top of page
dhaak.jpg

শারদীয় মাধুকরী ১৪২৭

পর্ব - ১

Durga-Trina-Dutta.jpg

শিল্পী - তৃণা দত্ত (ডালাস, টেক্সাস)

সূচীপত্র

কবিতা

Watercolor Butterfly 6

গল্প 

d2dd669cd332f54bf7950a1155f0b079.jpg

কবিতা সমগ্র

himadri2.jpg

কৃতজ্ঞতা স্বীকার

প্রচ্ছদ শিল্পী - মেঘমল্লার (ডালাস, টেক্সাস)

লেখক ও লেখিকাবৃন্দ ​

গল্প

সমীরণের পুজো

সমীরণের 

পুজো

কস্তুরী সিনহা

কলকাতা

oldman2.jpg

ষ্টমীর পুজোর খিচুড়ি লাবড়া পায়েস ভোগ খেয়ে সমীরণবাবু বিকট এক ঢেঁকুর তুলে গিয়ে বসলেন পুজো মণ্ডপের সামনে। পাশেই বসে আছেন ঘোষাল, পরিতোষ ঘোষাল।
- বুঝলেন ঘোষাল বাবু এই সব ছিঁচকে ক্যাটারিং এর ছেলে দিয়ে মায়ের ভোগ রান্না হয় না।
- কি বলছেন সমীরণবাবু, ছিঁচকে ক্যাটারিং কোথায়? মিহিদানা তো এলাকার বেশ নাম করা ক্যাটারিং। ওরা তো এই সব পুজো আচ্চার ছোট কাজ বিশেষ করে না, তবে শুভেন্দুর সাথে চেনা পরিচয় থাকায় রাজি হয়েছে।
- ও আচ্ছা, না মানে শুধু ক্যাটারিঙে কি হয়? মায়ের ভোগের জন্য দরকার সেই ভক্তি, সেই দরদ আর সেই কোয়ালিটির চাল।
- তাই নাকি? সে কি রকম?
- তবেই শুনুন, ভোগ হয় আমার বর্ধমানের মামদাদুর বাড়ির পুজোতে। আসল বাদশা ভোগ চালের খিচুড়ি, বিশুদ্ধ কামিনী ভোগ চালের পায়েস, উফফ কি তার স্বাদ, আর গন্ধ! আশেপাশের দশটা গ্রাম থেকে পাওয়া যেত সেই রান্নার গন্ধ।
- ও বাবা, তা সে সব জিনিস আগে পাওয়া যেত, এখন আর সেই সব বিশুদ্ধ জিনিস কোথায়?
- আরে না রে বাবা, এই তো গেল পূর্ণিমায় আমার মিসেস করলো রান্না গোপালের ভোগ দিতে। আগের বারে মামাতো ভাই বিপিন এসে দিয়ে গেছিলো দাদা-বৌদি ভালোবাসে বলে।
পাশের ১ নম্বর ব্লকের চ্যাংড়া ছেলে পীযুষ অনেকক্ষণ পাশে বসে শুনছিলো। ফুট কেটে বসলো-
- কই সেদিন তো কোনো গন্ধ পেলাম না আমরা। হিসাব অনুযায়ী তো ওপাশে বারুইপুর অব্দি গন্ধ যাওয়ার কথা। আর আমি থাকি আপনার পাশের ব্লকে। 
সমীরণবাবুর মুখখানা শুকিয়ে আমশি হয়ে গেলেও জোর করে হাসি টেনে বললেন, তোমার আর গন্ধ পাওয়ার সময় কোথায় বলো? সারাদিন তো কেমিস্ট্রি ল্যাব আর গাদা কাগজের মধ্যে নাক ডুবিয়ে বসে আছো।
- "সে যাকগে সমীরণবাবু, শুনলাম আপনার নাকি দুশো টাকা চাঁদা বাকি আছে" জিজ্ঞেস করলো চ্যাংড়া পীযুষ।
- ওটা আমি ইচ্ছে করেই বাকি রেখেছি, তারপরে গলাটা একটু নামিয়ে বললেন- "শালারা সব সময়ই টাকা মারে পুজোর বাজেট থেকে, তাই যতটা পারি হাত টেনে নিই। আর এই যে কুপন কেটে খাওয়া - (এএএএইউউউ! বলতে বলতেই আবার এক পেল্লায় ঢেঁ কুর) এতেও তো আমার খরচ হচ্ছে নাকি, সেটাও তো চাঁদারই অংশ, তো দেখতে গেলে (হিচিক কিচিক ইয়াঙ্ক) এডজাস্ট হয়ে গেলো না?"
গরদের কাজ করা পাঞ্জাবি আর গিলে করা ধুতি ততক্ষণে ঘামে ভিজে চুপসে সমীরণবাবুর চর্বিবহুল দেহাংশের সাথে চিপকে গিয়েছে।
"যাই বুঝলে, আবার সন্ধ্যে বেলা দেখা হবে।"
- আচ্ছা আচ্ছা, সন্ধ্যে বেলা পারলে একটু তাড়াতাড়ি আসবেন। সেলিব্রিটি গেস্ট আসবে, একটু দেখাশোনা---
সন্ধ্যে বেলা আটটা নাগাদ গেস্টরা পৌঁছলে সমীরণবাবুকে দেখা গেলো, আরেক রাউন্ড সিল্কের পাঞ্জাবি ধুতি পরে। হাসি মুখে করমর্দন করে গেস্টদের গাড়ি থেকে নামাচ্ছেন। চারপাশে ক্যামেরার ফ্ল্যাশ 'দেখি দেখি এই দিকে একটু তাকাবেন সকলে' বাহ্ এই তো। সবার সব ছবিতেই সেলেব্রিটিদের সাথে সমীরণবাবুকে পাওয়া গেলো। নিজে তৎপর হয়ে গেস্টদের বসানো, খাওয়ানো, পুজোর থিম বোঝানো সবেতেই যথেষ্ট active participation দেখা গেলো সমীরণবাবুর। খালি পুজোর থিম বোঝাতে গিয়ে বললেন "পুরাণেও যেমন দ্রৌপদী সীতা এরা প্রাধান্য পেয়েছে, ইম্পরট্যান্ট রোল প্লে করেছে, আমাদের আবাসনেও আমরা মেয়েদের সেই সুযোগ করে দিয়েছি, খালি আইডিয়াটা আমার।"
চ্যাংড়া পীযুষ, ফচকে সিদ্ধার্থরা সব পেছনেই দাঁড়িয়ে ছিল, তারা শুধু একে অন্যের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো আর কয়েকজন মহিলাকে পেছনে খালি দাঁত কিড়মিড় করতে দেখা গেলো। খাওয়ার জায়গাতেও উনি গেস্টদের সাথে সাথেই ছিলেন, আর কোন দীঘির মাছ, কোন বাগানের কাঁঠালপাতা খেয়ে বড় হওয়া খাসি, কোন চাক্কির আটার লুচি দিয়ে খাওয়া বেস্ট হয় গেস্টদের বোঝাচ্ছিলেন। অবস্থা বেগতিক এবং পুরস্কার হাতছাড়া হওয়ার প্রভূত সম্ভাবনা দেখে ছ্যাঁচড়া শুভাশিস সমীরণবাবুকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বললেন "ইয়ে মানে সমীরণবাবু, রান্নার তেল কিছু কম পরে গেছে। আপনার তো গাড়ি আছে মৃদুলকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে যদি দয়া করে তেলটা একটু এনে দেন।"
- তাই নাকি, নিশ্চয় নিশ্চয়, আচ্ছা আমি আসছি তাহলে বাড়ি থেকে গাড়ির চাবি নিয়ে।

যাক নিশ্চিন্ত হওয়া গেলো। কারণ ছ্যাঁচড়া শুভাশিস জানে কোনোভাবেই গাড়ির চাবি এখন সমীরণবাবু খুঁজে পাবেন না। আর ওনাকে পরদিন সকালের আগে আর দেখাও যাবে না। নবমীর দিন সকালে তেনাকে আবার দেখা গেলো পূজামণ্ডপে ফিনফিনে পাঞ্জাবি আর কড়কড়ে ধুতিতে। আরতি হচ্ছে, হঠাৎ দেখি ঢাক থেমে গেছে, কারণ ঢাকিকে ঢাকের তাল মাহাত্ম্য বোঝাচ্ছেন মাননীয় সমীরণবাবু। এবং সাথে সাথেই নিজে ডেমো দিতে শুরু করলেন। সে যা ডেমো- এক হাত নড়ছে তো আরেক হাত আটকে যাচ্ছে পাঞ্জাবিতে আর ঘড়িতে। ঢাকি বসে বসে ঢুলতে লাগলো। দুপুরে খাবার জায়গাতে গিয়ে তিনি হেসেই বাঁচেন না

- "হাঃহাঃ এগুলো লুচি নাকি? এগুলো তো লুচ্চা হয়েছে, কি হে তোমাদের নামী ঠাকুরটিকে একবার দেখি।" বলে সোজা চলে গেলেন লুচি যেখানে ভাজা হচ্ছে সেখানে।

"এই ভালো করে, হ্যাঁ হ্যাঁ, ওই ফুলো ফুলোগুলো আমার দিকে দেখি, নানা ঐপাশ চ্যাপ্টানো পাঁপড়ের মতো লুচি আমায় দেবে না।" পাশ থেকে ঘোষালের ছেলে ফুট কেটে চলে গেলো, "দাদু আপনার মালদার ময়দা নিয়ে আসুন, আর পুব দিক থেকে হাওয়া দিন, তবেই যদি লুচি হয়।" এরপরে তেনাকে দেখা গেলো চার পিস্ পাতুরি, আর খাসির থালাতে নিমগ্ন অবস্থায়। ঘন্টাখানেক সেখানে কাটিয়ে আবার একটা পেল্লায় ঢেঁকুর তুলে কিপটে শুভেন্দুকে ডেকে বললো- "আজ বিকেলে কেউ গেস্ট আসছে নাকি? আমাকে কিন্তু অবশ্যই ডেকো, আমি সামলে নেবো ওদেরকে। তোমরা এতো এদিকে ওদিকে ব্যস্ত থাকো, আমি ওটা একাই সামলে নেবো।" কিপটে শুভেন্দু জবাব দিলো, 

- "হ্যাঁ আসছে আজ আরো স্পেশাল গেস্ট, আনন্দময়ী অনাথ শ্রমের বাচ্চারা।"

-"ওঁওঁ - তা তারা কি করবে এখানে?"

- "কিছুই না, অনুষ্ঠান দেখবে, খাওয়া দাওয়া করবে, আর তাদের আমরা কিছু জামাকাপড় দেব।"
- "ওঁওঁ তা বেশ বেশ, আমার বাড়িতেও বেশ পুরোনো কিছু জামাকাপড় আছে, আমার ছেলের ছোটবেলার। তা ভালো হবে আমি সেগুলো দিয়ে যাবো তোমাদের।"
- "না সমীরণবাবু, পুরোনো না, আমরা এদের নতুন জামাকাপড় দেব।"
বাংলার পাঁচের মতো মুখ করে সমীরণবাবু জানালেন, চন্দননগর থেকে কোন নাকি তাঁর পিসতুতো ভাই আসছে সন্ধ্যেয়, তিনি আর আসতে পারবেন না মণ্ডপে।
পুজোর বাকি কটা বেলা তেনাকে পুজোর আচার, বিসর্জনের ঢাক, সিঁদুরের কোয়ালিটি, ভাসানের নাচ ইত্যাদি প্রভৃতি বিষয়ে মূল্যবান মতামত বিতরণ করতে দেখা গেলো। পুজো মিটলে চ্যাংড়া-ফচকে-ছ্যাঁচড়া পার্টিরা মিলে ঠিক করলো এইবারে ব্যাটাকে একটু টাইট দেওয়া দরকার। সাথে কিছু টাকার বিনিময়ে দলে নেওয়া হলো তাদের বাড়ির বিশ্বাসী কাজের মাসিকে। মাসির কাজ বিশেষ কিছু না, খালি ফেভিকুইক এর এক টিউব জানলার ছিটকিনিতে ঢেলে দেওয়া। জানলাটা সমীরণবাবুর বেডরুমে রাখা গোদরেজ আলমারিটার ঠিক মুখোমুখি। বিকেলে সিঙ্গারা-চা পার্টিতে সমীরণবাবুকে বিশেষভাবে ডেকে নিয়ে আসা হলো। ডাকতে অবশ্য বিশেষ বেগ পেতে হলো না কাউকেই -
পার্টিতে আলোচনা -
- এই শান্তনু তুই কি যেন বলছিলি ইনকাম ট্যাক্সের কাছে কে নাকি আমাদের সব ইনফরমেশন ফাঁস করছে।
- হ্যাঁ রে, করছে, কিন্তু তোদের চিন্তা কেন? তোদের তো সব প্যান আছে, রেগুলার ট্যাক্স payer তোরা। তোদের সব ইনফরমেশন তো ইনকাম ট্যাক্স দফতরে অলরেডি আছেই। চিন্তা যাদের বাড়িতে বা আলমারিতে টাকা রাখা থাকে।
- তাই নাকি? ও তাহলে তো আমরা সব সেফ। কিন্তু আলমারির খবর সব পাচ্ছে কোথায়?
- কি জানি কি সব বিশেষ ক্যামেরা নাকি লোকের অজান্তেই বসিয়ে দিয়ে যাচ্ছে ঘরে বা জানলার বাইরে। আর সব ওতেই তোলা হয়ে যাচ্ছে। আমি তো কাল ভিডিও ও দেখলাম একজনের গদির নিচে টাকার পুরু লেয়ার। টাকা বের করছে সেখান থেকে, আর ট্যাক্সের লোক এসে হাতেনাতে ধরছে।
হঠাৎ কেন জানি সমীরণবাবুকে খুব ঘামতে দেখা গেলো, উনি বললেন, "তোমরা গল্পগাছা কর বুঝলে, আমার আবার ওদিকে ওষুধ খাবার টাইম হয়ে যাচ্ছে।"
বাড়ি গিয়েই আলমারির লকার খুলতে গেলেন সমীরণবাবু, আর তখন-ই পেছনের জানলায় কেমন একটা ঢং ঢং খস খস যেন আওয়াজ হলো। তাড়াতাড়ি আলমারি বন্ধ করেই ছুটলেন জানলার দিকে দেখতে। নাহ কিছুই তো নেই। ভাবলেন মনের ভুল। আবার খুললেন, আবার সেই এক শব্দ। আবার ছুটলেন। আবার কিছু নেই। বেশ কয়েকবার এই একই ঘটনা বারে বারে ঘটতে থাকলো, আলমারি খুললেই পেছনে মনে হয় কেউ বা কিছু আছে, আর বন্ধ করলেই দেখা যায় কেউ নেই। তিনি ভাবলেন জানলা বন্ধ করে দিলেই তো আর চিন্তার কিছু থাকে না। কিন্তু হবে কি করে, জানলা লাগাতে গিয়েই তো আরেক চিত্তির। ইসঃ ছিটকিনিটার উপরে যে কি একটা লেগে রয়েছে, কিছুতেই জানলা বন্ধ হলো না। জল দিয়ে ধুয়ে, কাপড়ে মুছে কিছু ভাবেই সেই জিনিসটা সরানো গেলো না। এইবারে সমীরণবাবু মারাত্মক ঘামতে শুরু করলেন। রাতের খাবার-ও ঠিকমতো খেলেন না। শুলেন বটে কিন্তু জেগেই রইলেন আলমারির পানে চেয়ে। আলমারি খোলার-ও সাহস আর করে উঠতে পারলেন না। ভোর রাতের দিকে ঠিক করলেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কাল জানালাটার ব্যবস্থা আগে করতে হবে। ভোর হতে না হতেই বিল্ডিঙের কেয়ারটেকারকে খুঁজতে বেরোলেন। কিন্তু এতো সকলে কেউ-ই আসতে রাজি হলো না। খালি দেখা হলো চ্যাংড়া পীযুষের সাথে। চ্যাংড়া পীযুষ জগিং করতে বেরিয়েছিল। এত সকালে সমীরণবাবুকে হন্তদন্ত হয়ে ঘোরাঘুরি করতে দেখে জানতে পারলো, হঠাৎ তেনার জানলায় কিছু গড়বড় হয়েছে, আর তার ফলে এসি চালানো যায়নি, আর তাই রাতে উনি ঘুমোতে পারেননি।
- আচ্ছা চলুন তো দেখি আমি কিছু করতে পারি কিনা।
ঘরে এসে দেখে বেশ খানিক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে চ্যাংড়া পীযুষ বললো -
- আরেঃ এ তো দেখছি Methyl cyanoacrylate। এহহে। ভারী মুশকিল হলো। আচ্ছা বুঝেছি আপনি যে খৈনি খেয়ে খেয়ে জানলা দিয়ে পিক ফেলেন নিচের বাগানে, তার-ই রিএকশনের ফল এইটা।
- সেকি কিছু করা যাবে না এর? জানলা ভাঙতে হবে নাকি?
- আরে না নাঃ কোথায় এখন দশ হাজার টাকা খরচ করবেন আর লোকজন হাঁকডাক করবেন, আমি দেখি কিছু করতে পারি কিনা। তবে হ্যাঁ দশ না হলেও হাজার পাঁচেক খরচ হতে পারে এতে। আমাদের ল্যাবে এক মারাত্মক সল্যুশন আনা হয়, দেখি কোথাও সেটা পাই কিনা। তার দাম মোটামুটি ওই হাজার পাঁচেক।
- আরে টাকা দেখোনা বাবা তুমি, যা লাগবে আমি দেব। আমি এদিকে মরছি আমার জ্বালায়।
- ঠিক আছে, দিন তাহলে টাকাটা এক্ষুনি, আমি ঝট করে দোকান হয়ে আসি।
কড়কড়ে তিনহাজার টাকা নিয়ে বেরিয়ে গেলো চ্যাংড়া পীযুষ। ফিরলো তখন হাতে একটা শিশি লিকুইড (আসলে নেইল পালিশ রিমুভার), দাম ত্রিশ টাকা মতো।
- একটা পরিষ্কার কাপড় দিন তো।
কাপড় নিয়ে ওই শিশির লিকুইড ঢেলে দশ মিনিট চুপচাপ বসে থাকল চেপে।
- এই নিন, ব্যাস হয়ে গেছে।
হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন যেন সমীরণবাবু। অনেক্ষণ ধরে ভালো করে জানলা লাগিয়ে খুলে পরীক্ষা করে নিলেন বেশ করে। চ্যাংড়া পীযুষও হাসি মুখে বেরিয়ে এলো, সিদ্ধার্থ তো অলরেডি পৌঁছে গেছে খাসির দোকানে।

Comments

Top

গল্প

আজি গোধূলিলগনে

আজি

গোধূলিলগনে

অমিতাভ মৈত্র

ম্যানেজিং ডাইরেক্টর 

অরবিট অ্যানিমেট প্রাইঃ লিঃ

সল্টলেক, কলকাতা 

coffeehouse.jpeg

রাসবিহারীর মোড় থেকে বালিগঞ্জ গামী চলন্ত ট্রামটায় লাফ দিয়ে উঠে পড়লাম। ট্রামের ভেতরে গাদাগাদি ভীড় দেখে পাদানিতেই দাঁড়িয়েছিলাম। বড্ড ভ্যাপসানি গরম আজ। সেই মুদিয়ালী থেকে হেঁটেছি। লেক মার্কেটে ট্রামটা একটু ফাঁকা হলো। ভেতরে ঢুকে পড়লাম। মহিলাদের সিটগুলোর কোণে চোখ পড়তেই আমার চোখ আটকে গেল এক মাঝ বয়সী মহিলাকে দেখে। কোলে বাচ্চার স্কুলের ব্যাগ আর পাঁচ-ছ বছরের ছোট্ট ছেলেটি পাশে বসে। খুব চেনা লাগছে মহিলাকে। চিনতে বেশী সময় লাগলো না। মল্লিকাদি, …। সঙ্গে বাচ্চাটি বিলক্ষণ ওরই ছেলে। মল্লিকাদি আমার কাছে শুধু একটা নাম নয়, কয়েক বছরের সময়, সাদা-কালো যুগের মলিন হয়ে আসা এক নাটকীয় চলচ্চিত্র… আমাকে পিছিয়ে নিয়ে যায় সময়ের পথ ধরে অনেকটা পিছনে… মধ্য কলকাতায়… আমার পুরনো পাড়া, কলেজ স্কোয়ার, পুরনো কালের গান… থৈ থৈ শাওন এলো ওই, সন্ধ্যেবেলা ঘরে ঘরে মন খারাপ করা শাঁখের আওয়াজ, কয়লার উনুনের ধোঁয়া, নোনা ধরা ইঁটের দেওয়ালের ফাঁকে, আমার আবিস্কারের অপেক্ষায় বসে থাকা ছোটো ছোট গুঁড়ো সুরকির রহস্যময় স্তূপ… দিদির ডাক, ঘরে এসে পড়তে বসার… প্যারীচরণ সরকারের ফার্স্ট বুক অব রিডিং আর পটুয়াটোলা লেনের মধ্যে দিয়ে দৌড়ে পটলডাঙায় পৌঁছে যাওয়া মল্লিকাদির বাড়ি।
ট্রামে মল্লিকাদির সামনে সিটের আশায় হতাশ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলারা এখন সবাই মল্লিকাদির শরীরী ভাষায় বোঝার চেষ্টা করছেন আগামী এক-দু স্টপের মধ্যে ইনি উঠবেন কিনা। তাহলে অন্ততঃ দুটো সিট পাওয়া সুনিশ্চিত, তাই ডান দিকে বা বাঁদিকে এক চুলও নড়া চড়া নয়। আমার পক্ষে মল্লিকাদির দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করা বৃথা কারণ দাঁড়িয়ে থাকা চার জন মহিলা এক দূর্ভেদ্য প্রাচীর গড়ে তুলেছেন মল্লিকাদির সামনে। ট্রামের দুলুনিতে সেই প্রাচীরে কখন কখন ফাঁক দেখা দিচ্ছে আর মল্লিকাদিকে দেখছি তাকিয়ে আছে জানলার বাইরে। মল্লিকাদির পাশের সিটটা খালি হলো এতক্ষণে …সামনে ট্রায়াঙ্গুলার পার্ক। মল্লিকাদিকে সরাসরি দেখতে পাচ্ছি এবার। ডাকতে একটু অস্বস্তি লাগছে…চিনতে কোন ভুল হচ্ছে না তো! ওকে শেষ দেখেছিলাম বাইশ বছর আগে। ছেলের দিকে মুখ ঘুরিয়েছে এবার। কোন ভুল হয়নি আমার। গালের বাঁদিকের তিলটা দেখতে পাচ্ছি স্পষ্ট। যা থাকে কপালে, নাম ধরে ডাকলাম। চমকে তাকালো আমার দিকে। মুখে গভীর সংশয় নিয়ে সেই পুরনো ডাগর চোখে তাকিয়ে আছে মল্লিকাদি। সময় চলে গেছে অনেকটা আর সেই ফাঁকে মল্লিকাদির ত্বকে আর মাথার চুলে, বয়েস তার নিষ্ঠুর থাবায় আঁচড় দিতে কসুর করেনি একটুও।                                                          

বললাম, “কি, চিনতে পারছো না?”                                                 

সুন্দর কালো দুটি ধনুক বাঁকা ভুরু কুঁচকে গেল, চেনার গভীর আগ্রহে। একটু এগিয়ে গেলাম। মুখের দিকে তাকিয়ে আছে এখন।                               

হঠাৎ বললো, “মনে হচ্ছে চিনতে পেরেছি, কিন্তু ভাল নামটা ভুলে গেছি।”   

বললাম, “ওটা মনে রাখার কথা নয়, কিন্তু খারাপটা মনে আছে কেমন শুনি একবার।” 

“গাবলু না? নাকি ভুল বললাম?”                                                     

বললাম, “যাক নামটা মনে আছে তাহলে।”                                         

গড়িয়াহাট এসে গেল। সিট ছেড়ে মল্লিকাদি এগিয়ে এলো আমার দিকে।     

“এতো বড় দেখাচ্ছে যে তুমি বলবো না তুই বলবো বুঝতে পারছি না।” এবার সেই গালে টোল পড়া হাসি।                                                           

বললাম, “যা বলতে তাই বলবে। ওটা আবার পাল্টায় নাকি।”                     

“কেমন যেন গম্ভীর হয়ে গেছিস।”                                                 

“বয়েস হয়েছে তো।”                                                               

“চিমটি খাওয়াটা মনে আছে তো? ওটা খেলেই দেখবি বয়েস আবার কমে গেছে।”

হুঁ, মনে আছে। সেই সময়টা যদি ফিরে আসতো তাহলে অনেক চিমটি খেতে রাজী আছি। আচ্ছা, বড় হয়েছিস বোঝা যাচ্ছে, মুখে যা খই ফুটছে।             

ট্রামের মহিলাদের মধ্যে একটা নীরব সাড়া জেগেছে। বাঁধ ভাঙা কৌতূহল। এ নিশ্চয়ই ভেঙে যাওয়া এক প্রাচীন প্রেম, সমাপ্তির শেষ রেশটুকু মিলিয়ে গিয়েও মেলায়নি।                      মল্লিকাদি বলল, “আচ্ছা বল তো, তুই কি কাছাকাছি থাকিস?”                   

বললাম,  “কেয়াতলায়।”                                                               

হলে গড়িয়াহাটে নামবি, নারে?                                                      

না আরো একটু যাবো।                                                                  

কোথায় যাবি এখন?                                                                   

ওহো! এতো জেরা কিসের। এখনও তোমার সেই স্বভাবটা যায়নি। রাস্তায় দেখলেই পুলিশের জেরা। তোমার কি মনে হয় আমি এখন সেই রকম আছি?  

“ডাকু এখনো তুই ঐ সব করিস?” ফিসফিস করে কানের কাছে মুখ এগিয়ে নিয়ে বলল।    “কী সব?”                                                                             

“সেই যে রে নকশালবাড়ি।”                                                           

ও সব কথা বাদ দাও। বলও তো তুমি কোথায় থাকো।                             

আমি তো সেই থেকে ভবানী-পুরেই থাকি। সেখানেই আমার ঘর সংসার। দেখ আমি কর্ণ-ফিল্ড রোডের মুখে নামবো। ছেলের স্কুল বালিগঞ্জ প্লেসে। কিছুই তো জানা হলো না তোর কাছে। সবাই কেমন আছে রে? তোর দুই বোনের বিয়ে হয়ে গেছে নাকি? মাসিমা কেমন আছেন?                                   

আমিও ট্রাম থেকে নামতে নামতে প্রশ্নগুলোর যথা সম্ভব নাতিদীর্ঘ উত্তর দিলাম।              বালিগঞ্জ প্লেস পর্যন্ত হাঁটবে নাকি ছেলে কে নিয়ে? জিজ্ঞেস করলাম।         

না না রিক্সা নেবো। অতোদূর ছেলেকে নিয়ে এই গরমে…ক্ষেপেছিস নাকি।     

হঠাৎ কেমন চুপ করে গেল মল্লিকাদি, কি যেন ভাবছে ও। আমি বোধহয় বুঝতে পারছি ওর মনের কথা। হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো, “এই গাবলু এখন গান করিস রে? একদিন আমার বাড়িতে আয় না…বসে বসে তোর অনেক গান শুনবো। সেই যে রে… আজি গোধূলিলগনে এই বাদল গগনে…। মনে আছে তোর? বড্ড শুনতে ইচ্ছে করে তোর গলায়। কি করে এমন গাইতিস তুই বল তো? আমি ওই গানটা সুচিত্রাদির কাছে শিখেছিলাম রবিতীর্থে। কিন্তু তোর গলায় গানটা শোনার পর থেকে শুধু গুনগুন করি, গাই না। গুনগুন করলেই তোর গলাটা কানে ভাসে।”                                                           

একটানা থেমে থেমে বলে গেল মল্লিকাদি। এই গানটা ওকে আজও তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় শুনে কেমন ডুকরে উঠছিল আমার ভেতরটা। পটলডাঙায় ওদের পুরনো বাড়ির দোতলার ঘরে বা ছাতে গানের আসর বসতো। আমি তখন ক্লাস নাইনের ছাত্র।                           

“কি রে, কি এতো ভাবিস বলতো? এখনও তুই একই রকম আছিস…বোকার মতো কি আকাশ পাতাল ভাবিস। কি বললাম এতক্ষণ ধরে কানে কিছু কি গেল? আমার কিন্তু এবার দেরী হয়ে যাচ্ছে।”                                       

আমি শুনেছি তোমার কথা…আর সেই গানটার কথা। কিন্তু আমি তো তোমার বাড়ি চিনি না। “গড়িয়াহাট থেকে বেশী দূরে নয় রে বাবা। কলকাতার কতো জায়গায় হোড্ডি পিটিয়ে ঘুরে বেড়াস আর আমার বাড়ি চিনতে পারবি না?” মল্লিকাদি তার স্বভাব সুন্দর আবেগে বলে গেল…কোন দ্বিধা ছিল না। বাড়ির ঠিকানাটা লিখে দিলো একটা ছোট্ট কাগজে।               

 রিক্সায় উঠতে গিয়ে আবার একটু থামলো। “এই গাবলু, তুই বিয়ে করেছিস?” একটু ফিসফিস করে কাছে এগিয়ে এসে বললো।                                 

বললাম, “দূর! কী যে বলো…বিয়ে করে মরি আরকি।”                           

“কেন অসুবিধেটা কোথায়?”                                                         

“সেসব  অনেক কথা। ছেলেকে স্কুলে পৌঁছতে দেরী হয়ে যাবে কিন্তু।”       

“ও, এর মানে হলো আমাকে চলে যেতে বলছিস।”                             

আবেগের বশে হঠাৎ মল্লিকাদির গায়ে হাত দিয়ে বললাম, “ছি  ছি এমন কথা বলোনা। এখন যদি অনেকক্ষণ তোমার সঙ্গে গল্প করতে পারতাম তাহলে আমার থেকে খুশী তুমিও হতে কিনা সন্দেহ।”                                     

শুনে মুখটা যেন রক্তহীন হয়ে গেল। বলল, তুই এখন সেই রকমই ছেলেমানুষ আছিস। সেইসব কথা মনে রাখিসনি তো?                 

প্রশ্নের কোন উত্তর না দিলেও, মল্লিকাদির উত্তরটা অজানা নয়।                        

চলে গেল মলিদি, রিক্সায় উঠে, হাত নাড়তে থাকলো যতোক্ষণ না হারিয়ে গেল দূরে রাস্তার বাঁকে। কর্ণফিল্ড রোডের মোড়ে সিগারেটের দোকান থেকে একটা সিগারেট ধরিয়ে হাঁটতে থাকলাম লেকের দিকে। মল্লিকাদিকে জিজ্ঞেস করার ছিল অনেক কথা কিন্তু কোথায়, কিছু জানা হলো না তো। মল্লিকাদি কি এখন গান গায়? মল্লিকাদির স্বামী…কেমন মানুষ তিনি! 
মনে পড়ছে মল্লিকাদির পটলডাঙার বাড়ির কথা। তিনতলার ছাতে ঘিঞ্জি শহরের উনুনের ধোঁয়ায় বিষণ্ণ সন্ধ্যে নামতো। ছাতের ঘরে সন্দীপ বাজাতো হারমোনিয়াম আর আমি গাইতাম, “পৃথিবীর গান আকাশ কী মনে রাখে।”  মল্লিকাদির ছোট ভাই সন্দীপ আর আমি এক স্কুলে একই ক্লাসের হলায় গলায় বন্ধু ছিলাম। সন্দীপের বাড়ি ছিল গান-বাজনার বাড়ি। সন্দীপ অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছাত্র ছিল। ওর ওপরে ওর গুরুর প্রভাব এতোটাই বেশী ছিল যে সন্দীপ অশোকতরুকে অন্ধের মতো নকল করার চেষ্টা করতো। ব্যাপারটা কেমন যেন অস্বাভাবিক বা কৃত্রিম লাগতো আমার। কিন্তু অন্যদিকে আমি ছিলাম নিতান্তই স্নানাগার সঙ্গীত শিল্পী। আমার গুরু ছিল তখনকার ভ্যাল্বসেট রেডিওয় শোনা গান আর মিনিটে আটাত্তর পাক খাওয়া কালো চাকতির রেকর্ডে বন্দী হওয়া কলেরগান। চোঙার সামনে অপেক্ষমাণ প্রভুভক্ত কুকুরটির মতোই আমিও কান খাড়া করে শুনতাম দূর থেকে ভেসে আসা, “ও ঝরা পাতা এখনই তুমি যেওনা চলে” কিংবা “বিষ্ণুপ্রিয়া গো আমি চলে যাই…।”  স্কুলের সরস্বতী পুজো, রবীন্দ্রজয়ন্তীকে ঘিরে বছরে দু-তিনবার বেশ জমকালো অনুষ্ঠান হতো। এই অনুষ্ঠানগুলোতে সন্দীপ একজন পাকাপোক্ত রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইয়ে হিসেবে একটা জায়গা করে নিয়েছিল। টিফিনের সময় ক্লাসের টেবিলকে তবলা বানিয়ে আমার সঙ্গে সঙ্গত করতো আমার আর এক বন্ধু তন্ময়। আর খুব স্বাভাবিক ভাবেই আমার গাওয়া বাংলা আধুনিক গানের অনেক শ্রোতার মধ্যে সন্দীপ হয়ে উঠেছিল একজন সত্যিকারের সমঝদার। ক্লাস সেভেনে পড়তে সন্দীপ আমাকে জোর করে নিয়ে গিয়েছিল আমাদের অনুষ্ঠানগুলোর মুল পরিচালক এক শিক্ষকের কাছে। গানের অডিশনে পাশ করে রবীন্দ্রনাথের একখানি গান অনুষ্ঠানে গাইবার সুযোগ পেয়েছিলাম। সরস্বতী পুজোর অনুষ্ঠানে ভাল পরিবেশনার সুবাদে তারপর থেকে আমারও স্কুলের সব ছোট-বড় অনুষ্ঠানে ডাক পড়তো। এইসব অনুষ্ঠানের রিহার্সালের পরেও আমাদের গান-বাজনা চলতো, চলতো সেকালের বাংলা আধুনিক আর বাংলা ছবির গান যা আমাকে আজও বেঁচে থাকার রসদ জোগায়। সন্দীপের হারমোনিয়ামে আঙুল চলতো অনবদ্য আর আমি গাইতাম বাংলা আধুনিক গান, শান্ত নদীটি পটে আঁকা ছবিটি…বসে আছি পথ চেয়ে, ফাগুনের গান গেয়ে…মৌবনে আজ মৌ জমেছে…।  বেশ মনে আছে, সে বছর বাৎসরিক পরীক্ষার পর যখন শীতের লম্বা ছুটি পড়লো তখন বেশ কয়েক মাস, কী কারণে মনে নেই, সন্দীপের বাড়ির ছাতের ঘরে গান-বাজনাটা বন্ধ ছিল। পাড়ায় তখন সকাল থেকে চুটিয়ে চলতো ক্রিকেট খেলা। পড়াশুনো এমনিতেই শিকেয় তোলা থাকতো, শুধু দিদিই একমাত্র আমার ছেলেবেলার যা কিছু গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করে পড়াশুনোর যে শৃঙ্খলে বাঁধতো সেটা তখন মনের ভেতরে দূর্বলের অব্যক্ত বিরক্তি হয়ে বিদ্রোহ করতো। আর আজ আমি সবল, সেই অগণতন্ত্রকে মাথা পেতে নিয়ে, শৃঙ্খলে শৃঙ্খলিত হতে চাই আর একবার, আমার চিরকালের জন্যে হারিয়ে যাওয়া কারাগারে।   

তখন আমার আর একটু উঁচু ক্লাস। কলকাতা থেকে শীত যাবো যাবো করেও তখন চৌবাচ্চার প্রথম ঠান্ডা জল, গায়ে ঢালার আগে, একটু সাহস সঞ্চয়ের সময় নিতে বাধ্য  করছিল। দোলের আগের দিন স্কুলে এসেই সন্দীপ বলল, “শোন কাল দোলের দিন সন্ধ্যেবেলা বাড়িতে একটা ঘরোয়া অনুষ্ঠান আছে। তোকে আসতেই হবে। মা বলছিল অনেকদিন তুই ওইদিকটা মাড়াসনা।” আসবি কিন্তু। আমি অবশ্য কথা দিলাম যাবো।সন্দীপের বাড়ির আড়ম্বরহীন সান্ধ্য অনুষ্ঠানে বসেছিল চাঁদের হাট। ওদের বাড়িতে সবাই গান গায় আর কেউই আমার মতো তালিম না নেওয়া ভুঁইফোড় গায়ক বা গায়িকা ছিলেন না। ওদের বাড়িতে একবারে অপরিচিত মুখ না হলেও সন্দীপ সবারির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে প্রশংসায় পঞ্চমুখ হল আমার গানের গলা নিয়ে। শেষ করে আমার গলায় অরাবীন্দ্রিক সেকালের অনবদ্য সব বাংলা আধুনিক গানের কথা বলে। সন্দীপ আমার রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়া নিয়েও একটু বাড়াবাড়ি রকমের প্রশংসা করতে থাকলো। সন্দীপ প্রথমেই চেপে

ধরলো আমাকে আর আমি গাইলাম, “এই মেঘলা দিনে একলা ঘরে থাকেনা তো মন, কাছে যাবো কবে পাবো ওগো তোমার নিমন্ত্রণ।” সন্দীপের সঙ্গত ছিল লোম খাড়া করে দেবার মতো। আর আমি বোধহয় সেই বাজনায় বিভোর হয়ে গেয়েছিলাম গানটা। ঘর ভরা সমঝদার শ্রোতাদের অকুণ্ঠ তারিফ কুড়িয়ে বুকটা ভরে গিয়েছিল সেদিনের পূর্ণিমার সন্ধ্যায়। এবারে সন্দীপের এক দাদার কাছ থেকে আদেশ এলো রবীন্দ্র সংগীতের: “আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার, পরানসখা বন্ধু হে আমার।” সেদিন অনুভব করেছিলাম সমঝদার শ্রোতা আর অনবদ্য সঙ্গত, গানে এক অন্য মাত্রা যোগ করে। সন্দীপের দিদি, মল্লিকাদি, বসে ছিলেন এক কোণে। গান গাইতে গাইতে তাঁর দিকে বার বার চোখ চলে গিয়েছিল আমার। তাঁর চোখে যেন দেখেছিলাম এক আশ্চর্য আবেগ। সন্দীপ এবারে মল্লিকাদিকে বলল, বড়দি, এবার তোমার পালা। আমার গানের রেশ ধরে রেখে মল্লিকাদি গাইলো: “আজি গোধুলিলগনে এই বাদল গগনে, তার চরণধ্বনি আমি হৃদয়ে গনি…।” মল্লিকাদির গলায় সেই গান আমার বুকে মোচড় দিচ্ছিল। এতো গান নয়…যেন কার হাহাকার। বার বার যেন কেঁদে উঠছিল, “সে আসিবে আমার মন বলে সারাবেলা।” অনুষ্ঠান শেষ হয়েছিল প্রায় রাত দশটায়। আমার মাথার চুলে বিলি কেটে মল্লিকাদি বললো, এই ছেলে, তোকে গাবলু বলে ডাকলে আপত্তি নেই তো? আর আপত্তি করলেই বা কে শুনছে।” বলেই প্রাণখোলা হাসি।  আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম। এবার বললো, “কবে আবার আসবি এখনই বলতে হবে। তোর সঙ্গে আমার একটা বোঝাপড়া আছে। আমি বললাম, “কি বোঝা পড়া?”                তুই আমাকে আমার পছন্দ মতো কিছু আধুনিক গান তুলে দিবি, বল দিবি কিনা।”            আমি বললাম, “তাহলে কথা দাও, আজি গোধূলিলগনে গানটা আমাকে শেখাবে।” বললো, “বাবা, তোর ব্যবসা বুদ্ধিটা ভাল তো। না পেলে বুঝি কিছু ছাড়বি না?” আমি একথার কোন উত্তর খুঁজে পাইনি। এটা পাওনা-গণ্ডার হিসেবের বাইরে ছিল। মল্লিকাদির গলায় শোনা সুর কখন গেঁথে বসে গিয়েছিল আমার কানে আমি টের পাইনি।                                      “আচ্ছা একটা কথা জানাই হলো না, কার কাছে গান শিখিস তুই?” জিজ্ঞেস করেছিল মল্লিকাদি।                                            

বললাম, “আমি কারুর কাছে শিখিনি। রেডিও আর পাশের বাড়ির গ্রামোফোনে গান শুনে তুলে ফেলি।“ 

কি আশ্চর্য, তুই না শিখেই এমন গাইলি কি করে রে গাবলু! বল কবে আসবি আবার।“       এরপরে প্রায়ই যেতাম মল্লিকাদির বাড়িতে। এমন কোনদিন ছিল না যেদিন গান হতো না।   একদিন বললো, “গাবলু এবার তুই মার খাবি আমার কাছে।                     

আমি বললাম তুমি আবার মারতে পারো নাকি কাউকে?                         

ফাজলামি হচ্ছে, কি কথা ছিল? আধুনিক গান শেখানোর কথা বেমালুম ভুলে গেলি নাকি?   বললাম, তাহলে আগে পাওনাটা বুঝে নিই, এই গানটা আগে শোন, আমি গাইছি, ভুলগুলো ঠিক করে দাও। তারপরে তোমাকে, “থৈ থৈ শাওন এলো ওই” গানটা তুলে দেবো।            গান শুরু করলাম। মল্লিকাদি বাজাচ্ছিল হারমোনিয়াম। চোখ বুজে গাইছিলাম। সঞ্চারির কাছে এসে চোখ খুলে দেখলাম হারমোনিয়ামে আঙুল চলছে আর মল্লিকাদির বিভোর দুটি চোখ স্থির হয়ে আছে আমার দিকে। গান শেষ করে তাকিয়ে দেখি আমার দিকে ছলোছলো চোখে চেয়ে আছে। কি যেন একটা অপরাধ আমি আমার অজান্তে করে ফেলেছি। চোখে টল টল করছে জল আর কোড়ে আঙুলটা বার করে আমাকে দেখাচ্ছে। মুখে কোন ভাষা ছিল না।       

আমি বললাম “একি তুমি কাঁদছো!”                                                   

তোর সঙ্গে আড়ি, কথা বলবো না।                                                   

কেন আমি কি অপরাধ করলাম।                                                     

তোকে তো শেখাতে হলো না, শুনেই তুলে ফেললি। আর আমি যা পারিনি সেটাও তোর গলায় কি করে এসে গেল গাবলু। চোখ ফেটে জল আসছে আমার। কেমন করে গাইলি এমন গান “বনে বনে আজি একি কানাকানি, কিসের বারতা ওরা পেয়েছে না জানি।” …বুকটা ফেটে যাচ্ছে আমার।”         

চোখের কোলে এখন টল টল করছে জল, গাল বেয়ে নামলো বলে। মল্লিকাদির চোখ এখন পলকহীন। সিক্ত চোখের জিজ্ঞাসা কী বুঝতে চাইছে জানিনা। মনে হলো গালে হাত দিয়ে জলটা মুছিয়ে দিই। পারলাম না। কীসের বাধা, কীসের সংকোচ জানিনা আমি। হঠাৎ আমার হাতটা ধরে বলল, “এ জন্মে তো আর হলোনা, পরের জন্মে তুই আমার ছেলে হয়ে জন্মাস।” হাসতে হাসতে বললাম, “পরের জন্মে গলায় সুর থাকবে এমন গ্যারান্টি কে দেবে? আর আমি যে সেই বিগত জন্মের গাবলু তুমি আমায় চিনবে কী করে? আমি যেমন গাবলু থাকবো না, তুমিও তো তুমি থাকবে না। পরস্পর পরস্পরকে চিনবো কী করে?”              তুই একটা বোকা আর কাঠ-খোট্টা। তাই বুঝতে পারিস না আমার কথা। আসলে কী জানিস গাবলু, তোর সঙ্গে আমার বয়েসের ফারাক অনেকটা। তা অন্তত দশ বছরের হবে। তুইতো এখনও স্কুলে পড়িস আর আমি পোস্ট গ্র্যাজুয়েট করেছি, তাও আবার কবছর কেটে গেছে।  বললাম, “তাতে কী হলো? তুমি কী বলতে চাও, তোমার অনুভূতিকে আমি অ্যাপ্রেশিয়েট করতে পারছি না? আমি এতোটা শিশু নই।”                       

তুই সবটা কী সত্যিই বুঝতে পারিস?                                                 

মনে হয় পারি। যেমন ধরো, একটু আগে তোমাকে দেখে আমার একটা দুর্বার ইচ্ছেকে দমন করলাম, শুধু সংকোচ বোধ থেকে।                               

আমার কাছে তোর সব সংকোচ কবে কাটবে রে গাবলু? আমি বুঝতে পারি তুই আমাকে ততোটা আপন করে ভাবতে এখন পারিসনি। কী সেই দুর্বার ইচ্ছে হয়েছিল তোর, বলবি না আমাকে?                                                 

সেটা বলার নয়, করার।                                                               

অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে মল্লিকাদি। বেশ কিছুক্ষণ দুজনের মুখে কোন কথা ছিলনা। সন্ধ্যে নামছে ছাতে।                                                           

“কী করার? বুঝতে পারছি না আমি।” একটু অস্থির স্বরে বলল মল্লিকাদি।       

“সেই মুহূর্তে সেটা দুর্বার ছিল, এখন সেটা সুখস্মৃতি, পূরণ না হওয়া একটা মিষ্টি ইচ্ছে মাত্র।” কী এমন ইচ্ছে যা আমাকে মুখ ফুটে বলতে পারলি না?                         

