top of page
সূচীপত্র
independence.jpg
প্রবন্ধ
Saraswati3.jpg
ভারতে দেবী আরাধনা
Coverpage_image.jpg

ভারতে দেবী
আরাধনার ইতিবৃত্ত​​
সুবিমল চক্রবর্তী
ডালাস, টেক্সাস

প্রবন্ধ সমগ্র ।। মতামত ।। সূচীপত্র

 প্রবন্ধ সমগ্র

প্রাচীন কালের সিন্ধুনদের উপত্যকায় যে সভ্যতা গড়ে উঠেছিল সেই সভ্যতায় দেবীর আরাধনা প্রচলিত ছিল। সাড়ে চার থেকে সাড়ে তিন হাজার বছর আগে যাযাবর আর্যরা ভারত আক্রমণ করে এবং ভূমিপুত্রদের বশীভূত করে। সিন্ধুসভ্যতার দেবী আরাধনা নতুন বসতিস্থাপনকারী আর্যরা মাধ্যমে প্রচুর বিস্তার লাভ করে। শুধু তাই নয়, আরাধনার আচার অনুষ্ঠান সমূহ অনেক জটিল হয়ে ওঠে। আর্যরা অর্থনৈতিক ভিত্তি ছিল প্রধানত গবাদিপশু পালন। সম্ভবত কৃষি পদ্ধতি সম্পর্কে তাদের কোন জ্ঞানই ছিল না। কিন্তু তারা ছিল শক্তিশালী যোদ্ধা, তাই স্থানীয়দের পরাভুত করতে পেরেছিল সহজেই।

যাযাবর বৃত্তির চেয়ে একজায়গায় স্থায়ীভাবে বসবাস করে কৃষি কাজে মনোনিবেশ করলে যে নিরাপত্তা পাওয়া যায় এই সত্যটি তারা ক্রমশই উপলব্ধি করতে থাকে। তাই তারা কৃষিকাজে পারদর্শী হয়ে উঠতে থাকে। গঙ্গা ও যমুনা নদী বিধৌত ভারতের উর্বর ভূমি সহজেই যে পর্যাপ্ত ফসল ফলায় তা দেখে তারা অভিভূত হয়ে পড়ে। যাযাবরদের জন্য এটা ছিল একটা নূতন অভিজ্ঞতা। এই প্রথমবারের মত তাদের খাদ্য সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন ভাবে চলতে থাকে। অতএব, ‘পৃথিবী’—যা তাদের জীবনের নিশ্চয়তা বিধান করে তাদের কাছে হয়ে ওঠে প্রশংসিতা এবং পরিগণিত হয় দেবী হিসেবে। ‘পৃথিবী’ হ’ল উর্বরা নারীদাত্রী। তাদের কাছে এই দেবী ছিল মায়ের মত যে মা তাদেরকে এবং তাদের গবাদিপশুসমুহকে পালন করে এবং যার কৃষিভূমি তাদের নানাবিধ সাধ-আহ্লাদ এবং যাবতীয় আমোদ-প্রমোদকে নিশ্চিত করে তোলে। শস্য পাকার সময় কৃষিজমিতে তারা আবিষ্কার করল সোনালী স্তনযুক্তা এক নারীকে যে নারী থেকে উৎসারিত হচ্ছে সমস্ত আশীর্বাদ এবং সুখ।

অথর্ব বেদই হচ্ছে প্রথম বই যার মধ্যে রয়েছে ভূমি হিসেবে দেবী পৃথিবীর বিস্তারিত বর্ণনা। অপূর্ব সুন্দর একটা মন্ত্রের মাধ্যমে এই বেদে এই ভাবে এটি প্রকাশিত হয়েছে, 'অতীত ও বর্তমান কালের সমস্ত রাজাদের পত্নী এই দেবী আমাদের আয়ত্তের মধ্যে এনে দিন ভূমি। তিনি ধারণ করেন সবকিছু, লুক্কায়িত সমস্ত ধনরত্নের তিনিই আধার, সুঠাম স্তনযুক্তা এই দেবী যা কিছু জঙ্গম তার সব কিছুরই রক্ষাকর্ত্রী। মধুর জন্য এই দেবীকে আমরা দোহন করব, তিনি আমাদের উপর বর্ষণ করুন অপার মহিমা। এই ভূমি-যিনি আমার মা আমাকে দুগ্ধ দান করুন, দুগ্ধ দান করুন তাঁর সন্তানকে। তাঁর পাহাড় সমূহ, বরফাচ্ছাদিত পর্বতমালা, এবং তাঁর অরণ্যানী আমার জন্য আনন্দস্বরূপ হয়ে থাক। পীতাভ, কৃষ্ণকায়, বিচিত্র কারুকাজময়, লোহিত-সমস্ত বর্ণের অধিকারিণী এই কৃষিভূমিতে, এই ধরিত্রীতে যা কিনা ইন্দ্র কর্তৃক সুরক্ষিত আমি যেন নিরুপদ্রব, নিরুদ্বেগ এবং অক্ষত জীবন যাপন করতে পারি। তিনি যা সৃষ্টি করেছেন তার মধ্যে মরণশীল প্রাণীরা বিচরণ করে। তিনি ধারণ করেন দ্বিপদ ও চতুষ্পদ জীবসমুহকে তোমার ভেতর থেকে উৎসারিত হয় যে সুরভি, হে  দেবী পৃথিবী, সেই সুরভি উদ্ভিদ ও জল তাদের নিজেদের মধ্যে ধারণ করে।'

ধরিত্রীর এই প্রাচুর্য আর্যদের সমৃদ্ধিশালী করে ঠিকই, কিন্তু একই সঙ্গে তাদের মধ্যে একটা ভয় বেড়ে যায় যে, অন্যান্য শত্রুভাবাপন্ন যাযাবরগোষ্ঠী অথবা দেশীয় বাসিন্দারা বা ভূমিপুত্ররা জোরপূর্বক তাদের কাছ থেকে ভূমি কেড়ে নেওয়ার জন্য তাদেরকে আক্রমণ করতে পারে। তাদের ভুমি এবং শস্যভাণ্ডার লুটতরাজ এবং অন্যান্য উপদ্রবের কারণে বিনষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা সর্বদাই থেকে যায়। অপার উৎকর্ষ, ধনসম্পদ ও সমৃদ্ধির দেবী লক্ষ্মী যেন দেবী পৃথিবীর স্থান গ্রহণ করার গৌরব নিতে চাইলেন। কিন্তু এই ক্ষেত্রে আযরা একটা উভয়সঙ্কটের সম্মুখীন হল।

আর্যরা যে সময়টাতে উত্তর ভারত দখল করে নিয়েছিল, সেই সময় এই এলাকায় যারা বসবাস করত তাদের অর্থনৈতিক জীবন নির্ভরশীল ছিল কৃষিকাজের উপর। তারা উপাসনা করত তাদের শস্য দেবীকে। এই দেবীর প্রারম্ভিক নাম ছিল লক্ষ্মী, কারণ এই দেবী যুক্ত ছিলেন কর্দম ও জলকণার সঙ্গে এবং তিনি ছিলেন আর্য পূর্বকালীন সময়ের কৃষিকর্মও বৈষয়িক সমৃদ্ধির প্রতীক। পররতীকালে উত্তর ভারত দখলের পর আর্যরা যখন চাষবাসের পদ্ধতি আয়ত্ত করল এবং নিজেরাই যখন তাদের নিজেদের জন্য ফসল উৎপাদন করতে শিখল, তখন বিজিতদের মত তারাও সবকিছু উৎসর্গ করল লক্ষ্মীকে। কিন্তু তাদের সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠিত হতে পারত শুধুমাত্র আর্যরা পূর্বকালীন চাষবাসের দেবীকে অর্থাৎ লক্ষ্মীকে চূর্ণবিচূর্ণ করে, পরাস্ত করে এবং বিতাড়িত করে।

ফলত আর্যরা পূর্বকালীন সময়ের লক্ষ্মীর নাম দেওয়া হল অলক্ষ্মী এবং এই দেবীকে এখন দেখা হল একটা অপশক্তি হিসেবে। অত্যন্ত অমার্জিতভাবে এই অলক্ষ্মীকে তৈরি করা হল কাদা, জল এবং গোময় দিয়ে। আর্য পূর্ব কালীন দেবী 

করিষিনীর কথা স্মরণে রেখে এই অবয়ব গড়ে তোলা হল। এখানে উল্লেখ্য যে, করীষ শব্দের অর্থ গোময় অর্থাৎ গোবর। এই দেবীর হাতে শস্য ঝাড়ার কুলা যা দিয়ে  সে শস্য ঝাড়ছে। যতদিন না পর্যন্ত আর্য পূর্ব কালীন সৌভাগ্যের অবসান ঘটল, আর্যদের সাফল্য এবং কৃষি ক্ষেত্রে সৌভাগ্য যেন প্রতিষ্ঠিত হতে পারছিল না। মজার ব্যাপার হচ্ছে ঋগ্বেদের লক্ষ্মীর অপর দুটো নাম হচ্ছে জয়া বা জ্যেষ্ঠা যার আভিধানিক অর্থ হচ্ছে সবার চাইতে বড়। এর একটা অর্থ দাঁড়ায় যে, এই দেবী হচ্ছে আর্য পূর্ব কালীন সময়ের দেবী যার স্থান দখল করেছিল পরবর্তী সময়ে আর্যদের সৌভাগ্যের দেবী।

আর্যদের আচার অনুষ্ঠানে জল সব সময়ই একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। উত্তর ভারতে গঙ্গা ছিল সবচেয়ে  দীর্ঘ মনোরম নদী। বৈদিক যুগের শেষের দিকে যখন সিন্ধু সভ্যতা গঙ্গার দুই তীরে উন্নতির চরম শিখরে আরোহণ করেছিল, তখন থেকেই গঙ্গা দেবী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। স্বর্গ, সমুদ্র, হিমালয়, ঋষি জাহ্নু, ব্রহ্মা, শিব ও বিষ্ণু, এবং অন্যান্য দেবীদের সঙ্গে এই দেবীর পৌরাণিক যোগাযোগ তার পবিত্রতার ভাব মূর্তিকে বাড়িয়ে দিয়েছে। এমনকি অদ্যাবধি এই দেবী উপাসিত হয়ে থাকে পার্থিব বা বৈষয়িক সৌভাগ্যের জন্য। শুধু তাই নয়, চূড়ান্ত বা অন্তিম মুক্তির জন্যও এই দেবী আরাধ্যা। প্রয়াগে গঙ্গা নদী মিলিত হয় যমুনা নদীর সঙ্গে। এই সঙ্গম স্থল পুণ্যার্থীদের  জন্য একটা পবিত্র স্থান। গঙ্গা এবং যমুনা উভয়ই হিন্দু দেব-দেবীদের মধ্যে দুজন প্রধান দেবী হিসেবে স্বীকৃত। আর্য উপনিবেশকারীদের সভ্যতা আরও কয়েকটি নদীর, যেমন সরস্বতী  ও দৃশদবতী এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য - উপর নির্ভরশীল ছিল।

আর্যরা ধন সম্পদের অগাধ ভাণ্ডার গড়ে তুলতে পেরেছিল। তার ফলে তাদের জীবনে এসেছিল অবসর। আর এই অবসরকে তারা ব্যবহার করেছিল যাবতীয় সৃষ্টিশীল কাজকর্মে। তারা সমর্থ হয়েছিল বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানের পরিধি বাড়িয়ে তুলতে। শিল্পকলায় তারা প্রভূত উন্নয়ন সাধন করতে সমর্থ হয়েছিল। বিদ্যাদায়িনী সরস্বতী প্রতিষ্ঠিতা হল দেবী হিসেবে। এমনকি আর্যদের আগমনের পূর্বে ঋগ্বেদের যুগে বিশ্বাস করা হত যে, সরস্বতী নদীর রোগ নিরাময়ের ক্ষমতা ছিল, এবং তাকে চিহ্নিত করা হয়েছিল বেদের প্রাথমিক নিরাময়ের দেবতা অশ্বিনদের অন্যতমা হিসেবে। প্রাথমিক যুগের আর্য উপনিবেশের সময় সরস্বতী নদী আর্যদের উপনিবেশের পূর্ব সীমানা ছিল। মনুসংহিতায় উল্লেখ আছে, আর্যদের প্রাচীন বাসভূমি ব্রহ্মাবর্ত সরস্বতী ও দৃশদবতী নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত ছিল। দৃশদবতী নদী পরবতী কালে বালুর কারণে প্রবাহ হারিয়ে ফেলে এবং লুপ্ত হয়ে হয়ে যায়। প্রাথমিক পর্যায়ে সরস্বতী নদী আর্যদের উপনিবেশ সম্প্রসারণে এবং সভ্যতা সংস্কৃতির উৎকর্ষ সাধনে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল। আর্যরা সম্পূর্ণভাবে নিরক্ষর, গবাদিপশু পালক ও যাযাবর

ছিল। তারা যেহেতু লিখতে বা পড়তে জানত না, মুখের ভাষা অর্থাৎ ‘বাক’ তাদের কাছে ছিল অত্যন্ত মূল্যবান। তাই তাদের সংস্কৃতির যা মূলত ছিল বলি প্রদানের ধর্ম মুল ভিত্তি ছিল ‘বাক’, মুখে উচ্চারিত মন্ত্র। একই সঙ্গে তাদের গবাদিপশু সরস্বতী নদীর উভয় কুলে খুঁজে পেল বিস্তর চারণভূমি। আর্যরা ধীরে ধীরে যখন স্থায়ীভাবে বসতি গড়তে শুরু করল, তারা সৃষ্টি করল জটিল এবং বিশদ বলি প্রদানের আচার-অনুষ্ঠান। তাদের বিদ্যা সাধনার এক বিরাট অংশ বিধৃত হল এই উৎসর্গ বা বলির মন্ত্র সমূহে। ফলত, সরস্বতী হয়ে উঠল জ্ঞান বা বিদ্যার দেবী। ‘বাক’ বা মুখনিঃসৃত বাণী এবং উৎসর্গ বা বলির জন্য নির্বাচিত মন্ত্রাবলী সরস্বতী বা বাগদেবীর ধারণার উৎস হয়ে থাকল। এক পুরাণে উল্লেখিত আছে, অনার্য বা অসুরদের সঙ্গে আর্যদের এক আপস রফার সময় ‘বাক’ দেবী অনার্যদের সঙ্গে প্রতারণা করে তাদের পক্ষে না গিয়ে আর্যদের পক্ষ অবলম্বন করে। বস্তুত, এই পৌরাণিক কাহিনী ভারতের ভূমিপুত্রদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতির উপর আর্যদের ভাষা ও সংস্কৃতির প্রভুত্ব স্থাপনের ইতিহাস। বিশ্ব নিয়ন্ত্রক শক্তি হিসেবে ‘বাক’ দেবী কয়েকটি বৈদিক পুরাণে ও উল্লেখিত আছে।

ইতিমধ্যেই আর্যরা জ্ঞান ও সম্পদের জন্য পরিচিত হয়ে উঠল। ফলত তাদের সুপরিকল্পিত সম্প্রদায় সমূহের উপর বাইরের শত্রু কর্তৃক আক্রমণের ভয় বৃদ্ধি পেল। তবে যোদ্ধারা সদা প্রস্তুত ছিল। কিন্তু তাদের নিজেদেরকে এবং তাদের সহায় সম্পত্তি রক্ষা করা ক্রমশই কঠিন হয়ে উঠতে থাকল। তখন তাদের প্রয়োজন হয়ে পড়ল শক্তি, সাহস এবং বীরসুলভ সহিষ্ণুতার যার দ্বারা তারা আক্রমণকারীদের হঠিয়ে দিতে পারবে । মজার ব্যাপার হল, এই সময় কালে যত পুরাণের জন্ম হয়েছে সেগুলোর প্রায় সবগুলোতেই অনার্যদের চিত্রিত করা হয়েছে অসুর হিসেবে। দেখানো হয়েছে, তারা ছিল অসভ্য, অপশক্তি, কামুক, এবং কালো জাদুবিদ্যার অধিকারী। এই অপশক্তির মোকাবিলার স্বার্থে আরযরা ‘শক্তি’ এবং ‘মাতৃকা’ অর্থাৎ মাতৃদেবতা  উপাসনার পুজাপদ্ধতি বা ধর্মবিশ্বাসের সূত্রপাত করল। এই দেবীরা হল পুরুষ দেবতাদের মধ্য থেকে উদ্ভুত নারী দেবী অথচ পুরুষ দেবতাদের তুলনায় অনেক বেশী শক্তিশালী। দেব-দেবীর যে পদ্ধতি গড়ে উঠল তার মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান হল দুর্গা, চণ্ডিকা, চামুণ্ডা এবং কালীর। এই দেবীদের চিত্রিত করা হল বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিতা শক্তিশালী ও সশ্রদ্ধ ভয় বা বিস্ময় উদ্রেককারী ভয়াল দর্শনা রণরঙ্গিণী দেবী হিসেবে। কালী, চামুণ্ডা, ধুনাবতী এবং ছিন্নমস্তা দেবীরা এদের অন্তর্ভুক্ত। এই দেবীসমুহের কল্পনা এমনভাবে  করা হয়েছিল যাতে তারা আরযদের শত্রুদের উপর ভীষণ ত্রাসের সঞ্চার করতে সমর্থ হয়। এই দেবীসমূহের অর্চনা জটিল আচার অনুষ্ঠানের এবং পশুবলি বা উৎসর্গের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হত। প্রায়ই এই আচার অনুষ্ঠান ও বলি চলত কয়েকদিন ধরে।সেই সময় মাতৃকা ছাড়াও দশ মহাবিদ্যার তান্ত্রিক গ্রুপ প্রচলিত ছিল। দশমহাবিদ্যার প্রথম ছিল কালী, অন্য নয় দেবীর নাম তারা, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, ছিন্নমস্তা, ভৈরবী, ধুনাবতী, বগলা, মাতঙ্গী এবং কমলা।

বিপদনাশিনী বা উদ্ধারকরত্রী ‘তারা’ পরবর্তী কালে বৌদ্ধ তান্ত্রিকেরা উপাস্যা হিসেবে গ্রহণ করে। ষোড়শী ছিল ষোড়শ বর্ষীয়া সুন্দরী তরুণী দেবী। ভুবনেশ্বরী তারই এক রূপ যে হল সমগ্র বিশ্বের অধিপতি। যখন সে ছিন্নমস্তা, তখন সে ধারণ করেছে এক ভয়ঙ্কর মূর্তি। এই অবস্থায় সে নিজের বাম হস্তে ধারণ করে নিজেরই মস্তক এবং পান করতে থাকে ছিন্ন মস্তক থেকে উৎসারিত রক্ত।

ভৈরবী রূপেও সে ধারণ করে ভয়াল দর্শনারূপ। ক্রুদ্ধ এবং সংহারকারী শিবের সে স্ত্রী রূপ। ধূমাবতী সম্ভবত একমাত্র দেবী রূপ যার পরিধানে আছে বৈধব্যের বেশ। এই দেবী চিত্রিত হয়েছে কৃশকায়া বৃদ্ধা রমণী হিসেবে যার সৌন্দর্য ও মহিমাসবই নিঃশেষিত। মলিন ও ছেঁড়া বসন পরিহিতা এবং অবিন্যস্ত কেশযুক্তা এই দেবী হাতে ধারণ করে শস্য ঝাড়ার ঝুড়ি। এই দেবীর ছিল দীর্ঘ নাসিকা এবং তার চোখ থেকে যেন ঝরে পড়ছে নিষ্ঠুরতা। এই দেবীকে মনে হবে তার রয়েছে অনন্ত ক্ষুধা এবং তৃষ্ণা। তাকে দেখে মনে হবে সে ধূর্ত, কলহপ্রিয় এবং প্রবঞ্চক। সে ধারণ করে আছে সমস্ত বদ গুণ যা কোনবিধবার জন্য শোভাপায় না। সে যেন সেই বিধবা যার আনন্দের জগতে সহসাই যবনিকাপাত হয়েছে যার ফলে তার মধ্যে হাহাকার করছে অপূর্ণকামনা বাসনা সমূহ। যাই হোক, এই ধূমাবতী রূপ পরোক্ষ ভাবে এবং একক ভাবে সাক্ষ্য দেয় যে বিধবাকে তুষ্ট করার জন্য তাকে পূজা করা হত।

কৌমারী রূপে এই দেবী কুমারী পূজার উপর গুরুত্ব আরোপ করে, এবং দেবী সরস্বতী রূপে সে চিত্রিত হয় নিঃসন্তান স্ত্রীরূপে, এবং অপর সমস্ত রূপে সে মাতা রূপিণী দেবী যার স্বামী ও সন্তানরা জীবিত। বগলা দেবী রূপে বগলামুখী হিসেবেও পরিচিত (সম্ভত ‘বক’ শব্দ থেকে উদ্ভূত) এই দেবীর রয়েছে বকের শির। এই দেবী ছিল কুটিল জাদুবিদ্যা এবং বিষাক্ত দ্রব্যের  প্রতীক। বিস্ময়ের ব্যাপার হলেও এই দেবীর মুখায়বে প্রতিফলিত হয় যন্ত্রণা; মনে হয় কোন সংঘর্ষ জনিত কোন কষ্ট তাকে বিদীর্ণ করছে।

‘মাতঙ্গ’ শব্দের অর্থ হচ্ছে হস্তী। মাতঙ্গী হস্তীর যে শক্তি তার প্রতীক। শিব পরচিত ছিল হস্তীহন্তা হিসেবে এবং মাতঙ্গী ছিল তার স্ত্রী। তাকে কল্পনা করা হত একজন সুন্দরী নারী হিসেবে। সে বসে আছে এক সিংহাসনের উপর এবং উপবিষ্টা থেকে প্রদর্শন করছে হিতকর ক্ষমতা। কমলা হিসেবে এই দেবী সদাশিবের স্ত্রী। সে সুন্দরী ও সুপ্রসন্ন এবং শুভমঙ্গলময়ী।

তদুপরি দেবীদের ছিল আরো আটটি রূপ। এই দেবীদের দেখানো হয়েছে সংসার বিবাগী সন্ন্যাসিনীরূপে। এই দেবীরা হল ত্রিপুরা, ভীষণা, চণ্ডী, কর্ত্রী, ধরত্রী, হরত্রী, বিধায়িনী, করাল ও শূলিনী। আমারা দেখতে একই দেবী একই নাম একাধিক গ্রুপে উল্লেখিত হয়েছে।

কালীর যে ভিন্ন ভিন্ন রূপ আমরা দেখছি, সেগুলো নির্ধারিত হয়েছে কোন অঞ্চলে সে পূজিতা হয়েছে এবং কীউদ্দেশ্য সাধনের জন্যও এই পূজার আয়োজন করা হয়েছে। যেমন, এই দেবীকে আমরা দেখেছি শ্মশানকালী, ভদ্রকালী, গৃহকালী,  মহাকালী, রক্ষাকালী, ইত্যাদি হিসেবে। এমনকি, ডাকাতদেরও কালী রয়েছে; বাংলায় এই দেবী ডাকাতে কালী হিসেবে পরিচিত। ডাকাতি করার জন্য যাত্রার প্রাক্কালে ডাকাতের দল ধুমধামসহকারে এই দেবীর পূজা করে। কালীর এই সমস্ত রূপই স্থানীয় ভাবে জনপ্রিয় ও পূজিতা অপরাপর দেবীদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করে। সে যা-ই হোক, দেবীদেরকে পূজা করবার প্রচণ্ড এই ধর্মীয় বিশ্বাস কিন্তু নারী জাতিকে বিশেষ মর্যাদা প্রদানে সমর্থ হয়নি। বরঞ্চ, নিষ্ঠুর ও কঠোর পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীরা ভীষণভাবে পুরুষের পদানত থেকেছে এবং ভীষণভাবে তারা নিগৃহীত হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। নারীর মানসিক ও শারীরিক যন্ত্রণা সহ্য করবার সামর্থ্যকে শ্লাঘার বস্তু হিসেবে দেখা হয়েছে এবং এইসব নিয়ে তৈরি হয়েছে বিভিন্ন সাহিত্য। গৌরবান্বিত করা তাদের সংসারের জন্য পুরুষের জন্য তাদের  ত্যাগকে। তাদেরকে বসানো হয়েছে দেবীর আসনে। সীতা ও রাধা হচ্ছে প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এখানে উল্লেখিত অন্যান্য দেবীদের মত এই দুই দেবীর স্বর্গীয় গুণাবলী ছিল না। তাদের প্রধানতম সদগুণ ছিল যে তারা তাদের স্বামীর প্রতি ছিল অনুগত এবং উৎসর্গীকৃত।

সন্তানের জন্মদান এবং শৈশব অবস্থায় তাদের পালনই ঐতিহ্যগত ভাবে নারীর জন্য নির্ধারিত হয়েছে। দেবী ষষ্ঠীসদাশয়া এবং মাতৃস্নেহে পরিপূর্ণা এবং এই দেবীর মধ্যে বিধৃত হয়েছে এই স্বর্গীয় ক্ষমতা। সন্তানহীনাকে সন্তানদানের স্বর্গীয় ক্ষমতাও দেওয়া হয়েছে দেবী ষষ্ঠীকে।

রবীন্দ্রযুগে নারীর অগ্রগতি

প্রবন্ধ সমগ্র ।। মতামত ।। সূচীপত্র

 প্রবন্ধ সমগ্র

রবীন্দ্রযুগে


নারীর অগ্রগতি​​
পারোমিতা চট্টোপাধ্যায়

ষ্টাদশ শতাব্দীতে বাংলার নারী সমাজ অনেক পিছনে ছিল। তাদের অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে আসার প্রথম দিশারি বিদ্যাসাগর মহাশয়। স্ত্রী শিক্ষা প্রচলনে তার অবদান অনস্বীকার্য। তাছাড়া বিধবা বিবাই প্রচলন, বহু বিবাহ রোধ তিনি আইনের মাধ্যমে ঘটান। তৎকালীন হিন্দু সমাজপতিদের বহু বিদ্রুপ সহ্য করেও তিনি তার কাজে অচল ছিলেন। বেথুন স্কুল প্রতিষ্ঠা তার অন্যতম কৃতিত্ব। আজকে নারী যে জায়গায় আছে তার জন্য বিদ্যাসাগর চিরস্মরণীয়।

পরবর্তীকালে স্ত্রী শিক্ষাকে রক্ষা ও নারী প্রগতির ক্ষেত্রে ব্রাহ্মসমাজ রবীব্দ্রনাথ এবং ঠাকুর পরিবারের অবদান অসীম। বহুবিবাহ নামক নারকীয় প্রথা থেকে মুক্তি পাবার জন্য সে সময় বহু হিন্দু কুলীন ব্রাহ্মসমাজের অন্তর্ভুক্ত হন। ঠাকুরবাড়ি ও ব্রাহ্মসমাজের মহিলারা নারী মুক্তি ও নারী প্রগতির দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। ঠাকুরবাড়ির মেয়ে বধুঁদের যে দু-তিনটি নাম উজ্জ্বল তার মধ্যে প্রথমেই উঠে আসে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের কন্যা স্বর্ণকুমারী দেবী। তিনি নারী কল্যানমুলক কাজ আরম্ভ করেন তার প্রতিষ্ঠিত সখি সমিতির মধ্যে দিয়ে। বিধবাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার জন্য তার প্রচেষ্ঠা প্রশংসার দাবী রাখে। অসহায় বিধবাদের যন্ত্রণা, তাদের মর্মবেদনা তিনি তার বহু নাটকে ফুটিয়ে তোলেন। স্বর্ণকুমারীর জনপ্রিয় নাটকের মধ্যে একটি ছিল ‘কাহাকে’। এই নাটকের মাধ্যমে তিনি শিক্ষিতা আধুনিকা নারীদের অধিকার বোধ বিশ্লেষণ করেন। কবিতা লিখতেন, গান লিখতেন। তাছাড়া সংস্কারের কাজের জন্য তিনি এই কাব্য ও উপন্যাসের জগৎ ছেড়ে মন দিয়েছিলেন প্রবন্ধ লেখার কাজে। তিনি দীর্ঘদিন ‘ভারতী’ প্রত্রিকা সম্পাদনা করেন। দুঃস্থ মেয়েদের স্বাবলম্বী করার জন্য হাতের কাজ শেখানোর চেষ্টা উল্লেখযোগ্য। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাকে জগৎতারিণী স্বর্ণপদক দেওয়া হয়। এরপরে যার নাম আসে তিনি হলেন মহর্ষির মধ্যম পুত্র সত্যেন্দ্রনাথের পত্নী জ্ঞানদানন্দিনী। তিনি বাংলার নারী জাগরণের অন্যতমা ছিলেন। বাঙালি মেয়েদের আধুনিক শাড়ি পড়ার ধরণ তিনি আবিষ্কার করেন। তিনি তখনকার দিনে ভারতীয় রমণী যিনি স্বামীর সাথে বিলেত যান এবং ভারতের বহু শহরে ভ্রমণ করেন। সঙ্গীত, কাব্য, অভিনয় সব কিছুতেই তার অদম্য উৎসাহ ছিল। ভারতী পত্রিকায় স্ত্রীশিক্ষা বিষয়ক একটি প্রবন্ধ লেখেন।

এছাড়া ছোটদের জন্য ‘বালক’ পত্রিকা প্রকাশ করেন। তার রচিত ছোটদের ‘সাত ভাই চম্পা’ ও ‘তাক ডুমা ডুম’ খ্যাতি অর্জন করেন। রবীন্দ্রনাথের তৃতীয় ভ্রাতা হেমেন্দ্রনাথের পত্নী নিপময়ীর নাম উল্লেখ করা বিশেষ প্রয়োজন। তার ছবি আঁকা অসাধারণ প্রতিভা পরবর্তীকালে তার সন্তানের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। ‘পুণ্য’ পত্রিকায় তার আঁকা ছবি প্রকাশিত হয়। স্বর্ণকুমারী দেবীর কনিষ্ঠা কন্যা সরলাদেবীর নাম খুবই উল্লেখযোগ্য। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হন। রবীন্দ্রনাথের অনেক গানের স্বরলিপি তিনি দেন। ‘বন্দেমাতারম’ সঙ্গীতে সুর তিনি দেন। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে তিনি সক্রিয় ভাবে যুক্ত ছিলেন। তার রচিত গ্রন্থ জীবনের ঝরা পাতা থেকে তার এবং ঠাকুরবাড়ি সম্পর্কে অনেক তথ্য পাওয়া যায়। জ্ঞানদানন্দিনীর কন্যা ইন্দিরাদেবীর নাম অত্যন্ত সুপরিচিত।

রবীন্দ্রনাথের খুব কাছের এবং স্নেহ ভাজন ছিলেন। রবীন্দ্রসংগীতের প্রচুর স্বরলিপি তিনি রচনা করেন। সবশেষে আসা যাক রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে। ক্ষিতিমোহন সেনের ‘রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতন’ বইটিতে রবীন্দ্রনাথের মতে নারীর সাধনায় নারী সম্মন্ধে কবির মনোভাব সুন্দরভাবে আলোকিত হয়েছে। মহাত্মা গান্ধীর অনুরোধে গুজরাটে সাহিত্য সভায় যোগ দেবার জন্য গুরুদেব গুজরাট যাত্রা করেছিলেন। সম্মেলন শেষে গুজরাটের মহিলাদের আমন্ত্রণে কবি সেখানকার বণিতা আশ্রমের একটি প্রতিষ্ঠানে যান। সেখানে তিনি তার বক্তব্যে বলেন প্রত্যেক নারীর মধ্যে সুপ্ত আছে গৌরি যিনি তপস্যায় শিবকে জাগ্রত করে দৈত্যকুলের হাত থেকে স্বর্গকে উদ্ধার করেন। নারী যেন নিজের আত্মমর্যাদা ভুলে কখনই অন্ধের মত পুরুষকে অনুসরণ না করেন। এই কথাটাই কবিগুরু তার বিশ্বলক্ষী কবিতায় বলেছিলেনঃ ‘ভোগের আবর্জনা লুপ্ত হল ত্যাগের হোমাগ্নিতে’র বরোদায় একটি সম্মেলনে তিনি নারী দুটি রূপ বর্ণনা করেছিলেন। একজন প্রতিমা আর একরূপ তপস্বিনীর। বলাকা কাব্যে দুটি রূপ সুন্দর ভাবে চিত্রিত হন –

‘কোন ক্ষণ সৃজনের সমুদ্র মন্থনে

উঠেছিল দুই নারী                   

অতলের শয্যাতল ছাড়ি

একজনা উর্বশী, সুন্দরী

বিশ্বের কামনা রাজ্যে রাণী,

স্বর্গের ঈশ্বরী

আর জন ফিরিয়া আনে

অশ্রুর শিশির স্নানে স্নিগ্ধ বাসনায়

মহুয়ায় সবলা নামক কবিতাটি এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য।

‘নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার

কেন নাহি দিবে অধিকার

হা বিধতা’

রবীন্দ্রনাথ সাধারণ মেয়ে গৃহবধূদের মর্মবেদনা গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। এই উপলব্ধি আমরা পাই তার সাধারণ মেয়ে আর মুক্তি নামক কবিতার মধ্যে দিয়ে। গৃহবঁধুদের জীবন যে শুধু রাঁধা আর খাওয়ার মধ্যে দিয়ে বয়ে যেত এর বাইরে তাদের চিন্তা করার কোন অবকাশ ছিল না তা কবি মুক্তি কবিতায় সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। তাই রবীন্দ্রযুগে মহিলা সমিতি ও নানা রকম হাতের কাজ, ছোট পত্রিকা যেখানে মহিলারা তাদের কথা লিখতে পারেন এইসব সূচনা হয়। এই প্রসঙ্গে বলা আবশ্যক যে এই অগ্রগতিতে ব্রাহ্মসমাজ যত দ্রুত এগিয়ে ছিলেন হিন্দু সমাজের এই জায়গায় আসতে অনেক সময় লেগেছিল।

এসো গো

প্রবন্ধ সমগ্র ।। মতামত ।। সূচীপত্র

 প্রবন্ধ সমগ্র

এসো গো

স্বাতী মিত্র

traveller2.jpg

সুজনবরেষু আগামী,

আজ হেমন্ত ১৪১৮, তোমার আসার প্রতিক্ষায়, প্রতিক্ষা পরিবর্তনের, নতুন কোন চমকের, টাটকা কোন খবরের। ‘আমার এই অন্ধকারে কত রাত কেটে গেল, আমি আঁধারেই রয়ে গেলাম। তবু ভোরে স্বপ্ন থেকে সেই ছবি যাই এঁকে রঙে রঙে, সুরে সুরে, দেখ ওরা সব যেন গান হয়ে যেতে পারে।তুমি আসবে বোলেই সোনালী স্বপ্ন ভিড় করে আসে চোখে। কিন্তু কি আনবে আমার জন্যে, আমাদের জন্যে – ভাল কিছু খবর এনো। হঠাৎ খুশির অমুল্য কিছু মুহূর্ত, যা কিনা স্মৃতির মণিকোঠায় যত্ন করে সাজিয়ে রাখতে পারি। গোটাকতক সোনালি সকাল, গোধূলি মাখা সন্ধ্যে দু-চারখানা অথবা এক আকাশ তারায় সাজানো এক গুচ্ছ মায়াবী রাত। উথাল পাথাল কালবৈশাখী কিছু মন কেমন করা, অফিস ডুব দেওয়া বৃষ্টি ধোয়া দিন, শরতের শিউলি হৈমন্তী রোদ্দুর, মিঠে রোদমাখা শীতের চড়ুইভাতি, বসন্তের চৈতালী চাঁদ আর মহুয়ার মাতাল জোৎস্না। এমন কি দু-চারটে বিয়ের নিমন্ত্রনও আনতে পারো, হাল আমলের ধনতেরাস, জন্মদিন, মুখেভাত। খানকয়েক ভাল সিনেমা, সাহিত্য আর জীবনমুখী। কুলের আচার, ডালের বড়ি, পোস্তবাটা। সব দ্বন্দ্বের অবসান, অন্যায়ের প্রতিকার, টুকটাক অনিয়ম, নিছকই একটু মুস্কিল আসান, একমুঠো ইচ্ছাপূরণ, সবার জন্য ভাতকাপড়, আর মস্ত এক কৌটো শান্তি। অনেক বেশি চাওয়া হয়ে গেল কি। কি যে করি বল এক আশা নিয়ে, বোবা হয়ে মরি, এত ভাষা লয়ে। তাই তো এই খোলা চিঠি তোমার কাছে। এক সমুদ্দুর সুনামীর সর্বনাশ, অন্তহীন, অর্থহীন, বন্দুকবাজীর সন্ত্রাস জীবনের ত্রুটি চেপে ধরেছে প্রতিদিন। অথচ এমন তো কথা ছিল না। ‘ছোট ছোট রাত চেনা মৌতাত, পলাশের বন, অগোছালো ঘর, খড়কুটোময় চিলেকোঠা কোন – কথা ছিল হেঁটে যাব ছায়াপথ। তবে

কেন রোজ স্বপ্ন ভাঙার আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায়। কাহাতক আর রাজনীতির চচ্চড়ি দিয়ে ভাত খাওয়া যায়। বড্ড একঘেয়ে হয়ে গেছে। লোটন লোটন পায়রাগুলি পর্যন্ত বকম বকম করে না আর। এখন ফুড়ুৎ ফুঁড়ত চড়াইদের তরজা, আর তিনটে শালিক করে না রান্নাঘরের চালে নয়, ভোটবাহানার রঙ্গমঞ্চ। ‘অনেক তো দিন বৃথা গেল এ সংশয়ে, এসো এবার দ্বিধার বাঁধা পার হয়ে’ নতুন কিছু চাই। জানি সবই তো নেশা, সাগরে মেশা – একটি ঢেউ, একটি ঢেউ, তবু এদিন হোক না নদী, জানবে কেউ জানবে কেউ। এসো সেই প্রতিক্ষায়, সেই প্রতিক্ষার পথ বেয়ে। এক হাতে রেখো জিয়নকাঠি, অন্য হাতে স্বপ্নের ঝাঁপি। পূর্তিগন্ধময় জঞ্জাল নগরী, এই সেই শহর যার একদিন কল্লোলিনী তিলোত্তমা হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু সেখানে শুধু স্বপ্নের সমাধি খোঁড়াই জীবন। ভোরের খুব কাছে, কিন্তু সেখানে কখনো ভোর হবে না। তবে কিছু রঙ দিও ভোরে রোদে আর আকাশে – আহা গান দিও কিছু, নিকানো দাওয়ায় সোনা রঙ ধান ভাঙবার – কিছু সুখ দিও প্রিয়ার দু-চোখে স্বপ্নের দামাল শিশুর আলোছায়া হাসি কান্নায়। স্বপ্ন হারালে জীবনের আর থাকে কি। আগ মার্কা থোর বড়ি খাঁড়া আর খাঁড়া বড়ি থোর, এই জীবনে স্বপ্নই তো সব। নয় দিলেই ভরে আরো দু-একটা বাড়তি স্বপ্ন। ক্ষতি কি তাতে? আর একটা দিন বাঁচব নতুন কোন আশায়। হোক না সে স্বপ্নের অলীক মরীচিকা অথবা মোহনার স্বপ্নে দিকভ্রষ্ট কোন নদী। ক্ষণিকের বাঁচাটুকু তো সত্যি। জীবনের যেখানে যুদ্ধ, এস বীরের সাজে। জীবনের যেখান যজ্ঞ এস ঋত্বিক বেশে। এই কামনায়, অনেক শুভেচ্ছায়।

স্বাতী। 

গঙ্গার নিরন্ন মানুষেরা

প্রবন্ধ সমগ্র ।। মতামত ।। সূচীপত্র

 প্রবন্ধ সমগ্র

গঙ্গার নিরন্ন
মানুষেরা
আশরাফ উদ্দীন আহম্মদ
বাসুনিয়াপট্টি, ঘোড়ামারা, বাংলাদেশ
 

ঢাকা জেলার রাজানগর গ্রামে সমরেশ বসু’র (১৯২৪-১৯৮৮) খ্রিষ্টাব্দে জন্ম। পরবর্তী সময় পশ্চিমবঙ্গে চলে যান। তার উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি ‘গঙ্গা’ (১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে) তে তাঁর প্রতিভা স্পষ্ট ফুটে উঠেছে বলা অপেক্ষা রাখে না। যদিও প্রায় নব্বইটি উপন্যাস, পনেরোটি গল্প সংকলন এবং কালকূট ছদ্মনামেও অনেক গল্প আছে তাঁর। ছোটদের জন্য গোয়েন্দা কাহিনী-উপন্যাস-গল্প ছাড়াও গল্প ও উপন্যাসের চিত্রনাট্যও তৈরী করেছেন তিনি।

‘গঙ্গা’ পন্যাসটি দিয়েই  সুনামের চরম শীর্ষে পৌঁছে গেছেন, ‘গঙ্গা’ মূলত লড়াই করে বেঁচে থাকারই কাহিনীমালা। প্রকৃতি এবং মানুষের সঙ্গেই মানুষকে লড়াই করে বেঁচে থাকার নামই যে জীবন, সেই কথায় বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়। পাঠক বিলাসের সাহসিকতা আর উদ্দামতা দেখে শিহরিত না হলেও তার সমুদ্রে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা অনেকটা সংগ্রাম করে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা জাগায়। একজন সামান্য মাছমারা ধীবর হয়ে তার মধ্যে যে আগুন তার খুড়ো পাঁচু লক্ষ্য করে তা মোটেও অস্বাভাবিক নয়। হতদরিদ্র মাছমারারা কখনো সুখে-শান্তিতে থাকতে পারেনি, তাদের জীবনটাই চলমান নদীর মতো, কোথায় যে সুখের ঠিকানা, আর কোথায় বা মা গঙ্গার কৃপা, তারা জানে না। দাদন ব্যবসায়ীদের রক্তচক্ষু, আর মহাজনদের চড়া সুদে টাকা ধার, এবং ফড়েনিদের হুকুমজারি, অল্প দামে মাছ কিনে নেওয়ার ছলনা, সবই তাদের বিপক্ষে যায়, তারা শুধু অন্ধকারেই রয়ে যায়। ঘরে মা-বাবা স্ত্রী-সন্তান হা-হাপিত্যেশ করে বসে আছে, ঘরের মানুষ অকুল দরিয়ায় জীবন বাঁচানোর ফসল তুলতে গেছে, ঘুম কি আসে কারো চোখে। হাজারো চিন্তায় মনপ্রাণ উথালপাথাল।

এভাবেই জীবনটা চলে ধুকে-ধুকে, মালোপাড়ার মানুষের জীবনগুলো যেন বিধাতা এভাবেই গড়ে তুলেছে,যার কারণে রোগ-শোক চিরসঙ্গী। মৃত্যু যেন কাছের পড়শী, আর তাই দেখা যায় ‘গঙ্গা’র মূল চেতনা নদীর প্রতিকূলতার সঙ্গে জড়িত মৃত্যুবোধ। মানুষ-প্রকৃতি-পরিবেশ-নদী এই উপন্যাসের প্রধান বিষয়বস্তু'। সমরেশ বসু বিশেষ একটি অঞ্চলের মৎস্যজীবি সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রার নিখুঁত প্রতিচ্ছবি অংকিত করেছেন। নদীই হল উপন্যাসের সক্রিয় এবং আচরণশীল।

খুড়োর বারণ শর্তেও বিলাস মনে প্রাণে ভালোবেসে ফেলে দামিনী ফড়েনির নাতনি প্রেমিক পরিত্যক্ত হিমিকে, এই হিমিই তার জীবনটাকে একটা স্থিতি'তি জায়গায় এনে পরিবর্তন সাধিত করে, পতিতাপল্লীর মেয়ে এবং যার মা ছিল রাড়ী অর্থাৎ পতিতা, সেই মেয়েটাই বিলাসকে নতুন দিনের স্বপ্ন দেখায়, সমুদ্রে যাওয়ার প্রেরণা যোগায়, এমন কি সমুদ্র ধীবরের বউ হওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করে।

বিলাসের চরিত্রের মধ্য দিয়ে সমরেশ বসু নিজেকে বিশাল একটা জায়গায় নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, কারণ গঙ্গা থেকে সমুদ্রে যাওয়ার যে কাকুতি দেখতে পাওয়া যায় তা সত্যি অপূর্ব বলতেই হয়। বিলাসকে শুধুমাত্র গঙ্গা ধরে রাখতে পারেনি, পারার কথাও নয়, কারণ যার কানে সমুদ্রের ডাক পৌঁছে সে কি আর বদ্ধ স'স্থানে পড়ে থাকে, তাই দেখা যায়, বিলাসের মন অসি'র সর্বসময়, শহর ঘেঁষা  গঙ্গা, শহরের নানান লোভনীয় হাতছানি তাকে কিছুতেই বশ করতে পারেনি। বিলাসের দুঃসাহস দেখে কখনো খুড়ো পাঁচু অবাক হয়েছে, খিস্তি-খেউড় করেছে, কিন্তু' কোনোভাবে দমাতে পারেনি, কারণ সে জানে ওর রক্ত নিবারণ সাঁইদারের রক্ত, সেই দুঃসাহসিক মানুষটা যেমন ছিলেন গুণিন তেমনি ছিলেন সমুদ্রের বাছাড়ি নৌকার মাঝি, একত্রিশ হাত বাছাড়ি নৌকা নিয়ে সমুদ্রে মাছ ধরতে যেতো, কয়েকবার পাঁচুও সঙ্গী ছিল বড়দার, সেই দাদার আগুন ভাইপো বিলাসের মধ্যে দেখতে পেয়ে মনে মনে শিহরিত হলেও গর্বে বুক ভরে যেতো।

‘গঙ্গা’  উপন্যাসের সমস্যা- চরিত্র জেলেদের জীবন দিনলিপি, নিরবচ্ছিন্ন যুদ্ধ আর সংগ্রামের, জীবন যন্ত্রণার মধ্যেই জীবনের পটভূমি রচিত হয় বারংবার। মালোপাড়ার হতশ্রী মানুষগুলো একটু খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার জন্য যে যুদ্ধ করে  অর্থাৎ দিনরাত্রি অক্লান্ত- পরিশ্রম করে, তারপরও দারিদ্র্যে ভরপুর জীবন। বর্ষার মরশুম চার মাস, আষাঢ়-শ্রাবণ, ভাদ্র-আশ্বিন, মাছমারারা তখন অমাবস্যা-পূর্ণিমার জোয়ার-ভাটার গোন কোটালের পিছে-পিছে ভেসে বেড়ায় গাঙে-নদীতে, সে এক কঠিন সংগ্রাম।

সমরেশ বসুর জীবন ছিল ‘গঙ্গা’র মতো, বারবার কুল ভেঙে-ভেঙে সামনে যেতে চেয়েছেন, কিন্তু' বারবারই ব্যর্থ হয়েছেন, যে ‘গঙ্গা’ তার চেতনার আর উপলব্ধির পাড় ভেঙেছে বারবার, এই গঙ্গা আক্ষরিক অর্থে নদী নয়, জীবন-মহাজীবন, শুধু জীবনই বা বলি কেন ‘সময়’, নদী চলেছে সমুদ্রে, সময়ও। অতীত থেকে ভবিষ্যতের অকুল দরিয়ায়।আজ কাল পরশুর বাঁক ছাড়িয়ে চিরকালের বা মহাকালের দিকে, মহাকাল সে তো  সুদূর দিগন্তে-, অসীমের মাঝে হারিয়ে নিজেকে খুঁজে ফেরা, এই জীবন চেতনার সঙ্গে ওতপ্রোত হয়ে আছে মৃত্যু চেতনা।

সমরেশ তার রচনায় বিষয় ও ক্ষেত্র বা আঙ্গিক পরিবর্তন করেন, ফিরে এলেন সমতলের গঙ্গায়। ধীবর বা মালোদের জীবনের বিচিত্র কাহিনীতে, নদী থেকে সমুদ্রে যার বিস-বিস্তার, এই পৃথিবীর আদিম এক শিকারী সমাজ যাদের জীবনের সিকি ভাগ ডাঙায় আর বাকি তিন সিকি ভাগই পড়ে থাকে জলে, মাছেদের সাথে, নদী এসেছে তার জীবনে সর্বনাশা কুলত্যাগিনী নারীর অনিবার্য রূপকে, জলের ঋতু বদলায়, প্রহরে-প্রহরে রঙ বদল হয়, তার অদৃশ্য অজানা গর্ভে নিঃশব্দ পদসঞ্চারে দেখা দেয় জলের শস্য, জীবনের ফসল। সেখানে ঝরা-খরা ও মরার ত্রিমিতি, মিঠে জলে মেশে জীবনের লবণ। এই মানুষগুলির  দিবারাত্রির বারোমাস্যায় ছায়া ফেলে অসংখ্য জীবাশ্ম ঘটিত জটিল সংস্কার আর কিংবদনশীল গল্পমালা। জীবিকা হয়ে ওঠে জীবনের নেশা। নিয়তির মতো নিষ্ঠুর উদাসীন প্রকৃতির সঙ্গে পুরুষানুক্রমে দ্বন্দ্ব পুরুষানুক্রমে তা নাটকীয় রূপ নিয়েছে মাছমারাদের জীবনে।

এই মাছমারাদের হালে-জালে হাত রেখে তিনি তাদের নাড়ির স্পন্দন অনুভব করেছেন, যেন মুখোমুখি বসে একই বিড়ির আগুনে গল্প ধরিয়েছেন, এই অন্তরঙ্গতাই যুগিয়েছে গঙ্গা উপন্যাসের উপকরণ। তার চাল-চরিত্র এবং চালচিত্র। গাবে মজানো জালের মতোই গল্পের রসে আঁচিয়ে এর ক্যানভাসটা ছড়িয়ে পেতেছিলেন সমরেশ, প্রবল জলস্রোতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলেছিল এর ভাটিয়াল কাহিনী, বর্ণবহুল ঘটনায় ছলাৎ ছলাৎ দাঁড়টানার শব্দ শুনতে পাওয়া যাচ্ছিলো থেকে-থেকে, সে সঙ্গে আরো একটা বাড়তি পাওনা, সব ছাড়িয়ে আবেগ, অন্যরকম জলের টানের মতোই ভাষায়। তবে গঙ্গা উপন্যাসটি শহর ঘেঁষা বলা যেতে পারে, চরিত্রের অনুষঙ্গে, কাহিনীর দাবিতে গঙ্গা’য় বসিরহাট-ত্রিবেণী-নৈহাটি- হুগলী-ক্যানিং-হাসনাবাদ এবং চন্দননগরের মতো বেশ কিছু অঞ্চলের কথা উল্লিখিত হয়েছে, এসব অঞ্চলের বাতাবরণ শহর ঘেঁষা। তবে উপন্যাসের ভূমিকায়, সমরেশ বসু লিখেছেন, আতপুর ও হালিশহরের মৎস্যজীবিদের সহযোগিতা না পেলে ‘গঙ্গা’ লেখা সম্ভব হতো না। উপন্যাসটিলেখার আগে অনেক মালো পরিবারের সঙ্গে দিনরাত্রি গঙ্গাবক্ষে কাটিয়েছেন তিনি। ‘গঙ্গা’ কিন্তু' শেষ পর্যন্ত- পাঠককে সমুদ্রে নিয়ে যেতে পারেনি, ‘গঙ্গা’ শুধু মাত্র গঙ্গাতেই থেকে গেছে, উপন্যাসের তাবৎ জায়গা জুড়ে পাঁচু খুড়ো এবং ভাইপো বিলাসের

উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়, তাদের কথোপকথন এবং গঙ্গার দৃশ্যাবলী ছিল প্রধান আর্কষণ। তারপর একদিন আমাশয় আক্রান্ত- হয়ে পাঁচু মারা যায় উপন্যাসের শেষদিকে, ঠান্ডরামও মাছের আকালের কারণে দুঃখ কষ্টে একদিন নদীতে ডুবে প্রাণ বির্সজন দেয়। বিলাসের তারপর থেকে মন আর বসেনি, সমুদ্রে যাওয়ার ইচ্ছে জাগ্রত হয়, হিমির প্রেরণা তাকে আরো  উৎসাহিত করেছে কথাটা না বললেও অবিচার করা হয়। কিন্তু' সময়ের সঙ্গে ছুটে চলার যে প্রতিযোগিতা লক্ষ্য করা যায় তাও পাঠককে বিমোহিত করে। হিমি-বিলাসের প্রেম উপাখ্যানটিও চমৎকার বলতেই হয়,নদী আর মানুষের মধ্যে কতোখানি যে মিল তা ভাবিত করে এখানে। নদীর কাছে সবাই উদার হয়ে যায়, নদী তখন ভালোবাসার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে।

বড় প্রেম যে সবসময় কাছেই টানে না, অনেক সময় দূরেও সরিয়ে দেয়। গঙ্গা’র বিলাস-হিমির প্রেমের চিত্রটি একইভাবে অংকিত হয়েছে। বিলাস ফিরে গেছে ধলতিতার দিকে, এখানে একটু নাটকীয়তা লক্ষ্য করা গেলেও ভালোবাসা সব সময়ই সুন্দর তা চিত্রায়িত করেছেন সমরেশ।‘গঙ্গা’ উপন্যাসটি শেষ পর্যন্ত- গঙ্গা’য় সীমাবদ্ধ থেকেছে, সমুদ্রে যাওয়ার যে আকাঙ্ক্ষা এবং একত্রিশ হাত লম্বা সেগুন কাঠের বাছাড়ি নৌকা নিয়ে সমুদ্রে মাছ ধরার যে স্বপ্ন তা শুধুমাত্র স্বপ্নেই রয়ে গেছে বিলাসের। বিলাস সাঁইদার হয়েছে, শাবর নিয়ে সে রাইমঙ্গল ও ঝিল্লের মোহনায় অপেক্ষা করছে সমুদ্রযাত্রার মোহনায়। বাস-বে না দেখা গেলেও আসলে সে আবেগকে ছুঁয়ে যাওয়ার যে প্রয়াস তা পাঠক ভালোভাবেই অনুধাবণ করেছে, অর্থাৎ হিমিকে যেমন পাওয়া হল না তেমনি সমুদ্রেও যাওয়া হল না, শুধু একটা হাতছানি অথবা অন্যরকম অনুভূতি কাজ করেছে সর্বদা। জেলে জীবন মূলত গ্রাম নির্ভর, গঙ্গা উপন্যাসে ধীবরদের গ্রাম ভিত্তিক সমাজজীবনের পরিচয় খুব একটা অংকিত হয়নি, মালোদের স'স্থল জীবনের ছবি অল্প পরিসরে এসেছে, তাদের জলজ জীবনের বৈচিত্র্যই এখানে বিস্তৃতভাবে পরিলক্ষিত, নৌকার ওপরে কি ভাবে জীবন অতিবাহিত হয় তা দেখানো হয়েছে, তারপরও বিলাসের প্রথম যৌবনের টুকরো-টাকরা কিছু ছবির দৃশ্যাবলী আলোকপাত করা হয়েছে, যেমন কোনও এক উদ্ভ্রান্ত- দুপুরে অমৃতের তম্বী বউয়ের শরীরের ভাজে নিজের পুরুষত্বকে সর্মপণ করেছিলো বিলাস, তারপর থেকে ওর ভেতরে একটা চনমনে ভাব লক্ষ্য করা যায়। রমণীয় সুখ বা নেশা হয়তো একেই বলে, নিজেকে আর নিজের আয়ত্বের মধ্যে রাখতে পারেনি, সেই সুখের নেশা বুকে নিয়ে খুড়ো পাঁচুর সঙ্গে গঙ্গায় মাছ মারতে এসেছে বিলাস। তবে পাঁচু প্রত্যক্ষ করেছে, নিবারণের মতোই  বিলাস দুর্বিনীত এবং স্পষ্টভাষী, কারো কথায় পরোয়া করে না, হিরো হওয়ার জন্য নয়, অন্যায় সহ্য করতে পারে না, তবে নিবারণ জাত মাছমারা হলেও যেদিন অন্যের ঘের থেকে মাছ চুরি করতো, সেদিনই হাতে কিছু পয়সা থাকতো, সেদিন বাজারে গিয়ে মদ খেতো এবং পতিতা পল্লীতে গিয়ে শরীর ও মনটাকে কিছুসময়ের জন্য তৃপ্ত করে ফিরতো, অথচ বিলাস মদ খাই না, যদিও দামিনী তাকে জোড় করে একবার খাইয়ে দিয়েছিলো, তবে নারী শরীরের প্রতি একধরণের আসত্তি পুরোদস্তুর'র ছিল, সেই লোলুপতা থেকে একরকম ভালোবাসা বাসা বাঁধে মনের কোণে, হিমিই প্রকৃতপক্ষে নায়িকা বলা অপেক্ষা রাখে না। উপন্যাসে চরিত্র অনেক থাকলেও খুড়ো পাঁচু-বিলাস হিমি-দামিনী ঘুরে ফিরে মূখ্যভাবে এসেছে, এদের জীবন নাটকই উপন্যাসের প্রাণ, নদীর মতো এগিয়ে গেছে বাঁকে, কোথাও থেমে থাকেনি, গঙ্গা’ যেন মহাভারতের সেই পবিত্র গঙ্গা।  গঙ্গায় গোষ্ঠীবদ্ধ জেলে জীবনের  নানা প্রসঙ্গে মিথ-পুরাণের কথা যেমন এসেছে, লৌকিক-অলৌকিক অনেক সংস্কার আছে, পৌরাণিক চরিত্রেরা কদাচিৎ জেলেদের সংলাপে আবার কখনো মালো সমাজের বর্ণনায় ছুঁয়ে গেছে, শান-নু-গঙ্গা, জগন্নাথ ঠাকুর, শ্রীকৃষ্ণ-রাঁধা, কালী ডাকিনী-বাসুকি প্রমুখ প্রতীকতায় ধীবরসমাজে লগ্ন হয়ে উঠে এসেছে ‘গঙ্গা’য়। দক্ষিণরায় তথা বনবিবিকে জেলের শবর থেকে দূরে থাকার মিনতি জানায়, মাছের দেবতা খোকাঠাকুরকে উদ্দেশ্য করে জেলে বউয়ের কাতর আকুতি,‘ তুমিই মাছমারার দন্ডমুন্ডের কর্তা, তুমি দিলে আমি আমার সোয়ামির হাসিমুখ দেখবো, ঘরে আমার সোহাগের বান ডাকবে, আমার ছায়েরা হেসেখেলে বেড়াবে, আমার হাঁড়ি ভরে থাকবে, নতুন সুতো আসবে, নতুন জাল বুনবো, আমি পুজো দেবো তোমাদের সকলের পায়ে’। মা গঙ্গা কৈবর্তদের পরম আরাধ্য, মাছমারাদের সারাবছরের ভাত কাপড় গঙ্গার কাছেই পাওনা, তাই গঙ্গা’য় প্রার্থনার বিষয়বস্তু', তারই দয়া-দাক্ষিণ্যে ধীবরদের অসি-ত্ব এবং জীবিকার সংস্থান। গঙ্গা জেলেদের একমাত্র ভরসা। তাই বিশ্বাস করে, জীবন-যৌবন,মরণ-টাকাপয়সা-ধনদৌলত বেঁচে থাকার সকল সুখ নিয়ে মা-ঠাকুরুণ বসে আছে গাঙের তলায় এবং তার কৃপায় বিশ্বসংসার চলে। মা-ঠাকুরুণ সকল সহায়, সে বাঁচতে বলে বাঁচা, মরতে বললে মরা।

নদীতীরের জীবনযাত্রার দৃশ্যাবলী বেশ কাব্যময় করে তুলে ধরেছেন, কোথাও কৃত্রিমতা নেই, যেন কলমের আগায় সাবলীল ভাবে তরতর করে বের হয়ে আসছে জীবনের কথা ও প্রতিচ্ছবি। শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন,“গঙ্গা’য় মৎস্যজীবী সমাজের অলৌকিক সংস্কার-বিশ্বাসে আবিষ্ট, নদীসমুহের জোয়ার-ভাটা আবর্ত প্রভৃতি প্রকট ও গোপন বিপদের সহিত অবিরত সংগ্রামে প্রতিনিয়ত মৃত্যু রহস্যের সম্মুখীন, জলস্রোত ও মনোস্রোতের বেগবান প্লাবনের মধ্যে অত্যাজ্য সংস্কার পরিণত জীবননীতির নোঙরে দৃঢ়সংবদ্ধ জীবনের অপূর্ব পরিচয়”।

‘আদাব’ গল্পের সেই মুসলমান মাঝির বিপন্ন মানবিক অস্তিত্বের প্রতি পরিচিত কণ্ঠস্বর, সেদিনের মতো আজো শুনতে পাই। সাহিত্যিকের যাত্রারণ - ছেচল্লিশের দাঙ্গা -মানুষে মানুষের হানাহানি এবং অপরিমিত রক্তপাতের জ্বলন্ত উদাহরণ সামনে রেখে, মোড়ল-মহাজনেরা ততক্ষণে দেশের ভাগবাটোয়ারার কুটিল পরিকল্পনা তলে-তলে সম্পন্ন করেছে, আর  একজন শিল্পী চোখ মেলে দাঁড়িয়ে মানুষের স্বাভাবিক মানবিক আচরণের কথা ভাবছে, সে আচরণের চরমতম সত্য হল মানুষই শুধুমাত্র মানুষ।

সেই মানবিক ভাবনা থেকেই ‘গঙ্গা’ লেখা, সমরেশ বসু নিজেই বলেছেন, ‘উপন্যাসটি এক শিকারের কাহিনী, কিন্তু' অলক্ষ্যে চলে গেছে সেই বিবরণের ধারাবাহিকতায়। গঙ্গার বুকে মৎস্যজীবীদের সঙ্গে মাছ মারতে গিয়ে অন্যরকম এক উপলব্ধি জাগে, এবং সেই সময় ‘মাছ ধরা’ শব্দটি বড় বেমানান শোনায়, আর তাই মৎস্যজীবীদের আমিই অভিহিত করেছিলাম ‘মাছমারা’। আনন্দ বাগচীর একটি মন-ব্য, ‘খন্ড দৃষ্টিতে যে জীবন শুধুই জলের পাঁচালী, লৌকিক মহাকাব্য চাপা পড়ে আছে তারই তলায়। সমরেশ বসুর চোখে অবশ্যই সেটা এড়ায় নি, বহুবার ছুঁয়ে ছেনে-ছেঁদে দেখার মতোই এই নদী আর তার নাব্যজীবন তার অজানা ছিল না। এই মাছমারাদের হালেজালে হাত রেখে তাদের নাড়ীর স্পন্দন অনুভব করেছেন...”

নদী আর নারী দুই নিয়তির মতোই সমরেশকে চিরদিন বিপরীত আর্কষণে টেনেছে, নদীকে অবশ্য ব্যাপক অর্থে প্রকাশ করেছেন, জীবন যেখানে অতপ্রত ভাবে মিশে আছে, সেই জীবনের কথায় নদীর কাছে ব্যক্ত করেছেন কিন্তু' নারী সেই জীবনের এবং জীবনবোধেরই জ্বালানি। বারংবার আমরা তাই নদী আর নারীর কাছেই ছুটে আসি, জীবন যে এখানে চিরকালের বাঁধনে বাঁধা।

স্বাধীনতার সঙ্কট

প্রবন্ধ সমগ্র ।। মতামত ।। সূচীপত্র

 প্রবন্ধ সমগ্র

স্বাধীনতার
সঙ্কট
সুদীপ্ত বিশ্বাস
রাণাঘাট, নদীয়া, পশ্চিমবাংলা

৮৯৮ সাল। বিচার প্রহসন সমাপ্ত হল। দামোদরের বিরুদ্ধে হত্যা অপরাধের চার্জ। পুনার প্লেগ অফিসার রান্ড সাহেবকে হত্যা করেছেন মহারাষ্ট্রের এই বিপ্লবী। বিদ্রোহী চাপেকারের মৃত্যুদণ্ড উচ্চারিত হল কোর্টে। সহাস্যে দামোদর বললেন, ‘এই মাত্র? আর কিছু নয়?’ নির্দিষ্ট দিনে দামোদরের কণ্ঠ রোধ করল ফাঁসির নির্মম রজ্জু। ঝুলে পড়ল তার মৃত্যুহীন দেহটি। এই ভাবে শুধু মাত্র একটি নয়, একই মায়ের বুক থেকে ঝরে গেল তিন তিনটি ভাই- দামোদর, বালকৃষ্ণ ও বাসুদেব চাপেকার- চাপেকার পরিবারের তিন তিনটি সন্তান। দেশ জননীর অপমান অসহ্য মনে হয়েছিল বলেই তারা প্রাণ উৎসর্গ করেছিলেন দেশ মাতৃকার পরাধীনতার বন্ধন মোচনের জন্য। তাদের সংগ্রাম ছিল স্বাধীনতার সংগ্রাম। সাদা চামড়ার বিদেশি মানুষের বিরুদ্ধে দেশি মানুষের সংগ্রাম।সে সংগ্রাম ছিল শক্তিশালীর বিরুদ্ধে দুর্বলের, শোষকের বিরুদ্ধে শোষিতের, পরাধীনতার বিরুদ্ধে স্বাধীনতার। চাপেকার ভাইদের মত প্রাণ দিতে হয়েছে বহু বিপ্লবী বন্ধুদের। কিন্তু কখনোই পিছপা হয়নি ভারতের যুবকেরা। এক জনের মৃত্যুর পর আরও দশ জন হাসি মুখে এগিয়ে এসেছে প্রাণ দান করার জন্য। কারণ, তখন তাদের মধ্যে জেগে উঠেছিল দেশাত্মবোধ। তখন ভারতবর্ষে ছিল পরাধীনতার সঙ্কট। আজ যুগ বদলেছে, স্বাধীন হয়েছে ভারতবর্ষ। কিন্তু সে আজ ভুগছে মানবিকতার সঙ্কটে যা থেকে সৃষ্টি হচ্ছে স্বাধীনতার সঙ্কট। যা আরও অনেক জটিল আর ভয়ংকর। কোনও রোগকে যদি ধরা যায় তবে তা নির্মূলও করা যায়। কিন্তু রোগ ধরা না গেলে তার দাওয়াই দেওয়া সহজ নয়। সে সময় শত্রু পক্ষ ছিল সাদা চামড়ার ইংরেজ। ইংরেজ দেখলেই বয়কট কর, বিদ্রোহ কর, যুদ্ধ কর- এই ছিল রীতি। ভারতবাসী সেটা বুঝতে পেরেছিল। তাই এসেছিল স্বাধীনতাও। কিন্তু তথাকথিত স্বাধীন ভারতবাসী আজও বুঝতে পারছে না স্বাধীনতাটা ধরে রাখা যাবে কিভাবে? তারা নিজেরাই নিজেদের কবর খুঁড়ে বসছে। এ ক্ষেত্রেও রোগটি ঢুকেছে ওই সাদা চামড়ার দেশ থেকেই। শুধু AIDS বা ডিভোর্স নয়। ভারতবর্ষকে গ্রাস করেছে ভয়ংকর পশ্চিমী ভোগবাদ। কনভেন্ট এডুকেশনের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি শিশুর মনেই ঢুকে পড়েছে ভয়ংকর ভোগবাদ। ছোঁয়াচে এই রোগ খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে যারা কোনও দিন স্কুলে যায়নি তাদের মধ্যেও। আজ ভারতের মানুষ সবাই ভোগী। তারা চর্ব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয় ভোগ করতে চায়। এনজয়, এনজয়টাই আজকের ভারতের মূল মন্ত্র। টাকা, টাকা চাই। আজকের ভারত সকালে ঘুম থেকে উঠে বলে - টাকা চাই। সারাদিন হন্যে হয়ে ছোটে টাকার পিছনে। রাতে ঘুমতে যাবার আগেও হাই তুলতে তুলতে বলে, টাকা চাই। কিন্তু স্বপ্নের মধ্যেও সে ধরতে পারে না তার অধরা টাকাকে। সত্যি করে বললে কত টাকা চাই, কত টাকা পেলে এই টাকার পেছনে ছোটা বন্ধ হবে সেটা জানে না একজন ভারতীয়ও। তাই তারা শুধু ছুটছে আর ছুটছে। এই ছোটাছুটিতে পরস্পরকে শুধুমাত্র ধাক্কাধাক্কি নয়, মেরে ফেলতেও পিছপা নয় ভারতবাসী। তাদের মানবিকতার ফাঁসি হয়ে গেছে অনেকদিন। সবাই চায় সবাইকে ঠকাতে। আর এই ঠকানোর জুয়া চুরিতে ঠকতে হয় সবাইকেই। মাছওয়ালা ঠকায় খদ্দেরকে। সেই খদ্দেরই তাকে ঠকায় যখন সে তেল বা চাল কিনতে তাদের দোকানে যায়। ডাক্তার ঠকান রোগীকে। সেই রোগীও ডাক্তারকে ঠকান যখন ডাক্তার গাড়িতে চড়েন, বাজারে যান, ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করান, ফ্ল্যাট কেনেন অথবা নেহাতই হাওয়া বদল করতে বেড়াতে যান অন্য কোনও জায়গায়। সব ভারতবাসীই আপ্রাণ চেষ্টা করেন তার কাছে অন্য যেই আসুক, তার গলা কাটতে। শুধুমাত্র রাজনৈতিক নেতা বা পুলিশেরাই তাদের চরিত্র হারান নি, চারিত্রিকভাবে সর্বস্বান্ত হয়ে গেছেন আমজনতা। প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়েছে ভোগবাদ আর দুর্নীতি। রং মিস্ত্রি, সাইকেল মিস্ত্রি, জুতো পালিশের কবলার, ঠিকে ঝি, ছাত্র, শিক্ষক, হেডমাস্টার, জমির দালাল, ইঞ্জিনিয়ার, পলিটিশিয়ান - সবার চরিত্র সমান। সবাই-ই দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। সবাই জানে রোগ একটা হয়েছে। কিন্তু এ যে সর্ষের মধ্যেই ভূত- থুড়ি- ভূতের মধ্যেই সর্ষে। ভেজালের পরিমাণটা বাড়তে বাড়তে এতটাই বেড়ে গেছে যে এখন, আসল বস্তুটি যে কি সেটাই বোঝা দায়। স্বাধীনতার যুদ্ধটা ছিল অনেক সহজ একটা অঙ্ক।

ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর, ব্যস। কিন্তু আজ এ যে নিজেদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। নিজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। যা খুব কঠিন কাজ। সেদিন এক বিশ্ববিদ্যালয়ের হতাশ যুবক অধ্যাপকের সঙ্গে কথা হল। জীবনের যাঁতা কলে ঠকতে ঠকতে এখন তিনি দ্বিধাগ্রস্ত। দুটি সন্তান তার। নিজে খুব সহজেই ম্যানেজমেন্টের থিওরির উপর লেকচার দেন এম. বি. এ’র ক্লাসে। কিন্তু কি শিক্ষা দেবেন তিনি তার নিজের কচি কাঁচা ছেলে মেয়ে দুটিকে? তাদেরকে কি শেখাবেন মানবিক বোধ সম্পন্ন মানুষ হয়ে উঠতে? বিবেকবান হতে? না কি তাদের কে শেখাবেন স্বার্থপর হতে, স্রোতের সঙ্গে ভেসে গিয়ে টাকা, টাকা করে হাই তুলতে? বিবেকবান হলে তোতাদেরকে জীবন ভোর ঠকতে হবে, সাঁতার কাটতে হবে স্রোতের বিরুদ্ধে। কোনও মা বাবাই কি চান তার সন্তানেরা জীবনভোর ঠকুক? কষ্টে থাকুক? কিন্তু চাপেকার ভাইদের মা চেয়েছিলেন। পরাধীন ভারতের বহু মা বাবা চেয়েছিলেন তার ছেলে রায়বাহাদুর না হয়ে বিপ্লবী হোক। দুধেভাতে না থেকে গর্জে উঠুক, হাসতে হাসতে ফাঁসির দড়ি গলায় পড়ুক। সে সময়ে মানবিকতার সঙ্কটটি আসেনি। মানুষ মনের অন্তঃস্থল থেকে ফকির হয়ে যায়নি। আজ লাখপতি, কোটিপতি, মিলিয়নিয়ার, বিলিয়নিয়ার-সবাই ফকির। তারা চায় তাদের ছেলেরা আরও অনেক টাকা আয় করুক। আরও লোক ঠকাক। একটি পদার্থের মধ্যে কিছু পরিমাণ অপদ্রব্য মিশে গেলে তাকে পৃথক করা যায়। কিন্তু পদার্থটির প্রতিটি পরমাণুই যদি বিষাক্ত হয়ে পড়ে তবে তাকে বিষ ছাড়া অন্য কিছু বলা যায় কি? আজ ভারতীয় সমাজটির হয়েছে শেষোক্ত পদার্থটির দশা। ভাষা, জাতি, ধর্ম, রাজ্য নির্বিশেষে গোটা ভারতের একই চিত্র। ভারত একটি ভোগী দেশ। ভারত একটি দুর্নীতিপূর্ণ দেশ। যে ভারত পৃথিবীকে শুনিয়েছিল উপনিষদের শান্তির ললিত বাণী- ‘ত্যক্তেন ভুঞ্জিথ্যা’, তার এই নৈতিক অবনমন সত্যিই অকল্পনীয়। পশ্চিমী হালকা ভোগবাদ সম্পূর্ণ গ্রাস করেছে ভারতের গোটা সমাজটাকে। মিথ্যে বলা ও লোক ঠকানো ভারতবাসীর সাধারণ ধর্মে পরিণত হয়েছে। যিনি মিথ্যে বলেন না বা কাওকে ঠকান না তাকে সর্ব ক্ষেত্রেই ঠকতে হচ্ছে পদে পদে। বিপদে তার পাশে দাঁড়াবার কেউ থাকে না। তিনি সমাজের চোখে বোকা লোক। আজকের ভারতে –An honest man is a stupid man.

একটি  শিশুও জানে কিসে ভারতের মঙ্গল হবে আর কিসে হবে অমঙ্গল। কিন্তু গোটা ভারত বিশাল অজগরের মত জেগে ঘুমাচ্ছে। জাত-পাত ও ধর্ম ভিত্তিক সংরক্ষণ দেশের সব চেয়ে বড় শত্রু। কিন্তু ভোটের রাজনীতির যুগে দিন দিন বাড়ছে নানাবিধ সংরক্ষণের দাপট। দরকার, খুব দরকার এমন কিছু মানুষের যারা গলা উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করবে- রাজা তোর কাপড় কোথায়?

আমজনতা মনে করে সব দোষ শাসক দলের। শাসক দলটি বদলালেই সব কিছু ম্যাজিকের মত বদলে যাবে। আবার রাম রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। ফলে সবাই গর্জে ওঠে, পরিবর্তন, পরিবর্তন চাই। কি পরিবর্তন? না, নিজেরা সবাই দুর্নীতিগ্রস্থই থাকব, কিন্তু নতুন শাসক দল হবে ধোওয়া তুলসী পাতা। যা সত্যিই সোনার পাথর বাটি খোঁজার সামিল। সুতরাং পরিবর্তন প্রত্যাশী জনগণ নতুন শাসক দলের শাসনে কিছু দিনের মধ্যেই আবার বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে। এরপর গঠিত হয় আরও কিছু নতুন রাজনৈতিক দল যা আরও বেশি দুর্নীতিগ্রস্থ বলে প্রমাণিত হয় অল্প দিনের মধ্যেই। আসলে পরিবর্তনটি দরকার শাসক দলের নয়, জনগণের নিজেদের চরিত্রের। আম জনগণের মধ্যে থেকেই কেউ কেউ নেতা হন। সেই আম জনগণের চরিত্রই যদি কালিমা যুক্ত এবং ভোগ বাদে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়, তবে যিনি নেতা- তিনি শাসক বা বিরোধী যে দলেরই হন না কেন ,তিনি তো দুর্নীতিগ্রস্থ হবেনই। তিনি তো চুরি-চামারি, ডাকাতি, ধর্ষণ, রাহাজানি করবেনই, তিনি তো দেশটাকে বিক্রির ব্যবস্থা করবেনই। এতে অবাক হবারই বা কি আছে, হতাশ হবারই বা কি আছে?

