top of page

প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা ​

সূচীপত্র
durga101.jpg
পুজো বার্ষিকী
১৪৩২
girl-surajit.jpg
maa durga.jpg

প্রচ্ছদঃ সুরজিত সিনহা

লেখক/লেখিকাবৃন্দ

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

উপন্যাস

Sudip Ghosal.jpg

আয়নায় দেখা 

জীবন

সুদীপ ঘোষাল

পূর্ব বর্ধ্মান, পঃ বঙ্গ

touch.jpg
আয়নায় জীবন

এক

ঝুলু স্কুলে যাচ্ছে। এখনকার মত গাড়িতে নয়। একটা ছাতা বগলে, কাঁধে ব্যাগ আর মুড়ির কোটো। তখন টিফিন বক্সও ছিল না। আমূল দুধের কৌটো খালি হলেই ঝুলু ধুয়ে পরিষ্কার করে নিত। তারপর ঝুলুর মা মুড়ির টিন থেকে আমূলের কৌটোতে মুড়ি আর মুসুরির ডাল ভিজে আর দুটো নারকোল নারু দিয়ে রাখতেন।স্কুল যাওয়ার সময় হলেই টমাটো আর আলু দিয়ে বানানো ঝোল আর পোস্তোর বড়া খেয়ে ঝুলু টিফিন বক্স ভরে নিত ঝোলা ব্যাগে। আর সেই আকাশঘেরা বড় ছাতা ছিল তার নিত্যসঙ্গী। এই ছাতা দিয়ে রোদ, জল থেকে বাঁচা যেত আর ছোটখাটো বিপদ এলে ছাতা দেখালেই ভয় পেত পিছনে লাগা ছেলেরা।

ঝুলু ঠিক দশটায় বেরোতো বাড়ি থেকে আর অর্পিতা দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করত ঝুলুর। অর্পিতা খড়ের চালের আড়াল থেকে হাত নাড়াত ঝুলুকে লক্ষ্য করে। ঝুলু ভয়ে সিঁটিয়ে যেত। কেউ দেখে ফেললে তার সাদা চরিত্রে দাগ পড়ে যাবে গ্রামে। তবু কি করে যে প্রেমের গোপনকথা সকলে জেনে যায় ঝুলু জানে না।

তারপর আল রাস্তা। ঝুলু প্রথমে তারপর লাইন দিয়ে দশজন হনহন করে হেঁটে চলেছে সকলে স্কুলে। স্কুল ছিল তিন মাইল দূরে। মাঝে একটা কাঁদর। গ্রীষ্মকালে কাঁদরে জল না থাকলেও বর্ষাকালে থৈ থৈ করত জলে। ঝুলু মনে মনে ভাবে, কারও পিঠে চেপে পেরিয়ে গেলাম কাঁদর। এবার সাঁতারটা শিখতেই হবে। সাঁতার শেখার জন্য কলাবাগানের পুকুরে রাধাচূড়ার ডালটার কাছে সে ঋণী। এই ডাল ধরে সে সাঁতার শিখেছে।

একদিন পুকুরে ঝুলু অর্পিতাকে দেখতে পায়। অর্পিতা বলে, এ মা তুমি সাঁতার কাটতে পারো না। এই বলে অর্পিতা ঝাঁপ দেয় জলে আর সাঁতার কেটে পেরিয়ে যায় পুকুর। ঝুলু অবাক হয়ে দেখে অর্পিতার ভিজে আঁটসাঁটো ফুটন্ত বোঁটাহীন কুঁড়ি। ঝুলু চোখ নামিয়ে আপনমনে সাঁতার শেখে। অর্পিতা নিশ্চুপ।

তারপর কেটে গেছে কয়েক মাস, বছর, কাল।

স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজ জীবন। তারপর চাকরি জীবনে ব্যস্ততার ভিড়ে স্মৃতির কুঁড়ি ফুল হয়ে ফুটে হারিয়ে গেছে বড় বাগানে। এখনও ঝুলুর বিয়ে হয় নি। কোনো মেয়েকে পছন্দ হয় না তার। ঠিক কার মত হওয়া চাই, বন্ধুদের এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না গ্রাম্য ঝুলু, শহুরে কায়দায়। সেই কুঁড়ি দুটো আজও খু্ঁজে চলে ঝুলু শহরের আনাচে কানাচে।

একদিন অফিস আওয়ারের পরে ঝুলু তার পুরোনো স্কুলের স্যারের বাড়ি যায়। এই স্যারকে ঝুলুরা পাই স্যার বলে ডাকত। পাই স্যারের ছেলে চাকরি পেয়ে তার বাবা মাকে নিয়ে শহরে থাকে। ঝুলু শুনেছে কথাটা দুদিন আগে। আজ সময় করে অফিস থেকে সোজা স্যারের বাড়িতে ঢুকলো। স্যার বললেন, তোমার নামটা কি যেন গো..

- আমার নাম ঝুলু রায়। স্যার আপনাকে আমরা পাই স্যার বলে ডাকতাম।

- হ্যাঁ আমার মনে আছে সব কাহিনী।

- হ্যাঁ স্যার। আমার বন্ধু, সৈকত, স্কুলবেলায় আপনাকে খুব ভালবাসত। সৈকতের অন্য বন্ধুরা বলত পাই স্যার। সৈকত বলত, এইরকম স্যার হাজার হাজার প্রয়োজন আমাদের শিক্ষার জন্য। আপনার নাম ছিল পাই স্যার। মার্চ মাসে বিজ্ঞানী আইন স্টাইনের জন্ম। এই বিজ্ঞানীর জন্মদিনে খুব মজা করে আপনি বিজ্ঞান বোঝাতেন স্যার। একবার পনি বলেছিলেন, ছোটবেলায় আমরা সৌরজগতের গ্রহগুলোকে সূর্যের থেকে কত দূরে শিখেছিলাম। পৃথিবীর থেকে সূর্য পনেরো কোটি কিলোমিটার দূরে। কিন্তু মুশকিল হল এই পনেরো কোটি কিলোমিটার’–টা কতদূর তার ধারণা আছে নাকি আমাদের? তোমার স্কুল আর মামার বাড়ির দূরত্ব কত, বলতো সৈকত।

সৈকত বলল, স্যার তিন’ কিলোমিটার হেঁটে স্কুল যেতে মিনিট কুড়ি লাগে। একশো কিলোমিটার দূরে মামার বাড়ি যেতে বাসে ঘন্টাখানেক লেগে যায়। অমর বলল, আমার মামা দিল্লিতে থাকেন। কলকাতা থেকে দিল্লীর দূরত্ব দেড় হাজার কিলোমিটার – প্লেনে যেতে লাগে ঘন্টা দেড়েক কি দুয়েক। আপনি, বললেন, তাহলে দেখ, এই একশো কিলোমিটার বা দেড় হাজার কিলোমিটার দূরত্বের সাথে আমাদের অভিজ্ঞতা দিয়ে একটা সম্পর্ক তৈরি হল। কিন্তু পনেরো কোটি? সেটা কত বড় সংখ্যা তা বুঝি নাকি? সুতরাং, সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্ব আমাদের কাছে একটা মুখস্থ করার সংখ্যা হিসেবেই রয়ে গেলো। অনুভূতি বা‘ইনটুইশন’–এ সাথে যুক্ত হল না। আবার এই দূরত্বের সাপেক্ষে পৃথিবী কত বড়, সূর্যই বা কত বড়, তাও মনের মধ্যে ছবি হয়ে রইল না! এই ধরণের নতুন তথ্যকে আমাদের অনুভূতির সাথে যুক্ত করা যায় অনেকভাবে। যেমন, একটা উড়োজাহাজ যার কলকাতা থেকে দিল্লী যেতে এক-দেড় ঘন্টা লাগে, তার কতক্ষণ লাগবে একই বেগে পৃথিবী থেকে সূর্য যেতে? উত্তরটা সহজেই দূরত্বকে গতিবেগ দিয়ে ভাগ করে পাওয়া যাবে – প্রায় সতের বছর! আবার ব্যাপারটাকে অন্যভাবেও ভাবা যায়। ধরা যাক, পৃথিবীর সাইজ একখানা পাঁচ সেন্টিমিটার ব্যাসের রাজভোগ কি রসগোল্লার মত। তাহলে এই স্কেলে সূর্য কত বড় আর কত দূরে হবে? অমর বলল, অঙ্কটা চট করে কষতে পারব ঐকিক নিয়ম লাগিয়ে। আপনি বললেন, হ্যাঁ পৃথিবীর ব্যাস মোটামুটি ১২,৮০০ কিলোমিটার, সেটাকে ছোট করে ৫ সেন্টিমিটার করে নাও। তাহলে পনেরো কোটি কিলোমিটার হবে ‘৫ সেন্টিমিটার X ১৫ কোটি / ১২,৮০০’ সমান প্রায় ৬০০ মিটার। এবার কিন্তু সৌরজগত সম্বন্ধে আমাদের একটা ধারণা তৈরি হল। মনে মনে একটা ছবি বানিয়ে নিলাম যে আমার টেবিলের উপরের রসগোল্লাটা পৃথিবী, আর মিনিট পাঁচ–ছয় হেঁটে গেলে সূর্যকে পাব। কিন্তু সূর্য তো বিন্দু নয়! তার ব্যাস প্রায় চোদ্দ লাখ কিলোমিটার। তাহলে আবার ঐকিক নিয়মে দেখে নেব যে আমাদের উদাহরণে সূর্য হবে প্রায় সাড়ে পাঁচ মিটার মানে মোটামুটি একখানা বড়সড় ঘরের মত। ঘরের মত চৌকো নয় অবশ্য, মোটামুটি গোলাকার। এইভাবে তিনি বিজ্ঞান বোঝাতেন সহজ করে। তারপর যখন বারো ক্লাসে পড়ি তখন স্যার একবার স্কুল ল্যাবরেটরিতে ক্লাস নিলেন। স্যার সিরিয়াস হয়ে পড়াচ্ছেন। প্রায় কুড়ি মিনিট পরে ক্লাসে সকলেই হাসতে শুরু করেছে। সৈকত ও তার বন্ধুরা তো হাসছেই। তার সঙ্গে হাসছেন, পাই স্যার। আমরা অবাক হয়ে হাসছি। হাসির কলরবের শব্দ পৌঁছে গেল হেড মাষ্টারমশাইয়ের ঘরে। তিনি একটি শক্ত লাঠি নিয়ে এলেন মারার জন্য। তিনি চিৎকার করছেন আর বলছেন, চালাকি হচ্ছে। এটা স্কুল না বাজার। স্কুলে হাসি চলবে না। ঘরে ঢুকে, হেড মাষ্টার মশাইও হাসতে লাগলেন। সৈকতরা অবাক। কি ব্যাপার হলো। এদিকে আপনি হাসতে হাসতে এগিয়ে চলেছেন একটা মোটা কাঁচের বোতলের দিকে। 

ঝুলুর স্যার বললেন, আমি দেখলাম বোতলের মুখ খোলা। লেখা আছে বোতলের গায়ে নাইট্রাস অক্সাইড। আমি বন্ধ করলুম ঢাকনা। তারপর দশমিনিট পরে হেডস্যারকে বললাম, স্যার লাফিং গ্যাসের বোতল খুলে ফেলেছে কেউ। তার ফলে এই হাসি। অমর বললো, স্যার হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে গেছে। কে যে বোতলটা খুলেছিলো তা আজ পর্যন্ত জানতে পারি নি। ঝুলু তুই জানিস নাকি? 

ঝুলু বললো, না স্যার, জানি না। তবে যেই খুলুক সে ভালো করেছিলো। তা না হলে এই সুন্দর স্মৃতি কোনদিন রোমন্থন করার সুযোগ পেতাম না।

কিছুক্ষণ পরে ঝুলুর স্যার একবার ঘরের ভিতরে গেলেন। ঠিক সেই সময়ে চা নিয়ে ঢুকলো হারিয়ে যাওয়া এক মুহূর্তের হাওয়া। ঝুলু চমকে উঠে বললো, তুমি এখানে, অর্পিতা?

- হ্যাঁ ঝুলুদা। তোমাদের স্যারের ছেলে অমলের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছে। তুমি বিয়ে করেছো ঝুলুদা?

-  না, আমার বিয়ে করার সুযোগ হয়ে ওঠে নি। শুধু খুঁজে বেড়িয়েছি কলাবাগানের পুকুর, ভিজে যাওয়া কুঁড়ি।

- আমিও ঝুলুদা, স্বপ্ন দেখি। আমিও ভুলতে পারি নি সেই ফেলে আসা পুকুরঘাটে পা ডুবিয়ে বসে থাকার স্মৃতি।

- তোমরা আর গ্রামের বাড়ি যাও?

- যাবো, দুবছর পরে দুর্গাপুজোর সময় বাবার পালা নবমী আর দশমীর দিন। আমাদের পাড়ার দুর্গাপুজোর আরতির সময় তুমি কাঁসর বাজাতে নেচে নেচে। কতবার তোমাকে আপন করে পেতে চেয়েছি তুমি ধরা দাও নি।

- তোমার ডাক বুঝতে আমার দশবছর কেটে গেছে। কি করব বলো। আমি তো চিরকালের হাবাগোবা ছেলে। তা না হলে আমার সব কিছু হারিয়ে যায় কেন?

- তোমাকে একটা প্রণাম করি, ঝুলুদা।

ইতিমধ্যে স্যার এসেছেন ঘরে। স্যার বললেন, তোমার গ্রাম তো কেতুগ্রাম? ঝুলু বললো, হ্যাঁ স্যার। আমি আপনার বৌমাকে চিনি। উনিও চেনেন আমাকে। স্যারের ছেলে অমল সুপুরুষ। অফিস থেকে সোজা ঘরে ঢুকে সোফায় বসে ঝুলুকে বললো, আপনাকে ঠিক চিনতে পারলাম না তো? ঝুলুর স্যার বললেন, ঝুলু আমার ছাত্র। আবার তোর শ্বশুরবাড়ি কেতুগ্রামে বাড়ি। বৌমাকে ঝুলু চেনে। স্যারের ছেলে ভিতরে চলে গেলে ঝুলু কেমন আনমনা হয়ে বললো, স্যার আমি তা হলে আসি। স্যার বললেন, আবার আসবে ঝুলু। তোমার সঙ্গে কথা বলে বেশ হাল্কা হলাম। ঝুলু স্যারকে প্রণাম করে অন্দরমহলের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বড় রাস্তায় হাঁটতে শুরু করলো।

পূর্ব বর্ধমান জেলার পূর্ব অংশে কেতুগ্রাম থানা। হিন্দু ও মুসলমানের মিলিত মেলায় গড়ে উঠেছে এই জীবন মাঠ। এই থানার অন্তর্গত অনেকগুলি গ্রামের এই ইতিহাস। এখানে সতীপীঠ আছে দুটি। একটি নিরোলের কাছে অট্টহাস আর দ্বিতীয়টি কেতুগ্রামের বহুলা মায়ের মন্দির। কতকগুলি বর্ধিষ্ণু গ্রাম এখানে আছে। নিরোল, পাঁচুন্দি। গোমাই, কেতুগ্রাম, পুরুলিয়া, কোপা, কোমডাঙ্গা, ভুলকুড়ি, চরখী, শিবলুন, বেলুন, অম্বলগ্রাম প্রভৃতি আরও অনেক গ্রাম নিয়ে এই বিশাল এলাকা। কেতুগ্রামের মসজিদের আজানের সুর ছড়িয়ে পড়ে এলাকার গ্রামে গ্রামে। সকলের মঙ্গলের স্বার্থে এই ব্যবস্থা। গঙ্গাটিকুরি গ্রামে আর পুরুলিয়া গ্রামে এখনও গেলে অনেক পুরোনো রাজবাড়ি দেখা যাবে। প্রতিটি গ্রামের আনাচে কানাচে মোগল সাম্রাজ্যের ইতিহাস ফিস ফাস করে কথা বলে। একটু অনুসন্ধানী মন নিয়ে এইসব অঞ্চলে এলে ইতিহাসবিদের মনস্কামনা পূর্ণ হবে বলে মনে হয়। এখানে আঞ্চলিক নদী আছে যার নাম ঈশানী। আর এক প্রিয় নদ আছে অজয়। এই অজয়ের তীরে কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিকের বাড়ি ছিল। নদীগর্ভে তলিয়ে গেছে অনেক গ্রাম অনেক বাড়ি। আর এতদ্ অঞ্চলের কয়েকজন মানুষের জীবন নিয়ে গড়ে উঠেছে এই কাহিনী।

দুই

গ্রামে গঞ্জে কত প্রতিভা নষ্ট হয়, কত প্রতিভার অকাল মৃত্যু ঘটে তার ইয়ত্তা নেই। মৃত্যু বলতে দেহের মৃত্যু নয়, প্রতিভার মৃত্যু। ফুটবল-ক্রিকেট সমস্ত ক্ষেত্রে এই পরিণতি দেখে শিউরে উঠতে হয়। হয়ত কোনো সংস্থা  থেকে মাঝে মাঝে খোঁঁজ চলে। কিন্তু তাতে সঠিক সন্ধান এর অভাব থেকেই যায়। তবু মাঝে মাঝেই ডুবুরির মত সন্ধান করে মহাপুরুষরা  খোঁজ করেন প্রতিভা।

বস্তি পাড়ায় থাকে লোকেশ। সে এখন ক্লাস সেভেনে পড়ে কিন্তু পড়ার থেকে খেলার দিকে তার ঝোঁক বেশি। কবাডি খেলা খোকো খেলা, ফুটবল ক্রিকেট সব কিছুতেই সে প্রথম সারির সদস্য। কিন্তু একটা মানুষ সর্বদাই পারদর্শী হতে পারে না। 

লোকেশ এবং তার বন্ধুরা কিশোরবেলায় খুব ক্রিকেট ম্যাচ খেলেছে। সে বলল রতনকে, একবার ঠিক করলাম আমরা বিল্বেশ্বর গ্রামের সঙ্গে ম্যাচ খেলব। ভাবাও যা তার কিছুদিনের মধ্যেই আমরা বিল্বেশ্বরের সঙ্গে ম্যাচ খেলা ঠিক করে ফেললাম। ছয় মাইল পায়ে হেঁটে যেতে হবে। আমাদের গ্রাম থেকে ছয় মাইল দূরে বিল্লগ্রাম। সেখানে আমরা হেঁটে চলে গেলাম ১১ জন আর একজন এক্সট্রা মোট ১২ জন। আর দর্শক আমাদের সঙ্গে ছাত্রদল ১২ জন। তারপর দুটোর মধ্যে পৌঁছে গেলাম বিল্বেশ্বর মাঠে। অজয় নদীর ধারে মাঠ। বেশ বড়। সুন্দর মাঠ তিনটের সময় খেলা শুরু হলো। ওপেন করতাম আমি আর টুলাদা। আমি এক দিকে। আর টুলাদা রানার থেকে কোনরকমে কাটানো হল দু ওভার। বেশ জোরে বল।জোর বলের চেয়ে ভালো বলছে ব্যাটিং। কোনরকমে একদিকে ঠেকােনো হলো আর একদিকে টুলাদা পেটাতে লাগলো।কুড়ি ওভার করে মাত্র খেলা। এর মধ্যে রান তুলতে হবে ভাল রকম। না হলে জেতা যাবে না।টুলা দা ছয় মারতে গিয়ে ক্লিন বোল্ড হয়ে গেল মিডল স্টাম্প উড়ে চলে গেল। তারপরে নামল নীলুদা। নীলুদা নেমে ৪,৬ মারতে লাগল। কিছুক্ষণ পরে নিলুদা আউট হয়ে গেল। আমি একদিকে কোনরকমে ধরে রেখেছি। টুকটাক করে রান নিয়ে কোনরকমে ধরে রেখেছি। তারপরে এরকম করে পরপর যারা মারতে পারে তারা নামছে। ৪,৬ মারছে আর আউট হয়ে যাচ্ছে। এরকম করতে করতে আমাদের প্রায় দুশ কুড়ি রান হলো। দু শ কুড়ি রানে অল ডাউন।এবার ওদের পালা। এবার ওরা ব্যাট করবে আমরা ফিল্ডিং করব। আমরা ফিল্ডার হিসেবে এবার মাঠে নেমে পড়লাম। যে যার নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়লাম। আমি উইকেটকিপিং করতাম। উইকেটকিপার হিসেবে আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। এবার ওদের দুজন প্লেয়ার নামলো। দুজন প্রথম বলেই ক্লিন বোল্ড। একদম উঠে গিয়ে উইকেটকিপার পিছনে গিয়ে পড়েছে। উইকেট গেল ভেঙে। আবার নতুন আনা হলো বাবু খুব ভালো জোরে বল করতে পারে। বোলারদের কাছে কেউ টিকতে পারেনা। শেষে দেখা গেল ওরা ১০০ রানের মধ্যে অল ডাউন হয়ে গেল। আমরা জিতে গেলাম। খুব হুল্লোড় হইহই চেঁচামেচি করলাম। মাঠের মধ্যে আমাদের মাস্টারমশাই সুধীনবাবু ছিলেন। তিনি বললেন দাঁড়াও তোমরা জিতেছো। তোমাদের জন্য পুরস্কার আছে। তার সঙ্গে সঙ্গে আমরা স্কুলের গেট পর্যন্ত গেলাম। একটা হাই স্কুল আছে সেটাই আমাদের স্কুল। সেখানে আমরা পড়াশোনা করতাম। সেই স্কুলের মাস্টারমশাই সুধীনবাবু, করলেন কি, একটা বড় হাঁড়ি করে এক হাঁড়ি রসগোল্লা আমাদের হাতে তুলে দিলেন। অজয় নদীর বাঁধ ধরে কিছুটা এসে মাঠে নামতে হবে। তারপর আমরা হেঁটে যাওয়ার রাস্তা ধরে হাটবো। একটা বট গাছের তলায় আমরা সেই এক হাড়ি রসগোল্লা নিয়ে বসে পড়লাম। সবাই খেলাম। পাশে একটা কল ছিল। সেই কল থেকে জল নিলাম। চাষীদের কল। সেইসব  কল থেকে তখন জল পড়ছিল। বোতলে জল ভরে আমরা খেলাম। খুব আনন্দ হয়েছিল সেদিন তারপর আস্তে আস্তে স্লোগান দিতে বাড়ি গেলাম।বিল্বেশ্বরকে হারালো কে? পুরুলিয়া ছাড়া আবার কে। বিল্বেশ্বর কে হারালো কে পুরুলিয়া ছাড়া আবার কে?

তখন শীতকাল পৌষ মাস। শুধু খেলা আর খেলা। আবার এক মাসের মধ্যেই আমরা ম্যাচ ধরলাম। পাশের গ্রাম বেলুনের সঙ্গে। বেলুনে আমরা ওখানে খেলতে যেত খুব ভালো লাগত। কাঁদরধারে একটা মাঠ। ইশানী নদীকে কাঁদর বলে ওখানে। আবার আমার ছোট পিসির বাড়ি। যাই হোক সবাই মিলে খেলতে গেলাম। একটা ছোট ছেলে ছিল তার নাম তাপস। তাকে প্রথমে ওপেন করতে নামানো হলো। সে ওদের কি ভীষণ রাগ। ছোট ছেলের সঙ্গে আমরা খেলব না আমরা যখন বললাম, ওকে আউট করে দেখাও?

ওরা জোরে বল করলো। তাপস আস্তে করে ঢুকিয়ে দিলো স্লিপারের মাঝে। একদম সম্মানজনক এক্সপার্ট ব্যাটসম্যানের মত। তখন ওরা অবাক হয়ে গেল। আমি বললাম আউট করতে পারবে না। তারপর তো আমরা আছি। এরকম ভাবে খেলতে খেলতে বেলুনকেও আমরা হারিয়ে দিলাম। বেলুন থেকে যখন আসছি তখন আমাদের শ্লোগান হলো বেলুন ফুটো করলো কে? পুরুলিয়া ছাড়া আবার কে। নীলুদা অধুনা ক্যানাডাবাসি। সেই ছোটবেলায় খুব মজা করত। বেলুন থেকে ফেরার সময় এক দাড়িয়ালাকে দেখে বলছে, এ বাবা দাড়ি দেখ। এক দাড়িওয়ালা দাদু খুব রেগে গেছে। বলছে কি অসভ্য তোমরা। কাকে কি বলতে হয় জানো না নীলুদা এইভাবে আমাদের সাথে থাকতেন এবং আমাদের আনন্দ দিতেন। এরপরে আমরা ক্রিকেট দলের সবাই চিন্তা করলাম যে, ভালো কাজ করতে হবে। রাস্তা, তখন মাটির রাস্তা। রাস্তার এক জায়গায় গর্ত ছিল। সবাই মিলে ওই গর্ত ভরাট করলাম। তারপর ঠিক করলাম, এবার গাছ লাগাতে হবে। প্রচুর গাছ বিডিও অফিস থেকে নিয়ে এলাম। নিয়ে এসে রাস্তার ধারে, শিশু গাছ, আমগাছ, দেবদারু গাছ লাগিয়ে ছিলাম। মনে আছে। সেই গাছগুলো এখন কতো বড় বড় হয়ে গেছে। কিন্তু সেগুলো তো সব পঞ্চায়েতের অন্তর্গত হয়েছে। সেগুলোর উপর আমাদের অধিকার নেই ঠিকই। কিন্তু সকলের সুবিধার জন্য আমরা সেই গাছ লাগিয়ে ছিলাম। এখন সেই গাছগুলো দেখে আমাদের খুব আনন্দ হয়। নীলুদা বলতেন, পরের জন্য কাজ করে যে আনন্দ পাওয়া যায়, সেই আনন্দ আর কোথাও পাবি না। সেইজন্য মনে রাখবি সারা জীবন পরের উপকার করার চেষ্টা করবি। কোনদিন স্বার্থপরের মত শুধু নিজের কথা চিন্তা করবি না। গাছ লাগানোর নেশা আমাদের ভূতের মত পেয়ে বসে ছিল। আমরা গাছ লাগাতাম বিডিও অফিসে প্রচুর গাছ পেতাম। এনে লাগাতাম একদম রাস্তার ধারে ধারে। সেনপাড়া তালাড়ি গ্রামে। এখন গাছগুলো বড় বড় হয়ে গিয়ে তারা আমাদের সেই ছোটবেলার স্মৃতি মনে পড়িয়ে দেয় । আমরা সেই ক্রিকেটদল ছোটবেলা থেকেই নাটক, তারপর যে কোন অনুষ্ঠান, ২৫শে বৈশাখ  পালন করতাম। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন আমরা একটা ছোট্ট স্টেজ বানিয়ে সুন্দরভাবে পালন করতাম। প্রথমে গান গাইতো আমাদের পাড়ার মৌসুমী। তারপরে আবৃত্তি করত নয়ন। আরো অনেক ছেলে ছিল। তাছাড়া আমাদের ক্রিকেট দলের সবাই আমরা দেখাশোনা করতাম সকলকে। আমরা এইসব কাজ করতাম। তারপর রবীন্দ্র জয়ন্তী পালনের শেষে আমরা সবাইকে একটা করে কেক খেতে দিতাম। আমরা নিজেরাই চাঁদা তুলে কেক কিনে নিয়ে আসতাম।আমাদের দলে আমি মিলু বিশ্বরূপ এই তিনজন একসাথে সব সময় থাকতাম। আমরা তিনজন মোটামুটি দলটাকে পরিচালনা করতাম। তাই আমরা কোন অসুবিধা হলে কারো কাছে চাঁদা চাইলেই সহজেই পেয়ে যেতাম। একবার বন্যায় সব মাটির ঘর বাড়ি ভেঙে গেছিলো। আমাদের হাজরা পাড়ায়। তখন আমরা চাঁদা তুলে সেই পাড়ায় সকলের দেখাশোনা করেছিলাম। বন্যায় দু-চারজন ভেসে যাচ্ছিল। আমরা নৌকা করে তাদের হাত ধরে ছিলাম। এই সব স্মৃতি এখনো মনে পড়ে। মনে পড়লে খুব আনন্দ হয়। গর্ব হয় আমাদের কিশোরদলের।

স্কুলের শিক্ষক মহাদেববাবু একদিন লোকেশকে ডেকে বললেন আমাদের স্কুলের একটা ম্যাচ আছে তোকে খেলতে হবে। 

লোকেশ বলল, স্যার কি খেলা?

স্যার বললেন তোর প্রিয় খেলা, সেটা হচ্ছে ক্রিকেট এবং এই ক্রিকেট খেলায় তুই যদি আমাদের স্কুলকে জেতাতে পারিস তাহলে  তোকে একটা আমি পুরস্কার দেব। 

পরের দিন পুরো রেডি হয়ে লোকেশ মাঠে চলে গেল একঘন্টা আগে। মহাদেববাবু নিজে খেলার মাষ্টার। মাস্টারমশাই ভালো খেলেন এবং ভালো প্রশিক্ষক। লোকেশকে ওয়ার্ম আপ, করার জন্য বললেন। তিনি বললেন, খেলার আগে শরীরটাকে একটু চাঙ্গা করে নেওয়ার প্রয়োজন আছে। নানা রকম কসরত মহাদেববাবু দেখালেন স্কুলের টিমকে। 

এবার খেলা শুরু হলে, দুই দলের ক্যাপ্টেন হাতে হাত মেলালো। লোকেশের টিম টসে হেরে গেল। কেতুগ্রামের স্কুল ব্যাটিং নেওয়া স্থির করল। প্রথম ওভারের খেলা শুরু হল। লোকেশের বন্ধু শ্যামল বল করছে। প্রথম বলে কোনরকমে ঠেকিয়ে দিল ব্যাটসম্যান। পরের বলে দুই রান নিল কেতুগ্রাম দলের স্কুলের ওপেনার। 

খেলার মাঠের বাইরে দাঁড়িয়ে অসংখ্য দর্শক। দর্শকরা হাততালি দিয়ে চিৎকার করে উঠছে। খেলা খুব জমে গেল। কেতুগ্রাম স্কুল মোট ১৮০ রান করে মাঠ ছাড়লো। কুড়ি ওভারের খেলা। এই কুড়ি ওভারের মধ্যে মহাদেববাবুর স্কুলের দলকে এই রানের বেশি করতে হবে, জিততে হলে। 

লোকেশ বলল, স্যার আমরা সহজেই ১৮০ রান তুলে নেব। তার থেকে বেশি তুলব। মহাদেববাবু বললেন, ওভার কনফিডেন্স খুব ভালো নয়। ওরাও ভালো খেলবে, ওদের বল ভাল হয়। তোদের জিততেই হবে। এই খেলাটায় তোর পরীক্ষা। এটা তুই যদি জিততে পারিস পরবর্তী খেলার জন্য আমি তোকে অনেক সাহায্য করবো। লোকেশের মন আনন্দে নেচে উঠলো। 

লোকেশ ভাবল, এতদিন পরে এসে একজন যোগ্য লোকের নজরে সে পরেছে। লোকেশ ওপেনার হিসেবে ব্যাট হাতে মাঠে নামলো। টেনিস বল দিয়ে খেলা হচ্ছে। বিপক্ষ দল প্রস্তুত। প্রথম বলে কোনো রান হলো না। আস্তে করে ঠেকিয়ে  আত্মরক্ষা করল লোকেশ। দ্বিতীয় বলে সপাটে মারলো ছয়। একেবারে মাঠের বাইরে বল।সবাই হাততালি দিয়ে উঠল। আম্পায়ার উপর হাত তুলে ওভার বাউন্ডারির ইশারা করলেন অর্থাৎ ৬ রান। এবার বিপরীত দিকে ব্যাটসম্যান প্রথম বলেই আউট হয়ে গেল। আবার একজন খেলোয়াড় এল। কিন্তু সেও ক্যাচ আউট হয়ে ফিরে গেল। পরপর চারটি উইকেট খুব তাড়াতাড়ি পড়ে গেল। লোকেশের জন্য মহাদেববাবুর কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। 

এরপর টি-ব্রেক। মহাদেববাবু এই সুযোগে দলের সবাইকে বললেন, ঠিকমতো খেলতে হবে, পরপর আউট হয়ে গেল। লোকেশকে রীতিমতো সঙ্গ দিতে হবে। তাহলেই হবে। লোকেশের মনে স্যারের কথাগুলো গভীর দাগ কেটে দিলো। বজরংবলীকে স্মরণ করে লোকেশ হাত খুলে পেটাতে শুরু করল। 

পরপর বাউন্ডারি, ওভার বাউন্ডারি মেরে লোকেশ নিজের দলের রান হুহু করে বাড়িয়ে দিল। মহাদেববাবু খুব খুশি হলেন। সকলে হাততালি দিতে লাগল। শেষে বিজয়ী দল হিসাবে লোকেশের দল পুরস্কার লাভ করল। 

মহাদেববাবু লোকেশকে জড়িয়ে ধরে বললেন, তুই প্রত্যেকদিন আমার কাছে চলে আসবি। আমাদের বাড়ির সামনে মাঠে গিয়ে তুই শুধু ক্রিকেট খেলা অভ্যাস করবি। তার সাথে শরীরচর্চার জন্য সাঁতার আর ব্যায়াম করবি। অন্য খেলা করবি না শুধু ক্রিকেট। ক্রিকেট তোর ধ্যান, জ্ঞান হবে। তোকে বড় হতেই হবে। 

বাড়ি যাওয়ার পথে মাস্টারমশাই লোকেশকে একটা বড় হাঁড়িতে রসগোল্লা কিনে দিয়েছিলেন উপহারস্বরূপ। লোকেশের বাড়ির সামনে একটা পুকুর আছে। বস্তি পাড়ায় পুকুরটা জলের উৎস। এরা পুকুরের জলে সকলে কাপড় কাচা, বাসন মাজার কাজ করে। আর কলের জল পানীয় জল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। 

লোকেশের বাবা খড়ের চাল ছাইয়ে রোজগার করেন সামান্য অর্থ। লোকেশের বাবা বারুই, মাটির ঘরের চাল খড় দিয়ে ছাইয়ে দেয়। ঘরামি দুই থেকে তিনফুটের মাটির দেওয়াল তৈরি করে ধীরে ধীরে। তারপর বারুই বাঁশ আর খড়ের সাহায্য নিয়ে চাল তৈরি করে। বারুইরা তবু খুব গরীব ছিল।সামান্য মজুরিতে সংসার চলত না। একটা প্রবাদ আছে, বারুই এর ঘরের চাল ফুটো থাকে চিরকাল । কবি জসিমউদ্দিনের নকশি কাঁথার মাঠে, বারুই নায়ক ছিল রূপাই। মাটির সহজলভ্যতা, প্রয়োজনীয় উপকরণ আর শ্রমিক খরচ কম হওয়ায় আমাদের দিনে মানুষ মাটির ঘর, খড়ের ঘর বানাতে বেশ আগ্রহী ছিল। এঁটেল বা আঠালো মাটি কাদায় পরিণত করে দুই-তিন ফুট চওড়া করে দেয়াল তৈরি করা হতো। ১০-১৫ ফুট উঁচু দেয়ালে কাঠ বা বাঁশের সিলিং তৈরি করে তার ওপর খড়ের ছাউনি দেওয়া হতো। মাটির দেয়ালের চারপাশ ঘিরে গ্রামের সৌখিন গৃহিণীরা মাটির দেয়ালে খাটুনি দিয়ে বিভিন্ন রকমের আল্পনা এঁকে তাদের নিজ বসত ঘরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতেন। এটা ও এক ধরনের আনন্দ ছিল আমাদের মাঝে। পূর্ব বর্ধমান জেলার খড়ের ঘরের কারিগর উদয়চাঁদ বলেন , এসব খড়ের ঘর তৈরি করতে আমাদের সময় লাগত মাসখানেক। স্বল্প খরচে তৈরি করা হতো এসব ঘর। এই আধুনিকতার দিনে খড়ের তৈরি এসব ঘর এখন আর চোখে পড়ে না। এই ঘরগুলো গরমে থাকার জন্য বেশ আরামদায়ক গরমের দিনে শীতল থাকে খড়ের ঘরগুলো। তাই এই ঘরকে গরিবের এসিও বলা হয়ে থাকে। আমাদের নবগ্রাম অঞ্চলে ৮০ থেকে ৯০ এর দশকে প্রতিটি বাড়িতে একটি করে হলেও খড়ের ঘর চোখে পড়ত। প্রায় প্রতিটি গ্রামেরই ছোট খড়ের ঘরগুলো ও ঘরের পরিবেশ সবার নজর কাড়ত। এ যেন এক রাজ্য। ঝড়, বৃষ্টি থেকে বাঁচার পাশাপাশি তীব্র গরম ও শীত থেকে বাঁচতেও এই ঘরের জুড়ি মেলা ভার। কিন্তু কালের বিবর্তনে দালানকোঠা আর অট্টালিকার কাছে হার মেনেছে চিরচেনা মাটির ঘর। এই ঘরগুলো একশো বছরের বেশি টিকত। এখন ইঁটের বাড়ি জনপ্রিয় হয়েছে। মাটির ঘর ও খড়ের চাল এখন কম দেখা যায়। লোকেশ পুকুরে সাঁতার কাটে। তারপর জিম করতে যায় বিকেলে। তার প্রচুর খিদে পায় কিন্তু সে খেতে পায় না। কারণ সে গরীব ঘরের লোক। লোকেশের ঘরে খাবার যা থাকে তা যথেষ্ট নয়, এ কথা কাউকে বলতে পারে না। কিন্তু বাবা-মায়ের সঙ্গে পান্তাভাত আর মুসুরির ডাল খেতে খেতে মাস্টারমশায় কথা ভাবে। স্যার বলেন, ভালো খেলোয়াড় হতে গেলে ভালো খাদ্য বস্ত্র বাসস্থানের প্রয়োজন আছে। বিকেলে খেলতে গিয়ে আজ লোকেশ ক্যাচ মিস করলো। মাস্টারমশাই বললেন তুই এই খেলাটা কে একদম মাটি করে দিলি। একটা ক্যাচ মিস করা মানে দলকে হারতে। সাহায্য করা ব্যাট করতে গিয়েও ১০ রানে আউট হলো। স্যার বললেন, কি ব্যাপার বলতো তোরা। এতো গাছাড়া ভাব কেন তোর? আজ তোর বাড়ীতে বাবা মার সঙ্গে দেখা করে আসব। 

লোকেশ মাষ্টারমশাইকে আজ বাড়িতে নিয়ে এসেছে। মাষ্টারমশাই অবাক হয়ে বললেন, তুই এই বস্তি পাড়ায় থাকিস? তোর ঘরের এই অবস্থা ঘরের চাল ফুটো। লোকেশকে বকাঝকা করার জন্য মাস্টারমশাই খুব আফসোস হলো। তিনি মনে মনে লোকেশের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করার বিষয়ে চিন্তা ভাবনা করতে শুরু করলেন। তিনি ভাবলেন এর সম্পূর্ণ দায়িত্ব তাকে নিতে হবে, তাছাড়া সে বড় হতে পারবে না । 

মাস্টারমশাই লোকেশের বাবা মায়ের পারমিশন নিয়ে লোকেশকে নিজের ঘরে নিয়ে এলেন এবং নিজের বাড়িতে একটা ঘর তার জন্য বরাদ্দ করলেন। তার জামা প্যান্ট প্রয়োজনীয় সমস্ত জিনিসপত্র কিনে দিলেন। আর খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা তিনি নিজেই করলেন। 

লোকেশের মা আর তার বোন আজ তিন দিন হল মামার বাড়ি গেছে। অনুপমা আর অসীমা বেড়াতে খুব ভালোবাসে। তারা স্কুলে ছুটি পরলে এদিক-ওদিক বেড়াতে যায়। কিন্তু স্যার লোকেশ কে যেতে দেন না। খেলার মধ্যে ব্যস্ত রাখেন। 

লোকেশন মা বলেন আমরা তো আমাদের ছেলেকে ভালোমতো খেতে দিতে পারিনা তবু তো মাস্টার মশাই এর কাছে গেলে ভালো খেতে পাবে পড়তে পাবে শুতে পাবে আর আমাদের এখানে চাল ফুটো চাল আনতে নুন আনতে পান্তা ফুরায় এই অভাবে বাজারেও খেলোয়ার হতে পারবে না বাবা। 

লোক এসে বাবা মা মাষ্টারমশাইকে অনুরোধ করলেন আমাদের ছেলেটাকে আপনি লিখিয়ে পরিয়ে যেমন করে হোক মানুষের মত মানুষ করে গড়ে তুলুন মাস্টারমশাই ভগবান আপনার মঙ্গল করবেন। 

প্রত্যেক দিনের মতো আজ রবিবার বিকাল বেলা মাস্টারমশাই এলেন। আরো পাঁচজন ছেলে মাঠে নেট প্র্যাকটিস করছে। লোকেশ ব্যাট ধরেছে আর রতন বল করছে। রতন এই এলাকার ভাল পিস বোলার। তাই তাকে মাস্টারমশাই আসতে বলেন প্র্যাকটিসের সময়। লোকেশ খেলছে ভালো তবে ক্রিকেটের একটা গ্রামার আছে। সেই গ্রামার না জানলে  ক্রিকেট খেলা যায় না। কখনো এক পা এগিয়ে কখনো দুই পা পিছিয়ে খেলতে হয়, বলে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখতে হয়, মাস্টারমশাই বলেন। যখন তোর আই সেট হয়ে যাবে তখন ঐ ছোট বলগুলো একটা ফুটবলের মতো মনে হবে, কোনমতেই তোকে কেউ বোল্ড আউট করতে পারবে না।

খেলার মাঠে মাস্টারমশাই যখন উপদেশ দেন তখন খুব ভালোভাবে শোনে উপদেশগুলো লোকেশ।মাঝে মাঝে  অপমানিত হতে হয় কিন্তু লোকেশ হাসিমুখে সহ্য করে। একটা দেবতার মত মানুষকে লোকেশ পেয়েছে নিজের জীবনে। এই সুযোগ আর হাতছাড়া করতে চায়না। মাষ্টারমশাই ক্রিকেট খেলার আইন প্রসঙ্গে বলেন, মাঠের মধ্যভাগে চতুর্ভূজ আকৃতির হবে যার দৈর্ঘ্য ২২ গজ ও প্রস্থ ১০ ফুট। মাঠ পরিচালনাকারী কর্তৃপক্ষ পীচ প্রস্তুত ও নির্বাচন করবেন। কিন্তু খেলায় ঐ পীচটি একবারই ব্যবহৃত হবে। এরপর পীচটি আম্পায়ারদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। আম্পায়ারদ্বয় খেলার উপযোগী পীচ নির্বাচন করবেন। যদি তারা মনে করেন যে পীচটি অনুপযুক্ত তাহলে তারা উভয় অধিনায়কের সম্মতিক্রমে পীচ পরিবর্তন করবেন। পেশাদার ক্রিকেটে সর্বদাই পীচ ঘাসযুক্ত হবে। কিন্তু নন-টার্ফ পীচের ক্ষেত্রে কৃত্রিম আচ্ছাদন সর্বনিম্ন দৈর্ঘ্যে ৫৮ ফুট ও প্রস্থে ৬ ফুট হতে হবে। অধিকাংশ সময়ই উইকেটে দুইটি সেটের একটি হিসেবে তিনটি স্ট্যাম্প ও দুইটি বেইল উইকেটের শেষ প্রান্তসীমায় রাখা হয়। প্রত্যেকটি কাঠের স্ট্যাম্প লম্বায় ২৮ ইঞ্চি হবে। স্ট্যাম্পগুলো ব্যাটিং ক্রিজে সমান দূরত্ব বজায় রেখে স্থাপন করতে হবে। প্রস্থে এর অবস্থান হবে ৯ ইঞ্চি । দুইটি কাঠের বেইল স্ট্যাম্পের উপরিভাগে থাকবে। বেইলগুলো স্ট্যাম্পের উপরে ০.৫ ইঞ্চির বেশি হবে না। বেইলের দৈর্ঘ্য হবে ১০.৯৫ সেমি। তবে কিশোরদের ক্রিকেটে উইকেট ও বেইলের দৈর্ঘ্য পৃথক হয়। যদি বাতাসের কারণে বেইল নিচে পড়ে যায় তাহলে আম্পায়ারদ্বয় বেইলবিহীন অবস্থায় খেলা চালাতে পারবেন। উভয় পীচের শেষ প্রান্তরেখার মধ্যাংশে স্ট্যাম্পকে উদ্দেশ্য করে তৈরী করা হয়। প্রত্যেক বোলিং ক্রিজের দৈর্ঘ্য সর্বোচ্চ ৮ ফুট ৮ ইঞ্চি। পপিং ক্রিজে ব্যাটসম্যানের অবস্থান নিশ্চিত করাসহ নো-বল নির্ধারণ করা হয়। পীচের উভয় প্রান্তেই বোলিং ক্রিজের সমান্তরালে মধ্য স্ট্যাম্পের উভয়দিকে কমপক্ষে ৬ ফুট হবে। রিটার্ন ক্রিজ মূলত বোলার কর্তৃক বল ডেলিভারির ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। এর দৈর্ঘ্য ৪ ফুট ৪ ইঞ্চি হবে। সচরাচর পীচে বল ফেললে বল বাউন্স নিবে। বলের এ আচরণের অধিকাংশই পীচের অবস্থার উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। এ প্রেক্ষিতে পীচের ব্যবস্থাপনার জন্য বিস্তারিত নিয়ম রয়েছে। এ আইনে কিভাবে পীচ প্রস্তুত করতে হবে, রোলিং ও রক্ষণাবেক্ষণ সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। বৃষ্টি কিংবা শিশিরস্নাত অবস্থা থেকে রক্ষা পাবার উদ্দেশ্যে গ্রাউন্ডসম্যান কর্তৃক ঢাকতে হবে। পূর্বেই উভয় অধিনায়কদের সম্মতিতে পীচের ঢাকা হবে। পীচের কোথায় বল পড়লে মারাত্মক ক্ষতিসাধিত হবে, বোলারের রান-আপে সমস্যা হবে কি-না তা যথাসাধ্য নজর রাখতে হবে।

মাষ্টারমশাই আরও বলেন, ক্রিকেটের অদ্ভুত নিয়মগুলির মধ্যে আরেকটি হল ফিল্ডিং টিম যদি ব্যাটসম্যানের আউটের জন্য আবেদন না করেন, তবে ব্যাটসম্যান আউট হলেও তাঁকে আউট দিতে পারেন না আম্পায়ার। এর মানে ব্যাটসম্যান লেগ বিফোর উইকেট অথবা রান আউট হলে আম্পায়ার তাঁকে ততক্ষণ আউট ঘোষণা করতে পারবেন না যতক্ষন না ফিল্ডিং টিমের কেউ ওই ব্যাটসম্যানের আউটের জন্য আবেদন করছেন। আধুনিক ক্রিকেটে এমন ঘটনা খুব কমই দেখা যায় যেখানে কোনও ফিল্ডিং টিমের আবেদন না করার কারণে কোনও ব্যাটসম্যান আউটের হাত থেকে বেঁচে গেছেন। যদিও এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে যেখানে ফিল্ডিং টিম আবেদন না করায় ব্যাটসম্যান আউট হয়নি। তাহলে আউটের আবেদন যেন জোরালো হয়, মনে রাখবে সবাই।

লোকেশের টিম জেলাস্তরে জিতে রাজ্যস্তরে চান্স পেয়ে যায় ভাল খেলার গুণে।

লোকেশের কলেজের বন্ধু অনেক। কলেজে সৈকত, স্কুলে স্যারদের মধ্যে আপনাকে খুব বেশি শ্রদ্ধা করত, ভালোবাসত। আপনার একটা ছদ্মনাম আমরা দিয়েছিলাম।

স্যার বললেন, সেকথা আমিও জানতাম। তোরা বলতিস, পাই স্যার।

সৈকত বলত, পাই স্যারের মত এইরকম বিজ্ঞানপাগল স্যার, হাজার হাজার প্রয়োজন আমাদের সুশিক্ষার জন্য। 

ঝুলু বলল, মার্চ মাসে বিজ্ঞানী আইন স্টাইনের জন্ম। এই বিজ্ঞানীর জন্মদিনে খুব মজা করে আপনি  বিজ্ঞান বোঝাতেন। আপনি বলতেন বিজ্ঞানী আইনস্টাইনও খুব রসিক মানুষ ছিলেন।

স্যার বললেন, হ্যাঁ ঠিক। একবার তাঁর জন্মদিনে, লাফিং গ্যাসের বোতলের ঢাকনা খুলে গিয়ে হাসাহাসির কান্ডটা মনে পড়ে তোর। সকলে হাসছি আমরা। হেডস্যার রেগে ঘরে ঢুকেই হাসতে শুরু করলেন। লাফিং গ্যাস নাকে ঢুকলে হাসি পায় সকলের। ঝু্লু বলল, হ্যাঁ, মনে পড়ে আজও।আপনিও হাসছিলেন। স্যার বললেন, আমি  দেখলাম বোতলের মুখ খোলা। বোতলের গায়ে লেখা ছিল, নাইট্রাস অক্সাইড, মানে লাফিং গ্যাসের বোতল। আমি বন্ধ করলুম বোতলের ঢাকনা। তারপর দশমিনিট পরে হেডস্যারকে বললাম, স্যার লাফিং গ্যাসের বোতল খুলে ফেলেছে কেউ। তার ফলে এই হাসি। ঝুলু বলল, স্যার হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে গেছিল। স্যার বললেন, কে যে বোতলটা খুলেছিলো তা আজ পর্যন্ত জানতে পারি নি। ঝুলু, তুই জানতিস নাকি? ঝুলু বললো, না স্যার,  জানি না। তবে যেই খুলুক সে ভালো কাজই করেছিলো। তা না হলে এই সুন্দর স্মৃতি রোমন্থন করার সুযোগটা আর পেতাম না।

মহাদেববাবুর বন্ধু ছিলেন এই পাই স্যার। তিনি বলতেন, আমাদের স্কুলের গন্ডি পার করে কলেজে লোকেশ ক্রিকেট খেলে রাজ্যস্তরে চান্স পেয়েছে। মহাদেববাবু বললেন, লোকেশ আমার বাড়িতেই থাকে। পাই স্যার বললেন, আমি সব জানি। আপনি না থাকলে লোকেশ এতদূর পৌঁছতে পারবে না।

লোকেশ খেলার ফাঁকে অবসরে বাইরে বেড়াতে যায়। স্যার বলেন, মন ভালো থাকলে, খেলা, পড়াশোনা সবকিছুই ভালো হয়। লোকেশ এবার বেড়াতে গেল মন্দারমণি। লোকেশরা  চারজন বন্ধু  দীঘা বেড়াতে গেলাম কলকাতার ধর্মতলা থেকে বাস ধরে। লোকেশ স্যারের মেয়েকে গল্প বলে মন্দারমণির। সে বলে, মন্দরমণি পৌঁছানোর পর বঙ্কিম আমাদের লজ খুঁজতে সাহায্য করল। তাকে তার পারিশ্রমিক দিয়ে আমরা লজের কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করে থাকা খাওয়ার সমস্ত ব্যাবস্থা করে নিলাম। পিনু, মিলু, বিশু ও আমি চারজনে একটি ঘর নিলাম। তারপরের দিন দীঘার দর্শনীয় স্থানগুলি ঘুরে দেখলাম।

রোশনি বলল, অমরাবতী লেকের সাথে ছোট একটি পার্ক ও একটি সর্প-উদ্যান আছে। নৌকা ভ্রমণের সুবিধাও আছেে।

মিলু বলল, জুনপুটে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের পরিচালিত মৎস্য দপ্তরের মৎস্যচাষ ও মৎস্য গবেষণাকেন্দ্র আছে। আমি জানি মন্দারমণি, কাঁথি থেকে ১২ কিমি দূরে অবস্থিত বালুকাভূমিটির নাম স্থানীয় মন্দার ফুলের নামানুসারে রাখা হয়েছে। লাল কাঁকড়া অধ্যুষিত জায়গাটি এখন অন্যতম জনপ্রিয় অবকাশ যাপন কেন্দ্র।

বিশু বলল, তাজপুর, মন্দারমণি ও দীঘার নিকটে অপর একটি পর্যটন কেন্দ্র তৈরী হয়েছে। এখানে একটি সমুদ্রবন্দরের কাজ চলছে। উদয়পুর, নিউ দীঘার পাশে উড়িষ্যার বালেশ্বর জেলা ও বাংলার সীমানায় উদয়পুর সমুদ্রতট। শিবমন্দির, চন্দনেশ্বর, দীঘার ৬ কিমি পশ্চিমে এটি অবস্থিত। বিশুর পরামর্শমত আমরা ঘোরাঘুরি করলাম, দুপুুর অবধি।

দুদিন পরে আবার আমরা অজানা আকর্ষণে মন্দারমণি গেলাম। এখানে কমবয়সি ছেলেমেয়েরা গাইডের কাজ করে আয় করে। পৌঁছানো মাত্রই একটি কমবয়সি মেয়ে এসে, আমাদের ঘর ভাড়া করার জন্য নিয়ে গেল একটা বাড়িতে। বাড়িটা ফাঁকা। মেয়েটি বলল, আমি মোবাইলে কথা বলে নেব ম্যানেজারের সঙ্গে। আপনার ঘরে মালপত্তর রেখে ঘুরতে চলুন। আমরা একটু ঘোরাঘুরি করলাম, এখানে ওখানে মেয়েটির সঙ্গে। বিশু বলল, তোমার নাম কি?

- আমার নাম হল হল রোশনি এখান থেকে দু কিলোমিটার দূরে একটা গ্রামে আমার বাড়ি। পিনু বলল, রোশনি, একদিন তোমার বাড়ি যাব।

রোশনিও আমাদের সঙ্গে ছিল। কিন্তু একটি মেয়ে যে আমাদের সঙ্গে আছে সেকথা জেনেও আমাদের মনে কোন প্রতিক্রিয়া হয় নি। রোশনি আমাদের অভিভাবিকার মত হয়ে গেল।

পিনুর কথায়, রোশনি সম্মতিসূচকভাবে ঘাড় নাড়িয়ে চলে গেল আড়ালে। বিশু বলল, মেয়েটা খুব ভাল। ওর কথাবার্তাও খুব সুন্দর। 

আমি বললাম, কি রকম লাগছে তোকে বিশু? প্রেমে পড়ে গেলি নাকি? প্রেমে পড়লে এরকম কথা বলে ছেলেরা। তোর কি সেরকম কিছু হল?

বিশু বলল, হতেও পারে। অসম্ভব কিছু নয়। আমাদের তো এটা প্রেম করার বয়স। তারপর সবাই আমরা হেসে উঠলাম ওর কথা শুনে।

তারপর ঘোরাঘুরি শেষে লাল কাঁকড়া দিয়ে ডিনার সেরে ভাড়া ঘরে এসে আমরা ঘুমিয়ে পড়ি। বিকেল হল। চা, বিস্কুট খেলাম। রাতের খাবারও পেলাম। সাদা আ্যপ্রনে ঢাকা একজন লোক এসে বলল, আপনারা শুয়ে পড়ুন। আমি বাইরের দরজা বন্ধ করে দিচ্ছি। তারপর রাত এগারোটা নাগাদ আমরা সকলে ঘুমিয়ে পড়লাম। প্রায় রাত দুটোর সময় পিনুর চিৎকারে আমাদের ঘুম ভাঙ্গে। পিনু বলল, একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে ছিল এখানে। মিলু বলল, হ্যাঁ, ঠিক কথা, একটা মেয়ে দেখলাম পিনুর খাটের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল।

বিশু বলল,মেয়েটা কেমন দেখতে?

পিনু বলল, আমরা যে মেয়েটাকে গতকাল দিনের আলোয় বালির চরে দেখেছিলাম, সারাদিন আমাদের সঙ্গে ছিল, এটা সেই মেয়ে রোশনিই ছিল।

আমরা বললাম ম্যানেজারকে, কি করে রোশনি ঢুকল ঘরে। দরজা তো বন্ধ ছিল।

ম্যানেজার বলল, বসুন আপনারা। দরজা বন্ধ থাকলেও ঢুকতে পারে রোশনি। মেয়েটি এখানে রোজ আসে। আপনাদের মত রোশনিও বেড়াতে এসেছিল বর্ধমান থেকে ওর বন্ধুদের সঙ্গে। তার বন্ধুরা মদ খেয়ে মাতাল হয়ে ওকে রেপ করে এই ঘরে। তাই কোন ছেলের দল বেড়াতে এলে ও দেখে নেয়, দলে কোন মেয়ে আছে কি না? গতবার একটা দলে দুটি ছেলে ও একটা মেয়ে ছিল। পরের দিন বালুচরে দুটো লাশ পাওয়া যায়। বদ উদ্দেশ্য নিয়ে কেউ বেড়াতে এলে ও তাদের হত্যা করে প্রতিশোধ নেয়। 

কাহিনী শুনে আমাদের আর ঘুম হলো না। নিজেরা ঘরে গিয়ে আলোচনা করলাম, আর এখানে না থাকাই ভালো। বিশু বলল, ভালোয় ভালোয় বাড়ি চলে যাওয়াই ভাল।

মন্দারমণিতে তখন মন্দার ফুলের গন্ধ বাতাস জুড়ে। রাতে বেশ লাগছিল। চাঁদের আলো আর ফুলের সৌরভ একাকার হয়ে গেছিল সে রাতে, রোশনির দীর্ঘশ্বাসে।

পরেরদিন আমরা ব্যাগ গুছিয়ে ম্যানেজারের ঘরে গেলাম। গতরাতের ঘর তো  নয় এটা, এঘরটা তো মাকড়সার জালে ভর্তি। রোশনিই আমাদের এই বাড়িতে এনেছে। রোশনি বাড়িতে ঢোকে নি কিন্তু ঘরের সব দরজা খোলা। পিনু বলল, অবাক কান্ড।

রাতে ম্যানেজারের সঙ্গে কথা হয়েছিল টাকাপয়সার ব্যাপারে। আর কোন লোককে আমরা এ বাড়িতে দেখি নি।

আমরা বাইরে এসে কয়েকজনকে দেখতে পেলাম চায়ের দোকানে। আমি বললাম, কাকু এই বাড়িতে আমরা দুদিন ছিলাম। ভাড়ার টাকা বা খাওয়ার মূল্য নেওয়ার লোক এ বাড়িতে নেই। কি করি বলুন তো?

লোকটি বলল, ওটা ভূতের বাড়ি। প্রাণে বেঁচে গেছেন, ভূতের খাবার খেয়েছেন, ভূতের সঙ্গে গল্প করেছেন। এখন বাড়ি যান। ও বাড়িতে পাশের গ্রামের মৃত রোশনির আত্মা পাহারা দেয়। ম্যানেজার ছিল, ওর ছেলে বন্ধু। রোশনি মরে যাওয়ার পর ওর প্রেমিক ম্যানেজারও আত্মহত্যা করে, গলায় দড়ি দিয়ে। তারপর থেকে ও এই বাড়িতেই থাকে। ওরা বেড়াতে এসেছিল এ বাড়িতেই। কতযুগের পুরোনো এ বাড়ি তা কেউ জানে না। তবে যারা সভ্য, ভ্রমণপিপাসু বা ভদ্রলোকদের কোন অসুবিধা হয় নি আজ পর্যন্ত। কোন খারাপ কাজ এ বাড়িতে হলে তার আর রক্ষা নেই। এরকম কত ঘটনা যে আছে তা বলে শেষ হবে না। যান, তাড়াতাড়ি যান, এই তো বাস এসে গেছে, চেপে পড়ুন। আমরা চায়ের দাম দিয়ে বাসে উঠে পড়লাম কম্পিত হৃদয়ে।

স্যারের মেয়ে অপরূপা লোকেশের সঙ্গে একই কলেজে পড়ে। সে বলে, এবার কোথাও বেড়াতে গেলে আমাকে তোমার সঙ্গে নিয়ে যাবে। আমিও তো তোমার বন্ধু। তুমি ইন্ডিয়া টিমে চান্স পেলে সবথেকে বেশি আনন্দিত হব আমি। লোকেশ বলে, আমি সেকথা জানি।

লোকেশ আজ বিকেলে মাঠে গিয়ে প্র্যাকটিশ করল টিমের সকলকে নিয়ে। খেলার আগে সকলের সঙ্গে বোঝাপড়াটা প্রয়োজন। তারা সকলে তৈরি হল। 

পরেরদিন বিকেলে ঝাড়খন্ডের মাঠে পৌঁছে গেল খেলার তিনঘন্টা আগে। তারপর খেলা শুরু হল।কুড়ি ওভারের খেলায় চ্যাম্পিয়ন হল বাংলার দল। প্রায় একমাস থাকতে হয়েছিলো হোটেল ভাড়া করে। মহাদেববাবুও ছিলেন কোচ হিসেবে।

মহাদববাবু লোকেশকে বললেন, এবার তোমার টার্গেট ইন্ডিয়া ক্রিকেট টীমে নিজের নাম এন্ট্রি করা। তিনি লোকেশকে বললেন, তুমি তো জানো, ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মতো পশ্চিমবঙ্গেও ক্রিকেট অত্যন্ত জনপ্রিয় খেলা। লোকেশ বলল, হ্যাঁ স্যার, ভারতের বৃহত্তম ক্রিকেট স্টেডিয়াম, ইডেন গার্ডেনস স্টেডিয়াম কলকাতায় অবস্থিত। এই স্টেডিয়ামের এক লক্ষেরও বেশি দর্শক খেলা দেখতে পারেন। বিশ্বে যে দু'টি ক্রিকেট স্টেডিয়ামে এক লক্ষ আসন রয়েছে, ইডেন গার্ডেনস তার অন্যতম। ইডেন গার্ডেনস পূর্বাঞ্চল ও বাংলা ক্রিকেট দলের কার্যালয়। ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের কলকাতা নাইট রাইডার্স দলের কার্যালয়ও কলকাতায়। শাহরুখ খানের মালিকানাধীন এই দলটি ইডেন গার্ডেনকে নিজস্ব হোম টার্ফ হিসেবে ব্যবহার করে। ক্যালকাটা ক্রিকেট অ্যান্ড ফুটবল ক্লাব হল বিশ্বের দ্বিতীয় প্রাচীনতম ক্রিকেট ক্লাব।

মহাদেববাবু বললেন, এই রাজ্য থেকে কত প্রতিভা ভারতের দলে ক্রিকেট খেলেছেন। তুমিও খেলবে। তুমি পারবে লোকেশ। নিজেকে ভাল করে তৈরি কর। লোকেশ বলল, আপনার আশীর্বাদ আমার সঙ্গে আছে। তাই আমার বিশ্বাসও মজবুত আছে।

স্যার বললেন লোকেশকে, বাংলা ক্রিকেট দল পূর্ব ভারতের একটি ক্রিকেট দল। বাংলা বর্তমান বিজয় হাজারে ট্রফি চ্যাম্পিয়ন। তারা ফাইনালে দিল্লির ফিরোজ শাহ কোটলা স্টেডিয়ামে সৌরভ গাঙ্গুলীর এর অধিনায়কত্বে মুম্বাই-কে পরাজিত করে।

লোকেশ বলে, মহারাজ সৌরভদা আমাদের গর্ব স্যার। তাঁর তুলনা মেলা ভার।

স্যার বললেন, ওসব খেলোয়াড় সাধনা আর আদর্শের নজির। বাংলার মাটির এই বীরকে শ্রদ্ধা জানাই গোটা বিশ্ব।

স্যারের কথাগুলো লোকেশের মাথায় রাতে বাজতে থাকে গানের মত। তারপর সে ঘুমিয়ে পড়ে, স্বপ্ন দেখে বড় খেলোয়াড় হওয়ার স্বপ্ন। লোকেশ একজন ভালো খেলোয়াড় হয়েও ন্যাশানাল টীমে সুযোগ পায় নি। লোকেশ প্রতিশ্রুতিবান ছেলেমেয়েদের ক্রিকেট খেলা শেখানোর ব্রত গ্রহণ করল।এখন সে নিজেই ক্রিকেট খেলার কোচিং সেন্টার খুলে খেলা শেখায় কিশোর আর তরুণদের। ইন্ডিয়া টীমে নাম একবার উঠলেও লোকেশ খেলার সুযোগ কোনদিন পায় নি। হঠাৎ ঘোষণা হয় তার পরিবর্তে অন্য খেলোয়াড়ের নাম। লোকেশ বলে, তা হোক, আমিও মাষ্টারমশায়ের মত ডুবুরির মত গ্রামের খেলোয়াড়দের তুলে আনব, মণিমুক্তার মত। লোকেশ তার সংস্থার নাম দিল, ডুবুরির খোঁজ।

এখন তার সংস্থার সকলেই গ্রামের খেলোয়াড়দের সন্ধানে ব্যস্ত থাকেন।

পরের দিন রবিবার। রঙিন সকাল। আকাশে মেঘের আনাগোনা। কাশের কারসাজি নদীর তীর জুড়ে। বন্যার জল নেমে গিয়েছে। পুজো পুজো ভাব। বিশু কাশফুলের ভিড়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে। কয়েকদিন হলো তাকে দেখা যাচ্ছে না। আমি ঘুরতে ঘুরতে পুজো বাড়ির ঠাকুর দেখতে গেলাম। সেখানে দেখি বিশু হাতে কাদা মেখে শিল্পীকে সাহায্য করছে। তিন দিন ধরে এখানেই তার ডেরা। এখন তার মনে বাজছে ঢাকের ঢ্যামকুড়াকুড়। মন মন্দিরে তার দুর্গা গ্রামদেশ ছাড়িয়ে অভাবি বাতাসে বাতাসে। পুজো বাড়িতে আমাকে দেখেও কোনো কথা না বলে হাঁটতে হাঁটতে বাইরে চলে গেলো। আমি জানি সে এখন চাল, ডাল নিয়ে সর্দার বুড়িকে রেঁধে খাওয়াবে। সে বলে, ওর যে কেউ নেই। ও খাবে কি? বিশুর বাবা বছরে একবার বাড়ি আসেন। তিনি ভারতীয় সৈন্য বিভাগে কাজ করেন। বাড়িতে এলেই বিশুর হাতে হাতখরচ বাবদ তিনি বেশ কিছু টাকা দিয়ে যান। সেই টাকা বিশু লোকের উপকারে কাজে লাগায়। বড়ো অবাক হয়ে ভাবি, ছোটো বয়সে এতবড় মন সে পেল কোথা থেকে? 

স্কুলের দূরত্ব অনেক বেশি হওয়ায় আমাদের চার বন্ধুর বাড়ির গার্জেনরা শলা পরামর্শ করে হোষ্টেলে থাকার কথা বললেন। দায়িত্ব নিলো বিশু। কিন্তু হেড মাষ্টারমশাই বললেন, সেশনের মাঝে হোষ্টেল পাবি না। ঘর ভাড়া নিয়ে চারজনে থাক। পরীক্ষা এসে গেছে। কাছাকাছি থাকিস তিনটি মাস। রেজাল্ট ভালো হবে। ঘুরে ঘুরে অবশেষে ভাড়া ঘর পেলাম। কিন্তু বাড়িওয়ালার পাশের প্রতিবেশি বললেন, সাবধান ওই বাড়িতে ভূত আছে। আমরা ভয় পেয়ে তিনজনে বলেুু উঠলাম, তাহলে অন্য ঘর দেখি চল।

বিশু বললো, টাকা দেওয়া হয়ে গেছে। ভূতের বাড়িতেই থাকবো। বিশু যখন সঙ্গে আছে, ভয় কি তোদের।

তার অভয় বাণী ভরসা করে আমরা মালপত্তর নিয়ে ঢুকে পড়লাম লড়াইয়ের কোর্টে। ক্যাপটেন বিশু বাড়িটা এক চক্কর পাক দিয়ে হাতে একটা লাঠি নিয়ে বললো, চলে আয় ভূতের বাচ্চা। আমরা ওর সাহস দেখে অবাক হতাম। রমেন বলে উঠলো, ভূতের শেষ দেখে ছাড়বো। জীবনের মরণের ভয় একটু বেশি। সে কাঁপা গলায় বলে উঠলো, যদি গলা টিপে ধরে ভূত। বিশু বললো, ভয় নেই, আমি একাই একশো। তোর কিছু হবে না। হলে আমার হবে। 

এই বাড়ির নিচু তলায় কিছু অসামাজিক লোকের কাজকর্ম বিশু এক সপ্তাহের মধ্যেই টের পেয়ে গেলো। তারাই এই ভূতের ভয় দেখায়। একদিন জীবন বাথরুম গেছে এমন সময় নাকি সুরে একজন বলে উঠলো, এঁখান থেকে পাঁলা। ঘাড় মটকে দেবো। আবার একদিন রমেন ভয় পেলো। ঠিক সেই বাথরুমে। বিশু তদন্ত করে দেখলো বাথরুমের ভেন্টিলেটার ভেঙ্গে একটা সরু দড়ি ঢোকানো হয়েছে। বাইরে গিয়ে দেখলো দড়িটা নিচের ঘরের বারান্দায় শেষ হয়েছে। বাথরুমে ভাঙ্গা কাঁচে টান পরলে বিকট আওয়াজ হয়। আর মুখ বাড়িয়ে মুখোশ পড়ে নাকি সুরের কথায় সকলেই ভয় পাবে। বিশু বললো সবাই তৈরি থাকিস। আজ রাতেই ভূত ধরবো। কুসংস্কার বিশুর মন আচ্ছন্ন করতে পারে নি কোনদিন।

আজ আর কেউ স্কুল গেলাম না। একটা উত্তেজনা রাতে জাগিয়ে রেখেছে। এবার সেই বিকট শব্দ। বিশু বাঘের মতো লাফিয়ে লাঠি হাতে নিচের তলায় গিয়ে জলজ্যান্ত ভূতের পাছায় লাঠির আঘাতে ভূতকে কাবু করে ফেললো। ভূত বাবাজি জোড় হাতে বলছে, ছেড়ে দাও বাবা আমি আর ওসব করবো না। ভূতের সঙ্গিরা সব পালিয়েছে, আমাদের হাতে লাঠি দেখে। বিশু বললো, যাও, যেখানে বিশু আছে সেখানে চালাকি করার চেষ্টা কোরো না। বিপদে পড়বে।

তারপর থেকে আর কোনোদিন ভূতের উপদ্রব হয়নি সেই বাড়িতে।

বিশুর বাহাদুরি দেখেই আমরা সাহসী হয়ে উঠেছিলাম। বিশুর সঙ্গে আমরা বেরোলে সকলের চোখেমুখে একটা সাহসের, শান্তির ছাপ ফুটে উঠতো। পাড়ার কোনো মানুষ বিপদে পড়লে বিপদের বন্ধু এই টাইগার বিশুকেই স্মরণ করতো। তার সঙ্গে আমরা তো থাকতাম অবশ্যই। রমেন, জীবন, বিশু, আমি একবার বন্যার সময় নৌকা করে মানুষের খাবার জোগাড় করতে চড়খী গ্রামে গিয়েছিলাম। হেলিকপ্টার থেকে চিড়ের বস্তা, গুড়ের বস্তা ফেলছে চড়খীর ব্রীজে যার আসল নাম কাশীরাম দাস সেতু। সেখান থেকে আমরা চিড়ে, গুড়ের পাটালি নৌকায় তুললাম। রমেন পেটুক। বললো, একটু টেষ্ট করলে হয় না। বিশু বললো, এখন এটা সকলের সম্পত্তি। যা হবে সকলের সামনে হবে। কেউ হাত দিবি না। এখন তাড়াতাড়ি চল। বান বাড়ছে। বিশু দাঁড় টানে আর আমরা সবাই সাহায্য করে নৌকা ও খাবার নিয়ে চলে এলাম নতুন পুকুরের পাড়ে। সেখানে বাড়ি বাড়ি সকলকে সমানভাবে খাবার ভাগ করে দিলো বিশু। তারপর আমরা বাড়ি এসে জীবনের মায়ের হাতের রান্না, গরম খিচুড়ি আর পেঁপের তরকারি খেলাম। অমৃতের স্বাদ। বিশু বললো, কাকীমা অনেক পেঁপে গাছ পড়ে গেছে বন্যার স্রোতে। আমরা আপনাকে অনেক পেঁপে এনে দেবো। সেবার বন্যায় পেঁপে, গ্রামের লোকের প্রাণ বাঁচিয়েছিলো। আমাদের গ্রাম অজয় নদীর ধারে।  গ্রামগুলিও খুব নীচুস্থানে অবস্থিত। নদীর নাব্যতা বা গভীরতা অল্প। ফলে বন্যা প্রায় প্রতি বছর দেখা দিয়ে যেতো। জল যখন কমে যেতো তখন তোতনের মা ও পাড়ার মা বোনেরা মাঠে মাছ ধরার জন্য যেতো। নানারকমের শাক, ঢোল কলমি, শুশুনি তুলতো। খুব ভালো লাগতো নানারকমের মাছ ভাজা খেতে। আমি দেখলাম, তোতনের মা মাঠ থেকে দুই তিন রকমের শাক তুলেছে। ওরা ভিটামিন বোঝে না, শরীরচর্চ্চাও বোঝে না। ওরা জানে খাটবো, রোজগার করবো আর খাবো পেট ভরে। মাঠেই পাওয়া যেতো বেশির ভাগ শাক, সব্জী। খলসে ও আরও নানারকমের মাছ মাঠের জলে সাঁতার কেটে বেড়াতো। বেলে, তে চোখো, চ্যাঙ, ছিঙুরি, গচিমাছ ছাড়াও ছোটো কাঁকড়া তাল কাঁকড়া পাওয়া যেতো। গর্তে হাত ঢুকিয়ে বিশু অনেকবার তাল কাঁকড়া বের করে আমাদের দেখিয়েছে। পাঁকাল, গুঁতে, কৈ, মাগুর, ল্যাটা প্রভৃতি অসংখ্য মাছ। বিত্তি পেতে দিতো স্রোতের মুখে। আর এসব মাছ জমিতে কীটনাশক প্রয়োগে আর দেখা যায় না। বিশু বলছে, খাল কেটে মাঝখানে বিত্তি পেতে জল যাওয়ার নালা কেটে দিতো। মাছ লাফিয়ে ওই গর্তে পড়তো। টানা জাল, পাতা জাল দিয়ে মাছ ধরতো। এখন তোতনের মায়ের জায়গায বৌমা মাঠে যায়। কিন্তু কৃষিকাজে সার, ওষুধ প্রয়োগ করার ফলে সেইসব মাছ ইতিহাসের পাতায় চলে গেছে। শাকপাতাও পায় না মা বোনেরা। এখন সব বাজারমুখী। তখন শাক আঁচলে করে নিয়ে গিয়ে বাউরীবউ মুড়ি নিয় আসতো চাষি বাড়ি থেকে। মাঠের টাটকা শাক সবাই নিতো জলের দরে। আজ আর টাটকা কিছু পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশুর কথা একশো শতাংশ সত্য। এখন আমরা বড় হয়ে গেছি। কিন্তু, স্বর্ণযুগের সেইসব স্মৃতি মনের মণিকোঠায় চিরদিন স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

তিন

এরপর চলে এলো ২৫শে বৈশাখ। দিনের বেলা বলা হলো সকলের বাড়িতে। দুপুরে ঘুমিয়ে নিলাম সবাই। তারপর সকলকে সঙ্গে করে বিশু চললো স্কুলে। কোমডাঙ্গার অলক চলে এলো আমাদের সঙ্গে। আলপথে হেঁটে চলে এলাম কাঙরা গাবা। সেখানে একটা কাঁদর। তার পাশে একটা ঝুড়ি নামা বটগাছ। দিনের বেলাতেই জায়গাটা অন্ধকার। বিশু বললো আমি রাতে ফিরবো। তোরা হষ্টেলে থেকে যেতে পারিস। আমি বললাম, না আমরা সবাই বাড়ি ফিরবো। বিশু বললো, তাই হবে।

তারপর কাঁদর পেরিয়ে চলে এলাম হেঁটে স্কুলে। তারপর কাজ শুরু হলো। বিশু ঘোষকের ভূমিকায়।বড় সুন্দর অনুষ্ঠান পরিচালনা করে বিশু। প্রথমে লীলা উদ্বোধনী সঙ্গীত পরিবেশন করলো, আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে"। তারপর সভাপতি নির্বাচন। প্রদীপ প্রজ্জ্বলন, প্রধান অতিথি বরণ হলো। সকলে কবিগুরুর গলায় মালা দিলেন। তাঁর সম্বন্ধে দু চার কথা বললেন। 

আমি বললাম, সভাপতি নির্বাচন আগে করলে হত না। বিশু বললো, জানি সব জানি। তবে কি জানিস, আমার প্রিয় কবির জন্মদিনে গঙ্গাজলে গঙ্গাপুজো করার মত তাঁকে আগে বরণ করলাম। বাংলার মাষ্টারমশাই বললেন, তুই বিশু যাই করিস আমাদের ভালো লাগে। চালিয়ে যা। তারপর নাটক হতে হতে রাত দশটা বেজে গেলো। বিশু তাড়াতাড়ি স্যারের হাতে দায়ীত্ব দিয়ে আমাদের কাছে চলে এলো। হষ্টেলে খাওয়া হলো। তারপর বেড়িয়ে পড়লাম বাড়ির উদ্দেশ্য।

আমরা দুটো হ্যারিকেন এনেছিলাম। রতন বললো, বিশু হ্যারিকেন দুটো জ্বালিয়ে নি। বিশু বললো, অনেকটা পথ। দুটো হ্যারিকেন একসাথে জ্বালাস না। একটা হলেই হবে। আমি সামনে থাকবো। আর সাপ খোপ আছে। সবাই পা ফেলবি পরিষ্কার জায়গায়।

তারপর বিশু সামনে আর আমরা পিছনে। বেশ দ্রুত হাঁটছি আমরা। খিড়কি পুকুর, বটতলার মাঠ, তেমাথার মাঠ পেরিয়ে আমরা চলে এলাম কাঙরা গাবায়। এখানে একটা কাঁদর আছে। ছোটো নদীর মত। এবার পার হতে হবে। আমরা গামছা পড়ছি এমন সময় দেখলাম অলোক প্যান্ট জামা পরেই জলে নামছে। বিশু বললো, অলক তুই সাঁতার জানিস না। পাকামি করিস না।

বিশু ছুটে গিয়ে অলোককে ধরতে গেলো আর সঙ্গে সঙ্গেই এক বিকট হাসি অলোকের মুখে। যে অলোক সাত চরে রা কাড়ে না সেই অলোক ভূতুড়ে হাসি হাসতে হাসতে কাঁদরের জলের উপর দিয়ে হেঁটে পার হয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলো। আমি বললাম, বিশু অলোক কই? বিশু বললো, এই কাঙরা গাবায় ভূত আছে। এসব তার কাসাজি। শুনে রতন ও আমি বু বু করতে লাগলাম ভয়ে। বিশু বললো, চল ওপাড়ে গিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি যাই। আমরা কাঁপতে কাঁপতে জল পার হয়ে ছুটে চলে গেলাম অনেক দূরে। বিশু বললো, হ্যারিকেন দুটো ফেলে এসেছি। চল নিয়ে আসি। আমরা বললাম, বিশু তোর পায়ে পড়ি বাড়ি চল। হ্যারিকেন চুলোয় যাক।

তারপর বিশু ও আমরা অলোকের বাড়ি গেলাম। বাড়ি যেতেই ওর বাবা বাইরে এলেন। বিশু বললো, কাকু অলোক ফিরেছে। কাকু বললেন, না তো। সে কোথায় গেলো। বিশু সব ঘটনা খুলে বললো।কাকু বললেন, চলো আমরা সবাই থানায় যাই। সেখানে একটা খবর দেওয়া দরকার। আমি জানি কাঙরা গাবায় তেনারা থাকেন। রাতে তোমাদের যাওয়া ঠিক হয় নাই গো।

থানায় মেজবাবু সব শুনে বললেন, কাল সকাল অবধি অপেক্ষা করুন। দেখা যাক লাশ পেলেই সব বোঝা যাবে।

বিশু বললো, ও মরে নি। হাওয়ায় উড়ে গেছে। মেজবাবু বললেন, ঠিক আছে। সব কথাই শুনে রাখলাম। দেখা যাক এটা নিশি ভূতের কাজ কি না?

থানা থেকে বেড়িয়ে আমরা সবাই অলোকের বাড়িতে থাকলাম আর বিশু চলে গেলো তার নিজের কাজে। ও বললো, সকালবেলা আমি আপনার বাড়ি চলে আসবো কাকু। আপনি চিন্তা করবেন না। নিশি ভূত কাউকে প্রাণে মারে না।

এই বলে সে চলে গেলো ডোম পাড়ার বুড়িমার কাছে।

কাকু বললেন, বিশু ঠিক বলেছে। আমার অলোক ঠিক ফিরে আসবে।

তখন কোনো মোবাইল ছিলো না। ল্যান্ড ফোন দু একটা বাড়িতে ছিলো। বিশু সকলের বাড়ি গিয়ে বলেছিলো, ওরা সবাই অলোকের বাড়িতে আছে। কাল দুপুরের খাবারের নিমন্ত্রণ করেছেন কাকু।বিকেলে সবাই চলে আসবে।

আমরা সবাই রাত জেগে গল্প করে কাটিয়ে দিলাম। অলোকের বাবা লিকার চা করে খাওয়ালেন। ধীরে ধীরে পূব আকাশে সূর্য উঠলো। সব ভয় সরে গিয়ে আলো ফুটে উঠলো।

সবাই আমরা উৎকন্ঠা নিয়ে বসে আছি। কখন আসবে বিশু। ঠিক সকাল দশটায় পুলিশের গাড়ি চলে এলো গ্রামে। আমরা সবাই অবাক হয়ে দেখলাম পুলিশের গাড়ি থেকে নামছে অলোক। এর মধ্যে বিশুও হন্ত দন্ত হয়ে আমাদের কাছে এসে বললো, যাক কাকু, অলোক এসে গেছে। মেজবাবু কাকুকে বললেন, এটাই আপনার ছেলে অলোক তো?

---- হ্যাঁ স্যার।

----আমাদের থানার আশেপাশে ঘুরতে দেখে ওকে নিয়ে এলাম। আমাদের স্থির বিশ্বাস ছিলো এটা অলোক। ওর মুখে সব কিছু শুনলে বুঝতে পারবেন ওর সমস্যা। যাই হোক, আমরা আসি।

পুলিশের গাড়ি চলে গেলো। প্রায় দুঘন্টা হলো অলোক ঘুমিয়ে আছে। দুপুর একটায় ওর ঘুম ভাঙ্গলো। বিশু জিজ্ঞাসা করলো, তোর কি হয়েছিলো বল তো অলোক?

অলোক বলতে শুরু করলো তার অলৌকিক কাহিনী।

সে বললো, আমরা সবাই যখন কাঙরা গাবায় কাঁদর পার হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি তখনই আমাকে খনা গলায় নিশি ভূতটা বললো, কি রে তোর বাড়ি গিয়ে ডাকলাম। সাড়া পেলুম না। তাই গন্ধ পেয়ে এখানে এলাম। চল আমার সঙ্গে তোকে হাওড়া ব্রীজ দেখিয়ে আনি। আমি বললাম, এই রাতে বন্ধুদের ছেড়ে আমি হাওড়া যাবো না। নিশিটা বললো, যা বলবো শুনবি। তা না হলে উঁচু থেকে ফেলে দেবো। আমি আর ভয়ে কথা বলিনি। নিশি আমাকে উড়িয়ে নিয়ে গেলো হাওড়া ব্রীজে। আমি ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছিলাম। তারপর যখন নিশিটা আমাকে নিচে নামালো তখন জ্ঞান এলো। নিশি বললো, কেমন লাগছে। কি খাবি বল। তারপর আবার বললো, গঙ্গার জলে সাঁতা কাটবি নাকি?

আমি বললাম, আমি সাঁতার জানি না।

নিশি বললো, আমি থাকলে ওসব কিছু দরকার হয় না। এই বলে আমাকে ওপর থেকে গঙ্গার বুকে ঝুপ করে ফেলে দিলো। তারপর জামাটা মুঠো করে পুুতুলের মত তুলে নিয়ে ওপরে এলো। আমি ভাবলাম, আমার জীবনের শেষ দিন আজকে। নিশি মনের কথা জানতে পেরে বললো, আমরা প্রাণে মারি না কাউকে। শুধু ঘুরে বেড়াই। কাজ করি। তারপর দিনের আলো ফুটতেই নিশিটা পালিয়ে গেলো।

আমি দেখলাম একজন ভদ্রলোক আমার হাতে একশো টাকা দিলেন। তিনি বললেন, তোমাকে দেখে তো ভালো ছেলে মনে হচ্চে। তা তুমি এখানে কেন?

আমি বললাম, আপনি বিশ্বাস করবেন না আমার কথা। আমাকে নিশি ভূতে এখানে এনেছে।

ভদ্রলোক বললেন, আমি বিশ্বাস করি। তুমি সাবধানে যাবে।

আমি বললাম, আমাকে কাটোয়ার ট্রেনে চাপিয়ে দেবেন।

ভদ্রলোক বললেন, নিশ্চয়। ভোর চারটে পাঁচের ট্রেনটা পাবে চলো।

আমি তার সাথে চলে গেলাম। তিনি বললেন, মর্নিং ওয়াকে এই পথেই আমার আসা যাওয়া। তাই তোমার সঙ্গে দেখা হলো। যাও আর কোথাও নাববে না। সোজা বাড়ি চলে যাও।

অলক বললো, বুঝলাম অনেক ভালো লোক কলকাতায় আছেন। তারপর ট্রেন থামলো থানার কাছের স্টেশনে। সেখান থেকেই পুলিশ আমাকে ধরে আর এখানে নিয়ে আসে।

অলক আবার বললো, আমি আরও একটু ঘুমোবো। কাকু বললেন, ভাত খেয়ে নে। অলোক বললো, পরে খাবো।

অলোক খেলো না বলে বিশু ও আমরা না খেয়ে চলে এলাম। কাকু আর জোর করেন নি। ছোটো থেকে বড়ো  হলো। সত্যি কি বড় হলো।

বন্ধুর বলতো ওর বয়স বেড়েছে, মনটা কিন্তু শিশুর মতো রয়ে গেছে। ছোটোবেলায় কেউটে সাপ ধরা, গঙ্গা সাঁতার কেটে পেরোনো, গ্রামে গিয়ে ভূত ধরা সব মনে পরে বন্ধুদের। বাউড়ি বৌকে নিজের খাবার দিয়ে দিতো বিশু। সেই বিশু আজ নিজে একমুঠো খাওয়ার জন্য ছাত্র পড়ায়। বিয়ে করেছে সে। একটা কন্যা সন্তান হয়েছে। তারা গ্রামের বাড়িতে বড়দার কাছে থাকে। বড়দাকে মাসে পাঁচশো টাকা দিয়ে আসে। বিশু বাসা ভাড়া করে থাকে শহরে। একটা বোতল আর বিছানা তার সম্পত্তি। খাওয়াটা বেড়ার সস্তার হোটেলে সেরে নেয়। একটা ট্রেনের যাত্রীর মত তার জীবন। তবু তার মনে আনন্দের অভাব ছিলো না। আনন্দের ফেরিওয়ালা সে।কারও কোনো অসুবিধা হলেই তার ডাক পড়তো আগে। এবার বিশু চললো গঙ্গার ধারে নীলুদার আশ্রমে। নীলুদা বললেন, ওই তো সামান্য রোজগার। নিজেই সব খেয়ে নিলে পরিবারকে খাওয়াবি কি?

বিশু বললো, দাদা, তোমার ঘাড়ে বোঝা হয়ে যাবো আমি। তুমি সাধক মানুষ। তোমার অসুবিধা হবে না তো? নীলুদা বললেন, আমি ওসব বুঝি না। যদি আমি খেতে পাই। তোরও একমুঠো হবে। যা ওপরের ঘরে যা। রাত হোল। বিশুর ঘুম আসে না, গঙ্গার ধারে ওপাড়ে মরা মানুষ পুড়ছে। শবদেহের পোড়া গন্ধ ভেসে আসছে। হঠাৎ বিশু শুনতে পেলো, কিঁ রেঁ, ভয় পাঁচ্ছিস? বিশু তাড়াতাড়ি নীচে নেমে এলো। নীলুদা বললেন, কি রে ঘুম আসছে না? এই নে খা। তারপর গিয়ে শুয়ে পড়। মোরোব্বা খেয়ে ঠাকুরকে প্রণাম জানিয়ে বিশু শুয়ে পড়লো। ঘুম ভাঙ্গলো একদম সকালে। সকালে হরিনাম শুনলো। মন্দিরের সিঁড়িতে জল দিয়ে ধুয়ে ফুল রাখলো। তারপর চলে গেলো ছাত্র পড়াতে। সেখানে চা বিস্কুট খেলো। পরপর বারোটা অবধি ছাত্র পড়াতো। যেসব ছাত্ররা স্কুলে যেতো না, তারা ফোন করে ডেকে নিতো বিশু মাষ্টারকে। ছাত্রদের সঙ্গ তার ভালো লাগতো।তবে দু একটি বাড়িতে ছাত্রের অভিভাবক বসে থাকতেন। পড়ানো পরখ করতেন। তারওপরই মাষ্টারের ভবিষ্যৎ নির্ভর করতো। একবার এক বড়লোকের বাড়িতে মালকিনের ধমকে সে অপমানিত হয়ে পড়ানো ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলো। কারণ, ছাত্র প্রথম স্থান অধিকার করতে পারে নি। বিশু বলেছিলো, এবার পারেনি, আসছে বার পারবে নিশ্চয়। মহিলা বলেছিলেন, সরকারি চাকরি পাবে না, সেকেন্ড হলে। ফার্ষ্ট হতে হবে। আমি অন্য মাষ্টার দেখবো। বিশু ছেড়ে দিয়েছিলো পড়ানোটা। তারপর এলো সুখবর। নীলুদা বললেন, তুই মায়ের সেবা করে যা। মা তোকে দেখবেন।সত্যি, মা দেখেছিলেন। জীবনের কঠিন সময়ে মা সত্যিই একটা পার্শ্বশিক্ষকের চাকরী পাইয়ে দিয়েছিলেন। বিশুর ভাই খবর পাঠালো, দাদা গ্রামের স্কুলে দু হাজার টাকায় পার্শ্ব শিক্ষক নেবে। তুমি আ্যপ্লাই করো। বিশু পেয়ে গিয়েছিলো চাকরীটা। টিউশানির থেকে ভালো। মাইনে কম হলেও নিশ্চয়তা আছে। বিশু বন্ধুদের বললো। বন্ধুরা বললো, তুই সকলকে সাহায্য করিস। তোর কোনোদিন অভাব হবে না। মানুষের আশীর্বাদ তোর সঙ্গে আছে। তারপর নীলুদার আশীর্বাদে বিশুর নিজস্ব বাড়ি হোলো। আর বাসা বাড়ি নয়। নিজের বাড়িতে নিয়ে এলো মেয়ে আর বৌকে। চারদিকে বাঁশের বেড়া। কাছেই একটা গরীব পাড়া আর একটা পুকুর। সাপের রাজত্ব। সেখানে ঘর বাঁধলো বিশু। একবার রাতে বিরাট এক গোখরো ঢুকে পড়লো বিশুর ঘরে। ফণা তুলে ফোঁস ফোঁস করছে সাপটা। মশারির ভেতরে বৌ আর ঘুমন্ত কন্যা। বিশু এক হাতে লাঠি নিয়ে ফণা চেপে ধরলো সাপটার। আর অন্য হাতে সাপের লেজ ধরে ঝুলিয়ে নিয়ে এলো বাইরে।

তারপর বনের ভিতর ছেড়ে দিলো সাপটা। রাত হলেই তার উঠোন দিয়ে চলাচল করতো নানারকম সাপ। ডোমনা চিতি, শাঁখামুটি, চন্দ্রবোড়া, গোখরো কিছুই বাদ ছিলো না। সকলে বলতো মাঝমাঠে বাড়ি করলে ওইরকমই হয়। বিশু কি করে বোঝাবে, সে প্রকৃতির সন্তান। এই বন, জঙ্গল, সাপ তার বড় প্রিয়। সে সবাইকে নিয়ে আনন্দে থাকতে চায় না। কিন্তু মানুষ, সবাইতো আর সমান হয় না। প্রতিবেশিদের একজন তাকে শিক্ষা দিতে চায়, গাড়ি, বাড়ি আর নারী, ভেবেচিন্তে নিতে হয়। বড় নিষ্ঠুর কিছু মানুষ। গাড়ি, বাড়ি জড় পদার্থের সঙ্গে মায়ের তুলনা করে। বিড়বিড় করে সে। মনে ভাবে, আমি বিশু, আমার সামনে যা তা কথা বলে পার পেয়ে যায় এখন মানুষ। কিন্তু জানে না, এই বিশু ওদের শায়েস্তা করতে পারে এক মিনিটে। কিন্তু সময় বড় বিচারক। সে আজ বিশুকে কঠিন লড়াইয়ে নামিয়ে দিয়েছে। জীবনে টিকে থাকার লড়াই। এই যুদ্ধে ক্রোধের জায়গা নেই। ক্রোধকে জয় করার লড়াইয়ে জিততে হবে। তবেই হবে তার জয়।

সে এখন তার বাড়িতে অনেক ফুল গাছ লাগায়। আর অনেক ফুলের মাঝে সে সহজ হয়ে যায়।

ভাটফুল, ঢোল কলমি, পাহাড়ি কলমির ফুলের ঘ্রাণে, প্রাণে ভারতবর্ষের নির্মল সুন্দর গন্ধ ভেসে ওঠে। সুবাসে মন মাতোয়ারা। বসন্তের রঙ বাহারি ফুলের গানে হৃদয় দুলে ওঠে বিশুর।

ফল গাছের মাঝে বসে সে ভাবে পুরোনো দিনের কথা। সে জানে, change is the only constant in the world.

বিশু ভাবছে পুরোনো দিনের কথা, শীতকালে বন্ধুরা গোল হয়ে বসতাম। মাঝখানে জ্বলতো আগুন। পাতা চোতা কুড়িয়ে দিতাম আগুনে। আগুন নিভতো না। সেই আগুনে সেঁকে নিতাম হাত পা। আবার বাড়িতে গিয়ে মায়ের রান্নাঘরে মাটির তৈরি উনুনে সেঁকে নিতাম শীতল হাত, পা। মা সরজুগুলি, পিঠে বানাতেন। উনুনের ধারে বসে নলেন গুড়ের সঙ্গে আয়েস করে খেতাম। পায়েস খেতাম শেষ পাতে। রকমারি খাবারের সুগন্ধে মৌ মৌ করতো মায়ের হেঁসেল ঘর। পালো, বলে একরকমের খাবার মা বানাতেন যত্ন করে। সকালে উঠেই পালো খেয়ে ভুরিভোজ সারতাম। তারপর পিঠে রোদ লাগিয়ে সরব পড়া। বোঝার থেকে চিৎকার হতো বেশি। আনন্দ পেতাম সরব পড়ার প্রতিযোগিতায়। পাশের বাড়ির বন্ধুদের সরব পাঠের আওয়াজ পেলেই, ততোধিক জোরে শুরু করতাম পাঠ। স্কুলে গিয়ে তার আলোচনা হতো ক্লাসে। আরও জোরে পড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রতিযোগিতা চলতো মাসের পর মাস। কোনো দুঃখ, কষ্ট আমাদের মনে রেখাপাত করতে পারতো না। জীবনের আনন্দ ছড়ানো থাকতো ধুলো জোড়া পথে। এই ধুলো, মাটির সুগন্ধ আমাদের ভারতবর্ষের প্রাণ।

চার

কেউ যদি সাপ ভয় পান, তবে সেটা ভালো। সাপের কামড় খাওয়া মোটেই ভালো কিছু নয়। কিন্তু সাপ দেখলে যদি আপনি মাথা ঘুরে পড়ে যান – তবে এই রিএ্যাকশনটি তার জন্য খারাপ। আবার মানুষের সামনে কথা বলার সাহস না থাকাটা কোনও দিক দিয়েই ভালো নয়। এর জন্য  হয়তো অনেক বড় বড় সুযোগ মিস করেছে অনেকে এবং ভবিষ্যতেও করতে পারে। এভাবে এক একটি ভয় নিয়ে চিন্তা কর, এবং সেটার রিএ্যাকশন, ও রিএ্যাকশনের ফলাফল সংক্ষেপে লেখ। ক্রমশ বড় হয়ে আমরা কলেজে ভরতি হলাম। ট্রেনে একবার কলেজ থেকে বাড়ি আসার সময় রাজু ট্রেন থেকে পড়ে গেল। বিশু বলল, ওর স্বভাবটা খুব খারাপ। শুধু গেটের বাইরে মাথা নিয়ে মাস্তানী দেখাবে। অনিতা বলল, এখন আর ওরকম বলিস না। আমার রাজু মরে গেল নাকি দেখ। জীবন বলল, তোর রাজু মানে? আমাদের নয় নাকি। অনিতা বলল, আমরা দুজনে দুজনকে ভালবাসি। ওকে ছাড়া আমি বাঁচব না। বিশু বলল, আমরা পরের স্টেশনে নেমে উল্টোদিকে হাঁটতে হাঁটতে খুঁজব লাশ। জীবন বলল, থানায় একটা খবর দিয়ে দি। আমার কাছে মোবাইলে থানার নাম্বার আছে। ট্রেনের ভিতরে একটা গুঞ্জন। একজন বলছে, দেখ কোন বন্ধু হয়ত ঠেলে ফেলে দিয়েছে।আর একজন বলছে, এই বন্ধুই হল কাল। যত নষ্টের গোড়া এই বন্ধু। তাই বলে কি পৃথিবীতে বন্ধুত্ব বলে শব্দটা উঠে যাবে। ঠেলে যে ফেলবে সে ত বন্ধু নয় শত্রু। কে বোঝাবে বোকা পাবলিককে। অযথা বন্ধু শব্দের কদর্থ করার কোন অর্থ হয় না। তারপর ওরা পরের স্টেশনে নেমে খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে গেল রাজুকে। তখন সৎ পাবলিকের দল রাজুর মাথায় জল ঢেলে প্রায় সুস্থ করে তুলেছে। রাজু জ্ঞান ফিরে পেয়ে বলছে, অনিতা তুমি কোথায়। অনিতা রাজুর মাথাটা কোলে নিয়ে বসে সেবা করল।

বিশু বলল, দেখ পাবলিক দুরকমের। এক হুজুগে আর দুই উপকারি, বুদ্ধিমান, বাস্তববাদি পাবলিক। দুই নম্বরের সংখ্যাই বেশি। এরাই পৃথিবীর ভালমন্দ নির্ধারণ করার মালিক। এরাই ভগবান, আল্লা বা যিশু।

রাজু এ যাত্রায় বেঁচে গেল। পুলিশ অফিসার একটু বকাঝকা করলেন। তারপর বিশুকে ধন্যবাদ জানিয়ে চলে গেলেন। রাজু বলল, আমার পকেটে জিয়োনীর মোবাইল ছিল। বারো হাজার টাকা দাম রে। মানি ব্যাগে পাঁচটা দু হাজার টাকার নোট ছিল। এখন কিছুই নেই।

জীবন বলল, জীবন ফিরে পেয়েছিস এই যথেষ্ট। মানি লষ্ট ইস নাথিং লস।

বিশু বলল,একদল মানুষ বিপদে মানুষকে ফকির করে দেয়। রেলে কাটা পড়লে তারা লাশের আঙুলের আংটি, গলার চেন আর মানি ব্যাগের খোঁজ করে। নিজে যে একদিন লাশ হয়ে পড়ে থাকতে পারে সেকথা তাদের মনে থাকে না। কেউ গাঁজা খেয়ে সাধুগিরি করে আবার কেউ বা গাঁজার টানে বাটপারি করে সুখ পায়। বড় বিচিত্র এই মনুষ্যজগৎ। 

বিশুর দলে ঢুকে পড়েছিল ছুঁচ হয়ে নেপাল। লম্বা সুদর্শন চেহারা তার। অনিতা কলেজের শ্রেষ্ঠ সুন্দরী ছিল। তার পিছনে ঘুর ঘুর করত অনেক রোমিও। নেপাল ওই দলেরই ছিল। ধরেছিল জীবন। একবার পিকনিকের সময় অজয় নদীর শুখা বালুচরে নেপাল সুযোগ পেয়ে অনিতার গালে চুমু খেয়েছিল। জীবন শুনল, অনিতা বলছে, আমরা বিয়ে করে সিঙ্গাপুর যাব বলছ। সত্যি তো?  
নেপাল বলল, আমার বাবা বড় ব্যবসাদার। বাবার ব্যবসার দেখাশোনার জন্য আমাকে ওখানে যেতেই হবে। তোমাকে বিয়ে করে সঙ্গে নিয়ে যাব।
জীবন কথাটা বিশুকে বলেছিল। বিশু শুনে বলেছিল, রাজুকে এখন কথাটা বলিস না। দুঃখে আত্মহনন করবে। যখন ঘটনা ঘটবে জানতে পারবে এরই নাম জীবন। ঠিক নদীর মত। এক পাড় ভাঙ্গে তো আর এক পাড় গড়ে।
কলেজ জীবন শেষ হয়ে গেল। অনিতা নেপালকে বিয়ে করে চলে গেল সিঙ্গাপুর। ট্রেনে কোন এক পাগলের ছোড়া পাথরের ঘায়ে রাজুর ব্রেনে আঘাত লেগেছিল। বিশু এর মধ্যে রহস্যের গন্ধ পেয়েছিল কিন্তু কুল কিনারা করতে পারে নি। তারপর দশ বছর কেটে গেছে। এই দশ বছরে কেউ চাকরি পেয়েছে কেউ পায় নি।
বিশু চাকরি পায় নি। বিয়ে থা করে নি। একদিন রাস্তায় দেখা পেয়ে বসলাম চায়ের দোকানে। সেই চা ওয়ালা কোথায়? কলেজ জীবনে এখানে এসে বসলেই খুড়োর আদর পেতাম। তিনি পরম মমতায় আমাদের ডিমরুটি আর চা খাওয়াতেন। জিজ্ঞাসা করতে ছেলেটি এগিয়ে এসে বলল, আমি তার ছেলে। বাবা মরে গেছেন। এখন আমি দোকান চালাই। কলেজের ছেলেমেয়েরা এখনও এখানে আসে, বসে, চা পান করে। কথা বলতে বলতে বিশু হঠাৎ এক পাগলকে দেখতে পেল। চায়ের ছেলেটির কাছে এসে ইংরাজীতে পাগলটি বলল, গিভ মি এ কাপ ওফ টি।
---এই নে, যা যা
বিশু বলল, ওকে একটা ডিমরুটি দাও। পয়সা আমরা দিচ্ছি।
দোকানের ছেলেটি বলল, ও রোজ এখানে একবার আসে আর বলে, অনিতা তুমি ভাল আছ? আই লাভ ইউ।
বিশু বলল, ভাই ও শিক্ষিত। আমাদের বন্ধু। কলেজে এক সঙ্গে পড়তাম।
ছেলেটার হাত থেকে এক কাপ চা পড়ে গেল মাটিতে। তার চোখে বিস্ময়ের ছাপ। সে হয়ত মনে মনে একটা মনগড়া কাহিনী ফেঁদে বসল। মানুষের মন তো। মন তো নয় এক উপবন, রহস্যে ঘেরা। 
আমার বরাবরই বুদ্ধি একটু কম। বুঝতে সময় লাগে বেশি। বিশু বলল, আমাদের রাজু।
আমি বললাম, পাথরের আঘাতে বেচারা পাগল হয়ে গেছে।
বিশু একটু চুপ থাকল। তারপর বলল, পাথরের আঘাতে মাথা ভাঙ্গার থেকে মন ভাঙ্গার যন্ত্রণা অনেক বেশি। সবাই বইতে পারে না মাথায়। তাই হয়ত পাগল হয়ে যায় ।
বিশু পাগলকে নিয়ে চলে এল ডাঃ হরমোহন সিংহের তৈরি মানসিক চেম্বারে। সেখানে বিনা পয়সায় পাগলদের রেখে চিকিৎসা করার ব্যবস্থা আছে। আমি ছিলাম সঙ্গে। সেখানে সমস্ত রকম চিকিৎসা করার কথা বলে বিশু আর আমি চলে এলাম আমার বাড়ি। 
আমার বাড়িতে খাওয়া দাওয়া করে দুপুরে আমরা রাজুর করুণ পরিণতি নিয়ে আলোচনা করলাম। কারও দোষ নয়। আমরা সবাই নিজের কৃত কর্মের ফলে ডুবে মরি। কর্মফলে জীবন গড়ে আবার কর্মদোষে জীবন ভেসে যায় অলকানন্দা জলে। তবে কি রাজু ভালবেসে ভুল করেছিল। সকলে ভালবেসে কি অসফল হয়? না, শতকরা দশ শতাংশ অসফল হলেও বেশিরভাগ মেয়েরা করুণাময়ী। তারা আছে বলেই পৃথিবী এত মোহময়। তাদের ছাড়া আমাদের জীবন যৌবন যে অচল।

হেমন্ত ঋতুকে নিয়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হিমের রাতে ওই গানটিতে লিখেছেন,"হিমের রাতে ওই গগনের দীপগুলিরে, হেমন্তিকা করল গোপন আঁচল ঘিরে। ঘরে ঘরে ডাক পাঠালো ‘দীপালিকায় জ্বালাও আলো, জ্বালাও আলো, আপন আলো, সাজাও আলোয় ধরিত্রীরে।’ বিশ্বকবি তার নৈবদ্যে স্তব্ধতা কবিতায় লিখেছেন, ‘আজি হেমন্তের শান্তি ব্যাপ্ত চরাচরে জনশূন্য ক্ষেত্র মাঝে দীপ্ত দ্বিপ্রহরেশব্দহীন গতিহীন স্তব্ধতা উদাররয়েছে পড়িয়া শ্রান্ত দিগন্ত প্রসারস্বর্ণশ্যাম ডানা মেলি।’ হেমন্তের ফসল কাটাকে কেন্দ্র করেই নবান্ন উৎসবের সূচনা হয়। নবান্ন পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী শস্যোৎসব। নবান্ন হল নতুন আমন ধান কাটার পর সেই ধান থেকে প্রস্তুত চালের প্রথম রান্না উপলক্ষে আয়োজিত উৎসব, যা সাধারণত অগ্রহায়ণ মাসে আমন ধান পাকার পর এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের কোন কোন অঞ্চলে ফসল তোলার পরদিনই নতুন ধানের নতুন চালে ফিরনি-পায়েশ অথবা ক্ষীর তৈরি করে আত্মীয়স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীর ঘরে ঘরে বিতরণ করা হয়। নবান্নে জামাইকে নিমন্ত্রণ করা হয়, মেয়েকেও বাপের বাড়িতে ‘নাইওর’ আনা হয়। নবান্নে নানা ধরনের দেশীয় নৃত্য, গান, বাজনাসহ আবহমান বাংলার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পালিত হয়। লাঠিখেলা, বাউলগান, নাগরদোলা, বাঁশি, শখের চুড়ি, খৈ, মোয়ার পসরা বসে গ্রাম্য মেলায়।ইউরোপে ১লা সেপ্টেম্বর থেকে হেমন্তের শুরু। সেখানে একে বলা হয় বৈচিত্র্যময় রঙ ও পাতা ঝরার ঋতু। ঝাউ গাছগুলো ছাড়া সব গাছেরই পাতা এ সময় ঝরে যেতে শুরু করে এবং শীতের আগমনের আগেই সব বৃক্ষই ন্যাড়া হয়ে যায়।মা বলতেন, হেমন্তের শিশির ভেজা ঘাস, শীতের আগে ঝরে যাবার পূর্বে শেষবারের মতন সজ্জিত হয়ে ওঠা গাছের পাতা গ্রামবাংলায় যেন সকল ঋতুর মধ্যে হেমন্তকেই রানীর মুকুট পরিয়ে দেয়। তাই বলা হয় বসন্ত যদি ঋতুরাজ হয়, তবে নিশ্চিত ভাবেই হেমন্ত হলো ঋতুদের রানী। গ্রাম বাংলার বুকে ভোরের হালকা কুয়াশায় ধানক্ষেতে ধান গাছের উপর জমে থাকা বিন্দুবিন্দু শিশির যেন সমগ্র গ্রামের পরিবেশকেই এক অপরূপ মায়ায় আচ্ছন্ন করে রাখে। প্রকৃতির বুকে উৎসবের উত্তেজনার পর স্বস্তির প্রতীক হিসেবে হেমন্তের আগমন হলেও প্রকৃতি এই ঋতুকে প্রাকৃতিক দানের সমারোহ থেকে এতটুকুও বঞ্চিত করেনি। বরং সমগ্র হেমন্তকাল পূর্ণ হয়ে আছে বিভিন্ন প্রকার ফল ফুল ও ফসলের আড়ম্বরে। এ প্রসঙ্গে প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় হেমন্তকালে ফোটা বিভিন্ন প্রকার অনিন্দ্যসুন্দর ফুলগুলির কথা। শিউলি, কামিনী, গন্ধরাজ, মল্লিকা, ছাতিম, দেবকাঞ্চন, হিমঝুরি, রাজঅশোক ইত্যাদি ফুলের মাধুর্যে সমগ্র হেমন্তকালের প্রকৃতি যেন মাতোয়ারা হয়ে থাকে। ফুল ছাড়া মানুষের জীবন যেন রুক্ষ, প্রাণহীন। হেমন্তকাল মানুষের জীবনকে তার ফুলের ডালি উপুর করে দিয়ে সেই রুক্ষতায় নিয়ে আসে পেলবতার ছোঁয়া। অন্যদিকে হেমন্তের পরিবেশ বিভিন্ন প্রকার ফসল চাষের জন্য বিশেষভাবে অনুকুল। এই ঋতুতেই বিশেষভাবে বিকাশ লাভ করে বাঙালির প্রিয় আমন ধান। অন্যদিকে সমগ্র হেমন্তকাল জুড়ে গাছে গাছে শোভা পায় কামরাঙা, চালতা, আমলকি, কিংবা ডালিমের মতন বিভিন্ন ফল। তাছাড়া এই ঋতুর প্রধান ফল হলো নারিকেল। অনেক আগের কথা তখন বাদশা আকবরের রাজত্ব, সে সময় পহেলা অগ্রহায়ণকে (মধ্য নভেম্বর) বাংলা নববর্ষ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। সেই সময়ে প্রধান দুটি খাদ্য শস্য রোপণ করা হতো একটি আউশ এবং অন্যটি আমন। বেশিরভাগ সময় হেমন্ত কালে এই শস্যটি রোপণ করা হয় বলে অন্য কোন শস্য উৎপাদন হতো না। তখন সমস্ত দেশ এই শস্যে ছেয়ে যেতো। সে সময়ে আউশ বেশ জনপ্রিয় এবং ব্যাপক চাহিদা সম্পন্ন একটি শস্য। সারাদেশে এর চাহিদা ছিল প্রচুর। এদিক দিয়ে আমন চালের শস্যটি সারা বছরই কম বেশি উৎপাদন হয়ে থাকত বলে এই শস্যটি পাওয়া যেত সারা বছরই। অগ্রহায়ণ এর কিছুটা আগে মানে কার্তিক মাসে আউশ শস্যটি রোপণ করা হতো যার ফলে, হেমন্ত কাল এসে পোঁছাতেই শস্যের মাঠ হলুদে ছেয়ে থাকতো। ধান পেকে মাঠ হলুদ হয়ে আছে এই দৃশ্যের চেয়ে সুখকর কোন দৃশ্য পরিশ্রমী কৃষকরা দেখেনি। হলুদ মাঠ দেখে কৃষকদের মুখে ফুটে উঠত রাজ্যের হাসি। এ আনন্দ যেন থামবার নয়। তখনই ঐ সময়টাকে উৎসবে পরিণত করা হল, নাম দেয়া হয় “নবান্ন উৎসব” মানে “নতুন চাল বা অন্নের উৎসব”। এই সময় ধান কেটে শুকিয়ে সিদ্ধ করে তৈরি করা হয় নানা ধরনের পিঠাপুলি বা খাবার। সবাই এক হয়ে উপভোগ করে এই উৎসব। এবং মিলেমিশে নবান্ন উৎসব উদযাপন করে। সাদার মায়া আর মন মাতানো সুবাসে ছেয়ে থাকা শিউলি ফুল যখন আপনার আঙিনায় উজার হয়ে পড়ে থাকে তখনই হেমন্তের শুরু! শুধু কি শিউলি ফুল? দোলনচাঁপার হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া সুগন্ধ আমাদেরকে হেমন্ত কালে আবদ্ধ করে রাখার জন্য যথেষ্ট। সাদার পবিত্রতা আর সুবাসে মোহিত হয়ে চলুন হেমন্ত কালকে বরণ করে নেই। ঋতু রানী হেমন্ত এমনিতেই তো আর রানীর মুকুট পায়নি। তার এমন প্রাচুর্য্যের ঢের তাকে এনে দিয়েছে এই খ্যাতি। শরৎকাল বর্ষার কিছুটা পরে আসে। শরতের শেষ ভাগে এসে বৃষ্টি কিছুটা কমতে থাকে। সারি সারি মেঘ ভেসে বেড়ানো আকাশের গায়ে এসে পড়ে কুয়াশার আলতু স্পর্শ। হেমন্তের শুরুটা সেখান থেকেই। তবে শহরে হেমন্তের ঋতুর বৈশিষ্ট্য কিছুটা ভিন্ন। দিনগুলো একটু একটু করে কীভাবে যেন ছোট হয়ে আসে। বেলা পড়ে গেলেই সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে দ্রুত। রোদও হারিয়ে ফেলতে থাকে তার তেজ। এসব দেখেই সকলের অনুভব হয় বদলে যাচ্ছে ঋতু। হেমন্ত চলে এসেছে। মনমুগ্ধকর এই ঋতুতে চাইলে আপনি অনেক কিছু করে সময় কাটাতে পারেন। যে কারণগুলোর জন্য হেমন্ত কাল সকলের কাছে প্রিয় জানতে লেখাটি পড়তে থাকুন। শরতের কাঁচা হলুদের মতো সোনলি রোদ দিগন্তব্যাপী ছড়িয়ে দেয় চিরায়ত রূপের সুধা আর সৌন্দর্য। তাকে অনুসরণ করে হেমন্ত ঋতুর আবির্ভাব ঘটে ধীর পদসঞ্চারণে। প্রকৃতির হরিদ্রাভ সাজ দিকে দিকে নতুনের জাগরণ ঘোষণা করে। বর্ষার জল সরে গিয়ে মাঠঘাট মাটির সোঁদা গন্ধে ভরে ওঠে। শীতের পূর্বসূরি হেমন্ত হচ্ছে পাকা ধানের ঋতু। এসময় ঘরে ঘরে নতুন ধানের পিঠা খাওয়ার উৎসব শুরু হয়, ভোররাতে বাড়ি বাড়ি ঢেঁকিতে চিঁড়ে কোটার শব্দ ওঠে। তবে এ চিত্র সম্পূর্ণ গ্রামবাংলার। অথচ আজকাল বিশ্বব্যাপী যে প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতা, তার রেশ এসে পড়েছে বাংলার গ্রামেও। ষড়ঋতুর বিচিত্র বিকাশ আজ এই ভাটি বাংলার হৃদয় হতে মুছে যেতে বসেছে। তথাপি শীতের প্রাক্কালে হিমঋতু হেমন্তের পাতা ঝরার দৃশ্যের ভেতরে যে শূন্যতা ধরা পড়ে, তা আরো বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে আমাদের শিল্পসাহিত্যে। চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের প্রধান কবি কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী। দেশজ আচার ও লোকসংস্কৃতির সাথে বাংলাদেশের প্রকৃতি ও এর সঙ্গে মানব-সম্বন্ধের যে অকৃত্রিম প্রকাশ মুকুন্দরামের কাব্যে লক্ষ করা যায়, বাংলা সাহিত্যে তা বিরল। কবিকঙ্কণ বাংলাদেশের মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে প্রভাব-সঞ্চারী এ দেশের ষড়ঋতুর বিকাশ বৈচিত্র্যকে চমৎকার কাব্যরূপ দিয়েছেন। তাঁর ষড়ঋতুর এই ব্যঞ্জনায় শুধু হেমন্ত সম্পর্কে বলেন, ‘নিকেতন পরাণনাথ কৈলে বসবাস/আইল কার্ত্তিক মাস হিমের প্রকাশ’। আবার এ বাংলার প্রবাদ-প্রবচনও এই ষড়ঋতু কেন্দ্রিক কৃষির সাথে সম্পর্কযুক্ত। চিরায়ত ঋতুর এই চমকপ্রদ বৈশিষ্ট্যগুলো আবহমানকালের প্রকৃতিকে মানুষের কল্যাণ-অকল্যাণ, শুভাশুভ নির্ধারণে দিক নির্দেশনা দেয়। মা বলতেন, এখন চলছে হেমন্তকাল। আর হেমন্ত মানেই শিশিরস্নাত প্রথম প্রহর। শরতের কাশফুল মাটিতে নুয়ে পড়ার পরপরই হেমন্তের আগমন ঘটে। এর পরে আসে শীত, তাই হেমন্তকে বলা হয়ে শীতের পূর্বাভাস। হেমন্তে সকালবেলা আবছা কুয়াশায় ঢাকা থাকে চারদিকের মাঠঘাট। হেমন্তে শিউলি, কামিনী, গন্ধরাজ, মল্লিকা, ছাতিম, দেবকাঞ্চন, হিমঝুরি, রাজঅশোক ইত্যাদি নানা ধরনের ফুল ফোটে। হেমন্তের সকালে শিউলির সৌরভ বাঙালির প্রাণে আনে উৎসবের আমেজ। হেমন্তে বিভিন্ন ধরনের ফলের সমারোহ ঘটে। এ ঋতুর বিশেষ কিছু ফল হল- কামরাঙা, চালতা, আমলকী ও ডালিম। হেমন্তকাল জুড়েই আমরা দেখতে পাই আমন ধানের ক্ষেত- যা খুবই সুন্দর ও নয়নকাড়া। কচিকাঁচা ধানগাছগুলো সতেজ হতে আরম্ভ করে ক্রমেই। আর পাকা ধানের ক্ষেত সোনালি সূর্যের আলোয় চিকচিক করতে থাকে। প্রকৃতির বৈচিত্র্য জীবনকে করে তোলে বর্ণময়, আর সেই বৈচিত্র্যের রূপ জীবনের একঘেয়েমি দূর করে নতুন রঙে রাঙিয়ে দেয়। বাঙালির সৌভাগ্য যে, আমাদের স্বদেশ বঙ্গভূমিতে প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের কোনো অভাব নেই। বছরের বারো মাসে ছয় ঋতুতে প্রকৃতির নতুন রূপে নতুন লীলা বাংলার মানুষের জীবনকে অনাবিল স্নিগ্ধ আনন্দে ভরিয়ে তোলে। শিউলি শরতের ঘ্রাণে শিহরিত শরীর। শিউলি নামের শিউলি কুড়োনো ছেলেটি আমার শৈশব ফিরিয়ে দেয়। বাড়ির শিউলি গাছটার তলায় অপেক্ষা করে ঝরা ফুলের দল। প্রকৃতি জানে ফুল ঝরে গেলে তার কদর কম হয় ভাবি প্রজন্মের হাতে। সে আমাদের ফুল জীবনের পাঠ শেখায়। মানুষও একদিন  ঝরে যায় হেমন্তের শিউলিঝরার মত। বাবা বলতেন, কোশিগ্রাম রায়বেঁশে নৃত্য সংস্থার পরিচালক প্রবীণ গুরু স্বর্গীয় কালীকিঙ্কর পন্ডিত ও শঙ্কর পন্ডিত। সম্পাদক হলেন বাবলু হাজরা, সহ সম্পাদক গোপাল হাজরা। প্রতিষ্ঠা ১৯৬১ খ্রীষ্টাব্দ। রায়বেঁশে বা রায়বেশে  নৃত্য সম্পর্কে শোনা যায় বীরভূম জেলাতে নাকি প্রথম উদ্ভব হয়েছিল কিন্তু কথাটা ঠিক নয়। এর উদ্ভব হয়েছে মুর্শিদাবাদের বড়ঞা ও খড়গ্রাম থানাঞ্চলে মুর্শিদাবাদ জেলায়। তবে চর্চা, বিকাশ ও প্রকাশ ক্ষেত্র হিসেবে আমরা বীরভূমের নাম করতেই পারি। রায়বেঁশে বা রাইবেশে উদ্ভাবনের একটা আঞ্চলিক ইতিহাস আছে। অনেক আগে থেকে শারীরিক কসরতমূলক কিছু নৃত্যভঙ্গি বঙ্গের নানা প্রান্তে প্রচলিত ছিল এবং তা ছিল রায়বেঁশের আগে থেকেই। এই নৃত্যশৈলীর মুল বৈশিষ্টই হল, নর্তকরা ডানপায়ে ঘুঙুর পড়তো। ঘন্টা, ঢোল, করতালের ছন্দে ডানপায়ের ঘুঙুর সহকারে নৃত্য করতো। আর সাথে হাতে থাকতো কখনো ধনুক, কখনো বর্শা, তীর, টাঙি কখনো বা তলোয়ার। হাতের কৌশলে অস্ত্র ব্যবহারের ভঙ্গি প্রদর্শন এর প্রধান আকর্ষণ। এ নাচে বাজনার তালে তালে একই অঙ্গভঙ্গি করে নাচতে হয়। বাদ্য ও নৃত্যের এই সম্মিলিত গতি ও ছন্দে রায়বেঁশে নাচের সৌন্দর্য লুকিয়ে  থাকতো। লেঠেলরা নাকি যুদ্ধের ক্লান্তি দূর করতে এই নৃত্য করতো। দিল্লির মসনদে তখন সুলতান আকবর। সে সময় অধুনা মুর্শিদাবাদ জেলার ফতেসিং পরগনায় ফতে হাড়ি নামক এক স্বাধীনচেতা সামন্তরাজা সাহসের সঙ্গে রাজত্ব করতেন। তাঁর সৈন্যসামন্ত, দুর্গ, গড় সবই ছিল, আর ছিল তাঁর হস্তিবাহিনী। তিনি দিল্লির শাসন মানতেন না। ওই সময়ে ফতেসিং পরগনা সংলগ্ন অধুনা খড়গ্রাম থানার শেরপুর নামক দুর্গে দুর্গরক্ষক ছিলেন ওসমান খান। তিনি ছিলেন সুলতানি শাসকদের প্রতিনিধি। এঁরাও দিল্লির শাসন মানতেন না। ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে সেনাপতি মান সিংহকে আকবর এই অঞ্চলে পাঠান এঁদের দমন করে মুঘল শাসন কায়েম করার জন্য। মান সিংহের সঙ্গে আসেন তাঁর সহকারী সেনাধ্যক্ষ সবিতা রায় দীক্ষিত। তাঁর সঙ্গে ছিল দুধর্ষ ভীল সৈন্যদল, অর্থাৎ ভল্ল বা বল্লমধারী যোদ্ধা। মান সিংহ ওসমান খাঁকে পরাভূত করে এই অঞ্চলে মুঘল শাসন কায়েম করেন। সবিতা রায় দীক্ষিত মান সিংহের নির্দেশে ময়ূরাক্ষী নদীর তীরবর্তী মুণ্ডমালা নামক স্থানে হাড়ি রাজাকে যুদ্ধে পরাস্ত ও নিহত করেন। পুরস্কারস্বরূপ দিল্লির বাদশাহের অনুমতি নিয়ে তাঁকে ফতেসিং পরগনার শাসক হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। গড় নির্মাণ করে তিনি এখানে থেকে যান। জেমো-বাঘডাঙার রাজপরিবার সবিতা রায়ের উত্তরাধিকারী। রাজস্থান থেকে আগত ভল্লধারী যোদ্ধাবৃন্দও বাধ্য হয়ে এখানে থেকে যান। তাঁরা যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী হলেও চাষ-আবাদের কাজ জানতেন না। শেষ পর্যন্ত তাঁরা লেঠেল, পাইক-বরকন্দাজের জীবিকা গ্রহণ করেন। অনেকে আবার লুঠতরাজও করতেন। মা বলতেন, এই যোদ্ধারা জমিদারদের লেঠেল হিসেবে বাৎসরিক খাজনা আদায়ের সময় থাকতেন। ঘাঘরা পরে নৃত্যছন্দে বাদ্যভাণ্ডের তালে তালে তাঁরা যেতেন। দস্যুদলের আক্রমণ হলে তাঁরা বীরদর্পে ঢাল-তরোয়াল-বল্লম-লাঠি নিয়ে প্রতিহত করতেন। আগেকার দিনে বিয়ে পালকি সহযোগে হেঁটে হেঁটে যেত সেই সময় দুস্য ডাকাত দল যে কোনো সময়ে হানা দিত সেই জন্য বিয়ের বরযাত্রীর সহিত কিছু আগে ও শেষে নৃত্য করতে করতে যেত এই রায়বেঁশের দল এরা এক এক জন ১০ থেকে ১৫ জন ডাকাতকে একা প্রতিরোধ করতে পারতো। যাইহোক এঁরাই পাশাপাশি বসবাসকারী হরিজনের হাড়ি, বাগদি, ডোম, বায়েনদের নিয়ে রায়বেঁশে দল গঠন করেন। রায়বাঁশ থেকে রায়বেঁশে নামের উদ্ভব বলে অনেকে মনে করেন। রাই বেশ (রাধা বেশ) থেকে রাইবেশের উদ্ভব কথাটিও বলা যেতে পারে। এই ভল্লা জনগোষ্ঠীর বসতিকেন্দ্র সংলগ্ন মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, বর্ধমানের একটি নির্দিষ্ট এলাকায় রাইবেশে দলগুলির সৃষ্টি হয়েছে এবং এগুলিই তাদের বিকাশকেন্দ্র। এঁরা প্রধানত গ্রাম্য বিয়েতে অংশ নিয়ে জীবিকা চালান। ইদানীং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এঁরা বহু অনুদান পাচ্ছেন ও দেশের নানা স্থানে রাইবেশে প্রদর্শন করছেন। গত শতাব্দীর তিরিশের দশকে গুরুসদয় দত্ত মশাই বীরভূমের জেলা শাসক হিসেবে এসে রাইবেশের সঙ্গে পরিচিত হন। সে সময় ব্রিটিশ সরকার ভল্লাদের অপরাধপ্রবণ গোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। এই অভিশাপ থেকে তিনি তাঁদের মুক্তি দেন ও জীবনের মূল স্রোতে নিয়ে আসেন। রাইবেশে নৃত্যকেও পুনরুজ্জীবিত করেন। এই নৃত্যশৈলীর সহায়তায় স্বদেশ হিতৈষণা ও সমাজসেবাকে একীভূত করে তিনি একটি অসাধারণ নৃত্যশৈলী উদ্ভাবন করেন, যা আজও ব্রতচারী হিসেবে সগর্বে প্রচারিত। আজও মুর্শিদাবাদ জেলার খড়গ্রাম থানার রতনপুর গ্রামে নবোদয় রায়বেঁশে সমগ্র ভারতবর্ষে নিজেদের নাম প্রতিষ্ঠিত করে আছে। কয়েক বছর আগে সোনি টিভিতে এক ড্যান্স প্রোগ্রামে এদের নৃত্য ভঙ্গির মাধ্যমে নিজেদের প্রদর্শিত ক্রীড়াকৌশল দেখিয়ে দর্শকদের মনে জায়গা করে নিয়েছিল। রায়বেঁশে লোকনৃত্য নানা উত্থানপতনের মধ্যে টিকে আছে আজও, তবে রেয়ার। সত্তরের দশকে মুর্শিদাবাদে এই নৃত্য প্রায় বিলুপ্তির পথে গেলেও এখন লোকায়ত শিল্পী সংসদ তাকে পুনরুজ্জীবিত করে তুলেছেন। তাই এখনো কোনো কোনো অনুষ্ঠানে এই রায়বেঁশে নৃত্য ভঙ্গি ক্রীড়া কৌশলের মাধ্যমে সবাইকে আনন্দিত করে তোলে। আমাদের স্কুলে সুবর্ণ জয়ন্তীর সময় কোশিগ্রামের রায়বেশে নাচ দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন অনেকেই। ঐতিহ্যগতভাবে এই নৃত্য রায়বাঁশের আকৃতির অ্যাক্রোব্যাটিকসের সাথে শরীরের জোরালো এবং মাতাল চলাচল জড়িত। যার নাম থেকেই এটির উদ্ভব হয়েছিল। অভিনয়কারীরা ধনুক দিয়ে তীর ছোড়ার, বর্শা নিক্ষেপ করার এবং তরোয়াল চালানোর অঙ্গভঙ্গি করে। অভিনয়ের সময় তাদের গোড়ালির উপর একটি পিতলের নূপুর পরেন। এই নৃত্যের সাথে বাজানো হয় ঝিল্লি। এই নাচটি সম্প্রদায় উপস্থাপন বা আবিস্কার করেছিল। যারা মধ্যযুগীয় জমিদারদের দেহরক্ষী হিসাবে কাজ করেছিল। রায়বেঁশে দলকে ডাকাতদল পর্যন্ত যমের মত ভয় করত। জমি দখল বা কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক ভরসার স্থান ছিল রায়বেশে আখড়া। গোলোকপতি মশলাবাটার শিলনোড়া কুটে সংসার চালান। গোলোকপতি বলেন, এখন শিলকোটানোর রেওয়াজ নেই বললেই চলে। বাড়িতে এখন মিক্সি আর গুঁড়ো মশলার যুগ। মশলা বেঁটে খেতে পরিশ্রম বেশি হয়। আর পরিশ্রম বেশি হলেই বুদ্ধিমান মানুষ আবিষ্কার করে নব পদ্ধতির। তাই কালের প্রবাহে উঠে আসে নিত্য নতুন পদ্ধতির ব্যবহার। গোমাই গ্রামের বৃদ্ধ মানুষ এই গোলোকপতি। তিনি এখনও শিলকোটেন গ্রামে গ্রামে ঘুরে। একটা শিল নোড়া কুটতে সময় লাগে দশ মিনিট। পারিশ্রমিক পঞ্চাশ টাকা। কিন্তু তিনি বললেন, এখন আর কাজ পাই না দু একটি বাড়ি ছাড়া। তাই বাকি সময়ে অন্য কাজ করি। কখনও জলের ট্যাঙ্কি পরিষ্কার করি। কখনও বা জমির ঘাস পরিষ্কার করার কাজে রোজগার করি। তিনি বলেন, তাহলে এই শিলকোটার কাজের ভবিষ্যত অন্ধকারে নিমজ্জিত। এই শিলকোটার কাজে একটা ছেনি, একটা হাতুড়ি প্রয়োজন। বিভিন্ন ধরণের নক্সা করে শিলকোটেন শিল্পিরা। আমি হাঁক দিই সুর করে, শিল কোটাবেন গো? এই ডাকের মধ্যে এক সুর অন্তরে বাজে। আমার ছেলেরা এইরকমভাবে ঘুরে ঘুরে শিলকোটার কাজ করতে চায় না, বললেন গোলোকপতি। তিনি বললেন, আর এইসব করে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। তাই আমরাই হয়ত এই কাজের শেষ প্রজন্ম। মা বলতেন, সেই শিলা যুগে বা প্রস্তর যুগের শিল্প অচিরেই শেষ হয়ে যাবে ভাবতেই অবাক লাগে। আমার মায়ের মূল লক্ষ মানুষের সেবা করা। হয়তো তিনি আশ্রম করে যেতে পারেন নি। কিন্তু প্রত্যেক পুজোতে গরীব মানুষকে পেট ভরে প্রসাদ খাওয়াতেন। বাজারে দরদাম করে ঠাকুর কেনার পরে পুজোর ফলমূল, দশকর্মার জিনিসপত্র কিনে বাড়িতে আলপনা এঁকে ঠাকুরের প্রতিষ্ঠা হয়। তারপর পুরোহিতের পৌরোহিত্যে গৃহস্থের মঙ্গলসাধন। লৌকিক আচার, আচরণে বিশ্বাস জড়িয়ে থাকে। আর বিশ্বাসে মিলায় বস্তু। পুজোর প্রতিটি পর্যায়ে শিল্প ভাবনা বিরাজ করে। তারফলে পুজো আরো আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। দুর্গাপুজোয় ঢাক বাজে। প্যান্ডেলে কোটি কোটি টাকা খরচ করে কোনো কিছুর আদলে মন্দির বানানো হয়। যেমন, তাজমহল, খাজুরাহো, কোনারক প্রভৃতি। নানারকম বাদ্যযন্ত্র পুজেকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে। প্রত্যেক প্যান্ডেলে যদি নর নারায়ণ সেবা হতো তাহলে আরও ভালো লাগতো। সবিতাদেবী কথা বলার সঙ্গী পান না। তাই বসে বসে নিরালায় পুরোনো দিনের কথা ভাবেন।

