কিছু শ্রেণীর অসৎ মানুষের স্বার্থসিদ্ধির জন্য আমরা হারাতে বসেছি আমাদের শতাব্দী প্রাচীন ভূ প্রকৃতিকে। কুয়াশার মতো ধুলোয় ঢেকে যাচ্ছে রাস্তা, গাছের পাতাতে ধুলোয় জমে থাকা আস্তরণ, জানিয়ে দিচ্ছে তার বর্ণহীনতা। সত্যি কারো কোনো হেলদোল নেই, অবাধেই চলছে এ সব। মাঝে মাঝেই শোনা যায় আদিবাসীরা আন্দোলন করেছে, এটাই তো স্বাভাবিক। তাদের জীবনে ঢুকে পড়ছে এই দূষণের বিষ, পালানোর পথ নেই তাদের। শুধু মাঝে মাঝে চোখ আটকাচ্ছে সিধু কানুর স্ট্যাচুতে, এ যেন পাহাড় চুরির নির্লজ্জ প্রায়শ্চিত্ত। সত্যিই এসব দেখে মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে গেল। এরপরও আমরা বর্ষার জন্য চিৎকার করছি। এতো গাছ কাটা, পাহাড় ধ্বংস, এর ফল তো আমাদেরই ভোগ করতে হবে। সত্যিই শেষের সেদিন ভয়ঙ্কর।
আলো আধাঁরে মেশা দিনটা ভালোই কাটলো। এবার মন চল নিজ নিকেতনে। ও হ্যাঁ, ট্রেন ধরার তাড়ায় ফিরতিতে রামপুরহাট থেকে সাঁইথিয়া আসা বিনা টিকিটে।

De Chhut4.jpeg

ভ্রমণ

জয়ন্তী তুমি কার
Jaggeshar Bandhopadhya_edited.jpg
Jayanti-6.jpeg

জয়ন্তী তুমি কার?

পাহাড়, জঙ্গল না নদীটার

যজ্ঞেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায় 

সাঁইথিয়া, বীরভূম, পঃ বঙ্গ 

 এপ্রিল ২০২৩ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

'ই তো জীবন কালীদা' সাগিনা মাহাতোর সেই অমোঘ ডায়ালগ মনে করিয়ে দেয় আমি উত্তরবঙ্গে। ইদানীং কর্মস্থল আলিপুরদুয়ার হওয়ায় প্রথম সপ্তাহান্ত আর জলে যেতে দিলাম না, পাহাড়ি হিমশীতল জলে অবগাহন করে, এ যেন গঙ্গাজলে গঙ্গাপূজা।
তাই মহাভারতের বনপর্বে বর্ণিত লোমশ ঋষির উপদেশ মতো, যেটা তিনি পান্ডবদের বলেছিলেন যে, 'লঘুর্ভব মহারাজ লঘুঃ স্বৈরং গমিষ্যতি' অর্থাৎ যাত্রাপথের সাজ সরঞ্জাম লঘু হওয়া উচিৎ। সেই ট্র্যাডিশন বজায় রেখে শুধুমাত্র ব্যাকপ্যাক নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম জয়ন্তীর উদ্দেশে।
গতকালই NBSTC বাসস্ট্যান্ডে খবর নেওয়াই ছিল, সেই কথামতো সকাল পৌনে সাতটায় পৌঁছে গেলাম, সৌভাগ্যক্রমে বাসের প্রথম যাত্রী আমি। না না, চাঁদে পা রাখার মতো কোনো ব্যাপারস্যাপার নয়। ঠিক সাতটায় বাস ছাড়ল, ৩০ টাকার বিনিময়ে এই বাসযাত্রা। উপরি হিসেবে পুরো আলিপুরদুয়ার শহরকে চক্কর লাগিয়ে পুনরায় বাস, স্ট্যান্ডের পাশের ফ্লাইওভার দিয়ে ছুটে চললো। কথাবার্তায় বুঝলাম বাসের অনেকেই লোকাল লোকজন, আমার মতোও ঘুরতে যাওয়ার কজন রয়েছে তবে আমার মতো একমেবাদ্বিতীয়ম কেউ নেই।
ড্রাইভারের সাথে লোকাল মানুষ জনের বেশ ভাব, বিড়ি আদান-প্রদান তার প্রমাণ দেয়। মনে হচ্ছে তারা ব্যবসার জন্য ওখানে চললো, এখন থাক সে সব কথা। বাস চললো আলিপুরদুয়ার জংশন স্টেশন পার হয়ে দমনপুরের দিকে, এই দমনপুরেই আমাদের রাস্তাকে উপরে ফ্লাইওভারে ক্রস করলো আসাম হাইওয়ে। এই দমনপুর থেকেই জঙ্গল আমাদের সঙ্গ নিলো, রাস্তার ডানপাশে ঘন জঙ্গল বামপাশে রেললাইন যেটা হাসিমারা, মাল জংশন হয়ে জলপাইগুড়ি যাচ্ছে। এসে পৌঁছলাম রাজাভাতখাওয়া, আলিপুরদুয়ার থেকে ১৬ কিমি। সামনেই সবুজাভ গেট, Buxa Tiger Reserve এর প্রবেশপথ। চেকপোস্ট রয়েছে প্রাইভেট যানবাহনের জন্য, আমরা এগিয়ে চললাম।
শুরু হলো ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পথ চলা, সাথে দোসর বৃষ্টি। জঙ্গলে বৃষ্টি, আঃ এর চেয়ে মাদকতাময় আর কি হতে পারে। চোখ রয়েছে জঙ্গলের দিকে যদি এখানকার সভ্যদের দেখা মেলে, জঙ্গল আরো ঘন থেকে ঘনতর হয়ে পড়েছে।
এসে পড়লাম ২৮ বস্তিতে, ভুটিয়া বস্তি। কাঠের বাড়িগুলো ছবির মতো সাজানো, মহিলা পুরুষ একজোট হয়ে কাজ করছে। এ যেন আমার চেনা বাংলা কম, আসাম বেশী। পাশেই বিএসএফ ক্যাম্প। এখানকার বাসিন্দারা ডুকপা্ আদিবাসী সম্প্রদায়ের, এরা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী, তাই একটা ছিমছাম ছোট্ট গুম্ফাও চোখে পড়লো। সামনের রাস্তা চলে গিয়েছে সান্তালাবাড়ি, ওখান থেকে ৪ কিমি দূরে বক্সা ফোর্ট, তারও ৩ কিমি উপরে লেপচাখা্ গ্রাম। সে গল্প অন্য একদিন। 
আমাদের বাস কিন্তু ওখান অবধি গিয়ে আবার উল্টো রাস্তা ধরলো, বাস ফিরতি পথে চার কিমি এসে বাঁ দিকে টার্ন নিলো। জঙ্গল আরো গভীর, মাঝে মাঝে হাঁটা রাস্তা ঢুকে গেছে জঙ্গলের মধ্যে। অনেক গাছের সাথে সাদা টগর ফুলের আধিক্য, মনে করিয়ে দেয় শিলং পাহাড়ের সাদা কাঞ্চন ফুলের কথা। মাঝে বালা নদী পেরিয়ে এসে পৌঁছলাম জয়ন্তী।
রাজাভাতখাওয়া থেকে জয়ন্তী ১৫ কিমি। এখন সাড়ে ৮টা বাজে, বিকেলের ৪টের বাসে ফেরা অর্থাৎ হাতে সময় অফুরন্ত। এই বাসটি ৯টার সময় আলিপুরদুয়ার যাবে এবং পরে ২টোর সময় আলিপুরদুয়ার ছেড়ে পুনরায় জয়ন্তী আসবে, সেটাই ৪টেতে আমাদের নিয়ে ফিরে যাবে। দেখলাম বাসের সহযাত্রীরাই পসরা সাজিয়ে বসেছে, কারো কাছে মাছ, কারো কাছে কলা, আপেল তো কেউ বসেছে সবজি নিয়ে। ওখানে ৫-৬ টি দোকান রয়েছে, একটিতে ঢুকে জিজ্ঞেস করলাম কি পাওয়া যাবে? বললো পুরি সবজী ও রুটি সবজী। রুটি সবজী দিতে বললাম, মেনু চার্টে দেখি অনেক কিছুইরয়েছে। যাইহোক রুটি সবজীতে কনসেনট্রেট করলাম, সবজীতে লবণ বড্ড বেশী, আমার অভ্যাস মতো বলেও দিলাম ওদেরকে। আমার কথা শুনে বাকি খাদকরাও সমর্থন করলো, তার আগে তারা চুপটি করে প্রেসার বাড়িয়ে চলেছিল। এরপর হাতে চা নিয়ে আসেপাশেটা একটু চক্কর লাগালাম,

