ভিতরকণিকা –
জলে, জঙ্গলে
প্রদীপ কুমার বসাক
ভিতরকণিকা ন্যাশেনাল পার্ক
শহর কলকাতার কংক্রিট জঙ্গল আর ধুলো ধোঁয়ার বাইরে মন বহু দূর যেতে চায়। প্রকৃতির রাজ্যে যেখানে নেই কোন কোলাহল, কোন কৃত্তিমতা। প্রকৃতির অপার সজীবতা অনুভব করা যায় জল, জঙ্গল, নদী, পাহাড় বা সমুদ্রের স্পন্দনের মাঝে। অল্প কয়েকদিনের জন্য মুক্ত বাতাস গ্রহণের মাধ্যমে প্রাণের স্ফুর্ততা ও সক্রিয়তা বাড়ানোর জন্য আমাদের আসেপাশেই অল্প দূরত্বে এমন বহু জায়গা রয়েছে সেখানে যাতায়াত ও অবসর যেমন কাটানো যায় তেমন কিছু শিক্ষালাভও হয়। এই উদ্দেশ্যেই মাত্র কয়েকদিনের পরিকল্পনা শেষে আমরা কয়েকজন মিলে হঠাৎই বেরিয়ে পড়লাম পাশের রাজ্য ওড়িশার জল জঙ্গলময় এলাকা ভিতরকণিকার উদ্দেশ্যে।
জঙ্গলের নির্জনতা, দূর্ভেদ্যতা ও নদী প্রবাহের ক্ষিপ্রতা সম্পর্কে বিশেষভাবে অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য আমরা ঘন বর্ষাকালে বেড়িয়ে পড়লাম রাত্রি এগারোটা চল্লিশের তিরুপতি এক্সপ্রেসে। আমাদের যথারীতি বার্থ রিজার্ভ করাই ছিল। তাতে চেপে সারারাত আধ জাগা অবস্থায় মাঝে মধ্যে গল্প করতে করতে পরদিন ভোর ছ-টা তিরিশ মিনিটে ট্রেন ভদ্রক স্টেশনে থামল। আমরা সকলে বেশ তাড়াহুড়ো করে এখানে নেমে পড়লাম ট্রেন থেকে। কারণ এখানথেকেই ভিতরকণিকার খাঁড়িময় জঙ্গল পরিদর্শনের জন্য যেখানে থাকতে হয় সেই স্থান (চাঁদবালি) খুব কাছাকাছি, দূরত্ব মাত্র ষাট কিমি। ট্রেকার ধরে চাঁদবালি পৌঁছনোর জন্য আমরা স্টেশনের বাইরে বেড়তেই দু-তিনটে ট্রেকার চালক আমাদের কাছে ছুটে এল। তাদের মধ্যে একজনের সঙ্গে আমরা পাঁচশো টাকায় আমাদের নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা হল।
মাঝ রাস্তায় পথ নির্দেশ দেখতে দেখতে আমাদের মনে ট্রেকার চালক অন্য কোথাও নিয়ে যাচ্ছে আমাদের। তাকে জিজ্ঞাসা করাতে সে আমাদের ‘আরাডি’ নামে একটা জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে। ওখান থেকে চাঁদবালি পরে যাওয়া হবে। বুঝলাম গন্ডগোল কিছু একটা হতে চলেছে। কারণ ড্রাইভার আমাদের কথা কিছু একটা ভুল বুঝেছে। আমাদের গাড়ি ভাড়া নেওয়ার সময় তাকে বলেছিলাম চাঁদবালি যাওয়ার পথে যদি কোন দ্রষ্টব্য স্থান থাকে তাহলে তা দেখিয়ে দিত। আর সে করল কি আসল গন্তব্য চাঁদবালির দিকে না গিয়ে অন্য অন্য একদিকে চলে এসেছে। বাধল আমাদের সাথে তার বচসা। জুটল ওখাঙ্কার কিছু স্থানীয় অধিবাসী। তার সবকিছু শুনে ড্রাইভার বেশ বকাবকি করল। অগত্যা তারাই বলে দিল যে আমরা যেখানে এসে গেছি সেখান থেকে পিছনে না ফিরে বরং কিছু কম টাকায় রফা করে দিল ট্রেকারকে ওই আরডিতেই নামিয়ে দেওয়ায় জন্য। আমরা আরাডিতে নেমে সেখানকার প্রাচীন শিবমন্দির দেখলাম। ওড়িশা হিন্দুধর্ম তথা মন্দিরের পীঠস্থান সমৃদ্ধ। তারই একটি অন্যতম মন্দির ঘুরে দেখে আমরা আরাডি নৌকাঘাটে পৌঁছলাম। সকাল নয়টা, সামনে বৈতরণী নদী বয়ে চলছে বঙ্গোপসাগরে দিকে। রাস্তা শেষ। চাঁদবালি পৌঁছতে হলে এখান থেকে যন্ত্রচালিত নৌকাই ভরসা।
নৌকাচালক আড়াইশ টাকায় আমাদের চাঁদবালি পৌঁছে দিতে রাজি হল। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আরো কিছু স্থানীয় অধিবাসীদের নিয়ে নৌকা চলতে শুরু করল। ধীরে ধীরে নৌকা চলতে লাগল। পেরিয়ে যাচ্ছে পাশ দিয়ে নদী তীরের একের পর এক গ্রাম, ধানক্ষেত। বেশ কিছু বিভিন্ন ধরনের পাখি ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে চলেছে, দেখে ভালই লাগল। প্রায় পৌনে বারোটার সময় আমাদের নৌকা চাঁদবালি পৌঁছল। সামনেই আমাদের থাকার জন্য উৎকল ভবন থেকে বুক করা ছিল ট্যুরিজম ডেভলপমেন্ট কর্পোরেশনের ‘অরণ্য নিবাস’। সামনে দিয়ে বয়ে চলেছে বৈতরণী নদী।সবাই স্নান সেরে মধ্যাহ্নভোজ করতে বসে মনে হল চাঁদবালির সব বালিই বোধহয় খাবারের সাথে আছে। কোনক্রমে খাওয়া শেষ করে আমরা ম্যানেজারের কাছে সব জানিয়ে রাত্রের রান্না যাতে নিজেরাই করে নেওয়া যায় তার কথা বলা হল। তিনি তাতে কোন আপত্তি করলেন না। বিকেলের দিকে বেড়িয়ে ছোট্ট জনপদ অথা ভিতরকণিকার জঙ্গলে প্রবেশের আবাস্থল চাঁদবালি ঘুরে দেখা হল।‘ভিতরকণিকা’ জাতীয় উদ্যান ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম ম্যানগ্রভ অরণ্য। এর আয়তন ছ’শো বর্গ কিমির থেকেও বেশী। সমগ্র অঞ্চলটি সমুদ্র উপকূলস্থ খাঁড়িময় জলাকীর্ণ।এখানে প্রধানত বৈতরণী নদীর মোহনায় অবস্থিত একাধিক শাখানদী যা একে অপরকে ছেদ করেছে এবং শেষ পর্যন্ত সেগুলো বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে। অজস্র উদ্ভিদকুল ও প্রাণীকুলের আবাস্থল এই জঙ্গলে সুন্দরী ও গরান গাছের ঘন অবস্থান, জঙ্গলের অকৃত্তিমতা সুন্দরবনের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। এখানে অজস্র কুমীর, সাপ, বাঁদর, সম্বর ও ছোপ ছোপ হরিণ জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়। ডাংমালে কুমীর প্রজনন কেন্দ্র রয়েছে। আর এখানেই রাখা আছে একটি সাদা কুমীর যা পৃথিবীতে প্রায় অবলুপ্ত। জোয়ারের জল যখন খাঁড়িগুলোতে প্রবেশ করে তখন গাছের অনেকটা অংশ জলে ডুবে গিয়ে
পাতার সঙ্গে জল ঠেকে যায়। আর যখন ভাঁটা হয় তখন জলাভূমির দ্বীপগুলোর মাটির বিভিন্ন রকম স্তর খাঁড়ির উভয় দিকে চোখে পড়ে। এসব ঘুরে দেখার জন্য পরদিন ওড়িশা ট্যুরিজম ডেভলপমেন্ট কর্পোরেশনের মোটর লঞ্চ কলকাতা থেকেই বুক করে রেখেছি আমরা। সন্ধ্যায় মুড়ি মাখা আর চা খেতে খেতে গান, জোকস, এক একজনের পূর্বের বিভিন্ন স্থান ভ্রমণের অভিজ্ঞতা আলোচনার মাধ্যমে আড্ডা বেশ জমে উঠল। এর সাথে চলতে লাগল রাতের রান্না। সাড়ে দশটা নাগাদ খাওয়া শুরু হল কষা মাংস, রুটি আর স্যালাড। রাত্রি একটা পর্যন্ত গল্প করে সব শুতে যাওয়া হল।
পরদিন সকাল – সকাল ঘুম থেকে উঠে স্নান সেরে সারাদিনের খাবারের সরঞ্জাম গুছিয়ে নেওয়া হল। সময় মত নদীর ঘাটে আমাদের জন্য মোটর লঞ্চ এসে হাজির। সারাদিন ধরে জঙ্গলের বেশ কিছু দ্রষ্টব্য ঘুরিয়ে দেখানোর জন্য এর মোট ভাড়া ষোলশো টাকা। আমার খাবার ও জল নিয়ে উঠলাম লঞ্চে। লঞ্চ ছাড়ল নয়টা নাগাদ। প্রায় এক ঘন্টা বাদে আমরা ভিতরকণিকার খাঁড়িময় জঙ্গলের দোড়গোরায় থামলাম। গাইড প্রয়োজনীয় অনুমতি সংগ্রহ করে নিল। একটা ছোট্ট গ্রাম রয়েছে এখানে। ধান চাষও বেশ ভালই। বর্ষাকাল তাই ধান ক্ষেত জলে ভর্তি। নদীর জলও কিনারায় প্রায় উপছে পড়ছে। লঞ্চ আমার চলতে লাগল। শুরু হল গভীর জঙ্গল। জোয়ারের সময় গাছগুলো প্রায় ডুবন্ত। যেন আমাদের কাছে চলে এসেছে। এদিক ওদিক তাকিয়ে থাকতে থাকতে একে একে দেখা গেল বকের ঝাঁক ও বিভিন্ন রকমের পাখি। গাইড জানালেন সামনেই বার্ড স্যাংকচুয়ারি, যেখানে লক্ষ লক্ষ পাখি পাখি এসময় বাস করে। নির্দিষ্ট স্থানে লঞ্চ থামল। সুন্দরী ও গরান গাছের ডাল দিয়ে তৈরী সাঁকো দিয়ে আমরা জঙ্গলের ভিতর প্রায় আধ কিমি রাস্তা পেরিয়ে এসে দাঁড়ালাম ওয়াচ টাওয়ারের গোড়ায়। চারিদিকে অজস্র ছোট ছোট শ্বাসমূল জলাভূমির ওপর মাথা তুলে রয়েছে। প্রচন্ড নিস্তব্ধতার মধ্যে একটা যেন ঝর্ণার শব্দ কানে আসছে। গাইড জানালো একটা ঝর্ণা নয় এ হল লক্ষাধিক পাখির সম্মিলিত কলতান। তিনতলা সমান ওয়াচ টাওয়ারের ওপরে উঠে চারিদিকে তাকিয়ে যা দেখলাম তা জীবনে ভোলার নয়। অজস্র বিভিন্ন প্রজাতির বিভিন্নদেশের পাখিরা জঙ্গলে গাছের ডালে বসে রয়েছে। কিং ফিসার, সি ঈগল, স্যান্ড পাইপার প্রভৃতি পাখিরা আছে বলে গাইড জানালো। এক একটা সাদা, সাদা-কালো, সাদা-খয়েরী সংমিশ্রণে রঙের পালক সমৃদ্ধ পাখি এদিক ওদিক উড়ছে। মনে শিহরণ জেগে উঠল। ফটো তুলব ভাবতেই বর্ষার মেঘ ঘন আকাশ থেকে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। ছাতা বা বর্ষাতি নিয়ে কোন লাভ হল না। সম্পূর্ণ ভিজে গেলাম। ধীরে ধীরে ভেজা সিঁড়ি দিয়ে নেমে লঞ্চে এসে তোয়ালে আর গামছা দিয়ে একসঙ্গে গা মোছার তাড়াহুড়ো বেধে গেল। সময় বেলা বারোটা তিরিশ। লঞ্চ এবার আমাদের নিয়ে চলল ডাংমালের উদ্দেশ্যে যেখানে কুমীরের দেখা পাওয়া যায় অজস্র। কিন্তু বাঘ এই জঙ্গলে একটাও নেই। মুষলধারে বৃষ্টি নামল। সাথে তীব্র গতিতে ঝোড়ো হাওয়া। লঞ্চ টলমল করতে শুরু করল। চারিদিক ঘন জঙ্গল আর জলাভূমি। আমরা কয়েকজন ছাড়া বহুদূর পর্যন্ত কোন মানুষই নেই। লঞ্চ ডুবলে বাঁচা তো পরের কথা মরলেও খবর পাওয়া প্রায় অসম্ভব। বেলা দেড়টা নাগাদ লঞ্চ ডাংমালের কাছাকাছি পৌঁছল। কিন্তু বৃষ্টি আর ঝড়ে লঞ্চের অবস্থা বেহাল। সাথে আমাদেরও। চালক বলল এইভাবেই দুপুরের খাওয়া লঞ্চের মধেই সেরে ফেলতে হবে। বৃষ্টি থামলে ডাংমালে পৌঁছলে সেখানে নেমে ঘোরা যাবে। খাওয়া শেষ হল। বৃষ্টি পড়েই চলেছে। লঞ্চ এল ডাংমালে। বৃষ্টির মধ্যেই আমরা নেমে পড়লাম।
