শারদীয় মাধুকরী ১৪২৭
পর্ব - ১
শিল্পী - তৃণা দত্ত (ডালাস, টেক্সাস)
কবিতা
গল্প
কৃতজ্ঞতা স্বীকার
প্রচ্ছদ শিল্পী - মেঘমল্লার (ডালাস, টেক্সাস)
লেখক ও লেখিকাবৃন্দ
গল্প
সমীরণের
পুজো
কস্তুরী সিনহা
কলকাতা
অষ্টমীর পুজোর খিচুড়ি লাবড়া পায়েস ভোগ খেয়ে সমীরণবাবু বিকট এক ঢেঁকুর তুলে গিয়ে বসলেন পুজো মণ্ডপের সামনে। পাশেই বসে আছেন ঘোষাল, পরিতোষ ঘোষাল।
- বুঝলেন ঘোষাল বাবু এই সব ছিঁচকে ক্যাটারিং এর ছেলে দিয়ে মায়ের ভোগ রান্না হয় না।
- কি বলছেন সমীরণবাবু, ছিঁচকে ক্যাটারিং কোথায়? মিহিদানা তো এলাকার বেশ নাম করা ক্যাটারিং। ওরা তো এই সব পুজো আচ্চার ছোট কাজ বিশেষ করে না, তবে শুভেন্দুর সাথে চেনা পরিচয় থাকায় রাজি হয়েছে।
- ও আচ্ছা, না মানে শুধু ক্যাটারিঙে কি হয়? মায়ের ভোগের জন্য দরকার সেই ভক্তি, সেই দরদ আর সেই কোয়ালিটির চাল।
- তাই নাকি? সে কি রকম?
- তবেই শুনুন, ভোগ হয় আমার বর্ধমানের মামদাদুর বাড়ির পুজোতে। আসল বাদশা ভোগ চালের খিচুড়ি, বিশুদ্ধ কামিনী ভোগ চালের পায়েস, উফফ কি তার স্বাদ, আর গন্ধ! আশেপাশের দশটা গ্রাম থেকে পাওয়া যেত সেই রান্নার গন্ধ।
- ও বাবা, তা সে সব জিনিস আগে পাওয়া যেত, এখন আর সেই সব বিশুদ্ধ জিনিস কোথায়?
- আরে না রে বাবা, এই তো গেল পূর্ণিমায় আমার মিসেস করলো রান্না গোপালের ভোগ দিতে। আগের বারে মামাতো ভাই বিপিন এসে দিয়ে গেছিলো দাদা-বৌদি ভালোবাসে বলে।
পাশের ১ নম্বর ব্লকের চ্যাংড়া ছেলে পীযুষ অনেকক্ষণ পাশে বসে শুনছিলো। ফুট কেটে বসলো-
- কই সেদিন তো কোনো গন্ধ পেলাম না আমরা। হিসাব অনুযায়ী তো ওপাশে বারুইপুর অব্দি গন্ধ যাওয়ার কথা। আর আমি থাকি আপনার পাশের ব্লকে।
সমীরণবাবুর মুখখানা শুকিয়ে আমশি হয়ে গেলেও জোর করে হাসি টেনে বললেন, তোমার আর গন্ধ পাওয়ার সময় কোথায় বলো? সারাদিন তো কেমিস্ট্রি ল্যাব আর গাদা কাগজের মধ্যে নাক ডুবিয়ে বসে আছো।
- "সে যাকগে সমীরণবাবু, শুনলাম আপনার নাকি দুশো টাকা চাঁদা বাকি আছে" জিজ্ঞেস করলো চ্যাংড়া পীযুষ।
- ওটা আমি ইচ্ছে করেই বাকি রেখেছি, তারপরে গলাটা একটু নামিয়ে বললেন- "শালারা সব সময়ই টাকা মারে পুজোর বাজেট থেকে, তাই যতটা পারি হাত টেনে নিই। আর এই যে কুপন কেটে খাওয়া - (এএএএইউউউ! বলতে বলতেই আবার এক পেল্লায় ঢেঁ কুর) এতেও তো আমার খরচ হচ্ছে নাকি, সেটাও তো চাঁদারই অংশ, তো দেখতে গেলে (হিচিক কিচিক ইয়াঙ্ক) এডজাস্ট হয়ে গেলো না?"
গরদের কাজ করা পাঞ্জাবি আর গিলে করা ধুতি ততক্ষণে ঘামে ভিজে চুপসে সমীরণবাবুর চর্বিবহুল দেহাংশের সাথে চিপকে গিয়েছে।
"যাই বুঝলে, আবার সন্ধ্যে বেলা দেখা হবে।"
- আচ্ছা আচ্ছা, সন্ধ্যে বেলা পারলে একটু তাড়াতাড়ি আসবেন। সেলিব্রিটি গেস্ট আসবে, একটু দেখাশোনা---
সন্ধ্যে বেলা আটটা নাগাদ গেস্টরা পৌঁছলে সমীরণবাবুকে দেখা গেলো, আরেক রাউন্ড সিল্কের পাঞ্জাবি ধুতি পরে। হাসি মুখে করমর্দন করে গেস্টদের গাড়ি থেকে নামাচ্ছেন। চারপাশে ক্যামেরার ফ্ল্যাশ 'দেখি দেখি এই দিকে একটু তাকাবেন সকলে' বাহ্ এই তো। সবার সব ছবিতেই সেলেব্রিটিদের সাথে সমীরণবাবুকে পাওয়া গেলো। নিজে তৎপর হয়ে গেস্টদের বসানো, খাওয়ানো, পুজোর থিম বোঝানো সবেতেই যথেষ্ট active participation দেখা গেলো সমীরণবাবুর। খালি পুজোর থিম বোঝাতে গিয়ে বললেন "পুরাণেও যেমন দ্রৌপদী সীতা এরা প্রাধান্য পেয়েছে, ইম্পরট্যান্ট রোল প্লে করেছে, আমাদের আবাসনেও আমরা মেয়েদের সেই সুযোগ করে দিয়েছি, খালি আইডিয়াটা আমার।"
চ্যাংড়া পীযুষ, ফচকে সিদ্ধার্থরা সব পেছনেই দাঁড়িয়ে ছিল, তারা শুধু একে অন্যের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো আর কয়েকজন মহিলাকে পেছনে খালি দাঁত কিড়মিড় করতে দেখা গেলো। খাওয়ার জায়গাতেও উনি গেস্টদের সাথে সাথেই ছিলেন, আর কোন দীঘির মাছ, কোন বাগানের কাঁঠালপাতা খেয়ে বড় হওয়া খাসি, কোন চাক্কির আটার লুচি দিয়ে খাওয়া বেস্ট হয় গেস্টদের বোঝাচ্ছিলেন। অবস্থা বেগতিক এবং পুরস্কার হাতছাড়া হওয়ার প্রভূত সম্ভাবনা দেখে ছ্যাঁচড়া শুভাশিস সমীরণবাবুকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বললেন "ইয়ে মানে সমীরণবাবু, রান্নার তেল কিছু কম পরে গেছে। আপনার তো গাড়ি আছে মৃদুলকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে যদি দয়া করে তেলটা একটু এনে দেন।"
- তাই নাকি, নিশ্চয় নিশ্চয়, আচ্ছা আমি আসছি তাহলে বাড়ি থেকে গাড়ির চাবি নিয়ে।
যাক নিশ্চিন্ত হওয়া গেলো। কারণ ছ্যাঁচড়া শুভাশিস জানে কোনোভাবেই গাড়ির চাবি এখন সমীরণবাবু খুঁজে পাবেন না। আর ওনাকে পরদিন সকালের আগে আর দেখাও যাবে না। নবমীর দিন সকালে তেনাকে আবার দেখা গেলো পূজামণ্ডপে ফিনফিনে পাঞ্জাবি আর কড়কড়ে ধুতিতে। আরতি হচ্ছে, হঠাৎ দেখি ঢাক থেমে গেছে, কারণ ঢাকিকে ঢাকের তাল মাহাত্ম্য বোঝাচ্ছেন মাননীয় সমীরণবাবু। এবং সাথে সাথেই নিজে ডেমো দিতে শুরু করলেন। সে যা ডেমো- এক হাত নড়ছে তো আরেক হাত আটকে যাচ্ছে পাঞ্জাবিতে আর ঘড়িতে। ঢাকি বসে বসে ঢুলতে লাগলো। দুপুরে খাবার জায়গাতে গিয়ে তিনি হেসেই বাঁচেন না
- "হাঃহাঃ এগুলো লুচি নাকি? এগুলো তো লুচ্চা হয়েছে, কি হে তোমাদের নামী ঠাকুরটিকে একবার দেখি।" বলে সোজা চলে গেলেন লুচি যেখানে ভাজা হচ্ছে সেখানে।
"এই ভালো করে, হ্যাঁ হ্যাঁ, ওই ফুলো ফুলোগুলো আমার দিকে দেখি, নানা ঐপাশ চ্যাপ্টানো পাঁপড়ের মতো লুচি আমায় দেবে না।" পাশ থেকে ঘোষালের ছেলে ফুট কেটে চলে গেলো, "দাদু আপনার মালদার ময়দা নিয়ে আসুন, আর পুব দিক থেকে হাওয়া দিন, তবেই যদি লুচি হয়।" এরপরে তেনাকে দেখা গেলো চার পিস্ পাতুরি, আর খাসির থালাতে নিমগ্ন অবস্থায়। ঘন্টাখানেক সেখানে কাটিয়ে আবার একটা পেল্লায় ঢেঁকুর তুলে কিপটে শুভেন্দুকে ডেকে বললো- "আজ বিকেলে কেউ গেস্ট আসছে নাকি? আমাকে কিন্তু অবশ্যই ডেকো, আমি সামলে নেবো ওদেরকে। তোমরা এতো এদিকে ওদিকে ব্যস্ত থাকো, আমি ওটা একাই সামলে নেবো।" কিপটে শুভেন্দু জবাব দিলো,
- "হ্যাঁ আসছে আজ আরো স্পেশাল গেস্ট, আনন্দময়ী অনাথ শ্রমের বাচ্চারা।"
-"ওঁওঁ - তা তারা কি করবে এখানে?"
- "কিছুই না, অনুষ্ঠান দেখবে, খাওয়া দাওয়া করবে, আর তাদের আমরা কিছু জামাকাপড় দেব।"
- "ওঁওঁ তা বেশ বেশ, আমার বাড়িতেও বেশ পুরোনো কিছু জামাকাপড় আছে, আমার ছেলের ছোটবেলার। তা ভালো হবে আমি সেগুলো দিয়ে যাবো তোমাদের।"
- "না সমীরণবাবু, পুরোনো না, আমরা এদের নতুন জামাকাপড় দেব।"
বাংলার পাঁচের মতো মুখ করে সমীরণবাবু জানালেন, চন্দননগর থেকে কোন নাকি তাঁর পিসতুতো ভাই আসছে সন্ধ্যেয়, তিনি আর আসতে পারবেন না মণ্ডপে।
পুজোর বাকি কটা বেলা তেনাকে পুজোর আচার, বিসর্জনের ঢাক, সিঁদুরের কোয়ালিটি, ভাসানের নাচ ইত্যাদি প্রভৃতি বিষয়ে মূল্যবান মতামত বিতরণ করতে দেখা গেলো। পুজো মিটলে চ্যাংড়া-ফচকে-ছ্যাঁচড়া পার্টিরা মিলে ঠিক করলো এইবারে ব্যাটাকে একটু টাইট দেওয়া দরকার। সাথে কিছু টাকার বিনিময়ে দলে নেওয়া হলো তাদের বাড়ির বিশ্বাসী কাজের মাসিকে। মাসির কাজ বিশেষ কিছু না, খালি ফেভিকুইক এর এক টিউব জানলার ছিটকিনিতে ঢেলে দেওয়া। জানলাটা সমীরণবাবুর বেডরুমে রাখা গোদরেজ আলমারিটার ঠিক মুখোমুখি। বিকেলে সিঙ্গারা-চা পার্টিতে সমীরণবাবুকে বিশেষভাবে ডেকে নিয়ে আসা হলো। ডাকতে অবশ্য বিশেষ বেগ পেতে হলো না কাউকেই -
পার্টিতে আলোচনা -
- এই শান্তনু তুই কি যেন বলছিলি ইনকাম ট্যাক্সের কাছে কে নাকি আমাদের সব ইনফরমেশন ফাঁস করছে।
- হ্যাঁ রে, করছে, কিন্তু তোদের চিন্তা কেন? তোদের তো সব প্যান আছে, রেগুলার ট্যাক্স payer তোরা। তোদের সব ইনফরমেশন তো ইনকাম ট্যাক্স দফতরে অলরেডি আছেই। চিন্তা যাদের বাড়িতে বা আলমারিতে টাকা রাখা থাকে।
- তাই নাকি? ও তাহলে তো আমরা সব সেফ। কিন্তু আলমারির খবর সব পাচ্ছে কোথায়?
- কি জানি কি সব বিশেষ ক্যামেরা নাকি লোকের অজান্তেই বসিয়ে দিয়ে যাচ্ছে ঘরে বা জানলার বাইরে। আর সব ওতেই তোলা হয়ে যাচ্ছে। আমি তো কাল ভিডিও ও দেখলাম একজনের গদির নিচে টাকার পুরু লেয়ার। টাকা বের করছে সেখান থেকে, আর ট্যাক্সের লোক এসে হাতেনাতে ধরছে।
হঠাৎ কেন জানি সমীরণবাবুকে খুব ঘামতে দেখা গেলো, উনি বললেন, "তোমরা গল্পগাছা কর বুঝলে, আমার আবার ওদিকে ওষুধ খাবার টাইম হয়ে যাচ্ছে।"
বাড়ি গিয়েই আলমারির লকার খুলতে গেলেন সমীরণবাবু, আর তখন-ই পেছনের জানলায় কেমন একটা ঢং ঢং খস খস যেন আওয়াজ হলো। তাড়াতাড়ি আলমারি বন্ধ করেই ছুটলেন জানলার দিকে দেখতে। নাহ কিছুই তো নেই। ভাবলেন মনের ভুল। আবার খুললেন, আবার সেই এক শব্দ। আবার ছুটলেন। আবার কিছু নেই। বেশ কয়েকবার এই একই ঘটনা বারে বারে ঘটতে থাকলো, আলমারি খুললেই পেছনে মনে হয় কেউ বা কিছু আছে, আর বন্ধ করলেই দেখা যায় কেউ নেই। তিনি ভাবলেন জানলা বন্ধ করে দিলেই তো আর চিন্তার কিছু থাকে না। কিন্তু হবে কি করে, জানলা লাগাতে গিয়েই তো আরেক চিত্তির। ইসঃ ছিটকিনিটার উপরে যে কি একটা লেগে রয়েছে, কিছুতেই জানলা বন্ধ হলো না। জল দিয়ে ধুয়ে, কাপড়ে মুছে কিছু ভাবেই সেই জিনিসটা সরানো গেলো না। এইবারে সমীরণবাবু মারাত্মক ঘামতে শুরু করলেন। রাতের খাবার-ও ঠিকমতো খেলেন না। শুলেন বটে কিন্তু জেগেই রইলেন আলমারির পানে চেয়ে। আলমারি খোলার-ও সাহস আর করে উঠতে পারলেন না। ভোর রাতের দিকে ঠিক করলেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কাল জানালাটার ব্যবস্থা আগে করতে হবে। ভোর হতে না হতেই বিল্ডিঙের কেয়ারটেকারকে খুঁজতে বেরোলেন। কিন্তু এতো সকলে কেউ-ই আসতে রাজি হলো না। খালি দেখা হলো চ্যাংড়া পীযুষের সাথে। চ্যাংড়া পীযুষ জগিং করতে বেরিয়েছিল। এত সকালে সমীরণবাবুকে হন্তদন্ত হয়ে ঘোরাঘুরি করতে দেখে জানতে পারলো, হঠাৎ তেনার জানলায় কিছু গড়বড় হয়েছে, আর তার ফলে এসি চালানো যায়নি, আর তাই রাতে উনি ঘুমোতে পারেননি।
- আচ্ছা চলুন তো দেখি আমি কিছু করতে পারি কিনা।
ঘরে এসে দেখে বেশ খানিক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে চ্যাংড়া পীযুষ বললো -
- আরেঃ এ তো দেখছি Methyl cyanoacrylate। এহহে। ভারী মুশকিল হলো। আচ্ছা বুঝেছি আপনি যে খৈনি খেয়ে খেয়ে জানলা দিয়ে পিক ফেলেন নিচের বাগানে, তার-ই রিএকশনের ফল এইটা।
- সেকি কিছু করা যাবে না এর? জানলা ভাঙতে হবে নাকি?
- আরে না নাঃ কোথায় এখন দশ হাজার টাকা খরচ করবেন আর লোকজন হাঁকডাক করবেন, আমি দেখি কিছু করতে পারি কিনা। তবে হ্যাঁ দশ না হলেও হাজার পাঁচেক খরচ হতে পারে এতে। আমাদের ল্যাবে এক মারাত্মক সল্যুশন আনা হয়, দেখি কোথাও সেটা পাই কিনা। তার দাম মোটামুটি ওই হাজার পাঁচেক।
- আরে টাকা দেখোনা বাবা তুমি, যা লাগবে আমি দেব। আমি এদিকে মরছি আমার জ্বালায়।
- ঠিক আছে, দিন তাহলে টাকাটা এক্ষুনি, আমি ঝট করে দোকান হয়ে আসি।
কড়কড়ে তিনহাজার টাকা নিয়ে বেরিয়ে গেলো চ্যাংড়া পীযুষ। ফিরলো তখন হাতে একটা শিশি লিকুইড (আসলে নেইল পালিশ রিমুভার), দাম ত্রিশ টাকা মতো।
- একটা পরিষ্কার কাপড় দিন তো।
কাপড় নিয়ে ওই শিশির লিকুইড ঢেলে দশ মিনিট চুপচাপ বসে থাকল চেপে।
- এই নিন, ব্যাস হয়ে গেছে।
হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন যেন সমীরণবাবু। অনেক্ষণ ধরে ভালো করে জানলা লাগিয়ে খুলে পরীক্ষা করে নিলেন বেশ করে। চ্যাংড়া পীযুষও হাসি মুখে বেরিয়ে এলো, সিদ্ধার্থ তো অলরেডি পৌঁছে গেছে খাসির দোকানে।
গল্প
আজি
গোধূলিলগনে
অমিতাভ মৈত্র
ম্যানেজিং ডাইরেক্টর
অরবিট অ্যানিমেট প্রাইঃ লিঃ
সল্টলেক, কলকাতা
রাসবিহারীর মোড় থেকে বালিগঞ্জ গামী চলন্ত ট্রামটায় লাফ দিয়ে উঠে পড়লাম। ট্রামের ভেতরে গাদাগাদি ভীড় দেখে পাদানিতেই দাঁড়িয়েছিলাম। বড্ড ভ্যাপসানি গরম আজ। সেই মুদিয়ালী থেকে হেঁটেছি। লেক মার্কেটে ট্রামটা একটু ফাঁকা হলো। ভেতরে ঢুকে পড়লাম। মহিলাদের সিটগুলোর কোণে চোখ পড়তেই আমার চোখ আটকে গেল এক মাঝ বয়সী মহিলাকে দেখে। কোলে বাচ্চার স্কুলের ব্যাগ আর পাঁচ-ছ বছরের ছোট্ট ছেলেটি পাশে বসে। খুব চেনা লাগছে মহিলাকে। চিনতে বেশী সময় লাগলো না। মল্লিকাদি, …। সঙ্গে বাচ্চাটি বিলক্ষণ ওরই ছেলে। মল্লিকাদি আমার কাছে শুধু একটা নাম নয়, কয়েক বছরের সময়, সাদা-কালো যুগের মলিন হয়ে আসা এক নাটকীয় চলচ্চিত্র… আমাকে পিছিয়ে নিয়ে যায় সময়ের পথ ধরে অনেকটা পিছনে… মধ্য কলকাতায়… আমার পুরনো পাড়া, কলেজ স্কোয়ার, পুরনো কালের গান… থৈ থৈ শাওন এলো ওই, সন্ধ্যেবেলা ঘরে ঘরে মন খারাপ করা শাঁখের আওয়াজ, কয়লার উনুনের ধোঁয়া, নোনা ধরা ইঁটের দেওয়ালের ফাঁকে, আমার আবিস্কারের অপেক্ষায় বসে থাকা ছোটো ছোট গুঁড়ো সুরকির রহস্যময় স্তূপ… দিদির ডাক, ঘরে এসে পড়তে বসার… প্যারীচরণ সরকারের ফার্স্ট বুক অব রিডিং আর পটুয়াটোলা লেনের মধ্যে দিয়ে দৌড়ে পটলডাঙায় পৌঁছে যাওয়া মল্লিকাদির বাড়ি।
ট্রামে মল্লিকাদির সামনে সিটের আশায় হতাশ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলারা এখন সবাই মল্লিকাদির শরীরী ভাষায় বোঝার চেষ্টা করছেন আগামী এক-দু স্টপের মধ্যে ইনি উঠবেন কিনা। তাহলে অন্ততঃ দুটো সিট পাওয়া সুনিশ্চিত, তাই ডান দিকে বা বাঁদিকে এক চুলও নড়া চড়া নয়। আমার পক্ষে মল্লিকাদির দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করা বৃথা কারণ দাঁড়িয়ে থাকা চার জন মহিলা এক দূর্ভেদ্য প্রাচীর গড়ে তুলেছেন মল্লিকাদির সামনে। ট্রামের দুলুনিতে সেই প্রাচীরে কখন কখন ফাঁক দেখা দিচ্ছে আর মল্লিকাদিকে দেখছি তাকিয়ে আছে জানলার বাইরে। মল্লিকাদির পাশের সিটটা খালি হলো এতক্ষণে …সামনে ট্রায়াঙ্গুলার পার্ক। মল্লিকাদিকে সরাসরি দেখতে পাচ্ছি এবার। ডাকতে একটু অস্বস্তি লাগছে…চিনতে কোন ভুল হচ্ছে না তো! ওকে শেষ দেখেছিলাম বাইশ বছর আগে। ছেলের দিকে মুখ ঘুরিয়েছে এবার। কোন ভুল হয়নি আমার। গালের বাঁদিকের তিলটা দেখতে পাচ্ছি স্পষ্ট। যা থাকে কপালে, নাম ধরে ডাকলাম। চমকে তাকালো আমার দিকে। মুখে গভীর সংশয় নিয়ে সেই পুরনো ডাগর চোখে তাকিয়ে আছে মল্লিকাদি। সময় চলে গেছে অনেকটা আর সেই ফাঁকে মল্লিকাদির ত্বকে আর মাথার চুলে, বয়েস তার নিষ্ঠুর থাবায় আঁচড় দিতে কসুর করেনি একটুও।
বললাম, “কি, চিনতে পারছো না?”