ছাতের ঘরে বেশ খানিকটা দূরত্বে দুজনে বসেছিলাম, মাটিতে পাতা একটা শতরঞ্চির ওপর। মল্লিকাদির সামনে ছিল হারমোনিয়াম। হঠাৎ উঠে আমার কাছে এগিয়ে এলো। আমার দুটো হাত ধরে ইঙ্গিত করলো উঠে দাঁড়াতে। দুজনে দাঁড়িয়েছিলাম মুখোমুখি…বেশ কাছাকাছি।    তোকে বলতেই হবে তোর পূরণ না হওয়া ইচ্ছের কথা।                           

আমি চোখ নামিয়ে নিয়েছিলাম। আমার থুতনি ধরে মুখটা তুলে ফিশফিশিয়ে বলল, “বলবি না? না বললে নিজেই ঠকবি।”                                       

খানিকটা সংকোচে দুহাতে মল্লিকাদির চোখের প্রায় শুকিয়ে যাওয়া,সামান্য ভিজে চোখদুটো মুছে দিলাম। আবেশে চোখ বুজেছিল মল্লিকাদি। বললাম, “এই ছিল আমার দুর্বার ইচ্ছে।”    এরপরে যা ঘটলো তার জন্যে আমি প্রস্তুত ছিলাম না। আমাকে বুকে টেনে নিয়ে জড়িয়ে ধরলো মল্লিকাদি। আমিও জড়িয়ে ধরেছিলাম। আমার গালে আর কপালে মল্লিকাদির ঠোঁট থেকে চুম্বনের বৃষ্টি নেমেছিল। একবার বলল, গাবলু তুই আমার থেকে অনেক ছোট…এ আমি কী করছি? তোর সঙ্গে আমার এ সম্পর্কটা কী? আমি তোর দিদি না অন্য কিছু! তুই কেন আর একটু বড় হলি না গাবলু? আমার গালে গড়িয়ে পড়ছে মল্লিকাদির চোখের জল।  আমি তখনও মল্লিকাদির বুকে বন্দী হয়ে আছি। আমার সংকুচিত শরীর মল্লিকাদির কোমল বুকে বাঁধা পড়ে আছে আষ্টেপিষ্টে।                 

বললাম, আর একটু বড় হলে তোমার কী সুবিধে হতো? এখনই বা কী অসুবিধে হচ্ছে?       হাতের বাঁধন একবার আলগা করে আমার চোখে চোখ রাখলো। চোখের জল মোছাতে গিয়ে কাজল মাখামাখি হয়ে আছে দুটো চোখ। মল্লিকাদি যেন আরো সুন্দরী হয়ে উঠেছে। আমার ঠোঁটে একটা দীর্ঘ চুম্বন দিয়ে বলল, তুই বোকাটা জানিস না সবকিছু, তাই বড় হওটা দরকার। কিন্তু এটা আমি কী করছি! এ কোন সম্পর্কে জড়িয়ে গেলাম আমি তোর সঙ্গে? তোর গান শুনলে আমি নিজেকে স্থির রাখতে পারিনা। আমি স্বার্থপর হয়ে উঠছি, তোর কথা ভাবছি না। তোর বয়েস কম, তোর জীবনে অন্য কোন উপযুক্ত মেয়ে আসবে। আজকে যা ঘটলো সব ভুলে যা গাবলু। কথা দে আমাকে, কিছু মনে রাখবিনা।         

মনটা কী ছেলেবেলার স্লেট আর খড়ি নাকি, যা খুশী তাই আঁকিবুঁকি কাটলাম। তারপর যখন ইচ্ছে হলো মুছে দিলাম সব?                                         

তার মানে তুই সব মনে রেখে দিবি? ইশ! আমার ভীষণ লজ্জা করছে। তুই কতো ছোট, এ আমি কী করলাম।                                                   

যদি বলি মনে মনে তোমার এই আদরটুকু চেয়েছিলাম। মুখ ফুটে বলতে পারিনি।              ওরে পাজি! পেটে পেটে তোর এই ইচ্ছেটা ছিল তাহলে।                           

সন্ধ্যে নেমে গেছে, ঘর অন্ধকার। কেউ এসে গেলে বাজে ব্যাপার হবে। আমি এবার যাই মল্লিকাদি।                                                                   

তোকে ছাড়তে ইচ্ছে করছে না। ভয় করছে গাবলু, যদি তোর সঙ্গে আর দেখা না হয়।       কেন দেখা হবেনা? বাংলা আধুনিক গানটা তোলা হয়নি তো।                   

নীচ থেকে মাসীমার গলা পেলাম, মল্লিকাদির নাম ধরে ডাকছেন।             

আমি যাচ্ছি, মলিদি।                                                                   

কাল আবার আসবি তো?                                                             

ঠিক আছে।                                                                             

তিনতলার ছাত থেকে দ্রুতপায়ে নামছিলাম নীচে। হঠাৎ মাসীমা অর্থাৎ মলিদির মা ঘরের ভেতর থেকে আমাকে ডাকলেন, গাবলু, একবার শোন বাবা।         

মাসীমার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম, আমাকে ডাকছেন?                             

হ্যাঁ, কিন্তু কথাটা কিভাবে বলবো বুঝতে পারছি না।                               

একটা ঝড়ের আভাস পেলাম যেন। বলুন না, কী বলছেন।                       

কিছু মনে করিস না বাবা। আমার কাছে তুই আর সন্দীপ দুজনেই সমান। কিন্তু পাঁচটা বাইরের লোকও তো আছে। রোজ এসে অতক্ষণ ধরে ছাতের ঘরে দুজনে বসে অতো কথা আর গান-বাজনা সবারির চোখে ভাল দেখায় না। এখন তো আর তুই এতটুকুনি নেই। বড় হয়েছিস। আজ বাদে কাল মল্লিকার বিয়ে। সেটাও তো খেয়াল রাখতে হবে। সন্দীপের সঙ্গে আসবি মাঝে মাঝে কিন্তু চোখে যেটা অশোভন দেখায় সেটা করিসনা বাবা। কিছু মনে করলি নাতো? আসলে রোজই ভাবি বলবো কিন্তু সুযোগ পাইনি। আসিস আবার, কেমন।    গালে একটা চড় খেলে এর থেকে কম লাগতো। কোন রকমে কথা শেষ করে মলিদির বাড়ি থেকে শেষবারের মতো বিদেয় হয়েছিলাম। তারপরের তিন বছর পটলডাঙার ধারে কাছে ঘেঁসতাম না। কবে মল্লিকাদির বিয়ে হয়েছিল জানতে পারিনি কারণ হায়ারসেকেন্ডারী পরীক্ষার পর একবার মাত্র সন্দীপের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। দেখলাম এই কমাসে আন্তরিকতা, খুব স্বাভাবিক নিয়মে, ধূসর হয়েছে অনেকটা।                                      এলো ৭০-৭১ সাল। একদিকে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস আর অন্যদিকে দলের সঙ্গে মতাদর্শের সংঘাতে মধ্য কলকাতা আমার কাছে হয়ে উঠলো দুঃস্বপ্ন। গলিতে গলিতে, কারাগারে চলছিল গুপ্ত হত্যা। সঙ্গী-সাথীর লাশের ওপর রচিত হচ্ছিল আর এক সব হারানো মানুষের ব্যর্থ লড়াই-এর পান্ডুলিপি। কলকাতা ছেড়ে পালালাম।                                                        পটলডাঙার গানে মুখর সেই দোতলা বাড়িটা হয়ে রইলো আমার কাছে এক ফিকে হয়ে যাওয়া সুখস্মৃতি। সুখস্মৃতি সব সময় কান্না ভেজা সুখ, ছেঁটে বাদ দিয়ে দেয় সে… যা আমি ভুলতে চাই। আমি ভুলে গেছি আজ, কবে মল্লিকাদির বিয়ে হয়েছিল, কার সঙ্গে আর কোথায়। সেই স্মৃতিতে মধ্য কলকাতার ঘিঞ্জি গোলিতে নামে বর্ষা, দূর থেকে ভেসে আসে  সন্ধেবেলার সুকন্ঠীদের গলা সাধা, ধূতি পাঞ্জাবীতে গলদঘর্ম বাবার অফিস থেকে ফেরা, দিদি আর দাদাদের হারিয়ে যাওয়া স্নেহের ছত্রছায়া, অনুরোধের আসর শুনতে রেডিওর সামনে হাজিরা, কলের গানে রেকর্ড চাপিয়ে গান শোনা…ওগো মোর গীতিময়, সরস্বতী পুজোয় রাত জাগা, খুনসুটি…গোপন একটু হাতের ছোঁয়ায় সবটুকু মন পাওয়া আর গানে ভুবন ভরিয়ে দেওয়া পটোলডাঙায় সেই দোতলা বাড়িটা।            

আজ কর্ণফিল্ড রোডে আবার হারিয়ে গেল মল্লিকাদি বহু ব্যস্ততার ভীড়ে। আমি পিছিয়ে পড়ি বারবার বিস্মৃতির কুয়াশায় প্রায় হারিয়ে যাওয়া এক পূর্ণিমার পড়ন্ত সন্ধ্যায়…সে আসিবে আমার মন বলে সারাবেলা…এক সীমাহীন অপেক্ষা আর নিস্তব্ধ হাহাকারে খুঁজে চলেছি নিশ্চিত মুছে যাওয়া একটা সময়কে। 

Comments

Top

কবিতা সমগ্র

বিকাশ দাস

পাটলিপাডা, থানে, মুম্বাই

কবিতাঃ বিকাশ দাস
Bikash Das.png

পরিচিতি: বিকাশ দাস (মুম্বাই)

জন্ম ২৬শে আগস্ট ১৯৫৭ পশ্চিমবঙ্গের মালদা। পড়াশোনা সাহেবগঞ্জ, ঝাড়খণ্ড। তারপর কোলকাতায়। কর্ম সূত্রে দীর্ঘদিন দেশের বিভিন্ন প্রদেশে থাকতে হয়েছে।ছোটবেলা থেকেই ছড়ানো ছিটানো লেখার অভ্যেস ছিলো কিন্তু সেই লেখার অনেকটা অংশ ধরে রাখতে পারেনি। ইদানীং রোজকার পুজো আর্চার মত লেখা শুরু করেছি। দেশ পত্রিকা ছাড়া অন্য ছোট বড় পত্র পত্রিকায় কবিতা / গল্প প্রকাশ পেয়েছে। বর্তমানে মুম্বাইতে থাকি।

প্রকাশিত একক কাব্যগ্রন্থ:

এখন আমি একা / জরায়ুজ / নিকুচি করেছে কবিতা / কবির শেষপাতা / তবু ভালো দুঃখ দিও (গীতিকবিতা) / জীর্ণ ব্যথার মুখবন্দী কথা / বিকাশ দাসের নির্বাচিত কবিতা / ঈশ্বর এবার খেটে খা / মৃত্যুর জন্য কবিতা দায়ী।

ধন্যবাদ ঈশ্বর

 

তোমার নিকানো পাথরে খুঁজতে এসেছি ঘর
তোমার চরণ ধোয়া জলে নীরোগ থাকার বর। 
তবু,রোজ নিচু হয়ে আসি নিচু হয়ে বসি নিচু হয়ে ফিরে যাই 
অজান্তে তোমার পাপোশে আমার পায়ের ধুলো রেখে যাই। 
ধন্যবাদ, ঈশ্বর। 

যখন আমার তীর্থভূমি দুয়ার খোলা হাওয়ায় 
জেনেছি আমার ধুলোপায়ে আমার ঘরের গন্ধ 
আমার নিশ্বাস প্রশ্বাসে আমার সংসারের ছন্দ। 

ঘরে থাকতে আকাশ  
তোমার আকাশ কুর্নিশ করতে কেন যাবো? 
আমার উঠোন ছেড়ে 
তোমার উঠোনে  সুখ খুঁজতে কেন যাবো? 

ধন্যবাদ, ঈশ্বর। 
 
ইচ্ছে যখন
 

রাজা হবার ইচ্ছে যখন  
আগে নিজের হাতে মাটি কেটে ফসল ফলিয়ে দেখাও।
নেতা হবার ইচ্ছে যখন  
আগে নিজের শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়িয়ে দেখাও। 
মানুষ হবার ইচ্ছে যখন  
আগে নিজের মাথায় অন্যের মাথা উঁচু করে দেখাও। 
বন্ধু হবার ইচ্ছে যখন
আগে নিজের হারে বন্ধুর জিত মুখর করে দেখাও।
দোসর হবার ইচ্ছে যখন  
আগে সাগরের নুনে মিঠে জলের নদী করে দেখাও। 
 
লক্ষ্মীছাড়া কবিতা

নর্থ জেনে কবিতা ছেড়ে দিয়েছি 
অর্থের বৃষ্টিতে ভিজতে ফিরে এসেছি 
মাথার চাতাল বলতে খোলা আকাশ 
পায়ের তলায় মাটি ক্ষুর গাঁথা উচ্ছ্বাস। 

দু’ হাতে পাথরে পাথর গেঁথে ঈশ্বর পেয়েছি 
দূরত্ব ধরে ধরে দ্রুত নিজেকে এগিয়ে নিয়েছি 

লক্ষ্মীছাড়া দুঃখ শ্রম 
কোথায় কবে কখন শেষ হবে লাঞ্ছনার কাল বিষ তুলে 
কি ভাবে শুরুর বিধান হলে দূরের শেষ মহার্ঘ দুয়ার খুলে  
কল্পনার তীর্থে নির্বোধ ভেঙে ভেঙে বাস্তব পাবো  
রোজ দু’মুঠো ভাত কবিতার পাতায় বসে খাবো। 

​​অদৃষ্ট

কি আমার বর্ণপরিচয় জানিনা।  
ভাষার বর্ণমালার রঙ জানিনা।  
নির্যাতনের শতরঞ্জ খেলার অঙ্ক হিসাব করতে জানিনা 
বিজ্ঞানের উছলানি কোলাহলের ফেনায় মরতে জানিনা।  

ভূগোল জুড়ে কতটা দেশ 
ইতিহাসের কতটা অবশেষ 
বিশ্বের জঠর ভেঙে ভেঙে  দেশের বরাত করতে জানিনা 
লক্ষণ রেখার বৃত্ত ছাড়িয়ে রাবণের করাত ভাঙতে জানিনা। 

আমি তোমাকে ভালোবাসি 
তুমি আমাকে ভালোবাসো 
খড়কুটোর সজল ছায়ায় বসতবাড়ি, এক ফালি খোলা আকাশ
বিছিয়ে দহনবেলায় দু’জনার হৃদয় ক্ষ্যাপা মাটির গন্ধ বাতাস। 
 

কবির গণতন্ত্র

হে কবি পুঁথিতে পুঁথিতে গাঁথিও না ধর্ম শ্লোক মন্ত্র 
তোমার নিজস্ব শব্দের বিন্যাসে মুক্ত থাক গণতন্ত্র। 
হে কবি শঙ্খের ফুঁক নিয়ে আসুক ঘরে ঘরে মঙ্গল 
তোমার কলমের তীর্থ ভেঙে দিক মানুষের দঙ্গল।
হে কবি মন্দের ক্রান্তি  বিরোধ যাক নিপাত চিতায় 
তোমার কণ্ঠের স্বর মনুষ্যত্ব নিয়ে বাঁচুক বীরতায়।
হে কবি মিথ্যে জয়ের মুখোশে না খোয়ায় সততা 
তোমার শব্দের খড়গ মিছিলে মিশুক শান্তির বার্তা।
হে কবি জল মাটি বায়ুর শ্রীজাত গণতন্ত্রের আওয়াজ
তোমার বাণীর বাণে মানুষ হোক যতসব তোলাবাজ।
হে কবি বাঁধো ছন্দ স্তবকে স্তবকে কবিতার তোয়াজ 
তোমার কলমে কালির ছলাতে স্বচ্ছন্দ গণতন্ত্র আজ। 


বন্ধু

ন্ধু যেন 
চনমনে রোদের কাঁথা জড়িয়ে ধামাল শীতের কাঁপন 
আগলে লজ্জা নিবারণ নির্ভয়ের সুতোয় পোক্ত বাঁধন। 
বন্ধু যেন 
বুকে দুঃখ জ্বালা জুড়িয়ে রাখা আস্থা জাগানো বাতাস 
নিজের কাঁধে বোঝার ভার তুলে ঘর জড়ানো আকাশ।
বন্ধু যেন 
অবাধ ভুলের পাঁকে হাজার পদ্ম ফুটিয়ে তোলার সাধন 
জটিল দিনে ভরিয়ে রাখা রমণ মাখা নিত্য খুশির বাঁধন।
বন্ধু যেন 
মনে প্রাণে নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে বাঁচিয়ে রাখা জীবন মরণ 
খরার দিনে ঘরে ঘরে ছুটে আসা বর্ষবরণ রাতুল চরণ।
বন্ধু যেন 
ধর্ম সংস্কার খোলা মানব জমিন ভালোবাসার অরণ্য
পাপপুণ্যের সংকট ভেঙে নিঃসন্দেহে সবার অনন্য। 

সুখ


মার দুঃখ লাগা বাড়ির অনেক ভেতরে  
অনেক সুখের ঘর লুকিয়েছিলো আমার অগোচরে 

যখন  
সব দরজা খিড়কি খুলে স্পর্শ করলাম উদাম চোখে  
মাথার উপর এক গোটা আকাশি আকাশ।
বাস্তবের কাঁটা অসংখ্য কাগের গুন ভাগে  
রক্তের ফোঁটা আঙুলের ডগায়;  
হাতের রেখা তখনও সজাগ সততার দাগে।  
যখন  
দিন আনি দিন খাই সততার  হাতে। 
ক্ষুধার গর্ভে খুদা ঘুমায় নিশ্চিন্তে দীনতার রাতে।    
 
এখন তুমি যাও


ভাব এখন তুমি যাও  
আবার এসো 
কতটা খিদে কতটা ঘুম স্বচ্ছলতার  
বেঁচে থাকা দরকার  
তোমার দু’হাত  নেবো আমি নিংড়ে। 
 
অন্ধকার এখন তুমি যাও  
আবার এসো 
কতটা আলো কতটা ছায়া সম্ভোগের  
পেতে রাখা দরকার  
তোমার হৃদয়  নেবো আমি নিংড়ে। 
 
জীবন এখন তুমি যাও  
আবার এসো 
কতটা অন্ধ কতটা বধির অলক্ষ্যে  
ঢেকে রাখা দরকার  
তোমার শরীর  নেবো আমি নিংড়ে। 
 

জরায়ুজ


থাক বয়স দূরে অনেক দূরে গিয়ে  
থাক বয়স পাহাড় পাথর চাপা দিয়ে।  
থাক বয়স বন অরণ্যের কালান্তরে  
থাক বয়স সাগর জলধির ওপারে।

বয়সকে দিওনা ঘেঁষতে কোনো কৌশলে  
কুশল চিঠি সই পাতার হিল্লোলে  
পরিচর্যার অজুহাতে শরীরের ভেতরের ঘরে।
বয়স ধরলে শরীরের কল্লোলে ক্রমশ: ভাঙ্গন ধরে  
শরীরের বিনুনির গিঁট আলগা করে  
শিরদাঁড়ায় কালচে পড়ে।

পাপপুণ্য জল শূন্য জীর্ণ মাটি সামান্য ফসলের গন্ধে  
আকাশ মেঘময়।  
নিঃসঙ্গ বাতাসের সন্ততি থাক নিত্য পোশাকের ছন্দে  
শরীর অস্থিময়।  

শরীরের ভেতর আর এক শরীর বয়সের মূর্ধায় থির।
যদিও শরীর ..... 
আলো অন্ধকারের গমক গমক আঁচের গভীরে  
ষোলো আনা লোভ আরো বেঁচে থাকার বৃষ্টি সরস সরোবরে 
অন্তর্বাস তত্ত্বের বর্ণের ঝনৎকারে।  
দু’হাত কোলাহল হাতড়ে আরো বেপরোয়া আরো যত্নশীল  
সব বয়সের দিন দিগন্ত আঁকড়ে।

শরীর...... ভিখিরির জাত ক্ষুধিত স্বভাব  
জরায়ুজ।
শরীর...... পুরুষ নারীর স্নাত সংশোধিত পল্লব     
জরায়ুজ।
শরীর...... সংকল্পিত বাস্তব ভাস্কর্য   
জরায়ুজ। 

আমি আসবো


ব্যথার বিষ শেষ হলেও  
ক্লান্তির অবশেষ হলেও  
তোমার প্রয়োজনের কাছে বাড়তি হলেও 
আমি আসবো শর্তের দড়ি ছিঁড়ে  
তোমার রক্ত হবো; 
তোমার ধমনী শিরায় তোমার শরীরের কল্লোলের কলোনিতে।

বসন্তের আকাশি চাঁদ অপছন্দ হলেও  
আমি আসবো জন্মের সূত্র ধরে  
তোমার রক্ত হবো ;  
আগামী দিনে তোমার ক্লেশের ভেতর লবঙ্গ যোনির লাবণীতে। 
 
ব্যথার বিষ শেষ হলেও  
ক্লান্তির অবশেষ হলেও   
                        আমি আসবো ........
 

নিঃসঙ্গতার কবিতা


মার বয়সের কাঁধে এখন আর নেই কোনো ওজন  
শিরদাঁড়ায় হাত বুলিয়ে দেওয়ার মতো কোন স্বজন। 
নিস্তেজ পড়ে থাকা গন্ধমাখা রুমালে  
সেই আকাশী গগন ... 
আর  
প্রহরের গ্রিল খুলে দু’জনে এক সাথে বসে থাকা  
দু’বেণীর দোলায় সূর্য্যর আসা যাওয়া গায়ে মাখা। 
যদিও সময় থাকতে দিয়েছি মেয়ের বিয়ে  
ভালো ঘরে আমার সাধ্যের বাইরে গিয়ে  
ছেলেও খুঁজে নিয়েছে রোজগার নিজের বিদ্যা বুদ্ধি দিয়ে; 
তারা এখন ভীষণ ব্যতিব্যস্ত নিজের নিজের একান্ত সংসারে।

একদিন গাছে ফুল ছিলো ফল ছিলো;

ছিলো পাতার সবুজ সুরভি  
ছায়া রোদ্দুর মেঘলাগা বৃষ্টি; ঋতুর স্পর্শ সুখলাগা পৃথিবী।

কোলে পিঠের সম্পর্ক এখন ঝুললাগা ছবি; 
একলা ঘরের ভেতরে নিজের মতো করে   
আজো অতীত ভাতের গন্ধের মতো ছুটে আসে  
নিঃশব্দে পেরিয়ে চৌকাঠ স্বচ্ছতার বাতাসে।
আমার নিঃসঙ্গতার পাতায় হারানো সঙ্গতার   
অবাধ বর্ণের নিছক বর্ণনা টেনে আনায় কি কবিতা!


দুঃখ তুমি


দুঃখ তুমি  
শুকনো ভাতের দানায় 
উষ্ণতার স্বাদ খুঁজে নিও। 
দুঃখ তুমি  
ঘাত প্রতিঘাতে নির্বিশেষে 
স্বচ্ছ হৃদয় খুঁজে নিও।
দুঃখ তুমি  
শ্রমের লাঙ্গল ফলার শানে  
মাটি খুঁড়ে ফসল খুঁজে নিও। 
দুঃখ তুমি 
দু’চোখ বুজে অন্ধকারে     
সূর্য মাখা দিন খুঁজে নিও।
দুঃখ তুমি 
ঢালা বৃষ্টির ফোঁটায়    
ঝিলমিল আকাশ খুঁজে নিও। 
দুঃখ তুমি  
কঠিন বলিদানের দাগে   
ভাগ্যের ভাগ খুঁজে নিও।
দুঃখ তুমি  
সংঘর্ষের আখার কাঠে  
ফুলকো রুটির ভাপ খুঁজে নিও। 
দুঃখ তুমি 
সম্পর্কের ইটপাথরে মাঠে  
আজ ভিটের টুকরো খুঁজে নিও। 
দুঃখ তুমি 
খুলে অন্তরের গাঁঠ  
সহজ মনের জাত খুঁজে নিও। 
দুঃখ তুমি  
বিভাজনের চৌকাঠে   
উৎসবই বিধান খুঁজে নিও। 
দুঃখ তুমি 
নারীর মাতৃত্বের কোলে    
আগামী দিনের দীপ্তি খুঁজে নিও।  
দুঃখ তুমি 
জীবনের কোরা পাতায়  
প্রবৃত্তির দিক প্রবাহ খুঁজে নিও। 
দুঃখ তুমি 
সময়ের বুনোনিতে  
ইতিহাসের পরিহাস খুঁজে নিও। 
দুঃখ তুমি 
সম্প্রীতির সেমিনারে  
মানুষের  মেরুদন্ড খুঁজে নিও। 
দুঃখ তুমি 
বিপর্যয়ের আয়নায়  
হৃদয়ের একান্তে শান্তি খুঁজে নিও। 
দুঃখ তুমি 
জীবনের কাব্য গ্রন্থ 
মৃতোপম শব্দের হাড়ে খুঁজে নিও।

 


একতার প্রচ্ছদ


কার নয় 
দোকার নয়  
এ সবার নির্জলা শ্রম।  
একার নয় 
দোকার নয়  
এ সবার অবাধ স্পর্শ। 
একার  নয় 
দোকার নয়  
এ সবার নিঃস্বার্থ অর্ঘ।
এ সবার  
শ্রমের স্পর্শের অর্ঘের একতার খন্ড  
রঙ্গ-প্রবণ অন্তরঙ্গ সংহতির হৃদপিন্ড।
জলে স্থলে নদী সাগর রোদছায়া বৃষ্টির তোলপাড়  
আকাশ মেঘের ছাদে সূর্য চাঁদের দিবারাত নির্বিকার  
মাটির ঘাসে ঘাসে ঘন দুর্বার শিশিরে ভুবন একাকার   
অনাবিল অনঘ সৃষ্টি একতার সৃষ্টির দু’পার।

একার নয় দোকার নয় এ সবার .........।

 

সহবাস
বি বন্ধুরা ... 
তোমার পছন্দ মতো সমবেত শব্দ যতো  
প্রতীতি আঙুলে কুড়িয়ে তোমার লুকোনো  
অভিধান থেকে, 


লেখো ... 
সন্ধ্যা ভোর রাত্রির প্রতিহত হৃদয় জোড়া হৃদয় ভাঙা; 
আকাশ পাখি মেঘ বৃষ্টির, 
ছায়ার মোহক রোদ দৃষ্টির, 
তোমার মত করে  বিষাদ ভুলে  
এক ঘর থেকে আর এক ঘরের সব দ্বার খুলে।  
 
লেখো: 
রঙ রয়েছে পড়ে অনুভবের আবেগের সুখ ধরে  
যদিও নজর কাঁচা সরস তৃষ্ণার গন্ধে বুক ভরে।  
লেখো: 
কে খারাপের আড়ালে নষ্ট ছায়ে  
সারাদিন? 
কে হাঁটে ভালোর খাপে অসুখ পায়ে  
সারাদিন? 
লেখো: 
সব দুঃখ কষ্টর কথা  
বুক ফাটা জলভরা পাটাতন দীর্ঘ ভারে  
দু’চোখের নীরব প্রতিবাদ নদী থেকে সাগরে। 
 
লেখো: 
ব্যথার অন্তঃসারে নিঃশ্বাসের ভেতর সততার আঁচ  
বাতাসের হোমে ভরসার আগুন ছাই মাখা মণিময় কাচ। 
লেখো: 
দুঃখ কষ্টর মধ্যে সংঘর্ষ আর স্বপ্নের বসুন্ধরা 
দু’হাত ভর্তি ক্ষুধার খুদা ধানে চালে ভাতে কুশলপারা।
 
লেখো: 
এরাই অন্ধকার; 
এরাই অন্ধকারের শ্রেয়সী চাঁদ 
এরাই জোয়ার ভাটার রূপসী ফাঁদ। 
 
                   যে ব্যথা নিঃশ্বাসের নিঃশব্দতায়  
                   এরাই চাঁদলগ্ন ধারাময় বসুধায়।

ভবিতব্য


যাওয়াই ভালো  
দু’পায়ে অন্ধকার ঠেলে আর এক নতুন অন্ধকারে। 
যাওয়াই ভালো  
আলোর সাঁকো ফেলে আর এক নতুন অন্ধকারে। 
এখন  
মাকড়সার জালে ভর্তি দেশের বাড়ি  
বেঁচে থাকার তাগিদে বিদেশ পাড়ি  
জেনেও .... 
একদিন আসতে হবে ফেরত ঘরে  
সম্পর্কের সৌরভে দু’হাত চার করে । 
দুটি হাত দুটি প্রান্ত  
সতর্ক রেখে  
দু’হাত এক করো বা আলাদা করো  
ভগ্নাংশের মধ্যেই খুঁজে নিতে হবে তোমার অবশিষ্ট  
আকাশ মাটির গন্ধ তোমার ভবিতব্য   
যদিও  
তোমার দু’হাত আজ সর্বস্বান্ত অথর্ব    
ছেঁড়া ঘুড়ির মতো জীবনের সুতোয়  
একলা কাঁটা তারে ।

অপরাধবোধ


তুমি বলো  
শরীর বয়সের বশে থাকলে  
অপরাধ। 
অশুচির গন্ধ গায়ে মাখলে  
অপরাধ। 
মাথার উপর ভগবান পায়ের নীচে শয়তান  
মুখের আদল বদলে খুঁজতে হবে অবসান।

তুমি বলো  
ফিরে যাও ঘরে দু’হাতে রেখো ধরে  
দুঃখের দিন সুখের দিন ঘরের কোটরে 
খোলামেলা চাতাল। 
সূর্যের ভোর আকাশে রোদের চাদরে  
ফুলতোলা সকাল।

তুমি বলো 
দেনার ভার দু’হাতে থাকলে  
অপরাধ। 
কর্তব্য দায়সারা রাখলে  
অপরাধ।

তুমি বলো  
ফিরে যাও ঘরে দু’হাতে রেখো ধরে  
বারোমাস তেরো পার্বণ আদর আপ্যায়ন  
সম্প্রীতির দরবার। 
দুই প্রান্তের ঘর উঠোন পৃথিবীর নিকেতন  
একান্নবর্তী সংসার।
 


খোলা হাওয়ায়


তুমি এসো বা যাও ফিরে  
তোমার ইচ্ছে লাগার ভিড়ে।
যদিও নেই  
আমার ভেতর ঘরের বাসা সুখ দুঃখ কষ্ট মুখের ভাষা। 
আছড়ে মুচড়ে পড়ার ব্যথা সম্পর্কের কাঁচ ভাঙা অযথা। 
আলো আঁধারের বাড়াবাড়ি ধনদৌলতের কাড়াকাড়ি। 
ধারদেনার কোর্ট কাছারি  
হাট বাজারের ফর্দ হিসেব নিকেশ করার জারি। 
অনুষ্ঠানের বাড়তি আবর্জনা অহেতুক নেশার সরাই খানা। 
আরাম করার বাগান বাড়ি ভাগাভাগির জঞ্জাল ভারি। 
খুনসুটির ঝগড়াঝাঁটির বালা। 
সিংহদুয়ার সতর্কতার চাবিতালা।
এখানে শুধু রোজকার মতো ...... 
খোলা হাওয়ায় স্বাভাবিক আসে যায়  
ধারাবাহিক টাটকা ফুলের উজাড় গায়  
সন্ধ্যা ভোর মাটির গন্ধ আকাশ জোড়া  
ভালোবাসার বসত ঘর হৃদয় মোড়া।
 
 
বাবার কাছে কন্যার নিবেদন 
 

বাবা
মাথা ঠুকে কথা দিলাম 
তোমার জীবনের বোঝা হবো না
অভাবের গলার ফাঁস হবো না। 
দেয়াল দেওয়া আঁতুড় ঘরের ভুবন কাঁথায়
দুর্নিবার অনুভবের জীবন মেলার মুহূর্তের দরজা খুলে 
আমাকে আসতে দাও সম্মতির নির্জনে 
মায়ের প্রসব বেড়া খুলে। 
 
তোমার কঠোর দিনে সমস্ত বিষাদ মুছে 
আমি হবো তোমার চিন্তাহরণ নন্দিনী । 
কাজের কন্যা আষ্টেপৃষ্ঠে সংসারের ধারাপাতে 
প্রহর জুড়ানো প্রশান্তির নিরাময় নিঃসঙ্গ বিনিদ্র রাতে। 
 
উলসে সম্প্রীতির কামনা দৈবাৎ সুপ্ত হনন ভুলে 
আমাকে আসতে দাও প্রত্যয়ের গাহনে  
মায়ের জঠর ব্যথা খুলে। 
 
রোজকার কাজ কর্ম ক্লান্তির স্পর্শে তোমার শরীর ঝাঁঝরা হলে
আমি হবো তোমার সান্ধ্য আকাশ ডানামেলে ঘরের দুয়ারে ঢলে। 
 
ফসল তোলার উদ্বেগ জড়িয়ে দু’হাতের বাঁধন খুলে 
আমাকে আসতে দাও রক্তের লালিমায়   
মায়ের আনন্দ বিহান ফুলে । 
 
আমি জানি পুরুষ পুত্র আগামী দিনের অর্থ বৃত্তির সূত্রধার 
সব ঝি কন্যা উদ্বৃত্ত খরচপত্র সময়ের কাঁধে দেনার ভার। 

  


তোমার ভুলে যাওয়া
 

ভুলে যাওয়া তোমার সবকথা 
আমার ঠোঁটের রঙ হয়েছে 
ভুলে যাওয়া তোমার সবকথা 
আমার খোঁপার কাঁটা হয়েছে। 
 
কতোটা পেলে বলো আজ তুমি সুখী হবে 
ততোটা গুনে গুনে দেবো তোমায় তবে। 
এখন শুধু তোমার দরজার খিল খুলে দাও  
আমাকে তোমার ঘরের ভেতর আসতে দাও।

আমার খোঁপার সবকাঁটা নিজের চোখে না হয়   
তুমি গুনে নিও। 
আমার ঠোঁটের সব রঙ নিজের হাতে না হয় 
তুমি তুলে নিও।

 


দায়
 

সেদিন  
জ্যোৎস্নায় চাঁদ ছিলো না। 
সেদিন 
সমুদ্রে ঢেউ ছিলো না। 
সেদিন 
নদীতে  স্রোত ছিলো না। 
আমার দায় আমাকে কুড়ে কুড়ে গ্রাস করছিলো
প্রশ্নের ঘাড়ে প্রশ্ন আমার কাছে উত্তর ছিলো না। 
 
যেদিন তোমাকে দেখলাম 
সম্পর্ক জলের মতো ঠেলে নিয়ে যায় আমাকে অভিসারে
যেখানে চাঁদ 
জ্যোৎস্নার বালিশ মাথায় নিটোল ঠোঁটে রেখেছে আঙুল।
যেখানে ঢেউ
সমুদ্রে যুবতী বুকভরা স্তন মাতৃত্বের তৃষ্ণায় অস্থির আকুল।
যেখানে স্রোত
নদীর দুটি বেণীতে আত্মসারে বেঁধে জাগিয়ে পারের কুল।
 
দু’চোখ একবুক জল নিয়ে অন্ধকারের খাদে 
বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছি নিজের দায়ের কাছে। 

মৃত্যু
 

মৃত্যু মারা যায় না  
কারোর ডাকে রা কারে না। 
মৃত্যু আতঙ্ক ভয় জ্বর শূন্য  
মৃত্যু অহঙ্কারবোধ একলা  
মৃত্যু অঙ্ক অদৃষ্টের ধারধারে না।
 
কারোর দু’পায়ে বা দু’হাত ধরে বলে না  
আমার জীবন ফিরিয়ে দাও। 
মৃত্যু যুদ্ধ শেষ কুল অবশেষে বলে না  
আমার জীবন জিরিয়ে দাও।
 
মৃত্যু মনিব শরীরের শরিক মৃত্যু ভবিষ্যৎ
ভাগ্যের ধারধারে না। 
মৃত্যু রোগ মৃত্যু ভোগ জেগে থাকার শর্ত
ধাপ্পার ধার ধারে না।
 
মৃত্যু বিদায় মৃত্যুর চোখে নিশ্চুপ কান্নার  
অল্প ঘুম। 
মৃত্যু প্রেম মৃত্যু বিষ অসুস্থতার আরোগ্য  
সুস্থ ঘুম। 
মৃত্যু আঘাত মৃত্যু বিশ্রাম হাড়ের নিশ্চিন্ত  
মগ্ন ঘুম। 
মৃত্যু ইচ্ছে বেঁচে থাকা শরীরের ফাঁকজুড়ে  
অনন্ত ঘুম।
মৃত্যু ছাই মৃত্যু যায় মৃত্যু আসি  
মৃত্যুর ঠোঁটে মৃত্যুর একলা বাঁশি ।
 

কবির কবিতায় 
 

লমের দাগে 
কবির কবিতায় চাঁদ কলঙ্কিত। 
ফুলের দাগে 
শব্দের পাথর আজ ঈশ্বর। 
পাষাণ পল্লবিত।  
কবির দু’চোখ মুখরিত। 
 
শব্দের ঘুমে শব্দের রাত্রি শব্দের ভোর 
একলা একা কবিতার শিরদাঁড়ায়।
কবির পরকীয়া প্রেমে নিত্য হাঁটা তোর
যাযাবর শব্দ কবিতার পান্থশালায়।
শব্দের শ্যাওলা কবিতার জলে আশ্রিত। 
যদিও সূর্য পিপাসিত। 
কবির দু’হাত মুকুলিত। 
 
বৃষ্টির দাগে 
শব্দের ধুলো আজ সরব। 
বাতাস উচ্ছ্বসিত। 
কবির দু’হাত বিসর্জিত।                                     


গুমর 


তোমার দু’চোখ রেখেছো একাকার  
যখন ভাঙছিলো ঝনঝন করে বৃষ্টির কাচ  
রোদ্দুরের আঁচে 
দেখছিলে কাঁখ বাঁকানো নাচ  
এক অসূর্যস্পশ্যা নারীর । 
আমি ছুটেছিলাম কুড়োতে বৃষ্টির ফোঁটা  
দু’হাত আমার রক্তের আলপনায় যদিও একাকার ।  
এ’জখম আঘাত  
হৃদয়ের হয়রানিতে বাঁধছিলো অবাধে ভালবাসা  
শুধু তোমার । 
তুমি দেখলে না ছুঁয়ে একবারও  
আমার উপোষী ঠোঁটের পাতায় যতো রোদবৃষ্টির সাতকাহন । 

মৃত্যুর জন্য কবিতা দায়ী

থেমে গেছে বৃষ্টির ছলকানি 
থেমে গেছে আকাশের গোঙানি 
তবু তুমি আসোনি আকবর চাচার চায়ের দোকানে। 
ধ্বসে গেছে মাটির আত্মগ্লানি 
ধ্বসে গেছে বসতবাড়ির ঝলকানি 
তবু তুমি আসোনি শেষবিদায় দেখে নিতে শ্মশানে। 

কার শব রেখে চুল্লিতে ধরে আছো উছলান 
আগুনের সেঁক লেগে বেঁচে ওঠে মৃত্যুর প্রাণ। 

প্রকৃতির হৃদকমলে থাক ধর্মজাত যার যার 
এইটুকু পৃথিবী সবার সমান সমান অধিকার। 

কবির আঙুল জানে বেঁধে নিতে কবিতায় নিশ্চুপ কথার ঝংকার 
মৃত্যুর জন্য কবিতা দায়ী অবিমৃশ্য হাড় হৃদয়ের নিরর্থ অহংকার। 

 

বলাৎকার

সো কবি।  
এখন নির্জলা দুপুর 
আমায় নির্ভয়ে নগ্ন করো। 
শব্দের  কাঁচি  ছুরি ধরো। 
মায়াবী গন্ধের ইথার ভরো। 
আর  
খুবলে নাও শিকড় সমেত আমার উরস খুলে 
হোক ভাঙচুর তোমার রিরংসার কলম তুলে। 
আর্তনাদ পড়ে থাক একা নিশ্চুপ। 
ভালো থাকার ধৃতি শুধু ভালোবাসা নয় বলে
নিয়ে যাও কবিতা শরীর থেকে শরীর  ছিঁড়ে
হোক বলাৎকার; কবিতার চেয়ে বেশি দামি। 

নিকুচি করেছে কবিতা

যে পেটের ছেলে 
মায়ের দুঃখজ্বালা বোঝে না
গোবর ঘুঁটের গায়ে মায়ের হাতের ছাপ  
লোকের কাছে বলতে লজ্জা করে 
পরের উচ্ছিষ্ট বাসন মেজে মায়ের দু’হাত 
দু’মুঠো ভাত সংসারের ক্ষুধা ভরে;
সে ছেলে মুখ ফিরিয়ে 
মায়ের সঠিক ব্যাখ্যা সবিস্তারে ফলাও করে কবিতা লেখে 
শব্দ কুচির গর্ভে মায়ের কষ্ট জ্বালার আঁচড়ের স্তবক ঢেকে।
 
বা! কবিতা। 
যে ছেলে বুড়ো বাপের ঘাড়ে বসে অন্ন ধ্বংস করে
বাপকে ঊনতা দেখায় 
বংশের অভাব অনটনের অকিঞ্চনতার প্রদর্শন ধরে 
রংবাহারি কবিতা লেখায়।
সে ছেলে বাহুতে পৌরুষ দেখিয়ে 
বাপের সম্বল আধকাঠা জমির উপর পৈতৃক ভিটেমাটি 
উপড়ে ফলিতার্থ নির্মাণ চায় 
প্রচুর আমদানি চোলাই মদের ভাটির ঘাঁটি।
 
সে ছেলে বাপমায়ের রক্তঅশ্রুজমাট শিলায়
ইস্তাহার দিয়ে উদ্ভিদ উচ্ছেদের কবিতা লেখে।
শব্দের শিরদাঁড়ায় উঁচিয়ে গলা অধিকার দাবি। 
আমি 
প্রসবসূত্রে প্রথম উত্তরাধিকারী 
হাতকাটা বাপের শরীর থেকে শ্বাস নিবর্তন হলে
একবাক্যে বলতে পারে 
বাপের মৃত্যু 
বাপের মুখাগ্নি চুলোয় যাক।
কবিতার বীজমন্ত্র ফলমন্ত আধকাঠা মাটি
বেঁচে থাক বাপমায়ের দান নিকুচি করেছে কবিতা।
 
সুন্দরী বেশ্যা

রা সূর্য ডুবলে ঘর সাজিয়ে দরজা খুলে থাকে দাঁড়িয়ে
ওরা শরীর জড়ায় ঝলসে কাপড়ে শরীরের আঁচ বাড়িয়ে
ওরা ঘুমোয় কম চোখের মজ্জায়
অনিচ্ছা সম্ভোগ সহ্যের শয্যায়
নগদ গুনে হাতে।
ওরা দিনের গোচরে বেশি কালো, রাতের অন্ধকারে ফর্সা
ওরা বাস্তবে শরীর বিছিয়ে সহ্য করে আঘাতের তীক্ষ্ণ বর্শা 
সাজের গয়নায় সুন্দরী বেশ্যা
ওরা পায় কম, খোয়ায় বেশি।
ওরা নিজের প্রাণের দেরাজে  ওরা নিজের মনের দেরাজে
নিজের আসল শরীর লুকিয়ে
এঁটো না হয় জেনে নিজের পুতুল শরীর কষ্ট যন্ত্রণার ভাঁজে
পুরুষের প্রবৃত্তির কাম ভুলিয়ে
বেলোয়ারি কাঁচের সুন্দরী বেশ্যা
ওরা রতি কম, সতী বেশি।
ওরা পরের ঘর পুড়িয়ে নিজের ঘর বাঁধতে জানে না
ওরা পুরুষের ঘর বাঁধলে সমাজের বাসিন্দা মানে না
নিষিদ্ধ সন্ধ্যায় সুন্দরী বেশ্যা
ওরা রমণী কম,ঘরণী বেশি।
ওরা পায়ের পাতায় আলতা পড়ে মেয়েদের মতো ব্রত কথা পড়ে
ওরা স্নান সেরে পুজো আর্চা করে ঘরের দিনপঞ্জিকার পাতা ধরে
মানুষী সভ্যতায় সুন্দরী বেশ্যা
ওরা নোংরা কম, মাটি বেশি।
ওরা পেটের তাগিদে পেট খোলা রাখে শরীর ভেঙে খায়
ওরা নিরুপায় ‘নিহতাঃপূর্বমেব’ মর্মের স্রোতে তলিয়ে যায়
সময়ের বাগানে সুন্দরী বেশ্যা
ওরা ঘাস কম, দূর্বা বেশি।
ওরা
আজও কলঙ্কিত
আমাদেরই চরিত্রের কলঙ্কে।

খড়কুটো – দুই


মাথার উপর আকাশ 
তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন ঘরলগ্ন মাটি 
দেহ জুড়ানো দু'দন্ড শান্তি  
নামিয়ে ব্যক্তিগত বোঝার দায় পায়ের নিচে।

মাথার উপর ঈশ্বর  
তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন শ্রমলগ্ন হাত  

পেট জুড়ানো দু'মুঠো ভাত সারিয়ে রক্তজলের উৎস সময়ের উদ্ভিদে।

মাথার উপর ঐশ্বর্য তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন দেহলগ্ন বৃষ্টি ঢেঁকি জুড়ানো দু'ধামা ধান মাখিয়ে আপন্ন অধিকার সংঘাতের ঘামে।

মাতৃভাষা 
 

যে ফেরে এ দুয়ার ও দুয়ার দেখেও আমি ফিরিয়ে নিই মুখ 
হাত নেড়ে ইশারায় ভিখ মাগে যদি পায় একটু অন্নর সুখ 
আমি জানি সে ক্ষুধিত ভিখারী।  
 
ভোর উঠতেই যে পাখি ভাষার ডানা মেলে উড়ে যায় 
শূন্য হাওয়ায় মগ্ন চাওয়ায় দুনিয়াদারি ভুলে গান গায়  
আমি জানি সে হৃদয়খোলা সংসারী।  
 
যে পথ খুঁজে পথ হারায় খাম খেয়ালির স্তব্ধ হাওয়ায়  
যে ভাষায় প্রাণখোলা গানের কলি আত্মহারা চাওয়ায় 
আমি জানি সে আনন্দ পথচারী। 
 
দিনান্তে যখন ফিরি ঘরে ক্লান্ত সর্বস্বান্ত কাঠ শরীরে  
যে ভাষার দানা ভিজিয়ে জিভ গলার অন্তঃস্থল ঘিরে 
এ আমার মাতৃভাষা সুখভাসায় প্রচ্ছন্ন আত্মার নীড়ে  
আমি জানি সে জীবন যাপনকারী।  

মা তুমি ভালো থেকো  
 

টা ঠিক 
আমিও বড়ো হলে ভুলে যাবো মাকে 
ভুলে যাবো 
আমার দুধের ঝিনুক বাটি আমার বারকোশ আমার জলের গ্লাস। 
কথায় কথায় অদ্ভুত সব উজবুক বায়না জেদে ফুলে ওঠা শ্বাস।
একটু পরে খুঁদকুড়ো মন আবার মায়ের দুধে আমার চুপকান্না
নিজের দোষে ভাঙলে খেলনা 
বাড়তি পাওনা মায়ের আঁচলে আদরের দোলনা।  
 
