
প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা

পুজো বার্ষিকী
১৪৩০

কবিতা
কবিতা
প্রচ্ছদঃ সুরজিত সিনহা
লেখক/লেখিকাবৃন্দ

প্রবন্ধ
'মানুষ মানুষের জন্য', এই গানটাই প্রথম মনে এসেছিল ভাসমান নৌকায় ভাসতে ভাসতে এক আকস্মিক প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে। আর তারই ফসল আজকের এই বাড়তি পাওনা, অপূর্ব এক সবুজ দ্বীপ ভ্রমণ।
মাঝে মাঝে যেমন ঘরের ফার্নিচারের অ্যারেঞ্জমেন্ট বদলালে নতুন ঘরে বাস করছি বলে মনে হয় তেমনই মনকে সতেজ রাখতে স্থানান্তরের দরকার পড়ে, সেটা নিকট হোক বা দূর যাই হোক না কেন।
ইদানিং কর্মস্থল পশ্চিমবঙ্গ ও আসাম সীমানায় অবস্থানের সূত্রে এক অন্য দুয়ার খুলে গেছে আপনা থেকেই। সেই মতো আজকের গন্তব্য আসামের এক বহু প্রাচীন বন্দর শহর, ধুবড়ি। যার সাথে জড়িয়ে আছে পৌরাণিক লোকগাথা, ব্রিটিশ আমলের আন্তর্জাতিক নদী বন্দর, ম্যাচ ফ্যাক্টরি, গুরু নানকের পদধূলি থেকে দেবদাস খ্যাত প্রমথেশ বড়ুয়ার নাম।
যাত্রাপথে একে একে পেরিয়ে চললাম তুফানগঞ্জ, বক্সিরহাট, হালাকুড়া, আগমনী প্রভৃতি জনপদ। একেবারেই সাদামাটা মফস্বলি জায়গা, জনজীবন চলছে আপন ছন্দে। রাস্তাঘাট এবং গ্রামাঞ্চল দেখে বোঝা যাচ্ছে জায়গা গুলো মুসলিম অধ্যুষিত। ধুবড়ি জেলা ভারতের মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলা সমূহের মধ্যে অন্যতম। এরই মধ্যে কখন রাস্তার পাশে রেললাইন সঙ্গী হয়েছে। রাস্তার দুপাশে মান্দার ফুলের স্নিগ্ধ লালে চোখে ঘোর লাগার উপক্রম। ফাগুনের শেষে নিম্ন আসামের গোয়ালপাড়া ও ধুবড়ির দিকে মান্দার গাছে আগুন রঙা ফুলের আধিক্য চোখে পড়ার মতো।
এসে পড়লাম গৌরীপুর, যার নাম বহু আগে থেকেই শুনে আসছি নানাভাবে। এখানকার রাজবাড়ির সন্তান প্রমথেশ বাবু, তার ভাই হস্তি বিশারদ লালজি অর্থাৎ প্রকৃতীশ বড়ুয়া তথা ওনার কন্যা 'মাহুত বন্ধু রে' খ্যাত প্রতিমা বড়ুয়া সকলেই নিজ ক্ষেত্রে বিখ্যাত।
আসলে গৌরীপুর আর ধুবড়ি হল যমজ শহর। সামনের রাস্তা চলে গিয়েছে গুয়াহাটি অভিমুখে। আমরা গৌরীপুর থেকে ডাইনে টার্ন নিলাম। অনেক আগে থেকেই রেললাইন সাথে সাথে চলছিল, এখন রাস্তার বাঁ পাশে যোগ দিল গদাধর নদী যেটা ধুবড়িতে ব্রহ্মপুত্রে মিশেছে। বর্ষায় এর রূপ একদমই আলাদা, তখন গৌরীপুর ও ধুবড়ির অনেক স্থান বানভাসি হয় এর প্রকোপে। একপাশে রেললাইন অপর পাশে নদীকে সঙ্গে নিয়ে পৌঁছে গেলাম ধুবড়ি।
শহরে এখনো পুরনো রিক্সার চল, টোটো এখনো টো টো করে ঘুরতে শুরু করেনি।
রিক্সা ধরে এগিয়ে চললাম ঘাটের দিকে, রাস্তার দুপাশে চোখে পড়ছে নতুন ও পুরোনো বাড়ির মিশেল। রিক্সাওয়ালাকে এখানের ম্যাচ ফ্যাক্টরির কথা জিজ্ঞেস করাতে বললো যে সেটা তো অনেকদিন থেকে বন্ধ। কথার মধ্যে কোথাও একটা কষ্ট লুকিয়ে আছে মনে হলো। হয়তো এই ফ্যাক্টরির সাথে জড়িয়ে ছিল তার সম্পূর্ণ পরিবারের জীবন যেটা বন্ধ হওয়াতে তাকে এই জীবিকা বেছে নিতে হয়। সত্যিই একসময় সারা ধুবড়ি পরিচিত ছিল এই ম্যাচ ফ্যাক্টরির জন্য। ১৯২৬ সালে সুইডিশ কোম্পানি ১৩২ বিঘা জমিতে স্থাপন করে এই ম্যাচ ফ্যাক্টরি, তখন নাম ছিল Assam match factory। সে সময় ২০০০ শ্রমিক কাজ করতো তাতে। পরে ১৯৭৯ সালে এর নাম হয় WIMCO বা Western India Match Factory। পরে ১৯৯৭ সালে সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয় যে, সংরক্ষিত জঙ্গলের গাছ কাটা যাবে না আর তারই প্রভাব এসে পড়ে এই ম্যাচ ফ্যাক্টরিতে এবং সে বছরই পুরোপুরি ভাবে বন্ধ হয়ে যায় এই শতাব্দী প্রাচীন কারখানাটি।
এরই মধ্যে এসে পৌঁছলাম বিখ্যাত নেতাই ধুবুনীর ঘাটে। কথিত আছে সাপের দেবী মনসার ভগ্নী ছিলেন নেতাই, একজন ধুবুনী বা ধোপানী। নেতাই এর পরামর্শ মতে সতী বেহুলা তার স্বামী লখীন্দরের জীবন, যমের হাত থেকে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিল। এই নেতাই ধুবুনীর কাপড় কাচার ঘাট ছিল এখানে ব্রহ্মপুত্রের তীরে। ঘাটে অবস্থিত প্রকান্ড এক পাথর, যেটার উপরে কাপড় কাচা হতো, এখনো রয়েছে সেটা সংরক্ষিত অবস্থায়। আর এই ধুবুনী শব্দ থেকেই ধুবড়ি নামের উৎপত্তি বলা হয়।
কিছুক্ষণ বসে রইলাম ব্রহ্মপুত্রের অপার জলরাশির দিকে চেয়ে, পাশেই গদাধর এসে মিশেছে। স্লেট রঙা জলে ছায়া দোলে, ভাঙে, চুরমার হয়। ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে দাঁড়িয়ে দূরে গারো পাহাড়ের রেখা দৃশ্যমান। আহা, এ দৃশ্য যে ভোলার নয়। এতকিছু চোখের সামনে, ভাবতেই মন অনাবিল এক আনন্দে নেচে ওঠে অর্থাৎ আমি সঠিক জায়গায় এসে পৌঁছেছি। পাশেই রাহুল দেব বর্মণের নতুন বসানো আবক্ষ মূর্তি স্বভাবতই মন ভালো করে দিল, তাঁর সুরে মজে ছিল একসময় আসমুদ্রহিমাচল ভারতবাসী। আমিও তো সেই সাত বছর বয়স থেকে মজে মেহবুবার 'মেরে নয়না শাওন ভাদো' শোনার পর থেকে। যে কোন ভ্রমণ কাহিনী তো আসলে আত্মজীবনীরও একটা টুকরো।
কোনও নতুন জায়গা দেখতে হলে পায়ে হেঁটে ঘোরাই প্রকৃষ্টতম, তাই নদীর ধার বরাবর হাঁটা দিলাম। এ শহরের সাথে আমার দেখা চন্দননগরের মিল রয়েছে কিন্তু ব্রহ্মপুত্রের সাথে কারো কোনো তুলনা চলে না। কেউ কেউ নদ হয়ে জন্মায়, অন্যরা নদী। জনমানসে ভাবমূর্তিকে চাঙ্গা করে রাখতে রাখতে খানিকটা পুরুষালী গাম্ভীর্য ক্রমশ তার মজ্জায় ঢুকে পড়ে। তাই একটু এগিয়েই বিরাট ব্রহ্মপুত্র চলে গিয়েছে বাংলাদেশে, নারী হওয়ার বাসনায়। এতো দিনের পৌরুষ ত্যাগ করে সে সেখানে উচ্ছল যুবতী যমুনা।
এখানে তীর বরাবর এক একটি প্রশাসনিক দপ্তর, বেশ জমজমাট এ চত্বর। চোখে পড়লো কাঠের তৈরি অপূর্ব সার্কিট হাউস, কিছুক্ষণ আমাকে স্থবির করে রাখলো এই অসাধারণ কাঠের তৈরি ইমারত। এখানকার পৌরসভা ১৮৮৩ সালের, স্বভাবতই এক পুরাতনী জৌলুসপূর্ণ ছাপ রয়েছে সারা শহর জুড়ে। পাশেই ভূমিপুত্র ভুপেন হাজারিকার বিশাল মূর্তি। ভালো লাগলো যে মূর্তিতে পাখিদের আদরের চিহ্ন লেগে নেই। এগিয়ে চললাম নদীর তীর বরাবর। অচেনা, অজানা জায়গায় একা একা হাঁটতে ভারী ভালো লাগে। একা তো নয়, যেন নিজেকেই নিজের মধ্যে পরিপূর্ণ রূপে পাওয়া।
একটু পরেই এসে পড়লাম বিশালাকার গুরুদোয়ারার সামনে। ধুবড়ির অন্যতম প্রধান আকর্ষণ এই গুরু তেগ বাহাদুর সাহিব গুরুদোয়ারা। গুরু নানকের পবিত্র চরণধূলি মিশ্রিত এই মাটি। গুরু তেগ বাহাদুরও এসেছিলেন এই বন্দর নগরীতে। শিখ ধর্মাবলম্বীদের কাছে বড়ই পবিত্র এই ভূমি, অন্যান্য ধর্মের মানুষরাও এখানে শ্রদ্ধার সাথে আসেন। গেট পেরিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলাম, সামনে বিশাল প্রশস্ত চত্বর। একদিকে মূল মন্দির অপরদিকে লঙ্গরখানা সহ উপরে থাকার জায়গা।
জুতো খুলে, হাতে পায়ে জল দিয়ে, মাথার চুল ঢেকে প্রবেশ করলাম মূল মন্দিরে। আরাধনা চলছে ভিতরে, চারিদিক ঘুরে দেখলাম। অপূর্ব সব নকশা কারুকাজে সজ্জিত উপাসনাগৃহটি। আর এখানের প্রসাদ মানেই তো ঘিয়ে মাখোমাখো হালুয়া।
পাশে অফিস ঘর, ভিতরে গেলাম থাকার কি নিয়ম জানতে। যিনি ছিলেন তিনি সুপ্রসন্ন মুখে আমার দিকে চেয়ে বললেন 'আগে নাস্তা তো করে নেন'। খিদেও পেয়েছিল, তাই বাধ্য ছাত্রের মতো ওনার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে চললাম লঙ্গরখানার দিকে। যাওয়া মাত্রই আমাকে থালা নিতে বললেন। থালা নিয়ে বসে পড়লাম, পরিবেশিত হল রুটি, তরকা জাতীয় ডাল ও পায়েস। খেতে খেতে মনে পড়ছিল অমৃতসরের কথা, ওখানের বিশালাকার লঙ্গরখানার কথা। স্থানীয়দের কাছ থেকে জেনেছিলাম ওখানের প্রত্যেক বাড়ির মেয়ে, বৌমা বা শাশুড়ি কেউ না কেউ রোজ এসে এখানে সেবা দিয়ে যান। কথাটা শুনে খুব ভালো লেগেছিল, প্রত্যহ এমন সদ্ অভ্যাসের কথা ভেবে। যাইহোক এর মধ্যেই একজন চা দিয়ে গেল। পেটপর্ব সমাধা করে বের হলাম গুরুদোয়ারা থেকে।
কিছু দূর গিয়ে দেখি রাস্তার পাশেই এক ছিমছাম ব্রাহ্মমন্দির। চারপাশ সবুজ গালিচার মতো ঘাসে ভরা। লেখা রয়েছে স্থাপনা কাল, ১৮৭৫। বন্ধ দরজার সামনে বসে পথচলতি এক কিশোর কিছুটা জিরিয়ে নিচ্ছে। স্থাপনা কাল দেখেই মন এক ঐতিহাসিক হিসেব মেলাতে শুরু করলো। পড়েছিলাম যে ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেনের কন্যা সুনীতি দেবীর বিবাহ হয় কুচবিহারের রাজা নৃপেন্দ্রনারায়নের সাথে ১৮৭৮ সালে। কেবল কন্যার বিবাহ নয়, সঙ্গে সঙ্গে কেশববাবু নূতন ধর্ম ও নীতি কুচবিহারে নিয়ে গিয়েছিলেন। তাহলে কুচবিহার থেকে মাত্র ৮০ কিমি দূরের ধুবড়িতে তারো আগে ব্রাহ্মমন্দির প্রতিষ্ঠা হলো কার দ্বারা। এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া খুবই কঠিন কারণ এখন যে প্রকৃত সিধুজ্যাঠার বড়ই অভাব। যাইহোক এসব ভাবতে ভাবতেই এগিয়ে চললাম সামনের দিকে।
এখানের যাত্রী পরিবহনের মূল ঘাটটি হলো যোগমায়া ঘাট। সারি সারি লঞ্চ, নৌকা দাড়িয়ে রয়েছে। চারিপাশ থিকথিক করছে মানুষ জনে। সবার মধ্যেই ব্যস্ততা, কেউ ঘাটে নেমে শহরে আসছে তো কেউ লঞ্চ ধরতে ছুটছে। তারই মধ্যে চলছে হরেকরকমের বিকিকিনি, জোরকদমে। ঘাটের দুইপাশে সারি সারি খাওয়ার হোটেল, তাতেও ব্যস্ততা। প্রত্যেক হোটেলের খদ্দের ধরার তৎপরতা চোখে পড়ছে, কর্মচারীরা মেনু শুনিয়ে যাচ্ছে গড়গড়িয়ে। যেন এ এক অন্য ভারত চাক্ষুষ করছি
আমি। নিজেই মনে করার চেষ্টা করছি, এমন কি কখনো পেয়েছি আগে? না। তবে এমন বর্ণনা অনেক পড়েছি বইয়ে। সবই পূব বাংলা তথা পরের বাংলাদেশ কেন্দ্রিক লেখায় জাহাজঘাটার বর্ণনায়। তবে পড়ার সময় লঞ্চঘাটার সুস্বাদু খাবারের কথা শুনে যেভাবে জিভে জল আসতো, সেটা আর হলো না গুরুদোয়ারার উদরপূর্তি ও হোটেলের পরিবেশ দেখে। এক একটা লঞ্চ থেকে প্রায় ৫০০ মানুষ নামছে, হয়তোবা বেশীও হতে পারে। আসছে তারা তিন চার ঘন্টার পথ অতিক্রম করে ফুলবাড়ি, হাটসিংমারি থেকে। একটা লঞ্চ দিনে একবারই যাতায়াত করে। প্রত্যেক লঞ্চ বা নৌকায় উড়ছে ভারতীয় পতাকা তার নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য। সত্যিই এ এক অন্য জগৎ, এখানে না এলে এক অন্য ভারত এদেখা থেকে যেত। যাত্রীরা যেখানে অপেক্ষা করছে লঞ্চ ধরার জন্য, সেরকম একটা জায়গা বেছে একটু বসলাম। যদিও সেটা আমার কাছে অবজারভেশন ব্যালকনি বলা যায়। ফুরফুরে হিমেল হাওয়া বইছে চারিপাশে। সূর্য মাথার ওপরে, তবে এ রোদ কষ্ট দেয় না, এখনো শীত এদেশে। তবে যেটা মনে হচ্ছে শুধুমাত্র আমারই কোন গন্তব্যে পৌঁছবার তাড়া নেই। খবরদারি নেই ঘড়ির ওপর। মূল্যবান সময়কে পথের মেজাজের উপর ছেড়ে দিয়ে উদ্দেশ্যহীনতাকে পাথেয় করে এরকম বিরতির মজাই আলাদা।
ঘড়িতে এখন সাড়ে ১০টা বাজে, এগিয়ে গেলাম লঞ্চের খবর নিতে যদি কাছাকাছি কোথাও যাওয়া যায়। তবে খবর আশাপ্রদ নয়, কারণ এখানের প্রত্যেকটা লঞ্চ, যেটা যাবে তার গন্তব্যে, সে আর আজকে ফিরবে না কারণ যাত্রাপথ প্রত্যেকের কম বেশি তিন থেকে পাঁচ ঘন্টা। ধুবড়ি থেকে একমাত্র একটা লঞ্চ সকাল ৮টায় ছেড়ে হাটসিংমারি পৌঁছায় পৌনে ১২টায়। আবার সেটা ২টোয় ছেড়ে ধুবড়ি ফিরে আসে সন্ধ্যা ৬টায়। ধুবড়ি থেকে অফিস যাত্রীরা এটাতেই অফিস করে। হাটসিংমারি জায়গাটা হচ্ছে এক নদীবন্দর শহর যার অর্ধেকটা আসাম আর বাকি অর্ধেকটা মেঘালয়। কি, শুনেই যেতে ইচ্ছে করছে না এমন এক দিকশূন্যপুর দেশে। আমি আজ ফিরবো মনস্থির করে এসেছি, তাই ও পথে আর পা বাড়ালাম না কিন্তু যাব তো অবশ্যই একদিন। তাই বিফল মনোরথে ফিরে এলাম আগের স্থানে। এদিকে মন বলেই চললো যে হাতে কিন্তু সময় আছে তাই আবার খবরাখবর নিতে পাশের নৌকা ঘাটে গেলাম। আমার প্রোগ্রাম তাদের বলাতে, তারা বললো তাহলে নৌকা করে সামনের চরটা ঘুরে আসুন না। জিজ্ঞেস করে জানলাম ১১টায় যে নৌকা যাবে সেটি সামনের চরে পৌঁছাবে পৌনে ১২টা নাগাদ। তারপর সেটা ফিরে আসবে ১২টাতে আর ধুবড়ি পৌঁছাবে সাড়ে ১২টা নাগাদ।
সেই মতো নৌকায় চেপে বসলাম। নৌকার সকলেই প্রায় সামনের চরগুলোর বাসিন্দা, নানা বয়সের মহিলা পুরুষ। আপন আপন দলে গল্প বেশ জমিয়ে চলছে। মাঝে ঝালমুড়িওয়ালা এরই ফাঁকে যাত্রী টপকে বিক্রি করে চলেছে। সকলেই মুসলিম সম্প্রদায়ের, পুরুষদের অনেকের কাঁধে আসামের বিখ্যাত গামোছা জড়ানো। কোথাও যাওয়ার রাস্তায় সামনের অচেনা নারী পুরুষের চরিত্র, জীবিকা ও পাশাপাশি দুজনের মধ্যে সম্পর্ক ইত্যাদি নিয়ে ধারণা করে নি। অনেকসময় তা মেলে আবার কখনো তা মেলে না। তবু মনে মনে এই রকম অনুমানের খেলা খেলতে বেশ লাগে। যাত্রী বসার পর নৌকা ভরতে থাকলো নানারকম মালপত্রে, গ্রোসারি সামগ্রী থেকে ঝাঁকা ভর্তি মুরগী কিছুই বাদ থাকলো না। এরপর নৌকা ঘাট থেকে বেরোলো অনেককে পাশ কাটিয়ে, মাঝে মাঝে এক দুটো টক্কর যে লাগলো না তা নয়। নৌকা এবার মূল নদীতে এসে পড়লো। নৌকায় বেরিয়ে বুঝলাম, লঞ্চ ভ্রমণের সাথে এর কোনও তুলনায় হয় না। নৌকোয় বসে নদীকে অনেক বেশী কাছে পাওয়া যায়। চারিদিকের গল্পের মাঝে আমিই একমাত্র নদীকে দুচোখ ভরে চাক্ষুষ করছি কারণ বাকিদের তো এটা রোজনামচা। হাওয়ায় বেশ শীত শীত ভাব, মাঝে মাঝে ঝাঁকা ভর্তি মুরগী থেকে আসা বাতাস, আমাকে কল্পনার জগৎ থেকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনছে।
এরই মধ্যে আমার পাশে বসা এক পরিবারের একটা ২৫-২৬ বছরের সুশ্রী যুবক মাঝে মাঝে আমার দিকে তাকাচ্ছে। তারপর হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো 'আপনি কি হাসপাতাল যাবেন?' আমি না বলে, তার এই উদ্ভট প্রশ্নের কারণ জানতে চাইলাম। তখন সে বললো যে, সামনের চরে তার বাড়ি। ওখানের গ্রামীণ হাসপাতালে মাঝে মাঝে ধুবড়ি থেকে ডাক্তার বাবুরা আসেন। আমাকে সে ডাক্তার ভেবেছিল। হঠাৎ আমার চোখের সামনে ভেসে উঠলো সেইসব পরীক্ষার দিন গুলোর কথা, যদিও জানি ডাক্তারী পরীক্ষা আমার পক্ষে একটু হেভিই ছিল। ক্লোজ বন্ধু ডাক্তার হলে পার্থক্যটা আরো ভালো বোঝা যায়। শুধু মাথায় ঢুকছিল না হঠাৎ করে পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে আসামে ডাক্তারী করতে আসার ব্যাপারটা। আবার মুরগীর ঝাঁকার আমিষ হাওয়া আমাকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনলো।
এরপর আমাদের মধ্যে কথাবার্তা জমে উঠলো। সে বললো তার নাম সোহন হোসেন। সামনের স্থলভূমি দেখিয়ে বললো আগে ওখানে ওদের বাড়ি ছিল, এখন গৌরীপুরে থাকে, পড়াশোনা করে ব্যাঙ্গালোরে। মাকে নিয়ে দিদির বাড়ি চললো। আমার কাছে প্রোগ্রাম শুনলো যে সামনের চর ঘুরে এই নৌকাতেই ধুবড়ি ফিরে যাব। এরই মধ্যে নৌকা মাঝ নদী পেরিয়ে তীরের দিকে চলেছে। নদীর স্রোতধারার বুকেই পাশাপাশি এই রকম দু তিনটে চর, তবে সামনেরটা তো বিশাল এক দ্বীপ। সোহন বললো যে আপনার হাতে কতো সময় আছে, দু ঘন্টা আছে?
আমি বললাম কেন?
তখন সে বললো আপনি আমাদের চর ঘুরতে এসেছেন আর এভাবে ফিরে যাবেন, তাই কি হয়। আমি আপনাকে আমাদের চর ঘুরিয়ে দেব, দেড়টার মধ্যে আপনাকে আমি নৌকা ধরিয়ে দেব।
এরপর ও নদীর দিকে দেখিয়ে বললো ওই পিলারগুলো দেখতে পাচ্ছেন? দেখলাম সত্যিই দূরে নদীর মধ্যে অস্পষ্ট কয়েকটা পিলার দেখা যাচ্ছে। তখন ও বললো ধুবড়ি থেকে ফুলবাড়ি অবধি ব্রিজ তৈরি হচ্ছে ব্রহ্মপুত্রের উপর। পরে জেনেছিলাম এটা ভারতের দীর্ঘতম ব্রিজ হতে চলেছে, লম্বায় ১৯.৩ কিমি তবে শেষ হতে এখনো কয়েক বছর। আমাদের কথাবার্তায় শুধু ব্রহ্মপুত্রের অপার জলরাশি ভাগ হয়ে যাচ্ছিল পানি ও জল এই দুই ধর্মভাষায়।
নৌকা এরমধ্যে এক একটা ঘাটে দাঁড়াতে থাকলো। যাত্রী এবং মালপত্র একে একে নামছে। কপাল খুব ভালো, প্রথম ঘাটেই কুক্কুট ঝাঁকা নেমে গেল, যাক সাময়িক স্বস্তি। ঘাটে দাড়িয়ে রয়েছে ঘোড়ায় টানা গাড়ি মালপত্র বহনের জন্য। এদিকে আমার মধ্যে শুরু হয়েছে এক ধরনের মানসিক দ্বন্দ্ব। সোহনের কথা মতো যেতে তো ইচ্ছা করছেই এক নতুন পৃথিবী দেখতে কিন্তু আবার ভাবছি একদম অপরিচিতের সাথে এভাবে অচেনা জায়গা যাওয়াটা ঠিক হবে? মনস্থির করতে একটু সময় লাগলো, তারপর মনে হলো মানুষকে বিশ্বাস না করলে আর কাকে করবো? সাথে মনে আসছিল আসামের আতিথেয়তার কথা। আর এরকম একটা সুযোগ নষ্ট করতেও মন চাইছিল না। তাই তৎক্ষণাৎ ওকে আমার সম্মতিটা জানিয়ে দিলাম। সে তখন ফোন করে কাকে কি বললো। নৌকা একটি দুটি ঘাট পেরিয়ে চললো, আমরা নামবো শেষ ঘাটে। এখান থেকেই ফেরার নৌকা ছাড়বে। নৌকা ঘাটে লাগলে এক এক করে নামতে থাকলাম।
চরে নেমে শরীরটাকে একটু ছাড়িয়ে নিলাম, একটানা এতক্ষণ নৌকায় বসে থাকার জন্য। সোহনের কথা মতো এগিয়ে গেলাম ওর সাথে, দেখছি সবাই ওর পরিচিত, গ্রামে যে রকম হয়। কিছুদূর গিয়ে এক বাড়ির সামনে দাঁড়ালো। এদিকে আমার মধ্যে একটা ইতস্তত ভাব, কোথায় যাচ্ছি কিছুই জানি না, যার সাথে যাচ্ছি তাকেও চিনি না কিন্তু সেই এখন আমার এই অচেনা অজানা জগতে একমাত্র পরিচিত। এ এক অস্থির মানসিক দোলাচল, ফিরেও যাওয়া যায় না। এরমধ্যে দেখলাম ওর এক বন্ধুই হবে, বাইক বের করে রেখেছে। কিছু কথাবার্তার পর ওর মাকে বললো দিদির বাড়ি চলে যেতে, আমি চড়ে বসলাম বাইকে। বাইক চলতে থাকলে একটু স্বস্তি এলো মনে, একটু হালকা বোধ করলাম। ও একে একে দেখাতে থাকলো ওর পুরোনো স্কুল, মাদ্রাসা, পঞ্চায়েত অফিস। সাথে কথাবার্তাও চলছে, যেন কত দিনের পরিচয় আমাদের। চারিদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ। এই দেখুন মানসিক টানাপোড়েনে দ্বীপের নামটাই বলা হয়নি, এর নাম বীরসিং। দ্বীপে প্রচুর ঘোড়া গাড়ি মালপত্র বহনের জন্য, তাই এখানে সেখানে কয়েক শো ঘোড়া চোখে পড়লো। সোহন দেখালো, ওই যে আমাদের হাসপাতাল। আমি আমার রূপকথার কর্মস্থলটা একবার চাক্ষুষ করে নিলাম। শেষে দোকানে খাবার খাইয়ে আমাকে ঘন্টা খানেকের এক অনাবিল আনন্দ দিয়ে নৌকা ঘাটে পৌঁছে দিল। নৌকাও এসে পড়েছে, ১০ মিনিটের মধ্যেই ছাড়বে। এই ঘন্টা খানেকের আলাপে, সে এখন আমার আপনজন হয়ে পড়েছে, কত কথা বলে চলেছি দুজনে। সে আমাকে বলছে রাত্রে থেকে যেতে। বলে, আপনার জন্য তো কিছুই করা হলো না। পরের বার এসে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এলাম। হঠাৎ সে বললো উঠে পড়ুন, এবার নৌকা ছাড়বে। ফিরতে তো হবেই কিন্তু কোথাও একটা টান অনুভব করছিলাম ভিতর থেকে। চেপে বসলাম নৌকায়, ছাড়ার পর যতক্ষণ অবধি দুজন দুজনকে দেখতে পাচ্ছিলাম, দুজনে হাত নেড়ে চলছিলাম। এদিকে শীতের দুপুরের আলোছায়া মেখে ব্রহ্মপুত্র কেমন স্মিতমুখে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে।


কবিতা
সুব্রত মিত্র
কলকাতা
তলিয়েও অম্লান
আমাদের যৌবনের আবরণ মেখে
আমি স্নাতক হতে পারবো না,
প্রেমচাতক সাজবো,
তবু খরার ন্যাড়া মাথায় বৃষ্টির ঢেউ তুলব না।
প্রেম নগরে সবুজের বনে
বউ কথা কও কোকিলের কুহুবাণী
জানি আসবে কানে,
ভ্রমর নিরলস খোঁজে মধুর কলস
কোন কবি উপন্যাস লিখে চলে ধরণীর মায়াবলে।
বসন্তের রজনী, নিদ্রা লেগে তারাদের চোখে
যৌবন দেখেনি তবু, সুন্দরী রমণী
কালো কেশে প্রজাপতির কবিতা লেখে।
কবি কেন হয়েছি তারে ভালবেসেছি
এ যে মৃত্যুর প্রেরণার গান লিখে করেছি স্নান,
ভীরু কাপুরুষ তাই অসাহসে তলাই
রুক্ষ তরু বৃক্ষের পাশে আজও বসে আমি অম্লান

