প্রবন্ধ
ভারতে দেবী
আরাধনার ইতিবৃত্ত
সুবিমল চক্রবর্তী
ডালাস, টেক্সাস
প্রবন্ধ সমগ্র
প্রাচীন কালের সিন্ধুনদের উপত্যকায় যে সভ্যতা গড়ে উঠেছিল সেই সভ্যতায় দেবীর আরাধনা প্রচলিত ছিল। সাড়ে চার থেকে সাড়ে তিন হাজার বছর আগে যাযাবর আর্যরা ভারত আক্রমণ করে এবং ভূমিপুত্রদের বশীভূত করে। সিন্ধুসভ্যতার দেবী আরাধনা নতুন বসতিস্থাপনকারী আর্যরা মাধ্যমে প্রচুর বিস্তার লাভ করে। শুধু তাই নয়, আরাধনার আচার অনুষ্ঠান সমূহ অনেক জটিল হয়ে ওঠে। আর্যরা অর্থনৈতিক ভিত্তি ছিল প্রধানত গবাদিপশু পালন। সম্ভবত কৃষি পদ্ধতি সম্পর্কে তাদের কোন জ্ঞানই ছিল না। কিন্তু তারা ছিল শক্তিশালী যোদ্ধা, তাই স্থানীয়দের পরাভুত করতে পেরেছিল সহজেই।
যাযাবর বৃত্তির চেয়ে একজায়গায় স্থায়ীভাবে বসবাস করে কৃষি কাজে মনোনিবেশ করলে যে নিরাপত্তা পাওয়া যায় এই সত্যটি তারা ক্রমশই উপলব্ধি করতে থাকে। তাই তারা কৃষিকাজে পারদর্শী হয়ে উঠতে থাকে। গঙ্গা ও যমুনা নদী বিধৌত ভারতের উর্বর ভূমি সহজেই যে পর্যাপ্ত ফসল ফলায় তা দেখে তারা অভিভূত হয়ে পড়ে। যাযাবরদের জন্য এটা ছিল একটা নূতন অভিজ্ঞতা। এই প্রথমবারের মত তাদের খাদ্য সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন ভাবে চলতে থাকে। অতএব, ‘পৃথিবী’—যা তাদের জীবনের নিশ্চয়তা বিধান করে তাদের কাছে হয়ে ওঠে প্রশংসিতা এবং পরিগণিত হয় দেবী হিসেবে। ‘পৃথিবী’ হ’ল উর্বরা নারীদাত্রী। তাদের কাছে এই দেবী ছিল মায়ের মত যে মা তাদেরকে এবং তাদের গবাদিপশুসমুহকে পালন করে এবং যার কৃষিভূমি তাদের নানাবিধ সাধ-আহ্লাদ এবং যাবতীয় আমোদ-প্রমোদকে নিশ্চিত করে তোলে। শস্য পাকার সময় কৃষিজমিতে তারা আবিষ্কার করল সোনালী স্তনযুক্তা এক নারীকে যে নারী থেকে উৎসারিত হচ্ছে সমস্ত আশীর্বাদ এবং সুখ।
অথর্ব বেদই হচ্ছে প্রথম বই যার মধ্যে রয়েছে ভূমি হিসেবে দেবী পৃথিবীর বিস্তারিত বর্ণনা। অপূর্ব সুন্দর একটা মন্ত্রের মাধ্যমে এই বেদে এই ভাবে এটি প্রকাশিত হয়েছে, 'অতীত ও বর্তমান কালের সমস্ত রাজাদের পত্নী এই দেবী আমাদের আয়ত্তের মধ্যে এনে দিন ভূমি। তিনি ধারণ করেন সবকিছু, লুক্কায়িত সমস্ত ধনরত্নের তিনিই আধার, সুঠাম স্তনযুক্তা এই দেবী যা কিছু জঙ্গম তার সব কিছুরই রক্ষাকর্ত্রী। মধুর জন্য এই দেবীকে আমরা দোহন করব, তিনি আমাদের উপর বর্ষণ করুন অপার মহিমা। এই ভূমি-যিনি আমার মা আমাকে দুগ্ধ দান করুন, দুগ্ধ দান করুন তাঁর সন্তানকে। তাঁর পাহাড় সমূহ, বরফাচ্ছাদিত পর্বতমালা, এবং তাঁর অরণ্যানী আমার জন্য আনন্দস্বরূপ হয়ে থাক। পীতাভ, কৃষ্ণকায়, বিচিত্র কারুকাজময়, লোহিত-সমস্ত বর্ণের অধিকারিণী এই কৃষিভূমিতে, এই ধরিত্রীতে যা কিনা ইন্দ্র কর্তৃক সুরক্ষিত আমি যেন নিরুপদ্রব, নিরুদ্বেগ এবং অক্ষত জীবন যাপন করতে পারি। তিনি যা সৃষ্টি করেছেন তার মধ্যে মরণশীল প্রাণীরা বিচরণ করে। তিনি ধারণ করেন দ্বিপদ ও চতুষ্পদ জীবসমুহকে তোমার ভেতর থেকে উৎসারিত হয় যে সুরভি, হে দেবী পৃথিবী, সেই সুরভি উদ্ভিদ ও জল তাদের নিজেদের মধ্যে ধারণ করে।'
ধরিত্রীর এই প্রাচুর্য আর্যদের সমৃদ্ধিশালী করে ঠিকই, কিন্তু একই সঙ্গে তাদের মধ্যে একটা ভয় বেড়ে যায় যে, অন্যান্য শত্রুভাবাপন্ন যাযাবরগোষ্ঠী অথবা দেশীয় বাসিন্দারা বা ভূমিপুত্ররা জোরপূর্বক তাদের কাছ থেকে ভূমি কেড়ে নেওয়ার জন্য তাদেরকে আক্রমণ করতে পারে। তাদের ভুমি এবং শস্যভাণ্ডার লুটতরাজ এবং অন্যান্য উপদ্রবের কারণে বিনষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা সর্বদাই থেকে যায়। অপার উৎকর্ষ, ধনসম্পদ ও সমৃদ্ধির দেবী লক্ষ্মী যেন দেবী পৃথিবীর স্থান গ্রহণ করার গৌরব নিতে চাইলেন। কিন্তু এই ক্ষেত্রে আযরা একটা উভয়সঙ্কটের সম্মুখীন হল।
আর্যরা যে সময়টাতে উত্তর ভারত দখল করে নিয়েছিল, সেই সময় এই এলাকায় যারা বসবাস করত তাদের অর্থনৈতিক জীবন নির্ভরশীল ছিল কৃষিকাজের উপর। তারা উপাসনা করত তাদের শস্য দেবীকে। এই দেবীর প্রারম্ভিক নাম ছিল লক্ষ্মী, কারণ এই দেবী যুক্ত ছিলেন কর্দম ও জলকণার সঙ্গে এবং তিনি ছিলেন আর্য পূর্বকালীন সময়ের কৃষিকর্মও বৈষয়িক সমৃদ্ধির প্রতীক। পররতীকালে উত্তর ভারত দখলের পর আর্যরা যখন চাষবাসের পদ্ধতি আয়ত্ত করল এবং নিজেরাই যখন তাদের নিজেদের জন্য ফসল উৎপাদন করতে শিখল, তখন বিজিতদের মত তারাও সবকিছু উৎসর্গ করল লক্ষ্মীকে। কিন্তু তাদের সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠিত হতে পারত শুধুমাত্র আর্যরা পূর্বকালীন চাষবাসের দেবীকে অর্থাৎ লক্ষ্মীকে চূর্ণবিচূর্ণ করে, পরাস্ত করে এবং বিতাড়িত করে।
ফলত আর্যরা পূর্বকালীন সময়ের লক্ষ্মীর নাম দেওয়া হল অলক্ষ্মী এবং এই দেবীকে এখন দেখা হল একটা অপশক্তি হিসেবে। অত্যন্ত অমার্জিতভাবে এই অলক্ষ্মীকে তৈরি করা হল কাদা, জল এবং গোময় দিয়ে। আর্য পূর্ব কালীন দেবী
করিষিনীর কথা স্মরণে রেখে এই অবয়ব গড়ে তোলা হল। এখানে উল্লেখ্য যে, করীষ শব্দের অর্থ গোময় অর্থাৎ গোবর। এই দেবীর হাতে শস্য ঝাড়ার কুলা যা দিয়ে সে শস্য ঝাড়ছে। যতদিন না পর্যন্ত আর্য পূর্ব কালীন সৌভাগ্যের অবসান ঘটল, আর্যদের সাফল্য এবং কৃষি ক্ষেত্রে সৌভাগ্য যেন প্রতিষ্ঠিত হতে পারছিল না। মজার ব্যাপার হচ্ছে ঋগ্বেদের লক্ষ্মীর অপর দুটো নাম হচ্ছে জয়া বা জ্যেষ্ঠা যার আভিধানিক অর্থ হচ্ছে সবার চাইতে বড়। এর একটা অর্থ দাঁড়ায় যে, এই দেবী হচ্ছে আর্য পূর্ব কালীন সময়ের দেবী যার স্থান দখল করেছিল পরবর্তী সময়ে আর্যদের সৌভাগ্যের দেবী।
আর্যদের আচার অনুষ্ঠানে জল সব সময়ই একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। উত্তর ভারতে গঙ্গা ছিল সবচেয়ে দীর্ঘ মনোরম নদী। বৈদিক যুগের শেষের দিকে যখন সিন্ধু সভ্যতা গঙ্গার দুই তীরে উন্নতির চরম শিখরে আরোহণ করেছিল, তখন থেকেই গঙ্গা দেবী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। স্বর্গ, সমুদ্র, হিমালয়, ঋষি জাহ্নু, ব্রহ্মা, শিব ও বিষ্ণু, এবং অন্যান্য দেবীদের সঙ্গে এই দেবীর পৌরাণিক যোগাযোগ তার পবিত্রতার ভাব মূর্তিকে বাড়িয়ে দিয়েছে। এমনকি অদ্যাবধি এই দেবী উপাসিত হয়ে থাকে পার্থিব বা বৈষয়িক সৌভাগ্যের জন্য। শুধু তাই নয়, চূড়ান্ত বা অন্তিম মুক্তির জন্যও এই দেবী আরাধ্যা। প্রয়াগে গঙ্গা নদী মিলিত হয় যমুনা নদীর সঙ্গে। এই সঙ্গম স্থল পুণ্যার্থীদের জন্য একটা পবিত্র স্থান। গঙ্গা এবং যমুনা উভয়ই হিন্দু দেব-দেবীদের মধ্যে দুজন প্রধান দেবী হিসেবে স্বীকৃত। আর্য উপনিবেশকারীদের সভ্যতা আরও কয়েকটি নদীর, যেমন সরস্বতী ও দৃশদবতী এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য - উপর নির্ভরশীল ছিল।
আর্যরা ধন সম্পদের অগাধ ভাণ্ডার গড়ে তুলতে পেরেছিল। তার ফলে তাদের জীবনে এসেছিল অবসর। আর এই অবসরকে তারা ব্যবহার করেছিল যাবতীয় সৃষ্টিশীল কাজকর্মে। তারা সমর্থ হয়েছিল বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানের পরিধি বাড়িয়ে তুলতে। শিল্পকলায় তারা প্রভূত উন্নয়ন সাধন করতে সমর্থ হয়েছিল। বিদ্যাদায়িনী সরস্বতী প্রতিষ্ঠিতা হল দেবী হিসেবে। এমনকি আর্যদের আগমনের পূর্বে ঋগ্বেদের যুগে বিশ্বাস করা হত যে, সরস্বতী নদীর রোগ নিরাময়ের ক্ষমতা ছিল, এবং তাকে চিহ্নিত করা হয়েছিল বেদের প্রাথমিক নিরাময়ের দেবতা অশ্বিনদের অন্যতমা হিসেবে। প্রাথমিক যুগের আর্য উপনিবেশের সময় সরস্বতী নদী আর্যদের উপনিবেশের পূর্ব সীমানা ছিল। মনুসংহিতায় উল্লেখ আছে, আর্যদের প্রাচীন বাসভূমি ব্রহ্মাবর্ত সরস্বতী ও দৃশদবতী নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত ছিল। দৃশদবতী নদী পরবতী কালে বালুর কারণে প্রবাহ হারিয়ে ফেলে এবং লুপ্ত হয়ে হয়ে যায়। প্রাথমিক পর্যায়ে সরস্বতী নদী আর্যদের উপনিবেশ সম্প্রসারণে এবং সভ্যতা সংস্কৃতির উৎকর্ষ সাধনে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল। আর্যরা সম্পূর্ণভাবে নিরক্ষর, গবাদিপশু পালক ও যাযাবর
ছিল। তারা যেহেতু লিখতে বা পড়তে জানত না, মুখের ভাষা অর্থাৎ ‘বাক’ তাদের কাছে ছিল অত্যন্ত মূল্যবান। তাই তাদের সংস্কৃতির যা মূলত ছিল বলি প্রদানের ধর্ম মুল ভিত্তি ছিল ‘বাক’, মুখে উচ্চারিত মন্ত্র। একই সঙ্গে তাদের গবাদিপশু সরস্বতী নদীর উভয় কুলে খুঁজে পেল বিস্তর চারণভূমি। আর্যরা ধীরে ধীরে যখন স্থায়ীভাবে বসতি গড়তে শুরু করল, তারা সৃষ্টি করল জটিল এবং বিশদ বলি প্রদানের আচার-অনুষ্ঠান। তাদের বিদ্যা সাধনার এক বিরাট অংশ বিধৃত হল এই উৎসর্গ বা বলির মন্ত্র সমূহে। ফলত, সরস্বতী হয়ে উঠল জ্ঞান বা বিদ্যার দেবী। ‘বাক’ বা মুখনিঃসৃত বাণী এবং উৎসর্গ বা বলির জন্য নির্বাচিত মন্ত্রাবলী সরস্বতী বা বাগদেবীর ধারণার উৎস হয়ে থাকল। এক পুরাণে উল্লেখিত আছে, অনার্য বা অসুরদের সঙ্গে আর্যদের এক আপস রফার সময় ‘বাক’ দেবী অনার্যদের সঙ্গে প্রতারণা করে তাদের পক্ষে না গিয়ে আর্যদের পক্ষ অবলম্বন করে। বস্তুত, এই পৌরাণিক কাহিনী ভারতের ভূমিপুত্রদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতির উপর আর্যদের ভাষা ও সংস্কৃতির প্রভুত্ব স্থাপনের ইতিহাস। বিশ্ব নিয়ন্ত্রক শক্তি হিসেবে ‘বাক’ দেবী কয়েকটি বৈদিক পুরাণে ও উল্লেখিত আছে।