যেন নিজের বাগান বাড়িতে ঘুরছি। বিল মিটিয়ে নদী মুখে হাঁটা দিলাম, সামনের ২০০ মিটারের মধ্যেই নদী। আমার আগেই ওখানের রিসোর্ট মালিকের ফোন নম্বর নেওয়া ছিল, নাম জগদীশবাবু, অমায়িক মানুষ, দুপুরে খাওয়ার কথা বললাম। সাথে সাথে চা এসে গেল, বৃষ্টিও আমার মুখ চেয়ে নিজেকে সংযত করেছে, যাক আপাতত স্বস্তি। ওনার সাথে বসে প্রায় একঘন্টা কথা হলো, অনেক ভিতরের তথ্য সংগ্রহ করলাম, যে সব কথা অন্য কোথাও জানা যাবে না। ওনার এখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ১৪ টি রুম রয়েছে। আরো দু একটা রিসোর্টও রয়েছে। এখানে একদিন রাত্রিবাসও করবো তবে সেটা পূর্ণিমাতে, যে কোন জায়গা ভ্রমনপিপাসুদের একবার অন্তত পূর্ণিমাতে যাওয়া দরকার, তবেই সে জায়গার প্রকৃত রূপ সঠিক ভাবে উপভোগ করা যায়।এখানে মোট চারটি পয়েন্ট, দুটি জঙ্গলের কোর এলাকা, তৃতীয়টি পুকরি লেক ও চতুর্থটি হলো মহাকাল মন্দির। এখানের PWD বাংলোটি এখন আর নেই, হাতির হানার শিকার।এবার নদীর বাঁধে এসে দাঁড়ালাম। সেখান থেকে দৃশ্যটি প্রথাসিদ্ধ সুন্দর। সামনেই নদী, ওপারে নিবিড় জঙ্গল, পটভূমিকায় পাহাড়। এরকম দৃশ্য কখনও পুরোনো হয় না। নদীর নামও জয়ন্তী, জঙ্গলের ওপাশেই ভুটান, সেখানকার কোন পাহাড় থেকে নেমে এসেছে, কিছু দূর গিয়ে মিশে গেছে রাইডাক নদীতে। এখন নদী বেশ চওড়া। আগে নদী এর পাঁচ ভাগের একভাগ ছিল, এখন বিরাট তার পরিধি। তবে শুনলাম আগে ছোট হলেও নগণ্য ছিল না, লিটল ম্যাগাজিনের মতো, তেজ আছে। জলের ধারা বয়ে চলেছে ছোট ছোট ১০-১২ টি ভাগে, শেষের দুটি ধারাতে বেশ স্রোত, রীতিমতো কারেন্ট রয়েছে জলে। 
প্যান্ট যথাসম্ভব বিপদসীমার উপরে তুলে জলে নেমে পড়লাম, জলের ছোঁয়ায় সারা শরীর জুড়িয়ে গেল, হিম শীতল এই জল। জলের ধারে একটা পাথরে এসে বসলাম, শুনতে থাকলাম তার কলকলধ্বনি। বেশ লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটছিল, নৃত্যপরাও বলা যায়।
আগে আলিপুরদুয়ার থেকে ছোট ট্রেন চলতো জয়ন্তী অবধি, মালবাহী সাথে যাত্রী যাতায়াতও করতো। পাহাড়ের মধ্যে ডলোমাইট এর খনি ছিল, সেটা আনার জন্যই বিশেষত এই ট্রেন লাইনের পত্তন। পরে পরিবেশ সংক্রান্ত মামলায় ডলোমাইট খোঁড়া বন্ধ হয়ে যায় ফলত ১৯৮৬ সালে ট্রেন চলাচলও বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু এখনো তার স্মৃতি বহন করে চলেছে জয়ন্তীর বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন এলাকাটি, ওটাকে এখনো স্থানীয়রা স্টেশনই বলে। শুনলাম এখনকার দোকান গুলো, আগে এগুলো ছিল স্টেশনের প্লাটফর্ম তথা তার কোয়ার্টার। 'পাখি উড়ে চলে গেলেও তথাপি তার পালক পড়ে থাকে।'
শুনে মনটা স্বভাবতই খারাপ হয়ে গেল, এ এক প্রকৃতির সাথে মানব জীবনের অলিখিত দ্বন্দ্ব। ট্রেন তথা ডলোমাইট তোলা বন্ধ হওয়ায় অনেকেই রুজিরোজগার হারিয়ে ছিল সেই সময়। এভাবেই মানব সভ্যতা এগিয়ে চলেছে কালের করাল গ্রাস অতিক্রম করে।
নদীর স্রোত অতিক্রম করে ওপাড়ে যাওয়ার চেষ্টা করলাম কিন্তু বিফল  মনোরথে ফিরে এলাম। স্থানীয়রা কেউ কেউ সাবধান করে দিল আপনারা পারবেন না, ফলে কিছু দূর অন্তর জল মেপে চলেছি। এক সারমেয় আমার সাথ ধরেছে, সে হয়তো কিছু বলতে চাইছে কিন্তু আমিই অপারগ তার ভাষা বুঝতে। দূরে দুজন পুরুষ মহিলা জলের ধারে ঘুরছে, তারা আমার কাছে আসায় বুঝলাম পিতা পুত্রী। 
মেয়েটি বললো 'আপনি কি ওপারে যাবেন?'
আমি বললাম 'যাওয়ার তো ইচ্ছে আছে কিন্তু!'
তখন সে বললো আমরা যদি একসাথে যাই তো যাওয়া যেতে পারে। সেইমতো গবেষণামূলক অনেক জায়গায় জল পরিদর্শন করা হলো কিন্তু অচেনা পাহাড়ি নদী, তাই রিস্ক নিলাম না। শেষে এক স্থানীয়ের সহায়তায় আমরা পার হলাম। কুকুরটি আমার সঙ্গ তখনো ছাড়েনি। ওপারের পাহাড়ের দৃশ্য আরো মনোরম যা ভাষায় প্রকাশ করা মুশকিল, এ এক স্বর্গীয় পরিমন্ডল, অপার শান্তি বিরাজ করছে। ওখানকার জঙ্গলের অধিকাংশ গাছ আমলকী হরিতকীর, ডিসেম্বরে ফলে ভরতি হয়ে যায় এই বনভূমি। 
কুকুরটি এগিয়ে চলেছে পথ দেখিয়ে। খানিকটা ছুটে যায়, দাঁড়ায়, পিছনে ফিরে তাকায়। ঠিক আসছি দেখে আনন্দে লেজ নাড়ে। আবার এগিয়ে যায়। আবার দাঁড়ায়, ফিরে তাকায়। পিছিয়ে পড়েছি দেখে ছুটে ফিরে আসে কাছে। কিছুক্ষণ সঙ্গে চলে, আবার এগিয়ে যায়।
এভাবেই ফিরে আসি, ফেরার সময় নিজেরাই পার হয়ে এলাম, নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ালাম। এসেই স্নান করতে নেমে গেলাম হিমশীতল জলে, মন প্রাণ জুড়িয়ে গেল। দূরে স্থানীয় বাচ্চারা স্নানে মত্ত, ছোট ছোট মাছ গুলো মাঝে মাঝে আকুপ্রেসার দিয়ে যাচ্ছে, তারাও অবগত আজ শরীরে ধকল গেছে। স্নান সেরে খাবার খেতে গেলাম রিসোর্টে, দশ রকম পদ দিয়ে খাবার পরিবেশন হলো। গুন মানেও বেশ ভালো, আর যা খিদে পেয়েছে পাহাড় ভেঙে, প্রয়োজনের অতিরিক্ত খেয়ে ফেললাম। এবার যে ফেরার পালা, পাহাড়, জঙ্গল, নদীকে সাক্ষী রেখে জয়ন্তীকে কথা দিয়ে এলাম পরের বার তোমার সাথে পূর্ণিমাতে রাত্রিবাস।