বঙ্গের নিয়তি
আজ দৌলতবাজিতে দোল খায় দুনিয়া
দুনিয়ায় চলছে শুধু ধ্বংসের অবলীলা
অমনোযোগীরা হয় কৃতকার্য
মনোযোগীরা হয় সদা ব্যর্থ,
শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে দেখি এসব কি আয়োজন?
নেই সেথা শিক্ষা সংস্কৃতির পুনরাবৃত্তি
আছে শুধুই বিনোদন
আছে শুধু হাহাকার আছে শুধু আস্ফালন;
শিক্ষাঙ্গনেও নেতার মন্ত্র...!
রাজ্যজুড়ে আছে শুধু নেতা নেত্রীর রঙ্গমঞ্চ
তামাশার ভারে তারা খুঁজছে আরো কিছু সঙ্গ
দৌলতবাজির ধাক্কাতেই যাচ্ছে পিছিয়ে
আমাদের সোনার পশ্চিমবঙ্গ,
দৌলতের কারবারীরা ধাপ্পাবাজির স্কুল খুলেছে
সেই ইস্কুলেই রত্ন সম সম্ভাবেরা জ্বলছে আর পুড়ছে,
নিয়তির ফাঁড়ায় কি দশা-ই যে গিলছে তোমায় আমায়..!
আজ দৌলতবাজিতে দুনিয়াটা দোল খায়
ধাপ্পাবাজির খপ্পরে পড়ে আমরা সবাই অসহায়।

আওল ফাগুন
ফুটিলা পলাশ শাখে পিক কুহু গায়
চল চল যাব সখি শ্যামল বন ছায়।
আসিবে কালিয়া বঁধু সাথে লয়ে ধেনু
তমাল তলেতে বসি বাজাইবে বেনু।
দরশিব পিয়া মুখ হৃদয়ের আশ
জুড়াইব জ্বালা দুই আঁখির পিয়াশ।
পিয়া দরশন বিনা নহে চিত থির
কালিয়া বঁধুর লাগি হৃদয় অধীর।
দাবানল সম দহে যৌবন আগুন
অশোকানন্দন ভনে আওল ফাগুন।
কবিতা
সুকান্ত পাল
জিতপুর, মুর্শিদাবাদ
প্রাণের ভাষা বাংলা ভাষা
বাংলাকে বড় বেসেছি যে ভালো, বাংলাকে ভালোবাসি
আমি একবার নয়, বারবার যেন বাংলায় ফিরে আসি।
বাংলা আমার “গীতাঞ্জলী” “শ্যামলী” “সোনারতরী”
“অগ্নিবীণা”র বাংলা আমার, বাংলায় দ্রোহ করি।
এপার বাংলা ওপার বাংলা, বাংলায় বাঁধা সেতু
দুজনেরে বড় বেসেছি যে ভালো বাংলাই তার হেতু।
বাংলা আমার চিন্তা চেতনা, বাংলায় বাঁধি গান
গর্ব আমার বাঙালি আমি, ভারতের সন্তান।
বাংলা আমার মায়ের ভাষা, তারই জয়গান গাই
বিশ্বের প্রতি ভাষাকে আমার প্রাণের প্রণাম জানাই।
ভজ রে শ্রীগোরা ধন
মিছে বেলা গেল চলে না হল আর গুরু করণ
ভজ রে শ্রীগোরা ধনে ধরে নিতাই চাঁদের চরণ।
এই যে দেহ মহানগর রসে ভরা রসের সাগর
সেথায় রসে দিচ্ছে ভিয়েন মনোময় রূপ মনের নাগর
সেই নাগরের সাধন করো ওরে আমার পাগল মন
ভজ রে শ্রীগোরা ধনে ধরে নিতাই চাঁদের চরণ।
প্রেমময় কামকান্তমনি এই নগরে থাকেন শুনি
চৌদ্দভুবন চন্দ্র সুরজ তারই অধীন এমন গুণী
সুকান্ত কয় সেই নগরে দ্বারী সেজে আছেন মদন
ভজ রে শ্রীগোরা ধনে ধরে নিতাই চাঁদের চরণ।
আকাশ ভেঙে পড়েছে মাথায়
আ...কা...শ
মহিলারা প্রচন্ড লড়াই করছে
বোম নেই, নেই বুলেট বা বেয়নেটতর্কাতীত ঐক্যের ফলে
বিনা পিস্তলে
তোমাদের দেশে
দাউদাউ আগুন
গ্রাস করে নিচ্ছে
স্কার্ফ, হিজাব আর
মেকি মর্যাদা
তেহরানের রাস্তায়
মুখে মুখে আজ অভিশাপ—
'একনায়কের মৃত্যু চাই'।
নির্দয়কে বেড়ে ওঠার
সুযোগ না দিয়ে
লড়াই করে মরাই
বেশি ভালো নয় কি?
কবিতা
প্রজ্ঞা বাজপেয়ী
ভাষান্তর: গৌতম চক্রবর্তী
দয়ার মৃত্যু
মেহসা, শুনতে পাচ্ছ
সারা পশ্চিম আজ
ফেটে পড়েছে প্রতিবাদে
নির্মম অবিচার, ঔদাসীন্য
আর হৃদয়হীনতার বিরুদ্ধে
প্রতিবাদীরা মরছে কিন্তু হারছে না
দেখছি, দেখতে পাচ্ছি
নীতি পুলিশের মারে
তোমার কান দিয়ে রক্ত ঝরছে
উফফ, কী নির্মম
ওদের হাতে, ওখানে
হ্যাঁ, ওখানেই
দয়ার মৃত্যু হয়েছে
সে আঘাত কি আদৌ কম?
তোমার হয়তো ঘুম ভালো হচ্ছে
কিন্তু এখানে চেতনার মৃত্যুতে
ঘুমের দফারফা, যেন
প্রিয় মেহসা,
ওই প্রবল নারীশক্তির
হয়ে প্রার্থনা কর,
প্রার্থনা কর তোমার আত্মা
যাতে সুবিচার পায়।
ওরা যাতে আরও সাহসী হয়ে
প্রাণের জোয়ারে সব
ভাসিয়ে দিতে পারে
সেই কামনা কর,
কামনা কর শেষ পর্যন্ত
যেন এই মনোবল
ওদের অটুট থাকে।
ইরান এখন এক প্রতিরোধের প্রতিমূর্তি।
(হিজাব-বিরোধী প্রতিরোধের জন্য পুলিশ হেফাজতে থাকা মেহসা আমিনির মৃত্যু হয় মাত্র ২২ বছর বয়সে। সেই মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সমস্ত ইরান প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে ওঠে। কবিতাটির লেখিকা ন্যাশনাল ডিফেন্স আকাদেমিতে কর্মরতা একজন কেন্দ্রীয় সরকারি আধিকারিক।)
প্রাণ পাখি
মরণ ও মরণ
দেখছি যে কাছ থেকে।
ঘোলাটে চোখে
আবছায়া পরকায়া
যেনো। অঙ্গ হচ্ছে বিকল
যন্ত্রের হাওয়ায় হাঁপর টানার
পালা। অতিথি হয়ে
রাজসরালি, ডাহুকের মতো
উড়ে যাবে সোনাদিঘি আর ঝিনাইদহ ছেড়ে।
কবিতা
ভাস্কর সিন্হা
দুবাই


কবিতা
স্বরূপ মণ্ডল
কান্দি, মুর্শিদাবাদ, পঃ বাংলা

বহুরূপে
সিংহ দেখতে দেখতে হয়ে উঠি সিংহ,
বাঘ দেখতে দেখতে বাঘ
হরিণের পানে চেয়ে উঠেছি হরিণ হয়ে,
ছাগের ভিতরে আমি ছাগ
ফুলদলে দেখি চেয়ে নিজের শোভিত রূপ,
কাঁটাতে কন্টকিত মন
আগুনের মতো করে জ্বলেছি আগুন ভরে,
পুড়িয়েছি কতশত বন।
আকাশের আসমানী, নিজেরে আকাশ মানি
বাতাসেতে মিলিয়েছি শ্বাস
জলের জলীয় ভাবে, মাটিতেই মাটি হবে
দেহ, মন আর বিশ্বাস।

কাস্পিয়ান
তোমাকে নিয়ে—
অজানার পথে,
যেখানে থাকবে না কোনো সভ্য ট্রাইব—
দৃষ্টির বাইরে গিয়ে
নোঙর ফেলা গেলে কোথাও!
যেখানে চলবে না আন্তর্জাতিক আইন—
সেখানে,
যেখানে—
হিজলের বন পেখম মেলে ছড়িয়ে পড়বে,
আরও দূর থেকে ডেকে উঠলে রামশালিকের ছানা—
আমরা খেলব ছোঁয়াছুঁয়ি।
অথবা,
আমাদের ঠিকানা হতে পারে কাসপিয়ানে
যেখানের জলকে ঘিরে আছে কেবল উত্তেজনা!
না জানি কবে মধুকর ডিঙায় ভেসে গেলে
তুমি এবং আমি—
ওরা বলবে, এই প্রেম আমাদের।
কবিতা
এস এম রায়হান চৌধুরী
গাজীপুর, বাংলাদেশ

কবিতা
ডাঃ প্রণব কুমার দাস
বিদ্যাপীঠ রোড, কলকাতা

অহল্যা অভিশাপ
আজও নিয়মে ওঠে সূর্য
প্রখর তেজ, ঝাপসা আলো।
ধোঁয়াশায় ভারি বাতাস,
শ্বাস বায়ুর নিদারুণ সঙ্কট।
দিকে দিকে হাহাকার,
দগ্ধ- আবদ্ধ, ছারখার...
সংজ্ঞাহীন চেতনা, স্থবির প্রজ্ঞা।
তন্দ্রাচ্ছন্ন যৌবন, প্রবৃত্তির ঘোর লালসা।
দ্যুতিহীন ভবিষ্যৎ, আছে ভিক্ষার দান...
দুর্বৃত্তের উদ্দাম নাচ, ক্ষমতার আস্ফালন।
বিকারগ্রস্থ শিক্ষা, বেকারত্বের কারখানা।
জীবন - মৃত্যুর নামান্তর!
শুধুই প্রবঞ্চনা।
চাটুকারিতার তরুলতা - গুল্ম হতে পূর্ণ বৃক্ষ,
সর্বনাশা প্রশস্তির নিত্য আড়াম্বর।
তবু পাষাণী হৃদয়, উচ্চাভিলাষী...
চায় আরও ক্ষমতা, বোঝে জয়-পরাজয়।
স্থিতিহীন পরিস্থিতি...
উত্তাল সময়।
লেনদেন, বোঝাপড়া আর গোপন আঁতাত।
অস্তমিত যৌবন!
অন্তহীন অপেক্ষা ...' অহল্যা অভিশাপ'।

কবিতা
অনির্বাণ দত্ত
নিউটাউন, কলকাতা

শুধু লাশ গুনি
আমরা আসলে শুধু লাশ গুনি।
সাগরপাড়ে আয়তাকার বসে
ঢেউএর লাশ গুনি।
গোধূলি বিকেলে এক চিলতে ছাদের উপরে
সহস্র আলোকবর্ষ দূরের
কোনও ছোট্টোতারার পানে চেয়ে চেয়ে
লাশ গুনি না-বলা রূপকথার।
লাশ গুনি পকেটবন্দী সেই
ঘামে ভেজা রঙ্গণ ফুলের।
পরিমার্জিত পরিমিত কথার আড়ালে
কবিতার লাশ গুনি।
টিভির পর্দায় মানুষের লাশ গুনি,
দমচাপা কোনো শহুরে রাত্তিরে
সাবধানী জানলার গায়ে
বৃষ্টির লাশ গুনি।
জন্মের পর জন্ম
আমরা আসলে শুধু লাশ গুনি।
তারপর কোনো একবার
পরশবিহীন কোনো এক প্রগাঢ় পরশে
বেঁচে উঠি অবশেষে।
একটা তারার জন্ম
যখন মাঝ সাগরের বুকের কাছে
একলা আকাশ ঘনিয়ে আসে,
(তখন) এক নতুন তারার জন্ম হয়।
যখন খুব ব্যস্ত পথের ধারে
অচিন কোনো বাঁকে,
নদীর কথা নীরব বাজে
রঙ্গন ফুলের ভাঁজে,
(তখন) এক নতুন তারার জন্ম হয়।
যখন কোনো গভীর রাতে
হঠাৎ কোনো বৃষ্টিপাতে,
জানলা দিয়ে মনের ভেতর
ভিনগ্রহের এক বাতাস আসে,
(তখন) এক নতুন তারার জন্ম হয়।
আকুল, আমূল এক আনন্দে
নটরাজের 'সৃজন ছন্দে'
ইথার যখন উথাল-পাথাল,
শূণ্য-সুখে মত্ত মাতাল,
হাজার আলোকবর্ষ দূরে
কিম্বা মনের অচিনপুরে,
উঠলো জ্বলে একটা আলো,
ছোট্টো তারা বড্ডো ভালো।

কবিতা
ডক্টর সুব্রত ভট্টাচার্য্য
সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
প্রকৃতিপ্রেমী
প্রকৃতি আজ অনেক সকালেই বৃষ্টিস্নান সেরে
সারা আকাশটা গায়ে জড়ানোর পর,
গভীর সমুদ্রসম নয়নদ্বয়ে
মেঘের কাজল এঁকে
কাননের সৌরভে চারপাশ উদ্ভাসিত করতে করতে
জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে
আমার ঘুম ভাঙিয়েছে।
কিন্তু, সেইসময়
তার দিকে আর কতক্ষণ
চোখের পাতা না ফেলে
তাকিয়ে থাকতে পেরেছি!
সামনের বনানীতে তখন
কাকাতুয়া, টিয়া আর কোয়েলদের
খুব গল্প চলছিল;
আর ঝিঁঝিঁ পোকারা তো একটানা
গানের রেওয়াজ করেই যাচ্ছিলোl
চোখ কচলে, ওদের ডেকে
আমার এই আক্ষেপের কথাটা জানালে,
ওরা পরামর্শ দিলো ওদের রাজার কাছে যেতে;
তার কাছে নাকি এক চমৎকার ‘বর’ আছেl
রাজাকে খুশি করতে পারলে আমি
মানুষ হয়েও
প্রকৃতিকে চোখের পলক না ফেলে
একনাগাড়ে দেখে যেতে পারবো।
তবে, এটাও মাথায় রাখতে হবে যে
রাজার কিন্তু মোটেও মানুষদের পছন্দ নয়।
দেখলাম, ব্যাঙ আর কাঠবেড়ালিরাও
ওদের পরামর্শে সায় দিলো।
ভাবলাম
আমার সঙ্গে তো প্রকৃতির সখ্যতা আজন্মের,
কত না কথা হয় প্রতিদিন!
পরামর্শদাতা বন্ধুদের কাছে
আমার ব্যাপারে রাজা জানতে চাইলে
তখন কি ওরা অন্তত: এগুলোও
মনে করে বলবে না যে,
অস্ট্রেলিয়াতে বছরের পর বছর গাছের পরিচর্যা করে
শতশত ফুল ফোটালেও
সেই ফুল আমি কোনোদিনও গাছ থেকে তুলিনি!
যত্ন পেয়ে গোধূলিবেলায়
গাছেদের ঘুমোতে যাওয়াটাও ছিল কত আনন্দের!
আফ্রিকায় কর্মক্ষেত্রে ভয়ংকর সাপেদের
বিনা আঘাতে ধরে
তাদের জঙ্গলে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা তো
আমিই করেছিলাম!
কিংবা, আমার তত্ত্বাবধানে বতসোয়ানায়
প্রতিবেশীদের বাড়িতে
সেই সুবৃহৎ বৃক্ষগুলোর
শুকনো কাঠের মধ্যে গর্ত তৈরী করে
সেখানে পাখি এবং ছোট্ট প্রাণীদের
থাকার সুযোগ করে দেওয়াটা!
আর এর পরেও তো প্রকৃতি হাসিমুখে
আমার হয়ে
রাজাকে দু কথা বোঝাবেl
প্রকৃতির কোলে তো এমনিতেই রোজ ঘুমোই,
তবে, অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে পারলে
তার অসীম সৌন্দর্য দর্শন হতে
অনেকটাই কম বঞ্চিত হতে হয়!
তাই এমন চমকপ্রদ সুযোগ,
হাতছাড়া করা যায় না।
বৃথা সময় নষ্ট না করে
বেড়িয়ে পড়লাম ওদের রাজার সঙ্গে কথা বলতে।
দুইটি রবীন্দ্রসংগীত ও বিবাহ
সত্তরের সেই রোমহর্ষক দশকে
কুহেলিকাময় এক বৈশাখী অপরাহ্নে
করেন উন্মুক্ত গৃহের রুদ্ধ দ্বার,
মরিচা লাগি লৌহদরজা নির্গত
নানান শব্দসমারোহে।
স্বল্প উচ্চতা, চওড়া ভুরু,
রৌদ্রে-জলে বিবর্ণ কিঞ্চিৎ ধূসর কান্তি,
স্বল্পকেশী, গোল মুখাকৃতি;
আত্মগৌরবে গৌরবান্বিত
যৌবনকালের সুদর্শন এক প্রৌঢ় তিনিl
স্থূল শরীরে
দুলকি চালে
আসেন বাহিরে
খড়ম পড়িয়া
খটখট শব্দে
ডান বগলদাবা
আরাম কেদারা লইয়া
গোবর নিকানো অঙ্গনপথে;
সৌরভময় থোকা থোকা প্রস্ফুটিত লাল দৃষ্টিনন্দন
মাধবীলতা পুষ্প শোভিত
বংশ নির্মিত মাচার তলদেশ দিয়া।
স্থাপিয়া আরাম কেদারাটি সযত্নে
দুয়ারের মধ্যস্থলে
সাদা আটপৌরে ফতুয়া গায়ে
আট হাতি ধুতিতে
কুঁচি লাগানো লাল হাতের চিহ্ন দেওয়া তালপাতার পাখা
চালাইতে চালাইতে
পরম তৃপ্তিতে
হন বিরাজমান সেথায়
সামনের বাড়ির জ্যাঠামশাই।
হন জমায়েত রোয়াকগুলিতে
প্রতিবেশীগণ,
সান্ধ্যকালীন নিত্যকারের সেই আড্ডায়।
কচি কাঁচারা অনেকে
খেলাশেষে হই উপস্থিত সেখানে
স্বল্প কালের লাগি
গল্পদাদুর আসরে।
ফতুয়ার বোতামগুলি তাহার অব্যবহৃত প্রায়
গুম্ফযুগলে ডান হস্তে তা দিয়া যথাসম্ভব শোভাবর্ধন করিয়া
নগ্ন লোমশ প্রকান্ড বপুতে হস্ত বুলাইয়া
চারিপাশ গোচর করিয়া
হাস্যবদনে খুঁজিয়া নেন বাম হস্তে
পিতলের ছোট্ট নস্যির ডিবা
ফতুয়ার পকেট হইতে
আপন ভঙ্গীতে l
খুলিয়া সন্তর্পণে ডিবার প্যাঁচালো ঢাকনা
তুলিয়া নস্যি এক চিমটি
দেন ঝাঁকুনি সেই হাত কয়েকবার
আনমনে,
অতিরিক্তের বিতাড়িতের তরে।
তারপর, হইলে খুশি যথাযথ পরিমাণে
টানেন তীব্র প্রশ্বাসে সশব্দে তাহা
দুই নাসারন্ধ্র দিয়া।
বার তিনেক ক্রমাগত: হাঁচির প্রচন্ড শব্দে
হয় বিদীর্ণ যাবতীয় নি:স্তব্ধতা
দেন জানান আপন উপস্থিতিরে
সারা পাড়ায়।
বাহির করিয়া রুমাল
ফতুয়ার পকেট হইতে,
বারকয়েক ঘষিয়া
মুছিয়া নেন নাসিকাস্থল আর অঙ্গুলিদ্বয়।
খুলিয়া গৃহদ্বার
লইয়া বঙ্কিম যষ্টি
আসিয়া বসিলে মোর ঠাকুরদা
ফুট দশেক চওড়া গলির অপর পাড়ের আপন রোয়াকে
জ্যাঠামশাইসহ করেন সকলে সম্বোধন তাঁহারে
আছেন কেমন কাকাবাবু?
সকল কুশল বুঝি রয়!
হইলে শেষ উপস্থিত জনের কুশল বিনিময়
হয় নিমজ্জিত একেএকে সকলে
নির্ভেজাল বৈকালিক আড্ডায়l
ছিল এক সুশীলা বিবাহযোগ্য কন্যা
জ্যাঠামশায়েরl
আটপৌরে শাড়িতে স্বহস্তে
কারুকার্যময় ঝকঝকে কাঁসারের রেকাবিতে কয়েকটি বাতাসা এবং
তদুপরি রাখা শৌখিন কাঁসারের পাত্রে এক গ্লাস জল
লইয়া আসিয়া দাঁড়াইলে সেই দিদি;
করিয়া সেবন তাহা
বর্ষাইয়া অনন্ত তৃপ্তির সুর
মুছিয়া সিক্ত মুখ ধুতির খোঁট দিয়া
কহেন সস্নেহে ফিসফিসাইয়া জ্যাঠামশায় তাহারে
শিখিতে হইবে মা দুইটি গান তোমারেl
জ্যাঠামশায়ের ফিসফিসানি
শুনিলাম অনায়াসে
উপস্থিত সকলেইl
বুঝিলাম, হইতেছে শুরু বিশেষ প্রস্তুতি
হইবে বিবাহ দিদির শীঘ্রইl
সংগীত সাধনার লাগি
হন নিযুক্ত বিশিষ্ট এক গানের দিদিমণিl
হইলো বাহির
বাক্সবন্দী পুরাতন এক হারমোনিয়াম
খাটের নীচ হইতেl
চলিল সংস্কার তাহারl
অবশেষে একদিন
আসে সেই শুভদিন
হয় শুরু দিদির সংগীত শিক্ষা
হরিকীর্তন
আর
উলুধ্বনি দিয়া।
সকল জানালা গৃহের রহে উন্মুক্ত
দিদির সংগীত শিক্ষাকালে।
গানের দিদিমণি ভারী গুণী,
বেতারশিল্পী তিনি।
ছাত্রীকে শিক্ষাকালে করিলে তিনি গান
দেন বাহবা বহুজনে।
আশপাশের ঘরগুলিতে
স্বল্পের লাগি হয় বন্ধ রেডিও।
রহে নিবৃত্ত তাহারা
করিতে শ্রবণ
সান্ধ্যকালীন বিবিধভারতীর গানের আসরও।
কিন্তু, সহসা সা রে গা মা সুর চরাইলে দিদি
ওঠে পক্ষীকুল করিয়া চিৎকার
চারিপাশের বৃক্ষরাজি হইতে।
হয় চকিত সারমেয়কুল,
করে লম্ফ ঝম্প হনুমানেরা
আর চলে সেই সঙ্গে
তর্জন গর্জন উহাদের
সামনের প্রকান্ড তেঁতুল বৃক্ষে।
জানালাগুলি হয় বন্ধ ঝপাঝপ
চারপাশের গৃহগুলিতে।
হয় সৃষ্টি ক্রমে ক্রমে এক আতঙ্কের।
ত্রস্ত সকলে
এই বুঝি হইবে শুরু দিদির সংগীতচর্চা।
স্বল্পবয়সী জননীরাও দেখান ভয় আপন শিশুদের,
অঙ্গুলি নির্দেশিয়া
খড়খড়ি তুলিয়া
করিয়া সুর
"করহ শেষ শীঘ্র গ্লাসের দুধটুকু
নইলে দিদি ধরিবে গান
পারিবে না যাইতে বেশীদূর"
চলিয়াছিলো এমনটিই সপ্তাহ খানেক
লইয়া বিভ্রান্তিতেই।
এরপর একদিন
আনিলে পুনরায় জল ও বাতাসা,
কহেন জ্যাঠামশাই
ফিসফিসাইয়া দিদির কর্ণকুহরে
কহ গিয়া দিদিমণিরে
শিখাইতে মাত্র দুইটি গান
শুধুই রবিঠাকুরের;
চলিবে উহাতেই।
গাহিবে তুমি একটি,
রহিবে রিজার্ভ দ্বিতীয়টি,
বরপক্ষের সাদর অনুরোধের,
একান্ত পীড়াপিড়ি রক্ষার
খাতিরে!
ছিলেন দিদি সুগৌরী,
সুকেশী, এবং
বেশ সুন্দরী,
ভারী মিষ্টি স্বভাব তাহার।
ছিলেন না তবুও স্বস্তিতে জ্যাঠামশাই
পার করিবারে নিশ্চিন্তে তাহারে।
আদুরে কন্যার লাগি
ছিল তাই
সেই আবদার l
হইয়াছিল বিবাহ দিদির অচিরেই
বসিয়াছিল নহবত
বাজিয়াছিল সানাই
বেশ ধুমধামে
চারপাশ মুখরিত করিয়া।
গুণী জামাইবাবুর
ছিল না প্রয়োজন তেমন
দিদির সঙ্গীতেরে।
বিবাহোত্তর মুক্ত দিদি
আসিয়া একদিন গঙ্গার তীরে
করেন সমর্পণ শোধ্যে
কষ্টের সেই আপনার
সংগীত চর্চারে।
অবশেষে একদিন
জানাজানি হয় সত্য।
পড়িল ছড়াইয়া দাবানল গতিতে সেই তথ্য
গোটা পাড়া জুড়িয়া।
জানিলও লোকে
বুঝিলও লোকে
মানিলও লোকে
বিবাহ উত্তরণের চাঞ্চল্যকর সেই উপায়,
রবি ঠাকুরের দুই সংগীত শিক্ষণে।
ওঠে তাহারা হর্ষ করিয়া l
মুচকি হাসিয়া এপার ওপার
দিদিরা এরপর
করেন বিদায়
অনিচ্ছাকৃত কঠিন সংগীত চর্চার।
রহেন তাহারা ব্রতে
বিবাহের তরে
শিখিতে কেবল মাত্র
দুইটি রবীন্দ্রসংগীতে।
কবিতা
যোগেন শর্মা
মদনপুর, নদীয়া, পশ্চিমবঙ্গ

গ্রীষ্ম প্রেম
সূর্য জ্বলছে, দিনগুলি দীর্ঘ,
পাখিরা গাইছে, গ্রীষ্মের গান
দিনের উষ্ণতা যেন আলিঙ্গন,
একটু মনোরম হাওয়া প্রয়োজন।
গ্রীষ্মের আনন্দের একটি মৃদু অনুমান
ফুলের মিষ্টি গন্ধ, মৃদু চুম্বন
হাসির শব্দ, একটি নিখুঁত দিনে
সূর্য জ্বলছে, চলো খেলি বাগানে।
সূর্যের তাপ, গ্রীষ্মের নাচ
আইসক্রিমের মিষ্টি স্বাদ, এটা গ্রীষ্মের রোম্যান্স,
প্রকৃতির সৌন্দর্য, তার সমস্ত মহিমায়
আসুন এই গ্রীষ্মে উপভোগ করি পরিবেশ।
নদীর ঢেউয়ের আওয়াজ, শান্তিপূর্ণ বাতাস
রাতের আকাশে তারাদের দেখা,
ফুল ফুটেছে, একটি মনোরম দৃশ্য
আসুন এই গ্রীষ্মের রাতের সর্বোচ্চ সুখ অনুভব করি।
সূর্যের তাপ, গ্রীষ্মের তাপ
আসুন একটু বিরতি নেওয়া যাক,
বসুন আসুন কিছু স্মৃতি মনে করি, যা স্থায়ী হবে
এই গ্রীষ্মের জন্য মধুর করে রাখবে এই অসহ্য গরমেও।

কবিতা
রাসিক শেখ
মুর্শিদাবাদ, প: বঙ্গ
আকাঙ্ক্ষা
যদিও বা নেই কিছু আমার জন্য,
তবুও তো আছে কিছু না পাওয়ার জন্য,
যবে তুমি চেয়েছিলে শেষটুকু প্রাণ,
তখনো হয়নি মনের সে তো তোমারি দান।
রেখে চলে গেলে আমায় বহু দূরে ধীরে ধীরে,
চাইলে না একবারও মুখটাকে ফিরে।
সব দিয়েও যখন পায়নি হৃদয়ের চাবি,
বদ্ধ অন্ধকার ঘরে বসিয়া না জানি কেন একথায় ভাবি?
ক্ষণিক উল্লাস শুধু কিছু পেয়ে নেওয়া,
নাকি ভালোবাসার প্রতীক আকাঙ্ক্ষা হলো কিছু না পাওয়া।


কবিতা
শুভঙ্কর রানা
শামুক
কোমল দেহ কোমল করে
রেখেছ ঐ শক্ত আবরণে।
জীবন্ত কঙ্কালের মতো প্রাণ
মানুষের ভয়ে গুটিয়ে থাকে।
কতই কষ্ট সহ্য করে
মুখ বুজে মেনে নাও
সব অত্যাচার।
ভয়ে ভয়ে পালিয়ে বেড়াও,
ঠিক সেই আদিম সমাজের
শেষ উলঙ্গ মানুষীর মতো।
এছাড়া তুমি আর কি পারো
কিছু না, কিছুই না?
কতো লোকে তোমায় মারে
তোমায় ভাঙ্গে, তোমায় গড়ে;
তোমার কি মনে পরে নিজের রূপ?
ভাবো না! স্বাধীনভাবে বাঁচার কথা?
পাবে না! অন্যের হাত থেকে
চিরমুক্তির স্বাদ?
তার বদলে ভয়ে মুখ লুকাও
ঐ শক্ত খোলকের অন্তরালে।
তাই মানুষ তোমাদের পেয়ে বসেছে,
একবার বিদ্রোহী হয়ে জেগে ওঠো;
একবার দলবেঁধে চিৎকার করে বলো,
আমাদেরও বেঁচে থাকার অধিকার আছে,
আমাদের বাঁচতে দাও।

কবিতা
এহিয়া আহমেদ
মরিগাঁও, আসাম
তুমি বিহীন
তুমি বিহীন জীবন
নির্জন পথে তোমার সাথে
একসাথে হাঁটতে হাঁটতে
তোমার হার্ট বিট
সোনার খুব ইচ্ছে করে;
সীমানা ছাড়া স্বপ্ন দেখি
তুমি আমার স্বপ্নের রঙিন ছবি
একটু ভালোবাসা নিয়ে
কবে আসবে ফিরে (?) তুমি বিহীন জীবনে
স্মৃতিগুলো মনে পড়ে
মরুভূমির তপ্ত বালুচরে
ছটফট করে;
তোমার অপেক্ষায়
মন পাখি আমার
একটু জলের জন্য
হাহাকার করে।
হৃৎপিণ্ডটা কাদামাটি হয়ে গেলো
দিক না জেনে, পথ না চিনে
আমি এই রাস্তার ধারে;
এদেশে নেই প্রজাপতির দল
নেই কোনো পাহাড়ী ঝর্ণার
কুলুকুলু শব্দ,
তুমি বিহীন জীবনে সব
হারিয়ে গেলো।

কবিতা
ফাইয়াজ ইসলাম ফাহিম
তুমি ফুল শুকিয়ে যাবে
তুমি ফুল শুকিয়ে যাবে
থাকবে না তোমার যৌবন,
তুমি ফুল হারিয়ে ফেলবে
তোমার টইটম্বুর মৌবন।
তুমি ফুল রোদে শুকে যাবে
অলির ভালবাসা ছাড়া,
তুমি ফুল অসময়ে চুপসে যাবে
হবে সর্বহারা।
তুমি ফুল বুঝলে না অলির আদর
অলির শোকে একদিন হবে কাতর,
তুমি ফুল অলি'র সঙ্গ চাইবে একদিন
সেদিন তুমি ফুলের থাকবে দূর্দিন...
(এখানে ফুল কে হাওয়া নামক একজন নারীর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে...)
উষ্ণ বালিকা
উষ্ণ বালিকা
প্রেমের চালিকা
যৌবনের শক্তি
যে বালিকা উষ্ণ
তারে পুরুষ করে ভক্তি।
উষ্ণ বালিকার উষ্ণতায়
যায় পুরুষের মন পুড়ে,
উষ্ণ বালিকায়
পুরুষের স্বর্গ-নরক
তাই ডাকে তারে প্রেম সুরে।
উষ্ণ বালিকা ছাড়া
জমে না পুরুষের প্রেম,
উষ্ণ বালিকা পুরুষের
সেরা পছন্দ
যদিও পছন্দ নারী ফ্রেম।
উষ্ণ বালিকা
পৃথিবীর সব,
উষ্ণ বালিকা ছাড়া
যৌবন ঢব।
উষ্ণ বালিকার জন্য
পুরুষ করে সকল কাম,
উষ্ণ বালিকা না থাকলে
থাকতো না পুরুষ
থাকতো না পৃথিবী
থাকতো না কোন কিছুর দাম..