যতদিন না ভারতবর্ষের আমজনতার মধ্যে ফিরে আসবে বিবেকবোধ, যতদিন না ভারতবর্ষের আমজনতা ভোগবাদ ত্যাগ করে পরস্পরকে ঠকানোর জুয়োচুরি বন্ধ করে পরস্পরের সহাবস্থানে বিশ্বাসী হবে, তত দিন পর্যন্ত যতই শাসক শ্রেণীর বদল হোক, গণভোট হোক, কোনও পরিবর্তন হবে না, চলতে থাকবে, চলতেই থাকবে এই মানবিকতার সঙ্কট তথা স্বাধীনতার সঙ্কট।

রহস্য রোমাঞ্চ

প্রবন্ধ সমগ্র ।। মতামত ।। সূচীপত্র

 প্রবন্ধ সমগ্র

রহস্য রোমাঞ্চ কাহিনী - 
সাহিত্য না অন্য কিছু
সুব্রত মজুমদার
হিউস্টন, টেক্সাস

সুব্রত মজুমদারের জন্ম কলকাতায়। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স এন্ড টেক্নলোজি, থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে তিনি পাড়ি দেন সুদূর আমেরিকায়। সেখানেই তাঁর পেশাগত জীবনের পাশাপাশি চলতে থাকে লেখালেখি। নানা ধরেনের ওয়েবজাইনে তাঁর লেখা ছাপা হয়েছে এবং তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করা ও ভিন্ন স্বাদের লেখাগুলি অগণিত পাঠকদের মনোরঞ্জন ও প্রশংসা অর্জন করেছে। লেখকের মূল বৈশিষ্ট্য তাঁর ভ্রমণ ও অ্যাডভেঞ্চার প্রিয়তা।

ক ধরনের উচ্চাঙ্গ বা ক্লাসিকাল সাহিত্য আছে যা কেবলমাত্র উচ্চস্তরের সাহিত্যরসিকেরাই প্রাণভরে উপভোগ করে থাকেন। তাঁদের সংখ্যা কিন্তু শতকরা কুড়ি জনের বেশি নয়। বাকি শতকরা আশিজন যে ধরনের বই পড়ে আনন্দ পান, তাকে উচ্চস্তরের সেই সাহিত্যরসিকেরা কদাচিৎ উচ্চাঙ্গ সাহিত্য বলে মূল্য  দিতে চান। উইলিয়াম শেক্সপিয়ার ও আর্থার কোনান ডোয়েলের জনপ্রিয়তার তুলনা মূলক বিশ্লেষণ করলেই ব্যাপারটা বোঝা যায়। বাংলায় শরৎচন্দ্র আর শরদিন্দু ব্যাপারেও সেই একই কথা বলা যায়। সাহিত্যের মাপকাঠিতে কে কতটা ওপরে বা নিচে তার নিরপেক্ষ সমালোচনাও হয়ত করা হয়েছে বহুবার। আপাতদৃষ্টিতে রহস্য ও রোমাঞ্চ এর প্রধান উদ্দেশ্যই হল সাধারণ মানুষকে তাঁদের দৈনন্দিন ঘটনাচক্র থেকে ক্ষণিকের জন্য মুক্তি দেওয়া। যদিও তাঁদের নিজেদের জীবনের ধারা অতি সাধারণ কিন্তু একটা আশ্চর্য আর অসাধারণের খিদেয় এবং তৃষ্ণায় তাঁরা সর্বধা আপ্লুত হয়ে থাকেন। সেই প্রবল আকাঙ্ক্ষা থেকেই যে এই রোমাঞ্চকর সাহিত্যের জন্ম সে ব্যাপারে দ্বিমত থাকার কথা নয়। একটি ভাল রোমাঞ্চকর বইয়ের মাধ্যমে এই তীব্র আকুলতা অনায়াসে পূরণ হয়ে যায় এই বইয়ের ভিতরে থাকে না মামুলি ঘটনার বিবরণ এই গল্পের ইন্ধন নীরস আর একঘেয়ে নয় সব কিছু অভাবনীয়, চাঞ্চল্যকর, মনোময় ও রোমাঞ্চকর পাতায় পাতায় থাকে মাকড়শার জাল দিয়ে ঘেরা রহস্যের বেড়াজাল| সেই রকম বই হলে খুব অল্প খরচে এক অভূতপূর্ব জগতে নিমেষের মধ্যে চলে যাওয়া যায়

রহস্যের প্রতি যে কোন মানুষের আকর্ষণ দুর্নিবার। কিছুটা হয়ত জন্মগত। শিক্ষিত অর্ধ শিক্ষিত আমজনতার মধ্যে খুব কম ব্যক্তিই আছেন যিনি রহস্য কাহিনীতে কৌতূহলী হন না, কিংবা রহস্য কাহিনীতে মগ্ন হয়ে যাননি। গোয়েন্দা গল্পের সর্ব প্রথম স্রষ্টা কে বলা শক্ত, তবে এটা হলফ করে

বলা যায় যে হাজার হাজার বছর আগে যখন মানুষের জন্ম হয়েছিল অপরাধ বোধের সূচনাও হয়েছিল একই সাথে। আর মানুষের মধ্যে যখন প্রথম অপরাধবোধ জাগল সমাজে ঠিক তখনই নির্ঘাত ভাবে আবির্ভাব হয়েছিল একাধিক গোয়েন্দার। আর সেই গোয়েন্দাদের ওপর গোয়েন্দাগিরি করার জন্য পায়ে পায়েএগিয়ে এসেছিল আর এক দল লোক। এনারাই হলেন গোয়েন্দা গল্পের লেখক। সমাজের সব মানুষই গোয়েন্দা গল্পের পাঠক কিন্তু সাহিত্যের সব সেবক এর লেখক নন। গোয়েন্দা কাহিনীর রূপরেখা অনুগমন করলে দেখা যাবে যে এই ধরনের গল্পের নিজস্ব এক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বা ছক আছে এবং সেই ছকটি অন্য সব গল্প আর উপন্যাসের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।

ক্লাসিকাল সাহিত্যের সেবকরা ঘোরাফেরা করেন মানুষের মনের সদর রাস্তা দিয়ে। যদি বা কখন ভুল করে সরু কোন গলিতে ঢুকেও পড়েন তা হলেও সেই গলি থাকে আলো দিয়ে সাজানো। গোয়েন্দা কাহিনীর লেখকদের ঘোরাফেরা মানুষের মনের সঙ্কীর্ণ গুপ্ত গলিতে যেখানে থাকে শুধু অন্ধকার। কদর্যতা, নোংরা, বিপদজনক এবং কুৎসিত এর আবরণে ঢাকা এই গলির ভিতরে যে বিস্ময় লুকিয়ে আছে তাকে অন্ধকার থেকে আলোয়  টেনে বের করে আনার অসাধ্য সাধন করাই হল গোয়েন্দা কাহিনীর লেখকের মূলমন্ত্র। এই মূলমন্ত্রে পৌছনোর আগে পশ্চাদ-পটভূমিতে লেখক আর পাঠকের মধ্যে চলে প্রতিযোগিতামূলক এক বুদ্ধির লড়াই। এই প্রতিযোগিতায় জিত এর ওপরেই নির্ভর করে লেখকের সার্থকতা।

এই প্রসঙ্গে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎকার ও তাঁর মন্তব্যের নজির টানা খুবই দরকার। তিনি বলেছিলেন রহস্য রোমাঞ্চ সাহিত্য হিসেবে স্থান নিশ্চয়ই পেতে পারে। গল্পের বুনিয়াদ তো একই – মনুষ্য চরিত্র আর মানব ধর্ম। শুধু একটু রহস্যের গন্ধ আছে বলে সেটা নিম্ন মানের হবে কেন। নোবেল পুরস্কার পাওয়া অনেক লেখকও এই ধরনের গল্প লিখেছেন।  ভাষা হল গল্পের মিডিয়াম| সেই মিডিয়াম যদি ভালো না হয় তবে গল্প বলাও ভালো হবে না। গোয়েন্দা গল্প হলেও সেটাও একটা গল্প বই তো নয়। সুতরাং গল্পকে মনোজ্ঞ করে বলতেই হবে। সাহিত্য মানুষের রুচি পাল্টায় না মানুষের রুচির বুনিয়াদের ওপর ভিত্তি করে সাহিত্য বদলায়? প্রশ্নটি যেমন শক্ত এর উত্তরটিও তেমনই। স্থান, কাল আর পাত্র ভেদে এই প্রশ্নের সঠিক  উত্তর আজও অজানা।

ঘাটাল

প্রবন্ধ সমগ্র ।। মতামত ।। সূচীপত্র

 প্রবন্ধ সমগ্র
SanojCharaborty.jpg

ঘাটালের ঐতিহ্যের 
ইতিহাস ভাসাপুল
সনোজ চক্রবর্তী
পূর্ব মেদিনীপুর, পঃ বাংলা

সনোজ চক্রবর্ত্তী পেশায় স্কুল শিক্ষকতা। বানিজ্য বিভাগে স্নাতকোত্তর। ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখি। মুলত গল্পকার হলেও কবিতাও লিখেছেন বেশ কিছু। প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন পত্র পত্রিকাতে। লেখালেখি ছাড়া অন্যতম নেশা অভিনয় ও নাটক পরিচালনা।

ঘাটাল অবিভক্ত মেদিনীপুর তথা বর্তমানে পশ্চিম মেদিনীপুরের একটি মহকুমা শহর। সেই অর্থে নগর পরিসেবা না থাকলেও এ শহর অনেক প্রাচীন শহর। ঘাটাল শহরের প্রাণ শিলাবতী নদী, তবে কখনো কখনো ভারি বর্ষায় এ নদীই ঘাটালের প্রাণ সংশয় এর কারণ হয়ে পড়ে।

ইংরেজরা তখন আমাদের দেশ শাসন করছে। হয়তো তখনো রেলগাড়ি, যন্ত্র-শকট আবিষ্কৃত হয় নি। হয়তো আবিষ্কৃত হলেও তার প্রসার ঘটে নি। তখন কলিকাতা, হাওড়া, হুগলী জেলা সঙ্গে ঘাটাল সহ ঘাটালের পশ্চিমাঞ্চল ক্ষীরপাই, চন্দ্রকোনা, রামজীবনপুর, কামারপুকুর, গড়বেতা, পিয়ারডোবা, গোয়ালতোড়, শালবনি, সারেঙ্গা প্রভৃতি জায়গার যোগাযোগের একমাত্র উপায় শিলাবতী নদী। শিলাবতী নদী, বন্দর নামে একটি স্থানে দারকেশ্বরের শাখা নদী ঝুমী নদীর সঙ্গে মিলিত হয় ও এরপর নাম হয় রূপনারানণ। রূপনারায় রানীচক্, কোলাঘাট, তমলুক হয়ে এগিয়ে আসে গেঁওখালি। গেঁওখালিতে রূপনারায়ণ সঙ্গ পায় হুগলী নদীর। এই হুগলী নদীর পূর্বদিকে কলিকাতা আর পশ্চিম তীরে হাওড়া ও হুগলী জেলা। হুগলী-রূপনারায়ণ -শিলাবতী এই ছিল প্রধান পরিবহন পথ। এ পথেই সেকালে কলিকাতা থেকে প্রয়োজনীয় মালপত্র আমদানী হত ঘাটাল মারফৎ। আবার ঘাটাল সহ তার পশ্চিম দিকের বিস্তীর্ণ পশ্চার্ধ ভূমির উদ্বৃত্ত পণ্য রপ্তানির হতো কলিকাতা সহ নানা প্রান্তরে। ডিঙি, নৌকা, পানসি স্টিমার যোগে পণ্যের আমদানি রপ্তানি হতো। শুধু পণ্যই নয় যাত্রী পরিবহনের একমাত্র পথ ছিল শিলাবতী। আর সেই আমদা রপ্তানিকে কেন্দ্র করে, মূলত পণ্য ওঠা-নামার জন্য শিলাবতী নদীর তীরে গড়ে উঠেছিল অনেক ঘাট। সেই ঘাটের অপভ্রংশ হতে ঘাটাল নামের উদ্ভব হতে পারে।

যাইহোক অতীতে ঘাটাল ছিল ব্যবসা বাণিজ্যের এক প্রসিদ্ধ ভূমি। ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য অনেক মোকাম গড়ে উঠে ছিল ঘাটালে। রেশম শিল্প ও নীল চাষে উৎকর্ষ লাভ করেছিল ঘাটাল এলাকা। আর্মেনীয়, ডাচ, ইংরেজ, ফরাসী প্রভৃতি বিদেশীরাও নীল কুঠি স্থাপন করে ঘাটালে।এই সব কুঠিগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল ইংরাজ ব্যবসায়ী ওয়াটসন সাহেবের কুঠি। ওয়াটসন এন্ড কোম্পানির কুঠিটি ছিল বৃহত্তম রেশম উৎপাদন কেন্দ্র। ঐ কুঠিকে কেন্দ্র করে বাণিজ্য অঞ্চল কুঠিবাজার নামে পরিচিতি লাভ করে। কুঠিবাজার ছিল শিলাবতী নদীর পশ্চিম তীরে আর সাহেবদের বাসস্থান ছিল নদীর পূর্ব তীরে।

প্রতিদিনই সাহেবদের পূর্বতীরের বাসস্থান থেকে পশ্চিমের কুঠিতে আসতে হত। মাঝের নদীপথ ছিল ঝামেলার পারাপার। অপ্রসস্থ, শীর্ণ অথচ উত্তাল সেই জলস্রোতের উপর স্থায়ী সেতু নির্মাণের আধুনিক প্রযুক্তি তখনো সভ্যতার হস্তগত হয় নি।

সেসময় পারাপারের জন্য সাহেবরা শিলাবতীর উপর নির্মাণ করেন কাঠের পুল। যে পুলটি ভেসে থাকত নৌকোর উপর। জলস্তরের উঠা নামার সঙ্গে সংগতি রেখে পুলটি উঠত বা নামত। পুলটির ভাসমানতার জন্য এর নাম হয় ভাসাপুল। সাহেবরা ঘোড়ায় চড়ে ভাসাপুল হয়ে দিনের শুরুতে পূর্ব থেকে পশ্চিম আর দিন শেষে পশ্চিম থেকে পূর্বে যাতায়াত করত যাতায়াতের ঐ পথ ছিল কেবল সাহেবদের। এদেশের লোকজনের জন্য ঐ পথের লক্ষ্মণরেখা পার হওয়ার কোনো অনুমতি ছিল না। বিলাসী ভাসাপুল শুরুতে কেবল মাত্র বিদেশী সাহেবরা ব্যবহার করত।

পরবর্তী কালে বেঙ্গল ফেরী এ্যাক্ট ১৮৮৫ এর ৬নং ধারা অনুসারে, ১৯০৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর, পুলটি সাধারণের ব্যবহারের অনুমতি লাভ করে। স্বাধীনতা লাভের প্রায় তেরো বছর পর ১৯৬০ সালে শিলাবতী নদীর উপর আধুনিক প্রযুক্তির বিদ্যাসাগর সেতু নির্মাণ নিশ্চিত ভাবেই ভাসাপুলের চাপ কমিয়েছে। হয়তো তার উপযোগিতা নিয়েও আজ প্রশ্ন থাকতে পারে কিন্তু ঘাটাল বললে দৃশ্যপটে আজও প্রথমেই ভেসে উঠে ভাসাপুল। সুদীর্ঘ কাল ঘাটাল ও ঘাটাল-বাসির চরণে চরণে জড়িয়ে আছে বিলাসী কাঠপথ।

ভাসাপুল ঘাটালের ইতিহাসের এক উজ্জ্বল অধ্যায়। ঐতিহ্যের স্বর্ণালী স্মারক।

বাড়িয়ে দাও তোমার হাত

প্রবন্ধ সমগ্র ।। মতামত ।। সূচীপত্র

 প্রবন্ধ সমগ্র
SanojCharaborty.jpg

বাড়িয়ে দাও 
তোমার হাত
সনোজ চক্রবর্তী
পূর্ব মেদিনীপুর, পঃ বাংলা

village2.jpg

সনোজ চক্রবর্ত্তী পেশায় স্কুল শিক্ষকতা। বানিজ্য বিভাগে স্নাতকোত্তর। ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখি। মুলত গল্পকার হলেও কবিতাও লিখেছেন বেশ কিছু। প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন পত্র পত্রিকাতে। লেখালেখি ছাড়া অন্যতম নেশা অভিনয় ও নাটক পরিচালনা।

দাওয়ায় বসানো থাকত বেশ বড় একটা ডিবে, তার মধ্যে চাল। ডিবের মধ্যে হাত ডুবিয়ে মুঠো ভরে বের করতে হতো চাল। ছোট্ট হাতে মুঠো বড় করতে গিয়ে মুঠো আলগা হয়ে ছড়িয়ে পড়ত চাল। হাঁক শোনা মাত্র ভাই-বোনদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যেত কে আগে হাত ডোবাতে পারে ডিবেতে। সারা সপ্তা ধরে এলেও, ফি বুধবার ওরা দল বেঁধে আসত। ঘুরে বেড়াত বাড়ি বাড়ি কারণ বেস্পতিবার হাটবার, ঐ দিন হাট বসত নদীর পাড়ে। ভিক্ষা করে যে চালটু্কু পেত তার খানিক হাটে বেঁচে একটু নুন, একটু আলু, একটু ডাল কিনে নিত সুবিধে মতো। ওরা এলে যে ওদের চাল দিতে হয় তা শিখিয়ে ছিল বাড়ির গুরুজনেরা। মা-ঠাকুমার হাত জোড়া থাকলে চেঁচিয়ে ভিক্ষা দেওয়ার ফরমাশ আসত। সেই  দেওয়া নেওয়াতে আনন্দ ছিল উভয়পক্ষের। চাল পেয়ে চকচক করত ওদের মুখ। আর যখন ওরা আমাদের মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করত-- "বড় হও বাবা,

অনেক অনেক বড় হও।" সে আশীর্বাদের জোর এতোটাই বেশি ছিল যে তখন সত্যি সত্যি বড় হওয়ার পথে কয়েক ধাপ এগিয়ে যেতাম যেন। এখন বুঝেতে পারি আমাদের ছোটবেলায় বড়রা যে আমাদের হাত দিয়ে সাহায্যটা পৌঁছে দিত সে তাঁদের হাত জোড়া থাকত বলে নয়।ছোটবেলা থেকেই পরিবারের এমনতর অনুশাসনে, অনুশীলনে ধীরে ধীরে নির্মাণ হতো চরিত্র।এখন বাড়িতে ভিখারী এলে চাল দেওয়ার রেওয়াজ নেই বললেই চলে। ওরাও নিতে চায় না। একটা জায়গায় এক টাকার কয়েন রাখা থাকে সেখান থেকে একটা করে তুলে নিতে বলা হয়। সতর্ক করে দেওয়া হয় একের জায়গায় যেন দুই না নেয়। সাহায্যটুকু হাতে তুলে দেওয়ার ফুরসত নেই।কারো সময় নেই অপরের দিকে তাকাবার। অপ্রতিহত গতিতে ছুটে চলেছি আমরা অসীম চাহিদা চরিতার্থে। ছোটদের সরিয়ে রাখা হয়, পাছে তাদের লেখাপড়া নষ্ট হয়,পাছে ঐ দুঃখী মানুষগুলোর থেকে জীবাণু না ঢুকে পড়ে। হেলথ-হাইজিনের হদ্দমুদ্দ। এর ফলে কায়েমি স্বার্থপরতা বাসা বাঁধতে থাকে শৈশব থেকে।

মানুষের বিপদে পাশে দাঁড়ানো, সাহায্য করার যে পাঠ আমাদের শৈশব পেয়েছে আজকের শৈশবের সিলেবাসে তার জায়গাই নেই। তার ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে চারপাশে এতো স্বার্থপরতা, অসহযোগিতা। সমাজটা ক্রমশ অসামাজিক হয়ে উঠছে।

সাচ্চা-ঝুটা

প্রবন্ধ সমগ্র ।। মতামত ।। সূচীপত্র

 প্রবন্ধ সমগ্র
SaswatiBhattachrya.png

সাচ্চা-ঝুটা
শাশ্বতী ভট্টাচার্য
ম্যাডিসন, উইস্কন্সিন

office.jpg

প্রথম দেখি অফিসের মিটিংয়ে। পিঁজা আর তার সাথে ডায়েট কোক। কি ব্যাপার?  না হেলদী। এমনি কোকে তো অনেক চিনি, তাই ডায়েট কোক। শূন্য ক্যালোরি। হেলদী, স্বাস্থ্যকর। 

-সিরিয়াসলী? 

এর পরে এই শূন্য বা কম ক্যালোরির খাবার সব জায়গায় দেখতে শুরু করলাম। সভা-সমিতি, জলসা-ঘরে, বিবাহবাসরে। হোটেল-রেস্তোরায় তো বটেই। 

সত্তরের দশকে যার স্থান ছিল মেডিসিন ক্যাবিনেটে তা ছড়িয়ে পড়লো রান্না ঘরে, এমনকি পানীয় জল খাবার কুঁজোতেও। আমার ডায়াবেটিক দিদা চায়ে স্যাকারীন মিশিয়ে খেতেন, তাই ওই কেমিক্যালটিকে  আমার মা ঘরে মজুত রাখতেন, অবশ্যই তা থাকত আমাদের নাগালের বাইরে, ডেটল, বার্ণল আর এ্যনাসিনের সাথে। তবুও শান্তি ছিল, সেটা তখনও পূর্ন-বয়স্কদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।তারপর একদিন ওই শূন্য ক্যালোরিকে দেখলাম শিশুদের ব্যবহার্য খাদ্য-দ্রব্যে। 

প্রিয় বন্ধুর রান্না ঘরে দুধ, ডিম, ময়দা, তেল, ইস্টের পাশে পাতার পর পাতার কৃত্রিম চিনির  স্যাচেট। শুধু তাই নয়, কেকের সমারোহ বৃ্দ্ধি করার নানা রং-বেরঙ্গের আইসিং, ফ্রস্টিংয়ের যে সমাহার, তার উপরেও কালো -কালির বড়ো হরফে লেখা শূন্য ক্যালোরি কথাটা চোখে পড়লো।

- এইখানে এইগুলো কি রে? তোর ছেলে তো সবে দুই, আর মেয়েটা এই সেদিন থেকে স্কুলে যাচ্ছে?  ওরা কি ডায়া...? বলতে বলতে থেমে গিয়েছি। এই রকম একটা অশুভ প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা আমার একান্তই অনুচিত নয় কি?

- আরে বলিস কেন? আমার মেয়ের খুব রান্নার সখ বুঝলি? এই বয়সেই ও যা রান্না করে না! নির্ঘাত এমেরিল লাগাসের ঠাকুরমা ছিল গতজন্মে। দেখ না দেখ, এই কুকি, এই কেক, এই প্যস্ট্রি বানিয়ে চলেছে। তারপর  উইক-এন্ড হলো কি না, আসে পাশের গাদা গুচ্ছের সাদা-কালো  সব বন্ধু–বান্ধবকে ঘরে ডাকবে..., ওই সব ডেসার্ট বানাবে, খাবে আর  ঘরে বসে ভিডিও গেম খেলবে! আসলে ওর বাবারও তো ভিডিও গেমের শখ, তাই আমাদের বাড়িতে ভালো স্টক আছে। হইহই করে কথাগুলো বলে বন্ধু আমার দিকে তাকায়, সম্ভবত কিছু পড়েছে আমার ভ্রকুঞ্চনে, ...চিন্তা করিস না, ওগুলো সব জিরো ক্যলোরী। ভিডিও গেম খেলাটাতে তো তেমন কোন এক্সারসাইজ নেই!  বুঝলি না? এক ঢিলে দুই পাখি।

--না। বুঝলাম না বন্ধু। কোনটা সত্যি কোনটা মিথ্যা, সাচ্চা-ঝুটা ঝুটা-সাচ্চা সব কি আমরা গুলিয়ে ফেলছি? এতো ঠিক মঙ্গলময় বার্তা নয়। আমি দীর্ঘশ্বাস গোপন করি। জিভকে নকল মিষ্টির স্বাদ পাইয়ে নয় তো ফাঁকি দেওয়া গেল, কিন্তু এই মিষ্টির ব্যপারটা জিভেই শেষ হয় কি? জিভ থেকে যে বার্তাটা মগজ মানে, যাকে আমরা ইংরাজীতে ব্রেন বলি তার কথা মনে রেখেছো তো বন্ধু? বার্তাটা  পাওয়ার পর শরীরে অন্তত এক প্রকারের হরমোনের ক্ষরণ হতে পারে তার কথাটা মনে রেখেছো তো বন্ধু? সেদিন বলতে পারিনি।মাধুকরীতে আমার এই লেখাটা আজ তাই বন্ধু, তোমায় দিলাম।

বাজারে আরো তো চারটে স্বাদ আছে, তবে কেন মিষ্টির প্রতি এই আকর্ষণ? ব্যপারটা জটিল নয়, যদি মেনে নিতে পারি যে “মিষ্টি” শুধু মাত্র একটা  স্বাদই নয়। কেন মিষ্টির দিকে আমাদের এই অপ্রতিরোধ্য ঝোঁক, তা বোঝার জন্য বেশী দূর নয়, মাত্র কয়েক মিলিয়ন বছর আগের কথা ভাবলেই চলবে।

জীবাশ্ম বিজ্ঞান অনু্যায়ী প্রায় ২.৬ মিলিয়ন খৃষ্টাব্দে মানুষের পূর্বসূরী Hominids  এর দেখা পাওয়া যায়। যদিও Neolithic (New Stone age, আনুমানিক খৃষ্টাব্দ ১০,২০০ সাল) যুগকে মনুষ্য সভ্যতার শুরুর যুগ বলা যেতে পারে, বুঝতে হবে, তারও প্রায় ১৯০ হাজার বছর আগের Paleolithic (Old-Stone age) যুগে আজকের মানুষ বা Homosapien এর আবির্ভাবকাল। সবে বন্য জন্তু জানোয়ারের কবল থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য পাথরের ব্যবহার সে শিখেছে বটে, কিন্তু অন্য সমস্ত জীবিত প্রাণীর মতো নিছক প্রাণ ধারণের জন্য মানুষেরও দরকার ছিল খাদ্যের।

তার সেই অস্থায়ী যাযাবরের জীবনে না ছিল কোন বাসস্থান, না ছিল কোন নির্দিষ্ট খাবারের সরবরাহ, না ছিল বিশেষ একটা বাছ-বিচার করার পরিস্থিতি। তার বেঁচে থাকা, অথবানা-থাকা প্রধানতঃ কার্বোহাইড্রেট তথা গ্লুকোজের ওপর নির্ভর-শীল। নানা প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় সেই গ্লুকোজের রূপান্তরিত হয়ে তৈরী হবে এটিপি নামক এক অণু। যাবতীয় কাজ করার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তির মুদ্রা (Currency) এই অণুটি।

অতএব, বিবর্তনের সহজাত কর্ষণে মানুষ বুঝতে শিখেছে কিভাবে পরিশ্রমকে এক রেখে বেশী গ্লুকোজ তথা এটিপি পাওয়া যেতে পারে।  মিষ্টি পাকা ফলটা তাই, কাঁচাটার থেকে অনেক বেশী বাঞ্ছনীয়। এইভাবেই সদ্য জাত শিশুর প্রথম খাদ্য মায়ের দুধে মিষ্টি এবং তা উপভোগ করার জন্য যেমন জিভে তার উপযোগী স্বাদ-কলিকা, ব্রেনেও তেমনি, চিনির সরসতায় নির্দিষ্ট আনন্দানুভূতি এসেছে। এর অন্য প্রান্তে অদূর ভবিষ্যতে অনাহারের সম্ভাবনায় যতটা প্রয়োজন ঠিক ততখানি খরচা করে বাড়তি গ্লুকোজকে ফ্যাটের আকারে গড়ে মজুত করে রাখার আয়োজন হয়েছে। 

বন্ধু, বলা বাহুল্য এই ভাঙ্গা আর গড়ার কাজগুলি করার জন্য যার অবদান অপরিহার্য, তিনিই সেই সুপ্রসিদ্ধ ইনসুলিন হরমোন জগতের Swish army knife, কিম্বা সর্ব-ঘটের কদলী বৃন্ত। প্রাণী জগতে এই ভদ্রলোক ইনসুলিনটি বাবুটির আবির্ভাবকাল নিয়ে নানা গবেষণা থেকে বলা যায়, ইনি অতিবৃদ্ধ।

অন্তত পক্ষে মিলিয়ন বছর আগে তো বটেই, কেউ কেউ বলেন তার চেয়েও আরও আগে!

আজকাল দেখেছি অনেকে সাদা চাল, ওরফে ভাত পাউরুটি ইত্যাদি কার্বোহাইড্রেটকে শুধু কার্ব বলে ডাকেন (এবং বেশ ছিঃ ছিঃ কারও করেন)। ভুললে চলবে না চাল যেমন কার্বোহাইড্রেট, যে কোন ফল, সবজি, ডাল, দুধ, আলু, ভুট্টা, ওটমিল সব কিন্তু সেই একই। 

কার্বোহাইড্রেট এক ধরণের অণুর বংশগত নাম। গ্লুকোজ এই কার্বোহাইড্রেটের গোত্রের সব থেকে সিধাসাদা সদস্য, এবং এই প্রবন্ধে একেই আমি  সুগার, কিম্বা মাঝে মাঝে চিনি বলি ডেকেছি।

নানা বিপর্যয় থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রেখে, বনে জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে  কার্বোহাইড্রেট আহরণ করার জন্য এবং তাকে ঠিক মতো ব্যবহার করার এই যে রীতিমতো এটা অখণ্ড (ফেল প্রুফ) একটা সিস্টেমের উদ্ভাবন হয়েছে প্রকৃতিতে, ভাবলে অবাক হতে হয়।

অতএব পাঠক, পাকা আমটি মুখে দিয়ে যে সুখ, সেই সুখ এক-দুই দিনের মামলা নয়, বিগত কয়েক শত হাজারের বছরের বিবর্তনের আমদানি। মিষ্টির আকর্ষণ তো শুধু মাত্র জিভেই সীমাবদ্ধ নেই, লাল টুক-টুকে স্ট্রবেরীটিকে তাই চোখে দেখেও সুখ! ওটা মুখে পড়লে ব্রেন যে “আহা আহ্ আহা” বলে জানান দিয়ে উঠবে। তুমি আমি বন্ধু তো নশ্বর মানুষ, মেরে কেটে একশো বছরের আয়ু। কৌতূহলী পাঠকের জন্য জানাই, পৃথিবীর যাবতীয় প্রাণীর যাবতীয় দৃশ্য বা অদৃশ্য কাজ করার জন্য প্রয়োজন এটিপির। সাধারণতঃ  গ্লুকোজ (তথা অযৌগিক কার্বোহাইড্রেট)  থেকে এটিপি উৎপাদন হয় বটে, তবে ফ্যাট এবং সবিশেষ প্রয়োজনে আমাদের শরীর প্রোটিন থেকেও এটিপি উৎপাদন করে, (তার আগে কিন্তু সেই প্রোটিন থেকে কোন প্রকারে গ্লুকোজ বানাতে

হয়) তবে সেটা কেন ঠিক অভিপ্রেত নয় আজকের প্রবন্ধে সেই আলোচনায় যাবো না। মিষ্টি শুধু খেতেই নয়, মিষ্টি নিয়ে লিখতেও সুখ।  হ্যাঁ, আধুনিক মনুষ্য-সমাজ ঠিক এই রকম  পরিস্থিতির কবলে। 

বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে, রাসায়নিক পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে, আঁখ থেকে হোক, বা  ভুট্টা দানা থেকে হোক, আমরা চিনিকে ঘনীভূত করতে শিখেছি।  আর যেই না তা পেরেছি, আমাদের চেনা প্রায় সমস্ত খাদ্যে আমরা মিষ্টি দিতে শিখেছি, মুখে দেওয়ার মতো কিছু হলেই হলো, রুটি, পাউরুটি, ভাত, ডাল, মাংস, মায় ওষুধ...।  A spoonful of sugar helps the medicine go down, in the most delightful way!

আর তার ফল?  শিকারী খুদ ইহা শিকার হো গয়া!

বেঁচে থাকার তাগিদে যে গ্লুকোজ তথা  মিষ্টির দরকার ছিল এবং তাকে ভালো লাগার এবং সংযতভাবে ব্যবহার করার যে উপকরণ বিবর্তনের রাস্তা ধরে আমাদের মস্তিকে, শরীরের বিভিন্ন  অঙ্গ প্রত্যঙ্গে প্রোথিত হয়েছিল তা আজ এক আশ্চর্য আসক্তি হয়ে বহু মানুষের দূর্বিসহ জীবন এবং ক্ষেত্র-বিশেষে মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মিষ্টি বহু মানুষের কাছে অবিকল সিগারেট বা মদের মতো নেশাকারক এবং জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে সেই নেশায় এনারা আক্রান্ত। বলা বাহুল্য বাড়তি চিনি ইনসুলিনের প্রভাবে ফ্যাট বা বাড়তি ওজনে পরিণত হয়েছে এবং আদমশুমারি অনুযায়ী গত ২০১৫ সালে, সারা পৃথিবীতে বাড়তি ওজন মনুষ্য সভ্যতার প্রায় ৩০ শতাংশকে (২.২ বিলিয়ন)  অসুবিধায় ফেলেছে।

তা হলে উপায়?  নাহ,  কোন চিন্তা নেই!

যে বিজ্ঞান গোটা আঁখকে ছিবড়ে করে তার হৃদয় থেকে বার করে এনেছে জমায়িত চিনির স্ফটিক মানিকটিকে,  কিম্বা  ভুট্টার রস থেকে আমাদের মুখে তুলে দিয়েছে গ্লুকোজের ভাই ফ্রুকটোজকে সেই বিজ্ঞান এবার আমাদের হাতে তুলে দিয়েছে বেশ কয়েক প্রকারের আর্টিফিসিয়াল সুগার, বিগত কয়েক হাজার হাজার বছর ধরে বিবর্তিত হওয়া আমার মগজ যাদের মোটেও চেনে না।

এই ‘অচেনা” চিনিগুলোকে তাদের চরিত্র অনুযায়ী গোষ্ঠীবদ্ধ করলে, যারা এক্কেবারে রাসায়নিক দ্রব্য তারা হলো Sweet'N Low (Saccharin), Equal, NutraSweet (Aspartame),Sweet One (Acesulfame potassium)  Neotame (Aspartame বড়ো দাদা)। এর পরে  লাইন দিয়ে এলো Erythritol,  Isomalt, Lactitol,  Maltitol,  Mannitol, Sorbitol,  Xylitol, Splenda (Sucralose)  প্রভৃতি। এরা চিনি কিন্তু চিনি নয়, এরা Sugar alcohol. মোটামুটি চিনির মতো একটা অণু, তার সাথে একটা আরেকটা অণু এমন করে জুড়ে দেওয়া হয়েছে এদের মধ্যে যে আমাদের সেই সুপ্রসিদ্ধ বয়োজ্যেষ্ঠ ইনসুলিন বাবা-জীবন এদের ছোঁবেনও না, এরা মোটামুটি বাহ্য পদার্থ! বহু ক্ষেত্রে জোলাপের মতো এদের আচার ব্যবহার। এর মধ্যে Stevia নামক নকল চিনিটার মধ্যে যদি ও বা একটা প্রাকৃতিক- প্রকৃতিজ ভাব আছে, আসলে কিন্তু ওটিও Stevia rebaudiana নামক এক গুল্ম-ঝাড়ের পাতা থেকে রাসায়নিক পদ্ধতিতে বার করে আনা পদার্থ (stevioside)।

তা হলে কি দাঁড়ালো? ভেবে দেখলে ব্যাপারটা অত্যন্ত সহজ। স্বাদের বিচারে এরা চিনি থেকে বহুতর গুনে মিষ্টি  হওয়া সত্বেও বাড়তি চিনি সংক্রান্ত  কোন ঝামেলা থাকছে না। কেন না এরা তো মোটেও চিনি নয়, তাই ইনসুলিন নিঃষ্করণ হবে না ধরে নেওয়া যেতে পারে। আর কে না জানে ওই ইনসুলিনটাই তো যত্তো  গন্ডগোলের মূলে। এই সে গ্লুকোজকে কোষের কাছে বিলি করে  তার থেকে এনার্জি তৈরী করতে সাহায্য করছে, এই সে বাড়তি চিনিকে ফ্যাট তৈরী করে লিভারের কাছে জমা রাখতে এগিয়ে আসছে!

তা হলে তো মুস্কিল আসান?  প্রবলেম সল্ভড।

না! ধীরে বন্ধু ধীরে। গবেষণা চলতে চলতে থাকল এবং  প্রথম অন্তরায় দেখা গেল...।

যেমনটি ভাবা গিয়েছিল,  দেখা গেল তেমনটি ঠিক হচ্ছে না। অচেনা চিনির কয়েক জন সদস্য ইঁদুরের শরীরে ইনসুলিন বাড়িয়ে দিচ্ছে!  সত্যি?  কৃত্রিম চিনির সপক্ষে যাঁরা তারা বললেন, --বুঝেছি।  ইঁদুর ব্যবহার করা হয়েছে না? তাই। মানুষ আর ইঁদুর এক নাকি?

আসতে থাকল,  ‘এই কৃত্রিম চিনিটা ওই নকলটার থেকে ভালো’র  বিবৃতি, এবং একের পর এক নকল চিনিতে বাজার ছেয়ে যেতে লাগলো।

এই সব ক্ষেত্রে যা হয়ে থাকে, সেই চাপান উতোর চলতেই থাকল, আর অন্য দিকে, ১৯৮০ থেকে আজকের ২০১৮ সাল অবধি, বাজারে এতো প্রকারের কৃত্রিম চিনি এবং তাদের বিক্রি পুরো মাত্রায় বজায় থাকা সত্ত্বেও থেকে জন-সাধারণের ওজন বাড়তেই থাকল। কেন? কোথায় বাঁধলও গন্ডগোলটা? উত্তরের আশায় গবেষণা এবং কারণের খোঁজে জল ঘোলা হতেই থাকল। 

জানা গেল, কিছু কিছু নকল চিনি খাওয়ার পর মানুষের শরীরেও ইনসুলিনের ক্ষরণ হয়।  তখন সে প্রথমে খোঁজে তার অতি পরিচিত আসল গ্লুকোজটিকে  (তার পরে হাত বাড়ায় ফ্যাট কিম্বা প্রোটিনের ওপর)। ফলাফল সরূপ- রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কম, এবং  মগজে ক্ষুধানুভূতির বার্তা। খিদে পেয়েছে! খাবার কই? খাবার চাই! এখুনি চাই।  ফলাফল সরূপ-অতিভোজন।

জানা গেল, নকল মিষ্টি স্যাকারিন  কোকেনের মতো বহুপ্রসিদ্ধ নেশার জিনিষের চাইতে বেশি আকর্ষণীয় এবং নেশাকারক,  অন্তত গবেষণাগারের কতগুলি ইঁদুর কাছে।   

২০১৭ সালে মার্চ এবং ডিসেম্বরে প্রকাশিত হওয়া সুস্থ মানুষ নিয়ে করা দুটি প্রবন্ধের (Physiol Behav. 2017, 182:17-26, এবং International Journal of Obesity, 2017 41, 450–457) কথা উল্লেখ করবো।

এই দুটোতেই বক্তব্য যদিও বা সেই ‘আরো গবেষণার প্রয়োজন’ ভাবনাটা আছে,  দুটোতেই গবেষকেরা কৃত্রিম চিনির কোন উপকারীতা দেখতে পারেন নি। উল্টে নিয়মিত কৃত্রিম চিনি সেবন যে পৃথুলতা বা ডায়াবেটিস নামক রোগের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিতে পারে এমন একটা স্টাডির (CMAJ. 2017;189:E929-E939) কথা  বলা আছে একটি  প্রবন্ধে।

আমি নকল মিষ্টির সপক্ষে নই এটা হয়তো এতক্ষণে বোঝাতে পেরেছি।  আর রসগোল্লার বদলে যদি আপেল কিম্বা আমে মিষ্টি রসনা তৃপ্ত হয়, সেই চেষ্টাটাও তো করে দেখা যাক না বন্ধু। জলের মতো পানীয় আর হয় না কি?

বন্ধু, শেষ পর্যন্ত মানুষ অভ্যাসের দাস, কুকির বদলে কতগুলো ব্লুবেরী বা আঙ্গুর মুখে ফেলে দেখলে হয় না?  হয়তো কয়দিনেই সেটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যেতে পারে।

কথায় বলে না “Prevention is better than cure”?

পরিশেষে বলি,   পাঠক,  মিষ্টি খেতে ইচ্ছা হলে মিষ্টিই খান না! আপনি নেশাগ্রস্থ কিনা সেটা আপনারই বিচার। ভালো থাকুন, রসে বশে থাকুন।  

সোমেন চন্দের জীবন

প্রবন্ধ সমগ্র ।। মতামত ।। সূচীপত্র

 প্রবন্ধ সমগ্র

সোমেন চন্দের জীবন সম্মন্ধে

তথ্যচিত্রের খসরা    
দিলীপ মজুমদার
পর্ণশ্রী, বেহালা, কলকাতা 

chair.jpg

এক.
[
ন্ধ্যা। নদীর তীর। জলের শব্দ। অস্পষ্ট চলমান নৌকো। সোমেন চন্দের ছায়ামূর্তি। রবীন্দ্রনাথের ‘সুপ্রভাত’ কবিতা আবৃত্তি করছে। আর এক ছায়ামূর্তি পেছনে এসে দাঁড়ায়। সোমেনের কাঁধে হাত রাখতে সে চমকে ওঠে।]
সোমেন: আরে, সতীশদা কখন এলেন?
সতীশ: একটু আগে। তোমার আবৃত্তি শুনতে শুনতে এলাম ।
সোমেন: আপনার জন্য বিকেল থেকে অপেক্ষা করছি।
সতীশ: একটু দেরি হয়ে গেল সোমেন।
সোমেন: মিটিং ছিল?
সতীশ: হ্যাঁ। নতুন আদর্শ নিয়ে ফিরে এসেছি আন্দামান থেকে। এখন শুধু কাজ আর কাজ।
সোমেন: নতুন আদর্শ?
সতীশ: সাম্যবাদের আদর্শ। আন্দামানের বন্দিজীবনে এটাই তো ছিল নতুন আলো, নতুন পথের দিশা।
[অনেকের কথাবার্তার শব্দ। তার মধ্যে ‘লেনিন’ ‘নভেম্বর বিপ্লব’ ‘বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক’ এসব ভেসে আসে]
সতীশ: আন্দামানে নবজন্ম হল আমাদের। ত্যাগ করলাম সন্ত্রাসবাদের পথ। বুঝলাম অস্ত্র নয়, ক্ষমতার উৎস হল মানুষ। সেই মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে।
সোমেন: এসব বিষয়ে আরও জানতে ইচ্ছে করে সতীশদা।
সতীশ: সেই জন্যই তো এসেছি তোমার কাছে। চলে এসো আমাদের প্রগতি পাঠাগারে।
সোমেন: যাব, নিশ্চয় যাব।
সতীশ: শুনেছি গল্প-কবিতা লেখ, লেখক হতে চাও। জানো স্পেনের কথা? কি ঘটছে সেখানে জানো কি?
সোমেন: শুনেছি কিছু কিছু।
সতীশ: ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে শুরু হয়েছে জনগণের লড়াই।
[পর্দায় ভেসে ওঠে স্পেনের গৃহযুদ্ধের ছবি--- রা লহ ফিক্স আর কড-ওয়েলের ছবি]
সতীশ: সে লড়াইতে যোগ দিয়েছেন কবি আর লেখকরা। মৃত্যুবরণ করেছেন বিপ্লবী লেখক রা লহ ফিক্স।
সোমেন: লেখকও মরণের মাঝে ঝাঁপিয়ে পড়ল?
সতীশ: অত্যাচার যখন চরমে ওঠে, মানবতার বিকাশ যখন রুদ্ধ হয়, তখন কলম ছেড়ে ধরতে হয় তরবারি, বুকের রক্তে তৈরি করতে হয় নতুন সাহিত্য। তাই তো ফ্যাসিস্ট অত্যাচারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বাহিনীতে যোগ দিয়েছেন কবি-লেখকরা।
সোমেন: এঁরাই সত্যিকারের লেখক।


দুই.
[বিশ শতকের তিরিশের দশকের কমিউনিস্ট আন্দোলনের নানা টুকরো ছবি। সঙ্গে ভাষ্য: ১৯৩৭-৩৮ সাল। আন্দামানসহ নানা জেল থেকে বহু নেতৃস্থানীয় বন্দি মুক্তিলাভ করে ঢাকায় আসেন। কারাগারে এঁরা গ্রহণ করেছিলেন কমিউনিজমের আদর্শ। এঁদের মধ্যে ছিলেন জিতেন ঘোষ, জীবন চ্যাটার্জী, সত্যেন সেন, সুশীল ঘোষ, প্রবোধ গুপ্ত, নেপাল নাগ, বিনয় বসু, বঙ্গেশ্বর রায়, জ্ঞান চক্রবর্তী, অনিল মুখার্জী, ব্রজেন দাস, বারীন দত্ত, সতীশ পাকড়াশি, সতীন রায়, অন্নদা পালিত। এঁদের চেষ্টায় ১৯৩৮ সালের মধ্যে ঢাকা প্রেস শ্রমিক ইউনিয়ন, ইলেকট্রিক সাপ্লাই ওয়ার্কাস ইউনিয়ন, লক্ষ্মীনারায়ণ টেক্সটাইল মিল ওয়ার্কাস ইউনিয়ন গড়ে ওঠে। মানিকগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জ কৃষক সমিতি গড়ে ওঠে। ছাত্র ফেডারেশন শক্তিশালী হয়।]


তিন.
[ছোট মাটির ঘর। লেনিনের ছবি। চারদিকে প্রচারপত্র ছড়ানো। লন্ঠনের চারদিকে গোল হয়ে বসে কয়েকজন আলোচনা করছে]
রণেশ; সোমেন চন্দের সঙ্গে দেখা হল সতীশদা?

সতীশ: হ্যাঁ, বুঝলে রণেশ সোমেন খাঁটি হিরে।
রণেশ: নিরঞ্জনবাবু তার পরিবারের অনেক খবর এনেছেন। তার বাবা নরেন চন্দ ঢাকা মিটফোর্ড হাসপাতালের স্টোর্স বিভাগে কাজ করেন। সামান্য মাইনে। কোনোরকমে সংসার চলে। ম্যাট্রিক পাশ করেছে সোমেন।
সতীশ: আমার কি মনে হয় জানো! মনে হয় প্রগতি লেখক সঙ্ঘ গড়ার কাজে সোমেন হাতিয়ার হয়ে উঠবে।
নিরঞ্জন: রণেশ পাবে তার যোগ্য সহকর্মী।
সতীশ: ঠিক কথা। তবে খেয়াল রেখো, সোমেনের শরীরটা ভালো নয়, সবে প্লুরিসি থেকে উঠেছে।


চার.
[ঘরের সামনে সাইনবোর্ড ‘প্রগতি পাঠাগার’। ১০/১২ জন যুবক। একজন লেনিনের লেখা থেকে কিছু পড়ছে। এমন সময় এসে দাঁড়ায় সোমেন চন্দ]
সোমেন: ভেতরে আসব রণেশদা?
রণেশ: এই দ্যাখ, সোমেন এসেছে। এসো, এসো সোমেন।
[লাজুকভাবে সোমেন ঘরে ঢুকে এককোণে বসে]
রণেশ: সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। এই হচ্ছে সোমেন চন্দ। বাড়ি বিক্রমপুর। এখন অবশ্য দক্ষিণ মৈশুন্ডির বাসিন্দা। গল্প-কবিতা লেখে। কলকাতার ‘দেশ’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছে তার গল্প ‘শিশুতপন’। কাঁচা বয়েস কিন্তু পাকা হাত।
সোমেন: আঃ রণেশদা-
রণেশ: বড্ড লাজুক। আমাদের একজন হয়ে উঠলে অবশ্য কেটে যাবে লজ্জা। এখন থেকে সোমেন প্রগতি পাঠাগারের সদস্য।
সকলে: আমরা নতুন সদস্যের লেখা শুনব।
রণেশ: এ দাবি যে উঠবে তা জানতাম। সোমেনকে বলেও রেখেছিলাম।
সোমেন: ‘শিশুতপন’ গল্পটাই পড়ি!
রণেশ:  বেশ।
[সোমেন গল্প পড়তে শুরু করে। শেষ হতে সকলে হাততালি দিয়ে ওঠে]
সোমেন: আমি কিন্তু জানতে আর শনতে এসেছি। শুনতে চাই মার্কসবাদের কথা, রুশবিপ্লবের কাহিনী, গরিব মানুষের মুক্তিপথের  দিশা...


পাঁচ.
[বিভিন্ন ভঙ্গিমায় সোমেন। বইপত্র নাড়ছে, পড়ছে, লিখছে। ভাষ্য: শুধুমাত্র সাহিত্যের গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ থাকতে চাননি সোমেন। মানুষের মুক্তিপথের সন্ধানই ছিল তাঁর সাধনা। গভীর অধ্যবসায়ের সঙ্গে রাত জেগে পড়তেন মার্কসবাদী সাহিত্য, জানার চেষ্টা করতেন চাষি-মজুরের সমস্যা। কৃষাণের মজুরের জীবনের শরিক হতে চাইতেন।]


ছয়.

[শীতের সকাল। কুয়াশা। রেলওয়ে ওয়ার্কশপ। শিফট চেঞ্জের সময়। নাইট শিফটের শ্রমিকরা বেরিয়ে আসছে। গেটের ওধারে সোমেন।গায়ে বিবর্ণ উলের চাদর, পায়ে বিদ্যাসাগরী চটি ।কথা বলছে শ্রমিকদের সঙ্গে]
সোমেন: আপনি ইউনিয়নের সভ্য হয়েছেন?
শ্রমিক১: না।
সোমেন: আপনি?
শ্রমিক২: গত বছর ছিলাম ।
সোমেন: আপনি ?
শ্রমিক৩: সভ্য! নাতো।
সোমেন: আচ্ছা, আপনারা কি মনে করেছেন বলুন তো! ইউনিয়নের  সভ্য না হয়ে একা একা বাঁচতে পারবেন? ওরা শক্তিমান। ওদের সঙ্গে একা পারবেন লড়াই করতে! পারবেন আপনার দাবি আদায় করতে!
[আরও শ্রমিক ভিড় করে আসে। সকলে উৎসুক হয়ে শোনে সোমেনের কথা]
সোমেন: না, একা একা বাঁচা যায় না। মালিকের সঙ্গে লড়াই না করে আপনারা আপনাদের দাবি আদায় করতে পারবেন না। মালিক তো মেরতে মেরে গায়ের রঙ ফ্যাকাসে করে দিল। তবু আপনাদের চৈতন্য হচ্ছে না!

 

সাত.

[প্রগতি পাঠাগারের সামনে সোমেন ও সতীশ]সোমেন: আমি শ্রমিক ইউনিয়নে কাজ করতে চাই সতীশদা ।সতীশ:  না, না-সোমেন: কেন ?সতীশ: তোমার শরীর দুর্বল। তাছাড়া সে যে বড়ো পরিশ্রমের কাজ।সোমেন: পরিশ্রমই তো করতে চাই।সতীশ: তুমি বরং প্রগতি লেখক সংঘটা ভালো করে গড়ে তোল।সোমেন: তা তো করছি।সতীশ: দুটো একসঙ্গে—সোমেন: কিন্তু একটার জন্যে আর একটা দরকার যে!সতীশ: কি বললে!সোমেন: শ্রমিক জীবনের অভিজ্ঞতা না থাকলে প্রগতি সাহিত্য লিখব কি করে! এ যুগের পালাবদলে প্রোলেটারিয়েটের ভূমিকাই প্রধান। তাদের মধ্যে যদি কাজ না করতে পারলাম তাহলে শৌখিন কমিউনিস্ট বনে লাভ কি !

আট.

[জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে সোমেন লাভ করেছিল তার লেখার উপকরণ । তার বিখ্যাত ‘ইঁদুর’ গল্পের কথা ধরা যাক। গল্পের নায়ক সুকুমার আসলে সোমেনের আত্মপ্রতিকৃতি। সুকুমার ছিল মেহনতি মানুষের আপনজন। রেলওয়ে ইয়ার্ডের পাশ দিয়ে আপন মনে হেঁটে যাচ্ছে সুকুমার।শশধর নামক এক শ্রমিক তাকে ডাকে]শশধর: ও সুকুমারবাবু-সুকুমার: আরে শশধর যে!শশধর: কাছে আসুন কথা আছে।[সুকুমার আসে। দুজন পাশাপাশি বসে। শশধর বিড়ি ধরায়]সুকুমার: কি ব্যাপার শশধর!সুকুমার: সেদিন কারখানার সাহেব আমাকে ডেকেছিলেন।সুকুমার: কেন!শশধর: শালা বলে কিনা: ড্রাইভার ইউনিয়ন ছেড়ে দাও, নইলে মুশকিল হবে।সুকুমার: আপনি কি বললেন?

শশধর: বললাম ছাড়ব না। আপনার যা ইচ্ছা হয় করুন। বলেই এই রকম গটগট করে বেরিয়ে এলাম-[শশধর বীরদর্পে হাঁটার ভঙ্গি করে। সুকুমার হাসে। দুজনে উঠে দাঁড়ায়। কথা বলতে বলতে পথ চলে। দূরে এঞ্জিনের সাঁ সাঁ শব্দ। চিৎকার। কয়েকজন শ্রমিক সুকুমারকে দেখে আনন্দে হৈ হৈ করে ওঠে]সুকুমার: আরে ইয়াসিন,  দেশ থেকে কবে ফিরলেন?ইয়াসিন: দিন দুই হল।শঙ্কর: দেশে গিয়ে ইয়াসিন খুব বীরত্ব দেখিয়ে এসেছে জানেন সুকুমারবাবু- ইয়াসিন: খালি ইয়ার্কি-শশধর:  তাহলে নিজেই বল না ইয়াসিন।সুকুমার: হ্যাঁ বলুন না ইয়াসিনভাই।ইয়াসিন: তেমন কিছু নয়। তবে কিনা গাঁয়ের চাষিরাও জাগছে। তাদের একটা বৈঠকে হাজির ছিলাম। একজন আমাকে ইউনিয়নের কথা 

জানতে চাইল। আমি পকেট থেকে রসিদ বের করে দেখাতে তারা আনন্দে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল-তুমি যে আমাদেরই একজন।শশধর; জানেন সুরেন কি বলছিল?সুকুমার: কি?শশধর: বলছিল আপনি ব্যারিস্টার হলেন না কেন!সুকুমার: তার মানে!
শশধর: আপনাকে কথায় হারানো যায় না। বিরোধী লোকেরা হেরে ভূত হয়ে যায় আপনার কাছে।
[সকলে হেসে ওঠে]


নয়.
[একতলা মাটির ঘর। সাত-আট জন শ্রমিকের মধ্যে সোমেন। দরখাস্ত লিখছে। দরখাস্ত নিয়ে তারা চলে গেল। দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন অনিল মুখার্জী। দেখতে পেয়ে সোমেন ব্যস্ত হয়ে এগিয়ে এল]
সোমেন: আরে কি সৌভাগ্য, অনিলবাবু যে!
অনিল:  সে কি কথা! সৌভাগ্য তো আমার।
সোমেন:  এ কি বলছেন!
অনিল:  পাঁচ পাঁচবার চেষ্টার পরে দেখা পেলাম।
সোমেন:  বসুন বসুন।
[অনিলকে মাদুরে বসিয়ে সোমেন উঠে দাঁড়ায়]
অনিল: আবার উঠলেন যে!
সোমেন: এই আসছি, একটু বসুন।
[সোমেন চলে যায়। স্টোভ জ্বালানোর শব্দ শোনা যায়। একটু পরে সোমেন চা নিয়ে ঢোকে]
অনিল: আবার এসব কেন?
সোমেন:  অতিথি সৎকার আর কি!
অনিল: সরলানন্দ সেদিন বলছিল আপনার কথা।
সোমেন: আমার কথা! আমার আবার কি কথা!
অনিল: ঘর-সংসারের কাজেও আপনি এক্সপার্ট।
সোমেন: বাবা আর আমি এখানে থাকি। বাবা সময় পান না । তাই-
অনিল: সরলা বলছিল তাকে নাকি আপনি নিজের হাতে রান্না করে মুসুরির ডাল আর ইলিশমাছের ঝোল খাইয়েছিলেন।
সোমেন: হ্যাঁ সরলা এসেছিল একদিন।
অনিল: নতুন কিছু লিখলেন?
[সোমেন একটা পত্রিকা এগিয়ে দেয়। ওতে ‘মহাপ্রয়াণ’ গল্প ছাপা হয়েছে। পাতা ওলটাতে ওলটাতে অনিল বলেন]
অনিল: এত কাজ করার পরে লেখেন কখন? আপনি তো দেখছি অসাধারণ লোক। সমীন্দ্র বলছিল শুধু লেখা নয়, আপনি পড়াশুনোও করেন সময় পেলে!
সোমেন: কোথায় আর পড়তে পারি! বিদ্যে তো ম্যাট্রিক। ইংরেজি বই ভালো করে বুঝতে পারি না। দেখুন না কডওয়েলের ‘ইলিউশন আ্যন্ড রিয়েলিটি’ পড়ার চেষ্টা করলাম। অনেকটাই বুঝতে পারলাম না।


দশ.
[কলকাতার বালিগঞ্জের দোতলা বাড়ি। জানালার গরাদে হাত রেখে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে সোমেন। নিচের তলায় নির্মল ঘোষের অফিস ঘর। ‘বালিগঞ্জ’ পত্রিকার অফিস । একটু বাদে নির্মল ঘরে ঢুকলেন]
নির্মল: এ কি তুমি! এমন হঠাৎ!
সোমেন: হ্যাঁ। ঢাকা মেইলে চলে এলাম। এসে দেখি বাড়ি ফাঁকা।
[নির্মল হাসেন। কালো কোট হ্যাঙ্গারে ঝোলান। পরিচারককে চা আনতে বলেন]

নির্মল: কদিন আগেই তোমার চিঠি পেলাম। তুমি তো বড়দিনের বন্ধে আসবে লিখেছিলে! সোমেন: আগেই চলে এলাম। আমার উপর আবার একটা দায়িত্ব দিয়েছে কিনা!নির্মল: কি দায়িত্ব! সোমেন: এখানে তো প্রগতি লেখক সংঘের সম্মেলন শুরু হচ্ছে। সে সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে হবে। ঠিক হয়েছে ঢাকাতেও আমরা প্রগতি লেখক সংঘ গড়ে তুলব। নির্মল: সম্মেলনে যোগ দেবে? সোমেন: হ্যাঁ।নির্মল: বেশ। নিয়ে যাব। কিন্তু তোমার প্রতিশ্রুতির কথা মনে আছে তো! সেই যে বিত্তহীন মধ্যবিত্তদের নিয়ে একটা উপন্যাস লিখবে! [সোমেন হাসতে হাসতে ব্যাগ থেকে উপন্যাসের পান্ডুলিপি বের করে নির্মলের হাতে দেয়, তারপর বলে] সোমেন : প্লটটা শুনুন। [আলো কমে আসে। বন্যার ছবি ভেসে ওঠে। নৌকায় আসছে স্বেচ্ছাসেবকরা। গ্রামের ধারে জলমগ্ন একটা বাড়ি। জলে পা ডুবিয়ে সেই ঘরের বারান্দায় বসে আছে একটি মেয়ে। সোমেন তন্ময় হয়ে বলে যায়]সোমেন: এক বন্যাপীড়িত গ্রাম। সে গ্রামের এক মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে মালতী। ঘরে অভাব, তবু দারুণ স্বপ্নবিলাসী। বারান্দার নিচে জল দেখে, সেই জলে নিজের ছায়া দেখে তার আনন্দ। অথচ পিছনে তার অভুক্ত সংসার, খাবার ভিক্ষা, কান্না। এসবের মধ্যেও স্বপ্ন দেখে চলে সেই মেয়ে। এসময় গ্রামে ফ্লাড রিলিফ কমিটি এল। রজত এসেছে স্বেচ্ছাসেবক হয়ে। মালতীর অবাস্তব স্বপ্নকে আঘাত করল রজত]

এগারো.

[কলকাতার রাস্তায় কখনও নির্মল ঘোষের সঙ্গে কখনও একা একা ঘুরছে সোমেন]

বারো.

[আশুতোষ মেমোরিয়াল হল। প্রগতি লেখক সংঘের দ্বিতীয় সম্মেলন। বাইরে ফেস্টুন। বারবুশ, রোলাঁ, রবীন্দ্রনাথের ছবি। যুদ্ধবিরোধী বাণী। সোমেন কথা বলছে একজন স্বেচ্ছাসেবকের সঙ্গে] সোমেন: কে কে এসেছেন?স্বেচ্ছাসেবক : মুলকরাজ আনন্দ, শৈলজানন্দ মুখার্জী, বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত, সুরেন্দ্রনাথ গোস্বামী, সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার। সোমেন: রবীন্দ্রনাথ আসেন নি? স্বেচ্ছাসেবক: না, আসেন নি। তবে তিনি বাণী পাঠিয়েছেন। [এবার স্পষ্ট

হয়ে উঠল সত্যেন্দ্রনাথের কন্ঠ। সোমেন শুনছে তন্ময় হয়ে। সত্যেন্দ্রনাথ: এবার প্রগতি লেখক সংঘের খসড়া ইশতেহারটি আপনাদের অনুমোদনের জন্য উপস্থিত করছি ।-- ভারতীয় সমাজে মৌলিক পরিবর্তন ঘটেছে। প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি অস্তিত্ব রক্ষার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে। চিরায়ত সাহিত্যধারার অবলুপ্তির পর থেকে ভারতীয় সাহিত্যে জীবন বিমুখতার মারাত্মক প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।.....  সাহিত্যের মান যাদের হাতে অবনমিত হচ্ছিল সেই রক্ষণশীল শ্রেণির হাত থেকে সাহিত্যকে রক্ষা করা এবং জনগণের জীবনের সঙ্গে তাকে বাস্তবজীবনচিত্রণের উপযোগী ও ভবিষ্যতের কান্ডারী করাই  এই সংগঠনের উদ্দেশ্য।.... ভারতীয় সভ্যতার শ্রেষ্ঠ ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী হিসেবে গর্ব করার সঙ্গে সঙ্গে দেশের প্রতিক্রিয়ার শক্তিকে আমরা সমালোচনা করব এবং সৃজনশীল ও পারস্পরিক কাজের মধ্য দিয়ে জাতির নবজীবন সঞ্চারের চেষ্টা করব।

তেরো.
[চিন্তামগ্ন সোমেন হেঁটে যাচ্ছে শহরতলীর পথ দিয়ে। ভাষ্য: কলকাতার অভিজ্ঞতা নিয়ে ঢাকায় ফিরে এল সোমেন । শত বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে ঢাকায় প্রগতি লেখক সংঘ গড়ে তোলার সঙ্কল্প তার। এই সংঘ নতুন চেতনা দেবে দেশবাসীকে। উদ্বুদ্ধ করবে নব ভাবনায়। চিনিয়ে দেবে শ্রেণীশত্রুকে। প্রেরণা দেবে তার বিরুদ্ধে সংগ্রামের]

চোদ্দ.

[বিকেল। সরুগলি দিয়ে হাঁটছে সোমেন। গলায় গণসংগীতের সুর। পেছন থেকে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত]কিরণ: এতদিন কাটিয়ে এলে কলকাতায়। একটা চিঠি পর্যন্ত পেলাম না। সোমেন: বিশ্বাস করো একদম সময় পাই নি। কিরণ: উঠেছিলে কোথায়? সোমেন: নির্মল ঘোষের বাসায়। কিরণ:  বালিগঞ্জ পত্রিকার সম্পাদক? সোমেন: হ্যাঁ । জানো কিরণ, ওই পত্রিকার পরের সংখ্যা থেকে ছাপা হবে আমার উপন্যাস ‘বন্যা’। কিরণ: বাঃ, ভালো খবর। প্রগতি লেখক আন্দোলনের খবর কি? সোমেন: অনেক খবর এনেছি। [ঝোলা থেকে কাগজপত্র বের করে] এই ইশতেহার, এই সংবিধান। কিরণ: আমাদের সংগঠন গড়ার কাজে লাগবে। রণেশদার সঙ্গে দেখা হয়েছে? সোমেন: হ্যাঁ। পাঠাগারে মিটিং শুক্রবারে। আর শোন কিরণ, আমরা সোভিয়েতের উপর একটা চিত্র প্রদর্শনী করব। দেবপ্রসাদ আর তুমি হবে সে কমিটির যুগ্ম সম্পাদক। কিরণ: কোথায় হবে প্রদর্শনী? সোমেন: সদর ঘাটের কাছে ব্যাপটিস্ট মিশন হলে।

 

পনেরো.

[ব্যাপটিস্ট মিশন হলে চিত্র প্রদর্শনী। সোভিয়েত রাশিয়ার নানা চিত্র। মানুষের ভিড়। সোমেনঘুরে ঘুরে ব্যাখ্যা করে বোঝাচ্ছে।]

ষোলো. 

[হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা। চিৎকার। সরলানন্দের মুখ ভেসে ওঠে। তার কন্ঠে শোনা যায়: বৈশাখের কাঠফাটা রোদ। শহরে দাঙ্গা। রাজপথ দিনে-দুপুরে জনশূন্য। মানুষের পাশ দিয়ে গা ঘেঁষে চলতে মানুষ ভয় পায়। বুক কাঁপে। কিন্তু বিশ্রাম নেই সোমেনের। হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সদ্ভাব ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে বিরাম নেই তার। অনলস শিল্পী তোমাকে নমস্কার।]

সতেরো.

[বাড়ি জ্বলছে। চিৎকার। ছোটাছুটি। একদল মারমুখী লোককে থামাবার চেষ্টা করে সোমেন। তার তাকে ঠেলে ফেলে দিয়ে চলে যায়। অন্যদিক থেকে ভেসে আসে আর্তনাদ। সোমেন এগিয়ে গিয়ে দেখে একটা মৃতদেহ। ভালো করে দেখে ‘আরে এ যে মকবুল’ বলে সে শোকে ভেঙে পড়ে। এই সময় আর একদল মারমুখী জনতা আসে। সোমেন তাদের দিকে এগিয়ে যায়।] সোমেন: আপনারা মকবুলকে মেরে ফেললেন? [জনতা চুপ] সোমেন: কথা বলছেন না কেন? ও কি কারও ক্ষতি করেছিল? জনতা: না তা নয় তবে-সোমেন: তবে কি? জনতা: ও মুসলমান। ওর জাতভাইরা যোগেনকে খুন করেছে। সোমেন: কি বললেন?[আর্তনাদ করে ওঠে সোমেন। তারপর নিজের মনে বলে: বাঃ ভালোই হল। মকবুল আর যোগেণ ছিল গলায় গলায় বন্ধু । আপনাদের দুই দলের পাগলামির বলি হতে হল দুই বন্ধুকে। কিন্তু এই পাগলামি আর কতকাল চলবে? বলতে পারেন কবে থামবে এই ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা?

আঠারো.

[প্রগতি লেখক সংঘের আসরে সোমেন। অচ্যুত গোস্বামী বলে] অচ্যুত: ঢাকায় শুরু হয়েছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। এ ক্ষেত্রে প্রগতি লেখকদেরও একটা ভূমিকা আছে। সাহিত্যের মাধ্যমে সচেতন করতে হবে মানুষকে। গত বৈঠকে দাঙ্গাবিরোধী গল্প লেখার আবেদন জানানো হয়েছিল। কেউ কি এনেছেন গল্প? সোমেন: আমি এনেছি। সকলে: পড়ুন গল্পটা। সোমেন: ছোট ছোট কতকগুলো  চিত্রের মধ্য দিয়ে দাঙ্গার পরিস্থিতি তুলে ধরেছি।

দৃশ্যগুলির পটভূমিতে আছে এক পরিবার। মা-বাবা বিভ্রান্ত। ছোট ভাই অজয় হিন্দু সোশ্যালিস্টদের অশুভ চিন্তাদর্শের শিকার। বড়ভাই অশোক কমিউনিস্ট কর্মী। তাদের বাবা আর ফিরলেন না অফিস থেকে। দাঙ্গার শিকার হলেন তিনি ........[সোমেনের ‘দাঙ্গা’ গল্পের কিছু চিত্র ভেসে ওঠে]

১.[ দরজার কানাড়ার শব্দ। মা দরজা খুললেন। অশোক ঢুকলও] মা: একশবার বলেছি রাস্তায় যখন-তখন বেরবি না । কে শোনে কার কথা। যা না বাপু, মামার বাড়ি থেকে দিনকতক ঘুরে আয়। অশোক: এত কাজ ফেলে যাই কেমন করে মা? মা: কাজ না ছাই। কে শুনবে রে তোদের কথা? তোদের রাশিয়া পারবে জার্মানির সঙ্গে? অশোক: পারবে না কেন? বিপ্লবের মরণ নেই মা।

[মা খাবার এনে অশোকের পাশে বসলেন। অশোক খেতে শুরু করে]
মা: হ্যাঁরে এ কি সত্যি!
অশোক: কি মা?
মা: ওই যে তোর বাবা বললেন জার্মানি সব নিয়ে নিয়েছে রাশিয়ার! তারা একেবারে এসে পড়েছে আমাদের দেশের কাছে!
[অশোক হো হো করে হেসে ওঠে]
অশোক: এঁরা হিটলারের চেয়েও লাফিয়ে চলেন।
[এই সময় অজয় ঘরে ঢুকলও]
অজয়: জানিস দাদা, নবাববাড়ি সার্চ হয়ে গেছে?
অশোক: এটি আবার কোথ্থেকে আমদানি হল?
অজয়: বারে, নিজের কানে শুনে এসেছি।
অশোক: কচু শুনেছ।
অজয়: তা তো বলবেই। তোমরা কমিউনিস্টরা হিন্দুও নও, মুসলমানও নও।
অশোক: তাহলে আমরা ইহুদির বাচ্চা নারে!
২.
[রাত গভীর। ঘরের ভেতর অস্থিরভাবে পায়চারি করছে অশোক। উদ্বিগ্ন মা এলেন]
মা: তোর বাবা তো এখনো এলেন না !
অশোক: দেখি আর একটু ।
৩.
[ঢংঢং করে দুটো বাজল। বাইরে সৈন্যদের টহল। মা-বোন কাঁদছে। অশোকের বন্ধু বিমল এল]
অশোক: কি হল বিমল? কোন খোঁজ পেলি?
বিমল: অফিস থেকে পাঁচটায় বেরিয়েছেন।
অশোক: তাহলে!
[অশোকের অস্থিরতা বেড়ে যাব। তার চোখ ছলছল করে। এমন সময় ঘরে ধোঁয়া ঢোকে পাশের ঘর থেকে। অশোক ছুটে সে ঘরে ঢুকে দেখে হিন্দু- মুসলমান ঐক্যের আবেদনপত্রগুলিতে আগুন দিয়েছে অজয়। সেই আগুনে তাকে হিংস্র দেখায়]
অশোক: কি করছিস এসব?
অজয়: তোমাদের ঐক্যের মড়া পোড়াচ্ছি।
অশোক: অজু ভুল করছিস।
অজয়: দাদা রাখ তোমার কমিউনিজম। ওসব আমরা জানি ।
অশোক: কি জানিস?
অজয়: জানি যে তোমরা দেশের শত্রু।
অশোক: ফ্যাসিস্ট এজেন্টদের মতো কথা বলছিস। জানিস দাঙ্গা কেন হয়? জানিস কি প্যালেস্টাইন আর আয়ারল্যান্ডের কথা?


উনিশ.
[তন্ময় হয়ে লিখছে সোমেন। লেখাগুলো এবং সেই সঙ্গে সোমেনের কন্ঠস্বর ভেসে ওঠে: সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সংগ্রাম, ভারতীয়দের পারস্পরিক তিক্ততা আর শত্রুতা বন্ধ করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করা আজ দেশপ্রেমিক ভারতীয় বুদ্ধিজীবীদের কর্তব্য। শুধু মানবতার নিকট আবেদন এবং জনগণের মধ্যে স্বদেশপ্রেম জাগিয়ে তুলে, সাম্রাজ্যবাদ আর তার এজেন্টদের স্বরূপ উন্মোচন করেই এ কাজ করা যাবে না। জনগণের প্রাত্যহিক জীবন ও সংগ্রামের গৌরবময় ঐক্য গড়ে তুলতে হবে]


কুড়ি.
[হলঘরের বাইরে ব্যানার—‘ বর্ধিতায়ন সভা—ঢাকা প্রগতি লেখক সংঘ’। দেওয়ালের পোস্টারে লেখা :  হিটলার সোভিয়েত থেকে হাত ওঠাও, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়তে হবে একসাথে, দুনিয়ার মজদুর এক হও। মঞ্চে উঠলেন  রনেশ দাশগুপ্ত]
রণেশ; এবার বক্তব্য রাখবেন আপনাদের প্রিয় লেখক সোমেন চন্দ।
[করতালি। নানা মন্তব্য। মঞ্চে সোমেন]
সোমেন: বন্ধুগণ ১ গত ২২শে জুন হিটলার আক্রমণ করেছে সোভিয়েত রাশিয়া। এই আক্রমণ পৃথিবীর সামনে এনেছে নতুন বিপদ।
[হিটলার বাহিনী ও লালফোজের নানা দৃশ্য ভেসে ওঠে]
সোমেন: চাষি মজুরের দল রাশিয়ায় এক নতুন সভ্যতার ইমারত গড়ে তুলেছে দেখে গাত্রদাহ শুরু হয় ফ্যাসিস্টদের। হিটলার তাদেরই প্রতিনিধি। গতবছর পশ্চিম ইউরোপকে পদানত করে হিটলার বুঝেছিল সারা দুনিয়ায় জয়পতাকা ওড়াতে হলে ধ্বংস করতে হবে সোভিয়েতকে। দুনিয়ার মেহনতি মানুষ সোভিয়েতের উপর এই আক্রমণ সহ্য করবে না। তাই আসুন বন্ধুগণ আমরা ঐক্যের প্রাচীর গড়ে তুলি। ........
[করতালি। স্লোগান]


একুশ.
[নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, রাজশাহির ফ্যাসিবিরোধী অনুষ্ঠানের খণ্ডচিত্র। সর্বত্র সোমেনের মুখচ্ছবি]


বাইশ.
[সোভিয়েত সুহৃদ সমিতির অফিস। দরজার সামনে কিরণশঙ্কর। উত্তেজিত। রণেশ এলেন]
কিরণ; কালকের সভায় তো সিদ্ধান্ত নিলেন কিন্তু আমাদের কান্ডারি কই?
রণেশ; কার কথা বলছ ?
কিরণ: সোমেনের কথা।
রণেশ: ওর তো রাজশাহি যাবার কথা।
কিরণ: তা জানি। কিন্তু গতকালই তো ফেরার কথা।
রণেশ: তাই তো!
কিরণ: এদিকে দিনক্ষণ স্থির। কলকাতায় নেতাদের চিঠি পাঠানো হল।
[দূরে সোমেনকে আসতে দেখা যায়। এদের মুখে হাসি ফোটে। সোমেন কাছে আসে]
সোমেন: কি ব্যাপার এত উত্তেজিত কেন?
কিরণ: ঢাকায় ফ্যাসিবিরোধী সম্মেলনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সোমেন: চমৎকার।
রণেশ; তোমার উপর বিরাট দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
সোমেন: কি রকম?
কিরণ: বিরাট মিছিল আনতে হবে।
সোমেন: নিশ্চয় আনবো।


তেইশ.
[ঢাকার সূত্রাপুর।ফ্যাসিবিরোধী সম্মেলনের মঞ্চ। ব্যস্ততা। এককোণে রণেশ ও এক যুবক]
যুবক: সবাই এসে গেছেন?
রণেশ: মোটামুটি । জ্যোতি বসু, বঙ্কিম মুখার্জী...
[এক স্বেচ্ছাসেবক হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে এবং রণেশকে বলে]
স্বেচ্ছাসেবক:  সরলানন্দ আপনাকে তাড়াতাড়ি ডাকছে।
রণেশ: সে কোথায়?
স্বেচ্ছাসেবক:  মঞ্চের পাশে টিকিট ঘরে।
[রণেশ দ্রুতপায়ে সরলানন্দের কাছে এলেন] 
রণেশ: কি ব্যাপার সরলা?
সরলা: একটা গোলমালের আশঙ্কা করছি।
রণেশ: কেন?
সরলা: একটিই লোক বারে বারে এসে টিকিট নিয়ে যাচ্ছে।
রণেশ; চেনো তাকে? 
সরলা: না, আমাদের কেউ নয়।
[আর এক যুবক ব্যস্ত হয়ে ছুটে আসে]
যুবক: উপারে কয়েকজন জড়ো হয়েছে।
রণেশ: সংখ্যা?
যুবক: ৩০-৩৫এর মতো।
রণেশ: হাতে কিছু আছে?
যুবক: হকিস্টিক, লোহার ডান্ডা ।
[কিরণশঙ্কর  ছুটে এলেন]
কিরণ: সভা শুরু করব রণেশদা?
যুবক: কিন্তু...
রণেশ: হ্যাঁ শুরু করো সভা।
[রণেশ যুবকদের কি নির্দেশ দিলেন। তারা চলে গেল। সরলা আর রণেশ কথা বলতে লাগলেন]


চব্বিশ.
[সম্মেলনের মঞ্চ। জ্যোতি বসু বসে আছেন। বঙ্কিম মুখার্জী উঠে দাঁড়ালেন বক্তৃতা দেবার জন্য]


পঁচিশ.
[রেলওয়ে ইউনিয়নের অফিস। কয়েকজন শ্রমিক ও সোমেন। সমীন্দ্র হোড় এর প্রবেশ]
সমীন্দ্র; মিছিল চলে গেল যে !
সোমেন: জানি।
সমীন্দ্র; তুমি বসে কেন?
সোমেন: কয়েকজন আসবে। এলেই দৌড়াব। ধরে ফেলব মিছিল।
সমীন্দ্র:  আমি যাচ্ছি।  দেরি করো না।


ছাব্বিশ.
[ফ্যাসিবিরোধী সম্মেলনের মঞ্চ। সরলানন্দ গেটের কাছে। একজন দৌড়ে এসে কি বলল তার কানে কানে। মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। টলতে টলতে কোনোরকমে এল মঞ্চের কাছে। ডাকল রণেশকে। সরলার কথা শুনে হতচকিত রণেশ । তারপর কোনোরকমে নিজেকে সামলে উঠে এল মঞ্চে]
রণেশ: বন্ধুগণ! এইমাত্র খবর এল- কি ভয়ঙ্কর খবর- আমাদের সোমেন আর নেই। সম্মেলনের দিকে আসছিল সে মিছিল নিয়ে। পথে তাকে ঘিরে ধরে ফ্যাসিস্ট গুন্ডারা। নির্মমভাবে খুন করে।
[সভায় তীব্র উত্তেজনা। কান্না]


সাতাশ.
[ভেসে ওঠে সোমেনের মুখ]
সোমেন: হ্যাঁ নিহত হয়েছি আমি। ব্যক্তিমানুষ চলে যায় পৃথিবী ছেড়ে। কিন্তু আদর্শের মৃত্যু নেই। তার অনুরণন চলে যুগ যুগ। আমি ভালবেসেছিলাম মানুষকে। তাই মানুষের শত্রুদের কাছে আমি অপরাধী। কিন্তু আমার ভালোবাসা মৃত্যুহীন। তার বীজ থেকে যাবে। ভালোবাসার সেই বীজ নির্মূল করার সাধ্য কারোর নেই...........

