
প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা

পুজো বার্ষিকী
১৪২৯

‘ও দাদা দুটো টাকা দ্যাও না, বড্ড খিদে নেগেছে’ – জামার পিছন থেকে একটা ছোট্ট টান। ধুলো ময়লা মাখা, শীর্ণ হাতের ছোঁয়া।
বেহালা সখেরবাজার মোড়। সকালের দিকে প্রাত্যহিক যানজটে শহর কলকাতা আর র্যাট রেসে অভ্যস্ত শহরবাসী। গলির মুখে বাস স্ট্যান্ডের কাছে বেশ ভিড়। কি একটা কাজে গিয়েছিলাম, অতটা মনে নেই। পিছন ফিরে দেখি বছর সাত আটেকের একটা ছেলে। তখনও ওর শুকনো মুখে ভোরের প্রত্যাশার আলো লেগে।
- ‘কেন, কিছু খাস নি?’
- ‘খেয়েছি... সে তো কোন সক্কালে’
- ‘তাহলে, চাইছিস কেন? কি খেয়েছিস সকালে?’
- ‘বিস্কুট’
এভাবেই আমাদের কথাবার্তা শুরু। নতুন কোন ঘটনা নয়। পথেঘাটে কোন না কোন সময়ে এর সম্মুখীন আমাদের সবাইকেই হতে হয়। হাতে কাঁচা পয়সা দেওয়ার পক্ষপাতী আমি নই, টাকা পয়সার একটা অন্যদিক আছে, খিদে কমিয়ে দিতে পারে। ছেলেটা সামনে একটা হাত পেতে কাঁচুমাচু মুখে মাথা চুলকোতে লাগল। ওর দেখাদেখি আর একটা কখন যে এসে হাজির খেয়াল করিনি। তবে এটা বয়েসে একটু ছোট, হাঁ করে আমাদের কথা গিলছে।
‘দ্যাও না কিছু’ - মুখটা ব্যাজার করে আবার বলে উঠল। অন্যদিকে তাকালাম। ভাবলাম চলে যাবে। মনে মনে ভাবলাম, আরে যা না, এখনও দাঁড়িয়ে! অবজ্ঞাও বোঝে না!
‘ও দাদা, দ্যাও না’ – এ তো বড্ড নাছোড়বান্দা! এবার একটু বিরক্ত হয়ে বললাম – ‘সত্যিই খিদে, না তোর অন্য কোন ধান্দা আছে?’ আর এত লোক থাকতে - আর আমাকেই বা কেন বাবা! বিরক্তিকর!
- ‘বললুম তো! খিদে পেয়েছে। কতবার বলব বল দিকি? –
একটু ঝাঁঝিয়ে উঠে বিরক্তি উগড়ে দিল। কাঁচা বয়স, বুঝবে কি, যে সামর্থ্য না থাকলে কিছু পেতে এই সমাজে একটু ‘কুই কুই’ করতে হয়। সচ্ছল, সামর্থ্য লোকেরাই করে স্বার্থের জন্য, আর এরা তো কোন ছাড়! এটাই নিয়ম, পেটে ভাত থাকলে তবেই মেরুদণ্ড সোজা। আমার খুব একটা তাড়া নেই, তবে বাসটা চলে এলে দুম করে উঠে পালিয়ে যেতে পারতাম, এই যা। সেটা মনে হয় আজ আর হচ্ছে না।
কিছুটা বাধ্য হয়েই বললাম – ‘না ভাই, তোদের পয়সা দিচ্ছি না। খিদে পেলে চল আমার সঙ্গে।’ দুজনেই একটু চুপ মেরে গেল। বোধহয় আশা করে নি। ভেবেছিল দু-একটা টাকা গুঁজে দেব ওদের হাতে। কিন্তু তা আর হল না। তবে কোটরের ভিতর থেকেই ওদের চোখগুলো দপ করে জ্বলে উঠল মনে হল। অবজ্ঞা, তাচ্ছিল্য যাদের নিত্য দিনের সঙ্গী, তাদের চোখের ভাষায় বিশ্বাস স্থান পায় না। প্রতি মুহূর্তেই এই বাপে খেদানো বিপিনের দল আমাদের এই ভদ্রসমাজকে বিশ্বাস করতে ভয় পায়। একটু চুপ করে থেকে ঘাড় নেড়ে বলল – ‘চলো তাহলে’। পাশের ছোটটা আমাদের সঙ্গ নিতেই, তাকে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বড়টার এক ধমক –
‘তুই আসছিস কেন, আমি কি তোকে ডেকেছি?’ সমস্যা গভীরে। এখানেও অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই, ভয়। আমিত্ব অমৃত-সমান। বাঁচিয়ে রাখার লড়াই সমাজের প্রতিটি স্তরেই। আড়ালে আবডালে এর গতি প্রবাহমান। কচিটাও দমবার পাত্র নয়। টিকে থাকার লড়াইতে গলা উঁচু করে বাঁচতে হয়। গালাগাল দিয়ে বলে উঠল – ‘আমি এয়েচি তো তোর বাপের কি?’
