গল্প
দূর্গাবাড়ি । কবি সম্মান
হিমাদ্রীর হিমঘর । নূপুরের নূপুর । শব্দহীন বিবেকের কঙ্কাল
এমনও হয়ে যায় । শেষ ইচ্ছে
গল্প সমগ্র
ইকো
পয়েন্ট
বিকাশ ব্যানার্জ্জী
নামটা শুনেই ইন্টার্ভিউ বোর্ডের চেয়ারম্যান চমকে উঠলেন। 'কি নাম যেন বললেন আপনার?' 'স্যর, সায়ন চক্রবর্তী - গোল্ড মেডালিস্ট, এম. বি. এ (মার্কেটিং), পুনে বিশ্ববিদ্যালয়।' দ্বিতীয়বারও সেই একই নামটা শোনার পর আশ্বস্ত হলেন যে তিনি কানে ভুল শোনেন নি।
'কিন্তু এ কি করে সম্ভব?' সেই একই নাম, সেই একই পদবী, গায়ের রঙএরও কোন তফাত নেই, সেই একই বুদ্ধিদীপ্ত চাহনি আর সেই একই মিষ্টি হাসি, তার সব যেন কেমন গোলমাল হয়ে যেতে লাগল। হঠাৎ করে দৃষ্টি গেল দেওয়ালে টাঙ্গানো ক্যালেন্ডারের দিকে। কি আশ্চর্যজনক ব্যাপার, তারিখটাও সেই একই ৬ই আগস্ট হিরোশিমা দিবস। এই সব সাদৃশ্য কি নেহাতই কাকতালীয়? নাকি তা অন্য কিছু ইঙ্গিত বহন করছে? আজ থেকে বাইশ বছর আগে, ঠিক আজকের দিনেই, রাগের মাথায় তিনি নিজের হাতে তার পুরানো বন্ধু সায়ন চক্রবর্তীকে খাদে ফেলে খতম করে দিয়েছিলেন। তাহলে, সেই সায়ন চক্রবর্তী আবার এখানে ফিরে এলো কোথা থেকে? এই সমস্ত কথা ভাবতে ভাবতেই পাঁচতারা হোটেলের শীততাপ নিয়ন্ত্রিত চেম্বারে বসেও ঘামতে শুরু করলেন ওমেগা ফারমাসিউটিক্যলস লিমিটেড এর জোনাল সেলস ম্যানেজার প্রবাল ঘোষ দস্তিদার। পকেট থেকে রুমাল বের করে তিনি নিজের কপালের ঘাম মুছতে শুরু করলেন।
তার চোখের সামনে ভেসে উঠল বাইশ বছর আগের খান্ডালার ইকো পয়েন্টের সেই দৃশ্য। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য এম. বি. এ. পাশ করে তিনি ভাগ্যের সন্ধানে নবী মুম্বাইয়ে হাজির হন। নবী মুম্বাইয়ের বেলাপুরে তিনি একটা ওষুধের কোম্পানিতে চাকরি পেয়ে যান। কয়েক মাস চাকরি করার পর, ছুটির দিনে অফিসের বন্ধুদের সাথে বম্বের জুহু বিচ বেড়াতে গিয়ে তার একদিন হঠাৎ দেখা হয়ে গেল তার কলেজের পুরানো বন্ধু, মেধাবী ছাত্র সায়ন চক্রবর্তীর সাথে। কলেজ থেকে পাশ করার পর অনেক পুরানো বন্ধুর সাথেই প্রবালের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। তবে পুরানো বন্ধুদের মজা একটাই, দূরে যাওয়াও যেমন সহজ, কাছে আসাটা তার চেয়েও বেশি সহজ। নিজের পুরানো বন্ধুর সাথে জুহু বিচে বসে উইলস ফিল্টার সিগারেটে সুখ টান দিতে দিতে প্রবাল জানতে পারল যে তার পুরানো বন্ধু সায়ন এম.এস.সি পাশ করার পর আই. আই. টি. বম্বে থেকে পলিমার কেমিস্ট্রি নিয়ে পি. এইচ. ডি. করেছে। সিগারেট শেষ করে সমুদ্র সৈকতের ঠাণ্ডা হাওয়ায় দুই বন্ধু মিলে ভেলপুরি খেতে থাকল। সায়ন জানাল যে পি. এইচ. ডি. করার পর এখন সে পুনের ন্যাশনাল কেমিক্যাল ল্যাবরেটরিতে সায়েন্টিস্টের চাকরি করে। কথাগুলো শুনেই প্রবাল মনে মনে ভাবল, আমাদের দেশে বেকার সমস্যা যতই ভয়াবহ হোক না কেন, এই দেশে মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের চাকরির কোন অভাব নেই। ভেলপুরি খাওয়া শেষ হওয়ার পর সায়ন তাকে নেমন্তন্ন করল – 'প্রবাল আগামী শনিবার - রবিবার তুই কি করছিস রে? আমার পুনের ফ্ল্যাটে চলে আয় না, দুটো দিন ধরে দুই বন্ধু মিলে চুটিয়ে আড্ডা মারব'। প্রবাল প্রথমে কিছুটা ইতস্তত: করতে থাকায় মুচকি হেসে সায়ন বলল - 'তোর জন্য কিন্তু আমার পুনের ফ্ল্যাটে একটা বিরাট বড় চমক অপেক্ষা করছে রে'।
