
ভিতরকণিকা –
জলে, জঙ্গলে
প্রদীপ কুমার বসাক



ভিতরকণিকা ন্যাশেনাল পার্ক
শহর কলকাতার কংক্রিট জঙ্গল আর ধুলো ধোঁয়ার বাইরে মন বহু দূর যেতে চায়। প্রকৃতির রাজ্যে যেখানে নেই কোন কোলাহল, কোন কৃত্তিমতা। প্রকৃতির অপার সজীবতা অনুভব করা যায় জল, জঙ্গল, নদী, পাহাড় বা সমুদ্রের স্পন্দনের মাঝে। অল্প কয়েকদিনের জন্য মুক্ত বাতাস গ্রহণের মাধ্যমে প্রাণের স্ফুর্ততা ও সক্রিয়তা বাড়ানোর জন্য আমাদের আসেপাশেই অল্প দূরত্বে এমন বহু জায়গা রয়েছে সেখানে যাতায়াত ও অবসর যেমন কাটানো যায় তেমন কিছু শিক্ষালাভও হয়। এই উদ্দেশ্যেই মাত্র কয়েকদিনের পরিকল্পনা শেষে আমরা কয়েকজন মিলে হঠাৎই বেরিয়ে পড়লাম পাশের রাজ্য ওড়িশার জল জঙ্গলময় এলাকা ভিতরকণিকার উদ্দেশ্যে।
জঙ্গলের নির্জনতা, দূর্ভেদ্যতা ও নদী প্রবাহের ক্ষিপ্রতা সম্পর্কে বিশেষভাবে অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য আমরা ঘন বর্ষাকালে বেড়িয়ে পড়লাম রাত্রি এগারোটা চল্লিশের তিরুপতি এক্সপ্রেসে। আমাদের যথারীতি বার্থ রিজার্ভ করাই ছিল। তাতে চেপে সারারাত আধ জাগা অবস্থায় মাঝে মধ্যে গল্প করতে করতে পরদিন ভোর ছ-টা তিরিশ মিনিটে ট্রেন ভদ্রক স্টেশনে থামল। আমরা সকলে বেশ তাড়াহুড়ো করে এখানে নেমে পড়লাম ট্রেন থেকে। কারণ এখানথেকেই ভিতরকণিকার খাঁড়িময় জঙ্গল পরিদর্শনের জন্য যেখানে থাকতে হয় সেই স্থান (চাঁদবালি) খুব কাছাকাছি, দূরত্ব মাত্র ষাট কিমি। ট্রেকার ধরে চাঁদবালি পৌঁছনোর জন্য আমরা স্টেশনের বাইরে বেড়তেই দু-তিনটে ট্রেকার চালক আমাদের কাছে ছুটে এল। তাদের মধ্যে একজনের সঙ্গে আমরা পাঁচশো টাকায় আমাদের নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা হল।
মাঝ রাস্তায় পথ নির্দেশ দেখতে দেখতে আমাদের মনে ট্রেকার চালক অন্য কোথাও নিয়ে যাচ্ছে আমাদের। তাকে জিজ্ঞাসা করাতে সে আমাদের ‘আরাডি’ নামে একটা জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে। ওখান থেকে চাঁদবালি পরে যাওয়া হবে। বুঝলাম গন্ডগোল কিছু একটা হতে চলেছে। কারণ ড্রাইভার আমাদের কথা কিছু একটা ভুল বুঝেছে। আমাদের গাড়ি ভাড়া নেওয়ার সময় তাকে বলেছিলাম চাঁদবালি যাওয়ার পথে যদি কোন দ্রষ্টব্য স্থান থাকে তাহলে তা দেখিয়ে দিত। আর সে করল কি আসল গন্তব্য চাঁদবালির দিকে না গিয়ে অন্য অন্য একদিকে চলে এসেছে। বাধল আমাদের সাথে তার বচসা। জুটল ওখাঙ্কার কিছু স্থানীয় অধিবাসী। তার সবকিছু শুনে ড্রাইভার বেশ বকাবকি করল। অগত্যা তারাই বলে দিল যে আমরা যেখানে এসে গেছি সেখান থেকে পিছনে না ফিরে বরং কিছু কম টাকায় রফা করে দিল ট্রেকারকে ওই আরডিতেই নামিয়ে দেওয়ায় জন্য। আমরা আরাডিতে নেমে সেখানকার প্রাচীন শিবমন্দির দেখলাম। ওড়িশা হিন্দুধর্ম তথা মন্দিরের পীঠস্থান সমৃদ্ধ। তারই একটি অন্যতম মন্দির ঘুরে দেখে আমরা আরাডি নৌকাঘাটে পৌঁছলাম। সকাল নয়টা, সামনে বৈতরণী নদী বয়ে চলছে বঙ্গোপসাগরে দিকে। রাস্তা শেষ। চাঁদবালি পৌঁছতে হলে এখান থেকে যন্ত্রচালিত নৌকাই ভরসা।