ইতিমধ্যেই আর্যরা জ্ঞান ও সম্পদের জন্য পরিচিত হয়ে উঠল। ফলত তাদের সুপরিকল্পিত সম্প্রদায় সমূহের উপর বাইরের শত্রু কর্তৃক আক্রমণের ভয় বৃদ্ধি পেল। তবে যোদ্ধারা সদা প্রস্তুত ছিল। কিন্তু তাদের নিজেদেরকে এবং তাদের সহায় সম্পত্তি রক্ষা করা ক্রমশই কঠিন হয়ে উঠতে থাকল। তখন তাদের প্রয়োজন হয়ে পড়ল শক্তি, সাহস এবং বীরসুলভ সহিষ্ণুতার যার দ্বারা তারা আক্রমণকারীদের হঠিয়ে দিতে পারবে । মজার ব্যাপার হল, এই সময় কালে যত পুরাণের জন্ম হয়েছে সেগুলোর প্রায় সবগুলোতেই অনার্যদের চিত্রিত করা হয়েছে অসুর হিসেবে। দেখানো হয়েছে, তারা ছিল অসভ্য, অপশক্তি, কামুক, এবং কালো জাদুবিদ্যার অধিকারী। এই অপশক্তির মোকাবিলার স্বার্থে আরযরা ‘শক্তি’ এবং ‘মাতৃকা’ অর্থাৎ মাতৃদেবতা উপাসনার পুজাপদ্ধতি বা ধর্মবিশ্বাসের সূত্রপাত করল। এই দেবীরা হল পুরুষ দেবতাদের মধ্য থেকে উদ্ভুত নারী দেবী অথচ পুরুষ দেবতাদের তুলনায় অনেক বেশী শক্তিশালী। দেব-দেবীর যে পদ্ধতি গড়ে উঠল তার মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান হল দুর্গা, চণ্ডিকা, চামুণ্ডা এবং কালীর। এই দেবীদের চিত্রিত করা হল বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিতা শক্তিশালী ও সশ্রদ্ধ ভয় বা বিস্ময় উদ্রেককারী ভয়াল দর্শনা রণরঙ্গিণী দেবী হিসেবে। কালী, চামুণ্ডা, ধুনাবতী এবং ছিন্নমস্তা দেবীরা এদের অন্তর্ভুক্ত। এই দেবীসমুহের কল্পনা এমনভাবে করা হয়েছিল যাতে তারা আরযদের শত্রুদের উপর ভীষণ ত্রাসের সঞ্চার করতে সমর্থ হয়। এই দেবীসমূহের অর্চনা জটিল আচার অনুষ্ঠানের এবং পশুবলি বা উৎসর্গের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হত। প্রায়ই এই আচার অনুষ্ঠান ও বলি চলত কয়েকদিন ধরে।সেই সময় মাতৃকা ছাড়াও দশ মহাবিদ্যার তান্ত্রিক গ্রুপ প্রচলিত ছিল। দশমহাবিদ্যার প্রথম ছিল কালী, অন্য নয় দেবীর নাম তারা, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, ছিন্নমস্তা, ভৈরবী, ধুনাবতী, বগলা, মাতঙ্গী এবং কমলা।
বিপদনাশিনী বা উদ্ধারকরত্রী ‘তারা’ পরবর্তী কালে বৌদ্ধ তান্ত্রিকেরা উপাস্যা হিসেবে গ্রহণ করে। ষোড়শী ছিল ষোড়শ বর্ষীয়া সুন্দরী তরুণী দেবী। ভুবনেশ্বরী তারই এক রূপ যে হল সমগ্র বিশ্বের অধিপতি। যখন সে ছিন্নমস্তা, তখন সে ধারণ করেছে এক ভয়ঙ্কর মূর্তি। এই অবস্থায় সে নিজের বাম হস্তে ধারণ করে নিজেরই মস্তক এবং পান করতে থাকে ছিন্ন মস্তক থেকে উৎসারিত রক্ত।
ভৈরবী রূপেও সে ধারণ করে ভয়াল দর্শনারূপ। ক্রুদ্ধ এবং সংহারকারী শিবের সে স্ত্রী রূপ। ধূমাবতী সম্ভবত একমাত্র দেবী রূপ যার পরিধানে আছে বৈধব্যের বেশ। এই দেবী চিত্রিত হয়েছে কৃশকায়া বৃদ্ধা রমণী হিসেবে যার সৌন্দর্য ও মহিমাসবই নিঃশেষিত। মলিন ও ছেঁড়া বসন পরিহিতা এবং অবিন্যস্ত কেশযুক্তা এই দেবী হাতে ধারণ করে শস্য ঝাড়ার ঝুড়ি। এই দেবীর ছিল দীর্ঘ নাসিকা এবং তার চোখ থেকে যেন ঝরে পড়ছে নিষ্ঠুরতা। এই দেবীকে মনে হবে তার রয়েছে অনন্ত ক্ষুধা এবং তৃষ্ণা। তাকে দেখে মনে হবে সে ধূর্ত, কলহপ্রিয় এবং প্রবঞ্চক। সে ধারণ করে আছে সমস্ত বদ গুণ যা কোনবিধবার জন্য শোভাপায় না। সে যেন সেই বিধবা যার আনন্দের জগতে সহসাই যবনিকাপাত হয়েছে যার ফলে তার মধ্যে হাহাকার করছে অপূর্ণকামনা বাসনা সমূহ। যাই হোক, এই ধূমাবতী রূপ পরোক্ষ ভাবে এবং একক ভাবে সাক্ষ্য দেয় যে বিধবাকে তুষ্ট করার জন্য তাকে পূজা করা হত।
কৌমারী রূপে এই দেবী কুমারী পূজার উপর গুরুত্ব আরোপ করে, এবং দেবী সরস্বতী রূপে সে চিত্রিত হয় নিঃসন্তান স্ত্রীরূপে, এবং অপর সমস্ত রূপে সে মাতা রূপিণী দেবী যার স্বামী ও সন্তানরা জীবিত। বগলা দেবী রূপে বগলামুখী হিসেবেও পরিচিত (সম্ভত ‘বক’ শব্দ থেকে উদ্ভূত) এই দেবীর রয়েছে বকের শির। এই দেবী ছিল কুটিল জাদুবিদ্যা এবং বিষাক্ত দ্রব্যের প্রতীক। বিস্ময়ের ব্যাপার হলেও এই দেবীর মুখায়বে প্রতিফলিত হয় যন্ত্রণা; মনে হয় কোন সংঘর্ষ জনিত কোন কষ্ট তাকে বিদীর্ণ করছে।
‘মাতঙ্গ’ শব্দের অর্থ হচ্ছে হস্তী। মাতঙ্গী হস্তীর যে শক্তি তার প্রতীক। শিব পরচিত ছিল হস্তীহন্তা হিসেবে এবং মাতঙ্গী ছিল তার স্ত্রী। তাকে কল্পনা করা হত একজন সুন্দরী নারী হিসেবে। সে বসে আছে এক সিংহাসনের উপর এবং উপবিষ্টা থেকে প্রদর্শন করছে হিতকর ক্ষমতা। কমলা হিসেবে এই দেবী সদাশিবের স্ত্রী। সে সুন্দরী ও সুপ্রসন্ন এবং শুভমঙ্গলময়ী।
তদুপরি দেবীদের ছিল আরো আটটি রূপ। এই দেবীদের দেখানো হয়েছে সংসার বিবাগী সন্ন্যাসিনীরূপে। এই দেবীরা হল ত্রিপুরা, ভীষণা, চণ্ডী, কর্ত্রী, ধরত্রী, হরত্রী, বিধায়িনী, করাল ও শূলিনী। আমারা দেখতে একই দেবী একই নাম একাধিক গ্রুপে উল্লেখিত হয়েছে।
কালীর যে ভিন্ন ভিন্ন রূপ আমরা দেখছি, সেগুলো নির্ধারিত হয়েছে কোন অঞ্চলে সে পূজিতা হয়েছে এবং কীউদ্দেশ্য সাধনের জন্যও এই পূজার আয়োজন করা হয়েছে। যেমন, এই দেবীকে আমরা দেখেছি শ্মশানকালী, ভদ্রকালী, গৃহকালী, মহাকালী, রক্ষাকালী, ইত্যাদি হিসেবে। এমনকি, ডাকাতদেরও কালী রয়েছে; বাংলায় এই দেবী ডাকাতে কালী হিসেবে পরিচিত। ডাকাতি করার জন্য যাত্রার প্রাক্কালে ডাকাতের দল ধুমধামসহকারে এই দেবীর পূজা করে। কালীর এই সমস্ত রূপই স্থানীয় ভাবে জনপ্রিয় ও পূজিতা অপরাপর দেবীদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করে। সে যা-ই হোক, দেবীদেরকে পূজা করবার প্রচণ্ড এই ধর্মীয় বিশ্বাস কিন্তু নারী জাতিকে বিশেষ মর্যাদা প্রদানে সমর্থ হয়নি। বরঞ্চ, নিষ্ঠুর ও কঠোর পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীরা ভীষণভাবে পুরুষের পদানত থেকেছে এবং ভীষণভাবে তারা নিগৃহীত হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। নারীর মানসিক ও শারীরিক যন্ত্রণা সহ্য করবার সামর্থ্যকে শ্লাঘার বস্তু হিসেবে দেখা হয়েছে এবং এইসব নিয়ে তৈরি হয়েছে বিভিন্ন সাহিত্য। গৌরবান্বিত করা তাদের সংসারের জন্য পুরুষের জন্য তাদের ত্যাগকে। তাদেরকে বসানো হয়েছে দেবীর আসনে। সীতা ও রাধা হচ্ছে প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এখানে উল্লেখিত অন্যান্য দেবীদের মত এই দুই দেবীর স্বর্গীয় গুণাবলী ছিল না। তাদের প্রধানতম সদগুণ ছিল যে তারা তাদের স্বামীর প্রতি ছিল অনুগত এবং উৎসর্গীকৃত।
সন্তানের জন্মদান এবং শৈশব অবস্থায় তাদের পালনই ঐতিহ্যগত ভাবে নারীর জন্য নির্ধারিত হয়েছে। দেবী ষষ্ঠীসদাশয়া এবং মাতৃস্নেহে পরিপূর্ণা এবং এই দেবীর মধ্যে বিধৃত হয়েছে এই স্বর্গীয় ক্ষমতা। সন্তানহীনাকে সন্তানদানের স্বর্গীয় ক্ষমতাও দেওয়া হয়েছে দেবী ষষ্ঠীকে।
প্রবন্ধ সমগ্র
রবীন্দ্রযুগে
নারীর অগ্রগতি
পারোমিতা চট্টোপাধ্যায়
অষ্টাদশ শতাব্দীতে বাংলার নারী সমাজ অনেক পিছনে ছিল। তাদের অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে আসার প্রথম দিশারি বিদ্যাসাগর মহাশয়। স্ত্রী শিক্ষা প্রচলনে তার অবদান অনস্বীকার্য। তাছাড়া বিধবা বিবাই প্রচলন, বহু বিবাহ রোধ তিনি আইনের মাধ্যমে ঘটান। তৎকালীন হিন্দু সমাজপতিদের বহু বিদ্রুপ সহ্য করেও তিনি তার কাজে অচল ছিলেন। বেথুন স্কুল প্রতিষ্ঠা তার অন্যতম কৃতিত্ব। আজকে নারী যে জায়গায় আছে তার জন্য বিদ্যাসাগর চিরস্মরণীয়।
পরবর্তীকালে স্ত্রী শিক্ষাকে রক্ষা ও নারী প্রগতির ক্ষেত্রে ব্রাহ্মসমাজ রবীব্দ্রনাথ এবং ঠাকুর পরিবারের অবদান অসীম। বহুবিবাহ নামক নারকীয় প্রথা থেকে মুক্তি পাবার জন্য সে সময় বহু হিন্দু কুলীন ব্রাহ্মসমাজের অন্তর্ভুক্ত হন। ঠাকুরবাড়ি ও ব্রাহ্মসমাজের মহিলারা নারী মুক্তি ও নারী প্রগতির দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। ঠাকুরবাড়ির মেয়ে বধুঁদের যে দু-তিনটি নাম উজ্জ্বল তার মধ্যে প্রথমেই উঠে আসে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের কন্যা স্বর্ণকুমারী দেবী। তিনি নারী কল্যানমুলক কাজ আরম্ভ করেন তার প্রতিষ্ঠিত সখি সমিতির মধ্যে দিয়ে। বিধবাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার জন্য তার প্রচেষ্ঠা প্রশংসার দাবী রাখে। অসহায় বিধবাদের যন্ত্রণা, তাদের মর্মবেদনা তিনি তার বহু নাটকে ফুটিয়ে তোলেন। স্বর্ণকুমারীর জনপ্রিয় নাটকের মধ্যে একটি ছিল ‘কাহাকে’। এই নাটকের মাধ্যমে তিনি শিক্ষিতা আধুনিকা নারীদের অধিকার বোধ বিশ্লেষণ করেন। কবিতা লিখতেন, গান লিখতেন। তাছাড়া সংস্কারের কাজের জন্য তিনি এই কাব্য ও উপন্যাসের জগৎ ছেড়ে মন দিয়েছিলেন প্রবন্ধ লেখার কাজে। তিনি দীর্ঘদিন ‘ভারতী’ প্রত্রিকা সম্পাদনা করেন। দুঃস্থ মেয়েদের স্বাবলম্বী করার জন্য হাতের কাজ শেখানোর চেষ্টা উল্লেখযোগ্য। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাকে জগৎতারিণী স্বর্ণপদক দেওয়া হয়। এরপরে যার নাম আসে তিনি হলেন মহর্ষির মধ্যম পুত্র সত্যেন্দ্রনাথের পত্নী জ্ঞানদানন্দিনী। তিনি বাংলার নারী জাগরণের অন্যতমা ছিলেন। বাঙালি মেয়েদের আধুনিক শাড়ি পড়ার ধরণ তিনি আবিষ্কার করেন। তিনি তখনকার দিনে ভারতীয় রমণী যিনি স্বামীর সাথে বিলেত যান এবং ভারতের বহু শহরে ভ্রমণ করেন। সঙ্গীত, কাব্য, অভিনয় সব কিছুতেই তার অদম্য উৎসাহ ছিল। ভারতী পত্রিকায় স্ত্রীশিক্ষা বিষয়ক একটি প্রবন্ধ লেখেন।