প্রবাসে বাঙালি মানেই নিজের লোক, পরম-আত্মীয়। কলেজের পুরানো বন্ধুর সাথে ছুটির দুটো সুখের দিন কাটানোর লোভে প্রবাল শনিবার ভোরের বাসে চেপে সায়নের পুনের ফ্ল্যাটের উদ্দেশে রওনা দিল। এদিকে সায়ন যথা সময়ে পুনের শিবাজী নগর বাস স্ট্যান্ডে তার নতুন চেরী রেড রঙের মারুতি গাড়ি নিয়ে হাজির হল। এ. সি. কারে চেপে ঠাণ্ডা হাওয়ায় কার - স্টিরিওতে গান শুনতে মিনিট পনেরোর মধ্যেই প্রবাল বন্ধুর পুনের ফ্ল্যাটে হাজির হল। সায়নের ফ্ল্যাটের দরজার কলিং বেল বাজাতেই, মিলল সাঙ্ঘাতিক চমক, মেরুন রঙএর সালওয়ার কামিজ পরে গালে একমুখ হাসি নিয়ে ফ্ল্যাটের দরজা খুলতে এসেছে সায়নের স্ত্রী। তাদেরই কলেজের পুরানো বান্ধবী, পরমা সুন্দরী সাগরিকা। বন্ধুর ফ্ল্যাটের নরম সোফায় বসে ঠাণ্ডা পানীয় গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে কলেজের সোনালী দিনগুলো প্রবালের চোখের সামনে ভাসতে লাগল। সাগরিকা শুধু পরমা সুন্দরীই নয়, তার মিষ্টি গলার জন্য পুরো কলেজে সে 'কোকিল-কণ্ঠী' বলে সুপরিচিত ছিল। ভগবানের এমনই বিচিত্র লীলা যে এই দুনিয়াতে সাধারণত: গায়ক গায়িকাদের চেহারা সুন্দর হয় না, কিন্তু সাগরিকার বেলায় এই নিয়মেরও ব্যতিক্রম ঘটেছে। টানা টানা চোখ, দুধে আলতা গোলা গায়ের রঙ, মিষ্টি হাসি সবকিছু মিলিয়ে সাগরিকা ছিল কলেজের সব ছেলেদের কাছে স্বপ্ন সুন্দরী। রূপসী সাগরিকাকে যে কলেজে কত ছেলে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছেল তার কোন হিসেব নেই। সায়ন কলেজের সেই স্বপ্ন সুন্দরীকে শেষে নিজের বউ হিসেবে পেল, ব্যাটা সত্যিই ভাগ্যবান, তাকে হিংসা না করে পারা যায় না। প্রবালের কাছে গিয়ে মুচকি হেসে সায়ন বলল - 'কি রে তোকে বলেছিলাম না চমকে দেব।' স্নান সেরে দুপুরে দুই বন্ধু মিলে একসাথে ডাইনিং টেবিলে খেতে বসলেন। তাদের দুজনকে হেসে হেসে সাগরিকা খাবার পরিবেশন করতে থাকল। সে তার নিজের হাতেই আজকের সব পদ রেঁধেছে - মাটন বিরিয়ানি, বুন্দি রাইতা, চিংড়ি মাছের মালাইকারি, নারগিসি কোফতা আর খাবার শেষে রয়েছে নলেন গুড়ের পায়েস।
সাগরিকার শুধু গলায় জাদু নেই, তার হাতেও যে জাদু রয়েছে। সে ব্যাপারে প্রবালের আর কোন সন্দেহ রইল না। কথায় বলে – 'কোন পুরুষ মানুষের হৃদয়ে পৌঁছানোর সবচেয়ে সহজ রাস্তা হল তার পেট দিয়ে।' প্রবাল মনে মনে ভাবতে লাগল যে এমন সর্বগুণ সম্পন্না নারীর প্রেমে পড়বে না, এমন সাধ্য বোধহয় এ জগতে কারও নেই। খাওয়া দাওয়া শেষ হওয়ার পর সবাই মিলে জমিয়ে আড্ডার আসর বসাল।চলতে থাকল হাসাহাসি, অন্তাক্ষরী, সায়নের আবৃতির আসর।