ছয়
কাটোয়ার কার্তিক লড়াই, চন্দননগরে জগদ্ধা্ত্রী পুজো, কাগ্রামের জগদ্ধাত্রী পুজো বাংলার পুজোর জগতে বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। মা সব পুজোতেই মানুষকে খাইয়ে আনন্দ পেতেন। সঙ্গে সবিতা থাকতেন। মায়ের এই গুণ তার মধ্যেও প্রভাব বিস্তার করেছিলো। 
সবিতা দেবী এক লক্ষীপুজোর কথা মনে করছেন বসে বসে। অখন্ড অবসর তার।
পুজো এলেই মায়ের লক্ষ্মীর ঝাঁপি উন্মুক্ত হয়ে যেতো। বিরাজুল, ফতেমা আসত আমাদের বাড়ি। তাদের অনুষ্ঠানেও আমরা যেতাম। কোজাগরীর রাতে মা কম করে তিনশো লোকের খাওয়ার ব্যবস্থা করতেন। মাজা নীচু করে আসনে বসা মানুষদের প্রসাদ বিতরণ করতাম আমরা ভাই বোনেরা। পরের দিনও খিচুড়ির ব্যবস্থা থাকতো। ডোমপাড়ার সকলে এসে নিয়ে যেতো আনন্দে। সর্দার বুড়ি বেসকা দি, মঙ্গলীদি সবাই আসতো। ছোটো পিসি, মানা, বড়পিসী, সন্ধ্যা, রুনু, শংকরী সকলে আসতো। মায়ের ঘর পূর্ণ হয়ে উঠতো অতিথি সমাগমে। গম্গম্ করতো বাড়ি। মানুষই যে লক্ষ্মী তা আবার প্রমাণ হয়ে যেতো চিরকালের সত্য সুরে।
পুজোর বেশ কিছুদিন পরে মেয়েরা সকলে এক হয়ে মাংস, ভাতের ফিষ্টি করতো। মনে আছে আমার, খেতে এসে বিশাখাদি বলেছিলো, আমি বিধবা মাংস খবো কি করে? আমার মাসতুতো দিদি বলেছিলো, বিধবা আবার কি কথা? তোর স্বামী মরে গেছে। দুঃখের কথা। তার সঙ্গে মাংসের কি সম্পর্ক। আচ্ছা কেউ মনে কর মাংস খেলো না। আর মনে মনে স্বামীকে দোষ দিলো। সমাজপতিরা, সমাজের সেনাপতিরা মনের নাগাল কি করে পাবে? ওদের হাত ওই মাংস অবধি। অতএব, নো চিন্তা, ডু ফুর্তি। বিশাখাদি বলল, বিধবা হয়ে মাংস খাব। ভয় লাগছে। মা বললেন, কিসের ভয়। তোর মন চাইছে। তাহলে আপত্তি নেই। কুসংস্কার ভেঙে বাস্তবে ফিরে আয়। যেকোনো বিশ্বাস বা অভ্যাস - যেমন, এটি অজ্ঞতা থেকে উদ্ভূত হয়, বিজ্ঞান বা এর কার্যকারিতা নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি হওয়া, ভাগ্য বা জাদুতে ইতিবাচক বিশ্বাস অথবা যা অজানা তা থেকে ভয় পাওয়া। এছাড়াও "কুসংস্কার" বলতে ধর্মীয় বিশ্বাস বা অযৌক্তিকতা থেকে উদ্ভূত কর্মকাণ্ডকে বোঝায়। কুসংস্কার শব্দটি প্রায়ই একটি নির্দিষ্ট সমাজের অধিকাংশের দ্বারা অনুসরণ না করা ধর্মের কথা বলে ব্যবহৃত হয়, যদিও প্রথাগত ধর্মের মধ্যে কুসংস্কার রয়েছে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। এটি সাধারণত ভাগ্য, ভবিষ্যদ্বাণী এবং নির্দিষ্ট আধ্যাত্মিক জগতের বিশেষ করে বিশ্বাস এবং অভ্যাসগুলির ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়, বিশেষ করে এই ধারণাটি যে নির্দিষ্ট পূর্বের ঘটনাগুলি দ্বারা ভবিষ্যতের ঘটনাগুলির জন্য ভবিষ্যদ্বাণী করাকরা হয়। বিশাখাদি আনন্দে মাংস খেয়েছিলো। সমস্ত কিছুতেই চিরকাল কিছু মহিলার সংস্কারমুক্ত মনের জন্য পৃথিবী এত সুন্দর। উন্মুক্ত সমাজ আমাদের সর্দার পাড়ার। সেখানে সমাজের কোনো সেনাপতি বিধি আরোপ করে না। যে যার ইচ্ছেমতো খেটে খায়। কেউ মুনিষ খাটে, কেউ মাছ ধরে, কেউ কেরালা সোনার দোকানে কাজ করে। বুড়ো বয়সে তারা ছেলে মেয়েদের রোজগারে খায়। ওদের কাউকে বৃদ্ধাশ্রমে যেতে হয় না। কার কৃপায় ওরা বুড়ো বুড়ি হয় না? শক্ত সমর্থ থাকতেই পরকালের ডাকে ওপাড়ে চলে যায়। কাজই হলো আসল লক্ষ্মী। স্বামী বলতেন তার মায়ের কথা। তিনি বলতেন, আমার মা সাধনায় ছিলেন রামপ্রসাদ। মা রক্ষাকালীর পুজো দিতে দিতে গেয়ে উঠতেন রামপ্রসাদি। নিরামিষ মা কালীর আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে ছেলেদের নিয়ে সংসার চালাতেন জীবনানন্দ ছন্দে। অভাব থাকলেও কোনোদিন তার ছাপ পরেনি মায়ের চোখেমুখে। আসল মূল্যবান রত্নের সন্ধান তিনি পেয়ে গেছিলেন পুজোর আসনে বসে। কোনোদিন তার কথায় প্রকাশ পেতো না  সেসব কথা। তার চলনে, বলনে ফুটে উঠতো মাতৃরূপের জলছবি। মাকে দেখেই মাথা নত হয়ে যেতো সকলের। দাদু মাকে মা বলেই ডাকতেন। তিনি সময়ে অসময়ে মাকে রামপ্রসাদী শোনাতে বলতেন। মায়ের গান শুনতে শুনতে একদিন চলে গেলেন পরপারে তৃপ্ত মুখে। একবার বৈশাখি ঝড়ে আম গাছের ডাল ভেঙ্গে পড়লো। মা বললেন, তোদের দাদুর আত্মা মুক্তি পেলো। অই ডালে বাঁধা ছিলো দাদুর মুক্ত হবার লাল চেলি। অবশ্য এটা ছিলো এক সাধুবাবার তুকতাক। বুড়ি ঠাকুমা সেদিন কেঁদে উঠেছিলো জোরে। ঠাকুমা বলে উঠলেন, চলে গেলো, ও চলে গেলো। কোনো কিছুই আমরা নিশ্চিতভাবে জানি না। তবু কিছু ঘটনা বার বার তার অস্ত্বিত্বের কথা স্বীকার করে নেয়। একটা দেশি কুকুর আমাদের বাড়িতে থাকতো ছোটে থেকে। তোমরা বিশ্বাস করবে কি না জানি না? সে অমাবস্যা, পূর্ণিমায় কিছু খেতো না। রক্ষাকালী পুজোয় উপবাস করতো। তার সামনে খাবার দিয়ে দেখা গেছে সে খাবারের ধারের কাছে যেতো না। শুধু কথা বলতে পারতো না। কিন্তু ভাবে, ভঙ্গিমায় সব বেঝাতে পারতো মানুষের মতো। মা বলতেন, পূর্বজন্মে তোর সঙ্গে কোনো আত্মীয়তা নিশ্চয় ছিলো। তাই তোর আমাদের বাড়িতে আগমণ। যেদিন জিম দেহ রেখেছিলো সেদিন ওকে মাটি চাপা দিয়ে ধূপ আর ফুলে শেষ বিদায় জানিয়েছিলো সারা পাড়ার বাসিন্দা। তাহলে কি বলবে তুমি এই ঘটনাকে। কোন যুক্তিতে অস্বীকার করবে তার সারাজীবন ধরে পালন করা ব্রত, উপবাস। বলবে, কাকতালীয়। সেসব তো এক আধবার হয়। সারাজীবন ধরে নিয়মিত হয় না। বিজয়ার সময় আমার মা আমাদের পোষা কুকুর জিমকে প্রথম মিষ্টিমুখ করাতেন। ধান রাখার গোলার তলায় একবার গোখরো সাপ দেখে, ঘেউ ঘেউ শব্দ করে আমাদের দেখিয়ে দিয়েছিলো সাপটা। তারপর সাপুড়ে ডেকে সাপটি বনে ছেড়ে দেওয়া হয়। বড়দার বিছানার মাথার কাছে সে শুয়ে থাকতো। কোনো বিপদ বুঝলে ঝাঁপিয়ে পড়ত নিঃস্বার্থ ভাবে। প্রত্যেক প্রাণীর কাছে আমাদের শেখার আছে অনেক কিছু।

স্বামী চলে যাওয়ার পরে একদম একা হয়ে পড়েছিলেন তিনি। মনে পড়তো তার আদর। প্রথম ফুলশয্যার রাত। কি করে যে একটা একটা করে রাত, দিন পার হয়ে যায়, বোঝাই যায় না। তবু বুঝতে হয়, মেনে নিতে হয়। একটা ঘুঘু পাখি তার স্বামী মরে যাওয়ার পর থেকেই এবাড়িতে আসে। আম গাছের ডালে বসে আপন মনে কত কথা বলে। ঘুঘুর ঘু, ঘুঘুর ঘু। সবিতাদেবীর সঙ্গে পাখিটার খুব ভাব। মনে হয় স্বামী ঘুঘুর রূপ ধরে আসেন। তিনি আম গাছের তলায় খুদকুড়ো ছিটিয়ে দেন। ঘুঘু পাখিটা খায় আর গলা তুলু সবিতাদেবীকে দেখে। কিছু বলতে চায়। তিনি বোঝেন। আর আপনমনেই পাখিটার সঙ্গে বকবক করেন। পুরোনো দিনের কথা বলেন। ছেলের বৌ বল,বুড়িটা পাগলী হয়ে গেছে। প্রতিবেশীরা অতশত বোঝে না। হাসাহাসি করে। শুধু তার ছেলে বোঝে মায়ের অন্তরের কথা, ব্যথা। ঘুঘু পাখিটা সারাদিন ডেকে চলে। এবার আয়, এবার আয়। বুড়ি বলে, ও ঘুঘুর ঘু, বলে না। বলে,এবার আয়, এবার আয়। নাতি এসে মাঝে মাঝে ঠাকুমার কাছে বসে। আর ঘুঘু পাখিটার সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলে, এবার আয়। ফতেমার বাবা হুমায়ুন চাচা ছিলেন সংসারের বন্ধু।তাদের বিপদে আপদে খবর নিতেন। 

নাতিকে গল্প বলে ঠাকুমা। নিজের জীবনের কথা বলেন, জানিস, ছোটোবেলায় আমার বন্ধুদল ছিল। বক্রেশ্বর নদী ছিলো। গাছ ছিলো। তারাও আমার বন্ধুর দলে ভিড়ে গেয়েছিলো। নদীর ধারে বনকুলের গাছ ছিলো। তারা সাজিয়ে রাখতে আমাদের জন্য মিষ্টি কুল। আমরা আঁচলে করে, বা গামছায় বেঁধে মুড়ি নিয়ে যেতাম। ছোলাভাজা, কুসুম ফুলের বীজ ভাজা চালভাজা নিয়ে যেতাম। 
নদীর ধারে বসে জলে পা ডুবিয়ে খেতাম। নদীর জল হেঁট হয়ে বসে চুমুক দিয়ে পান করতাম। পায়ে বিভিন্ন রকমের রঙীন মাছ চুমু খেয়ে যেতো। আমরা মুড়ি খাওয়ার পরে গামছা করে রঙীন মাছ ধরতাম। আবার ছেড়েও দিতাম। তারা সাঁতার কেটে খেলা দেখাতো।

একবার সন্ধ্যা হল, আমরা আমড়া গাছে ভূত দেখেছিলাম। ভূতের কথা শুনে নাতি বললো, কি ভূত গো ঠাকুমা। ভালো না খারাপ।
তখন ভূতগুলোও ভালো ছিলো। আমাদের শুধু বলেছিলো, তিনি সন্ধেবেলা বাড়িতে পড়তে বসবি। এখন আমরা আসর জমাবো। তোরা বিকেলে খেলবি। জানিস না, তিনি সন্ধেবেলা, ভূতে মারে ঢেলা। ভূতের গল্প শুনে নাতি ঠাকুমার কোল ঘেঁষে বসতো। ঠাকুমা বলতেন, ভয় কি আমি তো আছি। ঠাকুমা সবিতা দেবী ঠাকুরকে বলেন, আর একবার সময়ের চাকাটা উল্টোদিকে ঘোরানো যায় না। তাহলে আবার ছোটো বয়সটা পাওয়া যাবে। নদীর জল খাওয়া যাবে। স্কুল ফাঁকি দিয়ে মাঠে, মাঠে ঘোরা যাবে। ঘু ঘু পাখিটা বিজ্ঞের সুরে বলে, না না না, ঘুঘু, ঘুঘু।

আজ সকাল থেকে সবিতাদেবী উঠোনের রোদে বসল আছেন। ছেলে অফিস যাওয়ার আগে আজকে প্রণাম করলো। কোনোদিন করে না তো। তিনি আশীর্বাদ করলেন ছেলেকে প্রাণভরে। ছেলে বললো, সাবধানে থেকো। আজ ওরা পিকনিক করতে যাবে পুকুরের ধারে। ছেলে চলে গেলো। এখন শীতকাল। পিকনিকের সময়। সবিতা দেবী উৎসাহ দিতেন, যাবে বৈকি। নিশ্চয় যাবে। তারাও যেতেন। যুগে যুগে পরম্পরা এইভাবেই তো ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। ভাবেন সবিতাদেবী। বৌমা নাতিকে দিয়ে একবাটি মুড়ি, তরকারী নামিয়ে দিয়ে গেলো। ঠাকুমা খিদে পেলে খাবে। ঠাকুমা বললেন, বেশ বাবা। তোমরা যাও। আমি ঠিক খেয়ে নেবো। মনে পরে গেলো একবার ফাঁকা বাড়ি পেয়ে রান্না করে খেয়েছিলেন। পুড়ে গেছিলো তরকারীটা। সেই প্রথম রান্নার অভিজ্ঞতা। তারপর দুপুরবেলা তালবোনা পুকুরে সাঁতার কেটে তাল কুড়িয়ে এনেছিলেন। সব মনে আছে। আরও মনে পরছে পাড়ার ধীরেন ফাঁকা বাড়ি পেয়ে তার কাছে এসেছিলো। খুব ভালে ছেলে। অনেক গল্প হয়েছিলো। একটা চুমু খেয়েছিলো। আর কিছু নয়। বলেছিলো, সারা জীবন এই স্মৃতি মনে থাকবে তার। ধীরেন এক বছর পরে ক্যান্সারে মারা গেছিলো। কিন্তু কিশোরী সবিতার কাছে সে অমর হয়ে আছে।
স্বামীকে সব কতা খুলে বলেছিলো। বড় সরল তার মন। বলার ফলে অশান্তি হয়েছিলো অনেক। একজন মৃত মানুষ জীবন্ত হয়ে উঠেছিলো সংসারের টানা পোড়েনে। তারপর বয়স বাড়লে তার স্বামী বুঝেছিলেন পাগলামীর কথা। তখন তার গোপন বাল্যপ্রেমের কথা তিনি বলেছিলেন সবিতা দেবীকে, যখন তখন নয়নার ছবি ভেসে উঠতো নয়ন জুড়ে। তবু সেকথা বলা হয়নি আজীবন। দূর থেকে শুধু দেখা আর দেখা। সে দেখা মৃত্যুর আগে অবধি ছিলো অন্তরজুড়ে। সবিতাদেবী এক মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে যৌবনে বিকেলে যখন বেড়াতে যেতেন তখন সবাই তাকিয়ে দেখতো। ছেলে বড়ো। মেয়ে ছোটো। মেয়েকে অনেকে ভালোবেসে চকলেট দিতেন। মেয়ে আর একটা হাত পেতে বলতো,আর একটা দাও। দাদা খাবে। ছোটো থেকে আমরা সবাই ভাগ করে খাবো, এই আদর্শে মানুষ তার ছেলে মেয়ে। ভারতীয় দর্শন তো সেই কথাই বলে। স্বামী অসীম চাকরী করতেন বেসরকারি একটা কারখানায়। ম্যানেজার ছিলেন তিনি। ছোটো থেকে নিজে অনেক কষ্ট করেছিলেন। মুদিখানা দোকান ছিলো তার বাবার। বৃদ্ধবাবা, বাজার যেতে পারতেন না। তখন রাস্তায় ছিলো মাটির ধুলো। বৃষ্টি পড়লে কাদায় পিছল হয়ে যেতো পথ। তবু মাথায় করে বয়ে আনতেন নুনের বস্তা, যার ওজন ছিলো ষাট কেজির মতো। অমানুষিক পরিশ্রম করে বড় হয়েছিলেন তিনি। পেট ভরে দুবেলা খাবার জুটতো না। সবিতাদেবীর খুব খারাপ লাগতো। তাই তিনি তার দাদা, দুকড়ি কে সব কথা খুলে বলেন। দুকড়ি দাদা কলকাতায় কাজ করতেন। অনেক মাড়োয়ারি, কারখানার মালিকের সঙ্গে তার জানাশোনা ছিলো। তিনি অসীমকে একটা কারখানার ম্যানেজার পদের চাকরী জোগাড় করে দিলেন। অসীম নিজের দুঃখের কথা ছেলেমেয়েদের কোনোদিন বলেন নি। তিনি ছেলে ও মেয়েকে জমিদারের সন্তানের মতো মানুষ করেছিলেন। ঝুলনের দিনে পুতুলে ভর্তি হয়ে যেতো ঘর। ছেলেমেয়েরা ঝুলন সাজাতো। আর অসীমবাবুর খুব ভালো লাগতো। ছোটোবেলার নিজের না পাওয়ার দুঃখ তিনি ভুলে যেতেন। দোলের সময় ছেলে মেয়েকে কিনে দিতেন নতুন জামা। সেই জামা পরে তারা দোল খেলতো। মিষ্টি, মাংস, ফল কিছু বাকি থাকতো না। কত লোক আসতো তার বাড়িতে রং মাখাতে। তারপর মিষ্টিমুখ করে ফিরে যেত রাম রাম বলে। আমরা শ্রদ্ধেয় লোককে দেখে যেমন নমস্কার করি। যারা হিন্দীভাষী তারা শ্রদ্ধেয় গণ্যমান্য লোককে দেখলে বলে, রাম রাম রায়বাবু। লিলুয়া শহরে পটুয়াপাড়ায় বাসা ভাড়া করে থাকতেন অসীমবাবু। তারপর একদিন তার গ্রামের ভাই মরে গেলো কম বয়সে। জীবন ওলট পালট হয়ে গেলো। চাকরী ছেড়ে আবার চলে গেলেন গ্রামে। জমানো পয়সা, সোনাদানা সব খরচ হয়ে গেলো। ধার, দেনা করে কোনোরকমে একটা দোকান করলেন। মুদিখানা। আবার শুরু হলে জীবন সংগ্রাম। মেয়ের বিয়ে হলো কোনোরকমে। ছেলের তখনও চাকরী হয় নি। শরীরের ওপর চাপ খুব বেশি হয়ে পড়লো। তার ফলে অল্প বয়সে মারা গেলেন তিনি। এবার দোকান চালায় ছেলে। দোকান বেশিদিন চালাতে হলো না। ছেলে চাকরী পেলো। সেদিন খুব আনন্দ হয়েছিলো সবিতাদেবীর। মনে পড়ে তার, একবার সুতিকা হয়েছিলো তার। পেট ফেঁপে যেতো। বারবার পায়খানা যেতে হতো। তখন মাঠে, ঘাটে সারতো সবাই। শ্বশুরমশাই খাল কেটে দিয়েছিলেন। তারপর শুয়োগাছি গিয়ে সাধুবাবার কাছে শেকড়, বাকড় খেয়ে বাবা ভূতনাথের দয়ায় অসুখ ভালো হয়েছিলো। শুয়োগাছি থেকে আসার সময় মেয়েটাকে সারা রাস্তা কাঁধে করে এনেছিলো ছেলে। বাড়িতে এসে দেখলেন, শ্বাশুড়ি মরে গেছেন। শ্বাশুড়ির ছোটো মেয়েটা ভুগছিলো খুব। কাঠির মতো শরীর হয়ে গেছিলো। শ্বশুর বললেন সবাইকে, ওর মরদেহের সঙ্গে মেয়েটাকেও বেঁধে দাও। ও তো আর কদিন পরেই মরবে। কিন্তু সেই মেয়ে বড়ো হয়ে গ্রামের শ্রেষ্ঠ সুন্দরী হয়েছিলো। রাখে হরি মারে কে? সবিতাদেবী ভাবেন ঈশ্বরের করুণার কথা। যাইহোক, চাকরী পাওয়ার পরে ছেলের বিয়ে দিলেন সবিতাদেবী। এখন ছেলে, ছেলের বৌ আর নাতি এই নিয়ে তার সংসার। কোনো কিছুর  অভাব নেই। তবু সবিতাদেবীর মনে হয়, আগের দিনগুলোই ভালো ছিলো। অভাব থাকলেও শান্তি ছিলো হৃদয় জোড়া। যাইহোক এখন বয়স হয়েছে। ভালোমন্দ সব সমান মনে হয়। 

বাথরুম যেতে গিয়ে কলতলায় পা পিছলে পরে গেলেন সবিতাদেবী। বুকটায় খুব ব্যাথা করছে। ঘুঘু পাখিটা নিচে নেমে এসেছে গলা কাঁপিয়ে কি দেখছে পাখিটা। তিনি ভাবছেন, আমাকেই দেখছে। একি হলো। আর কিছু দেখতে পাচ্ছি না কেন?। চিৎকার করার ইচ্ছে হলেও গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোলো না। তার বাবা, মা, স্বামীকে এবার দেখতে পাচ্ছেন। আর দেখছেন, তিনি ঘুঘু পাখি হয়ে গেছেন। একটা শীর্ণ শরীর পরে আছে কলতলা জুড়ে। তার শরীর বেশ হাল্কা লাগছে। ঘুঘু পাখিটার সঙ্গে উড়ে চলে গেলেন খোলা আকাশের নীচে।

সাত
সন্ধেবেলা ছেলে, বৌমা, নাতি এসে দেখে, মা পরে আছে কলতলায়। শরীর কাঠ হয়ে গেছে। সবাই ধরাধরি করে নিয়ে এলো বারান্দায় দড়ির খাটে। আর চাদর, বিছানা নষ্ট করে লাভ নেই। বৌমা ভাবছে। নাতি বললো, একটা চাদর ঢাকা দাও ঠাকুমাকে। ঠান্ডা লাগবে। ছেলে একটা সাদা শাড়ী এনে ঢাকা দিলো। তারপর পাড়ার লোকজন এসে নিয়ে গেলো শ্মশানে। সব মিটে গেলো পনেরো দিনের মধ্যেই।
এখন ছেলে একা। তার ছেলেও বড়ো হচ্ছে। সমানে অনন্তকাল ধরে চলেছে এই প্রবাহ। ছেলে ভাবছে, মা নেই, বাবা নেই। মন খারাপ। এবার তার মনের খবর কে নেবে? মায়ের কাছে সময় দিতে পারেনি। শুধু কাজ, কাজ আর কাজ। আর এই কাজ শেষ হলে সেও একা হয়ে পরবে। আজ কবি বন্ধু বাড়িতে এসেছে। বেশ ভালো লাগছে। বন্ধু বলছে, জন্ম, মৃত্যু তো থাকবেই। সত্যকে মেনে নিতে হয়। তাহলেই আনন্দ। সে বলছে, তবু সব কিছুর  মাঝেই ঋতুজুড়ে আনন্দের পসরা সাজাতে ভোলে না প্রকৃতি। সংসারের মাঝেও সাধু লোকের অভাব নেই। তারা মানুষকে ভালোবাসেন বলেই জগৎ সুন্দর  আকাশ মোহময়ী, বলেন আমার মা। সব কিছুর মাঝেও সকলের আনন্দে সকলের মন মেতে ওঠে। সকলকে নিয়ে একসাথে জীবন কাটানোর মহান আদর্শে, আমার দেশই আদর্শ।
সত্য শিব সুন্দরের আলো আমার দেশ থেকেই সমগ্র পৃথিবীকে আলোকিত করুক। 
আমি বললাম, এক নাগাড়ে বকে গেলি অনেকক্ষণ। বন্ধু বললো, তুমি আরও কিছু বলো। সেই জন্যই তোমার কাছে আসা। আমি আবার বলতে শুরু করলাম, আমার কথা আমার গোপন কথা। আমার অনুভবের কথা। কবি বন্ধু আমার কথা শুনতে ভালোবাসে। সে সংসারী। তবু সব কিছু সামলে তার কবিতা তো লিখে চলে।
আমি বন্ধুকে বলতে শুরু করলাম শরত জীবনের কথা। এবার আমার জীবনের পরবর্তী অঙ্ক শুরু।তারপর শুরু হলো আমার জীবনের রোজনামচা। আমি ট্রেনে এখন রবির সঙ্গেই যাওয়া আসা করি। রবির সঙ্গে আমার খুব ভাব। অন্তরঙ্গ বন্ধু আমার। তাছাড়া ধীরে ধীরে আরও বন্ধু হলো। রবি বললো, শোন আমার একটা কবি সম্মেলনের আলোচনার কথা। এই ট্রেন জার্নির অভিজ্ঞ তার কথা।
রবি বলছে, যে সব মানুষ অন্ধ, খোঁড়া কিংবা বার্ধক্যের কারণে মানুষের সাহায্য চেয়ে বাঁচতে চান তারা ভিখারি নন।
একটা সাহিত্য সম্মেলনে রবি বক্তব্য রাখছিলো। বিষয় হলো, ভিখারি- আপনার চোখে। স্টেজে উঠে গল্পটা বলছিলো।
রবি আবার  শুরু করলো তার বক্তব্য, দাঁড়িয়ে। সামনে অনেক কবি, সাহিত্যিক, ও আরও অনেক গণ্যমান্য মানুষ বসে আছেন, তাদের আমি সকলকে শ্রদ্ধা জানাই। আমি বলছি অভাবের কারণে, রোগের কারণে যারা ভিক্ষা করেন তারা ভিখারি নয়। কারণ বাঁচার অধিকার জ্ঞাপন করার জন্য তারা মানুষের দ্বারস্থ হন। বাঁচতে চাওয়া, একমুঠো খেতে চাওয়া তো অন্যায় নয়। মানুষকে ঠকিয়ে যারা টাকার পাহাড় গড়ে তোলে সত্যিকারের ভিখারি তারাই।
সে বলে চলেছে, আমি ভিখারি দেখেছি অনেক। সেই গল্প আমি আপনাদের শোনাবো। সবাই একবাক্যে বলে উঠলেন, বলুন, আমরা শুনতে চাই। 
রবি বলছে, যাদের প্রচুর আছে অথচ সামান্য পেনশেন ভোগীর কাছে ঘুষ নেয়, বিধবা মহিলাকে মৃত স্বামীর জমানো হক্কের টাকা পাইয়ে দেবার আগে তাকে শোষন করে ছারপোকার মতো তারাই প্রকৃত ভিখারি। এবার আমি আমার লেখা গল্প পাঠ করছি।
আমার বন্ধু আমার সঙ্গেই আসা যাওয়া করতেন। তিনি থাকলে আমার একাকিত্ব দূর হতো। দুজনে গল্প করতে করতে সময় কখন যে পার হয়ে যেতো বুঝতেই পারতাম না। আর এক বন্ধুর নাম সুকুমার। সুকুমার বললেন, দেখুন ট্রেন চলাকালীন বাইরের দৃশ্য মনোরম। দুর্গাপূজা হয়ে গেছে। কাশফুলগুলো মন খারাপ করে মাথা দোলানো বন্ধ করেছে। বৃষ্টি হয়ে গেলো। একটা ভ্যাপসা গরম মন আরও বিষন্ন করে তুলেছে।
আমি বললাম, আপনি তো বেশ কবির মতো কথা বলছেন। ঠিক বলেছেন। ট্রেনের ভিতরটা একবার দেখুন। কেউ বাদাম খেতে ব্যস্ত। কমবয়সীএকটা ছেলে একদৃষ্টে কলেজ ছুটির পরে বান্ধবীর দিকে তাকিয়ে আছে। তার তাকানো দেখে পাশের মেয়েটি মাথা ঘুরিয়ে দাঁড়ালো। একটা সমগ্র দোকান বয়ে বেড়াচ্ছে বুকে হরেক মাল সাঁটানো ফেরিওয়ালা। ফ্রিতে হজমিগুলি খেতে ব্যস্ত যাত্রী পাঁচজন। কিন্তু কেনার লোকের অভাব। একজন যাত্রী ভাবুক মনে সব কেনা কাটা দেখছে এক মনে। কেউ হিন্দীভাষী, কেউ ওড়িয়াভাষী, কেউ সাঁওতাল। সকলের সমান অধিকার। ট্রেনের একটা কামরা যেনো দেশ। আত্মীয় পরিজন নিয়ে উঠে খাওয়া দাওয়ায় ব্যস্ত। সোমড়াবাজারের মোহন ভোগ মানুষের রসনা মোহিত করে রেখেছে।
বন্ধু আর আমি কথা বলতেই ব্যস্ত। বড়ো ভালো লাগে ট্রেনের এগিয়ে যাওয়ার গতি। তারপর স্বস্থানে ফিরতে হবে সবাইকে।
আমার চোখে ট্রেনের কামরাটা গোটা পৃথিবী হয়ে উঠেছে। লন্ডন থেকে আসা লাল রঙের লোকটা নবদ্বীপে নেমে গেলো হরে রাম, হরে রাম ধ্বনি দিতে দিতে। তারপরই বিষ্ঞুপ্রিয়া হল্ট। আর সেখান থেকেই আধঝুড়ি আপেল নিয়ে এক বিক্রেতা উঠলেন।
তিনি হেঁকে চলেছেন, আপেল, কাশ্মীরী আপেল। এক কেজি সত্তর, পাঁচশো চল্লিশ টাকা। দেবো নাকি? ডিলিশাস, খেয়ে দেখুন।

এদিকে  শসাওয়ালা বলছেন, দেবো নাকি ছাল ছাড়িয়ে, নুন মাখিয়ে...
আপেল দেখলাম। খুব ভালো। দুজনেই নিলাম। আর ফুল ফ্যামিলি নিয়ে যে ধনী লোকটি এতক্ষণ সব কিছু দরদাম করে কানের পোকা মারছেন, তিনি এবার ডাকলেন, এই আপেল, এদিকে আয়।
----যাই বাবু, আপেল...
--- কই রে, কত করে
-দিলাম সত্তর করে। 
---- না না ষাট টাকার বেশি দেবো না।
তারপর অনেক কথা ক্ষয় করে বাবুটি পাঁচশো আপেল নিলেন। তারপর আমরা দুজনেই দেখলাম পঞ্চাশ টাকা তার হাতে দিলেন।
স্টেশনে এবার নামতে হবে। তাড়াতাড়ির মাথায় আপেলওয়ালা একশো টাকা মনে করে পঁয়ষট্টি টাকা ফেরত দিলেন বাবুটিকে। বাবু অম্লান বদনে নিয়ে নিলেন টাকা। আমরা দুজনেই প্রতিবাদ করলাম। আমি বললাম, আপনি তো পঞ্চাশ টাকা দিলেন। তাহলে কোন আক্কেলে আবার এতগুলো টাকা নিলেন।
বাবু বললেন, আমি একশো টাকা দিয়েছি। মুখ সামলে কথা বলবেন।
আপেলওয়ালা বললেন, আমার ভুল হয়েছে। দেখুন আপনি ভালো করে। আপনি পঞ্চাশ টাকা দিয়েছেন। বাবুটি সমানে তর্ক করে চলেছেন।
আপেলওয়ালা বললেন, বেশ আপনাকে আমি ভিক্ষা দিলাম।  এই বলে তিনি নেমে গেলেন।
তারপর দেখলাম বাবু বিজয় গর্বে বলছেন, এই সুযোগ কেউ ছাড়ে মশাই। একদম ফ্রিতে আপেল। তারপর আপেলে কামড় দিয়ে বললেন, আপনাদের দেখে নেবো। পরের স্টেশনে আমি নামবো। তারপর দেখছি।
আমার বন্ধুটি বললেন, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভিখারি আপনি। আপনার ক্ষমতা কই? আপনি তো নিঃস্ব রিক্ত। আপনাকে দেখে আমাদের দয়া হচ্ছে। বাবুটি ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেলেন। ওনার স্ত্রী চোখের ঈশারায় চুপ করতে বললেন স্বামীকে। পরের স্টেশনে ওনারা নেমে গেলেন।
বন্ধু বললেন, ভিখারি এরেই বলে... আমার গল্প এখানেই শেষ। এই বলে রবি সকলকে নমস্কার জানিয়ে বসে পড়লো। করতালি দিতে ভুলে গেলো অনেকেই...ট্রেন থেকে নেমে আমরা চলে গেলাম বাড়ি।

ছোটোবেলার মজার কথা বলতে, ভাবতে খুব ভালো লাগে। সারা রাত পুজো দেখতে গিয়ে বন্ধুদের দলের একজনের খুব টয়লেট যাবার প্রয়োজন হলো। বন্ধু পড়লে লজ্জা পাবে। নামটা নকল বলি। হেগো, হাগুর জন্য ছটফট করছে। সামনে কোনো ব্যবস্থা নেই। হেগো কাপড়ে চোপড়ে হবার আগে প্যান্টের বোতাম খুলে ফেলেছে। একটা ড্রেনে বসতে যাবে এমন সময়ে বাড়ির মালিক বলছেন, একি আমার বাড়ির সামনে, খোলা স্থানে, আরে ছি, ছি,...
হেগো বলছে, মেসোমশাই একটুখানি, এক সেকেন্ড...
----- আরে, আরে,বেয়ারা..
মেসো ততক্ষণে নাক চেপে ধরেছেন। হেগো তখন মরিয়া। কাজ সাবাড়। মার ছুট। মেসো আমাদের বললেন, তোমরা চেনো।
আমরা বললাম, না না। ব্যাটাকে ধরতে পারলেন না।
------ কি করে ধরবো। জল নেই। তবু, শালার ঘেন্না নেই।
বন্ধু বিপদমুক্ত হলে আমাদের আনন্দ হয়েছিলো। আবার সাঁতার শিখতে গিয়ে, ছোটোবেলার রায়পুকুরের রাধা চূড়ার ডালটা আজও আমায় আহ্বান করে হাত বাড়িয়ে। এই ডাল ধরেই এলোপাথারি হাত পা ছুড়তে ছুড়তে সাঁতার শিখেছি আদরের পরশে। ডুবন্ত জলে যখন জল খেয়ে ফেলতাম আনাড়ি চুমুকে, দম শেষ হয়ে আসতো তখন এই ডাল তার শক্তি দিয়ে ভালোবাসা দিয়ে জড়িয়ে ধরতো অক্লেশে। হয়তো পূর্ব জন্মে আমার দিদি হয়ে যত্ন আদর করতো এই ডালটা। কোনোদিন তাকে গাছ মনে করিনি আমি। এখনও জল ছুঁয়ে আদরের ডাক শুনতে পাই পুকুরের ধারে গেলে। রাধা নামের মায়াচাদর জড়ানো তার সবুজ অঙ্গে। ভালো থেকো বাল্য অনুভব। চিরন্তন প্রকৃতির শিক্ষা অঙ্গনে নাম লিখে যাক নব নবীন শিক্ষার্থী প্রবাহ। আমি এইসব ভাবছি। এমন সময় পিছন দিক থেকে একটা বড় পাঁঠা আমাকে গুঁতিয়ে জলে ফেলে দিলো। খুব রাগ হলো কিন্তু পাঁঠার সঙ্গে লড়াই করতে লজ্জা হলো। যদি কেউ দেখে ফেলে। তারপর গাজনের রাতে স্বাধীন আমরা। সারা রাত বোলান গান শুনতাম। সারা রাত নাচতাম বাজনার তালে তালে। সবাই মনে করতো, ব্যাটারা গাঁজার ভক্ত নাকি। গাজনে একজন হনুমান সেজেছিলো। আমরা তার লেজে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিলাম। পরে দেখলাম লোকটা রাগ করে নি। বলছে, লঙ্কা পুড়িয়ে ছারখার করে দেবো।
আর হনুমান লাফিয়ে শেষে জলে ঝাঁপ দিলো। চারদিকে প্রচুর লোকজন ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে।
বন্ধু রবি বলছ, ঠিক বলেছিস। তোর কথা শুনলাম। রবি আর আমি বসে গল্প করছি। 
এবার শোন আমার দাদুর কথা। আমার হৃদয়ের কথা। তোকে শোনাতে পারলে ভালো লাগবে। রাগ, হিংসা, ক্রোধের সংমিশ্রণে সংসার স্রোতে ভাসতে ভাসতে জীবন প্রবাহ এগিয়ে চলে। হয়তো এর ফলেই দাদুর শেষজীবনে সেবার সুযোগ পেয়েছিলাম আমরা। আমি নিয়ম করে দাদুকে গীতাপাঠ করে শোনাতাম। দাদু কত গল্প বলতেন। কোনোদিন হা পিত্যেশ করতে দেখিনি। আমার সময় কাটতো দাদুর কাছেই বেশি। পড়াশোনার ফাঁকে চলতো গীতাপাঠ। আমি জিজ্ঞেস করতাম, দাদু মরণের পরে আমরা কোথায় যাই? দাদু বলতেন, জানি না ভাই। তবে।। মরণের পরে যদি যোগাযোগ করা যায়, তাহলে আমি তোকে নিশ্চয় জানাবো। দাদু বলতেন, আমি যখন শেষ বিছানায় শোবো, তখন আমি ঈশারা করবো হাত নেড়ে। তখন তুই গীতার কর্মযোগ অধ্যায় পড়ে শোনাবি। তোর মঙ্গল হবে। আমিও শান্তিতে যেতে পারবো। হয়েছিলো তাই। কর্মযোগ পাঠ করা শেষ হতেই দাদুর হাত মাটিতে ধপাস করে পরে গেলো। দাদু ওপাড়ে চলে গেলেন হেলতে দুলতে চারজনের কাঁধে চেপে। মাথাটা দুই বাঁশের ফাঁক গলে বেরিয়ে ঝুলছিলো। আমি বলে উঠলাম, ওগো দাঁড়াও দাদুর লাগবে। মাথাটা ঠিক কর বালিশে দি। কেঁধো বললেন, মরে গেয়েচে। ছেড়ে দে। আমি বললাম, না ঠিক করো। তারপর ঠিক করলো দাদাভাই, দাদুর মাথাটা বালিশে দিয়ে।  
অনেক বছর অপেক্ষা করেছি, দাদুর কথা শুনবো ওপাড় থেকে। যোগাযোগের উপায় থাকলে নিশ্চয় করতেন। কিন্তু কোনোদিন স্বপ্ন পর্যন্ত দেখিনি। কথা শোনা তো দূর অস্ত। ট্রেন কাটোয়া ঢুকে পড়েছে। যে যার নিজের রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগলো। আমি বাড়ি এসেই খাওয়া দাওয়া করে বেরিয়ে পড়লাম ফাঁকা মাঠে হাওয়া খেতে। বন্ধুরা সবাই বেড়াতে আসে মাঠে। গল্পগুজব করতে করতেই সবাই বাড়ি ফিরলাম। তারপর কিছু ছেলেমেয়ে পড়তে আসে। তারা চলে গেলে সপরিবারে রাতের আহার সারি।
সকাল হলেই বন্ধু আশীষের খোঁজ নিতে গেলাম। ও ফিরে এসেছে ভেলোর থেকে। খবর ভালো নয়।

আশীষ নামের সীমাহীন আনন্দমাখা ছেলেটা ভেলোরে গিয়ে জানতে পারলো, তার হার্ট বড়জোর আর দুবছর চলবে। এত কথা জেনেও কোনোদিন মুষড়ে পরেনি তার মন। ফুটবল খেলতে ভালোবাসতো ছেলেটা। সারা বিকেল ছুটে ছুটে সে আনন্দ মাখতো সারা গায়ে। আলো নামের আলো মনের মেয়েটা জেনেশুনে তার সমস্ত কিছু দিয়েছিলো দুদিনের আনন্দের দেবদূতকে। পৃথিবীর রঙ, রূপ, রস সে একশো বছরের পরমায়ুর মতো পেয়ে গিয়েছিলো মনের প্রসারতায়। কেউ তাকে সান্ত্বনা দিতে এলেই কথা ঘুরিয়ে তার চোখে এঁকে দিতো স্বপ্ন।
তার সঙ্গে ঘুরতে গেছিলাম মুর্শিদাবাদের রামপাড়া। পাঁচুন্দির হাট থেকে গরু, মোষ কিনে গঙ্গা পাড় হয়ে নিয়ে গিয়ে গ্রামে বিক্রি করত মুসলমান চাচারা। তাদের বাড়িও কতবার গিয়েছি আমরা। অনেক পুরুষধরে চলে আসছে আমাদের এই আত্মীয়তা। 
গঙ্গার ধারে আশীষের  গ্রামটি। এই গ্রামেও হিন্দু, মুসলমান বাস করে আসছে চোদ্দ পুরুষ ধরে।ছোটো হলেও আমরা বন্ধুরা প্রত্যেকটি বাড়ি বাড়ি ঘুরেছি। কারো বাড়ি স্নান করা, কারও বাড়িতে খাওয়া দাওয়া। কারও বাড়িতে গান বাজনা করেই দিন চলে যেতো। দুর্গাপুজোর বিসর্জনের দিনে নৌকা করে ঠাকুর বিসর্জন দেখলাম। গঙ্গার ধারের সব গ্রামের ঠাকুর নৌকো করে মাঝ গঙ্গায় এনে বিসর্জন করা হচ্ছে ঢাক, ঢোল বাজিয়ে। দেখতে দেখতে সন্ধ্যা নেমে এলো। সন্ধ্যা নেমে এলো আশীষের জীবনে। রাত হওয়ার আগেই পাড়ি দিলো ভবসাগরের ওপাড়ে। তার সংসারে বাবা, মা, তিন বোন। আশীষের বাবাকে আমি জামাইবাবু বলতাম। তিনি কলকাতা লালবাজারের কমিশনারের দপ্তরে কাজ করতেন। তার দাপট ছিলো ভীষণ। তার নামে বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খেতো। তিনি ছেলের শোকে মারা গেলেন। দিদি কয়েক মাসের মধ্যেই চলে গেলেন। বড্ড প্রাণপ্রিয় ছিলো তার আশীষ। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। রামপাড়ার বাড়িতে আর কেউ নেই। কতকগুলো ঘুঘু মনখারাপের ডাক ডেকে চলে নিশিদিন। ওই নিরীহ পাখি মানুষকে সত্য, সুন্দরের বাণী শোনায় আজীবন। বড্ড প্রিয় আমার এই ঘুঘু পাখি। ভিটেতে ঘুঘু চড়ে না, সে মনে রাখে এই ভিটের মালিক একদিন আমাকে আশ্রয় দিয়েছিলো, আজও দিয়েছে। তাই কৃতজ্ঞ সুরে তার শোকপ্রকাশ মালিকের অবর্তমানে। আমার তাই মনে হয়। সত্য ঘটনা থেকে শিক্ষা নেওয়ার নাম ধর্ম। জীবন একটা ছোটো নাটক। জলে একমুঠো দেহছাই ছড়িয়ে গেলেই সব শেষ। রবি বলে চলেছে তার আবেগ, তার ভাবনার কথা।

কি করে একটা সাজানো বাগান তছনছ হয়ে যায়। বন্ধু রবি বললো, তবু কিছু মানুষের এত অহংকার। তারা মনে করে মৃত্যু বোধহয় তাদের ভুলে গেছে। সে ভোলে না। হঠাৎ চলে আসে। সময় থাকতে বাড়ির কাছের মানুষের সেবা করাই ভালো। পৃথিবী সুন্দর হয়ে উঠবে, পরস্পরের সেবা, ভালোবাসার মাধ্যমে। 

এখন ভিগো ভিডিও আর টিক টক এর যুগ। মোবাইলে ক্যামেরার সামনে নেকেড সিন বা বস্ত্র হরণের রমরমা। ভাইরাল হতে সময় লাগছে না বেশি। বিশু ভাবে, এরা তো অন্য কোন ভাবনায় যুক্ত হতে পারত। আবার ভাবে তাহলে হয়ত লক্ষ  লক্ষ লাইক পেত না, ভাইরাল হত না ভিডিও। সে ভাবে আমাদের ছোটবেলায় এসব হত না। শুধু ছোটাছুটি আর খাওয়ার পালা। শক্তিমান সিরিয়াল দেখে টিভিতে সময় কাটত কিছুক্ষণ। বেশির ভাগ সময় মগ্ন থাকতাম আপন সৃষ্টিকর্মে। ছবি আঁকা, তবলা বাজানো আর গৌরীর প্রেমে হাবুডুবু খেতাম। কোনোদিন গৌরীর সঙ্গে সামনাসামনি কথা হয়নি। শুধু চিঠি চালাচালি হত ভোরবেলা। তারপর ওদের বাড়িতে আগুন লাগলো রহস্যজনকভাবে। এদিক ওদিক হয়ে গেল প্রেম। হারিয়ে যাওয়া মালার মত প্রেমের বিরহ মা সুনীল আমি জ্যোৎস্না, বিশু, রমেন ও আরও অনেক বন্ধুগণ। জল, কাদা শুরুর ইতিহাস স্বপ্নছবি হয়ে আ আসলো। লোহার কোদাল, দুনি, গোরুর গাড়ির চাকা, লাঙল প্রভৃতি তৈরি হলো। গোরু বা মোষের কাঁধে লাঙল বেঁধে বোঁটা ধরে ধীরে ধীরে সারা জমি কর্ষণ করা হতো। মাদা কেটে দুনি দিয়ে পুকুরের জল জমিতে ফেলা হতো। তারপর বীজ ছিটিয়ে বিভিন্ন শস্যের উৎপাদন করা হতো। আলের বার নেওয়া, বীজ মারা, মাদা, দুনি, মুনিষ, ছিটেন মারা, বীজ পোঁতা, নিড়েন দেওয়া এসব চাষবাসের আঞ্চলিক কথা বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। হেমন্ত কাকা ও বড়দা, মদনকাকা কৃষিকাজে অভিজ্ঞ ছিলেন বলে গ্রামের সবাই পরামর্শ করতে আসতেন বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে। আমি ছোট থেকেই দেখেছি, সন্ধ্যাবেলা মুনিষরা সকলে কাজের ফাই ফরমাশি শুনে সকালে জমিতে গিয়ে সেইসব কাজ করতো। জমি দেখতে সকালে জলখাবার নিয়ে যেতো বাড়ির ছোটোরা। দুপুরে যখন মুনিষরা ভাত খেতো সে দেখার মতো ব্যাপার হতো। বড় বড় জামবাটিতে ভরতি ভাত, মোটা তরকারি, ডাল, মাছ, চাটনি, কাঁচালঙ্কা আর পিঁয়াজ। কি সুন্দর শৈল্পিক ছোঁয়া খাওয়ার মধ্যে। কেটিপতিরা খাবার সময় এই আনন্দ পায় কি? আমার মনে হয় পায় না। খাওয়ার আনন্দ পেতে গেলে খিদে চিনতে হয়। আর খিদের মতো উপহার পেতে গেলে দৈহিক শ্রমের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে হয়। তা বলে শুধু খিদের জ্বালায় জ্বলতে কার ভালো লাগে। কবে আসবে সেই দিন। সব খিদে পাওয়া মানুষগুলো পেট ভরে খেতে পাবে। আমার বড়দা সব সময় এই কথাগুলি বলে থাকেন। 
একটা অজ পাড়াগাঁয়ের কাহিনী আমার বড়দা আমাদের বলতেন। বড়দার বন্ধু মদনকাকা। বয়সে বড় হলেও মদনকাকা বড়দাকে বন্ধু হিসাবেই দেখতেন। আজও বড়দা তার কথায় বলছেন। তিনি বলছেন, গল্প হলেও সত্য কাহিনী। বড়দা বলতে শুরু করলেন তার বন্ধু ও সেই গ্রামের কথা, শরতের শেষ সময়। ধানগাছে দুধ হয়েছে। গ্রামবাসীদের খুব আনন্দ। আর ক' দিন পরেই সোনার ধান ট্রাকটরে চেপে রাস্তা আলো করে ঘরে ঘরে ঢুকবে। কিন্তু সে গুড়ে বালি। ছাড়া জলে ডুবে গেলো গর্ভবতী ধানগাছ। প্রকৃতি বিরূপ হয় না এতটা। মানুষের মনের কথা প্রকৃতি অনেক ভালো বোঝে। কথাটা বললেন, সহজ সরল মাটির মানুষ মদন কাকা।  
মদন কাকা অনেক মজার কথা বলেন। কোথা থেকে জানেন জানি না। সুমিত বললো। সে আরও বললো, আমি এই গ্রামের ছেলে। ছোটো থেকেই দেখে আসছি মদন কাকার চলা ফেরা কথাবলা আর জ্ঞানের  অফুরন্ত ভান্ডার। তার চিরকালের সঙ্গি রেডিও। যেখানেই যান রেডিও ছাড়া যান না। সব সময় খবর শোনেন। তিনি বলেন, রেডিও আর টিভির মূল বিষয় আমার মতে এই খবর বিভাগটি। 
মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা তার ধর্ম। কত জটিল বিষয় তার কাছে জানতে গেলেই সহজ জলের স্রোতের তির তির শব্দে অন্তরে প্রবেশ করে অচিরেই। দুর্গাপুজোর পরেই সাধারণ মানুষর মনে একটা ঘুঘুর একঘেয়ে ডাক ডেকে চলে অনবরত। গ্রামবাসিরা সকলেই এই সময় একটু হাত, পা মেলে বসেন মুক্ত আকাশের বিহঙ্গের মতো। কোনো অভাবের দাগ থাকে না অন্তরে। এই গ্রামগুলোই ভারতবাসীর প্রাণ, গান। কায়স্থ পাড়াতেই মদন কাকার চোদ্দ পুরুষের ভিটে। বিশে ওই মদন কাকার গুষ্টিরই ছেলে। লতায় পাতায় বংশবৃদ্ধির কারণে একটা বাড়ির লোকজন বেড়ে চোদ্দ পুরুষের লাইন ধরেএক একটা পাড়ার সৃষ্টি করেছে। কোনোটা ঘোষাল পাড়া, কোনোটা ডোম পাড়া, আবার কেনোটা ডেঙা পাড়া। এক একেকটা গ্রামে কুড়ি থেকে তিরিশটা পাড়া থাকে। হিন্দু, মুসলমান দীর্ঘকাল ধরে একসঙ্গে এই গ্রামগুলোতে বাস করে। একটা প্রবহমান সম্পর্কের সেতু বেঁধে রাখে এই গ্রামগুলি। পাশাপাশি যত গ্রাম আছে চৈত্র মাসে গাজন উৎসবের সময় শিবের পুজোতে আনন্দে মাতে একসাথে। সমগ্র জেলা জুড়েই চলে এই মহাদেবের পুজো। অনেকে সন্ন্যাসী বা ভক্ত হয়ে সমস্বরে বাবার নামে ধ্বনি দেয়, বলো শিবো মহাদেব। মদন কাকার মতো বয়স্ক লোকেরা পরিচালনা করেন এই উৎসব। রাতে বোলানের গান শুনতে শুনতে ঘুমে ঢুলে পড়েন কাকা। তবু মন্ডপতলার গানের আসরেই সারা রাত বসে থাকেন। তার সঙ্গে প্রচুর ছেলে, মেয়ে, আপামর শিশু থেকে বৃদ্ধ সকলেই ওই আনন্দ আসরেই রাত কাটান। সমস্ত দলাদলি, ঝগড়ার হিসেব নিকেশ হয়ে যায় এই রাতেই, বলতেন কাকা। এই আকর্ষণ ছেড়ে অন্য কোথাও যায় না গ্রামের মানুষ। কাকার বাড়ির শহরের এক কুটুম এই কাহিনী শুনে আনন্দিত। কাকা বললেন, নতুন কুটুম গো, তোমাকে বলছি, আমাদের এখানে এসে একবার গাজন দেখে যেও। খুব ভালো লাগবে। 

অনেক গ্রামবাসী মদনকাকার আশেপাশে বসে পড়েছে, গল্প শোনার জন্যে। কাকা গল্প বলার ফাঁকে ফাঁকে অনেক ভালো ভালো উপদেশমূলক কৌতুক কথাও বলে থাকেন। মুড তার সব সময়েই ভালো। কথায় কথায় বলেন, পেটে ক্ষিদে নিয়ে কিছু হয় না। ধর্ম, শিক্ষা, কাব্য, গল্প কিস্সু হয় না। নবীন বললো,ঠিক বলেছেন কাকা। আগে পেট তারপরে অন্যকিছু।

আট
মদন কাকা আবার শুরু করলেন কথা বলা। তার কথা সবাই শোনে। কিছু শেখে মানুষ। বলছেন, যুগে যুগে একটা নিয়ম চালু আছে। দেখবে প্রথম স্তরের গুড স্টুডেন্ট ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়র হন। দ্বিতীয় স্তরে এস ডিও বা বিডিও হন। তারা প্রথম স্তরকে শাসন করেন। মানে ডাক্তাররা বা ইঞ্জিনিয়ররা তাদের খুব 'স্যার স্যার' করেন প্রথম শ্রেণীর হয়েও। আবার তৃতীয় স্তরের স্টুডেন্ট নেতা হয়। তারা অর্ডার করে বিডিও বা উঁচু স্তরের অফিসারদের। আর চতুর্থ শ্রেণীর স্টুডেন্টরা হয় সাধুবাবার দল। নেতারা সব লুটিয়ে পরে তাদের চরণতলে। ভোট এলেই বাবার পুজো দিয়ে আশীর্বাদ নিতে আসেন গণ্য মান্য নেতার দল। তাই বলে কি সংসারে সাধু লোক নাই। নিশ্চয় আছে। তারা সংসারে আছেন গোপন সাধনায়। লোক দেখানো ভড়ং তাদের নাই। আর মন্ত্রী হওয়ার ক্ষেত্রে মিনিমাম রেগুলার মাষ্টার ডিগ্রী থাকা আবশ্যিক করুক সরকার। আর ভোট দেওয়া হোক বাড়িতে বসে আধার কার্ড লিঙ্ক করে। জালিয়াতি দূর হোক। সবাই বলো, জয় সাধুবাবা। নবীন বললো, আপনি ঠাকুরের নাম ছেড়ে, জয় সাধুবাবা বলেন কেন? 
----আরে বাবা দেখবি মানুষের কিছু মুদ্রা দোষ থাকে। ধরে নে তাই।
--- না না আপনি এড়িয়ে যেচেন। বলুন কেনে।
---- তাহলে শোন। এখন সাধু মানুষ, কোটিতে গুটি। সব সং সাজা সাধুু। তাই যারা সত্যিকারের সাধু তাদের শ্রদ্ধা জানিয়ে জয়ধ্বনি দিয়ে থাকি। ওই যে, মহাপুরুষের বাণী শোনো নাই। "সাধু হও, সাধু সাজিও না। সংসারী সাজিও, সংসারী হইও না।" 
--- কাকা, আপনি আচেন বলেই কঠিন কথা সহজ করে বুঝতে পারি। তা না হলে কিছুই জানা হতো না।
--- শুধু জানলেই হবে না। বাস্তবে,কাজে, কম্মে ব্যবহার দিয়ে দেখিয়ে দাও দিকিনি বাছা। তবেই বলবো বাহাদুর বাবা। খুবএকটা সহজ নয় বাবা। 
আবার আগের প্রসঙ্গে ফিরে গিয়ে কাকা সবাইকে বললেন, তাহলে কি হলো ব্যাপারটা। আগের কথায় ফিরে যাই।  ম্যান মেড ফ্ল্যাড। আর নয়, আধুনিক কবিতার মতো বাকিটা বুঝে নাও। বলো, জয় সাধুবাবা। সবাই বললো, জয় সাধুবাবা। 
মানুষ মরছে বানে। আর উনি জয় সাধুবাবা বলে পাড়া মাত করছেন। আপন মনে বললো, পাড়ার শিবু কায়েত। শিবু কায়েত শিবে বলেই পরিচিত।
হঠাৎ কুটুম জনা বলে উঠলেন, দেখুন, ওই গোরের ঘাটে কে বসে। কাকা বললেন, তুমি জানো না কিন্তু আর সবাই জানে। ও হলো মানে মাল। ওকে শিবে, বলেই পাড়ার লোকে ডাকে। বুদ্ধি খুব। কথায় বলে না, কায়েতি কায়দা। বোঝে রসের রসিক। তুমি আমি ছারপোকা। বললেন মদন কাকা। ছোটো থেকেই চালাকি বুদ্ধি ছিলো তার অসম্ভব। লাষ্ট বেন্চের ছেলে। বড়োদের সম্মান করতো না। তাদের সামনেই সিগারেট ফুঁকে বাহাদুরি দেখাতো শিবে। বাবা, মা বড়ো আশা করে তাকে স্কুল পাঠান। কিন্তু স্কুলের নাম করে সে মানুষকে জ্বালাতন করতো দিন রাত। তার জ্বালায় সকলেই বিরক্ত। এমনি করেই সে বয়সে বড়ো হলো। তার বাবা, মা একে একে মরে গেলো। এখন সে একা। তবু তার স্বভাব পাল্টালো না। 
শিবু কায়েত বানের পরে সেই যে কোথায় নিরুদ্দেশ হলো কেউ জানে না। মদন কাকা বলেন, আমি জানি কিন্তু প্রকাশিত হবে ক্রমশ। একবারে নয়। আমি যেদিন স্তরবিন্যাস করেছিলাম, সেদিন শিবে চুপ কোরে গোরের ঘাটে বসে ছিলো। হুঁ, হুঁ বাবা আমি দেকেচি। ও আড়ালে আবডালে সুযোগ খোঁজে। আলোকে ওই বেটা ভয় পায়। আমাদের কায়েত বংশের কুলাঙ্গার। ভালো হলে আমরা আছি। আর খারাপ হলে মানুষ ছাড়বে না বাবা। তোমার সব সাত চোঙার বুদ্ধি এক চোঙায় যাবে। বাদ দাও, বাদ দাও। বলো, জয় ভবা, জয় সাধুবাবা। 
সকলেই বললো, জয় ভবা, জয় সাধুবাবা। 
মদন কাকা বানের পরে ক্ষতিপূরণবাবদ কিছু টাকা পেয়েছলেন। গ্রামের সকলেই পেয়েছিলেন। সেই টাকাতেই সকলের বছরটা চলেছিলো। নীচু এলাকা বলে খরার চাষটা এখানে ভালোই হয়। আর বর্ষাকালে ভরসা নাই। অজয়ের গাবায় চলে যায় বর্ষার ফসল। সেইজন্যে অনেকে নামলা করে চাষ দেয়। আর তাহলে কিছু ধান ঘরে ঢোকে। যতই বান বন্যা হোক চেষ্টাতো করতেই হবে। কথায় বলে, আশায় বাঁচে চাষা। মনে মনে কত স্বপ্ন, গাঁথা। জমি ফেলে রাখলে বাঁজা হয়ে যাবে। তাই গ্রামের কোনো মানুষ হাল ছাড়ে না সহজে। 
কাকা গ্রামে সকালবেলা হাঁটতে বেড়োন। আর সকলের সঙ্গে দাঁড়িয়ে মাঝে মাঝে কথা বলেন। কাকা হঠাৎ সকালে একদিন গ্রামে চুল দাড়ি ওয়ালাএক সাধুবাবাকে ষষ্টিতলার বোল গাছের নীচে তার আসন পাততে দেখলেন। সাধুকে সকলেই বিশ্বাস ক'রে চালটা, কলাটা এনে তার ঝুলি ভরলেন। খাবার সময় হলে খাবার পেয়ে যান। কোনো অসুবিধা তার হয় না। আর সাধুবাবা গ্রাম ছাড়েন না। কাকার সন্দেহ হয়। খুব চেনা চেনা মনে হয়। কিন্তু স্থিতধি মানুষ তো। তাই ভাবেন পরিবর্তনশীল এই জগতে অসম্ভব কিছু নয়। শুভ হোক সকলের। এই কথাই সকলের জন্য বলতেন। তাই বেশ খুশি মনে মদনকাকা বিকেল হলেইএকবার সাধুবাবার কাছে আসতেন। বসে নিজে কথা বলতেন আবার সাধুবাবার কথাও শুনতেন। কাকা শুধু ধর্মের কথা নয় অন্য কথাও বলেন। ভন্ডামি তার অসহ্য। কাকা বলছেন বর্ডারগুলো একেবারে কি যে হয়েছে। বলে দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়লেন। গরু পাচার, মানুষ পাচার, রত্ন পাচার কোনো আইন বা কাঁটতার আটকাতে পারছে কি? কোটি টাকার প্রশ্ন হে। সর্ষের ভেতর ভূত থাকলে কোন ভূত দেশ ছাড়বে বলো। খুব চিন্তায় তিনি। সাধুবাবা বললেন, জয় জয় জয়। কাকা বললেন কার জয়। সাধুবাবা ওইটুকু বলেন। বাকি কথা বুঝে নেয় মানুষ। নিশ্চয় ওর কথার মধ্যে কিছু আনন্দ আভাষ আছে। সাধুবাবার ভক্তসংখ্যা বেড়েই চলেছে। একদিন হরিনাম হলো। গ্রামের মানুষজন সকলেই মচ্ছব খেলো। কাকা বলেন, মহোৎসব থেকে মচ্ছব কথাটা এসেছে। 

সুমিত বললো, আপনি তো ক্লাস সেভেন অবধি পড়েছেন। এত খবর কি করে রাখেন।
কাকা বলেন, আরে ক্লাসে পাশ না করেও বড়ো মানুষ হওয়া যায় রে মূর্খ। শুধু ভেতরের আলোটা জ্বেলে রাখবি। প্রদীপটা কোনো মতেই নিভতে দিলে হবে না বুঝলি।
সাধুবাবা জোরে হাঁক দিলেন, জয় জয় জয়। মানে কাউকে ডাকছেন।
সাধুবাবা আর কোনো মন্দিরে বা মসজিদে যান না। তিনি বালুবাড়ির কাঁদরের ধারে আস্তানা গেড়েছেন। নিজের মূর্তি মাটি দিয়ে বানিয়েছেন। যোগাসন বিদ্যা, যৌনবিদ্যা সব কিছুতেই পারদর্শী বাবা। বললো অসীম। আর বলবি বল কাকার সামনে। কাকা শুধোলেন, তুই কি করে জানলি হতভাগা, ঘাটের মড়া। মার খাবি যে শিষ্যদের হাতে। সাধু আবার যৌন কারবারে কি করবে? যত সব বাজে কথা। কিন্তু সাধুবাবা যে কোন রসের রসিক তার তল পাওয়া সাধারণ লোকের সাধ্যের বাইরে।
সাধুবাবা দুর্বল চরিত্রের মানুষ নির্বাচন করেন প্রথমে। তারপর তাকে দিয়ে বিভিন্ন কাজ করিয়ে নেন। একদিন ডোমপাড়ার বিজয় ওরফে বেজা এসে সাধুবাবার চরণতলে পড়লো। সাধুবাবা বললেন, বল্ কি বিপদ তোর। বেজা বললো, বাবা অনেক চেষ্টা করেও সন্তান হলো না। বাবা বললেন, তোর চেষ্টায় ত্রুটি আছে। তারপর হাজার রকমের কাজ দিয়ে বেজার মগজ বোঝাই করে দিলেন। বনে যাবি। উলঙ্গ হয়ে প্রতি শনিবার জবা ফুলের কুঁড়ি খাবি। জলে গোবোর গুলে খাবি। স্ত্রীর মুখদর্শন করবি না ছয় মাস। তারপর একবছর পরে দেখবি ঘর আলো করে আসবে আনন্দের ফেরিওয়ালা। তোর বংশের প্রদীপ। তবে হ্যাঁ, আর একটা কঠিন কাজ আছে। করতে পারবি।
বেজা বলে, বলুন, যত কঠিন হোক করবো আমি। সাধুবাবা বললো, সন্ধ্যা হলেই আমার আশ্রমে ওই পিটুলি গাছের পাতা তোর বউ দেবে আমার হাতে। কিন্তু কেউ জানবে না। তোর কথা শোনে বউ।
বেজা বলে, না না একেবারেই না। শুধু ঝগড়া করে। সাধুবাবার মুখ হাসিতে ভরে গেলো। তিনি বললেন, সব ঠিক হয়ে যাবে। যা যা আমার কথা বল গিয়ে। তারপর আর মুখদর্শন করবি না।

তারপর থেকে বেজার বউ আসে রোজ রাতে। ভোর হলেই চলে যায় ক্ষেতে। গ্রামের লোক ভাবে, জমিতে কাজ করে।

প্রথম যে রাতে বেজার বউ সাধুর আশ্রমে আসে সেই রাতে সাধু বললে, সব শুনেছি। আমার কথা শোন। ওই খাটে বস। সে সরল বিশ্বাসে বসেছিলো। সাধু অন্ধকার ঘরে বলে, সন্তান তো এমনি এমনি হয় না। তোকে রাতে রোজ শুতে হবে। আমার সঙ্গে।
বেজার বৌ বলে, আপনি সাধু হয়ে কি কথা বলছেন।
--- ঠিক বলছি, যা বলছি তাই কর। তা না হলে তোর স্বামীর মৃত্যু নিশ্চিত।
তারপর জোর করে ধর্ষণ করে সাধুবাবা, বেজার বৌকে। বেজার বৌ আর বাধা দেয় নি। 
কিন্তু পরের দিন আসার জন্যে সাধু জোর করে নি। তবু বেজার বৌ এসেছিলো। সাধু হেসে বলেছিলো, রোজ আসবি তো?
বেজার বৌ বলেছিলো, জানি না রে মিনসে। তোর কাছে যেটা পেয়েচি,উয়ার কাছে পাই লাই। তোর কাছে তাই চলে এলাম। দে এবার যত পারিস তোর মন্ত্র তন্ত্র, ঝাড় ফুকের বিষ। তবু আমার সোয়ামীর যেন ক্ষেতি না হয়। আর সন্তান দিবি। তা না হলে তোর মরণ আমার হাতে। 

তারপর থেকে সাধুর কারবার আরও ফুলে ফেঁপে উঠলো। বেজা দিন রাত সাধুর দেওয়া বিধি নিয়েই থাকে। তার বৌ একশো দিনের কাজ করে। মুনিষ খাটে। তা থেকেই ওদের সংসার চলে। কিন্তু বছর গড়িয়ে গেলেও সন্তান হয় না। বেজা বলে, আর যাস না সাধুর কাছে আর আমি জঙ্গলে যেচি ভয়ে।
বেজার বৌ বললো, তু কুথাও যাবি না। ঘরে থাকবি। তোর কিছু হলে হেঁসো দিয়ে সাধুর গলা দোবো পেঁচিয়ে। এখনও সন্তান হলো নি। তু এত বনে বনে গেলি। আমি পিটুলির পাতা দিলাম শালা ঢ্যামনাকে। দেখে লিবো একদিন দেখিস...

বেজা বললো, আর যাস না সাধুর কাছে। আমাদের কপাল খারাপ।
তারপর থেকে ওরা দুজনে আর আশ্রমমুখী হয় নাই। সাধু আর খবর নেয় নি। কারণ সে এখন আর একজনের পার করার কান্ডারি সেজেছে।

গোয়ালা পাড়ার সিধু ঘোষ চল্লিশ বছর বয়সে মরে গেছে। বিধবা বৌ রমা সাধুবাবার কাছে ভালো কথা শুনতে যেতো। কিন্তু গত পরশু রমাকে একা পেয়ে প্রসাদ দিলো। তার সঙ্গে নিশ্চয় কিছু মেশানো ছিলো ওষুধ বা কেনো শেকড় বাকড়। কিছুক্ষণের মধ্যেই রমা উত্তেজিত হয়ে সাধুকে জড়িয়ে ধরলো। রাতের অন্ধকারে সাধু নিজের সাধ মিটিয়ে নিলো।
রমা বললো, এ তো পাপ।
সাধু বললো, পাপ বলে কিছু হয় না। যাও রোজ আমার কাছে এই সময়ে আসবে।

একবার মেয়েদের ভয় ভেঙ্গে যাওয়ার সুযোগের অপেক্ষায় থাকতো সাধু। তারপরের পথ কুসুমাস্তীর্ণ।

মদন কাকা আর আশ্রমে আসেন না। কানাঘুষোয় অনেক কথা শুনেছেন। তাই নিজের মধ্যেই নিজেকে নীরবতার আড়ালে ঢেকে রাখেন। 

আর এদিকে সাধু একের পর এক শিষ্য বাড়িয়ে চলে আর তেষ্টা মেটায় নশ্বর শরীরের। কিন্তু নিজের সমাধির গর্ত অজান্তে কেটেই চলে। অবিনশ্বর আত্মার কথা কেন কেউ শোনে না। আকাশে বাতাসে দীর্ঘনিশ্বাসের মেঘছায়া নীরবে সত্যের দামামা বাজিয়ে চলে অবিরত। মানুষকুল শুনেও শোনে না কানে। 

বিজয় গ্র্যাজুয়েট হয়েছিলো। তারপর আবার তপশিলী। পুলিশের চাকরী একটা পেয়েছে বছর পাঁচেক হলো। 

বেজার বৌ কিন্তু ভোলেনি বেইমানকে। একদিন ডেঙা পাড়ার মাম্পি, বেজার বৌকে বললো, সাধু আমার ইজ্জত লিয়েছে। চড়াম করে রাগ হয়ে গেলো বেজার বৌ এর। এর আগে বিধবা বৌ ও আরও অনেকে রিপোর্ট করেছে বেজার বৌকে। ওদের গ্রামে মেয়েরা মেয়েদের কাছে সমস্ত কথা শেয়ার করে। বেজার বৌ বললো, তু বাড়ি যা। আমি দেকচি...

চারদিকে খবরটা ছড়াতে বেশি সময় লাগলো না। লোকজন মদন কাকাকে সঙ্গে করে চলে এলো বিচার করতে। মদন কাকা বললেন, সেদিন গোড়ের  ঘাটে তু আমার কথা শুনে সাধু হলি। তাও ভন্ড সাধু।
তখন শিবু বললো, আমি তোমাদের শিবু। আমাকে মাপ করে দাও। তোমরা আমাকে বাঁচাও কাকা।

মদন কাকা বললেন, তুমি এখন আমাদের নও শিবু। তুমি এখন আইনের হাতে অপরাধী শিবু।

শিবু বললো, আমি মেয়েটাকে বিয়ে করে সুখে রাখবো।
কাকা বললো, তোর মতো চরিত্রহীনকে কোনো ভারতীয় কন্যা বিয়ে করবে না।। সব চরিত্রহীনের মনে থাকা উচিত, এটা ভারতবর্ষ।

রাত পেরোলেই পুলিশ আসবে। হয়তো আজ রাতেই হাতকড়া পরবে শিবুর হাতে। শিবু তাড়াতাড়ি ব্যাগ গুছিয়ে পালানোর জন্যে বেজার বাড়ির পেছনের জঙ্গল দিয়ে পালাচ্ছে। আজ বিজয়ের নাইট ডিউটি। তার বৌ ধারালো হেঁসো নিয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে সাধুকে। এবার বেজার বৌ আর সাধু সামনা সামনি। সাধু বললো, কি রে আমার সঙ্গে যাবি। সন্তান দোবো। মাথায় রক্ত উঠে গেলো বেজার বৌয়ের। চালিয়ে দিলো ধারালো হেঁসো সাধুর গলা লক্ষ্য করে। পাঁঠার মতো ছট্ফট্ করে স্থির হয়ে গেলো সাধুর শরীর।
সন্তান প্রাপ্তির আনন্দে শরীর নেচে উঠলো কালী পুজোর ঢাকের তালে তালে, থানায় আজ রাতে কালীপুজো। বারবার বলা সত্ত্বেও বেজার বৌ থানায় আসে নি। সব পুলিশ অফিসারকে নিজের বৌ দেখানোর বড়ো সখ ছিলো বেজার। তার জন্যে নতুন  এল ই ডি শাড়িও কিনে দিয়েছে পাঁচ হাজার দিয়ে। তবু বেজার বৌ বলে, এই মাটির গন্ধ আমার জীবন।
সবে আসর জমে উঠেছে আর তখনই খবর এলো সাধু খুন হয়েছে। বেজা ভাবছে সাধুর কথায় পাশ করা ছেলে হয়েও বনে বনে ঘুরে বেড়িয়েছে সে। ধিক তার শিক্ষাকে। ডাক্তারবাবু বলেছেন, ওষুধে সব ঠিক হয়ে যাবে। আর দুবছরের মধ্যে তাদের ঘরে সন্তান, মা বাবার বুক আলো করে আসবে। কিন্তু সাধু খুন হওয়াতে একরাশ বৃষ্টির ছাট তার হৃদয় ভিজিয়ে দিলো। এখন খুনের তদন্তের দায়িত্ব পড়েছে তার উপর। সে এখানকার লোকাল ছেলে। সব কিছুই তার নখদর্পণে। এখানকার প্রকৃতি সহজ সরল বেজার সঙ্গে কথা বলে। লাশের কাছে দলবল নিয়ে যেতে যেতে বিজয়বাবুর চোখের সামনে তার বৌয়ের মুখের আদলে একটা মুখ আলো হাসি মাখানো চোখে ভেসে উঠলো গ্রামের শান্ত সবুজ জুড়ে...
বিজয় যখন জঙ্গলে লাশ দেখতে গেলো, তখন নিজের বাড়িতে একবার টুকি মেরে দেখলো। কাউকে দেখা গেলো না। পাশের বাড়িতে জিজ্ঞাসা করেও বৌয়ের খোঁজ পেলো না। তারপর বাধ্য হয়ে জঙ্গলে গেলো।

খুন করার পরেই রক্তমাখা হেঁসো নিয়ে বিজয়ের বৌ থানায় এসে হাজির। সে এসেই বললো, আমি সাধুকে খুন করেছি। পাড়ার মেয়ে বৌ সকলে খবর পেয়ে থানায় এসে হাজির। সবাই সাধুর নামে ধর্ষণের অভিযোগ করলো। অফিসার গ্রেপ্তার করলেন বিজয়ের স্ত্রীকে। তারপর বললেন, যা হবে কোর্টে হবে। আপনারা সাক্ষী হিসাবে সকলে যাবেন।

মদন কাকা বলছেন, এই কেসে কিছু হবে না রে। ধর্ষকের কোনো মতেই বেঁচে থাকার অধিকার নেই। তবে নিজের হাতে আইন তুলে নিবি না। আইনে ভরসা রাখবি। তার হাত অনেক লম্বা। কিছু উঠতি ছেলে বলে উঠলো, শালাকে খুন করে ভালোই করেছে বেজার বৌ। কাকা বললেন, ঠিক বলেছো। কাল আমরা সকলেই কোর্টে যাবো, বুঝলে হে। সবাই রাজি হলো। কয়েক মাসের মধ্যেই শোনা গেলো বেজার বৌ এর দুবছরের জেল হয়েছে। কাকা বললেন, যারা অপরের জন্যে জীবনের বাজি রাখে, সমাজকে সুস্থ রাখে তারাই হলো প্রকৃত সাধু।
পাড়ার জটাই বাগ্দি বললো, বেজার বৌ ওই খচ্চরটাকে বলি দিলো বলেই গ্রামের মা বোনের ইজ্জত বাঁচলো। তা না হলি ওর কি দায় পরেছে জেল খাটার।
কাকা বললেন, ঠিক বলেছে জটাই। সবাইকে বাঁচাতে গেয়ে ওর এই অবস্থা। স্বাধীনতার যুদ্ধের মাতঙ্গিনী হাজরা আমাদের এই বেজার বৌ। ও আমার বয়সে ছোটো হলেও আজকে আমার মা বলে মন হচ্চে রে। ধুতির খুঁট দিয়ে ঝাপসা চশমার কাঁচটা মুছে নিলেন কাকা।

কাকা সবাইকে বলছেন, ওদের জন্যে আমরা প্রার্থনা করি এসো। একটা সন্তান ওদের ঘর আলো করে আসুক। আর তাছাড়া আমাকে বলেছে, বিজয় শহরে বৌমাকে নিয়ে গিয়ে ডাক্তার দেখিয়ে এনেছিলো। ডাক্তারবাবু আশ্বাস দিয়ছেন। ওষুধও প্রয়োজন মতো দিয়েছেন। স্বামী, স্ত্রীর স্বাভাবিক সম্পর্কের সাথে সাথে ওষুধ খাবার পরামর্শ দিয়েছেন। কোনো সিষ্ট বা অস্বাভাবিক ত্রুটি কিছুই নেই। আল্টাসনোগ্রাফি করিয়েছে শহরের ভালো ডাক্তারের কাছে। বিখ্যাত ডাক্তার আর এন মন্ডল বলেছেন, চার বছরের মধ্যেই সন্তান হবে। এর অন্যথা হবে না। কাকা বলেন, ডাক্তার হচ্চে মর্ত্যের ভগবান। তারা যা বলেন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাই হয়। 

জেলে থাকলেও বিজয় ডাক্তারের ওষুধ দিয়ে আসতো প্রতি মাসে। নিজেও খেতো। দেখতে দেখতে দুবছর পার হয়ে গেলো।

আবার জীবনচক্র চলতে লাগলো। এবার বিজয় তার বৌকে আর মাঠে কাজ করতে যেতে দেয় না। শুধু অফিস যাওয়ার সময় রান্না করতো। আর সারাদিন সে পাড়ার কার কি সুবিধা অসুবিধা দেখতো আর তার সমাধান করে দিতো চট্জলদি। পাড়ার সব মহিলা একসাথে টাকা জোগাড় করে বিজয়ের বৌকে একটা সুন্দর শাড়ি কিনে দিয়েছে। গরীবলোকের অকৃত্রিম ভালোবাসা। তার স্বামী এখন চাকরী পেয়েছে। সরকারি পুলিশের চাকরি। তাদের এখন ধনী বলা যায়। কিন্তু বেজার বৌ মাম্পিদের বলে, খেপেছিস, আমি কি বসে থাকতে পারি। যতই বলুক তোর দাদা, আমি মাটি আর গোবরের স্পর্শ ভুলতে পারবো না। আমি যতদিন বাঁচবো, এই মাটি ছুঁয়েই থাকবো। এই বলে সে উঠোনের একমুঠো মাটি মাথায় বুলিয়ে নেয়। 

জীবনের গানে, গল্পে সময় বয়ে যায়। জেল থেকে আসার  দুবছর পরে বিজয়ের বৌয়ের বাচ্চা হলো। কন্যা সন্তান। বিজয় বিরাট ভোজের আয়োজন করলো। আশে পাশের পাঁচটা গ্রামের লোক ভোজ খেলো।
মদন কাকা একটা মিষ্টির প্যাকেট হাতে করে সন্ধ্যেবেলায় গেলেন বিজয়ের বাড়ি। তার বাড়ি ঢোকার আগে কাকা ব্যাগটা নামিয়ে জোড় হাতে নমস্কার জানালেন তার মনোজগতের মনমাতানো মহান সাধু মানুষকে। যাদের খোঁজ কাকা আজীবন করে এসেছেন। 
বড়দা গল্প বলে চোখ মুছলেন। তারপর আবার শুরু করলেন কাকার বাকি জীবনের কাহিনী। মদন কাকাকে বড়দা নিজের আত্মীয় মনে করতেন। তাই নিজের জীবনের কথা তাকে বলতেন। আজও বলছেন, বাবার চাকরীসূত্রে লিলুয়া শহরে জীবনের তিরিশ বছর কেটেছে। কেতুগ্রাম থানার বড় পুরুলিয়া গ্রামে আমার চোদ্দ পুরুষের ভিটে। আমরা তিন ভাই মামার বাড়িতে জন্মেছি। আর ছোটো ভাই পুরুলেতে জন্ম গ্রহণ করেছে। তাই জন্মস্থান আমার আহমদপুরে নেমে জুঁইতা গ্রামে।

বাবা আমাদের তিন ভাইকে ও মাকে নিয়ে লিলুয়া এলেন। আমরা বিদ্যুতের আলো দেখিনি। লিলুয়া গিয়ে হঠাৎ বিদ্যুতের আলো দেখে চমকে গেলাম। কোথা থেকে এত আলো এলো। আমাদের চোখ ঝলসে যাওয়ার অবস্থা। মা আমাদের বললেন, একে ইলেকট্রিক আলো বলে স্কুল যাওয়ার অভ্যাস গ্রামে থাকতেই হয়েছিলো।
কেউ গাঁয়ের মাষ্টারমশাই আমাদের পড়াতেন। পরের দিন আমরা দুই ভাই স্কুলে ভরতি হতে গেলাম। বড়দা গ্রামে কাকার কাছে আর ছোটো ভাই বাবু একদম ছোটো। স্কুলে মীরা দিদিমণি সহজ পাঠের প্রথম পাতা খুলে বললেন, এটা কি? আমি বললাম অ য়ে অজগর আসছে ধেয়ে।
আবার বই বন্ধ করলেন। তারপর আবার ওই পাতাটা খুলে বললেন, এটা কি?
আমি ভাবলাম,আমি বললাম এখনি। চুপ করে আছি। ঘাবড়ে গেছি। দিদি বাবাকে বললেন, এবছর ওকে ভরতি করা যাবে না।
ছোড়দা ভরতি হয়ে গেলো। তারপর বাসা বাড়িতে জীবন যাপন। সুবিধা অসুবিধার মাঝে বড়ো হতে লাগলাম। আমাদের খেলার সঙ্গি ছিলো হারু, মোহিনী, অশ্বিনী, গৌতম, গোরা, আশু, ভুট্টা, ছানু, বীথি, গায়ত্রী, জনা, গীতা, অশোকা, পেটুক, বিশু, বিপুল, অসীম ও আরও অনেক বন্ধু। ধীরে ধীরে আমরা বড়ো হয়ে টি আর জি আর খেমকা হাই স্কুলে ভরতি হলাম। তখন লাইনের পাশ দিয়ে যাওয়া আসা করার রাস্তা ছিলো না। লাইনের কাঠের পাটাতনের উপর  দিয়ে হেঁটে যেতাম। কতজন ট্রেনে কাটা পরে যেতো তার হিসাব নেই। তারপর ওয়াগন ব্রেকাররা মালগাড়ি এলেই চুরি করতো রেলের সম্পত্তি। কঠিন পরিস্থিতি সামলে চলতো আমাদের লেখাপড়া।

এখন পরিস্থিতি অনেক ভালো। পাশে রাস্তা আছে। ওয়াগান ব্রেকারদের অত্যাচার নেই।

মনে আছে ক্লাস সেভেন অবধি লিলুয়ায় পড়েছি। তারপর গ্রামে কাকাবাবু মরে গেলেন অল্প বয়সে। বাবা অবসর নিলেন চাকরী থেকে। মেজভাই রয়ে গেলো লিলুয়ায়। বাবা, মা ও আমাদের দুই ভাইকে নিয়ে এলেন বড় পুরুলিয়া গ্রামে।

গ্রামে কাকীমা ও দুই বোন। রত্না ও স্বপ্না। আমরা চারজন। মোট সাতজন সদস্য। শুরু হলো গ্রামের জীবন।

আবার বিল্বেশ্বর হাই স্কুলে ভরতি হতে গেলাম বাবার সঙ্গে। ভরতির পরীক্ষা হলো। হেড মাষ্টারমশাই বললেন, বাঃ, ভালো পত্রলিখন করেছে। বিজয়া প্রণামের আগে চন্দ্রবিন্দু দিয়েছে। কজনে জানে।
আমি প্রণাম করলাম স্যারকে। ভরতি হয়ে গেলাম।

তারপর থেকেই আমার কাছে তোমার যাওয়া আসা শুরু হলো। বললেন কাকা। তুমি অন্য গ্রামের ছেলে হলেও আমার কাছে মাসে একবার আসতে। আমি তোমাকে লাঠি খেলা, ব্যায়াম শেখাতাম তরুণ বয়সে। তুমি হলে যোগ্য ছাত্র।

তাই আজও বৃদ্ধ বয়সে তুমি আমার খোঁজ নাও।

বড়দা জানতেন, মদন কাকা বিয়ে করেন নি। আজীবন অকৃতদার। মানুষের মঙ্গল চিন্তাই তার ধ্যান, জ্ঞান, সাধনা। ভন্ডামি ছিলো না কোনোদিন। গেরুয়া রঙের হৃদয় আর সাদা বিশ্বাসে ভর করে মানুষের মাঝেই তার ঈশ্বর দর্শন। শেষ বয়সে আশেপাশের গ্রামে চাঁদা তুলে একটি লঙ্গরখানা বানিয়েছেন। সেখানে অনেক অভুক্ত মানুষ দুমুঠো খেয়ে দুহাতে প্রণাম করে সিদ্ধপুরুষ মদন কাকাকে।

নয়
জীবন ভাবে, মানুষ যা ভাবে তা হয় না কোনোদিন। তাদের বিয়ে হয় নি। মেয়েটা আর বিয়ে করে নি। সে এখন নামকরা কলগার্ল। সে হতে চেয়েছিল ঘরণী। একটা ঘর আর একটা সন্তান আর স্বামী। সবাই সব কিছু পায় না। জীবন এক রঙ্গমঞ্চ। অভিনয় করে যাই আমরা দিবারাতি। এক অদৃশ্য সুতোর টানে চলছে এই পুতুলখেলা। 
কিন্তু বিশুর মনের বয়স বাড়ে নি আমাদের মতো। কোনো বাচ্চাকে রাস্তায় দেখলে কোলে তুলে আদর করা, কুকুর ছানা দেখলে কোলে নেওয়া এখনও তার প্রিয় সখ। তার স্পর্শে সেজন ধন্য হয়ে যেতো।

 

পাঁচ
সিঙ্গাপুরে অনিতা বরকে নিয়ে বেশ সুখেই ছিল। তাদের ঘর আলো করে জন্ম নিয়েছে ফুটফুটে একটা ছেলে। জীবন এখন কর্মসুত্রে সিঙ্গাপুরেই থাকে। পৃথিবী বড্ড ছোট। ঘুরতে ঘুরতে একটা মলে দেখা হয়ে যায় জীবনের সঙ্গে অনিতার। জীবন বল, কি রে কেমন আছিস এখন।
অনিতা বলে, আর বলিস না রে। নেপাল বড়লোকের ছেলে। আরও কত সুন্দরী মেয়ে ওর সঙ্গি। বাড়িতে নিয়ে আসে। বিছানায় আমার সামনেই ফুর্তি করে। মদ খেয়ে মাতাল হয় ওরা সবাই।
জীবন বলে, বলিস কি রে। এ তো ভয়ানক ব্যাপার। তুই রাজি থাকলে আমি তোকে গ্রামের বাড়ি দিয়ে আসতে পারি। ছেলেও সঙ্গে আছে। পালিয়ে চল।
অনিতা বলে, তাই চল। ওখানে গিয়ে ফোন করে দেব। নেপাল খুশি হবে। হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে।খুব ভুল করেছি রাজুদাকে দুঃখ দিয়ে। সে কেমন আছে।
জীবন বলে, বিশুর মুখে মোবাইলে শুনলাম, সে পাগলা গারদে আছে।
অনিতা বলে, আমি প্রায়শ্চিত্ত করব। আমি ওকে সারিয়ে তুলব আমার সমস্ত অলংকার বিক্রি করে। আমাকে বাঁচা জীবন।
কয়েকদিনের মধ্যে রাজু খবর পেয়ে গেল আপদটা বিদায় হয়েছে। সে ডুবে গেল কামসাগরে। আজ রোদবেলায় তার অন্দকারের কথা মনে নেই। সে জানে না যৌবনের গর্ব, অর্থের জোর বেশিদিন থাকে না। কালের স্রোতে বিলীন হয়ে যায় অহংকার।অনিতা বাপের বাড়ি এসে বাঁচল। চোখের সামনে নিজের স্বামীর অনাচার কজন মেয়ে সহ্য করতে পারে। সঠিক সিদ্ধান্তে সে বিশুর কাছে ঠিকানা নিয়ে চলে এল সুদপুর মেন্টাল হসপিটালে। প্রথমদিন ডাক্তারকে বলে কথা বলার চেষ্টা করল। রাজু তাকে চিনতে পারল না। শুধু তার কথাটা বলল একঘেয়ে সুরে। আমি তোমাকে ভালবাসি অনিতা। আই লাভ ুইউ ইভেন নাউ। ডাক্তারবাবু বললেন, এই কথাটা ও বারবার বলে। আচ্ছা  বলতে পারেন, এই অনিতা কে?  
অনিতা গোপন করল না কোন কথা। সে সমগ্র ইতিহাস খুলে বলল। নিজের সম্মানের থেকে বড় এখন রাজুর সুস্থতা। যা করেই হোক তাকে সারিয়ে তুলতে হবে।
ডাক্তারবাবু বললেন, ভাল হল। আপনি আসবেন মাঝে মাঝে। আমাদের চিকিৎসার সুবিধা হল। আশার আলো আমরা দেখতে পাচ্ছি। তবে এটা হবে সময়সাপেক্ষ চিকিৎসা।
অনিতা সম্মতি জানিয়ে দিল। রাজুকে বলল, আমি তোমার অনিতা। আমি ফিরে এসেছি তোমার কাছে। কলেজের কথা মনে পড়ে তোমার। চায়ের দোকানের কথা, ঝাউবনের কথা। চুপি পাখিরালয়ের কথা। নৌকায় ঘোরার কথা। রাজু চিৎকার করে ওঠে। তার চিৎকারে ভয় পেয়ে কেঁদে ফেলে অনিতা।
ডাক্তারবাবু বলেন, ও আর সহ্য করতে পারবে না। আমরা আবার আপনাকে ডেকে পাঠাব। প্রয়োজনে রাজু আর আপনাকে নিয়ে যাব চায়ের দোকান, চুপি পাখিরালয়। সব স্মৃতি রাজুর মনে গেলেই ও সুস্থ হয়ে উঠবে। আপনি আশা রাখতে পারেন আমাদের ওপর। অনিতা অন্যান্য প্রয়োজনের জন্য পঞ্চাশ হাজার টাকা ডাক্তারবাবুর হাতে দিল। ডাক্তারবাবু বললেন, আমরা চিকিৎসাবাবদ টাকা নিই না। তবে এই টাকা আমরা দান হিসেবে গ্রহণ করলাম।
অনিতা যখন ফিরে এল তার বাচ্চাটা তখন তার মায়ের কোলে। এখানে সে স্বাধীন। বাচ্চাকে দুধ খাওয়ালো অনিতা। আর অনিতার মা এক গ্লাস দুধ মেয়েকে খাওয়ালেন। অনিতার চোখে জল। অনেকদিন পরে আবার নতুন করে বাঁচার ইচ্ছেটা জাগ্রত হল। 
জীবন আর বিরাজুল  সিঙ্গাপুরে  চাকরি পেয়েছে। তারা বিয়ে থা করেনি। একা অগোছালো সংসার। একজন মাসি আছেন। তিনি রান্নাবান্না করেন। কাজকর্ম যা করেন যথেষ্ট। এই বিদেশ বিভুঁইয়ে মাসিকে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। একদিন জীবন ছুটির দিনে মাসির বাড়ি গেল। মাসি গরীব হলেও বেশ রুচিশীল। মাসির এক ছেলে। স্বামী দিন মজুর। তবু বাড়িতেমএকটা শান্তির পরিবেশ।
মাসির ছেলে পাশের বাড়ির রীতাকে ভালোবাসে। জীবন বাইরে এসে মাসির ছেলেকে জিজ্ঞাসা করতেই একমুখ হাসি।
--- কি গো রতন, তুমি কি রীতাকে ভালোবাসো।
---- হূঁ, মিছে কথা বলব না। রীতাও আমাকে পছন্দ করে।
জীবন একথা জেনেছিল রীতার মুখে। মাসির অবর্তমানে রীতা একদিন জীবনের ঘরে কাজ করতে গিয়েছিল। জীবনের বেশ ভালো লাগছিল। সুন্দরী অল্পবয়সী মেয়ে। তাকিয়ে দেখছিল বারে বারে জীবন। রীতা বেশ স্মার্ট মেয়ে। সে ঘুরে তাকিয়ে বলেছিল, আমাকে একজন নিয়ে যাবে বলে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। তাড়াতাড়ি  কাজ সেরে নিই।জীবন বলল, ও কে হয় তোর।রীতা বলল,বুঝে নাও, কে হতে পারে। আমার সঙ্গে বিয়ে হবে ওর। আমার হবু বর।এই বলে খিল খিল করে হেসেছিল।জীবন অনেকদিন পরে মাসির মুখে শুনেছিল তার ছেলে মরে গেছে এক অপয়া সকালে। রাতে হয়ত চুরিডাকাতি করত। ভাগাভাগির অমিল হওয়াতে খুন করেছিল ওই ডাকাতের দল আমার ছেলেকে। মাসি হাওমাও করে কাঁদতে শুরু করেছিল জীবনের ঘরে। জীবন জানে না এখন বিরাজুল কোথায় থাকে?  সিঙ্গাপুর তো ছোট জায়গা নয়। থাকলে একবার বিরাজুলের সঙ্গে দেশে যেত।আমার কথা বলতে গেলে আমার জীবন জুড়ে রয়েছে মায়ের স্মৃতি। মায়ের বান্ধবী সবিতাদেবী ও আমার পছন্দের মহিলা। এই দুইজনের কথা কখনও ভুলতে পারব না। আমি সাজিয়ে গুছিয়ে কিছু কথা বলতে পারি না। বেশিরভাগটাই অপ্রকাশিত থেকে যায়। সবিতা দেবীর বয়স নব্বই ছুঁই ছুঁই। শরীরের নানারকমের অসুখ বাসা বেঁধেছে ডাক্তারবাবু বলেছেন কিডনি,হার্টের যা অবস্থা, বড়জোর আর কয়েকদিন বাঁচবেন। ছেলে একটা প্লাসটিকের গামলা কিনে দিয়েছে। বাথরুম শোবার ঘরের থেকে অনেক দূরে। ওই গামলায় পেচ্ছাপ করা যাবে। কিন্তু পায়খানা যেতেই হবে দূরে। ফলে রাতে দরজার তালা খুলে উঠোন পেরিয়ে বাথরুম যেতে হয়। তখন স্বামী বারবার বলেছিলেন,তোমার ঠাকুর ঘরের পাশেই বাথরুমটা হলে বুড়ো, বুড়ি আমাদের দুজনেরই সুবিধা হবে। কিন্তু সবিতারাণী রাজী হন নি। তিনি বলেছেন, ম্লেচ্ছ, নোংরা লোকের মতো কথা বলো না। ঠাকুর ঘরের পাশে আবার বাথরুম হয় নাকি? স্বামী বলেছিলেন,তাহলে মানুষের শরীরটাতো বাথরুমের থেকেও নোংরা। সবিতাদেবী তর্ক করেন নি আর। শুধু বলেছিলেন, দূরেই করো। সব মনে পড়ছে তার। স্বামী বারো বছরের বড় ছিলেন। আগেই চলে গেলেন মহাসিন্ধুর ওপাড়ে।
তাঁর স্বামী বড়ো অভিনেতা ছিলেন। সবিতাদেবীকে বলতেন, তিরস্কারের থেকে জীবনে পুরস্কারই বেশি পেয়েছি। অসংখ্য মানুষের ভালোবাসা। এর থেকে বড় পুরস্কার আমার অভিধানে নেই। আমার যোগ্যতার বেশি, তার পরিমাণ। ঈশ্বর সময় হলেই প্রত্যেকের যোগ্য পাওনাটুকু দিতে ভোলেন না। শুধু প্রয়োজন ধৈর্য আর সহনশীলতা। সময় কিন্তু কারও কথায় এগিয়ে আসবে না বা পিছিয়ে যাবে না। অভিজ্ঞ লোকেরা প্রথমে ধৈর্যের পরীক্ষা নিয়ে থাকেন। অন্য মানুষকে সহ্য করা, সম্মান করা ধর্মেরই নামান্তর। মানুষের জন্যই মানুষ। শুধু শুকনো লোক দেখানো ধর্ম যা মানুষকে ছোটো করে সেটা কখনই ধর্ম হতে পারে না। ধর্ম হচ্ছে অণুবিক্ষণের মতো। ছোটো জিনিসকে বড়ো করে দেখে।
সবিতাদেবীর মা ছিলেন গ্রামের লক্ষীদেবী। তার দান, ধ্যানের জন্য সকলেই খুব ভালোবাসতো। মনে পরে সবিতাদেবীর মায়ের কথা। তিনি বলতেন,কথিত আছে কোজাগরি লক্ষীপুজোয় পুজো করার পরে যে গৃহস্থ রাত্রি জাগরণ করে রাত কাটাবে তার ঘরে লক্ষী স্বয়ং বিরাজ করেন। কোনো অভাব, অনটন তাকে স্পর্শ করতে পারবে না। স্বার্থ নিয়েই মানুষ পুজো করে। কারণ সে সংসারী। ছেলে, মেয়ে, বাবা, মা, ঠাকুমা, দাদু সকলকে নিয়ে এই সংসার। তাদের মঙ্গল কামনা করেই মানুষের এই পুজো পার্বণ।
মা বলতেন বাংলার রূপের গল্প। বাবাও বলতেন বাংলার রূপের সাত সতেরোর গল্প। বাংলার বুকে ষড়ঋতুর বছরব্যাপী ঘুরতে থাকা চক্রের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অবহেলিত যদি কেউ হয় তবে নিঃসন্দেহে তার নাম হেমন্ত। 
সবিতাদেবীর বাবা বলতেন, নদীর ধার দিয়ে  নিত্য আমার আনাগোনা। গ্রীষ্মে দেখি শুকনো বালির বৈশাখী কালো রূপে আলো ঘেরা অভয় বাণী। বর্ষায় পরিপূর্ণ গর্ভবতী নারীরূপ। এই রূপে জলবতী নদীতে অতি বড় সাঁতারু ভুলে যায় কৌশল। আমি তখন নদীর বুকে দুধসাদা ফেনা হয়ে ভাসতে ভাসতে চলি বাক্যহারা হয়ে।
এবার শরতে কাশ ফুলের কারসাজি। তার মাথা দোলানো দেখে আমি দুর্গা পুজোর ঢাকি হয়ে যাই। আমার অন্তর নাচতে থাকে তালে তালে। মা তুই আসবি কবে আর, নতুন জামায় নাচে মন সবার।নদী এর পরে হেমন্তের বুকে ছবি এঁকে এগিয়ে যায় শীত ঋতুর আহ্বানে। লোটা কম্বল বগলে আমি রাজস্থানী সাজি। কখনও ধূতি পাঞ্জাবি পরিহিত শাল জড়ানো খাঁটি বাঙালি। মাঝে মাঝে কোট প্যান্ট পরিহিত বিদেশী সাহেবের সুন্দর সাজ। আমি সারা পৃথিবীর সাজে সজ্জিত হতে চাই শীতের আদরে।
শীতল আড়মোড়া ভাঙতেই বসন্তের বাসন্তী রঙের তালে তালে আমি রঙের ফেরিওয়ালা হয়ে যাই। সকলের অন্তরের গোপন রঙ ছড়িয়ে দেয় প্রকৃতি। এই সময়ে আমার রাধাভাব ছড়িয়ে পড়ে স্বচ্ছ অজয়ের রাধারমণের রূপে।
আমার সমস্ত শরীর মন ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে মনোদেবতার মহান চরণে ...
দূর থেকে ভেসে আসছে ভাদুগানের সুর। ছুটে গিয়ে দেখলাম জ্যোৎস্না রঙের শাড়ি জড়ানো বালিকা ভাদু বসে আছে। আর একটি পুরুষ মেয়ের সাজে ঘুরে ঘুরে কোমর নাচিয়ে গান করছে, "ভাদু আমার ছোটো ছেলে কাপড়় পর়তে জানে না"। অবাক হয়ে গিলে যায় এই নাচের দৃশ্য অসংখ্য অপু দুর্গার বিস্মিত চোখ। ঝাপানের সময় ঝাঁপি থেকে ফণা তোলা সাপ নাচিয়ে যায় চিরকালের চেনা সুরে ঝাপান  দাদা। ঝাপান দাদা ঝাপান এলেই গান ধরতো, "আলে আলে যায় রে কেলে, জলকে  করে ঘোলা। কিক্ষণে কালিনাগ বাসরেতে ঢোকে রে, লখিন্দরের বিধি হলো বাম"। গ্রামের পুরোনো পুজোবাড়ি গাজনের সময় নতুন সাজে সজ্জিত হত। বাবা শিবের ভক্তরা ভক্তি ভরে মাথায় করে নিয়ে গিয়ে দোল পুজো বাড়িতে নামাতেন। অসংখ্য লোকের নতুন জামা কাপড়ের গন্ধে মৌ মৌ করে উঠতো সারা বাড়ি। তারপর পুজো হওয়ার পরে দোল চলে যেতো উদ্ধারণপুরের গঙ্গায় স্নানের উদ্দেশ্যে। কিন্তু আমার মন ফাঁকা হয়ে একা হয়ে পড়তো। এই তো কিছুক্ষণ আগেই ছিলো আনন্দ ঘ্রাণ। তবু দোল চলে গেলেই মন খারাপের দল পালা করে শুনিয়ে যেতো অন্যমনস্ক কবির ট্রাম চাপা পড়ার করুণ কাহিনী। ঠিক এই সময়ে কানে ভাসতো অভুক্ত জনের কান্নার সুর। আমি নিজেকে প্রশ্ন করেছি বারংবার, সকলের অনুভূতি কি আমার মতো হয়?রাতে শোয়ার পরে বোলান দলের নুপুরের ঝুম ঝুম শব্দ কানে বাজতো বেশ কিছুদিন ধরে। 
ফাল্গুনে হোলিকার কুশ পুত্তলিকায় আগুন ধরিয়ে কি নাচ। নাচতে নাচতেই সবাই সমস্বরে বলতাম, ধূ ধূ নেড়া পোড়া, হোলিকার দেহ পোড়া।
অশুভ শক্তিকে পুড়িয়ে শুভ শক্তির উন্মেষ। পরের দিনে রং আর আবিরে ভরে যেত আকাশের নরম গা। বাতাসের অদৃশ্য গায়ে আবিরের আনাগোনা। সে এক অনির্বচনীয় আনন্দের প্রকাশে রাধা কৃষ্ণের প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশের আকুতি।
আশ্বিনের আকাশে বাতাসে বেলুনের অনিল পাঠকের রঙের খেলা। শিল্পী একমাটি, দুমাটি করে শেষে চোখ আঁকতেন পর্দার আড়ালে। আগে থেকে চোখ দেখতে নেই। আর আমার চোখ দেখার জন্য চাতুর্যের সীমা থাকতো না। পাঠক মশাইয়ের ফাই ফরমাশ খেটে সবার অলক্ষ্যে চোখ দেখে নিতাম একবার। সেই চোখ আজও আমার মনে এঁকে যায় জলছবি। কি যেন বলেছিলো সেই চোখ। আশ্বিন এলেই আমি প্যান্ডেলে ঠাকুর দেখে বেড়াই মায়ের চোখ দেখার বাসনায়। ছোটোবেলার দেখা চোখ কোথায় কোন গভীর জলে ডুব দিয়েছে কে জানে।
দরজা পুকুরের সবুজ সর সরিয়ে পানকৌড়ি ডুব দিয়ে খুঁজে চলে আজও আমার মায়ের চোখ।হাঁসগুলিও আমাকে সান্ত্বনা জুগিয়ে চলে জলে ডুবে ডুবে। হয়তো আমার জন্যই ওরা অভয় নাচ দেখিয়ে চলে মনদেবতার ঈশারায়।
কাশের কুঁড়ি রসদ মজুদ করছে ফোটা ফুলের সৌরভ বিতরণের। এরপরেই শুরু আনন্দে মাথা দোলানোর উৎসব। মননদীর গভীরে প্রোথিত তার আগমনী সংগীত। হাত নেড়ে বলছে, আসছে আসছে। দেবী কাশ রঙের সংকেতে তাঁর আগমনী বার্তা পাঠান যুগ যুগ ধরে।
আমাদের শোভন কাকা কাশ ফুল দেখলেই কারণে অকারণে গলা ছেড়ে গান গাইতেন। সেই মধুর সুরেই শোভন কাকা কাশ ফুলের শোভা বাড়িয়ে সকলের মনের সংকীর্ণ বেড়া ভেঙ্গে দিতেন।
আমরা সকলেই প্রিয়জন মরে গেলে দুঃখ পাই। কিন্তু নিজের মরণ বুঝতে পারলেও দুঃখ প্রকাশের সুযোগ পাই কি? সেই শোভন কাকা গানে গানে কিন্তু নিজের মরণের আগেই পরিণতির কথা শোনাতেন। অঘোষিত উঁচু পর্বে নাম খোদাই হয়ে গিয়েছিলো তার। মৃৎশিল্পেও তার দক্ষতা ছিল দেখার মতো। প্রতিমা তৈরির দায়িত্ব তার উপরেই দিয়ে নিশ্চিন্ত হত পূজা কমিটি।
শোভন কাকা এলেই আমাদের পুজোর গন্ধ গ্রাম জুড়ে গানের সুরের সঙ্গে ভেসে বেড়াতো। তিনি ছিলেন প্রাণজুড়ানো শান্ত পালক নরম আনন্দের ফেরিওয়ালা। তিনি মাটি হাতে মায়ের সঙ্গে মন মাতানো মন্দাক্রান্তা গাইতেন। তার চলন বলন দেখে ভালোবেসে তাকে শোভনানন্দ বলতেন তথাকথিত গুরুবৃন্দ। ভাইফোঁটা, পশ্চিম ভারতে এই উৎসব ভাইদুজ নামেও পরিচিত। সেখানে ভ্রাতৃদ্বিতীয়া পাঁচ-দিনব্যাপী দীপাবলি উৎসবের শেষদিন। আবার, মহারাষ্ট্র, গোয়া ও কর্ণাটকে ভাইফোঁটাকে বলে ভাইবিজ। নেপালে ও পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং পার্বত্য অঞ্চলে এই উৎসব পরিচিত ভাইটিকা নামে। সেখানে বিজয়াদশমীর পর এটিই সবচেয়ে বড় উৎসব। এই উৎসবের আরও একটি নাম হল যমদ্বিতীয়া। কথিত আছে, এই দিন মৃত্যুর দেবতা যম তার বোন যমুনার হাতে ফোঁটা নিয়েছিলেন। অন্য মতে, নরকাসুর নামে এক দৈত্যকে বধ করার পর যখন কৃষ্ণ তার বোন সুভদ্রার কাছে আসেন, তখন সুভদ্রা তার কপালে ফোঁটা দিয়ে তাকে মিষ্টি খেতে দেন। সেই থেকে ভাইফোঁটা উৎসবের প্রচলন হয়। ভাইফোঁটার দিন বোনেরা তাদের ভাইদের কপালে চন্দনের ফোঁটা পড়িয়ে দিয়ে ছড়া কেটে বলে, ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা, যমের দুয়ারে পড়ল কাঁটা।
যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা, আমি দিই আমার ভাইকে ফোঁটা॥
যমুনার হাতে ফোঁটা খেয়ে যম হল অমর।
আমার হাতে ফোঁটা খেয়ে আমার ভাই হোক অমর
একথা সত্য যে বিভিন্ন কারণবশত আধুনিক সভ্যতার যুগে সব জায়গায় সমানভাবে হেমন্তের প্রত্যক্ষ উপলব্ধি হয়না; তার প্রচ্ছন্ন অনুভূতি উপলব্ধ হয়। হেমন্ত আসে তার রূপের পসরা নিয়ে।পুকুরের ধারে কাশ আর শিউলি মাথা নাড়িয়ে আমাদের আহ্বান করত। আমরা কাশের বনে লুকোচুরি খেলতাম। শৈশবটাকে বেঁধে রাখলে ভাল হত কিন্তু সময় তো বয়ে চলে নদীর স্রোতের মত। আধুনিক সভ্যতার যুগে বাংলার বুকে সব জায়গায় বিশেষভাবে অনুভূত হয় মাত্র চারটি ঋতু। সেগুলি হল: গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ ও শীত। সভ্যতার করাল গ্রাসে বর্তমানে বাংলার ঋতুচক্র থেকে হেমন্তের নাম একরকম লুপ্তই হয়ে গেছে। শহরের বুকে তার রূপ অত্যন্ত প্রচ্ছন্ন, তবে এখনও গ্রাম বাংলার বুকে অল্প দিনের জন্য হলেও হেমন্তের আভাস পাওয়া যায়। হেমন্ত ঋতু অন্যান্যদের মতই আপন মহিমায় মহিমান্বিত। তার নিজস্ব স্বকীয় সৌন্দর্য রয়েেছে। বঙ্গভূমির প্রকৃতি প্রত্যেকটি ঋতুতে বাঙালির জীবনে এনে দেয় নব নব রূপ ও রসের অপরূপ ছন্দ। বাংলার বুকে এই ষড়ঋতুর চতুর্থটি হলো হেমন্ত। বর্ষার পর উৎসবমুখর শরৎ কালের অবসানে গুটিগুটি পায়ে শীতের পূর্বে আগমন ঘটে হেমন্তের। বাংলার বুকে কার্তিক-অগ্রহায়ণ এই দুই মাস নিয়ে হেমন্তের ব্যাপ্তি। বাংলার বুকে ষড়ঋতুর বছরব্যাপী ঘুরতে থাকা চক্রের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অবহেলিত যদি কেউ হয় তবে নিঃসন্দেহে তার নাম হেমন্ত। একথা সত্য যে বিভিন্ন কারণবশত আধুনিক সভ্যতার যুগে সব জায়গায় সমান ভাবে হেমন্তের প্রত্যক্ষ উপলব্ধি হয়না; তার প্রচ্ছন্ন অনুভূতি উপলব্ধ হয়। তবে গ্রাম বাংলার বুকে শরতের শেষ পর্ব থেকে হেমন্তের প্রত্যক্ষ অনুভূতি উপলব্ধ হয়। তবু হেমন্ত 
ঋতুচক্রের সবার মধ্যে অনাদৃত, এবং কিছুটা অবহেলিত। শরতের উৎসবমুখর সত্তার অবসানে হেমন্তের আগমন অত্যন্ত অনাড়ম্বর এবং গাম্ভীর্যপূর্ণ। সময়ের প্রয়োজন অনুযায়ী মানুষের উত্তেজনাকে ক্ষণিকের স্থিতি দান করতেই হয়তো প্রকৃতির এমন ব্যবস্থা। কিন্তু উৎসবের অবসানে হেমন্তের এই অনাড়ম্বরতা এবং গাম্ভীর্য তার অবহেলারও কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। হেমন্ত নামটি এসেছে হিম শব্দ থেকে। অর্থাৎ হেমন্তের নামের মধ্যেই লুকিয়ে আছে তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।

বিশু এখন দু একটা গান লেখে। আবার নিজের কন্ঠে গায়। তার গাওয়া গানে আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে ওঠে। আমি, বিশু, জীবন মধ্যবয়সে কাটোয়া স্টেশনে এসে বসি সন্ধ্যাবেলায়। পুরোনোদিনের স্মৃতি রোমন্থন করি বারেবারে। আমরা তিনজনেই কাটোয়া শহরে বাড়ি তৈরি করে আছি। বিশু বিয়ে থা করেনি। একা কাটায় জীবন আর আমরা আছি ওর সঙ্গে। বিশুর সার্থক মানুষ জন্ম। পরের উপকার করতে তার ভালো লাগে। এখনও স্টেশনের চালচুলোহীন মানুষের সেবা করার জন্য একটা সেবাদল তৈরি করেছে। জীবনের শেষ সম্বলটুকু মানে বাড়িটাও একদিন বিক্রি করে দিল সেবাদল চালানোর জন্য। আমরা সবাই মানুষ। কিন্তু বিশুর মত মানুষ জন্ম কজনের হয়।

বাবা-মা এখন আর নেই। তারা চলে গেছেন জমি-বাড়ি জায়গা ছেলেমেয়ে সব ছেড়ে। ওপারের ডাকে অচিনপুরে কেউ জানেনা কোথায় তারা। আর ছেলেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে তারা চিন্তা করেন না তারা বেশ সুখে শান্তিতে আছেন। এই ভাবেই জীবন প্রবাহ এগিয়ে চলে জীবন প্রবাহ চলতেই থাকে কোনদিন থামেনা।

এখন আমি বিশু, বিরাজুল, রমেন আরো অনেকে রেলওয়ে প্লাটফর্মে বসে থাকি। আর কখন যাবার ডাক আসবে কেউ জানেনা। শুধু অপেক্ষা প্রতীক্ষা ট্রেনের ট্রেনে চেপে পড়তে হবে তারপর ট্রেন চলে যাবে অচিনপুরে। মনে পড়ে আমাদের ছোটোবেলার কথা। কিন্তু একদিন তো চিতায় বা কবরে যেতে হবে। বিরাজুল বলত, মাটি হল শেষকথা গো। মাটি, খাঁটি। 

বিশু মাঝে মাঝে খোলা মাঠে আকাশের নিচে থাকতে ভালোবাসে। হাতে নিয়ে এসে একদিন বেশ দুম  করে চলে গেল অজয় নদের ধারে। বিশু ভরা বর্ষার অজয়ে নেমে পড়ল। জলে সাঁতার কাটতে কাটতে ওপারে চলল। আমি কিছু বোঝার আগেই সেজন্য জলে নেমে পড়ল আমি চিৎকার করে ডাকলাম বিশু, ভরা বর্ষার জলে তুই যাস না। কিন্তু কে শোনে কার কথা। সে সাঁতার কাটতে কাটতে চললো ওপারের আশায়। আমি অবাক হয়ে দেখলাম অজয়ের গভীর জলের স্রোত বিশুর মাথার উপর দিয়ে বড় বড় ঢেউ হয়ে পেরিয়ে যাচ্ছে। একটার পর একটা। ঢেউ যেন শেষ হতে চায় না। একটার পর একটা ঢেউ বিশুকে ঢেকে ফেলল। আর দেখা গেল না।

আমি একা একা বিষন্ন হৃদয়ে ফিরে এলাম দুদিনের বাঁধা ঘরে। আমি ভাবলাম বিশু ঢেউ হতে পারে, আমি কেন পারি না। জানি এ আফসোস বেশিদিনের নয়, আমাদের আড্ডার আসরে, আজান আলপনার মাঠে একজন আড্ডাবাজের নাম প্রকৃতির নিয়মে মুছে গেল চিরতরে। এবার পালা বদলানোর পালার প্রতীক্ষা। 

বর্ষার শেষ লগ্ন থেকেই আকাশে কমে আসে মেঘের ঘনঘটা, গোটা শরৎকাল জুড়ে নীল আকাশে ভেসে বেড়ায় পেঁজা তুলোর মতন সাদা মেঘ। হেমন্তের সেই মেঘ আরো কমে আসে। শরতের শেষে কয়েক পশলা বৃষ্টির পর হেমন্তের সকালগুলিতে অনুভূত হয় হালকা শীতের আমেজ। তবে গ্রাম বাংলার বুকে শরতের শেষ পর্ব থেকে হেমন্তের প্রত্যক্ষ অনুভূতি উপলব্ধ হয়। তবু হেমন্ত ঋতুচক্রের সবার মধ্যে অনাদৃত, এবং কিছুটা অবহেলিত। শরতের উৎসবমুখর সত্তার অবসানে হেমন্তের আগমন অত্যন্ত অনাড়ম্বর এবং গাম্ভীর্যপূর্ণ। সময়ের প্রয়োজন অনুযায়ী মানুষের উত্তেজনাকে ক্ষণিকের স্থিতি দান করতেই হয়তো প্রকৃতির এমন ব্যবস্থা। কিন্তু উৎসবের অবসানে হেমন্তের এই অনাড়ম্বরতা এবং গাম্ভীর্য তার অবহেলারও কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। হেমন্ত নামটি এসেছে হিম শব্দপ্রতি বছর দুর্গাপুজোয় কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী আসেন দেবী দুর্গার সঙ্গে। আবার কার্তিক মাসের সংক্রান্তিতে কার্তিক ঠাকুরের পুজো হয়। সূর্য উপাসনার অপর নাম ছট পুজো।এই বিশ্বাস অনুযায়ী একমাত্র সূর্য প্রতিদিন ওঠেন এবং অস্ত যায়। সূর্যের মত সত্য আর কিছু হতে পারে না। কর্মের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর মনে কর্ম প্রেরণা দিয়ে থাকেন। এই পূজার কখন উৎপত্তি হয়েছিল তার কোনো স্পষ্ট নিদর্শন পাওয়া যায় না। কিন্তু কিছু পৌরাণিক আখ্যানে ছট পূজার নীতি নিয়মের সঙ্গে মিল থাকা উৎসব দেখা যায়। ঋগ্বেদের শ্লোকসমূহে সূর্য্যবন্দনার স্পষ্ট নিদর্শন আছে। ভারতীয় সভ্যতার সঙ্গে গ্রীক, রোমান, মিশরীয় ইত্যাদির সভ্যতাসমূহেও সূর্য্য মূখ্য দেবতা ছিলেন। সেভাবে ঊষাও বৈদিক দেবী। বেদে উল্লেখ থাকা মতে, তিনি হলেন পূর্বের দেবী এবং অশ্বিনীকুমারদের মাতা। অগ্নি, সোম এবং ইন্দ্র ইত্যাদি দেবতা সকলের পরে তিনি হলেন অন্যতম উল্লেখযোগ্য বৈদিক দেবী। রাত্রি হল তার ভগ্নী যাকে হয়তো পরে পৌরাণিক যুগে সন্ধ্যা এবং ছায়ারূপে কল্পিত করা হয়েছে। রামায়ণে উল্লেখ থাকা মতে, রামের কুলদেবতা সূর্য্যের জন্য রাম এবং সীতা এই পূজা করেছিলেন। মহাভারতে উল্লেখ থাকা মতে, দ্রৌপদী ধম্য ঋষির উপদেশ মতে সূর্য্যকে আরাধনা করে অক্ষয় পাত্র লাভ করেছিলেন। সঙ্গে মহাবীর কর্ণের কোমর পর্যন্ত জলে নেমে সূর্য্যের উপাসনা করা উল্লেখ আছে। আজও ছট পূজা উদ্‌যাপন করা সকল মানুষকে কোমর পর্যন্ত জলে নেমে সূর্য বন্দনা করতে দেখা যায়। অন্য এক আখ্যান মতে, পাণ্ডু ঋষি হত্যার পাপের প্রায়শ্চিত্তের কারণে পত্নী কুন্তীর সঙ্গে বনে থাকায় পুত্র প্রাপ্তির জন্য সরস্বতী নদীর পাড়ে সূর্য্য উপাসনা এবং ব্রত করেছিলেন।পুরাণ মতে, প্রথম মনু প্রিয়বতের কোনো সন্তান ছিল না। তাই তার পিতা কাশ্যপ মুনি পুত্রেষ্ঠী যজ্ঞ করতে পরামর্শ দেন। এর ফলে তার পত্নী মালিনী একটি মৃত পুত্র জন্ম দিলেন। মৃত শিশু দেখে তারাও বিলাপ করতে থাকায় আকাশ থেকে এক দিব্য কন্যা প্রকট হলেন। তিনি নিজকে ব্রহ্মার মানস পুত্রী বলে পরিচয় দিলেন এবং মৃত পুত্রকে স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে সে জীবিত হয়ে উঠল। এখনও ঊষা দেবী বা ছটি মায়ের মূর্তি কোলে কিছু থাকা অবস্থায় কল্পনা করা হয় এবং পুত্র প্রাপ্তির জন্য ব্রত উপাসনা করা হয়। তদুপরি লৌকিক দেবী হিসাবে অন্য বহু লোককথা আখ্যান হিসাবে মানুষের মুখে মুখে চলে আসছে। ছটপূজাও বাংলার বুকে হয়। হিন্দু বর্ষপঞ্জীর কার্তিক মাসের শুক্ল পক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে উদযাপিত একটি প্রাচীন হিন্দু পার্বণ।সূর্য্যোপাসনার এই অনুপম লৌকিক উৎসব পূর্ব ভারতের বিহার, ঝাড়খণ্ড, পূর্ব উত্তরপ্রদেশ এবং নেপালের তরাই অঞ্চলে পালিত হয়ে থাকে। ধীরে ধীরে এই পার্বণ প্রবাসী ভারতীয়দের মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে প্রচলিত হয়েছে। ছট পূজা সূর্য্য ও তার পত্নী ঊষার  প্রতি সমর্পিত হয়, যেখানে তাকে পৃথিবীতে জীবনের স্রোত বহাল রাখার জন্য ধন্যবাদ জ্ঞাপন ও আশীর্বাদ প্রদানের কামনা করা হয়। ছটে কোনও মূর্তি পূজা করা হয় না। চারদিনের এই ব্রতের প্রথম দিনে ব্রতধারী বাড়িঘর পরিষ্কার করে স্নান সেরে শুদ্ধাচারে নিরামিষ ভোজন করেন (যাকে নহায়-খায় বলা হয়)। পরদিন থেকে উপবাস শুরু হয়; ব্রতী দিনভর নির্জলা উপবাস পালনের পর সন্ধ্যায় পূজার শেষে ক্ষীরের ভোগ গ্রহণ করেন। তৃতীয় দিনে নিকটবর্তী নদী বা জলাশয়ের ঘাটে গিয়ে অন্যান্য ব্রতীর সাথে অস্তগামী সূর্যকে অর্ঘ্য অর্থাৎ দুধ অর্পণ করা হয়। ব্রতের শেষদিনে পুনরায় ঘাটে গিয়ে উদীয়মান সূর্যকে পবিত্র চিত্তে অর্ঘ্যপ্রদানের পর উপবাসভঙ্গ করে পূজার প্রসাদরূপে বাঁশ নির্মিত পাত্রে সুপ, গুড়, মিষ্টান্ন, ক্ষীর, ঠেকুয়া, ভাতের নাড়ু এবং আখ, কলা, মিষ্টি লেবু প্রভৃতি ফল জনসাধারণকে দেওয়া হয়। বারবণিতাদের হাত ধরেই কাটোয়ায় শুরু হয় কার্তিক পুজো। পরবর্তীতে বারবণিতাদের কাছে আসা বণিক ও বাবুদের আভিজাত্য প্রদর্শনীই হয়ে ওঠে কাটোয়ার কার্তিক লড়াই। বর্তমানে কাটোয়া শহরের বিভিন্ন ক্লাবে আলোকসজ্জা, মন্ডপ, বাজনায় জমে ওঠে সুষ্ঠু লড়াই। যা কাটোয়ার ঐতিহ্যবাহী কার্তিক লড়াই নামে পরিচিত। তবে কার্তিকের শোভাযাত্রা যা লড়াই বলে পরিচিত তা কোভিড বিধির কারণে বন্ধ রেখেছে প্রশাসন। কাটোয়া দেব সেনাপতির আরাধনাকে ঘিরে কাটোয়ার কার্তিক লড়াইয়ের কথা আজ আর কারও কাছে অজানা নয়। তবে করোনা পরিস্থিতিতে কাটোয়ার সেই কার্তিক লড়াইতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে প্রশাসন। কার্তিক পুজোর আগেই কাটোয়ার স্থানীয় ক্লাবগুলিকে নিয়ে বৈঠকে বসা হয় পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে। বৈঠকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, পুজো করতে হবে সম্পূর্ণ কোভিড বিধি মেনে। প্যান্ডেলে মাস্ক পরে যেতে হবে দর্শনার্থীদের। রাখতে হবে স্যানটাইজার। হবে না কার্তিক লড়াই। এছাড়া নিরাপত্তার ওপরেও জোর দেওয়া হয়েছে। উৎসবের দিনগুলিতে গোটা কাটোয়া শহরে নজরদারি চালাবে প্রায় ২০০টি সিসি ক্যামেরা।অন্য বার কাটোয়া শহরের লেনিন সরণি থেকে শুরু করে পুরসভা মোড়, সংহতি মঞ্চের মোড়, টেলিফোন ময়দান, মাধবীতলা এলাকায় দাঁড়ানোর জায়গা থাকে না। আগে থেকে শোভাযাত্রার রুট নির্দিষ্ট করে দেয় প্রশাসন। এ বার বিকেল থেকে ফাঁকাই ছিল ওই সব রাস্তা। বাইরে থেকে কোনও দর্শককে শহরে ঢুকতে দেখা যায়নি। তবে রাত ৮টার পরে, রাস্তাঘাটে বেরিয়ে পড়েন শহরের অনেক বাসিন্দাই। শোভাযাত্রা না থাকলেও ভিড় করে রাস্তায় ঘুরতে বা মণ্ডপে যেতে দেখা যায় অনেকজনকে। যদিও পুলিশের দাবি, পুরোটাই স্বাস্থ্য-বিধি মেনে হয়েছে। বাংলায় কার্তিক সংক্রান্তির সাংবাৎসরিক কার্তিক পূজার আয়োজন করা হয়। পূর্বের তুলনায় এখন কার্তিক জনপ্রিয়তা কিছুটা কমেছে। পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার চুঁচুড়া-বাঁশবেড়িয়া কাটোয়া অঞ্চলের কার্তিক পূজা বিশেষ প্রসিদ্ধ। এছাড়া বাংলার গণিকা সমাজে কার্তিক পূজা বিশেষ জনপ্রিয়। দুর্গাপূজা সময়ও কার্তিকের পূজা করা হয়।কলকাতাতে তার মন্দির আছে। কার্তিক ঠাকুরের সাথে ছয় সংখ্যা জড়িয়ে আছে৷ সেজন্য হয়ত স্ত্রী ষষ্ঠীর সাথে তার মিল৷ তিনি বাচ্চা বড় না হওয়া অব্দি তাদের বিপদ থেকে রক্ষা করেন৷ তার কৃপা পেলে পুত্রলাভ, ধনলাভ হয়৷ সেজন্য বিয়ে হয়েছে কিন্তুু এখনও সন্তান আসেনি এমন দম্পতির বাড়ির সামনে কার্তিক ঠাকুরের মূর্তি ফেলা হয়। যা প্রজাপতি বিস্কুট সিনেমাতে ও দেখানো হয়েছে। সুঠাম গড়নের ল্যাংটো কাটোয়ার কার্তিক লড়াই খুব বিখ্যাত। কাটোয়ার কার্তিক পুজো বিখ্যাত বলেই এখানে এক পুজোর সঙ্গে অন্য পুজোর প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে কার্তিক লড়াই বলে। কার্তিক পুজোর দিন পথে কাটোয়ায় এক বড়সড় মিছিল নামে । সব পুজো-মণ্ডপের দলবল তাদের ঠাকুর নিযে বেরোয় শোভাযাত্রায়। চলে লড়াই কার ঠাকুর আগে যাবে। এ যুদ্ধ রীতিমতো লাঠিসোটা, এমনকী তরোয়াল নিয়েও চলে। হালিশহরের 'জ্যাংড়া কার্তিক' ও 'ধুমো কার্তিক' পূজা ও খুব বিখ্যাত। এভাবেই যুদ্ধ আর সন্তান উৎপাদন- দুইয়ের অনুষঙ্গেই কার্তিককে স্মরণ করে বাঙালি। প্রাচীন বর্ধমান তথা আজকের পশ্চিম বর্ধমান জেলার গৌরবাজার গ্রামে বিগত ১৬৬ বছর ধরে এই পুজো হচ্ছে। এই পুজোর বিশেষত্ব হল তিনটি কার্তিক- বড় কার্তিক, মেজো কার্তিক, ছোটো কার্তিক। বর্ধমান রাজাদের অধীনে তখন পালদের জমিদারি ছিল। তারা খুব বিখ্যাত ছিল। ১৮৫৩ সালের ঘটনা। জমিদার জয়নারায়ণ পাল, শ্যাম পাল ও লক্ষ্মীনারায়ণ পালের কোনো সন্তান ছিল না। তারা চরম চিন্তায় ছিলেন। অনেক উপায় অবলম্বন করেও কোনও সুরাহা হয় নি। তখন একদিন রাত্রে স্বপ্নে জয়নারায়ণ পাল আদেশ পান তাদের তিন ভাই কার্তিক পুজো করলে তাদের শূন্য‌ ঘর আলো হবে। তাই তাঁরা তিন ভাই মিলে ঘটা করে কার্ত্তিক মন্দির তৈরি করে একসাথে তিন কার্তিকের পূজা করতে লাগলেন। তারপরে ১৮৫৭ সালে লক্ষ্মীনারায়ণ পালের ধ্বজাধারী পাল নামে এক পুত্র সন্তান হয়। বাকি দুই ভাইয়ের একটি করে কন্যা সন্তান লাভ হয়। সেই থেকে এখানে পালদের বংশধরেরা আজও পুজো করে আসছেন। এর ফলে এই বংশে আর নেই নিঃসন্তান হয় নি। এখানে এখনো ধুমধামের সাথে কার্তিক পূজা করা হয়।কাটোয়ার থাকা কার্তিকের কাঠামোয় রামায়ণ মহাভারতের কোন কাহিনী নিয়ে পুতুল গড়া হয়।পরপর সাজানো থাকে মূর্তিগুলো।কাটোয়ার কার্তিক পুজোর পরের দিনে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিভিন্ন ক্লাবের প্রতিযোগিতা চলে দিনভর।এই প্রতিযোগিতা কার্তিক লড়াই নামে পরিচিত। অর্থাৎ হেমন্তের নামের মধ্যেই লুকিয়ে আছে তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। বর্ষার শেষ লগ্ন থেকেই আকাশে কমে আসে মেঘের ঘনঘটা, গোটা শরৎকাল জুড়ে নীল আকাশে ভেসে বেড়ায় পেঁজা তুলোর মতন সাদা মেঘ। হেমন্তের সেই মেঘ আরো কমে আসে। শরতের শেষে কয়েক পশলা বৃষ্টির পর হেমন্তের সকালগুলিতে অনুভূত হয় হালকা শীতের আমেজ।

ছোট গল্প

স্বাদ

গোগল দত্ত

দূর্গাপুর, পঃ বঙ্গ 

puri.jpg
স্বাদ

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

জানুয়ারি ২৭
আমার খিদে পাচ্ছে। প্রচণ্ড খিদে। সর্বগ্রাসী আগুনে খিদে। কারণ আছে এই যন্ত্রণার। আমি গত দুদিন ধরে কিছুই খাইনি। খালি কিছু কাঁচা ব্রকলি ছাড়া। দু দিন না তিন দিন? নাকি এক মাস? দু দিন হবে। আসলে খিদেতে সময়ের তাল থাকে না। তারপর এই দ্বীপে আমি একা। আমার হাতঘড়িতে সমুদ্রের নোনা জল ঢুকে খারাপ হয়ে গেছে। দ্বীপ না বলে একে বালির চড়া বলা উচিত। লম্বায় সাড়ে তিনশো পা, আর চওড়ায় মেরেকেটে আড়াইশো পা হবে। আর তিনটি সুন্দরী গাছ। একটি বড় রকম সাইক্লোন এলেই যে এই চড়ার কোনো নাম ও নিশানা থাকবে না, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। আমি ভয় পাচ্ছি না যদিও। কোনো বাঘের আওয়াজ পাইনি আমি এখনও। আর কিছু ঘণ্টার মধ্যেই নিশ্চয়ই আমাকে রেসকিউ করতে কেউ না কেউ আসবেই। 
আমি রুনু ঠাকুর। এটা আমার ডায়েরি। আমার এমনিতে ডায়েরি লেখার খুব অভ্যাস নেই। ডায়েরি কেন, কোনোকিছুই লেখার অভ্যাস নেই। কিন্তু এখন আমি একা। এই বালির চড়ায় আর কেউ নেই। আমার ডিঙি নৌকাটি ছাড়া। আর আছে একটি রেডিও ওয়েভ ট্রান্সমিটার। যেটি আমি চালু করে দিয়েছি। যেকোনো মুহূর্তেই পুলিশ রেসকিউ টিম চলে আসবে আমার উদ্ধারে এতক্ষণে তো চলে আসা  উচিত ছিল। দু দিন লাগছে কেন কে জানে? আর  আছে  দুটি  ব্রকলি। আমি ব্রকলি খেতে ভালোবাসি। যাই হোক যতক্ষণ না কেউ আমায় রেসকিউ করছে আমি এই ডায়েরি পাতা ভরতে থাকি। তারপর একে সমুদ্রে বিসর্জন দিয়ে দেব। আপাতত টাইম পাস করতে হবে। আমার মনটা খিদের দিকে যাতে না যায়, সেই চেষ্টা করতে  হবে।
কামিং ব্যাক - আমি রুনু। সাব ইন্সপেক্টর রুনু। পোস্টিং সুন্দরবনে। একটা দুর্ঘটনার ফেরে এই মুহূর্তে একটা জনমানব বিহীন দ্বীপে আমি নিখোঁজ হয়ে রয়েছি। ছোটবেলায় বাবা একটা চটি বই কিনে দিয়েছিল। প্রচ্ছদে একটা দাড়ি মুখ, মাথায় পাইরেট টুপি। বইটির নাম রবিনসন ক্রুসো। এখন আমি নিজেই রবিনসন ক্রুসো হয়ে গেছি। 
ওটা কী? দূরে যেন একটা তিতির পাখি মনে হচ্ছে? যাই আমি দেখি ধরতে পারি কিনা। সময় কাটানোর সাথী পাওয়া যাবে। ওর একটা ডানা ভেঙে দিলেই হবে যেমনটি আমি রিফিউজিদের ডানা ভেঙে দিয়েছি। মরিচঝাঁপিতে।

জানুয়ারি ৩১ 
ব্যথা। কী ব্যথা আমার ডান পায়ে। এই অসহ্য যন্ত্রণা আর সহ্য করতে পারছি না আমি। ওই লক্ষীছাড়া তিতিরের বংশ নির্বংশ হোক। ওটা কে যদি হাতের কাছে পাই আমি ওর একটা একটা করে পালক  ছিঁড়ে ছিঁড়ে যন্ত্রণা দিয়ে মারব। ওরে বাবা রে। ওরে মা রে। আমাকে যখন রেসকিউ করে নিয়ে যাবে তখন আমি সদর থানার ভেতরে একশোটা তিতিরের মাংস রোস্ট করে বাকিদের খাওয়াব। আমি খাবো না। আমিতো নিরামিষাশী। এই মুহূর্তে আমার চাই একটি - না না অনেকগুলি পেনকিলার। ওই হতচ্ছাড়া তিতিরের পিছু করছিলাম আমি। তিতিরটি গিয়ে উড়ে বসে ডিঙির উপর। আমি আমার হাতে একটি পাথর তুলে নিয়েছিলাম ওর ডানাটি ভাঙব বলে। ঠিক সেই মুহূর্তে উড়ে যায় এবং আমি পাথর লাগিয়ে ফেলেছিলাম নিজের ডান পায়ে। সেই অসম যন্ত্রণা আমি সহ্য করতে পারছি না। ওরা এখনো কেউ আসছে না কেন। খিদে - খিদে পেয়েছে আমার। যাই গিয়ে ব্রকলিটা খেয়ে আসি।

ফেব্রুয়ারি ৩
কতদিন হয়েছে আমি আর গুনতে পারছি না। ওরা কি আমাকে ভুলে গেছে। আমি ইন্সপেক্টর - সাব ইন্সপেক্টর রুনু। সুন্দরবনের পুলিশ অফিসার। আমাকে কি করে ওরা ভুলে যেতে পারে? আমি একা মরিচঝাঁপিকে শান্ত করেছি। সেই মরিচঝাঁপি যেখানে রিফিউজিগুলো এসে বসে সরকারি জমি কিনে নিজেদের জমি ভাবার ভুল করেছিল। বাঘ তাড়িয়ে নিজেদের বসতবাড়ি করার দুঃসাহস দেখিয়ে ছিল। আমার রিভলবারের বুলেটে অন্তত ২৫টা রিফিউজির শরীর ছুঁয়ে গেছে। ওদের লিডারের নাম ছিল নিমাই। অন্তত পাঁচশো জন লোক আমাকে ঘিরে ডেপুটেশন দিচ্ছিল। ওদের সাহস এত, আমায় বলে - আপনার ডিঙ্গি আটকে দেব। আপনাকে মেনল্যান্ডে ফিরে যেতে দেব না।

নিমাই বলে - এই জমি তো নোনা জমি। এই জমি অপ্রয়োজনীয়।

আমি ওর পায়ে গুলি চালিয়ে বলি - নে তোর এই পাটাও অপ্রয়োজনীয়। বাকি লোকগুলো ক্ষেপে উঠে আমাকে আক্রমণ করতে গেল। আমি ও ডিঙ্গিটা  চালিয়ে পালিয়ে চলে আসি এই দ্বীপে। আপনি বাঁচলে বাপের নাম। তবে এবার রেসকিউ টিম না এলে আমি বিপদে পড়ে যাব। আমার ডিঙ্গিটিতে যেটুকু খাওয়ার জল আছে তা আর বেশি দিন যাবেনা।

ফেব্রুয়ারি ২৮
আচ্ছা - আকাশের গায়ে কি সত্যি টকটক গন্ধ যেমন বলে গেছেন সীতানাথ - তবে এখানকার রাতের আকাশ রাতের বেলাতেও যেন নীল হয়ে থাকে  তারপর ধীরে ধীরে কালো হয়। ঠিক যেমন আমার ডান পাটা প্রথমে নীল তারপর কালো হয়ে গেছে। এরকম কালো একবার পুলিশ ট্রেনিংয়ের ম্যানুয়ালে দেখেছিলাম যখন এক ভদ্রলোকের গুলি লেগে গ্যাংরিন হয়ে গেছিল। গ্যাংগ্রিনের ফলে তার মাংসপেশিতে পচন ধরে। আমার পায়ে কি তবে গ্যাংগ্রিন হচ্ছে? তার তো একটাই চিকিৎসা কেটে বাদ দেওয়া এবং সেটা জলদি করতে হবে। আসছে না কেন আমাকে বাঁচাতে উদ্ধারকারী দল ? আমি ইতিমধ্যে একটি ব্রকলি খেয়ে ফেলেছি আর আরেকটি রেখে দিয়েছি।

মার্চ ৩
আমাকে কেউ রেসকিউ করতে আসবে না। কারণ কোন রেডিও সিগন্যাল যায়নি। আজ আমি রেডিও ট্রান্সমিটারটা খুলে দেখি ওর ব্যাটারি নোনা জলে খারাপ হয়ে ছিল। তাই রেডিও ট্রান্সমিটার চালু হয়েনি। তখন কার যেন একটি অট্টহাসির শব্দ শুনতে পাই। 

মার্চ ৭
পায়ের যন্ত্রণা লাঘব করার একটাই পথ। Amputation। আমি একটি পাথরকে ঘষে ঘষে তীক্ষ্ণ বানিয়েছি। ওটাই হবে আমার শল্য চিকিৎসার উপাদান। এ কার অট্টহাসির আওয়াজ আমার পিছনে ? এর সাথে আমি শুনতে পাচ্ছি কার কথা, সে বলছে, সে বলছে  - পাটা  অপ্রয়োজনীয়। ঘুরে তাকিয়ে দেখি - এ তো নিমাই! নিমাই এখানে কী করে?
-------
একটি স্পিডবোট এসে নেমেছে সুন্দরবন থেকে ১০০ কিমি ভিতরে বঙ্গোপসাগরের মাঝখানে অবস্থিত একটি দ্বীপে। সচরাচর এই দ্বীপে কেউ আসে না। কারণ দ্বীপটিতে কিছুই নেই। খালি তিনটি সুন্দরী গাছ ছাড়া। স্পিডবোট এসেছে অন্য কারণে। মাস তিনেক ধরে সাব ইন্সপেক্টর রুনু ঠাকুর নিখোঁজ। তার খোঁজে পুরো পশ্চিমবঙ্গ তোলপাড়। মরিচঝাঁপিতে নাকি পুলিশ অত্যাচার করেছে এবং তার প্রধান কালপ্রিট রুনু ঠাকুর। কিন্তু তাঁকে খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না। ইতিমধ্যে একটা জেলের নৌকা এদিকে মাছ ধরার সময় একটি ভাঙা ডিঙি দেখতে পেয়ে পুলিশকে জানায়। সেই সূত্রে ইন্সপেক্টরবাবু এই দ্বীপে এসেছেন। সঙ্গে দুজন কনস্টেবল আর একজন চালক।
ইন্সপেক্টরবাবু নিশ্চিত হন যে এই ডিঙ্গিটি রুনু ঠাকুরের। তার তাঁর পরার হাতঘড়িটি এবং একটি রক্ত মাখা ডায়েরি - দুটো জিনিস এই ভাঙা ডিঙির ভেতর পাওয়া গেছে। কিন্তু রুনু ঠাকুর নিজে কোথায়? আর ডায়েরিটিতে রক্ত কার?
--------
ইন্সপেক্টরবাবু রাতে নিজের রুমে সব এভিডেন্স ফাইল করতে লাগলেন। রাত জেগে কাজ করা স্বভাব। রুনু ঠাকুর নিখোঁজ বলে মামলা বন্ধ করা হবে। ইন্সপেক্টরবাবু খালি একটি ধাঁধার উত্তর খুঁজে পাচ্ছেন না। দ্বীপ থেকে উনি গেলেন কোথায়? উনি মৃত, এটা তাঁর মনে সন্দেহ নেই। বেচারি নিরামিষাশী ছিলেন। শেষ সময় লতাগুল্ম খেয়েই বিষক্রিয়ায় মারা গিয়ে থাকবেন। কিন্তু ডেড বডিটি কোথায়? ভাবতে ভাবতে যখন উনি চিন্তায় নিমগ্ন ওনার চোখ পড়ল টেবিলের উপর রাখা ডায়রিতে। সেই রক্ত মাখা ডায়রি যেটি দ্বীপে পাওয়া গিয়েছিল। পাতা উল্টোতে  থাকেন।

এপ্রিল ৭
ব্যথা। পায়ে ব্যথা। নিমাই বলেছে পা টা অপ্রয়োজনীয়। খাবার নেই। সুন্দরী গাছের পাতা খাচ্ছি আমি। নিমাই রাতে আসে। দিনে মিলিয়ে যায়। সমুদ্রের জলে। 

এপ্রিল ১৫
নিমাই বলল - দুটো পা অপ্রয়োজনীয়। আট আঙুল হাতের অপ্রয়োজনীয়। বলল - মাংস খাঁ।
বলল সমুদ্র সাঁতার কেটে পার হব আমরা দুজন। প্রচণ্ড ব্যথা।

এপ্রিল ২৫
সুন্দরীর পাতা শেষ।

মে ১
আজকে সাঁতার কেটে পার হব। আঙুল কাটলাম। খুব কুড়মুড়ে খেতে। মানুষের মাংসের স্বাদ ঠিক যেন ব্রকলি। 

কবিতাঃ রওশন মতিন

কবিতা

রওশন মতিন 

বিরামপুর, দিনাজপুর, বাংলাদেশ

অন্য জীবন 

 

বেয়াড়া বাতাসে মুখ থুবড়ে 

উল্টে যাওয়া বিল বোর্ডে 

ঝুলে আছে মৃত সুন্দরীর লাশ।

কৃত্রিম ফুসফুসের টবে কাগুজে ফুলের লাশ,

মাকাল সুন্দরীর অপূর্ব গ্রীবা সংগীতে

নপুংসকের মাতাল উল্লাস -এইসব ছাই-পাশ,

ঝুলে আছে অসুন্দরের স্থানচ্যুতির ব্যর্থ-বিলাপ

কুয়াশার হাহাকারে মোড়া প্রেতাত্মার আবদার।

 

পথের ধারে পাথর প্রতিমা নয়,

আমাকে এনে দাও হারানো মুক্ত আকাশ 

হৃদয়ের খিলানে ব্যাবিলনের সবুজ উদ্যান,

মেঘের পরে সাজানো মেঘ

সলজ্জ আকুলতা,কাজল চোখের ঢল

এক বুক ভালোবাসার অথৈ শ্রাবণ 

অথৈ শ্রাবণ ----

এবং জীবন -নদী ও অন্য জীবন।

স্বাধীনতার এই যে আমি 

 

জানালা খুলে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকি,

"ফুল ফুটেছে "- বলল ডেকে ভোরের পাখি,

রঙ ছড়াল রোদের ঝিলিক -মুক্ত আলো,

যতোই দেখি, অবাক চোখে লাগছে ভালো!