এখানে ট্যুরিষ্ট কটেজের ব্যবস্থা থাকলেও বর্ষাকালে রাত্রি যাপনের কোন অনুমতি মেলে না। এখানে বিভিন্ন জায়গায় কুমীরের বিভিন্ন প্রজাতি রাখা আছে। দেখা মিলল লুপ্ত প্রজাতির সাদা কুমীরের। বনকর্মীর সহায়তায় আমার কুমীরকে কাঁকড়া খাওয়ালাম আর সাদা কুমীরের খাবার গ্রহণের লম্ফঝম্প দেখা হল। বনবাংলোর পাশে এসে ঘুরে বেড়াচ্ছে বেশ কিছু হরিণ। অনেক চেষ্টা করেও কোন হরিণের গায়ে হাত দেওয়া গেল না।
বিকেলের দিকে ফেরার সময় গাইড বলল শীতকালে এখানে গাহিরামাঠা নামে এক স্থানে প্রশান্ত মহাসাগরের কচ্ছপ ডিম পাড়ার জন্য আসে। কিন্তু এখন সেখানে কিছুই নেই। তাই জঙ্গলের আরেকটা জায়গায় লঞ্চ আমাদের নিয়ে গিয়ে নামাল। গভীর জঙ্গল। গাইড আমাদের জঙ্গলের বেশ কিছুটা ভেতরের দিকে সরু রাস্তা দিয়ে নিয়ে যেতে লাগল। ধীরে ধীরে রাস্তা প্রায় শেষ। আগাছা রাস্তা ও আশপাশ ঢেকে দিয়েছে। তারই এক একটা গায়ে মুখে লেগে ছড়ে গেল। দেখা গেল বেশ কিছু বাঁদর, পোকামাকড়, সাপ ও বনমুরগী। বহু শ্বাসমূল এদিক ওদিক দেখা গেল।
বিকেল পাঁচটার সময় লঞ্চ চাঁদবালি ফিরিয়ে আনতে শুরু করল। ভাঁটার সময় খাঁড়ির পাশে দেখা মিলল বেশ কিছু কুমীরের। আর দেখা গেল মাটির বিভিন্ন স্তর। রাত্রি আটটা নাগাদ লঞ্চ থামল চাঁদবালিতে। সবাই সারাদিন ঘুরে আর জলে ভিজে ক্লান্ত। তারই মধ্যে রান্না ও খাওয়া সেরে ঘুমিয়ে পড়া হল।
সকাল হতেই তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে সূর্যোদয় দেখে নিজেরা কতকগুলো ছবি তুললাম। খেয়েদেয়ে ট্রেকারে চেপে দুপুর নাগাদ ভদ্রক স্টেশনে পৌঁছলাম। বিকালের ধৌলি এক্সপ্রেসে করে রাত নয়টা পঁচিশে হাওড়া স্টেশন।
মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল। প্রকৃতির হাতছানি মনের কোনে কোথাও যেন লুকিয়ে পড়ল। শুরু হল দৈনন্দিন জীবন। মাঝে মাঝে এই দৈনন্দিন জীবন যাপন আমাদের একঘেয়েমি এনে দেয়। সকল প্রাপ্ত বয়ষ্ক ও শিশুদের মানসিক ক্লান্তি ঘিরে ধরে। শিশু মনের বিকাশ, শিক্ষার পরিপূর্ণতা ও মনের সজীবতা বজায় রাখার জন্য সকলেই এভাবে সময় ও সুযোগ বুঝে বেড়িয়ে পড়তে পারেন প্রকৃতির কোলে।
ভ্রমণ সমগ্র
ভ্রমণ
ভ্রমণ সমগ্র
পাবলো নারুদার
দেশ চিলে
চৈতালি পুরকায়স্থ
ডালাস, টেক্সাস
বাচ্চারা ইলামার পিঠে
দক্ষিণ আমেরিকার চিলেতে এসে মনকে সবচেয়ে বেশী নাড়া দিল ভালপারাইযো শহর। প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে এই পুরাতন বন্দর সুবিখ্যাত ছিল একসময়। তখন ছিল না পানামা ক্যানাল। তাই কোন জাহাজকে ইউরোপ থেকে আসতে হলে দক্ষিণ আমেরিকার দক্ষিণপ্রান্ত পেরিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরে এসে প্রথম নোঙর ফেলতে হত ভালপারাইযো বন্দরে। তারপর আবার হয়তো যাত্রা শুরু হত উওরের দিকে। তাই এ শহর দেখলাম উন্নত মানের।
আমাদের অবাক করল বাড়ীগুলোর আকার। সমুদ্রের পাশে পাহাড় তাই বাড়ীগুলোর কোনদিকে দোতলা বা তিনতলা দেখতে পাচ্ছি, আবার রাস্তা ঘুরে যখন পেছন দিকে যাব তখন দেখব পাঁচতলা। অর্থাৎ পেছনের দিকে পাহাড়ের নীচু অংশ তাই আসল বাড়ীটা দেখা যাচ্ছে। এই ধরনের আর্কিটেকচার খুব কম দেশে দেখা যায়। বাইরে কোন কোন জায়গায় ট্রোলার কার এর ব্যবস্থা রয়েছে, যদি উঁচু থেকে নীচুতে যেতে হয় তাই। ঠিক যেন একটা ছোট ট্রামগাড়ী।
তবে সবচেয়ে আকৃষ্ট হলাম পোয়েটস পার্কে গিয়ে। একটি ছোট পার্ক, তাতে রয়েছে চিলের বিখ্যাত তিন কবির মূর্তি। তাঁদের মধ্যে একজন হলেন বিখ্যাত সাম্যবাদী কবি পাবলো নেরুদা, যিনি নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন ১৯৭১ সালে। পার্কের কাছেই রয়েছে পাবলো নেরুদার বাড়ী। এত দেশে গেলাম কিন্তু কোথাও দেখিনি কবিদের জন্যে পার্ক, যেখানে রয়েছে তাদের মূর্তি এবং সংক্ষিপ্ত জীবনকথা।
ভালপারাইযোর পথে আমরা অনেক যাত্রী একসঙ্গে রওনা হয়েছিলাম চিলের রাজধানী সান্তিয়াগো থেকে। যাত্রীরা বেশীরভাগ এসেছিল ব্রেজিল এবং মেহিকো অর্থাৎ মেক্সিকো থেকে। তাদের ভাষা ছিল স্প্যানিশ। আর আমরা তিনজন বাঙালী ও একটি অস্ট্রেলিয়ান মহিলা শুধুই ইংরিজি ভাষা বুঝি। আমাদের বাসের ড্রাইভারটি যেমন দক্ষ তেমনি চমৎকার তার ব্যবহার। আমাদের গাইড পর্তুগীজ ছেলে সিবাসটিয়ান। সে অত্যন্ত সহজ ও সুন্দর করে দুটি ভাষাতেই বুঝিয়ে দিচ্ছিল দ্রষ্টব্য স্থানগুলো। সে প্রথম থেকেই জানিয়েছিল পর্তুগীজ হলে কি হবে সে পর্তুগীজ ভাষা ভাল জানে না, সবচেয়ে ভালো জানে স্প্যানিশ। আমি লক্ষ্য করলাম সে ইংরিজিও কিছু কম ভালো জানে না।
এবার সে আমাদের নিয়ে এল শহরের কেন্দ্রস্থলে, ট্রলি কারের সাহায্য নিয়ে। আর ড্রাইভারটি রাস্তা দিয়ে নিয়ে গেল আমাদের বাসকে। সেখানে দেখলাম পার্লামেন্ট ভবন ও আরো অনেক ঐতিহাসিক বিল্ডিং। ঠিক যেন ইউরোপীইয়ান পুরনো শহর। সেখান থেকে গেলাম সমুদ্রতীরে একটি রেস্টুরেন্টে, মধ্যান্নভোজের জন্যে। চমৎকার দৃশ্য। আমি, সুবীর ও বন্দনা খেলাম একটি ব্রাজিলের দম্পতির সঙ্গে বসে একই টেবিলে। মেয়েটি বেশ সুন্দরী, দেখতে ঠিক ভারতীয় মহিলার মত। সেখান থেকে বাস চলল ঠিক পাশেই ভিনা ডেল মার শহরে। এ শহর অর্থশালী লোকেদের। সুন্দর সুন্দর দুর্গর মত দেখতে বাড়ী রয়েছে সমুদ্রতীরে আর পাহাড়ের চূড়ায়। আর রয়েছে অনেক উচ্চতল যুক্ত বাড়ী, প্রায় কাঁচ দিয়েই তৈরি। তা হল বড়োলোকদের ছুটি কাটাবার ফ্ল্যাট, চারিদিক থেকে অপূর্ব দৃশ্য সমুদ্রের। এই শহরে রয়েছে চিলের সবচেয়ে বড় ক্যসিনো, সমুদ্রের মধ্যে একটি দ্বীপের মত অংশে। এই সুন্দর শহর ছেড়ে এবার আমরা রওনা হলাম সান্তিয়াগোর পথে। আসবার সময় এসেছিলাম আমরা অনেক টানেলের মধ্যে দিয়ে অনেক পাহাড় পেরিয়ে। শুনেছিলাম যে
চিলের ৪৯% টাকা আসে মাইনিং ইন্ডাস্ট্রি থেকে। কিছু আগে সাংকোসে খনিতে যে দুর্ঘটনা হয়েছিল তা চিলের উওরাংশে। নিশ্চয়ই আপনাদের সকলের মনে আছে সে ঘটনা। টেলিভিশনে আমরা সবাই দেখেছিলাম উদ্ধারকারী দলের সঙ্গে উদ্বিগ্ন অবস্থায় অপেক্ষা করছেন চিলের প্রেসিডেন্ট। যতক্ষণ পর্যন্ত শেষ মানুষটিকে উদ্ধার করা হয়েছিল ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি কোথাও যাননি। এমন প্রেসিডেন্টের দেখা সহজে মেলে না, তাই এ ঘটনা আমি এখনও ভুলিনি।
চিলের মধ্য অংশ বিখ্যাত নানা রকমের ফলের জন্যে। তাই তৈরী হয় নানারকম মদ। এই অঞ্চলে হয় অলিভ গাছ, যাপাটা টানেল দিয়ে যাবার পথে আমাদের গাইড তা দেখিয়ে দিতে ভোলে নি। দক্ষিণ চিলেতে আছে শুধু কাঠ তৈরীর শিল্প, অনেক গাছপালা ভর্তি সেই অংশ। মানচিত্র দেখলে বোঝা যায় চিলে উওর দক্ষিণে বিস্তৃত কিন্তু পশ্চিম থেকে পূর্ব অংশ মাত্র ১১০ মাইলের বেশী নয়। পশ্চিমে প্রশান্ত মহাসাগর এবং সমুদ্র তীরবর্তি পর্বতমালা চিলেকে দিয়েছে অবর্ণনীয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য।
