গল্প সমগ্র ১
প্রচ্ছদঃ সুরজিৎ সিনহা, হলদিয়া, পঃ বাংলা
ইকো
পয়েন্ট
বিকাশ ব্যানার্জ্জী
নামটা শুনেই ইন্টার্ভিউ বোর্ডের চেয়ারম্যান চমকে উঠলেন। 'কি নাম যেন বললেন আপনার?।'
'স্যর, সায়ন চক্রবর্তী - গোল্ড মেডালিস্ট, এম. বি. এ (মার্কেটিং), পুনে বিশ্ববিদ্যালয়।' দ্বিতীয়বারও সেই একই নামটা শোনার পর আশ্বস্ত হলেন যে তিনি কানে ভুল শোনেন নি। 'কিন্তু এ কি করে সম্ভব?', সেই একই নাম, সেই একই পদবী, গায়ের রঙ্গেরও কোন তফাত নেই, সেই একই বুদ্ধিদীপ্ত চাহনি আর সেই একই মিষ্টি হাসি, তার সব যেন কেমন গোলমাল হয়ে যেতে লাগল। হঠাৎ করে দৃষ্টি গেল দেওয়ালে টাঙ্গানো ক্যালেন্ডারের দিকে। কি আশ্চর্যজনক ব্যাপার, তারিখটাও সেই একই ৬ই আগস্ট হিরোশিমা দিবস। এই সব সাদৃশ্য কি নেহাতই কাকতালীয়? নাকি তা অন্য কিছু ইঙ্গিত বহন করছে? আজ থেকে বাইশ বছর আগে, ঠিক আজকের দিনেই, রাগের মাথায় তিনি নিজের হাতে তার পুরানো বন্ধু সায়ন চক্রবর্তীকে খাদে ফেলে খতম করে দিয়েছিলেন। তাহলে, সেই সায়ন চক্রবর্তী আবার এখানে ফিরে এলো কোথা থেকে? এই সমস্ত কথা ভাবতে ভাবতেই পাঁচতারা হোটেলের শীততাপ নিয়ন্ত্রিত চেম্বারে বসেও ঘামতে শুরু করলেন ওমেগা ফারমাসিউটিক্যলস লিমিটেড এর জোনাল সেলস ম্যানেজার প্রবাল ঘোষ দস্তিদার। পকেট থেকে রুমাল বের করে তিনি নিজের কপালের ঘাম মুছতে শুরু করলেন।
তার চোখের সামনে ভেসে উঠল বাইশ বছর আগের খান্ডালার ইকো পয়েন্টের সেই দৃশ্য। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য এম. বি. এ. পাশ করে তিনি ভাগ্যের সন্ধানে নবী মুম্বাইয়ে হাজির হন। নবী মুম্বাইয়ের বেলাপুরে তিনি একটা ওষুধের কোম্পানিতে চাকরি পেয়ে যান। কয়েক মাস চাকরি করার পর, ছুটির দিনে অফিসের বন্ধুদের সাথে বম্বের জুহু বিচ বেড়াতে গিয়ে তার একদিন হঠাৎ দেখা হয়ে গেল তার কলেজের পুরানো বন্ধু, মেধাবী ছাত্র সায়ন চক্রবর্তীর সাথে। কলেজ থেকে পাশ করার পর অনেক পুরানো বন্ধুর সাথেই প্রবালের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। তবে পুরানো বন্ধুদের মজা একটাই, দূরে যাওয়াও যেমন সহজ, কাছে আসাটা তার চেয়েও বেশি সহজ। নিজের পুরানো বন্ধুর সাথে জুহু বিচে বসে উইলস ফিল্টার সিগারেটে সুখ টান দিতে দিতে প্রবাল জানতে পারল যে তার পুরানো বন্ধু সায়ন এম.এস.সি পাশ করার পর আই. আই. টি. বম্বে থেকে পলিমার কেমিস্ট্রি নিয়ে পি. এইচ. ডি. করেছে। সিগারেট শেষ করে সমুদ্র সৈকতের ঠাণ্ডা হাওয়ায় দুই বন্ধু মিলে ভেলপুরি খেতে থাকল। সায়ন জানাল যে পি. এইচ. ডি. করার পর এখন সে পুনের ন্যাশনাল কেমিক্যাল ল্যাবরেটরিতে সায়েন্টিস্টের চাকরি করে। কথাগুলো শুনেই প্রবাল মনে মনে ভাবল, আমাদের দেশে বেকার সমস্যা যতই ভয়াবহ হোক না কেন, এই দেশে মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের চাকরির কোন অভাব নেই। ভেলপুরি খাওয়া শেষ হওয়ার পর সায়ন তাকে নেমন্তন্ন করল – 'প্রবাল আগামী শনিবার - রবিবার তুই কি করছিস রে? আমার পুনের ফ্ল্যাটে চলে আয় না, দুটো দিন ধরে দুই বন্ধু মিলে চুটিয়ে আড্ডা মারব'। প্রবাল প্রথমে কিছুটা ইতস্তত: করতে থাকায় মুচকি হেসে সায়ন বলল - 'তোর জন্য কিন্তু আমার পুনের ফ্ল্যাটে একটা বিরাট বড় চমক অপেক্ষা করছে রে'।
প্রবাসে বাঙালি মানেই নিজের লোক, পরম-আত্মীয়।কলেজের পুরানো বন্ধুর সাথে ছুটির দুটো সুখের দিন কাটানোর লোভে প্রবাল শনিবার ভোরের বাসে চেপে সায়নের পুনের ফ্ল্যাটের উদ্দেশে রওনা দিল। এদিকে সায়ন যথা সময়ে পুনের শিবাজী নগর বাস স্ট্যান্ডে তার নতুন চেরি রেড রঙের মারুতি গাড়ি নিয়ে হাজির হল। এ. সি. কারে চেপে ঠাণ্ডা হাওয়ায় কার - স্টিরিওতে গান শুনতে মিনিট পনেরোর মধ্যেই প্রবাল বন্ধুর পুনের ফ্ল্যাটে হাজির হল। সায়নের ফ্ল্যাটের দরজার কলিং বেল বাজাতেই, মিলল সাঙ্ঘাতিক চমক, মেরুন রঙ্গের সালওয়ার কামিজ পরে গালে একমুখ হাসি নিয়ে ফ্ল্যাটের দরজা খুলতে এসেছে সায়নের স্ত্রী। তাদেরই কলেজের পুরানো বান্ধবী, পরমা সুন্দরী সাগরিকা। বন্ধুর ফ্ল্যাটের নরম সোফায় বসে ঠাণ্ডা পানীয়র গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে কলেজের সোনালী দিনগুলো প্রবালের চোখের সামনে ভাসতে লাগল। সাগরিকা শুধু পরমা সুন্দরীই নয়, তার মিষ্টি গলার জন্য পুরো কলেজে সে 'কোকিল-কণ্ঠী' বলে সুপরিচিত ছিল। ভগবানের এমনই বিচিত্র লীলা যে এই দুনিয়াতে সাধারণত: গায়ক গায়িকাদের চেহারা সুন্দর হয় না, কিন্তু সাগরিকার বেলায় এই নিয়মেরও ব্যতিক্রম ঘটেছে। টানা টানা চোখ, দুধে আলতা গোলা গায়ের রঙ, মিষ্টি হাসি সবকিছু মিলিয়ে সাগরিকা ছিল কলেজের সব ছেলেদের কাছে স্বপ্ন সুন্দরী। রূপসী সাগরিকাকে যে কলেজে কত ছেলে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছেল তার কোন হিসেব নেই। সায়ন কলেজের সেই স্বপ্ন সুন্দরীকে শেষে নিজের বউ হিসেবে পেল, ব্যাটা সত্যিই ভাগ্যবান, তাকে হিংসা না করে পারা যায় না। প্রবালের কাছে গিয়ে মুচকি হেসে সায়ন বলল - 'কিরে তোকে বলেছিলাম না চমকে দেব।' স্নান সেরে দুপুরে দুই বন্ধু মিলে একসাথে ডাইনিং টেবিলে খেতে বসলেন। তাদের দুজনকে হেসে হেসে সাগরিকা খাবার পরিবেশন করতে থাকল। সে তার নিজের হাতেই আজকের সব পদ রেঁধেছে - মাটন বিরিয়ানি, বুন্দি রাইতা, চিংড়ি মাছের মালাইকারি, নারগিসি কোফতা আর খাবার শেষে রয়েছে নলেন গুড়ের পায়েস। সাগরিকার শুধু গলায় জাদু নেই, তার হাতেও যে জাদু রয়েছে। সে ব্যাপারে প্রবালের আর কোন সন্দেহ রইল না। কথায় বলে – 'কোন পুরুষ মানুষের হৃদয়ে পৌঁছানোর সবচেয়ে সহজ রাস্তা হল তার পেট দিয়ে।' প্রবাল মনে মনে ভাবতে লাগল যে এমন সর্বগুণ সম্পন্না নারীর প্রেমে পড়বে না, এমন সাধ্য বোধহয় এ জগতে কারও নেই। খাওয়া দাওয়া শেষ হওয়ার পর সবাই মিলে জমিয়ে আড্ডার আসর বসাল।চলতে থাকল হাসাহাসি, অন্তাক্ষরী, সায়নের আবৃতির আসর। সাগরিকাও অসাধারণ সুন্দর দুটো রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনাল গোপন কথাটি রবে না গোপনে' এবং 'আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ'। কিভাবে যে পুরো দিনটা কেটে গেল, তা টেরই পাওয়া গেল না। রাত্রিবেলায় খাওয়ার টেবিলে বসে সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল যে আগামীকাল রবিবার অর্থাৎ ৬ই আগস্ট সায়নের নতুন কারে করে সবাই মিলে লোনাভালা, খান্ডালা হিল স্টেশন বেড়াতে যাওয়া হবে। দেওয়ালের ক্যালেন্ডারের দিকে চোখ পড়তেই সাগরিকা হেসে উঠল – 'হিরোশিমা দিবসের দিনে আমরা সবাই বেড়াতে যাচ্ছি, কোন বোমা না ফাটলেই হল।' কলেজের দিনগুলো থেকেই সায়নের ছিল ফটোগ্রাফির সাঙ্ঘাতিক নেশা। পাহাড়, নদী,
ঝর্ণা, ফুল, পাখি, প্রজাপতি - সব কিছুই প্রাণবন্ত হয়ে উঠত তার ক্যামেরার লেন্সের জাদুতে। কথা মতো পরের দিন ভোরবেলায় সবাই মিলে সায়নের কারে করে লোনাভালা খান্ডালার উদ্দেশ্যে রওনা দিল। খান্ডালার রাজামাচি গার্ডেনে পৌঁছে সায়ন মেতে গেল তার নতুন ক্যানন এস. এল. আর ক্যামেরায় ফটো তুলতে। আগস্ট মাসের বর্ষায় বৃষ্টির ধারা সহ্যাদ্রি পর্বত বেয়ে নীচে নেমে সুন্দর জলপ্রপাতের আকার ধারণ করেছে। যেদিকেই চোখ যায় সেই দিকেই কেবল সবুজের সমারোহ। বৃষ্টির জলে ভিজে গাছের পাতাগুলো সবুজ পান্নার মত চকচক করছে। এই রকম অনাবিল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যে নিজেকে পেয়ে প্রকৃতি প্রেমিক সায়ন আনন্দে আত্মহারা, তার খুশির সীমা নেই। মনের আনন্দে গাছপালা, ফুল, পাখি, অর্কিডের ছবি তুলতে লাগল সায়ন। এদিকে সায়ন যখন ছবি তুলতে ব্যস্ত, তখন নিজের মনে গুনগুন করে গান জুড়ে দিল সাগরিকা। তার মিষ্টি গান শুনতে শুনতে প্রবালের কলেজের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেল। সাগরিকার প্রতি প্রবালের দুর্বলতা সেই কলেজের দিন থেকেই, কিন্তু সাহস করে নিজের মনের কথা কোনদিন সে সাগরিকাকে বলতে পারে নি। অনেকক্ষণ ধরে ছবি তুলে ক্লান্ত হয়ে সায়ন অবশেষে গরম গরম কফি আর বাটার কর্ণ কিনে আনতে রাস্তার ওপারের দোকানে চলে গেল। কিছুটা সময়ের জন্য সাগরিকাকে কাছে একা পেয়ে তাকে নিজের পুরানো দুর্বলতার কথা সাহস করে প্রবাল জানিয়ে ফেলল। সাগরিকার নরম হাত ধরে বলে ফেলল প্রবাল - 'সাগরিকা তোমাকে আমার ভীষণ ভালো লাগে। সেই কলেজের দিনগুলো থেকেই আমি তোমার প্রেমে পাগল'। কথাগুলো শোনা মাত্রই এক ঝটকায় নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে প্রবালকে ভৎসনা করল সাগরিকা – 'তোমার লজ্জা করে না প্রবাল নিজের বন্ধুর স্ত্রীকে খারাপ নজরে দেখতে? ছিঃ, ছিঃ, তোমার শরীরে যদি মানুষের চামড়া থেকে থাকে তাহলে তুমি কোথাও গিয়ে ডুবে মরো'। সাগরিকার এমন সাঙ্ঘাতিক অপমানজনক কড়া কথা শুনে রাগে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে যায় প্রবাল। সাগরিকার প্রতিটি শব্দ তার বুকে তীরের মতো আঘাত করল। তবে প্রবাল এত সহজে ছেড়ে দেবার পাত্র নয়, এই অপমানের প্রতিশোধ সে নিয়েই ছাড়বে, দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিল সে।
খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ করে সায়নের কার এবার ছুটল খান্ডালার ইকো পয়েন্টের উদ্দেশে। পুরো ঘটনাটা ঘটে যাওয়ার পরে, কারের মধ্যে পরিবেশ একেবারেই থমথমে।প্রবাল আর সাগরিকা দুজনেই মুখ গোমড়া করে চুপচাপ বসে আছে। পুরো ঘটনাটা সম্বন্ধে অজ্ঞ সায়ন নীরবতা ভঙ্গ করল - 'কি ব্যাপার, তোমরা দুজনেই এমন গম্ভীর মুখ করে বসে আছ কেন? এত থমথমে পরিবেশ, ব্যাপারটা কি?' গম্ভীরভাবে উত্তর দিল সাগরিকা – 'কিছু হয় নি।' ইকো পয়েন্টে পৌঁছানোর পর সাগরিকা মনমরা হয়ে একটা বেঞ্চে চুপ করে একাকিনী বসে থাকল আর শিশুর মতো সরল সায়ন আবার মেতে গেল তার ফটো তোলার নেশায়। রসায়নের ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও সব গাছপালা, অর্কিডের বোটানিক্যাল নাম তার ঠোঁটস্থ। প্রবাল মনে মনে স্বীকার করল যে সায়নের মেধা আর প্রজ্ঞার প্রশংসা না করে কোন উপায় নেই। তার এই সাঙ্ঘাতিক প্রতিভার জোরেই সায়ন আজ সে জীবনে উচ্চ প্রতিষ্ঠিত, আর সেই জন্যই সাগরিকার মতো সর্বগুণ সম্পন্না নারী আজ তার স্ত্রী। এই সমস্ত কথা ভাবতে ভাবতেই প্রবালের মাথাটা গরম হয়ে গেল। হঠাৎ তার চোখে পড়ল ইকো পয়েন্টের রেলিঙের এক দিকটা ভাঙ্গা আর সেই জায়গাটার ঠিক নিচেই রয়েছে ভয়ানক খাদ। বৃষ্টির জলে ভিজে সেই রেলিঙের দিকে যাওয়ার রাস্তাটায় হাল্কা কাদা আর শ্যাওলা জমে গেছে, আর সেই রাস্তাটা হয়ে উঠেছে ভয়ানক পিছল। মুহূর্তের মধ্যে প্রবালের মাথায় খেলে গেল শয়তানি বুদ্ধি।
সায়নকে একা পাশে পেয়ে প্রবাল বলল - 'সায়ন, ওই রেলিঙের দিকটাতে গেলে নিচের উপত্যকার তুই খুব ভাল ভিউ পাবি। দারুণ ফটো আসবে কিন্তু'। আপন ভোলা সায়ন বন্ধুর কথায় অন্ধ বিশ্বাস করে সেই দিকটায় চলে গেল। ভাঙ্গা রেলিঙটার কাছে গিয়ে, সায়ন নীচের উপত্যকার সৌন্দর্যের ছবি তুলতে মেতে গেল। প্রবাল চারদিকটা একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিল। জায়গাটা একেবারে জনশূন্য। সায়ন যখন নিজের মনে ক্যামেরার ফোকাস ঠিক করতে ব্যস্ত, সেই সময় প্রবাল পেছন থেকে তাকে সজোরে ধাক্কা মেরে নিচের খাদে ফেলে দিল। 'বাঁচাও, বাঁচাও' - চিৎকার করতে করতে সায়ন কয়েক হাজার ফুটের নিচের খাদে পড়ে গেল। তার চিৎকার শুনে বেঞ্চ থেকে সাগরিকা দৌড়ে এল, কিন্তু ততক্ষণে সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। অসহায় সাগরিকা গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে থাকল - 'সায়ন, সায়ন'। আকাশ বাতাস ভেদ করে তার সেই হৃদয় বিদারক চিৎকার সহ্যাদ্রি পর্বতমালার গায়ে ধাক্কা খেয়ে প্রতিধ্বনিত হতে থাকল - 'সায়ন ... সায়ন ... সায়ন ... সায়ন ... সায়ন ... সায়ন।'
সাগরিকার সেই চিৎকার আজও প্রবালের কানে ভাসছে। ইকো পয়েন্টের সেই ভয়ানক স্মৃতি কোনদিনই প্রবাল ভুলতে পারবে না। আজ তাই ইন্টার্ভিউ চলাকালীন পুরানো বন্ধু সায়ন চক্রবর্তীর নামটা শুনেই তার খান্ডালার সেই ভয়ানক স্মৃতি মনে পড়ে যায়। তার মনটা পৌঁছে গেছিল বাইশ বছর আগের খান্ডালায়। নিজের পাশের চেয়ারে বসা ম্যানেজার উৎপলবাবুর বাঁজখাই গলার আওয়াজে হঠাৎ করে তার সম্বিৎ ফিরে এল। ইন্টারভিউ তখনো চলেছে, উৎপলবাবু একের পর এক প্রশ্ন করে চলেছেন সায়ন চক্রবর্তী নামের বাইশ বছরের সেই তরুণ যুবককে – 'আপনার সার্টিফিকেটগুলোই বলে দিচ্ছে যে আপনি মেধাবী ছাত্র। আচ্ছা, আপনি বলতে পারেন কি বিপণনের বীজ মন্ত্র কি?' মুহূর্তের মধ্যেই সঠিক উত্তর দিল সেই মেধাবী ছাত্র - 'আগে নিজেকে বিক্রি কর, তারপরে নিজের পণ্যকে বিক্রয় কর'। তরুণ যুবকটি হাসিমুখে একের পর সঠিক উত্তর দিয়ে চলেছে। তার অনন্য সাধারণ মেধার দ্বারা ইন্টার্ভিউ বোর্ডের সকলকেই সে চমকে দিল। যুবকটির অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা ও মেধা দেখে প্রবালের প্রতি মুহূর্তেই নিজের পুরানো বন্ধু সায়নের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। তার চটপট সঠিক উত্তর দেওয়ার ক্ষমতা দেখে ম্যানেজার উৎপলবাবু উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠে বলেন – 'সায়ন বাবু, আপনাকে অভিনন্দন জানাই। আপনার মতো মেধাবী ছাত্রকে নিয়োগ করতে পেরে আমরা সকলেই আনন্দিত।' প্রবাল নিজের মনে শুধু বিড়বিড় করতে থাকল - 'তাহলে কি সায়নই পুনর্জন্ম নিয়ে আবার এখানে ফিরে এল নাকি?' এই সব সাতপাঁচ কথা ভাবতে ভাবতে প্রবাল নিজের মাথা চুলকোতে লাগল।