আজ সকালের সূর্যটা কি রক্ত লাল,

বইছে হাওয়া স্বাধীনতার উড়িয়ে পাল,

ডানপিটে সব ইচ্ছেগুলো ডানা মেলে উড়তে চায়,

স্বাধীনতার সবুজ দেশে মন যে আমার হারিয়ে যায়

স্বাধীনতার লাল সূর্য দিগ্-দিগন্তে উঠলো ফুটে,

স্বাধীনতার খোলা বুকে, এই যে আমি চলছি ছুটে।

morning.jpg

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

কবিতাঃ ডক্টর সুব্রত ভট্টাচার্য্য 

কবিতা

ডক্টর সুব্রত ভট্টাচার্য্য 

সিডনি, অস্ট্রেলিয়া 

অস্তরাগের প্রতিচ্ছবি

চিত্রকল্প: দিনান্তে একা বসে আছি এই নির্জন সমুদ্রসৈকতে।

দূরের পাহাড় ছায়ার মতো ধীরে ধীরে মিশে যাচ্ছে কুয়াশায়,

মাথার উপর ঘন কালো মেঘের স্তর -

নীরব জলে প্রতিফলিত এক মুখ, বাস্তব নয়, কেবল কল্পনা।

সময় নিজস্ব ছন্দে গড়ায়—আস্তে আস্তে নামে আঁধার।

 

তুমি তোমার মতো থাকো - 

আলোর পেখম মেলে উড়ে চলা এক শূন্যতার বিহঙ্গের মতো,

নির্বিকার, নিঃশব্দ, অথচ অনন্ত স্পর্শের আকাঙ্ক্ষা জাগাও।

তোমার হাসি থাকুক তোমারই ওষ্ঠে,

তোমার চোখে জ্বলুক সেই অচেনা স্বপ্নের আলো - 

যা ছুঁতে পারি না, তবু প্রতিদিন অনুভব করি।

আমি আমার মতো থাকি - 

একটি ছায়া, একা এক নির্জন সৈকতে।

যেখানে তুমি কেবল এক প্রতিচ্ছবি,

থাকো - তবু ধরা দাও না।

 

আমার কল্পনার কুঠিরে

তুমি প্রতিদিন এসে বসো অলস দুপুরে,

ভেজা ঠোঁটের পাশে আমি রেখে দিই

আমার সব না-বলা কথাগুলো।

তুমি শোনো না, তবু তুমিই শ্রোতা - 

তোমার অনুপস্থিতিই আমার উপস্থিতির প্রেরণা।

 

আমি কিছুই চাই না আর - 

না ভালোবাসা, না সান্নিধ্য,

শুধু এই দূরত্বটুকু - 

যেখানে

তুমি দূরের তারার মতো - 

ছুঁতে পারি না, তবু আলোয় পথ খুঁজি।

তুমি মুক্ত,

আর আমি, সেই মুক্তির ছায়ায় পরিপূর্ণ।

গার্গীর জিজ্ঞাসা

 

প্রথম সর্গ — লোপামুদ্রার প্রভাতাভাস

 

হে বিদুষী, মহাজ্ঞানে মহিমাময়ী মাত: লোপামুদ্রা!

উদয়শৃঙ্গশোভা, অরুণালোক-মালিকা, কিরণকাঞ্চনবেণী দীপ্ত তব জটাজূটে,

যেন দীপ্যমান অগ্নিমণি-দীপশিখা!

করকমল হতে ঝরে ঋকমন্ত্রমাল্য, বাণীবিন্দুর অমৃতধারা;

দিগন্তবীণার তারে রৌদ্রোজ্জ্বল গম্ভীরতন্ত্রী,

ভৈরবীরাগগর্জনে করে জাগ্রত তপোবনের তমসারাশি।

 

স্মরি সে মহাদিন -

যেদিন নারীর অধরে ছিল না কিঞ্চিৎ ভূষণ, না ছিল ভীতির ছায়া;

নয়নের জ্যোতি ছিল দীপ্ত তপঃপ্রভায়;

গগনসম, অশঙ্ক, অবাধ, বিশাল -

কণ্ঠতরঙ্গ গর্জিয়া উঠিত তপোবনের সিংহীগর্জনসম।

সেদিন ব্রহ্মমন্দিরে, স্বয়ং তাঁরা উচ্চারিলেন সে প্রশ্ন,

যেন দিগন্তে উদিত মহাজিজ্ঞাসার প্রলম্ব তরঙ্গ।

 

কোথা সে দিবস? কোথা সে প্রশ্নশিখা?

আজ রাজদুর্গের লৌহশৃঙ্খলে রুদ্ধ নারীকণ্ঠ;

বন্দিনী বাণীদেবী, নীরবতার কারাগারে,

নির্বাপিত দীপশিখা গৃহের অন্তঃপুরে,

নিদ্রিত ধূলির স্তূপে ঢাকা, হায় রে নিয়তি!

 

হে প্রভাতদেবী! হে মুক্তিদায়িনী জননী!

কোথা তব অরুণ অঙ্গরাগ?  কোথা সে মুক্তির ধ্বজা?

লোপামুদ্রার অগ্নিগান ভাসিয়া চলে কালপ্রবাহে

কিন্তু নাই শ্রোতা - কে শোনে সে মেঘগর্জনের প্রতিধ্বনি?

যে কণ্ঠ ছিল অনন্ত অশঙ্ক ধ্বনিময়, আজ সে নিথর,

যেন অভিশাপ চির-উৎকীর্ণ জাতির ললাটে, অগ্নিবর্ণ রক্তাক্ষরে।

দ্বিতীয় সর্গ — শতপথ প্রশ্নযুদ্ধ 

হে জনকসভা!

হে মহর্ষি যাজ্ঞবল্ক্য!

নমো তোমারে!

স্মৃতির স্বর্ণশালায় শিলালিপি অম্লান, দীপ্ত সে দিবস—যেদিন আমি, গার্গী, ধী–শক্তি–সঞ্চিতা, পদতলে অচল গিরিশৃঙ্গসম,নয়নে তপঃঅগ্নি, বক্ষে যুক্তিবজ্র,

ছিলাম দন্ডায়মানে তব সম্মুখে অবিচল, নির্বিকার।

অধরে দীপ্ত প্রশ্নশূল, বাক্যে পদ্মঅমৃতধারা—
কহিলাম, “হে জ্ঞানপতি! কহ, ব্রহ্ম কিসে সীমাবদ্ধ?
কিসে তাহার দ্বার? কোথা তাহার অন্ত? কোথা অনন্ত প্রান্তর?”
 
স্তব্ধ তুমি, যেন অনন্ত সিন্ধুবক্ষে ডুবন্ত তরণী;
পরে বর্ষাইলে বাণী, মেঘগর্জনসম—
“গার্গী! অতিরিক্ত প্রশ্নে চঞ্চল হয় নীরব ব্রহ্মধাম;
জ্ঞান লিঙ্গাতীত, রূপাতীত; যে যোগ্য, সে-ই করিবে প্রবেশ।”
 
তথাপি নিভিল না অন্তরের অগ্নিপ্রদীপ!
প্রশ্নে প্রশ্নে প্রজ্বলিত, শতপথের দিগন্তপ্রান্ত;
ভাঙিল জনকসভার নীরবতার পাষাণবেষ্টনী!
কহিলাম, “যদি জ্ঞান সত্যই লিঙ্গাতীত, তবে তাহা সকলের অধিকারে;
যে করে অনুসন্ধান, সে-ই পায়, যোগ্যতায় হয় স্থির—
নহে নারীতে কিংবা পুরুষে।”
 
কিন্তু জানি—এ সভা প্রতিষ্ঠিত যেথা,
নারীর কণ্ঠ সর্বদা ক্ষীণ সেথা;
পিতৃতন্ত্রের দুর্গে বন্দিনী আলোকদেবী,
থাকে সে শৃঙ্খলবদ্ধা গৃহঅন্তঃপুরে, অশ্রুত, অবিদিত।
 

তৃতীয় সর্গ - জনকের রাজসভা 

দীপ্ত জনকযজ্ঞমণ্ডপে ধূম্রআবেশে গম্ভীর গগন,

মন্ত্রগুঞ্জরধ্বনি দোলায় অগ্নিকুণ্ড দাহনশিখা;

মহর্ষি বেদজ্ঞ, রাজর্ষি, তপোবনবৃক্ষপ্রতিম গুরুগণ,

আসনস্থিত, মনঃসমাহিত, জ্ঞানধারায় স্নাত:l 

মধ্যভাগে রাজাসনাসীন জনকমহারাজ,

মণিমুকুটে প্রাচ্যজ্যোতির অগণিত অরুণকিরণ;

দৃষ্টিপ্রখরে জ্ঞানের জ্যোতির্মালা,

চতুর্দিকে বেদ–বিতর্ক, যুক্তি–সংঘাত,

বাক্যতূণীরে অগ্নিবাণ, জ্ঞানধনুতে তীক্ষ্ণটান। 

সে সভায় বিরল নারীকণ্ঠ,

যেন মরুপ্রান্তে একাকী সরোবরে ক্ষীণ চন্দ্ররেখা;

তথাপি আমি গার্গী, করিয়াছি প্রবেশ জনক রাজসভায়; 

তপঃদীপ্ত পদক্ষেপে, প্রশ্নশস্ত্র হস্তে, ধীর, স্থির, অবিচল।  

 

চতুর্থ সর্গ - প্রশ্ন–বাণের প্রথম বর্ষণ

হে যাজ্ঞবল্ক্য, হে ব্রহ্মরহস্যের মহিমাময় ভাণ্ডার!

কহ, কিসে রচিত গগনদ্বার? কিসে বেষ্টিত ত্রিভুবনধাম?

যে সূর্যশশী বিরাজে অন্তরীক্ষে, কিসে পথরেখা অঙ্কিত তাঁহাদের?

যে বায়ু বহে, যে বারি ধায়,

যে অগ্নি জ্বলে, যে ভূমি অচল—

কিসে নির্ধারিত তাঁহাদের সীমা,

কিসে স্থির, কিসে বাঁধা অনন্তে? 

মোর প্রশ্নে সভাকাশে বজ্র

নিনাদবিকীর্ণ করিল ঘন শঙ্কার মেঘস্তর;

বাক্যবাণে গোধূলিমেঘে চমকায় বিদ্যুৎরেখা!

স্তম্ভিত বিস্ময়ে মুনি-ঋষিগণ—

যেন তপোবনের বৃক্ষশাখায় হঠাৎ অগ্নিস্পর্শ!  

 

পঞ্চম সর্গ - যাজ্ঞবল্ক্যের উত্তর 

তিনি শান্ত, দীপ্ত, গম্ভীর -

যেন হিমালয়ের তুষারাবৃত প্রভাতশিখর,

অবিচলিত, অপরিবর্তনীয় মহিমায়;

ধ্বনিল বাণী তাঁর, হিমালয়ের শিখরসম নীরব, অবিচল -

 

“গার্গী! অতিরিক্ত প্রশ্নে  হয় চঞ্চল ব্রহ্ম–আবরণ;

যে জানে, সে নীরব - কারণ জ্ঞান লিঙ্গাতীত, রূপাতীত, কালাতীত;

ব্রহ্ম যেন অনন্ত আকাশে বিরাজমান,

সকলেরে বেষ্টন করিয়াও নিজে অবেষ্টিত।” 

 

তথাপি, হে জননী জ্ঞানঅভিলাষা,

অন্তরে মোর নিভিল না অনুসন্ধানশিখা;

হইলো প্রশ্নশক্তি দৃঢ়, দীপ্ত ও আরও গভীর

যেন নিশির–গগনে চন্দ্রপ্রভাআরোহণ করে, অতীত শিখরে।

ষষ্ঠ সর্গ - দ্বিতীয় প্রশ্নযুদ্ধ 

বাক্য করি -

“যদি ব্রহ্ম, অনন্তদিগন্তবিস্তৃত,

সকল চরাচর পর্যন্ত করিয়া প্রলম্বিত রহে অবেষ্টিত,

তবে কাহার অবকাশ করিবে রুদ্ধ তুমি, হে মুনিশ্রেষ্ঠ?

যে তপোবল–প্রভায় দীপ্ত, যে অন্বেষণব্রতে অচল,

নহিবে কি সে অমৃতপদপ্রাপ্তির সমাধিকারী? 

 

যদি করো অবরোধ জ্ঞানধারামৃত লিঙ্গবিভাজনে,নহে কি তাহা অমোঘ অপরাধ শাশ্বত–ব্রহ্মধর্মলঙ্ঘনের?

জ্যোতি কি একমাত্র পুরুষগৃহদীপিকা?

যে মুক্তি, সে কি  কেবল অর্ধাংশ–মানবের দুষ্প্রাপ্য রত্নমালা?

নাকি যোগ্যতাতটে মান্য হয় তাহার প্রাপ্য,

যেথা হয় লীন লিঙ্গচিহ্ন, সর্বব্যাপী–মহাসমুদ্রে?

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

বলহ, হে যাজ্ঞবল্ক্য! -

যদি আত্মা নিত্য, নিরাকার, লিঙ্গ -অতীত,

তবে কি ক্ষণিক দেহ রচনাই জ্ঞানদ্বারপাল?

যদি ব্রহ্মরূপ সর্বজনসমগম্ভীর, সমজ্যোতির্ময়,


তবে কেমনে নারীকণ্ঠচ্চারিত প্রশ্ন, পুরুষের তুলনায় ক্ষুদ্রতর ধ্বনি?
যদি সত্য অনন্ত, অশঙ্ক, অবিকল,
তবে কি কম্পমান হয় তাহা ,
যখন নারীর অধরে বাজে তাহারই বজ্রনাম?
 
উত্তর দাও, ঋষি!-
যদি না পারো দিতে, তবে লিখ জনকসভামণ্ডপে
অগ্নিলিপি করিয়া,
‘আজ নারীকণ্ঠের বজ্রনিনাদে হইলো দোদুল্যমান প্রাচীন মর্যাদার কৃতবেষ্টন,
আর ব্রহ্মধামের মহাদ্বার রইল জ্যোতির্বিহীন গম্ভীর নীরবতায় আচ্ছাদিত।‘
 
স্তব্ধ সভা-
কেবল অগ্নিকুণ্ডের ক্ষুদ্র কড়কড় ধ্বনি,
আর গম্ভীর মুনিদৃষ্টি, প্রাচীন গিরিশৃঙ্গের শিলাখণ্ডসম;
তথাপি নাহি উত্তর কণ্ঠে-
যেন মহাকাশে ঝুলিয়া রহে অনন্ত নীরবতা!
 
সপ্তম সর্গ - বিলাপ
 
হা হন্ত! এ কি মোর সেই স্বপ্ন,
যেথা জনকসভায় নারীকণ্ঠ হইবে এক সমবেত বজ্রধ্বনি?
আজ যে সেথা পাষাণবেষ্টিত এক নীরবতার অন্ধকূপ!
 
গার্গীর জিজ্ঞাসার অগ্নিশিখা করিল দগ্ধ নীরব গগনের অন্তঃস্থল,
তবু প্রাচীন বদ্ধমর্যাদার শীত:শ্বাস তাহা নির্বাণ করিতে সচেষ্ট!
হে লোপামুদ্রা, হে গোপথ্য, হে সূর্যবালা -
তব তপোবনের প্রতিধ্বনি
আজ গুমরায় ধূলিতলে;
যেন গোধূলিপ্রান্তের ম্লান চন্দ্ররেখা
কম্পমান নক্ষত্রবিহীন গগনে-
অক্লান্ত, তবু অবদমিত!
 
রাজসভা আজও পূর্ণ ঋষি-মুনির প্রাচীন মর্যাদায়,
কিন্তু নারী -
সে কেবল শিরনত শ্রোতা!
জ্ঞানধারা বহে এক পুরুষতট হইতে আরেক পুরুষতটে,
নারীর তট রহে শুষ্ক
যেন বর্ষাহীন মরুবালুর প্রান্তর,
যেথা কেবল দোদুল্যমান স্মৃতির মরীচিকা l
 
অষ্টম সর্গ - আহ্বান
 
হে ভবিষ্যৎ জাগরণের প্রভাত!
আনহ সেই দিন,
যবে নারী-পুরুষে হইবে বিভাজন লুপ্ত জ্ঞানের দ্বারে;
যবে ধ্বনিত হইবে সভাকাশে নারীকণ্ঠের বজ্রপ্রশ্ন,
যবে জননীধারা পুনরায় করিবে উজ্জ্বল বিশ্বজ্যোতিতে।
 
তথাপি যতকাল সে দিন নাহি আসিবে,
ততদিন গার্গীর এ ধ্বনি ধ্বনিত হইবে -
যেন নিশির আকাশে অবিনশ্বর ধ্রুবতারা,
যেন যুগযুগান্তরে অনির্বাণ প্রদীপ,
যা হয় না নির্বাপিত, হয় না ক্ষয় ,
শুধু জ্বলে জাগরণের জন্য, মুক্তির জন্য!
 
লোপামুদ্রাস্বর, গার্গীর তর্ক, মৈত্রেয়ীর ধূপ -
তিনের মিলন, অনন্তকালের ধ্রুবজ্যোতি;
যা প্রতিটি কন্যার কপালে করিবে চুম্বন প্রভাতের প্রথম আলো,
করিবে উন্মুক্ত, প্রতিটি সভার দ্বার
সমানভাবে জ্বলে প্রতিটি বেদীর জ্যোতি, সকলের তরে।
 
হে উত্তরাধিকারিণীগণ! - লহ এই দীপ্যমান প্রদীপ,
যা শিখিয়েছে মুক্তি, শিক্ষা, এবং ধীর জিজ্ঞাসা;
হে প্রজন্ম! তুমি হবে প্রশ্ন, তুমি হবে যুক্তি,
তুমি হবে সেই দীপ্ত শিখা,
ভস্মীভূত হবে অজ্ঞানতার দুর্গ যাহার উষ্ণতায় l
 
আর তখন -
প্রলয়ের কৃষ্ণ মেঘ বিদীর্ণ করিয়া উঠিবে উদীয়মান সূর্য,
গগনজুড়িয়া উড়িবে অরুণ-অরুণিমা জ্যোতির পতাকা,
তপোবনের দীপমালা উঠিবে জ্বলিয়া প্রতিটি নগরগ্রামে;
বজ্রের গর্জন, মন্দাকিনীর স্রোতধ্বনি,
আর শঙ্খের অনন্তধ্বনি যাইবে মিশিয়া,
যেন বিশ্বমন্দিরে উৎসর্গীকৃত এক মহাসঙ্গীত!
 
সেই মহাপ্রভাতে উড়িবে জ্ঞানের পতাকা নিরবধি আকাশে,
চিরভাস্বর, এক নব সূর্যের মতো -
যাহার রশ্মি , সকলের জন্য সমান, অবিভাজ্য, অনন্ত!

কবিতাঃ সৌমেন রায়

সে যে আমার অতি আপন, নয়ন জোনাকি।

সে বিশ্বাস নিয়ে খেয়া দেয় তরী
সাত সাগর আর তেরো নদী!
সূর্যাস্ত ও সূর্যোদয়ের সন্ধিক্ষণে
বেজে ওঠে, রাগ_ভৈরবী।

উত্থান পতনের মাঝে অতি আপন ক’রে 
জড়িয়ে ধরি তাকে
আর শুকিয়ে যাওয়া ডালপালাগুলো পুনরায় নেচে ওঠে 
আনন্দে মাতে প্রজাপতি।

নিয়ে সবুজের গান, দাঁড়ে দিলাম টান_
তরঙ্গে বয় শুধা
চুপটি ক’রে বলে, “ওরে বিহঙ্গ“
“জীবন এখনও অনেক বাকি”! 
আর আমি বারবার বেঁচে উঠি 
বয়ে চলি তার সাথে সাজিয়ে অফুরন্ত স্বপ্নের ডালি।

হাঁ সন্ধ্যা হয়নি এখনো 
মরন হয়নি আমার 
মরন এর ওপারে,
আমি জীবন জোয়ারে ভাসি

কবিতা

সৌমেন রায়

জিতপুর, মুর্শিদাবাদ

অনাহূত

সেদিন গিয়েছিলাম তোমাদের মাঝে 
আমি অনাহূত এক অতিথি 
দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে, অতি সহজ ভাবে 
গিয়ে বসে পড়েছিলাম 
সারিবদ্ধ একটি চেয়ারে 
হঠাৎ উঠলো ঝড় 
কাউকে জেনো ঠিক চিনতে পারছিলামনা সেদিন 
আর বুকটা তোলপাড় করে উঠলো 
মনে মনে বললাম, এ আমি কি করলাম?

ক্রমশ বুকের মাঝে ব্যথা অনুভব করলাম 
আস্তে আস্তে চেনা মুখগুলো ঝাপসা হয়ে গেল 
বার বার ঠোঁটের ডগায় হাসি এসেও ঘুরেগেলো 
কিন্তু জানিনা কেনো তাঁকে দেখে হাসতে ইচ্ছে হয়েছিল 
কিন্তু আমি হাসতে পারিনি সেদিন 
পারিনি বলতে আমি অনাহূত......

কি জানি এক সন্দেহ বাসা বেঁধেছিল মনের কোণে 
যদি সেও না চেনে?
দেখলাম হঠাৎ করে সবাইকে পেরিয়ে সে আমার দিকে আসে 

মুখ ভরা হাসি নিয়ে সে বলে 
"কি রে একা কেনো এখানে"
চুপ করে বসে থাকলাম আমি ........

চলে গেলো সবাই এক এক করে 
হয়তো অনাহূতদের চিনতে নেই-
তারা এই বার্তা দিল 
বসে রইলাম অনেকটা সময় 
আস্তে আস্তে দেখলাম নিশ্বাসের গতি স্বাভাবিক হল 
কিন্তু ফিরেছিলাম বুকভরা তৃপ্তি নিয়ে 
সবাই না হোক কেউ তো চিনেছে আমায় 
অনাহূত নয়, শুধুমাত্র আমার নামটি মনে রেখে ...

​​

মাঝি


ন্ধ্যা হয়নি এখনো 
মরন হয়নি আমার 
ওরা উঁকি দেয়  মাঝে মাঝে 
নিশিদিন তারা জাগে
আর জাগে কতো কি।

হ্যাঁ মরনের ওপারে, আমি আজও বেঁচে আছি 
খুঁজে চলেছি সোনালী রোদ্দুর, 

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

কবিতাঃ পর্ণাভ দে

কবিতা

পর্ণাভ দে

বারাসাত, উত্তর ২৪ পরগনা

নিরসিত - নিরসনে

ভ্যতার ধ্বংসের পরোয়ানা বয়ে চলা মুখর বিদ্রুপ,

অনন্ত-সনাতন আকাঙ্খা। 

নিরব, নিরসিতের বিপ্লবের ভাষা জাগিয়ে তোলা-

সেই অনন্ত।

 

বসন্তের প্রেমের কবিতা নয়

পলাশের লাল-

যার ধ্বংসোল্লাসের আগুন-

সেই অনন্ত।  

 

অনন্ত - তুমি মানুষের হাত ধরো 

      তুমি মাটিতে কান পাতো 

      পৃথিবীর সব হাহাকার স্তব্ধ করো-

      স্তব্ধ করো, দৃঢ় সংকল্পে বাঁধ সভ্যতাকে।

তুমি নিরসিত, 

আজ তোমার সময়।

তুমি প্রতিশোধ নাও 

তোমার চেতনার সংকল্পে শক্ত করে বাঁধ।

সব কোমলতা সরিয়ে দাও,

প্রলেতারিয়েতের প্রতীক হও তুমি।

নীরব সমাজে আগুন জ্বালাও, 

নিপীড়িতের ভাষা হও তুমি। 

 

তুমি মানুষের হাত  ধরো 

তুমি মাটিতে কান পাতো

পৃথিবীর বুকে চলতে থাকা 

সহস্রাকাল ব্যাপী নিরন্তর হাহাকার -

স্তব্ধ করো, স্তব্ধ করো, স্তব্ধ করো।

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

shakun1.jpg
কবিতাঃ মো. সাইদুর রহমান সাঈদ

ক্যান্টরের সেটের ২য় বন্ধনীতে আমাদেরও যদি বাঁধা যেত!  

ইশশশ.. যদি যেত!  

কেউ নয়; আর কেউ নয়,  

শুধু আমি আর তুমি; তুমি আর আমি, হে চাঁদ!  

হতো তোমার কলংক আর আমার আধাঁরের অঙ্গে অঙ্গে মাখামাখি!  

সেদিন বুলবুলিও গান ধরতো; 

আমি তবু শুনতাম নাহ!  

চকোরও নিচোর চিরে চাইতো আমাদের পানে... 

তবুও আমি দেখতাম নাহ!  

আকাশের শুকতারা আর জমিনের নয়নতারা  

হাসত মিটিমিটি!  

ব্রক্ষ্মগুপ্তের অসম-ব্যাসার্ধের গোলকে আজ  

এক এরসাথে এক যোগে আর্যভট্টের শুন্য হয়ে যায়!  

তাই তো দূরেদূরে থাকি, 

সুর ধরি দূরে থেকে একাকী।  

কাছে পেয়েও হারিয়ে ফেলার ভয়!!

কবিতা

মো. সাইদুর রহমান সাঈদ 

পটুয়াখালী, বাংলাদেশ

একাকিত্ব 

 

হৃদয়ে জোছনা নাই! 

গাণিতিকহারে ব্যথা যত বাড়ে,  

জ্যাতিমিকহারে নেই তার নেমে আসা; 

তাই ঘোর অন্ধকার। 

ঘন-বিষাদের ভার!  

হৃদয়ে আমার জোছনা নাই!  

 

হৃদয়ে আমার বৃক্ষ নাই।  

ধু-ধু মরুভূমি সাহারা-গোবিছাপ,  

শুকনো-হৃদয়ে কাকে দিব ঠাঁই?  

ব্যথা দেবার ইচ্ছে নাই!  

তাই, আমার বেসুর মনের অসুরময় হাসি  

হেসে নিজেকে শুধাই। 

নাই, নাই সেথা বুলবুলি নাই। 

আকাশেও দেখি ঘোর অন্ধকার,  

তবুতো তার আছে আলো...আছে চাঁদ,  

আছে চকোর, কুমুদী, আছে প্রেমিক!

maple_edited.jpg

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

কবিতাঃ সম রায়হান

কবিতা

সম রায়হান

গাজীপুর, বাংলাদেশ

জয়নব

 

য়নব তোমার জন্য—

আমি উঠতে পারি প্রাচ্যনাটের মঞ্চে,

এতটুকু সাধ্য রয়েছে আমার।

কালো প্রলেপের এই শহরে

তোমার জন্য বুড়িগঙ্গাতেও চড়া যায়।

কাকের পিছে দৌড়ে গেলেও

আজকাল লোকে আর পাগল বলবে না।

দুটো দালানের ছোঁয়াছুঁয়ি দুরত্বে 

আমি বুনে দিতে পারি মালঞ্চ।

তোমাকে পাওয়ার আশায় হয়ত অন্যকেউ—

এভারেস্টেও চড়ে বসতে পারে!

রেসকোর্সের ময়দান— 

চালু হয়ে যেতে পারে আবারও!

অতএব জয়নব—

তোমার গণতান্ত্রিক অধিকার বুঝে নাও।

traveller2.jpg

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

কবিতাঃ পার্থ বর্মন

কবিতা

পার্থ বর্মন

কালিয়াগঞ্জ, উত্তর দিনাজপুর

মানবতার মরুশহর 

 

ভোর নামে নীল মুখোশে, হাঁটে ছায়ার দল,

হাসি আঁকে ঠোঁটে, অথচ ভেতর জ্বলন্ত বিকল।

রঙিন চোখে ঘোরে ছবি—দেয়ালের আঙুলে বাঁধা,

খালি পাতিলে ওঠে চাঁদ, শিশিরে আঁকে ব্যথার খাতা।

প্রেম খোঁজে নিয়মের ছায়া, ক্ষুধার পাশে দাঁড়িয়ে,

জানালা বেয়ে উঁকি মারে—নাটকের মুখোশ হাঁপিয়ে।

পাতার গন্ধ ম্লান, পৃষ্ঠা বদলায় না দিনের সূরে,

ভাষা হারায় ডিজিটাল নাচে, মন কাঁদে দূরে।

art1.jpg

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

আলো জ্বলে মঞ্চে, কে অভিনেতা বোঝা তা দায়,

অদৃশ্য কেউ পুতুল টানে—দৃশ্যপটে তালি পায়।

প্রশ্ন করলে নাম অন্য, কণ্ঠ ঘুমোয় শ্লোগান জয়,

পেটের কথা চাপা পড়ে পতাকার গর্জনে রয়।

তবু এক কাক, এক কোণে, ডাকে ভোরের দিকে,

"মানুষ হবার ইচ্ছেটুকু বাঁচে কি শূন্য গলিতে?"

সেই শব্দে নড়ে ওঠে কেউ, গোপনে পুড়ে থাকা ছাই,

হয়তো একদিন গড়ে উঠবে হৃদয়-শাসন, নিঃশব্দ তাই!

কবিতাঃ স্বরূপ ঘোষ

কবিতা

স্বরূপ ঘোষ

ওরঙ্গাল, তেলেঙ্গানা 

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

মাতৃহীনা

বারে মা আসছে না।
মন খারাপের গল্পে মা'ও এবার সামিল।
রাস্তার ধারের পোস্টারে হাত পড়েনি এখনো।
সময়ের সাথে খুলে ফেলা হবে তাকেও।
অনেক দূরে বাঁশির সুরে দুলছে কাশফুল;
বড় বড় চোখ মেলে সেদিকে দেখছে খোকা,
খোকার চোখেও আজ দুলছে এক বহ্নিশিখা।

রাত নেমে আঁধার ঘনিয়েছে।
রোজকার মত রাত্রি শেষে উঠবে সোনালী রোদ।
দুয়ার খুলে মানুষ বাহির হবে,
কিন্তু দুয়ারে আর পড়বে না কাল
সিঁদুর রাঙা ভোর।
 
সপ্তাহ খানেক আগের কথা,
সেদিনও উঠেছিল রোদ,
ডেকেছিল পাখি।
সবুজ ভরা মাঠে
খেলছিল খোকা ও খুকি।
তারপর নামল অন্ধকার।

কতগুলো মুখ মনে পড়ে খোকার,

যারা এসে ধরে নিয়ে গেছিল খুকিকে।

এক উন্মত্ত বিভীষিকায় হারিয়ে গিয়ে

আর কিছু মনে নেই খোকার।

শুধু মনে পড়ে সে ছুটেছিল বাড়ির পথে,

সকলের দৌড়ে পা মিলিয়েছিল সেদিন।

 

পরের দিন নীল আকাশের বুকে
আবার উঠল সূর্য।
বহু ভিড়ের মাঝে সে দেখেছিল
তার ছোট্ট দিদিকে।
ঘুমিয়ে আছে খুকি শীতের চাদর ঢেকে।
সেদিন থেকে খোকা হয়ে গেল একা।
গোটা গ্রামটাও হয়ে গেল বোবা।
আজও গেলে শোনা যায় ওরা বলে
হারিয়ে গেছে ওদের দুর্গা।

Durga1_edited.jpg
কবিতাঃ জয়দীপ রায়

কবিতা

জয়দীপ রায় 

লোকগীতি 

মার মনের ঘরে চোর ঢুকেছে, 

সখি তোকে হাজার টাকার ইনাম দেব

পারিস যদি ধরতে,, 

আমার মনের ঘরে চোর ঢুকেছে,

 

আমার মনের ঘরে প্রেমের আগুন জ্বালিয়ে! 

মজা দেখছে দূরে বসে।

সখি এমন চোর পারব না ছাড়তে, 

সখি তোকে হাজার টাকার ইনাম দেব পারিস যদি ধরতে,, 

maple_edited.jpg

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

ভয়ে আজি নিদ্রাহারা,

হঠাৎ যদি দেয় হানা -

মন চুরি করে নিয়ে যাবে পালিয়ে, 

সখি তোকে হাজার টাকার ইনাম দেব পারিস যদি ধরতে,, 

আমার মনের ঘরে চোর ঢুকেছে, 

 

আমার মনের ঘরে চোর ঢুকেছে, 

সখি তোকে হাজার টাকার ইনাম দেব পারিস যদি ধরতে,, 

আমার মনের ঘরে চোর ঢুকেছে

কবিতাঃ এহিয়া আহমেদ

কবিতা

এহিয়া আহমেদ

বরথল কছারীগাওঁ, মরিগাওঁ, আসাম

আমি সেই অভাগা সন্তান 

 

শৈশবের উঠোনে ছিল কত রঙিন দিন,

মা–বাবার স্নেহে ভরা ঘর ছিল স্বপ্নময়।

আমরা ভাইবোনেরা হাসি আর খেলায়,

জীবন গড়ে উঠত মধুর মেলায়।

 

হঠাৎ বাবা চলে গেলেন অচেনা পথে,

ফিরে এল না আর কখনো আপন ঘরে।

মা আজও বসে থাকেন জানালার ধারে,

অপেক্ষা করেন তিনি, প্রিয়জনের দ্বারে।

village3.jpg

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

আমগাছের ছায়ায় খেলাধুলার গান,

বর্ষার বৃষ্টিতে ভিজে ছুটে চলা প্রাণ।

শীতের সকালের উনুনের উষ্ণতা,

মায়ের হাতের পিঠায় মিশত ভালোবাসা।

 

যে দিনগুলো ছিল জীবনভরা আলো,

সেগুলো আজ স্মৃতির মালায় বাঁধা।

তবুও সেই স্মৃতিগুলো দেয় প্রাণে আশ্রয়,

অতীতের পৃষ্ঠাগুলো করে হাহাকার।।

কবিতাঃ দেবপ্রতীম দেব

দেশ নেতা

মেচ বক্সের দখলদারি হাতে নিয়ে 

আম্বা নিদা ও আদা নিদা বলে দিচ্ছে ভাই -

মেচ বক্সের ভেতরের তুমি

কড়া শাসনে জীবন দগ্ধ করে দিও ছাই,

তুমি শুধুমাত্র আমাদের একটি দেশলাই! 


 

আজ এই দুঃসময়ের ডাগর চোখে

বাউল বেশে কবিয়াল হেঁটে যায় 

গ্রামদেশের ধুলোমাটিতে  

বাঁশবনের ছায়াতলে বসে গান গায়  

দূরে ঝাউপাতারা নড়ে  

গাছ দোলে হাওয়ারা ভেসে যায় 

খালে বিলে সবুজ মাঠে কুঁড়েঘরের দেয়াল ছুঁয়ে 

 

গান থামেনি দিন ফুরিয়ে রাত হল 

ঝিঁঝি ডাকে লন্ঠনের আলোআঁধারিতে

জোনাকি মিটিমিটি 

নদী কাঁপে সাঁকো ভেঙে যায় দোলাচলের ভিড়ে

নৌকার দড়ি ঘাটে বেঁধেছে মাঝি  

ঘরছাড়া নারী স্বামী সন্তানে পালিয়ে এসেছে এ দেশান্তরে  

কবিতা

দেবপ্রতিম দেব 

ক্লান্ত কবিয়াল বিমর্ষ শীত রাতে 

ঘুম নেই চোখে ঠোঁটে সিগারেটের ধোঁয়া শেষে

ধরেছে গান পুনরায়  

কারও উঠোনে জ্বলে বনফায়ার 

ওপারে জ্বলে মশাল, মাঝি ফিরে গেল

চোরাচালানে বাড়তি কামাইয়ের লোভে জলসীমানায় 

নিহত মৎস্যজীবীর রক্ত জলে ভাসা ভাসা 

 

ওপারে রমণী ভোরবেলা জাগে  

পুকুরপাড়ে তার কলসি পড়ে থাকে একা  

ভেস্তে যাওয়া জলে ধূসর ঘাটের সিঁড়ি আবছা কুয়াশায় 

থেমেছে গান এবার থেমেছে মানুষের চোরাচালান 

কিছু লোক চলে এসেছে ফিরবে না বলে 

কিছু লোক হারিয়েছে বিচ্ছেদে স্বজন বলেছিল যারা 

কবিয়াল উঠে দাঁড়ায় বিদায় জানিয়ে বাঁশবনের মায়া 

 

এখন ফৌজ আসার পালা সন্দেহের সাজান মহড়া 

গান হয়েছে বিষম সেটা কেউ ভেবেছে বা তাকে ভাবান হয়েছে 

শত্রু যেন সুরক্ষার তাই আসবে না সেরকম বাউল রাত আর 

গ্রাম-গঞ্জ-পল্লী-শহর বেরোজগার অনাহার 

কবিয়াল হেঁটে যাবে এবার অন্ধ উন্মাদবেশে  

দূর কোনও সমুদ্র স্নানে কিংবা নিরুদ্দেশের দিকে 

 

বাজবে না গান দিনরাত হরদম  

কেটে ফেলা হয়েছে ঝাউগাছ বাঁশবন 

এবার যদি কেউ আসে ঝাঁঝালো রোদে  

 

ঝাঁপ দেবে কি সে আগুনের হ্রদে? 

ইটভাট্টার শিশু শ্রমিকের চোখ … 


বাড়ি গাড়ি স্মার্ট সিটি গ্রামান্তর 

ঘর আমাদের জন্য নয় 

 

স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়  

শিক্ষা আমাদের জন্য নয় 

 

তিন বেলা মাছ মাংস অন্ন ভোজ 

খাবার আমাদের জন্য নয় 

 

মরশুম বদলে জ্বর কাশি আবহাওয়া

অসুখ আমাদের জন্য নয় 

 

পায়ে পায়ে ধূলো উড়ে 

রুক্ষ কেশ মুখমন্ডল জুড়ে

পরিপাটি নতুন কাপড় আমাদের জন্য নয় 

 

এনজিও এসোসিয়েশন ধর্না মিছিল

প্রাপ্য রোজগার আমাদের জন্য নয়

 

হ্যাপি বার্থডে কেক বিয়ের এনিভার্সারি

উৎসব উদযাপনের রং আমাদের জন্য নয় 

 

কিটি পার্টি এলিমনি মহিলা সমিতি 

পুলিশ আদালত আমাদের জন্য নয় 

 

গঙ্গাস্নান তীর্থ কুম্ভমেলা 

সেবা আশ্রম সন্ন্যাসী গোশালা

পাপ পুণ্য ভগবান আমাদের জন্য নয় 

 

আমাদের কথা লিখছ তুমি কবিতায়

জেনে রাখো কবিতাও আমাদের জন্য নয় 

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

কবিতাঃ রীনা নন্দী

সঙ্গী

লে যায় সকলেই ছেড়ে

শুধুই সঙ্গে থাকে ছায়া

ছায়াসঙ্গী হয়ে পাশে পাশে,

নিজের সঙ্গে তখন শুধু 

নিজের কথা বলা।

কবিতা

রীনা নন্দী

বউবাজার, কলকাতা-১২

rangasthalam2.jpg

ঐ চাঁদ 

সে আজ হেঁটে যায় ---

সঙ্গে আজও চাঁদ হাঁটে 

মনে পড়ে যায় সেই কথা,

মায়া-চাঁদ ভেসে যেত 

হেসে হেসে তাহাদের সাথে।

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

কবিতাঃ দিশারী মুখোপাধ্যায় 

কবিতা

দিশারী মুখোপাধ্যায় 

সামান্যজন 

 

পাতায় বাহার আছে বলে গাছটিকে ওরা

টবে রেখে সাজিয়েছে ঘর,

ওর বুঝি আর কিছু নেই! স্বাদ নেই, গন্ধ নেই।

স্বপ্ন নেই ফুল ও ফলের।

একটুকরো ছায়া এসে গাছটির নিচে আশ্রয় নিয়েছে ,

বড়ো বড়ো গাছেদের নিচে হয়তো ওর জায়গা মেলেনি।

বড়ো ছায়াদের বড়ো আভিজাত্য,

দেমাকও ভীষণ মূল্যবান।

ফ্যাকাশে গন্ধের মতো ক্ষীণ দেহ নিয়ে 

এসেছে সে এইখানে -

পাতাবাহারের বাহার সরিয়ে, তার 

গোপন গল্পের কাহিনিতে।

এবার তোমার কথা বলো,

বাগানে কোথায় তুমি একা একা চুপ বসে আছ?

প্রতিলোম 

 

নাম না-জানা একটা গাছ জন্মেছে সেখানে,

যেমন জন্মায় সর্বত্রই, না চাইতেও।

বাড়িতে ঢুকে বসতে বলেনি কেউ তাকে,

দেওয়ালের বাইরে আছে, চোখের বাইরে একা একা।

অভিমান, অপমান - এইসব বোধ তার নেই,

শরীরে উজ্জ্বল আলো, স্বাস্থ্য জুড়ে গাঢ় ভালোবাসা 

নিজস্ব প্রেমের রাগে গান হয়ে ওঠে।

পোড়াইটের দেওয়ালের দিকে 

আজ সে ঈষৎ ঝুঁকে পড়েছে, তার একটি পাতার 

সামান্য ছোঁয়া লেগেছে সেই দেওয়ালে, তাতেই সেখানে 

অল্প একটু সবুজ আভা দেখা যাচ্ছে।

আমি তাকে মাঝে মাঝে চিঠি লিখি গোপন কাগজে।

আমন্ত্রণপত্র 

 

পৃথিবীর সমস্ত লোককে আমন্ত্রণ নিমন্ত্রণের জন্য 

পৃথিবীর সমস্ত রাস্তা বাদ দিয়ে 

কেবল আমার বাড়ির রাস্তা দিয়েই যাতায়াত করছ,

আমার নিমন্ত্রণ নেই সে কথা বুঝাবার জন্য।

অথচ অনন্ত জগতে যে এক মহাযজ্ঞের আয়োজন ও 

উদযাপন চলে অবিরাম,

সে যজ্ঞকে মৃত্যুঞ্জয়হীন করার পরিকল্পনা নেয় না কেউ।

তুমি যে সে জগতেরই ট্রিলিয়নতম ভগ্নাংশের 

কোটিতম কুঁচোর একটি কণামাত্র,

তা হয়তো জানো না।

যে রাস্তা দিয়ে তুমি হেঁটে যাও আনবাড়ি,

তার প্রতিটি ধুলোকণায়

আমার জন্য ছাপা আছে সোনালী বর্ণের অক্ষরে 

এক অমোঘ আমন্ত্রণের চিঠি।

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

কবিতাঃ সোমদেব পাকড়াশী

পুনরাবৃত্তি
                                                           

বার পুজো এসেছে।
পাড়ায় পাড়ায়, ব্যানার আর মাইকের ভীড়।  ….
মন্ডপে কাতারে লোক, রেস্তোরাঁ আর সিনেমা হাউস ফুল
চারপাশে নতুন পোষাকের ঝলক আর নিয়নের আলোর চমক।    

        
কোথাও, ভোর হতে রাত, আবেশে রঙ্গীন মাদকতা; …  
কোথাও ‘হরিপদ কেরানী’ কাবুলিওয়ালার টাকায় করে চারদিনের সার্থকতা।                                                                                                         
পুজো শেষ। মাইক, ব্যানার ভীড় করে নেই।     
রেস্তোরাঁ আর সিনেমা পাড়ায় হাঁকডাক কম।           
চারিদিক কেমন ফাঁকা ফাঁকা। ওদিকে …..                
ঋণে ‘হরিপদ’র চুল অব্দি বিক্রী।                                                                                                         

আবার পুজো আসবে।               
আবার ....।

কবিতা

সোমদেব পাকড়াশী

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

অপলক চোখে
                                                           

যায় সে ধীরে বৃষ্টি ভেজা অলস দিনে               
অলস লয়ে, কলস কাঁখে দিঘীর পানে।
যায় সিনানে,ঝুমুর ঝুমুর বাজে  নূপুর             
ইলশে গুঁড়ি পড়ছে ঝুরে ,শান্ত দুপুর।
চলে সে আদুর পায়ে এলো তার দীঘল বেণী       
সিক্ত বসন জড়িয়ে আছে উথাল পাথাল মন্দাকিনী।

পল অনুপল নিদয় হলো,                                             
এলো মেলো ঝাপ্টা বাতাস,                                             
অলক বসন বশ মানেনা                                                
শরমির এ ব্যর্থ প্রয়াস
হঠাৎ ঘন মেঘ ঘনাল                                                    
আকাশ কালো ঈশান কোনে,   

ম্লান দুপুরে আঁধার ছিঁড়ে                                           
অশনি চকিত বজ্র  হানে।                                    
তবু সে  চলে ক্ষীণকটি তনু                                       
ধীরা সে শঙ্কাহীনা,                                            
অপলক চোখে, দেখি তারে -                                          
যায় অধোমুখি আনমনা।                       
চিকুরের জলে মুক্তা চমকে                                            
চলনের ছাঁদে লাগে যে ঘোর,                                       
স্বপ্নালু চোখে চেয়ে চেয়ে দেখি                                         
এ মুহূর্তরে নিরন্তর।                                 
শমিত হোক এ দামাল প্রকৃতি
স্তব্ধ হোক এ সময়ক্ষণ,     
চলে সে বনিতা কাঁখেতে গাগরী -
এ লহমা  হোক চিরন্তন।

কবিতাঃ শ্রীতন্বী চক্রবর্তী

চন্দ্রনিবাসের লেখনী

 

বাড়ির নাম চন্দ্রনিবাস, জলজ অভিমানের ভিটেয় দিন গুনি,

সামনের বাগানে পিটুনিয়া, চন্দ্রমল্লিকা আর জোছনঘোর,

কমলকলি হাতে তিরতির করে ওঠে সুস্নাত পদ্ম, আদরের সরসিজ।

দুপুরঘুম-আবেশে চোখ জড়িয়ে আসে, গোপনে ফণা তোলে সাপ,

মঞ্জিরা আর শামুকখোল এলিয়ে থাকে ম্রিয়মান দুপুরের কোলে।

চন্দ্রনিবাসের রুদ্ধ দরজা, জাদুকরী জানালা আজ রিক্ত,

কালেভদ্রে, কোনো এক শ্রাবণ-সন্ধ্যায় সন্ধ্যামণি গাছটা এলিয়ে পড়ে

বেহায়া শঙ্খচূড় আজও ভালোবাসার অধ্যায় অনুলিখন করে চলে,

কিছুটা বিষধর ঠোঁটে ঠোঁট নির্বাক পংক্তি আর সিঁদুরডালা।

কাঠখিলান, বেনারসী-রাজস্ব, সিক্ত ফুলেলশয্যা,

তুমি ঠিক আগের মতো হিমবসনা পায়রা ধরে থাকো

এ বাড়ির নাম চন্দ্রনিবাস থেকে যায়,

জলের তলায় বুড়বুড়ি কাটি, নিঃশ্বাস ফেলি,

নিঃস্ব-ডুব, নিত্য-ডুব চলতে থাকে দিনরাত্রি,

শঙ্খচূড়, মঞ্জিরা আলিঙ্গনে একাকার।

কবিতা

শ্রীতন্বী চক্রবর্তী

কলকাতা 

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

অদৃশ্য দেওয়াল

তোমার হাতে সুদৃশ্য ঝর্ণা কলম,
আমার হাতেও থেকে যাক কিছুটা কালির নকশা
আমার মেয়েবেলার, হাড়পাঁজরের বাংলা অক্ষর
কেন এভাবে দরজার বাইরে দাঁড়ায়,
আর তোমার পেশীবহুল অক্ষর ক্ষমতার চেয়ারে বসে?

তোমার কণ্ঠস্বর পাহাড়ের মতো বাজে,
আমার কণ্ঠস্বরকে বলা হয়
সুললিত, শোভন,
ময়না, খঞ্জনা, বসন্তবৌরি বিকেল ঝরে পড়ে কণ্ঠের মুগ্ধতায়।


আমি যদি এক টুকরো আকাশ চাই—
আঁচলে বেঁধে রাখি নীলাভ স্বতন্ত্রতা?
তুমি বলো, রোদ গায়ে পড়বে,
আমি যদি মাটি চাই—চাই ডালপালা, ফুল, ফল নিয়ে বেড়ে উঠতে
তুমি বলো, সাবধানে, হাতে ধুলো লাগবে।

তবু আমি লিখি—
আমার অক্ষর দিয়ে,
তোমার ঝর্ণা কলম চলতে থাকে,
আমার অক্ষম অক্ষরের প্রতিধ্বনি শোনা যায় রাতের গভীরে
সুতীব্র উল্কাপাতে,
আগুনে।

subho-bijaya_edited.jpg

কবিতা

পার্থ সরকার 

কবিতাঃ পার্থ সরকার

আলো ধরলে আলোয় যাওয়া যায়    

 

ক জয়গান মিথ্যুক 

এক জয়গান ভাবুক 

 

আলো ধরলে আলোয় যাওয়া যায় 

অক্ষরের সূত্র ধরে সদাশয়ের পথে – 

কিন্তু ইহা এক প্রচলিত ফর্মুলা 

বিস্তর পাল্টেছে নগরের শবসাধনা 

প্রমোদতরীতে ভ্রান্তি 

তোমার এই সংকেতে পরিপূর্ণ মেদ নরকের 

অধিকন্তু আতর বোধহীন 

পতনের সম্পূর্ণ বোধ  

 

এক জয়গান মিথ্যুক 

এক জয়গান ভাবুক 

 

‘আলো ধরলে আলোয় যাওয়া যায়...’ 

 

সারা সকালের আলো যেমন আছে থাক না 

 

কেন মিথ্যেয় সাজাও নিজের জয়গান 

যখন...।

মন খারাপের হস্তাক্ষর

 

ন্ধ্যা আবলুস কাঠের মত 

ঢিবি অদ্ভত 

নেমে আসে পিলসুজের ধোঁওয়া 

তরাইদেশে 

প্রদীপ পুড়ছে? 

মন পুড়ছে? 

কোন শব্দ নেই 

হস্তাক্ষরের? 

এই শেষ স্বাক্ষর 

এরপরে

আমার হস্তাক্ষরহীনতার জন্য 

আমার 

মন খারাপের হস্তাক্ষর দায়ী। 

অন্ধ করা তারবার্তা আর কলকাতা 
 

বের হয়ে আসা তীর্থ 

(পরিবর্তনে ছুঁয়েছে আকাল) 

 

ছন্দপতন অসময়ে 

(আনন্দ খুব পতনে) 

 

মেঘ হয় খুব বিকেলে 

(ছাইপাঁশ ভাবনা আসে মর্গে) 

 

তথাগত চমৎকার 

(এক বিশ্ব গোলাকার) 

 

বিভাজিত আশ্বাস চারপাশ 

(বিবাগী মন খেলাপ করে আশপাশ) 

 

এখন বৃত্তি উচ্চারণ 

(মর্গে মৃতদেহ- খুব রোমাঞ্চ) 

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

somiron.jpg
কবিতাঃ ডাঃ রুদ্রজিৎ পাল

রাজকীয় স্যান্ডউইচ 

পাঁউরুটি সেঁকে নিয়ে কড়মড়ে টোস্টে 

একফালি মাখনটা হবে তাতে ঘষতে।

তিন কুঁচি শশা আর চার কুঁচি টমেটো-

ওপরে সাজিয়ে দিলে স্বাদটাও জমে তো!

গ্রেটারে চীজটা নিয়ে কিছু দাও কুচিয়ে

নোলা যদি বাড়ে তবে, সস দিও গুছিয়ে।

দেবে নাকি এক কোণে গোটা আলুসেদ্ধ?

ক্যালোরি কি বেড়ে যাবে? মনে রবে খেদ তো।

স্যান্ডউইচ তো হল, মাংস কি বাদ যায়?

বোনলেস গোটা তিন, পেতে দাও গায়ে গায়।

লাল সাদা সবই হল, সবুজটা কেন বাদ?

একটা লেটুস দিলে আরও খোলে তার স্বাদ।

এইবার মুখ খুলে কামড়াও সজোরে 

নিমেষেই আধখানা ঢোকে মুখ গহ্বরে। 

কবিতা

ডাঃ রুদ্রজিৎ পাল

কসবা, কলকাতা 

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

Rudrajit Paul.jpg
touch.jpg
কবিতাঃ মৈত্রেয়ী মুখোপাধ্যায়​

পুরোনো নাম

হুদিন শুনিনা দরজায় তোমার পদশব্দ
ধীর, কিন্তু দৃঢ়, অন্যরকম । 
সেই অবসরে,
একটুএকটু করে দূরে  সরিয়ে রাখি
আমার নাম, ভীষণ পুরোনো;
পদ্ম পাতায় জলের মতো প্রেম
কোনোমতে মেশেনা তোমার মনের সাথে,
কল্পনার মেঘে আমার আনাগোনা 
ঢেকে যায় বাস্তবতার অন্তরালে
অপরূপ কারুকার্য তার, রঙিন। 
সাদাকালো বড়ো ম্লান,
আমারই মতো বেমানান। 
এইতো জীবনের রঙ্গমঞ্চ,
সামনে সমাজের করতালি;
সেই শব্দে চাপা পড়ে যায় তোমার পদধ্বনি,
আসছো তুমি? আসছো শেষ বসন্তের বিকেলে?
যবনিকা পতনের আর কিছুমাত্র বাকি 
তারপর তারাখসাও বিলীনের পথে । 

কবিতা

মৈত্রেয়ী মুখোপাধ্যায়

কলকাতা 

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

touch.jpg
কবিতাঃ কপোতাক্ষী ব্রহ্মচারী চক্রবর্তী

খাড়া বড়ি থোড়
 

থোড় বড়ি খাড়া আর খাড়া বড়ি থোড়

এই করে কাটে দিন রাত হয় ভোর!

ভোর হলো দোর খোলো খুকুমণি ওঠো

হাই তুলে  নেট খুলে ইস্কুলে  ছোটো!

ছোটো তবে এখন তো সবই অনলাইন

ক্লাস শুরু  হলে  আগে করে দিও সাইন!

সাইন করে বুঝে নাও আজকের  পড়া

আমিও সুযোগ খুঁজে লিখি এই ছড়া!

ছড়া লেখা শেষ হলে যাই পাকশালে

রান্না কী হবে ভাবি হাত দিয়ে গালে!

গালে হাত দিলে বুঝি মনে আসে জোর?

ধুর ছাই,  ফের সেই  খাড়া বড়ি থোড়।

কবিতা

কপোতাক্ষী ব্রহ্মচারী চক্রবর্তী

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

কবিতাঃ প্রত্যয় লায়েক

কবিতা

প্রত্যয় লায়েক

বাঁকুড়া, পশ্চিমবঙ্গ 

শহীদের কবর 

নিস্তব্ধ মাটির বুকে, অশ্রুর কণা জমে,

শহীদের কবর যেন দেশাত্মবোধের জন্মভূমি।

তার রক্তমাখা স্মৃতিরা ঘুমিয়ে থাকে এখানে,

কিন্তু স্বপ্নেরা, তারা জেগে থাকে এক নতুন ভোরের প্রতীক্ষায়।

 

কবরের ফুলেরা বলে, 'আমরা তার ঘামের ফোঁটা,

স্বপ্ন ছিল শুধু তার, আজ আমরা সবার মনে বাঁচি।'

পাখির গান বাজে হাওয়ার মৃদু পরশে,

তাদের কণ্ঠে আছে শহীদের শেষ প্রতিশ্রুতি।

deadbody.jpg

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

মাটির নিচে নক্ষত্রেরা দ্যুতি ছড়ায়,

তারা জানে, অন্ধকারেও আলো ফুটবে একদিন।

এই কবর শুধু মাটি নয়, এটা বীরত্বের এক বীজ,

যা ফুল হয়ে ফুটবে, প্রজন্মের বুকে ছড়িয়ে দেবে আলোকধারা।

 

শহীদের কবরে বয়ে যায় সময়ের নদী,

তার ঢেউয়ে লেখা থাকে বীরত্বের কাব্য।

এই কবরেই লুকানো আছে যুদ্ধের সুর,

যা বাজবে চিরদিন, শোনা যাবে প্রান্তরে প্রান্তরে।

কবিতাঃ ভাস্কর সিনহা

কবিতা

ভাস্কর সিন্হা
দুবাই

তবু বেঁচে পুজো

গ্রামের শেষ রাজপ্রাসাদে আলো নিভে গেছে কবেই,
এখন শুধু প্রাচীন ইটের ফাঁকে বটের ঝুরি,

শ্যাওলার বিষণ্ণ সবুজ।
সন্ধ্যার বিষাদে এই ভাঙা দেওয়ালগুলো
গল্প বলে—অতীতের এক রাজবাড়ির উত্থান-পতনের।
একদিন এখানেই আলোর ছটা ছিল,
ঝাড়লণ্ঠনের নিচে দাঁড়িয়ে থাকত প্রজাদের উজ্জ্বল চোখ।
আজ সব কিছু হারিয়ে গেলেও,
স্মৃতিগুলো বাতাসে বাউল গানের মতো ভেসে বেড়ায়।

রাজবংশের উত্তরাধিকারীরা আজ সুদূরে—
দিল্লি, লন্ডন, কিংবা তারও বহুদূরে কোনো ব্যস্ত শহরে।
তারা শুধু আসে শারদীয়ার ক'টা দিন,
তারপর ফিরে যায় তাদের নাগরিক বাস্তবে।

Bhaskar Sinha.jpg
dhaak_edited.jpg

কিন্তু গ্রামের মানুষ ভুলে যায়নি কিছুই—
পুজোর আলোর উজ্জ্বলতা
তাদের চোখে আজও সজীব।
কামার, তাঁতি, কিষাণেরা সবাই এক হয়ে যায়
মণ্ডপ গড়তে, প্রদীপ জ্বালাতে, ঢাক বাজাতে।

ভোরবেলায় গ্রামের মেয়েরা শিউলি কুড়োয়
নদীর স্রোতের মতো বয়ে যায় তাদের হাসির ঢেউ।
ছেলেরা শিশির মেখে গাঁদা ফুল তোলে,
সেই শিশিরের স্পর্শে
তারা ছুঁয়ে দেখে শতাব্দীর পুরনো স্নিগ্ধতা।

রাজপ্রাসাদ নেই, তবু পুজো বেঁচে থাকে—
মানুষের মনে, মানুষের স্পর্শে,
বটের ঝুরি, শ্যাওলা আর প্রদীপের আলোয়।
এই মিলিত আনন্দেই বুঝি
আমরা খুঁজে পাই সেই স্নিগ্ধ পল্লী বাংলার
চিরায়ত আত্মাকে।

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

কবিতাঃ নূপুর রায়চৌধুরী

কবিতা

নূপুর রায়চৌধুরী

অপেক্ষা

পেক্ষার কথা বলছ সুচিরা?

আমি তো জানি না

এইক্ষণে আমার চেয়েও বেশি

কেউ দিন গুণে চলেছে

তোমাদের এই পৃথিবীর বুকেতে

সূর্য এইমাত্র পাটে বসল

বাতাস ঠান্ডা হয়ে এসেছে

আরেকটা গাঢ় রাত নেমে আসবে এক্ষুণি,

আমার অপেক্ষার ফাঁকে ফাঁকে

কতবারই যে সকালের সূর্য উঁকি মেরে গেছে!

দেখতে দেখতে আমার চারপাশ জুড়ে

গোলাপী বুনো ফুলরা ফুটে উঠছে,

চিকাডিরা গাছ থেকে

চিক-আ -ডি-ডি-ডি ক’রে ডাকছে,

জান? ওরা সব বসন্তের অতিথি

সাদা গলাওয়ালা বাচ্চা চড়ুইগুলোও

এইবেলা মায়ের কাছে দিব্যি শিখে নিল

কীভাবে উড়তে হয়

একদিন উড়তে উড়তে ওরাও

ঠিক হারিয়ে যাবে কোনো এক অজানা দিগন্তে

দূরের টিলার ঘাসগুলো

সেদিনও কত ঘন সবুজ ছিল

দেখতে দেখতে ওরাও

কেমন হলদেটে আর নিস্তেজ হয়ে আসছে ।

আরেকটা শীত কি এগিয়ে এল?

আমার অপেক্ষার শেষ কবে হবে নন্দিনী?

NupurRoychoudry.webp
maple1.jpg

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

কবিতাঃ প্রণব কুমার দাস

কবিতা

প্রণব কুমার দাস

বিদ্যাপীঠ রোড, কোলকাতা- ৫১

বিচারের আশায়


মুখোশের আড়ালে,
লুকানো ছিল দানবের নেশা।
মুখে হাসি, মিথ্যা ভরসা, বিশাল কপটতা।
লালসার আগুনে হাঠাৎ ছন্দপতন!
কুমারীর বেদনা,
রক্তাক্ত শরীর, দুঃখের চিহ্ন।
নীলচে আগুনে শরীর পুড়ে ছাই,
ভারাক্রান্ত মন....
এ কষ্টের কলরব শুনে,
নিঃশব্দেও কাঁদে অভিমান।

মানবতা অরক্ষিত,
আইনের শাসন আজ অস্তাচলে...
আর কতদিন যাবে,
এ নিষ্ঠুরতার দিকসন্ধানে ?
কাঁদছে শহরের বুক,
বিষণ্ণ রাতে নিঃশব্দে।
ধরণীর বুকে এভাবে কেন জ্বলছে ভগ্ন হৃদয়?
চোখের জলে স্রোত,
ভেসে যায় রাজপথ....
তবুও কেন মুছলো না,
স্তাবকতার কালো দাগ ?

উন্মাদের প্রলাপ, নিত্য অভিসম্পাতে -'

বিচারের বাণী কাঁদে ',

নীরবতার গহনে অসহায় রূপে।

তবু অভ্যাসে দেখি স্বপ্ন, প্রত্যাশায়...সমবেত কলরব - সোচ্চারে, আজও রাত জাগি বিচারের আশায়…

নিশ্বাসে রক্ত
রংতুলি নয়, আজ আঁকে 'রক্ত',
শিশু চোখে নিভে যায় ভোর,
পাঠশালার ঘর, খেলাঘরের স্বপ্ন—
সর্বত্রই আজ ধ্বংসের চিহ্ন।
তারা তো জানতো না রাজনীতি,
চেনেনি সীমান্তের মানচিত্র,
তাদের অপরাধ কেবল এটুকুই—
বদ্ধ ভূমিতে হয়েছিল জন্ম।
তারা ছিলো ভবিষ্যতের প্রতিচিত্র।
বর্তমানের কবরে চির নিদ্রায় গেছে সে ভবিষ্যৎ।

 

একটা খেলনা, একটা হাসি,
তাদের দুনিয়া ছিল এতটাই সরল।
তবুও ধ্বংস নামল নির্বিকার—
অনাহারে, অলক্ষে নেমে এলো মৃত্যু, 
মায়ের কোলে...
আর মা? 

 

মা হওয়ার জন্য নিজেকে অভিশাপ দেয় রোজ।

মাটির বুকেও সাড়া নেই আজ,
নেই কোন ঘাস অবশিষ্ট।
ধূলায় ধূসরিত গাজার বাতাস,
মৃত দেহে ঢেকে যায় উঠোন।
কচি মনে ছিলো যে আশা—
তা চাপা পড়ে বোমার শব্দে,
সাইরেনও সাবধান করে না আর।
বোমারু বিমানগুলো,
আর খুঁজে পায় না নতুন লক্ষ্য।
তবু  শকুনের ন্যায়  নিয়মিত ডানা মেলে, অভ্যাসে....

কে লিখবে এই হত্যার হিসাব ?

​কোন ধর্ম, কোন দেবতা নেবে দায়?

যে শিশু মাকে ডেকে ছিল শেষবার—

তার আর কোনো আগামী নেই আজ।

গাজার গলিতে গলিতে এখন

শিশুদের ছেঁড়া দেহ পড়ে থাকে,

পৃথিবী তবুও চুপচাপ দাঁড়িয়ে— তামাশা দেখে!

মানবতা মুখ ঢেকে অস্ফুটে কাঁদে,

কোন আশা আর অবশিষ্ট নেই....

ওখানে বাতাস সত্যিই বড় ভারী,

তাই প্রতি নিঃশ্বাসে আসে.... রক্ত!  

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

কবিতাঃ দেবাশীষ পট্টনায়েক

কবিতা

দেবাশীষ পট্টনায়েক

দিল্লী


এক শীতের সোনালী রাতে
তোমায় যখন প্রথম দেখেছিলাম –
স্বচ্ছ, ধীর স্রোতস্বিনী,
চাঁদের আলোয় সুহাসিনী।
চোখে যখন কুয়াশার নেশা লেগেছে
তখনি একদল নেকড়ে
মুখে রক্ত, দাঁতে রক্ত,
চোখে পিপাসার আগুন-
জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসে
ঝাঁপিয়ে পড়ল তোমার উপর,
মুহুর্তে লাল হয়ে উঠল জল
ঝলসে দিল কোমল শরীর।
তোমার নিথর দেহকে জড়িয়ে ধরে
চিৎকার করে বলেছিলাম
বন্যার রুদ্রমূর্তি ধারন করো
ঘূর্ণিপাকে ডুবিয়ে মারো পিশাচদের
মুছে যাক রক্তের দাগ।

শিশির বিন্দু

তুমি আর আমি
পদ্মপাতায় শিশির বিন্দু,
সকালে পাখির গান,
মন্দিরের কাঁসর ঘন্টা,
আজানের ধ্বনি শুনে
প্রাণ মন ভরে যায়
ভুলে যাই আমাদের টলমল জীবন।
দিনে রোদের আলো
বুকে শুয়ে নিয়ে
জীবনছন্দে ঝিকিমিকি -
পীঠে ডানা বেঁধে
প্রজাপতি হয়ে উড়ে বেড়াই -
কলকে ফুলের মধু,
বকুলের ফুল, ডুমুরের ফল
সওদা করি ঘাটে ঘাটে।
রাতে চাদের আলোয় ভিজে
বহু তারা হওয়ার স্বপ্ন দেখি।

 

আজ প্রভাতে

জ প্রভাতে রবি হাসে নীল গগনের ভালে,
প্রাঙ্গনে মোর দোলে হাওয়ার তালে তালে
রঙ বেরঙের বিচকিত শতদল,
তারই সাথে গুঞ্জরিয়া ভ্রমর করে কলরোল।
হৃদয় আমার স্বপ্নে রঙিন আকুল আবেশে
কাহার বাণী স্বপ্তসুরে ঝংকারে এ কোন হরষে,
চোখের পাতায় থেকে থেকে লাগে যে কম্পন
সে বুঝি তোমায় আবাহনের গীতের আলাপন।
বাতাস সুবাস মাখা হয়েছে পত্রলেখা নিমন্ত্রণের ছলে
তাই রামধনু রঙ চিত্রকলা মোর এ লাজুক কপোলে,
পাই না ভেবে কেমন ভাবে সাজাই পূজার উপাচার
গানের ভেলায় কথার মালায় জীবননদে বিহার।
তোমার কাজল আঁখির নম্র মধুর চাওয়া
জীর্ণ তরীর সাদা পালে লাগায় মিঠা হাওয়া,
পুষ্প কোরক ঠোঁটের হাসি মাখা কথা
মন্ত্রবলে দূর করে দেয় সকল মনের ব্যথা।
যদি তুফান উঠে ভারি হয় টলমল ছোটো এ তরী
জানি ধরবে হাত ওগো মোর জীবন কান্ডারী;
তোমার পরশ হয়ে বরাভয় মালা দুলবে আমার গলে
করবে সুগম যাত্রা ফুটবে স্বপ্নতারা কালো রাত্রির কোলে। 

কানীন

 

ঘুটঘুটে অন্ধকার,
কনকনে ঠাণ্ডা পঁচিশে ডিসেম্বরের রাত;
গোয়াল ঘরের উঠোন থেকে
পাগলীর কান্না ভেজা চিৎকার।
কিছুক্ষণ পরে আর একটা কান্না
পাগলীর কান্না ছাপিয়ে,
লালের পতাকা নগ্ন শরীরে এঁকে
মুষ্টিবদ্ধ হাতে দুপায়ের দাবিতে।
সপ্তর্ষীমন্ডলের, কালপুরুষের তারারা কি
নেমে এল পৃথিবীতে 
আশীর্বাদের ফুল নিয়ে?
রাতের শুকতারা কি পথ দেখাল?
নিশুতি রাতে ব্যথার শিশির 
টুপটাপ-টুপটাপ।


আলুথালু, ছিঁড়ে যাওয়া ময়লা পোষাকে
বিড়বিড় করে আপন মনে কথা বলতে বলতে 
পাড়াময় ঘুরে বেড়াত পাগলী।
গত জ্যৈষ্ঠ মাসের অমাবশ্যা রাতে
খাওয়ারের লোভ দেখিয়ে কে যেন
ডেকে নিয়ে গিয়েছিল দূরে পুকুর পাড়ে।
তাড়ি খেয়ে খিলখিল করে হাসছিল পাগলী-
সারাগায়ে সুড়সুড়ি,
কি যেন খুঁজছিল লোকটা তার শরীরে;
তার পরে শুধু ব্যথা, অবশতা, অলসতা,
গোয়াল ঘরের উঠোনে শুয়ে বসে।
ভাষাহীন চোখের পাতায়
উড়ে উড়ে যাওয়া, ছিঁড়ে ছিঁড়ে যাওয়া 
কুয়াশা কুয়াশা গন্ধহীন দিনের দল
পদ্মফুল হয়ে ফুটেছে কুমারীর কোলে।
ঘুম ঢুলুঢুলু  রাতের ঘোলাটে চোখে 
টিম-টিম ধ্রুবতারা জ্বলে।

প্রতিশ্রুতি


মৃন্ময়ী মা আসবেন
আকাশে, বাতাসে, মনে
কেমন এক খুশির ছোঁয়া।
মা আসেন, আবার চলে যান;
কান্না ভেজা চোখে
তা্ঁকে বিদায় দিয়ে
দিনগুনি পরের বছরের-
তাঁর আবাহনের,
তাঁকে নূতন করে সাজানোর।
সব কিছুর মাঝে
চোখ চলে যায় ওই রাস্তার দিকে,
ওই রাস্তা - যেটা 
ন্যাড়া বেল গাছের পাস দিয়ে
সদরখানা-বটতলা পেরিয়ে
আরো দূরে চলে গেছে।
সেই যে তুমি
তীর্থভ্রমন-সাগরসঙ্গমে
যাবে বলে গেলে -
যাবার আগে কাঁধে মাথা রেখে
ফিসফিসিয়ে বলেছিলে
শাহজাহান তাজমহল বানিয়েছিল
তার রানী মমতাজের জন্য,
আমার জন্য তুমি কি বানাবে?
কিছু উত্তর দিতে পারিনি,
শুধু কপালে হাত বুলিয়ে দিয়েছিলাম।
বিদায় বেলায় বলেছিলে
পূজোয় ফিরে আসবে;
পেছন থেকে হাত নাড়তে নাড়তে
মনে মনে বলেছিলাম- বানাবো
তোমার জন্য একটা হাসপাতাল।


তারপর পথ চেয়ে চেয়ে
দিন কেটেছে, বছর ঘুরেছে।
আবার শরৎ এসেছে,
মা আসবেন -
ঘর গোছানো সাজানোর পালা,
প্রবাসী প্রিয়জনের কলতান
ঢাকের আওয়াজ, ময়রার ভিয়ান,
সদরখানায় শালুক ফুলের মেলা।
বিকেলবেলায় চায়ের কাপ হাতে
বারান্দায় বসে রাস্তার দিকে তাকিয়ে -
দেখলাম তোমার প্রতিছবি
তোমার হাসি চুরি করে
গলায় স্টেথো ঝুলিয়ে
গাড়ি থেকে নেমেই
দুহাত মেলে ছুটে আসছে-
আবছা চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে
বললাম - রক্ত দিয়ে বানিয়েছি
তোমার জন্য একটা হাসপাতাল।


কামধেনু


শ্রাবণ কুহেলী-
পূবালী হাওয়ার নাচ,
আকাশে মেঘের ষড়যন্ত্র
এক আগুন ঢেকে
অন্য আগুন জ্বালানোর।
সামনে উত্তাল শঙ্খিনী নদী,
শ্যামল অঙ্গে হরিদ্রাভ ছটা,
দেহে ঢেউয়ের ভাঁজ,
গলায় পাহাড়ি রাগের সুর।
রুদ্ররূপেও তুমি সুরভী,
গায়ে ভেজা মাটির গন্ধ
প্রলয় তালে সৃষ্টির আনন্দ।
মন্ত্রমুগ্ধ অপলক
একপা একপা করে নামছি –
সা্ঁতার কাটবো, ভেসে যাবো, 
হারিয়ে যাবো-
পরিপূর্ণ হবো, পবিত্র হবো।

প্রতীক্ষা


শ্রাবণ -
আরো ঢাল, আরো ঢাল,
তপ্ত ধূসর বুকে, 
বাড়ুক সবুজের তৃষ্ণা;
ধিকিধিকি তূষের আগুন 
জেগে উঠুক দাবানল হয়ে।


মেঘ -
হঠাৎ হঠাৎ, বারবার,
মিলনের খুশিতে গেয়ে উঠো মল্লার;
না ফোটা সব সুর,
ছিঁড়ে যাওয়া সব গানের কলি
খুঁজে পাক ছন্দের বাহার।


পূবালী হাওয়া  -
নাচের তালে, যখন খুশি, ছুঁড়ে মারো
বৃষ্টির সাতরাঙা আবির;
ভাসুক ছায়া ছায়া বেদনা,
সোনালী স্বপ্নের আভা 
পলকহারা চোখের তারায়।


রজনীগন্ধা -
বিনিদ্র রাতের সাথী,
বুলিয়ে দিও শরীর মনে
তোমার মধুর গন্ধসুধা;
নেশার রক্তিম মাদকতা
বাজুক শিরায় শিরায়।


সে আসবে  -
হয়তোবা নিশীভোরে,
বাতায়ন খুলে দিয়ে,
আশার প্রদীপ জ্বেলে,
বিরহী একতারা গাইছে
ছলছল কলকল নদীর গান।

Debashis Pattanakye.jpg

লেখক পরিচিতিঃ

জন্ম ১৯৬৭ সালে মেদিনীপুর জেলার (বর্তমান পূর্ব মেদিনীপুর) তমলুক মহকুমায়। চাকরি সূত্রে দিল্লী নিবাসী, গবেষণা ও অধ্যাপনায় নিযুক্ত। কবিতা লেখা শখ। কিছু কবিতা প্রকাশিত হয়েছে পত্রিকায়।

সবুজ স্বপ্ন

দী: সারাক্ষণ আমার চারপাশে
লোভীর মত কেন ঘুরে বেড়াস?

মেঘ: তুই যে আমার যাযাবর জীবনের মাধুকরী।

তাইতো পাগলের মতো বারবার
ছুটে আসি তোর বুকে ঝাপিয়ে পড়তে।

নদী: আমার বুকে তৃষ্ণার আগুন
আছে, ভয় করেনা?

মেঘ: ওই আগুনে ঝাঁপ দিয়ে আমার
প্রাণে মল্লার সুর জাগে - গোধূলি বেলায়
পাখিরা নীড়ে ফিরে যে সুরে
মনের অন্ধকারে আশার আলো জ্বালায়;
বন্ধনের সুখে মনকে রাঙিয়ে
আমি ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখি।

নদী: সকল তৃষ্ণার নিবারণ হয় তুই যখন
অবুঝের মতো, পাগলের মতো
আমার বুকে ঝাপিয়ে পড়িস।
সারা শরীরে খুশির হিল্লোল জাগে,
মাটির মিষ্টি গন্ধ ফোটে;
ঢেউয়ের আঁচল উড়িয়ে আমি নেচে
বেড়াই স্বপ্নের প্রলেপ এঁকে।

মেঘ: তোর কোমল নীলে আমার কৃষ্ণ কালো
যখন এক হয় তখন সবুজ চোখ মেলে তাকায়।

নদী: হাতে হাত রেখে ধীর পায়ে
আমরা সাগর দর্শনে যাই।

বর্ষা


তুমি যেন সেই নারী,
মনের অন্ধকার চিলেকোঠায়
প্রতিটি পুরুষ যাকে
স্বযত্নে লুকিয়ে রাখে।
রিরংসার তৃষ্ণায় নয়,
একান্ত নিরালায় গোপনে
প্রথম প্রেমের চিঠি পড়ার
পরম নিবিড় অনুভূতির মতো।
চরম ব্যথায় যখন হৃদয় স্তব্ধ,
পৃথিবীর সমস্ত কোলাহল থেকে দূরে
কোন এক নিভৃত নিরালায়
মনসিজ সে নারীর বুকে মাথা রেখে
চোখে যখন অঝোরে ঢল নামে;
তার কোমল শরীরের
সুঘ্রান ও উষ্ণতা
মরুতৃষ্ণায় শুষে নিয়ে
যে অনাবিল অনুভূতি জাগে-
তোমার ছোঁয়ায় তেমনি শিহরণ।
সেই প্রথম আলিঙ্গনের দিন থেকে
যদিও প্রতিবার তুমি
একই সাজে ধরা দাও
তবুও তুমি নবরূপে অপরূপা -
চির নূতন, চির মধুর শ্যামাঙ্গী।
কখনো ঝড় নিয়ে আসো
কবিতার পাতা উড়ে যায়,
কলম ফেলে অপলক তোমায় দেখি,
সময় থেমে থাকে।
কখনো বা চুপিচুপি এসে
আলতো ছোঁয়ায় শিহরণ জাগাও,
চেনা রাস্তা ছেড়ে
অচেনা পথ ধরি
পাহাড়ের বুকে ঝর্ণার মতো
সবুজের নেশায় অমৃতকুম্ভের সন্ধানে;
জোনাকির মতো বুকে আলো জ্বেলে
স্বপ্ন লোকে উড়ে যাই।

 

‘মোহময়ী কাসল’

কোন ইন্দ্রজালের মায়ায়
বাঁধা পড়েছে দশপাকে
সবুজের ওড়নায় নীলের উত্তরীয় !
অভিসার রসে আত্মবিহ্বলা কিশোরী 
ঘুঁঘুর পায়ে নেচে নেচে 
সপ্তম সুরে গেয়ে বেড়ায় পাহাড়ি রাগ;
শিশির স্নাত হাওয়া প্রেমজ্বরে
ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায় তার ঠাণ্ডা সাপিলা শরীর।
মেঘের কালো চুলে মুখ ঢেকে 
রূপসী বনিতা চাঁদ 
লজ্জার মোহময়ী হাসি হেসে 
পাথরের পেয়ালায় রূপালী জোৎস্নার মদ ঢালে।
রূপের নেশায় মাতাল হয়ে
অচেনা বেদনার পিপাসায়
চোখের আগুনে রাতের সায়াকে
ছিঁড়ে ফেলার খেলার মাঝে
শিথিল মনকে ঢাকা দিয়ে যায় 
খুব চেনা মিষ্টি গন্ধেভরা
এ কার ভালোবাসার আঁচল!
মনের আকাশে আবছা স্বপ্নে
ভাসে এ কার মুখচ্ছবি!

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

কবিতা

ডঃ বিশ্বজিৎ মজুমদার 

লেক গার্ডেন্স, কলকাতা ​

কবিতাঃ ডঃ বিশ্বজিৎ মজুমদার

আমাদের ভীষণ দানবীয় ঢক্কানিনাদ-

পর্বতের মূষিক প্রসব –

NICKEL SHIELD-

DIAMOND SHIELD-

এসব লোকাল অগ্নি নির্বাপণ –

আর খরস্রোতা নদী পারাপারে ব্যবহৃত হয় –

আর আন্তর্জাতিক ব্যঙ্গ -বিদ্রূপ –

আমাদের  কিছুই এসে যায় না –

কারণ আমরা তো লেখাপড়াই জানি না --!!!

কি বলছে -আমরা বুঝি ই না --!!!

আমাদের লোকাল মিডিয়া বুঝিয়ে দেয় –

আন্তর্জাতিক মিডিয়া সব ঢপ মারছে –

HUMAN CORRUPTION INDEX –বলে কিছু হয়না –

HUMAN HUNGER INDEX -বলে কিছু হয়না –

 

আমাদের ৫০০ বছর আগের শ্বাস প্রশ্বাস-

আমাদের ৫০০ বছর আগের ধ্যান – ধারণা-

আর লক্ষ্মী ছেলের মতো ঘাড় নাড়া –

 

আর আমাদের সেই  HALF CALIFORNIA –

HALF SOUTH AFRICA  তত্ত্ব –

সঠিক বলে প্রমাণিত হল –

যারা যারা প্রাচীন সম্রাটের ঘরে জন্মেছে –

DUKE – বা জমিদার হয়ে –

তাদের সন্তানরা উন্নত দেশের দিকে পাড়ি দেয় –

আর আমরা জেলের উঁচু পাঁচিলের দিকে হাপিত্যেশ চেয়ে থাকি -কখন পাগলা ঘণ্টী বাজবে এই আশায় -!!!

NAZI SERIES –

 

খন হয়ত ১৯৩৩ বা ১৯৪০-

ওই তো জার্মান সাধারণ স্কুল টিচার –

NAZI বাহিনীকে সমর্থন না করার জন্যে -ধীরে ধীরে বিতাড়িত হয়ে যাচ্ছে স্কুল থেকে –

এবং একটা সময় দেশ ছেড়ে পালাতে গিয়ে –

নাৎশি বাহিনীর হাতে –

ওই তো কত কত ট্রেন - লক্ষ লক্ষ ইহুদীদের নিয়ে ঢুকে যাচ্ছে 

CONCENTRATION CAMP -এ –

বিস্তীর্ণ জলাভূমির উপর দিয়ে –

লাশের পাহাড় ডিঙিয়ে-

রক্তের নদী পেরিয়ে –

আমিও -আমিও ইতিহাস ঘাঁটতে বেরিয়ে পড়েছি -

​​​

এলোমেলো কলম ---- 

 

ত্যি  বলছি –এখন বিবেকানন্দ ছাড়া কেউ টানে না –

কে বুকের বিভাজিকা দেখিয়ে অনেক কে ফাঁদে ফেলেছে –

কে দু দিনের REAL ESTATE এর মালিক স্বামীকে নিয়ে 

EUROPE TOUR-এ যাচ্ছে –

কে তিন চারটে APARTMENT কিনে 

INVEST করে রাখছে – RAJARHAT REAL ESTATE -এ –

বড়ো বড়ো বিশ্বকর্মার ছেলে মেয়ে চামচিকে হয়ে রাজা উজির মারছে –

STATUS দিচ্ছে –

আসলে যে CAPITALIST দের সুবিধা করে দিচ্ছে –

এ সব এখন আর নাড়া দেয় না ---

আমি সত্যি এমন ভক্ত দেখেছি –

যারা সতী দাহ প্রথাকে সমর্থন করে ---যারা  NAZI 

বাহিনীর মত খতম করতে চায় বিরোধী গোষ্ঠী কে –

সেই তাদের দেখেছি –

বিরাট গাড়ী বাড়ী –পেটে বিদ্যা নেই ---

২য় বিশ্ব যুদ্ধ -বা NAZI CONCENTRATION CAMP –

12-13 YEARS IMPROVISATION-INSPIRATION FOR NEXT GENERATION – NOW ITS TIME TO CONCENTRATE ON ME –

এখন নিজের দাগ রেখে যাওয়ার সময় --

এখনকার NAZI -বেয়োনেট -বেকুবের কারবারি –এবং 

 

2ND WORLD WAR—

NAZI বাহিনীর মধ্যে দিয়ে –

যে সব মানুষেরা গিয়েছে –

আমি তাদের কিছু কিছু কথা জেনেছি –

আইনস্টাইন টা এখনো বেঁচে আছে কি করে?—

এ কথা আইনস্টাইন কে শুনতে হয়েছে বারে বারে –

আমাদের সব ই লোকাল –

আমাদের খেলা লোকাল –

ক্রিকেট লোকাল –

আমাদের ফুটবল- 

পাড়ার ফুটবল –

হাজার হাজার কোটী টাকার লোকাল –

আমাদের ঘুগনি লোকাল –

আমাদের মাটন লোকাল –

আমাদের TURKISH CUISINE –

ITALIAN CUISINE –

সব লোকাল –

বাবা ভাঙ্গার অনুকরণে ভবিষ্যৎ বাণী --

 

প্রজারা পিঁপড়ে হলে -সেই দেশের সর্বনাশ –

প্রজারা  HEADLESS MONSTER  হলে -সেই দেশের সর্বনাশ –

 

কিন্তু রাজাদের পোয়াবারো –

একদল প্রজা থাকবে -তারা  গাধা -তারা ভালো মন্দ কিছুই  বুঝবে  না – ইংরেজি তে  এই অবস্থা কে বলে –

ALEXITHYMIA –

প্রচুর পয়সা -কিন্তু বুদ্ধি হাঁটুতে –তাদের যে কোন সময় ছাগলের মতো জবাই করে ফেলা হবে –

কিন্তু তাদের হাতে প্রচুর পয়সা থাকবে –

তারা দেশের প্রভূত  ক্ষতিসাধন করবে –

 

তাদের ছেলেরা দামী  নিয়ে ঘুরবে –আর মেয়েদের 

EVE TEASING করবে –রেপ করবে --

এরা  UPPER MIDDLE CLASS  বা উচ্চবিত্ত শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হবে –

এদের পয়সা দেখে -এদের পিছনে প্রচুর মেয়েরা ঘোরাফেরা করবে –

এদের বাবারা- হাজার হাজার কোটী টাকা ব্যাংক থেকে মেরে দেবে –

অবশ্য তাতে ব্যাংক ম্যানেজার দের হাত থাকবে –

কাট মানি -কমিশন –

EUROPE TOUR –

FOREIGN SETTLEMENT ---

কিন্তু আশ্চর্য জনক ভাবে সরকার এদের কিছু বলবে না --!!!!

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

গল্প

Rudrajit Paul.jpg

ড্রইং ক্লাস
ডাঃ রুদ্রজিৎ পাল 

কসবা, কলকাতা 

nupur1.jpg
ড্রইং ক্লাস

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

​ড্রয়িং ক্লাস শুরু হল। প্রথমেই হোমওয়ার্ক দেখাতে হবে। সবাই নিজের বাড়ি থেকে করে আনা ড্রয়িং জমা করল। 
তুলিকা ম্যাডাম গম্ভীর মুখে ক্লাসে ঢুকে ধপ্‌ করে হাতের বিশাল ব্যাগটা টেবিলে রেখে বসলেন। বাচ্চারা সবাই দুরু দুরু বুকে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইল। যারা ভালো করে এঁকে এনেছে, যেমন আর্ণিক বা সুহানা, তারা অনেক আশা নিয়ে তাকিয়ে রইল। আর যারা শেষ মুহূর্তে কোনরকমে শেষ করে খাতা জমা দিয়েছে, তারা ভয়ে ভয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে বসে রইল। তুলিকা ম্যাডাম সব খাতা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন। তারপর ভালো হলে প্রশংসা, আর খারাপ হলে সবার সামনে প্রচণ্ড বকা।
উনি আস্তে করে ব্যাগ থেকে চশমা বার করে খাতার স্তূপ থেকে প্রথম খাতা তুলে নিলেন। আজকে বিষয় ছিল দুর্গাঠাকুর। উনি বলেছিলেন শুধু পেন্সিলে স্কেচ করে আনতে। তার পর উনি রঙ করা শেখাবেন। 
“পর্না? কোথায়?”
পর্না উঠে দাঁড়াল। পর্ণা বেশি কথা বলে না। চুপচাপ কাজ করে। ম্যাডাম বললেন,

“বড্ড ছোট করে এঁকেছ। পুরো পাতা জুড়ে আঁকবে তো। এত সাদা জায়গা খালি রেখেছ কেন?” পর্না কিছু না বলে বসে পড়ল।
“চন্দ্রিল? এদিকে এস।“

চন্দ্রিল ভালো ছেলেদের দলে পড়ে। মানে ক্লাসের পরেও ম্যাডামের কাছে গিয়ে নানা কথা জিজ্ঞাসা করে। ক্লাসে সবার আগে আঁকা শেষ করে খাতা জমা দেয়। ও উঠে টেবিলের কাছে গেল। “ভালোই হয়েছে। এই সামনের হাতটা একটু বেঁকে গেছে। দেখে নাও।“ ম্যাডাম চন্দ্রিলের খাতায় রবার দিয়ে মুছে আবার এঁকে দিলেন। এরপর সুহানাও প্রশংসা পেল। আরও বেশ কয়েকজন। এরপর এল আর্ণিকের পালা। আর্ণিক মাঝারি ছাত্র। খুব ভালো আঁকে না, কিন্তু একদম ফেলে দেওয়ার মতও নয়। আজকে ও অনেক যত্ন করে এঁকে এনেছে। দুর্গাঠাকুর প্রথমত ওর খুব প্রিয় সাবজেক্ট। তার ওপর ও নিজে নিজে ইউটিউব দেখে একটা নতুন টেকনিক শিখেছে। সেটা ব্যবহার করে আজকে ফিগার এঁকেছে। আজকে ম্যাডাম চমকে যাবে। 
তুলিকা ম্যাডাম বেশ কিছুক্ষণ ওর আঁকাটা দেখলেন। তারপর পাতা উল্টে আগের আঁকা দেখলেন। তারপর ওর দিকে থম্থমে মুখে তাকিয়ে বললেন, “তুমি এঁকেছ?”
আর্ণিক মাথা নাড়ে। ওর নতুন স্টাইল তার মানে কাজে লেগেছে। কিন্তু একী? ম্যাডাম যে উঠে ওর দিকেই আসছেন। হাতে সেই খাতা। 
“এটা তুমি এঁকেছ?” ম্যাডাম সেই পাতাটা খুলে ওর সামনে দাঁড়িয়ে বললেন। আর্ণিক মাথা নাড়ল। “হ্যাঁ। আজকেই।“
“মিথ্যে বলবে না। এটা তোমার আঁকা? এই হাত পায়ের লাইন, এই ঠাকুরের পায়ের নীচে সিংহ, এসব তোমার আঁকা?”
আর্ণিক মাথা নাড়ে। ওর গলাটা কেমন শুকিয়ে এসেছে। কী হল কিছুই বুঝতে পারে না। 
“এই এ পাশে এরকম এবড়ো খেবড়ো লাইন আর অন্যদিকে এত পরিষ্কার লাইন? আমাকে মিথ্যে বললেই হবে? এটা তোমাকে বাড়িতে কেউ করে দিয়েছে। কে দিয়েছে বল?”
আর্ণিক চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।

“বল কে দিয়েছে? নইলে কিন্তু আজকে ক্লাস করতেই দেব না।“
আর্ণিকের পেটটা কেমন খালি খালি লাগতে থাকে। ম্যাডাম পাশের চেয়ারে চন্দ্রিলকে খাতা দেখালেন।

“তুমি বল, এই দুটো জায়গা এক লোকের আঁকা?” সাত-আট বছরের ছেলে ম্যাডামের সামনে আর কী বলবে? চন্দ্রিল মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দিল যে ম্যাডামের কথাই ঠিক। 
ম্যাডাম বললেন, “আর্ণিক, বেরিয়ে যাও।“

এবার আর্ণিক ভয় পেল। ওর ভালো আঁকার জন্য যে এরকম সমস্যা হবে ও ভাবতেও পারেনি।

পরিস্থিতি সামলানোর জন্য ও বলল, “ম্যাডাম, এই লাইনটা বাবা---”

ওর মুখের কথা শেষ হওয়ার আগেই তুলিকা ম্যাডাম সেই পাতাটা ওর চোখের সামনে ছিঁড়ে চার

টুকরো করে গোল্লা পাকিয়ে জানলা দিয়ে বাইরে ফেলে দিলেন। তারপর খাতাটা ওর সামনে টেবিলে ছুঁড়ে দিয়ে ফিরে গেলেন নিজের চেয়ারে। আর্ণিক চুপচাপ চেয়ারে বসে পড়ল। কারুর দিকে তাকাতে পারল না। তখন তুলিকা ম্যাডাম বলছেন,

“যদি আর কেউ বাড়ির কাউকে দিয়ে ছবি আঁকিয়ে জমা দাও, তাহলে কিন্তু আমার ক্লাসে আর আসবে না।“ 

এরপর চন্দ্রিলের খাতা নিয়ে ম্যাডাম জলরং করা শুরু করলেন। সবাই সেখানে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকল। আর্ণিক সবার পেছনে শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে রইল। কেউ আর ওর সঙ্গে কোনও কথা বলল না। 

……………………………………………………………………………………………………………………
“সেইদিন সত্যিই আমি খুব দুঃখ পেয়েছিলাম, জানেন?” সাংবাদিক সত্যেন্দ্র মাথুরকে বলছিলেন নিক রয়। নিক রয় একজন পৃথিবীবিখ্যাত শিল্পী। বেশিরভাগ সময়ে থাকেন আমেরিকায়। নিউ ইয়র্কে বেশিরভাগ গ্যালারিতে ওনার প্রদর্শনী হয়ে গেছে। নিক আসলে কলকাতার ছেলে। আর্ণিক রায়। আমেরিকায় গিয়ে নাম হয়েছে নিক রয়।
নিক বলতে থাকেন, “তখন কতই বা বয়স? সাত বা সাড়ে সাত। সেই সময়ে ওরকম সব বন্ধুর সামনে আমার ড্রইং খাতার পাতা ছিঁড়ে ফেলে দিল। কীরকম অপমান বলুন? ওই বয়সে অপমানের বোধ তো থাকে, তাই না?”
সত্যেন্দ্র বললেন, “কী করলেন আপনি? বাড়িতে বললেন?”
“নাহ। আমি বাড়িতে কিছুই বলিনি। দোষ না করে অপরাধী হয়েছি। কী বলব বলুন? বাবাকে বলব যে ম্যাডাম তোমার আঁকা মনে করে আমার আঁকা ছিঁড়ে দিয়েছে? আসলে আমি তো বুঝতেই পারছি না যে আমার দোষ ঠিক কোথায়।“
“তারপর?”
“তারপর আর কী? একটা অদ্ভুত কমপ্লেক্স হয়ে গেল, জানেন? সাফল্যের প্রতি একটা ভয়। একটা অপরাধবোধ। ভালো আঁকতে গেলেই মনে হত, এই বুঝি কেউ বলবে যে সেটা আমার আঁকা নয়। এরকম অনেকবার হয়েছে যে ভালো এঁকেও মুছে দিয়ে খারাপ করে এঁকেছি। সেই দিনটার ধাক্কা কাটতে অনেক সময় লেগেছে।“
“কিন্তু আপনি যে বললেন একদম শেষে আপনি ম্যাডামের কাছে স্বীকার করতে গিয়েছিলেন যে—”
“আরে, সাত বছরের একটা বাচ্চা তখন আমি। ম্যাডাম বকছে দেখলে আর কী করবে? সে তো তখন ভাবছে যে মিথ্যে বললে যদি ম্যাডাম খুশি হয়, সেটাই বলব।“
সত্যেন্দ্র হাসলেন।
আর্ণিক বললেন, “অনেক, অনেক পরে দিল্লির একজন আঁকার শিক্ষক আমার এই কমপ্লেক্স ভেঙ্গেছিলেন। উনি বলেছিলেন এই ঘটনাটা থেকে আমি কিন্তু শুধু নেগেটিভ দিক নয়, একটা বিশাল পজিটিভ দিকও পেতে পারি। মানে, আমার আঁকার কোয়ালিটি সেই সাত বছর বয়সে এতই ভালো ছিল যে একজন অভিজ্ঞ ম্যাডাম ভেবেছেন যে সেটা বড় কারুর আঁকা। সেটা কী কম কথা?”
“তারপর?”
“সেই যে দিল্লির শিক্ষক আমার চোখ খুলে দিলেন, তারপর আর পিছনে ফিরে তাকাইনি। এতদিন নিজের যে প্রতিভা চেপে রেখেছিলাম, এবার বাঁধ ভেঙ্গে খুলে দিলাম।“
“তাহলে আপনি সেদিনের সেই ঘটনাটাকে কী বলবেন?”
“দেখুন, এখন হয়ত আমি সফল আর্টিস্ট। কিন্তু সেইদিনটা মনে করলে এখনও কেমন একটা বিষাদ বোধ জাগে। আমার প্রথম আঁকার পাতাটা ওইভাবে গোল্লা পাকিয়ে জানালা দিয়ে রাস্তার দিকে না গেলেই ভালো হত।“ 

উপমন্যু
কিশোর ঘোষাল

কলকাতা

উপমন্যু

গল্প

hospital1.jpg

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

শীতের বেলা চট করে শেষ হয়ে আসে, গরমে ঠিক তার উল্টো, যেন নড়তেই চায় না। ভোর থেকে বেলা যত এগোতে থাকে, সূর্য আগুন ঢালে। শুকনো খড়কুটো-পাতা জড়ো করে আগুন ধরালে তার ধোঁয়ায় যেমন গন্ধ ছাড়ে, দুপুরের বাতাসে সেরকম পোড়া গন্ধ টের পায় বিজু। কোথাও যেন আগুন ধরেছে। 
চাটুজ্জে বাড়ি কাজ সেরে সে আর মা ফিরেছে একটু আগে। ঘরে ঢুকে রান্নার যোগাড় করেই মা বেরিয়ে গেল ঘাটে স্নান সারতে। যাওয়ার সময় বিজুর মাথায় হাত রেখে বলল, “চানটা সেরে আয় বিজু, আমি ফিরে এসেই ভাত চড়াব। অনেক বেলা হল, খিদে পেয়েছে খুব, না রে?” মায়ের এই স্নেহের কথাটাও সহ্য হল না বিজুর। কত বেলা হল, মা জানে না? কখন থেকে তার খিদে পেয়েছে সে কথাটাও মায়ের অজানা নয়। মাথায় হাত দিয়ে মিষ্টি করে কথা বললেই খিদে মিটে যায় বুঝি? প্রচণ্ড গরমে আর আনচান খিদেয় বিজুর শরীরে এখন জমা হতে লাগল রাগ। সে রাগটা তার মা কিংবা বাবার ওপর নয়, কিন্তু কার ওপর? বিজু জানে না। বিজু ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল। চান করতে পুকুরের দিকে না গিয়ে, হাঁটা দিল উলটো দিকে। 
ওদিকে কেউ বড়ো একটা যায় না, ঝোপঝাড় আর আগাছার আড়ালে পড়ে আছে একটা পচা ডোবা। স্বল্প জলে পোকামাকড়, ব্যাঙাচি কিলবিল করে। বিকেল হলেই আনাচ-কানাচ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে মশা উড়ে আসে।  নোংরা জলে গাছের ডালপালা আর পাতা পচে দুর্গন্ধ ওঠে। ওপাড়েই কারা আবার ঠ্যাংয়ে দড়ি বাঁধা একটা মরা কুকুর ফেলে দিয়ে গেছে। পচে ফুলে উঠেছে সেটা। বড়ো বড়ো নীল মাছিরা ভনভন উড়ছে ওটাকে ঘিরে। দমকা তপ্ত বাতাসের সঙ্গে ভেসে আসছে উৎকট দুর্গন্ধ। 
অন্যসময় হলে বিজু হয়তো পালাত এই কদর্য পরিবেশ থেকে, কিন্তু এখন সে নির্বিকার। বিশাল তেঁতুল গাছের নিচু একটা ডালে বসে সে সবই দেখল। আরও দেখল তার পায়ের নিচে ঢোল কলমির ফুলে ফুলে উড়তে থাকা ফড়িংয়ের ঝাঁক। ফিনফিনে ডানা কাঁপিয়ে পতঙ্গগুলো উড়ছে বসছে উড়ছে। যেন খুব ব্যস্ত। তার চোখে পড়ল পাড়ের কাছে জলে স্থির ভেসে থাকা একটা তেকোণা মুখ। তার চকচকে পুঁতির মতো দুটো চোখ। মুণ্ডুটুকু বের করে একভাবে তাকিয়ে আছে জলঢোঁড়াটা। 
ঝিরিঝিরি পাতার ছাউনির নিরিবিলি ছায়ায় বসে সে দেখতে পেল অনেক দূরের মাঠঘাট, বড়ো রাস্তা, এমনকি তাদের দোতলা স্কুলবাড়িটাও। সামনে একলা একটা টিউবওয়েল নিয়ে, নির্জন দাঁড়িয়ে আছে, মাঠের প্রান্তে, বড়ো রাস্তার ধারে। পরশুদিন বিকেলে একবার গিয়েছিল ওদিকে, দরজা জানালা সব বন্ধ। বারান্দায় পুরু হয়ে জমে উঠেছে ধুলো, শুকনো কাঠকুটো-পাতা, ছাগল নাদি আর শুকনো গোবর। ছাদের কাছে মাথা চাড়া দিচ্ছে অশ্বত্থের চিকন চারা। 
বছর পেরিয়ে গেল স্কুল যাওয়া বন্ধ। গতবার গরমের শুরুতেই সেই যে বন্ধ হয়েছিল, আর খোলেনি। সেই সঙ্গেই তার এবং তার বাবা মায়ের জীবনটাও পাল্টে গেছে। শুধু স্কুল নয়, সবই বন্ধ হয়ে গেল একে একে। তার বাবার টোটো চালানোও বন্ধ হল। মায়েরা যে সমিতিতে কাজ করত সেটাও বন্ধ হয়ে গেল। কয়েকমাস আগে বাবা টোটোটা বিক্রি করে দিল। পাশের পাড়ার রমেশ পোদ্দার বাবার হাতে নগদ টাকা গুঁজে দিয়ে বলেছিল, “বড্ডো ঠকা হয়ে গেল রে, রাজু, এই পুরোনো টোটোর জন্যে এতগুলো টাকা গুণাগার দেওয়া, সে শুধু তোর মুখ চেয়ে”। সেই মুহূর্তেই তার বাবার টোটোটা হয়ে গেল রমেশ পোদ্দারের। বাইকের ব্যাটারি থেকে টোটো চালু করে ড্রাইভার সনাতন টোটো নিয়ে চলে গেল। মৃদু হেসে রমেশ পোদ্দার এগিয়ে গেল তার বাইকে।  
মা আক্ষেপ করেছিল, “দেশ জুড়ে কী যে লক ডাউন শুরু হল, বুঝি না বাপু। লোকজন করেকম্মে খাবে কী করে? সবার বাড়িতে বুঝি কাঁড়িকাঁড়ি টাকা জমানো থাকে?”
বিজু অল্পঅল্প ইংরিজি শিখেছে, সে বলল, “লক মানে তালা আর ডাউন মানে নীচু – তাই না মা?”
বিজুর মা বলল, “আমরা এখন নীচু তলার মানুষ। তোর বাবার গাড়িটা ছিল। ছুটির দিনে আমরা কেমন সবাই মিলে বিশালাক্ষী তলায় পুজো দিতে যেতাম। স্টেশন বাজারে যেতাম। এখন সে সব গেল চুলোর দুয়োরে।” 
বিজুর বাবা বিষণ্ণমুখে বলেছিল, “এখন আমাদের সবদিনই ছুটি, কাজের দিনগুলো সব লোপ পেয়ে গেছে। কবে যে শেষ হবে এই ছুটির অভিশাপ”। অভিশাপ ব্যাপারটা ঠিক কী বিজু বুঝতে না পারলেও, বাবার টোটো বেচা টাকায় বিজুদের কিছুদিন ভালই চলেছিল। দিন তিনেক বাড়িতে চিকেনও এসেছিল। বহুদিন পরে ভরপেট তৃপ্তির স্বাদ এসেছিল তাদের জীবনে। সে স্বাদ এখনও মনে পড়ে বিজুর। 
যতদিন স্কুল চালু ছিল, ছুটি ব্যাপারটায় বেশ মজাই পেত বিজু। বর্ষার ছুটি, পুজোর ছুটি। তাছাড়াও স্বাধীনতার ছুটি। শিবরাত্রি, জন্মাষ্টমী, ঈদের ছুটি। প্রজাতন্ত্রের ছুটি। কিন্তু এখনকার এই ছুটি বড়ো একঘেয়ে। কবে যে শেষ হবে কেউ বলতে পারে না। এই ছুটি এখন বিভীষিকা, তাদের জীবনটাকেই আমূল বদলে দিয়েছে। বিজুর বাবা সাইকেলে রোজ স্টেশন বাজারে যায়, বণিকদের দোকানে বস্তা তোলা নামানোর কাজে। বিজুর মা এখন ঝি, চাটুজ্জে আর হাজরা, দুই বাড়িতে কাজ নিয়েছে। ঘরদোর ঝাঁট দেওয়া, এঁটো বাসনকোসন ধোয়া, ময়লা জামাকাপড় কেচে শুকোতে দেওয়া। 
গতমাস থেকে চাটুজ্জে বাড়িতেই কাজে লেগেছে বিজুও! ওদের গোয়ালের তিনটে গাই আর দুটো বাছুরের দেখভাল করতে হয়। খড়কাটা, ডাবায় জাবনা দেওয়া, গোয়াল সাফ করা। পুরোনো কাজের লোককে মনিবরা এখনও ছাড়িয়ে দেয়নি। তার বয়েস হয়েছে, ঘোলাটে চোখ, কোমর সোজা হয় না। সে সাহায্য করে বিজুকে। প্রথম প্রথম কষ্ট হত খুব, ঘেন্না লাগত, এখন সয়ে গেছে। 
তেঁতুল গাছের ডালে বসে স্কুলবাড়িটা দেখতে দেখতে, বিজু ভাবে, স্কুল খুললেই কী তারা আবার ফিরে যাবে তাদের আগের জীবনে? তার বাবা আবার টোটো কিনবে? স্টেশন থেকে সাজাদপুর - যাত্রী নিয়ে আবার যাওয়া আসা করবে? মা ঝিগিরি ছেড়ে তাদের বাড়ির কাজেই আবার ব্যস্ত হয়ে উঠবে? 

ইন্দিরাদিদিকে খুব মনে পড়ে বিজুর। এই স্কুলে উনি বছর তিনেক হলো এসেছেন। এর মধ্যেই ছেলেমেয়েদের সব থেকে প্রিয় দিদিমণি হয়ে উঠেছেন। উনি বাংলা পড়ান। ক্লাসে পায়চারি করতে করতে পড়ার কবিতাগুলি আবৃত্তি করে শোনাতেন, অদ্ভূত লাগত শুনতে। গোটা ক্লাস চুপটি করে শুনত। তাদের ক্লাসের হাড় বজ্জাত পানু, যে শেষ বেঞ্চে বসে সারাক্ষণ অন্য সবার পেছনে লাগত, সেও মুগ্ধ হয়ে শুনত। ইন্দিরাদিদি সব দিনই ক্লাশে এসে যে পড়াতে শুরু করতেন, তাও নয়।

এক এক দিন ফাঁকিও দিতেন। বলতেন, “তোরা যেমন বাড়িতে পড়া না করে কিংবা ক্লাশে বসে কাটাকুটি খেলে পড়ায় ফাঁকি দিস, আজ আমিও সেরকম ফাঁকি দেব। আজ আমি শুধু গপ্পো করবো।  রোজ রোজ পড়া করতে ভালো লাগে, বল? আজ তাই গপ্পো হবে। 
সে অনেকদিন আগের গল্প। সে সময় আমাদের দেশে বিখ্যাত সব ঋষিমুনিরাই ছিলেন মাস্টারমশাই। তাঁরাই ছেলেদের পড়াতেন। তখনকার দিনে মাস্টারমশাইকে বলত গুরু আর ছাত্রদের বলত শিষ্য। এমন একজন গুরু ছিলেন ধৌম্য। তাঁর শিষ্যদের মধ্যে একজন ছিল উপমন্যু। শিষ্যরা তখন ঋষিদের আশ্রমেই থাকত, তাঁদের বাড়ির কাজ করে দিত, আবার সময়মতো পড়াও মুখস্থ করত। ঋষি ধৌম্যর অনেকগুলো গরুবাছুর ছিল, সেগুলোর দেখাশোনার ভার ছিল তাঁর এই শিষ্য উপমন্যুর ওপর। ভোরবেলা উঠে উপমন্যু রোজ গরুবাছুরগুলোকে নিয়ে মাঠে চরাতে যেত। সন্ধে নামার আগেই তাদের আবার ফিরিয়ে আনত গুরুর আশ্রমে। সন্তোষ জিজ্ঞাসা করেছিল, “দিদিমণি, উপমন্যু তার মানে রাখালি করত?” ইন্দিরাদিদি হেসে উত্তর দিয়েছিলেন, “ঠিক তাই”। 
গরুগুলো তো মাঠে সারাদিন ঘাস-পাতা খেয়ে পেট ভরাত। কিন্তু উপমন্যু সারাটা দিন কী খাবে? গুরু সেকথা একটুও ভাবতেন না। বেচারা উপমন্যুর ঠিক তোদের মতোই বয়েস। ভোর থেকে সন্ধে পর্যন্ত কিচ্ছুটি না খেয়ে মাঠে মাঠে ঘুরে বেড়ালে কী রকম খিদে পাবে বলতো? উপমন্যুরও ভীষণ খিদে পেত, সে এক একদিন এক একটা গরুর দুধ খেয়ে পেট ভরাত। এদিকে গুরু ধৌম্য খুব অবাক হলেন, ভাবলেন ছেলেটা সারাটাদিন তো কিচ্ছু খায় না, সাতদিনেই তো তার দুর্বল আর রোগা হাড়জিরজিরে হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু তা না হয়ে সে আগের থেকেও বেশী স্বাস্থ্যবান হয়ে উঠছে কী করে? তিনি উপমন্যুকে জিজ্ঞাসা করলেন, “সারাদিন তুই কী খাস রে, উপমন্যু?”
তখনকার দিনে লোকে মিথ্যে কথা বলত খুব কম, আর উপমন্যু তো তোদের মতো ছোট্টছেলে, সে তো মিথ্যে কথা বলতে জানতই না। সে সত্যি কথা বলতেই ঋষি ধৌম্য খুব বিরক্ত হলেন, বললেন, “না না, এ তোর ভারি অন্যায়, তোর দুধ খাওয়ার জন্যে বাছুরেরা কম দুধ পাচ্ছে, তারা দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া আশ্রমেও দুধের ঘাটতি হচ্ছে। কাল থেকে তুই আর দুধ খাবি না”। গুরুর আদেশে উপমন্যু দুধ খাওয়া বন্ধ করল। কিন্তু খিদে তো বন্ধ হবার নয়। গরুরা ভরপেট খাওয়ার পর এক জায়গায় বসে জাবর কাটে দেখেছিস তো? সেই জাবর কাটার সময় দেখবি তাদের মুখ থেকে ফেনা বের হয়। উপমন্যু এবার খিদের জ্বালায় সেই ফেনাই খেতে লাগল রোজ”। ক্লাশের অনেক ছেলেমেয়েই একসঙ্গে বলে উঠল “ইস্‌, এ ম্ম্যা”। 
ইন্দিরাদিদি মৃদু হাসলেন, বললেন, “খিদে কী ভয়ংকর হতে পারে, সে ধারণা তোদের কারও কোনোদিন যেন না হয়। প্রচণ্ড খিদেয় মানুষ কত কী যে খায়! সে যাকগে, গরুর মুখের ফেনা খেয়েই উপমন্যুর দিন কাটতে লাগল। গুরু ধৌম্য কিছুদিন পর আবার লক্ষ্য করলেন, সারাদিন না খেয়েও উপমন্যু আগের মতোই সুস্থ স্বাভাবিক রয়েছে। এবার তিনি উপমন্যুকে ডেকে বেশ ধমকেই বললেন, “হতভাগা তুই এখনও দুধ খাচ্ছিস?” উপমন্যু খুব ভয়ে ভয়ে সত্যি কথাই বলল। গুরু ধৌম্য বললেন, “ছি ছি এও তোর অন্যায়, উপমন্যু। গরুগুলো তোকে চেনে, তোকে ভালোবাসে। জাবর কাটার সময় নিজেরা কম খেয়ে তোর জন্যে তারা বেশি করে ফেনা তোলে রে, হতভাগা! তোর লোভের জন্যে এবার আমার গরুগুলোই দুর্বল হয়ে পড়বে দেখছি। কাল থেকে তুই ফেনাও খাবি না, দুধও না। কোনভাবেই তুই ওদের বিরক্ত করবি না”।
ইন্দিরাদিদি একটু থেমে স্মিতমুখে ছেলেমেয়েদের চোখের দিকে তাকিয়ে যেন অনুভব করলেন, গুরু ধৌম্যের প্রতি তাদের বিতৃষ্ণা। তিনি আবার শুরু করলেন, “গুরুর আদেশ উপমন্যু অমান্য করে কী করে? উপমন্যু পরেরদিন দুধ কিংবা ফেনা কিছুই খেল না। কিন্তু খিদে তো গুরুর আদেশ মানে না। খিদের জ্বালায় উপমন্যু জংলী গাছের কিছু পাতা চিবিয়ে খেয়ে ফেলল। সেই পাতার মধ্যে কিছু ছিল দারুণ বিষাক্ত, সে বিষে তার শরীর অসুস্থ হয়ে পড়ল, সে অন্ধ হয়ে গেল। ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে বলে উঠল, “ইসস্‌স্‌”, ইন্দিরাদিদি তাদের মুখে দেখতে পেলেন তীব্র সমবেদনা। 
“সন্ধে হল, বেশ রাতও হয়ে এল। উপমন্যু আশ্রমে ফেরেনি, ফেরেনি আশ্রমের গরুবাছুরগুলিও। গুরু ধৌম্য চিন্তিত হয়ে পড়লেন, এমন তো কোনদিন হয়নি। কিছু শিষ্যদের সঙ্গে হাতে মশাল নিয়ে তিনি মাঠের দিকে রওনা হলেন। মাঠে গিয়ে দেখলেন, গরুগুলি রাতের অন্ধকারে ভয় পেয়ে একজায়গায় জড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু উপমন্যুর কোন হদিশ নেই। তিনি এবং তাঁর শিষ্যরা ডাকাডাকি করতে উপমন্যুর সাড়া মিলল। সে পড়ে আছে গভীর এক গর্তের মধ্যে। গুরু ধৌম্য খুব রেগে গেলেন, চেঁচিয়ে বললেন, “এত রাত অব্দি এখানে কী করছিস, হতভাগা”? 
উপমন্যু হাতজোড় করে, খুব মৃদু স্বরে বলল, “বিষাক্ত গাছের পাতা খেয়ে আমি অন্ধ হয়ে গেছি, গুরুদেব। তারপর এই গর্তে পড়ে গিয়েছি”।  
গুরু জিজ্ঞাসা করলেন, “বিষাক্ত পাতা তুই খেলি কেন?” 
“আপনি দুধ কিংবা ফেনা খেতে মানা করেছিলেন, তাই খাইনি। কিন্তু আমার যে ভীষণ খিদে পেয়েছিল, গুরুদেব...”। সকলে মিলে তাকে গর্ত থেকে তুলে আনার পর গুরু ধৌম্য উপমন্যুকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন, বললেন, “কঠোর সত্যের এমন প্রতিজ্ঞা যার রয়েছে উপমন্যু, তার আর কোন্‌ শিক্ষার দরকার হয়? তোর শিক্ষা আজ সম্পূর্ণ হল। আজ থেকে তুই পরম জ্ঞানী, তোর দৃষ্টি ফিরে আসুক, সে দৃষ্টি হোক আরও উজ্জ্বল, আরও গভীর”। 
ইন্দিরাদিদি থামতেই সবাই কৌতূহলে জিজ্ঞাসা করেছিল, “উপমন্যু, সত্যিই সব শিখে ফেলেছিল। সত্যিই সে ফিরে পেয়েছিল তার দৃষ্টি?” ইন্দিরাদিদি মাথা নীচু করে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, তারপর স্মিতমুখে বললেন, “গল্পে তো তাই বলে”।

পুঁতির মতো চোখওলা জলঢোঁড়া সাপটা আচমকা এক ঝটকায় ধরে ফেলল, ছোট্ট একটা মাছ। মাছটা  ছাড়া পেতে প্রাণপণ ছটফট করছিল সাপটার মুখে। 
“বিজু, কোথায় গেলি, বাবা, আমি যে খাবার বেড়ে বসে আছি...”। মায়ের ব্যাকুল ডাক কানে এল। বিজু ছোট্ট লাফে মাটিতে পা দিল। তার পায়ের শব্দে সন্ত্রস্ত সাপটা নিস্তরঙ্গ জলে মৃদু ঢেউ কেটে ডুব দিল গভীরে। 
ভয়ংকর খিদেটা বিজু আবার টের পেল সমস্ত শরীরে। বাড়ির দিকে পা বাড়ালো। তার মনে হল, এই খিদের কথাই কী বলেছিলেন, ইন্দিরাদিদি? স্কুলে না গিয়েও সে কী উপমন্যুর মতোই সব শিক্ষা পেয়ে যাবে! চাটুজ্জে বাড়ির রাখালি করে আর ইন্দিরাদিদির আশীর্বাদে? গল্পে নাকি তাই বলে!