সুন্দর কালো দুটি ধনুক বাঁকা ভুরু কুঁচকে গেল, চেনার গভীর আগ্রহে। একটু এগিয়ে গেলাম। মুখের দিকে তাকিয়ে আছে এখন।
হঠাৎ বললো, “মনে হচ্ছে চিনতে পেরেছি, কিন্তু ভাল নামটা ভুলে গেছি।”
বললাম, “ওটা মনে রাখার কথা নয়, কিন্তু খারাপটা মনে আছে কেমন শুনি একবার।”
“গাবলু না? নাকি ভুল বললাম?”
বললাম, “যাক নামটা মনে আছে তাহলে।”
গড়িয়াহাট এসে গেল। সিট ছেড়ে মল্লিকাদি এগিয়ে এলো আমার দিকে।
“এতো বড় দেখাচ্ছে যে তুমি বলবো না তুই বলবো বুঝতে পারছি না।” এবার সেই গালে টোল পড়া হাসি।
বললাম, “যা বলতে তাই বলবে। ওটা আবার পাল্টায় নাকি।”
“কেমন যেন গম্ভীর হয়ে গেছিস।”
“বয়েস হয়েছে তো।”
“চিমটি খাওয়াটা মনে আছে তো? ওটা খেলেই দেখবি বয়েস আবার কমে গেছে।”
হুঁ, মনে আছে। সেই সময়টা যদি ফিরে আসতো তাহলে অনেক চিমটি খেতে রাজী আছি। আচ্ছা, বড় হয়েছিস বোঝা যাচ্ছে, মুখে যা খই ফুটছে।
ট্রামের মহিলাদের মধ্যে একটা নীরব সাড়া জেগেছে। বাঁধ ভাঙা কৌতূহল। এ নিশ্চয়ই ভেঙে যাওয়া এক প্রাচীন প্রেম, সমাপ্তির শেষ রেশটুকু মিলিয়ে গিয়েও মেলায়নি। মল্লিকাদি বলল, “আচ্ছা বল তো, তুই কি কাছাকাছি থাকিস?”
বললাম, “কেয়াতলায়।”
হলে গড়িয়াহাটে নামবি, নারে?
না আরো একটু যাবো।
কোথায় যাবি এখন?
ওহো! এতো জেরা কিসের। এখনও তোমার সেই স্বভাবটা যায়নি। রাস্তায় দেখলেই পুলিশের জেরা। তোমার কি মনে হয় আমি এখন সেই রকম আছি?
“ডাকু এখনো তুই ঐ সব করিস?” ফিসফিস করে কানের কাছে মুখ এগিয়ে নিয়ে বলল। “কী সব?”
“সেই যে রে নকশালবাড়ি।”
ও সব কথা বাদ দাও। বলও তো তুমি কোথায় থাকো।
আমি তো সেই থেকে ভবানী-পুরেই থাকি। সেখানেই আমার ঘর সংসার। দেখ আমি কর্ণ-ফিল্ড রোডের মুখে নামবো। ছেলের স্কুল বালিগঞ্জ প্লেসে। কিছুই তো জানা হলো না তোর কাছে। সবাই কেমন আছে রে? তোর দুই বোনের বিয়ে হয়ে গেছে নাকি? মাসিমা কেমন আছেন?
আমিও ট্রাম থেকে নামতে নামতে প্রশ্নগুলোর যথা সম্ভব নাতিদীর্ঘ উত্তর দিলাম। বালিগঞ্জ প্লেস পর্যন্ত হাঁটবে নাকি ছেলে কে নিয়ে? জিজ্ঞেস করলাম।
না না রিক্সা নেবো। অতোদূর ছেলেকে নিয়ে এই গরমে…ক্ষেপেছিস নাকি।
হঠাৎ কেমন চুপ করে গেল মল্লিকাদি, কি যেন ভাবছে ও। আমি বোধহয় বুঝতে পারছি ওর মনের কথা। হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো, “এই গাবলু এখন গান করিস রে? একদিন আমার বাড়িতে আয় না…বসে বসে তোর অনেক গান শুনবো। সেই যে রে… আজি গোধূলিলগনে এই বাদল গগনে…। মনে আছে তোর? বড্ড শুনতে ইচ্ছে করে তোর গলায়। কি করে এমন গাইতিস তুই বল তো? আমি ওই গানটা সুচিত্রাদির কাছে শিখেছিলাম রবিতীর্থে। কিন্তু তোর গলায় গানটা শোনার পর থেকে শুধু গুনগুন করি, গাই না। গুনগুন করলেই তোর গলাটা কানে ভাসে।”
একটানা থেমে থেমে বলে গেল মল্লিকাদি। এই গানটা ওকে আজও তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় শুনে কেমন ডুকরে উঠছিল আমার ভেতরটা। পটলডাঙায় ওদের পুরনো বাড়ির দোতলার ঘরে বা ছাতে গানের আসর বসতো। আমি তখন ক্লাস নাইনের ছাত্র।
“কি রে, কি এতো ভাবিস বলতো? এখনও তুই একই রকম আছিস…বোকার মতো কি আকাশ পাতাল ভাবিস। কি বললাম এতক্ষণ ধরে কানে কিছু কি গেল? আমার কিন্তু এবার দেরী হয়ে যাচ্ছে।”
আমি শুনেছি তোমার কথা…আর সেই গানটার কথা। কিন্তু আমি তো তোমার বাড়ি চিনি না। “গড়িয়াহাট থেকে বেশী দূরে নয় রে বাবা। কলকাতার কতো জায়গায় হোড্ডি পিটিয়ে ঘুরে বেড়াস আর আমার বাড়ি চিনতে পারবি না?” মল্লিকাদি তার স্বভাব সুন্দর আবেগে বলে গেল…কোন দ্বিধা ছিল না। বাড়ির ঠিকানাটা লিখে দিলো একটা ছোট্ট কাগজে।
রিক্সায় উঠতে গিয়ে আবার একটু থামলো। “এই গাবলু, তুই বিয়ে করেছিস?” একটু ফিসফিস করে কাছে এগিয়ে এসে বললো।
বললাম, “দূর! কী যে বলো…বিয়ে করে মরি আরকি।”
“কেন অসুবিধেটা কোথায়?”
“সেসব অনেক কথা। ছেলেকে স্কুলে পৌঁছতে দেরী হয়ে যাবে কিন্তু।”
“ও, এর মানে হলো আমাকে চলে যেতে বলছিস।”
আবেগের বশে হঠাৎ মল্লিকাদির গায়ে হাত দিয়ে বললাম, “ছি ছি এমন কথা বলোনা। এখন যদি অনেকক্ষণ তোমার সঙ্গে গল্প করতে পারতাম তাহলে আমার থেকে খুশী তুমিও হতে কিনা সন্দেহ।”
শুনে মুখটা যেন রক্তহীন হয়ে গেল। বলল, তুই এখন সেই রকমই ছেলেমানুষ আছিস। সেইসব কথা মনে রাখিসনি তো?
প্রশ্নের কোন উত্তর না দিলেও, মল্লিকাদির উত্তরটা অজানা নয়।
চলে গেল মলিদি, রিক্সায় উঠে, হাত নাড়তে থাকলো যতোক্ষণ না হারিয়ে গেল দূরে রাস্তার বাঁকে। কর্ণফিল্ড রোডের মোড়ে সিগারেটের দোকান থেকে একটা সিগারেট ধরিয়ে হাঁটতে থাকলাম লেকের দিকে। মল্লিকাদিকে জিজ্ঞেস করার ছিল অনেক কথা কিন্তু কোথায়, কিছু জানা হলো না তো। মল্লিকাদি কি এখন গান গায়? মল্লিকাদির স্বামী…কেমন মানুষ তিনি!
মনে পড়ছে মল্লিকাদির পটলডাঙার বাড়ির কথা। তিনতলার ছাতে ঘিঞ্জি শহরের উনুনের ধোঁয়ায় বিষণ্ণ সন্ধ্যে নামতো। ছাতের ঘরে সন্দীপ বাজাতো হারমোনিয়াম আর আমি গাইতাম, “পৃথিবীর গান আকাশ কী মনে রাখে।” মল্লিকাদির ছোট ভাই সন্দীপ আর আমি এক স্কুলে একই ক্লাসের হলায় গলায় বন্ধু ছিলাম। সন্দীপের বাড়ি ছিল গান-বাজনার বাড়ি। সন্দীপ অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছাত্র ছিল। ওর ওপরে ওর গুরুর প্রভাব এতোটাই বেশী ছিল যে সন্দীপ অশোকতরুকে অন্ধের মতো নকল করার চেষ্টা করতো। ব্যাপারটা কেমন যেন অস্বাভাবিক বা কৃত্রিম লাগতো আমার। কিন্তু অন্যদিকে আমি ছিলাম নিতান্তই স্নানাগার সঙ্গীত শিল্পী। আমার গুরু ছিল তখনকার ভ্যাল্বসেট রেডিওয় শোনা গান আর মিনিটে আটাত্তর পাক খাওয়া কালো চাকতির রেকর্ডে বন্দী হওয়া কলেরগান। চোঙার সামনে অপেক্ষমাণ প্রভুভক্ত কুকুরটির মতোই আমিও কান খাড়া করে শুনতাম দূর থেকে ভেসে আসা, “ও ঝরা পাতা এখনই তুমি যেওনা চলে” কিংবা “বিষ্ণুপ্রিয়া গো আমি চলে যাই…।” স্কুলের সরস্বতী পুজো, রবীন্দ্রজয়ন্তীকে ঘিরে বছরে দু-তিনবার বেশ জমকালো অনুষ্ঠান হতো। এই অনুষ্ঠানগুলোতে সন্দীপ একজন পাকাপোক্ত রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইয়ে হিসেবে একটা জায়গা করে নিয়েছিল। টিফিনের সময় ক্লাসের টেবিলকে তবলা বানিয়ে আমার সঙ্গে সঙ্গত করতো আমার আর এক বন্ধু তন্ময়। আর খুব স্বাভাবিক ভাবেই আমার গাওয়া বাংলা আধুনিক গানের অনেক শ্রোতার মধ্যে সন্দীপ হয়ে উঠেছিল একজন সত্যিকারের সমঝদার। ক্লাস সেভেনে পড়তে সন্দীপ আমাকে জোর করে নিয়ে গিয়েছিল আমাদের অনুষ্ঠানগুলোর মুল পরিচালক এক শিক্ষকের কাছে। গানের অডিশনে পাশ করে রবীন্দ্রনাথের একখানি গান অনুষ্ঠানে গাইবার সুযোগ পেয়েছিলাম। সরস্বতী পুজোর অনুষ্ঠানে ভাল পরিবেশনার সুবাদে তারপর থেকে আমারও স্কুলের সব ছোট-বড় অনুষ্ঠানে ডাক পড়তো। এইসব অনুষ্ঠানের রিহার্সালের পরেও আমাদের গান-বাজনা চলতো, চলতো সেকালের বাংলা আধুনিক আর বাংলা ছবির গান যা আমাকে আজও বেঁচে থাকার রসদ জোগায়। সন্দীপের হারমোনিয়ামে আঙুল চলতো অনবদ্য আর আমি গাইতাম বাংলা আধুনিক গান, শান্ত নদীটি পটে আঁকা ছবিটি…বসে আছি পথ চেয়ে, ফাগুনের গান গেয়ে…মৌবনে আজ মৌ জমেছে…। বেশ মনে আছে, সে বছর বাৎসরিক পরীক্ষার পর যখন শীতের লম্বা ছুটি পড়লো তখন বেশ কয়েক মাস, কী কারণে মনে নেই, সন্দীপের বাড়ির ছাতের ঘরে গান-বাজনাটা বন্ধ ছিল। পাড়ায় তখন সকাল থেকে চুটিয়ে চলতো ক্রিকেট খেলা। পড়াশুনো এমনিতেই শিকেয় তোলা থাকতো, শুধু দিদিই একমাত্র আমার ছেলেবেলার যা কিছু গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করে পড়াশুনোর যে শৃঙ্খলে বাঁধতো সেটা তখন মনের ভেতরে দূর্বলের অব্যক্ত বিরক্তি হয়ে বিদ্রোহ করতো। আর আজ আমি সবল, সেই অগণতন্ত্রকে মাথা পেতে নিয়ে, শৃঙ্খলে শৃঙ্খলিত হতে চাই আর একবার, আমার চিরকালের জন্যে হারিয়ে যাওয়া কারাগারে।
তখন আমার আর একটু উঁচু ক্লাস। কলকাতা থেকে শীত যাবো যাবো করেও তখন চৌবাচ্চার প্রথম ঠান্ডা জল, গায়ে ঢালার আগে, একটু সাহস সঞ্চয়ের সময় নিতে বাধ্য করছিল। দোলের আগের দিন স্কুলে এসেই সন্দীপ বলল, “শোন কাল দোলের দিন সন্ধ্যেবেলা বাড়িতে একটা ঘরোয়া অনুষ্ঠান আছে। তোকে আসতেই হবে। মা বলছিল অনেকদিন তুই ওইদিকটা মাড়াসনা।” আসবি কিন্তু। আমি অবশ্য কথা দিলাম যাবো।সন্দীপের বাড়ির আড়ম্বরহীন সান্ধ্য অনুষ্ঠানে বসেছিল চাঁদের হাট। ওদের বাড়িতে সবাই গান গায় আর কেউই আমার মতো তালিম না নেওয়া ভুঁইফোড় গায়ক বা গায়িকা ছিলেন না। ওদের বাড়িতে একবারে অপরিচিত মুখ না হলেও সন্দীপ সবারির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে প্রশংসায় পঞ্চমুখ হল আমার গানের গলা নিয়ে। শেষ করে আমার গলায় অরাবীন্দ্রিক সেকালের অনবদ্য সব বাংলা আধুনিক গানের কথা বলে। সন্দীপ আমার রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়া নিয়েও একটু বাড়াবাড়ি রকমের প্রশংসা করতে থাকলো। সন্দীপ প্রথমেই চেপে
ধরলো আমাকে আর আমি গাইলাম, “এই মেঘলা দিনে একলা ঘরে থাকেনা তো মন, কাছে যাবো কবে পাবো ওগো তোমার নিমন্ত্রণ।” সন্দীপের সঙ্গত ছিল লোম খাড়া করে দেবার মতো। আর আমি বোধহয় সেই বাজনায় বিভোর হয়ে গেয়েছিলাম গানটা। ঘর ভরা সমঝদার শ্রোতাদের অকুণ্ঠ তারিফ কুড়িয়ে বুকটা ভরে গিয়েছিল সেদিনের পূর্ণিমার সন্ধ্যায়। এবারে সন্দীপের এক দাদার কাছ থেকে আদেশ এলো রবীন্দ্র সংগীতের: “আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার, পরানসখা বন্ধু হে আমার।” সেদিন অনুভব করেছিলাম সমঝদার শ্রোতা আর অনবদ্য সঙ্গত, গানে এক অন্য মাত্রা যোগ করে। সন্দীপের দিদি, মল্লিকাদি, বসে ছিলেন এক কোণে। গান গাইতে গাইতে তাঁর দিকে বার বার চোখ চলে গিয়েছিল আমার। তাঁর চোখে যেন দেখেছিলাম এক আশ্চর্য আবেগ। সন্দীপ এবারে মল্লিকাদিকে বলল, বড়দি, এবার তোমার পালা। আমার গানের রেশ ধরে রেখে মল্লিকাদি গাইলো: “আজি গোধুলিলগনে এই বাদল গগনে, তার চরণধ্বনি আমি হৃদয়ে গনি…।” মল্লিকাদির গলায় সেই গান আমার বুকে মোচড় দিচ্ছিল। এতো গান নয়…যেন কার হাহাকার। বার বার যেন কেঁদে উঠছিল, “সে আসিবে আমার মন বলে সারাবেলা।” অনুষ্ঠান শেষ হয়েছিল প্রায় রাত দশটায়। আমার মাথার চুলে বিলি কেটে মল্লিকাদি বললো, এই ছেলে, তোকে গাবলু বলে ডাকলে আপত্তি নেই তো? আর আপত্তি করলেই বা কে শুনছে।” বলেই প্রাণখোলা হাসি। আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম। এবার বললো, “কবে আবার আসবি এখনই বলতে হবে। তোর সঙ্গে আমার একটা বোঝাপড়া আছে। আমি বললাম, “কি বোঝা পড়া?” তুই আমাকে আমার পছন্দ মতো কিছু আধুনিক গান তুলে দিবি, বল দিবি কিনা।” আমি বললাম, “তাহলে কথা দাও, আজি গোধূলিলগনে গানটা আমাকে শেখাবে।” বললো, “বাবা, তোর ব্যবসা বুদ্ধিটা ভাল তো। না পেলে বুঝি কিছু ছাড়বি না?” আমি একথার কোন উত্তর খুঁজে পাইনি। এটা পাওনা-গণ্ডার হিসেবের বাইরে ছিল। মল্লিকাদির গলায় শোনা সুর কখন গেঁথে বসে গিয়েছিল আমার কানে আমি টের পাইনি। “আচ্ছা একটা কথা জানাই হলো না, কার কাছে গান শিখিস তুই?” জিজ্ঞেস করেছিল মল্লিকাদি।
বললাম, “আমি কারুর কাছে শিখিনি। রেডিও আর পাশের বাড়ির গ্রামোফোনে গান শুনে তুলে ফেলি।“
কি আশ্চর্য, তুই না শিখেই এমন গাইলি কি করে রে গাবলু! বল কবে আসবি আবার।“ এরপরে প্রায়ই যেতাম মল্লিকাদির বাড়িতে। এমন কোনদিন ছিল না যেদিন গান হতো না। একদিন বললো, “গাবলু এবার তুই মার খাবি আমার কাছে।
আমি বললাম তুমি আবার মারতে পারো নাকি কাউকে?