উজ্জয়িনী-ইন্দোরঃ

মধ্য ভারতের দুই রত্ন 

ডাঃ রুদ্রজিৎ পাল 

কসবা, কলকাতা 

UJ-IND5.jpg

ভ্রমণ

উজ্জয়িনী

রাজওয়াড়া প্রাসাদের সম্মুখভাগ, ছবিঃ লেখক

 এপ্রিল ২০২৩ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

মহাকাল করিডর, উজ্জয়িনী, ছবিঃ লেখক

রামঘাট, শিপ্রা নদী - ছবিঃ লেখক

যন্তরমন্তর, উজ্জয়িনী, ছবিঃ লেখক

গোপনীয়েষু

অপর্ণা চক্রবর্তী

টালিগঞ্জ, কলকাতা 

women.jpg
গোপনীয়েষু
aparnachakroborty.jpg

জ্জয়িনী। প্রাচীন ভারতের এক কিংবদন্তী শহর। চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্যের অন্যতম রাজধানী, মহাকবি কালিদাসের কর্মস্থান। আর এই চন্দ্রগুপ্তের প্রায় ছয়শ বছর আগে সম্রাট অশোকের প্রথম জীবনের কর্মস্থানও ছিল এই উজ্জয়িনী। একদিকে মধ্য ভারতের এক অপরিহার্য বাণিজ্যকেন্দ্র আর অন্যদিকে ভারতহৃদয়ের ধর্মজিজ্ঞাসার উৎসবিন্দু—এই দুই রূপেই উজ্জয়িনী শহর ইতিহাসে প্রতিভাত।
মধ্যপ্রদেশের ব্যস্ত শহর, ইন্দোরের খুব কাছেই অবস্থিত এই উজ্জয়িনী। তির তির করে বয়ে চলা শিপ্রা নদীর তীরে গড়ে উঠেছিল এই জনবসতি। এই নদীর পাশেই রয়েছে একটি অক্স-বো লেক বা অশ্বক্ষুরাকৃতি সরোবর। আর সেই সরোবরের ধারেই রয়েছে মহাকালের মন্দির। মহাকাল অর্থাৎ শিব। ভারতে যে “জ্যোতিলিঙ্গ” নামে বারোটি বিশেষ শিবমন্দির রয়েছে, তাঁর অন্যতম এই মহাকালেশ্বর। গাড়ি থেকে নেমে অজস্র ফুল-প্রসাদ এবং খাবারের দোকান পেরিয়ে তারপর মন্দির। বিশেষ বিশেষ দিন ছাড়া সেরকম লাইন থাকে না; তবে শিবরাত্রির দিন বা শ্রাবণ মাসের সোমবারে অবশ্যই প্রচণ্ড ভিড় হয়। এই মন্দিরের শিবলিঙ্গ দক্ষিণমুখী। 
মন্দিরে ঢোকার নানারকম লাইন রয়েছে। আপনি চাইলে বিনা টিকিটের লাইনে দাঁড়িয়েও ঢুকতে পারেন, কিন্তু তাতে সময় লাগবে অনেক বেশি। আর বিশেষ দর্শনের জন্য রয়েছে দুরকমের টিকিট, ২৫০ টাকা এবং ১৫০০ টাকা। গেটের বাঁদিকেই টিকিট কাউন্টার। ১৫০০ টাকায় যেতে পারবেন একদম গর্ভগৃহ অবধি, চাইলে স্বহস্তে শিবলিঙ্গের দুগ্ধস্নানের অভিজ্ঞতাও লাভ করতে পারবেন। তবে সেখানে যেতে হলে পুরুষদের ধুতি পরে ঢুকতে হবে। আর ২৫০ টাকার লাইনে সাধারণ পোশাক পরেই আপনি যেতে পারবেন শিবলিঙ্গের পনেরো ফুটের মধ্যে। আর সেখানে ২৪ ঘণ্টা লাইভ টিভিতে গর্ভগৃহের পূজাপাঠ সম্প্রচার চলছে। ফলে সেখানেও আপনি স্বচক্ষে দর্শন সেরে নিতেই পারেন। এই মন্দিরে পূজার ফুল হল পদ্ম। আর প্রসাদ হল লাড্ডু আর নকুলদানা। কোনোরকম বিশেষ মন্ত্র বা অঞ্জলির দরকার পড়ে না। পরে বাইরে বেরিয়ে মন্দির কমিটির দোকান থেকে প্রসাদ কিনে নেবেন। দুরকম বাক্স রয়েছে, ৭০ টাকা আর ১৫০ টাকা। আর বিশেষ মূল্যের প্রসাদ তো আছেই। মন্দির চত্বরে শিব ছাড়াও গণেশ, নারায়ণ ইত্যাদি মন্দির