 

গল্প

ম্যাডোনা

ম্যাডোনা
অনিশা দত্ত

সল্টলেক, কলকাতা

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

Anisha Dutta.jpg
himadri1.jpg

চেম্বার থেকে ফিরতে রাত ন'টা বাজলোl বাড়ি ঢোকা মাত্র উমা উচ্ছসিত হল, জানিস দাদা, আইস-স্কেটিং এ গিয়েছিলামl তিন দিনের এগজিবিশন চলছে, প্রচুর ডিসকাউন্টl'
- বুঝেছি, তুই একগাদা অকাজের জিনিষ কিনে নিয়ে এলি তো? 
কতবার বলেছি সেলের জিনিষ কখনও ভালো হয় নাl দোকানদার কি লোকসান করে 'ব্যবসা করবে না কি? তোদের মতোন বোকা-সোকা লোকেরা ঠকতে যায়l'
- হ্যাঁ তোl আর তোদের মতন চালাক লোকেরা বাড়ি বসে থাকেl সব বিক্রেতারাই ক্লিয়ারেন্স সেল দেয়l ডিসকাউন্টের জন্যই তো ক্রেতারা আগ্রহী হয়l খরিদ্দার বাড়ে, কারো লোকসান হয় নাl কাস্টমার খুশিl একসঙ্গে দেদার বিক্রি হয়ে যায়l উভয় পক্ষই লাভবানl
- ওরা আগে থেকে দাম বাড়িয়ে প্রাইস-ট্যাগ আটকায়l তারপর লোক-দেখানি ডিসকাউন্ট দেয়l      - তোর সঙ্গে তর্ক করা বৃথাl অন্য একটা ইন্টারেষ্টিং খবর দিইl  
একজিবিশনে ছিল কস্টিউম জুয়েলারী, মেয়েদের-বাচ্চাদের ফ্যান্সি জামাকাপড়, ঘর সাজাবার টুকি টাকিl সবই অতি চমৎকারl যে মেয়েটি উদ্যোগী কোম্পানীর প্রতিনিধি হয়ে এসেছে, আমারই বয়সী হবে, বছর বাইশ তেইশl নাম ঊর্বশীl দিল্লির মেয়ে, পদবী শ্রীবাস্তবl মা বাঙালিl চমৎকার বাংলা বলছিলোl একেবারে মার্-মার্ কাট্-কাট্ সুন্দরীl
হাতে অপূর্ব ডিজাইনের বালা পরেছিলো, সোনা কি নকল জানি না, সাংঘাতিক ঝকমক করছিলোl আমার রেডিওতে শোনা পুরোনো দিনের সতীনাথের গাওয়া গানের কলি মনে পড়ে গেল, 'সোনার হাতে, সোনার কাঁকনকে কার অলংকার'l মেয়েটা কাউন্টারে ছিল, ওর কাছেই পেমেন্ট করলামl আমি থাকতে পারলাম নাl বিশদ আলাপ করে নিয়েছি ফোন নম্বর এক্সচেঞ্জ করেছিl কলকাতায় দিন সাতেক আছেl
আমাকে অনুরোধ করেছে কলকাতার দ্রষ্টব্য ঘুরে দেখিয়ে দিতে। রাজী হয়ে গিয়েছিl 
- অল্প পরিচয়ে লোকের সঙ্গে মাখা-মাখি করার অভ্যেস তোর গেল নাl
- খুব ভালো অভ্যেস দাদাl ওই করেই তো পরিচিতি বাড়েl তাছাড়া রূপ বাদ দিয়েও, মেয়েটার অন্য আকর্ষণ আছেl যাকে ইংরাজিতে বলে 'pleasing  personality simultaneous glamorous'.  
- বেশ-বেশl শুনেই মুগ্ধ হয়ে গেছিl

দিন তিনেক পর উমা বললো, 'দাদা, একটা আন্তরিক অনুরোধ আছেl ঊর্বশীর একটা প্রব্লেম হয়েছেl ডাক্তারি পরামর্শ চায়l তোকে না জিজ্ঞাসা করেই তোর চেম্বারের ঠিকানা দিয়ে দিয়েছিl তোর চেম্বার তো রাত সাড়ে আটটায় শেষl তারপর যেতে বলেছিl তোর অসুবিধে হবে নাl মনে রেখো আমার বিশেষ বন্ধু, ফিস নেওয়া চলবে নাl কিন্তু সাংঘাতিক স্বাভিমানী মেয়েl ওর আত্মসম্মানে ঠেস না পৌঁছিয়ে, তোকে ম্যানেজ করতে হবেl তুই তো নিজেকে দারুণ স্মার্ট মনে করিসl আশা করি, পারবিl                                                                                    *                                                               
রাতে পৌনে নটা নাগাদ ঊর্বশী এলোl সুঠাম দীর্ঘাঙ্গিনী, স্নিগ্ধ ফর্সা, সুনয়নাl ঈষৎ চাপা ওষ্ঠ্যl বাম দিকের গালে একটি ছোট্ট টোল ফেলে পরিমিত হাসি হাসলোl মান্না দে'র গাওয়া গান মনে পড়লো, একই অঙ্গে এতো রূপ দেখিনি তো আগেl মনে হলো এই তো সেই মেয়ে যার জন্য জন্ম-জন্মান্তর  অপেক্ষা করা যায়l' 
- 'হাঁ তুম বিল্কুল এইসি হো জাইসা হি ম্যানে সোচা থা' ছোট বোন উমার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা উথলিয়ে উঠলোl ছোট বোনের বন্ধুl 
অতএব নিশ্চিন্তে তুমি সম্বোধন করলাম - 'বোসোl তোমার কী অসুবিধে হচ্ছে? সমস্যাটা কী?
- 'গুরুতর কিছু হয়তো নাl তবে জিনিষটা থেকেই যাচ্ছেl মাথা ঘোরা, বমিl সর্বদাই ক্লান্তি লাগেl'   একটু ইতস্ততঃ করে বললো - 'গত মাসে পিরিয়ড মিস করেছিl এন্টাসিড খেয়ে কোনো লাভ হয় নি l  নার্সকে ডাকলাম, বললাম - 'পরীক্ষা করে দেখতে হবেl প্রাথমিক পরীক্ষার পর নার্স জানালো, মেয়েটি গর্ভবতীl এতক্ষন আমি ঊর্বশীকে নিয়ে ভবিষ্যৎ জীবনের পরিকল্পনায় যে প্রদীপ জ্বালিয়ে ফেলেছিলাম, এক লহমায় তা নিভে গেলোl ধুক্ করে নিভে গেল, বুক ভরা আশা।
তাহলে ঊর্বশী বিবাহিতাl উমাও জানে না নিশ্চয়ইl তাহলে ঘটকালির কথা বলতো নাl
নার্সকে ইশারায় চলে যেতে বললামl দুজনে মুখোমুখি বসেছিl
বললাম 'চিন্তার কিছু নেইl তুমি মা হতে চলেছোl শিশু পালনের জন্য মনে মনে প্রস্তুত হওl তুমি  তো ব্যস্ত, কর্মরতাl
- হ্যাঁl নিয়মিত বুটিকে বসতে হয়, সত্যই দারুণ ব্যস্ততাl
- বাড়িতে শাশুড়ি, বা মা, বা মাতৃস্থানীয়া কেউ আছেন, যিনি শিশুর পরিচর্যায় তোমার সহায় হতে পারবেন?
- নাl তেমন তো কেউ নেইl
- তাতে কি? 
পিতার দায়িত্ব তো কম নয়l বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ তাঁর কাবুলিওয়ালা গল্পে, পিতাকে মহান আসনে বসিয়ে গেছেনl   
তবু মিনির বাবার উক্তিতে আছে, বাচ্চাকে কোলে নিয়ে আদর করতে, তার সঙ্গে খেলা করতে খুব  ভালো লাগে, কিন্তু সে কান্না জুড়িলেই তাকে মায়ের কোলে সমর্পণ করিয়া নিশ্চিন্ত হইl তবে দিনকাল পাল্টাচ্ছেl   
আধুনিক স্বামীরা গৃহকর্মে স্ত্রীকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেনl
উপায় কি? দুজনেই যখন বাইরে কর্মরতl   
- যথার্থ বলেছেনl শ্রমবন্টন পদ্ধতিl আমার এক নব পরিণীতা বান্ধবী নিয়ম করেছে, বিছানায় সে যেদিকে শোবে, শুধু সেই দিকটা ঝাড়বেl
চমৎকৃত হলাম শুনেl ঊর্বশী বলে চলেছে, 'দুই যুগ আগে, আমার মায়ের এক বান্ধবী নিয়ম করেছিলেন, তিনি যদি একবার বাচ্চার কাঁথা পাল্টান, তবে পরের বার কাঁথা পাল্টানোর দায়িত্ব স্বামীরl সে যুগে তিনি যথেষ্ট চর্চিতা হয়েছিলেনl কিন্তু আধুনিক পতিরা বাচ্চার ডায়পার পাল্টাতে যথেষ্ট অভ্যস্থl  

বললাম 'দেখো ঊর্বশী, সন্তান ধারণ, সন্তানের জন্মদান ও স্তন্যদান, এই তিনটি বিষয়ে পিতার কোনো ভূমিকা নেইl কিন্তু বাচ্চার মুখে বোতল ধরা, ন্যাপি পাল্টানো বা শিশুর অসুস্থতায় প্রয়োজনে রাত জাগা, অবশ্যই বাবার কর্তব্যে আসবেl তবে, দুবছর বয়স পর্যন্ত শিশু মায়ের  কোল ঘেঁষে শুতে চাইবেইl এসময়ে তার দাবী মেনে নেওয়াই সঙ্গতl যতই হোক, ন'মাস শিশু তো মায়ের শরীরের মধ্যেই বড় হয়l মায়ের সঙ্গে শিশুর অচ্ছেদ্য বন্ধন জন্মগত প্রবৃত্তিl সন্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাবাকে অর্জন করতে হয়l মাকে করতে হয় নাl স্বীকার করো কি না?

- অবশ্যই করিl কিন্তু আপনি কি নিশ্চিত, আমি প্রেগন্যান্ট?

- সেন্ট পারসেন্টl নিশ্চিন্ত মনে দিল্লি ফিরে যাওl

- আমি খুব নার্ভাস বোধ করছিl

- নির্ভয়ে থাকোl প্রকৃতি সব সময়ে জননীর সহায়l বাড়ি ফিরে স্বামীকে সুখবরটা জানাওl তাকে বেবি সিটিং এর জন্য প্রস্তুত করোl

দৃপ্ত ভঙ্গিতে ঊর্বশী জবাব দিলো 'আমি অবিবাহিতা'l থতমত খেলামl প্রগতিশীলা রমণীl আমার কিছু বিরূপ মন্তব্য মানায় নাl বললাম, 

- 'বেশ সমস্যা নেইl বর্তমান সমাজ যথেষ্ট শিথিল ও সহিষ্ণুl লিভ টুগেদার লোকে মেনেও নিচ্ছেl সন্তান কোনও অবস্থাতেই অবৈধ নয়l অবিবাহিতা মায়ের সন্তানও পিতার সম্পত্তির অধিকারীl তবে কী ,, আমাদের সমাজ তো পাশ্চাত্য সমাজের মতন অত অগ্রসরী নয়l বিয়ে করে নাওl মাত্র তিন সপ্তাহের ভ্রূণl তুমি বলতে না চাইলে, সমাজ কোনও প্রশ্ন তুলতেও পারবে নাl

- আমি লিভ টুগেদার করি নাl ফ্ল্যাট নিয়ে একাই থাকিl

- তোমার মা-বাবা, ভাই-বোন? 

- কেউ নেইl বলতে পারেন আমি অনাথl শুনেছি, খুব ছেলেবেলায় আমার মা-বাবা কার একসিডেন্টে মারা যানl মামার দায়বদ্ধতা ও মামীমার বাধ্যবাধকতায় অনাদরে প্রতিপালিতাl গ্রাজুয়েশনের পর চাকরি পাইl তখনই ফ্ল্যাট ভাড়া নিইl  

- সে যাকl তাহলে, তোমার প্রেমিককে সুসংবাদটা দাওl দেখবে, শোনামাত্র, সে রেজিস্ট্রি অফিসে নোটিশ দিতে ছুটবেl তোমাকে কোনও হাঙ্গামা পোহাতেই হবে নাl' 
ঊর্বশী নির্ভীক নিস্কম্প স্বরে ঘোষণা করলো 'আমার কোনও প্রেমিক নেইl'           
তার স্পষ্টবাদিতায় বজ্রস্পৃস্ট হলামl কিন্তু বিচলিত বা উত্তেজিত না হয়ে, শান্ত সুরে বললাম

- কোনও সমস্যা নেইl ভোরে কখন ঘুম থেকে ওঠো?
- সাধারণতঃ, ছটা থেকে সাতটাl রাতে পার্টি থাকলে, আটটা-নটা–
খানিকটা প্রগলভ হওয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না, বললাম 'কাল শেষ রাতে উঠবে, পূর্ব  আকাশের দিকে তাকালে দেখবে বেথেলহেমের তারা জ্বল জ্বল করছেl চিন্তার কোনো কারণ নেইl   প্রভু যীশু আসছেন।'
ঊর্বশী উঠে দাঁড়ালোl থমথমে মুখে বললো, 'আমি আপনার পরিহাসের পাত্রী নইl'   
বুঝলাম, একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেছেl লজ্জিত হয়ে বললাম, 
- 'দুঃখিত, ঊর্বশীl তোমাকে আঘাত দিতে চাইনিl উমা যেমন তোমার বিশেষ বন্ধু, আমাকেও বিশেষ বন্ধু ভাবতে পারোl কেউ কি তোমার সঙ্গে প্রতারণা করেছে? আমি কি কোনো সাহায্যে   আসতে পারি?
- ধন্যবাদ স্যারl প্রয়োজন নেই l আই ক্যান টেক কেয়ার অফ মাইসেলফl' ঊর্বশী যাবার জন্য উঠে দাঁড়ালোl
আর তো আমার এই 'তুলনাহীনা'র সঙ্গে দেখা হবে নাl বুকের মধ্যে এক শূন্যতা গুমরিয়ে উঠলোl মরীয়া হয়ে বলে ফেললাম'

- 'বোসো, কথা আছেl'
বিস্মিত ঊর্বশী বসলোl বললাম 'বাড়ি ফিরলে উমা জিজ্ঞাসা করবে, 
- 'তোমার কী অসুখ! আমি বলবো, তেমন কিছু নয়, সামান্য হজমের গোলমালl তোমাকে উমার কাছে বিব্রত হতে হবে না'l
- 'যা খুশি বলবেনl এ বিষয়ে আমার কোনও বক্তব্য নেইl'
- 'তুমি কবে দিল্লি ফিরছো?'
- 'জেট এয়ারওয়েজে ওপেন টিকেট আছেl এখনও কন্ফার্ম করিনিl কাল উমা আমাকে বোটানিকসে নিয়ে যাবেl পরশু রবিবার গঙ্গায় নৌকো নিয়ে বেড়াবার কথাl
- 'কাল তো আমার চেম্বারl রবিবার আমি ফাঁকাl যদি তোমার আপত্তি না থাকে, তবে ওই দিন তোমাদের নৌকাবিহারে সঙ্গী হতে পারিl
- 'অবশ্যই আসবেনl My pleasure.'    
ঊর্বশী উঠে দাঁড়ালো 'bye! চলি আজl পরশু দেখা হবেl'
ঊর্বশী ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হলেও, আমার আবার মনে প্রফুল্লতা ফিরে এলোl তাহলে আবার দেখা হবেl
*                                    
বাড়ি ফিরতেই উমা পাকড়াও করলো 'ঊর্বশী গিয়েছিলো?'         
- এসেছিলোl   
- কেমন দেখলি  ?
- তেমন কোনো অসুখ হয় নিl নতুন জায়গা, অন্যরকম খাওয়া-দাওয়াl হজমের গোলমাল সামান্য l ওষুধ দিয়েছিl
- সে আমিও জানিl কেমন লাগলো তোর?
- অসামান্য সুন্দরীl
- সে আমিও জানিl রূপ বাদ দিয়ে তোর কী impression? কথা বলে কী মনে হলো? জীবন সঙ্গিনী হিসাবে ভাবতে পারিস?
- পারি বোধহয়l
- বোধহয় কেন? 'নিশ্চয়ই' নয় কেন?
- কারণ ঊর্বশীর আমাকে কেমন লেগেছে, আমি জানি নাl সেটা তুই কাল জেনে দিবিl কাল তো একসঙ্গে  বোটানিকস-এ যাচ্ছিস, খোলাখুলি জিজ্ঞাসা করে নিবিl পরশু আমিও তোদের সঙ্গে নৌকা বিহারে যাচ্ছিl তখন আমার সঙ্গে দেখা হবে, সব পরিষ্কার হয়ে যাবেl
- বাঃ বাঃ নিজে তো প্রোগ্রাম সেট করেই এসেছিসl আমাকে আর টানছিস কেন মিছিমিছি?
- তুই তো ঘটকালি করতে চেয়েছিলিl স্বীকার করছি, আমার প্রথম দর্শনে প্রেমl কিন্তু ও পক্ষের মন না জেনে তো বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া যায় নাl যদি মিয়াঁ-বিবি উভয়েই রাজী থাকে, তবে কাজীর ভূমিকায় আসবিl
- তোর দেখছি বড্ড তাড়া? কেন রে? কদিন মেলা-মেশা করে জেনে - বুঝে নে'l পরে পশ্চাতে সিদ্ধান্তে আসিসl 
- তুই জানিস, কোনো জিনিষ অনর্থক ফেলে রাখতে আমি চাই নাl তাছাড়া, দুচার মাস মেলামেশায় কিছু বুঝে ফেলা যায় নাl সারা জীবন ধরে চিনতে হয়l
- যথা আজ্ঞাl কাল সরাসরি তোর প্রস্তাব জানিয়ে দেবl

 *
পরদিন চেম্বার থেকে ফিরে দেখি, উমা আগেই ফিরেছেl আমাকে দেখেই বললো 'হাত-মুখ ধুয়ে আয়, সব বলছিl বুঝলাম আশাপ্রদ জবাব পাওয়া যায়নিl তাহলে তো উমা তখনি বলে দিতl অতএব কৌতূহল না দেখিয়ে নিজের ঘরে চলে এলামl
উমা আধ ঘন্টা পর এলো 'কত আশা করে ঊর্বশীকে বোটানিকস–এ নিয়ে গেলাম, পুরো হতাশl তোর মনে আছে, ছোটবেলায় বোটানিকস-এ স্মৃতিতে রয়েছে দুষ্প্রাপ্য তরু লতা গুল্মে পূর্ণ সুসজ্জিত পুষ্পিত উদ্যানl এখন দেখি, খান্ডারl শুধু অক্ষয় বট স্বমৰ্য্যাদায় দর্শনীয় হয়ে রয়েছেl সেই যে মস্ত বারকোষের আকারের শালুক পাতা ভাসতো আর বিশাল শালুক ফুল, সব অদৃশ্যl নোংরা ডোবায় ছোট্ট শুকনো ফুল, ছেঁড়া পাতাl আর সরাসরি, তোর হয়ে ঊর্বশীকে প্রেমে নিবেদন করে দিয়েছি l বলেছি 'দাদার প্রথম দর্শনেই প্রেমl তুমি যদি রাজী থাক, বিয়ের দিন স্থির করা যেতে পারে l শুনে হাসলও না, রাগলোও নাl কেমন থম  মেরে গেলোl এক্কেবারে চুপl নির্বাকl কিন্তু তার মুখে কোনও প্রফুল্লতা ছিল নাl পরিবর্তে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা ছিলl তাই তার নীরবতাকে 'মৌনং সম্মতি' বলা যাবে নাl কাল তুই নিজেই জিজ্ঞাসা করে নিস্l আমি তোদের একা থাকার সুযোগ করে দেবl

*                                           

পরদিন ঊর্বশীকে আমরা গেস্ট হাউস থেকে তুলে গঙ্গার পাড়ে গেলামl স্থির হলো, গাড়ি ওখানেই রেখে আমরা বেলুড় মঠ ঘুরে আসবোl সেই মতো, ঊর্বশীকে মঠের মধ্যে ঘুরিয়ে এনে তিনজনা গঙ্গার পাড়ে বসলামl উমা কথা রাখলোl মিনিট দশেকের মাথায় 'একটু আসছি' বলে উঠে গেলোl আমি আর ঊর্বশী মুখোমুখিl বাক্যহারাl কী বলি? ও যদি মুখ না খোলে, আমি শুরু করতে পারছি নাl এদিকে সময় বয়ে যাচ্ছেl উমা আসার আগে তো আমাকে ওর মনের কথা জানতেই হবেl বোকার মতন বলে উঠলাম - 'কবে দিল্লি ফিরছো? টিকেট কন্ফার্ম হয়েছে?'
ঊর্বশী দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো, 'নাঃl কিং কর্তব্য বুঝে উঠতেই পারছি নাl ভাবাবেগকে প্রশ্রয় দেব? না কি যুক্তি দিয়ে বিচার-বিশ্লেষণে যাবো?
আপনার প্রস্তাব এতই অভাবনীয়, এমনই অপ্রত্যাশিত! আমি দ্বিধা দ্বন্দ্বে হাবু ডুবু খাচ্ছিl কুল পাচ্ছি নাl আপনি যদি আশা করেন, আপনার প্রস্তাবে আমি সম্মত আছি, তাহলে .. মানে ...       
- আমার আশা বৃথাl তাই তো!
- না মানে, বলছি  কি, আপনি যদি ভেবে থাকেন, বিয়ের প্রস্তাবে আমি রাজী, তবে সসঙ্কোচে বলতে হয় .....          
- আমার ভাবাটা ভুলl বলে দাওl I won't mind. 
- মানে বলতে চাইছি, আপনি যদি ভেবে থাকেন, আমি 'হ্যাঁ' বলব, তাহলে বলি, 'you are right,'
আমি রাজীl‘

রহস্য গল্প

 

চিত্রকলা রহস্য

প্রসূন কুমার দত্ত

দিল্লী

teacher.jpg
চিত্রকলা রহস্য

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

পনবাবু দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির অধ্যাপক ছিলেন। এখন অবসর প্রাপ্ত। বয়স সত্তর ছুঁইছুঁই। জমা পুঁজি বিশেষ নেই। ধার দেনা করে পূর্ব দিল্লির একটা সোসাইটিতে ফ্ল্যাট কিনেছিলেন। দুটো শোবার আর একটা বসার ঘর ছাড়া একটা ছোট পড়ার ঘর আছে। এই ঘরেই ফোন আর ল্যাপটপ নিয়ে ওনার সময় কাটে। ব‌ই পড়া, শেয়ার বাজার আর জ্যোতিষ চর্চা। 

তপন বাবুর স্ত্রী সুজাতা দেবীর বয়স পঁয়ষট্টি পেরিয়েছে। তবে দেখে দশ বছর কম‍ই মনে হয়। রুচিশীল মহিলা। নিজে ফিটফাট থাকেন ফ্ল্যাটটাকেও ফিটফাট রাখেন। তপনবাবুর পড়ার ঘরটাতেও ওনার রুচিশীলতার ছাপ রয়েছে। সেগুন কাঠের পড়ার চেয়ার টেবিলটা বাদ দিলে টেবিল ক্লথ, চেয়ার কুশন, জানালার পর্দা, ঘরের মেঝে সব‍ই রঙ মিলিয়ে জলপাই রঙের। কিছুদিন আগে মানে বছর দুয়েক আগে অবধি একটা পুরনো বেমানান রঙ চটা লোহার আলমারি ছিল। সেটা বাড়ির কাজের মহিলা রমাকে সুজাতাদেবী দিয়ে দিয়েছেন।

পড়ার টেবিলের বাঁদিকে একটা জলপাই রঙের আলমারি। আলমারিটার ওপরের অংশটায় স্বচ্ছ কাঁচের পাল্লা ঢাকা ব‌ই তাকে কতগুলো ব‌ই। অর্থনীতি ছাড়া আছে ইতিহাস, বিশ্বরাজনীতি আর জ্যোতিষ। ব‌ই তাকের নিচে আলমারিতে আছে দুটো‌ ড্রয়ার আর তার নিচে একটা ফাইল ক্যাবিনেট। টেবিলের ওপর একটা শ্বেত পাথরের মূর্তি। মিকেল অ্যাঞ্জেলোর ডেভিডের কপি। জলপাই রঙের দেয়ালে একটা ফ্রেমে বাঁধানো হাতে আঁকা রঙিন ছবি। আয়তাকার দেড়ফুট চওড়া আর এক ফুট উঁচু। বছর চল্লিশ আগে তপনবাবু ইতালি গিয়েছিলেন। ওখানেই ভেনিসের সান মার্কো স্কোয়ারে ছবি আঁকছিল এক তরুণ চিত্রকার। তার থেকেই অনেক দরদাম করে কিনেছিলেন। ছবিতে ভেনিসের সরু খাল, ছোটো নৌকো গন্ডোলা, কয়েকটা বাড়ি আর সেগুলোর ব্যালকনিতে ফুল গাছ। 

বাড়িতে ছবিটা রয়েছে। তবে শুরুর দিকে ওটাতে কারোর কোনো বিশেষ আগ্রহ ছিল না। কেনার পর খামে ভরে কাগজপত্রের সঙ্গে আলমারিতে রাখা ছিল। ফ্ল্যাটটা কেনার পর বছর বিশেক আগে ভাড়া বাড়ি ছেড়ে নিজের ফ্ল্যাটে এসে ছবিটা ফ্রেমে বাঁধান তপনবাবু। এ্যাক্রিলিক ফ্রেম জলপাই রঙের। 

হঠাৎ মিহিরবাবু এসে সবকিছু গোলমাল করে দিলেন। উনি তপনবাবুর বাল্য বন্ধু। চিত্রকলার ব্যবসা করেন। দেশের উদীয়মান চিত্রকারদের আঁকা ছবি কিনে ইউরোপে বিক্রি করেন। রমরমা ব্যবসা। ইউরোপে থাকেন। মাঝে মাঝে দিল্লি এলে তপনবাবুর ফ্ল্যাটে থাকেন। শেষ এই বাড়িতে এসেছিলেন বছর তিনেক আগে ২০২১এ কোভিডের সময়। ডেল্টা ওয়েভ চলছে। আন্তর্জাতিক বিমান পরিসেবা বন্ধ। সুজাতাদেবী সুইডেনে ছেলের কাছে গিয়ে আটকে পড়েছিলেন। কোভিড আক্রান্ত তপনবাবু। কোনোমতে সরকারি হাসপাতালে বেডের ব্যবস্থা করে ওনার প্রাণ‌ বাঁচিয়েছিলেন মিহিরবাবু। ২০২৩এ মানে গত বছরের গোড়ার দিকে উনি দিল্লি এসেছিলেন। তখন তপনবাবু পরিবারের একটা বিয়ের অনুষ্ঠানে সস্ত্রীক জামশেদপুর গিয়েছিলেন। তাই মিহিরবাবু একটা হোটেলে উঠেছিলেন।

এবার এসে রমাকে মসলা চা বানাতে বলে হঠাৎ ছবিটার দিকে এক ঝলক তাকিয়ে বললেন চিত্রকার লোরেঞ্জো আকার্দি এখন বেশ নাম করেছে। এটার দাম এখন লাখ‌ বিশেক। সাবধানে রেখো ভাই। অংকটা শুনে তপনবাবুর চোখ কপালে। দরজাটা ভেজিয়ে নিচু স্বরে বললেন দিন মন্দা যাচ্ছে ভাই। জ্যোতিষ বিদ্যেতে ভরসা করে একটা শেয়ারে টাকা লাগিয়েছিলাম। ভরাডুবি হয়েছে। এখন যদি ভাল দামে ছবিটা বিক্রি হয় বড় উপকার হবে।

কথা আর এগলো না। রমা চা নিয়ে এলো। তোমার ছেলের পড়াশোনা কেমন চলছে রমা, মিহির বাবু জানতে চেয়েছিলেন। আপনার দয়ায় ভাল‌ই চলছে বাবু, রমার সংক্ষিপ্ত উত্তর। রমা বিধবা। ২০২০তে কোভিডের প্রথম তরঙ্গে ওর স্বামী মারা যায়। বছর দশেক এই বাড়িতে কাজ করছে। সারাদিন থাকে। রাতে বাড়ি যায়। ঘরের সব কাজ আর রান্না করে। বিশ্বস্ত মহিলা। দয়াপরবশ হয়ে মিহিরবাবু ওর ছেলের পড়াশোনার খরচ দেন। এবার কলেজে ভর্তি হয়েছে।

মিহিরবাবু অর্থবান কিন্তু পরোপকারী। দুদিন এই ফ্ল্যাটে কাটিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। গন্তব্য ভারতের বিভিন্ন শহর। ব্যবসার কাজে উদীয়মান চিত্রকারদের চিত্রকলার খোঁজে। উনি যাবার আগে তপন বাবুর ব্যাংক একাউন্টে লাখ দশেক ঢুকলো। বলে গেলেন, তপন আপাতত এই টাকাটা রাখ। মাস ছয়েক বাদে আবার আসছি। দেখি তোর ইতালির ছবিটার কী করা যায়।

এসব সুজাতাদেবী জানতে পারলেন না। জানাতে গেলে জ্যোতিষ বিশ্বাসে শেয়ার মার্কেটে দাগা খাওয়ার ব্যপারটা বলতে হয় তাই তপনবাবু বেমালুম চেপে গেলেন।

তপনবাবুর দিদি কলকাতায় থাকেন। প্রতি বছর তপনবাবু ফোঁটা নিতে কলকাতা যান। এবারেও গেলেন। সুজাতাদেবীর ভাই অসিতবাবু এবছর‌ও জয়পুর থেকে ফোঁটা নিতে এলেন। দিদির জন্য এনেছিলেন শ্বেত পাথরের গনেশ মূর্তি। ভেনিসের ছবিটা ওনার খুব পছন্দ। তপনবাবু বলেছিলেন ওনাকে উপহার দেবেন। দেব দেব করে দেওয়া হয় নি। এবার দিদিকে পটিয়ে হাতিয়ে নিলেন।

কলকাতা থেকে ফিরে তপনবাবু সব শুনলেন। ওনার অনুমতি না নিয়ে ছবিটা অসিতবাবুকে দেওয়ায় সুজাতাদেবীকে বকা ঝকা করলেন। মিথ্যের আশ্রয় নিয়ে বললেন সেটা মিহিরবাবুকে দেবেন কথা দিয়েছেন। ক্ষুব্ধ সুজাতাদেবী অসিতবাবুকে ফোন করায় উনি কয়েক দিন বাদে ছবিটা ফেরত দিয়ে গেলেন। 

এক সপ্তাহ পরে মিহিরবাবু এলেন। এবার উনি কয়েকটা ছবি বেশ কম দামে কিনেছেন। বেচে মোটা কামাবেন তাই খুশির মেজাজে ছিলেন। গুলাঠির বাটার চিকেন আর গার্লিক নান দিয়ে লাঞ্চ করে একটু বিশ্রাম নিয়ে ভেনিসের ছবিটা নিয়ে চলে গেলেন। রাতের খাবারে ছিল বাসন্তী পোলাও আর দ‌ই রুই। সুজাতাদেবী রান্নায় সিদ্ধহস্ত। কিন্তু মিহিরবাবু খেলেন না। ভেনিসের ছবিটা ফেরত দিয়ে কটু ভাষায় গালাগালি করলেন। বললেন তপন তুই এতবড় জালিয়াত জানা ছিল না। 

ছবিটা নাকি নকল। আসলের ফটো কপি। ধার নেওয়া দশ লাখ টাকা ফেরত না পেলে আইনি ব্যবস্থা নেবার ধমকি দিয়ে নিজের লাগেজ নিয়ে মিহিরবাবু চলে গেলেন। 

সুজাতাদেবী তপনবাবুর কীর্তিকলাপ জেনে ফেললেন। মিহিরবাবু চলে যাবার পর স্বামী স্ত্রীর তুমুল ঝগড়া হল। পাশের ফ্ল্যাটে আওয়াজ পৌঁছে ছিল যা আগে কখনো হয় নি।

তপনবাবু অসিতবাবুকে পছন্দ করতেন না। কেননা উনি প্রায়ই সুজাতাদেবীর থেকে পাঁচশ হাজার ধার নিয়ে ফেরত দিতেন না। ছবিটা কয়েক দিনের জন্য ওনার কাছে ছিল। তখন‌ই হয়ত উনি আসল সরিয়ে ফ্রেমে নকলটা ঢুকিয়েছেন। প্রমান নেই তাই শালাকে অভিযুক্ত করা সমীচীন হবে না বলেই ওনার মনে হল।

আমি তপনদাকে চিনতাম। আই পি এক্সটেনশনের পূর্বাশা কালি বাড়িতে প্রায়ই দেখা হত। এবার দেখা হলে সেই ছবির ব্যাপারটা জানালেন। অনিকেতের সাহায্য পাওয়া যাবে কিনা জানতে চাইলেন। অনিকেত যাদবপুরে আমার সহপাঠী ছিল। সত্যান্বেষী তবে মূলত কর্পোরেট অপরাধ নিয়ে কাজ করে। আমার অনুরোধে তপনদার কেসটা নিতে রাজি হল।

রাজি অবশ্য সহজে হয় নি। বলেছিল আমার সময় নেই রে। স্কুলের বন্ধু রঞ্জিত অনেক করে বলেছে। ওর কেসটার জন্যই সময় দিতে পারছি না। আবার এই উটকো ঝামেলা। আমি অবশ্য হাল ছাড়ি নি। অনিকেত আমার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আমার কথা ফেরাবে না তপনদাকে এই আশ্বাস দিয়েছিলাম। এখন অনিকেত কেসটা না নিলে লজ্জার ব্যাপার। তাই অনেক পেড়াপিড়ি করে রাজি করিয়েছিলাম।

এরপর অনিকেত কী করেছিল আমার ঠিক জানা নেই। ও বলেছিল এই কেসের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সকলের সঙ্গে ও কথা বলেছে। 

দুসপ্তাহ পর অনিকেত আমাকে তপনবাবুর ফ্ল্যাটে ডেকেছিল। আর তার ঠিক দুদিন আগে তপনদা সুজাতা বৌদি আর একজন ভদ্রলোককে দেখেছিলাম এক স্থানীয় উকিলের অফিসে ঢুকতে। পাশের ব্যাংকটায় আমার একটা কাজ ছিল। ওনারা আমাকে দেখতে পান নি। আমি অনিকেতকে জানিয়েছিলাম।

সেদিন তপনদার ফ্ল্যাটে অনিকেত, আমি, তপনদা, সুজাতা বৌদি ছাড়া আর‌ও কয়েক জন ছিল যাদের আমি চিনতাম না। অনিকেত আলাপ করিয়ে দিল। মিহিরবাবু, অসিতবাবু, মলয়বাবু, রমা, সোসাইটির গার্ড রমেশ আর সাধারণ পোশাকে দিল্লি পুলিসের বড় অফিসার অনিকেতের বন্ধু দীপক মিত্র। বুঝলাম সেদিন তপনদা আর সুজাতাবৌদির সঙ্গে যে ভদ্রলোককে দেখেছিলাম তিনি মিহিরবাবু।

অনিকেত তার স্বভাব সিদ্ধ শৈলীতে বলতে শুরু করলো। 

চল্লিশ বছর আগে তপনবাবু লোরেঞ্জো আকার্দির আঁকা ছবিটা মাত্র পঞ্চাশ ডলারে ভেনিসে কিনেছিলেন। সে তখন উদীয়মান প্রতিভা। গতবছর ভাই ফোঁটার সময় অসিতবাবু এসেছিলেন সঙ্গে ছিলেন মলয়বাবু। উনি একজন আর্ট ডিলার। গুরগাঁওতে একটা আর্ট গ্যালারির মালিক। উনি অসিতবাবুকে বলেছিলেন ছবিটার দাম লাখ দশেক হবে। এনে দিতে পারলে অর্ধেক মানে লাখ পাঁচেক অসিতবাবু পাবেন। গতবছর না হলেও এই বছর ভাই ফোঁটায় ছবিটা ওনার হাতে এসেছিল। উনি চুপচাপ ফেরত দিয়েছিলেন কেননা মলয়বাবু বলেছিলেন সেটা আসলের ফটো কপি। ছবিটা যে রঙিন ফটো কপি মাত্র তা তিনি তপনবাবু আর সুজাতাদেবীকে জানালেন না। নিজের ওপর কোনো রকম সন্দেহের আঁচ আসে তা তিনি চান নি।

২০২১শের অভিশপ্ত মে মাসে কোভিড আক্রান্ত তপনবাবু হাসপাতালে। বাড়িতে পরিবারের কেউ নেই। শুধু মিহিরবাবু ছিলেন। একদিন সন্ধ্যের পর রমা এসেছিল মাইনের টাকা নিতে। তখন কাজের লোকেদের আবাসনে ঢোকা মানা ছিল। তবে বিশেষ দরকারে আসতে দেওয়া হত। গার্ড রমেশ কারণটা জেনে রমাকে আসার অনুমতি দিয়েছিল।

রমেশ ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালো।

রমা বার দুয়েক বেল বাজাবার পর মিহিরবাবু দরজা খুলে ছিলেন। আসার কারণ শুনে রমাকে বাইরে অপেক্ষা করতে বলে মাইনের টাকাটা আনতে ভেতরে গিয়েছিলেন। মিনিট দুয়েকের জন্য হবে। ভেতরে ঢুকলে বসার ঘর পেরিয়ে সদর দরজার ঠিক উল্টো দিকে বারান্দার পাশেই তপন বাবুর পড়ার ঘর। 

সদর দরজার বাইরে থেকে রমা দেখেছিল পড়ার ঘর খোলা কিন্তু দেওয়ালে ভেনিসের ছবিটা নেই। পড়ার টেবিলে পড়ে থাকা ছবির ফ্রেমটা দেখা যাচ্ছিল। রমা এই বাড়ির অনেক দিনের পুরনো কাজের লোক। ছবিটা কোনো দিন দেয়াল ছাড়া হতে দেখে নি। 

মাইনের টাকাটা নিয়ে নেহাত কৌতুহল বশত সে মিহিরবাবুকে প্রশ্ন করেছিল।

মিহিরবাবু প্রমাদ গুনলেন। তপনবাবু হাসপাতাল থেকে ফিরলে রমার কাছে শুনবেন। কী জবাব দেবেন মিহিরবাবু? এর চেয়ে রমার মুখ বন্ধ রাখাই সমীচীন। ঠিক হল মাসে মাসে ছেলের পড়াশোনার খরচের নামে তিন হাজার টাকা দেবেন তিন বছর। কথার নড়চড় হয় নি। এছাড়াও সম্প্রতি হাজার পঞ্চাশেক দিয়েছেন। রমার ব্যাংক এ্যাকাউন্টে এর পরিষ্কার প্রমান আছে। 

রমার মুখ নিচু। চোখে জল। বললো ওর স্বামী ধার রেখে মারা গিয়েছিলেন। আসল সুদ মিলিয়ে পঞ্চাশ হাজার দেনা। মিহিরবাবুর দয়ায় এই দেনা সে এবার মিটিয়ে দেবে।

মিহিরবাবুর পেশা উদীয়মান চিত্রকরদের আঁকা ছবি কিনে ইউরোপে বিক্রি করা। এর জন্য ওনাকে আসল ছবির নকল করতে হয় খরিদ্দারদের দেখাবার জন্য। তাই উনি ওনার সঙ্গে একটা দামি উচ্চমানের স্ক্যানার আর রঙিন প্রিন্টার রাখেন। এবাড়িতে এলে উনি জিনিস দুটো তপনবাবুর পড়ার টেবিলে রাখেন আর এই ঘরটাই নিজের কাজের জন্য ব্যবহার করেন।

তপনবাবু সম্মতির ঘাড় নাড়লেন। 

অনিকেত আবার বলতে শুরু করলো। মিহিরবাবু ছবি নিয়ে কাজ করেন। তাই ফ্রেমটা খুলে আসলটা বের করে ছবিটা স্ক্যান করে কয়েকটা রঙিন প্রিন্ট নেন। একটা প্রিন্ট আবার ফ্রেমে ভরে দেন। আসল নকলে ফারাক ফ্রেমে বন্দী ছবিটা দেখে বোঝা যায় না।

মিহিরবাবু হেসে বললেন, গল্পটা বেশ মজাদার অনিকেতবাবু। কিন্তু আসল ছবিটা গেল কোথায়? 

অনিকেত নির্বিকার ভাবে জলের গ্লাসে একটা চুমুক দিয়ে বললো, একটু ধৈর্য রাখুন মিহিরবাবু। 

মিহিরবাবুর গোঁফের ফাঁকে তাচ্ছিল্যের হাসি। অনিকেত প্রশ্ন করলো, মিহিরবাবু আপনি মলয় বাবুকে চেনেন নিশ্চয়ই।

চিনি বৈকি। আধঘন্টা আগে এখানেই আলাপ হলো তো। মিহিরবাবুর বাঁকা হাসি আর শ্লেষাত্মক জবাব।

এতক্ষণ পুলিশ অফিসার দীপক মিত্র চুপ করে ছিলেন। এবার বললেন। আমাদের বোকা বানানো সহজ নয় মিহিরবাবু। আপনার কল রেকর্ড বলছে আপনি প্রায়ই মলয়বাবুর সঙ্গে কথা বলেছেন। 

মিহিরবাবুর মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। মলয়বাবু মাথা নিচু করে প্রায় অস্ফুট স্বরে বললেন মিহির আর আমার এক‌ই রকম ব্যবসা। তাই যোগাযোগ থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু তপনবাবুর ভেনিসের ছবি তো আমার কাছে নেই। ফ্রেমে বাঁধানো কপিটা অসিত দেখিয়েছিল। জাল ফালতু মালে আমার কোনো আগ্রহ নেই।

অনিকেত আবার বলতে শুরু করলো। নেই তা আমি জানি তবে এবার একটু ঝেড়ে কাশুন মলয় বাবু। আমার বন্ধু চিত্রকর রঞ্জিত মিত্রের আকাশ গঙ্গা ছবিটা চুরির অভিযোগে গ্রেফতার হতে পারলেন জানেন?

অনিকেতের প্রশ্নটায় একটু থতমত হলেও সামলে নিয়ে গলার জোর বাড়িয়ে মলয়বাবু বললেন। চুরির কথা আসছে কোথা থেকে? রঞ্জিতবাবু আমায় ফোন করেছিলেন। ওনার আঁকা কয়েকটা ছবির ফটো পাঠিয়েছিলেন। আমার পছন্দ হয় নি।

অনিকেত অবাক হবার ভান করে বললো তাই নাকি? হতেও পারে। আচ্ছা আপনার কপালে নাকের ঠিক ওপরে কাটা দাগটা কী মারপিটের নিশান?

মলয়বাবু হেসে বললেন আমার পেটানো শরীরটা লক্ষ্য করেছেন নিশ্চয়ই। মারপিট করলে প্রতিপক্ষের শরীরে ওই দাগ হত। আমারটা অনেক দিন আগে। কলেজে হেলমেট না পরে ব্যাট করার কুফল। বাউন্সারটা বুঝতে পারি নি।

অনিকেত এবার নিজের ফোনে একটা ফটো দেখালো। সেলফি। ফর্সা মত দাড়ি গোঁফ কামানো গোলগাল চেহারার একজন বয়স্ক লোকের পাশে দাঁড়িয়ে পাগড়ি পরা দাড়ি ওয়ালা সর্দারজি। অনিকেত জানালো অন্যজন ওর বন্ধু রঞ্জিত মিত্র।

সবাই এক বার ভাল করে ফটোটার দিকে দেখুন তো। সবাই দেখলাম সর্দারজির কপালে দাগটা। মলয়বাবুর দাগের সঙ্গে হুবহু মিলে যাচ্ছে। 

ছদ্মবেশের কারণ কী দীপকবাবুর এই জিজ্ঞাসার কোনো জুৎস‌ই উত্তর মলয়বাবুর ছিল না। শুধু বললেন ছদ্মবেশ ধারণ কোনো অপরাধ নয়।

অনিকেত রমাকে বাড়ি যেতে বলে আবার বলতে শুরু করলো। দারুন চাল চেলে ছিলেন মলয়বাবু। রঞ্জিতের আকাশ গঙ্গা ছবিটার ফটো দেখেই মলয়বাবু বুঝেছিলেন এই ছবির আর্থিক ভবিষ্যত খুব উজ্জ্বল। তাই মাস দুয়েক আগে কলকাতা গিয়ে ওর বাড়ি গিয়েছিলেন। সকাল দশটা কী এগারোটা হবে।

অনিকেতকে থামিয়ে দিয়ে মলয়বাবু বললেন সত্তর হাজার দিতে চেয়েছিলাম। লোকটা তিন লাখ চেয়েছিল। সঠিক দামটা যাচাই করার জন্য ঘন্টা কয়েকের জন্য এক বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম। ওনার থেকে ছবিটা নেওয়ার সময় আমি লিখে দিয়েছিলাম আর ফেরত পেয়ে উনি লিখে দিয়েছিলেন। রঞ্জিতবাবু খুব অমায়িক লোক। লেন দেন না হলেও সেলফি তোলা হল। জমিয়ে আড্ডা হল। উনি বেহালা বাজান। ছবিটা সন্ধ্যায় ফেরত দিয়ে বাজনা শুনেছিলাম। আমি সৎ ব্যবসায়ী অনিকেতবাবু। চোরাই মাল আমি রাখি না।

মুচকি হেসে অনিকেত বললো। তাহলে আমার কথাটা শুনুন মলয়বাবু। সন্ধ্যায় সাতটা নাগাদ আপনি রঞ্জিতের বাড়ি গিয়েছিলেন ছবিটা নিয়ে। সঙ্গে ছিল এক বোতল দামি বিদেশি হুইস্কি। ওর যে ভাল হুইস্কিতে একটু দুর্বলতা আছে তা আপনি সকালে গল্প করার সময় বুঝে গিয়েছিলেন। রঞ্জিত আমাকে বলেছে প্রথম দফায় পেগ তিনেক খেয়েছিল। তার পর আপনার অনুরোধে মিনিট পনেরো বেহালা বাজিয়ে আর‌ও দেড় কী দুপেগ। তারপর নেশায় টলমলে মানুষটাকে আসলের বদলে আকাশ গঙ্গা ছবিটার নি‌খুঁত রঙিন ফটো কপি ধরিয়ে প্রাপ্তি রসিদ স‌ই করিয়ে নিয়ে ছিলেন। ছবিটা একটা খামে ভরে রঞ্জিত একটা ফাইল ক্যাবিনেটে রেখেছিল। আপনাকে সন্দেহ করে নি কেননা যে ব্যক্তি বানিজ্যিক লেন দেন না করেও বিনামূল্যে দামি মদ খাওয়ায় তাকে সন্দেহ করার কোনো কারণ‌ও হয়ত ছিল না। সম্প্রতি মাত্র মাস খানেক আগে আর একজন গ্রাহককে ছবিটা দেখাতে গিয়ে জানতে পারে ছবিটা আসল নয়। রঞ্জিত আপনাকে ফোন করেছিল। 

অবশ্যই করেছিল। আমি দুঃখ প্রকাশ করে জানিয়েছিলাম আসল ছবিটাই ওনাকে দিয়েছি আর উনি প্রাপ্তি স্বীকার করেছিলেন। ওনার স‌ই করা প্রাপ্তি রসিদ এর ফটো তুলে হোয়াটসঅ্যাপে ওনাকে পাঠিয়েছিলাম। তারপর উনি আর ফোন করেন নি। অবৈধ মাল আমি রাখি না অনিকেতবাবু। মলয় বাবু আত্মবিশ্বাসের স্বরে জবাব দিলেন।

অনিকেত বললো আমি নিশ্চিত আসল ছবিটা আপনার গুরগাঁওএর আর্ট গ্যালারিতে নেই। আপনার হয়ত জানা নেই আপনার গ্যালারির কেয়ার টেকার সুবোধ এই সোসাইটির গার্ড রমেশের খুড়তুতো ভাই। রমেশের সাহায্যে ওর সঙ্গে যোগাযোগ করে কাল রাতে আমি ওই আর্ট গ্যালারিতে গিয়েছিলাম। সব ছবি দেখেছি। রেকর্ড চেক করেছি। প্রত্যেকটার যথাযথ মালিকানা সার্টিফিকেট আছে। 

মলয়বাবুকে আশ্বস্ত মনে হল। বললেন এত কষ্ট করার দরকার কী ছিল অনিকেতবাবু। আমাকে বললে আমি তো নিজেই আপনাকে সব দেখিয়ে দিতাম।

অনিকেত নিরুত্তাপ স্বরে বললো। নিজের কাছে রাখার প্রয়োজন তো ছিল না। চিত্রকর রঞ্জিত মিত্রের আঁকা আকাশ গঙ্গা ছবিটা তো আপনি গত সপ্তাহে মিহিরবাবুকে বেচে দিয়েছেন। কত টাকায় সেটা অবশ্য এখনও জানি না। 

মলয় বাবু চমকে উঠে আমতা আমতা করে কিছু বলতে চাইছিলেন। ঠিক সেই সময় একজন মহিলা পুলিশের সঙ্গে এলো রমা। পুলিশের হাতে ছিল একটা বাদামি রঙের চ‌ওড়া খাম। পুলিশ মহিলা জানালেন রমার ঘরে একটা পুরনো লোহার আলমারিতে খামটা ছিল।

আমাদের‌ই পুরনো আলমারিটা। রমাকে এমনি‌ই দিয়েছিলাম। সুজাতাবৌদি বললেন।

পুলিশ অফিসার দীপক বাবু খামটা খুললেন। পাওয়া গেল দুটো ছবি। লোরেঞ্জো আকার্দি আর রঞ্জিত মিত্র। সঙ্গে ছিল আইনি কাগজ। স্ট্যাম্প পেপারে তপনবাবু লিখে দিয়েছেন লোরেঞ্জো আকার্দির ছবিটা উনি মিহিরবাবুকে বিক্রি করেছেন দশ লাখে। ছবিটার পেছনে লোরেঞ্জো আকার্দি চল্লিশ বছর আগে স‌ই করে লিখেছিলেন “সোল্ড টু তপন রয় ফ্রম ইন্ডিয়া - ফিফটি ডলারস্ “। আর আকাশ গঙ্গা ছবিটায় একদম নিচে ডান দিকের কোনে রঞ্জিত মিত্রের সাক্ষর আছে।

অনিকেত আবার বলা শুরু করলো। কয়েক বছর আগে রোমের এক মিউজিয়াম থেকে চুরি যাওয়া একটা মূর্তি কোনো এক অপরাধী কলকাতার এক নামকরা ব্যবসায়ীকে বিক্রি করেছিল। সেই কেসটার ব্যাপারে রোমে গিয়েছিলাম। মিউজিয়ামের বড়কর্তার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। এখনও যোগাযোগ আছে। উনি বলেছেন লোরেঞ্জো আকার্দির আঁকা কোনো ছবি‌র দাম এক কোটির কম নয়। 

২০২১এ ছবিটা চুরি করে মিহিরবাবু ইউরোপে গিয়ে এর দাম যাচাই করেছিলেন। দাম বাড়ছে তবে ভাল দাম পেতে গেলে বৈধ মালিকানা সার্টিফিকেট চাই। ২০২৩এ তিনি ছবিটা নিয়েই দেশে এসেছিলেন। দীপকবাবু খোঁজ নিয়ে জেনেছেন তিনি দক্ষিণ দিল্লির একটা মাঝারি ধরণের হোটেলে উঠেছিলেন। কয়েক জন ওনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। আমার মনে হয় ওই ছবির ব্যাপারেই। কিন্তু সম্ভবত বৈধ মালিকানার প্রমান না থাকায় ঠিক দাম পাচ্ছিলেন না। 

এর মধ্যে মলয়বাবুর থেকে রঞ্জিত মিত্রের আকাশ গঙ্গা ছবিটা কিনেছেন। দুটো ছবি‌ই চৌর্যবৃত্তির ফসল। একটা বন্ধ খামে ভরে ছবি দুটোকে রমার হেফাজতে রাখার ব্যবস্থা করে ফেললেন। রমা ওর মৃত স্বামীর দেনার কথা মিহিরবাবুকে জানিয়ে ছিল। মিহিরবাবু ওকে পঞ্চাশ হাজার দিলেন। রমা কিছু একটা হয়ত আন্দাজ করেছিল। কিন্তু পঞ্চাশ হাজার পেয়ে ও আর কিছু ভাবে নি।

চিত্রকলার উচিত মূল্য বিশেষজ্ঞরা জানেন। সাধারণ মানুষের বোধগম্য হ‌ওয়া সম্ভব না। তপনবাবুর কাছে নকল ছবি। মিহিরবাবুর কাছে আসল ছবি কিন্তু বৈধ মালিকানার প্রমান নেই। উনি ভাবলেন তপনবাবুকে মাত্র বিশ লাখ দিয়ে ছবিটা নিজের নামে লিখিয়ে নেবেন। দশ লাখ অগ্রিম দিয়ে তিনি ব্যবসার কাজে বেরিয়ে পড়লেন।

এর মধ্যে অন্য একটা ঘটনা ঘটলো। সুজাতাদেবী ভাইয়ের আবদারে ভেনিসের ছবিটা ভাই অসিত বাবুকে দিয়ে দিলেন। তখন অবশ্য মিহিরবাবু আর রমা ছাড়া কেউ জানত না ফ্রেমের মধ্যে ছবিখানা নকল। একটা ভাল ফটো কপি মাত্র। পরে যখন জানাজানি হয়ে গেল তখন মিহিরবাবু নতুন সুযোগ পেলেন। 

এতটা বলার পর অনিকেত প্রশ্ন করলো। তপনবাবু, দিন দুয়েক আগে মিহিরবাবু আর সুজাতা দেবীকে সঙ্গে নিয়ে উকিলের কাছে যাওয়ার দরকার পড়লো কেন?

জবাবটা এলো সুজাতাবৌদির থেকে। মিহিরদা ফোনে বার বার হুমকি দিচ্ছিল। বলছিল আমরা লোরেঞ্জো আকার্দির আসল ছবিটা লুকিয়ে রেখে একটা মামুলি ফটো কপি বেচবো বলে দশ লাখ অগ্রিম নিয়েছি। এক সপ্তাহ আগে রাত নটা নাগাদ এই ফ্ল্যাটে এসে চোর অপবাদ দিয়ে মিহিরদা বলেছিল দুদিনের মধ্যে টাকাটা ফেরত না পেলে মামলা করবে। লজ্জায় অপমানে দুঃখে আমি কেঁদে ফেলেছিলাম। বলতে বলতে সুজাতাবৌদি কেঁদেই ফেললেন।

তপনদা বললেন দোষটা আমারই। জ্যোতিষে বিশ্বাস করে ধার নিয়ে রদ্দি শেয়ার কেনায় ভরাডুবি হয়েছিল। মিহিরের টাকাটা দিয়ে ধার মিটিয়ে ইজ্জত বাঁচিয়েছিলাম। ছেলেকে জানালে সে হয়ত টাকাটা পাঠিয়ে দিত। কিন্তু ছেলের কাছে মান ইজ্জত খোয়াতে চাই নি। সুজাতাও চায় নি। মিহিরের কাছে হাতজোড় করে ক্ষমা চেয়েছিলাম। টাকাটা ফেরত দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বছর খানেক সময় চেয়েছিলাম। 

আবার অনিকেতের বলার পালা। ও বলা আরম্ভ করলো। মিহিরবাবু বলেছিলেন আইনি কাগজ তৈরি হবে। দশ লাখ টাকা তিনি ফেরত নেবেন না। বিনিময়ে উনি ছবিটার স্বত্বাধিকার পাবেন। উকিলের অফিসে এই আইনি কাগজে সইসাবুদ হয়েছিল। তখন অবশ্য তপনবাবু, সুজাতাদেবী এমনকি উকিলবাবুও জানতেন না ছবিটা মিহিরবাবু রমার ঘরে রেখেছেন।

আমরা খোঁজ নিয়েছি। উকিলের খরচ তপনবাবু দিয়েছিলেন। মন্তব্য করলেন দীপক বাবু।

হঠাৎ অসিতবাবু উত্তেজিত হয়ে মলয়বাবুকে উদ্দেশ্য করে বললেন শালা চোর। দিদির কাছে ভাই ফোঁটা নিয়ে ছিলিস। প্রতিদানে জামাইবাবুর কোটি টাকার ছবি হাতিয়ে আমায় মোটে পাঁচ লাখ দিতে চেয়েছিলিস। 

সুজাতাবৌদি কিছু বলতে চাইছিলেন। থামিয়ে দিয়ে দীপকবাবু বললেন। আপনিও তো কম অপরাধী নন। ছবিটা দামি জেনেও দিদিকে ঠকিয়ে মোটা টাকা কামানোর চেষ্টা অপরাধ বৈকি। 

অসিতবাবুর বেলুন চুপসে গেল। অনিকেত বললো রঞ্জিত পুলিশের ঝামেলায় যেতে চায় না। আকাশ গঙ্গা ফেরত পেলেই সে খুশি। 

দীপকবাবু বললেন। তপনবাবু চাইলে আপনি পূলিশে অভিযোগ করতে পারেন। 

তপনদা বললেন হাজার হোক মিহির কোভিডের সময় আমার প্রান রক্ষা করেছিল। আমি কৃতজ্ঞ। ছবিটা ফেরত পেলে আমিও পুলিশি ঝামেলায় যেতে চাই না। একটু সময় লাগবে কিন্তু ওর দশ লাখ ফেরত দেব। তবে বন্ধুত্বের এখানেই শেষ। মিহির এবাড়িতে আর আসিস না। 

সুজাতা অসিতবাবুকে কঠিন গলায় বললেন। তুই আর আমার ভাই নয়। এখানে আর কখনও আসিস না। রমার চাকরি গেল। ঘটনাটা জানাজানি হতে এই অঞ্চলে কেউ ওকে কাজ দেয় নি। 

কিছুদিন বাদে রঞ্জিতবাবু দিল্লি এলেন। অনিকেতের ফ্ল্যাটে রাতের খাবার খেয়ে ওনার আকাশ গঙ্গা নিয়ে গেলেন। বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও এক ফোঁটা হুইস্কি নিলেন না।মাসখানেক বাদে অনিকেতের ফোন পেলাম। রঞ্জিতবাবু জানিয়েছেন ওনার আকাশ গঙ্গা কলকাতায় চার লাখে বিক্রি হয়েছে।
 

অনুবাদ

আশায় উৎফুল্ল

প্রাণ
লক্ষ্মীনাথ ফুকন

মূল অসমিয়া থেকে অনুবাদ: বাসুদেব দাস

download.jpg
আশায় উৎফুল্ল

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

fukon.jpg

লেখক পরিচিতি- আবাহন যুগের অন্যতম গল্পকার লক্ষ্মীনাথ ফুকন ১৮৯৭ সনে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯১৮ সনে প্রকাশিত ছোটো গল্পের সংকলন ‘মালা’র মধ্য দিয়ে সাহিত্য জগতে আবির্ভাব। ‘ওফাইডাং’ এবং ‘মরমের মাধুরী’ দুটি গল্পের সংকলন। ‘টাইপিষ্টের জীবন’, ’মেধি’ লেখকের সুখপাঠ্য গল্প। লেখকের গল্পে সমাজের প্রতি এক বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ্য করা যায়। 

fukon.jpg
BasudevDas.jpg

অনুবাদক পরিচিতি - ১৯৫৮ সনে অসমের নগাঁও জেলার যমুনামুখে বাসুদেব দাসের জন্ম হয়। ১৯৮২ সনে গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্য ও ভাষাতত্ত্বে এম এ করেন। আজ পর্যন্ত অসমিয়া অনূদিত গল্পের সংখ্যা পাঁচশত কুড়িটির ও বেশি। সরকারি চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে নিয়মিতভাবে অসমিয়া গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ এবং উপন্যাস অনুবাদ করে চলেছেন। গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপরিচিত সংস্থা NEINADএর পক্ষ থেকে অসমিয়া ভাষা-সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসারের জন্য Distinguished Life Membership এর দ্বারা সম্মানিত করা হয়। প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা তেতাল্লিশটি। হোমেন বরগোহাঞির অসমিয়া উপন্যাস ‘সাউদর পুতেকে নাও মেলি যায়’ (সওদাগরের পুত্র নৌকা বেয়ে যায়) বাংলা অনুবাদের জন্য ২০২৪ সনের সাহিত্য আকাদেমি অনুবাদ পুরস্কারে সম্মানিত হন।

(১)
মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তৃতীয় মহলের পাঁচ নম্বর ঘরটার জানালা থেকে সামনের দিকে তাকালে দেখা যায় ব্রহ্মপুত্রের ধীর স্থির বিস্তারিত জলধারা এবং তার ডান দিকে দূরে বালির উপরে মন্দির এবং গাছপালা ঘিরে রাখা পাহাড়ের শ্রেণি। জয়শ্রী চেয়ারটা জানালার কাছে টেনে নিয়ে তাতে বসে বাইরের এই মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখতে থাকল। যত দেখল ততই জয়শ্রী অভিভূত হয়ে পড়ল। সকালের কোমলতায় চারদিক পরিপূর্ণ। কিছু একটা কোমল অলসতারভাবে পাথরে বাঁধানো ট্রেন্ড রোডটা বিভোর। এখন ও ব্যস্ততা উচ্ছলিত হয়ে ওঠেনি।
আজকের সকালটা জয়শ্রীর খুব ভালো লাগছে। জয়শ্রীর শরীরটাও আজ অন্যান্য দিনের চেয়ে ভালো লাগছে। আজ জয়শ্রীর মনটাও আগের চেয়ে অনেক বেশি উৎফুল্ল। গতকাল প্রণবেশ্বর তাকে খবরটা দিয়েছে। যে খবরের জন্য জয়শ্রী ছটফট করছিল, যে খবরের সঙ্গে জয়শ্রীর জীবন মরণের সম্পর্ক, যে খবরটা এতদিন না পেয়ে জয়শ্রীর উৎকণ্ঠার সীমা ছিল না, সেই পরম সুখের খবরটা জয়শ্রী গতকাল পেয়েছে। সে পাবে বলে ভাবেই নি। আনন্দে জয়শ্রীর ভালো করে ঘুম হল না। ভালো করে ঘুম না হলে ও জয়শ্রী আজ সুস্থ, এতটা সুস্থ সে আগে কোনোদিন অনুভব করেনি।
বাঁদিকে নিচে দুটিকে দুটি টিনের ঘরের মধ্যে এক টুকরো মসৃণ ঘাস। উপর থেকে সবুজ কার্পেটের মতো দেখায়। ঘাসের উপর দিয়ে একদল ছেলে মেয়ে। মেয়েদের মধ্যে দুজন যুবতী, যুবতী না হলে ও শাড়ি পড়ে এসেছে দুজনেই, নাকের ফুল দূর থেকেই ঝলমল করছে, পিঠে বেণী ঝুলছে। নিশ্চয় মাড়োয়ারি মেয়ে। ওরা সেখানটাতে বসল। ওরা বসে কি করছে? দুব্বো বন ছিঁড়ছে দেখছি। হাতে হাতে করে এক মুঠো দুব্বো নিয়ে ওরা যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকেই ফিরে গেল।
আশার প্রতীক এই ছেলে-মেয়েদের কী মধুর ভাব কী মধুর ভঙ্গি। জয়শ্রী ওদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। ওরা যে দুব্বোগুলি নিয়েছে সেগুলি দিয়ে কী করবে? নিশ্চয় ওরা খরগোস পুষছে, সেইজন্যই দুব্বো জোগাড় করার জন্য সকালে ওদের এই অভিযান। এখন সেই মেয়ে দুটি গিয়ে খরগোসকে দুব্বো ঘাস খাওয়াবে, আদর করবে। জয়শ্রীর মনে হল এভাবেই কণ্বমুনির আশ্রমে শকুন্তলাও হরিণশিশুটিকে আলগোছে ঘাস খাইয়েছিল এবং কণ্ব মুনির আশ্রমে শকুন্তলা দূষ্মন্তকে এবং দুষ্মন্ত শকুন্তলাকে মনপ্রাণ বিলিয়ে দিয়েছিল যেভাবে গতকাল বিলিয়ে দিয়েছিল জয়শ্রী প্রণবেশ্বরকে এবং প্রণবেশ্বর জয়শ্রীকে।
জানালাটার নিচে কয়েকটি কাক কলরব করছিল। জয়শ্রী তিনটি বিস্কুট টিন থেকে বের করে এনে ভেঙে ভেঙে ওদের দিকে টুকরো টুকরো করে ছুঁড়ে দিল। বিস্কুটের টুকরোটা মাটিটা পড়া মাত্র কাক এসে ঠোঁটে করে কামড়ে বিস্কুটগুলি নিয়ে সেখান থেকে একটু দূরে সরে যায় এবং পা দিয়ে মাটিতে চেপে ধরে একটু একটু করে খায়। বিস্কুট খেতে পেয়ে কাকদের মধ্যে যে আনন্দ স্ফুর্তি ওদের বিস্কুট খেতে দিয়ে জয়শ্রীর আনন্দ তারচেয়ে অনেক বেশি।  

   
(২)
আজ কখন এসে প্রণবেশ্বর উপস্থিত হল। মানসিক অস্থিরতার জন্য গতকাল জয়শ্রী প্রণবেশ্বরকে জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেছে সে কখন আসবে, সকালে না বিকেলে।সে হাসপাতালে আসার পর থেকে প্রণবেশ্বর তার কাছে রোজই আসছে, আজও নিশ্চয় আসবে। আজ প্রণবেশ্বরকে জয়শ্রীর আরও ভালো লাগবে। প্রণবেশ্বরকে সবসময়ই জয়শ্রীর ভালো লাগে, সেই সেদিন থেকে যেদিন সে বুঝতে পেরেছে প্রণবেশ্বর তার দিকে তাকানোর সময় তার চোখে প্রকাশ পায় এক নতুন ধরনের দীপ্তি এবং তার সঙ্গে কথা বলার সময় তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে লজ্জা সংকোচ আনন্দলতায় মিশ্রিত অপূর্ব শ্রী। 
তেজপুরের পিসির বাড়িতে গিয়েছিল জয়শ্রী। সেখানে এই পর্বের সূত্রপাত। এমনিতে দুষ্টু প্রণব। তাকে সেদিন সেখানে নিঃসঙ্গ পেয়ে প্রণবেশ্বর তাকে জড়িয়ে ধরল। সে নিশ্চয় সুযোগ খুঁজে বেড়াচ্ছিল। কিন্তু সে কি শপথ খেয়ে বলতে পারবে যে সেও তাকে সেই সুযোগ করে দেয় নি।জড়িয়ে ধরার সময় সে কেন বাধা দিল না? সে কেন সেখান থেকে ছিটকে বেরিয়ে গেল না? জয়শ্রী প্রণবেশ্বরকে অন্তত কেন বলল না, এসব ভালো নয় আমি পিসিকে বলে দেব।’ কিন্তু তার মুখে কোনো কথা জোগাল না। জয়শ্রীর মুখে কথা নাই হয়ে গেল, তার গাল মুখ তপ্ত নিঃশ্বাসে গরম হয়ে উঠল।
দুয়েকদিন জয়শ্রী প্রণবেশ্বরের দিকে ভালোভাবে তাকাতেই পারল না। কিন্তু তার দিকে তাকাতে না পারলেও তার খুব ইচ্ছা করছিল প্রণবেশ্বরের কাছাকাছি থাকার জন্য, তার আশেপাশে ছায়ার মতো ঘুরে বেড়াতে। পিসনের মামার ছেলে প্রণবেশ্বর।তাঁদের ঘর থেকে ছয়মাইলের মতো দূরে ওদের বাড়ি হলেও দুটো বাড়ির ভেতরে আগে থেকেই আসা-যাওয়া ছিল। প্রণবেশ্বর প্রায় প্রতিদিনই আসে, এখন আসা যাওয়া আরও বেশি হল। মোহন-মদিরা মাখানো দিনগুলি কীভাবে যে পার হয়ে গেল জয়শ্রী বলতেই পারে না; কলেজ খোলার আগে আগে তাকে গুয়াহাটিতে ফিরে আসতে হল।জয়শ্রীর দিনগুলি এখন আর পার হতে চায় না। কিন্তু তার প্রতি বিধি প্রসন্ন। কয়েকমাস পরে প্রণবেশ্বর গুয়াহাটিতে লেকচারার হয়ে এল। তেজপুরে বিল্ব-ষষ্ঠী হয়েছিল গুয়াহাটিতে প্রতিমার প্রাণ প্রতিষ্ঠা হল। যুবক-যুবতীর মন অনেক সময় বুড়ো মানুষরা বুঝেও বুঝতে পারে না। প্রণবেশ্বরের পিতা বাধা হয়ে দাঁড়াল। তারা আর্জি ঠিকমতোই নিয়ে গিয়েছিল, সেই আর্জি তিনি মঞ্জু্র করলেন না। তাঁর মতে প্রণবেশ্বরের মতো বুদ্ধিমান এবং গুণী ছেলে হাজারের ভেতর একটা পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ আছে; কীভাবে যে এম এ তে প্রথম শ্রেণির পরিবর্তে সে দ্বিতীয় শ্রেণী পেল তিনি ভেবে কোনো কুল কিনারা পাচ্ছেন না; হয় পরীক্ষকের কোনো ভুল হয়েছে, নতুবা পরীক্ষক তাকে হিংসার জন্যই হিংসা করেছে; সে এখন কলেজের লেকচারার হয়েছে ঠিক আছে; কিন্তু সে লেকচারার হয়ে থেমে গেলে চলবে না, তাকে আই এ এস পরীক্ষা দিতে হবে। বাবা ইতিমধ্যে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে- প্রণবেশ্বর আই-এ-এস পাশ করে দায়িত্বপূর্ণ পদে যোগদান করবে এবং তারপরে রাজকন্যার সঙ্গে অর্ধরাজ্যের অধিকারী হবে। এরকম একজন মেয়ের কথা তিনি ভেবে রেখেছেন, সময় হলেই প্রস্তাব পাঠাবেন। প্রস্তাব তাকে কেনই বা পাঠাতে হবে? সে শুধু আই-এ-এসের জন্য নির্বাচিত হোক, প্রস্তাব এমনিতেই আসবে। প্রণবেশ্বরের বাবা ভাবেন আর মুচকি মুচকি হাসেন।
প্রাণের আবেগ ঢেলে প্রণবেশ্বর মাকে লিখেছিল,‘জয়শ্রীকে বিয়ে করতে না পারলে আমার জীবন একেবারে মরুভূমি হয়ে যাবে।’ মা বাবাকে কথাটা বলায় বাবা বিদ্রূপের সুরে বললেন, ‘জীবন মরুভূমি হয়ে যাবে!’ আই-এ-এস হতে না পারলেই জীবন মরুভূমি হয়ে যাবে। জয়শ্রী বা মঞ্জুশ্রী কোনো একজনকে বিয়ে করতে না পারলে জীবন মরুভূমি হয়ে যায় না, রাজকন্যা বিয়ে করতে না পারলেও নয়।’। এরপরেও মা ছেলের হয়ে ওকালতি করতে যেতেই তিনি আদেশের সুরে বললেন, ‘তুমি ওর কাছে চিঠি লিখে পাঠাও জয়শ্রী মঞ্জুশ্রীর চিন্তা ছেড়ে আইএস পরীক্ষাটা পাস করার জন্য উঠে পড়ে লাগতে, আগে আইএস পা্‌শ তারপরে বিয়ের চিন্তা।’
বাবার আদেশ মায়ের চিঠিতে পেয়ে প্রণবেশ্বরের মন বিদ্রোহী হয়ে উঠল। প্রণবেশ্বর জয়শ্রীকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে কী বলেছিল তার এখনও ভালোভাবে মনে আছে। প্রণবেশ্বর বলেছিল– ‘আইএস পরীক্ষা দিতে হবে। আমি আইএস পরীক্ষা দেব না, তুমি কোনো ভয় করবে না জয়শ্রী। আমি তোমাকেই বিয়ে করব, করব যখন বলেছি করবই। বাবা নিষেধ করলেও করব। প্রয়োজন দেখলে এখান থেকে কোথাও চলে যাব, কলকাতা দিল্লি বা মুম্বাই, সেখানে গিয়ে দুজনে সংসার পাতব।’
প্রণবেশ্বরের মনের উত্তাপ শুনে এবং বুকের উত্তাপ বুঝে জয়শ্রী অভিভূত হয়ে পড়েছিল।

(৩)

খাসিয়ানী নার্সটি তার চেয়ে বয়সে  বড়ো। রিহা মেখেলা পরা আয়ার সঙ্গে মিলে বিছানাটা  ঝেড়ে সুন্দর করে পেতে দিয়ে গেল। জয়শ্রী চেয়ার থেকে এসে বিছানায় শুয়ে পড়ল, দুই মিনিটের মতো পড়ে রইল, তারপরে একটা বালিশ বুকে জড়িয়ে নিয়ে মাথাটা কাত করে চোখ দুটি বুজে নিল।জয়শ্রীর বন্ধ চোখ আবার খুলে গেল। বিছানা থেকে চট করে জয়শ্রী উঠে বসল, খোপাটা টান করে বাধল, বেঁধে আবার খুলে ফেলল, খুলে চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়াল, আর বাড়ি থেকে নিয়ে আসা ছোটো আয়নাটাতে মুখ দেখল। গাল দুটি সে ভালো করে টিপল; গাল দুটি এখনও আগের মতোই কোমল, কিন্তু গাল দুটির রং এখন আর আগের মতো নেই, যদিও ফ্যাকাশে ভাবটা আগের চেয়ে অনেক কমেছে। কয়েকদিনের মধ্যে সে আগের মতো সুস্থ হয়ে উঠবে বলে জয়শ্রীর বিশ্বাস হল।অসুখে পড়ে জয়শ্রীকে খুব ভুগতে হল। জন্ডিসে ভোগে তার যা চেহারা হয়েছিল। প্রণবেশ্বরই শলা পরামর্শ দিয়ে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করে দিল। বাড়িতে থাকলে এত দ্রুত তার এতখানি উন্নতি নিশ্চয় হত না। সেদিন ডাক্তার গোস্বামী প্রণবেশ্বরকে বলতে সে নিজে শুনেছে ‘আপনি হাসপাতালে নিয়ে এসে খুব ভালো কাজ করেছেন, হাসপাতালে ভর্তি হতে দেরি হলে সুস্থ হতেও দেরি হত। এখন আর কোনো চিন্তা নেই। কয়েকদিনের মধ্যেই মিসেস দুয়ারা একেবারে সুস্থ সবল হয়ে উঠবে।’ প্রণবেশ্বর ডাক্তার গোস্বামীর ভুলটা শুধরে দিলেন, ‘মিসেস দুয়ারা নয়, মিস ফুকন।’ ডাক্তার গোস্বামী এবং প্রণবেশ্বর হয়তো ভেবেছিল জয়শ্রী কোনো কিছু শুনেনি। জয়শ্রী বিছানায় চোখ বুজে পড়েছিল এবং তারা তাই জয়শ্রী ঘুমিয়ে পড়েছে বলে ভেবে ধীরে ধীরে বারান্দায় কথা বলছিল। ডাক্তার গোস্বামী বললেন, ‘এখন  মিস ফুকন হলেও, মিসেস দুয়ারা হতে আর বেশি দিন বাকি নে্‌ই, কী বলেন?’ শুনে জয়শ্রী চোখ দুটো খুলে পুনরায় বন্ধ করে দিয়েছিল এবং কানদুটি সজাগ করে রেখেছিল উত্তরে প্রণবেশ্বর কী বলে তা শোনার জন্য। কিন্তু প্রণবেশ্বর কিছুই বলল না।কিছুই না বললেও প্রণবেশ্বরের চোখ আর মুখের হাসি অনেক কিছু বলল। ডাক্তার গোস্বামী বললেন, ‘হাত দিন।’ দুজনেই যে সেখানে দুজনের হাত ঝাঁকালেন জয়শ্রী বিছানা থেকে বুঝতে পারল। যাবার সময় ডাক্তার গোস্বামী  প্রণবেশ্বরকে বলে গেল, ‘বিয়েতে নিমন্ত্রণ করতে ভুলে যাবেন না।’ ‘কেন ভুলে যাব? কখনও ভুলব না।’ জ্যোতির্ময় ভেতরে এল। বাড়ি থেকে সে টিফিন কেরিয়ারে দিদির জন্য ভাত নিয়ে এসছিল। ভাইকে দেখে জয়শ্রীর হুঁশ এল, আর বুঝতে পারল যে অনেক বেলা হয়ে গেছে। এখনও যখন প্রণবেশ্বর এল না, এই বেলা আর আসার আশা নেই। সকালে এলে এর আগে প্রণবেশ্বর চলে আসে আর নিজে সামনে থেকে তাকে ভাত খাওয়ায়। ঘী মসলা না থাকা মাংস বা মাছের তরকারি তার খেতে ভালো না লাগলেও প্রণবেশ্বরের কাকুতি মিনতিতে তাকে খেতে হয়। প্রণবেশ্বর বলে, ‘শরীর ভালো না থাকলে আমার সঙ্গে কীভাবে পালিয়ে যাবে? খেয়ে দেয়ে শরীরটাকে মজবুত করে নাও।’ জয়শ্রী খেতে আর কোনোরকম আপত্তি করে না। খেতে বলার জন্য প্রণবেশ্বর না থাকায় আজ জয়শ্রীর ভালো করে খাওয়াই হল না। ভাই বলল–

’মনোযোগের অভাব কেন, ভালো করে খাওয়া দাওয়া করছিস না কেন?’ কিন্তু ভাইয়ের কথা তার কানে মধু বর্ষণ করল না। কোনো একটি কথা একজন বললে যতটা ভালো লাগে অন্য একজন বললে ততটা ভালো লাগেনা, মানুষ ভেদে কথারও স্বাদ কমে মূল্যও কমে। জ্যোতির্ময়ও বুঝতে পারে তার কথায় জয়শ্রী খুব একটা গুরুত্ব দেয় না, তথাপি সে না বলে থাকতে পারল না। ‘স্বাদ-গন্ধ কিছু নেই, এসব খেতে হবে। খাব না যা।’ ঘর থেকে বেরোতে গিয়ে জ্যোতির্ময় থমকে দাঁড়িয়ে দিদিকে বলল– ’তোকে বলতে ভুলে গেছি। প্রণব দাদা আজ সকালে উত্তর গুয়াহাটিতে দিদির বাড়িতে গিয়েছে। তোকে বলতে বলে গিয়েছে। আজ নাকি নাও ফিরতে পারে। কিন্তু আগামীকাল নিশ্চয় ফিরে আসবে, সম্ভব হলে সকালেই, না হলে বিকেলে।’   

‘এই কথাটা আগে কেন বলিস নি?’ --জয়শ্রীর মনের কথাটা অপ্রকাশিত থেকে গেল।

(৪)
আগের দিনের কথাগুলি জয়শ্রীর বারবার মনে পড়তে লাগল। প্রনবেশ্বরকে এতটা আনন্দিত সে বহুদিন দেখেনি। তার চোখে মুখে জ্বলজ্বল করছিল পশ্চিম আকাশের সিঁদুরে আলোর রেশ।
জয়শ্রীকে প্রণবেশ্বর জিজ্ঞেস করল, ’আজ দেখছি  খুব স্ফুর্তি। কারণটা কি?’
‘স্ফুর্তি হওয়ার কথাই। একটা ভালো খবর পেয়েছি।’
‘কী ভালো খবর?’
‘বলতো ভালো খবরটা কি? আমি দেখি বলতে পার কি পার না।’
জয়শ্রী বাঁ গালটা বাঁ হাতের তালুতে রেখে বুড়ো আঙ্গুলটা দিয়ে থুতনিটা চেপে ধরে চোখ বড়ো করে কিছু একটা ভাবছে এমন একটা ভাব করে বলল ’তুমি দিল্লিতে সেই যে ভালো কাজটার জন্য দরখাস্ত করেছিলে তার খবর। তোমাকে কাজ করার জন্য ডেকে পাঠিয়েছে? ভালোই হবে, দিল্লিতে থাকতে ভালো লাগবে আমার।’
‘তুমি আমাকে হাসালে। কাজের খবর নয়। তার চেয়েও ভালো খবর। বল, আর ও একবার চেষ্টা করে দেখ।’
জয়শ্রী পুনরায় ভাবল। ঘরের ভিতরে এক পা দু পা করে এদিক থেকে ওদিকে ঘোরাঘুরি করতে লাগল। দুবারের মতো ঘোরাঘুরি করে বেণীটার সম্মুখভাগটা সে চেয়ারে বসে থেকে তাঁর রূপ সুধা পান করা প্রণবেশ্বরের গালে হালকা করে বুলিয়ে দিল। চঞ্চলা অসমিয়া নার্সটি পর্দা তুলে ভেতরে ঢুকতে গিয়ে জিহ্বায় কামড় দিয়ে অপ্রস্তুত অবস্থায় সেখান থেকে সরে গেল। 
প্রণবেশ্বরের মুখের দিকে তাকিয়ে জয়শ্রী জিজ্ঞেস করল’ কাজের খবর নয় যদি আর কীসের ভালো খবর? গল্প, উপন্যাস, কবিতা বা অন্য কোনো ধরনের বই এখনও তুমি লেখনি যে সাহিত্য আকাদেমি থেকে তোমাকে পুরস্কার দেবে; সরকারের শুভদৃষ্টি ও তোমার উপরে পড়েনি যে তুমি পদ্মশ্রী বা পদ্মভূষণ পাবে।’
‘পদ্মভূষণ না হলেও জয়শ্রীভূষণ তো হতে পারি? জয়শ্রীভূষণই হয়েছি আমি।’
‘আমি তোমার এই ধরনের প্যাঁচালো কথা বুঝতে পারিনা। আমাকে বুঝিয়ে বল।’
প্রনবেশ্বর জয়শ্রীর গালে আস্তে করে একটা টোকা মেরে বলল, ’আজ মায়ের চিঠি পেয়েছি। দীর্ঘ চিঠি।’
‘মায়ের চিঠি। দেখি কোথায়। চিঠিতে মা কী লিখেছে?’
প্রণবেশ্বর পকেটের মধ্যে চিঠিটা নাড়াচাড়া করতে থাকল, বের করে আনল না। সে বলে গেল, ’মা অনেক কথাই লিখেছে। শহরের কাছে থাকা আমাদের কয়েক বিঘা মাটি সরকার নিয়েছে, তার মূল্য নব্বই হাজার টাকা কিছুদিন আগে পেয়েছে, নতুন করে বাড়িটা সাজাতে চাইছে। বোনের একটি ছেলে হয়েছে, এটাই প্রথম সন্তান, আমাদের বাড়িতে এখন মা-ছেলে ভালোই আছে। বাবা আমাকে পড়ানোর জন্য বিলেত পাঠানোর কথা ভাবছে, কিন্তু একেবারে বিয়ে করে স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে। অবিবাহিত অবস্থায় সেখানে যাওয়াটা নাকি ভয়ের কথা। বিয়ে করে এখানে ছেলেমেয়ে রেখে বিলেত গিয়ে যুবক ডাক্তার একজন যে বিলেতে স্বামী ত্যাগী কোনো একটি মহিলাকে বিয়ে করেছে সেটাও মা চিঠিতে লিখেছে।’
জয়শ্রী খপ করে বলে উঠল, ’যাক তাহলে বিয়ে করে বউ নিয়ে বিলেতে যাও। পাত্রী নিশ্চয় ঠিক হয়ে গেছে।’
‘হ্যাঁ, পাত্রী ঠিক হয়ে গেছে।’
‘যাক তাহলে বিয়ে কর গিয়ে।আমার এখানে তাহলে কেন এসেছ?’
‘তোমার কাছে না এসে কার কাছে যাব?’
‘বিয়ে ঠিক হওয়া পাত্রীর কাছে।’
প্রণবেশ্বর ডান হাতের আঙ্গুলগুলি জয়শ্রীর আঙ্গুল গুলির ফাঁকে ফাঁকে ঢুকিয়ে মুঠো করে ধরে বলল,’বিয়ে ঠিক হওয়া পাত্রীর কাছেই তো এসেছি। মা লিখেছে, বাবা রাজি হয়েছে। এখন আর কোনো চিন্তা নেই।’
‘বাবা কীভাবে রাজি হল? আগে তো সম্পূর্ণ বিরোধী ছিলেন।’
প্রণবেশ্বর পকেট থেকে মায়ের চিঠিটা বের করে জয়শ্রীর হাতে দিয়ে বলল– ’এটা পড়ে দেখ, তাহলেই বুঝতে পারবে মা কীভাবে বাবার মনের পরিবর্তন ঘটিয়েছে। বুঝেছ জয়শ্রী ছেলের জন্য মা করতে পারে না এমন কোনো কাজ নেই।’


(৫)
সেদিন প্রণবেশ্বর আসবে না, ভাই জয়শ্রীকে বলে গেছে। জয়শ্রী বাড়ি থেকে নিয়ে আসা উপন্যাসটা পড়ার জন্য মেলে ধরল। এই কয়েকদিনে উপন্যাসটা শেষ হয়ে যাওয়া উচিত ছিল, কিন্তু জয়শ্রী অর্ধেকের বেশি পড়তে পারেনি। কীভাবে পারবে? জয়শ্রীর চোখ বইয়ের পাতাতে থাকলেও মন কোনো এক স্বপ্নপুরীতে ঘুরে বেড়ায়।
চিঠিতে মা প্রণবেশ্বরকে লিখেছে বাড়িটা দুই মাসের মধ্যে তৈরি হয়ে যাবে, আর বাড়ি তৈরি হলেই বিয়ের অনুষ্ঠান করা হবে। এখন চৈত্র মাস, তাহলে জৈষ্ঠ মাসে না হলেও আষাঢ় মাসে বিয়ে হবেই। জৈষ্ঠ মাসে না হয়ে আষাঢ় মাসে হওয়াই ভালো। আষাঢ় মাসটিতে মাদকতা আছে। এমনিতেই কী আর কালিদাস ’আষাঢ়ষ্য প্রথম দিবসে’বলেছেন? বর্ষার পরিবেশ, হয়তো ভালোভাবেই বৃষ্টি হবে। হলে হবে, সেই জন্য কী আর বিয়ে আটকে থাকবে? 
এই কয়েক মাসের মধ্যে এতটা ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েছে জয়শ্রী, কত আলাপ আলোচনা, হাসি-ঠাট্টা করেছে। এতটা না হলেই ভালো ছিল কি? প্রণবেশ্বর যদি একেবারে অপরিচিত হত তার সঙ্গে বিয়ে হলে কেমন লাগত? এখনের চেয়ে বেশি ভালো লাগতো নাকি কম ভালো লাগত? একটা কথা ঠিক, প্রণবেশ্বরের প্রতি তখন তার একটা সংকোচের ভাব ছিল, এখনও প্রথম রাতে প্রণবেশ্বরের প্রতি তার লজ্জার ভাবই থাকবে। প্রণবেশ্বর যেন তার কাছেই রয়েছে, এরকম একটা ভাবে সে ডান হাতের তালু দিয়ে চোখ দুটি ঢেকে নিল। 
বিয়ের পরে মধুচন্দ্রযাপন করার জন্য তারা কোথাও যাবে। কোথায় যাবে? কলকাতা, দিল্লি, মুম্বাই, মাদ্রাজ? না দার্জিলিং, নৈনিতাল, শিমলা, কাশ্মীর? কাশ্মীরে যাওয়াটাই সবচেয়ে ভালো হবে। যাবার সময় একদিনের জন্য হলেও আগ্রায় থেকে তাজমহল দেখে যেতে হবে। মনের আনন্দে জয়শ্রী গেয়ে উঠল, ’এক বিন্দু নয়নের জল, শুভ্র সমুজ্জ্বল, হে তাজমহল।’ সম্রাজ্ঞী মমতাজের প্রতি সম্রাট শাহজাহানের গভীর প্রেমের নিদর্শন এই তাজমহল। শুধু কি তাই? তাজমহল মোগল সম্রাটের সৌন্দর্য লিপ্সা, ঐশ্বর্য বিভূতি, আত্ম গরিমার জ্বলন্ত প্রতীক। তাজমহলের গায়ে হেলান দিয়ে তারা একটি ফোটো তুলবে, আরও একটি ফোটো তুলতে হবে তাজমহলের পাশের ঘাসে দুজনে বসে, জয়শ্রী বসে আর প্রণবেশ্বর জয়শ্রীর কোলে মাথা রেখে শুয়ে।
কিন্তু শুধুমাত্র তাজমহল দেখেই জয়শ্রীর কখনও আশ মিটবে না। অজন্তায় যেতে হবে। অজন্তা না দেখলে চলবে না, সমস্ত কিছু দেখার সার্থকতা লাভ করবে অজন্তা দেখার পরে। জয়শ্রীর মনে পড়ল প্রণবেশ্বর সেদিন বলেছিল কোনো একজন ইংরেজ মনীষীর মতে তাজমহলের চেয়ে অজন্তা বেশি চমকপ্রদ এবং অতীত ভারতের সৃষ্টি এবং সভ্যতার অপূর্ব নিদর্শন। মধুচন্দ্রিকায় যেতে যদি ওদের অজন্তায় যাওয়া না হয়, তাহলে পরে  ওরা একবার  অজন্তায় যাবে, নিশ্চয় যাবে, না গিয়ে থাকবে না। ওরা তো বিলেত যাবেই। তখনই দুদিন হাতে রেখে অজন্তায় একবার ঢুঁ মেরে এসে বিলেতের জাহাজে উঠবে। বিলেতে যদি তাদের কেউ জিজ্ঞেস করে অজন্তা দেখেছ কি তখন দেখিনি বলতে, জয়শ্রীর ভীষণ লজ্জা লাগবে যে।
বিলেত থেকে প্রণবেশ্বর পড়াশোনায় নাম করে ডিগ্রি নিয়ে ফিরে আসবে। জয়শ্রী ও সেখানে বসে বসে দিন কাটাবে না। তাকেও কিছু একটা করতে হবে। সে কাজ করবে। বিলেতে কাজ পাওয়া আমাদের এখানকার চেয়ে নাকি সহজ। কাজ করার সঙ্গে সঙ্গে কিছু একটা নিয়ে সে পড়াশোনাও করবে। কিন্তু বেশি পরিশ্রম তার সহ্য হয় না। তাকে যেকোনো কিছু একটা করতে হবে। সে অন্যান্য কাজেরও সুযোগ পাবে। তাকে ছোটো একটি সোয়েটার বুনতে হবে, আর বুনতে হবে ছোটো দেখে উলের মোজা। সোনার টুকরো একটা ছোটো শিশু আসবে যে তাদের সংসারে।
পাশেই বাইরে কোথাও একটা পাখি কলরব করে উঠল; কেউ উলু দিল বলে জয়শ্রীর মনে হল।


(৬)
আগের দিনের মতোই পরের দিন সকালে জয়শ্রী জানালাটার পাশে চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসে বাইরের দিকে তাকাল। তার চোখ গিয়ে কর্মনাশায় পড়তেই সে চেয়ারটা একটু ঘুরিয়ে নিল এবং এবার চোখের দৃষ্টি এনে অশ্বক্লান্ত মন্দিরে স্থাপন করল। কৃষ্ণ কুণ্ডিল নগর থেকে রুক্সীণিকে হরণ করে এনে এই পাহাড়ের সমতলে নাকি বিশ্রাম নিয়েছিল এবং সেই জন্যই এর অশ্বক্লান্ত নাম। কথাটা মনে পড়া মাত্র জয়শ্রীর ভালো লাগল।
জানালাটার ওপরে ডাল পাতাহীন শুকনো একটা খেজুর গাছ। গাছটার জীর্ণশীর্ণ মাথায় বসে নীল বর্ণের পাখি গলা মেলে এদিক ওদিকে তাকিয়ে ছিল। কী ধরনের পাখি জয়শ্রী বুঝতে পারল না। কিছুক্ষণ পরে একই ধরনের অন্য একটি পাখি এসে সেখানে বসে এটার সঙ্গে জোড়া বাঁধল। ওদের ভালোবাসার বাতাস লেগে গাছটা হেলতে লাগল। একটা পাখি উড়ে গেল, অপরটিও তাকে অনুসরণ করল। 
জয়শ্রী হাত ঘড়িটার দিকে তাকাল। দশটা বেজে গেছে। প্রণবেশ্বর এখনই এসে উপস্থিত হবে। গতকাল উত্তর গুয়াহাটি থেকে ফিরে আসেনি যদিও আজ সকালে সে নিশ্চয় গুয়াহাটি ফিরে এসেছে। দিদি হয়তো গতকাল আদর-যত্ন করে ভাইকে রেখে দিয়েছে, সেই জন্যই আসতে পারেনি। প্রণবেশ্বরের এই দিদি বড়ো আদরের। দিদির কাছে প্রণবেশ্বর প্রায়ই জয়শ্রীর প্রসঙ্গ উত্থাপন করে। দিদি হয়তো জিজ্ঞেস করছে ’ভাইয়ের বউ দেখতে কেমন?’ ভাই কী উত্তর দিতে পারে? বলেছে কি, ’আমি কি আর যাকে তাকে পছন্দ করার মতো মানুষ?’ দিদি তবুও জিজ্ঞেস করছে, ’বলতো কেমন, দেখতে কার মতো।’ এবার প্রণবেশ্বর বলছে, ’কেমন–দেখতে পাবিই তো, বিয়ের আর বেশি দিন বাকি নেই।’
দরজার পর্দাটা নড়ে উঠল। কিন্তু প্রণবেশ্বর ভেতরে এল না। ভেতরে এল জয়শ্রীর মা এবং অন্য একজন বয়স্ক মহিলা। জয়শ্রী চট করে উঠে দাঁড়িয়ে চেয়ারটা মহিলাটির দিকে এগিয়ে দিল। 
মা জিজ্ঞেস করল, ‘অশোক শইকীয়াকে জানিস?’
‘জানি, ইএসি হওয়ার আগে আমাদের কলেজে কিছুদিন প্রফেসার ছিলেন, আমাদের ইতিহাস পড়াতেন।’
‘ইনি অশোকের মা। অশোকের বাবাও এসেছে।’
বাবার সঙ্গে গল্প করে আশ মিটছে না। তার মধ্যে দুজনই নাকি পুরোনো বন্ধু, অনেক বছর পরে দেখা হয়েছে। তুই এখন আমাদের সঙ্গে চল। আমরা তোকে নিয়ে যেতে এসেছি।’
একটু আশ্চর্য হয়েই যেন জয়শ্রী জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায়?’
‘বাড়িতে’।
‘এভাবে চল বললেই যাওয়া যায় না। হাসপাতাল থেকে ডিসচার্জ সার্টিফিকেট নিতে হবে, টাকা পয়সা মিটিয়ে দিতে হবে, তারপরে।
‘সে সব আমরা ঠিক করে এসেছি। তুই এখন চল। উনারা আজ বিকেলেই চলে যাবেন। তার আগে তোকে আংটি পরিয়ে যেতে চায়। বৈশাখ মাসেই বিয়ে, অশোকের ও তাই ইচ্ছা।
জয়শ্রী পুনরায় একবার বাইরের দিকে তাকাল। ঝড়-তুফানে নদীটা আন্দোলিত হচ্ছে। ওপারের মন্দির পাহাড় এবং গাছপালা কিছুই দেখা যাচ্ছে না। নদীটা উপরের দিকে উঠে গিয়ে যেন আকাশকে স্পর্শ করছে। যেন আকাশটা নেমে এসে নদীর সঙ্গে এক হয়ে গেছে। নড়বড়ে ভাবে একটা নৌকা এগিয়ে যাচ্ছে,তুফানের কবলে পড়ে দিশাহারা হওয়া একটি নৌকা। নৌকাটা যেদিকে এগিয়ে চলেছে গন্তব্যে পৌছতে পারবে কি? না কি ঘাটেই থেকে যেতে হবে, কে জানে?
----------

প্রবন্ধ

রাজনৈতিক সাংবাদিকতার অগ্রদূত

হরিশচন্দ্র মুখার্জী

দিলীপ মজুমদার

পর্ণশ্রী, কলকাতা 

harishchandra.jpeg
অগ্রদূত হরিশচন্দ্র

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

বিখ্যাত ‘হিন্দু পেট্রিয়টে’র প্রবাদপ্রতিম সম্পাদক হরিশচন্দ্র মুখার্জী স্বনির্মিত ও স্বশিক্ষিত মানুষ। আপ্তবাক্যে বিশ্বাস তাঁর ছিল না, তিনি ছিলেন আদ্যন্ত যুক্তিবাদী। তৎকালীন সমাজ ও রাজনীতি বিষয়ে তাঁর সিদ্ধান্তের সঙ্গে আমরা একমত হই বা না হই, স্বীকার করতে হয় যে তিনি সংস্কারানুগ পথে বিচরণ করেন নি। হিন্দু কলেজে পড়ার সৌভাগ্য তাঁর হয় নি, এ দেশে যুক্তিবাদের দীক্ষাগুরু ডিরোজিওর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ পরিচয় ছিল না; কিন্তু তিনি মনে-প্রাণে ছিলেন ডিরোজিওর শিষ্য।
তাঁকে শুধু রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন মানুষ বলা সঠিক নয়; রাজনীতি ছিল তাঁর ধ্যান-জ্ঞান। এই রাজনীতির টানে তিনি ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’ পত্রিকার পরিচালনভার গ্রহণ করেছিলেন । বাক্যে ও আচরণে এই রকম নির্ভেজাল রাজনৈতিক মানুষ তাঁর সমকালে আর কেউ ছিলেন না। রামমোহন, দ্বারকানাথ, প্যারীচাঁদ প্রভৃতিরা রাজনৈতিক প্রসঙ্গ আলোচনা করেছেন; ইয়ং বেঙ্গল সম্প্রদায়ের সদস্যরা তাঁদের পত্রিকায় কখনও কখনও রাজনীতি বিষয়ে পর্যালোচনা করেছেন; কিন্তু হরিশ রাজনীতিচর্চা ব্যতীত অন্য কিছু করেন নি। তাই নিঃসন্দেহে তাঁকে এ দেশের রাজনৈতিক সাংবাদিকতার অগ্রদূত বলা যেতে পারে।
রাজনীতিচর্চার জন্য তিনি নিজেকে প্রস্তুত করেছিলেন একলব্যের মতো গভীর অধ্যবসায়ে । তাঁর রচনায় ইংরেজ অর্থনীতিবিদ জেমস উইলসনের উল্লেখ, লা মার্টিনের উদ্ধৃতি, চতুর্দশ লুই ও নেপোলিয়নের প্রসঙ্গ, ইজিপ্ট-পেরু-গ্রিসের ঐতিহাসিক প্রসঙ্গ, ফরাসি ও আমেরিকার বিপ্লবের উল্লেখ আছে। ‘সেন্ট্রাল স্টার’ ‘দ্য ফ্রেণ্ড অব ইণ্ডিয়া’, ‘দ্য ইংলিসম্যান’ , ‘দ্য মর্নিং স্টার’ , ‘দ্য এডিনবার্গ উইটনেস’, ‘দ্য ওয়েস্টমিনিস্টার রিভিউ’, ‘দ্য ঢাকা নিউজ’, ‘দ্য ম্যাড্রাস অ্যাথেনিয়াম’, ‘দ্য লিডার’ প্রভৃতি দেশি-বিদেশি পত্র-পত্রিকার তন্নিষ্ঠ পাঠক ছিলেন তিনি। সমকালীন সরকারি ঘোষণাপত্র ও দলিল-দস্তাবেজের সন্ধান করতেন; বিভিন্ন সভা-সমিতি এবং পার্লামেন্টের বিতর্ক তাঁর দৃষ্টিপথের অন্তর্গত ছিল। উনিশ শতকের প্রধমার্ধের শিক্ষিত বাঙালির মতো হরিশচন্দ্র ব্রিটিশ শাসনের ইতিবাচক দিকগুলি গ্রহণ করেছিলেন এ কথা সত্য কিন্তু ব্রিটিশ শাসন সম্বন্ধে তাঁর সংশয়ও ছিল।
তিনি বলেছেন হাউজ অব কমন্সে হয়তো ভারত দরদী কেউ কেউ আছেন, কিন্তু এইসব মানুষের ব্যক্তিগত দাক্ষিণ্যের উপর ভারতবাসী বাঁচতে পারে না। আরও স্পষ্ট করে তিনি বললেন ভারতবাসীর পরাধীনতাজনিত বেদনার কথা: ’There is not a single native of India who does not feel the full weight of the grievances imposed upon him by the very existence of the British rule in India’.
ইউরোপীয় সভ্যতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়েও ইংরেজের জাতিগর্ব ও তৎপ্রসূত বিভাজন নীতির তীব্র সমালোচনা করেছেন তিনি। তাঁর অসাধারণ একটি প্রবন্ধ ‘হু ইজ টু ব্লেম?’ এখানে তিনি বলেছেন ১] অনস্বীকার্য যে ইংরেজের প্রতি ভারতবাসীর গোপন অন্তরে সঞ্চিত আছে ক্ষোভ ও ঘৃণা---এর জন্য দায়ী কে?

২] ভারতবর্ষে শাসক ও শাসিতের মধ্যে পারস্পরিক বিদ্বেষের বিস্তৃতির জন্য দায়ী কে?

৩] ভারতের বর্তমান শাসকরা একদিন ঘৃণা করত নর্মানদের, আজ ভারতে তারা নিজেরাই ঘৃণার পাত্র, এর জন্য দায়ী কে?
আইনের ক্ষেত্রে ইউরোপীয় ও ভারতীয়দের বৈষম্যের কঠোর সমালোচনা করেছেন তিনি। এই বৈষম্যের উৎস যে সরকারি নীতি, সে কথাও স্পষ্ট করে তিনি বলেছেন। আক্রমণাত্মক 
অন্যায়কারীর প্রতিবিধান না হলে আইনের আড়ম্বর অর্থহীন বলে তিনি মনে করেন।

ইংরেজদের কালা-কানুন (ব্ল্যাক অ্যাক্ট) বিরোধী আন্দোলন এ দেশে জাতিবৈর সৃষ্টি করেছে।হরিশের মতে প্রশাসনিক ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদে ভারতীয়দের নিয়োগ করা দরকার, এতে বিভাজন যেমন কমবে তেমনি সরকারের অর্থনৈতিক সুবিধা হবে। হাইকোর্টে দেশীয় বিচারক নিয়োগ না করার পক্ষে ইংরেজরা যে সব যুক্তি উথ্থাপন করেছে, হরিশ সেগুলিকে কুযুক্তি বলেছেন। সমকালে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় ভারতীয়দের নিয়োগের যে দাবি উঠেছিল, হরিশ তাকে সমর্থন করেছেন এবং সমকালের সিভিল সার্ভিসের নীতি-নিয়ম, কার্যধারা, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে তিনি মধ্যযুগীয় বলে উল্লেখ করেছেন।‘ফেডারাইলেজেশন’, ‘দ্য ইণ্ডিয়ান ডেবেট’, ‘মিঃ ব্রাইট’স লাস্ট ইণ্ডিয়ান স্পিচ’ প্রভৃতি প্রবন্ধগুলি প্রমাণ করে যে হরিশ যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর কথা ভেবেছিলেন। তাঁর মতে ভারতবর্ষে একটি কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের ফলে:
ক] সমগ্র দেশ জুড়ে রাজনৈতিক স্থবিরতা সৃষ্টি হয়েছে,
খ] ভারতবাসীর নানা বৈচিত্র্যকে অস্বীকার করে সব প্রদেশে এক রকম নীতি-নিয়ম আরোপ করার চেষ্টা হয়েছে,
গ] শাসন ও বিচারবিভাগের মধ্যে সীমারেখা টানা হয় নি,
ঘ] অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নৈরাজ্যের সৃষ্ট হয়েছে ।
শুধু যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো নয়, প্রশাসনিক ক্ষেত্রে ভারতীয় জনতার প্রতিনিধিত্ব দাবি করেছেন হরিশচন্দ্র, বলেছেন: The time is nearly come when all Indian questions must be solved by the indian’.
সিপাহি বিদ্রোহের রাজনৈতিক তাৎপর্য  হরিশ উপলব্ধি করতে পারেন নি। সেটা সে কালের বিচারে সম্ভবও ছিল না। কিন্তু সে কালের অন্যান্য শিক্ষিত বাঙালির মতো এ ব্যাপারে ভীতিতাড়িত হন নি বা উপেক্ষাও করেন নি। তিনি তাঁর মতো করে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করেছিলেন। সুবেদার হায়দার আলির প্রবন্ধের উল্লেখ করে তিনি বললেন বিদ্রোহের কারণ শুধু জীবিকার ক্ষেত্রে হতাশা, অযোধ্যা অধিকার, চর্বি মাখানো কার্তুজ নয়; তার সঙ্গে প্রবলভাবে আছে জমি হারানোর ভীতি ও বেদনা – ‘ The Sepoys began to fear not only for their estate and their pay, but likewise for their lands. ’ এমন কি এই বিদ্রোহের গণচরিত্রের আভাসো তিনি দেখতে পেয়েছিলেন, ‘They have from the beginning drawn the sympathy of the country.’ দেশের সাধারণ মানুষ মনে করেছিল মহৎ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য এই সিপাহিরা শহিদের ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। সিপাহিদের অত্যাচার ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে ইংরেজরা অতিরঞ্জিত সংবাদ পরিবেশন করে বিশ্বজনমতকে যেভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছিল, হরিশ তার তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন। তিনি বিদ্রুপ করে বলেছিলেন যারা ইংরেজের চরিত্র জানে তারা ইংরেজের এহেন অতিরঞ্জনকে সহজে ধরে ফেলতে পারবে (…..’can not surprise those who have studied the English character’)।
নীল বিদ্রোহে হরিশচন্দ্র প্রত্যক্ষ ভূমিকা গ্রহণ করছিলেন। রামগোপাল সান্যাল বলেছেন যে হরিশের ভবানীপুরের বাড়ি হয়ে উঠেছিল নীল আন্দোলনের ‘ধর্মশালা’। দলে দলে নীল চাষিরা আসত তাঁর কাছে। তিনি তাদের অর্থসাহায্য করতেন, পরামর্শ দিতেন, আইনজীবী ঠিক করে দিতেন মামলা লড়বার জন্য। আর পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করে যেতেন নীলকরদের নানা অত্যাচারের কাহিনি। এই কাহিনি সংগ্রহের জন্য তিনি একদল শিক্ষিত সাংবাদিক তৈরি করেছিলেন। শেষে নীল কমিশনে জবানবন্দি দিতে গিয়ে তিনি নীলকরদের জঘন্য ভূমিকাকে অনাবৃত করে দিয়েছিলেন। এর জন্য তাঁকে চরম মূল্যও দিতে হয়েছিল।

 

***লেখক সেনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক***

গল্প

বুলেট ম্যানের

ডায়েরি 

ডাঃ রুদ্রজিৎ পাল

কসবা, কলকাতা 

family.jpg
বুলেট ম্যানের ডায়েরি
Rudrajit Paul.jpg

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

১২ অক্টোবর, ২০২৪
মি আজকে প্রথম ডায়েরি লিখলাম। মা জোর করেছে বলে লিখতে হল। তবে আমি মাকে দিয়ে প্রমিস করিয়ে নিয়েছি যে আমার ডায়েরি আমার বিছানার নীচে থাকবে। অন্য কেউ পড়বে না। মা বলেছে ডায়েরি লিখলে আমার হাতের লেখা ভালো হবে। এই ডায়েরিটা মা গড়িয়াহাট থেকে কিনেছে। মলাটে একটা ড্রাগন প্রিন্সের ছবি আছে। 
মা বলেছে আর কেউ আমার ডায়েরি খুলবে না। কিন্তু আমি দিদিকে ঠিক বিশ্বাস করি না। ডায়েরি আমি একটা সিক্রেট জায়গায় রাখব। দিদি আমার ঘরে এসে আমার খাতা খুলে দেখে। ও যদি ডায়েরি দেখে ফেলে? 
আমি দেখেছি যে একটা খাতা লেখা শুরু করার আগে দাদু খাতার ওপরে কী একটা লিখত। লাল কালি দিয়ে। তাহলে আমি যে ডায়েরি লেখা শুরু করলাম, আমাকে কী খাতার প্রথম পাতায় কিছু লিখতে হবে? দিদি জানত। কিন্তু ওকে জিজ্ঞাসা করা যাবে না। আমি একটা মিনিয়নের ছবি এঁকেছি প্রথম পাতায়। ড্রয়িং স্যার এলে দেখাব। 
কালকে আমার পুজোর ছুটি শুরু হয়েছে। আমি একটা ইরেজার স্কুলে ফেলে এলাম। ছুটির পর ফেরত নেব। বলরামকাকু সবকিছু তুলে রেখে দেয়। মা জানে না যে আমি ইরেজার ফেলে এসেছি।

 

১৩ অক্টোবর
আমার নামটা লেখা হয়নি এখানে। আজকে বাবার ডায়েরি দেখছিলাম। বাবা ডায়েরিতে সব কাজ লিখে রাখে। শুরুতেই বাবা নিজের নাম লিখেছে। তাহলে আমাকেও লিখতে হবে। নইলে কেউ বুঝবে কি করে যে এটা কার ডায়েরি? 
আমার নাম অরণ্য দাশগুপ্ত। কিন্তু এই নামটা আমার পছন্দ নয়। আগে আমার পছন্দ ছিল। কিন্তু ছুটির আগে অলিভিয়া বলেছে যে অরণ্য মানে ফরেস্ট। আর সেখানে থাকে জন্তুরা। তার মানে আমিও জন্তু। তাই আমি ঠিক করেছি যে আমার নাম পাল্টে নেব। এই ডায়েরিতে আমি আমার নিজের নেওয়া নাম লিখেছি----বুলেটম্যান। আর ডায়েরির প্রথম পাতায় লিখেছিঃ মাস্টার অফ দ্যা গ্যালাক্সি। এই ডায়েরির ওপর ড্রাগন প্রিন্স আছে। ড্রাগন প্রিন্স আর বুলেটম্যান একসাথে মনস্টারদের সাথে যুদ্ধ করবে। 
এই নামটা আমি জানি আর দিদি জানে। দিদি অবশ্য আমার কোন কিছুতেই পাত্তা দেয় না। ও শুনে মুখ বেঁকিয়ে চলে গেছে। ঠিক আছে, আমি ওরও একটা নাম দিলামঃ মনস্টার উইচ। স্কুলের লাইব্রেরিতে একটা কমিক্স পড়েছিলাম, জাপানি উইচ নিয়ে। লম্বা মুখ, সাদা সাদা ব্রেইড করা চুল, পায়ে আঙ্গুলের জায়গায় থাবা। আমি দিদির ওইরকম একটা ছবি আঁকব। এঁকে দিদির ব্যাগে লাগিয়ে দেব। 
আরও অনেক কিছু লেখার আছে। কিন্তু এখন অ্যাংরি বার্ড কার্টুনের সময়। বাবা টিভি চালিয়েছে। এর পর বাবা হিস্ট্রি চ্যানেল দেখবে, আর আমায় টিভি দেখতে দেবে না। এখন একটু টিভি দেখে নিই। পরে লিখব। আমার কাছে তিনটে অ্যাংরি বার্ড স্টিকার আছে। 

১৫ অক্টোবর, ২০২৪
কালকে ডায়েরি লিখব ভেবেছিলাম। কিন্তু সকালে উঠেই দেখি খুব জ্বর। প্রথমে আমি মাকে বলিনি। বললেই মা বলবে যে পুজোর ছুটির আগে শেষ দিন যে পার্কে কাদার মধ্যে দৌড়িয়েছিলাম, সেই জন্য আমার জ্বর হয়েছে। তাহলে আমার ভলিবল খেলা বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু সকালে আমি খাবার জন্য টেবিলে বসতেই মা বলল, “কী রে? তোর চোখটা লাল লাগছে মনে হচ্ছে। এদিকে আয় তো। কপালটা দেখি।“
আমি বুদ্ধি করে কপালে ফ্রিজ থেকে বরফ লাগিয়ে এসেছিলাম। যাতে মা কপালে হাত দিয়ে ঠাণ্ডা পায়। কিন্তু আমার ব্যাড লাক যে, মা যখন কপালে হাত দিয়েছে, তখনই খুব জোরে একটা হাঁচি হল। মা আমাকে সঙ্গে সঙ্গে ঘরে ফেরত পাঠিয়ে দিল। আমি দিদির মোবাইলটা নিয়ে এসে শুয়েছিলাম। কিন্তু দিদি নালিশ করায় মা বলল, “তোর এখন জ্বর। চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাক। মোবাইল দেখলে মাথা ধরবে।“ 
আর দিদির যেন ধরবে না। দিদি কত বড় আমার থেকে? মাত্র পাঁচ বছর। কিন্তু নিজেকে খুব বড় ভাবে। আর আমি ওর মোবাইল নিলেই মাকে নালিশ করে। ঠিক আছে। আমি এখন ক্লাস থ্রিতে পড়ি। বাবা বলেছে ক্লাস ফাইভ থেকে সিক্স-এ উঠলেই আমাকে ট্যাবলেট দেবে। তখন আমি দিদিকে সেটা ধরতেই দেব না। নিতে এলেই ওর চুল ধরে টেনে দেব। কালকে জ্বর ছিল বলে মা আমাকে আইসক্রিম খেতে দেয়নি। আগেরদিন দিদির জ্বর ছিল। ও না বলে খেয়েছিল। 
ক্লাসে ম্যাম শিখিয়েছে যে তারিখ লিখলে দিনের নাম, মাসের নাম আর বছর লিখতে হয়। কি বোকা বোকা ব্যাপার। কিন্তু ম্যামকে সেটা বলা যাবে না। বললেই রেগে যাবে। আমি একদিন বলেছিলাম যে “ম্যাম, আপনার মাথায় একটা সাদা চুল কেন?” 
সেটা শুনে ম্যাম আমাকে পুরো ক্লাস দাঁড় করিয়ে রেখেছিল। অলিভিয়া পরে বলেছিল যে বড়োদের ওরকম বলতে নেই। কিন্তু আমি বলেছিলাম, “কেন বলতে নেই? সাদা চুল দেখেই তো বলেছিলাম। আমার বাবার মাথায় ওরকম সাদা চুল অনেক আছে।“
অলিভিয়া আমায় বলেছিল, “তুই একটা ছাগল।“
অবশ্য অলিভিয়া একদম ম্যামের কাছে কাছে থাকে। একদিন ক্লাসে পড়ানোর সময়ে ম্যামের হোয়াইট বোর্ড মার্কার শেষ হয়ে গিয়েছিল। অলিভিয়া সঙ্গে সঙ্গে নিজের ব্যাগ থেকে একটা মার্কার বার করে দিল। এইজন্য ও এবার পরীক্ষায় টপ করেছে। কিন্তু অ্যানুয়ালে আমি ছাড়ব না। ও যতই ম্যামকে খুশি করুক, সায়েন্সে আমার সাথে পারবে না। 
অলিভিয়ার সঙ্গে এখন আমার আড়ি চলছে। আমার নাম নিয়ে মজা করেছে বলে। অবশ্য এই নতুন নামটা ও জানে না। ছুটির পর বলব। বুলেটম্যান শুনলে ওর চোখ গোল গোল হয়ে যাবে। 
আজকে গানের ক্লাসে আমাদের একটা গান করালো। এটা হিন্দি গান। দশেরার গান। আমি খাতায় লিখতে ভুলে গেছি। পরের দিন রিমার কাছ থেকে লিখে নেব। আমি ঠিক করেছি বড় হলে ইংলিশ গান করব। গিটার বাজিয়ে। মা মাঝে মাঝে ইংলিশ গানের ভিডিও দেখে। সেরকম। 

১৬ অক্টোবর
আমি ঠিক করেছি যে তারিখ লেখার সময়ে বছর লিখব না। আমার ডায়েরি তো কেউ পড়বে না। আমি পড়ব। তাহলে আমার বছর লেখার দরকার কী? পরীক্ষার খাতায় লিখলেই হবে। আর বছর লিখলে ২০২৪ লিখব না। আমাদের ক্লাসে ক্যালেন্ডার নিয়ে প্রোজেক্টের সময়ে স্যার বলেছেন যে এখন কোরিয়ান সাল ৪৩৫৭। তাহলে আমি তারিখ লিখব ১৬ অক্টোবর, ৪৩৫৭। এটাই বুলেটম্যানের তারিখ। স্পেশ্যাল। কেউ জানবে না। 
কালকে থেকে দুর্গাপুজো। আমাদের বাড়ির সামনে একটা বড় ঠাকুর এসেছে। বাবা অবশ্য খুব বিরক্ত। গাড়ি ঢোকাতে অসুবিধা হচ্ছে। আমি বলেছিলাম, “বাবা তুমি গাড়ি বাইরে রেখে এস।“ শুনে বাবা খুব রেগে গেল। পুজোর প্যান্ডেলটা খুব সুন্দর করেছে। অনেকটা আমাদের ক্লাসে নিখিলেশ স্যার একবার যে স্প্রে পেইন্ট শিখিয়েছিলেন, সেইরকম। আমার স্প্রে পেইন্ট করতে ভালো লাগে। কিন্তু করতে গেলেই চারিদিকে রঙ লেগে যায়। সেই ডাইনোসর রঙ করতে গিয়ে বিছানার চাদরে কালো রঙ লেগে গিয়েছিল। কেউ কিন্তু জানে না। আমি তার ওপর দিদির একটা চকলেট লাগিয়ে দিয়েছিলাম। সবাই ভেবেছিল দিদি বিছানায় বসে চকলেট খেয়েছে, তাই চাদরে লেগেছে। দিদিও বুঝতে পারেনি। নইলে আমাকে মারত। 
আমাদের বারান্দা থেকে শুধু গণেশ ঠাকুরটা দেখা যাচ্ছে। আমি জু-তে হাতি দেখেছিলাম। তার শুঁড়টা গণেশ ঠাকুরের থেকে বড় ছিল। হাতি কী দু পায়ে দাঁড়াতে পারে? দিদি একটা সার্কাসের ছবি দেখিয়েছিল। সেখানে হাতি দুপায়ে দাঁড়িয়ে আছে। এরপর চিড়িয়াখানায় গেলে আমি বলব হাতিকে দুপায়ে দাঁড়াতে। গণেশ ঠাকুরের মাথায় একটা বড় ক্রাউন লাগিয়েছে। 
আমি বিকালে বারান্দায় দাঁড়িয়ে সামনের গাছের সেই কাঠবিড়ালিটা খুঁজছিলাম। কিন্তু ওকে দেখতে পেলাম না। ও মনে হয় প্যান্ডেল দেখে ভয় পেয়েছে। ওর জন্য আমি বারান্দায় কয়েকটা আমন্ড আর কাজুবাদাম রেখে এলাম। কিন্তু দিদি সেটা দেখে মাকে চীৎকার করে বলল, “মা, দেখ। ভাই বারান্দা নোংরা করছে।“
মা সেই শুনে বারান্দায় সব বাদাম ঝাঁট দিয়ে ফেলে দিল! অবশ্য ওরা কেউ জানে না যে বারান্দার গ্রিলেও আমি কয়েকটা বাদাম রেখে দিয়েছি। কিন্তু সেই শালিকটা না খেয়ে নেয়! অবশ্য পুজোর সময়ে প্যান্ডেলে অনেক খাবার। কাঠবিড়ালি এদিকে আসবে কী? 
একটা আমন্ড আমি মুখে দিয়ে দেখলাম। খুব বাজে খেতে। বাবা যে কি করে সকালে উঠে খায়, কে জানে। অবশ্য বাবা অনেক কিছু বাজে জিনিস খায়। করেলা জামুন জুস খায়। একবার আমাকে খাইয়েছিল। খুব তেঁতো। তার পর আমি এমন বমি করেছিলাম যে বাবার নতুন জামায় দাগ পড়ে গিয়েছিল। তারপর থেকে বাবা আর আমায় দেয় না। মা কে দেয়। কিন্তু আমি দেখেছি মা গ্লাসটা নিয়ে চুপিচুপি বারান্দার গাছের টবে ঢেলে দিয়েছে। মা জানে না যে আমি দেখেছি। আমি অবশ্য বাবাকে বলিনি। কিন্তু এতে করে সেই সুন্দর কোলিয়াস গাছটা মরে গেল। 
আমার হোমওয়ার্ক বাকি। অবশ্য ম্যাথস নিয়ে আমার চিন্তা নেই। হিসট্রির প্রোজেক্টটাই শক্ত। দেখি দিদিকে ধরতে হবে। ও অবশ্য ঘুষ চাইবে। ওকে একটা অ্যাংরি বার্ড স্টিকার দেব। যদি দিদি না করে দেয়, তাহলে ও যে মাঝে মাঝে মোবাইলে রাতের বেলা গল্প করে, সেটা মাকে বলে দেব। হিস্ট্রি আমার ভাল্লাগে না। বাবা অনেক মোটা মোটা হিস্ট্রির বই পড়ে। একবার খুলে দেখেছিলাম। একটা বইয়ে মাথা ছাড়া একটা মূর্তির ছবি আছে। বাবা বলল ওটা নাকি কনিষ্ক। আমার গানের ক্লাসে একটা বন্ধু আছে কনিষ্ক নামে। খুব ভালো র‍্যাপ করতে পারে। কনিষ্ক আর আমি মিলে গানের ব্যান্ড খুলব। আমরা প্ল্যান করেছি। নাম হবে—বুলেট স্টার। 

১৬ অক্টোবর, ৪৩৫৭; রাত নটা
এমারজেন্সি! শত্রুর আক্রমণ!
একটু আগে যখন ডায়েরি লিখছিলাম, তখন দিদি ঘরে এসে বলল, “রন, কী লিখছিস্‌ রে?”
আমি বললাম, “হোমওয়ার্ক।“ ওর মনে হয় বিশ্বাস হল না। দেখলাম আমার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকাল। তারপর আমি যখন ডায়েরি লিখে বিছানার নীচে ঢোকালাম, ও দেখলাম দরজার বাইরে থেকে আড়চোখে দেখছে। তাই আমি ডায়েরি অন্য জায়গায় রাখলাম। এখন বাথরুমে ঢুকে চুপিচুপি ডায়েরি লিখছি, যাতে কেউ না দেখতে পায়। 
ডায়েরি কোথায় রেখেছি, কাউকে বলব না। শুধু একটা সূত্র দিয়ে রাখলামঃ ফ। ন। আমি দেখেছি ইভিল স্পাই এভাবে সঙ্কেতে কথা বলে। 
দিদির হাতে পড়লেও এটা বুঝতে পারবে না। দিদির অবশ্য এদিকে মন নেই। ও কালকে বন্ধুদের সাথে প্রথমবার পুজোয় বেরোবে। সেই সাজ করতেই ব্যস্ত। একটু আগে দেখেছি, আলমারি খুলে জামা ঠিক করছে। 

১৭ অক্টোবর, ৪৩৫৭ 
আজকে ষষ্ঠী। মা বলল। আজকে নাকি পুজো শুরু হয়। সকালে বাড়ির সামনে ঢাকের শব্দে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। আমি একটা আয়রন ম্যানের স্বপ্ন দেখছিলাম। কালকে রাতে আয়রন ম্যান এসেছিল আমার ঘরে। তারপর আমরা দুজনে মিলে অ্যাটমিক ফ্লাওয়ার তৈরি করলাম। আমার স্বপ্নের কথা কাউকে বলি না। আগে বলতাম। তাতে বাবা বলল যে, “তুই এত কমিক্স পড়িস বলে রাতে ওইসব স্বপ্ন দেখিস্‌। এবার কমিক্স পড়া বন্ধ।“ এর জন্য আমি আর কাউকে বলি না। আমি তো লাস্ট এক মাস আয়রন ম্যানের কমিক্স পড়িনি। শুধু প্রোফেসর শঙ্কুর কমিক্স আর বাল গণেশ পড়েছি। কিন্তু কালকে স্বপ্নে দেখলাম আয়রন ম্যান। আয়রন ম্যানের যেরকম ড্রেস আছে, আমাকেও সেরকম বানাতে হবে। 
আজকে স্কুলের ব্যাগ খুলে দেখলাম সেই ইরেজারটা আছে। ব্যাগের নীচে ছিল। অরিন নিয়েছিল ড্রয়িং ক্লাসে। ও আমার ব্যাগের মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। অরিন সেদিন আমার একটা পেন্সিলও নিয়েছিল। হাত থেকে ফেলে ভেঙ্গে দিয়েছে। 

দিদি সকালে বেরিয়ে গেল। এখন বারোটা বাজে। একটু আগে মা আমায় বারান্দায় ডেকে কলা বউ দেখাল। একটা কলা গাছ নিয়ে সবাই ঢাক বাজিয়ে প্যান্ডেলে ঢুকল। সেটাকেই মা বলল কলা বউ। আমি বুঝতে পারলাম না। কার বউ? প্যান্ডেলে তো দুর্গা ঠাকুরের পুজো হচ্ছে। তাহলে এটা কি দুর্গা ঠাকুরের বউ? বাবাকে জিজ্ঞাসা করলাম। বাবা কিছু বলে নি। বাবা পুজোর চার দিন বই নিয়ে ঘরে বসে থাকে। বেরোতে চায় না। আমায় অবশ্য প্রমিস করেছে যে বিকালে বেরোবে। মা এখন প্যানকেক রান্না করছে। সকালে নিচের ফ্ল্যাটের রুমাআনটি এসেছিল। মাকে রান্না শেখাচ্ছিল। 
আমার স্কুল খুলতে আর সাত দিন দেরি। ম্যাথস হোম ওয়ার্ক আজকে করব। কালকে প্যান্ডেলে ম্যাজিক দেখাবে। আমি এখন ছবি আঁকব। বুলেট ম্যানের ড্রেস, কেপ আর গাড়ির ডিজাইন করতে হবে। নিচের ফ্ল্যাটের অর্চনদা ম্যাজিক দেখাতে জানে। আমাকে একবার দেখিয়েছে। একটা সাদা বল নিয়ে একটা গ্লাসের নীচে রেখে সেটাকে ভ্যানিশ করে দিয়েছিল। 

১৮ অক্টোবর, ২০২৪ (৪৩৫৭)
আজকে বিকালে ম্যাজিক দেখাবে। মা বলল আমার ক্লাসের তিনজন বন্ধু আসবে এখানে। অলিভিয়াও আসবে।

কালকে বিকালে ডায়েরি লিখতে পারিনি। দিদি ঘুরে বেড়াচ্ছিল। কালকে দিদি অনেক দেরি করে ফিরেছে। মা ওকে বকেছে। বাবা ওর হয়ে কথা বলতে গিয়েছিল, তাই বাবাকেও মা বকেছে। দিদি