কবিতা
দীপ্তেন্দু ভট্টাচার্য্য
যাত্রাপথে
ঘন্টা ছয়েক বরাদ্দ প্রতিদিন যাতায়াতে,
কিছু চেনা মুখ কতেক অচেনা, টুকরো কিছু হাসি
টুকরো সংলাপ কিছু, হালকা হওয়ায় ভাসে।
কাটানো কিছু সময় তারই মাঝে, একান্ত অবসরে,
ব্যস্ততার মোড়কে, একাকী ভিড়ের মাঝে।
কর্মহীন কর্মব্যস্ততায়, কখনো ঘরের কোনে,
মাঠে ঘাটে পথে প্রান্তরে, কিছু খুচরো সময়;
বেহিসেবী খরচা করা, কিছু করা অপচয়।
সুদিন নাকি মৃত্যু, কি জানি কিসের অপেক্ষায়,
কিছু কথা, কথায় কথায়, মনে থেকে যায়
টুকরো কিছু ছবি, ধরা পরে কিছুবা হারায়।
কিছু বা দাগ কেটে যায়, চিরকাল মনের আঙিনায়।
কিছু ছেঁড়া হাসি, কান্না কাটি হল্লা হাটি;
কিছু উড়ো ঝর, ধুলো মাখা রাস্তায়।
ধুলো মাখা শরীর, আর মলিন কাপড়ে,
শুয়ে থাকা জীবন্ত লাশ, রাস্তার মোরে।
কিছু মুখ ঢাকা বোরখায়, কিছু বিজ্ঞাপনে,
আরও কত শত ছবি, রঙ রূপ কথা কিছু ধরা পড়ে;
তারও চেয়ে বেশি, রয়ে যায় অধরা, অথবা ধরা পড়ে,
অন্য কোনো খানে, অন্য কারো চোখে, অন্য রূপে।
চলার পথে, পথে ফুটপাতে, কত ছবি রঙিন,
কতক বা সাদা কালো, রূপ নেয় অহরহ।
ছন্দে বাঁধা পড়ে কবিতা, লেখা হয় কত গল্প
মনে হয় যাতায়াতের সময় বুঝি বা বড় অল্প।
রম্য-রচনা
এ তো
বড় রঙ্গ!
অনিশা দত্ত
সল্টলেক, কলকাতা


দাম্পত্যের দ্বাদশ বার্তা
বিবাহের প্রথম বৎসর:
স্বামী - আচ্ছা, তুমি আন্টার্টিকা বেড়াতে গিয়েছো? আমি যাই নি।
স্ত্রী - আমিও যাই নি।
স্বামী - সত্যি! আমাদের কি মিল।
স্ত্রী - প্রত্যেক শীতে আর বর্ষায় আমার সর্দি-কাশি হবেই হবে।
স্বামী - আমারও। দেখো, আমাদের ধাত ও একই রকম। দারুণ মিল। আমার না রোমান্টিক মুভি দেখতে সবচেয়ে ভালো লাগে। তোমার?
স্ত্রী - আমার সবচেয়ে পছন্দ রোমান্টিক সিনেমা।
স্বামী - দেখছো তো আমরা একেবারে রাজযোটক।
*************
দুই বৎসর পর :
স্ত্রী - কাল রাতে স্বপ্ন দেখলাম, এবার বিবাহ-বার্ষিকীতে তুমি আমাকে হীরের কানের দুল উপহার দিচ্ছ।
স্বামী - আমিও একই স্বপ্ন দেখেছি, আরো দেখেছি, তোমার বাবা ওটা কিনতে চেক পাঠিয়ে দিয়েছেন।
*************
আর ও দুই বৎসর পর:
স্বামী - আমি যদি হঠাৎ মরে' যাই, তুমি কি আবার বিয়ে করবে?
স্ত্রী - কক্ষনো নয়। আমি আমার ছোট বোনের সঙ্গে থাকবো। আর যদি মারা যাই, তুমি কি আবার বিয়ে করবে?
স্বামী - কক্ষনো না। আমরা দুজনে দুজনের জন্য। তোমার সঙ্গে আমি সহমত। একই সিদ্ধান্ত আমার ও। আমিও তোমার ছোট বোনের সঙ্গেই থাকবো।
*************
আর ও দুই বৎসর পর:
স্ত্রী - বিয়ের এলবামে, অত খুঁটিয়ে কী দেখছো? আমি তো সামনেই দাঁড়িয়ে। সেজেছি আজ, আমার দিকে দেখো।
স্বামী - না দেখছি, সেই ঘোর বিপদের দিনে কোন কোন বন্ধু আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল।
*************
আর ও দুই বৎসর পর:
স্বামী - তোমাকে বিয়ে করে জেরবার হয়ে গেলাম। এর চেয়ে শয়তানের সঙ্গে বিয়ে হলেও বোধহয় অনেক ভালো থাকতাম।
স্ত্রী - কিন্তু আমি যতদূর জানি, আমাদের সমাজে এক গোত্রে বিবাহ নিষিদ্ধ।
আর ও দুই বৎসর পর:
স্বামী - যতই চেষ্টা করো না কেন, বেড়ালটাকে কিছুতেই পোষ মানাতে পারবে না। সর্বদা ফোঁস-ফোঁস করবে।
স্ত্রী - ঠিক পারবো। দুদিন বাদেই মিউ-মিউ করে পায়ে পায়ে ঘুরবে। তোমাকে বাগে আনতেও যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে। অভ্যাস আছে।
*************
আরও দুই বৎসর পর:
স্বামী: (মদ খেতে-খেতে)- আমি তোমাকে ভীষণ-ভীষণ ভালোবাসি।
স্ত্রী (হৃষ্ট চিত্তে) - একথা কে বলছে? মাতাল না কি আমার স্বামী?
স্বামী - তোমার স্বামীই বলছে, তার মদের বোতলকে।
*************
আরও দুই বৎসর পর:
স্বামী - দিনরাত যদি অতই ঝগড়া করবে, তবে আর একটা বিয়ে করে চলে গেলেই তো হয়।
স্ত্রী - খুব ভালো হয়, বাঁচি আমি। আমার বাবা অনেক দেখে-শুনে পয়সা খরচ করে 'তোমার সঙ্গে আমার বিয়ে দিয়েছিলেন। এবার তুমি দেখে শুনে আমার একটা ভালো বিয়ে দিয়ে দাও।
*************
আরও দুই বৎসর পরঃ
কলহের জেরে, স্বামী - স্ত্রীতে বাক্যালাপ বন্ধ।
স্বামীকে ভোরের ফ্লাইট ধরতে রাত চারটে-তে ঘুম থেকে উঠতে হবে। স্বামী তাই একটা চিরকুটে লিখলেন 'কাল আমাকে রাত চারটে -তে ঘুম থেকে উঠিয়ে দেবে। তারপর চিরকুটটি স্ত্রীর বালিশের ওপর রেখে ঘুমিয়ে পড়লেন। পরদিন সকাল সাতটায় ঘুম ভাঙতে, স্ত্রীর ওপর চীৎকার করতে গিয়ে দেখেন, তাঁর বালিশের পাশে- রাখা চিরকুটে লেখা 'চারটে বেজেছে, উঠে পড়ো।' **************
আরও দুই বৎসর পর:
স্বামী - আমি নিশ্চিত কাল রাতে তুমি আমার ব্যাচেলার বন্ধু রঞ্জিতের বাড়িতে রাত কাটিয়েছো।
স্ত্রী - মোটেই না, কাল আমি আমার বিধবা বান্ধবী রঞ্জনার বাড়িতে ছিলাম। বেচারী একা থাকে।'
স্বামী - তুমি অবিশ্বাসিনী জানতাম, কিন্তু এমন মিথ্যাবাদী জানতাম না। কাল রাতে রঞ্জনার বাড়িতে তো আমি ছিলাম।
**************
আরও দুই বৎসর পর:
স্ত্রী - বিয়ের সার্টিফিকেট -এ কী অত খুঁটিয়ে দেখছো? জাল সার্টিফিকেট নয়।
স্বামী - জানি তো আসল সার্টিফিকেট। খুঁজে দেখছি কোথাও এক্সপায়ারি ডেট লেখা আছে কিনা?
**************
পঁচিশ বৎসরের বিবাহ বার্ষিকী আসন্ন। রৌপ্য জয়ন্তীতে দ্বিতীয় হনিমুনে গিয়ে দম্পতি এক পাঁচ তারা হোটেলে উঠেছেন। স্বামী রাত বারোটায় হোটেলের ঘর থেকে ইন্টারকমে ম্যানেজারকে চীৎকার করে ডাকছেন 'শিগগির আসুন এ ঘরে। আমার স্ত্রী আমার সঙ্গে ঝগড়া করে জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়বেন বলছেন।' ম্যানেজার দুঃখিত স্বরে ক্ষমাপ্রার্থী হলেন 'আমার কিছু করণীয় নেই। সম্পূর্ণ আপনাদের দাম্পত্যের আওতায় পড়ে।'
স্বামী আরও রেগে চীৎকার করে উঠলেন 'না মশাই। এখানে দাম্পত্য নিষ্ক্রিয়। বিষয়টি হোটেলের মেনটেনান্সএর আওতায় পড়ে। জানালাটা খোলাই যাচ্ছে না। তুরন্ত আসুন। খুলে দিয়ে যান।'
ফেলে আসা
জাহাজের ডেক
প্রতীক মাইতি
রাজারহাট, কলকাতা

ভ্রমণ

ট্যুরটা শেষ হয়ে এলো। এদিক-ওদিক ছড়িয়ে শীতবস্ত্র, আলোয়ান, কোল্ডক্রিম। ছোট ছোট টিলার মত উবু হয়ে ভাঁজ করে নিচ্ছি শুশ্রূষার আলো। শুশ্রূষাই বটে, যখন মুগ্ধ হয়ে দেখি একটা আশ্চর্য রাঙা রোদ্দুর কিভাবে বাঁকে গড়ায়, কিভাবে পথ দেখায়, উচ্চ থেকে উচ্চতর পাহাড়ের চূড়ায় নিজেকে বিছিয়ে দেয়। আদরে গলে যেতে যেতে আমাদেরও ভিজিয়ে দ্যায় সে। আমাদের গলায় তখন শুধুই বিস্ময়, আমাদের স্বরে মন্দ্র সপ্তক। এই অস্থির উদযাপনের দিনে সে কি শুশ্রূষা নয়?
ট্যুরের শেষ দিনে আমরা এসেছি নীলডি পাহাড়ে। নীলডির ভৌগোলিক অবস্থান পুরুলিয়া-ঝাড়খন্ড সীমান্তের কাছাকাছি। পর্যটকদের কাছে খুব বেশি পরিচিত নয় এই পাহাড়। পর্যটনকে খুব যে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এখানে তেমনও নয়। থাকার মধ্যে একটা ভাঙাচোরা চিলড্রেন পার্ক, একটা ভগ্নপ্রায় মন্দির আর বেশ অনেকখানি জায়গা জুড়ে পিকনিকের ব্যবস্থা। তবে মূল আকর্ষণ অন্য জায়গায়। ছোট বড় বিভিন্ন পাথরের ওপর বেশ সুন্দর কিছু পেন্টিং দেখলাম। কোথাও বাঘের মুখ, কোথাও প্রকাণ্ড রাক্ষসের রুদ্র হুংকার। রুক্ষ তামাটে নীলডির বুকে আক্ষরিকই রঙিন সেলুলয়েড! একটার পর একটা ছবি দেখছি আর মুগ্ধ হচ্ছি এমন অভূতপূর্ব নির্মাণে। আমাদের ভ্রমণসঙ্গী রাজু এখানকার স্থানীয়। ওর কাছেই শুনলাম যিনি পরিকল্পনা করেছেন এগুলোর, তিনি সীমান্ত লাগোয়া চেলিয়ামা বিজলীপ্রভা স্কুলের শিক্ষক অভিষেক মিশ্র। জয়চন্ডী পাহাড়েও চলছে এমন উদ্যোগ ওনার তত্ত্বাবধানে। উত্তরণ নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা চালান উনি।
পাঞ্চেত, গড়পঞ্চকোট বা অযোধ্যার ভিড় এখানে নেই। খাবার বানিয়েই নিয়ে এসেছি আমরা, ক্রমশ কুয়াশায় ঢাকতে থাকা পাহাড়ের কোলে বসে খানিক জিরিয়ে নিয়ে ফিরব আলো ফুরাবার আগেই। পথ সামান্যই, জয়চন্ডী স্টেশন থেকে নেমে রঘুনাথপুর আর রঘুনাথপুর থেকে আধঘন্টার সফর। রঘুনাথপুর থেকে মিশকালো পিচের রাস্তায় সাত-আট কিমি গেলে গোবরান্দা, সেখান থেকে তিন কিমি দক্ষিণে গেলেই পাবড়া। নীলডির পাদদেশ শুরু পাবড়া থেকেই। স্থানীয়দেরই ভিড়, বাইরের মানুষ প্রায় নেই বললেই চলে। দূরে পাওয়ার গ্রিড, চিমনি প্রায় অস্পষ্ট হয়ে আসছে। একটা
উত্তুরে ঠান্ডা হাওয়া পাহাড়ের পাঁজরে ধাক্কা খেয়ে আমাদের দৃশ্যতই কাঁপিয়ে দিচ্ছিল মাঝেমধ্যে।রটারডাম থেকে ভিডিও কলে এলো নবনীতা ও সমীরণ। আমাদের বাল্যবন্ধু। ঠান্ডা হওয়ার দাপট ওখানেও। হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে সাজানো সুন্দর একটা দেশ থেকে যখন ওরা বলে উঠল হ্যাপি নিউ ইয়ার, মনে পড়ে গেল আমাদের স্কুলের দিনগুলোয় এমনই নৈসর্গিক হতো গ্রিটিংস কার্ডের কভারগুলো। বছরভর যে বন্ধুদের সাথে একই বেঞ্চে বসে ভাগ করে টিফিন খাওয়া, অর্ধেক টিফিন খেয়ে খেলার মাঠে হারিয়ে যাওয়া, কি এক অভাবনীয় উদ্মাদনা তবু কাজ করতো রঙিন খামে মুড়ে কার্ডের দেওয়া নেওয়ায়। ফেলে আসা সেই ইস্কুলবাড়ির দালান যেন জীবনের অকুলদরিয়ায় নোঙর করতে করতে ছেড়ে আসা জাহাজের ডেক। সেখানে পড়ে আছে সেই সব রঙিন খাম, তার কম্পাসে লেগে আছে ক্ষয়ে যাওয়া চকের দাগ, তার কেবিনে ঠান্ডা হয়ে আসছে আট আনার আলুর চপ, তার শার্সি খুলে ধরেছে ক্লাসের সবচেয়ে দামাল ছেলেটা, উড়ে আসছে কাঠবাদামের খোসা। শ্রাবণ সমুদ্র সাঁতরে তাকে পৌঁছতেই হবে ইস্কুলবাড়িটায় অবশেষে। আত্মভ্রমে পুড়ে যাওয়া পথিকের বোধিবৃক্ষের ছায়া সেখানেই। এমন অখ্যাত নীলডির কোলেই।
ট্যুরটা শেষ হয়ে গেল। আকাশ নদী পাহাড়ের নয়নাভিরাম যাপন ছেড়ে আবার শামুকের খোলস জীবন। আমাদের ভাষায়, আমাদের কথায়, আমাদের দূরতম কল্পনায় শুধুই জাগতিক, ব্যক্তিকেন্দ্রিক পাওয়া না-পাওয়ার গল্প থাকবে আবার। গাড়ি ঘুরিয়ে ফেরার পথে স্থানীয় দোকান থেকে কিনে নিলাম এখানকার বিখ্যাত পকোড়ি আর ভাবরা ভাজা। রঘুনাথপুর - চেলিয়ামা রোডের দুধারে সারিসারি তাল আর খেজুরের বাগান ক্রমশ ঢেকে যাচ্ছে সন্ধ্যের অভ্যর্থনায়। আমরা গাড়ির ভিতর প্রত্যেকেই কেমন চুপ হয়ে আছি। আসলে চুপ করে বসে থাকার ভিতর একটা জানলা আছে। দৃষ্টি পিছলে কখনও বাইরে পড়লে ভেসে ওঠে জলরঙের একটা শতছিন্ন ছবি। অপটু হাতের আঙ্গুল চুঁইয়ে মিলেমিশে একাকার হয়ে গ্যাছে সেখানে ছাইরঙা আকাশ, জলপাই উঠোন আর হলুদ ডুরে শাড়ির মেয়েটা। সেই নাম না জানা ঠিকানা খুঁজে চলাই জীবন!
গল্প
মালী
তানভি সান্যাল (সাহেব সেখ)
মুর্শিদাবাদ, প: বঙ্গ

মালী ভালো করেই জানে যে ফুলটার মালিক ও নয়।
যতদিন যায় ফুলটার প্রতি মালীর ভালোবাসা ততটাই বাড়ে। কিন্তু ও এটা মেনে নিয়েছে যে এই ফুলটা অন্যের বাগানের ফুল। যাকে সে কোনোদিনও নিজের বাগানে বসাতে পারবে না। পারবে না ফুলটাকে আপন করে নিতে।
এবার প্রশ্ন হচ্ছে তাহলে কেন মালী এই ফুলের প্রতি এতটা যত্নশীল? কেন মালী ফুলটাকে সেবা করে? কী কারণে মালী ফুলটাকে এতটা ভালোবাসে? যদিও সে ভালোমতই জানে যে সে চেষ্টা করলে আকাশের চাঁদকে ছুঁতে পারবে না। আচ্ছা মালী তো ভালোমতই জানে সে ফুলটা অন্যের বাগানের আমানত. তবুও কেন ?
এর উত্তর হলো মালী সব জানে, সব বোঝে, কিন্তু সে বুকের উপর পাথর চাপিয়ে রেখেছে। ওর কিছু আসে যায় না যে ফুলটা অন্যের বাগানে বসানো হবে। কারণ ও নিজের কষ্টকে নিজের হৃদয়ের বোতলে ভরে ছিপি লাগিয়ে রেখে দিয়েছে। পরে একান্তে সে বোতলের মুখ খুলে চুমুক দেয় আর হাউ হাউ করে কাঁদে। যাকে আমরা বলি একান্ত আপন। এই শূন্য পৃথিবীতে মালীর কষ্ট ভাগ করার কেউ নেই।
কেউ তার কষ্টে আহহ বলার ও নেই। মালীর কপালটাই খুব পোড়া। পৃথিবীতে যত মানুষ আছে সবাই নিজের জীবনে সুখী। মালী কিন্তু মুখে কিছু কাওকে বলতে পারে না। কিন্তু মালীও রক্ত মাংসে গড়া একটা মানুষ তার ও মন নামক বস্তু আছে। সেও কষ্ট পায়। ব্যাথা পায়। জীবন যন্ত্রণার
আগুনে একটু একটু করে পুড়ে। যাই হোক মালী কিন্তু ফুলটাকে নিঃস্বার্থ ভাবে সেবা করবে, পূজা করবে, যত্ন করবে এটাই ভেবে নেয়। মালী ত্যাগের বিনিময়ে ফুলটাকে পাবে সে এটাও জানে যদিও এই পাওয়াটা ironical।সে ফুলটাকে হারিয়ে দেবে কিন্তু আবার ফিরে পাবে।
ফুলটাকে অন্যের বাগানে বসানো হবে। হারিয়ে যাবে ফুলটা মালীর চোখের সামনে থেকে। চলে যাবে ফুলটা মালীর কোল শূন্য করে। আচ্ছা এবার প্রশ্ন হচ্ছে সে কিভাবে তাকে পাবে?
ফুল মালীর হৃদয়ে আবার বসবে তাকে সেদিন ফিরে পাবে যেদিন সে অন্যের বাগানের অংশ হয়ে উঠবে। মালী চোখ বন্ধ করলেই ফুলটাকে দেখতে পাবে মনের মন্দিরে সেই ফুলটা চিরদিনই পূজিত হতে থাকবে। কী হয়েছে যে ফুলটা অন্যের বাগানে বসানো হয়েছে। কী হয়েছে ফুলটা সময়ের কালোস্রোতে মালীকে ভুলে গেছে? মালী তো তাকে ভুলতে পারেনি বা পারবে না?
মালী তাকে মনের মন্দিরে আসন দিয়েছে। মালী নিজেকে বলী দিয়েছে তার মুখে একটু হাসি দেখার জন্যে। আর মালী পারবে ও না তাকে ভুলে যেতে।
মালী সারাজীবন ফুলটাকে মনের মন্দিরে পুজো করবে। ভক্তি করবে। মালী তাকে সেবা করবে।
নিজেকে মাটি করে দিয়েও মালী তার সেবা করে যাবে। এটাই মালীর জীবনের লক্ষ্য। কারণ সে মালী। যে রক্ষা করে, সেবা করে যত্ন করে।
ফুলের পাঁপড়ি একটু নিস্তেজ হলে মালীর জান বেরিয়ে যায়।
মালী হাউ হাউ করে কাঁদে ফুলের কষ্টে। তাই মালী পারবে না ফুলটাকে বানের জলে ভাসিয়ে দিতে।
গল্প