বুড় শালিকের ঘাড়ে রোঁ

প্রবন্ধ সমগ্র ।। মতামত ।। সূচীপত্র

 প্রবন্ধ সমগ্র
subimal.JPG

‘বুড় শালিকের ঘাড়ে রোঁ

এবং মধুসূদন দত্তর

সমাজসচেতনতা

সুবিমল চক্রবর্তী                                ডালাস, টেক্সাস

michael.JPG

বাংলা অভিধান বলছে, প্রহসন মানে হচ্ছে হাস্যরসাত্মক নাটক। ‘প্রহসন’ শব্দটির মধ্যেই হাস্যরসের ইঙ্গিত রয়েছে। ইংরেজিতে প্রহসনকে বলি farce। প্রহসনের হওয়ার কথা বাস্তবতাবর্জিত। সাহিত্যের বিশ্বকোষের দিকে তাকানো যাকঃ হাল্কা নাট্যধর্মী  রচনা যার মধ্যে সন্নিবেশিত থাকবে অসম্ভব সব ঘটনা, ঘটনার অতিরঞ্জন, বাঁধাধরা চরিত্রসমূহ, এবং সহিংস ক্রীড়ামোদ বা ডানপিটেমি। প্রহসনে একসঙ্গে সবগুলো বৈশিষ্ট্য থাকবে এমন কথা নেই। প্রহসনকে ‘নাট্যধর্মী রচনা’ না বলে নাটকই বলা যায়। কমেডিও এবং প্রহসনের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ সহজ নয়। কমেডিকে হতে হবে হাল্কা মেজাজের এবং মনোরঞ্জনকারী নাটক। আবার কমেডিতে সিরিয়াস এবং গভীর বিষয় হাল্কা পরিচিত এবং ব্যাঙ্গাত্মকভাবেও পরিবেশিত হতে পারে। আমরা বাংলায় কমেডিকে একটা সীমিত অর্থেও ব্যবহার করি। কমেডিকে আমরা বলি মিলনাত্মক নাটক যেখানে সচরাচর মধুর মিলনের মধ্য দিয়ে নাটকের পরিসমাপ্তি ঘটে। ‘Farce-comedy’ নামে সাহিত্যে এমন এক কমেডির ধারণা আছে যাতে প্রহসনের বৈশিষ্ট্যও বিদ্যমান।

নাটকের ইতিহাসে প্রহসন বা কমেডি নতুন কোন সংযোজন নয়। প্রাচীন গ্রীসে প্রহসন এবং কমেডি লেখা হত এবং অভিনীতও হত। নাটকের প্রধান এই দুটো ধারাই সর্বকালে সর্বযুগে দেশে দেশে জনপ্রিয়তা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। শুধু তাই নয়, সমাজ বদলের হাতিয়ার হিসেবেও প্রহসন এবং কমেডি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তবে এখানে একটা কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন। সাধারণভাবে সৌন্দর্যতত্ত্ব এবং বৌদ্ধিকবিচারে প্রহসনকে কমেডির তুলনায় নিকৃষ্টমানের মনে করা হয়। এমনটা মনে করার কারন প্রহসনের মধ্যে পরিশীলতার অভাব (যেমন, ভাঁড়ামি) এবং অবাস্তব ঘটনার সন্নিবেশ থাকতে পারে। যেহেতু আমরা মধুসূদনের ‘বুড় শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ প্রহসনটি নিয়ে আলোচনা করব, এই কথাগুলো আমাদের মনে রাখলে সুবিধে হবে।

‘মধুসূদন রচনাবলী’র সম্পাদকদ্বয় ভূমিকায় বলেছেন, “মধুসূদন যত বড় কবি ছিলেন অবশ্যই সে মাপের নাট্যকার ছিলেন না। কিন্তু বাংলা নাট্যসাহিত্যের ইতিহাসে তাঁর স্থান খুবই উঁচুতে। শৈশবের দুর্বলতা কাটিয়ে তিনি বাংলা নাটকের যৌবনের শক্তি দিয়েছিলেন, কিন্তু আন্তর্জাতিক মানের কথা মনে রাখলে তাঁর কোন সিরিয়াস নাটককেই প্রথম শ্রেণীর লেখা বলা যায় না। কিন্তু লঘু-ব্যঙ্গ নাট্যে তাঁর কৃতিত্ব বিশ্বমানের, বিশেষত ‘বুড় শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ অতি উচ্চ মানের উচ্চ স্তরের প্রহসনের মর্যাদা দাবী করে। “ মধুসূদন ‘শরমিষ্ঠা’ নাটক লিখেন ১৮৫৯ সনে এবং বাংলা নাটক দিয়েই পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে বাংলা সাহিত্যের চর্চায় মনোনিবেশ করেন। ঐ সময়টাতে বাংলা নাটক দিয়ে রামনারায়ণ তর্করত্ন বাজার মাত করে রেখেছেন। তাঁর নাটকে সমাজসচেতনতা ছিল, তবে পুরাণভিত্তিক নাটক লিখতেন এবং প্রধানত সংস্কৃত নাটকের অনুবাদ করতেন। মধুসূদনের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল প্রবল। তিনি চাইছিলেন ইউরোপীয় ধারায় নাটক রচনা করতে। কিন্তু ইউরোপীয় ধাঁচের নাটকের দর্শক তখনো তৈরি হয়নি। তাই সংস্কৃত নাটকের ধাঁচেই লিখতে হ’ল ‘শর্মিষ্ঠা'। কিন্তু সমসাময়িক নাটকের তুলনায় ‘শরমিষ্ঠা’ অনেক বেশি উজ্জ্বল বলে সাহিত্য- এবং নাট্যরসিকদের কাছ থেকে যথেষ্ট প্রশংসা পেয়েছিলেন।   

‘শরমিষ্ঠা’ নাটক বেশ জাঁকজমকের সাথে বেলগাছিয়া থিয়েটারে অভিনীত হয়েছে। থিয়েটারকর্তৃপক্ষ চাইছিলেন একটু নতুন ধরণের হাস্যরসাত্মক ছোট নাটক যা একই দিনে মঞ্চস্থ।করা যাবে। মধুসূদন তখন ‘পদ্মাবতী’ (গ্রিক পুরাণের ‘স্বর্ণ আপেলের’ কাহিনিকে ভারতীয় পুরাণের মত করে লেখা)  নাটক লিখছিলেন। প্রতিভাবান মধুসূদন ‘পদ্মাবতী’ লেখা স্থগিত করে খুব দ্রুত দুটো প্রহসন লিখে ফেললেন। প্রহসন দুটো হ’ল ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ এবং ‘বুড় শালিকের ঘাড়ে রোঁ’। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে এই দুটো প্রহসনের একটিও মঞ্চস্থ হ’ল না। এর আগে রামনারায়ণ তর্করত্ন লিখেছেন ‘কুলীনকুল-সর্বস্ব’। নাটকটি চিন্তাধারার দিক থেকে বেশ আধুনিক ছিল, কিন্তু এটি নাট্যকার লিখেছিলেন সংস্কৃত নাটকের রীতি অনুসরণ করে। মধুসূদন সংস্কৃত নাটকের বাইরে এসে ইউরোপীয় ধারার নাটক লিখতে চাইলেন। এবং তিনি সেটাই করলেন। পৌরাণিক কাহিনি ও চরিত্রের মোড়কে আধুনিক চিন্তাধারার অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে অর্থাৎ পুরাণের ছদ্মাবরণে নাটক রচনা না করে সমসাময়িক নগ্ন ও নিষ্ঠুর বাস্তবতাকে তাঁর প্রহসনের উপজীব্য করলেন। এটা করলেন বিদেশী আদর্শকে সম্পূর্ণ আত্মসাৎ করে নিয়ে। মধুসূদনের সমাজচেতনা যে কতটা গভীর ছিল এই প্রহসনদুটো তার জ্বলজ্যান্ত প্রমান। তবে ‘বুড় শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ রচনা হিসেবে ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ রচনাটির চেয়ে অনেক উঁচু মানের। প্রফুল্ল কুমার পাত্র এবং ডঃ ক্ষেত্র গুপ্ত ‘মধুসূদন রচনাবলীর’ ভূমিকায় এই কথাটি খুব সিন্দর করে ফুট্যে তুলেছেনঃ ‘কিন্তু বর্ণহীন বাস্তবতার দিকে চোখ পড়তেই তাঁর মনে হ’ল অনেক স্খলন পতন পাপ জীবনের মধ্যে জীবনের মধ্যে জমা হয়ে আছে। তার প্রতি কবির ব্যঙ্গ উদ্যত হয়ে রইল এদুটি লেখায়।

‘বুড় শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ প্রহসনে মধুসূদন সমাজের যে চিত্র এঁকেছেন সে সমাজ বৃহত্তর সমাজের আংশিক প্রতিফলন মাত্র; অর্থাৎ কিনা যে চরিত্রগুলো এখানে সাজানো হয়েছে বৃহত্তর সমাজে এদের আনাগোনা আছে ঠিকই, কিন্তু এরাই সমাজের একমাত্র প্রতিনিধি নয়। এখানে শোষিত কৃষক আছে, আছে ধর্মের ধ্বজাধারী নারীলোভী প্রজাশোষক অর্থ গৃধ্নু জমিদার, আর আছে জমিদারের তোষামোদকারী অর্থলোভী দালালেরা। এখানে যেমন আছে লোভ ও ভণ্ডামি, তেমনি আছে ক্রোধ প্রতিশোধ-আকাঙ্ক্ষা ছলচাতুরী এবং বিদ্রোহ। নীচে একটু বিস্তারিত বলা হ’ল।

ভক্তপ্রসাদ বাবু জমিদার। ভদ্রপ্রসাদ বৈষ্ণব মতে বিশ্বাসী। হানিফ গাজী গরীব কৃষক। গা-গতরে কঠোর পরিশ্রম করলেও ফসলের জন্য প্রকৃতির উপর ভরসা করে থাকতে হয়। এবার প্রচন্ড খরা হওয়াতে ফলন খুব খারাপ। ‘দশ ছালা ধানও বাড়ী’ আনতে পারেনি। পীরের দরগায় শিন্নি দিয়েও কোন লাভ হয়নি। কিন্তু ভগ্নপ্রসাদ ছাড়বে কেন? কড়ায় গণ্ডায় সব উসুল করে নেবে। কাকুতি মিনতি শুনবে না কিছুতেই। এই সময় হাতে মালা জপতে জপতে সময় মত খাজনা না দেওয়ার জন্য হানিফকে কটূ ভাষায় গালিগালাজ করতে করতে ভক্তপ্রসাদ এগিয়ে আসে। খাজনা পাওনা হয়েছে এগারো সিকে আর হানিফ দিতে চায় তিন সিকে যদিও পুরো এগারো সিকে সে সঙ্গে এনেছে। ভক্তর কর্মচারী গদাধর এই সুজগে কিছু ফায়দা লুটতে চায়। সে হানিফকে বোঝায় সে জমিদারের সঙ্গে ওর হয়ে কথা বলবে। হানিফকে একটু দূরে সরিয়ে দিয়ে লম্পট নারীলোভী ভক্তকে সে হানিফের জওয়ান বৌয়ের লোভ দেখায়। ভক্তর জিবে জল এসে যায়।

এদিকে আবার ধরমের ভয় আর ‘মুসলমান মাগীদের মুখ’ থেকে পেঁয়াজের গন্ধ আসে বলে মন্তব্য করে। ধূর্ত গদাধর বুঝিয়ে বলে ‘শ্রীকৃষ্ণ ব্রজে গোয়ালাদের মেয়েদের নিয়ে কেলি করেন’। কামলোলুপ ভক্ত তিন সিকে নিয়েই হানিফকে বিদেয় করে। এখন তার মাথায় খেলছে কিভাবে হানিফের বৌ ফতেমাকে পাওয়া যায়। গদাধরের সঙ্গে অনেক দরাদরি করে কুড়ি টাকা খরচ করতে রাজী হয়। এই সময় হাজির হয় বাচস্পতি। বাচস্পতি শ্রদ্ধেয় মানুষ। শ্রদ্ধার সাথে বিনয়ের সাথে কথা বলতে হয়। কিন্তু তাই বলে শোষণ থেমে থাকে না। ভক্ত তার ব্রহ্মত্র ভূমি দখল করেছে। মা ঠাকরুন পরলোক গমন করেছে। টাকা দরকার। অনেক শুকনো সহানুভূতি দেখিয়ে কোন রকম সাহায্যের আশ্বাস না দিয়েই বাচস্পতিকে বিদেয় করে দিল ভক্ত। বাচস্পতি চলে গেলে ভক্ত গদাধরের সঙ্গে তার পুরনো নারীসংক্রান্ত কুকীর্তি নিয়ে আলাপে মশগুল হ’ল। তার খপ্পরে পড়ে ভটচায্যিদের মেয়ে এখন ‘বাজারে’ হয়ে গিয়েছে। এই লম্পটের কোন প্রকারের শোক আফসোস নেই। এখন তার মাথায় ঘুরছে ফতেমা। কত তাড়াতাড়ি ছুঁড়িকে পাওয়া যায় সেটাই এখন চিন্তা। গদাধরও তার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তার সঙ্গে খেলছে। কর্তা যত বেশি লালায়িত হবে, ততই তার লাভ। মনে মনে বলে, ‘গো মড়কেই মুচির পার্বণ’। এমন সময় ভগী আর তার মেয়ে পাঁচি জল আনতে ঘাটের দিকে যায়। পাঁচিকে দেখেও ভক্ত লোভের হাত বাড়ায়। 

কাছে ডাকে। গুরুজনসুলভ আচরণের অভিনয় করলেও তার কামুক দৃষ্টি সদ্যবিবাহিতা পাঁচির চোখ এড়ায় না। স্বামী কোলকাতায় থাকে। কায়দা করে ভক্ত জেনে নেয় পাঁচির বাবা পীতাম্বর কয়েক দিনের জন্য গ্রামের বাইরে গিয়েছে। নবযৌবনা পাঁচিকে পাওয়ার এই তো সুযোগ। গদাধরকে বলে যত টাকাই লাগুক এই মেয়েকে তার চাইই। গদাধর বলে পঞ্চাশ টাকা হলে পিসিকে দিয়ে কাজটা করানো যাবে। এত কিছুর মধ্যে তার ধর্মকর্ম সবই চলছে।

হানিফ গোঁয়ারগোবিন্দ। তবে পাঁচির মত ধুরন্ধরও বটে। দু’জনে ঠিক করে মানসম্মান না খুইয়ে কিভাবে ভক্তর কাছ থেকে টাকাপয়সা হাতিয়ে নেওয়া যায়। টাকাপয়সা ও কুপ্রস্তাব নিয়ে পুঁটি আসে। হানিফ আড়ালে লুকোয়। সে হানিফকে যমের মত ভয় করে। মনে মনে ভক্তর লাম্পট্যের কথা ভাবতে ভাবতে, ‘পাতিনেড়ে বেটাদের’ বাড়িঘরের ছিরি দেখে ভেতরে ভেতরে ঘেন্না করতে করতে নিশ্চিত হয়ে নিল যে হানিফ বাড়ি নেই। হানিফ জানত পুঁটি কেন এসেছে। আড়ালে দাঁড়িয়ে থেকে সে ফুঁসতে লাগল। হিন্দু ব্যাটার এত দুঃসাহস মুসলমানের ইজ্জৎ মারতে চায়। পুঁটি ফতেমাকে টাকা দিয়ে কখন কি করতে হবে বলে চলে গেল। যাবার আগে বলে গেল নেড়েদের আবার মান্সম্মানের ব্যাপার আছে নাকি, ওরা তো আবার বিয়ে বস্তে পারে। ফতেমাও কথা মুখপোড়া ফতেমাও কথা শোনাতে ছাড়ল না। ইঙ্গিত দিল, হিন্দু মেয়েরা বিধবা হলে বিয়ে করে ঠিকই, কিন্তু কি করে কে না জানে। সন্ধ্যেবেলা তাকে আমবাগানে জেতে হবে। ক্রুদ্ধ হানিফ ফতেমাকে বারবার হুঁশিয়ার করে দিল কাফের জেন তার গায়ে হাত না দিতে পারে। শ্রাদ্ধের খরচ যোগাতে বাচস্পতির তেঁতুল গাছ বিক্রি করার প্রয়োজন হয়ে পড়ল। গাছ কাটতে হানিফের

শরণাপন্ন হ’ল। বাচস্পতিকেও ভক্ত ঠকিয়েছে। দুজনেই শোষিত। ফলে ওদের মধ্যে এক ধরনের ঐক্য তৈরি হ’ল। হানিফ বাচস্পতিকে একটু আগের ঘটনা সব খুলে বলল।  বাচস্পতি নিজেও নেড়েদের সম্পর্কে শ্রদ্ধাবোধ না থাকলেও শোষক জমিদারকে জব্দ করে কিভাবে ন্যায্য পাওনা আদায় করা যায় সে ব্যাপারে পরামর্শ করে ফেলল। এদিকে পুঁটি আবার এসে ফতেমাকে গোপনে বলে গেল যে আমাবাগানে গেলে কাজ হবে না, পুরনো শিবমন্দিরে যেতে হবে।

ভক্তর তো আর সময় কাটে না। কখন সন্ধ্যে হবে। ভাল করে সাজগোঁজ করে নিল। পাঁচিকে পেল না, ফতেমাকে পাবে তো? এই অস্থির অবস্থায় এল আনন্দ। আনন্দ কোলকাতায় থাকে। তার ছেলে অম্বিকার সঙ্গে যোগাযোগ আছে। আলাপ করে জানতে পারল কোলকাতায় জাতিভেদ উবে যাচ্ছে। ব্রাহ্মণদের সেই সম্মান আর নেই। গঙ্গাস্নানের প্রতি সেই ঝোঁক আর নেই। কোলকাতায় নেড়েদের হাতের রান্না পর্যন্ত খায় অনেকে। রক্ষণশীল ভক্ত শিউড়ে উঠল। এমনকি যাতে গোল্লায় না যায় তার জন্য ছেলেকে গ্রামে ফিরিয়ে আনতে চাইল। আনন্দ মত দিল এমনটা করা ঠিক হবে না যেহেতু অম্বিকা অত্যন্ত বুদ্ধিমান ছেলে। গদাধরের বাবুর কথা শুনে মনে মনে হাসে। ভাবে বুড়ো একটা আস্ত ভণ্ড। সে যাইহোক, সবাই চলে গেলে গদার ইচ্ছে করে বাবুর মত আরাম করে হুঁকো টানে আর তখন কেউ তার পা টিপে দিক। ভৃত্য রামের সাথে কিছুক্ষণ এই মজা করে। বাবুর পায়ের শব্দ শুনে তড়িঘড়ি করে উঠে পড়ে। বাবু আসে। তার সাজগোজ দেকে সে স্বগতোক্তি করে, ‘আজ বুড়োর ঠাট দেখলে হাসি পায়! শান্তিপুরে ধুতি, জামদানের মেরজাই, ঢাকাই চাদোর, জরির জুতো, আবার মাথায় তাজ। হা! হা! হা!’

ভক্ত মনে মনে বলে, তাজ পরে ভালই হয়েছে। নেড়ে মাগীরা এই সব পছন্দ করে। আর এতে টিকিটাও ঢাকা পড়েছে। বুড়ো গায়ে আতরও মেখে নিল খানিকটা। ভাবে, ‘নেড়েরা আবাল বৃদ্ধ বনিতা আতরের খোসবু বড় পছন্দ করে।‘ নেড়ে মাগীর গায়ে পেঁয়াজের গন্ধ থাকতে পারে এই চিন্তায় আতরের কয়েকটি ছোট শিশি সঙ্গে নিল। আয়নায় মুখ দেখতে দেখতে ভক্তকে বলে গেল, কেউ খোঁজ করলে বলতে যে সে জপে ব্যস্ত।

প্রহসনের ক্লাইমেক্স ঘটে দ্বিতীয় অঙ্কের দ্বিতীয় গর্ভাঙ্কে। এটাই শেষ দৃশ্য। এবং এটি ঘটে একটি উদ্যানের পরিত্যক্ত ষিব মন্দিরের কাছে। ভক্ত বাবু আসবে অভিসারে। বাচস্পতি ও হানিফ কাছেই আত্মগোপন করে থাকে। গোঁয়ারগোবিন্দ হানিফ ভেতরে ভেতরে অস্থির। পারে তো এখনি ভক্তর গলা টিপে ধরে। বাচস্পতি তাকে সংযত রাখতে চেষ্টা করে।

ঘটনাস্থলে ফতেমা এবং পুঁটি প্রবেশ করে। ফতেমা ভয়ে অস্থির। ভূতের ভয়ও আছে। গোঁয়ার স্বামীর কথা তো বলাই বাহুল্য। পুঁটি তাকে সান্ত্বনা দেয়, ধৈর্য ধরতে বলে, আশ্বাস দেয়। ভূতের ভয় পুঁটিরও আছে। ভয়ে অস্পৃশ্য ফতেমাকে জড়িয়ে ধরে। ফতেমা পাশের মসজিদে আশ্রয় নিতে চায়। পুঁটি সায় দেয় না আর মনে মনে ভাবে, ‘আঃ, এই বুড় ডেকরা মরেছে না কি?’ এর মধ্যেই ভক্ত ও গদাধর চলে আসে। এসেই তার ‘মনোমোহিনীর’ খোঁজ করে। ফতেমাকে দেখতে পেয়ে মনে মনে বলে, যবনী হলে

কি হবে, এ তো রূপে লক্ষ্মী। কেউ আসছে কি না সেদিকে নজর রাখতে বলে ভক্ত ভয়ে ও লজ্জায় আড়ষ্ট ফতেমার দিকে এগিয়ে যায়। হরিবোল বলতে বলতে ফতেমাকে কাছে আহ্বান করে। গদাধর মনে মনে বলে, হরিবোল বলছ কেন? আল্লা আল্লা বল। গোঁয়ার চাষির ঘরে এমন রূপসী! ভক্তর প্রাণে কাব্য আসেঃ

ময়ূর চকোর শুক চাতকে না পায়।  

হায় বিধি পাকা আম দাঁড়কাকে খায়।।

পুঁটি মনে মনে বলে, আজ বাদে কাল বুড়ো শিঙ্গে ফুঁকবে, কিন্তু এখনো রসের নাগর। প্রকাশ্যে কর্তাকে বলে, নেড়ে মেয়ে কি এইসব কাব্যি বুঝবে? এদিকে ফতেমার ভয় কাটে না, সে পালাতে চায়। পুঁটি বিরক্ত হয়। বলে, ‘তেঁতুল নয় মিষ্টি, নেড়ে নয় ইষ্টি।‘ এত কাকুতি মিনতি, এত প্রেম নিবেদন—তবু ছুঁড়ির মন ভরে না! কামাতুর ভক্তর কাব্যি আর কমে না। পুঁটি বোঝাতে চায় ফতেমা ভয় পাচ্ছে পাছে কেউ দেখে ফেলে। তাই মন্দিরে যাওয়ার পরামর্শ দেয়। ভক্তর ধরমের ভয় আছে। আবার যুক্তি দেয় ভগ্ন শিবে শিবত্ব নেই। ভাবে ‘বিশেষ এমন স্বর্গের অপ্সরীর জন্যে হিন্দুয়ানি ত্যাগ করাই বা কোন ছার?’ নেপথ্যে শোনা যায় গম্ভীর গলায় কে বলছে, ‘বটে রে পাষণ্ড, নরাধম দুরাচার?’ সবাই ভয় পায়। ভক্ত গদাকে কাছে ডাকে। পুঁটি মূর্ছা যায়। আবার হুঙ্কার ধ্বনি। গদা পালায়। ভক্ত বলে, ও মা গো। হুঙ্কার আবার ভেসে আসে। ভক্ত কিছু জানে না দাবী ‘অষ্টাঙ্গে প্রণিপাত’ হয়। হানিফ মুখ ঢেকে এসে ভক্তকে উত্তম মধ্যম দিয়ে বেগে পালিয়ে যায়। ভক্ত ভয়ে ব্যথায় কোঁকাতে থাকে। এইসময় বাচস্পতি রামপ্রসাদী গাইতে গাইতে আসে ‘মায়ের এই তো বিচার বটে’। বাচস্পতির আগমনে গদাধর ভরসা পায় কারন ভূত ব্রাহ্মণকে ভয় পায়। পুঁটি উঠে বসে। উঠে বসে ভক্ত। আমরা আগে দেখেছি সবই বাচস্পতি ও হানিফের সাজানো খেলা। তবুও বাচস্পতি ফতেমাকে দেখে রহস্য করে বলে, ও এখানে কেন? ভক্তর আর কোন কিছু গোপন করার নেই। ভয়ে অপমানে সব স্বীকার করে। শপথ করে আর কখনো এই অধর্মের পথে পা বাড়াবে না। বাচস্পতির কাছে কৃপা ভিক্ষা করে, তাকে পরম আত্মীয় বলে সম্বধন করে। বাচস্পতি সুযোগ লুফে নেয়। বলে, তার ব্রহ্মত্র ভূমিটুকু কর্তা কেড়ে নেওয়ার পর এখন নিঃস্ব, কর্তার আত্মীয় হবে কি করে! ভক্ত ওই জমি ফিরিয়ে দেবে প্রতিশ্রুতি দেয়। প্রায়শ্চিত্তস্বরূপ নগদ টাকাও দেবে অঙ্গীকার করে। এমন সময় হাজির হয় হানিফ। বলে বিবিকে খুঁজতে খুঁজতে একানে এসেছে। ভক্তর কাটা ঘায়ে সে নুনের ছিটা দেয়। বলে, কর্তার মুসলমান হওয়ার সাধ হয়েছে তা বললেই হ’ত, ফতেমার দিকে নজর দেওয়ার দরকার ছিল না, সে তাকে ‘সোনার চাঁদ’ ধরে এনে  দিত। ভক্ত হানিফের কাছে মাপ চায় আর বলে সে তাকে কিছু টাকাপয়সা দেবে। হানিফ ক্ষান্ত হয় না। কর্তাকে মনে করিয়ে দেয় সে কথায় কথায় নেড়ে বলে গালিগালাজ করে আর এখন নিজেই তো নেড়ে হতে চাইছে। এই খুশির খবর সে সবাইকে সে বলে বেড়াবে। এইভাবে ভীতিপ্রদর্শন ভাল ফল দেয়। ভক্ত লজ্জায় মাটির সঙ্গে মিশে জেতে চায়। বাচস্পতি হানিফকে আড়ালে ডেকে নিয়ে কিছু বলে। ফতেমাও টিটকিরি মারতে ছাড়ে না। বাচস্পতি মিটমাট করে দিতে চায়। ভক্তকে বলে হানিফকে দু’শ টাকা দিতে। ভক্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও রাজী হয়। গদা দুশ্চিন্তায়, তার রোজগারের রাস্তা বন্ধ হয়ে গেল ভক্তর ভাল মানুষ হওয়ার প্রতিজ্ঞা শুনে। পুঁটি এই ব্যবসা বাদ দিয়ে গতর খাটিয়ে উপার্জন করবে বলে ঠিক করে। তবে ওর মনে সন্দেহ থেকে যায়, নেড়ে মাগীদের সাথে পোষা ভূত থাকে কি না! ভক্তর অনেক খেসারত দিতে হ’ল। মানসম্মান তো যথেষ্ট খোয়া গেল। নারায়ণের কাছে প্রার্থনা করি যেন এমন দুর্মতি তার আর না ঘটে।

দুই অঙ্কের সর্বমোট চার দৃশ্যের নাটকটির দুটো সফল মঞ্চায়ন দেখেছি। একটি ছিল হিউষ্টনের একটি নাট্যগ্রুপের। সময় পাল্টেছে। এমন নাটক পরে অনেক হয়েছে এবং হচ্ছে। মনে রাখতে হবে মধুসূদন এটি লিখেছিলেন আজ থেকে একশ আটান্ন বছর আগে। তখনো রবীন্দ্রনাথের জন্ম হয়নি। বাংলা গদ্য নিয়ে তখনো নিরীক্ষা চলছে। যশোরের আঞ্চলিক ভাষা সার্থকভাবে ব্যবহার করেছেন কারো কারো মুখে। আগেই বলেছি, বাংলা নাটককে সংস্কৃত নাটকের ধারাবাহিকতা থেকে মুক্তি দিয়ে ইউরোপীয় ধারায় প্রবাহিত করতে চেয়েছেন। এবং তিনি অসম্ভব সফলতা পেয়েছেন। ডঃ অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন - ‘সম্প্রতি কোন কোন অতি আধুনিক সমালোচক বলতে শুরু করেছেন—মাইকেল বাংলা জানতেন না। এই দু’খানি প্রহসন থেকেই দেখা যাবে মাইকেলের নানা ধরনের বাংলা, মায় উপভাষা—কতটা জানা ছিল, আর জনজীবনের সঙ্গে তিনি কতটা নিবিড়ভাবে পরিচিত ছিলেন।‘ প্রতিভাশালী দীনবন্ধু মিত্রও মধুসূদনের প্রহসনের  আদর্শে ‘সধবার একাদশী’ লিখেছিলেন। আমরা আগেই বলেছি বেলগাছিয়া থিয়েটারের অনুরোধে (অন্য এক সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে, পাইকপাড়ার বিদ্যোৎসাহী জমিদার সিঙ্ঘভ্রাতাদের অনুরোধে) ‘পদ্মাবতী’ নাটক লেখা মাঝপথে স্থগিত রেখে প্রহসন লিখেছিলেন। কিন্তু থিয়েটার কর্তৃপক্ষ প্রহসনদুটোর মঞ্চায়ন করেননি। রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের মধ্য থেকে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে এমন ভয় ছিল এটা সম্ভবত নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। এই প্রহসনদুটো যাতে মঞ্চস্থ না হয় তার জন্য প্রতিপক্ষ থেকে শাসানিও এসে ছিল। মধুসুদন মনে খুব কষ্ট পেয়েছিলেন। রেগে গিয়ে লিখেছিলেন, উনি বাংলায় আর লিখবেন না, লিখবেন হিব্রু আর চীনা ভাষায়। সুখের বিষয় বেলগাছিয়াতে না হলেও অন্যত্র এগুলো অভিনীত হয়েছিল।

বিস্ময় জাগে যখন ভাবা যায় তিনি তাঁর বিচিত্র জীবনের এত উত্থান পতনের কোন ফাঁকে সমাজের আবিলতাকে এত সূক্ষ্মভাবে দেখার সুযোগ পেয়েছেন বা দেখেছেন। আর দেখতে পেরেছিলেন বলেই বাংলা গদ্য বাংলা নাটককে মধুসূদন অনেক খানি মুক্ত করে দিয়ে গেছেন। 

কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ

১। প্রফুল্ল কুমার পাত্র ও D; ক্ষেত্র গুপ্ত কর্তৃক সম্পাদিত ‘মধুসূদন রচনাবলী’।

২। ডঃ অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় প্রণীত ‘বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত’ (১৯৯৫ সংস্করণ)।

৩। Merriam Webster’s Encyclopedia of Literature (1995).

নারী দিবসের ভাবনা

প্রবন্ধ সমগ্র ।। মতামত ।। সূচীপত্র

 প্রবন্ধ সমগ্র

থিমঃ নারী
দিবসের ভাবনা
স্নেহাশীষ দাস
সারদা পার্ক, কলকাতা 

download.jpg

দ্বিচক্রযানঃ

বেশবাবুর একাদশী কন্যা বিদিশার দ্বিচক্রযান চালনাকে উপলক্ষ্য করিয়া বিবেকানন্দ পল্লীতে একটি বিপ্লব ঘটিয়া গেল। বিদিশা চতুর্থ শ্রেণীতে উল্লেখযোগ্য ফল করায় তাহার মাতুল তাহারই ইচ্ছাক্রমে দ্বি-চক্রযানটি তাহাকে উপহার দিয়াছিলেন।বিদিশা দ্বিচক্রযানে আরোহণ রপ্ত করিতেই তাহার সমবয়স্ক বালকরাও দ্বিচক্রযানে উৎসাহী হইল। তাহারা স্বীয় স্বীয় অবিভাবকগণের নিকট দ্বিচক্রযানের নিমিত্ত উৎপাত শুরু করিল। অনেকগুলো দ্বিচক্রযান পাড়ায় আসিল। সকলেরই রাবিশ ফেলা রাস্তায় ফরফর ঝরঝর করিয়া দ্বিচক্রযান চালাইতে লাগিল। অভিভাবকবৃন্দ সাধারণভাবে ইহার মধ্যে মন্দ কিছু দেখেন নাই। সর্ব বিষয়ে দৃষ্টিপ্রদায়িনী পাড়ার স্বঘোষিত অভিভাবিকা কামিনী বৌদি সর্বপ্রথম আবিষ্কার করলেন বালকদিগের সকল দৌড় বিদিশাকে কেন্দ্র করিয়া এবং বিদিশা থাকিলে সকলে নিজ নিজ দ্বিচক্রযানের বেগ এরূপ বৃদ্ধি করে যে কোন সময় দুর্ঘটনা ঘটিতে পারে। কামিনী বৌদি তাহার পর্যবেক্ষণ ও ভাবনার কথা অভিভাবকদিগের অন্তরে গোপনে ঢালিলেন। তাহার চমকাইয়া উঠিলেন, সর্বনাশ হইতে কিছু বাকি নেই। তাহার জোট বাঁধিলেন, হ্যাঁ অত্যন্ত অশোভনভাবে ভবেশবাবুর পত্নীকে স্মরণ করাইয়া দিলেন যে কন্যা বড় হইয়াছে। কেবলমাত্র ‘মেয়ে’ এই অপরাধে বিদিশার দ্বিচক্রযান চালনা বন্ধ হইল।

লেডিজ সীট

তুনহাট নারী প্রগতির সম্পাদিকা সুনীতা পাল শকুন্তলা পার্কের উচ্চতর উপার্জনকারী শ্রেণী চিহ্নিত ফ্লাটে থাকেন। আমাদের এই হাজামাটা নতুনহাটে ‘উইম্যান্স লিবের’ প্রধান এবারের অনুষ্ঠানের দু-দিন আগে সুনীতাদেবী ব্লিচ করিয়েছেন। অনুষ্ঠানের দিন বক্তা। ফিবছর নারী দিবসে নারী প্রগতির বিশেষ অনুষ্ঠান হয়। প্রগতি কিছু হয় কিনা তা বলার সাহস আমার নেই। তবে পোশাক, গহনার, সুগন্ধীর এক মনোরম পরিবেশ হয়।কমলালেবুর খোসা, শসা, কাঁচাহলুদ, টকদই, মুলতানি মাটি, মুসুরডাল বাটা ইত্যাদি মিশিয়ে মাস্ক নিয়েছেন। চুল রঙ করেছেন। দুপুর দুটো থেকে মেকআপ এ বসেছেন। আইলাইনারের সুক্ষ টাচ, হালকা মেকআপ, ঠোঁটে মানানসই রঙ, লাগসহ খোঁপা, কুঁচিতে পিন – আরো কত কি। মুশকিল হল পৌনে পাঁচটা নাগাদ ড্রাইভার ফোন করে জানালো যে সে আসতে পারবে না। অগত্যা সমস্ত ‘ফ্যানিটি’ ব্যাগে পুরে বাসে চাপতে হল। ভীড়ে 

ভরা ১৮-সি তে মহিলা সনে একজন বয়স্ক মানুষ বসেছিলেন। মহিলারাই তাকে অনুমতি দিয়েছিলেন। সুনীতাদেবী পছন্দ করলেন না। বললেন –

"দেখি সিটটা ছাড়ুন তো, দেখছেন তো এটা লেডিস সিট’। বৃদ্ধ বললেন –

"মাগো আমার শরীরটা একটু খারাপ লাগছিল। তাই এনাদের বলে একটু বসেছি।

তৎক্ষণাৎ ঝাঁঝিয়ে উঠলেন –

"শরীর খারাপ লাগতেই পারে, কিন্তু আপনি তো যাবেন জেন্টসের দিকে। যান ওদিকে ওদের বলুন একটু বসতে দিতে। চাষিদের এক বউ ছেলে কোলে বসেছিল ময়নাগোড় নামবে। বৃদ্ধ উঠার উপক্রম করতেই তার হাত ধরে তাকে বসালো। বলল –

"বাবা, তুমি এখানেই বসো, দিদিমণি আপনি আমার এখানটায় বসুন।"

বৌটি ছেলে কোলে দাঁড়াল আর সুনীতাদেবী তা কেন বলে আর দেরী করলেন না।

কেয়ার অ্যান্ড কাবলি

কাল ছটায় কলিংবেলটা বাজলো। রাণীহাটি মহাবিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী শ্রীপর্ণা দরজাটা খুলে অপ্রত্যাশিতভাবে তার বান্ধবী তন্দ্রাকে পেল। এত সকালে আসার কারণ জানতে চাওয়ার আগেই তন্দ্রা বলল –

"নারী দিবসের থিম।" শ্রীপর্ণা বলল –

"কি করতে চাস?" তন্দ্রা বলল –

"তোর স্বদেশী যুগের সেই বিদেশী পণ্য পোড়ানোর আন্দোলন মনে আছে। -

"হ্যাঁ মনে আছে, মানে সিনেমায় দেখেছি। আবার তন্দ্রা বলল -

"হ্যাঁ নারী দিবসে এমনই একটা কিছু করতে চাই।

"মানে? কি পোড়াবি তুই?" শ্রীপর্ণা বলে -

"কেয়ার অ্যান্ড কাবলি’ সংক্ষেপে ‘কে আ কা’। শ্রীপর্ণা –

"কেন তাতে কি লাভ?" তন্দ্রা বলল –

"তুই টিভিতে ওদের অ্যাডটা দেখেছিস’ – বলে কিনা কাশ হামারা এক বেটা হোতা। বেটিতে সাধ মেটে না। তার চেয়েও মেয়ে বাপের সাধ মেটাচ্ছে ‘কেয়ার অ্যান্ড কাবলি’ মেখে। মানে মেয়েদের যোগ্যতা লেখাপড়ায় নয় রঙে। রঙ সাদা হলে তবেই সে উপার্জনক্ষম। এতো নারীত্বের অবমাননা। নারী কি পণ্য নাকি যে রঙ চং মেখে নিজেকে বিক্রয়যোগ্য করে তুলতে হবে। আমরা এটার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েই নারী দিবস পালন করবো। তুই খালি একটা পোস্টার লিখে সকাল সাড়ে নটায় রাণীহাটির মোড়ে চলে আয়। ওদের সব আমি খবর দিচ্ছি।"

এক ঝাঁক তরুণীর কেয়ার অ্যান্ড কাবলি বহ্নুৎসবের জেরে রানীহাটির মোড়ে বেশ কিছুক্ষণ ট্র্যাফিক আটকে ছিল।

বিপ্রতীপ পদার্থ

প্রবন্ধ সমগ্র ।। মতামত ।। সূচীপত্র

 প্রবন্ধ সমগ্র

বিপ্রতীপ-পদার্থ বা

অ্যান্টাই-ম্যাটার

সুবিমল চক্রবর্তী

ডালাস, টেক্সাস

ব্যাপারটা বুঝতে সুবিধে হবে যদি আমরা শুরু করি বিপ্রতীপ-কণা দিয়ে। কণা ও বিপ্রতীপ-কণার একই ভর থাকবে, কিন্তু থাকবে বিপরীত বৈদ্যুতিক চার্জ। যেমন, ইলেকট্রনের বিপ্রতীপ-কণা হচ্ছে পজিট্রন। ইলেক্ট্রন ও পজিট্রনের ভর একই, কিন্তু ইলেক্ট্রনের চার্জ ঋণাত্মক এবং পজিট্রনের চার্জ ধনাত্মক। সাধারণ মানুষের কাছে রেড কোয়ার্ক পরিচিত কণা নয়। রেড কোয়ার্কের বিপ্রতীপ-কণা হচ্ছে বিপ্রতীপ-লাল বিপ্রতীপ-কোয়ার্ক। এখানে ‘লাল’ কিন্তু আমাদের পরিচিত লাল রং নয়। বৈজ্ঞানিকেরা ‘লাল’ শব্দটি দিয়ে কণাটির একটা বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করেছেন মাত্র। যে সব কণার চার্জ নেই সেই সব কণার বিপ্রতীপ-কণা নিজেরাই। যেমন, নিউট্রনের কোন চার্জ নেই বলে নিউট্রনের বিপ্রতীপ কণাও নিউট্রন। এখন আমরা যদি কণা থেকে ম্যাটার বা পদার্থে যাই, আমরা বলব যে, বিপ্রতীপ-পদার্থ পদার্থের এক আজব ছায়া যেখানে বাম হয়ে যায় ডান এবং ধনাত্মক হয়ে যায় ঋণাত্মক। একটা স্থূল দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। ধরা যাক মাটি কেটে কেউ একটা পুতুল বানিয়ে সেটা হুবহু তুলে আনল। পুতুলটাকে যদি বলি পদার্থ, পুতুলবানানো জায়গাটার পুতুলাকৃতির যে গর্ত পড়ে থাকল সেই গর্তকে বলব বিপ্রতীত-পদার্থ। কোন পদার্থ যদি তার বিপ্রতীপ-পদার্থের মুখোমুখি হয়, মুহূর্তের মধ্যে তারা ‘মৃত্যু নৃত্যে’ শরিক হয়ে একে অপরকে ধ্বংস করে দেবে। তার মানেই হচ্ছে, পদার্থ ও বিপ্রতীত-পদার্থ পরস্পর পরস্পরের যম।এই আজব বিপ্রতীপ কণার অস্তিত্বের সম্ভাবনার দিকে আঙুল নির্দেশ করা হয়েছিল মাত্র সাতাশি বছর আগে। আর কয়েক বছর পরেই সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল উপরে উল্লেখিত পজিট্রনের।

মনুষ্য সমাজের জন্য এটা অত্যন্ত আনন্দের ব্যাপার যে, বিপ্রতীপ-পদার্থঅত্যন্ত বিরল, বলতে গেলে এর কোন অস্তিত্বই নেই। এই বাস্তব সত্যের কারনেই আমরা এখনো পৃথিবীর বুকে দাপিয়ে বেড়াচ্ছি। তা না হলে পদার্থ ও বিপ্রতীপ-পদার্থের ক্ষণিকের মৃত্যু-নৃত্যের মধ্য দিয়ে আমরা সবাই কোথায় হারিয়ে যেতাম, হারিয়ে যেত আমাদের ‘বিপ্রতীপ-আমরা’। এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা এইটুকু জোর দিয়ে বলতে পারেন যে, আমাদের এই সমগ্র বিশ্বের স্বাভাবিকতা হচ্ছে পদার্থ, বিপ্রতীপ-পদার্থ নয়। ধারণা করা হয়, বিগ ব্যাং বা মহা বিস্ফোরণের (যে প্রক্রিয়ায় এই বিশ্বের সূত্রপাত হয়েছিল) পরবর্তী মুহূর্তে প্রথমেই যেটা ঘটেছিল সেটা হ’ল বিপ্রতীপ-পদার্থের ধ্বংস-সাধন। যে বস্তুবিশ্ব এখন টিকে আছে, সে বস্তুবিশ্বেএখন বিরাজিত শুধুমাত্র সেই সব উচ্ছিষ্ট যেগুলো চৌদ্দ বিলিয়ন বছর আগে ঘটে যাওয়া‘মহা সংহার’-এর খেলা যে খেলায় পদার্থ ও বিপ্রতীপ-পদার্থ পরস্পরকে সংহার করেছিল। সেই মহা সংহারেরখেলায় সব বিপ্রতীপ পদার্থ খতম হয়ে গেছে, কিন্তু সব পদার্থ খতম হয়নি। তার মানে দুষ্ট বিপ্রতীপ পদার্থ এই খেলায় হেরে গেছে এবং জিৎ হয়েছে পদার্থের। আমরা জানি এই বিশ্বে শুধুমাত্র পদার্থই নয়, চৌদ্দ বিলিয়ন বছর ধরে এখানে বিরাজ করছে ইলেক্ট্রো-ম্যাগনেটিক বিকিরণ। এখন কথা হচ্ছে, বিপ্রতীপ পদার্থ যখন পদার্থকে 

ধ্বংস করে (নিজেও অবশ্য ধ্বংস হয়ে যায়), তখন কী ঘটনা ঘটে? একটা বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে একটা গামা রশ্মির স্ফুলিঙ্গ তৈরি হতে পারে। এই গামা রশ্মি আলোর বেগে বধ্য ভুমি থেকে মুহূর্তের মধ্যে অনেক দূরে চলে যাবে। সব বিপ্রতীপ পদার্থই যে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে এটা বলা যাবে না। এই মহাবিশ্বের কোন দূর প্রান্তে হয়ত এদের হদিস পাওয়া যাবে। এমন কি হতে পারে না যে, মহাবিশ্বের দুর প্রান্ত থেকে ছুটে এসে বিপ্রতীপ পদার্থ আমাদের পৃথিবীর উপরই পতিত হ’ল? আমাদের পৃথিবীতো পদার্থ দিয়ে তৈরি। আমাদের পৃথিবীর পদার্থও মহাশূন্য থেকে উড়ে আসা বিপ্রতীপ পদার্থের ক্ষণিকের মৃত্যু-নৃত্যের মধ্য দিয়ে মহা ধ্বংস সাধিত হতে পারে। বিনিময়ে সম পরিমানের বিকিরণ দৃষ্ট হবে। এমন একটা ঘটনা ঘটেছিল এমনটাই বিশ্বাস করেন বিজ্ঞানীরা। ঘটনাটি ঘটেছিল ১৯০৭ সালের ৩০শে জুন। ঘটেছিল মস্কো থেকে এক হাজার মাইল পুবে টাঙ্গাস্কা (Tunguska) নদীর বিরল বসতির উপত্যকায়। চোখ ঝলসানো আগুনের গোলা নিমেষের মধ্যে অতিক্রম করে গিয়েছিল দক্ষিণ-পূর্বথেকে উত্তর-পশ্চিম দিকে। সারা পৃথিবীতে ভূকম্পন অনুভূত হয়েছিল। বায়ুমণ্ডলে চাপের তরঙ্গ রাশিয়া ও সমগ্র ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছিল। বিস্ফোরণ ৭০০ কিলোমিটার দূর থেকেও পরিদৃশ্যমান ছিল। লন্ডনে সময়ের আগেই দিনের আলো ফুটে উঠেছিল। মনে করা হয় এক ঘনমিটারের মত বিপ্রতীপ-শিলা সেদিন পৃথিবীকে আঘাত করেছিল।টাঙ্গাস্কা (Tunguska)’র ঘটনা শুধু আমাদের এটাই মনে করিয়ে দেয় যে, বিপ্রতীপ পদার্থের সুপ্ত শক্তি বা ক্ষমতা কতটা ভয়ানক হতে পারে। বিগ ব্যাং-এর পর বিপুল পরিমানের শক্তি বিবিধ কণায় রূপান্তরিত হয়েছিল। এই সব কণিকা দিয়ে তৈরি হয়েছিল পরমাণু আর এই পরমাণু দিয়েই তৈরি হয়েছে পৃথিবীর যাবতীয় সবকিছু। রাসায়নিক ও নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ার মাধ্যমে এগুলোর পুনর্বিন্যাস ঘটে এবং তৈরি হয় নতুন নতুন অণু-পরমাণু। জীবিত পদার্থগুলো রাসায়নিক কারখানার মত। কার্বন, অক্সিজেন, আর অন্যান্য যে সকল মৌলিক পদার্থ দিয়ে এগুলো তৈরি তাদের মধ্যে ক্রমাগত যে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটছে তার ফলে এনার্জি বা শক্তি নিঃসৃত হচ্ছে। পদার্থের বেশির

     

ভাগ শক্তি পরমাণুর কেন্দ্র বা নিউক্লিয়াসে জমা থাকে। এই জন্যই নিউক্লিয়ার পাওয়ার কেমিক্যাল পাওয়ারের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। কিন্তু এই নিউক্লিয়ার এনার্জিও সম্পূর্ণ সুপ্ত এনার্জির অত্যন্ত ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। এক কিলোগ্রাম বিপ্রতীপ পদার্থকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করলে যে পরিমান শক্তি নিঃসৃত হবে তার পরিমান এক কিলোগ্রাম টিএনটি বিস্ফোরণে যে শক্তি নিঃসৃত হবে তার দশ বিলিয়ন গুণ বেশি। আর নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ায় উৎপাদিত শক্তির হাজার গুণ বেশি শক্তিশালী।প্রাকৃতিক নিয়মেই তৈরি হচ্ছে ইলেক্ট্রনের বিপ্রতীপ কণা পজিট্রন। সবচেয়ে হাল্কা নিগেটিভ চার্জের ইলেকট্রন যেমন সকল পদার্থের পরমাণুতেই থাকে, তত্ত্বগতভাবে তেমনি পজিট্রন থাকে বিপ্রতীপ-বিশ্বের বিপ্রতীপ-পরমাণুতে। এই বিশ্বে যত মৌলিক পদার্থ রয়েছে (হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, নাইট্রজেন, লোহা, রূপা, সোনা,ইত্যাদি) তাদের অনেকগুলোর (যেমন, রেডিয়াম) নিউক্লিয়াসের মৌলিক কণাগুলোর মধ্যে ক্রমাগত পুনর্বিন্যাস ঘটছে আর এই পুনর্বিন্যাস ঘটবার সময় পরমাণুটি তেজ বিকিরণ করছে। প্রাকৃতিক এই পদ্ধতি radioactivity নামে পরিচিত। এই বিকিরণের মাধ্যমে মৌলিক পদার্থটি অন্য একটি মৌলিক পদার্থে রূপান্তরিত হয়ে স্থিতাবস্থা প্রাপ্ত হয়। অর্থাৎ যে মৌলিক পদার্থে রূপান্তরিত হয় সেটি আর তেজ বিকিরণ করে না। এটি একাধিক স্তরে ঘটতে পারে। রেডিয়াম রুপান্তরিত হয় র‍্যাডন-এ। নিউক্লিয়াসের ভেতরে মৌলিক কণাগুলোর (নিউট্রন ও প্রোটন) পুনর্বিন্যাসের সময় পজিট্রন তৈরি হতে পারে। সদ্য-সৃষ্ট এই পজিট্রন নিউক্লিয়াস থেকে ত্বরিতগতিতে উধাও হয়ে যায়। কিন্তু উধাও হয়ে কোথায় যাবে! আমরা দেখেছি, পজিট্রনের বিপ্রতীপ কণা হচ্ছে ইলেক্ট্রন। ইলেকট্রনগুলো পরমাণুর অংশ কিন্তু থাকে নিউক্লিয়াসের বাইরে। সদ্যসৃষ্ট পজিট্রন নিউক্লিয়াসের চার দিকে ঘূর্ণায়মান কোন এক ইলেক্ট্রনের সঙ্গে সহমরনে বিলুপ্ত হয়ে যায়। বিনিময়ে তৈরি হয় গামা রশ্মি। এখানে উল্লেখ্য যে, গামা, আলো, মাইক্রোওয়েভ, ইত্যাদি সবই ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক তরঙ্গ। এদের মধ্যে গামা রশ্মি খুব শক্তিশালী। বিপ্রতীপ কণা মরণ খেলায় মত্ত হলেও একে নিয়ন্ত্রণ করে (PET (Positron Emission Therapy)) জীবন রক্ষাকারী চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়।

সূর্যের কেন্দ্রে প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে অজস্র পজিট্রন তৈরি হয়। আজ যে সূর্যালোকে আমরা স্নাত হচ্ছি তার মূল উৎস হ’ল এক লক্ষ বছর আগে সূর্যের কেন্দ্রে সৃষ্ট পজিট্রন। তবে সেই পজিট্রন তৈরি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়। সূর্যের বেশির ভাগই হাইড্রোজেন। হাইড্রোজেন সবচেয়ে সরল মৌলিক পদার্থ। হাইড্রোজেন পরমাণুর কেন্দ্র নিউক্লিয়াসে নিউট্রন নেই, আছে শুধুমাত্র একটি প্রোটন।আর নিউক্লিয়াসের বাইরে নিউক্লিয়াসকে প্রদক্ষিণ করছে শুধুমাত্র একটি ইলেক্ট্রন। সূর্যের কেন্দ্রে তাপমাত্রা হচ্ছে এক কোটি ডিগ্রি। এই তাপমাত্রায় হাইড্রজেন প্রোটন ও ইলেকট্রন এই দুই উপাদানে বিশ্লিষ্ট হয়ে দিগ্বিদিকে ছুটতে থাকে। কখনো কখনো দুটো প্রোটন একত্রে মিলিত হয়ে শেষ পর্যন্ত হিলিয়াম নামক মৌলিক পদার্থে পরিণত হয়। হিলিয়াম হাইড্রোজেনের পরের সরলতম মৌলিক পদার্থ যার পরমাণু দুটো প্রোটন আর দুটো নিউট্রনের সমন্বয়েগঠিত। দুটো আলাদা প্রোটন একত্রিত হয়ে যখন হিলিয়ামের বীজ তৈরি করে (মনে রাখতে হবে, পূর্ণ হিলিয়াম পরমাণু হতে হলে দুটো নিউট্রনও লাগবে), তখনআইনস্টাইনের বিখ্যাত E=mc2 সমীকরণ অনুসারে কিছু শক্তি বা এনার্জি হারায়। এই শক্তি অনেকগুলো ধাপ অতিক্রম করে আলোতে পরিণত হয়। অনুকূল পরিস্থিতিতে প্রোটন কণা নিউট্রন কণায় রুপান্তরিত হয় এবং কিছু এনার্জি বা শক্তিও উৎপাদন করে। উৎপাদিত এই শক্তির কিছুটা পজিট্রন কণায় পরিণত হয়। পজিট্রন ছুটন্ত ইলেকট্রনের সান্নিধ্যে এসেই চিরতরে হারিয়ে যায়। কিন্তু তৈরি হয় গামা রশ্মির। নবজাত এই গামা রশ্মি জন্মভূমি সূর্য থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে আলোর গতিতে (সেকেন্ডে এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মেইল)। কিন্তু বেরিয়ে যাওয়া সহজ হয় না যেহেতু ফুটন্ত সূর্যের মধ্যে  ঘুরে বেড়াচ্ছে বৈদ্যুতিক চার্জযুক্ত ইলেকট্রন এবং প্রোটন কণা। গামা রশ্মি ক্রমশঃ শক্তি হারাতে হারাতে এক লক্ষ বচ্ছর পর সূর্যের উপরিভাগে এসে পৌঁছুতে পারে। শক্তি হারানো মানেই গামা রশ্মি রূপান্তরিত হয় এক্স-রেতে এবং এক্স-রে শক্তি হারিয়ে পরিনত হয় অতিবেগুনী (আল্ট্রাভাইওলেট) রশ্মিতে এবং পরিশেষে পরিণত হয় আমাদের পরিচিত আলোতে যার মানে আমাদের দৃষ্টিগ্রাহ্য রংধনুর রং-গুলোতে। সুতরাং, দিনের আলো হচ্ছে সূর্যের কেন্দ্রে সৃষ্ট ইলেক্ট্রনের বিপ্রতীপ কণা পজিট্রনের সংহার।

বিপ্রতীপ পদার্থের সংহার করবার ক্ষমতা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর একটা প্রিয় বিষয়। তবে বাস্তবের সঙ্গে এই কল্প কাহিনির কোন মিল নেই, এগুলো সবই অবৈজ্ঞানিক। বিপ্রতীপ পদার্থ ব্যবহার করে প্রচন্ড শক্তিশালী মারনাস্ত্র বানানোর অবাস্তব দুর্বুদ্ধিও যুদ্ধবাজদের মাথায় যে ভর করেনি তা নয়। তবে সুসংবাদও আছে। আগে উল্লেখ করেছি পজিট্রন এমিশন থেরাপির কথা। বিপ্রতীপ ঠিক মত নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে মানবসভ্যতার প্রয়োজনে ব্যবহার করা যাবে হয়ত। তবে একে সংগ্রহ করে প্রয়োজনের সময় ব্যবহার করা একটা বড় চ্যালেঞ্জ।

একজন আদর্শ শিক্ষক

প্রবন্ধ সমগ্র ।। মতামত ।। সূচীপত্র

 প্রবন্ধ সমগ্র
Mijanur Rahman.jpg

একজন আদর্শ, সফল ও

গুণী শিক্ষকের কথা

মিজানুর রহমান মিজান

বিশ্বনাথ, সিলেট, বাংলাদেশ

মানুষ গড়ার কারিগর বা হাতিয়ার বলা হয়ে থাকে শিক্ষককে। মূলত: শিশুর জন্মের প্রাথমিক ধাপ মা বাবা পরিচালনা করেন। এরপরই একটা শিশু তার প্রতিভা, জ্ঞান, মেধা, বিবেক বুদ্ধি বিকাশের সার্বিক দায়িত্ব পালন করেন একজন শিক্ষক। সুতরাং শিক্ষক যত গুণী, জ্ঞানী ও মেধা সম্পন্ন হবেন ছাত্রের উপর এর প্রভাব কমবেশি প্রতিফলিত হবেই। কারণ শিশুরা অনুকরণ ও অনুস্মরণযোগ্য। শিক্ষকের প্রত্যেকটা কাজকর্ম, আচরণ লক্ষ্য করে ছাত্ররা। পাশাপাশি পারিবারিক ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার সমন্বয় সাধিত হয়। শিক্ষকরা জাতীর বিবেক বলে আখ্যায়িত করা হয় এ সমস্ত কারণে। সর্বোপরি শিক্ষকের উপর নির্ভর করে ছাত্রছাত্রীর সার্বিক সফলতা নির্ভর চারিত্রিক সনদ। শিক্ষকরা অর্পিত দায়িত্ব সচেতনতাবোধে কাজকর্ম পরিচালনা করে সমাজকে একটা দিকনির্দেশক যন্ত্রের নিয়ামক ভূমিকা পালন করে আত্মমর্যাদা সম্পন্ন সমাজ সৃষ্টির প্রয়াস অব্যাহত রাখেন। আমাদের উল্লেখিত শিক্ষক জ্ঞান, গুণ ও আদর্শের প্রতীক রূপে গণ্য। তিনি তাঁর কর্মময় জীবনটা ব্যয় করেন এ পথেই।

জন্ম-মৃত্যু মানুষের অবধারিত। এটাকে জয় করা সম্ভবপর হয় না কাহার ও। তথাপি পৃথিবীর বুকে কিছু কিছু মানুষ বা প্রতিভা বিকশিত হয় ফল ও ফুলে। সুশোভিত ও বিমুগ্ধ করে সবাইকে। আর ক্ষণজন্মা এসব প্রতিভাকে আমরা সঠিক মূল্যায়ন করি না। কিন্তু ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না। তার সঠিক ও যথার্থ কম পদ্ধতি আগ-পিছ একদিন মুখরিত হয়। কিন্তু আমরা যেন দর্জিও ফিতার মাপে কাটসাট করা মানুষ। গুণসম্পন্ন ব্যক্তিদের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে বেশি কৃপণতাবোধে আমরা ভোগী। যার যা প্রাপ্য তা দিতে হয়। নতুবা “যে সমাজ, জাতীয় গুণীর কদর জানে না, সে সমাজে গুণীজন জন্মায় না” এ অপবাদে ও অপরাধে তাড়িত হবো সর্বক্ষণ। সুতরাং এ বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসার কঠিন ও দৃপ্ত প্রত্যয় ও প্রত্যাশী।

সিলেট জেলার বিশ্বনাথ উপজেলার তেলিকুনা গ্রাম একটি অজপাড়া গাঁ। আর এ গ্রামেই জন্মগ্রহণ করেন ১৯১৮ সালের ১লা সেপ্টেম্বর মৌলবী মো: আব্দুর রাজ্জাক বি.এস. সি. বি. টি। তৎকালীন সময়ে শিক্ষাক্ষেত্রে বিশ্বনাথ উপজেলা ছিল অন্ধকারে নিমজ্জিত। এ অপবাদ অদ্যাবধি আমরা ঘুচাতে পারিনি সম্ভবত। ২০/৩০ টি গ্রাম ঘুরে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সন্ধান পাওয়া ছিল দুষ্কর। শিক্ষিত লোকের পরিমাণ বা সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য ছিল। যা হোক আশার কথা পূর্ব থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা শিক্ষিত লোকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। তথাপি এ ফলাফল ও পর্যাপ্ত নয়। সে দিন ও খাজাঞ্চী ইউনিয়নে কোন হাইস্কুল ছিল না। আজ যদি ও দু’টি বিদ্যমান। এ থেকে সহজে অনুধাবনযোগ্য শিক্ষাক্ষেত্রের হালচাল। মুসলমানরা ছিলেন অত্যন্ত নাজুক পর্যায়ে। যাহোক আব্দুর রাজ্জাক সাহেবের মামার বাড়ি ছিল চৌধুরী গাঁও। সেখানে যাওয়া-আসার সুবাদে রাম সুন্দর হাই স্কুলের ছাত্রছাত্রীর স্কুলে আগমন দেখার সুযোগ হয়েছিল। ছাত্রছাত্রীর আসা-যাওয়া দেখে তাঁহার শিক্ষার প্রতি ঝোঁক, আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। কিন্তু' আগ্রহবোধ করলেই তখন লেখাপড়া করা সম্ভব ছিল না আমাদের পারিপার্শ্বিকতায়। কারণ অধিকাংশ মুসলমানরা ছেলেমেয়েদের স্কুলে দিতেন না বা অভিশাপ মনে করতেন নানা প্রকার কুসংস্কারের ফলে। তবু ও রাজ্জাক সাহেব দমিবার পাত্র নন। তিনি আত্মীয় স্বজনের মাধ্যমে অভিভাবককে রাজী করান স্কুলে ভর্তি হবার নিমিত্তে। ভাগ্য চক্রেই হোক আর লেখাপড়ার উৎসাহে অনুপ্রাণিত হয়েই হোক আমার শিক্ষক রাজ্জাক সাহেব লেখাপড়া চালিয়ে যেতে থাকেন কৃতিত্বের সহিত। প্রত্যেকটি পরীক্ষায় প্রথম স'সন্তানের অধিকারী ছিলেন তিনি। স্যারের লেখাপড়ার আগ্রহ এবং মেধায় মুগ্ধ হয়ে রাম সুন্দর হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক বৃত্তি প্রদান করেন প্রথমার্ধেই। তখনকার সময়ে বৃত্তি প্রাপ্তি অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার ছিল। বৃত্তি প্রদান করা হত মেধাভিত্তিক অথচ অঞ্চল ভিত্তিক। বিশ্বনাথের ঐতিহ্যবাহী রাম সুন্দর হাই স্কুল হতে স্টার মার্কসহ এস এস সি পাশ করেন ১৯৩৩ সালে। অত:পর তিনি ঐ বৎসরই সিলেট মুরারী চাঁদ কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৩৫ সালে আই এস সি পাশ করেন প্রথম বিভাগে। তারপর ১৯৩৭ সালে একই কলেজ হতে বি এস সি প্রথম বিভাগে পাশ করেন। স্যারের কৃতিত্বপূর্ণ

সফলতায় বৃটিশ সরকার আমন্ত্রণ জানায় বৃত্তিসহ বোম্বে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবার নিমিত্তে।তিনি পারিবারিক বিবিধ জটিলতার আবর্তে ঘুর পাকের মাধ্যমে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি না হয়ে বি টি ট্রেনিং এর জন্য ১৯৩৮ সালে ভারতের শিলং চলে যান। ১৯৩৯ সালে ট্রেনিং সমাপনান্তে সরকারের আমন্ত্রণে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে শিলং ইউনিভার্সিটির মধ্যে ২য় হন। প্রথম শ্রেণীর একজন ম্যাজিস্ট্রেট রূপে ভারতের কুকি অঞ্চলে প্রেরণের নির্দেশ প্রাপ্ত হন। কিন্তু স্যার উপজাতীয় পরিবেশ, সামাজিকতা, আচরণ ইত্যাদিতে অনভ্যস্ততার দরুণ রাজি না হবার সুবাদে সাব-ইন্সপেক্টর পদে সিলেটের বানিয়াচং থানায় নিয়োগ প্রদান করা হয়।

তখনকার সময় সিলেট জেলার শিক্ষা অফিসার ছিলেন ফজলুর রব সাহেব। তিনির ভাষ্য থেকে জানা যায় ১৯৪৪ সালে বানিয়াচং থানার সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থার একমাত্র রাস্তা ছিল নদী পথে। নদী পথে ও এক মাত্র বাহন ছিল ভাড়া করা নৌকা বা চায়না নৌকা বলে খ্যাত সে সময়কার এক প্রকার ছোট ছোট নৌকা। এ ভাড়া করা নৌকায় করে এক দিন স্যার পাড়ি জমান বানিয়াচং থানার উদ্দেশ্যে মাঝি মাল্লাসহ। কিন্তু সেখানকার আবহাওয়া ও পরিবেশ দর্শনে স্যার বিচলিত ও শঙ্কিত হয়ে উঠেন। সেখানকার অবস্থা অত্যন্ত করুণ, কঠিন ও দুর্যোগপূর্ণ থাকার কারণে সারা রাত্রি মাঝি মাল্লাসহ নৌকায় রাত যাপন করে পরদিন ভোর বেলা সিলেটের পথে রওয়ানা হন।

সে সময় একদিকে যেমন চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নত ছিল না বা ডাক্তার প্রাপ্তি ছিল কঠিন। অপরদিকে বর্তমানের মত এত ঔষধপত্র ও আবিষ্কৃত হয় নাই। এমতাবস্থায় বানিয়াচং থানায় ম্যালেরিয়া রোগের প্রাদুর্ভাব মহামারী হিসেবে দেখা দেয়। হাজার হাজার মানুষ ম্যালেরিয়া রোগে ঐ বৎসর মারা যান। কোন কোন গৃহে বাতি জ্বালাবার মত মানুষ ছিল না। লাশের গন্ধে বানিয়াচং এর বাতাস বিকট রূপ লাভ করেছিল। এ দুর্যোগ ও সংকটময় মুহূর্তে সেখানে বসবাস করা অনুপযোগী ভেবে তিনি চলে আসেন। সর্বোপরি রাজ্জাক সাহেব লাশের পর লাশ দেখে ভীত সন্ত্রস্থ হয়ে পড়েন।

এরপর ঐ বৎসরই তিনি স্কুল সাব ইন্সপেক্টর পদ হতে বিজ্ঞান শিক্ষক হিসেবে সুনাম গঞ্জ জুবিলী হাই স্কুলে যোগদান করেন। ১/৯/৪৪ খ্রীষ্টাব্দ হতে ১৩/৮/৪৭ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত ২ বৎসর সফলতার সহিত শিক্ষকতা করে বদলি হয়ে চলে আসেন সিলেট সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে। ১৪/৮/৪৭ খ্রী: হতে ১৫/৮/৬৭ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ বিশ বৎসর উক্ত স্কুলে কৃতিত্ব ও সফলতার সহিত শিক্ষকতা করে সহকারী প্রধান শিক্ষক রূপে পদোন্নতি দিয়ে সরকার ফেনি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রেরণ করেন। কিন্তু রাজ্জাক সাহেব ফেনিতে না যাওয়ায় প্রায় এক বৎসর প্রাপ্ত ছুটি কাটিয়ে সিলেট সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে যোগ দেন। এখানে কয়েক বৎসর চাকুরী করে ১৯৭৪ সালের এপ্রিল মাসে অবসর গ্রহণ করেন।

অবসর জীবন অতিবাহিত করার প্রাক্কালে কিছু দিন বেসরকারি তথা সিলেট রেল ষ্টেশন সংলগ্ন নছিবা খাতুন উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রূপে অতিবাহিত করেন। সর্বশেষ বিশ্বনাথ উপজেলার নিজ গ্রামের পার্শ্ববর্তী উত্তর বিশ্বনাথ উচ্চ বিদ্যালয়ে চার বৎসর প্রধান শিক্ষক রূপে চাকুরী জীবন অতিবাহিত করে বার্ধক্য জনিত কারণে স্কুল ছেড়ে বাড়িতে বাকী জীবন কাটান।

১৯৯৩ খ্রীষ্টাব্দের ১০ অক্টোবর নিজ বাড়িতে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যু কালে তিনি দুই পুত্র ও চার মেয়ে রেখে যান। তিনির কিছু বিজ্ঞান বিষয়ক লিখা প্রবন্ধ ও কবিতার পান্ডুলিপি বড় ছেলের নিকট রেখে যান। এগুলোর মধ্যে একটি প্রবন্ধ ও একটি কবিতা আমি এনে তা আমার সম্পাদিত ম্যাগাজিন দীপ্তিতে প্রকাশ করলে বিপুল পাঠক প্রিয়তা অর্জন করে। বাকি লেখাগুলি প্রকাশিত হলে অনেক কিছু অবগত হওয়া যাবে। কালের আবর্তনে একদিন হারিয়ে যাবে বিস্মৃতির অতলান্তে হয়ত। যেমন হারিয়ে গেছেন আমোদের মধ্য থেকে শ্রদ্ধেয় স্যার আব্দুর রাজ্জাক। আমার দৃঢ় বিশ্বাস স্যার ছিলেন বিশ্বনাথের প্রথম মুসলিম এক জন বি এস সি। আমি স্যারের মাগফেরাত কামনা করি নিরন্তর সর্বান্তকরণে। জ্ঞানের আলো বিতরণে প্রদীপ থেকে প্রদীপান্তরে ক্ষয় নাই, আছে অমরত্ব।

ওঁ সহ নাববতু

প্রবন্ধ সমগ্র ।। মতামত ।। সূচীপত্র

 প্রবন্ধ সমগ্র
SanojCharaborty.jpg

ওঁ সহ নাববতু ও অসৎ

হইতে মোরে সৎ পথে নাও

সনোজ চক্রবর্ত্তী

পূর্ব মেদিনীপুর, পঃ বাংলা 

সনোজ চক্রবর্ত্তী পেশায় স্কুল শিক্ষকতা। বানিজ্য বিভাগে স্নাতকোত্তর। ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখি। মুলত গল্পকার হলেও কবিতাও লিখেছেন বেশ কিছু। প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন পত্র পত্রিকাতে। লেখালেখি ছাড়া অন্যতম নেশা অভিনয় ও নাটক পরিচালনা।

মার জীবনের প্রথম প্রার্থনা সঙ্গীত "অসৎ হইতে মোরে সৎ পথে নাও, জ্ঞানের আলোক জ্বেলে আঁধার ঘুচাও..."।

তখন আমি পল্লীজ্যোতি পাঠাগারের ক্রেশে পড়ি। আমাদের কুকড়াহাটীর অনেকেরই হাতেখড়ি পাঠাগারে, ইন্দুমাসি আর সুকৃতিপিসির কাছে। আমরা যারা ক্রেশে পড়তাম তাদের সবাই ওদের দিদিমণি বললেও আমি মাসি ও পিসি বলতাম। আমাদের বাড়ির উল্টোদিকে ওদের দুজনের বাড়ি। ক্রেশে শুধু লেখাপড়া নয় গান, ছড়া, কবিতা, ব্রতচারী খেলাধুলাও হত। টিফিনে ছিল রোজ দিন নানা রকম খাওয়ার। কখনো মুড়ি-বাতাসা-বাদাম কোনোদিন চিঁড়ে-দই, আবার কোনোদিন সুজির হালুয়া। যেদিন পায়েস হতো সেদিন সকাল থেকে ক্লাস রুম গন্ধে থাকত ভরে। সেদিন লেখাপড়ায় বারবার ভুল হয়ে যেত আমাদের। এই খাবারগুলো আসত সরকারিভাবে। শৈশব বয়স খাওয়ারটাই বুঝত। তার আবার সরকার হয়, সে বয়সে এতো সব বুঝিনি।

সকাল সকাল ইন্দু মাসি বা সুকৃতি পিসির হাত ধরে চলে যেতে হতো পাঠাগারে, ঘুম জড়ানো চোখে। চোখ জুড়ে আসতে ঘুমে, পা জড়িয়ে যেত, হ্যাঁচকা টানে অগ্রসর হতো অনিচ্ছার যাত্রা। শৈশবের আবার একাল-সেকাল! সেই দিক থেকে শৈশব বরাবরই অত্যাচারিত। প্রার্থনার সময় আমরা জনা চল্লিশেক পাঠাগারের দেওয়ালে পিঠ রেখে দাঁড়িয়ে পড়তাম। দাঁড়াতাম ভি এর মতো পা, নমস্কারের মুদ্রায় হাত দুটি জোড়া আর শিব নেত্রে। তখন তো আমরা শিশু, তাই প্রার্থনা করতাম না। প্রার্থনা গাইতাম। গাইতাম গলা ছেড়ে, বিশুদ্ধ সুর কোনো দিনই হতো না। যে দিনগুলোতে রামকৃষ্ণ, সারদা মা বা বিবেকানন্দকে নিয়ে গান হতো, সে গান গাইতে ভারি ভাল লাগত। ভাল লাগার কারণ হয়তো মানুষগুলোকে চিনি বলে। চেনা বলতে ছবিতে আর গল্পে চেনা আর কি। 

আমাদের ক্রেশে "আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে..."হত কিন্তু "জনগণ মন..." বেশি হত না। প্রার্থনা গাইতাম এ টুকুই সত্য কিন্তু "অসৎ হইতে মোরে সৎ পথে..." - আমরা ঠিক বুঝে উঠতাম না। ইন্দু মাসি বা সুকৃতি পিসি প্রার্থনার পর যখন বলত - ভাল হতে হবে, সত্যি কথা বলতে হবে, লেখাপড়া করতে হবে তখন কথা গুলো বুঝতে পারতাম। বুঝতে পারতাম প্রার্থনার নাম করে আমাদের দিয়ে কায়দা করে ঐ কথাগুলো বলিয়ে নেওয়া হয়। আমাদের ছুটি হলে দেখতাম পাঠাগারের সামনে দিয়ে বড় ইস্কুলের দিকে বড় বড় দাদারা সাদা জামা, নীল প্যান্ট আর দিদিরা সাদা জামা, সবুজ ফ্রকের সঙ্গে মাথায় সবুজ ফিতে লাগিয়ে বেণী দোলাতে দোলাতে চলে যেত। আমার খুব ইচ্ছে হত ঐ স্কুলে যাওয়ার।

ছুটির পর রাস্তার ধারে কৃষ্ণচূড়া গাছের গায়ে ঠেস দিয়ে ওদের স্কুল যাওয়া দেখতাম। ফর্সা মতো একটি মেয়ে তার বেণী দুটো দুলিয়ে স্কুল চলে গেলে বাড়ি ফিরতাম। ততক্ষণে মাসি বা পিসি ক্রেশে তালা ঝুলিয়ে বাড়ির পথ ধরত। ঐ মেয়েটিকে নিয়ে সন্দীপের সঙ্গে একবার আমার মারামারি পর্যন্ত হয়ে গিয়েছিল। একদিন আমি সন্দীপকে বলেছিলাম ওটা আমার বউ। একথা শুনে, কিছু না বোঝার আগেই, সন্দীপ আমার নাকে একটা ঘুষি লাগিয়ে দে ছুট। নাকে ব্যথা নিয়ে এক সপ্তাহ ক্রেশ কামাই হয়েছিল আমার। সেই সাত দিন বিছানায় শুয়ে শুয়ে ঘুমের মধ্যে কৃষ্ণচূড়ার লাল ফুল, সবুজ ফিতে বাঁধা ছোট্ট দুটো বেণীর দোলুনি জেগে উঠত স্বপ্নে।

তারপর ক্রেশ ছেড়ে প্রাইমারি স্কুল। রোজদিন "জনগণ মন..." গাই। গাওয়া হয় যতটা চিৎকার হয় তার বেশি। তখন প্রার্থনায় পাশের কাউকে কাতুকুতু দেওয়া,চুল ধরে টেনে দেওয়ার নেশা পেয়ে বসেছিল আমাকে। শুধু আমাকেই নয় তাপস, ভ্রমর, দিলীপ, সন্দীপ এদেরও হাত নিশপিশ করত প্রার্থনার সময়। কে কতটা বেয়াদপি করল তা নিয়ে একটা অলিখিত প্রতিযোগিতা ছিল নিজেদের মধ্যে। পুরো চার বছর "জনগণ মন..." গেয়েও তার অর্থ বুঝে ওঠা হয় নি।

ক্রেশের মতো কেউ কোনোদিন ভেঙে দেয় নি "জনগণ মন..." কে। প্রাইমারি স্কুল টপকে হাইস্কুল। অনেক ছাত্র-ছাত্রী। প্রার্থনার দীর্ঘ লাইন। লাইনে লাইনে ছড়ি হতে হেড মাস্টার মশাই -এর চোখ রাঙানি। নিচের দিকের ক্লাস ভয়ে চুপ। একেবারে পুজোর নিয়ম মেনে প্রার্থনা। প্রার্থনা শেষে