ভুলে যাবো 
মায়ের ভুলিয়ে ভালিয়ে গল্পে গানে 
ভালো করে ভাত চটকে চিবুক টেনে টপকরে আমার মুখে গ্রাস গেলানো     
অনেক পাখি চেনানো শিস ডাক টেনে 
বিষম লাগলে  
চট করে আমার মাথায় হাত বোলানো 
মায়ের জিভের ডগায় ষাঠ ষাঠ 
আমি সোনার ছেলে মায়ের রাজ্যে আমিই রাজ্যপাট আমিই বড়লাট।   
 
ভুলে যাবো 
হঠাৎ হঠাৎ ঘুম ভাঙলে 
মায়ের হাত আমার পিঠে উল্কি আঁকা হাজার আকাশ ঘুম পাড়ানী
মেঘ ডাকলে বৃষ্টি হলে বাজ পড়লে সোজা মায়ের বুকে একঝাঁপে। 
আমার সব দুষ্টুমির খেলায় মা সামিল যেন কৃষ্ণ গোপালা যশোদারানী।  
ঘর উঠোনময় আমার পালিয়ে বেড়ানো খপ করে ধরাপড়া মায়ের একধাপে। 
 
ভুলে যাবো 
হাড়খাটুনির মায়ের কষ্ট লাগা চোখের থেকে 
আমার চোখ পেয়েছি পেয়েছি চলার সড়ক আলোর দানী
ফেলা গেলে অন্ন 
শাসন বিধি রাখতেন কাছ থেকে
চারবেলার বিজ্ঞাপনের দুনিয়ায় সব চিনি সব জানি।     
 
ভুলে যাবো 
খুব শীতে মায়ের শরীর থাকতো ঝুঁকে নিজের ছায়ায় দিকে 
মায়ের দু’পায়ে হাঁটুর ব্যথা কিন্তু রোদ রাখতো ঠিক আমার দিকে।  
আবার খুঁটিয়ে দেখা 
স্কুল ফেরৎ টিফিন বাক্স আর হোমওয়ার্ক রুটিন মতো
আবার বুঝিয়ে তখনি 
বকাঝকার মধ্যে আমার দু’গালে আদর চুমু উজাড় যতো।
 
ভুলে যাবো 
মায়ের সেই শুভ্র শাড়ি কালো পাড় বাঁধা কিনারা 
নিষ্পত্র চরাচর উপোষী শরীর 
আমার ভুবনসঙ্গী বাকি পৃথিবীর সব স্বাদ আল্হাদ ভুলে 
পেটের প্রসব জ্বালা 
কোলেপিঠে মানুষ করার দহন 
আকাশ ভাঙা জলঝুপ্পুস ঝড় মাথায় তুলে। 
 
তখনও মা সজাগ  
রাখতে আরোগ্য নিরাময় 
স্নেহ মমতার অন্তঃস্থলে আগলে আমায়  
আমার অনেক অকাজ জেদের আবোল তাবোল ভাঁজে।  
মায়ের লহুগতর  
হিমশিম দু’হাত অষ্টপ্রহর আমাকে শুধু মানুষ করার কাজে।  
 
ইদানিং ব্যতিব্যস্ত আমি নিজের স্বার্থের কাজে 
পেলেই অবসর বেশ কাটে সময় বউ ছেলের কাছে 
নিজের সংসারের রোজকার কলহ গিলতে না পেরে
শেষমেশ দ্বন্দ্ব কাটিয়ে 
দ্রুত হাতে 
গলগ্রহ মাকে 
রেখেছি পাশের দেওয়াল লাগা আলোবদ্ধ ঘরে 
ভালো থাকবেন বলেই করে দিয়েছি একঘরে। 
তবু কাঁটাতারের অন্ধকারে মায়ের দু’চোখ অস্থির 
ঘরের চৌকাঠে চৌকাঠে পৌঁছে দিতে শান্তির নীড় 
আশিস মাখা দু’হাতে।   
 

এখন 


মা থুত্থুড়ে প্রায়শ: শুয়ে অবসাদ ক্লান্তির কাঁথায়  
বিড়বিড় করেন মহাভারত রামায়ণ কখনও গীতার শ্লোক শোনান। 
আবার ঠিক সময় ধরে আমার ঘরের একাকীর জীবনযাত্রার পরিধান 
সুঁচ নিয়ে হাতে জীর্ণ দৃষ্টির ভেতর দিয়ে 
প্রযত্নে মঙ্গল সুতো পড়ান 
দু’চোখে রাত জাগান 
আনতে ছেলের সংসারে সুখ সমৃদ্ধির সমাধান।  
 
আজও মা নিয়মিত একলা ঘরে 
নিস্তব্ধ রাত দুপুরে সেলাই করে  
সুঁচ ফুটিয়ে মায়ের 
আঙ্গুলে রক্ত পড়ে  
চোখের জল পড়ে না 
আমি গায়ে সুখের দামী পোশাক পড়ে  
বলতে লজ্জা করে,
মা তুমি ভালো থেকো। 
মা তুমি ভালো থেকো।  
 

চৌকাঠ 


কটা ঘরে 
অনেকদিনের সংসার 
কাটিয়ে এসেছি দু’জনে।
 
বেশির ভাগটা রমণীর গুণে। 
 
এক কাঁথায় শীত ভাগ করে 
এক কাপড়ে সুখ দুঃখ ধরে
রেখেছি বেঁধে হৃদয় হৃদয়ের স্পন্দনে। 
 
বেশির ভাগটা রমণীর গুণে। 
 
এক চুটকি 
সম্বরার ঝাঁজে গোটা সংসার। 
এক মুচকি 
হাসির ভাঁজে গোটা সংসার। 
 
বেশির ভাগটা রমণীর গুণে। 
 
দিনযাপন আলাপনে 
বিয়ের বাসন কোসনে 
এক বাক্যের শাসন
এসো ঘরে
বসোনা চৌকাঠ ধরে 
সুখশান্তি চলে যায় অন্য বাড়ির উঠোনে।
 

খারিজ বাক্যিলাপ
 

নেক গাছ পুঁতলাম  
সময়মত রোদ জল দিলাম  
তোর নদী থৈ থৈ করে আর বাড়লো নাতো।

খুশির গতর দিলাম  
বছর বছর পোয়াতি হলাম   
তোর সংসার ফলবন্তরমণ আর হলো নাতো।

চিঠি পত্তর দিলাম  
অশ্রুজলে চোখ ভাসালাম  
তোর জ্বালাপোড়ায় দোসর আর পেলি নাতো।

অগাধ উপায় দিলাম 
সব দোষ ত্রুটি ঘাড়ে নিলাম  
তোর পকেটে সততা খুঁজে আর পেলি নাতো।

কতো পাথর ভাঙলাম 
বাঁঝামাটি কেটে ফসল ধরলাম  
বুকের পাঁজর ভেঙে হৃদয় আর পেলি নাতো।
 
সম্পত্তির সিন্দুক দিলাম 
সৎসঙ্গতির বাসিন্দা দিলাম 
তোর মনুষ্যত্ব জাগান দিতে আর পারলি নাতো। 
 
প্রচুর দৌলত দিলাম 
সকালসন্ধ্যে সেলাম ঠুকলাম  
তোর খোদার পদচারণ মাটিতে আর পড়লো নাতো। 
 
এখন অবসর দিলাম  
সব দরজা দুয়ার খুলে দিলাম 
তোর হুইলচেয়ার ছেড়ে উঠতে আর পারলি নাতো।
 

জানিয়ে রাখা ভালো

ন্দ্রিমা 
তুমি ও সুখে 
আমিও সুখে 
জানিয়ে রাখা ভালো তোমার ভালোবাসা 
পাথরের পাষাণে সোহাগের আসন পাতা   
কাঁসার বাসনে ফুলের অমূল্য সুবাস 
ভোরের শিশিরে লজ্জানত শীতল দুটি হাত 
মন্ত্রের পবিত্রতার অক্ষরে অক্ষরে বেঁচে থাকার সমস্ত প্রপাত 
শীতের দুপুরে নিখাদ রোদ্দুর ভালো থাকা সুখ শান্তির ছলাৎ। 
ঘরদোর উঠোন চৌকাঠ লক্ষ্মীর দু’চোখ সচ্ছলতায়  
ফুলের গন্ধ বসন্তবিহীন বনান্ত নির্ভেজাল হাওয়ায় 
শাঁখা সিঁদুরে শরীরের ভেতর শরীর মাতানোর রমণ প্রবণ 
অঞ্জলিতে অঞ্জলিতে সব অন্ধকার নিংড়ে আলোর শোধন  
সন্ধ্যাবাতির অহংকার ভেঙে নিস্তব্ধ রাতের মদির শয়ন। 

জানিয়ে রাখা ভালো 
জেনেছি তোমার বুকে শুয়ে 
খুব সহজ ফুল ছিঁড়ে আনা, ফুল ফোটানোর কষ্টখানা 
অন্যের দুঃখব্যাথা নিমিষে জলের মতন করতে জানা 
আকাশের চেয়েও ভাস্বর তোমার রূপ  
অরণ্যের চেয়েও নিবিড় প্রেয়সী বুক 
রঙিন উচ্ছ্বাসে 
যথাযথ দেখেছি তোমার গোপন গোপনে 
গহনের নন্দনে সন্ধ্যাকাল তৃপ্তির ঘাম
ভালোবাসা দহন যজ্ঞ -চিরন্তন নিষ্পাপ নাম 
সুখী ঘুমের স্তনের বোঁটা
আমাদের সংসার গোটা 
সুখ আছে বেঁচে বিনোদনের মহার্ঘ আবহ নিয়ে 
ফিরে আসি কলঙ্ক ধুয়ে অধিকারের রঙ দিয়ে
তোমার নিকানো উঠোনে নিয়েছি দিব্যি দু’জনে
প্রজাপতির রঙ বাহারি যৌবনের প্রত্যূষ গহনে 
জন্মান্তর ধরে তুমি হবে জননী আমি হবো পিতা 
সন্ততির সশ্রদ্ধ হাতে উঠবে জ্বলে শান্তির চিতা । 
 

কষ্ট

মার দু’হাতে তোমার স্পর্শের গন্ধ লেগে আছে
গন্ধের সুবাসে 
তাই এখনও আমি জীবিত।
আমার বুকে তোমার ঠোঁটের আকর্ষী লেগে আছে 
আকর্ষীর সুবাদে 
তাই এখনও আমি জীবিত।
ঘাসের নরম শিকড় ছিঁড়ে, অভিমানে... বাইরে চলে যাচ্ছ?

যাও তবে। 
অনেকদিন তো হলো সঙ্গে ছিলে ঘর-গেরস্তির সত্যিটুকু জড়িয়ে কবে? 

আকাশকে সাক্ষী রেখে নিশীথে সাজানো গোছানো মাহফিলে 
তোমার মনপসন্দ একগুচ্ছ কবিতা পড়ে শোনাবার কথা নয় 
তবু পড়ে চলেছি।

আবেগ মুছে রুমালে।

সবার তো সব পাওয়া নয়। 

আলোর আশাতীত কাজলে
ক্রমশ হাওয়ার আস্পর্ধায় কবিতার ঝনৎকার ভেঙে নিভৃতে 
পাগলের মতো খুঁজে যাচ্ছিলো চুকেবুকে যাওয়া ভালোবাসা। 

দিনদুপুরের আড়ালে 
দাঁড়িয়ে আছি আয়নার সমীপে আমাকে তোমার মতো করে নাও।
অন্ধকারে দুঃখের দিয়ার সলতে আগুনের আলোতে পুড়তে দাও।
আমার কষ্ট তোমার অন্তরের পর্দায় লেগে আছে
কষ্টের নিহিতে 
তাই এখনও আমি জীবিত।

 

স্বস্তি 

দি ফিরিয়ে দাও
তবে বলো। কোথায় যাবো!
পায়ে পায়ে বিপণ্ণতা, ব্যর্থ আমার কবিতা
শ্রাবণভরা দিনেও তীব্র দহন বৃষ্টির জ্বলন 
দুঃখগুলো তৃষ্ণার সংশয়ের কাব্যমরণ।  
যদি ফিরিয়ে দাও,তবে বলো। কোথায় যাবো!

অনেক আগেই কলম নিয়েছে ফিরিয়ে মুখ 
চৌকাঠ থেকে তুমিও যদি ফিরিয়ে নাও মুখ 
তবে বলো।

কোথায় দাঁড়াবো! 

অহংকার পুড়িয়ে এসেছি নিজেরই অন্তঃপুরে 
শোণিত স্রোতে ভাসিয়ে দিয়েছি জীবন জুড়ে 
লজ্জায় নত মাথা আলোর বিহানে নিশ্চিন্ত অনাবিল নিঃস্বতার গানে। 

এবার অন্তত একটু স্বস্তি না দিলে 
অনিবার্য মৃত্যুর বুকে কি করে ফোটাবো আমার কবিতার   
শব্দে প্রাণবন্ত জোর।  
ভোর করে দেওয়ার মতো ডাকে নিয়ত নামিয়ে আকাশ
ভুবনজোড়া ভোর। 


কবির মৃত্যু নেই 

র কবিতা লিখে উঠতে পারিনা। 
তবু লেখার কলম একলা ছেড়ে যেতে পারিনা। 
যদিও নিঃশ্বাসের উচ্ছ্বাস বুকের পাঁজর ভেঙে শব্দেরা  
উদ্বাস্তু আঙুলের স্পর্শ নিতে আর উৎসাহী নয়। 
কবিতার খাঁচার ভেতর আকাশ তেমন নয় বলে...

এক এক করে শব্দেরা ঘর ছেড়ে চলে যায় 
নিজের নিজের মৌচাকের বাসিন্দায় 
গুঁজে অজস্র সখ্যতার শর্ত বালিশের তলায়। 

রোজ দু’বেলা শব্দ খুঁজে বেড়াই   ... 
এখানে সেখানে সাজোর বিলাসে।

জ্যোৎস্নার আঁচে। 
প্রেয়সীর সহবাসের গন্ধে।

সকালের অগোছালো বিছানায়।  
বাসি কাপড়ের কোঁচড়ে।

ঘরদোরের ধুলোঝড়ে।

এঁটো বাসনে। 
উঠোনে পড়ে থাকা রোদের উত্তাপে।

চায়ের চুমুকে।

চুপ চুম্বনে।  
স্নানের নগ্নতায়।

প্রণামের আঙুলে।

সংকোচের  কাঁচে।
আড়ালে বুকভারি বারবনিতার দোরে।

নির্বিশেষে ‘ইউজ মি’ ডাস্টবিনে।  

প্রকৃতির দু’হাত ছুঁয়ে যায় আমার কবিতার শেষ পাতা। 
রেখে যায় তার চোখের দৃষ্টির ছাপ।

স্পর্শটুকুর অধিবাস। 
নিঃশব্দতার নির্নিমেষ কোলাহলে জানিয়ে যায় দুর্দিনে  
দুর্যোগে প্রতিবাদী হও।

না হলে তোমার একদিন সর্বনাশ। 
 
বৃষ্টি এসে ধুয়ে যায় কথার নিমিষহারা সোহাগ। 
কবিতারা সুখে আছে।

জীবনে আরো কিছু খোয়াক মেনে। 
আমি আজও শব্দ খুঁজে বেড়াই কবির মৃত্যু নেই জেনে। 

Comments

Top

কবিতা

ডঃ বিদ্যার্থী দত্ত

ডিপার্ট্মেন্ট অফ লাইব্ব্রেরী অয়ান্ড ইনফরমেশন সাইন্স 

বিদ্যাসাগর ইউনিভার্সিটি 

মেদিনীপুর, পশ্চিমবঙ্গ

কবিতাঃ বিদ্যার্থী দত্ত

রক্তকরবী  

 

কশো বছর আগের একটি দিনে
এমনি করেই ফুটেছিল তুমি,
জোড়াসাঁকোর মূল ফটকের পাশে
রেণু তোমার ছুঁয়েছিল ভূমি।

লোহালক্কড় হাজারটা জঞ্জাল,
ধুলোয় ঢাকা ব্যস্ত সে চিৎপুর,
তারই মাঝে ছোট্ট সবুজ দোলায়
লাল কুঁড়িটি হাসছিল ভরপুর।

হঠাৎ তোমায় দেখতে পেলেন তিনি,
শুনতে পেলেন তোমার মনের কথা,
মিষ্টি হেসে শুনিয়েছিলে তুমি -
"যতই আনো যন্ত্র হেথা হোথা,
পারবে না কো তবুও কোনো ভাবে,
থামিয়ে দিতে ছোট্ট আমার প্রাণ",
তখন তিনি বলেছিলেন তোমায়,
"বন্ধু তুমি অনন্তেরই দান"।

অমর তিনি করে গেছেন তোমায়,
আজও শুনি তোমার কথা তাই,
নন্দিনী আর বিশুপাগলের সুরে,
রোজই তোমায় নতুন করে পাই।

তুমি আমার সাতসকালের সখা,
তুমি আমার সাগর-বুকের ঢেউ,
আড়াল থেকে রঙ্গন যায় হেসে,
রাজার ডাক কি শুনতে পেল কেউ?

ডাকঘর


পাঁচমুড়ো পাহাড় থেকে রাস্তা একটা
এঁকেবেঁকে চলে গেছে
শ্যামলী নদীর দিকে,

নদীর ঘাটে এলাম,
স্মৃতি হয়ে এল ফিকে;
পশ্চিমের আলোয় মাখা
সোনালী ধুলোর রেখা
লুকোনো মুহূর্তের নুড়িগুলোয়
ভরসার রঙতুলি ছুঁয়ে যায়;

এতদিনের বন্ধ দরজা
হঠাৎ খুলে যায়;
দূরের ঘর থেকে
ডাক শোনা যায়;

সেটাই কি তবে ডাকঘর?

যত্নে রাখা রঙপেন্সিলে ফুটে ওঠে
আত্মার চেয়ে থাকা,

কবিরাজের পাঁচিল ডিঙিয়ে
ঠাকুরদার পাখার ঝাপট
সুদূর ক্রৌন্ঞ্চদ্বীপের সংকেত নিয়ে
দরজায় কড়া নাড়ে -

অদৃশ্য আলোর চিরাগ জ্বলে,
সাঁঝের আকাশ লাজে পরকাশি,
বুকের দীঘিতে লাল শাপলার রাশি
ধূর্জটির দিকে চেয়ে পার্বতীর হাসি,

ছোট্ট সুধার কথা মনে আছে -
আমাকে ভুলবে না কোনো ও দিন।

postman.jpg

Comments

Top

কবিতা

সাত্যকি (পলাশ দাস)

ঋষি অরবিন্দ সরণি, সরকার বাগান

বারাসত, কলকাতা

কবিতঃ সাত্যকি

মুখ

ক ঝলক রোদ ওঠে
ফিকফিকে হাসির মতো বৃষ্টি হওয়ার পর 
চাঁচের বেড়ার ফাঁক থেকে 
রোদ ঠিকরে পড়ে ভিজে যাই
গায়ের রোমে জমে থাকা জল চিকচিক করে 
এক পুকুর জল ছলকে ওঠে বুকের কাছেও 
ভেসে ওঠে একটা মুখ 
দুর্দিনে যে ভাত দিয়েছিল 
মাথার উপর ধরেছিল ছাতা
এই সুদিনে জলে ভেসে ওঠে তার মুখ 

অভিমান

কিছু অনুযোগ আর বেশ কিছুটা অভিযোগ
আমার দিকে ছুঁড়ে দিয়েছিলে 
হয়তো কিছু না ভেবে 
হয়তো অনেক কিছু যোগ বিয়োগের পর 
কখনও কি ভেবেছিলে 
কিসের জন্য তোমরা লড়ছো 
যেখানে সবটাই তোমাদের আর বাকিটুকু 
আশ্চর্য অঙ্গুলিহেলনে সীমাবদ্ধ থাকবে 
আমারও একটা মন ছিল সেখানে 
কিছু স্বপ্নেরা বাসা বেধেছিল
তোমার এই কুঁচলে দেওয়া 
জিতে যাওয়ার অভ্যাসের বাইরে থেকে 
আমার অন্যভাবে আকাশ ছোঁয়ার ইচ্ছে ছিল
ভেবেছিলে তোমার মতো আমার স্বপ্নদেরও 
বেঁচে থাকার পূর্ণ অধিকার ছিল।

বনসাই ঠেস দিয়ে 

 

টুকরো টুকরো অন্ধকারগুলোকে 

গুটিয়ে এনে বিছিয়ে দিয়েছি চাঁদের নীচে

চাঁদ দুমড়ানো গামলার মতো চেয়ে আছে

ঘাসের উপর মাথা রেখে শুয়ে আছে 

শিশিরের গন্ধে ভিজে যাচ্ছে শরীর 

বনসাই মূলে ঠেস দিয়ে 

কলমি ফুলের থেকে গল্প শুনছি 

প্রজাপতির আর ফড়িংয়ের 

রাত আরও গভীর হলে 

কলমির গায়ের গন্ধ আরও 

বেশি করে মাটিতে নেমে এলে 

দেখেছি টুকরো অন্ধকারগুলো 

মুক্তো হয়ে গেছে...

Comments

Top

কবিতা

জিনিয়া চৌধুরী

কবিতাঃ জিনিয়া চৌধুরী

মানব বাহনে ভাইরাস

ভাইরাসটা যদি কাকের শরীর বেয়ে আসতো,
তবে-সকল শহরের আকাশ করা হতো কাক মুক্ত।

শত-শত কাকের লাশে ভরে উঠতো ভাগাড়গুলো।
প্রাণঘাতী অসুখটা যদি আদরের কুকুর, বিড়াল কিংবা খাঁচায় পোষা পাখিটার গা বয়ে আসতো,

তবে পাখি শূন্য হয়ে যেতো খাঁচা।

বাঁচা নিশ্চিত করতে মানুষেরা কুকুরের পালে দিতো হানা, বেড়ালের দুধের বাটিতে মিশাতো বিষ।
ভাইরাসটা যদি ইঁদুরের গা বয়ে আসতো তবে হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা ডাকা হতো,

ঝাঁকে-ঝাঁকে ইঁদুরেরা আত্মাহুতি দিত অলকানন্দার জলে!!
মহামারীটা এসেছে মানুষের গা বেয়ে!!
মানবিক মানুষেরা তাই মানুষকে বাঁচাতে খোঁজে শ্বাস।

খোঁজে আকুতি, খোঁজে বিশ্বাস, খোঁজে যন্ত্র, খোঁজে মন্ত্র...
আরশোলার মতো গৃহকোণে খোঁজে আশ্রয়, বাঁচার আকুলতায় ঝাপটায় ডানা,

কখনো নিঃশব্দে-কখনো সশব্দের আকুতি।
কাক, কুকুর, বিড়াল, ইঁদুরের মতো তাদের আত্মাহুতি কাম্য নয়,

কারণ প্রতিটি মানুষ মানেই বুঝি এক-একটি জীবন।

এক একটি অনন্য গল্প।
আমরা মানুষকে সংখ্যায় গুনিনা,অথচ আমরা মানুষেরাই সংখ্যায় গুনি

ফাঁদে পড়া ইঁদুর, খাঁচায় পোরা পাখি, রাস্তায় খোলা বেওয়ারিশ কুকুর...!!

crow.JPG

Comments

Top

কবিতাঃ কুমকুম বৈদ্য

কবিতা

কুমকুম বৈদ্য (করিম)

সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার

এরিক্সন ইন্ডিয়া গ্লোবাল সার্ভিসেস প্রাইভেট লিঃ

জীবন যাপন
 

ব তারা খসা হয়ে গেলে
অমাবস্যার রাতে
বসব দুজনে খোলা আকাশের মুখোমুখি
তোমার খোলা কবিতার খাতা
আমার ভাব সম্প্রসারণ
দেবদারু গাছে ঝুলে থাকা বাদুরের ডানার ঝাপট
উগ্র চাঁপার গন্ধ
বেহিসাবি রাত কাটাবো দুর্ধর্ষ

মেঘ ভেজা আপসের দিন
গরম ভাতে ইলিশের সুবাস
আলস্যের আলতো দুপুর
কার্নিশে কাকভেজা কাক
ডান চোখে বিপ্লবের আশ্বাস

ভ্রমণ
 

তুমি যদি কোথাও যাও, বেশ একটু দূরে
ফেরার সময় কি আনবে মুঠোয় তোমার ভরে?
নতুন ধানের কুঁড়ো এনো হেমন্ত কাল হলে
বর্ষাকালে বৃষ্টি এনো পদ্মপাতায় মুড়ে
গ্রীষ্মকালে ঘেঁটু এনো,
উষ্ণতা শীতকালে
মনখানি খুব রাঙিয়ে এনো বসন্ত কাল হলে।
চিরকুট:মনে গ্রীষ্ম, বর্ষা, হেমন্ত, শীত, বসন্ত

- এদের যে কোনো পারমুটেসান চলতে পারে।
আর শরতটা পুজোর ছুটিতে পুজো সংখ্যা লিখছে
আর গ্রীষ্মের ঘেঁটু আসলে ঘেঁটু ফল।

স্পর্শ
 

মায় স্পর্শ করে সকালের রোদ্দুর
কিম্বা পূর্ণিমার জ্যোৎস্না
অথবা উড়ে আসা ধূলো
নিদেন পক্ষে আমার পায়ের চটিজোড়া
যাদের কারোর প্রতি আমার স্পর্শকাতরতা নেই!

অভ্যাসের ভালোবাসা
শ্রমিকের হেঁটে আসা
নিঃসঙ্গ বন্দি জীবন
এদের প্রতি আমি স্পর্শকাতর নই?
স্পর্শ এখন নিত্য প্রয়োজনীয় নয়

তাই আমার মৃত্যু সংক্রান্ত উইল কাগজের লেখনী নয়..
শ্যাম্পু করা ঝরে যাওয়া এক গোছা চুল-
স্যানেটাইজ করা হাতে কাগজে মুড়ে
২ নম্বর বইয়ের আলমারির ৪ নম্বর তাকে
অপারেটিং সিস্টেম আর ম্যাক্সিম  গোর্কির ফাঁকে
যত্ন করে রাখা আছে।

কোনোমতে মরে যদি যাই,
বেওয়ারিশ লাস হতে দিয়ো আমায়।
মৃত্যু সংবাদ দিয়ো না কাউকে
শোক যেন নাগাল না পায়।

কোনোমতে বেঁচে যদি যাই
সমস্তরকম স্পর্শকাতরতা ফিরে পাই
তবু ও থাকবো আমি স্পর্শহীন -
গভীর এক প্রেমের অপেক্ষায়

touch.jpg

পালকে শকুন হবার ডাক
 

সেই যে জন্মে আমরা গাংচিল ছিলাম
মনে আছে আলি আকাশের গায়ে-
আঁশটে গন্ধ পেতাম
আর স্বর্গের সিঁড়িতে দাঁড়াতেন শিব
ডমুরুর তালে তালে উড়ে যেতাম আফ্রিকার নীলে

আর যে জন্মে উটপাখির ঠোঁট
গতিশীল উষ্ণতা
নামবিয়ার সশস্ত্র সংগ্রাম

ডানাতে লেগেছে টান
আর এক জন্মের আহ্বান
পালকে শকুন হবার ডাক
এক আকাশ উঠোনে পড়ে আছে লাশ।

Comments

Top

কবিতাঃ পীযুষকান্তি দাস

কবিতা

পীযূষ কান্তি দাস

কবিতা

সন্দীপ মিত্র

পল্লীশ্রী, কলকাতা

কবিতাঃ সন্দীপ মিত্র

পরিচিতিঃ জন্ম - অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রাম। ইচ্ছা ছিলো সাহিত্য নিয়ে পড়াশুনা করে শিক্ষকতাকে পেশা হিসাবে নেওয়া। কিন্তু বাস্তবতা আর নিয়তি টেনে নিয়ে গেল অন্যপথে আর পেশা হল স্বাস্থ্যকর্মী। দীর্ঘ চল্লিশ বছর পেশার চাপে সব রকমের সাহিত্য থেকে বহুৎ দূরে। পরে একটু অবসর পেয়ে ভার্চুয়াল বন্ধ।

কলকাতা তুমি

তুমি আজো একই রয়ে গেলে -

আজো রাজপথ জুড়ে চলে 

লাল - সবুজ - গেরুয়া - তিরাঙ্গার মিছিল!

আজও ফুটপাতে বালিকা - হয় যে ধর্ষিতা 

তুমি চুপচাপ - বিবেকের ঘরে দিয়ে খিল।

চৌত্রিশ বছর ধরে বন্ধ্যা হরতাল 

অজস্র ঘটনার ঘনঘটা!

ভেবেছিলো মানুষ - বদলে যাবে প্রেক্ষাপট 

সরে যাবে তমসা - ফিরবে সুদিনের ছটা।

দিন যায় -- মাস যায় --

অর্ধযুগ অতিক্রান্ত হয়,

যেই তিমিরে ছিলে তুমি

আজো দেখি সেই তিমিরই রয়।

লোক পাল্টায় --- নীতি পাল্টায় 

পাল্টায় না মানুষের কপাল।

"কালো" "কালো" রব ওঠে চারিদিকে 

কবে ফিরবে - সাধারণ মানুষের হাল?

আজো মিথ্যে স্বপ্ন দেখায় কতই 

প্রতারিত লোক দিকে দিকে,

"অন্ধাগলি"তে হাতড়ে বেড়াই 

কি করে রয়েছি আজও টিকে?

আরো কতযুগ - আরো কতকাল 

লাগবে ঘোচাতে দৈন্যদশা?

নাকি তুমিও পড়বে ভেঙ্গে 

বেকার যুবকের মতো -

গ্রাস করবে তোমারেও - সুতীব্র হতাশা?

kolkatas6.jpg

বিষাদনগরী

বেচারা শহর
অভাগা শহর
চোখ মেলে আছে
মধ্যরাতেও
আড়মোড়া ভেঙে
রক্তচক্ষু
জমেছে পিচুটি
চির বুভুক্ষু 
পদাঘাতে আর 
চাকার মিছিলে
রণক্লান্ত
ব্যধিতে জড়াতে
ভীতির কুয়াশা
আপাদমস্তক 
ঢেকেছে চাদর

গন-অনাদর
মানুষে মানুষে
দূরত্ববিধির
ঝুলছে ফতোয়া
আনাচে কানাচে
বিষ-বাতাসের
স্বৈরাচারের
হলুদ দূষণ 
কল্লোলিনীর 
আনন্দস্নানে
সহসা আনত
অ্যাসিড বৃষ্টি
প্রাসাদ নগরী
অশ্রু সিক্ত।

riksha3.jpg

Comments

Top

কবিতাঃ বিপাশা চৌধুরী

কবিতা

বিপাশা চৌধুরী

মহারণ্যে মহাকাব্য

 

কাশের রং কাকের ডিমের চেয়েও কালো।
এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা গ্রাস করে নিল পুরো পৃথিবীটা।
দু এক ফোঁটা মুক্তধারা নেমে এসে মাটির শুষ্কতাটাকে এক্কেবারে শুষে নিয়েছে।
সোঁদা গন্ধ গ্রাস করেছে কামিনীর কাম বাসনাকে।
হাঁটু মুড়ে বসে থাকে বুনো শালিকের দল।
জল গড়ায় পাকপাখালির ডানায়।
চঞ্চুতে জল নিয়ে উরে চলে বাবুই আর ফিঙে।
অদ্ভুত রহস্যময় অভিযাত্রী দলের কালো পতাকা হাতে এগিয়ে যায় কোকিল।

হাড়ির ভিতর টগবগ আওয়াজ...
চালের অভাব ভুলে, একাকী জল ফোঁটার শব্দ।
শেষ ভাত খেয়েছিল কবে, কে জানে ?
অভাব ভুলে স্বভাববশত সেই শব্দেই শান্ত খুৎপিপাসাচ্ছন্ন শিশু।
বুনো ফুলের মতই শান্ত অথচ উগ্র তার সুবাস।
হয়ত কোনো অজানা ঝরে,অন্য এক বীজ উড়ে এসে সুপ্ত হয়েছে গর্ভে।

অন্ধকারের জরায়ু ছিঁড়ে দু এক ফোঁটা রৌদ্র রস মাটিতে ঝরে পড়ে।

চিরহরিৎ এর ঔপনিবেশিকতার কাছে হার মেনে ক্লান্ত সে।

দূর থেকে ভেসে আসে মজা নদীর হুহু ক্রন্দন ধ্বনি।

ডুরে পাড়ের শাড়ি গায়ে, মাছ ধরতে নামে মাছরাঙা।

মাঝে নৈঃশব্দ....আর কয়েকটা বন্য স্বপ্ন তাজা হয়ে থাকে।

লাশ 


কাটাছেঁড়া আমি
লাশকাটা ঘরে, একা পরে আছি..
হিম ঘরের গুমোট মেজাজ..
আর ঠান্ডা হাওয়ার গন্ধ!
ধারালো ছুরির চকচকে মসৃণতা,
গলার কণ্ঠী থেকে তলপেট বরাবর ফাঁক করে দিয়ে গেছে!
এই গলার সুরও কবে-কাকে জেনো পাগল করে গিয়েছিল।
দেহের ভিতর প্রতি মুহূর্তে খেলে যাচ্ছে শিহরণের ঝিলিক!
বন্ধ হয়ে যাওয়া হৃৎপিণ্ড ঘিরে রহস্যের মাতামাতি।
তরলতা ভুলে ধীরে ধীরে জমাট বাঁধতে শুরু করেছে রক্ত।
লাশকাটা ঘরে কাটাছেঁড়া আমি, আর কয়েকটা মুহূর্ত!
এ জেনো নৈশব্দ দিয়ে মোড়া এক রত্ন পেটিকা।
ধমনীর নীল রঙে, মেদ এর ছিটে জেনো মুক্তোর ঝিলিমিলি।
এ জেনো সহস্র পোখরাজ, চুনি পান্নার সমাহার।
ছুরির মসৃণ আঘাতে একের পর এক উদঘাটিত রহস্য..
রহস্য নয়, সমাধান!
করাতের দাঁত একবারের চেষ্টায় আলগা করে ফেলেছে নিশ্চিন্ত খুলিটাকে।
খোলসের ভিতরে দিব্য চিরঘুমে সুসজ্জিত ঘিলু।
শুধু একটাই চাওয়া বার বার পাক খেয়ে মরছে।
ডাক্তার আমি তো বাঁচতে চেয়েছিলাম..!

Comments

Top

কবিতা

সজল খোরশেদ

কবিতাঃ সজল খোরশেদ

শব্দাবনি
 

ঙিন বেসাতি বলয় প্লাবনই হে শব্দগুচ্ছ অবনি
স্বপ্নের বুঝি রঙ খোঁজ তুমি ঐকান্তিক রৈখিক মলয়
উড়ন্ত লাল নীল খয়েরী প্রজাপতির আজন্ম স্নানের জয়
দিন আর রাতের অধরে এ বিচরণ, তরঙ্গ ধ্বনি
 
ভূযুদ্ধ মাখানো রঙধনুর তবুও আগমনী বারতা
মায়াবিনী পুকুরে অগণিত ফুটন্ত জলপদ্ম
বিমুগ্ধতার শবাসন বেসে এই তো সত্য
প্রেম চাই, তাই ভ্রান্তি বিলাসে তোমার দুরন্ত নগ্ন
 
অশথ গাছের ছায়ায় বসেছে সহস্র প্রেতাত্মা
ওসবেরা আমার নিউরন তটিনীতে বাঁধে বাসা
হোমস্যাপিয়েন নক্ষত্র আলোয় এ ইজেল চাষা
তোমার ময়ূর পেখম ও নশ্বরীর ভৌগোলিক যাত্রা
 
কাব্যচিত্র অতঃপর পূর্ণাঙ্গ মানচিত্রের ধমনী প্রভাত

সীতার শরীর গড়ানো জলশব্দ চলছে ধেয়ে স্বপ্ন স্নাত

শুভ্রসিতা

 

বাসতাম ভালো, এখনো কী আমি ভালোবাসি

ঐ ধোঁয়ার কুণ্ডলীকেরাশ পূর্ণিমা বেঁধেছে বাসাশরীরে তোমারকেলীমগ্না এ ধরিত্রী বুকেকলা কৌশলীর অনুভবযাজকই পবনে মনহরি হেঅনন্তের উঠোনে এই আমৃত্যু খেলা প্রসাদপাত্রের এতোটা প্রেমকোন মন্দিরে ভজিবে তুমিখন্ড খন্ড এ মৃত্যুর জন্যই আমি কতকাল করেছি প্রার্থনা বিগব্যাণ্ডে জন্ম নেওয়া বিস্তর এ পাত্রের চুম্বনে চুম্বনে পরে আছে দেহ

ক্রোমোজোম সাগরে,

শূন্য কফিনের পার্শে বসে তুমি

মেলাচ্ছ ইতিহাস পাতা

পরিচয়ের ‘প্রাথমিক পর্ব‘ অতঃপর নিদিষ্ট হলো
ঐ শূণ্যতা পূরণের সকল গুণে গুণান্বিত আমি
কফিনের পর্দা’র নিচেই শুভ্রসিতা
রাখছি আমার শ্রেষ্ঠ পাণ্ডুলিপি


বঙ্গমাতার কিন্নরী এ তটে জলের মহাসমারোহ
কৃষকের অস্থি মজ্জা তলে গেছে ভবিষ্যৎ
বীজভূক্ষ বিস্তর মাঠ প্রতীক্ষায়
পলিজমা বুকে ঘটবে আবারও সবুজ প্লাবন
গ্লোবালাইজেশন উধ্গিরীত লাভায় ঝংকৃত
এলে ‘উর্ণনাভ’ তুমি
বেকনের ‘মৌমাছি’ রূপেই আমি দেখি কিন্তু
বৈভবী এমন শরীরী সত্ত্বা
নয় সে কখনো ----------

শুভ্রসিতা

প্রকৃতির প্রাণে মুক্ত অশরীরী সত্ত্বায়
রূপ দেখি তার
প্রীতির দৃষ্টি রেখায় ও আমাতে কেলীমগ্না
কী উন্মাদিনী স্পর্শ
পঞ্চ ইন্দ্রিয়ে ধ্বনিত সেই গান
সুর পেতে চলে টেবিলে আমার

প্রবাহমান এখনো মাতোয়াশির জলকান্নার চিহ্ন বিধৃত ইতিহাস পাতায়

অনেক অনেক যু্দ্ধ সভ্যতার কার্নিশে

ঘুমন্ত শিশুর দোলনার পার্শেও

আমরা সবাই পরিবর্তনে বিশ্বাসী

পরিবর্তন মৃত্যু কূপের বিনিময়ে

পরিবর্তন ধ্বংসের বিনিময়েকবির কলম কী নয় শক্তিধর যুদ্ধের চেয়েশিল্পীর তুলির রঙ কী নয় শান্তির মহার্ঘ বাতায়ন

ফিরে আসি ভীষণ যন্ত্রণা- মুক্তির পাথেয় রূপেশুভ্রসিতা তোমার কাছে শুধুছড়িয়ে দাও তোমার পরিহিত ওড়নার অবশিষ্টাংশদৃষ্টির ‘পরে

সভ্যতা পরিবর্তনের ইজারাদার বৃটেন

এ্যালেন্সগিন্সব্যার্ক – ইতিহাস অজ্ঞ
তোমার জন্মভূমি
গিলতে থাকলো আবারও রঙধনুর সাতরং

ছড়িয়েছো এ কোন বিষ হৃদয়ে আমার
বিষাদের জিরাফ গৃহ্বায় অনুভূতির সতেজ তৃণ
বিচূর্ণ দন্তাঘাতে, আধফালি চাঁদ নিয়ে ওপাশে
দাঁড়িয়েছে  আকাশ -অথচ
আমি তাকাতেও পারছি না
খাবার টেবিলে বসছিলাম এই
একটু আগে; এরই নাম কী প্রেম
উফ এতোটা কঠিন নয় মৃত্যু যন্ত্রণাও
হুমড়ি দিয়ে ঢুকছে প্রেম, আশ্চর্য এতোটুকু ঘড়ে
ঠিকানা ভুল করেছো বুঝি
কত নাম্বার রোড- বলো বাড়ী নাম্বার কত
কোন গলিপথই অচেনা নয় এ শহরে
দিতে পারি পৌঁছে নিশ্চিত
তোমার আপন ঠিকানায়


সারাতে পারবো না আর অতীতের ভুলগুলোকে
তোমার স্পর্শ অনুভূতিরা এখন হৃদয়ে
রঙধনু আচ্ছাদিত মন্দির
শব্দ ও ছন্দের মহতি  মেলায় ক্ষয় হোক
আমার এই একটি জন্ম
সভ্যতার উত্তরের জানালায় এগিয়ে  আসছে
গুটি গুটি পায়ে যে শিশু
চুম্বন আঁকানো আদরের এ পাত্র
হাতে দিও তার গাঙে নতুন জোয়ার
কখনো লুম্বিনি গাঁয়ের বাতাসে শুভ্রসিতা
শুকে যায় যদি তোমার এ পারফিউমের ঘ্রাণ
পৃথিবীতে বসন্ত আসার পূর্বলক্ষণ-
প্রজাপতির ডানায় আবারও,
শিল্পীর নতুন তুলি নতুন রঙের ছোঁয়া
গুড় গুড় শব্দে মেঘের কবিতা আবৃতি
আমার পাণ্ডুলিপি তখন ভিজছে বৃষ্টিতে
আর তোমার শুকনো শেমিজ তুলবার তাড়া

কবিতাঃ জীৎ ভট্টাচার্য্য

কবিতা

জীৎ ভট্টাচার্য্য

Comments

Top

পরিযায়ী  

 

তদিন হলো? এটা কে? কোথায় চললে?
আজ্ঞে বাবু ছেলে আমার, ব্যথা করছে পায়ে তাই কাঁধে 
নিয়ে বেড়াই।
খেয়েছ কিছু? খিদে পায়নি তোমার?
খিদে? খিদে কি হয় বাবু? আমি খালি বাড়ি যেতে চাই।
আমি খালি বাড়ি যেতে চাই,
আমার মা বউ অপেক্ষা করছে বাবু,
আজ দশদিন ধরে আমি আর ছেলে 
খালি খেয়ে আছি ছাতু।
বাড়ির দাওয়ায় হয়ত মা বসে আছে,
হয়তো বুড়ো বাপটা আরো অন্ধ হয়ে গেছে
জানিনা তারা কিছু খেয়েছে কিনা।
আমি খালি বাড়ি যেতে চাই।
আমি খালি বাড়ি যেতে চাই।
আর একবার বল তো, একটা ছবি তুলব তোমার?
জানাবো মিডিয়াতে, বলবো করে বাহার।
এই নাও পাঁচশো টাকা, নিয়ে যেও বাড়িতে।
খাইয়ে পরিয়ে রেখো তোমার আহ্লাদীকে।
টাকা নিয়ে হাতে তাকালো আকাশপানে,
আজ দিন এলো ভিক্ষা নিতে হচ্ছে পথে,
তবে পেট যে মানে না, সব রোগের বড় রোগ খিদে।

সরকার তার দরকারে করেছে অনেক ব্যবহার,
অনেক প্রতিশ্রুতি, অনেক চকমকি,
কিন্তু তারা এখন কোথায়?

women.jpg
women.jpg
women.jpg

কোথায় আমার ছেলের ভাতের থালা।

বড় শখ করে নিয়ে এসেছিলাম ছেলেকে দেখাবো

নগর,কত আলো, কত রেস্তরাঁ, কত উঁচু উঁচু ফ্ল্যাট

দেখে ছেলে আনন্দে পাগল।

বলেছিল যাবে না আর পোড়া গ্রামে,

এই শহরেই থাকবে, বড় হবে নতুন নামে।

তবে উঠলো যেদিন এই মহামারীর হুঙ্কার,

সেদিন বললাম, বাবা এবার সত্যি বাড়ি যাওয়া দরকার।

খবরে খবরে গর্জে উঠলো আরো মিথ্যে কান্নার রব,

তকমা লাগলো পরিযায়ী বলে, মিথ্যে অস্তিত্ব সব।

মনে পরে, কখনো আমি গড়েছি তোমার আলিশান মহল,
কখনো আমি তুলি দিয়ে এঁকেছি প্রাণের শহর।
কখনো আবার আঁধার রাতে খিদে মিটিয়েছি তোমার,
কখনো বা ড্রেনের ভিতরে নোংরা হাতিয়েছি সবার।
আমি সাধারণ, আমার ক্ষমতা সাধারণ,

আমার উপার্জন সাধারণ
আমার খিদেও সাধারণ।
আমার রোগ হয়না, আমায় মহামারি ছোঁয়ে না, 
আমাকে রোদ্দুর ঝলসে দেয় না।
তুমি খুঁজে পাওয়া না আমায় ওই রাজনীতির গদি থেকে,
তুমি দেখতে পাওনা আমায় ওই মন্দির মসজিদের চূড়া থেকে।
আমাদের রক্তে সিচে উঠেছে তোমাদের রাজপথ,
আমরা যে আজীবন গোলাম, এই আমাদের জন্মগত শপথ।
এখন আর চাই না কিছু, এখন খালি হেটে যাই
ও ভাই, আমরা খালি বাড়ি যেতে চাই।

Comments

Top

কবিতা

দেবার্ঘ্য চক্রবর্তী

কবিতঃ দেবার্ঘ্য চক্রবর্তী

ময়নাতদন্ত

দীর ওপার জানেনা,
জানতেও চায়না কি আছে;
এদিকের মাটি খুঁড়ে কখনো জানা যায় না 
ওদিকের চাপা পরে থাকা সমাধির 
বেওয়ারিশ গল্প ...
সাদা কোট আর ছুরি হাতে
দরজার পাল্লা সরালেই দেখতে পাচ্ছি 
আগুন জ্বলছে, সাপ লুডো খেলা চিতার শিখায় 
উড়ে যাচ্ছে মানুষের শরীর, 
ছাই র তলায় রন্ধ্রে রন্ধ্রে চাপা পড়ে যাচ্ছে 
থমকে যাওয়া সময়ের শেষ অপেক্ষা .....
বিশ্বাস করতে চাইছি সময় শেষ;
তবু যেন শেষ নেই ....
খালি খুঁড়ে যাচ্ছি তোমার শরীরের একটা একটা অঙ্গ;
ঘাম মাখা হৃদয় আর রক্তমাখা হৃদপিন্ড;
ট্রেন ছেড়ে আজ প্লাটফর্ম ছুটছে, সে আর থামবে না ....
চলে যাবে যতদূর খুশি, যেখানে হারিয়ে যাওয়া দাবি, 
ফুরিয়ে যাওয়া প্রশ্ন শুনবে না কেউ,
আর সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি সেই কিছু ক্ষত,
যেই ক্ষত খুঁড়ে হয়তো কখনো কেউ বসবে

আমার ভবিষ্যতের সাথে অতীতকে মেলাতে;

শরীর টুকরো টুকরো করে দেখবে আমার ধর্ম, আমি সামাজিক না কোনো শীতল শোণিত প্রাণী .....কলকাতা মেডিকেল কলেজের একেবারে ওপর তোলার ঘর নোনাপুকুর মর্গ থেকে বেরোলো শরীরটা,

নিভে যাওয়া আলো আর জ্বলে ওঠা স্মৃতির জন্য আজ তাকে নিয়েই হবে

আমার ময়না তদন্ত 

অর্ধাঙ্গীনি

 

ক্লান্ত শহর, চাদর ঘিরে ঘুমের কোলাজ বোনা;

সময় চলে আকাশ পথে, ঘড়ির অবসরে

নষ্ট হওয়া আলোর নীচে রংমিলান্তি বাতিল;

পোস্টবক্সের সব ঠিকানাই শ্রান্ত হয়ে পড়ে।

 

অন্ধকারের নাগরিকতায় নারাজ প্রজাপতি।

অচেনা পথে দিকভ্রান্তির জমাট ঘন কালো,

জোনাকিরা সেইখানে যায় পথের বাড়ির খোঁজে;

সেই ঠিকানায় ওদের ছোঁয়ায় জ্বলবে শীতল আলো।

 

মেঘবালিকা, নীরা সবার ঘুমপাড়ানির পরে

যে শহরে রাতের বেলা সব যোগাযোগ মৃত-

মিথ্যাচারের রক্তপাতে কলমদানি সাজে

কথপোকথন চলে নেহাত ব্যবহার-জনিত।

 

শহর খুঁজে তবুও যদি সেই জোনাকি আনি,

জেনো আজও খরস্রোতা, স্রোতের অর্ধাঙ্গিনী।

Comments

Top

লকডাউন

লকডাউন

শর্মিষ্ঠা গোষ্মামী

girl.jpg

মনে রাখবেন......