সাগরিকাও অসাধারণ সুন্দর দুটো রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনাল গোপন কথাটি রবে না গোপনে' এবং 'আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ'। কিভাবে যে পুরো দিনটা কেটে গেল, তা টেরই পাওয়া গেল না। রাত্রিবেলায় খাওয়ার টেবিলে বসে সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল যে আগামীকাল রবিবার অর্থাৎ ৬ই আগস্ট সায়নের নতুন কারে করে সবাই মিলে লোনাভালা, খান্ডালা হিল স্টেশন বেড়াতে যাওয়া হবে। দেওয়ালের ক্যালেন্ডারের দিকে চোখ পড়তেই সাগরিকা হেসে উঠল –
'হিরোশিমা দিবসের দিনে আমরা সবাই বেড়াতে যাচ্ছি, কোন বোমা না ফাটলেই হল।' কলেজের দিনগুলো থেকেই সায়নের ছিল ফটোগ্রাফির সাঙ্ঘাতিক নেশা। পাহাড়, নদী, ঝর্ণা, ফুল, পাখি, প্রজাপতি - সব কিছুই প্রাণবন্ত হয়ে উঠত তার ক্যামেরার লেন্সের জাদুতে। কথা মত পরের দিন
ভোরবেলায় সবাই মিলে সায়নের কারে করে লোনাভালা খান্ডালার উদ্দেশ্যে রওনা দিল। খান্ডালার রাজামাচি গার্ডেনে পৌঁছে সায়ন মেতে গেল তার নতুন ক্যানন এস. এল. আর ক্যামেরায় ফটো তুলতে। আগস্ট মাসের বর্ষায় বৃষ্টির ধারা সহ্যাদ্রি পর্বত বেয়ে নীচে নেমে সুন্দর জলপ্রপাতের আকার ধারণ করেছে। যেদিকেই চোখ যায় সেই দিকেই কেবল সবুজের সমারোহ। বৃষ্টির জলে ভিজে গাছের পাতাগুলো সবুজ পান্নার মত চকচক করছে। এই রকম অনাবিল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যে নিজেকে পেয়ে প্রকৃতি প্রেমিক সায়ন আনন্দে আত্মহারা, তার খুশির সীমা নেই। মনের আনন্দে গাছপালা, ফুল, পাখি, অর্কিডের ছবি তুলতে লাগল সায়ন। এদিকে সায়ন যখন ছবি তুলতে ব্যস্ত, তখন নিজের মনে গুনগুন করে গান জুড়ে দিল সাগরিকা। তার মিষ্টি গান শুনতে শুনতে প্রবালের কলেজের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেল। সাগরিকার প্রতি প্রবালের দুর্বলতা সেই কলেজের দিন থেকেই, কিন্তু সাহস করে নিজের মনের কথা কোনদিন সে সাগরিকাকে বলতে পারে নি। অনেকক্ষণ ধরে ছবি তুলে ক্লান্ত হয়ে সায়ন অবশেষে গরম গরম কফি আর বাটার কর্ণ কিনে আনতে রাস্তার ওপারের দোকানে চলে গেল। কিছুটা সময়ের জন্য সাগরিকাকে কাছে একা পেয়ে তাকে নিজের পুরানো দুর্বলতার কথা সাহস করে প্রবাল জানিয়ে ফেলল। সাগরিকার নরম হাত ধরে বলে ফেলল প্রবাল - 'সাগরিকা তোমাকে আমার ভীষণ ভালো লাগে। সেই কলেজের দিনগুলো থেকেই আমি তোমার প্রেমে পাগল'। কথাগুলো শোনা মাত্রই এক ঝটকায় নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে প্রবালকে ভৎসনা করল সাগরিকা – 'তোমার লজ্জা করে না প্রবাল নিজের বন্ধুর স্ত্রীকে খারাপ নজরে দেখতে? ছিঃ, ছিঃ, তোমার শরীরে যদি মানুষের চামড়া থেকে থাকে তাহলে তুমি কোথাও গিয়ে ডুবে মরো'। সাগরিকার এমন সাঙ্ঘাতিক অপমানজনক কড়া কথা শুনে রাগে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে যায় প্রবাল। সাগরিকার প্রতিটি শব্দ তার বুকে তীরের মতো আঘাত করল। তবে প্রবাল এত সহজে ছেড়ে দেবার পাত্র নয়, এই অপমানের প্রতিশোধ সে নিয়েই ছাড়বে, দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিল সে।
খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ করে সায়নের কার এবার ছুটল খান্ডালার ইকো পয়েন্টের উদ্দেশে। পুরো ঘটনাটা ঘটে যাওয়ার পরে, কারের মধ্যে পরিবেশ একেবারেই থমথমে। প্রবাল আর সাগরিকা দুজনেই মুখ গোমড়া করে চুপচাপ বসে আছে। পুরো ঘটনাটা সম্বন্ধে অজ্ঞ সায়ন নীরবতা ভঙ্গ করল - 'কি ব্যাপার, তোমরা দুজনেই এমন গম্ভীর মুখ করে বসে আছ কেন? এত থমথমে পরিবেশ, ব্যাপারটা কি?' গম্ভীরভাবে উত্তর দিল সাগরিকা – 'কিছু হয় নি।' ইকো পয়েন্টে পৌঁছানোর পর সাগরিকা মনমরা হয়ে একটা বেঞ্চে চুপ করে একাকিনী বসে থাকল আর শিশুর মতো সরল সায়ন আবার মেতে গেল তার ফটো তোলার নেশায়। রসায়নের ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও সব গাছপালা, অর্কিডের বোটানিক্যাল নাম তার ঠোঁটস্থ। প্রবাল মনে মনে স্বীকার করল যে সায়নের মেধা আর প্রজ্ঞার প্রশংসা না করে কোন উপায় নেই। তার এই সাঙ্ঘাতিক প্রতিভার জোরেই সায়ন আজ সে জীবনে উচ্চ প্রতিষ্ঠিত, আর সেই জন্যই সাগরিকার মতো সর্বগুণ সম্পন্না নারী আজ তার স্ত্রী। এই সমস্ত কথা ভাবতে ভাবতেই প্রবালের মাথাটা গরম হয়ে গেল। হঠাৎ তার চোখে পড়ল ইকো পয়েন্টের রেলিঙের এক দিকটা ভাঙ্গা আর সেই জায়গাটার ঠিক নিচেই রয়েছে ভয়ানক খাদ। বৃষ্টির জলে ভিজে সেই রেলিঙের দিকে যাওয়ার রাস্তাটায় হাল্কা কাদা আর শ্যাওলা জমে গেছে, আর সেই রাস্তাটা হয়ে উঠেছে ভয়ানক পিছল। মুহূর্তের মধ্যে প্রবালের মাথায় খেলে গেল শয়তানি বুদ্ধি।
সায়নকে একা পাশে পেয়ে প্রবাল বলল - 'সায়ন, ওই রেলিঙের দিকটাতে গেলে নিচের উপত্যকার তুই খুব ভাল ভিউ পাবি। দারুণ ফটো আসবে কিন্তু'। আপন ভোলা সায়ন বন্ধুর কথায় অন্ধ বিশ্বাস করে সেই দিকটায় চলে গেল। ভাঙ্গা রেলিঙটার কাছে গিয়ে, সায়ন নীচের উপত্যকার সৌন্দর্যের ছবি তুলতে মেতে গেল। প্রবাল চারদিকটা একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিল। জায়গাটা একেবারে জনশূন্য। সায়ন যখন নিজের মনে ক্যামেরার ফোকাস ঠিক করতে ব্যস্ত, সেই সময় প্রবাল পেছন থেকে তাকে সজোরে ধাক্কা মেরে নিচের খাদে ফেলে দিল। 'বাঁচাও, বাঁচাও' - চিৎকার করতে করতে সায়ন কয়েক হাজার ফুটের নিচের খাদে পড়ে গেল। তার চিৎকার শুনে বেঞ্চ থেকে সাগরিকা দৌড়ে এল, কিন্তু ততক্ষণে সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। অসহায় সাগরিকা গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে থাকল - 'সায়ন, সায়ন'। আকাশ বাতাস ভেদ করে তার সেই হৃদয় বিদারক চিৎকার সহ্যাদ্রি পর্বতমালার গায়ে ধাক্কা খেয়ে প্রতিধ্বনিত হতে থাকল - 'সায়ন ... সায়ন ... সায়ন ... সায়ন ... সায়ন ... সায়ন।'
সাগরিকার সেই চিৎকার আজও প্রবালের কানে ভাসছে। ইকো পয়েন্টের সেই ভয়ানক স্মৃতি কোনদিনই প্রবাল ভুলতে পারবে না। আজ তাই ইন্টার্ভিউ চলাকালীন পুরানো বন্ধু সায়ন চক্রবর্তীর নামটা শুনেই তার খান্ডালার সেই ভয়ানক স্মৃতি মনে পড়ে যায়। তার মনটা পৌঁছে গেছিল বাইশ বছর আগের খান্ডালায়। নিজের পাশের চেয়ারে বসা ম্যানেজার উৎপলবাবুর বাঁজখাই গলার আওয়াজে হঠাৎ করে তার সম্বিৎ ফিরে এল। ইন্টারভিউ তখনো চলেছে, উৎপলবাবু একের পর এক প্রশ্ন করে চলেছেন সায়ন চক্রবর্তী নামের বাইশ বছরের সেই তরুণ যুবককে –