প্রাণের
বান্ধব
বিকাশ ব্যানার্জ্জী
'পোঁ-ঘড়াঙ্গ-ঘং-ধক-ধডাশ-পোঁ' - বিকট কর্কশ আওয়াজ করতে করতে একটা কয়লা বোঝই মালগাড়ী অতি মন্থর গতিতে অন্ডাল রেল ষ্টেশন অতিক্রম করে চলেছে। ষ্টেশনের ঠিক পাশেই অবস্থিত রেল কলোনি। রেল ষ্টেশনের মাইকের প্রতিটি ঘোষণাই কলোনির বাসিন্দারা নিজেদের কোয়ার্টার থেকে পরিষ্কার ভাবে শুনতে পান।তবে সেই ঘোষণা না শুনতে পেলেও তারা সঠিকভাবে বলে দিতে পারেন যে কোন ট্রেন ষ্টেশন অতিক্রম করছে। সব ট্রেনেরই নাম আর নম্বর তাদের সকলেরই মুখস্থ, ট্রেন তাদের জীবনের এক অপরিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এই রেল কলোনির ঠিক মাঝখানেই অবস্থিত একটা বিরাট বড় মাঠ, আর সেই মাঠের পাশেই রয়েছে গোটা পনেরো ছোট্ট সিঙ্গেল রুমের রেলের কোয়াটার। এই কোয়ার্টারেই থাকে রেলের গ্যাংম্যান বুধন মাহাতো। গ্রীষ্মকালের প্রখর রৌদ্রে তার শরীর তেতে পুড়ে যায়, বর্ষাকালে বৃষ্টির জলে তার গোটা শরীর ভিজে যায়। সারা বছর ধরেই ভারী, ভারী ওজন নিজের কাঁধের ওপর রেখে, রেল-লাইনের ওপর দিয়ে রোজ বিশ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে যায়। তবে সাঙ্ঘাতিক পরিশ্রমী এই রেল কর্মচারীর নিজের পাড়ায় কেবল একটাই পরিচয় 'মাতাল বুধন'। কোলিয়ারির কাছাকাছি অবস্থিত বলে অন্ডালে প্রতি বছরই সাংঘাতিক গরম পড়ে। গ্রীষ্মের দাবদাহ সহ্য করতে না পেরে রেল কলোনির বাসিন্দারা প্রতিদিন সন্ধেবেলায় এই বড় মাঠেই বসে থাকে। 'এর আগে কখনো এত সাঙ্ঘাতিক গরম এখানে পড়ে নি' – এই কথা বলতে বলতে রাত্রের স্নান সেরে গায়ে পাউডার লাগিয়ে মাঠে এসে বসলেন রেলের টি. টি. ই জনার্দনদা। তাঁর কথায় সায় জানাল কেবিন ম্যান মুকুল দাস - 'দাদা, আপনি ঠিকই বলেছেন। এই প্রচণ্ড গরমে আর নিজেদের ঘরে বসে থাকতে পারা যাচ্ছে না। এ বছর, একদিনের জন্যও কালবৈশাখীর দেখা নেই। বর্ষা যে কবে নামবে তা শুধু ভগবানই জানে।' গলদঘর্ম হয়ে হাঁসফাঁশ করতে থাকেন গার্ড নীহারবাবু - 'একটু যে গায়ের ঘামগুলো শুকোবে সেই সুযোগটুকুও নেই, গাছের একটা পাতাও কোথাও নড়ছে না রে বাবা।' গরমের গল্পে যখন সবাই মশগুল, সেই সময় হঠাৎ মাঠের পাশে অবস্থিত বুধনের বাড়ী থেকে হুংকার শোনা গেল। 'কারো বাপের ধার ধারি না, নিজের মেহনতের পয়সায় মদ খাই, তোর যদি না পোষায়, তাহলে তুই আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যা' – এই বলে নিজের স্ত্রী জয়াকে অশ্রাব্য গালাগালি দিতে শুরু করল মাতাল বুধন। মদ খেয়ে গালাগালি, চিৎকার, চেঁচামেচি করা বুধনের নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। প্রতিদিনই মদ খেয়ে এসে সে নিজের বাড়িতে অশান্তি করে। কলোনির পরিবেশ কলুষিত করছে বলে তার ওপরে পাড়ার সকলেই প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত। বহুদিন ধরেই কলোনির তাকে সকলে মিলে এই ব্যাপারে বুঝিয়ে চলেছে, কিন্তু তাদের সব প্রচেষ্টাই নিষ্ফল হয়ে গেছে। নিজেকে শোধরানো তো দুরের কথা, বুধনের মাতলামি যেন ইদানীং সব মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছিল। মাঠে বসে সকলে মিলে যখন বুধনের মাতলামি নিয়ে আলোচনা করছিল, এমন সময় তার স্ত্রী জয়ার কান্নার আওয়াজ শোনা গেল। 'আমাকে বাঁচাও গো, মেরে ফেলবে গো।' রাতের অন্ধকারেই বুধন নিজের বউকে মারতে মারতে বাড়ির থেকে বের করে দিচ্ছে, এই দৃশ্য নিজেদের চোখের সামনে দেখে সকলেরই মাথা গরম হয়ে গেল। রাগের মাথায় উপস্থিত জনতা গর্জন করতে থাকল। 'অনেক দিন ধরেই তোর অত্যাচার আমরা সহ্য করে চলেছি, কিন্তু আজ আমাদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেছে। - 'আজ তোরই একদিন নয় তো আমাদেরই একদিন' এই বলে সকলে মিলে বুধনকে দু-চার হাত লাগিয়ে দিল। প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণে মদ খেয়ে বুধনের শরীরের শক্তি বহুদিন আগেই নিঃশেষিত হয়ে গেছে। গণধোলাই খেয়ে টাল সামলাতে না পেরে, সে পাড়ার খোলা নোংরা ড্রেনে পড়ে যায়। মদ্যপ অবস্থায় ড্রেনে পড়ে গিয়ে,সেখান থেকে বেরিয়ে আসার ক্ষমতাও সে হারিয়ে ফেলেছে। হাউহাউ করে অসহায় ভাবে সে শিশুর মতন কাঁদতে থাকল - 'আমাকে ছেড়ে দাও গো, মরে যাবো গো,আমাকে বাঁচাও গো।'
স্বামীর করুণ আর্তনাদ শুনে জয়ার রাগ অভিমান মুহূর্তের মধ্যে কর্পূরের মতো উধাও হয়ে গেল। প্রাণপণ চেষ্টা করে সে নিজের দু-হাত দিয়ে নিজের স্বামীকে টেনে ড্রেন থেকে বের করে আনল। ড্রেনে পড়ে যাওয়ার পর, বুধনের গোটা গায়ে নোংরা পচা কাদাজল লেগে রয়েছে, আর তার ঠোঁটের কোণা দিয়ে রক্ত ঝরে পড়ছে। পায়ে চোট লাগার জন্য সে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে থাকে। নিজের স্বামীর এই রকম অসহায় অবস্থা দেখে জয়া চিৎকার করতে থাকে – 'আমার স্বামী, আমাকে মেরেছে, তা বেশ করেছে। কিন্তু তাই বলে এই অসুস্থ মানুষটাকে জানোয়ারের মতন মারতে, তোমাদের এতটুকু বিবেকে বাঁধল না গো?' এই বলে হাউ-হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে জয়া নিজের মাতাল স্বামীকে ধরে ধরে নিজেদের ঘরের ভেতরে নিয়ে গেল। মাতাল স্বামীর প্রতি জয়ার এই ধরণের অদ্ভুত ভালোবাসা দেখে পাড়ার সকলেই স্তম্ভিত হল। মহানায়ক উত্তমকুমারের অন্ধ ভক্ত জনার্দনদা গুনগুন করে নিজের মনে গান জুড়ে দিলেন - 'নারী চরিত্র বেজায় জটিল, কিছুই বুঝতে পারবে না, এরা কোন ল মানে না, তাই এদের নাম ললনা।' এ বছর বৃষ্টি নামার কোন লক্ষণই নেই, প্রতিদিন গ্রীষ্মের প্রখরতা বেড়েই চলেছে। গ্রীষ্মের প্রকোপ বৃদ্ধির সাথে সাথেই রেল কলোনিতে লোডশেডিং আর জলকষ্টের সমস্যা বাড়তে থাকল। সাঙ্ঘাতিক গরমে লোকদের প্রাণান্তকর অবস্থা হয়ে
উঠল। গ্রীষ্মের দাবদাহ থেকে পরিত্রাণ পাবার জন্য পাড়ার বাসিন্দারা মনস্থির করলেন বৃষ্টির সমবেত প্রার্থনা করে পাড়ায় চব্বিশ প্রহর হরিনাম সংকীর্তনের আয়োজন করা হবে। সেই মতো পাড়ার ক্লাবের ছেলেরা চাঁদা তুলে রেল কলোনিতে হরিনামের আয়োজন করল। আকাশ বাতাস মুখরিত হল 'জয় গৌর-নিতাই, জয় রাধা মাধব' ধ্বনিতে। পাড়ার সকলের সাথে সাথে মাতাল বুধনও হরিনাম সংকীর্তনে মেতে গেল। সে নিজের হাতে চায়ের কেটলি নিয়ে কীর্তন দলের লোকজনকে চা পরিবেশন করতে লাগল। গরম গরম চা খাওয়ানোর পর বুধন তাদের কাছে আবদার করল- 'ঠাকুর, তোমরা হলে গিয়ে গুণীজন। তোমাদের গান শুনে আমারও সবাইকে নাম গান শোনাতে ইচ্ছে করছে। তোমরা কিন্তু আমার গানের সাথে একটু বাজনা বাজিও গো।' সন্ধ্যাবেলায় স্নান সেরে নতুন ঘিয়ে রঙের পাঞ্জাবী পড়ে কপালে চন্দনের তিলক কেটে হাজির হল বুধন। মঞ্চে উঠে, উপস্থিত সকল শ্রোতাদের নমস্কার করে বুধন গান ধরল - 'ভজো গৌরাঙ্গ, কহ গৌরাঙ্গ, লহ গৌরাঙ্গের নাম রে, যে জনা গৌরাঙ্গ ভজে, সে হয় আমার প্রাণ রে।' বুধনের গানের মিষ্টি গলা শুনে সকলেই অবাক, মাতাল বুধনও যে এত সুন্দর গান গাইতে পারে, কলোনির কারোরই তা জানা ছিল না। পাড়ার জনার্দনদার স্ত্রী মাধবী বরাবরের ঠোঁট কাটা। বুধনের গান শেষ হবার পর, তিনি তাকে জিজ্ঞেস করে ফেললেন - 'বুধনদা, আপনার যখন ভগবানের নাম গান এতই ভাল লাগে, তাহলে আপনি রোজ এত মদ খান কেন?' তার কড়া কথা শুনে বুধনের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল - 'বৌমা, আমি কি আর শখ করে মদ খাই গো? উনিশ বছরের একমাত্র মেয়েটা চারদিনের জ্বরে দুনিয়া ছেড়ে চলে গেল, ওপরওয়ালার কি অদ্ভুত বিচার দেখ, তাই নিজের সব দুঃখ, যন্ত্রণা ভুলে থাকার জন্যই আমি রোজ মদ খাই।' বুধনের কথাগুলো শুনে উপস্থিত সকলের মনটা উদাস হয়ে গেল। সারাজীবন ধরে শুধু একের পর এক দুঃখ পাবার জন্যই কিছু মানুষ বোধহয় এই পৃথিবীতে জন্ম নেয়। সংসারে সুখের মুখ দেখবার সৌভাগ্য তাদের কোনদিনই হয় না। বুধনের সংসারে প্রতিদিনই অশান্তি লেগে থাকত। নিজের মেয়ে হারানোর শোকে বুধনের স্ত্রী জয়া সবসময় মনমরা হয়ে থাকত। পাড়ার লোকদের সাথে সে খুব একটা বেশি কথা বলত না। নিজের দুঃখকে সে নিজের বুকের মধ্যেই লুকিয়ে রাখত। একদিন রাত ডিউটি সেরে বুধন যখন নিজের বাড়িতে ফিরল,সে নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারল না। সে দেখল তার ঘরের মেঝেতে জয়ার নিষ্প্রাণ দেহ পড়ে রয়েছে।রাত্রিবেলায় ঘুমোতে ঘুমোতেই জয়ার হৃদযন্ত্র চিরকালের মতো স্তব্ধ হয়ে গেছে। বুধনের বুকফাটা কান্নার আওয়াজে একে একে পাড়ার সব লোকজন জড় হয়ে যায়। তার ছোট্ট কোয়ার্টারে পাড়া প্রতিবেশীদের ভিড় জমে যায়। পাড়ার সবাই মিলে জয়ার নিষ্প্রাণ দেহ বুধনের ঘরের উঠোনে নামিয়ে রাখে। কলোনির এয়ো স্ত্রী-রা তার পার্থিব শরীরের পাশে ধুপ জ্বালিয়ে দিয়ে। তারা জয়ার সিঁথিতে লাল রঙ্গের সিন্দূর দিয়ে তার পায়ে আলতা লাগিয়ে দেয়। বুধনের দুঃখের কথা ভেবে পাড়ার সকলেরই চোখ ছলছল করতে থাকল। হঠাৎ সবার লক্ষ্য হল, বুধন তার নিজের বাড়ি থেকে গায়েব হয়ে গেছে। তখন সবাই মিলে তার খোঁজ চালাতে লাগল, কিন্তু আশেপাশের কোথাও তার দেখা মিলল না। এদিকে বেলা বাড়ছে, পাড়ার ক্লাবের ছেলেরা মৃতদেহ সৎকারের জন্য তাড়াহুড়ো করতে লাগল। কেবল বুধনের জন্যই সেই কাজ আটকে আছে বলতে থাকল সবাই। ধীরে ধীরে সকলের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যেতে থাকল আর মাতাল বুধনের ওপর সবাই রাগারাগি করতে থাকল।
পাড়ার সব বাসিন্দারা যখন তার ওপরে ভয়ানকভাবে বিরক্ত, সেই সময়ে নিজের দু-চোখ জবা ফুলের মতো লাল করে আকণ্ঠ মদ খেয়ে টলতে টলতে বুধন নিজের কোয়ার্টারে হাজির হল। বহুদিন আগেই ভগবান তার কাছ থেকে তার একমাত্র মেয়েকে কেড়ে নিয়েছিল। আজ সেই ভগবানই তার তেইশ বছরের পুরানো সাথী জয়াকে তার থেকে আবার ছিনিয়ে নিল। এত বড় পৃথিবীতে আজ বুধন একেবারে একা হয়ে পড়ল। টলবল করতে করতে জয়ার মরদেহর পাশে গেল বুধন। তার মাথায় নিজের হাত রেখে তাকে শেষবারের মতো প্রাণভরে আশীর্বাদ করল বুধন। সে উপলব্ধি করতে পারল যে সারা জীবন জয়াকে কোন সুখই দিতে পারে নি। অতীতের প্রতিটি ঘটনা তার চোখের সামনের ভেসে উঠল। তার মনে পড়ে গেল প্রতিদিন মদ্যপ অবস্থায় বাড়ি ফিরে এসে নিজের স্ত্রীকে সে কত অশ্রাব্য গালাগালি দিয়েছে। কতবার যে সে তার গায়ে সে হাত তুলেছে তার কোন হিসেব নেই। হাজার বার অপমান করা সত্ত্বেও, কিন্তু জয়া তার প্রচণ্ড খেয়াল রাখত। তার হয়ে সে পাড়ার সকলের সাথে ঝগড়া করত। জয়ার ভালোবাসার দাম সে কোনদিনই দিতে পারে নি। এই হৃদয়হীন, নিষ্ঠুর সমাজে আর কার জন্যই বা সে বেঁচে থাকবে। এই কথা ভাবতে ভাবতে, সাথীহারা বুধন হাউ-হাউ করে কাঁদতে লাগল। আকাশের দিকে ওপরে তাকিয়ে অদৃশ্য ওপরওয়ালার উদ্দেশে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বুধন গান জুড়ে দিল - 'প্রাণের বান্ধব রে, দাও দেখা দয়া করে।' মাতাল বুধনের দুঃখে দেখে সকলের প্রাণ কেঁদে উঠল। জয়ার মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে 'বল হরি হরিবোল' ধ্বনি দিয়ে, রাস্তায় খই ছড়াতে ছড়াতে, মন্থর গতিতে ক্লাবের ছেলেরা শ্মশানের উদ্দেশ্যে এগিয়ে চলল।
গড্ডল
কিশোর ঘোষাল
- 'তোমার নামটা কি যেন হে?'
- 'মন্টু, আজ্ঞে, মন্টু মাজি।'
- 'জেরক্সটা করে আনলে আর অরিজিনালটা কোথায় হারালে, য়্যাঁ। এক নম্বরের গাড়ল তুমি একটি। যাও, শিগগির খুঁজে নিয়ে এস। যত্তোসব।'
সক্কাল সক্কাল ঝাড় খেয়ে গোলগাপ্পি মুখ করে ছোট সায়েবের চেম্বার থেকে বের হল মন্টু।
ব্যাপারটা হয়েছিল কি, জেরক্স টেরক্স সাধারণত বিকাশ করায়, সে আসেনি এখনও। এদিকে ছোট সায়েব চলে এসেছেন অন্য দিনের চেয়ে তাড়াতাড়ি। এসেই ছোট সায়েবের জেরক্স দরকার, অগত্যা মন্টু গিয়েছিল জেরক্স করাতে, দোকানেই ফেলে এসেছে অরিজিনালটা আর কপি সায়েবকে জমা করতে গিয়েই বিপত্তি।
বাঁধা দোকান অসুবিধা হবে না। মন্টু দৌড়ে গেল আবার দোকানে। শ্যামল ছিল দোকানে তাকে ব্যাপারটা বলতে মেশিনের ঢাকনা খুলে অরিজিনালটা ফেরত দিল। চলেই আসছিল মন্টু, কি মনে হতে শ্যামলকে জিগ্যেস করল – 'শ্যামলদা, গাড়ল মানে কি বলো তো, জানো?'