ন ঘন প্রস্রাব 
ঘন ঘন দুঃস্বপ্ন 
ঘন ঘন লুকিয়ে পড়া 
ঘন ঘন বংশ পাল্টানো 
ঘন ঘন শুধু নিজেরটা বোঝা 

যদি এই উপসর্গগুলিতে ভোগেন 
তবে অবিলম্বে যোগাযোগ করুন – 
ডাঃ অবিনাশ দত্ত 
মনে রাখবেন ডাঃ অবিনাশ দত্ত 
যিনি বিনাশ করেন 
যিনি প্রদান করেন 
সমতলজোড়া সমস্ত জ্যামিতি 
এক চুষিকাঠি সব হারানোর ব্যথা 
আর সেটা হাতে নিলেই 
স্বেচ্ছায় ভুলে যায় মাতৃপরিচয়ের প্রথম পদ 
এক লাল-সাদা পোষ মানানো।  

ফড়িং মন
      

থারা পাথর হয়ে বুকে ঘর করে
পাষাণী, তবু তোর ইচ্ছে মরে না!!!
জল ছুঁয়ে গেলে সবুজ ঢল নামে
নিঃশব্দে ভাঙে পাথুরে কল্পনা।

কল্পনার যদি পাখা গজায় তবে
ভাবনার শেষ নেই, অবশেষ তবু
আছে কি উডিয়ে দেওয়ার, মন কি পোষা পাখি?
জানে তবু রঙের এলোমেলো আঁকিবুঁকি।

এলোমেলো রঙের তুলিতেই গজায় ডানা,
মেলে আকাশ নীলে তবু ঠিকানা অজানা।
ভালোবাসি তাই ফিরে আসা, 
ফড়িং-মনা তুই, তোর কিসের বাসা!

শোক পথচলতি

 

শোক পথচলতি 

পায়ে পায়ে পোশাকের রং নীল 

মোয়া ভেঙে 
ছড়িয়ে খায় 
নগণ্য মিডিয়া 

শোক পথচলতি 

মিডিয়া মরণের পথে 
পথে সাদা খই 

ট্র্যাফিকের রং বেগুনী। 

কবিতা

পার্থ সরকার 

কবিতা

জয়তী চৌধুরী

কবিতাঃ পার্থ সরকার
কবিতাঃ জয়তী চৌধুরী

গল্প

Comments

Top

লোর টোপর ঠিকমতো মাথায় গলানোর আগেই ঝিরঝির এ নিম পাতার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিত কচি ফিনফিনে সকালটা। ঘুমে ভারী চোখ দুটো একটু আলগা করে দেখে নিত বাবা কল পাম্প করে জল দিচ্ছে গাছপালায়। কলা দিঘির পাড় থেকে টুকি দেওয়া লাল সূর্যের মতন টুকটুকে পার, ঘিয়ে খোলের পাট এর শাড়ি পড়ে ভিজে খোলা চুলে ফুল তুলছে মা।। বাবার গলায় 'শ্রীরামকৃষ্ণ ভগবান, তব সুপ্রভাত ম'..…......। কোন কোন দিন মায়ের পুজো সারা। সারা বাড়ি ধুপ ধুনো গুগগুল আর ফুলের গন্ধে মম,......। উঠোনময় গুড়ি গুড়ি ব্যাঙের রাত পুইয়ে ঘর ফেরতার ব্যস্ততা। ভোরের হিলহিলে ধান সিজনও বাতাস আদরে ভরিয়ে দিত খিড়কি থেকে সদর। নিমফুল ছড়ানো উঠোনে গোলা দিয়ে লালমাটির টিপ পরিয়ে দিত অঞ্জলি দিদা। তে এঁটে মিশকালো তালগুলো ধুপ ধাপ গা ভেজাতো দিনু কাকার ডোবায়। নীল আকাশ, এলো বাতাস আর দড়ি ছেঁড়া দস্যিপনা, এইতো সেদিন।ইলশে গুড়ি বৃষ্টিতে পায়ের চেটো ভিজিয়ে সই বাড়ির মাটির দাওয়ায়। পয়লা পঞ্চমীর রাতে এক পুকুর ভাব আর এক সমুদ্দুর আড়ি নিয়ে মুড়কি নাড়ু দেয়া নেয়া। সাঁঝ পুজুনি, পুণ্যি পুকুর, মুড়ির নাড়ু ছড়িয়ে ছাতা ঘোরানোর লুটোপুটি শৈশব। খুড়তুতো জেঠতুতো মামাতো পিসতুতো মাসতুতো, একসাথে জাপটাজাপটি, হইহই করা ঝগড়া ভালোবাসার টইটুম্বুর উৎসব। সবুজ  ধোয়া ধানের ক্ষেত সোনার রং মাখার আগেই নরুন চোখে পাহারা দেওয়া

কখন ধানের দুধে চাল হবে। তারপর ধান বোঝাই গরুর গাড়িতে ঝুলতে ঝুলতে সুখ খাওয়া। সুখ......সুখ......।
সেই সুখ আজ নাকের ডগায়। হীরে থেকে জিরে, এক নিমিষে পাওয়া। ঝকমকানি আলো, আরো অনেক ভালো চটজলদি পাওয়ার সুখ। নীল আকাশ থেকে একটু একটু করে সরে এসে ড্রয়িং বেডরুম আর ব্যালকনিতে তো  করে খুশিগুলো সাজিয়ে রাখার সুখ। স্বপ্নগুলো ফাঁকফোকরে ডানা মেলে, ছাদের মাথায় পায়চারিতে। আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজে, সেটুকু ও আজ 'লক এন্ড কি'..... লকডাউন এ।
বিষণ্ণতা আর মন কেমনের ঝিম-ধরা দুপুরগুলো গুমরে গুমরে কেঁদে বলে আর কেন, আর মান কোর না। তোমার অবলা বাছারা যেমন নানা রঙে খিলখিলিয়ে ফুটে উঠছে তোমার বুকে, নির্ভয় এ তিরবিরিয়ে তোমার কোলে খেলা করে জানান দিচ্ছে তুমি তাদের ও। আমরা ও তো তোমারি, একটু শুধু লোভী। আমরা তোমার কাছ থেকে শুধু তো আঁজলা ভরে নিতেই জানি, আরো পাওয়ার হাতছানিতে ছুটতে জানি। তুমি তো সবই বোঝ!

কোল পাতো মা, দু দণ্ড তোমার কোলে জুড়োই। ঘটিং, খোলাং নুড়ি পাতা ধুলো পথে পা ফেলে, একটু একটু করে বেরিয়ে এসো তোমার বিরূপতা থেকে। কনে দেখা আলোয় বিছিয়ে দাও তোমার আদর মাখা আঁচল..........

Comments

Top

একদা

রবীন্দ্রনাথ

অদিতি সুর

RabindraJoyonti.jpg
একদা রবীন্দ্রনাথ

গল্প

জ খুব তাড়াতাড়ি স্কুলে পৌঁছাতে হবে তৃণার, অনেক দায়িত্ব আজ ওর। স্কুলে আজ রবীন্দ্র জয়ন্তী পালন করা হবে। পুরো স্টেজ ডেকোরেশন এর কাজ ওর ওপর। কাল একটু দেরি করে ফিরেছে স্কুল থেকে। ছুটির পর ও শর্মিলা, অর্পিতা, মৃত্তিকা, বিদিশা এই কজন।ওরা সাজানো গোছানোর ভার নিয়েছে।
এই মার্চ মাসেই ও ক্লাস নাইন এ উঠেছে। ক্লাস নাইন মনেই বেশ একটা বড়োসড় হাবভাব।ক্লাস টেন তো মাধ্যমিক দেবে তাই পড়াশুনা নিয়েই ব্যস্ত থাকবে, আর ক্লাস নাইন স্কুলের যাবতীয় অনুষ্ঠানের ভার নেবে। এটাই অনেকদিন থেকে হয়ে আসছে। এ বছরও তার ব্যাতিক্রম নয়।
আঁকাঝোকাতে বরাবরই সে বেশ ভালো। দারুন একটা রবীন্দ্র নাথের অয়েল পেইন্টিং করে স্কুলে বড়দিকে দেখিয়েছিল সেদিন, উনি সেটা ওর থেকে নিয়ে বাঁধিয়েছেন। আজ ওটা হলঘরে স্টেজ এর সামনে রাখা হবে। তাতে বড়দি মালা দেবেন।

কাল হলঘরটা রাংতা কাগজের ফুল দিয়ে ওরা সাজিয়েছিল। দারোয়ান অজয়কাকু সকালে গাঁদা ফুলের মালা আর বেল জুঁই ফুলের মালা বাজার থেকে নিয়ে আসবে। গাঁদা ফুলের মালা বাইরে মেইন গেটে আর জানলাতে লাগানো হবে। একটা বড়ো ফুলদানিতে রজনীগন্ধা রাখা হবে প্রবেশপথের সামনে। নাচের আর নাটকের মেয়েদের জন্য জুঁই আর বেল এর মালা রাখা থাকবে। গিয়ে আলপনাটা তাড়াতাড়ি এঁকে ফেলবে ও। বিদিশা আর পল্লবী ওকে সাহায্য করবে। টিফিনের পর শুরু হবে রবীন্দ্র জয়ন্তীর অনুষ্ঠান।
"মা জলদি খেতে দাও, রিকশা কাকু এসে যাবে। তুমি ব্যাগ এ টিফিনটা ঢুকিয়ে দিয়েছ?"
"হ্যা রে মাম। তুই এখন খেতে বোস তো।"
গরম ভাত ঘি আর আলু সেদ্ধ দিয়ে মেখে তাড়াতাড়ি খেতে থাকে তৃণা। গরমের চোটে ঠোঁটের ওপর বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে থাকে।
"তুই কিছু নাচগান করবি না রে?" মা জিজ্ঞেস করেন।
"আমি কি ওসব পারি নাকি? প্রিয়াঙ্কা করবে, কি সুন্দর গান গায় ও।"
বাইরে রিকশা কাকুর প্যাক প্যাক করে রিকশাতে বেল দেওয়ার আওয়াজ শোনা যায়।
"দেখলে তো মা তুমি কথা বলে দেরি করে দিলে! কাকু এসে গেছে, আমি আর খাবো না"
"আরে খেতে খেতে না শেষ করে উঠতে নেই, দেরি আছে তো এখনও।"
"না আমি আসছি, বাকিটা তুমি খেয়ে নিও।"
মাকে প্রণাম করে ব্যাগ নিয়ে রিকশাতে ওঠে তৃণা। "আসছি মা" বলে হাত নেড়ে মাকে বাই করে। রিকশা কাকু রিকশা চালাতে শুরু করে।

"কাকু আজ একটু প্লিজ জলদি চলো স্কুলে। পোগ্রাম আছে। দশটার মধ্যে পৌঁছাতে হবে যে করেই হোক।"
রিকশা কাকু হেসে বলে" ঠিক আছে মামুনি। পৌঁছে দেব তাড়াতাড়ি। আজ তো রবি ঠাকুরের জম্মদিন, সবাই সেজেগুজে ইস্কুল যাচ্ছে, তুমি সাজলে না?"
"না কাকু আমি গান, নাচ পারিনা, তাই স্কুল সাজাবো।" তৃণা কথাটা বলে হাতের ঘড়ি দেখে পৌনে নটা। আধঘন্টাতে আরামসে পৌঁছে যাবে সে।

রিক্সাটা গলির মোড়ে আসতেই জ্যাম এ আটকে যায়, একটা পেল্লাই লরি রাস্তা আটকে স্টোন চিপ ফেলছে রাস্তাতে, তার সামনে একটা বড়ো জিপ এসে দাঁড়িয়ে আটকে গেছে।তারপর রিকশা, ভ্যান, সাইকেল, অটো সব এক এক করে আটকে পড়েছে। বিশাল বিশৃঙ্খলা সকাল সকাল। লরিটা কারুর কথা শুনছে না, কাজ না শেষ করে সে এক চুল ও নড়বে না। "এই জ্যাম ছাড়বে কখন?" কাকুকে উদ্বিগ্ন মুখে প্রশ্ন করে তৃণা।

কিন্তু একি রাস্তা শেষ কেন হচ্ছেনা? সে ঠিক পথেই তো এসেছে রাস্তা চিনে। আর কতক্ষণ লাগবে। প্রোগ্রাম শুরু হয়ে যাবে তো! তৃণা এবার একপ্রকার দৌড়াতে শুরু করে। গরমে

ভালোই কষ্ট হতে থাকে, স্কুল ড্রেস ঘামে ভিজে জব জবে হয়ে ওঠে। চুলগুলো সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে হাঁটার গতিতে। সেদিকে ওর ভ্রুক্ষেপ নেই। স্কার্ট এর পকেট থেকে রুমাল বার করে ঘাম মুছবে সে ফুরসৎ নেই। চেনা রাস্তা ধরে ঝড়ের গতিতে এগিয়ে চলে তৃণা।

দশটা বেজে গেলো, হাত ঘড়ির দিকে তাকায় সে! সবাই এসে তার জন্য অপেক্ষা করবে তো। কি মনে করবে তারা! ওর কোন একটা দায়িত্ব নেওয়ার ক্ষমতা নেই! এখনো আলপনা দেওয়া বাকি। কাল দেরি হয়ে  যাওয়ার জন্য ওরা আলপনা দিতে পারেনি। শেষে কি আলপনা ছাড়া রবীন্দ্র জয়ন্তী হবে! খুঁত থেকে যাবে তার কাজ এ। বন্ধুরা কি ভাববে! আর বড়দি?! তিনি তো জানেন তৃণা খুব ভালো করে কাজ করবে, শেষে ওনার আশাতে জল ঢালবে নাকি ও!

এ কথা ভেবে মনের দুঃখে একটা চায়ের দোকানের সামনের রাস্তাতে বসে কাঁদতে থাকে সে! চায়ের দোকানের লোকটা অবাক হয় ওকে দেখে, জিজ্ঞেস করে "কি হলো দিদি কাঁদছো কেন?" তৃণা চোখ মুছে বলে ওর আজ স্কুলে তাড়াতাড়ি পৌঁছানোর কথা কিন্তু জ্যামের জন্য দেরি হয়ে গেল। লোকটা হেসে বলে" দিদি আমি তোমাকে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি দাড়াও।" লোকটা একটা রিকশার ব্যাবস্থা করে তাকে স্কুলে পৌঁছে দেয়।তৃণা স্কুলে পৌঁছে দৌড়ে গেট দিয়ে স্কুলে ঢোকে। গিয়ে দেখে বন্ধুরা সবাই আলপনা দিতে বসেছে। শর্মিলা ওকে দেখে বলে "তোর কোন একটা কান্ডজ্ঞান নেই। অদ্ভুত! এত দেরি করে এলি?" তৃণা দুঃখ পায় ওর কথা শুনে। চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে অপমানে। সে আল্পনার সরঞ্জাম নিয়ে চায়, ওরা সেটা ওকে নিতে দেয় না। ও ওদেরকে ওকে সাথে নেওয়ার জন্য ওদের অনুরোধ করে আর বলে দেরির কারণ। কেউ ওর কথা শুনতে চায় না। ও বাধ্য হয় ধস্তাধস্তি করতে। এমন সময় ইতিহাসের সুতপা ম্যাম ওখানে আসেন। উনি ওদের ঐভাবে দেখে জিজ্ঞেস করেন যে কেন ওরা অমন করছে?

তৃণা কিছু উত্তর দিতে যাবে এমন সময় মনে হয় তাকে ধরে কেউ জোড়ে ঝাঁকাচ্ছে।

"কি গো কি হলো? কাঁদছ কেন?এই ওঠো!"
ধরমড়িয়ে উঠে পড়ে তৃণা। আরে সে তহ স্বপ্ন দেখছিল তার মানে। চোখের কোণে আঙ্গুল দিয়ে দেখে জল। যাহ বাবা! আবার চোখের কোণে জল। সে কাঁদছিল নাকি! পাশে বসা ওর স্বামী তথাগত তখন ক্যাবলার মত ওর মুখের দিকে তাকিয়ে।
"কি হলো? বাজে স্বপ্ন দেখেছো নাকি?"
তথাগত জিজ্ঞেস করলে তৃণা পুরো স্বপ্নটা বলে তাকে। দুজনে মিলে খুব হাসে সেটা নিয়ে।
একধাক্কাতে যেন সে ছোটোবেলাতে পৌঁছে গিয়েছিল। মোবাইলের ঘড়িতে ছটার অ্যালার্ম বেজে ওঠে। অ্যালার্মটাকে অফ করে চা বানাতে ওঠে সে, তথাগত মোবাইলের রেডিও অন করে ।

"আয় তবে সহচরী হাতে হাত ধরি ধরি,
নাচি বো ঘিরি ঘিরি গাহিবো গান"
রবীন্দ্রনাথের গান ভেসে আসে শোয়ার ঘর এ তথাগতর মোবাইল থেকে। ওঃ আজ তো রবীন্দ্র জয়ন্তী! ভুলেই গেছিল সে নানা কাজের মধ্যে। মনটা ভরে গেছে আজ স্বপ্নের মাধ্যমে এক টুকরো ছোটবেলা ফিরে পেয়ে।
সে শুনেছিল ভোরের স্বপ্ন নাকি সত্যি হয়। কথাটা কতটা ঠিক জানা নেই। কিন্তু এটা সত্যি হলে মন্দ হয় না। আবার ছোটবেলাতে স্কুলের দিনগুলোতে ফিরে যাওয়া যাবে। ইশ যদি সত্যি এমনটা হতো। মুচকি হাসি ওর মুখে ফুটে ওঠে।
কবিগুরু কে প্রণাম করে চায়ের জল বসায়ে সে। আর মনে মনে গুন গুনিয়ে ওঠে
"ঘরেতে ভ্রমর এলো গুন গুণিয়ে........"

গল্প

নিষ্পত্তি

নিষ্পত্তি

স্বরূপ মণ্ডল 
বাগডাঙ্গা, কান্দি, মুর্শিদাবাদ

girl.jpg

Comments

Top

ই সাইকেলটা নিয়েই বিজয়বাবুর যত ঝঞ্ঝাট! না পারেন বিক্রি করতে, না পান চালাতে। চাকরিসূত্রে বাইরে থাকতে হয়। মাঝে-মধ্যে যখন বাড়ি আসেন তখন দু-চারদিন যা চালানো হয়। তারপর ভাল করে পুঁছে, তেল, মোবিল, হাওয়া যা দরকার দিয়ে আবার চলে যান। বাবার সাইকেল। বয়সটাও কম হলো না। প্রায় পঞ্চাশ তো হবেই। আজ-কাল ওই রকম মজবুত সাইকেল মেলা ভার! তাছাড়া বাবার স্মৃতিও জড়িয়ে রয়েছে। বাড়িতে বৃদ্ধা মা তাঁর স্বামীর স্মৃতি আঁকড়ে পড়ে রয়েছেন। তাঁকে নড়ানোর জোটি নেই। কাজেই সপরিবারে চাকুরী স্থলে বাস করার বাসনা ত্যাগ দিয়েছেন বিজয়বাবু। এতে টানাপড়েন বেশি হয় ঠিকই কিন্তু সব দিক বজায় থাকে। এমনটা অবশ্য বিজয়বাবুই ভাবেন। প্রথম প্রথম অশান্তি করে দেখেছে আহুতি। কোন লাভ হয় নি। পরে এভাবেই মানিয়ে নিয়েছে সে।        

আহুতি অনেকবার বলেছে, সাইকেলটা চাকরির জায়গায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। বাড়িতে পড়ে থেকে থেকে অচল হতে বসেছে। তাছাড়া যেখানে ঘর-ভাড়া নিয়েছেন সেখান থেকে স্কুলটা প্রায় দু কি.মি. তো হবেই। একটা সেকেন্ড-হ্যান্ড সাইকেলের খোঁজ করে দেখেছেন। দেড়-দু হাজারের কমে নয়। সাইকেলটা আনাই যায়। কিন্তু আনবেন কি উপায়ে? বাস জার্নির কথা ভাবলেই গা গুলিয়ে ওঠে। আবার ‘সাইকেল পার্সেল’ ব্যাপারটা কতকটা সম্মান হানিকরও বটে। অনেক ভেবে একটা উপায় বাতলেছে আহুতি। ঘণ্টা নয়েকের জার্নি, জেনেরাল কামড়ার জানলায় চেন দিয়ে কোনোরকমে বেঁধে দিতে পারলেই কেল্লা ফতে! আহুতির বুদ্ধি আছে বটে। অবশ্য সাংসারিক বিষয়ে মেয়েদের বুদ্ধি একটু বেশিই হয়। সে কথা মানেন বিজয়বাবু। যেমনি ভাবনা তেমনি কাজ।        

জঙ্গীপুর স্টেশন। বাড়ি থেকে আধ ঘণ্টার রাস্তা। সাইকেল চালিয়ে স্টেশনে গেলেন বিজয়বাবু। সন্ধ্যে সাড়ে সাতটায় তিস্তা-তোর্সা। একটা চালু টিকিট কেটে প্লাটফর্মের শেষ প্রান্তের দিকে এগিয়ে গেলেন। এর আগে বেশ কয়েকবার জেনেরাল কম্পার্টমেন্টে যাতায়াত করেছেন। জায়গা মতো সাইকেলটা নিয়ে দাঁড়ালেন। ট্রেন আসার খবর হয়ে গেছে।

মিনিট দু’য়েকের মধ্যে ট্রেন ঢুকলো। তড়িঘড়ি করে ব্যাগ থেকে চেনটা বের করে সাইকেলটা জানলার সঙ্গে বাঁধতে লাগলেন। জানলার পাশেই একজন মাঝবয়সী ভদ্রলোক বসেছিলেন। চেঁচিয়ে উঠলেন, “করছেন কি?” “দেখতেই তো পাচ্ছেন,” বিজয়বাবুর ডাঁটের সঙ্গে বললেন। ভদ্রলোক ভাবলেন, লোকাল প্যাসেঞ্জার, পরের স্টেশনেই হয়ত নেমে যাবেন, তাই চুপ করে গেলেন। বাঁধা-ছাঁদা করে বিজয়বাবু কামড়ায় উঠলেন। ফেব্রুয়ারীর মাঝামাঝি। এ সময় ভিড় একটু কমই থাকে। জিজ্ঞাসাবাদ করে একটা বসার জায়গার ব্যবস্থা করে ফেললেন। ব্যাগ থেকে একটা তুঁষের চাদর বের করে গায়ে জড়িয়ে আরাম করে বসতেই আহুতির ফোন। “কি গো, ট্রেনে উঠেছ? আর সাইকেলটার ব্যবস্থা হয়েছে? বসার জায়গা পেয়েছ?” আহুতি এরকমই। জিজ্ঞাসা করতে শুরু করলে একসঙ্গে একাধিক প্রশ্ন করে ফেলে, উত্তরের অপেক্ষা করে না। যেন জিজ্ঞাসার জন্যই জিজ্ঞাসা করা। বিজয়বাবু একে একে তার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে আশ্বস্ত করলেন যে সবকিছু ঠিকঠাকই আছে। ফোন রেখে ঝোলা ব্যাগ থেকে একটা বাসি ম্যাগাজিন বের করে স্বভাবসিদ্ধ ভাবেই পড়তে শুরু করলেন। পড়তে পড়তে আপনা আপনিই চোখ চলে যাচ্ছে জানলার বাইরে ঝুলন্ত সাইকেলটার দিকে। ত্রস্ত চোখ স্বস্তি পেয়ে ফিরে আসছে পাতায়। এতে পড়ার গতি কমলেও মনের গতি ঠিক থাকছে বিজয়বাবুর। বাঁ হাতটা চোখের সামনে ধরলেন। রাত সাড়ে ন’টা।

চারপাশটা চোখ বুলালেন। বেশির ভাগই স্মার্টফোনে ডুবে রয়েছে, কেউ কেউ রাতের খাবারে মনোনিবেশ করেছে, হকারদের আনাগোনা তো লেগেই রয়েছে। ট্রেন চলছে আপন গতিতে। টিফিন কৌটোটা বের করে খুলতেই ভ্রু কুঁচকালেন। “আহুতির এই এক দোষ! আদর করে মানুষ মেরে ফেলবে, রাতের খাবার আর দিনের খাবারের মধ্যে তফাৎ টুকুও বোঝে না,” বিড়বিড় করলেন বিজয়বাবু। 
মালদা টাউন ঢুকলো ট্রেন। যতটুকু পারলেন খেয়ে বাকিটুকু ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে হাতমুখ ধুয়ে টিফিন কৌটোটা জায়গা মতো রেখে নিশ্চিন্ত হয়ে বসলেন। মনে মনে বললেন, “আর ঘণ্টা ছ’য়েক”। মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখলেন ইতোমধ্যে আহুতি বার কয়েক কল করেছিল। কল ব্যাক করতেই অপর প্রান্ত থেকে আবার প্রশ্ন, “খেয়েছ? তরকারি নষ্ট হয়ে যায় নি তো? পেট ভরেছে? ট্রেন মালদা ঢুকেছে?” বিজয়বাবু উত্তর দিয়ে মা ও মেয়ের খোঁজ খবর নিয়ে ফোন রাখলেন। তারপর মোবাইলে অ্যালার্ম সেট করে চোখ বুজলেন।… 
চোখ খুললেন এক আর.পি.এফ অফিসারের চেঁচামেচিতে। হাত ঘড়িতে তখন রাত আড়াইটা। কোন একটা স্টেশনে দাঁড়িয়ে রয়েছে ট্রেন। ঠিক ঠাওর করতে পারলেন না। অফিসার জিজ্ঞাসা করলেন, “এই সাইকেলটা কার?” সবাই এ ওর দিকে চাইতেই বিজয়বাবু বলে উঠলেন, “ওটি আমার, কেন কি হয়েছে?” অফিসারটি বললেন, “ফাইন লাগবে।” “ফাইন কিসের মশাই! আমি কি সাইকেলের জন্য কারও কোনো অসুবিধা করেছি? সাইকেলটা তো বাইরে বাঁধা রয়েছে,” চেঁচিয়ে বললেন বিজয়বাবু।

“পার্সেল করেন নি কেন? এসব জিনিস পার্সেল করে নিয়ে যেতে হয়,” অফিসার ঝাঁঝিয়ে উঠলেন। ‘এ তো মহা বিড়ম্বনায় পড়া গেল!’ স্বগতোক্তি করলেন বিজয়বাবু।

“আপনি আমার সঙ্গে আসুন,” ধমকের সুরে বললেন অফিসার।

“দেখুন আমি কোথাও যেতে-টেতে পারবো না, কত ফাইন লাগবে তাই বলুন?” পাল্টা আক্রমণ করলেন বিজয়বাবু। “এটা কি লোকাল ট্রেন পেয়েছেন? যা খুশি, যেমন করে খুশি নিয়ে গেলেই হলো, আসুন বলছি,” ব্যবহার ক্রমশ রুক্ষ হচ্ছিল অফিসারটারটির। বিজয়বাবু কিছুতেই বুঝিয়ে উঠতে পারলেন না, একটা সাইকেল যার সঙ্গে তাঁর বাবার স্মৃতি জড়িয়ে আছে সেটাকে কারও কোনো অসুবিধা না করে নিয়ে যাওয়ার জন্য লোকাল ট্রেন আর এক্সপ্রেস ট্রেনের মধ্যে পার্থক্য কি আছে? স্কুলের অনেক অবাধ্য, অমনোযোগী ছাত্রকে তিনি নিজে হাতে গড়ে তুলেছেন। অথচ এত চেষ্টা করেও এই আর.পি.এফ অফিসারকে বোঝাতে পারলেন না। ভুল যখন করেছেন তখন মাশুলও গুণতে হবে। মনে মনে রাগ হচ্ছিল, আহুতি যদি বুদ্ধিটা না দিত তাহলে আজ এইভাবে অপদস্থ হতে হতো না। যখন বুঝলেন কোনোভাবেই এদের বোঝানো যাবে না, তখন ফাইন দিয়ে পাকা রসিদ নিয়ে নিজের জায়গায় এসে বসলেন। ব্যাগের পকেটে রসিদটা রেখে জানলার দিকে তাকাতেই বাজ পড়লো মাথায়। সাইকেল কোথায়? এ যে শুধু চেনটা ঝুলছে! বিজয়বাবু মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন। 
ঝিমঝিম করছিল মাথাটা। কখন যে ঝিমুনি এসেছিল বুঝতেই পারেন নি। অ্যালার্মের টোনে ঘোর কাটলো। ভোর চারটা। নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে ঢুকলো ট্রেন। শান্তভাবে নেমে গেলেন বিজয়বাবু। জানলার দিকে ফিরেও তাকালেন না। চেনটা তখনও ঝুলছে। ঝোলা ব্যাগের ভিতরে বেজেই চললো ফোনটা। 

Comments

Top

কবিতাঃ ঋষি

কবিতা

ঋষি

(সেনজিৎ বসু, কলকাতা )

সানি লিওনি আর ভারতবর্ষ
 
সানি লিওনি চেনো তো ভারতবর্ষ
সদ্য ফ্লাইট থেকে নেমে মোবাইলের পর্দায় শরীর খুলে দাঁড়ালো সে, 
ভুখা ভারতবাসী তাকিয়ে আছে তার স্তনের দিকে।
সেই স্তন যেখানে আজ অবধি ঠোঁট রাখে নি কোন ভারতবাসী
সেই স্তন যেখানে আজ অবধি ঠোঁট রাখে নি কোন শিশু
শুধু দুমড়ে মুচড়ে কিছু কামুক দাঁত চিহ্ন রেখে গেছে
আর রেখে গেছে শারীরিক বিজ্ঞাপন মানুষের কামুক ভাবনার।
.
সানি লিওনি শরীর প্রদর্শন করছে
প্রথমে নাভি, তার পর জঙ্ঘা, তারপর যোনি
ভুখা ভারত বাসী লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে হাততালি দিচ্ছে। 
রাত্রে মদের ঘোরে কোন রিক্সাওয়ালা শহরের কোন বস্তিতে 
বাংলা নেশায় মত্ত হয়ে
পিষে চলেছে তার লোকের বাড়ি কাজ করা ক্লান্ত বউকে তুমুল বিক্রমে
দু চড় মেরে সে বউয়ের মুখে ঠেসে দিচ্ছে রুগ্ন ভারতবর্ষ। 
.
সানি লিওনি বিজ্ঞাপনী প্রচারে কোলে তুলে নিতে চাইছে

ফুটপাথের আগামী ভারতবর্ষ
বাচ্চাটা চিৎকার করে কাঁদছে,
চারিদিকে পুলিশ ব্যারিকেড ভারতবর্ষ সানি লিওনিকে ছুঁতে চাইছে,
বাচ্চাটা মনে হয় বুঝে গেছে সানি লিওনির স্তনকে
আর মনকে।
ঠিক এই সময় ক্লাস এইটের এক ছাত্র বাথরুমে ভূগোল খুলে বসেছে
ঠিক এই সময়ে কলেজের এই ছাত্রী অন্য এক ছাত্রীকে জড়িয়ে চুমু খাচ্ছে
হাত বোলাচ্ছে একে অপরের গোপনাঙ্গ এ স্যানি লিওনির মতো।
.

এই ভাবে ভারতবর্ষের তিন কাল জাগছে
সানি লিওনি হাসছে 
খুব হাসছে,
কারণ ভুখা ভারতবাসী জানে না খালি পেটে অর্গানিজম
শুধু মাত্র জনসংখ্যা বাড়ায়, বাড়ায় ধর্ষণ। 
কিন্তু সানি লিওনি মনে মনে জানে তার শরীরে লুকোনো ক্ষতের মানে
তার আসল পরিচয়, 
অথচ ভারতবাসী চিরকাল যৌনাঙ্গ আর যৌন ফ্যান্টাসিতে মত্ত 
বড় অদ্ভুত তাই না!

  

ট্র্যাজেডি 

 

যোগ, বিয়োগ, গান্ধীজি, ট্রাজেডি 
সব জুড়ে কি দাঁড়াচ্ছে বুঝতে পারছি না,
বাড়ির পাশের নারকেল গাছটা ঝুঁকে পড়েছে তোমার দিকে 
তুমুল ঝড়ে সব কটা ডালপালা ভেঙে গেছে। 
এত জোর 
সময়ের দুর্বলতার আগে মানুষ জীবটা মিথোজীবী। 
.
গান্ধীমূর্তিটা তৈরী হয়েছে এই রাষ্ট্রে কোথাও দাঁড়াবে বলে 
সবরমতি আশ্রম, গঙ্গার ঘাট, মহারাষ্ট্রের গান্ধী মার্কেট,
দেশ সংশয়ে কোথায় দাঁড় করাবে মূর্তিটা? 
মহান গান্ধীজী ভাবছেন আমার কি দাঁড়াবার জমিটুকু নেই এই ভারতবর্ষে
না হিংসা নয়, ত্যাগ   
গঙ্গার ঘাট ধরে গান্ধীজী হেঁটে যাচ্ছেন জমির খোঁজে  
নিজের জমি। 
.
যোগ, বিয়োগ, ত্রিভুজ, বৃত্ত আর সরলরেখা 
আমার যোগটাই ভালো লাগে 
ভালো লাগে বৃত্ত ধরে তোমার চারপাশে সরতে,
সেকেন্ড, মুহূর্ত, ঘণ্টা। 
ঘড়ির কাঁটা, পুরোনো ঘড়ি, বালি ঘড়ি, ক্রমশ হুড়মুড় করে 
ভেঙে পড়া নারকেল গাছটা তুমুল ঝড়ে,
জানি শিকড় সরে না 
জানি আরো গভীরে যাওয়া আটকাতে পারে না তুমুল ঝড় 
তবুও গাছ ভাঙে। 
লেগে থাকে মাটি ছুঁয়ে শিকড়ের বাঁচা 
কিংবা বাঁচতে চাওয়া,
ট্র্যাজেডি এটা সালোকসংশ্লেষে যুক্তি তৈরী হয় না 
তৈরী হয় জীবন।

 

যে শব্দরা একা 
 


উফস
এই পৃথিবীতে চিরকাল আমার অপ্রিয় কিছু শব্দ।

ঈশ্বর হিমালয় থেকে নেমে এলেন

তাকে প্রশ্ন করলাম, চেনেন মশাই এই শব্দগুলো? 

উনি খুব গর্বের সাথে উত্তর দিলেন

আমি তোমাদের কণ্ঠ দিয়েছি নিজেদের ভাব প্রকাশের জন্য

এর থেকে বেশি কৈফিয়ত আমি দিতে পারবো না।

আমি চলন্তিকার কাছে চরম সংগমকালে শুনলাম শব্দগুলো

জানতে চাইলাম শব্দগুলোর মানে, 

চলন্তিকা হাসলো অদ্ভুত ভাবে চোখে চোখে 

মাথায় হাত বুলিয়ে বললো এই শব্দগুলো চরম তৃপ্তির।

আমি তখন দেখতে পাচ্ছি আমার ঈশ্বর এগিয়ে যাচ্ছে ফেরিঘাটের দিকে

আমি ছুটে গেলাম তার দিকে,  

শুধু একটা প্রশ্ন করবো বলে।

আমি হিমালয় ঘুরে সারা ভারতবর্ষের ঘুরে 

খুঁজে পেলাম না আর ঈশ্বরকে,

শুধু সারা পৃথিবী ঘুরে আমি শুধু শুনতে পেলাম হাহাকার 

কোটি, কোটি অসহায় মানুষের চিৎকার 

আর আউ উফস।

আমি সেদিন থেকে বুঝেছি এই শব্দগুলো আসলে শুধু কষ্টের 

আর যে কষ্টগুলো ভীষণ একা,

কাউকে দেওয়া যায় না

শুধু অনুভব করতে হয়। 

পভার্টি লাইন 

মি তখন সম্পূর্ণ নগ্ন
এক আকাশের তলায় দাঁড়িয়ে খুঁজে চলেছি পভার্টি লাইন, 
পভার্টি লাইন মানে কী
প্রশ্ন করেছিলাম জংগল-মহলে আকস্মিক মৃত্যুর কাছে
উত্তরে তুমুল ঝড় তারপর বৃষ্টি 
হাওয়ারা আমার কানে কানে বলে গেল "খিদে"।

আমি সম্পূর্ণ নগ্ন 
পায়ের কাছে জমে আছে শতাব্দী সময় শুধুমাত্র বেঁচে থাকায়, 
আমি নিচু হলাম ফুঁ দিলাম
সরে গেল কিছু শতাব্দী,
অবাক হয়ে চেয়ে দেখি এক মানবীর নাক, ঠোঁট, ভ্রু
আবার ফুঁ দিলাম
এবার স্তন, নাভি, উরু, ক্রমশ শতাব্দী সরে এক সম্পূর্ণ মানবী আমার সামনে।

মানবী উঠে দাঁড়ালো
আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমাকে বললো কি হলো আমাকে ভালোবাসবে না,
আমি মুখ চেপে ধরলাম তার স্তনে, জিভ ঠেকালাম তার স্তনাগ্রে
কিন্তু পেলাম পৃথিবীর রক্তের  স্বাদ, 
আমি নেমে এলাম তার পেটে, তার নাভিতে 
শুনতে পেলাম পৃথিবীর হাহাকার, কান্না আর খিদে। 
আমি ছিটকে সরে এলাম
প্রশ্ন করলাম
কে তুমি মানবী, কি তোমার নাম? 
মানবী হাসতে লাগলো আকাশ, পাতাল কাঁপিয়ে 
আবার অন্ধকার হয়ে এলো প্রকৃতি, তারপর ঝড়, তারপর বৃষ্টি
আমি ভয় পেয়ে হাঁটু গেড়ে বসলাম,
এবার এক লাল শাড়ি কোথা থেকে উড়ে এসে ঢেকে দিল মানবীকে।
মানবী হেঁটে চলে যাচ্ছে সোজা রাস্তা ধরে
তার পায়ের ছাপে ফুটে উঠছে রক্ত 
আমি বুঝলাম মানবীর ওই সোজা রাস্তাটা হলো পভার্টি লাইন। 

রোদ, বৃষ্টি 
 

খন বুকের ভিতরটা দুমড়েমুচড়ে যায় 
আমি রোদ্দুর খুঁজি। 
আমার খুঁজে চলা বুকের ছন্দে অনবরত ক্ষরণ
আমার শহর, 
কোন এক বিকেলে বৃষ্টি হয়ে নেমে আসে তোমার  বারান্দায়
আমি তখন ঠিক তোমার মতো তোমার পাশে তখন আকাশ খুঁজি 
খুঁজি মুহূর্ত অন্য কোন বৃষ্টি দিনে। 


চলন্তিকা তুমি আমাকে প্রশ্ন করেছিলে 
প্রেম কি ?
আমি তোমাকে একঝলক সিগারেটের আগুন দেখিয়ে বলেছিলাম 
পুড়তে থাকা,
পুড়তে থাকা নিজের ভিতর মুহূর্তের জ্বালাপোড়া 
অজস্র না বলতে পারা চিৎকার। 
চলন্তিকা তুমি বলেছিলে পরজন্মে গাছ হবো 
আমরা গাছের মতো চেয়ে থাকবো একে ওপরের দিকে,
হাওয়া এসে ছুঁয়ে যাবে 
আলো এসে ছুঁয়ে যাবে 
ছুঁয়ে যাবে আমাদের সবুজ জন্ম অনবরত কোন অধিকার। 

তাই তো আমি আমার সমস্ত অস্তিত্ব দিয়ে রৌদ্র খুঁজি 
যখন বুকের ভিতরটা দুমড়েমুচড়ে যায় 
খুঁজি আলো। 
আমার না বলা কথারা আকাশ হয়ে তোমাকে ছুঁয়ে থাকে 
মাঝে মাঝে বৃষ্টি আসে 
তোমার মতো আমার গভীরে তখন উথালপাথাল 
অনেক কিছু বলা যে বাকি থেকে গেলো। 

মুসাফির

ক ঝড়ের রাতে জড়িয়ে ধরেছি তোমাকে চলন্তিকা
এক ঝড়ের রাতে সমুদ্রের ধারে কাঁচের ঘরে শুধু স্বপ্ন,
পায়ের সাথে পা জড়িয়ে ধরে বালুচরে
আকাশের চাঁদে জ্যোৎস্না এসে ধরা দেয় কবিতার মতো।
আছড়ে আছড়ে পড়ে বুকে শব্দ ঘোর
পাগল প্রেমিকের মতো আমি আর আমার বালি ঘর।

তুমি ঠিক বলেছো চলন্তিকা
আমার সংসারী হওয়া হলো,
হাতের দোতারায় প্রেম যেন ছুঁয়ে থাকে পাগল বিশ্বাস
আঙুল গড়িয়ে নামে ইচ্ছা সংবেদনশীল চেতনার মতো।
শুধু স্তব্ধতা ধরা দেয়
যখন জড়িয়ে ধরি তোমায় একলা আমি বুকের ভাঁজে। 

এসেছিল জল দস্যু সাজে সমুদ্রের হাওয়া
ছুঁতে ছেয়েছিল তোমায়,
সেই থেকে আমি পাগলপারা মুসাফির পালিয়ে এসেছি নদীতে,
নদীর পাশে তোমার হাত ধরে প্রতিজ্ঞা করেছি
নারী আমি গাছ হয়ে থেকে যাবো।
নারী আমি হয়ে যেতে পারি কোন একলা বাঁশির শব্দ 
কোন মন আনছান বাঁশির সুর
পাগল করছে আমায়,
হাতছানি দিয়ে ভুলে যাওয়া সমুদ্র ক্রমশ মুখ লুকোচ্ছে
নদীর মিষ্টি জলে।
আমি আরও গভীরে তলিয়ে তোমার মত মুখ দেখছি নদীতে
ক্রমশ এগিয়ে চলেছে নদী সম্পর্কের সাজে
তুমি ঠিক বলেছো চলন্তিকা আমি প্রেমিক হতে পারি
কিন্তু সংসারই না
শুধু মুসাফির আমি তোমার প্রেমে।  

জব চার্ণক

দিলীপ মজমদার 

পর্ণশ্রী, বেহালা, কলকাতা 

job.jpg
জব চার্নক

শ্রুতি-নাটক

Comments

Top

১.


[গুনগুন করে গান গায় রেশমি] 
     বন্দি বাবা মসলন্দি না করিও বা।
     কদমেতে লিখে রাখো অভাগার না।।
বিবিজান। রেশমি – রেশমি –
রেশমি। কি বিবিজান-
বিবি। কি গান গাইছিলি?
রেশমি। মসলন্দির গীত বিবিজান। কাল এক ফকিরের মুখে শুনলাম।
বিবি। মসলন্দি কে রে?
রেশমি। উদার, ধর্মপ্রাণ এক জমিদার। সাধারণ মানুষ তাঁকে পীর বলে মনে করত। তাঁর মৃত্যুর পরে লোকে তাঁকে মসলন্দি পীর বলে।
বিবি। রসুলপুর নদীর মোহানার মুখে যে মসজিদ আছে, ওটাই কি?
রেশমি। হ্যাঁ, বিবিজান। ওই মসজিদের চুড়ো দেখে মাঝিমাল্লারা দিক ঠিক করে। সেলাম জানায় তাঁর নামে।
[তোপের শব্দ]
বিবি। এ কি রে! কিসের শব্দ?
রেশমি। তোপের শব্দ।
বিবি। কোন দিক থেকে আসছে শব্দটা?
রেশমি। রসুলপুরের দিক থেকে বলে মনে হচ্ছে।                      

বিবি। এ তো আমাদের তোপের শব্দ নয়! তাহলে! রেশমি একবার খোঁজ নিয়ে আয় সাহেবের। দেখ তিনি গড়ের ভেতর আছেন কিনা!
রেশমি। যাই বিবিজান। [রেশমি চলে যায়। আবার তোপের শব্দ]
বিবি। [আপনমনে] কি হল আবার কে জানে! ভয় করে, বড্ড ভয় করে। ভাগ্য মানুষটাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। ঘরে-বাইরে তার শত্রু।
[রেশমি ফিরে আসে]
রেশমি। না, বিবিজান, চার্নকসাহেব তো গড়ে নেই।
বিবি। নাই? তাহলে...
[আবার তোপের শব্দ]
বিবি। আবার কিছু একটা ঘটতে চলেছে, বুঝলি রেশমি। বড্ড ভয় করে রে!
রেশমি। অত ভাববেন না বিবিজান। চার্নকসাহেব ঠিক একটা ফন্দি-ফিকির বের করবেন। তাঁর যা বুদ্ধি!
বিবি। বুদ্ধি.. হ্যাঁ, বুদ্ধি তাঁর আছে। কিন্তু তাঁর শত্রুও যে অনেক রে। সেই হেজেসসাহেবের কথা মনে নেই তোর!
রেশমি। মনে থাকবে না আবার! মহা শয়তান লোক। চার্নকসাহেবকে হিংসে করতেন, তাঁকে জব্দ করতে চেয়েছিলেন। শেষে কি হল! নিজেই জব্দ হয়ে চলে গেলেন।
[তোপের শব্দ। সৈন্যদের ছোটাছুটি ও চিৎকারের শব্দ। ]
বিবি। জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখলাম এরা তো আমাদের সৈন্য। রেশমি, তুই একটু বাইরে গিয়ে দেখ তো কোন খবর পাস কিনা।
রেশমি। যাচ্ছি। [রেশমির যাওয়ার শব্দ]
বিবি। [আপনমনে] সাহেব ভেবেছিলেন এই হিজলিতে একটু শান্তিতে কাটাবেন। তা বোধ হয় হল না। মানুষ ভাবে এক, ঈশ্বর ঘটান আর এক।
[রেশমি হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে আসে]
বিবি। কিরে কি হল!                            