রয়েছে। আর মন্দির থেকে বেরোনোর পথেই সম্প্রতি “মহাকাল লোক করিডর” নামে সুন্দর করে সাজানো প্রমোদসরণীর নির্মাণ সম্পূর্ণ হয়েছে। এই অপূর্ব করিডরের ছবি এখানে রইল, কিন্তু এর পূর্ণ রূপ দেখতে হলে আপনাকে সন্ধ্যেবেলায় আসতে হবে। সেটা অবশ্য খুব কষ্টকর কিছু নয়। ইন্দোর থেকে পালিশ করা রাস্তা। দুই শহরের মধ্যে গাড়িতে সময় লাগে এক ঘণ্টার একটু বেশি। সুতরাং ইন্দোর থেকে দুপুরের পর বেরিয়ে বিকেলে মন্দির দর্শন করে মহাকাল করিডরের আলোকসজ্জা দর্শন করে আবার রাতে ইন্দোরে ফিরে আসতেই পারেন। বা উজ্জয়িনীতে রাতে থাকতেও পারেন। 
এই মহাকাল মন্দিরের বাইরের দোকানে কিছু বিরল পসরার সন্ধান পেতে পারেন। যেমন গাছের ডালসুদ্ধ রুদ্রাক্ষ ফল। ইচ্ছে হলে সংগ্রহ করতে পারেন। পাণ্ডার অত্যাচার একদমই নেই। নিজে নিজেই মন্দিরে ঢুকে পুজো দিয়ে দেবেন। আর মন্দির থেকে বেরিয়ে উল্টো দিকেই রয়েছে ভারত মাতার মন্দির। বিশাল সিংহ বাহিনী ভারত মাতা; পাশে বঙ্কিমচন্দ্রের বন্দে মাতরম গানটি লেখা। আর এই দুই মন্দিরের মাঝে রয়েছে বিশাল অতিথি নিবাস। 
এর পর চলে আসুন রামঘাটে। শিপ্রা নদীর ঘাট। সুন্দর করে বাঁধানো। নদীর উপর ছোট্ট সেতু। ওপারে রয়েছে নানারকম রঙ করা স্নানের ঘাটের সিঁড়ি। স্নান করার জায়গা লোহার দণ্ড দিয়ে নির্দিষ্ট করা। নদীর তীরে রয়েছে ছোট ছোট অনেক মন্দির। চারপাশে বসে রয়েছেন জ্যোতিষী, সাধু এবং পণ্ডিতের দল। হরিদ্বারের মত এখানেও নদীতে ভাসিয়ে দেওয়ার জন্য প্রদীপ পাওয়া যায়। আর পাওয়া যায় নদীর জল সংগ্রহ করার জন্য প্লাস্টিকের বোতল। নদীতে বোটিং এর ব্যবস্থা রয়েছে। এই ঘাটের পাশেই রয়েছে কিছু ধর্মশালা। কুম্ভ মেলার সময়ে এই নদীর ঘাটে লক্ষ লক্ষ মানুষের ভিড় উপচে পড়ে। 
এর পরে এই প্রাচীন শহরে রয়েছে আরও কিছু মন্দির। যেমন, চিন্তামন গণেশ মন্দির, ইস্কন মন্দির এবং হরসিদ্ধি মন্দির। এই শেষ মন্দিরটি একটি শক্তিপীঠ। রাত্রে থাকলে এই মন্দিরের বিখ্যাত আরতি দেখতে পাবেন। উজ্জয়িনী ছোট শহর। এই সব মন্দির পায়ে হেঁটেই দেখে নিতে পারেন। আর সাথে গাড়ি থাকলে তো কথাই নেই। উজ্জয়িনীতে হিন্দু মন্দিরের সাথে সাথে কিছু জৈন মন্দিরও রয়েছে। 
ধর্ম তো হল। এবার কিছু বিজ্ঞানের দর্শন হোক। উজ্জয়িনী থেকে বেরোবার মুখেই রয়েছে যন্তর মন্তর, অর্থাৎ, সেই প্রাচীন যুগের নক্ষত্রবিদ্যার ল্যাবরেটরি। সম্রাট যন্ত্র, অর্থাৎ সান ডায়াল তো আছেই। এছাড়া নানা নক্ষত্র এবং গ্রহের অবস্থান নির্ণায়ক নানা স্থাপত্য রয়েছে এখানে, যেমন শঙ্কু যন্ত্র বাঁ দিগাংশ যন্ত্র। প্রবেশমূল্য ১০ টাকা। সুন্দর করে সাজানো বাগান। এছাড়া এর একদিকে রয়েছে একটি আকর্ষণীয় উদ্ভিদ সংগ্রহ। প্রাচীন ভারতীয় পুঁথি অনুযায়ী প্রত্যেক নক্ষত্রের সঙ্গে