'আপনার সার্টিফিকেটগুলোই বলে দিচ্ছে যে আপনি মেধাবী ছাত্র। আচ্ছা, আপনি বলতে পারেন কি বিপণনের বীজ মন্ত্র কি?' মুহূর্তের মধ্যেই সঠিক উত্তর দিল সেই মেধাবী ছাত্র -
'আগে নিজেকে বিক্রি কর, তারপরে নিজের পণ্যকে বিক্রয় কর'। তরুণ যুবকটি হাসিমুখে একের পর সঠিক উত্তর দিয়ে চলেছে। তার অনন্য সাধারণ মেধার দ্বারা ইন্টার্ভিউ বোর্ডের সকলকেই সে চমকে দিল। যুবকটির অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা ও মেধা দেখে প্রবালের প্রতি মুহূর্তেই নিজের পুরানো বন্ধু সায়নের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। তার চটপট সঠিক উত্তর দেওয়ার ক্ষমতা দেখে ম্যানেজার উৎপলবাবু উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠে বলেন –
'সায়নবাবু, আপনাকে অভিনন্দন জানাই। আপনার মতো মেধাবী ছাত্রকে নিয়োগ করতে পেরে আমরা সকলেই আনন্দিত।' প্রবাল নিজের মনে শুধু বিড়বিড় করতে থাকল - 'তাহলে কি সায়নই পুনর্জন্ম নিয়ে আবার এখানে ফিরে এল নাকি?' এই সব সাতপাঁচ কথা ভাবতে ভাবতে প্রবাল নিজের মাথা চুলকোতে লাগল।
গল্প সমগ্র
প্রাণের
বান্ধব
বিকাশ ব্যানার্জ্জী
'পোঁ-ঘড়াঙ্গ-ঘং-ধক-ধডাশ-পোঁ' - বিকট কর্কশ আওয়াজ করতে করতে একটা কয়লা বোঝই মালগাড়ী অতি মন্থর গতিতে অন্ডাল রেল ষ্টেশন অতিক্রম করে চলেছে। ষ্টেশনের ঠিক পাশেই অবস্থিত রেল কলোনি। রেল ষ্টেশনের মাইকের প্রতিটি ঘোষণাই কলোনির বাসিন্দারা নিজেদের কোয়ার্টার থেকে পরিষ্কার ভাবে শুনতে পান। তবে সেই ঘোষণা না শুনতে পেলেও তারা সঠিকভাবে বলে দিতে পারেন যে কোন ট্রেন ষ্টেশন অতিক্রম করছে। সব ট্রেনেরই নাম আর নম্বর তাদের সকলেরই মুখস্থ, ট্রেন তাদের জীবনের এক অপরিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এই রেল কলোনির ঠিক মাঝখানেই অবস্থিত একটা বিরাট বড় মাঠ, আর সেই মাঠের পাশেই রয়েছে গোটা পনেরো ছোট্ট সিঙ্গেল রুমের রেলের কোয়াটার। এই কোয়ার্টারেই থাকে রেলের গ্যাংম্যান বুধন মাহাতো। গ্রীষ্মকালের প্রখর রৌদ্রে তার শরীর তেতে পুড়ে যায়, বর্ষাকালে বৃষ্টির জলে তার গোটা শরীর ভিজে যায়। সারা বছর ধরেই ভারী, ভারী ওজন নিজের কাঁধের ওপর রেখে, রেল-লাইনের ওপর দিয়ে রোজ বিশ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে যায়। তবে সাঙ্ঘাতিক পরিশ্রমী এই রেল কর্মচারীর নিজের পাড়ায় কেবল একটাই পরিচয় 'মাতাল বুধন'। কোলিয়ারির কাছাকাছি অবস্থিত বলে অন্ডালে প্রতি বছরই সাংঘাতিক গরম পড়ে। গ্রীষ্মের দাবদাহ সহ্য করতে না পেরে রেল কলোনির বাসিন্দারা প্রতিদিন সন্ধেবেলায় এই বড় মাঠেই বসে থাকে।
'এর আগে কখনো এত সাঙ্ঘাতিক গরম এখানে পড়ে নি' – এই কথা বলতে বলতে রাত্রের স্নান সেরে গায়ে পাউডার লাগিয়ে মাঠে এসে বসলেন রেলের টি. টি. ই জনার্দনদা। তাঁর কথায় সায় জানাল কেবিন ম্যান মুকুল দাস -