ফাজলামি হচ্ছে, কি কথা ছিল? আধুনিক গান শেখানোর কথা বেমালুম ভুলে গেলি নাকি? বললাম, তাহলে আগে পাওনাটা বুঝে নিই, এই গানটা আগে শোন, আমি গাইছি, ভুলগুলো ঠিক করে দাও। তারপরে তোমাকে, “থৈ থৈ শাওন এলো ওই” গানটা তুলে দেবো। গান শুরু করলাম। মল্লিকাদি বাজাচ্ছিল হারমোনিয়াম। চোখ বুজে গাইছিলাম। সঞ্চারির কাছে এসে চোখ খুলে দেখলাম হারমোনিয়ামে আঙুল চলছে আর মল্লিকাদির বিভোর দুটি চোখ স্থির হয়ে আছে আমার দিকে। গান শেষ করে তাকিয়ে দেখি আমার দিকে ছলোছলো চোখে চেয়ে আছে। কি যেন একটা অপরাধ আমি আমার অজান্তে করে ফেলেছি। চোখে টল টল করছে জল আর কোড়ে আঙুলটা বার করে আমাকে দেখাচ্ছে। মুখে কোন ভাষা ছিল না।
আমি বললাম “একি তুমি কাঁদছো!”
তোর সঙ্গে আড়ি, কথা বলবো না।
কেন আমি কি অপরাধ করলাম।
তোকে তো শেখাতে হলো না, শুনেই তুলে ফেললি। আর আমি যা পারিনি সেটাও তোর গলায় কি করে এসে গেল গাবলু। চোখ ফেটে জল আসছে আমার। কেমন করে গাইলি এমন গান “বনে বনে আজি একি কানাকানি, কিসের বারতা ওরা পেয়েছে না জানি।” …বুকটা ফেটে যাচ্ছে আমার।”
চোখের কোলে এখন টল টল করছে জল, গাল বেয়ে নামলো বলে। মল্লিকাদির চোখ এখন পলকহীন। সিক্ত চোখের জিজ্ঞাসা কী বুঝতে চাইছে জানিনা। মনে হলো গালে হাত দিয়ে জলটা মুছিয়ে দিই। পারলাম না। কীসের বাধা, কীসের সংকোচ জানিনা আমি। হঠাৎ আমার হাতটা ধরে বলল, “এ জন্মে তো আর হলোনা, পরের জন্মে তুই আমার ছেলে হয়ে জন্মাস।” হাসতে হাসতে বললাম, “পরের জন্মে গলায় সুর থাকবে এমন গ্যারান্টি কে দেবে? আর আমি যে সেই বিগত জন্মের গাবলু তুমি আমায় চিনবে কী করে? আমি যেমন গাবলু থাকবো না, তুমিও তো তুমি থাকবে না। পরস্পর পরস্পরকে চিনবো কী করে?” তুই একটা বোকা আর কাঠ-খোট্টা। তাই বুঝতে পারিস না আমার কথা। আসলে কী জানিস গাবলু, তোর সঙ্গে আমার বয়েসের ফারাক অনেকটা। তা অন্তত দশ বছরের হবে। তুইতো এখনও স্কুলে পড়িস আর আমি পোস্ট গ্র্যাজুয়েট করেছি, তাও আবার কবছর কেটে গেছে। বললাম, “তাতে কী হলো? তুমি কী বলতে চাও, তোমার অনুভূতিকে আমি অ্যাপ্রেশিয়েট করতে পারছি না? আমি এতোটা শিশু নই।”
তুই সবটা কী সত্যিই বুঝতে পারিস?
মনে হয় পারি। যেমন ধরো, একটু আগে তোমাকে দেখে আমার একটা দুর্বার ইচ্ছেকে দমন করলাম, শুধু সংকোচ বোধ থেকে।
আমার কাছে তোর সব সংকোচ কবে কাটবে রে গাবলু? আমি বুঝতে পারি তুই আমাকে ততোটা আপন করে ভাবতে এখন পারিসনি। কী সেই দুর্বার ইচ্ছে হয়েছিল তোর, বলবি না আমাকে?
সেটা বলার নয়, করার।
অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে মল্লিকাদি। বেশ কিছুক্ষণ দুজনের মুখে কোন কথা ছিলনা। সন্ধ্যে নামছে ছাতে।
“কী করার? বুঝতে পারছি না আমি।” একটু অস্থির স্বরে বলল মল্লিকাদি।
“সেই মুহূর্তে সেটা দুর্বার ছিল, এখন সেটা সুখস্মৃতি, পূরণ না হওয়া একটা মিষ্টি ইচ্ছে মাত্র।” কী এমন ইচ্ছে যা আমাকে মুখ ফুটে বলতে পারলি না?
ছাতের ঘরে বেশ খানিকটা দূরত্বে দুজনে বসেছিলাম, মাটিতে পাতা একটা শতরঞ্চির ওপর। মল্লিকাদির সামনে ছিল হারমোনিয়াম। হঠাৎ উঠে আমার কাছে এগিয়ে এলো। আমার দুটো হাত ধরে ইঙ্গিত করলো উঠে দাঁড়াতে। দুজনে দাঁড়িয়েছিলাম মুখোমুখি…বেশ কাছাকাছি। তোকে বলতেই হবে তোর পূরণ না হওয়া ইচ্ছের কথা।
আমি চোখ নামিয়ে নিয়েছিলাম। আমার থুতনি ধরে মুখটা তুলে ফিশফিশিয়ে বলল, “বলবি না? না বললে নিজেই ঠকবি।”
খানিকটা সংকোচে দুহাতে মল্লিকাদির চোখের প্রায় শুকিয়ে যাওয়া,সামান্য ভিজে চোখদুটো মুছে দিলাম। আবেশে চোখ বুজেছিল মল্লিকাদি। বললাম, “এই ছিল আমার দুর্বার ইচ্ছে।” এরপরে যা ঘটলো তার জন্যে আমি প্রস্তুত ছিলাম না। আমাকে বুকে টেনে নিয়ে জড়িয়ে ধরলো মল্লিকাদি। আমিও জড়িয়ে ধরেছিলাম। আমার গালে আর কপালে মল্লিকাদির ঠোঁট থেকে চুম্বনের বৃষ্টি নেমেছিল। একবার বলল, গাবলু তুই আমার থেকে অনেক ছোট…এ আমি কী করছি? তোর সঙ্গে আমার এ সম্পর্কটা কী? আমি তোর দিদি না অন্য কিছু! তুই কেন আর একটু বড় হলি না গাবলু? আমার গালে গড়িয়ে পড়ছে মল্লিকাদির চোখের জল। আমি তখনও মল্লিকাদির বুকে বন্দী হয়ে আছি। আমার সংকুচিত শরীর মল্লিকাদির কোমল বুকে বাঁধা পড়ে আছে আষ্টেপিষ্টে।
বললাম, আর একটু বড় হলে তোমার কী সুবিধে হতো? এখনই বা কী অসুবিধে হচ্ছে? হাতের বাঁধন একবার আলগা করে আমার চোখে চোখ রাখলো। চোখের জল মোছাতে গিয়ে কাজল মাখামাখি হয়ে আছে দুটো চোখ। মল্লিকাদি যেন আরো সুন্দরী হয়ে উঠেছে। আমার ঠোঁটে একটা দীর্ঘ চুম্বন দিয়ে বলল, তুই বোকাটা জানিস না সবকিছু, তাই বড় হওটা দরকার। কিন্তু এটা আমি কী করছি! এ কোন সম্পর্কে জড়িয়ে গেলাম আমি তোর সঙ্গে? তোর গান শুনলে আমি নিজেকে স্থির রাখতে পারিনা। আমি স্বার্থপর হয়ে উঠছি, তোর কথা ভাবছি না। তোর বয়েস কম, তোর জীবনে অন্য কোন উপযুক্ত মেয়ে আসবে। আজকে যা ঘটলো সব ভুলে যা গাবলু। কথা দে আমাকে, কিছু মনে রাখবিনা।
মনটা কী ছেলেবেলার স্লেট আর খড়ি নাকি, যা খুশী তাই আঁকিবুঁকি কাটলাম। তারপর যখন ইচ্ছে হলো মুছে দিলাম সব?
তার মানে তুই সব মনে রেখে দিবি? ইশ! আমার ভীষণ লজ্জা করছে। তুই কতো ছোট, এ আমি কী করলাম।
যদি বলি মনে মনে তোমার এই আদরটুকু চেয়েছিলাম। মুখ ফুটে বলতে পারিনি। ওরে পাজি! পেটে পেটে তোর এই ইচ্ছেটা ছিল তাহলে।
সন্ধ্যে নেমে গেছে, ঘর অন্ধকার। কেউ এসে গেলে বাজে ব্যাপার হবে। আমি এবার যাই মল্লিকাদি।
তোকে ছাড়তে ইচ্ছে করছে না। ভয় করছে গাবলু, যদি তোর সঙ্গে আর দেখা না হয়। কেন দেখা হবেনা? বাংলা আধুনিক গানটা তোলা হয়নি তো।
নীচ থেকে মাসীমার গলা পেলাম, মল্লিকাদির নাম ধরে ডাকছেন।
আমি যাচ্ছি, মলিদি।
কাল আবার আসবি তো?
ঠিক আছে।
তিনতলার ছাত থেকে দ্রুতপায়ে নামছিলাম নীচে। হঠাৎ মাসীমা অর্থাৎ মলিদির মা ঘরের ভেতর থেকে আমাকে ডাকলেন, গাবলু, একবার শোন বাবা।
মাসীমার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম, আমাকে ডাকছেন?
হ্যাঁ, কিন্তু কথাটা কিভাবে বলবো বুঝতে পারছি না।
একটা ঝড়ের আভাস পেলাম যেন। বলুন না, কী বলছেন।
কিছু মনে করিস না বাবা। আমার কাছে তুই আর সন্দীপ দুজনেই সমান। কিন্তু পাঁচটা বাইরের লোকও তো আছে। রোজ এসে অতক্ষণ ধরে ছাতের ঘরে দুজনে বসে অতো কথা আর গান-বাজনা সবারির চোখে ভাল দেখায় না। এখন তো আর তুই এতটুকুনি নেই। বড় হয়েছিস। আজ বাদে কাল মল্লিকার বিয়ে। সেটাও তো খেয়াল রাখতে হবে। সন্দীপের সঙ্গে আসবি মাঝে মাঝে কিন্তু চোখে যেটা অশোভন দেখায় সেটা করিসনা বাবা। কিছু মনে করলি নাতো? আসলে রোজই ভাবি বলবো কিন্তু সুযোগ পাইনি। আসিস আবার, কেমন। গালে একটা চড় খেলে এর থেকে কম লাগতো। কোন রকমে কথা শেষ করে মলিদির বাড়ি থেকে শেষবারের মতো বিদেয় হয়েছিলাম। তারপরের তিন বছর পটলডাঙার ধারে কাছে ঘেঁসতাম না। কবে মল্লিকাদির বিয়ে হয়েছিল জানতে পারিনি কারণ হায়ারসেকেন্ডারী পরীক্ষার পর একবার মাত্র সন্দীপের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। দেখলাম এই কমাসে আন্তরিকতা, খুব স্বাভাবিক নিয়মে, ধূসর হয়েছে অনেকটা। এলো ৭০-৭১ সাল। একদিকে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস আর অন্যদিকে দলের সঙ্গে মতাদর্শের সংঘাতে মধ্য কলকাতা আমার কাছে হয়ে উঠলো দুঃস্বপ্ন। গলিতে গলিতে, কারাগারে চলছিল গুপ্ত হত্যা। সঙ্গী-সাথীর লাশের ওপর রচিত হচ্ছিল আর এক সব হারানো মানুষের ব্যর্থ লড়াই-এর পান্ডুলিপি। কলকাতা ছেড়ে পালালাম। পটলডাঙার গানে মুখর সেই দোতলা বাড়িটা হয়ে রইলো আমার কাছে এক ফিকে হয়ে যাওয়া সুখস্মৃতি। সুখস্মৃতি সব সময় কান্না ভেজা সুখ, ছেঁটে বাদ দিয়ে দেয় সে… যা আমি ভুলতে চাই। আমি ভুলে গেছি আজ, কবে মল্লিকাদির বিয়ে হয়েছিল, কার সঙ্গে আর কোথায়। সেই স্মৃতিতে মধ্য কলকাতার ঘিঞ্জি গোলিতে নামে বর্ষা, দূর থেকে ভেসে আসে সন্ধেবেলার সুকন্ঠীদের গলা সাধা, ধূতি পাঞ্জাবীতে গলদঘর্ম বাবার অফিস থেকে ফেরা, দিদি আর দাদাদের হারিয়ে যাওয়া স্নেহের ছত্রছায়া, অনুরোধের আসর শুনতে রেডিওর সামনে হাজিরা, কলের গানে রেকর্ড চাপিয়ে গান শোনা…ওগো মোর গীতিময়, সরস্বতী পুজোয় রাত জাগা, খুনসুটি…গোপন একটু হাতের ছোঁয়ায় সবটুকু মন পাওয়া আর গানে ভুবন ভরিয়ে দেওয়া পটোলডাঙায় সেই দোতলা বাড়িটা।
আজ কর্ণফিল্ড রোডে আবার হারিয়ে গেল মল্লিকাদি বহু ব্যস্ততার ভীড়ে। আমি পিছিয়ে পড়ি বারবার বিস্মৃতির কুয়াশায় প্রায় হারিয়ে যাওয়া এক পূর্ণিমার পড়ন্ত সন্ধ্যায়…সে আসিবে আমার মন বলে সারাবেলা…এক সীমাহীন অপেক্ষা আর নিস্তব্ধ হাহাকারে খুঁজে চলেছি নিশ্চিত মুছে যাওয়া একটা সময়কে।
কবিতা সমগ্র
বিকাশ দাস
পাটলিপাডা, থানে, মুম্বাই
পরিচিতি: বিকাশ দাস (মুম্বাই)
জন্ম ২৬শে আগস্ট ১৯৫৭ পশ্চিমবঙ্গের মালদা। পড়াশোনা সাহেবগঞ্জ, ঝাড়খণ্ড। তারপর কোলকাতায়। কর্ম সূত্রে দীর্ঘদিন দেশের বিভিন্ন প্রদেশে থাকতে হয়েছে।ছোটবেলা থেকেই ছড়ানো ছিটানো লেখার অভ্যেস ছিলো কিন্তু সেই লেখার অনেকটা অংশ ধরে রাখতে পারেনি। ইদানীং রোজকার পুজো আর্চার মত লেখা শুরু করেছি। দেশ পত্রিকা ছাড়া অন্য ছোট বড় পত্র পত্রিকায় কবিতা / গল্প প্রকাশ পেয়েছে। বর্তমানে মুম্বাইতে থাকি।
প্রকাশিত একক কাব্যগ্রন্থ:
এখন আমি একা / জরায়ুজ / নিকুচি করেছে কবিতা / কবির শেষপাতা / তবু ভালো দুঃখ দিও (গীতিকবিতা) / জীর্ণ ব্যথার মুখবন্দী কথা / বিকাশ দাসের নির্বাচিত কবিতা / ঈশ্বর এবার খেটে খা / মৃত্যুর জন্য কবিতা দায়ী।
ধন্যবাদ ঈশ্বর
তোমার নিকানো পাথরে খুঁজতে এসেছি ঘর
তোমার চরণ ধোয়া জলে নীরোগ থাকার বর।
তবু,রোজ নিচু হয়ে আসি নিচু হয়ে বসি নিচু হয়ে ফিরে যাই
অজান্তে তোমার পাপোশে আমার পায়ের ধুলো রেখে যাই।
ধন্যবাদ, ঈশ্বর।
যখন আমার তীর্থভূমি দুয়ার খোলা হাওয়ায়
জেনেছি আমার ধুলোপায়ে আমার ঘরের গন্ধ
আমার নিশ্বাস প্রশ্বাসে আমার সংসারের ছন্দ।
ঘরে থাকতে আকাশ
তোমার আকাশ কুর্নিশ করতে কেন যাবো?
আমার উঠোন ছেড়ে
তোমার উঠোনে সুখ খুঁজতে কেন যাবো?
ধন্যবাদ, ঈশ্বর।
ইচ্ছে যখন
রাজা হবার ইচ্ছে যখন
আগে নিজের হাতে মাটি কেটে ফসল ফলিয়ে দেখাও।
নেতা হবার ইচ্ছে যখন
আগে নিজের শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়িয়ে দেখাও।
মানুষ হবার ইচ্ছে যখন
আগে নিজের মাথায় অন্যের মাথা উঁচু করে দেখাও।
বন্ধু হবার ইচ্ছে যখন
আগে নিজের হারে বন্ধুর জিত মুখর করে দেখাও।
দোসর হবার ইচ্ছে যখন
আগে সাগরের নুনে মিঠে জলের নদী করে দেখাও।
লক্ষ্মীছাড়া কবিতা
অনর্থ জেনে কবিতা ছেড়ে দিয়েছি
অর্থের বৃষ্টিতে ভিজতে ফিরে এসেছি
মাথার চাতাল বলতে খোলা আকাশ
পায়ের তলায় মাটি ক্ষুর গাঁথা উচ্ছ্বাস।
দু’ হাতে পাথরে পাথর গেঁথে ঈশ্বর পেয়েছি
দূরত্ব ধরে ধরে দ্রুত নিজেকে এগিয়ে নিয়েছি
লক্ষ্মীছাড়া দুঃখ শ্রম
কোথায় কবে কখন শেষ হবে লাঞ্ছনার কাল বিষ তুলে
কি ভাবে শুরুর বিধান হলে দূরের শেষ মহার্ঘ দুয়ার খুলে
কল্পনার তীর্থে নির্বোধ ভেঙে ভেঙে বাস্তব পাবো
রোজ দু’মুঠো ভাত কবিতার পাতায় বসে খাবো।
অদৃষ্ট
কি আমার বর্ণপরিচয় জানিনা।
ভাষার বর্ণমালার রঙ জানিনা।
নির্যাতনের শতরঞ্জ খেলার অঙ্ক হিসাব করতে জানিনা
বিজ্ঞানের উছলানি কোলাহলের ফেনায় মরতে জানিনা।
ভূগোল জুড়ে কতটা দেশ
ইতিহাসের কতটা অবশেষ
বিশ্বের জঠর ভেঙে ভেঙে দেশের বরাত করতে জানিনা
লক্ষণ রেখার বৃত্ত ছাড়িয়ে রাবণের করাত ভাঙতে জানিনা।
আমি তোমাকে ভালোবাসি
তুমি আমাকে ভালোবাসো
খড়কুটোর সজল ছায়ায় বসতবাড়ি, এক ফালি খোলা আকাশ
বিছিয়ে দহনবেলায় দু’জনার হৃদয় ক্ষ্যাপা মাটির গন্ধ বাতাস।
কবির গণতন্ত্র
হে কবি পুঁথিতে পুঁথিতে গাঁথিও না ধর্ম শ্লোক মন্ত্র
তোমার নিজস্ব শব্দের বিন্যাসে মুক্ত থাক গণতন্ত্র।
হে কবি শঙ্খের ফুঁক নিয়ে আসুক ঘরে ঘরে মঙ্গল
তোমার কলমের তীর্থ ভেঙে দিক মানুষের দঙ্গল।
হে কবি মন্দের ক্রান্তি বিরোধ যাক নিপাত চিতায়
তোমার কণ্ঠের স্বর মনুষ্যত্ব নিয়ে বাঁচুক বীরতায়।
হে কবি মিথ্যে জয়ের মুখোশে না খোয়ায় সততা
তোমার শব্দের খড়গ মিছিলে মিশুক শান্তির বার্তা।
হে কবি জল মাটি বায়ুর শ্রীজাত গণতন্ত্রের আওয়াজ
তোমার বাণীর বাণে মানুষ হোক যতসব তোলাবাজ।
হে কবি বাঁধো ছন্দ স্তবকে স্তবকে কবিতার তোয়াজ
তোমার কলমে কালির ছলাতে স্বচ্ছন্দ গণতন্ত্র আজ।
বন্ধু
বন্ধু যেন
চনমনে রোদের কাঁথা জড়িয়ে ধামাল শীতের কাঁপন
আগলে লজ্জা নিবারণ নির্ভয়ের সুতোয় পোক্ত বাঁধন।
বন্ধু যেন
বুকে দুঃখ জ্বালা জুড়িয়ে রাখা আস্থা জাগানো বাতাস
নিজের কাঁধে বোঝার ভার তুলে ঘর জড়ানো আকাশ।
বন্ধু যেন
অবাধ ভুলের পাঁকে হাজার পদ্ম ফুটিয়ে তোলার সাধন
জটিল দিনে ভরিয়ে রাখা রমণ মাখা নিত্য খুশির বাঁধন।
বন্ধু যেন
মনে প্রাণে নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে বাঁচিয়ে রাখা জীবন মরণ
খরার দিনে ঘরে ঘরে ছুটে আসা বর্ষবরণ রাতুল চরণ।
বন্ধু যেন
ধর্ম সংস্কার খোলা মানব জমিন ভালোবাসার অরণ্য
পাপপুণ্যের সংকট ভেঙে নিঃসন্দেহে সবার অনন্য।
সুখ
আমার দুঃখ লাগা বাড়ির অনেক ভেতরে
অনেক সুখের ঘর লুকিয়েছিলো আমার অগোচরে
যখন
সব দরজা খিড়কি খুলে স্পর্শ করলাম উদাম চোখে
মাথার উপর এক গোটা আকাশি আকাশ।
বাস্তবের কাঁটা অসংখ্য কাগের গুন ভাগে
রক্তের ফোঁটা আঙুলের ডগায়;
হাতের রেখা তখনও সজাগ সততার দাগে।
যখন
দিন আনি দিন খাই সততার হাতে।
ক্ষুধার গর্ভে খুদা ঘুমায় নিশ্চিন্তে দীনতার রাতে।
এখন তুমি যাও
অভাব এখন তুমি যাও
আবার এসো
কতটা খিদে কতটা ঘুম স্বচ্ছলতার
বেঁচে থাকা দরকার
তোমার দু’হাত নেবো আমি নিংড়ে।
অন্ধকার এখন তুমি যাও
আবার এসো
কতটা আলো কতটা ছায়া সম্ভোগের
পেতে রাখা দরকার
তোমার হৃদয় নেবো আমি নিংড়ে।
জীবন এখন তুমি যাও
আবার এসো
কতটা অন্ধ কতটা বধির অলক্ষ্যে
ঢেকে রাখা দরকার
তোমার শরীর নেবো আমি নিংড়ে।
জরায়ুজ
থাক বয়স দূরে অনেক দূরে গিয়ে
থাক বয়স পাহাড় পাথর চাপা দিয়ে।
থাক বয়স বন অরণ্যের কালান্তরে
থাক বয়স সাগর জলধির ওপারে।
বয়সকে দিওনা ঘেঁষতে কোনো কৌশলে
কুশল চিঠি সই পাতার হিল্লোলে
পরিচর্যার অজুহাতে শরীরের ভেতরের ঘরে।
বয়স ধরলে শরীরের কল্লোলে ক্রমশ: ভাঙ্গন ধরে
শরীরের বিনুনির গিঁট আলগা করে
শিরদাঁড়ায় কালচে পড়ে।
পাপপুণ্য জল শূন্য জীর্ণ মাটি সামান্য ফসলের গন্ধে
আকাশ মেঘময়।
নিঃসঙ্গ বাতাসের সন্ততি থাক নিত্য পোশাকের ছন্দে
শরীর অস্থিময়।
শরীরের ভেতর আর এক শরীর বয়সের মূর্ধায় থির।
যদিও শরীর .....