রেশমি। মোগল সৈন্য তোপ দাগছে বিবিজান।
বিবি। মোগল সৈন্য!
রেশমি। হ্যাঁ। শায়েস্তা খাঁ আবদুল হামেদকে পাঠিয়েছেন চার্নকসাহেবকে জব্দ করার জন্য।
বিবি। কি সর্বনাশ।
রেশমি। সত্যি বিপদ বিবিজান। আরও একটা খবর শুনলাম। মালেক কাশেমও এসেছে।
বিবি। মালেক কাশেম!
রেশমি। হ্যাঁগো। হিজলির রক্ষাকর্তা মালেক কাশেম। চার্নকসাহেবের আদেশে সৈনাধ্যক্ষ নিকলসনসাহেব আসায় যে পালিয়ে গিয়েছিল!
বিবি। হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে পড়েছে।
রেশমি। রসুলপুরে ঘাঁটি গেড়ে বসেছে মালিক কাশেম। গোলন্দাজ সেনাদের এনে জড়ো করেছে।
বিবি। এখন উপায়! একদিকে মালেক কাশেম, অন্যদিকে আবদুল হামেদ....

 

২.


নিকলসন। কি বললে চার্নক! আবদুল হামেদ!
চার্নক। সেই রকম খবর পেলাম নিকলসন। তাকে কমপ্লিট ফ্রিডম দিয়ে পাঠিয়েছে শায়েস্তা খাঁ।
নিকল। সৈন্য কত!
চার্নক। সাতশো অশ্বারোহী, দুশো গোলন্দাজ।
নিকল। বল কি! এত টেরিবল নিউজ।
চার্নক। মালেক কাশেমও এসেছে।
নিকল। টেরিবল টেরিবল।
[তোপের শব্দ]
চার্নক। শুনতে পাচ্ছ! তোপের শব্দ।
নিকল। এতো কষ্ট করে হিজলি দখল করলাম। চমৎকার শেলটার। এবার বুঝি ফস্কে গেল। 
চার্নক। ঠিক বলেছ। চমৎকার শেলটার ছিল হিজলি। একদিকে কাউখালি নদী, আর একদিকে রসুলপুর নদী, সামনে সমুদ্র ।
নিকল। এই তো সেদিনের কথা। আমরা রিট্রিট করছিলাম সুতানটি থেকে। তখন সেইফ জায়গা দরকার আমাদের। পথে পড়ল বাদশাহি নিমক মহল আর থানা দুর্গ। সেগুলো ডেসট্রয় করলাম আমরা। তারপর তোমার পরামর্শে এলাম হিজলি।
চার্নক। আমি ভেবেছিলাম এখানে শেলটার নিলে হুগলি বা ঢাকা থেকে ফৌজ পাঠিয়ে মোগলরা আমাদের আ্যাটাক করতে পারবে না।
[জুতোর শব্দ]
চার্নক। কে যেন আসছে। দেখা যাক নতুন কোন নিউজ পাওয়া যায় কিনা। তুমি একটু বাইরে গিয়ে দেখে এসো।
[নিকলসন বাইরে যায়]
চার্নক। [আপনমনে] আবার নতুন স্ট্রাটেজি ঠিক করতে হবে। হিজলি বোধহয় ছাড়তে হবে । তাহলে চলে যাব সুতানটি। ওই সুতানটি আমাকে এমন টানে কেন!
[নিকলসনের প্রবেশ]
নিকল। টেরিবল নিউজ চার্নক। আবদুল হামেদের সৈন্যদল রসুলপুরের মোহানা পেরিয়ে চলে এসেছে। চারদিকে তোপখানা বসিয়েছে। ইংরেজ জাহাজের উপর গুলি বর্ষণ করবে। তারপর এগিয়ে আসবে আমাদের ফোর্ট দখল করতে। আমরা পেরে উঠব না। আমাদের সৈন্য কম, তার উপর..
চার্নক। বলো, বলো..
নিকল। এখানকার ড্রিঙ্কিং ওয়াটার খারাপ। অলরেডি ১৮০ জন সৈন্য অসুস্থ হয়ে পড়েছে। কি হবে চার্নক?
নিকল। মোগলদের হাবভাব বোঝা মুশকিল।
নিকল। রাইট। সেবার হুগলিতে যেমন হল। লড়াইতে জিতলাম আমরা। ফৌজদার আবদুল গনি নৌকায় চেপে ছদ্মবেশে পালিয়ে গেল। তোপখানা আমাদের দখলে এল। হুগলির শাসনকর্তা সন্ধির কথা বলল। ব্যস তারপরে চুপচাপ। আমরা বুঝতে পারিনি যে ওরা গোপনে গোপনে যুদ্ধের আয়োজন করছে।
চার্নক। হুগলি ছাড়তে হল আমাদের। বালেশ্বর যাবার পথে আমরা হল্ট করলাম সুতানটিতে । জানো নিকলসন, সুতানটি আমার চোখের সামনে ছবির মতো ভাসে। সামনে নদীর এমন একটা বাঁক, যেখানে নোঙর করা যায় জাহাজ। আবার সেখান থেকে মোহানাও খুব বেশি দূর নয়। গভীর জঙ্গল, বাদা, খালবিলে ভরা। বাহির থেকে সুতানুটিকে আক্রমণ করা সহজ নয়।
[তোপের শব্দ]
নিকল। তুমি সুতানুটির স্বপ্ন দেখছ, আমি শুনছি তোপের শব্দ।
[রেশমির প্রবেশ]
রেশমি। সাহেব, আপনি এখানে! আমি চারদিক খুঁজে বেড়াচ্ছি।
চার্নক। কেন?
রেশমি। তোপের শব্দ শুনে বিবিজান উতলা হয়ে পড়েছে। তারপরে আবার শুনলাম মোগলরা এসেছে। আপনি একবার চলুন সাহেব।
চার্নক। বলো যাচ্ছি।
[রেশমি চলে যায়]
নিক । ইউ আর লাকি চার্নক। তোমার হিন্দুস্তানি বিবিকে যত দেখি, তত অবাক হই। এমন স্যাক্রিফাইস, এমন টোটাল ডিভোশন সচরাচর দেখা যায় না।
চার্নক। ইয়েস, আই আ্যম লাকি। ভাগ্যবান আমি। ইয়েস। শি ইজ লাইক আ্য জেন্টেল ব্রিজ । সে আমাকে সব দুঃখ-কষ্ট ভুলিয়ে দেয়।
[মিউজিক]


৩.


[রাত্রির পরিবেশ]
চার্নক। বিবি, বিবি — আরে সাড়া দিচ্ছ না কেন? গেল কোথায়?  বোধহয় পাশের ঘরে গেছে । প্রেয়িং টু গডেস কালী। আমি জানি, আমার জন্যই প্রার্থনা করছে।
[বিবির প্রবেশ]
বিবি। আরে, তুমি ঘুমোও নি?                        

চার্নক। ঘুম ভেঙে গেল।
বিবি। তবু শুয়ে বিশ্রাম নিতে পারতে, উঠে এলে কেন?
চার্নক। দেখতে এলাম তুমি কি করছ?
বিবি। কি আর করব, ভাবছি।
চার্নক। কি বলল তোমার গডেস? আমার জয় না পরাজয়?
বিবি। দেখো, ঠাকুর-দেবতাদের নিয়ে এমন ঠাট্টা ভালো নয়।
চার্নক। এই দেখো, তুমি সিরিয়াস হয়ে গেলে। মোটেই আমি ঠাট্টা করতে চাইনি। তোমার ঠাকুর নিয়ে আমি কি কখনও ঠাট্টা করেছি? আরে চার্নক তো পুরোপুরি ইণ্ডিয়ান বনে গেছে । তার জাতভাইরা তো সেকথা বলে। বলে চার্নক কালীবাড়ি যায়, হিন্দু খানা খায়, হিন্দুবিবির..
বিবি। যাঃ।
চার্নক। লোকে যা বলে তা তো মিথ্যে নয়। চার্নক তার হিন্দুবিবির কথায় ওঠবস করে। করি তো। এতে লজ্জার কিছু নেই।
বিবি। তুমি এত ভালোবাসো আমাকে ?
চার্নক। দুটো যুগ পার হবে গেল, এখনও তোমার সন্দেহ!
বিবি। ছিঃ, সন্দেহ করব তোমাকে!
চার্নক। তবে?
বিবি। মেয়েরা যে স্বামীর ভালোবাসার কথা বারে বারে শুনতে চায়।
চার্নক। দ্যাটস রাইট ডার্লিং।
বিবি। ওসব ডালিং ফালিং বলবে না।
চার্নক। ভুল হয়ে গেছে বিবি।
বিবি।  চলো, এবার শুয়ে পড়বে চলো। অনেক রাত হল।
চার্নক। ঘুম কি আসবে?                      

বিবি। কেন, কেন?
চার্নক। মাথার মধ্যে নানা দুশ্চিন্তা বিবি। ঘুম আর আসবে না। তার চেয়ে চলো, ওই বারান্দায় বসি।
[পদশব্দ]
চার্নক। হিজলি জায়গাটা তোমার কেমন লাগে বিবি?
বিবি। ভালোই তো।
চার্নক। ঘুরে দেখেছ জায়গাটা?
বিবি। একদিন বেরিয়েছিলাম।
চার্নক। মেয়েদের সঙ্গে নিয়েছিলে তো!
বিবি। মেরি আর এলিজাবেথ ছিল। জামাই চার্লসও ছিল।
চার্নক। চার্লস যখন গাইড, তখন নিশ্চয়ই পায়ে হেঁটে ঘুরতে হয়েছে!
বিবি। ওতে কষ্ট হয় নি। হ্যাঁগো, চার্লস বলছিল এখানে নাকি বাঘ আছে?
চার্নক। আছে, তবে ভেতরের দিকে।
বিবি। জায়গাটা আমার ভালো লেগেছে।
চার্নক। আমারও । কিন্তু বিবি, এবার বোধহয় এখান থেকে পাততাড়ি গোটাতে হবে।
বিবি। কেন, আবার কি যুদ্ধ হবে?
চার্নক। মোগলদের তোপের আওয়াজ তো সেই কথাই বলছে।
বিবি। না, আর যুদ্ধে কাজ নেই। চলো আমরা অন্য কোথাও চলে যাই।
চার্নক। কোথায় যাবো? যেখানেই যাই শায়েস্তা খাঁ আমাকে ছাড়বে না। যুদ্ধ করতেই হবে । বিবি, এবার যুদ্ধে আমি যদি মারা যাই?
বিবি। [কান্নায় ভেঙে পড়ে] এমন কথা আর কোনদিন উচ্চারণ করবে না, কোনদিন না..
চার্নক। এই দেখো। একেবারে আপসেট। বিবি, তোমার সঙ্গে রসিকতা করছিলাম। কিন্তু বিবি, এখান থেকে আমাদের যেতেই হবে।                         

বিবি। যাব, তুমি যেখানে নিয়ে যাবে, সেখান যাব।
চার্নক। ভবঘুরের মতো ঘুরে বেড়ালে কি হবে! তোমাদের জন্য একটা স্থায়ী আস্তানা দরকার ।
বিবি। আমাদের জন্য ভেবো না। আমি সব সামলে নেবো।
চার্নক। তা জানি। তবু একটা পারমানেন্ট সেটেলমেন্ট দরকার।
বিবি। আমাদের কথা ভেবে শরীর খারাপ করো না।
চার্নক। [গভীর স্বরে] বিবি, তুমি আমার কাছে এক বিস্ময়। কোথা থেকে পেলে এমন ধৈর্য্য, এমন সহ্যশক্তি! সব কিছু এমন সহজে মেনে নিতে পারো তুমি।
[মিউজিক]
চার্নক। মাঝে মাঝে মনে পড়ে যায় সেদিনের কথা। সেদিন যদি আমি বার্নিংঘাটে উপস্থিত না হতাম, তাহলে কোনদিন তো তোমার দেখা পেতাম না। মনে পড়ে , মনে পড়ে সেইসব কথা.........
[ফ্ল্যাশব্যাক। ঢাকের শব্দ। ‘জয় সতীমায়ের জয়’ ধ্বনি ]
চার্নক। কি হচ্ছে এখানে? এত ক্রাউড কেন? কে এই লেডি?
জনৈক। সতীদাহ হচ্ছে সাহেব। এই মেয়েটাই সতী হবে। মৃত স্বামীর চিতায় শুয়ে সতী হবে।
চার্নক। হোয়াট! লিভিং লেডিকে পুড়িয়ে মারবে! ও কি মরতে উইলিং?
জনৈক। কি বললেন সাহেব?
চার্নক। স্বেচ্ছায় মরবে?
জনৈক। তা নয় তো কি ? হিন্দু বিধবারা স্বেচ্ছায় মরে।
চার্নক। টেলিং লাই। বাজে কথা। স্টপ, স্টপ দিজ। কতোই বা বয়েস মেয়েটির! থার্টিন অর ফোর্টিন। পুওয়র ইয়ং গার্ল। ওকে ছেড়ে দাও। নাহলে ফায়ার করব।
জনৈক। এমন করবেন না সাহেব। পাপ লাগবে।
চার্নক। তাহলে শুনবে না কথা! বেশ। [বন্দুকের ফাঁকা আওয়াজ। সকলে ছুটে পালায়। মেয়েটি ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে] আরে তুমি কাঁদছ কেন? ইউ আর সেইভড।
মেয়ে। আমাকে বাঁচালেন কেন সাহেব ?                     

চার্নক। স্ট্রেঞ্জ। বেঁচে তুমি খুশি নও?
মেয়ে। না, সাহেব। 
চার্নক। সবাই তো বাঁচতে চায়।
মেয়ে। আমি চাই না সাহেব।
চার্নক। কিন্তু কেন?
মেয়ে। কে আমাকে ঠাঁই দেবে সাহেব?
চার্নক। কেন, তুমি তোমার মা-বাবার কাছে যাবে।
মেয়ে। তিনি তো আমাকে আর নেবেন না। ইচ্ছে থাকলেও নিতে পারবেন না সমাজের জন্য ।
চার্নক। স্ট্রেঞ্জ।
মেয়ে। সাহেব আমার অন্য কোন গতি নেই। তাই বলছিলাম, আমাকে বাঁচালেন কেন।
চার্নক। শোন ইয়ং লেডি, তোমার আপত্তি না থাকলে তুমি আমার কাছে থাকতে পারো।
মেয়ে। আপনার কাছে কিভাবে থাকবো! লোকে কি বলবে!
চার্নক। আই ক্যান ম্যারি ইউ।
মেয়ে। কি বললেন সাহেব?
চার্নক। তোমাকে সাদি — মানে বিবাহ করতে পারি।
মেয়ে। তা হয় না সাহেব।
চার্নক। হোয়াই? কেন?
মেয়ে। হিন্দু মেয়ের একবারই বিয়ে হয়।
চার্নক। সেসব পরে ভাববে। এখন তোমার একটা শেলটার দরকার। চলো আমার সঙ্গে।
[ফ্ল্যাশব্যাক শেষ হয়]
চার্নক। সেই থেকে তুমি আছ আমার কাছে। তোমাকে পেয়ে আমার জীবনটাই বদলে গেছে বিবি। আই আ্যম হ্যাপি, ভেরি হ্যাপি। খুব খুশি আমি।
বিবি। আমিও সাহেব।
[বাহির থেকে ডাক ‘চার্নক-- চার্নক’]
চার্নক। আরে এ যে নিকলসন। এই ভোর রাতে! তুমি ও ঘরে যাও বিবি। রেস্ট নাও।
[বিবি চলে যায়, নিকলসনের প্রবেশ ]
চার্নক। কি ব্যাপার নিকলসন!
নিকল। একটা গুড নিউজ দিতে এলাম।
চার্নক। নিউজটা কি!
নিকল। ব্রিটিশ শিপ...
চার্নক। কি বললে !
নিকল। ইয়েস। কাল মিডনাইটে ক্যাপটেন ডেনহ্যাম এসেছে। পারহ্যাপস উই আর সেইভড ।
চার্নক। সোলজার কত? অস্ত্রশস্ত্র?
নিকল। ডিটেলস কিছু জানিনা। 
চার্নক। নিউজ কে দিল?
নিকল। আমাদের একজন নাইট ওয়াচম্যান। খবরটা পেয়ে ছুটে এসেছি। এমন একটা খবর ! আমিতো এক্সাইটেড। তুমি এত প্যাসিভ কেন?
চার্নক। কি বললে?
নিকল। এত বড় খবরে আনন্দ হচ্ছে না?
চার্নক। কে বলল আনন্দ হচ্ছে না! তবু ভালো করে জানতে-বুঝতে হবে। লেটস গো। চলো, ডেনহ্যামের সঙ্গে দেখা করে আসি।            


৪.


[জলের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ। জাহাজের দুলুনি]
চার্নক। হ্যালো ক্যাপটেন ডেনহ্যাম ।
ডেন। হ্যালো চার্নক।
চার্নক। থ্যাঙ্ক গড, এরকম ক্রুসিয়াল পিরিয়ডে আপনি না এলে কি যে হত!
ডেন। শুনলাম মোগলরা আ্যটাক করার জন্য তৈরি হচ্ছে !
চার্নক। ঠিকই শুনেছেন।
ডেন। আমাদের সৈন্য কত?
চার্নক। সেটাই তো সমস্যা।
ডেন। কি রকম?
চার্নক। ওদের সৈন্য অনেক বেশি। যুদ্ধ হলে ডিফিট সিওর।
ডেন। সন্ধি করা যায় না!
চার্নক। হ্যাঁ করা যায়। কিন্তু সেটা ফ্রুটলেসও হতে পারে।
ডেন। কি রকম?
চার্নক। প্রিভিয়াস এক্সপিরিয়েন্স সে কথাই বলে। হুগলির ঘটনার পরে মিঃ ভরমলের চেষ্টায় মোগলদের সঙ্গে সন্ধির প্রস্তাব হয়। সেই সন্ধিপত্র ঢাকায় পাঠানো হয় শায়েস্তা খাঁর সিগনেচারের জন্য। কিন্তু..
ডান। তারপর?
চার্নক। আফটার ওয়ান মান্থ সেই সন্ধিপত্র সিগনেচার না করেই ফেরৎ আসে।
ডেন। স্ট্রেঞ্জ।
চার্নক। শুধু তাই নয়। বাংলার মোগল শাসনকর্তাদের ইংরেজ তাড়ানোর জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়।
ডান। কিন্তু ঔরংগজেব?
চার্নক। সম্রাট ঔরংগজেব বিরাট ক্ষমতা দিয়ে বাংলায় পাঠিয়েছেন শায়েস্তা খাঁকে।
[মোগল সৈন্যদের চিৎকার, তোপধ্বনি]
চার্নক। শুনতে পাচ্ছেন?
ডান। পাচ্ছি বৈকি।
চার্নক। আমরা এখন এনসার্কেলড।
ডেন। হোয়াট ইজ টু বি ডান?
[বেগে নিকলসনের প্রবেশ]
নিকল। চার্নক, টেরিফিক নিউজ। চার্নক। কি রকম?
নিকল। মোগলবাহিনী হিজলি শহরে ঢুকে পড়েছে।
চার্নক। হোয়াট?
নিকল। রেজিস্ট করা যায় নি।
চার্নক। নো কনফ্রন্টেশন?
নিকল। নো। এখন লুটপাট চলছে। নানা জায়গায় আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। এক ইংরেজ সেনাকে হত্যা করেছে, তার স্ত্রী-পুত্রকে বন্দি করেছে। মোগল জাহাজ লুঠ করে আমরা যে চারটি হাতি এনেছিলাম, সেগুলি হস্তগত করেছে।
চার্নক। শুনছেন ডেনহ্যাম?
ডেন। এখন কি করা যায়? একি চার্নক আপনি হাসছেন কেন? এটা কি হাসির সময়?
চার্নক। বিপদের সময় হাসলে মাথা ঠান্ডা থাকে।
ডেন। আমি সিওর, আপনি নিশ্চয়ই নতুন কোন ফন্দি ইনভেন্ট করেছেন।
চার্নক। ঠিক ধরেছেন। শুনুন তবে। [চার্নক ও ডেনহ্যামের ফিসফিস কথা। দূর থেকে চিৎকার, তোপধ্বনি]
চার্নক। বলুন তো আমাদের সৈন্য কত?                        

ডেন। নিউমারাস। 
চার্নক। অস্ত্র-শস্ত্র?
ডেন। কাউন্টলেস।
চার্নক। অথচ ইন রিয়েলিটি ফিউ, ভেরি ফিউ। ম্যাজিক, ম্যাজিক।


৫.


[ইংরেজ শিবির। জয়ের উল্লাস। মদ্যপান। ধ্বনি: থ্রি চিয়ারস ফর জোব চার্নক হিপ হিপ হুররে। মদ্যপানের ফলে জড়িতস্বরে কথা বলছে জেমস আর উইলিয়াম নামে দুজন সৈন্য]
জেমস। উই আর সেইভড। জানে বেঁচে গেছি। কি বলো উইলিয়াম?
উইলি। ঠিক বলেছ। থ্যাঙ্ক গড।
জেমস। যা টেররে কেটেছে।  যা ডিটারমিনড আর ফেরোসাস ছিল মোগলরা। চার্নক বুদ্ধি না বাৎলালে ফিনিশড হয়ে যেত ইংরেজ সেনারা।
উইলি। ব্যাপরটা বলো না শুনি।
জেমস। ক্যাপটেন ডেনহ্যামের জাহাজে হার্ডলি হানড্রেড সোলজার ছিল। অথচ মোগলরা দেখল নিউমারাস সৈন্য। কি করে জানো? শোন তাহলে। রাতের বেলায় হিজলি ফোর্ট থেকে সৈন্যরা লুকিয়ে গিয়ে উঠল ডেনহ্যামের জাহাজে। দিনের বেলায় তারাই মার্চ করতে করতে ফোর্টে ফিরতে লাগল। এরকম চলল দিনকয়েক। মোগলরা ভাবল প্রচুর ইংরেজ সৈন্য এসেছে।
উইলি। [হাসতে হাসতে] তাই ভয়ে তারা সারেন্ডার করল। থ্রি চিয়ার্স ফর চার্নক। এরকম ইনটেলিজেন্ট লিডারের আন্ডারে কাজ করার মজা আলাদা।
জেমস। রাইট ইউ আর। কিন্তু জানো উইলিয়াম, এইরকম ইনটেলিজেন্ট মানুষটি আনফরচুনেট।
উইলি। কেন? কেন?
জেমস। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্তারা চার্নককে নিয়ে খুশি নন। শুনেছি হুগলির ঘটনার সব দোষ তারা চাপিয়েছে চার্নকের ঘাড়ে। এখান থেকে যারা বিলাতে রিপোর্ট পাঠায়, তারাও চার্নককে দেখতে পারে না।
উইলি। যেমন হ্যামিলটন, হেজেস...
[জুতোর শব্দ। চার্লসের প্রবেশ]
জেমস। আরে চার্লস যে! গ্রেট চার্নকের গ্রেট সান-ইন-ল। এসো চার্লস, একটু মদ্যপান করো। আজ বড় আনন্দের দিন।
চার্লস। তোমরা আনন্দ করছে, কিন্তু জানো কি ফরমান এসে গেছে।
                 

জেমস। ফরমান? কার ফরমান?

চার্লস। শায়েস্তা খাঁর। সে ফরমানে আছে হিজলি ত্যাগ করে চলে যেতে হবে উলুবেড়িয়ায় ।জেমস। চার্নক কোথায়?

চার্লস। তিনি ডেনহ্যামের সঙ্গে আলোচনা করছেন। শায়েস্তা খাঁর ফরমান নিয়ে। তাঁর মনে সন্দেহ আছে, শায়েস্তা খাঁকে তিনি বিশ্বাস করেন না। 

জেমস। রাইট। এখন ভালোমানুষের মতো উলুবেড়িয়ায় থাকতে বলছেন, কিছুদিন বাদে সেখান থেকে তাড়াবেন।

চার্লস। তাই চার্নক সুতানটি চলে যাবার কথা ভাবছেন।


৬.


[জাহাজ চলার শব্দ। মাঝিমাল্লার চিৎকার]
চার্নক। [আপনমনে] শায়েস্তা খাঁর কথা বিশ্বাস করতে পারছি না। উলুবেড়িয়ায় থেকে লাভ কি! সেখান থেকে বাণিজ্য করা যাবে না। হুগলিতেও ফেরা যাবে না। মোগলদের সঙ্গে কনফ্রন্টেশন হতে পারে। বরং সুতানটি ভালো। আত্মরক্ষার উপযুক্ত জায়গা।
[বিবিজানের প্রবেশ]
বিবি। সাহেব, তুমি এখানে!
চার্নক। এসো, এসো।
বিবি। তোমার শরীর খারাপ করে নি তো!
চার্নক। [হেসে] আরে না,না।

বিবি। মেরি বলছিল আমরা সুতানটি যেতে পারি।
চার্নক। সেই কথাই ভাবছিলাম।
বিবি। মেরি আরও বলছিল সুতানটি জায়গাটা তোমার খুব পছন্দের।
চার্নক। ঠিকই বলেছে মেরি।
বিবি। সে বলেছে এবার সেখানে গেলে সে চিত্রেশ্বরী কালী মন্দিরে যাবে। গতবার তাড়াহুড়োর জন্য দেখতে পারে নি। ওদের সঙ্গে আমিও যাবো কিন্তু।
চার্নক। সে আমি জানি। স্বামীর মঙ্গল কামনায় তোমাকে যেতে হবে। বিবি, তুমি নিজেকে এমন উজাড় করে দিতে পারলে কোন শক্তিতে?
বিবি। ভালোবাসার শক্তিতে।
চার্নক। বিবি, এক বড় ইংরেজ কবির নাম শেক্সপীয়র। তিনিও ভালোবাসার শক্তির কথা বলেছেন। ভালোবাসা কোন বাধা মানে না।
[‘মা’, ‘মা’ ডাকতে ডাকতে মেরির প্রবেশ]
চার্নক। কি ব্যাপার মেরি? এনি প্রবলেম?
মেরি। প্রবলেম তৈরি করে তোমার জামাই।
চার্নক। কি হল ?
মেরি। ওর কোটটা খুঁজে পাচ্ছে না।
বিবি। আরে, ওটা আমি তুলে রেখেছি। চল দিয়ে আসি।
মেরি। তোমাকে যেতে হবে না। আমি খুঁজে নেবো।
[মেরি চলে যায়। মাঝিমাল্লার শব্দ ভেসে আসে]
চার্নক। নদীর মতো মানুষের জীবনটাও ক্রমাগত সামনের দিকে চলেছে। কুড়ি পাউন্ডের বেতনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে পাঁচ বৎসরের কড়ারে চাকরি নিয়ে চলে এলাম ইন্ডিয়ায়। বালেশ্বর আর রাজমহলের কুঠিতে কাজ করে তারপরে এলাম পাটনায়। পাঁচ বছর কাটল সেখানে। সেখানেই পেলাম তোমাকে। তারপর কাশিমবাজার, তারপর হুগলি, সেখান থেকে সুতানটি, তারপরে হিজলি, আবার
হিজলি থেকে সুতানটি।
[নিকলসনের প্রবেশ]
নিকল। তাহলে সুতানটিই ফাইনাল। সেখানে আবার কোন অবস্থায় পড়তে হবে কে জানে!
চার্নক। সেখানে কোন অসুবিধা হবে না মনে হয়। ডেনহ্যাম কোথায়?
নিকল। কিচেনে ব্যস্ত। বড্ড পেটুক মানুষ।
চার্নক। হিজলির হট্টগোলে কদিন বেচারার খাওয়া হয় নি।
নিকল। [হেসে] তার অবশ্য অন্য কারণ ছিল ।
চার্নক। কি কারণ?
নিকল। ভয়। এসেই শুনেছে হিজলির জল খারাপ। কলেরা হচ্ছে। সেই ভয়ে খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়েছিল।
চার্নক। তাহলে তো বড় কষ্টে দিন গেছে বেচারার।

 

৭.


[নদীর জলের শব্দ]
ডেনহ্যাম। নিকলসন, এই তোমাদের সুতানটি?
নিকল। ইয়েস ক্যাপটেন। 
ডেন। রিমুট ফ্রম সিভিলাইজড ওয়ার্ল্ড।
নিকল। ঘাবড়ে যাচ্ছেন।
ডেন। ঘাবড়াব না? বল কি ! এ যে ফরেস্ট।
নিকল । ফরেস্টেই তো সুবিধে। মোগলরা বিরক্ত করতে পারবে না।
ডেন। তা নাহয় হল, কিন্তু...
নিকল। কি?                           

ডেন। এখানে টাইগার আছে?
নিকল। থাকতে পারে। 
ডেন। বল কি!
নিকল। তবে শেয়ালকে টাইগার ভেবে ভয় পাবেন না যেন।
ডেন। হোয়াট ডু ইউ মিন?
নিকল। গতবারে এমন এক্সপিরিয়েন্স হয়েছিল। আমাদের এক সেনাপতি শেয়ালকে বাঘ ভেবে খুব হট্টগোল পাকিয়ে ছিলেন। আরে চার্নক না!
ডেন। কোথায়? কোথায়?
নিকল। ওই যে বাঁ দিকে। একজন নেটিভের সঙ্গে কথা বলছে। চার্নক নেটিভদের সঙ্গে ইজিলি মেলামেশা করতে পারে। ইন্ডিয়াকেও বেশ ভালোবেসে ফেলেছে। চলুন আমরা একটু এগিয়ে যাই ।
[চার্নক ও নেটিভের কথাবার্তার শব্দ]
চার্নক। এই যে নিকলসন, একে চিনতে পারছ?
নিকল। মিঃ বসাক না!
চার্নক। ঠিক ধরেছ। গোবিন্দনারায়ণ বসাক।
গোবিন্দ। নমস্কার। 
চার্নক। আর ইনি আমাদের আর এক বন্ধু, মিঃ ডেনহ্যাম।
গোবিন্দ। নমস্কার। 
নিকল। মিঃ বসাক, গতবারে আমরা যে আটচালাগুলো তৈরি করেছিলাম, সেগুলো কোথায় ?
চার্নক। আমিও সেকথা বলছিলাম। 
গোবিন্দ। ঝড়ে সব পড়ে গেছে সাহেব। আমাদের বাড়িঘরেরও অনেক ক্ষতি হয়েছে।
চার্নক। আবার টেম্পোরারি সেটেলমেন্ট তৈরি করতে হবে। আপনাদের সাহায্য প্রয়োজন।

গোবিন্দ। সে আপনি নিশ্চিত থাকুন।
চার্নক। আপনাদের ভরসাতেই তো আবার এলাম সুতানটি।
গোবিন্দ। থাকবেন তো?
চার্নক। থাকারই তো ইচ্ছে।
নিকল। এই জায়গাটাকে বিজনেস সেন্টার গড়ে তুলতে চাই। 
চার্নক। এখান থেকে ব্যবসা চালাব।
গোবিন্দ। বাঃ, খুব ভালো।
চার্নক। ফোর্ট হবে, ফ্যাক্টরি হবে, অবশ্য বিলাতের কর্তারা যাদি বাদ না সাধেন।

 


[মিউজিক]
চার্নক। [আপনমনে] সুতানটি হবে বাণিজ্যকেন্দ্র।... জমিনদার সাবর্ন চৌধুরী, কালীঘাটের লক্ষ্মীকান্ত মজুমদার - এদের সকলের হেল্প দরকার। ইনফ্লুয়েন্সিয়াল নেটিভস আ্যন্ড নেটিভ বিজনেসম্যানস -- ফ্রেন্ডলি রিলেশনস উইথ দেম — আই মাস্ট  কনভিন্স দেম —সুতানটির পসিবিলিটি অনেক - আ্যজ অ্যা বিজনেস সেন্টার সুতানটি ইজ পারফেক্ট.... আই মাস্ট কনভিন্স দ্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি — অ্যা ড্রিম হন্টস মি — অনেক ধৈর্য, অনেক লেবার চাই ..... ইংল্যান্ড থেকে আসছেন মিঃ হিথ, কি সংবাদ নিয়ে আসছেন কে জানে....
[মিউজিক]

 

৯. 


চার্নক। বলুন মিঃ হিথ, কি খবর?
হিথ। আপনি তৈরি হোন।
চার্নক। মানে?
হিথ। টু লিভ দিজ প্লেস।
চার্নক। সে কি!

হিথ। ইয়েস, ইমিডিয়েটলি।
চার্নক। সুতানটির মতো প্লেস, আইডিয়াল সেন্টার ফর বিজনেস...
হিথ। অল বোগাস। এটা সিম্পলি একটা ফরেস্ট।
চার্নক। কি বলছেন মিঃ হিথ?
হিথ। ঠিকই বলছি। তাছাড়া, কোম্পানির কর্তারা খুব চটে আছেন আপনার উপর।
চার্নক। কেন?
হিথ। হিজলির ব্যাপারে। এই দেখুন তাঁরা চিঠিতে কি লিখেছেন [ চিঠি বের করার শব্দ। হিথ চিঠি পড়ে যান] : ‘চার্নক, তুমি যাহা কিছু করিয়াছ, তাহাতে তোমার চরম নির্বুদ্ধিতা প্রকাশ পাইয়াছে। হুগলিতে মোগলদের সহিত বিবাদ বাধাইয়া হিজলিতে না গিয়া যদি সরাসরি আমাদের প্রেরিত সেনাদের লইয়া চট্টগ্রাম যাইতে, আমাদের আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করিতে, তাহা হইলে আমাদের এত ক্ষয়-ক্ষতি হইত না। চট্টগ্রাম দখল করিলেই মোগল শাসনকর্তারা ভীত হইয়া আমাদের প্রার্থিত স্বত্বগুলি বিনা বাক্য ব্যয়ে দান করিতেন। আমাদের লাভ হইত। তাহা হয় নাই। তোমার অদূরদর্শিতার জন্য আমাদের প্রভূত ক্ষতি হইয়াছে।’ [চিঠি পড়ার পরে রাগতস্বরে]  ইউ আর গিল্টি, বুঝলেন।
চার্নক। সব আমার দোষ! ও গড।
হিথ। হ্যাঁ, আপনারই দোষ। তারপরে আপনি কি করলেন, হিজলি ত্যাগ করে চট্টগ্রাম না গিয়ে এলেন সুতানটিতে। কেন? হোয়াই ডু ইউ সিলেক্ট দিজ প্লেস?
চার্নক। বিকজ অফ ইটস  জিওগ্রাফিক্যাল পজিশন। ইন ফিউচার এটা একটা বড় বাণিজ্যকেন্দ্র হবে উঠতে পারে বলে।
হিথ। আপনি মূর্খের স্বর্গে বাস করছেন মিঃ চার্নক।
চার্নক। লেট মি এক্সপ্লেইন মাই পয়েন্ট।
হিথ। থামুন। কোম্পানি আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন আমার সঙ্গে আপনাকে চট্টগ্রাম যাবার। 
চার্নক। সেটা কি ঠিক হবে মিঃ হিথ?
হিথ। মানে?                          

চার্নক। চট্টগ্রাম যাওয়ার ডিশিসন কি ঠিক হবে?
হিথ। হু আর ইউ টু ডিকটেট রাইট অর রং?
চার্নক। না, না, আমি ডিকটেট করছি না..
হিথ। ইউ মাস্ট একজিকিউট দ্য অর্ডার।
চার্নক। মিঃ হিথ গ্রাউন্ড রিয়েলিটিটা বুঝুন।
হিথ। রিয়েলিটিটা কি?
চার্নক। আপনার অধীনে কত সৈন্য আছে?
হিথ। থ্রি হানড্রেড।
চার্নক। অনলি ? মোগলদের সৈন্য কত জানেন?
হিথ। কত?
চার্নক। নিয়ারলি টুয়েলভ থাউজেন্ট।
হিথ। তা হলেও আমার কিছু করার নেই। উই মাস্ট ক্যারি আউট দ্য অর্ডার।
চার্নক। কিন্তু...
হিথ। কোন কিন্তু নয়। তৈরি থাকবেন।
[হিথের প্রস্থান]
চার্নক।[আপনমনে] চট্টগ্রাম দখল? আনওয়াইজ অ্যান্ড অ্যাবসার্ড। গ্রাউন্ড রিয়েলিটি বুঝবে কি করে কোম্পানি? তারা তো এখানকার কিছু প্রতিনিধির কথা শুনে ডিশিসন নেয়। যেতে হবে চট্টগ্রাম। আবার অপারেশন সাকসেসফুল না হলে দোষ হবে আমার।
[বিবির প্রবেশ]
বিবি। একি, হিথ সাহেব চলে গেলেন যে!
চার্নক। তিনি এখন চট্টগ্রাম দখল করতে যাবেন। আমাকেও যেতে হবে তাঁর সঙ্গে। কোম্পানির আদেশ নিয়ে এসেছে। 
বিবি। আবার যুদ্ধ!
চার্নক। যুদ্ধ হবে, আর আমরা গো-হারান হারবো।
বিবি। তুমি বুঝিয়ে বলেছিলে?
চার্নক। অনেক চেষ্টা করলাম। শুনলেন না। ভাগ্যের পরিহাস। আমি এ দেশের মাটিতে বসে যা দেখছি এবং যা বুঝছি সেটা ভুল; আর ওরা সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপারে থেকে যা বলবে সেটা ঠিক বলে মানতে হবে।


১০.


[নদীর জলের শব্দ। বিবিজান বসে আছে। কথা বলতে বলতে চার্লস ও মেরির প্রবেশ]
মেরি। ওই দেখো, মা বসে আছে।
চার্লস। তোমার বাবার অপেক্ষায়, বুঝলে! আচ্ছা মেরি, আমি যদি বাইরে যাই, তুমি আমাকে ছেড়ে থাকতে পারবে?
মেরি। তুমি বাইরে যাবে কেন?
চার্লস। ধরো তোমার বাবা যদি আমাকে বাইরে পাঠান?
মেরি। আমিও যাব তোমার সঙ্গে।
[ওদের দেখতে পেয়ে বিবি ওদের ডাকে]
বিবি। চার্লস, ওদের কোন খবর পেয়েছ?
চার্লস। তেমন কিছু নয়। তবে এটুকু শুনেছি যে মিঃ হিথ মিঃ চার্নককে নিয়ে চিটাগাঙের আগে বালেশ্বরে গেছেন।
বিবি। বালেশ্বর?
মেরি। হ্যাঁ মা, সেখানে হিথ শহর লুটপাট করেছেন। কয়েকজন ইংরেজ মোগলদের হাতে বন্দিও হয়েছেন। তাদের বিপদের মুখে ফেলে ছোট বহর নিয়ে মিঃ হিথ চিটাগাঙ যাত্রা করেছেন।
চার্লস। এই হিথই যত নষ্টের মূল। বাবার কোন যুক্তি তিনি শুনতে চান নি।
বিবি। হ্যাঁ, উনি বলেছিলেন চিটাগাঙ গিয়ে কোন লাভ হবে না, উল্টে বিপদ বাড়বে।
মেরি। হিথ যুক্তির ধার ধারেন না। যেন এ দেশেকে তিনি বাবার চেয়ে বেশি চেনেন।
বিবি। এসব ওঁকে বিপদে ফেলার মতলব।
মেরি। তুমি কিছু ভেবো না মা। বাবা ঠিক বিপদ থেকে বেরিয়ে আসবে।
বিবি। বড্ড ভয় করে রে! আমি তো আর তোদের মতো ইংরেজ বাপের বেটি নই।


১১.


[জাহাজ চলছে। যুদ্ধের পরিবেশ। গুলির শব্দ। আর্তনাদ]
হিথ। মিঃ চার্নক !
চার্নক। বলুন মিঃ হিথ।
হিথ।একটা ওয়ে আউট বের করুন।
চার্নক। রিট্রিট-
হিথ। সেটা তো শেষ কথা। 
চার্নক। এ ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই।
হিথ। আমি ভাবতে পারি নি চিটাগাঙ এত ওয়েল প্রটেক্টেড।
চার্নক। আমি বলেছিলাম।
হিথ। পাস্ট ইজ পাস্ট। এখন আপনার সাজেশন কি!
চার্নক। ফিরে যেতে হবে।
হিথ। আমার একটা প্ল্যান শুনবেন! দুমুখো নীতি নিলে কেমন হয়?
চার্নক। বুঝলাম না।

হিথ। এখানকার মোগলদের সঙ্গে সন্ধি করব।
চার্নক। সে কি ! আপনি তো ওদের শায়েস্তা করতে এসেছিলেন।
হিথ। আপনি দেখছি ডিপ্লোম্যাসির কিছুই বোঝেন না।
চার্নক। তা অবশ্য।
হিথ। একদিকে মোগলদের সঙ্গে বন্ধুত্বের ভান করব, অন্যদিকে আরাকান রাজের সঙ্গে কন্সপিরেসি চালাব। পরে আরাকানকে সঙ্গে নিয়ে মোগলদের টাইট দেব।
চার্নক। মিঃ হিথ , আপনি মোগলদের যতটা বোকা ভাবছেন, তারা তত বোকা নয়।
হিথ। আমাদের কৌশল ধরে ফেলবে, বলছেন?
চার্নক। আমার তো তাই মনে হয়। তাছাড়া এখানে আমাদের কোন বেস নেই। তাছাড়া, আপনি বোধ হয় জানেন না যে সৈন্যদের মধ্যে একটা ডিজিজ দেখা দিয়েছে।
হিথ। হোয়াট ডিজিজ?
চার্নক। স্কর্ভি। তাই বলছিলাম, ফিরে চলুন।
হিথ। অগত্যা। কিন্তু আমি মাদ্রাজ যাব। আপনাকেও আমার সঙ্গে যেতে হবে। ওখানে রিপোর্ট করতে হবে।

 

১২


[চার্লস দৌড়াতে দৌড়াতে আসে, মেরিকে ডাকতে ডাকতে]
মেরি। কি হল চার্লস, কি খবর?
চার্লস। মিঃ হিথকে রিট্রিট করতে হয়েছে চিটাগাং থেকে।
মেরি। তাহলে বাবারা এখানে আসছেন।
চার্লস। না।
মেরি। কেন?

চার্লস। মিঃ হিথ বাবাকে নিয়ে মাদ্রাজ যচ্ছেন।
মেরি। সে কি? কেন?
চার্লস। তা জানি না।
মেরি। এ কথা শুনলে মা বড় চিন্তিত হয়ে পড়বে। শোন চার্লস, মাকে এ কথা জানানোর দরকার নেই। এই রে, মা যে এদিকে আসছে।
[বিবির প্রবেশ]
বিবি। ওরা সব বলাবলি করছে চট্টগ্রাম থেকে খবর এসেছে?
চার্লস। হ্যাঁ। চট্টগ্রাম থেকে ওঁরা বেরিয়েছেন, তবে, মানে আর কি হল আমি জানি না। 
বিবি। তুমি কি কিছু লুকোবার চেষ্টা করছ?
চার্লস। বাকিটা মেরির কাছে শুনুন। আমাকে আবার একটু বেরুতে হবে ল
[চার্লসের প্রস্থান]
বিবি। ঠিক কি হয়েছে বলতো মেরি।
মেরি। কি আবার হবে!
বিবি। চট্টগ্রাম থেকে এখানে আসছে তো!
মেরি। না মা, বিশেষ কাজে হিথের সঙ্গে বাবাকে মাদ্রাজ যেতে হচ্ছে।
বিবি। সে কি রে !
মেরি। অত উতলা হোয় না। সব ঠিক হবে যাবে।

 

১৩.


[জাহাজ চলার শব্দ। ইংরেজদের কথাবার্তা]
জেমস। চার্নক কি বললেন উইলিয়াম?
উইলিয়াম। একটা সুরাহা হয়েছে।

জেমস। কি রকম?
উইলি। এবার হাল ধরেছেন সুরাটের কুঠির অধ্যক্ষ স্যার জন চাইল্ড। বঙ্গদেশে মোগলরা ইংরেজদের বাণিজ্য করতে দিচ্ছে না শুনে তিনি সম্রাট ঔরঙ্গজিবকে বলে দিয়েছেন তাঁদের কথায় কান না দিলে তাঁরা সুরাট থেকে বাণিজ্য তুলে দেবেন, সমুদ্রগামী জাহাজে লুটপাট চালাবেন। সম্রাট দেখলেন বাণিজ্য বন্ধ মানে রাজকোষের ক্ষতি। তাই তিনি বাংলায় ইংরেজদের বাণিজ্যের অনুমতি দিয়েছেন। [চার্নকের প্রবেশ]
চার্নক। একটু ভুল হল উইলিয়াম।
[জেমস ও উইলিয়াম সচকিত –‘একি চার্নক যে’]
চার্নক। মোগল সম্রাট বাণিজ্যের অনুমতি দিলেও শর্ত দিয়েছেন।
জেমস। কি শর্ত?
চার্নক। সম্রাটের লুণ্ঠিত দ্রব্যের মূল্যস্বরূপ দেড় লক্ষ টাকা দিতে হবে। তাঁর ফরমান চলে গেছে ইব্রাহিম খাঁএর কাছে।
উইলি। ইব্রাহিম খাঁ আবার কে?
চার্নক। শায়েস্তা খাঁ এর পরে বাংলার শাসনকর্তা। তিনি শান্তিপ্রিয় মানুষ। সুতরাং আমাদের অসুবিধা হবে না।
[তোপধ্বনি]
জেমস ও উইলি। একি! থানাদুর্গ থেকে তোপধ্বনি কেন?
চার্নক। ভয় পেয়ো না। সুতানটিতে আমাদের অভ্যর্থনা জানানো হচ্ছে।
[মিউজিক]


১৪.