'দাদা, আপনি ঠিকই বলেছেন। এই প্রচণ্ড গরমে আর নিজেদের ঘরে বসে থাকতে পারা যাচ্ছে না। এ বছর, একদিনের জন্যও কালবৈশাখীর দেখা নেই। বর্ষা যে কবে নামবে তা শুধু ভগবানই জানে।' গলদঘর্ম হয়ে হাঁসফাঁশ করতে থাকেন গার্ড নীহারবাবু -
'একটু যে গায়ের ঘামগুলো শুকোবে সেই সুযোগটুকুও নেই, গাছের একটা পাতাও কোথাও নড়ছে না রে বাবা।' গরমের গল্পে যখন সবাই মশগুল, সেই সময় হঠাৎ মাঠের পাশে অবস্থিত বুধনের বাড়ী থেকে হুংকার শোনা গেল।
- 'কারো বাপের ধার ধারি না, নিজের মেহনতের পয়সায় মদ খাই, তোর যদি না পোষায়, তাহলে তুই আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যা' – এই বলে নিজের স্ত্রী জয়াকে অশ্রাব্য গালাগালি দিতে শুরু করল মাতাল বুধন। মদ খেয়ে গালাগালি, চিৎকার, চেঁচামেচি করা বুধনের নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। প্রতিদিনই মদ খেয়ে এসে সে নিজের বাড়িতে অশান্তি করে। কলোনির পরিবেশ কলুষিত করছে বলে তার ওপরে পাড়ার সকলেই প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত। বহুদিন ধরেই কলোনির তাকে সকলে মিলে এই ব্যাপারে বুঝিয়ে চলেছে, কিন্তু তাদের সব প্রচেষ্টাই নিষ্ফল হয়ে গেছে। নিজেকে শোধরানো তো দুরের কথা, বুধনের মাতলামি যেন ইদানীং সব মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছিল। মাঠে বসে সকলে মিলে যখন বুধনের মাতলামি নিয়ে আলোচনা করছিল, এমন সময় তার স্ত্রী জয়ার কান্নার আওয়াজ শোনা গেল। 'আমাকে বাঁচাও গো, মেরে ফেলবে গো।' রাতের অন্ধকারেই বুধন নিজের বউকে মারতে মারতে বাড়ির থেকে বের করে দিচ্ছে, এই দৃশ্য নিজেদের চোখের সামনে দেখে সকলেরই মাথা গরম হয়ে গেল। রাগের মাথায় উপস্থিত জনতা গর্জন করতে থাকল।
- 'অনেক দিন ধরেই তোর অত্যাচার আমরা সহ্য করে চলেছি, কিন্তু আজ আমাদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেছে। - 'আজ তোরই একদিন নয় তো আমাদেরই একদিন' এই বলে সকলে মিলে বুধনকে দু-চার হাত লাগিয়ে দিল। প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণে মদ খেয়ে বুধনের শরীরের শক্তি বহুদিন আগেই নিঃশেষিত হয়ে গেছে। গণধোলাই খেয়ে টাল সামলাতে না পেরে, সে পাড়ার খোলা নোংরা ড্রেনে পড়ে যায়। মদ্যপ অবস্থায় ড্রেনে পড়ে গিয়ে,সেখান থেকে বেরিয়ে আসার ক্ষমতাও সে হারিয়ে ফেলেছে। হাউহাউ করে অসহায় ভাবে সে শিশুর মতন কাঁদতে থাকল
- 'আমাকে ছেড়ে দাও গো, মরে যাবো গো,আমাকে বাঁচাও গো।'
স্বামীর করুণ আর্তনাদ শুনে জয়ার রাগ অভিমান মুহূর্তের মধ্যে কর্পূরের মতো উধাও হয়ে গেল। প্রাণপণ চেষ্টা করে সে নিজের দু-হাত দিয়ে নিজের স্বামীকে টেনে ড্রেন থেকে বের করে আনল। ড্রেনে পড়ে যাওয়ার পর, বুধনের গোটা গায়ে নোংরা পচা কাদাজল লেগে রয়েছে, আর তার ঠোঁটের কোণা দিয়ে রক্ত ঝরে পড়ছে। পায়ে চোট লাগার জন্য সে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে থাকে। নিজের স্বামীর এই রকম অসহায় অবস্থা দেখে জয়া চিৎকার করতে থাকে