দু-পা হেঁটে সখেরবাজারের দিকে যেতে বাঁ দিকে একটা ছোট্ট দোকান। সামনে বিশাল লোহার তাওয়া। নিচে গনগনে কয়লার আঁচ। বড্ড লাল, চোখে ধাঁধাঁ লাগে। গরম গরম পরোটার গন্ধে ছোট্ট দোকানটা ভরপুর। পাশে বিশাল একটা ডেকচিতে লাল টকটকে আলুর দম। দোকানের পাশে একটা ভাঙ্গা বেড়ার পাশে একটা সাইকেল কাত করা, নিচে একটা কুকুর কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে, একটু ঘুম কাতুরে মনে হল।
- কি নাম তোর? বসে গেলাম ওদের সঙ্গে। ছোট্ট স্টিলের থালায় আমার জন্য এল হালকা পেটানো, ফিনফিনে, রূপসী পরোটা আর সঙ্গে বাটিতে লালচে আলুর দম।
- ‘পরেশ’। সবে পরোটা-টা ছিঁড়ে গালে পুরতে যাবে, থামিয়ে বলে উঠলাম– 'যা হাত ধুয়ে নে। দেখ... হাতে তো সব নোংরা লেগে রয়েছে’। অনিচ্ছা সহকারেই উঠল।
- ‘আর তোর’ – ছোটটা আমার ডানদিকে বসে। মুখখানা মিষ্টি। গাল দুটো ফোলা ফোলা, ঢল ঢল চোখ, এখনও শৈশবের আদল চিবুক ছুঁয়ে।
- 'ভুটে’
- 'ভুটে!!! ভুটে কারোর নাম হয় নাকি?' আমি তো অবাক।
- 'হয় তো, আমারই নাম তো ভুটে।‘ বল পড়তে না পড়তেই ছক্কা।
- 'স্কুলে যাস না?'
- 'না।'
- 'কেন?'
কোন উত্তর নেই। ঠক ঠক করে কাচের গ্লাসে চামচ নাড়ার শব্দ। গরম আগুনের আঁচ খেতে খেতে চায়ের জল নাচছে, তাতে বড় কয়েক চামচ দুধ পড়ল। এবার দুধ জলে মিশে একটা বড় সড় জলতরঙ্গের প্রস্তুতি। যার ফলশ্রতু চায়ের জলে উথলে পড়া বান, যা সামলাতে দোকানীর শকুনি দৃষ্টি।
বাচ্চা দুটোর কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। ছোট ছোট শীর্ণ আঙ্গুলের ফাঁকে হালকা পরোটা আর আলুর ঝোলের পিরিত চলছে। আলু চেটে পুটে খাচ্ছে, নিভছে আর একটা অদৃশ্য গনগনে আগুন। পিছনের দিকে মাথা গুঁজে চুপচাপ এঁটো বাসন মেজে চলেছে ওদের মতই আর একজন। জল বাঁচিয়ে, অল্প জলেই। নোংরা একটা তোয়ালেতে ফাইনাল টাচ।
- ‘স্কুল যাস না, সারাদিন ঘুরে বেড়াস, বাড়িতে কিছু বলে না’।
ফিক করে হাসির শব্দ। তার সঙ্গে সঙ্গে তাল মিলিয়ে একটা চাঁটির।
- ‘এই তুই যেতিস না, তোকে তো শম্ভুদা ভরতি করে দেছিল, তুই তো পাইলে এলি’ বলেই ভুটেকে পরেশের একটা চাটি।