[সুতানটিতে জাহাজ ভিড়ল। হট্টগোল। ‘তেরো মাস পরে এলাম আবার’,‘’ জেমস এদিকে এসো’, ‘নিকলসন নিকলসন’, ‘চার্নক কোথায় গেলেন?’]

 


১৫.


বিবি। ধীরে সুস্থে খাও।
চার্নক। তেরো মাসের খাওয়া কি একদিনে সারতে চাও বিবিজান?
বিবি। কিভাবে যে কেটেছে এই কয় মাস!
চার্নক। কি করব! উপায় ছিল না। এবার বোধহয় একটু সুস্থির হতে পারব। সুতানটিকে বাণিজ্যের কেন্দ্র করে তুলব। তোমার মা কালীর কাছে সেই প্রার্থনা করো।


১৬.
চার্নক। আরে বসাকবাবু, আসুন আসুন।
বসাক। আপনি ফিরেছেন শুনে দেখা করতে এলাম। এবার এখানে একটু থিতু হয়ে বসুন তো !
চার্নক। আমারও তাই ইচ্ছে। তবে কিনা, কোম্পানির আদেশকে তো অমান্য করতে পারি না । তাঁরা আবার সুতানটিকে তেমন আমল দিতে চান না।
বসাক। সুতানটিকে আপনি সত্যই ভালোবেসে ফেলেছেন সাহেব। আপনি কাজে লাগুন। আমাদের সাহায্য পাবেন।
চার্নক। শ্যামরায়ের উৎসবের জায়গায় একটা পাকা কুঠি পাওয়া যাবে শুনলাম।
বসাক। হ্যাঁ, ঠিক শুনেছেন। ব্রাহ্মণ জমিদারদের জমিতে প্রয়োজনমতো জমা-বন্দোবস্ত করা যাবে। কাল হাটে আসছেন তো?
চার্নক। যাবো, যাবো।
বসাক। আজ তাহলে উঠি।
[বসাক চলে গেলেন]
চার্নক। [আপনমনে] আমি - আমি যেন দেখতে পাই হুগলি নদীর বুক চিরে চলেছে বড় বড় বাণিজ্যতরী.. তাদের বাঁশি বাজছে... পতাকা উড়ছে... জল কেটে ছুটে চলেছে জাহাজ...[মিউজিক]
[বিবিজানের প্রবেশ]
বিবি। কোন জাহাজ সাহেব?

চার্নক। এ আমার স্বপ্নের জাহাজ বিবি। আমার সেই সুতানটির স্বপ্ন। অনেক--- অনেক দূরের স্বপ্ন।
[চার্লস ও মেরির প্রবেশ]
চার্নক। এই যে মেরি, এই যে চার্লস, তোমরাও শোন... একদিন সুতানটি হয়ে উঠবে বিরাট শহর... বড় বড় রাজপথ ঝলমল করবে আলোয়... ব্যবসায়ী আসবে, ডিপ্লোম্যাট আসবে, শিল্পী আসবে... ইন্ডিয়ার নিউক্লিয়াস হবে সুতানটি... সেদিন আমি থাকবো না, শেঠ-বসাকরা থাকবে না, তোমরাও থাকবে না... সুতানটি থাকবে... আমার স্বপ্ন সফল হবে, হবেই....
[আধুনিক কলকাতার আভাস ফুটে উঠবে শব্দের অনুষঙ্গে]

Comments

Top

প্রবন্ধ

কৃষ্ণনাম না রবীন্দ্রনাম?

হেমন্তবালা - কোথায়

পেলেন অমৃতধাম? 

ইন্দ্রজিৎ সেনগুপ্ত

এইচ বি টাউন, সোদপুর, কলকাতা

images.png
কষ্ণনাম না রবীন্দ্রনাম

৯৩৯ সালের গোড়ার দিকে রবীন্দ্রনাথের কাছে কপিং পেন্সিলে লেখা নাম ঠিকানাবিহীন একখানা চিঠি এল – “যোগাযোগের গ্রন্থকারকে অজস্র নমস্কার”। 
দ্বিতীয় একখানা চিঠি এল তাঁর কাছে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে দ্বারকানাথ ঠাকুরের লেনে, যদিও ঠিকানায় বাড়ির নম্বর দেওয়া ছিল না। চিঠিখানা ছিল আগাগোড়া পদ্যাকারে রচিত –
‘হে মোর অমর কবি হে চির মধুর’  ইত্যাদি। 
নীচে সাক্ষর ছিল খদোৎবালা। এরপরে তৃতীয় একখানা চিঠির উল্লেখ করতে হয়, সেখানা এসেছিল জোনাকি দেবীর কাছ থেকে – গুরুদেবের কাছে কাকুতি মিনতি করে তাঁর স্বাক্ষর ভিক্ষা করে। তিনি রবীন্দ্রনাথকে উদ্দেশ্য করে লিখলেন, -
‘জোনাকি চায় রবি! চরণে তব’
এই চিঠির জবাব গেল –
‘কল্যাণীয়া জোনাকি,
তুমি আমার অন্তরের আশীর্বাদ গ্রহণ করো’।
ইতি ৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩১
শুভাকাঙ্ক্ষী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
তখনও রবীন্দ্রনাথ শ্রী বর্জিত হননি। তারপর এই আসরে দেখা দিলেন ‘দক্ষবালা দেবী’। তিনি রবীন্দ্রনাথের কাছে একটি আনকোরা নতুন কবিতা প্রার্থনা করে চিঠি লিখলেন। তাতে প্রশ্ন করলেন, কবি কার উদ্দেশ্যে এমন সুন্দর সুন্দর কবিতা রচনা করে থাকেন? তিনি কি ভগবান না মানুষ? নর না নারী? তার নাম কি ইত্যাদি।
আশ্চর্যের কথা, রবীন্দ্রনাথ অজ্ঞাত নামধারিণী অপরিচিতা মহিলার প্রার্থনা পূরণ করেছিলেন। তিনি নীহারিকা নামক একটি নতুন কবিতা দক্ষবালা দেবীর কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
“অস্তরবির-পথ-তাকানো মেঘে
কালোর বুকে আলোর বেদন লেগে--
কেন এমন খনে
কে যেন সে উঠল হঠাৎ জেগে
আমার শূন্য মনে”।
কবিতা পেয়ে হেমন্তবালাদেবীর আনন্দ আর ধরে না। যেন অভাবিত ঐশ্বর্য লাভ হয়েছে তাঁর। শ্রীশ্রী ঠাকুর তাঁর সদ্য প্রয়াত হয়েছেন। আশ্রম আর সংসারের টানাপোড়েনে দিশেহারা হেমন্ত-বালা তখন রবীন্দ্রনাথের কাছে নিজের যন্ত্রণা তুলে ধরছেন, 
‘যে গান দিয়ে গেছে আমার কানে
জপিতে আজীবন ধরে
যে গান ছাড়া মোর জগৎ মাঝে
নিজের আর কিছু নাই
সে গান ভুলে গেছি, কৃপায় তব
স্মরণে ফিরে পেতে চাই’।
এরপর মন স্থির আর সাহস সঞ্চয় করে হেমন্তবালাদেবী নিজের প্রকৃত পরিচয় জানিয়ে রবীন্দ্রনাথকে শেষ পর্যন্ত একটা চিঠি লিখে ফেললেন। তাঁর সঙ্গে পত্রালাপের কথা শ্বশুরবাড়ির লোকেরা জানতে পারলে পাছে রাগ করেন, এই ভয়ে হেমন্তবালাদেবী এতদিন নিজের পরিচয় গোপন রেখেছিলেন, ছদ্ম নাম ঠিকানা দিয়ে চিঠি লিখেছিলেন এবং এ জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। এই চিঠি পেয়েই রবীন্দ্রনাথের টনক নড়ল। আর সেই সময়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে লিখেছেন আটখানা চিঠি এবং তাঁকে একটি নতুন কবিতাও নিজের হাতে লিখে উপহার পাঠিয়েছিলেন। ৮নং চিঠিতে তিনি লিখেছেন
“তুমি কে তা আমি জানি নে— কিন্তু তোমার লেখা থেকে এটুকু বুঝতে পেরেছি যে তুমি লিখিয়ে, অর্থাৎ আমাদেরই দলের লোক তাই তোমার দাবী অগ্রাহ্য করা সম্ভব হোল না”।  তিনি আরও লিখেছেন –
“তোমার চিঠিতে তোমার কবিতার যে পরিচয় পেয়েছি তাতে আমি বিস্মিত হয়েচি। অত্যন্ত খাটি কবিতা, বানানো নয়, পরিণত লেখনীর সৃষ্টি। তুমি বাংলাদেশে অনেককে আবিষ্কার করেচ লিখেচ —বোধ হয় নিজেকেও আবিষ্কার করেচ কিন্তু প্রকাশ করেচ কি না জানি নে”। চিঠিগুলি ছিল সাহিত্য রসে সমৃদ্ধ, এ যেমন একটি কারণ, আরও একটি কারণ ছিল যে জন্যে এক অজানা অপরিচিতা মহিলার চিঠি রবীন্দ্রনাথের অন্তরকে স্পর্শ করেছিল এবং তিনি তাতে সাড়া না দিয়ে পারেননি।
“আমার সময় বড়ো কম। আমাকে অনেকে বাজে চিঠি লেখে —তার উত্তর দিতে গেলে আমার সময়ের অপব্যয় হয়। তুমি তোমার সত্য প্রয়োজনেই আমাকে লিখেচ বলেই আমি তোমাকে ভালো করে বুঝিয়ে লিখতে কৃপণতা করি নে। তা ছাড়া তুমি লিখতে জানো তাই লেখা আদায় করা তোমার পক্ষে সহজ”।
“তোমার চিঠি পড়ে আমি বিরক্ত হচ্চি এমন কল্পনা কোরো না। যে গভীর উপলব্ধির ভিতর দিয়ে তুমি গিয়েচ সেটা আমার জানতে ভালোই লাগচে”।  
“তোমার চিঠি পড়তে আমার বিশেষ ভালো লাগে । তোমার জীবনের যা গভীরতম উপলব্ধি তার সৌন্দৰ্য্য ও সত্যতা আমি মনে বেশ বুঝতে পারি। আমার নিজের পথ তোমার থেকে পৃথক বলেই তোমার অভিজ্ঞতার বিবরণ শুনতে আমি এত ঔৎসুক্য অনুভব করি “। 
হেমন্ত-বালা দেবী গুরুতর মানসিক অশান্তির মধ্যে পড়েছিলেন। তিনি বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষা নিয়েছিলেন। এই ব্যাপার নিয়ে সংসারের সাথে তাঁর বিরোধ ঘটে, তিনি শ্রীবৃন্দাবনে চলে যাওয়ার চেষ্টা করেন, কিন্তু সংসার থেকে বাধা পান। ফলে, একটা দ্বন্দ্ব-সংঘাত এবং মনের বিক্ষুব্ধ অবস্থা তাঁর চলছিল। এইরকম সময়ে হেমন্ত-বালা দেবীর হাতে পড়ে রবীন্দ্রনাথের ‘সঞ্চয়’, ‘যোগাযোগ’ ও ‘শেষের কবিতা’। পড়ে তিনি চমকে ওঠেন। রবীন্দ্রনাথের কিছু লেখা তিনি আগেও পড়েছিলেন তবে নিতান্তই ভাসাভাসা ভাবে। আজ তাঁর মনে হল বাঙালি ঘরের এত সব সমস্যা তিনি জানলেন কি করে? কিংবা এমন ফোটোগ্রাফারের মত লিখতে পারলেনই বা কি করে? এ তো যে সে মানুষের কর্ম নয়। নিশ্চয়ই তাঁর মধ্যে শ্রীভগবানের বিভূতি আছে।
এর ফলেই রবীন্দ্রনাথ পেয়েছিলেন ‘খদোৎবালা’, ‘জোনাকি’, ও ‘দক্ষবালা’ দেবীর উচ্ছ্বাসপূর্ণ বিভিন্ন চিঠি। প্রসঙ্গত বলা যেতে পারে, দক্ষবালা ছিল তাঁর কোষ্টিগত রাশিনাম এবং আর যে দুটি ছদ্মনামের আশ্রয় তিনি নিয়েছিলেন, সেই খদোৎ বা জোনাকি রবিরই প্রসাদভিক্ষু

স্বল্পজ্যোতির অধিকারী ক্ষুদ্র প্রাণী। এইভাবে রবীন্দ্রনাথের প্রতি তিনি এক প্রবল আন্তরিক আকর্ষণ অনুভব করে পরিশেষে তাঁর সংস্পর্শে এসেছিলেন। হেমন্তবালা দেবী লিখছেন, “রবীন্দ্রনাথের ‘সঞ্চয়’, ‘যোগাযোগ’ ও ‘শেষের কবিতা পড়ি, তাঁর কবিতা ও গান কিছুকিছু পড়া ছিল – অকস্মাৎ তাঁর একটি নতুন পরিচয় আমার কাছে উদঘাটিত হয়”। অথচ তিনি নমস্কার জানালেন বেছে বেছে শুধু ‘যোগাযোগ’ উপন্যাসের গ্রন্থকার রবীন্দ্রনাথকে। কুমুদিনীর বিড়ম্বিত জীবনের বেদনার মধ্যে, যেন ‘অবিকল ফটোগ্রাফির মত করে লেখা’। তাই ‘যোগাযোগ’ উপন্যাসই সম্ভবত তাঁকে বিশেষভাবে অভিভূত করেছিল।
রবীন্দ্রনাথকে যখন চিঠি লেখা শুরু করেছিলেন তখন জোনাকি ছদ্মনামটুকুই ছিল আশ্রয়। পরিবারে সবটা জানাজানি হয়ে যায় এই ছিল হেমন্তবালার ভয়। রবীন্দ্রনাথ এই আড়ালটুকুকে শ্রদ্ধা করেই তা বজায় রেখেছেন সবসময়। এই কবিতায় জোনাকি ওরফে হেমন্তবালা মনে করছেন রবীন্দ্রনাথ যেন তাঁকে দেখতে চাইছেন, জানতে চাইছেন, তাঁর আসল পরিচয়। সঙ্গে রয়েছে জোনাকির উত্তরও, -
“ও জোনাকি বালা
আঁখির আগে এসে দাঁড়াও
দেখি রূপের আলা।
জোনাকি কয় মোর পরিচয়
আড়াল থেকেই হবে নিতে
তোমার সাথে আমার আলাপ
সুলভ তো নয় ধরণীতে”।
রবীন্দ্রনাথকে হেমন্তবালা যেসব কবিতা পাঠিয়েছেন তার বেশিরভাগই স্তুতিমূলক। যেন রবীন্দ্রনাথকে ভজনা করছেন তিনি, 
“কচি কোমল কদলীপত্র গাঁথিয়া
আসন তোমার রেখেছি পাতিয়া।
মল্লিকামালা দিয়েছি বুলায়ে যেখানে যেমন সাজে”।
আবার কখনও অন্য কবিতায় গুরুদেবকে নিবেদন করেছেন অন্তরের প্রণাম
“তুমি মোরে কর আশীর্বাদ
সকল অন্তর দিয়ে  ও চরণে প্রণামিয়ে
মাগি আমি তোমার প্রসাদ।“
আবার অন্য একটি কবিতায় কবিকে বলেছেন যেখানেই তিনি যাবেন হেমন্তবালাকেও যেন সঙ্গে করে নিয়ে যান।
“যেথা যাও যাও নিয়ে গৈরিক আঁচল দিয়ে
ঢেকে নাও বিশাল অন্তরে
লালিয়া-পালিয়া স্নেহে এখন এ বন-গেহে
একা ফেলে যেও না অন্তরে”।
অন্য আর একটি কবিতাতেও রবীন্দ্রনাথের স্মরণ চাইছেন হেমন্তবালা।
“চাহিনা গো, মুক্তি নাহি চাই
স্নেহময় বক্ষতলে   অবিরাম স্নেহাঞ্চলে
কিঞ্চিৎ শরণ যদি পাই”।
রবীন্দ্রনাথকে সম্বোধন করে হেমন্তবালাদেবী বলেছিলেন, - “আপনি আমার দেবতা …আমার কল্পলোকের রাজা”। এই সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “আমার কল্পরূপকে আশ্রয় করে যাঁকে তুমি হৃদয়ে উপলব্ধি করেচ আমি তাঁরই পূজা করে থাকি, তিনি আমাদের সকলের মধ্যেই, তিনি পরম মানব”।
একবার হেমন্তবালার জন্মদিনে ‘অপূর্ণ’ কবিতা লিখে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে আশীর্বাদ জানিয়েছিলেন,-
“মনের যে-ক্ষুধা চাহে ভাষা,
সঙ্গের যে ক্ষুধা নিত্য পথ চেয়ে করে কার আশা,
যে ক্ষুধা উদ্দেশহীন অজানার লাগি
অন্তরে গোপনে রয় জাগি --
সবে তারা মিলি নিতি নিতি
নানা আকর্ষণবেগে গড়ি তোলে মানস-আকৃতি”।
রবীন্দ্রনাথকে তিনি পেয়েছিলেন, এ যেমন তাঁর এক সৌভাগ্য, তাঁকে তিনি দৈবের বিপাকে পড়ে অকুণ্ঠচিত্তে পুরোপুরি গ্রহণ করতে পারলেন না, এও তাঁর এক দুর্ভাগ্য। রবীন্দ্রনাথকে তিনি পেয়েও পেলেন না, রবীন্দ্রনাথ তাঁর নন, কিন্তু তিনি রবীন্দ্রনাথেরই আশ্রিতা, রবীন্দ্রনাথেরই সেবিকা। “এ জন্মে আর আপনাকে দেখা, আপনার কথা শোনা, আপনাকে জানা চেনা আমার হল না। আমার জীবন অসমাপ্ত সৌভাগ্যে, সুসমাপ্ত দুর্ভাগ্যে পূর্ণ রহিয়া গেল। -তবুও মনে রাখিবেন, আমি যতই কেননা অধম হই, আমি আপনার”।

হেমন্তবালাদেবীকে লিখিত রবীন্দ্রনাথের সর্বশেষ চিঠি - 
“কল্যানীয়াসু,
জরার প্রান্তসীমায় আমি আজ শয্যাগত। তোমরা যে অর্ঘ্য আজ আমাকে পাঠিয়েছ মুখে উপযুক্ত সমাদর প্রকাশ করতেপারলেম না। আনন্দ অন্তরে অব্যক্ত রইল। নিশ্চিত জানি তোমার কাছে তা অগোচর থাকবে না। তুমি আমার আশীর্বাদপূর্ণ অভিনন্দন গ্রহণ করো। 
ইতি ১০।০৫।৪১
শুভাকাঙ্ক্ষী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


বাইশে শ্রাবণ হেমন্তবালাদেবী লিখলেন,
“তুমি কি বাণী লইয়া এলে আজি।
অগ্নিবীণায় তব কি সুর উঠল হৃদে বাজি
শান্তি-শান্তি হোক।
পুড়ে যাক জীবনের গ্লানি”।


ঋণ:- রবীন্দ্রজীবনী – প্রশান্তকুমার পাল। শরণদাতা রবীন্দ্রনাথ ও হেমন্তবালাদেবী - প্রভাত চন্দ্র গুপ্ত। হেমন্তবালাদেবীর রচনা সংকলন –দে’জ

Comments

Top

বাঙালী

‘ব্যবসা করো’

অনিন্দিতা মাইতি নন্দী

খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর

newspaper.jpg

প্রবন্ধ

বাঙালী ব্যবসা করো

ন্মসূত্রে আমি এমন একটি বাঙালী পরিবারে জন্মেছি যেখানে শিক্ষকতাই মূল পেশা পরিবারের আত্মীয়রাও সকলের কম বেশী চাকুরীজীবি। বাণিজ্য -এর 'ব' সম্পর্কে তেমন কোনো সুস্পষ্ট ধারণা নেই আমার। স্কুল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর রসায়ন নিয়েই পড়ার অদম্য উৎসাহে, বিশ্ববিদ্যালয় অব্দি রসায়নের রস আস্বাদনের সুযোগ পাই। মুখস্ত বিদ্যেতে আমার প্রবল অনীহা নাকি অক্ষমতা জানা নেই, তবে বোধশক্তির ওপর বরাবর জোর দিয়ে গেছি, তাই পরীক্ষায় এই দৌড় নিয়ে যতটুকু যাওয়া যায় সেই অব্দি কোনরকমে  পৌঁছনোর একট চেষ্টা করেছি। আর পাঁচজন, রসায়ন পড়তে গিয়ে, যেমন- 'রসায়ন' কি বা ভারতীয় রসায়নের জনক কে? ইত্যাদি জানেন আমিও তেমন ভাবেই ভারতীয় রসায়নের জনকের নাম জেনেছি, তিনি যে'মাস্টার অফ নাইট্রাইটস' -এগুলো তো রসায়ন পাঠ্য পুস্তকেই পড়েছি। কিন্তু এই বিশ্ব করোনা সংক্রমণে হঠাৎ করে এই প্রখ্যাত রসায়নবিদ্ প্রতিষ্ঠিত 'বেঙ্গল কেমিক্যালস' -এর উপর এতই আলোকপাত হয় যে নতুন করে আবার আমাদের আচার্যকে স্মরণ করতে হয়।

ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন ধরণের বই পড়ার অভ্যেস আমার। বুঝি বা না বুঝি বইয়ের পাতা ওল্টাতে আমার ভালো লাগে- এখনো সেই পুরানো অভ্যেসটা আমার রয়ে গেছে। এমনি ভাবেই একটি বই যেখানে বিভিন্ন বিজ্ঞানীর জীবনী পড়তে গিয়ে কিছু বিশেষ পাতায় আমার চোখ আটকে যায়--- কে ঐ রসায়নবিদ্ যিনি আশি বছর বয়সেও উদাত্তচিত্তে ডাক দেন---‘বাঙালী ব্যবসা করো’।

তিনি বাংলার নবজাগরণের পুরোধা পুরুষ, ভারতে রাসায়নবিদ্যার জনক, শিল্প প্রতিষ্ঠাতা আবার, ব্যবসা বাণিজ্য উদ্যোগী, 'বেঙ্গল কেমিক্যাল' ভারতের প্রথম ফার্মা ইন্ডাস্ট্রির প্রতিষ্ঠাতা, মাস্টার অফ নাইট্রাইটস্ আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়।

আচার্যদেব ১৮৬১ সালের ২রা আগস্ট রাড়ুলি গ্রামে জন্মেছিলেন যা ছিল কপোতাক্ষ নদের তীরে। কিছুদূরেই কবি মধুসূদন জন্মভূমি সাগরদাঁড়ি। আচার্যদেব স্বয়ং তাঁর জন্মসালটি কে একটি ঐতিহাসিক ঘটনার সাথে যুক্ত করে বলেন "এই বৎসর টি রাসায়নশাস্ত্রের ইতিহাসে স্মরণীয়, কেন না ঐ বৎসরেই ক্রূক্স'থ্যালিয়াম' আবিষ্কার করেন"। থ্যালিয়ামের বর্ণালীর রঙ সবুজ, যেন সবুজ সঙ্কেত দেয় রসায়নবিজ্ঞানী হয়ে ওঠা প্রফুল্লচন্দ্রকে। ১৮৬১ সালটি প্রকৃতপক্ষে বাঙালীদের জন্য স্বর্ণযুগের বছর কারণ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ও প্রখ্যাত ডাঃ নীলরতন সরকার ওই একই বছর জন্মগ্রহণ করেন। বাংলাকে, ভারতকে ভরিয়ে দিতেই যেন এই ত্রয়ীর একইসাথে আবির্ভাব। আচার্যদেব চিন্তাভাবনায় ভারতীয় আবার আন্তর্জাতিকও। তিনি ছিলেন একজন ব্যতিক্রমী বাঙালী। তিনিই একমাত্র বিজ্ঞানী যিনি গবেষণাগারে শুধু আবদ্ধ না থেকে অতিসাধারণ মানুষের পাশে এসে, কর্মকলাপের মাধ্যমে প্রকৃত দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

বাঙালীর আর্থিক দূর্দশা, দৈন্যদশা, চারিত্রিক দুর্বলতা নিয়ে এভাবে আর কোন প্রথিতযশা বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনা করে আলোকপাত সেযুগে করেননি।

বাঙালীকে অন্তরের অন্তরস্থল থেকে প্রকৃত ভালোবাসতেন এই আচার্যদেব, তাই বাঙালির প্রকৃতি, স্বভাব, অভ্যাস, কর্মদক্ষতা ও চারিত্রিক ত্রূটি বিচ্যুতির ওপর একমাত্র যথার্থ বিশ্লেষণ করেছেন, ছুরি চালনা করে অ্যানাটমি বিশ্লেষকের ভূমিকায় এই আচার্য। তাই 'আত্মচরিত'এ তিনি বলেছেন:-

“আমি বাঙালী চরিত্র বিশ্লেষণ করিয়া তাহার দোষ ত্রূটি দেখাইতে দ্বিধা করি নাই। অস্ত্রচিকিৎসকের মতই আমি তাহার দেহের ছুরি চালাইয়াছি এবং ব্যাধিগ্রস্ত অংশ দূর করিয়া তাহাতে ঔষধ প্রয়োগ করিতে চেষ্টা করিয়াছি। কিন্তু বাঙালি আমারই স্বজাতি এবং তাহাদের দোষ ত্রূটির আমিও অংশভাগী। তাহাদের যেসব গুণ আছে, তাহার জন্যও আমি গর্বিত, সুতরাং বাঙালীদের দোষ-কীর্তন করিবার অধিকার আমার আছে।”

ব্যবসা-বাণিজ্যের দিকে বাঙালীর দৃষ্টি ফেরানোর জন্য তিনি নিজে সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু বাঙালী আচার্যবাণীতে কোনরকম কর্ণপাত করেনি। বিস্ময়ে স্তব্ধ হতে হয় এই কট্টর বিজ্ঞানী, বাস্তবসম্মত অর্থনীতির সমর্থক ও সমাজবিশ্লেষক যিনি তার দূরদর্শী ঝানু ব্যবসায়িক বুদ্ধি দিয়ে বাংলা ও বাঙালীর অভাব ও দুর্দশা মোচনে অবিরাম পরিশ্রম করে গেছেন। ভাবলে বিস্ময় লাগে একজন রসায়নবিদ কি করে আচার্য হয়ে উঠলেন- কিভাবে বাঙালীকে সঠিক দিশা দেখাতে আলোর পথযাত্রী হয়ে উঠলেন।

তিনি যেন সেই আলোক শিখা যিনি অক্লেশে বলেন, "আমাদের কি দুর্বল চিত্ত, চাকরি প্রিয়, বিলাসী বাবু হওয়া সাজে? শক্ত হতে হবে, মেরুদন্ড বিশিষ্ট মানুষ \ হতে হবে। \ অন্ন \ মীমাংসা করতে পারলে সঙ্গে সঙ্গে অনেক প্রশ্নের সমাধান হয়ে যাবে।

তাই ব্যবসা-বাণিজ্য ছাড়া আজ আমার অন্য কিছু বলবার নাই। ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজে আমাদের স্পৃহা নেই- প্রবৃত্তি নাই। এই প্রবৃত্তি আগে জাগিয়ে তুলতে হবে।"

শিল্পে ও বিজ্ঞানে ভারত যেন পাশ্চাত্য দেশের সমকক্ষ হয়ে উঠে এই ছিল তার সাধের স্বপ্ন। তাঁর সারাজীবনের পরিশ্রমে বিজ্ঞান চর্চা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল।

চিররুগ্ন ও চিরকুমার অত্যন্ত সরল ও অনাড়ম্বর জীবন যাপন করতেন। তিনি সত্যি প্রকৃত শিক্ষক ছিলেন- তাই দেশের সকল ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বিমর্ষভাবে ডেকে বলেন, "সাবধান! বিপদ সন্নিকট। ছাত্র তোমরা, দেশের ভবিষ্যৎ আশাস্থল। অপ্রিয় সত্য তোমাদের বলছি- মধ্যবৃত্ত বাঙালির সন্তান ডিগ্রী পেলেই জীবিকা সংস্থান করতে পারবে, আর ডিগ্রির অভাবে চারিদিকে অন্ধকার দেখবে- এটা কত বড় ভুল আজ নিঃসংশয়ে তা বুঝে নিতে হবে।"

আবার নিঃসংকোচে কি অদ্ভুত বাস্তব সত্য যা আজও আমাদের সমাজকে গ্রাস করেছে তা বলেন- ''কলেজের দ্বারে এই যে শত শত ছাত্র আঘাত করছে, মাথা খুঁড়ছে এরা কি প্রকৃত জ্ঞান পিপাসু বিদ্যার্থী অথবা ডিগ্রীধারী মাত্র উদ্দেশ্য গলাধঃকরণ, উদ্গিরণ ও ডিগ্রীগ্রহণ..... যে শিক্ষায় শুধু মেরুদণ্ডহীন গ্রাজুয়েট তৈরী হয়, মনুষ্যত্বের সঙ্গে পরিচয় হয় না, যে শিক্ষা আমাদের 'করে খেতে' শেখায় না, দুর্বল অসহায় শিশুর মতো সংসার- পথে ছেড়ে দেয়, সে শিক্ষার প্রয়োজন কি?

এই চাবুকের মত বাক্যবানগুলি যে কতখানি সত্যি তা আমরা প্রখ্যাত কবি সুকুমার রায়ের কবিতা, ''জীবনের হিসাব" এ দেখতে পাই,

বিদ্যে বোঝাই বাবুমশাই চড়ি সখের বোটে,

মাঝিরে কন, "বলতে পারিস সূর্যি কেন ওঠে?"

-এদিকে কবিতাটির শেষাংশের উলটপুরাণ আচার্যদেবের বাণীকেই স্মরণ করিয়ে দেয় -

মাঝি শুধায়, ''সাঁতার যেন?" - মাথা নাড়েন বাবু

মূর্খ মাঝি বলে, মশাই, এখন কেন কাবু?

আবার স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর 'অসন্তোষের কারণ' নামক প্রবন্ধে ও শিক্ষা সম্পর্কে একই কথা বলেছেন,

"কলসীতে শুধু জলই ভরিতে থাকিলাম, কিন্তু সে জল কখনো দানপাত্রের উপযুক্ত হইতে পারিল না।"

ভাবলে বিস্ময় লাগে রবীন্দ্রনাথ এবং প্রফুল্লচন্দ্র এই দুই মনিষী একজন বিশ্বকবি অন্যজন বৈজ্ঞানিক হওয়া স্বত্তেও কি প্রবলভাবে বাণিজ্যমনস্ক ব্যক্তিত্ব। ঠাকুর পরিবারের ঐতিহ্য,ও ঐশ্বর্য্য সম্পর্কে আমরা সবাই অবহিত। আবার প্রফুল্লচন্দ্র এক সম্ভ্রান্ত ও অভিজাত ঐতিহ্যিক পরিবারে জন্ম নেন। ফলে বিশ্বকবি ও আচার্যের বাণিজ্যিক মনস্কতা বিস্ময় জাগায়। কবি, রবীন্দ্রনাথ যেখানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান 'শান্তিনিকেতন' এবং কৃষিবিদ্যালয় 'শ্রীনিকেতন' প্রতিষ্ঠা করেন, সেখানে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র 'মডার্ন ইন্ডিয়ান রিসার্চ স্কুল ইন কেমিস্ট্রি' এবং'বেঙ্গল কেমিক্যালস এন্ড ফার্মাসিউটিক্যালস্' (ভারতে প্রথম ফার্মাসিউটিক্যাল কম্পানি) প্রতিষ্ঠা করেন। কেবল বেঙ্গল কেমিক্যাল নয়, অন্যান্য অনেকগুলি শিল্প প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসার সহিত ঘনিষ্টভাবে জড়িত ছিলেন আচার্য। তাঁর উৎসাহ ও প্রচেষ্টায় ক্যালকাটা পটারি ওয়ার্কস, ন্যাশনাল ট্যানারি ওয়ার্কস, বেঙ্গল এনামেল, ভারতী ইঞ্জিনিয়ারিং কোং, ইত্যাদি গড়ে ওঠে। তিনি ছিলেন এইসব প্রতিষ্ঠানের প্রেরণাশক্তি, কেন্দ্রীয় শক্তি। শ্রমিকদের প্রতি আচার্যদেবের অপার সহানুভূতি ও ভালোবাসা ছিল। বেঙ্গল কেমিক্যাল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি দেশীয় প্রতিভার বিকাশ ঘটিয়ে ভারতীয়দের আত্মনির্ভরতা ও আত্মশক্তির প্রকাশ ঘটিয়ে ছিলেন। বিস্ময় আরও বাকি থাকে, রুদ্ধনিঃশাসে বাকস্তব্ধ হয়ে যায় যখন দেখি, আচার্যদেবের সেই বিখ্যাত উক্তি - বিশ্ববিদ্যালয় হবে - “পান্ডিত্য, গবেষণা ও উচ্চতর সংস্কৃতির কেন্দ্রস্বরূপ, যারা জ্ঞানান্বেষণের জন্য সমগ্র জীবন উৎসর্গ করিতে প্রস্তুত, তারাই কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা পাক্”।

কিংবা যখন অভিভাবকরূপে বলেন, "বিশ্ববিদ্যালয়ের যা একাডেমিক ইয়ার তাতে তো দুবছরে দশমাস মাত্র পড়া হয়। এই দশমাস পড়ে সব বিদ্যা আয়ত্ত হয়ে যায় কি? আজীবন না পড়লে শেখা যায় না। প্রত্যেকদিন নূতন নূতন তত্ত্ব প্রকাশিত হচ্ছে,সে-সকলের খবর রাখতে হবে। ফার্স্ট হও আর না হও পাস করার পরেই কেতাবের সঙ্গে সেলাম আলেকম্ করে তার নিকট চিরবিদায় গ্রহণ কি ভয়ঙ্কর! কী সর্বনাশ!, এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধিকারী দেখলে আতঙ্কে আমার প্রাণ শিউরে ওঠে।তারা ছদ্মবেশী মূর্খ।"

কী ভয়ঙ্কর বাস্তব সত্যি কথা বলে গেছেন আচার্য আজ আমরা সবাই তা প্রতিপদে উপলব্ধি করছি। তাঁর মতে - জগতে যারা প্রকৃত বিদ্যাভ্যাস করেছেন,তাদের মধ্যে অনেকেই নিজের চেষ্টায় বা সেলফ্ টট্ মেথডে শিখেছেন। এরা সম্পূর্ণ শিক্ষিত, এঁদের শিক্ষার মূলে স্বাবলম্বন। এরা পাঠাগারে বই পড়েন-নোট পড়েন না। বই এর পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকি কিছুক্ষণ, হে আচার্য আমরা আপনার মতো জ্ঞানতপস্বী, বৈজ্ঞানিক-সন্ন্যাসী, জাত-শিক্ষক প্রখর ব্যবসায়িক বুদ্ধিসম্পন্ন, বাংলা ও বাঙালীর দুর্দশা ও অভাব মোচনে অবিরাম সংগ্রামী তপস্বী পাইনি আগে, যিনি কথার চাবুক মেরে বলতে পারেন, সঠিকপথ দেখতে পারেন ছাত্রদের যে "ডিগ্রিধারীদের ‘মনপোলি’তে মৌলিক চিন্তা বিনষ্ট হয়, প্রতিভার বিকাশ ব্যাহত হয়, মননশীলতা ঊষর মরুপ্রান্তরে পরিণত হয়।" সারাজীবন ধরে বাঙালীজাতিকে আরামপ্রিয়তা,আলস্য ত্যাগ করে শিল্পমুখী, ব্যবসা-বাণিজ্যমুখী হওয়ার জন্য অনুপ্রেরণা জাগিয়ে গেছেন।

ভাবলে শিউরে উঠতে হয়, এই আচার্যের কৌটিল্যের মতো দূরদৃষ্টিকে - ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর রবীন্দ্রনাথ তার 'নাইট' উপাধি ফিরিয়ে দিলেও প্রফুল্লচন্দ্র তা করেননি বরং এই রসায়নবিদ্ ওই উপাধির দৌলতে অনেক বিপ্লবীকে নানাভাবে সাহায্য করেছেন, আবার কিছু বিপ্লবীকে নিরাপদ আশ্রয় ও দিয়েছেন। আবার এই রসায়নবিদ্ জীবনের শেষ পর্যায়ে এসেও বাঙালী তথা ভারতবাসীদের বারবার উৎসাহিত করেছেন শিল্পব্যবসায়। তাই অশিবছর বয়সেও বলেন - "আমার বয়স হল আশি - এখন জীবন - সন্ধ্যায় পৌঁছেছি যে কোন সময়ে ওপারের ডাক এসে পৌঁছবে। যে কটা দিন থাকব ঐ একই কথা বলব - ভারতবাসী এখনও ফেরো, সঙ্গবদ্ধ হয়ে শিল্প - বাণিজ্যে ব্যবসায়ে মন দাও, তবে যদি বাঁচতে পারো, নইলে তোমাদের ভবিষ্যৎ নেই।

....... ব্যবসা মানে নিন্দের জিনিস, ছোট কাজ এমন ধারণা ছাড়। যদি আমার রূঢ় কথায় কারও দৃষ্টি ফেরে, তবেই সার্থক হবে আমার সমস্ত সাধনা শেষ বয়সের শেষের কথায় আমার দেশবাসীর কাছে এই একমাত্র আবেদন।" হে আচার্যদেব, আজ সারা বাংলা কাঁদছে, সারা ভারতবর্ষ কাঁদছে, এমত অবস্থায় কি সম্ভব আচার্যদেব, ''সম্ভবামি যুগে যুগে।"

রচনা সূত্র (Reference):

আচার্য প্রফুলচন্দ্রের চিন্তাধারা - রতনমনি চট্টোপাধ্যায়

আচার্য প্রফুলচন্দ্রের জীবনবেদ – নন্দলাল মাইতি

  • ১৯৮০ সালের ৮ই ডিসেম্বর রাত্রি ৮টার সময়ে অল্ ইন্ডিয়া রেডিওর প্রচারিত আচার্যের বেতার বক্তৃতা।

  • 'প্রবাসী' ষষ্ঠবার্ষিকী স্মারক গ্রন্থে ও মাসিক 'শিক্ষা' পত্রিকায়

  • 'আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র স্মারক' বই

  • 'আত্মচরিত'

  • বিজ্ঞানাচার্য – ডাঃ মাহেন্দ্রলাল সরকার

  • ছবি: ভারত সরকার এর নথি

Comments

Top

অচেনা মুখ

চেনা সম্পর্ক

শর্মিলা ঘোষনাথ

coffeehouse.jpeg
অচেনা মুখ

প্রবন্ধ

ত্মীয় বলতে আমরা তাঁদেরই বুঝি, যাঁরা আমাদের আত্মার খুব কাছের। হাত বাড়ালেই যাঁদের কাছে পাওয়া যায়। বাধা বিপত্তি এসে যখন চারপাশের জগতকে থমকে দিয়েছে বলে মনে হয়, তখন  আবার যাঁরা নতুন করে জীবন পথে চলার ভরসা যোগান - তাঁরাই তো প্রকৃত আত্মীয়। সে সম্পর্ক কি শুধুমাত্র বংশলতিকা বা পারিবারিক যোগসূত্রের ক্ষুদ্র বন্ধনে বেঁধে রাখা যায়? আমার  জীবনের অভিজ্ঞতা কখনই তা মানতে পারেনা। চলার পথে রক্তের সম্পর্ক ছাড়াই এমন অনেক মানুষ এসে চোখে - অন্ধকার - দেখা মূহুর্তে আমার সামনে অযাচিতভাবে হাত বাড়িয়ে সামলে দিয়েছেন, ভেঙে পড়তে দেননি। ঈশ্বরকে দেখা যায় না কিন্তু কোন কোন সময়ে মনে হয় তিনি বোধহয় মানুষের রূপে কাণ্ডারী হয়ে এসে ঝড় - তুফানে টলমল নৌকোটির হাল ধরে পার করিয়ে দেন, নতুন করে আলোর দিশা দেখান, আর মনে করিয়ে দেন “মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারিও না”। 
সেইসব মানুষদের কারুর মুখ মনে আছে, কারুর বা মুখ মনে নেই, কিন্তু আজ আমার করজোড়ে তাঁদের প্রত্যেককে বলতে ইচ্ছে করে, “তোমরা সবাই আমার পরমাত্মীয়, আমার জীবনে তোমরা না থাকলে হয় আমিই থাকতাম না অথবা জীবনটা এ রকম থাকত না তোমাদের ভুলি কি করে?”। তেমন কিছু মানুষের গল্প নিয়ে আজ আমার কৃতজ্ঞতা জানানোর এ ক্ষুদ্র প্রয়াস।