এবার বলি চিলের রাজধানী সান্তিয়াগোর কথা। অপূর্ব সুন্দর দৃশ্য, চারিদিক ঘিরে উঁচু পাহাড় মধ্যে উপত্যকায় শহর। শুনলাম শীতকালে পর্বতমালা যখন তুষারাবৃত হয় তখন যে কি মনোরম হয় চতুর্দিক, তা যারা দেখেছে তারাই বলতে পারে । শুনলাম ঠিক নাকি সুইজারল্যান্ডের মত। আমরা এসেছি এপ্রিল মাসে, চিলের গরমকাল শেষ হয়ে হেমন্ত আসছে, তাই আমাদের তা দেখার সৌভাগ্য হল না। তবে শহর দারুণ পরিচ্ছন্ন, লোকেদের চেহারা ইউরোপীয়ানদের মত। বেশীরভাগ লোক ভালো ইংরিজি জানে।
পরদিন একটা দোতলা বাস নিয়ে অন্য যাত্রীদের সঙ্গে আমরা গেলাম শহরের কেন্দ্রে বেলাভিস্তা অঞ্চলে। সেখানে অনেক দোকান পাট। পাহাড়ী ট্রেন নিয়ে আমরা উঠলাম এক পাহাড়ের চূড়ায়। সে পাহাড়ের চূড়ায় রয়েছে মা মেরীর বিশাল মূর্তি, পাথরে তৈরী। আমরা চুপ করে বসে রইলাম অনেকক্ষণ, শুনলাম ভক্তদের গান।
পাহাড়ের নীচে যখন নেমে এলাম তখন দেখলাম ইলামাদের (স্থানীয় জন্তু) সঙ্গে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কিছু স্থানীয় লোক। বাচ্চারা যদি ইলামার পীঠে চড়তে চায় তাদের রাইড দিচ্ছে। চারিদিকে অনেক ছোট ছোট দোকান আমাদের মত বিদেশী আগন্তুকদের জন্যে। সেখান থেকে একটু পায়ে হেঁটে গেলাম এক দর্শনীয় স্থানে, তা হল পাবলো নেরুদার শহরের বাসস্থান। মিউজিয়ামে পরিণত হয়েছে এখন। ১৯৭৩ সালে মৃত্যু হয়েছিল পাবলো নেরুদার।
চিলেতে বিখ্যাত হল দুটি জিনিষ - লাপিস লাজোলি পাথর এবং রুপো। এই বিশেষ পাথরটি পাওয়া যায় শুধু চিলে আর আফগানিস্থানে। জানা মুস্কিল কেন শুধু এই দুই দেশ। নিশ্চই এই দুই দেশের কোন বিশেষত্ব আছে। শুনলাম পাথরের রং যত গাঢ় নীল হবে তত ভাল জাতের।
চলে আসার দিন সকালে আমাদের যাবার সুযোগ হল শিল্পীদের মেলায়। নানারকম ধাতুর তৈরী অনেক জিনিষ রয়েছে সেখানে। নানারকমের গয়নার দোকান, বিশেষত লাপিস লাজোলি এবং রুপোর। মহিলাদের মনোহরণের জায়গা, সন্দেহ নেই।
চিলে খুবই সুন্দর দেশ, তবে মানুষ সবই ইউরোপীয়ান। একটি আমেরিকান ইন্ডিয়ানকেও দেখলাম না এই দুই শহরে। নিরাশ হলাম আমি। এমনটি ঠিক আশা করি নি দক্ষিণ আমেরিকার দক্ষিণ প্রান্তে এসে।
ভ্রমণ সমগ্র
জয়রামবাটির মা,
কামারপুকুরের মাটি,
বিশ্বে বাংলার মানুষ
জাহির রায়হান
সার্কাস ময়দান, বেলডাঙ্গা, মুর্শিদাবাদ
তখনও বুঝিনি বিয়ে বাড়ি গিয়ে দেবভূমি দর্শন হতে পারে। যদিও নিজের আখাম্বা জীবনদর্শনই সেই সুযোগ দিল ঘটিয়ে। পিনাকী’র বিয়ে। পিনাকী আমার সহকর্মী, আমার ছোটভাই এবং আমাদের চিটফান্ডের নিরলস সদস্য। চিটফান্ডের বাকি শয়তান মেম্বারগুলো সহজে যুদ্ধজয়ের সম্ভাবনায় পিনাকী’র শ্বশুর ঘর অর্থ্যাৎ কল্যানী যাওয়া ঠিক করল। আমি বললাম, তা হবে না, আমি বৌভাতেই যাবো, প্রয়োজনে একা একাই। কারণ পিনাকী’র বাড়ির অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করাটাই উচিৎ কর্তব্য। আমার দর্শনে আকৃষ্ট হয়ে জুটে গেল দুই মন্ডল, মিলন ও পরিতোষ, সঙ্গে আরও এক ভাইসাহেব, ফজলে নূর। দুই হিন্দু আর দুই মুসলিম মোট চার বাঙালি বেড়িয়ে পড়লাম বৌভোজের সকাল বেলায় হুগলির গোঘাটের উদ্দেশ্যে, যেখান থেকে কামারপুকুর ও জয়রামবাটি স্রেফ এপাড়া ওপাড়া।
ভূগোল বরাবরই কেমন গোল গোল ব্যাপার, তাই পিনাকী যখন জানালো খুব নিকটেই সেই পবিত্র মাটির অবস্থান, একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম নিজের অজান্তেই। টবিন রোড ছাত্রাবাস থেকে বরানগর রামকৃষ্ণ মিশন তো ছিল পায়ে হাঁটা দূরত্বে, বাগবাজারের ‘মায়েরবাটী’ আর একটু দূরে, আর দক্ষিণেশ্বর তো আমার বহু ভালোলাগার সাক্ষী। বান্ধবীর সান্নিধ্য আর হিং-এর কচুড়ি। আজ তবে উৎসমুখের নিকটে, যে আকর্ষণ শুরু হয়েছিল সারগাছি রামকৃষ্ণ মিশনে, তা আজ বেলুড় মঠ, দক্ষিণেশ্বর বা বরানগর পেরিয়ে অজান্তেই টেনে এনেছে সেই যুগপুরুষের জন্মভিটেয়। গাড়ি এগোলো, মিলনদা বলল, জাহির কি ভাবছ? উত্তর দিলাম ‘টাকা মাটি, মাটি টাকা’।
বেশ কিছু ব্যাপারে দেখবেন আপনার সঙ্গে আমারও বেশ মিল আছে, যেমন গাড়ির ড্রাইভার। যে যে ড্রাইভারকে আপনি চেনেন তারা সকলেই আমার চেনা ড্রাইভারের মতোই জোরে জোরে গান বাজায় এবং প্রায় সব ড্রাইভারই একই ধরণের চটুল গান বাজায় গাড়িতে। তবে আজকের কেসটা আলাদা বোধ হচ্ছে প্রথম থেকেই। আজ সহ্য লয়ে মিষ্ট গান। দেবভূমির মাহাত্ম্য না পিনাকী’র চিমটি বুঝলাম না। আমাদের পরিতোষ, সারগাছির ছাত্র। রামকৃষ্ণ মিশনের নানা গল্প তার কাছে পাওয়া গেল। শুধু সন্ন্যাসীদের নাম ভবানন্দ, বিদ্যুতানন্দ বা তড়িতানন্দ ঠিক কেন বা কি পদ্ধতিতে হয়, আমার সে কৌতুহলের নিরসন সে করতে পারল না। এম এম কিছু বলতে শুরু করতেই, গাড়ি পার্ক হয়ে গেল, ড্রাইভার জানালো-জয়রামবাটী।
খুব ছোটতেই নরেনের গল্প পড়েছিলাম, ব্রহ্মদত্যির গল্পে বন্ধুদের উপদেশ দিয়েছিল নরেন, ‘নিজে চোখে না দেখে কখনও কোন কথা বিশ্বাস করবি না’। দূরন্ত, ডানপিটে নরেন পরবর্তীতে রামকৃষ্ণ পরমংহসদেবের সান্নিধ্যে এসে আমূল বদলে গিয়েছিলেন। পথে হুগলি জেলা ছাড়িয়ে যেই
বাঁকুড়ার মাটিতে প্রবেশ করেছিলাম, রাস্তার অদ্ভূত একটা বাঁক আর রাস্তায় নেমে আসা পার্শ্ববর্তী বৃহৎ একটি বৃক্ষের অনিয়ন্ত্রিত ডালপালার কোলাজ, মনটাতে উদাস ভাবের বীজ রোপন করেছিল। শ্রীশ্রী সারদা মায়ের কুটির প্রাঙ্গনে প্রবেশ করার পর অতি দ্রুত মনের সেই উদাসীভাব শাখাপ্রশাখা বিস্তার করতে শুরু করল।পরিপাটি, নিকানো, সুস্থির সেই কুটির প্রাঙ্গনে প্রবেশ যেন আমাদের নিজগৃহেই প্রবেশ, যেখানে অপেক্ষায় রয়েছে মা, পায়ের শব্দ পেয়ে দাওয়াতে বেরিয়ে হাসি হাসি মুখে বলবে, খোকা ফিরেছিস। অজান্তে, অসংলগ্ননে মনটাও যেন সেই রকমই একটি মাতৃডাকের আশায় ছুঁ ছুঁ করছে।এত যত্নে, এত নিপুনতায় যে ভিটে রয়েছে, সেখানে মা নেই? হতেই পারে না! মাটি লেপাকুটিরে হাত ছোঁয়ালেই শরীরে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হচ্ছে যেন, নিরন্তর ঘুরপাক খেতে খেতে, পুরো চত্বর, পুরো অঙ্গন, যেখানে যেখানে শ্রীশ্রীমার পদচারণা ঘটেছে, হেঁটে এলাম দম দেওয়া পুতুলের মতো অনিয়ন্ত্রিত আবেগে। তখনও প্রার্থনা শুরু হয়নি, প্রস্তুতি চলছে, ভক্ত অথবা সন্তান সমাগম শুরু হয়েছে বিক্ষিপ্তভাবে। আমরা বেরিয়ে এলাম শ্রান্ত মন নিয়ে। প্রবেশ পথের দু’ধারে হরেক মালের পসরা। বাবা হওয়ার পর থেকে ‘যা হবে দেখা যাবে’ বোধ ক্রমশ অদৃশ্য হয়ে চলেছে। ফলে সে বৈকালিক হরেকরকম্বায় অংশগ্রহণ করতেই হলো মেয়ের কথা ভেবে, বেলতলায় হাঁড়ি কাঠে গলা দেওয়ার পূর্ব প্রজন্মে আমার কাছে যা ছিল নিছকই বদাভ্যাসের নমুনা। আমার দেখাদেখি বাকিরাও মগ্ন হল কেনাকাটায়। এর আগে বীরভূমের কিছু গ্রাম্য মহল্লা দেখার অভিজ্ঞতা আছে আমার। জয়রামবাটীর এই পুণ্যভূমি ও সংলগ্ন আধা গ্রাম আধা মফস্বলে সে অভিজ্ঞতার সাযুজ্য রয়েছে।
কামারপুকুরে আমার যাবতীয় আকর্ষণ কেন্দ্রীভূত হলো ঠাকুর রামকৃষ্ণের নিজহস্তে রোপিত আম গাছটিতে। গাছ ভর্তি আম তখন, অপরাধ নেবেন না পাঠকগণ, বাকিদের নজর এড়িয়ে একটা আম পেড়ে নেওয়ার বদখেয়াল মনের মধ্যে উদয়ও হলো একবার। বহু কষ্টে লোভসংবরণ করে, গাছের নীচে ইতি উতি খুঁজতে থাকলাম যদি সে অমৃত একখান পড়ে থাকে কোনওখানে! কিন্তূ এমন পাপী আমি, সেটারও দেখা মিলল না। তবে দেখলাম যা তাতে ইহজীবনের কিছু পাপ যে আমার ক্ষয় হবে সেটা হলপ করে বলা যায়। দেখলাম নির্দিষ্ট সেই স্থানটি যেখানে ঠাকুর ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন। নমস্কার করব না গড় হয়ে করব প্রণাম, ভারী দো’টানায় পড়ে গেলাম। বাকিদের দিকে তাকিয়ে দেখি সবারই একই অবস্থা। কিন্তূ সবার চোখ চিকচিক করছে অদ্ভূত এক আভায়। কথিত আছে এক জ্যোতিষ্ক সদৃশ আলো মাতৃগর্ভে প্রবেশের পরই জন্ম হয় ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের। এখনও কি সেই আলোকছটা রয়েছে ওখানে? পাপী তাপী, হিন্দু, মুসলিম নির্বিশেষে সে আলো ধরা পড়ে আগত দর্শনার্থীদের চোখেমুখে!