- ‘তুইও তো যাস নি, আমারে বলছিস’ – গালাগালটা এসে গিয়েছিল একদম জিভের ডগায়, আমার দিকে তাকিয়ে ঢক করে গিলে নিল। রাগে গজ গজ করতে করতে মাথায় চাঁটির জায়গায় কয়েকবার হাত বুলিয়েই মুখে পুরে দিল পাতের একটা মস্ত আলু। ছোট্ট স্বচ্ছ গ্লাসে গরম চায়ের আলতো হাতছানি, যা উপেক্ষা করার সাধ্যি আমার নেই। ইশারা করতেই দোকানী বলল ‘একটু বসুন, দিচ্ছি .. এই চা ফুটতেছে’। এরই মাঝে বাইরে হঠাৎ সোরগোল। দুটি সারমেয়র এলাকা দখলের লড়াই। যেমন হয় আর কি, মানুষ পশুতে এখন তো আর কোন তফাত চোখে পড়ে না। সর্বত্রই লড়াই। একেবারে পাড়া মাথায় করে তোলে। তারই মধ্যে গলা তুলে দোকানীর শাসানি কাজের ছেলেটিকে - ‘কি রে এত দেরী হচ্ছে কেন, টেবিলের প্লেটগুলো কে তুলবে, তোর.....।‘ একবার মুখ তুলে আবার কাজে লেগে পড়ল ছেলেটি। কথাটা গায়ে মাখল বলে তো মনে হল না। অস্তিত্ব রক্ষার এই মহাকবজটিকে এই সামান্য বয়সেই বেশ ভালই রপ্ত করে নিয়েছে। আর না করেই বা উপায় কি। তবে মানতে হল, আজও ওর কাছে আমি শিক্ষার্থী।
চা-টা বেশ ভাল। ওপরে ভাসা ভাসা সর। স্বাদ আছে। রূপটা আরো খুলত যদি একটা ভাঁড় জুটত। ওদিকে ছেলেদুটোরও তো প্রায় খাওয়া শেষ।
পরেশকে বললাম – ‘তোর বাড়িতে কে কে আছে রে?’ এঁটো হাতে একটুকরো আলু লেগে, সেটা যথাস্থানে চালান করে বলে উঠল – - ‘মা, বোন,.’ .
- আর বাবা?
- আছে... একটু দায়সারা গোছের উত্তর।
- সে না হয় আছে, কিন্তু করে কি?
- জোগাড়ের কাজ... রোজ তো করে না। তাই তো মা তো রেগে যায়।’ চটপট উত্তর।
তারপর চুপ। আমার ডান পাশে ভুটে, ঝোলের ঝালে নাক টানছে আর আমাদের কথা গিলছে। ইশারায় ওকে বলি – আর তোর?
উত্তর দিল না। একবার তাকিয়ে জার থেকে গ্লাসে জল ঢালতে লাগল।
- ‘ওর তো কেউ নেই।’ ভুটের হয়ে জবাবটা পরেশই দিয়ে দিল।
- তার মানে, কেউ নেই মানে!
- নেই মানে নেই।’ পরেশের কাটাকাটা জবাব। তারপর চুপ।
মনে নানা প্রশ্নের জট। আরে বলে কি ছেলেটা! নেই।। নেই বললেই হল... এইটুকু বাচ্চা ছেলে, এখনও চিবুক ছুঁয়ে সারল্য, একা তো আর থাকতে পারে না, কারোর না কারোর সঙ্গে তো থাকে। ভুটের কোন ভ্রূক্ষেপ নেই, নিষ্পাপ মিষ্টি মুখটাতে সামান্য হলেও একটু পরিতৃপ্তির ছোঁয়া, ছোট্ট শরীরে ভিতরের আগুনটার সাময়িক পরিসমাপ্তি ঘটেছে যে!