আলো অন্ধকারের গমক গমক আঁচের গভীরে
ষোলো আনা লোভ আরো বেঁচে থাকার বৃষ্টি সরস সরোবরে
অন্তর্বাস তত্ত্বের বর্ণের ঝনৎকারে।
দু’হাত কোলাহল হাতড়ে আরো বেপরোয়া আরো যত্নশীল
সব বয়সের দিন দিগন্ত আঁকড়ে।
শরীর...... ভিখিরির জাত ক্ষুধিত স্বভাব
জরায়ুজ।
শরীর...... পুরুষ নারীর স্নাত সংশোধিত পল্লব
জরায়ুজ।
শরীর...... সংকল্পিত বাস্তব ভাস্কর্য
জরায়ুজ।
আমি আসবো
ব্যথার বিষ শেষ হলেও
ক্লান্তির অবশেষ হলেও
তোমার প্রয়োজনের কাছে বাড়তি হলেও
আমি আসবো শর্তের দড়ি ছিঁড়ে
তোমার রক্ত হবো;
তোমার ধমনী শিরায় তোমার শরীরের কল্লোলের কলোনিতে।
বসন্তের আকাশি চাঁদ অপছন্দ হলেও
আমি আসবো জন্মের সূত্র ধরে
তোমার রক্ত হবো ;
আগামী দিনে তোমার ক্লেশের ভেতর লবঙ্গ যোনির লাবণীতে।
ব্যথার বিষ শেষ হলেও
ক্লান্তির অবশেষ হলেও
আমি আসবো ........
নিঃসঙ্গতার কবিতা
আমার বয়সের কাঁধে এখন আর নেই কোনো ওজন
শিরদাঁড়ায় হাত বুলিয়ে দেওয়ার মতো কোন স্বজন।
নিস্তেজ পড়ে থাকা গন্ধমাখা রুমালে
সেই আকাশী গগন ...
আর
প্রহরের গ্রিল খুলে দু’জনে এক সাথে বসে থাকা
দু’বেণীর দোলায় সূর্য্যর আসা যাওয়া গায়ে মাখা।
যদিও সময় থাকতে দিয়েছি মেয়ের বিয়ে
ভালো ঘরে আমার সাধ্যের বাইরে গিয়ে
ছেলেও খুঁজে নিয়েছে রোজগার নিজের বিদ্যা বুদ্ধি দিয়ে;
তারা এখন ভীষণ ব্যতিব্যস্ত নিজের নিজের একান্ত সংসারে।
একদিন গাছে ফুল ছিলো ফল ছিলো;
ছিলো পাতার সবুজ সুরভি
ছায়া রোদ্দুর মেঘলাগা বৃষ্টি; ঋতুর স্পর্শ সুখলাগা পৃথিবী।
কোলে পিঠের সম্পর্ক এখন ঝুললাগা ছবি;
একলা ঘরের ভেতরে নিজের মতো করে
আজো অতীত ভাতের গন্ধের মতো ছুটে আসে
নিঃশব্দে পেরিয়ে চৌকাঠ স্বচ্ছতার বাতাসে।
আমার নিঃসঙ্গতার পাতায় হারানো সঙ্গতার
অবাধ বর্ণের নিছক বর্ণনা টেনে আনায় কি কবিতা!
দুঃখ তুমি
দুঃখ তুমি
শুকনো ভাতের দানায়
উষ্ণতার স্বাদ খুঁজে নিও।
দুঃখ তুমি
ঘাত প্রতিঘাতে নির্বিশেষে
স্বচ্ছ হৃদয় খুঁজে নিও।
দুঃখ তুমি
শ্রমের লাঙ্গল ফলার শানে
মাটি খুঁড়ে ফসল খুঁজে নিও।
দুঃখ তুমি
দু’চোখ বুজে অন্ধকারে
সূর্য মাখা দিন খুঁজে নিও।
দুঃখ তুমি
ঢালা বৃষ্টির ফোঁটায়
ঝিলমিল আকাশ খুঁজে নিও।
দুঃখ তুমি
কঠিন বলিদানের দাগে
ভাগ্যের ভাগ খুঁজে নিও।
দুঃখ তুমি
সংঘর্ষের আখার কাঠে
ফুলকো রুটির ভাপ খুঁজে নিও।
দুঃখ তুমি
সম্পর্কের ইটপাথরে মাঠে
আজ ভিটের টুকরো খুঁজে নিও।
দুঃখ তুমি
খুলে অন্তরের গাঁঠ
সহজ মনের জাত খুঁজে নিও।
দুঃখ তুমি
বিভাজনের চৌকাঠে
উৎসবই বিধান খুঁজে নিও।
দুঃখ তুমি
নারীর মাতৃত্বের কোলে
আগামী দিনের দীপ্তি খুঁজে নিও।
দুঃখ তুমি
জীবনের কোরা পাতায়
প্রবৃত্তির দিক প্রবাহ খুঁজে নিও।
দুঃখ তুমি
সময়ের বুনোনিতে
ইতিহাসের পরিহাস খুঁজে নিও।
দুঃখ তুমি
সম্প্রীতির সেমিনারে
মানুষের মেরুদন্ড খুঁজে নিও।
দুঃখ তুমি
বিপর্যয়ের আয়নায়
হৃদয়ের একান্তে শান্তি খুঁজে নিও।
দুঃখ তুমি
জীবনের কাব্য গ্রন্থ
মৃতোপম শব্দের হাড়ে খুঁজে নিও।
একতার প্রচ্ছদ
একার নয়
দোকার নয়
এ সবার নির্জলা শ্রম।
একার নয়
দোকার নয়
এ সবার অবাধ স্পর্শ।
একার নয়
দোকার নয়
এ সবার নিঃস্বার্থ অর্ঘ।
এ সবার
শ্রমের স্পর্শের অর্ঘের একতার খন্ড
রঙ্গ-প্রবণ অন্তরঙ্গ সংহতির হৃদপিন্ড।
জলে স্থলে নদী সাগর রোদছায়া বৃষ্টির তোলপাড়
আকাশ মেঘের ছাদে সূর্য চাঁদের দিবারাত নির্বিকার
মাটির ঘাসে ঘাসে ঘন দুর্বার শিশিরে ভুবন একাকার
অনাবিল অনঘ সৃষ্টি একতার সৃষ্টির দু’পার।
একার নয় দোকার নয় এ সবার .........।
সহবাস
কবি বন্ধুরা ...
তোমার পছন্দ মতো সমবেত শব্দ যতো
প্রতীতি আঙুলে কুড়িয়ে তোমার লুকোনো
অভিধান থেকে,
লেখো ...
সন্ধ্যা ভোর রাত্রির প্রতিহত হৃদয় জোড়া হৃদয় ভাঙা;
আকাশ পাখি মেঘ বৃষ্টির,
ছায়ার মোহক রোদ দৃষ্টির,
তোমার মত করে বিষাদ ভুলে
এক ঘর থেকে আর এক ঘরের সব দ্বার খুলে।
লেখো:
রঙ রয়েছে পড়ে অনুভবের আবেগের সুখ ধরে
যদিও নজর কাঁচা সরস তৃষ্ণার গন্ধে বুক ভরে।
লেখো:
কে খারাপের আড়ালে নষ্ট ছায়ে
সারাদিন?
কে হাঁটে ভালোর খাপে অসুখ পায়ে
সারাদিন?
লেখো:
সব দুঃখ কষ্টর কথা
বুক ফাটা জলভরা পাটাতন দীর্ঘ ভারে
দু’চোখের নীরব প্রতিবাদ নদী থেকে সাগরে।
লেখো:
ব্যথার অন্তঃসারে নিঃশ্বাসের ভেতর সততার আঁচ
বাতাসের হোমে ভরসার আগুন ছাই মাখা মণিময় কাচ।
লেখো:
দুঃখ কষ্টর মধ্যে সংঘর্ষ আর স্বপ্নের বসুন্ধরা
দু’হাত ভর্তি ক্ষুধার খুদা ধানে চালে ভাতে কুশলপারা।
লেখো:
এরাই অন্ধকার;
এরাই অন্ধকারের শ্রেয়সী চাঁদ
এরাই জোয়ার ভাটার রূপসী ফাঁদ।
যে ব্যথা নিঃশ্বাসের নিঃশব্দতায়
এরাই চাঁদলগ্ন ধারাময় বসুধায়।
ভবিতব্য
যাওয়াই ভালো
দু’পায়ে অন্ধকার ঠেলে আর এক নতুন অন্ধকারে।
যাওয়াই ভালো
আলোর সাঁকো ফেলে আর এক নতুন অন্ধকারে।
এখন
মাকড়সার জালে ভর্তি দেশের বাড়ি
বেঁচে থাকার তাগিদে বিদেশ পাড়ি
জেনেও ....
একদিন আসতে হবে ফেরত ঘরে
সম্পর্কের সৌরভে দু’হাত চার করে ।
দুটি হাত দুটি প্রান্ত
সতর্ক রেখে
দু’হাত এক করো বা আলাদা করো
ভগ্নাংশের মধ্যেই খুঁজে নিতে হবে তোমার অবশিষ্ট
আকাশ মাটির গন্ধ তোমার ভবিতব্য
যদিও
তোমার দু’হাত আজ সর্বস্বান্ত অথর্ব
ছেঁড়া ঘুড়ির মতো জীবনের সুতোয়
একলা কাঁটা তারে ।
অপরাধবোধ
তুমি বলো
শরীর বয়সের বশে থাকলে
অপরাধ।
অশুচির গন্ধ গায়ে মাখলে
অপরাধ।
মাথার উপর ভগবান পায়ের নীচে শয়তান
মুখের আদল বদলে খুঁজতে হবে অবসান।
তুমি বলো
ফিরে যাও ঘরে দু’হাতে রেখো ধরে
দুঃখের দিন সুখের দিন ঘরের কোটরে
খোলামেলা চাতাল।
সূর্যের ভোর আকাশে রোদের চাদরে
ফুলতোলা সকাল।
তুমি বলো
দেনার ভার দু’হাতে থাকলে
অপরাধ।
কর্তব্য দায়সারা রাখলে
অপরাধ।
তুমি বলো
ফিরে যাও ঘরে দু’হাতে রেখো ধরে
বারোমাস তেরো পার্বণ আদর আপ্যায়ন
সম্প্রীতির দরবার।
দুই প্রান্তের ঘর উঠোন পৃথিবীর নিকেতন
একান্নবর্তী সংসার।
খোলা হাওয়ায়
তুমি এসো বা যাও ফিরে
তোমার ইচ্ছে লাগার ভিড়ে।
যদিও নেই
আমার ভেতর ঘরের বাসা সুখ দুঃখ কষ্ট মুখের ভাষা।
আছড়ে মুচড়ে পড়ার ব্যথা সম্পর্কের কাঁচ ভাঙা অযথা।
আলো আঁধারের বাড়াবাড়ি ধনদৌলতের কাড়াকাড়ি।
ধারদেনার কোর্ট কাছারি
হাট বাজারের ফর্দ হিসেব নিকেশ করার জারি।
অনুষ্ঠানের বাড়তি আবর্জনা অহেতুক নেশার সরাই খানা।
আরাম করার বাগান বাড়ি ভাগাভাগির জঞ্জাল ভারি।
খুনসুটির ঝগড়াঝাঁটির বালা।
সিংহদুয়ার সতর্কতার চাবিতালা।
এখানে শুধু রোজকার মতো ......