মন্টুদের আপিসের সঙ্গে মাসকাবারি খাতা সিস্টেমে তার কাজ চলে। পুরোটাই ধারে, এ মাসের টাকা পেতে পেতে পরের মাসের শেষ। তাও আবার কমিসন দিতে হয় বিকাশকে, কপিতে দশ পয়সা। আজ বউনি হবার আগেই মন্টু এসে জেরক্স করাতে তার মেজাজ বিগড়েই ছিল। তার ওপর ওই প্রশ্ন শুনে তেলে বেগুনে চটে উঠল শ্যামল - 'দ্যাখ মন্টু, বাড়াবাড়ির একটা সীমা আছে। তোদের সঙ্গে খাতা চালাই বলে, যখন তখন আসবি আবার যা খুশী বলবি?' ব্যাপারটা সুবিধের নয় বলে মন্টু আমতা আমতা করে কেটে পড়ে তৎক্ষণাৎ।
বাড়ি থেকে ছটায় সাইকেলে বেরিয়ে ছটা সাতাশের শেয়ালদা লোকাল ধরে মন্টু বালিগঞ্জ স্টেশনে পৌঁছয় সাতটা পনের নাগাদ। সেখান থেকে আপিস অব্দি হেঁটে আসতে আরও মিনিট কুড়ির ধাক্কা। এদিকে নটা থেকে আপিস শুরু। তার আগে বড়, মেজ, ছোট তিন সায়েবের চেম্বার, রিসেপশন ছাড়াও সবার চেয়ার, টেবিল, মনিটার, কি-বোর্ড, মাউস, ফোনের হাতল পরিষ্কার করা, সবার টেবিলে পুরোনো জল পালটে নতুন জল ভরে বোতল রাখা , হাজার কাজ। এর মধ্যে ঝাড়ুদার আসে ঘর, টয়লেট সাফ করতে, তার আবার একটু হাতটান আছে। নজর না রাখলেই গায়েব হয়ে যায় ছোট খাটো জিনিষপত্র। এসব সেরে পৌনে নটার মধ্যে চায়ের জল চাপাতেই হবে। তাও দুজায়গায়, একটা ছোট সসপ্যানে বড় তিন সায়েবের জন্যে আর অন্যটা ঢাউস সসপ্যানে বাকি সবার জন্যে। দুরকমের চায়েরও কোয়ালিটি আছে ‘ইস্পেসাল’ আর চালু। নটা বাজার পাঁচ সাত মিনিট আগে থেকে নটা পনের বিশ অব্দি সবাই চলে আসে। ওই সময়টায় মন্টু মড়ারও সময় পায় না। সবার পছন্দমতো হরেক রকমের চায়ের সাপ্লাই, চিনি ছাড়া, কড়া চিনি, ফিকা চিনি, লিকার চা, লিম্বু চা। ভুল চা দিয়ে ফেললেই আবার ঝাড়।
সেদিন সাড়ে নটা নাগাদ একটু ফাঁক পেয়ে এক কাপ কড়া চিনি চা নিয়ে মন্টু ভাবতে বসল সকালের ঘটনাটা নিয়ে। ছোট সায়েব এই মাসখানেক হল এসেছে। সব সময়েই যেন চড়ে থাকে, খুব কড়া মেজাজ। অথচ ওঁনার ঘরের এসিটাই সবচেয়ে জোর চলে, একবার ঢুকলেই কেমন যেন শীত ধরে যায়। কিন্তু পান থেকে চুন খসলেই মাথা একদম গরম। সাত ঝামেলার মধ্যে ‘অরজিনাল’ পেপারটা না হয় ভুলেই এসেছিল, তা বলে সক্কাল সক্কাল ওভাবে ঝাড়তে হবে? গাড়ল বলতে হবে? গাড়ল। এই শব্দটা মন্টুকে বহুবার শুনতে হয়েছে ছোটবেলা থেকে। আজকে ছোট সায়েব বলাতে মনে পড়ে যাচ্ছে সব। সিক্সে প্রথম ইংরিজি শেখার সময় মহিমবাবু এক ‘কেলাস’ ছেলের সামনে তাকে গাড়ল বলেছিলেন। গলায় গলায় বন্ধু নন্দকে ‘টিপিন’ ঘন্টায় মন্টু গাড়ল মানে জিগ্যেস করাতে নন্দ পাত্তা দেয়নি। পরের দিন এক ফাঁকে তাদের কেলাসের ‘ফাস্ট’ বয় রাজুকে জিগ্যেস করাতে ফিচেল হেসে উত্তর দিয়েছিল – 'গাড়ল মানে মন্টু মাজি।'
দু-দুবার চেষ্টা করেও সিক্স থেকে সেভেন উঠতে পারল না মন্টু, ইংরিজি আর অংকের যুগপৎ বজ্জাতিতে। গ্রিল কারখানার ওয়েল্ডার মন্টুর বাবা নিমাই মাজি একদিন তার মাকে ডেকে বলল – 'গাড়লটার নেকাপড়া কিসু হবে নি, কাল আমি ওরে নে যাব, হৃদয়বাবুকে বলা আছে। কম সে কম গিরিল বানানোটা শিখুক।' হৃদয়বাবু বাবার গ্রিল কারখানার মালিক।
নয় নয় করেও মাস ছয় সাত গ্রিল কারখানায় কাজ শিখতে চেষ্টার কসুর করে নি মন্টু। বার দশেক হাতে পায়ে ছ্যাঁকা খেল।ওয়েল্ডিং আর গ্যাস কাটিং করা গরম লোহার টুকরোর ওপর হয় দাঁড়িয়ে পড়ে, নয় তো হাত দিয়ে খামচে ধরতে গিয়ে। শেষের দিন ওয়েল্ডিং মেসিনের কানেকসনে হাত দিয়ে চেক করতে গিয়েছিল মেসিনে কারেন্ট আসছে কিনা। কারেন্ট ছিল এবং সেটা সবাই হাড়ে হাড়ে টের পেল, যখন মন্টু এক ঝটকায় চিৎপাৎ হল। বেশ কিছুক্ষণ টোটকা চিকিৎসায় চোখ ওলটানো মন্টু উঠে বসল। ধরাধরি করে সবাই অফিস ঘরে নিয়ে গিয়ে পাখার তলায় বসিয়ে দিল মন্টুকে। সামনেই ভোলাদার চায়ের দোকান থেকে এক গ্লাস গরম দুধও চলে এল মন্টুর সেবায়।মন্টুর দুধের গ্লাস যখন হাফ, হৃদয়বাবু সবাইকে বললেন
কাজে যেতে। ঘরে রইল শুধু মন্টু আর তার বাবা নিমাই মাজি। গম্ভীর গলায় হৃদয়বাবু বললেন -
'নিমাই, তুমি এখন বাড়ি যাও মন্টুকে নিয়ে। আর কালকে
তোমার ছেলেকে আর এন না বাপু, কবে কোনদিন কি ঘটিয়ে বসবে। হাতে হ্যারিকেন হয়ে, ব্যবসা আমার লাটে উঠবে।'' না, না, বাবু, আপনি ঠিক কয়েচেন, এই কান মলতেসি, ওরে কাল থিকে আর আনব নি। তবে বাবু, কি যে করি ওটারে লিয়ে, একদম হাবা গবা, গাড়ল একখান। না শিখল নেকাপড়া না শিখল হাতের কাজ।' মুখ কাঁচুমাচু করে নিমাই মাজি দাঁড়িয়ে থাকে।
'ও নিয়ে ভেব না নিমাই, একটা কিছু হয়ে যাবে ঠিক। তুমি ওকে নিয়ে ঘরে যাও এখন। মন্টুর একটু রেস্ট দরকার।'
সেদিন রিকশ করে বাপের সাথে ঘরে ফিরেছিল মন্টু। ঘরে ফিরে মা খানিক হাউমাউ করেছিল, বাবাকে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল – 'ওই সব্বনেশে গিরিলের কারখানায় কচি ছেলেকে কেউ নে যায়? তোমার যেমন বুদ্ধি। কাল থিকে ও আর যাবে নি। কক্খনো যাবে নি আর।' বাবা কিছু বলে নি, বেরিয়ে গিয়েছিল বাড়ি থেকে।
গায়ে মাথায় মায়ের হাত বোলানোর আরামে মন্টু ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম ভাঙল শাঁখের আওয়াজে। প্রদীপ দেখিয়ে, ধূপ জ্বেলে, শাঁখ বাজিয়ে মা ঘরে এসে মন্টুকে জেগে ওঠা দেখে খুশি হল খুব। বিছানায় বসে মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল -
'কেমন বুজচিস বাবা, বল পাচ্চিস শরীলে?' মন্টু ঘাড় নেড়ে সায় দেয়।
'খিদে পেয়েচে, মুড়ি খাবি?' মন্টু আবার ঘাড় নেড়ে সায় দেয়। মা বিছানা থেকে নেমে ও ঘরে যাচ্ছিল, মন্টু ক্ষীণ স্বরে ডাকে -
'মা, শোন।' মা কাছে আসে।
'কি হয়েছে, বাবা?'। মন্টু মায়ের একটা হাত ধরে বলে - 'গাড়ল মানে কি, মা?'
'তোরে গাড়ল বলেচে? কে বলেচে? যে বলেচে সে নিজেই একটা গাড়ল।' বলে মা রেগে দুম দুম করে পা ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় মুড়ি আনতে।
হৃদয়বাবু হৃদয়হীন নন, সোজা সাপটা ভোলাভালা মন্টুকে তিনি পছন্দই করতেন। ছেলেটার বুদ্ধিসুদ্ধি কম। তা হোক, খাটিয়ে এবং বিশ্বাসী। এটুকু তিনি লক্ষ্য করেছিলেন। যে আপিসে এখন মন্টু কাজ করে, তারা ঘর বাড়ি তৈরির কাজ করে। এদের সঙ্গে হৃদয়বাবুর অনেকদিনের লেনদেন ও ব্যবসা। সেই সূত্রেই হৃদয়বাবু মন্টুকে ঢুকিয়ে দেন এই আপিসে। সেও প্রায় আজ বছর পাঁচেক হল। এর পরে আরও একবার গাড়ল কথাটা শুনতে হয়েছিল একদম অচেনা লোকের থেকে। বছর খানেক আগে আপিসে আসার সময় ঢাকুরিয়ার আগে ট্রেনটা মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে গেল। সামনে অবরোধ, ট্রেন আর যাবে না। কখন অবরোধ উঠবে কে জানে। মন্টু ট্রেন ছেড়ে বড় রাস্তায় এসে বাসে চেপে পড়েছিল আপিসে দেরী হয়ে যাবার ভয়ে। গড়িয়াহাটের মোড়ে চলন্ত বাস থেকে লাফ দিয়েছিল উলটো মুখ করে। পড়তে পড়তেও সামলে গিয়েছিল মন্টু, কিন্তু কানে এসেছিল বাস কন্ডাক্টারের মন্তব্যটা – 'দ্যাখ, দ্যাখ, আরেকটু হলে মরত গাড়লটা।' মন্টু সবার টেবিল থেকে এঁটো চায়ের কাপগুলো নিয়ে আসে। সিঙ্কে কল খুলে কাপ প্লেট ধুতে ধুতে ভাবে গাড়ল
মানে সত্যিই কি মন্টু মাজি?
কাপপ্লেট ধোয়াধুয়ি শেষ হবার আগেই বিকাশ এসে বলল -
- 'সকাল সকাল শ্যামলদাকে, কি বলেচিস, তুই?'
- 'কই সেরকম কিছু বলিনা তো'
– 'গাড়ল না কি বলেচিস যে? যা, এবার সরকারবাবু কেমন দেয়, দ্যাখ।'
এই অফিসের পত্তনের সময় থেকে সরকারবাবু আজ প্রায় বছর বিশেক একই সিংহাসনে সমাসীন। শুরুর দিন থেকে কোম্পানীর লাভ ক্ষতি, সাদা কালোর হিসেব তার হাতে। কোন সায়েব কোন ফুলে তুষ্ট হয়, তার হাল হকিকত নখের ডগায়। যে যতো বড় অফিসারই হোক না কেন, তাঁর মাতব্বরি মানতেই হবে। সরকারবাবুকে বিগড়ে দিলে বড় সায়েবদের কান ভাঙানি দিয়ে অতিষ্ঠ করে তুলবে যে কোন কলিগের জীবন। কাজেই সরকারবাবুকে সমঝে চলে না এমন কেউ নেই এই অফিসে।কাজেই বিকাশের কথায় মন্টুর শরীরটা কেমন ঠাণ্ডা হয়ে এল। এক পেট জল গিলে নিল জলের জগ উল্টে। তবুও গলার শুকনো ভাবটা কাটল না। মিয়োনো মুড়ির মত মন্টু গিয়ে দাঁড়াল সরকারবাবুর টেবিলের সামনে। শ্যামলদা দাঁড়ানো ওদিকের কোনটা ঘেঁষে, চুপচাপ মাথা গোঁজ করে। গলা ঝেড়ে সরকারবাবু সিনেমায় দেখা পাক্কা জজসায়েবি চাল মেরে বলতে শুরু করল - 'মন্টু, আজ সকালে জেরক্স করাতে গিয়ে শ্যামলকে তুমি কি বলেচ?'
সরকারবাবু অন্য সময় মন্টুকে তুই বলে, এখন তুমি বলছে মানে কেস গড়বড়, এটা মন্টু আগেও লক্ষ্য করেছে।
- 'আজ্ঞে খারাপ তো কিচু বলি না।' মন্টু শুকনো মিহি গলায় বলে।
- 'সকাল সকাল যেচে পড়ে আমায় গাড়ল বলিস নি?' শ্যামল খেঁকিয়ে ওঠে।
- 'আঃ, শ্যামল, অফিসের মধ্যে চেঁচামেচি আমি ভালবাসি না। তোমায় তো বললাম আমি দেকচি। খারাপ বলনি, তার মানে শ্যামল বাজে কথা বলচে?' শেষ কথাটা মন্টুকে বললেন সরকারবাবু।- 'আজ্ঞে, তা না।' মন্টুর মিনমিনে উত্তর। 'আসলে আমি... মানে... গাড়ল মানে কি, জান তি ... শ্যামলদাকে ...।'- 'গাড়লের মানে? তার মানে?' সরকারবাবু তাঁর চাকরি জীবনে অনেক থানা পুলিশ কোর্ট কাছারির এঁড়ে সওয়াল
ম্যানেজ করেছেন, কিন্তু এমন প্রশ্নে তিনিও হতবাক। কিছুটা ধাতস্থ হয়ে জিগ্যেস করলেন,
- 'তা তোমার গাড়লের মানে হঠাৎ এমন জরুরি হয়ে উঠল কেন?'
খুব করুণ মুখে করে মন্টু আজ সকালের পুরো ইতিহাসটা ঘোষণা করল, সবার সামনে। শ্যামলদা খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে উঠল সব শুনে। মন্টুর ওই হাসি দেখে শেয়ালের কথা মনে পড়ল। তাদের বাড়ির পিছনে বাঁশঝাড়ে আছে একপাল। রাত্রে ঝোপেঝাড়ে টর্চ জ্বাললে, মাঝে মাঝে অবিকল ওই ভাবে ধেয়ে আসে, অবিকল ওই আওয়াজ, ওইরকম দাঁত, কোন ফারাক নেই। হাসছিল সবাই। মন্টু ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল হলে প্রায় সকলেই হাসছে, তার মানে সবাই শুনেছে সব কথা। এই সাবর্জনীন অপমানটা মন্টুরও গায়ে লাগে। সরকারবাবু হাসে নি, কিন্তু চোখে মুখে হাসির পরতটা বোঝা যাছিল। গম্ভীর মুখোসটা মুখে লেগে থাকা সত্ত্বেও। সরকারবাবু বললেন - 'ঠিক আছে এখন যা'। আস্তে আস্তে হল থেকে বেরিয়ে আসে মন্টু, মাথা নীচু করে। এই অপমানের মধ্যেও একটা ব্যাপারে সে নিশ্চিন্ত হয় চাকরিটা এখনই যাচ্ছে না। সরকারবাবু তাকে আবার আগের মতোই ‘তুই’ বলেছেন। বিকাশের কোন কাজ নেই? বসে বসে ‘প্রতিদিন’ পড়ছিল। ওটা রোজ দে-সায়েব নিয়ে আসেন। তার মানে দে-সায়েব চলে এসেছেন, বিনা চিনি লিকার চা। দে-সায়েবের চায়ের জল বসাল মন্টু।
দে-সায়েবও সরকারবাবুর মতো আদ্যিকাল থেকে আছে এই অফিসে। বড়ো সায়েবদের স্টেনো টাইপিস্ট। আলাদা খুপরি, গৌরবে চেম্বার। আগে ছিল টরেটক্কা টাইপ মেসিন, পরে ইলেক্ট্রনিক্স্। সে সব পাট উঠে গেছে বেশ ক’বছর। বাক্স বাজানো বন্ধ হয়ে কম্পিউটার চলে এসেছে। ইংরিজিতে দখল আর টাইপিংয়ের স্পিডের জন্যে আগে বড় সায়েবদের প্রিয় ছিলেন। এখন এক ছোঁড়া অরুণ এসেছে এই বছর পাঁচেক হল। কম্পিউটার জানে কিন্তু ইংরিজি শিখেছে ক্লাস সিক্স থেকে। ড্রাফট বানিয়ে দে-সায়েবের থেকে মেরামত করে নেয় ইংরিজিটা। দে-সায়েব আর অরুণ একে অপরের পরিপূরক হয়ে টিকে আছে কোন মতে।
অফিসের সময় নটা হলেও দে-সায়েব কদাচ সাড়ে দশটার আগে ঢোকেন না। মন্টু চা নিয়ে দে-সায়েবের ঘরে ঢুকল প্রায় এগারোটায়।
-'কিরে, তোকে নিয়ে কি মহাসভা চলছিল শুনলাম। তুইও কিছু ঘাপলা করেছিস না কি?'
আস্তে আস্তে ফুঁ মেরে আর লম্বা আওয়াজে টান দিয়ে চা পানের অভ্যাস। ভীষণ ধীর স্থিরভাবে সব কাজ করেন দে-সায়েব। এমনকি চোখের পাতা ফেলতেও বেশ সময় নেন তিনি। প্রতিটি কথা মুখ থেকে নামানোর আগে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পরখ করে নেন। মন্টুকে নিরুত্তর দেখে আবার বললেন 'যাক এতদিনে তুই মানুষ হলি বলতে হবে।'
'কেন, এর আগে কি সিলাম, গাড়ল?'
মন্টুর এ হেন কথায় দে-সায়েবের মতো নাচমকানো লোকও একটু থমকে গেলেন। চা পান থামিয়ে চোখ তুলে বললেন - 'কি ব্যাপারটা রে, আজ তোরও মেজাজ মনে হচ্ছে চড়া? কি হয়েছে কি?'