নাকি একটি বিশেষ উদ্ভিদের যোগ রয়েছে। সেই নক্ষত্রের নাম এবং তার পাশে সেই গাছ লাগানো। অনেক স্বল্প জানা গাছের সন্ধান পাবেন এখানে; যেমন খয়ের গাছ, বেত গাছ বা মহুয়া গাছ। সব মিলিয়ে উজ্জয়িনী ঘুরে দেখতে এক দিনই যথেষ্ট। তবে আপনি যদি শিপ্রা নদীর তীরে বসে সময় কাটাতে চান, তবে দু-তিন দিনও থাকতে পারেন। অজস্র হোটেল রয়েছে। এখন মেকমাইট্রিপ বা গোআইবিবো থেকে বুক করা খুব সহজ। উজ্জয়িনী বেড়াতে হলে সবথেকে সহজ হল ইন্দোর এসে সেখান থেকে গাড়ি বা বাসে করে যাওয়া। তবে ভোপাল থেকেও বাস রয়েছে। আর কলকাতা থেকে সরাসরি উজ্জয়িনী, ইন্দোর বা ভোপাল যেতে হলে উপায় শিপ্রা এক্সপ্রেস। ইন্দোরে একটি সুন্দর বিমানবন্দর আছে। তবে কলকাতা থেকে সরাসরি বিমান একটিই, সন্ধে ছটায়। 

তাহলে এর পর একটু ইন্দোরের বর্ণনা দেওয়া যাক। ইন্দোর যেমন একদিকে একটি বহু প্রাচীন শহর, তেমন অন্যদিকে আধুনিক সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে উত্তরোত্তর এর অভাবনীয় উন্নতিও হয়ে চলেছে। আপনারা জানেন নিশ্চয়ই যে ইন্দোর হল ভারতের সবথেকে পরিষ্কার শহরের মর্যাদাপ্রাপ্ত। এছাড়াও এই শহরে এলে দেখতে পাবেন যে রাস্তাঘাট বেশ সুন্দর করে সাজানো, প্রায় প্রত্যেক দেওয়ালেই সুন্দর সব ছবি আঁকা। এছাড়া রাস্তার পাশে ফুটপাথে মনোরম সব ডিজাইনের টবে নানা গাছ লাগানো। ফলে এই ছোট্ট শহরের রাস্তাঘাটে এমনি হাঁটলেও বেশ ভালো লাগবে। এখন দ্রুতগতিতে ইন্দোর মেট্রোর কাজ চলছে। ফলে আপনারা যারা পরের বছর এই শহরে যাবেন, তারা হয়ত এই মেট্রো চলতেই দেখবেন। 
এই শহরে রয়েছে ঐতিহাসিক রাজওয়াড়া প্রাসাদ। ইতিহাসের নানা সময়ে এই প্রাসাদ অনেকবার ঝড়-ঝাপটার শিকার হয়েছে। এখন প্রাসাদের সামনের “ফ্যাসাড”টাই শুধু অবশিষ্ট রয়েছে। আর লোহার কীলক দেওয়া প্রায় দোতলা সমান উঁচু কাঠের দরজা। এর পশ্চাতের অংশ প্রায় অনেকটাই নতুন করে বানানো। তবে সেখানে কাঠের বা পাথরের পিলার দেওয়া অংশগুলি দেখতে বেশ সুন্দর। একটি সুন্দর মিউজিয়াম রয়েছে এর ভেতরে। প্রবেশমূল্য মাত্র ১০ টাকা। মূলত হোলকার রাজপরিবারের নানা সদস্যের পরিচয়, রাজপরিবারের ব্যবহার্য তৈজসপত্র এবং অনেক ছবি রয়েছে। কয়েকটি ছবি বিশেষ করে নজর কাড়েঃ সেগুলি হল প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এই রাজপরিবারের অংশগ্রহণের ছবি। ফ্রান্সের রণাঙ্গনে ভারতীয় ফৌজের যুদ্ধ করার ছবি দেখে আপনার গায়ে কাঁটা দিতে বাধ্য। এই প্রাসাদের চারপাশে রয়েছে বিখ্যাত রাণী অহল্যাবাই হোলকারের প্রতিষ্ঠা করা নানা সুন্দর মন্দির। মন্দির ঘিরে কাঠের থামের দালান, তাঁর গায়ে কাঠের ওপর কাজ করা জানালা। 
এর পর চলে আসুন কাঁচ মন্দিরে। একদম পায়ে হাঁটা পথ। এটি একটি জৈন মন্দির। মেঝে, দেওয়াল, সিলিং--- সমস্ত কাঁচের। সত্যিই দেখার মত কাজ। তিন প্রধান জৈন তীর্থঙ্করের মূর্তি রয়েছে এখানে। যখন বিকালে মন্দিরের ভেতরে নানা রঙের আলো জ্বলে ওঠে, তখন সেই আলো ছোট ছোট কাঁচের টুকরোর গায়ে প্রতিফলিত হয়ে এক মায়াবী পরিবেশের সৃষ্টি করে। মন্দিরের ভেতরে রাখা রূপোর বিশাল পালকি দেখতে ভুলবেন না। এছাড়াও ইন্দোরে রয়েছে আরও অনেক মন্দির, যেমন অন্নপূর্ণা মন্দির, বড় গণপতি মন্দির এবং খাজরানা গণেশ মন্দির।
এবার দেবতার পূজার পর, আসুন পেটপুজায়! ইন্দোরে সরকার থেকে সমস্ত স্ট্রীট ফুড একসাথে করে এক জায়গায় একটি বাজার বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। একে বলে ছাপ্পান্ন বাজার। ছাপ্পান্ন না হলেও অনেকগুলি দোকান রয়েছে এখানে। এইখানেই মুখে পুরে দিন ইন্দোরের নানা বিখ্যাত খাবার। কয়েকটি নাম বলে দিই এখানে। ভুট্টা কী কীস, অর্থাৎ ভুট্টা সেদ্ধ করে, ঘীতে ভেজে তার সাথে নানা মশলা দিয়ে চাট বানানো।  সাবুদানার বড়া এবং সাবুদানার খিচুড়ি। আর মিষ্টির মধ্যে রয়েছে গজক, অর্থাৎ তিলের পাটালি। এর সাথেই রয়েছে নানারকম পেঁড়া। এইসব একটু একটু করে খেলেই সে রাতের মত আপনার পেট টইটম্বুর!! সব শেষে খাবেন এখানকার বিখ্যাত কুলফি। 
হাতে সময় থাকলে ইন্দোর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে পাতালপানি জলপ্রপাত দেখে আসুন। শান্ত পরিবেশ। একটি ছোট নদী ঝাঁপ দিয়েছে ৩০০ ফুট গভীর খাদে। চারপাশের পরিবেশ মন জুড়িয়ে দেবে। বর্ষার সময়ে নদী খরস্রোতা। কিন্তু অন্য সময়ে একদম কম জল থাকে। পায়ে হেঁটে নদী পেরিয়ে ওপর দিকের গাছপালার মধ্যে ঘুরে বেড়াতে পারেন। যারা পাখির ছবি তোলেন, তারা অনেক রকম পাখির সন্ধান পাবেন এখানে। তবে এই নদীর পাড়ে রয়েছে নানা কাঁটাগাছ। তাই একটু সাবধানে হাঁটতে হবে। 
এভাবে হাতে দুতিনদিন থাকলে মধ্য ভারতের এই দুই ছোট শহরে ছুটি কাটিয়ে আসতেই পারেন। যদি বিশেষ তিথিতে বিশেষ মন্দিরে যাওয়ার পরিকল্পনা থাকে, তাহলে তো অন্য কথা। নইলে এই দুই শহরে ডিসেম্বর মাসে গেলেই সবথেকে ভালো। 