খোলা হাওয়ায় স্বাভাবিক আসে যায়
ধারাবাহিক টাটকা ফুলের উজাড় গায়
সন্ধ্যা ভোর মাটির গন্ধ আকাশ জোড়া
ভালোবাসার বসত ঘর হৃদয় মোড়া।
বাবার কাছে কন্যার নিবেদন
বাবা
মাথা ঠুকে কথা দিলাম
তোমার জীবনের বোঝা হবো না
অভাবের গলার ফাঁস হবো না।
দেয়াল দেওয়া আঁতুড় ঘরের ভুবন কাঁথায়
দুর্নিবার অনুভবের জীবন মেলার মুহূর্তের দরজা খুলে
আমাকে আসতে দাও সম্মতির নির্জনে
মায়ের প্রসব বেড়া খুলে।
তোমার কঠোর দিনে সমস্ত বিষাদ মুছে
আমি হবো তোমার চিন্তাহরণ নন্দিনী ।
কাজের কন্যা আষ্টেপৃষ্ঠে সংসারের ধারাপাতে
প্রহর জুড়ানো প্রশান্তির নিরাময় নিঃসঙ্গ বিনিদ্র রাতে।
উলসে সম্প্রীতির কামনা দৈবাৎ সুপ্ত হনন ভুলে
আমাকে আসতে দাও প্রত্যয়ের গাহনে
মায়ের জঠর ব্যথা খুলে।
রোজকার কাজ কর্ম ক্লান্তির স্পর্শে তোমার শরীর ঝাঁঝরা হলে
আমি হবো তোমার সান্ধ্য আকাশ ডানামেলে ঘরের দুয়ারে ঢলে।
ফসল তোলার উদ্বেগ জড়িয়ে দু’হাতের বাঁধন খুলে
আমাকে আসতে দাও রক্তের লালিমায়
মায়ের আনন্দ বিহান ফুলে ।
আমি জানি পুরুষ পুত্র আগামী দিনের অর্থ বৃত্তির সূত্রধার
সব ঝি কন্যা উদ্বৃত্ত খরচপত্র সময়ের কাঁধে দেনার ভার।
তোমার ভুলে যাওয়া
ভুলে যাওয়া তোমার সবকথা
আমার ঠোঁটের রঙ হয়েছে
ভুলে যাওয়া তোমার সবকথা
আমার খোঁপার কাঁটা হয়েছে।
কতোটা পেলে বলো আজ তুমি সুখী হবে
ততোটা গুনে গুনে দেবো তোমায় তবে।
এখন শুধু তোমার দরজার খিল খুলে দাও
আমাকে তোমার ঘরের ভেতর আসতে দাও।
আমার খোঁপার সবকাঁটা নিজের চোখে না হয়
তুমি গুনে নিও।
আমার ঠোঁটের সব রঙ নিজের হাতে না হয়
তুমি তুলে নিও।
দায়
সেদিন
জ্যোৎস্নায় চাঁদ ছিলো না।
সেদিন
সমুদ্রে ঢেউ ছিলো না।
সেদিন
নদীতে স্রোত ছিলো না।
আমার দায় আমাকে কুড়ে কুড়ে গ্রাস করছিলো
প্রশ্নের ঘাড়ে প্রশ্ন আমার কাছে উত্তর ছিলো না।
যেদিন তোমাকে দেখলাম
সম্পর্ক জলের মতো ঠেলে নিয়ে যায় আমাকে অভিসারে
যেখানে চাঁদ
জ্যোৎস্নার বালিশ মাথায় নিটোল ঠোঁটে রেখেছে আঙুল।
যেখানে ঢেউ
সমুদ্রে যুবতী বুকভরা স্তন মাতৃত্বের তৃষ্ণায় অস্থির আকুল।
যেখানে স্রোত
নদীর দুটি বেণীতে আত্মসারে বেঁধে জাগিয়ে পারের কুল।
দু’চোখ একবুক জল নিয়ে অন্ধকারের খাদে
বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছি নিজের দায়ের কাছে।
মৃত্যু
মৃত্যু মারা যায় না
কারোর ডাকে রা কারে না।
মৃত্যু আতঙ্ক ভয় জ্বর শূন্য
মৃত্যু অহঙ্কারবোধ একলা
মৃত্যু অঙ্ক অদৃষ্টের ধারধারে না।
কারোর দু’পায়ে বা দু’হাত ধরে বলে না
আমার জীবন ফিরিয়ে দাও।
মৃত্যু যুদ্ধ শেষ কুল অবশেষে বলে না
আমার জীবন জিরিয়ে দাও।
মৃত্যু মনিব শরীরের শরিক মৃত্যু ভবিষ্যৎ
ভাগ্যের ধারধারে না।
মৃত্যু রোগ মৃত্যু ভোগ জেগে থাকার শর্ত
ধাপ্পার ধার ধারে না।
মৃত্যু বিদায় মৃত্যুর চোখে নিশ্চুপ কান্নার
অল্প ঘুম।
মৃত্যু প্রেম মৃত্যু বিষ অসুস্থতার আরোগ্য
সুস্থ ঘুম।
মৃত্যু আঘাত মৃত্যু বিশ্রাম হাড়ের নিশ্চিন্ত
মগ্ন ঘুম।
মৃত্যু ইচ্ছে বেঁচে থাকা শরীরের ফাঁকজুড়ে
অনন্ত ঘুম।
মৃত্যু ছাই মৃত্যু যায় মৃত্যু আসি
মৃত্যুর ঠোঁটে মৃত্যুর একলা বাঁশি ।
কবির কবিতায়
কলমের দাগে
কবির কবিতায় চাঁদ কলঙ্কিত।
ফুলের দাগে
শব্দের পাথর আজ ঈশ্বর।
পাষাণ পল্লবিত।
কবির দু’চোখ মুখরিত।
শব্দের ঘুমে শব্দের রাত্রি শব্দের ভোর
একলা একা কবিতার শিরদাঁড়ায়।
কবির পরকীয়া প্রেমে নিত্য হাঁটা তোর
যাযাবর শব্দ কবিতার পান্থশালায়।
শব্দের শ্যাওলা কবিতার জলে আশ্রিত।
যদিও সূর্য পিপাসিত।
কবির দু’হাত মুকুলিত।
বৃষ্টির দাগে
শব্দের ধুলো আজ সরব।
বাতাস উচ্ছ্বসিত।
কবির দু’হাত বিসর্জিত।
গুমর
তোমার দু’চোখ রেখেছো একাকার
যখন ভাঙছিলো ঝনঝন করে বৃষ্টির কাচ
রোদ্দুরের আঁচে
দেখছিলে কাঁখ বাঁকানো নাচ
এক অসূর্যস্পশ্যা নারীর ।
আমি ছুটেছিলাম কুড়োতে বৃষ্টির ফোঁটা
দু’হাত আমার রক্তের আলপনায় যদিও একাকার ।
এ’জখম আঘাত
হৃদয়ের হয়রানিতে বাঁধছিলো অবাধে ভালবাসা
শুধু তোমার ।
তুমি দেখলে না ছুঁয়ে একবারও
আমার উপোষী ঠোঁটের পাতায় যতো রোদবৃষ্টির সাতকাহন ।
মৃত্যুর জন্য কবিতা দায়ী
থেমে গেছে বৃষ্টির ছলকানি
থেমে গেছে আকাশের গোঙানি
তবু তুমি আসোনি আকবর চাচার চায়ের দোকানে।
ধ্বসে গেছে মাটির আত্মগ্লানি
ধ্বসে গেছে বসতবাড়ির ঝলকানি
তবু তুমি আসোনি শেষবিদায় দেখে নিতে শ্মশানে।
কার শব রেখে চুল্লিতে ধরে আছো উছলান
আগুনের সেঁক লেগে বেঁচে ওঠে মৃত্যুর প্রাণ।
প্রকৃতির হৃদকমলে থাক ধর্মজাত যার যার
এইটুকু পৃথিবী সবার সমান সমান অধিকার।
কবির আঙুল জানে বেঁধে নিতে কবিতায় নিশ্চুপ কথার ঝংকার
মৃত্যুর জন্য কবিতা দায়ী অবিমৃশ্য হাড় হৃদয়ের নিরর্থ অহংকার।
বলাৎকার
এসো কবি।
এখন নির্জলা দুপুর
আমায় নির্ভয়ে নগ্ন করো।
শব্দের কাঁচি ছুরি ধরো।
মায়াবী গন্ধের ইথার ভরো।
আর
খুবলে নাও শিকড় সমেত আমার উরস খুলে
হোক ভাঙচুর তোমার রিরংসার কলম তুলে।
আর্তনাদ পড়ে থাক একা নিশ্চুপ।
ভালো থাকার ধৃতি শুধু ভালোবাসা নয় বলে
নিয়ে যাও কবিতা শরীর থেকে শরীর ছিঁড়ে
হোক বলাৎকার; কবিতার চেয়ে বেশি দামি।
নিকুচি করেছে কবিতা
যে পেটের ছেলে
মায়ের দুঃখজ্বালা বোঝে না
গোবর ঘুঁটের গায়ে মায়ের হাতের ছাপ
লোকের কাছে বলতে লজ্জা করে
পরের উচ্ছিষ্ট বাসন মেজে মায়ের দু’হাত
দু’মুঠো ভাত সংসারের ক্ষুধা ভরে;
সে ছেলে মুখ ফিরিয়ে
মায়ের সঠিক ব্যাখ্যা সবিস্তারে ফলাও করে কবিতা লেখে
শব্দ কুচির গর্ভে মায়ের কষ্ট জ্বালার আঁচড়ের স্তবক ঢেকে।
বা! কবিতা।
যে ছেলে বুড়ো বাপের ঘাড়ে বসে অন্ন ধ্বংস করে
বাপকে ঊনতা দেখায়
বংশের অভাব অনটনের অকিঞ্চনতার প্রদর্শন ধরে
রংবাহারি কবিতা লেখায়।
সে ছেলে বাহুতে পৌরুষ দেখিয়ে
বাপের সম্বল আধকাঠা জমির উপর পৈতৃক ভিটেমাটি
উপড়ে ফলিতার্থ নির্মাণ চায়
প্রচুর আমদানি চোলাই মদের ভাটির ঘাঁটি।
সে ছেলে বাপমায়ের রক্তঅশ্রুজমাট শিলায়
ইস্তাহার দিয়ে উদ্ভিদ উচ্ছেদের কবিতা লেখে।
শব্দের শিরদাঁড়ায় উঁচিয়ে গলা অধিকার দাবি।
আমি
প্রসবসূত্রে প্রথম উত্তরাধিকারী
হাতকাটা বাপের শরীর থেকে শ্বাস নিবর্তন হলে
একবাক্যে বলতে পারে
বাপের মৃত্যু
বাপের মুখাগ্নি চুলোয় যাক।
কবিতার বীজমন্ত্র ফলমন্ত আধকাঠা মাটি
বেঁচে থাক বাপমায়ের দান নিকুচি করেছে কবিতা।
সুন্দরী বেশ্যা
ওরা সূর্য ডুবলে ঘর সাজিয়ে দরজা খুলে থাকে দাঁড়িয়ে
ওরা শরীর জড়ায় ঝলসে কাপড়ে শরীরের আঁচ বাড়িয়ে
ওরা ঘুমোয় কম চোখের মজ্জায়
অনিচ্ছা সম্ভোগ সহ্যের শয্যায়
নগদ গুনে হাতে।
ওরা দিনের গোচরে বেশি কালো, রাতের অন্ধকারে ফর্সা
ওরা বাস্তবে শরীর বিছিয়ে সহ্য করে আঘাতের তীক্ষ্ণ বর্শা
সাজের গয়নায় সুন্দরী বেশ্যা
ওরা পায় কম, খোয়ায় বেশি।
ওরা নিজের প্রাণের দেরাজে ওরা নিজের মনের দেরাজে
নিজের আসল শরীর লুকিয়ে
এঁটো না হয় জেনে নিজের পুতুল শরীর কষ্ট যন্ত্রণার ভাঁজে
পুরুষের প্রবৃত্তির কাম ভুলিয়ে
বেলোয়ারি কাঁচের সুন্দরী বেশ্যা
ওরা রতি কম, সতী বেশি।
ওরা পরের ঘর পুড়িয়ে নিজের ঘর বাঁধতে জানে না
ওরা পুরুষের ঘর বাঁধলে সমাজের বাসিন্দা মানে না
নিষিদ্ধ সন্ধ্যায় সুন্দরী বেশ্যা
ওরা রমণী কম,ঘরণী বেশি।
ওরা পায়ের পাতায় আলতা পড়ে মেয়েদের মতো ব্রত কথা পড়ে
ওরা স্নান সেরে পুজো আর্চা করে ঘরের দিনপঞ্জিকার পাতা ধরে
মানুষী সভ্যতায় সুন্দরী বেশ্যা
ওরা নোংরা কম, মাটি বেশি।
ওরা পেটের তাগিদে পেট খোলা রাখে শরীর ভেঙে খায়
ওরা নিরুপায় ‘নিহতাঃপূর্বমেব’ মর্মের স্রোতে তলিয়ে যায়
সময়ের বাগানে সুন্দরী বেশ্যা
ওরা ঘাস কম, দূর্বা বেশি।
ওরা
আজও কলঙ্কিত
আমাদেরই চরিত্রের কলঙ্কে।
খড়কুটো – দুই
মাথার উপর আকাশ
তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন ঘরলগ্ন মাটি
দেহ জুড়ানো দু'দন্ড শান্তি
নামিয়ে ব্যক্তিগত বোঝার দায় পায়ের নিচে।
মাথার উপর ঈশ্বর
তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন শ্রমলগ্ন হাত
পেট জুড়ানো দু'মুঠো ভাত সারিয়ে রক্তজলের উৎস সময়ের উদ্ভিদে।
মাথার উপর ঐশ্বর্য তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন দেহলগ্ন বৃষ্টি ঢেঁকি জুড়ানো দু'ধামা ধান মাখিয়ে আপন্ন অধিকার সংঘাতের ঘামে।
মাতৃভাষা
যে ফেরে এ দুয়ার ও দুয়ার দেখেও আমি ফিরিয়ে নিই মুখ
হাত নেড়ে ইশারায় ভিখ মাগে যদি পায় একটু অন্নর সুখ
আমি জানি সে ক্ষুধিত ভিখারী।
ভোর উঠতেই যে পাখি ভাষার ডানা মেলে উড়ে যায়
শূন্য হাওয়ায় মগ্ন চাওয়ায় দুনিয়াদারি ভুলে গান গায়
আমি জানি সে হৃদয়খোলা সংসারী।
যে পথ খুঁজে পথ হারায় খাম খেয়ালির স্তব্ধ হাওয়ায়
যে ভাষায় প্রাণখোলা গানের কলি আত্মহারা চাওয়ায়
আমি জানি সে আনন্দ পথচারী।
দিনান্তে যখন ফিরি ঘরে ক্লান্ত সর্বস্বান্ত কাঠ শরীরে
যে ভাষার দানা ভিজিয়ে জিভ গলার অন্তঃস্থল ঘিরে
এ আমার মাতৃভাষা সুখভাসায় প্রচ্ছন্ন আত্মার নীড়ে
আমি জানি সে জীবন যাপনকারী।
মা তুমি ভালো থেকো
এটা ঠিক
আমিও বড়ো হলে ভুলে যাবো মাকে
ভুলে যাবো
আমার দুধের ঝিনুক বাটি আমার বারকোশ আমার জলের গ্লাস।
কথায় কথায় অদ্ভুত সব উজবুক বায়না জেদে ফুলে ওঠা শ্বাস।
একটু পরে খুঁদকুড়ো মন আবার মায়ের দুধে আমার চুপকান্না
নিজের দোষে ভাঙলে খেলনা
বাড়তি পাওনা মায়ের আঁচলে আদরের দোলনা।
ভুলে যাবো
মায়ের ভুলিয়ে ভালিয়ে গল্পে গানে
ভালো করে ভাত চটকে চিবুক টেনে টপকরে আমার মুখে গ্রাস গেলানো
অনেক পাখি চেনানো শিস ডাক টেনে
বিষম লাগলে
চট করে আমার মাথায় হাত বোলানো
মায়ের জিভের ডগায় ষাঠ ষাঠ
আমি সোনার ছেলে মায়ের রাজ্যে আমিই রাজ্যপাট আমিই বড়লাট।
ভুলে যাবো
হঠাৎ হঠাৎ ঘুম ভাঙলে
মায়ের হাত আমার পিঠে উল্কি আঁকা হাজার আকাশ ঘুম পাড়ানী
মেঘ ডাকলে বৃষ্টি হলে বাজ পড়লে সোজা মায়ের বুকে একঝাঁপে।
আমার সব দুষ্টুমির খেলায় মা সামিল যেন কৃষ্ণ গোপালা যশোদারানী।
ঘর উঠোনময় আমার পালিয়ে বেড়ানো খপ করে ধরাপড়া মায়ের একধাপে।
ভুলে যাবো
হাড়খাটুনির মায়ের কষ্ট লাগা চোখের থেকে
আমার চোখ পেয়েছি পেয়েছি চলার সড়ক আলোর দানী
ফেলা গেলে অন্ন
শাসন বিধি রাখতেন কাছ থেকে
চারবেলার বিজ্ঞাপনের দুনিয়ায় সব চিনি সব জানি।
ভুলে যাবো
খুব শীতে মায়ের শরীর থাকতো ঝুঁকে নিজের ছায়ায় দিকে
মায়ের দু’পায়ে হাঁটুর ব্যথা কিন্তু রোদ রাখতো ঠিক আমার দিকে।
আবার খুঁটিয়ে দেখা
স্কুল ফেরৎ টিফিন বাক্স আর হোমওয়ার্ক রুটিন মতো
আবার বুঝিয়ে তখনি
বকাঝকার মধ্যে আমার দু’গালে আদর চুমু উজাড় যতো।
ভুলে যাবো
মায়ের সেই শুভ্র শাড়ি কালো পাড় বাঁধা কিনারা
নিষ্পত্র চরাচর উপোষী শরীর
আমার ভুবনসঙ্গী বাকি পৃথিবীর সব স্বাদ আল্হাদ ভুলে
পেটের প্রসব জ্বালা
কোলেপিঠে মানুষ করার দহন
আকাশ ভাঙা জলঝুপ্পুস ঝড় মাথায় তুলে।
তখনও মা সজাগ
রাখতে আরোগ্য নিরাময়
স্নেহ মমতার অন্তঃস্থলে আগলে আমায়
আমার অনেক অকাজ জেদের আবোল তাবোল ভাঁজে।
মায়ের লহুগতর
হিমশিম দু’হাত অষ্টপ্রহর আমাকে শুধু মানুষ করার কাজে।
ইদানিং ব্যতিব্যস্ত আমি নিজের স্বার্থের কাজে
পেলেই অবসর বেশ কাটে সময় বউ ছেলের কাছে
নিজের সংসারের রোজকার কলহ গিলতে না পেরে
শেষমেশ দ্বন্দ্ব কাটিয়ে
দ্রুত হাতে
গলগ্রহ মাকে
রেখেছি পাশের দেওয়াল লাগা আলোবদ্ধ ঘরে
ভালো থাকবেন বলেই করে দিয়েছি একঘরে।
তবু কাঁটাতারের অন্ধকারে মায়ের দু’চোখ অস্থির
ঘরের চৌকাঠে চৌকাঠে পৌঁছে দিতে শান্তির নীড়
আশিস মাখা দু’হাতে।
এখন
মা থুত্থুড়ে প্রায়শ: শুয়ে অবসাদ ক্লান্তির কাঁথায়
বিড়বিড় করেন মহাভারত রামায়ণ কখনও গীতার শ্লোক শোনান।
আবার ঠিক সময় ধরে আমার ঘরের একাকীর জীবনযাত্রার পরিধান
সুঁচ নিয়ে হাতে জীর্ণ দৃষ্টির ভেতর দিয়ে
প্রযত্নে মঙ্গল সুতো পড়ান
দু’চোখে রাত জাগান
আনতে ছেলের সংসারে সুখ সমৃদ্ধির সমাধান।
আজও মা নিয়মিত একলা ঘরে
নিস্তব্ধ রাত দুপুরে সেলাই করে
সুঁচ ফুটিয়ে মায়ের
আঙ্গুলে রক্ত পড়ে
চোখের জল পড়ে না
আমি গায়ে সুখের দামী পোশাক পড়ে
বলতে লজ্জা করে,
মা তুমি ভালো থেকো।
মা তুমি ভালো থেকো।
চৌকাঠ
একটা ঘরে
অনেকদিনের সংসার
কাটিয়ে এসেছি দু’জনে।
বেশির ভাগটা রমণীর গুণে।
এক কাঁথায় শীত ভাগ করে
এক কাপড়ে সুখ দুঃখ ধরে
রেখেছি বেঁধে হৃদয় হৃদয়ের স্পন্দনে।
বেশির ভাগটা রমণীর গুণে।
এক চুটকি
সম্বরার ঝাঁজে গোটা সংসার।
এক মুচকি
হাসির ভাঁজে গোটা সংসার।
বেশির ভাগটা রমণীর গুণে।
দিনযাপন আলাপনে
বিয়ের বাসন কোসনে
এক বাক্যের শাসন
এসো ঘরে
বসোনা চৌকাঠ ধরে
সুখশান্তি চলে যায় অন্য বাড়ির উঠোনে।
খারিজ বাক্যিলাপ
অনেক গাছ পুঁতলাম
সময়মত রোদ জল দিলাম
তোর নদী থৈ থৈ করে আর বাড়লো নাতো।
খুশির গতর দিলাম
বছর বছর পোয়াতি হলাম
তোর সংসার ফলবন্তরমণ আর হলো নাতো।
চিঠি পত্তর দিলাম
অশ্রুজলে চোখ ভাসালাম
তোর জ্বালাপোড়ায় দোসর আর পেলি নাতো।
অগাধ উপায় দিলাম
সব দোষ ত্রুটি ঘাড়ে নিলাম
তোর পকেটে সততা খুঁজে আর পেলি নাতো।
কতো পাথর ভাঙলাম
বাঁঝামাটি কেটে ফসল ধরলাম
বুকের পাঁজর ভেঙে হৃদয় আর পেলি নাতো।
সম্পত্তির সিন্দুক দিলাম
সৎসঙ্গতির বাসিন্দা দিলাম
তোর মনুষ্যত্ব জাগান দিতে আর পারলি নাতো।
প্রচুর দৌলত দিলাম
সকালসন্ধ্যে সেলাম ঠুকলাম
তোর খোদার পদচারণ মাটিতে আর পড়লো নাতো।
এখন অবসর দিলাম
সব দরজা দুয়ার খুলে দিলাম
তোর হুইলচেয়ার ছেড়ে উঠতে আর পারলি নাতো।
জানিয়ে রাখা ভালো
চন্দ্রিমা
তুমি ও সুখে
আমিও সুখে
জানিয়ে রাখা ভালো তোমার ভালোবাসা
পাথরের পাষাণে সোহাগের আসন পাতা
কাঁসার বাসনে ফুলের অমূল্য সুবাস
ভোরের শিশিরে লজ্জানত শীতল দুটি হাত
মন্ত্রের পবিত্রতার অক্ষরে অক্ষরে বেঁচে থাকার সমস্ত প্রপাত
শীতের দুপুরে নিখাদ রোদ্দুর ভালো থাকা সুখ শান্তির ছলাৎ।
ঘরদোর উঠোন চৌকাঠ লক্ষ্মীর দু’চোখ সচ্ছলতায়
ফুলের গন্ধ বসন্তবিহীন বনান্ত নির্ভেজাল হাওয়ায়
শাঁখা সিঁদুরে শরীরের ভেতর শরীর মাতানোর রমণ প্রবণ
অঞ্জলিতে অঞ্জলিতে সব অন্ধকার নিংড়ে আলোর শোধন
সন্ধ্যাবাতির অহংকার ভেঙে নিস্তব্ধ রাতের মদির শয়ন।
জানিয়ে রাখা ভালো
জেনেছি তোমার বুকে শুয়ে
খুব সহজ ফুল ছিঁড়ে আনা, ফুল ফোটানোর কষ্টখানা
অন্যের দুঃখব্যাথা নিমিষে জলের মতন করতে জানা
আকাশের চেয়েও ভাস্বর তোমার রূপ
অরণ্যের চেয়েও নিবিড় প্রেয়সী বুক
রঙিন উচ্ছ্বাসে
যথাযথ দেখেছি তোমার গোপন গোপনে
গহনের নন্দনে সন্ধ্যাকাল তৃপ্তির ঘাম
ভালোবাসা দহন যজ্ঞ -চিরন্তন নিষ্পাপ নাম
সুখী ঘুমের স্তনের বোঁটা
আমাদের সংসার গোটা
সুখ আছে বেঁচে বিনোদনের মহার্ঘ আবহ নিয়ে
ফিরে আসি কলঙ্ক ধুয়ে অধিকারের রঙ দিয়ে
তোমার নিকানো উঠোনে নিয়েছি দিব্যি দু’জনে
প্রজাপতির রঙ বাহারি যৌবনের প্রত্যূষ গহনে
জন্মান্তর ধরে তুমি হবে জননী আমি হবো পিতা
সন্ততির সশ্রদ্ধ হাতে উঠবে জ্বলে শান্তির চিতা ।
কষ্ট
আমার দু’হাতে তোমার স্পর্শের গন্ধ লেগে আছে
গন্ধের সুবাসে
তাই এখনও আমি জীবিত।
আমার বুকে তোমার ঠোঁটের আকর্ষী লেগে আছে
আকর্ষীর সুবাদে
তাই এখনও আমি জীবিত।
ঘাসের নরম শিকড় ছিঁড়ে, অভিমানে... বাইরে চলে যাচ্ছ?