এছাড়া ছোটদের জন্য ‘বালক’ পত্রিকা প্রকাশ করেন। তার রচিত ছোটদের ‘সাত ভাই চম্পা’ ও ‘তাক ডুমা ডুম’ খ্যাতি অর্জন করেন। রবীন্দ্রনাথের তৃতীয় ভ্রাতা হেমেন্দ্রনাথের পত্নী নিপময়ীর নাম উল্লেখ করা বিশেষ প্রয়োজন। তার ছবি আঁকা অসাধারণ প্রতিভা পরবর্তীকালে তার সন্তানের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। ‘পুণ্য’ পত্রিকায় তার আঁকা ছবি প্রকাশিত হয়। স্বর্ণকুমারী দেবীর কনিষ্ঠা কন্যা সরলাদেবীর নাম খুবই উল্লেখযোগ্য। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হন। রবীন্দ্রনাথের অনেক গানের স্বরলিপি তিনি দেন। ‘বন্দেমাতারম’ সঙ্গীতে সুর তিনি দেন। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে তিনি সক্রিয় ভাবে যুক্ত ছিলেন। তার রচিত গ্রন্থ জীবনের ঝরা পাতা থেকে তার এবং ঠাকুরবাড়ি সম্পর্কে অনেক তথ্য পাওয়া যায়। জ্ঞানদানন্দিনীর কন্যা ইন্দিরাদেবীর নাম অত্যন্ত সুপরিচিত।
রবীন্দ্রনাথের খুব কাছের এবং স্নেহ ভাজন ছিলেন। রবীন্দ্রসংগীতের প্রচুর স্বরলিপি তিনি রচনা করেন। সবশেষে আসা যাক রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে। ক্ষিতিমোহন সেনের ‘রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতন’ বইটিতে রবীন্দ্রনাথের মতে নারীর সাধনায় নারী সম্মন্ধে কবির মনোভাব সুন্দরভাবে আলোকিত হয়েছে। মহাত্মা গান্ধীর অনুরোধে গুজরাটে সাহিত্য সভায় যোগ দেবার জন্য গুরুদেব গুজরাট যাত্রা করেছিলেন। সম্মেলন শেষে গুজরাটের মহিলাদের আমন্ত্রণে কবি সেখানকার বণিতা আশ্রমের একটি প্রতিষ্ঠানে যান। সেখানে তিনি তার বক্তব্যে বলেন প্রত্যেক নারীর মধ্যে সুপ্ত আছে গৌরি যিনি তপস্যায় শিবকে জাগ্রত করে দৈত্যকুলের হাত থেকে স্বর্গকে উদ্ধার করেন। নারী যেন নিজের আত্মমর্যাদা ভুলে কখনই অন্ধের মত পুরুষকে অনুসরণ না করেন। এই কথাটাই কবিগুরু তার বিশ্বলক্ষী কবিতায় বলেছিলেনঃ ‘ভোগের আবর্জনা লুপ্ত হল ত্যাগের হোমাগ্নিতে’র বরোদায় একটি সম্মেলনে তিনি নারী দুটি রূপ বর্ণনা করেছিলেন। একজন প্রতিমা আর একরূপ তপস্বিনীর। বলাকা কাব্যে দুটি রূপ সুন্দর ভাবে চিত্রিত হন –
‘কোন ক্ষণ সৃজনের সমুদ্র মন্থনে
উঠেছিল দুই নারী
অতলের শয্যাতল ছাড়ি
একজনা উর্বশী, সুন্দরী
বিশ্বের কামনা রাজ্যে রাণী,
স্বর্গের ঈশ্বরী
আর জন ফিরিয়া আনে
অশ্রুর শিশির স্নানে স্নিগ্ধ বাসনায়
মহুয়ায় সবলা নামক কবিতাটি এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য।
‘নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার
কেন নাহি দিবে অধিকার
হা বিধতা’
রবীন্দ্রনাথ সাধারণ মেয়ে গৃহবধূদের মর্মবেদনা গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। এই উপলব্ধি আমরা পাই তার সাধারণ মেয়ে আর মুক্তি নামক কবিতার মধ্যে দিয়ে। গৃহবঁধুদের জীবন যে শুধু রাঁধা আর খাওয়ার মধ্যে দিয়ে বয়ে যেত এর বাইরে তাদের চিন্তা করার কোন অবকাশ ছিল না তা কবি মুক্তি কবিতায় সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। তাই রবীন্দ্রযুগে মহিলা সমিতি ও নানা রকম হাতের কাজ, ছোট পত্রিকা যেখানে মহিলারা তাদের কথা লিখতে পারেন এইসব সূচনা হয়। এই প্রসঙ্গে বলা আবশ্যক যে এই অগ্রগতিতে ব্রাহ্মসমাজ যত দ্রুত এগিয়ে ছিলেন হিন্দু সমাজের এই জায়গায় আসতে অনেক সময় লেগেছিল।
প্রবন্ধ সমগ্র
এসো গো
স্বাতী মিত্র
সুজনবরেষু আগামী,
আজ হেমন্ত ১৪১৮, তোমার আসার প্রতিক্ষায়, প্রতিক্ষা পরিবর্তনের, নতুন কোন চমকের, টাটকা কোন খবরের। ‘আমার এই অন্ধকারে কত রাত কেটে গেল, আমি আঁধারেই রয়ে গেলাম। তবু ভোরে স্বপ্ন থেকে সেই ছবি যাই এঁকে রঙে রঙে, সুরে সুরে, দেখ ওরা সব যেন গান হয়ে যেতে পারে।তুমি আসবে বোলেই সোনালী স্বপ্ন ভিড় করে আসে চোখে। কিন্তু কি আনবে আমার জন্যে, আমাদের জন্যে – ভাল কিছু খবর এনো। হঠাৎ খুশির অমুল্য কিছু মুহূর্ত, যা কিনা স্মৃতির মণিকোঠায় যত্ন করে সাজিয়ে রাখতে পারি। গোটাকতক সোনালি সকাল, গোধূলি মাখা সন্ধ্যে দু-চারখানা অথবা এক আকাশ তারায় সাজানো এক গুচ্ছ মায়াবী রাত। উথাল পাথাল কালবৈশাখী কিছু মন কেমন করা, অফিস ডুব দেওয়া বৃষ্টি ধোয়া দিন, শরতের শিউলি হৈমন্তী রোদ্দুর, মিঠে রোদমাখা শীতের চড়ুইভাতি, বসন্তের চৈতালী চাঁদ আর মহুয়ার মাতাল জোৎস্না। এমন কি দু-চারটে বিয়ের নিমন্ত্রনও আনতে পারো, হাল আমলের ধনতেরাস, জন্মদিন, মুখেভাত। খানকয়েক ভাল সিনেমা, সাহিত্য আর জীবনমুখী। কুলের আচার, ডালের বড়ি, পোস্তবাটা। সব দ্বন্দ্বের অবসান, অন্যায়ের প্রতিকার, টুকটাক অনিয়ম, নিছকই একটু মুস্কিল আসান, একমুঠো ইচ্ছাপূরণ, সবার জন্য ভাতকাপড়, আর মস্ত এক কৌটো শান্তি। অনেক বেশি চাওয়া হয়ে গেল কি। কি যে করি বল এক আশা নিয়ে, বোবা হয়ে মরি, এত ভাষা লয়ে। তাই তো এই খোলা চিঠি তোমার কাছে। এক সমুদ্দুর সুনামীর সর্বনাশ, অন্তহীন, অর্থহীন, বন্দুকবাজীর সন্ত্রাস জীবনের ত্রুটি চেপে ধরেছে প্রতিদিন। অথচ এমন তো কথা ছিল না। ‘ছোট ছোট রাত চেনা মৌতাত, পলাশের বন, অগোছালো ঘর, খড়কুটোময় চিলেকোঠা কোন – কথা ছিল হেঁটে যাব ছায়াপথ। তবে
কেন রোজ স্বপ্ন ভাঙার আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায়। কাহাতক আর রাজনীতির চচ্চড়ি দিয়ে ভাত খাওয়া যায়। বড্ড একঘেয়ে হয়ে গেছে। লোটন লোটন পায়রাগুলি পর্যন্ত বকম বকম করে না আর। এখন ফুড়ুৎ ফুঁড়ত চড়াইদের তরজা, আর তিনটে শালিক করে না রান্নাঘরের চালে নয়, ভোটবাহানার রঙ্গমঞ্চ। ‘অনেক তো দিন বৃথা গেল এ সংশয়ে, এসো এবার দ্বিধার বাঁধা পার হয়ে’ নতুন কিছু চাই। জানি সবই তো নেশা, সাগরে মেশা – একটি ঢেউ, একটি ঢেউ, তবু এদিন হোক না নদী, জানবে কেউ জানবে কেউ। এসো সেই প্রতিক্ষায়, সেই প্রতিক্ষার পথ বেয়ে। এক হাতে রেখো জিয়নকাঠি, অন্য হাতে স্বপ্নের ঝাঁপি। পূর্তিগন্ধময় জঞ্জাল নগরী, এই সেই শহর যার একদিন কল্লোলিনী তিলোত্তমা হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু সেখানে শুধু স্বপ্নের সমাধি খোঁড়াই জীবন। ভোরের খুব কাছে, কিন্তু সেখানে কখনো ভোর হবে না। তবে কিছু রঙ দিও ভোরে রোদে আর আকাশে – আহা গান দিও কিছু, নিকানো দাওয়ায় সোনা রঙ ধান ভাঙবার – কিছু সুখ দিও প্রিয়ার দু-চোখে স্বপ্নের দামাল শিশুর আলোছায়া হাসি কান্নায়। স্বপ্ন হারালে জীবনের আর থাকে কি। আগ মার্কা থোর বড়ি খাঁড়া আর খাঁড়া বড়ি থোর, এই জীবনে স্বপ্নই তো সব। নয় দিলেই ভরে আরো দু-একটা বাড়তি স্বপ্ন। ক্ষতি কি তাতে? আর একটা দিন বাঁচব নতুন কোন আশায়। হোক না সে স্বপ্নের অলীক মরীচিকা অথবা মোহনার স্বপ্নে দিকভ্রষ্ট কোন নদী। ক্ষণিকের বাঁচাটুকু তো সত্যি। জীবনের যেখানে যুদ্ধ, এস বীরের সাজে। জীবনের যেখান যজ্ঞ এস ঋত্বিক বেশে। এই কামনায়, অনেক শুভেচ্ছায়।
স্বাতী।
প্রবন্ধ সমগ্র
গঙ্গার নিরন্ন
মানুষেরা
আশরাফ উদ্দীন আহম্মদ
বাসুনিয়াপট্টি, ঘোড়ামারা, বাংলাদেশ
ঢাকা জেলার রাজানগর গ্রামে সমরেশ বসু’র (১৯২৪-১৯৮৮) খ্রিষ্টাব্দে জন্ম। পরবর্তী সময় পশ্চিমবঙ্গে চলে যান। তার উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি ‘গঙ্গা’ (১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে) তে তাঁর প্রতিভা স্পষ্ট ফুটে উঠেছে বলা অপেক্ষা রাখে না। যদিও প্রায় নব্বইটি উপন্যাস, পনেরোটি গল্প সংকলন এবং কালকূট ছদ্মনামেও অনেক গল্প আছে তাঁর। ছোটদের জন্য গোয়েন্দা কাহিনী-উপন্যাস-গল্প ছাড়াও গল্প ও উপন্যাসের চিত্রনাট্যও তৈরী করেছেন তিনি।