 

UJ-IND1.jpg
Uj-IND4.jpg
UJ-IND3.jpg
UJ-IND2.jpg

পাতালপানি জলপ্রপাত, ছবিঃ লেখক

প্রবন্ধ

 এপ্রিল ২০২৩ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

==========================
"
দেখা না দিলে বন্ধু, কথা কইও না..."  
==========================
শহরে কোথাও চলমান সিঁড়িতে পা দেওয়ার আগে আমাকে এখনও ভাবতে হয় ডান পা আগে দেব, না বাঁ পা। বড় কোনো ক্রসিং পার হবার সময়, কারও হাতের মুঠোর আশ্রয় খোঁজে মন। শপিং মলের চাকচিক্য দেখলে দিশাহারা লাগে। শহুরে অভ্যাসে আ
মি এখনও সপ্রতিভ নই। কিন্তু, অনায়াসে বলে দিতে পারি- ময়দানের কোন জারুল গাছটার একটা শাখা খুব নীচু। যেখানে গিয়ে দাঁড়ালে অনায়াসে ফুলের গালে আঙুল ছোঁয়ানো যায়। বলে দিতে পারি - দক্ষিণ কলকাতায় কোথায় কোথায় পলাশ ফোটে, কোথায় স্বর্ণচাঁপা। আলিপুরে কোথায় কুর্চি ফুলের গাছ আছে।
যাদবপুরে যেখানে একটা বাগানবিলাস গাছ, সারা গায়ে থোকা থোকা ম্যাজেন্টা ফুল নিয়ে হামলে পড়েছে বাসস্ট্যান্ডের ওপর, আমি প্রতিদিন তার পাশের চায়ের দোকান থেকে আপনার সাথে চা খাই। জানি আপনি নেই; এই শহরের কোথাও আপনি নেই। কিন্তু ওই চায়ের ভাঁড়ে মাটির গন্ধে আপনার উপস্থিতি লেগে থাকে। আপনিই আমার সেই মাটির কবি।
এই গন্ধ আমাকে নিয়ে যায় সেইখানে, যেখানে - যেতে হলে কলকাতা থেকে পাড়ি দিতে হয় এমন কোন জায়গায়, যার হদিস গুগল ম্যাপে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। যেখানে দুপাশে তালগাছের সারিকে সঙ্গী করে মেঠো পথটি বহুদূর আনমনে কোথাও বিবাগী হয়েছে। সেই মোরাম পথের পাশে বাঁশ বাগানের নীচে ছোট একটা চায়ের দোকান। বাঁশগাছ সারাদিন দোকানের গায়ে রোদ্দুর দিয়ে কাটাকুটি খেলে। ঝিরিঝিরি আলোছায়ার নীচে অলস বসে থাকেন গ্রাম্য দোকানী। খরিদ্দার এলে বাড়ির মানুষের মতো আতিথ্য করেন। বাঁশের মাচায় চাটাই পেতে বসতে দেন। দ্রুত হাতে পাম্প স্টোভে চায়ের কেটলি চাপিয়ে দেন। 
দোকানের বেড়ায় ঝুলে থাকে একখানা ডিমের ঝুড়ি। তাকের ওপর আধময়লা কৌটোয় সস্তা বিস্কুট, পাউরুটি, চালকুমড়োর মোরোব্বা ঠাসা কেক। এমন একটা দোকানের চায়ের ভাঁড়ে ঠিক এমনি মাটির স্বাদ, যেমনটা এই যাদবপুরের দোকানে।
চা শেষ করে - মনগড়া অলীক কথপোকথনের সঙ্গে একলা ফিরতে হয় রোজ। শহরে বৃষ্টি নামে। বৃষ্টির গন্ধ মিশে যায় ধুলো ধোঁয়ায়, হাইরাইজের গায়ে। ইমন রাগের সময় ঘনিয়ে আসে কলকাতায়। আমার কল্পনায় ভাসতে থাকে আপনার বলা "সাবধানে যেও" -শব্দ দুটো।
ফিরতি পথের বাসে উঠতে হয়। বাসের জানলায় ঝাঁপিয়ে পড়ে বৃষ্টি। কাঁচের গায়ে বাষ্পের আঁকিবুঁকিতে আপনার নাম লিখতে ইচ্ছে হয় খুব। বাইরে প্রবল ট্রাফিক জ্যাম। স্বার্থপরের মতো আমার সেটাও ভালো লাগে। বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে হয় না। আমার পাড়ার অনেক আগে বাস থমকে যায়। আজকের এই ট্রাফিক জ্যামের মতো, আপনার সমস্ত ব্যস্ততা শুধু আমার জন্য থমকে যায় না কেন কবি?