বাঙালি ভাগ্যবান, ঠাকুর জন্মেছিলেন এই বাংলায়।বাঙালি ভাগ্যবান কারণ বাঙালি দর্শন করেছিল দেবতাসদৃশ এক যুগপুরুষকে, যাঁর কোন পুঁথিগত বিদ্যা হয়ত ছিল না সে অর্থে, কিন্তূ যে বিদ্যা দীপ্তির তিনি অধিকারী ছিলেন, তা তথাকথিত শিক্ষিত পন্ডিত ব্যক্তিবর্গের কাছে আজও অধরা। নিতান্তই ছাপোষা, অতি সাধারণ জীবন যাপনে অভ্যস্ত ঠাকুর যে জ্ঞান দান করেছেন বিশ্ববাসীকে তা কাল পেরিয়ে যুগোত্তীর্ণ। যাঁর মতবাদ, যাঁর ভাবধারা বহন করে স্বামী বিবেকানন্দ, বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছেন আমার আপনার দেশ ভারতবর্ষকে। জয়রামবাটি, কামারপুকুর দর্শন করে তাই মনে হলো নিতান্তই তুচ্ছ অহঙ্কারে অহঙ্কারী আমরা। ধর্মবিভেদে, জাতি বিদ্বেষে আমরাও নানা ধর্মের ধ্বজাধারী পতাকা বাহক বোধহয়। আমরাও কোনদিন হয়ে যেতে পারি কোন সাম্প্রদায়িক সংগঠনের অংশ। তাই মনেহয় চিৎকার করে বলি, ঠাকুর আর একবার তুমি ফিরে এসো, আর একটিবার তুমি বলো আমাদের - “যত মত তত পথ, কালী, খ্রিষ্ট, আল্লা সবই এক”।
ভ্রমণ সমগ্র
হাওয়াইতে
আট দিন
মণিদীপ সেনগুপ্ত
পালো অল্টো, ক্যালিফোর্নিয়া
হনলুলু বিচ, হাওয়াই
পার্ল হারবার মেমোরিয়াল, হাওয়াই
চলুন বেড়িয়ে পড়ি কিছুদিনের জন্য প্রকৃতির রূপ দেখতে, ডালাস থেকে মাত্র আট ঘন্টার যাত্রা। সকাল আটটায় প্লেন ছাড়ে ডি এফ ডবলু এয়ারপোর্ট থেকে বিকেল চারটে নাগাদ হাওয়াই এর রাজধানী হনুলুলু। বছর কয়েক আগে এই পথে আমরা একবার হেঁটেছিলাম। তারই স্মৃতি রোমন্থন করে এই বিবরণ লিখছি পরের বারের জন্য। কি করা যায় না করা যায় তার কিছুটা আন্দাজ আমাদের আগে থেকেই ছিল। কিছু রিজার্ভেশন করা, গাড়ি আর হোটেলের ব্যবস্থা, লুয়া খাওয়ার জায়গা ইত্যাদি ইত্যাদি। আজকাল ইন্টারনেট ঘেঁটে অনেক কিছুর খোঁজ পাওয়া যায়।
প্লেন থেকে নেমে একটা কনর্ভাটেবল গাড়ি ভাড়া করে প্রথমেই আমরা যাব লুয়া খেতে। বাঙালির ভোজন রসিকতার সুনামটা রাখতে হবে তো। অবশ্য আসল আকর্ষণ হল ওখানকার হুলা নাচ। ঘাসে ঢাকা সুন্দরীদের কোমর দুলিয়ে মনোরঞ্জন। একদিকে দামামা বাজছে, পিছনে সমুদ্রের গর্জন। খাবারটা তেমন কিছু নয়, শুয়োর মেরে বালিতে পুঁতে রেখে কিছু একটা ওরা রান্না করে। খেতে ভাল না লাগলে কোন অসুবিধা নেই, টেবিলে সাজানো থাকে থরে থরে বুফে। নাচের সাথে সাথে জলন্ত লাঠি নিয়ে নানা ভোজবাজি আর জাগলারির খেলা। অনেক সময় মনে হয় সার্কাস দেখছি। যাইহোক সন্ধ্যেবেলা মানচিত্র দেখে হোটেল খুঁজে ঘুমোনোর পালা, সেই হুলা নাচের স্বপ্ন দেখতে দেখতে। ঐ নাচ দেখেই হাওয়াই আসা সার্থক মনে হয়। ওরা সব দর্শকদের নাচতেও শিখিয়ে দেয়। নাচের জন্য পার্টনারের দরকার হতে পারে। আপনি নিজের সঙ্গিনী নিয়ে নাচতে পারেন, অনেকে নিজের ছেলেমেয়েদের নিয়েও নাচের প্র্যাকটিস করেন। আবার অনেকে ওখানকার কোন ঘাসের পাতায় মোড়া স্থানীয় শিল্পীকেও পেয়ে যান। আপনি কাকে নিয়ে নাচবেন আর নাচাবেন?
ঘুম থেকে উঠে বাসে করে আমরা যাব পার্ল হার্বর দেখতে। বাসের ব্যবস্থা হোটেল থেকেই করা যায়। প্রথমে সেই বাস নিয়ে যায় পার্ল হার্বর মেমোরিয়াল। বেশ জনপ্রিয় জায়গা, লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কাটতে হয়। ইউ-এস-এস অ্যারিজনা কিভাবে জলের নিচে ডুবে রয়েছে তা ঐ মেমোরিয়াল থেকে দেখা যায়, ফোঁটা ফোঁটা করে তেল বেরিয়ে আসছে। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় ১৬০০ নাবিক সমেত এই যুদ্ধ জাহাজটি জাপানী বোমার ঘায়ে ডুবে গিয়েছিল। ঘন্টা দুয়েক লাগে সেখানে। তারপর ঐ বাস আমাদের নিয়ে যাবে হনলুলু শহর দেখাতে। কন্ডাক্টর ভারী মজার লোক, নানা রকমের চুটকি বলতে বলতে হাওয়াই এর ইতিহাস বুঝিয়ে দেয়। হনলুলু শহরে রয়েছে হাওয়াই এর রাণীর প্রাসাদ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একমাত্র রাজসিক স্থাপত্য।বাস খালি বাইরের থেকে দেখিয়ে দেবে। আমরা সময় করে জায়গাটা ঘুরে ঘুরে দেখতে পারি।
হনলুলু শহরটা ওয়াহ শহরের দক্ষিণ প্রান্তে। দুটো হাইওয়ে দু-দিক থেকে দ্বীপটাকে ঘিরে রেখেছে। আমরা সেবার রওনা দিয়েছিলাম পূর্বদিকে মাকাপু পয়েন্ট নামের একটা জায়গা দেখতে। পাহাড়ে নিচে ছোট ছোট বিচ ওপর থেকে দেখা যায়। কাছেই সমুদ্রের মধ্যে থেকে উঠেছে কিছু ছোট ছোট দ্বীপ। নৌকা করে যাওয়া যায় তবে জনবসতি নেই। ছবি তোলার অনবদ্য জায়গা। হাইওয়ে ধরে ঘুরতে ঘুরতে এবার আমরা যাব ‘পালী স্টেট পার্কে’ ওয়াহ দ্বীপের মাঝামাঝা জায়গায়। মেইল মাইল খানেক একটা হাইক আছে পালী লুক আউটে যাবার জন্য। সেখান থেকে পুরো দ্বীপটার ভূগোল চোখের সামনে দেখা যায়।
ওয়াইকিকি বিচ, হাওয়াই
দুপুরের দিকে হাইকিং করার একটা ভাল জায়গা হল ডায়মন্ড হেড। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময়কার মার্কিন কামান কোথায় কিভাবে তাক করা থাকতো তা একটা পাহাড়ের চূড়ায় উঠে দেখা যায়। প্রায় তিন ঘন্টা লাগে পার্কিং লট থেকে উপরে উঠতে। ভাল জুতো থাকাটা বেশ জরুরী। এই হাইকিং এর পরে বিকেল বেলায় যাব আমরা বিখ্যাত ওয়াইকিকি বীচে হাঁটতে। সন্ধ্যায় হনলুলু ইন্টারন্যাশেনাল মার্কেট। কিছু স্যুভেনিয়ার তো কিনতে হবে।চব্বিশ ঘন্টা হয়ে গেল আমাদের এই বেড়ানো এর পরেও শরীর দিলে গাড়ি নিয়ে পাহাড়ের ওপর থেকে দেখবো আলো ঝলমলে হনলুলু শহর। ফিরে এসে কোন নাইট ক্লাবেও যেতে পারি – ওখানকার নৈশ জীবন দেখতে। একটা সতর্কতা – হনলুলু শহরের অনেক রাস্তা ওয়ান ওয়ে আর রাস্তাগুলো সমান্তরাল নয়। আমাদের সাথে জি পি এস ছিল না তাই রাস্তা খুঁজতে অনেক জায়গায় বেগ পেতে হয়েছিল।
দ্বিতীয় দিন – ভোরবেলা ওয়াইকিকি বীচে প্রার্তভ্রমণ। সে এক দর্শনীয় বেলাভূমি। কাতারে কাতারে লোক, কেউ দৌড়াচ্ছে, কেউ হাঁটছে, আবার অনেকে জলে নেমে পড়ছে। জলের তাপমাত্রা ৮২ ডিগ্রী – যেন শীততাপ নিয়ন্ত্রিত সুইমিং পুল। গতকাল ঐ জলে না নেমে থাকলে আজ নামতে হবে। আকণ্ঠ জলে দাঁড়িয়ে সূর্্যপ্রমাণ করার আদর্শ জায়গা।
ও জবা কুসুম সংকাশন...। তাড়াতাড়ি করতে হবে। তারপরই স্নান সেরে হোটেল ছেড়ে দিয়ে সোজা এয়ারপোর্ট। গাড়ি জমা দিয়ে প্লেন করে বিগ আইল্যান্ড। নতুন গাড়ি নিয়ে জায়গাটা ঘুড়ে বেড়াবো, ওখানকার স্থানীয় খাবার চেখে দেখবো। বেশী সময় হাতে থাকবে না ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে হেলিকপ্টার ট্যুর আগ্নেয়গিরি দেখবো। মাটির নিয়ে গনগনে লাভা জ্বলছে। সেই লাভা কি ভাবে গড়িয়ে চলছে সমুদ্রের দিকে, সমুদ্রে পৌঁছে তা কতটা বাষ্প তৈরী করতে পারে। ভাল পাইলট পেলে হাওয়াই-এর দেবদেবীর গল্প শোনাবে। জানিয়ে দেবে যে হাওয়াইতে কোন সাপ নেই, লাভা কি ভাবে পাহাড়ের কোলে একটা মাত্র বাড়ি বাঁচিয়ে রেখেছে ইত্যাদি... ইত্যাদি...। হেলি-ট্যুর সেরে আরেকটা প্লেনে করে হনলুলু, সেখানে থেকে মাউই দ্বীপ। এয়ারপোর্টে আমাদের তৃতীয় গাড়ি। চালিয়ে যাব দ্বীপের অন্য প্রান্তে সান সেট ক্রুইজ নিতে। নীল সমুদ্রের মধ্য সেই ক্রুইজ নিয়ে যায়। অনেক রকম রীফ দেখায়, সঙ্গে নানা ধরনের গান আর খানা পিনার আয়োজন।