তবে কি... ধুর।। যত্ত সব বাজে চিন্তা। আর ওর কে আছে না আছে তাতে আমারই বা কি এসে গেল।
সবে উঠতে যাব, হঠাৎ ভুটে বলে উঠল -
‘দাদা, তুমি হুই বড় বড় আপিসে কাজ কর তাই না? অনেক পয়সা পাও?’। একটু ক্যাড়ক্যাড়ে গলা, অনেক দূর থেকে শোনা যায়। ভুটের চোখ উজ্জ্বল। আমার উত্তরের অপেক্ষায়, আমার চোখে চোখ।
- ‘কেন রে’ – একটু অবাক হলাম। ওদিকে দোকানির ফিঁক করে দেঁতো হাসি।
- ‘এমনি।’ - মনের কথাটা আর ভাঙল না।
পরেশের দাদাগিরি। খেঁকিয়ে বলে উঠল – ‘এ রকম বলতি আছে? ভদ্রনোকের সঙ্গে কথা বলতে শিখিস নি’।
আড় চোখে দোকানী সবই দেখছে, শুনছে। চোখে চোখ পড়তেই হেসে বলে উঠল – ‘দাদা, এদের বেশী নাই দেবেন না, মাথায় চড়ে বসবে, সব মুক্ষু সুক্ষু মানুষ, কথা বলতি জানে না’।
হেসে ভুটেকে বলি – ‘আমি বড় অফিসে কাজ করি, আর নাই বা করি, তাতে তোর কি?’। আর একটু দার্শনিকের মত বললাম – ‘তুইও যদি স্কুলে যাস, ঠিকঠাক পড়াশোনা করিস, তাহলে তুইও চাকরী করবি, পয়সা পাবি’। কতটা বুঝলো জানি না। তবে আমার দিকে একবার তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিল।
পরশের ধমক খেয়ে ভুটে নিঃশ্চুপ। দুটো পরোটা আর আলুর ঝোলের মূল্য ওর কাছে অনেক। এই জটিল সমীকরণটা হয়ত ওর ঐ ছোট্ট মনে জেগে উঠেছে। এই বয়েসেই জীবনের অর্থ প্রতি-নিয়তই, প্রতিদিনই বুঝছে চড়া দামে। তবে সবই কি আর বোঝা যায়। বুঝতেও তো একটা বয়স লাগে। জ্বলন্ত খিদে কাউকে বেয়াত করে না। আগুনে সব পোড়ে। পেটের মোচড় বুকে এসে লাগে। আর কিছু বুঝুক না বুঝুক এই চরম সত্যটা বুঝেছে হাড়েহাড়ে, যার কোন বয়স-ধর্ম লাগে না।
সবাই চুপ। আড়চোখে ওদের দেখছি, আর ওরাও আমায়। ভাবছে, কে এই লোকটা, উপযাজক হয়ে, গায়ে পড়ে পড়ে গল্প করছে। পরেশের মধ্যে একটু উঠি উঠি ভাব। একটা পা সমানে দুলিয়ে চলেছে। একটু অস্থির মতির। শুধু বলার অপেক্ষায়, বললেই পালাবে।
বললাম – ‘কি রে পরেশ, তুই তোর দিদিকে ছাড়াই খেয়ে নিলি যে’। একটু অবাক চোখে ও বলে উঠলো – ‘ও তো বাড়িতে।’ পরক্ষণেই ঝাঁঝিয়েই উঠল - ‘ও যে আমারে দেয় না মাঝে মাঝে, পুরোটাই তো খেয়ে ল্যায়। কারোরেই তো দেয় না।’
‘সে যতই হোক, তোর দিদি তো! ওকে ছাড়াই...তুই... এটা ঠিক করলি?’ – ইচ্ছে করেই বললাম। দেখি না কি বলে। অবশ্য না বললেও চলত। খবরদারী করা আমাদের রক্তে। ওৎ পেতে বসি শুধু সুযোগের অপেক্ষায়। ওর ঝাঁঝটা নিভে গেল দ্রুত। মুখ ভার করে নিচের দিকে তাকিয়ে রইল। একবার আড় চোখে আমায় দেখল। একেই বলে রক্তের টান। হয়ত দিদির কথায় বুকের ভিতর কিছু একটা চলছে যা আমার সামনে লুকিয়ে রাখা খুব জরুরী।