=======================
"
মার মনের মোহের মাধুরী, 
মাখিয়া রাখিয়া দিও
তোমার অঙ্গসৌরভে।"
=======================
অপ্রাপ্তির কষ্ট জমিয়ে মেঘ হয়ে যেতে ইচ্ছে হয়। তারপর জমতে জমতে অভিমানের বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়তে ইচ্ছে হয় আপনার বারান্দায়, আপনার জানলায়, আপনার মানিপ্ল্যান্টের নরম সবুজ পাতার ওপর। সবুজ দেখলেই এখন শুধু আপনাকেই মনে পড়ে। সবুজ রঙের একটা আলাদা গন্ধ থাকে, বুকের বাঁ পাশে আমি তাই সবুজ পুষে রাখি। সেই পোষ্য কখনও পাখী, কখনও মাঠ ভর্তি বীজতলা ধান, আবার কখনও সবুজ রঙা তাঁতের শাড়ি হয়ে যায় আমার স্বপ্নে। 
একটা সময় ছিল যখন আমি একা থাকার অনেক আনুষ্ঠানিকতা তৈরি করেছিলাম। পরে বুঝেছি সংসারে থেকে ঢাক ঢোল পিটিয়ে একা হওয়া অসম্ভব এবং মূর্খামীও বটে। তাই এভাবেই কাল্পনিক চিঠি লিখে আপনার সাথে আমার একলা যাপন। যে রাতে আপনি স্বপ্নে আসেন- আমার নির্জনতায়, আমার একাকীত্বে, আমার নিঃসঙ্গতায় সবুজ রঙের ছিটে লাগে। 
সেদিন আমার ঘুম ভাঙে দেরীতে। জানলার বাইরের আকাশে আমার উদাসী চোখ। আকাশের গায়ে থোকা থোকা কুর্চি ফুলের মত আলস্য লেগে আছে যেন। বিছানায় নয় আমি বোধহয় শুয়ে আছি আলতো সবুজ ঘাসে। সবুজের বোধ আমার স্বপ্ন থেকে ক্রমাগত বাস্তবকে আচ্ছন্ন করে দেয়।
বড় কম সময়ের এই প্রেমময় জীবন। নিজের পাশে বসে থাকতে থাকতে বাদবাকি চার আনা সময় কখন যে ফুরিয়ে যাবে জানি না। তার আগে আরেকবার আকন্ঠ বেঁচে নেব প্রেমে। সবুজের মাঝখানে আপনার পাশে বসে থাকার আকাঙ্ক্ষা অপূর্ণই রাখবো চিরকাল। পেয়ে যাওয়ার হাততালিতে বেঁচে থাকার আনন্দ আমি খুঁজে পাইনি কখনও। পেতে চাইনা আর কোনোকিছুই।
একাকীত্ব আর অপ্রাপ্তির ওপারে - আমার ওই আকাশটা আপার শূন্যতায় যেন- আরও গাঢ় নীল হয় কবি।

=====================

"মি বহু বাসনায় প্রাণপণে চাই,

বঞ্চিত করে বাঁচালে মোরে।"

=====================

হ্যালো, হ্যাঁ বেরিয়েছি। 

••••••••

নানা, সাতসকালে অনেক গুলো কাজ সেরে, তারপর বেরোতে হল। দুপুরে বাইরে কিছু খেয়ে নেব, চিন্তা কোরো না।

••••••••

উফ্, এত বাজে বকতেও পারো তুমি, সত্যি! নিজে খেয়ে বেরিয়েছো তো?

••••••••

হুঁ, আচ্ছা। হ্যাঁ, আসব তো। পরশু বিকেলে দেখা হচ্ছে।

••••••••
মনে আছে মশাই, মনে আছে। 
••••••••
হুঁ, ওটাই পরে আসব। 

••••••••
আচ্ছা তুমি কি বলোতো! নিজের জন্মদিনে আমাকে নতুন শাড়ি পরতে বলছো! 
••••••••
আচ্ছা আচ্ছা, বুঝলাম। অফিসে বসে, লোকজন জানিয়ে আর প্রেমিক সাজতে হবে না। কাজ করো। রাখছি আমি। বিকেলে কথা হবে।

বেশ কিছুক্ষণ কথপোকথনের পর, ফোন রেখে আনমনে চেয়ে থাকি কাঁচের বাইরে শীত-রোদের দিকে। ট্যাক্সি গোলপার্ক ছাড়িয়ে ছুটছে। রিয়ার-ভিউ-মিরর থেকে মাঝেমধ্যেই আমার দিকে ঠিকরে আসছে ড্রাইভারের সন্দিগ্ধ নজর। আড়চোখে আমাকে লক্ষ্য করছে। পড়ে ফেলতে চেষ্টা করছে একজন প্রেমিকার মুখ, তার চোখের ভাষা। ট্যাক্সিতে ওঠার পর থেকে, ঠিক এইটাই আমি চাইছিলাম। চাইছিলাম - অচেনা ড্রাইভার আমাকে দেখুক। আমার কথা গুলো কান পেতে শুনুক।

আমি একজনকে অষ্টপ্রহর বুকের ভেতর আগলে নিয়ে ঘুরে বেরাচ্ছি- অথচ পৃথিবীতে কেউ সেকথা জানতে পারছে না। এ যে কী ভীষণ দমবন্ধ করা আদর! আমি প্রতি মুহূর্তে পুড়ে যাচ্ছি তার আঁচে। একটা সময় আসে, যখন পুড়তে পুড়তে - আমি চিৎকার করতে চাই, জানাতে চাই আপনার কথা। আমি বোঝাতে চাই আপনার অস্তিত্ব। আপনি আছেন, সবসময় আছেন আমার সাথে। কেউ তো জানুক!!