- 'ঘাপলা যদি করতি পারতুন তো আজ এই অপমানটা সহ্যি করতি হত না। আমি গাড়ল কিনা, সকলে তাই শুনায় ঘুরায়ে ফিরায়ে'। দে-সায়েব মৃদু হাসেন – 'অ্যাই, আমার কাছে ঝাল ঝাড়ছিস কেন, যদি ক্ষমতা থাকে যে বলেছে তাকে বলগে, যা সেখানে তো মেনিমুখো।'
দে-সায়েব নির্ঝঞ্ঝাটে মানুষ, সাতে পাঁচে থাকেন না। থাকার উপায়ও নেই। কারণ এই অফিসে আজকাল তাঁকে আর প্রয়োজন নেই। দীর্ঘদিন ভাল কাজ করার সুবাদে, আজও তাঁকে পোষা হচ্ছে নিছক চক্ষু লজ্জার খাতিরে। যে কোনদিন অফিস বলতেই পারে, দরজা খোলা আছে হে, কেটে পড় ফুল অ্যান্ড ফাইন্যাল নিয়ে। তাঁর যা এলেম এই শেষ বয়সে অন্য কোথাও আর কিছু হবারও নয়।
অফিসে এই দে-সায়েবের সঙ্গেই মন্টুর যা দু-চারটে মনের কথা হয়। সেই অধিকারেই মন্টু একটু ঝাঁজ দেখিয়ে ফেলেছিল। দে-সায়েবের কথায় একটু লজ্জা পায়।
'সকাল থিকে আমারে লিয়ে যা চলতিসে...'
'সেটাই তো জিগ্যেস করছি, কি হয়েছে কি?'
মন্টু সব কথাই সবিস্তারে বলে দে-সায়েবকে। বলে আর কিছু না হোক হাল্কা হয় মনে মনে। সব শুনে টুনে দে সায়েব বেশ কিছুক্ষণ গুম মেরে থাকে। মন্টু একটু অপেক্ষা করে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। সোয়া এগারোটা বেজে গেছে, আরেক রাউন্ড চা না পেলে আবার হাল্লা শুরু করবে। অফিসের লোকগুলোর দশা দেখে মনে হয়, চা নয় যেন বেঁচে থাকার দাওয়াই নিচ্ছে। না পেলে হেদিয়ে টেঁশে যাবে।সকলের চা সাপ্লাই করে মন্টু দে সায়েবের জন্যে এক কাপ বিনা চিনি কফি নিয়ে ঢোকে। বড় সায়েবদের জন্যে কফি রাখা থাকে। কখনো সখনো সায়েবরা খায়, আর সরকারবাবু আর দে সায়েবের ইচ্ছে হলে। বাকি কেউ অ্যালাউড নয়।
- 'তখন চা টা রাগের মাথায় বানাইসিলাম, ঠিক হয় নি হবে। এখন এট্টু কফি খান, স্যার। আর বলেন দিকি গাড়ল কথাটা কি?' কফিতে একটা লম্বা চুমুক দিয়ে দে-সায়েব বললেন - 'মানে জেনে কি করবি? ধর আমি বললাম গাড়ল মানে খুব খারাপ কিছু। কি করবি?' মন্টুর দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করেন। মন্টু ইতস্ততঃ করে বলে,
- 'তা, সত্যি বটে। কিছুই করতে পারব নি। শুনেও চুপচাপ হজম করতিই হবে। মানেটা সত্যি কি খুব খারাপ, স্যার?'
- 'না, না, তা নয়। আসলে গাড়ল মানে ভেড়া। তার মানে বোকাসোকা, নিরীহ, ভিড়ের মধ্যে একাকার। আলাদা করে চেনা যায় না। একদম সাধারণ। কিছু বুঝলি? আমরা সবাই। তুই, আমি, এ অফিসে, বাসে ট্রামে ট্রেনে। রাস্তাঘাটে, চলার পথে। আমরা সবাই সাধারণ। আমরা সকলেই একে অন্যকে নিজের ধান্দা মত, সুবিধে মত গাড়ল বানাই, আবার প্রায়ই গাড়ল বনি।'
কফির কাপটা শেষ করে মন্টুর হাতে খালি কাপ প্লেট দিলেন দে-সায়েব, বললেন - 'মানে তো বললাম, কি কদ্দূর বুঝলি, তুইই জানিস। মানেটা জেনেই বা তোর কটা হাত পা গজাল আর কি করবি কে জানে'।
- 'আজ্ঞে, সকলের এঁটো কাপপ্লেটগুলো নে এসে ধুই গিয়ে, আপনের আজ কি টিপিন আনব বলে দে, ওদিকে আবার সায়েবরা কি বলে দেখি।'
দণ্ডিতের
সাথে
ডাঃ সুপ্তেন্দ্রনাথ সর্বাধিকারী
স্বাস্থ্যকেন্দ্রের বা হেলথ সার্ভিসের ডাক্তারকে যে রোগী অজ্ঞান করা থেকে মড়া কাটা অবধি সবকিছুই করতে হয় সেটা তো বনফুল একাধিক গল্পে বাংলা সাহিত্যপ্রেমীদের জানিয়েছেন এবং সেই অভিজ্ঞতার ভাগ পেয়ে আমরাও ধন্য হয়েছি। আবার ডাক্তারের সামনে জমিদার এবং দরিদ্রতম প্রজাও সমান কাতরতা নিয়ে উপস্থিত হন| অন্যদিকে আবার পুলিশ তথা বিচারব্যবস্থার সঙ্গেও ডাক্তারদের একইরকম দহরম মহরম। সুতরাং ন্যায় অন্যায় প্রাণদান প্রাণনাশের ক্ষমতা যাদের আছে তাদের দৃষ্টিভঙ্গিরও কিছু মিল তো থাকতেই পারে।
এই গল্প একজন বিচারকের। ধরুন আমিই সেই ডাক্তার যে প্রায় বছর সাতেক আগে পোস্ট মর্টেম করেছিল এক ভদ্রমহিলার। তাতে মৃত্যু পরবর্তী পোড়া ছাড়া আর বিশেষ কিছুই পাইনি আমি। এতদিনে মামলা উঠেছে আদালতে - অগত্যা সাক্ষী দিতে গেছি কোর্টে।
পৌঁছে শুনি জজ সাহেব শুনানি মুলতুবি রেখেছেন - এবং একান্তে আমার সাক্ষাতপ্রার্থী। বুঝলাম "ডাল মে কুছ কালা"। সাধারণত সাক্ষ্য দেবার পরে জজ নিভৃতে ডাকলে কাটিয়ে দেওয়া যায় - কাজ আছে বলে - সই সাবুদ পরে হবে। কিন্তু এখনো আমার সাক্ষ্য দেওয়া হয়নি তাই আদালত ছেড়ে যাবার কোনো উপায় নেই। ভাবলাম উনি যাই বলুন না কেন আমি আমার মতেই দৃঢ় থাকব।
ঘরে ঢুকতেই আমায় সাদর অভ্যর্থনা করলেন জজ সাহেব। "দেখুন ডাক্তারবাবু, আপনাকে প্রভাবিত করতে ডাকিনি, তবে আমার মনে হয় যে আপনার পুরো কেসটা জানা দরকার। আমি যা জানি এবং ভেবেছি সবই আপনাকে বলছি - তারপরে আপনি যা ভালো বুঝবেন তাই করবেন।"
"আমায় যা বলার অনুমতি দেবেন আদালতে তার বেশি তো বলতে পারবনা, তাছাড়া যাই বলিনা কেন আপনি তো তার গুরুত্ব নাও দিতে পারেন।"
"ঘটনাটা বছর সাতেক আগেকার। ভদ্রমহিলার ডেড বডি পাওয়া গেছলো ওনার বাড়ি থেকে মাইল তিনেক দুরে, আশেপাশে কেরোসিনের টিন বা দেশলাই বাক্স কিছুই ছিল না। যদি ধরেও নেওয়া যায় আত্মহত্যা, ভদ্রমহিলা নিশ্চয়ই গায়ে আগুন লাগিয়ে তিন মাইল যাননি! আর এও নয় যে গায়ে কেরোসিন ঢেলে তিন মাইল গিয়ে তারপরে গায়ে আগুন ধরিয়েছেন। এছাড়াও কয়েকজন পড়শী সেই রাতে ওই ভদ্রমহিলা আর তার স্বামীর মধ্যে তুমুল ঝগড়ার আওয়াজ পেয়েছিলেন। সবচেয়ে বড় কথা হলো যে ওনাদের আট বছরের ছেলে আর পাঁচ বছরের মেয়ে ওই ঘটনার সাক্ষী যে ওদের বাবা ওদের মাকে গলা টিপে মেরে ফেলে গায়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। এবং এই ঘটনার তারা লিখিত জবানবন্দিও দিয়েছে।"
“তাহলে তো এটা একটা Open and shut case”।
"সেক্ষেত্রে আপনায় ডাকতাম না। সাত বছর বাদে এখন ছেলেটার বয়েস পনেরো আর মেয়েটার বয়েস বারো। ওরা দুজনেই জবানবন্দী অস্বীকার করছে আর বলছে যে তখন বাচ্চা ছিল তাই না বুঝেই সই করে দিয়েছে। আর প্রতিবেশীরা বলছেন যে পুলিশ ওদের ভয় দেখিয়ে ওদের থেকে জবানবন্দী আদায় করেছে।"
"তাহলে আপনি কি করতে চান?"
"আমি জানি লোকটা খুন করেছে - আর ফাঁসির হুকুম দিতে পারি। ছেলেমেয়েরা এখন অস্বীকার করছে সম্ভবত ভয়ে - যদি বাবা ওদেরও মেরে ফেলে, অথবা, মাকে তো হারিয়েছ - আর বাবাকেও হারাতে চায় না। এবারে ভাবুন যদি ওদের বাবার ফাঁসি বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়, ওরা কিন্তু একেবারেই ভেসে যাবে - হয়তো অ্যান্টিসোস্যাল নয়তো ভিখিরী হবে - দুটো তাজা জীবন নষ্ট হবে অথচ যে গেছে সে তো আর ফিরে আসবেনা। আর যদি দৃষ্টান্ত হিসেবে ফাঁসির রায় দিই, আপনি কি মনে করেন যে অন্যরা তাই দেখে ভয় পাবে বা শিখবে? কখনোই না! ভাববে যে ও ম্যানেজ করতে পারেনি তাই ফেঁসে গেছে - আমি ঠিক বেরিয়ে যাব! হাঁ একটা বাজে জিনিস নিশ্চয়ই হবে, লোকটা ভাববে যে জজটাকে কেমন বুদ্ধু বানালাম! কিন্তু আশা করা যাই যে বাচ্চা দুটো অন্তত সিকিওর্ড লাইফ পাবে এবং নিশ্চয়ই সুনাগরিক হবে।"
ভদ্রলোককে দেখে আমার মনে হলো কথাগুলো আন্তরিক - অন্য কোনভাবে প্রভাবিত হয়ে ওপর চালাকি করছেন না।বললাম "উকিলবাবু যদি জিজ্ঞেস করেন উনি পুড়ে মারা গেছেন কিনা - আমার উত্তর না-ই হবে - আর যদি জানতে চান যে গলা টিপে মারা হয়েছে কিনা সেটাও আমার পক্ষে বলা সম্ভব হবেনা। যদি সম্ভাবনার কথা উকিলবাবু জিজ্ঞেস করেন তাহলে আমাকে বলতেই হবে যা যা কারণ হতে পারে - সুতরাং আপনি ওই প্রশ্নে objection sustain করতে পারেন।" Circumstantial evidence-এর ব্যাপারে তো আমার কিছুই বলার নেই। তাই আপনি যতটুকু জানতে চাইবেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে তার চেয়ে বেশি আমি কিছুই বলবনা। তারপরে তো সব আপনারই হাতে।”
"অনেক ধন্যবাদ ডাক্তারবাবু। মুশকিল কি জানেন, এই কথা কারো সঙ্গে আলোচনাও করতে পারব না - ভুল বোঝার সম্ভাবনাও আছে অথচ রায় দেওয়ার আগে সবদিক ভালোভাবে দেখতে হয়। বাইরে আসামির উকিল বাহবা ও মোটা ফিজ নেবে - বলবে কেমন দারুণ কেস সাজিয়েছি - একদম বেকসুর খালাস!"
ফেরার পথে ভাবছিলাম তাহলে শুধু আমরাই জীবন রক্ষা করি না।
নির্বাসন
মিজানুর রহমান মিজান
বিশ্বনাথ, সিলেট, বাংলাদেশ
টিপ দিন না - এত বিলম্ব কিসের? বলে সাজ্জাদ সাহেব বাঁ হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি ছেপে ধরে কার্বন পেপারে ঘষে মেডিকেল কার্ডে ছাপ দেন।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও শুধু দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে রহিম সাহেব আঙ্গুলটি মুক্ত করে নেন। তাকে খুবই চিন্তিত মনে হয়। কারণ এ মুহূর্তে কেহই সহজে বিশ্বাস করবে না এল.এল.বি পরীক্ষার্থী রহিম সাহেব ডিম্বাকৃতি টিপ সহি দিয়ে সবেমাত্র বিদেশ ভ্রমণের ছাড়পত্র পেলেন।
অর্থ! এ নাট্য শালায় অর্থের জন্য মানুষ কি না করছে, মা হয়ে কোলের শিশুটিকে টাকার বিনিময়ে অন্যের হাতে সমর্পণ, পিতা-পুত্র সম্পর্কচ্ছেদ, নব দম্পতির বিচ্ছেদ। শুধুমাত্র অর্থের লোভেই এ সমস্ত ঘটনার সূচনা। কিন্তু সব ক্ষেত্রেই যে অর্থের লোভ তা নয়। কখন ও কখন ও এর ব্যতিক্রম পরিলক্ষিত হয়। ব্যতিক্রমটি প্রশমিত হয়ে পড়ে যারা চাষা-ভুষা, দীনহীন, সহায়-সম্বল হারা। সমাজে যারা প্রতিষ্ঠিত (সব নয়), যাদের অর্থ আছে তারা অর্থের জাদুকরী প্রভাবে ফেলে গোটা পৃথিবীটাকেই যেন লাটিম বানিয়ে খেলছেন। আমি কাউকে কটাক্ষ বা হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে বলছি না। যা সত্যি তা বলছি। কারণ সমাজে রুই, কাতলা আর অর্থের টানা পোড়নে আমরা সংকীর্ণতার এমন স্তরে এসে পৌঁছেছি, অর্থের প্রভাবে সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে¦ তেমন করে সুর ধরে বাজে না। আমরা যেন দর্জির ফিতার মাপে কাট ছাট করা মানুষ। রহিম সাহেব আমারই একজন বন্ধু, বাল্য সহচর। তিনির সুখ-দু:খ, সবটাই আমার নখ দর্পণে। যে দিন রহিম সাহেব আমার হাত ধরে কেঁদেছিলেন ,সে দিন আমার আবেগ প্রবণতা, অশ্রুকে ধরে রাখতে পারিনি। মনের অজান্তে নয়ন অশ্রু ভারাক্রান্ত। মাথাটা চক্কর শুরু করে। সবকিছু যেন ঝাপসা হয়ে যায় ঘটনার আকস্মিতায়।
মেট্রিক পাশ করেই হন্যে হয়ে ঘুরে একটা চাকুরী সংগ্রহ করতে পারেননি। এদিকে নাইট কলেজে ক্লাস করে বি.এ পাশ করেছেন। যেখানেই দেখেছেন, শুনেছেন আবেদন করতে কাল বিলম্ব করেননি। তথাপি চাকুরী পাওয়া তার পলেমঘ মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছাত্র হিসাবে ও তিনি মন্দ নন। যেহেতু একবার বৃত্তি পেয়েছেন সরকারী। চাকুরীর ব্যাপারে বর্তমানে একটু হতাশা, বিতৃষ্ণা ভাব জন্ম নিয়েছে।একদিন প্রতিবেশী এক ভদ্রলোক তাকে ডেকে বললেন – এই যে রহিম সাহেব লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু একটা চাকুরীতে জয়েন্ট করলে আপনার আট সদস্যের পরিবারে কষ্টের একটু লাঘব হত। চাকুরী না করলে আজ হয়ত একাহারি দিনাতিবাহিত হচেছ। কয়দিন পর সর্ষে ফুল দেখবেন। তবে আমার মামার অধীনে কোন চাকুরী নেই। এ প্রত্যাশা করো না। আমার চাকুরীর ব্যাপারে মামাকে অনেক কাঠখড় পোহাতে হয়েছে। শুনেছি অন্য একজনকে বাদ দিয়ে আমার দফারফা। মামা ঊর্ধ্ব¦তন কর্মকর্তা থাকায় রক্ষা।
মানুষ অল্প দু:খ বা আঘাত পেলে বিমর্ষ, নীরবতায় ভোগে। তার অধিক হলে কান্নাকাটি করে। কিন্তু অত্যধিক চাপে নিথর পাথর বনে যায়। তাই যে কোন ঘটনা অনেক ক্ষেত্রে রসিকতায় গুরু থেকে লঘু করার প্রয়াসে মনকে প্রবোধ বা সান্ত্বনার প্রচেষ্টা চালায়। এমনি রহিমসাহেব মনের শক্ত বোঝা লাঘবের উদ্দেশ্যে প্রতি উত্তর স্বরূপ বলেন চাকুরী করে কাকে খাওয়াব, চাকুরীর প্রয়োজনই বা কি? আরো কি যেন বলতে গিয়ে থেমে যান।
ভদ্রলোক এবার জোঁকের মত মাংসের সাথে মিশে যাবার উপক্রম। আরে রহিমসাহেব- এখন ও বিবাহ করেননি। আপনি যে পিতা-মাতা, ভাই-বোনকে একটু আদর, লালন পালন করবেন তা সহজেই অনুমেয়। ভাবী স্ত্রীর ভরণ পোষণের জন্য দেখছি এখন থেকেই নিমগ্ন। তাইত আমার ছেলেকে স্কুলেই দেই নাই। লেখাপড়া শিখে ছেলে মেয়েরা অমানুষ হয়ে যায়। ভুলে যায় জনক-জননীর কথা। শেষ পর্যন্ত ভদ্রলোক রহিম সাহেবের পিতা মাতার কাছে এ কথা ব্যক্ত করে ক্ষান্ত হন। প্রত্যেক জনক জননী তাঁর সন্তান সম্পর্কে অবগত। হোক সে সাদা-কালো, ভাল-মন্দ। সুতরাং রহিম সাহেব যে মাতাপিতার একান্ত বাধ্য সন্তান, অনুগত তা নূতন করে কেউ বলতে হবে না। তারাই ভাল জানেন রহিমের চাল-চলন, আচার-আচরণ আরো দশজন। অন্য দশটি সন্তানের চেয়ে তিনি অনেক অনেক উর্ধেব। তাই তারা অতি সহজে ঘটনাটি আঁচ করতে দ্বিধাবোধ করেননি, এ যে রহিমের প্রলাপ। তবে দু:খ হয় শুধু ভদ্রলোকের ব্যবহারে। হয়ত তিনি কথার মর্মার্থ বুঝতে পারেননি বা বুঝার চেষ্টা ও করেননি। কিন্তু পিতার কাছে ব্যক্ত করায় কতটুকু উপকৃত হয়েছেন, কত পার্সেন্ট মুনাফা লাভে বা সুনাম অর্জনে সক্ষম হয়েছেন। তাই জিজ্ঞাস্য?