নীল সাগরের মধ্যে থেকে থেকে উঠছে সবুজ রঙের হাওয়াই এর বিভিন্ন দ্বীপ, সূর্যাস্থের সাথে সাথে তা কালচে হয়ে আসে। ডেকের পাশে ডলফিন লাফিয়ে বেড়ায়, ডেকের ওপর সান্ধ্য নাচ। ঘন্টা তিনেকের ক্রুজ সেরে আবার হোটেল খোঁজার পালা। বেশী রাত হয়ে গেলে রাস্তা কি রকম থমথমে হয়ে যায়। রাস্তায় বেশী আলো নেই। মোড়ে মোড়ে বিভিন্ন নাইটক্লাবে গান বাজনার আওয়াজ আর পিছনে সমুদ্রের গর্জন। এই দ্বিতীয় দিনের শেষে আবার মনে হবে হাওয়াইতে আসা কতটা সার্থক। মাউই দ্বীপটা অত্যন্ত সুন্দর। এখানে অন্তত আরো কয়েকটা দিন থাকলে ভাল হত। এদিন সকালে আমার যাব স্নরকেলিং করতে। এর জন্য খুব ভাল সাঁতার জানারও দরকার নেই। স্নরকেলিং এর সমস্ত সামগ্রী বোটের লোকেরাই জোগাড় করে রাখে। বিভিন্ন জায়গায় জলে বোট দাঁড় করিয়ে সবাইকে জলে নামায়। কত রকম রং বেরঙের মাছ, কচ্ছপ, ডলফিন, কোরাল রিফ – সব দেখায়। এখানে কেউ গেলে ভাল ক্যামেরা নিয়ে যাওয়া উচিত। বোটের ওপর থাকে নানা
ধরনের খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা। ঘন্টা পাঁচেকের প্রোগ্রাম এটা। আর একদিন যাব হালিয়াকালা ন্যাশেনাল পার্কের পাহাড় চুড়ায়। ক্রেটারের কাছেই রয়েছে ওখানকার অবজার্ভেটরি। গাড়ি চালিয়ে একেবারে পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছান যায়। ওখানকার ঘাস পাতা আর নতুন ধরনের মাটি দেখার জন্য। সমুদ্র থেকে ১০,০০০ ফুট, ত্রিশ মাইলের মধ্যে। কোথাও ফুল গাছের বাহার কোথাও রুক্ষ জমি। পথে পড়ে দু-একটা ছোট্ট ছোট্ট গ্রাম। সেখানে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে কফি খাবো। স্থানীয় দোকানে ফুলের বাহার। কোনটা পছন্দ হলে সেই ফুলের বাহার ওরা আপনাকে ডালাসে পাঠিয়ে দেবে। সাইকেল ভাড়া করারও ব্যবস্থা আছে ওখানে। আপনাকে আর আপনার সাইকেলকে বাসে করে হালিয়াকালা ক্রেটারের মাথায় ছেড়ে দেবে। আপনি সাইকেল চালিয়ে গড়গড়িয়ে নেমে আসবেন ১০,০০০ ফুট।মাউই সম্ভবত হাওয়াই এর সবচেয়ে জনপ্রিয় দ্বীপ। এয়ারপোর্টটা উত্তর প্রান্তে। সেখান থেকে পূর্ব দিকে যায় হানা হাইওয়ে। রাস্তায় ৭২টা জলপ্রপাত আর শ-দেড়েক হেয়ার পিন বেল্ড। প্রত্যেক জলপ্রপাতেই মনে হয় দাঁড়িয়ে কিছু ছবি তুলি। তাই ২৫ মাইল রাস্তা ঘুড়ে আসতে ছয় থেকে দশ ঘন্টা সময় লাগে।
রাস্তায় মাঝে মাঝেই অসাধারণ বীচ। কেউ সার্ফিং করছে, কেউ সূর্যস্নান। অনেকে ছোট ছোট নৌকায় পাল তুলে দিয়ে সমুদ্রে সাইলিং করছে। অনেকেই শিক্ষানবীশ, পাল উলটে পড়ে যায়,আবার তা সোজা করে নেয়। এয়ারপোর্ট থেকেও পশ্চিমের দিকেও আমরা একবার রওনা দিয়েছিলাম। তবে সে রাস্তাটা খুব একটা ভাল নয়। তাছাড়া সন্ধ্যা নেমে আসছিল। তবে সে রাস্তাটাও খুব একটা ভাল নয়। কিছু দূর গিয়ে আমরা ফিরে এসেছিলাম। দক্ষিণ প্রান্তে সুন্দর সুন্দর বেলাভূমি, পার্ক আর ঝর্ণায় ভরা। কোথায় দাঁড়াবে আর কোনটা গাড়ি চালিয়ে ঘুরে নেবো বোঝা মুশকিল। সময় হাতে থাকলে আমরা দিন দুয়েক আরো এখানেই থাকতাম।আরেকদিন কয়েক ঘন্টা সময় করে আমরা যাবো ইয়াও নিডলস দেখতে। দু-পাশে ঘন জঙ্গলে ঢাকা পাহাড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে এক চূড়া। হাজার দুয়েক ফুট হবে তাও ঘন গাছপালায় ঢাকা। ভারতবর্ষ হলে লোক শিবলিঙ্গ মনে করে পূজা শুরু করত। ওখানেও পূজা হত তবে আজকাল বোধহয় হয় না। নিডলসের চারিদিকে হাইকিং করার ট্রেল হয়েছে একটা ছোট নদীর ধার ধরে। দু-ঘন্টার ট্রেল সেটাও আমি হাইক করে নিতে পারি।
অবসর বলে মাউইতে কিছুই নেই, যে কদিনের জন্যই যাই প্রতিদিন সকাল, দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যায় কিছু না কিছু করার রয়েছে। ওখানে আমরা প্যারাগ্লাইডিং, সার্ফিং, ক্রুজ… আগে থেকে একটু জেনে গেলে ভাল হয়। আর একটা কথা, মাউই থেকে সরাসরি হেলকপ্টার ট্যুরের ব্যবস্থা আছে বিগ আইল্যান্ডের আগ্নেয়গিরি দেখতে যাওয়ার। কেবল লাভা দেখতে হলে আলাদা প্লেনের টিকিট কেটে ওখানে গেলে সময় আর পয়সা দুইই নষ্ট হয়। ক’দিন কাটালাম আমরা মাউই-তে? তিনদিন পর প্লেনে করে হনলুলু, সেখান থেকে আর একটা প্লেনে করে কাউই দ্বীপ। এই দ্বীপটা প্রাকৃতিক দিক থেকে সবচেয়ে সুন্দর। লোকজন খুব বেশী নেই, পাহাড়ি ঝর্ণা চতূর্দিকে। আমাদের হোটেল ঠিক করে দক্ষিণ প্রান্তের হাইওয়ে ধরে যাবো দ্বীপের শেষ কোনায়। ওখানে এক নতুন ধরনের গ্রান্ড ক্যানিয়ন দেখবো – অ্যারিজোনার মতই গভীর কিন্তু সবুজ। ছোট্ট দ্বীপ কিন্তু প্রচুর বৃষ্টি পড়ে। দ্বীপের সমস্ত নদী নালা সারা বছর জলে টইটুম্বুর হয়ে থাকে। ক্যানিয়নের পরে আমরা একটা পার্কে দাঁড়াতে পারি – সমুদ্রে ওপর জলের ফোয়ারা। পাথরের ফাটলে সমুদ্রের ঢেউ ঢুকে এই ফোয়ারা তৈরী করে। সেই পার্ক থেকে বেরিয়ে আমরা গিয়েছিলাম গোলাপের বাহার দেখতে। ওখানকার অনেক বাড়ির বেড়া তৈরী করা হয়েছে গাছের ফুল দিয়ে। অসাধারণ ফুল। কানের ওপর গুঁজে আমার স্ত্রীকেও এক অনন্যা সুন্দরী মনে হচ্ছিল। এই সব দেখতে দেখতে আমার ষষ্ঠ দিনটাও চলে গেল।
সপ্তম দিন সকালে হোটেল থেকে বেড়িয়ে গাড়ি চালিয়ে উত্তর দিকে। কিলাই –এর সোনা বেলা।শেষ মাথায় একটা লাইট হাউস আছে। ওয়াইকিয়া ফলস মাঝারি সাইজের জলপ্রপাত। ওখান থেকে আর নীচের থেকে দেখার জন্য ভিস্তা পয়েন্ট রয়েছে। জলের কাছে আমরা সেবার যেতে পারিনি, এবার চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে। হোটেলের দিকে ফেরার পথে আরেকটা বড় আকর্ষণ একটা বোট রাইড। ওখানকার ছোট্ট নদীতে। আমাদের নিয়ে যাবে একটা গুহা দেখতে। ওখানে অনেক স্বনামধন্য লোকজন নাকি বিয়ে করতে যায়। এই বোট রাইডের আরেকটা আকর্ষণ হল হুলা নাচের প্রদর্শন। ওরা যে কত রকমের মুদ্রা ব্যবহার করে, আর তার মানি কি তা প্রাঞ্জল করে শিখিয়ে দেয়।
হাওয়াই-এর অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কার, গান বাজনার একটা সুন্দর বিবরণও পাওয়া যায়। দুপুরবেলায় খাওয়া সেরে – আমাদের এক সফরের দ্বিতীয় হেলিকপ্টার রাইড – সারা দ্বীপটা ঘুরিয়ে দেখাবে। আগের দিনের ক্যানিয়নটা আবার দেখবো আকাশ থেকে। ঘুরতে ঘুরতে যাব দ্বীপের উত্তরপূর্ব কোনায়। এমন সব বেলাভূমি আছে যে সেখানে আজও মানুষের পায়ের ছাপ পড়েনি। ঢেউ ঝাঁপিয়ে পড়ছে পাহাড়ের কোলে, আর ওপর থেকে নামছে ঝর্ণা। পাইলট হেডফোনে বিবৃতি দিতে দিতে চলেছে। সারি সারি পাহাড়ের মাঝে আমাদের হেলিকপ্টার উড়ছে, যে দিকে তাকাই ঝর্ণা। একটা নয়, দুটো নয় ডজনে ডজনে। জুরাসিক পার্কের শুটিং হয়েছিল এখানে। যেমনি ঘন সবুজ বন।, তেমনি পাহাড়, নদী আর ঝর্ণা। পৃথিবীর এই চেহারাটা একবার দেখলে আর ভোলা যায় না। অদ্যই শেষ রজনী মনে মরে আমরা ঘুমোতে গিয়েছিলাম।