পয়সা মিটিয়ে রাস্তায়। ভাবলাম দুটোই দৌড় মারবে। আমরা যেমন মারি, কাজ মিটলেই ধাঁ। এই র্যাট রেসের দুনিয়ায় স্বার্থের বাইরে এক মুহুর্তও না। চলতে নেই। স্মার্টনেসের আপডেটেড সংজ্ঞা এটাই। বোকারাই পরের কথা ভাবে, খোঁজ নেয়। দু-পা হেঁটে পরেশ দাঁড়ায়। ফিরে এসে পকেট হাতড়ায়। ওর ঐ নোংরা ছোট্ট পকেটে যে কি গুপ্তধন লুকিয়ে থাকতে পারে তা না দেখে আমিও নড়ছি না। আমায় দেখে থমকে গেল, একটু ইতঃস্ততভাব। এই প্রথম মনে হল যে আমার উপস্থিতি ওর কাছে আর কাম্য নয়, কিছু একটা লুকোতে চাইছে।
ও কি খুঁজছে আমার অজানা নয়। একটু এগিয়ে গেলাম, করুণ মুখে দাঁড়িয়ে। বললাম – ‘অনেক হয়েছে, যা দোকানে আমার বলা আছে, প্যাকেটগুলো নিয়ে সোজা বাড়ি চলে যা’।
একটু অবাক চোখে দেখল। এক অদ্ভুত দৃষ্টি। অতি সামান্য একটু খাবার, তার জন্য কি অপরিসীম এক কৃতজ্ঞতা ওর দু-চোখে ঝরে পড়ছে! এত অল্পে কেউ খুশি হতে পারে! ধারণা ছিল না। দোকান থেকে প্যাকেটটা নিয়েই এক দৌড়। তবে এবারেও তাই, ঐ দু-পা। আবার থমকে দাঁড়াল। পিছন ফিরে আমার চোখে চোখ। বললাম – ‘কি রে দাঁড়ালি কেন? যা... ’। মুখটা মাটিতে। কিছু না বলেই দাঁড়িয়ে রইল। হাজার মানুষের ভিড়। আর এই ভিড়ের মাঝেই সবার অগোচরেই জন্ম নিচ্ছে এক বাস্তব চিত্রনাট্য। যার সঙ্গে বাইরের জগতের কোন সম্পর্ক নেই, কোন সংলাপ নেই। থাকার কথাও নয়। ব্যস্ত শহর, তার থেকেও ব্যস্ত মানুষ। আমাদের সময় কোথায়! কি এই চিত্রনাট্যের ক্লাইম্যাক্স! কার কি এসে গেল। হেসে বললাম – ‘যা, তোর মায়ের জন্যও আছে’...। একবার আমার দিকে তাকিয়েই এক দৌড়। এ দৌড় আর থামেনি। জানি আর থামবে না। ওর বুকের মধ্যে যে ছোট্ট নদীটা আছে, তার পাড় ভাঙছে অবিরত, কোন এক অযাচিত ঢেউয়ের ধাক্কায়, যার উৎস ওর একান্ত ব্যক্তিগত, সংগোপনে বাঁচিয়ে রাখার অধিকার ওর একার। অনুধাবন করতে হলে ডুবুরী ফেলতে হবে ওর চোখের ভাষায়।
এই প্রবল ভাঙন বুকের এই ছোট্ট খাঁচায় আর কতক্ষণই বা সামলে রাখা যায়...। তাই আর দেরী করে নি, এক নিমেষে হারিয়ে গেছে জন অরণ্যে।
প্রচ্ছদঃ সুরজিত সিনহা
লেখক/লেখিকাবৃন্দ
গল্প

পাড় ভাঙ্গার শব্দ
কৃষ্ণতরু বর্মন
ডালাস, টেক্সাস
কবিতাঃ বাসব রায়
রাজবাটি, দিনাজপুর, বাংলাদেশ


এলোমেলো হিসেব
আমার কান তোমাকে দেখে
দেখে তোমার অনন্ত সৌন্দর্য
আমার চোখ তোমাক শোনে
শোনে তোমার যৌবনভরা গান -
আমি ঝড়-বাউলের দেশের লোক
আমার হিসেবের খাতা নেই
তোমরা যেটাকে পরিহাস বলো
সেটাই আমার নিয়তি বা অদৃষ্ট -
দামাল বাতাসে আমি স্থির
দৃঢ় অঙ্গীকারে আমি নেই
স্পর্শ অধিকারে বিশ্বাসী নই
অনুভবে আমি কাতর ভীষণ -
তোমার অনুপস্থিতি উপভোগ করি
তখন পুরুষসিংহ আমি -
ওষ্ঠ যখন ছুঁয়ে যায় অকাতর
তখন আমি পৌরাণিক জড়ভরত!