বলল যে রাস্তায় জ্যাম ছিল, তাই দেরি হয়েছে। কিন্তু আমি জানি যে ও শ্রীজাদির বাড়িতে গল্প করছিল। দিদি আমায় আগেও বলেছে যে ও শ্রীজাদির বাড়িতে গল্প করতে যায়। শ্রীজাদির মা নাকি খুব সুন্দর ফিশফিঙ্গার বানায়। আমার মা চিকেন ললিপপ বানাতে পারে। 
কালকে মার বকা খেয়ে দিদি যখন ঘরে গেল, তখন আমি গিয়ে বললাম, “তুই শ্রীজাদির বাড়িতে গিয়েছিলি?” দিদি আমায় জিভ দেখাল। আমি তখন বললাম, “আমার হিস্ট্রি প্রোজেক্ট করে দে।“ দিদি মাথা নাড়তেই আমি বললাম, “তাহলে আমি মা কে ডাকি?”
দিদি ভয় পেয়ে করে দেবে বলেছে। আমার দিদি খুব ভালো প্রোজেক্ট করে। হিস্ট্রি আর বায়ওলজি। আমাদের স্কুলে ও ফেমাস। ওর বায়ওলজি প্রোজেক্ট দিল্লিতে প্রাইজ পেয়েছে। একটা ট্রফি। সেটা আমাদের ড্রয়িং রুমে ক্যাবিনেটে আছে। মা মাঝে মাঝে সেটা মুছে রাখে। ট্রফির নিচটা সাদা। আমি একবার সেখানে মার্কার পেন দিয়ে সবুজ করে দিয়েছিলাম। গোল্ডেন ট্রফি, নিচটা সবুজ হলে ভালো লাগবে। দিদি দুটো অ্যাংরি বার্ড স্টিকার নিয়েছে। আমি জানি ও সেগুলো রাফ খাতায় লাগাবে। 
দিদি এখন আমার হিস্ট্রি প্রোজেক্ট করছে। আমার প্রোজেক্টঃ ওয়েস্ট বেঙ্গলের সব ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ স্থানের বর্ণনা। দিদি প্রিন্ট আউট করলে তারপর আমি লিখব। আমি কালকে বুলেট ম্যানের ড্রেস এঁকেছি। আর মুখোশ। আজকে অলিভিয়া আসবে। আমি ওকে দেখাব। 
বাবা এখন বইয়ের আলমারি গোছাচ্ছে। বাবার ছোটবেলার সব বই বার করে দেখছে। আমি যাব না। আমার পুরনো বইয়ের মধ্যে গেলেই হাঁচি হয়। তারপর ইনহেলার নিতে হয়। আমাদের ক্লাসে সায়ন আর বিহানও ইনহেলার নেয়। বিহান একবার আমার ইনহেলার নিয়েছিল। প্যান্ডেলে এখন একটা গান বাজছে। বাবা বলল ওটা নাকি বাবাদের ছোটবেলার পুজোর গান। আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। পুজোর গান মানে কী? যে গান পুজোর প্যান্ডেলে বাজে? কেন বাজে? 
বিকেল পাঁচটাঃ 
একটু পরে ম্যাজিক শো শুরু হবে। মা দুপুরে প্যান্ডেলে গিয়েছিল। আমি যাইনি। মা অনেকক্ষণ গল্প করছিল। বাবা নিজের ছোটবেলার সব কমিক্স বার করে আমায় দেখাচ্ছিল। কিন্তু আমার ভালো লাগে নি। কেমন বোকা বোকা। বাবা বলল যে এইসব কমিক্স নাকি বাবাদের স্কুলে সবাই লুকিয়ে পড়ত। একটা কমিক্স দেখাল, ফ্ল্যাশ গর্ডন। কি বোকা বোকা নাম। বুলেটম্যান অনেক ভালো নাম। বুলেটম্যানের অ্যাসিস্ট্যান্ট হবে ভেনম। 
মা এখন ছাদে গেছে গাছে জল দিতে। আমাদের একটা হলুদ জবা গাছ আছে। অনেক ফুল হয়। মা কয়েকটা ফুল আজকে প্যান্ডেলে দিয়েছে। দিদি এখন ফোনে গল্প করছে। আমার প্রোজেক্ট দিদি করে দিয়েছে, তাই আমি ওর একটা ক্র্যাফট করে দেব। আজকে রাতে করব। আজকে আমি ব্ল্যাক ড্রেস করে যাব। এটা বাবা পুজোয় দিয়েছে। সামনে একটা এলিয়েনের ছবি আছে। এরকম এলিয়েন আমি একবার টিভিতে দেখেছি। স্পেসশিপে করে এসেছিল। 
আমাদের স্কুলে ম্যাজিক দেখিয়েছিল। বিহানকে স্টেজে তুলে একটা বাক্সে বন্ধ করে বাক্সটা ভ্যানিশ করে দিয়েছিল। একটা মন্ত্র বলেছিল। সেই মন্ত্র পরে আমরা সবাই একে অন্যের ওপর আপ্লাই করে দেখেছিলাম যে বন্ধুরা ভ্যানিশ হয়ে যায় কিনা। কিন্তু মন্ত্র কাজ করেনি। মন্ত্রটা আমার খাতায় লেখা আছে। সেটা এই ডায়েরিতে তুলে নেব। এই ডায়েরিতে আমার সব ইম্পরট্যান্ট কথা লেখা থাকবে। সেইজন্য ডায়েরি সিক্রেট জায়গায় রাখতে হবে।

 

১৯/১০/২৪
কালকে ম্যাজিক শো দারুণ হল। একটা খালি টুপি উপুড় করে সেখান থেকে একটা পায়রা বার করল। তারপর পায়রাটা আমাদের হাতেও দিল। আমি ধরে দেখলাম। খুব নরম। আমার যে সিন্ধুঘোটকের টয়টা আছে, অনেকটা সেরকম লাগল। এই খেলনাটা বাবা আমাকে দুবাই থেকে এনে দিয়েছিল। বাবা দুবাই গিয়েছিল লাস্ট জানুয়ারি। আমার জন্য এই খেলনা আর চকলেট এনেছে। দিদির জন্যও চকলেট এনেছে। আমার মিন্ট আর দিদির জন্য ক্যামেল মিল্কের চকলেট। দিদি আমাকে ভাগ দিয়েছিল। একটুখানি।
কালকের ম্যাজিক শোয়ে একটা কাগজ ছিঁড়ে ফেলে আবার জোড়া লাগিয়ে দিল। ম্যাজিশিয়ানের নাম মাস্টার ম্যান্ড্রেক। বাবা বলল যে বাবাদের ছোটবেলায় একটা কমিক্স ছিল ম্যান্ড্রেক নামে। বাবা পড়েছে। সে নাকি এইরকম ম্যাজিক করত। আর ম্যাজিক দিয়ে দুষ্টু লোক ধরত। আমি বাবার কাছে ম্যান্ড্রেকের কমিক্স চেয়েছি। মা বলেছে তিনদিন রোদে রেখে তারপর আমাকে দেবে। তাহলে আমার আর অ্যাজমা হবে না। আজকে আমায় একবার ইনহেলার নিতে হল।
অলিভিয়া কালকে বুলেটম্যানের ছবি দেখেছে। ও জিজ্ঞাসা করছিল বুলেটম্যান কি খায়। আমি বললাম, “রেডিওএকটিভ ফ্লাওয়ার।“ ও আমাকে বলেছে এই বুলেটম্যানের ড্রেস পরে ক্রিসমাস পার্টিতে যেতে। আগেরবার এই স্কুলের পার্টিতে আমি ইভিল স্পাই সেজেছিলাম। 
আজকে সকালে মা বাবার সাথে প্যান্ডেলে অঞ্জলি দিলাম। আমি কলাবউ খুঁজছিলাম। কিন্তু দেখতে পেলাম না। দুর্গার পায়ের নীচে লায়ন আছে। আর একদিকে একটা পেঁচা আছে। আমাদের বাড়িতে একবার একটা পেঁচা এসেছিল। সারারাত আমাদের বারান্দায় বসে ছিল। দিদি ওটাকে বাদাম খেতে দিয়েছিল।
আজকে একটু আগে সামনের গাছে কাঠবিড়ালিটাকে দেখলাম। খুব ব্যস্ত। প্যান্ডেলে অনেক খাবার আছে। মা আজকে প্যান্ডেলে মিষ্টি আর ফল দিয়েছে। বাবা আমাকে চারটে ম্যান্ড্রেক দিল। পুরনো বই। নীল টুপি পরা একটা লোক। পরে পড়ব। এখন দিদির ক্র্যাফট করব। দিদির ক্র্যাফট হল একটা স্পেসশিপের থ্রি ডি মডেল। 
বুলেটম্যান এরকম স্পেসশিপে করে গ্যালাক্সি ট্র্যাভেল করে। সুপারফাস্ট শিপ। অন্য ডাইমেনশানে ট্র্যাভেল করে। দিদির অবশ্য সায়েন্স ফিকশান ভালো লাগে না। ও খালি পড়ে হরর। স্টিফেন চবস্কি পড়ে। আর রাতের বেলা ভুতের ভয় পায়। আমি জানি। একদিন রাতে ও বিছানায় উঠে বসে ছিল। জানালায় নাকি শব্দ হচ্ছিল। আমি অবশ্য জানি যে সেই কাঠবিড়ালিটা মাঝে মাঝে জানালায় খেলতে আসে। কিন্তু আমি বলিনি। বেশ হয়েছে ভয় পেয়েছে। দিদি একবার আমাকে মুখোশ পরে ভয় দেখিয়েছিল। ক্রিসমাসের দিন। তাই আমি বলেছি, “দিদি, ওই যে আমাদের বাড়ির পেছনে হন্টেড হাউস আছে, সেখানে একটা ভূত থাকে, জানিস?”
দিদি সেদিকে একবার তাকিয়ে জানালাটা বন্ধ করে দিয়েছে। ওই হন্টেড হাউসে ভূত নেই। পাঞ্চালি মাসি থাকে। পাঞ্চালি মাসি আমাদের বাড়ির সামনে চা বিক্রি করে। আমি জানি। আমাদের দারোয়ান আলি ওখানে রোজ চা খায়। আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখেছি যে আলি বিস্কুট কিনে সেই কাঠবিড়ালিটাকে খাওয়ায়। কাঠবিড়ালি আমার কাছে বাদাম খায় আর আলির কাছে বিস্কুট। 
দিদি স্টিফেন চবস্কি পড়লেও নামের বানান জানে না। আমি একবার ওকে বানান করতে বলেছিলাম। পারেনি। দিদি এখন কম্পিউটারে ক্রসওয়ার্ড করছে। ও আমাকে বলেছে বড় হয়ে ও সায়েন্টিস্ট হবে। 

২০ অক্টোবর, ২০২৪
আজকে খুব ক্লান্ত। তাই বেশিক্ষণ ডায়েরি লিখব না।
সবাই শুয়ে পড়েছে। আজকে আমরা চারজন ঠাকুর দেখতে বেরিয়েছিলাম। অনেক হাঁটতে হল। আমার হাঁটতে ভালো লাগে না। বাবা একটা প্যান্ডেলে গিয়ে চেয়ারে বসে পড়ল। আমাদের বলল, “তোমরা সব ঘুরে দেখে এস। আমি রেস্ট নিচ্ছি।“
আমাদের লাইনে দাঁড়িয়ে ঢুকতে হল। এই প্যান্ডেলে একটা ফরেস্ট বানিয়েছিল। ফরেস্ট-এর বাংলা হল অরণ্য। আমি জানি। মা বলছিল, “এটা তোর নামে প্যান্ডেল।“
সেই প্যান্ডেলে অনেক বার্ডস ছিল। ছবি নয়। সত্যি বার্ড। খাঁচায় রাখা ছিল। এক জায়গায় একটা এমু ছিল। মা ছবি তুলল। দিদি এমুটার খুব কাছে চলে গিয়েছিল। ওটা মাথা বাড়িয়ে দিদির চুলের ক্লিপ খেতে গিয়েছিল। মা দিদির হাত ধরে টেনে নিয়ে এল। আমি হলে আনতাম না। দিদির চুলের ক্লিপটা এমু টেনে নিলে মজা হত। 
এখন ঘরের লাইট বন্ধ করে দেওয়ার কথা। মা দেখতে পেলে বকবে। এবার রেখে দেব। কিন্তু পুজোর ছুটি শেষ হলে আবার যখন স্কুলে যাব, আমি কয়েকটা প্রমিস করছি।
১। আমার হাতের লেখা ভাল করব।
২। রোজ পড়া শেষ করে বই বন্ধ করে রাখব।
৩। চকলেট খেলে বন্ধুদের ভাগ দেব।
৪। আমাদের বাড়ির নীচে যে বিড়ালটা আছে, ওকে আর জল ছুঁড়ব না।
৫। পিপ্পি লংস্টকিংএর বইটা দুমাসে পড়া শেষ করব।
৬। ক্লাসে কথা বলব না।
আজকে খুব ঘুম পাচ্ছে। ঠাকুর দেখতে অনেকক্ষণ হেঁটেছি। প্যান্ডেলের কথা কালকে লিখব।

২১ অক্টোবর
বাবা বলছিল আজকে দশমী। এর মানে হল ঠাকুর নাকি আজকে দেশে ফিরে যাবে। ঠাকুরের দেশ কোথায়? বাবা বলল হিমালয়ে। আর মা বলল আকাশে। আমি আজকে একটু ম্যান্ড্রেক পড়েছি। ম্যান্ড্রেক যেমন পাহাড়ের ওপর জানাডুতে থাকে, দুর্গা ঠাকুর কি সেরকম পাহাড়ের ওপর বাড়িতে থাকে? আমি কোনদিন ঠাকুরের বাড়ির ছবি দেখিনি। দিদিকে জিজ্ঞাসা করতে হবে যে ও দেখেছে কিনা।
এখন বিকাল ছটা। একটু পরে নিচের ফ্ল্যাটের রুমা আনটি আর দিলীপকাকু আসবে। দশমীর দিন নাকি সবাই অন্যের বাড়িতে মিষ্টি খেতে যায়। মা এদিকে আমাকে মিষ্টি খেতে দেয় না। দাঁত খারাপ হয়ে যাবে বলে। তাহলে ওরা মিষ্টি খায় কী করে? আমি দেখেছি বাবা সকালে চকলেট মিষ্টি এনে রেখেছে। দিলীপকাকুর দাঁত দেখতে হবে, খারাপ কিনা। 
কালকে অনেকগুলো ঠাকুর দেখেছি। একটা জায়গায় ফরেস্ট বানিয়ে তার মধ্যে জ্যান্ত পাখি রাখা ছিল। এমু ছিল, ম্যাকাও ছিল, কোকাবুরা ছিল। কোকাবুরা খুব সুন্দর পাখি। আমি বড় হয়ে এই পাখি পুষব। 
আরেকটা প্যান্ডেলে একটা ডাইনোসর ছিল। সেটার চোখে লাল আলো জ্বলছিল। দিদি ওটার সামনে আমার একটা ছবি তুলেছে। মা অনেক ছবি তুলেছে। এরপর দেখলাম একটা রাজবাড়ি। অনেক সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হল। খুব ভিড় ছিল। একজন লোক আমার নতুন জুতো মাড়িয়ে দিয়েছে। বাবা আমাদের সবাইকে পেস্তা আইসক্রিম আর চিকেন লেগপিস খাইয়েছে। আজকে বাবা ব্যাগ গোছাচ্ছে। কালকেই বাবার কাজ। সকালে প্লেন ছাড়বে। 
একটা প্যান্ডেলে মেলা হচ্ছিল। সেখানে আমি কার রেসিং করেছি। মা ফুচকা খেয়েছে। দিদিও খেয়েছে। দিদির ঝাল খেলেই পেট ব্যথা হয়। তাও খেয়েছে। আজকে একটু আগে আমাকে বলছিল যে ওর পেট ব্যথা করছে। আমি চুপি চুপি মার ওষুধের বাক্স থেকে সেই ওষুধটা এনে দিলাম। দিদির ক্র্যাফট প্রোজেক্ট শেষ। ওকে দিয়ে দিয়েছি। আচ্ছা, এই যে ঠাকুর দেশে ফিরে যাবে আজকে, তাহলে ঠাকুরকে এরকম স্পেসশিপ দিলে হয় না। আমি দেখছিলাম আমাদের বাড়ির সামনে একটা বড় ট্রাক দাঁড়িয়ে। বাবা বলল ওতে করেই নাকি ঠাকুর চলে যাবে। সবাই কী বোকা! এর থেকে ঠাকুরকে স্পেসশিপ দিলে খুব তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে যেত।
আমার হোমওয়ার্ক শেষ। মা দেখে বলল, খুব ভালো। কিন্তু হোম ওয়ার্ক করার পর দেখলাম আমার সেই ইরেজারটা হারিয়ে গেছে। আমি জানালার সামনে বসে কাজ করছিলাম। সেই কাঠবিড়ালি এসে নিয়ে যায়নি তো? আমি দেখেছি ওটা সব খায়। একদিন মা পাঁপড় রোদে দিয়েছিল। সেটাও খেয়ে গিয়েছিল।
বেল বাজল। কাকুরা এসে গেছে। এবার রাখলাম। দিদি এখন আর আমার সাথে আর ঝগড়া করছে না। তাই আমি ডায়েরি নিজের টেবিলেই রাখলাম। 

২২/১০/২৪
বাবা আজকে সকালেই চলে গেছে। আমি তখন ঘুমাচ্ছিলাম। বাবা আমার জন্য একটা সারপ্রাইজ গিফট রেখে গেছে। এটা পুজোর সময়ে দেয়নি। একটা বই। হ্যারি পটারের ফার্স্ট পার্ট। দিদির সবকটা আছে। কিন্তু আমার জন্য বাবা আলাদা করে কিনে দিয়েছে। আজকে আমার পুজোর ছুটির শেষ দিন।
কালকে স্কুল শুরু হবে। আজকে ড্রয়িং স্যার এসেছিলেন। উনি আমার জন্য একটা চকলেট এনেছিলেন। এটাকে নাকি বলে বিজয়ার গিফট। আমি যখন বড় হব, তখন সবাইকে বিজয়ার গিফট দেব। আর যে কোকাবুরা পাখি পুষব, তাকে দেব আমন্ড। 
দিদির নেক্সট উইক থেকে পরীক্ষা। ও আজকে থেকেই দরজা বন্ধ করে পড়ছে। আমার পরীক্ষা কালিপুজোর পর। স্কুল খুলে ডিক্টেশান পরীক্ষা আছে। মা আমাকে আজকে প্র্যাকটিস করালো। সব ঠিক আছে।
আমাদের বাড়ির সামনের প্যান্ডেল খুলছে। আজকে বিকালে আমাদের সামনের রাস্তা দিয়ে অনেক ঠাকুর গেছে। মা বাবার সাথে ভিডিও কল করছিল। তখন বাবাকে দেখিয়েছে ঠাকুর। বাবা কালিপুজোর সময়ে আসবে। 
এবার আমার একটা জামা কম হয়েছে। নিচের ফ্ল্যাটের অর্চনদা বলছিল ওর সাতটা জামা হয়েছে। আমার ছটা হয়েছে। তবে বাবা প্রমিস করেছে যে কালিপুজোর সময়ে আরেকটা দেবে। কালকে থেকে স্কুলে আবার সেই পচা টিফিন খেতে হবে। মা খালি ছানা দেয় টিফিনে। আমার ভালো লাগে না। কালকে স্কুলে গিয়েই কনিষ্কর সাথে কথা বলব। আমাদের রক ব্যান্ড শুরু করতেই হবে। পরের বার বার্থডেতে আমি গিটার গিফট নেব। 
 

গল্প

oldman2.jpg
নাম বিভ্রাট

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

কানাই নামেই সুমন্ত বাবুর ঘোরতর আপত্তি। কানু থেকে কেন্নো যে কোনো ধরনের ছোট বড় মাঝারি মাপের বিদঘুটে হোক, সহজ সরল হোক যাই হোক না কেন কানাই জাতীয় নাম বা নামের গন্ধ থাকলেই সে নামেই বেদম আপত্তি সুমন্ত পালিতের। কানাই নামে এলার্জি এতটাই প্রবল যে, যে কোন ধরনের কানাই মিশ্রিত নামের গন্ধ থাকার ধারে পাশেই থাকার বান্দা নন সুমন্তবাবু। ছেলে উদীয়মান ক্রিকেটার হিসেবে ছোটবেলা থেকেই নাম করছিল। ক্লাস ফাইভে পড়তে পড়তে আন্ডার থার্টিন এর জায়গা প্রায় পাকা হয়ে গেছিল শহরের সবথেকে নামি ক্লাবটার ক্রিকেট টিমে। একদিন শুনলেন, ওই টিমের ব্যাটিং কোচ কানাই হালদার! ব্যাস হয়ে গেল! অমনি  ছেলেকে নিয়ে হিরহির করে টানতে টানতে নিয়ে কোচিং ছাড়িয়ে দিলেন সুমন্তবাবু। দীর্ঘদিনের পরিচিত ধোপার ছেলের নাম, যে ছেলেটি বাড়িতে দীর্ঘদিন ধরে জল দিয়ে যেত--- এমন অনেকের সঙ্গেই সম্পর্ক ছিন্ন করে দিয়েছেন সুমন্ত শুধুমাত্র ওই কানাই নামের গন্ধ থাকার কারণে। এমনকি পাড়ার দীর্ঘদিনকার পরিচিত তিনুকাকার দোকান সুমন্তবাবু ছেড়ে দিলেন শুধু ওই এক কারণেই ---- ঐ নাম বিভ্রাট। একদিন সকালবেলায় সুমন্তবাবু দোকানে গিয়ে দেখলেন তিনুবাবুর জায়গায় তার এক নাতি ক্যাশ সামলাচ্ছে। খুব তাড়াতাড়ির মধ্যে দুই প্যাকেট সয়াবিন চাইতেই নাতিটি একটু উঁচু গলায় বলে উঠলো - 'এই কানাই এই এই কাকাকে দু প্যাকেট সয়াবিন দে তো!' এরপরে যতই তিনুকাকার ভাইপো পেছন থেকে ডাকুক না কেন কোন মতেই কর্ণপাত না করে হন করে দোকান থেকে সেই যে বেরিয়ে এলেন সুমন্তবাবু আর দোকানমুখো হননি সেই থেকে। কর্মক্ষেত্রের কলিগরা এ বিষয়টি নিয়ে বিস্তর চাপাচাপির পর সুমন্তবাবু বলেছিলেন, কানাই চন্দ্র গুছাইত মানে ওনার শ্বশুর ওনাকে নাকি একবার গুছিয়ে বাক্য বাণীতে জর্জরিত করেছিলেন মানে রীতিমতো অপমানিত করেছিলেন ওর শ্বশুরবাড়িতে। জানা যায় ওনার স্ত্রী সর্বজয়া বহু বছর আগে বিয়ের প্রথম বিবাহ বার্ষিকীতে একটা সোনার বালা দাবি করেছিলেন ওনার কাছ থেকে। ছাপোষা কেরানির চাকরি করে বৌয়ের আবদার রাখতে পারেননি। সে খবর যখন শ্বশুরবাড়িতে পৌঁছয়, তখন নাকি যা নয় তাই ভাষায় শ্বশুরমশাই রীতিমতো বেইজ্জত করেছিলেন ওনাকে গোটা পরিবারের সামনে। অবিশ্যি তারপর থেকেই প্রতিজ্ঞা করেছিলেন! জীবদ্দশায় ওই বাড়িতে আর নয়"। তাঁর মতে, বড়লোক বাবার ঘর ছেড়ে এসে এক ছাপোসা কেরানির বাড়িতে বিয়ে দিয়ে যথেষ্টই ভুল নাকি করেছিলেন তার শ্বশুর কানাইবাবু। আসলে ঝানু ব্যবসাদার কানাই গুছায়েত মেয়ে সর্বজয়ার বিয়ে দিয়েছিলেন এমন এক দপ্তরের কেরানির সঙ্গে যেখানে উপরি আয়ের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকে। কিন্তু সাদামাটা জীবন যাপনে অভ্যস্ত সুমন্তবাবুর এ সমস্ত ছিল না পসন্দ। তাই ও পথে তিনি কোনদিনও যাননি। ফলে বউয়েরর বড়লোকি আবদার মেটানোর মত উপরি অর্থ উপার্জন করার তাগিদটাই কোনদিনই জোটাতে পারেননি সুমন্তবাবু। পরে অবশ্য প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে টাকা তুলে বৌয়ের গয়নার আবদার মিটিয়েছিলেন সুমন্ত পালিত। কিন্তু নিজের ইগোকে এইভাবে আঘাত পেতে দেখে সুমন্তবাবু মনে মনে সেই সময় প্রতিজ্ঞা করেছিলেন আর যাই হোক না কেন, কানাই নামক নামের পিছনে সামনে কোন জায়গাতেই তাকে আর দেখা যাবে না। অবশ্যই নিজে শ্বশুরবাড়িতে না গেলেও স্ত্রী সর্বজয়ের বাপের বাড়ি গমনে কখনোই তিনি বাধা হয়ে দাঁড়াননি। এবং কানাই নাম থেকে দশ হাত দূরে কেন শতযোজন দূরে থাকার জন্য যা যা করার দরকার তাই করেন সুমন্ত পালিত। সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিল কিন্তু পা ভোরকে গেল ঘরের মাঠেই। বাড়িতে সকালবেলায় খবরে কাগজটি উল্টে পাল্টে দেখছিলেন সুমন্তবাবু। অফিস ছুটি, তাই একটু বেলাতেই বাজারে যাবেন বলে আয়েস করে চায়ের সঙ্গে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিলেন পাত্র পাত্রী চাই বিজ্ঞাপনের পেজটা। এমন সময় তার প্রাণপ্রিয় মেয়ে অম্বালিকা এসে বেশ কিছুক্ষণ উসখুস করতে সুমন্তবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কিরে কি হয়েছে মা কিছু বলবি?
- না মানে বাবা, তুমি তো বেশ কয়েকদিন ধরেই আমার জন্য পাত্র খুঁজছো...
- হ্যাঁ তা তো বটেই খুঁজতে তো হবে রে মা মেয়ের বাবা হয়েছি।
- না মানে বাবা...... ওই কথাই বলতে চাইছিলাম।
- বলনা, কি বলবি।
- বলছিলাম কি বাবা, মানে...
আমতা আমতা করে মেয়ে বলতে লাগলো, আমার অফিসেরই এক কলিগ মানে... কথোপকথন এর মাঝেই স্ত্রী এসে জুড়ে বসলেন, ও তোমাকে কিছুতেই বলতে পারছিল না গো, আসলে ও একজনকে পছন্দ করেছে, এখন তুমি সায় দিলেই বিষয়টা নিয়ে আমরা এগোতে পারি।
মেয়ের সঙ্গে বেশ খোলামেলা সুমন্তবাবু মেয়ের পছন্দকে কোনদিনই অপছন্দ করেন নি,
- বল কি!!!তা বেশ তো! আমাকে আগে বলবি তো তাহলে আর এই পরিশ্রমটা করতে হতো না। হে হে.....ওকে একদিন বাড়িতে ডাক, কথাবার্তা বলি, বা ওর বাবার সঙ্গে।
কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর সুমন্তবাবু হঠাৎই বলে উঠলেন, হ্যাঁরে মা, ওদের ওখানে ঐ ধানাই পানাই জাতীয় কিছু নেই তো, বলেই আর চোখে একটু দেখে নিলেন স্ত্রীর দিকে। না মানে তুই তো আমার বিষয়টা জানিসই।

মেয়ে হেসে উত্তর দিল, তুমি ওই নিয়ে একবারেই ভেবো না বাবা। আমি আগে থেকে শুনে নিয়েছি, ওর পরিবার কেন গুষ্টির মধ্যে কেউ নেই যার নাম কানাই। মেয়ে অম্বালিকা এরপর নেমন্তন্ন করে তার হবু স্বামীকে বাড়িতে ডাকলো। প্রাক বিবাহ একটা ছোটখাটো ইন্টারভিউ আরকি।
সুমন্তবাবু অত্যন্ত খুশি।

"তোমাদের বিষয়টা আমাকে নিয়ে জানিয়েছে, আমাদের কারোরই কোন আপত্তি নেই। এটা তো পরিবারের সঙ্গে পরিবারের মিল। তোমার বাবা মার সঙ্গে একবার কথা বলে নিতে চাইছি রীতিমত গদগদ হয়ে বললেন পালিতবাবু।

এরপর আমতা আমতা আমতা ভাবে সুমন্ত বলে উঠলেন, কি জানো তো আমার কোনোটাতেই কিছু আপত্তি নেই শুধু একটা বিষয়ে!! হে হে মানে আমি আসলে কি বলবো!
অম্বালিকার হবু স্বামী কর্নেন্দু পরিস্থিতি বিচার করে মৃদু হেসে বললেন ও নিয়ে আপনি একেবারেই ভাববেন না কাকু, অম্বালিকা আমাকে সবই বলেছে। আপনার আলার্জি র....ঐসব কিছুই পাবেন না আমাদের পরিবারে।
না মানে....
আসলে.....তোমার নামের মধ্যেই... এইভাবে ঢোক দিলে পালিতবাবুকে কথা বলতে শুনে কর্ণেন্দু হেসে বললেন, ও বুঝেছি আপনি আমার নামের মধ্যে কানাই বা ওই জাতীয় কিছু খুঁজছেন বুঝি!! না আপনি নিশ্চিন্ত হতে পারেন সেরকম কিছু নেই আমার মধ্যে।
যাক বাবা, আশ্বস্ত হলাম। তাহলে বল, কবে বাকি কথা ছাড়া যায়?
এরপর খুব তাড়াতাড়ি চার হাত এক জায়গায় হয়ে গেল। বৌভাতের দিন মেয়ে পক্ষের সঙ্গে কথোপকথন রত কর্নেন্দুর বাবা কল্যাণবাবুর সামনে তাঁর এক ভাই অপ্রত্যাশিতভাবেই হাজির হলেন বৌভাতে। এরপর, যা হল তা সুমন্ত পালিতের ভাবনারও অতীত ছিল। কর্ণেন্দুর কাকার সঙ্গে পরিচিত হতে গিয়ে বাঁধলো-বিপত্তি। পরস্পরের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সময় ভদ্রলোক নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে গর্বের সঙ্গে বললেন তার নাম কালিকা প্রসাদ সিংহ।
অমনি পাস থেকে কে যেন বলে উঠলেন আরে ওর নাম কালিকাপ্রসাদ ওরফে কানু!!!!!
ওরফে কানু সিংহ। বলেন কি!!!! যেন ভূত দেখে চমকে উঠলেন পালিতবাবু। সুমন্ত পালিতের মুখের ভূগোলই যেন গেল বদলে!! কি? কি বললেন আপনি? আপনার নাম কি বললেন!!
----কালিকাপ্রসাদ
না না তারপর!!!!! কানু সিংহ! শুনলাম না!!! একরাশ হতাশামিশ্রিত কণ্ঠস্বর পালিতের গলায়!!
সঙ্গে সঙ্গে উচ্চস্বরে মেযে অম্বালিকার দিকে সজোরে ধাবিত হলেন সুমন্তবাবু।
বললেন, আমার সঙ্গে ধোঁকা হয়েছে!! আমি বলেছিলাম না এই পরিবারে কানাই নামে কেউ থাকলে সেখানে আমি সম্পর্ক করব না!
মেয়ে অত্যন্ত থতমতো খেয়ে বলল - বাবা, কোথাও ভুল হচ্ছে, এদের বাপ ছেলে কারোর নামই তো কানু বা কানাই নয়! এদের গুষ্টিতেই ওনাম নেই।

- বাপ ছেলের নাম না হলেও পরিবারে তো আলবোত আছে, রাগে অপমানে যেন জল গরমের মতো ফুট ছিলেন সুমন্ত পালিত।
এরপরে আসরে নামলেন খোদ জামাই বাবাজি।
- বাবা, আপনি আবার অযথা চাপ নিচ্ছেন। আমরা কেউই আপনাকে মিথ্যে কথা বলে বিভ্রান্ত করিনি। আপনি ঠিকই শুনেছেন উনি আমার বাবারই ভাই। তবে আমার আপন কাকা নন। এমনকি উনি আমাদের গোত্রেরও নন। ছোটবেলায় নাকি ওনাকে কুড়িয়ে পেয়েছিলেন আমার ঠাকুর দাদা। কিন্তু উনার চালচলন অত্যন্ত রুঢ় হওয়ার কারণে পরবর্তীকালে ওনাকে ত্যাজ্য পুত্র করেন আমার ঠাকুরদা। সেই থেকে যোগাযোগই ছিল না বললেই চলে। আমার আমার বিয়ের কথা শুনে উনি এসেছেন নিজে থেকেই আজকে। এখন বলুন উনাকে কি তাড়িয়ে দেওয়া যায় না উচিত হবে? তাছাড়া এতে আপনারই মান সম্মান কমবে বই বাড়বে না। আপনার অবজেকশনটা যদি জানাজানি হয় তাহলে হয়তো আপনারই খারাপ লাগবে পরে এই ভেবে যে আপনি আজকের দিনে এই সম্পর্কটা জোড়া লাগতে হয়তো দিলেন না শুধুমাত্র আপনার ইগোর কারণে। তাছাড়া আপনি বলুন না উনি কি আমাদের পরিবারের অংশ হলেন? রক্তের সম্বন্ধ ধরে যদি পরিবার হয় তবে নিশ্চয় নয়। আপনি শান্ত হন।

এরপর ঘটনার এবং সম্পর্কের গভীরতা বুঝে সুমন্তবাবু স্থির হলেন বটে, কিন্তু মনে মনে খটকা একটা থেকেই গেল। মনে পড়ে গেল ছোটবেলাকার সেই কথা, পৃথিবীটা গোল এবং আরও একটি প্রবাদ যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধ্যা হয়। যে কানাই নামকে তিনি তাচ্ছিল্য করে এসেছেন এতদিন ভুল পথে হলেও সেই কানাইয়ের বাঁশির আওয়াজ তাকে ত্যাগ করল না বলাই বাহুল্য।
আস্তে আস্তে হাতে হাত দিয়ে বললেন এত বছর তো গেল একটা অপমান ক্ষমা করে দিতে পারো নাএক আকাশ বিহলতা চোখে নিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় সুমন্ত পালিতের কানে তখন ভেসে আসছে বৌভাতের সন্ধ্যায় হালকা সুরে বাজা ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খানের সানাইয়ের সুর!!!

গল্প

দেওয়াল ঘড়ি

সঞ্জীব চক্রবর্তী
কোলকাতা

crow.JPG
দেওয়াল ঘড়ি

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

বিবারের সকাল। ভুবন সোমের কাছে আজকাল যদিও রোজই রবিবার কিন্তু সপ্তাহের এই শেষ দিনটায় সকালে বিছানা ছাড়া হতে গড়িমসি তাঁর দীর্ঘ দিনের অভ্যাস যা গত দু বছর রিটায়ার্ড জীবনেও কাটিয়ে উঠতে পারেন নি।
ভুবনবাবুর সংসারে আরো দুজন সদস্য আছে। ঘরের কাজের সাহায্যকারী নিতাই। এখন তার নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে নেত্য। আর একজন হলো “ভৌ”, একটি গোল্ডেন রিট্রিভার। অফিসের সহকর্মীরা ফেয়ারওয়েল অনুষ্ঠানে উপহার দিয়েছিলেন কারণ ভুবনবাবু কুকুর ভালবাসেন। এরা দুজন তাঁর নিত্য সঙ্গী। নেত্য আর “ভৌ” দুজনেই তাঁর টিভি দেখার সঙ্গী। টিভি দেখার সময় তারা নিজ নি ভঙ্গিতে ও ভাষায় মন্তব্যও করে থাকে। রাতে “ভৌ” শোয় ভুবনবাবুর খাটের পাশে তার নিজস্ব শোয়ার জায়গায়।
রবিবার সকালে তাঁর আর একটি অভ্যাস হল, পার্ক ষ্ট্রিটের নিলামের শো রুমে যাওয়া। নিজে কখনো সরাসরি নিলামে অংশ না নিলেও তিনি অন্যদের দর হাঁকাহাঁকির উত্তেজনার আঁচ পোহান। পার্ক ষ্ট্রীটের তাঁর পরিচিত নিলাম দারের শো রুমের পিছনের গোডাউনে অগোছাল পড়ে থাকা অসংখ্য পুরানো জিনিস পত্রের মাঝে ভুবনবাবু ঘুরে বেড়ান। কখনো দাঁড়িয়ে পড়েন মানুষ প্রমাণ উঁচু ভেনিসিয়ান আয়না বা জোড় হারানো একা দাঁড়িয়ে থাকা কাট গ্লাসের সেজ বাতি অথবা বিশাল আরাম কেদারার সামনে, তখন ভুবনবাবু মন ঘুরে বেড়ায় সেই সব মানুষের মাঝে যাদের হাসি কান্না আনন্দ জড়িয়ে আছে এই নির্বাক জড় বস্তুদের পরতে পরতে। তিনি স্পষ্ট টের পান অতীতের ওই মানুষ জনের চিন্তা ধারা, দেখতে পান তাঁদের জীবনযাত্রার ছবি।
সেদিনটাও ছিল রবিবার। ভুবনবাবু যথারীতি বেরনোর সময় পাশের ফ্ল্যাটের বিমলবাবু সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। ইনি প্রাইভেট অফিসে কাজ করেন আবার বিমার দালালিতেও যুক্ত। ভুবনবাবু এনাকে পছন্দ করেন কারণ এনার সাথে আধ ঘন্টা বসলেই পৃথিবীর তামাম খবর জানা হয়ে যায়।
“নিলামে যাচ্ছেন নিশ্চয়ই?” আকর্ণ বিস্তৃত হাসি হাসেন বিমলবাবু।“ বিকেলে চা খেতে আসব কিন্তু আজ।” বলে ব্যস্ত বাগীশ বিমলবাবু হন্তদন্ত হয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যান। ভুবনবাবু শুনতে পেলেন বিমলবাবু তাঁর পুরনো স্কুটারে বিকট আওয়াজ তুলে চলে গেলেন।

সেদিন প্রথমে গেলেন পরিচিত পার্ক ষ্ট্রীটের নিলাম ঘরে। ইঙ্গ ভারতীয় মালিক সহাস্য মুখে বলেন- 
“আসুন আসুন ভুবনবাবু, নিলামে তোলার আগে আজ একটা জিনিস দেখাব আপনাকে” ভুবনবাবু কে নিয়ে গেলেন পিছনের গুদামের এক কোনায়। 
- “একেবারে আসলি চিজ দাদা।” 
ভুবনবাবু দেখেন বেশ পুরানো কালি ঝুলি মাখা একটি বড় দেওয়াল ঘড়ি। ঘন্টা নির্দেশক সংখ্যা গুলি বাংলায় লেখা। ডায়ালটা একটু বিবর্ণ হলদেটে হয়ে গেছে। মিনিটের দাগগুলো ঝাপসা। পেন্ডুলামটা মনে হয় পালিশ পেলেই ঝকমকিয়ে উঠবে।  
নিলামদার বলে চলেছেন -- 
“স্যার, দেউলিয়া এক জমিদার বাড়ির লোকেরা ছেড়ে দিলেন। একেবারে আসলি জাপানি মেক,  ‘MEIJI’ ১৮৯৫, কোনো এদিকউদিক করা নেই। একবার চাবি দেবেন, পাক্কা আট দিন নিশ্চিন্তে চলবে। ঠিক ঘন্টায় ঘন্টায় আর প্রতি আধা ঘন্টায় আওয়াজ দেবে। কাঠামো আসলি মেহগনির।”
ভুবনবাবু চোখ ফেরাতে পারছেন না ঘড়িটার থেকে। মনে পড়ছে একেবারে এটার মতো না হলেও, ছানার মুড়কি খেতে খেতে এরকম বাংলা সংখ্যা দেওয়া গোলা কৃতি ঘড়ি তিনি দেখেছেন বটে বউবাজারের ভীম নাগের দোকানে। সাধারণত বিক্রির জন্য রাখা ঘড়ির কাঁটা দশটা বেজে দশে হয়ে থাকে কিন্তু এই ঘড়িটার বড় কাঁটা ১২র ঘরে আর ছোটটা ৩ এ। হতে পারে এই ভাবেই আগের মালিকের কাছে পড়েছিল ঘড়িটা। কোনো কারণে বন্ধ হওয়া ঘড়িতে আর দম দেওয়া হয়নি। 
এদিকে নিলামদার বলে চলেছেন “আপনি কত দিনের কাষ্টমার স্যার, সমঝদার মানুষ, জানি এ জিনিস আপনার পছন্দ হবেই—আপনি নিতে রাজি হলে ঘড়িটাকে আর নিলামে তুলব না। ফিক্সড প্রাইসে ছেড়ে দেব। কাল বিকেলের মধ্যে অয়েলিং, পালিশ করে পৌঁছে দেব আপনার বাড়িতে।” ঘড়িটির প্রতি অদ্ভুত আকর্ষণ বোধ করছেন তিনি । দোনা মোনা না করে রাজি হয়ে গেলেন ভুবন বাবু ।
নিলামের দোকান তাদের কথা মত ঘড়িটা পৌঁছে দিয়েছে আজ তাঁর ফ্ল্যাটে। সত্যি! নতুন পালিশে মেহগনি কাঠামো, পিতলের পেন্ডুলাম ঝকঝক করছে। তাঁর ছোট ফ্ল্যাটের পক্ষে ঘড়িটা ঠিক মানানসই নয় তবে নেত্যকে দিয়ে বসার ঘরের দেওয়ালে হুক লাগালেশ ঘড়িটা ঝোলানোর জন্য। দিব্যি চলছে ঘড়িটা। অপেক্ষায় আছেন কখন একটা ঘন্টা পুরো হয়। আওয়াজটা শোনা যাবে তখন। নেত্য মাঝে মাঝে রান্না ঘর থেকে উঁকি মারছে। “ভৌ” সামনের দু পায়ে ভর দিয়ে ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে বসে। বোধ হয় বুঝতে পেরেছে নতুন কিছু শুনবে ওই অদ্ভুত বস্তুটির থেকে।
এই সময় হঠাৎ বিমলবাবুর আগমন। তিনি ভেতরে এসেই টিক টিক আওয়াজে দেওয়াল ঘড়িতে দৃষ্টি ফিরিয়ে বলেন-
“এ আবার নতুন কি আমদানি করলেন মশায়? আপনার এ সব পুরানো লজঝড়ে মাল পছন্দ হয় কি করে বলুন দেখি? ঠকিয়েছে নিশ্চয়ই!” হতাশায় মাথা নাড়ান বিমলবাবু। তাঁর চোখ এবার পড়ে “ভৌ” এর দিকে। “ভৌ” সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়েছে বিমলবাবুর দিকে। এরা দুজন পরস্পর কে ঠিক বন্ধুত্বের বৃত্তে রাখে না।
“ একটা নেড়ি কুকুর জুটিয়েছেন, এবার এটা ঘড়ি নাকি ঘোড়া কি এনেছেন, কে জানে!” 
“কতবার আপনাকে বলেছি “ভৌ” নেড়ি নয় বিমলবাবু, গোল্ডেন রিট্রিভার, জাত কুকুর মশাই।”
“ভৌ” মনে হয় বুঝেছে তার ব্যাপারেই কথা হচ্ছে। স্বদন্তের ঝিলিকের সাথে মৃদু গর্জনে সে বিমল বাবুকে যেন বুঝিয়ে দিল আলোচনার বিষয়টি তার নাপসন্দ।
“দেখেছেন তো, কুকুরকে যে নামেই ডাকা হোক সে কুকুর’ই থাকে। সব কুকুরের চরিত্র একই হয় মশায়। একটা দরকারি কাজে যাচ্ছি। তা হলে এখন উঠি। ঘড়িটা কেমন চলে জানাবেন।” বিমল বাবু স্বভাব মত হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেলেন।
ভুবনবাবু বড় খুশি হন ঘড়ির ঘন্টা ধ্বনির আওয়াজে, কি গম্ভীর। তাঁর ছোট্ট ফ্ল্যাটটা গমগম করে উঠছে। এরপর তিনি রোজ সকাল বিকেল তাঁর নিজের হাত ঘড়ি ও টিভির সাথে দেওয়াল ঘড়ির সময় মেলাতে থাকেন। কি আশ্চর্য! এত পুরনো ঘড়ি কিন্তু সময়ের এক চুল এদিক ওদিক হয় না। এর মধ্যে বার দুয়েক বিমলবাবু ঘড়িটার খোঁজখবর নিয়েছিলেন। তাঁর মতো সব সময় খুঁত খোঁজা লোকও অবাক হয়েছেন। তাও একবার বলেছেন- 
“ তা মশায় এই ঘড়ির ঘন্টার আওয়াজটা একটু কন্ট্রোল করা যায় না? রাত দুপুরে পিলে চমকে ওঠে। আরে! আগেকার জমিদার বাবুদের অ্সুবিধে হয়ত হত না। তাদের বাড়িও ছিল পেল্লায়। আবার দেউড়ি হয়ত বাড়ির থেকে কোয়াটার মাইল দুরে, দরোয়ানদের মনে হয় জেগে থেকে রাত পাহারার জন্য চোখে সরষের তেল রগড়ানোর দরকার পড়ত না। বোধ হয় এই ঘড়ির পিলে চমকানো ঘন্টা ধ্বনি তাদের সেই দেউড়িতেও জাগিয়ে রাখার পক্ষে যথেষ্ট ছিল। সেই হিসেবে ঘড়ির আওয়াজটা মানানসই হত বটে কিন্তু আপনার তো আর তা নয় মশায়। এর মধ্যেই আশপাশের বাড়ির লোকেরা বলতে শুরু করেছে ‘হ্যাঁ সোমবাবু ঘড়ি একটা কিনেছেন বটে, পাড়ার কারুর বাড়িতে আর ঘড়ি রাখতে হবে না’!” 
ভুবনবাবু কোনো উত্তর না দিয়ে, ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে তৃপ্তির হাসি হাসেন।
এইভাবে বেশ কয়েক সপ্তাহ কেটে যায়।
এর পর কিছু রাত তিনি লক্ষ্য করেন “ভৌ” কেমন যেন ছটপট করছে ঘুমের মধ্যে। আবার এক রাতে তার গোঙানির শব্দ শুনতে পেলেন। সচরাচর ভুবনবাবুর ঘুম আসতে দেরি হয়। ঘুম না আসা অবধি বই পড়েন। তাঁর এখন আবার নতুন অভ্যাস হয়েছে। রাতে ঘড়ির ঘন্টার আওয়াজ শুনলেই, খাটের পাশের টেবিলে রাখা হাত ঘড়িটা তুলে সময় মেলানো। সে দিন রাত তিনটের ঘন্টাগুলো বাজতেই, “ভৌ” এর অস্ফুট গোঙানি শুনে তাকে তাঁর বিছানায় তুলে নিলেন। তাকে সান্তনা দিতে গায়ে হাত বুলোতেই আশ্চর্য হলেন – “ভৌ” এর শরীরের রোমগুলো খাড়া হয়ে উঠেছে, সাথে অস্ফুট গোঙানি।“ কুকুররা কি মানুষের মত ঘুমের মধ্যে দু:স্বপ্ন দেখে নাকি! সকালে একবার ব্রুস ফোগলের “The Dog’s Mind” বইটা দেখা দরকার। সমাধান না খুঁজে পেলে ডা: কুলকার্ণীর কাছে নিয়ে যেতে হবে।” ভাবেন ভুবনবাবু। ডা:কুলকার্ণী বাঁধা ব্যবস্থা মত মাসে এক বার তাঁর চেম্বারে “ভৌ”এর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে থাকেন।
পরের দিন সকালে ব্রেকফাস্টের সময় নেত্যকে ঘটনাটা বললেন ভুবনবাবু। 
তিনি মাঝে মাঝে সারা দুপুরটা কাটিয়ে আসেন গোল পার্কের রামকৃষ্ণ মিশনের লাইব্রেরীতে। সে দিন বিকেলে ফিরতেই – নেত্য উত্তেজিত হয়ে রিপোর্ট করে –
“ভৌ” কে সামলাতে আজ সারা দিন খুব মুশকিল হয়েছে দাদাবাবু। কিচ্ছু খায় নি সারা দিন। বসার ঘরে এক কোণে থাবা গেড়ে বসে রইল দিন ভোর। ঘড়ির দিকে মাঝে মাঝে তাকায় আর গর গর করে ওঠে। ওই দেখুন এখনো সেইভাবে বসে রয়েছে।”
ভুবনবাবুকে সোফায় বসতে দেখে “ভৌ” উঠে এসে তাঁর হাঁটুতে মাথা রেখে তাকায় কাতর চোখে। তিনি তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন “কি হয়েছে রে তোর? খাস নি কেন সারা দিন?” কথা বলতে অপারগ “ভৌ” তাঁর দিকে তাকিয়ে কিছু যেন বলতে চায়। শেষে হতাশ হয়ে তাঁর পা ঘেঁসে শুয়ে পড়ে। ভুবনবাবু তার গায়ে কিছুক্ষণ হাত বুলিয়ে চিন্তা করেন “ভৌ” এর গত কয়েক রাত্রের অদ্ভুত আচার-আচরণ। উঠে গিয়ে সেলফ থেকে বইটা নিয়ে চোখ বোলান। না: কুকুরদের এই অদ্ভুত আচরণ নিয়ে় কিছু পেলেন না। শেষে ঠিক করেন আর কিছু দিন “ভৌ” ওপর লক্ষ্য রেখে, ডা: কুলকার্ণী কাছে নিয়ে যাবেন।
পর পর বেশ কয়েক সপ্তাহ ঘটনা বিহীন কেটে গেল। “ভৌ” এর আচার- আচরণ আবার আগের মত স্বাভাবিক। খাওয়া দাওয়াও করছে ঠিক মত। ভুবনবাবু নিশ্চিন্ত হলেন ভেবে, হয়ত সাময়িক কোন শারীরিক কারণে সে অস্বাভাবিক আচরণ করেছে। 
আবার গতানুগতিক ভাবে দিনগুলো কেটে যেতে থাকে। অবশ্য তাঁর নতুন অভ্যাস, ঘন্টায় ঘন্টায় দেওয়াল ঘড়ির সময় মেলানোটা বজায় থাকল।
এবার এলো নেত্যর পালা।
সে দিন মঙ্গলবার। ভুবনবাবু সকালের প্রথম চা’ এর কাপে বেশ মৌজ করে চুমুক দিচ্ছেন। সামনের টেবিলে খোলা খবরের কাগজ। ধিরে সুস্থে হেড লাইনে চোখ বোলাচ্ছেন তিনি। ভাবছেন আজ সন্ধ্যায় বিমলবাবু এলে রাজনীতি নিয়ে কি প্রশ্ন করা যেতে পারে। আড় চোখে খেয়াল করেন চা’ এর টেবিলের সামনে নেত্যর ইতস্তত: ঘোরাফেরা। কিছু যেন বলতে চায় কিন্তু দোটানায় পড়ে বলতে পারছে না।
“কি রে নেত্য কিছু বলবি নাকি?” ভুবনবাবুর স্বরে প্রশ্রয়।
নেত্য কিছুক্ষণ মাথা চুলকে, কাঁধের গামছায় হাত মুছে দাঁড়িয়ে থাকে। ভুবনবাবু আশশ্ত করলে, সে বলেই ফেলে –
“দাদাবাবু কি বলবো জানি না। আমার ভ্রম হচ্ছে হয়ত। আপনি তো জানেন ওই বসার ঘরের জানলার দিকের দেওয়াল ঘেঁসে আমি রাতে শুই।” গলাটা একটু ঝেড়ে নিয়ে আরম্ভ করে – “এখন একটু অভ্যাস হয়ে গেলেও, ওই ঘড়ির ঘন্টার আওয়াজে মাঝে মাঝে ঘুমটা একটু চটে যায়। তা কাল রাতে দাদাবাবু, তখন ঘড়িতে তিনটের ঘন্টা বাজতেই ঘুমটা আমার ভেঙে গেল। দেওয়ালের দিকে পাশ ফিরে শুতে যাব, শুনলাম হালকা একটা শব্দ। অনেকটা বুড়ো মানুষদের লাঠি ঠুকে ঠুকে পা ঘসটে চলার মত। উঠে আলো জ্বালাতে যেতেই, আওয়াজটা থেমে গেল। আমার মনের ভুল হল কিনা বলতে পারি না দাদাবাবু।” 
মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে নেত্য।
ভুবনবাবু কিছু ক্ষণ চিন্তা চিন্তা ভাব দেখিয়ে বলেন - 
“শুনেছিস হয়ত ঠিক। ইঁদুরে হয়ত কিছু টানাটানি করছিল। আজ বিমলবাবু এলে একটু মনে করিয়ে দিস। ওনার বাড়ি ঘরদোর ফিউমিগেশনের লোকজন জানা থাকতে পারে। তাদের দিয়ে ফিউমিগেট করিয়ে নেওয়া যাবে। তুই এখন থেকে একটু খেয়াল রাখিস। বাড়ির দোতলায় ইঁদুর ঘুরে বেড়াচ্ছে সেতো ঠিক নয়।” 
নেত্য সমস্যার এই সহজ সমাধান শুনে, একটু দাঁড়িয়ে মাথা নাড়তে নাড়তে রান্না ঘরের দিকে চলে যায়। বোঝা যায় সমস্যাটা ইঁদুর শুনে সে যেন খুব একটা নিশ্চিন্ত হয়নি। 
সে দিন বিকেলে বিমলবাবু এলে জানা গেল তাঁর এক বন্ধুর ফিউমিগেশনের কারবার আছে। কিন্তু তাঁকে কিছুটা চিন্তান্বিত মনে হল –
“বলেন কি মশায়! আপনার দোতলার ফ্ল্যাটে ইঁদুর? অবশ্য হতে পারে – আপনার “ভৌ”, শুনতে পাই রোজ বিকেলে নেত্যর সঙ্গে পাড়া বেড়াতে বেরোয়। এই সব কুকুরদের বিশ্বাস নেই মশায়। দেখুন - কি না কি মুখে নিয়ে এসেছে। পেছন পেছন ইঁদুরের পাল ঢুকিয়েছে আপনার ফ্ল্যাটে। চিন্তায় ফেললেন দেখছি। আমার ফ্ল্যাট তো আপনার পাশেই। ছেলেপুলে নিয়ে ঘর। তা’হলে আপনার ফ্ল্যাটের সঙ্গে আমারটাও ফিউমিগেট করিয়ে নিতে হবে।”
“ভৌ” বসে আছে ভুবনবাবুর পায়ের কাছে। সাধারণত: বিমলবাবুর কাছে নিজের নাম শুনলে সে একটু বিরক্তি প্রকাশ করে থাকে কিন্তু আশ্চর্য, আজ সে তার সামনের দুই পা’ এর মাঝে মাথা গুঁজে চোখ পিটপিট করে শুয়ে রইল। ভুবনবাবু লক্ষ্য করেছেন সেই দিনের সামান্য অসুখের পর থেকে “ভৌ” যেন একটু নিস্তেজ হয়ে আছে। না: সামনের রবিবার ওকে নিয়ে ডা: কুলকার্ণীর কাছে যেতেই হবে।
বিমলবাবু আরো দু’চার কথা বলে বিদায় নিলেন।
একটা সপ্তাহ কেটে যায়। সে দিনটাও মঙ্গলবার। রাতের খাওয়া দাওয়া মিটে যাওয়ার পর যথা রীতি ভুবনবাবু তাঁর বাকি দু’জন সঙ্গী নিয়ে টিভির সামনে আধ ঘন্টা মতন বসে শুতে গেলেন। নেত্য বসার ঘরে তার পছন্দের জায়গা জানলার নিচে দেওয়াল ঘেঁসে বিছানা পাতে। “ভৌ” যেন একটু নিস্তেজ হয়ে শুয়ে তার নিজস্ব জায়গায়। ভুবনবাবুর খাটের পাশে রাখা হালকা পড়ার আলোটা ছাড়া ফ্ল্যাটের বাকি সব আলো নিবে গেল। তাঁর খানিকটা পড়া প্রিয় লেখক উইলবার স্মিথের “ফারাহও” বইটার বুক মার্ক রাখা পাতাটা পড়তে আরম্ভ করেন। নিশুতি রাত। বসার ঘরের দেওয়াল ঘড়ির কানে সয়ে যাওয়া অবিরাম টিক টিক শব্দ, মাঝে মাঝে পাড়ার রাত জাগা কুকুরদের নিজেদের মধ্যে বিতণ্ডা জবাবে “ভৌ’ য়ের ঘুমের ঘোরে মৃদু প্রতুত্তরের প্রয়াস ছাড়া, আর কোনো শব্দ নেই। ভুবনবাবু বই’য়ের পাতা উল্টে চলেন। পড়তে পড়তে কানে আসে দেওয়াল ঘড়ির ঘন্টা নিরুপক গম্ভীর আওয়াজ যাকে নির্ঘোষও বলা যেতে পারে। রাত বয়ে যায়। ভুবনবাবুর মন পুরোপুরি নিবিষ্ট হয়ে আছে মিশরীয় রাজ কাহিনীর অন্দর কন্দরে।
ভুবনবাবুর মনোযোগ বিচ্ছিন্ন হয় ঘড়ির পর পর তিনটি ঘন্টা ধ্বনির সাথে সাথে “ভৌ”য়ের কাতর আর্তনাদ। তারপরই সে লাফিয়ে খাটে উঠে ভুবনবাবুর গা ঘেঁসে শুয়ে পড়ে ভয়ার্ত ক্রন্দনের সাথে যেন কিছু বলতে চায়। “ভৌ”য়ের এই অদ্ভুত ব্যবহারে ভুবনবাবু কিছুটা হতভম্ব হন। ঘরের চারপাশ দেখে বুঝতে চেষ্টা করেন তার স্বভাব বিরুদ্ধ এই বিস্ময়কর আচরণের কারণ। কিন্তু সে রকম কোন অস্বাভাবিকতা তাঁর নজরে আসে না। এর পরেই শোনেন তাঁর ঘরের দরজায় বেশ জোরে একটানা ঠকাঠক শব্দের সাথে দরজার ওপার থেকে ভেসে আসে নেত্যর আতঙ্কিত স্বর- 
“দাদাবাবু দরজা খুলুন – দরজা খুলুন।” ভুবনবাবু তাড়াতাড়ি উঠে দরজা খুলতেই প্রায় মুক্তকচ্ছ নেত্য হুড়মুড়িয়ে তাঁর গা’য়ের ওপর পড়ে তোতলাতে থাকে “ইঁদুর নয় দাদাবাবু, ইঁদুর নয়।” কিংকর্ত্তব্য বিমূঢ় ভুবনবাবু কোনোক্রমে নেত্যকে তাঁর খাটে বসিয়ে টেবিলে রাখা জলের গ্লাস এগিয়ে দিলে, নেত্য এক চুমুকে তা শেষ করে বসে বসে হাঁপাতে থাকে। তার জামা কাপড়ের ঠিক নেই, বিস্ফারিত চোখের দৃষ্টি। ও দিকে মহা প্রতাপশালী “ভৌ” খাটের ওপর প্রায় জড় সড় হয়ে দু’পায়ের মাঝে মুখ গুঁজে বসে, তার লম্বা জিব বেরিয়ে আছে মুখের এক পাশে, অসহায় মৃদু করুণ স্বরে কেঁদে চলেছে। ভুবনবাবু বুঝতে পারেন না এই দু’জনের এহেন অবস্থা হল কি জন্যে! তবে এটা  বোঝা যাচ্ছে এরা দু’জনে নিশ্চয়ই কোনো কিছুতে ভীষন ভয় পেয়েছে। ভুবন বাবু ঘরের সব আলো জ্বালিয়ে তাদের ধাতস্থ হওয়ার সময় দেন। তাঁর চিন্তার অন্যমনস্কতার ছেদ পড়ে কোন আওয়াজে। দেখেন নেত্য এর মধ্যে খাট থেকে উঠে দাঁড়িয়ে লজ্জা লজ্জা মুখে দাঁড়িয়ে আছে।ওদিকে “ভৌ” অনেকটা স্বাভাবিক, তার এক টানা কান্না বন্ধ হয়েছে। নেত্যকে জিজ্ঞাসা করেন ব্যাপারটা কি। নেত্য লজ্জা ভাব কাটিয়ে বলতে শুরু করে –
“কি বলি দাদাবাবু, আমার মাথাতেও ঢুকছে না। কাল রাতে আপনি দরজা দিলে পর, আমি রোজকার মত আমার বিছানা ওই জানলার নিচে পেতে ফেলি। মনে আছে তখন বড় ঘড়িতে ঠিক ১১টা ঘন্টা পড়ল। তা শুয়ে পড়েছিলাম, ঘুমও এসে গেছিল। এরপর ঘড়ির এক টানা ১২টা বাজার শব্দে ঘুমটা চটকা মেরে কেটে গেল। এ রকম বলতে পারেন প্রায় রোজই হয়ে। তবে অন্যান্য রাতে আবার ঘুমিয়ে পড়ি। কিন্তু আজ যেন কিছুতেই ঘুমোতে পারছিলাম না। একটু অস্বস্তি হচ্ছিল, ভেবে ছিলাম বদ হজম হবে বোধ হয়। এ পাশ ও পাশ করতে করতে চোখ দুটো একটু জুড়ে এসেছিল।তবে আধ ঘুমন্ত অবস্থায় ২টো বাজার ঘন্টাটাও শুনেছি। তারপর দাদাবাবু হঠাৎ কানে এল ঘড়িটার ৩ বার ঘন্টার সঙ্গে সঙ্গে লাঠির খুট খুট শব্দ সাথে কিছু ঘসটে ঘসটে ঘরের জানলার দিকে এগিয়ে আসছে। ঘুম পুরো ভেঙ্গে গেল। এ শব্দ ইঁদুর করতে পারে না দাদাবাবু। প্রথমে মনে হল ঘরে চোর ঢুকেছে বোধহয়। প্রাণপণে দু চোখ বুজে ছিলাম। বুঝতে পারলাম কেউ এসে দাঁড়িয়েছে আমার শিয়রে। জোর করে চোখ একটু খুলে দেখি হাতে লাঠি, লম্বা মতন এক বুড়ো মানুষের ছায়া, কাঁচের গ্লাসে রাখা জলের মধ্যে দিয়ে যেমন দেখায়, তিরতির করে কাঁপছে আবার উধাও হয়ে যাচ্ছে। তারপর মনে নেই দাদাবাবু।” হাঁপাতে থাকে নেত্য। ভুবনবাবু কি বলবেন বুঝে উঠতে পারলেন না। নেত্যকে গত চোদ্দ বছর চেনেন। আজগুবি গল্প বানিয়ে বলার লোক সে নয়। বোঝা যাচ্ছে সত্যি সে ভয় পেয়েছে। বেশ কিছু দিন “ভৌ”এর রকম সকম তেমন সুবিধের বলে মনে হচ্ছে না। আগের রাতে তার অবস্থা ছিল বড়ই শোচনীয়। তিনি জানলা দিয়ে বাইরে তাকালেন। ধীরে ধীরে ভোরের আলো ফুটে উঠছে। একটা দুটো পাখির ঘুম ভাঙ্গা ডাক শোনা যায়। শোয়ার ঘর থেকে বসার ঘরে এসে দেওয়াল ঘড়ির নিচে দাঁড়িয়ে চোখ তুলে দেখেন, জানলার শার্শি চোঁয়ানো ভোরের আবছা আলোয় ঝকঝকে পেন্ডুলামটা মনের আনন্দে দুলে চলেছে। বিমলবাবুর মুখটা ভেসে ওঠে চোখের সামনে। একটু বাজে বকেন বটে কিন্তু চোখে বুদ্ধির ছাপ আছে। আর একটু বেলা হলে তাঁর অফিস বেরনোর আগে একবার দেখা করতে হবে। নিজের শোয়ার ঘরে ফিরে দেখেন নেত্য আর “ভৌ” যে যার জায়গা থেকে নড়ে নি। মনে হয় বসার ঘরের দিকে আসতে দুজনেই ইতস্তত: করছে। তাঁর হঠাৎ মনে হল নেত্য বা “ভৌ” সত্যি হয়ত কিছু অনুভব করেছে! দেওয়াল ঘড়িটা আনার পর প্রথমে “ভৌ” পরে নেত্যর এই অস্বাভাবিক আচরণ। 
না: বিমলবাবুর সঙ্গে আলোচনা করতেই হবে।
সাধারণত: বিমলবাবু তাঁর যাতায়াত বেশ জানান দিয়ে করে থাকেন। বেরোবার আগে ঘরের লোক কে বলার দরকারি কথাগুলো তিনি বলেন ফ্ল্যটের বাইরে এসে এবং বেশ উচ্চ স্বরে। কথার শেষে দড়াম করে ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ করেন। কিছু পরেই শোনা যায় স্কুটারে বিকট আওয়াজ। অন্য সময় ভুবন বাবু এই অহেতুক ভেসে আসা শব্দ প্রবাহে বিরক্ত হন। কিন্তু আজ তিনি উৎকর্ণ হয়ে অপেক্ষায় থাকেন।
এর মধ্যে ভয়ার্ত দু’জন সাহস সঞ্চয় করে তাঁর শোয়ার ঘরে থেকে বেরিয়ে এসেছে। নেত্যর বাড়িয়ে দেওয়া চা’য়ের কাপে চুমক দিতে না দিতেই শুনতে পান – বিমলবাবু তাঁর ফ্ল্যাটের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে বাজারের ফর্দটা উচ্চস্বরে রিপিট করছেন। ভুবনবাবু তাড়াতাড়ি দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন - “গুড মর্নিং দাদা । কি হল সকাল সকাল?” বিমলবাবুর সহাস্য উক্তি।
ভুবনবাবু বলেন “খুব জরুরী ব্যাপারে আপনার সাথে কিছু আলোচনা করার ছিল। মানে যখন আপনার একটু সময় হবে, যদি এক বার আসেন।” 
বিমলবাবু কিছুটা আশ্চর্য হন- “কি হলো বলুন দেখি? এত আর্জেন্ট!ভআপনার মুখ চোখের অবস্থা তো ভালো ঠেকছে না? আপনার “ভৌ” আবার কিছু কান্ড বাঁধালো নাকি মশায়? আচ্ছা, তা’হলে বাজারটা সেরে চলে আসছি। আজ আমাদের অফিস ছুটি ডিক্লেয়ার করেছে, সকালে ফোনে খবর পেলাম। আমাদের এক কলিগ হঠাৎ কাল রাতে মারা গেছেন তাই।” বিমলবাবু হন্তদন্ত হয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলেন।
ভুবনবাবু অপেক্ষায় রইলেন।
ঘন্টা দুয়েক পরে ভুবনবাবু বারান্দা থেকে শুনতে পেলেন কলিং বেলের আওয়াজ তার সাথে দরজা খোলার ও “ভৌ” এর মৃদু উপেক্ষা জড়িত ডাক। তারপরই বিমলবাবুর উদাত্ত স্বর- 
“আরে নেত্য তোমার অবস্থাও তো দেখি দাদাবাবুর মতো। তোমাদের হল’টা কি ? ভালো করে কড়া এক কাপ চা বানাও দেখি।”
ভুবনবাবু বারান্দা থেকে বেরিয়ে আসেন। বিমলবাবু ততক্ষণে দেওয়াল ঘড়ির সঙ্গে তাঁর হাত ঘড়ির সময় মেলাচ্ছেন – “যাই বলি না কেন মশায়, আপনার এই ঘড়ি সময়টা দেখায় কিন্তু এক্কেবারে পাক্কা।”
ভুবনবাবু অল্প হেসে বসেন সামনের সোফায়।
চা’য়ের কাপে সশব্দে চুমুক দিয়ে বিমলবাবু বলেন “এবার বলুন দেখি ব্যাপারটা কি? আমার তো

মশায় তর সইছে না। আপনার আবার এমন কি প্রবলেম হলো যে আমার সাথে আর্জেন্ট আলোচনা করতে হবে? আপনার জীবন বিমা নিয়ে কিছু নাকি?” 

“আরে না না, জীবন বিমা নয়। অন্য কিছু, যা নিয়ে কয়েকটা দিন অনেক ভেবেও কুল কিনারা পাচ্ছি না।” এবার ভুবনবাবু ধীরে সুস্থে দেওয়াল ঘড়িটা কেনার পর থেকে মাঝে মাঝেই “ভৌ” এর অস্বাভাবিক আচরণ, এরপর নেত্যর পরপর দু’রাত অলৌকিক কিছু দেখার ও শোনার অনুভূতির কথা বিমলবাবুকে বলেন। যেমন প্রথমবারের ঘটনা ইঁদুরের দৌরাত্ম মনে করা হয়েছিল। আবার বিশেষ করে গত রাত্রে দেওয়াল ঘড়ির ঠিক রাত তিনটের ঘন্টা ধ্বনির পর নেত্যর কিছু দেখার অভিজ্ঞতা। দুটো ঘটনাই দেখা যাচ্ছে রাত তিনটের সময়। এর সাথে যোগ করলেন নিজের সন্দেহ। পুরো ঘটনাবলী যেন আবর্তিত হচ্ছে এই ঘড়িটা জড়িয়ে। সেই জন্য তাঁর কারুর সঙ্গে আলোচনা দরকার আর তিনি আশা করছেন বিমলবাবু যদি এই ব্যাপারটায় কিছু আলোক পাত করতে পারেন।শুনতে শুনতে বিমলবাবুর সব বিষয়ে খুঁত খোঁজা ভ্রু কোঁচকানো তীক্ষ্ণ চোখ দুটি ক্রমশ বর্তুলাকার ধারণ করে।

“বলেন কি মশায়? আপনার কথা যদি সত্যি হয় – এতো ভয়ানক ব্যাপার!” এবার তিনি রান্না ঘরের দরজায় দাঁড়ানো নেত্য ও তাঁর দিকে সন্দেহ পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা “ভৌ” এর ওপর চোখ বুলিয়ে বলেন - 
“দেখুন দাদা, এতো মনে হচ্ছে ভুত প্রেতের ব্যাপার। আমার এক জন তান্ত্রিকের সাথে জানা শোনা আছে। যদি বলেন আমি একবার তাঁর সাথে শলা পরামর্শ করতে পারি। অবশ্য যদি আপনি মত দেন।”
ভুবনবাবু তাৎক্ষনিক এই পরামর্শ নস্যাত করে বলেন “দেখুন বিমলবাবু আমার ওসব তন্ত্র মন্ত্রে বিশ্বাস নেই। যদি অন্য কিছু ভেবে বার করতে পারেন তো বলুন।”
বিমলবাবু এরপর গভীর চিন্তান্বিত হয়ে নেত্যকে চা দিতে বল্লেন। চা’এর সঙ্গে গোটা দু’য়েক সিগারেট পুড়িয়ে, গলা খাঁকরি দিয়ে ভুবনবাবুর দিকে ফিরে চোখ গোল করে বলেন – 
“সব ঘটনা শুনে মনে হচ্ছে ভুবনবাবু ব্যাপারটা সত্যি রহস্যময়। আপনি বলছেন প্রতি মঙ্গলবার ওই ঘড়িটায় রাত তিনটে বাজলে ঘটনাটা ঘটে এই বসার ঘরে কারণ নেত্য দু রাত কিছুর উপস্থিতি অনুভব করেছে বা দেখেছে। যত দুর জানি নেত্যর নেশা ভাঙের অভ্যাস নেই। কুকুরের আচরণটায় অবশ্য বিশেষ গুরুত্ত্ব দিতে চাই না। তাই আমি ভাবছি আমরা দু’জন এই পরের মঙ্গলবার রাত তিনটে নাগাদ এই ঘরে হাজির থেকে ব্যাপারটার কারণ বার করার যদি চেষ্টা করি, অবশ্য আপনি যদি রাজি থাকেন।” ভুবনবাবু এই পরামর্শে উৎসাহিত হয়ে সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যান।
পরের মঙ্গলবার দেওয়াল ঘড়িতে রাত বারোটার ঘন্টা শেষ হতে না হতে বিমলবাবু এসে হাজির। তিনি সঙ্গে করে এনেছেন একটি লাঠি আর এক পাঁচ সেলি টর্চ।
ভুবনবাবুর কৌতুহলের তিনি উত্তর দিলেন- 
“আরে বুঝলেন না মশায়, আজকাল চোরেরা কত রখম ফন্দি ফিকির বার করে চুরি করার জন্য। যদি সত্যি তাই হয়ে, আমাদের তৈরি থাকা উচিত নয় কি?” কথা আর না বাড়িয়ে ভুবনবাবু রাত জাগার ব্যবস্থাদি করেন। ঠিক হলো তিনি আর বিমলবাবু বসার ঘরের সোফায় বাকি রাতটা কাটাবেন। নেত্য শুয়ে থাকবে ঘরের জানলার নিচে তার নির্দিষ্ট জায়গায়, আর “ভৌ” কে বন্ধ রাখা হবে ভুবনবাবুর শোয়ার ঘরে।
নেত্যর সরবরাহ করা চা’য়ের সাথে তাঁরা নানা গল্প করে সময় কাটাতে লাগলেন। ঘড়িতে রাত আড়াইটের একবারের ঘন্টায় বসার ঘরটা গমগম করে উঠল। পূর্ব পরিকল্পনা মত নেত্য চট জলদি জানালার নিচে মেজেতে তার বিছানা পেতে শুয়ে পড়ল। ফ্ল্যাটের সব আলো নেবানো হলো। বসার ঘরের জানলা দিয়ে রাস্তার ক্ষীণ আলোর তির্যক টুকরো এসে পড়েছে ঘরের সিলিঙের এক কোণে। রাস্তার রাত জাগা কুকুরগুলো বোধহয় এতক্ষণ হৈ হট্টগোল করে ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছে। শুধু মাঝে মাঝে “ভৌ” এর দরজা আঁচড়িয়ে শোওয়ার ঘরে বদ্ধ থাকার আপত্তি জানানো আর দেওয়াল ঘড়ির টিক টিক অবিরাম শব্দ ছাড়া আর কোনো আওয়াজ নেই।
বিমল বাবু মাঝে ফিস ফিসিয়ে কিছু বলতে চাইলে ভুবনবাবু তাঁর হাতে চাপ দিয়ে থামাবার চেষ্টা করেন। ঠিক এই সময় গম গম করে দেওয়াল ঘড়িতে তিনটে ঘন্টা পড়ার রেশ কেটে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে “ভৌ”এর দরজা আঁচড়ানো বন্ধ হয়ে গিয়ে শুরু হয় তার আর্ত গোঙানি। হঠাৎ টের পেলেন ঘরের আবহাওয়ার কিছু পরিবর্তনের। অস্বাভাবিক দম বদ্ধ হওয়ার ভাব বেড়ে উঠেছে। শ্বাস প্রশ্বাসের কষ্ট উপলব্ধি হতে থাকে। তাঁর হাত শক্ত করে ধরে পাশে বসে থাকা বিমলবাবু - নিথর, কোন সাড় নেই। তাঁর হাতে ধরা টর্চটা গড়াগড়ি দিচ্ছে সোফার নিচে। আড় চোখে লক্ষ্য করেন নেত্যর অবস্থা তথৈবচ। দেওয়াল ঘড়ির অবিরাম টিক টিক আওয়াজও স্তব্ধ হয়ে গেছে। সময়টা যেন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে এক জায়গায়। নিবিড় নিস্তব্ধতার মাঝে ভুবন বাবু অনুভব করেন খুব মন্থরভাবে কোন কিছুর মেজে ঘসটাতে ঘসটাতে এগিয়ে আসা শব্দের সাথে আলগোছে লাঠির ঠুক ঠুক শব্দ। আকস্মিক নজরে আসে ঠিক যেন জল স্তরে কম্পমান মানুষের ছায়া ক্ষণে ক্ষণে গঠন পাল্টাতে থেকে এখন ভাসছে দেওয়াল ঘড়ির নিচে। ছায়াময় মূর্তি কি যেন খুঁজে বেড়ায় ঘরের চারিপাশ। ক্রমশ সেই টলটলায়মান বায়বীয়ও ছায়ামূর্তি ঘরের মেজে ছুঁয়ে ভেসে যায় শোয়ার ঘরের দরজায়। স্পষ্ট শোনা যায় “ভৌ”এর ক্রমশ মৃয়মান কাকুতি মিনতি। আন্দাজে বোঝেন মোটামুটি রূপ পাচ্ছে সেই দীর্ঘ ছায়াময় আকৃতি - ঘাড় ছোঁয়া থাক থাক পাকা চুলের ঢল, হাঁটু অবধি ফ্যাকাসে পিরান। বাঁ পা টা যেন নেতিয়ে আছে মেজেতে। এবার সেই বায়বীয় ছায়াময় মূর্তি শোয়ার ঘরের দরজা থেকে ক্রমে ভেসে যায় দেওয়াল ঘড়ির ঠিক নিচে। কয়েক নিমেষ মাত্র, তিরিতিরি কাঁপা ছায়াময় আকৃতি ছত্রাখান হয়ে ছড়িয়ে পড়ে কোথায় মিলিয়ে গেল চোখের সামনে। 
ভুবনবাবু স্তব্ধ হয়ে কতক্ষণ বসে আছেন খেয়াল নেই।
দেওয়াল ঘড়িতে ৫টা বাজার গম গমে আওয়াজে তাঁর হুঁস ফেরে। তখন ভোরের আলো জানলা দিয়ে উঁকি দিচ্ছে। দেওয়াল ঘড়ির পেন্ডুলাম মনের আনন্দে দুলে টিক টিক আওয়াজ তুলছে।বাড়ির সামনের গাছে কয়েকটা চড়াই আর শালিক দিনের প্রথম আলো মেখে খুশিতে নিজেদের ভাষায় অনর্গল কথা বলে চলেছে।
বিমোহিত ভুবনবাবু সোফা থেকে উঠে দাঁড়ান। দেখেন নিসাড় বিমলবাবু সোফার এক দিকে হেলে বসে রয়েছেন। নেত্য পা ছড়িয়ে দেয়ালে টাল খেয়ে আধ শোয়া। একটু ঠেলা দিয়ে বোঝেন দু’জনেই অচেতন। নিজেকে সামলে নিয়ে তাড়াতাড়ি রান্না ঘর থেকে জল এনে তাদের মাথায় মুখে ঝাপটা দিতে প্রথমে নেত্য, একটু পরে বিমলবাবুর জ্ঞান ফিরে আসে। 
বিমলবাবু চোখ খুলেই বলে ওঠেন “আরে আরে কি করেছেন দাদা? জামা টামা একে বারে ভিজিয়ে দিলেন যে!”

“কি করি বলুন – আপনি অজ্ঞান হয়ে গেছিলেন যে। তাই জলের ছিটে দিতে হল।” জবাব দিলেন ভুবনবাবু। 
"কে বলেছে আমি জ্ঞান হারিয়েছি? সারা রাত জেগে থেকে ওই চোখ দুটো একটু বুজে গেছিল আর কি।” বিমলবাবু প্রতিবাদ করে ওঠেন। ভুবনবাবু কথা আর না বাড়িয়ে, এগিয়ে যান শোওয়ার ঘরের দিকে। একটু পরেই ভুবনবাবুর চিৎকার ভেসে আসে 
“বিমলবাবু শিগ্গিরি আসুন, দেখুন “ভৌ”য়ের কি অবস্থা!” বিমল বাবু চট জলদি শোওয়ার ঘরে গিয়ে দেখেন ভুবনবাবু “ভৌ”য়ের নিথর দেহ কোলে নিয়ে বসে আছেন।
“দেখুন “ভৌ”য়ের কি হয়েছে! কিন্তু বেঁচে আছে মনে হচ্ছে। প্লিজ নেত্যকে বলুন একটা ট্যাক্সি ডাকতে। আমি ততক্ষণ ডা:কুলকার্ণী কে ফোন করি।”
তিন জনে ধরাধরি করে “ভৌ”কে ট্যাক্সিতে তুলে নিয়ে আসেন ডা: কুলকার্ণীর ক্লিনিকে। ব্যাপারটার গুরুত্ব বুঝে ডা:কুলকার্ণী এই সকালে ক্লিনিকে চলে এসেছেন। “ভৌ”কে ডাক্তারের জিম্মায় রেখে সবাই বাড়িতে যখন ফিরে আসেন, তখন দেওয়াল ঘড়িতে সকাল আটটার ঘন্টা ধ্বনি এক এক করে বেজে চলেছে। তিন জনের দৃষ্টি কিছুক্ষণ দেয়াল ঘড়িতে স্থির হয়ে থাকে। বিমলবাবু মেজেতে ছড়িয়ে পড়ে থাকা টর্চ আর লাঠিটা তুলে নিয়ে একটু পরে আসছেন বলে বেরিয়ে গেলেন।
ঠিক এগারোটার সময় বিমলবাবু ফিরে এসে দেখেন, বসার ঘরে ভুবনবাবু অন্যমনস্ক চোখে জানলার বাইরে তাকিয়ে। গভীর চিন্তার ছাপ চোখে মুখে।
“দেখলেন তো মশায়! বলিহারি শখ আপনার, যত রাজ্যের পুরানো মান্ধাতা আমলের জিনিস জুটিয়ে নিয়ে এসে কি বিপত্তি বাঁধিয়েছেন!” ভুবনবাবু এ কথার উত্তর না দিয়ে চিন্তান্বিত স্বরে বলেন-
“ভাবছি এর রহস্যটার সমাধান খুব তাড়াতাড়ি করা দরকার। ঠিক করলাম এক বার নিলামের শো রুমের মালিকের সঙ্গে কথা বলা দরকার। ওনার এই ঘড়িটার ইতিহাস যদি কিছু জানা থাকে তা’হলে সমস্যাটার সুরাহা করার চেষ্টা করা যেতে পারে। কি বলেন?”
বিমলবাবু সায় দেন। ঠিক হলো আগামি কাল বৃহস্পতিবার তাঁরা দুজনে নিলামের শো রুমের মালিকের কাছে যাবেন। বিমলবাবু বললেন “আমার বেশ কিছু ছুটি জমে গেছে বুঝলেন। এই অদ্ভুত ব্যাপারটা যা দেখলাম কিছুতেই মাথায় ঢুকছে না মশায়। আমি যাব আপনার সঙ্গে।”
পরের দিন তাঁরা পৌঁছলেন নিলামের শো রুমে। মালিক শো রুমের অফিসে তাঁদের অপেক্ষায় ছিলেন। ভুবনবাবুর কাছে পুরো ঘটনাটা শোনার পর তাঁর মন্তব্য -  
“আশ্চর্য! এত বছর এ্যান্টিক জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করছি স্যার, আপনি যা বললেন কখনো এরকম ঘটনা শুনি নি। আপনাকে নিশ্চয়ই হেলপ করব।” 
তিনি ম্যানেজারকে তখনি ডেকে ঘড়িটার ডিটেলস বার করতে বলেন। ম্যানেজার মোটামুটি আধ ঘন্টার মধ্যে এসে একটা কাগজের স্লিপ দিয়ে গেলেন। তিনি স্লিপে চোখ বুলিয়ে ভুবনবাবুর দিকে তাকান-
– “দেখুন ওই ঘড়ি ও অন্যান্য কিছু এ্যান্টিকের খোঁজ এনেছিল এক জন ব্রোকার। তার মাধ্যমে আমি জিনিসগুলো কিনেছিলাম। আসল মালিকের নাম ঠিকানা নিয়ম অনুযায়ী রেকর্ডে রাখা আছে।” 
তিনি একটি কাগজে ঘড়িটার আসল মালিকের নাম ঠিকানাটা লিখে ভুবনবাবুকে দিয়ে অনুরোধ করলেন – “ঘড়িটার পুরো ইতিহাস যদি জানতে পারেন, আমাকে কাইন্ডলি জানাবেন স্যার। খুব ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে।”
রাজি হয়ে তাঁরা দুজনে শো রুম থেকে বেরিয়ে এলেন।
বাড়ি ফিরে দুজনে নাম ঠিকানা আর একবার দেখেন “ফনীন্দ্র মোহন রায়। স্থানীয় পাড়ার নাম, হরিনাভী, দক্ষিণ ২৪ পরগনা।” ফোন নম্বর দেওয়া নেই।
বিমলবাবু ঠিকানা দেখে বলেন “দেখুন আজ বৃহস্পতিবার। পরশু হলো গিয়ে শনিবার। চলুন, সামনের শনিবার সকালে আমার স্কুটারে হরিনাভীর ওই জায়গাটায় পৌঁছে, ফনীন্দ্র রায়ের খোঁজ করা যাবে। কি বলেন?” ভুবনবাবু সম্মতি জানালেন। 
পরের শনিবার দু’জনে সকালের দিকে রওনা দিলেন হরিনাভীর দিকে। হরিনাভী পৌঁছতে বিশেষ অসুবিধে হয়নি তবে রাস্তায় হঠাৎ স্কুটারের ষ্টার্ট বন্ধ হয়ে যেতে, বিমলবাবু “ও কিছু না” বলতে বলতে স্কুটারের কলকব্জা কি সব নাড়াচাড়া করলে স্কুটার আবার চালু হয়ে যায়। কাগজে লেখা স্থানীয় পাড়াটা খুঁজতে কিছু সময় গেল। এর পর পাড়ার মুদির দোকানে ফনীন্দ্র মোহন রায় নামটা বলতে, ভদ্রলোক কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে উঠলেন – ওহ! ফণীবাবু কে খুঁজছেন? দাঁড়ান।“ পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ছেলেকে বলেন – “এই সজল, এনাদের ফণী বাবুর বাড়ি পৌঁছে দে’ত বাবা।” 
ভুবনবাবু ছেলেটির সঙ্গে এগিয়ে যান, বিমলবাবু স্কুটারটা ঠেলে নিয়ে অনুসরণ করেন। কংক্রিটের স্ল্যাব বিছানো সরু রাস্তা ধরে কিছুটা এগিয়ে, ডান দিকের একটা ইঁটের সরু গলির মুখে ছেলেটি দাঁড়িয়ে পড়ে আঙুল তুলে দেখিয়ে দেয় গলির শেষে একটি লোহার গ্রিলের গেট। কানা গলি। বেশ বোঝা যায় এককালে খোলা মেলা জায়গা এখন নতুন হওয়া বাড়ি ঘরদোরে ভরে গেছে। ভুবনবাবুরা এগিয়ে গেলেন গেটের সামনে। মরচে ধরা গ্রিলের ফাঁক দিয়ে দেখা যায় এক কালের বাগান এখন অযত্নে ঝোপ ঝাড়ের জঙ্গলে পরিবর্তিত হয়েছে। সেই ঝোপঝাড়ে ভরা জমির মাঝে দাঁড়িয়ে আছে শেওলা ধরা ইঁট বার করা বেশ পুরনো এক তলা বাড়ি। লোকজন থাকে বলে মনে হয়। বিমলবাবুর মন্তব্য “এ কেমন জমিদার বাড়ি মশায়!” স্কুটার গেটের বাইরে রেখে, দু’জনে গেট ঠেলে ভেতরে এসে – “ফণীবাবু আছেন” বার দু’য়েক ডাকলে, বাড়ির সামনের ছোট বারান্দায় ফরসা রোগা, ধুতি লুঙ্গী করে পরা, আদুড় গা’য়ে এক ভদ্রলোক বেরিয়ে আসেন। পরিচয় দিলে ভদ্রলোক তাঁদের এখানে আসার কারণ জানতে চাইলে, ভুবনবাবু নিলামে কেনা দেওয়াল ঘড়ির আর নিলামের শো রুম থেকে ওনার ঠিকানা পাওয়ার কথা বলতে, তিনি একটু আশ্চর্য হয়ে তাঁদের বাড়ির ভেতরে নিয়ে আসেন।
দিনের বেলাতেও আলো অন্ধকার, খুবই শোচনীয় অবস্থার একটি ঘরে বসে, সময় নষ্ট না করে ভুবনবাবু দেওয়াল ঘড়িটার বর্ণনা করে তিনি সেটা বিক্রি করেছিলেন কিনা জিজ্ঞাসা করাতে- 
ফণীবাবু বলেন – “হ্যাঁ, এক জনকে অন্যান্য কিছু জিনিসের সঙ্গে একটা দেওয়াল ঘড়ি বিক্রি করেছিলাম কিন্তু আপানারা কি জন্য এসেছেন?”
ভুবনবাবু বলেন ওই ঘড়িটার ইতিহাস যদি ওনার কিছু জানা থাকে তা’হলে খুব উপকার হয়। এবার সবিস্তারে ঘড়িটা কেনার পর তাঁদের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করলেন।
ফণীবাবু সব শুনে কেমন যেন অস্বস্তিতে পড়লেন। বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে, একটু বসতে বলে ভেতরে চলে গেলেন। বিমলবাবু প্রায়ান্ধকার ঘরের চারপাশটা দেখছিলেন। হঠাৎ ভুবনবাবুকে  ঘরের কোনের দিকে আঙুল তুলে দেখান। ভুবনবাবু পাশ ফিরে দেখেন একটি মানুষ প্রমাণ সাইজের অয়েল পেইন্টিং। ছবির হালকা সবুজ পটে চোগা চাপকান পরা কোন বৃদ্ধের। ঘরের কোনে ড্যাম্প ধরা দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড় করানো। একটু আশ্চর্য হয়ে তিনি উঠে গেলেন ছবিটার কাছে।পেইন্টিংটা কালের প্রভাবে বিবর্ণ হয়ে গেছে। কিছু কিছু জায়গায় রং উঠে ক্যনভাসের সাদা অংশ প্রকট হয়েছে। বিস্মিত হ’য়ে দেখেন – বৃদ্ধের ঘাড় অবধি নেমে আসা সাদা চুলের বাবরি, একটু বাঁ দিক হেলে, রুপো বাঁধানো লাঠিতে মনে হয় ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে। ঘরের জানলার বাইরের ঝাঁকড়া গাছের ডালপালার ফাঁক দিয়ে ঘরের ভেতর আসা একটু ঝাপসা আলোয় বেশ বোঝা যায় বৃদ্ধের মাথার ওপরে যেন কোনো দেওয়াল ঘড়ির কাঠামোর নিচের অংশের আভাস। তাঁর সামনে দু’পায়ে ভর দিয়ে বসে, বেশ বড়সড় বাঘের মত একটি কুকুর, স্থির চোখে তাকিয়ে আছে শিল্পীর দিকে। 
ভুবনবাবু কোনক্রমে সামনের দেওয়ালে হাত রেখে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করেন। 
“আমার প্রমাতামহের ছবি, শ্রী রাঘব চন্দ্র সরকার, সৌখিন মানুষ ছিলেন।” ফণীবাবু ঘরে এসে দু’কাপ চা ছোট টেবিলে রেখে বললেন।“ আর নিচে বসা তাঁর প্রিয় কুকুর টাইগার। ছবিতে একটি দেওয়াল ঘড়ির কিছুটা অংশ দেখা যাচ্ছে, সেটা তিনি কোলকাতার এক বিদেশী ঘড়ির এজেন্টে মারফত অর্ডার দিয়ে বানিয়েছিলেন। নাচ ঘরের দেওয়াল ঘড়িটা টাঙানো থাকত। ছবিটা তখনকার দিনের এক নামী সাহেব শিল্পীকে দিয়ে আঁকানো।“
ভুবনবাবু নিজেকে কিছুটা ধাতস্থ করে চেয়ারে বসলেন।
“আপনাদের আশ্চর্য অভিজ্ঞতা শুনে মনে হচ্ছে, আমি যতটা জানি সব খুলে বলা ভাল।” ফণীবাবু কি যেন ভেবে নিয়ে আরম্ভ করেন।
“আমার মাতৃকূল বাংলা দেশের এক কালের নামজাদা বংশ। দক্ষিণ বঙ্গের কোনো জেলায় তাঁদের প্রায় আড়াইশো বছরের জমিদারি। আমার এই প্রমাতামহের পিতা করিতকর্মা মানুষ ছিলেন। তিনি ইংরেজ ও অন্যান্য দের সাথে ব্যাবসা করে সম্পত্তি আরো বৃদ্ধি করেছিলেন। তাঁরা বহু জমি জাগীরের মালিক ছিলেন। কিন্তু কালের প্রভাবে ও ভাগ্যের খেয়ালে রাঘব চন্দ্রের জীবদ্দশায় অবস্থা ক্রমশ নিম্নমুখী হতে থাকে।
যাই হোক জীবনের শেষ দিকে রাঘব চন্দ্রের শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। জীবন যাত্রার লাগামহীণ উশৃঙ্খলতায় তাঁর শরীরের বাঁ অংশে পক্ষাঘাতের লক্ষণ দেখা দিতে থাকে। তখন তাঁর সর্ব ক্ষণের সঙ্গী ছিল ওই টাইগার। গল্প কি না জানি না রাঘব চন্দ্রের তালিমে টাইগার এতটা হিংস্র হয়ে উঠেছিল যে তাঁর হুকুমে সে অবাধ্য প্রজাদের প্রাণে মেরে দিত। 
অল্প কথায় বলি – তিনি তাঁর শেষের সময় টাইগারকে নিয়ে একা থাকতেন বার বাড়ির নাচ ঘরে। সারা রাত ঘুমোতেন না। একটা গুপ্তিতে ভর দিয়ে মদে বেসামাল তিনি পক্ষাগ্রস্থ পা টেনে টেনে পায়চারি করতেন সারা রাত।
এরপর এল তাঁর জীবনের ভয়ঙ্কর সেই রাত। সে দিন মাঝ রাতে লুট করে আনা কোনো বর্ধিষ্ণু প্রজার কুলবধুকে নাচ ঘরের এক কোনে বেঁধে রাখা হয়েছিল। পাহারা দিচ্ছিল টাইগার। নেশাগ্রস্থ লেঠলরা পড়েছিল দেউড়ির আনাচে কানাচে। এই ঘটনায় চারপাশের প্রজারা খেপে উঠেছিল সে দিন। শেষরাতে, ভোর হওয়ার আগে, দল বেঁধে তারা হামলা চালায় জমিদারের নাচ ঘরে। মদে বেসামাল তিনি লেলিয়ে দেন টাইগারকে তাদের রোখার জন্য। মশালধারী মানুষের ঢলে টাইগার নাকি ভয়ে সরে আসে তাঁর কাছে। মদে ঘোরে রাগের মাথায় তাঁর গুপ্তির মারণ ঘায়ে লুটিয়ে পড়ে টাইগার। ক্ষিপ্ত গ্রাম বাসীরা তছনছ করে মশালের আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছিল নাচ ঘর। প্রমাতামহ সম্ভবত মারা যান অগ্নি দগ্ধ হয়ে -‍ এক মাত্র জীবিত সাক্ষী ছিল তাঁর নিজস্ব খিদমতগার পাঁড়ে। পাঁড়ে পাগোলের মত হয়ে গিয়ে ঘটনার তিন দিনের মাথায় চাকরী ছেড়ে দিয়ে নিজের দেশে ফিরে যাওয়ার আগে, আমার প্রমাতামহীর পিড়াপিড়িতে তাঁকে সে রাতের পুরো ঘটনা সবিস্তারে জানিয়ে দিয়ে যায়। এই ঘটনার পর সেই অভিশপ্ত নাচ ঘর চিরকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়। মাতামহীর কাছে শোনা বংশের অধ:পতনের এই হল ইতিহাস যা এখানেই শেষ। এই ইতিহাস তিনি বোধ হয় শুনেছিলেন আমার প্রমাতামহীর কাছে”।

ফণীবাবু একটু চুপ করে, শুরু করেন আবার - “এই বংশের বর্তমান উত্তর পুরুষেরা শাখা প্রশাখায় বিভক্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে দেশে বিদেশে।জমিদারি আর নেই। বসত বাড়ির ভগ্নাবশেষ কয়েক মাস হল বিক্রি হয়ে গেছে। বিক্রির আগে বাড়ির পিছনে ভগ্ন স্তুপ সরানোর সময়, চাপা পড়া মাটির তলায় একটি লোহার দরজাওলা বন্ধ ঘর খুঁজে পাওয়া যায়। খুব সম্ভবত জমিদারদের গুমঘর। দরজার মরচে ধরা বহু পুরোন তালা ভেঙ্গে দেখা যায় বেশ কিছু পুরোন জিনিস পত্র। সেগুলোর মধ্যে অক্ষত অবস্থায় ওই দেওয়াল ঘড়িটাও ছিল। কিছু কিছু আসবাব পত্রে ছিল স্পষ্ট পোড়া দাগ। শরিকদের মধ্যে ভাগ হয়ে যায় সে গুলো। আমার ভাগে পড়েছিল দেওয়াল ঘড়ি, ওই পেইন্টিং আর দু’একটা জিনিস। অর্থনৈতিক কারনে ছবিটা ছাড়া বাকি সব নিলাম ঘরের দালালকে বিক্রি করে দিয়েছিলাম।”- ফণীবাবু কিছুক্ষণ থেমে বলেন - 
“আপনাদের দেওয়াল ঘড়ি জড়িত অভিজ্ঞতা শুনে আমার মনে একটা খটকা জেগে উঠেছে। দেখুন ওই দেওয়াল ঘড়িটা বন্ধ অবস্থায় বহু দশক পড়ে ছিল গুম ঘরে। মাস খানেক আগে ঘড়িটা এখানে নিয়ে আসার পর স্পষ্ট মনে আছে সেটার বড় কাঁটা স্থির হয়ে ছিল বাংলায় লেখা ১২’য়ে আর ছোট কাঁটা ছিল ৩ এর ঘরে। হয়ত নাচ ঘর তছনছের সমষ দেওয়াল ঘড়িটা পড়ে যাওয়ার ধাক্কায় থেমে গেছিল ওই সময়টায়।
আমার ধারনা বহু বছর আগে ঘটে যাওয়ার ঘটনাটির শেষ সাক্ষী হয়ে আছে আপনার কেনা ওই জড় দেওয়াল ঘড়িটি। আমি হয়ত কুসংস্কারাচ্ছন্ন কিন্তু কেন জানিনা মনে হচ্ছে পাপী রাঘব চন্দ্রের অতৃপ্ত আত্মা এত দিন পর জেগে উঠেছে তাঁর প্রিয় ঘড়ি সচল হতে। সেই অতৃপ্ত আত্মা এখন জাগরিত হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে  প্রিয় কুকুর টাইগারকে, যে মারমুখি প্রজাদের হাত থেকে বাঁচার জন্য প্রভুর প্রতি অটল বিশ্বাসে তাঁর কাছে পালিয়ে এসেছিল। অতৃপ্ত আত্মা হয়ত খুঁজে পেয়েছিল আপনার “ভৌ”কে তাঁর প্রিয় টাইগারের প্রতিভূ হিসেবে। 
ঘটনাটির আর কোনো ব্যাখ্যা আমার মাথায় আসছে না ভুবনবাবু।” 
পড়ন্ত বিকেলে ফণীবাবুর ঘর আরো অন্ধকার হয়ে আসে। 
ভুবনবাবুরা ফিরে এলেন তাঁদের ফ্ল্যাটে। সন্ধ্যে হয়ে গেছে। উজ্জল আলোকিত কোলকাতা শহর। নানা যান বাহন, মানুষ জনে মুখরিত। কুসংস্কার কাছে পিঠে ঘেঁসতে পারে না এই আলো ঝলমলে জনবসতির। কিন্তু কিছু ঘটেছে এই শহরের প্রাণ কেন্দ্রের একটি ফ্ল্যাটে। যার যৌক্তিক ব্যাখ্য বোধহয় অজানা।
ভুবনবাবু আশ্চর্য হয়েছেন বিমলবাবুর স্বভাবের অস্বাভাবিক পরিবর্তনে। এতটা পথ আসার সময় তিনি ছিলেন নিশ্চুপ।
“কাল সকালে আপনার ওই লাঠিটা কিছু ক্ষণের জন্য ধার দেবেন বিমলবাবু?”
বিমলবাবু মাথা হেলিয়ে সায় দিয়ে তাঁর ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ করলেন।
“এখুনি বাজার থেকে বড়সড় দেখে চটের বস্তা নিয়ে আয় দেখি।” হতবাক নেত্যর হাতে কিছু টাকা দিয়ে বলেন ভুবনবাবু। 
নেত্য খালি চটের বস্তা নিয়ে এসে দেখে ঘড়িটা পড়ে রয়েছে সোফার ওপর। ভুবনবাবু তাকে বলেন ঘড়িটা বস্তায় পুরে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলতে। শোওয়ার ঘরে চলে যান তিনি “ভৌ” কে নিয়ে।
পরদিন সকালে কৌতুহলী বিমলবাবু সেই মোটাসোটা লাঠিটা নিয়ে আসেন।
ভুবনবাবু যেন অপেক্ষায় ছিলেন। লাঠিটা প্রায় কেড়ে নিয়ে, এলোপাথাড়ি আঘাতে বস্তায় থাকা দেওয়াল ঘড়ি গুঁড়ো গুঁড়ো করে দিলেন ভুবনবাবু। হাঁপাতে হাঁপাতে বিমলবাবুকে তাঁর অনুরোধ ছিল – “নেত্যকে নিয়ে বস্তাটা যদি দয়া করে আউট্রামের গঙ্গায় ফেলে দিয়ে আসেন।” 

একটি গাছ, একটি পাখি, একটি আশ্বাস
অদিপ রায় 

ক্যালিফোর্নিয়া

একটি গাছ, একটি পাখী
maple_edited_edited.jpg

গল্প

adip_roy.webp

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

বুধবার, সাতই জানুয়ারি ২০২৫।
প্রতিদিনের মতোই সকালে উঠে জানালার ভারী পর্দা সরিয়ে অলিভিয়া দেখল, আকাশ আজও নীল, শান্ত, মোটামুটি উজ্জ্বল। ওর বিছানা ছেড়ে ওঠা মাত্রই শোবার ঘরে ঢুকল লুনা—ওর প্রিয় হাস্কি কুকুর। লুনার যখন মাত্র চার-পাঁচ মাস বয়স তখন থেকেই ওর জীবনে এসেছে । এখন প্রায় আট বছর পেরিয়ে গেছে, লুনা অলিভিয়ার পরিবারের সদস্য হয়ে উঠেছে। 
প্রাতঃভ্রমণের জন্য বাইরে বেরোলো তারা। ম্যালিবুর রকপোর্ট এলাকায়, পাহাড়ের উপর এক নির্জন এবং আভিজাত্যপূর্ণ প্রান্তে অলিভিয়ার বাড়ি। নিচের দিকে তাকালে প্রশান্ত মহাসাগরের জলরেখা দেখা যায়। এই অঞ্চলে পথচারী কম, কেবল কুকুর নিয়ে বেরোনো কিছু প্রতিবেশীর দেখা মেলে কদাচিৎ। আজ তাও নেই।  
লুনা আজ কেমন যেন অন্যমনস্ক। সাধারণত দৌড়ঝাঁপ করে, আজ চুপচাপ। সাদা-কালো ঘন লোম, নীল চোখ, নেকড়ের মতো চেহারা,  দেখলেই আদর করতে ইচ্ছে করে। দশ বছরের মেয়ে আমেলিয়ার সঙ্গেও লুনার গভীর সম্পর্ক। তিনজনে মিলে গড়ে তুলেছে ছোট্ট এক জগৎ।
নিচে প্রশান্ত মহাসাগরের ঢেউ উপকূলে ভেঙে পড়ছে, যেন এক নীরব গান গাইছে। বাড়ির সামনে জাকারান্ডা গাছের পাতা হাওয়ায় দুলছে। সকালের নরম আলো, স্নিগ্ধ হাওয়া, নিস্তব্ধতা—সব মিলিয়ে অলিভিয়ার মন হঠাৎই এক নির্মল আনন্দে ভরে উঠল। 
এই আনন্দময় মুহূর্তকে আঁকড়ে ধরতেই ও ফিরে এলো ঘরে, কফির কাপ হাতে বসে পড়ল নিজের প্রিয় জানালার ধারে। স্ক্রিপ্ট শেষ করতে হবে—একটি প্রেমের দৃশ্যের সংলাপ লিখছে ও।
কিন্তু প্রেমের প্রসঙ্গে চলে আসে হেনরির কথা—প্রাক্তন স্বামী। কলেজ জীবনের প্রেম, তারপর বিয়ে, আমেলিয়ার জন্ম, আর তারপরই সম্পর্কের ছেদ। সেই দুঃসহ অধ্যায় এখন অনেকটাই পুরনো, তবুও বিহ্বল করে তোলে অলিভিয়াকে।  
মন শক্ত করে আবার লেখায় মন দিল ও। 
বেশ খানিকটা লিখে ফেলেছে দু কাপ কফি শেষ, হঠাৎ ফোন বাজল—প্রতিবেশীর কণ্ঠস্বর, উত্তেজিত:
“আমাদের এলাকা ছেড়ে যাওয়ার নির্দেশ এসেছে অলিভিয়া! কি করবে?”
ওর ফোনে আসা একাধিক মেসেজে জানা গেল, সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ প্যালিসেডস অঞ্চলে দাবানল শুরু হয়েছে, আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে ম্যালিবুর দিকে।
হুড়োহুড়ি করে দুটো সুটকেস গোছাতে গিয়ে মনে পড়ল, ওয়াশিং মেশিনে ভেজা জামাকাপড় বোঝাই করে রাখা। যন্ত্রটা চালিয়ে দিয়ে আবার লেখায় মন দিলেও টের পেল, লুনা অস্থির হয়ে বারবার দরজার দিকে ছুটছে। 
জানালার দিকে তাকাতেই বুক কেঁপে উঠল—আকাশ অস্বাভাবিক লালচে, প্রবল হাওয়ায় সামনের জাকারান্ডা গাছটা দুলছে বিপজ্জনকভাবে। আর দেরি করা যাবে

না। তাড়াতাড়ি গাড়ি স্টার্ট করে স্কুল থেকে আমেলিয়াকে তুলে, মা-বাবার বাড়ির দিকে রওনা দিল ওরা।
বাড়ির বাইরে পা রাখতেই ঝড় যেন ঝাঁপিয়ে পড়ল—৭০-৮০ মাইল বেগে ধুলো, পাতা, ছাই উড়ে চলেছে। আগুনের শিখা পাহাড়ের মাথা ছুঁয়ে ফেলছে যেন।
প্রতি বছর ক্যালিফোর্নিয়ায় দাবানল ঘটে—কিন্তু তা টিভির পর্দায় দেখা আর নিজের জীবনে অনুভব করা একেবারে ভিন্ন জিনিস।
পরের দিনগুলো অলিভিয়ার জীবনে কেটেছে দুশ্চিন্তা আর অনিশ্চয়তায়। বাবা বারবার বলছিলেন, "তোরা বেঁচে ফিরেছিস, সেটাই বড় কথা। বাড়ি আবার হবে।"
দু'সপ্তাহ পর প্রশাসনের অনুমতি মিলল রকপোর্টে যাবার। লুনা গাড়িতে অস্থির—কারণ রাস্তার ধীরগতি, একটি মাত্র লেন খোলা।
রকপোর্ট এলাকায় ঢোকার মুখে কড়া চেকিংয়ের পর যখন অলিভিয়া নিজের বাড়ির এলাকায় ঢুকল, হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে গেল—চারপাশে শুধু পোড়া কাঠ, ছাই আর শব-সদৃশ গাছ।  
নিজের বাড়ির সামনে এসে কান্না চাপতে পারল না। যে বাড়িটি ছিল স্মৃতি আর ভালোবাসায় গড়া, তা এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত। সাধের বাগানের কমলালেবু গাছ, ফুলের গাছ, কিছুই আর নেই।
লুনাও গাড়ি থেকে নেমে ঘুরছে বিস্ফারিত চোখে, মাঝে মাঝে কুঁই কুঁই শব্দ করছে। অলিভিয়া বুঝে গেল—এই অবলা প্রাণীটিও তার মতোই মনের ভেতরে কান্না চেপে রেখেছে।
ও হাঁটু গেড়ে বসে লুনাকে জড়িয়ে ধরল, চোখের জলে সব বাঁধ ভেঙে গেল।
কিছুক্ষণ পর উঠে দাঁড়িয়ে ও দেখল সেই জাকারান্ডা গাছ। আগুনে পুড়ে ঝলসে একেবারে মৃত, তবু একটি ডালে দুটি কচি সবুজ পাতা দেখা যাচ্ছে। সেখানে বসে আছে একটি ছোট হলুদ পাখি।
নীল আকাশে হালকা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে দেখে আর ধোঁয়া নেই। এই মুহূর্তেই যেন একটা আশার আলো ফুটে উঠল।
নতুন করে শুরু করার আশ্বাস যেন সেই সবুজ পাতায় লেখা— পোড়া ভস্মের বুক চিরে।

(এই গল্পের সব চরিত্র কাল্পনিক, তবে একটি সত্য ঘটনার ছায়া এই গল্পে আছে।) 


পটভূমি
প্রশান্ত মহাসাগরের পাড় ঘেঁষে বিস্তৃত, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর ক্যালিফোর্নিয়ার ম্যালিবু অঞ্চলে 'প্যালিসেডস ফায়ার' নামে একটি ভয়াবহ দাবানলের শিকার হয়। এই দাবানলটি ৩১ জানুয়ারি’২৫ পর্যন্ত চলতে থাকে এবং এটি ম্যালিবু, প্যাসিফিক প্যালিসেডস এবং টোপাঙ্গা অঞ্চলে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। এই দাবানলে ১২ জন প্রাণ হারান, ৭ জন নিখোঁজ হন এবং ১০৫,০০০ জনেরও বেশি মানুষকে সরিয়ে নিতে হয়। প্রায় ৬,৮০০টি বাড়িঘর ধ্বংস হয় । 
গল্পের ম্যালিবুর রকপোর্ট এলাকায় প্রায় ২৫০ টি বাড়ির মধ্যে ২২৫ টি বাড়িই এই দাবানলে পুরোপুরি ধ্বংস হয়।

অপয়া

অনুভা সাহা

girl.jpeg
অপয়া

গল্প

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

মি অহনা। শারীরিক ও মানসিকভাবে ভীষণ নির্যাতিতা ছিলাম আমার মায়ের কাছে। তবুও এত কষ্টের মধ্যে আমি স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসতাম। স্বপ্ন যে সত্যি হবেই এমনও নয়, তবুও!! আমার চোখের সবাই খুব প্রশংসা করতো। বড় বড় দুটি ডাগর চোখ। সেই চোখে অনেক স্বপ্ন সাজিয়েছিলাম সৈকতকে নিয়ে। সৈকত আমার স্বামী। এক সন্ধ্যের বিপর্যয় আমার সমস্ত স্বপ্নকে গুঁড়িয়ে দিলো.....

বাড়ি থেকে বেরোতে একটু দেরী হয়ে গিয়েছিল। যাচ্ছিলাম বারাসাত.... শ্বশুরবাড়ি। মামণি, অর্থাৎ আমার শাশুড়ি-মা খুব অসুস্থ, তাই। সেদিন পেপারে আবহাওয়ার খবরে দেখলাম বিকেলের দিকে ঝড়বৃষ্টি হওয়ার কথা। বাইরে বেরিয়ে আকাশের দিকে তাকাতে মনে হলো আকাশের গায়ে যেন কেউ কালি ঢেলে দিয়েছে। কোথাও এতটুকুনি ফাঁকা নেই। আমরা নিজেদের গাড়ি না নিয়ে ভাড়াগাড়ি নিয়েছিলাম। আবহাওয়া খুব গুমোট। যে কোনো সময়ে ঝড় উঠতে পারে। কিছুক্ষণ বাদে গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরেটা দেখছিলাম। দেখি, ঝড় শুরু হয়ে গেছে। ধুলোর ঝড়। বেশ কিছুক্ষণ বাদে গাড়ির উইন্ডস্ক্রিনে বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে শুরু করলো। আমরা এয়ারপোর্ট সবে ছাড়িয়েছি। ঝড়-বৃষ্টি দুটোরই দাপট বাড়তে লাগলো। এতটাই জোর ছিল যে বাইরে কিছুই দেখা যাচ্ছিলো না। ড্রাইভারকে বললাম গাড়ি একটু সাইডে লাগাও। ঝড়বৃষ্টি একটু কমুক....

- "না না ম্যাডাম!! অসুবিধে হবে না। আস্তে আস্তে চলে যেতে পারবো। আপনি চিন্তা করবেন.............."

পুরো কথাটা শেষ করার আগেই প্রচন্ড জোরে একটা আওয়াজ। দেখলাম গাড়ি কিছুটা ওপরে উঠেই নীচে নামতে শুরু করলো। আমার আর কিছু মনে নেই.......

জ্ঞান ফিরতেই মামণির গলা পেলাম। আমার মাথায় মামণির হাতের স্পর্শ.....

-"এ আমি কোথায় মামণি? কিছু বুঝতে পারছি না......"
-"তুই হসপিটালে!!"
-"আমি কিছু দেখতে পাচ্ছি না কেন?"

কালকের ঘটনাটা হঠাৎ মনে পড়তেই আমি শিউরে উঠলাম। চিৎকার করে মামণিকে ডাকলাম....

-"মামণি, আমি কেন কিছু দেখতে পাচ্ছি না? তুমি কোথায়? সৈকত কোথায়?"

মামণি যা বোঝার বুঝে নিলো.......  

চার মাস বিয়ের বয়স।

-"মামণি, সৈকত ভালো আছে তো? ও তো একবারও এলো না? ওকে একটু ডাকো না মামণি....."

এই চার মাস ধরে মামণিকে দেখে যেটা বুঝেছি উনি সোজা কথা সোজাসুজি বলতেই পছন্দ করেন। আড়াল-আবডাল একদমই পছন্দ করেন না। উনি একটি স্কুলের হেডমিস্ট্রেস ছিলেন। আমাকে খুব শান্তভাবে বললেন, "বাবুকে যে তুই হারিয়ে ফেলেছিস। বাবু তোর জীবনে আর কখনও আসবে না !!"

-"কি বলছো? মামণি তুমি এ কথা কি করে বলতে পারলে?"
-"হ্যাঁ রে মা !! বলতে পারলাম। কারণ আমি তোকে বারবার আঘাত দিতে পারবো না। তোকে মিথ্যে বলে কি লাভ হবে বল? আবার নতুন করে আরেকটা আঘাত দেবো। তার থেকে এই ভালো। সব কষ্ট সহ্য করে তুই সোনা হয়ে ওঠ্........"

-"মামণি, আমাকে কি এই অন্ধকারকে সাথী করে চলতে হবে? আমি কি আর কখনও রৌদ্রোজ্জ্বল নীল আকাশ, তারাভরা রাতের আকাশ দেখতে পাবো না? তোমাকে কি আর দেখতে পাবো না? তোমাকে ছাড়া আমি কি করে বাঁচবো? আমি যে তোমাকেই মা বলে মানি। জন্মদাত্রীর কাছে তো আমি ছোট থেকেই অপয়া হয়েই আছি। এ বাড়িতে আসার পরই তো মায়ের ভালোবাসা, স্নেহ কি বুঝতে পেরেছি..."
-"না রে মা তুই একা নোস্। আমি তোর সব দুঃখ-কষ্ট ঘুচিয়ে দিয়ে একটা সুস্থ জীবন ফিরিয়ে দেবো। তোর কাছে এই আমার অঙ্গীকার....."

এই মুহূর্তে মামণির মুখ আমি দেখতে পাচ্ছি না। তবে আমার অন্তর্দৃষ্টি দেখতে পাচ্ছে মামণির চোখ জলে ভরা। না.... আমি ভুল ছিলাম না। আমার চোখের পাতায় মামণির চোখের জল পড়লো.....
উফ্ !! মামণির কি কষ্ট !! চারমাস একসাথে থেকে যদি আমি এত কষ্ট পাই তবে যাকে গর্ভে ধারণ করে এত বড় করে তুললো তার মা আজ কিভাবে এই কষ্ট সহ্য করছে? মামণির কথা ভেবে আমি আমার কষ্ট ভুলে গেছি। আমার কাছে মামণিকে সান্ত্বনা দেওয়ার মত কোনো ভাষা জানা নেই। বলতে আমার কোনো সঙ্কোচ হচ্ছে না আমার গর্ভধারিণী মায়ের থেকে মামণিকে আমি অনেক বেশি ভালোবাসি কারণ মামণি সেটা পাওয়ার যোগ্য। আমি আমার গর্ভধারিণীর কাছ থেকে আদর-ভালোবাসা কখনও কিছু পাইনি। শুধু একটা কথাই শুনেছি, অপয়া..... অপয়া...... আর অপয়া !!!! অপয়া কেন? আমি যেদিন পৃথিবীতে আসি সেইদিনই আমার বাবা এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। তাই মায়ের ধারণা এর জন্য আমিই দায়ী। আমি ঠাম্মির কাছে শুনেছি আমার মা আমাকে জন্মের পরে কোলে পর্যন্ত নেয়নি। বুকের দুধ পর্যন্ত খেতে দেয়নি। আমার ঠাম্মিই আমাকে বড় করেছে। আমার পড়াশুনা, আমার বিয়ে দেওয়া সবই করেছেন আমার দুই জেঠু আর ঠাম্মি মিলে......

সৈকতকে হারিয়ে আমি আবার প্রমাণ করে দিলাম আমি অপয়া। মামণি এ কথা মানতে নারাজ। মামণির কথা, সময় সবকিছু বলবে যে তুই অপয়া নোস্.......

আমার চোখের জন্য মামণি ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। ডাক্তার কিছু পরীক্ষানিরীক্ষা করার পর মামণিকে বললেন, "মা, ওনার চোখের একটা অপারেশন করতে হবে। তাহলেই উনি চোখে দেখতে পাবেন।" ডাক্তারের গলার স্বরটা আমার কাছে খুব চেনা লাগছে। বুঝতে পারছি না কে এই ডাক্তার? আমি কি তাকে চিনি? ডাক্তার অপারেশনের জন্য একটা তারিখ দিলেন। অপারেশনের দিন নার্সিংহোমে মামণি, ঠাম্মি আর মামণির দুই কলিগ্ সুদীপ্তা আন্টি আর নীলিমা আন্টি উপস্থিত ছিলেন। অপারেশন থিয়েটারে ডাক্তার আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেয়ে আপনি প্রথমে কাকে দেখতে চান? আমার উত্তর ছিল যে আমাকে আমার চোখের দৃষ্টি ফিরিয়ে দেবে বলে ভরসা দিলেন অবশ্যই তাকে আর আমার মামণিকে..... 

লাগছিল। এই মুখের ছবি যে আমার মনের মণিকোঠায় রাখা আছে……

কিছু সময়ের জন্য অন্যমনস্ক হয়ে চলে গেলাম কয়েক বছর পেছনে। আমার চিন্তার জাল ছিন্ন

করে দিলেন ডঃ শিবাজী। আস্তে করে কথাটা ছুঁড়ে দিলেন.... "কিছু কি মনে পড়ছে?".... দুজনেই ডন বস্কোর ছাত্র। ডঃ শিবাজী ছিলেন আমার থেকে চার বছরের সিনিয়র.....

বর্তমানে এই ভরসার হাতটা ধরে আমি বাঁচতে চাই। অনেক না বলা কথা ছিল যেটা আমরা কখনও কেউ কাউকে বলে উঠতে পারিনি। সৈকতের সাথে তো আমার সম্পর্ক ভালোভাবে গড়ে উঠতে না উঠতেই সব শেষ হয়ে গেল। তবে এই ভরসার হাতটা ধরে উঠে দাঁড়াতে চাওয়াটা কি আমার অন্যায়? আমার পুরোনো ভালোলাগা-ভালোবাসা যেটা আমি কখনও কাউকে বলিনি। শিবাজীও আমায় ভালোবাসতো সেটা ওর বন্ধুদের মুখেই আমি শুনেছি। ও-ও আমাকে কখনও কিছু বলেনি। বন্ধুদেরকে নাকি বলতো, "ও শুধু আমার জন্যই জন্মেছে।" ক'দিন ধরেই শিবাজীকে দেখতে পাচ্ছিলাম না। কথা হতো না ঠিকই অথচ দুজন দুজনকে দেখার জন্য পাগল ছিলাম। স্কুল ছাড়ার পর জানতে পারলাম ও পড়াশুনার জন্য বিদেশ চলে গেছে। ইতিমধ্যে বাড়ি থেকে আমাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য জেঠুরা ব্যস্ত হয়ে পড়লো। বড়জেঠুই সমস্ত খোঁজখবর করেন। তারপরে এক শুভদিনে আমার বিয়ে হয়ে গেল। আমি কোনো বাধা দেইনি। কারণ, বাবা নেই.... মায়ের কাছেও আমি অপয়া.... তাই সবকিছু মেনে নিয়েছিলাম। সৈকতের সাথে বিয়ে হয়ে গেল। শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে আমি এক নতুন জীবনে প্রবেশ করলাম। আমার শাশুড়ি-মায়ের ভালোবাসায় আমি ভুলে গেলাম আমার নিজের গর্ভধারিণীকে। আর ভুলতে পারছিলাম না শিবাজীকে......

ডঃ শিবাজী কাছে এসে কথা বলছেন। কথা বলার ধরণে মামণি কিছু একটা আন্দাজ করতে পেরেছেন যে আমরা দুজনেই দুজনকে চিনি। আর একটা অদ্ভুত ব্যাপার হলো যে ডঃ শিবাজী মামণির বান্ধবী সুদীপ্তা আন্টির ছেলে। ও ছোট থেকেই নাকি মামণিকে মা বলে ডাকে। সেজন্যই সেদিন চেম্বারে মামণিকে মা বলে ডেকে কথা বলছিলেন। মামণি শিবাজীকে বললেন, "হ্যাঁ রে ডাক্তার তুই আমার মেয়েকে চিনিস বলে মনে হচ্ছে?" শিবাজী একটু লজ্জা পেয়ে সরে যেতেই মামণি আমাকে সোজাসুজি জিজ্ঞাসা করলেন, "হ্যাঁ রে মা তুই যে শিবাজীকে আগে থেকেই চিনতিস, সেটা তো স্পষ্ট হলো। তুই কি ওকে পছন্দ করতিস?" আমি মামণিকে সবটাই খুলে বললাম....

-"মামণি আমাদের কখনও দুজনের দুজনকে কিছু বলা হয়নি। বুঝতাম ও কিছু বলতে চায় কিন্তু বলে উঠতে পারেনি। আর আমারও কিছু বলা হয়নি। তারপর ও চলে গেল বিদেশে পড়াশুনা করতে আর বাড়ির চাপে বাধ্য হয়ে আমাকে বিয়েটা করতে হলো।"

-"তুই আমার ভাবনাটাকে অনেকটা এগিয়ে নিয়ে যেতে সহজ করে দিলি।"

-"বুঝলাম না মামণি !! কি বলছো তুমি?"

-"কেন? এটা তো খুব সহজ। দুজনে যখন দুজনকে ভালোই বাসিস তাহলে আর বাধা কোথায়? আমি আমার বান্ধবীকে কথাটা বলবো....."

-"কিন্তু মামণি.... এখন তো আর তা সম্ভব নয়...."

-"কেন সম্ভব নয়? বাবু ছিল তোর অতীত। বর্তমানকে ধরে বাঁচ। বাবু তোর ছিল না। পাপাই (শিবাজীর ডাকনাম) তোর। তাই তো এতদিন বাদে অদ্ভুতভাবে তোদের দেখা। বাবু চলে গিয়ে তোদের পূর্ণতা পাইয়ে দিয়ে গেল....."

মনের গোপনে যে কথা রয়ে গেছে সেটা মামণিকে বলতে বাঁধছে। আমি যে সত্যিই শিবাজীকে খুব ভালোবাসতাম। এখন দেখার পরে পুরোনো ভালোলাগা, ভালোবাসা সবটাই যেন মনের মধ্যে তোলপাড় করে দিচ্ছে.....

এক ছুটির দিনে শিবাজী আর সুদীপ্তা আন্টি আমাদের বাড়ি এলেন। মামণি আমার ঠাম্মিকেও ডেকে পাঠালো। আমাদের দুজনের জীবনের ভবিষ্যৎ নিয়ে কথাবার্তা হলো। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কথাটা ছিল এটাই মামণি সুদীপ্তা আন্টি আর শিবাজীকে একটা শর্ত দিলো। শর্তটি ছিল এইরকম -

-"সুদীপ্তা, আমি আমার মেয়েকে কিন্তু কোথাও যেতে দেবো না। আমি ওকে ছাড়া থাকতে পারবো না। আর আমার এই এতবড় বাড়িটাকে কে দেখাশোনা করবে? পাপাই তুই তো আমাকে মা বলে ডাকিস। তাহলে মা'কে একা করে দিয়ে চলে যেতে পারবি এই শূন্য বাড়িতে? তাই বলছি তুই যে ফ্ল্যাট বুক্ করেছিস, সেটা ক্যান্সেল করে দে। এই বাড়িই হবে তোদের দুজনের নতুন সংসারের ঠিকানা। তবে আমাদের এই বাড়িতে আরেকজন অতিথিকে আনতে চাই। ভারতীদি। অহনার ঠাম্মি !!........"

না। কোনো বিয়ের তারিখ ছিল না। এক তিথি দেখে পুণ্যলগ্নে এক মন্দিরে মায়ের সামনে সিঁদুর পরিয়ে মালাবদল করে আমাদের চারহাত এক হলো। এরপরে আমরা সকলে মিলে মাতৃদর্শনের সামনে এসে দাঁড়ালাম। মাতৃদর্শন আমাদের বাড়ির নাম। মামণি আমাদের দাঁড়াতে বলে ফোনে কাউকে কিছু বলতে লাগলেন। মামণি শিবাজীকে বললেন, "পাপাই, তোরা দুজনে আগে বাড়িতে ঢুকবি।" দুজনে হাত ধরে পা বাড়াতেই ওপর থেকে দুজনের মাথাতেই ফুলের পাপড়ি ছড়িয়ে দেওয়া হলো। সামনেই লাল কার্পেট পাতা। আমরা এগোতেই মুহূর্তে বেজে উঠলো রবীন্দ্রসঙ্গীত - "মোর বীণা ওঠে কোন সুরে বাজি....."

মামণির দুই বোনঝি সামনে এসে দুজনের হাত ধরে গেয়ে উঠলেন -"এসো এসো আমার ঘরে এসো, আমার ঘরে।" তার পেছনে মাসিমণি বরণডালা নিয়ে আমাদেরকে বরণ করে নিলেন। দুজনে মাতৃদর্শনে মা রাখলাম। পেছনে মামণি, ঠাম্মি আর সুদীপ্তা আন্টি হাতে হাত রেখে প্রবেশ করলেন। সারাদিনই রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজলো। বাড়ির বাইরে কোনো আড়ম্বর ছিল না। বাড়ির ভেতরটা মামণির ভাইবোনেরা খুব সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছিল। সন্ধ্যায় আমি সবার জন্য চা করে এনে দিলাম। আন্টির হাতে চায়ের প্লেট দিয়ে বললাম, "আন্টি তোমার চা।" আন্টি আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, "এখনও আন্টি বলবি? মা বলবি না?" এখন আমি দুই মায়ের আর ঠাম্মির ভালোবাসায় এতটাই আপ্লুত যে বলে বোঝাতে পারবো না.....

মামণি যেটা করলো আমার জন্য, সেটা উঁচু মনের মানুষের পক্ষেই সম্ভব। মামণির মুখের হাসিটা দেখে মনে হয় মামণির এই কথাটা রেখে হয়তো মামণিকে একটু সুখ দিতে পেরেছি। সকলকে একসাথে পেয়ে সৈকতকে হারানোর দুঃখটা হয়তো একটু ভুলে থাকতে পারবে। মামণির ভাবনাটাকে স্যালুট্ জানাই। সৈকত তুমি যেখানেই থাকো, ভালো থেকো.... মামণিকে ভালো রাখার দায়িত্ব আমি নিলাম !!