যাও তবে।
অনেকদিন তো হলো সঙ্গে ছিলে ঘর-গেরস্তির সত্যিটুকু জড়িয়ে কবে?
আকাশকে সাক্ষী রেখে নিশীথে সাজানো গোছানো মাহফিলে
তোমার মনপসন্দ একগুচ্ছ কবিতা পড়ে শোনাবার কথা নয়
তবু পড়ে চলেছি।
আবেগ মুছে রুমালে।
সবার তো সব পাওয়া নয়।
আলোর আশাতীত কাজলে
ক্রমশ হাওয়ার আস্পর্ধায় কবিতার ঝনৎকার ভেঙে নিভৃতে
পাগলের মতো খুঁজে যাচ্ছিলো চুকেবুকে যাওয়া ভালোবাসা।
দিনদুপুরের আড়ালে
দাঁড়িয়ে আছি আয়নার সমীপে আমাকে তোমার মতো করে নাও।
অন্ধকারে দুঃখের দিয়ার সলতে আগুনের আলোতে পুড়তে দাও।
আমার কষ্ট তোমার অন্তরের পর্দায় লেগে আছে
কষ্টের নিহিতে
তাই এখনও আমি জীবিত।
স্বস্তি
যদি ফিরিয়ে দাও
তবে বলো। কোথায় যাবো!
পায়ে পায়ে বিপণ্ণতা, ব্যর্থ আমার কবিতা
শ্রাবণভরা দিনেও তীব্র দহন বৃষ্টির জ্বলন
দুঃখগুলো তৃষ্ণার সংশয়ের কাব্যমরণ।
যদি ফিরিয়ে দাও,তবে বলো। কোথায় যাবো!
অনেক আগেই কলম নিয়েছে ফিরিয়ে মুখ
চৌকাঠ থেকে তুমিও যদি ফিরিয়ে নাও মুখ
তবে বলো।
কোথায় দাঁড়াবো!
অহংকার পুড়িয়ে এসেছি নিজেরই অন্তঃপুরে
শোণিত স্রোতে ভাসিয়ে দিয়েছি জীবন জুড়ে
লজ্জায় নত মাথা আলোর বিহানে নিশ্চিন্ত অনাবিল নিঃস্বতার গানে।
এবার অন্তত একটু স্বস্তি না দিলে
অনিবার্য মৃত্যুর বুকে কি করে ফোটাবো আমার কবিতার
শব্দে প্রাণবন্ত জোর।
ভোর করে দেওয়ার মতো ডাকে নিয়ত নামিয়ে আকাশ
ভুবনজোড়া ভোর।
কবির মৃত্যু নেই
আর কবিতা লিখে উঠতে পারিনা।
তবু লেখার কলম একলা ছেড়ে যেতে পারিনা।
যদিও নিঃশ্বাসের উচ্ছ্বাস বুকের পাঁজর ভেঙে শব্দেরা
উদ্বাস্তু আঙুলের স্পর্শ নিতে আর উৎসাহী নয়।
কবিতার খাঁচার ভেতর আকাশ তেমন নয় বলে...
এক এক করে শব্দেরা ঘর ছেড়ে চলে যায়
নিজের নিজের মৌচাকের বাসিন্দায়
গুঁজে অজস্র সখ্যতার শর্ত বালিশের তলায়।
রোজ দু’বেলা শব্দ খুঁজে বেড়াই ...
এখানে সেখানে সাজোর বিলাসে।
জ্যোৎস্নার আঁচে।
প্রেয়সীর সহবাসের গন্ধে।
সকালের অগোছালো বিছানায়।
বাসি কাপড়ের কোঁচড়ে।
ঘরদোরের ধুলোঝড়ে।
এঁটো বাসনে।
উঠোনে পড়ে থাকা রোদের উত্তাপে।
চায়ের চুমুকে।
চুপ চুম্বনে।
স্নানের নগ্নতায়।
প্রণামের আঙুলে।
সংকোচের কাঁচে।
আড়ালে বুকভারি বারবনিতার দোরে।
নির্বিশেষে ‘ইউজ মি’ ডাস্টবিনে।
প্রকৃতির দু’হাত ছুঁয়ে যায় আমার কবিতার শেষ পাতা।
রেখে যায় তার চোখের দৃষ্টির ছাপ।
স্পর্শটুকুর অধিবাস।
নিঃশব্দতার নির্নিমেষ কোলাহলে জানিয়ে যায় দুর্দিনে
দুর্যোগে প্রতিবাদী হও।
না হলে তোমার একদিন সর্বনাশ।
বৃষ্টি এসে ধুয়ে যায় কথার নিমিষহারা সোহাগ।
কবিতারা সুখে আছে।
জীবনে আরো কিছু খোয়াক মেনে।
আমি আজও শব্দ খুঁজে বেড়াই কবির মৃত্যু নেই জেনে।
কবিতা
ডঃ বিদ্যার্থী দত্ত
ডিপার্ট্মেন্ট অফ লাইব্ব্রেরী অয়ান্ড ইনফরমেশন সাইন্স
বিদ্যাসাগর ইউনিভার্সিটি
মেদিনীপুর, পশ্চিমবঙ্গ
রক্তকরবী
একশো বছর আগের একটি দিনে
এমনি করেই ফুটেছিল তুমি,
জোড়াসাঁকোর মূল ফটকের পাশে
রেণু তোমার ছুঁয়েছিল ভূমি।
লোহালক্কড় হাজারটা জঞ্জাল,
ধুলোয় ঢাকা ব্যস্ত সে চিৎপুর,
তারই মাঝে ছোট্ট সবুজ দোলায়
লাল কুঁড়িটি হাসছিল ভরপুর।
হঠাৎ তোমায় দেখতে পেলেন তিনি,
শুনতে পেলেন তোমার মনের কথা,
মিষ্টি হেসে শুনিয়েছিলে তুমি -
"যতই আনো যন্ত্র হেথা হোথা,
পারবে না কো তবুও কোনো ভাবে,
থামিয়ে দিতে ছোট্ট আমার প্রাণ",
তখন তিনি বলেছিলেন তোমায়,
"বন্ধু তুমি অনন্তেরই দান"।
অমর তিনি করে গেছেন তোমায়,
আজও শুনি তোমার কথা তাই,
নন্দিনী আর বিশুপাগলের সুরে,
রোজই তোমায় নতুন করে পাই।
তুমি আমার সাতসকালের সখা,
তুমি আমার সাগর-বুকের ঢেউ,
আড়াল থেকে রঙ্গন যায় হেসে,
রাজার ডাক কি শুনতে পেল কেউ?
ডাকঘর
পাঁচমুড়ো পাহাড় থেকে রাস্তা একটা
এঁকেবেঁকে চলে গেছে
শ্যামলী নদীর দিকে,
নদীর ঘাটে এলাম,
স্মৃতি হয়ে এল ফিকে;
পশ্চিমের আলোয় মাখা
সোনালী ধুলোর রেখা
লুকোনো মুহূর্তের নুড়িগুলোয়
ভরসার রঙতুলি ছুঁয়ে যায়;
এতদিনের বন্ধ দরজা
হঠাৎ খুলে যায়;
দূরের ঘর থেকে
ডাক শোনা যায়;
সেটাই কি তবে ডাকঘর?
যত্নে রাখা রঙপেন্সিলে ফুটে ওঠে
আত্মার চেয়ে থাকা,
কবিরাজের পাঁচিল ডিঙিয়ে
ঠাকুরদার পাখার ঝাপট
সুদূর ক্রৌন্ঞ্চদ্বীপের সংকেত নিয়ে
দরজায় কড়া নাড়ে -
অদৃশ্য আলোর চিরাগ জ্বলে,
সাঁঝের আকাশ লাজে পরকাশি,
বুকের দীঘিতে লাল শাপলার রাশি
ধূর্জটির দিকে চেয়ে পার্বতীর হাসি,
ছোট্ট সুধার কথা মনে আছে -
আমাকে ভুলবে না কোনো ও দিন।
কবিতা
সাত্যকি (পলাশ দাস)
ঋষি অরবিন্দ সরণি, সরকার বাগান
বারাসত, কলকাতা
মুখ
এক ঝলক রোদ ওঠে
ফিকফিকে হাসির মতো বৃষ্টি হওয়ার পর
চাঁচের বেড়ার ফাঁক থেকে
রোদ ঠিকরে পড়ে ভিজে যাই
গায়ের রোমে জমে থাকা জল চিকচিক করে
এক পুকুর জল ছলকে ওঠে বুকের কাছেও
ভেসে ওঠে একটা মুখ
দুর্দিনে যে ভাত দিয়েছিল
মাথার উপর ধরেছিল ছাতা
এই সুদিনে জলে ভেসে ওঠে তার মুখ
অভিমান
কিছু অনুযোগ আর বেশ কিছুটা অভিযোগ
আমার দিকে ছুঁড়ে দিয়েছিলে
হয়তো কিছু না ভেবে
হয়তো অনেক কিছু যোগ বিয়োগের পর
কখনও কি ভেবেছিলে
কিসের জন্য তোমরা লড়ছো
যেখানে সবটাই তোমাদের আর বাকিটুকু
আশ্চর্য অঙ্গুলিহেলনে সীমাবদ্ধ থাকবে
আমারও একটা মন ছিল সেখানে
কিছু স্বপ্নেরা বাসা বেধেছিল
তোমার এই কুঁচলে দেওয়া
জিতে যাওয়ার অভ্যাসের বাইরে থেকে
আমার অন্যভাবে আকাশ ছোঁয়ার ইচ্ছে ছিল
ভেবেছিলে তোমার মতো আমার স্বপ্নদেরও
বেঁচে থাকার পূর্ণ অধিকার ছিল।
বনসাই ঠেস দিয়ে
টুকরো টুকরো অন্ধকারগুলোকে
গুটিয়ে এনে বিছিয়ে দিয়েছি চাঁদের নীচে
চাঁদ দুমড়ানো গামলার মতো চেয়ে আছে
ঘাসের উপর মাথা রেখে শুয়ে আছে
শিশিরের গন্ধে ভিজে যাচ্ছে শরীর
বনসাই মূলে ঠেস দিয়ে
কলমি ফুলের থেকে গল্প শুনছি
প্রজাপতির আর ফড়িংয়ের
রাত আরও গভীর হলে
কলমির গায়ের গন্ধ আরও
বেশি করে মাটিতে নেমে এলে
দেখেছি টুকরো অন্ধকারগুলো
মুক্তো হয়ে গেছে...
কবিতা
জিনিয়া চৌধুরী
মানব বাহনে ভাইরাস
ভাইরাসটা যদি কাকের শরীর বেয়ে আসতো,
তবে-সকল শহরের আকাশ করা হতো কাক মুক্ত।
শত-শত কাকের লাশে ভরে উঠতো ভাগাড়গুলো।
প্রাণঘাতী অসুখটা যদি আদরের কুকুর, বিড়াল কিংবা খাঁচায় পোষা পাখিটার গা বয়ে আসতো,
তবে পাখি শূন্য হয়ে যেতো খাঁচা।
বাঁচা নিশ্চিত করতে মানুষেরা কুকুরের পালে দিতো হানা, বেড়ালের দুধের বাটিতে মিশাতো বিষ।
ভাইরাসটা যদি ইঁদুরের গা বয়ে আসতো তবে হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা ডাকা হতো,
ঝাঁকে-ঝাঁকে ইঁদুরেরা আত্মাহুতি দিত অলকানন্দার জলে!!
মহামারীটা এসেছে মানুষের গা বেয়ে!!
মানবিক মানুষেরা তাই মানুষকে বাঁচাতে খোঁজে শ্বাস।
খোঁজে আকুতি, খোঁজে বিশ্বাস, খোঁজে যন্ত্র, খোঁজে মন্ত্র...
আরশোলার মতো গৃহকোণে খোঁজে আশ্রয়, বাঁচার আকুলতায় ঝাপটায় ডানা,
কখনো নিঃশব্দে-কখনো সশব্দের আকুতি।
কাক, কুকুর, বিড়াল, ইঁদুরের মতো তাদের আত্মাহুতি কাম্য নয়,
কারণ প্রতিটি মানুষ মানেই বুঝি এক-একটি জীবন।
এক একটি অনন্য গল্প।
আমরা মানুষকে সংখ্যায় গুনিনা,অথচ আমরা মানুষেরাই সংখ্যায় গুনি
ফাঁদে পড়া ইঁদুর, খাঁচায় পোরা পাখি, রাস্তায় খোলা বেওয়ারিশ কুকুর...!!
কবিতা
কুমকুম বৈদ্য (করিম)
সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার
এরিক্সন ইন্ডিয়া গ্লোবাল সার্ভিসেস প্রাইভেট লিঃ
জীবন যাপন
সব তারা খসা হয়ে গেলে
অমাবস্যার রাতে
বসব দুজনে খোলা আকাশের মুখোমুখি
তোমার খোলা কবিতার খাতা
আমার ভাব সম্প্রসারণ
দেবদারু গাছে ঝুলে থাকা বাদুরের ডানার ঝাপট
উগ্র চাঁপার গন্ধ
বেহিসাবি রাত কাটাবো দুর্ধর্ষ
মেঘ ভেজা আপসের দিন
গরম ভাতে ইলিশের সুবাস
আলস্যের আলতো দুপুর
কার্নিশে কাকভেজা কাক
ডান চোখে বিপ্লবের আশ্বাস
ভ্রমণ
তুমি যদি কোথাও যাও, বেশ একটু দূরে
ফেরার সময় কি আনবে মুঠোয় তোমার ভরে?
নতুন ধানের কুঁড়ো এনো হেমন্ত কাল হলে
বর্ষাকালে বৃষ্টি এনো পদ্মপাতায় মুড়ে
গ্রীষ্মকালে ঘেঁটু এনো,
উষ্ণতা শীতকালে
মনখানি খুব রাঙিয়ে এনো বসন্ত কাল হলে।
চিরকুট:মনে গ্রীষ্ম, বর্ষা, হেমন্ত, শীত, বসন্ত
- এদের যে কোনো পারমুটেসান চলতে পারে।
আর শরতটা পুজোর ছুটিতে পুজো সংখ্যা লিখছে
আর গ্রীষ্মের ঘেঁটু আসলে ঘেঁটু ফল।
স্পর্শ
আমায় স্পর্শ করে সকালের রোদ্দুর
কিম্বা পূর্ণিমার জ্যোৎস্না
অথবা উড়ে আসা ধূলো
নিদেন পক্ষে আমার পায়ের চটিজোড়া
যাদের কারোর প্রতি আমার স্পর্শকাতরতা নেই!
অভ্যাসের ভালোবাসা
শ্রমিকের হেঁটে আসা
নিঃসঙ্গ বন্দি জীবন
এদের প্রতি আমি স্পর্শকাতর নই?
স্পর্শ এখন নিত্য প্রয়োজনীয় নয়
তাই আমার মৃত্যু সংক্রান্ত উইল কাগজের লেখনী নয়..
শ্যাম্পু করা ঝরে যাওয়া এক গোছা চুল-
স্যানেটাইজ করা হাতে কাগজে মুড়ে
২ নম্বর বইয়ের আলমারির ৪ নম্বর তাকে
অপারেটিং সিস্টেম আর ম্যাক্সিম গোর্কির ফাঁকে
যত্ন করে রাখা আছে।
কোনোমতে মরে যদি যাই,
বেওয়ারিশ লাস হতে দিয়ো আমায়।
মৃত্যু সংবাদ দিয়ো না কাউকে
শোক যেন নাগাল না পায়।
কোনোমতে বেঁচে যদি যাই
সমস্তরকম স্পর্শকাতরতা ফিরে পাই
তবু ও থাকবো আমি স্পর্শহীন -
গভীর এক প্রেমের অপেক্ষায়
পালকে শকুন হবার ডাক
সেই যে জন্মে আমরা গাংচিল ছিলাম
মনে আছে আলি আকাশের গায়ে-
আঁশটে গন্ধ পেতাম
আর স্বর্গের সিঁড়িতে দাঁড়াতেন শিব
ডমুরুর তালে তালে উড়ে যেতাম আফ্রিকার নীলে
আর যে জন্মে উটপাখির ঠোঁট
গতিশীল উষ্ণতা
নামবিয়ার সশস্ত্র সংগ্রাম
ডানাতে লেগেছে টান
আর এক জন্মের আহ্বান
পালকে শকুন হবার ডাক
এক আকাশ উঠোনে পড়ে আছে লাশ।
কবিতা
পীযূষ কান্তি দাস
কবিতা
সন্দীপ মিত্র
পল্লীশ্রী, কলকাতা
পরিচিতিঃ জন্ম - অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রাম। ইচ্ছা ছিলো সাহিত্য নিয়ে পড়াশুনা করে শিক্ষকতাকে পেশা হিসাবে নেওয়া। কিন্তু বাস্তবতা আর নিয়তি টেনে নিয়ে গেল অন্যপথে আর পেশা হল স্বাস্থ্যকর্মী। দীর্ঘ চল্লিশ বছর পেশার চাপে সব রকমের সাহিত্য থেকে বহুৎ দূরে। পরে একটু অবসর পেয়ে ভার্চুয়াল বন্ধ।
কলকাতা তুমি
তুমি আজো একই রয়ে গেলে -
আজো রাজপথ জুড়ে চলে
লাল - সবুজ - গেরুয়া - তিরাঙ্গার মিছিল!
আজও ফুটপাতে বালিকা - হয় যে ধর্ষিতা
তুমি চুপচাপ - বিবেকের ঘরে দিয়ে খিল।
চৌত্রিশ বছর ধরে বন্ধ্যা হরতাল
অজস্র ঘটনার ঘনঘটা!
ভেবেছিলো মানুষ - বদলে যাবে প্রেক্ষাপট
সরে যাবে তমসা - ফিরবে সুদিনের ছটা।
দিন যায় -- মাস যায় --
অর্ধযুগ অতিক্রান্ত হয়,
যেই তিমিরে ছিলে তুমি
আজো দেখি সেই তিমিরই রয়।
লোক পাল্টায় --- নীতি পাল্টায়
পাল্টায় না মানুষের কপাল।
"কালো" "কালো" রব ওঠে চারিদিকে
কবে ফিরবে - সাধারণ মানুষের হাল?
আজো মিথ্যে স্বপ্ন দেখায় কতই
প্রতারিত লোক দিকে দিকে,
"অন্ধাগলি"তে হাতড়ে বেড়াই
কি করে রয়েছি আজও টিকে?
আরো কতযুগ - আরো কতকাল
লাগবে ঘোচাতে দৈন্যদশা?
নাকি তুমিও পড়বে ভেঙ্গে
বেকার যুবকের মতো -
গ্রাস করবে তোমারেও - সুতীব্র হতাশা?
বিষাদনগরী
বেচারা শহর
অভাগা শহর
চোখ মেলে আছে
মধ্যরাতেও
আড়মোড়া ভেঙে
রক্তচক্ষু
জমেছে পিচুটি
চির বুভুক্ষু
পদাঘাতে আর
চাকার মিছিলে
রণক্লান্ত
ব্যধিতে জড়াতে
ভীতির কুয়াশা
আপাদমস্তক
ঢেকেছে চাদর
গন-অনাদর
মানুষে মানুষে
দূরত্ববিধির
ঝুলছে ফতোয়া
আনাচে কানাচে
বিষ-বাতাসের
স্বৈরাচারের
হলুদ দূষণ
কল্লোলিনীর
আনন্দস্নানে
সহসা আনত
অ্যাসিড বৃষ্টি
প্রাসাদ নগরী
অশ্রু সিক্ত।
কবিতা
বিপাশা চৌধুরী
মহারণ্যে মহাকাব্য
আকাশের রং কাকের ডিমের চেয়েও কালো।
এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা গ্রাস করে নিল পুরো পৃথিবীটা।
দু এক ফোঁটা মুক্তধারা নেমে এসে মাটির শুষ্কতাটাকে এক্কেবারে শুষে নিয়েছে।
সোঁদা গন্ধ গ্রাস করেছে কামিনীর কাম বাসনাকে।
হাঁটু মুড়ে বসে থাকে বুনো শালিকের দল।
জল গড়ায় পাকপাখালির ডানায়।
চঞ্চুতে জল নিয়ে উরে চলে বাবুই আর ফিঙে।
অদ্ভুত রহস্যময় অভিযাত্রী দলের কালো পতাকা হাতে এগিয়ে যায় কোকিল।
হাড়ির ভিতর টগবগ আওয়াজ...