– 'আমার স্বামী, আমাকে মেরেছে, তা বেশ করেছে। কিন্তু তাই বলে এই অসুস্থ মানুষটাকে জানোয়ারের মতন মারতে, তোমাদের এতটুকু বিবেকে বাঁধল না গো?' এই বলে হাউ-হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে জয়া নিজের মাতাল স্বামীকে ধরে ধরে নিজেদের ঘরের ভেতরে নিয়ে গেল। মাতাল স্বামীর প্রতি জয়ার এই ধরণের অদ্ভুত ভালোবাসা দেখে পাড়ার সকলেই স্তম্ভিত হল। মহানায়ক উত্তমকুমারের অন্ধ ভক্ত জনার্দনদা গুনগুন করে নিজের মনে গান জুড়ে দিলেন - 'নারী চরিত্র বেজায় জটিল, কিছুই বুঝতে পারবে না, এরা কোন ল মানে না, তাই এদের নাম ললনা।' এ বছর বৃষ্টি নামার কোন লক্ষণই নেই, প্রতিদিন গ্রীষ্মের প্রখরতা বেড়েই চলেছে। গ্রীষ্মের প্রকোপ বৃদ্ধির সাথে সাথেই রেল কলোনিতে লোডশেডিং আর জলকষ্টের সমস্যা বাড়তে থাকল। সাঙ্ঘাতিক
গরমে লোকদের প্রাণান্তকর অবস্থা হয়ে উঠল। গ্রীষ্মের দাবদাহ থেকে পরিত্রাণ পাবার জন্য পাড়ার বাসিন্দারা মনস্থির করলেন বৃষ্টির সমবেত প্রার্থনা করে পাড়ায় চব্বিশ প্রহর হরিনাম সংকীর্তনের আয়োজন করা হবে। সেই মতো পাড়ার ক্লাবের ছেলেরা চাঁদা তুলে রেল কলোনিতে হরিনামের আয়োজন করল। আকাশ বাতাস মুখরিত হল 'জয় গৌর-নিতাই, জয় রাধা মাধব' ধ্বনিতে। পাড়ার সকলের সাথে সাথে মাতাল বুধনও হরিনাম সংকীর্তনে মেতে গেল। সে নিজের হাতে চায়ের কেটলি নিয়ে কীর্তন দলের লোকজনকে চা পরিবেশন করতে লাগল। গরম গরম চা খাওয়ানোর পর বুধন তাদের কাছে আবদার করল,
- 'ঠাকুর, তোমরা হলে গিয়ে গুণীজন। তোমাদের গান শুনে আমারও সবাইকে নাম গান শোনাতে ইচ্ছে করছে। তোমরা কিন্তু আমার গানের সাথে একটু বাজনা বাজিও গো।'
সন্ধ্যাবেলায় স্নান সেরে নতুন ঘিয়ে রঙের পাঞ্জাবী পড়ে কপালে চন্দনের তিলক কেটে হাজির হল বুধন। মঞ্চে উঠে, উপস্থিত সকল শ্রোতাদের নমস্কার করে বুধন গান ধরল।
- 'ভজো গৌরাঙ্গ, কহ গৌরাঙ্গ, লহ গৌরাঙ্গের নাম রে, যে জনা গৌরাঙ্গ ভজে, সে হয় আমার প্রাণ রে।' বুধনের গানের মিষ্টি গলা শুনে সকলেই অবাক, মাতাল বুধনও যে এত সুন্দর গান গাইতে পারে, কলোনির কারোরই তা জানা ছিল না। পাড়ার জনার্দনদার স্ত্রী মাধবী বরাবরের ঠোঁট কাটা। বুধনের গান শেষ হবার পর, তিনি তাকে জিজ্ঞেস করে ফেললেন,
- 'বুধনদা, আপনার যখন ভগবানের নাম গান এতই ভাল লাগে, তাহলে আপনি রোজ এত মদ খান কেন?' তার কড়া কথা শুনে বুধনের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল,
- 'বৌমা, আমি কি আর শখ করে মদ খাই গো? উনিশ বছরের একমাত্র মেয়েটা চারদিনের জ্বরে দুনিয়া ছেড়ে চলে গেল, ওপরওয়ালার কি অদ্ভুত বিচার দেখ, তাই নিজের সব দুঃখ, যন্ত্রণা ভুলে থাকার জন্যই আমি রোজ মদ খাই।'