অন্ধকারে আমি পূর্ণিমায় ভাসি
জোয়ারে আমি বিস্তীর্ণ বালুচরে
পড়শীরা আমায় জানে না
আমার দিনপঞ্জীতে কিন্তু ওরাই৷
কবিতাঃ ড. কোহিনূর কর
অ্যারিজোনা, ইউ এস এ


স্বপ্ন-জাল
স্বপ্ন দেখা ভালো।
(তবে) স্বপ্নের জাল বোনার শেষে দাঁড়ালো
দুটো সমান্তরাল রেখা।
শৈশব থেকে কৈশোর পার করে যৌবন;
সব বয়েসেই স্বপ্ন আসে, কাটে দৈনন্দিন জীবন।
দুটো রেখা কিন্তু এক দুরত্ব রেখে চলে।
স্বপ্নের জাল কালো;
তা সে যতই কালো হোক,
স্বপ্ন দেখা ভালো।
স্বপ্নের কত আকৃতি প্রকৃতি,
সেইসাথে শৈশব-কৈশোর-যৌবন মনের আকুতি;
ঘুম ভাঙ্গে কিন্তু রেখাদুটো মোছে না।
কে আমায় ওঠালো?
সত্যি নাহলেও বেশ দেখি তো
স্বপ্ন জমকালো।
সাধ বলে, দোষ কী আমার?
উত্তর আসে অন্য রেখার থেকে,
তোর এসব অসাধ্য, অন্য কিছু ভাব না!
চোখ ভর্তি আলো।
ঘুম ভাঙ্গানো গর্জনে ওই
বিদ্যুৎ চমকালো!
কবিতাঃ সুদীপ্ত বিশ্বাস
রাণাঘাট, নদীয়া, পঃ বাংলা

মৃত্যু
জলের উপর একটা বুদবুদ
এই আছে এই নেই
হঠাৎ মহাকাশের বুকে
খসে পড়ে তারা
ভোরের শিউলি টুপ করে
ঝরে যায় বৃন্ত থেকে।
কেউ কেউ টুক করে চলে যায়
অজানার আঙিনায়
কেউ যার ঠিকানা জানে না...
তুমি পরাজিত
জন্ম এবং তোমার আসা
এর মধ্যে এই যে বেঁচে থাকা
এই যে জীবনের অনুভূতি
এই যে আবেগময় অস্তিত্ব
এই যে হৃৎপিণ্ডের ছন্দিত স্পন্দন
এই যে 'ঈশা বাস্য মিদং সর্বং' অবলোকন
চেতন অবচেতনের প্রাচীন দ্বন্দ্বকে
অতিক্রম করে আজও
এই যে জীবনের পাদচারণা
তার মধ্যেই বুঝি তোমার পরাজয়
জীবনের জয়গান একটানা বেজে চলেছে
জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে...
সেই কোন সুপ্রাচীন অতীত থেকে
হে মৃত্যু, তুমি পরাজিত।
জীবনের জয়গান
মৌমাছিরা গাইল গুঞ্জন
ফুলে এসে বসল প্রজাপতি
পাতালের গভীরে শিকড় চলল জলের সন্ধানে
সন্ধানী পাতারা খুঁজল সূর্যালোক
পাখিরা ধরল গান
উড়ে চলল আকাশের বুক চিরে
মৃত্যুর শীতল ছোবলকে নস্যাৎ করে দিয়ে
সবাই চলল জীবনের জয়গান গাইতে...