প্রবন্ধ

একজন বিস্মৃতপ্রায় ইতিহাসবিদের উত্তরবঙ্গে

শিক্ষার অঙ্গনে পদার্পণ

সুখময় ঘোষ 

শ্রীরামপুর, হুগলী, পঃ বঙ্গ 

একজন বিস্মৃতপ্রায় ইতিহাসবিদ
Sukhamay Ghosh_edited.jpg
nalinikanta_archaeoligist.jpg

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

৯১২ সালের ২৫ জুলাই। পুরনো ঢাকার নর্থব্রুক প্রেক্ষাগৃহে চলছে জমজমাট এক আলোচনা সভা। আলোচনার বিষয়বস্তু: প্রত্নতত্ত্ব সামগ্রী ভালোভাবে সংরক্ষণ করার উপায়। সভায় উপস্থিত স্বয়ং লর্ড কারমাইকেল। আলোচনার শেষের দিকে বক্তব্য রাখতে উঠলেন ২৪ বছরের এক সুদর্শন যুবক। তাঁর অসাধারণ বাগ্মীতা এবং বিজ্ঞান ও যুক্তি- নির্ভর  পর্যবেক্ষণে কারমাইকেল সেদিন মুগ্ধ ও চমকৃৎ। উপস্থিত সকলের প্রশংসা কুড়িয়ে সদিনের সেই যুবক তাঁর ধারালো বক্তব্যের জন্য ছোটলাট কারমাইকেলের কাছ থেকে ২০০০ টাকা পুরস্কার হিসাবে পেয়েছিলেন। ইতিহাস নিয়ে চিরকালের আগ্রহী সেদিনের এই তরুণ যুবক ছিলেন ঐতিহাসিক ডঃ নলিনীকান্ত ভট্টশালী। যার অবদান না থাকলে বাংলদেশ বা উত্তরবঙ্গের প্রত্নতত্ত্ব গবেষণাও হয়তো পূর্ণতা পেত না। ইতিহাসবেত্তা, মুদ্রা ও লিপিবিশারদ এই বিখ্যাত পণ্ডিত ব্যক্তির সঙ্গে বালুরঘাটের শিক্ষাজগতের একটা সংস্রব বর্তমান আছে। বালুরঘাট মহাবিদ্যালের ৭৫ বর্ষপূর্তিতে এই শহরের শিক্ষা পরিমণ্ডলের সাথে বিশেষ করে মহাবিদ্যালয়ের অঙ্গনে জড়িয়ে থাকা গুণী ব্যাক্তিত্ত্বদের চর্চা করতে গিয়ে এই বিস্মৃতপ্রায় বাঙ্গালী প্রত্নতাত্ত্বিকের কাহিনী স্মরণে এল যার কর্মসূত্রে বালুরঘাটে পদার্পণ এই শহরের শিক্ষার বাতাবরণকে অবশ্যই গৌরবান্বিত করেছিল। নলিনীকান্ত ভট্টশালী এই ইতিহাসবিদের নামের সঙ্গে আমাকে  প্রথম  পরিচয় করে দিয়েছিলেন বালুরঘাট  মহাবিদ্যালয়ের বাংলা সাহিত্যের স্বর্গীয় অধ্যাপক বদরী প্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়। একাদশ শ্রেণীতে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস পড়ানোর সময় বদরীবাবু এই প্রতিযশা গুণী মানুষটির বালুরঘাট উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষাকতার কথা উল্লেখ করেন যা শুনে সেইসময় খুবই রোমাঞ্চিত বোধ করে ছিলাম। পরবর্তীকালে ঢাকা যাদুঘরের সাথে তথ্য আদানপ্রদানের সূত্রে উপলব্ধি করেছিলাম একজন কত বড় ইতিহাসবিদ-এর সাথে বালুরঘাটের সংস্পর্শ ঘটেছিল।                  
একটি জাতির সভ্যতা ও প্রগতির স্মারক তার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির মধ্য দিয়েই প্রতিফলিত হয়। উত্তরবঙ্গ তথা বরেন্দ্রভূমির এই ঐতিহ্যের ইতিহাসকেই বিদ্যোৎসাহী ও গবেষকদের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন ইতিহাস অন্তপ্রাণ প্রত্নতত্ত্ববিদ নলিনীকান্ত ভট্টশালী। যেদিন ঢাকার নর্থব্রুক হলের আলোচনায় ছোটলাট লর্ড কারমাইকেলের প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন প্রকৃতপক্ষে সেইদিন থেকেই ঢাকার জাদুঘরের পরিকল্পনা শুরু হয়ে গিয়েছিল এবং রচিত হয়েছিল বিদ্যোৎসাহী ও গবেষকদের জন্য বাংলার অতীত ইতিহাসের ধারক ও বাহক নির্মাণের রূপরেখা। তাঁরই  প্রচেষ্টায় ১৯১৩ সালের ৭ আগস্ট গর্ভনর কারমাইকেল ঢাকায় নবনির্মিত সচিবালয়ের একটি কক্ষে ‘ঢাকা জাদুঘর’ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন। প্রত্নতত্ত্ব সমৃদ্ধ পূর্ববাংলায় সেইসময় ঐতিহাসিক সামগ্রীগুলির সংরক্ষণের কোন স্থায়ী জায়গা ছিল না। ইতিহাসবিদ নলিনীকান্ত ভট্টশালীর একক প্রচেষ্টায় সেদিন পূর্ণতা পেয়েছিল যাদুঘরের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ। মাত্র ২৮ বছর বয়সে তিনি হলেন ঢাকার জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা কিউরেটর।
মুন্সিগঞ্জ জেলার (বর্তমানে বাংলাদেশে) অন্তর্গত বিক্রমপুরের পাইকপাড়া গ্রামে এক শিক্ষিত ও সাংস্কৃতিবান ব্রাহ্মণ পরিবারে ১৮৮৮ সালে ২৪ জানুয়ারী তিনি জন্মগ্রহণ করেন। সোনারগাঁও হাইস্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পদক ও বৃত্তিলাভ করে ১৯১২ সালে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ ডিগ্রী অর্জনের পর স্যার আশুতোষের এই প্রিয় ছাত্র ইতিহাসের শিক্ষক হিসাবে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে যোগদান করেন। কুমিল্লার পূর্বে বালুরঘাট উচ্চ বিদ্যালয়ে তাঁর কর্মজীবনের সূত্রপাত। ১৯১৩ সালে বালুরঘাট উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসাবে যোগদান নলিনীকান্তবাবুর জীবনে উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এই জেলায় অবস্থানকালে জেলার বিভিন্ন এলাকার সাথে তাঁর যোগাযোগ ঘটে। এইসব অঞ্চলের ইতিহাস এবং প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে তাঁর গভীর আগ্রহ ছিল। এই অপরিসীম আগ্রহের জন্য তিনি বলতেন, ”মনে অহরহ ইচ্ছা জাগিতেছে যে, স্বহস্থে কোদাল ধরিয়া সমস্ত উচ্চভূমি খুঁড়িয়া সমান করিয়া দিই“। যদিও এই শহরে নলিনীকান্ত ভট্টশালী স্বল্প সময়ের শিক্ষক জীবন অতিবাহিত করে ছিলেন তবুও এই জেলাশহর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় ছড়িয়ে থাকা ইতিহাসের মৌন-মুখর সাক্ষীগুলো পরবর্তী সময়ে তাঁর গবেষণার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল। তপন, কুশমণ্ডি, গঙ্গারামপুর ও মহীপাল প্রভৃতি অঞ্চলে প্রাপ্ত বেশকিছু লিপি এবং দেবতার মূর্তির সময়কাল ও বিবরণ তাঁর গবেষণালব্ধ তথ্যে উঠে এসেছিল।
নলিনীকান্ত ভট্টশালীর গবেষণার পূর্ব সময়ে প্রাচীন বাংলার ইতিহাস নিয়ে ইতিহাসবিদের কোন ধ্যানধারনা ছিল না। উত্তরবাংলাসহ পূর্ব বাংলার অতীত ইতিহাস পুনরুদ্ধারে তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমে কোটালিপাড়া, দেউলবাড়ী, বড়কামতা, মহাস্থান ও ময়নামতির মত ঐতিহাসিক স্থানগুলি বিস্মৃতির অতীত থেকে ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছিল। তিনি ব্রাহ্মণ্য ও বৌদ্ধসহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রাচীন পুঁথিগুলি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পাঠ করে এবং হিন্দু ও বৌদ্ধ মূর্তিগুলির বিজ্ঞানভিত্তিক বিবরণ উন্মোচনের মধ্য দিয়ে বাংলার ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছেন। প্রাচীন ও মধ্যযুগের ইতিহাস নিয়ে দেশী ও বিদেশী পত্রপত্রিকায় নলিনীকান্ত ভট্টশালীর মৌলিক ও গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ ইতিহাসবিদ ও প্রত্নতত্ত্ববিদদের মধ্যে যথেষ্ট আগ্রহের সঞ্চার করেছিল।                  

বরেন্দ্রভূমি ও সমতটের ইতিহাস গবেষণায় ভট্টশালীকে যথার্থই পথপ্রর্দশক রূপে গণ্য করা হয়। পূর্ববঙ্গ ও উত্তরবঙ্গে ব্যাপক ভ্রমণ ও নিরলস অনুসন্ধানের ফলে এই অঞ্চলের ইতিহাস ও সভ্যতাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা অস্পষ্টতা ও অজ্ঞতাকে তিনি অনেকাংশে দূর করেছিলেন। ইতিহাস উন্মোচনে তাঁর ঐতিহাসিক স্থানগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল বিক্রমপুর, সাভার, রামপাল , দিনাজপুর, ব্রজযোগীনি ও ঢাকা-কুমিল্লা সড়কের উভয় পার্শ্বে ময়নামতির উচ্চ এলাকায় কোটাবাড়ীর প্রাচীন নিদর্শনগুলি। খড়্গ, বর্মণ, পাল, চন্দ্র ও পরবর্তী দেব বংশের অজানা পরিচয়ের ইতিহাস তুলে ধরার জন্য তিনি ক্লান্তহীনভাবে সচেষ্ট  ছিলেন। বিশেষকরে সেই সময়কার আবিষ্কৃত গুপ্ত ও মৌর্য যুগের বেশকিছু তাম্রশাসন ও লিপির পাঠোদ্ধার করে বাংলার প্রাচীন ইতিহাস ও সভ্যতা উদ্ঘাটনের মধ্যে দিয়ে মূল্যবান তথ্যগুলি ইতিহাসবিদদের সামনে তুলে ধরেছিলেন। ঐতিহাসিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, নীহাররঞ্জন সরকার, স্যার যদুনাথ সরকার এবং রমেশ চন্দ্র মজুমদার তাঁদের গ্রন্থ রচনায় ও লিপির পাঠোদ্ধারে ভট্টশালী মহাশয়ের অবদানকে বারংবার স্বীকার করে এসেছেন। প্রাচীন মূর্তিগুলির পরিচয় উদঘাটনে এবং যাদুঘরের জন্য পুরাতাত্ত্বিক প্রাচীন বস্তু সংগ্রহের কাজে তিনি আমৃত্যু চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। যেখানেই তিনি প্রাচীন বস্তুর সন্ধান পেতেন কালক্ষেপ না করে চলে আসতেন পথের যে কোন বিপদকে উপেক্ষা করেই। প্রাচীন শিলালিপি ও প্রত্নসামগ্রী উদ্ধারে তিনি দুর্গম অঞ্চলে একাই চলে যেতেন। সঙ্গে থাকত কিছু শুকনো খাবার, ক্যামেরা ও ছোট রেডিও ও টর্চ লাইট। গ্রামবাসীরা মাটি খুঁড়ে কোন মূর্তি পেলে সিঁদুর লাগিয়ে মূর্তিটিকে ভগবানরূপে পূজো আরম্ভ করত। তখন এই প্রত্নপাগল মানুষটি বলতেন- “তোমরা আমাকে মূর্তিটা দাও, ওটি জাদুঘরে নিয়ে পূজো দেব”। প্রাচীন বস্তু সংগ্রহে না আসা পর্যন্ত তিনি শান্তি পেতেন না। ইতিহাস নিয়ে তিনি নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। এই মূর্তি উদ্ধারে তিনি ছদ্মবেশ ধারণ করতে পেছপা হন নি। মূর্তি পূজোর খবর পেলে তিনি ধবধবে সাদা ধুতি ও গলায় পুঁতির মালা পড়ে গৃহস্থের বাড়িতে সটান হাজির হতেন। সুপুরুষ গৌরবর্ণ নলিনীকান্ত ভট্টশালীর সেই রূপ দেখে পরিবার কর্তা স্বয়ং মূর্তিটি তাঁর হাতে সম্প্রদান করতেন। অনেকসময় জেলাশাসকের দপ্তরে মূর্তি জমা পড়লে তিনি কেতাদুরস্ত সাহেবী পোশাক পড়ে সরকারী দপ্তরে চলে আসতেন। তখন তাঁকে উচ্চপদস্থ সরকারী আমলা মনে করে মূর্তিটি দিয়ে দেওয়া হত। এমনকি জেলেদের সাথে তিনি চারদিন রাত কাটিয়েছেন শুধুমাত্র প্রত্নবস্তু উদ্ধারের জন্য। 
ইতিহাসের শিক্ষক হিসাবে কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজে অধ্যাপনার পরে বহু বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভট্টশালী মহাশয় প্রাচীন বাংলা সাহিত্য ও হস্তলিপিবিজ্ঞান বিষয় নিয়ে পড়িয়েছেন। বাংলাসাহিত্য নিয়ে তাঁর গবেষণা বহু প্রাচীন বাংলা গ্রন্থেকে নিয়ে ঘিরে থাকা অস্পষ্টতা ও অজ্ঞতা বহুলাংশে দূর করেছিল। প্রধানত তাঁরই প্রচেষ্টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ও সংস্কৃত পান্ডূলিপি সংগ্রহের একটি কেন্দ্র সৃষ্টি করা হয়েছিল। ‘বাংলার স্বতন্ত্র সুলতানি শাসনের সালতামমি এবং মুদ্রা’ এই গ্রন্থের জন্য (১৯২২ সালে কেম্ব্রিজ থেকে প্রকাশিত) তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রিফিথ পুরস্কার লাভ করেন। এই গ্রন্থে তিনি রাজা গণেশের সম্পর্কে বহু তথ্য প্রকাশ করেন যা গৌড়ের ইতিহাস বির্বতনে বহুভাবে সাহায্য করেছিল। ‘Bengal Past and Present’ গ্রন্থে প্রকাশিত তাঁর ‘ Bengal Chiefs Struggle for Independence in the Reigns of Akbar and Jahangir’ শীর্ষক দীর্ঘ প্রবন্ধটি বাংলার বারো ভুঁইয়ার ইতিহাসকে পন্ডিত সমাজের কাছে নতুনভাবে উন্মোচিত করে। হিন্দু ও বৌদ্ধ মূর্তিগুলি নিয়ে তাঁর গবেষণা প্রাচীন আজানা ইতিহাসকে নতুনভাবে সামনে এনেছিল। Iconography of Buddhist and Brahmanical Sculptures in the Dacca Musuem (1929) – এই  গ্রন্থটি প্রকাশ তাঁর অধ্যবসায় ও পরিশ্রমের ফসল যা এখনও পর্যন্ত এই বিষয়ে একটি প্রামাণ্য দলিল। ১৯৩৪ সালে মুদ্রাতত্ত্ব ও মূর্তিতত্ত্ব নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি পি এইচ ডি ডিগ্রী লাভ করেন। 
বিজ্ঞানভিত্তিক যুক্তি ও স্বাতন্ত্র্য দৃষ্টিভঙ্গিই ছিল তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। অসামান্য নিষ্ঠা ও কর্মশক্তি বলে নলিনীকান্ত ভট্টশালী ঢাকার জাদুঘরের মত এক ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানকে এই উপমহাদেশে এক বৃহত্তর মহীরূপে পরিণত করেছিলেন। ১৯৪৭ সালের ৬ ফ্রেব্রুয়ারী মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত প্রায় ৩৩ বছর তিনি এই দূরূহ দায়িত্ব পালন করেছিলেন। স্বল্পবেতন এবং গবেষনায় আর্থিক সমস্যা থাকা সত্ত্বেও তিনি জাদুঘর ছেড়ে চলে যাননি। জাদুঘরের প্রতি তাঁর এই অপত্যস্নেহ আমৃত্যু অটুট ছিল। ঢাকার জাদুঘর প্রাঙ্গণেই তাঁর প্রয়াণ ঘটে।
দক্ষিণ দিনাজপুর, এই পুরো জেলাটাকেই বলা যেতে পারে পাল, সেন, এবং গৌড়ীয় সুলতানি ইতিহাসের আতুঁড় ঘর। এই তথাকথিত ইতিহাসকে রক্ষণাবেক্ষণ করা বা প্রত্নসামগ্রী ও নিদর্শনগুলিকে সংরক্ষণ – এর কোনটার সম্পর্কেই আমরা সচেতন নই অথবা সচেতনভাবে নির্লপ্ত রয়েছি এই কাজ থেকে। তাই আজকে এই জেলায় প্রয়োজন একজন নলিনীকান্ত ভট্টশালী অথবা অচিন্ত্যকৃষ্ণ গোস্বামী যাঁদের অনুপ্রেরণা ও নিরলস গবেষণায় বর্তমান ছাত্র – যুবরা ঐতিহাসিক সামগ্রীগুলোকে রক্ষার মাধ্যমে ইতিহাসকে বাঁচিয়ে রাখবে এবং ভুল প্রমাণ করে দেবে ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিস্থের বক্তব্য – “ভারতীয়রা ইতিহাস বিস্মৃত জাতি”। 

গল্প

বড় বাড়ি

বড় বাড়ি 
স্বাতী দে 

ওয়েষ্ট পিন্যান্ট হিল 

অস্ট্রেলিয়া ​

SwatiDey.jpg

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

bighouse1.jpg

পাড়ার একমাত্র তিন তলা অট্টালিকাকে সকলে ‘বড় বাড়ি’ নামেই চেনে। আশেপাশের ছোট ছোট বাড়িগুলো যেন কোনো ভাবেই প্রতিযোগিতা করে উঠতে পারে না এই ‘বড় বাড়ি’র সঙ্গে। কবে কারা এই নাম দিয়েছিল কেউ জানে না, তবে নামের সঙ্গে সাযুজ্য রয়েছে বটে। উঁচু প্রাচীর ঘেরা অন্ধকার-গোপন এক প্রাসাদ, যেন নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে শত রকম গোপন রহস্য বুকে চেপে। প্রাচীরের গায়ে শিকড় গেঁথে বসে থাকা অশ্বত্থ-অশোকের গাছগুলো যেন ইচ্ছে করেই বাড়িটিকে আড়াল করে রেখেছে, চোখে পড়লেও হৃদয়ে পৌঁছাতে দেয় না।
গেটের ভারী গ্রিলে সারাক্ষণ তালা ঝোলে। বহুদিন ফাঁকা পড়ে আছে বাড়িটা। 
হঠাৎ একদিন খবর এল - বাড়িটা নাকি বিক্রি হয়ে গেছে। খবরের সঙ্গে সঙ্গে পাড়ার বউ-ঝিরা কাজ ফেলে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়ল, ছেলেপুলে গেটের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিতে লাগল। সাত দিন ধরে ট্রাক আসছে, আসবাব নামছে, আবার অচেনা লোকেরা ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে।
পরদিন সকালে চকচকে এক বিদেশী গাড়ি ‘বড় বাড়ি’র গেটের সামনে এসে দাঁড়াল। গেট খুলতেই অতনু সান্যাল নামলেন - ত্রিশের কোঠার যুবক, চওড়া বুক, আত্মবিশ্বাসী চোখ। তার পিছনেই নামলেন দেবকী। মুহূর্তেই পাড়ার মানুষ শ্বাসরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো। সাদা-নীল শাড়িতে তিনি যেন আলোয় গড়া প্রতিমা। ঠোঁটে নরম হাসি, চোখে এক অদ্ভুত গভীরতা।
সুদর্শন বাবু, মানে বাড়ির দালালের কাছ থেকেই পাড়ার সকলে খবর পেয়েছে বাড়ির মালিক, অতনু সান্যাল আর তার স্ত্রী দেবকী এখন থেকে এখানেই থাকবেন। অতনু ব্যবসায়ী ঘরের ছেলে। টাকা পয়সার অভাব নেই। দেবকী একটা অনাথ আশ্রম চালায়। নিজেদের কোনো ছেলেপুলে হয়নি এখনো।
এ পাড়ায় প্রায় সবাই সবাইকে চেনে। সুদর্শন বাবুও কাছে পিঠেই থাকেন। দেবকীর অনুরোধে সুদর্শন বাবু মিনতিকে খুঁজে পেতে এনে দিলেন সান্যাল বাড়িতে কাজের লোক হিসেবে। মিনতি তিন বাড়ি কাজ করে খায়। সুদর্শন বাবুর কাছে টাকার অংকটা শুনে মিনতি না বলতে পারেনি। 
প্রথম দিন ‘বড় বাড়ি’র গেট পেরোনোর সময় মিনতির বুক ধড়ফড় করছিল। মনে হয়েছিল যেন প্রাসাদ নয়, অন্য এক অজানা জগতে পা দিচ্ছে। দেবকী দরজা খুলে দাঁড়াতেই মিনতির নিশ্বাস আটকে গেল। এ কেমন রূপ! যেন চোখের সামনে সজীব দুর্গা প্রতিমা। মিনতি মনে মনে ভাবল, “মানুষও এত সুন্দর হয়!”
দেবকী মিষ্টি হেঁসে বলল—
“তুমি-ই মিনতি? ভেতরে এস।“
“হ্যাঁ।“ মিনতি তখনও একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে দেবকীর দিকে। ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে ভাবল, “দেবকী এত সেজেগুজে আছে, নিশ্চয়ই কোথাও বেরোবে।“
“তুমি কি আজ থেকেই কাজ শুরু করবে?”
“আপনি কি কোথাও বের হচ্ছেন? আমি না হয় তাহলে পরে আসব।“
“না না আমি কোথাও বেরোচ্ছি না। তুমি আজ থেকে কাজ শুরু করলেই আমার সুবিধে হয়। দেখো না সব কিছু কি রকম অগোছালো হয়ে রয়েছে।“ বলতে বলতেই দেবকী মিনতিকে সব কাজ বুঝিয়ে দিতে লাগলো। 
মিনতি এত বড় বাড়ি এর আগে কখনো দেখেনি। এত গুলো ঘর ও কি করে পরিষ্কার করবে তাই ভাবতে লাগলো। দেবকী ওর মুখ দেখে হয়তো মনের কথাটা বুঝতে পেরেছে, তাই বলল, “আমরা মাত্র দুজন থাকবো এখানে। তাই অধিকাংশ ঘরগুলোই বেশির ভাগ সময় বন্ধ থাকবে, তোমাকে রোজ পরিষ্কার করতে হবে না।“ 
“ঠিক আছে,” বলে মিনতি কাজে লেগে গেল। 
সেদিন থেকেই শুরু হলো মিনতির ‘বড় বাড়ি’তে কাজ। দেবকীকে প্রথম দেখাতেই মিনতির মনে হল যেন এক মমতাময়ী মা। অতনু সান্যালকে খুব একটা দেখা যেত না। সকালেই বেরিয়ে যেতেন, ফিরতেন অনেক রাত করে। 
মিনতির কাজ হয়ে গেলে দেবকী কাজে যায়। কোনো কোনো দিন আবার যায় না। দেবকীর বাড়িতে সারাদিন গান চলে। মাঝে মাঝে আবার কম্পিউটার নিয়ে বসে থাকে দেবকী। কম্পিউটারে কী কাজ করে মিনতি অবশ্য সেটা বুঝে উঠতে পারে না। ওর বিদ্যে তো সেই ক্লাস টু পর্যন্ত। 
প্রথম দু বছর স্কুলে পাঠিয়ে তারপর আর না পেরে ওর মা নিজের সঙ্গে কাজের বাড়িতে নিয়ে যেতে শুরু করে। 
মিনতি বারবার স্কুলে যাবার জন্য বায়না করলে ওর মা বলেছিল, “পড়াশুনা কি আর সবার জন্য?” 
আজ প্রায় চার মাস হয়ে গেল মিনতি দেবকীর বাড়িতে কাজ শুরু করেছে। দেবকীকে মাঝে মাঝে যেন কি রকম অন্য মনস্ক লাগে আজকাল। আজ সকালে মিনতিকে খাবার বের করে দেবার সময় মিনতি লক্ষ্য করল দেবকীর ডান হাতে কালশিটে দাগ পরে আছে। 
মিনতি সহজভাবেই জিজ্ঞেস করল, “হাতে এরকম ব্যথা পেলে কী করে? কোনো ওষুধ লাগিয়েছ?”
দেবকী সঙ্গে সঙ্গে হাতটা সরিয়ে নিয়ে বলল, “ওটা কিছু না গো, কালকে দরজায় গুঁতো খেয়ে এরকম হয়ে গেছে।“ 
মিনতি আর কথা না বাড়িয়ে নিজের কাজে মন দিল। কিন্তু মনের থেকে ভাবনাগুলো কিছুতেই সরাতে পারছিল না। দেবকীর হাতে এরকম দাগ দরজায় লেগে হতে পারে না। দেবকীর বাড়িতে তো শুধু দেবকী আর অতনু থাকে। তাহলে কি অতনুও ...।
না না, আর ভাবতে চায় না মিনতি। প্রতি রাতে ওর মাতাল স্বামী যখন ওকে মারধর করে তখন তো ওর শরীরে এরকমই দাগ হয়। পরদিন আবার শাড়ির আঁচলে শরীর ঢেকে কাজে বের হয় মিনতি। স্বামীকে ছেড়েও যেতে পারে না। কোথায় বা যাবে? 
কিন্তু মিনতি নিজের সঙ্গে কী করে দেবকীকে গুলিয়ে ফেলছে? দেবকী শিক্ষিত, সুন্দরী, বড়লোক। ভগবান অনেক যত্নে ওকে বানিয়েছেন। কোনো রকম কার্পণ্য তো বিধাতা করেননি। হয়তো মিনতিরই বোঝার ভুল। 
আরো কিছুদিন গেল। এর মধ্যে মিনতির শরীরটা একটু খারাপ হওয়ায় ও কাজে যেতে পারেনি। দু’দিন পর আজ কাজে এসে দেখল দেবকীর পা ভেঙেছে। পায়ে প্লাস্টার করা হয়েছে। ভাঙা পা নিয়েই ক্রাচে ভড় করে এসে দরজা খুলে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কেমন আছো, মিনতি? শরীরটা কি একটু ভাল এখন?”

“আমি তো ভাল আছি। কিন্তু আপনি পা ভাঙলেন কি করে?”

“আর বলো না, বাথরুমে পড়ে গিয়েছিলাম।“ 

“আপনি কি বাড়িতে একাই আছেন?”
“হ্যাঁ, অতনুকে অফিসে যেতে হয়েছে।“
মিনতি দেবকীকে ধরে নিয়ে গিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বলল, “আপনি নিশ্চয়ই কিছু খাওয়া দাওয়া করেন নি? আপনি বসুন, আমি আপনার জন্য চা বানিয়ে আনছি।“
চা আর বিস্কুট দিয়ে মিনতি বলল, “আমি আজ আপনার সঙ্গেই থাকছি। অন্য বাড়ির কাজগুলো আজ আর করব না।“
“না না, তুমি এখানের কাজটা করে চলে যাও। ওরা তো তোমার জন্য অপেক্ষা করে থাকবে।“
“কিছু হবে না। কাল গিয়ে ওদের বলে দেব আমি অসুস্থ ছিলাম।“ কথাটা বলে মিনতি মুচকি হাসল। মিনতি দেবকীর জন্য রান্না করল, আবার রাতের জন্য কিছু খাবার তৈরি করে ফ্রিজে রেখে দিল। তারপর বালতি করে জল এনে দেবকীর মাথা ধুইয়ে দিল। 
মাথার চুলগুলো সরাতেই ঘাড়ের কাছে আবার কালশিটে দাগ চোখে পড়ল মিনতির। মনে হচ্ছে যেন পাঁচ আঙ্গুলের দাগ বসে গেছে। চুলগুলো সরিয়ে ঘাড়ের কাছে জল মুছতেই দেবকী যন্ত্রনায় চিত্কার করে উঠল। 
মিনতি লোকের বাড়িতে কাজ করে ওর পেটের যোগাড় করে, তাই ওর মুখের ভাষায় মধু ঝরে না। তাই একটু কর্কশ গলায় জিজ্ঞেস করল, “ঘাড়ে তো একেবারে কালশিটে পড়ে গেছে। এটাও কি আপনার দরজায় লেগে হয়েছে?”
“বুঝতে পারিনি গো, কখন কিভাবে লেগে গেছে।“ দেবকী নিজের মনে বিড়বিড় করে বলল। 
মিনতি এবার আর সহ্য করতে না পেরে বলেই ফেলল - “আপনার ঘাড়ে পাঁচ আঙ্গুলের দাগ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। আপনি কেন এসব সহ্য করছেন?” 
তারপর গলার স্বর নামিয়ে বলল, “আমার স্বামী রোজ রাতেই আমাকে পেটায়। আমার সারা শরীরে সব সময় এরকম দাগ দেখতে পাবেন। আমি না হয় গরীব অশিক্ষিত কাজের মেয়ে, স্বামীর ঘর ছেড়ে আর কোন যাবার জায়গা নেই। আর কোথাও গেলে সেখানেও যে চিল শকুনেরা আমায় ছেড়ে দেবে সে সম্ভবনাও কম। কিন্তু আপনি? কেন?” 
দেবকী অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইলো। হয়তো কী জবাব দেবে ও নিজেও জানে না। 
তারপর কিছুটা দুঃখ আর হয়তো কিছুটা ক্ষোভ মিশিয়ে বলল, “আমাদের দুজনের অবস্থাই প্রায় একই রকম, মিনতি। তুমি অভাবের হাতে বন্দী, আর আমি প্রাচুর্যের শিকলে। কেউই এর বাইরে বেরিয়ে আসতে পারবো না।“
মনটা সেদিন খুব খারাপ নিয়েই ‘বড় বাড়ি’ থেকে বেরিয়ে এসেছিল মিনতি। এতদিন ও ভাবত সব দুঃখ কষ্টের মূলে এই অভাব! ওদের বিয়ের সময় বিমল কারখানায় কাজ করত, তখন ওর জীবনটা এতটা কষ্টের ছিল না। কিন্তু কারখানাটা হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে যাবার পর থেকে বিমল আর কোনো কাজ পায় নি, পাওয়ার চেষ্টাও করেনি। সারাদিন পাড়ার চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দেয়, আর রাতে দেশী মদ খেয়ে এসে মিনতির উপর পুরুষত্ব দেখায়। রোজ রোজ টাকার জন্য মিনতির গায়ে হাত তোলে। 
কিন্তু আজ দেবকীকে দেখে মিনতির ভুল ভাঙল। টাকা থাকলেই যদি সুখী হওয়া যেত তাহলে তো দেবকীর কোনো কষ্ট থাকার কথা নয়। ওর এই অল্প বুদ্ধিতে কিছুই যেন বুঝে উঠতে পাড়ছে না মিনতি! 
সারা রাত দেবকীর কথা ভেবে মিনতির ঘুম হল না। ভোর রাতে উঠে ঘরের কাজ সেরে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়ল। ভাবল সকাল সকাল দেবকীর বাড়িতে গিয়ে কিছু কাজ করে দিয়ে তারপর অন্য কাজে যাবে। বাইরের গেটে তালা না থাকায় মিনতি গেট খুলে ভেতরে ঢুকে দরজায় কড়া নাড়তে যাবে, এমন সময় ঘরের ভেতর থেকে কথাবার্তার শব্দ কানে এল। 
“রেবতীকে আমার চাই, আমি আমার ক্লায়েন্টকে কথা দিয়ে রেখেছি। আর জানো ওকে বিক্রি করলে কত টাকা পাবো? তুমি সারা বছর চাকরি করলেও সেটা পাবে না। দশ লাখ! তোমার এই বাড়ি গাড়ি - এসব কি এমনি এমনি হয়ে যায় ভেবেছো?” মিনতি দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে কথাগুলো শুনেই বুঝতে পারল অতনু রাগে ফুঁসছে। 
“আমি কিছু জানি না। আমি তোমাকে আর এই পাপ করতে দেব না। রাইয়া একটা বাচ্চা মেয়ে। আমাকে ও মা-এর মত ভালোবাসে। তুমি ঐ অনাথ আশ্রম থেকে অনেক বাচ্চা নিয়েছ। কিন্তু আমি রাইয়াকে কিছুতেই নিতে দেব না।“ দেবকীর গলার স্বর ধরে এল। 
“তুমি না বলার কে? তোমাকে ঐ অনাথ আশ্রমের চাকরিটা কে দিয়েছে, ভুলে গেছ? তোমার শ্বশুরমশাই, অনিমেষ সান্যাল। সান্যাল বাড়ির বউরা চাকরি করে না, কিন্তু তবুও তোমাকে অনাথ আশ্রমের চাকরিটা দিয়েছে, কেন? ঐ অনাথ আশ্রমটা আমাদের পারিবারিক ব্যবসা। আশ্রমের আড়ালে বাচ্চাদের বিক্রি করাই যে আমাদের পেশা, সেটা তো তুমি জেনেই গেছ। তোমার জন্য তো আর আমরা পথে বসতে পারি না।“
মিনতি বাইরে থেকে দেবকীর কান্নার শব্দ শুনতে পাচ্ছে। অতনু একটু থেমে আবার বলতে শুরু করল, “তোমার কাছে দুটো রাস্তা খোলা আছে। হয় তুমি দেখেও না দেখার ভান করে আগের মতই চুপ করে থাকো, নইলে এরপর আর পা ভেঙে, গলা টিপে ছেড়ে দেব না। গলা টিপে একেবারে শেষ করে দেব। কথাটা মনে রেখ।“ 
মিনতি দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ভয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগলো। ও যে এখানে দেবকীকে সাহায্য করতে এসেছিল, সেটাই ভুলে গিয়ে নিঃশব্দে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এল। 
বাইরে এসেই মিনতির মনে হল দেবকীকে একা একা ও রকম একটা পাষণ্ড লোকের সঙ্গে রেখে আসা ঠিক হল না। কিন্তু মিনতিই বা কি করবে? যদি ওকে মেরে দেয়? 
অনেক ভেবে মিনতি দৌড়ে সুদর্শন বাবুর বাড়িতে গিয়ে উঠল। হাঁফাতে হাঁফাতে কোনো রকমে ওকে ঘটনাগুলো বলতেই সুদর্শন বাবু মিনতিকে সাথে নিয়ে থানায় গেলেন। 
মিনতি থানার অফিসারের কাছে হাত জোর করে বলল, “আপনারা দেবকীকে বাঁচান, নাহলে ওর স্বামী ওকে মেরে ফেলবে।“
পুলিশের হাতে এরপর অতনু সান্যাল গ্রেপ্তার হল। পরে জানা গেল শুধু স্বামী নয়, দেবকীর শ্বশুরমশাই, অনিমেষ সান্যালও একই চক্রের সঙ্গে জড়িত। আশ্রমের আড়ালে শিশু পাচারের ব্যবসা!
দেবকী শেষ পর্যন্ত এই শেকল থেকে মুক্তি পেল। চাকরি পেল এক স্কুলে। রাইয়াকে দত্তক নিল - এবার সত্যিকারের মা-মেয়ে হয়ে বাঁচবে তারা।

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

গল্প

আয়না
সোমা বন্দোপাধ্যায় 

আয়না
women.jpg

বিছানাটা আজ ছাড়তেই ইচ্ছে করছে না। শীতটা চলে গেলেও ভোরের দিকটা এখনও বেশ আরামদায়ক। আজ থেকে ঘোড়দৌড়ের ছুটি। গত তিনদিন ধরে সহকর্মীদের ভালোবাসার জোয়ারে ভেসে গিয়েছিল মেঘ। এবার একটু থিতু হওয়া। দীর্ঘ চল্লিশ বছর ধরে শুধু ছুটেই চলেছে। পারিবারিক বিপর্যয় সামলে উঠে দাঁড়ানোর জন্য ছোটা। টুইশন করতে একবাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে ছোটা। নাকেমুখে গুঁজে সময়মতো কাগজের অফিসে ছোটা। বাড়ি ফিরেই রান্নাঘরে ছোটা।ছুটতে ছুটতে একদিন দেখা হয়েছিল মল্লারের সঙ্গে। বেশ লেগেছিল মেঘের। অনেকটা ওরই মতো ছোটখাটো চেহারা। স্বপ্নময় উজ্জ্বল গভীর চোখদুটোয় কতই না অব্যক্ত কথা! সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। কথা বলে মনে হয়েছিল পড়াশোনায় গভীরতা আছে। পথ চলতে চলতে মেঘ জেনেছিল মল্লারের বিপ্লবী পরিবারটাকে। জেনেছিল আদিগন্ত মরুভূমির উত্তপ্ত বালিতে সেঁকতে সেঁকতে মল্লারের বেড়ে ওঠার গল্প। মেঘ ভেবেছিল মল্লারের মরুভূমিতে সে বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়বে। ছোট্ট সংসারটা একটুকরো মরুদ্যানের মতো তৃপ্তি নিয়ে আসবে ওদের জীবনে।
ডোরবেলটা বেজেই চলেছে। ঘড়ির দিকে তাকালো মেঘ। পারুল এলো নিশ্চয়ই। মল্লার এখনও ঘুমের দেশে। ওর তো কোনও ছোটার তাড়া নেই। কোনওদিন ছিলোও না অবশ্য। আর সে জন্যই অবসরের মজাটা কখনও অনুভবই করলো না।
“দিদি সব বাসন মেজে নেছ! আমি যে বল্লুম এখে দিও!”
“না না কাল বন্ধুরা এসেছিলো, দোকান থেকে খাবার আনা হলো। কাল ডাক্তার কি বললো পারুল!”
“আর বলুনি দিদি।  ডাক্তার দেখানো তো নয়! যাওয়া মাত্তরই একখানা নাল কাগজে খস খস করে কি চাড্ডি নিকে দিল, বললো টেস করিয়ে এক হপ্তা পরে আবার আসবে। জ্বালাতন! কতো ছুটি নেবো বলো দিকিনি!”
“সে বললে কি হবে অসুখ করলে তার চিকিৎসা তো করতেই হবে পারুল! তোমার খাটুনির শরীর। ঘরে বসে থাকলে চলবে! তা কি এত টেস্ট দিলেন?”
“ওই পেস্কিশানটা এনিচি তোমায় দেখাবো বলে”
টি পটে চা ভিজিয়ে সোফায় হেলান দিয়ে বসলো মেঘ। বিশেষ কিছু না শধুই কয়েকটা রুটিন টেস্ট। ডাক্তারদেরও বলিহারি একবার ভাবেও না এসব করানোর সামর্থ্য রুগির আছে কিনা। 
দামি দার্জিলিং চায়ের সুগন্ধে আড়মোড়া ভেঙে উঠলো মল্লার। বরাবর লেট রাইসার। ঘর থেকে বেরিয়েই চেঁচিয়ে উঠল-
“সুপ্রভাত আমার অবসৃত অর্ধাঙ্গিনী….”
মেঘ অবাক হয়ে যায়। এ আবার কি নতুন সম্ভাষণ! সরকারি চাকরি থেকে অবসর মিললেও ঘরবাড়ির চাকরি থেকে তো আমৃত্যু মুক্তি নেই। 
“দিদির আর আপিস যাওয়ার তাড়া নেই বাবা! বাঁচা গেছে। যা দৌড়ঝাঁপ করে বেরুতে তুমি!”
মোচা কাটতে কাটতে নিজের মনে বলছে পারুল। মেঘের শৌখিন রান্নার লোক মোচা কাটতে চায় না। পাছে হাতে কালো দাগ হয়ে যায়। অগত্যা এসব পারুলের ঘাড়েই পড়ে। 
মল্লারের বাজার করার কোনও ছিরি নেই। একসঙ্গে সব এনে হাজির করবে। লাউ, বাঁধাকপি, এঁচোড়, মোচা। কে এসব কুটবে  তা নিয়ে কোনও মাথাব্যথা নেই ওর। কোনওরকমে বাজারের থলিটা এনে ফেলে দিলেই ছুটি। পারুল টেনে টেনে কাজ খুঁজে আনে। কাঁচালংকার বোঁটা ছাড়ানো, কড়াইশুঁটির খোসা ছাড়ানো, মাসকাবারি ফর্দ করা, ভিজে জামাকাপড় রোদে উলটে দেওয়া। এ ছাড়া বাসন মাজা, ঘরদোর পরিষ্কার তো আছেই। পারুলের উপর গোটা সংসারটা ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে চাকরি করেছে মেঘ। প্রতিদিন বেরোনোর সময় ঘটিতে জল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে পারুল। মেঘের জুতো পরা হয়ে গেলেই তার হাতে দু ফোঁটা জল দেয়। ঘটিটা কপালে ঠেকিয়ে মেঘের নিরাপদ যাত্রার প্রার্থনা করে–
“গোবিন্দ…. দুগগা দুগগা……”
আজকের দিনে পারুলের মত মানুষ সত্যিই বিরল। মেঘ মনে করার চেষ্টা করে মল্লার কখনও দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে? হয়তো দাঁড়িয়েছে, কিন্তু সে তো শুধুই দাঁড়ানোর জন্য। বেরোনোর সময় চিরকাল মেঘ একটাই ছবি দেখেছে। কোনওরকমে দুটি খেয়ে, অফিসের ব্যাগ, টিফিন, জল, দরকারি ফাইল, ড্রয়ারের চাবি, সব একজায়গায় করতে যখন হিমসিম খায় মেঘ, মল্লার তখন হাবিজাবি  কথা বলে সব গুলিয়ে দেয়। হুড়োহুড়িতে কিছু না কিছু ভুল হয়ে যায়। কোনওদিন বাড়ির চাবি, কোনওদিন ফোন, কোনওদিন পার্স, কোনওদিন বা সবচেয়ে প্রয়োজনীয় ফাইলটা। লিফট পর্যন্ত গিয়ে আবার ফিরে আসে মেঘ। 
“কি হলো কিছু ভুললে নাকি!”
মোবাইল বা বই এর পাতা থেকে কোনওরকমে মুখ তুলে জিগ্যেস করে মল্লার। রিডিং গ্লাসের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসা চোখদুটোর সঙ্গে মল্লারের সেই স্বপ্নময় চোখের আসমান জমিন ফারাক। কখনও সোফা থেকে উঠে এগিয়ে আসে না যাতে মেঘের দুটো মিনিট সময় সাশ্রয় হয়।
“ও দিদি! কাল আমার আসতে একটু দেরি হবে। নাতিটার পরীক্ষা আচে ইস্কুলে দে আসবো।”
চমকে ওঠে মেঘ। “বাবা তোমার ঘাড়ে আবার এটাও পড়লো নাকি পারুল!”
“না গো দিদি ওকে তো আমার বর দে আসে খুঁইড়ে খুঁইড়ে।”
“তাহলে?”
“কাল উনি যেতি পারবেন না ওনার পাটির মিটিং আচে। সারা জেবন ওই পাটি পাটি করেই তো হাড়মাস জাইলে দিলো”
“তা তোমার ছেলে? সে তো দিয়ে আসতে পারে”
“ও বাবা! সে তো আজার ব্যাটা আজা গো। এম এ পাশ করে ইস্কুল মাস্টার হইচে না! ওর সময় নেই। দু দুটো বাচ্চা নিয়ে হিমসিম খায় বৌ টা। কুটো নেড়ে দুটো করে না গো দিদি…..”
মেঘ আর মল্লারের সংসারে পারুল এক ফরিস্তা। নয় নয় করে বছর দশেক হয়ে গেল এ বাড়িতে কাজ করছে পারুল। কোনওদিন মুখফুটে এক টাকা মাইনে বাড়াতে বলেনি। মেঘ যখনই মাইনে বাড়ায় পারুলের মনে হয়  কাজের তুলনায়  বেশি মাইনে পাচ্ছে সে। মেঘ আর মল্লার দুই বিপরীত মেরুর। মেঘের পরিপাটি ঘরের সবকিছু অগোছালো  করে দিয়ে আনন্দ পায় মল্লার। এলোমেলো জিনিস ম্যাজিকের মতো গুছিয়ে ফেলে পারুল। গোছানোর চোটে মাঝেমাঝে মেঘ খুঁজেই পায়না দরকারি জিনিস। পারুলের সমস্ত শরীরে ডগডগে এয়োস্ত্রীর চিহ্ন। আটপৌরে করে পরা শাড়ি আর ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা স্নিগ্ধ হাসিটুকু দিয়ে কেমন মায়ায় বেঁধে ফেলে সকলকে।

চাকরির চাকায় ঘুরতে ঘুরতে নিজের ইচ্ছের অনেকটাই পূরণ করে উঠতে পারেনি মেঘ। একে একে সেগুলো শেষ করার কথা মনে হয়। কিন্তু তরুণ বয়সের ফেলে রাখা কাজ কি এই বয়সে সবটা করা সম্ভব? তবুও সাধ আর সাধ্যের রেখা দুটো যতটা কাছাকাছি আনা যায়। মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবন নিয়ে কিছু লেখার চেষ্টা করছে মেঘ। বইপত্র জোগাড় করে পড়াশুনোও শুরু করেছে একটু আধটু….“মেঘ, আজ দু তিন জন সাংবাদিক আসবে বুঝলে, আমার একটা ইন্টারভিউ নিতে”   এসবে মেঘের আর শিহরণ জাগে না। বছরের পর বছর স্পটলাইটের আলোয় বসে বলা একই ঘোরানো প্যাঁচানো কথা শুনতে ক্লান্ত লাগে আজকাল। বইয়ের পাতায় চোখ রেখেই মেঘ উত্তর দেয়-

“বেশ, ইন্টারভিউ শুরু হলে এ ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিও”। মেঘকে একদম অচেনা লাগে মল্লারের। সাংবাদিক বাড়িতে আসা তো নতুন কিছু নয়! শুধু সাংবাদিক কেন মল্লার তো যাকে যখন যেভাবে মনে করেছে বাড়িতে এনে তুলেছে। তা সে পরের দিন মেঘের জরুরি মিটিং থাক বা মেয়ের ফাইনাল পরীক্ষা। পরোয়া করেনি কিছুর। কিন্তু এমন উদাসীন তো মেঘ কখনও থাকেনি! মেঘের অতিথি আপ্যায়ণে বরং লোকসমাজে বেশ ছাতি ফুলিয়ে ঘুরে বেরিয়েছে মল্লার। বন্ধ দরজার আড়াল থেকে মেঘ শুনতে পায় মল্লার বলে চলেছে-     

“ঘরে বাইরে নারীদের সম্মান করাটা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। সমানাধিকার তো খাতায় কলমে হয় না, সমাজ গঠনের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে মেয়েদের পাশে দাঁড়াতে হবে আমাদের। প্রতিটি মেয়ের সম্মান এবং সুরক্ষার দায় সরকারের। বিশেষ করে অনুন্নত সম্প্রদায়ের নারীদের আরও বেশি করে সচেতন করতে হবে। বুঝিয়ে দিতে হবে তাদের অধিকার…….”

মেঘের চোখে ছায়া ঘনায়। সেদিন ধুম জ্বর ছিল মেয়েটার। সারাদিন ঘ্যানঘ্যান করে যাচ্ছে। অফিসে সেদিন না গেলেই নয়। মল্লার যথারীতি পান্ডিত্যের সন্ধানে বই এর পাতায়। ওষুধপত্র খাইয়ে কাজের

মেয়েটার জিম্মায় দিয়ে অফিসে ছোটে মেঘ।
“মল্লার তুমি মেয়েকে একটু দেখে রেখো আমি মিটিংটা সেরেই চলে আসছি”
“আরে হ্যাঁ হ্যাঁ তুমি সাবধানে যাও। চিন্তা কোরো না আমি সব দেখে রাখবো”
বাস থেকে নেমে হাঁটাপথটুকুর জন্যও রিক্সা নিয়েছে মেঘ। গলির মুখ থেকে শুনতে পাচ্ছে ককিয়ে যাচ্ছে মেয়েটা। একদৌড়ে ঘরে ঢুকে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে মেঘ। জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে গা। 
“সোনালি তোর দাদা নেই?”
“না বৌদি তুমি বেরোনোর একটু পরেই তো দাদা বেরিয়ে গেল। বললো কি বক্তৃতা আছে”
জ্বরে কাবু মেয়েটার দু চোখে গঙ্গা যমুনা।
“মা তুমি ককন তেকে আমি কানচিয়াম......”
“মেঘ একবার এসো ওনারা তোমার সঙ্গে আলাপ করতে চাইছেন…..”
মেঘ একেবারে ডুবে গিয়েছিল মাইকেল মধুসূদনের জীবন আখ্যানে। একরাশ বিরক্তি চেপে দেঁতো হাসি নিয়ে বেরিয়ে এলো।
“মেঘ, আমার স্ত্রী। আমার সহযোদ্ধা”
বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে মেঘের। এই বয়সে শুধুমাত্র কারও স্ত্রী হিসেবে পরিচিত হতে আর মন চায় না। নিজের একটা সম্মানজনক পরিচয় প্রতিষ্ঠা করার মতো কতোকিছুই তো তার আছে! সত্যিই কি জীবনের কোনও লড়াইতে ‘সহযোদ্ধা’ হিসাবে পাশে দাঁড়িয়েছে মল্লার?
“দিদি গো…..” কোনও কথা বলার আগে এভাবেই হাঁক পাড়ে পারুল। “ডাক্তার তো বলতিচে সব ইপোর্টই ভালো। কোলেস্টো, বেলা ছোঁকা, ইউরিয়া, থাইরা সব। শুধু হিগোবিনটা একটু কম।”
“ওষুধপত্র কিছু দেননি ডাক্তারবাবু?”
“না গো বললো কিচুই হয়নি কি ওষুধ খাবি? শুধু একমাস অন্তর ক্যালসল নিকে দেচে।”
রিপোর্টটায় চোখ বুলিয়ে মেঘ দেখলো পারুলের হিমোগ্লোবিনটা সত্যিই কম। কিন্তু তাতেও কাজ করে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই পারুলের।
“শরীর যখন খারাপ তখন কাজ করার দরকার কি? ছেলে স্কুলে কাজ করে, স্বামী তো আছেন….” তাত্ত্বিক সাম্যবাদীর উপদেশ আসে। 
“সোয়ামির কতা আর বোলো না দাদা, সারাজেবন আমার হাড় মাস জাইলে খেলো। বিয়ের সময় শুনেচিনু চাকরি করে কারকানায়। তা ওজগার তো কিচু চোকে দেকলুম না”
“পারুল, ঠিক করে খাওয়াদাওয়া তো করতে হবে….” মেঘের গলায় চাপা উদ্বেগ। 
“দিদি গো ঘরের ডালভাতের উপর আর কি খাবো বলো দিকিনি! চার বাড়ি কাজ করে যা মাইনে পাই তার অদ্দেক চলে যায় বরের ওষুধ কিনতে। বাইপাস উগি নায় গো!”
“তবু রোজ অন্তত একটা ডিমসেদ্ধ….”
কপালে দুটো হাত ঠেকিয়ে হেসে গড়িয়ে যায় পারুল… “দিদি গো তুমি আর হাসির কতা বলুনি। ডাক্তার বললে দুদিন এস্ট নাও। ঘরে তাকলে এত অশান্তি তার থেকে আমার কাজে বেইরে আসা ভালো”
স্ত্রীর প্রতি স্বামীর এই উদাসীনতা…এ তো মানবাধিকার লঙ্ঘন আর সে কথা একজন নির্যাতিতাকে বোঝানো মল্লারের নৈতিক দায়িত্ব। হাজার হলেও মল্লার সংগ্রামী সমাজকর্মী, সমানাধিকার আন্দোলনের পথিকৃত…
“সে কি তোমার ভরণ-পোষণ করা, ওষুধ, পথ্য, মানসিক শান্তি এসব দেখার দায়িত্ব তো তোমার স্বামীর। সেটা তো তাঁকে করতেই হবে”
শীতল চোখে মল্লারের দিকে তাকিয়ে থাকে মেঘ। ভরণ-পোষণ এর অর্থ কি সত্যিই বোঝে মল্লার! জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও ‘স্বামী কি করেন’ এ প্রশ্নের জবাব দিতে পারে না মেঘ। এই মানসিক যন্ত্রণার খবর কি মল্লার রাখে? এড়িয়ে যাওয়ার অছিলায় মেঘ বলে- “ উনি বিখ্যাত মানুষ, খ্যাতনামা সমাজকর্মী”... নিজের সঙ্গে লুকোচুরি খেলার এই তীব্র দহনের আঁচ কি লাগে মল্লারের গায়ে?
“কি যে বলো দাদা! ছেলেটা যখন পেটে, বলা নেই কওয়া নেই দুম করে ছেড়ে দেলো কারকানার চাকরি। সে নাকি নেতা হবে। পাড়ায় পাড়ায়, হাটে বাজারে, এ গাঁয়ে ও গাঁয়ে ফেলাগ নিয়ে ছুটে বেড়াতে নাগলো- দিতে হবে দিতে হবে…। ভরা পোয়াতি পেট নিয়ে লোকের এঁটো বাসন মেজেচি। বিয়ে হয়ে ইস্তক সংসারের জোয়াল বইতে বইতে কুঁজো হয়ে গেলুম গো দাদা। ওনার খালি নম্বা চওড়া বুলি।”
“আজকের বাজারে নেতাদের তো পোয়া বারো পারুল…” একটু উসকে দেয় মেঘ। 
“দিদি গো…. সে হতি গেলি কায়দা জানতি হয়, শুধু বুলি ঝাড়লি হয় না। বুলি ঝাড়তি যায়, একটা ফুল আর মিষ্টির প্যাকেট ধইরে বিদেয় করি দেয়। গুইচ্ছে নেয় ওই পাঁচু, কালু, শমসের রা। উনি নাম ফাটিয়েই খুশি। ঘরে ভাত চড়লো কিনা সে খোঁজে কাজ নেই।  সারাজেবন খালি ঢোল বাইজ্যে গেলো গো এট্টুও শোধরালোনি।”
মেঘ লম্বা শ্বাস ফেলে….কেউ কি আদৌ শোধরায়?
তুলতুলে নরম মাংসের টুকরোতে কামড় দিতে দিতে দেশোদ্ধারের কাজের ফিরিস্তি দিচ্ছে মল্লার। 
“.......এইসব বঞ্চিত মানুষদের জন্য আমাদের ভাবা উচিৎ। দেখি কাল বিপ্লবকে ফোন করবো। এসব নিয়ে যদি কোনও কাজ করা যায়। এই জন্যই মেয়েদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা দরকার। এভাবে অন্যায় সহ্য করে পড়ে থাকতে হয়না তাহলে। নিজের মতো করে বাঁচার কথা ভাবতে পারে……”
মেঘ স্বগতোক্তি করে “স্বাধীন হলেই কি সব বেড়ি কেটে বেরোনো যায়…..?”
আজকের পোস্ট-এডিটোরিয়ালে নারী স্বাধীনতা নিয়ে একটা লেখা বেরিয়েছে। মন দিয়ে পড়ছিল মেঘ। মেয়েদের কাগুজে স্বাধীনতার গপ্প। ঝনঝন করে বেজে উঠলো ইন্টারকম ফোনটা।
“ম্যাডাম আপনার গেস্ট আছে”
“কি নাম?”
“মনোরঞ্জন বাগদি”
সে আবার কে রে বাবা! “মল্লার! মনোরঞ্জন বাগদি কে? তোমার গেস্ট?”
“কই না তো!”
রান্নাঘর থেকে দৌড়ে আসে পারুল। “আমার সোয়ামি গো দিদি, ওষুধ কিনে নেচি তাই নিতে এয়েচে…”
“তাই বলো। পাঠিয়ে দিন….”
“পারুল উনি আসবেন তুমি বলোনি তো?” গৃহকর্তা প্রশ্ন করেন।
“কাজের ঠেলায় মনে নি গো দাদা। ও আর এমন কি ব্যাপার আসবে তো….”
মল্লার মোবাইলে মন দেয়। কত কি হয়ে চলেছে গোটা পৃথিবীটা জুড়ে। শাসক আর শোষিতর জব্বর লড়াই চলছে দেশ থেকে দেশান্তরে। এসব নিয়ে মল্লার লিখবে পাতার পর পাতা। পোস্ট হবে ফেসবুকে, লাইক আর কমেন্টের বন্যা বইবে। আহ দাদা, বাহ দাদা, ও ভাইটি, গুরুদেব আরও কতরকম প্রশস্তি।
“আসুন ভিতরে আসুন। বসুন….। পারুল উনি এসেছেন”
“আসতেচি গো দিদি”
মোবাইল থেকে চোখ তোলে মল্লার। সোফায় সোজাসুজি বসে আছে মনোরঞ্জন। ওর দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ের ঘোর কাটে না মল্লারের। ইনি মনোরঞ্জন! এ কি করে সম্ভব। বাস্তবে এমন হয় নাকি! এ তো গল্প উপন্যাসে, সিনেমায় হয়।
“কি দেখছ মল্লার! ওনাকে তুমি চেনো নাকি?”
“হ্যাঁ… অনেকদিন…  না…মানে না…”
মল্লারের মুখ ফ্যাকাসে, রক্তহীন। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। সমস্ত শরীর জুড়ে অস্বস্তির ছাপ স্পষ্ট।
“কি হলো মল্লার? শরীর খারাপ লাগছে?”
“না মেঘ, আমি ঠিক আছি”
না। মল্লার ঠিক নেই। মনোরঞ্জনকে দেখে ঠিক থাকতে পারেনি মল্লার। ভয়ে আধমরা মল্লারের বুক থেকে উড়ে গিয়েছে প্রাণবায়ু। মনোরঞ্জনকে কেমন অবিকল মল্লারের মত দেখতে। ওর চোখ, কথা বলার ভঙ্গি, হাত পা নাড়া, শরীরের ভাষা কোনও কিছুতে কোনও তফাৎ নেই। মল্লার যে আয়নার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।

প্রবন্ধ

শিব না বাঁদর নাকি শিব গড়তে বাঁদর সবটাই অভিভাবকের ইচ্ছা ও চেষ্টা

সনোজ চক্রবর্তী

পূর্ব মেদিনীপুর, পঃ বঙ্গ

asukh2.jpg
শিব বা বাঁদর
SanojCharaborty.jpg

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

১ম পর্ব
ই পৃথিবীতে আপনার সবচেয়ে দামী সম্পদ কোনটি? জমি, বাড়ি, গাড়ি, অলংকার, কোম্পানীর কাগজপত্তর? হ্যাঁ এগুলো সম্পদ, জীবনে বেঁচে থাকার জন্য এগুলো দরকার কিন্তু এগুলো সবিশেষ দামী সম্পদ নয়।
এগুলোর কোন একটির জন্য আপনার দম আটকে আসে না। আমাদের জলে ডুবিয়ে রাখলে যে আকপাকানিটা আসে এগুলোর জন্য তেমনটা হয় না। এগুলোর কোন এক এমনকি একাধীকের জন্য আপনি চিন্তাগ্রস্ত হয়ে ক্রমশ রোগাতুর হয়ে যান না।
আমাদের প্রত্যেকের জীবনে আরো বিনিদিষ্ট ভাবে বললে প্রত্যেক বিবাহিত নারী-পুরুষের জীবনে উত্তারধিকারী হল সবচেয়ে দামী সম্পদ। সেই উত্তরাধিকারীর হাতেই ব্যটন তুলে দেই আমরা। সেই আমাদের বংশ-বাতি কে আরো উজ্জ্বলতর করে এগিয়ে নিয়ে যায় ভবিষ্যতের পথে।
আপনার সন্তান আপনার সবচেয়ে দামী সম্পদ। সন্তান ইশ্বরের আশির্বাদ। সবাই তো সন্তান পায় না। কত মানুষ সন্তানের জন্য মন্দির, দরগা, তীর্থে তীর্থে মাথা কুটে মরছে। হাঃ সন্তান হাঃ সন্তান করে কত মানুষের একটা আস্ত জীবন হতাশায় ডুবে যায়।
যদিও বর্তমানে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি হয়েছে সন্তান ধারনের-- সেসব শুধু ব্যয় বহুল নয় কষ্টকরও।তাছাড়া অনেক সময় নানা অস্বাভাবিকতা নিয়ে পৃথিবীতে ভূমিষ্ট হয় সেসব সন্তান। আপনি যদি স্বাভাবিকভাবেই সেই সৌভাগ্যের অধিকারি হন। ভেবে দেখুন কত সৌভাগ্য আপনার। ইশ্বর আমাদের উত্তরাধিকারী দেন। কমার্সের পরিভাষায় কাঁচামাল পাই আমরা। তাকে যোগ্য উত্তারাধিকারি বানানোর দায় আমাদের। আপনি শিব গড়বেন না বাঁদর নাকি শিব গড়তে বাঁদর সে আপনার ইচ্ছা ও চেষ্টা।
ঐ কা়ঁচামাল অর্থাৎ আপনার সন্তানকে যোগ্য উত্তরাধিকারি করে গড়ে তুলতে পারলে - সে শুধু আপনার গৌরব নয়, সে আপনার কুলগৌরব, সমাজ তথা দেশের গৌরব।
আপনার বংশের মুখ উজ্জ্বল করে সে সন্তান বস্তুগত সম্পদ অনেক থাকতে পারে কিন্তু সন্তান যদি ভালো মানুষ না হয় তবে আপনি সুখি নন। আপনি সন্তানের জন্য অনেক কিছু করে গেলেন -- জমি, বাড়ি গাড়ি ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স লোকে হয়তো বলবে আপনি বাবার কর্তব্য করেছেন। আপনি ভেতরে ভেতরে জানবেন আপনি একজন ব্যর্থ মানুষ। সন্তানের জন্য সম্পদ না করে সন্তানকেই সম্পদ করে তুলুন।

২য় পর্ব
একটা সময় পর্যন্ত বাবার পরিচয়ই হয় সন্তানের পরিচয়, যেমন রামবাবুর ছেলে অশোক--লোকে অশোককে দেখিয়ে বলে "এ হল রাম বাবুর ছেলে।" পরিচয়টা পরে পরে যদি এমনটা হয় যে রামবাবুকে দেখিয়ে লোকে বলে "ইনি অশোকের বাবা"-- তবেই সার্থক বাবা-মা হওয়া যায়।
শিক্ষা আসলে মানুষের অন্তর্নিহিত ক্ষমতার পরিপূর্ণ বিকাশ। এই যে পরিচয় সুত্রের একশ আশি ডিগ্রি ঘুরে যাওয়া সেটা সুশিক্ষার মধ্য দিয়েই হয়। মানুষ সারা জীবন ধরে শেখে। ধরুন একজন মানুষ ৭৫ বছর বাঁচল, সে শিখল ৭৫ বছর ধরে। কন্তু আমি মনে করি সে শিখল প্রায় ৭৬ বছর ধরে। মানুষ যখন ভ্রুন, মায়ের পেটে একটু একটু করে বড় হচ্ছে প্রস্তুত হচ্ছে পৃথিবীত আসার তখন থেকেই তার শেখা শুরু। মায়ের পেটে থাকতে থাকতে সে মায়ের সুঅভ্যাসগুলো শিখতে থাকে। সেই কারনে গর্ভাবস্থায় মাকে ভালো চিন্তা করতে বলা হয়, ভালো বই, ধর্মগ্রন্থ পাঠ করতে বলা হয় আনন্দে থাকতে বলা হয়।
মায়ের গর্ভ যদি শিশুর প্রথম শিক্ষালয় হয় তবে ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর পরিবার হয় দ্বিতীয় শিক্ষালয়।শিশু যেহেতু সে সময় পরিবার বা বাড়ির বাইরে বেরাতে পারে না, তখন শিশু পরিবার থেকে পরিবারের লোকজনের অভ্যাস থেকে দ্বিতীয় পর্যায়ের শেখা শুরু করে।
মুলত বাবা মায়ের থেকেই শিশুর দ্বিতীয় পর্যায়ের শিক্ষা শুরু হয়। তাই বাবা-মা শিশুর প্রথম শিক্ষক। পরিবার থেকে যখন শেখার উপাদান একপ্রকার (শেখার বিষয় তো সেই অর্থে ফুরায় না) ফুরিয়ে আসে তখন আরে বেশি কিছু শেখার জন্য শিশু স্কুল যায়। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এ হল তৃতীয় পর্যায়ের শিক্ষালয়। এ অবস্থায় শিশুর দায়িত্ব নেন শিক্ষক। তাকে যত্ন দিয়ে পরিচর্চা কনরেন। শিশুর মধ্যে যে অসীম সম্ভাবনা তার হদিশ দেন শিক্ষক।
এ কারনেই কালিদাস বলেছেন, 'প্রবর্তেত দীপ ইব প্রদীপাৎ'। একটি দীপ থেকে তার জ্বলন্ত শিখা থেকে অন্য দীপ জ্বালিয়ে দেওয়াই শিক্ষা। এ পর্যায়ে শিক্ষকই শিশুর অবলম্বন, ভরসার জায়গা। তাই শিক্ষককে দ্বিতীয় পিতা বলা হয় এবং বিদ্যালয় হল উপসদন বা দ্বিতীয় বাড়ি।
ঠিক এই সময় অধিকাংশ অভিভাবক সন্তানকে স্কুলে পাঠিয়ে খানিকটা হলেও দায়িত্ব মুক্ত হয়ে যান। এদ্দিন বাড়িতে থেকে সমুহ ঝামেলা নিতে হয়েছে অভিভাবকদের। যেন এবার সবটাই  স্কুল ও শিক্ষকরা দেখে নেবেন। গোলটা বাঁধে এখানেই।
এই প্রথম বাড়ির বাইরের পরিবেশে শিশুটি বেরিয়ে বাইরের পরিবেশের নানা বাঁধা পরিবেশের অভিনবত্বে খানিক হকচকিয়ে যায়। সীমাহীন কৌতুহল তার অনন্ত জিজ্ঞাসা। এই সময় অভিভাবকের অনেক বেশি সতর্ক থাকা দরকার। সন্তানের পাশে থাকা দরকার। বাইরের পরিবেশটার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া দরকার। নিয়মিত স্কুলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা দরকার।
অভিভাবকরা যোগাযোগ রাখেন না তা নয়, তবে তা প্রয়োজনের নিরিখে অনেকটাই কম।

৩য় পর্ব
ধীরে ধীরে শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ের  ছোট ক্লাস থেকে বড় ক্লাসে উত্তীর্ণ - জীবনের সে এক আশ্চর্য সময়। শেখার বিষয়গুলো কঠিন থেকে আরো কঠিন হতে থাকে। অনেক সময় বিষয়গুলো অভিভাবকদের আয়ত্বের বাইরে চলে যায়। অভিভাবক তখন একেবারেই দায় মুক্ত। শিক্ষার্থীর কাছে বিষয়টা পরিস্কার-- "বাবা বিষয়টা বোঝে না।" অনেক সময় তো বলেই ফেলে- "এটা তোমার বিষয় নয়, যা বোঝ না তা নিয়ে বলো না। "
অভিভাবক যখন বুঝতে পারে সত্যিই বিষয়টা তাঁর আয়ত্তে নেই। তখন তিনি  পুরোপুরি হাল ছেড়ে দেন। নিজের না জানা বিষয়টা তদারকির জন্য মাস মাইনের প্রাইভেট টিউটরের ব্যবস্থা করেন।মজার বিষয় হল ঐ বয়সটা শিক্ষার্থীর কাছে অদ্ভুৎ এক সন্ধিক্ষণ। ঐ সময়ে তার শরীরে নানা পরিবর্তন দেখা দিতে থাকে। যার উত্তর তার কাছে নেই। হাজারটা বিষয়, অদ্ভুৎ ও উদ্ভট সব প্রশ্ন তাকে অস্থির করে তোলে। অনেকক্ষেত্রে নিষিদ্ধ বিষয়গুলোর প্রতি শিক্ষার্থী বেশি বেশি কৌতুহলী হয়ে যায়। লেখাপড়া থেকে নিজেকে সরিয়ে ফেলে। তার মনে হতে থাকে সে নিজেই নিজের চালক। সে স্বাধীন, সে মুক্ত -- এই ভাবনাই তাকে স্বেচ্ছাচারি করে তোলে।
এই সময় অভিভাবক তার কাছে অসহ্য- সে দূরত্ব চায়। আবার বাবা-মা শিক্ষার বিষয়গুলো কঠিন হয়ে যাওয়ায় নিজেরা সরে যান। ফলত অভিভাবকহীন উদ্দেশ্যহীন শিক্ষার্থী বিপথগামী হয়ে যায়।একটু ভেবে দেখুন তো আগের দিনের বাবা মায়েরা কতটা পড়াশুনা জানতেন!
তাঁরা জানতেন তাঁরা জানেন না, তাই তারা বিকল্প হিসাবে পথ নিয়ন্ত্রণ করতেন সন্তানকে, নিয়মিত স্কুলে গিয়ে খোঁজ নিতেন। নাছোড়বান্দা জেদে শিক্ষকমশাই এর সঙ্গে দেখা করার জন্য বসে থাকতেন স্টাফ রুমের বাইরে।
ইচ্ছে করেই সন্তানের নজরে আসতেন-- যে তিনি স্কুলে এসেছেন ছেলের খোঁজে। শিক্ষকমশাই ও ক্লাসে গিয়ে ছাত্রটিকে দাঁড় করিয়ে জানিয়ে দিতেন-- "কি লেখপড়া ঠিকমতো হচ্ছে তো? বাবা এসেছিলেন।" শিক্ষার্থী বুঝে নিত বেচাল হওয়া যাবে না। এই ভয় বা আশংকাটা অন্য শিক্ষার্থীদের (আমার বাবা আসতে পারে/ আসে নি তো!) মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ত অনুদৈর্ঘ তরঙ্গে।

৪র্থ পর্ব
বর্তমান পরিকাঠামোয় বিদ্যালয় শিক্ষার পরিপূরক টিউশন। ক্লাস ভর্তি শিক্ষাথীদের উপর নিখুঁত নজরদারি, তাদের প্রত্যেকের চাহিদা-ঘাটতি শিক্ষকের পক্ষে অত কম সময়ে ধরা সম্ভব নয়। স্কুলে ৭০/৮০ জনের ক্লাসে শিক্ষকমশাই এমন একটা স্তর থেকে শুরু করেন এবং আলোচনাটা একটা নিদিষ্ট সারল্যে বেঁধে দেন যাতে সবচেয়ে কম জানা শিক্ষার্থীরও বুঝতে বা জানতে অসুবিধা না হয়।
এক্ষেত্রে বেশী আগ্রহী শিক্ষার্থী পড়ে সমস্যায়। তার বাড়তি চাহিদা দূর করার সুযোগ পায় না।টিউশন সেক্ষেত্রে মুশকিল আসান। টিউশন থেকে পূরণ হয় সেই বাড়তি চাহিদা। আচ্ছা কম জানা বেশি জানা এমনটা হয় কেন।
আসলে লেখাপড়াটা একটা জার্নি। শিক্ষাদীক্ষা নিয়ে গালভরা কথা যাই থাক না কেন শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হল How to earn তবে সেই রোজগার সম্মানজনক হতে হবে। অধিকাংশ চাকুরির ক্ষেত্রে স্নাতক বা গ্রাজুয়েশন হল গড়পড়তা শিক্ষাগত যোগ্যতা। তাহলে তো একটা নিদিষ্ট বয়সে শিক্ষার্থীকে স্নাতক স্তরের শিক্ষা দিয়ে চাকুরির উপযুক্ত করে তুললেই হয়-- বাস্তবে তা হয় কি? না, তা হয় না। শিক্ষার্থীকে ধীরে ধীরে স্নাতক স্তরের উপযুক্ত করা হয়।
শিশু জন্মালে তাকে প্রথমাবস্থায় তরল খাওয়ার দেওয়া হয় ধীরে ধীরে কঠিন বা অন্য ধরনের খাওয়ার। এডুকেশনেও তাই হয়, শিশু শ্রেণী থেকে মাধ্যমিক মাধ্যমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্নাতক তারপর স্নাতকোত্তর, শিক্ষার্থীকে একটু একটু করে পরের স্তরের উপযুক্ত করা হয়।
ধরুন কোন একটা শ্রেণীতে পদার্থ ও তার অবস্থা সম্পর্কে বলা হল-- পরবর্তীতে অনু পরমানু সংকেত যোয্যতা-- পরবর্তীতে পরমানুর গঠন- রাসায়নিক বিক্রিয়া- সমীকরণ ইত্যাদি প্রভৃতি। এখন যে শুরুর দিকটায় ফাঁকি দিল, পরবর্তীটুকু তার কাছে শক্ত মনে হবে-- অর্থাৎ ঐ শ্রেণীর উপযুক্ত সে হয় নি। শিক্ষককে তার কথাও মাথায় রেখে বলতে হচ্ছে।
আবার ঐ যে খাওয়ার কথা বললাম। এখন কেউ যদি খাওয়ার না চিবিয়ে, গিলে নেয়-- সে তো খাদ্যের স্বাদ পায়ই না তার ক্ষেত্রে খাদ্যগুনের বেশিটা কাজেও আসবে না। ফলত কোন শ্রেণীতে বুঝে না পড়া, মুখস্থ করা শিক্ষার্থীকে অপেক্ষাকৃত অশক্ত ও দুর্বল করে। শ্রেণী শিক্ষণের বাইরে গৃহশিক্ষণ সেই সমস্যার মুশকিল আসান হতে পারে এক্ষেত্রে টিউশন শিক্ষক নির্বাচন সঠিক হতে হবে।

৫ম পর্ব
আচ্ছা কে কোন ক্লাস পড়াতে পারেন? মানে বলতে চাইছি কে কোন শ্রেণীর পাঠদানে উপযুক্ত?এটা বুঝতে হলে গতানুগতিক ১০, ১০+২, ১২+৩ ও স্নাতকোত্তর স্তর ও কার্যক্রম বুঝতে হবে।মাধ্যমিক পর্যন্ত সকল শিক্ষার্থীদের একটা সাধারণ শিক্ষা দেওয়া হয়। উচ্চমাধ্যমিক অর্থাৎ ১০+২ থেকে কলা, বিজ্ঞান ও বানিজ্য শাখায় শিক্ষার্থীদের যে শিক্ষা বা ধারনা দেওয়া হয় তার বিশ্লেষণ, ব্যাখ্যা সহ কার্য কারন সম্পর্ক আলোচিত হয় পরবর্তী স্নাতক স্তরে এবং ঐ স্তরে আরো কিছু নতুন বিষয় ও ধারণার অবতারনা হয়।
স্নাতক স্তরের বিষয়গুলো স্নাতকোত্তরে আরো গভীরভাবে আলোচিত হয় যাতে পূববর্তী স্তরের ধারণাগুলো আরো সচ্ছ হয়ে যায়। এখান থেকে বোঝা যাচ্ছে কোন স্তর সঠিক ভাবে জানাতে গেলে পরবর্তী স্তরের শিক্ষা দরকার। ধরুন কেউ বি.কম পাশ তিনি সচ্ছন্দে উচ্চাধ্যমিক কমার্স পড়াতে পারবেন অবশ্য তাঁকে বি.কমটা কমসে কম সচ্ছভাবে জানতে হবে। যিনি বি.কম তিনি সুস্পষ্টভাবে বি.কম পড়াতে পারবেন না। গৃহশিক্ষকতার বিজ্ঞাপনে দেখা যায় কোন শিক্ষক উচ্চমাধ্যমিক, বি.কম, এম.কম, সি.এ, কস্টিং, সি.এস সবই পড়ান। কিন্তু তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা বি.কম। আসলে শিক্ষকমশাই একটু মস্ত করে ভেবে নিয়েছেন আপনাকে প্রভাবিত করার জন্য।
একজন ডাক্তারবাবু বড় বড় অপারেশন করেন এমনটা শুনলে আপনি অবশ্যই তাঁর কাছে ফোঁড়া গালাতে পিছ'পা হবেন না। এটাকে আমাদের কমার্সের পরিভাষায় উইডো-ড্রেসিং বলে। না, এমন শিক্ষক কাজের নন। টিউশন যদি স্কুলের পরিপূরক হয়ে তবে স্কুলের পঠন পাঠনকে অনুসরন করবে টিউশন।
স্কুল ও টিউশনে দু'টো ভিন্নতর বিষয় আলোচিত হলে শিক্ষার্থীর অবস্থা -- না ঘরকা না ঘাটকা।শিক্ষার্থীর মনযোগ দু'ভাগে ভাগ হয়ে যায় তার ফলে কোনটাই সেই অর্থে সম্পূর্ণতা পায় না। তাই টিউশন দিয়ে হাল ছেড়ে দেওয়া নয়-- প্রতিনিয়ত নজরদারি তদারকিই একমাত্র উপায়। অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি স্কুলে পড়াচ্ছি ছাত্র-ছাত্রীরা পাথর চোখে বসে আছে। টিউশন থেকেই বলে দেওয়া হচ্ছে ক্লাসে শুনতে না। ক্লাসে শুনলে নাকি সব গোলমাল হয়ে যাবে। স্কুল শিক্ষককে অশ্রদ্ধা করার মদত পাচ্ছে শিক্ষার্থী। ক্লাসে কিছুই বুঝছে না কেবল পাথর চোখে তাকিয়ে থাকছে মাত্র।
আমাদের মস্তিষ্ক বড্ড অলস, সে সবসময় চায় পরিচিত পথ বেছে নিতে- একই রকম  অভ্যাস, একই জায়গা, একই মানুষদের সঙ্গে সময় কাটানো। কারন এগুলোই কম পরিশ্রমে মস্তিষ্কের স্বাচ্ছন্দ্যের এলাকা। যেটা মুখস্থ করে প্রতিনিয়ত অভ্যাস করে রপ্ত করা যায়- যেহেতু সেটা কম পরিশ্রমের তাই মস্তিষ্ক সেটাই পচ্ছন্দ করে। স্কুল শিক্ষক যেটা বোঝাতে চাইছেন সেটা যদি টিউশনে মুখস্থ বা অভ্যাসে আয়ত্ত হয়ে যায় তবে শিক্ষার্থী বুঝতে চাওয়ার পরিশ্রম করবে কেন! শর্টকাট এর কারনে টিউশন বেশি গুরুত্ব পায়। স্কুলের শিক্ষক ক্রমশ অবজ্ঞার পাত্র হয়ে যান। শিক্ষার্থী মনে করে স্কুল থেকে কিছু নেওয়ার নেই।

৬ষ্ঠ পর্ব
আপনি যদি নস্তিক হন তবে দেবতার কাছে আপনার কিছু চাওয়ার থাকে? থাকে না। ছাত্রের মাথায় যদি ঢুকিয়ে দেওয়া হয় স্কুল থেকে কিছু শেখার নেই সে তো কেবল পার্সেন্টেজ এর জন্য স্কুলে আসছে।
তদ্বিদ্ধি প্রণিপাতেন পরিপশ্নেন সেবায়া
প্রণিপাত অর্থাৎ শ্রদ্ধাভাব
প্ররিপশ্ন অর্থাৎ প্রশ্ন কিম্বা কৌতুহল 
সেবা
এই তিন ছাড়া শিক্ষা হয় না।
শাস্ত্র বলে শ্রদ্ধাবান লভতে জ্ঞানম
গীতা বলছে-- 
"তিদ্বিদ্ধি প্রণিপাতেন পরিপ্রশ্নেন সেবয়া।"
প্রণিপাত পরিপ্রশ্ন ও সেবা এগুলো হল শিষ্যের ধর্ম। শিষ্য আচার্যের প্রতি শ্রদ্ধা পরায়ণ হবেন। তাই শাস্ত্র বলছে 'শ্রদ্ধাবান লভতে জ্ঞানম।' আচার্যের প্রতি বিশ্বাস,তাঁর প্রজ্ঞায় আস্থাটুকু না থাকলে শিষ্য আচার্যর কাছে হাত পাতবে কি কারনে! তিনিই অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে যেতে পারেন এই আত্মবিশ্বাসে, শিষ্য গুরুর চরণে নিজেকে নিবেদন করে দেবে-এই হল শিক্ষার পূর্বশর্ত। আমার হাত ধরে তুমি নিয়ে চল সখা আমি যে পথ চিনি না।
আবার শিষ্যের মধ্যে থাকতে হবে অপার অনুসন্ধিৎসা। নিরবিচ্ছিন্ন জিজ্ঞাসা। "অসতো মা সদগময়" --এই হবে শিষ্যের প্রার্থনা। সে অন্তর দিয়ে চাইবে অসৎ অর্থাৎ অপূর্নতা থেকে সৎ অর্থাৎ পূর্ণতায় উত্তীর্ণ হতে।
উপনিষদের সময়ে শিষ্য বিধিপূর্বক উপসদনে যেত। আগেই বলেছি উপসদন হল গুরুগৃহ, এখনকার শিক্ষালয় যা আসলে দ্বিতীয় বাড়ি। বিধিপূর্বক বলতে শিষ্য সমিৎপানি হয়ে গুরুগৃহে যাবে। সমিৎ হল যজ্ঞের কাঠ। সমিৎপাণির অন্য আর একটি তাৎপর্য রয়েছে--- সমিৎ বা কাঠটি হল ইন্ধনের প্রতীক, যার মধ্যে আগুন ঘুমিয়ে আছে।
এক্ষেত্রে শিক্ষার্থী মধ্যেও লুকিয়ে আছে সম্ভাবনা। মানুষের মধ্যে সুপ্তভাবে নিহিত থাকে যে পূর্ণতা শিক্ষা হল তারই প্রকাশ। আচার্যের পরিচর্চায় সেই পূর্ণতার প্রকাশ ঘটে। শিষ্য হল অধর-অরণি, নিচের কাঠ আর গুরু হল উত্তর অরনি, উপরের কাঠ। শিষ্য নিজেকে পেতে দেবে, বিছিয়ে দেবে, নিবেদন করে দেবে গুরুদেবের চরণে।
শিষ্য অর্থাৎ নিচের কাঠটি নিশ্চেষ্ট হয়ে পড়ে থাকবে আর উপরের কাঠটি থাকবে সক্রিয়। উপরের কাঠটি নিচের কাঠটির উপর অবিরাম ঘর্ষণ করতে থাকবে তার ফলেই এক সময় দপ করে জ্বলে ওঠবে আগুন- এরই নাম অগ্নিমন্থন। এই হল অন্ধকার থেকে আলোয় উত্তরণ। এখানে নিচের কাঠটি সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় Utterly passive আর উপরের কাঠ প্রবলভাবে সক্রিয় Intensely activeএখানে নিষ্ক্রিয় বলতে অনাগ্রহকে নির্দেশ করে না।
এখানে নিষ্ক্রিয়-এর অর্থ শান্ত বা অবিচল থাকা। নিষ্ক্রিয় বলতে বোঝায় শিক্ষকের কাছে সব পাব এই মনোভাব নিয়ে সম্পূর্ণ সমর্পণ। অথচ এক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয়তা -যথার্থই নিষ্ক্রিয়তা।

৭ম পর্ব

বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ বিটোভেন একটা ঘরোয়া আসরে পিয়ানো বাজাচ্ছেন। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছেন সবাই। শ্রোতাদের মধ্যে একজন অস্ফুটে বলে উঠলেন

--"ঈশ্বর প্রদত্ত প্রতিভা!" বিটোভেন পিয়ানো বাদন শেষ করলেন, ধীর ও শান্ত কন্ঠে সেই শ্রোতাকে উদ্দেশ্য করে বললেন-- "কিছুই ঈশ্বর প্রদত্ত নয় আপনি বছর চল্লিশ আট দশ ঘন্টা অনুশীলন করলে এমনই বাজাতে পারবেন।"

এই পৃথিবীতে সবাই কোন না কোন প্রতিভা নিয়ে জন্মায়। কেবল নিরবিচ্ছিন্ন পরিশ্রম আর অধ্যাবসায়ে কেউ কেউ বিশ্ব বিখ্যাত হয়ে যান। মনের জোর আর অনুশীলনে শানিত হয় প্রতিভা।ব্যাক্তি মানুষ ধনী হয় মনের জোরে। যার মনের জোর যত বেশি সে তত বড়লোক, যার মনের জোর যত কম তার দুর্দশা তত, দারিদ্র্য তার আজীবনের।আমরা যখন কোন উদ্দেশ্যমুলক কাজে নামি তখন পরিকল্পনা করি কার থেকে কি কি ভাবে সাহায্য পেতে পারি। কে কি ধরনের উপকরণ দিয়ে সহায়তা দিতে পারে। যখন দেখি যথেষ্ট সহায়তা মিলছে না তখন আমরা হীনবল হয়ে পড়ি।

মানুষ বৃথাই শক্তি খুঁজে ফেরে, উদ্দেশ্যে সাধনে শক্তি ও উপায়ের অনর্থক সন্ধান করে! সে জানে না তার ভেতরেই রয়েছে আশ্চর্য সেই ক্ষমতা। মানুষের মন বা মাইন্ড পাওয়ার এমন এক অসীম শক্তি যা আসলে আমাদের উদ্দেশ্যকে সাকার করে। মন এক আশ্চর্য বস্তু। অসীম তার ক্ষমতা। মন কাজ করে চিন্তা ও আবেগ দিয়ে। চিন্তা মনে বাসা বাঁধলেও আসে প্রকৃতি ও পরিবেশ থেকে।
পঞ্চ ইন্দ্রিয় হল মনের দরজা জানালা, তাদের মারফত চিন্তা আসে, আসে মনের সচেতন স্তরে।বারবারের একই চিন্তা আবেগ তৈরি করে। ইন্দিয় যেমন ভালো মন্দ সব উত্তেজনায় সাড়া দেয় তেমনি ভালো মন্দ দু'রকমের চিন্তা মানুষের মনে প্রশ্রয় পায়। চিন্তা মানুষের মনে প্রশ্রয় পেলেও স্থায়ী হয় না, নানা ধরণের চিন্তার স্রোত মনে আছড়ে পড়ে।
বারবার একই ধরণের চিন্তা মনে আনাগোনা করলে, মনের সঙ্গে তার বনিবনা তৈরি হয় এক কথায় বন্ধুত্ব হয়। তাই বলা হয় যে যেমন সে তেমন। আমরা যদি ভালো চিন্তার অনুশীলন করি আমরা ভালো কিছু করি, আমরা ভালো হয়ে উঠি। যে সর্বদা মন্দ ভাবে সে তেমনই হয়। মনের দুটো স্তর-- প্রথমটি সচেতন স্তর অন্যটি অবচেতন স্তর।
সচেতন স্তর ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে কাজ করে, আমরা যখন জেগে থাকি তখন ইন্দিয়গুলি সজাগ থাকে তখন মনের সচেতন স্তরে চিন্তা জেগে ওঠে। সুষুপ্তির সময় সচেতন স্তর ঘুমিয়ে যায় তখন সচেতন স্তরের চিন্তাগুলো অবচেতন স্তরে প্রতিভাত হয়। অবচেতন স্তর ভাল মন্দ বাছতে পারে না। সে চিন্তগুলোকে আরো বিস্তার করে, আরো রঙীন হয়ে ওঠে চিন্তা জগত। আবার একসময় তা ফিরে আসে সচেতন স্তরে। ফলত আমাদের চিন্তাজগত যেমন হয় তেমনই হয় আমদের কর্মজীবন।
তেমন ভাবেই তৈরি হয় আমাদের চরিত্র। বারবার ভালো চিন্তা করতে করতে একটা অভ্যাস তৈরি হয়ে যায় --
ঘুমানোর আগে যদি আমরা ভালো সুস্থ গঠনমুলক বা ইতিবাচক চিন্তা নিয়ে ঘুমাই তবে সেই ইতিবাচক চিন্তার রূপকল্প অবচেতনে আসে। অবচেতনে সেই চিন্তা আরো রঙীন হয়ে রঙীন--বর্ণময় করে তোলে জীবনকে। 


৮ম পর্ব
আপনার সন্তান আপনার জেরক্স করি। জিন তো একটা ফ্যক্টর, অন্য যে বিষয়টাকে আমরা প্রায়শই গুরুত্ব করি না তা হল আমাদের আচরণ। শিশুরা বাবা-মা কে নকল করে খুব শিশু অবস্থা থেকেই। তাদের মনে হয় তার বাবা সব জানে, একটা বয়স পর্যন্ত তাদের মনে হয় তাদের বাবা-মা পারে না এমন কোন কাজই নেই। শিশু অবস্থা থেকে বাবা-মা এর আচরণ গিলতে থাকে শিশু।আপনার শিশুর আশি শতাংশ অভ্যাস আপনার থেকে পাওয়া। শিশু কি ধরণের চিন্তায় অভ্যস্থ হবে সেটা শিশুর পরিবারের সংস্কার।
পরিবারের লোকজন যদি চিৎকার করে কথা বলে শিশুও শেখে। যে পরিবারে গান বাজনার চল রয়েছে, সেই পরিবারের শিশু আপনা থেকেই হারমনিয়াম চিনে যায়। তার কথা বার্তা চিৎকৃত না হয়ে অনেকটা পেলব হয়। আমরা তো কেউ আগাগোড়া সৎ মানুষ নই-- সন্তানের কথা ভেবে নিজেকে পাল্টাতে হবে। নিজেকে করে তুলতে হবে অনুকরণীয়। 
কৈশোরে শিশুর মনে হয় বাবা কিচ্ছু জানে না- তখন বাইরের পরিবেশ তাকে বেশি প্রভাবিত করে।
কিন্তু ততদিনে যদি আপনি তাকে,তার চিন্তার জগৎটা নিদিষ্ট ভাবে চিনিয়ে দিতে পারেন তবে রক্তক্ষরণের সম্ভাবনা কমে আসে। পরিবারে শিশুকে সবথেকে ভালো ভাবে গড়ে তুলতে পারে দাদু ঠাকুমা। বাবা-মা ভালোবাসা দেয়, বাবা সময় দেয়, অর্থ দেয়, জ্ঞান দেয়। দাদু ঠাকুমা ভালোবাসা দেয়, অর্থ দিতে পারে না কিন্তু যা দিতে পারে- তা হল সময়।
অখন্ড অবসর তাঁদের, অসীম তাঁদের ধৈর্য। আর তাঁদের দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতা, জীবন গঠনে মজবুত বুনিয়াদ গড়ে দেয়। নিজের সন্তানকে গড়ে তুলতে গিয়ে কি কি ভুল হয়েছিল তাঁদের সে ত্রুটিগুলি থেকে শিক্ষা- তাঁদের অভিজ্ঞতাকে অনেক নিখুঁত করে। তাই জীবনকে তাঁদের চোখে বুঝলে অনেক বেশি বোঝা যায়। এখন তো 'অনু-পরিবার' সেই পরিবারে দাদু নেই, ঠাকুমা নেই, ঠাকুমারঝুলি নেই। ফলত জীবন থেকে নীতিশিক্ষা হারিয়ে যাচ্ছে।
জীবনটাকে আতস কাঁচের তলায় এনে বুঝিয়ে দেওয়ার লোকগুলোকেই অনেক দূরে সরিয়ে ফেলছে সময়। ফলত শিশুর প্রতিদিনের ভুল ত্রুটির সংশোধন সুযোগ নেই। শিশুকাল থেকে একা থাকার অভ্যাস থেকেই - স্বার্থপর জীবনে ঢুকে পড়া। স্বজনহীন একলা বাঁচার যে জীবন আমরা খুঁজে নিয়েছি সেখানে বাবা-মা ভাই বোন ছাড়া বাকি সম্পর্কগুলো সম্পর্কে একদিন হয়তো আমাদের কোন ধারণাই থাকবে না।
অথচ দাদু-ঠাকুমা-পিসি-কাকা এই সম্পর্কগুলো একটু একটু করে শিশুকে পূর্ণাঙ্গ মানুষ করে গড়ে তোলে। এইসব সম্পর্ক থেকে দূরে সরে গিয়ে, শুধু শৈশব নয় জীবনের একটা দিক যে অনালোকিত হয়ে রইল তা যত তাড়াতাড়ি বোঝা যাবে তত কম অসামাজিক হবে সমাজ। 

৯ম পর্ব
"তোকে দিয়ে কিশ্যু হবে না, তোরই বয়সী রনো সারেগামাপা -তে চান্স পেয়েছে!" কিম্বা-- " তুই অমুকের পটির যোগ্য নয়!" শিশুকে কারো সঙ্গে তুলনা করবেন না। প্রতিটি শিশু তার নিজের মতো। আচ্ছা যদি আপনার সন্তান অন্য করো বাবা বা মায়ের সঙ্গে আপনার তুলনা করে -- কেমন অনুভূতি হয় আপনার? তখন আপনার সন্তানকে আপনার অচেনা ঠেকে না? আপনি তুলনা করলে সন্তানের একই রকম মনে হয়। 
বরং জীবনের অনেক ঘাত প্রতিঘাতে আপনি সামলে নিতে পারেন কিন্তু আপনার শিশু সামলাতে পারে না। এই তুলনাগুলোই পরবর্তীতে পরিস্থিতি সাপেক্ষে আপনাকে ফিরে পেতে হয়। প্রতিটি শিশু আসলে তার তার মতো করে সু্ন্দর-- আপনার কাজ সেই সত্যটির সঙ্গে তার সাক্ষাৎ করিয়ে দেওয়া। তাকে জানিয়ে দেওয়া কেবল তার জন্যই পৃথিবীতে একটি মহৎ কাজ পড়ে আছে, যা অন্য কাউকে দিয়ে সম্ভব নয়।
যা খালি চোখে দেখা যায় আমরা তা নিয়েই বেশি কনসার্ন। যেমন ধরুন-- সন্তানের জন্মদিন, তার শরীর স্বাস্থ্য, তার হোম ওয়ার্ক, তার আঁকা, তবলার ক্লাস, তার মার্কসীট, নম্বর, পার্শেন্টেজ। না, আমি একথা বলছি না যে এগুলো অবহেলার। মানুষের মধ্যে যে জিনিসগুলো মাপা যায়, আরো সহজ ভাবে বললে যা দেখা যায় তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল যা মাপা যায় না, যা দেখা যায় না।আমাদের চিন্তা- উদ্বেগ, আগ্রহ-অনাগ্রহ, বিশ্বাস-অবিশ্বাস, আস্থা-অনাস্থা, সন্দেহ-গোপনীয়তা, কাম-ক্রোধ এমনকি পিপাসা, খিদে এগুলো খালি চোখে দেখা যায় না।
শিশুর মধ্যেও এসব অনুভূতি আসে, যেহেতু তাদের অভিজ্ঞতা কম তাই এসব অনুভবের অধিকাংশের ভালো মন্দ তারা বুঝতে পারে না। ভয়ংকর ধাক্কা খায়। অভিভাবককেই চিনিয়ে দিতে হয় পরিস্থিতি, স্বাভাবিক করে দিতে হয় সবটা।
প্রশ্ন সঙ্গত এসব বিমূর্ত ধারণা যদি চোখে দেখাই না যায় তবে অভিভাবকের কাছে তো এটা সমস্যা।
অন্ধও তো দেখে, অনুভব দিয়ে দেখে, ছুঁয়ে দেখে। তাদের ছুঁয়ে দেখাটা এতোটাই গভীর যে তারা একজন দৃষ্টিশক্তি সম্পন্নের থেকেও বেশি দেখে। সন্তানকে বুঝতে হবে, প্রতি মুহুর্তে তার আচার আচরণ স্ক্যান করে নিতে হবে অভিভাবককে। তাকে সময় দিতে হবে। সময়ের বিকল্প আরো একটু বেশি সময়। আমার সময় নেই তার পরিবর্তে অন্য কোন বস্তুগত উপকরণে সামলে নেব তা হয় না।
এমন নয় যে ভালো ভালো খাওয়ার, দামি জামা কাপড়, গিফ্ট সুখ সাচ্ছন্দ্যেই একটা কোয়ালিটি টাইমের বিকল্প হয়ে উঠবে।
এই পৃথিবীতে সবাই রাজপুত্র হয়ে জন্মায় না। সবাই শারিরীক ভাবে সমান সক্ষম হয় না। আপনার শিশুর যদি কোন অক্ষমতা থাকে তবে কোন না কোন সময়ে তার মধ্যে হতাশা আসবে। মনে রাখবেন তার অক্ষমতার হতাশা যেন আপনাকে কোন ভাবে গ্রাস না করে। শিশুর মনের জোর ফিরিয়ে দেবেন আপনিই-- আপনিই তার সারথি।

ডেমোস্থিনিসের কথা দিয়ে শেষ করব আজকের পর্ব। তিন'শ চুরাশি খ্রিষ্টপূর্বাব্দে গ্রীক দেশে জন্মগ্রহণ করেন ডেমোস্থিনিস। জন্ম থেকেই তোতলা। জন্মের পরপরই ডেমোস্থিনিস অনাথ হয়ে গেলেন। তাঁর বাবা মা দুজনই মারা গেলেন। কাকা সুযোগ বুঝে ডেমোস্থিনিসের সব সম্পত্তি আত্মসাৎ করলেন আইনের দ্বারস্থ হয়েও ডেমোস্থেনিস পেরে উঠলেন না।
জীবনে হতাশা যখন তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে ঘিরে ধরেছে, সেই সময় গ্রীসের পথে একজন সোফিষ্টকে বক্তৃতা করতে দেখলেন ডেমোস্থিনিস। আশ্চর্য হলেন তার বাগ্মিতায়। একটা সাদামাটা মানুষ, বেঁটে খাটো চেহারা, অনুজ্জ্বল রং, আরো সাধারণ তাঁর পোশাক আশাক কিন্তু লোকটা কেবল কথা দিয়ে সম্মোহিত করে রেখেছে জটলাটাকে। কেবল সম্মোহিতই নয় তাঁর প্রতিটি কথা অনুপ্রাণিত করছে ডেমোস্থিনিসকে।
ডেমোস্থিনিসের মনে হল এই পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিমান মানুষ ঐ লোকটা। স্বীদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল ডেমোস্থিনিস - সে একজন বিখ্যাত বাগ্মী হবে আগামীতে। লক্ষ্যটা ডেমোস্থিনিসের পক্ষে সহজ ছিল না কারন ডেমোস্থিনিস ছিলেন তোতলা। নাছোড় জেদ চেপে বসল ডেমোস্থিনিসের মাথায়।
শুরু হল অনুশীলন-- প্রথম অবস্থায় স্পষ্ট উচ্চারণের ধারে কাছেই পৌঁছতে পারলেন না ডেমোস্থিনিস। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ডেমোস্থিনিস নানা আকারের নুড়ি জিভের নিচে রেখে বর্ণগুলোর স্পষ্ট উচ্চারণের অনুশীলন শুরু করলেন।
শুরু হল দীর্ঘ পথ চলা--একটা লম্বা শ্বাসে একটা একটা লম্বা লাইন বলতে চেষ্টা করলেন ডেমোস্থিনিস। নির্জন সমুদ্রতীরে দাঁড়িয়ে একা চিৎকার করে বক্তৃতা করতে থাকলেন ডেমোস্থিনিস। গ্রীক মহাকাব্য, দর্শন, আইনের বইগুলো নিয়মিত অনুশীলনে কন্ঠস্থ হয়ে গেল তাঁর।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নাটকীয় ভঙ্গীতে বক্তৃতার অভ্যাস করলেন তিনি। ধীরে ধীরে তিনি হয়ে উঠলেন পৃথিবীর অপ্রতিদ্বন্বী বাগ্মী।

পর্ব দশ

"যদা বৈ করোত্যথ নিস্তিষ্ঠতি"। যিনি কর্তব্যপরায়ণ হন তিনিই নিষ্ঠাবান হন। যিনি নিষ্ঠাবান তিনি শ্রদ্ধাবান--  "য বৈ নিস্তিষ্ঠত্যথ শ্রদ্দধাতি"। জানার জন্য নিরন্তর সচেষ্ট থাকাই হল নিষ্ঠা।          নিষ্ঠা হল লেগে থাকা। একাগ্রতা ও আত্মসংযমের সঙ্গে কর্তব্যকর্মে লেগে থাকা। "যদা বৈ শ্রদ্দধাত্যম মনুতে-- "
মানুষ যখন শ্রদ্ধাবান হন তখন তিনি মনন করতে পারেন। শ্রদ্ধা না থাকলে আমরা কোনো বিষয়কে গুরুত্ব দিতে চাই না। বিশ্বাস বা শ্রদ্ধা থেকেই বিষয়ের প্রতি অনুরাগ আসে। তাকে চিন্তা বা মনন করার ইচ্ছা জাগে। কৃতসংকল্প হয়ে তার সবটুকু জানতে পারলে আনন্দ লাভ হয়- আলোকিত হয় অন্তর। উঁচু জায়গায় যেমন জল জমতে পারে না, গড়িয়ে যায়, তেমনি  শ্রদ্ধাহীন অহংকারীর মধ্যে সৎগুণ স্থায়ী হয় না। "যদা বৈ মনুত্যেথ বিজানাতি। নামত্বা বিজানাতি।"
যিনি মনন করেন তিনি বিশেষভাবে জানেন, যিনি করেন না তিনি জানতে পারেন না। মনন করার অর্থ হল কোনো বিষয়কে গভীরভাবে ভালোবাসা। ধ্যানের মতো গভীরে ডুব দেওয়া।
রামকৃষ্ণ বলেছেন--
আমাদের মন হল পুটলিতে রাখা সরষের মতো। একবার একটা ছিদ্র পেলে সরষে বেরিয়ে যায়। তখন তাকে ঐ ছিদ্র দিয়ে পুটলিতে ভরা সহজ কাজ নয়।
একবার কোন কাজ থেকে মনঃসংযোগ সরে গেলে উদ্দেশ্য দূরবর্তী হয়ে যায়। তাই কাজ করতে হবে মনঃসংযোগের সঙ্গে, কৃত সংকল্প হয়ে। কোন একটা সময়ে একটা কাজই করতে হবে। একসঙ্গে দুই বা তার বেশি কাজে মনঃসংযোগ করা কঠিন। সে হল দীর্ঘ অভ্যাসের ফল। এখনকার কাজ এখুনি করে ফেলতে হবে,ফেলে রাখা যাবে না। শিক্ষকমশাই হোমওয়ার্ক দিয়েছেন, ভাবলাম পরে করব। সেই পর আর হল না। ফলত হোমওয়ার্ক হলই না। আবার মনে হল এমন একটা সময় তখন হাতে সময় কম, তাই কোন রকমে কাজটা সারলাম- উৎকর্ষ তো দূর অস্ত, কাজটি হল ত্রুটিপূর্ণ। 
অন্য দিকে যদি অনেক আগে হোমওয়ার্ক সারা হত তবে প্রতিদিন সেই হোমওয়ার্ক ত্রুটি সংশোধনের মধ্য দিয়ে হয়ে উঠত ঝকঝকে ত্রুটিহীন উৎকর্ষযুক্ত। National parent-teacher পত্রিকায় এক মার্কিন সমালোচক বর্তমান শিক্ষার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন..
"সেই রহস্যজনক পদ্ধতি যা দিয়ে অধ্যাপকের বক্তৃতা থেকে তথ্যগুলি-- দুজনের কারো মনের মধ্য দিয়ে না গিয়েই ফাউনটেন পেনের মধ্য দিয়ে ছাত্রের খাতায় গিয়ে পৌঁছায়"
স্বামীজী 'Future of india' বক্তৃতায় বলেছেন...
"শিক্ষা বলতে মাথায় কতকগুলো তথ্য ঢোকানো নয়, যা সারা জীবন হজম না হয়ে এলোমেলোভাবে মাথায় ঘুরতে থাকবে। বিভিন্ন ভাবকে এমনভাবে নিজের করে নিতে হবে, যাতে জীবন গঠিত হয়, মানুষ তৈরি হয়, চরিত্র গঠিত হয়।"
একই কথা কবিগুরু বললেন...
"শিক্ষাকে আমরা বহন করিলাম, বাহন করিলাম না।" অদ্ভুৎ ভাবে এই একই কথা উপনিষদেও পাওয়া যায়...
"যথা খরশ্চন্দনভারবাহী ভারস্য বেত্তা ন তু চন্দনস্য।"
চন্দন কাঠ বহনকারী গর্ধব যেমন চন্দনের ওজন বোঝে চন্দনের মূল্য বোঝে না। আজীবন ভার বয়ে বেড়ায় সৌরভ লাভ করে না। আমাদের ছাত্র-ছাত্রীদের বর্তমান অবস্থা ঐ ভারবাহী গর্ধবের মতো।উপলব্ধি ছাড় তাদের মস্তিষ্ক এখন তথ্যের ভান্ডার। শিক্ষা হল অন্তর্নিহিত ক্ষমতার পরিপূর্ণ বিকাশ। মার্কসিটে কত নম্বর এল সে বড় নয়।
বর্তমান উচ্চমাধ্যমিক স্তরে যে সেমিস্টার পদ্ধতিতে প্রশ্ন সহ যে পরীক্ষা ব্যবস্থা তাতে একটি ছাত্র কিছু না জেনেও সত্তর শতাংশ নম্বর পেয়ে যেতে পারে। ১২ ক্লাসের তৃতীয় সেমিস্টারে এমসিকউ টাইপ প্রশ্ন থাকে চল্লিশ নম্বরের। যেখানে শিক্ষার্থীদের প্রদত্ত উত্তর থেকে সঠিকটি নির্বাচন করতে হয়।
অভিজ্ঞতায় দেখেছি উপলব্ধিহীন মুখস্থ ও অন্যের থেকে টুকে অনায়াসে শিক্ষার্থী ৩০ বা তার বেশি নম্বর পেয়ে যাচ্ছে।পরবর্তী সেমিসটারে একই রকম চল্লিশ নম্বরের (২×৫+৩×৫+৫×৩) প্রশ্নপত্রে, উত্তর দেওয়া থাকো না। শিক্ষার্থীদের উত্তর লিখতে হয়।
এই সেমিস্টারে যদি শিক্ষার্থী ১৫ পায় (২ নম্বরের ৫ টি প্রশ্ন ম্যানেজ হলেই তা সম্ভব) তবে তার প্রাপ্ত নম্বর প্রোজেক্টের ২০ সহ ৬৫( ৩০+১৫+২০)। অথচ সে কিছুই শেখে নি। তাই নম্বর নয় আপনার সন্তান কতটা শিখল বা সে নিজেকে কতটা বদলাতে পারল সেটাই বড় কথা।
মানুষ মিথ্যা থেকে সত্যতে যায় না- মানুষ সত্য থেকে সত্যে যায়। মানুষ এক সত্য থেকে আরো উন্নত বা উৎকৃষ্ট সত্যে যায়। একটা উপলব্ধি থেকে আরো মহৎ উপলব্ধিতে যায়। আমি থেকে আরো বড়ো আমি, আরো ভালো আমিতে উত্তরণ হল শিক্ষা।
অভিভাবককে প্রতিদিন সচেতনভাবে নজর করতে হবে তার সন্তান আজ নতুন কি শিখে এল। তার আচরণে কি কি পজিটিভ পরিবর্তন হচ্ছে। বুঝে নিতে হবে বিগত দিনের ভুলগুলো ফিরে আসছে কিনা। কেবল নিজের ক্যারিয়ার নয় সমষ্টিগত চিন্তা কোথাও তাকে ধাক্কা দিচ্ছে কিনা। এই পরিবর্তনগুলো একমাত্র অভিভাবকই নিখুঁত ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পারেন।
স্বামী বিবেকানন্দ একবার রামকৃষ্ণকে বলেছিলেন -
" আমি সমাধিতে ডুবে থাকতে চাই.."
রামকৃষ্ণ তাকে তিরস্কার করে বলেছিলেন--
" তুই তো বড় হীনবুদ্ধি রে! ভেবেছিলাম তুই বিরাট বটগাছের মতো হবি। সংসারদগ্ধ লোকেরা তোর ছায়ায় এসে আশ্রয় পাবে। তা নয়! তুই কেবল নিজের মুক্তি চাস!...."
আপনার সন্তানকে ঐ বড় বটগাছ হতে হবে। সে ছায়া দেবে---ভাল মন্দ  শত্রু মিত্র বিচার না করে মানুষের জন্য কাজ করবে। সমাজের জন্য কাজ করবে-- আনন্দের সঙ্গে কাজ করবে।
উপনিষদ বলেছে--
"যদা বৈ সুখং লভত্যেথ করোতি।
নাসুখং লব্ধ্বা  করোতি"।
কাজের মধ্যে দিয়ে মানুষ সুখ লাভ করে। যে কাজ করে না, তার সুখ প্রাপ্তি হয় না। আগামীর বটগাছ আপনার হাতে--- আপনার যত্ন, আদর, সার সেচ, পর্যবেক্ষণ আপনার সন্তানকে আগামীর মহিরুহ করে তুলবে।

শ্যাম বিষ

ওয়াশ

শংকর রায়

গল্প

airport.jpg
শ্যাম বিষ ওয়াশ

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

শীতের সকাল, ঘুম থেকে উঠতে আজ একটু দেরি হয়ে গেছে। শ্যাম আজ নূতন অফিসে হাজিরা দেবে। ঘুম ঘুম চোখে কোনরকমে সকালের কাজগুলো সেরে নিয়ে গাড়ি চালিয়ে সোজা নেপারভিল স্টেশন। সাময়িক যান্ত্রিক গোলযোগের জন্য ট্রেনটা আজ অনেকক্ষণ নেপারভিল স্টেশনে দাঁড়িয়ে ছিল। শিকাগো ইউনিয়ন স্টেশনগামী ট্রেনটা সেদিন যাত্রী বোঝাই ছিল। কোনরকমে ট্রেনের মধ্যে পা রাখতে হয়েছিল। একটু দেরি হলেও গাড়িটা শেষমেশ ছাড়লো। কিন্তু, পরবর্তী স্টেশন আসার আগেই মাঝপথেই ট্রেনটা থেমে যায়। যান্ত্রিক গোলযোগের জন্য ট্রেনের প্রতিটি কামরার দরজা তালাবন্ধ হয়ে যায়। কোন অবস্থাতেই কেউ বাইরে আসতে পারছিলো না। ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা  করার পরেও দরজা খোলা সম্ভব না হওয়াতে ট্রেন ভর্তি যাত্রীরা অসহায় বোধ করতে থাকে। প্রতিটি অফিস যাত্রী সেল ফোনে তাদের অফিস বসকে জানাতে চেষ্টা করে তাদের অফিসে সময়মতো না আসার কারণ। এক এক করে যাত্রীরা ঝিমিয়ে পড়তে শুরু করে। ওদিকে পাগলের মতো ট্রেন কর্মীরা চেষ্টা করে যেতেই থাকে ট্রেনের দরজা খুলবার, কিন্তু ব্যর্থ হয়। শ্যাম বহুক্ষণ নিজের সজীবতা ধরে রাখতে পারলেও একটা সময়ের পর আধা অচেতন হয়ে পাশে দাঁড়ানো একটি মেয়ের কাঁধে এলিয়ে পরে। আস্তে আস্তে শ্যামের অবচেতন মস্তিস্ক কোন এক কল্পলোকে অধিষ্ঠান করে, আর ফেলে আসা গ্রামের মেঠোপথে কাটানো শৈশবের দিনগুলোকে আবার ফিরে পেতে চায়। সব পুরোনো দিনের কথা স্মৃতি রোমন্থন  হতে থাকে।
বাঁকুড়ার জয়রামবাটীর গোবেচারা ছেলে শ্যামলেন্দু বিশ্বাস। পড়াশোনায় একেবারেই ভালো ছিল না। রঙিন স্বপ্ন দেখতে ভীষণ ভালবাসতো। অনেক চেষ্টা করে স্কুলের গন্ডিটা কোন রকমে উৎরে ছিল। সরকারি স্কুলের বাংলা মাধ্যমে পড়ার কারণে ইংলিশটা ঠিকমতো রপ্ত করা আর হয়ে ওঠেনি। ওদিকে মাথায় মার্কিন মুলুকে আসার ভূত চেপে বসে আছে। অনেক চেষ্টা করেও কলকাতা শহরে যখন কোন চাকরি জুটলোনা, শ্যামলেন্দু তখন নানা উপায় খুঁজতে থাকে কিভাবে মার্কিন মুলুকে যাওয়া যায়। প্রতিদিন কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার "পাত্র চাই" বিজ্ঞাপনগুলো দেখতে শুরু করে, আর তার পছন্দের কোন বিজ্ঞাপন দেখলেই নীল খামে করে চিঠি পাঠিয়ে দেয় সুদূর মার্কিন মুলুকে। খুঁজতে খুঁজতে দুটো বছর কেটে গেল। একদিন সকালে  শিকাগো থেকে একটা ফোন কল এল।     
"হ্যালো, আমি তিন্নি বলছি। চিনতে পারছেন?" 
“ঠিক চিনতে পারছি না।" 
“আমার আনন্দবাজার পত্রিকার "পাত্র চাই" বিজ্ঞাপন বিভাগে একটা বিজ্ঞাপন বেরিয়েছিল, আর আপনি চিঠি পাঠিয়ে যোগাযোগ করেছিলেন।"
শ্যামলেন্দু আনন্দে আত্মহারা হয়ে গিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পরে। কি করবে, কি বলবে কিছুই ভেবে না পেয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তিন্নি ক্রমাগত হ্যালো হ্যালো করতেই থাকে।
"হাঁ, মনে পড়ছে। আপনি এখন কোথায়?”
"আমি কলকাতায় এসেছি। আপনার সাথে দেখা করতে চাই।"
দুজনেরই সম্মতিতে ঠিক হল কলকাতার মেট্রো সিনেমা হলের পাশে কাফে ডি মনিকো রেস্তোরাঁয় মধ্যাহ্নভোজ। ভাদ্র মাসের পচা গরম। তিন্নি রেস্তোরাঁর সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল সঠিক সময়ের অনেক আগেই।  শ্যামলেন্দু ঠিক সময়েই পৌঁছয়, কিন্তু তিন্নিকে চিনতে পারে না কারণ রেস্তোরাঁর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার সাথে তাকে পাঠানো ফটোর কোনো মিল নেই। জয়রামবাটির শ্যামলেন্দু আজ বন্ধুদের কাছ থেকে ধার করা পয়সায় দামি জামাকাপড় পরেই এসেছিল হবু স্ত্রী তিন্নিকে অভ্যর্থনা করতে। হঠৎই অতি আধুনিক একটি গোলগাল বেঁটে গোছের মেয়ে শ্যামলেন্দুর কাছে এসে বলে, গুড 

আফটারনুন, আমি তিন্নি আর আপনি নিশ্চয়ই শ্যামলেন্দু। বেচারি শ্যামলেন্দু প্রথমটায় একটু থতমত খেয়ে যায়, তারপর বলে, হাঁ আমিই শ্যামলেন্দু আর আপনি নিশ্চয়ই তিন্নিদেবী। দুজনে গিয়ে বসে রেস্তোরায়। তিন্নি তার নিজের পরিবারের কথা, বিশেষ করে তার বাবার কথা প্রথমে ব্যাক্ত করে। সে চায় প্রথমে তার ষাট বছরের বাবার বিবাহ দিতে, কারণ বাবার এই নিঃসঙ্গ জীবন মেয়ে হয়ে আর দেখতে পারছে না। বাবার বিবাহ ঠিক করতেই এখানে আসা, আর তার সাথে নিজের গাঁটছড়াটা যদি ঠিকঠাক করে নিতে পারে। আমার বাবার বিবাহ ঠিক হয়ে গেছে আগামী অগ্রহায়ণে। যদিও তিন্নিকে এতটুকু পছন্দ হয়নি, তবুও মধ্যাহ্নভোজ শেষ করার পরেই শ্যামলেন্দু তিন্নিকে বিবাহের প্রস্তাব দেয়, তার সম্পর্কে বেশী কিছু না জেনেই। অবশেষে বাবা আর মেয়ের বিবাহ সুষ্ঠ ভাবেই সম্পন্ন হয়। বিবাহ শেষ হতেই বাবা আর তিন্নি শিকাগো চলে যায়। ইমিগ্রেশনের কাগজপত্র ঠিক হতেই তিন্নির সৎমা শশী প্রথমে শিকাগো পারি দেয়। তারও ছয় মাস পরে শ্যামলেন্দুর ডাক আসে।
আজ রবিবার। কলকাতা নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস আন্তজার্তিক বিমান বন্দরে শ্যামলেন্দু বিশ্বাস। লাল জামা আর লাল টুপি পরে অনাবিল আনন্দ নিয়ে টিকেট কাউন্টারে ব্যাগেজ চেক-ইন করে, সিকিউরিটি চেক করে নিদৃষ্ট সময়ে বিমানে গিয়ে উঠে পড়ল শ্যামলেন্দু। শিকাগোর ও'হারে আন্তজার্তিক বিমান বন্দরে নেবে সে একেবারে দিশেহারা হয়ে যায়। তিন্নি বিমান বন্দরে এসে শ্যামকে তুলে নিয়ে বাড়ি নিয়ে যায়। ছটা মাস বেশ কেটেছিল গোল গোবিন্দ শ্যামলেন্দুর। আচমকা একদিন সকালে তিন্নি ডিভোর্সের প্রস্তাব করে। বাধ্য করে শ্যামলেন্দুকে ডিভোর্স পেপারে দস্তখত করার জন্য। শ্যামলেন্দু কিছু বোঝার আগেই তিন্নি তাকে বাড়ি থেকে বার করে দেয়। শ্যামলেন্দু মনে খুব আঘাত পায়, কিন্তু অন্য কোনো উপায় না থাকায় অগত্যা বন্ধু কমলের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। কমলের চেষ্টায় অবশেষে তার অফিসে সিকিউরিটি গার্ডের একটা চাকরি জোটে, সেটাই নিয়ে নেয়। চাকরি পাবার একমাস পর নেপারভিলে একটা ছোট ষ্টুডিও এপার্টমেন্ট ভাড়া করে সেখানেই চলে যায়। এর পরেই নূতন জীবন শুরু হয়।
মার্কিন মুলুকে মার্কিনরা ছোট ছোট নামই পছন্দ করে। তারাই শ্যামসুন্দর বিশ্বাস নামটাকে ছোট করে ডাকতো শ্যাম বিষ ওয়াশ বলে। মার্কিনরা যখন শ্যাম বা মিস্টার বিষ ওয়াশ বলে ডাকতো, এক অনাবিল আনন্দে শ্যামের মন প্রাণ ভরে যেত। মার্কিনরা বিষ ওয়াশ বলতো কারণ তাদের উচ্চারণে অনেকটাই অসুবিধা ছিল। কিন্তু বাঙালি জনতা শ্যামের চরিত্র বিশ্লেষণ করে পিছনে বলতো বিষ ওয়াশ। এমনই করে একটা অপমান, অনাদরের বিষাক্ত পরিবেশে শ্যাম দিন কাটাতে থাকে। কিন্তু, কোন কিছুকেই সে গায়ে মাখেনা, কারণ তার শরীরে যে আমেরিকা বিষ ঢুকেছে তা বেরোবার নয়। কিন্তু, এটাও শ্যাম বুঝে গিয়েছিলো যে আমেরিকা দেশটা সকলের জন্য নয়, অন্ততঃ তার জন্যতো একেবারেই নয়। এতো কিছু বুঝলেও, তার অন্তরে যে বিষের গড়ল আশ্রয় নিয়েছে তা যাবার নয়।   জীবনে এতো কিছু ঘটে গেলেও সে মনে মনে ভাবে, একদিন আবার জয়রামবাটিতে যাবে আর ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন আর বিশেষ করে প্রিয় বান্ধবী যুথিকে তার গলাদ্ধকরণ বিষের ছটা দেখিয়ে দেবে।            
ট্রেনটা প্রায় আরো বারো ঘন্টা পর শিকাগো ইউনিয়ন স্টেশনে এসে পৌঁছয়। অন্ততঃ প্রায় দু হাজার লোকের নিথর দেহ ট্রেনের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েছে। উদ্ধারকারী কর্মীরা এক এক করে দেহ টেনে বার করে। প্রতিটি মানুষের প্রিয় মানুষেরা স্টেশন চত্তরে ভিড় করেছে তাদের প্রিয় মানুষগুলোর খবর জানতে। কান্নায় আকাশ বাতাস আন্দোলিত হচ্ছে, কি করুন সে দৃশ্য। কিছু সময়ের পরে স্টেশন চত্বর ফাঁকা হয়ে গেল, শুধু একটি সাদা কাপড়ে মোরা লাশ পরে রইলো। কোনো দাবিদার নেই সেই লাশটার। উদ্ধার কর্মীরা লাশটাকে নিয়ে স্থানীয় মর্গে পাঠিয়ে দেয়। কিছুদিন সেখানে ছিল , কিন্তু কোনো দাবিদার না থাকাতে, শেষ পরিণতি কি হয়েছিল তা জানা যায়নি। এখানেই ইতি শ্যাম বিষ ওয়াশের। আমেরিকা বিষ হতে আজ বুঝি মুক্তি পেল শ্যামলেন্দু বিশ্বাস।  

সংলাপ

সুব্রত মজুমদার

হিউস্টন, টেক্সাস 

গল্প

somiron.jpg
সংলাপ

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

র্তা – কি হোলটা কি? কতক্ষণ ধরে বলছি এক কাপ চা দাও। কানে শুনতে পারছ না ?
গিন্নি – আমিও তো প্রায় আধঘণ্টা ধরে বলছি, একটা কাজে ব্যস্ত আছি, পাঁচ মিনিটের মধ্যেই করে দিচ্ছি। আবার  বলছে কানে শুনতে পারছ না? 
কর্তা – কি বললে পাঁচ ঘণ্টা লাগবে এক কাপ চা করতে  ।
গিন্নি (নিজের মনে)  – যত বুড় হচ্ছে তত ধৈয্য কমছে। কানেও শোনে না, পারিনা বাবা আর এই বুড়োটাকে নিয়ে। বললাম পাঁচ মিনিট শুনল পাঁচ ঘণ্টা ।
কর্তা – এই বুড়ো বুড়ো করো না তো । আর কানে কম শোনার কথাও বলবে না। 
গিন্নি- ওমা এইতো শুনতে পেলে। অনেক সময় মনে হয় তুমি ইচ্ছে করে না শোনার ভান কর। আমি কিছু দরকারি কথা বললেই না শোনার ভান কর। সত্যি করে বলতো তুমি কি সত্যিই কানে কম শোনো ?  
কর্তা -  বাজে কথা বোলো না তো। তোমার দরকারি কথা মানেই হোল কাজের কথা । হয় এটা করো নয় ওটা করো । 
গিন্নি  -এই তো সেদিন তোমায় বললাম ডালটা বসিয়েছি একটু দেখো,আমি গায়ে একটু জল দিয়ে আসি। সেই শুনে তুমি কি বলেছিলে ভুলে গেছো? 
কর্তা – কেন কি বলেছিলাম?
গিন্নি – ওমা তাও ভুলে গেছ? তুমি বললে জল দিতে গেলে কেউ আবার গায়ে শাল বসিয়ে যায়?  আমায় তাও আবার দেখতে হবে? 
কর্তা – তুমি পরিষ্কার করে কথা বলতে পারোনা ?      
গিন্নি – ও তাহলে সবটাই আমার দোষ । অন্তত উত্তরটা দিয়েছিলে। নাহলে আমি তো এসে দেখতাম ডালটা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। 
কর্তা – তোমার কোন কথাই দরকারি নয়। 
গিন্নি – অ তাই বুঝি এ কান দিয়ে শুনে ওই কান দিয়ে বের করে দাও। তাছাড়া আর কি কথা আছে আমাদের? আমি কি তোমার সঙ্গে এখন প্রেমের কথা বলব? যত বুড়ো হচ্ছ তত ভীমরতি ধরছে।  
কর্তা – আবার আমাকে বুড়ো বলছ, এখনি বারণ করলাম না। আমার কথা তো কোনদিনই ভ্রুক্ষেপ কর না, কিন্তু ডাক্তারের কথাটা তো মানবে। আমার ডাক্তারটা ইয়াং ম্যান, কিন্তু  খুব ভাল ডাক্তার। এইতো গত সপ্তাহে ইয়ারলি চেক আপের জন্য গিয়েছিলাম তখন ডাক্তার কি বলেছিল জানো? তোমাকে তো সেই কথাটা বলতেই ভুলে গেছি । শুনলে তুমি একেবারে আঁতকে উঠবে।   
গিন্নি –বাবা আজ তোমার হোলটা কি? আমার প্রত্যেকটা কথা শুনতে পারছ?  হ্যাঁ তা ডাক্তার কি বলেছিল শুনি?  
কর্তা –আমায় বলল “Get a hot mamma and be cheerful”
গিন্নি – ও বলেছে বুঝি ? শখ আর ধরে না বুড়ো বয়েসে।  আর আমাকে তোমার ডাক্তার ফোনে যা বলেছে তা শুনলে তুমিও আঁতকে উঠবে। 
কর্তা –কেন কি, কি বলেছে তোমায়?  
গিন্নি – ডাক্তার ফোনে আমায় বলল “HE GOT HEART MURMUR, BE CAREFUL”
কর্তা – তাই বলেছে বুঝি তোমায় । আমি অনেক দিন থেকেই তোমায় বলব বলব ভাবছিলাম যে ইয়াং ডাক্তার গুলো সেরকম সুবিধের নয়। কিছু তো জানলোই না, বুঝলই না , ডাক্তার হয়ে গেল।  শুধু পয়সা করার ধান্দা। আমাদের সময় ডাক্তার ছিল বিধান রায়। শুধু দূর থেকে দেখেই বলে দিতেন  টাইফএড, নিমনিয়া না ম্যানেঞ্জাইটিস।   
গিন্নি – ওই আবার শুরু হয়ে গেল । আমাদের দেশের সব ভালো আর এদের সব খারাপ। তা এত যদি সবকিছু আমাদের ভালো হবে তবে মরতে এদেশে এসেছিলে কেন? 
কর্তা – আহা আমাদের দেশের ভালো করার জন্য তো অনেক লোক দেশেই আছে, এদেশে  আসেনি । তাই তো এরা আমাদের এখানে সাদরে ডেকে এনেছিল ।   
গিন্নি – তবে যে বিয়ের পর থেকে সব সময় বলতে দামি কিছু কিনবে না, সময় ভীষণ খারাপ।  যে কোন সময় লে অফ কোরে দেবে। যাদের সাদরে ডেকে নিয়ে আসে তাদের সঙ্গে  কখনো কেউ  এরকম করে নাকি? খালি মিথ্যে কথা। 
কর্তা – কেন কি মিথ্যে কথাটা বলেছি তোমায়?
গিন্নি- কেন তুমি বলোনি যে সারা জীবন ধরে আমাকে ভালবাসবে?
কর্তা – আরে বাবা তখন কি ধারনা করতে পেরেছি, যে এতদিন বাঁচব।
গিন্নি- আজকাল তো আমার সঙ্গে কথাই বল না, শুধু ফেসবুক খুলে বসে থাক।
কর্তা – আসলে কানে তো ভালো শুনিনা। কি শুনতে কি শুনব আর কি বলব। আর তাছাড়া ফেসবুকে একতরফা কথা বলা যায় । ফেসবুক ফোঁস করে কথায় কথায় ফনা ধরে না।
গিন্নি – কি ? আমি সবসময় ফনা ধরি। আমি কি সাপ? হে ভগবান কতদিন বেঁচে থাকব আর কত গালাগালি শুনতে হবে।  (কান্না কান্না সুরে )
কর্তা – কি যে বল না, এখন নাতিনাতনি হয়ে গেছে এখন কি আর গলাগলি করে বসা যায় ? 
গিন্নি (মনে মনে)  – জালাতন, গালাগালি বললাম শুনল গলাগলি। ভাল করে ঝগড়াও করা যায় না। কি নিয়ে বাঁচব আর। দুঃখের কথা কাকেই বা বলব । সবাইকারি তো একি অবস্থা । এ বলে আমায় দেখ ও বলে আমায় দেখ।    
গিন্নি – যাকগে চায়ের লিকার বসিয়েছি । হিউস্তনে বৃষ্টি তো লেগেই আছে, যাই একটু পেঁয়াজি কোরে আনি।  চায়ের সঙ্গে ভালই লাগবে। 
কর্তা – কী বললে নেতাজি? সে আবার কোথা থেকে এলো ? যাকগে তোমার চায়ের কতদুর? ওত লিকারের কি দরকার?