চালের অভাব ভুলে, একাকী জল ফোঁটার শব্দ।
শেষ ভাত খেয়েছিল কবে, কে জানে ?
অভাব ভুলে স্বভাববশত সেই শব্দেই শান্ত খুৎপিপাসাচ্ছন্ন শিশু।
বুনো ফুলের মতই শান্ত অথচ উগ্র তার সুবাস।
হয়ত কোনো অজানা ঝরে,অন্য এক বীজ উড়ে এসে সুপ্ত হয়েছে গর্ভে।
অন্ধকারের জরায়ু ছিঁড়ে দু এক ফোঁটা রৌদ্র রস মাটিতে ঝরে পড়ে।
চিরহরিৎ এর ঔপনিবেশিকতার কাছে হার মেনে ক্লান্ত সে।
দূর থেকে ভেসে আসে মজা নদীর হুহু ক্রন্দন ধ্বনি।
ডুরে পাড়ের শাড়ি গায়ে, মাছ ধরতে নামে মাছরাঙা।
মাঝে নৈঃশব্দ....আর কয়েকটা বন্য স্বপ্ন তাজা হয়ে থাকে।
লাশ
কাটাছেঁড়া আমি
লাশকাটা ঘরে, একা পরে আছি..
হিম ঘরের গুমোট মেজাজ..
আর ঠান্ডা হাওয়ার গন্ধ!
ধারালো ছুরির চকচকে মসৃণতা,
গলার কণ্ঠী থেকে তলপেট বরাবর ফাঁক করে দিয়ে গেছে!
এই গলার সুরও কবে-কাকে জেনো পাগল করে গিয়েছিল।
দেহের ভিতর প্রতি মুহূর্তে খেলে যাচ্ছে শিহরণের ঝিলিক!
বন্ধ হয়ে যাওয়া হৃৎপিণ্ড ঘিরে রহস্যের মাতামাতি।
তরলতা ভুলে ধীরে ধীরে জমাট বাঁধতে শুরু করেছে রক্ত।
লাশকাটা ঘরে কাটাছেঁড়া আমি, আর কয়েকটা মুহূর্ত!
এ জেনো নৈশব্দ দিয়ে মোড়া এক রত্ন পেটিকা।
ধমনীর নীল রঙে, মেদ এর ছিটে জেনো মুক্তোর ঝিলিমিলি।
এ জেনো সহস্র পোখরাজ, চুনি পান্নার সমাহার।
ছুরির মসৃণ আঘাতে একের পর এক উদঘাটিত রহস্য..
রহস্য নয়, সমাধান!
করাতের দাঁত একবারের চেষ্টায় আলগা করে ফেলেছে নিশ্চিন্ত খুলিটাকে।
খোলসের ভিতরে দিব্য চিরঘুমে সুসজ্জিত ঘিলু।
শুধু একটাই চাওয়া বার বার পাক খেয়ে মরছে।
ডাক্তার আমি তো বাঁচতে চেয়েছিলাম..!
কবিতা
সজল খোরশেদ
শব্দাবনি
রঙিন বেসাতি বলয় প্লাবনই হে শব্দগুচ্ছ অবনি
স্বপ্নের বুঝি রঙ খোঁজ তুমি ঐকান্তিক রৈখিক মলয়
উড়ন্ত লাল নীল খয়েরী প্রজাপতির আজন্ম স্নানের জয়
দিন আর রাতের অধরে এ বিচরণ, তরঙ্গ ধ্বনি
ভূযুদ্ধ মাখানো রঙধনুর তবুও আগমনী বারতা
মায়াবিনী পুকুরে অগণিত ফুটন্ত জলপদ্ম
বিমুগ্ধতার শবাসন বেসে এই তো সত্য
প্রেম চাই, তাই ভ্রান্তি বিলাসে তোমার দুরন্ত নগ্ন
অশথ গাছের ছায়ায় বসেছে সহস্র প্রেতাত্মা
ওসবেরা আমার নিউরন তটিনীতে বাঁধে বাসা
হোমস্যাপিয়েন নক্ষত্র আলোয় এ ইজেল চাষা
তোমার ময়ূর পেখম ও নশ্বরীর ভৌগোলিক যাত্রা
কাব্যচিত্র অতঃপর পূর্ণাঙ্গ মানচিত্রের ধমনী প্রভাত
সীতার শরীর গড়ানো জলশব্দ চলছে ধেয়ে স্বপ্ন স্নাত
শুভ্রসিতা
বাসতাম ভালো, এখনো কী আমি ভালোবাসি
ঐ ধোঁয়ার কুণ্ডলীকেরাশ পূর্ণিমা বেঁধেছে বাসাশরীরে তোমারকেলীমগ্না এ ধরিত্রী বুকেকলা কৌশলীর অনুভবযাজকই পবনে মনহরি হেঅনন্তের উঠোনে এই আমৃত্যু খেলা প্রসাদপাত্রের এতোটা প্রেমকোন মন্দিরে ভজিবে তুমিখন্ড খন্ড এ মৃত্যুর জন্যই আমি কতকাল করেছি প্রার্থনা বিগব্যাণ্ডে জন্ম নেওয়া বিস্তর এ পাত্রের চুম্বনে চুম্বনে পরে আছে দেহ
ক্রোমোজোম সাগরে,
শূন্য কফিনের পার্শে বসে তুমি
মেলাচ্ছ ইতিহাস পাতা
পরিচয়ের ‘প্রাথমিক পর্ব‘ অতঃপর নিদিষ্ট হলো
ঐ শূণ্যতা পূরণের সকল গুণে গুণান্বিত আমি
কফিনের পর্দা’র নিচেই শুভ্রসিতা
রাখছি আমার শ্রেষ্ঠ পাণ্ডুলিপি
বঙ্গমাতার কিন্নরী এ তটে জলের মহাসমারোহ
কৃষকের অস্থি মজ্জা তলে গেছে ভবিষ্যৎ
বীজভূক্ষ বিস্তর মাঠ প্রতীক্ষায়
পলিজমা বুকে ঘটবে আবারও সবুজ প্লাবন
গ্লোবালাইজেশন উধ্গিরীত লাভায় ঝংকৃত
এলে ‘উর্ণনাভ’ তুমি
বেকনের ‘মৌমাছি’ রূপেই আমি দেখি কিন্তু
বৈভবী এমন শরীরী সত্ত্বা
নয় সে কখনো ----------
শুভ্রসিতা
প্রকৃতির প্রাণে মুক্ত অশরীরী সত্ত্বায়
রূপ দেখি তার
প্রীতির দৃষ্টি রেখায় ও আমাতে কেলীমগ্না
কী উন্মাদিনী স্পর্শ
পঞ্চ ইন্দ্রিয়ে ধ্বনিত সেই গান
সুর পেতে চলে টেবিলে আমার
প্রবাহমান এখনো মাতোয়াশির জলকান্নার চিহ্ন বিধৃত ইতিহাস পাতায়
অনেক অনেক যু্দ্ধ সভ্যতার কার্নিশে
ঘুমন্ত শিশুর দোলনার পার্শেও
আমরা সবাই পরিবর্তনে বিশ্বাসী
পরিবর্তন মৃত্যু কূপের বিনিময়ে
পরিবর্তন ধ্বংসের বিনিময়েকবির কলম কী নয় শক্তিধর যুদ্ধের চেয়েশিল্পীর তুলির রঙ কী নয় শান্তির মহার্ঘ বাতায়ন
ফিরে আসি ভীষণ যন্ত্রণা- মুক্তির পাথেয় রূপেশুভ্রসিতা তোমার কাছে শুধুছড়িয়ে দাও তোমার পরিহিত ওড়নার অবশিষ্টাংশদৃষ্টির ‘পরে
সভ্যতা পরিবর্তনের ইজারাদার বৃটেন
এ্যালেন্সগিন্সব্যার্ক – ইতিহাস অজ্ঞ
তোমার জন্মভূমি
গিলতে থাকলো আবারও রঙধনুর সাতরং
ছড়িয়েছো এ কোন বিষ হৃদয়ে আমার
বিষাদের জিরাফ গৃহ্বায় অনুভূতির সতেজ তৃণ
বিচূর্ণ দন্তাঘাতে, আধফালি চাঁদ নিয়ে ওপাশে
দাঁড়িয়েছে আকাশ -অথচ
আমি তাকাতেও পারছি না
খাবার টেবিলে বসছিলাম এই
একটু আগে; এরই নাম কী প্রেম
উফ এতোটা কঠিন নয় মৃত্যু যন্ত্রণাও
হুমড়ি দিয়ে ঢুকছে প্রেম, আশ্চর্য এতোটুকু ঘড়ে
ঠিকানা ভুল করেছো বুঝি
কত নাম্বার রোড- বলো বাড়ী নাম্বার কত
কোন গলিপথই অচেনা নয় এ শহরে
দিতে পারি পৌঁছে নিশ্চিত
তোমার আপন ঠিকানায়
সারাতে পারবো না আর অতীতের ভুলগুলোকে
তোমার স্পর্শ অনুভূতিরা এখন হৃদয়ে
রঙধনু আচ্ছাদিত মন্দির
শব্দ ও ছন্দের মহতি মেলায় ক্ষয় হোক
আমার এই একটি জন্ম
সভ্যতার উত্তরের জানালায় এগিয়ে আসছে
গুটি গুটি পায়ে যে শিশু
চুম্বন আঁকানো আদরের এ পাত্র
হাতে দিও তার গাঙে নতুন জোয়ার
কখনো লুম্বিনি গাঁয়ের বাতাসে শুভ্রসিতা
শুকে যায় যদি তোমার এ পারফিউমের ঘ্রাণ
পৃথিবীতে বসন্ত আসার পূর্বলক্ষণ-
প্রজাপতির ডানায় আবারও,
শিল্পীর নতুন তুলি নতুন রঙের ছোঁয়া
গুড় গুড় শব্দে মেঘের কবিতা আবৃতি
আমার পাণ্ডুলিপি তখন ভিজছে বৃষ্টিতে
আর তোমার শুকনো শেমিজ তুলবার তাড়া
কবিতা
জীৎ ভট্টাচার্য্য
পরিযায়ী
কতদিন হলো? এটা কে? কোথায় চললে?
আজ্ঞে বাবু ছেলে আমার, ব্যথা করছে পায়ে তাই কাঁধে
নিয়ে বেড়াই।
খেয়েছ কিছু? খিদে পায়নি তোমার?
খিদে? খিদে কি হয় বাবু? আমি খালি বাড়ি যেতে চাই।
আমি খালি বাড়ি যেতে চাই,
আমার মা বউ অপেক্ষা করছে বাবু,
আজ দশদিন ধরে আমি আর ছেলে
খালি খেয়ে আছি ছাতু।
বাড়ির দাওয়ায় হয়ত মা বসে আছে,
হয়তো বুড়ো বাপটা আরো অন্ধ হয়ে গেছে
জানিনা তারা কিছু খেয়েছে কিনা।
আমি খালি বাড়ি যেতে চাই।
আমি খালি বাড়ি যেতে চাই।
আর একবার বল তো, একটা ছবি তুলব তোমার?
জানাবো মিডিয়াতে, বলবো করে বাহার।
এই নাও পাঁচশো টাকা, নিয়ে যেও বাড়িতে।
খাইয়ে পরিয়ে রেখো তোমার আহ্লাদীকে।
টাকা নিয়ে হাতে তাকালো আকাশপানে,
আজ দিন এলো ভিক্ষা নিতে হচ্ছে পথে,
তবে পেট যে মানে না, সব রোগের বড় রোগ খিদে।
সরকার তার দরকারে করেছে অনেক ব্যবহার,
অনেক প্রতিশ্রুতি, অনেক চকমকি,
কিন্তু তারা এখন কোথায়?
কোথায় আমার ছেলের ভাতের থালা।
বড় শখ করে নিয়ে এসেছিলাম ছেলেকে দেখাবো
নগর,কত আলো, কত রেস্তরাঁ, কত উঁচু উঁচু ফ্ল্যাট
দেখে ছেলে আনন্দে পাগল।
বলেছিল যাবে না আর পোড়া গ্রামে,
এই শহরেই থাকবে, বড় হবে নতুন নামে।
তবে উঠলো যেদিন এই মহামারীর হুঙ্কার,
সেদিন বললাম, বাবা এবার সত্যি বাড়ি যাওয়া দরকার।
খবরে খবরে গর্জে উঠলো আরো মিথ্যে কান্নার রব,
তকমা লাগলো পরিযায়ী বলে, মিথ্যে অস্তিত্ব সব।
মনে পরে, কখনো আমি গড়েছি তোমার আলিশান মহল,
কখনো আমি তুলি দিয়ে এঁকেছি প্রাণের শহর।
কখনো আবার আঁধার রাতে খিদে মিটিয়েছি তোমার,
কখনো বা ড্রেনের ভিতরে নোংরা হাতিয়েছি সবার।
আমি সাধারণ, আমার ক্ষমতা সাধারণ,
আমার উপার্জন সাধারণ
আমার খিদেও সাধারণ।
আমার রোগ হয়না, আমায় মহামারি ছোঁয়ে না,
আমাকে রোদ্দুর ঝলসে দেয় না।
তুমি খুঁজে পাওয়া না আমায় ওই রাজনীতির গদি থেকে,
তুমি দেখতে পাওনা আমায় ওই মন্দির মসজিদের চূড়া থেকে।
আমাদের রক্তে সিচে উঠেছে তোমাদের রাজপথ,
আমরা যে আজীবন গোলাম, এই আমাদের জন্মগত শপথ।
এখন আর চাই না কিছু, এখন খালি হেটে যাই
ও ভাই, আমরা খালি বাড়ি যেতে চাই।
কবিতা
দেবার্ঘ্য চক্রবর্তী
ময়নাতদন্ত
নদীর ওপার জানেনা,
জানতেও চায়না কি আছে;
এদিকের মাটি খুঁড়ে কখনো জানা যায় না
ওদিকের চাপা পরে থাকা সমাধির
বেওয়ারিশ গল্প ...
সাদা কোট আর ছুরি হাতে
দরজার পাল্লা সরালেই দেখতে পাচ্ছি
আগুন জ্বলছে, সাপ লুডো খেলা চিতার শিখায়
উড়ে যাচ্ছে মানুষের শরীর,
ছাই র তলায় রন্ধ্রে রন্ধ্রে চাপা পড়ে যাচ্ছে
থমকে যাওয়া সময়ের শেষ অপেক্ষা .....
বিশ্বাস করতে চাইছি সময় শেষ;
তবু যেন শেষ নেই ....
খালি খুঁড়ে যাচ্ছি তোমার শরীরের একটা একটা অঙ্গ;
ঘাম মাখা হৃদয় আর রক্তমাখা হৃদপিন্ড;
ট্রেন ছেড়ে আজ প্লাটফর্ম ছুটছে, সে আর থামবে না ....
চলে যাবে যতদূর খুশি, যেখানে হারিয়ে যাওয়া দাবি,
ফুরিয়ে যাওয়া প্রশ্ন শুনবে না কেউ,
আর সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি সেই কিছু ক্ষত,
যেই ক্ষত খুঁড়ে হয়তো কখনো কেউ বসবে
আমার ভবিষ্যতের সাথে অতীতকে মেলাতে;
শরীর টুকরো টুকরো করে দেখবে আমার ধর্ম, আমি সামাজিক না কোনো শীতল শোণিত প্রাণী .....কলকাতা মেডিকেল কলেজের একেবারে ওপর তোলার ঘর নোনাপুকুর মর্গ থেকে বেরোলো শরীরটা,
নিভে যাওয়া আলো আর জ্বলে ওঠা স্মৃতির জন্য আজ তাকে নিয়েই হবে
আমার ময়না তদন্ত
অর্ধাঙ্গীনি
ক্লান্ত শহর, চাদর ঘিরে ঘুমের কোলাজ বোনা;
সময় চলে আকাশ পথে, ঘড়ির অবসরে
নষ্ট হওয়া আলোর নীচে রংমিলান্তি বাতিল;
পোস্টবক্সের সব ঠিকানাই শ্রান্ত হয়ে পড়ে।
অন্ধকারের নাগরিকতায় নারাজ প্রজাপতি।
অচেনা পথে দিকভ্রান্তির জমাট ঘন কালো,
জোনাকিরা সেইখানে যায় পথের বাড়ির খোঁজে;
সেই ঠিকানায় ওদের ছোঁয়ায় জ্বলবে শীতল আলো।
মেঘবালিকা, নীরা সবার ঘুমপাড়ানির পরে
যে শহরে রাতের বেলা সব যোগাযোগ মৃত-
মিথ্যাচারের রক্তপাতে কলমদানি সাজে
কথপোকথন চলে নেহাত ব্যবহার-জনিত।
শহর খুঁজে তবুও যদি সেই জোনাকি আনি,
জেনো আজও খরস্রোতা, স্রোতের অর্ধাঙ্গিনী।
লকডাউন
শর্মিষ্ঠা গোষ্মামী
মনে রাখবেন......
ঘন ঘন প্রস্রাব
ঘন ঘন দুঃস্বপ্ন
ঘন ঘন লুকিয়ে পড়া
ঘন ঘন বংশ পাল্টানো
ঘন ঘন শুধু নিজেরটা বোঝা
যদি এই উপসর্গগুলিতে ভোগেন
তবে অবিলম্বে যোগাযোগ করুন –
ডাঃ অবিনাশ দত্ত
মনে রাখবেন ডাঃ অবিনাশ দত্ত
যিনি বিনাশ করেন
যিনি প্রদান করেন
সমতলজোড়া সমস্ত জ্যামিতি
এক চুষিকাঠি সব হারানোর ব্যথা
আর সেটা হাতে নিলেই
স্বেচ্ছায় ভুলে যায় মাতৃপরিচয়ের প্রথম পদ
এক লাল-সাদা পোষ মানানো।
ফড়িং মন
কথারা পাথর হয়ে বুকে ঘর করে
পাষাণী, তবু তোর ইচ্ছে মরে না!!!
জল ছুঁয়ে গেলে সবুজ ঢল নামে
নিঃশব্দে ভাঙে পাথুরে কল্পনা।
কল্পনার যদি পাখা গজায় তবে
ভাবনার শেষ নেই, অবশেষ তবু
আছে কি উডিয়ে দেওয়ার, মন কি পোষা পাখি?
জানে তবু রঙের এলোমেলো আঁকিবুঁকি।
এলোমেলো রঙের তুলিতেই গজায় ডানা,
মেলে আকাশ নীলে তবু ঠিকানা অজানা।
ভালোবাসি তাই ফিরে আসা,
ফড়িং-মনা তুই, তোর কিসের বাসা!