মৃত্যু
বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের কনডেনসারের মতো
পার্থিব জীবনে মৃত্যুও এক খুব প্রয়োজনীয় ক্ষতি।
নতুন মুখের শিশু, টাটকা গোলাপ
কিছুই থাকত না, মৃত্যু না থাকলে।
মৃত্যু না থাকলে আজ পৃথিবীটা ভরে যেত
বৃদ্ধ বৃদ্ধায় আর বৃদ্ধাশ্রমে।
পোড়া
যতদিন প্রাণ ছিল পুড়িয়েছি মন
তিলেতিলে মন পোড়া,ওটাই জীবন।
আজ আর মন নেই,মন পুড়ে শেষ
চিতাতেই মহাসুখে শুয়ে আছি বেশ।
পোড়াবে? পোড়াও তবে,আজ আমি স্থির
পুড়বে না মন আর,পুড়বে শরীর।
লাশ কাটা ঘর
একদিন আমার বদলে বিছানায়
শুয়ে থাকবে আমার লাশ।
একদিন আমিও নিশ্চিন্তে
শুয়ে থাকব ওই লাশ কাটা ঘরে,
অন্যান্য লাশের পচা গলা গন্ধ
বেমালুম ভুলে গিয়ে।
যত বার হেঁটে গেছি মর্গের রাস্তায়
নাকে চেপে ধরেছি রুমাল
পেরিয়ে গিয়েছি খুব দ্রুত।
যতই এড়িয়ে চলি, যতই ছুটি না কেন
একদিন ঠিক পৌঁছে যাব
ওই লাশ কাটা ঘরে।
শ্মশান
ফিরতি ট্রেনের যাত্রীরা সব জড় হয়েছে
এখানেও খুব লম্বা লাইন।
এক এক করে সব উঠে পড়ছে
রিজার্ভ স্লিপার কামরায়।
চিচিং ফাঁকের মত দরজাটা ঝপ করে বন্ধ হল
তারপর সাদা ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে
ট্রেনটা চলে গেল দূর থেকে দূরে
সেই নীল তারাদের দেশে।
বয়ে যায় রোদ বিনামূল্যে
পুড়ে গেছে গীটার
তারবার্তায় মাটির নরম ঘুম
আর যাবে না চেতনা
বাড়ি ঘরে দেনা আর পাওনা
সংলাপ অপ্রয়োজনীয়
ঈষৎ কঠিন
ঈষৎ ঢলে পড়া নগ্নিকা
বাতাসে বিভীষিকার প্রণাম
বয়ে যায় রোদ বিনামূল্যে
সাফল্য পায় বড়সড় কালীয়দমন পালা।
কবিতাঃ পার্থ সরকার
সপ্তাহের মাঝামাঝি বিবর্ণ প্রজাপতি মুখ
বিবর্ণ প্রজাপতি মুখ
সপ্তাহের মাঝামাঝি
যারপরনাই আধখাওয়া পৃথিবী
সমান সমান পঠনপাঠন
সমান সমান অজ্ঞানতা
ধূলিসাৎ মোক্ষবিদ্যা
অহমিকা শেষ
দুটো ঢিল ছুড়ল পুকুরে মাৎসর্য।


কবিতাঃ মনোরঞ্জন সাঁতরা
শত্রু স্বয়ম্ভূ
আজ আমি আমারই সবচেয়ে বড় শত্রু;
যুদ্ধে অবতীর্ণ আমিদ্বয় - এযেন এক কুরুক্ষেত্র।
কত বিনিদ্র রাত কাটছে আমার
সিদ্ধান্তহীন ব্যস্ততায়,
জিততে গিয়ে পিছিয়ে পড়ছি আমি
বার বার তারই ছলনায়।
দশের সেবায় ডুবতে গিয়ে
কানে মন্ত্র - আখের গোছাও,
সুখ স্বাচ্ছন্দ্য লুটে নাও
জীবন আর কদিন মাত্র!
তারপর হয়তো বা আমি
সেবার ছাতা নিয়ে হাজির,
দাসত্বের বেড়া অজান্তেই পড়ি
ছুঁয়ে যায় মন কামনায় কামনায়।
একি রূপ! বহুরূপে কোথায় খুঁজেছি আমায়,
শুনতে পাই - বাঁধন শক্ত করো
হবে জয় নিশ্চয়।

ভোটাধিকার
কল্পনা কাকিমার বয়স অনেকটাই বেড়েছে
হাত পায়ে আগের জোর নেই
মাথাটা মাঝে মাঝে ঘোরে
চোখেও তেমন আর দেখতে পায়না
তবে খিদেটা প্রায়ই ওঠে আর মরে।
কিন্তু কাকিমার নিজের অধিকার
আজও সেটা একশ ভাগ সচেতন।
কাকিমার ভোট কোনো নির্বাচনেই
বাদ পড়ে না;
বাদ পড়ে শুধু ভাবনার!