‘গঙ্গা’ পন্যাসটি দিয়েই সুনামের চরম শীর্ষে পৌঁছে গেছেন, ‘গঙ্গা’ মূলত লড়াই করে বেঁচে থাকারই কাহিনীমালা। প্রকৃতি এবং মানুষের সঙ্গেই মানুষকে লড়াই করে বেঁচে থাকার নামই যে জীবন, সেই কথায় বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়। পাঠক বিলাসের সাহসিকতা আর উদ্দামতা দেখে শিহরিত না হলেও তার সমুদ্রে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা অনেকটা সংগ্রাম করে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা জাগায়। একজন সামান্য মাছমারা ধীবর হয়ে তার মধ্যে যে আগুন তার খুড়ো পাঁচু লক্ষ্য করে তা মোটেও অস্বাভাবিক নয়। হতদরিদ্র মাছমারারা কখনো সুখে-শান্তিতে থাকতে পারেনি, তাদের জীবনটাই চলমান নদীর মতো, কোথায় যে সুখের ঠিকানা, আর কোথায় বা মা গঙ্গার কৃপা, তারা জানে না। দাদন ব্যবসায়ীদের রক্তচক্ষু, আর মহাজনদের চড়া সুদে টাকা ধার, এবং ফড়েনিদের হুকুমজারি, অল্প দামে মাছ কিনে নেওয়ার ছলনা, সবই তাদের বিপক্ষে যায়, তারা শুধু অন্ধকারেই রয়ে যায়। ঘরে মা-বাবা স্ত্রী-সন্তান হা-হাপিত্যেশ করে বসে আছে, ঘরের মানুষ অকুল দরিয়ায় জীবন বাঁচানোর ফসল তুলতে গেছে, ঘুম কি আসে কারো চোখে। হাজারো চিন্তায় মনপ্রাণ উথালপাথাল।
এভাবেই জীবনটা চলে ধুকে-ধুকে, মালোপাড়ার মানুষের জীবনগুলো যেন বিধাতা এভাবেই গড়ে তুলেছে,যার কারণে রোগ-শোক চিরসঙ্গী। মৃত্যু যেন কাছের পড়শী, আর তাই দেখা যায় ‘গঙ্গা’র মূল চেতনা নদীর প্রতিকূলতার সঙ্গে জড়িত মৃত্যুবোধ। মানুষ-প্রকৃতি-পরিবেশ-নদী এই উপন্যাসের প্রধান বিষয়বস্তু'। সমরেশ বসু বিশেষ একটি অঞ্চলের মৎস্যজীবি সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রার নিখুঁত প্রতিচ্ছবি অংকিত করেছেন। নদীই হল উপন্যাসের সক্রিয় এবং আচরণশীল।
খুড়োর বারণ শর্তেও বিলাস মনে প্রাণে ভালোবেসে ফেলে দামিনী ফড়েনির নাতনি প্রেমিক পরিত্যক্ত হিমিকে, এই হিমিই তার জীবনটাকে একটা স্থিতি'তি জায়গায় এনে পরিবর্তন সাধিত করে, পতিতাপল্লীর মেয়ে এবং যার মা ছিল রাড়ী অর্থাৎ পতিতা, সেই মেয়েটাই বিলাসকে নতুন দিনের স্বপ্ন দেখায়, সমুদ্রে যাওয়ার প্রেরণা যোগায়, এমন কি সমুদ্র ধীবরের বউ হওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করে।
বিলাসের চরিত্রের মধ্য দিয়ে সমরেশ বসু নিজেকে বিশাল একটা জায়গায় নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, কারণ গঙ্গা থেকে সমুদ্রে যাওয়ার যে কাকুতি দেখতে পাওয়া যায় তা সত্যি অপূর্ব বলতেই হয়। বিলাসকে শুধুমাত্র গঙ্গা ধরে রাখতে পারেনি, পারার কথাও নয়, কারণ যার কানে সমুদ্রের ডাক পৌঁছে সে কি আর বদ্ধ স'স্থানে পড়ে থাকে, তাই দেখা যায়, বিলাসের মন অসি'র সর্বসময়, শহর ঘেঁষা গঙ্গা, শহরের নানান লোভনীয় হাতছানি তাকে কিছুতেই বশ করতে পারেনি। বিলাসের দুঃসাহস দেখে কখনো খুড়ো পাঁচু অবাক হয়েছে, খিস্তি-খেউড় করেছে, কিন্তু' কোনোভাবে দমাতে পারেনি, কারণ সে জানে ওর রক্ত নিবারণ সাঁইদারের রক্ত, সেই দুঃসাহসিক মানুষটা যেমন ছিলেন গুণিন তেমনি ছিলেন সমুদ্রের বাছাড়ি নৌকার মাঝি, একত্রিশ হাত বাছাড়ি নৌকা নিয়ে সমুদ্রে মাছ ধরতে যেতো, কয়েকবার পাঁচুও সঙ্গী ছিল বড়দার, সেই দাদার আগুন ভাইপো বিলাসের মধ্যে দেখতে পেয়ে মনে মনে শিহরিত হলেও গর্বে বুক ভরে যেতো।
‘গঙ্গা’ উপন্যাসের সমস্যা- চরিত্র জেলেদের জীবন দিনলিপি, নিরবচ্ছিন্ন যুদ্ধ আর সংগ্রামের, জীবন যন্ত্রণার মধ্যেই জীবনের পটভূমি রচিত হয় বারংবার। মালোপাড়ার হতশ্রী মানুষগুলো একটু খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার জন্য যে যুদ্ধ করে অর্থাৎ দিনরাত্রি অক্লান্ত- পরিশ্রম করে, তারপরও দারিদ্র্যে ভরপুর জীবন। বর্ষার মরশুম চার মাস, আষাঢ়-শ্রাবণ, ভাদ্র-আশ্বিন, মাছমারারা তখন অমাবস্যা-পূর্ণিমার জোয়ার-ভাটার গোন কোটালের পিছে-পিছে ভেসে বেড়ায় গাঙে-নদীতে, সে এক কঠিন সংগ্রাম।
সমরেশ বসুর জীবন ছিল ‘গঙ্গা’র মতো, বারবার কুল ভেঙে-ভেঙে সামনে যেতে চেয়েছেন, কিন্তু' বারবারই ব্যর্থ হয়েছেন, যে ‘গঙ্গা’ তার চেতনার আর উপলব্ধির পাড় ভেঙেছে বারবার, এই গঙ্গা আক্ষরিক অর্থে নদী নয়, জীবন-মহাজীবন, শুধু জীবনই বা বলি কেন ‘সময়’, নদী চলেছে সমুদ্রে, সময়ও। অতীত থেকে ভবিষ্যতের অকুল দরিয়ায়।আজ কাল পরশুর বাঁক ছাড়িয়ে চিরকালের বা মহাকালের দিকে, মহাকাল সে তো সুদূর দিগন্তে-, অসীমের মাঝে হারিয়ে নিজেকে খুঁজে ফেরা, এই জীবন চেতনার সঙ্গে ওতপ্রোত হয়ে আছে মৃত্যু চেতনা।
সমরেশ তার রচনায় বিষয় ও ক্ষেত্র বা আঙ্গিক পরিবর্তন করেন, ফিরে এলেন সমতলের গঙ্গায়। ধীবর বা মালোদের জীবনের বিচিত্র কাহিনীতে, নদী থেকে সমুদ্রে যার বিস-বিস্তার, এই পৃথিবীর আদিম এক শিকারী সমাজ যাদের জীবনের সিকি ভাগ ডাঙায় আর বাকি তিন সিকি ভাগই পড়ে থাকে জলে, মাছেদের সাথে, নদী এসেছে তার জীবনে সর্বনাশা কুলত্যাগিনী নারীর অনিবার্য রূপকে, জলের ঋতু বদলায়, প্রহরে-প্রহরে রঙ বদল হয়, তার অদৃশ্য অজানা গর্ভে নিঃশব্দ পদসঞ্চারে দেখা দেয় জলের শস্য, জীবনের ফসল। সেখানে ঝরা-খরা ও মরার ত্রিমিতি, মিঠে জলে মেশে জীবনের লবণ। এই মানুষগুলির দিবারাত্রির বারোমাস্যায় ছায়া ফেলে অসংখ্য জীবাশ্ম ঘটিত জটিল সংস্কার আর কিংবদনশীল গল্পমালা। জীবিকা হয়ে ওঠে জীবনের নেশা। নিয়তির মতো নিষ্ঠুর উদাসীন প্রকৃতির সঙ্গে পুরুষানুক্রমে দ্বন্দ্ব পুরুষানুক্রমে তা নাটকীয় রূপ নিয়েছে মাছমারাদের জীবনে।
এই মাছমারাদের হালে-জালে হাত রেখে তিনি তাদের নাড়ির স্পন্দন অনুভব করেছেন, যেন মুখোমুখি বসে একই বিড়ির আগুনে গল্প ধরিয়েছেন, এই অন্তরঙ্গতাই যুগিয়েছে গঙ্গা উপন্যাসের উপকরণ। তার চাল-চরিত্র এবং চালচিত্র। গাবে মজানো জালের মতোই গল্পের রসে আঁচিয়ে এর ক্যানভাসটা ছড়িয়ে পেতেছিলেন সমরেশ, প্রবল জলস্রোতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলেছিল এর ভাটিয়াল কাহিনী, বর্ণবহুল ঘটনায় ছলাৎ ছলাৎ দাঁড়টানার শব্দ শুনতে পাওয়া যাচ্ছিলো থেকে-থেকে, সে সঙ্গে আরো একটা বাড়তি পাওনা, সব ছাড়িয়ে আবেগ, অন্যরকম জলের টানের মতোই ভাষায়। তবে গঙ্গা উপন্যাসটি শহর ঘেঁষা বলা যেতে পারে, চরিত্রের অনুষঙ্গে, কাহিনীর দাবিতে গঙ্গা’য় বসিরহাট-ত্রিবেণী-নৈহাটি- হুগলী-ক্যানিং-হাসনাবাদ এবং চন্দননগরের মতো বেশ কিছু অঞ্চলের কথা উল্লিখিত হয়েছে, এসব অঞ্চলের বাতাবরণ শহর ঘেঁষা। তবে উপন্যাসের ভূমিকায়, সমরেশ বসু লিখেছেন, আতপুর ও হালিশহরের মৎস্যজীবিদের সহযোগিতা না পেলে ‘গঙ্গা’ লেখা সম্ভব হতো না। উপন্যাসটিলেখার আগে অনেক মালো পরিবারের সঙ্গে দিনরাত্রি গঙ্গাবক্ষে কাটিয়েছেন তিনি। ‘গঙ্গা’ কিন্তু' শেষ পর্যন্ত- পাঠককে সমুদ্রে নিয়ে যেতে পারেনি, ‘গঙ্গা’ শুধু মাত্র গঙ্গাতেই থেকে গেছে, উপন্যাসের তাবৎ জায়গা জুড়ে পাঁচু খুড়ো এবং ভাইপো বিলাসের
উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়, তাদের কথোপকথন এবং গঙ্গার দৃশ্যাবলী ছিল প্রধান আর্কষণ। তারপর একদিন আমাশয় আক্রান্ত- হয়ে পাঁচু মারা যায় উপন্যাসের শেষদিকে, ঠান্ডরামও মাছের আকালের কারণে দুঃখ কষ্টে একদিন নদীতে ডুবে প্রাণ বির্সজন দেয়। বিলাসের তারপর থেকে মন আর বসেনি, সমুদ্রে যাওয়ার ইচ্ছে জাগ্রত হয়, হিমির প্রেরণা তাকে আরো উৎসাহিত করেছে কথাটা না বললেও অবিচার করা হয়। কিন্তু' সময়ের সঙ্গে ছুটে চলার যে প্রতিযোগিতা লক্ষ্য করা যায় তাও পাঠককে বিমোহিত করে। হিমি-বিলাসের প্রেম উপাখ্যানটিও চমৎকার বলতেই হয়,নদী আর মানুষের মধ্যে কতোখানি যে মিল তা ভাবিত করে এখানে। নদীর কাছে সবাই উদার হয়ে যায়, নদী তখন ভালোবাসার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে।
বড় প্রেম যে সবসময় কাছেই টানে না, অনেক সময় দূরেও সরিয়ে দেয়। গঙ্গা’র বিলাস-হিমির প্রেমের চিত্রটি একইভাবে অংকিত হয়েছে। বিলাস ফিরে গেছে ধলতিতার দিকে, এখানে একটু নাটকীয়তা লক্ষ্য করা গেলেও ভালোবাসা সব সময়ই সুন্দর তা চিত্রায়িত করেছেন সমরেশ।