অপরিসীম ক্লান্তিতে চোখ জড়িয়ে আসছে কিন্তু ছোট্ট ঘরে টিউব লাইটের আলো চোখের ওপর জ্বললে কারও পক্ষে কি নিশ্চিন্তে ঘুমোনো সম্ভব? একে মাত্র তিনদিন আগেই সিজারিয়ান সেকশনের ধকল, তার পরেও এত কষ্টে পৃথিবীতে আনা ঐ ছোট্ট ধুকপুকে প্রাণটা আদৌ টিকে থাকবে কিনা - সেই নিয়ে খোদ ডাক্তারদেরই সংশয়। সেই পরিস্থিতিতে কোন মা কি ঘুমোতে পারে? ও জন্মাবার পর থেকে কোন আত্মীয় স্বজন, বন্ধুবান্ধবকে এ ঘরে ঢোকার অনুমতি দেওয়া হয় নি, আয়ামাসিকে কঠোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে যখন তখন বাচ্চাকে, কাঁদলে, এমন কি বিছানা নষ্ট করে ফেললেও, যেন কোলে নেওয়া না হয়। এতই ক্ষীণ তার গলার স্বর যে এই তিনদিনে, দ্বিতীয় সন্তানের মা পূর্ব অভিজ্ঞতা অনুসারে বাচ্চার কান্নার আওয়াজ নিজের বিছানা থেকে শুনতে পায়নি। দ্বিতীয় দিনে অর্থাৎ ২৪ ঘন্টার পার করে যখন মার কাছে বাচ্চাকে প্রথম দেওয়া হল, তখন দেখা গেলো তার ছোট ছোট দুহাতের কবজি থেকে আঙুল অবধি মোটা তুলোর আস্তরণের মোড়া, নাকে খাওয়ানোরা জন্যে রাইল’স টিউব পরানো। জ্ঞান আসার পর থেকে বাচ্চার টালমাটাল শারীরিক অবস্থা নিয়ে আলোচনা শুনতে শুনতে অনুভূতিগুলো বোধহয় বোবা হয়ে গিয়েছে, নাহলে মনের মধ্যে যে প্রশ্ন আসছে তা মুখে আনার সাহস হচ্ছে না কেন যে, “ওর কি হাতের তালু তৈরী হয় নি?”  শিশু বিশেষজ্ঞ, সম্ভবত: মায়ের চোখের প্রশ্নটা বুঝে অভয় দিলেন, “হাতের গঠন ঠিকই আছে। শুধু নাক থেকে নল যাতে টেনে খুলে না ফেলে, তাই এই ব্যবস্থা” বাচ্চা স্বাভাবিক ভাবে মাতৃদুগ্ধ পান করছে দেখে নাক থেকে নল খুলে দিয়ে আরো আশার বাণী শোনালেন, “এরকম ভাবে ৭২ ঘন্টা কাটলেই ও বিপন্মুক্ত হয়েছে, বলা যাবে। তারপর সব কিছু স্বাভাবিক”। তার মানে মাঝে শুধু আরেকটা দিন কাটার অপেক্ষা, তারপরই শুধু খুশী আর আনন্দ। বেঁচে থাকা নিয়েই এত সংশয় তাই ভয়ে ভয়ে এ কদিন কারুর কাছে মা জানতেও চায় নি ও মেয়ে না ছেলে? যদিও বিশেষ কোন আকাঙ্ক্ষা ছিল না, কামনা ছিল শুধুই একটি সুস্থ সন্তান যে কিনা ওদের মেয়ের সঙ্গী হবে। কাছে দেওয়ার আগে এক আয়ামাসি মায়ের না জানতে চাওয়ায় বিস্ময় প্রকাশ করে নিজেই হেসে হেসে জানালেন, “ছেলে হয়েছে গো, বড্ড রোগা, তাই একটু কালো লাগে। সে ঠিক আছে, দিনে দিনে কোলেই বেড়ে উঠবে।“ ও নল ছাড়াই স্বাভাবিক বাচ্চাদের মত খাদ্য গ্রহণ করতে পারছে, ওর বিপদ মুক্তি ঘোষণা করার আগে আর মাত্র ২৪ ঘন্টার প্রতীক্ষা - এ খবরে কি তার চেয়েও বেশী পুলক জাগানোর ক্ষমতা আছে? মোটেই না। ওর বাবা অনেক আগেই নিজের পছন্দের সাদা শার্ট কিনে রেখেছে নতুন জামা পরে সন্তানের জন্মকে সেলিব্রেট করব বলে কিন্তু এ কদিন আলমারির কোন কোনে তা পড়ে রয়েছে, তার খবর কেউ রাখেনি। সদ্যোজাত সন্তানের ছবি তুলবে বলে আগাম প্রস্তুতি নিয়ে ক্যামেরায় ফিল্ম ভরে রাখা ছিল, তাতে হাতও পড়েনি। এবার সে সবের সদ্ব্যবহার হবে। মেয়েকে বলে রাখা হয়েছে আর তাকে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে হবেনা, আর দু’একদিনের মধ্যেই সে তার ছোট্ট ভাইকে দেখতে পাবে, মনটা তাই খুশিয়াল। শুধু আজ সকাল থেকে ছেলেটা আবার খাওয়া বন্ধ করেছে। আয়ামাসির মুখ থেকে জানা গেল যে কাঁদছেও না, নড়াচড়াও করছে না। মা প্রশ্ন করায় সিস্টারদিদি বাচ্চাকে দেখে বলে গেলেন, “আন্ডারওয়েট বাচ্চা তো, দুর্বল, তাই একটু বেশী ঘুমোচ্ছে, চিন্তার কিছু নেই, ও ঠিক হয়ে যাবে”। কিন্তু সন্ধেবেলা অবধি একই অবস্থা দেখে নার্সিংহোম থেকেই শিশু বিশেষজ্ঞকে ডেকে পাঠানো হ’ল। তিনি আবার রাইল’স টিউব দিয়ে খাওয়াবার ব্যবস্থা করে দিলেন। বাচ্চার বাবা দেখতে এসে মাকে অযথা দুশ্চিন্তা করে শরীর খারাপ করতে বারণ করল। ডাক্তার দেখে গেছেন, সেরকম কোন বিপদের সম্ভাবনা থাকলে তিনি কি জানাতেন না? তাছাড়া বাচ্চা যখন একবার স্বাভাবিক নিয়মে মাতৃদুগ্ধ পান করতে পেরেছে, তখন আবারও করবে। এসব শুনে কি মায়ের মন খানিকটা আশ্বস্ত হ’ল, কে জানে? কিন্তু অপারেশনের ধকল সয়ে, তার ওপর টানা দু রাত্রি ওষুধের প্রভাবে আধো ঘুম আধো জাগরণে কাটিয়ে আজ যেন দু চোখ খোলা রাখতে চাইলেও পারা যাচ্ছে না, জড়িয়ে আসছে। তার মধ্যে রাত্রের আয়ামাসি ঘোষণা করে দিলেন যে মায়ের অসুবিধা হলেও ঘরের আলো নেভানো যাবে না। সারা দিন খাটাখাটুনির পর অন্ধকারে তাঁর নিজের চোখ জুড়ে আসার সম্ভাবনা আছে, অসুস্থ বাচ্চার দিকে নজর রাখায় গাফিলতি হতে পারে, তাই তিনি সেটা করতে পারবেন না। রাত্রে সিস্টারদিদিরা বিশেষ টহল দেন না, টেবিলের ওপর পা তুলে ঝিমিয়ে নেন। সব ঘরের আয়ারাও সেই সুযোগে একটু ঘুমিয়ে নেন কিন্তু এই ঘরের আয়ামাসি কোথা থেকে একটা টুল যোগাড় করে এনে এক পা তুলে দেওয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে ঠায় বসে রয়েছেন। কেউ দেখছে না, সারাদিন গরীবের সংসারে হাড় ভাঙা খাটুনি শেষ করে রাতে ডিউটি করতে আসতে হয়, তবু তিনি তার কর্তব্যে অবিচল। চোখের ওপর আলোটা মায়ের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে, তা হোক, মনে একটা কথাই গুণাগুণ করছে, “শুধু তো আজকের রাতটা কাটার অপেক্ষা”।
চোখ লেগেই এসেছিল, হঠাৎ মনে হ’ল আয়ামাসি ধনুকের ছিলার মত ছিটকে উঠে বাচ্চার খাটের কাছে গেলেন, এক লহমা দেখে নিয়েই দুহাতে ওকে তুলে নিয়ে উর্দ্ধশ্বাসে দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে গেলেন, ওখানেই রাতে সব সিস্টারদিদিরা থাকেন। একে খাটে শুয়ে থাকলে বাচ্চাকে দেখা যায় না, তারপর ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে যাওয়া মা দুর্বল শরীরে সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে নীচে সিস্টারদের ছোটাছুটি, উত্তেজিত স্বরে কথা বলাবলির শব্দই শুধু শুনতে পেল। নীচে নামার ক্ষমতা নেই, নেই অনুমতিও। চারদিকের ঘরে অন্য পেশেন্টরা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, নাইট ল্যাম্প ছাড়া অন্য আলোগুলোও নেভানো। বড্ড যে অসহায় লাগছে, কেউ কি তাকে বলবে, “কি হয়েছে?” শেষে আর থাকতে না পেরে মা ঠিক করল যে তার যা হয় হোক, সে বসে বসেই নীচে নামবে। যার সন্তান বিপদের মুখে, তার কি নিজের শরীরের কথা ভাবলে চলে? নামতেই যাচ্ছিল, ঠিক সেই সময় এক সিস্টার দিদি নীচ থেকে উঠে এসে ধমক দিলেন, “আপনি কোথায় যাচ্ছেন? বাচ্চা একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছে, আমরা সুস্থ করার চেষ্টা করছি, শিশু বিশেষজ্ঞকেও খবর দেওয়া হয়েছে। আমি ইঞ্জেকশন দিয়ে যাচ্ছি, যান আপনি শুয়ে পড়ুন।“ আচ্ছা, সে রাতে কি মাথা ঠিক করে কাজ করছিল না? না হলে মা বাধ্য মেয়ের মত কিভাবে শুয়ে পড়তে পারে?
পরের দিন ভোরবেলা ঘুম জড়ানো চোখে জীবন সঙ্গীর থমথমে মুখ থেকে জানা গেলো যে আগের রাত্রে তড়কা আক্রমণে ছেলের শারীরিক অবস্থা খুবই বিপজ্জনক পর্যায়ে চলে গেছে তাই ডাক্তারের পরামর্শে ওকে বড় হাসপাতালের ইনকিউবেটরে অর্থাৎ শ্বাসপ্রশ্বাসের ব্যবস্থা সহ কৃত্রিম মাতৃজঠরের উষ্ণ পরিবেশে স্থানান্তরিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সেখানে নিয়ে  যাওয়ার জন্যেই বাবাকে ফোন করে বাড়ি থেকে ভোরবেলা ডাকা হয়েছে। কথাগুলো, ওষুধের প্রভাবে বোধশূণ্য মস্তিষ্কের কোষগুলোতে, কি কোন তাৎপর্য বহন করছিল? বোধহয় না। নাহলে কোন প্রশ্ন না করে মা শুধু মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো কেন?
একটু বেলায় আবার তন্দ্রার ঘোরে স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ, যাঁর হাতে বাচ্চার জন্ম, দেখা গেল। স্বভাবগত ভাবে ঈষৎ রূঢ়ভাষী ডাক্তার, মায়ের বিছানা একদম কাছ ঘেঁষে মাথায় হাত রেখে দাঁড়িয়ে, গম্ভীর মুখে অথচ কোমল আশ্বাসের স্বরে বললেন যে তার বাচ্চাকে সুস্থ করে তোলার জন্যে অনেকজন ডাক্তার মিলে অবিরাম লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন, ওর চিকিৎসার কোন ত্রুটি হতে দেওয়া হবে না। কবে ও সুস্থ হয়ে ফিরে আসবে - মায়ের এই প্রশ্নের সরাসরি উত্তর না দিয়ে গুরুজনসুলভ উপদেশ দিলেন, “ঈশ্বরকে ডাকো, মানুষের প্রচেষ্টা যেখানে পৌঁছাতে পারে না, সেখানে সেই সর্ব শক্তিমানের ওপরই ভরসা করতে হয়। সন্তানের এইরকম বিপদের সময় মাকে ভেঙে পড়তে নেই, কাঁদতে নেই, তাতে সন্তানের অমঙ্গলের হয়”। স্বল্পভাষী,  প্রয়োজন ছাড়া কথা না বলা বিলেতফেরৎ ডাক্তারের মুখে এই ধরণের কথা ও কোমল আচরণ মায়ের মস্তিষ্কে কি প্রথম আসন্ন চরম বিপদের সঙ্কেত দিল?নাহলে আগের রাত্রি থেকে বাচ্চাকে দেখতে না পাওয়া সত্বেও এতক্ষণ পর মায়ের চোখ থেকে জল গড়িয়ে আসবে কেন?
তারপর চলল পরবর্তী কালে হাসপাতালের এক জুনিয়র রেসিডেন্ট ডাক্তারের মুখ থেকে শোনা, সন্তানকে নিয়ে যমে ডাক্তারের টানাটানি। নার্সিংহোম থেকে শ্বাসপ্রশ্বাস ক্ষীণ অবস্থায় নিয়ে আসা বাচ্চাকে হাসপাতালে ভর্তি করার সময়ই ডাক্তাররা বলে দিয়েছিলেন যে তাঁরা তাকে বাঁচাবার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করবেন কিন্তু বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কোন আশার বাণী শোনাতে পারছেন না।
শুরু হল নার্সিংহোম থেকে শূণ্য কোলে বাড়ি ফিরে যাওয়া মায়ের সদ্যোজাত সন্তানকে কোলে ফিরে পাওয়ার প্রতীক্ষা। মেয়ের অবুঝ প্রশ্নের উত্তরে স্তোকবাক্য শোনানো যে খুব শীঘ্রই ভাই সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে আসবে আর তখন তাকে কোলে নেওয়া  যাবে। কিন্তু সত্যিই নিজের মন মানে কি? জিজ্ঞাসা করবার সাহস নেই, তাই প্রতিদিন ছেলের বাবা হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরলে উদগ্রীব হয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকা যদি কোন ব্যতিক্রমী  সুখবর থাকে, কিন্তু সে প্রত্যাশা পূরণ হয় কই?
অবশেষে সেই আলো ঝলমলে দিনটা এলো, যেদিন ইনকিউবেটর থেকে বাচ্চাকে সাধারণ বেডে স্থানান্তরিত করে মাকে হাসপাতালে তার দেখভালের জন্যে যেতে বলা হল। জন্মের পর সেই প্রথম বাচ্চাকে কোলে পাওয়া। তারপর আরো কিছুদিন চিকিৎসাধীন থেকে ছেলেকে নিয়ে সবার মাঝখানে মায়ের বাড়ি ফিরে আসা। 
অনেক বছর কেটে গেছে। বাচ্চার সুস্থ হয়ে ওঠার পেছনে ডাক্তারদের ভূমিকা অনস্বীকার্য  তবুও সেদিনের কথা মনে পড়লে আজও মায়ের মনে হয় সেদিন রাত্রে যদি আয়ামাসি শারীরিক ক্লান্তির বশবর্তী হয়ে বাচ্চার ওপর বিরামহীন নজর রাখার দায়িত্বে, এতটুকু গাফিলতি করতেন, শুধুমাত্র চোখ বুজে বিশ্রামই নিতেন যা তার পক্ষে স্বাভাবিক ছিল, তাহলে কি পরের দিন ঐ বাচ্চাকে চিকিৎসা করার সুযোগ পাওয়া যেত? আজকাল প্রায়ই কর্মরত আয়াদের কাজে ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা, অসুস্থ, অপারগ রোগীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের কাহিনী এখানে ওখানে শোনা যায় কিন্তু  এই মায়ের অভিজ্ঞতা তো সম্পূর্ণ বিপরীত কথা বলে। নার্সিং হোম থেকে ছুটি পাওয়ার দিন মাকে চোখের জলে বিদায় দিতে গিয়ে সেই অহরহ অসুস্থ মানুষ দেখে চোখ অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া সামান্য বেতনের আয়ামাসি বলেছিলেন, “দিদি তোমার ছেলেটা দুর্বল ছিল তো, বিরক্ত করত না শুধু বড় বড় চোখ মেলে তাকিয়ে থাকত। ওর ওপর এ কদিনে বড্ড মায়া পড়ে গিয়েছিল গো। আমি লোকনাথ বাবার কাছে মানত করেছি, দেখো ছেলে ঠিক সুস্থ হয়ে তোমার কোলে ফিরে আসবে।“ এসবে মায়ের বিশেষ আস্থা না থাকলেও তার শুভকামনা, বিশ্বাসকে অমর্যাদা করতে সেদিন মন সরেনি।
বাচ্চা বাড়ি আসায় আত্মীয় স্বজন, বন্ধুবান্ধব, প্রতিবেশী সবাই  চিকিৎসার উৎকর্ষের জন্যে ডাক্তারদের ধন্য ধন্য করেছেন, তাঁর কথা কেউ বলেনি, তাঁকে কেউ বাহবা দেয় নি, তিনি নেপথ্যেই থেকে গেছেন। যিনি পৃথিবীর আলো দেখান, তাঁকেই তো মা বলে। আর যিনি চোখ থেকে আলো নিভতে দেন না, তার সমস্ত শক্তি দিয়ে ঢাল হয়ে আগলে দাঁড়ান, তাঁকে কি নামে ডাকা যায়?

আরেকজন এমন পরমাত্মীয়কে মা খুঁজে পেয়েছিল ঐ হাসপাতালের রেসিডেন্ট জুনিয়র মহিলা ডাক্তারের ভেতরে। মাতৃদুগ্ধে খিদে মিটছে না মনে করে মা, হাসপাতালের রাউন্ডে আসা সিনিয়ার ডাক্তারের কাছ থেকে, বোতলে দুধ খাওয়ানোর অনুমতি চেয়ে নিয়েছিল। সেই জুনিয়ার ডাক্তার, সেই মূহুর্তে সিনিয়ারের সামনে কিছু না বলতে পারলেও পিছন থেকে চোখের ভাষায় অনুনয় করেছিলেন ডাক্তারের নির্দেশ মেনে কিছু না করতে। তারপর সিনিয়ার ডাক্তার চলে যেতে না যেতেই দৌড়ে এসে, উত্তেজিত স্বরে, মাকে স্তম্ভিত করে দিয়ে জানতে চেয়েছিলেন, “আপনি কি চান বলুন তো, বাচ্চাটাকে মেরে ফেলতে?” এমন অদ্ভুত অভিযোগে হতভম্ব মায়ের বিস্ময়ের ঘোর কাটার কোন সুযোগ না দিয়েই অসহিষ্ণু ভাবে এক নিঃশ্বাসে আবার বলে উঠেছিলেন, “ও প্রায় ওপারে চলেই গিয়েছিল, আমরা টেনে রেখে ওকে যেতে দিইনি, ফিরিয়ে এনেছি। চিকিৎসা কোন পথে হবে, সিনিয়ার ডাক্তার তার বিধান দিতে পারেন, কিন্তু সামনে দাঁড়িয়ে থেকে নির্জীব হয়ে আসা বাচ্চাটার  শরীরে প্রাণ ফিরিয়ে আনার লড়াইটা আমরাই করেছি। তিনদিন ওর পাশ থেকে আমি এক পাও নড়িনি, কোন ক্রমে নাকে মুখে গুঁজে খাবার খেয়ে আবার ফিরে এসেছি। না থাকার ঐটুকু সময়েও উৎকন্ঠায় মনে হত ফিরে গিয়ে ওকে দেখতে পাবো তো? আপনি মা হতে পারেন, ওর জীবনের ওপর আমার অধিকার আপনার চেয়ে কোন অংশে কম নয়। খিদেয়  কাঁদে কাঁদুক, বাইরের খাবার খেয়ে এই দুর্বল বাচ্চার শরীরে যদি ইনফেকশন হয়, তাহলে ওকে আর বাঁচানো যাবে না। এত কষ্টে ফিরিয়ে আনা প্রাণের সঙ্গে এমন অন্যায় আমি কিছুতেই হতে দেব না।“ সেই জ্বলন্ত দৃষ্টির সামনে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে মা আন্দাজ করতে চেষ্টা করছিলেন যে অদৃষ্টের সঙ্গে পাঞ্জা কষে বাচ্চাটিকে ছিনিয়ে আনার সেই হার না মানা লড়াইয়ে, শিক্ষাগত দক্ষতা বা পেশাগত দায়িত্বের সঙ্গে, কতখানি নিঃশর্ত আন্তরিকতা যুক্ত হলে এমন অধিকারবোধ জন্মায়। আজকাল প্রায়ই  ডাক্তারদের অমানবিক আচরণ বা পেশাদারী মনোভাবের অভাব নিয়ে অনেক হতাশাব্যঞ্জক কথা কানে আসে। সেদিন কিন্তু সেই মায়ের মনে হয়েছিল, এই তো আসল মায়ের রূপ যে সন্তানের বিপদে দিন রাত এক করে দিতে পারেন আবার তার মঙ্গলের জন্যে প্রয়োজনে রুদ্রমূর্তি ধরে সারা পৃথিবীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে দ্বিধা করেন না। এ কোন গল্প কথা নয়, কারুর মুখ থেকে শোনা উপাখ্যানও নয়, নিজের জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতার কাহিনী। সেই মা আর কেউ নয়, এই লেখিকা স্বয়ং আর সেই ছেলে এখন ২২ বছরের তরুণ। সেই আয়ামাসি বা রেসিডেন্ট ডাক্তারের মুখগুলো এখন আর ভালো করে মনে পড়ে না কিন্তু ছেলের চোখের দিকে তাকালে প্রায়শই তাঁদের কথা স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করে ওঠে। তাঁরা ছিলেন বলেই ও এখনও পৃথিবীর আলো বাতাসে শ্বাস নিচ্ছে। ওর জীবনে তাঁরা, মনে হয়, যেন  ঈশ্বর প্রেরিত হয়ে এসেছিলেন। তাঁরা এতদিনে হয়তো কাজের ব্যস্ততায় সেসব দিনের কথা ভুলে গেছেন কিন্তু সেই মা মনে করে  যে এই ছেলে শুধু এই মায়ের সন্তান নয়, তাঁদেরও মানসপুত্র, তাই তাঁরা তার পরমাত্মীয়।

                                                    ****

ট্রেন যখন পৌঁছল, ঘড়ির কাঁটা আটটা ছুঁইছুঁই। স্টেশন চত্বরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। মাঝখানের একটুখানি ছাউনি দেওয়া অংশে টিমটিম করে কয়েকটা টিউব লাইট জ্বলছে, বাকি প্ল্যাটফর্মে আলো জ্বালিয়ে অকারণে বিদ্যুতের খরচ বাড়ানো - কর্তৃপক্ষ সম্ভবত: প্রয়োজনীয় মনে করেননি, তাই কোন আলো লাগাবার ব্যবস্থাও চোখে পড়ছে না। বর্ধমান জেলাশহর থেকে বেশ দূরে সিঙ্গল লাইনবিশিষ্ট এই অখ্যাত রেল স্টেশনে এত রাতে, কাজ থেকে ঘরে ফেরা গুটিকয় মানুষ ছাড়া কেউ ট্রেন থেকে নামেন না। পুরো স্টেশন চত্বরটা নিত্যযাত্রীদের, হাতের তালুর মত করে চেনা। সারাদিনের খাটাখাটুনির পর ক্লান্ত শরীরগুলোর ঘরে ফেরার তাড়াও কম নয়, তাই ট্রেন থামার পর মানুষের আনাগোনা, কথোপকথনের শব্দে যাও বা স্টেশন চত্বরে একটু প্রাণসঞ্চার হয়েছিল, কয়েক মূহুর্তের মধ্যে খালি হয়ে আবার নিঝুম হয়ে গেল। কাঁধে নেওয়া ছোট জামাকাপড়ের ব্যাগ আর পার্স নিয়ে অন্ধকারে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে মেয়েটি ঠিক করে উঠতে পারছিল না কি করা উচিত।অফিসের একটি সেমিনারে যোগ দিতে আসা, হিমঘর সংক্রান্ত সেমিনার। আলু হিমঘরে মজুত করার কাজে সমস্যা ও সমাধান নিয়ে পরস্পরের অভিজ্ঞতার আদানপ্রদান ও বিশেষজ্ঞদের অভিমত জানার জন্য এই আলোচনা চক্র। এই অঞ্চলে আলুর উৎপাদন প্রচুর তাই হিমঘরের সংখ্যাও অনেক। এখান থেকে দূরে শহরে আয়োজন করলে চাষি, হিমঘর মালিক বা গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্য- সবার পক্ষে অংশগ্রহণ করা অসুবিধার হবে তাই সবার স্বার্থে সরকারের পক্ষ থেকে আলোচনা চক্রটি এই অঞ্চলের একটি হিমঘর চত্বরেই আয়োজন করা হয়েছে। গ্রাম্য অঞ্চল বলে কাছাকাছি কোন হোটেল বা থাকবার উপযুক্ত জায়গা নেই, তাই দূর থেকে আগত অংশগ্রহণকারীদের রাত্রিবাসের ব্যবস্থাও আশেপাশের বিভিন্ন হিমঘরের অতিথিশালায় করা হয়েছে। কলকাতা শহর থেকে অনেকটা পথ, পরের দিন সকাল বেলা সেমিনার শুরু তাই সরকারী আধিকারিকদের আগের দিন অনুষ্ঠানের জায়গায় পৌঁছে যেতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।কলকাতায় জন্মে, বড় হওয়া মেয়েটির, অফিসের কাজে গ্রামাঞ্চলে আসা এই প্রথম নয়, কিন্তু এইভাবে একা এত রাতে কোথাও পৌঁছানোর অভিজ্ঞতা এর আগে কখনো হয়নি। তার ওপর এই জায়গাটিতে প্রথমবার আসা, তাই সম্পূর্ণ অচেনা। সরকারী অফিসে আধিকারিকদের মধ্যে কনিষ্ঠতম সদস্য হিসাবে যোগদান করার পর থেকে, বয়োজ্যেষ্ঠ আধিকারিকরা তাকে কন্যা বা ভগিনীর নজরে দেখেন। কখনোও অফিসিয়াল ট্যুরে একা আসতে দেন না, এক বা একাধিক জন সবসময় সঙ্গে থাকেন। খোলামেলা পরিবেশে অভ্যস্ত, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য পাশ করা মেয়েটির মাঝে মাঝে, সেইসব বয়সে অনেক বড়, রক্ষণশীল ঊর্ধ্বতনদের, অতিরিক্ত অনুশাসনের বাঁধনে দমবন্ধ লাগে, বিদ্রোহ করে বলতে ইচ্ছে করে যে সে তার নিরাপত্তার দায়িত্ব নিজেই নিতে পারে, এত বিধিনিষেধের প্রয়োজন নেই। কিন্তু মা বলেন, “যতই হোক, তোমাকে নিরাপদে রাখায় তো ওঁদের কোন স্বার্থ নেই। ওনারা তোমাকে স্নেহ করেন, তোমার মঙ্গল চান, তাই নিজেদের মত করে আগলে রাখেন। ওঁদের সেই শুভ উদ্দেশ্যকে অসম্মান করতে নেই।‘ অগত্যা সব কিছু চুপ করে মেনে নিতে হয়। 

এবারেও বেশ কিছু বরিষ্ঠ আধিকারিকদের সঙ্গে হাওড়া স্টেশনে একজোট হয়ে আসবার কথা ছিল কিন্তু সদ্য স্বামীহারা মায়ের একমাত্র মেয়ে সে। বাড়িতে তার দুদিনের অনুপস্থিতির কারণে যাতে মায়ের কোন অসুবিধা না হয়, সে সব দেখতে গিয়ে বেরোতে দেরী হয়ে গেল। হাওড়ায় পৌঁছে জানা গেল নির্দিষ্ট ট্রেন অনেক আগেই ছেড়ে গেছে। তখন মোবাইলের যুগ আসেনি তাই খবরাখবর নেওয়ার এত সুবিধা ছিল না। হয়তো অন্যরা ভেবেছেন কোন কারণে মেয়েটি আসতে পারবে না, তাই তাঁরা গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেছেন। অচেনা জায়গায় একা যাওয়ার সাহস না করে হয়তো বাড়িই ফিরে যেত মেয়েটি কিন্তু হঠাৎ দেখা হয়ে গেল আরেক খুব পরিচিত সিনিয়ার সহকর্মীর সঙ্গে, তিনিও স্টেশনের ট্রেন ধরতে এসেছেন একই সেমিনারে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে। মেয়েটি বাড়ি ফেরার পরিকল্পনা বাতিল করে দিয়ে নিশ্চিন্ত মনে তাঁর সঙ্গে ট্রেনে উঠে পড়ল। গল্প করতে করতে বেশ ভালোই যাওয়া হচ্ছিল, হঠাৎ সেই দাদাস্থানীয় সহকর্মীটির মনে পড়ল কাছেই তাঁর এক দূরসম্পর্কের আত্মীয় থাকেন যাঁর সঙ্গে, সুযোগের অভাবে, বহুদিন দেখাসাক্ষাৎ হয় নি। তিনি ঠিক করলেন সেদিনের রাতটা সেই আত্মীয়ের বাড়িতে কাটিয়ে পরের দিন ঠিক সময়ে সেমিনার শুরু হওয়ার আগেই অনুষ্ঠানের জায়গায় পৌঁছে যাবেন। মেয়েটিকে জানালেন সে কথা, সঙ্গে তাঁর সঙ্গে সেই আত্মীয়ের বাড়িতে যাওয়ার প্রস্তাবও দিলেন। সম্পূর্ণ অজানা, অচেনা বাড়িতে থাকার সেই প্রস্তাবে মেয়েটি সম্মত হতে পারল না। তাছাড়া তখন মোটে বিকেল ৪ টের মত বাজে, আকাশে সূর্যের আলো ঝলমল করছে, সহকর্মী দাদার কাছ থেকে জানা গেছে যে সেখান থেকে নির্দিষ্ট স্টেশনে পৌঁছাতে বড়জোর দেড় - দুঘন্টা লাগবে। বাইরে থেকে আগত অতিথিদের নিয়ে যাওয়ার জন্যে স্টেশনে সরকারী গাড়ির ব্যবস্থাও থাকার কথা, তাহলে চিন্তা কি?সহকর্মী নেমে গেলেন, ট্রেনও ছেড়ে দিল কিন্তু তারপরেই শুরু হল বিপত্তি। সিঙ্গল লাইন, প্রতিটি স্টেশনে, উল্টোদিক থেকে আসা সব ট্রেনকে পথ দিতে গিয়ে, এই ট্রেনটি অনেক সময় ধরে দাঁড়িয়ে পড়তে শুরু করল। এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে হতে ঐ টুকু পথ যেতে ২ ঘন্টার জায়গায় কখন যে ৪ ঘন্টা পার হয়ে গেল, বোঝাই গেল না। মেয়েটির আর কিছু করার ছিল না, চুপচাপ বসে ট্রেনের জানলা দিয়ে সূর্যের অস্ত যাওয়া, বিকেল গড়িয়ে রাত নেমে আসা, ঝোপে ঝাড়ে জোনাকি জ্বলা নেভা দেখতে দেখতে অবশেষে গন্তব্য স্টে শনে ট্রেন পৌঁছল। ট্রেন থেকে নেমে ঐ নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে কোন সরকারী কর্মী বা আশেপাশে কোন গাড়ি নজরে এলো না। এরকম পরিস্থিতিতে অনভিজ্ঞ মেয়েটি, প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছিল কি করবে সে?ফিরতি ট্রেন ধরে কলকাতা ফিরে যাবে? কিন্তু ফেরার ট্রেন কখন আছে, জানা নেই। এখন ট্রেন ধরলে তো পৌঁছতে মাঝরাত হয়ে যাবে, সে ঝুঁকি নেওয়া কি উচিত হবে? যে হিমঘরের গেস্ট হাউসে তাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে তার নামটা জানা আছে। মেয়েটি ভাবলো, তাহলে একটাই পথটা খোলা আছে, ওই হিমঘরেই পৌঁছে যাওয়া, কিন্তু যাবে কি করে? প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে গুটিগুটি পায়ে বাইরে আসতে একটা ঝুপড়িতে চায়ের দোকান নজরে এলো, কয়েকটা ভাঙাচোরা বেঞ্চি আর টেবিল পাতা। একটা বেঞ্চিতে, যাদের দেখলে অল্পবয়সী মেয়েরা চোখ নামিয়ে দ্রুত সে জায়গা এড়িয়ে চলে যেতে চায়, সেইরকম চেহারার কিছু ছেলে উচ্চৈঃস্বরে প্রাকৃত ভাষায় আড্ডা দিচ্ছে। তাদের মধ্যিখানে হৃষ্টপুষ্ট, বেশ ভয় জাগানো চেহারার, বোধকরি, দলের পাণ্ডা নেতৃত্বসুলভ ভঙ্গিতে সবাইকে কিছু বলছে, বাকিরা মাঝে মাঝে সম্মতিসূচক মন্তব্য করছে। কথা বলার মত আর কারুকে আশেপাশে দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ মায়ের কথা মনে পড়ল। মা বলেন, “কোন মানুষই আগাগোড়া খারাপ হয় না। যাদের সমাজ খারাপ বলে জানে, তাদের ভেতরেও শুভবুদ্ধি সুপ্ত থাকে। সমাজ তাদের দিকে বারবার আঙুল তুলে খারাপ বলে চিহ্নিত করে বলে ভালো হওয়ার ইচ্ছে মরে গিয়ে, তারা জিদের বশে আরো খারাপ পথে চলতে থাকে। শুভবুদ্ধি জাগ্রত করতে পারলে তারাও অনেকের উপকারে আসতে পারে।“ মায়ের সেই কথাকে মাথায় রেখে মেয়েটি চায়ের দোকানের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দর্শন সেই দলনেতার দিকে এগিয়ে গেল, কোমল অথচ ভীতু, ভীতু গলায় ডাকল, “দাদা, দয়া করে একটু শুনবেন।“যে ছেলেটি স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে, সম্ভবত: সামনে সমীহ পেয়ে আর আড়ালে পিছনে ‘মস্তান’, ‘গুণ্ডা’ ইত্যাদি বিশেষণে ভূষিত হয়ে অভ্যস্ত, তাদের কাছে এই ডাকটা বোধহয় অপ্রত্যাশিত ছিল, সে ও আবার এক শহুরে, ভদ্রসভ্য চেহারার অল্পবয়সী মেয়ের কাছ থেকে, তাই দলের কেউই প্রথমে আমল দেয় নি। দ্বিতীয় বার ডাক দিতে একজন সহযোগী, মেয়েটির দিকে দলনেতার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। তার ঈষৎ রক্তবর্ণের চোখের দিকে তাকিয়ে ভেতরে ভেতরে ভয়ে কাঁপতে থাকা মেয়েটি, যথা সম্ভব গলার স্বর শান্ত রেখে, নিজের সমস্যার কথা অকপটে খুলে বলে সোজাসুজি জিজ্ঞাসা করল কিভাবে ওই হিমঘরে সে পৌঁছাতে পারে। শুনে ছেলেটি এতক্ষণের কর্কশ গলা আশ্চর্যজনক ভাবে নামিয়ে নরম স্বরে বলল, “দিদি, জায়গাটা স্টেশন থেকে বেশ দূরে, হেঁটে তো যেতে পারবেন না, আবার নির্জনও। দিনকাল তো আজকাল ভালো নয়, চেনাজানা ছাড়া যে কোন রিকশাওলার সঙ্গে যাওয়া নিরাপদ হবে না। দাঁড়ান দেখছি।“ বলে হঠাৎ দুরে দাঁড়ানো এক সাইকেল রিকশাচালককে নাম ধরে ডেকে বলল, “শোন, এই দিদি সরকারী কাজে এসেছেন, খুব সাবধানে এনাকে নিয়ে যাবি আর ঠিকঠাকভাবে পৌঁছে দিবি। লোকজন না থাকলে ফাঁকা জায়গায় নামিয়ে দিয়ে আসবি না।“ ছেলেটি কোন কথা না বলে শুধুই ঘাড় নাড়ল, কম ভোল্টেজের আলোআধাঁরিতে রিকশায় উঠবার আগে মেয়েটা তার মুখখানাও ভালো করে দেখতে পেল না।

স্টেশন চত্বরে পেরিয়ে রিকশা যে রাস্তায় পড়ল, সেটি সম্ভবত: মফস্বল শহরের প্রধান সড়ক। রাস্তায় তেমন আলো না থাকলেও খোলা দু চারটে দোকানপাট, কংক্রিটের বাড়ি থেকে আলো এসে পড়ছে। ভোল্টেজ কম তবু মানুষের সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। নিজের বুদ্ধি ও সাহসিকতার জন্যে নিজেকেই বাহবা দিতে দিতে, নিশ্চিন্ত হয়ে মেয়েটি রিকশার ওপর আরাম করে বসল। খানিকটা রাস্তা গিয়ে রিকশাচালক হঠাৎ বাঁক নিয়ে মেঠো পথে ঢুকে পড়ল। মেয়েটির একটু অস্বস্তি হলেও সেরকম বিশেষ কিছু ভীতিপ্রদ মনে হল না- হিমঘর তো আর শহরে বানানো হয় না, গ্রাম্য জায়গা তো হবেই। রিকশা চলেছে তো চলেছেই, পথ যেন আর ফুরোচ্ছে না। চাঁদের আলোয় মনে হচ্ছে চারিদিকে মাইলের পর মাইল জুড়ে শুধু চাষের জমি, না কোন মানুষজন, না ঘরবাড়ি। যতদূর দৃষ্টি যায়, কোন হিমঘরে তো চোখে পড়ছে না। এ কোথায় চলেছে সে?একবার মনে হল, স্টেশনের চায়ের দোকানের ওই অসামাজিক দেখতে ছেলেটিকে  বিশ্বাস করে ভুল পদক্ষেপ নিয়ে ফেলল না তো? এমন নয় তো যে এই রিকশাচালকের সঙ্গে ঐ ছেলেটির কোন বিশেষ বোঝাপড়া বা লেনদেনের চুক্তি আছে, তাই বেছে বেছে এর রিকশাতেই মেয়েটিকে উঠতে বলা হল? ভাবতেই শিরদাঁড়া দিয়ে হাড়হিম করা ঠাণ্ডা  স্রোত বয়ে গেল। কি করবে এখন মেয়েটা? তারস্বরে চিৎকার করলেও তো শোনার জন্যে কয়েক মাইলের মধ্যে কেউ নেই। নিজের নির্বুদ্ধিতায় নিজের এ কোন বিপদ ডেকে আনল? পার্সে তেমন কিছু অর্থ না থাকলেও মধ্যবিত্ত বাঙালী পরিবারের মেয়ের উপযোগী হাতে, কানে সামান্য কয়েকটা আটপৌরে সোনার গয়না আছে। সেসব দিয়ে দিতে হলে খুব একটা আফশোস হবে না কিন্তু তার চেয়েও বেশী কিছু যদি ছিনতাই হওয়ার উপক্রম হয়? কি করে নিজেকে বাঁচাবে সে? না আছে গায়ে শক্তি, না আছে হাতের কাছে আঘাত করার উপযুক্ত কোন বস্তু। স্কুলে পড়ার সময় মেয়েদের আত্মরক্ষার জন্যে একবার মার্শাল আর্টের ট্রেনিং নেওয়ার সুযোগ এসেছিল। এখন মনে হচ্ছে সেসময় ট্রেনিং না নিয়ে কি মূর্খামি করেছে সে। ভয়ে মাথা কাজ করছে না, তবু বুদ্ধিতে যা এলো, তার ভরসায় রিকশাচালকের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলো মেয়েটা, যদি এতে মাথায় আসা অপচিন্তা দূর করা যায়, “দাদা আমি সরকারী অফিসার, সরকারী কাজেই এখানে এসেছি।“ (যদিও এই কথাগুলো আগে থেকেই রিকশাচালকের জানা আর ঐ অন্ধকার জনমানবশূণ্য প্রান্তরে সরকারী অফিসারের তকমা কি ভাবে রক্ষাকবচ হতে পারে, সে প্রশ্নের উত্তর মেয়েটার জানা নেই)। তারপর তার মানবিক বোধকে জাগিয়ে তুলতে, “বাড়িতে বিধবা মাকে একা রেখে এসেছি।“ অনেকক্ষণ একা নিজে নিজে বকে যাওয়ার পর রিকশাচালক মুখ খুললেন, “দিদি, আপনি ভয় পাবেন না। আমি বেশী লেখাপড়া লিখিনি তাই রিকশা চালাই কিন্তু আমার বাড়িতেও তো মা বোন আছে। আপনি নিশ্চিন্তে বসুন, আমি ঠিক আপনাকে পৌঁছে দেব।” বোঝা গেল বাইরে যতই সাবলীল দেখাবার চেষ্টা করুক না কেন, মেয়েটা যে ভয় পেয়েছে, সেটা রিকশাচালকের কাছে লুকোতে পারেনি, তার অসংলগ্ন কথায় ধরা পড়ে গেছে। কিন্তু হেরে গেলে তো চলবে না। তখনও মেয়েটা কথা চালিয়ে যাচ্ছে, ”সে তো নিশ্চয়ই। আপনারা আছেন বলেই তো আমরা নির্ভয়ে এভাবে সরকারী কাজ করতে একা একা গ্রামেগঞ্জে যেতে পারি।“ (পরে কোন সময়ে মনে পড়লে মেয়েটির হাসি পেত এই ভেবে যে সে কিভাবে সম্ভ্রম জাগানোর অস্ত্র হিসেবে ‘সরকারী’ শব্দটিকে, ঐ পরিস্থিতিতে অর্থহীন ও হাস্যকর ভাবে বারবার ব্যবহার করেছিল)। বোধহয় রিকশাচালকেরও তা বুঝতে অসুবিধা হয় নি। উত্তরে সে জিজ্ঞাসা করল, “দিদি, আমার কাছে পরিষ্কার কলের  জল আছে, খাবেন? মনে হচ্ছে আপনার গলা শুকিয়ে গেছে।“ সঙ্গে সঙ্গে মনে হল, জলে বেহুঁশ করে দেওয়ার ওষুধ মেশানো নেই তো? সভয়ে মেয়েটি গলার সব জোর একত্রিত করে প্রতিবাদ করে উঠল, “না না, তার কোন দরকার নেই। আমি একদম ঠিক আছি। দয়া করে একটু তাড়াতাড়ি চলুন।“ সম্ভাব্য বিপদ কোন কোন দিক থেকে আসতে পারে- ভাবতে ভাবতে চোখ বুজে ফেলল সে।

কতক্ষণ চলার পর, মনে নেই, হঠাৎ রিকশাটা, যেন মাটি ফুঁড়ে গজিয়ে ওঠা, একটা আলো জ্বলা চত্বরে ঢুকে পড়ল আর চোখের সামনে দেখা দিল চেনা সহকর্মীদের অনেকগুলো মুখ। মৃত্যুর মুখ থেকে জীবনে ফিরে এলে কেমন লাগে? মেয়েটির বোধহয় সেরকম কিছুই অনুভূতি হচ্ছিল। তাই রিকশা থেকে ব্যাগটা নামানোর জন্যেও অপেক্ষা না করে এক দৌড়ে অতিথিশালার নিরাপদ আশ্রয়ে ঢুকে পড়েছিল, রিকশার ভাড়া দেওয়া যে তখনও বাকি, মনে ছিল না। সেদিন কোন সহকর্মী ভাড়া মিটিয়েছিলেন আর কে ই বা ব্যাগ নামিয়েছিলেন, জানা নেই কিন্তু  চারদিক থেকে অঢেল তিরস্কার যে জুটেছিল সেটা ভালো করেই স্মরণে আছে। কেন সে স্টেশনে অন্য কোন সহকর্মীকে খুঁজে পাওয়া অবধি অপেক্ষা করেনি? কেন সে অন্ধকারে, জনমানবশূণ্য এতটা রাস্তায় একা আসার মত এমন হঠকারী সিদ্ধান্ত নিল? কি ভেবে সে স্টেশন মাস্টারের শরণাপন্ন হওয়ার বদলে মারাত্মক বিপদের ঝুঁকি নিয়ে ওইসব চায়ের দোকানে আড্ডা মারা অসামাজিক ছেলেদের কাছে সাহায্য চাওয়ার মত অবিমৃষ্যকারিতার পরিচয় দিল? এরকম নানা প্রশ্নে সেদিন মেয়েটিকে জর্জরিত হতে হয়েছিল। জানা গিয়েছিল পূর্বপ্রতিশ্রুতিমত অফিসের স্থানীয় শাখার কয়েকজন কর্মী, সহজে নজরে পড়ব বলে, ফেস্টুনসহ স্টেশনের ওভারব্রীজের ওপর দাঁড়িয়েছিলেন, বাইরে একটু দূরে গাড়িও ছিল কিন্তু মেয়েটি অন্ধকারে ওপরের দিকে না তাকিয়ে শুধু আশেপাশে খুঁজেছিল তাই দেখতে পায়নি। আরো কয়েকজনের পরের ট্রেনে আসার কথা ছিল কিন্তু সে কথাও মেয়েটির জানা ছিলনা। আর একে অনভিজ্ঞতা, তার ওপর ওইরকম পরিস্থিতিতে ঘাবড়ে যাওয়ায়, স্টেশনের মাস্টারের কাছে সাহায্য চাওয়ার কথা মাথায়  আসেনি। কোন কোন বয়োজ্যেষ্ঠ সহকর্মী রাগত স্বরে মন্তব্য করেছিলেন যে এইসব উচ্চশিক্ষিতা এখনকার (মানে সে যুগের হিসাবে) মেয়েদের এই রকমের প্রয়োজনের অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস, নির্বুদ্ধিতারই নামান্তর। মেয়েটির কিন্তু তাতে রাগ হচ্ছিল না বরং মায়ের কথা মনে পড়ছিল, “ওঁরা তোমার ভালো মন্দ নিয়ে চিন্তা করেন বলেই, তোমাকে আপন ভেবে শাসন করেন। চাকরি করতে গিয়ে এত স্নেহ পাওয়া- এ তো তোমার সৌভাগ্য।“ মনে মনে সে আরো বলছিল, “মা, তোমার কথা মিথ্যে হয় নি, তুমি ঠিকই বল- সবার মধ্যেই একটা ভালোমানুষ লুকিয়ে থাকে, খুঁজে নিতে পারলে তার হদিস ঠিকই পাওয়া যায়।“  মেয়েটির পরিচয় নাহয় উহ্যই থাক, শুধু এইটুকু বলা যেতে পারে, এখন সে প্রৌঢ়ত্বের সীমানায় উপনীত হয়েছে। মা সেই কবে তাঁকে ছেড়ে চলে গেছেন। বয়োজ্যেষ্ঠ, স্নেহপ্রবণ সেই ঊর্ধ্বতন আধিকারিকদের অনেকেও আজ আর ইহজগতে নেই। সেসময়ে অপেক্ষাকৃত অল্পবয়স্ক যাঁরা ছিলেন, তাঁরাও আজ বার্ধক্যের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে। আজকাল খবরের কাগজে, দূরদর্শনের পর্দায় প্রায়ই মেয়েদের, প্রকাশ্য দিবালোকে, বাড়ির ঘেরাটোপে, স্কুলের নিরাপদ আশ্রয়ে, বড় হয়ে ওঠা নিজের চেনা পাড়ার মধ্যে, এমনকি শিশু, বৃদ্ধাকেও অব্যাহতি না দেওয়া সম্মান হানির সব অবিশ্বাস্য খবর পাওয়া যায়। তখন মেয়েটির