আর কয়েকটা দিন, তারপরেই পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিতে হবে। আমাদের মহাকাশযান 'গন্তব্য' প্রায় রেডি। এটি প্রায় আলোর গতিতে ছুটবে মহাশূন্য দিয়ে। প্রায় পাঁচ বছরে আমরা পৌঁছে যাব আমাদের সৌরমন্ডলের বাইরে কাছাকাছি একটা গ্রহে - আমরা পৃথিবীবাসীরা ওর নাম দিয়েছি 'নতুন পৃথিবী' বা 'দ্য নিউ আর্থ'। প্রতিদিনই এসব নিয়ে বাড়িতে আলোচনা হচ্ছে, ফোনকল আসছে - তাই থেকেই সব জানতে পারছে অর্ক আর সবু। সবু মানে সবিতা - অর্কর একমাত্র বোন, ক্লাস ফোরে পড়ে। যেখানেই কান পাতবে, সেখানেই এই আলোচনা, নতুন গ্রহ সম্পর্কে কত কি নতুন নতুন তথ্য - কোনটা ঠিক, আর কোনটা বানানো - তাও বোঝা যাচ্ছে না। কেউ বলছে,
-আরে ওখানে এখন তো ইলেক্ট্রিক নেই, মানুষ থাকবে কি করে?
-কেন সিইএসসি ওখানে কোন বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা চালু করতে পারে নি? ওরা তো অনেকদিন আগেই চলে গেছে ওখানে।
-আরে না না। এত সহজ না কি? একটা নতুন সেট আপ তৈরি করতে সময় লাগবে না? তারপর তো ইলেক্ট্রিক ডিস্ট্রিবিউশন। তাছাড়া এখনও ওখানে ক'জন কনজুমার আছে?
-তা ঠিক। তা বটে।
ঘাড় নাড়ে অর্কর জ্যাঠামশাই। জেঠুর আবার হার্টের অসুখ, এ. সি. ছাড়া থাকবেন কি করে? তাই দুশ্চিন্তা বাড়ে তাঁর।
অর্করা শুনেছে, 'নতুন পৃথিবী'-তে এখনও পৃথিবীর মতো কিছুই প্রায় নেই। সামান্য কিছু মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিং বানানো হয়েছে। যারা আগে পৌঁছবে তাদের থাকার মানে মাথা-গোঁজার ঠাঁই দেওয়ার জন্য। ওখানে প্রচুর ওপেন ল্যান্ড অর্থাৎ খোলা জমি পড়ে আছে। গিয়ে চাষ-আবাদ করতে হবে তো? নাহলে মানুষ খাবে কি? অনেক মাল্টিবিলিওনিয়াররা চড়া দামে জমি কিনে রেখেছেন যাতে মনের মতো বাড়ি বা বাংলো ইত্যাদি বানিয়ে নিতে পারেন। তাঁরা বোধহয় সঙ্গে করে বিল্ডিং মেটিরিয়াল আর রাজমিস্ত্রীও নিয়ে যাবেন। তবে তার জন্য তাঁদের অনেক মূল্য দিতে হবে। সে সব সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে।
'নতুন পৃথিবী' মস্তবড় একটা গ্রহ, যার জলবায়ু অনেকটা পৃথিবীর মতোই। তবে পৃথিবীর থেকে অনেকগুণ বড় একটি গ্রহ। বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে দেখেছেন ওর মাটি চাষবাসযোগ্য। জল আর অক্সিজেনও আছে ওখানে। কিন্তু ইকো সিস্টেম গড়ে তুলতে হলে পৃথিবী থেকে নিয়ে যেতে হবে নানা ধরনের চারাগাছ, সব ধরনের প্রাণী, উদ্ভিদ, শৈবাল, ছত্রাক, ব্যাক্টেরিয়া, অ্যামিবা আর পতঙ্গ ইত্যাদি। সেসব খুব সহজ ব্যাপার নয় মোটেই।
'নতুন পৃথিবী'-কে পৃথিবীর মতো গড়া কয়েক বছরের কম্ম নয় তা জানে অর্কর মায়ের ঠাকুমাও। বুড়ি রোদে পিঠ রেখে বসে চোখ বুজে স্মৃতিরোমন্থন করে বলে,
-জানিস, আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন এখানে এতো বাড়িই ছিল না। আমার তো মাত্র এগারো বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল। ওই যে দূরে পুরোনো বাড়িটা দেখছিস, ওটা ঘোষেদের বাড়ি। তখন ওটা ছিল। আর ওই যে হলুদ বাড়িটা - ওটা মিত্তিরদের বাড়ি । ওটাও ছিল। বাকি সব ফাঁকা জমি। সন্ধ্যে হলে বাজারে বা দোকানে যেতে কারও সাহস হতো না। শুধু দু'পাশে জঙ্গল, ফাঁকা জমি আর পুকুর ছিল। ঠ্যাঙারেদের উপদ্রব ছিল খুব। দিনের বেলাতেও লোকজন একসঙ্গে দলবেঁধে যাতায়াত করত। যেই না বাংলাদেশ ভাগ হলো, ওদেশ থেকে হুড়হুড় করে লোক আসতে লাগল এখানে। কোথাও আর ফাঁকা জমি রইল না।
মায়ের ঠাকুমাকে অর্ক, সবুরা 'বড়মা' বলে ডাকে। বড়মার বয়স বোধহয় একশোর কাছাকাছি কিংবা তারও বেশি। বড়মা এই বয়সেও খালি চোখে বেশ পরিষ্কার দেখতে পায়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে এই পৃথিবীতে মৃত্যুর হার অনেক কমে গেছে। অবশ্য বার্ধক্যের কারণে বড়মার মুখের চামড়া, হাত-পায়ের চামড়া কুঁচকে গেছে। গায়ের চামড়া ঝুলে গেছে। মাথার চুল যে ক'টা আছে - সব শণের নুড়ির মতো। দিনের বেলা শুধু ভাত আর নিরামিষ ঝোল খায়। রাতে খই আর দুধ।
বড়মা বলেছে, উনি আর এই পৃথিবী ছেড়ে, স্বামী-শ্বশুরের ভিটে ছেড়ে 'নতুন পৃথিবী'-তে যেতে চান না। উনি এখানেই মরতে চান। একে তো এত বয়স হয়েছে, তার উপরে মহাকাশযানে চড়ে যাওয়ার ধকল সইবে না। পৃথিবীর মায়া উনি কাটিয়ে উঠতে পারছেন না কিছুতেই। যদি পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলে বড়মা এই বাড়িতেই মরবে!
সবাই একটা কথা বলাবলি করছে, পৃথিবী ধ্বংস হতে আর বেশী দেরী নেই। বিজ্ঞানী স্টিফেন উইলিয়াম হকিং অনেক বছর আগেই সাবধানবাণী করেছিলেন, "ধ্বংস ধেয়ে এল বলে, দ্রুত পৃথিবী ছাড়ুন!" কিন্তু "পৃথিবী ছাড়ুন" বললেই কি আর পৃথিবী ছাড়া যায়? তার প্রস্তুতি আছে তো নাকি? তাছাড়া, পৃথিবীর মত একটা গ্রহও তো খুঁজে বের করতে হবে? এত পুরাতন পৃথিবীর যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা আর তার মানবসভ্যতাকে এক কথায় সরিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব? কিন্তু উপায়ও তো নেই কিছু। তবে ধ্বংসের দিনক্ষণ কেউই সঠিকভাবে বলতে পারছেন না। সবাই আতঙ্কিত। সবাই পালাতে চায়, যতদূর সম্ভব। কিন্তু সেটাও বাস্তবে সম্ভব নয়। কবে কখন ক'জন গিয়ে পৌঁছবে নতুন গ্রহে, সেখানে গিয়ে খাবে কি? থাকবে কোথায় - সেটাও নিশ্চিত নয়। এক একজনের যদি যেতে পাঁচবছর বা তার বেশি সময় লাগে, তবে সেই মহাকাশযানে খাদ্য সংকট বা জ্বালানি সংকটও দেখাদিতে পারে। মহাশূন্যে কোন গ্রহ বা তারার সাথে ধাক্কা হতেও পারে। ওই মহাকাশযানগুলি আবার যদি ফিরে আসে আরো চার-পাঁচ বছর কিংবা তারও পরে, খালি মহাকাশযান ফিরে আসতে হয়তো এক বছর কম সময় লাগতে পারে, তাহলে বাকিরা যাবে কবে? যতই মহাকাশযান তৈরি হোক না কেন, এই পৃথিবীর জনসংখ্যার তুলনায় তা খুবই অপ্রতুল।
অর্কর বাবা একজন নামকরা কার্ডিওলজিস্ট, তাই তিনি একটু বেশি সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেন। কিন্তু বাকিরা? সাধারণ মানুষ কবে গিয়ে পৌঁছবে তাদের 'নতুন পৃথিবী' - তে তা খুবই অনিশ্চিত। সেদিন খেলার মাঠে এই নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। অর্কর বন্ধু হাবুল বলছিল,
"তোরা যা। আমাদের আর যাওয়া হবে না। আমাদের ডাক আসতে আসতে আমরা এখানে মরেই যাব!" শুনে অর্কর চোখে জল এসে গিয়েছিল। খেলার মাঠের সব আনন্দ ঢেকে গিয়েছিল বিষন্নতায়।
অর্ক একটা নামী স্কুলে ক্লাস এইটের ফার্স্টবয়। ওদের স্কুলে ভূগোলের আন্টি বোর্ডে লিখেছিলেন - "পৃথিবীর আসন্ন ধ্বংসের কারণ কি?"
উত্তরে অর্ক লিখেছিল," এই ধ্বংসের পিছনে মানুষই দায়ী। মানুষের কারণেই দ্রুত হারে বেড়েছে জনসংখ্যা। সেই কারণেই চাপ পড়েছে প্রাকৃতিক পরিবেশে। পরিবেশ দূষণও এর জন্য অনেকাংশে দায়ী। শিল্পায়নের ফলেই বেড়েছিল পরিবেশ দূষণ। জলবায়ুতে মারাত্মক প্রভাব ফেলেছিল বিশ্ব-উষ্ণায়ণ, পৃথিবীপৃষ্ঠের গড় উষ্ণতা বেড়ে গিয়েছিল - তার ফলেই মেরুপ্রদেশের বরফ গলেছে, জলচ্ছাস হয়েছে পৃথিবীর বহু জায়গায় এবং বহু প্রজাতির প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এক সময় মানুষ শুধু বাসস্থান নির্মাণ এবং সভ্যতা বিস্তারের জন্য নির্বিচারে কেটে ফেলেছিল গাছপালা, তার ফলেই উদ্বেগজনক হারে দ্রুতগতিতে বদলে গিয়েছিল পৃথিবীর জলবায়ু। ফুরিয়ে গেছে প্রাকৃতিক ও জৈব সম্পদ। নষ্ট হয়ে গেছে 'বাস্তুতন্ত্র' বা 'ইকোসিস্টেম'। বায়ুমন্ডলের দূষণের মাত্রা ছাড়িয়েছে এবং তার সাথে বেড়েছে কার্বন-ডাই-অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড, মিথেন, ক্লোরোফ্লরোকার্বনের মতো গ্রিন হাউস গ্যাস। এর ফলেই দেখা দিয়েছে অস্তিত্বের সংকট।" আন্টি ওকে দশের মধ্যে নয় দিয়েছেন।
এই পৃথিবী ছেড়ে যাওয়া ছাড়া গতি নেই জেনেই অর্কর মতো সবারই মুখভার, মনখারাপ। দেখা হলেই শুধু একই গল্প, একই কথা। ভাল্লাগে না আর! সবাই ভাবছে, কি করে এত বড় সভ্যতার এত সুখের সম্ভার এত উন্নতির কৌশল আবার নতুন করে গড়ে তোলা হবে 'নতুন পৃথিবী' - তে।
অর্ক ওর সমস্ত বইখাতা, জ্যামিতি বক্স, রং-পেন্সিল আর গল্পের বইগুলো গুছিয়ে নিয়েছে। বাবা নিয়েছেন স্টেথোস্কোপ, ডাক্তারী যন্ত্রপাতি, ওষুধপত্র, সিগারেটের অনেকগুলো প্যাকেট আর বেশ কয়েকটা লাইটার আর হয়ত কিছু টাকা পয়সাও। মা নিয়েছেন প্রেশার কুকার, নুন-চিনি-তেল-মশলা, হাতা-খুন্তি আর সাংসারিক অনেক জিনিসপত্র আর কিছু জামাকাপড়। অর্কর বোন সবু নিয়েছে ওর প্রিয় খেলনা আর পুতুলগুলো। সরকার থেকে সবাইকে বলে দেওয়া হয়েছে কেউ যেন কুড়ি কেজির বেশি জিনিসপত্র না নেয়, এক একটা মহাকাশযানে পঞ্চাশ জনের বেশি লোক নেওয়া যাবে না।
অবশেষে ওদের যাওয়ার দিন এগিয়ে আসতে লাগল। পনেরোই আগষ্ট ভারতবর্ষের স্বাধীনতার দিনটাকে বেছে নেওয়া হয়েছে ভারতবর্ষ থেকে প্রথম দশটা মহাকাশযানকে 'নতুন পৃথিবী' - র উদ্দেশ্যে পাঠানোর জন্য। এদেশ থেকে বাছা বাছা কয়েকজনকে পাঠানো হচ্ছে তাঁদের পরিবারের লোকজন সমেত। তবে শুধু মা-বাবা, স্ত্রী ও ছেলে-মেয়েকেই নিয়ে যাওয়া যাবে। অর্কদের যেতে হবে থিরুভানন্তপুরমে। ওখান থেকেই রওনা হবে ওরা। তার আগে অর্কর বাবা সব বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজনের সাথে একটা গেট-টুগেদারের ব্যবস্থা করলেন। এই শেষ দেখা, শেষ মিলন! শেষ আনন্দ ভাগাভাগি করার মুহূর্ত কেউ হারাতে চাইল না। কিন্তু গল্পগুজবের থেকে জরুরী কথাবার্তা আর কান্নাকাটিই হ'ল বেশি। ভালো ভালো খাবার সামনে থাকা সত্ত্বেও কেউ খেতে পারছিল না। সবাই একটা কথা জানতে চাইছিল, তারা কবে যেতে পারবে? কি করলে যেতে পারবে? অর্কদের সাথে আর কখনো দেখা হবে কি না ইত্যাদি ইত্যাদি।
যাওয়ার সময়ে আবার কান্নার মাত্রা বেশি হয়ে গেল। অর্কের মনটা ভারী হয়ে গিয়েছিল, সে একটু শ্বাস নেওয়ার জন্য ছাদে গেল। আকাশটা কেমন ঘোলাটে, রোদের তেমন জোর/তেজ নেই। বাতাসে একটা টকটক গন্ধ। শ্বাস নিতেও যেন কষ্ট হচ্ছিল। অর্ক নেমে এল নীচে। সারা বাড়িতে সেন্ট্রালাইজড এ. সি.। বাইরে থাকার চেয়ে ভেতরেই ভালো লাগছিল। কিন্তু সকলে তখনও কেঁদেই চলেছে । বাড়িতে লোকেলোকারণ্য। কোথাও একটু বসার জায়গা নেই। অর্কর খুব অস্বস্তি লাগছিল।১২ই আগস্ট অর্কর বাবা-মা দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে রওনা হয়ে গেলেন থিরুভানন্তপুরমে। ওখানে অনেক কিছু চেকিং হবে। ওর বাবা সকলকে ফিট রাখার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। একটু অসুস্থ হয়ে পড়লেই মুশকিল। তাকে চিরতরে রেখে যেতে হবে এখানে, এই পৃথিবীতে। আর যেখানে ফিরে আসা যাবে না কোনমতে।
১৫ই আগস্ট, ঘড়িতে দশটা দশ, পৃথিবী ছাড়ল মহাকাশযান 'গন্তব্য'। ঠিক একটা বড়সড় বিমানের মতো। দুটি বিমানকে মাঝখান থেকে জুড়ে দিলে যেমন হয় আর কি। পাঁচটা বছর সময় কম তো নয়। এর মধ্যেই খাওয়া-দাওয়া, শোয়া-বসা, হাঁটাচলা সব কিছু। তবে শুধু প্রিজার্ভড ফুড খেয়েই থাকতে হবে। অর্কর মন খারাপ হয়ে যাচ্ছিল শুধু বাড়ির লোকজনের জন্যই নয়, বন্ধুদের জন্য, লেখাপড়ার জন্য, স্কুলের জন্য, আরো অনেক কিছুর জন্য। এই পাঁচটা বছর ও পড়াশোনা করতে স্কুলে যেতে পারবে না। এক অনিশ্চিত জীবনের শুরুটা কেমন হবে সেটা ভেবে ও কূলকিনারা পাচ্ছিল না।
-দাদা এখন ক'টা বাজে রে?
বোন সবুর গলা শুনে অর্কর চমক ভাঙল। হাত ঘড়িটা দেখতে গিয়ে ওর মনে পড়ল ওরা এখন পৃথিবী পাড় হয়ে চলে এসেছে। এই ঘড়ির সময়ের সাথে আর মিলবে না।
বিদায় পৃথিবী, বিদায়! আর, তোমার সাথে দেখা হবে না আর! তবু তুমি বেঁচে থাকো, অস্তিত্বের সংকট কাটিয়ে উঠো। রক্ষা করো এই মানবসভ্যতাকে আরো হাজার হাজার বছর ধরে।
গল্প

রাজেশ্বর মিত্তির সরকারি দপ্তরে ছাপোষা কেরানী। বাবা মা কোন সুপ্ত বাসনায় ছেলের নাম রেখেছিলেন ‘রাজেশ্বর’, তাঁর অজানা। বন্ধুরা ডাকেন রাজাবাবু। ব্যঙ্গ করে কিনা কে জানে! আলোকোজ্জ্বল শহরের চৌহদ্দি ভিতর এক তস্য গলির অন্ধকার ময় দুটি কামরায় স্ত্রী মাধবী ও পুত্র নিয়ে থাকেন। ভবিতব্যহীন গতানুগতিক জীবন। জীবনযাত্রায় তাঁর আশা আকাঙ্ক্ষা নির্দিষ্ট পরিধিতে আবদ্ধ। রাজেশ্বরের এই হলো রাজত্ব।
সেদিন বাড়ি ফিরে চা’য়ের কাপ হাতে অফিসের বাতিল হওয়া সেই দিনকার বারোয়ারি খবরের কাগজে চোখ বোলাচ্ছেন।
মাধবীর বিরক্তি ঝরা স্বরে চমক ভাঙে –
“কতবার বলি একটা খবর কাগজ বাড়িতে নাও, দুপুরে একটু পড়তে পারি। এখন দেখ - বাড়ি ফিরেও কাগজটা দখল নিয়ে বসে আছে! দেখ তো লটারির রেজাল্ট বেরিয়েছে কি না?”
“হ্যাঁ এই তো কি একটা লটারির নম্বরের লিস্ট দেখছি,” এবার কটমট করে তাকান স্ত্রীর দিকে –এই মাগ্যিগন্ডার বাজারে অহেতুক খরচ তাঁর একেবারেই না’পসন্দ।
“আরে পাড়ার লটারির এজেন্ট পল্টু সে দিন টিকিটটা গছিয়ে দিলে। না করতে পারলাম না। দেখ তো পোড়া কপালে কিছু লাগলো কি না?”
রাজেশ্বর প্রচ্ছন্ন বিরক্তিতে বলেন –
“টিকিটের নম্বরটা বলো দেখি। হুম! 852313-”। ভাবেন টাকাটা গেছে, পাশের ভাড়াটের টিভিতে রাজনীতির কচকচানি শোনার থেকে নম্বরটা মেলাই। মাধবীকে চটানো ঠিক হবে না।
নিরুৎসাহি রাজেশ্বর লটারি রেজাল্টে চোখ বোলাচ্ছেন। টিকিটের দাম দেখে ভাবেন ওই টাকায় তিন দিনের বাজার হয়ে যেত। হঠাৎ তিনি থমকে গেলেন – চশমার কাঁচ মোছেন, দু’চোখ ঘষেন – না: ঠিকই দেখছেন, ঘরের ঝুলের ঝালরে মোড়া বাল্বের হলুদ আলোয় এই তো স্পষ্ট প্রথম প্রাইজের 852313 নম্বরটা ঝলমল করছে। হাতের কাগজ খসে পড়ে ঘরের মেজেতে। শিরদাঁড়ায় মনোরম অনুভূতির স্রোত ওঠে নামে, আচ্ছন্ন রাজেশ্বর ককিয়ে ওঠেন –
“মাধবী, মাধবী – 852313 নম্বরটা রয়েছে, আড়াই কোটির প্রাইজ!” আবেগে কথা জড়িয়ে যায় রাজেশ্বরের। সন্দিগ্ধ মাধবী বেরিয়ে আসে রান্না ঘর থেকে।
“এই তো দেখ – 852313।“ গলা বুঁজে আসে রাজ্যেশ্বরের। মাধবী চেয়ে থাকেন রাজেশ্বরের বিস্ময় জড়ানো আতঙ্কিত মুখের পানে। বুঝলেন লোকটা সত্যি কথা বলছে। পরক্ষণে তাঁর হাতের সদ্য ধোয়া কাঁচের প্লেট মাটিতে পড়ে ঝনঝন শব্দে ছত্রখান হয়ে ছড়িয়ে পড়ে ঘরের চতুর্দিকে।
রাজ্যেশ্বর বোকা বোকা হাসি নিয়ে তাকিয়ে থাকেন মাধবীর নানান অনুভূতি খেলা মুখের দিকে। বাক্য হারা মাধবীও শেষ অবধি খুশির আবেগ সামলে নিয়ে বসে পড়েন ঘরের কোণের ভাঙা চেয়ারে। হঠাৎ খুশির দমক কমলে দুজনে হয়ে পড়েন কিংকর্তব্যবিমূঢ়। অভাব তাড়িত জীবনে হঠাৎ করে দু এক হাজার টাকা হাতে এলে তাঁরা সামাল দিতে পারেন কিন্তু এক্কেবারে আড়াই কোটি টাকা পাওয়ার ঝক্কি কি ভাবে সামলাবেন! এত টাকায় কি সুখ তাঁরা কিনতে পারেন? অনেক খুঁজেও তাঁরা তল পান না। দিশা খুঁজে পান না দু’জনে। দুশ্চিন্তার মাঝে স্বপ্নাতীত পাওনায় হতবুদ্ধি দুজনে পরস্পরে দিকে বিহ্বল চোখে তাকিয়ে থাকেন নি:শব্দে।
রাজেশ্বর ঘরের এ কোণ থেকে ও কোণ পায়চারি করেন। জড়সড় হয়ে বসা মাধবীর মন অলীক চিন্তার কানা গলিতে মাথা কুটতে কুটতে ফিরে আসে এই সুপরিচিত অস্বাচ্ছন্দ্যের আটপৌরে জগতে। পায়চারীরত রাজ্যেশ্বর দাঁড়িয়ে পড়েন --
– “দ্যাখ, টিকিটটা যদি আমার কেনা হত - তা’হলে প্রথমে রক্ত চোষা অফিসের দারোয়ান পান্ডের হাজার পাঁচেক টাকার দেনাটা মেটাতাম। আর ধর একটু বাগানওলা, বেশ আলো হাওয়া খেলা ছোট্ট দোতলা বাড়ি কেনা – কত দাম হতে পারে বলতো? বড় সাহেব ওই রকম একটা বাড়ি কিনেছেন দমদমের ওদিকে। তারপর ধর বাড়িটা তোমার মনের মত করে সাজাতে খরচ হবে পনেরো কুড়ি হাজার, ওতেই হয়ে যাবে মনে হয়। এরপর সবাই মিলে প্রতি বছর বেশ বেড়াতে যাওয়া যাবে, তোমার দীঘা পুরী যাওয়ার কত শখ। আর বাকি টাকাগুলোর মাসকাবারি সুদে আমাদের বেশ চলে যাবে, কি বলো?”
মাধবী অনেক ভেবে বলেন - “কিন্তু বাড়ির সঙ্গে জমিটা একটু বেশি নিতে হবে, শাক সবজির বাগান করতে হবে না! ছেলেটার ভালো স্কুল দরকার।” কিছুটা থেমে – “পুরীতে সমুদ্রের ধারে একটা বাড়ি নেওয়া যাবে, কি বলো? যে সময় যাব না তখন ভাড়া দিলে কিছু রোজগারও হবে।“
প্রথম ধাক্কা কিছুটা সামলে নির্দিষ্ট পরিধির আটপৌরে আশা আকাঙ্ক্ষার হরেক ছবি ক্রমশ: মিলিয়ে গিয়ে জায়গা করে নেয় অন্য আরো জমকালো চটকদার ছবি। নিজের নিজের কল্প জগতে ঘুরপাক খান তাঁরা।
রাজেশ্বর পায়চারি করেন আর ভাবেন –
‘অফিসের ওই ঝুলে ভরা ফাইলের গুদামে কাল আর ঢুকতে হবে না। দূর- কাল কেন? ওই অফিসে কোনো দিন যেতে হবে না আর। বড় রাস্তার আলো ভরপুর দোকানটায় মানুষ পুতুলগুলো কত সুন্দর সুন্দর জামা প্যান্ট পরে দাঁড়িয়ে থাকে। ওই রকম কিছু কিনে নেবো। হাতে কত সময় থাকবে তখন, ধীরে সুস্থে সাজ পোষাক পরে ঘুরে বেড়াবো। পুরী নয় - দার্জিলিংয়ে বাড়ি নেব একটা। এই এঁদো পচা কাদা মাখা গলি, ইঁদুর ঘুরে বেড়ানো এই আলোহীন, বিষণ্ণ পরিবেশ চিরকালের মত ছেড়ে, দার্জিলিংয়ের পাহাড়ি পথে সকালে বেড়িয়ে, দুপুরে পাহাড়ের গা ঘেঁষা বাড়ির ফুলে ভরা বারান্দায় বসে মিঠে রোদ পোয়াবো – উফ! ভাবতেই পারা যায় না। ছেলেটাকে ওখানকার সাহেবি স্কুলে ভর্তি করে দিতে হবে। সে দিন বড় সাহেবের দার্জিলিংয়ের স্কুলে পড়া ছেলেটা অফিসে এসেছিল, কি চলন বলন, যেন সাহেবের বেটা!‘
রাজেশ্বরের রঙিন চিন্তায় ছেদ পড়ে। আড় চোখে মাধবী কে বলেন – “ভাবছি সিঙ্গাপুর ঘুরে আসব, বড় সাহেব গত বছর বেড়াতে গেছিল।“
“আমারও ইচ্ছে বিদেশে কিছুদিন কাটিয়ে আসা, সে দিন পাড়ার রমলার বোন আর ভগ্নীপতি
বিদেশের গল্প করছিল – সেখানে কেবল খুশি আর আনন্দ! যাক গে এখন রাত হয়ে গেছে, পল্টুকে ফোনে কাল সকাল সকাল আসতে বলো, ওর সাথে আগে পরামর্শ করতে হবে।” রাজেশ্বর ক্রমশ: বেড়ে ওঠা চাপা উত্তেজনায় ছোট্ট আলোআঁধারি ঘরটায় ঘুরপাক খেতে থাকেন। আবার একরাশ বিরক্তি নিয়ে আড় চোখে নিজস্ব ভাবনায় ডুবে থাকা মাধবী কে দ্যাখেন –
‘মাধবী এ আবার কি বলে? সত্যিই বিদেশে যেতে চায় না কি? বিদেশে গিয়ে ও কি করবে! সে বার পুরী যাওয়ার সময় সারাক্ষণ ছেলে কি খাবে, কি পরবে, প্রতিটি খরচ নিয়ে খিটিমিটি, রাজ্যের পুঁটলি পোঁটলা নিয়ে আমাকেই নাস্তানাবুদ হতে হবে ......।‘- কি করতে মাধবী বিদেশে যেতে চায় বুঝি না। একবার হোটেলে উঠে আর তো বেরবে না! সেবার পুরী গিয়ে দেখা গেছে, নিজেও বেরবে না – আবার আমার একা বেরনো নিয়ে হাজার বাধা নিষেধ। কিন্তু তাঁর মন এখনো তরুণ, শখ আহ্লাদ করার ইচ্ছে শেষ হয়ে যায় নি। না না: ওকে বুঝিয়ে একাই বিদেশ যেতে হবে। মাধবীর কাছে বিদেশ বা পুরী, বেনারস একই। ওই বেনারসে একবার ঘুরিয়ে আনলেই হবে। ‘ঘরের ঝিমনো আলোয় মনে হলো মাধবী বড়ই সাধারণ --‘ অকালে বুড়ি হয়ে যাওয়া অতি সাধারণ। চুলের চওড়া খয়া সিঁথিতে ঘামে তেলে ভেজা ধ্যাবড়া সিঁদুর। শুকনো পাকিয়ে যাওয়া শরীর। রান্নার মশলা ও সস্তা জর্দার তীব্র গন্ধের মিশেলে কাছে ঘেঁষা যায় না। কিছু দিন হলো হাঁপানিতে ধরেছে। পরমুহূর্তে মনে ভেসে ওঠে বড় সাহেবের কেতাদুরস্ত সেক্রেটারির যৌবনের দীপ্তি, টিভির লাস্যময়ী নায়িকার শরীরী আকর্ষণ ...। রাজেশ্বরের শিরায় শিরায় ওঠায় রক্তের জোয়ার ---- ‘কিন্তু লটারির টিকিটটা কিনেছে মাধবী। দীর্ঘশ্বাস ফেলেন রাজেশ্বর। ক্ষণিকের জন্য লটারির টিকিট পাওয়ার উচ্ছ্বাস মিলিয়ে গিয়ে স্বাভাবিকতায় ফিরে আসেন।
‘পনেরো বছর মাধবীর সঙ্গে আছি। আগে কখনো এমন চিন্তা তো মাথায় আসে নি! বোধহয় সহজে পাওয়া ভালোবাসার মানুষটার সঙ্গ কখন পর্যবসিত হয়েছে অভ্যাসে, টের পান নি। আবার কখন সেই অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে শারীরিক অনীহায়! বুঝতেই পারেন নি রাজেশ্বর।’ কিন্তু কোন অতৃপ্ত আত্মার তাড়নায় আবার ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন।
‘ভাবতে পারছি না মাধবী হঠাৎ বিদেশ যেতে চায় কেন? পুরী দিঘা বা সিঙ্গাপুর - ওর কাছে তো কোন তফাৎ নেই? তা’হলে কি ওর উদ্দেশ্য আমার পথে বাধা সৃষ্টি করা! টাকার জোরে আমাকে ওর ওপর নির্ভরশীল করে তোলা? আমার হাতে অল্প কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে বাকিটা নিজের কাছে রেখে রাজ্যের আত্মীয় স্বজনদের খোরপোশ যোগাবে! নিশ্চয় এটাই মাধবীর উদ্দেশ্য। নিজের আত্মীয়দের কথাও তাঁর মনে আসে। সবগুলোই ভণ্ড ও অপদার্থ। তফাৎ নেই।
ঘরের অন্য কোণে বসে থাকা মাধবীর দিকে ফিরতে মনে হল ওর দৃষ্টিতে যেন জড়িয়ে রয়েছে তাঁর প্রতি তীব্র বিদ্বেষ, অবিশ্বাস। রাজেশ্বরের মনে ধিকি ধিকি চাপা ক্রোধের আগুন জ্বলে ওঠে ---
‘খুব ভালো করে জানে লটারির টিকিটা ওর। একেবারে কঞ্জুস, এক পয়সাও হাতে দিয়ে গলে না। আমি বেশ বুঝতে পারছি এক পয়সা দেবে না আমাকে! আমার কপালে বাকি জীবনটা অফিসের ওই অন্ধকূপে কেটে যাবে।’
বিদ্বেষের দৃষ্টিতে দ্যাখেন স্ত্রীকে। মাধবীর শীতল দৃষ্টি যেন বুঝিয়ে দিচ্ছে সে’ও দিবাস্বপ্ন দেখতে জানে। তারও নিজস্ব ইচ্ছা অনিচ্ছা, ভাবনা আছে। দীর্ঘ পনেরো বছরের দাম্পত্যের অভিজ্ঞতায় সে বুঝতে পারছে রাজেশ্বরের মনের অন্দরে কিসের টানাপড়েন ঝড় উঠেছে ? টাকাটা হাতে এলে রাজেশ্বর ঠিক ঝাঁপিয়ে পড়ে হস্তগত করার চেষ্টা করবে। ওই তো সেদিন জোর করে লক্ষীর ভাঁড় ভেঙে পাড়ার মুদির ধার মেটালো কিন্তু এবার আমার টাকা হাতিয়ে নেওয়া খুব সহজ হবে না।
রাত গভীর হয়। অপ্রশস্ত ঘরের মাঝ বরাবর মাথা চাড়া দেওয়া অদৃশ্য প্রাচীরের দুই পাড়ে পরস্পরের প্রতি হিংস্র শ্বাপদের দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন দু’জনে।
কখন ভোর হল দু’জনে টের পান নি। ঘরের এক ফালি জানলার গ্রিলে বসা পরিচিত দুটি চড়াই পাখির কিচিরমিচির জানান দিল নতুন সকালের। তারা যেন টের পেয়েছে দুটি মানুষের পুঞ্জীভূত জমাট ক্ষোভে ঘরটার পরিবেশ হয়ে উঠেছে বিষাক্ত। পাশের বাড়ির ভাঙা দেওয়ালে প্রতিফলিত চুঁইয়ে আসা চিলতে ভোরের আলোয় মাধবীর রাত জাগা চোখে ক্লান্তির আভাস -রাজেশ্বরের আলোড়িত মনে জাগায় অস্বস্তি।
সদরে কড়া নাড়ার শব্দে চমক ভাঙ্গে। রাজেশ্বর শশব্যস্ত হয়ে দরজা খুলে দেখেন হাসিমুখে দাঁড়িয়ে লটারি এজেন্ট পল্টু।
“দাদা – টিকিটটা দেখান দিকি –আপনার ফোনের পর রাতে ঘুমোতে পারি নি। আপনারাও ঘুমোননি মনে হচ্ছে!” মাধবী কাঁপা হাতে দলা পাকানো টিকিটটা এগিয়ে দিলেন পল্টুকে। ব্যাগ থেকে ছাপানো লিস্ট বার করে পল্টু টিকিটের নম্বর মেলায়। নিজেদের অজান্তে পরস্পরের হাত আঁকড়ে স্বামী স্ত্রীর উদগ্রীব দৃষ্টি অনুসরণ করে লটারি রেজাল্টে পল্টুর আঙুলের ওঠা নামায় -।
পল্টুর আক্ষেপ – “উফ বৌদি- কান ঘেঁসে বেরিয়ে গেছে। নম্বরটা ফার্স্ট প্রাইজের বটে কিন্তু সিরিজ যে অন্য !” এবার সে এক গাল হাসে – “দু:খের কিছু নেই বৌদি। সান্ত্বনা পুরস্কার হাজার টাকা পেয়ে গেছেন। বিকেলে টাকাটা নিয়ে আসব। আপনার হাতের ইশ্পেসাল চা খেয়ে যাব কিন্তু - হা: হা:।“
পল্টুর সাইকেল ক্রিং ক্রিং শব্দ তুলে গলি দিয়ে চলে গেল। দু’ জনে হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। পরস্পরের হাতের বাঁধন আরো দৃঢ় হয়ে ওঠে। পরস্পরের প্রতি রাতের বিদ্বেষ, অবিশ্বাস কোন মন্ত্রবলে হঠাৎ উধাও হয়ে – নিজেদের পরিচিত কঠিন বাস্তবের পৃথিবীতে ফিরে এসে দু’জনেই স্বস্তির নিশ্বাস নিলেন। এজমালি চৌবাচ্চার জল মাথায় ঢালতে ঢালতে রাজেশ্বর ঠিক করেন দেরি না করে আজ সাহেবের কাছে মাধবীর হাঁপানির চিকিৎসার জন্য প্রাপ্য ভাতার দরখাস্ত জমা দেবেন। মাধবী ততক্ষণে রান্না ঘরে রাজেশ্বরের প্রিয় পরোটা আলু চচ্চড়ি বানানোর তদ্বিরে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।
এক রাতের আকাশ কুসুম স্বপ্ন চুর চুর হয়ে ভেঙ্গে – দু’জনেই তখন ফিরে এসেছেন তাঁদের দারিদ্র ভরপুর সংসারের স্বস্তিকর পৃথিবীতে।
প্রবন্ধ