এবার রহিম সাহেবের মুখ নি:সৃত জীবনের অন্যান্য কিছু ঘটনাবলী পাঠক সমাজকে উপহার দেবার চেষ্টা করবো। তাহলে আসুন দেখি তিনি কি বলেন? স্থান-কাল-পাত্র ভেদে পৃথিবীতে প্রত্যেক জিনিষের মূল্য উঠা-নামা করে। তবে বর্তমানে জগতে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই মূল্যের নমনীয়তার চেয়ে ঊর্ধ্ব গতি অত্যধিক স্থায়িত্ব প্রাপ্ত। ১৯৭২ সালে পিতার শেষ সম্বল ২ কেদার জমি বিক্রি করে ১২ হাজার টাকা আদম বেপারী রসিদের হাতে তুলে দেই। কথা ছিল যদি বিদেশ পাঠাতে না পারেন, তবে টাকা ফেরত দেবার প্রাক্কালে ঐ সময়কার মূল্য হিসাবে পরিশোধ করতে হবে। দিনে দিনে মাস, মাসে মাসে বছর-এ ভাবে তিন তিনটি বছর অতিবাহিত বিদেশ পাঠানো আর হল না। চাইলাম টাকা তা ও অস্বীকার। শুরু করলাম বিচার। যাদের সম্মুখে টাকা দেয়া হয়েছিল, তারাই আসলেন বিচারক হয়ে। বিচারের নামে যে প্রহসন, তা আগে টের পাইনি। সে দিন হাড়ে হাড়ে টের পেলাম, নূতন করে অভিজ্ঞতা অর্জিত হলো। দুই একজন যারা ছিলেন সত্যিকার বিচারক রূপে, সৎ ও মহত হৃদয়ের অধিকারী, তারা পাত্তাই পেলেন না। কথায় বলে যত বড় শক্তিশালী, জ্ঞানী গুণী হোন না কেন, দশের কাছে আপনি নগণ্য। আপনার স্থান এখানে নয়, অন্যখানে, অন্য কোথাও। অন্যায়কে ন্যায় করতে হলে বর্তমানে হয় একশলা সিগারেট নতুবা এক কাপ চা-ই যথেষ্ট। সিগারেটের ক্রিয়া এক ঘণ্টা হলে চায়ের ক্ষেত্রে দ্বিগুণ। অর্থ হলেত কথাই নেই। যত বড় অপরাধ আর অপরাধী হোন না কেন এক পলকে মুক্তি। নেই অর্থ! আরে মশাই আপনার ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য নয়। করতালি পেতে হলে চাই একটু বন্ধুত্ব। বোধ হয় জানেন না, ”মধু থাকলে ভ্রমরের অভাব নেই”। পাছে পাছে গুণ গুণ গান কত মধুর। নি:শেষ হলে ছায়া দৃষ্টি গোচর মহাসমষ্যা। সুতরাং আমার বিচার ও তাই। মনকে শুধু প্রবোধ দিয়ে শান্ত হলাম।সুবিচার এক মাত্র খোদার কাছে, তিনিই অন্তর্যামী।
দূর সম্পর্কীয় এক ভদ্রলোক। ইয়া লম্বা দাঁড়ি। বয়স অনুমান পঞ্চাশের কাছাকাছি। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন। মনে হয় তিনির মত খোদা ভক্ত খুবই কম। কথায় কথায় ভাবুকতার রেশ। আমরা ৫ জন তরুণ, তারুণ্যের প্রতীক। একত্রে বসবাস করে আসছি দীর্ঘ একটি বছর। বাহির থেকে সহজে কেহ ধারণা করতে পারবে না ভিন্ন ভিন্ন পরিবার থেকে আগত। চাল-চলন, আচার-আচরণে আশপাশের সবাই অভিভূত “একটি বৃন্তে পাঁচটি ফুল“। যদি ও আমাদের প্রত্যেকে পৃথক বৈশিষ্ট্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। এখানে নেই জৌলুসটা, অহংকার ও আভিজাত্য। বেশ আনন্দঘন প্রতিটি ক্ষণ অতিবাহিত হয়। কিন্তু রফিক ছিল একটু চঞ্চলমতি, রসিক, একরোখা, বড় নীতি পরায়ণ, সদালাপি।আমি বরাবরই মিশুক স্বভাবের। প্রত্যেকের সাথে তাল মিলিয়ে, তার মনের অবস্থান, গতি বুঝে চলাফিরা করি যতটুকু সম্ভব। ঐ ভদ্রলোক পত্র লেখার উদ্দেশ্যে একদিন আমাদের বাসায় আগমন করেন। পরিচয় হয়, হৃদ্যতা গড়ে উঠে মোদের মাঝে। আসতেন ঘন ঘন। শোনাতেন অমোঘ বাণী, মিষ্টি কথার ফুল ঝুরি। রফিক ব্যতীত সকলেই তার অন্ধ ভক্ত। কিন্তু রফিক এমন ব্যবহার দিত যা ছিল স্বাভাবিক আসুন-বসুন। অতিরিক্ত ভক্তি, শ্রদ্ধা কোনটাই প্রশ্রয় দিত না তিনির বেলায়। এই হল কাল, অপরাধ। একদিন তিনি বলেই ফেললেন, ছেলেটার দেমাগ বেশী। আচ্ছা!
সেদিন থেকে তিনি ওর পেছনে যে লেগেছেন, তা যদি ও একটু আধটু অনুভব করেছিলাম। কিন্তু মনের দুর্বলতা বলে নিজে উড়িয়ে দিতাম। যেহেতু তিনি একজন বর্ষীয়ান, মুরবিব সমতুল্য। কিন্তু ভদ্রলোক নাছোড় বান্দা। তিনি পাড়া পড়শী ছেলে মেয়েদের ক্ষেপিয়ে তুললেন, রফিকের স্বভাব, চরিত্র সম্পর্কে। যার সংস্পর্শে রফিক কোন দিন যায়নি, ঘৃণা ছিল প্রচন্ড। সে সকল কলঙ্ক তার উপর রটানো হল। এমন কি আমাদের মধ্যে দু-দু‘টি দলে বিভক্ত করে ছাড়লেন। একদিকে আমি। অপর দিকে অন্য তিন জন। রফিক কিন্তু বেকায়দায় পড়ে গেছে। অনেক চেষ্টা করে ও কাউকে বুঝাতে পারি নি যে, এ হল প্রতিশোধের পালা, প্রতিহিংসার দাবানল। রফিক মনে করল তিন সদস্যের দলন্তর্ভুক্ত, ওরা বুঝে নিল বিপরীত। আমার প্রচেষ্টা হল অরণ্যে রোদন, মায়া কান্না। ঘটল বিস্ফোরণ। নিমেষে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল এত দিনের বন্ধুত্ব, মমত্ব, প্রীতি ও ভালবাসা। ছিটকে যে যেখানে সুবিধা পেল, সেখানেই আশ্রয়স্থল হল।এ সময় থেকে ভদ্রলোকের পাত্তাই নেই। হঠাৎ একদিন রাস্তায় সাক্ষাৎ জিজ্ঞেস করলাম, চাচা এ কি করলেন? উত্তরে উপহার পেলাম এক ঝলক হাসি। বললেন ছেলেটার দেমাগ দেখিয়ে দিলাম। আর কিছু নয়, অতি অল্প। আমি হতভম্ব। কোথায় আছি ? জীবিত না মৃত,চেতন না অচেতন অনুমানে আসছে না। আঁখিদ্বয় আপনা আপনি বুজে আসে। বাকশক্তি রহিত। দু‘ ঠোঁটে কালবৈশাখীর ঝড়। নীরবতা ব্যতীত আমি অগ্রসর হতে পারি নি ঘটনার আকস্মিকতায়। বুঝলাম যখন, তখন দু‘গন্ড বেয়ে তপ্ত অশ্রু বাহিত। চেয়ে দেখি তিনি অনেক দূর চলে গেছেন। আমার কথার সীমানা ছাড়িয়ে। কথায় না বলে, “অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ“। তা কিন্তু সহজে পরিচয় পাবেন না। কারণ বর্তমানে নিজকে চেনা বড় কঠিন। মানুষের মন মানসিকতা বুঝে উঠা মুশকিল। দীর্ঘ প্রচেষ্টা চালিয়ে পরবর্তীতে যে ফসল তুলে এনে ছিলাম। তা হল -ঘটনা সম্পর্কে প্রত্যেককেই সম্যক জ্ঞান দান, উপলব্ধি, আঁচ করতে সক্ষম হল। তখন কিন্তু নাগালের বাইরে
একত্রে বাস করা আমাদের পক্ষে দুষ্কর। আমরা সবাই তখন সাংসারিক। কাজের নিমিত্তে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে অবস্থানরত।
বাড়ী থেকে কলেজের দূরত্ব তখন ৯ মাইল। যোগাযোগের একমাত্র বাহন ট্রেন। যদি কোন ক্রমে ট্রেন ফেল হয় তখন শ্রীচরণের ভরসা। রীতিমত ট্রেন চড়েই লেখাপড়া করতে হয়। হয়ে গেলাম দৈনিক ট্রেন যাত্রী। সে দিন ট্রেনে বসে সিগারেট টানছি অন্যমনস্ক ভাবে। বিচিছন্ন চিন্তা জট পাকাচ্ছ। হঠাৎ কম্পার্টমেন্টে সোরগোল, লোকের চিৎকারে হক চকিয়ে গেলাম। ফিরে এলাম ভাবনা রাজ্য থেকে বাস্তব জগতের মোকাবিলা করতে। দামী চশমা , টাই, সুট-কোট পরা একজন লোককে অপদস্থ করার চেষ্টা চলছে। ঘটনা বুঝার ব্যাকুল আগ্রহ নিয়ে অগ্রসর হলাম কি হচেছ, কেন? পোষাকে মনে হচেছ শিক্ষিত, ভদ্র, খান্দানি বংশের লোক। ততক্ষণে পরিস্থিতি আয়ত্বে আনতে দু‘ব্যক্তি আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালিয়ে আয়ত্বে, নিয়ন্ত্রণে সক্ষমতা অর্জনে শুরু হল বিচার। ভদ্রলোক সীটে বসে পত্রিকা পড়ছেন। কিন্তু সীটের উপর পা তুলে ছড়িয়ে দিয়েছেন পার্শ্ববর্তী সীটে। বেশ আরামে বসেছেন অতিরিক্ত সিট দখলকারীর খাতায় নাম লিখে গৌরবান্বিত অহমিকায়। দ্বিতীয় ব্যক্তি সাধারণ শার্ট লুঙ্গি পরিহিত, নেই আভিজাত্য বা জৌলুসের চিহ্ন মাত্র। সারা কামরায় খালি সীট না পেয়ে অগ্রসর হন প্রথম ব্যক্তির ব্যক্তিগত কোর্টে। আসামী স্বরূপ হাজির হয়ে পা নামিয়ে বসার স্থান প্রদানের জন্য বার বার অনুরোধ করেন। আসামী এজন্য বলছি বর্তমানে আমাদের সামাজিক জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে হলে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার মন যুগিয়ে চলতে হবে, হচেছ। নতুবা রোষানলে পতিত হয়ে সারা জীবন ভর এর ভার সহ্য করতে হবে। তাই তো অনেক সময় অন্যায়কে চোখ বুজে মেনে নিতে হবে। যেহেতু “সুবচন নির্বাসনে“। প্রথম ব্যক্তি অনুরোধ উপেক্ষা করেন অবহেলা, অবজ্ঞায় “এটা দ্বিতীয় শ্রেণীর কামরা“ বলেই পত্রিকায় দৃষ্টিপাত। কিছুক্ষণ নীরবে দাড়িয়ে থেকে দ্বিতীয় ব্যক্তি আবারো অনুরোধ, মিনতি 'একটু জায়গা সাহেব, বড্ড ক্লান্ত।'
এবার কিন্তু বোমা ফাটলো। চোখ রাঙ্গিয়ে আগুনের স্ফুলিংগ বের করে প্রথম ব্যক্তি, “জায়গা, জায়গা“। বললাম না, এটা দ্বিতীয় শ্রেণীর কামরা। যান - তৃতীয় শ্রেণীর কামরায় প্রচুর জায়গা, ইচেছ করলে ঘুমিয়ে যেতে পারবেন। ওটা লাল টিকেটের গাড়ী। মান-সম্মান, মর্যাদা রক্ষা করা আপনাদের দৌরাত্ব্যে কঠিন। এখানে এসেও স্বস্থির নি:শ্বাসে বাধা। ট্রেনে ভ্রমণ আজ কাল বিপদজনক।
পার্শ্ববর্তী লোকজন আর ধৈর্য্য ধরতে পারলেন না। ধৈর্য্য, সহ্য জ্ঞান মানুষের মহৎ লক্ষণ। কিন্তু ধৈর্য্য এর সীমা আছে। যারা অতিরিক্ত ধৈর্য্যশীল, তারা ক্ষেপে গেলে লক্ষ্য থাকে সীমানার। সে সীমানা তখন হয়ে উঠে আগ্নেয়গিরির জ্বালা মুখ। গলিত ও উত্তপ্ত লাভা নির্গমণের পর স্বাভাবিক থাকে না। এখানে ও তদরুপ অবস্থার সৃষ্টি। বিশেষ করে একজন কলেজ পডুয়া ছাত্র অগ্রণী ভূমিকার স্রষ্টা রূপে কাজ করে। যাকে সহপাঠীরা নিরীহ, সহজ, সরল ও নিয়মতান্ত্রিকতার বাহক হিসাবে “ভাবুক“ বলে ডাকত। ছাত্রটি যখন হুংকার ছেড়ে গর্জে উঠে। এমনি সীট থেকে পা নেমে যায়। পরবর্তীতে ক্ষমা প্রার্থনা নি:শর্ত ভাবে। দ্বিতীয় ব্যক্তি বি.এ পাশ শিক্ষকতার মহান পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তি। তিনিই শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সহযোগি ব্যক্তি, দ্বিতীয় শ্রেণীর টিকেটধারী।
অসংখ্য তারকারাজি আকাশে উদিত আলো বিতরণের প্রত্যাশায়। কিন্তু চন্দ্রলোকের কাছে পরাজিত হয়ে মিটমিটে। তথাপি দৃষ্টি গোচরীভূত হতে পারে ক্ষীণ ও ম্রিয়মাণ। এক্ষেত্রে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, অতি দূরত্ব এদের কৈফিয়ত। তবু ও দু‘একটি আলোকবর্তিকার সফল উজ্জ্বল তারকা। আর অবশিষ্টগুলি ক্ষুদ্র বলে নীরব প্রতিবাদের ঝড় তুলে অনেক দুর থেকে বিদায় নেয়। ওদের হিসাব ক‘জন রাখারাখির প্রয়োজন বোধহয় নেই। তাই অভিমানে কিছু বলতে পারে না। শুধু চায় কর্তব্য জ্ঞান ও মূল্যবোধের পরিচয়। এক্ষেত্রে প্রতিরোধ কি সম্ভব ? হ্যাঁ অসম্ভব, যদি মেঘ এসে ঢ়েকে ফেলে, সারা আকাশে বিস্তৃতি লাভ করে। প্রশ্নগুলি আমাকে লক্ষ্য করেই। চার চোখের মিলন বেলা দেখলাম অশ্রু ভারাক্রান্ত। জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কাঁদছ ? অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। কাঁদব কেন? কাঁদতে যে আমরা জানি না। হাসি কান্নার সংজ্ঞা অজ্ঞাত। শিখিনি, শিখতে পারিনি। বিমান বন্দরে সে দিন দেখলাম। পিতামাতা দীর্ঘ প্রবাস থেকে আগত ছেলের গলায় ধরে অঝোর কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছেন। তাদের কান্নায় যোগ দিয়ে ছেলেটি ও ঐ পথের যাত্রী হয়ে গেল। অপর পিতামাতা মৃত ছেলেকে কোলে নিয়ে কাঁদছেন। বলুন তো কোনটি হাসি, কোনটি কান্না? কিন্তু সারগর্ভে ভিন্নতা। কেউ স্বাগতম জানিয়ে, কেউ বিদায় সম্ভাষণের মাধ্যমে। তবে এটা চির বিদায়। জবাব দিন-কণ্ঠে উত্তেজনার রেশ।
হৃদয়ে একটা তুমুল ঝড় বয়ে গেল। দু‘ঠোট কেঁপে উঠলো। কিন্তু অদৃশ্য হাতের ছোঁয়ায় র‘ল অপ্রকাশিত। অনুভব করলাম আমার নয়ন কোনে পানি জমে আসছে। তাড়াতাড়ি পকেট থেকে রুমাল বের করে মুছে নিলাম। একটু পূর্বে না ওকে বলেছি “তুমি কাঁদছ“? লক্ষ্য করলাম রহিম আমার জবাবের তোয়াক্কা করছে না, বোধ হয় অভিমানে। সমস্ত জ্বালা বুকের ভিতর রেখে খুব টেনে টেনে কথা বলছে। “ছাত্র জীবন সুখের জীবন, যদি না হয় এক্জামিনেশন“ প্রথম জীবনে উহাকে গুরুত্ব দিতাম অধিক, ভাবতাম চিরন্তন সত্য। কিন্তু সে দিন থেকে মোর মনে হল, অনুভব করলাম পদে পদে “ছাত্র জীবন সুখের জীবন, বিত্তবান যদি হন“। কারণ স্কুলে গিয়েছি - শিক্ষক মহাশয় ক্লাস নিচেছন, তিনি এত সুন্দর করে পড়াতেন, বাড়ীতে পড়ার কোন প্রয়োজন হত না। ক্লাসেই বসে রপ্ত হত। কিন্তু দু‘দিনের অনাহারী, পেঠে আগুন জ্বলছে দাউ দাউ করে। বলুন- কেমন করে মনোযোগী হলাম? অমনোযোগীর অপরাধে শিক্ষক তৎক্ষণাৎ উপহার দিলেন দু‘গন্ডা বেত্রাঘাত। জ্বি-না কাঁটা গায়ে লবণ ছিটা নয় বিমূর্ত প্রতীক। শিক্ষককে অপরাধী সাব্যস্ত করছি না। তিনি তো আর জ্যোতিষ নন।
একদিন এক শিক্ষক বলে ছিলেন, “লেখাপড়া বক ধ্যান“। অন্বেষণ কর, ধ্যানে নিমগ্ন থেকো। সাফল্যের চরম শিখরে আরোহণ জলবৎ তরল। তিন দিনের উপবাসান্তে ঔষধ বিহীন ছোট বোন শিরিন যখন পরপারে পাড়ি জমাল, বক ধ্যান করেছি সত্য। কিন্তু লেখাপড়ায় নয়। জটের জ্বালায় অজ্ঞান হয়ে। ভাল ছাত্র ছিলাম। আশায় বুক বেঁধে তরণী ভাসালাম সাগরে। মাঝি হলাম, তবে বৈঠা বিহীন। ওপারে পৌছা হাস্যস্পদ নয় কি? তথাপি অন্ধের পথ চলার মত। সবাই যখন পঞ্চমুখ, চলে যাচেছ ঐ ঐ। অন্ধ ব্যক্তি ও সমস্বরে বলছে, জিজ্ঞেস করলে প্রতি উত্তরে, তোমরা না সবাই বলছো। আমি বললে অপরাধী।
আপনাদের সমাজ আমাকে এমন ভাবে বেঁধেছে। অদৃশ্য রশি পায়ে দিয়েছেন পরিয়ে আদর করে। সমাজ যতটুকু দেয় ততটুকুই। এক পা সামনে এগুলে টান পড়ে, মুখ থুবড়ে পড়ে যাই। রক্তক্ষরণ, ধুয়ে-মুছে শেষ। টেবলেটের প্রয়োজন আমাদের নেই।
তা নয় কি? জবাবের আশায় ধাক্কা মারে।
থতমতিয়ে উঠলাম। চৈতন্যোদয় হল। উত্তর কি দেব ভেবে পাইনি। সান্ত্বনার আশায় মুখে শুধু বললাম “তোমার প্রতিটি কথা অবশ্য আমি একাগ্রতায় শুনছি“। বলুন-তারপর জবাব পাব না আমি জানি। তবু ও বলবো যখন নদী প্রবাহিত। নদীর চলার পথে স্বল্প বাঁধ আটকিয়ে রাখতে পারে না। ভেঙ্গে অথবা একটু সুযোগ পেলে প্রবাহমান উচলিয়ে পড়ে। মানুষ যখন দু:খ বা আঘাত পায় ,তখন অন্যের কাছে বলে এবং সান্ত্বনার আশ্রয় খোঁজে। যদি ও ঐ ব্যক্তি তা দুর করতে বা লাঘব করতে অক্ষম।