গিন্নি – মাগো আমাকে নিয়ে নাও। আর পারিনা । পেঁয়াজি শুনতে শুনল নেতাজি। পেঁয়াজি করার মজাটাই চলে গেল। সত্যি আমাদের মধ্যে মিলের থেকে অমিলই বেশি। 

কর্তা – একটা কথা কখন চিন্তা করে কি দেখেছ যে এত কিছু অমিলের মধ্যেও আমাদের জেনারেশানের বিয়ে গুলো কেমন টিকে আছে? আর এদের আজকাল কথায় কথায় ডিভোর্স । এটা জেনারেশানের তফাৎ, বুঝলে । আমাদের জেনারেশান ভাঙ্গা জিনিষ জোড়া লাগিয়ে  ব্যবহার করতে জানে, ভেঙ্গে গেছে বলে ছুঁড়ে ফেলে দেয় না।
গিন্নি – ওরা হোল মিলিমিটারের জেনারেশান। ওদের সব কিছু আলাদা আমাদের থেকে। তবে এইটুকু বলতে পারি যে আমাদের জেনারেশানের বিয়েটা টিকিয়ে রেখেছে আমাদের মেয়েরাই।
কর্তা – আরে ওটা মিলিমিটার নয় ওদের বলে মিলিনিয়াম জেনারেশান। এতদিন আমেরিকায় আছ আর এটা জানো না?
গিন্নি - কি জানি মাঝে মাঝে মনে হয় আমি যখন কথা বলি তখন তুমি কালা সাজার ভান কর । যে কথাগুলো শুনতে চাও শুধু সেইগুলো শোনো আর বাকিগুলো এই কান থেকে ওই কান দিয়ে পাস করিয়ে দাও। বউয়ের খুঁত কেউ এইভবে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। একটু ভালো ভাবেও ত কথাটা বলা যায় নাকি? আসলে তুমি একদম রোম্যান্টিক না । 
কর্তা – আমি রোম্যান্টিক নই? কেন বিয়ের পর তো একথা বলতে না। বরঞ্চ উলটোটাই বলতে শুনেছি।  
গিন্নি – বিয়ের পর সব মেয়েরাই ওই রকম বলে।  না বললে তুমি আমাকে ভালবাসবে ? 
না শাড়ী , গয়না কিনে দেবে ?  
কর্তা – তা হলে এখন সবকিছু পাল্টে গেল কেন? 
গিন্নি – আসলে এক্সপিরিএন্স বলে তো একটা জিনিষ আছে। প্রায় চল্লিশ বছর বিয়ের পর অনেক দেখেছি আনেক শুনেছি তাই এখন রোম্যান্টিক ব্যাপারটা কোম্পেয়ার করতে শিখেছি।
কর্তা –তাই । তা কি শিখেছ শুনি ?
গিন্নি – এই তো ধর না, তোমার যে বন্ধু অলোক। সদ্য নতুন বাড়ি কিনে হিউস্টোনে মুভ করল, বউকে নিয়ে, রিটায়ার করে।  
কর্তা –আবার অলোককে নিয়ে পড়লে কেন এই বয়সে। তাকে কি তোমার আবার ভালো  লাগছে ? কিন্তু সে তো বিবাহিত । 
গিন্নি – আ মরণ আমার। তিন কাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে এখন আমাকে এইসব কথা বলা হচ্ছে। যখন বয়েস কম ছিল তখন কিছু করালাম না আর এখন হাঁটুর ব্যাথা নিয়ে আর পেঙ্গুইনের মত হাঁটা নিয়ে এসব কথা শুনতে ভালো লাগে না। 
কর্তা –তবে অলোকের কথা উঠছে কেন। ওকি কি তোমাকে আড়ালে কিছু বলেছে? কলেজে ত এরকম ছিল না। একেবারে বোকাবোকা মুখচরা টাইপের ছিল। সবাই ওর পেছনে লাগত।
গিন্নি – আরে না না। সে সব কিছু নয়। শুধু বলছিলাম ওদের যেদিন খেতে ডেকেছিলাম আমাদের বাড়িতে, সেদিন দেখছিলাম তোমার বন্ধু কেমন সুন্দর ভাবে ওর বউ লিলাকে সুইটি পাই, ডারলিং, হানি বলে ডাকছিল আর ওর বউ কনে বউয়ের মত মিষ্টি হাসি হাসছিল। লিলার ন্যাকামিটা অসহ্য লাগলেও অলোকের ওই সম্বোধন গুলো কিন্তু শুনতে খুব রোম্যান্টিক লাগছিল। তুমি কোনদিন আমাকে ওইরকম করে ডাকলেই না। বিয়ের আগে আমার কত স্বপ্ন ছিল আমার  বর আমাকে একটা নতুন নাম দেবে বা অলোকের মত করে ডাকবে। সে সব কিছুই হল না। অলোক বোকাসোকা হতে পারে , কিন্তু সে বেশ রোম্যান্টিক, তোমার মত নয়। 
কর্তা –ও এই কথা। তা আগে এই কথা বলোনি কেন? আমিও লক্ষ্য করেছিলাম আর খুব অবাকও হয়েছিলাম। অলোক তো ঠিক এরকমটা ছিল না।  তারপর ভাবলাম অনেকদিন দেখা সাক্ষাৎ নেই  মানুষের পরিবর্তন ত হতেই পারে। যাই হোক বুদবার করে আমাদের সিনিয়ারদের প্যানারা ব্রেডে যে পার্টি হয় সেখানে আড়ালে ডেকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ব্যাপারটা নিয়ে। 
গিন্নি –কি বলল অলোক ?
কর্তা – কি আর , যা আমাদের সবাইকার হচ্ছে অলোকেরও হচ্ছে। 
গিন্নি –ওতো ভনিতা না করে সোজাসুজি বল না।
কর্তা –গত একবছর ধরে অলোককে এলজাইমারে ধরেছে। ও অনেক কথা মনে রাখতে পারে আবার কিছু কিছু জিনিষ একদম মনে রাখতে পারে না। অনেক চেষ্টা করেও পারে না। তার মধ্যে একটা হোল লিলার নামটা ও কিছুতেই মনে রাখতে পারে না। তাই ওইসব সুইটি পাই, ডারলিং, হানি এই সব বলে লিলাকে ডাকে। লিলা এখনও ধরতে পারেনি কিন্তু যেদিন ধরতে পরাবে সেদিন কি হবে অলোক জানেনা। বেশ ভয়ে ভয়ে থাকে।
গিন্নি – ওমা সে কি কথা।  আমি তো ভাবলাম ওদের গভীর প্রেম। না বাবা অতো সুইটি পাই, ডারলিং, হানিতে আমার আর দরকার নেই। যাক গে সেই আধঘণ্টা ধরে চা চা করে বাড়ি মাথায় করছিলে ,এই নাও ধর ,তোমার চা।  চিনির বদলে সুইটনার দিয়েছি।  ডাক্তার বলেছে চিনি একদম বাদ দিতে।  
কর্তা – থাঙ্কু অনু হানি। বাদ দিতে দিতে সব কিছুই তো বাদ হয়ে গেলো। আর রইলটা কি? চিনি সুইটনার কিছুরই দরকার নেই। তুমি যা মিষ্টি, শুধু তোমার আঙ্গুলটা দিয়ে একবার নেড়ে দিলেই মিষ্টি হয়ে যাবে। 
গিন্নি – থাক আর অত ন্যাকামি করতে হবে না। তোমাকে ওসব মানায় না । এতদিন ধরে চেষ্টা করেও আমার মত করে মানুষ করতে পারলাম না। চল্লিশ বছরে একদিনের জন্যেও বললে না, আর আজ, খোঁটা দিয়েছি বলে নতুন করে কোন কিছু শুরু করার দরকার নেই । বাবা মার দেওয়া সুন্দর অন্বেশা নামটা বদলে  দিয়ে বিয়ের পরে যেদিন থেকে অনু বলে ডাকতে শুরু করলে আমার খুব একটা ভালো লাগেনি । কিন্তু আজ এই চল্লিশ বছর পরে তোমার কাছে অলোকের কথাটা শোনার পর, তোমার মুখ থেকে ওই অনু ডাকটা নতুন করে খুব ভালো  লাগছে। অন্তত আমাকে তোমার এখনও মনে আছে, আমার নামটাও ভুলে যাওনি। তোমাকে আর আমি আমার মত করে মানুষ করার চেষ্টা করব না। তুমি যেমন আছো তেমনি থাক ।  

খুনে

সুব্রত মজুমদার

হিউস্টন, টেক্সাস 

খুনে

গল্প

crow.JPG

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

হ্যাঁ আমি স্বীকার করছি আমি খুব খারাপ।
কিন্তু আবার এই আমারই জন্য তোমার সমস্ত কামনা বাসনা ও দেহটা শুধু আমাকে আর আমাকে একবার কাছে পাওয়ার জন্য তৎপর, আরো উৎসুখ হয়ে থাকে কিনা?
হাঁ আমি জানি আমি সেই লোক যার স্পর্শ লেগে থাকে তোমার দুটো ঠোঁটে আমি চলে যাওয়ার অনেকক্ষণ পরেও।  

রবীন্দ্রনাথের মতো বলতে ইচ্ছে করেঃ
“অধরের কানে যেন অধরের ভাষা
দোহার হৃদয় যেন পান করে-
গৃহ ছেড়ে নিরুদ্দেশ দুটি ভালোবাসা
তীর্থযাত্রা করিয়াছে অধরসঙ্গমে”
আমার কনফিডেন্স, সাহস আর মাচো ভাবটা তোমার ভালো লাগে। আমি সেটা খুব ভালো করেই জানি। আমি এও জানি যে লোকে আমাকে আড়ালে লেডি কিলার বলে। আমি না শোনার ভান করে শুধু মুচকি হাসি। 
খারাপ লোক, চরিত্রহীন যাই বলো এই কথাগুলোর মধ্যে একটা নাটকীয়তা আছে।
কেমন যেন একটা রহস্যময়তা ঘিরে আছে কথাগুলোর মধ্যে। ওই যে কে যেন একবার বলেছিলেন না যে বাঙালি ছেলেরা চরিত্রবান তার কারণ চরিত্রহীন হওয়ার মতন দুঃসাহস তাদের নেই। আমার আছে, আর আছে বলেই তো সবাই যখন রাত্রে ডিনার টেবিলে বসে খাওয়ার জন্য, তখনই আমার কথা ওঠে। আমাকে নিয়ে কথা বলে ওরা। মানে কঙ্কনা আর ওর বাবা মা। আমি তখন হয়ে উঠিনট টপিক। বাবা ও মা মেয়েকে বোঝাতে চেষ্টা করে আমি কতটা চরিত্রহীন আমি কতটা খারাপ। কঙ্কনা চুপ করে থাকে কোন উত্তর দেয় না। খাওয়া হয়ে গেলে আস্তে আস্তে উঠে যায়। কঙ্কনা উঠে গেলে কি হবে, ওর বাবা আর মা আরো অনেকক্ষণ বসে বসে আমার পিন্ডি চটকান। প্রার্থনা করেন ভগবানের কাছে একদিন, এক সপ্তাহ, এক মাস, এক বছরের মধ্যে কঙ্কনা আমাকে ছেড়ে দেবে। আমাকে ভুলে যাবে। 
আমি জানি কঙ্কনার বাবা আর মাকে। খুব ভালো করে জানি ওনারা কি ধরনের লোক। অনেক রাত্রি অবধি আমি শুনেছি ওনাদের আলোচনা করতে আমাদের নিয়ে। ওনারা জানতেও পারেন না যে আমি ঠিক ওনাদের পাশের ঘরে কঙ্কনার পাশে আরামে শুয়ে আছি। কঙ্কনা আজকাল মাঝে মধ্যেই আমাকে লুকিয়ে ওর ঘরে নিয়ে আসে। আমরা দুজনেই কাটাই সারাটা রাত, ওদের ঠিক নাকের উপর দিয়ে। আমি চোখ বন্ধ করে শুনি ওদের কথা, কথা তো নয় যেন হুল ফুটানো হচ্ছে। বাবাটাই কথা বেশি বলে, মাটা শুধু ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদে। 
“কি করলে কঙ্কনা ওকে ছাড়বে? কেউ যদি আমাকে বলে দিত তো তাই করতাম। আমরা তো কঙ্কনাকে ভালোভাবেই মানুষ করার চেষ্টা করেছি। শিক্ষার তো কোনো ত্রুটি রাখেনি। তবে কেন সে এমনটা করল? আর লোকটাকেও বলি, ছিনে জোঁকের মত আমাদের মেয়েটার পিছু নিয়েছে, কিছুতেই ছাড়ছে না। এরকম একটা মহজাল ফেলে রেখেছে চারিদিকে যে আমাদের মেয়েটা তার ভেতর থেকে আর বেরিয়ে আসতে পারছে না। অপমান তো কম করা হয়নি অন্য কেউ হলে এতদিনে সব ফেলে চলে যেত। সবই অদৃষ্ট বোঝনা, সবই অদৃষ্ট।“
“মহজাল” আমি হাসি ওদের কথা শুনে, আবার রাগও হয়। আমি তোমাদের মেয়ের উপর মহজাল বিছিয়েছি? সব দোষ আমার? কঙ্কনা নিজেই যেচে আমার কাছে এসেছে, আমি নিজের থেকে কখনো এগোয়িনি ওর দিকে। এই যে আমাদের মধ্যে এতবার ঝগড়া হয়েছে, এমনকি ছাড়াছাড়িও হয়েছে, তার কথা কি তোমরা জানো? প্রত্যেকবার কঙ্কনাই এসেছে আমার কাছে, ক্ষমা চেয়েছে

তারপর তার দুটো পাতলা ঠোঁট দিয়ে আদর করেছে, আর আদর করেছে। তোমরা সেই সব কথা কখনো তোমাদের মেয়েকে জিজ্ঞাসা করেছো? তা করবে কেন? তোমাদের মেয়ে তো? তার সব ভালো, আর আমার সব খারাপ, তাই না? আমার তো কেউ নেই তাই তোমরা যা খুশি বলতে পারো।আমি জানি আমার দুর্নিবার আকর্ষণ করার ক্ষমতা, কঙ্কনাও জানে সে কথা। জানেনা শুধু তার বাবা আর মা। আমার তো মনে হয় জানতেও চায় না। আর এই নিয়ে আমাদের মধ্যে ওরা অশান্তির বীজ বুনে দিয়েছে।
কঙ্কনা জানে আমার অতীত- আমি ওকে সব বলেছি, কিছুই লুকোইনি। ও আমার অতীত নিয়ে মাথা ঘামায় না। কঙ্কনা  জানে সময় সময় আমি কত ভয়ানক হয়ে উঠতে পারি, আমার ধারণা ও মনে মনে সেটা পছন্দই করে। কেউ তো কখনো আমায় শেখায়নি অন্যরকম ব্যবহার করার জন্য, কেউ আমায় অন্য পথও দেখায়নি। সবাই শুধু আমাকেই দোষ দিয়ে গেছে। সব জেনেশুনেই কঙ্কনা আমাকে মেনে নিয়েছে। আমাকে জীবন সাথী করার স্বপ্ন দেখেছে।
হ্যাঁ আমি অনেককেই  অসন্তুষ্ট করেছি, কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, কে না করে? আর খুন করা? হ্যাঁ সেটা আমার মাথায় সব সময় আছে। কিন্তু তার জন্য আমাকে জঘন্য বলা কি উচিত? কই কঙ্কনা তো বলে না। আমরা যখন ঠোঁটে ঠোঁট মেলাই আমি বুঝতে পারি কঙ্কনার অনুভূতি। আনন্দে চোখটা বন্ধ করে ফেলে কঙ্কনা। আমি জানি ও আমায় ভালোবাসে। কি মিষ্টি মেয়েটা আর হবে নাই বা কেন, বয়স তো মাত্র সতের। কালো রেশমের মত মাথা ভর্তি কোকড়ানো চুল, ঠিক যেন একরাশ কালো মেঘ ঘাড়ের উপর নেমে এসেছে। আর চোখ দুটো? ওই চোখ যে দেখেছে সে কোনদিন ভুলতে পারবে? আর তার ফিগার? যতই বলি না কেন কম বলা হবে। সব মিলিয়ে বলতে গেলে যে কোন ছেলের মাথা ঘুরিয়ে দিতে পারে কঙ্কনা- আমার কি দোষ?
তবে হ্যাঁ ওকে আমি মারবো। একদিন না একদিন মারবোই। আমি যে  না মেরে পারি না, ওটাই যে আমার স্বভাব। কঙ্কনার মত কত মেয়েকে আমি আগেও মেরেছি পরেও মরবো। প্রত্যেকবার আমার দুঃখ হয় কিন্তু আমি যে কিছুতেই পারি না নিজেকে সামলাতে। আমার যে কি কষ্ট হয় তোমরা বুঝবে না। আর এই মেয়েগুলোও যেন কেমন? স্বেচ্ছায় এসে আমার কাছে ধরা দেয়। সেই এক ফর্মুলা প্রতিবার, একটু ভালোবাসার কথা বল, বিশ্বাস অর্জন করো ব্যস তোমার বশ হয়ে যাবে। তখন যা বলব তাই শুনবে, তাই করবে। এত বোকা কি করে হয় আমি বুঝতে পারি না। আমিও অপেক্ষা করে থাকি, আমার তো কোন তাড়া নেই। বলে না যে সবুরে মেওয়া ফলে, কথাটা সত্যি। আমি জানি একটা সময় আসে তখন আমাকে ছাড়া ও আর থাকতে পারে না। আর তখনই আমার খেলা শুরু হয়। আমি প্ল্যান করি, হিসাব নিকেস করি, কখন কি করে মারবো। সুখ আর দুঃখ দুটো অনুভূতি একই সঙ্গে আমার শরীরের মধ্যে দৌড়োদউরি করে। আমি তখন পাগল হয়ে যাই।
হ্যাঁ আমি খারাপ। কঙ্কনাও জানে সে কথা, সে এতটাও জানে যে আমার আরো অনেকগুলো নাম আছে, অন্তত এক ডজন তো হবেই। আমি জানি, কারণ প্রত্যেকবার তাকের উপর থেকে যখন আমাকেই শুধু তুলে নেয় তখন আমার বাকি কমরেডরা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি ওদের দিকে তাকিয়ে শুধু মুচকি হাসি। কঙ্কনা জানে খুনি বলে আমার বদনাম আছে, কিন্তু তা সত্বেও আমাকে কিনে নেয়, আর প্যাকেট থেকে আমাকে বের করে আগুন ধরিয়ে একটা সুখটান দিয়ে আমাকে ফুসফুসের একদম ভেতরে ঢুকিয়ে  নেয়। আর তারপর আমাকে বের করে দেয় দুটো ঠোঁটের মাঝখান দিয়ে আস্তে আস্তে ঠিক রুপলী মেঘের মতো। কঙ্কনা আমাকে চায়, কঙ্কনা আমাকে ভীষণ ভালোবাসে, কঙ্কনার যে আমাকে দরকার। 
বাবা আর মার জন্য দুঃখ হয়, ওরা বোঝে না, বুঝতে চায় না। 

প্রবন্ধ

বনেদী পোষাক

২০১০ সালে আবিস্কৃত একটি অপূর্ব সুন্দর বনেদী পোষাক

দেবযানী পাল

আমস্টারডাম, নেদারল্যান্ড

নেডারল্যন্ডের

গরু

দেবযানী পাল

আমস্টারডাম, নেদারল্যান্ড

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

nederland-cow_edited.jpg

০১০ সালে ডুবুরীরা নেদারল্যন্ডের টেসেল (Texel) দ্বীপের ৪০০ বছরের এক জাহাজ ডুবি ভালভাবে পর্য্যবেক্ষণ করতে আসে। আশ্চর্য হয়ে যায দেখে যে কাঠের বাক্সে হাজারেরও বেশী জিনিষপত্রের মধ্যে দুটো সপ্তদশ শতকের জামা ঠিক রয়েছে। এর ওপর গবেষণা করেছেন নেদারল্যন্ডের লেইডেন শহরের পোষ্ট-ডক (post-doc) Janet Dickinson। সারা ইউরোপে এই নিয়ে সারা পড়ে যায়। ইউরোপের সর্বত্র এ ঘটনাটি উত্তেজনা জাগায়। পোষাকটি এখন Texel শহরের মিউজিয়াম কাপ স্কিলে আছে।
 

dress.jpg

তো সুন্দর দেখতে। সাদা কালোর ছাপ, কানের ভেতরে সুন্দর রংএর বাহার। অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম। বিশালকায় চেহারা, সহজ চোখ, সরল মায়ন মাখানো দৃষ্টি  মাপহীন বিশাল বপু। আমার শাড়ি পরা ছিল। কোনও কিছু না বলেই, ও আমার শাড়ির আচঁল চিবোতে শুরু করলো। চোখ বন্ধ করে। যেন রাজভোগ খাচ্ছে। প্রথমে আমি লক্ষ্য করিনি কথায় ব্যস্ত ছিলাম। পরে ওর দিকে তাকিয়ে মনে হল, ও আমার সাথে মস্করা করছে। ও কিন্তু আমার পরিধানের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। আমি ওকে শাড়ি সম্বন্ধে অনেক বিশদ বিবরণ দিলাম। শুনছে মনে হল, কারণ কর্নদ্বয় আমার মুখের দিকে সোজা রেখে, ও চোখ প্রায় নিমিলিত করে স্থির হয়ে  দাঁড়িয়ে আছে। যখন প্রায় বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে মনে হল, হাত জোর করে বললাম, সুন্দরী, এবারে আমাকে ছেড়ে দাও। ওকি কিন্তু কথা শুনলো, একবার হাম্বা করে কাপড়ের আচঁল ছেড়ে দিল। অপূর্ব অভিজ্ঞতা, ভোলবার নয়। আমাকে হয়তো কখনও চিনতো, “হেথানয়, হেথানয়, অন্য কোথা, অন্য কোন খানে।”

গল্প

অভিনেতা

অভিনেতা 

সুব্রত মজুমদার

হিউস্টন, টেক্সাস

station.jpg

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

ট্রেনটা আজ একটু লেট রান করছে অন্তত দশ মিনিট তো হবেই। রিস্টওয়াচটার দিকে আর একবার চোখটা বুলিয়ে নিল অমলেশ। অমলেশ মৌলিক বয়স ষাটের একটু ওপরে, পেশায় অভিনেতা। নামকরা নয় তবে নানা ধরনের টিভি সিরিয়ালের ছোটখাটো চরিত্রে এবং মাঝে মধ্যে বিভিন্ন অ্যাডএজেন্সির হয়ে অভিনয় করে চলে যায় অমলেশের। কম করে ১০০ ওপর টিভি সিরিয়ালে অভিনয় করেছে সে। অভিনয় করতে খারাপ লাগে না অমলেশের, ব্যাপারটা বেশ মজার। বাস্তব জীবনে সবাইকে একটা চরিত্রেই অভিনয় করতে হয়। পেশাদার অভিনেতা বলে অমলেশ হরেকরকম চরিত্রে অভিনয় করতে পারে। কখন সে ডাক্তার, কখন উকিল আবার কখন বা ইঞ্জিনিয়ার। কখন সাধু আবার কখন ক্রিমিন্যাল। ক্যারেক্টার অ্যাক্টর হিসেবে নাম আছে অমলেশের। যখন যে ভূমিকাতেই অভিনয় করুক না কেন, মনে হবে সেই ভূমিকাতেই সে অভ্যস্ত। এমন সাবলিল তার অভিনয়। 
ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে করতে পাটা ধরে গেছে। আর এক কাপ চা হলে মন্দ হত না। তাড়াতাড়ি বাড়ি থেকে বেরনোর ফলে সকালের চাটা জুৎ করে খাওয়া হয়ে ওঠে নি অমলেশের। ভাল করে এক কাপ চা সকাল বেলায় না খেলে সারা দিনটা যেন কেমন আনচান করে অমলেশের। পকেট থেকে মানি ব্যাগটা বের করে চায়ের দাম দিয়ে প্রথম চুমুকটা দেওয়ার পরেই চোখটা পড়েছিল সামনের দেওয়ালে ঝোলানো বড় আয়নাটায় নিজের সম্পূর্ণ প্রতিবিম্বটার ওপর। খুঁটিয়ে নিজেকে দেখল কিছুক্ষন অমলেশ। না বাষট্টির তুলনায় খুপ একটা খারাপ চেহেরা নয়। সহকর্মীরা তো বিশ্বাসই করেনা যে অমলেশের বয়স ষাটের ওপর। অনেক কমবয়সি নায়িকারাও ওর চেহেরার প্রশংসা করেছে। নিয়ম করে যোগ ব্যায়াম করার ফলে বার্ধক্যকে আটকে রাখতে পেরেছে। মনে মনে নিজের তারিফ না করে পারল না অমলেশ। আরাম করে চায়ের কাপে আর একটা চুমুক দিল খুশী মনে। অল্পতেই খুশী অমলেশ। দুঃখ বোধে মুখ ভার করে থাকতে কেউ কখন দেখেনি তাকে। তবে হ্যাঁ দুঃখ যদি কোন ব্যাপারে থাকে তো সে একটাই আর সেটা হলো কোনদিন ফিল্মে অভিনয় করার সুযোগ পায়নি সে। স্বপ্নের মত হিন্দি ফিল্মি দুনিয়ার গ্ল্যামার আজও তাকে টানে। যদি একবার কেউ তাকে সুযোগ দেয় তাহলে এই বয়সেও দেখিয়ে দিতে পারে অভিনয় করা কাকে বলে। অনেক কম বয়স থেকে অভিনয় করছে অমলেশ, সেই যখন অভিনেতাকে বাছাই বা পচ্ছন্দ করা হতো শুধু তার চেহারা আর অভিনয়ের জন্য নয়, তার গলার আওয়াজের জন্যেও। বড় থিয়েটারের শেষ সারিতে বসা লোকেরাও যাতে অভিনেতার গলার আওয়াজ পরিষ্কার শুনতে পায় সেই ভাবে কথা বলার ও গলার স্বর উঁচুনিচ করার ট্রেনিং নিতে হয়েছিল তাকে। আজকাল অবশ্য মাইক্রোফোনের দৌলতে গলার আওয়াজের আর সেরকম প্রয়োজন নেই। তবু আজকালকার ছেলে ছোকরাদের তুলনায় তার গলার আওয়াজটা সত্যিই অন্যরকম। দাদা আপনার মত গলার আওয়াজ যদি পেতাম না, তো ফাটিয়ে দিতাম- এই ধরনের তারিফ বহুবার শুনেছে অমলেশ আজকালকার নায়কদের কাছ থেকে।
ট্রেনে উঠে জানলার ধারে একট সিট নিয়ে ধীরে সুস্থে ফিল্মফেয়ার ম্যাগাজীনটা ব্রিফকেস থেকে বের করে পাশে রাখল অমলেশ। একটু অবাক হয়ে গেল, ট্রেনটা আজ বেশ ফাঁকা। অফিস টাইম যদিও পেরিয়ে গেছে তবু এতটা ফাঁকা পাবে আশা করেনি। ট্রেনটা একটা বিরাট জোরে হুইসিল দিয়ে আবার চলতে শুরু করেছে। যাক বাঁচা গেছে আর কেউ উঠতে পারবে না। মনে মনে আবার খুশী হল অমলেশ, ভীড় গাদাগাদি একদম পচ্ছন্দ নয় তার। আরাম করে পায়ের ওপর পাটা তুলে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকাল আর তখনই চোখে পড়ল ঘটনাটা। আরে লোকটা কি করতে

চাইছে। চলন্ত ট্রেনটার সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটে চলেছে ওঠার জন্য, প্ল্যাটফর্মটাও শেষ হয়ে আসছে, আর একটু হলেই পড়ে যাবে যে।হ্যাঁচকা একটা টানে লোকটাকে তুলে ট্রেনের ভিতরে নিয়ে এল অমলেশ। যেন কিছুই হয়নি যেন নিত্যনীমিত্তিক ঘটনা, নীরস মুখে একটা ধন্যবাদ দিয়ে লোকটা বসে পড়ল ব্রিফকেসটা নিয়ে অমলেশের সিটের উল্টো দিকে ভাবলেশহীন মুখে। অমলেশ লক্ষ্য করছিল সামনে বসা লোকটিকে। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি হবে। চালাক চতুর চেহেরা। হয়ত কম্পটার লাইনের লোক হবে। আজকাল বেশীর ভাগ লোকই তো ওই লাইনের। 

“একটা অ্যাকসিডেন্ট হতে পারত।” কথা শুরু করল অমলেশই নিস্তব্ধতা ভাঙ্গার জন্য। 
“সত্যি যা বলেছেন। হতে পারত কিন্তু হয়নি। এটাই বড় কথা। যাই হউক আজকের দিনটা ভালোই যাবে কি বলেন, বৃষ্টি পড়বে বলে মনে হয় না, তাই না?” 
অমলেশ বুঝতে পারল লোকটা ব্যাপারটা লঘু করার জন্য কথাটা ঘুরিয়ে দেবার চেষ্ট করছে। আপত্তি করা করার কোন কারণ দেখল না অমলেশ। দীর্ঘ সময়টা ওর দুজনে কাটিয়ে দিল পলিটিক্স, টেরোরিজম, মুসলিম ফান্ডামেন্টালিস্ট, সোশ্যালিজম, ওয়ালর্ড কাপ সকার আর ক্রমবর্ধমান আনএমপ্লয়মেনট নিয়ে। লোকটি একসময় অমলেশকে তার পেশা সম্বন্ধেও জিঞ্জাসা করেছিল। অমলেশের খারাপ লাগে অপরিচিত কাউকে নিজের সঠিক পরিচয় জানাতে। এই নয় যে সে নিজের কাজকে অপচ্ছন্দ করে। ওই যে লোকে শোনার পর বলবে তাই আপনাকে কোথায় দেখেছি দেখেছি মনে হচ্ছিল, কি কি মুভিতে আপনি অভিনয় করছেন, বা কি করে ওই সব লাইন মুখস্থ রাখেন কে জানে। এইগুলোই আসলে অমলেশের অপচ্ছন্দ। বেশীরভাগ সময়েই সে অভিনীত চরিত্রের একজন বলে নিজের পরিচয় দেয়। কখন সে সাজে ডাক্তার, কখন ইঞ্জিনিয়ার আবার কখন উকিল। ব্যাপারটা অবশ্যই একটু রিস্কি, যেমন নিজেকে ডাক্তার বলে পরিচয় দেওয়ার পর যদি জানতে পারে যে যাকে নিজের পরিচয় দিল সেই ভদ্রলোক হাঁটুর সার্জেন। অবশ্য এখন অবধি সেই পরিস্থিতে তাকে কখন পড়তে হয় নি। এই কিছুদিন আগেই তাকে টিভি সিরিয়ালে এক দুধে উকিলের ভুমিকায় অভিনয় করতে হয়েছে। অভিনয়ের জন্য প্রশংসাও পেয়েছে সবার কাছে। “এককালে ওকালতি করতাম এখন রিটায়ার্ড। আজকাল একটু আদুটু ফ্রিলান্সিং করি এদিক সেদিক।”
ট্রেনটার স্পিডটা কমে আসছে বোধহয়, আর একটা স্টেশন এল। 
“আমার স্টেশন এসে গেছে, আমায় এবার নামতে হবে।” লোকটা ব্রিফকেসটা নিয়ে উঠে দাঁড়াল।
“আপনাকে দেখে আমার মনে হয়েছিল যে আপনি অ্যাকটিং করেন। বিশেষ করে আপনার গলার আওয়াজটা। বেশীর ভাগ সময় দেখেছি আমার ধারনাটাই ঠিক হয়। এক্ষেত্রেও অবশ্য আমার ধরনাটাই ঠিক। যাই বলুন উকিলরাও তো একধরনের অ্যাকটর তাই না? কোর্টরুমে যা হয় সেও তো একধরনের নাটকই।” ট্রেনটা থামল, স্টেশন এসে গেছে।
“আমার নাম গৌরব ঘোষ। পেশায় হিন্দি ফিল্মের ডিরেক্টার। বর্তমানে একটা ছবির পরিচালনায় ব্যস্ত আছি ও তার জন্য একজন দক্ষ এবং বয়স্ক অভিনেতা খুঁজে বেড়াচ্ছি। ফেস্ স্টাডি করি। তাই ট্রেনে চড়ি, ঘুরে বেড়াই চারিদিকে চোখ কান খোলা রেখে। ওই যে বলে না যেখানে দেখিবে ছাই উড়াইয়া দেখো তাই মিলিলেও মিলিতে পারে অমুল্য রতন। যাই হউক আপনার সঙ্গে আলাপ করে ভালো লাগল, সময়টা ভালো কাটলা। চলি তা হলে। বাই।” 

রিওয়াইনড

সুব্রত মজুমদার

হিউস্টন, টেক্সাস

girl.jpg
রিওয়াইন্ড

গল্প

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

ঞ্জনা স্টিমিং চায়ের কাপে আরেকবার চুমুক দিয়ে কাপটা নামিয়ে রাখল টেবিলে। চোখটা আটকে রইল জানালার বাইরে। তাজমহলের মস্ত মহিমায় মাখা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা মনোমুগ্ধকর দৃশ্য তার চোখকে দিচ্ছিল অপূর্ব এক ইন্দ্রিয়তৃপ্তি। বিকেলের পড়ন্ত সূর্যের আলো যেন হাতির দাঁত-সাদা স্মৃতিসৌধটিকে স্নান করিয়ে, প্রস্তুতি করছিল আর একটি নরম আলোকসজ্জার ব্যবস্থার জন্য যা এই তাজমহলকে আরও জাঁকজমকপূর্ণ করে তুলবে। রাতের তাজমহল এক বিরল অতুলনীয়, রাজোচিত দৃশ্য। অঞ্জনার মন ঘুরে বেড়াচ্ছিল যখন সে প্রথমবার এসেছিল। এই স্থাপত্য বিস্ময়ের জটিল মার্বেল খোদাই এবং সূক্ষ্ম মিনারগুলি তখনই তাকে বিস্মিত করেছিল। এমন একটি আইকনিক পটভূমিতে পর্যটকদের ঘুরে বেড়াতে দেখে অবিশ্বাস্য বিস্ময়, প্রশান্তি আর গর্ব অনুভব করা ছাড়া আর কিছু করতে পারেননি।

“তুই যাই বলিস মোগলাই খানার থেকে ভালো খাবার আর হয় না। এই একটা ভালো জিনিস কিন্তু মুঘলরা আমাদের দিয়ে গেছে। এই জন্যই তোদের বলেছিলাম এই হোটেলটার কথা। আর কিছু না হোক অন্তত খাবারটা ভালো হবে। তোর মনে আছে আমরা শেষবার যখন এসেছিলাম আমার মনে আছে এ হোটেলটাতেই উঠেছিলাম। একটু পুরনো হয়ে গেছে বটে কিন্তু চলে যায়।“ উত্তরের অপেক্ষায় অঞ্জনা বাণীর দিকে তাকালো।
বাণী উত্তর না দিয়ে, মুচকি হাসলো। বাণী বুঝল যে কথাটা তাকে উদ্দেশ্য করেই বলা হয়েছে। মোগলাই তার ভালো লাগে ঠিকই, কিন্তু চাইনিজ খেতে ওর আরও বেশি ভালো লাগে। চিকেন বিরিয়ানির থেকে চিকেন ফ্রাইড রাইস অনেক বেশি মজাদার। বাণী ওকে এটাও বলল না যে হোটেলটা ওরা সবাই মিলেই পছন্দ করেছে কারণ সবাইকার পছন্দের  মত কিছু কিছু জিনিস শুধু এই হোটেলটাতেই আছে। যেমন হাঁটা পথে তাজমহল, ভালো মোগলাই, চাইনিজ আর ওয়েস্টার্ন খাবার আর রুমের সঙ্গে লাগানো বাথরুম ২৪ ঘন্টা গরম জল, আর খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। 
আরও একটা জিনিস বাণীর ভালো লাগে সেটা হল খাবার ঘরে বসলে যে কোন জায়গা থেকেই তাজমহলটাকে দেখা যায়।
লাঞ্চ খাওয়া ওদের অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। বেয়ারা টেবিলে শেষ প্লেটটাও তুলে নিয়ে গেছে। মেয়েরা চলে গেছে সাজগোজ করতে বাইরে যাবে বলে। বাণীর অনেকক্ষণ থেকেই মনে হচ্ছে যে বেয়ারাটা হয়তো লজ্জায় ওদের বলতে পারছে না উঠে যেতে। বাণী একবার বেয়ারাটার দিকে তাকিয়ে অঞ্জনার দিকে তাকালো। 
অঞ্জনা বোধয় ওর মনের ভাব বুঝতে পেরেই বলল “আমি কিন্তু এখন এখান থেকে উঠছি না। ভীষণ ভালো লাগছে এখানে বসে থাকতে। তুই বরঞ্চ আরো দু কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে দে, তোর যদি খুব খারাপ লাগে। এমনিতেও লোক তেমন আসছে না, আর যদি আসেও তো অনেক টেবিল খালি পড়ে আছে। তোর সবকিছুতেই একটু বাড়াবাড়ি। আর যদি চায়ের অর্ডার দিস তো বাদশাহি চায়ের অর্ডার দিবি এবার। এদের বাদশাহী চাটা খুব ভালো।”

বেয়ারাটা চলে যেতে না যেতেই ওদের দুই মেয়ে এসে হাজির।
“তোমরা নিশ্চয়ই এখন আর বেরোচ্ছে না। তোমরা না এখানে এসে একদম বুড়ি হয়ে গেছো। আমরা একটু বেড়াতে যাচ্ছি।” বাণীর মেয়ে রাহি কথাটা বলে, একটু হেসে অঞ্জনার দিকে তাকালো।
অঞ্জনার মেয়ে কলি একটু ঝুঁকে মার গলাটা জড়িয়ে ধরে আদর করলো, অঞ্জনা আদর করে হাত বুলিয়ে দিল মেয়ের গালে। 
“তোমরা যাচ্ছোটা কোথায়?” বাণী রাহিকেই প্রশ্নটা করলো।
“আমরা এখন যাবো একটু শপিং করতে তারপর একটু সন্ধ্যে হলে যাব তাজমহল দেখতে। তোমাদের কলির আবার রাতের তাজমহল না দেখলে নাকি ঘুম হবে না। কিরে কলি তাই না?”
“আমি শুধু বলছি নাকি? সৌরভই তো বলছিল যে রাতের তাজমহল নাকি আরো সুন্দর দেখতে।”  কলির গলার লজ্জার আভাস।
“ঠিক আছে যাও কিন্তু দুজনেই একটা গরম জামা নিয়ে নিও। এখানে রাতের দিকে বেশ ভালোই ঠান্ডা পড়ে। ঠান্ডা লেগে যদি জ্বর হয় তাহলে কিন্তু সব আনন্দই মাটি হয়ে যাবে।“ বাণী দেখলো তার কথা শেষ হবার আগেই দুই মেয়ে দৌড়াতে শুরু করেছে সিঁড়ির দিকে। 
“তোর চিন্তা করার কিছু নেই, সৌরভ তো থাকবে ওদের সঙ্গে।” অঞ্জনার গলায় সান্তনার সুর।
“হ্যাঁ তা ঠিক। তবে ঠাণ্ডাটা তো আর সৌরভ আটকাতে পারবে না।” 
বাণী কিছু না বলে একটু মুচকি হাসলো। বাণী জানে দুপুরের খাওয়ার পর অঞ্জনার একটু বিউটি ন্যাপ নেওয়ার অভ্যাস। তাই বাণী একটু নিচু হয়ে প্যাকেট থেকে গল্পের বইটা বের করে তোড়জোড় করল পড়বার জন্য। বাণী দেখছিল আধশোয়া অঞ্জনাকে। যদিও অঞ্জনা বয়সের তুলনায় এখনও বেশ সুন্দরী, কিন্তু বয়সকালে যারা মিস ক্যালকাটা অঞ্জনা সেন কে দেখেছে তারা আজ চিনতেই পারবেনা আজকের অঞ্জনাকে দেখলে। সত্যিই কি সুন্দরী ছিল, ছেলেদের মধ্যে রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলতো অঞ্জনা সেনের সঙ্গ পাওয়ার জন্য। অঞ্জনা অবশ্য কোন ছেলেকেই খুব একটা পাত্তা দিত না অথচ মেডিকেল কলেজ থেকে সদ্য পাস করা সুদর্শন রোহিত সান্যালের চোখ যখন অঞ্জনার উপর পড়লো, সেই চোখ কিন্তু ফিরিয়ে দিতে পারেনি  অঞ্জনা। 
বিয়ের পরই অঞ্জনা আর রোহিত পাড়ি দেয় শুধু আমেরিকার লসএঞ্জেলাস শহরে। সেখানে ডাক্তারিতে রোহিতের খুবই নাম ডাক হয়। দামী বাড়ি গাড়ি কোন কিছুরই অভাব রাখেনি সে অঞ্জনার। লস এঞ্জেলাস শহরের বাসিন্দাদের কাছে মিস্টার এন্ড মিসেস সান্যাল এর নাম সব লোকের মুখে মুখে ঘুরত একসময়। সবই ছিল রোহিতের ছিল না শুধু দীর্ঘ আয়ু। প্রায় দু বছর আগে হঠাৎ একদিন একটা বড় কার এক্সিডেন্টে মৃত্যু হয় রোহিতের। অঞ্জনা আজও ভুলতে পারে না সেই দিনটার কথা। ভেঙে পড়েছিল খুবই কিন্তু কলির মুখের দিকে চেয়ে সবকিছু সামলে নিয়েছিল। আবার গত বছর যখন বাণীর স্বামী রঞ্জনও মারা গেল ক্যান্সারে তখন খবরটা পাওয়া মাত্র অঞ্জনা সোজা চলে এসেছিল কলকাতায়। পাশে দাঁড়িয়ে ছিল বন্ধুর। খুব কেঁদেছিল দুই বন্ধু মিলে। তারপর নিজেরাই মনকে শক্ত করেছিল ওদের মেয়েদের জন্য। দুজনেই দুজনকে দিয়েছিল শান্তনা আর মনের বল।
“তুই ঠিক আমার মা আর মাসিমের মতো হয়েছিস। মনে আছে আমাদের মারাও ঠিক এরকম করেই আমাদের বলতো সন্ধ্যেবেলা এখানে ভীষণ ঠান্ডা পড়ে। কত রকম ভাবে আমাদের বলতো রাত্তির দিকে না বেড়ানোর জন্য।” অঞ্জনা হঠাৎ বলে উঠলো। 
হঠাৎ অঞ্জনার গলার আওয়াজে চমকে উঠেছিল বাণী। হাত থেকে বইটা প্রায় পড়ে যাচ্ছিল, সামলে নিয়ে তাকালো অঞ্জনার দিকে, বলল্ “দেখ কিছু কিছু জিনিস সময়ের সঙ্গে চেঞ্জ হয় না এগুলোকেই তো প্যারাডাইম বলে তাই না? যেমন ঠান্ডা লাগার ব্যাপারটা। তবে যাই বলিস আমাদের মারা আরো বেশি প্রটেকটিভ ছিল।”
“ওদের দুজনকে দেখে হঠাৎ মনে হল যেন রিওইয়াইন্ড করে আমাদের ছোটবেলাতেই ফিরে গেছি। মনে আছে আমরাও ঠিক এই ভাবেই ঘুরে বেড়াতাম। মা বাবাদের সঙ্গে ঘুরতে একেবারেই ভালো লাগতো না।“ অঞ্জনা চেহারা একটু হেলান দিয়ে বসলো।
ওরা দুজনেই নিশ্চিন্ত ছিল ওদের মেয়েদের ব্যাপারে। এখানে আসার পরেই অঞ্জনার মেয়ের সঙ্গে হঠাৎ আলাপ হয়েছে সৌরভের। ছেলেটি ইন্ডিয়ান এয়ার ফোর্সের পাইলট। বেড়াতে এসেছে বন্ধুদের সাথে। খুব স্মার্ট দেখতে শুনতে ভালই। ওদের সঙ্গে আলাপও করিয়ে দিয়েছে। অঞ্জনার তো ছেলেটিকে খুব পছন্দ হয়েছে। কলির সঙ্গে মানাবে ভাল। 
আজ রাহি আর কলিকে একসঙ্গে দেখে হঠাৎ অঞ্জনার মনটা কেমন যেন খারাপ হয়ে গেল। বাণীর মেয়ের রাহিকে কলির পাশে যেন অনেকটা বেশি সুন্দর দেখতে লাগে। আর লাগবে নাই বা কেন, কি রকম সাজে মেয়েটা। অঞ্জনা কতবার মেয়েকে বলেছে একটু সুন্দর করে সাজার জন্য, কিন্তু মেয়েটা কানেই দেয় না। অঞ্জনা এখনো সাজগোজের ব্যাপারে ভীষণ মর্ডান। কিন্তু মেয়েটা হয়েছে একেবারে উল্টো। রাহি কিরকম চোখে মুখে কথা বলে। কলি সে তুলনায় অনেক চুপচাপ। ওই স্বভাবটাও কলি মায়ের মত পায়নি। রোহিত যতদিন বেঁচে ছিল বলতো আরে এত ঘাবড়াবার কি আছে? কতই বা বয়েস? একটু বড় হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। অঞ্জনার ভয় হয়, রাহি না কলির কাছ থেকে সৌরভকে কেড়ে নেয়। কলির যা মন খারাপ হবে না। অঞ্জনার একদম ভালো লাগে না কথাটা ভাবতে। 
“আচ্ছা তোর মনে আছে শেষ যে বার আমরা আগ্রায় এসেছিলাম বাবা-মাদের সঙ্গে, তখন আমাদের সঙ্গে রোহিতও  এসেছিল, তবে অন্য হোটেলে ছিল। আমাদের তখন এনগেজমেন্ট হয়ে গেছে।“ অঞ্জনা হঠাৎ বাণীর দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করল।

বাণী ভেবেছিল অঞ্জনা কোথায় ঘুমিয়ে পড়েছে, তাই একটু অবাক হয়ে বলল “হ্যাঁ কেন মনে থাকবে না।” 
অঞ্জনা চেয়ার থেকে উঠে বারান্দার পাঁচিলের উপর ভর দিয়ে সামনের তাজমহলের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। অঞ্জনার মনে দ্বিধা, কলি কি তার মনের মানুষকে পাবে? অঞ্জনা যে রকম পেয়েছিল রোহিতকে। সত্যি, কি ভালো লাগছে আজকের তাজমহলটাকে দেখতে। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল তাজমহলটার দিকে। এই তাজমহলটা যেন আজ তার দিকে তাকিয়ে কত প্রেমিক ও প্রেমিকার ভালোবাসার কথা বলার চেষ্টা করছে। এতকাল তাজমহলটা শুধু নীরব শ্রোতা হয়ে শুনেছে আর শুনেছে। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে তাজমহলটা শুধু শুনছে না যেন তার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে হাসছে।
একটু ঘুরে দাঁড়িয়ে এগিয়ে এসে বাণীর দিকে ফিরে অঞ্জনা বলল “মনে আছে, তোর মা একটা গল্প বলতো যে তোদের এক আত্মীয় নাকি আগ্রায় সন্ধ্যেবেলা বেড়াতে বেরিয়ে এমন ঠান্ডা লাগিয়েছিল যে নিমোনিয়া হয়ে গেছিল। আর সেই নিমোনিয়ার অসুখেই তিনি নাকি মারা যান। আমি ভাবতাম তোর মা আমাদের ভয় দেখানোর জন্য বোধহয় ওই গল্পটা বানিয়ে বলতো। কিন্তু তুই যেদিন রাত করে ফিরলি আর তার পরের দিন থেকে তোর ভীষণ জ্বর শুরু হলো সেদিন কিন্তু আমি ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম।“
“হ্যাঁ, তুই তো ভয় পাওয়ার মেয়ে” 
“না সব সময় হয়তো নয়, কিন্তু বিশ্বাস কর, যখন তুই জ্বরে পড়লি দেরি করে ফেরার জন্য, তখন সত্যিই আমার ভয় করছিল। তোর যদি কিছু হতো আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারতাম না।“ অঞ্জনা তাকালো  বাণীর দিকে। “তোর নিশ্চয়ই মনে পড়ে, তখনকার দিনের তাজমহলের সেই দিককার কথাটা- একটু স্যাতস্যাতে, টিমটিমে আলো- সন্ধ্যে হতে না হতেই যেখানে কেউ ভয় আর

মাড়াতো না। তখন ঐদিকের গেটটায় তালা লাগিয়ে দিত, সন্ধ্যে না হতেই। অবশ্য তখনকার দিনে একটু পয়সা খাওয়ালেই ওই দারোয়ানটাই আবার গেটটা খুলে দিত আমাদের মত প্রেমিক প্রেমিকাদের একটু সুযোগ দেওয়ার জন্য। আমি আর রোহিত বেশ কয়েকবার ওখানে গিয়ে রোমান্স করেছি। তখনকার দিনে তো সবকিছু এত খোলামেলা ছিল না, তাই একটু চুপিসারেই করতে হত। তোর মনে পড়ে না।”
“তা হয়তো হবে।” বাণী কেমন আনমনা হয়ে গেল।
“কেন তোর সেসব মনে নেই?”
“আমি- আমি, কি করে এসব জানবো” বাণী উত্তর দিল।
“কেন তোর মনে নেই, সেদিনটার কথা, যেদিন তুই ওই জায়গাটায় অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েছিলি। তারপর ফিরে এসে ভীষণ জ্বরে পড়লি, প্রায় এক সপ্তাহ। আমাদের সবাইকে কি চিন্তাতেই ফেলেছিলি। অনেকে তখন বলাবলি করছিল তোকে নাকি ওরা ওখানে দেখেছিল। আর তুই, বেমালুম ভুলে গেলি।“ অঞ্জনার গলায় ফুল ফোটানোর সুর।
একটু চুপ করে থেকে বাণী বলল “সত্যি, লোকে এরকম বলেছিল নাকি? দেখ এসব অনেকদিন আগে্কার কথা। হঠাৎ আজকে তুই এসব বলছিস কেন বুঝতে পারছি না?”  
“এই যে তুই নেকা সাজছিস, এই যে তুই স্বীকার করছিস না যে তুই ওইখানে গিয়েছিলি। তুই কি ভাবিস আমি জানিনা। আমি সব জানি। আর কেউ জানুক বা না জানুক আমি খুব ভালো করে জানি যে তুই ওইখানে গিয়েছিলি” বেশ ঝাঁঝের সঙ্গে অঞ্জনা কথাটা বলল।

“কি আশ্চর্য! তুই কি যা তা বলছিস, আমি কেন ওখানে যেতে যাব?”
“তুই ভাবছিস আমি মিথ্যে কথা বলছি? আমি মিথ্যুক? তুই গিয়েছিলি রোহিতের সঙ্গে দেখা করার জন্য। সেই রোহিত যার সঙ্গে আমার এনগেজমেন্ট পর্যন্ত হয়ে গেছে। তুই কি করে পারলি? আর তুই আমার সবচেয়ে বড় বন্ধু। তোকে আমি বিশ্বাস করেছিলাম। তাহলে শোন, আজ তোকে আমি বলবো। যে চিঠিটা পড়ে তুই ওখানে গিয়েছিলি সেই চিঠিটার প্রত্যেকটা কথা আমার এখনো মনে আছে, এখনো শোনাতে পারি। শুনবি?”
“না, না, প্লিজ আমাকে শোনাতে হবে না। ওই চিঠিটা প্রত্যেকটা কথা আমারও মনে আছে।” বাণীর চোখে জল।
বানীর মনে পড়ে গেল ওই চিঠিটার কির। চিঠিটার নামের সই এর জায়গায় “আর ও এস” দেখে ওর একবারও অসুবিধা হয়নি বুঝতে ওটা কার লেখা। বাণীর চোখে জল বাঁধ ভাঙল।
অঞ্জনা তাকিয়ে ছিল বাণীর দিকে তীব্র ঘৃণার সঙ্গে।

“কিন্তু তুই, তুই কি করে জানলি ওই চিঠিটার কথা? আমি তো চিঠিটা পাওয়ার সাথে সাথে ওটা পুড়িয়ে ফেলেছিলাম।” হঠাৎ বানীর মুখ থেকে বেরিয়ে গেল।

“হ্যাঁ তা তো পোড়াবেই। তোমার মত বুদ্ধিমতি মেয়ে কি আর ঐ চিঠি নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ঘুরবে? তাই ভাবছো, আমি জানলাম কি করে, তাই না?” বেশ চিবিয়ে চিবিয়ে কথাগুলো বলল অঞ্জনা।

“হ্যাঁ আমি ওই চিঠিটার প্রত্যেকটা কথা জানি কারণ চিঠিটা একজনের হাত দিয়ে রহিতই আমাকে প্রথম পাঠিয়েছিল।”
“কিন্তু চিঠিটা আমার কাছে তবে কেন এল? কে পাঠাল?” বানীর আগ্রহ বাঁধ মানছিল না।
“ আমিই পাঠিয়েছিলাম তোর ঘরে। ইচ্ছে করে, দেখতে চেয়েছিলাম, তুই চিঠিটা পেয়ে কি করিস।“
“কিন্তু কেন? কেন?”
সময় স্থির হয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছিল, কারণ তারা দুজনেই প্রচণ্ড আবেগ এবং অ্যাড্রেনালিন-জ্বালানী প্রত্যাশার মধ্যে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিটি নিঃশ্বাস পরিমাপ করা, এবং ইচ্ছাকৃত; প্রতিটি হৃদস্পন্দন যুদ্ধের ড্রামের মতো আসন্ন সংঘর্ষের ইঙ্গিত দিচ্ছিল। তাদের চোখ অনেক কথা বলছিল - অবাধ্যতা, সাহস এবং জয় করার নিরলস ইচ্ছা। তারা যেন অদৃশ্য বিভাজনের বিপরীত দিকের যোদ্ধা, এই মহাকাব্যিক সংগ্রামে জড়িত হওয়ার জন্য ভাগ্য দ্বারা আবদ্ধ। হৃদস্পন্দনের মধ্যবর্তী সেই সংক্ষিপ্ত মুহুর্তে, মনে হচ্ছিল যেন পুরো বিশ্ব তাদের সাথে নিঃশ্বাস ধরে রেখেছে, ঝড় ভাঙ্গার জন্য অপেক্ষা করছে।
দুজনে দুজনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। বিকেলে পড়ন্ত রোদ দুজনকেই ছুঁয়ে গেল, কিন্তু শান্ত করতে পারল না। বাণী দুহাতে মুখ ঢেকে চেয়ারে  বসে পড়ল।
“চিঠিটায় তোর কোন নাম ছিল না। আমি চিঠিটা পেয়ে ভেবেছিলাম রোহিত আমাকে চায়। তাই চিঠিটা আমাকেই লিখেছিল। এর আগে কেউ কোনদিন আমাকে এরকম চিঠি পাঠায় নি। হ্যাঁ আমি ভালবাসতাম রোহিতকে। রোহিতের মতো ছেলেকে কোন মেয়ে ভালো না বেসে থাকতে পারে? আমি সত্যি গিয়েছিলাম ওই চিঠিটা পাওয়ার পর।” বাণী কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।
শিকারি বাঘ যে রকম হরিণকে খেলায় সেই রকমভাবে অঞ্জনা আবার শুরু করলো -

“আমার অনেক দিন ধরে সন্দেহ ছিল যে তোর রোহিতকে ভালো লাগে। তুই চুপচুপ চাপ থাকতিস, তাই বোঝা যেত না। কিন্তু তোর চোখে মুখে ফুটে উঠতো রোহিত কাছাকাছি এলে। হ্যাংলার মতন মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতিস। আমি তোকে ঘেন্না করতাম তার জন্য। আবার হাসিও পেত। তাই মজা করার জন্য রোহিতের লেখা চিঠিটা তোর কাছে পাঠিয়েছিলাম। দেখি তুই কি করিস? ভালোই করেছিস চিঠিটা পুড়িয়ে ফেলে। কিন্তু তুই যখন জ্বরে পড়লি তখন সত্যিই আমার খুব খারাপ লেগেছিল, এটা তোকে বিশ্বাস করতেই হবে।”
বাণী একটু চুপ করে রইল তারপর বলল “আমি জীবনে ওইরকম একটাই চিঠি পেয়েছি কারো কাছ থেকে, আর তুই বলছিস ওটা মজা করার জন্য আমাকে পাঠিয়েছিলি?” 
“কেন তুই কি রোহিতকে এখনো ভালোবাসিস?”
“না শুধু তার স্মৃতিটাকে।”
অঞ্জনার রাগ আরো বেড়ে গেল, বাণীর কথা শুনে। ওইরম একটা মেয়ের আশ্পর্ধা কি করে হয়, রোহিতের মতো একটা ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক ভাবার, এটাই অঞ্জনার মাথায় ঢুকছে না। আয়নায় কি নিজের মুখটা কখনো দেখেনি? কি করে ভাবে যে রোহিতের মতো ছেলে ওর দিকে তাকাবে পর্যন্ত। আশ্চর্য একটা বুদ্ধিমতী মেয়ের এরকম মতিভ্রম কি করে বরদাস্ত করবে ভেবে পেল না।
এই মুহূর্তে তার বাণীর উপর হিংসে হচ্ছে না, বরঞ্চ মায়াই হচ্ছে। 

“দেখ বাণী আমি অনেক সময় এটা নিয়ে ভেবেছি, একবার ভেবেছি তোকে বলবো, আবার ভেবেছি বলবো না। অনেকদিন আগের ঘটনা, তখন বয়সও কম বুদ্ধিও কম। যা মনে এসেছে তাই করেছি। আমাদের আগ্রা থেকে ফেরার এক মাসের মধ্যে তোর বিয়ে হয়ে গেল। আমি ভেবেছিলাম আমার বিয়েটাই আগে হবে, তাই একটু অবাক লেগেছিল। মা বলেছিল তোর মা আর আমার মায়ের মধ্যে রেষারেষি ছিল কার মেয়ের বিয়ে আগে হবে। তাই তোর মা ভেতরে ভেতরে তোর বিয়ের চেষ্টা করছিল। একটা মোটামুটি ভালো পাত্র পাওয়া মাত্র তোর বিয়ে দিয়েছিল। তুই বিয়েতে মত দেওয়াতে আমিও নিজেকে দোষ দিতাম, এই ঘটনাটার জন্য। এটা বোধহয় না করলেই পারতাম।”
“আমারও তাই মনে হয়, চিঠিটা বোধহয় আমাকে না পাঠালেই ভালো করতিস।”
দুজনেই আবার চুপচাপ। তাজমহলের রূপ পড়ন্ত আলোয় বদলাতে শুরু করেছে। দুজনেই তাজমহলের দিকে তাকিয়ে আছে, কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। বেয়ারটা বেশ কয়েকবার এসে ঘুরে গেছে। মেম সাহেবদের ঘাঁটাতে সাহস পায়নি। 
অঞ্জনা ঘটনাটাকে একটু লঘু করার চেষ্টা করল ”ধরে নে এটা রসিকতা, বয়স কম ছিল রাগের মাথায় করে ফেলেছি।”

“তুই এটাকে রসিকতা বলছিস?”
“কেন এসব ব্যাপারে রাগের মাথায় মেয়েরা তো শুনেছি আরো অনেক খারাপ কিছু করে থাকে। তুই যখন ওখানে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর রোহিতকে না দেখে ফিরে এসে জ্বরে পড়লি তখন সত্যি আমার ভীষণ খারাপ লেগেছিল। যদি তোর কিছু হত, তাহলে নিজেকে কোনদিন ক্ষমা করতে পারতাম না।” চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে কাপটা টেবিলের নামিয়ে রাখল অঞ্জনা। 
বাণী অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে গলাটাকে নামিয়ে বলল “রোহিত এসেছিল। গার্ডকে পয়সা খাইয়ে আমরা ভেতরেও ঢুকেছিলাম।“ 
“কি বললি? রোহিত এসেছিল, মিথ্যুক কোথাকা্র‌, রোহিত পয়সা খাইয়ে তোকে নিয়ে ভেতরে ঢুকেছিল? বাজে কথা বলার জায়গা পাসনি। ভালো হবে না কিন্তু বলে দিচ্ছি। আমি তোর সঙ্গে রসিকতা করেছি বলে, তুই তার শোধ  নিচ্ছিস?”
“হ্যাঁ এসেছিল রোহিত এসেছিল, রোহিত তো আসবেই-”
“রোহিত কেন আসবে? রোহিত আসতেই পারে না। রোহিত তো জানতোই না চিঠির ব্যাপারটা। আমি তো রোহিতকে চিঠির উত্তর পাঠাই নি। কোনদিন জানাই নি।”
“কিন্তু আমি পাঠিয়ে ছিলাম। চিঠিটা পাওয়ার পর রোহিতকে উত্তরও পাঠিয়েছিলাম, যে আমি আসবো। আমি দেখা করতে রাজি।”
“তুই ওকে উত্তর পাঠিয়েছিলি? আমি তো ভাবতেই পারছি না তুই কেন চিঠির উত্তর লিখলি?”

শাড়ির আঁচলটা বানী জড়িয়ে নিয়ে বলল “কেন পাঠাবো না? আমি তো ভেবেছি চিঠিটা রোহিত আমাকে লিখেছে।
রনে ভঙ্গ দেওয়ার সুরে বানী গলা নিচু করে বলল “যাক যা হওয়ার তা হয়ে গেছে, কিন্তু এখন তোর জন্য আমার দুঃখ হচ্ছে।“ বাণী উঠে দাঁড়ালো ঘরে যাওয়ার জন্য। 
“কেন আমার জন্য তোর দুঃখ হচ্ছে কেন? বুঝতে পারলাম না তো?” আঞ্জনার গলায় উৎকণ্ঠা।
“তার কারণ তুই যে ভেবেছিলি আমি ওখানে গিয়ে একা একা দাঁড়িয়ে থাকবো। রোহিত আসবে না। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে তারপর ফিরে আসবো, তা তো হয়নি, সেই জন্য।”
“ঠিক আছে ওটাতে হয়তো আমার হার হয়েছে। কিন্তু আমি যে রোহিতের সঙ্গে সুখে স্বাচ্ছন্দে এতগুলো বছর কাটালাম তার কথা ভাব। রোহিতের কাছ থেকে আমি সবকিছু পেয়েছি। রোহিতের স্পর্শ, রহিতের সংগ, রোহিতের ভালোবাসা। সবকিছু রোহিত আমাকে উজাড় করে দিয়েছে। আসলে তুই আমার কাছে হেরে গেছিস। তোর আমার উপর দুঃখ হচ্ছে, আর হাসাস না। তুই রোহিতকে এতদিন ধরে ভালবাসলি, কিন্তু কি পেয়েছিস তার বদলে? শুধু স্মৃতি?”
এক পা এগিয়ে এসে অঞ্জনার চোখে চোখ রেখে খুব চাপা গলায় বাণী বলল “আমি শুধু রহিতের স্মৃতিকেই পাইনি, আমি রাহিতকেও পেয়েছি।“
চেয়ারের ওপর রাখা শালটা তুলে নিয়ে শরীরে জড়িয়ে অঞ্জনাকে ফেলে রেখে, বাণী পা বাড়ালো নিজের ঘরের দিকে।

কৃতজ্ঞতা স্বিকারঃ একটি  বিদেশী গল্পের অনুকরণে লেখা

ভ্রমণ

গার্নার 

স্টেট পার্ক

কৃষ্ণতরু বর্মন

ডালাস, টেক্সাস 

গার্নার স্টেট পার্ক
3-frio-river_edited.jpg

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

garner-state-park_edited.jpg
garner8_edited.jpg

- ‘ল না কোথাও ঘুরে আসি, সোমবার তো ছুটি, লেবার ডে‘ ডিনার টেবিলে প্লেট সাজাতে সাজাতে বলেই ফেললাম। কয়েকদিন ধরেই মাথায় ঘুরছিল। সামনে বসে ছেলে কৌস্তভ, ওরফে সনু। বলা মাত্রই লুফে নিল,
- ‘কোথায় ড্যাডি? আর উই গোইং সামহোয়্যার? দু-চোখের পাতা জুড়ে এক অদ্ভুত কৌতূহল। 
- ‘ওরে বাবা দাঁড়া, উঠলো বাই তো কটক যাই! এখনো কিছুই ঠিক করিনি’। 
দায়সারা গোছের একটা জবাব দিয়ে যার উদ্দেশ্যে এই মন্তব্য তার জবাবের অপেক্ষায় রইলাম। কিন্তু প্রশ্ন হল এই দু-তিনদিনের ছুটিতে যাই বা আর কোথায়। বিমানে আর চাপছি না, কারণ দূরে যাওয়ার তেমন কোন পরিকল্পনা নেই। আর কাছাকাছি বলতে ওই স্যান অ্যাান্টনিও, অস্টিন-হিউস্টন হয়ে গ্যালভেস্টনের গালফ অফ মেস্কিকো কিম্বা দক্ষিণ পশ্চিমে বিগ বেন্ড ন্যাশেনাল পার্ক, আর ফেরার পথে এল পাসো, তাও সে তো অনেক দূর। তাছাড়া করপাস ক্রিস্টি আট ঘন্টার ড্রাইভ। আর দু-একটা জায়গা আছে তাও হাতে গোনা। ওকলাহোমা বা আর্কান্সাসের দিকেও যাওয়া যেতে পারে, কিন্তু সেখানেও ওই শহরের ভীড় বাদ দিলে সেই তো জংগল, পাহাড়, লেকে ঘেরা কিছু কিছু অচেনা টুরিষ্ট স্পট। তাহলে যাই কোথায়… এ তো আর পশ্চিমের বে এরিয়া নয়, যে হাজারটা যাওয়ার জায়গা … চুপচাপ খেতে খেতে প্ল্যানটা ভাঁজছিলাম। 
- ‘একটু কোথাও যেতে পারলে তো ভালই হয়, সনুরও ভাল লাগত, কিন্তু যাবে কোথায়? নতুন কোন ভালো জায়গা যদি থাকে তো বলো’ - মিক্স ভেজিট্যাবেলের প্লেট থেকে এক চামচে গালে পুরে স্বাতী বলে উঠল। তা ঠিক - একটু অচেনা, কোন এক নতুন জায়গাতে যাওয়া যেতেই পারে। আর তাছাড়া এই সময় সব নামী টুরিষ্ট স্পটেই অসম্ভব ভীড়। 


 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

শুক্রবারের বিকেল। শহরের বুকে অসম্ভব ট্র্যাফিক। বিশেষ করে লম্বা ছুটির আগে সবাই যেন শহর ছেড়ে পালাতে ব্যস্ত। অবশ্য তারও ব্যতিক্রমও আছে। হাইওয়ে আই-টুয়েন্টিতে পড়ার আগে সামান্যই ভিড় নজরে পড়ল। তার মানে ভিড়টা অন্যদিকে। কয়েক সপ্তাহ আগেই হিউস্টনে এক বন্ধুর বাড়িতে যাওয়ার সময় ডালাস ডাউনটাউন পার হতেই প্রায় দেড় ঘন্টা। অফিস থেকে ফিরেই হুড়মুড় করে বেড়িয়ে পড়েছি। ডালাস থেকে মোটামুটি ঘন্টা পাঁচেকের পথ। চলেছি গার্নার স্টেট পার্ক। প্রায় তিনশ মাইল দক্ষিণে। টেক্সাস হিল কাউন্টির মধ্যে ইউভাল্ডি এলাকার খুব ছোট শহর কনক্যান। আর এই নির্জন কনক্যানের একেবারে দক্ষিণে এই পার্ক। হাইওয়ে আই টুয়েন্টি ছাড়াতেই হাতের কাছেই তিনশ সাতাত্তর সাউথ, ওয়ান ওয়ে লেন, নির্জন রাস্তা। পথে পড়ল গ্রানবেরি (লোকসংখ্যা ৮,৭০০), স্টেপেনভিল (লোকসংখ্যা ১৮,০০০), কোমাঞ্চে (লোকসংখ্যা ৪,০০০), ব্রাউনউড (লোকসংখ্যা ১৯,০০০), ব্রাডির (লোকসংখ্যা ৫,৫০০) মত সব ছোট ছোট অচেনা নির্জন শহর, পেরিয়ে যেতেই আবার অন্ধকার, নিস্তব্ধতা। ব্রাডির কাছে একটা রাস্তার ধারের এক মটেলে গুজরাটি ভাইএর কাছ থেকে রাতের অন্ধকারে জনশূণ্য রাস্তায় গাড়ি চালানোর ফ্রি টিপসও পাওয়া গেল। রাতের সমস্যা হল মধ্যপথে দাঁড়িয়ে থাকা হরিণের দল। যে কোন বাঁকের মুখেই বেশ বিপদজনক। তবে খুবই ভাগ্য ভাল যে ওরা বেশ কিছুটা নিরাপদ দূরত্ব থেকেই আমাদের হাই-হ্যালো জানালো। মূল গন্তব্যস্থলের প্রায় সত্তর মাইল আগেই একটা ছোট্ট শহর ‘জংশনে’ আমাদের রাত্রিবাস। ‘জংশন’ পাহাড় ঘেরা, বুক চিরে চলেছে পাহাড়ি নদী ‘লাওনো’। বড্ড নির্জন। লোকসংখ্যা আর কত হবে... মেরে কেটে হাজার আড়াই। রাস্তার অনেকটাই কান্ট্রি রোড অর্থাৎ কিনা গ্রাম্য পথ, ওয়ান ওয়ে লেন। আর চলেছি জনশূন্য জঙ্গলের ভিতর দিয়ে। 
- 'কি যাত্রাপথ কেমন লাগছে? বেশ রোমাঞ্চকর তাই না?’ বলাতে স্বাতীর তরফ থেকে একটু ‘হু’ ছাড়া আর কিছু শোনা গেল না। 
বেলাতেই ঘুম ভাঙল। একেবারে রিল্যাক্সড মুডে। তাড়াহুড়োর কিছু নেই। জানলার পর্দা সরাতেই দূরে পাহাড়। সামনে হাইওয়ে আই টেন। অদূরেই কিছু খাবার দোকান, গ্যাস স্টেশন আর ম্যাকডোনাল্ড। ব্যাস আর কি। হেভি ব্রেকফাষ্ট সেরে বেড়িয়ে পড়া গেল। গার্নার স্টেট পার্ক এখান থেকে এক ঘন্টার একটু বেশী। দূরে পাহাড়ের সারি। একটা অ্যানিম্যাল ফার্মও নজরে এল। সিনিক ভিউ। হাইওয়ে তিরাশি ধরে একটু দক্ষিণে এগিয়েই শহর ‘লিকি’। সনু বলে উঠল - ‘লিকি, বেশ মজার নাম তো।’ মাথার ওপর বেশ কিছু ফ্যাল্কনকে উড়তে দেখা গেল। শহরের নামে ওদের নাম লিকি ফ্যাল্কন। পথের ধারে কিছু পড়ে থাকা মরা ফ্যালকনের কথা বলতে বলতে লিকি ছাড়িয়েই কনক্যান। 
- ‘আমার জন্য একটা চিজ বার্গার, আর তুই কি খাবি’ সনুর দিকে তাকালাম। ও তখন ঝুঁকে পার্কের ম্যাপ দেখতে ব্যস্ত। একটু আগেই পার্কে ঢুকেছি। প্রবেশ পথে সেম ডে ভিজিটরদের আলাদা লাইন। ক্যাম্পিং এর জন্য আলাদা ব্যবস্থা। একটু এগিয়ে বাঁ দিকে প্যাভিলিয়ন। পাশেই একটা মোবাইল ফাষ্ট ফুড ভ্যান। চমৎকার ব্যবস্থাপনা। অর্ডার দিয়ে মিনিট পনেরোর মধ্যেই গরম গরম খাবার। এই পাহাড় জঙ্গলে আর কি চাই! সনুকে বললাম,  

5-frio-river-mountain.jpg

ফ্রায়ো নদী

প্রবেশ পথ

সবুজ পাহাড়ের কোলে ফ্রায়ো নদী

- ‘চল না, আগে লাঞ্চটা সেরে নি, তারপর ঘোরা যাবে। এখানে আলাদা করে কিন্তু কোন রেষ্টুরেন্ট নেই। যা খাবার এখানেই খেতে হবে।'

- 'আই থিঙ্ক দেয়ার ইজ এ ট্রেইল নিয়ারবাই’ - আঙ্গুলের ফাঁকের ফ্রেঞ্চ ফ্রাইটা ক্যাচ আপের কাপে ডুবিয়ে বলে উঠল সনু। 

- ‘ও ঠিকই বলেছে, আমারও তাই মনে হচ্ছে’ - স্বাতীর সায়। সামনেই ম্যাড্রোন ট্রেইল। পাশ দিয়ে প্রায় একশো ফুট নিচে বয়ে চলেছে ফ্রিয়ো নদী। সাড়ে তিনফুটি রাস্তা মিশে গেছে জঙ্গলে। কথা কানে যেতেই পাশের তরুণ বলে উঠল,
- ‘ইউ ক্যান সি কাপল অফ ট্রেইলস হিয়ার, ইফ ইউ লাইক ট্রেকিং, দিস ইজ দি প্লেস ম্যান’ - ম্যান জুড়ে দিয়ে একেবারে পারফেক্ট আমেরিক্যান স্টাইলে বলে আমাদের দিকে একটা হাসি ছুঁড়ে দিল। হ্যান্ডসাম তরুণ, ফুড স্টোরে কাজ করছে, বেশ ছটফটে গোছের।

পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ। দু-পাশে বল্ড সাইপ্রাশের সারি, এই গাছগুলি এখানে সর্বত্র। একটু আগেই ম্যাড্রোন ট্রেইল সেরে এসেছি। পাথুরে রাস্তার শেষ নদীর বুকে। এখানে স্রোত কম, আলগোছে রাবার টিউবে ভেসে চলেছে এক বয়স্ক আমেরিকান। দেখে হাত নাড়লেন। নিরুদ্বেগে ভেসে চলেছেন মাত্র তিন ডলারে ভাড়া করা টিউবে। আসেপাশের মধ্যেই কয়েকটা ট্রেইল। যেমন ক্রিস্টল কেভ, ব্রিজেস, ওল্ড বল্ডি, ওল্ড হর্স, ব্লিন রিভার আরো কয়েকটা। প্রথম তিনটি খুবই কঠিন, প্রচন্ড চড়াই। দুই হাঁটুর অসম্ভব জোর আর বুকের খাঁচায় দম থাকলে তবেই একমাত্র সম্ভব। ভ্রাম্যমাণ এক পুলিস অফিসারের সঙ্গে কথোপকথনের সময় জানলাম এই ট্রেইলগুলোতে অনেকেই মাঝপথ থেকে ফিরে আসেন। - ‘গো অ্যাট ইয়োর ওন রিক্স’ বলে বাজাজী চোখ টিপে কেটে পড়লেন। এ তো মহা জ্বালা, কোথায় বাবা সাহস দিবি, তা না?  যত্তসব’। বউকে বললাম, 
- ‘ছাড়ো তো, ওদের কথা।’  দিব্বি সেরে এলাম, তবে পুলিশ বাবাজী খারাপ কিছু বলেন নি। বেশ চড়াই ও অত্যন্ত কষ্টকর। 
জল দেখলেই নামার জন্য যেমন সব বাচ্চারা ঘ্যান ঘ্যান করে, আমার পুত্রটিও তার ব্যতিক্রম নয়। - ‘ড্যাডি, লেটস গো ফর সুইমিং"। আসা থেকে ওর ধান্দা জলে নামা। তাতে মায়েরও অসম্ভব প্রশ্রয় আছে। 
- ‘একটু নামুক না, কি হয়েছে কি, আমি তো আছি’। অগত্য ওল্ড বোল্ড মাউন্টইনের দিকে গাড়ি ঘোরালাম। আঁকাবাঁকা পথ শেষ হল উঁচু পাহাড়ের কোলে। আর এই কোল দিয়ে বয়ে চলেছে দুষ্টু মিষ্টি ‘ফ্রিয়ো’ নদী। পার্কিং লটে গাড়ির ভীড়। সামনে একটা ছোট্ট ড্যাম। নদীর বুকে সবাই নেমে পড়েছে। কেউ ভাসছেন রাবার টিউবে, কেউ বা প্যাডেল বোটে আবার কেউ বা পাতি হাতপা ছুঁড়ে সাঁতার। পাড়ে বিশাল বিশাল বল্ড সাইপ্রাসের সারি। জলে তারই প্রতিচ্ছবি। দূরে পাহাড়, বর্ণময় প্রকৃতির সাজ। সবুজ মাঠে নানা রঙের ক্যাম্পিং টেন্ট। বোঝা গেল পার্কের এটাই সবচেয়ে জনপ্রিয় স্পট। হামলে পড়ে প্রকৃতির আদর খেতে খেতে পাহাড়ের কোলে সবুজ আঁচলে রাত্রি যাপন। বেশ ভীড় এই ক্যাম্পিং গ্রাউন্ডে। হঠাৎ দেখি সঙ্গীরা নেই, খোঁজ পেলাম নদীর বুকে। বাবু ঝপাং ঝপাং করছেন। লোভ হল, একটু পরে আমিও। তবে জল বেশ ঠান্ডা, কেটে পড়লাম তাড়াতাড়ি। 
একদিনের ঝটিকা সফরে তো আর সব হয় না। তবুও তারই মধ্যে দুটো একটা ট্রেইলএ যেতেই পারি, ব্যাস উঠলো বাই তো কটক যাই। আর কটক গিয়েই দম শেষ। উঁচু নিচু পাথুরে রাস্তায় হাঁটু দুটির দফা রফা। ভীড় কাটিয়ে কোন রকমে প্যাভিলিয়নের নিরিবিলিতে এসে একটু বসলাম। আলাপ হল গিফট সপের এক কর্মী লিন্ডার সঙ্গে। বহু বছর কাজ করছেন। কথায় কথায় জানালেন ১৯৪১ সালে জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া এই পার্কের নামকরণ হয়েছে আমেরিকার প্রাক্তন ভাইস প্রেসিডেন্ট জন ন্যান্স গার্নার এর নামে, যিনি এই অঞ্চলেরই বাসিন্দা ছিলেন। কোথা থেকে আসছি শুনে হেসে বললেন,
- ‘আমি বাপু এই পাহাড় জংগলে ভালই আছি। তোমার ঐ শহরের ভীড় আর ঝুট ঝামেলা থেকে অনেক দূরে’। আজই ফিরছি শুনে চোখ টিপে বললেন, 
- ‘পারলে আর একটু থেকে যাও ভায়া, রাত সাড়ে আটটা নাগাদ এই প্রাঙ্গণেই নাচ গানের অনুষ্ঠান। এই রকম খোলা আকাশের নিচে এ রকম নাচ গানের সুযোগ আর পাবে না কিন্তু এই বলে দিলুম।'
এই নাচ গানের ব্যাপারটা এখানে নতুন না, বহু বছর ধরেই এটা চলে আসছে, এটাই ট্রাডিশন। গাছের ডালে কয়েকটা গোল্ডেন চিকড ওয়াব্লার পাখি খেলে বেড়াচ্ছে, গলার কাছে হলুদ। এটা বোধহয় ওদের নাচের প্রস্তুতি।  
ফেরার পথে ‘কি রে সনু, কেমন লাগল রে তোর…‘ জিজ্ঞাসা করাতে - ‘ভালই …তবে’ বলে চেপে গেল। ব্যাপারটা কি!!  জলে এত লম্পঝম্প যার তার মুখে বাক্কি নেই কেন? পরে বুঝলাম যে ওনার আর একটু জলের থাকার ইচ্ছা ছিল। সেটা আর কার না থাকে বিশেষ করে এই বয়েসে। সে যাই হোক ফ্রিয়োকে অনেক পিছনে ফেলে এলেও, সঙ্গে করে কুড়িয়ে নিয়ে এলাম কিছু স্মৃতির নুড়ি-পাথর আর স্বচ্ছ জলের ছলাৎ ছলাৎ ঢেউয়ের কলতান। 

Crystal Cave Trail.jpg

ক্রিস্টাল ট্রেইল

2-frio-river.jpg

্ফ্রায়ো নদী

garner4_edited.jpg

ছোট্ট ড্যাম

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

ভয়ংকর সুন্দর

কিলিমাঞ্জারো

ভ্রমণ অভিজ্ঞতা - অরিন্দম রায় 

অনুলিখন - কৃষ্ণতরু বর্মন

ডালাস, টেক্সাস 

 

ভ্রমণ

25-peak1.jpg
ভয়ংকর সুন্দর কিলিমাঞ্জারো

- ‘ও তাই নাকি, কবে যাবি? ভাল করে খোজঁ খবর নিয়ে যাস' - বৈঠকখানার সোফাতে চারমূর্তিতে আড্ডা চলছে। তারই মাঝে ফিস ফ্রাইতে কামড় মেরে বলে উঠল চাঁদু। মোবাইল ফোনে ডুবে থাকা সাগু মুখ তুলে অবাক চোখে বলল - 'কোথায় যাবি রে কেতু, বুঝলাম না তো'। যথারীতি আমিও তখন ফিস ফ্রাইতে ডুবে। সবে কিচেনে গেছি সস খুঁজতে, হুড়মুড় করে এসে হাজির হলাম অরিন্দমের মুখেই ওর কিলিমাঞ্জারোর বেড়ানোর পরিকল্পনা শুনতে। 
সুত্রপাত এখানেই। বহুদিনের একটা সুপ্ত বাসনার শুরুটা যে এভাবেই ঘটবে ও হয়ত আগে কখনো ভাবে নি। নানা হাবিজাবি ভাবনা আমাদের মনে অগোচরে উঁকি মারলেও, বাস্তবায়িত হয় আর কটা। নির্মম পরিহাসে মনের অতলে তলিয়ে থাকা স্বপ্নের আঁকিবুঁকিগুলো সময়ের ঢেউএ মুছে যায়। তবে তারও ব্যাতিক্রমও আছে। যেমনটি আজ ঘটলো ওর ক্ষেত্রে। কাল্পনিক হলেও আমিও চললাম ওর পাশাপাশি দোসর হয়ে এই অভিযানে।  

টার্কিস এয়ারলাইন্সের ফাইট যখন কিলিমাঞ্জারোর এয়ারপোর্টের মাটি ছুল, তখন প্রায় রাত দেড়টা। বাইরে জমাট অন্ধকার। আসেপাশে জোনাকির মত নিভু নিভু কিছু আলো। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে নানা টানাপোড়েন, ই-ভিসার অনিশ্চয়তা, ট্রেকিংএর প্রস্তুতি সংক্রান্ত হাজার সংশয় পার হয়ে আজ এসে পৌছঁলাম। স্বভাবতই মেজাজও বেশ ফুরফুরে। তবে সময়ের মধ্যে ই-ভিসাটা না পেলে খুবই মুস্কিলে পড়তাম। 
কিলিমাঞ্জারো খুব শান্ত এক নির্জন এয়ারপোর্ট। তবে সিজনে ভীড় লেগেই থাকে। প্রতি বছর প্রায় তিরিশ থেকে পঞ্চাশ হাজার মানুষ কিলিমাঞ্জারোতে আসেন, যাদের মধ্যে বেশিরভাগই আসেন গ্রীষ্মকালে। 

১৩ই জুন ডালাস থেকে রাতের ফ্লাইটে ইন্তানবুল হয়ে তাঞ্জানিয়ার এই বিখ্যাত টুরিষ্ট স্পটের মাটি ছুঁতে লেগে গেল পাক্কা ২১ ঘন্টা। এয়ারপোর্টের বাইরে সাটেল ধরে মাইল ছয়েকের মধ্যেই এয়ারপোর্ট প্ল্যানেট লজে পৌছে গেলাম। কিন্তু সমস্যা হল আমার লাগেজ পাওয়া যাচ্ছে না। কি বিপদ! শারীরিক ক্লান্তির থেকেও এই লাগেজের চিন্তায় আমার রাতের ঘুম মাথায় উঠল। খোঁজ নিয়ে জানালাম ইস্তানবুল এয়ারপোর্টেই আমার লাগেজ প্লেনে তোলাই হয় নি। কাল পাঠিয়ে দেবে বলছে ঠিকই, কিন্তু যতক্ষণ না হাতে পাই একটা চিন্তা থেকেই যায়। একটা বিকল্প ব্যবস্থার কথা মাথায় রেখেই কিলিমাঞ্জোর কোলে মাথা রেখে দুঃচিন্তার ঘুম। 

Kili-1-Africa-FD1.jpg

এয়ারপোর্ট প্লানেট লজে ফাদার্স ডে উদযাপন 

03-KNP_edited.jpg

কিলিমাঞ্জারো ন্যাশেনাল পার্কে সামনে আমরা 

পরেরদিন বেলা এগারোটা নাগাদ জি অ্যাডভেঞ্চারের লোকজন হই হই করে এসে হাজির। কানাডার নামী ট্যুর কম্পানী 'জি অ্যাডভেঞ্চার'। আমাদের ডেজিগনেটেড গাইড ও তার সাঙ্গপাঙ্গ। বিশ্বজুড়ে ওদের সার্ভিস। ট্রেকিংএর যাবতীয় পরিকল্পনা, থাকা-খাওয়া সব কিছুর দায়িত্বই ওদের হাতে। ব্যবস্থাপনার মধ্যে প্রফেশানালিজম এর ছাপ বেশ স্পষ্ট। গুগুল রেভিউ অত্যন্ত ভাল। হাই, হ্যালো, পরিচয় পর্ব মেটার পর মালপত্তর নিয়ে সোজা ট্যুর বাসে। গন্তব্য উইরুউইরু রয়্যাল রিসর্ট। ওখানেই রাত্রিবাস। আজ আবার ফাদার্স ডে। রাতের দিকে নাকি  স্পেশাল ফাদার্স-ডে পার্টিও আছে। দেখাই যাক না কি হয়! তাঞ্জানিয়ার বুকে কিলিমাঞ্জোরর কোলে আমার এই প্রথম ফাদার্স ডে সেলিব্রেশন! এ এক নতুন অভিজ্ঞতা! 
উইরুউইরু রয়্যাল রিসর্ট কিন্তু ভারী সুন্দর। পিছন দিকে কিলিমাঞ্জারোর অসাধারণ দৃশ্য। কাছেই শান্ত নদী উইরুউইরুর তিরতির করে বয়ে চলার কলতান। খুব ছিমছাম, সাজানো গোছানো পরিবেশে অতিথিদের থাকার জন্য প্রায় বত্রিশটি শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত ঘরের সুবন্দোবস্থ। আভিজাত্যের ছাপ সর্বত্র। এই রিসর্ট শুধু যে থাকার জায়গা তা নয়, এটিকে বলা হয় আফ্রিকার কেন্দ্রস্থলের প্রবেশদ্বার। আর ভ্রমণার্থীরা ইচ্ছে করলেই জায়গাটা ঘুরে দেখে নিতে পারেন। লজ থেকেই সব ব্যবস্থা করা যায়। আসেপাশে ঘুরে বেড়ানোর মধ্যে কফি প্লান্টেশন ট্যুর, উইরুউইরু এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের মধ্যে দিয়ে সাইকেলে ভ্রমণ, মারাঙ্গু কালচারাল ট্যুর সবই আছে। কিছুটা দুরেই কিলিমাঞ্জারোর পাদদেশে সবুজ ঘন জঙ্গলের মধ্যে প্রায় একশো ফুট উচু মাটারুনি ফলস ঘুরে আসাই যায় একইসঙ্গে। 

পরদিন সকাল সকাল লাগেজ এসে গেল। ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। ব্রেকফাষ্ট সেরে বেড়িয়ে পড়লাম । সাত জনের ছোট্ট একটা দল। ফোর্টওয়ার্থ থেকে কায়েল, তার বন্ধু হেকটর আর হেকটরের ছেলে কেলাব। ফ্লোরিডা থেকে উড়ে এসেছে তরুনী গিলিয়ান, কানাডা থেকে ডাঙ্কান আর পেট্রিক। আলাপ পর্ব শেষ। গাইডের ইশারাতে যাত্রা শুরু। সঙ্গে সামগ্রী বলতে স্লিপিং ব্যাগ, এক্সট্রা জ্যাকেট, কয়েকটা প্রটিন বার আর সব টুকিটাকি কিছু দরকারী জিনিষ। জয় মা দূর্গা বলে বেড়িয়ে পড়লাম।

13-Horombo-hut.jpg

হোরোম্বো হাট

14-Horombo-hut-group.jpg

হোরোম্বো হাট

15-Horombo to Kibo.jpg

কিবোর পথে

কিলিমাঞ্জারো ন্যাশেনাল পার্ক তানজানিয়ার কিলিমাঞ্জারো অঞ্চলে নিরক্ষরেখা থেকে ১৯০ মাইল দক্ষিণে প্রায় ১,৬৮৮ বর্গ কিলোমিটার (৬৫২ বর্গ মাইল) এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। ১৯৮৭ সালে ইউনেস্কো এটিকে বিশ্বের অন্যতম একটি ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসাবে ঘোষণা করে। মান্দার হাটে থাকার ব্যবস্থা কিন্তু খুবই সুন্দর এবং পরিপাটি। এখানে পৌঁছেই ওয়াসি ওয়াসির দু মগ জলেই কোন রকমে তোয়ালে ভিজিয়ে গা হাত পা একটু মুছে নিলাম। ডিনারের পর সারাদিনের ক্লান্তি জোর করেই ঘাড় ধরে বাঙ্কের বেডে শুইয়ে দিল। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই চোখের পাতা জুড়ে প্রশান্তির ঘুম। 

বেস ক্যাম্প কিবো হাটের পথে 

20- To Kibo Base Camp.jpg
18-Horombo To Kibo-cloud2.jpg
23-Kibo-hut1.jpg

সকাল সকাল ঘুম ভাঙ্গলো। গরম কফিতে চুমুক, সঙ্গে মুচমুচে টোস্ট আর স্ক্রাম্বেল এগ। আহা! আর কি চাই! চটপট তৈরী হয়ে নিলাম। আজ যাচ্ছি হোরোম্বো হাট। মান্দারা হাট থেকে হোরোম্বো হাটের দুরত্ব প্রায় ১১ কিমি। ট্রেকিং এ সময় লাগে ছয় থেকে সাত ঘন্টা। সবাইকে জড়ো করে গাইড বাবাজী ছোট্ট একটা টিপস দিয়েই 'পো লো পো লো' বলে হাঁটা শুরু করে দিল। আমরা সবাই পিছু পিছু। বেশ কিছুটা হাটারঁ পর মুরল্যান্ড জোনে পৌঁছোলাম। এটি একটি পাথুরে ভূখণ্ড যেখানে গাছপালা আর তেমন একটা নেই। পরিবর্তে, পাথরগুলি শ্যাওলা এবং শৈবাল দ্বারা আবৃত। এই অঞ্চলের উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪,০০০ থেকে ৫,০০০ মিটার (১৩,১২৩ থেকে ১৬,৪০৪ ফুট) পর্যন্ত। ১৪,০০০ ফুট উচ্চতায় গাছপালা বলতে বিশাল লোবেলিয়া। সামনে মাইলের পর মাইল তৃণভূমি, ঝোপঝাড় এবং চিরন্তন বন্যফুলে ঢাকা। সবুজ পিট শ্যাওলা দিয়ে বেষ্টিত কিছু কিছু ছোট স্ট্রিমও চোখে পড়ল। সকালের কুয়াশার মধ্য দিয়ে হাঁটতে হাটতে ক্যান্ডেলাব্রা আকৃতির গ্রাউন্ডসেল দেখতে পাওয়া যায়। বৈজ্ঞানিকভাবে ডেনড্রোসেনেসিও কিলিমাঞ্জারি নামে পরিচিত এই জায়ান্ট গ্রাউন্ডসেল হল প্রাগৈতিহাসিক উদ্ভিদ যা তানজানিয়ার কিলিমাঞ্জারো পর্বতের চূড়ায় পাওয়া যায়। তারা দশ লক্ষ বছর আগে ১৪,০০০ ফুটের বেশি উচ্চতার অঞ্চলে জন্মাত। যেখানে তারা শূন্যের নিচে তাপমাত্রায় বেঁচে থাকতে পারতো। বেশ কিছুটা আগেই আমরা রেইন ফরেষ্ট শেষ করে আলপাইন মরুভূমি অঞ্চলের মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলেছি। হোরোম্বো হাটে (৩৭২০ মিটার, ১২২০৫ ফুট) পৌছলাম বিকেলের দিকে। তারপর একটু সাইট সিয়িং সেরেই লম্বা ঘুম। কাল আমাদের চতুর্থ দিনের ট্রেকিং।  

kili-lobelia_edited.jpg

লোবেলিয়া

kili-groundsel-kilimanjaro_edited.jpg

গ্রাউন্ডসেল

kili-chat-bird_edited.jpg

চ্যাট পাখী 

kili-Lammergeier_edited.jpg

ল্যামারজিয়ার

kili-Rock_hyrax_edited.jpg

রক হাইরাক্স

05-Marangu.jpg

মারাঙ্গু গেট

10-Dinner-Mandara-Hut.jpg

কার্ব-প্রোটিনে সমৃদ্ধ লাঞ্চ-ডিনার 

06-Rain-Forest.jpg

রেইন ফরেষ্টের মধ্যে দিয়ে

kili-4-_edited.jpg

যাত্রা শুরু

07-Rain-Forest.jpg

রেইন ফরেষ্টের মধ্যে দিয়ে

09-Washy-Washy.jpg

ওয়াসি ওয়াসি 

​ইউরুইউরু রিসর্ট থেকে যাচ্ছি কাছেই আর একটি শহর মোশিতে। মাত্র ১১ কিমি পথ যেতে লাগে মিনিট কুড়ি। মাউন্ট কিলিমাঞ্জারোর নিম্ন ঢালে এই অপূর্ব সুন্দর মোশি শহর হল উত্তর-পূর্ব তানজানিয়ার কিলিমাঞ্জারো অঞ্চলের রাজধানী। এর জনসংখ্যা প্রায় ২২১ হাজার। মোশি নামটির অর্থ হল পর্বত থেকে নির্গত ধোঁয়া। প্রায় ৫৯ বর্গকিলোমিটার (২৩ বর্গ মাইল) জুড়ে বিস্তৃত মোশি তানজানিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র। কাছাকাছি পর্যটন কেন্দ্রগুলির মধ্যে রয়েছে কিলিমাঞ্জারো ন্যাশেনাল পার্ক, মকোমাজি ন্যাশেনাল পার্ক। এছাড়াও রয়েছে লেক জিপে, লেক চালার পাশাপাশি বেশ কয়েকটি জলপ্রপাত, প্রাকৃতিক ঝর্ণা এবং রেইন ফরেস্ট। এই মোশি থেকেই টুরিষ্টরা সেরেঙ্গেটি ন্যাশেনাল পার্ক, এনগোরোঙ্গোরো সংরক্ষণ এলাকা, আরুশা ন্যাশেনাল পার্ক, লেক মানিয়ারা ন্যাশেনাল পার্ক এবং তারাঙ্গিরে ন্যাশেনাল পার্কএর মতো অন্যান্য জায়গাতে দিব্বি ঘুরেও আসা যায়। মোশিতে আজ তেমন কিছু করার নেই। কাজেই ডিনার শেষে লম্বা ঘুম।  

পরদিন সকাল নটা নাগাদ জি অ্যাডভেঞ্চারের গাড়িতে চললাম মারাঙ্গু গেট। ৩৯ কিমি পথ যেতে সাধারণত সময় লাগে মিনিট পয়তাল্লিশ। মারাঙ্গু কিলিমাঞ্জারো পর্বতের পাদদেশে ১৩০০ মিটার উচ্চতায় (৪,৩০০ ফুট) ছবির মত সুন্দর একটি ছোট্ট গ্রাম। এই গ্রামের বুকেই চাগ্গা প্রজাতীর মানুষের বাস। প্রকৃতির সঙ্গে চাগগাদের নিজস্ব ঐতিহ্যের এক অনাবিল মেলবন্ধন ঘটেছে এই গ্রামের বুকেই। চারিপাশে সবুজ ঘন জঙ্গল, দু-পা দুরেই মারাংগু জলপ্রপাত। চাগ্গা জাদুঘরেও ঢুঁ মেরে আসা যায় যদি ওদের ইতিহাসে ডুব মারার ইচ্ছা ও সময় দুটোই থাকে। রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার স্বাদও মেলে সহজেই যদি সামান্য হেঁটে ভূগর্ভস্থ গুহাগুলিতে উঁকি দেওয়া যায়। পাশেই স্থানীয় কফির ফার্ম। কফি শিল্পের পিঠস্থান। দেখে আসতে ভুলবেন না কিন্তু।

08-Mandara-hut.jpg

মান্দারা হাট

11-Mandara to Horombo1.jpg

হারাম্বো হাটে উদ্দ্যেশ্যে

12-Mandara to Horombo2.jpg

হারাম্বো হাটে উদ্দ্যেশ্যে

মারাঙ্গু গেটকে মাউন্ট কিলিমাঞ্জারোর অ্যাক্সেস পয়েন্ট হিসাবেই ধরা হয়। তার কারণ হল, এখান থেকেই সবচেয়ে জনপ্রিয় মারাঙ্গু ট্রেইল শুরু। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা ১,৯৭০ মিটার ( ৬,৪৬৩ ফুট)। কিলিমাঞ্জারোতে উঠার সময় মাচামে গেট দিয়ে উঠতে হয় আর ফেরার পথে পড়ে মারাঙ্গু গেট। প্রসঙ্গত বলে রাখি যে, মারাঙ্গু গেটটি বৃহত্তম এবং মাউন্ট কিলিমাঞ্জারোতে সবচেয়ে ব্যস্ততম পথগুলির মধ্যে একটি। মারাঙ্গু ট্রেইল পর্বতারোহীদের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় একটি হাইকিং ট্রেইল। বিভিন্ন ফরমালিটিস সামলে মাচান গেট পৌঁছতে পৌঁছতেই বেলা দেড়টা। এখান থেকেই আমাদের মূল ট্রেকিং শুরু হবে। আকাশে হালকা মেঘের ঘনঘটা। বাতাসে ঝুরো মেঘের মিষ্টি সোহাগ। সব কিছুতে আর একবার চোখ বুলিয়েই বেড়তে বেড়তেই বেলা দুটো।

গন্তব্যস্থল 'মান্দারা হাট'। গেটে রেজিস্ট্রেশনের পর মান্দারা হাটে পৌঁছতে মোটামুটি ঘন্টা চার-পাঁচেক লাগে। দুরত্ব ৮ কিমি। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মান্দারা হাটের উচ্চতা ২,৭২০ মিটার (৮,৯২৩ ফুট)। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলে যে, কিলিমাঞ্জারো পর্বতের এই অংশটা রেইন ফরেস্ট এর অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় ট্রেকিংএর সময় বিকেলের দিকে হালকা বৃষ্টিপাতের একটা সম্ভাবনা থাকে। আমাদের ক্ষেত্রেও কিন্তু তার ব্যাতিক্রম ঘটে নি। ঝুরো হালকা বৃষ্টির সঙ্গে পায়ের তলার ভিজে জংলা পাথুরে মাটির এক মেলবন্ধন ঘটেছে। খুবই সাবধানে চলা বাঞ্ছনীয়। এই বৃষ্টিভেজা ঘন ভেজিটেশন জোন মন্টেন ফরেষ্টের পথে চলার অভিজ্ঞতাও কিন্তু কম রোমাঞ্চকর নয়। আধো আলো অন্ধকারে চারদিক বেশ রহস্যজনক। টুরিষ্ট গাইড সোয়াহিলি ভাষায় সমানে বলে চলেছে 'পো লে... পো লে..." যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায় 'ধীরে ধীরে'। তাঞ্জানিয়ার অধিবাসীরা সোয়াহিলি ভাষাতেই কথা বলে। এই 'পো লে পো লে' নীতিতে অবশ্য আমাদেরই লাভ কারণ এই অচেনা অজানা পরিবেশে আবহাওয়া ও উচ্চতার সঙ্গে নিজেদের একটু মানিয়ে নেবার সময় হাতে থাকে। বন্যপ্রানী বলতে এখানে ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট কোলোবাস বানর জাতীয় প্রাণী আর ব্লু ভেলভেট নামে সুন্দর দেখতে এক ধরনের পাখী। আরো কয়েক ধরনের প্রজাতীর পাখীরও খোজঁ মেলে এই রেইনফরেষ্টে। ইউক্যালিপ্টাসের জঙ্গল পেরিয়ে হাঁটিহাঁটি পায়ে পৌছে গেলাম মান্দারা হাটের যাত্রীনিবাসে। পথে পড়ল মান্দারা হাট ক্যাম্প সাইটের কাছেই পাহাড়ে ঢালে এক বিলুপ্তপ্রায় মাউন্ডি ক্রেটার। যার সৃষ্টি হয়েছিল কিলিমাঞ্জারোর ভলকানিক আক্টিভিটিস থেকে। এখান থেকে উত্তর তাঞ্জানিয়া ও কেনিয়া সহ আশেপাশের কিছু এলাকা সহজেই নজরে পড়ে। 

- 'কি কেমন লাগছে ভায়া! সবে তো শুরু! এখনি দাঁড়িয়ে পড়লে চলবে? - প্যাট্রিকের ঠোঁটের কোনে মৃদু হাসি। পিছনে গালিয়ান। বছর তেইশের যুবতী, ফ্লোরিডা থেকে একাই চলে এসেছে এই অ্যাডভেঞ্চারের নেশায়। জি অ্যাডভেঞ্চারের সদস্যদের কাঁধে আমাদের লাগেজ। টুকটাক কথাবার্তার মধ্যেই চলছে আমাদের 'পো লো পো লো' গতিতে চলা। আমাদের সাতজন পর্বতআরোহীর তদারকির জন্য প্রায় জনা পনেরো লোকের ব্যবস্থা। গাইড সহ লাগেজ বইবার ও রান্নার জন্য আলাদা লোক। ওরা আমাদের অনেক আগেই ক্যাম্পে পৌছেঁ গিয়ে সবার জন্য লাঞ্চ বা ডিনার তৈরী করে রাখে।   

17-Horombo to Kibo-cloud1.jpg

কিবোর পথে, মেঘেরা নিচে

চতুর্থ দিনে সকাল সাতটা নাগাদ বেস ক্যাম্প কিবো এর উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। এগিয়ে চলেছি লক্ষ্যের খুব কাছাকাছি। স্বভাবতইঃ পথের ক্লান্তি ছাপিয়ে সকলের চোখে মুখে একটা চাপা উত্তেজনা।  বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ এতটাই কম যে অনেককেই বারবার থামতে হচ্ছে। তবে না, অক্সিজেন নেবার মত প্রয়োজন বা সময় এখনো আসে নি।  

হোরোম্বো হাট থেকে কিবো বেস ক্যাম্প কিবো হাটের দুরত্ব ১০ কিমি। যেতে সময় লাগে ছয় থেকে আট ঘন্টার মত। উষ্ণভূমির মধ্য দিয়ে ধীরগতিতে ট্রেকিং করতে করতে ঢুকে পড়লাম আলপাইন মরুভূমিতে। এখানকার উচ্চতা ও পরিবেশের পরিবর্তনের ফলে পর্বতারোহীদের কাছে হাইকিং করা বেশ প্রতিকূল। একমাত্র উপায় হল হাঁটার গতি কমিয়ে ফেলে পরিবেশের সঙ্গে শরীরকে মানিয়ে নেওয়ার একটু সময় করে দেওয়া। চলেছি কিলিমাঞ্জারোর কিবো এবং মাওয়েঞ্জির চূড়ার মাঝখানে অবস্থিত একটি স্যাডেল বা উপত্যকার মধ্যে দিয়ে। এই অঞ্চলটির বেশিরভাগই অনুর্বর। হাঁটতে হাঁটতে পাথরের সাথে লেগে থাকা শ্যাওলা এবং লাইকেনের মতো শক্ত গাছপালা, ছোট গুল্ম এবং এমনকি প্রস্ফুটিত ফুল নজরে পড়ল। প্রতিকূল জলবায়ু সত্ত্বেও চ্যাট এবং ল্যামারজিয়ারের মতো পাখিরা এই পরিবেশের সাথে দিব্বি খাপ খাইয়ে নেয়। রক হাইরাক্সের মতো ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণীরা পাথুরে ভূখণ্ডে দিব্বি ঘুরে বেড়ায়। বেস ক্যাম্প কিবো হাটে পৌছতে পৌছতেই বেলা দুটো। এখানকার উচ্চতা ৪,৭২০ মিটার, প্রায় ১৫,৮৮৫ ফুট। ক্লান্তি, খিদে আর ঠান্ডায় প্রাণ ওষ্ঠাগত। এখন কয়েক ঘন্টা শুধুই বিশ্রাম। আবার হাঁটা শুরু হবে রাত বারোটার পর। চটজলদি ডিনার সেরে একটু গড়িয়ে নিলাম।। 

21-Kibo Base Camp.jpg
22-Kibo-hut.jpg
kili-sunrise.jpg

​কাটায় কাটায় রাত বারোটা। সবাই তৈরী। আর মাত্র ঘন্টা ছয়-সাতের হাইকিং, তার পরেই সামিট মানে কিলিমাঞ্জারোর চূড়াতে। বেশ এক্সাইটেড লাগছে। রাতের অন্ধকারে মাথায় হেড লাইট জ্বেলে আবার চলা শুরু। দুরত্ব ছয় কিমি। বেশ চড়াই। 

৫,৬৮১ মিটার (১৮,৮৮৫ ফুট) উচ্চতায় গিলম্যানস পয়েন্টে একটু দাঁড়ালাম। এই গিলম্যান্স হল বেস ক্যাম্প ছেড়ে যাওয়ার পর কিলিমাঞ্জারো পর্বতের শেষ তিনটি ক্যাম্পের মধ্যে একটি। এখান থেকেই কিলিমাঞ্জারোর আসল চূড়া উরুহু শৃঙ্গে ওঠার পথে 'স্টেলা পয়েন্ট' নামে আর একটা ক্যাম্প অতিক্রম করতে হয়। তারপর আসে সামিট অর্থাৎ উহুরু, আফ্রিকার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। গিলম্যানস পয়েন্টটি ক্রেটার রিমের একদম গা ঘেঁষে। শুধুমাত্র মারাঙ্গু, রোঙ্গাই এবং উত্তর সার্কিট রুটের পর্বতারোহীরা রাতে গিলম্যানস পয়েন্ট দিয়ে যাতায়াত করেন। কিবো থেকে রওনা হয়ে এখানে পৌছনোই এই হাইকিং এর সবচেয়ে প্রতিকূল পথ। চূড়ায় পৌঁছাতে লাগে প্রায় ৬ ঘন্টা থেকে ৮ ঘন্টা। পর্বতারোহীদের সবাই যে উরুহু শৃঙ্গে পৌছতে পারেন তা কিন্তু নয়। অনেককেই ক্লান্তি বা উচ্চতাজনিত অসুস্থতার জন্য এখান থেকে ফিরে আসতে হয়।  বলাবাহুল্য আমাদের সাত জনের মধ্যে চারজন শেষ পর্যন্ত উহুরু শৃঙ্গে এসে পৌছতে পেরেছি।   

গিলম্যান্সকে পিছনে ফেলে আবার চড়াই শুরু। কিছুটা আসার পর পৌছলাম স্টেলা পয়েন্ট এ। ৫,৭৫৬ মিটার উচ্চতায় স্টেলা পয়েন্টের নামকরণ হয়েছে স্টেলা লাথাম এর নামে, যিনি ১৯২৫ সালে সর্বপ্রথম এখানে এসে পৌছান। এই স্টেলা পয়েন্টই হল সর্বশেষ ক্যাম্প। এর পরই উহুরু শৃঙ্গ। 

কিবো হাট 

উহুরু শৃঙ্গ 

25-peak1.jpg
28-Peak4-glacier.jpg
27-Peak3.jpg
26-Peak2.jpg

সকাল সাড়ে সাতটা। আমরা উহুরু শৃঙ্গে এসে পৌছলাম। আমরা বলতে চারজন। বাকিদের শারীরিক অসুস্থতার কারণে ফিরে যেতে হয়েছে। চারদিক সূর্যালোকে ঝলমল করেছে। অসম্ভব ঠান্ডা। মেঘেরা অনেক নিচে। চারিদিক সাদা বরফে ঢাকা। বিশ্বাসই হচ্ছে না যে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫,৮৯৫ মিটার (১৯,৩৪১ ফুট) উচচতায় আফ্রিকার সর্বোচ্চ পর্বত শিখরে দাঁড়িয়ে। অদূরেই একটি হিমবাহ। ছবি তোলার ধুম পড়ে গেল। বুকের ছাতি চওড়া। মিশন সাক্সেসফুল। 

প্রতি বছর হাজার হাজার পর্বতারোহী যারা কিলিমাঞ্জারো পর্বতের  আরোহণের চেষ্টা করেন তাদের চূড়ান্ত গন্তব্যস্থল হল উহুরু শৃঙ্গ। জানা গেল পর্বতারোহীদের মধ্যে মাত্র ৪০% উরুহু চূড়ায় এসে পৌঁছাতে পারেন। 

উহুরু নামটি সোয়াহিলি ভাষায় উহুরু নামটির অর্থ হল 'স্বাধীনতা'। ১৯৬১ সালে যখন তানজানিয়ার অংশ টাঙ্গানিকা যুক্তরাজ্য থেকে স্বাধীনতা লাভ করে তখন এই স্থানটির নামকরণ করা হয়।

কিলিমাঞ্জারো সাতটি রুট রয়েছে - মারাঙ্গু রুট, মাচামে রুট, লেমোশো রুট, শিরা রুট, রোঙ্গাই রুট, নর্দার্ন সার্কিট এবং উম্বওয়ে। মারাঙ্গু, মাচামে এবং উম্বওয়ে রুটগুলি পাহাড়ের দক্ষিণ দিক থেকে আসে (মওয়েকা কেবল অবতরণের জন্য ব্যবহৃত হয়)। লেমোশো, শিরা এবং নর্দার্ন সার্কিট রুটগুলি পাহাড়ের পশ্চিম দিক থেকে আসে। রোঙ্গাই রুটটি উত্তর দিক থেকে আসে। এগুলির অসুবিধা ভিন্নভিন্ন। 

​​কিছুটা সময় কাটিয়ে দু চোখ ভরে উরুহুর অপরূপ সৌন্দর্য্যই উপভোগ করছিলাম। একটু পরেই উহুরুকে বিদায় জানাতে হবে। ফিরে যেতে হবে আবার এতটা পথ। এসেছিলাম শূণ্য হাতে, কিন্তু ফিরছি উহুরুর অসংখ্য স্মৃতি বিজরিত মূহুর্তগুলোকে দুটো হাতের মুঠোতে ভরে। বারবার পিছনে তাকাই, ইচ্ছে করছে না। হাজার হাজার মাইল দূরে আবার আমার জন্য এক কৃত্তিম যান্ত্রিক জীবন অপেক্ষা করছে।  আর একটু কি সময় থাকা যেত না? 

হঠাৎ একটা ছোট্ট ঝাঁকুনিতে ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। আমাদের ফ্লাইট ডালাসের মাটি ছূঁল। চেনা শহরে ফিরলাম কিছু অচেনা গল্প আর অভিজ্ঞতার ঝুলি নিয়ে। কাল থেকেই আবার মিশে যাবো সেই গতানুগতিক জীবনের বাঁধা ছকে। হাজার হাজার মাইল দূরে উরুহু তুষারাবৃত হয়ে অনাহুত হয়েই হয়ত পড়ে থাকবে শুধু স্মৃতির পাতায়। 

টার্নার ফলস

ভ্রমণ

অপরূপা 

টার্নার

কৃষ্ণতরু বর্মন

ডালাস, টেক্সাস 

TF-3.jpg

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

- 'কি ব্যাপার? কি করছো?' বিকেলের দিকে হঠাৎ সুব্রতর ফোন। সবেমাত্র একটা মিনি দিবানিদ্রা সেরে আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠবো উঠবো করছি, তো সুব্রত উঠিয়েই ছাড়লো। 
- 'হ্যাঁ বলো। আরে তেমন কিছুই না। ওই এক্টু দিবানিদ্রায় ব্যস্ত ছিলাম।' 
- 'ও তাই নাকি! ঘুম ভাঙ্গালাম না তো?' 
- 'একদমই না। উঠবো উঠবো করছিলাম। তা বলো, এই শ্রীমানকে হঠাৎ কি মনে করে?' 
- 'হ্যাঁ, শোন যে কারণে তোমাকে ফোন করা... '

শুরু হল আমাদের মুঠোফোনের আড্ডা। চলল বেশ কিছুক্ষণ। সব্রত, আমার খুবই পরিচিত বন্ধু-বান্ধবের মধ্যে একজন। বহু বছরের আলাপ। অনেক ভাঙা-গড়া, নানা অভিজ্ঞতার নীরব সাক্ষী। ডালাস এয়ারপোর্টের অদূরে রওনোকের বাসিন্দা। বহু বছর হয়ে গেল ওদেরও এই ডালাসের মাটিতে। সময় পেলেই বসে যাই, চলে নির্ভেজাল আড্ডা, গান। বেশী হিসাব করে কথা বলতে গেলে কোন আড্ডাই তার পরিপূর্ণতা পায় না। কথার পিঠে চেপে কথা নামে ঠিকই, কিন্তু সবগুলোই যে অত্যন্ত গুরুগম্ভীর বা প্রচন্ড বাস্তব্বাদী হতে হবে এমন কোন কথা নেই। বড্ড আর্টিফিসিয়াল, কর্পোরেট মোড়কে সাজানো হাসির আড্ডা তার নিজস্বতা হারায়। অন্তত ওর সঙ্গে খোলা মনে হালকা উদ্দামতা মিশিয়ে জমাটি আড্ডা মারা যায়।  
বেড়িয়ে পড়লাম। গন্তব্যস্থল টার্নার ফলস স্টেট পার্ক। ওকলাহোমার সবচেয়ে পুরোনো পার্ক। বিভার বেনড, রবার্স কেভ এমন কি রেড রক ক্যানিয়ন সবই এসেছে অনেক পরে। এটি ওকলাহোমার একটা ছোট্ট শহর ডেভিসএ অবস্থিত। এই টার্নার ফলসই হল ওকলাহোমার সবচেয়ে উচ্চতম। প্রায় ৭৭ ফুট উঁচু থেকে নেমে এসে একটা সুইমিং পুলে মিলে গিয়ে ছন্দে ছন্দে নেচে নেচে আর্বাকাল মাউন্টেইনের গহনে হারিয়ে গেছে। এই ফলস এর নামকরণ করা হয়েছিল টমাস টার্নারের নামে। তা এই টার্নারবাবু ১৮৭৮ সালে হানি ক্রিকের ধারে একটি কেবিনে তার স্ত্রীকে নিয়ে বসবাস শুরু করেন এবং এই ফলসটি আবিষ্কার করেন। ডেভিস শহরের কর্তপক্ষ ১৯২৫ সালে টার্নার পরিবারের কাছ থেকে পার্কের জন্য মাত্র সতেরো হাজার ডলার দিয়ে ৩৭০ একর জমি কিনেছিল। তারপর প্রায় এক শতক পেরিয়ে গেলেও এই শহরের জনসংখ্যা আজও বেশ নগন্য, হাজার তিনেকের কাছাকাছি। ধার করা এই জ্ঞান যাদের উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে মারলাম, পুরোটাই দেখলাম ভষ্মে ঘি ঢালা... ছেলে ও তার মায়ের কান থেকে সুতো ঝুলছে আর তার ওপর প্রান্ত ফোনে গোঁজা। লে হালুয়া!!!  
প্রায় ১৫০০ একর জমিতে ক্যাসেলস, কেভস, হাইকিং ট্রেইলস আর ক্রিক নিয়ে অত্যন্ত এক মনোরম ও মনোমুগ্ধকর পরিবেশে এই টার্নার ফলস স্টেট পার্ক। ডেলাসের খুব কাছেই। দূরত্ব মাত্র ১২৫ মাইল, সময় লাগে ঘন্টা দুয়েক। সামার সিজিন পয়লা মে থেকে সেপ্টেম্বরের ৩০ পর্যন্ত। এই সময় প্রবেশমূল্য একটু চড়া। উইক-ডেতে মাথাপিছু ১৬, বাচ্চাদের ৯। আর সেটাই উইক-এন্ডে বেড়ে ২০ আর ১৬। অবশ্য শীতের সময় মানে পয়লা অক্টোবর থেকে এপ্রিলের শেষ দিনের মধ্যে এলে ডলার গুনতে হবে তুলনামূলকভাবে একটু কম। উইক-ডেতে মাথাপিছু ৯ আর ৬, উইক-এন্ডে ১২ আর ৯। কাজেই টুরিষ্ট যখন বেশী ঝোপ বুঝে মারো কোপ।   
- 'কি আর কত দূর?' - সব্রত এর ফোন। 
- 'এই এসে গেছি। ১৫ মিনিটেই ল্যান্ড করছি।' গরম কফির চুমুক সামলাতে সামলাতে রাস্তায় নজর। 
- 'আচ্ছা। আমরা পার্কিং লটেই আছি।'

এক ঝটকায় এই ঝটিকা সফরের যিনি উদোক্তা সেই সুব্রত যথারীতি পারকিং লটে দাঁড়িয়ে।

- 'আরে এই যে এখানে, এদিকে'। শ্রীচৈতন্য স্টাইলে দু হাত তুলে ডেকে নিল। আজ ভীড়টা একটু কম। বাঁ দিক দিয়ে হানি ক্রিক ছোট বড় পাথর, নুড়ি সামলে জলতরঙ্গে মৃদু সুর তুলে নেচে নেচে এগিয়ে চলেছে। ডানদিকে কলিন্স ক্যাসেল। ওকলাহোমা ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ডঃ এলসওয়ার্থ কিছু নেটিভ স্টোন দিয়ে তার গ্রীষ্মকালীন একটি ভ্যাকেশন হোম বানিয়েছিলেন। পরে অবশ্য এটি 'বার সি র‍্যাঞ্চ' এর হেডকোয়ার্টার হিসাবেই ব্যবহার করা হয়। কিছুটা ভাঙাচোরা পাথুরে সিঁড়ি চলে গেছে ক্যাসেলের ভিতরে। ১৯৩০ সালে তৈরী এই ক্যাসেল এখনও ভগ্নপ্রায় মনে হলেও কিছু কিছু জায়গা কিন্তু বেশ মুজবুত। বড় বড় পাথরের দেওয়ালে কান পাতলে আজও যেন কেউ ফিসফিসিয়ে অতীতের গল্প শোনায়। নিচু সিলিং, খাড়া সিঁড়ি সহ গোলকধাঁধার মতো ঘরগুলো, বাঙ্কহাউস, সরু জানালা সহ প্যারাপেট এবং স্থানীয় গোলাপী পাথর দিয়ে সাজানো একটি 

ফায়ারপ্লেসও ছিল। কিছু ধ্বংসাবশেষ এখনো ঘুরে দেখা যেতেই পারে। কলিং ক্যাসেলের পাশ দিয়ে একটা রাস্তা আরো ওপরের দিকে চলে গেছে। উঁকি মারতেই - 'ও দিক চলো পরে যাওয়া যাবে, আগে ফলস দেখে আসি' - অগত্যা নেভিগেটরের ইশারায় ইউটার্ন। 

- 'বাহ! পিজাটা বেশ গরম আছে তো, স্বাদও অতুলনীয়' - এক কামড়েই বুঝলাম। একগাল হাসিতে পরিতৃপ্তির বহিঃপ্রকাশ। থ্যাংকস টু সুব্রত, ও-ই নিয়ে এসেছিল। খিদেও পেয়েছিল। কাজেই চোখের নিমেষে আমার কাজ শেষ। ওরা তখনও টেবিল জুড়ে গল্পে মত্ত। ক্যামেরা নিয়ে এগিয়ে গেলাম।  মিষ্টি রোদের স্পর্শ, সিডারের শীতল স্নিগ্ধ ছায়া ঠিক যেন মমতায় ভরা আচঁল আর প্রকৃতির সবুজ হাতছানি সব মিলে মিশে একাকার। তেমন একটা ভীড়ও নেই। কিছু বাচ্চা অগভীর জলে নেমে নুড়ি কুড়োতে ব্যস্ত। সমানতালে চলছে আমার ক্যামেরায় ছবি তোলা। 

এরই মাঝে সুব্রত এসে হাজির।

- 'চল, ওই দিকে একটা ট্রেইল মনে হছে, ঘুরে আসি।' সুব্রতর ইশারায় দিক পরিবর্তন। এবড়ো খেবড়ো পাথরে টাল খেতে খেতে পা বাঁচিয়ে চললাম চার-মুর্তি। দু-পাশে জংগল। আমাদের কথাবার্তা ক্রমাগত ভাঙছে জংগলের নিজস্ব অকৃত্তিম নির্জনতা। সুব্রত বলল,

- 'কিছ বন্যপ্রাণী দেখতে পেলে?'
- 'হ্যাঁ, পেলাম বইকি। তবে আমাদের এই চারজন ছাড়া আর তেমন কিছু নজরে পড়ল না।' সুব্রত হেসে উঠলো। বাকিরা একটু এগিয়ে। ভাগগিস শুনতে পায় নি। 

- 'শুনেছি, এখানে নাকি সাদা লেজযুক্ত হরিণ আর বন্য টার্কির নাকি দেখা পাওয়া যায়। ওরা হয়ত আজ অন্যদিকে পিকনিকে ব্যস্ত। মানুষ থেকে কে না দূরে থাকতে চায় বলো। আমরাই তো অযাচিতভাবে ওদের পিছনে হামলে পড়ি।'  চোখ টিঁপে মুচকি হেসে বললাম ওকে। 
রক ক্লাইম্বিং যাদের পছন্দ কিংবা অচেনা, অজানা কোন কেভ এক্সপ্লোর করা যাদের নেশা তারা ক্রিপসাইড ট্রেইল ধরে ফলসের ওপরের দিকে একটু এগিয়ে গেলেই একটা ন্যাচারাল কেভে অনায়াসেই পৌছেঁ যেতে পারবেন। অনায়াসেই বললাম ঠিকই তবে বাস্তবটা তার ঠিক উলটো। রাস্তা বেশ কঠিন। কাজেই সুব্রতর প্রস্তাবে না শোনার ভান করে কোনক্রমে প্রাণটা বাঁচালাম।  

গাড়িতে চেপেই কয়েকটা ভিউ পয়েন্ট সেরে ফেললাম। একটা ভিউ পয়েন্ট থেকে আর্বাকাল মাউন্টেইন এর প্যানারোমিক ভিউ এক কথায় অসাধারণ! যে দিকে তাকাই শুধু পাহাড় ঘিরে সবুজ বনরাজি আর এক অদ্ভুত নিঃস্তব্ধতা। দিগন্তের সবুজ রেখা নীল আকাশের কোলে বিলীন। ফিরে আসতে মন চাইছিল না। শহুরে মানুষকে এই ভয়ংকর সুন্দর নিঃস্তব্ধতা যে কোন মুহুর্তেই পাগল করে তুলতে পারে। দুচোখ ভরে শুধু দেখার পালা। ফিরতে কার ভাল লাগে! 

ট্রেডিং পোষ্ট এ সাময়িক ব্রেক। টুকটাক সামগ্রী নিয়ে ছোট্ট একটা গিফট শপ। বেশ ছিমছাম। পিছন দিয়ে বয়ে চলেছে হানি ক্রিক। এদিকটাতে জল অনেকটাই কম। অদূরেই একটা ব্রিজ। পেরোলেই ব্লউ হোল। 

- 'ব্লউ হোল, এখানে! ব্যাপারটা কি?"