শিল্পী রেম্ব্রান্টের বাড়ি। এখন মিউজিয়াম।

শিল্পী রেম্ব্রান্ট স্ত্রী সাসকিয়ার সাথে।
সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি থেকে আমষ্টারডাম শহরের নাগরিকেরা এক অদ্ভুত আর অবিশ্বাস্য দৃশ্য দেখতে আসতো। শ্রীলংকা থেকে আগত এক হাতী নানারকম খেলা দেখিয়ে এ শহরের জনসাধারণকে অপরিসীম আনন্দ দিত। হাতীটির জন্ম ১৬১০ সালে শ্রীলংকাতেই (Ceylon)। ওর নাম দেয়া হয়েছিল হানস্কেন (Hansken)| একে শিল্পী রেম্ব্রান্টের (Rembrandt van Rijn (1606-1669) হাতীও বলা হয়, কারণ ১৬৩৭ সালে এই হাতীকে আমষ্টারডাম শহরে প্রথম দেখে রেম্ব্রান্ট এত মুগ্ধ হয়েছিলেন যে ওর কয়েকটা ছবিও একেঁছেন। তামিল ভাষায় হাতী হল আন্নাই। সেদিন আমষ্টারডাম শহরের রেম্ব্রান্ট হাউজ মিউজিয়ামে এর ওপর সুন্দর Exhibition হয়ে গেল। সপ্তদশ শতকের ইউরোপে এ হাতীর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল।
সপ্তদশ শতকে শ্রীলংকা ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর একটা বড় ঘাঁটি ছিল। ওখানকার ওলন্দাজ গভর্ণর প্রিন্স ফ্রেডেরিক হেনরী (Frederick Henry, Prince of Orange, 1584-1647) হঠাৎ ছোট হাতীর প্রতি কৌতূহল দেখান। ১৬৩৩ সালে হাতী হল্যান্ডে আসে, আর প্রিন্স ওকে অন্যান্য জন্তুর সাথে রাজকীয় আস্তাবল রাখেন। ওর তামিল নাম হল আন্নাই (হাতী)। ওকে এ সময় প্রায় এক মিলিয়ন ডলার দিয়ে কেনা হয়েছিল। ১৬৩৭ সালে রেম্ব্রান্ট ওকে দেখেছেন আর চক দিয়ে হাতীর চারটি ছবি আঁকেন। Amsterdam শহরের ধনী লোকেরা, যেমন কর্নেলিস ভন গ্রনভেল্ট
(Cornelis Van Groenevelt, 1580-1642), প্রায় ২০,০০০ ডাচ পয়সা দিয়ে হাতীকে কেনেন।
হাতী এ সময় অনেক কিছু শেখে, যেমন, একটি বাস্কেট শুঁড়ে নেওয়া, তরবারী নেওয়া, বন্দুক ছোঁড়া ইত্যাদি। ১৬৩৭ সালে আন্নাই আময্টারডামে থাকাকালীন রেমব্রান্ট হাতীটিকে আঁকেন। এই শিল্পকলাই হয়তো শিল্পী ওর আদম আর ইভ অঙ্কনের সাথে যুক্ত করেন। ১৬৩৮ সালে আঁকা রেমব্রান্টের এই ছবিটি তেল আভিভ মিউজিয়াম, ইসরায়েলে সংরক্ষিত রয়েছে।
হাতীটি ইউরোপের অনেক জায়গাতেই ঘুরে বেড়িয়েছে। জাহাজে বল্টিক অঞ্চল, হেঁটে ডেনমার্ক অঞ্চল, আর ইতালি ও ইউরোপের নানা দেশ।
ফ্লোরেন্স শহরের বিশেষ স্কোয়ার পিযাজ্জা দেল্লা সিনোরিয়াতে এসে হাতী হঠাৎ মাটিতে পরে কিছুক্ষণের মধ্যেই মারা যায়। এ দৃশ্য দেখেছেন ইটালিয়ান স্টেফানো দেল্লা বেল্লা। ইনি ফ্লোরেন্সে ছাপাখানায় লেখা সংক্রান্ত কাজ করতেন।
এরপর কোম্পানীর ভন গ্রুনভেল্ট (Van Groenevelt) হানস্কেনের শরীর তোস্কানীর ডিউক ফারদিনানদো, দ্য মেদিচীকে বিক্রি করে। ইনি প্রাকৃতিক বিজ্ঞান পছন্দ করতেন। রেমব্রা্ন্টের প্রিয় হাতী হানস্কেনের সাথে পরিচয়ে এই জগত বরেণ্য শিল্পী ওকে কয়েকবার দরদ দিয়ে অঙ্কিত করে চিরস্মরণীয় করে রেখেছেন।

হাতী হানস্কেনের রেখাচিত্র।

প্রদর্শনী, রেমব্রান্ট হাউজ সংগ্রহশালা।
গল্প

যমুনার কোনোদিন কোনো অজানা অচেনা রাস্তায় হাঁটার কথাই ছিলো না। এমন কি কোনো অচেনা ভিড়ে পথ খোঁজার কথাও ছিলো না তার। আসলে যমুনাদের বাড়িটা ছিলো সেকেলে ধরনের । রক্ষণশীল গাম্ভীর্য জমাট বাঁধা থাকতো তাদের বাড়ির খিলানে, উঁচু উঁচু সিলিং-এ। উঁচু, ভারী দরজাগুলো সহজে খুলতো না তাদের বাড়ির। যমুনা বেশ শান্ত, নিস্তব্ধতায় জীবনের অনেকটা সময় সেই বাড়ির বন্ধ দরজার ওপারে কাটিয়ে দিয়েছে; অনায়াসে। তখনো তার জীবনে কবিতারা আসেনি। তারপর একদিন অনেক কিছুই অন্যরকম ঘটলো। যে কথা ছিলো না সেই কথাগুলোই সত্যি হয়ে গেলো তার জীবনে।
কবিতাই হয়তো ঘটালো। সেই কবিতা, যা বোধহয় হঠাৎই আসে। এক দৈবের মত। কিংবা বলা যায় হঠাৎ এসে যাওয়া বৃষ্টির মত। যমুনারও কাছে কবিতা এসেছিল তেমনি। একটা কবিতা সাদা পাতায় লেখা হোলো। দ্বিতীয় কবিতা মনের মধ্যে এলো; দ্বিতীয় পাখি উড়ে এলো খাতার সাদা পাতায়, ফুটে উঠতে থাকলো কবিতার অক্ষরগুলি। এইভাবে একটা, দুটো, তিনটে, চারটে করে পাখি উড়ে আসতে থাকলো। আর আশ্চর্য এক দুনিয়া খুলে যেতে থাকলো মনের আঙিনায়। সে কবিতার পর কবিতায় সাদা খাতা ভর্তি করতে থাকলো। কবি কথাটা সে নিজের নামের আগে লেখে আর কাটে। যদি কেউ দেখে ফেলে। বেশ লজ্জা পায়। কাঁধের ঝোলানো ব্যাগে কবিতাগুলি রেখে দেয়। যেখানে যায় ওরাও সঙ্গে থাকে।
যমুনাদের বাড়িটা যেখানে, সেখান থেকে অনতিদূরে ছিল অন্য একটা রাস্তা। বাড়ির সামনের টানা ট্রাম লাইনটা সোজা গিয়েছে সেই রাস্তাটায়। সেই রাস্তাটা যমুনার জীবনের এক আশ্চর্য পথ। এক আলো আঁধারি তারাজ্বলা সরণি।
হঠাৎই যমুনা পৌঁছে গেছিলো সেই অচেনা অজানা রাস্তাটায়, হঠাৎ পৌঁছনো চওড়া রাস্তাটায় তখন কার্নিভ্যাল চলছে। জীবনের কার্নিভ্যাল। সে এক অন্য পথের পথিক - একা মেয়ে সেই আলো আঁধারি রাস্তায় পৌঁছে যেন জীবন উদযাপনের এক স্রোত মুখরতা অনুভব করলো।
আর সেই রাস্তার ধারেই বসেছিল এক জাদুকর। যমুনা সেখানে পৌঁছতেই, তার সাদা কালো জীবনে নিমেষে জাদুকর ছড়িয়ে দিয়েছিল হরেক রঙ। নিজের মর্জিতে নিজের আনন্দে। লাল, নীল, সবুজ , হলুদ, বেগুনির পাশাপাশি অনেকটা ধূসর রঙেরও আবির্ভাব ঘটেছিলো যমুনার জীবনে সেদিন থেকে। আসলে তীব্র আনন্দের সঙ্গে কষ্ট যন্ত্রণারও গাঁটছড়া আছে যে! সুতরাং হরেক রঙের ঝলকানি হঠাৎই আলোড়িত করেছিল যমুনাকে।
এক প্রৌঢ় জাদুকর যেন অপেক্ষায় বসেছিল। তার থেকে সঠিক ভাবে বললে বলা যায় ঘাপটি মেরে বসেছিল অপেক্ষায়। নিতান্তই এক মাঝামাঝি জীবন যাপনে ক্লান্ত যমুনা আচমকাই নানা রঙের আলোকে আলোকিত হতে হতে ভেবেছিল জীবনে কতকিছুই দেখার বাকি ছিল!
বেশ কয়েকটা অচেনা রাস্তা পেরিয়ে ট্রামটা যেদিন তাকে ঐ রাস্তাটায় পৌঁছে দিয়েছিল; যমুনার সাইড ব্যাগটার ভিতরে সবুজ মলাটের খাতায় তখন বেশ অনেকগুলো কবিতা জমে গেছে। যেন তখনও সে ছিল এক কিশোরী। কবিতাগুলো কাপড়ের কাঁধ ব্যাগের ভিতর লুকোনো প্রেমপত্র; সঙ্গে নিয়ে ঘুরছে। কেমন লজ্জা, কেমন ভয় ভয়; দারুণ উত্তেজনা বুকের ভিতর। আদৌ কি এগুলো কাউকে দেখানো যায়! ভেবে পেতো না সেই যুবতীর মোড়কে আদতে কিশোরী মেয়েটি।
আসলে সেই মেয়েটা এক লুকানো সময়ের খাঁজে লুকিয়ে ছিল। একদিন হঠাৎই কতগুলো খুচরো পয়সা হাতে নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়া বালিকার মতই বেরিয়ে পড়েছিল ভীষণ ব্যস্ত, ভীষণ সপ্রতিভ অন্যরকম এক শহরে। অচেনা, অজানা এক ট্রামরাস্তা ধরে সে পৌঁছেছিল রঙবাহারি সেই এক রূপকথার জগতে।
এই যে মানুষ কবিতা লেখে, তার থেকে বোধহয় একরকম গন্ধ বেরোয়। খাতার মলাট খুললেই সুবাস ছড়িয়ে পড়ে কবিতা থেকে। ভাসতে থাকে সুগন্ধ আকাশে বাতাসে। মানুষের থেকে দ্রুততায় কবিতার গন্ধ পৌঁছে যায় অন্যত্র। যমুনার কয়েকটা কবিতায় বোধহয় তেমনি কোনো সুগন্ধ ছিল। সেই সুগন্ধ ঠিক গিয়ে পৌঁছেছিল প্রৌঢ় জাদুকরের নাকে। যমুনা যাওয়ার আগে সেই নতুন রাস্তায় তার কবিতাগুলো উড়ে গিয়ে বসেছিল জাদুকরের কাঁধে মাথায়। জাদুকর নতুন রাস্তার ধারে যমুনাকে দেখে কেমন হকচকিয়ে যায় প্রথম দিন। জল খাচ্ছিলো সে। বিষম খেয়ে জল তার দুই চোখে। যমুনা জিজ্ঞাসা করে, 'কি হলো?' জাদুকর সামলে নেয় নিজেকে। হেসে ঘোষণা করার ঢঙে বলে, 'কি হবে! আমি জাদুকর। ভোল পালটে সোজাকে উল্টে দিয়ে মানুষকে অবাক করাই আমার কাজ। আমার সহজে কিছু হয় না।'
সে কথা ক'টা বলে মৃদু মৃদু মোহন হাসি হাসতে থাকে। তার বহু চেষ্টায় তৈরী করা কারিগরিতে নিজেকে মেলে ধরতে চায়। সে জানে এইভাবেই মানুষেরা মোহিত হয়। বিশেষ করে মেয়েরা। সুতরাং সামনের মেয়েটিও হবে।
কিন্তু পুরোপুরি সেটাতো হয় না। ভালো লাগে বটে যমুনারও। কিন্তু শুধুই মোহিত হওয়া তো হয়ে ওঠে না তার। সে যে জাদুকরকে তার নিজস্ব আতস কাঁচের তলায় দেখে নেয়! তার চোখের মণিতে কে যেন সেই কোন ছোট্ট বয়স থেকে সামনের মানুষটার বুকের ভিতর পর্যন্ত দেখে নেওয়ার যন্ত্র লাগিয়ে দিয়েছে। সে খুব সহজেই সকলকে খুব ভিতর থেকে দেখে নেয়।
সহজাত সেই স্বভাব মতই সে জাদুকরের হৃদয়ের খুব কাছেই দাঁড়িয়ে থাকে। লোকটার সুখ, দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা সবকিছু নিজের হাতের তালুর মত দেখতেও পায়। আর জাদুকরের হাড় পাঁজরা গুণে ফেলে খুব সহজেই।
যমুনার ব্যাগের মধ্যে থাকা খাতার ভিতর কবিতাগুলোয় তখন ক্রমশ প্রজাপতির পাখা জুড়ে গেছে । হঠাৎ লেখা গল্পগুলোতে রামধনুর রঙ খেলে যাচ্ছে। জাদুকর বলে, 'ও মেয়ে তোমার কবিতাগুলো বেশ ভালো সুগন্ধ ছড়াচ্ছে এখন।' সে মৃদু হাসে। জাদুকর বলে,
- 'তোমার লেখা গল্পগুলো নজর করেছো, বেশ চমৎকার হচ্ছে।'
যমুনা তৃপ্তির শ্বাস ফেলে।
যমুনা ভাবে, আজকাল বেশ হয়েছে -- বুকের মধ্যে কেমন ধুকপুকুনি। কখন যাবো ট্রাম রাস্তা ধরে জাদুকরের চেনানো সেই গলিতে। জাদুকরকে খুঁজে পাবো তো! আসবে তো ঐ পথে! কেমন এক উচাটন। সারাক্ষণ দেখা হওয়ার অপেক্ষা। দেখা হতেই যমুনা বড় করে শ্বাস নেয় বাতাসে। জাদুকর দেখতে পেয়ে রেগে যায়। 'ঝড় বৃষ্টি মাথায় করে কেউ বাড়ি থেকে বের হয়। এমন বজ্র বিদ্যুৎ নেমে আসছে আকাশ থেকে; ঠায় দাঁড়িয়ে আছো কেন মেয়ে? তোমার কি বোধবুদ্ধি লোপ পেয়েছে, বলতো আমায়!'
যমুনা ভাবে, কি করে বলে সে, হ্যাঁ জাদুকর তাই। আগের সেই যমুনা আর এই যমুনায় যে আকাশ পাতাল ফারাক। জাদুকরের সঙ্গে দেখা না হলে যে তার মন কেমন করে। কেমন এক শঙ্কা, উত্তেজনায় ত্রস্ত হয়ে থাকে সে।
যমুনাকে ধমক ধামক দিয়ে আপনমনে হাসে জাদুকর। সেই হাসি দেখে মনে হয়, সে জানে এমন হওয়ার কথা ছিল। তার জাদু এমনই মারাত্মক। ঠিকঠাক কাজ করেছে তার জাদু। তৃপ্ত খুশির ভাব তার চোখের তারায় ঝিলিক তোলে। জাদুকরের মুখের চামড়ার তলায় খুশির কম্পন দেখতে পায় যমুনা।
তার চোখের আতস কাঁচের তলায় সেই অল্প সময়ের মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠে জাদুকরের হৃদয়ের সব প্রকোষ্ঠ। সে পড়ে ফেলে লুকিয়ে থাকা কথাগুলো। --- লোকটা সারাটা জীবন এমন তীব্র আগ্রহের জন্যেই যেন অপেক্ষা করেছে। অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেছে, তবুও পায়নি। তারপর হঠাৎ একদিন এই আকুলতার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছে। জাদুকর একদম বেকুব বনে গিয়েছে। মানুষটা কম অবাক হয়নি! সে নিজেই জানতো না তার জাদুর এত জেল্লাও আছে!
যেতে আসতে কত যে টানাপোড়েন তৈরী হয় এই দুটি মানুষের মধ্যে। কত যে কষ্ট কাজ করে বুকের ভিতর। রোজ সেই আলো আঁধারি সরণি থেকে ফিরবার সময় বাতাস ভারী হয়ে যায়। জাদুকর আর যমুনার মধ্যবর্তী বাতাসে জলকণা ভাসতে থাকে আর কুয়াশায় অস্বচ্ছ হয়ে আসে পারিপার্শ্বিক।
---- 'জাদুকর বলোতো কেন এমন হয়। রোজ যাওয়ার সময় কি কষ্ট! কেন আমায় চলে যেতে হয় জাদুকর, কেন চলে যাওয়ার সময় এত কষ্ট হয়! কেন এত পিছুটান! কোথা থেকে জন্মালো জাদুকর!'
যমুনার দিকে ভারী বিষণ্ণ হয়ে তাকায় জাদুকর। ঘন কুয়াশা ছেয়ে থাকে তার চোখে মুখে। আত্মগত স্বরে বলে, 'এই কষ্টটাই তো মুশকিল। তার চেয়ে…….. ।'
তার শেষ না হওয়া কথা শেষ হওয়ার আগেই হাঁকুপাঁকু করে যমুনা থামিয়ে দেয়। ---'চুপ করো জাদুকর, চুপ করো। ও কথা বলো না। আমার কোনো কষ্ট হয় না। কোনো কষ্ট নাই আমার। জাদুকর, জীবন যেমন দেবে তাই তো তুমি পাবে! তার এক সুতো বেশিও না এক সুতো কমও না। আমার দেখো কোনো বিষাদ নেই চোখে মুখে। আছে? দেখো তুমি। 'সে জোর করে জাদুকরের মুখ ঘুরিয়ে নেয় নিজের দিকে।
তার জাদুকর হাসে। যমুনার মুখের দিকে তাকিয়ে সেই বিষণ্ণ হাসি! দেখে বুকের ভিতরটা টনটন করে যমুনার। চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসে। মুখ ঘুরিয়ে আড়ালে চোখ মুছে ফেলে সে। জোর করে হেসে উঠে বলে, 'কি একটা হাসি হাসলে জাদুকর, যেন উত্তমকুমার!'
দু'জনেই সেই এক আলোকোজ্জ্বল সরণিতে বুকের মধ্যে অব্যক্ত যন্ত্রণা চেপে হেসে ওঠে জোরে। জাদুকরের চোখ দুটো ঝিকমিক করতে দেখে যমুনা নিয়নের আলোয়।
জাদুকর অন্ধকার নেমে আসা সন্ধ্যায় হাত ঘোরায় জাদুকাঠি নাড়ানোর মত। যমুনা অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। ভাবে, জাদুকর নতুন করে আবার কি জাদু দেখাবে এখন!
জাদুকর হাসে। বলে, 'সামনের দিকে তাকাও, দেখো কি মায়া পৃথিবীর। দুনিয়ার সুর, রঙ, গন্ধ অনুভব করো মেয়ে।'
যমুনা আশ্চর্য হয়ে দেখে সামনের দিকে। চারপাশটা লক্ষ্য করে। সত্যিই তো কি ঝলমলে শহর। মায়াময় সন্ধ্যায় শহরটা যেন চমৎকার এক আলোখেলা নদী। জাদুকর আর সে পায়ে পায়ে হেঁটে যায় সেই আনন্দনগরীর পথ বেয়ে।
যমুনা ফেরার পথের মোড়ে দাঁড়িয়ে জাদুকরের দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। জিজ্ঞাসা করে,
'জাদুকর আমি তোমার কে বলতো? তোমার আমার মধ্যে কী আছে জাদুকর?'
জাদুকর রহস্যময় মুখে বলে, 'কিছু তো একটা আছে নিশ্চয়। না হলে কেন আমরা এইখানে এই এক আশ্চর্য জীবনের মোড়ে দুজনে একসঙ্গে দাঁড়িয়ে আছি। যমুনা সপ্রশ্ন চোখে তাকায়। জাদুকর মায়াবী হেসে বলে, 'তুমি আমার কল্পমানসী গো বুঝলে না মেয়ে!'
যমুনা হাসে, তার চোখের আতস কাঁচের তলায় জাদুকরকে দেখে। যমুনার মায়াকাজল লাগানো চোখ জাদুকরের ভিতর পর্যন্ত যেন দেখতে পায়। সে বোঝে, জাদুকরকে যখন প্রথম দেখেছিলো তার থেকে আকাশ পাতাল ফারাক এই সামনের মানুষটার। আগে সে যেন ছিল শুধুমাত্র টাকা নিয়ে জাদু দেখানোর কারিগর। আর আজ সে নিজের আনন্দের জন্যই জাদু দেখায়। আর তখন তৃপ্তি তার চোখে মুখে ফুলের রেণুর মতই ছড়িয়ে পড়ে। সে এখন অনায়াসে ভেল্কি দেখিয়ে ঢুকে পড়তে পারে পার্লামেন্টে, ফাটা কলারের জামা পরেই চলে যেতে পারে গ্র্যান্ড হোটেলের ভিতরে। যমুনা অনুভব করে , প্রথম দেখা দুঃখী সেই ভেল্কিবাজ আজকে যেন আশ্চর্য পরিণত এক মানুষ। সুখ দুঃখের সমব্যথী এক সত্যিকারের জাদুকর। যমুনার ইচ্ছে করে তার হাতটা শক্ত করে ধরতে। কিন্তু ধরে না। পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে ছুঁয়ে থাকে তার হাত। এক অদ্ভুত চিরন্তন সংযোগ স্থাপিত হয়। তারা এই পৃথিবীতে দুটি মানুষ যতটা পারে একসঙ্গে হেঁটে যেতে থাকে। জাদুকর আর তার কল্পমানসীর ঝোলায় সঞ্চিত হতে থাকে অজস্র রঙ, অজস্র সুখ দুঃখের গল্প আর তারাখেলা কবিতার সঞ্চয়।
গল্প
রাজকুমারী
দেবপ্রতিম দেব
ফার্স্ট লিংক রোড, শিলচর, আসাম

এক দুই ফোঁটা বৃষ্টিতে অফিস থেকে বেরিয়ে রাজীব নিকটবর্তী মার্কেটে ঢুকেছিল; দুই তিন দিনের জন্য মাছ, সব্জি একসাথে সেরে ফেলল।
বাচ্চাদের জন্য দুটো দুটো লজেন্স নিয়ে রাজীব ঢালু রাস্তা দিয়ে খুব দ্রুত হাঁটতে হাঁটতে ঘরে ফিরছে। বৃষ্টি নেই, বৃষ্টির জল নেমে আসছে নীচে, রাজীবের দিকে। রাস্তা এবং নালার মাঝখানে যথাক্রমে কাদামাটি আর ঘাস। সেই ভেজা সবুজ ঘাসে এদিক ওদিক ছড়িয়ে আছে ছোট্ট ছোট্ট ফুল সাদা, হলুদ।
বাড়িতে আজ তার বোন রুহি ছেলে মেয়েকে নিয়ে আসবে। এপার্টমেন্টে যাবার পরে এই প্রথম।পাহাড়ের অপোক্ত মাটিতে একমাত্র এই বহুতল আবাসনটি গড়ে তোলা প্রশাসনিক কর্মী বলেই সম্ভব হয়েছে প্রোমোটারের।
বাড়িতে পৌঁছে রাজীব যথারীতি ছয়টা জুতো দেখল দরজার বাইরে। ঘরের ভিতরে তার ভাগ্নে মুস্তাফার সঙ্গে কথা বলছে, ওরা মিলেমিশে গিয়েছে তা দেখে রাজীব আপ্লূত। রাজীব দুটো চকলেট বাড়িয়ে দিতেই মুস্তাফা রাজীবকে বলল - 'পিশিএ তামিনারে গাইল্ লাইসে'। তার ভাগ্নী এবং রুহি দুজনই গম্ভীর। কি হয়েছিল তা রাজীব রুহির কাছে জেনে বলল - ও, ইতা নি কান্ড, খেলনা নিয়ে ঝগড়া!
রুহি ওঠে দাঁড়াল এবং - 'অনেক সময় তেকিয়া ওয়েইট করসি তর লাগিয়া … আর বইয়ার না আজকে' - বলে রাজীবকে বাই জানিয়ে ছেলে মেয়েকে নিয়ে চটজলদি বেরিয়ে যেতে লাগল। রাজীব কোনোমতে তার ভাগ্নে - ভাগ্নীকে লজেন্স হাতে তুলে দিতে সক্ষম হয়।
রুহি চলে যাবার পর রাজীব তামিনার ঘরে তাকে খুঁজে পায়নি। রান্নাঘরে বাজারের ব্যাগ রেখে এসে তামিনাকে ডাক দিল রাজীব - কোনো শব্দ নেই; ফের সে তামিনাকে ডাকল অনেকবার, সমস্ত বাড়িতে খুঁজে দেখল - কোনো শব্দ নেই! মুস্তাফাকে সঙ্গে নিয়ে এবার রাজীব রাস্তায় বেরোল। খুঁজতে খুঁজতে রাত ৯টা ১০টা ১১টা ১২টা ছাপিয়ে গেছে। মুস্তাফা অনেকক্ষণ থেকে রাজীবের কোলে ঘুমোচ্ছে।
সদ্য-কিশোরী তামিনা এবং শিশু মুস্তাফা ওরা অনাথ ভাই বোন। জন্মের পর থেকে রহিমের আশ্রমে ছিল অনেক বছর। সেখানে তাদের নামকরণ, সেখানেই সম্পর্ক। তামিনা মুস্তাফাকে দেখেশুনে রাখতে প্রথম থেকেই খুব সাবলীল।
রহিমের মৃত্যুর পর ডোনেশনের অভাবে আশ্রম-গেটে তালা ঝুলছে। তখন থেকে বাচ্চারা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। তামিনা এবং মুস্তাফাকে প্রতিদিন সকাল - সন্ধে মার্কেট এলাকায় দেখা যেত, এর কাছে ওর কাছে হাত বাড়িয়ে টাকা খুঁজত।
রাজীব দেয়নি কোনোদিন; সে স্পষ্ট বলে দিত -
'কিচ্ছু খাইতে চাইলে খাইতে পারবায় কিন্তু কেশ দিয়ার না'।
তামিনাদের ডালপুরি খুব পছন্দের। তাদের খাওয়া শেষ হলে রাজীব আপেল বা কলা দিয়ে যেত হাতে।
মধ্য-চল্লিশের রাজীব একা থাকত, একদিন তার ছোট বোন রুহিকে বলল যে সে বাচ্চা এডপ্ট করবে। রুহি বিশেষ কিছু বলেনি, দাদাকে শুধু প্রশ্ন করেছিল -
'তর এখনের সেলারি দিয়া পারবে যে তুই শিওর নি'?
সমস্ত শহরে তামিনাকে খুঁজতে খুঁজতে সময়টা ভোরের কাছাকাছি। মুস্তাফা এখনো ঘুমে। রাজীব আবার সেই ঢালু রাস্তায়, নামছে এবার, অফিস-পাড়ার দিকে এগিয়ে চলেছে।
সাদা, হলুদ যে সব ছোট্ট ফুলগুলো সে গত সন্ধ্যায় দেখেছিল, সেইগুলো যেন আরো বড় হয়েছে।হাঁটতে হাঁটতে রাজীব তার ভগ্নীপতির অফিসের সামনে ভিড় দেখতে পেল; সামান্য কিছুদূর যেতেই সে কান্নাকাটির আওয়াজ শুনতে পায় যেদিকে রুহিরা থাকে। কণ্ঠস্বরটা তার ভগ্নীপতির, এমনই মনে হয়েছিল রাজীবের। রাজীব থমকে দাঁড়ালো, তার যে আশঙ্কা ছিল - সেটা কি সত্যি ঘটেছে?
'ভূমিকম্প হইসে মনো হয়, তে টের পাইলাম না কেনে? '...
'রুহি তারার বিল্ডিং ঠিকঠাক আসে তো?' - এই কথাগুলো ভাবতে ভাবতে সে বহুতল আবাসনটির দিকে হাঁটা দিল।
যত এগিয়ে যাচ্ছে রাজীব, তত বেশি ধোঁয়া। ধোঁয়া ভেদ করে সে প্রথম এবং তারপর সবাই দেখতে পেল বিশাল ধ্বংসস্তূপ, যার চূড়ার দিকে কোনো জীব হামাগুড়ি দিচ্ছে।
সূর্যালোকে সবাই সেই চূড়ায় একটি মেয়েকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক, ওরা কেউ তার নাম জানে না, জানার কথা নয়। কিন্তু রাজীব জানত সেই নাম। '
তামিনা!' - মুহূর্তে সবাই রাজীবের দিকে চেয়ে রইল যখন মুস্তাফা দিদির নাম বলল।
গল্প
অপূর্ব দাশগুপ্ত