সারিবদ্ধভাবে ক্লাসরুমে যাওয়া। কোনো কোনো স্যার আমাদের মতো বা আমাদের থেকেও নিষ্ঠা ভরে প্রার্থনার লাইনে দাঁড়াত। তাঁদের দেখে প্রার্থনাকে একটা পুজা, একটা উপাসনা, একটা নিবেদন, একটা বিশ্বাস বলে মেনে নিতে ইচ্ছে হতো। সব বদমাইশি ভুলে একাত্ম হয়ে যেতে চাইত মন প্রার্থনায়।

এরপর যখন ক্লাস এইট বা নাইন, যখন গলার স্বর একটু একটু করে ধার হারিয়ে মোটা হয়ে যাচ্ছিল, তখন প্রার্থনা মানে একটা লাইন ছাড়া আর কিছু ছিল না। বাধ্য ছেলের মতো লাইনে দাঁড়ানো। এর মধ্যে যারা বেশি রকমের ওঁচাটে তার প্রার্থনায় অাদনান্দ স্বামী হয়ে উঠত। একটা বিকৃত সুরে "জনগণ মন..." গাইত। এমন একটা অন্তরাল রেখে গাইত যে বদমাইশিটা বোঝা গেলেও, বদমাইশটাকে খোঁজা - খড়ের গাদায় সুঁচ খোঁজার সামিল ছিল।

আমার অন্তত এক দিনের আদনান্দ স্বামী হওয়ার ইচ্ছে থাকলেও, সাহস ছিল না বলে, নিজের গলাটা ভিন্ন ধারায় কানে এল না কোনো দিন। সে যাত্রায়ও "জনগণ মন..." বোঝার বাইরেই থেকে গেল। "জনগণ মন..." কিম্বা "আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে...." কে নিজের থেকে বোঝার মতো বয়সটা যখন হলো। তখন আর প্রার্থনা গাইতে হতো না। তখন আমি কলেজ। পৃথিবীটা সত্যিই গোল। না হলে এমন দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর আবার প্রার্থনা লাইনে দাঁড়াতে হয়! স্কুলে পড়াতে এসে দেখলাম দিন দিন প্রার্থনাটা পাল্টে যায়। কোন দিন - "জনগণ মন..." তো কোন দিন- "আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে..."।

কিন্তু একটা স্তোত্র রোজদিন উচ্চারিত হয়-

ওঁ সহ নাববতু

সহ নৌ ভুনক্তু

সহ বীর্যং করবাবহৈ

তেজস্বী নাবধীতমস্ত

মা বিদ্বিষাবহৈ

ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ

প্রার্থনার সময় আমার স্কুলের মাস্টারমশাইদের কথা মনে পড়ত। যাদের আমি আমার ছাত্রাবস্থায়, প্রার্থনার সময় ঋষি হয়ে যেতে দেখেছি। আমি তাঁদের মতো প্রার্থনায় নিবিষ্ট হতে চাইতাম। শুদ্ধ উচ্চারণে স্তোত্র বলতাম। অন্তর দিয়ে প্রার্থনা করতাম। একদিন প্রার্থনা শেষে এক ছাত্র আমার কাছে স্তোত্রটির অর্থ জানতে চাইলো। আমার বুকের ভিতরে বিশ্বাস শূন্য অবস্থা। আপ্রাণ চেষ্টা করছি স্মার্ট হওয়ার। চেষ্টা করছি পরিস্থিতি সামলে নেওয়ার। আমি অক্ষমতা আড়াল করতে, পরে আসিস বলে জিজ্ঞাসার পাশ কাটালাম।

উপনিষদ খুলে বসলাম-

ওঁ সহ নাববতু-

পরমেশ্বর আমাদের অর্থাৎ শিষ্য ও গুরু উভয়ের চিত্তে ব্রহ্মবিদ্যা প্রকাশের দ্বারা উভয়কে সর্বতোভাবে রক্ষা করুন।

সহ নৌ ভুনক্তু-

ব্রহ্মবিদ্যার ফল যে পরমানন্দ সেই আনন্দ-অমৃতে আমাদের পরিতৃপ্ত করুন।

সহ বীর্যং করবাবহৈ-

আমরা উভয়েই যেন বীর্যবান হতে পারি।

তেজস্বী নাবধীতমস্ত-

আমাদের অধীত বিদ্যা যেন নিষ্প্রভ না হয়।

মা বিদ্বিষাবহৈ-

আমরা একে অপরকে যেন দ্বেষ না করি।

ওঁ শান্তিঃ,শান্তিঃ,শান্তিঃ-

আত্মজ্ঞান লাভের যাবতীয় প্রতিবন্ধক উপশান্ত হোক।

পড়তে পড়তে আশ্চর্য জনক ভাবে ফিরে ফিরে আসছিল স্কুলের প্রার্থনা লাইন,মাস্টার মশাই দের তাপস মূর্তি,পাঠাগারের দেওয়াল জুড়ে গোটা চল্লিশেক শৈশব,ইন্দুমাসি, সুকৃতিপিসি আর শিব নেত্রে শৈশবের সেই প্রার্থনা - "অসৎ হইতে মোরে সৎ পথে নাও..."। "ওঁ সহ নাববতু.." - এর সঙ্গে "অসৎ হইতে মোরে সৎ পথে নাও..." কিভাবে যেন মিলে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছিল। মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছিল আঙ্গিকে, অনুভবে, অনুধ্যানে।  অনুভব করলাম অন্তর প্রার্থনার অন্তর্নিহিত ভাবনায় অবগাহন করলে জীবনটাই হয়ে ওঠে প্রার্থনা।

প্রবন্ধ সমগ্র ।। মতামত ।। সূচীপত্র

কালীনাচ ও চড়কমেলা
 প্রবন্ধ সমগ্র
SanojCharaborty.jpg

কালীনাচ ও চড়কমেলা 

একটি গ্রাম্য সংস্কৃতি

সনোজ চক্রবর্ত্তী

মেদিনীপুর, পশ্চিমবঙ্গ 

সনোজ চক্রবর্ত্তী পেশায় স্কুল শিক্ষকতা। বানিজ্য বিভাগে স্নাতকোত্তর। ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখি। মুলত গল্পকার হলেও কবিতাও লিখেছেন বেশ কিছু। প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন পত্র পত্রিকাতে। লেখালেখি ছাড়া অন্যতম নেশা অভিনয় ও নাটক পরিচালনা।

মাদের কুকড়াহাটী ও তার পড়শি গ্রামের মানুষজন বছরে দুটো দিন খুব ভোর ভোর ঘুম থেকে উঠে পড়ে। মহালয়ার ভোর আর চৈত্র সংক্রান্তির ভোর। চড়কের ভোরে অপেক্ষাকৃত একটু আগেই উঠে পড়ে মানুষজন,প্রায় শেষ রাত থেকে। ছেলে, বুড়ো, পুরুষ, মহিলা সকলেই সে রাত্রি জাগারণের শরিক হয়। এক সময় আমার বাবা আমার হাত ধরে নিয়ে যেতেন আমাকে, এখন আমি আমার সন্তানের হাত ধরে নিয়ে যাই ভোর রাতের শিব তলায়। মোটামোটি বৈশাখ থেকে রৌদ্র প্রখর হতে শুরু করে। গ্রামের কৃষিজীবি মানুষেরা যারা প্রকৃত অর্থে দুঃখজীবিও, তার বর্ষার প্রত্যাশায় গাজন উৎসবে ব্রতী হয়। নিম্নবর্গের হিন্দুরা প্রায় এক বস্ত্রে শিবের উপাসনা শুরু করে। এই ব্রতীরা সন্ন্যাসী নাম পায় তখন।সারা বছর শিব-উপাসনার একছত্র অধিকার ছিল উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণদের। বছরের শেষ কটা দিন শিব উপাসনায় অবর্ণনীয় কৃচ্ছ্র সাধনে মেতে উঠে গ্রামের প্রান্তিক মানুষেরা। শারীরিক ভাবে নিজেদের ক্ষত বিক্ষত করে তারা সন্তুষ্ট করতে চায় মহাদেবকে। সারা বছর ধরে প্রান্তিক মানুষজনদের কষ্ট, বঞ্চনা, ব্যর্থতা যেন অর্ঘ হয়ে উঠে অনায়াসে।আসলে দেব আরাধনার ঐ বিভৎসতা বোধহয় বারেবারে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় আর্থ সামাজিক বৈষম্যকে। সারা দিনে একবার খাওয়া। মোটামুটি পাঁচ দিন ধরে চলে উপাসনা। ভোর রাতে মুলত ভারী খাওয়াটা খায় সন্ন্যাসীরা।

চৈত্র মাসের শেষদিন চড়ক মেলা হয়। সেই চড়ক মেলায় কারসাজি দেখায় সন্ন্যাসীরা।যাইহোক ঐ দিনের ভোরে কালীনাচ হয়। সন্ন্যাসীদের কাউকে কাউকে কালী সাজানো হয়।জুন পুড়িয়ে তার সঙ্গে চিটেগুড় মিশিয়ে যে কালো রং তৈরী হয় সেই রংই হয় কালীর গাত্রবর্ণ।ভোরের আলো আঁধারীতে আলো বলতে মশাল। তাল গাছের কাঁচা ডাসায় কাপড় জড়িয়ে তৈরী হয় মশাল। মশালের ইন্ধন হল পোড়া মবিল।মশাল থেকে ঝরে পড়া আলোক ফোঁটাগুলো গ্রামের পথে আলোর আলপনা হয়ে জ্বলে।সারাদিনের না খাওয়ায় কালী রূপী সন্ন্যাসীর একটা ঘোর, একটা আচ্ছন্নতা তৈরী হয়।উন্মত্তের মতো নাচতে থাকে কালী।মবিলের মশাল পথ নির্দেশ করে।ভোরের আলো আঁধারী, কালীর করাল রূপ, লকলকে জিভ, চকচকে খর্ড়্গ চারপাশে একটা ভৌতিক পরিবেশ জাগিয়ে তোলে। কালীকে ঘিরে ধরা দর্শনার্থীদের কখনো কখনো তাড়া করে কালি। কতবার এমন হয়েছে ছোট বয়সে বাবার হাতছুট হয়ে কালীর তাড়ায় পথের ধারের কাঁটা ঝোপে ক্ষত বিক্ষত হয়েছি। তবুও শেষ রাতের অন্ধকার সালটে ঐ কালীর উদ্দাম নৃত্য, চারপাশের আমোদিত মানুষজন, কালীর হাত থেকে বাঁচার জন্য হুড়োহুড়ি, মশালের আলো, পোড়া মোবিলের গন্ধ, সন্ন্যাসীদের নিয়ম-নিষ্ঠার অন্য রকম একটা আকর্ষণ আছে। ভোরের আলো মাখা, শরীর ধোয়ানো মিঠে বাতাস, সবাই মিলে এক হওয়া, আনন্দ করা সে ভোলার নয়। তাই শান্তিদেব ঘোষ 

অনুরোধ করে বসলেন গুরুদেবের কাছে, জন্মদিনে একটা গান লিখতে। কবি শান্তিদেবকে বোঝান, এ সম্ভব নয়।
নিজের জন্মদিনের গান নিজে লিখলে লোকে কি বলবে।
শেষ পর্যন্ত ১৯২২ সালে লেখা পঁচিশে বৈশাখ কবিতাটি একটু অদল বদল করে সুর দেওয়া হল ২৩ শে বৈশাখ।
ঐ জন্মদিন ছিল তাঁর জীবৎকালের শেষ জন্মদিন। আর ঐ গানটি ছিল শেষ গান।

তথ্যসুত্রঃ গানের পেছনে রবীন্দ্রনাথ// সমীর সেনগুপ্ত।

"তুমি কেমন করে গান কর হে গুণী"

১৯০৯ সাল, ২৮ শে সেপ্টেম্বর। ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে সংগীতজ্ঞ এনায়েৎ খাঁ-এর সংবর্ধনা সভা। কবিও উপস্থিত।
সংবর্ধনা শেষে কবিকে গানের অনুরোধ করা হলে কবি আপত্তি করলেন। সবার অনুরোধ ক্রমশ জোরদার হচ্ছিল কিন্তু কবি ওস্তাদের সামনে মুখ খুলবেন না।
অনুরোধকারীদের মধ্যে গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন।

তিনি বললেন ' আপনি ভাল গাইতে পারেন বলে অহংকার আছে, সেই অহংকারে পাছে কোন দিক দিয়ে ঘা লাগে তাই.....'
এরপর আর কবি না গেয়ে পারলেন না।
খালি গলায় গাইলেন।
"তুমি কেমন করে গান কর হে গুণী"

তথ্যসুত্রঃ গানের পিছনে রবীন্দ্রনাথ// সমীর সেনগুপ্ত।

"তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা"

ভগ্নহৃদয় গীতিকাব্যটি গ্রন্থাকারে প্রকাশ পায় ১৮৮১ তে।
এই গ্রন্থেই প্রথম উৎসর্গ পত্র দেখা যায়।
কবির জীবৎকালে প্রকাশিত ২০৮ টি বাংলা গ্রন্থের ৬৪ টি তে উৎসর্গ পত্র দেখা যায়।
৭টি গ্রন্থ কাদম্বরী দেবীকে উৎসর্গীকৃত।
ম্যাকবেথ এর প্রধানা ডাইনির নাম হেকটি।
রবীন্দ্রনাথ কাদম্বরীদেবীকে মজা করে হেকটি বলতেন।
গ্রন্থটির উৎসর্গ পত্রে লেখা ছিল-
'শ্রীমতী হে-কে'
গ্রন্থটির উপহার পৃষ্ঠায় ঐ গানটি আছে।

কবি গানটিতে তিন বার সুর দেন।
স্বামী বিবেকানন্দের খুব প্রিয় গান এটি।
রামকৃষ্ণদেবকে তিনি দু-বার গানটি শুনিয়েছেন।

তথ্য সুত্রঃ গানের পিছনে রবীন্দ্রনাথ// সমীর সেনগুপ্ত।

দেশভ্রমণ

প্রবন্ধ সমগ্র ।। মতামত ।। সূচীপত্র

 প্রবন্ধ সমগ্র
Mijanur Rahman.jpg

দেশ ভ্রমণ

মিজানুর রহমান মিজান

বিশ্বনাথ, সিলেট, বাংলাদেশ

প্রত্যেক মানুষের জ্ঞান অর্জন করা অবশ্য কর্তব্য। মনের চোখ ফুটাতে জ্ঞানার্জন অপরিহার্য। বার্টানড্‌ রাসেল বলেছেন, “সংসার জ্বালা যন্ত্রণা এড়াবার প্রধান উপায় হচ্ছে, মনের ভিতর আপন ভুবন সৃষ্টি করে নেওয়া এবং বিপদকালে তার ভিতর ডুব দেওয়া। যে যত বেশী ভুবন সৃষ্টি করতে পারে, ভব যন্ত্রণা এড়াবার ক্ষমতা তার তত বেশী হয়।“তাই জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে মনের চোখ ফুটিয়ে মনের ভিতর অসংখ্য ভুবন সৃষ্টি করত দু:খ, ক্লেশ এড়িয়ে যেতে হলে এ কাজের  উৎকৃষ্ট পথ দেশ ভ্রমণ। ক্লান্তি ও গ্লানি দুরের সঞ্জীবনী ভ্রমণ, দেখে শেখার একটি উত্তম মাধ্যম। মানব সমাজের বৈশিষ্ঠ পরিস্ফুটিত হয় তার মেধা, মনন ও বুদ্ধি মত্তায়। তাই  মানুষের অদম্য স্পৃহা এক স্থান থেকে অন্য স্থান যেতে অনুপ্রাণিত করার মাধ্যমে ভ্রমণ করায় হৃদয়ে আলোড়িত করে। আল্লাহ কতই না সুন্দর ও বৈচিত্র্যময় বৈচিত্রতা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন এ পৃথিবী। সৃষ্টি অপার সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে ভ্রমণের প্রয়োজন। শিক্ষার্থীরা বইয়ের পাতা থেকে যা অর্জন করে তা অস্পষ্ট। বর্ণনার চেয়ে বাস্তব অতি স্পষ্ট। তাই শিক্ষা সফর বা ভ্রমণের মাধ্যমে উপাদানগুলো দর্শনে প্রত্যক্ষ আনন্দের খোরাক যোগায়। বিভিন্ন দেশের মানুষ, সৃষ্টি, সভ্যতা, আবহাওয়া ইত্যাদির সঙ্গে পরিচিত হয়ে সংকীর্ণতা, ক্ষুদ্রতাকে পরিহার পূর্বক উদার, নৈতিকতা, মনুষ্যত্ব ও মানবিক মূল্যবোধে আকৃষ্ট হতে পারে এবং জীবনে পূর্ণতা প্রাপ্তির সুস্পষ্টটা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ হতে পারে। ব্রিটেনে অল্প দিনের ভ্রমণে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হলো সে দেশের মানুষ সময়কে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়। নয়টার অফিস নয়টায় যোগদান। কিঞ্চিত বিলম্বতায় অনভ্যস্ত। যা আমাদের দেশে অত্যন্ত কম পরিলক্ষিত হয়।

আলস্যে ভর করে “করব“ বলে সময় ব্যয়ে অধিক অভ্যস্ত। কিন্তু সময়ের "এক ফোড়.. দশ ফোড়“ কথাটির যথার্থ মর্মার্থ অনুধাবনে অনেক ক্ষেত্রে ব্যর্থ। জনগণ আইন মান্যে, পালনে যথেষ্ট সচেতন, শ্রদ্ধাশীল। সরকার ও জনগণের সমস্যা সমাধানে যথেষ্ট আন্তরিক। উদাহরণ স্বরূপ ট্রেন সরকারী সম্পদ, জনগণের কল্যাণার্থে ব্যবহৃত। কোন প্রকার ত্রুতি বিচ্যুতির নিমিত্তে বিলম্ব হলে বিকল্প সরকারী বাস তাৎক্ষণিক বিনা মূল্যে রাস্তায় চালু করবে, করে জনগণকে ভোগান্তি থেকে রক্ষার্থে। অথচ আমাদের দেশে তা দুরে থাক,অনেক ক্ষেত্রে নোটিশ প্রদান ও করবে না। উপরন্তু “নয়টার গাড়ী কয়টায় ছাড়ে“ প্রশ্নের সম্মুখীন। গাড়ীর যন্ত্রাংশ চুরি হচ্ছে না, কেউ তামাসাচ্ছলে ও হাত দিয়ে দেখছে না। আমি বেশ কিছুদিন সৌদি আরবে ছিলাম। সেখানে অত্যধিক গরমের আধিক্যতা। ব্রিটেনে ঠান্ডার সখ্যতা, মেঘলা আকাশ, অধিকাংশ সময়। ঠান্ডারও রকমফের রয়েছে। কখন ও পতিত হয় বরফ, কখন ফ্রীজি ঠান্ডা (অত্যধিক ঠান্ডা) কখন অল্প মাত্রার অর্থাৎ শীত প্রধান দেশ। আমাদের দেশে ঠান্ডা-গরম উভয়ের সংমিশ্রণ। ব্রিটেনে প্রতিটি ক্ষেত্রে নিয়মানুবর্তিতা, শৃংখলাবোধ, সুন্দরেরও উন্নয়নের, সমৃদ্ধির স্পর্শ ছোঁয়া বিরাজমান। 

সকল মানুষ ভ্রমণে সাধ্যানুযায়ী অভ্যাস হলে জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে দ্বার হবে প্রসারিত। মহান আল্লাহর দরবারে কামনা জ্ঞানার্জনের জন্য প্রয়োজনে “সুদূর চীন দেশে যাও“ বাক্যটির যথার্থতা উপলব্ধি ও বাস্তবায়নের জন্য সাধ্যাতীত প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার তৌফিক দান করতে। আর “মানুষ মানুষের জন্য“ এবং “মানুষ মানবতার জন্য“ এ আলোকে হোক  উদ্ভাসিত।       

শান্তির বীজ

প্রবন্ধ সমগ্র ।। মতামত ।। সূচীপত্র

 প্রবন্ধ সমগ্র

নতুন ইংরেজী বছর ২০১৮ হউক

শান্তির বীজ বপনের সাল

মোস্তফা কামাল

নতুন নতুন স্বপ্ন, আশা, সংকল্প আর প্রত্যাশা নিয়ে শুরু হলো ইংরাজী নববর্ষ ২০১৮। আনন্দ আর রকমারী উৎসবের মধ্য দিয়ে সমগ্র বিশ্ববাসী স্বাগত জানিয়েছে নতুন খ্রিস্টীয় বছর ২০১৮-কে এবং সকলের মাঝে মেতে উঠেছে নতুন বছরের নতুন নতুন প্রত্যাশা। বিগত বছরের প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির হিসাব নতুন বছরের পরিকল্পনাগুলিকে আরও উজ্জীবিত করবে এমন ভাবনাগুলিকে সম্বল করে বিশ্ববাসী খ্রিস্টীয় ২০১৮ সালকে সাদরে বরণ করে নিয়েছে, সকলেই নতুন নতুন স্বপ্নের ছক আঁকছে, পরিকল্পনা করছে উন্নত জীবন আর সামগ্রিক উন্নয়নের। পাশাপাশি নতুন বছরের  এই শুভক্ষণে সকলেরই অজানা সামনের দিনগুলোতে কী অপেক্ষা করছে বিশ্ববাসীর ভাগ্যে। তবে সব কিছু ভাগ্যেরউপর ছেড়ে না দিয়ে ভাল কিছু প্রত্যাশা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার শপথ এখন সকলেরই। সকলেরই মঙ্গলময় প্রত্যাশা সব সময়ই থাকে, উন্নয়নের আশায়ই পথ চলাশুরু হয় নতুন বছরের নতুন দিনগুলোতে। নতুন বছর ২০১৮ এর শুরু থেকেই সকলেই প্রত্যাশা আর স্বপ্নে উদ্ভাসিত হোক এবং সূচনা হোক আলোকিত আর নিরাপদ জীবনধারার ।বিশ্বের সকল আশাবাদী মানুষের অপূর্ণতাগুলি পরিপূর্ণতা লাভ করবে নতুন এই বছরে এবং জীবনের পুরনো সমস্যাগুলির সমাধান খুঁজতে সক্ষম হবে সকলেই। সুষ্ঠ এবং যুগোপযোগী পরিকল্পনার মাধ্যমে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবে ন্যায়বিচার, প্রতিটি মানুষ ফিরে পাবে তার কাঙ্ক্ষিত অধিকার- নতুন বছরে এমন প্রত্যাশা আজ সকলের মনে। দেশপ্রেমের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বিভেদহীন সমাজ গঠনে আমাদের প্রত্যেকের

প্রতিজ্ঞা হোক নতুন এই বছরে। ঐক্যবদ্ধ উন্নয়ন পরিকল্পনার মাধ্যমে পরিশ্রম ও সততাকে সম্বল করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সংকল্প হওয়া আমাদের প্রত্যেকের জন্যই জরুরী। সরকারী উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ইতিবাচক ও গঠনমূলক কাজগুলি দেশের উন্নয়নে সহায়ক হবে, ইংরাজী নতুন বছরে ভাল কিছু করার শপথ নিব আমরা প্রত্যেকেই এবং দিনবদলের প্রত্যয়ে সকলেই দেশপ্রেমিক হিসেবে কাজ করে সমৃদ্ধিতে ভরে তুলবো আমাদের ভারতবর্ষকে।বিশ্বের বয়স বাড়ল আরও এক বছর, সূচনা হলো একটি নতুন বছরের। “সময় ও নদীর স্রোত কারও জন্যই অপেক্ষা করে না”- আবহমান সূর্য একটি পুরনো বছরকে কালস্রোতের উর্মিমালায় বিলীন করে আবার শুরু করল নতুন যাত্রার। নতুন বছরকে স্বাগত জানিয়ে উন্নয়ন, অগ্রগতি আর অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়ার অপরিমেয় প্রত্যাশায় উদ্ভাসিত হোক ২০১৮। বছরের নতুন দিনের সূর্যালোকে স্নান করে সিক্ত হবে জাতি-ধম-বর্ণ-নির্বিশেষে সব শ্রেণী পেশার মানুষ। বিগত সময়ের সব ভুল শুধরে নেয়ার সময় এসেছে আজ, ২০১৮ হবে শান্তির বীজ বপনের সাল, অনাবিল স্বপ্ন আর অফুরন্ত প্রাণোম্মাদনা নিয়ে নতুন সূর্যের আলোয় অগ্রসর হবে সকল মানুষ, নতুন বছরে সকলেরই প্রত্যাশা একটি ক্ষুধা-দারিদ্রমুক্ত সুখী সমৃদ্ধিশালী দেশ দেখার। নতুন বছরে সকল শান্তিকামী মানুষের প্রার্থনা-“আর কোন হিংস্রতা বা সন্ত্রাস নয়, নয় কোন হত্যা-খুন বা অপহরণ, ২০১৮ হউক শান্তির বীজ বপনের সাল”।

বুদ্ধিমান দাঁত

প্রবন্ধ সমগ্র ।। মতামত ।। সূচীপত্র

 প্রবন্ধ সমগ্র

বুদ্ধিমান

দাঁত

 সরসিজ দাস

কাশে এখনো সূর্য রয়েছে। সন্ধ্যা হতে ঢের দেরী। তবু আজ ওদের খেলা তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল। সব মিলিয়ে এক ঘন্টাও খেললনা ওরা।
'কি-রে আজ পটলা, রাজু, হোদল-র খবর কি? খেলতে এলনা কেন? ওদের ছাড়া আজ খেলাটা জমল না।', খেলা শেষে মাঠে বসে  বলল টিটু।
'কি জানি? সূর্য আজ পশ্চিম দিক দিয়ে উঠেছে মনে হয়। রাজু খেলতে এলনা, ভাবা যায়!', বলল টিটু।
'কাল তো বলাই-দার টিউশন-এ ওরা তিন জন-ই এসেছিল', বলল ভোম্বল।
'এই তো সবে মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হল, এর-ই মধ্যে টিউশন! পারিস-ও বটে তোরা। তা, বলাই-দা মানে যিনি অঙ্ক করান তো। শুনেছি, ওনার ছাত্ররা জল খেতে চাইলে উনি ওনার মেয়ে-কে বলেন আধ গ্লাস জল এনে দিতে!', বলল গুগুল।
'আধ গ্লাস', হো হো করে হেসে উঠলো ওরা।

'লোক-টা রাম কিপ্টে', বলল  ভোম্বল, 'খাতা কারেক্ট করার সময়ও  স্টুডেন্টদের পেন ব্যবহার করে। নিজের পেনের কালি পর্যন্ত খরচ করতে চায় না।'
'আচ্ছা ওদের মোবাইল-এ কল করেছিলি? আমি করেছিলাম, কিন্তু কেউ ধরল না।', টিটু বলল।
'দাড়া আমি এখন আর-একবার করে দেখছি,' বলে হোদল-কে ফোন করল গুগুল।
'কি-রে আজ এলিনা কেন? .........সেকি! কি করে?..........আমাদের-কে বাদ দিয়ে দিলি!.......... বেশ হয়েছে ..........কবে আসবি আবার ............ ওকে, বাই .....', ফোনে এই কথা গুলো বলল গুগুল।
'কি হয়েছে?', গুগুল ফোন রাখতেই জানতে চাইল টিটু। 'শালাগুলো কাল টিউশানির পর খেতে গেছিল। হোদলের থেকে জোর করে কোল্ড-ড্রিঙ্কস আর প্যাটিস আদায় করেছিল', বলল গুগুল।
'আমাকে ডাকল না তো', মুখ কালো করে বলল ভোম্বল। 'তুই কাঁদিস পরে, আগে আমাকে কথাটা শেষ করতে দে', বলল গুগুল, 'প্যাটিস-গুলো বোধহয় ভালো ছিল না। ওই তিন-জনের-ই food poisoning হয়ে গেছে।''বেশ হয়েছে, আমাদের না দিয়ে খেলে এটাই হবে', বলল হোদল, 'তা ওরা আবার কবে খেলতে আসবে?'
'বমি-টা বন্ধ হয়েছে। তবে লুস-মোশন চলছে। 'লুস' টাইট হলে তবেই ওরা আসবে। আরো এক-দুই দিন লাগবে বোধ হয়', বলল গুগুল।
'আমাদের বাড়িতে কাল এই নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। আমাদের এক আত্মীয়ও food poisoning-র জন্য হাসপাতালে ভর্তি', বলল ভোম্বল। 
'আমাদের দেশ-এ ফুড ইন্সপেক্টর-রা এত ফাঁকিবাজ আর ঘুষখোর হয়। কেউ নিজের কাজ ঠিক করে করে না', বলল টিটু।
'ফুড ইন্সপেকশন কিন্তু সব সময় কাজ করে না। মনে নেই, ২০১১-তে জার্মানি-তে কত লোক E-Coli ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে মারা গেছিল। শাকসবজির মধ্যে দিয়ে এই ব্যাকটেরিয়া মানুষের শরীরে প্রবেশ করেছিল। ওদের দেশ-এ কিন্তু ফুড inspection বেশ ভালো ভাবে হয়। তবু-ও  ওরা এটা আটকাতে পারেনি', বলল গুগুল।

'কাল, আলোচনার সময় বুড়ো-দা একটা নতুন আবিষ্কারের কথা বলল যা food poisoning আটকাতে সাহায্য করতে পারে', বলল ভোম্বল।' বুড়ো-দা মানে তোর জ্যাঠতুতো দাদা তো, যে USA-তে PhD করে। সে এখন এখানে?', জানতে চাইল গুগুল।' হ্যাঁ, পরশু দিন বুড়ো-দা এসেছে,' বলল ভোম্বল।'তা একদিন আমাদের সাথে আলাপ করিয়ে দে', বলল টিটু। 'হ্যাঁ, মা বলছিল তোদের একদিন নেমন্তন্ন করবে,' বলল ভোম্বল।'দারুণ ব্যাপার তো। এবার বল, তোর বুড়ো-দা কি বলল?',

বলল টিটু। 'বুড়ো-দা বলল যে USA-র Princton এবং Tufts ইউনিভার্সিটির গবেষকরা এক রকম বুদ্ধিমান দাঁত আবিষ্কার করেছেন, যেটা বলে দেবে যে মুখের মধ্যের খাবার-এ কোনও হানিকারক ব্যাকটেরিয়া আছে কিনা?', বলে থামল ভোম্বল। দেখল সবাই হাঁ করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।
'বুদ্ধিমান দাঁত! একমিনিট সময় দে ব্যাপারটা একটু হজম করে নি', বলল টিটু।
'আর একটু খুলে বল, এটা কি ভাবে কাজ করে? এটা কি কোন কৃত্রিম দাঁত?', জানতে চাইল গুগুল।

'না, কৃত্রিম নয়। আসল দাঁত। গ্রাফেন - নামের একটি পদার্থ দিয়ে ওনারা দাঁত-র উপর একটা ট্যাটু বানান। সেই ট্যাটু মুখের মধ্যে কোনও ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি ধরতে পারে', বলল ভোম্বল।

'গ্রাফেন কি?', জানতে চাইল টিটু।
'সহজ ভাবে বললে এটা one-atom thick layer of Graphite', বলল ভোম্বল।
'one atom thick বানায় কি ভাবে? এতো কল্পনা করাই মুশকিল!' বলল টিটু।
'nanotechnology-তে এরকম নাকি বানানো যায় এখন', বলল ভোম্বল।
'আচ্ছা, ওই ট্যাটু কোন ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতির কথা মানুষ-দের জানায় কি ভাবে? ওই ট্যাটুর মধ্যের খবর জানার জন্য কি কোনও wire ওই  ট্যাটুর সাথে লাগাতে হবে?', জানতে চাইল গুগুল।
'না না, ওই ট্যাটু-র মধ্যে ছোট একটা antenna আছে। antenna-টা গ্রাফেনের সাথে যুক্ত থাকে। কিন্তু ওই ট্যাটু-র মধ্যে কোনও battery নেই। একটা receiver যন্ত্র  wireless communication-র মাধ্যমে ওই ট্যাটু-র সাথে যোগাযোগ করে এবং ওই ট্যাটু-র  মধ্যে জমা তথ্য সংগ্রহ করে।  রোগীর মুখে কোন ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া এলে ওই receiver যন্ত্রে সেটা ফুটে ওঠে। কোন wire ব্যবহার  না ব্যবহার করেই ডাক্তার বা রোগী নিজে ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতির কথা জানতে পারে। এর ফলে, ডাক্তার-রা কোন অসুখ শুরুতেই ধরতে বা চিকিত্সা করতে পারবে আর রোগীরাও অসুখ সম্পর্কে সাবধান হয়ে যাবে। ', বলল ভোম্বল।
'ওনারা এটা কি মানুষের উপর পরীক্ষা করেছেন?' বলল গুগুল।
'ওনারা এই ট্যাটু গরুর দাঁতে লাগিয়ে তার উপর মানুষের মুখের ভেতরের হওয়া ছেড়ে দেখেছেন যে ওই ট্যাটু ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি ধরতে পেরেছে। গরুর দাঁত ব্যবহার করেছেন কারণ মানুষের দাঁতের পক্ষে ওই ট্যাটু একটু বড়। তবে ওনারা এরপর মানুষের দাঁতের মত করে ওই  ট্যাটু বানাবেন', বলল ভোম্বল।
'ওই ট্যাটু কোন কোন ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি ধরতে পারে?', জানতে চাইল টিটু।
'গবেষকরা এখনো পর্যন্ত  কিছু stomach ulcers and some cancer-র সাথে যুক্ত ব্যাকটেরিয়া সনাক্ত করতে পেরেছেন। যদিও আরো গবেষণার দরকার আছে', বলল ভোম্বল।
'আচ্ছা, খাবার খেলে বা ব্রাশ-করলে ওই ট্যাটু-টা উঠে আসবে না তো?', জানতে চাইল গুগুল।
'হ্যাঁ, এটা খুব দরকারী বিষয়। এই মুহূর্তে, ওই ট্যাটু খুব স্থায়ী নয়। তবে গবেষকরা এটাকে আরো স্থায়ী করার চেষ্টা করছেন যাতে দাঁত মাজলে বা খাবার খেলে এটা দাঁত ছেড়ে বেরিয়ে না আসে', বলল ভোম্বল।
'বুদ্ধিমান দাঁত-ই বটে! হাই-ফাই আবিষ্কার কিন্তু!', বলল গুগুল। সবাই মাথা নেড়ে তাতে সায় দিল।
'ও! একটা হেব্বি রসালো খবর আছে। আমি ভুলেই গেছিলাম বলতে', বলে উঠল গুগুল।
বিকেল প্রায় শেষ হতে চলল। ওরা এবার অন্য বিষয়ে আলোচনা করতে সুরু করল। তবে আমাদের তাতে আগ্রহ নেই, কি বল তোমরা?

প্রজেক্ট বালুচরী

প্রবন্ধ সমগ্র ।। মতামত ।। সূচীপত্র

 প্রবন্ধ সমগ্র

প্রোজেক্ট
বালুচরী
সুশান্ত বিশ্বাস

রূপকথা আর পুরাণের বর্ণময় দৃশ্য, মনের মাধুরী মেশানো শৈল্পিক নৈপুণ্যে, রেশমের কাপড়ে ফুটিয়ে তোলার এক কালোত্তীর্ণ মাধ্যম বাংলার বালুচরী শাড়ি। বিষয় বৈচিত্র্য এবং সূক্ষ্ম কারুকাজের অপরূপ মেলবন্ধনে এর খ্যাতি দেশের সীমা ছাড়িয়ে গেছে ইতিহাসের কাল থেকে।অষ্টাদশ শতাব্দীতে রাজধানী স্থানান্তরণের সময় বাংলার নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদের জিয়াগঞ্জ সন্নিহিত বালুচর গ্রামে এই শাড়ি তৈরির শিল্প আমদানি করেন। তাঁরই পৃষ্ঠপোষকতায় ও উৎসাহে এই ঐতিহ্যবাহী শিল্প সমৃদ্ধি লাভ করে। পরবর্তীকালে এক বিধ্বংসী বন্যায় গ্রামটি ডুবে যাওয়ার পর বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরে বালুচরীশাড়ি শিল্প নতুন করে গড়ে ওঠে। সেই সময় মল্ল রাজাদের শাসনকালে তা বিশেষ সমৃদ্ধিও লাভ করে। মল্ল রাজবংশের অন্যতম ঐতিহাসিক কীর্তি পোড়ামাটির মন্দিরের দেওয়ালে খোদাই করা পৌরাণিক চিত্রের প্রভাব দেখা যায় বালুচরী শাড়িতে।কিন্তু এই সমৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকে নি। রাজনৈতিক ও আর্থিক কারণে ব্রিটিশ শাসনকালে ক্রমেই তা মুমূর্ষু শিল্পে পরিণত হয়। বেশিরভাগ তাঁতিরা বাধ্য হন তাদের পেশা পরিত্যাগ করতে। স্বাধীনতার পর সুভো ঠাকুর ও কমলাদেবী চট্টোপাধ্যায়ের উদ্যোগে বিষ্ণুপুরের নক্সাকার অক্ষয় দাসের কৃতিত্বে দীর্ঘকাল পরে নতুন চেহারায় আবার বিষ্ণুপুরেই বালুচরী শাড়ির প্রকাশ ঘটে। এরপর ক্রমশঃ বিষ্ণুপুরেরই নিজস্ব শিল্প হয়ে উঠল বালুচরী।

বালুচরি শাড়ি তৈরির প্রক্রিয়াটি দীর্ঘ। এর মূল উপাদান রেশম সুতো। মালদহ থেকে কিলোগ্রাম হিসেবে লাচির আকারে সংগ্রহ করা কোরা সুতো নরম করে তুলতে পরিমাণ মতো সোডা সাবানের জলে ফুটোনো হয়।তারপর শাড়ির প্রয়োজন অনুযায়ী নানা রঙে তা রাঙিয়ে তোলা। দু’পাশে টান-টান করে হাতের দুই তালুতে চাপ দিয়ে এই সুতো বিপরীত মুখে পাকানো হয়। রেশমের এই সুতো এর পর বড় লাচি থেকে ছোট ছোট ববিনে পাকিয়ে পরে আবার দুটি করে ছোট ববিনের সুতো নিয়ে একটি ববিনে পাকানো হয়, যা পাকোয়ান বাট্যুইস্টিং নামে পরিচিত। এই পাকানো সুতোর পাক মজবুত করতে ড্রামের মধ্যে স্টিমিং করা হয়। এরপর মেশিনের সাহায্যে সেই সুতো থেকে তৈরি হয় বড় লাচি এবং তা থেকে আবার ছোট লাচি। টানা বা খাড়া বুননের জন্য সেই ছোট লাচি পুড়নি বা ওয়ার্প (Warp) করা হয়। এরপর সানা গাঁথা বা ডেন্টিং করার পালা। সানা করাসুতো বিম-এ গোটানো হয়। অন্যদিকে, ভরনা বা অনুভূমিক বুননেরজন্য ছোট লাচি করা সুতো খিয়া বা ওয়েফট (Weft) করা হয়। এই সুতোকে পোক্ত করে তুলতে তা গামিং করা হয়। এরপর সেই খিয়া করা সুতো নলি বা ছোট কাটিমে গুটিয়ে রাখা হয়। তারপর নক্সা অনুযায়ী জ্যাকার্ড মেশিনে খাঁচান বেঁধে সেই মতো শিল্পী শাড়িটি মাকুর সাহায্যে বয়ন করেন। ববিন বা নলি মাকুর মধ্য দিয়ে যাওয়া আসা করে। শাড়ির আঁচলেও গায়ে মোটিফ তৈরি বালুচরী বয়নের এক জটিল প্রক্রিয়া। নকশাটি আঁকা হয় গ্রাফ বা ছক কাগজের ওপর। আঁচল, পাড় ও বুটির পরিকল্পনা অনুযায়ী নকশার বিন্যাস নির্ধারণ করা হয়। রামায়ণ মহাভারতের দৃশ্য, রাজপুতানার মিনিয়েচার পেন্টিং, অজন্তা ইলোরার শিল্পকর্ম ছাড়াও তৎকালীন মুঘল ও ব্রিটিশ যুগের প্রভাবও দেখা যায় এর আয়তাকার বর্গাকার নকশায়। গ্রাফ কাগজের নকশাটি রঙীন করে সেই অনুযায়ী কার্ড ফুটো বা পাঞ্চ করা হয়।

পাঞ্চিং এর পর নকশার হিসেব অনুযায়ী কার্ড সাজিয়ে সেগুলি সেলাই করা হয়। এরপর জ্যাকার্ড মেশিনে সেগুলিকে আঁটা হয়। সম্প্রতি খাদি পর্ষদের উদ্যোগে স্বয়ংক্রিয় কার্ড পাঞ্চিং যন্ত্র স্থাপনেরও পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।

১৮০১ শতাব্দীতে জোসেফ এম জ্যাকার্ড, ফুটো বা পাঞ্চ করা প্রচুর কার্ডের ধারাবাহিক বিন্যাসক্রমে সাজানো গুচ্ছ বা চেন দিয়ে জটিল নক্সার বস্ত্র বয়নের সরলীকরণের জন্য তাঁত যন্ত্র জ্যাকার্ড মেশিন বা লুম উদ্ভাবন করেন। কার্ডের প্রতিটি অবস্থানের সঙ্গে খাপ খাইয়ে, পিণ্ডাকার মাথা যুক্ত হুক লাগানো থাকে, যা কার্ডের ফুটো বা ভরাট অংশের ওপর নির্ভর করে ওঠে বা আটকে থাকে।

হুকটি লাগামের মতো সেই অংশকে টেনে তোলে বা নামিয়ে দেয়, যা পুড়নি বা ওয়ার্প (Warp) সুতোটিকে বহন ও চালিত করে যাতে খিয়া বা ওয়েফট (Weft) সুতোটি তার ওপরে বা নীচে প্রসারিত হয়। নির্বাচিত রঙের সুতো তাঁতে বেঁধে দুই বা তার বেশী মাকু ব্যবহার করে বালুচরী শাড়ি তৈরি হয়। শাড়ির পাড়, গা ও আঁচলের জন্য গলানি মাকু ও বুটির জন্য চালানি মাকু ব্যবহৃত হয়। জ্যাকার্ড তাঁত প্রচলিত হবার পর একটি শাড়ি কম পক্ষে ৫ থেকে ৬ দিনের মধ্যে তৈরি করা যায়। এতে শিফট ভিত্তিতে ১ জন পুরো সময় ও ১ জন আংশিক সময়ের জন্য অর্থাৎ মোট ২ জন তাঁতি কাজ করেন।রাজ্যের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুপ্রেরণায়, ক্ষুদ্র ছোট মাঝারি উদ্যোগ ও বস্ত্র দপ্তরের অধীন পশ্চিমবঙ্গ খাদি ও গ্রামীণ শিল্পপর্ষদ, বালুচরী শাড়ী শিল্পের বিকাশে, বাঁকুড়া জেলা কার্যালয়ের তত্ত্বাবধানে এর উৎপাদনের এলাকা বিষ্ণুপুর থেকে সোনামুখী পর্যন্ত প্রসারিত করার লক্ষ্যে একটি বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এতে সোনামুখী ও তার সন্নিহিত এলাকার তাঁতিদের জীবিকা অর্জনের সুযোগ বাড়ছে। কয়েক বছর হ’ল, স্থানীয় অঞ্চলের কিছু দক্ষ কাটুনী ও বয়নশিল্পীদের সহায়তায় এখানে রেশম বস্ত্র উৎপাদনের কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। কেন্দ্রটির প্রয়োজনে নিজস্ব জমিতে সংশ্লিষ্ট সকলের সহায়তার জন্য খাদি পর্ষদ একটি বাড়ি তথা কর্ম-শালা নির্মাণ করেছে। যেখানে কম্পিউটার সহায়ক নকশা যন্ত্র সহ জ্যাকার্ড লুম বসানো হয়েছে।স্থানীয় তাঁত-শিল্পীদের বালুচরী শাড়ি তৈরিতে সাহায্য করার জন্য, পর্ষদ প্রয়োজনীয় দক্ষতার উন্নতিকল্পে, সোনামুখীর ৬০ জন তাঁতিকে নিয়ে প্রশিক্ষণ শিবিরের আয়োজন করেছে। সহায়ক সংস্থার সহযোগিতায় বালুচরীর নকশায় রেশম বস্ত্র উৎপাদনে বিশেষগুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন সম্প্রদায় ও আধুনিক ক্রেতার কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে বালুচরীর চিরাচরিত নক্সায় নানান পরিবর্তন এনে তা যুগোপযোগী করে তোলার আয়োজন করা হয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তি, নকশা, কম্পিউটার সহায়ক নকশার সঠিক ব্যবহার ও বিনিয়োগ-প্রসারণ নিশ্চিত করতে খাদি পর্ষদ সরকারী-বেসরকারী অংশীদারিত্বের মডেলে প্রোজেক্ট বালুচরী রূপায়ণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। রেশম খাদি শিল্পের এই ঐতিহ্যবাহী ও অনন্য সাধারণ পণ্যটির উপযুক্ত বিপণন বাজারে এর চাহিদা বৃদ্ধি করে তাঁত-শিল্পীদের জীবিকা উন্নয়নে যে সাহায্য করবে, সে বিষয়ে খাদি পর্ষদ আশাবাদী। ক্রেতার দৃষ্টি আকর্ষণে, রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় গ্রামীণ এর বিক্রয় কেন্দ্রগুলিতে সারা বছর, খাদি ও মসলিন বস্ত্রের পাশাপাশি, বিভিন্ন নকশার ও মূল্যের বালুচরী-র সম্ভার প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সঙ্গে থাকছে বালুচরীর নকশায় সিল্কের কুর্তা, পাঞ্জাবী ও রকমারি আধুনিক ড্রেস মেটেরিয়াল। এছাড়াও, রাজ্য স্তরে কোলকাতার মিলন মেলায়, জাতীয় স্তরে দিল্লির প্রগতি ময়দানে এবং আন্তর্জাতিক স্তরে ইতালির নাপোলস সহ বিভিন্ন জায়গায় রেশম খাদি পণ্য বালুচরীর প্রদর্শনে পর্ষদ বিশেষ ভূমিকা নিয়েছে।

এরই পাশাপাশি, তাঁতিদের জীবনযাত্রার সার্বিক মান উন্নয়নে জনশ্রী বীমা যোজনা সহপশ্চিমবঙ্গ সরকারের নানান জনকল্যাণমুখী প্রকল্পে তাদের সামিল করে তুলতেও পর্ষদ বিশেষভাবে উদ্যোগী। স্পন্ডাইলোসিস, চক্ষু রোগের মতোপেশা জনিত অসুস্থতা নিরাময়, নিরাপদ পানীয় জল ব্যবহার, স্বাস্থ্য সচেতনতা, স্যানিটেশন ও সাক্ষরতা ইত্যাদি বিষয়ে যথাযোগ্য গুরুত্ব দিতে পর্ষদ কর্ত্তৃপক্ষ অনুপ্রেরক নিয়োগ করেছেন। কালের দীর্ঘ যাত্রায় বহুবার বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছে, বাংলার বালুচরী শাড়ি শিল্প। কিন্তু তার নান্দনিক সৌন্দর্যের আকর্ষণে নিশ্চিত বিলুপ্তির পথ থেকে তাকে কখনও ফিরিয়ে এনেছে রাজন্যবর্গের পৃষ্ঠপোষকতা কখনও বা শিল্পী মনের অকৃত্রিম ভালোবাসা। ইতিহাস তার সাক্ষী। অস্তিত্ব রক্ষার নানা সমস্যার মোকাবিলা করে,আজ এই রেশম শিল্প ও তার শিল্পীর জীবন ও জীবিকার সামগ্রিক উন্নয়নে ব্রতী পশ্চিমবঙ্গের খাদি পর্ষদ। বালুচরীর হারিয়ে যাওয়া গর্ব ফিরিয়ে আনতে বদ্ধ পরিকর, প্রোজেক্ট বালুচরী।

দহন বেলার কবি নজরুল

প্রবন্ধ সমগ্র ।। মতামত ।। সূচীপত্র

 প্রবন্ধ সমগ্র

দহন বেলার
কবি – নজরুল
পারোমিতা চট্টোপাধ্যায়

(২১শে মে ২০১২ সালে, আকাশবাণী কলকাতার ‘প্র্যাত্যহিকী’ অনুষ্ঠানে, সম্প্রচারিত হয়েছিল এই লেখা)

বাংলার কাব্য সাহিত্যের ঝিরিঝিরি মৃদু বাতাস আর রাখালিয়া মিঠে সুরের অপরাহ্নে হঠাৎ কালবৈশাখীর প্রমত্ততা নিয়ে, অরণ্য তোলপাড় করে, ধুলোর ঝড় তুলে, চারদিক সচকিত করে বাংলা কাব্য সাহিত্যে হাজির হয়েছিলেন নজরুল। তাঁর “এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরি, আর হাতে রনতুর্য”। তাঁর অগ্নিক্ষরা চোখে ছিল বিপ্লবের অশনি সংকেত| তিনি বিদ্রোহী কবি।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্ত। ইংরেজ সরকার যুদ্ধশেষে ভারতবাসীকে ‘স্বরাজ’ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যুদ্ধে তাদের পুরোদস্তুর সাহায্য নিল। কিন্তু যুদ্ধাবসানে সেই প্রতিশ্রুতি বেমালুম ভুলে গিয়ে চালু করল কুখ্যাত রওলাট আইন। সাম্রাজ্যবাদী ইংরাজের অত্যাচার, দেশ জোড়া নিপীড়িত মানুষের হাহাকার, জাতপাতের অন্যায় ভেদাভেদ, সর্বোপরি নিরন্ন মানুষের কান্নায় ভারতের আকাশ বাতাস ঘন বাষ্পীভূত। ঠিক এইরকম রুক্ষ, দগ্ধ দহন দিনে কবির আবির্ভাব, বাংলা কাব্য সাহিত্যে।

১৮৯৯ সালের ২৪শে মে বর্ধমানের চুরুলিয়া গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারের জন্ম নেন নজরুল। ডাক নাম দুখু মিঞা। পিতা ধর্মপ্রাণ ফকির আহমেদ ও মাতা জাহেদা খাতুন। সীমাহীন দারিদ্র্য ও অনিশ্চয়তার মধ্যেও তিনি পেয়েছিলেন মানবতার মহামন্ত্রের দীক্ষা ও দুঃখ জয়ের মহৎ উত্তরাধিকার। প্রখর-মেধা-নজরুলের জ্ঞান আহরণের তীব্র আকাঙ্খা থাকলেও দুঃসহ দারিদ্র্য তাঁকে বারবার সরিয়ে গেছে শিক্ষাঙ্গন থেকে। কখনো গার্ড সাহেবের বাড়ির চাকর, আবার কখনো রুটির দোকানের ‘বয়’, কখনো বালেটোর দলে গণ বেঁধে দিন কাটিয়েছেন। কিন্তু তাঁর জানা ও শেখার আগ্রহ থেমে থাকেনি। পড়েছেন কোরান, রামায়ণ, মহাভারত, ভাগবত, পুরাণ। উর্দু, আরবী, ফারসী, সংস্কৃত ভাষা শিখেছেন। 

সেই সুত্রে সান্নিধ্য লাভ করেছেন বহু বাউল, সুফী, ফকির ও সাধু সন্যাসীর। এইভাবে অনিশ্চিতের ঘাটে ঘাটে খেয়া ভেড়াতে ভেড়াতে এসে ভিড়লেন রানীগঞ্জের সিয়ারসোল্ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণীতে। সবে প্রি-টেস্ট দিয়েছেন, সেই সময়েই বেজে উঠল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের রণ-দামামা। ব্রিটিশ বাহিনীর বাঙ্গালী রেজিমেন্টে যোগ দিয়ে নজরুল পাড়ি দিলেন সুদুর রনাঙ্গনে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে ইংরেজ বাহিনীর বেঙ্গল রেজিমেন্টের বীর সৈনিক নজরুল দেশে ফিরলেন। যুদ্ধের রক্তাক্ত স্মৃতিতে হৃদয় ক্ষত বিক্ষত। বুকে পরাধীনতার জ্বালা। তাঁর গান, কবিতায় তাঁর সেই জ্বালা যেন অজস্র জ্বালামুখে লাভা উদগীরণ করতে লাগল। সদম্ভে ঘোষনা করলেন –          

'আমি বিদ্রোহী ভৃগু,

ভগবান বুকে এঁকে দেব পদচিহ্ন'।

এত জেহাদীর মুখের ভাষা! কিন্তু কার বিরুদ্ধে তাঁর এই জেহাদ? আসলে যেখানেই মানবতার লাঞ্ছনা দেখেছেন, দেখেছেন ধর্মের নামে ভন্ডামি ও ভ্রষ্টাচার, দেখেছেন অসাম্য, সীমাহীন শোষণ ও সাম্রাজ্যবাদীর নির্লজ্জ, নির্বাক অধিকার হরণ সেখানেই তার লেখনি আপসহীন।

তাই একাধারে যখন বুভুক্ষু মানুষের হাহাকার অন্যদিকে রাষ্ট্র নেতাদের 'স্বরাজ' নিয়ে রশি টানাটানি, ব্যথিতকবি প্রতিবাদে মুখর হন।

'ক্ষুধাতুর শিশু চায়না ‘স্বরাজ’,

চায় দুটোভাত একটু নুন।

বেলা বয়ে যায় খায়নিকো বাছা,

কচি পেটে তার জ্বলে আগুন'।

১৯২২ সালে প্রকাশ করলেন সাপ্তাহিক ‘ধূমকেতু’। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ‘ধূমকেতু’কে আশির্বাদ করে লিখলেন -

'আয় চলে আয় রে ধূমকেতু

আঁধারে বাঁধ অগ্নি সেতু

দুর্দিনের এই দুর্গশিরে

উড়িয়ে দে তোর বিজয়কেতন'।

বাংলার বিপ্লবীরা তাঁকে একান্ত আপন করে পেলেন তাঁর কবিতায়ে ও গানে। তাই নজরুল মহাবিপ্লবের পুরোহিত।অন্যায় জাতপাতের বিরুদ্ধেও তিনি তীব্র কষাঘাত হেনেছেন।

'জাতের নামে বজ্জাতি

সব জাত-জালিয়াত খেলছ জুয়া।

ছুঁলেই তোর জাত যাবে?

জাত ছেলের হাতের নয়তো মোয়া'।

কিংবা লিখছেন - ‘মানুষে রে ঘৃণা করি, ও কারা কোরাণ, বেদ, বাইবেল চুম্বিছে মরিমরি'?

নজরুল স্বপ্ন দেখতেন এক শোষণহীন, পরাধীনতাশূন্য স্বাধীন সাম্যবাদী সমাজের।

তিনি লিখেছেন -    

'গাহি সাম্যের গান

যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা ব্যবধান'।

কিন্তু বাস্তবে দেখেন মানবাত্মার সীমাহীন লাঞ্ছনা।

কবি সোচ্চারে সকলকে -                                                

'মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই নহে কিছু মহীয়ান'।

কখনও কখনও মনে হয় এবার কবি বোধহয় শ্রান্ত, যখন উচ্চারণ করছেন -                                                   'বন্ধুগো! আর বলিতে পারিনা,

বড় বিষ জ্বালা এই বুকে।

দেখিয়া শুনিয়া খেপিয়া গিয়াছি,

তাই যাহা আসে কই মুখে'।

পরক্ষণেই কম্বুকন্ঠে কবির ঘোষণা -

'...... আমি সেই দিন হব শান্ত

যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল

আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না

অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ -

ভীম রণভূমে রনিবে না।'

নজরুল যে কাজেই হাত দিয়েছেন, সে কাজেই উপচে পড়েছে তাঁর প্রাণ প্রাচুর্য। যেখানেই থাকতেন তাঁর অফুরন্ত প্রাণ শক্তিতে সেই স্থান আলোড়িত হত। কারাগারে বন্দী নজরুল গান লিখতেন আর রাজনৈতিক বন্দীর দল মহা উন্মাদনায় গাইত সেই গান –  

“কারার এই লৌহ কপাট,

ভেঙে ফেল্ কর্ রে লোপাট,    

রক্তজমাট শিকল পূজার পাষাণ বেদী।'                         

অথবা

'শিকল পরা ছল মোদের এই শিকল পরা ছল

 শিকল পরেই শিকল তোদের করব রে বিকল।'

তাঁর ‘অগ্নিবীণা’, ‘বিষের বাঁশি’, ‘দোলনচাঁপা’, ‘সর্বহারা’, ‘ভাঙার গান’ প্রভৃতি কাব্য গ্রন্থে দেশের লাঞ্ছিত ভাগ্যহত চাষী, মজুর, জেলে সকলেই যেন নিজেদের মর্যাদা খুঁজে পেল। লিখলেন বহু প্রবন্ধ, অজস্র সংগীত, কয়েকটি নাটক।

বাংলা সাহিত্যে নজরুল ইসলাম একটা ব্যতিক্রম| ঝিমিয়ে পড়া সুরের দেশে কাব্যে ও সঙ্গীতে তিনি যে প্রলয় ঝঙ্কার তুলেছিলেন তা তুলনাহীন। তিনি দহন দিনের সেই সমাজের গরলটুকু পান করে সাধনা করেছেন অমৃতের|

তাই তিনিই বলতে পারেন -

'আমি চিরবিদ্রোহী বীর,

বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির উন্নত শির'।

প্রবন্ধ সমগ্র ।। মতামত ।। সূচীপত্র

জীবনানন্দ দাশ
 প্রবন্ধ সমগ্র

অগ্রন্থিত নির্জনতার কবি জীবনানন্দ দাশ
উদয় শংকর দুর্জয়

'মাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে

কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে'

এই লাইন দুটি এখনো মানুষের মুখে মুখে ফেরে। উল্লেখিত পঙক্তিদ্বয় জীবনানন্দ দাশের মাতা রচিত আদর্শ ছেলে কবিতার অন্তর্গত যা কবি জীবনানন্দ দাশের আদর্শিক জীবনের সাথে সরাসরি মিলে যায়। পিতা সত্যানন্দ দাশ ও মাতা কুসুমকুমারী দাশের জ্যেষ্ঠ পুত্র আধুনিক বাঙলা কবিতার সফল সম্রাট কবি জীবনানন্দ দাশ।

এই অক্টোবর মাস অধুনা বাঙলা কবিতার প্রধান পুরুষ কবি জীবনানন্দ দাশের তিরোধানের মাস। কবির জন্য বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।   মাইকেল মধুসূদন এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরে যারা কবিতাকে ভাষা, ছন্দ, কাব্যময়তা দিয়ে কবিতাকে আধুনিক করতে চেয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯ - ১৯৫৪), সুধীন্দ্রনাথ দত্ত (১৯০১ - ১৯৬০), বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮ - ১৯৭৮), বিষ্ণু দে (১৯০৯ - ১৯৮২) ও অমিয় চক্রবর্তী অন্যতম। এই পাঁচজন আধুনিকতার স্বপ্নদ্রষ্টা কবিদের মধ্যে জীবনানন্দ দাশ সবচেয়ে বেশি আলোচিত এবং সুপঠিত। রাবীন্দ্রিক যুগ বা সমসাময়িক কবিতার প্রেক্ষাপট থেকে বেরিয়ে এসে জীবনানন্দ দাশ দুঃসাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন; লিখেছিলেন বনলতা সেন। নাটোরের আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে রূপসী বাঙলার সুদর্শন নায়ক জীবন বাবুর কাব্যকুটিরে ধরা দিয়েছিল মিস সেন। সেই থেকে জীবন বাবুর নাম উচ্চারিত হওয়ার সাথে সাথে বনলতা সেনের নামটিই উচ্চারিত হয়। বনলতা সেন এখন একটি নক্ষত্রের মতো, আকাশের গায় জ্বলে থাকা আলোর ফুল। আর আবেগ - অনুভূতি - ভালোবাসার কবিতা মানেই ‘আমারে দু’দণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন’। শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯২-১৯৭০) বলেছিলেন - 'জয়দেব -চণ্ডিদাস - বিদ্যাপতি - রবীন্দ্রনাথের উত্তরাধিকার যে আধুনিক বাঙলায় সম্পূর্ণ অপচিত হয় নাই, জীবনানন্দের কবিতা সেই আশ্বাসের বাণী বহন করে'।

জীবনানন্দের কবিতা মানেই এক অমৃত শব্দপাঠ; এক আত্মতৃপ্তির স্রোত বয়ে চলে পাঠকের চৈতন্যে। তখন বিংশশতাব্দীর শুরু আর রবির আলোয় আলোকিত কবিতা অঙ্গন; জীবনানন্দ দাশ পা দিয়েছেন কবিতার উঠোনে। প্রকাশিত হল প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরা পালক’ ১৯২৭ সালে কিন্তু কবি বা পাঠক মহলে তেমন হৈচৈ ফেলতে পারেনি তবে বাঙলা সাহিত্যের সর্বোপরি প্রামাণিক - ইতিহাসের রচয়িতা সুকুমার সেন ‘ঝরা পালক’ এ অন্তর্ভুক্ত ‘পলাতক’ কবিতার সমালোচনা করে বলেছিলেন ‘ঝরা পালক এর একটি কবিতায় দ্বিতীয় -তৃতীয় দশাব্দসুলভ পল্লী রোমান্সের - অর্থাৎ করুণানিধান -যতীন্দ্রমোহন - কুমুদরঞ্জন - কালিদাস - শরৎচন্দ্র প্রভৃতি কবি ও গল্প লেখকদের অনুশীলিত ছবি পাই’।

তিনি জীবনানন্দ সম্পর্কে আরও বলেছিলেন যেঃ ‘নূতন ইংরেজি কবিতার অনুসরণে যাহারা বাঙলায় কবিতা কম অবলম্বন করিলেন তাদের মধ্যে জীবনানন্দ দাশ প্রধান’। ইতিহাস খুঁজলে দেখা যায় আধুনিক কবিতার কারিগর যে পাঁচজন কবি জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯ - ১৯৫৪), সুধীন্দ্রনাথ দত্ত (১৯০১ - ১৯৬০), বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮ - ১৯৭৮), বিষ্ণু দে (১৯০৯ - ১৯৮২) ও অমিয় চক্রবর্তী তাঁরা সবাই ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন। সেই সাথে বলা যায় বাঙলা কবিতায় আধুনিকতার যে বাঁক সৃষ্টি হয়েছিল তা মূলত ইংরেজি আর ইউরোপিয়ান সাহিত্যের উৎস ধারা থেকে। সাথে সাথে স্মরণ করতে হয় বিংশ শতাব্দীর শুরুতে পাশ্চাত্যে কবিতায় আধুনিকতার নবযাত্রা ঘটিয়েছিলেন যে মহানায়কগণ তাঁদের মধ্যে এটারা পাউন্ড, টি এস এলিয়ট ও অমি লাওয়েল অন্যতম এছাড়া জন কিটস, ইয়েটস ও বায়রনের নামও উঠে আসে সমস্বরে। জীবনানন্দ দাশের ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি' প্রকাশের পড় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে একটি পত্র লিখেছিলেন -

‘তোমার কবিতাগুলি পড়ে খুশি হয়েছি। তোমার লেখায় রস আছে, স্বকীয়তা আছে এবং তাকিয়ে দেখার আনন্দ আছে।’

আবার এমনও বলেছিলেন কিছুটা তাচ্ছিল্য করে - ‘তোমার কবিত্বশক্তি আছে তাতে সন্দেহমাত্র নেই। – কিন্তু ভাষা প্রকৃতি নিয়ে এত জবরদস্তি কর কেন বুঝতে পারিনে।'

কাব্যের মুদ্রাদোষটা ওস্তাদিকে পরিহাসিত করে। বড় জাতের রচনার মধ্যে একটা শান্তি আছে যেখানে তার ব্যাঘাত দেখি সেখানে স্থায়িত্ব সম্বন্ধে সন্দেহ জন্মে। জোর দেখানো যে জোরের প্রমাণ তা নয় বরঞ্চ উল্টো’।     

ঘরমুখো নির্জনতার কবি জীবনানন্দ দাশকে বঙ্গীয় সাহিত্য সমাজে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বুদ্ধদেব বসু এবং অজিত দত্তের অবদান বহুগুণে বেশি। বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘কবিতা’, সঞ্জয় ভট্টাচার্য ও প্রেমেন্দ্র মিত্র সম্পাদিত ‘নিরুক্ত’, সঞ্জয় ভট্টাচার্য সম্পাদিত ‘পূর্বাশা’ প্রভৃতি পত্রিকাগুলো জীবনানন্দ নির্ভর হয়ে ওঠে। দীনেশরঞ্জন দাশ সম্পাদিত ‘কল্লোল’ এবং প্রেমেন্দ্র মিত্র, মুরলীধর বসু ও শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘কালি-কলম’ যা জীবনানন্দকে অনেক বেশি মূল্যায়ন করেছিল; উল্লেখ করতে হয় তখনকার সময় এই দুটি সাহিত্য পত্রিকা ছিল আধুনিক সাহিত্যের অগ্রদূত। সাহিত্যিক নীহাররঞ্জন রায় জীবনানন্দ দাশের কবিতা সম্পর্কে বলেন - ‘যে অল্প সংখ্যক কবির কবিকর্ম নিয়ে আমার এই গর্ব, সাম্প্রতিক বাঙলা কাব্যের গর্ব, জীবনানন্দ তার অন্যতম এবং সম্ভবত মহত্তম’।

কবি জীবিত থাকা কালীন মাত্র সাতটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল আর ঐসব কাব্যগ্রন্থে সর্বসাকুল্যে মাত্র ১৬২টি কবিতা স্থান পেয়েছিল। কবির অপ্রকাশিত গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধের কথা না হয় নাই লেখা হল কিন্তু শত শত কবিতা বহুকাল পর্যন্ত প্রকাশের অন্তরালে পড়েছিল। কবি জানলেন না প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ের গহন পথে আজ অবধি হেঁটে চলেছেন। অগ্রন্থিত নির্জনতার কবি লিখেছেন - ‘মিনারে মেঘ সোনালি চিলেরে তার জানালয় ডাকে’। কবি তাঁর তীক্ষ্ণ কল্পনা শক্তি দিয়ে হরণ করে এনেছেন সুদূর মিনারের মেঘ। এক বিকেলের আড্ডা ফেলে জানালয় দাঁড়িয়ে ডাকবেন কোনও সোনালি ডানার চিলকে, যে রোদ্দুর সব আলো ডানায় মেখে, মেঘকে নামিয়েছে মিনারের চূড়ায়।    

      'আমার জীবনে কোনও ঘুম নাই

      মৎসনারীদের মাঝে সবচেয়ে রূপসী সে নাকি

      এই নিদ্রা?