কবিতাঃ সায়নী আচার্য্য

দুর্গাপুজো এলো বলে,
ঢাকের বাজনা কানে আসে।
শরৎ মেঘে আকাশ ঢাকে,
কাশফুল চোখে ভাসে।
নতুন নতুন জামা-কাপড়,
জমজমাট সব দোকান ঘর।
নতুন সাজে সেজে উঠতে,
ব্যস্ত যেন বাড়িঘর।
সন্ধ্যে যত এগিয়ে আসে,
চারিদিক সব সেজে ওঠে।
পুজোর মজায় মত্ত হয়ে,
রাস্তাগুলো জেগে ওঠে।
মনের সব দুঃখ ভুলে,
এগিয়ে আসে মানুষ।
গান বাজনায় মেতে উঠে,
বিভেদ ভোলে মানুষ।
ধনী-গরীব তফাত যেন,
কোথায় চলে যায়।
সব দূরত্ব ঘুচে গিয়ে,
এক হয়ে যায়।
হঠাৎ যেন ঘুম ভাঙে,
বুঝতে পারি স্বপ্ন।
আকাশ এসে বলে যায়,
সময় আসেনি এখনো।

কবিতাঃ অনিশা দত্ত
সল্টলেক, কলকাতা
গণতন্ত্র
সাধারণ তন্ত্র, জপিতেছে মন্ত্র, চিত্ত উদভ্রান্ত
কোন্ দলের হবে জয়!
ধরমেতে যুদ্ধের হাওয়া,
করমেতে খাওয়া-শোওয়া,
হেঁটমুণ্ড বেপরোয়া,
নাহি ভয়।
ফিকির-ফন্দী, নোট বন্দী
অর্থ নীতির নেইকো মাত্রা
স্বাধীন মতামত, মারদাঙ্গা
বিপদ সংকুল জীবনযাত্রা।
ক্রাইম-পেট্রল, সাবধান ইন্ডিয়া
ছাপোষা পরিবার ঊর্ধনেত্রা
স্বচ্ছ ভারত হোক অক্ষয়
মূল্য বৃদ্ধি গুণমান হ্রাস
জনগণ মরে, করে হাঁস ফাঁস
উঠল বুঝি নাভিশ্বাস
শরীরের নাম মহাশয়।
নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান
বিবিধের মাঝে দেখ, মহা যুযুধান।
দেখিয়া ভারতে নানা দলের উত্থান
জগজন মানিকে বিস্ময়।
নারীবাদ
‘নারীবাদ – জিন্দাবাদ ‘, নারীবাদ – জিন্দাবাদ‘, নারীবাদ – জিন্দাবাদ‘
বাহ্ – বাহ্, তুই তো চিরকালের নারীবিদ্বেষী!
ভূতের মুখে রামনাম!
হঠাৎ নারীবাদ, নারীবাদ, জিন্দাবাদ‘
এতদিনে সারসত্য জেনেছি।
সমস্ত সুযোগ – সুবিধা থেকে নারীকে বাদ দাও, সার্থক নারীবাদ আমি তাই জীবন থেকেও
নারীকে বাদ দিয়েছি, আমি ব্রহ্মচারী।
বাজেট
ভারত গণতন্ত্র, বিশ্বে লার্জেস্ট
অর্থনীতি মানছে সকলের ইন্টারেস্ট
দেখেছো কি বুলেটিন?
বছরের বাজেট
সরকার দিলদার করছেন সাজেস্ট
গরীব পাবে সাবসিডি, উচ্চবিত্ত রিবেট
মধ্যবিত্ত, খোলো টিভি, শুনে যাও
ডিবেট উচ্চবিত্ত পাবে ঋণ,
নিম্নবিত্ত ত্রাণ মধ্যবিত্ত!
সারাদিন হাত ধুয়ে যান।
জন্ম - মৃত্যু কথা
(১)
- কারা যেন আপেল খেয়েছিলো,
আমরা জন্মাতে বাধ্য হলাম
- কারা যেন বাদুড় খেয়েছিলো,
আমরা মরতে বাধ্য হচ্ছি
(২)
ভগবান – খোকা, তুমি তোমার জন্ম ক্ষণ মনে করতে পার?
খোকা - পারি, সে রাতে বাবা মাকে একা রেখে পার্টিতে গিয়ে ছিলেন ফূর্তি করতে।
(৩)
- এমন কথা আমি তো বাপের জন্মেও শুনিনি
- শোনা সম্ভব ও নয়, তোর বাপের জন্মের সময় তুই জন্মাসনি
(৪)
অপূর্ব - আমি মরে গেলেও আপনার হাতে খেতে পারব না।
ভারতী – আমি বেঁচে থেকে খাওয়ার কথা বলছি।


কবিতাঃ প্রতীক মাইতি
রাজারহাট, কলকাতা