এক এক দিন হাওয়া ওঠে পাগলের মত। শুকনো যত পাতা, অশ্বত্থ, বাঁশ, পেয়ারা আর যত সব হাবিজাবি, ছেঁড়া কাগজের টুকরা, ন্যাকড়া এইসব নিয়ে মস্করা করে এলোমেলো হাওয়ার স্রোত।একবার গাছতলা থেকে এদের উড়িয়ে নিয়ে বেড়ার গায়ে চেপে ধরে, আবার ক্ষণিক পরেই তাদের পাক খাওয়ায় শুন্যে। পর্যাপ্ত ধুলো ওড়ে। বাতাসের এইসব পাগলামিকে প্রশ্রয় দিতেই যেন দিনপতি, তার প্রভা সেদিন কমিয়ে আনে। চারদিকের এই ঘোলাটে আবহাওয়া দেখলে মুনিয়ার মেজাজ খুব বিগড়ে যায়। মন তার বারোমাস খারাপ। যেদিন সে পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়, যেদিন তার জন্ম দিন, যেদিন নতুন লাভ লেটার পায়, কোনদিনই মুনিয়ার মনে খুশি নেই। আজকের এই পাগল হওয়াও তাকে বোধহয় কাঁদাবে।
কাঠের দোতালা বাড়িটির বারান্দায় একা একটি বেতের বড়ো চেয়ারে বসে আছে সে। একটা গানের লাইন মনে পড়তে চায়না কিছুতে। বড় অশান্তি।
এ এক গঞ্জ এলাকা। যথেষ্ট দূরত্ব রেখে গৃহস্থদের বাড়িগুলি শান্ত দাঁড়িয়ে থাকে। কাঠের দেওয়াল আর টিনের ছাউনি, মাটি থেকে একটু উঁচুতে খুঁটির উপর দাঁড়িয়ে। খুব হাতির ভয় ছিল নাকি একসময়, এখনও কিছু অবশিষ্ট আছে তাদের ভয়। জানলা দিয়ে হাতির শুড় প্রবেশ করছে এ দৃশ্য ভালো লাগে না! তাই এই উচ্চতা। সামনে বাগান আছে প্রায় সবক'টি বাড়িতেই। আম কাঠাল, লিচু, ডেউয়া, নগকেসর, বড়ো বড়ো এইসব গাছ যেমন আছে, তেমনি আছে গোলাপ, জুঁই, কলাবতীর ঝোপ। দূরে জলরঙে আঁকা পাহাড় পূর্বে দেখ যায়। পাদদেশে অরণ্য যেন পাহাড়ের ফেন্সিং।
মুনিয়াদের বাড়িটির শ্রী একটু আলাদা, অন্য বাড়িগুলির চেয়ে বেশি সুন্দর। তাদের বাড়ির চালের রং ঝকঝকে রূপালী আর কাঠের দেওয়ালের রং বটল গ্রীন। মালিদের যত্নে তাদের বাগান সেজে থাকে প্রতি ঋতুর সঙ্গে মানিয়ে। মুনিয়ার বাবার বড় কাঠের ব্যবসা। কিন্তু এ কারণে তার সময় বড্ড কম। মুণিয়ার মাও দিনের পর দিন শুয়ে থাকেন, কোন শারীরিক অসুবিধে নেই,তবু। তিনিও অকারণে দুঃখী। সংসার চালায় মাইনে করা লোকেরা।
তিমির যাচ্ছিল রাস্তা দিয়ে হেঁটে, তার সাইকেল বিগড়েছে। অনিলদার দোকানে তার চিকিৎসা চলছে। মুনিয়াদের বাড়ি পাড় হলে পড়ার লাইব্রেরি। দুপুরের রসদ জোগাতে এই হাওয়ার মধ্যে সে বেড়িয়েছে। বিলে 'আবার জখের ধন' বইটি কাল ফেরত দিয়েছে। বইটি তুলতে হবে আগে গিয়ে।দশটা বেজে গেছে। লাইব্রেরি খুললো এবার।
মুনিয়া রাস্তায় তিমিরকে দেখতে পেয়েই ডাকে,
- 'তিমির, উপরে উঠে আয়, বাগানের গেট খোলা।'
- 'লাইব্রেরি থেকে বই তুলতে যাচ্ছি,ফেরার পথে আসি?'
- 'না, এক্ষুনি আয়।'
তিমির কী আর করে, 'দ' আকারের কাঠের সিড়ি ভেঙে সে দোতলার বারান্দায় পৌঁছায়। গোল বেতের টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। বিপরীত দিকে চেয়ারে মুনিয়া বসে আছে। মলিন মুখশ্রী, তবু মুখখানি তে কী মধু মাখা। চোখদুটি গভীর দীঘির মত, গৌর বর্ণের মুখে কালো চোখদুটি কী মায়া যেন ছড়ায়। কোন ভূমিকা ছাড়াই মুনিয়া বলে,
- 'ওই গানটা তোর মনে আছে?'
- 'কোন গান বলবি তো!'
- 'তুই গতবার রবীন্দ্র-জয়ন্তীতে গাইলি 'মেঘ বলেছে যাব যাব'। গাইলি না দেবব্রত বিশ্বাসকে নকল করে? তারপর আমি কোন গানটা গাইলাম, বল না শিগগিরি।'
- 'নাথ হে, প্রেম পথে বাধা, এটাই তো গেয়েছিলি।'
তিমির মুনিয়াকে খুশি হতে দেখে। খুশি গলায় মুনিয়া বলে,
- 'বোস না তিমির। গানটা মনে করিয়ে দিলি।' এইকথা বলে সে তিমিরের উপস্থিতি ভুলেই যেন গাইতে থাকে, নাথ হে প্রেম পথে বাধা……।
যে মেয়েকে সাধ্য-সাধনা করে কেউ গাওয়াতে পারে না, সে নিজে থেকে গাইছে। তিমির বসে। গান যখন শেষ হয়, তিমির মুখ তুলে দেখে, মুনিয়ার চোখে প্লাবন নেমেছে। বড় মুশকিলে পড়ে তিমির।কী বলবে এখন, তিমির ভেবে পায় না। মুনিয়াটা এমনিই মেয়ে।
মুনিয়াই তাকে উদ্ধার করে, হাতের উলটো পিঠে চোখ মুছে বলে,
তুই এবার যা তিমির।
দূর মফস্বলের এই অঞ্চলটির মানুষগুলির মধ্যে জটিলতা কম। সংসার আর রোজগার করতে গিয়ে মানুষকে স্বাভাবিক সারল্য কিছুটা বাধা রাখতে হয়েছে, যেমন হয়ে থাকে মানুষের সমাজে,তবু তুলনায় এখানকার মানুষেরা সাদাসিধে। খবর কাগজ পড়ে, রেডিও শোনে, রবিবারে রবিবারে ভাল করে বাজার করে। বেশির ভাগ মানুষ ব্যবসা করে, কেউ কেউ চাকুরীজীবী, স্কুলে, সরকারি নানা দপ্তরে তারা রুজির জন্য যায়। একটু সম্পন্ন ঘরের কর্তারা ছেলে মেয়েদের বলেন, পড়, পড়। ভালো পাস করলে কলকাতায় পড়াবো। কলকাতা বড় দূরের। বড়ই রহস্যের জায়গা, বুদ্ধিমানেদের জায়গা এদের কাছে। কেউ কলকাতা ঘুরে এলে, এরা তাকে ঘিরে ধরে। বলে, কোথায় কোথায় গেলে? কালিঘাট গিয়েছিলে, পার্টি পলিটিক্সের হালচাল কী, যুক্ত ফ্রন্ট টিকবে মনে হয়?
গঞ্জে সম্প্রতি একটা হেলথ সেন্টার খুলেছে। ডাক্তারও এসেছে একজন, কলকাতার ছেলে, একেবারে নবীন যুবক। ড.দ্বৈপায়ন বসুর নায়কদের প্রায় সব গুণাগুণ আয়ত্বে। চেহারাও দেখবার মত। সে কি না পারে! তিমিরদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলতে নেমে পড়ে। কথা বলে মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে। তার চিকিৎসায়, তার ব্যবহারে লোকজন খুশি। ফাংশনে সে গাইল, 'মুক্তি মন্দির সোপান তলে কত প্রাণ হল বলি দান।' ছেলে মেয়েরা সকলেই মুগ্ধ হয়। মেয়েরা একটু বেশি। তিমির আর তার বন্ধুদের সঙ্গে তার খুব জমে যায়।
তিমির ডক্টর বসুর অবসরে তার কোয়ার্টারে যায়। তিমিরের সঙ্গে আড্ডা মারতে দ্বৈপায়নেরও ভালো লাগে। একদিন তিমির গিয়েছে দ্বৈপায়নের সান্নিধ্যণপেতে। এটা সেটা কথার পর দ্বৈপায়ন বলে,
- 'তিমির তোর শালা মাগী পটানো চোখ।'
তারপর বের করে রং ও তুলি,ব লে, 'একটু মুখটা ঘুরিয়ে বোস।'
- 'আপনি ছবিও আঁকেন?'
- 'আরে তেমন কিছু নয়,মাঝে মাঝে সা রে গা মা বাজিয়ে নিই।'
তিমির গলায় মজা ঢেলে বলে,
- 'আপনাকে নাকি রোজ সন্ধ্যায় মুনিয়াদের বাড়িতে দেখা যাচ্ছে?'
দ্বৈপায়ন ঘাবড়ে যায় না। একটু চুপ করে থাকে, সামান্য বিষণ্ণ দেখায় তাকে। একটু পরে বলে,
- 'মেয়েটার বড্ড ইমোশন তিমির!আমার ইমোশন আমি ছবিতে প্রকাশ করে ফেলি। মুনিয়া করবে কী?'
- 'গানে প্রকাশ করবে।'
- 'না রে, তা হবে না, ওকে তবে নিজে গান লিখতে হবে, সুর দিতে হবে। ও গভীর ডিপ্রেশনের আছে তিমির। ওর বাবাকেও বলেছি। ওর দীর্ঘ চিকিৎসার দরকার। ইমিডিয়েট দরকার। কিন্তু ওর বাবা গুরুত্ব দিলেন না।'
এর পর বছর খানেক কেটে গেছে। মার্চ মাস শেষ হতে চলেছে। এখানে এ সময়েও আলতো শীত থেকে যায়, যদিও শীতের ফুল ম্লান হচ্ছে। রাত্রে আকাশ থাকে পরিষ্কার, দূরে অন্ধকারে জোনাকিরা জ্বলে, যেমন আকাশে জ্বলে নক্ষত্রমালা। একদিন সন্ধ্যার পর তিমির মুনিয়ার সঙ্গে দেখা করতে যায়।
হায়ার সেগেন্ডারির টেস্ট পরীক্ষা থেকেই মুনিয়ার রেজাল্ট খারাপ হতে থাকে। যে মেয়ে পরীক্ষায় প্রথম হত, হায়ার সেগেন্ডারিতে সে পাস করে তৃতীয় বিভাগে। তমালরা অনেকেই কলকাতায় ভর্তি হতে যাবে। মুনিয়া পণ করেছে সে আর পড়বে না। খবরটা শুনে তিমির আজ ছুটে আসে।
- 'কী সব সিদ্ধান্ত নিচ্ছিস এসব?'
মুনিয়া তার ঘরে বসে আছে দেয়ালে হেলান দিয়ে। দু চোখ দিয়ে জল ঝরছিল আগে থেকেই।তিমিরের কথায় সে মাথা কোলে গুঁজে নিলো। তার ফরসা আঙ্গুল হাঁটু জড়িয়ে রেখেছে।
পরে নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে উঠে গিয়ে দেরাজ খুলে একটা চিঠি এনে তিমিরের হতে দেয়।দ্বৈপায়নের চিঠি।
মাস খানেক আগে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে দ্বৈপায়ন কী এক ডিগ্রি নিতে চলে গিয়েছে দিল্লিতে। সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়েছিল সে। মুনিয়ার থেকেও। তিমিররা এক সন্ধ্যায় তাকে বিদায় জানিয়েছে অনুষ্ঠান করে। মুনিয়ারর গান গাইবার কথা ছিল। সে আসে নি সেদিন। দ্বৈপায়ন বলেছিল,
- 'মুনিয়া এলো না, তিমির। কী যে হয় মেয়েটার।'
- 'পড়বো চিঠি?' তিমির অনুমতি চাইলে মুনিয়া বলে,
- 'পড়তেই তো দিলাম তোকে।'
তিমির পড়ে,
মুনিয়া,
কী সন্মোধন করি তোমায় বুঝতে পারি না। তোমার চিঠির উত্তরে বলি, তোমার মধ্যে আমি সব সম্পর্কের স্বাদ পেয়েছি। প্রেমিকার, ছোট বোনের, এমনকি মায়ের। একজন নারীর সব গুণগুলি দিয়ে তুমি আমাকে ধন্য করেছ। আমাদের সম্পর্কের কোন সংজ্ঞা হয়না। একসঙ্গে জীবন যাপনে তুমি বা আমি কেউই সুখী হবো না, এটুকু বুঝেছি।
আমি তোমার সঙ্গে মনে মনে সব সময় থাকবো। চিঠি লিখবে। আমি পৌঁছে আমার নতুন ঠিকানা জানাবো তোমাকে।
তোমাদের
দ্বৈপায়ন দা।
বছর দুয়েক পরে তিমির পুজোর ছুটিতে বাড়ি ফিরে শুনল যে মুনিয়ার বাবা ব্যবসা গুটিয়ে নিয়ে আসামে চলে গেছেন। মুনিয়ার বিয়ে হয়েছে কলকাতায়। বর পোস্টেড শিলং শহরে। সেখানেই মুনিয়া বরের সঙ্গে আছে। তিমিরদের কোন বন্ধুকেই মুনিয়া তার বিয়ের খবর জানায় নি। তিমিরের মনটা খারাপ হয়ে যায়। নিবিড় দুঃখবোধ থেকে মুনিয়া ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছিল কী? কে জানে!গ্রেজুয়েশনটা পর্যন্ত করলো না। পুজোর ছুটিতে তিমির বাড়ি ফিরেছে অনেক দিন পরে। অন্যান্য বন্ধুরা ছুটে আসে। হৈ হৈ করে পুজোর দিনগুলি কাটে, কিন্তু তিমিরের মনটা একটু বিগড়েই থাকে।সে ঘুর পথে লাইব্রেরি যায়, যাতে মুনিয়াদের বাড়ি আর চোখে না পড়ে তার।
জীবন কেটে যায় জীবনের নিয়ম মাফিক, বাঁধাধরা পথে। তিমির ফিজিক্সে সাম্মানিক নিয়ে পাস করে ভারতীয় স্টেট ব্যাংকে চাকরি পায়। বিয়ে করে, প্রমোশন পায়, ভারতের বিভিন্ন জায়গায় বদলি হতে থাকে ঘন ঘন। এরই মধ্যে ছেলে মেয়ে মানুষ করা, বদলি আটকাতে দৌড়াদৌড়ি করা, ছা - পোষা জীবন কাটে তিমিরের।
একদিন মেয়ের কী একটা বইয়ের খোঁজে তিমির গিয়েছিল কলেজ স্ট্রিট। সেই কলেজ জীবনের প্রেসিডেন্সি কলেজের গেটে দ্বৈপায়নের সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে যায়।
দ্বৈপায়ন দা!
- 'তিমির না? রীতিমত জেন্টেলম্যান,সেই রোগা ছেলেটার এই হাল, ভাবা যায় না।'
হাতে সময় ছিল দুজনেরই, দুজনে কফি হাউসে বসে। 'সংসার করেছ দ্বৈপায়ন দা?'
- 'হুমম, একটি মেয়ে।'
সেই ফেলে আসা দিনগুলির কথা হয়। তিমির খবর দেয়,
- 'মুনিয়ার শিলং এ বিয়ে হয়েছিল, জানো দ্বৈপায়ন দা।'
- 'তুই খোঁজ রাখিস ওর।'
- 'না, চেষ্টা করেছি পারিনি। ফেসবুকে খুঁজেছি, নেই। বন্ধুদের কারও সঙ্গে ও যোগাযোগ রাখেনি।'
দ্বৈপায়ন চুপ করে থাকে। শেষে বলে 'ফোন নম্বরটা দে তোর। একটা মিসকল করে রাখ। আমি পরশু ফিরব ব্যাঙ্গালোর। আসিস একবার। ফোন করিস।
অবসরের পর কলকাতা থেকে সাময়িক বিদায় নিয়ে তিমির তার সেই অখ্যাত ভিটে বাড়িতে মাঝে মাঝে ফেরে। অতবড় বাড়ি আজ খা খা করে। মা বাবা চলে গেছেন। শুন্য বাড়ি সামলে রাখে পুরোনো এক মালি। এ বাড়ি আর রাখা যাবে না। বিক্রি করে দিতে হবে। এখানেও কত নতুন আধুনিক ধারায় বাড়ি হয়েছে। তাদের বাড়িটি এখনও টিনের চাল আর কাঠের দেওয়াল নিয়ে দাড়িয়ে আছে। এর সংস্কার করেও লাভ নেই।
তিমির বসেছিল খাটে। জানালার পাশে। লোহার শিকের ফ্রেমে বাঁধানো আকাশ দেখা যাচ্ছে। সন্ধ্যা নামছে। দপ করে বিদ্যুৎ চলে যায়। তিমির আলোর ব্যবস্থা কী করবে ভাবছে, এমন সময় ফোন বেজে ওঠে।অচেনা নম্বর।
-'তিমির কাকুর সঙ্গে কথা বলছি?'
- 'হাঁ, আমি তিমির।'
- 'আমি বহ্নিশিখা চক্রবর্তীর ছেলে, নীলয়।'
- 'বহ্নিশিখা? তুমি মুনিয়ার ছেলে?'
- 'মা কথা বলবে,ধরুন। কদিন থেকে আপনাদের কথাই বলছে কেবল।'
এতদিন পর মুনিয়া কথা বলতে চাইছে। ফোন নম্বর জোগাড় করলো কেমন করে?
তিমির ফোন কানে নিতেই শুনতে পায় মুনিয়ার হাসি। হাসতেই থাকে বহুক্ষণ। শেষে কোনক্রমে হাসি থামিয়ে বলে, - 'দ্বৈপায়ন এসেছিল জানিস। কী অদ্ভুত না? এতদিন পরে কোথা থেকে এসে হাজির। আমার জন্যে কত মায়া এখনো জানিস?'
তিমির বলে,
- 'তাই? তোর খবর বল?আ মি এখন এসেছি লতাবাড়িতে।'
- 'আমার আর কি খবর। বরের সঙ্গে তো অনেকদিন ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। ছেলের কাছে থাকি,বুঝলি। খুব শরীর খারাপ রে আমার। বিছানাতে জীবন কাটছে।'
এই কথা বলে সে আবার হাসতে থাকে, যেন বরের না থাকা, শয্যাশায়ী থাকা সব খুব হাসির কথা।
- 'দ্বৈপায়ন আসাতে তোর কথা খুব মনে পড়ল। ফোন নম্বর জোগাড় করলাম তোর। আমাদের বাড়িটা আছে রে টিকে?'
- 'আছে।'
- 'তুই এখন থাকিস কোথায় মুনিয়া, শিলং এ নয় নিশ্চয়।'
- 'না রে, কলকাতায়, লেকটাউনে।'
- 'আমি কলকাতা ফিরে তোর সঙ্গে দেখা করতে যাবো একদিন। ফোন করবো।'
- 'আমাকে দেখে তোর ভালো লাগবে না তিমির। দ্বৈপায়ন বলছিল, খুব খারাপ দেখতে হয়েছি নাকি।'
- 'শোন মুনিয়া, লাইট নিভে গেল হঠাৎ। আজ ছাড়ছি। আমি কাল ফোন করছি তোকে।'
পরদিন আর ফোন করা হয়নি।
পরের দিন আবার সেই পাগলা হাওয়া উঠেছে,সেই আগের মত। এত জায়গায় কাটালো তিমির, এমন হওয়া কেবল এখানেই বয়। বড়ো মন খারাপ আমদানি করে পাগল করা-উদাসী এই হাওয়া।
সন্ধ্যাবেলা মুনিয়ার ছেলের ফোন আসে। সে বলে,
- 'মা গতকাল গায়ে আগুন দিয়েছে কাকু। আমরা বাড়ি ছিলাম না……তখন।'
তিমির প্রায় আর্তনাদ করে ওঠে - 'কী করে ? কেন?'
- 'মা তো বহুদিন অসুস্থ। অসংলগ্ন কথা বলত ইদানিং। শরীর ঠিক ছিল না। তোমাদের কথা শেষের দিকে বলত খুব।'
- 'দ্বৈপায়নদা এসেছিল কবে? মানে কতদিন আগে?'
- 'এরকম কেউ আসেনি তিমির কাকু। এই নাম আমিও প্রথম শুনলাম মায়ের মুখে।'
কী আর বলে তিমির। চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ, শেষে বলে,
- 'সাবধানে থেকো তোমরা। তোমার মা আমার খুব বন্ধু ছিল, জানো। ফোন করো, যোগাযোগ রেখো।'
গল্প

দেশে পরিবর্তন এসেছে। এসেছে পরিবর্তন মানুষের জীবনে। সমাজ পাল্টে গেছে। পাল্টে গেছে মানুষের জীবন। কত রং-বে রঙের পরিবর্তন চারিদিকে। যার হিসাব করা কঠিন। শুধুই কঠিন না। যার হিসাব এখন আর কেউ করতেই চায় না। মুনির চৌধুরীর ভাষায় বলতে হয়, মানুষ মরে গেলে পচে যায়, বেঁচে থাকলে বদলায়, কারণে অকারণে বদলায়। আসলে এই রঙিন দুনিয়ায় আমিও যে বদলে যেতে পারি, এ কথা ভুলেও কখনো ভাবিনি। সরল বিশ্বাস ছিল; আমি একদিন ফিরে আসবোই। কিন্তু কোনদিন আমার আর ফিরে আসা হলো না। রঙিন দুনিয়ায় আমিও রঙিন হয়ে ভুলেই গেছিলাম রুনা নামের কোন এক মেয়ের অস্তিত্ব আমার জীবনে কোনো একসময় ছিল।
আমার সাথেই মেয়েটি পড়াশোনা করতো। ক্লাস ওয়ান থেকে এসএসসি পর্যন্ত, পরে ওর আর পড়াশোনা করা হলো না। মেয়েটির আগ্রহ থাকলেও সে আর পড়াশোনা করতে পারলো না। তিন মাইল হেঁটে এসে বদর মাঝির ঘাট। ঘাট পার হয়ে ভ্যানে করে আরো মাইল পাঁচেক পাড়ি দিয়েই তবেই পেতাম একটা লক্কড় জক্কর মার্কা ছেড়া টিনের হাই স্কুল ঘর। এখান থেকেই আশপাশ পনেরো থেকে বিশ গ্রামের ছেলে মেয়েরা এসএসসি পাশ করে। কলেজে পড়তে হলে সেই জেলা শহর ছাড়া আর কোন উপায় নেই। তাই এসএসসি পাশের পড় শতকরা প্রায় আশি থেকে নব্বই জন্য ছেলে মেয়ের পড়াশোনা থেমে যায়। অর্থাৎ এক থেকে দুইজন ছেলের কপালে জুটতো শহরের পড়াশোনা। আমার ব্যাচের একমাত্র আমিই কেবল কলেজে ভর্তি হওয়ার দুর্দান্ত সাহস যোগাড় করতে পেরেছিলাম। সেটা অবশ্যই আমার সাহস বললে ভুল হবে। সাহসটা ছিল রুনার। আমার যাবতীয় খরচ বহন করতো মেয়েটি। আমাকে ভালবাসার জন্য কত যে গঞ্জনা মেয়েটি সহ্য করেছে। সেটা ঈশ্বর ছাড়া আর কেউ জানে না। কখনো মুখের ফাঁসা দিয়েও উচ্চারণ করে নাই। কারণ, আমি জানলে কষ্ট পাবো বলে। যাইহোক কোন এক সময় রুনার মা-বাবা আমাকে মেনে নেয়। রুনা খরচ দিলেও মাঝে মাঝে রুনার মা আমাকে খরচ পাঠাতো কাউকে না জানিয়ে, খুব গোপনে। আমিও চরম কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতাম। এইচএসসি পাশের পাড়ার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। জীবনে চলে আসে পরিবর্তন। সাদাকালো পৃথিবী হয়ে যায় রঙিন। আসমানি পর্দা নীল থেকে হয়ে যায় লাল। পৃথিবীর লোভ-লালসায় আমি মেতে উঠি। ভুলে যায় অতীত। হৃদয়ে ধারণ করা রুনা নামের স্মৃতির পাতার পর্দায় আধুনিকতার কালো ধুলো পরে আমার জীবন থেকে হারিয়ে যায় গ্রামের সহজ সরল মেয়ে রুনা। রুনার জায়গায় জায়গা করে নেয় ঢাকার শহরের আলতা মডার্ন বড়লোকের বেটি নিকৃষ্ট নিতম্বধারিণী ছলনাময়ী কল্পনা চৌধুরী সর্ণা। সর্ণা যে আমার জীবনে দুঃখের বন্যা দিয়ে চলে যাবে সে কথা কে জান তো! তার আবেগময়ী কথায় আমি মেতে উঠি। পড়াশোনা শেষ করে আমি সোনালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার হিসেবে যোগদান করি সাভার শাখায়। সোনালী ব্যাংকে যোগদান করার কয়েক মাসের মধ্যে আমাদের বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের পরে মন্ত্রণালয়ে একটি চাকরি হয় আমার কিন্তু সর্ণা যোগদান দিতে বাঁধা সৃষ্টি করে। এমন কাজ যে, কেন করে ছিল তখন না বুঝলেও পরে অবশ্যই বুঝেছিলাম। আমাকে সর্ণা বুদ্ধি দিলো, আমার ব্যাংক থেকে সে ঋণ নিয়ে বড় কোম্পানি খুলবে। তার সাথে তার বাবা মা ভাই কাজ করবে । কোম্পানি ভালো পজিশনে দাঁড়িয়ে গেলে আমাকে চাকরি ছেড়ে দিয়ে কোম্পানির এমডি পদ নিতে হবে। আমি ওর কথায় রাজি হলাম না। কথায় আছে, রাজা শাসন করছে রাজ্য, রাজাকে শাসন করছে রানী। আমিও শাসিত হলাম আমার স্ত্রীর দ্বারা। অবশেষে কর্ত্রীর ইচ্ছায় কর্ম হলো। কোম্পানি হলো, ঋণ পাশ হলো। সব হলো। একদিন বাড়ীতে এসে শুনি আমার স্ত্রী বিদেশে গেছে। সাথে তার বাপ-মা সবাই। আমাকে ফাঁদে ফেলানো হয়েছে। পরে দেখি আমার নামে কারিকারি টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে। অবশেষে সাংবাদিক লেগে গেলো আমার পিছে। আমার বিচার হলো, দশ বছর জেল।
দশ বছর জেল খেটে আমি নিঃস্ব হয়ে কারাগার থেকে বের হলাম। কোথায় যাবো। কী করবো কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। অতীতের কথা মনে পরে, নিজেকে খুব অপরাধী মনে হতে লাগলো। কেমন যেন মনে হলো রুনার সাথে আমি অন্যায় করেছি। ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে। এরপরে বিদায় নিবো এই পৃথিবী নামক অযোগ্য কারাগার থেকে। জানি এতদিনে রুনা তার সংসার পেতে বসেছে। আমারই মত হয়তো সেও ভুলে গেছে যে, তার জীবনে শুফম নামের কোন একজন প্রেমিক পুরুষ ছিল। হয়তো গিয়ে দেখবো, সে তার বাচ্চা কাচ্চা স্বামীর সংসার নিয়ে খুব ব্যস্ত আছে । আমাকে আর চিনতে পারছে না। অনেক কথা বলার পরে হয়তো চিনবে।
গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। পশ্চিম আকাশে সূর্য রক্তিম লাল আভা নিয়ে ডুবে যাচ্ছে। গ্রামের মাটিতে পা রাখলাম। নির্মল মৃদু হাওয়ায় আমার হৃদয় জুড়ে গেলো। মনে হচ্ছে এই বুঝি আমি নতুন জীবন ফিরে পেলাম। আমি কৃষক শুফম, মাঠে থেকে কাজ সেরে বাড়ি ফিরছি। আমার স্ত্রী রুনা আমার গোসলের জন্য টিওবওয়েল থেকে পানি তুলে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। কখন আসবে প্রাণের স্বামী, কখন আসবে প্রাণের স্বামী! যাই হোক এসব আমার কল্পনা। যা আর কখনো বাস্তবে রূপ নেবে না।
আমাদের সেই সালাসপুর গ্রাম আর সালাসপুর নেই। তার বুকেও এসেছে পরিবর্তন। কাঁচা মেঠো রাস্তা হয়ে গেছে পাকা। গ্রামে ছোঁনের ছাওনির ঘরের পরিবর্তে টিনের কিংবা বিল্ডিংয়ের ঘর উঠেছে । পরিবর্তন। সব পরিবর্তন। আমার পক্ষে আর আহমেদ আলির বাড়ী খুঁজে পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। পথে অনেকের সাথে দেখা হলো, মনে হলো কেউ চিনতে পারে নি। চিনবে কেমনে! সেই শুফম আর আজকের শুফমের মধ্যে রাত দিন তফাৎ। দূরে একটি ছোট্ট পিচ্চি ছেলে দেখতে পেলাম, খেলা করছে। ওরে ডাক দিলাম। কাছে আসলো ও ।
"আহমেদ আলির বাড়ি চেনো?" আমি ওরে জিজ্ঞাসা করলাম।
"কোন আহমেদ আলি?" পিচ্চি আমারে জিজ্ঞাসা করলো।
"আমি তো অবাক। এখন কী বলি।"
পাশ দিয়ে একজন মাঝবয়সী মানুষ যাচ্ছিল। সে হয়তো আমাদের কথা শুনতে পেয়েছে। ঐই পিচ্চির মাথায় থাপ্পর দিয়ে বলো, "ব্যাংকারের বাড়ি নিয়ে যা।" পিচ্চি আগে আগে আর আমি ওর পিছে পিছে চললাম। আহমেদ আলি আমার দাদা। আমার বাবা মা নৌকাডুবিতে অনেক অনেক বছর আগেই মারা গেছেন। বড় হয়েছি দাদার কাছেই। তিনিও মারা গেছেন আমি যখন কলেজে পড়ি। থাকার মধ্যে ছিল এক সৎ দাদী। জানি না তিনি কেমন আছেন। তার কাছেই যাচ্ছি। তার কাছ থেকে রুনাকে খুঁজে বের করে, রুনার ঠিকানায় গিয়ে ক্ষমা চেয়ে মুক্তি নিবো অযোগ্য এই পৃথিবী থেকে।
কিছু দূর হাঁটার পরে পিচ্চি আমাকে নিয়ে ডুকে পড়লো একটি বাড়ীতে। খালা খালা করে চিৎকার দিয়ে বাড়ীটাকে মাথায় করে তুললো ছেলেটি। তখন সন্ধ্যার আযান চারিদিকে কলরব সুরে পড়ছে। রান্নাঘরে রান্না ফেলে রেখে একটি মেয়ে বেরিয়ে এসে বললো, "কী রে মধনা এত ডাকছিস কেন?"
ছেলেটি আমাকে দেখিয়ে দিয়ে বলো, "দেখ তো কাকে নিয়ে এসেছি?"
আমার চোখের দিকে তাকিয়ে মেয়েটি তার চোখের জল আর ধরে রাখতে পারলো না। পাহাড়ের বুক চিরে যেমন ঝর্ণার পানি পড়ে নদীর বুকে ঠিক তেমনি করে তার চোখের জল ঝরতে লাগলো।
একটু কাছে তার এগিয়ে যেতেই সে আমাকে জড়িয়ে ধরে হাওঁমাঁও করে কেঁদে উঠলো। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সেই পিচ্চি চিৎকার করে বলে উঠলো, "রুনা খালার স্বামী শুফম ব্যাংকার বাড়ি ফিরছে, রুনা খালা তারে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে।"
আমিও আবেগ ধরে রাখতে পারলাম না। দুচোখের জলে ভেসে হয়ে গেলাম একাকার ।
নোটিফিকেশন
দীপাঞ্জন চক্রবর্তী
নক্সভিল, টেনিসী