‘গঙ্গা’ উপন্যাসটি শেষ পর্যন্ত- গঙ্গা’য় সীমাবদ্ধ থেকেছে, সমুদ্রে যাওয়ার যে আকাঙ্ক্ষা এবং একত্রিশ হাত লম্বা সেগুন কাঠের বাছাড়ি নৌকা নিয়ে সমুদ্রে মাছ ধরার যে স্বপ্ন তা শুধুমাত্র স্বপ্নেই রয়ে গেছে বিলাসের। বিলাস সাঁইদার হয়েছে, শাবর নিয়ে সে রাইমঙ্গল ও ঝিল্লের মোহনায় অপেক্ষা করছে সমুদ্রযাত্রার মোহনায়। বাস-বে না দেখা গেলেও আসলে সে আবেগকে ছুঁয়ে যাওয়ার যে প্রয়াস তা পাঠক ভালোভাবেই অনুধাবণ করেছে, অর্থাৎ হিমিকে যেমন পাওয়া হল না তেমনি সমুদ্রেও যাওয়া হল না, শুধু একটা হাতছানি অথবা অন্যরকম অনুভূতি কাজ করেছে সর্বদা। জেলে জীবন মূলত গ্রাম নির্ভর, গঙ্গা উপন্যাসে ধীবরদের গ্রাম ভিত্তিক সমাজজীবনের পরিচয় খুব একটা অংকিত হয়নি, মালোদের স'স্থল জীবনের ছবি অল্প পরিসরে এসেছে, তাদের জলজ জীবনের বৈচিত্র্যই এখানে বিস্তৃতভাবে পরিলক্ষিত, নৌকার ওপরে কি ভাবে জীবন অতিবাহিত হয় তা দেখানো হয়েছে, তারপরও বিলাসের প্রথম যৌবনের টুকরো-টাকরা কিছু ছবির দৃশ্যাবলী আলোকপাত করা হয়েছে, যেমন কোনও এক উদ্ভ্রান্ত- দুপুরে অমৃতের তম্বী বউয়ের শরীরের ভাজে নিজের পুরুষত্বকে সর্মপণ করেছিলো বিলাস, তারপর থেকে ওর ভেতরে একটা চনমনে ভাব লক্ষ্য করা যায়। রমণীয় সুখ বা নেশা হয়তো একেই বলে, নিজেকে আর নিজের আয়ত্বের মধ্যে রাখতে পারেনি, সেই সুখের নেশা বুকে নিয়ে খুড়ো পাঁচুর সঙ্গে গঙ্গায় মাছ মারতে এসেছে বিলাস। তবে পাঁচু প্রত্যক্ষ করেছে, নিবারণের মতোই বিলাস দুর্বিনীত এবং স্পষ্টভাষী, কারো কথায় পরোয়া করে না, হিরো হওয়ার জন্য নয়, অন্যায় সহ্য করতে পারে না, তবে নিবারণ জাত মাছমারা হলেও যেদিন অন্যের ঘের থেকে মাছ চুরি করতো, সেদিনই হাতে কিছু পয়সা থাকতো, সেদিন বাজারে গিয়ে মদ খেতো এবং পতিতা পল্লীতে গিয়ে শরীর ও মনটাকে কিছুসময়ের জন্য তৃপ্ত করে ফিরতো, অথচ বিলাস মদ খাই না, যদিও দামিনী তাকে জোড় করে একবার খাইয়ে দিয়েছিলো, তবে নারী শরীরের প্রতি একধরণের আসত্তি পুরোদস্তুর'র ছিল, সেই লোলুপতা থেকে একরকম ভালোবাসা বাসা বাঁধে মনের কোণে, হিমিই প্রকৃতপক্ষে নায়িকা বলা অপেক্ষা রাখে না। উপন্যাসে চরিত্র অনেক থাকলেও খুড়ো পাঁচু-বিলাস হিমি-দামিনী ঘুরে ফিরে মূখ্যভাবে এসেছে, এদের জীবন নাটকই উপন্যাসের প্রাণ, নদীর মতো এগিয়ে গেছে বাঁকে, কোথাও থেমে থাকেনি, গঙ্গা’ যেন মহাভারতের সেই পবিত্র গঙ্গা। গঙ্গায় গোষ্ঠীবদ্ধ জেলে জীবনের নানা প্রসঙ্গে মিথ-পুরাণের কথা যেমন এসেছে, লৌকিক-অলৌকিক অনেক সংস্কার আছে, পৌরাণিক চরিত্রেরা কদাচিৎ জেলেদের সংলাপে আবার কখনো মালো সমাজের বর্ণনায় ছুঁয়ে গেছে, শান-নু-গঙ্গা, জগন্নাথ ঠাকুর, শ্রীকৃষ্ণ-রাঁধা, কালী ডাকিনী-বাসুকি প্রমুখ প্রতীকতায় ধীবরসমাজে লগ্ন হয়ে উঠে এসেছে ‘গঙ্গা’য়। দক্ষিণরায় তথা বনবিবিকে জেলের শবর থেকে দূরে থাকার মিনতি জানায়, মাছের দেবতা খোকাঠাকুরকে উদ্দেশ্য করে জেলে বউয়ের কাতর আকুতি,‘ তুমিই মাছমারার দন্ডমুন্ডের কর্তা, তুমি দিলে আমি আমার সোয়ামির হাসিমুখ দেখবো, ঘরে আমার সোহাগের বান ডাকবে, আমার ছায়েরা হেসেখেলে বেড়াবে, আমার হাঁড়ি ভরে থাকবে, নতুন সুতো আসবে, নতুন জাল বুনবো, আমি পুজো দেবো তোমাদের সকলের পায়ে’। মা গঙ্গা কৈবর্তদের পরম আরাধ্য, মাছমারাদের সারাবছরের ভাত কাপড় গঙ্গার কাছেই পাওনা, তাই গঙ্গা’য় প্রার্থনার বিষয়বস্তু', তারই দয়া-দাক্ষিণ্যে ধীবরদের অসি-ত্ব এবং জীবিকার সংস্থান। গঙ্গা জেলেদের একমাত্র ভরসা। তাই বিশ্বাস করে, জীবন-যৌবন,মরণ-টাকাপয়সা-ধনদৌলত বেঁচে থাকার সকল সুখ নিয়ে মা-ঠাকুরুণ বসে আছে গাঙের তলায় এবং তার কৃপায় বিশ্বসংসার চলে। মা-ঠাকুরুণ সকল সহায়, সে বাঁচতে বলে বাঁচা, মরতে বললে মরা।
নদীতীরের জীবনযাত্রার দৃশ্যাবলী বেশ কাব্যময় করে তুলে ধরেছেন, কোথাও কৃত্রিমতা নেই, যেন কলমের আগায় সাবলীল ভাবে তরতর করে বের হয়ে আসছে জীবনের কথা ও প্রতিচ্ছবি। শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন,“গঙ্গা’য় মৎস্যজীবী সমাজের অলৌকিক সংস্কার-বিশ্বাসে আবিষ্ট, নদীসমুহের জোয়ার-ভাটা আবর্ত প্রভৃতি প্রকট ও গোপন বিপদের সহিত অবিরত সংগ্রামে প্রতিনিয়ত মৃত্যু রহস্যের সম্মুখীন, জলস্রোত ও মনোস্রোতের বেগবান প্লাবনের মধ্যে অত্যাজ্য সংস্কার পরিণত জীবননীতির নোঙরে দৃঢ়সংবদ্ধ জীবনের অপূর্ব পরিচয়”।
‘আদাব’ গল্পের সেই মুসলমান মাঝির বিপন্ন মানবিক অস্তিত্বের প্রতি পরিচিত কণ্ঠস্বর, সেদিনের মতো আজো শুনতে পাই। সাহিত্যিকের যাত্রারণ - ছেচল্লিশের দাঙ্গা -মানুষে মানুষের হানাহানি এবং অপরিমিত রক্তপাতের জ্বলন্ত উদাহরণ সামনে রেখে, মোড়ল-মহাজনেরা ততক্ষণে দেশের ভাগবাটোয়ারার কুটিল পরিকল্পনা তলে-তলে সম্পন্ন করেছে, আর একজন শিল্পী চোখ মেলে দাঁড়িয়ে মানুষের স্বাভাবিক মানবিক আচরণের কথা ভাবছে, সে আচরণের চরমতম সত্য হল মানুষই শুধুমাত্র মানুষ।
সেই মানবিক ভাবনা থেকেই ‘গঙ্গা’ লেখা, সমরেশ বসু নিজেই বলেছেন, ‘উপন্যাসটি এক শিকারের কাহিনী, কিন্তু' অলক্ষ্যে চলে গেছে সেই বিবরণের ধারাবাহিকতায়। গঙ্গার বুকে মৎস্যজীবীদের সঙ্গে মাছ মারতে গিয়ে অন্যরকম এক উপলব্ধি জাগে, এবং সেই সময় ‘মাছ ধরা’ শব্দটি বড় বেমানান শোনায়, আর তাই মৎস্যজীবীদের আমিই অভিহিত করেছিলাম ‘মাছমারা’। আনন্দ বাগচীর একটি মন-ব্য, ‘খন্ড দৃষ্টিতে যে জীবন শুধুই জলের পাঁচালী, লৌকিক মহাকাব্য চাপা পড়ে আছে তারই তলায়। সমরেশ বসুর চোখে অবশ্যই সেটা এড়ায় নি, বহুবার ছুঁয়ে ছেনে-ছেঁদে দেখার মতোই এই নদী আর তার নাব্যজীবন তার অজানা ছিল না। এই মাছমারাদের হালেজালে হাত রেখে তাদের নাড়ীর স্পন্দন অনুভব করেছেন...”
নদী আর নারী দুই নিয়তির মতোই সমরেশকে চিরদিন বিপরীত আর্কষণে টেনেছে, নদীকে অবশ্য ব্যাপক অর্থে প্রকাশ করেছেন, জীবন যেখানে অতপ্রত ভাবে মিশে আছে, সেই জীবনের কথায় নদীর কাছে ব্যক্ত করেছেন কিন্তু' নারী সেই জীবনের এবং জীবনবোধেরই জ্বালানি। বারংবার আমরা তাই নদী আর নারীর কাছেই ছুটে আসি, জীবন যে এখানে চিরকালের বাঁধনে বাঁধা।
প্রবন্ধ সমগ্র
স্বাধীনতার
সঙ্কট
সুদীপ্ত বিশ্বাস
রাণাঘাট, নদীয়া, পশ্চিমবাংলা
১৮৯৮ সাল। বিচার প্রহসন সমাপ্ত হল। দামোদরের বিরুদ্ধে হত্যা অপরাধের চার্জ। পুনার প্লেগ অফিসার রান্ড সাহেবকে হত্যা করেছেন মহারাষ্ট্রের এই বিপ্লবী। বিদ্রোহী চাপেকারের মৃত্যুদণ্ড উচ্চারিত হল কোর্টে। সহাস্যে দামোদর বললেন, ‘এই মাত্র? আর কিছু নয়?’ নির্দিষ্ট দিনে দামোদরের কণ্ঠ রোধ করল ফাঁসির নির্মম রজ্জু। ঝুলে পড়ল তার মৃত্যুহীন দেহটি। এই ভাবে শুধু মাত্র একটি নয়, একই মায়ের বুক থেকে ঝরে গেল তিন তিনটি ভাই- দামোদর, বালকৃষ্ণ ও বাসুদেব চাপেকার- চাপেকার পরিবারের তিন তিনটি সন্তান। দেশ জননীর অপমান অসহ্য মনে হয়েছিল বলেই তারা প্রাণ উৎসর্গ করেছিলেন দেশ মাতৃকার পরাধীনতার বন্ধন মোচনের জন্য। তাদের সংগ্রাম ছিল স্বাধীনতার সংগ্রাম। সাদা চামড়ার বিদেশি মানুষের বিরুদ্ধে দেশি মানুষের সংগ্রাম।সে সংগ্রাম ছিল শক্তিশালীর বিরুদ্ধে দুর্বলের, শোষকের বিরুদ্ধে শোষিতের, পরাধীনতার বিরুদ্ধে স্বাধীনতার। চাপেকার ভাইদের মত প্রাণ দিতে হয়েছে বহু বিপ্লবী বন্ধুদের। কিন্তু কখনোই পিছপা হয়নি ভারতের যুবকেরা। এক জনের মৃত্যুর পর আরও দশ জন হাসি মুখে এগিয়ে এসেছে প্রাণ দান করার জন্য। কারণ, তখন তাদের মধ্যে জেগে উঠেছিল দেশাত্মবোধ। তখন ভারতবর্ষে ছিল পরাধীনতার সঙ্কট। আজ যুগ বদলেছে, স্বাধীন হয়েছে ভারতবর্ষ। কিন্তু সে আজ ভুগছে মানবিকতার সঙ্কটে যা থেকে সৃষ্টি হচ্ছে স্বাধীনতার সঙ্কট। যা আরও অনেক জটিল আর ভয়ংকর। কোনও রোগকে যদি ধরা যায় তবে তা নির্মূলও করা যায়। কিন্তু রোগ ধরা না গেলে তার দাওয়াই দেওয়া সহজ নয়। সে সময় শত্রু পক্ষ ছিল সাদা চামড়ার ইংরেজ। ইংরেজ দেখলেই বয়কট কর, বিদ্রোহ কর, যুদ্ধ কর- এই ছিল রীতি। ভারতবাসী সেটা বুঝতে পেরেছিল। তাই এসেছিল স্বাধীনতাও। কিন্তু তথাকথিত স্বাধীন ভারতবাসী আজও বুঝতে পারছে না স্বাধীনতাটা ধরে রাখা যাবে কিভাবে? তারা নিজেরাই নিজেদের কবর খুঁড়ে বসছে। এ ক্ষেত্রেও রোগটি ঢুকেছে ওই সাদা চামড়ার দেশ থেকেই। শুধু AIDS বা ডিভোর্স নয়। ভারতবর্ষকে গ্রাস করেছে ভয়ংকর পশ্চিমী ভোগবাদ। কনভেন্ট এডুকেশনের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি শিশুর মনেই ঢুকে পড়েছে ভয়ংকর ভোগবাদ। ছোঁয়াচে এই রোগ খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে যারা কোনও দিন স্কুলে যায়নি তাদের মধ্যেও। আজ ভারতের মানুষ সবাই ভোগী। তারা চর্ব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয় ভোগ করতে চায়। এনজয়, এনজয়টাই আজকের ভারতের মূল মন্ত্র। টাকা, টাকা চাই। আজকের ভারত সকালে ঘুম থেকে উঠে বলে - টাকা চাই। সারাদিন হন্যে হয়ে ছোটে টাকার পিছনে। রাতে ঘুমতে যাবার আগেও হাই তুলতে তুলতে বলে, টাকা চাই। কিন্তু স্বপ্নের মধ্যেও সে ধরতে পারে না তার অধরা টাকাকে। সত্যি করে বললে কত টাকা চাই, কত টাকা পেলে এই টাকার পেছনে ছোটা বন্ধ হবে সেটা জানে না একজন ভারতীয়ও। তাই তারা শুধু ছুটছে আর ছুটছে। এই ছোটাছুটিতে পরস্পরকে শুধুমাত্র ধাক্কাধাক্কি নয়, মেরে ফেলতেও পিছপা নয় ভারতবাসী। তাদের মানবিকতার ফাঁসি হয়ে গেছে অনেকদিন। সবাই চায় সবাইকে ঠকাতে। আর এই ঠকানোর জুয়া চুরিতে ঠকতে হয় সবাইকেই। মাছওয়ালা ঠকায় খদ্দেরকে। সেই খদ্দেরই তাকে ঠকায় যখন সে তেল বা চাল কিনতে তাদের দোকানে যায়। ডাক্তার ঠকান রোগীকে। সেই রোগীও ডাক্তারকে ঠকান যখন ডাক্তার গাড়িতে চড়েন, বাজারে যান, ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করান, ফ্ল্যাট কেনেন অথবা নেহাতই হাওয়া বদল করতে বেড়াতে যান অন্য কোনও জায়গায়। সব ভারতবাসীই আপ্রাণ চেষ্টা করেন তার কাছে অন্য যেই আসুক, তার গলা কাটতে। শুধুমাত্র রাজনৈতিক নেতা বা পুলিশেরাই তাদের চরিত্র হারান নি, চারিত্রিকভাবে সর্বস্বান্ত হয়ে গেছেন আমজনতা। প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়েছে ভোগবাদ আর দুর্নীতি। রং মিস্ত্রি, সাইকেল মিস্ত্রি, জুতো পালিশের কবলার, ঠিকে ঝি, ছাত্র, শিক্ষক, হেডমাস্টার, জমির দালাল, ইঞ্জিনিয়ার, পলিটিশিয়ান - সবার চরিত্র সমান। সবাই-ই দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। সবাই জানে রোগ একটা হয়েছে। কিন্তু এ যে সর্ষের মধ্যেই ভূত- থুড়ি- ভূতের মধ্যেই সর্ষে। ভেজালের পরিমাণটা বাড়তে বাড়তে এতটাই বেড়ে গেছে যে এখন, আসল বস্তুটি যে কি সেটাই বোঝা দায়। স্বাধীনতার যুদ্ধটা ছিল অনেক সহজ একটা অঙ্ক।
ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর, ব্যস। কিন্তু আজ এ যে নিজেদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। নিজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। যা খুব কঠিন কাজ। সেদিন এক বিশ্ববিদ্যালয়ের হতাশ যুবক অধ্যাপকের সঙ্গে কথা হল। জীবনের যাঁতা কলে ঠকতে ঠকতে এখন তিনি দ্বিধাগ্রস্ত। দুটি সন্তান তার। নিজে খুব সহজেই ম্যানেজমেন্টের থিওরির উপর লেকচার দেন এম. বি. এ’র ক্লাসে। কিন্তু কি শিক্ষা দেবেন তিনি তার নিজের কচি কাঁচা ছেলে মেয়ে দুটিকে? তাদেরকে কি শেখাবেন মানবিক বোধ সম্পন্ন মানুষ হয়ে উঠতে? বিবেকবান হতে? না কি তাদের কে শেখাবেন স্বার্থপর হতে, স্রোতের সঙ্গে ভেসে গিয়ে টাকা, টাকা করে হাই তুলতে? বিবেকবান হলে তোতাদেরকে জীবন ভোর ঠকতে হবে, সাঁতার কাটতে হবে স্রোতের বিরুদ্ধে। কোনও মা বাবাই কি চান তার সন্তানেরা জীবনভোর ঠকুক? কষ্টে থাকুক? কিন্তু চাপেকার ভাইদের মা চেয়েছিলেন। পরাধীন ভারতের বহু মা বাবা চেয়েছিলেন তার ছেলে রায়বাহাদুর না হয়ে বিপ্লবী হোক। দুধেভাতে না থেকে গর্জে উঠুক, হাসতে হাসতে ফাঁসির দড়ি গলায় পড়ুক। সে সময়ে মানবিকতার সঙ্কটটি আসেনি। মানুষ মনের অন্তঃস্থল থেকে ফকির হয়ে যায়নি। আজ লাখপতি, কোটিপতি, মিলিয়নিয়ার, বিলিয়নিয়ার-সবাই ফকির। তারা চায় তাদের ছেলেরা আরও অনেক টাকা আয় করুক। আরও লোক ঠকাক। একটি পদার্থের মধ্যে কিছু পরিমাণ অপদ্রব্য মিশে গেলে তাকে পৃথক করা যায়। কিন্তু পদার্থটির প্রতিটি পরমাণুই যদি বিষাক্ত হয়ে পড়ে তবে তাকে বিষ ছাড়া অন্য কিছু বলা যায় কি? আজ ভারতীয় সমাজটির হয়েছে শেষোক্ত পদার্থটির দশা। ভাষা, জাতি, ধর্ম, রাজ্য নির্বিশেষে গোটা ভারতের একই চিত্র। ভারত একটি ভোগী দেশ। ভারত একটি দুর্নীতিপূর্ণ দেশ। যে ভারত পৃথিবীকে শুনিয়েছিল উপনিষদের শান্তির ললিত বাণী- ‘ত্যক্তেন ভুঞ্জিথ্যা’, তার এই নৈতিক অবনমন সত্যিই অকল্পনীয়। পশ্চিমী হালকা ভোগবাদ সম্পূর্ণ গ্রাস করেছে ভারতের গোটা সমাজটাকে। মিথ্যে বলা ও লোক ঠকানো ভারতবাসীর সাধারণ ধর্মে পরিণত হয়েছে। যিনি মিথ্যে বলেন না বা কাওকে ঠকান না তাকে সর্ব ক্ষেত্রেই ঠকতে হচ্ছে পদে পদে। বিপদে তার পাশে দাঁড়াবার কেউ থাকে না। তিনি সমাজের চোখে বোকা লোক। আজকের ভারতে –An honest man is a stupid man.
একটি শিশুও জানে কিসে ভারতের মঙ্গল হবে আর কিসে হবে অমঙ্গল। কিন্তু গোটা ভারত বিশাল অজগরের মত জেগে ঘুমাচ্ছে। জাত-পাত ও ধর্ম ভিত্তিক সংরক্ষণ দেশের সব চেয়ে বড় শত্রু। কিন্তু ভোটের রাজনীতির যুগে দিন দিন বাড়ছে নানাবিধ সংরক্ষণের দাপট। দরকার, খুব দরকার এমন কিছু মানুষের যারা গলা উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করবে- রাজা তোর কাপড় কোথায়?
আমজনতা মনে করে সব দোষ শাসক দলের। শাসক দলটি বদলালেই সব কিছু ম্যাজিকের মত বদলে যাবে। আবার রাম রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। ফলে সবাই গর্জে ওঠে, পরিবর্তন, পরিবর্তন চাই। কি পরিবর্তন? না, নিজেরা সবাই দুর্নীতিগ্রস্থই থাকব, কিন্তু নতুন শাসক দল হবে ধোওয়া তুলসী পাতা। যা সত্যিই সোনার পাথর বাটি খোঁজার সামিল। সুতরাং পরিবর্তন প্রত্যাশী জনগণ নতুন শাসক দলের শাসনে কিছু দিনের মধ্যেই আবার বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে। এরপর গঠিত হয় আরও কিছু নতুন রাজনৈতিক দল যা আরও বেশি দুর্নীতিগ্রস্থ বলে প্রমাণিত হয় অল্প দিনের মধ্যেই। আসলে পরিবর্তনটি দরকার শাসক দলের নয়, জনগণের নিজেদের চরিত্রের। আম জনগণের মধ্যে থেকেই কেউ কেউ নেতা হন। সেই আম জনগণের চরিত্রই যদি কালিমা যুক্ত এবং ভোগ বাদে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়, তবে যিনি নেতা- তিনি শাসক বা বিরোধী যে দলেরই হন না কেন ,তিনি তো দুর্নীতিগ্রস্থ হবেনই। তিনি তো চুরি-চামারি, ডাকাতি, ধর্ষণ, রাহাজানি করবেনই, তিনি তো দেশটাকে বিক্রির ব্যবস্থা করবেনই। এতে অবাক হবারই বা কি আছে, হতাশ হবারই বা কি আছে?
যতদিন না ভারতবর্ষের আমজনতার মধ্যে ফিরে আসবে বিবেকবোধ, যতদিন না ভারতবর্ষের আমজনতা ভোগবাদ ত্যাগ করে পরস্পরকে ঠকানোর জুয়োচুরি বন্ধ করে পরস্পরের সহাবস্থানে বিশ্বাসী হবে, তত দিন পর্যন্ত যতই শাসক শ্রেণীর বদল হোক, গণভোট হোক, কোনও পরিবর্তন হবে না, চলতে থাকবে, চলতেই থাকবে এই মানবিকতার সঙ্কট তথা স্বাধীনতার সঙ্কট।
প্রবন্ধ সমগ্র
রহস্য রোমাঞ্চ কাহিনী -
সাহিত্য না অন্য কিছু
সুব্রত মজুমদার
হিউস্টন, টেক্সাস
সুব্রত মজুমদারের জন্ম কলকাতায়। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স এন্ড টেক্নলোজি, থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে তিনি পাড়ি দেন সুদূর আমেরিকায়। সেখানেই তাঁর পেশাগত জীবনের পাশাপাশি চলতে থাকে লেখালেখি। নানা ধরেনের ওয়েবজাইনে তাঁর লেখা ছাপা হয়েছে এবং তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করা ও ভিন্ন স্বাদের লেখাগুলি অগণিত পাঠকদের মনোরঞ্জন ও প্রশংসা অর্জন করেছে। লেখকের মূল বৈশিষ্ট্য তাঁর ভ্রমণ ও অ্যাডভেঞ্চার প্রিয়তা।
এক ধরনের উচ্চাঙ্গ বা ক্লাসিকাল সাহিত্য আছে যা কেবলমাত্র উচ্চস্তরের সাহিত্যরসিকেরাই প্রাণভরে উপভোগ করে থাকেন। তাঁদের সংখ্যা কিন্তু শতকরা কুড়ি জনের বেশি নয়। বাকি শতকরা আশিজন যে ধরনের বই পড়ে আনন্দ পান, তাকে উচ্চস্তরের সেই সাহিত্যরসিকেরা কদাচিৎ উচ্চাঙ্গ সাহিত্য বলে মূল্য দিতে চান। উইলিয়াম শেক্সপিয়ার ও আর্থার কোনান ডোয়েলের জনপ্রিয়তার তুলনা মূলক বিশ্লেষণ করলেই ব্যাপারটা বোঝা যায়। বাংলায় শরৎচন্দ্র আর শরদিন্দু ব্যাপারেও সেই একই কথা বলা যায়। সাহিত্যের মাপকাঠিতে কে কতটা ওপরে বা নিচে তার নিরপেক্ষ সমালোচনাও হয়ত করা হয়েছে বহুবার। আপাতদৃষ্টিতে রহস্য ও রোমাঞ্চ এর প্রধান উদ্দেশ্যই হল সাধারণ মানুষকে তাঁদের দৈনন্দিন ঘটনাচক্র থেকে ক্ষণিকের জন্য মুক্তি দেওয়া। যদিও তাঁদের নিজেদের জীবনের ধারা অতি সাধারণ কিন্তু একটা আশ্চর্য আর অসাধারণের খিদেয় এবং তৃষ্ণায় তাঁরা সর্বধা আপ্লুত হয়ে থাকেন। সেই প্রবল আকাঙ্ক্ষা থেকেই যে এই রোমাঞ্চকর সাহিত্যের জন্ম সে ব্যাপারে দ্বিমত থাকার কথা নয়। একটি ভাল রোমাঞ্চকর বইয়ের মাধ্যমে এই তীব্র আকুলতা অনায়াসে পূরণ হয়ে যায়। এই বইয়ের ভিতরে থাকে না মামুলি ঘটনার বিবরণ। এই গল্পের ইন্ধন নীরস আর একঘেয়ে নয়। সব কিছু অভাবনীয়, চাঞ্চল্যকর, মনোময় ও রোমাঞ্চকর। পাতায় পাতায় থাকে মাকড়শার জাল দিয়ে ঘেরা রহস্যের বেড়াজাল| সেই রকম বই হলে খুব অল্প খরচে এক অভূতপূর্ব জগতে নিমেষের মধ্যে চলে যাওয়া যায়।
রহস্যের প্রতি যে কোন মানুষের আকর্ষণ দুর্নিবার। কিছুটা হয়ত জন্মগত। শিক্ষিত অর্ধ শিক্ষিত আমজনতার মধ্যে খুব কম ব্যক্তিই আছেন যিনি রহস্য কাহিনীতে কৌতূহলী হন না, কিংবা রহস্য কাহিনীতে মগ্ন হয়ে যাননি। গোয়েন্দা গল্পের সর্ব প্রথম স্রষ্টা কে বলা শক্ত, তবে এটা হলফ করে
বলা যায় যে হাজার হাজার বছর আগে যখন মানুষের জন্ম হয়েছিল অপরাধ বোধের সূচনাও হয়েছিল একই সাথে। আর মানুষের মধ্যে যখন প্রথম অপরাধবোধ জাগল সমাজে ঠিক তখনই নির্ঘাত ভাবে আবির্ভাব হয়েছিল একাধিক গোয়েন্দার। আর সেই গোয়েন্দাদের ওপর গোয়েন্দাগিরি করার জন্য পায়ে পায়েএগিয়ে এসেছিল আর এক দল লোক। এনারাই হলেন গোয়েন্দা গল্পের লেখক। সমাজের সব মানুষই গোয়েন্দা গল্পের পাঠক কিন্তু সাহিত্যের সব সেবক এর লেখক নন। গোয়েন্দা কাহিনীর রূপরেখা অনুগমন করলে দেখা যাবে যে এই ধরনের গল্পের নিজস্ব এক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বা ছক আছে এবং সেই ছকটি অন্য সব গল্প আর উপন্যাসের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।