বিস্ময়ে সবার চোখেমুখে। অবাক হবার মতই বিষয়। কারণ ব্লউ হোল বলতে আমার প্রথমেই যেটা মনে পড়ল সেটা হল নিউ মেস্কিকোর সান্টা রোসার বিখ্যাত 'ব্লউ হোল'। সান্তা রোসার ব্লউ হোল অবশ্য আয়তনে ও গভীরতায় এত গুন বেশী যে তুলনাতেই আসে না।  
- 'ব্লউ হোল হল একটা ন্যাচারাল সুইমিং পুল। হানি ক্রিক জংগল-পাহাড়ের ভিতর দিয়ে এসে এই পুলে মিশেছে। সামারে এই অগভীর পুল আবালবৃদ্ধবনিতাদের ভীড়ে, কোলাহলে প্রাণ ফিরে পায়। এই ছোট্ট পার্কটা সেজে ওঠে, গমগম করে। ট্রেডিং পোষ্ট এর কাছে গাড়ি পার্কিং করে ব্রিজ টপকে আর দু পা। বিনোদনের ব্যবস্থা আছে। সকলের জন্যই রয়েছে জাম্পিং প্লাটফর্ম। আর হুড়মুড়িয়ে গড়াগড়ি খেয়ে উল্টে পালটে জলে পড়ার জন্য ওয়াটার স্লাইড। ব্যবস্থাপনার কোন ত্রুটি পাবে না ভায়া'। একনাগাড়ে বকবক করে ঢকঢক করে বগলে রাখা জলের বোতলের তলানিটাও শেষ।

স্বাতী হেসে বলল - 'চল এবার,  হল তোমার? ওরা তো এগিয়ে গেল।' 

- 'যাত্তেরি! বলবে তো! এতক্ষণ আমি একাই বকে গেলাম। কপালটাই খারাপ। যখনই একটু সুযোগ মেলে লোকজন হাওয়া!' - আমার দীর্ঘশ্বাস। তবে সবসময় এই ওয়াটার অ্যাক্টিভিটিসগুলো জনসাধারণের জন্য খোলা থাকে না। কাজেই আগে থেকে একটু খোঁজ নিয়ে আসাই ভাল। 
পুলের আসেপাশে কিছু আনমার্কড ট্রেইলস। হাতে সময় থাকলে একটু ঢুঁ মেরে আসা যেত। ক্লিফ সাইড ওভারলুক খুব কাছেই। ওটা আমরা গাড়িতেই আগেই ঘুরে নিয়েছি। বিশেষ করে ফলসের মাথা থেকে পারিপার্শিক দৃশ্য অসাধারণ। মনের ক্যামেরায় তোলা ছবিগুলো সারা জীবনের পাথেয়, নাই বা গেল সোসাল মিডিয়াতে।

এবার ফেরার পালা। পার্কিং লটে ফিরতে ফিরতে আবার দাঁড়ালাম।
- 'এই কয়েক ঘন্টার জন্য না এসে নেক্স টাইম দু-একদিন থাকলে কেমন হয়' - ক্যামেরায় চোখ রেখে সুব্রতকে জিজ্ঞাসা করলাম। 
- 'মন্দ হয় না। আগে থেকে বুক করে আসা যেতেই পারে। তাহলে ট্রেইলগুলো আমরা কমপ্লিট করতে পারবো।' সুব্রতর লম্বা হাঁটার অভ্যাস আছে। ফাইভ কে,  টেন কে ম্যারাথনে পার্টিশিপেট করে। কাজেই হাঁটা ওর কাছে নস্যি।  

- 'রাইট। দেখো অনেক অপসন আছে। ইচ্ছা করলেই তুমি ক্যাম্পিং করতে পারো। যেটা মোস্ট কমন। এছাড়া কেবিন, আর ভি, স্ক্রিং সেল্টার, কভার্ড ওয়াগেন, টিপিস, বাংক হাউস ভাড়া নেওয়ার সবরকমই বন্দোবস্থ আছে। ক্যাম্পিং আর আর-ভি-টাই বেশী নজরে পড়ে বলে মনে হয়।'

প্রবেশপথেই টিকিট কাউন্টার থেকে পার্কের পুরো ম্যাপ হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়। ম্যাপে লেবেল এক, দুই, তিন করে মার্কিং করা আছে। গাড়ি করেই সবকটা ভিউ পয়েন্টে দিব্বি ঘুরে আসা যায়। কাজেই অসুবিধা হওয়ার কোন কথা নয়। সবচেয়ে বড় কথা হল মাত্র কয়েক ঘন্টার দূরত্বে টুরিস্ট স্পট হিসেবে টার্নার ফলস স্টেট পার্কের জনপ্রিয়তার জুড়ি মেলা ভার। শুধু বড়রাই নয়, বাচ্চাদের ও নানান ওয়াটার অ্যক্টিভিটি। সামারে খোলা আকাশের নিচে এই অনুপম পরিবেশে দুটি সুইমিং পুলেই সারাটা দিন কাটিয়ে দেওয়া যায়। যার লোভে আশেপাশের শহর থেকে অনেকেই পরিবার নিয়ে এখানে এসে ভীড় জমান। কঁচিকাঁচাদের কোলাহলে তখন এই পার্কও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। পড়ন্ত বিকেলের স্নিগ্ধতায় এই শান্ত পবিত্র বাতাবরণে এক নতুন রূপে পাওয়া গেল। হানি ক্রিকের তির তির করে বয়ে চলা পাথুরে অলস জলে পা ডুবিয়ে ছলাৎ ছলাৎ, সে এক অনন্য অনুভুতি।

এবার উঠতে হবে। সন্ধ্যা নামছে গুটিগুটি পায়ে। আর্বেকাল মাউন্টেনের সবুজ গালিচার রঙ বদলাতে শুরু করেছে। দূরের পাহাড় আর সিডারের হাতছানি পরিবেশটাকে রহস্যময় করে তুলছে। ঘরের ছেলের এবার ঘরে ফেরার পালা। বাড়ি ফেরার পথে কোন জায়গায় থেমে পেট পুজো করে নিলেই ব্যস আর কি! হলোও ঠিক তাই। 

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

ভ্রমণ

মরিশাসে  

দিন কয়েক

সোমদেব পাকড়াশী 

Mauritius-7.jpg
মরিশাসে দিন কয়েক

মালপত্র নিয়ে এয়ারপোর্টের বাইরে এসে দেখি ট্যুরিজম এজেন্সির এক মহোদয়া হাতে আমাদের নামের বোর্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে। কাছে যেতেই বলল,

- 'ওয়েলকাম, I am Justin।' মজা করে বললাম,

- 'so you are just in'!                                       

- 'Well yes, .…no I am not just in… yes, I am Justin….. well, that’s my name'

হাসিমুখে সে তার জবাব সহ একটা মরিশাস ভ্রমণসূচী আমার হাতে ধরিয়ে দিল। কাছেই আমাদের জন্য সুদৃশ্য একটি চার-চাকা দাঁড়িয়ে আছে। সেটিতে মিনিট পনেরোর মধ্যে একদিকে নাতি উচ্চ পাহাড়শ্রেণী, অপর  দিকে মাঝে মাঝে, কোনো সুন্দর সমুদ্র সৈকতের পাশ দিয়ে পরিচ্ছন্ন রাস্তাঘাট বেয়ে যেতে যেতে ভারী মনোরম একটা রিসর্টে এসে উঠলাম। বিশাল ছড়ানো রিসর্টের পেছন ণদিকে লাগোয়া নানা সুদৃশ্য গাছগাছালি, বড় সুইমিং পুল, স্পা ইত্যাদি। এর পর বিস্তীর্ণ সবুজ ঘাসের লন পেরিয়ে অর্ধ চন্দ্রাকৃতি বিস্তৃত সমুদ্র সৈকত এটিকে স্বতন্ত্র মর্যাদা দিয়েছে।                বিশাল চত্বরের একটি আকর্ষণীয় অংশে আমাদের ঘরের অবস্থান। আমাদের ঘরের পেছন দিকে লাগোয়া চওড়া বারান্দা থেকে এগিয়ে পরিপাটি ঘাসের সামান্য লন পেরোলেই চমৎকার বালির সৈকত গিয়ে মিশেছে 'টার্টল বে' নামে এক শান্ত বিশাল জলরাশিতে। এ ধরণের সাগরমুখী বারান্দাগুলো সুপরিকল্পিত। সকাল থেকে সন্ধ্যা বিভিন্ন রঙে আর রূপে সমৃদ্ধ সমুদ্রের নানান মজা উপভোগ করে ছুটি কাটানর পক্ষে আদর্শ।                         

সৈকতের সৌন্দর্য উপভোগ করতে ধীর পায়ে এগোচ্ছি, একটি ডিঙি ছোট্ট জেটির পাস্ থেকে আমাদের ইশারায় জানাল যে আমরা চাইলে তাদের সঙ্গে কিছুক্ষণ জলবিহার করে আসতে পারি। এই আনন্দ ভ্রমণ আমাদের রিসর্টটির নিজস্ব আয়োজন জেনে আমরা দুজনে সঙ্গ দিতে দ্বিরুক্তি করিনি।

শান্ত বিশাল জলরাশি কেটে আমাদের একরত্তি ডিঙিটি জেটি থেকে দূরে আরো দূরে নিঃশব্দে এগিয়ে চলেছে। কোন সুদূরের পানে কে জানে। বহুদূরে এক দুইখান বিশাল জাহাজ এখানে ওখানে দাঁড়িয়ে বোধকরি বিশ্রাম নিচ্ছে। ভারী সুন্দর সময়টা যেন তাড়াতাড়িই কেটে গেল। পাড়ে এসে দেখি মধ্যাহ্ন ভোজনের সময় এখনো হয়তো আছে। সৈকতের বালুকাবেলায় সাজানো ছোট্ট রেস্তোরাঁয় বসে প্রায় নিস্তব্ধবেলায় শান্ত সাগরের বিভিন্ন রঙ রূপ দেখতে দেখতে নরম পানীয় সহ মরিশাসের প্রিয় খাবার ‘গ্যাটো পাইমেন’ (এরা ‘চিলি কেক’ ও বলে - আদতে আমাদের ‘কড়াইশুঁটির পাকোড়া’), আর ‘বোল রেনভার্স’ (এই নামকরণ এটির উপুড় করা বাটির মত চেহারার জন্য। থাকে থাকে কিছুটা ভাত ও চিকেনকষা, উপরে ডিমভাজার মিলিত স্বাদে এটি অনবদ্য) এসে উপস্থিত। ভোজন শেষ হতে বেলা প্রায় গড়িয়ে গেল। এরপর হোটেলের ঘরে এসে ধারাস্নানে দুজনেই আরো একটু চনমনে এখন। আরও এগোনোর আগে, মরিশাস দেশটিকে কিছুটা জানতে এ ব্যাপারে অল্প কিছু গল্প সেরে নেওয়া ভালো।
১৮৩৫ সালে সেখানে দাসপ্রথার অবসান হলে আমাদের দেশের হিন্দীভাষী অঞ্চল থেকে প্রচুর শ্রমিক আনা হয় আখের ক্ষেতে কাজ করার জন্য। ওখানে তখন ফরাসীরাজ চলছে। এরপরে ধীরে ধীরে ক্ষেতের কাজ ছাড়াও কলকারখানা, এবং বিভিন্ন নির্মাণ সংস্থায় এরা নিয়োজিত হতে থাকে। আজ প্রায় দুশ বছর পর এদেশে হিন্দীভাষী হিন্দুর সংখ্যা সর্বাধিক। এছাড়া বেশ কিছু খ্রীস্টান, মুসলিম ও বৌদ্ধ ধর্মের লোকের বাস এখানে।                                                          পরেরদিন একটু বেলা করেই ঘুম ভাঙল কারণ কোনো ভ্রমণসূচী আজ রাখা হয়নি। ইচ্ছে হলে আজ রিসর্ট লাগোয়া সমুদ্র সৈকত ‘টার্টল বে’ মনভরে উপভোগ করা যেতে পারে। আবার চাইলে এখানকার চিড়িয়াখানায় গিয়ে নাকি ‘বাঘের সঙ্গে হাঁটা’ও যেতে পারে। জানা গেল যে সে বাঘ নাকি আবার কামড়ায় না - একদম নিরাপদ! তাছাড়া এখানে ‘প্যাম্পল মুস’ নামের একটি বিশালাকায় বোটানিক গার্ডেন আছে - সেখানেও উপভোগ্য সময় কাটান যায়।                                       

যা হোক, ভীরু মধ্যবিত্ত মানসিকতায় 'বাঘের সঙ্গে হাঁটা' ব্যাপারটি অবিলম্বে বাদ দেওয়া হল। ক্যাব ভাড়া করে, 'চলো বাঙালি প্যাম্পল মুস' অর্থাৎ বোটানিক গার্ডেনটি বেড়িয়ে আসাটাই ঠিক করলাম। ‘টার্টল বে’র গোধূলির রূপ না হয় সূর্যাস্তের আগে ফিরে এসে দেখা যাবে।                    প্যাম্পল মুস' বাগানটির ভেতরে চারিদিক পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়ানোতে এটির বিশালত্ত্ব আন্দাজ করা গেল। বাগানটির বিভিন্ন প্রান্তে সুপরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন দেশের উল্লেখযোগ্য নানা আকারের গাছপালা, বিচিত্র রং ও রূপের ফুল ও ফলের গাছ ইত্যাদি সাজান হয়েছে। এছাড়া হাঁটাচলার বিশেষ ইচ্ছা না হলে বা কোনো অসুবিধা থাকলে ওই পার্কটির ভেতরেই রাখা হালকা চারিদিক খোলা গাড়ি সর্বদা পাওয়া যায় – কোনো  দক্ষিণা ছাড়াই। এতো  বিশাল আর সুচারু পরিচর্যায় বিন্যস্ত সুন্দর সাজানো বাগান আগে কোথাও দেখেছি বলে মনে হয় না।

ভারতের বিভিন্ন সময়কালের প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতিদের এখানে নানাসময়ে উপস্থিতির স্মারক ফলক এই বিশাল বাগানে সুন্দর করে সাজান আছে। সব মিলিয়ে মরিশাস ভ্রমণের খুবই আকর্ষণীয় দিক 'প্যাম্পল মূস' নামের এই বাগানটি। এখান থেকে ফিরে আবার আমাদের রিসর্টের পেছনের দিকে সাগর সৈকত 'টার্টল বে'র 'অপরূপ বৈকালিক ও সান্ধ্যকালীন দৃশ্যাবলী আর বিশাল জলরাশির উপর সময়ে সময়ে পরিবতিত রঙের খেলা দেখতে দেখতে স্যান্ডউইচ এর সাথে কফি সেবন চলল বেশ কিছুক্ষণ। সঙ্গে রইলো দূর থেকে দূরান্তরে মিলিয়ে যাওয়ার আগে, মাঝে মধ্যে, জাহাজের গম্ভীর ভেঁপুর হাতছানি আর সূর্যদেবের মনকাড়া রঙের খেলায় সাগরবক্ষে অস্তগমন। মনে হয় দিনকর যেন সাগরে অবগাহন করতে ব্যস্ত - তাই অতি দ্রুত নিমজ্জিত হলেন। অপূর্ব সে দৃশ্য! সুতরাং চলমান এবং স্থাবর ছবি তোলার কাজে দুজনেই হাত লাগালাম যতক্ষণ না চারিদিক আঁধার হয়ে আসে। এরপর দিক চক্রবালে দেখাযায় বিন্দু বিন্দু আলো - কিছু আলো ক্রমাগত নিবছে জ্বলছে। আবার এখানে সেখানে দেখা যায় বিশাল দুতিনটি জাহাজ - রঙীন আলোর মালায় সেজে ওই দূরে অবস্থান করছে।                                              

প্রকৃতির কোলে বসে তারই সৌন্দর্যে বুঁদ হয়ে আছি কতক্ষণ জানি না, রিসর্টের এক খাদিম এসে জানাল সময় হয়েছে - সান্ধ্যকালীন খাবার টেবিল আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।

খাওয়ার টেবিলের কাছে আসতেই জানা গেল আজ শনিবারের সপ্তাহান্তে কিছু বিশেষ স্বাদু খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সঙ্গে আবার রয়েছে চিত্তাকর্ষক ‘সেগা’ নাচের আয়োজন। কোরিওগ্রাফি অসাধারণ। দেশীয় সামাজিক পটভূমিকায় কুমারী রমণীর পুরুষের প্রতি আকর্ষণ, তার মান অভিমান, অনুরাগ বিরাগ - সবকিছুই   সুন্দরভাবে সেগা নাচের আঙ্গিকে যেন মূর্ত হয়ে উঠছে। আমাদের সোভাগ্য যে ওই নর্তকী মরিশাসের জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্তা। নাচের সঙ্গে ছিল মনমাতানো এদেশের ঐতিহ্যবাহী বাজনা। আনন্দ সন্ধ্যার শেষে ঘরে ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় দশটা। আজ সারাটা দিন ঘরে বাইরে ভারী সুন্দর কাটল।

এর পরদিন সকাল সকাল আমরা পোঁছলাম কুরেপি (Curepipe) নামের একটি অঞ্চলে। এখানে ফরাসী উপনিবেশের বেশ কিছুটা ছাপ এখনও পাওয়া যায়। স্থানীয় লোকেদের উচ্চারণে এর নাম 'কুপিপ'। কয়েকটি ছিমছাম পরিচ্ছন্ন পাড়ায় এই ছোট্ট অঞ্চলটি বিন্যস্ত। ম্যালেরিয়া জনিত মহামারীর হাত থেকে বাঁচাতে ১৮৬৭ সালে  মরিশাসের রাজধানী পোর্ট লুই থেকে প্রায় সমস্ত লোকজনকে প্রায় ১৮ কিমি দূরে এই পশ্চিমাঞ্চলের উচ্চভূমিতে পুনর্বাসন দেওয়া হয়। তৎকালীন ফরাসী প্রশাসন নিজেদের দেশের একটি ছোট শহরের নামে এটির নামকরণ করে।

কিছু কেনাকাটার জন্য সময় দিয়ে স্থানীয় গাইডটি আমাদের বারবার সাবধান করে জানিয়ে দিল খুব দরাদরি করে কেনাকাটা করাই ঠিক হবে এখানে। ভয়ে ভয়ে কিছু গিফট এবং কিউরিও কেনার পর জানা গেল সেগুলোর আসল দাম নাকি আরো কম। কিন্তু আমরা খুশি - কেনা জিনিষপত্রগুলো সত্যিই অপূর্ব। পরবর্তী গন্তব্য এক মৃত আগ্নেয়গিরির মুখ - নাম  'ত্রু ও  সার্ফ’ (Trou Aux 

Cerfs)। ক্রেটারটি মোটামুটি ৮০মি গভীর এবং এটির ব্যাস প্রায় ৩৫০ মিটার। এ এক অনিন্দ্য অভিজ্ঞতা। চারিদিকে পাহাড়শ্রেণীর অনির্বচনীয় ঘেরাটোপের মাঝখানে আমরা দাঁড়িয়ে - একপাশে কিছুটা নীচে মৃত আগ্নেয়গিরির মুখ- চারিদিকে সবুজের অসীম সমারোহ - এক বর্ণনাতীত দৃশ্য। 'কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা, মনে মনে’ মনে হ’ল সময়ের হিসাব যেন হারিয়ে ফেলেছি। ‘জাস্টিন’ – সেই স্থানীয় গাইডটির ডাকে অবশেষে সম্বিৎ ফিরল।ফেরার পথে ছোট্ট জলপ্রপাত সেসিল দেখে গেলাম অতি বিখ্যাত স্থান ‘শ্যামারেল’ (Chamarel) এর স্বাদ নিতে। বিশাল এই জায়গাটি ধরে সাতরঙা খনিজ মাটি আসলে মৃত আগ্নেয়গিরির অজৈব, প্রধানত ধাতব, অবশেষে থেকে তৈরি। স্থানটি প্রকৃতির বিচিত্র খেয়ালে তৈরি সুবিশাল এবং বিস্ময় উদ্রেককারী বহুকালের সঞ্চিত এক খনিজ মৃত্তিকাউদ্যান যা - বিভিন্ন রং ও বর্ণের সম্ভারে সজ্জিত। এই সাতরঙা, চিত্র বিচিত্র ‘শ্যামারেল’ এর রূপ  বিভিন্ন দিক থেকে অনেকক্ষণ ধরে নিরীক্ষণ ও উপভোগ করার পর পাশেই এক ছোট্ট কফিশপে কিছুটা সময় কাটানোর পর ফিরে আসলাম আমাদের পরিচিত ডেরায় - আমাদের রিসর্টে।

মরিশাসের মূল আকর্ষণগুলোর প্রধান জায়গা জুড়ে অবশ্যই এখানকার অপরূপ সৈকতগুলি। প্রতিটি তার নিজস্ব দৃশ্যমানতা আর সৌন্দর্যে অনন্য। আমরা দুপুরের খাওয়ার আগে বা পরে এখানে যেকটি সৈকত সৌন্দর্য উপভোগ করার সুযোগ  পেয়েছি তার মধ্যে ‘বেল মেয়ার’ (Belle Mare) ও ‘মঁ সোয়াসি’ (Mont Choicy) সৈকত দুটি বেশী আকর্ষণীয় লেগেছে। ‘বেল মেয়ার’এ নানা জলক্রীড়ার কয়েকটি (যেমন বেনানা বোটিং, প্যারা গ্লাইডিং ইত্যাদি) ভারী মজাদার। এখানে কম  সময়ের জন্য হলেও নানা জলক্রীড়ার মজা আর হুটোপুটিতে বয়েসটা যেন হঠাৎই বেশ কিছুটা কমে গেল। দ্বিতীয় সৈকতটি অর্থাৎ ‘মঁ সোয়াসি’ আবার বিচরণ ভ্রমণের নতুন স্বাদে আমাদের আবিষ্ট করে। বলা বাহুল্য, নিজ সৌন্দর্যে সৈকতটি উল্লেখনীয়।
এছাড়া এরই মধ্যে আবার একদিন মহানন্দে ছোট এবং আধুনিক স্পীডবোটে চেপে ‘ইল ও সার্ফ’ (Ile Aux Cerfs) নামে একটি ছোট্ট সুন্দর দ্বীপে আমরা অল্প সময়ের জন্য ঘুরে আসলাম। দ্বীপটিতে চা, কফি ও সামান্য খাওয়াদাওয়ার এবং ছোট খাটো কেনাকাটার দোকান থাকাতে পুরো অধ্যায়টি ছিল ভারী সুন্দর। আসলে মরিশাস দ্বীপটি নিজেই তার বিচিত্র রূপ ও রঙের সম্ভারে আফ্রিকার একটি অসামান্য ভ্রমণবান্ধব অভিজ্ঞতা।
আমাদের বিশেষ অনুরোধে একদিন সময় করে ‘গঙ্গা তালাও’ পৌঁছল আমাদের ছোট ট্যুরিস্ট কোচটি। নামেই মালুম এখানে হিন্দীভাষাভাষীদের প্রাধান্য রয়েছে। বেশ বড়সড় চত্বর সহ হিন্দুদেবদেবীর ছিমছাম সুন্দর একটি মন্দির রয়েছে এখানে। পূজা পাঠের জন্য অল্প কিছু ঔপচারিক কাজ, দেবদেবী দর্শন, দক্ষিণা প্রদান ইত্যাদি চলছে দেখা গেল। সবটাই অবশ্য মন্দিরের সুন্দর নিয়ম মেনে - কোলাহলহীন নীরবাতায়। আসার পথে মন্দিরটির অনতিদূরে অতিবিশাল এক দন্ডায়মান শিবমূর্তির দর্শনের সৌভাগ্য হয়েছিল - আসলে মন্দির চত্বরের শুরু সেখান থেকেই। এখানকার সমস্ত রাস্তাঘাট, চত্বর ইত্যাদি ভারী পরিচ্ছন্ন এবং পরিপাটিভাবে রাখা। মূলমন্দির চত্বরের একপাশে একটি বাঁধানো খাল কাটা আছে যেটি চত্বরটিতে বৃষ্টিবাদল এবং অন্যান্য কারণে হওয়া জলবহন করে পাশের একটি ছোট পুকুরে ফেলে। বিভিন্ন হিন্দু উৎসবাদিতে মরিশাসের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রচুর সংখ্যায় ধর্মপ্রাণ দর্শনার্থী ভক্তরা এখানে জমায়েত হন বলে জানা গেল।  শান্ত, সুন্দর মন্দির ও সংলগ্ন এলাকায় বেশ কিছুটা আনন্দময় সময় কেটে গেল।
রিসর্টে ফিরে এসে আজ আবার সেই নাচ গানা হই হুল্লোড় সহ নৈশ ভোজের ঢালাও ব্যবস্থা।  দেখতে দেখতে আমরা মরিশাস ভ্রমণের শেষ পর্বে। প্রাতরাশ সেরে রওনা হলুম রাজধানী পোর্ট লুই এর দিকে। এটি মরিশাসর  সবচেয়ে বড় শহর এবং ঐতিহ্যময়। প্রথমেই গেলুম স্মরণীয় সিটাডেল (Citadelle) দুর্গ দর্শনে। প্রাচীন দুর্গটির নির্মাণকাল ১৮৩৫-১৮৪০ সালের মধ্যে। তখন ব্রিটিশ শাসক উইলিয়াম IV এর রাজত্ব। দুর্গটির নাম ফোর্ট এডিলেড (Fort Adelaide) সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২৪০ ফুট উঁচু এই দূর্গটি পার্শবর্তী বন্দরের দেখভাল এবং সুরক্ষার কারণে তৈরী। নাতিবৃহৎ দুর্গটির ছাদ থেকে পোর্ট লুই শহরটির বৈশিষ্ঠ চোখে পড়ে - একদিকে পুরানো বিশাল স্থাপত্যের পাশাপাশি নতুন জামানায় তৈরি সুউচ্চ আকাশচুম্বী বহুতল গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে। অপরদিকে বিশাল বন্দর জাহাজ এখানে সেখানে নোঙ্গর করে ভাসমান। সামনে চিনি রাখার জন্য বিশাল বেলানাকৃর্তি স্তম্ভগুলি পরপর যেন গম্ভীরভাবে কার অপেক্ষায় দিবানিশি দাঁড়িয়ে। সৌন্দর্যে ও ঐতিহ্যে এই পোর্ট লুই শহরটি যে কোনো ইউরোপেও শহরের সাথে তুলনীয়। পুরান ফরাসী এবং ব্রিটিশ স্থাপত্যের নিদর্শন বহু সরকারীদপ্তর এবং ভবনে চোখে পরে। এছাড়া কাছেই রেসকোর্স ও স্পোর্টস সম্পর্কিত কার্যকলাপ/চর্চার এর জন্য সুপরিকল্পিত ব্যবস্থা দেখা গেল। পোর্টলুই শহরটি ভালকরে দেখার জন্য যথেষ্ট সময় পাওয়া গেলে আরো ভাল লাগত।                                      যা হোক, যা দেখা গেল তাই বা কম কি! পরেরদিনটা শুরু হলো একটি ঐতিহ্যময় স্থানে। দর্শনীয় স্থানটি ‘লা কডান’ (Le Caudan - ফরাসীতে উচ্চারণ ‘লা কোদঁ’) নামে ওয়াটারফ্রন্ট শপিং কমপ্লেক্স’ বা সংক্ষেপে  ‘কডান ওয়াটারফ্রন্ট’ নামে খ্যাত। এর অবস্থান পোর্ট লুই এর একটি মনোরম স্থানে - একদম সমুদ্রের ধারঘেঁষে সুন্দর ঐতিহ্যপূর্ণ বন্দরটির পাশে। খুব ছিমছাম ও সুন্দরভাবে সাজানো কডান ওয়াটারফ্রন্টের যে দিকেই তাকান যায় - ভারী চমৎকার। সুন্দর লাগছে বন্দর সন্মুখস্থ বিশাল জলরাশিতে ইতস্তত জাহাজ ও সুদৃশ্য মোটর বোটের উপস্থিতি এবং আনাগোনা।                                 

জানা গেল বিভিন্ন হিন্দী সিনেমার সুটিং এই কম্প্লেক্সটির বিভিন্ন দৃষ্টিনন্দন স্থানে মাঝেমাঝেই হয়ে

থাকে। বেড়ানোর জন্যও স্থানটি যে আকর্ষণীয় একথা আলাদা করে বলার অপেক্ষা রাখেনা।         
কিছু কেনাকাটা করার আগেই  সমুদ্রের  ধারে সুন্দর একটি দোকান থেকে একদম ভারতীয় পদ্ধতিতে করা (যদিও এখানে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা অনেকটাই বেশি) আখের রস খাওয়া গেল তাড়িয়ে তাড়িয়ে।  
সাগরমুখী মূল শপিং কমপ্লেক্সটি অনেকটা ছড়ান একটি সুন্দর বহুতল বাড়ী। এটির মাঝে মাঝে অনেকখানি জায়গা উন্মুক্ত আকাশের নীচে। শপিং কমপ্লেক্সটিতে কেনাকাটার নানাবিধ উন্নতমানের আধুনিক সম্ভার, জামা কাপড়, গিফট এবং স্যুভেনিরের বিপনী ছাড়াও নানা স্বাদের রেস্তোরাঁ বা ক্যাফে রয়েছে।                                                                         

কডান ওয়াটারফ্রন্টের কোথাও একটি খোলা চত্বরে দেখা গেল ভারী আকর্ষণীয় নাচ গানের এক জমাটি আসর বসেছে। বেশ কিছুক্ষণ ধরে সেখানে ইউরোপীয় নৃত্যগীতের পরিবেশনা উপভোগ করা গেল। অদূরে কমপ্লেক্সটির তিনতলায় দেখলাম ছোট্ট অথচ সুদৃশ্য একটি সিনেমাহলে হলিউডের কোন পুরোনো সিনেমা রম রম করে চলছে।                         

এছাড়া কমপ্লেক্সটিতে রয়েছে বেশ বড় আকারের একটি পুস্তকালয়। এছাড়া এখানে ছোট্ট দ্বিতল জাদুঘরটিতে নানা দর্শনীয় বস্তুর মধ্যে মরিশাসে নানা দেশের শাসনকালের ঐতিহ্যপূর্ণ ইতিহাসের সাক্ষ্য বহনকারী নানা মুদ্রা, পোশাক, জাহাজের অপূর্ব ও নিখুঁত প্রতিরূপ এবং আরো নানা দ্রষ্টব্য বস্তুগুলি সময় ও কৌতূহল নিয়ে দেখার মত। এছাড়াও এখানে বহু পুরানো ও দুর্লভ ডাকটিকিটের সংগ্রহ উল্লেখযোগ্য। শপিং কমপ্লেক্সটিতে নানা অত্যাধুনিক নকশার জামাকাপড় সহ কেনাকাটার বহুল সম্ভারের প্রায় সবই সারা পৃথিবী থেকে আসে। তাই সময় নষ্ট না করে বেশ কিছু গিফট আর সুভেনিরের সাথে সাথে ইউরোপ থেকে সদ্য আসা কিছু পছন্দসই জামা কাপড়ও কেনাকাটি করা হল। এর মধ্যে ওখানে কেনা বিভিন্ন সময়ে ব্যবহৃত নানা গড়নের জাহাজের নিখুঁত প্রতিরূপের একটি নমুনা, স্থানীয় নকশার তৈরী রূপোর কিছু গয়না আর অধুনা বিলুপ্ত ডোডো পাখির নানা ফটো সহ স্যুভেনিরটি নজর কাড়ার মতন।                                                                  কডান ওয়াটারফ্রন্টের অপেক্ষাকৃত নুতন এবং দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যে নির্মিত আর্ট সেন্টারের কথা না বললে কমপ্লেক্সটির পরিচয় অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। জানা গেল এখানে বিভিন্ন দেশের বিখ্যাত নাটক ও অপেরা প্রায়শই অনুষ্ঠিত হয় - আমাদের ভ্রমণকাল স্বল্প হওয়াতে যা উপভোগ করা গেল না। এছাড়া এটিতে আধুনিক বৈদ্যুতিক আয়োজন সহ কনফারেন্স হলেরও সুন্দর ব্যবস্থা রয়েছে।  সবমিলিয়ে সমুদ্র বন্দরের লাগোয়া লা কডান ওয়াটারফ্রন্টটি, তার সাজানো চত্বর, নানা দর্শনীয় এবং উপভোগ্য বহুমুখী সম্ভার এবং বিভিন্ন লোভনীয় স্বাদের খানা ও পিনার ব্যবস্থা ইত্যাদি সহ কমপ্লেক্সটিকে পর্যটকদের কাছে একটি উৎ কৃষ্ট দর্শনীয় স্থানের মর্যাদা দিয়েছে।দেখতে দেখতে বিকেল ঘনিয়ে এল।                                                                                      দেখার মত অনেক কিছু রয়ে গেল। তবু --- বাই বাই ‘কডান’, বাই বাই মরিশাস। ইচ্ছা না থাকলেও এগোতে হবে এখন। এয়ারপোর্টের দিকে। সেখানে আমাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য বাতানুকূল বাসটি এসে দাঁড়িয়ে আছে।   

শেষ হয় দিনের আলো

শেষ হয়

দিনের আলো

শ্রীকান্ত দাস

youngman.JPG

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

গল্প

- 'ইন্দ্রদীপদা। আরে ও ইন্দ্রদীপদা। কোথায় যে গেল লোকটা এই তো এখানেই দেখলাম। আরে দাদা একটু সাইড দিন না।'
সকালবেলায় এই বোঝাওয়ালাগুলো জীবনটা যেন ঝালাপালা করে দেয়।
- 'বিপ্রতিপবাবু ….. আরে ও বিপ্রতীপবাবু কাউকে খুঁজছেন নাকি? (বারইপুর লোকালের ইঞ্জিন বগি থেকে দেবাশীষবাবুর ডাক)
- 'না ঠিক কাউকে খুঁজছি না। তবে.......'
- 'চলে আসুন চলে আসুন এখানে জায়গা আছে।' 
- 'আমি তো দেখলাম আপনি হ্ন্তদন্ত হয়ে কার পিছনে যেন ছুটছিলেন।'
- তা ভায়া এখনো কলেজে লাইফের অভ্যাসটা যায়নি কোন বান্ধবী টান্ধবীকে দেখলেন নাকি?'
(ট্রেনের কামড়ায় উঠে)
বিপ্রতীপ বলল - 'আরে না আমাদের সিকিউরিটি গার্ড ইন্দ্রদীপদাকে যেন দেখলাম মনে হল। তাই আর কি কিন্তু কোথায় যেন লোকটা উধাও হয়ে গেল। আর দেখতেই পেলাম না। 
পাশ থেকে একজন লোক বললেন- 'দাদা সিগনাল কি হয়ে গেছে।' 
একটু বিরক্ত হয়ে বিপ্রতীপ বলল - 'না দাদা দেখিনি।' 
প্রতিদিনের মতো ছাতাটা ব্যাগে ঢুকিয়ে ব্যাগটা ট্রেনের বাঙ্কারে তুলে দিল বিপ্রতীপ। দেবাশীষবাবু জিজ্ঞেস করলেন - 'আরে মুড অফ নাকি।' 
- 'না। মুড অফ থাকবে কেন? কিন্তু আপনি কাল এলেন না যে?' 
- 'না কালকে একটা বই উদ্বোধনের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। কিন্তু আপনি কার পিছনে ছুট ছিলেন মশাই। বৌদিকে একবার ফোন করে জানাতে হবে মনে হচ্ছে।'
- 'আর না দাদা দশটা পাঁচটা ডিউটি করে আর এই লোকাল ট্রেনের ধাক্কা খেতে খেতে পরকীয়া বিষয়টা এখন বিশ বাও জলে চলে গেছে।' 
- 'আমি আমাদের সিকিউরিটি গার্ড ইন্দ্রদীপদাকে যেন দেখতে পেলাম মনে হল। পরশু রাত্রে কমপ্লেক্সে যখন গাড়ি পার্ক করছি হঠাৎ এসে জিজ্ঞেস করলেন - 'দাদা কোন গ্যাসের ট্যাবলেট আছে?'
আমি বললাম - 'না দাদা। রাত দশটাও বেজে গেছে, সব ওষুধের দোকানও প্রায় বন্ধ। তারপর আমি উপরে ফ্ল্যাটে উঠে গেছি। দেখিওনি। আজ হঠাৎ সকালবেলা স্টেশনে দেখে পিছন থেকে কি যেন মনে হল ইন্দ্রদীপদা। যতই হোক ভদ্রলোক খুব মিশুকে সব সময় বলেন - কিছু চিন্তা করবেন না স্যার আপনি নিশ্চিন্তে যেখানে খুশি যান। তাই আর কি।'
- 'সারারাত কাজ করার পর সকালে আবার কলকাতায় কোথায় একটা কাজে যান উনি।'
- 'ও হ্যাঁ ওই মোটামত লোকটা। আপনাদের নাইটগার্ড। আগের বাড়ি উনাকে দেখেছিলাম আপনার ফ্ল্যাট এ যাবার সময়।'
- 'হ্যাঁ আমি যেন দেখলাম ওনাকে তাই পিছন থেকে ডাকছিলাম। কিন্তু কোথায় একটা উধাও হয়ে গেলেন উনি।'
পাশ থেকে ভদ্রলোক বললেন - 'আমাদের এখন এরকমই অবস্থা দাদা। আমিও একটা এ টি এম এ রাতে কাজ করি। মাত্র ৮০০০ টাকা দেয়। সংসার চলে বলুন। এর পর কলেজ স্ট্রীট এ ছাপাখানায় টানা আট ঘণ্টা কাজ। কোম্পানিগুলো এত মাইনে কম দেয়.....কি আর বলব।' 
বিপ্রতীপ ঘাড় নেড়ে লোকটার দিকে তাকায়।। মনে মনে ভাবে এইভাবেই সংসারের চাকা টানতে টানতে কত মানুষ বাঁচে। ট্রেন চলতে শুরু করে।

গল্পের শুরুটা একটু অন্যরকম। হঠাৎ একদিন বিপ্রতীপ এর বিলাসী কমপ্লেক্সে এ ৪ তলায় খুব চিৎকার শুনে সকালে ঘুম ভেঙে যায়। কিসের চিৎকার চেঁচামেচি।
সাধারণত এরম তো রোজকারের ঘটনা নয়। শান্তিপ্রিয় ফ্ল্যাটএ কার এরকম চিৎকার। গিয়ে দেখে একজন নতুন সিকিউরিটি গার্ড উপরের ঘরের মিত্তিরবাবুর মাকে কাঁধে চাগিয়ে নিয়ে আসছেন নিচ থেকে। এম্বুলেন্স ড্রাইভার এর যুক্তি এক্সট্রা পয়সা না দিলে পেসেন্টকে তুলবে না। রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে যাবে। তাতেই নতুন সিকিউরিটি গার্ড এর সাথে বাক বিতন্ডা একপ্রকার চলছে। সাথে পাশের ঘরের ম্যাডাম ও চিৎকার করছেন।
বিপ্রতীপ - 'আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না।'
- 'নমস্কার স্যার।' মোটা গোঁফ মাথায় টুপি কোম্পানির কালো ইউনিফর্ম পরিহিত একজন বছর পঞ্চাশ পঞ্চান্ন লোক। 
- 'আপনি?'
- 'স্যার আমি আপনাদের নতুন সিকিউরিটি গার্ড ইন্দ্রদীপ ভট্টাচার্য। স্যার কি বলব বলুন। এম্বুলেন্স এর ড্রাইভারটা মাসিমাকে নিচে নামিয়ে চলে যাচ্ছিলেন। আমি বললাম তুমি এটা ঠিক করছ না।'
ও তখন বলছে - 'তুমি সিকিউরিটি গার্ড বেশি কথা বলবে না।' 

- 'কি বলব স্যার। আমি মিত্তিরবাবুকে চিনি। উনি বললেন। আর না করতে পারিনি।'- 'বাঃ। সে তো ভালো কথা'। এই সময় মিত্তিরবাবুর পাশের ঘরে ফ্ল্যাট বিতে আমার হাত লেগে কলিংবেলটা বেজে উঠেছে।ম্যাডাম বেরিয়ে  আমায় বলছেন - 'হাউ ডেয়ার ইউ। সাচ এ ইল্লিটারেট পারসনস।' ম্যাডামকে হাত জোড় করে বললাম - 'সরি ম্যাডাম। ভুল হয়ে গ্যাছে। তাও বললেন - ইডিয়েট একটা। আর থাকতে পারলাম না। দেখছেন লিফট বন্ধ। পাঁচতলা পর্যন্ত মাসিমাকে টেনে তুললাম।'

বললাম - 'ম্যাম আই অ্যাম নট আন ইল্লিটারেট, ইডিয়েট পার্সনস। মিসফরফর্চুন হ্যাস টেকেন মি হেয়ার টুডে।
চমকে উঠল বিপ্রতীপ। - 'আপনি মানে.....আপনি।'
সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে ইন্দ্রদীপ বললেন - 'স্যার .....বঙ্গবাসী কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েট আমি। কাজ করছিলাম এক বেসরকারি সংস্থায়। কিন্তু করোনার সময় কোম্পানি বসিয়ে দেয়। কি করব বলুন। স্ত্রী অসুস্থ। মেয়ের পড়াশুনা চলছে। ভাগ্যের পরিহাসে সিকিউরিটি গার্ড এর চাকরি করি। আবার একটা সংস্থাতে বৌবাজারেও কাজ করি।'
এভাবেই বিপ্রতীপ আর ইন্দ্রদীপবাবুর মধ্যে ভালো এক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। অনেক সময় বিপ্রতীপ বাড়িতে না থাকলেও তার গাড়ি পার্কিং এ ঠিকঠাক আছে কিনা দেখা, কেউ যদি ফ্ল্যাট এ আসতেন তাকে বিপ্রতীপবাবুর ফ্ল্যাট এ নিয়ে যাওয়া, ফোন করে যোগাযোগ করা, সব মিলিয়ে এক দারুণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে দুজনের। এই তো গতবার বিপ্রতীপের অফিসের ক্যালেন্ডার নিয়ে ফ্ল্যাটে ঢোকার মুখে একপ্রকার জোর জবরদস্তি করে হাসিমুখে যেন কেড়েই নিলেন ইন্দ্রদীপবাবু। বিপ্রতীপও এইসব বিষয়ে কোনো আপত্তিও করত না। বাড়িতে কোন পুজো অনুষ্ঠান থাকলেও নিজের মনে করে প্রসাদ নিতে চলেও যেতেন ইন্দ্রদীপবাবু। এক প্রকার যেন নিজে থেকেই আত্মীয় হয়ে গিয়েছিলেন বিপ্রতীপের সাথে। একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন এতটাই যে দূর থেকে যখন দেখতেন বিপ্রতীপ মুখে সিগারেট নিয়েছেন দৌড়ে এসে বলতেন - 'স্যার না খেলেও আপনার জন্য দেশলাইটা কিন্তু রেখে দিয়েছি।'

মুখ বুজে একজন মানুষ দিনের পর দিন ডিউটি করে গেছেন। অনেকবার ফ্ল্যাট এর সবাই দেখেছেন তিনটে শুকনো রুটি নিয়ে জলে ভিজিয়ে খাচ্ছেন ইন্দ্রদীপ। কাউকে বলেন নি কিছু খাবার এর জন্য। কখনো কখনো নিচের ফ্লাটের দীনেশবাবু ডেকে ইন্দ্রজিৎবাবুকে রাতে রুটি খাওয়ার জন্য কিছু সবজি ও দিতেন। তিনি এক অন্য জগতের মানুষ যেন। ক্রমেই আস্থা ভরসার এক জায়গা বানিয়ে ফেলেছিলেন তিনি।
পুরানো সেসব কথা  ভাবতে ভাবতে আর মোবাইলে তোলা পুরানো ছবিগুলো দেখতে দেখতে কখন যে ট্রেন শিয়ালদহ এসে গেছে বিপ্রতীপ ভাবতেই পারেনি। দেবাশীষবাবু হঠাৎ তন্দ্রা কাটিয়ে রোজগারের মতো বললেন।

- 'উফ শিয়ালদা এসে গেল। কাল রাতে ঘুম হয়নি ঠিকঠাক। ও মশাই চলুন। আরে ও বিপ্রতীপবাবু।
- 'ও হ্যাঁ চলুন।'
- 'বাইরের দিক দেখতে দেখতে আর মোবাইল ঘাটতে ঘাটতে সারাটা রাস্তা চলে এলেন। কি যে দেখেন এত মোবাইলে আপনারা কে জানে।' ইচ্ছাহীনভাবে বিপ্রতীপ হালকা হাসলেন।
শিয়ালদা প্লাটফর্মে বিপ্রতীপ কাঁধের ব্যাগটা দেবাশীষবাবুকে ধরতে বললেন। - 'শরীরটা কেমন একটু লাগছে দাদা। ব্যাগটা একটু ধরবেন?'
- 'হ্যাঁ অভ্য়িয়াসলি। কিন্তু কি হয়েছে।'
- 'না মুখে চোখে একটু জল দিই। ঠিক হয়ে যাবে।' বেসিনে চোখে মুখে জল দিয়ে ঢুকরে কেঁদে ফেলল বিপ্রতীপ।
- 'আরে কি হয়েছে কি বিপ্রতীপবাবু, 
ও বিপ্রতীপবাবু। সব ঠিক আছে তো?'
চোখ মুছে দেবাশীষবাবুর কাঁধে মাথা রেখে বললেন। দাদা সেদিন যদি একবার ওষুধটা এদিক ওদিক দেখে একবার ওনাকে জোগাড় করে দিতাম........আজ উনি বেঁচে থাকতেন। দাদা আমি নিজেকে নিজে ক্ষমা করতে পারব না কোনোদিন।
- 'কিন্তু কার কি হয়েছে?'
- 'পরশু রাতে আমার কাছ থেকে যখন ইন্দ্রদীপদা ওষুধ চাইলেন, তারপরও উনি নিচের ফ্ল্যাট এর দীনেশবাবুর কাছেও ওষুধ খুজেছিলেন......পাননি।'
- 'রাতে বুকের ব্যথায় ডিউটি করতে করতে স্থানীয় হাসপাতালে যান একাই। বাড়িও চলে যান।কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি কাল সকালে স্ট্রোক হয়ে মারা যান ইন্দ্রদীপবাবু।'

- কিন্তু আপনি যে সকালবেলা ট্রেনে ওঠার সময় বললেন ইন্দ্রজিৎবাবুকে স্টেশনে দেখেছেন। বড় বড় চোখ করে দেবাশীষ বাবু বিপ্রতীপের দিকে চেয়ে থাকেন ……… মানে আপনি জানতেন উনি মারা গেছেন। তাও……'
লেখক বন্ধু দেবাশীষবাবুর সমস্ত বিষয় বুঝতে সময় লাগে নি।
- 'কি বলবো দেবাশীষবাবু আমি যেন এখনো মেনে নিতে পারছি না বিষয়টা। অনেকবারই এভাবেই ১০.৫৪ ট্রেনে উনাকে আমি দেখেছি। আজও যেন চোখের সামনে থেকে তিনি উধাও হয়ে গেলেন।
শুধু তাই নয় পৃথিবী ছেড়ে ও উধাও হয়ে গেলেন। একটা বারের জন্য শেষ দেখাটাও দেখতে পেলাম না। কাল রাতে বাড়ি ফেরার পর নিচের দোকানে আলোচনা হচ্ছিল। যখন শুনলাম ততক্ষণে সব শেষ। আমি যেন এখনো ঠিক মেনে নিতে পারছি না ইন্দ্রদীপদা নেই।'
পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখমুখ মুছে বিপ্রতীপ ব্যাগটা দেবাশীষবাবুর কাছ থেকে নিয়ে বলল - 'চললাম। আপনার সেই কথাটা আজ যেন মিলে গেল দেবাশীষদা বেঁচে আছি এটাই আশ্চর্য। যাক রাতে ৮:৪০ এর ট্রেনে দেখা হবে।'
- 'হ্যাঁ সাবধানে যাবেন।' 
শিয়ালদা স্টেশনের ভিড়ের মধ্যে মিশে যায় বিপ্রতীপ। স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে থাকেন দেবাশীষবাবু।

গল্প

বছর কুড়ি

পরে  

গোগোল

দূর্গাপুর 

বছর কুড়ি পরে

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

tea teaster.jpg

মাদের মন খারাপ। আমরা বলতে আমাদের তিনজনের কথা বলছি। সুনীল, শক্তি এবং আমি দীপ।
মনোহর কলেজের ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র আমরা। তবে বেশি দিন আর ছাত্র থাকব না। প্রাক্তন হয়ে যাব। এই ভাবনাই আমাদের মাঝে মাঝে বিষণ্ণ করে তোলে। তবে খুব বেশি বিষণ্ণতায় না থাকা ভালো। আমরাও থাকি না। তিনজনেই বেরিয়ে পড়ি। আমাদের তীর্থস্থানে।
মনোহর কলেজের পূর্ব দিকের গেটে একটি বিশাল বড় অশ্বত্থ গাছ আছে। সেই গাছের নিচে একটি চায়ের দোকান অবস্থান করে। কথিত যে দোকানটি নাকি কলেজের থেকেও পুরনো। এবং দোকানের মালিক আমাদের অতি প্রিয় দিলীপদা নিজের হাতে নাকি কলেজের স্থাপন করেছেন। এখানেই আমরা আড্ডা দিয়ে থাকি।
চায়ের দোকান সকাল ৫টায় খোলে। দোকানের সামনে একটু জল ছিটিয়ে উনুন জ্বালান দিলীপদা। সেই উনুনে একটি বড় ডেকচিতে দুধ গরম করা হয়। উনুনটি যেন রাবণের চিতা। নেভে একদম রাত্রিতে।
দিলীপদার চায়ের খ্যাতি আছে। ঐ চায়ের দোকানটিতেই প্রাক্তন থেকে বর্তমান ছাত্ররা এসে আড্ডা জমায়। সেই আড্ডা থেকেই উঠে আসে নানা গল্প। সেই গল্পের মাঝে দিলীপদাও যোগ দেয়।
আজকেও চা এবং সিগারেটের ধোঁয়াতে পুরো দোকানটি যেন গ্যাস চেম্বার হয়ে উঠেছে। বাইরে আকাশটি মেঘলা। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হবে কিছুক্ষণের মধ্যেই। এর মধ্যে আড্ডাটিও জমে উঠেছে। আড্ডার বিষয়, কি চিরস্থায়ী? এই যে মনোহর কলেজে মানুষ তিন বছর, পাঁচ বছর কাটায় এতে কি চিরস্থায়ী বন্ধুত্ব হয় না? চাকরি সূত্রে দূরত্ব তৈরি হলেও যোগাযোগের একটি ক্ষীণ সূত্র থেকেই যায়। এবং যখন বছরের ব্যবধানে বন্ধুরা মিলিত হয় তখন যে পুরাতন স্মৃতির ধারা বয়ে ওঠে সেটিও এক আলাদা অনুভূতি।
এরকম কথায় যখন আড্ডা জমে উঠেছে তখন দিলীপদা বলে ওঠেন -

"তোমরা কি জানো এই অশ্বত্থ গাছের নিচে তোমাদের এই প্রাক্তনরাই শপথ করে যে তারা ২০ বছর পরে দেখা করবে। তবে সেটার ফলে একটি মারাত্মক ব্যাপারও ঘটে।"
"কী মারাত্মক ব্যাপার দিলীপদা?" - আমরা সবাই বলে উঠি।
"দাঁড়াও তবে আরেক কাপ করে চা হোক। আমিও বানিয়ে দিচ্ছি। এমনিতেও যা অবস্থা বৃষ্টি শুরু হলো বলে - আর শুরু হলেই এক ঘন্টা তো লাগবেই থামতে।" - দিলীপদার কথা যেন বেদবাক্য।
বৃষ্টি পড়া শুরু হলো অঝোর বেগে। আমরা সবাই আরেক ভাঁড়  করে চা নিয়ে বেঞ্চিতে বসলাম। দিলীপদা শুরু করলেন মজলিস...
"সেটিও এই রকম বৃষ্টি ভরা সন্ধ্যে ছিল। খদ্দের নেই একটাও। আমি ভাবছি এবার উনুনে জল দিয়ে নিভিয়ে দেবো আর দোকানটি বন্ধ করে দেবো। কিন্তু বন্ধ করেও লাভ কী বলো? আমার বাড়ি তো সেই বেলঘরিয়াতে। যা অঝোর বৃষ্টি পড়ছে আমি তো বাড়ি যেতে গিয়ে কাকভিজে হয়ে যাবো। বৃষ্টি বন্ধ হবার অপেক্ষা করতে করতে যখন আমি অধৈর্য হয়ে উঠেছি, ঠিক তখনই তার আবির্ভাব।"
"কার দিলীপদা?" - শক্তি বলে উঠলো।
"এক ভদ্রলোকের। উনি লম্বা একটি বর্ষাতি পরেছিলেন যেটি একদম পায়ে অবধি পৌঁছে গেছে। বর্ষাতি  এতই বড় যে উনার শরীরের কিছু অংশ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। কলারটি সোজা করা, সেটি ওনার মুখশ্রীটিকে অর্ধেক ঢেকে দিচ্ছে। মাথার ওপর একটি আমেরিকান টুপি।"
"আমি তো এরকম বেশভূষা দেখে অবাক হয়ে গেলাম।"
"একটু চা পাওয়া যাবে?" - আগন্তুকের মুখে প্রশ্ন।
"না বাবু, আমি তো উনুন বন্ধ করে দিয়েছি। দেখতেই তো পাচ্ছেন কোনো খদ্দের নেই।"
"আমি তো আছি" - ভদ্রলোক বলে তাকিয়ে থাকলেন আমার দিকে।
"বাবা এতো উত্তমকুমার" - সুনীল গল্পের মাঝে একটি ফুটকি কেটে মন্তব্য করে উঠলো।
দিলীপদা বললেন - "তা রহস্য সিনেমার মতো একটু নাটকীয় ভাব ছিল ভদ্রলোকের। নিজেকে যেন লুকাতে চাইছেন।"
"আমি আবার চেয়ে দেখলাম ভালো করে আগন্তুককে।"
"ওতো বড় বর্ষাতি  পরা সত্ত্বেও উনি বৃষ্টির জলে ভিজেই গেছেন। ঠাণ্ডায় হালকা কাঁপছেন।"
"আমার একটু মায়া হলো। যতই হোক অতিথি দেব ও ভবো ।"
"আমি বললাম - তা ঠিক আছে। একটু চা করাই যেতে পারে। আপনি বেঞ্চটিতে বসুন।"
"আমি চা বানাতে লাগলাম।"
সুনীল আবার ফুটকি কাটল একটি - "দিলীপদার তো আমাদের মায়ার শরীর।"
"তা বাবু কথাটি মিথ্যে নয় - আমার ছেলেছোকরার দলকে চা খাইয়ে সময় কেটে গেলো।"
"এই যে তোরা আর আসবি না কিছুদিন পর আর আমাকে ভুলেই যাবি, আমি কিন্তু মনে রাখবো তোদের।"
দিলীপদার চোখ হালকা ছলছল করে উঠলো আবেগে।
"কী বল দিলীপদা, আমরা আসবো তোমার কাছে এবং প্রতি সপ্তাহে চা খেয়ে যাবো।"- আমি বললাম।
"কী রে সুনীল, কী রে শক্তি কী বলিস?"
"নিশ্চয়ই - তিনজনে সত্যি কথা দিলাম আমরা এই অশ্বত্থ গাছের নিচে ঠিক তোমার গল্পের চরিত্রের মতো -" সুনীল শক্তি একসাথে বলে উঠলো।
দিলীপদা যেন এই আশ্বাসের অপেক্ষায় ছিলেন। তিনি বললেন - "থাক বাপু তোদের আর ওতো কষ্ট করতে হবে না। নে গল্পটা শোন।"
আবার শুরু হলো দিলীপদার কাহিনী।
ভদ্রলোক গল্প করার মেজাজে ছিলেন। "কলেজ তবে একই রকম আছে। কিছুই পরিবর্তন হয়নি। আপনার নামটা যেন কী?"
"আমি সবার দিলীপদা। আপনি কি এখানে পড়তেন?"
"হ্যাঁ আজ থেকে ঠিক কুড়ি বছর আগে আমি পাস করি এই কলেজ থেকে।"
"ও আপনি তাহলে প্রাক্তনী।" এই বলে আমি তাকে একটা চায়ের কাপ এগিয়ে দিলাম। "ধন্যবাদ।"
"হ্যাঁ প্রাক্তনী তো বটেই। তবে কালকের দিনটি  অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আমার কাছে।"
আমার কোনো আগ্রহ নেই জানার।
কিন্তু ভদ্রলোক একা, দোকানেও কেউ নেই এবং বৃষ্টিটিও বেশ জোরেই পড়ছে। গল্প করছেন উনি তাই আমিও ভাবলাম শুনি।
"কেন? কালকের তারিখের কী এমন মাহাত্ম্য আছে?"
"তবে শুনুন - কলেজে আমার এক বন্ধু ছিল - সহদেব। আমরা দুজনে ছিলাম হরিহর আত্মা। যেন একই আঙুলের দুই পিঠ। কলেজ বাঙ্ক করে সিনেমা দেখা, কলেজ ইউনিয়নের রাজনীতিতে মারপিট করা, থানা ঘেরাও করা, তারপর পরীক্ষার এক রাত আগে নোটস শেয়ার করা সবই আমরা একসাথে করেছি। কত সিগারেট খেয়েছি এই অশ্বত্থ গাছের নিচে।" এতগুলো কথার পর একটি দীর্ঘশ্বাস বার হলো ভদ্রলোকের বুক থেকে।
"আপনার নামটা?" আমি জিজ্ঞেস করলাম।

ঠিক তখনই বাইরে চরম করে একটি বজ্রপাত হলো।
"ওহ হো! দেখেছেন আমি নামটা বলতেই ভুলে গেছি। আমার নাম ত্রিকোণ মিত্র।"
বলেই ভদ্রলোক তার বর্ষাতি কলারটি নীচে করলেন। আমি প্রথমবার তার মুখটি দেখতে পেলাম।
সুপুরুষ ব্যক্তি। চৌকো নাক। তীক্ষ্ণ চোখের দৃষ্টি যেন সার্চলাইটের রশ্মির মতো ভেদ করে দিচ্ছে আমাকে। ভ্রুর ওপর একটি কাটা দাগ। দাগটি তাজা বলে মনে হলো। উনি বুঝতে পেরেছিলেন আমার মনে কী চলছে।
বললেন - "আমার গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল তার নিশান এটি।"

আবার জোরে বজ্রপাতের আওয়াজ হলো। এবং আবির্ভাব ঘটলো আরেক ব্যক্তির।

তবে এনার পোশাক স্পষ্ট। ইনি পুলিশের লোক। আর হাতে একটি মস্ত পোড়া দাগ। মুখ ভর্তি তার দাড়ি। পুলিশ হয়েও কেউ এত দাড়ি রাখতে পারে এটি একটু আজব। ক্যাম্পাসের কাছে পুলিশ ভেবে আমি চিন্তিত হয়ে পড়লাম। আবার স্টুডেন্ট ইউনিয়ন কিছু ঝামেলা করেছে নাকি? না কোনো অঘটন ঘটেছে? আসলে তখনকার সময় তো কলেজে একটু হলেও ডিসিপ্লিন ছিল। এখানে আমরা একটু প্রতিবাদ করে উঠলাম -

"কী বলো দিলীপদা আমরা কি উচ্ছৃঙ্খল। আমাদের শিরদাঁড়া আছে, অন্যায় সহ্য করি না।"

দিলীপদা আমাদের বললেন - "তাও বটে। তবে আরেক রাউন্ড চা করি কী বলিস?"

এটার উত্তরে যেন আরেকটি বজ্রপাত হলো। আমরা তিনমূর্তি বললাম -

"নিশ্চয়ই। গল্পেও বজ্রপাত, এখানেও বজ্রপাত। তাহলে গল্প চলাকালে চা তো খেতেই হবে।"

দিলীপদা চা করে চারটি কাপে ঢেলে দিলেন এবং তারপর আবার শুরু করলেন গল্প। পুলিশবাবুকে ক্যাম্পাসে দেখে ত্রিকোণ মিত্র যেন একটু অস্বস্তি বোধ করতে লাগলো।

"তা আপনি এখানে?" - আমি জিজ্ঞেস করলাম।

"নমস্কার আমার নাম, এই মুহূর্তে আগন্তুক বলেই ডাক হোক। আমি বৃষ্টিতে আটকে গেছি, আমার গাড়ির কার্বুরেটারে জল ঢুকে গেছে তাই স্টার্ট করতে পারছি না। ভাবলাম কোথাও যদি চা পাই আর…"

"থাক থাক আর বলতে হবে না - এই নিন চা "- আমিও এক কাপ বাড়িয়ে দিলাম ওনাকে।

"আপনি কি মাস্টার?" পুলিশবাবু ত্রিকোণকে জিজ্ঞেস করে উঠলেন।

"না না। আমি মাস্টার নই। আমি এসেছি বন্ধুর সাথে দেখা করতে।"

"আজকে এই বৃষ্টিতে? ফিরে যান মশাই।"

"না না এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ দেখা। এই দেখুন চিঠি" - বলে ত্রিকোণবাবু রেইনকোটের পকেট থেকে একটি অনেক ময়লা খাম বার করলেন।

"আসলে বাবু এটা সেই সময় যখন তোদের মতো এত হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক এই সব ছিল না।

বন্ধুত্বটা তো সরাসরিই পালন করা হতো।" - দিলীপদা গল্পের মাঝে একটু দীর্ঘশ্বাস দিয়ে বিরতি নিলেন।

সুনীল বলে উঠলো - "দিলীপদা এই সোশ্যাল কমেন্টারি-টা পরে শুনবো। তুমি এবার বলো তো কী হলো?"
"হ্যাঁ বাবা বলছি - তোরা তো পরামর্শ শোনার লোকও নস্।" দিলীপদা আবার শুরু করলেন।
"কী আছে এই চিঠিতে? পুরানো প্রেমিকার প্রেমপত্র - তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না সখা? না কী উনি কপালকুণ্ডলা - লিখেছেন পথিক তুমি কি পথ হারায়েছ?"
পুলিশবাবু রসিক মানুষ বুঝতে পারলাম। খাকি ইউনিফর্ম ওনার হৃদয়ের রস শুকিয়ে দেয়নি।
ত্রিকোণবাবুও হেসে উঠলেন - "না এরকম কিছু না। তবে মশাই আপনিও আমার বন্ধুর মতোই কথা বলেন। সেও এমন রসিক ব্যক্তি ছিল। আর সেও পুলিশ হতে চাইতো।"
"ছিল?"
"আছে। সে নিশ্চই আছে।" ত্রিকোণবাবু খুব জোর দিয়ে বলে উঠলেন।
"তাই? নাম কী আপনার বন্ধুর? হয়তো পুলিশ হয়ে গেছে আর আমি তাকে চিনি? চোরের মতো পুলিশ পুলিশও মাস্তুত ভাই জানেন তো।"
"আমার বন্ধু ঠিক আজকের তারিখটিতে এই কলেজে দেখা করবে বলেছে। আজ থেকে কুড়ি বছর আগে। এই অশ্বত্থ গাছের নীচে। আমি তার জন্যই এসেছি।"
"তা আপনি বললেন না তো আপনার বন্ধু কী করেন?"
"সেটাই তো আর জানি না মশাই। ও শেষবার চিঠি লিখেছিল সেখানে বলেছিল সরকারি চাকরি খুঁজছে। আসলে দূরে চলে গেলে তখন দৈনিক কথাবার্তা তো আর হয় না।"
"তা মশাই এই কুড়ি বছর আপনি কোথায় ছিলেন?"
"আমি কলেজ পাস করে উত্তরপ্রদেশ চলে যাই। সেখানে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে চাকরি করি।"
"আপনি চিনতে পারবেন তো আপনার বন্ধুকে?"
"হ্যাঁ চিনতে নিশ্চয়ই পারবো। তবে আমার বন্ধুকে অনেকটা আপনার মতো দেখতে।"
"চোখের ওপর কাটা দাগটা কীসের?"
"আরে মশাই আপনি তো আমাকে একদম জেরা করা শুরু করেছেন।" ত্রিকোণবাবু যেন একটু বিরক্ত হয়ে উঠলেন।

"পড়ে গিয়ে আঘাত লেগেছে।"
"না মশাই জেরা নয়। আসলে পুলিশের তো তাই কৌতূহল বেশি।" আগন্তুকবাবু দাড়িটা একটু ছুঁয়ে বললেন।
"তা আপনার বন্ধুকে চিনবেন কী করে?"
ত্রিকোণবাবু আবার শান্ত হয়ে গেছেন। উত্তর দিলেন "নাড়ির টান কি ভোলা যায়? তাছাড়া আমাদের একটি সংকেত আছে।"
"কী সংকেত?" - এবার সুনীল জিজ্ঞেস করে উঠল। দিলীপদা বললেন -

"সবুরে মেওয়া ফলে। একটু ধৈর্য না ধরলেই কী নয়?" শক্তি জবাবে বলে -

"এর উল্টো তাও ঠিক। শুভস্য শীঘ্রম্।"
আবার শুরু হলো কাহিনি।
"কী যেন সংকেতের কথা বলছিলেন মশাই?" আগন্তুক বাবু উৎসাহী চোখে ত্রিকোণ বাবুর দিকে তাকিয়ে রইলেন।
"সংকেতটি কিছুই না - আমরা কলেজের শেষ দিনে ঠিক করি যে আবার কুড়ি বছর পর আমরা এই অশ্বত্থ গাছের নিচে দেখা করবো। আর গান গাইব।"
"হয়তো আমাকে কারুর মনে নেই, আমি যে ছিলাম সেখানেই।"
"বাহ - আপনারা তো বেশ নাটুকে মশাই।"
"আরে বাঙালির রক্তে নাটক।" - ত্রিকোণবাবু এটি বলে হালকা হেসে উঠলেন।
আগন্তুকবাবু সম্মতি দিয়ে বললেন - "ঠিক বলেছেন। আমি যাই এবার। আশা করি আপনার সাথে আপনার বন্ধুর দেখা হোক।"
পুলিশবাবু বৃষ্টির মধ্যেই বেরিয়ে পড়লেন তার গাড়ির দিকে। আমি আর ত্রিকোণবাবু অপেক্ষা করতে লাগলাম।
যতই হোক, আমারও কৌতূহল হচ্ছিল। মিনিট কুড়ি পেরিয়ে গেছে এবং যখন আমরা ধরে নিয়েছি যে আর কেউ আসবে না, ঠিক তখনই এলেন।
আরেক ব্যক্তি। সাদা শার্ট এবং পান্ট  পরিহিত। ঠোঁটে গান - “হয়তো আমাকে কারুর মনে নেই, আমি যে ছিলাম সেখানেই ।”
"সহদেব!" - আমরা তিনমূর্তি একসাথে চিৎকার করে উঠলাম। দিলীপদা মুচকি হেসে গল্পে ফেরত গেলেন আবার।
"সহদেব তুমি?" - ত্রিকোণবাবু বেঞ্চ থেকে উঠে পড়েছেন।
"হ্যাঁ। কেমন আছো ত্রিকোণ?"
"আরে তুমি একটু কাছে এসো। এই বৃষ্টির ফলে এমনিতেই দোকানে আলো নেই।"
"দিলীপদা একটু মোমবাতি বা দেশলাই জ্বালবেন একবার।"
"আরে তার কী দরকার? তার থেকে তুমি বাইরে এসো।"
"এই বৃষ্টিতে? আমার ওভারকোটটি ভিজে গেছে।"
"আরে এসো তো। বাইরে এসো না।" সহদেব বারবার জোড়াজুড়ি করতে লাগলেন।
"দাঁড়ান তো। মশাই আপনি কে? আপনাকে তো সহদেব বলে মনে হচ্ছে না।"
"আপনি ঠিক বলেছেন ত্রিকোণবাবু। আমি কলকাতা CID থেকে এসেছি।"
"আপনাকে এরেস্ট করা হচ্ছে।"
"কী!!!"
আমি সুনীল ও শক্তি একসাথে চিৎকার করে উঠলাম। সুনীল বলল - "একি দিলীপদা এত থ্রিলার গল্প হয়ে গেলো।"
শক্তি যোগ করল - "এরেস্ট কেন? কী কারণ?"
দিলীপদা বললেন - "আমিও অবাক হয়ে যাই তোদের মতো। ভদ্রলোক কুড়ি বছর পর কলকাতা এসেছেন এবং বন্ধুর সাথে দেখা করার জায়গায় হাজতবাস করবেন। একেবারে অন্যায়।"
আমি জিজ্ঞাসা করলাম - "অফিসার উনি কী করেছেন? কেন এরেস্ট করা হচ্ছে?"
তার উত্তরে CID বাবু বললেন - "ইনি ক্রিমিনাল ত্রিকোণ। তিন দিন আগে ব্যাংক ডাকাতি করে উত্তরপ্রদেশ থেকে পালিয়েছেন। ইনার ভ্রুর উপর এই দাগটা ছুরির দাগ। হাতাহাতি করতে গিয়ে নিজের চুরিতে নিজেই আহত হন। উত্তরপ্রদেশ পুলিশ আমাদের ফ্যাক্স করে ইনার একটি ছবি পাঠিয়ে দিয়ে রেড এলার্ট জারি করতে বলে।"
এই বলে CID বাবু ত্রিকোণবাবুকে দোকান থেকে বের করে নিয়ে গেলেন। আমি হতবাক হয়ে দেখতে থাকলাম ধীরে ধীরে লম্বা ওভারকোট এবং তার সাথে একটি সাদা শার্ট পরা ব্যক্তি মিলিয়ে যেতে থাকলো দিগন্তে। "এটা খুব দুঃখজনক গল্প দিলীপদা।" - সুনীল বলল।
"তাহলে কী কলেজ শেষ হলে বন্ধুত্ব থাকে না?" আমি একটু হতাশ হয়ে পড়েছিলাম গল্পটি শুনে।
"চল বাড়ি যাই। বৃষ্টি কমে এসেছে।" শক্তি ওঠার তোড়জোড় করতে লাগল।
"গল্প কিন্তু শেষ নয়" - দিলীপদা বলে উঠলেন।
"মানে?" - আমরা অবাক হয়ে চেয়ে রইলাম।
দিলীপদা ফিরে গেলেন অতীতে। পরের দিন বিকেলবেলার দিকে আবার একজন দোকানে উপস্থিত হয়ে এসে বলে - "দিলীপদা একটা চা।" ভিড় প্রচণ্ড। আমিও গত দিনের কথা ভুলে দোকানে ব্যস্ত। একটি চা বাড়িয়ে দিলাম তাঁকে। কিছুক্ষণ পর একটা গান শুনতে পেলাম।
"হয়তো আমাকে কারুর মনে নেই।"
আমি মুখ তুলে দেখলাম - "আরে এত আগন্তুকবাবু। কিন্তু আজকে তো একদম ক্লিন-শেভড।"
আমি জিজ্ঞেস করলাম - "আরে আগন্তুকবাবু, কাল আপনার দাড়ি ছিলো, আজ একদম ক্লিন? আপনি কী ত্রিকোণবাবুর খোঁজ নিতে এসেছেন নাকি? না দেখতে এসেছেন ত্রিকোণবাবুর বন্ধুটি আসবে কিনা? কাল কিন্তু একটি ঘটনা…"
আগন্তুকবাবু বললেন - "জানি কাল কী হয়েছে। আমি খালি গান গাইতে এসেছি।"
"আর আমার নাম সহদেব।"
"সহদেব!!"
"হ্যাঁ। আমি ওর ছবি ইউপি পুলিশের ফ্যাক্সে দেখে চমকে যাই। তারপর আমার মনে পড়ে আমাদের কুড়ি বছর আগে করা শপথের কথা। আমি জানতাম ত্রিকোণ খুব জেদি। ও আসবেই। হয়তো একদিন আগেই আসবে।"
"কিন্তু আমি চাইনি ও আমায় চিনে ফেলুক। তাই নকল দাড়ি আর গোঁফ লাগিয়ে এসেছিলাম।"
"ওনাকে চিনতে পেরেছিলাম। কিন্তু এটাও সত্যি যে উনি ক্রিমিনাল আর আমি আমার কর্তব্য অবহেলা করতে চাইনি। তাই পরিচয় না দিয়েই বেরিয়ে যাই।"
"তারপর আমার সহকর্মী আসে গান গাইতে গাইতে যাকে আপনি কাল দেখেছেন, শুনেছেন এবং তারপর কী হয়েছে বাকিটা আপনার জানা ।"
"ত্রিকোণের মনে আমার বন্ধুত্বটা অক্ষুণ্ণ থাকুক। আর আমার নিজর কর্তব্য ঠিক রইলো" এই বলে সহদেববাবু গানটি গুনগুন করতে করতে বেরিয়ে যান দোকান থেকে।
আর আমার দোকানের পাশের অশ্বত্থ গাছের পাতা ঝরে পড়তে থাকে। দিলীপদার গল্প শেষ হলো। ওনার চোখের কোনে যেন ঈষৎ জলের উপস্থিতি। আমরা তিনজন একে অপরের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলাম। ঠিক সেই সময় অশ্বত্থ গাছের পাতা আমাদের উপর পড়তে থাকল।

নাটিকা

কাঠবিড়ালি

দেবাশিষ পট্টানায়েক

দিল্লী

কাঠবিড়ালি
thief.jpg
Debashis Pattanakye.jpg

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

রিত্র
১. ক্ষুদি: - মেসের মালিক
২. পরিবেশক:- মেসের পরিবেশক
৩-৭. অলোক, নীহার, নির্মল, বিপিন ত্ত দিবাকর: - কলেজ ছাত্র
৮. শিশির ভাদুড়ী:- কলেজের অধ্যাপক
৯. চারু মজুমদার: - নকশাল আন্দোলনের নেতা
১০- ১১. পুলিশ ১, পুলিশ ২: - স্থানীয় থানার পুলিশ
১২. মেয়ে: - ভারত মা

প্রথম দৃশ্য
পর্দা উঠল
(পটভূমি শ্রীনিকেতন। ছোটো একটা মেস। একটা লম্বা ঘরে টেবিল চেয়ার পাতা রয়েছে, ছাত্র- ছাত্রীরা বসে খাওয়া- দাওয়া করছে আর চুপি চুপি কথা বলছে। ঘরের এক কোনে টেবিল চেয়ারে ক্যশ বাক্সের সামনে বসে হিসাব লিখছে ক্ষুদি।)

পরিবেশক: (পরিবেশন করতে করতে) সাত নম্বরে আলুভাজা- ডাল ভাত, নয় নম্বরে মাছভাজা- ডাল ভাত, দশ নম্বরে ডিমের ঝোল।
ক্ষুদি:  ঠিক আছে।

(পরিবেশকের প্রস্থান)
নির্মল: খবরটা কি সত্যি?
অলোক: শিশিরদা আমাকে বলেছেন যে আজ রাতে কমরেড চারু মজুমদার আমদের সাথে মিটিং করবেন।
নীহার: ভাবতে পারছিনা উনার মত নেতা ---!
অলোক: উনি চান শ্রীনিকেতন নকশাল আন্দোলনের খুব সক্রিয় কেন্দ্র হোক।
বিপিন: কখন আর কোথায় হবে মিটিং?
অলোক: পুরোনো guesthouse এ রাত বারোটার সময়।
(ক্ষুদি ছাত্রদের দিকে এগিয়ে এসে)
ক্ষুদি: তোরা কি গুজুর- ফুসুর করছিস বলতো! ক্লাসে যাবি না?
দিবাকর: কিছুনা ক্ষুদিদা, সামনে Agromony র পরীক্ষা আছে তো, তাই seed rate আলোচনা করছিলাম।
ক্ষুদি: তোরা কি আমাকে এতই বোকা ভাবিস। কয়েক দিন থেকেই তোদেরকে একটু অন্যরকম দেখছি। গত মাসের মেসের পয়সা দিসনি এখনো।
নির্মল: খুব তাড়াতাড়ি দিয়ে দেব, চিন্তা কোরো না।
ক্ষুদি: আমার পরিবার না খেতে পেয়ে মরে গেলে তখন দিবি। 
নীহার: একটু অসুবিধায় পড়েছি আমরা তাই। তোমার টাকা তাড়াতাড়ি দিয়ে দেব। 
ক্ষুদি: বাবা কষ্ট করে টাকা পাঠাচ্ছে, আর বাবুমশাইরা টাকা উড়াচ্ছেন।
অলোক: টাকার বাইরে ও একটু ভাবো ক্ষুদিদা। তোমার কি মনে হয় না আমাদের এই স্বাধীনতা মিথ্যা। প্রতিবেশী দেশ চিনকে দেখ কেমন প্রগতির পথে এগোচ্ছে, আর আমরা পিছিয়ে পড়ছি।
ক্ষুদি: আচ্ছা, তাহলে রাজনীতি করা শুরু হয়েছে।
নির্মল: না, না, অলোক GK পড়ছে আজকাল চাকরির পরীক্ষার জন্য।
দিবাকর: পরীক্ষার পড়ার চাপে ওর মাথাটা একটু খারাপ হয়ে গেছে।
নিহার: চিন্তা করো না ক্ষুদিদা, তাড়াতাড়ি মিটিয়ে দেব মেসের টাকা।
ক্ষুদি: তোদের মত অনেক ছাত্র এল আর গেল। একদিন মেসে খাওয়া বন্ধ করে দিলে বাপ বাপ করে টাকা দিয়ে যাবি।
বিপিন: না, না ক্ষুদিদা please, পরীক্ষা আছে আমাদের।
ক্ষুদি: শোন, তোরা রাজনীতি কর বা বনের মোষ তাড়া, যা খুশি কর তা আমার মেসের বাইরে গিয়ে কর, মেসে খেয়ে নয়। পুলিশ, কোট- কাছারির ঝামেলায় যেন আমাকে জড়াতে না হয়। এই সপ্তাহের মধ্যে বকেয়া না দিলে মেস বন্ধ। মনে থাকে যেন।
(প্রস্থান)
বিপিন: বুড়ো টাকা না পেয়ে ক্ষেপে আছে।
অলোক: ওর কথা ছাড়, আজকের মিটিং এর কথা ভাব। এমন কিছু করব না যাতে কেউ সন্দেহ করে। মন দিয়ে ক্লাস করব, আর রাত বারোটার আগে চুপিচুপি guesthouse এ পৌঁছে যাবো।
সমস্বরে: ঠিক আছে।
(পর্দা নেমে আসে)

 

দ্বিতীয় দৃশ্য
(একটা খালি হল ঘরে টেবিল এর পেছনে দুটো চেয়ার। মেছেতে পাতা চাটাই এর উপর ছাত্ররা বসে রয়েছ। ঘরে মিটমিটে একটা বাল্ব জলছে। কালো কাপড় মুড়ি দিয়ে দুজন মানুষের প্রবেশ।)

শিশির ভাদুড়ী: অত্যন্ত গর্বের বিষয় যে তোমাদেরকে বিপ্লবের মন্ত্রে দীক্ষিত করতে কমরেড চারু মজুমদার মহাশয় এসেছেন শিলিগুড়ি থেকে। আমাদের শ্রদ্ধাভরা প্রণাম ও ধন্যবাদ উনাকে। কমরেড, ছাত্ররা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে আপনার বাণী শোনার জন্য।
চারু মজুমদার: কমরেড শিশিরবাবু ও প্রিয় ছাত্র বন্ধুরা, এই সাহিত্যের পীঠস্থানে এসে আমার মনে রোমাঞ্চ ও দুঃখ দুটোই একসাথে হচ্ছে। কবিগুরু যে ভয়হীন ভেদাভেদ হীন স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন দেখেছিলেন তা হারিয়ে যাচ্ছে এই সরকার আর বুর্যোয়াপন্থিদের ষড়যন্ত্রে। তোমরা কি শুনতে পাচ্ছনা ভারত মায়ের কান্না তার গরিব সন্তানদের ক্ষুধার হাহাকার শুনে। তোমারা দেশের ভবিষ্যৎ, তোমাদেরকে এগিয়ে আসতে হবে, মোছাতে হবে দু:খিনী মায়ের চোখের জল।
ছাত্ররা সমবেত: কি ভাবে সম্ভব কমরেড?!
চারু মজুমদার: বিপ্লব, সসস্ত্র বিপ্লব, চিন বিপ্লবের নেতা মাও সে তুং এর ' People War' এর আদলে জনগনের সসস্ত্র বিপ্লবের পথে আমাদের নামতে হবে। অর্থ ও অস্ত্র বুর্যোয়াদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গরিব জনগণের হাতে তুলে দিয়ে তাদেরকে এই বিপ্লবে সামিল করতে হবে। আজ আমি তোমাদের সেই অগ্নি মন্ত্রে দীক্ষিত করলাম। তোমারা মায়ের পূজার অর্চনা।
(কাঁধের ব্যগ থেকে একটা পিস্তল বের করে দুহাতে ছাত্রদের দিকে এগিয়ে দিল। ছাত্ররা সবাই মিলে হাত পেতে পিস্তল গ্রহন করল।)
ছাত্ররা সমবেত: আমরা সসস্ত্র বিপ্লবের শপথ নিলাম, নিজেদেরকে উৎসর্গ করলাম ভারত মায়ের সেবায়।
চারু মজুমদার: In-Club জিন্দাবাদ।
সমস্বরে: In-Club জিন্দাবাদ।
(চারু মজুমদার ও শিশির ভাদুড়ীর প্রস্থান)অলোক: (পিস্তল হাত উত্তেজিত ভাবে) এই দিনটার জন্য আমি অপেক্ষা করে ছিলাম! আজ আমাদের জন্ম সার্থক!
দিবাকর: সত্যি, আমার কেমন রোমাঞ্চ মনে হচ্ছে!
নির্মল: বিপ্লবী ক্ষুদিরাম, বিনয়- বাদল- দীনেশ আর সুভাষচন্দ্রের মত আমরাও দেশ সেবায় নিজেদের বিলিয়ে দেব!
নীহার: কমরেড, আমরা বিপ্লব কে কিভাবে এগিয়ে নিয়ে যাব?
দিবাকর: আর কিভাবে আমরা বিপ্লবের মূল ধারার সাথে যুক্ত থাকব?
অলোক: শিশিরদা আমাদের শ্রীনিকেতন unit এর নেতা, আর Highcommand আর আমাদের interface। উনি আমাদের guide করবেন আমরা কিভাবে এগোবো।
বিপিন: উনি কি কিছু বলেছেন এই মুহূর্তে আমরা কিভাবে এগোবো?
অলোক: আমার শিশির দার সাথে আগেই কথা হয়েছে। As per plan কাল অমাবস্যার রাতে আমরা ঘোষেদের বাড়িতে হামলা করে টাকা- পয়সা ছিনিয়ে নিয়ে দুলে পাড়ায় বিলিয়ে দেব।
নীহার: দারুন idea! আমরা কাল রাত বারোটার পরে খোয়াই এর জঙ্গলে মিলিত হব।

সমস্বরে: In-Club জিন্দাবাদ, বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক।

(পর্দা নেমে আসে)

তৃতীয় দৃশ্য

(অন্ধকার মধ্যরাত্রি। খোয়াই এর জঙ্গলের রাস্তা। ঝিঁ ঝিঁ র আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। ক্ষুদি টলমল করতে করতে বাড়ি ফিরছে। তার হাতে মহুয়ার বোতল।)

ক্ষুদি:     "কি বলিলি মালিনী ফিরে বল বল,
             রসে তনু ডগমগ মন টল টল"।
[এমন সময় নেপথ্যে কথা বলার আওয়াজ শোনা যায়।]
অলোক (নেপথ্যে): সবাই এসে গেছিস?
ক্ষুদি: কে, কে? ওরা কারা এত রাতে! ব্যাপারটা সুবিধার মনে হচ্ছে না, লুকিয়ে গিয়ে দেখি।
(প্রস্থান)
(ছাত্রদের প্রবেশ)
নীহার: আমরা সবাই এসে গেছি।
অলোক: শোন, আমি আর নীহার ঘোষেদের বাড়িতে ঢুকব। বিপিন, নির্মল আর দিবাকর বাইরে পাহারা দিবি। একটা কথা আমাদের মনে রাখতে হবে - আমরা বিপ্লবী, খুনি নই, তাই অজথা কোন রক্তপাত নয়।
(এমন সময় নেপথ্যে পুলিশের হুইসেল।)
পুলিশ (নেপথ্যে): কে, কারা ওখানে? Hands Up। কেউ পালাবার চেষ্টা করবে না।
অলোক: পুলিশ! পালিয়ে যা তোরা, । আমি আটকে রাখার চেষ্টা করছি।
(অলোক গুলি ছোড়ে। পুলিশের পাল্টা গুলি। অলোকের বুকে গুলি লাগে আর অলোক চিৎকার করে পড়ে যায়। সবাই ছুটে আসে অলোকের দিকে।)
নীহার, বিপিন, নির্মল ও দিবাকর: অলোক!
অলোক: আমার গুলি লেগেছে, তোরা পালা।
নীহার, বিপিন, নির্মল ও দিবাকর: তোকে ছেড়ে আমরা যাবো না।
অলোক: ওরে পালিয়ে যা। এরা ভাড়াটে গুন্ডার দল, ধরতে পারলে মেরে হাড় গুঁড়িয়ে দেবে। আমি যতক্ষণ পারছি ওদেরকে আটকে রাখছি। যা, it's my order।
নীহার, বিপিন, নির্মল ও দিবাকর:  অলোক --- (কাঁদতে, কাঁদতে পালিয়ে যায়)
(অলোক গুলি ছুঁড়তে থাকে)
অলোক: আমায় ক্ষমা করে দিও মা, তোমার পূজায় লাগার আগেই আমাকে চলে যেতে হবে! আ:, আমার হাত শিথিল হয়ে আসছে, চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে।
(পিস্তল হাত থেকে পড়ে যায়। অলোক মাটিতে শুয়ে পড়ে। পুলিশ ছুটে আসে। পুলিশ ১ অলোকের নাড়ি পরীক্ষা করে।)
পুলিশ ১: এখনো বেঁচে আছে। (এক লাথি মারে) এই শালা কুত্তা কি নাম তোর?
অলোক: আ:, বলবো না।
পুলিশ ২: (এক ডান্ডা মারে) তোর সাথে কারা কারা ছিলো?
অলোক: আ:, আমি জানি না, কিছু জানি না।
পুলিশ ১: শালা নকশালবাদী সহজে মুখ খুলবে না দেখছি। তবে দেখ (ডান্ডা দিয়ে বুলেটের ক্ষত স্থানে চেপে ধরে); বল শালা তোদের নেতার নাম কি?
অলোক: (যন্ত্রনায় চিৎকার করতে থাকে) মাগো, আমাকে ক্ষমা করে দিও । In- Club জিন্দাবাদ, In-Club জিন্দাবাদ, In-C---l---u--b  জি--ন্দা--- বা -- দ ।
(অলোকের চোখ বুজে আসে, মারা যায়।)
পুলিশ ২: বাকি শালারা পালিয়েছে।
পুলিশ ১: চল লাশটাকে থানাতে নিয়ে যাই।
পুলিশ ২: চল।
(পুলিশ চাংদোলা করে লাশ উঠিয়ে নিয়ে যায়।)
(ক্ষুদির প্রবেশ)
ক্ষুদি: (এক হাতে মহুয়ার বোতল, আরেক হাতে বুক চাপড়াতে চাপড়াতে) হায় ভগবান, এ আমি কি দেখলাম! এমন পাশবিক আর অমানবিক অত্যাচার! কিন্তু মুখ খুললো না, বরং কেঁদে গেল কি মায়ের সেবা করতে পারল না! একটা জ্বলজ্বল করা নক্ষত্র হারিয়ে গেল খোয়াই এর জঙ্গলে! এত নিষ্ঠুর তুমি ভগবান!
(এমন সময় চাপা কান্নার আওয়াজ ভেসে এল)
কে, কে কা্ঁদে ওখানে?! কে, কে তুমি?!
(এক আবছা মেয়ের অবয়ব ভেসে ওঠে)
মেয়ে: আমায় চিনতে পারছো না ক্ষুদি! 
ক্ষুদি: কে, কে তুমি?! এত রাতে এখানে কেন?
মেয়ে: জাগো ক্ষুদি, জাগো; ভালো করে চেয়ে দেখো! জানো, আমি কেন কাঁদছি!

(ধীরে ধীরে মেয়ের অবয়ব ভারতের মানচিত্র হয়ে ফুটে ওঠে।)

ক্ষুদি: পেরেছি! আমার চোখ খুলে গেছে! মাগো, তোমায় চিনতে পেরেছি!
(ক্ষুদি কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।)

(পর্দা নেমে আসে)

চতুর্থ দৃশ্য
(ক্ষুদির মেস। ছাত্ররা চুপচাপ খাওয়া দাওয়া করছে। এক কোনে ক্যাশ বাক্সের সামনে ক্ষুদি)

(পুলিশ১ এবং পুলিশ২ প্রবেশ)


ক্ষুদি: Sir, আসুন Sir, বসুন Sir। এই কে আছিস? দু-কাপ চা বিস্কুট নিয়ে আয়। কি ব্যপার Sir?
পুলিশ ২: (একটা ফটো দেখিয়ে) এই ছেলেটাকে চেনেন?
ক্ষুদি: এতো অলোক, অলোক রায়! কি হয়েছে অলোকের Sir!
পুলিশ ১: ছেলেটা নকশালবাদী, কাল রাতে আমাদের সাথে encounter এ মারা গেছে। ওর সাথের ছেলেরা পলিয়েছে। আমরা তাদেরকে খুঁজছি। আমাদের সন্দেহ যে আপনার মেসের ছেলেরা যুক্ত।
ক্ষুদি: খুবই বেদনা ও দুঃখের ঘটনা! কিন্তু Sir, অলোকতো এই মেসে গত মাস অব্দি খেয়েছে। টাকা দেয়নি তাই এ মাসে মেস থেকে ছাড়িয়ে দিয়েছি। গতকাল মেসে grand feast ছিল, এরা সবাই দের-রাত্রি অব্দি মেসেই ছিল, আনন্দ গান বাজনা করছিল।
পুলিশ ২: আচ্ছা, আপনি ছাত্রদের protect করছেন। এর পরিনাম কিন্তু ভালো হবে না। আজকে যাচ্ছি। কিন্তু, খুব তাড়াতাড়ি ছাত্র সহ আপনাকে হাজতে ভরব আর খুব আদর আপ্যায়ন করব। 
(পুলিশ১ এবং পুলিশ২ র প্রস্থান)
নিহার: Thank you ক্ষুদিদা।
নির্মল: Sorry তোমাকে বিপদে ফেললাম।
বিপিন: মেস ছেড়ে দেব ক্ষুদিদা, তোমাকে বিপদে ফেলব না।
দিবাকর: মেসের বকেয়া মিটিয়ে দিয়ে মেস ছেড়ে দেব।
ক্ষুদি: ওরে তোরা আমায় আর কত কাঁদাবি। অলোককে হারিয়েছি, তোদেরকে হারাতে চাই না। আমি সংসারের চাপে বেশিদূর পড়াশোনা করতে পারিনি। তোরা মনদিয়ে পড়াশোনা কর। মনে বিপ্লব নিয়ে আয় বড় হওয়ার, মানুষের মত মানুষ হয়ে দেশের মুখ উজ্বল করার। মেসের টাকার কথা তোদের চিন্তা করতে হবে না। এই ক্ষুদিদা থাকতে তোদের দুবেলা খাওয়ার অভাব হবে না। ভারত গড়ার এই মহান অভিযানে আমি নাহয় কাঠবেড়ালি। শুধু তোদের কা্ঁধে কাঁধ মিলিয়ে বলতে দে --- In-Club জিন্দাবাদ।

(সবাই ছুটে এসে ক্ষুদিকে জড়িয়ে ধরে)

সমস্বরে: In-Club জিন্দাবাদ । 
(পর্দা নেমে আসে।) 
 সমাপ্ত ।

প্রবন্ধ

কামধেনু: পুরাণ, প্রতীক ও সভ্যতার

সাংস্কৃতিক কল্পনা

ড. সুব্রত ভট্টাচার্য্য 

সিডনি, অস্ট্রেলিয়া

কামধেনু
newspaper.jpg

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

সারসংক্ষেপ
এই গবেষণা প্রবন্ধটি ভারতীয় পৌরাণিক কল্পনার এক বহুমাত্রিক প্রতীক কামধেনুর উৎপত্তি, এর নিহিত দার্শনিক ও সাংস্কৃতিক তাৎপর্য, এবং বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এর প্রতিসরণকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করে। কামধেনুকে কেবল একটি ইচ্ছাপূরণকারী পৌরাণিক গাভী হিসেবে নয়, বরং মানবজাতির চিরন্তন প্রাচুর্য, দানশীলতা, শুদ্ধতা, নৈতিকতা এবং দীর্ঘমেয়াদী জীবনধারার এক মহৎ প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। প্রবন্ধটি উপনিষদীয় দর্শন ও প্রতীকচিন্তার অন্তঃশীল স্তর, পৌরাণিক সংঘাতের মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক বিশ্লেষণ, ইকোফেমিনিস্ট দৃষ্টিকোণ, এবং বৈশ্বিক পৌরাণিক কাহিনীগুলোর তুলনামূলক অধ্যয়নের মাধ্যমে কামধেনুর বহুস্তরীয় তাৎপর্যকে উন্মোচন করে। বিশেষভাবে, এটি বিশ্লেষণ করে দেখায় যে কীভাবে এই প্রাচীন প্রতীক বর্তমান আধুনিক সমাজের পরিবেশগত অবক্ষয়, নৈতিক চ্যালেঞ্জ এবং দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়নের প্রেক্ষাপটে এক মূল্যবান পথনির্দেশক হতে পারে, যা আন্তঃসাংস্কৃতিক সংলাপ ও বৈশ্বিক পরিবেশ সচেতনতাকে উৎসাহিত করে। সাম্প্রতিক গবেষণা প্রকাশনাগুলির আলোকে কামধেনুর প্রতীকী রূপায়ণ, নন্দিনীর ভূমিকা এবং তার সমকালীন বিশ্বাস ও রাজনৈতিক ব্যবহারের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করা হয়েছে, এবং কার্ল ইয়ুংয়ের আর্কিটাইপ ধারণা ও উত্তর-ঔপনিবেশিক পাঠের মাধ্যমে এর মনস্তাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক গভীরতা অন্বেষণ করা হয়েছে। এটি decolonial myth studies, ইকোফেমিনিস্ট দর্শন এবং ইয়ুঙীয় মনোবিশ্লেষণের মাধ্যমে এক বহুস্তরীয় আলোচনার ক্ষেত্র উন্মোচন করে। এটি কোনো ধর্মীয় লেখা নয়, বরং একটি সাংস্কৃতিক ও মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ।

১. ভূমিকা: কামধেনু - একটি সাংস্কৃতিক মেটাফর ও তার দার্শনিক ভিত্তি
ভারতীয় পুরাণ কেবল দেব-দেবী বা অলৌকিক ঘটনার বিবরণ নয়; এটি মানব সভ্যতার জ্ঞান, নৈতিক মূল্যবোধ, আধ্যাত্মিক উপলব্ধি এবং দার্শনিক চিন্তার এক বিশাল আধার। প্রতিটি পৌরাণিক চরিত্র ও ঘটনা গভীর প্রতীকী অর্থ বহন করে, যা যুগ যুগ ধরে মানব জীবন ও সমাজকে প্রভাবিত করে আসছে। এর এক উজ্জ্বল উদাহরণ হলো কামধেনু (Basham, 1954), (Pattanaik, 2022) l 'কাম' অর্থ ইচ্ছা বা আকাঙ্ক্ষা (যা কেবল ব্যক্তিগত নয়, বরং সমষ্টিগত কল্যাণও বোঝায়) এবং 'ধেনু' অর্থ গাভী- একত্রে "ইচ্ছা পূরণকারী গাভী" বা "প্রাচুর্যের গাভী"। ভারতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতে কামধেনু কেবল একটি পৌরাণিক প্রাণী হিসেবে পূজিত হন না, তিনি অসীম প্রাচুর্য, দানশীলতা, লালন-পালন, পবিত্রতা এবং কল্যাণের চূড়ান্ত প্রতীক হিসেবে বিবেচিত (Doniger, 2014)। তার প্রতীকী তাৎপর্য গরুর প্রতি ভারতীয় সমাজের গভীর শ্রদ্ধার সাথে নিবিড়ভাবে জড়িত, যেখানে গরু কেবল প্রাণী নয়, বরং পরিবারের সদস্য ও দেবীসুলভ সত্ত্বা।
এই গবেষণাপ্রবন্ধে, কামধেনুর বিভিন্ন দিকগুলি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করা হবে:
পৌরাণিক জন্মবৃত্তান্তের দার্শনিক তাৎপর্য: কামধেনুর উৎপত্তির মাধ্যমে নিহিত গভীর দার্শনিক অর্থ উন্মোচন।
উপনিষদীয় দর্শনে অবস্থান ও বহুত্ববাদী সত্যের প্রতীকায়ন: উপনিষদীয় চিন্তাধারায় কামধেনুর ভূমিকা এবং কীভাবে এটি বহুত্বের মধ্যে একত্বের ধারণাকে প্রতীকায়িত করে তার বিশ্লেষণ।
বশিষ্ঠ ও বিশ্বামিত্রের কাহিনীর মাধ্যমে নৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক তাৎপর্য: ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে নৈতিকতার বিজয় এবং আত্মসংযমের গুরুত্ব অনুধাবন।
বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে প্রাসঙ্গিকতা অনুসন্ধান: বিশ্বব্যাপী অন্যান্য সংস্কৃতিতে 
পরিশেষে, আধুনিক ইকোফেমিনিস্ট দৃষ্টিকোণ থেকে কামধেনুর সমকালীন গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করা হবে। ক্রমবর্ধমান পরিবেশগত সংকট এবং নৈতিক অবক্ষয়ের সময়ে এই দৃষ্টিকোণ এক নতুন দিশা দেখাতে পারে। এই বিশ্লেষণটি কামধেনুকে একটি স্থিতিশীল, নৈতিক এবং পরিবেশ-বান্ধব সমাজ গঠনের জন্য একটি মডেল হিসেবে প্রস্তাব করবে।

২. কামধেনুর ব্যুৎপত্তি ও পৌরাণিক তাৎপর্য - সৃষ্টির প্রতীকী জন্ম ও তার রূপান্তরশীল পরিচয়:
কামধেনুর উৎপত্তি ভারতীয় পুরাণের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, সমুদ্র মন্থনের সাথে ওত:প্রোতভাবে জড়িত। দেবীভাগবত পুরাণ (Devi Bhagavata Purana) অনুসারে, যখন দেব-দানবেরা মন্দার পর্বতকে মন্থন দণ্ড এবং নাগরাজ বাসুকিকে রজ্জু হিসেবে ব্যবহার করে ক্ষীরসাগর মন্থন করছিলেন, তখন এই কর্মযজ্ঞের ফলে একের পর এক মূল্যবান রত্ন ও সত্ত্বা  উৎপন্ন হয়। এই চৌদ্দটি রত্নের অন্যতম হিসেবে অমৃত (অমরত্বের অমৃত), ঐরাবত (দেবরাজ ইন্দ্রের হাতি), উচ্চৈঃশ্রবা (শুভ্র অশ্ব), লক্ষ্মী (সম্পদের দেবী) এবং শুভ্র গাভী কামধেনুও জ্যোতিষ্মান হয়ে উঠে আসেন। এই ঘটনাটি কামধেনুকে সৃষ্টির এক অবিচ্ছেদ্য এবং অত্যন্ত শুভ অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে, যা কেবল জাগতিক সম্পদ নয়, বরং জীবনের মৌলিক পুষ্টি ও ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করে।
সমুদ্র মন্থন কেবল একটি বাহ্যিক প্রক্রিয়া নয়, এটি মহাজাগতিক এবং অভ্যন্তরীণ মন্থনের প্রতীক, যেখানে শুভ (দেবতা) ও অশুভ (দানব) শক্তি একত্রিত হয়ে পরম জ্ঞান, সমৃদ্ধি এবং আত্মিক বিশুদ্ধতা উৎপন্ন করে। কামধেনুর উদ্ভব ইঙ্গিত দেয় যে, প্রাচুর্য ও দানশীলতা সৃষ্টির এক মৌলিক এবং অবিচ্ছেদ্য উপাদান, যা ব্রহ্মাণ্ডের অন্তর্নিহিত ভারসাম্যকে প্রতিফলিত করে। অন্যান্য পুরাণ, যেমন স্কন্দপুরাণ (Skanda Purana, Classical Sanskrit text) ও ব্রহ্মান্ড পুরাণে,(Brahmanda Purana, Classical Sanskrit text)  কামধেনুকে 'সুরভি' নামেও উল্লেখ করা হয়েছে, যিনি দক্ষ প্রজাপতির কন্যা এবং অন্যান্য গাভীদের মাতা হিসেবে পরিচিত। এই একাধিক উৎস-কথা কামধেনুর বহুস্তরীয় এবং বহুমুখী পরিচয়কে তুলে ধরে, যা পৌরাণিক কল্পনার বিবর্তনশীল প্রকৃতিকে নির্দেশ করে। তিনি কেবল দুগ্ধের যোগানদাতা হিসেবে সীমিত নন, বরং সমৃদ্ধ কৃষি-জীবন, সামাজিক নৈতিকতা এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্যের এক অবিচ্ছেদ্য উৎস।
কামধেনুর স্তন্য থেকে শুধু দুগ্ধ নয়, উৎপন্ন হয় যজ্ঞের প্রধান উপাদান ঘি (যা পবিত্রতা, আধ্যাত্মিক আহুতি এবং বিশুদ্ধতার প্রতীক), ঔষধি (যা আরোগ্য, সুস্থতা ও জীবনের পুনরুজ্জীবনের প্রতীক), শস্য (যা খাদ্যের প্রাচুর্য, জীবনের ভিত্তি এবং সভ্যতার বিকাশের প্রতীক), এবং অলঙ্কার (যা সৌন্দর্য, সমৃদ্ধি ও সামাজিক মর্যাদার প্রতীক)। ভারতের কৃষিভিত্তিক সমাজে, যেখানে গরুর গোদুগ্ধ জীবনধারণের অপরিহার্য অংশ ছিল এবং গোসম্পদকে ধন-সম্পদের চূড়ান্ত প্রতীক মানা হতো, সেখানে কামধেনু অসীম প্রাচুর্য ও কল্যাণের প্রতীক হয়ে ওঠেন (Altekar, 1949)। তাঁর স্তন্য হতে নির্গত মঙ্গলধারা যেন সমগ্র সৃষ্টিকে পুষ্ট করে, সকল জীবের চাহিদা পূরণ করে এবং সমাজকে কল্যাণ ও সমৃদ্ধির পথে পরিচালিত করে। এই চিত্রটি ভারতীয় সংস্কৃতিতে প্রকৃতি এবং নারীশক্তির (মাতৃশক্তির) দানশীলতার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও পূজাকে মূর্ত করে তোলে। এটি দেখায় যে, প্রকৃতির সঙ্গে মানবজাতির সম্পর্ক কেবল গ্রহণ-প্রদানের নয়, বরং গভীর শ্রদ্ধা ও পারস্পরিক নির্ভরতার, যা একটি স্থিতিশীল বাস্তুতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য।
সাম্প্রতিক গবেষণাগুলি কামধেনুর প্রতীকী রূপায়ণে আরও গভীর অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে। কামধেনু সাধারণত: সাদা গাভীরূপে, মানবীর মস্তক ও স্তন, পাখির ডানা এবং ময়ূরের লেজ সমন্বিত অবস্থায় চিত্রিত হন। কিছু চিত্রকল্পে তাঁর দেহে বিভিন্ন দেব-দেবীকে স্থান দেওয়া হয় (যেমন ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব), যা তাঁকে 'সৃষ্টির উৎস' এবং 'পরম সত্ত্বার প্রকাশ' হিসেবে চিহ্নিত করে। তাঁর কন্যা নন্দিনীকে প্রায়শ:ই 'সহজলভ্যতা', 'নির্দেশনা' এবং 'আধ্যাত্মিক জ্ঞানার্জনের' প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। এই রূপায়ণগুলি কামধেনুর সার্বজনীন এবং মহাজাগতিক প্রকৃতিকে আরও সুদৃঢ় করে।

৩. সিন্ধু সভ্যতায় গো-প্রতীকবাদ: কামধেনুর আদি ভিত্তি
ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীনতম নগরকেন্দ্রীক সভ্যতা সিন্ধু সভ্যতাতে (প্রায় ৩৩০০-১৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) গবাদি পশুর প্রতি গভীর অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং প্রতীকী তাৎপর্য বহন করত। যদিও "কামধেনু" ধারণাটি মূলত: পরবর্তীকালের বৈদিক ও পৌরাণিক যুগের সৃষ্টি, তবে সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনে প্রাপ্ত গবাদি পশুর উপস্থিতি এই অঞ্চলের মানুষের কাছে গরুর গুরুত্বের এক দীর্ঘ ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা নির্দেশ করে (Penn Museum. (n.d.)।
সিন্ধু সভ্যতার বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক স্থলে, বিশেষ করে হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোতে, জিবু ষাঁড় (Bos indicus) (Sriram IAS) এবং অন্যান্য গবাদি পশুর চিত্র অসংখ্য সীলমোহর, পোড়ামাটির মূর্তি এবং হাড়ের অবশেষ পাওয়া যায়। এই প্রমাণগুলো ইঙ্গিত দেয় যে গবাদি পশু শুধু কৃষি ও খাদ্যের উৎস হিসেবেই ব্যবহৃত হত না (দুধ, মাংস, হালচাষ), বরং তাদের একটি গভীর সাংস্কৃতিক ও সম্ভবত: ধর্মীয় তাৎপর্যও ছিল।)
অর্থনৈতিক গুরুত্ব: সিন্ধু সভ্যতার অর্থনীতিতে গবাদি পশু, বিশেষত জিবু ষাঁড়, ছিল অপরিহার্য। প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানগুলি হতে প্রাপ্ত যাবতীয় প্রাণীর হাড়ের প্রায় ৫০-৬০% ছিল গরুর, যা তাদের ব্যাপক ব্যবহার নির্দেশ করে। দুগ্ধ এবং কৃষিকাজে লাঙ্গল টানার জন্য গরু ব্যবহৃত হত (Unacademy. (n.d.),
প্রতীকী ও ধর্মীয় তাৎপর্য: সীলমোহরে ষাঁড় এবং 'ষাঁড়-মানুষ' বা 'গাভী-নারী' সদৃশ চিত্রের উপস্থিতি তাদের ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক গুরুত্বের ইঙ্গিত দেয়। কিছু পণ্ডিত মনে করেন যে, ষাঁড় শক্তি, উর্বরতা এবং পুরুষত্বের প্রতীক ছিল। যদিও কামধেনুর মতো সরাসরি 'ইচ্ছা পূরণকারী গাভী'র উল্লেখ পাওয়া যায় না, তবে এই প্রাচীন সভ্যতায় গরুর প্রতি যে গভীর শ্রদ্ধা ও অর্থনৈতিক নির্ভরতা ছিল, তা পরবর্তীতে বৈদিক এবং পৌরাণিক যুগে কামধেনুর মতো সর্বশ্রেষ্ঠ গাভী ধারণার বিকাশে একটি মৌলিক ভিত্তি স্থাপন করেছিল। এটি নির্দেশ করে যে, গাভী বা bovine প্রতীক ভারতীয় চেতনার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে সহস্রাব্দ ধরে বিকশিত হয়েছে।
ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা: সিন্ধু সভ্যতায় গরুর এই গুরুত্ব পরবর্তী বৈদিক যুগে 'গোমাতা' এবং পৌরাণিক যুগে কামধেনুর ধারণার উদ্ভবের সাথে একটি ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা তৈরি করে। এটি প্রমাণ করে যে, গরুকে পবিত্র এবং পূজনীয় মনে করার ঐতিহ্য ভারতীয় সংস্কৃতিতে বহু প্রাচীনকাল থেকেই বিদ্যমান, যা কেবল বৈদিক যুগের অবদান নয়, বরং তারও পূর্ববর্তী সভ্যতার গভীরে প্রোথিত।
এই ঐতিহাসিক সংযোগ কামধেনুর ধারণাকে কেবল একটি পৌরাণিক উপাখ্যান হিসেবে নয়, বরং ভারতীয় উপমহাদেশের দীর্ঘস্থায়ী সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় বিবর্তনের অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।

৪. দার্শনিক প্রেক্ষাপট: প্রতীকচিন্তার অন্তঃশীল স্তর - অপরিগ্রহ, যোগ ও কামধেনু
কামধেনু ভারতীয় দর্শনের গভীর প্রতীকচিন্তার একটি অন্তঃশীল স্তরকে তুলে ধরেন। তিনি শুধুমাত্র বাহ্যিক উপচারের প্রতীক নন, বরং ভারতীয় দর্শনের 'অপরিগ্রহ' (যা অযাচিত গ্রহণ বা অতিরিক্ত সঞ্চয় না করাকে বোঝায়) ও 'যোগ' ধারণারও মূর্ত রূপ। উপনিষদের 'অপরিগ্রহ'-এর নৈতিক দর্শন কামধেনুর অন্তর্গত যোগ-মানসিকতার সাথে এক গভীর সাযুজ্য স্থাপন করে। কামধেনু আমাদের শেখান যে, সম্পদ সীমাহীন হলেও তাতে অতিকায় ভোগবাসনা জন্মালে তা ধ্বংসাত্মক হতে পারে। পতঞ্জলি যোগসূত্রের (Patanjali Yoga Sutras. Book 1, Verse 33) একটি মৌলিক নীতি হলো 'অপরিগ্রহ স্থাইলে জন্মান্তরকথা জ্ঞানং' । এর অর্থ হলো, যখন কেউ অপরিগ্রহের নীতিতে দৃঢ় থাকে, তখন সে তার পূর্বজন্ম এবং ভবিষ্যৎ জীবনের জ্ঞান অর্জন করে। কামধেনুর দানশীলতা এবং ক্ষমতার অপব্যবহার প্রসঙ্গকে এই সূত্র এক নতুন দার্শনিক মাত্রা দেয়।
বশিষ্ঠ-বিশ্বামিত্র উপাখ্যানটি এখানে একধরনের 'ধ্যান-সংযম বনাম ভোগবাদী শক্তি'-র প্রতীকী সংঘাত (Thapan, 1997)। বশিষ্ঠের সংযম এবং অপরিগ্রহের নীতি তাকে কামধেনুর ঐশ্বরিক শক্তি ধারণ করার ক্ষমতা দেয়, যেখানে বিশ্বামিত্রের ভোগবাদী আকাঙ্ক্ষা এবং সম্পদ দখলের প্রচেষ্টা তাকে পরাজিত করে। কামধেনু এখানে প্রকৃতির সেই অসীম দানশীলতার প্রতীক, যা কেবল সংযমী ও নৈতিক ব্যক্তির কাছে তার অপার ভাণ্ডার উন্মুক্ত করে, কিন্তু লোভ ও আগ্রাসনের মুখোমুখি হলে তা নিজেই প্রতিরক্ষামূলক রূপ ধারণ করে। এটি মানব অস্তিত্বের গভীরে নিহিত আকাঙ্ক্ষা এবং তার উপর নৈতিক নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তার এক শক্তিশালী দার্শনিক প্রকাশ।

৫. বশিষ্ঠ-বিশ্বামিত্র দ্বন্দ্ব: ক্ষমতা বনাম নৈতিকতার সংঘাত ও উত্তর-ঔপনিবেশিক দৃষ্টি:বশিষ্ঠ ও বিশ্বামিত্রের কাহিনী ভারতীয় পুরাণের এক অন্যতম শক্তিশালী এবং বহু-স্তরীয় আখ্যান (Thapar, 2002), যা ক্ষমতা, আধ্যাত্মিকতা এবং নৈতিকতার চিরায়ত সংঘাতকে তুলে ধরে (Thapan, 1997)। এই আখ্যানের কেন্দ্রে রয়েছে কামধেনু, যিনি নৈতিক শ্রেষ্ঠত্ব ও আধ্যাত্মিক শক্তির প্রতীক। ঋষি বশিষ্ঠের আশ্রমে যখন ক্ষত্রিয় রাজা বিশ্বামিত্র তার বিশাল বাহিনী নিয়ে ভ্রমণ করেন, তখন কামধেনুর অলৌকিক ক্ষমতা তাকে বিস্মিত করে। কামধেনু তার ইচ্ছানুসারে যেকোনো খাবার তৈরি করতে সক্ষম ছিলেন, যার দ্বারা বশিষ্ঠ স্বল্প সম্পদ নিয়েও রাজা ও তার বিশাল বাহিনী কে পরম সন্তুষ্টি সহকারে আপ্যায়ন করেন। রাজার মনে কামধেনুকে নিজের করে নেওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা জাগে। তিনি বিশ্বাস করতেন যে এই গাভী তার রাজকীয় শক্তি, সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব এবং ভোগবাদকে আরও বৃদ্ধি করবে। এটি বস্তুগত ক্ষমতা ও আধিপত্যের প্রতীকী ক্ষুধা, যা মানব ইতিহাসের একটি পুনরাবৃত্ত বিষয়।কিন্তু বশিষ্ঠের ঋষিশক্তি (যা তপোবল ও আত্মিক শক্তির প্রতীক) এবং কামধেনুর ব্রহ্মশক্তি (যা ঐশ্বরিক এবং অলৌকিক ক্ষমতার প্রতীক) বিশ্বামিত্রের বিশাল সামরিক ক্ষমতাকে পরাস্ত করে। কামধেনু তার স্তন্য থেকে অসংখ্য সৈন্য উৎপাদন করেন (নন্দিনী বা শবলা, তার কন্যা) যারা বিশ্বামিত্রের সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে। এই ঘটনা বিশ্বামিত্রকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে এবং তিনি বুঝতে পারেন যে প্রকৃত শক্তি বাহুবলে বা বস্তুগত অধিকারে নয়, বরং নৈতিকতা, জ্ঞান, আধ্যাত্মিকতা এবং সংযমের মধ্যে নিহিত। ম্যাডেলিন বিয়ারদু এই প্রসঙ্গে বলেছেন: "Kamadhenu is the symbol of legitimated abundance; the axis of the Vedic economy rooted in ritual and hierarchical order" (Biardeau, 1994) । অর্থাৎ, কামধেনু বৈধ প্রাচুর্যের প্রতীক, যা বৈদিক অর্থনীতির আচার এবং ক্রমভিত্তিক শৃঙ্খলার উপর প্রতিষ্ঠিত (Rig Veda)। এই উক্তিটি ইঙ্গিত করে যে, প্রকৃত প্রাচুর্য একটি নির্দিষ্ট নৈতিক ও ধর্মীয় কাঠামোর মধ্যে উদ্ভূত হয়, যা বলপ্রয়োগ বা দখলের মাধ্যমে লাভ করা যায় না। এটি 'ধর্ম' এবং 'অর্থ' এর মধ্যে সম্পর্কের একটি মৌলিক বৈদিক বোঝাপড়া।এই আখ্যানটি বর্তমান সমাজে ক্ষমতার অপব্যবহার, বস্তুবাদের প্রতি অন্ধ আসক্তি এবং নৈতিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে নৈতিকতার বিজয়ের এক শাশ্বত বার্তা দেয়। এটি মনে করিয়ে দেয় যে, আধ্যাত্মিক সম্পদ এবং নৈতিক উচ্চতা যেকোনো পার্থিব শক্তির চেয়েও বেশি শক্তিশালী। উত্তর-ঔপনিবেশিক দৃষ্টিতে, বিশ্বামিত্রের লোভ এবং বশিষ্ঠের ঋষিশক্তিকে উপনিবেশ বনাম আদি সংস্কৃতি, অথবা সাম্রাজ্যবাদ বনাম স্থানীয় প্রতিরোধের দৃষ্টিকোণ থেকে পাঠ করা যেতে পারে। বশিষ্ঠের আশ্রমকে এখানে একটি দীর্ঘমেয়াদী স্থানীয় বাস্তুতন্ত্র (Sustainable Local Ecosystem) হিসেবে দেখা যায়, যা তার স্বনিয়মে পরিচালিত হয়। অন্যদিকে, বিশ্বামিত্রের রাজশক্তি বহিরাগত দখলদার, যারা স্থানীয় সম্পদের উপর আধিপত্য বিস্তার করতে চায়। এই বিশ্লেষণ গায়া থিওরি (Gaia Theory) বা আদিবাসী জ্ঞান ব্যবস্থার (Indigenous Knowledge Systems) গবেষণায় নতুন মাত্রা যোগ করে, যেখানে প্রকৃতির সাথে সহাবস্থান এবং সম্পদের স্থানীয় ব্যবস্থাপনা গুরুত্ব পায়। একজন রাজা থেকে একজন ব্রহ্মর্ষিতে বিশ্বামিত্রের রূপান্তর হলো এই গল্পের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক, যা প্রমাণ করে যে, অহংকার ও বস্তুবাদ ত্যাগ করে আধ্যাত্মিক উপলব্ধির দিকে যাত্রা মানব জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য। এটি ব্যক্তির অভ্যন্তরীণ সংগ্রাম এবং সামাজিক কাঠামোতে নৈতিকতার অপরিহার্য ভূমিকার প্রতীক, যা আধুনিক বিশ্বের নেতৃত্ব ও শাসনের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য।৬. কামধেনুর বৈশ্বিক প্রতিসরণ ও আন্তঃসাংস্কৃতিক সংযোগ - একটি তুলনামূলক অধ্যয়ন:
কামধেনুর ধারণাটি কেবল ভারতীয় পুরাণের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং বিশ্বের বিভিন্ন সংস্কৃতিতে অসীম প্রাচুর্য, দানশীলতা এবং জীবনদায়ী শক্তির অনুরূপ প্রতীক ও মিথ খুঁজে পাওয়া যায়। এটি মানব সভ্যতার এক মৌলিক এবং বিশ্বজনীন চিন্তাভাবনার প্রতিফলন। এই সাদৃশ্যগুলি প্রমাণ করে যে, বিভিন্ন ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক সীমারেখা পেরিয়ে মানবজাতি একই ধরনের মৌলিক আকাঙ্ক্ষা ও মূল্যবোধ ধারণ করে। এই তুলনামূলক অধ্যয়ন কামধেনুর বিশ্বজনীন আবেদনকে আরও স্পষ্ট করে তোলে এবং মানবজাতির সম্মিলিত আধ্যাত্মিক চেতনার প্রমাণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে:
নরডিক পৌরাণিক কাহিনীর অডহামলা (Audhumla): নর্ডিক সৃষ্টিতত্ত্বে, আদিম গাভী অডহামলা এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি বরফ চেটে  বুরি (Buri) দেবতাকে (যিনি দেবতাদের পূর্বপুরুষ) জাগিয়ে তোলেন। অডহামলাও সৃষ্টির এক মৌলিক শক্তি এবং জীবন ও প্রাচুর্যের উৎস হিসেবে উপস্থাপিত। কামধেনুর মতো অডহামলাও কেবল একটি প্রাণী নয়, বরং মহাজাগতিক প্রাণশক্তির প্রতীক, যা শুষ্ক ও কঠিন পরিবেশেও জীবন সৃষ্টি করতে পারে l এটি প্রাকৃতিক বিশ্বে নিহিত শক্তির প্রতি এক শ্রদ্ধার প্রতীক এবং সৃষ্টিতত্ত্বে গাভীর অপরিহার্য ভূমিকার বিশ্বজনীন স্বীকৃতি।
গ্রিক কর্নুকোপিয়া (Cornucopia): "প্রাচুর্যের শিং" নামে পরিচিত কর্নুকোপিয়া হলো গ্রিক পুরাণের এক বিখ্যাত প্রতীক (Frazer, 1922)। এটি অ্যামালথিয়ার ছাগলের শিং থেকে জন্ম নেয়, যিনি শিশু জিউসকে দুগ্ধ পান করিয়েছিলেন। কর্নুকোপিয়া তার ইচ্ছা অনুযায়ী যেকোনো খাদ্য ও ধনসম্পদ সরবরাহ করতে সক্ষম ছিলেন। এটি কামধেনুর 'ইচ্ছা পূরণকারী' এবং 'অসীম

দানশীলতা' গুণের সাথে সরাসরি সাদৃশ্যপূর্ণ (Zimmer , 1946)। উভয়ই অসীম প্রাচুর্য ও নিরন্তর দানের প্রতীক, যা প্রকৃতির উদারতাকে প্রতিফলিত করে। এটি মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের প্রতীক, যা প্রাচীন কৃষিভিত্তিক সমাজে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ এবং ফলন ও উর্বরতার সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিত l 

চীনা রু ই (如意 - Ru Yi): তাওবাদের এই প্রতীকটি "যেমন ইচ্ছা তেমন হোক" ধারণাকে প্রকাশ করে। রু ই একটি অলৌকিক দণ্ড, ধারকের ইচ্ছা পূরণ করতে সক্ষম। এটি করুণা, ক্ষমতা এবং ইচ্ছা পূরণের আধার, যা কামধেনুর বরদায়ী রূপের সাথে তুলনীয় এবং চীনা সংস্কৃতিতে শুভকামনার প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। রু ই প্রায়শ:ই দেবতাদের হস্তে দেখা যায়, যা ঐশ্বরিক ক্ষমতার একীকরণ এবং মানবমঙ্গলের (সুখ, সমৃদ্ধি এবং দীর্ঘায়ু) একটি শক্তিশালী প্রতীক।
আব্রাহামিক ধর্মসমূহ (ইসলাম ও খ্রিস্টধর্ম): ইসলাম ধর্মে জান্নাতে (স্বর্গে) দুগ্ধ, মধু ও অমৃতের নদীর বর্ণনা রয়েছে, যা অনন্ত প্রাচুর্য এবং ঐশ্বরিক দানের রূপক। কোরআনে জান্নাতের নহরগুলোর বর্ণনা দেওয়া হয়েছে যা শরাব, দুধ ও মধুর তৈরি। খ্রিস্টান ধর্মেও "দুগ্ধ ও মধুর ভূমি" (Land of Milk and Honey) এর ধারণা ঐশ্বরিক প্রাচুর্য ও আশীর্বাদের প্রতীক, যা ঈশ্বরের প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ভূমিকে নির্দেশ করে। এই প্রতীকী নদীগুলি কামধেনুর স্তন্যধারার প্রতীকী অর্থ বহন করে, যা ঐশ্বরিক অনুগ্রহ ও সমৃদ্ধির ধারণা দেয় এবং মানবজাতির জন্য অফুরন্ত কল্যাণ নির্দেশ করে (Singh 2021)। এগুলি পার্থিব সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত এক আদর্শিক রাজ্যের চিত্র তুলে ধরে, যেখানে অভাব বা কষ্টের কোনো স্থান নেই।
ল্যাটিন আমেরিকা ও আফ্রিকার প্রসঙ্গ (Decolonial Myth Studies): এই তুলনার পরিধিকে আরও বিস্তৃত করে আমরা ল্যাটিন আমেরিকার 'পাচামামা' (Pachamama, Andean Earth Mother) এবং আফ্রিকার 'আসাসেয়া আফ্রিকান ফার্টিলিটি গডডেস' (Asase Yaa, Akan Earth Goddess) এর সাথে কামধেনুর সাদৃশ্য খুঁজে পেতে পারি। আন্ডিজ পার্বত্য অঞ্চলের ইনকা সভ্যতার উর্বরতা দেবী পাচামামা, যিনি পৃথিবী ও প্রকৃতির লালন-পালনকারী শক্তিকে মূর্ত করেন। তিনি মানুষের সীমাহীন লোভের শিকার হন, যেমন কামধেনু বিশ্বামিত্রের লোভের শিকার হয়েছিলেন। একইভাবে, ঘানার আকান জনগণের মধ্যে আসাসেয়া হলো পৃথিবী দেবী, যিনি উর্বরতা, জীবন এবং মৃত্যুর সঙ্গে সম্পর্কিত। এই দেবীরাও প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য এবং মানুষের ভোগের আকাঙ্ক্ষার মধ্যে ভারসাম্যের প্রতীক।
মিশরীয় হাথর ও মেসোপটেমীয় ইনান্না/ইশতার: কামধেনুর ধারণাটি প্রাচীন মিশরীয় ও মেসোপটেমীয় সভ্যতার সঙ্গে  প্রতীকি সাদৃশ্য বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। প্রাচীন মিশরে হাথর ছিলেন মাতৃত্ব, উর্বরতা ও আনন্দের দেবী, যিনি প্রায়ই গাভীর শিং ও সূর্যের চাকতির সমন্বয়ে চিত্রিত হতেন। ‘স্বর্গীয়-গাভী’ (Heavenly Cow) হাথর সূর্যদেব রা’র জন্ম দিয়েছেন বলে বিশ্বাস করা হয়। তাঁর দুগ্ধ পুনর্জন্ম ও অমরত্বের প্রতীক হিসেবে গণ্য হয়, যা কামধেনুর স্তন্যধারা থেকে উৎপন্ন অমৃত, ঘৃত ও শস্যের মঙ্গলধারার সঙ্গে সরাসরি সাদৃশ্যপূর্ণ। Wilkinson (2003)- এর গবেষণায় দেখা যায়, হাথরের এই প্রতীকায়ন মিশরীয়দের জন্য এক আধ্যাত্মিক পুনর্জাগরণের মডেল ছিল।
মেসোপটেমীয় সভ্যতায় সুমেরীয় উর্বরতা দেবী ইনান্না বা ইশতার-এর পৌরাণিক কথায়ও গাভী ও দুধপ্রদায়িনী শক্তির উল্লেখ আছে। ইনান্না ছিলেন কৃষি, প্রেম ও প্রাচুর্যের দেবী। তাঁর মূর্তিতে প্রায়শ:ই উর্বরতা ও প্রাণশক্তির প্রতীক হিসেবে গোদুগ্ধের উপমা পাওয়া যায়। এছাড়া আকাশদেব আন্নু বা অনু-র সঙ্গে গাভীর প্রতীকি যোগ আছে, যা কামধেনুর মহাজাগতিক প্রাচুর্যের ধারণার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। ক্রামার (Kramer 1961) এর বিশ্লেষণ অনুযায়ী, মেসোপটেমীয় পৌরাণিক কাহিনীতে গাভী দেবতাদের কাছে বলিদানযোগ্য পবিত্র প্রাণী হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল, যা জীবনের পুনরাবর্তন ও চক্রাকার সৃষ্টিশীলতাকে প্রতিফলিত করে।
উপরিবর্নীত সাদৃশ্যগুলি প্রমাণ করে যে গাভী প্রতীকটি একান্তই ভারতীয় নয়। বরং প্রাচীন সভ্যতার সামষ্টিক চেতনায় এটি অফুরন্ত পুষ্টি, নৈতিক ভারসাম্য ও প্রাচুর্যের মূর্ত প্রতীক হিসেবে বিরাজ করেছে, যা মানবজাতির মৌলিক আকাঙ্ক্ষা ও প্রাকৃতিক শক্তির প্রতি শ্রদ্ধার প্রতিফলন। এই দৃষ্টিভঙ্গি উপনিবেশবাদের শিকার আদিবাসী সংস্কৃতি ও তাদের জ্ঞান ব্যবস্থার গুরুত্ব তুলে ধরে, যেখানে প্রকৃতি কেবল সম্পদ নয়, বরং একটি জীবন্ত সত্ত্বা হিসেবে পূজিত হয়। ওয়েন্ডি ডনিগার (Doniger, 2014) যেমন বলেছেন, "The idea of inexhaustible nourishment connects myths across civilizations," অর্থাৎ, অফুরন্ত পুষ্টির ধারণা বিভিন্ন সভ্যতা জুড়ে পৌরাণিক কাহিনীগুলিকে সংযুক্ত করে। এটি কেবল সাংস্কৃতিক সাদৃশ্য নয়, বরং মানবজাতির সম্মিলিত চেতনার এক প্রামাণ্য দলিল, যা প্রমাণ করে যে প্রাচুর্য, দানশীলতা এবং জীবনধারার আকাঙ্ক্ষা মানব অস্তিত্বের এক মৌলিক দিক, যা বিভিন্ন রূপে প্রকাশ পায় কিন্তু একই মূল সত্যকে ধারণ করে। এই বিশ্বজনীনতা কামধেনুকে শুধু একটি ভারতীয় প্রতীক না রেখে, তাকে এক মানবীয় চেতনার প্রতিনিধি হিসেবে তুলে ধরে, যা বৈশ্বিক সংলাপে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, কামধেনু ধারণার উৎসকে এককভাবে প্রাচীন মিশর বা মেসোপটেমিয়া হতে আগত বলে দেখা যায় না। বরং গাভী বা স্তন্যধারী দেবীর প্রতীক প্রায় সকল প্রাচীন কৃষিভিত্তিক সভ্যতার এক সমান্তরাল সাংস্কৃতিক বিবর্তনের ফসল। মিশরে হাথর দেবীকে স্বর্গীয়-গাভী হিসেবে পূজা করা হয়েছে, যিনি সূর্যদেব রা’কে জন্ম দেন এবং দুধের মাধ্যমে অমরত্বের প্রতীক হয়ে ওঠেন (Wilkinson, [25])। মেসোপটেমীয় সুমেরীয় মিথে ইনান্না/ইশতার দেবীও উর্বরতা ও পুনর্জন্মের শক্তি হিসেবে গাভী প্রতীকের সঙ্গে যুক্ত (Kramer, [26])। এই প্রতীকী সাদৃশ্যের মধ্য দিয়ে বোঝা যায়, প্রাচীন সভ্যতাগুলি কৃষি, পশুপালন এবং মায়ের স্তন্যকে জীবনের পুষ্টি ও ধারাবাহিকতার মূল উৎস হিসেবে দেখেছে।
তবে ভারতীয় পুরাণে কামধেনু শুধু স্তন্যধারী প্রাচুর্যের প্রতীক নন; তিনি বশিষ্ঠ-বিশ্বামিত্রের উপাখ্যানের মাধ্যমে আধ্যাত্মিক শক্তি, নৈতিকতা, অপরিগ্রহ ও যোগ-দর্শনের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত (Altekar, 1949)। এই দার্শনিক স্তর এবং আধ্যাত্মিক গভীরতা মিশরীয় বা মেসোপটেমীয় আখ্যানের তুলনায় একেবারেই স্বতন্ত্র। অতএব সামগ্রিক কামধেনু ধারণা ভারতীয় উপমহাদেশের মৌলিক পুরাণকল্পনার সৃষ্টি, তবে গাভী/স্তন্যধারী দেবীর সাদৃশ্য আমাদের মানবজাতির সম্মিলিত চেতনায় প্রকৃতি ও মাতৃত্বের প্রতি অফুরন্ত শ্রদ্ধার এক বহুজাতিক প্রতিফলন।

৭. ইকোফেমিনিস্ট দৃষ্টিকোণ ও সমকালীন প্রাসঙ্গিকতা - পরিবেশ ও লিঙ্গ-ন্যায়বিচারের প্রতীক:
কামধেনুকে এক  শক্তিশালী ইকোফেমিনিস্ট প্রতীক হিসেবেও ব্যাখ্যা করা যায়, যা বর্তমান সময়ের জন্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক (Mies 1993), (Vandana Shiva, 1997), (Ganguli, 2025)। ইকোফেমিনিজম হলো এক দার্শনিক ও সামাজিক আন্দোলন যা নারী এবং প্রকৃতির মধ্যে ঐতিহাসিক ও কাঠামোগত সংযোগ স্থাপন করে, এবং উভয়কেই পুরুষতান্ত্রিক ও পুঁজিবাদের দ্বারা শোষিত হিসেবে দেখা হয় (Mitra, 2025)। ভারতীয় সমাজে প্রকৃতিকে প্রায়শ:ই 'মা' হিসেবে শ্রদ্ধা করা হয় (যেমন ধরিত্রী মাতা, গো মাতা) এবং তার দানশীলতাকে সম্মান জানানো হয়। এই প্রজ্ঞা কামধেনুর ধারণার গভীরে প্রোথিত, কারণ তিনি একইসাথে মা, গাভী, দেবী এবং পৃথিবী ও তার সম্পদের প্রতীক। কামধেনু কেবল একটি পৌরাণিক গাভী নন, তিনি দেবীস্বরূপ, আশ্রমের কল্যাণী এবং কৃষিভিত্তিক সমাজের প্রাণকেন্দ্র। তার মাধ্যমে প্রকৃতি ও নারীর লালন-পালনকারী এবং জীবনদায়ী শক্তিকে একীভূত করা হয়। এই প্রতীকী সংযোগ আধুনিক বিশ্বে পরিবেশগত সংকট মোকাবিলায় প্রাচীন প্রজ্ঞার গুরুত্ব তুলে ধরে। কামধেনুর এই রূপায়ন পরিবেশ সচেতনতা এবং লিঙ্গ-সমতার এক জীবন্ত প্রতীক হিসেবে কাজ করে, যা দীর্ঘমেয়াদী কৃষি-আন্দোলন এবং পরিবেশগত নৈতিকতার নৈতিক শিকড় হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
সাম্প্রতিক গবেষণাগুলি ইকোফেমিনিজম এবং ভারতীয় পুরাণের মধ্যে সম্পর্ককে আরও বিস্তারিতভাবে বিশ্লেষণ করেছে (Vandana Shiva, 1997, Mitra, 2025 )। দক্ষিণ এশিয়ার কৃষিভিত্তিক সমাজে 'গাভী ও নারী উভয়ই অবমূল্যায়নের শিকার' - এই বাস্তবতা বিভিন্ন সাম্প্রতিক গবেষণায় উঠে এসেছে। এই গবেষণাগুলি দেখায় যে কীভাবে নারী এবং প্রকৃতির শোষণ পুরুষতান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অধীনে সংঘটিত হয়েছে। কামধেনু সহ অন্যান্য ভারতীয় পৌরাণিক নারী ও প্রকৃতির প্রতীকগুলি (যেমন ধরিত্রী মাতা, নদীর দেবী) এই শোষণের বিরুদ্ধে 'প্রতিরোধ' এবং 'সংরক্ষণের' প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বর্তমানের 'গো-রাজনীতি' (cow politics) কীভাবে কামধেনুর আদি অন্তঃসারকে বিকৃত করছে এবং নারীর শরীর ও প্রকৃতিকে একইভাবে শোষণ করছে, তা একটি গুরুত্বপূর্ণ সমকালীন সংযোগ। এই ধরনের রাজনীতি গরুর দার্শনিক পবিত্রতাকে  ব্যবহার করে রাজনৈতিক ও সামাজিক বিভাজন তৈরি করে, যা কামধেনুর মূল অর্থ, অর্থাৎ দানশীলতা ও সর্বজনীন কল্যাণ, থেকে বিচ্যুত হয়।
সাম্প্রতিক সাহিত্যিক বিশ্লেষণগুলিতে, যেমন চিত্রা ব্যানার্জী দিভাকারুনির (Chitra Banerjee Divakaruni) 'দ্য ফরেস্ট অফ এনচ্যান্টমেন্টস' বা উৎকর্ষ প্যাটেলের (Utkarsh Patel) 'শকুন্তলা: দ্য ওম্যান রংড' (Paul, 2025)- এর ইকোফেমিনিস্ট পাঠগুলিতে দেখা যায় যে, প্রকৃতি কীভাবে নারী চরিত্রের দুর্ভোগের প্রতি সহানুভূতিশীল এবং কীভাবে প্রকৃতির সাথে গভীর বন্ধন নারীদের পিতৃতান্ত্রিক কঠোরতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার শক্তি যোগায়। এটি প্রমাণ করে যে, প্রাচীন ভারতীয় আখ্যানগুলি আধুনিক পরিবেশগত এবং লিঙ্গ-ভিত্তিক ন্যায়বিচারের বিতর্কের জন্য একটি মূল্যবান কাঠামো প্রদান করতে পারে। পরিবেশগত ন্যায়বিচারের জন্য 'কামধেনু মডেল' কে রাজনৈতিক কৃষি আন্দোলনের  দীর্ঘমেয়াদী রূপক হিসেবে দেখানো যেতে পারে, যা স্থানীয় জ্ঞান এবং প্রকৃতির সাথে সহাবস্থানের উপর জোর দেয়।

৮. সৃজনশীল ব্যাখ্যা: কামধেনুর ‘আর্কিটাইপ’ ও কার্ল ইয়ুঙের মিথবিশ্লেষণ:
কার্ল ইয়ুং (Jung, 1968) এর বিশ্লেষণাত্মক মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে, কামধেনু এক শক্তিশালী 'আর্কিটাইপ' (Archetype) বা আদি প্রতিরূপ। তিনি 'গ্রেট মাদার আর্কিটাইপ' (Great Mother Archetype) এর একটি বিশেষ রূপ, যিনি অফুরন্ত উৎস, লালন-পালনকারী শক্তি, সৃষ্টি এবং ধ্বংস - উভয়কেই ধারণ করেন। কামধেনুর এই প্রতীকী রূপায়ণ মানবজাতির সম্মিলিত অচেতন মনে (collective unconscious) প্রোথিত সেই শাশ্বত ধারণাটিকে মূর্ত করে, যা আমাদের পুষ্টি, নিরাপত্তা এবং অসীম সম্ভাবনা সম্পর্কে মৌলিক আকাঙ্ক্ষাগুলি পূরণ করে। মনস্তাত্ত্বিক পৌরাণিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে, কামধেনুকে কেবল একটি পৌরাণিক চরিত্র হিসেবে না দেখে, বরং মানব মনের গভীরতম স্তরের প্রতীক হিসেবে বোঝা যায় । তিনি কেবল বাহ্যিক প্রাচুর্যই নন, বরং অভ্যন্তরীণ মানসিক এবং আধ্যাত্মিক সমৃদ্ধিরও প্রতীক। যখন বিশ্বামিত্রের মতো কোনো চরিত্র কামধেনুকে অধিকার করতে চায়, তা মানব মনের সেই লোভ ও আকাঙ্ক্ষার প্রতীক, যা অভ্যন্তরীণ শান্তির পরিবর্তে বাহ্যিক বস্তুবাদকে অনুসরণ করে। এই ইয়ুঙীয় দৃষ্টি পুরাণ-মনস্তত্ত্বের বিশ্লেষণকে শক্তিশালী করে এবং দেখায় যে, প্রাচীন পৌরাণিক কাহিনীগুলি কীভাবে মানব অস্তিত্বের মৌলিক মনস্তাত্ত্বিক কাঠামোকে প্রতিফলিত করে।

৯. উপসংহার- এক অন্তহীন চেতনাধারা, চিরন্তন বার্তা ও সমসাময়িক 'Call to Action':
কামধেনু ভারতীয় পুরাণের এক অসাধারণ সৃষ্টি, যিনি কেবল একটি পৌরাণিক গাভী বা প্রাচীন মিথের অংশ নন; তিনি মানবজাতির অন্তর্লীন আকাঙ্ক্ষা, প্রাচুর্য এবং নৈতিক শুভবোধের এক গভীর প্রতিফলন (Doniger, 2014)। বৈশ্বিক পৌরাণিককথায়  অনুরূপ ধারণাগুলোর উপস্থিতি প্রমাণ করে যে কামধেনু এক আন্তঃসাংস্কৃতিক চেতনার ধারা, যা সময় ও ভৌগোলিক পরিবেশ অতিক্রম করে মানুষকে শেখায় যে প্রকৃত প্রাচুর্য বাহ্যিক বস্তুগত সম্পদে নয়, বরং অন্তর্নিহিত মঙ্গল, সংযম, নৈতিকতা ও জ্ঞানের মধ্যেই নিহিত (Biardeau, 1994, Smith, 1994)। এই দর্শনটি প্রাচীন ভারতীয় মূল্যবোধের কেন্দ্রবিন্দু, যেখানে আত্মিক সমৃদ্ধিকে বস্তুগত অর্জনের ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়া হয়। কামধেনুর এই চিরন্তন বার্তা মানবজাতিকে প্রকৃতির সাথে সুসম্পর্ক এবং একটি দীর্ঘমেয়াদী ও নৈতিক ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে চলতে আজও অনুপ্রাণিত করে।
বর্তমান সংকটময় পরিবেশে, যেখানে প্রাকৃতিক সম্পদের যথেচ্ছ ব্যবহার, ভোগবাদ এবং মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয় চরম আকার ধারণ করেছে, সেখানে কামধেনুর শাশ্বত বার্তা আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। কামধেনুর দর্শন থেকে রাষ্ট্রনীতি, কর্পোরেট সামাজিক দায়িত্ব (CSR), কৃষি ও পরিবেশনীতি কী শিক্ষা গ্রহণ করতে  পারে, তার স্পষ্ট সুপারিশ করা যায়।
নীতিগত সুপারিশ: রাষ্ট্রীয় নীতিতে 'অপরিগ্রহ' ও 'সংযম'-এর নীতি অন্তর্ভুক্ত করা উচিত, যা সম্পদের সুষম বন্টন এবং পরিবেশগত ন্যায়বিচারকে অগ্রাধিকার দেবে।
CSR ও কৃষিনীতি: কর্পোরেট সংস্থাগুলোকে কেবল মুনাফার দিকে না তাকিয়ে, কামধেনু মডেলের মতো দীর্ঘমেয়াদী উৎপাদন, বন্টন ও ভোগ ব্যবস্থার প্রতি দায়বদ্ধ থাকতে হবে। কৃষি নীতিতে রাসায়নিকের ব্যবহার কমিয়ে জৈব ও প্রাকৃতিক কৃষিকে উৎসাহিত করতে হবে, যা মাটির উর্বরতা ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা করবে (Aich 2024)
পরিবেশ নীতি: প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে, পরিবেশ নীতিতে প্রকৃতিকে কেবল 'সম্পদ' হিসেবে না দেখে 'জীবন্ত সত্ত্বা' হিসেবে সম্মান জানানোর দর্শন গ্রহণ করা উচিত।
জাতিসংঘের দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDG Goals) এর সাথে কামধেনুর আদি দর্শনকে যুক্ত করা যায়। উদাহরণস্বরূপ, SDG 12 (Responsible Consumption and Production - দায়িত্বশীল ভোগ ও উৎপাদন) কামধেনুর অপরিগ্রহ এবং দানশীলতার নীতিকে সরাসরি সমর্থন করে। SDG 15 (Life on Land - ভূমিতে জীবন) ভূমি ও বাস্তুতন্ত্রের সুরক্ষা এবং টেকসই ব্যবহারের উপর জোর দেয়, যা কামধেনুর প্রকৃতির সাথে সহাবস্থানের ধারণার সাথে সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ।

তথ্যসূত্র
1. Aich, P. (2024). Ecofeminism in India: Challenges and Prospects. Journal of Environmental Studies, 15(2), 112-128. 
2. Basu, B. (2023). The Plight of the Rural Woman in Agrarian India: A Socio-Economic Perspective. Academic Press. 
3. Biardeau, Madeleine. (1994). Hinduism: The Anthropology of a Civilization. Oxford University Press 
4. Bose, Mandakranta. (2020). Women in the Hindu Tradition. Routledge. 
5. Devi Bhagavata Purana. Skandha 12. 
6. Doniger, Wendy. (2014). The Hindus: An Alternative History. Penguin Press. 
7. Frazer, James George. (1922). The Golden Bough: A Study in Magic and Religion. MacMillan. 
8.  Ganguli, R. (2025). The Sacred Feminine and Nature: An Ecofeminist Reading of Indian Mythology. Asian Journal of Myth and Culture, 8(1), 45-60. 
9. Jung, Carl Gustav. (1968). Man and His Symbols. Dell Publishing. 
10. Kinsley, David R. (1986). Hindu Goddesses: Visions of the Divine Feminine in the Hindu Religious Tradition. University of California Press. 
11. Mehta, B. (2024). Gender and Environmental Justice in South Asia: A Critical Analysis. University Press 
12. Mies, Maria. (1993). Ecofeminism. Zed Books. 
13. Mitra, A. (2025). Nature as a Protagonist: Ecofeminist Themes in Contemporary Indian Fiction. Journal of Postcolonial Literature, 12(1), 78-92. 
14. Pattanaik, Devdutt. (2022). Devi: The Mother-Goddess: An Exploration. Penguin Random House India. 
15. Paul, S. (2025). The Ecofeminist Lens: Reinterpreting Shakuntala's Relationship with Nature. Studies in Indian Literature, 5(2), 110-125.
16. Patanjali Yoga Sutras. 
17. Rig Veda. Mandala 1, Hymn 164, Verse 46. 
18. Shrivastava, M. (2024, September 10). Villagers worship cow believed to be reincarnation of Kamadhenu. The Times of India. 
19. Shiva, Vandana. (1989). Staying Alive: Women, Ecology and Development. Zed Books. 
20. Singh, V. (2021). The Sacred Cow as a Symbol of Hindu-Muslim Unity in Late 19th Century Hindi Novel. Journal of South Asian Studies, 4(3), 180-195. 
21. Skanda Purana. 
22. Brahmanda Purana. 
23. Zimmer, Heinrich. (1946). Myths and Symbols in Indian Art and Civilization. Princeton University Press. 
24. Wilkinson, R.H. (2003). The Complete Gods and Goddesses of Ancient Egypt. Thames & Hudson. 
25. Kramer, S.N. (1961). Sumerian Mythology. Harper & Row. 
26. Penn Museum. (n.d.). Cattle and the Harappan Chiefdoms of the Indus Valley. Retrieved from https://www.penn.museum/sites/expedition/cattle-and-the-harappan-chiefdoms-of-the-indus-valley/ 
27. Unacademy. (n.d.). Domestication Of Animals In The Indus Valley Civilisation. Retrieved from https://unacademy.com/content/bpsc/study-material/history/domestication-of-animals-in-the-indus-valley-civilisation/ 
28. Srirams IAS. (n.d.). The Zebu Bull in Harappan Civilization. Retrieved from https://www.sriramsias.com/upsc-daily-current-affairs/the-zebu-bull-in-harappan-civilization/

 

মতামত

Please mention the "name of the article and the author" you would like to comment in the following box... Thank you.

  পুজো বার্ষিকীঃ ১৪৩২ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

bottom of page