গল্প
আজ গেঁড়ি খুব খুশি। দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান হতে চলেছে তার। অনেক পরিকল্পনার পরে গেঁড়ি ও তার মহিলা ব্রিগেড যাত্রা শুরু করবে কাঞ্চনজঙ্ঘার উদ্দেশ্যে। স্বাভাবিকভাবেই আনন্দের এভারেস্টে বিরাজ করছে গেঁড়ি এখন। আর, হবে নাই বা কেন! মধ্যবিত্ত রক্ষণশীল বাঙালি পরিবার থেকে মহিলা দলবল তৈরি করে ঘুরতে যাওয়া, এই একবিংশ শতাব্দীতেও বেশ কৃতিত্বের। বেড়াতে যাওয়ার ভাবনার কৃতিত্ব যে শুধুই গেঁড়ির, তা বললে কিছুটা ভুল বলা হবে বৈকি। অনেকটা অংশীদারিত্ব তার প্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদরও প্রাপ্য। কিছুদিন আগেই শুভ্র সমগ্র পড়তে পড়তে একটা লাইনে পৌঁছে চোখ আটকে যায়। মাথা গরম হয়ে ওঠে; প্রিয় লেখকের উপর প্রচন্ড রাগ হয়। সেই রাগের ফলশ্রুতি এই পাহাড় ভ্রমণের ঝটিকা প্ল্যান।
গেঁড়ি এখন পদার্থবিদ্যা নিয়ে গবেষণা করছে কলকাতার এক ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটে। পাঁচ বছরের দীর্ঘ সময় তাকে থাকতে হবে ক্যাম্পাসে। এক বছরও অতিক্রান্ত হয়নি; তবে বন্ধু-বান্ধবীর সংখ্যা দেখে তা বোঝা দুষ্কর। ক্যান্টিনে লাঞ্চ করতে গেলে বেশ একটা বড় দল হাঁকিয়ে যায়; এই একটা কারণে বেশ ঈর্ষান্বিত হয় অন্য ডিপার্টমেন্টের ছেলে মেয়েরা। সেদিনও দুপুরে লাঞ্চ সেরে ল্যাবে ফিরে চেয়ারে হেলান দিয়ে প্রিয় লেখকের গল্পের বই পড়তে শুরু করেছিল গেঁড়ি। আসলে দিনের এই সময়টায় কোয়ান্টাম মেকানিক্সের জটিল সমীকরণের প্যাঁচ থেকে বেরিয়ে গল্পের বইয়ের জগতে অবাধ বিচরণ করতে ভালোবাসে সে। গল্প পড়তে বেশ মজা লাগছিল তার, কারণ গল্পের মূল বিষয়বস্তু কলেজের বন্ধুদের একসাথে সমুদ্রে ঘুরতে যাওয়া। যদিও সমুদ্রের থেকে পাহাড় তার বেশি পছন্দের, তাও বেড়ানোর কথা শুনলে বা পড়লে মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে ওঠে। খুব ইচ্ছে করে কাছের পাহাড় বা জঙ্গলে বন্ধুদের সাথে বেড়াতে যেতে। ইচ্ছে হয় পাহাড়ের কোল বেয়ে নেমে আসা ছোট ঝর্ণার পাশে ছবি তুলতে, জঙ্গলের নিস্তব্ধতায় পাখির ডাক শুনতে, ভোরের প্রথম আলোয় কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে, আরো কত কি! যাইহোক গল্পের কিছু লাইন পড়ে চমকে ওঠে গেঁড়ি
- 'মেয়েরা যদি শেষ পর্যন্ত সঙ্গে যায় তাহলে এই পরিকল্পনার প্রশ্নই ওঠে না। মেয়েরা সম্ভবত যাবে না। মেয়েরা সব ব্যাপারে শুরুতে খুব উৎসাহ দেখায়, তারপর বাড়ি থেকে যেই একটা ধমক খায় অমনি সব ঠান্ডা।'
অচেনা লেখকের উপর প্রচন্ড রাগ হয় তার। খানিকটা ধাতস্থ হওয়ার পরে মনে প্রশ্ন জাগে,
- 'এত রাগ হচ্ছে কেন? লেখক কি তাহলে অপ্রিয় সত্যিটা মুখের ওপর বলে দিতে পেরেছেন? মনে মনে শপথ নেয় যে লেখকের এই উপলব্ধি সে ভুল প্রমাণ করেই ছাড়বে।'
যেমনি ভাবা তেমনি কাজ, সেদিন চায়ের আড্ডায় বন্ধুদের সামনে পাহাড়ে বেড়াতে যাবার প্রসঙ্গ তোলে সে। অনেক তর্কবিতর্কের পরে মেধা, পশু এবং পলুকে রাজি করাতে সক্ষম হয় সে, খানিকটা জোর করেই বলা যেতে পারে। এবার ভাবনা শুরু হয় গন্তব্যস্থল নিয়ে। খুব কাছের পাহাড় বলতে উত্তরবঙ্গ। সেখানে গেলে বাড়ির লোকজনদের রাজি করাতে সুবিধা-ই হবে। সবাই মিলে ঠিক করা হলো দীপুদার পরামর্শ নিয়ে প্ল্যান ফাইনাল হবে। পাহাড়ের ব্যাপারে দীপুদার জ্ঞানের পরিধি অসীম বললেও ভুল বলা হবে না। ইনস্টিটিউটের ছাত্র-ছাত্রীরা তাই পাহাড়ে বেড়াতে গেলে দীপুদার পরামর্শ নিয়েই যায়। সন্ধ্যাবেলা গেঁড়ি তার দলবল হাঁকিয়ে দীপুদার কাছে যায়; মোটামুটি যে প্ল্যান ফাইনাল হয়, তার খসড়া নিম্নরূপ:
কলকাতা---নিউজলপাইগুড়ি---লেপচাজগত---দার্জিলিং---মানেভঞ্জন---শিলিগুড়ি---কলকাতা
পাঁচ দিনের ট্যুর প্ল্যান হয়। শেষ দিনে মানেভঞ্জন থেকে ছোট্ট একটা ট্রেক করার কথাও হয়। সবই অবশ্য নির্ভর করছে সমগ্র যাত্রা পথে সবার শরীর কেমন থাকে তার উপরে। রাত্রে গেঁড়ি ও পলু দায়িত্ব নিয়ে দার্জিলিং মেলের টিকিট কেটে ফেলল। পশু ও মেধা দীপুদার কাছ থেকে পাওয়া হোটেলের ফোন নম্বরে যোগাযোগ করে যথাযথ দিনে বুকিং করে ফেলে। যাত্রার সমস্ত আয়োজন বেশ বাধাহীন ভাবে সম্পন্ন হয়। এরপর থেকেই তাঁদের কাছে সময়ের গতি যেন বেশ খানিকটা কমে যায়। যাক অবশেষে আজ তাদের দিন গোনার পালা শেষ। শুভ যাত্রার শুভারম্ভ আর ঘন্টা চারেক পরেই।
রাত দশটা বাজতে বাকি মিনিট দশেক। গেঁড়ি, পশু, পলু ও মেধা সময় মত তাদের সিটে বসে পড়েছে। কোচ নম্বর এস সেভেন, সিট যথাক্রমে- ৩৩, ৩৪,৩৫, ও ৩৬; অর্থাৎ দুটি লোয়ার, একটা মিডিল ও একটা আপার বার্থ। পলু রীতিমতো ঝগড়া করেই আপার বার্থের মালিকানা হাসিল করেছে, বাকিরা কোথায় শোবে তা এখনো ঠিক করা হয়নি। কূপের বাকিদের মধ্যে রয়েছে সদ্য বিবাহিত স্বামী স্ত্রী, সম্ভবত মধুচন্দ্রিমা অতিবাহিত করতেই চলেছে; সাইড আপার ও সাইড লোয়ারে দুজন বেশ বয়স্ক ভদ্রলোক। পলুর ধারণা অনুযায়ী তাদের দুজনেরই বয়স ৬০ পেরিয়েছে। আসলে বয়সের হিসেব-নিকেশে পলুর কাছে স্বয়ং আর্যভট্ট-ও হার মেনে যাবে। ট্রেন ছাড়ার মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই পশু খাবার তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছে। গেঁড়ির মায়ের হাতে বানানো লুচি ও চিকেন কষা একে একে প্লেটে পরিবেশন করছে সে। বিগত কয়েক বছরে রান্না ও পরিবেশনে বেশ হাত পাঠিয়েছে পশু। আসলে নিজের হোস্টেল রুমে বাকিদের নিমন্ত্রণ করে খাওয়ানোর আয়োজন করতে গিয়ে এইসমস্ত কাজে পোক্ত হয়ে উঠেছে সে। বাকিদেরও বেশ খিদে পেয়ে গেছিলো। ফলস্বরূপ সবাই দ্রুতগতিতেই খাবার শেষ করে ফেলল। হাতমুখ ধুয়ে এসে সবে একটু বসেছে গেঁড়ি। হঠাৎ পাশের ভদ্রলোক বেশ গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করল-
- 'তোমরা কোথায় যাচ্ছো একসাথে? তোমরা কি কলেজে পড়ো?' উত্তরে গেঁড়ি বলল,
- 'আমরা সবাই মিলে লেপচাজগত, দার্জিলিং ঘুরতে যাচ্ছি। আমরা প্রত্যেকেই পিএইচডি করছি; কলেজ আমরা অনেকদিন আগেই পাশ করেছি।'
আসলে গেঁড়ির ছোট উচ্চতা ও বাচ্চা মুখ দেখলে সকলেই তাকে স্কুল পড়ুয়া বলে মনে করে, এইক্ষেত্রে ভদ্রলোক তবুও কলেজ বলেছেন। ভদ্রলোকটি আবার বলল,
- 'তোমরা কি শুধু মেয়েরা যাচ্ছ, নাকি এনজেপি থেকে তোমাদের আরও বন্ধুরাও যোগ দেবে?' গেঁড়ি এবার বেশ আত্মবিশ্বাসের সুরেই প্রত্যুত্তর দিল,
- 'হ্যাঁ, আমরা চার জনই যাচ্ছি। কেন মেয়েরা কি ছেলেদের ছাড়া যেতে পারে না নাকি?' ভদ্রলোক বললেন,
- 'হ্যাঁ, তা যেতে পারবে না কেন? আলবাত পারে। তবে দিনকাল তো ভালো না, তাই বলছিলাম আরকি।' গেঁড়ি পুনরায় উত্তর দেবার প্রয়োজন বোধ করল না। একই রকম হুঁশিয়ারি ছোট থেকেই সে শুনে এসেছে বাড়িতে। বিরক্তি দূর করতে হেডফোন কানে লাগিয়ে গান শুনতে শুরু করলো সে। বাকিরা এবার যে যার বার্থে পিঠ এলিয়ে দিয়েছে। পশু তীব্র চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তার প্রেমিকের সাথে ভিডিও কলে কথা বলতে। কিন্তু চলন্ত ট্রেনে নেটওয়ার্ক পাওয়া মুশকিল। পশুর মুখে বিরক্তির ছাপ দেখে মেধার মনে মনে হাসি পাচ্ছে। তবে মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছে না, আসলে যতই হোক ল্যাবের সিনিয়র দিদি বলে কথা। অন্যদিকে পলুর দৃষ্টি সেই বিবাহিত যুগলদের দিকেই নিবদ্ধ; তাদের প্রতিটি কার্যকলাপ মন দিয়ে অনুসরণ করছে সে। গান শুনতে শুনতে গেঁড়ি কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে বুঝতেই পারেনি। ঘুম যখন ভাঙলো, বাইরে হালকা আলো ফুটেছে। একটু পরেই ট্রেন থামল। জানালা দিয়ে সে দেখল স্টেশনের নাম কিষাণগঞ্জ, সময় তখন সকাল সাড়ে ছটা। ট্রেন মিনিট দশেক লেট আছে। ভারতীয় রেলের ঐতিহ্য অনুযায়ী এই লেট যে আসলে কিছুই না তা বেশ অনুভব করতে পারে গেঁড়ি। কিছুক্ষণ পরে সে ডেকে দেয় বাকিদের। ব্রাশ করে, চা বিস্কুট দিয়ে প্রি ব্রেকফাস্ট সেরে নেয় সকলে। তারপরে গল্প করতে করতে বাকি ঘন্টা দেড়েক যে কিভাবে কেটে যায়, ঠাওর করতে পারে না কেউই। মেয়েদের গল্পের এই এক বিশেষত্ব, শুরু হলে শেষই হতে চায় না। ট্রেন যখন এনজেপি পৌঁছালো, ঘড়িতে সময় দেখাচ্ছে ৮:১৫ মিনিট। স্টেশনে নেমেই গগনদা-কে ফোন করলো পলু। জানতে পারলো বাইরেই গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে গগন দা, দীপুদার কথা মনে পড়ল গেঁড়ির, - 'গগনদা কিন্তু সময়ের দাম জানে।'
স্টেশনে প্রাতঃকৃত্ত সেরে নেওয়ার ফলে পশু, মেধা ও গেঁড়ির বেশ খিদে পেয়েছে। অন্যদিকে পলুর বাথরুমের ব্যাপারে খুব বাতিক আছে; ভালো হোটেলের ভালো বাথরুম ছাড়া পেট পরিষ্কার করা তার কাছে দুঃসাধ্য। গগনদা-র সুমো গাড়িতে সাত জনের সিট। তাই বেশ হাত পা ছড়িয়েই বসে গেল সবাই। সামনের সিটে অর্থাৎ ড্রাইভারের পাশে বসার জন্য একটা চার্ট তৈরি করাই ছিল। প্রথমে বসার সুযোগ পেল পশু। গগনদা গাড়ি স্টার্ট করে দিল। প্রথম গন্তব্য মিরিক লেক। শিলিগুড়ি শহর পেরিয়ে একটা দোকানে ব্রেকফাস্ট করা হবে বলে জানালো গগনদা।
গাড়ি শুকনা দুধিয়া হাইওয়ে দিয়ে এগিয়ে চলেছে। শুকনা পৌঁছবার একটু আগে একটা দোকানে ব্রেকফাস্ট সেরে নিল সকলে, ব্রেকফাস্ট এর আলু পরোটা খেয়ে সবাই বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। পলু সামনের সিট দখল করেই গান চালিয়ে দিয়েছে। একের পর এক হিন্দি গান বাজছে; তার সাথে বাইরের রাস্তার সৌন্দর্য সত্যিই অসাধারণ। দুধিয়ার বালাসন নদীর উপরে ব্রিজ অতিক্রম করলেই শুরু হয়ে যায় পাহাড়ি রাস্তা। পাথরের বোল্ডারের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া বালাসন নদীর ধারে প্রচুর মানুষ জমা হয় শীতের মরশুমে পিকনিক করতে। ব্রিজ অতিক্রম করে মিনিট দশেক এগিয়ে গেলেই পুরোপুরি পাহাড়ি রাস্তার সূত্রপাত। আরও কিছুদূর অতিক্রম করতেই রাস্তার একদিকে চা বাগান ও অপরদিকে দিগন্তে দূরের পাহাড়, সব মিলিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের রূপমাধুর্যে তারা সকলেই মুগ্ধ। গগনদা গাড়ি চালাতে চালাতেই বিভিন্ন গল্প বলছে, সাথে প্রত্যেকের অনুসন্ধিৎসা নিরসনের আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মিরিকের পথে চা বাগানের মধ্যে দিয়ে এই পাহাড়ি রাস্তা পলুকে মুন্নারের স্মৃতি ফিরিয়ে দিচ্ছে। মেধা তো বলেই ফেলল,
- 'আর্থিক কারণে যারা মুন্নার যেতে পারে না, এই রাস্তা তাদের মুন্নারের পরিপূরক হয়ে উঠতে পারে।'
দুধিয়া থেকে এক ঘন্টার পথ অতিক্রম করে গাড়ি এসে দাঁড়ালো টিংলিং টি গার্ডেনে। এখানে টি গার্ডেনের মধ্যে কিছু ছবি তুলে নিলো সকলে। এখান থেকে কিছুটা পথ এগোলেই আই লাভ মিরিকের সেলফি স্পট। স্বাভাবিকভাবেই সেলফি তোলার হিড়িক পড়ে গেল। অন্তত খান পঞ্চাশেক সেলফি ও গ্রুপ পি তোলার পরে পলুর মন শান্ত হল। গাড়িতে আর মিনিট দশকের মধ্যেই তারা পৌঁছে গেল মিরিক লেক, যার ভালো নাম সুমেন্দু লেক। হালকা বৃষ্টি শুরু হওয়ায় সকলেই একটা দোকানে দাঁড়িয়ে দুপুরের খাবার অর্ডার করে দেয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই বৃষ্টি থেমে যায়, সাথে বৃষ্টি পরবর্তী লেকের সৌন্দর্য যেন হাজার গুণ বেড়ে যায়। লেকের পাশ দিয়ে হেঁটে তারা ব্রিজের কাছে যায়, এই ব্রিজ বেরোলেই লেকের অপর ধারে পাইনের ঘন জঙ্গল। ব্রিজের উপর থেকে এই লেকের পুরোপুরি ভিউ পাওয়া যায়। একদিকে পাইনের ঘনজঙ্গল, অপরদিকে পাহাড়ের ধাপে ধাপে গড়ে ওঠা মিরিক শহর, আর তার মাঝেই এই সুমেন্দু হ্রদ। অনেকেই বোটিং করছে, কেউ আবার ঘোড়ায় চড়ে পাইনের জঙ্গলের মধ্য দিয়ে লেকের চারিদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সকলেই হেঁটে চলল পাইন বনের মধ্য দিয়ে। কিছুটা এগিয়ে যেতেই হ্রদের একদম সামনে এসে পড়ল তারা। এই জায়গাটা থেকে হ্রদের যে ভিউ পাওয়া যায় তা সত্যিই অবর্ণনীয়। কিছুটা এগিয়েই আবার আই লাভ মেরিকের সেলফি স্ট্যান্ড। এখানে অনেক লোকজন ছবি তুলতে ব্যস্ত; জায়গাটা ভালোই চেনা লাগছে গেঁড়ির। সম্ভবতঃ শিবাজীদার ট্রাভেল ব্লগেই দেখেছে। এখানেও সকলে মিলে অনেক ফটো তুললো। প্রায় ঘন্টাখানেক মিরিক লেক এবং তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল ঘুরে বেড়ানোর পরে তারা খাবার দোকানে ফিরে এলো। খাবার অর্ডার আগে থেকেই দেওয়া ছিল, ভেজ থালি ও চিকেন কষা। গরম গরম খাবার অন্যদের খেতে দেখে সবারই জিভে জল এসে গেল। তাড়াতাড়ি হাত মুখ ধুয়ে নিয়ে খেতে বসে পড়ল তারা। ভেজ থালি-তে ভাত, ডাল, আলুভাজা ও স্কোয়াশের তরকারি। পাহাড়ে বেড়াতে এসেছে অথচ স্কোয়াশের তরকারি খায়নি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া অসম্ভবই বটে। তবে চিকেন কষার দুর্দান্ত স্বাদ স্কোয়াশ খাওয়ার দুঃখ টুকু ভুলিয়ে দিল। খেতে বসে গেঁড়ি দেখতে পেল ট্রেনের সহযাত্রী সেই ভদ্রলোক দুটিকে, ধীর পায়ে হেঁটে দোকানের সামনে দিয়ে ব্রিজের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কেন জানিনা এদের দেখামাত্রই গেঁড়ীর বেশ রাগ হলো। যাইহোক ঘাড় নিচু করে সে পুনরায় খাবারে মন দিল। প্রসঙ্গত গগন্দা তেমন কিছু খেলো না; শুধু ডিম টোস্ট আর চা খেয়ে মধ্যাহ্নভোজ সারলো। গাড়ির ড্রাইভাররা সাধারণত দুপুরে বেশি খেতে চায় না। তার প্রধান কারণ অবশ্যই গাড়ি চালানোর সময় অনভিপ্রেত তন্দ্রা উপেক্ষা করা। আরো কিছু ফটো তুলতে চাইছিল পলু; কিন্তু বাধ সাধলো গগনদার বকুনি। আবার যাত্রা শুরু হল তাদের। এখান থেকে তারা যাবে লেপচাজগত। কিছুদূর এগিয়ে যেতেই রাস্তার দু'ধারে ঘন পাইন গাছের সারি তাদের যেনো জড়িয়ে ধরলো। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ, কখনো পাইন আবার কখনো ঝাউবনের মধ্য দিয়ে যেন নদীর মতো বয়ে গেছে। রাস্তার মাঝে মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। গেঁড়ি গাড়ির জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে সেই মেঘ স্পর্শ করছে। সত্যিই এ যেন স্বর্গের উদ্যান। ঘন পাইন বনের মধ্যে এমনিতেই সূর্যালোক তেমন প্রবেশ করে না। আজ মেঘলা দিন রাস্তার অন্ধকার আরো বাড়িয়ে তুলেছে। গগনদা গাড়ির লাইট অন করে দিল। ঘন্টাখানেকের রাস্তা পেরিয়ে তারা পৌঁছে গেল সীমানা ভিউ পয়েন্ট, যেখান থেকে নেপাল দেখা যায়। আকাশ পরিষ্কার থাকলে এখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা স্পষ্ট দেখা যায়। কিন্তু আজকের মেঘলা আকাশ সেই সম্ভাবনা সম্পূর্ণরূপে খারিজ করেছে। দূরের নেপাল দেখতে বড় সুন্দর লাগছে। পাহাড়ের ধাপে ধাপে ছোট ছোট বাড়ি, তার ওপরে মেঘের ভেসে বেড়ানো, মেধাকে তার ছোটবেলায় কল্পনায় আঁকা পাহাড়ি গ্রামের ছবিগুলোর কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে।
এখানে একটা দোকান থেকে কফি কিনে কফি কাপ হাতে এই সীমানার সৌন্দর্য দারুন ভাবে উপভোগ করল সকলে। জায়গাটা খুব পছন্দ হয়ে গেছে সবার, ছেড়ে যেতে একদমই ইচ্ছে করছে না। শেষমেশ আধঘন্টা পরে গগনদার তাড়া খেয়ে সকলে গাড়িতে চেপে বসলো। গগনদা বলেই দিল,
- 'এবার একদম লেপচাজগত গিয়েই গাড়ি থামবে। মাঝে গাড়ি থামানোর আবদার করা যাবে না।' এতক্ষণের যাত্রায় গেঁড়ির মনে হলো যে গগন দা ভালো মনের মানুষ, তাদের সকলকে খুব আগলে রাখছে। আধঘন্টারও কম সময়ে তারা পৌঁছে গেল লেপচাজগত। পাখরিন হোমস্টেতে তাদের রুম বুক করা ছিল, বেশ সাজানো হোমস্টে, দুতলার ও তিনতলার ব্যালকনি থেকে পুরো দার্জিলিং নাকি দেখা যায়, কারণ লেপচাজগত দার্জিলিংয়ের তুলনায় বেশি উচ্চতায় অবস্থিত। তবে রাতের দার্জিলিং দেখতে পাবার জন্য আকাশ পরিষ্কার থাকা অবশ্য দরকার, মেঘ যদি কমে তবেই দেখা যাবে।হোটেলে পৌঁছতেই হোটেলের মালিকের কথা অনুযায়ী তারা সকলেই গরম চিকেন সুপ পেয়ে গেল, দীর্ঘ পথের ক্লান্তি কিছুটা হলেও লাঘব হলো। সন্ধ্যেবেলা স্নাক্সে পকোড়া, কফি দেবে বলে জানালো এখানকার ভাঁড়ারের দায়িত্বে থাকা গৌড়দা। মাঝের ঘন্টা দুয়েক সময় পেয়ে তারা ঠিক করলো পাইনের জঙ্গলে ঘুরে আসবে। পাখরিনের ঠিক পিছনেই এই পাইনের জঙ্গল, জঙ্গলের ওপরে রয়েছে সানরাইজ পয়েন্ট। জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানোর কথা হোটেল মালিক জানতেই তাদের সতর্ক করে দিল জোঁকের সম্পর্কে। জোঁকের হাত থেকে বাঁচতে সকলেই রেইনকোটের প্যান্ট পড়ে নিল, সাথে মোজা হাঁটু অব্দি। পাইন গাছের পাশে দাঁড়িয়ে গেঁড়ির নিজেকে অনেক ছোট মনে হল। এমনিতেই সে উচ্চতায় খাটো, তার ওপরে বিশাল পাইন গাছের নীচে নিজের ক্ষুদ্রতা বুঝতে পেরে এক মহান অনুভুতি হলো তার। সত্যিই আমরা প্রকৃতির কাছে কত ছোট, কত ক্ষমতাহীন, তাও কিছু মানুষের এত দম্ভ কিসের, সত্যিই সে বোঝেনা। এত সাবধানতা সত্ত্বেও জোঁক তাদের পিছু ছাড়লো না। পলুর প্যান্টে প্রায় গোটা পাঁচেক জোঁক আঁকড়ে ধরেছে, তবে ভাগ্য ভালো যে রেনকোটের প্যান্ট, তাই ছাড়াতে বেশি বেগ পেতে হলো না। ধীরে ধীরে পাইন বনের মধ্য দিয়ে তারা পৌঁছল সানরাইজ পয়েন্টে। এখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায় শুনেছে, যদিও এখন সামনে মেঘের সমুদ্র, বাকি কিছু দেখা যাওয়ার কথা কল্পনাও করা যাচ্ছে না। প্রায় দেড় ঘন্টা পরে তারা আবার ফিরে এলো হোমস্টেতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই কফি ও পকোড়া রুমে দিয়ে গেল গৌড় দা, জানিয়ে গেল যে রাতে দেশি মুরগির ঝোল ও ভেজ থালি। আদ্যোপান্ত বাঙালি হলে যা হয় আর কি, খাবারের নাম শুনেই মন খুশিতে ভরে ওঠে সকলের। আগামীকাল টাইগার হিল থেকে সূর্যোদয় দেখতে যেতে হলে ভোর রাতেই ঘুম থেকে উঠতে হবে। তাই আজ রাত আটটায় খাওয়াদাওয়া সেরে ঘুমিয়ে পড়লো সবাই। অবশ্য শুয়ে পড়ার আগে দোতলার ব্যালকনিতে অনেকক্ষণ বসে থেকেও রাতের দার্জিলিংয়ের দেখা মেলেনি। হঠাৎ অ্যালার্ম বাজতে গেঁড়ির ঘুম ভাঙ্গলো, ঘড়িতে সকাল ৭ টা। চমকে উঠলো গেঁড়ি। অর্ধ উন্মীলিত চোখে মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে গেঁড়ি দেখলো দুটি নোটিফিকেশন- একটা হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজের নোটিফিকেশন যেখানে দীপুদা লিখেছে সে কাসোল পৌঁছে গেছে; মাইকেল, সাকি, শিবু, অয়ন দের সাথে সার পাস ট্রেক করবে সে। অন্যটা আইআরসিটিসি থেকে ইমেইল যার সাবজেক্ট - 'Your ticket is cancelled.'
গত সপ্তাহে পলু ও মেধার বাড়ি থেকে আপত্তির কারণে তারা টিকিট ক্যান্সেল করায়। গতকাল পশুর শরীর একটু খারাপ হওয়ায় তার বাড়ি থেকেও ছাড়পত্র কেড়ে নেওয়া হয়। অগত্যা বাকি টিকিট গতকালই ক্যান্সেল করে গেঁড়ি যার নোটিফিকেশন আজ এসেছে। গেঁড়ির স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে যায়। সকালের আকাশে যেন প্রিয় লেখকের অবয়ব দেখতে পায় সে, মুখে হালকা মুচকি হাসি।
একগুচ্ছ
রডোডেন্ড্রন
অঙ্কুর ঘোষ