ক্লাসিকাল সাহিত্যের সেবকরা ঘোরাফেরা করেন মানুষের মনের সদর রাস্তা দিয়ে। যদি বা কখন ভুল করে সরু কোন গলিতে ঢুকেও পড়েন তা হলেও সেই গলি থাকে আলো দিয়ে সাজানো। গোয়েন্দা কাহিনীর লেখকদের ঘোরাফেরা মানুষের মনের সঙ্কীর্ণ গুপ্ত গলিতে যেখানে থাকে শুধু অন্ধকার। কদর্যতা, নোংরা, বিপদজনক এবং কুৎসিত এর আবরণে ঢাকা এই গলির ভিতরে যে বিস্ময় লুকিয়ে আছে তাকে অন্ধকার থেকে আলোয় টেনে বের করে আনার অসাধ্য সাধন করাই হল গোয়েন্দা কাহিনীর লেখকের মূলমন্ত্র। এই মূলমন্ত্রে পৌছনোর আগে পশ্চাদ-পটভূমিতে লেখক আর পাঠকের মধ্যে চলে প্রতিযোগিতামূলক এক বুদ্ধির লড়াই। এই প্রতিযোগিতায় জিত এর ওপরেই নির্ভর করে লেখকের সার্থকতা।
এই প্রসঙ্গে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎকার ও তাঁর মন্তব্যের নজির টানা খুবই দরকার। তিনি বলেছিলেন রহস্য রোমাঞ্চ সাহিত্য হিসেবে স্থান নিশ্চয়ই পেতে পারে। গল্পের বুনিয়াদ তো একই – মনুষ্য চরিত্র আর মানব ধর্ম। শুধু একটু রহস্যের গন্ধ আছে বলে সেটা নিম্ন মানের হবে কেন। নোবেল পুরস্কার পাওয়া অনেক লেখকও এই ধরনের গল্প লিখেছেন। ভাষা হল গল্পের মিডিয়াম| সেই মিডিয়াম যদি ভালো না হয় তবে গল্প বলাও ভালো হবে না। গোয়েন্দা গল্প হলেও সেটাও একটা গল্প বই তো নয়। সুতরাং গল্পকে মনোজ্ঞ করে বলতেই হবে। সাহিত্য মানুষের রুচি পাল্টায় না মানুষের রুচির বুনিয়াদের ওপর ভিত্তি করে সাহিত্য বদলায়? প্রশ্নটি যেমন শক্ত এর উত্তরটিও তেমনই। স্থান, কাল আর পাত্র ভেদে এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর আজও অজানা।
প্রবন্ধ সমগ্র
ঘাটালের ঐতিহ্যের
ইতিহাস ভাসাপুল
সনোজ চক্রবর্তী
পূর্ব মেদিনীপুর, পঃ বাংলা
সনোজ চক্রবর্ত্তী পেশায় স্কুল শিক্ষকতা। বানিজ্য বিভাগে স্নাতকোত্তর। ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখি। মুলত গল্পকার হলেও কবিতাও লিখেছেন বেশ কিছু। প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন পত্র পত্রিকাতে। লেখালেখি ছাড়া অন্যতম নেশা অভিনয় ও নাটক পরিচালনা।
ঘাটাল অবিভক্ত মেদিনীপুর তথা বর্তমানে পশ্চিম মেদিনীপুরের একটি মহকুমা শহর। সেই অর্থে নগর পরিসেবা না থাকলেও এ শহর অনেক প্রাচীন শহর। ঘাটাল শহরের প্রাণ শিলাবতী নদী, তবে কখনো কখনো ভারি বর্ষায় এ নদীই ঘাটালের প্রাণ সংশয় এর কারণ হয়ে পড়ে।
ইংরেজরা তখন আমাদের দেশ শাসন করছে। হয়তো তখনো রেলগাড়ি, যন্ত্র-শকট আবিষ্কৃত হয় নি। হয়তো আবিষ্কৃত হলেও তার প্রসার ঘটে নি। তখন কলিকাতা, হাওড়া, হুগলী জেলা সঙ্গে ঘাটাল সহ ঘাটালের পশ্চিমাঞ্চল ক্ষীরপাই, চন্দ্রকোনা, রামজীবনপুর, কামারপুকুর, গড়বেতা, পিয়ারডোবা, গোয়ালতোড়, শালবনি, সারেঙ্গা প্রভৃতি জায়গার যোগাযোগের একমাত্র উপায় শিলাবতী নদী। শিলাবতী নদী, বন্দর নামে একটি স্থানে দারকেশ্বরের শাখা নদী ঝুমী নদীর সঙ্গে মিলিত হয় ও এরপর নাম হয় রূপনারানণ। রূপনারায় রানীচক্, কোলাঘাট, তমলুক হয়ে এগিয়ে আসে গেঁওখালি। গেঁওখালিতে রূপনারায়ণ সঙ্গ পায় হুগলী নদীর। এই হুগলী নদীর পূর্বদিকে কলিকাতা আর পশ্চিম তীরে হাওড়া ও হুগলী জেলা। হুগলী-রূপনারায়ণ -শিলাবতী এই ছিল প্রধান পরিবহন পথ। এ পথেই সেকালে কলিকাতা থেকে প্রয়োজনীয় মালপত্র আমদানী হত ঘাটাল মারফৎ। আবার ঘাটাল সহ তার পশ্চিম দিকের বিস্তীর্ণ পশ্চার্ধ ভূমির উদ্বৃত্ত পণ্য রপ্তানির হতো কলিকাতা সহ নানা প্রান্তরে। ডিঙি, নৌকা, পানসি স্টিমার যোগে পণ্যের আমদানি রপ্তানি হতো। শুধু পণ্যই নয় যাত্রী পরিবহনের একমাত্র পথ ছিল শিলাবতী। আর সেই আমদা রপ্তানিকে কেন্দ্র করে, মূলত পণ্য ওঠা-নামার জন্য শিলাবতী নদীর তীরে গড়ে উঠেছিল অনেক ঘাট। সেই ঘাটের অপভ্রংশ হতে ঘাটাল নামের উদ্ভব হতে পারে।
যাইহোক অতীতে ঘাটাল ছিল ব্যবসা বাণিজ্যের এক প্রসিদ্ধ ভূমি। ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য অনেক মোকাম গড়ে উঠে ছিল ঘাটালে। রেশম শিল্প ও নীল চাষে উৎকর্ষ লাভ করেছিল ঘাটাল এলাকা। আর্মেনীয়, ডাচ, ইংরেজ, ফরাসী প্রভৃতি বিদেশীরাও নীল কুঠি স্থাপন করে ঘাটালে।এই সব কুঠিগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল ইংরাজ ব্যবসায়ী ওয়াটসন সাহেবের কুঠি। ওয়াটসন এন্ড কোম্পানির কুঠিটি ছিল বৃহত্তম রেশম উৎপাদন কেন্দ্র। ঐ কুঠিকে কেন্দ্র করে বাণিজ্য অঞ্চল কুঠিবাজার নামে পরিচিতি লাভ করে। কুঠিবাজার ছিল শিলাবতী নদীর পশ্চিম তীরে আর সাহেবদের বাসস্থান ছিল নদীর পূর্ব তীরে।
প্রতিদিনই সাহেবদের পূর্বতীরের বাসস্থান থেকে পশ্চিমের কুঠিতে আসতে হত। মাঝের নদীপথ ছিল ঝামেলার পারাপার। অপ্রসস্থ, শীর্ণ অথচ উত্তাল সেই জলস্রোতের উপর স্থায়ী সেতু নির্মাণের আধুনিক প্রযুক্তি তখনো সভ্যতার হস্তগত হয় নি।
সেসময় পারাপারের জন্য সাহেবরা শিলাবতীর উপর নির্মাণ করেন কাঠের পুল। যে পুলটি ভেসে থাকত নৌকোর উপর। জলস্তরের উঠা নামার সঙ্গে সংগতি রেখে পুলটি উঠত বা নামত। পুলটির ভাসমানতার জন্য এর নাম হয় ভাসাপুল। সাহেবরা ঘোড়ায় চড়ে ভাসাপুল হয়ে দিনের শুরুতে পূর্ব থেকে পশ্চিম আর দিন শেষে পশ্চিম থেকে পূর্বে যাতায়াত করত যাতায়াতের ঐ পথ ছিল কেবল সাহেবদের। এদেশের লোকজনের জন্য ঐ পথের লক্ষ্মণরেখা পার হওয়ার কোনো অনুমতি ছিল না। বিলাসী ভাসাপুল শুরুতে কেবল মাত্র বিদেশী সাহেবরা ব্যবহার করত।
পরবর্তী কালে বেঙ্গল ফেরী এ্যাক্ট ১৮৮৫ এর ৬নং ধারা অনুসারে, ১৯০৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর, পুলটি সাধারণের ব্যবহারের অনুমতি লাভ করে। স্বাধীনতা লাভের প্রায় তেরো বছর পর ১৯৬০ সালে শিলাবতী নদীর উপর আধুনিক প্রযুক্তির বিদ্যাসাগর সেতু নির্মাণ নিশ্চিত ভাবেই ভাসাপুলের চাপ কমিয়েছে। হয়তো তার উপযোগিতা নিয়েও আজ প্রশ্ন থাকতে পারে কিন্তু ঘাটাল বললে দৃশ্যপটে আজও প্রথমেই ভেসে উঠে ভাসাপুল। সুদীর্ঘ কাল ঘাটাল ও ঘাটাল-বাসির চরণে চরণে জড়িয়ে আছে বিলাসী কাঠপথ।
ভাসাপুল ঘাটালের ইতিহাসের এক উজ্জ্বল অধ্যায়। ঐতিহ্যের স্বর্ণালী স্মারক।
প্রবন্ধ সমগ্র
বাড়িয়ে দাও
তোমার হাত
সনোজ চক্রবর্তী
পূর্ব মেদিনীপুর, পঃ বাংলা
সনোজ চক্রবর্ত্তী পেশায় স্কুল শিক্ষকতা। বানিজ্য বিভাগে স্নাতকোত্তর। ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখি। মুলত গল্পকার হলেও কবিতাও লিখেছেন বেশ কিছু। প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন পত্র পত্রিকাতে। লেখালেখি ছাড়া অন্যতম নেশা অভিনয় ও নাটক পরিচালনা।
দাওয়ায় বসানো থাকত বেশ বড় একটা ডিবে, তার মধ্যে চাল। ডিবের মধ্যে হাত ডুবিয়ে মুঠো ভরে বের করতে হতো চাল। ছোট্ট হাতে মুঠো বড় করতে গিয়ে মুঠো আলগা হয়ে ছড়িয়ে পড়ত চাল। হাঁক শোনা মাত্র ভাই-বোনদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যেত কে আগে হাত ডোবাতে পারে ডিবেতে। সারা সপ্তা ধরে এলেও, ফি বুধবার ওরা দল বেঁধে আসত। ঘুরে বেড়াত বাড়ি বাড়ি কারণ বেস্পতিবার হাটবার, ঐ দিন হাট বসত নদীর পাড়ে। ভিক্ষা করে যে চালটু্কু পেত তার খানিক হাটে বেঁচে একটু নুন, একটু আলু, একটু ডাল কিনে নিত সুবিধে মতো। ওরা এলে যে ওদের চাল দিতে হয় তা শিখিয়ে ছিল বাড়ির গুরুজনেরা। মা-ঠাকুমার হাত জোড়া থাকলে চেঁচিয়ে ভিক্ষা দেওয়ার ফরমাশ আসত। সেই দেওয়া নেওয়াতে আনন্দ ছিল উভয়পক্ষের। চাল পেয়ে চকচক করত ওদের মুখ। আর যখন ওরা আমাদের মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করত-- "বড় হও বাবা,
অনেক অনেক বড় হও।" সে আশীর্বাদের জোর এতোটাই বেশি ছিল যে তখন সত্যি সত্যি বড় হওয়ার পথে কয়েক ধাপ এগিয়ে যেতাম যেন। এখন বুঝেতে পারি আমাদের ছোটবেলায় বড়রা যে আমাদের হাত দিয়ে সাহায্যটা পৌঁছে দিত সে তাঁদের হাত জোড়া থাকত বলে নয়।ছোটবেলা থেকেই পরিবারের এমনতর অনুশাসনে, অনুশীলনে ধীরে ধীরে নির্মাণ হতো চরিত্র।এখন বাড়িতে ভিখারী এলে চাল দেওয়ার রেওয়াজ নেই বললেই চলে। ওরাও নিতে চায় না। একটা জায়গায় এক টাকার কয়েন রাখা থাকে সেখান থেকে একটা করে তুলে নিতে বলা হয়। সতর্ক করে দেওয়া হয় একের জায়গায় যেন দুই না নেয়। সাহায্যটুকু হাতে তুলে দেওয়ার ফুরসত নেই।কারো সময় নেই অপরের দিকে তাকাবার। অপ্রতিহত গতিতে ছুটে চলেছি আমরা অসীম চাহিদা চরিতার্থে। ছোটদের সরিয়ে রাখা হয়, পাছে তাদের লেখাপড়া নষ্ট হয়,পাছে ঐ দুঃখী মানুষগুলোর থেকে জীবাণু না ঢুকে পড়ে। হেলথ-হাইজিনের হদ্দমুদ্দ। এর ফলে কায়েমি স্বার্থপরতা বাসা বাঁধতে থাকে শৈশব থেকে।
মানুষের বিপদে পাশে দাঁড়ানো, সাহায্য করার যে পাঠ আমাদের শৈশব পেয়েছে আজকের শৈশবের সিলেবাসে তার জায়গাই নেই। তার ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে চারপাশে এতো স্বার্থপরতা, অসহযোগিতা। সমাজটা ক্রমশ অসামাজিক হয়ে উঠছে।
প্রবন্ধ সমগ্র
সাচ্চা-ঝুটা
শাশ্বতী ভট্টাচার্য
ম্যাডিসন, উইস্কন্সিন
প্রথম দেখি অফিসের মিটিংয়ে। পিঁজা আর তার সাথে ডায়েট কোক। কি ব্যাপার? না হেলদী। এমনি কোকে তো অনেক চিনি, তাই ডায়েট কোক। শূন্য ক্যালোরি। হেলদী, স্বাস্থ্যকর।
-সিরিয়াসলী?