আবার হয়ত বা কোনদিন এখানে বেড়াতে আসবে। সাত দিন ধরে চারখানা দ্বীপ ঘুরে আমরা তখন ক্লান্ত । ঘুম ভাঙল মোরগের ডাকে। ক’বছর আগে নাকি ঝড়ে এখানে অনেক খামার নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। সেই থেকে যত মোরগ আর মুরগী নিজেদের থেকেই ঘুরে বেড়ায়। আর হ্যালোজেন লাইট থেকে সূর্্য মনের করে চেঁচায়। যাই হোক ভোর রাতে উঠে আমরা একটা স্থানীয় পার্কে গেলাম। সে এক অনবদ্য সূর্যদয়। অনেক ছবিই তুলে রেখেছি কিন্তু চোখে না দেখলে সেই সৌন্দর্্য্য অনুভব করা যায় না। সেদিন আমাদের ভ্যাকশন শেষ হবার মুখে। এয়ারপোর্টে গাড়ি ফেরত দিয়ে প্লেনে চেপে হনলুলু। কয়েক ঘন্টা হাতে সময় ছিল হাতে, ওখানকার লাউঞ্জে ঘুরে ঘুরে আরো কয়েকটা ছবি তুলে ফেললাম। প্লেনের সময় হয়ে গেল, আট ঘন্টা পরে ডালাস।
তাহলে পরের বার কি রকম প্ল্যানিং হবে? আমাদের এই আট দিনের সফরটা বেশ একটা ঝটিকা সফর হয়ে গিয়েছিল। এই দ্বীপগুলোর কোনটিতে তিন বা চার দিন না থাকলে ঠিক সুবিচার হয় না। হোটেল, প্লেন, আর গাড়ি ভাড়া ডালাস থেকেই করবো। আর বাকি সব কিছুই ওখানে পৌঁছে। খরচা পাতি কি রকম। হোটেল, গাড়িভাড়া, পেট্রল আর খাওয়াদাওয়ার খরচ এখানকার মতোই, হয়তো বা সামান্যই বেশী। প্রধান খরচা হচ্ছে প্লেনের টিকিট। দ্বীপ থেকে দ্বীপান্তরে যেতে হলে হাওয়াইতে প্লেন ছাড়া গতি নেই। তাছাড়া রয়েছে ওখানে যা যা করবেন তার খরচা। হেলি-ট্যুরগুলো শ-দুয়েক ডলার। আর লুয়া ভোজন, স্নরকেলিং বা ক্রুজ নিলে এক একটা প্রায় পঞ্চাশ ডলার। আমার মতে দশ বারো দিনের জন্য গেলে পয়সা উশুল হয়ে আসে। যাওয়ার সব থেকে ভাল সময় হল শীতকাল। সমস্ত বুকিং আগে থেকে করা ঠিক নয়, ওখানকার স্থানীয় কাগজে অনেক কুপন পাওয়া যায়।
হাওয়াই থেকে ফিরে আসার আগে একটা মুদ্রা আপনাদের শিখিয়ে দিই। ডান হাতটা মুঠো করুন। এবার বুড়ো আঙুল দুটো যত সম্ভব ফাঁক করুন। অনেকটা শ্রীকৃষ্ণের বাঁশীর মতো। এবার এই মুঠোটা কাউকে দেখান – ভাঁজ করা আঙুলগুলো যাকে দেখাচ্ছেন তার দিকে। এটা হল এক হাওয়াইয়ান মুদ্রা মানে হল হ্যাং লুস।
ভ্রমণ সমগ্র
পায়ের তলায়,
কেদারতাল ট্রেক
দেবাশীষ চৌধুরী
সার্কাস ময়দান, বেলডাঙ্গা, মুর্শিদাবাদ
(প্রথম পর্ব)
ট্রেকিংয়ের স্বর্গরাজ্য গাড়োয়াল। এমন কোন ট্রেকার পাবেন না, যিনি গাড়োয়ালে ট্রেক করেননি। বিদেশী ট্রেকারদের ভাষায় গাড়োয়ালের রূপের তুলনায় আল্পস্’ও নাকি পিছনে থাকবে। প্রকৃতপক্ষে আমরা কেউই পাহাড়ে যাই না, পাহাড় তার নিজের কাছে আমাদের টেনে নিয়ে আসে, নিশির ডাকের মত! পাহাড়ীরা একটা কথা খুব বলে…… “পাহাড় বুলাতা হ্যায়”
সালটা ২০০৫, মাসটা মার্চের শেষ কিংবা এপ্রিলের প্রথম। অফিসে অমলদার ফোন এল। অমলদার ফোন মানেই……… “পাহাড় বুলায়া হ্যায়”। ২০০৫’এর ফেব্রুয়ারীতে সান্দাকফু ট্রেকের প্রোগ্রাম ছিল। কিন্তু কপাল মন্দ, ঘি-সিং সাহেব পাহাড়েবন্ধ ডেকে বসলেন। ওঃ ভগবান, সেকি মনের অবস্থা। দু-তিন মাসের প্রস্তুতি জলে। যাদের বেড়ানর, বিশেষত ট্রেকিংয়ের নেশা তাঁরাই বুঝবেন কি ভীষণ চাপ পড়ে মনের উপর এই সময়ে।
“কেদারতাল যাবি”?
“কবে বেরুতে চাইছ”?
“এই ধর জুনের শেষে”।
“সঙ্গে আর কে কে যাচ্ছে”?
“তুই আমি আর পঞ্চানন”।
“তিনজনের টিমে গাড়োয়াল-ট্রেক! খরচাটা ভাব”।
“দূর ছাড়ত, কত আর খরচা হবে”!
“তুমি আর পঞ্চ’দা তো ব্যাঙ্ক-অফিসার, ফাটবে ত আমার”!
হ্যা হ্যা করে হেসে অমলদা বলল, “টিকিট কেটে তোকে ফোন করব”।
২৫শে জুন দুন এক্সপ্রেসে তিনজনে রওনা হলাম, গন্তব্য হরিদ্বার। দুর্ভোগের দু’রাত্রি কাটিয়ে ২৭শে জুন সকালে হরিদ্বার পৌঁছে তখনই রওনা দিলাম হৃষীকেশের উদ্দেশ্যে। ছবির মতন দেখতে ঋষিকেশ রেল স্টেশন। রেল স্টেশনের কাছই জিপ-আড্ডা। একটা ধাবায় টিফিন সেরে সওয়ার হলাম শেয়ার জিপে, আজকের গন্তব্য উত্তরকাশী।
নরেন্দ্রনগর, শ্রীনগর আর ছবির মত সুন্দর টেহেরি ড্যাম পার হয়ে বিকেল পাঁচটা নাগাদ জিপ পৌঁছল উত্তরকাশী। উত্তরকাশীর জিপ-স্ট্যান্ডের সামনের হোটেলটাই ‘ভান্ডারী-হোটেল’। আজকের রাতের আস্তানা ওখানেই। কাল সকালে শুরু হবে গঙ্গোত্রীর পথে যাত্রা।
২৮শে জুন সকাল আটটায় জিপ-যাত্রা শুরু হল। মা গঙ্গাকে বাঁদিকে রেখে ক্রমশই উঁচু থেকে আরও উঁচুতে ওঠা। পড়ন্ত দুপুরে হরশিল। মূল রাস্তা ছেড়ে ডানদিকের রাস্তা ধরে আপেলহীন আপেল বাগানের পথ পেরিয়ে হরশিল জিপ-আড্ডা। কিছুক্ষণের যাত্রাবিরতি। ঠান্ডা সেই উত্তরকাশী থেকেই পাচ্ছি। এখানে ঠান্ডার আধিক্যটা বেশ ভালই।
শেষ বিকালে ভৈরোঁঘাঁটি পেরিয়ে গঙ্গোত্রী। ১০,৭০০ফুট উচ্চতায় ঠান্ডা তার উপস্থিতি প্রবলভাবেই জানান দিচ্ছে। আগামীকাল বিশ্রাম। ঠিক করতে হবে পোর্টার গাইড, কিছু কেনাকাটাও করতে হবে, বিশেষত ‘মিট্টি-তেল’ মানে কেরোসিন!
(দ্বিতীয় পর্ব)
৩০শে জুন সকাল সাতটায় শুরু হল কেদারতাল ট্রেক। আজকের গন্তব্য ভূজ খড়ক, উচ্চতা ১২,৫০০ফুট। পুর পথটাই খাড়া চড়াই। আমাদের দলে নতুন দু’জন যোগ দিয়েছে, গাইড পন্ডিতজী আর পোর্টার তোম্বা। পন্ডিতজী গাড়োয়ালী আর তোম্বা নেপালী। সারাটা ট্রেকরুটে গাড়োয়ালী আর নেপালী’দের মধ্যে কারা শ্রেষ্ঠ ক্লাইম্বার, তার ফয়সালা এই দু’জনে করতে পারেনি!
“গঙ্গা মাইকী, জয়য়য়য়”………….পিঠে রুকস্যাক, বুকে ন্যাপস্যাক নিয়ে যাত্রা হল শুরু। ঘন পাইনের জঙ্গল ভেদ করে ট্রেল ধরে ক্রমাগত আকাশকে ধরতে চাওয়ার এক অসম লড়াই। সমতলের মানুষ আমরা, দু’পা উঠতেই শরীর বিদ্রোহ শুরু করে দিল। অমলদা কড়া লিডার, নো ধানাই-পানাই!
“ও দেখ সাব, গ্লেসিয়ার।” সম্বিত ফেরে গাইড পন্ডিতজীর কথায়। হ্যাঁ, সত্যিই তো। সামনের ট্রেল’টা সাদা চাদরে মোড়া! গ্লেসিয়ারে উঠতেই বিপত্তির শুরু! বাটার চারশো টাকা দামের পাওয়ার আর যাইহোক গ্লেসিয়ারে চড়ার উপযুক্ত নয়……যা হবার তাই হল, পা স্লিপ্ করে চিতপটাং! “বড়া সাব, ছোটা সাব গির গিয়া!” গাইড পন্ডিতজীর ডাকে খানিকটা এগিয়ে থাকা অমলদা আর পন্চাদা পিছন ফিরে আমার দুরাবস্তা দেখে একটি আদিরসাত্মক মন্তব্য ছুঁড়ে দিয়ে আবার চলতে শুরু করল। আমিও গাইডের হাত ধরে খাড়া হলাম।
“এটাই এই ট্রেকরুটের অন্যতম বড় বাধা। অনেক দলই এখান থেকে ফিরে যায়। যদি ‘ভার্গো’ অর্থাৎ খাদের দিকে তাকালে মাথা ঘোরার ব্যামো থাকে, তবে আর না এগোনই ভাল!” অমলদার কথায় সামনের দিকে তাকিয়ে দেখি, ট্রেল’টা খুব বেশী হলে ফুট তিরিশের মত হবে। কিন্তু চওড়া নয়-দশ ইঞ্চির বেশী হবেনা। পুরো ট্রেলটাই পাহাড়ের গা ধরে ধরে আড়াআড়ি ভাবে যেতে হবে, কোন ভাবে পা যদি একবার ফস্কায় সোজা কেদারগঙ্গার বুকে!!!