গল্প
সুরজিত প্রথম মেয়েটিকে দেখতে পায়- উত্তর সিকিমের এই হোটেলের করিডরে। সে এখানে একা বেড়াতে এসেছে। এখন তার কলেজে গ্রীষ্মের ছুটি চলছে। তার আবার খুব ফটোগ্রাফির নেশা। মাত্র একদিনই হয়েছে বেড়াতে এসেছে- সারাদিন পাইনবনের ধারে অনেকগুলো ছবি তুলে সে নিজের রুমেই ফিরে যাচ্ছিল, এমন সময় হঠাৎ দ্রুতপদে হেঁটে-চলা একটি ছায়ামূর্তির সঙ্গে তার ধাক্কা লাগে। হাত থেকে ক্যামেরাটা আর একটু হলেই ফসকে পড়ে যাচ্ছিল, আর কি!
‘উঃ! সরি! আমায় ক্ষমা করবেন,’ বলে ওঠে ছায়ামূর্তিটি। তখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। অন্ধকারের আস্তরণ হোটেলের এই সরু করিডরে ইতিমধ্যে জমাট বাঁধতে শুরু করেছে। সুরজিত মুখ তুলে চাইল। মেয়েটির মুখ সে তখন ভালো করে দেখতে পায়নি। বছর কুড়ি বয়স হবে হয়তো, মাথায় লম্বা, বিস্রস্ত চুল। তবে, তার মুখমণ্ডলে একটি জিনিস সুরজিতের মনে বিশেষ রেখাপাত করেছিল- তা হল, মেয়েটির চোখ দুটি; কেমন নিষ্প্রাণ সে চাহনি! অথচ সে চাহনির মুখোমুখি হলে ভয় হয় না, বরঞ্চ মনে হয়, এই স্বল্পবয়স্কা তরুণী যেন এত কম বয়সেই জীবনের শত সহস্র বেদনা, যন্ত্রণা, শোক উপলব্ধি করে ফেলেছে। জীবনের প্রতি তাই আর তার কোনো আগ্রহ নেই। আপনা থেকেই, তরুণীর প্রতি সমবেদনা জেগে ওঠে। সুরজিত জিজ্ঞাসা করে,
‘আপনার লাগেনি তো?’
‘না, না আমি ঠিক আছি।’ মেয়েটি মৃদু হাসে।
সুরজিত সাহস করে জিজ্ঞাসা করে বসে, ‘আজই এলেন, নাকি?’ মেয়েটি যেন কয়েক মুহূর্তের জন্য ভারী উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল, অন্তত তাই মনে হল সুরজিতের আলো-আঁধারিতে। কী ভেবে মেয়েটি সংক্ষেপে উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ।’ তারপর আর বেশি কথা না বলে সে বিদায় নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নীচের তলায় নেমে গেল। কাঠের সিঁড়ির উপর তার পদশব্দের অনুরণন মিলিয়ে যাওয়া অবধি দাঁড়িয়ে রইল সুরজিত। তারপর, সেও নিজের ঘরে ফিরে এল।
সেদিন রাত্রে সুরজিত একটা ভারী অদ্ভুত স্বপ্ন দেখল। দেখল, একা একটা খোলা জমিতে সে দাঁড়িয়ে রয়েছে। চারিদিক অন্ধকার, কুয়াশাচ্ছন্ন। খানিক বাদে ধীরে ধীরে কুয়াশার আবরণ হালকা হয়ে আসতে লাগল, আর তখন সে দেখল- একটা গোরস্থানে সারি সারি সমাধির মাঝে সে দাঁড়িয়ে রয়েছে। শ্বেত ফলকে তাদের গায়ে মৃত ব্যক্তির পরিচয় খোদাই করা আছে। এমন সময় একটা কণ্ঠস্বর শুনে সে চমকে ঘুরে দেখে, সে একা নেই- আরও একটি মূর্তি কখন এসে বসেছে একটা সমাধির ধারে। এ যে সেদিন সন্ধ্যায় দেখা সেই মেয়েটি! তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসছে। তারপর হঠাৎ সেই হাসি কোথায় মিলিয়ে গেল- মেয়েটি উঠে দাঁড়াল। সুরজিতের উপস্থিতি উপেক্ষা করে হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। সুরজিত এরপর কিছু বুঝে ওঠার আগেই, তার ঘুম ভেঙে যায়। সে ধড়মড়িয়ে উঠে বসে নিজের বিছানায়।
তার সারা দেহ তখনও শিহরিত হচ্ছে স্বপ্নটার কথা ভাবলে। আর কী ঠাণ্ডা ঘরে! বিস্মিত হয়ে সে দেখে, মাথার কাছে জানলাটা কখন দমকা হাওয়ার ঝাপটায় খুলে গিয়েছে। বাইরে অনর্গল বৃষ্টি হয়ে চলেছে। কাছেই কোথাও বাজ পড়ল বোধহয়। সে জানলাটা ভেজিয়ে, পাশ ফিরে আবার ঘুমের চেষ্টা করল। ভোর হতে তখনও ঘণ্টা-দুই দেরি।
সকালে ব্রেকফাস্টের সময় মেয়েটির দেখা পেল না সুরজিত। তাকে সেদিন তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়তে হয়েছিল। দূরে কয়েকটা ভিউপয়েন্টে ছবি তোলার ইচ্ছা ছিল তার। বৃষ্টির পর পাহাড়ের সৌন্দর্য যেন আরও বেড়ে যায়। সজল ধারায় স্নাত সতেজ গাছের পাতা মন ভাল করে দেয়। গতরাত্রের স্বপ্নের কথা কখন সে ভুলে গেল।
সারাদিন ভিউপয়েন্টে ঘুরে ঘুরে ছবি তুলে, সে হোটেলের দিকেই ফিরে আসছিল। তখন বিকেল চারটে মতো বাজে। কুয়াশায় আস্তে আস্তে ছেয়ে যাচ্ছে পাহাড়ি জনপদ। তবে, পথ চলায় বাধা দেওয়ার মতো তেমন ঘন কুয়াশাও নয়। সুরজিতের এরকম নির্জন পাহাড়ি রাস্তায় হাঁটতে বেশ ভালোই লাগে। একটি সোজা রাস্তা ধরে সে হাঁটছিল, এমন সময় একটা জায়গায় এসে সে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। রাস্তার ধারে একটা সাইনবোর্ডে বড়-বড় করে লেখা- ‘সামনে গির্জা’। এই গির্জাটির কথা সুরজিত হোটেল ম্যানেজারের মুখে একবার শুনেছিল। ব্রিটিশ আমলের তৈরি। এখন অবশ্য পরিত্যক্ত। সেখানে তার মতো অনেক শখের ফটোগ্রাফার নাকি যায় ছবি তোলার মানানসই শটের আশায়। সুরজিত ভাবল, একবার ওইদিকটা ঘুরে দেখে আসলে মন্দ হয় না। কিছু ভালো শট পাওয়াও তো যেতে পারে?
গির্জায় পৌঁছিয়ে, অবশ্য তার পছন্দ মতো কোনও শট ক্যামেরাবন্দি করতে সে পারল না। তবে, তার আসল বিচিত্র অভিজ্ঞতার শুরু গির্জা পেরিয়ে, পিছনের অংশে কৌতূহলবশত পা রাখবার পর। সে ফিরেই যাচ্ছিল, নেহাত কৌতূহলের বশে পিছন দিকটা চোখ বুলিয়ে নিল। এদিকে যে একটা গোরস্থান রয়েছে, তা সে আগে থাকতে জানবে কী করে? গির্জার পিছনভাগে পা রাখতেই সে হতবাক- সারি সারি শ্বেত পাথরের সমাধি বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে মাটি আগলে রয়েছে। কোন অদৃশ্য আকর্ষণ যেন তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকল, একবার জায়গাটি ভালো করে দেখে যেতে। কয়েক পা এগোতেই অবশ্য সে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।
একটি নারীমূর্তি স্থির হয়ে বসে রয়েছে একটি সমাধির ধারে। লম্বা, ঘন কালো চুল, পরনে একটা নীল গাউন। বিবর্ণ হয়ে যাওয়া ফটোগ্রাফে দেখা সেকেলে আমলের মেমসাহেবদের পোশাকের কথা যেন মনে করিয়ে দেয়। সুরজিতের দিকে এতক্ষণ সে পিছন ফিরে বসেছিল। এইবার হঠাৎ তার দিকে চাইতেই একটা হিমেল স্রোত নেমে গেল তার মেরুদণ্ড দিয়ে- এ যে হোটেলে দেখা সেই মেয়েটিই! তরুণীটি সুরজিতকে দেখে হালকা হাসল। তবে, তাকে দেখে বিচলিত হয়েছে বলে মনে হল না। নিজেই বোঝানোর সুরে বলল,
‘আমাকে এখানে দেখে নিশ্চয়ই খুব অবাক হচ্ছেন?
আসলে, ব্যাপারটা আর কিছুই নয়- আমার ফ্যামিলির এক প্রিয়জনকে এখানে সমাধি দেওয়া হয়েছিল, কয়েক বছর আগে।’
তারপর যেন একটু আনমনা হয়ে বলে চলল,
‘ওর জন্যই আমি প্রতিদিন ফুল নিয়ে আসি। ওর রডোডেন্ড্রন খুব প্রিয় ছিল।’ তারপর, কয়েক মুহূর্তের জন্য দম নিয়ে আবার বলে উঠল,
‘এখানে এলেই ওর জন্য আমার মন যে কেমন করে ওঠে!’ সুরজিত এতক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছে। সে বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে, এখন বরঞ্চ সমবেদনার সুরে বলল,
‘নিশ্চয়ই সে আপনার খুব কাছের মানুষ ছিল, মিস...।’
‘মার্গারেট।’ নিজের নাম বলে তরুণী। তবে, মার্গারেট সুরজিতের এই প্রশ্নের কোনও সরাসরি উত্তর দিল না। কেবল, সমাধিটির দিকেই একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকল। সুরজিত তার পাশে এসে সমাধির গায়ে ফলকটায় একবার চোখ বুলিয়ে নিল- ‘মারিয়া সন্ডারর্স। মৃত্যু, ২০১৬।’ অনেক পুরনো, ফাটলধরা সমাধি ছড়িয়ে রয়েছে এই সিমেটারিতে। তার মাঝে, এই একটা নতুন সমাধি কেমন বেমানান লাগছিল সুরজিতের চোখে। তরুণীর কণ্ঠস্বরে সে আবার তার দিকে ফিরে তাকাল। মার্গারেট বলে চলেছে, কিছুটা যেন নিজেকেই,
‘আমি মারিয়ার সঙ্গে আজও কথা বলি। এই তো আজ যেমন বলছিলাম, বছরটা কার কেমন কাটছে।’ তার শেষ কথাটা সুরজিতের মোটেই ভালো লাগল না। সেটা আন্দাজ করতে পেরেই তরুণী বলল,
- ‘না, না আমায় পাগল ভাববেন না। আসলে, প্রিয়জনকে হারানোর দুঃখ কি সহজে মেনে নেওয়া যায়?’ এরপর দু’জনেই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। সুরজিত অবশেষে জিজ্ঞাসা না করে পারল না, - ‘আপনি এবার হোটেলে ফিরবেন না, মিস মার্গারেট? অন্ধকারে আপনার এখানে একা থাকা সেফ নয়।’
- ‘হ্যাঁ, আমি আর কিছুক্ষণ এখানে থেকেই ফিরে যাব। আমি আসলে মারিয়ার পাশে এসে দাঁড়ালে, বড্ড কাতর হয়ে পড়ি, কত স্মৃতি ফিরে আসে। আপনি বরং আগে-আগে চলুন, আমি আপনার পিছনে আসছি।’
মার্গারেটের চোখের কোণায় জলের ফোঁটা চিকচিক করে উঠল। তার স্বরে এমন কিছু দৃঢ়তা ছিল, যে সুরজিত বিদায় নিয়ে একা ফিরে যেতে বাধ্য হল। পথে দু’-একবার পিছন ফিরে তাকালও। কিন্তু মার্গারেটকে দেখতে পেল না। একবার ভাবল, তরুণীকে একা ওইরকম রেখে আসা কি ভদ্রজনোচিত হল? পরে নিজেই নিজেকে বোঝাল, তাকে এখন একা থাকতে দেওয়াই শ্রেয়। আহা, মারিয়ার মৃত্যুটা এখনও মেনে নিতে পারেনি মেয়েটি! তবে, একটা বিষয় জানা হল না তার, মারিয়া এই তরুণীর ঠিক কে হয়? পরদিন সকালেই সুরজিতের বেরিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। একবার সে ভাবল, মার্গারেটের সঙ্গে দেখা করে যায়। ছোট্ট হোটেল। একজন কর্মচারীকে তরুণীর নাম জিজ্ঞাসা করতে সে কোনও সদুত্তর দিতে পারল না। বলল, এমন কোনও নামের স্ত্রীলোক নাকি এই সপ্তাহে তাদের হোটেলে আসেইনি। আশ্চর্য! তখন, সুরজিত নিজেই মার্গারেটের সঙ্গে দেখা করার একটা উপায় বের করল- কেন, সেই সিমেটারিটা একবার ঘুরে এলে কেমন হয়?
গোরস্থানটি হাঁটা পথ হোটেল থেকে। পরিত্যক্ত গির্জার মরচে-ধরা গেট পেরিয়ে, হাঁটার সময় তার বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল। গতকালের সেই সমাধিটার কাছে এসে সে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। দেখতে পেল, একটি মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে ঠিকই, কিন্তু এ যে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক! খুব শীর্ণকায় তাঁর শরীর। পরনে কালো কোট, মাথায় হ্যাট। সেই তরুণী আশেপাশে কোথাও নেই। সুরজিতের পদশব্দ শুনে বৃদ্ধ ঘুরে তাকালেন তার দিকে। সুরজিত দোনোমনা করতে করতে প্রশ্নটা করেই ফেলল,
- ‘স্যার, এখানে কোনও ইয়াং লেডিকে দেখেছেন?’ বৃদ্ধ অল্প বিস্মিত হলেন। বললেন,
- ‘না তো, এদিকে তো কারো আসার কথা নয়। তুমি কাকে খুঁজতে এসেছ?’
- ‘আজ্ঞে, মার্গারেট তাঁর নাম... গতকালই তাঁর সঙ্গে কথা বলেছিলাম এখানে... ঠিক যেখানে আপনি-’ তাকে আর শেষ করতে হল না, বৃদ্ধ কাতর কণ্ঠে ডুকরে কেঁদে ওঠার মতো বলে উঠলেন,
- ‘তুমি সত্যি দেখেছ মার্গারেটকে? বলো, আমার মেয়েকে তুমি দেখেছ? ঠিক বলছ?’ তার হাতদুটি জড়িয়ে ধরলেন বৃদ্ধ ভদ্রলোক।
বৃদ্ধ নিজেকে খানিকটা সামলে নিতে, সুরজিত জানতে চাইল,
- ‘আপনার মেয়ে মার্গারেট?’
- ‘হ্যাঁ, মার্গারেট আর মারিয়া- দুই যমজ মেয়ে আমার। দুজনের মধ্যে যে কী ভাব ছিল! মারিয়া বিশেষ করে ভীষণ পাহাড় ভালবাসত! এখানেই আমরা সাত বছর আগে বেড়াতে এসেছিলাম। একদিন সন্ধেয় হোটেলে ফেরার পথে কীভাবে যেন মারিয়া খাদে পড়ে যায়- দুইদিন হাসপাতালে ছিল। ওর শেষ ইচ্ছে ছিল, এই পাহাড়ের কোনও সিমেটারিতেই যেন ওকে শুইয়ে দেওয়া হয়। তারপর থেকে আমি প্রতিবছর আসি ওর জন্য ফুল নিয়ে...।’
‘আর মার্গারেট বুঝি আপনার সঙ্গেই এসেছে?’ এইবার বৃদ্ধ আরও চমকে উঠলেন।
- ‘হায়! মার্গারেটও কি আর আছে? ওকে আমেরিকায় পাঠিয়েছিলাম লেখাপড়ার জন্য। দু’ বছর আগে, প্যান্ডেমিকের মধ্যে সেও যে আমাকে হঠাৎ করে ছেড়ে চলে গেল! ওর সঙ্গে শেষ দেখাটাও আমার হয়নি। এখন আমি যে সম্পূর্ণ একা! আই অ্যাম সো লোনলি!’
বৃদ্ধ সুরজিতকে পাশে নিয়ে সমাধির ধারে, ঘাসের উপর বসলেন। তার মুখে সমস্ত অভিজ্ঞতার কথা শুনলেন। তারপর, অনেকক্ষণ চোখ বুজে, চুপ করে বসে রইলেন। সব শেষে উঠে দাঁড়িয়ে, তার কাঁধে হাত দিয়ে বললেন,
‘এবার ওঠা যাক।’
সন্তানহারা, মুহ্যমান বৃদ্ধ ভদ্রলোকটির সঙ্গে সিমেটারি থেকে বেরিয়ে আসার ঠিক আগের মুহূর্তে, সুরজিতের একটা কথা হঠাৎ মনে পড়ে গেল- রডোডেন্ড্রন! মনে আসতেই, গোরস্থানের পাঁচিলের উপর বেড়ে ওঠা একটা গাছ থেকে দু’টি ফুল পেড়ে, মারিয়ার সমাধির সাদা পাথরের বুকে রেখে আসল। তারপর, চোখ বুজে, হাতজোড় করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল।
যখন আবার চোখ খুলল, তখন দেখতে পেল, দুটি লাল রডোডেন্ড্রন এমনভাবে পাশাপাশি শুয়ে রয়েছে, যে মনে হচ্ছে- দু’জন বন্ধু যেন পরম নিশ্চিন্তে হাত জড়াজড়ি করে রয়েছে।
একটা দীর্ঘনিশ্বাসের সঙ্গে অজান্তেই সুরজিতের মুখে মৃদু হাসির একটি রেখা ঝিলিক দিয়ে উঠল।
প্রবন্ধ
বাগানে লাগান
চন্দ্রমল্লিকা
ডাঃ রুদ্রজিৎ পাল
কসবা, কলকাতা


চন্দ্রমল্লিকা। গন্ধ না থাকলেও রঙে-রূপে এক অনবদ্য ফুল। কোনটা সাদা, কোনওটা হলুদ আবার কোনওটা মেরুন। ঠিক সময়ে যদি গাছ লাগান, তবে সারা শীতকাল জুড়ে আপনার বাগান, সে বাড়ির সামনে একটুকরো জমিই হোক বা বাগানের ঝুলন্ত টব, রঙে রঙে ভরিয়ে রাখবে। কিন্তু যদি কারুর বাড়িতে এইরকম মনভোলানো ফুলের বাহার দেখে ভাবেন যে এই গাছ লাগালেই ফুলে ফুলে ভরে উঠবে, সেটা কিন্তু সবসময়ে হবে না। অনেকে যত্ন করে গাছ লাগিয়েও ফুল ফোটাতে পারেন না। একই গাছ, এক রকম টব, কিন্তু দেখা যায় যে কারুর ফুলের ভারে ডাল নুয়ে পড়ছে, আর কারুর ডাল-পাতা বেড়েই চলেছে, ফুলের আর দেখা নেই।
প্রথম কথা হল, টবে কী মাটি দেবেন? যে কোন মাটি দিলে কিন্তু গাছ হবে না। অনেকে রাস্তা খোঁড়ার সময়ে যে মাটি উঠে আসে, সেই মাটি নিয়ে এসে টবে ভরে দেন। এরকম ইটের টুকরো বা বালি ভর্তি মাটি দিয়ে লাভ নেই। আজকাল ফ্লাওয়ারিং প্ল্যান্টের জন্য সব উপাদান অনুপাত অনুযায়ী মেশানো মাটি অনলাইনে পাওয়া যায়। সময় কম থাকলে সেই তৈরি করা মাটি কিনে নেবেন। আর যদি হাতে অঢেল সময় থাকে তবে মাটি নিজেই মিশিয়ে বানান। ৪০% ভালো ঝুরঝুরে মাটির সাথে ২০% কোকো পিট, ২০% ভারমি-কমপোস্ট মেশাতে হবে। এঁটেল মাটি, (উদাহরণ হল গঙ্গামাটি) কিন্তু ব্যবহার করবেন না। খুব এঁটেল মাটিতে গাছের শিকড় বিস্তার হবে না। এছাড়া মাটিতে নিমখোল কিছুটা দিতে পারেন। তবে মনে রাখবেন যে মাটি কিন্তু আগেই বানাতে হবে। সেই মাটি রোদ-জল খাওয়াতে হবে কিছু দিন। নার্সারি থেকে গাছ কিনে এনে তারপর মাটি মিশিয়েই গাছ লাগিয়ে দিলে কিন্তু লাভ নেই।
এরপর বলি টবের উচ্চতার কথা। একদম ছোট টবে চন্দ্রমল্লিকা লাগিয়ে লাভ নেই। ফুল ঠিকমত হবে না। অন্তত ৮ ইঞ্চি টবে গাছ লাগাবেন। আরও উঁচু টব হলে আরও ভালো। যারা কাটিং করে নতুন গাছ বানাবেন, তারা প্রথমে ৩—৪ ইঞ্চি টবে লাগিয়ে তারপর গাছ বড় হলে ৮ ইঞ্চি টবে রি-পট করতে পারেন।
ফুলগাছ যেন সারাদিনে ঠিকমত রোদ পায়। ছায়াঘেরা জায়গায় লাগালে গাছ হয়ত বেঁচে থাকবে কিন্তু ফুল আসা মুশকিল। এবার যদি আপনার ছোট্ট বারান্দায় রোদ না আসে, তখন কী তাহলে আপনার চন্দ্রমল্লিকার শখ অপূর্ণ থেকে যাবে? এর এখন একটা উপায় আছে। অনলাইনে গ্রো লাইট পাওয়া যায়। সেটা ব্যবহার করে দেখতে পারেন।
প্রচুর ফুল পেতে হলে চন্দ্রমল্লিকা লাগাতে হবে শীতের এক দেড় মাস আগেই। আরও আগে হলে ভালো হয়। সূর্যালোকের সময় যত কম থাকবে, চন্দ্রমল্লিকায় ফুল আসবে তত তাড়াতাড়ি। আপনারা জানেন যে ২১শে ডিসেম্বর অবধি আমাদের দিনের দৈর্ঘ্য কমে, তারপর আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে। সুতরাং ভালো ফুল পেতে হলে চন্দ্রমল্লিকা গাছ কিন্তু এই ২১শে ডিসেম্বরের অন্তত এক-দেড় মাস আগেই লাগাতে হবে।
শীতকালে অনেকসময় বৃষ্টি হয়। তখন যে টবসুদ্ধ গাছ ঘরের ভেতর সরিয়ে আনতে হবে সেরকম নয়। একটু বৃষ্টিতে কিছু ক্ষতি হয় না। কিন্তু দেখবেন যেন গাছের গোঁড়ায় জল না দাঁড়ায়। টব কাত
করে জল ফেলে দিন। ফুলের গাছে বেশি বেশি সার দেবেন না। বেশি নাইট্রোজেন যুক্ত সার দিলে কিন্তু গাছের ডাল-পাতা বড় হতে শুরু করবে, ফুল আর আসবে না। তাই প্রথমে যেভাবে বললাম, সেভাবে টবের মাটি বানান। কিন্তু তারপর খুব বেশি সার আর দেবেন না। অনেকে আছেন রোজ সকালে চা বানিয়ে সেই ভিজে পাতা গাছের গোঁড়ায় ঢেলে দেন। এরকম একদম করবেন না, অন্তত চন্দ্রমল্লিকার জন্য। সর্ষের খোল ভেজানো জল দিতে পারেন। কিন্তু ১৫—২০ দিনে একবার। বেশি দিলে কিন্তু মাটি নষ্ট হয়ে যাবে।
চন্দ্রমল্লিকা গাছের পরিচর্যার একটি প্রধান অঙ্গ হল পিঞ্চিং। এর মানে হল মাঝে মাঝেই গাছের ডগার নতুন পাতাগুলো ছেঁটে দেওয়া। নতুন পাতার কুঁড়ি কিন্তু বেশি বাড়তে দেওয়া যাবে না। তাহলে দেখবেন এই গাছের ডালই লম্বায় বেড়ে চলেছে; কিন্তু ফুলের কুঁড়ি আর আসছে না। প্রত্যেকটা ডালের একদম ডগার পাতা কেটে দিতে হবে বার বার। এর ফলে দেখবেন পাশ দিয়ে নতুন নতুন ডাল বেরোচ্ছে। সেই সব ডাল একটু বড় হলে (২—৩ ইঞ্চি) তাদের পাতার কুঁড়িও ছেঁটে দিতে হবে। বার বার এরকম করতে করতেই দেখবেন একসময়ে ফুলের কুঁড়ি চলে এসেছে। এই কাজটা কিন্তু শুরু করতে হবে গাছ লাগানোর কিছুদিন পর থেকেই। যদি আপনি দেরি করেন, মানে গাছ লাগানোর পর দুমাস অপেক্ষা করে তারপর পিঞ্চিং শুরু করেন, তাহলে লাভ নেই। দুমাসে দেখবেন সেই গাছের ডাল বিশাল লম্বা হয়ে ঝুঁকে পড়েছে। চারিদিকে ডাল বেরিয়ে প্রায় ছোট একটা ঝোপ হয়ে গেছে। সেই গাছে তখন আর ফুল হওয়া মুশকিল। ঠিকমত পিঞ্চিং করলে গাছটি এক-দেড় ফুট লম্বা হতে না হতেই ফুলের কুঁড়ি চলে আসবে। তখন আর গাছ লম্বায় বাড়বে না।
অনেকে গাছ লাগানোর পর সেটি একটু বড় হলেই ফসফেট সার দিয়ে দেন। একদম শুরুতেই এটা করা কিন্তু উচিত নয়। ফসফেট সার গাছে ফুলের কুঁড়ির জন্ম দিতে পারে ঠিকই, কিন্তু একদম ছোট গাছে এটা দিলে কয়েকটা মাত্র ফুল দিয়েই গাছ মরে যাবে। যে গাছে একশোটা ফুল হতে পারত, সেখানে দশ-বারোটা মাত্র ফুল হবে। তার থেকে এক-দু মাস গাছের পরিচর্যা করে তারপর ফসফেট দিলে ফুলও বেশি হবে, তার রঙও ভালো হবে।
চন্দ্রমল্লিকার কুঁড়ি থেকে ফুল হতে কিন্তু অনেক সময় লাগে। অনেকে এই সময়ে ধৈর্য হারিয়ে ফেলেন। এদিকে অপরাজিতা বা জবা গাছে আজকে কুঁড়ি এলেই কাল বা পরশু সুন্দর ফুল ফুটে যায়, আর ওদিকে চন্দ্রমল্লিকার কুঁড়ি ছোট থেকে বড় হতেই সাত-দশ দিন; তার পরে সেই কুঁড়ি ফুটতে আরও দশ দিন। একদিনে তো আর ফুলের সব পাপড়ি মেলবে না, এক-এক সারি করে আস্তে আস্তে ফুল ফুটে উঠবে। তবে এই যে ধৈর্যের পরীক্ষা, এর পরে কিন্তু আপনার মুখে হাসি ফুটবেই। আর এই ফুল গাছে থাকেও অনেকদিন। প্রত্যেকদিন সকালে সূর্যস্নাত ফুল আপনাকে স্বাগত জানাবেই। তাই কুঁড়ি কেন ফুটতে দেরি হচ্ছে, সেই সম্বন্ধে অধৈর্য হবেন না।
শেষে আর দুটি কথা। প্রথমত এক টবে তিন চারটি গাছ লাগাবেন না। একটি গাছকেই টবে বাড়তে দিন। আর দ্বিতীয় হল, একবার ফুল হয়ে গেলে গাছ তুলে ফেলে দেবেন না। ডালগুলো ছেঁটে দিন। কিছুদিন পরে আবার ফুল আসতে পারে।
অনুগল্প