      গায় তাঁর ক্ষান্ত সমুদ্রের ঘ্রাণ - আবাদ সুখ

      চিন্তার পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন - বিমুখ

      প্রাণ তার ……'

                    এই নিদ্রা/ অগ্রন্থিত কবিতা

মৎসকন্যাদের মাঝে সবচেয়ে রূপবতী হোল নিদ্রা। সে নিদ্রার কথা ভেবেই কবি নির্ঘুম সমুদ্র-ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়েছেন। গোলাপি আভায় ঢাকা ধূসর মেঘ যেমন বোঝে না বিয়োগ-ব্যথা ঠিক তেমনি পাখি-মন, প্রজাপতি-শতদল কখনও ছুঁয়ে দেখে না বিষণ্ণ নিঃশ্বাস। কবি ‘পাখি’ কবিতায় জ্যোৎস্না ও শীতের মাঝে আনন্দ এবং হাহাকার অনুভব করেছেন। তবু তাকে চেয়েছেন এই শীতে, শোক বিহ্বল চোখে সে আসুক, শিহরণ জাগাক নিস্তব্ধ ঘাসের শরীরে, যেখানে জ্যোৎস্নারা ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে থাকে, অঘ্রানের বিকেলের রঙে আরও শূন্যতায় ভ’রে উঠলে রংচটা বাদামী পাখি অপেক্ষায় থাকে এক ঝাঁক উজ্জ্বল রোদের জন্য।

পাতা কুড়াবার দিন এসে অপেক্ষা করে ঘাসের উঠোনে। সোনামাখা ধান রুপোলি কারুকাজ ভুলে গিয়ে শুয়ে থাকে মাঠের উল্টো পিঠে। তবু কবি আহ্বান করেন, কেউ যেন এঁকে যায় অঘ্রানের বিকেলের ছবি। শিশির এসে মুছে দিয়ে যাক ভুল রঙের অনুজ্জ্বল কথামালা। “আমি এই অঘ্রানেরে ভালোবাসি - বিকেলের এই রং - রঙের শূন্যতা/রোদের নরম রোম - ঢালু মাঠ - বিবর্ণ বাদামি পাখি - হলুদ বিচালি। পাতা কুড়াবার দিন ঘাসে ঘাসে - কুড়ুনির মুখে নেই কোনও কথা’’। এই সব কোলাহল রেখে কবি পেরিয়ে যেতে চান সব জীবনের মানে পিছনে ফেলে। কিন্তু কবিতো নির্জনতার! কোথায় হারাবেন তিনি! নাকি কল্পনার মেঘে চড়ে সব অগোচরে দেখে যাবেন অঘ্রানের মাঠ, কার্ত্তিকের কুয়াশা, মাছরাঙার ঠোঁট, জ্যোৎস্নার অসীম বিল। কবি চলে গেছেন অরণ্যের পাতার ফাঁকের এক লোভী টুকরো আলোর পেছন পেছন।

    'চলে গেছি;

এ জীবন কবে যেন মাঠে মাঠে ঘাস হয়ে রবে

নীল আকাশের নিচে অঘ্রানের ভোরে এক

- এই শান্তি পেয়েছি জীবনে

শীতের ঝাপসা ভোরে এ জীবন

ভেলভেট জ্যাকেটের মাছরাঙা হবে

একদিন - হেমন্তের সারাদিন

তবুও বেদনা এল - তুমি এলে মনে

হেমন্তের সারাদিন - অনেক গভীর রাত -

অনেক অনেক দিন আরও

তোমার মুখের কথা - ঠোঁটে রং চোখে চুল -

এই সব ব্যথা আহরণে” 

                                     এই শান্তি/ অগ্রন্থিত কবিতা

    

    কবি ঝাপসা ভোর আর ভেলভেটের জ্যাকেট যেন মুড়ে দিলেন একে অপরকে। এমন করে গেঁথে দিয়েছেন জীবনের মানে। কবিতার সাথে প্রকৃতি, প্রকৃতির সাথে দেহ - মন, শীতের সাথে কুয়াশা-জ্যাকেট যেন মিলিয়ে দিলেন লাইনের পর লাইন। কবি কখনো বুনোহাঁসের পালকে পালকে উড়ে যেতে দেখেছেন জ্যোৎস্নার আলো, শবের জঙ্গল ছেড়ে নদী মাঠ খেয়া ঘাট ফেলে উড়ে চলেছে পাখি সব। কবে কোন কোমল স্থির নিরিবিলি পালকের রুপো দিয়ে বনের আঁধার বুনেছিল, কবি আজ এপারে বসে শুনতে পান বুনো মোরগের বুকে জেগে থাকা রাতের বিস্ময়। সব বিস্ময় কেটে গিয়ে জীবনানন্দের আলোয় আলোকিত হতে থাকবে আগামীর কবিতার শব্দ সম্ভার, রূপসী বাঙলায় কবি বার বার ফিরে আসবেন শিশিরের শব্দের মতন।

প্রবন্ধ সমগ্র ।। মতামত ।। সূচীপত্র

আমার ছেলেবেলার পুজো
 প্রবন্ধ সমগ্র

আমার ছেলেবেলার 

পুজো

সনোজ চক্রবর্তী

পূর্ব মেদিনীপুর, পঃ বাংলা

সনোজ চক্রবর্ত্তী পেশায় স্কুল শিক্ষকতা। বানিজ্য বিভাগে স্নাতকোত্তর। ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখি। মুলত গল্পকার হলেও কবিতাও লিখেছেন বেশ কিছু। প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন পত্র পত্রিকাতে। লেখালেখি ছাড়া অন্যতম নেশা অভিনয় ও নাটক পরিচালনা।

মার ছেলেবেলার পুজোপ্রায় ফি-বছর শারদোৎসবের সময় মা আমাদের ভাই বোনদের নিয়ে হাজির হতেন তাঁর বাবার বাড়ী অথাৎ আমাদের মামা বাড়ীতে। ফলত পুজো আসার আগে আগেই এক অপার আনন্দ পেয়ে বসত আমাদের। পুজোর মাস খানেক আগে, আমাদের এখানে বাজারে ঠাকুরদালানে নেপাল পোটিদার খড় দিয়ে ঠাকুরের কাঠামো বাঁধত। বাজার গেলেই একবারটি ঢুঁ মেরে আসতাম মন্ডপ থেকে। দাঁড়িয়ে থেকে দেখতাম কিভাবে খড়ের কাঠামো পাল্টে যেত মা-দূগ্গায়। বাড়ি ফিরে নেপাল পোটিদারকে নকল করতাম। পুকুরের পাড় থেকে মাটি নিয়ে দূগ্গা বানাতাম মেজদি আর আমি। মামাবাড়ি যাওয়ার আগে সে দূগ্গাকে সিঁড়ির তলায় লুকিয়ে রাখতাম যত্ন করে। পুজোর ছুটি শুরুর সপ্তা খানেক আগে আমাদের পুজোবকাশ শুরু হয়ে যেত। মা-দূগ্গা তাঁর ছেলেপুলে নিয়ে বাপের বাড়ি আসার জন্য হয়তো তখনও লটবহর বাঁধাছাঁদা আরম্ভ করেন নি কিন্তু আমার মা আমাদের নিয়ে হাজির হয়ে যেতেন তাঁর বাপেরবাড়িতে অর্থাৎ আমাদের মাতুলালয়ে। মামাবাড়ি বড় আমোদের,বড় প্রশ্রয়ের আশ্রয়। কেবল কেষ্ট ছাড়া মাতুলালয় কারো কাছেই কষ্টকর হয়নি কখনও। শুধু সঙ্গত আবদার নয়, অসঙ্গত আবদারের প্রকাশে "মামাবাড়ির আবদার" এই শব্দবন্ধটি মেজাজের সঙ্গে ব্যবহার হয়েছে আবহমানকাল। মামাবাড়ির প্রতি চুম্বকটানের আরো বড় একটি কারণ ছিল আমি আর আমার ছোটমামা সমবয়সী ছিলাম। মামাবাড়ি থেকে ফিরে কুকড়াহাটীর পুজোর গপ্প শুনতাম আর মন খারাপ হয়ে যেত। তখন আমাদের এলাকার পূজো বলতে কেবল বাজার কমিটির পুজো। আমার ঠাকুরদাদা শিক্ষক ছিলেন, বেশ

নাম-যশ ছিল। শোনা কথা রাষ্ট্রপতি পুরস্কার হাতছাড়া হয়েছিল কোন এক নিন্দুকের তৎপরতায়। বাজারে ঠাকুরদাদার একটা বই ও কাপড়ের দোকানও ছিল। বাজারের পুজোর প্রধান পুরোহিত ছিলেন আমার ঠাকুরদাদা। আমার এক পিশেমশাই ঐ পুজোয় চন্ডী পাঠ করতেন, প্রায় বীরেন্দ্র কৃষ্ণের আদলে। আমরা রেডিও শোনার মতো করে শুনতাম। ঐ পুজোর মন্ডপে আমাদের মতো দু-একটি পরিবার জায়গা পেত। বাকিরা মন্ডপের বাইরে। দু-এক বার আমরা ভাই বোনেরা ঐ পুজোয় থেকেছি। ঠাকুরের এতো কাছাকাছি হওয়ার চেয়েও আমাদের কাছে পুজোর সময় মামা বাড়ী যাওয়ার আনন্দই ছিল অন্য রকম।মামাবাড়ির দাদু কলকাতায় একটা বনেদী বাড়িতে পুজো করতে যেতেন। দশমীর পরের দিন আমি আর ছোটো মামা সকাল থেকে দাঁড়িয়ে থাকতাম বাসস্ট্যান্ডে। পুজো ফেরত দাদুর বোচকা বয়ে আনতাম ঘাম ঝরিয়ে। বোচকা থেকে বেরাত নারকেল নাড়ু, হাল্কা টোকচে যাওয়া সন্দেশ, ফল, আলতা, সিঁদুর, গামছা, কাপড় আরো কত কি। মায়ের জন্য বরাদ্দ হত শাড়ি আর আমাদের হাতে দেওয়া হত নারকেল নাড়ু, সন্দেশ আর ফল। তখন রাগ হত, কেন কার্তিক গনেশকে প্যান্ট-শার্ট দেওয়া হয় না! মামা বাড়ীর ওখানে পুজো নিয়ে উন্মাদনা কোন দিনই ছিল না। যদিও মামা বাড়ী থেকে দু-কিমি পায়ে হেঁটে এক বনেদি বাড়ীর পুজো দেখতে যেতাম ভাই-বোন মিলে। বাবা কিন্তু কোন দিন আমাদের ঐ মামা বাড়ী যাওয়ার আনন্দে বাদ সাধেন নি। দু-এক বছর ছাড়া মা কেও মামা বাড়ী যাওয়ার কথা মনে করিয়ে দিতে হয় নি। পরে বড় হয়ে বুঝেছি অধীকাংশ বছর পুজোয় আমাদের ভাই-বোনেদের নতুন জামা-কাপড় হত না। বাবা তাঁর সাধ্যের বাইরে বেরিয়েও পুরো পরিবারের গ্রাসাচ্ছাদন ও আমাদের লেখাপড়ার আয়োজন সম্পূর্ন করে উঠতে পারতেন না। তাছাড়া বর্ষার পর পর খোরাকির একটা অনটন দেখা দিত সংসারে। তাই মা প্রায় ফি-বছর আমাদের সরিয়ে নিতেন মামা বাড়ীর আনন্দ ঘন আশ্রয়ে, যেখান থেকে দু-কিমি দূরে মা দুগ্গা আসতেন সপরিবারে।

গ্রাম্য কুসংস্কার

প্রবন্ধ সমগ্র ।। মতামত ।। সূচীপত্র

 প্রবন্ধ সমগ্র
Mijanur Rahman.jpg

গ্রাম্য কুসংস্কার

একটি ব্যাধি
মিজানুর রহমান মিজান
বিশ্বনাথ, সিলেট, বাংলাদেশ

গ্রাম প্রধান বাংলাদেশ। গ্রামের অধিকাংশ মানুষ আজ ও অনেক ক্ষেত্রে অসচেতন। তাছাড়া শিক্ষিতের হার কোন কোন ক্ষেত্রে যদি ও বলা হয়ে থাকে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তথাপি প্রকৃত শিক্ষার হার আনুপাতিক হারে কম বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিক্ষিত মাত্রই সুশিক্ষিত ও স্বশিক্ষিত। এ শ্রেণীর আনুপাতিক হার এর কথা বলছি। সরকার ছাত্রীদের বেতন মওকুফসহ উপবৃত্তি চালু করে সত্যিই একটি প্রশংসনীয় ও গর্বিত উদ্যোগ নিয়েছেন। ফলশ্রুতিতে পূর্বের তুলনায় বর্তমানে গ্রামের স্কুলগুলিতে ছাত্রী সংখ্যা উল্লেখজনক বৃদ্ধি পেয়েছে। কারণ অনেক অভিভাবক কিছু দিন পূর্বে ও মেয়েকে স্কুলে পাঠানো বিভিন্ন কারণে অভিশাপ মনে করতেন। কিন্তু' এখন উপবৃত্তিসহ বেতন মওকুফের ফলে স্কুলে পাঠাতে বা শিক্ষা লাভে আগ্রহী। শিক্ষাক্ষেত্রে এটা উল্লেখযোগ্য বা আশানুরূপ ফল প্রাপ্তির একটা অংশ। তথাপি দেশের শিক্ষার্থীর একটা বিরাট অংশ প্রাথমিক বা মাধ্যমিক বিপর্যয়ে ঝরে পড়ে। ঝরে পড়া অংশ বা অল্প শিক্ষিত ছেলেমেয়েদের মধ্যে কুসংস্কার বাসা বেঁধে আছে গ্রামাঞ্চলে। গ্রামের মানুষের মধ্যে অসংখ্য সমস্যা বিদ্যমান। তার অন্যতম একটি সমস্যা হচ্ছে কুসংস্কার। গ্রামের কুসংস্কারগুলো মেয়েদের মধ্যে বহুল পরিমাণে বিরাজমান। কুসংস্কারকে ওরা ধর্মীয় ফরজ কাজের মত আঁকড়ে ধরে। ফলে ধর্মীয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিরাট অন্তরায়। 
গ্রামে এক সময় কঠোর নিয়ম চালু ছিল সোমবারে মেয়েরা বাপের বাড়ি হতে স্বামীর বাড়ি আসবে না। মেয়ের মা এক্ষেত্রে সাধারণত প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবেই। এ যে কুসংস্কার তা বুঝানো যাবে না। অনেক ক্ষেত্রে আমি দেখেছি মারাত্মক জটিলতার সৃষ্টি করবে। এমন ও রূপ ধারণ করে যা বিচ্ছেদ পর্যন্ত গড়াবে। কিন্তু পরিশেষে এ ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা হবে। পূর্ব পুরুষরা এ কাজে উৎসাহিত করেছেন। তা পালনে অদ্যাবধি অভ্যাস' অনেক পরিবার। এক্ষেত্রে একজন শিক্ষিত ব্যক্তি যতই বুঝাবার চেষ্টা করবে, ততই বিপদ ও ঝক্কি ঝামেলা পোহাতে হবে। তবে আশার কথা বর্তমানে অনেকটা দূরীভূত হয়েছে।
কয়েক বৎসর পূর্বে ও গ্রামাঞ্চলে চৈত্রের শেষে গুরুতর রোগ মুক্তি উপলক্ষ্যে এক প্রকার “রুট” নামক রুটি তৈরী করে বণ্টন করা হত। রুটিটি ছিল অত্যন্ত মজাদার ও ব্যয়বহুল। এটা ছিল গৃহস্থের'র গরুর পরিমাণের উপর নির্ভরশীল। গৃহস্থের যে কয়টা গরু ছিল ছোট বড় ততটা রুটি তৈরী হত। এ রুটি তৈরী করতে উক্ত সময় গ্রামময় হিড়িক পড়ে যেত। প্রতিদিন একাধিক পরিবারে রুটি তৈরী হত। গ্রামের যুব সম্প্রদায় এ কাজে ব্যস্ত থাকতেন প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত। মুরবিবয়ানরা দিক নির্দেশনা প্রদান করতেন। খেতে ও অনেক সুস্বাদু ছিল। কিন্তু' বর্তমানে গ্রামাঞ্চলে গরুর সংখ্যা পূর্ব থেকে অনেক কমে গিয়াছে এবং অনেক পরিবারে গরু থাকলে ও আজ আর রুট নামক রুটি তৈরী মোটেই হয় না। রুটের কথা মানুষ ভুলেই গেছে। বয়স্কদের মুখ থেকে অনেক সময় শুনি আক্ষেপের সুরে, ‘বহুদিন হয় উহার স্বাদ থেকে বঞ্চিতের কথা’।
ছোট শিশুর দাঁত পর্যায় ক্রমে পতিত হয়ে আবার নূতন দাঁত গজায়। পড়ন্ত দাঁত কাক দেখলে নূতন দাঁত উঠবে না এ বিশ্বাস অনেকের মধ্যে বিদ্যমান। পোকায় খাওয়া আম খেলে শিশুরা সহজে সাঁতার শিখতে পারবে, পারা যায়। সুতরাং শিশুকে পোকায় খাওয়া আম খেতে প্রতিযোগিতায় নামানো হয়। 
কোথাও যাত্রা কালে পিছন থেকে ডাকা অমঙ্গল। জরুরী কিছু ফেলে গেলে ও অমঙ্গলের লক্ষণ। কথা হল জরুরী, এমন কি যে কার্যোপলক্ষ্যে যাত্রা শুরু সে জিনিষ ফেলে গেলে ভুল বশত: ফিরে এসে নেয়াটা অমঙ্গলের লক্ষণ বিদ্যমান। এক্ষেত্রে যুক্তি কতটুকু তা ভেবে কুল কিনারা পাই না। 

আমি এক দিন ভীষণ বিপদে পড়ে যাই পথিমধ্যে এক লোকের অদ্ভুত আচরণে। তার কথা হল ওর ডান পাশ দিয়ে কেহ যেতে পারবে না। জানিনা তিনি কতটুকু জীবন চলার পথে এ নিয়ম মেনে চলতে পারেন। অনেক আছেন কোথাও যাত্রাকালে গৃহের দরজাকে সালাম দিয়ে যাত্রা শুরু করেন। ফলশ্রুতিতে নাকি গৃহে নিরাপদে ফিরে আসার অভয় বার্তার একটি সুলক্ষণ বা নিশ্চয়তার অনেক গ্যারান্টি। চলার পথে সকল বিপদ আপদ থেকে মুক্তির পূর্ণ অবলম্বন। যাত্রাকালে শূন্য কলসী দর্শন অমঙ্গল আশঙ্কা। এক্ষেত্রে অনেকে অনেক প্রকার অশালীন উক্তি বা আচরণ করে থাকেন। রাত্রিকালে ঘর থেকে অনেকে টাকাপয়সা লেনদেন করেন না, লক্ষই চলে যাবার ভয়ে বা অজুহাতে। কিন্তু সর্বক্ষেত্রে জীবনের কি এ নিয়ম যথাযথ পালনের মাধ্যমে পরিচালিত হতে পারেন এটাই আমার জিজ্ঞাস্য? রবি ও বৃহস্পতিবার বাঁশ কাটতে মানা। সন্ধ্যার পর ঝাডু দিয়ে আবর্জনা বাহিরে ফেলতে নেই। রাত্রি বেলা আয়নায় মুখ দর্শন নিষিদ্ধ। গৃহস্থ' খাবার গ্রহণ কালে ভিক্ষুক দরজায় দাড়িয়ে ভিক্ষা চাইলে দিতে মানা। ছোট বড় কেহ যদি কঠিন অসুখে ভোগে দীর্ঘদিন তবে রোগীর রোগমুক্তি হবে কি না, তা জানার উদগ্র আগ্রহ নিয়ে সন্ধ্যার পর তিনজন মহিলা (একজন বিধবা, একজন বিবাহিত, একজন অবিবাহিত মহিলা) তিন রাস্তার সংযোগ স্থলে আড়ালে দাড়িয়ে ঠিকবাজি বা আলামত প্রাপ্তির উদ্দেশ্যে নীরবে কিছুক্ষণ বসে থাকেন। ঐ সময় ঐ রাস্তা দিয়ে যাতায়াতকারী লোকদের কথাবার্তা থেকে ঠিকবাজরা ধারণা পেয়ে থাকেন রোগীর রোগ সম্পর্কে। আমি ১৯৯৭ সাল থেকে উভয় পায়ের হাটুঁর জয়েন্টে মারাত্মক ও ভীষণ যন্ত্রণায় কাতর। এ রোগ আমাকে যে কষ্ট ও জ্বালা দিচ্ছে তা একমাত্র আল্লাহ ও আমি ছাড়া কেহ অনুধাবন করতে পারবে না। বুঝতে পারবে যদি আমার মত এ জাতীয় রোগে কেহ আক্রান্ত হয়ে থাকেন। অনেক ডাক্তার, ঔষধ পত্র ব্যবহার করে কোনো ফলাফল প্রাপ্তি হচ্ছে না বিধায় আমার মা, স্ত্রী অসির একটিবার পীর ফকিরের নিকট যেতে। কিন্তু আমার কোন সময়ই পীর ফকিরের (প্রকৃত আলীম ব্যতীত) নিকট যেতে বা ওরা কিছু করতে পারবে বলে বিশ্বাস নেই। তবু ও শেষ পর্যন্ত মায়ের পীড়াপীড়িতে এক দিন রওয়ানা হলাম এক মহিলা পীরানীর নিকট। তিনি নাকি রোগীর সব কিছু বলে দিতে পারেন। এমন কি বলে দেন হিসেবে অনেক লোকের যাতায়াত তথায় হয়। মহিলার বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হলাম সকাল দশটায়। পেয়ে গেলাম সেখানে আমার মত দু’জন পুরুষ রোগী। আর বাকি সাতজন রোগী সবাই মহিলা। রোগীর পরিমাণ কমপক্ষে ধীরে ধীরে বর্ধিত হয়ে ২৫/৩০ জনে উন্নীত হল। ধারাবাহিকতায় পীরানী প্রথম কিস্তি দশজন রোগীর আর্জি নিয়ে (তাদের ভাষায়) মোরাকাবায় বসলেন। একেক করে বলতে লাগলেন প্রত্যেকের মনের অভিলাষ। আর রোগীরা বলতে লাগলেন ঠিক ঠিকই পীরানী বলে যাচ্ছেন তাদের হৃদয়ের কথা, মনের অভিব্যক্তি। সবাইকে তাবিজ কবজ দিলেন নিলেন তার বিনিময়ে টাকা পয়সা যার যার রোগ বুঝে পথ্যের মত। দ্বিতীয় দফায় প্রথম ক্রমিকে আমি তারপর অপর দু’পুরুষ এর সর্বশেষে নিলেন আর সাতজন মহিলা রোগীর আর্জি। বসলেন মোরাকাবায়। ডাক পড়ল আমার। তিনি বলে যাচ্ছেন আমার মাথা ঘুরে, বুকে পিঠে বেদনা, কোমর বেদনা ইত্যাদি। কিন্তু একটিবার ও বললেন না আমার হাঁটুর অসুবিধা বা রোগের কথা। কারণ হল আমাকে দেখতে সুস্থ অনুভূত হয়। কিন্তু আমি হাঁটু মোটেই ভাঁজ করতে পারি না। চেয়ার ব্যতীত বসতে পারি না। দেখতে পারছেন না বা আমি পূর্বে কিছুই বলিনি বিধায় বলা সম্ভব হচ্ছে না। আমি জবাব দিলাম আমার রোগের বা উদ্দেশ্যের সাথে সামঞ্জস্য হচ্ছে না। তিনি জবাব দিলেন বুঝতে পারছি না আপনার সব কিছু আমি ঝাপসা দেখছি। যাহোক আমাকে বাদ দিয়ে ক্রমান্বয়ে পরবর্তী পুরুষদের বেলা ও একই রূপ। অর্থাৎ ওরা জবাব দিলেন তাদের রোগের বা উদ্দেশ্যের সাথে মিল হচ্ছে না।

অত:পর ঐ দু’ব্যক্তির বেলা ও বলা হল আপনাদের সব কিছু অন্ধকার দেখছি। তবে পরবর্তী রোগীদের সব কিছু তিনি বলে দিলেন এবং রোগীরা ঠিক ঠিক বলে চলেছেন। শেষ মুহূর্তে আমরা পুরুষদের বলা জবাব হল জানি না আপনাদের ভাগ্য মন্দ না তিনির ( পীরানীর) ভাগ্য মন্দ। যাহোক অন্য একদিন আপনারা আসুন দেখা যাবে। কি আর করা বিফল মনোরথ হয়ে ফিরে আসলাম। তবে এখানে যা লক্ষণীয় তাহলো মহিলাদের বেলা কিছু কমন কথা বললেই তাদের মনের কথার সাথে মিলে যায়। যেমন ‘আপনার খন্নির দোষ, চালানের মুখে পড়েছেন, মাথা ঘুরায়, তলপেটে বেদনা, একটি মহিলা আপনার স্বামীর প্রতি আগ্রহী, স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ে করার বাসনা ইত্যাদি। অপর দিকে মহিলারা পীরানীর নিকটে গিয়েই শুরু করেন বলাবলি কি উপলক্ষ্যে গমণ

অথবা অপর মহিলার সাথে আলাপ জুড়ে দেন, আমি এসেছি বোন আমার মেয়ের বিবাহের অনেক আলাপ আসে কিন্তু ফিরে যায়, আমার স্বামী সর্বদা অন্যমনস্ক থাকেন, স্বামী সংসারের প্রতি উদাসীন ইত্যাদি। রোগী মেয়েদের মুখ থেকেই পীরানী পেয়ে যান আগমণের হেতু বা কার্যকারণ। সুতরাং রোগ সম্পর্কে বলতে পীরের কোন প্রকার প্রতিবন্ধকতা থাকে না। 

মহিলার বাড়ি থেকে বের হয়ে খবর পেলাম উক্ত গ্রামে আরেকজন নব্য ছেলে পীর হয়েছে মাস খানেক হবে। আমরা তিনজন পুরুষ পরামর্শ করে ঐ সময়ই রওয়ানা হলাম পীরের বাড়ি অভিমুখে। সেখানে ও লক্ষ্য করলাম মহিলাদের সংখ্যাধিক্যতার। অর্থাৎ পুরুষ রোগী নেই বললেই চলে। বেশ কিছু সময় বসতে হল সারির মাধ্যমে পীরের সাক্ষাৎ পেতে। তাই করলাম। ইত্যবসরে পীর সাহেবের পিতা আমাদেরকে আপ্যায়ন করলেন পান, সুপারী ও সিগারেট পরিবেশনের মাধ্যমে। আমরা তা সানন্দে গ্রহণ করলাম। যেহেতু আশেপাশে কোন দোকান ছিল না বলে পান সুপারী থেকে বঞ্চিত ছিলাম অনেকক্ষণ যাবত। এক সময় পীরের সাহচর্য পেতে সক্ষম হলাম। পীর সাহেব আমাকে বললেন, আমার মাথা ঘুরায়, শারীরিক দূর্বলতা ইত্যাদি। কিন্তু আমি যে উদ্দেশ্যে গিয়েছিলাম তার ধারে কাছে ও যেতে সক্ষম হন নাই। তথাপি পীর সাহেব আমার হাতে একটি তাবিজ ধরে দিলেন যা পূর্ব থেকে লিখিত অনেকগুলির মধ্যে একটি। অপর সঙ্গিদ্বয় এমতাবস্থায় বিফল হয়ে ফিরে আসলেন। বাহিরে এসে পথ চলতে চলতে তাবিজ খুলে দেখলাম হ-য-ব-র-ল কিছু আরবী লিখা। দিনটা খসে পড়ল জীবন চলার পথ থেকে বিস্মৃতির পথে। সাথে অর্থনৈতিক ও শারীরিক পরিশ্রম। রাতে পায়ের ব্যথায় ঘুম হল হারাম। পীর সাহেবদের এ হল কেরামতি। কিন্তু আমি অর্জন করলাম এ বিরাট তথ্য ও তত্ত্ব। 

মেয়েরা মায়ের জাত। আবার একটা প্রবাদসম ‘তাদের অন্তর অত্যন্ত কোমল’। তথাপি মানুষের মন বড়ই সন্দেহ প্রবণ। কথায় আছে ‘সন্দেহ প্রবণ মন, আঁধার ঘুচে না কখন’। সন্দেহ নামক বস'টি যার অন্তরে একবার স্থান লাভ করেছে তা থেকে পরিত্রাণ প্রাপ্তি অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ব্যাপার। পীর সাহেবরা (প্রকৃত আলীম ব্যতীত) সহজ সরল মেয়েদের মধ্যে একটি সন্দেহের বীজ বপন বা রোপণ করে অনেক সংসারে আগুন জ্বালিয়ে দেন। যে আগুনে পুড়ে সোনার সংসার ধ্বংস হয় তার হিসেব আমরা রাখি না। অনেকটা থেকে যায় অজ্ঞাতে। যেমন স্ত্রী গেলেন রোগ সারাতে পীর সাহেব বলে দিলেন আপনার স্বামী একটি বাড়িতে যান ঘন ঘন। দ্বিতীয় বিয়ে করার সম্ভাবনা। অথবা একটি মেয়ে আপনার স্বামীর প্রতি আগ্রহী। কিন্তু এক্ষেত্রে হয়ত স্বামী প্রবল ঘুণাক্ষরে ও এ জাতীয় কাজের থেকে অনেক দুরের বাসিন্দা। কিন্তু স্ত্রী এ জাতীয় কথাকে সঠিক ও বিশ্বাস করে শুরু করলেন দৌড় বিভিন্ন রূপে। কারণ কোন স্ত্রীই চায় না স্বামীর অংশে ভাগ দিতে বা বসাতে। সুতরাং স্ত্রী ঐ বাড়ির প্রতি, সংসারের প্রতি, লোকের প্রতি সর্বোপরি।

স্বামীর প্রতি সন্দেহ প্রবণতার মাধ্যমে সাংসারিক সব কিছু তুচ্ছ করে গুরুত্ব দিলেন ধ্যান ধারণায়, চিন্তা চেতনায় উল্লেখিত ব্যাপারটিকে। কেমন করে স্বামীকে বশে আনা বা রাখা যায়। শুরু হল এখানে ওখানে যাতায়াত। অনেকটা জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে স্বামীর। এতে একদিকে অর্থ ব্যয়, অপর দিকে সংসারের প্রতি একটা উদাসীনতা। মনে সর্বক্ষণ স্বামীকে বশে আনা বা রাখা। আমি এসব ও প্রত্যক্ষ করেছি এ ধরণের অনেকক্ষেত্রে স্বামীর প্রতি সরাসরি বাক্য ছুড়ে দেয় স্ত্রী, আপনি এখানে ওখানে যান? এ থেকে শুরু হয় দ্বিধা, ধন্ধ। এমন কি বিচ্ছেদ পর্যন্ত গড়ায়। অপর দিকে পীর সাহেব পথ্য দানের মাধ্যমে তিনি হচ্ছেন চর্বিদার। বৃদ্ধি হচ্ছে মোটা, তাজা। খেলাটা শুরু না করলে তিনির কাছে লোক যাতায়াত হবে না, অর্জিত হয় না তিনির টাকা রোজগারের ব্যবস্থা। এ প্রকৃতির অনেক পীর সাহেবকে প্রত্যক্ষ করেছি দু’চার বৎসর পীর হয়ে পরবর্তীতে অন্য পেশার মাধ্যমে জীবিকার্জন করতে। পীর যদি সত্যিই পীর হয়ে থাকেন তবে কেন পেশার পরিবর্তন? দীর্ঘ দিন কেন থাকে না পীরের কেরামতি? অর্থাৎ যে ক’দিন মানুষকে প্রতারণা করা যায় ততদিন পীর এবং রোগীরা যখন প্রতারণা বুঝে ফেলে তখনই চলে যায় পীরালী। কিন্তু এ অল্প দিন পীর ব্যবসার মাধ্যমে অনেক অনেক সংসারে আগুন জ্বালিয়ে তিনি হন ক্ষান্ত। এ আগুন জ্বলে কিন্তু অনির্বাণ লোক চক্ষুর অন্তরালে, অলক্ষ্যে দিনের পর দিন, চিরদিন। অপর দিকে শুধু পীর সাহেবকে দোষ দিয়ে লাভ কি? আমি, আমরা না গেলে - বিশ্বাস না করলে, পীর কি করে আমাকে নিয়ে যাবে? সব নষ্টের মুল আমরাই। আমরা বিশ্বাস করি বলেই পীর সাহেব ধোঁকা দেবার প্রয়াস পান, ধোঁকায় তৃপ্ত হন, তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জিত হয়। (সব নয়) মহিলা শ্রেণী এ পক্ষের বেশী অনুসারী। তাদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে বুঝাতে হবে। বুঝাতে সক্ষম হলে অবশ্যই একটি সুফল বয়ে আসবে, পাবো এটা নিশ্চিত করে বলা যায়। 
এক লোক সুদীর্ঘ ১৪ বৎসর প্রবাস জীবন কাটায় স্ত্রী সন্তান তথা পরিবারের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের নিমিত্তে। আমি লক্ষ্য করেছি ঐ লোকটি না খেয়ে না পরে টাকা পয়সা পাঠিয়ে দিত স্ত্রী সন্তানের জন্য। তার কথা ছিল যদি আমি না খেয়ে না পরে স্ত্রী সন্তানকে ভাল ও উন্নত বস্ত্র পরিহিত করাতে পারি এটাই সুন্দও ও সার্থক। কিন্তু জানি না কোন অপরাধে স্ত্রী স্বামীকে এ জাতীয় কার্যের মাধ্যমে প্রবাস ছাড়া, সংসার ছাড়া, সন্তান থাকাবস্তায় সন্তানবিহীন অবস্থায় দিনাতিবাহিত করছে। সোনার সংসারটা তছনছ করে লোকটি বিপর্যস্ত অবস্থায় বিচ্ছেদ পর্যন্ত গড়িয়েছে। তারপর ও স্বামী ছিল উদগ্রীব স্ত্রী যদি ভুল বুঝতে পারে বা আসার দৃঢ়তা প্রকাশ করে, তবে একটি পথের সন্ধান বা সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে স্বামী তার চাচাত ভাই, ভাতিজা সঙ্গে নিয়েছে যে কারো সঙ্গ ধরে আসার উপলক্ষ্য মনে করে যদি ইচ্ছুক হয়। এখানে স্ত্রী কোন সুযোগ নেয়নি। বরং তারই (স্ত্রী) সম্মুখে তার পিতা, ভাই উদ্ধত আচরণ প্রদর্শন, এমন কি হুমকি প্রদান করে। তারপর ও স্বামী হাল ছাড়ে নাই। সে (স্বামী) ভেবেছে হয়ত অন্য কোন পন্থায়, সুযোগে স্বামীকে একা পেয়ে সুযোগ নিতে চায়। একা সম্মুখস্থ হয়েছে। চেয়েছে টাকা। যে আসবে না তাকে আনার কথা বলা বা প্রচেষ্টা হবে নির্যাতন তুল্য ভেবে তৎক্ষণাৎ টাকা প্রদানে সম্মতি এবং টাকা যথারীতি প্রদেয়। মোশাররফ হোসেন বিষাদ সিন্ধুতে সীমারের কার্যকলাপে যথার্থ বলছিলেন, ‘অর্থ! রে পার্থক্যই অর্থ! তুই সকল অনর্থের মুল’। এ জগতে যে যে বা যারা সীমারসম পাষন্ড হয়ে টাকাকে অধিক গুরুত্ব দেয়, ওরা কি চায়সহজেই বিজ্ঞজনের অনুধাবন যোগ্যতায় ধরা পড়ে, পড়বে। তা পাঠকের উপর ন্যস্ত। এখানে ও কথা ছিল না যদি পরবর্তীতে আসার ইচ্ছা ব্যক্ত না হত। ‘সময়ের এক....অসময়ের দশফোঁড়’ এরম ত স্বামী প্রবর ততদিনে বিয়ে করে সম্মুখ পানে এগিয়ে যাবার যাত্রায় সামিল। স্বগতোক্তি স্বরূপ উচ্চারিত হয়, ‘এখন কেন কান্দ গো রাই, আগে কি মনে ছিল না’।
গ্রামে সন্তান জন্মের পর মায়েরা আজো জাল বা বিভিন্ন লতাপাতার অংশ বিশেষ ইত্যাদি আঁতুড় গৃহে বা রুমে লটকোয়ে রাখেন, রুমটি বন্ধ রাখার পক্ষপাতী। জালের টুকরো রাখেন লটকোয়ে জিন বা শয়তানের আছর থেকে পরিত্রাণের আশায়। আগুন জ্বালানো হয় প্রত্যেক দরজায় শয়তান নাকি আগুনকে ভয় পায়। বাচ্চাকে অনেক দিন বের করতেন না রোগ থেকে বাঁচার একমাত্র উপলক্ষ্য মনে করে। অনেক  মাকে বুঝানো অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ব্যাপার শাল দুধ শিশুকে খাওয়াতে। তাদের অভিমত শাল দুধ শিশুর জন্য বিষসদৃশ। তবে আশার কথা হলো বর্তমানে অনেকটা দূরীভূত হয়েছে বিভিন্ন প্রকার প্রচারণার পরিপ্রেক্ষিতে।
গ্রামের অশিক্ষিত বা অল্প শিক্ষিত মানুষের অনেকের মধ্যে এ ধরণের শত শত কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস বিরাজমান। জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এ সমস্ত কুসংস্কার বিশ্বাস করে মিথ্যা ও ক্ষতিকর অনেক রুসুম বা রেওয়াজকে বাধ্যতামূলক পালন করার ফলে অনেক ক্ষেত্রে মারাত্মক জটিলতার সৃষ্টি করে প্রতিবন্ধকতার মাধ্যমে সমাজকে প্রগতির পথকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়ে মারাত্মক বিঘ্নের সহায়ক। সঠিক ও পূর্ণ ইসলামী আকিদার অভাবে সমাজ সংসারকে সঠিক দিক নির্দেশনা থেকে বঞ্চনার ফলে একটি সুন্দর, সুস্থ জীবনকে ধ্বংসের পথে এগিয়ে নিয়ে যায়। সুতরাং এ ব্যাধি আক্রান্ত সমাজকে নিরক্ষরতার মতো অভিশাপ থেকে রক্ষা কল্পে রেড়িও, টিভি এমন কি পাঠ্য পুস্তকে প্রবন্ধ অন্তর্ভুক্ত করে অভিযান পরিচালনা অত্যন্ত জরুরী। ইসলামী আকিদার পূর্ণ প্রচার ও প্রসারতা কাম্য নিরন্তর।  

তোমার অসীমে

প্রবন্ধ সমগ্র ।। মতামত ।। সূচীপত্র

 প্রবন্ধ সমগ্র

তোমার অসীমে

প্রাণমন লয়ে

অনিমা ভট্টাচার্য্য

ডালাস, টেক্সাস

চারদিকের কোলাহলের মাঝে মনকে এক এক সময় বিশ্রাম দিতে ইচ্ছে করে। কোলাহল থেকে সরিয়ে এনে মন চিন্তার গভীর দেশে নিজেকে নিমজ্জিত করতে চায়। মন ভাবে নিশীথে, নিরজনে – এ জগতে কত কি চাইবার ছিল – তাও চাওয়া হ’ল না। “কত যে বলার ছিল, হল না কিছুই বলা; কত যে চাওয়ার ছিল হ’ল না কিছুই চাওয়া ...... “এই অতৃপ্তি, দুর্নিবার আকাঙ্খার মাঝেই কাটে জীবন – মন তার ভার বয়ে বেড়ায়।

যাদুকরের যাদুতে মন মেতেছিল, নৃত্য গীতের তালে তালে মন নেচেছিল এক সময় – এখন সেই যাদুকর ও নেই, নৃত্যগীতের তালের গতিও নিস্তেজ হয়ে আসে। কোথায় যেন সব কিছুর তাল কেটে যায়।

অন্তরে দ্বন্দ্ব, বাইরেও দ্বন্দ্ব – কিন্তু কেনো এত দ্বন্দ্ব তার উত্তর কে দেবে। ‘তুমি’ ‘তুমি’ আর ‘আমি’ ‘আমি’ এই যে বেড়া গড়ে তুলেছি ‘তোমার’ ‘আমার’ মাঝে, এই বেড়াইতো মনের সহজ গতিকে অসহজ করে তোলে। তার থেকেই সৃষ্টি হয় দ্বন্দ্বের। সামাজিক জীবনের নিয়ম কানুন আপাতদৃষ্টিতে সেই দ্বন্দ্বের খানিকটা সমাধান করতে চেষ্টা করে, ক্ষণিকের জন্য সরে গেলেও আবার সুযোগ পেলেই যেন সে মাথাচাড়া দিয়ে বেরিয়ে আসে। তাই ধর্মপ্রাণ মহাঋষিরা বলেছেন, যতই আনন্দ করো, রূপরসের মাধুরী যতই পান করো না কেনো ‘দুঃখ তোমার ঘুচবে না যতক্ষণ না  ‘তোমার’ ‘আমার’ মধ্যে যে মিথ্যা প্রাচীর খাড়া করেছ তাকে ভেঙে ফেলতে পারছো। তোমার সুখ, তোমার দুঃখ যে  কেবল তোমারই তা নয় – তা আমারও। এ কেবল সহানুভূতির কথা নয়, compassion ও নয়, empathy ও নয়, এটি হ’চ্ছে ‘একাত্মবাদের’ মূল কথা। একাত্মবাদের মূল চেতনা হচ্ছে ‘তোমার’ ‘আমার’ ‘সত্তার’ একই রূপ – অনন্ত সচ্চিদানন্দের রূপ। এটি কেবল theoretical level এর জ্ঞান নয় – এটি অনুভূতির ব্যাপার। এই চেতনাকে উপলব্ধির স্তরে আনতে হবে। 

‘যুক্তিটা’ এখানে বড় কথা নয় – এখানে উপলব্ধির গভীরতাটাই বড়ো – where logic fails, awareness in the intuition succeeds.

শুধুমাত্র উপলব্ধির পর্য্যায়ে রাখলেই হবে না। সেই উপলব্ধির সঙ্গে মিশ্রণ হবে “আনন্দের”। সেই ‘আনন্দ’ প্রকাশিত হবে সকল কর্মে, সকল ধর্মে। “সকল কর্মে সকল বাক্যে প্রকাশিবে তব আরাধনা...”।

এই হবে জীবনপথের সাধনা, এ যেমন সত্য, তেমনই আনন্দোজ্জ্বল।

‘যুক্তি বিদ্যা’র সঙ্গে ‘উপলব্ধি’র একটি বিপরীত সম্পর্ক রয়েছে। যুক্তিজ্ঞানকে ‘খন্ডিত’ করে আর ‘উপলব্ধি’ অখন্ড  সত্যকে জানার কথা বলে। ‘খন্ডিত সত্য’ ‘সোনার পাথরবাটির’ মতনই অসম্ভব ধারণা। তাই যা ‘সত্য’ তাই ‘পূর্ণ’, তাই ‘একক’ – ‘পূর্ণমিদং পূর্ণমদঃ পূর্ণাৎ পূর্ণমুদচ্যতে ......’।

এই পরিপূর্ণ ভাবটি উপলব্ধি করার মধ্যে ‘আনন্দ’ ‘আছে’, ‘বিমল প্রশান্তি’ও আছে। তাই কবিগুরু বললেন, ’তোমার অসীমে প্রাণ মন লয়ে যতদূর আমি যাই, কোথাও দুঃখ, কোথাও মৃত্যু, কোথা বিচ্ছেদ নাই ...’। আমাদের এই সসীমতাকে অসীমতার মাঝে ডুবিয়ে দিতে পারা আর কোলাহল দ্বন্দ্বময় জীবন থেকে নিজেকে মুক্ত করা – একই কথা, এজন্যে গীতায় শ্রীভগবান অর্জুনকে দ্বন্দ্বহীন চেতনার কথা বললেন,

           “নির্দ্বন্দ্বো, নিত্যসত্ত্বস্থো,

            নির্যোগক্ষেম আত্মবান্ ......”

এতেই মনের প্রশান্তি, মায়াময়লীলার সমাপ্তি, আর আনন্দলোকের প্রাপ্তি !!

“শরৎ, তোমার শিশির-ধোওয়া কুন্ডলে –

বনের পথে লুটিয়ে পড়া অঞ্চলে

আজ প্রভাতের হৃদয় ওঠে চঞ্চলি”।।                          -  রবীন্দ্রনাথ

রবি ঠাকুরের খাওয়াদাওয়া

প্রবন্ধ সমগ্র ।। মতামত ।। সূচীপত্র

 প্রবন্ধ সমগ্র

রবি ঠাকুরের

খাওয়াদাওয়া

ফারুক আব্দুল্লাহ

কল্যাণী, পশ্চিমবাংলা

বীন্দ্রনাথ আমদের সবার প্রিয় কবি এবং  শ্রদ্ধার ব্যক্তি। প্রিয় মানুষদের জীবনের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে জানার আগ্রহ বোধহয় কমবেশি সবারই থাকে। রবীন্দ্রনাথকে নিয়েও আমাদের  কৌতূহলের অন্ত নেই। লেখক রবীন্দ্রনাথ আমাদের কাছে সুপরিচিত হলেও তার ব্যক্তিগত জীবনের বিভিন্ন দিক আজও অনেকের কাছেই অজানা। রবীন্দ্রনাথের চরিত্রের এমনই এক ঊল্লেখযোগ্য দিক হল তার ‘ভোজনরসিকতা’। রবীন্দ্রনাথ ছোটবেলা থেকেই খেতে খুব ভালবাসতেন এবং আমৃত্যু কাল পর্যন্ত খাবারের প্রতি তার ভালোবাসা থেকেই গেছিল। এ সম্পর্কে কবির বাল্যকালে লেখা একটি কবিতার উল্লেখ করা যেতে পারে যেখানে তিনি প্রাতরাশের বিভিন্ন খাদ্য সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন।

“আমসত্ব দুধে ফেলি. তাহাতে কদলি দলি'. সন্দেশ মাখিয়া তাতে... হাপুস হুপুস শব্দ, চারিদিক নিঃশব্দ,. পিপীলিকা কাঁদিয়া যায় পাতে...”    রবীন্দ্রনাথ সারাদিনে বেশ কয়েকবার খেতেন। তিনি ভোরবেলায় খুব তাড়াতাড়ি উঠে পড়তেন, তার দিনের শুরু হত এক কাপ চা অথবা কফি খেয়ে। একটু বেলা হয়ে প্রাতঃরাশে ভেজা বাদাম, মধু সহযোগে টোস্ট এবং এক কাপ দুধ। আবার মাঝে মাঝে তার ছোটবেলার প্রিয় খাবার সন্দেশ, কলা, দুধে ফেলে মেখে খেতেন। এর পর সকাল দশটা নাগাদ তিনি লেবুর রস খেতেন এবং মধ্যাহ্ন ভোজনে রবীন্দ্রনাথ ভাত খেতেন, তবে তিনি ভাত খুব অল্প পরিমাণে খেতেন। বিকেলে কবির জন্য বরাদ্দ ছিল মুড়ি ও চা। কবির রাতের খাবারে থাকত সব্জির স্যুপ কয়েকটি লুচি ও তরকারী। রবীন্দ্রনাথ দুপুরের খাবার পরিবারের সবাই মিলে ঘরের মেঝেতে বসে খেতেন কিন্তু রাতের বেলায় তিনি খেতেন ডাইনিং টেবিলে বসে।

আমিষ ও নিরামিষ সব ধরনের খাবারই রবীন্দ্রনাথের পছন্দের তালিকায় ছিল। দেশী বিদেশী কোন খাবারেই তার অরুচি ছিল না। তার প্রিয় খাবারের তালিকায় ছিল ব্রিটিশ পদ, আপেল দিয়ে রান্না খাসীর মাংস, তুর্কী কাবাব, তিনি বিদেশে গিয়ে যে সব খাবার খেতেন সেগুলির রান্না পদ্ধতি জেনে ঠাকুর বাড়ির রান্না ঘরে সেগুলি করার অনুরোধ করতেন। ঠাকুর বাড়ির মেয়েরা রান্না নিয়ে প্রচুর পরীক্ষা –নিরীক্ষা চালাতেন, নিত্য নতুন  খাবারের পদ তৈরিতে তারা সব সময় ব্যস্ত থাকতেন।

তারা অতিসাধারণ  উপাদান যেমন পটল ও আলুর খোসা দিয়েও সুস্বাদু পদ তৈরি করতেন। রবীন্দ্রনাথের একটি স্বভাব ছিল তিনি দেশে বিদেশে যেখানেই নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যেতেন সেখানকার মেনুকার্ড তিনি  সংগ্রহ করতেন এবং সেগুলি তিনি সংরক্ষণ করে রাখতেন এই ঘটনা থেকেই রবীন্দ্রনাথের ভোজন রসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়।

দেশীয় খাবারের মধ্যে কৈ মাছের তরকারী, চিতল মাছের পেটি ভাজা, এছাড়া ভাপা ইলিশ, ফুলকপি দিয়ে তৈরি  নানান পদ ছিল রবীন্দ্রনাথের খুব প্রিয়। এছাড়া মিষ্টি খাবারের মধ্যে পায়েস, চন্দ্রপুলি, ক্ষীর, নারকেল দিয়ে তৈরি মিষ্টি, দই এর মালপোয়া, চিঁড়ের পুলি,মানকচুর জিলিপি, আমসত্ত্ব এগুলি খেতে খুব ভালবাসতেন তিনি। তবে পায়েস ও পিঠে পুলির প্রতি কবির টান ছিল বেশি।

রবীন্দ্রনাথের ফলের প্রতিও একটা আকর্ষণ ছিল। তিনি দুপুরের খাওয়ার আগে ফল খেতেন যেমন পাকা পেঁপে,কলা,বাতাবি লেবু আমের সময় আম তবে আম ছিল রবীন্দ্রনাথের অত্যন্ত প্রিয় ফল। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাস এলে রবীন্দ্রনাথের ভীষণ খুশী হতেন। কবি আম কেটে খেতে পছন্দ করতেন না তিনি আম চুষে খেতেন। টমি ওয়াডা নামে রবীন্দ্র অনুরাগী এক জাপানী ভদ্র মহিলার আমন্ত্রণে দ্বিতীয়বার কবি জাপানে যাওয়ার কথা ভাবতে থাকেন, কিন্তু সেটি আমের সময় ছিল রবীন্দ্রনাথ ছিলেন আমের ভক্ত ফলে পাকা আমের লোভ তার জাপান যাওয়ার পথে বাধা হয়ে দাড়ায়। অবশেষে ঠিক হয় বড় বড় বরফ বক্সে করে আমও কবির সাথে জাপান যাবে।

তথ্য সূত্র-

১) দুর্গাপদ চট্টোপাধ্যায়, অজানা রবীন্দ্রনাথ, এ পি পি,১১৭, কেশব চন্দ্র সেন স্ট্রিট,কলকাতা-৭০০০০৯

২)http//Bengalcuisine.in/tagorean¬_cuisine

৩) http//hindustantimes.com/india/savour…

একুশে ফেব্রুয়ারী

প্রবন্ধ সমগ্র ।। মতামত ।। সূচীপত্র

 প্রবন্ধ সমগ্র
Mijanur Rahman.jpg

একুশে

ফেব্রুয়ারী 

মিজানুর রহমান মিজান

বিশ্বনাথ, সিলেট, বাংলাদেশ

মাদের জাতীয় জীবনের একটি গুরুত্ব পূর্ণ দিন হচ্ছে মহান একুশে ফেব্রুয়ারী। এ দিনের সাথে আমাদের স্বাধিকার, গৌরব, বেদনা  অর্জন ও প্রাপ্তির ইতিহাস অন্তর্ভুক্ত, নিখাদ প্রেমাসক্তে সিক্ত। নিজ মাতৃভাষার যথোপযুক্ত মর্যাদা রক্ষা ও প্রতিষ্ঠার নিমিত্তে সংগ্রামে সচকিত কয়েকজন তরুণ অকাতরে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে রাজপথ করেছিল রঞ্জিত। সে এক অপূর্ব, অতুলনীয় ইতিহাস। যাকে ভাষা আন্দোলন নামে অভিহিত করা হয়। আবার একুশে ফেব্রুয়ারীর ভাষা আন্দোলনের পথ বেয়ে স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় সক্ষমতা অর্জন একান্ত গৌরবের। এ কাহিনী জন্ম দিয়েছে “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস“এর। বিশেষ সময় ও বিশেষ আন্দোলনের স্মৃতির সহিত সম্পৃক্ত না থেকে জাতীয় চেতনার প্রতিকে রূপান্তরিত সার্থক সফলতা। বাঙ্গালী জাতীর সাধনা, আন্দোলন সংগ্রামের প্রেরণা উৎস মুলে বিরাট অবদানের স্বীকৃত অস্তিত্ব। পৃথিবীতে মায়ের ভাষা রক্ষায় জীবন দানকারী একমাত্র জাতি বাঙ্গালী হিসাবে চিহ্নিত। একুশে ফেব্রুয়ারী আমাদের ন্যায্য দাবী আদায়ের সংগ্রামী ইতিহাস। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ বেনিয়াদের হাত থেকে মুক্ত হলে ও আমাদের কাঙ্ক্ষিত মুক্তি সম্ভব হয়নি বলে একুশে ফেব্রুয়ারী তার জ্বলন্ত উদাহরণ। পাকিস্তানি শাসকরা যে এদেশের উপর নির্যাতন, নিপীড়ন চালিয়েছিল তার জ্বলন্ত প্রমাণহিসাবে বলতে হয় সর্বাগ্রে মাতৃভাষা কেড়ে নেয়ার চক্রান্ত অন্যতম। বৃহদাংশ জনগণের মাতৃভাষা বাংলা হলে ও অমর্যাদা স্বরূপ উর্দুকেই রাষ্ট্র ভাষা রূপে প্রতিষ্ঠার অশুভ চক্রান্ত চালায়। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের কর্ণধার মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষারমর্যাদার কথা বললে বাঙ্গালী প্রতিবাদ জানায়। কিছু দিন নীরব থাকলে ও খাজা নাজিমউদ্দিন সরকার কর্তৃক আবারো উত্থাপিত হলে প্রতিবাদে

বাংলার ছাত্র সমাজ ফুঁসে উঠে। ১৪৪ ধারা জারী করে ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারী ছাত্র সমাজকে দমাতে চাইলে ছাত্র সমাজ ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার নিমিত্তে ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে জড়ো হতে থাকলে পুলিশ গুলি চালিয়ে রফিক, বরকত, জব্বার, সালামসহ আরো অনেকে নিহত হয়। সে সংবাদ দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লে সারা বাংলায় দাবানলের মত মানুষ প্রতিবাদ মুখর হয়ে উঠে এবং  ঐ দিনকে “শহিদ দিবস“ হিসাবে আখ্যায়িত করে। কিন্তু' শহিদ দিবস কেবল পালনের মধ্যেই সীমিত থাকেনি। এর প্রভাব বিস্তার লাভে স্বাধিকার আন্দোলনের পথ প্রসারিত করে। ১৯৭১ সালের দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ফলে বাংলাদেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ে পৃথিবীর বুকে পৃথক মানচিত্র ও পতাকার অধিকার লাভে সক্ষম হয়। বাঙ্গালী বীরের জাতি। পর্যায়ক্রমে ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ১৮৮ জাতি সমন্বয়ে সংগঠিত জাতি সংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো প্যারিস অধিবেশনে “একুশে ফেব্রুয়ারী“কে “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস“ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে এ জাতির একটি বিশিষ্ট অর্জনকে স্বীকৃতি দান করেছে। প্রতিবাদের সহিত অর্জনের সমন্বয় সাধনে একুশের চেতনা জাতীয়তা-বোধে উজ্জীবিত ও অনুপ্রাণিতের মুল মন্ত্র। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে ঢাকায় ছাত্রদের উপর গুলি চালাবার সংবাদ পেয়ে ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারী রাত্রে রোগ শয্যায় শায়িত থেকে চট্টগ্রামের মাহবুব-উল-আলম চৌধুরীর একুশের প্রথম কবিতা “কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি“। কবিতাটি আন্দোলনকে বেগবান করতে বিরাট ভূমিকা রাখে। সর্বত্র, সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠিত হোক মর্যাদার স্ব-মহিমায় “শহিদ দিবস“ থেকে যেমন “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে“ উত্তরণ হয়েছে। এ আমার প্রাণের দাবী।

প্রবন্ধ সমগ্র ।। মতামত ।। সূচীপত্র

হাসান রাজার বাড়িতে
 প্রবন্ধ সমগ্র
Mijanur Rahman.jpg

একদিন সুনামগঞ্জের

হাসান রাজার বাড়িতে 

মিজানুর রহমান মিজান

বিশ্বনাথ, সিলেট, বাংলাদেশ

জুলাই মাসের ১৮ তারিখ ২০১৭ সাল। আমি সবেমাত্র অপারেশন করে ডাক্তারের পরামর্শানুযায়ী বিশ্রামে আছি। আমার অসুস্থতার খবর পেয়ে আমার লন্ডন প্রবাসী ভাগিনা দবির উদ্দিন স্ত্রী সন্তানসহ আসেন আমাকে দেখতে। আমি অপারেশন করালাম তাদের সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধানে ও নিবিড় পরিচর্যায়ে থেকে। একটু সুস্থতার পথে। ভাগনা ফিরে যাবার সময় ঘনিয়ে এসেছে। তাদের অভিলাষ একবার সুনাম গঞ্জে যাবার। ভাটি এলাকা পরিদর্শন ও কিছু পারিবারিক কাজ জগঝাপ ইউনিয়ন ভূমি অফিসে। সুনামগঞ্জ পরিদর্শন করা আমারই মতো আমার প্রবাসী ভাগিনী ও নাতিদের। তাই তাদের আর্তি পূরণার্থে এবং আমার ও দারুণ ইচ্ছে একবার সুনামগঞ্জ ভ্রমণ করা। দিন তারিখ ঠিক করে ভোর ৮ ঘটিকায় রওয়ানা দিলাম নোহা যোগে লামাকাজি হয়ে সুনামগঞ্জ রোড ধরে। আমরা সকাল নয় ঘটিকায় পৌঁছলাম জগঝাপ ভূমি অফিসে। অফিস খোলা পেলাম। কিন্তু কর্মকর্তার আগমন এখন ও ঘটেনি। তাই চা পানের উদ্দেশ্যে পার্শ্বের অনতিদূরে স্টলে গেলাম। গাড়িতে রয়ে  গেলেন আমার প্রবাসী ভাগিনী তিন নাতিসহ। চা পান করলাম। আবার আসলাম অফিসে। পেয়ে গেলাম কর্মকর্তাকে। আমাদের কাঙ্ক্ষিত কাগজের কথা বলতেই এবং আমি সাংবাদিক শুনেই তিনি আমাকে আশ্বস্ত করলেন, আপনি ঘুরে আসুন। আমি কাগজ রেডি করে রাখবো। আশ্বস্থতায় আনন্দই পেলাম। আমরা ছুটলাম লক্ষ্যপানে। 
বেলা সাড়ে বারাটায় পৌঁছলাম সুনামগঞ্জ শহরে। চলে গেলাম জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে। তথ্য সেবা কেন্দ্রের মাধ্যমে কিছু কাগজ সংগ্রহের নিমিত্তে। এখানে প্রায় ঘন্টা খানেক সময় অতিবাহিত হল। উদ্দেশ্য আমাদের সফল হয়নি। কারণ আমাদের যে সকল কাগজ ও তথ্যের প্রয়োজন তা নাকি জমা হয়নি। তাই মনস্থ করলাম কিছু খেয়ে নেবার। তাই ঢুকলাম একটি বড় হোটেলে। খাবার গ্রহণ শেষে অনেক আলাপ আলোচনায় সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম তাহির পুর তথা টাঙ্গুয়ার হাওর ঘুরে আসা সম্ভব হবে না। সময় আমাদেরকে যাত্রা সংক্ষিপ্ত করণের আভাষ দিচ্ছে। তাই সে আশা ছেড়ে দিয়ে মনোনিবেশ করলাম সুনামগঞ্জ শহরের অনতিদূরে অবস্থিত হাসন রাজার বাড়ি দর্শন করে বাড়ির দিকে ফিরে আসা।যেমন কথা বা সিদ্ধান্ত, তেমনি কাজে হলাম ধাবিত। আমাদের গাড়ি ছেড়ে দিলাম সে উদ্দেশ্য সার্থক ও সফলতার চূড়ান্ত রূপদানে। দশ মিনিটের ব্যবধানে আমরা পৌঁছলাম হাসন রাজার বাড়ির ফটকে। সুরমা নদীর তীর ঘেঁষে হাসন রাজার বাড়িটির অবস্থান। আমাদের গাড়িটি ফটক অতিক্রম করে ভিতরে নিয়ে গেলাম। মুল গৃহের একটু আগে গাড়ি থামিয়ে নেমে পড়লাম সবাই একে একে।ভিতরে প্রবেশ করলাম যখন আমরা তখন যাদুঘরটি একেবারে জনশূন্য। একজন তরুণ সেখানে সার্বক্ষণিক থাকেন।যার নাম হল রেদোয়ানুল ইসলাম হৃদয়। তিনি আমাদের গাইড লাইন দিলেন। আমরা দেখতে লাগলাম যাদুঘরের প্রতিটি কক্ষ ঘুরে ঘুরে। ঐ তরুণ আমার পরিচয় জেনে আমাকে জানালেন তিনি হাসন রাজার গান গেয়ে শুনাবেন যদি আমরা আগ্রহ প্রকাশ করি। আমি সানন্দে সম্মতি প্রদান করলে তিনি একে একে তিনটি গান গেয়ে শোনালেন। বেশ ভালই লাগলো। আমরা দেখছিলাম প্রতিটি কক্ষে রক্ষিত হাসন রাজার ব্যবহৃত পোশাক, তাঁর বংশ পরিচয়, নিত্য ব্যবহার্য সামগ্রী, গানের পাণ্ডুলিপি, সঙ্গীত চর্চায় ব্যবহৃত ঢোলসহ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র এবং নানা দুর্লভ উপকরণ সমূহ। যাদুঘর থেকে বের হয়ে দেখতে গেলাম হাসন রাজার বাড়ি। ঘরে ঘুরে দেখলাম সব কিছুই। বাড়িতে একটি তিনতলা, একটি দুতলা ভবনসহ প্রাচীনআমলের কাঠ ও টিনের চালার মোট সাতটি গৃহ। তিনতলা ঘরের নিচতলার চারটি ঘর নিয়ে হাসন রাজা মিউজিয়ামের অবস্থান। অভ্যর্থনা কক্ষের সম্মুখ দেয়ালে রয়েছে হাসন রাজার একক একটি ছবি এক পাশে এবং অপর পাশে রয়েছে ঘোড়ার উপরে বসা অবস্থায় হাসন রাজারই ছবি। অভ্যর্থনা কক্ষের ভিতরে একটি ফ্রেমে বাঁধা রয়েছে হাসন রাজার বংশ পরিচয়। দেখা গেল সুরমা নদী তীরের তেঘরিয়া ( লক্ষণশ্রী) গ্রামে ১৮৫৪ সালের ২১ শে ডিসেম্বর জন্মেছিলেন এ ঘুসুর সাধক। পিতার নাম দেওয়ান আলী রাজা চৌধুরী ও মাতা হুরমত জান বিবি। হাসন

রাজার পূর্বপুরুষ ছিলেন ভারতের অধিবাসী। ভাগ্যন্বেষনে তাঁরা আসেন বাংলাদেশের যশোর জেলায়। সেখানে একটি খন্ড রাজ্য স্থাপন করে ও স্থায়ী হতে পারেননি। এ রাজ্যের প্রতিষ্টাতা রাজা বিজয়সিংহ দেব পারিবারিক কলহ ও ছোট ভাই দুর্জয় সিংহের শত্রুতায় চলে আসেন সিলেটের বিশ্বনাথ থানার অন্তর্গত কোনাউরা গ্রামে।সময়টা তখন ছিল ষোড়শ শতকের শেষের দিকে। বানারসীরাম ছিলেন তাঁর অধ:স্তন পুরুষ। বানারসীরামের ছেলে বীরেন্দ্র চন্দ্র ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হন এবং মুসলিম নাম বাবু খান গ্রহণ করেন।তিনির কয়েক পুরুষ পর বাবু খানেরই উত্তর পুরুষ দেওয়ান আলী রাজার দ্বিতীয় সন্তান হচ্ছেন হাসন রাজা। মায়ের দিক থেকে হাসন রাজা হচ্ছেন হুরমত জাহান বেগমের সন্তান।দেওয়ান আলী রাজা তৎকালীন মোমেনশাহী জেলার খারিয়াজুরী পরগণার ভূইয়া পরিবারের মজলিশ প্রতাপ সাহেবের বংশধর হুরমত জাহান বেগমকে বিয়ে করেন। সুতরাং হাসন রাজার নানার বাড়ি হচ্ছে ময়মনসিংহ। দেওয়ান আলী রাজা হুরমত জাহান বেগমকে বিবাহ করার পর বৈবাহিক সূত্রে শ্বশুর প্রদত্ত সুনামগঞ্জের লক্ষণছিরিতে (তেঘরিয়া) অনেক সম্পত্তি লাভকরেন এবং সেখানে বাড়ি নির্মাণ করেন।তাই দেখা যায় হাসন রাজার পিতা, পিতামহ প্রপিতামহ সকলই ছিলেন বিশ্বনাথের রামপাশা গ্রামের অধিবাসী। অপরদিকে দৃষ্ট হয় হাসন রাজার একটি গানে ও আত্ম-পরিচয় দিতে গেয়েছেন- “হাসন রাজা মরিয়া যাইব না পুরিতে আশা, লক্ষণছিরি জমিদারী বাড়ি রামপাশা”।
জাদুঘরের একটি শোকেসে রাখা হাসন রাজার পোশাক, একটি মখমলের আলখেল্লা ও সাদা দু’টি গেঞ্জি। জানা যায় তিনি বেশির ভাগ সময় সাদাসিধা পোষাকে পরতে ছিলেন অভ্যস্ত। সাদা ধুতি পরতেন লুঙ্গির মত করে এবং গায়ে থাকত সাদা গেঞ্জি। পায়ে দিতেন কাঠের খড়ম। আর কোন অনুষ্ঠান বা উৎসবে পরতেন জরির কারুকার্য খচিত আলখেল্লা। জাদুঘরের একাংশে লক্ষিত হল চেয়ার-টেবিল। তাতে বসেই হাসন রাজা নাকি গান লিখতেন।
যাদুঘরের একটি কক্ষে রয়েছে একটি বজরা( বড় নৌকা)। এ নৌকায় চড়ে হাসন রাজা নাকি বের হতেন নৌবিহারে। বর্ষাকালে হাসন রাজা নৌবিহারে বেরুলে নৌকায় নাচ-গানের আসর বসাতেন। এখানে থাকতো বাদ্যযন্ত্রসহ নাচের ব্যবস্থা।অনেক সময় হতেন তিনি নিমগ্ন গান, কবিতা রচনায়। অপর একটি রোমে আছে হাসন রাজার হাতের স্পর্শ পাওয়া একটি দোতারা ও দু’টি ঢোল। আবার কখন  ও কখন ও ঘোড়া বা হাতিতে চড়ে ও বের হতেন শিকারে। যাদুঘরে রক্ষিত একটি হাতে অঙ্কিত ছবিতে দেখা যায়, তিনি হাতিতে চড়ে শিকারে যাচ্ছেন। যাদুঘরে আরো আছে তাঁর ব্যবহৃত দুধের পাত্র ও পানদানি। আছে তিনির স্বহস্তের লিখিত গানের পাণ্ডুলিপি। আমাদের আগমনের খবর পেয়ে আসলেন তত্ত্বাবধায়ক সামারীন দেওয়ান।তিনির সাথে আলাপ হল। জানলাম অনেক কিছু। মুল বাড়ি দেখার আগ্রহ প্রকাশ করলাম। বললেন ভিতরে যেতে। চলে গেলাম ভিতর বাড়ি। প্রাচীন আমলের পাকাযুক্ত গৃহের ছাদ দেয়া হয়েছে বড় বড় তক্তার দ্বারা। গৃহের চাল আগেকার দিনের টিনের দ্বারা চাউনি যুক্ত তা আমাদেরকে জানান দিচ্ছিল। কাঠগুলি আজো রয়েছে অক্ষত। কোন পোকা ধরেনি। হেঁটে হেঁটে চলে গেলাম ঘর পেরিয়ে পুকুর পাড়ে। সামান্য ঝোপ-জঙ্গল বেষ্টিত পুকুর পাড়, পুকুর আজকের প্রজন্ম করছেন ব্যবহার। তিনি ১৯২২ সালে মারা যান। তাঁকে কবরস্থ করা হয় রামপাশা গ্রামের পারিবারিক কবর স্থানে। সেখান থেকে বেরিয়ে এসে বিদায়ী সাক্ষাতে মিলিত হলাম সামারীন দেওয়ানের সঙ্গে।তিনি একটি বই আমাকে উপহার প্রদান করলেন হাসন রাজা সম্পর্কিত। আমার বাবা একজন বাউল শিল্পী ছিলেন জেনে তিনি আরো আনন্দিত হলেন। অত:পর সেখান থেকে বেরিয়ে চলে গেলাম সুরমা নদীর তীরে। দেখলাম নৈসর্গিক দৃশ্য।সময় কম হাতে থাকায় নদীর তীরে বেশিক্ষণ থাকা হয়নি। রওয়ানা দিলাম বিশ্বনাথের তথা বাড়ির দিকে। আসার বেলা কিন্তু শহিদ মুক্তিযোদ্ধার ভাস্কর্য ও পাগলার মসজিদ ঘুরে আসতে এবং ছবি তোলতে ভুল করিনি।অন্যদিন পাগলার বড় মসজিদের সম্পর্কে লেখার আশাবাদ ব্যক্ত করে আল্লাহর শোকরিয়া আদায়ান্তে এখানেই সমাপ্য ঘোষণা করছি।          

শিক্ষক রজনী কান্ত

প্রবন্ধ সমগ্র ।। মতামত ।। সূচীপত্র

 প্রবন্ধ সমগ্র
Mijanur Rahman.jpg

একজন আদর্শ

শিক্ষক:রজনী কান্ত

মিজানুর রহমান মিজান

বিশ্বনাথ, সিলেট, বাংলাদেশ

নবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় আমাদেও জাতীয় জীবন জাগরণের অগ্রদূত, অন্ধকারাচছন্ন এলাকায় আলোর পরশ বিতরণে ইতিহাসের এক উল্লেখযোগ্য অধ্যায়ের সুচনাকারী শ্রদ্ধেয় শিক্ষক রজনী কান্ত দেব। কেননা এ সময় অত্র এলাকায় শিক্ষার আলো পৌছেনি বললেই চলে।

স্বর্গীয় রজনী কান্ত দেব আনুমানিক ১৮৯১ সালে টাকা দক্ষিণের ফুলসাইন গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। রাস গবিন্দ রায় এর দুই পুত্রের মধ্যে বড় ছিলেন আমাদের উল্লেখিত শিক্ষক রজনী কান্ত দেব। গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এম. ই পরিক্ষায় কৃতিত্বের সহিত পাশ করে স্থানীয় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মানুষ গড়ার কাজে যোগ দেন। ২ বৎসর শিক্ষকতার পর তিনি বি. টি ট্রেনিং এর নিমিত্তে ভারতের শিলচরে নর্মাল স্কুলে চলে যান। সেখান থেকে এক বৎসরে কৃতিত্বের সহিত ট্রেনিং সমাপনান্তে আবার ঐ স্কুলে চলে আসেন। কিন্তু ভাগ্যচক্রেই হোক আর অত্র এলাকাবাসীর সৌভাগ্য ক্রমেই হোক কিছু দিনের মধ্যেই তিনি চলে আসেন উত্তর বিশ্বনাথে। এ সময় বিশ্বনাথ থানার খাজাঞ্চী ইউনিয়নের অন্তর্গত চন্দগ্রাম অভয়াচরন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক প্রমথনাথ ভট্রাচার্য্যের স্থলাভিষিক্ত হয়ে তাঁর পদার্পণ এ ক্ষীণ শিখা, সমস্যা জর্জরিত বিদ্যাঙ্গনে। কারণ প্রমথনাথ এর বাড়ি ছিল পঞ্চখন্ডে। তিনি ব্যক্তিগত কারনে ১৯১২ সালে বাড়িতে থাকার ইচছা প্রকাশ হেতু প্রধান শিক্ষকের শুন্য পদ পুরণার্থে তাঁকে ছয় মাসের জন্য ঐ স্থানে পাঠানো হয়। প্রথমাবতস্থায় প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান এর জন্য তাঁকে অত্র এলাকাবাসী “বড় মাষ্টারবাবু” নামে অভিহিত করেন এবং আজ ও তাঁর ছাত্রদের ও জনগণের কাছে ঐ নামেই বহুল পরিচিতির কথা শুনা যায়। এখানে আসার অল্প দিনের মধ্যেই তাঁর শিক্ষাদান পদ্ধতিতে মুগ্ধ হয়ে এলাকাবাসী উর্ধবতন কর্মকর্তার কাছে আবেদন করে এ স্থানে থাকার অনুরোধ জানান এবং এতে তিনি ও সম্মতি প্রদান করেন। অত্র স্খুলের প্রতিষ্ঠাতা অভয়াচরণ এর গৃহে লজিং হিসেবে বসবাস করার সুযোগ পান।

কবিতার অনুসরণে যাহারা বাঙলায় কবিতা অবলম্বন করিলেন তাদের মধ্যে জীবনানন্দ দাশ প্রধান। ইতিহাস খুঁজলে দেখা যায় আধুনিক কবিতার কারিগর যে পাঁচজন কবি জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯ - ১৯৫৪), সুধীন্দ্রনাথ দত্ত (১৯০১ - ১৯৬০), বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮ - ১৯৭৮), বিষ্ণু দে (১৯০৯ - ১৯৮২) ও অমিয় চক্রবর্তী তাঁরা সবাই ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন। সেই সাথে বলা যায় বাঙলা কবিতায় আধুনিকতার যে বাঁক সৃষ্টি হয়েছিল তা মূলত ইংরেজি আর ইউরোপিয়ান সাহিত্যের উৎস ধারা থেকে। সাথে সাথে স্মরণ করতে হয় বিংশ শতাব্দীর শুরুতে পাশ্চাত্যে কবিতায় আধুনিকতার নবযাত্রা ঘটিয়েছিলেন যে মহানায়কগণ তাঁদের মধ্যে এটারা পাউন্ড, টি এস এলিয়ট ও অমি লাওয়েল অন্যতম এছাড়া জন কিটস, ইয়েটস ও বায়রনের নামও উঠে আসে সমস্বরে। জীবনানন্দ দাশের ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি' প্রকাশের পড় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে একটি পত্র লিখেছিলেন - ‘তোমার কবিতাগুলি পড়ে খুশি হয়েছি। তোমার লেখায় রস আছে, স্বকীয়তা আছে এবং তাকিয়ে দেখার আনন্দ আছে।’ আবার এমনও বলেছিলেন কিছুটা তাচ্ছিল্য করে - ‘তোমার কবিত্বশক্তি আছে তাতে সন্দেহমাত্র নেই। – কিন্তু ভাষা প্রকৃতি নিয়ে এত জবরদস্তি কর কেন বুঝতে পারিনে। কাব্যের মুদ্রাদোষটা ওস্তাদিকে পরিহাসিত করে। বড় জাতের রচনার মধ্যে একটা শান্তি আছে যেখানে তার ব্যাঘাত দেখি সেখানে স্থায়িত্ব সম্বন্ধে সন্দেহ জন্মে। জোর দেখানো যে জোরের প্রমাণ তা নয় বরঞ্চ উল্টো’। ঘরমুখো নির্জনতার কবি জীবনানন্দ দাশকে বঙ্গীয় সাহিত্য সমাজে দৃঢ় ভাবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বুদ্ধদেব বসু এবং অজিত দত্তের অবদান বহুগুণে বেশি। বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘কবিতা’, সঞ্জয় ভট্টাচার্য ও প্রেমেন্দ্র মিত্র সম্পাদিত ‘নিরুক্ত’, সঞ্জয় ভট্টাচার্য সম্পাদিত ‘পূর্বাশা’ প্রভৃতি পত্রিকাগুলো জীবনানন্দ নির্ভর হয়ে ওঠে। দীনেশরঞ্জন দাশ সম্পাদিত ‘কল্লোল’ এবং প্রেমেন্দ্র মিত্র, মুরলীধর বসু ও শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘কালি-কলম’ যা জীবনানন্দকে অনেক বেশি মূল্যায়ন করেছিল; উল্লেখ করতে হয় তখনকার সময় এই দুটি সাহিত্য পত্রিকা ছিল আধুনিক সাহিত্যের অগ্রদূত। সাহিত্যিক নীহাররঞ্জন রায় জীবনানন্দ দাশের কবিতা সম্পর্কে বলেন - ‘যে অল্প সংখ্যক কবির কবিকর্ম নিয়ে আমার এই গর্ব, সাম্প্রতিক বাঙলা কাব্যের গর্ব, জীবনানন্দ তার অন্যতম এবং সম্ভবত মহত্তম’।

কবি জীবিত থাকা কালীন মাত্র সাতটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল আর ঐসব কাব্যগ্রন্থে সর্বসাকুল্যে মাত্র ১৬২টি কবিতা স্থান পেয়েছিল। কবির অপ্রকাশিত গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধের কথা না হয় নাই লেখা হল কিন্তু শত শত কবিতা বহুকাল পর্যন্ত প্রকাশের অন্তরালে পড়েছিল। কবি জানলেন না প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ের গহন পথে আজ অবধি হেঁটে চলেছেন। অগ্রন্থিত নির্জনতার কবি লিখেছেন - ‘মিনারে মেঘ সোনালি চিলেরে তার জানালয় ডাকে’। কবি তাঁর তীক্ষ্ণ

কল্পনা শক্তি দিয়ে হরণ করে এনেছেন সুদূর মিনারের মেঘ। এক বিকেলের আড্ডা ফেলে জানালয় দাঁড়িয়ে ডাকবেন কোনও সোনালি ডানার চিলকে, যে রোদ্দুর সব আলো ডানায় মেখে, মেঘকে নামিয়েছে মিনারের চূড়ায়।    

      'আমার জীবনে কোনও ঘুম নাই

      মৎসনারীদের মাঝে সবচেয়ে রূপসী সে নাকি

      এই নিদ্রা?