বুধনের কথাগুলো শুনে উপস্থিত সকলের মনটা উদাস হয়ে গেল। সারাজীবন ধরে শুধু একের পর এক দুঃখ পাবার জন্যই কিছু মানুষ বোধহয় এই পৃথিবীতে জন্ম নেয়। সংসারে সুখের মুখ দেখবার সৌভাগ্য তাদের কোনদিনই হয় না। বুধনের সংসারে প্রতিদিনই অশান্তি লেগে থাকত। নিজের মেয়ে হারানোর শোকে বুধনের স্ত্রী জয়া সবসময় মনমরা হয়ে থাকত। পাড়ার লোকদের সাথে সে খুব একটা বেশি কথা বলত না। নিজের দুঃখকে সে নিজের বুকের মধ্যেই লুকিয়ে রাখত। একদিন রাত ডিউটি সেরে বুধন যখন নিজের বাড়িতে ফিরল,সে নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারল না। সে দেখল তার ঘরের মেঝেতে জয়ার নিষ্প্রাণ দেহ পড়ে রয়েছে। রাত্রিবেলায় ঘুমোতে ঘুমোতেই জয়ার হৃদযন্ত্র চিরকালের মতো স্তব্ধ হয়ে গেছে। বুধনের বুকফাটা কান্নার আওয়াজে একে একে পাড়ার সব লোকজন জড় হয়ে যায়। তার ছোট্ট কোয়ার্টারে পাড়া প্রতিবেশীদের ভিড় জমে যায়। পাড়ার সবাই মিলে জয়ার নিষ্প্রাণ দেহ বুধনের ঘরের উঠোনে নামিয়ে রাখে। কলোনির এয়ো স্ত্রী-রা তার পার্থিব শরীরের পাশে ধুপ জ্বালিয়ে দিয়ে। তারা জয়ার সিঁথিতে লাল রঙ্গের সিন্দূর দিয়ে তার পায়ে আলতা লাগিয়ে দেয়। বুধনের দুঃখের কথা ভেবে পাড়ার সকলেরই চোখ ছলছল করতে থাকল। হঠাৎ সবার লক্ষ্য হল, বুধন তার নিজের বাড়ি থেকে গায়েব হয়ে গেছে। তখন সবাই মিলে তার খোঁজ চালাতে লাগল, কিন্তু আশেপাশের কোথাও তার দেখা মিলল না। এদিকে বেলা বাড়ছে, পাড়ার ক্লাবের ছেলেরা মৃতদেহ সৎকারের জন্য তাড়াহুড়ো করতে লাগল। কেবল বুধনের জন্যই সেই কাজ আটকে আছে বলতে থাকল সবাই। ধীরে ধীরে সকলের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যেতে থাকল আর মাতাল বুধনের ওপর সবাই রাগারাগি করতে থাকল।
পাড়ার সব বাসিন্দারা যখন তার ওপরে ভয়ানকভাবে বিরক্ত, সেই সময়ে নিজের দু-চোখ জবা ফুলের মতো লাল করে আকণ্ঠ মদ খেয়ে টলতে টলতে বুধন নিজের কোয়ার্টারে হাজির হল। বহুদিন আগেই ভগবান তার কাছ থেকে তার একমাত্র মেয়েকে কেড়ে নিয়েছিল। আজ সেই ভগবানই তার তেইশ বছরের পুরানো সাথী জয়াকে তার থেকে আবার ছিনিয়ে নিল। এত বড় পৃথিবীতে আজ বুধন একেবারে একা হয়ে পড়ল। টলবল করতে করতে জয়ার মরদেহর পাশে গেল বুধন। তার মাথায় নিজের হাত রেখে তাকে শেষবারের মতো প্রাণভরে আশীর্বাদ করল বুধন। সে উপলব্ধি করতে পারল যে সারা জীবন জয়াকে কোন সুখই দিতে পারে নি। অতীতের প্রতিটি ঘটনা তার চোখের সামনের ভেসে উঠল। তার মনে পড়ে গেল প্রতিদিন মদ্যপ অবস্থায় বাড়ি ফিরে এসে নিজের স্ত্রীকে সে কত অশ্রাব্য গালাগালি দিয়েছে। কতবার যে সে তার গায়ে সে হাত তুলেছে তার কোন হিসেব নেই। হাজার বার অপমান করা সত্ত্বেও, কিন্তু জয়া তার প্রচণ্ড খেয়াল রাখত। তার হয়ে সে পাড়ার সকলের সাথে ঝগড়া করত। জয়ার ভালোবাসার দাম সে কোনদিনই দিতে পারে নি। এই হৃদয়হীন, নিষ্ঠুর সমাজে আর কার জন্যই বা সে বেঁচে থাকবে। এই কথা ভাবতে ভাবতে, সাথীহারা বুধন হাউ-হাউ করে কাঁদতে লাগল। আকাশের দিকে ওপরে তাকিয়ে অদৃশ্য ওপরওয়ালার উদ্দেশে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বুধন গান জুড়ে দিল -
'প্রাণের বান্ধব রে, দাও দেখা দয়া করে।' মাতাল বুধনের দুঃখে দেখে সকলের প্রাণ কেঁদে উঠল। জয়ার মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে 'বল হরি হরিবোল' ধ্বনি দিয়ে, রাস্তায় খই ছড়াতে ছড়াতে, মন্থর গতিতে ক্লাবের ছেলেরা শ্মশানের উদ্দেশ্যে এগিয়ে চলল।