নৌকাচালক আড়াইশ টাকায় আমাদের চাঁদবালি পৌঁছে দিতে রাজি হল। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আরো কিছু স্থানীয় অধিবাসীদের নিয়ে নৌকা চলতে শুরু করল। ধীরে ধীরে নৌকা চলতে লাগল। পেরিয়ে যাচ্ছে পাশ দিয়ে নদী তীরের একের পর এক গ্রাম, ধানক্ষেত। বেশ কিছু বিভিন্ন ধরনের পাখি ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে চলেছে, দেখে ভালই লাগল। প্রায় পৌনে বারোটার সময় আমাদের নৌকা চাঁদবালি পৌঁছল। সামনেই আমাদের থাকার জন্য উৎকল ভবন থেকে বুক করা ছিল ট্যুরিজম ডেভলপমেন্ট কর্পোরেশনের ‘অরণ্য নিবাস’। সামনে দিয়ে বয়ে চলেছে বৈতরণী নদী।সবাই স্নান সেরে মধ্যাহ্নভোজ করতে বসে মনে হল চাঁদবালির সব বালিই বোধহয় খাবারের সাথে আছে। কোনক্রমে খাওয়া শেষ করে আমরা ম্যানেজারের কাছে সব জানিয়ে রাত্রের রান্না যাতে নিজেরাই করে নেওয়া যায় তার কথা বলা হল। তিনি তাতে কোন আপত্তি করলেন না। বিকেলের দিকে বেড়িয়ে ছোট্ট জনপদ অথা ভিতরকণিকার জঙ্গলে প্রবেশের আবাস্থল চাঁদবালি ঘুরে দেখা হল।‘ভিতরকণিকা’ জাতীয় উদ্যান ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম ম্যানগ্রভ অরণ্য। এর আয়তন ছ’শো বর্গ কিমির থেকেও বেশী। সমগ্র অঞ্চলটি সমুদ্র উপকূলস্থ খাঁড়িময় জলাকীর্ণ।এখানে প্রধানত বৈতরণী নদীর মোহনায় অবস্থিত একাধিক শাখানদী যা একে অপরকে ছেদ করেছে এবং শেষ পর্যন্ত সেগুলো বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে। অজস্র উদ্ভিদকুল ও প্রাণীকুলের আবাস্থল এই জঙ্গলে সুন্দরী ও গরান গাছের ঘন অবস্থান, জঙ্গলের অকৃত্তিমতা সুন্দরবনের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। এখানে অজস্র কুমীর, সাপ, বাঁদর, সম্বর ও ছোপ ছোপ হরিণ জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়। ডাংমালে কুমীর প্রজনন কেন্দ্র রয়েছে। আর এখানেই রাখা আছে একটি সাদা কুমীর যা পৃথিবীতে প্রায় অবলুপ্ত। জোয়ারের জল যখন খাঁড়িগুলোতে প্রবেশ করে তখন গাছের অনেকটা অংশ জলে ডুবে গিয়ে
পাতার সঙ্গে জল ঠেকে যায়। আর যখন ভাঁটা হয় তখন জলাভূমির দ্বীপগুলোর মাটির বিভিন্ন রকম স্তর খাঁড়ির উভয় দিকে চোখে পড়ে। এসব ঘুরে দেখার জন্য পরদিন ওড়িশা ট্যুরিজম ডেভলপমেন্ট কর্পোরেশনের মোটর লঞ্চ কলকাতা থেকেই বুক করে রেখেছি আমরা। সন্ধ্যায় মুড়ি মাখা আর চা খেতে খেতে গান, জোকস, এক একজনের পূর্বের বিভিন্ন স্থান ভ্রমণের অভিজ্ঞতা আলোচনার মাধ্যমে আড্ডা বেশ জমে উঠল। এর সাথে চলতে লাগল রাতের রান্না। সাড়ে দশটা নাগাদ খাওয়া শুরু হল কষা মাংস, রুটি আর স্যালাড। রাত্রি একটা পর্যন্ত গল্প করে সব শুতে যাওয়া হল।