উপবাস অবস্থায় প্রায়ই থাকতে হত। জাঁক-জমক ব্যতীত সাধারণ পোষাক পরা ছিল ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। মনে পড়ে শেখ সাদী (র:) ‘র পোষাককে আহার করানোর ঘটনা। জ্ঞানী, গুণী আর বুদ্ধিমান যতই থাকুন না কেন? আমরা যে শেখ সাদীর (র:) মূল্য, কদর বুঝি না। তবে হ্যাঁ, বুঝি তিনির পোষাকের। অতএব সহজেই অনুমেয় আমার মত শত শত অভাগার কথা। অবস্থার করুণ দৃশ্য। বেতনের চাপে কলেজের রোলকল বন্ধ হবার ঘটনা নতুন নয়, অনেক অনেক পুরাতন। মনের দৃঢ়তা, সাহস, জ্ঞানার্জনের অদম্য স্পৃহায় আকৃষ্ট হয়ে কোন রকমে ঠিকে থাকলাম, নৌকার হাল ধরলাম। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলাম। কিন্তু থমকে থমকে, খুড়িয়ে খুড়িয়ে চললাম।
”আগাছা সমুলে উৎপাটন বুদ্ধিমানের কাজ” এ নীতিতে বিশ্বাসী হয়ে আমার পিছনে কম করেন নি। যদি প্রকৃত জ্ঞানার্জন করে,“এক যে ছিল হিকমত আলী“ গল্পের হিকমত হয়ে যাই, আপনাদের কর্মকান্ড জেনে নেই। সুতরাং হিকমত যাতে অগ্রসর হতে না পারে, সে জন্য নির্বাসন দিলেন।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবার শুরু করে। গলা ধরে এসেছে। তথাপি রাজ্যের বেদনা যেন জমাট বেঁধে আছে। তা থেকে রেহাই পেতে চায়। উজ্জ্বল ভবিষ্যতের অলীক কল্পনায় আরো দশ জনের অনুসারী হয়ে আদম বেপারীর শরণাপন্ন হলাম। ইচছা, দারুণ ইচ্ছা। প্রবাসে যাব, টাকা আসবে ইত্যাদি।
এক্ষেত্রে ও স্বাভাবিকতা নিয়ে নয় দুরু দুরু বক্ষে। অর্থাৎ অবৈধ ভাবে। এ ছাড়া পথ ছিল না মোর সম্মুখে। আরেকটু পরিষ্কার হবে আপনাদের কাছে - এক দিন গ্রামের এক লোক কথাচ্ছলে বলছে। এবার বাদশা মিয়া বল্ডারে অনেক লোক সৌদি আরব পাঠাচেছ। লোকটির কথা সঠিক ভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে পারি নি, হেড কোয়ার্টারে ঢুকে নাই। তবে হ্যাঁ, অনেকক্ষণ পরে বুঝলাম এর কথা। এটা হল ওমরাহ্ বা হজ্জ্ব ভিসার মাধ্যমে রোজগার করার অভিনব পন্থা অবলম্বন। আমি ও বর্তমানে ঐ পথের পথিক হয়ে গেলাম। রহিম নামের পরিবর্তে মছদ্দর আলী। আমি “জেনে শুনে বিষ করেছি পান“এর মত। প্রবাসে কতটুকু সান্ত্বনা বা সফলতা আসবে তা এক মাত্র ললাট লিখক বা ভাগ্য নিয়ন্তা জ্ঞাত।
অলক্ষ্মী
অপর্ণা চক্রবর্তী
কলকাতা
চোদ্দবছর বয়সে প্রথম জেনেছিলাম - আমার জন্মের খবর পেয়ে ঠাম্মা মাথায় হাত দিয়ে বারান্দায় বসে পড়েছিল। আমি, বাবা মার দ্বিতীয় কন্যা সন্তান। এই ঘটনার ঠিক দেড় বছর পর আমার ভাইয়ের জন্ম হয়।
ঠাম্মা আমাকে সারাজীবন 'লক্ষ্মীছাড়ী' বলেই ডাকতো। ছোটবেলাতেই বুঝে গিয়েছিলাম বাড়ীতে আমার আর দিদির জন্য এক রকম ব্যবস্থা, আর ভাইয়ের জন্য অন্যরকম। পুজোয় ভাইয়ের জন্য চারটে জামা; আমার-দিদির একটা একটা। ভাইয়ের টিফিনবক্সে আপেল-কলা-মিষ্টি। আমার-দিদির যা হোক কিছু। এসব কড়া নিয়মের বাইরে বেরোনোর ক্ষমতা আমার মায়ের ছিলনা। দিদিও কখনো নিয়ম ভাঙার চেষ্টা করেনি। কিন্তু আমাকে বারবার ঠাম্মার কাছে শুনতে হয়েছে - "এ মেয়ের বড় নোলা, ভীষণ লোভ, এক্কেবারে অলক্ষ্মী এসেচে কোথা থেকে।" তবুও আমার বায়নার অন্ত ছিলনা। মা মাঝে মাঝেই আমার বায়না মেটাতে, সবাই কে লুকিয়ে পয়সা দিত। দিদিকে কখনো কিছু চাইতে দেখিনি।
আমি তখন ক্লাস সিক্স-এ। স্কুল থেকে ফিরে দেখি মা'র মুখ থমথমে। কিছু একটা হয়েছে আন্দাজ করতে পারছি। সন্ধ্যেবেলা পড়তে বসে দিদি বলল- "তুই মা কে এত বিপদে ফেলিস কেন? আজ ঠাম্মা দেখেছে, মার থেকে লুকিয়ে পয়সা নিচ্ছিস।" আমার থেকে সাড়ে তিন বছরের বড় দিদি সেদিন আমাকে বুঝিয়ে ছিল এ'বাড়ীতে মেয়েদের কি কি করতে নেই।মেয়েদের মুখফুটে কিচ্ছু চাইতে নেই; বেশী কথা বলতে নেই; লাফাতে নেই; দৌড়াতে নেই। মেয়েদের চিৎকার করতে নেই; ঘুড়ি ওড়াতে নেই; গুলি খেলতে নেই; পা ছড়িয়ে বসতে নেই; হা হা করে হাসতে নেই, সব সময় খাই খাই করতে নেই।
অবাক হয়ে সেদিন আমি ..."নেই"-য়ের ফর্দ শুনেছিলাম। দিদিকে খুব বেশীদিন এত 'নেই' মানতে হয়নি। আমার রোগা ভোগা দিদিটা বিয়ের ধকল সামলাতে পারেনি। বিয়ের দু'বছর পর, মাত্র বাইশে, শ্বশুরবাড়ীতেই মারা যায়।
সেদিন প্রথম আমার মা, সারাদিন বিছানায় শুয়ে ছিল। ঠাকুমা, ভাই আর বাবার মানবিকতা বোধকে, সেই একদিনের জন্য কিছুটা জাগ্রত অবস্থায় দেখেছিলাম। সারাদিন কেউ মাকে কোনো ফরমাইশ করেনি।সত্যি বলব- এত দুঃখের দিনেও, সেদিন আমার ভালো লাগছিল; একটাই কথা ভেবে- আমার কাকভোরে ওঠা মা, এই সুযোগে, একটা পূর্ণ দিনের বিশ্রাম তো পেল!! কলেজে এক অধ্যাপক, ফাঁকা ক্লাসরুমে আমার এক বান্ধবীর হাত চেপে ধরেছিল। ব্যাপারটা প্রিন্সিপল্ কে জানাতে গেলাম। তিনি বললেন- "গার্লস কলেজে ওসব হয়েই থাকে। এ'নিয়ে বেশী সোরগোল করো না। আমি দেখছি কি ব্যবস্থা নেওয়া যায়।" তিনি যে কি ব্যবস্থা নিয়ে ছিলেন আজও জানতে পারিনি।
কিন্তু, আমার ভাই ব্যাপারটা কোনো ভাবে জেনে, আমাকে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল। বাবার সামনে দাঁড়িয়ে সে সোজা ভাষায় আমাকে বলল- "তোর আর সেজেগুজে কলেজ যাবার দরকার নেই। বাড়িতে পড়ে পরীক্ষা দে।" আমি তো দিদির মত লক্ষ্মী মেয়ে নই, তাই অন্যের করে দেওয়া ব্যবস্থা, আমার পক্ষে মানা সম্ভব হয়নি।
আমার 'মেয়েবেলার', আর এক দিনের কথা খুব মনে পরে। বাড়ীতে কি একটা পুজো ছিল। দিদি মাকে রান্নাঘরে সাহায্য করছে। ঠাম্মা আমাকে ঠাকুরঘরে নিয়ে গিয়ে প্রসাদ, ঘট, ফুল বেলপাতা সাজানোর প্রশিক্ষণ দিচ্ছে।
পুজোর জোগাড় শেষ হল, আমার শিক্ষা সম্পূর্ণ হল। কিন্তু, আমার চোখ তখনো আটকে আছে, নারায়ণের জন্য সাজানো প্রসাদী নৈবেদ্যর থালায়। নৈবেদ্যর চূড়ায় চূড়ামণি হয়ে বসে আছে, বেশ বড় সাইজের একটা নলেনগুড়ের সন্দেশ।
যথা সময়ে পুজো শেষ হল। মা প্রসাদ ভাগ করার তোরজোড় করছে। হঠাৎ! সবকিছু সরিয়ে, সবাইকে অবাক করে দিয়ে, আমি - সেই মহার্ঘ্য সন্দেশ, ছোঁ'মেরে তুলে নিয়ে, মুখে পুড়ে দিলাম। মুখভর্তি সুস্বাদে আমি তখন অভিভূত।
হুঁশ ফিরল, যখন সন্দেশ ভরা গালে মায়ের প্রচন্ড এক চড় এসে পড়লো।
ঠাকুমার প্রভূত গালিগালাজ থেকে বুঝলাম- নৈবেদ্য যতই আমার সাজানো হোক; সেই প্রসাদের সিংহভাগের অধিকারী বাড়ীর পুরুষ সদস্যরা।
দু'গালে মায়ের পাঁচ আঙুলের দাগ নিয়ে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি। অনেক রাতে মায়ের ছোঁয়ায় ঘুম ভাঙলো। অভিমানে- রাগে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে রইলাম। কিন্তু, আমার চুলে হাত বুলাতে বুলাতে, মায়ের অসহায় কান্না, কোনোদিন ভুলতে পারি নি।
"মরার সময় ছেলের হাতের জল না পেলে স্বর্গবাস হয় না।" ঠাম্মার এই কথাটা বাবা মনে প্রাণে বিশ্বাস করতো। ভাই ছিল আমার বাবার সেই স্বর্গবাসের ইনভেস্টমেন্ট।
আমার ভাই, বর্তমানে ব্যাঙ্গালোরের এক বহুজাতিক সংস্থায় কর্মরত এবং বিবাহিত। তার অবাঙালী পরিবারকে নিয়ে সেখানেই নিরাপদ জীবন যাপন করছে। এ'শহরে খুব একটা আসার দরকার পড়ে না। এলেও অফিসের ভি.ই.পি গেস্টহাউজে থাকে। পূর্ব- দক্ষিণ খোলা বিশাল ফ্ল্যাটের অভ্যস্থ জীবন; এ'বাড়ীর স্যাঁতস্যাতে দেওয়ালে ওদের কষ্ট হয়। বাবা মারা গেছেন প্রায় দু'বছর হল। প্রভিডেন্ট ফান্ডের ষাট শতাংশ ছেলের ক্যারিয়ারে খরচ করেছেন। ইনভেস্টমেন্টের পুরোটাই যে জলে গেছে সেটা মৃত্যুর দিনেও বিশ্বাস করেতে পারেন নি।
ঠাকুমার প্রায় চুরাশী চলছে। বৃদ্ধার আর ছেলের হাতের জল পাওয়া হলনা। আমার ছাত্র পড়ানো আর স্কুলে চাকরীর টাকায়, সংসারটা কোনো মতে দাঁড়িয়ে আছে।
সেদিন সবে বাড়ীর দরজায় পা রেখেছি। মা ছুটে এল- "তাড়াতাড়ি আয়। সকাল থেকে কিচ্ছু খাচ্ছে না। বারবার তোকে খুঁজছে।"
ঘরে ঢুকে বৃদ্ধার মাথার কাছে বসলাম। মনে হল আমাকে দেখে, একটু যেন হাসলো। আমার হাতে ধরা দুধের গ্লাস থেকে দু'চুমুক মুখে দিয়েই, আবার ক্লান্তিতে মাথাটা বিছানায় এলিয়ে দিল। ইশারায় আমাকে কাছে ডাকলো। আমি মুখটা নামিয়ে আনলাম মুখের কাছে। খুব আস্তে, প্রায় নিভে যাওয়া কন্ঠে ঠাম্মা বলল - "লক্ষ্মীছাড়ী বিয়ে কোরিস; তোর মেয়ে হতে ইচ্ছা হয়। বুড়িটাকে ক্ষমা করে দিস।"
মা আর আমি সেদিন সারারাত জেগে বসে রইলাম। সারারাত ঠাম্মার বন্ধচোখ থেকে গড়িয়ে পড়া জল মুছলাম। এত দিন পরে বৃদ্ধার কাছে আমার 'অলক্ষ্মী' জন্ম সার্থক হয়েছে ।
অজান্তেই
কৃষ্ণতরু বর্মন
ডালাস, টেক্সাস
সময় চলে যায়। রেখে যায় একমুঠো স্মৃতি। আর আমরা সবাই এই মুঠোর মধ্যেই খুবই সযত্নে, আলগোছে বাঁচিয়ে রাখি ফেলে আসা সময়ের চেনা সেই বিক্ষিপ্ত মূহুর্তগুলো, যা ফিকে হতে হতে এখনও বিলীন হয়ে যায় নি সময়ের এই চোরাস্রোতে। আর মনের ক্যানভাসে ভেসে আসা এই প্রত্যেকটি অবয়বের আড়ালেই কিন্তু থেকে যায় এক টুকরো ঘটনা, যা হঠাৎই মনের তীরে চলে আসে কোন এক ঢেউএর অযাচিত ঝাপটায়।
স্কুল জীবনের নানা ছোট-বড় ঘটনার সাক্ষী আমরা সবাই। হয়ত কিছুটা কম কিম্বা বেশী। আর সবচেয়ে বড় মজার ব্যাপার হল যে, এই ঘটনাগুলোর মধ্যে তেমন একটা নতুনত্ব কিছু নেই। বন্ধু মহলে যখন স্কুল কলেজের নানা পুরোনো প্রসঙ্গ উঠে আসে, নানা মজার ঘটনার মোড়কে ফেলে আসা সময়কে সাময়িকভাবে কাছে টানলেও বাস্তবিকভাবে তোমার আমার ঘটনায় খুব বেশী ফারাক থাকে না। আমার ঝুলিতে এমন কিছু থাকে না, যা তোমার থেকে আলাদা। তাই আলাদা করে স্কুল কলেজের প্রসঙ্গ আর নাই বা টানলাম। তবে একটা ছোট্ট উপলব্ধি যা আজও ভাবায়, হতেই পারে এটাই একমাত্র ব্যাতিক্রম।
পড়তাম বড়িষায়, বেহালা অঞ্চলের বেশ পুরোনো স্কুল। শুরুটা প্রাইমারীতে বাবার সাইকেলে চেপে ভোরের স্কুল। বেশ কষ্ট হত বিশেষ করে শীতকালে, ভালই ঠান্ডা পড়ত সেই সময়। তারপর একটু লায়েক হতেই হাই স্কুল, পিঠে ব্যাগ চাপিয়ে সাতাত্তর নম্বর বাস। বেশ কয়েকটা বছর কেটেছে ঐ স্কুলের ধুলো বালি গায়ে মেখে আর কাঠের শক্ত বেঞ্চিতে। আর পড়া না পারলে সে আর এক মজা। শাস্তি স্বরূপ বেঞ্চির ওপর দাঁড়ালেই বাইরের জগতটা চোখের সামনে আরও পরিস্কার। সেই চেনা সবুজ মাঠ, ঘাসের ফাঁকে ফাঁকে কয়েক পশলা বৃষ্টির জল, আর তাতে কিছু বোকা বকেদের সতর্কিত পদক্ষেপ। অদূরে পাঁচিলের ওপারে ব্যস্ত শহর। হাজার স্মৃতির ভীড়ে চেনা অচেনা কিছু বন্ধু বান্ধব, কিছু টুকরো টুকরো ঝরে পড়া কথা, কিছু সংলাপ বয়ে চলে নাটকের মত। মান-অভিমানের অকারণ ক্ষুদ্র হিসাব নিকাশ সময়ের কালে কালে ক্যানভাস থেকে যা আজ সবই প্রায় বিলুপ্ত।
প্রসঙ্গে ফিরে আসি। বাংলা পড়াতেন স্যার। একটু রোগা, ছিপছিপে চেহারার মানুষ। পড়তেন ধুতির সাথে অতি সাধারণ মানের পাঞ্জাবি। পায়ে সেকেলে আমলের সস্তার জুতো। খুবই স্বাভাবিক, কারণ তখনকার দিনে শিক্ষকরা খুব বেশী যে মাইনে পেতেন তা কিন্তু নয়। ক্লাসে ওনার খুব প্রিয় ছাত্রদের মধ্যে আমি পড়তাম না, আবার খুব যে অপছন্দ করতেন তাও নয়। তবে একদিনের একটা ঘটনার কথা বলি। তখন বোধহয় আমি ক্লাস সিক্সে। কোন একটা কারণে স্যারের মনটা হয়ত ভাল ছিল না। ক্লাস চলাকালীন অতি সামান্য কথায় স্যার আমাকে শরৎবাবুর
‘বহুরূপী’ গল্পের রামকমলের মত ভাল করে তুলোধুনে দিলেন। অথচ আজও আমার কারণটা অজানা। তফাৎ শুধু একটাই। শরৎবাবুর গল্পে কয়েকজন পেয়াদা মিলে রামকমলবাবুর শোচনীয় দশা করে ছেড়েছিল, আর বাস্তবে মানে আমার ক্ষেত্রে স্যার ছিলেন একাই একশো। পরে টিচার্স রুমে ডেকে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেও ব্যথা তাতে বিন্দুমাত্র কমে ছিল বলে তো মনে পড়ে না। কোন এক বন্ধু মারফত খবরটা পেয়েছিলাম। অমল স্যার অসুস্থ। খুবই সাধারণ ঘটনা। স্কুল ছেড়েছি বহু বছর আগে। কর্মসুত্রে দেশের বাইরে আরো বেশ কয়েক বছর। সত্যি বলতে কি - ‘ও তাই নাকি? কেন কি হয়েছে?’ ব্যাস ওইটুকুই। কর্তব্য শেষ। আবার হাজার কথার ধাঁধায় হারিয়ে গেছি। মনে রাখিনি। সময় অনেক কিছুই শেখায়, ভোলায়। তাই আবার মানুষ নতুন করে বাঁচতে পারে, নতুন স্বপ্ন দেখতে পারে। সময়ের চোরা স্রোতে অনেক কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি আমরা সবাই, কম বেশী। জলের ধাক্কা খেতে খেতে কখনো সখনো কাদা মাটিও পাথরে পরিণত হয় মনটাও খানিকটা তাই। তাই সাময়িক কিছু আবেগ আর সেন্টিমেন্টের ধুলো গা থেকে ঝেড়ে ফেলতে আর কতক্ষণ। কিন্তু কেন জানিনা সাতপাঁচ না ভেবেই একদিন হঠাৎই চলে গেলাম অমল স্যারের বাড়ি । হয়ত না গেলেই ভাল করতাম। বকুলতলার ঠিক মোড়েই বাড়িটা। সরসুনার যাবার রাস্তায় একটু ঢুকেই বাঁ দিকে। একটু জীর্ণ, অযত্নের ছাপ বাড়ির চারপাশ ঘিরে। হয়ত যত্নটা বেশি জরুরী বাড়ির ভিতরের মানুষটার। বহু যুগ বাদে উনি চিনতে পারবেন তো! যাওয়াটা কি ঠিক হচ্ছে, কি বা ভাববেন। তাই একটু দ্বিধা নিয়েই দরজাতে টোকা। শরীর ভাঙলেও আমার চিনতে কিন্তু কোন অসুবিধা হয় নি স্যারকে । আর উনি যে
আমায় চিনবেন না, সেটা আমি আগে থেকেই জানতাম। একটু অবাক হয়ে ঝাপসা চোখে বললেন - ‘কে’?