      গায় তাঁর ক্ষান্ত সমুদ্রের ঘ্রাণ - আবাদ সুখ

      চিন্তার পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন - বিমুখ

      প্রাণ তার ……'

                    এই নিদ্রা/ অগ্রন্থিত কবিতা

মৎসকন্যাদের মাঝে সবচেয়ে রূপবতী হোল নিদ্রা। সে নিদ্রার কথা ভেবেই কবি নির্ঘুম সমুদ্র-ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়েছেন। গোলাপি আভায় ঢাকা ধূসর মেঘ যেমন বোঝে না বিয়োগ-ব্যথা ঠিক তেমনি পাখি-মন, প্রজাপতি-শতদল কখনও ছুঁয়ে দেখে না বিষণ্ণ নিঃশ্বাস। কবি ‘পাখি’ কবিতায় জ্যোৎস্না ও শীতের মাঝে আনন্দ এবং হাহাকার অনুভব করেছেন। তবু তাকে চেয়েছেন এই শীতে, শোক বিহ্বল চোখে সে আসুক, শিহরণ জাগাক নিস্তব্ধ ঘাসের শরীরে, যেখানে জ্যোৎস্নারা ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে থাকে, অঘ্রানের বিকেলের রঙে আরও শূন্যতায় ভ’রে উঠলে রংচটা বাদামী পাখি অপেক্ষায় থাকে এক ঝাঁক উজ্জ্বল রোদের জন্য। পাতা কুড়াবার দিন এসে অপেক্ষা করে ঘাসের উঠোনে। সোনামাখা ধান রুপোলি কারুকাজ ভুলে গিয়ে শুয়ে থাকে মাঠের উল্টো পিঠে। তবু কবি আহ্বান করেন, কেউ যেন এঁকে যায় অঘ্রানের বিকেলের ছবি। শিশির এসে মুছে দিয়ে যাক ভুল রঙের অনুজ্জ্বল কথামালা। “আমি এই অঘ্রাণেরে ভালোবাসি - বিকেলের এই রং - রঙের শূন্যতা/রোদের নরম রোম - ঢালু মাঠ - বিবর্ণ বাদামি পাখি - হলুদ বিচালি। পাতা কুড়াবার দিন ঘাসে ঘাসে - কুড়ুনির মুখে নেই কোনও কথা’’। এই সব কোলাহল রেখে কবি পেরিয়ে যেতে চান সব জীবনের মানে পিছনে ফেলে। কিন্তু কবিতো নির্জনতার! কোথায় হারাবেন তিনি! নাকি কল্পনার মেঘে চড়ে সব অগোচরে দেখে যাবেন অঘ্রানের মাঠ, কার্ত্তিকের কুয়াশা, মাছরাঙার ঠোঁট, জ্যোৎস্নার অসীম বিল। কবি চলে গেছেন অরণ্যের পাতার ফাঁকের এক লোভী টুকরো আলোর পেছন পেছন।

'চলে গেছি;

এ জীবন কবে যেন মাঠে মাঠে ঘাস হয়ে রবে

নীল আকাশের নিচে অঘ্রানের ভোরে এক

- এই শান্তি পেয়েছি জীবনে

শীতের ঝাপসা ভোরে এ জীবন

ভেলভেট জ্যাকেটের মাছরাঙা হবে

একদিন - হেমন্তের সারাদিন

তবুও বেদনা এল - তুমি এলে মনে

হেমন্তের সারাদিন - অনেক গভীর রাত -

অনেক অনেক দিন আরও

তোমার মুখের কথা - ঠোঁটে রং চোখে চুল -

এই সব ব্যথা আহরণে” 

                                     এই শান্তি/ অগ্রন্থিত কবিতা

কবি ঝাপসা ভোর আর ভেলভেটের জ্যাকেট যেন মুড়ে দিলেন একে অপরকে। এমন করে গেঁথে দিয়েছেন জীবনের মানে। কবিতার সাথে প্রকৃতি, প্রকৃতির সাথে দেহ - মন, শীতের সাথে কুয়াশা-জ্যাকেট যেন মিলিয়ে দিলেন লাইনের পর লাইন। কবি কখনো বুনোহাঁসের পালকে পালকে উড়ে যেতে দেখেছেন জ্যোৎস্নার আলো, শবের জঙ্গল ছেড়ে নদী মাঠ খেয়া ঘাট ফেলে উড়ে চলেছে পাখি সব। কবে কোন কোমল স্থির নিরিবিলি পালকের রুপো দিয়ে বনের আঁধার বুনেছিল, কবি আজ এপারে বসে শুনতে পান বুনো মোরগের বুকে জেগে থাকা রাতের বিস্ময়। সব বিস্ময় কেটে গিয়ে জীবনানন্দের আলোয় আলোকিত হতে থাকবে আগামীর কবিতার শব্দ সম্ভার, রূপসী বাঙলায় কবি বার বার ফিরে আসবেন শিশিরের শব্দের মতন।

পরিবেশ দূষণ

প্রবন্ধ সমগ্র ।। মতামত ।। সূচীপত্র

 প্রবন্ধ সমগ্র

পরিবেশ দূষণ
কৃষ্ণতরু বর্মন
ডালাস, টেক্সাস

রিবেশ দূষণ বেশ পরিচিত শব্দ। যদিও এর প্রভাব বা কুফল সম্মন্ধে আমরা যথেষ্ট ওয়াকিবহাল, তবুও দূষণ ছাড়া আমাদের একটি দিনও চলা সম্ভব নয়। কোন না কোন ভাবেই এই দূষণ আমাদের নিত্য সঙ্গী, তা আমরা পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকি না কেন। এটা কোন প্রাদেশিক বা আঞ্চলিক সমস্যা নয়, এই সমস্যা এখন সারা পৃথিবীর।

মানুষ আজ এক কঠিন সমস্যার মুখোমুখি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সমাজে পরিবেশ সচেতনতা নিয়ে যে লাফালাফি করা হয়, বাস্তবে আমরা কতটা সচেতন? এক কথায় উত্তর বেশ কঠিন। একেবারে যে সচেতন নই যে তা ঠিক না, আবার যতটা দরকার ততটা আমরা পারি কি? যদি তাই-ই হত প্রতি বছরে শুধু বায়ু দূষণেই তিন মিলিয়ন মানুষ মারা যেত না।
বায়ু ও জলকে পরিবেশ দূষণের মধ্যম হিসাবে ধরা যেতে পারে। কিন্তু সবচেয়ে বড় সমস্যা আমরা নিজেই। আমাদের চরম অবজ্ঞা ও অবহেলাই আমাদের সবাইকে চরম বিনাশের দিকে ধীরে ধীরে টেনে নিয়ে চলেছে। অজ্ঞতা বলা হয়ত ঠিক হবে না, এক অদ্ভুত উদাসীনতাই আমাদের বিপদ ডেকে আনছে। তবে যে সবাই হাত গুটিয়ে বসে তাও ঠিক না। সম্প্রতি ব্রিটেনের দূষণ বিষয়ক একটি রিপোর্টে জলকেই দূষণের প্রধান মাধ্যম হিসাবে ধরা হয়েছে। এই দেশের ৭৬ শতাংশই জুড়ে রয়েছে ছোট বড় ফার্ম। এই সমীক্ষায় জানা গেছে, এই সমস্ত ফার্মগুলির পরিচালন-গত ত্রুটি থাকার ফলে নিকটবর্তী নদী, লেক বা জলাশয়েই ৯০ শতাংশ নাইট্রেট ও ৪০ শতাংশ ফসফরাস মিশ্রিত হয়। জলে নাইট্রেট ও ফসফরাসের মিশ্রণে ইউট্রোফিকেশন অবস্থার সৃষ্টি হয় যাতে কিনা অ্যাকোয়েটিক পরিবেশের ইকোলজিক্যাল ব্যালেন্স ক্ষতিগ্রস্থ হয়। তাছাড়া এলগল ব্লুম যেমন অ্যালগে জলে অক্সিজেনের পরিমাণ কমিয়ে দেয় ফলে জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীদের জীবন বিপন্ন হয়ে পড়ে। ব্রিটিশ সরকার ইতিমধ্যে প্রায় দুই লক্ষ্য চাষীকে তাদের ফার্মগুলি দূষণমুক্ত করার নির্দেশ দিয়েছে। সরকারী মহলের ধারণা এর ফলে প্রায় ১৫ – ২০ শতাংশ ফার্ম বন্ধ হয়ে যেতে পারে। বাস্তবে কাজ কতটা এগোবে তাতে সন্দেহ থাকলেও উদ্যোগটি যে বেশ প্রশংসাজনক তাতে কোন সন্দেহ নেই।এই দূষণের ভয়াল করাঘাত থেকে বাদ পড়ে নি মহাসাগরও। ধরা যাক, ‘রেড টাইড’ এর কথা। সমুদ্রের ধারে একধরণের লাল রঙের এলগি পাওয়া যায় যাকে বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় বলা হয় ‘রেড টাইড’।

দঃ আমেরিকার দক্ষিণ-পূর্বে ফ্লোরিডার টেম্পা উপকূলে এই ধরনের এলগি পাওয়া যায়। অনেকটা সেলের মত দেখতে বিভিন্ন প্রজাতির মেরিন উদ্ভিদ একত্রে মিলিত হয়ে এই রেড টাইড তৈরি করে। এগুলোতে কেমিক্যাল টক্সিন থাকায় সামুদ্রিক মাছ তো মরেই তাছাড়া এই সংস্পর্শে এলে মানুষেরও রেসপিরেটরি সমস্যা দিতে পারে। শিল্প ও কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহৃত কেমিক্যালই জলে দূষণের মূল কারণ। সরকারী নিয়ম অনুযায়ী শিল্প ও কৃষিজাত বর্জ্য পদার্থগুলির বিনষ্টিকরণ পদ্ধতি বেশ জটিল ও অত্যন্ত ব্যয়বহুল। তার ফলে ছোট কিংবা বড় উৎপাদনশীল সংস্থাগুলি সবার লক্ষ্যে বা অলক্ষ্যে নিকটবর্তী নদী বা লেকে তাদের বর্জ্য পদার্থগুলি ফেলে দিতে দ্বিধা বোধ করে না। পরিবেশ সচেতনতার আর কি বড় উদাহারণ থাকতে পারে! পরিসংখ্যান থেকেই জানা যায় যে, ১৯৭০ থেকে ১৯৯৮ সালের মধ্যেই সারা বিশ্বে কেমিক্যাল দ্রব্য বিক্রি ১৭১ বিলিয়ন থেকে বৃদ্ধি পেয়েছে ১৫০০ বিলিয়নে দাঁড়িয়েছে অর্থাৎ কিনা প্রায় ৯ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সবচেয়ে ক্ষতিকারক দ্রব্যগুলির মধ্যে পড়ে ব্যাটারিতে থাকা মার্কারি, গ্যাসোলিনের সীসা এবং পলিউটেন্ট যেগুলো তেল থেকে তৈরী করা হয় যেমন প্লাস্টিক। এই হেভি মেটাল পুরো ফুড চেইনকে কন্ট্যানিমেট করে।  এর ফলে বিষক্রিয়া থেকে আমরাও বাদ পড়ি না।

দূষণের ফলে গত ৫০ বছরে ইউরোপে ও আমেরিকাতে টেস্টিক্যাল ক্যান্সারের হার প্রায় তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্রেষ্ট ক্যান্সার ১৯৬০ সালে যেখানে ছিল প্রতি ২০ জনে ১, এখন সেটা বেড়ে প্রতি ৮ জনে ১ জন এসে দাঁড়িয়েছে। তাছাড়া প্রতি বছর ১০০০ নতুন নতুন কেমিক্যাল তৈরী করা হচ্ছে, যা কিনা বাজারে আরো ৭,০০০ কেমিক্যাল মলিকিউলস এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে কেমিক্যালের সংখ্যা বাড়িয়ে চলেছে। দূষণ এত মারাত্মকভাবে বাড়ছে যে প্রাণীর রেসপিরেটরি অঙ্গগুলিকে ব্লক করে দেয় এমন ডি-ডি-টি অ্যান্টার্কটিকার পেঙ্গুইনের ফ্যাটেও পাওয়া গেছে।

সারা বিশ্বে নিউক্লিয়ার ওয়েস্টের পরিমাণ প্রায় ২০০,০০০ টন। স্বভাবতই প্রশ্ন আসে এই বিপুল পরিমাণ বর্জ্যপদার্থ নিয়ে আমরা কি করব? এক কথায় উত্তর দেওয়া বেশ কঠিন।

আর এও জানি যে কমপক্ষে এর ৫ শতাংশ আগামী হাজার হাজার বছর এই পৃথিবীতে থাকবে। উন্নতিশীল দেশগুলি যেমন ইংল্যান্ড, জার্মানি, হল্যান্ড, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া তাদের নিউক্লিয়ার বর্জ্যপদার্থ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে রপ্তানি করে। এর পিছনে প্রধান কারণ বর্জ্যপদার্থ বিনষ্টকরণ পদ্ধতি বেশ জটিল ও অর্থবহল। তবে তৃতীয় বিশ্বের দেশ এখন কিন্তু আমদানীর ব্যাপারে বেশ সতর্ক। ১৯৯১ সালে ‘বামকো’ চুক্তির মাধ্যমে দঃ আফ্রিকা বর্জ্যপদার্থ আমদানি বন্ধ করেছে। দঃ পূর্ব এশিয়া ও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলি কিন্তু এখনো আমদানি বন্ধ করে নি। একটি সার্ভতে জানা গেছে আমেরিকার রিসাইকেল্ড কমপিউটারের অর্ধেকই চীনে রপ্তানি হয়। তাছাড়া উন্নতিশীল দেশে যে সব দ্রব্য সামগ্রী নিষিদ্ধ প্রায় ৪৭ রকমের ওষুধ, ৫০০,০০০ টন কীট নাশক সেগুলো অনায়াসে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে বিক্রি হচ্ছে।

আমেরিকার কথাই ধরা যাক। আপাতদৃষ্টিতে এখানকার পরিবেশ অন্য দেশের তুলনায় বসবাস যোগ্য মনে হলেও এদেশে দূষণের বহর কম নয়। শিল্প হল এদেশের পরিবেশ দূষণের মূল কারণ। প্রায় ৩৭০ হাজার উৎপাদনশীল সংস্থা তাদের শিল্পজাত বর্জ্যপদার্থ নদী, লেক বা কোন স্ট্রিমে ফেলে দেয়। ইউ এস এনভায়রনমেন্ট প্রটেকশন এজেন্সির মতে দেশের প্রায় ৪০ শতাংশ নদী, লেক বা স্ট্রিমের জল এত দূষিত যে তা ব্যবহারের অযোগ্য। এই পলিউটেন্টের মধ্যে আছে ফসটেট, নাইট্রেট, মার্কারি, সীস, কস্টিক সোডা, সালফার, সালফিউরিক অ্যাসিড, পেট্রোকেমিক্যাল ও অন্যান্য সোডিয়াম কম্পাউন্ড। জমিতে ব্যবহৃত

কীটনাশকের ভূমিকাও কম নয়। সারা বিশ্ব জুড়ে কীটনাশকের ব্যবহার বেড়েই চলেছে। আমেরিকার স্যান জ্যাকুইন এ বছর কীটনাশক জনিত দূষণ একধাপে ৩৪ শতাংশ বেড়ে গেছে। যার ফলঃশ্রতু এখানকার এলাকার বাতাসে প্রায় ৬ শতাংশ স্মোক মেকিং গ্যাস বেড়েছে। কাজেই প্রতিদিন সারা পৃথিবীতে যে কত পরিমাণ কীটনাশক জনিত দূষণ ছড়াচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই। এই স্মোক গ্যাসের প্রকোপে প্রতি বছর অসংখ্য মানুষ অ্যাজমাতে ভোগেন। ১৯৯৭ সালে অ্যাজমা রোগীর আনুমাণিক সংখ্যা ছিল ১৪.৯ মিলিয়ন। তার মধ্যে শিশুর সংখ্যাই ছিল প্রায় ৫ মিলিয়ন। শুধুমাত্র পূর্ব আমেরিকাতেই ১৯৯৭ সালে ১৬০,০০০ মানুষ চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল ভর্তি হয়েছিলেন। পরিবেশের ক্ষতি করতে পাওয়ার প্লান্টের ভূমিকাও কম নয়। আমেরিকাতে প্রতি বছর পাওয়ার প্ল্যান্টএর দূষণের ফলে প্রায় ২৩,০০০ মানুষ মারা যান। ইউ এস এনভায়রনমেন্ট প্রটেকশন এজেন্সির তক্তাবোধনে একটি কন্সাল্টিং কোম্পানির রিপোর্ট এ জানা যায় ইউনিভার্সিটি অফ মেরিল্যান্ডের একটি পর্যবেক্ষক দল গত বছর আগষ্ট মাসে একটি পাওয়ার প্ল্যান্ট ২৪ ঘন্টা বন্ধ থাকার আগে ও পরে দূষণের মাত্রা পরীক্ষা করার জন্য সমীক্ষা চালায়। এতে দেখা গেছে প্ল্যান্টটি চব্বিশ ঘন্টা বন্ধ থাকার ফলে বাতাসে সালফারডাই অক্সাইড গ্যাসের পরিমাণ ৯০ শতাংশ এবং স্লগ স্মোকের পরিমাণ ৫০ শতাংশ কমে গেছে। বলাবাহুল্য অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বা পাওয়ার ইন্ডাস্ট্রি এই রিপোর্ট মানতে চান না। তবে ১৯৯৮ সালে একটি সরকারী রিপোর্টে জানা যায় বাতাসে ছড়িয়ে থাকা সালফারডাই অক্সাইডের ৬৭ শতাংশ, নাইট্রোজেন অক্সাইডের ২৫ শতাংশ, মার্কারির ৩৩ শতাংশ এবং কার্বন ডাই অক্সাইডের ৪০ শতাংশই আসে এই পাওয়ার প্ল্যান্টগুলি থেকে। এবারে হু-এর (ওয়ার্ল্ড হেলথ অরগানাইজেশন) একটি সাম্প্রতিক রিপোর্টের দিকে তাকানো যাক। মেক্সিকো সিটির নাম একদম উপরে। এই শহরের বাতাস হু এর মতে পৃথিবীর সবচেয়ে কন্ট্যামিনেটেড। যখন কোন ব্যাক্তির বছরে ৩৬৫ দিনের মধ্যে কম করে এক দিনও তার নিঃসৃত বাতাসে ১০০-১২০ পি পি বি (পার্টস পার বিলিয়ন) ‘ওজোন কন্ট্যামিন্যান্টস’ থাকে তাহলে সেই বাতাসকে কন্ট্যামিনেটেড বলে ধরা হয়। এই শহরের বাসিন্দাদের বছরে প্রায় ৩০০ দিনই তাদের নিঃশ্বাসে গড়ে ২৫০ পি পি বি ওজোন কন্ট্যামিন্যান্টস নিয়ে থাকেন। এর ফল স্বরূপ শহরের হাসপাতাল ও ক্লিনিকের রিপোর্ট অনুসারে ৪০০,০০০ মানুষ চিকিৎসার জন্য ভর্তি হন এবং কম করে ৩০০ !!! জন মানুষ মারা যান। দূষণ নিয়ে লিখতে গেলে পাঠকদের সামনে এরকম অজস্র উদাহারণ তুলে ধরা যেতে পারে। চলতেই পারে নানা যুক্তি তর্কের নানা ভারী ভারী পর্যালোচনা। যতই আমরা এই দূষণ নিয়ে আলোচনা করি না কেন, এই প্রভাব ক্ষণিকের। সাময়িকভাবে মনে রেখাপাত করলেও কয়েক মিনিটেই উধাও। যা হয় হবে, কি আর করা যাবে গোছের একটা আড়মোড়া ভেঙে ল্যাপটপের সাট-ডাউন করে দিলেই মস্তিষ্ক ফাঁকা। দু-পা দূরে লিভিং রুমের সোফায় একটা জম্পেশ সিনেমা চালিয়ে দিলেই ব্যস... মনটা ফুরফুরে হালকা।

অশোকের রক্তিমরাগে

প্রবন্ধ সমগ্র ।। মতামত ।। সূচীপত্র

 প্রবন্ধ সমগ্র

অশোকের
রক্তিমরাগে
সুস্মিতা দত্ত
কলকাতা

শোকের রক্তিমরাগে
রাঙা হাসি রাশি রাশি অশোকে পলাশে
রাঙা নেশা মেঘে মেশা প্রভাত আকাশে  

                                        ----- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

 

অশোকের রক্তরাগ মাখানো আকাশ হৃদয়ে দোলা জাগিয়ে ঋতুরাজ বসন্তের আগমন বার্তাকে সূচিত করে। মেতে ওঠে প্রতিটি হৃদয় রঙের খেলায়। অশোক ভারতীয় সংস্কৃতির সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত শুকনো পাহাড়ী অঞ্চলের বিশেষত গ্রাম বাংলার রাঢ় অঞ্চলের একটি বিলুপ্তপ্রায় বৃক্ষ। বৈজ্ঞানিক নাম Saraca Asoca। একে আঙ্গনপ্রিয়া বা হেমপুষ্প ও বলা হয়।  সব শোক হর্ন করায় এর আর এক নাম অশোক অর্থাৎ নাই শোক বা শোকবিহীন বৃক্ষ।    

ভারতীয় পৌরাণিক চরিত্র কুবেরের যক্ষিণীর সাথে জড়িত এই অশোক বৃক্ষ। ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীন বৌদ্ধ ও হিন্দু মন্দিরের প্রবেশদ্বারের শিল্পকলায় এর স্থাপত্য নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায়। 

অশোক গাছের নিচে মূলে দণ্ডায়মান প্রস্ফুটিত ফুলের শাখা হাতে নারী মূর্তি উর্বরতার দেবীর প্রতীকী হিসেবে গণ্য করা হয়। হিন্দুশাস্ত্র মতে প্রেমের দেবতা কামদেবের পঞ্চবাণের একটি পুষ্প এই অশোক ফুল। আবার হিন্দু মহাকাব্য রামায়ণে সিঙ্ঘলরাজ রাবণ রামচন্দ্রের সীতাকে এই অশোক বাটিকাতেই বন্দিনী করে রেখেছিলেন যেখানে প্রভুভক্ত হনুমান মাতা সীতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ভারতীয় সাংস্কৃতিক পরম্পরায় এই পবিত্র বনস্পতিটি প্রতিবছর চৈত্রমাসে পূজিত হয়।

চিরসবুজ প্রকৃতির শিম্বগোত্রীয় এই উদ্ভিদটি ১৫-২০ মিটার লম্বা হয়ে থাকে। পাতাগুলি ১৫ সেন্টিমিটার দীর্ঘ আয়তাকার। হলুদ-কমলা বা লাল রঙের গুচ্ছাকারে সারা বছর ফুল ফোটে, তবে মার্চ থেকে মে মাসে প্রচুর পরিমাণে দেখা যায়। ফুলগুলি সুগন্ধিযুক্ত। ফলগুলি মসৃণ, চর্মকৃত

পাতা

ফুল

ফল ও বীজ

চওড়া। জন্মস্থান উষ্ণমন্ডলীয় বৃষ্টি প্রধান অঞ্চল প্রধানত ভারত, বর্মা ও মালয়েশিয়া। ভারতে এটি হিমালয় অঞ্চলে, কেরালা, দাক্ষিণাত্য মালভূমি অঞ্চলে এবং পশ্চিমবঙ্গে দেখা যায়। পবিত্র এই উদ্ভিদটির ছাল, পাতা, বীজ, ফুল সবই মূল্যবান ঔষধি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই ঔষধিটির ছালে রয়েছে tannins, flavonoids, steroids, volatile oil, glycosides, and various steroidal glycosides. পাতা থেকে পাওয়া যায় carbohydrates, tannins, gallic acid এবং egallic acid.  ফুলগুলি সমৃদ্ধ saracasin, saracadin, waxy substances, proteins, carbohydrates and steroids এ এবং বীজে রয়েছে বিভিন্ন fatty acids, oleic, linoleic, palmitic and stearic acid. তিক্তস্বাদ বিশিষ্ট এই ঔষধিটি ক্ষত, আলসার, টিউমার দূরীকরণে ও রক্তক্ষরণ রোধে ব্যবহৃত হয়। এই ঔষধিটির স্বাভাবিক পরিষ্কারক ধর্ম থাকায় এটি শরীরের বিষক্রিয়া দুর করে সাহায্য করে। শীতলকারক এই বনস্পতিটি শুধু কৃমিনাশকই নয়, এটি হৃদরোগের মহাষৌধ, শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে, ক্লান্তি দুর করে এবং হরমোনের সমতা বিধান করে। রক্তের উপাদানগুলির ও রক্ত সঞ্চালন নিয়মিত করে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া মহিলাদের বাধক যন্ত্রণা দূরীকরণ এবং ঋতুস্রাব নিয়মিত করতে, জরায়ু রক্তক্ষরণ ও জরায়ু টিউমার, ডিম্বাশয়ের সিস্ট, প্রদরস্রাব সারাতে এটি একটি উল্লেখযোগ্য ঔষধি। এছাড়াও পিত্ত ও কলিক যন্ত্রণার ঔষধ।উপকারী এই ঔষধি বৃক্ষটিকে শহরাঞ্চলে রাস্তার দুধারে রোপন করা হলে  ছায়াপ্রদানের সাথে সৌর্ন্দ্রয্যায়ন ও হবে এবং অবলুপ্তির হাত থেকে রক্ষিত হবে।

প্রবন্ধ সমগ্র ।। মতামত ।। সূচীপত্র

স্বপ্ন-সত্য-বাস্তব
 প্রবন্ধ সমগ্র
Mijanur Rahman.jpg

স্বপ্ন-সত্য-বাস্তব

মিজানুর রহমান মিজান

বিশ্বনাথ, সিলেট, বাংলাদেশ

envpoll2.jpg

ডিগ্রি পরীক্ষার রেজাল্ট আউট হয়েছে তিন দিন পূর্বে জানা থাকা সত্ত্বে ও একটা অজানা আশঙ্কা, দ্বিধা, সংকোচে ফলাফল দেখতে শফিক কলেজে যাচ্ছে না। ঘনিষ্ঠ বন্ধুর অনুরোধে সবার অলক্ষ্যে চুপিসারে ঐদিন রাত্রে কলেজে যাবার পথে সহপাঠী আতাউর যখন বলল, “শফিক পাশ করেছ জেনে ও কেন আমাকে দেখা দিচ্ছ না? আতাউর ও শফিক একই সঙ্গে ডিগ্রি পরীক্ষা দিয়েছিল, পাশ ও করেছে। কিন্তু' শফিক এ মাত্র যাত্রারম্ভ করেছে বাস্তব ও সত্যতা যাচাই করতে ফলাফল সম্পর্কে। কারণ শফিকের মনে একটা দ্বন্ধ। সে পাশ করতে পারবে কি না? আজ ঘনিষ্ঠ বন্ধু কয়েছ দু‘বার পরীক্ষায় ফেল করে পড়াশুনা ছেড়ে দিয়ে বেকার জীবন কাটাচ্ছে। দরিদ্র পিতামাতার এক মাত্র সন্তান শফিক হওয়া সত্ত্বে ও অমানসিক পরিশ্রম আর কষ্টের বিনিময়ে দ্বিতীয় বিভাগে এস এস সি পাশ করেই একটি দোকানে চাকুরী গ্রহণ করে। চাকুরীতে অনভ্যাস' এবং ভোর ৬টা থেকে এক নাগাড়ে রাত্রি ১২টা পর্যন্ত কর্তব্য ও দায়িত্ব পালনে শারীরিক অবস্থা অত্যন্ত কাহিল হয়ে পড়ায় চাকুরীতে ইস্তফা দিতে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। কারণ শফিকের কাজে ফাঁকি দেয়ার বিন্দু মাত্র ইচ্ছে নেই। বরং অতিরিক্ত কাজ করতে ইচ্ছুক বা সদা প্রস্তুত। সুতরাং মালিক পক্ষ শফিকের দায়িত্ববোধ, কর্তব্যে একনিষ্ঠতা ও সততায় মুগ্ধ হয়ে বার বার থাকার অনুরোধ উপেক্ষা করে একদিন চলে আসে। প্রাপ্ত বেতনের সামান্য অংশ আট সদস্যের পরিবারে খরচ করে বাকী টাকা দ্বারা কলেজে একাদশ বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয় যদি ও সে ছাত্র ছিল মানবিক বিভাগের এস এস সি-তে। শফিক লেখাপড়ায় অত্যন্ত ভাল ছিল বলে আলাদা একটা সুনামের অধিকারী ছিল স্কুল সহ এলাকায়। অনেক সহপাঠী চ্যালেঞ্জ করে ও দ্বিতীয় স্থানে পিছু হঠাতে পারেনি কখন ও। প্রত্যেকটা পরীক্ষায় প্রথম থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত ফাষ্ঠ বয় হিসেবে উত্তীর্ণ হয়েছে।১৯৭৭ সালে শহর ব্যতীত পল্লী অঞ্চলে কোন কলেজ শফিকের এলাকায় ছিল না। তাছাড়া শফিকের বাড়ি থেকে শহরের দূরত্ব ছিল (১২ মাইল) প্রায় ১৮ কিলোমিটার। শহরের সাথে যোগাযোগের এক মাত্র ব্যবস্থা ছিল রেলওয়ে। বাড়ি থেকে ৫ কি.মি পায়ে হেটে ষ্টেশন পর্যন্ত পৌছাব। সেখান থেকে ট্রেনে শহরে পৌছা অবলম্বন। কোন দিন ট্রেন ফেল করলে শ্রীচরণের উপর নির্ভর করে অভীষ্ট বা গন্তব্যস্থল'ল কলেজে পৌছতে হত। তবে এখনকার মত নয়টার ট্রেন কয়টায় ছাড়ে  এ প্রশ্নের উদ্রেক হত না। যথা নিয়মে নির্দিষ্ট সময় ট্রেন চলাচল ছিল নৈমিত্তিক ব্যাপার, দৈবাৎ ব্যতিক্রম ছাড়া। সুতরাং ট্রেন ফেলের ভয়ে সেহরীসম খাবার খেয়ে শহরে পৌঁছে দশটার তথা ক্লাস আরম্ভ হবার পূর্বক্ষণ পর্যন্ত হোটেল অথবা কলেজের ক্যান্টিনে বসে সময় কাটাতে হত। তবে একটা সুন্দর ও আনন্দ ঘন পরিবেশ ছিল অত্র এলাকা থেকে তখন কলেজ যাত্রী ছাত্র সংখ্যা প্রায় চল্লিশ জনের মত ছিল নিয়মিত। শফিক বন্ধুদের সাহচর্যে থেকে ক্লাস করে। তারপর ও নিয়তির অমোঘ বিধান আর ভাগ্যের সুপ্রসন্নতা বুঝি অদূরে থেকে মিটি মিটি হাসছিলেন। অর্থনৈতিক দুরাবস্থা এবং পারিবারিক দায়িত্ব বোধে সচেতনতার জন্য চাকুরী বা অর্থোপার্জন অতীব জরুরী হয়ে পড়ে। সমস্যা জর্জরিত জীবনে পড়ালেখায় মনোযোগী কতক্ষণ থাকা সম্ভবপর? চারদিক থেকে অমাবস্যার আঁধার চাঁদের আলোকে ম্লান করে দেয় ধীরে ধীরে। অন্যনুপায় হয়ে একজন উকিলের সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করে দিনের বেলা। প্রয়োজন আর বাস্থবতার নিরিখে কলেজের দিবা বিভাগ থেকে নৈশ বিভাগে পরিবর্তন আনতে হয়। তিন মাস বিজ্ঞান বিভাগে পড়ার সুবাদে স্যারদের আশ্বাস বাণী বা আত্ম-বিশ্বাস এসেছিল শফিকের প্রতি মানবিক বিভাগ থেকে আসলে ও বিজ্ঞান বিভাগে সফলতা অর্জনের সম্ভাবনার পরিচয়। কিন্তু' নৈশ বিভাগে বিজ্ঞান বিভাগের সুযোগ ছিল না। তবে সবচেয়ে আশার কথা তখন নৈশ বিভাগ ছিল মদন মোহন কলেজ বলে অন্তত পক্ষে শফিকের লেখাপড়া করার একটা পথ ছিল। নতুবা অকালে ঝরে পড়ত অত্যন্ত আগ্রহী থাকা সত্ত্বে ও। সে সময় বর্তমানের মত এত সুযোগ বা বেসরকারী ব্যবস্থা'ও ছিল না। যা হোক শফিক গ্রুপ পরিবর্তন করে বাণিজ্য বিভাগের বই পত্র পুরাতন ক্রয় করে পরিচিত অগ্রজ এক জনের নিকট থেকে। কলেজ যাত্রী সহপাঠীদের সহিত আংশিক সাহচর্য রল শফিকের ভাগ্য লিপির খাতায়। সকালের ট্রেনে প্রতি দিন সবার সহযাত্রী থাকা সম্ভব হল না। বন্ধুরা কলেজের পাঠ সমাপ্তির পর বিকাল বেলার ট্রেনে বাড়ি অভিমুখে রওয়ানা। আর শফিক দিনের বেলা কর্তব্য পালনের পর নৈশ বিভাগে ক্লাস করে রাত্রি দশটার ট্রেনে বাড়ি অভিমুখে যাত্রা করে গৃহে পৌঁছে আহার বিহার সমাপ্তির পর নিদ্রা দেবীকে জড়িয়ে কতক্ষণ পর সেহরী তুল্য আহার গ্রহণ এবং গোসল, পোষাক পরিচ্ছদ পরিধানের পর প্রাত্যহিক কাজ শুরু করতে সময় কতটুকু থাকে, তা সহজে অনুমেয়। তথাপি শফিকের জীবন যুদ্ধ থেমে নেই।

একজন অকুতোভয় সৈনিক হিসেবে যুদ্ধ ক্ষেত্রে অগ্রযাত্রী রূপে অগ্রসরমান। 

বৈচিত্র্যময় পৃথিবীর বিচিত্র রূপ সর্বক্ষণ ধারণ করে চলছে কালের চাকায় পিষ্টতার নিরিখে। সমাজ, সামাজিকতা পরিবর্তনশীল অহরহ নিত্য নুতন রূপে। আরো বিচিত্রিতা বৈচিত্র্যময় বাংলার শ্যামল সুন্দর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মন্ডিত প্রান্তরে কত মানুষ কত রূপে যে জীবন যাপিত করছে তার হিসাব আমরা বা ক‘জন রাখি? আমরা প্রয়োজন বোধ করি ? তবে জেনে রাখা ভাল সম্ভব হলে এ প্রয়োজনটুকু বোধ আপন নিবাস থেকে চাওয়া-পাওয়া রূপে। এতে লাভ ছাড়া ক্ষতি দেখি না। একাধারে দু‘মাস শফিক আইনজীবির সহকারী হিসেবে ব্যয় করে যদি ও একটু স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছিল। কিন্তু' তার মনে অজানা একটা শঙ্কা ও সংকোচ বোধ ছিল সদা জাগ্রত।

“এখানে নয়, অন্য খানে, অন্য কোথাও “এ ভাব বা বোধে ছিল মত্ত। সত্যিই এক দিন এ কাজে ইস্তফা দিয়ে ঢুকে পড়ে সাব রেজিষ্টারী অফিসে নকল নবীশ পদে যোগদানের মাধ্যমে। নকল নবীশ চাকুরী থেকে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা পাশ করে তৃতীয় বিভাগে। শফিক দারুণ চিন্তায় পতিত হল। তৃতীয় বিভাগে পাশ করা কাম্য ছিল না। কিন্তু' ভোর বেলা বাড়ি হতে রওয়ানা হয়ে রাত ১২ টা - ১টায় এসে লেখাপড়ার সুযোগ কতটুকু তা আবার একটু তীক্ষ্ন দৃষ্টি প্রখরতা মেলে দিলে অংক মেলবে। তথাপি শফিকের জীবন যুদ্ধ থেমে নেই। কারণ পৃথিবী ঘূর্ণায়মান, আর জীবন চলমান, চলতেই হবে। চলা থামানো সম্ভব নয় এ দুনিয়ার ঘূর্ণিপাকে।

এত পরিশ্রম করে শারীরিক, মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত' হয়ে চিন্তার মহাসমুদ্রে সাতার কেটে চলেছে। কোন কুল কিনারা নেই। চোখের সম্মুখে ভেসে উঠে মা-বাবা-বোনদের করুণ চাহনি। অপর দিকে লেখাপড়ার অত্যন্ত আগ্রহ, ইচ্ছাকে দমন করতে ও বিবেক নামক বস' বার বার দায়িত্ববোধ ও কর্তব্য সচেতনতার ঘণ্টা অনবরত চোখের সামনে তুলে ধরে। তাছাড়া ডিগ্রি ক্লাসে লেখাপড়া করা কতটুকু সহজ বা কঠিন তা শিক্ষিত মাত্রই জ্ঞাত। ঐ হোক অনেক ভাবনা চিন্তার পর ভর্তি হল ঠিকই ফাষ্ট ইয়ারে নাইট বিভাগে। কিন্তু' লেখাপড়ার পরিধি এবং কাজের সমন্বয় সাধনে অসামঞ্জস্যতা দেখা দেয়। এক মাস ক্লাস করার পর লেখাপড়া ছেড়ে দেবার সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হয় বাধ্য হয়ে চাকুরীকে ধরে রেখে। এখানে মনে হয় ভাগ্য দেবী সুপ্রসন্ন হয়ে শফিককে আহবান জানান প্রথম থেকে দশম পর্যন্ত পঠিত একটি মাদ্রাসায় শিক্ষক হিসেবে যোগদানের। শফিক বহু চিন্তা ভাবনার পর সিদ্ধান্ত নেয় অন্তত পক্ষে শহরে যাওয়া আসার সময়টুকু বাঁচবে। অপর পক্ষে মাদ্রাসা বাড়ির নিকটবর্তী এবং শিক্ষকতায় লেখাপড়ার সহায়তা ও অর্থনৈতিক দিক সচল থাকবে। নিজের পক্ষে লেখাপড়ার পথ সুগম হবে। সুতরাং স্কুলে (মাদ্রাসায়) যোগদান করাই শ্রেয় বিবেচনায় চাকুরী ছেড়ে বাড়িতে আসে। মাদ্রাসায় শিক্ষক হিসেবে এক বছর অতিক্রান্তে সাধ্য মত লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করে।

এমনি সময় ডাক আসে শফিকের নিজ অধ্যয়নকারী হাই স্কুলে যোগদানের নিমিত্তে। এলাকার আহবানকে স্বাগত জানিয়ে আনন্দ চিত্তে যোগদান করে ঐ স্কুলে সহকারী শিক্ষক রূপে। স্কুলে ঐ সময় তারই অপর এক সহপাঠী ও যোগদান করে। সহপাঠির লেখাপড়া নিয়মিত সচল থাকলে ও শফিক অনিয়মিত। ফাষ্ট ইয়ার থেকে সেকেন্ড ইয়ারে উত্তীর্ণ পরীক্ষা শফিকের দেয়া সম্ভব হয়নি নানাবিধ জটিলতার কারণে। লেখাপড়ার ক্ষেত্রে যবনিকাপাত ঘটেপ্রায় শফিকের জীবনে। কিন্তু' টেষ্ট পরীক্ষার মাত্র এক মাস পূর্বে শফিকের ভাবান্তর ঘটে, দারুণ আগ্রহ ও ঝোঁক চেপে বসে মাথায় এবং অধ্যক্ষের নিকট যোগাযোগ করে তার হৃদয়ের আর্তি অতি যত্ন সহকারে প্রকাশ করে তিনির দোয়াসহ অনুমতি প্রার্থী হয়।

শ্রদ্ধেয় অধ্যক্ষ মহোদয় শফিকের অদম্য স্পৃহা, আগ্রহ, ইচ্ছা, অনুপ্রেরণা, উৎসাহ উদ্দীপনায় মুগ্ধ হয়ে শেষ পর্যন্ত অনিচ্ছার ইচ্ছা প্রকাশ বা মতামত প্রদান করেন। শেষ পর্যন্ত পরীক্ষার ফলাফলে সবাইকে চমকে দিয়ে উত্তীর্ণ হয়। কিন্তু' সহপাঠী (যে নিয়মিত) অবিশ্বাস্য ও অপ্রত্যাশিত ভাবে ফেল করে। কিন্তু' আমি নির্ধিদ্বায় ও অত্যন্ত সচেতনতার সহিত বলতে পারি দৃঢ়তার সঙ্গে নকল নামক শব্দটির সঙ্গে শফিক ছিল সম্পূর্ণ অজ্ঞাত ,অখ্যাত। শফিকের মেধা শক্তিই তার সাফল্যের চাবি কাঠি। কিন্তু' লজ্জায় এ সকল প্রতিভা থেকে যায় অজ্ঞাত, লোক চক্ষুর অন্তরালে। পল্লীতে এমন অনেক প্রতিভা সুপ্ত বিকশিত হতে পারে না দারিদ্র্যতার কষাঘাতে জর্জরিত থাকার ফলে। ওরা পারে না নীচে নামতে। আবার উপরে উঠার সিঁড়ি থাকে নাগালের বাইরে। অপর শফিকের প্রতিভা যেন বিকাশের পথ সহজ সাধ্য হয় এ কামনা সর্বান্তকরণে, সর্বক্ষণ।

“ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়“ যত বাধা বিপত্তি আসুক না কেন? জয় হোক স্পৃহা ও বাসনার সর্বকালে।

অলৌকিক সংলাপ

প্রবন্ধ সমগ্র ।। মতামত ।। সূচীপত্র

 প্রবন্ধ সমগ্র

অলৌকিক

সংলাপ

দিলীপ মজুমদার

পর্ণশ্রী, বেহালা, কলকাতা

mahalaya1.jpg

হালয়ার কাকভোরে জাগ্রত হলাম নিদ্রা থেকে। জাগ্রত হতে বাধ্য হলাম বলাই ভাল। এ তো কবিদের প্রিয় শরৎ নয়। তা যদি হতো তা হলে দিনভোর রাতভোর থাকত না এমন তাপপ্রবাহ। আকাশে বাতাসে স্নিগ্ধতার লেশমাত্র নেই। নেই পুজোর আগাম কোন গন্ধ। নিস্পন্দ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বৃক্ষগুলি। পথ হারিয়েছে বাতাস। তাই ঘর্মাক্ত হয়ে জেগে উঠলাম কাকভোরে।
আজ মহালয়া। একটু পরে শুরু হবে মহিষাসুরমর্দিনী। বীরেন্দ্রকৃষ্ণের জলদগম্ভীর কণ্ঠস্বরে। তারপরে টি ভি-র হরেক চ্যানেলে হরেক বেশে সজ্জিত হয়ে বিচিত্র দৃশ্যের অবতারণা করবেন হরেক অভিনেতা-অভিনেত্রী।
আবছা অন্ধকার আছে এখনও। ভাবছিলাম অলৌকিক কোন উপায়ে যদি দেখা হয়ে যেত মা দুগ্গার সঙ্গে! দেখা হলে করজোড়ে মাকে বলতাম:  হে মা দুগ্গা, তোমার অসুরবধের কথা শুনে আসছি বহুকাল; এবার মা তুমি তাপাসুরনাশিনীরূপে আবির্ভূত হও। মাগো, ঋতুরঙ্গের কথা আমরা বিস্মৃত হতে বসেছি। শিশুপাঠ্য রচনা ছাড়া আর কোথাও নেই ঋতুরঙ্গের কথা। সম্বৎসর গ্রীষ্মের দাপট। শেষপর্যন্ত তোমার সন্তানরা তাপদগ্ধ হয়ে কি বেঘোরে প্রাণ হারাবে!

একথা ভাবার পরে মনে হল আমার কথা খণ্ডন করার জন্য মা যদি বিপরীত যুক্তি প্রতিস্থাপন করেন! যদি বলেন: বৎস, স্বকৃত পাপের ফল ভোগ করছ তোমরা। বসত গড়ার অভিপ্রায়ে বন কেটেছ নির্বিচারে, বিষাক্ত গ্যাসে ভরিয়ে দিয়েছ ভুবন, নিজেই নিজের পায়ে মেরেছ কুড়ুল। আমার তো কিছু করার নেই বাছা। মা দুগ্গা একথা বললে কি উত্তর দেব, তারও একটা খসড়া তৈরি করে নিলাম মনে মনে।

বলব: "মা, তুমিই তো আমাদের বুদ্ধি দিয়েছ। নবনবোন্মেষশালিনী প্রতিভা দিয়েছ। সেই বুদ্ধি আর প্রতিভা তো প্রগতির সমস্যা সৃষ্টি করেছে মা। উল্লম্ফনের নাম যে প্রগতি। মানুষ তো এক পা আগে দুই পা পিছে করে চলতে পারে না।মনে এইসব চিন্তার তরঙ্গ চললেও নিদ্রার ঘোর ছিল। হঠাৎ চোখের সামনে একটা তীব্র আলোর ঝলকানি। চোখ মেলে তাকিয়ে আমি ঘাবড়ে ঘোড়া। এ কি! আমার সামনে যে স্বয়ং মা দুগ্গা! কিন্তু কোথায় তাঁর দশটি হস্ত! হস্তে হস্তে প্রহরণ! কোথায় অসুরবধের পরিচিত উল্লাস! তাঁর করুণাঘন আয়ত চক্ষুদুটি আমার সব সন্দেহ নিরসন করল।আরে, এতো আমাদের দেশের বাড়ির সুবোধকাকুর বানানো দুগ্গার চক্ষুদুটি। অবিকল। নতজানু হয়ে বললাম: "আমি ধন্য মাগো। আমার মনের ভাবনা শুনে দেখা দিলে তুমি। আর কদিন বাদে

আসছ তুমি, তার আগে তোমাকে আসতে হল। কিন্তু মা, এ কি রূপে দেখছি তোমায়!" মা বললেন,

"কেন বাছা, একথা কেন?" বললাম:

"কোথায় গেল তোমার দশটি হাত, দশ হাতে দশটি প্রহরণ?" মা মৃদু হাসলেন।

তারপরে বললেন: "আমার দশপ্রহরণধারী রূপটা কল্পনায় সৃষ্টি করেছ তোমরা। নারীশক্তির কল্পনা। কিন্তু নিজেরাই নিজেদের কল্পনাকে নির্মমভাবে বিনষ্ট করে দিয়েছ।"

বুঝতে পারলাম না মা কি বলতে চাইছেন।

সেটা বুঝে তিনি বললেন:

"অপ্রতিহত গতিতে চলে আসছে পুরুষতন্ত্র। পদদলিত হচ্ছে নারী। মহোৎসব চলছে ধর্ষণ খুন হত্যার। পরিসংখ্যানগুলো উল্টেপাল্টে দেখ।"

সব্বোনাশ!! পরিসংখ্যানের কথা যখন বলছেন তখন তো রীতিমতো হোমওয়ার্ক করে এসেছেন মা। তাঁর কসমিক স্মৃতির সঙ্গে পাল্লা দেওয়া তো অসম্ভব। তাই কথা ঘুরিয়ে ভিন্ন প্রসঙ্গে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। তাই বললাম:

"মা, কদিন বাদেই তো আসছ, সব গোছগাছ করে রেখেছ তো!" মা বললেন:

"আনার এখানে আসাটাকে তো তোমরা বেশ উৎসব আর ব্যবসা বানিয়ে ফেলেছ। আমি এখানে এলে তোমাদের চাহিদা মতো আওড়ে যাও মন্ত্র। ভাবো সেসব মন্ত্রে খুশি হব আমি!" 

এসব কি বলছেন জগজ্জননী! বুঝতে না পেরে তাকিয়ে থাকি বোকার মতো। মা বলেন:

"মন্ত্র আওড়ে কি চাও ভাবো তো দেখি। জয় চাও, যশ চাও, ধন চাও, বিঘ্ন বিপদ থেকে উদ্ধার চাও। অসুর আসলে সেইসব বিঘ্নবিপদের প্রতীক। তাই তোমাদের কল্পনা অসুরনাশিনীর মূর্তি সৃষ্টি করেছে। তোমরা ভণ্ড। তোমাদের উপর আর কোন অনুকম্পা আমার নেই। বিজ্ঞান আর প্রযুক্তিকে হাতিয়ার করে, প্রগতির জয়োল্লাস করে তোমরা হত্যা করেছ ঈশ্বরকে, বিনষ্ট করেছ প্রকৃতিকে, ধ্বংস করেছ নৈতিকতা-মমতা-ভালোবাসাকে। বিকল্প নির্মাণ কিছু করনি। কেবল বিনষ্টির তাণ্ডব। সেই সঙ্গে নিজেদের অগোচরে ছড়িয়ে দিয়েছ সন্দেহ আর সংশয়ের বীজ, ঘৃণা আর অবিশ্বাস আর নির্মোহ নৈর্ব্যক্তিকতার শত শত বীজ।"

শেষদিকে মা দুগ্গার কণ্ঠস্বরে বেশ রূঢ়তা ও বক্রতা এসেছিল। ঠিক সে সময় ভেসে এল বীরেন্দ্রকৃষ্ণের গম্ভীর কণ্ঠস্বর। ঘোর কেটে গেল আমার।

শকুন্তলা, শকুন্তলা

প্রবন্ধ সমগ্র ।। মতামত ।। সূচীপত্র

 প্রবন্ধ সমগ্র

শকুন্তলা, শকুন্তলা

এবং শকুন্তলা

সুবিমল চক্রবর্তী

ডালাস, টেক্সাস

shakun2.jpg

প্রবন্ধের নাম দেওয়া যেতে পারত “মহাভারতের দুষ্যন্ত-শকুন্তলা, কালিদাসের অভিজ্ঞান শকুন্তলা, এবং সেলিম আল-দীনের শকুন্তলা”। সবগুলোতেই নায়িকা শকুন্তলা এবং কাহিনি তিন ক্ষেত্রেই আবর্তিত হয়েছে শকুন্তলাকে কেন্দ্র করে। প্রথমটির বয়স সম্ভবত আড়াই হাজার বছর, দ্বিতীয়টির দেড় হাজার বছরেরও বেশি এবং তৃতীয়টি হাল আমলের। মহাভারতের কথিত রচয়িতা কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস ও কালিদাস এক অর্থে বা বলতে গেলে প্রায় একই কাল এবং স্থানের বাসিন্দা ছিলেন এবং তাই একই আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবেশের ফসল ছিলেন। স্পষ্টত ডঃ সেলিম আল-দীন বেড়ে উঠেছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশে। তাই শকুন্তলা আখ্যান তিন হাতে তিনটি ভিন্ন রূপ পেয়েছে। আমাদের বর্তমান প্রবন্ধটিতে এই তিন হাতের তিন রূপের উপরই আলোকপাত করতে সচেষ্ট হব।

মহাভারত নাটক নয়, মহাকাব্য। কিন্তু কালিদাসের শকুন্তলা এবং সেলিম আল-দীনের শকুন্তলা এই দুটোই নাটক। মহাভারতের বিভিন্ন চরিত্র ও উপকাহিনি নিয়ে ভারতের বিভিন্ন ভাষায় যুগে যুগে অজস্র সাহিত্য রচিত হয়েছে। সৃজনী সাহিত্য স্বাভাবিকভাবেই ব্যাসদেববর্ণিত চরিত্র বা কাহিনিকে নিরঙ্কুশভাবে আঁকড়ে ধরে থাকেনি। সৃজনী সাহিত্যে সময়, স্থান এবং লেখকের ভাবাদর্শ এবং জীবনের অভিজ্ঞতার প্রভাব পড়বেই। এই সত্যটুকু মনে রাখলে আমাদের আলোচনার বুঝতে সুবিধে হবে।

কালের হিসেবে এটা ধরে নেওয়াটা অসঙ্গত হবে না যে মূলত মহাভারতই কালিদাস এবং সেলিম আল-দীনের নাটকের মূল এবং প্রধান অনুপ্রেরণা। হয়ত এটাও বলা অসঙ্গত হবে না যে সেলিম আল-দীনের উপর কালিদাসের শকুন্তলারও পরোক্ষ প্রভাব রয়েছে। তবে একটা সতর্ক উচ্চারণ এখনি করে রাখা আবশ্যক। আর সেটি হচ্ছে, সেলিম আল-দীন শকুন্তলার চরিত্রচিত্রণে তাঁর যুগের প্রভাবকে অস্বীকার কতে পারেননি, তাই তাঁর শকুন্তলা ব্যাসদেব এবং কালিদাসের শকুন্তলা থেকে অনেক দূরে সরে এসেছে। সেলিম আল-দীনের শকুন্তলার যন্ত্রণার মাত্রা ও তীব্রতা পৌরাণিক শকুন্তলা এবং সংস্কৃত নাটকের শকুন্তলার যন্ত্রণার মাত্রা ও তীব্রতার মধ্যে বিস্তর ব্যবধান।

মহাভারতের শকুন্তলা

প্রথমে মহাভারতের কাহিনিটি সংক্ষেপে বর্ণনা করা যাক। পুরুবংশীয় বীর্যবান রাজা দুষ্যন্ত সমস্ত পৃথিবী শাসন করতেন। তিনি একবার শিকারে বেরিয়ে বহু পশু বধ করে ক্লান্ত হয়ে পড়েন। বিশ্রামের জন্য তাই শান্ত মনোরম অন্য এক বনে প্রবেশ করেন। সেই বনে মালিনী নদীর তীরে কণ্ব মুনির আশ্রম। হিংস্র পশুরাও এই বনে শান্তস্বভাবের। আশ্রমের ভেতরে ঢুকে মুনির দেখা না পেয়ে উচ্চকণ্ঠে বললেন, এখানে কে আছেন? বেরিয়ে এল মনোমুগ্ধকর এক সন্ন্যাসী বালিকা রাজাকে স্বাগত জানাতে। রাজাকে জানাল, তার পিতা কণ্ব ফলের সন্ধানে বেরিয়েছেন এবং তিনি শিগগিরই চলে আসবেন। ‘সুনিতম্বিনী চারুহাসিনী রূপযৌবনবতী’ কন্যার পরিচয় জানতে চাইলেন বিমোহিত রাজা। বালিকা বলল, কণ্ব মুনি তার পিতা। রাজা জানতেন যে কণ্ব ঊদ্ধরেতা সিদ্ধ পুরুষ; তিনি কিভাবে সন্তানের জন্ম দেবেন? বালিকা তার জন্মের কাহিনি শুনে ফেলেছিল যখন কণ্ব একদিন সেই কাহিনি শুনিয়েছিলেন আরেক ঋষিকে। বালিকা তার জন্মবৃত্তান্ত রাজাকে শোনালঃ দেবরাজ ইন্দ্র মুনি বিশ্বামিত্রের ঘোর ভীত হয়ে তাঁর ধ্যান ভঙ্গ করার জন্য চক্রান্ত করে স্বর্গের অপ্সরী মেনকাকে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেন। নৃত্যরতা মেনকার বসন বায়ু হরণ করে নিলে বিশ্বামিত্র নগ্নিকাকে দেখে নিজেকে আর স্থির রাখতে পারলেন না। বিশ্বামিত্র ও মেনকার সঙ্গমে এক বালিকা সন্তানের জন্ম হ’ল। মেনকা নবজাতিকাকে মালিনী নদীর তীরে রেখেই ইন্দ্রসভায় ফিরে গেলেন। সেই সন্তানকে প্রাথমিকভাবে শকুন্ত অর্থাৎ পাখিরা পালন করল বলে তার নাম হ’ল শকুন্তলা। মহর্ষি কণ্ব কুড়িয়ে নিলেন এবং আশ্রমে গিয়ে নিজের দুহিতার মত লালনপালন করতে লাগলেন।

রাজা বিশ্বামিত্রের ঔরসজাত শকুন্তলাতো রাজপুত্রী। দুষ্যন্ত শকুন্তলাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। আর বললেন, তাঁর সমস্ত রাজ্য শুধুমাত্র শকুন্তলার। শকুন্তলা পিতার আদেশের জন্য ও পিতাকর্তৃক সম্প্রদানের জন্য অপেক্ষা করতে চাইলে রাজা বললেন, গান্ধর্বরীতিতে বিয়ে হবে এবং এই বিয়েই শ্রেষ্ঠ বিয়ে। শকুন্তলা শর্ত আরোপ করলঃ তার সন্তান যুবরাজ হবে এবং দুষ্যন্তের পরে সে-ই হবে রাজা। রাজা বললেন, তথাস্তু। আর আশ্বাস দিলেন, রাজা রাজধানীতে ফিরে গিয়ে চতুরঙ্গিনী সেনা পাঠাবেন শকুন্তলাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কণ্ব আশ্রমে ফিরলেন এবং দিব্যদৃষ্টিতে সবকিছুই জানতে পারলেন। লজ্জাবনতা শকুন্তলা আশ্বস্ত হ’ল যখন বুঝতে পারল যে পিতা খুব খুশি হয়েছেন। কণ্ব বর দিলেন, পুরুবংশীয়গণ ধর্মিষ্ঠ হবে এবং তারা কক্ষনো রাজ্যচ্যুত হবে না। তিন বছর পর শকুন্তলা একটি ‘সুন্দর মহাবলশালী অগ্নিতুল্য দ্যুতিমান’ পুত্র প্রসব কর। সকল পশুকে দমন করতে পারত বলে আশ্রমবাসীরা তার নাম দিল সর্বদমন। সর্বদমনের যুবরাজ হবার সময় হয়েছে। তাছাড়া মেয়েদের দীর্ঘকাল পিতৃগৃহে থাকলে লোকনিন্দার ভয় থাকে। কণ্ব শকুন্তলাকে রাজধানীতে পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন। রাজা দুষ্যন্ত নিজের ঔরসজাত সন্তানকে স্বীকার করা তো দূরের কথা, শকুন্তলাকে পর্যন্ত না চেনার ভান করলেন। রাজা শকুন্তলাকে ভ্রষ্টা ও দুষ্ট তাপসী বলতে পর্যন্ত কসুর করলেন না। রাজা বিশ্বামিত্রকে ব্রাহ্মণত্বলোভী, কামুক ও নির্দয় বলে অভিহিত করলেন। শকুন্তলার জননী মেনকাকে বললেন অসতী ও নির্দয়া। শকুন্তলা বললেন মেনকা দেবতাদের মধ্যে গণ্যা।

শকুন্তলা লজ্জায় ও দুঃখে নির্বাক নিশ্চল হয়ে রইল। শকুন্তলার “চোখ রক্তবর্ণ হ’ল, ওষ্ঠ কাঁপতে লাগল, বক্র কটাক্ষে তিনি যেন রাজাকে দগ্ধ করতে লাগলেন।“ তারপর তিনি রাজাকে অভিসম্পাত করলেন, শকুন্তলাকে বিশ্বাস না করলে রাজার মাথা “শতধা বিদীর্ণ হবে”। শকুন্তলা রাজাকে আরো বললেন, রাজা চলেন ভূমিতে আর তিনি চলেন অন্তরীক্ষে। যাবার আগে শুধু বলে গেলেন যে রাজার সঙ্গে তাঁর মিলন সম্ভব নয়। আর রাজার সাহায্য না পেলেও তাঁর সন্তান সর্বদমন পৃথিবীর রাজা হবেই। তখন দুষ্যন্ত এক দৈব বাণী শুনলেনঃ শকুন্তলা যা বলেছেন তার সবটাই ঠিক। রাজা বললেন, তিনি এতক্ষণ যা বলেছেন বা করেছেন তার সবটাই ছিল অভিনয়। শকুন্তলার সতীত্ব প্রমান করার জন্যই এই অভিনয় করেছেন। তিনি শকুন্তলাকে গ্রহণ করলেন এবং আশ্বাস দিলেন যে সর্বদমনই তাঁর পর রাজা হবে। শকুন্তলা তাঁর উপর রুষ্ট হয়ে যে কথাগুলো বলেছিলেন সেগুলোর জন্য তিনি শকুন্তলাকে ক্ষমা করে দিলেন, কিন্তু নিজে অসদাচরণের জন্য মোটেই ক্ষমা চাইলেন না।

কালিদাসের শকুন্তলা 

অনেক অনেক বছর আগে ভারতবর্ষে দুষ্যন্ত নামে এক সম্রাট ছিলেন। একবার অনেক সৈন্য সামন্ত নিয়ে তিনি মৃগয়ায় বেরিয়েছিলেন। তিনি প্রাণভয়ে ভীত এক হরিণশিশুকে শিকারের লক্ষ্য করলেন। অকস্মাৎ দুই তপস্বী রাজাকে উদ্দেশ্য করে বললেন যে এটি আশ্রমমৃগ এবং নিরপরাধ প্রাণীটিকে যেন বধ না করা হয়। রাজার অস্ত্র আর্তের পরিত্রাণের জন্য। রাজা লজ্জিত হলেন এবং তপস্বীদেরকে প্রনাম কলেন। তপস্বীরা খুশি হয়ে তাঁকে আশীর্বাদ করলেন যে তাঁর পুত্র হবে এবং সেই পুত্র পৃথিবীর অদ্বিতীয় রাজা হবেন। রাজাকে অবগত করানো হ’ল নিকটবর্তী মালিনী নদীর তীরেই কণ্ব মুনির আশ্রম। কণ্ব মুনি সোমতীর্থে গিয়েছেন। অতিথিসৎকারের দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছেন কন্যা শকুন্তলার হাতে। রাজা আত্মাকে পবিত্র করার জন্য আশ্রম দর্শন করতে উদগ্রীব হলেন। রাজা তপোবনে প্রবেশ কলেন। খুব কাছেই অপূর্বদর্শনা তিন আশ্রমকন্যা তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করল। বালিকাত্রয়ের মধ্যমণিকে রাজা সহজেই শকুন্তলা বলে অনুমান করে নিতে পারলেন। অন্য দু’জন প্রিয়ংবদা এবং অনসূয়া। একটি ভ্রমর শকুন্তলাকে ভীষণভাবে উত্যক্ত করতে করছিল। সখিরা শকুন্তলাকে বললেন দুষ্যন্তকে স্মরণ করতে। এই কথা রাজার মনে সাহসের সঞ্চার করলে তিনি তাঁদের দিকে এগিয়ে গেলেন। এই অচেনা অতিথি শকুন্তলার মনে ‘তপোববিরুদ্ধ ভাবের’ উদয় হ’ল। অনসূয়া রাজার পরিচয় জানতে চাইলেন। রাজা নিজের পরিচয় গোপন করে নিজেকে রাজ্যের ধরমাধিকারে নিযুক্ত আছেন বলে জানালেন। রাজা ও শকুন্তলা দুজনেরই চিত্ত চঞ্চল হয়ে উঠল। ব্রহ্মচারী কণ্ব কিভাবে কন্যাসন্তান লাভ করলেন এই কথা জানার জন্য রাজা আকুলতা প্রকাশ করলেন। সখীরা যা জানতেন তা রাজাকে বললেন।    রাজর্ষি বিশ্বামিত্র একবার গোমতী নদীর তীরে কঠোর তপস্যা শুরু করেন। ভয় পেয়ে দেবতারা বিশ্বামিত্রের ধ্যান ভঙ্গ করার জন্য অপ্সরা মেনকাকে পাঠিয়ে দেন বিশ্বামিত্রের তপস্যাভঙ্গের জন্য। মেনকার মায়াজালে বিশ্বামিত্রের ধ্যানভঙ্গ হলে দু’জনের মিলনের ফলে এক কন্যাসন্তানের জন্ম হয়। মেনকা এই শিশুকে অরণ্যে পরিত্যাগ করে স্বস্থানে চলে যান। এক শকুন্ত এই শিশুকে প্রতিপালন করতে লাগল। তাই তাদের সখীর নাম হ’ল শকুন্তলা। কণ্ব দৈবযুগে এই শিশুর সন্ধান পেয়ে আশ্রমে নিয়ে গিয়ে বড় করেন। উপযুক্ত পাত্র পেলে তাঁর বিয়েও দেবেন রাজা জানতে পারলেন। মেনকার গর্ভজাত সন্তানতো মানবী নন। শকুন্তলালাভ রাজার অভীষ্ট হয়ে উঠল। শকুন্তলারও অবস্থাও তথৈবচ। ইত্যবসরে রাজার হাতে দুষ্যন্তনামাঙ্কিত আংটি দেখে নিশ্চিত হওয়া গেছে এই ছদ্মবেশী রাজা দুষ্যন্ত ছাড়া আর কেউ নন। এখন প্রশ্ন হ’ল কেম্ন করে প্রেম নিবেদন কর যায়। সখীদের কথা মোতাবেক শকুন্তলা পদ্মপাতায় প্রেমপত্র লিখে সখীদের শোনানোর জন্য শব্দ করে পড়তে লাগল। আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা রাজা সব শুনতে পেয়ে সাহস পেয়ে আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে জানালেন যে তিনিও শকুন্তলার প্রেমে ভেতরে ভেতরে দগ্ধ হচ্ছেন। রাজা আশ্বাস দিলেন যদিও তাঁর অনেক মহিষী আছেন, শকুন্তলাই হবেন তাঁর প্রিয়তমা মহিষী। প্রেমবিনিময়ের মধ্য দিয়ে কখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। পিতৃষ্বসা গৌতমি এলেন শকুন্তলার কুশল জানতে। রাজা আড়ালে চলে গিয়েছেন। পিসিকে শকুন্তলা বানিয়ে বললেন যে তাঁর সহচরীরা নদীতে জল আনতে গিয়েছেন। এরূপ কিছুদিন চলার পর দুষ্যন্ত ও শকুন্তলা গান্ধর্বমতে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হলেন। তারপর ধর্মারণ্যে কিছুদিন অবস্থান করে রাজা রাজধানীতে ফিরে গেলেন। বিদায়বেলায় নিজের নামাঙ্কিত আংটি শকুন্তলাকে হাতে দিয়ে গেলেন।

চরম বিরহে দিন কাটছে শকুন্তলার। একদিন দুর্বাসা মুনি এলেন। বাহ্যজ্ঞানশূন্য শকুন্তলা দুর্বাসা মুনির পরিচর্যায় মনোযোগী হলেন না। ক্রুদ্ধ মুনি শকুন্তলাকে অভিসম্পাত করলেনঃ শকুন্তলাকে রাজা দুষ্যন্ত চিনতে পারবেন না। অতিকুটিলহৃদয় দুর্বাসা প্রিয়ংবদা ও অনসূয়া অনেক অনুনয়ের পর বললেন, শকুন্তলা যদি কোন অভিজ্ঞান দেখাতে পারে তাহলেই রাজা তাঁকে চিনতে পারবেন। কিছুদিন পর কণ্ব মুনি সোততীর্থ থেকে ফিরলেন। তিনি দিব্যজ্ঞানে সবকিছুই জানতে পেরেছেন। সবকিছু জেনে তিনি খুব খুশি হলেন। তিনি আরো জানতে পারলেন যে শকুন্তলা সন্তান্সম্ভবা। তিনি

স্থির করলেন অচিরেই শকুন্তলাকে পতিসন্নিধানে পাঠিয়ে দেবেন। বিদায়ের কাল অশ্রুভারাক্রান্ত হয়ে উঠল। বনের গাছপালা পশুপাখি শকুন্তলার নিত্যসঙ্গী ছিল।

দুর্বাসা মুনির অভিশাপ অক্ষরে অক্ষরে ফলতে লাগল। রাজা দুষ্যন্ত শকুন্তলাকে চিনতে পারলেন না। ঋষি শাঙ্গরব ও ঋষি গৌতমী অনেক বোঝালেন, কিন্তু তাতেও কোন ফল হ’ল না। শকুন্তলা অনেক অনুনয় বিনয় করতে শুরু করলেন। কিন্তু রাজার মন অটল। রাজা শকুন্তলাকে উদ্দেশ্য করে নানান কটূক্তি করতে লাগলেন। শেষ চেষ্টাস্বরূপ শকুন্তলা রাজাপ্রদত্ত রাজার নামাঙ্কিত রাজাকে দেখানোর জন্য সেটির অনুসন্ধান করতে শুরু করলেন। ভাগ্যের কি পরিহাস! শকুন্তলা অঙ্গুরী পেলেন না। রাজার ঘৃণা দ্বিগুণ হয়ে উঠল। প্রবঞ্চনা স্ত্রীজাতির স্বভাবসিদ্ধ বিদ্যা এমন কথা পর্যন্ত রাজার মুখ থেকে নির্গত হ’ল। শকুন্তলা সহসাই রুষ্ট হয়ে উঠলেন এবং রাজাকে অনার্য বলে সম্বোধন করলেন। শারদ্বত এবং শার্ঙ্গরব  এই দুই ঋষি শকুন্তলার সাথে এসেছিলেন। শার্ঙ্গরব ছিলেন উদ্ধতস্বভাবের। শকুন্তলাকে জন্মাবধি নিষ্কলুষ দাবী করে বললেন, রাজারা পরপ্রতারণা বিদ্যা শিক্ষা ও প্রয়োগ করে। রাজা কথাটা মেনে নিয়েও বললেন শকুন্তলাকে প্রতারণা করে তাঁর কী লাভ! অধিকতর শান্তস্বভাবের ঋষি শারদ্বত বললেন, অযথা বিবাদ বাড়িয়ে লাভ নেই। রাজা তাঁর পত্নীকে নিয়ে কি করবেন তার দায়িত্ব রাজার কাছে অর্পণ করে প্রস্থানোদ্যত হলেন। অসহায়া শকুন্তলা কান্নার রোল তুলে তাঁদের পেছন নিলেন। গৌতমী শকুন্তলাকে সঙ্গে নিতে চাইলেন। শার্ঙ্গরব শকুন্তলার গোপনে রাজাকে বিয়ে করার ব্যাপারটিকে কখনো মন থেকে মেনে নেননি। তিনি পাপিয়সী বলে গর্জন করে উঠলেন আর বললেন রাজার আলয়ে থেকে নিজেকে পতিব্রতা প্রমান করতে। এই কথা শুনে রাজা দুষ্যন্ত আবার নিজেকে সৎ দাবী করলে ঋষি রাজার স্মৃতিবিভ্রমের সম্ভাবনার প্রতি ইঙ্গিত করলেন। এই কথা শুনে রাজা পুরোহিতের মতামত জানতে চাইলেন। পুরোহিত সন্তান ভূমিষ্ট না হওয়া পর্যন্ত শকুন্তলাকে আশ্রয় দেওয়ার পক্ষে মত জ্ঞাপন করলেন, কারন ভূমিষ্ট সন্তানের শরীরে রাজচিহ্ন থাকলে শকুন্তলার দাবী প্রমানিত হবে। রাজার অনুমতি নিয়ে পুরোহিত শকুন্তলাকে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দেওয়ার জন্য সঙ্গে নিয়ে চললেন। পথে এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটল। অপ্সরাতীর্থের কাছে পৌঁছুলে এক জল। তিঃপদার্থ স্ত্রীবেশে সহসা আবির্ভূত হয়ে শকুন্তলাকে নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। রাজা এই কথা শুনে নির্বিকার থাকলেন।

এদিকে এক অভাবনীয় কান্ড ঘটল। স্নান করার সময় শকুন্তলার আঁচল থেকে রাজার দেওয়া অঙ্গুরী নদীর জলে পড়ে গিয়েছিল। সেটি চলে গিয়েছিল এক মাছের পেটে। মাছ যখন কাটা হ’ল তখন এটি চোখে পড়ল। জাইহক, শেষপর্যন্ত ঘটনা রাজার কানে গেল। অঙ্গুরী দেখামাত্র রাজার পূর্বস্মৃতি মনে পড়ে গেল। রাজা বিমর্ষ হলেন। তাঁর মধ্যে অনুতাপ হ’ল এবং শকুন্তলাকে ফিরে পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলেন। তিনি বিলাপ করতে লাগলেন যে শকুন্তলাকে হারিয়ে তিনি নিঃসন্তান থাকবেন এবং ধীরে ধীরে তাঁর রাজবংশের বিলোপ ঘটবে। এই সময় দেবরাজ ইন্দ্রের সারথি মাতলি উপস্থিত হয়ে রাজাকে জানালেন যে কালনেমির সন্তান দুর্জয় নামে দুর্দান্ত দানবেরা দেবতাদের সাথে শত্রুতায় মত্ত হয়েছে এবং ইন্দ্র চান রাজা শত্রুদমনে আত্মনিয়োগ করেন। দুষ্যন্ত ইন্দ্রের আজ্ঞা শিরোধার্য করে ইন্দ্ররথে দেবলোকে প্রস্থান করলেন। শত্রুদমনের পর রাজা মাতলির রথে মর্তের পথে যাত্রা করলেন। তিনি কশ্যপ মুনির আশ্রম হেমকূট পর্বতে নেমে গেলেন ঋষিকে প্রণাম করার উদ্দেশ্যে। ভগবান কশ্যপ তখন নিজের পত্নী অদিতি এবং অন্যান্য ঋষিপত্নীদেরকে পতিব্রতা ধর্ম শ্রবণ করাচ্ছেন। রাজা অপেক্ষায় থাকলেন।

তিনি দেখলেন এই বনে মানুষ, পশু, পাখি ইত্যাদি সব পরস্পরকে আক্রমন না করে পরম শান্তিতে দিন যাপন করে। এম্ন সময় দেখতে পেলেন একটি বালক এক সিংহ শাবককে উত্যক্ত করছে আর দুই তাপসী তাকে বিরত রাখার জন্য অনুনয়বিনয় করছে। শিশুর দৃষ্টি অন্যত্র  ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য তাপসীরা যখন তাকে মিছিমিছি খেলনা দিতে গেলেন এবং খেলনা নেওয়ার জন্য সে যখন হাত বাড়াল, রাজা তার হাতে চক্রবর্তীলক্ষণ দেখতে পেলেন। অজানা আনন্দে তাঁর মন পরিপূর্ণ হয়ে উঠল। নিঃসন্তান রাজার মন কেমন বিষন্নতায় ভরে গেল। সত্যিকারের খেলনা না পেয়ে শিশু আরো বেশি বেশি করে শিশুকে উত্যক্ত করতে শুরু করল। তাপসীরা অসহায় বোধ করে সাহায্যের জন্য এদিক ওদিক তাকাল। রাজা আড়ালেই ছিলেন। এগিয়ে এসে শিশুকে ঋষিকুমার বলে সম্বোধন করলেন। তাপসীরা জানালেন যে শিশু আসলে পুরুবংশীয়। রাজার কথায় শিশু পশুউৎপীড়ন থেকে বিরত থাকল। শিশুর স্পর্শ পেয়ে রাজার মন আনন্দে উদবেলিত হয়ে উঠল। রাজার মনে প্রশ্ন জাগল এই দেবভূমিতে মানুষের উপস্থিতি কেন? তাপসী জানালেন এই শিশুর জননী অপ্সরাসম্বন্ধে এখানে এসে সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। রাজা আরো জানতে পারলেন, এই শিশুর মায়ের নাম শকুন্তলা। রাজা আশানৈরাশ্যের দোলাচলে অন্তস্থিত হলেন। এমন সেখানে শকুন্তলা উপস্থিত হলেন। দু’জন পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থেকে নির্বাক হয়ে রইলেন। রাজা তাঁর অতীত কর্মের জন্য বারবার ক্ষমা চাইতে লাগলেন। রাজা সকল বৃত্তান্ত শকুন্তলাকে বললেন। শকুন্তলা দোষ দিলেন অদৃষ্টকে। রাজা দুষ্যন্ত ও শকুন্তলা দু’জনে একসঙ্গে কশ্যপ মুনির সঙ্গে দেখা করলেন। কশ্যপ তাঁদের প্রাণভরে আশীর্বাদ করলেন। কশ্যপ দুর্বাসা মুনির অভিশাপ ইত্যাদি সমস্ত বৃত্তান্ত শকুন্তলা ও দুষ্যন্তকে বিস্তারিত বললেন। ভগবান কশ্যপ আরো বললেন, তাঁদের এই সন্তান একদিন এই সসাগরা পৃথিবীর অধীশ্বর হবেন। অদিতির পরামর্শক্রমে দূতের মাধ্যমে সবকিছু কণ্ব মুনিকে জানানো হ’ল। রাজা দুষ্যন্ত ও শকুন্তলা তাঁদের সন্তানকে নিয়ে রাজধানীতে চলে গেলেন এবং পরম সুখে রাজ্যশাসন অ প্রজাপালন করতে লাগলেন।

পৃষ্ঠার হিসেবে মহাভারতের শকুন্তলা উপাখ্যান লেখা হয়েছে তিরিশ পৃষ্ঠায় আর কালিদাসের শকুন্তলা নাটক একশ সাত পৃষ্ঠা দীর্ঘ। মহাভারতের রচয়িতা শকুন্তলা-দুষ্যন্তের খুব দ্রুত কিন্তু অত্যন্ত চমৎকারিত্বের সঙ্গে বর্ণনা করেছেন এবং পাঠক বা শ্রোতার মন জয় করেছেন। এই মহাকাব্যিক বর্ণনায় এবং ঘটনার পরিবেশনায় নাটকীয়তাও রয়েছে। কিন্তু মহাভারতের কাব্যগুণ এক দিক দিয়ে বিচার করলে কালিদাসের শকুন্তলার কাব্যগুণ থেকে অনেক আলাদা। তার মানেই কালিদাস মহাভারতের মূল অনেক নতুন জিনিস ঢুকিয়েছেন। কালিদাসের বইয়ের কলেবর বৃদ্ধির অন্য কারন অবশ্যই এই একজন শ্রেষ্ঠ কবির কবিত্ব যা প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর প্রকৃতির, প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যকার ঐক্য, এবং মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার বর্ণনায়। কাহিনির দিক থেকে প্রধান এবং গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য এসেছে কালিদাসের শকুন্তলায় দুর্বাসা মুনির অভিশাপ সংযোজন। আমরা উপরের বর্ণনায় দেখেছি এই অভিশাপ কেমন করে বারবার কাহিনির গতি পাল্টেছে। অভিজ্ঞানের (রাজা দুষ্যন্তের নামাঙ্কিত অঙ্গুরী) উল্লেখ মহাভারতে নেই। এটি কালিদাস সম্ভবত বৌদ্ধ জাতক থেকে নিয়েছিলেন। এই গল্প অনুযায়ী এক রাজা বনে সাক্ষাৎ হয়েছে এমন এক ললনাকে বিয়ে করেন। বিদায়ের আগে তিনি তাঁর নবপরিণীতা স্ত্রীকে নিজের চিহ্নসম্বলিত একটি আংটি দিয়ে যান এবং বলে যান রাজার সঙ্গে পুনরায় মিলনের আগে যেন এই আংটি এবং পুত্র সন্তান সঙ্গে নিয়ে যান।  রমণী এক পুত্র সন্তানের (হবু বুদ্ধ) জন্ম দেন এবং সন্তানকে নিয়ে রাজার সঙ্গে দেখা করতে যান। রাজা তাঁকে চিনতে পারেন না। যাইহোক এক দৈব ঘটনার বলে তিনি রাজাকে বাধ্য করেন তাঁদের মধ্যকার বৈধ সম্পর্ক স্বীকার করে নিতে। ভাগবত পুরাণ এবং পদ্ম পুরাণেও শকুন্তলার কাহিনি আছে। তবে সময়ের হিসেবে এই দুই পুরাণের শকুন্তলাসম্পর্কিত কাহিনি মহাভারত থেকেই নেওয়া হয়েছে এটা হয়ত মেনে নেওয়া যায়।

সেলিম আল-দীনের শকুন্তলার কাহিনি মহাভারত এবং কালিদাসের শকুন্তলার কাহিনির এক খুদ্র ভগ্নাংশ মাত্র। না দেবী না মানবী শকুন্তলার তীব্র অস্তিত্ত্বের সঙ্কট এই নাটকের প্রধান উপজীব্য। এখানে রাজা দুষ্যন্ত নেই, গান্ধর্ব বিবাহ নেই, অভিজ্ঞান নেই, নেই রাজা দুষ্যন্ত কর্তৃক তার বিয়ে এবং সন্তানের নিষ্ঠুর অস্বীকৃতি এবং পরে দৈবক্রমে রাজার সঙ্গে মিলন। ঘটনা সামান্য, কিন্তু মানুষের যন্ত্রণার গভীরতা এবং মানুষের সমাজের মলিনতা মহাভারতের কালকে ছাপিয়ে আধুনিক যুগ পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। যেমন, বিশ্বামিত্র মর্তের মানুষের মুক্তিকামনায় ধ্যানে নিমগ্ন। মানুষকে দেবতাদের মতই মৃত্যুহীন করবেন। কিন্তু দেবরাজ ইন্দ্র এতে শঙ্কিত এবং ঈর্ষান্বিত। তাই ইন্দ্রের ধ্যানভঙ্গের জন্য মেনকাকে মর্তে পাঠালেন। মেনকা সফল হলেন বিশ্বামিত্রের পদস্খলন ঘটাতে। মেনকার গর্ভে বিশ্বামিত্রের ঔরসে শকুন্তলার জন্ম হ’ল। মেনকা নবজাতিকাকে পরিত্যাগ করে মর্ত্য ছেড়ে চলে গেলেন। শকুন্তলা বড় হতে লাগলেন কণ্ব মুনির আশ্রমে। প্রকৃতি, বনের জীবজন্তু এবং দুই আশ্রমবালিকা তাঁর নিত্য সঙ্গী। একদিন সময় এল তাঁর নিজের পরিচয় জানার। এটাই হ’ল তাঁর জীবনের দুরুহতম সময়। মর্ত্যের মাটিতে ‘শৃঙ্খলিত’ স্বর্গের দেবী। তিনি তাঁর আপন মা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। এই বিচ্ছিন্নতাবোধ সকিছুকে অর্থহীন করে তুলেছে। শুধু হাহাকার। শুধুই কানামাছি। পৃথিবী তাঁর কাছে অতীব নোংরা এক জায়গা। এ এক ঘোরতর অস্তিত্বসঙ্কট। এইভাবেই শকুন্তলার এই হাহাকারের মধ্য দিয়েই নাটকের যবনিকাপাত ঘটে।

নাট্যকার এই নাটকে অনেক চরিত্রের এবং ঘটনার সমাবেশ ঘটিয়েছেন যা ব্যাসদেব বা কালিদাসে নেই। তার মানেই তিনি ভারতীয় পুরাণের অন্যত্রও বিচরণ করেছেন। যেমন অর্ক চরিত্র। বিশ্বামিত্রের চোখের যন্ত্রণা। যন্ত্রণার উপশমের জন্য ইন্দ্রের পাঠানো কামবৃক্ষের শিকড়। বিশ্বামিত্রের কামার্ত হয়ে যাওয়া। দেবরাজ ইন্দ্রের চক্রান্তের অংশ হিসেবে নাট্যকার চতুর নারদকে এনেছেন। এনেছেন তক্ষককে নদীর জলকে বিষাক্ত করে দেওয়ার জন্য। তক্ষক এসেছে শূদ্রের সাজে। সে ‘জল’ না বলে বলছে ‘পানি’। শূদ্রের নদীর জল স্পর্শ করার অধিকার নেই। বিশ্বামিত্রের প্রিয় নদী কৌশিকী উল্লেখিত হয়েছে নাটকে। নাটকে উল্লেখিত হয়েছে সমুদ্রমন্থনের বাসুকির কথা। নাটকে দেবতাকে মানুষের বিরুদ্ধশক্তি হিসেবে অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে দেখানো হয়েছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, মহাভারত এবং কালিদাসের শকুন্তলায় মানুষের নৈতিকতার ভিত্তি হিসেবে ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস রয়েছে। সেলিম আল-দীন মানবতার বা মানুষের জয়গান গাইতে চেয়েছেন। শকুন্তলার তীব্র অস্তিত্বসঙ্কটকে উপলক্ষ করে নিয়েছেন।

কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ

১। রাজশেখর বসুর মহাভারতের সারানুবাদ।

২। বিদ্যাসাগরের ‘শকুন্তলা’।

৩। Myth = Mithya by Dr. Devdutt Pattanaik.

৪। An English translation of Kalidas’s Recognition of Shakuntala by W.J.Johnson.