“শালা ওটা টিকটিকি নাকি!” বিশাল এক বোঝা নিয়ে শিস দিতে দিতে পোর্টার তোম্বা সিং অবলীলাক্রমে পেরিয়ে যেতেই ‘মেজ-সাব’ পন্চাদার সরস মন্তব্য। এবার আমাদের পালা, প্রথমে অমলদা তারপর পন্চাদা। পন্চাদার পিছনে গাইড আর তার পিছনে আমি। পাহাড়ের গা ধরে একপা একপা করে এগুচ্ছি(পড়ুন-ঘষটাচ্ছি)আর ইষ্টনাম জপছি! কেলো’টি পাকল ফুট দশেক যাবার পর। ডান হাত দিয়ে যে পাথরটা ধরলাম, সেটা খুলে হাতে চলে এল! ভাগ্যিস বাঁ হাত দিয়ে যে পাথরটা ধরেছিলাম সেটা খুলে যায়নি, খুলে গেলে আর দেখতে হতনা সোজা কেদারগঙ্গায় ল্যান্ড করতাম।
এখন সাড়ে বারটা বাজে, পৌঁছে গেছি ১২,৫০০ফুট উচ্চতার ভূজ খড়কে। ট্রেল থেকে সামান্য নিচুতে ক্যাম্পিং গ্রাউন্ড। ফাটাফট দুটো টেন্ট ডিচ্ করা হয়ে গেল। ওদিকে ভাঙাচোরা একটা টিনের শেডের তলায় পন্ডিতজী আর তোম্বা রান্না চাপিয়েছে। সারাটা রাস্তা বৃষ্টি জ্বালিয়েছে, যদিও ঝিরঝিরে এই আছে তো এই নেই! এতক্ষণ পথশ্রমে গলদঘর্ম হচ্ছিলাম, এখানে বসতে না বসতেই ঠান্ডা তার প্রাবল্য টের পাইয়ে দিল। একদিকে খাদ আর বাকি তিনদিক জুড়ে বড় বড় গাছের জঙ্গল। ভূর্জপত্রের অনেক গাছ রয়েছে বলেই বোধহয় এই স্থানের নাম ‘ভূজ খড়ক’।
(তৃতীয় পর্ব)
১লা জুলাই, এখন সাড়েদশটা বাজে। শুরু হল আজকের গন্তব্য কেদার খড়কের উদ্দেশ্যে যাত্রা। গতকাল বিকাল থেকেই বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। কপাল ভাল বরফ পড়েনি। সকালে আবার এক কেলো! বৃষ্টির মধ্যেই পলিথিন মুড়ি দিয়ে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে জঙ্গলে ঢুকেছি। খেয়াল পড়ল ‘বিশেষ- কর্ম’ সারা হতে! টিসু-পেপার তো টেন্টে রুকস্যাকের মধ্যে রেখে এসেছি!!! জঙ্গলে একধরনের ছোট গাছ হয়, দেখতে অনেকটা পালংয়ের মত। পাতাগুলোও বেশ বড় আর গোল গোল, আপাতত তাই দিয়েই টিসু-পেপারের কাজ সারলাম!
টানা ঘন্টা তিনেক হাঁটার পর একটা জায়গায় এসে বিশ্রামের হুকুম মিলল। সকালে পন্ডিতজীর বানানো টিফিন মেস্টিন থেকে বার করে খাচ্ছি আর খেতে খেতে পন্ডিতজীর কথা শুনছি, “সাব, ঔর আধা ঘন্টা বাদ মিলেঙ্গে এহি রুট’কা সবসে বড়া মুসিবত……ধসা পাহাড়”। এই ধসা পাহাড়ের কথা আগেই শুনেছিলাম।
দেড়শো মিটার ট্রেল’টা গেছে একটা ঝুর পাথরের ঢালের উপর দিয়ে। একপা এগোলে দু’পা খাদের দিকে হড়কাতে হবেই আর তার সঙ্গে ওপর থেকে সারাক্ষণইছোট বড় বিভিন্ন আকারের নুড়ি গড়িয়ে পড়ে। সত্যিই খুবই কঠিন এই জায়গাটা পার হওয়া।
“ওঃ এটাই সেই ‘ধসা পাহাড়’!!! পার হব কিকরে”? “শুধুমাত্র মনের জোরে”, জবাব এল অমলদার থেকে। সত্যি, মনের জোর ছাড়া একে পেরনো অসম্ভব। প্রথমে তোম্বা গেল বোঝা সমেত। ও হড়কাল বটে, মোটে দু-চার পা! এরপর অমলদা আর পন্চাদাও পেরিয়ে গেল, আট-দশ ফুট হড়কাল মাত্র। এবার আমার পালা। একপা করে এগুচ্ছি আর পিছন থেকে পন্ডিতজী ‘সাবস বেটা’ বলে চলেছে।
ভালই চলছিলাম, হঠাৎ যেন ভূমিকম্প হল! পন্ডিতজীর ‘সাবস বেটা’ মোটে বিশ ফুট হড়কেছে। একরকম আরও বার তিনেক হড়কে ওদিকে পৌঁছলাম।
এই জায়গাটার সিনিক বিউটি অসাধারণ। অতলস্পর্শী খাদের শেষে কেদারগঙ্গা আপনমনে বয়ে চলেছে গঙ্গোত্রী অভিমুখে। অপরপাড়ে মন্দার পর্বতশ্রেণী মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে, কোথাও সবুজের লেশ মাত্র নেই। এপারে ট্রেলের পাশে সামান্য সবুজ ঘাসের আভা, আমরা ট্রি-জোন ছাড়াতে চলেছি যে!
ঘন্টা খানেক আরও হাঁটার পর ফুট দশেক চড়াই ভেঙে ওপরে উঠতেই অবাক বিস্ময়ে থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম। অচেনা এক জগত তার রূপের ডালি সাজিয়ে যেন আমারই প্রতীক্ষায়। অসম্ভব একটা ভাল লাগার আবেশ যেন গ্রাস করে নিল সমস্ত সত্ত্বা’কে। পথশ্রমের ক্লান্তি অনুভব করার বোধশক্তিটাই তো তখন বিলীন হয়ে গেছে।
এটা যে গাড়োয়াল……গাড়োয়াল হিমালয়! এর টানেই যে বারবার ছুটে আসি। না ভুল বললাম, ঘাড় ধরে সমতল থেকে নিজের কোলে টেনে আনে! সামনে সবুজ মখমলের এক সুবিশাল বুগিয়াল। সামনে অর্থাৎ দক্ষিণদিকে তুষারাবৃত শৃঙ্গরাজি মেঘের আড়াল থেকে ‘টুকি’ করছে, পূর্বদিক জুড়ে কেদারগঙ্গার ওপারে মন্দার পর্বতশ্রেণী আর পশ্চিমে পাহাড়ের গা বেয়ে বুগিয়াল ওপরে উঠে যেন হাতছানি দিয়ে
ডাকছে। কোথায় বড় গাছের চিহ্ন মাত্র নেই। থাকবে কিকরে, আমরা ট্রি-জোনের ওপরে যে! পৌঁছে গেছি ১৪,৫০০ফুট উচ্চতার কেদার খড়ক।
প্রথমে অভ্যর্থনা জানাল একটি পাহাড়ি ডগী। ইনি মেষপালকের পোষ্য। এনার ডিউটি হচ্ছে সারারাত জেগে থেকে ভেড়ারপালকে বন্যজন্তুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করা আর দিনের বেলায় তাদের উপর খবরদারী করা। এনারা দলে তিনজন, বাকি দু’জন পালের সঙ্গে আছেন। সামনেই মেষপালকের তাঁবু। আমাদের গলার আওয়াজ পেয়ে বেরিয়ে এলেন। কথায় কথায় জমে গেল আলাপ। “দিনের পর দিন একা থাকেন কি করে”? আমার প্রশ্ন শুনে হেসে উত্তর দিলেন, “আদত হো গিয়া সাব”।
অদ্ভুত জীবন এই মেষপালকদের। শীতের বরফ গলতেই মালিকের মেষের পাল চরাতে বেরিয়ে পড়েন গাঁও ছেড়ে। ফিরবেন সেই শীতের শুরুতে। সারাটাদিন কাটে জড়িবুটি সংগ্রহে আর বিকাল থেকে তাঁবুতে, দৈনন্দিন রুটিনের কোন পরিবর্তন নেই। ভাবতে পারেন, TV, FM, ফেসবুক, হোটাসএ্যাপ ছাড়া দিনের পর যদি আপনাকে এইরকম সঙ্গীহীনজীবন কাটতে হত! D.A., Pay Commission, G.T., M.T. নিয়ে কতই না অসন্তোষ আমাদের! এঁদের জীবন দেখলে সভ্যতার সব অভিযোগই কিরকম যেন যুক্তিহীন লাগে।
তাঁবু খাটানর কাজ শেষ। পন্ডিতজী আর তোম্বা’র তদারকিতে রান্না চেপেছে। খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে আমরা চা খাচ্ছি। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে আসছে। গাঢ় কুয়াশা, সাদা চাদর বিছিয়ে চারদিক ক্রমশ ওয়াশআউট করে দিচ্ছে। দশহাত দূরের তাঁবুটাও আস্তে আস্তে অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। না, ঠান্ডায় আর বাইরে থাকা যাচ্ছেনা। ঢুকে পড়লাম তাঁবুর মধ্যে স্লিপিংব্যাগের নিরাপদ
আশ্রয়ে। কাল যে পৌঁছতে হবে প্রায় ১৬,৫০০ ফুট উচ্চতার কেদারতালের ক্যাম্পিং গ্রাউন্ডে, দি লাস্ট ডেস্টিনেশন!
(চতুর্থ পর্ব)
২রা জুলাই, সকাল হয়েছে কেদার খড়কে। বাইরে ঝলমলে রোদের মাঝে ‘শুভ্র সমুজ্জ্বল’ থালাইসাগর, ভৃগুপন্থ, আরও নাম না’জানা কত তুষারাবৃত-শৃঙ্গ। সবুজ মখমলের বুগিয়ালে তখনও অচেনা শিশির বিন্দু ঘাসের ডগায় বসে হাসছে। ভেড়ারপাল বুগিয়ালের ঢাল বেয়ে চরতে চলেছে। আর আমরাও মিঠে রোদ গায়ে মেখে পথে নামলাম। বুগিয়াল পেরতেই ‘বোল্ডার-জোন’ শুরু হয়ে গেল। কোথাও সবুজের চিহ্ন মাত্র নেই। প্রকৃতির এই রুক্ষ রূপ আত্মস্থ করা কঠিন।
‘ভয়ঙ্কর-সুন্দর’ শব্দটা বইয়ের পাতাতেই এতদিন পড়েছি, এবার চাক্ষুষ করলাম। উপলব্ধি হল মহাদেবের রুদ্র-রূপের মহিমা, ‘সত্যম-শিবম-সুন্দরম’ এর যে কোন পুঁথিগত ব্যখ্যাই যেন এর কাছে অপূর্ণ। দেবভূমি হিমালয়, তপঃভূমি হিমালয় তাঁর স্বীয়-মহিমা নিজ-গুনে প্রকাশ না করলে সাধারণ মানবের সাধ্য কি তাকে অনুভব করে!! তাই তো প্রকৃত সাধকেরা সাধারণত ১৬০০০ ফুট উচ্চার নিচে নামেন না!!!
পাহাড়ের এক একটা বাঁকে প্রকৃতি যেন নিজেকে উজাড় করে দিচ্ছে। গাড়োয়ালের এই রূপ ভাষায় প্রকাশ করার ক্ষমতা ঈশ্বর আমাকে দেননি। শুধুই একটা আবেশ, একটা ঘোর, একটা অনাস্বাদিত আনন্দের হিল্লোল সারা দেহ-মন জুড়ে বয়ে চলেছে। দূরে চোখ গেলে শুধুই তুষারাবৃত পাহাড়। সেই পাহাড়ের গায়ে সূর্য-বিকিরণের ঝলসানিতে গাঢ় কালো রোদ-চশমাও হারমেনে যাচ্ছে, বেশীক্ষণ তাকান যাচ্ছেনা সেদিকে। ভাগ্যিস ট্রেলে এখন বরফ নেই তাই যেতে পারছি, অন্যথায় নেমে আসতে হত!