এর পরে এই শূন্য বা কম ক্যালোরির খাবার সব জায়গায় দেখতে শুরু করলাম। সভা-সমিতি, জলসা-ঘরে, বিবাহবাসরে। হোটেল-রেস্তোরায় তো বটেই।
সত্তরের দশকে যার স্থান ছিল মেডিসিন ক্যাবিনেটে তা ছড়িয়ে পড়লো রান্না ঘরে, এমনকি পানীয় জল খাবার কুঁজোতেও। আমার ডায়াবেটিক দিদা চায়ে স্যাকারীন মিশিয়ে খেতেন, তাই ওই কেমিক্যালটিকে আমার মা ঘরে মজুত রাখতেন, অবশ্যই তা থাকত আমাদের নাগালের বাইরে, ডেটল, বার্ণল আর এ্যনাসিনের সাথে। তবুও শান্তি ছিল, সেটা তখনও পূর্ন-বয়স্কদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।তারপর একদিন ওই শূন্য ক্যালোরিকে দেখলাম শিশুদের ব্যবহার্য খাদ্য-দ্রব্যে।
প্রিয় বন্ধুর রান্না ঘরে দুধ, ডিম, ময়দা, তেল, ইস্টের পাশে পাতার পর পাতার কৃত্রিম চিনির স্যাচেট। শুধু তাই নয়, কেকের সমারোহ বৃ্দ্ধি করার নানা রং-বেরঙ্গের আইসিং, ফ্রস্টিংয়ের যে সমাহার, তার উপরেও কালো -কালির বড়ো হরফে লেখা শূন্য ক্যালোরি কথাটা চোখে পড়লো।
- এইখানে এইগুলো কি রে? তোর ছেলে তো সবে দুই, আর মেয়েটা এই সেদিন থেকে স্কুলে যাচ্ছে? ওরা কি ডায়া...? বলতে বলতে থেমে গিয়েছি। এই রকম একটা অশুভ প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা আমার একান্তই অনুচিত নয় কি?
- আরে বলিস কেন? আমার মেয়ের খুব রান্নার সখ বুঝলি? এই বয়সেই ও যা রান্না করে না! নির্ঘাত এমেরিল লাগাসের ঠাকুরমা ছিল গতজন্মে। দেখ না দেখ, এই কুকি, এই কেক, এই প্যস্ট্রি বানিয়ে চলেছে। তারপর উইক-এন্ড হলো কি না, আসে পাশের গাদা গুচ্ছের সাদা-কালো সব বন্ধু–বান্ধবকে ঘরে ডাকবে..., ওই সব ডেসার্ট বানাবে, খাবে আর ঘরে বসে ভিডিও গেম খেলবে! আসলে ওর বাবারও তো ভিডিও গেমের শখ, তাই আমাদের বাড়িতে ভালো স্টক আছে। হইহই করে কথাগুলো বলে বন্ধু আমার দিকে তাকায়, সম্ভবত কিছু পড়েছে আমার ভ্রকুঞ্চনে, ...চিন্তা করিস না, ওগুলো সব জিরো ক্যলোরী। ভিডিও গেম খেলাটাতে তো তেমন কোন এক্সারসাইজ নেই! বুঝলি না? এক ঢিলে দুই পাখি।
--না। বুঝলাম না বন্ধু। কোনটা সত্যি কোনটা মিথ্যা, সাচ্চা-ঝুটা ঝুটা-সাচ্চা সব কি আমরা গুলিয়ে ফেলছি? এতো ঠিক মঙ্গলময় বার্তা নয়। আমি দীর্ঘশ্বাস গোপন করি। জিভকে নকল মিষ্টির স্বাদ পাইয়ে নয় তো ফাঁকি দেওয়া গেল, কিন্তু এই মিষ্টির ব্যপারটা জিভেই শেষ হয় কি? জিভ থেকে যে বার্তাটা মগজ মানে, যাকে আমরা ইংরাজীতে ব্রেন বলি তার কথা মনে রেখেছো তো বন্ধু? বার্তাটা পাওয়ার পর শরীরে অন্তত এক প্রকারের হরমোনের ক্ষরণ হতে পারে তার কথাটা মনে রেখেছো তো বন্ধু? সেদিন বলতে পারিনি।মাধুকরীতে আমার এই লেখাটা আজ তাই বন্ধু, তোমায় দিলাম।
বাজারে আরো তো চারটে স্বাদ আছে, তবে কেন মিষ্টির প্রতি এই আকর্ষণ? ব্যপারটা জটিল নয়, যদি মেনে নিতে পারি যে “মিষ্টি” শুধু মাত্র একটা স্বাদই নয়। কেন মিষ্টির দিকে আমাদের এই অপ্রতিরোধ্য ঝোঁক, তা বোঝার জন্য বেশী দূর নয়, মাত্র কয়েক মিলিয়ন বছর আগের কথা ভাবলেই চলবে।
জীবাশ্ম বিজ্ঞান অনু্যায়ী প্রায় ২.৬ মিলিয়ন খৃষ্টাব্দে মানুষের পূর্বসূরী Hominids এর দেখা পাওয়া যায়। যদিও Neolithic (New Stone age, আনুমানিক খৃষ্টাব্দ ১০,২০০ সাল) যুগকে মনুষ্য সভ্যতার শুরুর যুগ বলা যেতে পারে, বুঝতে হবে, তারও প্রায় ১৯০ হাজার বছর আগের Paleolithic (Old-Stone age) যুগে আজকের মানুষ বা Homosapien এর আবির্ভাবকাল। সবে বন্য জন্তু জানোয়ারের কবল থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য পাথরের ব্যবহার সে শিখেছে বটে, কিন্তু অন্য সমস্ত জীবিত প্রাণীর মতো নিছক প্রাণ ধারণের জন্য মানুষেরও দরকার ছিল খাদ্যের।
তার সেই অস্থায়ী যাযাবরের জীবনে না ছিল কোন বাসস্থান, না ছিল কোন নির্দিষ্ট খাবারের সরবরাহ, না ছিল বিশেষ একটা বাছ-বিচার করার পরিস্থিতি। তার বেঁচে থাকা, অথবানা-থাকা প্রধানতঃ কার্বোহাইড্রেট তথা গ্লুকোজের ওপর নির্ভর-শীল। নানা প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় সেই গ্লুকোজের রূপান্তরিত হয়ে তৈরী হবে এটিপি নামক এক অণু। যাবতীয় কাজ করার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তির মুদ্রা (Currency) এই অণুটি।
অতএব, বিবর্তনের সহজাত কর্ষণে মানুষ বুঝতে শিখেছে কিভাবে পরিশ্রমকে এক রেখে বেশী গ্লুকোজ তথা এটিপি পাওয়া যেতে পারে। মিষ্টি পাকা ফলটা তাই, কাঁচাটার থেকে অনেক বেশী বাঞ্ছনীয়। এইভাবেই সদ্য জাত শিশুর প্রথম খাদ্য মায়ের দুধে মিষ্টি এবং তা উপভোগ করার জন্য যেমন জিভে তার উপযোগী স্বাদ-কলিকা, ব্রেনেও তেমনি, চিনির সরসতায় নির্দিষ্ট আনন্দানুভূতি এসেছে। এর অন্য প্রান্তে অদূর ভবিষ্যতে অনাহারের সম্ভাবনায় যতটা প্রয়োজন ঠিক ততখানি খরচা করে বাড়তি গ্লুকোজকে ফ্যাটের আকারে গড়ে মজুত করে রাখার আয়োজন হয়েছে।
বন্ধু, বলা বাহুল্য এই ভাঙ্গা আর গড়ার কাজগুলি করার জন্য যার অবদান অপরিহার্য, তিনিই সেই সুপ্রসিদ্ধ ইনসুলিন হরমোন জগতের Swish army knife, কিম্বা সর্ব-ঘটের কদলী বৃন্ত। প্রাণী জগতে এই ভদ্রলোক ইনসুলিনটি বাবুটির আবির্ভাবকাল নিয়ে নানা গবেষণা থেকে বলা যায়, ইনি অতিবৃদ্ধ।
অন্তত পক্ষে মিলিয়ন বছর আগে তো বটেই, কেউ কেউ বলেন তার চেয়েও আরও আগে!
আজকাল দেখেছি অনেকে সাদা চাল, ওরফে ভাত পাউরুটি ইত্যাদি কার্বোহাইড্রেটকে শুধু কার্ব বলে ডাকেন (এবং বেশ ছিঃ ছিঃ কারও করেন)। ভুললে চলবে না চাল যেমন কার্বোহাইড্রেট, যে কোন ফল, সবজি, ডাল, দুধ, আলু, ভুট্টা, ওটমিল সব কিন্তু সেই একই।
কার্বোহাইড্রেট এক ধরণের অণুর বংশগত নাম। গ্লুকোজ এই কার্বোহাইড্রেটের গোত্রের সব থেকে সিধাসাদা সদস্য, এবং এই প্রবন্ধে একেই আমি সুগার, কিম্বা মাঝে মাঝে চিনি বলি ডেকেছি।
নানা বিপর্যয় থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রেখে, বনে জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে কার্বোহাইড্রেট আহরণ করার জন্য এবং তাকে ঠিক মতো ব্যবহার করার এই যে রীতিমতো এটা অখণ্ড (ফেল প্রুফ) একটা সিস্টেমের উদ্ভাবন হয়েছে প্রকৃতিতে, ভাবলে অবাক হতে হয়।
অতএব পাঠক, পাকা আমটি মুখে দিয়ে যে সুখ, সেই সুখ এক-দুই দিনের মামলা নয়, বিগত কয়েক শত হাজারের বছরের বিবর্তনের আমদানি। মিষ্টির আকর্ষণ তো শুধু মাত্র জিভেই সীমাবদ্ধ নেই, লাল টুক-টুকে স্ট্রবেরীটিকে তাই চোখে দেখেও সুখ! ওটা মুখে পড়লে ব্রেন যে “আহা আহ্ আহা” বলে জানান দিয়ে উঠবে। তুমি আমি বন্ধু তো নশ্বর মানুষ, মেরে কেটে একশো বছরের আয়ু। কৌতূহলী পাঠকের জন্য জানাই, পৃথিবীর যাবতীয় প্রাণীর যাবতীয় দৃশ্য বা অদৃশ্য কাজ করার জন্য প্রয়োজন এটিপির। সাধারণতঃ গ্লুকোজ (তথা অযৌগিক কার্বোহাইড্রেট) থেকে এটিপি উৎপাদন হয় বটে, তবে ফ্যাট এবং সবিশেষ প্রয়োজনে আমাদের শরীর প্রোটিন থেকেও এটিপি উৎপাদন করে, (তার আগে কিন্তু সেই প্রোটিন থেকে কোন প্রকারে গ্লুকোজ বানাতে
হয়) তবে সেটা কেন ঠিক অভিপ্রেত নয় আজকের প্রবন্ধে সেই আলোচনায় যাবো না। মিষ্টি শুধু খেতেই নয়, মিষ্টি নিয়ে লিখতেও সুখ। হ্যাঁ, আধুনিক মনুষ্য-সমাজ ঠিক এই রকম পরিস্থিতির কবলে।
বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে, রাসায়নিক পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে, আঁখ থেকে হোক, বা ভুট্টা দানা থেকে হোক, আমরা চিনিকে ঘনীভূত করতে শিখেছি। আর যেই না তা পেরেছি, আমাদের চেনা প্রায় সমস্ত খাদ্যে আমরা মিষ্টি দিতে শিখেছি, মুখে দেওয়ার মতো কিছু হলেই হলো, রুটি, পাউরুটি, ভাত, ডাল, মাংস, মায় ওষুধ...। A spoonful of sugar helps the medicine go down, in the most delightful way!
আর তার ফল? শিকারী খুদ ইহা শিকার হো গয়া!
বেঁচে থাকার তাগিদে যে গ্লুকোজ তথা মিষ্টির দরকার ছিল এবং তাকে ভালো লাগার এবং সংযতভাবে ব্যবহার করার যে উপকরণ বিবর্তনের রাস্তা ধরে আমাদের মস্তিকে, শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গে প্রোথিত হয়েছিল তা আজ এক আশ্চর্য আসক্তি হয়ে বহু মানুষের দূর্বিসহ জীবন এবং ক্ষেত্র-বিশেষে মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মিষ্টি বহু মানুষের কাছে অবিকল সিগারেট বা মদের মতো নেশাকারক এবং জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে সেই নেশায় এনারা আক্রান্ত। বলা বাহুল্য বাড়তি চিনি ইনসুলিনের প্রভাবে ফ্যাট বা বাড়তি ওজনে পরিণত হয়েছে এবং আদমশুমারি অনুযায়ী গত ২০১৫ সালে, সারা পৃ