৫। সেলিম আল-দীনের শকুন্তলা নাটকের মঞ্চাভিনয়।

৬। ‘শকুন্তলা’ চলচ্চিত্র।

এপার বাংলায় সোমেন চন্দ

প্রবন্ধ সমগ্র ।। মতামত ।। সূচীপত্র

 প্রবন্ধ সমগ্র

এপার বাংলায় সোমেন চন্দ : পুনরাবিষ্কার ও প্রতিষ্ঠা

দিলীপ মজুমদার

পর্ণশ্রী, বেহালা, কলকাতা 

somen1.jpg

সাল ১৯৭২। প্রখর গ্রীষ্মকাল। দগ্ধ হচ্ছে তিলোত্তমা কলকাতা। সে তাপ আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে তখনকার রাজনীতি। চারদিকে সন্ত্রাসের তাপ। কমিউনিস্ট, বিশেষ করে মার্কসবাদী কমিউনিস্ট কর্মীরা আক্রান্ত হচ্ছে। প্রতিক্রিয়াশীল ও অতিবামেদের আক্রমণ। কখনও সামনা-সামনি, কখনও চোরাগোপ্তা।

এমনি এক তাপদগ্ধ দিনে আমি বেলভিডিয়ারে জাতীয় গ্রন্থাগারে। পুরনো পত্রিকার পাতা উল্টানো আমার নেশা। সেদিন পাতা উল্টাচ্ছি ‘পরিচয়’ পত্রিকার। হঠাৎ চোখে পড়ল ‘ইঁদুর’ নামক একটি গল্প। লেখক সোমেন চন্দ। অপরিচিত নাম। আগে শুনিনি কোনদিন। সময় কাটানোর জন্য পড়তে শুরু করলাম। প্রথম অনুচ্ছদে বাসায় ইঁদুরের উপদ্রবের কথা, দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে ইঁদুর মারা পরিকল্পনার কথা। তৃতীয় থেকে পঞ্চম পরিচ্ছেদও মামুলি। কিন্তু তারপর আর উদাসীন থাকা গেল না। কথা বলতে শুরু করল ইতিহাস। দেখতে পেলাম মধ্যবিত্ত শ্রেণির স্বার্থরোপিত বনস্পতির কোটরে ও ফাটলে অস্বস্তিকর ইঁদুরের উপদ্রব। দেখতে পেলাম অর্থনৈতিক সংকট কিভাবে জটিলতা সৃষ্টি করে মানব-সম্পর্কের। ক্লেদাক্ত হয়ে ওঠে সম্পর্ক। স্বামী তার স্ত্রীকে বলে, ‘শয়তান মাগী বেরিয়ে যা।’ কিন্তু দুর্বার জীবনীশক্তি মানুষের। তাই বিবাদের পরে সুবাদ। অপমানিতা স্ত্রী উজ্জ্বল হয়ে উঠলেন আপন মহিমায়, ‘অল্প একটু ঘোমটা টেনে কাপড়ের প্রচুর দৈর্ঘ্য দিয়ে নিজেকে ভালোভাবে আচ্ছাদিত করলেন। তারপর এক অশিক্ষিতা নববধূর মতো ধীর পদক্ষেপে অগ্রসর হতে লাগলেন। অঙ্গভঙ্গির সঞ্চালনে যে সঙ্গীতের সৃষ্টি হয়, সেই সঙ্গীতের  আয়নায় আমার কাছে সব স্পষ্ট হয়ে উঠল।’

এই গল্প আঠারো-উনিশ বছরের তরুণের লেখা! বিস্ময়, বিস্ময়। এই গল্পের পাশাপাশি পড়লাম সতীশ পাকড়াশির স্মৃতিচারণ। কৈশোর থেকেই সাহিত্যানুরাগী সোমেন চন্দ। ঢাকার বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হত তাঁর লেখা। কলকাতার বিখ্যাত ‘দেশ’ পত্রিকায় ‘শিশু তপন’ নামে একটি গল্পও প্রকাশিত হয়েছিল। ঘটনাচক্রে সোমেনের সঙ্গে আন্দামানফেরৎ বিপ্লবী সতীশ পাকড়াশির পরিচয় হয় , তাঁর মাধ্যমে পরিচয় হয় অন্যান্য মার্কসবাদী কর্মীদের সঙ্গে। এঁদের গভীর প্রভাব পড়ে সোমেনের জীবনে। কৃষাণ ও মজুরের জীবনের শরিক হয়ে কর্মে ও কথায়-গানে তাঁদের আত্মীয়তা অর্জনের জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন সোমেন চন্দ। মাত্র ২২ বছর বয়েসে রাজনৈতিক আততায়ীদের হাতে নিহত হন তিনি।

সোমেনের এই পরিচয় জানার পরে আমার কৌতূহল বেড়ে গেল। কোথায় পাওয়া যাবে তাঁর অন্যান্য লেখার খোঁজ, কোথায় পাওয়া যাবে তাঁর বিস্তৃত জীবনবৃত্ত! প্রথম খোঁজ করলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের কাছে। ড. ক্ষেত্র গুপ্তের মতো যাঁরা মার্কসবাদীমনোভাবাপন্ন তাঁরা বললেন, সোমেন চন্দের নাম জানলেও তাঁর বিস্তৃত পরিচয় জানেন না। যেসব মার্কসবাদী নেতা পরিচিত ছিলেন এক এক করে তাঁদের কাছেও গেলাম। ফল হল না কিছু। আমাদের ছাত্রফ্রন্টের নেতা শ্যামল চক্রবর্তী পরামর্শ দিলেন কাকাবাবুর কাছে যাবার। কাকাবাবু হলেন মুজফফর আহমদ। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। তিনি তখন লেক প্লেসে সেন্ট্রাল কমিটির অফিসে থাকেন। তাঁর বই লেখার কাজে সাহায্য করে আমাদের রবীন্দ্র ভারতীর ছাত্রনেতা সুমন্ত হীরা। সুমন্তই একদিন আমাকে নিয়ে গেল কাকাবাবুর কাছে  লেক প্লেসে। আমার মুখে সোমেন চন্দের কথা শুনে কাকাবাবু কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তাঁর মুখে বেদনার ছায়া। তারপর মৃদুকন্ঠে বললেন: অকালে প্রাণ দিতে হল এমন প্রতিভাবান ছেলেটাকে। 

পথ দেখালেন কাকাবাবু। তিনি আমাকে শিশির নাগ আর সুধী প্রধানের কা্ছে যেতে বললেন। সুধী প্রধান আমার বাড়ির কাছে নিউ আলিপুরে থাকেন। তাঁর কাছে পেলাম সোমেনের একটি গল্পগ্রন্থ। ‘সংকেত ও অন্যান্য গল্প’। চল্লিশের দশকে ঢাকা থেকে ছাপা। কিন্তু সুধীবাবু বলে দিলেন বইটি নিয়ে যাওয়া চলবে না, তাঁর বাড়িতে বসে কপি করে নিতে হবে। তাই সই। আমার বন্ধু চিত্রা ধর দিন পনেরো ধরে কপি করল। ‘দেশ’ পত্রিকা থেকে খুঁজে পেলাম সোমেন চন্দের ‘শিশুতপন’ গল্পটি। শিশির নাগ আমাকে নিয়ে গেলেন কবি ও সোমেনের বন্ধু কিরণশঙ্কর সেনগুপ্তের বাসায়। এখানে পেলাম প্রচুর সাহায্য। পেলাম সোমেনের ‘বনস্পতি’ গল্পগ্রন্থ, পত্রিকায় প্রকাশিত সোমেনের দুটি একাঙ্ক নাটক, ‘প্রতিরোধ’ পত্রিকার ফাইল। অক্লান্ত চিত্রা এসব কপি করে গেল নীরবে। কিরণবাবু বললেন: সোমেনের মৃত্যুর ৩০ বছর পরে আপনি যে উদ্যোগ নি্যেছেন তার জন্য ধন্যবাদ। তিনি তো ধন্যবাদ দিলেন কিন্তু সোমেনের লেখা কপি করে বা তাঁর জীবনবৃত্ত উদ্ধার করে আমি কি করব! কে ছাপবে সোমেনের রচনাবলি! লেখালেখির জগতে আমি তো হরিদাস পাল। কে চেনে আমাকে!

কলেজ স্ট্রিট মার্কেটের ভূপেন কেবিনে প্রতি শুক্রবার বিকেলের দিকে আড্ডা দিতে আসেন কয়েকজন অধ্যাপক। তাঁদের মধ্যে আছেন পীযূষ দাশগুপ্তের ভাই অধ্যাপক শঙ্কর দাশগুপ্ত আর রবীন্দ্রভারতীর নবনিযুক্ত অধ্যাপক রবীন গুপ্ত। এঁরা দুজনেই মার্কসবাদী কমিউনিস্ট দলের অনুরাগী, কিন্তু সদস্য নন। আমার কথা শুনে দুজনেই উৎসাহিত। কলেজ স্ট্রিট মার্কেটের নবজাতক প্রকাশন শঙ্করদার কয়েকটি বই প্রকাশ করেছেন। শঙ্করদা সেইদিনই আমাকে নিয়ে গেলেন নবজাতকে। পরিচয় করিয়ে দিলেন প্রকাশক মজহারুল ইসলামের সঙ্গে। বামপন্থী বই প্রকাশ করে তাঁর তখন নামডাক হয়েছে। শঙ্করদার কথা শুনেই রাজি হয়ে গেলেন মজহারুল। আমার মনে হচ্ছিল যেন স্বপ্ন দেখছি। নামডাকহীন, প্রায় অজ্ঞাতকুলশীলের জীবনের প্রথম বই এত সহজে, কোন কাঠখড় না পুড়িয়ে প্রকাশের পথ পেয়ে গেল! প্রকাশক আমাকে প্রুফ দেখে দিতে বললেন প্রুফ দেখা জানি না শুনেও হতোদ্যম হলেন না কিছুতেই। বললেন প্রেসে বসতে বসতে শিখে যাব। তবে আর একটা অনুরোধ করলেন। কি না, মুজফফর সাহেবের ভূমিকা যেন থাকে বইতে। তখন মুজফফরসাহেব বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। লেখাপড়া বন্ধ। তবু তিনিও হতোদ্যম হলেন না। ঠিক হল তিনি মুখে বলবেন, আর সুমন্ত সেটা লিখে নেবে।

প্রেসে দেওয়ার জন্য পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করতে লাগলাম। আমার হাতে আছে সোমেনের ২০টি গল্প : শিশুতপন, মরুদ্যান, ভালো-না-লাগার শেষ, আমিল, সত্যবতীর বিদায়, সিগারেট, গান, প্রত্যাবর্তন, অকল্পিত, মহাপ্রয়াণ, প্রান্তর, বনস্পতি, পথবর্তী, রাত্রিশেষ, স্বপ্ন, একটি রাত, সংকেত, দাঙ্গা, ইঁদুর, মুহূর্ত। একাঙ্ক নাটিকা ২টি: বিপ্লব, প্রস্তাবনা। কবিতা একটি: রাজপথ। এরপর যোগ করলাম ৬টি পরিশিষ্ট। সোমেনের জীবন ও কর্মের পরিচয় দেবার জন্য বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা থেকে বিভিন্ন তথ্যের সংকলন। পরিশিষ্টগুলি এইরকম:

১] সোমেন চন্দের সামগ্রিক পরিচয় ২] সোমেন চন্দের লেখা কয়েকটি চিঠি ৩] সোমেন চন্দের দুটি গল্পসংকলনের ভূমিকা ৪] সোমেন চন্দের সাহিত্য প্রতিভা- সমসাময়িক সমালোচনা ও তথ্য  ৫] সোমেনের মৃত্যু ও তার প্রতিক্রিয়া ৬] সোমেনের মৃত্যু ও নতুন সম্ভাবনা। বইএর সব ফর্মা ছাপা হবার পরেই সুমন্ত কাকাবাবুর ভূমিকা নিয়ে হাজির হল। কিম্বার নার্সিং হোমে চরম অসুস্থ অবস্থায় লেখা হয়েছে। এটাই মুজফফর আহমদের শেষ লেখা। সেদিক থেকে ফাঁকতালে আমি ঈর্ষণীয় গৌরব লাভ করেছি। ন্যাশনাল বুক এজেন্সি ছিল পার্টির বইএর দোকান। নবজাতকের বই ভালই বিক্রি হত সেখান থেকে। ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আমার সম্পাদনায় প্রকাশিত হল ‘সোমেন চন্দ ও তাঁর রচনা সংগ্রহ’। নবজাতকের কর্মচারী মুস্তাফাকে মজহারুল পাঠালেন ন্যাশনাল বুক এজেন্সিতে। বিক্রির জন্য বই দিয়ে আসতে। কিন্তু সে এজেন্সির এক কর্তাব্যক্তি বললেন: ‘ ১৯৬৪ সালে পার্টি ভাগ হওয়ার পরে ( সি পি আই ও সি পি এম ) সোমেন চন্দ কোন দলে আছেন তা না জানলে তাঁর বই  তো রাখা যাবে না।’ কাকাবাবুকে সেকথা জানাতে তিনি সেই কর্তাকে ডেকে পাঠিয়ে বললেন, ‘আপনারা কি কোন খোঁজ রাখেন না? সোমেন চন্দ পার্টি ভাগ হওয়ার অনেক আগে ১৯৪২ সালে মারা গেছেন।’

বইটি প্রকাশিত হওয়ার পরে কিরণবাবুর পরামর্শে অন্নদাশঙ্কর রায় ও তাঁর স্ত্রী লীলা রায়, রণেশ দাশগুপ্ত, সোমেনের বৈমাত্রেয় ভাই কল্যাণ চন্দ, শিশির নাগ, সুধী প্রধান এঁদের এক কপি করে বই দিয়ে এলাম। একদিন কিরণশঙ্করবাবুর বাড়িতে বই দিতে গিয়ে দেখি বিখ্যাত কবি বীরেন চট্টোপাধ্যায় আছেন সেখানে। তিনি বললেন সোমেনের হত্যাপ্রসঙ্গে বিশেয করে কোন রাজনৈতিক দলের নাম না করাই ভালো। তখনো আমি জানতাম না সোমেনের হত্যাকাণ্ডে আর এস পি দলের লোক জড়িত ছিলেন। সেটা পরে জানতে পেরেছি ‘একতা’ পত্রিকায় কমিউনিস্ট নেতা জ্ঞান চক্রবর্তীর একটি  প্রবন্ধ পড়ে। বীরেনদা নিজে আর এস পি দলের সঙ্গে ছিলেন এবং তখন পশ্চিমবঙ্গের যুক্তফ্রন্টে আর এস পি যুক্ত ছিল। সেই কারণে বিশেষ কোন রাজনৈতিক দলের নাম না করার কথা বলেছিলেন বীরেনদা। দুঃখের বিষয় শ্রদ্ধেয় বীরেনদার কথা আমি রাখতে পার নি। তা করতে হলে ইতিহাসের মর্ষাদা লঙ্ঘন করতে হয় ।

সোমেন চন্দ্রর রচনাবলি প্রকাশিত হবার পরে দর্পণ, বাংলাদেশ, যুগান্তর, সত্যযুগ, কালান্তর, গণশক্তি প্রভৃতি পত্রিকায় প্রকাশিত হয় সমালোচনা। ‘দেশ’ পত্রিকায় তখন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সনাতন পাঠকের ছদ্মনামে সাহিত্য সমালোচনা করতেন। একদিন অধীর পাল তাঁর বাড়িতে নিয়ে গেলেন আমাকে। বই দিলাম। তিনি ‘দেশ’ পত্রিকায় আমার প্রচেষ্টার প্রশংসা করে একটি অনুচ্ছেদ লিখলেন। এভাবে ধীরে ধীরে বইটি জনপ্রিয় হতে লাগল। আবদুল্লাহ রসুল, সৈয়দ শাহেদুল্লাহ, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, অনুনয় চট্টোপাধ্যায়, সুদর্শন রায় চৌধুরী, সুধাংশু দাশগুপ্ত প্রমুখ কিছু সি পি এম নেতাও মৌখিকভাবে বইটির প্রচারে সাহায্য করেছিলেন। সি পি এমের বিভিন্ন লোকাল কমিটি নবজাতক থেকে রাজনীতির বই নিয়ে যেতেন। তাঁদের হাতে হাতে ঘুরতে লাগল আমার বইটি। পুজো স্টলেও এ বই শোভা পেল। এভাবে সোমেন চন্দ ধীরে ধীরে পরিচিত ও জনপ্রিয় হতে লাগলেন এপার বাংলার মানুষজনের কাছে। ‘সোমেন চন্দ ও তাঁর রচনাবলির’ দীর্ঘ সমালোচনা প্রকাশিত হয় ‘যুগান্তর’ পত্রিকায়। এই সমালোচনা লিখেছিলেন সাংবাদিক ও সোমেন চন্দের বন্ধু সরলানন্দ সেন। তাঁর ঢাকুরিয়ার বাড়িতে গিয়ে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে এসেছিলাম। এই সমালোচনা প্রকাশিত হবার দিন পাঁচেকের মধ্যে একটা চিঠি পেলাম। লিখেছেন নির্মলকুমার ঘোষ। লিখেছেন সোমেনের সঙ্গে তাঁর অন্তরঙ্গ পরিচয় ছিল। তাঁর পত্রিকায় সোমেনের কয়েকটি গল্প ও একটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়। সেসব তাঁর কাছে আছে। আমাকে তিনি দিয়ে যেতে চান। আনন্দে লাফিয়ে উঠলাম। তাহলে ‘সোমেন চন্দ ও তাঁর রচনাবলি’ ২য় খণ্ড প্রকাশ করা যাবে।

কালবিলম্ব না করে পরের দিনই দাশনগরে নির্মলবাবুর বাসায় চলে গেলাম। চল্লিশের দশকে তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হত ‘বালিগঞ্জ’ আর ‘সবুজবাংলার কথা’। সেই দুটি পত্রিকা থেকে পেলাম সোমেনের উপন্যাস ‘বন্যা’। আর  চারটি গল্প: ‘মরুভূমিতে মুক্তি’,‘রানু ও স্যার বিজয়শঙ্কর’, ‘এক্স

সোলজার’, ‘অন্ধ শ্রীবিলাসের আনেক দিনের একদিন’। পত্রিকা থেকে লেখাগুলি কপি করে দিল রনজিৎ মাইতি। করবে সোমেনের জন্মদিবস। ১৯৭৬ সালের ১৬মে গঠিত হল সেই কমিটি।সভাপতি- নারায়ণ চৌধুরী, সহ সভাপতি- ড. রবীন্দ্র গুপ্ত, সাধারণ সম্পাদক-নীতীশ বিশ্বাস, যুগ্ম সম্পাদক- বিশ্বেশ্বর রায় ও শুভাশিস চক্রবর্তী, কোষাধ্যক্ষ-তপন মজুমদার; সদস্য –সুদর্শন রায় চৌধুরী, রজত রায়, মজহারুল ইসলাম, নকুল দাস, উজ্জ্বল চক্রবর্তী, রাসবিহারী দত্ত, তাপস ঘোষ, কুমার সেনগুপ্ত, মুস্তফা কামাল, শিখা চন্দ, মুহম্মদ সাদিকুজ্জমান , দুলাল সরকার, অজয় কোলে, মুকুলেশ বিশ্বাস, সীমা বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রণব বিশ্বাস, স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়, শিপ্রা মুখোপাধ্যায়, দিলীপ মজুমদার।

কলকাতার স্টুডেন্স হলে এই স্মৃতি রক্ষা কমিটির উদ্যোগে সোমেনের জন্মদিবস পালিত হয়। সভাকে সাফল্যমণ্ডিত করার জন্য আমরা দেশের বিশিষ্ট লেখক, বুদ্ধিজীবী, অধ্যাপকদের এক বিবৃতি প্রচার করি। বিশিষ্টজনের তালিকাটি এইরকম: অন্নদাশঙ্কর রায়, বিনয় ঘোষ, সুধী প্রধান, সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, সুচিত্রা মিত্র, বিজন ভট্টাচার্য, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, ড. রবীন্দ্র গুপ্ত, ড. ক্ষেত্র গুপ্ত, ড. অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়, ড. হিরন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়, ড.অরুণ বসু, ড. মহাদেবপ্রসাদ সাহা, নেপাল মজুমদার, মহম্মদ আবদুল্লাহ রসুল, ভবানী মুখোপাধ্যায়, কৃষ্ণ চক্রবর্তী, তপোবিজয় ঘোষ, নন্দগোপাল সেনগূপ্ত, জ্যোতি ভট্টাচার্য, নারায়ণ চৌধুরী, গোপাল হালদার, কৃষ্ণ ধর , অমিতাভ দাশগুপ্ত, প্রফুল্ল রায়, মোহিত চট্টোপাধ্যায়, সুধাংশু ঘোষ, শিবরাম চক্রবর্তী, খগেন্দ্রনাথ মিত্র,  কল্পতরু সেনগুপ্ত, খালেদ চৌধুরী, এস এ মাসুদ, লীলা রায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, ড. অরবিন্দ পোদ্দার, ড, প্রভাত গোস্বামী, জীবনলাল গোস্বামী, মিহির আচার্য,  নির্মাল্য আচার্য, ধনঞ্জয় দাশ, সৌরি ঘটক, অমিতাভ চৌধুরী, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, বিমল কর, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত, চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়, ড. ক্ষুদিরাম দাশ, ড. দেবীপদ ভট্টাচার্য, ড. সরোজমোহন মিত্র।

স্টুডেন্স হলের সভা সাফল্যমণ্ডিত হয়। সভায় জ্যোতি বসু, আবদুল্লা্হ রসুল, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য প্রভৃতি বামপন্থী নেতাদের পাশাপাশি উপস্থিত ছিলেন নারায়ণ চৌধুরী, নেপাল মজুমদার, ড. রবীন্দ্র গুপ্ত, কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত, অমিতাভ দাশগুপ্ত, তরুণ সান্যাল, দীপেন বন্দ্যোপাধ্যায়, কল্যাণ চন্দ প্রভৃতি বুদ্ধিজীবীরা। সোমেন স্মৃতি রক্ষা কমিটির পাশাপাশি আমরা সোমেনের ব্যক্তি ও রচনা পরিচয় সম্বলিত একটি ছোট পুস্তিকা মুদ্রিত করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে পাঠাতে থাকি। এটা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে সোমেনের নাম ও অবদান যুক্ত করার প্রচেষ্টা। ড. সুকুমার সেন, ড. অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়, ড. দেবীপদ ভট্টাচার্য, ড. ক্ষেত্র গুপ্ত প্রভৃতি বাংলা সাহিত্যের ঐতি্হাসিকদেরও দ্বারস্থ হই।

১৯৭৭ সালের ৫-অগস্ট মুজফফর আহমদের জন্মদিনে প্রকাশিত হয় ‘সোমেন চন্দ ও তাঁর রচনা সংগ্রহের’ ২য় খণ্ড । এতে তাঁর ‘বন্যা’ উপন্যাস আছে; আর আছে ৪টি গল্প : মরুভূমিতে মুক্তি, রানু ও স্যার বিজয়শঙ্কর, এক্স সোলজার, অন্ধ শ্রীবিলাসের অনেক দিনের একদিন। অশোক মিত্রের ‘ইঁদুর’ গল্পের ইংরেজি অনুবাদ ও লীলা রায়ের ‘সংকেত’ গল্পের ইংরেজি অনুবাদও যুক্ত করেছিলাম। কাকাবাবু বলেছিলেন ‘ইঁদুর’ গল্পটি অন্যান্য ভারতীয় ভাষায়  অনূদিত হয়েছিল। সেসব অনুবাদের সন্ধান পাই নি।

২য় খণ্ডের পরিশিষ্ট ছিল ৬টি : ১] সোমেন চন্দ : স্মৃতিকথা, আলোচনা ২] সোমেন চন্দ : পটভূমি ঢাকা ৩] সোমেন চন্দ ও কয়েকটি পত্রিকা ৪] সোবিয়েত সুহৃদ সমিতি ৫] প্রগতি লেখক সঙ্ঘ ও ফ্যাসিবিরোধী লেখক সঙ্ঘ: কিছু তথ্য ও আলোচনা ৬] সোমেন ও সমকালীন সাহিত্যচিন্তা । দ্বিতীয় খণ্ডের ভূমিকায় আমি লিখেছিলাম : ‘ প্রথম খণ্ড প্রকাশের সময় আমার ভীতি ছিল বিস্মৃতির গর্ভে প্রায় নিমজ্জিত একজন জীবনসংগ্রামী জীবনশিল্পীকে মানুষ কিভাবে গ্রহণ করবেন এ কথা ভেবে। আজ আনন্দের সঙ্গে বলি আমার শ্রম সাথর্ক হয়েছে।

‘বাংলাদেশের প্রগতিপরায়ণ মানুষ সোমেনানুরাগী হয়েছেন এবং সোমেনানুরাগী মানুষ সোমেন-সাহিত্য প্রচারে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছেন। সোমেনের অনুপ্রেরণাতে উদ্বুদ্ধ হয়ে এই শ্রেণিবিভক্ত সমাজে অব্যাহত থাকুক শিল্পীর সংগ্রাম এবং সৃষ্টি হতে থাক সংগ্রামের শিল্পী।’

সোমেন চন্দের প্রচারে কয়েকটি পত্রিকা বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। ‘সত্যযুগ’ পত্রিকার রবিবারের পাতায় আমি লিখি‘ সোমেন চন্দ; বাংলার প্রথম সাহিত্যিক শহিদ ’ নামক একটি ছোট প্রবন্ধ। সোমেন যে প্রথম সাহিত্যিক শহিদ, একথা পরে সকলেই স্বীকার করে নেন। নেপাল মজুমদারও সোমেনকে ফ্যাসিবিরোধী আন্দোলনের প্রথম শহিদ বলে উল্লেখ করেন। কবি দুর্গাদাস সরকার  সাপ্তাহিক ও মাসিক ‘বাংলাদেশ’ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি আমাকে সোমেনের গল্পের শিল্পশৈলী নিয়ে লেখতে পরামর্শ দেন। আমার সে লেখা ১০টি কিস্তিতে প্রকাশিত হয়। হীরেন বসুর দর্পণ পত্রিকায় ড. ক্ষেত্র গুপ্তের এক অনবদ্য গ্রন্থসমালোচনা। আকাশবাণী কলকাতার কথিকা বিভাগ পরিচালনা করতেন প্রখ্যাত কবি কবিতা সিংহ। তিনি সোমেন চন্দ বিষয়ে আমার একটি কথিকা প্রচারের সুযোগ করে দেন। এই কথিকা একাধিকবার সম্প্রচারিত হয়েছে। তখন দূরদর্শনের বাড়বাড়ন্ত হয় নি। বেতার ছিল ভীষণ শক্তিশালী মাধ্যম। আমার কথিকা দেশের বিভিন্ন জেলার মানুষের কাছে যে ছড়িয়েছিল তার প্রমাণ পেয়েছি। কথিকাটি পরে ‘বেতার জগৎ’ পত্রিকায় মুদ্রিত হয়েছিল।সোমেন চন্দের প্রচারে সি পি এম দলের বিভিন্ন গণসংগঠন বিশেষ করে গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী কলাকুশলী সম্মিলনী উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। বিভিন্ন জেলার মতো কেন্দ্রীয়ভাবেও তাঁরা আলোচনাসভার আয়োজন করেন।

আমি তখন ড. ক্ষেত্র গুপ্তের অধীনে পরশুরামের গল্প নিয়ে গবেষণা শুরু করেছিলাম। কিন্তু সে ব্যাপারে উৎসাহ পাচ্ছিলাম না। সোমেন চন্দের সাহিত্য কেন গবেষণার বিষয় হতে পারে না, সে প্রশ্ন ঘুরছিল আমার মাথায়। সোমেনের সঙ্গে রাজনীতি জড়িত বলে ক্ষেত্রবাবুও উৎসাহ দেখান নি। উৎসাহ দেখালেন ড. রবীন্দ্র গুপ্ত। ‘বাংলাদেশ’ পত্রিকায় আমার ধারাবাহিক প্রবন্ধ পড়েছিলেন তিনি। সে কথা তিনি ক্ষেত্রবাবুকে বলে রাজি করালেন। জমা দেওয়া হল synopsis. কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বাতিল করলেন । কারণ রাজনীতি। তারপরে ড. দেবীপদ ভট্টাচার্য উপাচার্য হয়ে এলেন রবীন্দ্র ভারতীতে। দেবীবাবু বামপন্থার অনুরাগী ছিলেন এবং রবীনবাবু ছিলেন তাঁর স্নেহভাজন। সোমেন চন্দ বিষয়ে গবেষণার বিশেষ উদ্যোগ নিলেন উপাচার্য স্বয়ং । কেটে গেল সব বাধা। ১৯৮৫ সালে আমাকে পি এইচ ডি ডিগ্রি দেওয়া হল ‘ প্রগতি লেখক আন্দোলনের প্রথম পর্যায় ও সোমেন চন্দের সাহিত্যচর্চা’ বিষয়ে। গাইড ছিলেন ড. ক্ষেত্র গুপ্ত; পরীক্ষক ছিলেন—নন্দগোপাল সেনগুপ্ত এবং ড. ক্ষদিরাম দাশ। ভাইবা বা মৌখিক জিঞ্জাসাবাদের দিন মজার ঘটনা ঘটে। ক্ষেত্রবাবু যখন অন্যান্য পরীক্ষকদের প্রশ্ন করতে বললেন তখন নন্দগোপালবাবু হাসতে হাসতে বললেন, ‘ওকে প্রশ্ন করতে হলে ওর বই পড়েই প্রশ্ন করতে হবে।’ গবেষণার বিযয়টি পরে ‘সোমেন চন্দের সাহিত্যচর্চা’ নামে বই আকারে প্রকাশ করেন নবজাতক প্রকাশন। তখন অবশ্য মজহারুল প্রয়াত। তাঁর ছেলে বুলবুলই উদ্যোগ নিয়ে বইটি প্রকাশ করে। ততদিনে স্নাতকস্তরে সোমেন চন্দের গল্প পাঠ্য হয়ে্ছে। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে স্বল্প পরিসরে হলেও স্থান পেয়েছেন সোমেন চন্দ।

যতদূর জানি তখনো বাংলাদেশে সোমেন চন্দের রচনাবলি প্রকাশিত হয় নি। এ বিষয়ে আমি একটি প্রস্তাব দিই ঢাকার বাংলা একাডেমিকে। তাঁরা ১৯৭৯ সালের মার্চ মাসের (পত্রসংখ্যা- ৬৩৮২) চিঠিতে জানান;‘ মহাপরিচালক সাহেবকে লিখিত আপনার ২৫.১.৭৯ তারিখের চিঢির জন্য ধন্যবাদ। বাংলা একাডেমির প্রত্যেকটি কাজ উন্নয়ন পরিকল্পনার অর্ন্তভুক্ত। বর্তমানে দ্বিবার্ষিকী উন্নয়ন পরিকল্পনার (১৯৭৮-৮০ ) কাজ চলছে।

স্বর্গীয় সোমেন চন্দের রচনাবলি প্রকাশের জন্য কোন অর্থ বরাদ্দ নেই। কাজেই উক্ত রচনাবলি প্রকাশের দায়িত্ব গ্রহণ করা আমাদের পক্ষে সম্ভবপর হচ্ছে না বলে আমরা দুঃখিত।’ বাংলা একাডেমির সংকলন বিভাগের পক্ষে এই চিঠি লিখেছিলেন এ কে এন হাবিবুল্লাহ খোন্দকার। 

এর পরেও আমি বাংলা একাডেমিকে চিঠি দিয়েছি। উত্তর পাই নি। ২০১১ সালে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালককে শামসুজ্জামান খান সাহেবকে আমি একটি চিঠিতে লিখেছিলাম : ‘হয়তো আপনার বিদিত আছে যে সোমেন চন্দের সম্পূর্ণ রচনাবলি আমার সম্পাদনায় প্রথম প্রকাশিত হয়। কলকাতার নবজাতক প্রকাশন সোমেন চন্দ ও তাঁর রচনা সংগ্রহের প্রথম খণ্ড ১৯৭৩ সালে এবং ২য় খণ্ড ১৯৭৭ সালে প্রকাশ করেন।

১৯৭৯ সালের ২৫ জানুয়ারি একটি পত্রে আমি ঢাকার বাংলা একাডেমিকে সোমেন চন্দের সম্পূর্ণ রচনাবলি প্রকাশের অনুরোধ জানাই। সে পত্রের উত্তরে আপনি অর্থনৈতিক কারণ অক্ষমতার কথা জানান। ‘আমার উক্ত গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছিলেন মুজফফর আহমদ। সোমেন চন্দের রচনাকে বাংলা সাহিত্যে নতুন সংযোজন বলে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন অন্নদাশঙ্কর রায়, হিরন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়, বিনয় ঘোষ, ড.ক্ষুদিরাম দাস, ড. ক্ষেত্র গুপ্ত , প্রেমেন্দ্র মিত্র, বিষ্ণু দে, সুভাষ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ লেখক ও গবেষকরা। সোমেন চন্দ সম্বন্ধে গবেষণার জন্য আমি পি এইচ ডি ডিগ্রি লাভ করি।

‘২০০০ সালে শিল্পী আক্রান্ত নামে আমি সোমেন চন্দের জীবনোপন্যাস লিখি। ২০১০ সালে প্রকাশিত হয় আমার বই : সোমেন চন্দের সাহিত্যচর্চা। ‘সোমেন চন্দ ছাড়াও ময়মনসিংহের কেদারনাথ মজুমদার সম্বন্ধে আমি গবেষণা করেছি। ঐতিহাসিক ড. নিশীথরঞ্জন রায়ের ভূমিকাসম্বলিত কেদারনাথ ও সৌরভ এবং বাঙ্গালা সাময়িক সাহিত্য আমার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। সম্প্রতি আমার সওগাত-মুসলিমমানস-রবীন্দ্রনাথ নামে আর একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।

‘গ্রন্থগুলির একটি করে কপি পাঠালাম। আমার শ্রম ও সাধনাকে বাংলা একাডেমি স্বীকৃতি জানালে ধন্য হব। বয়সের উপান্তে উপনীত বলে উপযাচক হয়েই এই আবেদন করছি।’

দুঃখের বিষয় এ চিঠির কোন উত্তর পাই নি। আমার শিক্ষক ড. ক্ষেত্র গুপ্ত বক্তৃতা উপলক্ষে ঢাকা গিয়েছেলেন। ফিরে এসে তিনি জানালেন যে ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকার কথাপ্রকাশ প্রকাশন থেকে ড. বিশ্বজিৎ ঘোষের সম্পাদনায় সোমেন চন্দের রচনাবলি প্রকাশিত হয়েছে।

মাঝে মাঝে এমন ভাবনা হয় যে সোমেন চন্দকে বিস্মৃতি ও বঞ্চনার হাত থেকে বাঁচাবার চেষ্টা করতে গিয়ে আমিও বঞ্চিত হয়েছি। পরবর্তীকালে আমাদের এপার বাংলায় নেপোয় মারে দই প্রবাদের সার্থকতা দেখতে পাচ্ছি। সোমেন চন্দের প্রচুর আবিষ্কারক গজিয়ে উঠছেন। সরকারি পুরস্কার ও অনুষ্ঠানে আমি ব্রাত্য। আশা ছিল সোমেন চন্দের জন্মভূমি ওপার বাংলায় সামান্য হলেও স্বীকৃতি পাব। তা হব নি। না হোক, এটুকু সান্ত্বনা আমার থাকবে যে একজন জীবনশিল্পীকে বিস্মৃতির হাত থেকে বাঁচাতে পেরেছি আমি।

প্রবন্ধ সমগ্র ।। মতামত ।। সূচীপত্র

 প্রবন্ধ সমগ্র
চাঁন মিয়া
sahestha.png

মরমী বাউল শিল্পী

চাঁন মিয়া আমাদের 

মোহাম্মদ সায়েস্থা মিয়া   

মহা-সচিব: সিলেট সাহিত্য ফোরাম,সিলেট।

harmonium.jpg

     ন্ম হোক যথা কর্ম হোক তার জয়

         মানুষ মানুষের কাছে দেয়, ব্যবহারে  তার পরিচয়।

 

আমরা বিশ্বাস করি মানুষ তার আপন কর্মে মরে গিয়ে ও অমর হয়ে বেঁচে থাকে। বিশ্বাস না করে উপায় নেই, কারণ অতীতের মানবরা যে পথ মত এবং এগিয়ে যাওয়ার দ্বার উন্মোচন করে গেছেন আমরা তাদের অনুস্মরণ ও দেখানো পথ ছাড়া নতুন কোন পথ আবিষ্কার করতে পারছি কি? সুস্পষ্ট উত্তর নেই। জবাবটা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে কেউ উপস্থাপন করতে পারবেন, মনে হয় তা সম্ভব নয়। তাইতো বলতে হয় আমরা তাদের পথে হাঁটছি। কথা না বাড়িয়ে বলবো অমরত্বœকে জাগ্রত বিশ্বাসে মেনে নেয়া ছাড়া কোন গতি পথ খোলা থাকে না। তর্ক না করাই বুদ্ধিমানের কাজ। আজকের প্রসঙ্গ একজন বাউল  শিল্পী নিয়ে, যাহার সুর আমাদের প্রাণে বাজে, আমাদের সুখ দু:খে তাদের রচনা তাদের কণ্ঠ এগিয়ে যেতে সাহস যোগায়, আনন্দ দেয় নির্জনতাকে তাড়ায় যে কথা, সুর, গান প্রাণের খোরাক বলে সিক্ত। বাউল বা গীতিকার যে কোন একজন গুণী মানুষের যাপিত জীবন সংগ্রাম ও তাঁর জীবন যাপন করার বিষয়গুলো দু-চার কলম লিখে শেষ করার নয়। কিন্তু সর্বত্রই আমাদের পরিসর থাকে ছোট তাই আমাদের অনিচ্ছাকৃত ভাবে কলেবর সংক্ষিপ্ত করতেই হয়। সংক্ষিপ্ত আকারে বাউল শিল্পী চাঁন মিয়ার জীবন সংক্রান্ত আলোচনা আজকে উপস্থাপন করছি যা আরো দীর্ঘ পরিসরে আগামীতে লিখার চেষ্টা রাখবো অব্যাহত এই আশায়। আজকের পরিসরে মনের অজান্তে কোন ত্রæটি লক্ষিত হলে সবাইকে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখার আশাও রাখছি পাঠক মহলে। মরমী বাউল শিল্পী চাঁন মিয়া আমাদের অহংকার শিরোনামে ঐ ব্যক্তি কে ছিলেন তার সংক্ষিপ্ত পরিচয় নিম্মে তোলে ধরলাম।

জন্ম, নাম, ঠিকানা।

সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার ০২ নং খাজাঞ্চী ইউপি’র অন্তর্ভুক্ত জয়নগর (নোয়াপাড়া) নামে একটি প্রাচীন গ্রামের নাম। ঐ গাঁয়ের তালুকদার আসরব আলী সাহেবের তিন ছেলের কনিষ্ঠ সন্তান এক কালের প্রয়াত কণ্ঠশিল্পী ও গীতিকার, গায়ক, অজ¯্র ভক্তবৃন্দের প্রিয় মুখ, তখনকার শিল্প সংস্কৃতির ধারক বাহক যাকে এক নামেই দেশ বিদেশের সবাই চিনতো। বাউল শিল্পী চাঁন মিয়া যার নাম। ১৯২৪ সালে সভ্রান্ত তালুকদার মুসলিম পরিবারে তাঁর জন্ম হয়।  তাঁর বড় দু’ভাই মোঃ হারুন রশিদ এবং মেঝো ভাই মোঃ তোতা মিয়া। ব্যক্তিগত জীবনে বাউলের ভাইয়েরা ছিলেন প্রতিষ্ঠিত। দেখতে বাউল চাঁন মিয়া ছিলেন অত্যন্ত সুশ্রী , সুন্দর , সুঠাম দেহের হাস্যজ্জোল, লাবণ্যময়ী এক বুদ্ধি বিচক্ষণতার উজ্জ্বল আলোক বর্তিকা। যাকে চেহারায় অনেকটা পরিচয় ঘটিয়ে দিতো। চাঁন মিয়াকে একবার দেখলে যে কারোর স্মৃতিপট থেকে মুখয়ব অগোচরে অচেনা থাকতো না। যার চেহারা আজ ও আমার স্মৃতির আয়নায় উজ্জ্বল হয়ে আছে।

বাউল শিল্পী চাঁন মিয়ার লেখা পড়া ও শিক্ষা-দীক্ষা

আজ থেকে প্রায় শতবছর আগের শিক্ষাদীক্ষার পরিবেশ কেমন ছিল তা আমাদের সবারই জানা। বাল্য জীবন ধর্মীয় অনুশাসনের মাধ্যমে মসজিদ ও মক্তবে শুরু হতো সবার, কিংবা অনেকেই লেখাপড়া থেকে থাকতেন বঞ্চিত। মসজিদ মক্তবের পাশাপাশি পাড়া গায়ের দূর দূরান্তে দু-চারটা প্রাথমিক বিদ্যালয় তখন ছিল, রাষ্ট্রীয় শিক্ষা শুরুর একমাত্র সূচনার অগ্রযাত্রা হিসাবে। পায়ে হেটে অনুন্নত গ্রামীণ জনপদে প্রাথমিক শিক্ষার পাঠশালায় মানুষের হাতে খড়ির যাত্রা ছিল কঠিন সংগ্রামে জীবন যুদ্ধে বিজয়ের মুকুট পরিধান সমতুল্য। মানুষ কষ্ট ক্লেশ সহ্য করে ছোট বেলায় দুর গাঁয়ে স্কুলের আঙ্গিনায় পদচারণ করে শিক্ষা লাভ করতেন। কতো ঝড় ঝাপটা সহ্য করে তিলে তিলে অগ্রসর হতো-তা বাউল শিল্পী চাঁন মিয়ার জীবন তার বাস্তব উদাহরণ। তিন কিলোমিটার প্রচুর কাঁদা মাড়িয়ে স্কুল আঙ্গিনায় পদচারণ করতে একটু ও পিছু হটেননি তিনি। চাঁন মিয়ার জন্মস্থানের পুরো এলাকার মাঝে চন্দ্রগাম সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়টি ছিল বলে তথ্য সূত্রে আমি অবগত হয়েছি। তিনির শিক্ষা জীবন ঐ স্কুলেই। জয়নগর থেকে বাউল শিল্পী চাঁন মিয়া এ স্কুলে ভর্তি হয়ে লেখাপড়া শুরু করেন এবং এক সময় প্রাইমারী পড়া শেষ করেন।এখন লেখাপড়ার যে মান তাতে বলা যায় বর্তমান মেট্রিক এর চাইতে বেশি তাৎপর্য্য পূর্ণ হবে প্রাইমারীর লেখাপড়া আমি মনে করি। আগের লেখাপড়ার মান ভাল ছিল, যেহেতু বর্তমানে বি.এ. পাশ করে ও অনেকে দরখাস্ত লিখতে জানে না, পারে না। যাক আগেকার লেখাপড়া আর বর্তমান লেখাপড়ার গুরুত্ব বেশি না কম তার বিবেচনা করবেন পাঠক। প্রাইমারী শেষ করার পর তিনি সংস্কৃতি ভাষার উপর গভীর জ্ঞান, ধ্যান ও চর্চা আয়ত্ব করে পরবর্তীতে জীবন সফলতায় ব্যবহার করেন। মাধ্যমিক স্কুলে লেখাপড়া করার সুভাগ্য তাঁর হয়নি। কিন্তু লেখাপড়ার প্রতি প্রচুর আগ্রহ যে ছিল তার, সেই বিষয়টি আজ অনায়াসে ¯স্বীকার করতে হয়। নানা  জনের কাছে খোজ নিলেই পাওয়া যায়, তার সেই জীবন ইতিহাসগুলো।

যুব বয়সে গানের প্রতি তার আগ্রহ:

মরমী বাউল চাঁন মিয়ার বয়স পা পা করে বাড়তে লাগলো। আনুমানিক ২০/২২ বৎসর যখন তার বয়স তখন তিনি হারমোনিয়াম বাজানো শিখেন। এখনকার মতো আগে এতো আধুনিক বাদ্যযন্ত্র ছিলনা। হারমোনিয়াম শিখে গান রিহার্সাল করতে থাকেন। তখন সংস্কৃতি ও বিনোদনের মধ্যে মানুষ পুঁথি পাঠ, জারী, সারী, ভাটিয়ালী, পল্লী গান বেশি পছন্দ করতো। সে সব গানের আসর হতো মানুষের ঘরে ঘরে আঙিনায় আঙিনায়। বাউল চাঁন মিয়াও পুঁথিপাঠ দিয়ে তার গানের জীবন শুরু করেন। প্রথমে তিনি আগেকার নামী দামী শিল্পীদের গানের আসরে সহযোগী শিল্পী হিসাবে যাতায়াত করতেন। প্রয়াত বাউল দূরবীনশাহ ও প্রয়াত বাউল সফর আলীসহ সে সময়ের গুণী শিল্পী ও গায়কের গানের আগ্রহ ও উৎসাহ চাঁন মিয়াকে গানের জগতে প্রবেশে সহায়তা করে।

 

বৈবাহিক জীবন:

তিনি এক মাত্র ঘনিষ্ঠ সহযোগী যার জন্ম একি গ্রামে, এবং চাঁন মিয়ার বয়সে ছোট হয়ে যার জন্ম তার নাম মোঃ উম্মর আলী। বাউলের সহ-সাথীর কাছে জানতে চেয়েছিলাম বাউলের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ইতিহাস। উম্মর আলী যে সব তথ্য প্রদান করেন তা অবিকল লিখার চেষ্টা করছি। তারপর ও বহু সংমিশ্রিত জীবনাতীত ঘটনাবলীর মাঝে সব বলা যাবে না, জানা যায়নি এখন পর্যন্ত। যতটুক জানতে পেরেছি তা বাউলে জীবনের সাথে সংযুক্ত হয়ে আছে। উম্মর আলীর ভাষ্যমতে বাউল শিল্পী চাঁন মিয়া বত্রিশ বছর বয়সে বিবাহিত জীবন শুরু করেন এবং এ সময়ে তার গানের জগতে ব্যাপক পরিচিতি সু-খ্যাতি ছড়িয়েছে চার দিকে। তাঁকে আনুষ্ঠানিক পালা গানের অনুষ্ঠানে গান পরিবেশনের জন্য চতুর্দিক থেকে একের পর এক দাওয়াত আসতো। তখন বৃহত্তর সিলেট জেলার (বিভাগ তখন হয়নি) মানুষ তার যাদুমাখা কণ্ঠে উদ্বেলিত হয়ে শিল্পীর মায়াবী সুরেলা জগতের ভক্তে ভক্ত হয়ে পড়ে।

গুরুজনের সান্নিধ্যে ও গান পরিবেশন:

শিল্পীর সাধনা শুরু সখের বসে, ভাবের তাড়নায়, দশের ভাল’র জন্য। জীবনের উন্নতির জন্য আধ্যাত্বিক ও আত্মশুদ্ধি প্রয়োজন। আত্মশুদ্ধির জন্য গুরুর দীক্ষা আবশ্যক তাই উস্তাদ বা গুরুর শরণাপন্ন হতে হয়। কিন্তু বাউলের এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। নিজে কোন দিন উস্তাদের কাছে গান শিখতে যাননি। জীবনের উন্নয়নে এত সব তার নিজের ব্যক্তি সাধনা, আরাধনা, চেষ্টা, আগ্রহ থাকার কারণে আয়ত্ব করতে সম্ভব হয়েছে। হারমোনিয়াম শিখার পর তিনি সরঞ্জামাদি কিনে নিয়ে দুতারা নিজের হাতে বানিয়ে ছিলেন এবং বহু কাল অনুষ্ঠানে নিজের বানানো দুতারা দিয়ে গান গাইতেন। পরে তিনি বিখ্যাত মরমী বাউল দুরবীন শাহের সাহচার্য্য লাভ করেন। দুরবীন শাহ গানের আসরে আসরে গাইতেন। মরমী বাউল দুরবীন শাহের গান আজও মানুষের কাছে অমিয় বাণীর মতো শ্রোতাদের কাছে গ্রহণীয়।

সাধক দুরবীনশাহ বাউল চাঁন মিয়াকে তার রচিত একটি গানের বই উপহার দেন। তিনি রাতভর গান রিহার্সাল করতেন এবং পরিবেশন করতেন। তখনকার সময় কারবালার ইতিহাসের ঘটনা পুথি আকারে বাউল সাধকেরা গাইতেন এবং মানুষ তৃপ্তি সহকারে শ্রবণ করতো। মর্মান্তিক নিদারুণ কারবালার ইতিহাসকে জঙ্গঁনামার পুঁথি নামে মানুষের কাছে পরিচিত ছিল। মাধুর্য্য মন্ডিত কোকিলা কণ্ঠের শিল্পীদের দ্বারা পরিবেশন করিয়ে সবাই দলে দলে শুনতো এই কাহিনীগুলো। হিন্দি ভাষায় রচিত জঙ্গঁনামার পুঁথি, গাজী কালুর কেচ্ছা এ রকম আরো অনেক জারী, সারী, ভাটিয়ালী গানের আসর বসিয়ে গ্রামের লোকজন আনন্দ বিনোদন উপভোগ করতো। মানুষ মরিয়া হয়ে উঠেছিলো চাঁন মিয়ার কণ্ঠে গান শুনার জন্য তার গলার সুর ছিল অতি মাধুর্য্য ও মিষ্টভাষী। সরু কণ্ঠ ও ভাব গাম্ভীর্যপূর্ণ অঙ্গ ভঙ্গিমা প্রদর্শন শিল্পীর সাফল্যের ছিল এক মাত্র কারণ। মানুষ যখন শুনতো কোথাও চাঁন মিয়ার আগমন, উপস্থিতি তখন মানুষের ভারে ঐ স্থানের জায়গা সংকুলান হতো না। এ সময় টেপ রেকর্ডারের কদর ছিল প্রচুর। মানুষ টেপ দ্বারা গান রেকর্ড করে শুনতো। বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ টেপরেকর্ডার নিয়ে আসতো বাউল চাঁন মিয়ার গান রেকর্ড করার জন্য। প্রতিটি গানের আসরে শতেকটা টেপ রেকর্ডার থাকতো হাজির। প্রত্যেক টেপ ওয়ালা খুশি মনে বাউলকে ৩০/৪০/ বা ততোর্ধো টাকা দিতো বখশিস। এছাড়া বাউল শিল্পী সফর আলীর গান ও তিনি পছন্দ করে গাইতেন। বাউল সফর আলীর ঐ গানটি গেয়ে  ছাতক থানার দুলার বাজারে একটি আসর মাতিয়েছিলেন। হাজার দর্শকের মন জয় করেছিলেন সেদিন চাঁন মিয়া। গানটি নিন্মরূপ:

বন্ধু আইওরে গগনেরেই চান

বাটায় সাজাইয়া রাখছি সোনামুখি পান।

বন্ধু আইওরে।

বন্ধুরে,তুই বন্ধু আসিবে বলে দ’ুভাগ মাথার চুল

চুলের উপর বাইন্ধা রাখছি সোনা মুখি ফুল

বন্ধু আইওরে।

বন্ধুরে নিশিকালে নীরব হইলে আইও

অভাগিনীর ফুলে মধু একবার খেয়ে যাইও

বন্ধু আইওরে।

সফর আলী কয়রে বন্ধু তুমি না আসিলে

ফুলের শয্যা জলে ভাসাইবো রাত্রি নিশা কালে

বন্ধু আইওরে।

 

এ রকম কত গান তিনি গেয়েছেন তার কোন পরিসংখ্যান নেই, সংরক্ষণের কারণে, যা কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। বাউল চাঁন মিয়া একাধারে ৩ বছর মরমী সাধক দুরবীন শাহের নিকট যাতায়াত করেছেন এবং রাতভর গান রচনা করে গান গেয়ে জীবন কাটিয়েছেন। তিনির বাল্যসাথী উম্মর আলী বলেন, আগে মানুষ হৃদয় দিয়ে গান শুনতো চোখের জলে বুক ভাসাতো কেউ কেউ। কিন্তু এখন মানুষ সুখের বসে শুনে গান কেউ হৃদয় দিয়ে গানের ভাষা , গানের কথা উপলব্ধি করতে চায়না। বর্তমানে নানান ধারায় আবিষ্কৃত গান আমাদের পুরনো সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, কৃষ্টিকে ধ্বংস করে ফেলছে। পুরনো ঐতিহ্যকে আমাদের ঠিকিয়ে রাখতে উদ্যোগ গ্রহণ করতে আমাদের প্রতি তার পরামর্শ। দাওয়াতি পালা গানের আসরে জীবনের অনেক সময় কাটিয়েছেন বাউল শিল্পী চাঁন মিয়া।

বাউল চাঁন  মিয়ার উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গানের অনুষ্ঠানের স্থান:

একদিনের জন্য দাওয়াত আসলে যখন অনুষ্ঠানে হাজির হতেন তখন ৪/৫ দিন গান পরিবেশন করে ও রেহাই পাওয়া যেত না। একের পর এক গানের আসর চলতে থাকত। ভক্তরা এসে জোর করে এখান থেকে অন্য-খানে নিয়ে যেত। সিলেটের মেনি খলা গ্রামে আপ্তাব মিয়া বাড়িতে এক নাগাড়ে ছয়মাস প্রতি মঙ্গলবার সাপ্তাহিক ভাবে পালাগানের অনুষ্ঠান চলতেই থাকে। সালুটিকর বল্লা গ্রামে,ছাতক থানার রাজারগাঁও, বালাগঞ্জ থানার তাজপুর, সহ মাসের পর মাস, দিনের পর দিন বাউল চাঁন মিয়া গান গেয়েই যেতেন।

কয়েক ভক্তের ঘটনা:

এক মহিলা ভক্ত লন্ডন থেকে তার গান শুনে দেশে এসে বাউল চাঁন মিয়াকে দাওয়াত করলেন, মহিলার বাড়ি কোম্পানিগঞ্জে। বাউলের সাথে উম্মও আলী আব্দুল হামিদ, ইর্শাদ আলী,আয়ুব আলী, রতন নামের আরো একজন নিয়ে মহিলার বাড়িতে উপস্থিত হলেন। সেখানে গিয়ে অবাক কান্ড। মহিলা একশত পাঠি বিছিয়ে বিরাট মাহফিল আয়োজন করেছেন তাঁর আঙ্গিনায়। হাজার হাজার লোকের সমাগম হয়েছে। গান শুরু হল। এক পর্যায়ে গান শুনে মহিলার ভাবের বাদ ভেঙ্গে মাঠিতে লুঠিয়ে কাঁদছেন। কারবালার ঘটনা তার হৃদয়ে এমন কঠোর আঘাত করেছে যা তিনি সামলে নিতে পারছেন না। ভদ্র মহিলার মাটিতে পড়ে এমন কান্না দেখে শিল্পী তাকে সান্ত্বনা দিয়ে  কান্না বারণ করালেন। এমন ঘটনা নারী পুরুষের মধ্যে অনেকবার ঘটেছে। প্রিয় পাঠক অনুভব করুন বাউল চাঁন মিয়ার কণ্ঠ এবং তার গান পরিবেশনার ভঙ্গি কেমন শৈল্পিক ছিল।

মাতৃভূমির প্রতি বাউলের ভালবাসা:

মানুষ যেখানে জন্মে যে দেশে জন্মে সে স্থান ও সে দেশকে প্রাণের চেয়ে বেশি ভালবাসে। বাউল চাঁন মিয়াও তাই। জাগ্রত বিবেক এবং মরমী বাউল, শিল্পী, কবি, সাহিত্যিক গণ সর্বদায় দেশপ্রেমে নিবেদিত থাকেন। সমাজের অধিকার, বঞ্চনা, নির্যাতন, জুলুম, শোষণ কবি প্রাণে বেশি লাগে। মা-মাটিকে নিয়ে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত করেন গৌরব। মা-মাটির উপর জুলুম অত্যাচার নির্যাতন শোষণ শাসন বরদাস্ত হয়না দেশপ্রেমিকের। এক্ষেত্রে বাউল চান মিয়া উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

বাংলাদেশকে যখন পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর দখলদারিত্বের হাত থেকে মুক্তির দীর্ঘ সংগ্রাম চলে ১৯৭১ সালে তখন তার অবদান স্মরণীয়। অন্যান্য কবি শিল্পীদের মত তিনি ও মাতৃভাষা ও মাতৃভূমির জন্য উজ্জীবিত হয়ে গান রচনা করে বিভিন্ন স্থানে পরিবেশন করেন।  মুক্তিকামী আবাল বৃদ্ধ বণিতা মৃত্তিকা উদ্ধারে বাউলদের সুরে ও তাদের সুরের মূর্ছনায় উদ্বেলিত হয়ে বীর বিক্রমে করেছে যুদ্ধ। গান  কবিতা তাদের দিয়েছিলো গায়ে শক্তি প্রেরণা। উপযুক্ত সংরক্ষণের অভাবে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালের গানগুলো আজ নেই, তবে জনমুখে দু-চার লাইন করে গুন গুন এখনো দুটি শ্লোক শুনা যায়। বাল্য সাথী উম্মর আলী তার একটি গানের শ্লোক তার মুখে এভাবেই উচ্চারণ করেন।

ইন্দিরা জননী হইয়া মায়ের ছেলে কুলে লইয়া

দুধ খাওয়াইলও রিলিফ দিয়া

রক্ষা করল সবার প্রাণ

গাওরে সবাই মুক্তির জন্য বাংলাদেশের গান।

এছাড়া তাঁর সচরাচর আরো কয়েকটি গান সংরক্ষিত করা হয়েছে যা নিম্নরূপ।

 

গান ১) 

পিঞ্জরার পাখিরে ওরে পাখি তরে বিনয় করি

অভাগীরে কাঁদাইয়া যাইও না আর ছাড়ি।

 

দুধ কলা মাখন ছানা ওরে পাখি,

খাবাইলাম আদর করি

ফুলের বিছানায় রাখলাম

কতই না যতন করি।

 

আগে যদি জানতাম পাখিরে,

ওরে পাখি যাইবে পাসরী

লোহার শিকল দিয়া,

রাখতাম বন্দি করি।

আমারে ছাড়িয়া পাখিরে

ওরে পাখি রইলে কার ঘরে

চাঁন মিয়া কয় আসবে একদিন

আমার ঘরে ফিরি।

গান ২)  

 ময়নায় কান্দেরে পিঞ্জরার বানে চাইয়া

কোন দিন জানি যাবে ময়না পিঞ্জরা ফেলিয়া।

জীবন কাটাইলাম মাটির পিঞ্জরায় থাকিয়া

এখন আমি কোথায় যাব পিঞ্জরা ফেলিয়া।

মাটির কায়া মাটিতে যাবে মিশিয়া

কথায় নিয়া রাখবো আল্লায় পাই না ভাবিয়া।

চাঁন মিয়া কয় জানতাম যদি যাইব মিশিয়া

তবে না করিতাম খেলা মাটির কায়া লইয়া।

 

গান ৩)      

কি করলেরে ফকির বেটা

সারা জীবন ফকিরি

ফল পাইবে শূন্য একটা।

১)মদ গাঞ্জা করিয়া পান

হারাইলে হুশ জ্ঞান

না মানিয়া হাদিছ কোরান

চুলেতে লাগাইলে জটা।

২)লাল টুপ মাথায় বান্দিয়া

লোহার ডান্ডা হাতে নিয়া

আবুল তাবোল তাই বকিয়া

হাতে টানলে গুটা।

৩) শরিয়ত ছাড়া মারফত মিলে না

কোরানেতে আছে জানা

হাদিছ ছাড়া কিছুই পাবে না

না শিখাইলে মুর্শিদ বেটা।

৪) বাউল ও চাঁন মিয়া বলে

কি করবে তুই হাশরের কালে

আমল নামা দেখবে খোলে

পড়ে গেছে বিষম ঠাটা।

 

গান ৪)            

যেদিন হতে বন্ধু হারা ধারা বয় দুই নয়নে

কুলমান সবই নিল গো সই কি যাদু জানে।

১) আকাশেতে নাইরে চন্দ্র কি করে তার আগুনে

ওরে নারীর ও বসন্ত কালে পুরুষ রাখে যতনে।

২) নয়া ঘর বান্দিয়া লোকে ছানি দেয় উলু ছনে

যে বা নারীর দামী নাই গো কি করে তার রুপ ঘনে।

৩)  যৌবন কালে পিরিত মিষ্টি পান মিষ্টি হয় চুনে

বাউল ও চাঁন মিয়া বলে পিরিত করে অন্তরে ধরল ঘুণে।

 

গান ৫)   

বহু দিনের পোড়া বন্ধু যাও শীতল করিয়া

বন্ধু মোরে যাইও না ছাড়িয়া।

১/ হৃদয় বাসরে রাখমু বন্ধু যতন করিয়া

চরণ তলে পড়ে থাকমু তোমার দাসী হইয়া।

২/ কুল ছাড়া করিল বন্ধু পিরিতি শিখাইয়া

লোক সমাজে যাই না বন্ধু তোমার লাগিয়া।

৩/ চাঁন মিয়া দীন দুখিনী কাঁদি নিশিদিয়া

ছাইড়া যাইতে সঙ্গে নিও দু:খিনী জানিয়া।

 

আরো কয়েকটি গানের প্রথম কলি।

 

১। আমার রজনী ভোর হইল গো

কোকিলায় ডাকিল

ডাক শুনিয়া দুই নয়নে নিদ্রা না আইল।

 

২। বহু দিনের পোড়া যাও শীতল করিয়া

    বন্ধু মোরে যাইও না ছাড়িয়া।

 

৩। যে দিন হতে বন্ধু হারা, ধারা বয় দুই নয়নে

কুল মান সবই নিলো গো সই, কি যাদু জানে।

 

৪। কে কয় পিরিত ভালা গো

এর মত আর নাই জ্বালা।

 

৫।  ক্ষণস্থায়ী এই জগতে রবে না চিরকাল

     আসা যাওয়া বিফল হইল, পারের কড়ি নাই আমার।

 

৬। গরীব হইলে ভবে কেউ চিনে না

    গরীব ধনির বাড়িতে যায়,

    মনে মনে কইতে রয়

    কোন জিনিষটা নিত আইছে করে ভাবনা।

 

৭। হরিণী কাঁদিয়া বলে, পড়িয়া শিকারীর জালে

    তরাইয়া লও আমারে নবী মোস্তফায়।

 

৮। একদিন নবী গেলেন সংসার ছাড়ি

    কইতে না পরি।

 

৯।  সাহারাতে ফুটলরে ফুল,দু’জাহানের বাদশা মকবুল

      ভ্রমর আকুল গন্ধ পাইয়া তার।

 

১০।  সব হারাইলাম কামিনীর হাটে গো, একদিন ধরিবে যমদূতে।

 

বাউল চাঁন মিয়ার সন্তান সন্ততি:

তিনি সাত মেয়ে এক ছেলে সন্তানের গর্বিত জনক। মেয়েদের উপযুক্ত পাত্রদের হাতে সমর্পণ করে এক মাত্র ছেলেকেও উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। ছেলেকে সমাজের সুনাগরিক হিসাবে গড়েছেন। বর্তমানে বাউল চাঁন মিয়ার মত তিনি ও সমাজ থেকে সমাজান্তরে একটি নাম নিয়ে উদ্ভাসিত। বৃহত্তর বাংলার সবাই তাকে একজন লেখক কলামিস্ট হিসাবে চিনতে পারছে। এটাকেই বলে ‘বাপে বেটা’। বাউল চাঁন মিয়ার একমাত্র ছেলের নাম মিজানুর রহমান মিজান। তিনি বর্তমানে লেখালেখির পাশাপাশি বিশ্বনাথ প্রেসক্লাবের সভাপতির দায়িত্বে নিয়োজিত। মরমী বাউল চাঁন মিয়ার একমাত্র ছেলে একজন সু-সাহিত্যিক ও বটে।

কঠিন রোগাক্রান্ত বাউল:

মানুষের সব কোলাহলের দিন এক সময় ফুরিয়ে আসে বয়স বাড়ার সাথে সাথে। কখনো রোগ এসে বাসা বাধে মানব দেহে আর এসব আল্লাহর ইচ্ছায় হয়। আল্লাহ যাকে খুশি সুস্থ রাখেন, যাকে খুশি অসুখ বা রোগ দান করেন। বাউল চাঁন মিয়ার বসয় যখন ৮০তে পৌঁছে তখন তিনি দুরারোগ্য ব্যাধি ক্যানসারে আক্রান্ত হন। দীর্ঘ পাঁচটি বছর ঐ রোগে ভুগেন।  দিন দিন রোগ যন্ত্রণা প্রবল হয়। সময় তার গতিতেই চলে।

বাউলের ইন্তেকাল:

সব ঝংকার নিস্তেজ-শোকের মাতম বাউল শিল্পী চাঁন মিয়া ২০০৪ সালের ১৭ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৭ ঘটিকায় নিজ বাসগৃহে ইন্তেকাল করেন।(ইন্না... রাজিউন)।

 শিল্পী চাঁন মিয়ার সাথীগন:

১। ঢোলক ঢফকি বাদক মোঃ উম্মর আলী সাং জয়নগর  নোয়াপাড়া) ডাক রাজাগঞ্জ বাজার, উপজেলা বিশ্বনাথ, জেলা সিলেট,  ২। মন্দিরা বাদক মোঃ আব্দুল হামিদ সাং জয়নগর  নোয়াপাড়া) ডাক রাজাগঞ্জ বাজার, উপজেলা বিশ্বনাথ, জেলা সিলেট, ৩। অন্যান্য যন্ত্র বাদক মোঃ ইর্শাদ আলী সাং গনাইঘর ডাক রাজাগঞ্জ বাজার, উপজেলা বিশ্বনাথ, জেলা সিলেট, ৪। আয়ুব আলী, সাং কাবিলপুর, ডাক রাজাগঞ্জ বাজার, উপজেলা বিশ্বনাথ, জেলা সিলেট, ৫। বাঁশী বাদক মোঃ রতন, সাং কাবিলপুর, ডাক রাজাগঞ্জ বাজার, উপজেলা বিশ্বনাথ, জেলা সিলেট।

বাউল চাঁন মিয়ার স্মৃতি রক্ষার্থে পাঠাগার প্রতিষ্ঠা:

মানুষ মরে গেলে তার সু-কর্মগুলো ধরে রাখার ব্যবস্থা করা উচিত। বাউল চাঁন মিয়ার স্মৃতিকে যুগ যুগ ধরে রাখার জন্য তাঁর এক মাত্র পুত্র সাংবাদিক, সাহিত্যিক, কলামিস্ট মিজানুর রহমান মিজান বাউলের নামানুসারে ২০০৬ সালে বিশ্বনাথের রাজাগঞ্জ বাজারে “চাঁন মিয়া স্মৃতি পাঠাগার” প্রতিষ্ঠা করেন। যেখানে প্রতিনিয়ত এলাকার মানুষ বিনা পয়সায় বই পত্রিকা পড়ে জ্ঞান ব্যপ্তি করছে। পাঠাগারের এ যাত্রা যেন চিরজাগরুক থাকে এই আশাবাদ হৃদয়ে। বাউল চাঁন মিয়াকে নিয়ে আরো শিকড় সন্ধানী গবেষণা  করলে এবং তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করলে সমাজের জন্য মঙ্গল বয়ে নিয়ে অসবে এই ক্ষণজন্মা গুণীজন আমাদের গৌরব হয়ে থাকবেন এই থাকছে সবার প্রতি বার্তা।

প্রবন্ধ সমগ্র ।। মতামত ।। সূচীপত্র

স্টাফরুমের একাল সেকাল
 প্রবন্ধ সমগ্র
SanojCharaborty.jpg

স্টাফ রুমের  
একাল সেকাল
সনোজ চক্রবর্তী
পূর্ব মেদিনীপুর, পঃ বাংলা

village1.jpg

সনোজ চক্রবর্ত্তী পেশায় স্কুল শিক্ষকতা। বানিজ্য বিভাগে স্নাতকোত্তর। ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখি। মুলত গল্পকার হলেও কবিতাও লিখেছেন বেশ কিছু। প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন পত্র পত্রিকাতে। লেখালেখি ছাড়া অন্যতম নেশা অভিনয় ও নাটক পরিচালনা।

প্ত দুপুরের রোদ ভেঙে ইটের এবড়ো থেবড়ো পথ ধরে এগিয়ে চলেছে সাইকেলটা। আরোহী সহ সাইকেলের ছায়া মিশে গেছে চাকার তলায়। মাথার উপর সূর্য। জীর্ণ সাইকেলটার সারা শরীরে শব্দ। সাইকেলটি যেমন জীর্ণ ঠিক তেমনই আরোহীও ভগ্ন স্বাস্থ্য। প্রায় ছয় কিমি পথ বেয়ে স্যার চলেছেন সহকর্মীকে দেখতে। তখন তো আর হাত ফোন ছিল না, যে বাথরুম করতে করতে বিশ্বের খবর নেওয়া যাবে! লেবু জল হাতে নিয়েই বসে গেল শরীর। অসুস্থ সহকর্মীকে দেখতে এসে নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়লেন। এ ঘটনা বছর পঁচিশ আগের ঘটনা।
কিছু দিন আগে আমার এক বন্ধুর মা মারা গেলেন, মৃত্যুর দিন দুই পর তার অতি ঘনিষ্ঠ এক শিক্ষক সহকর্মী খোঁজ নিয়েছিলেন। ‘মাসিমা কেমন আছেন?’ আবার হেডমাস্টার পাহাড়ি মশাই এতো ব্যস্ততার মাঝেও বারবার খোঁজ নিয়েছেন। ২৬/৪/১৭ একটি পোষ্ট দেখার পর ইচ্ছেটা বেশ তাড়া দিচ্ছিল লেখার জন্য। বারবার মনকে বোঝালাম না এ হয় না, কারো পোষ্ট দেখে লেখাটা ভালো দেখায় না। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম লেখাটাই উচিত কাজ হবে। শিক্ষকদের একাল সেকাল বলে বোধহয় কিছু হয় না। সেকালের শিক্ষকদের মধ্যে মারামারি হতো আর একালের শিক্ষকরা সবাই গৌতম বুদ্ধের ভাইপোর নাতির ঘরের পুতি, তার নাতির নাতি.... তার নাতির খুড়তোতো ভাইয়ের নাতির কাছে দীক্ষা নিয়েছেন এ কষ্ট কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়। আমার শিক্ষকতার দশ বছর পূর্ণ হলো। সে হিসাবে আমি একালেই পড়ব তবুও এতো বড় মিথ্যাকে প্রশ্রয় করার শিক্ষা আমি পাইনি।সময়ের স্রোতে ভাল মন্দ দুইই আছে। বিগত দিনে অসংখ্য

সুশিক্ষকদের মধ্যে মন্দ ছিল। তা না হলে ভালো মন্দের দ্বন্দ্বটা থাকে কি করে। এখনও ভালো শিক্ষকের পাশাপাশি মন্দরাও রয়েছেন। প্রশ্ন থাকতে পারে কোন সময়টা ভাল? এ প্রশ্নের জবার একটু অন্য ভাবে আসুক। আমরা যারা একালের শিক্ষক, আমাদের আচার আচরণ, পড়ানো, কথা বলা, হাঁটা চলা,এমন কি ছাত্র-ছাত্রীদের বকা ঝকা করাটাও আমাদের বিগত দিনের কোনো না কোনো শিক্ষকের আদলে নির্মিত। এটা আমার বিশ্বাসের জায়গা, অন্য কেউ ভিন্ন মত হতেই পারেন। মানুষ অনুকরণ প্রিয়। সমাজে বর্তমানে যে ক্ষয়িষ্ণু ভাব তার জন্য অনুকরণ যোগ্য চরিত্রের অভাব কিঅ ন্যতম কারণ নয়? বর্তমানে অধিকাংশ মানুষের আত্মকেন্দ্রিকতা অসহিষ্ণুতা, মূল্যবোধের অভাব এগুলো কি প্রমাণ করে যে আমরা একটা ভাল সময়ের মধ্য দিয়ে হাঁটছি?কাজের মধ্য দিয়ে মানুষ যতটা শিক্ষা নেয় তার অধিক শিক্ষা নেয় অবসরে। অবসরই তাকে আত্মসমালোচনার পরিসর এনে দেয়। নিজের ত্রুটি বিচ্যুতি নির্ণয় ও তার সংশোধন মূলক ব্যবস্থার জন্য পর্যাপ্ত অবসরের প্রয়োজন। অবসর অলস সময় নয় বরং অবসর মানুষকে পূর্ণতা দান করে।এখন এই একটি জিনিসের বড় অভাব। আমাদের কোনো অবসর নেই। ফলত আত্মসমালোচনা, আত্মসংশোধনের সুযোগ প্রায় নেই বললেই চলে। ফলত ত্রুটিপূর্ণ জীবনের বহমানতা সমাজের বহুদূর পর্যন্ত বিস্তার পেয়ে যায়। আর যদি সেই চরিত্রের অনুকরণ ঘটে তবে তা সমাজের ক্ষয় ত্বরান্বিত করে। কর্মক্ষেত্রে সহকর্মীর জন্মদিন পালন কাজের পরিবেশকে আন্তরিক বা স্বাস্থ্যকর করবে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ থাকে না। যারা এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে তাদের একটা বাড়তি মিষ্টি দেওয়ার প্রস্তাব রইল। যদি জন্মদিনের বিরোধীতায় কতিপয় পুরানো শিক্ষক থেকে থাকেন তবুও এই বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঐ সময়টাকে অস্বীকার করা যায় না। একাল সেকাল বলা যায় না।বর্তমান সময় হল উইন্ডো ড্রেসিং- এর সময়।জন্মদিন পালন যেন বাতায়ন সজ্জায় পরিণত না হয়। সে যেন কেবল আয়োজনে আটকা না পড়ে, অন্তরের অন্দর মহলের আহ্বান হয়ে ওঠে।

স্বর্গের পারিজাত

প্রবন্ধ সমগ্র ।। মতামত ।। সূচীপত্র

 প্রবন্ধ সমগ্র

স্বর্গের পারিজাত

সুস্মিতা দত্ত

কলকাতা

রাতে প্রস্ফুটিত ফুলের সুবাসে, প্রভাতে শিশির ভেজা সবুজ ঘাসে ঝড়ে পড়া শুভ্র-কমলার চোখ-জুড়ানো আচ্ছাদনে, শিউলি বা শেফালি জানিয়ে দেয় শরৎ ঋতুর আগমন বার্তা। শিউলি বা শেফালি গ্রাম-বাংলার একটি অতি পরিচিত গাছ। বৈজ্ঞানিক নাম Nyctanthes Arbor Tristis যা স্বর্গের পারিজাত নামে অভিহিত। ইংরাজী নাম Night Jasmine.
কথিত আছে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্বর্গের দেবরাজ ইন্দ্রের বাগান থেকে পারিজাত মর্ত্যে এনেছিলেন। আবার ভগবৎ গীতা, মহাভারত ও বিষ্ণুপুরাণ মতে সমুদ্র মন্থনে উঠেছিল এই পারিজাত। এর অপর একটি নাম Arbor Tristis অর্থাৎ Sad tree. বেলা বাড়ার সাথে সাথে এই ফুলের উজ্জ্বলতা নষ্ট হয়ে বিষণ্ণতায় পরিণত হয়, তাই এই নামকরণ। জলপাই বা অলিভ প্রজাতিভুক্ত এই ভেষজ উদ্ভিদটির জন্মস্থান দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া- ভারত, বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড, ক্রান্তীয় আবহমন্ডল।

চিরসবুজ প্রকৃতির এই উদ্ভিদটির উচ্চতা ১০ মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। রন্ধন কার্য্যে ঔষধি হিসেবে এর কিছু ব্যবহার সর্বজনবিদিত। শিউলি ফুলের বোঁটা থেমে নি:সৃত নির্যাস খাদ্যদ্রব্যে ও কাপড় রঙিন করতে ব্যবহৃত উৎকৃষ্ট রঞ্জক। এই উদ্ভিদের কান্ড, গাছের ছাল, ফুল, ফল, পাতা সবকিছুই উপকারী। পুষ্টিগত গুণের দিক দিয়ে ক্ষারীয় প্রকৃতির এই ভেষজ উদ্ভিদটির পাতায় রয়েছে Anthocyanins, Ascorbic Acid, Astragalin, Benzoic Acid, Beta-Armin, Beta-Sitosterol, Fructose, Manital, Glucose, Carotene, Tannic Acid, Methyl Salicylate, Oleanolnic Acid, Nicotifloin. গাছের ছাল বা বাকলে রয়েছ ফুলের নির্যাসে রয়েছে Glycosides, Alkaloids। এই উদ্ভিদের বীজ থেকে পাওয়া যায়  Arbortristosides A ও B,

গাছ

ফুল ও পাতা  

বীজ

ফুল ও কুড়ি 

Oleic Glycerides of lanoleic, Myristic Acid, Nyctanthic Acid এবং জলে দ্রবণীয় Polysaccharides.চিকিৎসাক্ষেত্রে এই ঔষধির উপকারিতা অনস্বীকার্য। ডেঙ্গু এবং চিকিনগুনিয়ার ক্ষেত্রে শিউলি পাতার রস খুবই কার্যকারী। এটি রক্তের অনুচক্রিকার মাত্রা কমাতে সাহায্য করে। শুধুমাত্র কৃমি ও উকুননাশকই নয়, উচ্চ রক্তচাপ, সায়টিকা বাত, ম্যালেরিয়া, জন্ডিস, হেপাটাইটিস, মধুমেহ, কোষ্ঠবদ্ধতা, ডায়রিয়া, স্কার্ভি ইত্যাদি রোগের উৎকৃষ্ট  প্রতিষেধক। ব্যথানাশক তিক্তস্বাদ বিশিষ্ট উদ্ভিদটির ব্যবহার চুলের অকালপক্কতা, খুস্কিরোধে ও চর্মরোগে ফলপ্রদ। এই উদ্ভিদটির ছালের নির্যাস গেঁটেবাত এবং কাশি, হাঁপানি রোগে বিশেষ ফলদায়ী। পরিশেষে বলি, শুধু নয়নাভিরাম শোভায়  নয়, প্রাকৃতিক ভেষজগুণে ভরপুর এই অমূল্য সম্পদ জীবজগতের কল্যাণে বিধাতার কি অপূর্ব সৃষ্টি! সকলের উচিত এই নৈসর্গিক ঐশ্বর্য্যকে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা।