পরদিন সকাল – সকাল ঘুম থেকে উঠে স্নান সেরে সারাদিনের খাবারের সরঞ্জাম গুছিয়ে নেওয়া হল। সময় মত নদীর ঘাটে আমাদের জন্য মোটর লঞ্চ এসে হাজির। সারাদিন ধরে জঙ্গলের বেশ কিছু দ্রষ্টব্য ঘুরিয়ে দেখানোর জন্য এর মোট ভাড়া ষোলশো টাকা। আমার খাবার ও জল নিয়ে উঠলাম লঞ্চে। লঞ্চ ছাড়ল নয়টা নাগাদ। প্রায় এক ঘন্টা বাদে আমরা ভিতরকণিকার খাঁড়িময় জঙ্গলের দোড়গোরায় থামলাম। গাইড প্রয়োজনীয় অনুমতি সংগ্রহ করে নিল। একটা ছোট্ট গ্রাম রয়েছে এখানে। ধান চাষও বেশ ভালই। বর্ষাকাল তাই ধান ক্ষেত জলে ভর্তি। নদীর জলও কিনারায় প্রায় উপছে পড়ছে। লঞ্চ আমার চলতে লাগল। শুরু হল গভীর জঙ্গল। জোয়ারের সময় গাছগুলো প্রায় ডুবন্ত। যেন আমাদের কাছে চলে এসেছে। এদিক ওদিক তাকিয়ে থাকতে থাকতে একে একে দেখা গেল বকের ঝাঁক ও বিভিন্ন রকমের পাখি। গাইড জানালেন সামনেই বার্ড স্যাংকচুয়ারি, যেখানে লক্ষ লক্ষ পাখি পাখি এসময় বাস করে। নির্দিষ্ট স্থানে লঞ্চ থামল। সুন্দরী ও গরান গাছের ডাল দিয়ে তৈরী সাঁকো দিয়ে আমরা জঙ্গলের ভিতর প্রায় আধ কিমি রাস্তা পেরিয়ে এসে দাঁড়ালাম ওয়াচ টাওয়ারের গোড়ায়। চারিদিকে অজস্র ছোট ছোট শ্বাসমূল জলাভূমির ওপর মাথা তুলে রয়েছে। প্রচন্ড নিস্তব্ধতার মধ্যে একটা যেন ঝর্ণার শব্দ কানে আসছে। গাইড জানালো একটা ঝর্ণা নয় এ হল লক্ষাধিক পাখির সম্মিলিত কলতান। তিনতলা সমান ওয়াচ টাওয়ারের ওপরে উঠে চারিদিকে তাকিয়ে যা দেখলাম তা জীবনে ভোলার নয়। অজস্র বিভিন্ন প্রজাতির বিভিন্নদেশের পাখিরা জঙ্গলে গাছের ডালে বসে রয়েছে। কিং ফিসার, সি ঈগল, স্যান্ড পাইপার প্রভৃতি পাখিরা আছে বলে গাইড জানালো। এক একটা সাদা, সাদা-কালো, সাদা-খয়েরী সংমিশ্রণে রঙের পালক সমৃদ্ধ পাখি এদিক ওদিক উড়ছে। মনে শিহরণ জেগে উঠল। ফটো তুলব ভাবতেই বর্ষার মেঘ ঘন আকাশ থেকে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। ছাতা বা বর্ষাতি নিয়ে কোন লাভ হল না। সম্পূর্ণ ভিজে গেলাম। ধীরে ধীরে ভেজা সিঁড়ি দিয়ে নেমে লঞ্চে এসে তোয়ালে আর গামছা দিয়ে একসঙ্গে গা মোছার তাড়াহুড়ো বেধে গেল। সময় বেলা বারোটা তিরিশ। লঞ্চ এবার আমাদের নিয়ে চলল ডাংমালের উদ্দেশ্যে যেখানে কুমীরের দেখা পাওয়া যায় অজস্র। কিন্তু বাঘ এই জঙ্গলে একটাও নেই। মুষলধারে বৃষ্টি নামল। সাথে তীব্র গতিতে ঝোড়ো হাওয়া। লঞ্চ টলমল করতে শুরু করল। চারিদিক