ছোট্ট একটা ঘর। সামনে এক ফালি বারান্দা। পাশে এক টুকরো জমিতে কিছু মরা ঘাস, ধুলো আর অযত্নের ফুল গাছ। ঘরের এক কোনে বিছানা। পাশের ছোট্ট টেবিলে ওষুধের খোলা বাক্স। আধো-আলো অন্ধকারে ঘরটা বড়ই অগোছালো। দ্বিতীয় কেউ থাকেন বলে তো মনে হল না। রাস্তার দিকের জানলাটা পাকাপাকি বন্ধ। মাথার কাছে জানলার ভাঙ্গা পাল্লা দিয়ে পর্দা উড়িয়ে বিকেলের আলতো হাওয়া। সিলিং ফ্যানটা ঘুরতে হয় তাই ঘুরছে। স্যার আমাকে ভাল করে দেখলেন। বুঝলাম ওনার চোখের ভাষায় তখন হাজার জিজ্ঞাসা। একটা টুল এগিয়ে দিয়ে নিজের মনে বললেন - ‘কেউ তো আর আসে না রে… যতদিন চাকরী করতাম… পড়াতাম... বাকি কথা আর শোনা গেল না। রুগ্ন শরীরটা নিয়ে বিছানায় বসলেন। ভাবলাম অনেক গল্প করব। কিন্তু হল না। স্কুল জীবনের অনেক কথাই মনে করতে পারলেন না। ছোট্ট এই ঘরটা ঘিরে কি রকম এক দুঃসহ নীরবতা। যেটুকু কথা হয়ত এখনও বেঁচে তার শীতলতা অত্যন্ত গভীরে, অতলে। সঙ্গে কেউ না থাকলে মানুষ বোধহয় কথা বলার অভ্যাসটাও হারিয়ে ফেলে। ঘরের অন্ধকারে হয়ত মন শীতল হয়, কিন্তু এই নিঃস্তব্ধতা! যা মানুষকে কুড়ে কুড়ে শেষ করে। হাঁপিয়ে উঠলাম। তাকালাম স্যারের দিকে। রুগ্ন, জীর্ণ শরীরের এক অব্যাক্ত যন্ত্রনা তার শান্ত চোখের প্রতিটি ইশারায়। এখনও হয়ত ভেবে চলেছেন কে এই ছেলেটি, কোন ব্যাচ, কোন সাল, কেনই বা এল? কি দরকার ছিল? চোখ তুলে বললেন - ‘শরীরটা ভাল নেই বুঝলি, সারাদিন তো প্রায় শুয়েই থাকি।’ অতি সামান্য, অতি সাধারণ আরো কিছু কথা - ‘কোথায় আছিস, কি করছিস।’ বললাম, বিনিময়ে কিছু পেলাম না, এক অভিব্যাক্তিহীন নিস্ফল চাহনি ছাড়া। পাথর চোখের দৃষ্টিতে বললেন - ভাল। ব্যাস ওইটুকুই তারপর আবার চুপচাপ। বেশীক্ষণ বসি নি। বসে থাকতে পারি নি। আর ঐ শীর্ণ হাতের চায়ের অফার ছেড়ে দিয়েছি অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে। উনি আর কিছু বলেন নি।
দরজা পর্যন্ত এলেন । মাথায় হাত রেখে বললেন - ‘এলি ভাল লাগল। ভাল থাকিস।’ কোনও কথা বলতে পারিনি। কেন জানি না। প্রণাম সেরে সোজা রাস্তায়। তাকিয়ে ছিলেন যতদূর দেখা যায়। দূর থেকে হাত নেড়ে রাস্তার হাজার মানুষের ভীড়ে আমিও মিশে গেলাম নিমেষে।
ফেরার পথে স্কুলে থামতে হল। স্কুলের পরিকাঠামোগত পরিবর্তন বাইরে থেকেই নজরে পড়ে। ভিতরে না ঢুকলে আসল পরিবর্তনটা বোঝা যায় না। শিক্ষকমহলে এখন তারুণ্যের জোয়ার। আমাদের সময় যারা ছিলেন তারা আর কেউ নেই। অনেকে মারাও গেছেন। আলাপ হল এই তরুন শিক্ষকদের সঙ্গে। প্রাক্তন বলাতে এল চায়ের অফার। এক ম্যাথের টিচারকে বললাম - ‘একটা ক্লাস রুমে যেতে চাই, অনুমতি দেবেন’? ভদ্রলোক বিনয়ের সঙ্গে বলে উঠলেন - নিশ্চয়ই। আমিই নিয়ে যাচ্ছি আপনাকে।’ টিচার্স রুম থেকে বেরিয়ে একটু সোজা গেলেই একটা ছোট্ট ক্লাস রুম। ঐ ক্লাসেই পড়াতেন স্যার। ভদ্রলোককে বললাম - ‘রুমটা আমি চিনি, আপনি ব্যস্ত হবেন না।’ সেই বেঞ্চ, ব্ল্যাক বোর্ড, বাতাসে চকের গুড়ো, জানলার ওপারে খেলার মাঠ সবই আছে। শুধু চলে গেছে সময় আর আমরা, এই মানুষগুলো। সময় আর জায়গা ছেড়ে দিতে হয়। এটাই জীবনের নিয়ম। বেঞ্চএ গিয়ে বসলাম। কে বলে আমরা সব ভুলে যাই! কই আমি তো কিছুই ভুলিনি। একটা একটা করে মনে পড়ছে সব কথা। মনের ক্যানভাসে আবার স্পষ্ট হয়ে উঠছে সেই ভুলে যাওয়া মুখগুলো। দেবাশীষ, অভিক, চম্পক, দিব্যেন্দু, রূপম, পবিত্র আছি, আমরা সবাই আছে। আর ওই তো সামনেই চেয়ারে বসে বাংলা শিক্ষক আমাদের অমল স্যার। সামনে খোলা বাংলা কবিতা। কিছু বলিনি, কথা বলছিলাম নিজের সাথেই। চোখে চোক পড়তেই দেখলাম ভদ্রলোক একটু অবাক। হেসে বললাম - ‘চলুন আর দেরী করাবো না’।
স্যারের বাড়ি থেকে বেড়নোর সময় উনি কিন্তু একবার ও বলেন নি যে আবার আসিস। কলকাতার ছাড়ার কয়েকমাস পরেই হঠাৎই সেই বন্ধুটির এস এম এস। স্যার আর নেই। আমার মনে হল উনি জানতেন তাই আর আমায় আর আসতে বলেন নি।
(এটি একটি অনুগল্প হলেও বছর দশেক আগে স্যারের সঙ্গে শেষ দেখাটা আজও আমাকে ভাবায়। প্রতিটি মূহূর্ত অনুভব করি আজও। তবে পাঠকেরা দয়া করে আজ কেন এটা লিখতে বসলাম জিজ্ঞাসা করবেন না। কারণ উত্তরটা আমার জানা নেই)।
দুর্গাবাড়ি
আইভি চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা
সকালে এ বাড়ির কাজে এসেই বুঝতে পেরেছে, একটা কিছু হয়েছে। হাওয়া চলছে না, গুমোট। দাদা জলখাবার না খেয়েই বেরিয়ে গেল, বৌদিও বোধহয় অফিস যাবে না। মোবাইল হাতে বিছানায় শুয়ে পড়ল। সর্বক্ষণ মোবাইল নিয়ে কি করে কে জানে। একমাত্র মেয়ে কলেজের পড়া করতে বাইরে গেছে, এখানে সংসারে মিয়া-বিবি দুজনে মিলে একা। সে এখানে বলে নয়, পাড়ার সব বাড়িতেই এমন। হয় পড়া নিয়ে, নয় চাকরি নিয়ে ছেলেমেয়েরা সব বাইরে বাইরে। বাড়ি বলতে শুধু বুড়ো-বুড়ি। এরা অবশ্য বুড়ো-বুড়ি নয়, দুজনেই চাকরি করে। মেয়েটা এই দু’বছর হল পড়তে গেছে।
বৌদি মোবাইলে কথা বলছে, গলার আওয়াজে বেশ ঝাঁঝ। দাদার সঙ্গে ঝগড়া করছে বোধহয়। রাস্তাঘাটে কত ভিড়, গাড়ি চালাতে চালাতে কথা বলাই ঠিক নয়, আর ঝগড়া করছে বৌদি? বলব না ভেবেও ডেকেই ফেলল দুর্গা, ‘অ বৌদি, দাদা বাড়ি ফিরলে এসব কথা বোলো গো। ব্যাটাছেলে মানুষ, এমনিই মাথা গরম.. তার ওপর রাস্তাঘাটের আজকাল যা অবস্থা..’
‘তুই নিজের কাজ কর, আমার মাথাটাও কম গরম নয়। মাথা গরম দেখাচ্ছে..’ রাগ হলেও ফোন বন্ধ করেছে। একবার বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। আজ আকাশ মেঘলা, বাইরেটা নরম, সবুজ সবুজ। রাতে বৃষ্টি হয়েছিল, জলে ভিজে নিচের রাস্তাটাও মায়া মায়া শান্ত। তবু বোধহয় বৌদির মন শান্ত হল না। বাইরের ঘরের সোফায় বসল, আবার ঘরে গিয়ে ফোন হাতে খাটে শুয়ে পড়ল। খুব অস্থির।
‘না রে, আজ আসছি না’, অফিসে ফোন করছে, ‘আর বলিস না। আমার তো শান্তিতে থাকার উপায় নেই। জানিসই তো সব। পিতৃভক্ত ছেলে, বৌয়ের কথা সংসারের কথা ভাবে না।‘
কেন যে ঘরের কথা বলে এমন! যতই একসঙ্গে কাজ করো, কেউ বন্ধু নয়। বিয়ের পর বাপের ঘরে গিয়েও সব কথা বলতে নেই। আর এ তো বন্ধু। তোমার সোয়ামীকে নিয়ে কথা অন্যের কাছে বলবে কেন? বস্তীর ঘরে এমন হয়। তোমরা লেখাপড়া জানা মানুষ, কত বড় বড় চাকরি করছ, এটুকু বোঝো না?
‘শ্বশুরমশাইয়ের চোখের অপারেশন। নিজের এত টাকাপয়সা, ওঁর টাকায় খায় কে? অথচ অপারেশনের খরচ ছেলে দেবেই। রীতিমতো ঝগড়া করল আমার সঙ্গে।’
সকালে এ বাড়ির কাজে এসেই বুঝতে পেরেছে, একটা কিছু হয়েছে। হাওয়া চলছে না, গুমোট। দাদা জলখাবার না খেয়েই বেরিয়ে গেল, বৌদিও বোধহয় অফিস যাবে না। মোবাইল হাতে বিছানায় শুয়ে পড়ল। সর্বক্ষণ মোবাইল নিয়ে কি করে কে জানে। একমাত্র মেয়ে কলেজের পড়া করতে বাইরে গেছে, এখানে সংসারে মিয়া-বিবি দুজনে মিলে একা। সে এখানে বলে নয়, পাড়ার সব বাড়িতেই এমন। হয় পড়া নিয়ে, নয় চাকরি নিয়ে ছেলেমেয়েরা সব বাইরে বাইরে। বাড়ি বলতে শুধু বুড়ো-বুড়ি। এরা অবশ্য বুড়ো-বুড়ি নয়, দুজনেই চাকরি করে। মেয়েটা এই দু’বছর হল পড়তে গেছে।
বৌদি মোবাইলে কথা বলছে, গলার আওয়াজে বেশ ঝাঁঝ। দাদার সঙ্গে ঝগড়া করছে বোধহয়। রাস্তাঘাটে কত ভিড়,
গাড়ি চালাতে চালাতে কথা বলাই ঠিক নয়, আর ঝগড়া করছে বৌদি? বলব না ভেবেও ডেকেই ফেলল দুর্গা, ‘অ বৌদি, দাদা বাড়ি ফিরলে এসব কথা বোলো গো। ব্যাটাছেলে মানুষ, এমনিই মাথা গরম.. তার ওপর রাস্তাঘাটের আজকাল যা অবস্থা..’‘তুই নিজের কাজ কর, আমার মাথাটাও কম গরম নয়। মাথা গরম দেখাচ্ছে..’ রাগ হলেও ফোন বন্ধ করেছে। একবার বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। আজ আকাশ মেঘলা, বাইরেটা নরম, সবুজ সবুজ। রাতে বৃষ্টি হয়েছিল, জলে ভিজে নিচের রাস্তাটাও মায়া মায়া শান্ত। তবু বোধহয় বৌদির মন শান্ত হল না। বাইরের ঘরের সোফায় বসল, আবার ঘরে গিয়ে ফোন হাতে খাটে শুয়ে পড়ল। খুব অস্থির।
‘না রে, আজ আসছি না’, অফিসে ফোন করছে, ‘আর বলিস না। আমার তো শান্তিতে থাকার উপায় নেই। জানিসই তো সব। পিতৃভক্ত ছেলে, বৌয়ের কথা সংসারের কথা ভাবে না।‘কেন যে ঘরের কথা বলে এমন! যতই একসঙ্গে কাজ করো, কেউ বন্ধু নয়। বিয়ের পর বাপের ঘরে গিয়েও সব কথা বলতে নেই। আর এ তো বন্ধু। তোমার সোয়ামীকে নিয়ে কথা অন্যের কাছে বলবে কেন? বস্তীর ঘরে এমন হয়। তোমরা লেখাপড়া জানা মানুষ, কত বড় ‘মেয়েটার খরচ লাগে না? সেখানে থাকার খরচ দিয়েই তুমি হাত গুটিয়ে নাও, তার শখ আহ্লাদ মেটানোর খরচ নেই? বন্ধুদের জন্মদিনের গিফট, বাইরে খেতে যাওয়া, ওদের জেনারেশন কি আমাদের মতো? তোমার বাবা ভাই বোনই সব? আমার মেয়েটা জলে ভেসে এসেছে? আর আমি নিজে? চাকরি না করলে তুমি একটা হাতখরচ তো দিতে। নাকি? চাকরি করি বলে নিজের সব খরচ আমার?’
এই রে, এবার যে কান্নাকাটি শুরু করল। শান্ত না হলে ছুটির কথাটা বলে কি করে? মনটা
একটু নরম করতে হবে। ঘর মুছতে মুছতে মুখ তুলল দুর্গা, ‘সবই বুঝছি বৌদি। তোমারও তো মা ভাই আছে। সেখানেও তো দিতে থুতে খরচ হয় কিছু। দাদা নিশ্চয় সবটা..’