অনন্যা কাদম্বরী

প্রবন্ধ সমগ্র ।। মতামত ।। সূচীপত্র

 প্রবন্ধ সমগ্র

অনন্যা

কাদম্বরী

রজত কান্তি সিংহ

কাদম্বরী এবং রবীন্দ্রনাথের মধুর সম্পর্ক নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলেন। রবীন্দ্রনাথের মতন প্রতিভাবান ব্যক্তিত্বের সঙ্গে যে নারী ঘনিষ্ঠতা অর্জন করেছিলেন তাকে যতই সাধারণ নারী বলে মনে করা হোক না কেন তিনি নিশ্চয়ই অনন্যা। কাদম্বরী দেবী বাবা-মায়ের তৃতীয় কন্যা ছিলেন। বড়দিদি বরদাসুন্দরী, মেজদিদি মনোরমা এবং ছোটবোন ছিলেন শ্বেতাম্বরী। বাবা ছিলেন শ্রী শ্যাম গাঙ্গুলি এবং মা ছিলেন শ্রীমতি ত্রৈলোক্যসুন্দরী। কাদম্বরীর জন্ম হয় 5th July, 1859 – রবীন্দ্রনাথের থেকে দু বছরের বড়।           
কাদম্বরীর বাবা শ্যাম গাঙ্গুলি জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির বাজার সরকার ছিলেন। ঠাকুরবাড়ির একতলায় ছোট একটি ঘরে শ্যাম এবং ত্রৈলোক্যসুন্দরী কাদম্বরীর জন্মের আগে থেকেই বাস করতেন। ছোটবেলায় কাদম্বরী ছোট রবিকে বারান্দায় রেলিং ধরে আকাশের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে এবং বাগানে খেলতে অনেকবার দেখেছেন। হয়তো তার ইচ্ছেও হয়েছিল রবির সঙ্গে গিয়ে খেলা করে। কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও অভিজাত এবং ধনী পরিবারের রবির সঙ্গে খেলতে যাওয়ার সাহস এবং সুযোগ কোনটাই গরীব ঘরের মেয়ে কাদম্বরীর ছিল না। 
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের তেরোটি ছেলে - মেয়ে। সকলের ছোট ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের ডাক নাম ছিল রবি। রবির জন্ম হয় 1861 সালের 7th May। রবির নতুনদা, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জন্ম হয় 1849 সালের 4th May - রবীন্দ্রনাথের থেকে ১২ বছরের বড়। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ যেমন ছিলেন রূপবান তেমনি ছিলেন বিদ্বান - নানা বিষয়ে ছিল তাঁর জ্ঞান এবং পারদর্শিতা - যাকে বলা যায় Multitalented Personality। একাধারে ছিলেন লেখক, নাট্যকার, অভিনেতা, সম্পাদক, অনুবাদক এবং উচ্চমানের শিল্পি। তিনি ভালো আঁকতে পারতেন  আবার পিয়ানো, সেতার, বেহালা, হারমোনিয়াম ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র গুলিও বাজাতে পারতেন ভালো। পিয়ানোতে উনি নতুন নতুন সুর সৃষ্টি (Music Compose)  করে প্রথমের দিকে বন্ধু অক্ষয় চন্দ্র চৌধুরী এবং পরে ভাই রবিকে পাশে বসিয়ে সেই সুরের উপর কথা বা Lyrics দিতে বলতেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ জোড়াসাঁকোর বাড়িকে সাহিত্যে, নাটকে এবং সঙ্গীতে মাতিয়ে রাখতেন। মেজ বৌঠাকুরাণী জ্ঞানদানন্দিনী ঠাকুরপো জ্যোতির বিয়ের জন্য সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বন্ধু ডাঃ সূর্য্যকুমার চক্রবর্ত্তীর বিলেত ফেরত মেয়েকে পছন্দ করেছিলেন। কিন্তু দেবেন্দ্রনাথ রাজি না হওয়ায় সেখানে জ্যোতির বিয়ে হল না। পরে, দেবেন্দ্রনাথ স্বয়ং তাঁদেরই কর্মচারী শ্যাম গাঙ্গুলির ৯ বছরের কালো ও রোগা মেয়ে কাদম্বরীর সঙ্গে জ্যোতির বিয়ে ঠিক করে ফেললেন। দেবেন্দ্রনাথের এই সিদ্ধান্তে ঠাকুরবাড়ির মাহিলা মহল খুবই অসন্তুষ্ট হলেন। তারা কেহই কাদম্বরীকে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের যোগ্য পাত্রী বলে মেনে নিতে পারেননি। বিয়ের দিন ঠিক হল 5TH July, 1865। দিনটা ছিল কাদম্বরীর জন্ম দিন। বিয়ের দিন নিয়ে মা ত্রৈলোক্যসুন্দরী আপত্তি জানালেন। কারণ জন্মদিনে বিয়ে হলে মেয়ে সুখী হয় না। কিন্তু দেবেন্দ্রনাথ কোন সংস্কার বা কারুর কোন কথা শুনলেন না। নির্ধারিত দিনেই বিয়ে হল।
কাদম্বরী যখন নতুন বৌ হয়ে ঠাকুরবাড়িতে এলেন তখন তার লেখাপড়ার জ্ঞান খুবই সামান্য ছিল। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ প্রথমেই তার শিক্ষার ব্যবস্থা করলেন এবং সাথে সাথে ঘোড়ায় - চড়ার প্রশিক্ষণও তাকে দিতে লাগলেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ নারী শিক্ষা এবং নারী মুক্তির সমর্থক ছিলেন। কিছু দিনের মধ্যে ঘোড়ায় চড়া শিখে নিয়ে কাদাম্বারী জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সঙ্গে ঘোড়ায় চড়ে তদানীন্তন মহিলা সমাজের সকল সংস্কার এবং লজ্জাকে উপেক্ষা করে প্রায় প্রত্যেকদিন বিকেলে ময়দানের দিকে বেড়াতে যেতেন। 

ছোটবেলায় রবীন্দ্রনাথের একমাত্র খেলার সঙ্গী এবং বন্ধু হয়ে উঠেছিল কাদম্বরী। কাদম্বরীকে উনি মনের সব কথা খুলে বলতে পারতেন। স্কুল থেকে এসেই রবি কাদম্বরীর ঘরে চলে যেতেন। কাদম্বরী ও রবির জন্য তাঁর পছন্দমত কিছু খাবার প্রত্যেকদিন ঠিক করে রাখতেন যাতে রবি স্কুল থেকে এসে কিছু খেতে পায়। নিজেদের মধ্যে মাঝে মাঝে দাবা খেলা হত। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ কোনদিন খেলায় জিততে পারতেন না। নতুন কোন কবিতা রচনা করলেই তিনি কাদম্বরীকে পড়ে শুনাতেন। কাদম্বরী মন দিয়ে শুনতেন এবং মাঝে মধ্যে মন্তব্যও করতেন। ধীরে ধীরে কাদম্বরীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠতা বাড়তে লাগল, সম্পর্ক ও হয়ে উঠল মধুর। দুজনে দুজনের চোখের সামনে কৈশোর কাটিয়ে যৌবনে পদার্পণ করলেন।  চার – পাঁচ বছরের মধ্যে কাদম্বরী ঠাকুরবাড়ির বিভিন্ন

সাংস্কৃতিক তৈরী করে ফেললেন। একবার ঠিক হল জ্যোতিন্দ্রনাথের “অলীকবাবু” নাটকটি বাড়িতে মঞ্চস্থ করা হবে। অলীকের অভিনয় করলেন রবীন্দ্রনাথ আর নায়িকা হেমাঙ্গিনীর অভিনয় করলেন কাদম্বরী। সেদিন কাদম্বরীর সাবলীন এবং সুন্দর আভিনয় দেখে সকল দর্শক হতবাক এবং মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। কবি বিহারীলাল চক্রবর্তী জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বন্ধু ছিলেন। সেই সুত্রে ঠাকুরবাড়িতে মাঝে মাঝে আসতেন। তখন কাদম্বরীর সঙ্গে বিহারীর পরিচয় এবং বন্ধুত্ব হয়। উনি নতুন কিছু রচনা করলে কাদম্বরীকে শোনাতে আসতেন। কাদম্বরী বিহারীলালের গুনমুগ্ধ শ্রোতা এবং পাঠিকা ছিলেন। রবিকে বিহারীর থেকে আরও ভাল কবিতা লেখার জন্য প্রেরণা দিতেন। প্রথম প্রথম বিহারীলালের কবিতা কাদম্বরীর ভাল লাগলেও পরবর্তী কালে বিহারীর কবিতা কাদম্বরীর মনে বিশেষ কোন আবেদন জাগাতে পারত না, বড্ড সেকেলের বলে মনে হত। রবীন্দ্রনাথের কবিতা তখন তাঁর বেশি ভাল লাগত। উনি বেশ বুঝতে পারছিলেন রবীন্দ্রনাথ বিহারীলালের প্রভাব মুক্ত এক আলাদা গোত্রের কবি। ইচ্ছে করে প্রশংসার মাত্রা একটু চেপে রেখে রবিকে কবিতা লেখার জন্য প্রেরণা দিতেই থাকতেন।

গ্রীষ্মের দুপুরে যখন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ নীচের তলায় কাছারির কাজে ব্যস্ত থাকতেন তখন রবীন্দ্রনাথ নিজের লেখা কবিতা পড়ে অথবা কোন কোন দিন সেই সময়ের প্রখ্যাত লেখকের লেখা যেমন বঙ্কিমচান্দ্রের “বিষবৃক্ষ” পড়ে কাদম্বরীকে শুনাতেন। কাদম্বরী হাতপাখা দিয়ে হাওয়া করতেন আর মন দিয়ে পাঠ শুনতেন। রবীন্দ্রনাথের “নষ্টনীড়” গল্পের ভিত্তিতে নির্মিত সত্যজিৎ রায়ের “চারুলতা” সিনেমায় অমল–চারুর সম্পর্ক যেন রবি–কাদম্বরী সম্পর্কেরই প্রতিফলন। কাদম্বরী বাড়ির ছাদের উপর একটা বাগান করেছিলেন। সেখানে অনেক রকম ফুলের গাছ ছিল। বিকেলে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, কাদম্বরী এবং রবীন্দ্রনাথ সেখানে বসে মনোরঞ্জন করতেন। সেইসময় নানা কথা, গল্প এবং গানও হত। কাদম্বরী ভাল গান গাইতে পারতেন। রবীন্দ্রনাথ বলতেন বৌঠান তার ঠাকুরদার থেকে কণ্ঠ পেয়েছেন। কাদম্বরীর ঠাকুরদা জগমোহন গাঙ্গুলি এক উচ্চমানের সঙ্গীত শিল্পি ছিলেন।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ নিজেকে নানা কাজে অত্যন্ত ব্যস্ত রাখার জন্য কাদম্বরীকে প্রাণবন্ত সঙ্গ দিতে পারতেন না। কাদম্বরী নিঃসন্তান ছিলেন। তার উপর ঠাকুরবাড়ির মহিলা মহল কাদম্বরীকে অবহেলা করতেন। ফলে একাকীত্বের যন্ত্রণায় কাদম্বরী কষ্ট পেতেন। রবীন্দ্রনাথ তখন বিলেতে। রবীন্দ্রনাথের দিদি স্বর্ণকুমারী দেবীর ছোটমেয়ে নির্মলাকে নিয়ে কাদম্বরী ব্যস্ত থাকতেন। একদিন খুব মগ্ন হয়ে একটি পত্র পড়ছিলেন। সেইসময় ক্ষনিকের জন্য ছোট্ট নির্মলার খেয়াল কাদম্বরী করতে পারেননি। ঠিক ঐ সময়ে নির্মলা লোহার পাক দেওয়া সিঁড়ী থেকে পড়ে  গিয়ে দুঃঘটনা ঘটায়। দুর্ভাগ্যবশতঃ ওই দুঃঘটনায় নির্মলার মৃত্যু হয়। কাদম্বরী অত্যধিক শোকে বিধ্বস্ত হয়ে পড়লেন এবং সারাজীবন অপরাধ বোধের দুঃসহ কষ্ট ভোগ করেছেন।  
একবার কাদম্বরী খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তখন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তাঁকে নিয়ে চন্দননগরের বাগান বাড়িতে কয়েকদিনের জন্য বেড়াতে নিয়ে যান। পরে রবীন্দ্রনাথ ও তাদের সঙ্গে যোগ দেন। সেখানে প্রত্যেকদিন বিকেলে সবাই মিলে নৌকায় করে গঙ্গাবক্ষে বেড়াতেন। সোনালী বিকেলে এবং সন্ধ্যার জ্যোৎস্নায় গঙ্গাবক্ষের চতুর্দিকের মনোরম দৃশ্য উপভোগ করে সকলে আনন্দপূর্ণ মন নিয়ে বাসায় ফিরতেন। এক ঝড় বৃষ্টির দিনে ঘরে ফিরেই রবীন্দ্রনাথ মনের আনন্দে নিজের রচিত সুরে বিদ্যাপতির পদ গেয়ে শুনিয়েছিলেন বৌঠানকে -                                                 
             “ভরা বাদর, মহা ভাদর
             শূন্য মন্দির মোর –’                       

ছোটবেলায় রবীন্দ্রনাথ মাকে হারিয়েছেন। মায়ের আদর যত্ন তিনি বেশি দিন পাননি। কাদম্বরী না আসা পর্যন্ত তাঁর জীবনে নারী বলে যেন কোন কিছুই ছিল না। কাদম্বরীর ভিতর দিয়ে রবীন্দ্রনাথ যেন জীবনে প্রথম নারীকে চিনলেন। কাদম্বরী হলেন সেই নারী যিনি রবীন্দ্রনাথের প্রাণের ভিতর প্রথমে প্রবেশ করে তাঁর হৃদয়ের গভীরতম স্থলে নিজের স্থান করে নিয়েছিলেন। কাদম্বরী হলেন সেই নারী যিনি তাঁর খেলার সঙ্গী হয়েছিলেন, বন্ধু হয়েছিলেন, তাঁকে যত্ন করেছিলেন, স্নেহ করেছিলেন, প্রেরণা দিয়েছিলেন এবং ভালবেসেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ একদিন বললেন – ‘বৌঠান, তুমি আসার আগে বুঝিনি মেয়েরা কত ভালবাসা, কত আদর ঢেলে দিতে পারে একটা পুরুষের জীবনে।’

সুন্দর সমাজ

প্রবন্ধ সমগ্র ।। মতামত ।। সূচীপত্র

 প্রবন্ধ সমগ্র

সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে

নৈতিকতার প্রয়োজন

অবশ্যম্ভাবী

মিজানুর রহমান মিজান

বিশ্বনাথ, সিলেট, বাংলাদেশ

village1.jpg

কটা সুসভ্য সমাজ গঠনে মানুষের নৈতিকতাবোধ সম্পন্ন আচার-আচরণ, সৌহার্দ পূর্ণ মনোভাব থাকা আবশ্যক। নৈতিক উৎকর্ষতা সমাজ বিনির্মাণে সুসংগঠনের মুল মন্ত্র হিসেবে পরিগণিত। সমাজ, সভ্যতা,শালীনতা সমৃদ্ধ হয়ে দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় মানবিক মূল্যবোধে এগিয়ে যাবার নামই সংস্কৃতি। আবার সুন্দর ও কল্যাণের পথ অনুসরণে সমাজের সুদৃঢ় ভিত জীবন যাত্রার অন্যতম উপাদান। সুন্দরের প্রতি মানুষের আকর্ষণ যেমন বেশী, অসুন্দরকে মানুষ অনুরূপ বর্জন করার পক্ষপাতী। কিন্তু' সামাজিক অবস্থানে অনেক সময় লোভ-লালসার মোহে অসুন্দরকে আঁকড়িয়ে ধরে। ফলে সমাজে সৃষ্টি হয় বিশৃঙ্খলার। সুন্দরের পরিবর্তে অসুন্দর মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। যাকে বলা চলে অপসংস্কৃতি। কিন্তু' অপসংস্কৃতি কখনই মঙ্গল বয়ে আনে না বা বয়ে আনতে পারে না। এক্ষেত্রে প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব আব্দুর রহমান শাদাব বলেছেন, “সমাজ জীবন বিষিয়ে তুলতে দুরাচারীর সংখ্যা বেশী হবার দরকার নেই। পর পর তিন রাত্রি পাড়ায় ডাকাতি হলে গৃহস্থের চোখে আর ঘুম থাকে না“ বলে বাস্তবতার স্বরূপ উন্মোচন করেছেন সুনৈপূণ্যতার সহিত। আবার নিকোলাস চেমস ফোর্ড বলেন, সমাজ দুই ধরনের লোক নিয়ে গঠিত যারা তাদের আহারের রুচি বা ক্ষুধার তুলনায় অনেক বেশী খাবার খায়, আর যারা ক্ষুধার তুলনায় খুব কম আহার খায়“। আবার সময়ের সহিত পাল্লা দিয়ে বা যুগের সহিত তাল মিলাতে গিয়ে অনেক কিছু হয়ে উঠে নির্ধারিত,অবধারিত ও অনিবার্য। সর্বোপরি সুন্দর সমাজ প্রতিষ্ঠায় সত্য, সততা ও মানবিক মূল্যবোধের সরব উপস্থিতি ধরে রাখা বা পুনরুদ্ধারে এগিয়ে যাওয়া অপরিহার্য। এক্ষেত্রে ভিনসেন্ট বলেন, “পরিবর্তনের জন্য প্রচেষ্টা থাকলে জীবনে অথবা সমাজে পরিবর্তন আসবেই“। সত্য ,সুন্দরের পূজারী হওয়া সর্বোত্তম পন্থা। 
আমরা সুতীক্ষ্ণ নজরদারীতে দেখতে পাই এক সময় আমাদের সমাজ জীবনে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক অত্যন্ত মধুর ছিল। আজ তা বহুলাংশে নির্বাসিত জীবনের অধিকারী। ছাত্র শিক্ষকের মধ্যে সুসম্পর্ক হেতু শ্রদ্ধা, সম্মান, মর্যাদা বন্ধু সুলভ আচরণে বিমোহিত হওয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। কিন্তু' লোভ লালসা ও প্রতিহিংসার দাবানলে তা পরিপূর্ণ গ্রাসের সম্মুখীন। যা কখন ও কাম্য ছিল না বা থাকার কথা ও নয়। আমরা ছোট বেলা প্রত্যক্ষ করেছি, স্বজন ব্যতীত ও এলাকার কোন মুরবিবয়ান বা বয়োজৈষ্টদেও সম্মুখে যুবক সম্প্রদায় এমন কোন কাজ করতে ইতস্তত বোধ করতেন যা বেয়াদবির বা অমর্যাদার সামিল। যা আজ উধাও শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। “কি হলো“ বা আমিত্বের অহংকারে গর্বিত। প্রাইভেট পড়াব বর্তমান ছাত্রদের ক্ষেত্রে অত্যাবশ্যক বলে বিবেচিত। আমি বুঝি না যে শিক্ষক প্রাইভেট পড়ান স্কুলে ক্লাসের সমসংখ্যক ছাত্রদের জড়ো করে। ঐ শিক্ষকই ত ক্লাস নেন ঐ বিষয়ের উপর। প্রাইভেট পড়লে ছাত্ররা অনায়াসে বুঝে। কিন্তু' ক্লাস নিলে ছাত্ররা বুঝে না। এ দু‘য়ের মাঝে কি পরিমাণ পার্থক্য বিরাজমান? শিক্ষক  যেমন প্রাইভেট পড়াতে অভ্যাস', অনুরূপ ছাত্ররা ও পড়তে অতি উৎসাহী। সুতরাং এক্ষেত্রে ছাত্র শিক্ষক অভিভাবক সচেতন হলে এ থেকে পরিত্রাণের উপায় উদ্ভাবন সম্ভব। কোমল মতি ছাত্রদের যে দিক নির্দেশনা দেবেন বা মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত রেখে শিক্ষক দেবেন। তাই তারা গ্রহণে অনুপ্রাণিত হবে, আগ্রহ জমবে। গাইড বই নিষিদ্ধ। কিন্তু' এক শ্রেণীর শিক্ষক এ ব্যাপারে জড়িত। ছাত্রদের উৎসাহিত করে তোলেন বই বিক্রির মাধ্যমে মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যকে সামনে রেখে। কিন্তু' ঐ শিক্ষকের বিবেক বোধ জাগ্রত না হলে করণীয় কিছুই নেই। যে শিক্ষকের বিবেক বিসর্জিত, ঐ শিক্ষকের  নিকট থেকে ছাত্ররা কি শিখবে আমার প্রশ্ন থেকেই যায়। নীতির অভাব ঐ শিক্ষকের চরিত্রে প্রকট। সুতরাং নৈতিকতার প্রয়োজন সর্বাগ্রে। সরকার আইন করে যথাযথ প্রয়োগের সহিত নাগরিকের আইন মান্যের বা পালনের অভ্যাস গঠন অতীব জরুরী।  বয়ঃক্রম অনুসারে গ্রামের মানুষজন সম্মিলিত ভ্রাতৃত্ববোধ, সহযোগিতা, সহমর্মিতা প্রকাশ বা বিপদে এগিয়ে আসা নৈমিত্তিক ব্যাপারে ছিল পরিগণিত। এ ক্ষেত্রে দু‘একটা ঘটনার উদ্ধৃতি বিষয়টিকে সুস্পষ্ট রূপে প্রতীয়মানে সাহায্য করবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। আমি ১০/১১ বছরের বালক। শীতের সকাল বেলা প্রতি দিনের মত গ্রামের সকল সমবয়সী জমায়েত হত এক স্থানে। আমরা ও কয়েকজন ছোট হওয়াতে তাঁদের থেকে একটা দূরত্ব বজায় রেখে খোশ গল্পে মত্ত। ওরা একে অপরের চুল কাটছেন পালাক্রমে অত্যন্ত আনন্দ উল্লাসের সহিত। যা নিয়মের আবর্তে নির্ধারিত। ইত্য বসরে গ্রামের এক বয়োজৈষ্ট ব্যক্তি দুর থেকে একজনের নাম ধরে বললেন তিনির ছোট ছেলের চুল কেটে দিতে পায়ে চলা না থামিয়ে। তাৎক্ষণিক এক যুবক ছোট বিবেচনায় সাথে সাথে চুল কেটে দিলেন এবং ঐ বয়সের আরো দু‘জনের। অত:পর তাদের কর্মে নিয়োজিত। 
দশ পনের জনের কাফেলা। দু‘জন দু‘জন হয়ে পারস্পরিক চুল কাটায় মশগুল। ফাঁকে ফাঁকে রং তামাশা। সবেমাত্র একজনের আগমন। আগন্তুক ব্যক্তিকে একজন ধরেন বিড়ি প্রদানের নিমিত্তে। এ ক্ষেত্রে উভয়ে তামাশা স্বরূপ জেদ ধরেছেন দিবেন না এবং না নিয়ে ছাড়বেন না। অপর একজন শরিক হয়েছেন নেবার দলে এবং তিনির হাতে সম্পূর্ণ নুতন ব্লেড খোলে ঐ ব্যক্তির কনুইর উপর ধরে বলছেন, না দিলে হাত কেটে দেব। হঠাৎ ধৃত ব্যক্তি মুক্ত হবার প্রত্যাশায় জোরে ঝাঁকুনি   

মারতেই পূর্ণ ব্লেড হাতের মাংসে ঢুকে পড়ে। শুরু হয় অঝোর ধারায় রক্তপাত। প্রচুর রক্তপাতের ফলে মানুষটি ফ্যাকাসে বর্ণ ধারণ করে। এখন সকল যুবক ঐ যুবকের সুস্থতার চিন্তায় মগ্ন। সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে যুব সম্প্রদায়ের মাঝে। সমবয়সীদের মুহূর্তে আগমন। কিন্তু' কেউ কাউকে কটু বাক্য, অশালীন  বা উত্তেজনা মূলক কথা থেকে বিরত। একটাই মাত্র সবার লক্ষ্য ওকে সুস্থ করে তোলা এবং সুস্থ হয়ে ওঠা। যে ক‘দিন ঐ ব্যক্তি অসুস্থ ছিলেন সকলেই তার প্রয়োজনীয় পারিবারিক কাজ কর্ম সমাধা করে দিয়েছেন। তার অনুপস্থিতি পরিবারকে বুঝতেই দেয়া হয়নি। আর অভিভাবক মহল সমবয়সীদের ব্যাপার বলে সর্বক্ষণ এড়িয়ে চলার নীতিতে ছিলেন বিশ্বাসী এবং অটল। 

আমি আশির দশকে স্কুলে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত ছিলাম। একটি ঘর তৈরীর প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ঘর তৈরীর সকল সরঞ্জাম ক্রয় করেছি বিভিন্ন স্থানে। এগুলো সংগ্রহে আমার অনেক টাকার দরকার। ভাবনায় কুল কিনারা পাচ্ছি না। অকস্মাৎ পাশের গ্রামের এক যুবক বললেন উপযাচক হয়ে আপনার যাবতীয় সরঞ্জাম পরিবহনের একটি তারিখ নির্দিষ্ট করে জানানোর নিমিত্তে। তিনির কথা মত তারিখ সাব্যস্ত করে বলতেই ঐদিন আমার সকল সরঞ্জাম বিশ জন যুবক মিলে এনে দিলেন এবং তারা সুবিধা জনক দিনক্ষণ ঠিক করে স্বেচ্ছায় এসে ঘরটি তৈরী করে দিলেন। সে সময় এ জাতীয় কর্ম পন্থা ছিল প্রচুর বিদ্যমান। কিন্তু বর্তমানে একে অপরের ছোট খাট ব্যাপারে ও এগিয়ে আসার প্রবণতা হ্রাস পেয়েছে বা একে বারে নির্বাসিত। বড় হলেত কথাই নেই। সর্বত্র কর্ম বিমুখতার লক্ষণ পরিলক্ষিত হয় অধিক হারে।

খেলাধুলা, উৎসব অনুষ্ঠানে ছিল ঐক্যের প্রাণ চাঞ্চল্য। নিত্যদিন প্রত্যেক গ্রামের নির্দিষ্ট মাঠে বিভিন্ন বয়সের মানুষের একত্রিত হবার সুবাদে একে অপরের সুখ-দু:খের অংশীদার, সমব্যথী ছিলেন সর্বক্ষণ। ভাব বিনিময়ের মাধ্যমে ভ্রাতৃত্বের অপূর্ব বাঁধন হত মজবুত। “মানুষ মানুষের জন্য“শ্লোগান ছিল যুতসই। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় অত্যাধুনিক আবিষ্কারের ফলে প্রত্যেকের ঘরে বসে টিভি, ভিসিডি ইত্যাদি দর্শনে সক্ষম হওয়ায় পূর্বের মত ভাবের আদান-প্রদান উঠেছে লাটে। কে কোথায়, কখন চলছে পাশের গৃহের প্রতিবেশী ও খবর রাখার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন না বা হয় ও না। এ জাতীয় জীবন যাত্রাকে বলা হত শহুরে জীবন। আজ গ্রামকে গ্রাস করেছে শহুরে জীবনের প্রভাবে। সবাই যেন যন্ত্র চালিত, যন্ত্র মানব রোবট। উৎসবে, অনুষ্ঠানে গ্রামের সবাই নিজের কাজ হৃদয়তন্ত্রীতে ধারণ পূর্বক রাত দিন ছিল কর্মব্যস্ত। আজ টাকার বিনিময়ে শ্রমিক নিয়োজিত। একে অপরের সহিত কথাবার্তা, আচার-আচরণে শ্রদ্ধা, সম্মান, সমীহ, আন্তরিক সৌহার্দ্য পূর্ণতার পরিবর্তে মেকির প্রবণতা লক্ষণীয়। জায়গা জমি ক্রয়-বিক্রয়ে মৌখিক কথাবার্তা অনেক গুরুত্ব বহনকারী ছিল। কথা রক্ষা, ওয়াদা পালনে ছিলেন অধিক সচেষ্ট। ভঙ্গ বা বর খেলাফের সংখ্যা ছিল নগণ্য। সহজ সারলিকতা প্রদর্শন ছিল নৈমিত্তিক। কারসাজি, প্রতারণার হার ছিল হাতে গোণা। গ্রাম্য সালিশ বৈঠকে ন্যায় বিচার প্রাপ্তি বা ন্যায়ের পক্ষে কথা বলার প্রবণতা অধিক মাত্রায় হত প্রতিষ্ঠিত। আজ সালিশ বিচারে ও ঘুষের ছড়াছড়ি এবং মুখ চেয়ে বিচারের ফলে “বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে“ অহরহ। ন্যায় বিচার ব্যবস্থাটা'াটা যেন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। অসহায়ের ন্যায় বিচার প্রাপ্তি সোনার হরিণ তুল্য। সালিশ বিচারকরা আধুনিক ঘুষের প্রবণতায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত। এই যেমন বিচারে আসতে হলে টাকা নেবে ঋণ স্বরূপ অথবা চাইবে ঋণ। না দিলে আসবে না। আবার দিলে তা আর ফেরত পাবে না। এ ধারার সংস্কৃতিকে আমি বলতে চাই আধুনিক ঘুষ। দুর্বলের স্বপক্ষে, ন্যায়ের পক্ষে কথা বলার মানুষের বড়ই অভাব, তীব্র থেকে তীব্রতর। এ থেকে উত্তরণ জরুরী। সৎ থাকা ও সত্য বলা দু:স্বপ্নের মত।“ বিবেক মানুষের সর্বোচ্চ আদালত“ বাক্যটিকে আমাদের জীবন যাত্রায় প্রতিষ্ঠিত করার সচেতনতা সবার হৃদয়ে ধারণ করা এবং লালনে অগ্রসর থাকা আবশ্যক। বিয়ে শাদীর ক্ষেত্রে বর পক্ষ থেকে গ্রামের সকল মুরবিবয়ানকে নিমন্ত্রণ করে “বর সাজাতে হত“। আবার কনে পক্ষের বাড়ীতে বরকে বরণ করতে কনের গ্রামের মুরবিবয়ানকে নিমন্ত্রণ করে অনুমতি সাপেক্ষ ব্যাপার ছিল। এটা এক প্রকার বাধ্যতামূলকের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু' আজ পঞ্চায়েত বা গ্রাম বাসীর নিমন্ত্রণে কোন প্রকার বাধ্যবাধকতা ছাড়া ও “ইচ্ছে হলে“ নিমন্ত্রণের ব্যাপার বলে গণ্য। পুরাতন বলে এ সকল নিয়ম নীতি পরিগণিত। নিত্য নুতন নিয়ম প্রতিষ্ঠিত। নৈতিকতার মান উন্নত হলে একটি জাতি ,দেশকে এগিয়ে নেয়া সম্ভব। নতুবা নীতি হীনতার পচনে সোপান হয় ব্যাহত।   অর্থ ও জনবলে বলীয়ান হয়ে প্রতিবেশীর ভূ-সম্পত্তি তিলে তিলে গ্রাস যা সর্বক্ষেত্রে নীতিহীনতার পরিচায়ক। আপনার গাছের ডাল কাটবেন না অপরের বিরাট ক্ষতির পর ও তা কি মানবিক? আপনার ভূমির এক ইঞ্চি ও রাখবেন না, খনন করবেন জলাশয়। ভাঙ্গনের মাধ্যমে মাটি নেবার আজব ফন্দি এবং চাতুরী। মানুষ নামের অমানুষের কাজ নয় কি? মরণ রয়েছে সর্বক্ষণ তোমার সাথী হয়ে। নিবে না কিছুই সঙ্গে। কোন লোভে পশুত্বের আচরণে মগ্ন? ভাবিয়া করিও কাজ, নাহি পাবে লাজ। মানব জীবন সবার সফল ও সার্থক হোক মানবীয় গুণাবলীতে এ আশাবাদ মহান আল্লাহর দরবারে। 

রথযাত্রা

প্রবন্ধ সমগ্র ।। মতামত ।। সূচীপত্র

 প্রবন্ধ সমগ্র
SanojCharaborty.jpg

রথ যাত্রা
ও মনুষ্য জীবন
সনোজ চক্রবর্তী
পূর্ব মেদিনীপুর, পঃ বাংলা

rath.jpg

সনোজ চক্রবর্ত্তী পেশায় স্কুল শিক্ষকতা। বানিজ্য বিভাগে স্নাতকোত্তর। ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখি। মুলত গল্পকার হলেও কবিতাও লিখেছেন বেশ কিছু। প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন পত্র পত্রিকাতে। লেখালেখি ছাড়া অন্যতম নেশা অভিনয় ও নাটক পরিচালনা।

ত্মানাং রথীনং বিদ্ধিঃ 
শরীরং রথ মে ব তু। 
বুদ্ধিং তু সারথিং বিদ্ধিঃ 
মনঃ পগ্রহঃ মে ব চঃ। 

রথ আর রথীতে পার্থক্য প্রবল। আমরা সাধারণ ভাবনায় রথকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকি। প্রকৃত পক্ষে রথীই হলেন রথের মালিক। রথ চলে রথীর ইচ্ছায়, রথীর অভিপ্রায়ে। রথ রথীকে তার গন্তব্যে পৌঁছে দেয় মাত্র। রথ হল রথীর বাহন। রথীর ইচ্ছানুযায়ী রথ চালনা করে সারথি। আবার সারথি রথ নিয়ন্ত্রণ করে লাগামের সাহায্যে। আত্মানাং রথীনং বিদ্ধিঃ- শরীর মধ্যস্থ আত্মাই রথী অর্থাৎ রথের মালিক। 

শরীরং রথ মে ব তু- শরীর হল রথ। শরীর আত্মার বাহন। বুদ্ধিং তু সারথিং বিদ্ধিঃ- বুদ্ধি হল রথের চালক বা সারথি। মনঃ পগ্রহঃ মে ব চঃ- মন হল লাগাম।  রথ যাত্রা আসলে মানব জীবন ও জীবন যাত্রারই বিমূর্ত ছবি। রথ বলতে আমরা চাকা বিশিষ্ট যান বুঝি। রথ তো দাঁড়িয়ে থাকার জন্য নয়,রথ চলার জন্য। যে রথ দাঁড়িয়ে থাকে তার সার্থকতা কোথায়!

তাই রথকে পথে নামতেই হয়। রথ সচলতার, গতিশীলতার প্রতীক। তার এই গতিশীলতা রথীর জন্য, এই গতিশীলতা রথীর উত্তরণ যাত্রা। আত্মা আমাদের শরীর নামক রথে চেপে উত্তরণের অভিপ্রায়ে চলছে। তার যাত্রা অনন্ত কালের, তার গন্তব্য পরমাত্মার সন্ধান,পার্থিব সুখ সমৃদ্ধি হেলায় অবহেলা করে তার এগিয়ে যাওয়া। এই যাত্রায় বুদ্ধি আত্মার সারথি। সে রথকে সঠিক দিশায় এগিয়ে নিয়ে যায়। বুদ্ধি দ্বিবিধ - সু ও কু। সুবুদ্ধি উৎকর্ষের, উত্তরণের পথে যাত্রার নির্দেশ দেয়। কুবুদ্ধি অপকর্ষ ও অধঃপতনের পথে টেনে নামায়।

পৃথিবীতে মানুষের হাতে দু-ধরনের খেলনা আছে। একটা শ্রেয়- একেবারে সাদামাটা, পরিষ্কার, ঝকঝকে স্ফটিক পাথর। অন্যটা প্রেয়- সেটা রং বাহারি। শ্রেয় বলে যদি আমাকে নিয়ে খেল তবে তুমি আমার মতো হবে সাদাসিধে, দিলখোলা। প্রেয় বলে আমার সঙ্গে খেললে আমারর মতো চটকদারি, রঙিন হবে। শ্রেয় হল মোক্ষ, প্রেয় হল পার্থিব সুখ আর ঐশ্বর্য। মানুষ প্রেয়-ই প্রতি বেশি আসক্ত হয়ে পড়ে। এই প্রেয় আসলে মানুষের ইন্দ্রিয় আসক্তি। এগুলো হল দুষ্টু ঘোড়া। তাই দুষ্টু ঘোড়াগুলোকে সঠিক পথে চালনা করতে পারে একমাত্র দক্ষ সারথি। আমাদের বুদ্ধি হল সারথি। সারথির হাতিয়ার হল লাগাম। ঘোড়াগুলি নিয়ন্ত্রণে না থাকলে রথ কখনোই গন্তব্যে পৌছাতে পারে না। ঘোড়াগুলি নিয়ন্ত্রিত হয় লাগামের সাহায্যে, এক্ষেত্রে আমাদের মন হল লাগাম। মন শরীরস্থ ঘোড়া রূপী ইন্দ্রিয়গুলির নিয়ন্ত্রক। মনের লাগাম যদি কষে ধরা যায় তবে সঠিক দিশায় যাত্রা সম্পন্ন সম্ভব হয়।

যার মন ইন্দ্রিয়গুলিকে বশীভূত করতে পারে তার আত্মা পরমাত্মার সন্ধান পায়।

বাংলা গানের একাল সেকাল

প্রবন্ধ সমগ্র ।। মতামত ।। সূচীপত্র

 প্রবন্ধ সমগ্র

বাংলা গানের

একাল সেকাল

মহুয়া ব্যানার্জ্জী (সঙ্গীত শিল্পী)

কলকাতা 

harmonium.jpg

ই সেদিন ও বলতে শুনতাম - "What Bengal thinks today, India thinks tomorrow" আর আজ আমরা আক্ষেপ করে বলি বাংলার স্বর্ণযুগের গান নিয়ে বা সেই বাঙালির অহংকার কোথায়? যদিও আজ আমরা সমকালীন বাংলা গানকেও প্রায় একই রকম ভাবে পিছনে ফেলে দিচ্ছি। ছোটবেলায় আমাদের গান শোনার একমাত্র যন্ত্র ছিল রেডিও। সেই সময় বাংলা গানের কথা ও সুর আমরা রেডিও তে হাঁ করে গিলতাম। তৎক্ষনাৎ শুনে সেটা লেখার চেষ্টা করতাম। অপেক্ষা করতাম আবার শোনার জন্যে। আর এখন তো বাংলা গান নিয়ে এমন সব পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু হয়েছে তাতে সব কিছু তালগোল পাকিয়ে যাবার জোগাড়। আজ বাংলা গানের গায়ে লেগেছে বিশ্বায়নের ছোঁয়া। হাইটেক প্যাকেজিং এর লেবেল। আর বলাবাহুল্য এই ভাবেই কিন্তু তৈরি হচ্ছে একটা হচপচ অবস্থা।

গ্রামোফোন রেকর্ড থেকে ক্যাসেট সেই অবধি ঠিক ছিল। তার পরবর্তীতে এলো সিডি। কিন্তু এই সিডি নিয়ে আমরা নতুন প্রজন্মরা কিন্তু একদমই আশাবাদী হতে পারছি না তাই আমরা ঝুঁকছি ডিজিটাল রিলিজ এর দিকেই।

প্রথমত সিডির অডিও ফরম্যাট করতে খরচ তারপর বিপণীর জন্য আলাদা খরচা। সিডি কেনা থেকে সরে এসেছেন বহু মানুষ। ফলে লোকের কাছে গান পৌঁছচ্ছে না। বিকল্প হিসেবে আমরা সিডির সব চেয়ে ভালো গান টার দৃশ্যায়ন করতে শুরু করলাম সেখানেও অনেকটা খরচ। এরপর সেই ভিডিওটা চ্যানেলের মাধ্যমে লোকের কাছে পৌছনো। সেখানেও খরচ। সুতরাং এত খরচ করার পরে দ্বিতীয় বার সিডি করার কথা খুব কম শিল্পীই ভাবছেন.. তাহলে বাকি শিল্পীরা

কোথায় যাবেন আর শিল্পীর নতুন গানই বা কোথায় যাবে? এত টাকা খরচ করার পর শিল্পী কি বা রিটার্ন পাবে?

আমি আগেই বলেছি আগে গান শোনার মাধ্যমই ছিল রেডিও। কিন্তু কোন এক অজানা কারণে এফ এম রেডিও ও নতুন গান শোনানো থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে (সেটা সিনেমার গানের ক্ষেত্রে নয় কিন্তু) তাই আজ আমাদের ডিজিটালই ভরসা .. নিজের ইউটিউব চ্যানেল করো সেখানে গান বানিয়ে দিয়ে দাও (এই বিষয়কে কেন্দ্র করে একটি ব্যাস এক নিমেষেই পৃথিবীর সারা প্রান্তে নিজের গান পৌঁছনো তো যাচ্ছে। কাউকে তো বলতে হচ্ছে না সিডি কিনুন … আর বেশী সংখ্যক ভিউয়ার্স হলে শিল্পী তার কিছুটা লভ্যাংশও পাচ্ছে. এতে করে নতুন শিল্পীরা কিন্তু উৎসাহ পাচ্ছে।

কিন্তু ডিজিটাল এ একটি অসুবিধে হল প্রবীণ মানুষের কাছে না পৌঁছনো। কারণ তারা এখনো টেকস্যাভি নন। তাই অনেকেই লিঙ্ক এর মানে বোঝেন না। আর সিডি উপহার দেওয়া ও নেওয়া থেকেও আমরা বঞ্চিত হচ্ছি। গ্রামোফোন বা ক্যাসেট সিডি বাড়িতে আমরা সংরক্ষণ করতে পারলেও ডিজিটাল কিন্তু কম্পিউটার ও মোবাইল বন্দীই থাকছে। তাই সিডি করবো না ডিজিটাল রিলিজ করবো - এই প্রসঙ্গে আমি নিজে একজন নতুন প্রজন্মের সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে মনে করি যতদিন না সিডিকে তার পুরনো জায়গায় ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে বা বিকল্প কোন রাস্তা পাওয়া যাচ্ছে যতদিন না এফ এম এর সাহায্যে লোকের ঘরে গান পৌঁছে দেওয়া যাচ্ছে ততদিন পর্যন্ত আমরা ডিজিটাল এই ঝুঁকে থাকবো... যে ফরম্যাট এই হোক আপনারা নতুন গান শুনুন ও শোনান এইটুকুই কাম্য।

বৌদ্ধ ঐতিহ্য

প্রবন্ধ সমগ্র ।। মতামত ।। সূচীপত্র

 প্রবন্ধ সমগ্র

বৌদ্ধ ঐতিহ্যের পথ

ধরে মোগলমারি

 অতনু প্রধান

Mogolmari7.jpg
Mogolmari4.jpg
Mogolmari8.jpg
Mogolmari1.jpg

মোগলমারি আজ আর কেবল অখ্যাত গ্রাম নয়, সংবাদ শিরোনামে অবস্থান তার। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরের বিদগ্ধ মহলে প্রত্নচর্চার অন্যতম অবলম্বন হয়ে উঠেছে। মোগলমারিকে নিয়ে নিরন্তর গবেষণায় ইতিহাস যেমন উদ্‌ঘাটিত হচ্ছে, তেমন সমৃদ্ধ ও সংযোজিত হচ্ছে ইতিহাসের পৃষ্ঠা।  


নাম মাহাত্ম্য –  
১) বহু বছর ধরে ইতিহাস গর্ভে ধারণ করে থাকা গ্রাম মোগলমারি। সপ্তদশ শতাব্দীতে মির্জা নাথান লিখিত ‘বাহারিস্তান-ই-ঘাইবি’ বইটিতে দুই মোঘল সম্রাট আকবর ও জাহাঙ্গীরের আমলে বাংলার হাল হকিকত জানা যায়। ১৫৭৫ সালে মেদিনীপুর আর জলেশ্বরের(ওড়িশা) মাঝামাঝি তুকারুই নামে এক স্থানে মোঘল ও পাঠানের যুদ্ধ হয়। সেই যুদ্ধে মোঘলদের বহু ক্ষয়-ক্ষতি হয়। সেই মোঘল থেকেই হয়তো মোগলমারি নামের উৎপত্তি।  
২) স্থানীয় কিংবদন্তি অনুসারে মাড় শব্দের অর্থ সড়ক বা পথ। মোঘলরা এই পথ মাড়িয়ে গিয়েছিল বলে এই স্থানে মাড় > মাড়ই > মাড়ি - ব্যবহৃত হয়েছিল। তাই কালের বিবর্তনে মোগলমাড়ি > মোগলমারি নামাঙ্কিত হয়ে প্রচলিত হয়ে আসছে। দাঁতন-১ ব্লকের অন্তর্গত মোগলমারি গ্রাম। এই দাঁতনের পুরোনো নাম দণ্ডভুক্তি ছিল বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন। সপ্তম শতাব্দীতে রাজা শশাঙ্কের রাজত্বকালে এই দণ্ডভুক্তিতেই তাঁর ভূমিদানের দলিল পাওয়া যায়। 

ইতিহাস – 
ঐতিহাসিক ও গবেষকদের কেউ কেউ মনে করেন, গ্রামটির প্রাচীন নাম ‘অমরাবতী’। এই অঞ্চলের ক্ষুদ্র সামন্ত রাজা ছিলেন বিক্রমকেশরী। তাঁর বিদূষী কন্যা সখীসেনার এক সময়ের অধ্যয়নের কেন্দ্র ছিল এখানে- অনেকেই তা মনে করেন। সখীসেনার সাথে মন্ত্রীপুত্র অহিমাণিকের প্রণয় কাহিনীর জনশ্রুতি রয়েছে, যা বর্ধমানের লোককবি ফকির রামের অমর কাব্য ‘সখীসোনা’ থেকে পাওয়া যায়। প্রখ্যাত সাহিত্যিক সুবোধ ঘোষ তাঁর ‘কিংবদন্তীর দেশে’ গ্রন্থে এই কাহিনী ‘সখীসেনার পাঠশালা’ নামে বর্ণনা করেছেন। ক্ষুদ্র পল্লীমাটির উপর আজ পড়ে রয়েছে সেই মুখর পাঠশালার এক ভগ্নস্তূপ। 
চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং ৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার বিভিন্ন বৌদ্ধবিহার গুলি পরিদর্শন করেন। তিনি তাঁর সি-ইউ-কি গ্রন্থে বঙ্গদেশের চার রাজ্যের বিশেষ বর্ণনা করেছিলেন- পুন্ড্রবর্ধন, সমতটী, কর্ণসুবর্ণ এবং তাম্রলিপ্ত। এই তাম্রলিপ্ত রাজ্যে ১০টি বৌদ্ধবিহার ও এক-হাজার বৌদ্ধ সন্নাসীর উপস্থিতির কথা উল্লেখ করেছিলেন। এযাবৎ  কাল পর্যন্ত তাম্রলিপ্ত সন্নিহিত অঞ্চলে কোন বৌদ্ধবিহার-ই আবিষ্কৃত হয়নি, মোগলমারি ব্যতিত।  
পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন স্থলের মধ্যে মোগলমারি অতীতের একটি বিষ্ময়কর রত্নভাণ্ডার। যা আজ সখীসেনার পাঠশালার সকল জনশ্রুতির দ্বিধা দ্বন্দ্বকে দূরে সরিয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতে অবস্থিত অন্যান্য বৃহৎ ও প্রাচীন বৌদ্ধ স্থাপত্যগুলির মধ্যে এটি অন্যতম।

Mogolmari2.jpg
Mogolmari5.jpg
Mogolmari6.jpg

আবিষ্কার ও প্রত্নখননের সময় সারণি -     

১৯৯৯ সালে প্রাচীন নদী-বাণিজ্য সংক্রান্ত পুরাতাত্ত্বিক সাক্ষ্যের খোঁজে সুবর্ণরেখার গতিপথ ধরে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের কাজে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার দাঁতন শহরে আসেন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. অশোক দত্ত। ড. দত্তের সঙ্গে পরিচয় হয় দাঁতন হাইস্কুলের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক, ইতিহাস প্রেমী শ্রী নরেন্দ্রনাথ বিশ্বাস মহাশয়ের। প্রাচীন বাংলার ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে নানান আলোচনার সূত্রে শ্রী বিশ্বাস দাঁতন ১ নং ব্লকের মোগলমারি (২১˚৫৭’ উঃ অঃ / ৮৭˚১৬’ পূঃ দ্রাঃ)গ্রামে সখীসেনা ঢিবি নামে একটি প্রাচীন ইটের ঢিবির সন্ধান দিয়েছিলেন। ঢিবিটি গ্রামের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত এবং বর্তমানে মোগলমারি তরুণ সেবা সংঘ ও পাঠাগার নামে একটি সংস্থার নিয়ন্ত্রাণাধীন। প্রত্নসমীক্ষার সময় দেখা গেছে গ্রামে অবস্থিত সুউচ্চ ঢিবিটিই শুধু নয়, বর্তমানে প্রায় সমগ্র গ্রামটি অবস্থিত একটি বিশাল প্রাচীন প্রত্নক্ষেত্রের উপর। গ্রামের অভ্যন্তরে অবস্থিত ইটের তিনটি গোলাকার স্তূপের অংশ এবং গ্রামবাসীদের কাছে সযত্নে সংরক্ষিত পোড়ামাটির গোলাকার উৎসর্গ ফলক, যার উপর উৎকীর্ণ খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতকের ব্রাহ্মী লিপিতে এবং মিশ্র সংস্কৃত-প্রাকৃত ভাষায় লেখা বৌদ্ধ ধর্মের অতি প্রাচীন বাণী ‘এ ধর্ম হেতু প্রভব ---’ এবং ভূমিস্পর্শ মুদ্রায় মস্তকহীন বুদ্ধ মূর্তি ড. অশোক দত্তের বৌদ্ধ নিদর্শন সংক্রান্ত ধারণাকে যেমন সুদৃঢ় করেছিল তেমনি ড. দত্ত উদ্বুদ্ধও হয়েছিলেন মোগলমারির সখীসেনা ঢিবিতে প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখনন করার জন্য। 

প্রত্নখননের প্রথম পর্যায় (২০০৩-২০০৪):খননকার্য শুরু হয় ঢিবির উত্তর পশ্চিম ও দক্ষিণ অংশে। খননে পাওয়া যায় নকশাযুক্ত ইট, বৌদ্ধ ভিক্ষু বা সন্ন্যাসীদের বাসস্থানের কুঠুরি। পাওয়া যায় ত্রিরথ কাঠামো যুক্ত নকশা, যা দেখে গবেষকদের প্রাথমিক অনুমান স্থানটিতে মন্দির বা গর্ভগৃহ ছিল। গ্রামের অভ্যন্তরে খনন চালিয়ে বেশ কয়েকটি বৌদ্ধস্তূপ

ও এক বিশেষ ধরনের মৃৎপাত্র পাওয়া যায়, যাকে কৃষ্ণ-লোহিত মৃৎপাত্র বলা হয়।

প্রত্নখননের দ্বিতীয় পর্যায় (২০০৬-২০০৭):      

এই পর্যায়ের খনন ঢিবির পূর্ব ও পশ্চিম দিকে পরিচালিত হয়। পাওয়া যায় নকশাযুক্ত ইট দ্বারা সুসজ্জিত দেওয়াল, স্টাকো পলেস্তারা যুক্ত দেওয়াল, বৌদ্ধ ভিক্ষুদের থাকার কুঠুরি।

উদ্ধার হয় খণ্ড বিখণ্ড বুদ্ধের মূর্তি, আদি মধ্যযুগ থেকে মধ্যযুগ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ের পুরাবস্তু, লোহার সামগ্রী এবং ষষ্ঠ শতাব্দীর সিদ্ধমাতৃকা লিপিতে উৎকীর্ণ পোড়ামাটির সিল। 

প্রত্নখননের তৃতীয় পর্যায় (২০০৭-২০০৮):                         

খননকার্য হয় ঢিবির উত্তর, পূর্ব ও মধ্যভাগে। খননে স্টাকোর পদ্মের পাঁপড়ির ন্যায় পলেস্তারার নকশাযুক্ত সুসজ্জিত দেওয়াল, প্রদক্ষিণ পথ, বৌদ্ধস্তূপ, স্টাকো নির্মিত মুখাবয়ব, পাথরের মূর্তি, তামার মুদ্রা ও প্রচুর মৃৎপাত্র পাওয়া যায়।

প্রত্নখননের চতুর্থ পর্যায় (২০০৯-২০১০):    

এই পর্যায়ের উৎখনন ঢিবির উত্তর দিকে পরিচালিত হয়। আবিস্কৃত হয় বৌদ্ধ বিহারের মূল প্রবেশদ্বার, প্রবেশদ্বারের উভয় দিকে দুটি সমায়তনের বৃহৎ কক্ষ, ইটের কারুকার্য মণ্ডিত স্তম্ভযুক্ত কুলুঙ্গি, চুনের পলেস্তারা যুক্ত মেঝে এবং পোড়ামাটির প্রদীপ। 

প্রত্নখননের ষষ্ঠ পর্যায় (২০১১-২০১২):        

এই পর্যায়ের খননকার্য হয় ঢিবির দক্ষিণ, মধ্য ও দক্ষিণ পশ্চিম দিকে। ঢিবির মধ্যভাগে পশ্চিমমুখী দেওয়ালে ১৩টি স্টাকোর মূর্তি উন্মোচিত হয়, যার মধ্যে কুবের জাঙ্গুলী, অবলোকিতেশ্বর, লোকেশ্বর, গন্ধর্ব, নৃত্যরত মানব মানবী ও গণমূর্তি প্রভৃতি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও সিদ্ধ মাতৃকা হরফে উৎকীর্ণ বুদ্ধের বাণী সম্বলিত সিল, প্রদীপ, লোহার কাঁটা, আতরদান, নকশাযুক্ত ইট, নিত্য ব্যবহার্য মৃৎপাত্র ইত্যাদি পাওয়া যায়। এই পর্যায়-ই ছিল ড. অশোক দত্তের নেতৃত্বে শেষ বারের জন্য মোগলমারির বুকে প্রত্নখনন। এরপর পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তর ৭ই মার্চ’ ২০১৩ মোগলমারি ‘সখীসেনা ঢিবি’-কে রাজ্য সংরক্ষিত সৌধের মর্যাদা প্রদান করে এবং রাজ্য প্রত্নতত্ত্ব ও সংগ্রহশালা অধিকারের অধীনে মোগলমারিতে সপ্তম পর্যায়ের প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননের কাজ। 

প্রত্নখননের সপ্তম পর্যায় (২০১৩-২০১৪):       

খননকার্য হয় ঢিবির উত্তর, পশ্চিম এবং দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে। পশ্চিম দিকে উন্মোচিত হয় সীমানা প্রাচীর, গর্ভগৃহ, প্রদক্ষিণ পথ, বৌদ্ধ ভিক্ষুদের থাকার কুঠুরি। পাওয়া যায় বেশ কয়েকটি স্টাকো মূর্তি, যার মধ্যে মঞ্জুশ্রীর মূর্তিটি উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও পাওয়া যায় মস্তকহীন বুদ্ধমূর্তি, রাজা সমাচার দেবের মিশ্রধাতুর মুদ্রা এবং সোনার লকেট। এই পর্যায়ের খননের শেষের দিকে উৎখনন চালিয়ে বিহারের নামফলক বা নামমুদ্রা উদ্ধার হয়। ফলকটিতে “শ্রীবন্দক মহাবিহারে আর্যভিক্ষু সংঘ” লেখা রয়েছে বলে গবেষকগণ প্রাথমিক পাঠোদ্ধার করেন

প্রত্নখননের অষ্টম পর্যায় (২০১৪-২০১৫):         

অষ্টম পর্যায়ের উৎখনন হয় ঢিবির উত্তর, উত্তর-পূর্ব ও মধ্যভাগ জুড়ে। উন্মোচিত হয় বিশালাকার স্থাপত্যের ধ্বংসাবশেষ, বৌদ্ধ স্তূপ, উৎসর্গ ফলক, মূর্তির ভাঙা অংশ, লোহার কাঁটা, তামার বালা ও আংটি, পোড়ামাটির প্রদীপ, হাতির দাঁতের জপমালা, নকশাযুক্ত ইট ইত্যাদি। 

প্রত্নখননের নবম পর্যায় (২০১৫-২০১৬):     
এই পর্যায়ে ঢিবির দক্ষিণ, পূর্ব ও মধ্যভাগ জুড়ে খননকার্য করা হয়। উৎখননে ঢিবির কেন্দ্রস্থল থকে উদ্ধার হয় ৯৫টি ব্রোঞ্জের মূর্তি, যার মধ্যে ২৫-৩০টি বুদ্ধমূর্তি ছাড়াও অবলোকিতেশ্বর, হারীতী, তারা, সরস্বতী প্রভৃতি মূর্তিও পাওয়া যায়। উদ্ধার হয় স্বর্ণ মুকুটের একটি অংশ। এছাড়াও পাওয়া যায় ধাতুর ধুনুচি, জল ছিটানোর কমন্ডলু, ধাতব স্তূপ, খেলনা গাড়ির চাকা, নিত্য ব্যবহার্য মৃৎপাত্র, পোড়ামাটির অলঙ্কার, পাথরের মূর্তির ভাঙা অংশ ও ভাস্কর্য ইত্যাদি। 

নিরীক্ষণ: 
মোগলমারি বৌদ্ধ মহাবিহারে নবম পর্যায়ের উৎখনন পরিসমাপ্তির পর প্রাপ্ত পুরাবস্তু ও প্রত্নক্ষেত্রটি পর্যালোচনা করে প্রত্নতত্ত্ববিদগণ নিম্নরূপ মন্তব্য পোষণ করেন –
১) মোগলমারি গ্রামের অভ্যন্তরে উৎখননে প্রাপ্ত কৃষ্ণ-লোহিত মৃৎপাত্র, এই অঞ্চলে তাম্রাশ্মীয় বা প্রাক-ঐতিহাসিক যুগের জনবসতির মুখ্য নিদর্শন।
২) মহাবিহারটি গঠন শৈলী ছিল ত্রিরথ কাঠামো। আয়তনে মহাবিহারটি ৬০ মিটার × ৬০ মিটার (৩৬০০ বর্গমিটার)। এযাবৎ পশ্চিমবঙ্গে আবিষ্কৃত বৌদ্ধবিহার গুলির মধ্যে সর্ববৃহৎ।
৩) এযাবৎ খননে প্রায় ৫২ ধরনের নকশাযুক্ত ইটের ব্যবহারের নিদর্শন এবং স্টাকো ব্যবহারের নিদর্শন বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
৪) মহাবিহারটির নির্মাণ ও পুনঃনির্মাণের তিনটি পৃথক পৃথক পর্যায় চিহ্নিতকরণ করা হয়েছে।

৫) রাজা সমাচারদেবের মিশ্রধাতুর মুদ্রা, স্বর্ণ লোকেট, স্বর্ণ মুকুট এবং মহাবিহারের নামফলক বা নামমুদ্রা উদ্ধার হল উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার।  
৬) সময়গত ও গঠনগত দিক দিয়ে এই মহাবিহারটি নালন্দা, বিক্রমশীলা, পাহাড়পুর, ময়নামতী প্রভৃতি বিহারের সঙ্গে সাদৃশপূর্ণ।

৭) সর্বোপরি উৎখননে বিষ্ময়কর আবিষ্কার হল, মহাবিহারটির একটি স্থানে, একদিনে, একসঙ্গে ৯৫টি ব্রোঞ্জ মূর্তি উদ্ধার সমগ্র পৃথিবীর প্রত্নখননের ইতিহাসে এক বিরলতম দৃষ্টান্ত।  

উপসংহার :
মোগলমারির সঙ্গে মোঘল সাম্রাজ্যের একটা অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক থাকলেও এক সময় ঐতিহ্যমণ্ডিত বৌদ্ধ সংস্কৃতি নির্ভর একটি বিস্তীর্ণ জনপথ গড়ে উঠেছিল মোগলমারিতে। শুধুমাত্র বৌদ্ধ মহাবিহার নয়, সমগ্র গ্রাম জুড়েই ছড়িয়ে রয়েছে বৌদ্ধ স্থাপত্যের নিদর্শন, যা এক কথায় অনবদ্য। মোগলমারিতে অতীত ও বর্তমান যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। এক সময় এই গ্রামের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হতো সুবর্ণরেখা নদী। এই নদীকেই কেন্দ্র করে, নদীর বাম তীরে প্রায় ১৫০০ বছর আগে গড়ে উঠেছিল বিহারটি। বর্তমান নদীটি প্রত্নক্ষেত্রটির ৪.৫ কিলোমিটার পশ্চিমে প্রবাহিত হচ্ছে। বিহারটির দেওয়ালের বাইরের অংশ কারুকার্য মণ্ডিত নকশাযুক্ত স্টাকোর পলেস্তারা যুক্ত থাকায় এক সময় সূবর্ণরেখার তীরে বিহারটী এক অপরূপ সৌন্দর্য বহন করতো। কিন্তু কালের নিয়মে সবই আজ ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়েছে। তবে এখনো যে টুকু অক্ষত রয়েছে তাও কোন অংশেই কম নয়। সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ  যদিও অনন্য নয়, একদিকে  বিহারের দক্ষিণঅংশ এবং অন্য দিকে উড়িষ্যার উত্তরাংশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ স্থাপন করেছিল সাম্প্রতিক আবিষ্কৃত মোগলমারি। এভাবে মোগলমারি প্রাথমিক মধ্যযুগে ভারতের পূর্বাঞ্চলে বৌদ্ধ সংস্কৃতির এক ঐতিহ্য বহন করেছিল, যেখানে আজ থেকে কয়েকশ বছর পূর্বে উচ্চারিত হতো সেই পবিত্র মহামন্ত্র ‘বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি .......’।  

করোনার কবলে ইউরোপ

প্রবন্ধ সমগ্র ।। মতামত ।। সূচীপত্র

 প্রবন্ধ সমগ্র

করোনার কবলে ইউরোপ – নেদারল্যান্ডেসের চিঠি

​​শর্মিষ্ঠা ভট্টাচার্য

নেদারল্যান্ড

800px-SARS-CoV-2_without_background.png
corona1.png
corona5.png
corona3.png

কোলকাতায় জন্ম আর বড়ো হওয়া। যাদবপুর থেকে বিদ্যুৎ বিভাগে এঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে চাকরী জীবন শুরু। তারপর বিয়ে আর কিছুদিন বাঙ্গালরে বাস। ওখান থেকেই নতুন চাকরী নিয়ে  সপরিবারে বিদেশের মাটিতে পাড়ি। প্রায় দু’দশক ছুঁতে গেল হল্যান্ডে বাস। পরদেশে এসে নতুন ভাষা, সংস্কৃতি, মানুষজন, উচ্চশিক্ষা, চাকরী, সংসার সবকিছু মানিয়ে নিতে গিয়ে অনেকটা সময় চলে গেল। তবে অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার নিঃসন্দেহে সমৃদ্ধ হয়েছে। সেইসঙ্গে ঘোরা হয়েছে অনেক দেশ। তাই ভ্রমণের গল্প লেখার ভাবনাটা হঠাৎই মাথায় এলো। আজকাল ইন্টারনেটের যুগ, নিজের ভাবনাগুলো লেখার আর অন্য মানুষের কাছে সহজে পৌঁছিয়ে দেবার একটা খুব ভালো জায়গা আছে। তাই চাকরীর ফাঁকে ফাঁকে অনেকদিনের এই সুপ্ত বাসনাটাকে একটু জাগিয়ে তোলার প্রচেষ্টা যাতে মন আর মস্তিষ্ক দু’ই নবীন আর প্রফুল্ল থাকে।

ত বছরের ডিসেম্বরে চীনের উহান শহরে প্রথম শোনা যায় “করোনা” ওরফে “COVID-19” ভাইরাল ফিভারের কথা। এই জ্বরের প্রাথমিক লক্ষণ সাধারণ ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো হলেও, ঐ ভাইরাস দুর্বল শরীরে প্রবেশ করলে আক্রমন করে আমাদের ফুসফুসকে এবং কালক্রমে শরীরের অন্য ভাইটাল অরগ্যানকেও। তাই অতি অল্প সময়ের মধ্যেই আক্রান্ত মানুষ দুরারোগ্য ব্যাধিতে কাবু হয়ে আগ্রাসী মৃত্যুর শিকার হতে পারে। নতুন বছর ২০২০ শুরু হতে না হতেই করোনার কালো ছায়া চলে এলো এশিয়া মহাদেশ পার করে ইউরোপের বুকে।

জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে ইটালির উত্তরের দিকে অবস্থিত লোম্বারডি নামের অঞ্চলটিতে প্রথম শোনা যায় করোনা ভাইরাসের খবর। প্রতি বছর শীতের সময় পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা প্রচুর মানুষ আসে আল্পস পর্বতমালায় স্কি করতে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এর অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে চলাফেরার সুবিধার জন্যেই অনতিবিলম্বে করোনার ছায়া ছড়িয়ে পড়লো ইউরোপের বিভিন্ন শহরে। প্রথমদিকে গরিষ্ঠ সংখ্যক জনগণ বোধকরি কিছুটা হালকা চালে নিয়েছিলো এই জীবাণুর মহামারীরূপী ব্যাপ্তিকে। একটা করে দিন কাটতে থাকলো, আর সংক্রামিত মানুষের সংখ্যা এবং মৃত মানুষের পরিসংখ্যান দুইই ক্রমশই বাড়তে লাগলো। খবরে আসতে শুরু করলো ইটালি তথা অন্য ইউরোপের দেশগুলোর প্রতিদিনের অসহায়তার দৃশ্য, দেখা গেলো ইউরোপের অন্যতম উন্নতমানের দেশেও চিকিৎসা ব্যবস্থার অক্ষমতার চিত্র। চিকিৎসকরা প্রকাশ্যে বললেন যে সব অসুস্থ মানুষদেরকে চিকিৎসা করতে তারা এই মুহূর্তে নিরুপায়, কারণ হাসপাতালে পর্যাপ্ত পরিমাণে বেড এবং আবশ্যক সামগ্রী নেই। তাদের বিবেচনা করে নির্ণয় করতে হচ্ছে রুগীদের মধ্যে কাকে তারা বাঁচাতে সক্ষম। এই রকম সামাজিক বিপর্যয়ের সময় বেঁচে কার জন্যে ভাগ্যের সহায়তা এবং উপরওয়ালার কৃপাদৃষ্টি একান্তই জরুরি।

ইটালিতে করোনার প্রভাব বাড়তে থাকায় চীনদেশ পাঠালো তাদের অভিজ্ঞ মেডিক্যাল টিম এবং প্রয়োজনীয় সামগ্রী। শুধু ডাক্তার বা নার্স নয়, এগিয়ে এলো অনেক স্থানীয় বাসিন্দারা নানাভাবে সাহায্য করতে। তাদের এই অকৃত্তিম স্বার্থ ত্যাগকে জনসাধারণ বারংবার বাহবা জানিয়েছে সমবেতভাবে করধ্বনি করে, সঙ্গীত পরিবেশন করে, ইন্টারনেটের বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে। ইতিমধ্যে এই জীবাণুর বিশ্বব্যাপী প্রকোপ দেখে ১১ই মার্চ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা(WHO) “COVID-19” কে “প্যানডামিক” বা “বিশ্ব-মহামারী” ঘোষণা করলো। সারা বিশ্বের শেয়ার বাজার একলাফে অনেকটা নিচে পড়ে গেল, কিছু কিছু নামী কোম্পানিও অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে দেউলিয়া ঘোষণা করলো।

এই সঙ্কটের পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতির ভরাডুবি প্রতিরোধ করতে ইউরোপের দেশগুলো মিলিত ভাবে সিদ্ধান্ত নেয় যে সমস্ত ব্যবসা বানিজ্য একসাথে বন্ধ না করে, অবস্থা বুঝে ক্রমাগতভাবে বন্ধ করবে। এইভাবে বিবেচিত পদক্ষেপ নিলে বেকারত্বের সংখ্যা হয়তো কম রাখা যাবে। পরিস্থিতি যখন ক্রমশ আয়ত্তের বাইরে চলে যেতে শুরু করে, বাধ্য হয়ে আরও শক্ত নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলো। বলা হোল যে জনসাধারণ যেন খুব প্রয়োজনীয় দরকার ছাড়া ঘরের বাইরে না বের হয়। সবাই নিজেদের মধ্যে কমপক্ষে ১,৫ মিটার দূরত্ব বজায় রাখবে, সোশ্যাল মিটিং নিষিদ্ধ, বয়স্ক মানুষদের সাথে দেখা করতে যাওয়ার উপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ হল যেহেতু তারা অপেক্ষাকৃত দুর্বল আর রোগ প্রতিরোধে অসমর্থ শ্রেণী। একমাত্র সেবামূলক কাজ করতে, বা দৈনন্দিনের বাধ্যতামূলক প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনতে কিছু সময়ের জন্যে বাইরে যাওয়া যেতে পারে। প্রতিনিয়ত রাস্তায় টহল দিচ্ছে পুলিশ, যারা প্রত্যেক পথচারীকে থামিয়ে তদন্ত করছে। ইউরোপের স্বাধীন সামাজিক জীবনযাত্রায় এ এক বিরল চিত্র। আর এইসব নিয়মকে আরও কার্যকারী করতে ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া এবং নেদারল্যান্ডস জানিয়েছে যে এই নিষেধাজ্ঞা না মানলে শতাধিক ইউরো জরিমানা হবে। কোন কোন দেশ আবার অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সাহায্য নিচ্ছে, যেমন রোবট চালিত ড্রোনের মাধ্যমে নিশ্চিত করা হচ্ছে যে কেউ অনাবশ্যক জনপথে ঘোরাফেরা করছে কিনা।

নেদারল্যান্ডসে করোনা রুগীর প্রথম খবর পাওয়া যায় ফেব্রুয়ারির ২৮ তারিখে। এক সপ্তাহের মধ্যেই এর ক্রমবর্ধমান গতি দেখে ডাচ গভর্নমেন্ট জনগণের উদ্দেশ্যে জানায় যে তারা যেন আশু পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতন থাকে। এই ঘোষণার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই দেখা যায় সুপার মার্কেটে উপচে পড়া ভিড়। নিমেষের মধ্যে শেষ হয়ে গেল পাস্তা, ডিপ-ফ্রিজের ও টিনের সংরক্ষিত সবজি-মাছ, টয়লেট পেপার, হ্যান্ড-সেনিটাইজার, প্যারাসিটামল ট্যাবলেট, ইত্যাদি। একে নাকি বলে ‘হ্যাম-স্টার এফেক্ট’। এই পরিস্থিতি দেখে শেষে ডাচ প্রধানমন্ত্রী জনগণকে আবেদন করলেন সংবেদনশীল হতে, বাকি মানুষদের কথা ভাবতে- কেউ যেন বঞ্চিত না হয় দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় সামগ্রী থেকে। প্রধানমন্ত্রীর এই বার্তা কাজ হল, শীঘ্রই ফিরে এলো সেই পরিচিত সুপার মার্কেটের

ছবি। করোনার উপদ্রব যখন দেশে ছড়াতে শুরু করেছে, ডাচ গভর্নমেন্ট সিদ্ধান্ত নিলো স্কুল চালু রাখতে, শিশুদের জন্যে ডে-কেয়ার খোলা রাখতে। এই দেশের বিশেষজ্ঞদের বিশ্বাস ছিল যে ১৬ বছর বয়সের নিচের বাচ্চারা করোনার প্রভাবে খুব একটা আসবে না। আর বাচ্চারা যদি নিজেদের জায়গায় ব্যস্ত থাকে, তাহলে তাদের মা-বাবারা ঘর থেকেই অফিস, ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারবে। ফলস্বরুপ দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি ঠেকানো যাবে। নিষেধাজ্ঞা জারি করা হল শুধুমাত্র রেস্টুরেন্ট, সেলুন, জিম, সিনেমাহল, ফুটবল স্টেডিয়াম, চার্চের প্রার্থনা সভা, আর কিছু প্রতিষ্ঠানের উপরে যেখানে অনেক মানুষ এক সাথে হবার সম্ভবনা বেশি। মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে জারি হল ‘সোশ্যাল ডিসটেন্সসিং’ এর নিয়মাবলী। ডাচ সরকার এর নাম দিল ‘ইনটেলিজেন্ট লকডাউন’। যারা হাসপাতালের পরিসেবাতে আছেন তাদের সুরক্ষিত পোশাক এবং মাস্ক পরা আবশ্যক করা হল, এবং তাদেরকেই শুধুমাত্র নিয়মিত পরীক্ষা করা হবে এই ব্যাধির সংক্রামণের সম্ভবনাকে সনাক্ত করতে। কারন বিশ্ব জুড়ে দেখা যাচ্ছে যে বেশ কিছু সংখ্যক চিকিৎসকও করোনা রুগীদের সেবা কালীন নিজেরাই এই মারাত্মক জীবাণুতে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারাচ্ছেন, যা সত্যি খুবই দুঃখের ব্যাপার।

ডাচল্যান্ডের বর্তমান পরিস্থিতি খুব একটা আশাপ্রদ নয়। এই ১৭ মিলিয়ন জনসংখ্যার দেশে এরই মধ্যে অন্তত ৩৭০০ লোক প্রাণ হারিয়েছে, আর ৩৩,০০০ এর বেশী সংক্রামিত বলে চিহ্নিত করা হয়েছে (পরিসংখ্যান- ২০ এপ্রিল, ২০২০)। আর প্রতিদিনই বেড়ে চলেছে এই সংখ্যাগুলো। মার্চে ঘোষিত তিন সপ্তাহের ‘ইনটেলিজেন্ট লকডাউন’ এর সময়সীমা এই মুহূর্তে এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত বহাল রাখা হয়েছে। ডাচ সোসাইটিকে অবশ্য পুরোপুরি গৃহবন্দী থাকার জন্যে নেদারল্যান্ডস গভর্নমেন্ট তেমন চাপ দিচ্ছে না। দেশবাসীর উপর ভরসা রাখা হয়েছে যে তারা নিজেদের সুরক্ষার সম্পর্কে সচেতন থাকবে। জারি করা শর্ত মেনে চললে বাইরে নিজের বাড়ির কাছাকাছি ঘুরে আসতে, অথবা দোকানে যেতে কোন বাধা নেই। জগৎবিখ্যাত টিউলিপ গার্ডেন অবশ্য এই বছর জনসাধারনের জন্যে খোলা হবে না। এই বসন্তের সোনালি রোদ্দুরে গা ভেজাতে সি-বিচের কাছে যাওয়াও এখন সম্পূর্ণ নিষেধ। নেদারল্যান্ডসের মতো সুইডেনও পুরোপুরি লকডাউন পলিসিতে বিশ্বাসী নয়। করোনার ভয়াবহ প্রকোপে পড়েছে সদ্য ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া দেশ ব্রিটেনও। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই এই দেশের রাজপুত্র, প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে বহু আমজনতা এই ভাইরাসের আক্রমণে নাজেহাল। আজকের হিসেবে বিশ্বজুড়ে অন্তত ২.৫ মিলিয়ন মানুষ আক্রান্ত, লক্ষাধিক মানুষ ইতিমধ্যেই প্রাণ হারিয়েছে। মৃতের তালিকায় আছে ১ বছরের শিশু থেকে ১০০ বছরের বৃদ্ধ। আবার এই প্রাণঘাতী জীবাণুর সাথে লড়াই করে জিতে ফিরেছেন ১০৭ বছরের প্রবীণ তার উদাহরণও আছে। আশার কথা এই যে আক্রান্তদের মধ্যে শতকরা ৬০-৭০% জনের সংক্রামণ হালকা ধরণের, তাই সেক্ষেত্রে হাসপাতালে যাবার প্রয়োজন হচ্ছে না। তারা বাড়ির পরিচর্যাতেই সুস্থ হয়ে উঠছেন। ইউরোপে বেশীরভাগ দেশেই হাসপাতালের আইসিইউ এর সেবা বিভাগের সংখ্যা সীমিত। একমাত্র ব্যতিক্রমী দেশ জার্মানি। এই দেশের করোনায় মৃতের সংখ্যাও ইউরোপের অন্য দেশগুলোর থেকে অপেক্ষাকৃত কম। ডাচল্যান্ডেও আইসিইউর সংখ্যা বেশ সীমিত। তাই অতিরিক্ত ইমারজেন্সি বেডের চাহিদা মেটাতে হাসপাতালের বাইরে তৈরি করা হয়েছে বিশেষ মেডিক্যাল ক্যাম্প; মিউজিক হল আর স্টেডিয়াম এই মুহূর্তে রূপ নিয়েছে আপাত-হাসপাতালের কেবিনের। পরিস্থিতির গুরুত্ব দেখে নেদারল্যান্ডসে ৮০ বছরের ঊর্ধের করোনায় আক্রান্ত সিনিয়াররা, অথবা বয়স্ক ক্যান্সার রুগীরা অনেকেই স্বেচ্ছায় আইসিইউর সেবা নিতে প্রত্যাখ্যান করছেন। এমনকি হৃদরোগে আক্রান্ত হলে রি-অ্যানিমেট করা যেন না হয় এই রকম আবেদনও করছেন অনেকে। নিজের স্বার্থের সঙ্কীর্ণ গণ্ডি পার করে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কথা ভাবতে পারা ডাচ সমাজের মানবিকতার এক উজ্জ্বল দিক।

নেদারল্যান্ডসে মৃত ব্যক্তির সৎকারের পদ্ধতিও অভূতপূর্ব। বেশীরভাগ লোকই তাদের ভবিষ্যতের পরকাল যাত্রার বন্দোবস্ত “ডেথ-ইনস্যুরেন্স” এর মাধ্যমে নিজেদের জীবনকালেই নির্ধারিত করে যায়। ইনস্যুরেন্স কোম্পানির লোকেরাই ঐ দুঃখের সময়ে পরিবারের পাশে থাকে, আর অন্তিম সৎকারের সব দায়িত্ব কাঁধে নেয়। এই দেশে তাই কারোর মৃত্যুর ৫-৭ পরে নির্ধারিত দিনে সব পরিজনের উপস্থিতিতে তাঁর স্মৃতি চারণ করা হয় এবং বাদ্যযন্ত্রের সুরের ছোঁয়ায় তাঁকে চিরবিদায় জানানো হয়। আজকে এই শেষ বিদায়ের ছবি পুরোপুরি অন্যরকম। এখনকার এই ‘সোশ্যাল ডিসটেন্সসিং’ সময়ে শুধুমাত্র নিকট পরিবারের লোকজন ছাড়া আর কাউকে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না শেষ বিদায়ের অনুষ্ঠানে। এতো কফিনের ভিড়ে অসম্ভব হয়ে পরেছে ট্র্যাডিশনাল নিয়মে সুচারুভাবে শেষ বিদায় জানানো্র প্রথা। তাই এখন ইন্টারনেটের সাহায্য নিয়ে পরিচিতরা পাঠাচ্ছেন বিদেহী প্রিয়জনের উদ্দেশে বিদায়ী ভাষণ। আর সময় বিশেষে চলছে সন্মিলিত সৎকার বা “মাস ক্রিমেশন”।

এতো কিছু বিরূপ চিত্র’র মধ্যেও কিছু ভালো খবর আছে। যেমন ‘সোশ্যাল ডিসটেন্সসিং’ কাছে এনেছে পরিবারের লোকজনকে। বাড়ির বাচ্চারা এখন তাদের পরিবারকে সারাক্ষণ কাছে পাচ্ছে। বাড়ি থেকে অফিসের কাজ করার এই নতুন অভ্যেস হয়তো আমাদের জীবনকে সংযমী করতে শেখাবে, নিজের স্বার্থে বুঁদ হয়ে না থেকে সমাজের কথা ভাবাতে শেখাবে, জীবনের নতুন দিক খুঁজে বার করার প্রেরণা দেবে। তদুপরি, আমাদের পরিবেশের বায়ুদূষণ অনেক পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে। সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা এই জীবাণুর প্রতিষেধক খুঁজে বের করার প্রয়াস নিয়ে দিবারাত্রি নিরলস কঠোর পরিশ্রম করে চলেছেন। সারা বিশ্ববাসীর এখন একমাত্র প্রার্থনা যত শীঘ্র সম্ভব এই প্রচেষ্টা সফল হোক এবং সেই রহস্যময় অজানা ওষুধ শিগগিরি আবিষ্কার হোক। মনুষ্য জগত কিছুতেই পরাজয় মানবে না এই ক্ষুদ্র আপাত-অদৃশ্য ভাইরাসের কাছে- ‘আমরা করবো জয় নিশ্চয়ই!’।

corona6.png
corona7.png
corona2.png
মতামত

প্রবন্ধ সমগ্র ।। মতামত ।। সূচীপত্র

Please mention the "name of the article and the author" you would like to comment in the following box... Thank you.

bottom of page