“সাব, ইয়ে জায়গা’নে অক্সিজেন বহুত কম হ্যায়। যিতনা জলদি হো’সকে ইস্ জায়গা পার হোনা হ্যায়”। সম্বিত ফেরে পন্ডিতজীর কথায়।
সামনে তাকিয়ে দেখি হাফ্-কিলোমিটার ট্রেল’টা গেছে একটা বেসিনের মত জায়গার মধ্য দিয়ে। আমরা এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছি আর ওপারটার উচ্চতা এক। ট্রেলটা প্রথমে ডাউনওয়াড হয়েছে, পরে আপওয়াড হয়ে ও’মাথায় উঠেছে। এমনিতেই ট্রি-জোনের পর অক্সিজেনের লেয়ার ক্রমশ কমতে থাকে আর এই রকম বেসিনের মত পকেটে কার্বনডাই অক্সাইডের লেয়ারটা বেড়ে থাকে। গাছ নেই যে, কেবানাবে কার্বনডাই অক্সাইড থেকে অক্সিজেন! পুকুরে বা নদীতে ডুব দিয়ে একটু বেশীক্ষণ থাকলে যেমন একটা কষ্ট হয়, সেইরকম একটা কষ্ট সয়ে আমরা সবাই ওমাথায় পৌঁছলাম। ক্ষণিকের বিশ্রামের পর আবার চরৈবেতী। যত অল্টিচিউট গেন করছি তত’ই রোদের তেজ পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। হাতের গ্লাভস্ অমলদার নিষেধ সত্ত্বেও আগেই খুলে রেখেছিলাম, এখন বুঝছি কি ভুল করেছি! ফুলহাতা জামার হাতা অবধি মোটামুটি ঠিক আছে। কিন্তু তারপর! হাতের তালু-চেটো সান-বার্ণ হয়ে গাঢ় কালচে-লাল রঙের হয়ে গেছে!(এই স্মৃতিচিহ্ন’টি মাসখানেক ছিল)
কিছুক্ষণ ধরেই কামান দাগার মত একটা শব্দ শুনতে পাচ্ছি, জিজ্ঞাসা করলাম পন্ডিতজীকে।
উত্তর এল, “ও’তো এ্যাভেল্যান্জ’কা আওয়াজ হ্যায়। ধূপ যিতনা বাড়েগা, এ্যাভেল্যান্জ উতনাই য্যাদা হোগা”!
পাহাড়ের তুষারাবৃত অংশে রোদের তেজে বরফ কিছুটা নরম হয়ে পড়লে বরফের একটা অংশ নুড়ি-পাথর সমেত নিচের দিকে গড়িয়ে আসে, এই ঘটনাটাকে এক কথায় ‘এ্যাভেল্যান্জ’ বলে! বড় এ্যাভেল্যান্জ হলে, দূর থেকে দেখা যায় পাহাড়ের গায়ে যেন ধোঁয়া উড়ছে! যারা ক্লাইম্বার, তাঁদের এ্যাভেল্যান্জের কবলে পড়ার একটা সম্ভাবনা থেকে যায়। আমরা সখের ট্রেকার, আমাদের এর কবলে পড়ার কোন সম্ভাবনা নেই।
ট্রেল থেকে অনেকটা দূরে পাহাড়ের গায়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা বরফের মাঝে চ্যাটালো জায়গায় পান্না-সবুজ জলের ছোট ছোট জলাশয় দেখতে পাচ্ছি। জিজ্ঞাসা করাতে অমলদা উত্তর দিল,
“দেবা, প্রকৃতির লীলা বোঝা ভার! মা জগদম্বা তাঁর অবোধ-সন্তানদের তৃষ্ণার কথা ভেবেই হয়ত এই দুর্গমস্থানে জলের ব্যবস্থা করে রেখেছেন! রোদের তাপে আশেপাশের বরফ-গলা জলে ওই জলাশয়গুলি সবসময়ই পূর্ণ থাকে আর ওতেই WILD-LIFE তৃষ্ণা মেটায়”।
“ঔর কিতনা দূর পন্ডিতজী”? প্রশ্নের জবাব পেলাম,
“ব্যাস্, আগিয়া”। “ব্যাস্, আগিয়া” কথাটা বার দশেক শোনার পর, ডানহাতি এক পাহাড়ি-চড়াইয়ের বাঁকের ধারে দেখা মিলল হাল্কা-নীল জলের একটি লেকের ছোট ভগ্নাংশের। হ্যাঁ, এটাই কেদারতাল!! চলার পথে প্রথম দর্শন এখান থেকেই হয়। একটা লক্ষ্যে পৌঁছনোর আনন্দ, একটা মন ভরে ওঠার তৃপ্তি, একটা সব পেয়েছির দেশে প্রথম পা রাখার অনুভূতি। সব মিলিয়ে একটা কেমন যেন থম মেরে গেলাম।
“চলিয়ে সাব, ঔর তো স্রিফ্ পনরো-বিশ মিনিট কা বাত হ্যায়”। সম্বিত ফেরে পন্ডিতজীর কথায়। সবাই এগিয়ে গেছে, আমিই শুধু দাঁড়িয়ে আছি। পা চালালাম ক্যাম্পিং গ্রাউন্ডের দিকে।
দেবাত্মা হিমালয়, শিবভূমি হিমালয়, আত্মজ্ঞান লাভের পীঠস্থান হিমালয়। তোতাপাখির মতন বইয়ে পড়া মন্ত্রসম শব্দগুলি কোনদিন যে জীবন্ত হয়ে চোখের সামনে উঠে আসবে, তা ছিল কল্পনাতীত। দাঁড়িয়ে আছি ক্যাম্পিং-গ্রাউন্ডে। সামনের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব দিকে থালাইসাগর, ভৃগুপন্থ ইত্যাদি শৃঙ্গগুলি যেন মহাদেবের এক একটি রূপ! পশ্চিমে কেদারগঙ্গার উৎস প্রাকৃতিক-হ্রদ কেদারতাল স্ব-মহিমায় বিরাজমান! এ্যাভেল্যান্জের শব্দে যেন সৃষ্টি হচ্ছে দেবাদিদেবের ডমরু-বাদ্য। সমুদ্র মানুষকে Extrovert করে দেয় আর পাহাড় আমাদের Introvert করে নেয়! কোন কথা বলতে ভাল লাগছেনা, একটা আবেশ সারা দেহ-মনে জড়িয়ে আছে। মৃত্যুর পর স্বর্গে যাওয়া যায় কিনা জানিনা, তবে জীবদ্দশায় নিশ্চিত স্বর্গারোহণ হয়ে গেল!
(পঞ্চম পর্ব)
ক্যাম্পিং-গ্রাউন্ড থেকে প্রায় হাজার দেড়েক ফুট নিচে কেদারতাল। নামার রাস্তা দু’টি, একটি শর্টকাটে টিকটিকির মত পাথর বেয়ে নামতে হবে আর অপরটি অপেক্ষাকৃত সমতল জায়গা দিয়ে অনেকটা ঘুরে আসতে হবে। অমলদা উত্তরকাশীর নেহেরু ইন্সটিটিউট অফ মাউন্টেনিয়ারিং’এর বেসিক-কোর্স পাস করা। উনি প্রথম পথটা বাছলেও আমি চললাম দ্বিতীয় পথটা দিয়ে। অনেকটা ঘুরে আসতে গিয়ে একটা বাড়তি লাভ হল। এক জায়গায় দেখি পাথুরে জমিতে, কেদারগঙ্গা যেখান থেকে সবে মাত্র কেদারতাল থেকে বেরিয়ে নদীরূপ পাচ্ছে, সেখানে প্রকৃতির আপন খেয়ালে সৃষ্টি হয়েছে গুল্ম আর ঘাস জাতীয় কিছু উদ্ভিদের, রুক্ষ পাথুরে প্রকৃতির মাঝে অনেকটা জায়গা নিয়ে সবুজের আভাস যেন বিশ্ব-প্রাণের প্রতীক। মনে পড়ে গেল স্বামীজীর সেই বিখ্যাত উক্তি, “Life is the unfoldment and development of a being under circumstances tending to press it down”.
“এ্যাই লে, ছোটাবাবু উলাট গিয়া”! ক্যাম্পিং-গ্রাউন্ড থেকে ‘মেজবাবু’র রসালো মন্তব্য। ভুলটা আমারই ছিল। শর্টকাটের বাসনায় একটা লাফ দিয়েছিলাম কেদারগঙ্গার এপার থেকে ওপারে যাবার বাসনায়। কিন্তু লাফ দেওয়ার মুহূর্তে যে পায়ে ভর দিয়েছিলাম, সে যে মাটিতে আটকে থাকবে তা কিকরে জানব!
ফলে হল কি লক্ষ্যের বদলে যেখানে এসে পড়লাম, পুরো থকথকে কাদা। হাঁটু অবধি কাদায় ঢুকে গেল। কোনরকমে খাড়া হয়ে ওই অবস্থায় চলতে শুরু করলাম।
কেদারতালের পাড়ে এখন যে জায়গাটায় দাঁড়িয়ে আছি, এটাই হচ্ছে বেস্ট ভিউ পয়েন্ট। প্রচন্ড হাওয়ার বেগে জলে ছোট ছোট ঢেউ উঠেছে, ফলে জলে থালাইসগরের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠছেনা। শুনেছিলাম অপূর্ব লাগে সেই দৃশ্য, কপাল খারাপ আমাদের। ফিরে এলাম ক্যাম্পিং-গ্রাউন্ডে আর এখান থেকেই উপভোগ করতে লাগলাম কেদারতালের মাধুর্য্য। সূর্য্যের অবস্থানের তারতম্যে জলের রঙের পটপরিবর্তন হচ্ছে। কখনও হাল্কা সি-গ্রীন, কখনওবা গাঢ়-সবুজ। আবার কখন যেন নীল থেকে গাঢ় নীল।
এখান থেকে দক্ষিণদিকে আরও কিছুটা গেলে এ্যাডভান্স বেস-ক্যাম্প। সে জায়গার রূপ’ও আলাদা। উন্মুক্ত পশ্চিম দিগন্ত জুড়ে শুধুই স্নো-পিক। যোগিন ১,২,৩ ছাড়াও খর্চাকুন্ডকে স্পষ্ট দেখা যায় এখান থেকে। কিন্তু কেদারতালের ক্যাম্পিং-গ্রাউন্ডের পর থেকে ‘স্নো-জোন এরিয়া’ শুরু হচ্ছে। রুক্ষ পাথরের রাজত্ব শেষ হয়ে তুষার রাজত্বের শুরু। উপযুক্ত সাজ-সরঞ্জাম ছাড়া ওপথে যাওয়া অনুচিত। আমাদের দৌড়’ও এই অবধি, আগামীকাল ফিরে যাব গঙ্গোত্রীতে, ২১কিমি উতরাইয়ের পথে।
এখন বিকাল পাঁচটা, বৃষ্টি হয়ে গেছে একটু আগে। সে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা! বৃষ্টির জল মাটিতে পড়ে কচুপাতার উপরে থাকা জলের মত আকার নিচ্ছিল। না জল, না বরফ। আঙুল দিয়ে স্পর্শ করতেই ভেঙে জল হয়ে যাচ্ছিল। প্রচন্ড ঠান্ডা কিন্তু পরিষ্কার আকাশ। সূর্য্য পশ্চিমপাটে যাবার আগে পেঁজা তুলোরমত মেঘের গায়ে রঙের খেলা দেখাল বটে! সূর্য্যাস্ত হচ্ছে কেদারতালে, চারিদিকে আলো ক্রমশ কমে আসছে। সূর্য্য-রশ্মির ফোকাস-বিন্দু এখন থালাইসাগরের মাথায়, ওঃ সে এক অপার্থিব দৃশ্য। মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে আছি সেদিকে।
চাঁদ উঠেছে। থালাইসাগরের গায়ে তার রিফ্লেক্সান এক অপার্থিব জগতের সৃষ্টি করেছে। পৃথিবীটা এখন শুধুমাত্র দু-র