থামিয়ে দিয়ে বলে উঠল, ‘দেখলি? তুই কেমন বুঝলি? এ লোকটা যদি বুঝত! আমি যদি এবার আমার বাপের বাড়ি টেনে আনি? তবে জানিস তো? ওদিকে আমার খরচা নেই। একেবারে ঝাড়া হাতপা। মাকে বলেই দিয়েছি, পরগোত্তর করে দিয়েছ, আর আমাকে কিছু বোলো না। ভাইয়ের সংসারে মানিয়ে গুছিয়ে থাকো, বৌটাকে জ্বালিও না। হ্যাঁ, আমার আপন পর নেই। পরের বাড়ির মেয়ে বলেই তাকে সব ঝামেলা নিতে হবে, তা যেন না হয়।’
কাজ শেষ করে দরজায় এসে দাঁড়াল।
বিছানায় উপুড় হয়ে মোবাইলে কি করছে বৌদি। ছবি দেখছে, ছবি তুলছে। বিছানার পাশে জলখাবার পড়েছিল, দাদা না খেয়ে বেরিয়ে গেছে, সেটার ছবি তুলল। মোবাইলে সেই ছবিটা নিয়ে দেখছে, আর খুটুর খুটুর করছে।
‘কি রে, কিছু বলবি? বিকেলে তাড়াতাড়ি আসিস, আজ তো বাড়িতেই আছি।‘
‘ওই কথাই বলছিলাম বৌদি। আজ বিকেলে একবার সোনারপুর যাব। ফিরতে রাত হবে। কাল সকাল সকাল চলে আসব।’
‘কেন? তোর শাশুড়ি আবার ডেকেছে নাকি? মেরেধরে তাড়িয়ে দিয়েছিল, এখান রোজগার করছিস বলে বারবার ডাক দিচ্ছে? নাকি তোর বর বেশি মা-মা করছে? নিজে তো রোজ ওসব খেয়ে সব টাকা উড়িয়ে দেয়..’
‘না গো। আমার বর যদি একটু মা-মা করত, তাইলে কি আর এত খারাপ হতে পারত? রোজ ওসব খেয়ে টাকা নষ্ট, শরীর নষ্ট.. সে কি বোঝে? কতবার লক্ষ্মী-সরস্বতীর মাথায় হাত রেখে পোতিগ্গে করেছে.. এমনিতে মেয়েদের এত ভালোবাসে.. কিন্তু নেশার এমন জোর..’
‘যাকগে, বাদ দে। আমি মরছি নিজের জ্বালায়.. এসব শোনার মন নেই আমার। কাল সকালে কামাই করবি না। আয় এখন, দরজা টেনে দিয়ে যাস।‘
প্রায় বেরিয়ে এসেছে, আবার ডাক দিল বৌদি, ‘তোর ননদের কথাটা মনে আছে তো? আমার বন্ধুর বাড়ি বাচ্চা সামলাবার কাজের কথা? বাড়িতে বসে আছে, মাসে অতগুলো টাকা রোজগার হবে, অমন সুন্দর বাড়িতে থাকতে পারবে.. বুঝিয়ে শুনিয়ে আনতে পারিস তো, এবারই নিয়ে আসিস। শিপ্রাকে আমি প্রায় কথা দিয়েই ফেলেছি। তোর ভরসায়, তুই কথা দিয়েছিলি।’
‘না বৌদি, মিনু আর কাজ করবে না। ওই কথা বলতেই যাচ্ছি আজ। আমাদের পাশের ঘরের তপন, চেনো তো ওকে? ইলেকট্রিকের কাজ করতে এসেছে কতবার.. নিজের দোকান দিয়েছে গতমাসে। ওর সঙ্গে মিনুর বিয়ে ঠিক করেছি। এই পুজোটা কাটলেই বিয়ে। তপনের মা বাবার মিনুকে খুব পছন্দ। তাই শাশুড়িমাকে আর মিনুকে আনতে যাচ্ছি। বুড়ো মানুষটা একা একা থাকে, দ্যাওর-জা দেখে না। মিনুটাও চলে যাবে এবার। আমার কাছেই থাকবে এখন থেকে। মিনুও চোখের সামনে থাকবে, নিজের সংসার নিয়ে।’
‘তুই কি পাগল? ওই দজ্জাল শাশুড়ি। সামলাতে পারবি? নিজের চারটে ছেলেমেয়ে। তোর মাও তো থাকে তোর কাছে। দুই বুড়িতে ঝগড়া করবে, আর তুই ভুগবি। আর তোদের ওই সোনারপুরের ঘর ছেড়ে শাশুড়ি আসবেই বা কেন? ছোট ছেলের সঙ্গে ওই নিয়েই ঝামেলা না?’
‘কি আর বলব বলো? আমার দ্যাওর তো আলাদা হাঁড়ি করেছে। নিত্যি ঝগড়া। বুঝিয়ে শুনিয়ে নিয়ে আসব। তবে এবার মিনুর বিয়ে। ঠিক চলে আসবে। এমনিতে আমার গণেশকে বড্ড ভালোবাসে, বড় নাতি বলে কথা.. নাতির টানও আছে।’
‘জানি না। এত কথা মাথায় নিতে পারছি না আমি। যা ভালো বুঝিস, কর। পরে আমায় বলতে আসিস না। আর অত ঝামেলা নিয়ে কাজে কামাই করলেও শুনব না আমি।’
‘না গো বৌদি। এখন তো খরচ আরো বাড়ল। আমার কাত্তিক অবিশ্যি কাজ করছে আজকাল। কেবল টিভির কাজ করছে, সেদিন বললাম না? মায়ে-পোয়ে চালিয়ে নেব। কাজে গাফিলতি করব না। কাজ চলে গেলে অতগুলো পেট খাবে কি? আসলে.. লোভে পড়েছি গো।‘
‘মানে? কার লোভ? কিসের লোভ?’ এমন অবাক যে, মোবাইল থেকে মুখ তুলেছে বৌদি।
‘মানে ওই বাসন্তীমাসি.. মানে তপনের মাযের একটা কথা। আমাকে বলেছে, মিনুকে যে আমরা নিচ্ছি তা তোকে দেখে রে দুগ্গা। তোর নামখানা সার্থক। চার ছেলেমেয়ে, লক্ষ্মী সরস্বতী কাত্তিক গণেশ। মাতাল সোয়ামী, মা দুগ্গার বুড়ো শিবের মতো। বুড়ো মাকে এনে রেখেছিস, আবার অবলা ননদের জন্যেও এত ভাবনা। শাশুড়ি অত অত্যাচার করেছিল, সব ভুলে তাকেও আশ্রয় দিচ্ছিস? এত মায়া, সব্বার জন্যে এত ভাবনা.. বাড়িখানা যে সত্যিই দুগ্গাবাড়ি করে ফেলেছিস। দুগ্গাবাড়ি থেকে মেয়ে আনছি, কত ভাগ্যি আমার!’
ঘামে ভেজা লজ্জা লজ্জা মুখ অপরূপ আলোয় টলটল, ঠিক মা দুর্গার তেল তেল মুখখানার মতো।
সান্ধ্যকালে
সূর্যময়ী
আবু রাশেদ পলাশ
শেরপুর, বাংলাদেশ
শ্রাবণের মাঝামাঝি থেমে যাওয়া বর্ষাটা দিন দুই বিশ্রামের পর পূর্বাবস্থায় ফেরত যায়। আজকাল বৃষ্টি শুরু হলে থামে না সহসা। মধ্যাহ্নে সূর্যের দিকে দৃষ্টি গেলে বুড়ো মনে হয় ওকে। দিনমান পাংশুটে মেঘের আড়ালে ডাকা থাকে ওটা। গাঁয়ের পথে আলো আঁধারি খেলা হয় এ সময়। মাঝে মাঝে গুড়ুক গুড়ুক মেঘ ডাকে, বিদ্যুৎ চমকায় না। কর্মহীন গাঁয়ের বউয়েরা মেঝেতে বসে কাঁথা সেলায়। কিশোরীরা দল বেঁধে পুতুল বিয়ের খেলা করে সখীদের সাথে । উলঙ্গ, অর্ধউলঙ্গ উড়নচণ্ডী ছেলেগুলো হৈ হৈ রব তুলে কাদা জলে গড়াগড়ি খায়। দৃষ্টিগোচর হলে ধমক দেয় বাবারা - 'হারুনি, শিগগির উইঠা আয় হারামির পুত। ব্যারাম অইলে পাগারে চুবান দিমু নিজ্জস'।
আষাঢ়ে বর্ষা হয়। তার জলে বন্যা হয় করাতকান্দি। শ্রাবণে জলের ধারা থৈ থৈ করে গাঁয়ের সর্বত্র। আউসের ক্ষেত ভাসে সাদা জলে। এবারের বর্ষায় আবাদি জমি গেছে চাষিদের। শুকনো মরসুমে অনাহারে থাকতে হবে অনেককে। উত্তরপাড়ার বিনোদ বর্ষায় আবাদি জমি হারালে চিন্তিত হয়। বিকেলে বানের জলে ডুবে যাওয়া চারাগুলো টেনে তুলে সে। আলীনা পাড়ার আহালু বড়শীতে মাছ ধরতে এলে চোখাচোখি হয় দুজনের। তারপর হাঁক দেয় আহালু
- 'বিনদেনি, চারাগুলান তুলো যে'?
- 'গরুরে খাওয়ামু মিয়া ভাই'।
- 'উঠে আহ বিড়ি খাই। দখিনা বাতাসে শইলে সার পাইনে গো'।
বর্ষার ধারা থেমে গেলে দখিনা বাতাস বয় গাঁয়ের সর্বত্র। হিমবাতাস আলিঙ্গন করলে বস্ত্রহীন শরীরে কম্পন ধরে সহসা। বড় ব্যাঙের ম্যাগো ম্যাগো শব্দগুলো তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। রাতে ঘরের পাশে ঝিঝি পোকার অবিশ্রাম আওয়াজ শুনা যায়। জানালা খুলে বাইরে তাকালে জোনাকির মিটিমিটি আলো জ্বলে এ সময়। এ আলো গাঁয়ের পথে পথিকের পথ চলা প্রাঞ্জল করে না কখনও। তবে ওর দিকে দৃষ্টি গেলে দিনভর উপোস বেহুলা, জমিলার মত মেয়েরা ক্ষণিকের জন্য পেটের খিদে ভুলে সত্যি।
উত্তরপাড়ার হামিদ মাস্টার মারা গেছে পাঁচ বছর হতে চলল। কাছে কুলে কেউ নেই তার। একমাত্র ছেলেটা নিখোঁজ আজও। ইটে তৈরি প্রকাণ্ড বাড়িটার চারপাশে জঙ্গল গজিয়েছে অনেক আগেই। লোকে বলে বড় বাড়ি। রাতে শেয়ালের আওয়াজ শুনা যায় বড়বাড়ির চারপাশে। হামিদ মাস্টারের দ্বিতীয় বউ হাসিনা বেগম স্বামীর মৃত্যুর পর বাপের বাড়ি থাকে। বছর দুই আগেও এ পাড়ার জামাল কাজির সাথে যোগাযোগ ছিল তার। জামাল কাজির বড় ছেলে সমু পর মা বলে ডাকতো তাকে। এখন এ পাড়ায় গত সে। জামাল কাজি হামিদ মাস্টারের বাল্যবন্ধু। মৃত্যুর আগে সে বলেছিল - 'কাছে কুলে কেউ নাই যখন জমিগুলান বউরেই লিখে দেও হামিদ।'
জামাল কাজীর কথায় রাজি হয় নি হামিদ মাস্টার। সে বলেছিল - 'না, পুলা যদি ফেরত আসে জমিগুলান ওরে দিও জামাল।'
হামিদ মাস্টারের কথায় সেদিন আপত্তি করেনি হাসিনা বানু । অসম বয়সের যে মানুষের সাথে সংসার বেঁধেছে সে, আর যায় হোক এখন তো সে সত্তার কেউ। তার কাছে ভালবাসা ছাড়া আর কি বা চাওয়ার আছে? এরপর একদিন বড়ঘরের মেঝেতে গড়াগড়ি দেয় হাসিনা বানু। হামিদ মাস্টার মারা গেছে একটু আগে। সমু এখন করাতকান্দি প্রাইমারী স্কুলের হেডমাস্টার। জামাল কাজির কিনে দেওয়া সাইকেলটা এখনো আছে ওর। মোটা ফ্রেমের চশমাটা পড়ে বাইরে বের হলে সমীহ করে সবাই। বিকেলে বাড়ি ফেরার পথে হামিদ মাস্টারের বাড়িটা পাশ কাটিয়ে আসতে হয় সমুকে।ওদিকে দৃষ্টি গেলে পুরনো মানুষগুলোর কথা মনে হয় তার। দুবছর হতে চলল হামিদ মাস্টারের এক বিধবা বোন এসে বসতি গড়েছে এখানে। সাথে জুয়ান ছেলে তার, নাম ভুলা। বদের হাড্ডি, হাতে একটা ধারালো চাকু নিয়ে সারাদিন পাড়ায় ঘোরাঘুরি করে সে। নিরীহ মানুষগুলোর কাছে নিজেকে ডাকু বলে পরিচয় দেয়। লোকে বলে ভুলা ডাকু। ভুলা ডাকু দুর্ধর্ষ, এ পাড়ার কেউ লাগতে যায় না ওর সাথে। করাতকান্দির বখে যাওয়া ছেলেগুলোর সাথে বন্ধুত্ব করেছে সে। রাতে ওদের সাথে মেথর পাড়ার ভাত পচা মদ খেয়ে পড়ে থাকে রাস্তায়। সংসারের ধার ধারে না। বড়বাড়ির চারপাশে মৌসুমি ফলের বাগান। এগুলো বেচেই সারা বছর সুখে দিনাতিপাত করে মা-ছেলে।
এর মধ্যে একদিন জ্বরে পড়ে সমু। সেদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে রাস্তার কাদায় পড়ে যায় সে। বৃষ্টির পানিতে ভিজলে গায়ে জ্বর আসে ওর। সে জ্বর কমেনা সহসা। দিন দুই প্রায় অচেতন থাকার পর একদিন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ে সকালে। কিন্তু শরীরে শক্তি পায় না সে। হাতের চশমাটা চোখে দিলে উঠানে দৃষ্টি পড়ে ওর। ঝম ঝম বৃষ্টি হচ্ছে এখনও। সমু হাঁক দেয়,
- 'মা, আজ কি বার কও তো?'
রাহেলা বানু বলে - 'বিসসুদবার।'
- 'বিসসুদবার?' সহসা চমকে উঠে সমু। গত দুইদিন প্রায় অচেতন ছিল মনে নেই তার। উত্তরপাড়ার হারেস আলীর ছেলে মনা সমুদের বাড়িতে চুক্তি খাটে। সমুর ডাক শুনলে এক সময় এসে ভেতরে দাঁড়ায় সে। হাতে একটা কাগজ দিয়ে সমু বলে,
- 'কাগজখান তর ঝুমু আপারে দিস মনা।' উত্তর পাড়ায় হোসেন তালুকদারের বাড়িটা মসজিদের কুল ঘেঁষে। পাড়ায় সচ্ছল গেরস্ত সে। ঘরে বউ ছাড়াও একমাত্র মেয়ে আছে তার। নাম ঝুমু। সমুর সাথে মন দেওয়া নেওয়া করেছে সে।
ওদের সম্পর্কের বয়স হয়েছে বেশ। এখন সম্পর্কে স্থিত হওয়ার স্বপ্ন দুজনের। সময় পেলে গাঁয়ের পথ ধরে হাঁটে ওরা। নিতাই মাঝির ধান ক্ষেতের পাশ দিয়ে যে বড় সড়ক শহরমুখী চলে গেছে তার পাশে বসে গল্প করে দুজন।এরপর একদিন করাতকান্দি গ্রামে অপরিচিত মুখের আগমন ঘটে হঠাৎ। এক বিকেলে হাঁটু সমান কাদা মাড়িয়ে ভেজা কাকের মত নিজ বাড়িতে ফিরে আসে তারেক।
তারেকের কথা মনে আছে? হামিদ মাস্টারের ছেলে বাবার সাথে রাগ করে একদিন নিরুদ্দেশ হয়েছিল সে। সেই তারেক ফিরে এসেছে পনের বছর পরে। ও নিরুদ্দেশ হওয়ার পর বছরে একটা দুটো চিঠি লিখত বাবার কাছে। কিন্তু গ্রামে আসেনি কোনদিন। হামিদ মাস্টার মারা যাওয়ার আগে ছেলেকে দেখার ইচ্ছে হয়েছিল খুব। কত খুঁজেছে ওকে, সন্ধান দিতে পারেনি কেউ। তারেক ফিরে এলে গাঁয়ের মেয়েরা বলাবলি করে,
- 'হুনছনি বু, হামিদ মাস্টরের পুলানি ফেরত আইচে কাইল।'
- 'হাচানি, বাপের ভিটায় বাতি জ্বলব মালুম অয়।'
তারেকের ফেরার সংবাদে কিছুদিন জটলা করে গাঁয়ের ছেলে বুড়োরা। কুশলাদি জিজ্ঞেস করে ওর। এতদিন কোথায় ছিল, কি করত এসব কথা জানতে চায় সবাই। এদিকে তারেকের ফেরার খবর মনার মাধ্যমে জানতে পারে জামাল কাজি। তারপর লোক মারফত খবর পাঠায় সে -তারেক যেন একবার দেখা করে ওর সাথে। বয়সের বাড়ে ন্যুব্জ কাজি হাঁটতে পারে না এখন। লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়ালে শরীরটা ঠক ঠক কাঁপে তার। অবশেষে খবর পেয়ে তারেক স্বয়ং একদিন দেখা করতে যায় কাজি বাড়ি। তারেক এলে আহাজারি করে জামাল কাজি,
- 'আইলাগো বাজান? এতদিন পরে যে, বাপ আর নাইগো তোমার'।
সহসা জবাব দেয় না তারেক। এ কথার উত্তর কি হতে পারে জানা নেই তা। ও চুপ করে থাকলে জামাল কাজী আবার বলে - 'মরুন কালে তোমারে দেখুনের সাধ অইচিল তোমার বাপের, কত খুঁজলাম পাইলামনা তোমারে।'
- 'আপনের শরীর কেমুন কাকা?'
- 'ভালা, আইছ যহন যাইও না আর। মিসতিরি খবর দেও, ঘরখান মেরামত কর তাইলে।'
- 'একলা মানুষ ........?'
- 'বউরে নিয়া আহ বাজান। বাপের ভিটা ফেলায় রাখুন ভালানা'।
ঐদিন ফেরার পথে সমুর সাথে দেখা হয় তারেকের। তারপর চোখাচোখি হয় দুজনের। সমু দৃষ্টি সরিয়ে নিলে তারেক হাঁক দেয়,
- 'আমারে ভুইলে গেচিস গুল্লু?'
গুল্লু বললে পুরনো কথাগুলো মনে হয় সমুর। ছোটবেলায় গুলগুলি খাওয়ার নেশা ছিল ওর। তারেকের পকেটের টাকা কতবার ওর পেছনে খরচ হয়েছে তা কি ভুলা যায়? রাতে ঘুমানোর আগে মায়ের সাথে গল্প করে সমু। এক এক করে সবার কথা মনে হয় তখন। করাতকান্দি গ্রামে হামিদ মাস্টারের বাড়িটা শহরমুখি সড়কের কূল ঘেঁষে। মস্ত বাড়ি। একপাশে তার মৌসুমি ফলের বাগান, অন্যপাশে প্রকাণ্ড বাঁশঝাড়। গ্রীষ্মের উন্মত্ত সূর্যও এখানে মৃত প্রায়। বাড়িতে দিনের এলো পড়ে না সহসা। হামিদ মাস্টারে