ঘন জঙ্গল আর জলাভূমি। আমরা কয়েকজন ছাড়া বহুদূর পর্যন্ত কোন মানুষই নেই। লঞ্চ ডুবলে বাঁচা তো পরের কথা মরলেও খবর পাওয়া প্রায় অসম্ভব। বেলা দেড়টা নাগাদ লঞ্চ ডাংমালের কাছাকাছি পৌঁছল। কিন্তু বৃষ্টি আর ঝড়ে লঞ্চের অবস্থা বেহাল। সাথে আমাদেরও। চালক বলল এইভাবেই দুপুরের খাওয়া লঞ্চের মধেই সেরে ফেলতে হবে। বৃষ্টি থামলে ডাংমালে পৌঁছলে সেখানে নেমে ঘোরা যাবে। খাওয়া শেষ হল। বৃষ্টি পড়েই চলেছে। লঞ্চ এল ডাংমালে। বৃষ্টির মধ্যেই আমরা নেমে পড়লাম।
এখানে ট্যুরিষ্ট কটেজের ব্যবস্থা থাকলেও বর্ষাকালে রাত্রি যাপনের কোন অনুমতি মেলে না। এখানে বিভিন্ন জায়গায় কুমীরের বিভিন্ন প্রজাতি রাখা আছে। দেখা মিলল লুপ্ত প্রজাতির সাদা কুমীরের। বনকর্মীর সহায়তায় আমার কুমীরকে কাঁকড়া খাওয়ালাম আর সাদা কুমীরের খাবার গ্রহণের লম্ফঝম্প দেখা হল। বনবাংলোর পাশে এসে ঘুরে বেড়াচ্ছে বেশ কিছু হরিণ। অনেক চেষ্টা করেও কোন হরিণের গায়ে হাত দেওয়া গেল না।
বিকেলের দিকে ফেরার সময় গাইড বলল শীতকালে এখানে গাহিরামাঠা নামে এক স্থানে প্রশান্ত মহাসাগরের কচ্ছপ ডিম পাড়ার জন্য আসে। কিন্তু এখন সেখানে কিছুই নেই। তাই জঙ্গলের আরেকটা জায়গায় লঞ্চ আমাদের নিয়ে গিয়ে নামাল। গভীর জঙ্গল। গাইড আমাদের জঙ্গলের বেশ কিছুটা ভেতরের দিকে সরু রাস্তা দিয়ে নিয়ে যেতে লাগল। ধীরে ধীরে রাস্তা প্রায় শেষ। আগাছা রাস্তা ও আশপাশ ঢেকে দিয়েছে। তারই এক একটা গায়ে মুখে লেগে ছড়ে গেল। দেখা গেল বেশ কিছু বাঁদর, পোকামাকড়, সাপ ও বনমুরগী। বহু শ্বাসমূল এদিক ওদিক দেখা গেল।
বিকেল পাঁচটার সময় লঞ্চ চাঁদবালি ফিরিয়ে আনতে শুরু করল। ভাঁটার সময় খাঁড়ির পাশে দেখা মিলল বেশ কিছু কুমীরের। আর দেখা গেল মাটির বিভিন্ন স্তর। রাত্রি আটটা নাগাদ লঞ্চ থামল চাঁদবালিতে। সবাই সারাদিন ঘুরে আর জলে ভিজে ক্লান্ত। তারই মধ্যে রান্না ও খাওয়া সেরে ঘুমিয়ে পড়া হল।
সকাল হতেই তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে সূর্যোদয় দেখে নিজেরা কতকগুলো ছবি তুললাম। খেয়েদেয়ে ট্রেকারে চেপে দুপুর নাগাদ ভদ্রক স্টেশনে পৌঁছলাম। বিকালের ধৌলি এক্সপ্রেসে করে রাত নয়টা পঁচিশে হাওড়া স্টেশন।
মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল। প্রকৃতির হাতছানি মনের কোনে কোথাও যেন লুকিয়ে পড়ল। শুরু হল দৈনন্দিন জীবন। মাঝে মাঝে এই দৈনন্দিন জীবন যাপন আমাদের একঘেয়েমি এনে দেয়। সকল প্রাপ্ত বয়ষ্ক ও শিশুদের মানসিক ক্লান্তি ঘিরে ধরে। শিশু মনের বিকাশ, শিক্ষার পরিপূর্ণতা ও মনের সজীবতা বজায় রাখার জন্য সকলেই এভাবে সময় ও সুযোগ বুঝে বেড়িয়ে পড়তে পারেন প্রকৃতির কোলে।
ভ্রমণ সমগ্র

ভ্রমণ