অপরিচিত ট্যাক্সি ড্রাইভারের সাথে আমার নিজেরই বানানো খেলায় আমি জিতে যেতে থাকি। তাকে বোঝাতে থাকি, কেউ আছে, আমার ফোনের ওপাশে কেউ একজন আছে...

কথোপকথন কখনও কখনও আরও দীর্ঘায়িত হয়। এক তরফা,একটানা,একা একাই। না, ফোনের ওপাশে কেউ নেই কবি। কেউ কখনও সঙ্গে থাকে না। কারণ- কথা শুরু করার আগেই মোবাইল এয়ারপ্লেন মোডে রেখে সব নেটওয়ার্ক - সমস্ত যোগাযোগ আমি বন্ধ করে দিই। তারপর একটা প্রাইভেট ট্যাক্সিতে উঠে, আপনার সাথে অলীক কথপোকথনে সওয়ার হয়ে, ভাসতে থাকি কোলকাতায়। দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকে - আপনার সাথে আমার এমন কাল্পনিক ফোনালাপ। সাক্ষী থাকে অচেনা ট্যাক্সি ড্রাইভার। অদ্ভুত একটা খেলা না! অদ্ভুতই বটে! এমন অদ্ভুত কিছুই চেয়েছি আজীবন।

গোলপার্ক, বালিগঞ্জ, কসবা, তিলজলা, বিধাননগর, বেলেঘাটা পার করে, ট্যাক্সি ঘুরে যায় ডানদিকে। সল্টলেকের কোনো একটা রাস্তায়। শান্ত নিরিবিলি পাড়ায়। দুএকটা প্রাইভেট অফিস, গাছপালা ঝুঁকে পড়া ছায়া ছায়া রাস্তা। এখানে ট্যাক্সি ছেড়ে দিই আমি। হাঁটতে থাকি নিজের ছায়ার পাশে। হাঁটতে থাকি একা। হাঁটতে থাকি এলোমেলো, সামনের দিকে। ইয়ারফোনে একটানা বাজতে থাকে আমার পছন্দের অদ্ভুত প্লে-লিস্ট-

"সারাদিন আঁখি মেলে দুয়ারে‌ রব একা,

শুভক্ষণ হঠাৎ এলে তখনই পাব দেখা।"

দেখা পাব কিনা জানিনা। কাকে দেখতে চাই, তাও এখন আর বুঝতে পারি না। শুধু জানি 'পথ চাওয়াতেই আনন্দ'। হাঁটতে হাঁটতে- গান বদলে যায়।

"I walk a lonely road

The only one that I have ever known

Don't know where it goes

But it's only me, and I walk alone"

রাস্তার পাশে একটা ল্যাম্পপোস্ট আমার মতোই একা দাঁড়িয়ে আছে। সেখানে দাঁড়াই কিছুক্ষণ। ঠিক উল্টো দিকে একটা কাঠ বাদাম গাছ, বাদামী রঙের পাতায় আলতো আড়াল করে রেখেছে - সুন্দর বাড়িটার ঝুল বারান্দা-কে। ল্যাম্পপোস্টের সাথে বারান্দার সম্পর্কের কথা, শুধুমাত্র একজন প্রেমিক জানে। হয়তো সেই প্রেমিক এখনও প্রতিদিন সন্ধ্যায় এই ল্যাম্পপোস্টের আলোর নীচ একা এসে দাঁড়ায় কিছুক্ষণ। তারপর আঘাত লগ্নে ভেঙে যাওয়া স্বপ্নের সাথে পা মিলিয়ে, হেঁটে যায় এই সরনী ধরে। ফাঁকা বারান্দা তখন আড়ালে চোখ মোছে ওই প্রেমিকের গায়ে ঠিকরে পড়া ল্যামপোস্টের আলোর জন্য।

আমার ইয়ারফোনে তখনও বাজছে -

"I walk this empty street

On the Boulevard of Broken Dreams

Where the city sleeps

And I'm the only one, and I walk alone"

আমাকেও হেঁটে যেতে হবে আরও কিছুটা। আরও কিছুটা এলোমেলো হাঁটা বাকি আমার। গানটা এক্ষুনি শেষ হবে। আমি জানি আমার এই অদ্ভুত প্লে-লিস্টে এরপর কি গান বাজবে। সেই গানটা শুরু হবার আগে আমাকে পৌঁছে যেতে হবে খানিকটা দূরে, ওই করঞ্জা গাছের আলোছায়ার নীচে।

স্মৃতির শাল গায়ে, মুহূর্তের মাফলার জড়িয়ে, বেদনার বলিরেখা নিয়ে- ওখানেই বসে আছে শীতকাল। বিষন্ন, একা, পাতা ঝরা- একটা শীতকাল। অপেক্ষা করছে আমার জন্য। আমার একার আস্ত একটা শীতকাল পেয়ে যাব ওখানে পৌঁছলেই। ঠিক ওই করঞ্জা গাছটার নীচে।

ইয়ারফোনে পরের গানটা শুরু হওয়ার আগে আমাকে পৌঁছে যেতে হবে ওর কাছে। তারপর, ওর পাশে বসে শুনবো - অমোঘ অত্যাশ্চর্য কটা লাইন---

"না চাহিতে মোরে যা করেছ দান-

আকাশ আলোক তনু মন প্রাণ

দিনে দিনে তুমি নিতেছ আমায়

সে মহা দানেরই যোগ্য ক'রে"

ভাগ্যিস আমি বঞ্চিত। সেই জন্যই এই ব্যথার অনুরণনটুকু সম্বল করে হাঁটতে শিখেছি-- বিষন্ন শীতকালের দিকে। ওকে পেয়ে গেলেই, আপনার কথা বলার জন্য প্রতিবার আর কোনো ট্যাক্সি ড্রাইভারের প্রয়োজন হবে না।

শীতের একটা নিজস্ব বিষাদ থাকে, অথবা বিষাদের একটা একান্ত শীতকাল।

আপনি বুঝতে পারেন তো কবি?

মতামত

Please mention the "name of the article and the author" you would like to comment in the following box... Thank you.

 এপ্রিল ২০২৩ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

bottom of page