শোক পথচলতি
শোক পথচলতি
পায়ে পায়ে পোশাকের রং নীল
মোয়া ভেঙে
ছড়িয়ে খায়
নগণ্য মিডিয়া
শোক পথচলতি
মিডিয়া মরণের পথে
পথে সাদা খই
ট্র্যাফিকের রং বেগুনী।
কবিতা
পার্থ সরকার
কবিতা
জয়তী চৌধুরী
গল্প
আলোর টোপর ঠিকমতো মাথায় গলানোর আগেই ঝিরঝির এ নিম পাতার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিত কচি ফিনফিনে সকালটা। ঘুমে ভারী চোখ দুটো একটু আলগা করে দেখে নিত বাবা কল পাম্প করে জল দিচ্ছে গাছপালায়। কলা দিঘির পাড় থেকে টুকি দেওয়া লাল সূর্যের মতন টুকটুকে পার, ঘিয়ে খোলের পাট এর শাড়ি পড়ে ভিজে খোলা চুলে ফুল তুলছে মা।। বাবার গলায় 'শ্রীরামকৃষ্ণ ভগবান, তব সুপ্রভাত ম'..…......। কোন কোন দিন মায়ের পুজো সারা। সারা বাড়ি ধুপ ধুনো গুগগুল আর ফুলের গন্ধে মম,......। উঠোনময় গুড়ি গুড়ি ব্যাঙের রাত পুইয়ে ঘর ফেরতার ব্যস্ততা। ভোরের হিলহিলে ধান সিজনও বাতাস আদরে ভরিয়ে দিত খিড়কি থেকে সদর। নিমফুল ছড়ানো উঠোনে গোলা দিয়ে লালমাটির টিপ পরিয়ে দিত অঞ্জলি দিদা। তে এঁটে মিশকালো তালগুলো ধুপ ধাপ গা ভেজাতো দিনু কাকার ডোবায়। নীল আকাশ, এলো বাতাস আর দড়ি ছেঁড়া দস্যিপনা, এইতো সেদিন।ইলশে গুড়ি বৃষ্টিতে পায়ের চেটো ভিজিয়ে সই বাড়ির মাটির দাওয়ায়। পয়লা পঞ্চমীর রাতে এক পুকুর ভাব আর এক সমুদ্দুর আড়ি নিয়ে মুড়কি নাড়ু দেয়া নেয়া। সাঁঝ পুজুনি, পুণ্যি পুকুর, মুড়ির নাড়ু ছড়িয়ে ছাতা ঘোরানোর লুটোপুটি শৈশব। খুড়তুতো জেঠতুতো মামাতো পিসতুতো মাসতুতো, একসাথে জাপটাজাপটি, হইহই করা ঝগড়া ভালোবাসার টইটুম্বুর উৎসব। সবুজ ধোয়া ধানের ক্ষেত সোনার রং মাখার আগেই নরুন চোখে পাহারা দেওয়া
কখন ধানের দুধে চাল হবে। তারপর ধান বোঝাই গরুর গাড়িতে ঝুলতে ঝুলতে সুখ খাওয়া। সুখ......সুখ......।
সেই সুখ আজ নাকের ডগায়। হীরে থেকে জিরে, এক নিমিষে পাওয়া। ঝকমকানি আলো, আরো অনেক ভালো চটজলদি পাওয়ার সুখ। নীল আকাশ থেকে একটু একটু করে সরে এসে ড্রয়িং বেডরুম আর ব্যালকনিতে তো করে খুশিগুলো সাজিয়ে রাখার সুখ। স্বপ্নগুলো ফাঁকফোকরে ডানা মেলে, ছাদের মাথায় পায়চারিতে। আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজে, সেটুকু ও আজ 'লক এন্ড কি'..... লকডাউন এ।
বিষণ্ণতা আর মন কেমনের ঝিম-ধরা দুপুরগুলো গুমরে গুমরে কেঁদে বলে আর কেন, আর মান কোর না। তোমার অবলা বাছারা যেমন নানা রঙে খিলখিলিয়ে ফুটে উঠছে তোমার বুকে, নির্ভয় এ তিরবিরিয়ে তোমার কোলে খেলা করে জানান দিচ্ছে তুমি তাদের ও। আমরা ও তো তোমারি, একটু শুধু লোভী। আমরা তোমার কাছ থেকে শুধু তো আঁজলা ভরে নিতেই জানি, আরো পাওয়ার হাতছানিতে ছুটতে জানি। তুমি তো সবই বোঝ!
কোল পাতো মা, দু দণ্ড তোমার কোলে জুড়োই। ঘটিং, খোলাং নুড়ি পাতা ধুলো পথে পা ফেলে, একটু একটু করে বেরিয়ে এসো তোমার বিরূপতা থেকে। কনে দেখা আলোয় বিছিয়ে দাও তোমার আদর মাখা আঁচল..........
একদা
রবীন্দ্রনাথ
অদিতি সুর
গল্প
আজ খুব তাড়াতাড়ি স্কুলে পৌঁছাতে হবে তৃণার, অনেক দায়িত্ব আজ ওর। স্কুলে আজ রবীন্দ্র জয়ন্তী পালন করা হবে। পুরো স্টেজ ডেকোরেশন এর কাজ ওর ওপর। কাল একটু দেরি করে ফিরেছে স্কুল থেকে। ছুটির পর ও শর্মিলা, অর্পিতা, মৃত্তিকা, বিদিশা এই কজন।ওরা সাজানো গোছানোর ভার নিয়েছে।
এই মার্চ মাসেই ও ক্লাস নাইন এ উঠেছে। ক্লাস নাইন মনেই বেশ একটা বড়োসড় হাবভাব।ক্লাস টেন তো মাধ্যমিক দেবে তাই পড়াশুনা নিয়েই ব্যস্ত থাকবে, আর ক্লাস নাইন স্কুলের যাবতীয় অনুষ্ঠানের ভার নেবে। এটাই অনেকদিন থেকে হয়ে আসছে। এ বছরও তার ব্যাতিক্রম নয়।
আঁকাঝোকাতে বরাবরই সে বেশ ভালো। দারুন একটা রবীন্দ্র নাথের অয়েল পেইন্টিং করে স্কুলে বড়দিকে দেখিয়েছিল সেদিন, উনি সেটা ওর থেকে নিয়ে বাঁধিয়েছেন। আজ ওটা হলঘরে স্টেজ এর সামনে রাখা হবে। তাতে বড়দি মালা দেবেন।
কাল হলঘরটা রাংতা কাগজের ফুল দিয়ে ওরা সাজিয়েছিল। দারোয়ান অজয়কাকু সকালে গাঁদা ফুলের মালা আর বেল জুঁই ফুলের মালা বাজার থেকে নিয়ে আসবে। গাঁদা ফুলের মালা বাইরে মেইন গেটে আর জানলাতে লাগানো হবে। একটা বড়ো ফুলদানিতে রজনীগন্ধা রাখা হবে প্রবেশপথের সামনে। নাচের আর নাটকের মেয়েদের জন্য জুঁই আর বেল এর মালা রাখা থাকবে। গিয়ে আলপনাটা তাড়াতাড়ি এঁকে ফেলবে ও। বিদিশা আর পল্লবী ওকে সাহায্য করবে। টিফিনের পর শুরু হবে রবীন্দ্র জয়ন্তীর অনুষ্ঠান।
"মা জলদি খেতে দাও, রিকশা কাকু এসে যাবে। তুমি ব্যাগ এ টিফিনটা ঢুকিয়ে দিয়েছ?"
"হ্যা রে মাম। তুই এখন খেতে বোস তো।"
গরম ভাত ঘি আর আলু সেদ্ধ দিয়ে মেখে তাড়াতাড়ি খেতে থাকে তৃণা। গরমের চোটে ঠোঁটের ওপর বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে থাকে।
"তুই কিছু নাচগান করবি না রে?" মা জিজ্ঞেস করেন।
"আমি কি ওসব পারি নাকি? প্রিয়াঙ্কা করবে, কি সুন্দর গান গায় ও।"
বাইরে রিকশা কাকুর প্যাক প্যাক করে রিকশাতে বেল দেওয়ার আওয়াজ শোনা যায়।
"দেখলে তো মা তুমি কথা বলে দেরি করে দিলে! কাকু এসে গেছে, আমি আর খাবো না"
"আরে খেতে খেতে না শেষ করে উঠতে নেই, দেরি আছে তো এখনও।"
"না আমি আসছি, বাকিটা তুমি খেয়ে নিও।"
মাকে প্রণাম করে ব্যাগ নিয়ে রিকশাতে ওঠে তৃণা। "আসছি মা" বলে হাত নেড়ে মাকে বাই করে। রিকশা কাকু রিকশা চালাতে শুরু করে।
"কাকু আজ একটু প্লিজ জলদি চলো স্কুলে। পোগ্রাম আছে। দশটার মধ্যে পৌঁছাতে হবে যে করেই হোক।"
রিকশা কাকু হেসে বলে" ঠিক আছে মামুনি। পৌঁছে দেব তাড়াতাড়ি। আজ তো রবি ঠাকুরের জম্মদিন, সবাই সেজেগুজে ইস্কুল যাচ্ছে, তুমি সাজলে না?"
"না কাকু আমি গান, নাচ পারিনা, তাই স্কুল সাজাবো।" তৃণা কথাটা বলে হাতের ঘড়ি দেখে পৌনে নটা। আধঘন্টাতে আরামসে পৌঁছে যাবে সে।
রিক্সাটা গলির মোড়ে আসতেই জ্যাম এ আটকে যায়, একটা পেল্লাই লরি রাস্তা আটকে স্টোন চিপ ফেলছে রাস্তাতে, তার সামনে একটা বড়ো জিপ এসে দাঁড়িয়ে আটকে গেছে।তারপর রিকশা, ভ্যান, সাইকেল, অটো সব এক এক করে আটকে পড়েছে। বিশাল বিশৃঙ্খলা সকাল সকাল। লরিটা কারুর কথা শুনছে না, কাজ না শেষ করে সে এক চুল ও নড়বে না। "এই জ্যাম ছাড়বে কখন?" কাকুকে উদ্বিগ্ন মুখে প্রশ্ন করে তৃণা।
কিন্তু একি রাস্তা শেষ কেন হচ্ছেনা? সে ঠিক পথেই তো এসেছে রাস্তা চিনে। আর কতক্ষণ লাগবে। প্রোগ্রাম শুরু হয়ে যাবে তো! তৃণা এবার একপ্রকার দৌড়াতে শুরু করে। গরমে
ভালোই কষ্ট হতে থাকে, স্কুল ড্রেস ঘামে ভিজে জব জবে হয়ে ওঠে। চুলগুলো সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে হাঁটার গতিতে। সেদিকে ওর ভ্রুক্ষেপ নেই। স্কার্ট এর পকেট থেকে রুমাল বার করে ঘাম মুছবে সে ফুরসৎ নেই। চেনা রাস্তা ধরে ঝড়ের গতিতে এগিয়ে চলে তৃণা।
দশটা বেজে গেলো, হাত ঘড়ির দিকে তাকায় সে! সবাই এসে তার জন্য অপেক্ষা করবে তো। কি মনে করবে তারা! ওর কোন একটা দায়িত্ব নেওয়ার ক্ষমতা নেই! এখনো আলপনা দেওয়া বাকি। কাল দেরি হয়ে যাওয়ার জন্য ওরা আলপনা দিতে পারেনি। শেষে কি আলপনা ছাড়া রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে! খুঁত থেকে যাবে তার কাজ এ। বন্ধুরা কি ভাববে! আর বড়দি?! তিনি তো জানেন তৃণা খুব ভালো করে কাজ করবে, শেষে ওনার আশাতে জল ঢালবে নাকি ও!
এ কথা ভেবে মনের দুঃখে একটা চায়ের দোকানের সামনের রাস্তাতে বসে কাঁদতে থাকে সে! চায়ের দোকানের লোকটা অবাক হয় ওকে দেখে, জিজ্ঞেস করে "কি হলো দিদি কাঁদছো কেন?" তৃণা চোখ মুছে বলে ওর আজ স্কুলে তাড়াতাড়ি পৌঁছানোর কথা কিন্তু জ্যামের জন্য দেরি হয়ে গেল। লোকটা হেসে বলে" দিদি আমি তোমাকে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি দাড়াও।" লোকটা একটা রিকশার ব্যাবস্থা করে তাকে স্কুলে পৌঁছে দেয়।তৃণা স্কুলে পৌঁছে দৌড়ে গেট দিয়ে স্কুলে ঢোকে। গিয়ে দেখে বন্ধুরা সবাই আলপনা দিতে বসেছে। শর্মিলা ওকে দেখে বলে "তোর কোন একটা কান্ডজ্ঞান নেই। অদ্ভুত! এত দেরি করে এলি?" তৃণা দুঃখ পায় ওর কথা শুনে। চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে অপমানে। সে আল্পনার সরঞ্জাম নিয়ে চায়, ওরা সেটা ওকে নিতে দেয় না। ও ওদেরকে ওকে সাথে নেওয়ার জন্য ওদের অনুরোধ করে আর বলে দেরির কারণ। কেউ ওর কথা শুনতে চায় না। ও বাধ্য হয় ধস্তাধস্তি করতে। এমন সময় ইতিহাসের সুতপা ম্যাম ওখানে আসেন। উনি ওদের ঐভাবে দেখে জিজ্ঞেস করেন যে কেন ওরা অমন করছে?
তৃণা কিছু উত্তর দিতে যাবে এমন সময় মনে হয় তাকে ধরে কেউ জোড়ে ঝাঁকাচ্ছে।
"কি গো কি হলো? কাঁদছ কেন?এই ওঠো!"
ধরমড়িয়ে উঠে পড়ে তৃণা। আরে সে তহ স্বপ্ন দেখছিল তার মানে। চোখের কোণে আঙ্গুল দিয়ে দেখে জল। যাহ বাবা! আবার চোখের কোণে জল। সে কাঁদছিল নাকি! পাশে বসা ওর স্বামী তথাগত তখন ক্যাবলার মত ওর মুখের দিকে তাকিয়ে।
"কি হলো? বাজে স্বপ্ন দেখেছো নাকি?"
তথাগত জিজ্ঞেস করলে তৃণা পুরো স্বপ্নটা বলে তাকে। দুজনে মিলে খুব হাসে সেটা নিয়ে।
একধাক্কাতে যেন সে ছোটোবেলাতে পৌঁছে গিয়েছিল। মোবাইলের ঘড়িতে ছটার অ্যালার্ম বেজে ওঠে। অ্যালার্মটাকে অফ করে চা বানাতে ওঠে সে, তথাগত মোবাইলের রেডিও অন করে ।
"আয় তবে সহচরী হাতে হাত ধরি ধরি,
নাচি বো ঘিরি ঘিরি গাহিবো গান"
রবীন্দ্রনাথের গান ভেসে আসে শোয়ার ঘর এ তথাগতর মোবাইল থেকে। ওঃ আজ তো রবীন্দ্র জয়ন্তী! ভুলেই গেছিল সে নানা কাজের মধ্যে। মনটা ভরে গেছে আজ স্বপ্নের মাধ্যমে এক টুকরো ছোটবেলা ফিরে পেয়ে।
সে শুনেছিল ভোরের স্বপ্ন নাকি সত্যি হয়। কথাটা কতটা ঠিক জানা নেই। কিন্তু এটা সত্যি হলে মন্দ হয় না। আবার ছোটবেলাতে স্কুলের দিনগুলোতে ফিরে যাওয়া যাবে। ইশ যদি সত্যি এমনটা হতো। মুচকি হাসি ওর মুখে ফুটে ওঠে।
কবিগুরু কে প্রণাম করে চায়ের জল বসায়ে সে। আর মনে মনে গুন গুনিয়ে ওঠে
"ঘরেতে ভ্রমর এলো গুন গুণিয়ে........"
গল্প
নিষ্পত্তি
স্বরূপ মণ্ডল
বাগডাঙ্গা, কান্দি, মুর্শিদাবাদ
ওই সাইকেলটা নিয়েই বিজয়বাবুর যত ঝঞ্ঝাট! না পারেন বিক্রি করতে, না পান চালাতে। চাকরিসূত্রে বাইরে থাকতে হয়। মাঝে-মধ্যে যখন বাড়ি আসেন তখন দু-চারদিন যা চালানো হয়। তারপর ভাল করে পুঁছে, তেল, মোবিল, হাওয়া যা দরকার দিয়ে আবার চলে যান। বাবার সাইকেল। বয়সটাও কম হলো না। প্রায় পঞ্চাশ তো হবেই। আজ-কাল ওই রকম মজবুত সাইকেল মেলা ভার! তাছাড়া বাবার স্মৃতিও জড়িয়ে রয়েছে। বাড়িতে বৃদ্ধা মা তাঁর স্বামীর স্মৃতি আঁকড়ে পড়ে রয়েছেন। তাঁকে নড়ানোর জোটি নেই। কাজেই সপরিবারে চাকুরী স্থলে বাস করার বাসনা ত্যাগ দিয়েছেন বিজয়বাবু। এতে টানাপড়েন বেশি হয় ঠিকই কিন্তু সব দিক বজায় থাকে। এমনটা অবশ্য বিজয়বাবুই ভাবেন। প্রথম প্রথম অশান্তি করে দেখেছে আহুতি। কোন লাভ হয় নি। পরে এভাবেই মানিয়ে নিয়েছে সে।
আহুতি অনেকবার বলেছে, সাইকেলটা চাকরির জায়গায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। বাড়িতে পড়ে থেকে থেকে অচল হতে বসেছে। তাছাড়া যেখানে ঘর-ভাড়া নিয়েছেন সেখান থেকে স্কুলটা প্রায় দু কি.মি. তো হবেই। একটা সেকেন্ড-হ্যান্ড সাইকেলের খোঁজ করে দেখেছেন। দেড়-দু হাজারের কমে নয়। সাইকেলটা আনাই যায়। কিন্তু আনবেন কি উপায়ে? বাস জার্নির কথা ভাবলেই গা গুলিয়ে ওঠে। আবার ‘সাইকেল পার্সেল’ ব্যাপারটা কতকটা সম্মান হানিকরও বটে। অনেক ভেবে একটা উপায় বাতলেছে আহুতি। ঘণ্টা নয়েকের জার্নি, জেনেরাল কামড়ার জানলায় চেন দিয়ে কোনোরকমে বেঁধে দিতে পারলেই কেল্লা ফতে! আহুতির বুদ্ধি আছে বটে। অবশ্য সাংসারিক বিষয়ে মেয়েদের বুদ্ধি একটু বেশিই হয়। সে কথা মানেন বিজয়বাবু। যেমনি ভাবনা তেমনি কাজ।
জঙ্গীপুর স্টেশন। বাড়ি থেকে আধ ঘণ্টার রাস্তা। সাইকেল চালিয়ে স্টেশনে গেলেন বিজয়বাবু। সন্ধ্যে সাড়ে সাতটায় তিস্তা-তোর্সা। একটা চালু টিকিট কেটে প্লাটফর্মের শেষ প্রান্তের দিকে এগিয়ে গেলেন। এর আগে বেশ কয়েকবার জেনেরাল কম্পার্টমেন্টে যাতায়াত করেছেন। জায়গা মতো সাইকেলটা নিয়ে দাঁড়ালেন। ট্রেন আসার খবর হয়ে গেছে।
মিনিট দু’য়েকের মধ্যে ট্রেন ঢুকলো। তড়িঘড়ি করে ব্যাগ থেকে চেনটা বের করে সাইকেলটা জানলার সঙ্গে বাঁধতে লাগলেন। জানলার পাশেই একজন মাঝবয়সী ভদ্রলোক বসেছিলেন। চেঁচিয়ে উঠলেন, “করছেন কি?” “দেখতেই তো পাচ্ছেন,” বিজয়বাবুর ডাঁটের সঙ্গে বললেন। ভদ্রলোক ভাবলেন, লোকাল প্যাসেঞ্জার, পরের স্টেশনেই হয়ত নেমে যাবেন, তাই চুপ করে গেলেন। বাঁধা-ছাঁদা করে বিজয়বাবু কামড়ায় উঠলেন। ফেব্রুয়ারীর মাঝামাঝি। এ সময় ভিড় একটু কমই থাকে। জিজ্ঞাসাবাদ করে একটা বসার জায়গার ব্যবস্থা করে ফেললেন। ব্যাগ থেকে একটা তুঁষের চাদর বের করে গায়ে জড়িয়ে আরাম করে বসতেই আহুতির ফোন। “কি গো, ট্রেনে উঠেছ? আর সাইকেলটার ব্যবস্থা হয়েছে? বসার জায়গা পেয়েছ?” আহুতি এরকমই। জিজ্ঞাসা করতে শুরু করলে একসঙ্গে একাধিক প্রশ্ন করে ফেলে, উত্তরের অপেক্ষা করে না। যেন জিজ্ঞাসার জন্যই জিজ্ঞাসা করা। বিজয়বাবু একে একে তার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে আশ্বস্ত করলেন যে সবকিছু ঠিকঠাকই আছে। ফোন রেখে ঝোলা ব্যাগ থেকে একটা বাসি ম্যাগাজিন বের করে স্বভাবসিদ্ধ ভাবেই পড়তে শুরু করলেন। পড়তে পড়তে আপনা আপনিই চোখ চলে যাচ্ছে জানলার