সেইদিনের কথা মনে পড়ে। ২৫/ ২৬ বছরের একটি তরুণীর সেদিন, দু ধারে চাষের জমির মাঝখানের নির্জন মেঠো পথ দিয়ে সম্পূর্ণ অরক্ষিত অবস্থায় যাওয়ার সময় কত কি ই না হতে পারত? ওই আপাতদৃষ্টিতে অসামাজিক ছেলের দল তার অসহায়তার সুযোগ নিতে পারত? এমনকি সোনার গয়না  বা পার্সের টাকাকড়ি ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যে যে কেউ মেরে মাঠের মধ্যে ফেলে দিতেও পারত? তেমন হলে তার মৃতদেহ খুঁজে পেতেই বহুদিন চলে যেত, দেহ হয় তো শনাক্তকরণের অবস্থায়ই থাকত না। কি হত মায়ের, একমাত্র সম্বল মেয়েটিকে হারিয়ে? পাগল হয়ে  যেত না অসুস্থতায় শয্যাশায়ী হয়ে পড়ত? কিন্তু সে সব কিছুই হয় নি।  সেদিনের সেই রোমহর্ষক কাহিনী বলার জন্যে আজও মেয়েটি বহাল তবিয়তে বেঁচে আছে। কিন্তু কেন? সেযুগেও তো খুন, রাহাজানি, মেয়েদের সম্মানহানির ঘটনা নেহাত কম শোনা যেত না? রিকশাচালকটি নিশ্চিতভাবে সৎ ছিলেন (এমন আরো অনেকের কথা শোনা যায়  যাঁরা যাত্রীর অসাবধানে ফেলে যাওয়া মানিব্যাগে হাজার হাজার টাকা পেয়েও আত্মসাৎ না করে ফিরিয়ে দেন) কিন্তু ওই তথাকথিত অসামাজিক ছেলেগুলো? তারা কেন কোনরকম অন্যায়  সুযোগ নেওয়ার বদলে মেয়েটিকে যথেষ্ট সম্মান দিয়েছিলেন? সঠিক পথ দেখিয়েছিলেন? সে কি তবে শিক্ষিত, তাদের তুলনায়  সামাজিক উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন একটি তরুণীর ভরসা করে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করার জন্যে, সাহায্য চাওয়ার জন্যে? না কি ‘দাদা’ সম্বোধন করে তাদের অপ্রত্যাশিত মর্যাদা দেওয়ার জন্যে? এই ব্যবহার কি তাদের বহুদিনের অব্যবহৃত, ঘুমিয়ে থাকা সৌজন্যবোধকে জাগিয়ে দিয়েছিল? মেয়েটির জানা নেই তবু সে আজও মায়ের কথামতো মনপ্রাণ দিয়ে বিশ্বাস করতে চায়, “কেউ কখনো পুরোপুরি খারাপ হয়  না। যতই চাপা দিয়ে রাখা হোক না কেন, শুভবুদ্ধি ঠিক সব মানুষের অন্তরের এক কোণে লুকিয়ে থাকে। তাকে জাগ্রত করতে পারলে এ যুগেও দস্যু রত্নাকরের ভেতরে বাল্মিকী মুনিকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব। “অন্যের কাছে ঘটনাটি যতই অকিঞ্চিতকর মনে হোক না কেন, সেই ভয়াবহ রাত, ওই জনমানবহীন প্রান্তর তার একা পেরোনোর কথা মন পড়লে মেয়েটির এখনো মনে হয় ওই বখাটে ছেলেগুলি ও আপাতদৃষ্টিতে ভয়ঙ্কর দর্শন দলনেতাটির দাক্ষিণ্যেই সে সেদিন নিরাপদে গন্তব্যস্থলে পৌঁছাতে পেরেছিল। তাদের বাহ্যিক অবয়ব দেখে প্রাথমিক ভাবে চরিত্রের ধারণা করেছিল ভেবে মেয়েটি এখন লজ্জিতই বোধ করে, বরং মনে হয় তারা সেদিন অচেনা পরমাত্মীয়ের রূপেই, তার কাছে ধরা দিয়েছিলেন।
পাহাড়ি  পাকদণ্ডী পথ দিয়ে  চলতে গিয়ে বেশ রোমাঞ্চই  হচ্ছে।  মনে হচ্ছে এরকম কিছু  অভিজ্ঞতা না হলে অফবিট জায়গায় বেড়াতে আসার কোন মানেই হয়  না।  যাত্রাপথের সবটাই যদি পূর্বপরিকল্পনা মত,  ছকে বাঁধা হয়,  তাহলে ফিরে গিয়ে জমিয়ে গল্প করার মত থাকেটাই বা কি? 
খুব সরু মাটির পথ, স্কুলের বাচ্চাদের মত একজনের পেছনে আরেকজন লাইন দিয়ে চলেছি। আমরা কজন ছাড়া আর কোন জনমানব নেই,। মুখ তুললেই মাথার ওপর অনন্ত আকাশ, সঙ্গী হিসেবে চারধারে উঁচু উঁচু পাহাড়ের সারি আর সবুজে ঘেরা অপার পৃথিবী। এ অপার্থিব রূপসুধা আকণ্ঠ পান করেও যেন তৃষ্ণা মেটে না। এ যেন শুধু প্রাণ ভরে বিশুদ্ধ বাতাস বুক ভরে নেওয়ার সময়, প্রকৃতির ভিতর দিয়ে সেই ত্রিভুবনেশ্বরকে উপলব্ধি করার মূহুর্ত। সামান্য কথা বলার শব্দও যেন এই মৌন, ধ্যানগম্ভীর পরিবেশে ছন্দপতন ঘটাবে।
লঘু ছন্দে পা ফেলে মনে মনে গুণগুণ করে গান গাইতে গাইতে পথ চলেছি, “জগতের আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ, ধন্য হল মানবজীবন”। হঠাৎ পাশ থেকে সঞ্জয় নামের সেই বাচ্চা গাইড ছেলেটি হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “ম্যাডাম জি,আমার হাতটা শক্ত করে ধরুন, আপনার চলতে সুবিধে হবে।“ স্মিত হেসে হাত নেড়ে জানালাম, লাগবেনা। নিজের পূর্ব অভিজ্ঞতা মত বোধহয় ওর জানা আছে যে চল্লিশোর্ধ বাঙালী মহিলাদের শারীরিক সক্ষমতার দৌড় কতদূর হয়, তাই এই সাহায্যের হাত বাড়ানো। মনে মনে বেশ একটা সূক্ষ্ম আত্মতৃপ্তি বোধ করলাম এই ভেবে যে এই ছেলেটা জানে না যে এই মহিলা শুধু শুয়ে বসে দিন কাটায় না, রীতিমত ৮ থেকে ১০ কিলোমিটার রোজ হাঁটতে অভ্যস্ত। এইটুকু হাঁটা তার কাছে কোন সমস্যাই নয়। আর সামান্য পথ হাঁটলেই নীচের রাস্তায় নেমে অপেক্ষমান বাস ধরা যাবে, সেই বাসেই হোটেলে ফিরে গিয়ে বিশ্রাম। সারাদিন বেশ ধকল গেছে, তাই কম্বলের তলায় হোটেলের নরম বিছানাটা যেন শরীরকে টানছে। কিন্তু পথ শেষ হতে আর কতদূর? এ তো পার্কের কংক্রিটে বাঁধানো রাস্তায় হাঁটা নয়, উঁচু নীচু, অসমান পথে হাঁটতে গিয়ে বুকে যেন অল্প হাঁপরের টান অনুভব করা যাচ্ছে।
কোন পথে হাঁটা আর কেনই বা বেড়াতে এসে এই অকারণ ঝামেলায় জড়িয়ে পড়া?  এবার একটু পূর্বকথা না বললে যে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। গৌরচন্দ্রিকার অছিলায়  তাই এবারের ভ্রমণ বৃত্তান্তের শুরুটা যতটা পারি, সংক্ষেপে পেশ করার চেষ্টা করি। আমরা দুজন মধ্যবয়সী স্বামী স্ত্রী এসেছিলাম একটি দলের সদস্য হয়ে ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স ভ্রমণ করতে। রাস্তা দুর্গম ও অনিশ্চয়তায় ভরা, সেজন্য এই প্রথম ছেলেমেয়েকে বাড়িতে পরিচারিকার ভরসায় রেখে দুজনে আসা। মনটা একটু খচখচ করছে, ঘোরার শেষ করে বাড়ি ফেরার তাগিদও এবারে বেশী।
দেরাদুন অবধি আকাশপথে এসে গাড়িতে হরিদ্বার, তারপর সেখানে সন্ধ্যায় গঙ্গারতি দেখে পরের দিন সকালে ছোট ভ্যানগাড়িতে চেপে অন্যান্য সহযাত্রীদের সঙ্গে, পরবর্তী গন্তব্য স্থল গোবিন্দঘাট পৌঁছে গেলাম। পথে পড়ল যোশিমঠ ও সেই বিখ্যাত পঞ্চপ্রয়াগ, প্রতিটিই রূপে অনির্বচনীয়। খরস্রোতা অলকানন্দার ওপারের বিশাল গুরুদোয়ারা ‘শ্রী গোবিন্দধাম’ এর পাশ দিয়ে শুরু হল ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স এর বেসক্যাম্প ঘাংঘারিয়ায় পৌঁছানোর ট্রেকিং। গাড়ির পথ ঐ গোবিন্দঘাট পর্য্যন্তই, তবে পাহাড়ি পথ চলার ধকল এড়াতে আমাদের মত যাত্রীদের ঘোড়ার ব্যবস্থাও আছে। ঝর্ণা, সবুজ শ্যামলিমায় ঘেরা পাহাড়ি পথের মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য দুচোখ ভরে দেখতে দেখতে বিকেলের দিকে ঘাংঘারিয়া পৌঁছালাম। খুবই ছোট জায়গা, থাকা খাওয়া সবই অতি সাধারণ। 
পরের দিন সেই বহু প্রতীক্ষিত ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স দেখতে দলপতি তথা মূল গাইডের নেতৃত্বে বেরিয়ে পড়া হল। তখনই জানা গেল যে গত বছর প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে মূল উপত্যকায় ধ্বস নেমে চারিদিকে রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে। উপত্যকার ভিতরে যাওয়া বিপজ্জনক, তাই সেখানে ঢোকার সরকারী অনুমতি নেই। সংবাদটি, প্রাথমিক ভাবে মনোভঙ্গের কারণ ঘটালেও, দলনেতা তথা মূল গাইড এই বলে আশ্বস্ত করলেন যে মূল উপত্যকার মত অপর্যাপ্ত পরিমাণে না হলেও ঐ সময়ে ফোটা নানা প্রজাতির ফুল উপত্যকার মুখে ও আশেপাশের অঞ্চলেও দেখতে পাওয়া  যায়। ঐসব অঞ্চলে গিয়ে বেশ কিছু প্রজাতির ফুল দেখাও হল। সব ফুলের বোটানিক্যাল নাম মনে না থাকলেও সাধারণের কাছে বজ্রদন্তী নামে পরিচিত ফুল আর হলুদ পাপড়ির ওপর লালের টিপ দেওয়া খুব ছোট এক ধরণের ফুল, যার চাহিদা নাকি রূপচর্চায় ব্যবহৃত সামগ্রী প্রস্তুতিতে খুব বেশী, সেই স্যাক্সিফ্রাগা ব্রুনোনিস, বিশেষ করে নজর কাড়লো। এছাড়া চেনাজানা চেহারার বা পরিচিত নামের অর্কিড, প্রিমুলা, জেরানিয়াম, পিটুনিয়া, ক্যলেনডুলা, জিনিয়া আর অজস্র রডোডেনড্রন তো আছেই। ছবি তুলে মনের দুঃখ কিছুটা হলেও মিটল কিন্তু সেইসঙ্গে যা দেখে গা শিউরে উঠল তা হচ্ছে প্রকৃতির ধ্বংসলীলা। শুনেছিলাম কেদারনাথে আকস্মিক বন্যা (ফ্লাশ ফ্লাড) এসে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি ঘটিয়েছে। এখানে এসে মনে হল গোটা উত্তরাঞ্চলেই যেন কোন দানব তাণ্ডব চালিয়ে গেছে যা একবছর পার করেও সামলে ওঠা যায়নি। রাস্তাঘাট সারাইয়ের কাজ শুরু হয়েছে কিন্তু পাহাড় থেকে ক্রমাগত পাথর ভেঙ্গে পড়ে নতুন করে ধ্বস নেমে বিভিন্ন অঞ্চল তছনছ করে দিচ্ছে। সাধারণ জ্ঞান দিয়েই বুঝতে অসুবিধা হয়  না যে এখানকার ইকোলজি, বিগত বছরের বন্যার ফলে, পুরোপুরি স্থিতিশীলতা হারিয়েছে। যাইহোক, পরের দিন আবার দুরন্ত চড়াই ভেঙ্গে হেমকুণ্ড সাহিব দেখতে যাওয়া হল। তুলনামূলকভাবে এই অঞ্চলটি প্রকৃতির রোষ থেকে রেহাই পেয়েছিল তাই চারপাশে থরে থরে ফুল ফুটে আছে। অপরূপ রূপসী ব্লু পপি ও স্বনামধন্য ব্রম্ভকমল, এখানে এসেই প্রথম দেখতে পেলাম, যা দুচোখ সার্থক করে দিল। গুরু গোবিন্দ সিং এর স্মৃতিধন্য ৪৬০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত, ঘিরে রাখা সাতটি পর্বতের অতন্দ্র প্রহরায় থাকা গুরুদোয়ার ‘শ্রী হেমকুণ্ড সাহিব জী’ শিখ ধর্মাবলম্বীদের পবিত্র ধর্মস্থান। এক ধ্যানগম্ভীর পবিত্র পরিবেশ, মন আপনিই শান্ত হয়ে যায়। গুরুদোয়ারার পাশেই একটি সরোবর। বিস্মিত হলাম দেখে যে অনেক তীর্থযাত্রী, গোবিন্দঘাট থেকে ১৯ কিলোমিটার খাড়াই পথ পায়ে হেঁটে এখানে পৌঁছাবার ধকল নেওয়ার পরেও, শুধুমাত্র বিশ্বাসের জোরেই, অপ্রতুল অক্সিজেন ও কনকনে ঠান্ডা হাওয়াকে অগ্রাহ্য করে ঐ সরোবরের হিমশীতল জলে ডুব দিয়ে স্নান করে গুরুদোয়ারায় প্রবেশ করছেন। লঙ্গর খানায় সকল যাত্রীর জন্য বরাদ্দ গরম সাবুর পায়েস গ্রহণ করে ফিরে এলাম ঘাংঘারিয়া। পরের দিন ফিরতি পথে গোবিন্দঘাটে পৌঁছে গেলাম।
ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স ও হেমকুণ্ড সাহিব দর্শনের পরই যদি এবারের ভ্রমণ সমাপ্ত হত, তাহলে এই যাত্রার ক্লাইম্যাক্স অদেখাই থেকে যেত। আর অসম্পূর্ণ থেকে যেত মানুষের প্রতি নতুন করে বিশ্বাস ফিরে পাওয়ার উপাখ্যান। হয়তো ঈশ্বরের অভিপ্রায় ছিল অন্যরকম তাই আমাদের পূর্বনির্ধারিত যাত্রাসূচী অনুসারে, আরো দু একটি স্থান দেখা তখনও বাকি ছিল, আমাদের বাড়ি ফেরার জন্য প্লেনের টিকিটও কাটা ছিল কয়েকদিন পরের। কদিন ধরে আকাশে মেঘের আনাগোনা লেগেই রয়েছে, সূর্যের মুখ দেখা ভার। আমাদের দলনেতা, তাই প্রথমেই যাত্রাসূচীর অন্তর্গত আউলি উপত্যকা দর্শন, বাতিল করে দিলেন এই বলে যে চারিপাশ মেঘে ঢেকে থাকলে যে মনোরম দৃশ্য দেখার উদ্দেশ্য নিয়ে যাত্রীরা ওখানে যান, তা কিছুই উপলব্ধি করা যাবে না। অতএব দ্রষ্টব্য স্থানগুলির মধ্যে অবশিষ্ট রইলো শুধু বদ্রীনাথধাম ও মানা গ্রাম। 
বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রায় প্রতিদিন, ধ্বস নামার ঘটনা কানে আসায় আমাদের দলের পরিচালক এই স্থানগুলিতেও না যাওয়ায় প্রস্তাব দিলেন,পরিবর্তে নিকটবর্তী পাণ্ডুকেশ্বর মন্দিরে, যেখানে বদ্রীনাথজী শীতকালে মন্দির বন্ধ হয়ে গেলে পূজিত হন, দেখিয়ে আনলেন। পায়ে হাঁটা সামান্য সেই পথ চলতে গিয়েও চারদিকের পাহাড় থেকে অনবরত ছোটবড় পাথর গড়িয়ে পড়া প্রত্যক্ষ করলাম। বেশ কিছু জায়গায়, পাথরের আঘাত এড়ানোর জন্যে, প্রায়  দৌড়ে পেরোতে হল। চোখে সামনে এই ঘটনা দেখে বেশ কিছু সহযাত্রী নতুন কোন অভিযানে যাওয়ার সাহস করলেন না, বাকি দিনগুলো হোটেলেই কাটিয়ে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। এত কাছে এসে বদ্রীনারায়ণ দর্শন না করে ফিরে যাব- এতে মন সায় দিচ্ছিল না। দলের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে আলোচনায় জানা গেল দলের আরো বেশ কয়েকজন আমার সঙ্গে সহমত পোষণ করেন। দলনেতাকে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে বলায় প্রথমে তিনি স্বীকৃত হলেন না, শেষে অনেক জোরাজুরি করতে এক শর্তে রাজি হলেন যে গোবিন্দঘাট থেকে বদ্রীনাথধামের পথে আনুমানিক তিন কিলোমিটার দূরত্বে এক জায়গায়, যেখানে প্রায়শই ধ্বস নামার খবর পাওয়া যাচ্ছে, তার আগে অবধি গাড়ি করে যাত্রীদের পৌঁছে দেওয়া হবে। ঐ অঞ্চলটি পায়ে হেঁটে পেরিয়ে নিজের দায়িত্বে অন্য গাড়ি ধরে তাঁরা বাকি পথ যাবেন। গাড়ি ওখানেই অপেক্ষা করবে, ওই জায়গায় ফিরে এলে আবার গাড়িতে করে তাঁদের হোটেলে ফিরিয়ে আনা হবে। পথে ধ্বস নেমে রাস্তা বন্ধ হয়ে গাড়ি আটকে পড়ার ঝুঁকি তিনি কোন মতেই নিতে পারবেন না। তাতেই সম্মত হওয়া ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। ‘যা থাকে কপালে, দেখা যাবে’ ভেবে নিয়ে আমরা কয়েকজন তিনটি ভ্যানগাড়িতে করে বেরিয়ে পড়লাম, আমাদের গাড়ি সবার পেছনে। এ গাড়িতে আমরা সহ দুই মধ্যবয়সী দম্পতি, এক সদ্য বিবাহিত অল্পবয়স্ক স্বামী স্ত্রী ও মাঝবয়সী তিন পুরুষ বন্ধুর দল, আর যাত্রীদের প্রয়োজনে সাহায্য করার জন্যে সঙ্গে, আমার মেয়ের চেয়েও বোধহয় বয়সে ছোট সেই গাইড, সঞ্জয়- মোট আটজন।
বেশ নিরুপদ্রবে তিন কিলোমিটার পথ পাড়ি দেওয়ার পর সামনের দুটি গাড়ির দেখা মিলল, তারা দলনেতার নির্দেশ অনুযায়ী যাত্রীদের নামিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তায় কোন ধ্বস নামার লক্ষণ নেই, অবাধে গাড়ি যাতায়াত করছে। কথা বলে আগেই বোঝা গিয়েছিল আমাদের গাড়ির চালকটি বেশ ভালমানুষ। তিনি আমাদের বাকি রাস্তা নিয়ে যেতে অনিচ্ছুক নন কিন্তু তার ওপর অন্যরকম নির্দেশ থাকায় যেতে পারছেন না। দেখা যাচ্ছে সামনের রাস্তা পরিষ্কার। সবাই মিলে অনুরোধ করায় তিনি, সামান্য কিছু অতিরিক্ত পারিশ্রমিকের বিনিময়ে, এগিয়ে যেতে রাজি হলেন। বেশ নির্বিঘ্নে বদ্রীনাথধাম পৌঁছানো গেল কিন্তু মন্দির,মধ্যাহ্ন বিরতিতে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পুনরায় খোলা অবধি আমরা অপেক্ষা করতে বাধ্য হলাম। এটাই কি আসন্ন রোমাঞ্চকর নাটক, যা অভিনীত হতে চলেছে, তার প্রথম ওয়ার্নিং বেল ছিল? আমরা কজন গর্ভগৃহে প্রবেশ করে, যে মন্দিরে সারা বছর ভক্ত সমাগমে তিল ধারণের স্থান থাকে না, সেখানে আমরা কজন ফাঁকা মন্দিরে আশ মিটিয়ে অনেকক্ষণ ধরে প্রার্থনা করলাম। বেরিয়ে আসতেই গাড়ির চালক তাড়া দিলেন ফিরে যাওয়ার জন্যে। আর একটু গেলেই মানা গ্রাম। চিন সীমান্তের আগে ভারতের শেষ বসতি, সরস্বতী নদীর উৎস স্থল, শ্রী গণেশের মুখে শুনে বেদব্যাসের মহাভারত রচনার স্থান- এত কিছু না দেখে ফিরে যাওয়া কি বুদ্ধিমানের কাজ? তাছাড়া এখনো বৃষ্টি নামার লক্ষণ নেই, তাই নতুন করে ধ্বস নামার সম্ভাবনাই বা কোথায়? চালককে আবার অনুরোধ করা হ’ল, তিনিও সামান্য আপত্তির পর অপেক্ষা করতে রাজি হলেন। চালকের কথা অমান্য করাতেই সম্ভবত: আসন্ন নাটকের দ্বিতীয় ঘন্টা পড়লো। সব দেখা হ’ল, ফাঁকা মাঠে গোল দেওয়ার মত। মানা গ্রাম থেকে হাতে বোনা ভেড়ার লোম থেকে তৈরী পশমের কার্পেট কিনলাম। দর্শনার্থী- ক্রেতা কেউ নেই তাই অন্য বছরের তুলনায়  অনেকটা কম দামেই পাওয়া গেল। তারপর গাড়িতে উঠে পড়লাম। কোথাও কোন বিপদের সঙ্কেত নেই, সহযাত্রীদের সঙ্গে নিশ্চিন্তে গল্প করতে করতে চলেছি। আমাদের দলের বাকি যাদের মাঝপথে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাদের সঙ্গে আর দেখা হয়নি, তাই তারা আদৌ বদ্রীনাথধামে পৌঁছাতে পারলেন কি না - সেই আলোচনাও চলছে। হঠাৎ গাড়ি দাঁড়িয়ে গেল, সামনে আরও দু চারটে গাড়ি দাঁড়ানো। তখনও আমাদের গল্পকে ভাঁটা পড়েনি। শুনলাম সামনের রাস্তা ধ্বস নেমে বন্ধ হয়ে গেছে। পাহাড়ি পথে বেড়াতে এলে এ ঘটনা আকছার ঘটতে দেখা যায়। জেসিবি লোডার মেশিন এসে পাথর সরিয়ে রাস্তা গাড়ি চলাচলের উপযুক্ত করে দেয়- এ জানা কথাই, তাই গাড়িতে বসে অপেক্ষা করতে করতেও গল্পে ভাটা পড়ল না।
বেশ কিছুক্ষণ কেটে যাওয়ার পর দলের পুরুষ সদস্যরা গাড়ি থেকে নামলেন সামনের ঝুপড়ির দোকান থেকে চায়ের জোগাড় করতে, সেইসঙ্গে রাস্তা ঠিক হতে কত সময় লাগবে, তার আন্দাজ করতে। ফিরে এসে যা জানালেন, তা মোটেই আশাব্যঞ্জক মনে হল না। সামনে বেশ বড়সড় ধ্বস নেমেছে। আর্মি পোস্ট থেকে জানা গেছে যে, ইদানীং এই অঞ্চলে ধ্বস নামার প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় পরিষ্কার করার মেশিনও, চাহিদামত সর্বত্র সরবরাহ করা যাচ্ছেনা। কবে নাগাদ রাস্তা খুলবে, তার কোন নিশ্চয়তা নেই, দুতিনদিনও লাগতে পারে। আশেপাশে কোন থাকবার জায়গাও নেই। তাই তাঁরা পরামর্শ দিয়েছেন যে রাস্তা খোলার ভরসায় বসে না থেকে পাহাড়ি পায়ে চলা পথ ধরে খানিকটা এগিয়ে যাওয়াই শ্রেয়। কিছুটা গেলে আবার গাড়ি চলার উপযুক্ত রাস্তা পাওয়া যাবে। আমার কর্তাটি গাড়ির রাস্তা থেকে কিছুটা উঁচুতে একটি সমান্তরাল পায়ে চলা পথ দেখিয়ে বললেন যে ঐ পথ ধরে খানিকক্ষণ হাঁটলেই আবার রাস্তায় নেমে গাড়ি ধরা যাবে। অন্যরা একটু সন্দিগ্ধ হলেও আমি আসন্ন অ্যাডভেঞ্চারের প্রত্যাশায় বেশ উত্তেজনা অনুভব করলাম। 
তারপর শুরু হল পথ চলা, প্রথমে লঘু পায়ে পথের চারপাশের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে, তারপর ধীর পায়ে বড় বড় শ্বাস নিতে নিতে আর কতটা পথ বাকি আছে তার আন্দাজ করতে করতে, তারও পরে ক্লান্ত টলোমলো পায়ে, প্রতি মূহুর্তে খাদে গড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে। কিন্তু সামান্য পথ পার করতে এত সময় লাগছে কেন? পরে জেনেছিলাম, মিলিটারিদের সঙ্গে কথোপকথনে, কতটা দূরত্ব অতিক্রম করতে হবে, সে বিষয়ে আমার কর্তার সম্যক ধারণা থাকলেও, আমাদের মনোবল অক্ষুণ্ণ রাখার উদ্দেশ্যে তিনি তা প্রকাশ করেন নি।
এবড়োখেবড়ো মাটির পথ, কয়েকদিন আগে বৃষ্টি হওয়ায় নরম, আঠালো হয়ে আছে, কাদা মাটিতে পা পড়লে কোথাও পিছলে যাচ্ছে আবার কোথাও এমন ঢুকে যাচ্ছে যে পা ওঠানোই মুশকিল হয়ে পড়ছে। চারদিকে বড় বড় ঘাস আর পাহাড়, গাড়ির রাস্তার কোন হদিস নেই, নেই কোন ঘরবাড়িও। প্রত্যেকেই অসমান পথে শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন। দাঁড়াতে গেলে পায়ের পাতার সঙ্গে শরীরও হয় সামনের দিকে, নতুবা আরো বিপজ্জনকভাবে পিছনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে, ঘুরে দাঁড়িয়ে পেছনের মানুষটিকে দেখার উপায়ও নেই, সাহায্য করা তো দূরস্থান। দলের বাকি দুজন মহিলা সদস্যের মধ্যে একজন তরুণী আর অন্যজন আমার কাছাকাছি বয়সের হলেও মহারাষ্ট্রের গ্রামের মেয়ে, শৈশবে গাছে চড়ে, টিলায় উঠে শরীর অনেক শক্তপোক্ত, ছিপছিপেও, আমার মত কংক্রিটে বাঁধানো ট্র্যাকে হেঁটে সৌখিন শরীরচর্চায় অভ্যস্ত নন।  
দলের বাকি সদস্যদের থেকে বেশ খানিকটা পিছিয়ে পড়েছি। পথ অজানা, মনের জোর ক্রমশঃ কমে আসছে। চড়াই উৎরাই ভাঙতে গিয়ে, মনে হচ্ছে, দম ফুরিয়ে আসছে, আর হাঁটতে পারছি না।  আরো কতদূর চলতে হবে? সেই সময় আবার পাশ থেকে সেই সঞ্জয় নামের গাইড ছেলেটির হাত এগিয়ে এলো, “মা জি, এবার জিদ ছেড়ে আমার হাত ধরুন, নাহলে হাঁটতে পারবেন না, এখনো অনেক পথ চলতে হবে।“ ওকে তো আমি ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। সবাই এগিয়ে গেছে, ও কি শুধু আমার জন্যেই অপেক্ষা করছিল? এবার আর ফেরানো গেল না। ওর ডাকটা ম্যাডাম থেকে মা তে বদলে যাওয়ার জন্যে না কি স্বরে এমন কিছু জোর ছিল বলে- জানি না।  ধরলাম হাতটা, যদিও মনে মনে জানি যে পা পিছলে গেলে এই দোহারা চেহারার ছেলেটার পক্ষে আমার ওজন সামাল দেওয়া সম্ভব হবে না। তবুও একটা ভরসার খুব দরকার ছিল।
সরু পথের একপাশে গভীর খাদ। এমন অবস্থায় পাশাপাশি দুজনের চলা অসম্ভব, দুজনেরই খাদে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। পথ এত পিচ্ছিল আর উঁচু নীচু যে একটা পাও সোজা করে রাখা যাচ্ছে না। তবু ছেলেটা বিপজ্জনক ভাবে খাদের একদম ধার ঘেঁষে হাত ধরে পাশে পাশে চলেছে। ওর পায়ের চাপে মাটি নীচে ধ্বসে পড়ছে। কয়েকবার ওর পড়ে যাওয়ার ভয়ে আমি চেঁচিয়ে উঠলাম কিন্তু ও নির্বিকার। বারবার বলে যাচ্ছে, “মা জি, মাটির ওপর শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে পা চেপে ফেলো, আলগা করে রেখো না, পড়ে যাবে। আর দাঁড়িয়ে পড়ো না, চলতে থাকো। আমি আছি না?” পায়ের জোর, নিয়ন্ত্রণ দুটোই হারিয়ে ফেলেছি, যেখানে রাখতে চাইছি, পা সেখানে না পড়ে অন্য কোথাও পড়ছে। দু একবার পিছলে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হল কিন্তু জাদুকরের মত অদৃশ্য শক্তিকে ছেলেটা পড়তে দিল না, ঐ হালকা শরীরে ঠিক সামলে নিল। সেইসঙ্গে সমানে সাহস জুগিয়ে চলেছে, “কিচ্ছু হয় নি মা জি, ভয় পেও না।“ সঙ্গে আরো একটি অদ্ভুত প্রস্তাব, “আমি মাটির ওপর পা রাখছি, তুমি আমার জুতোর ওপর পা রাখো, তাহলে পিছলোবে না।“ বললাম, “সে আমি পারব না। তার চেয়ে তুমি আমার হাতটাই ভালো করে ধরো।“
মেঘলা আকাশে আলো কমে আসছে। পা থরথর করে কাঁপছে, আর উঠছে না। মনে হচ্ছে এই শেষ, এবার বুঝি আর বাড়ি ফেরা হল না। ছেলেমেয়ের মুখগুলো একবার মনে পড়ল। কেঁদে ফেলে বললাম, “আমাকে ছেড়ে দাও, এখানেই বসে পড়ি। তারপর ঠাণ্ডায়ই হোক বা বন্য জন্তুর আক্রমণেই হোক, মরি, মরবো। আমার আর এক পা চলারও ক্ষমতা নেই।“ ছেলেটা ওই পরিস্থিতিতেও হেসে উঠে বলল, “তুমি পাগল না কি? তোমাকে মা জি বলে ডেকেছি না? তোমাকে একা ছেড়ে আমি কি যেতে পারি? তুমি বসে পড়লে যে আমাকেও বসে পড়তে হবে। রাতের বেলা এই খোলা আকাশের নীচে বসে থাকলে আমরা দুজনেই ঠাণ্ডায় জমে যাব। তুমি তোমার বাড়িতে, ছেলেমেয়ের কাছে ফিরতে চাও না? তাছাড়া এই বয়সে আমিও এই পাহাড়ে চিরদিনের মত থেকে যাই, তুমি কি তাই চাও?” কি উত্তর দেব, বুঝে উঠতে পারলাম না। শুধু ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে চোখের জলে ভিজিয়ে দিতে ইচ্ছে হল। ও আবার বলে উঠল, “মা জি, তার চেয়ে এক কাজ কর। আমি তোমাকে পিঠে তুলে নিচ্ছি, তুমি পেছন থেকে আমার গলা শক্ত করে ধরে থাকো, বাকি পথটা এভাবেই পার করে ফেলি।“ ঐ অবস্থায় আমি কাঁদবো না হাসবো- ভেবে পেলাম না। কি বলে ছেলেটা? আমার ওজন সম্বন্ধে ওর কোন ধারণা আছে? সে কথা বলতে ও জানালো যে আগের বছর বন্যার সময় ও নাকি আটকে পড়া আমার চেয়েও বেশী ওজনের অনেক মানুষকে পিঠে তুলে উদ্ধার করেছে। আরো বলল যে ওদের মত বেশ কিছু স্থানীয় ছেলেকে, উদ্ধারের কাজে সাহায্য করতে, আর্মি থেকে হাতেকলমে ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে, কাজেই আমার চিন্তার কোন কারণ নেই। এতেও আমি ওর কথায় সম্মতি জানাতে পারলাম না। দ্রুত আলো কমে আসছে, আর কিছুক্ষণ পরেই অন্ধকার গ্রাস করে নেবে পাহাড়টাকে আর শুরু হবে হাড় হিম করা শৈত্যপ্রবাহ। ছেলেটা বলল, “আর দেরী করলে চলবে না। চলো মা জি, একটা বড় করে শ্বাস নাও, আমরা দৌড়ে বাকি রাস্তাটা পেরিয়ে যাই।“
মৃত্যু অনিবার্য বলে মেনে নিলে, বোধকরি, মন চিন্তাশূণ্য হয়ে যায়, আমারও মনের অবস্থাও তখন সেইরকম। ছেলেটা আমাকে প্রায় টানতে টানতে নিয়ে চলল, আর আমি মন্ত্রাবিষ্টের মত ওর কথায় যতটা দ্রুত পদক্ষেপে চলা সম্ভব, চলতে লাগলাম। একদমে বেশ খানিকটা চড়াই ভেঙে একটা পাহাড়ের মাথায়  উঠে এসে বললাম, “একটু দাঁড়াও, দম নিয়ে  নিই।“ ও বলল, “মা জি, এখানে এক মূহুর্তও দাঁড়ানো নিরাপদ নয়।“ কারণ জানতে চাইলে পাহাড়ের মাথা থেকে ঝুঁকে দেখালো যে আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, তার নীচে আড়াআড়ি করে এক বিশাল ফাটল ধরেছে। বলল, “যে কোন সময়ে আমাদের নিয়ে পাহাড়টা ধ্বসে পড়বে, তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, এই জায়গাটা পেরিয়ে যেতে হবে।“ আবার দৌড়।
এরকম ভাবে কতক্ষণ পথ চলেছি, মনে নেই। হঠাৎ ছেলেটার কথায় আচ্ছন্ন ভাব কাটল, “ওই দেখ মা জি, নীচে রাস্তা দেখা যাচ্ছে। আমরা পৌঁছে গেছি।“ দেখলাম দলের বাকিরা অনেকটা আগে পৌঁছে গেছে। খবর পেয়ে আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে হোটেল থেকে বাসও এসে গেছে। আমার গৃহকর্তাটি উদ্বিগ্ন মুখে ওপরের পাহাড়ি পথের দিকে চেয়ে আছেন। জল ভরা চোখে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে  বললাম, “আজ তুমি আমায় নতুন জীবন দিলে। তুমি না থাকলে আমি কোন ভাবেই এই রাস্তাটা পার হতে পারতাম না। আজ থেকে জানবো তুমিও আমার একটা ছেলে।“ উত্তরে ও একটু হেসে বলল, “এটা তো আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। যখন তুমি বাড়িতে তোমার নিজের ছেলেমেয়ের কাছে ফিরে যাবে, তখন আমার কথা হয়তো তোমার মনেই পড়বে না।“ এবারে ওর হাসিটা কেমন যেন করুণ লাগলো। সবাই বাসে উঠে ডাকাডাকি করছে, এতবড় বিপদ পেরিয়ে এসে আমিও বড্ড অবসন্ন, তাছাড়া এখানেও পাহাড় থেকে ক্রমাগত পাথর পড়ছে তাই বাস ড্রাইভার বেশীক্ষণ দাঁড়াতে নারাজ, আর কথা হল না। পরে জেনেছিলাম,পাকদণ্ডী পথে আমরা দু দুটো পাহাড় ডিঙিয়েছি। 
সঞ্জয়ের সঙ্গে চেষ্টা করেও আর দেখা হয়নি। ওর কথা জানতে চেয়েছিলাম, প্রাণ ভরে আরো একবার ধন্যবাদ জানাতে চেয়েছিলাম, সামান্য দৈনিক মজুরীতে অস্থায়ীভাবে নিযুক্ত ছেলেটাকে, কিছু অর্থ কৃতজ্ঞতাস্বরূপ দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু পারিনি। জানলাম, এবারের ভ্রমণ শেষ হয়ে  যাওয়ায় দল পরিচালক আর একদিনের জন্যেও বাড়তি খরচ করতে নারাজ, তাই ওকে বরখাস্ত করা হয়েছে। বরখাস্ত হওয়ার আগে দল পরিচালকের কাছ থেকে সঞ্জয়ের প্রচুর তিরস্কার জুটেছে - প্রধানত: তাঁর বারণ সত্বেও ওর উপস্থিতিতে, গাড়ি বদ্রীনাথধাম অবধি নিয়ে যেতে, পর্যটকদের বাধা না দেওয়ার জন্যে। দ্বিতীয় অভিযোগটি আরো গুরুতর- কর্তব্যে অবহেলার। ওর দায়িত্ব ছিল সব যাত্রীদের দেখভাল করা কিন্তু একজন যাত্রীকে সাহায্য করতে গিয়ে ও অন্যদের দিকে নজর দেয়নি। সেই সদ্যবিবাহিত দম্পতি দলপতির কাছে অভিযোগ করেছেন যে তাঁরা পাহাড়ি পথে অন্যদের তুলনায় দ্রুত চলার ফলে দল থেকে খানিকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। অপেক্ষা করেও পথনির্দেশে সাহায্য করতে কারুকে পাওয়া যায়  নি, তাই তাঁরা দিকভ্রষ্ট হয়ে বহুক্ষণ ভুল পথে চলে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েন। শেষে ভাগ্যক্রমে এক স্থানীয় মানুষের দেখা পেয়ে সঠিক পথের সন্ধান পান। এই ঘটনার জন্যে তাঁদের আঙুল কর্তব্যরত গাইড সঞ্জয়ের কাজে গাফিলতির দিকেই উঠেছিল। সম্ভবত: নিজস্ব সময় একান্তে উপভোগ করার উদ্দেশ্যে ইচ্ছাকৃত ভাবে দলের থেকে অনেকটা এগিয়ে গিয়ে তাঁরা যে দলছুট হয়েছিলেন, সে ব্যাপারে কিছুই বলেননি। শুনলাম সঞ্জয় না কি বিনা প্রতিবাদ মাথা নীচু করে সব অভিযোগ স্বীকার করে নিয়েছে। এর শাস্তিস্বরূপ ওর আর্থিক প্রাপ্য থেকেও কিছু কাটা গেছে কি না জানা নেই। গরীব ঘরের ছেলে, আর্থিক সংস্থান নেই, প্রথাগত শিক্ষা অর্থাৎ ডিগ্রীর জোর আছে বলেও মনে হয় না। এইসব ভ্রমণ সংস্থাগুলির পক্ষ থেকে, পর্যটক নিয়ে এলে, অস্থায়ী সহযোগী গাইড হিসেবে, দৈনিক মজুরীর ভিত্তিতে ওকে কাজে লাগানো হয়, তাদের কথার প্রতিবাদ করবে- এমন সাহস ওর কোথায়? ওর মত ছেলের অভাব তো এ অঞ্চলে নেই। সামনের ট্যুরে যদি ওর জায়গায় অন্য কারুকে নিয়োগ করা হয়? ওর কাজ যদি না জোটে? সেই ঝুঁকি নেওয়ার সাহস ওর নেই।
সেই তিরস্কারের সাক্ষী ছিলাম না, তাই আপত্তি জানাতেও পারি নি। দল পরিচালককে বলতে পারি নি, “ও আমাকে হাত ধরে নিয়ে না এলে হয় তো পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়ে সেদিনই আমি শেষ হয়ে  যেতাম অথবা অচেতন অবস্থায় রাস্তার ওপর পড়ে থাকা আমাকে খুঁজে পেতে আবার লোক পাঠাতে হত- এতে আপনার হয়রানি বাড়তো বই কম তো না।“ 
পরিশেষে জানাই, এত কিছুর পরেও সেবারে আমাদের অগ্নিপরীক্ষা শেষ হয় নি। আরো অনেক কঠিন পরিস্থিতি পেরিয়ে তবে বাড়ি ফিরতে পেরেছিলাম। দেরাদুনে এসে প্লেন ধরতে গোবিন্দঘাট থেকে ফেরার দিন, হোটেলের কাছাকাছির একটি পাহাড় থেকে রাস্তার ওপর অনবরত কাদামাটি ও পাথর ধ্বসতে শুরু করেছিল। সারা দিন অপেক্ষা করে বিকেলের দিকে আর্মির প্রহরায়, নিজেদের মালপত্র পিঠে, মাথায় বয়ে আমরা, একজন একজন করে জায়গাটা দৌড়ে পার হয়ে তবে গাড়িতে উঠতে পেরেছিলাম। চারদিকে ধ্বস নামার কারণে বারবার যাত্রার গতিপথ বদল করতে হয়েছিল। তারপর প্লেন ধরতে না পারার আশঙ্কায়, চালকের আপত্তিকে অগ্রাহ্য করে ভয়ঙ্কর বিপদের ঝুঁকি নিয়ে, কোথাও পাথর পড়ে ভেঙ্গে যাওয়া, কোথাও প্রচণ্ড জলের তোড়ে ভেসে যাওয়া রাস্তা দিয়ে, মেঘে ঢাকা আকাশের অন্ধকারে মাঝরাত অবধি তাকে গাড়ি চালাতে আমরা বাধ্য করেছিলাম। শেষে সব হোটেল বন্ধ থাকায় নিরুপায় হয়ে ট্রাক ড্রাইভারদের থাকার উপযুক্ত এক সরাইখানায়, সারাদিন না খাওয়ার পর অখাদ্য ডাল রুটি দিয়ে কোনক্রমে ক্ষুণ্ণিবৃত্তি করে, অবসন্ন শরীর তক্তাপোষে এলিয়ে দিয়ে রাতটুকু কাটিয়েছিলাম। পরের দিন ভোর থাকতে থাকতেই আবার যাত্রা শুরু করে একেবারে শেষ মূহুর্তে প্লেন ধরতে পেরেছিলাম।
ভারতবর্ষের অনেক জায়গায় ঘুরেছি। পাহাড়ি পথে নান রকম অজানা বাধার সম্মুখীনও হয়েছি কিন্তু এইরকম শিহরণ জাগানো, রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা আর কখনই হয় নি। যখনই আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুবান্ধবদের কাছে ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স ভ্রমণের গল্প করি, শুনে তাঁরা শিউরে ওঠেন আর আমাদের বিপদের ঝুঁকি নেওয়ার সাহসকে বাহবা দেন। তখন মুখে না বললেও, সবার অলক্ষ্যে আমার সেই ক্ষণিকের জন্যে খুঁজে পাওয়া ছেলের জন্যে মনটা আজও সজল হয়ে ওঠে। 
সঞ্জয় সেদিন ওখানে উপস্থিত না থাকলে আজ গল্প বলার জন্য আমিও থাকতাম কি? এত বড় উপকারের বিনিময়ে ওর জন্যে কিছুই করতে পারিনি কিন্তু ওর কথামত ওকে ভুলতেও পারিনি। ওর কোন ছবি আমার কাছে নেই তাই মুখখানা স্মৃতিতে অস্পষ্ট হয়ে গেছে কিন্তু ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্সে ভ্রমণের প্রসঙ্গ উঠলে বা বাড়িতে আসা কোন অতিথিকে ওখানকার ছবি দেখাতে বসলেই মনের মধ্যে সঞ্জয়ের কথাগুলো অনুরণন শুনতে পাই, “ভয় পেও না মা জি, আমি আছি না। আমার হাতটা শক্ত করে ধরো, আমরা ঠিক এই পথটা পেরিয়ে যাব।“ লোকে যতই বাড়াবাড়ি বলুক, মনে মনে আমি জানি, ও যে আমার পথে খুঁজে পাওয়া পরমাত্মীয়।
পথে ঘাটে চলতে অপ্রত্যাশিত ভাবে এমন অনেক মানুষের দেখা পেয়েছি যাঁরা সেই সময় তাঁরা না থাকলে পৃথিবীটা বোধহয় আজও এত সুন্দর মনে হত না। হিমাচল প্রদেশের চন্দ্রতাল থেকে কেলং আসার পথে আমাদের গাড়ির গিয়ার বক্স থেকে উপড়ে চালকের হাতে চলে এসেছিল। যাঁরা ঐ পথে গেছেন, তাঁরা জানেন সম্পূর্ণ কাঁচা, অনবরত বরফ গলা জলের স্রোত বয়ে যাওয়া, একটি মাত্র গাড়ি যাওয়ার মত প্রস্থের কি দুর্গম সেই পথটি। সারাদিনে একটি করে বাস আপ ও ডাউনে চলে, গাড়িও চলে হাতে গোণা। মাঝখানে নেই কোন থাকার, খাওয়ার জায়গা, গ্যারাজ তো দুরস্থান। আমাদের সঙ্গে না ছিল খাবার, না পর্যাপ্ত জল। ঐ অবস্থায় একটি সরকারী গাড়ি ঈশ্বরপ্রেরিতের মত এসে আমাদের উদ্ধার করে কেলং এর হোটেলেই শুধু পৌঁছে দেয়নি, দমকলের ব্যবস্থা করে আমাদের অচল গাড়িকে মোটর মেকানিকের দোকান অবধি টেনে নিয়ে যেতেও সাহায্য করেছিল। এজন্য ওই গাড়ির আরোহীদের সারাদিন খাওয়া জোটেনি। ধন্যবাদ দিতে গেলে সেই সরকারী কর্মচারীরা বিনয়ের সঙ্গে জানিয়েছিলেন যে তাঁরা ধন্যবাদের যোগ্য এমন কিছুই করেননি। পাহাড়ি পথে একে অপরকে সাহায্য করা তো কর্তব্য, না হলে জীবন চলবে কি করে? অবাক হয়ে গিয়েছিলাম সহজ, সরল ভাষায় বলা তাঁদের সেই মহান জীবনবোধের পরিচয় পেয়ে।
আরো একবার বালি বেড়াতে গিয়ে,  পুত্রসহ আমরা পরিবারের তিন সদস্য জঙ্গলের গভীরে নেমে জলপ্রপাত দেখতে গিয়ে পথ হারিয়ে কন্যার থেকে, যে স্বইচ্ছায় উপরেই ছিল, অনেকক্ষণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলাম। কন্যা, পরিবারের সদস্যদের বিপদের আশঙ্কায় জ্ঞানশূণ্য হয়ে সন্ধ্যা নামার মুখে একাই সেই অচেনা, অজানা জঙ্গলের পথে আমাদের খুঁজতে যাওয়ার উপক্রম করেছিল। ভাষার কারণে মত আদানপ্রদানের সমস্যা থাকা সত্বেও, মাত্র দুদিনের পরিচিত অল্পবয়স্ক গাড়ির চালক, তাকে একা যেতে দেননি, নিজে সঙ্গে করে খুঁজতে নিয়ে গিয়েছিলেন। তারওপরে ক্রন্দনরত কন্যাকে, পরিচিত একটি ছেলের সঙ্গে মোটরবাইকে ওপরের নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠিয়ে নিজেই পায়ে হেঁটে আমাদের খুঁজতে বেরিয়েছিলেন। সেদিন দেখেছিলাম কিভাবে সেই বিদেশ বিভুঁইয়ে স্থানীয় একাধিক ছেলেরা আমাদের উৎকন্ঠা বুঝতে পেরে, না চাইতেই নিজেদের উদ্যোগে মোটরবাইক নিয়ে ও মোবাইলের সহায়তায় চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে পুনরায় আমাদের আবার মিলিত হতে সাহায্য করেছিল। সামান্য অর্থের বিনিময়ে কি এই উপকারের প্রতিদান দেওয়া সম্ভব ছিল? এরকম কাহিনী বলে শেষ করার নয়। এঁদের প্রত্যেকের অবদান, আমাদের জীবনে অপরিসীম। নাই বা হল তাঁদের সঙ্গে আর কোনদিন দেখা, তাঁরা সবাই আমাদের পরমাত্মীয়।

ইংরাজী কবিতার 

বাংলা অনুবাদ

অঞ্জন ঘোষ

অনুবাদঃ অঞ্জন ঘোষ

Comments

Top

গতকাল তুই এলিনা
(Yesterday morning I began waiting for you)

আর্সেনি তারকোভস্কি

 

তকাল
তুই আসবি বলেছিলি,
তাই কাকভোর থেকে
শুধু তোরই অপেক্ষায়
সারা দিনমান বয়ে গেল,
তুই তো তবুও এলিনা!

তোর মনে পরে সেদিনের কথা?
হাওয়ায় ছুটির গন্ধ,উৎসবের মোলায়েম মেজাজ
আমি কোট না চড়িয়েই তাড়াহুড়ো
বেরিয়ে এসেছিলাম শুধু তোর অপেক্ষায়!

আজকেও দেখ!
ওদেরই কারসাজি এইসব..
মন খারাপ করা এলোপাথাড়ি দিন
এত সময় বয়ে গেল,
তবু আঁধার আকাশে দুষ্টুমি শেষ নেই
একগুঁয়ে বাদলায় বানচাল করবেই সবকিছু
দেখ, কেমন অঝোরে বৃষ্টির ফোঁটা
শৈত্য শাখাপ্রশাখা থেকে চুঁইয়ে পড়ছে অবিরাম!

তুই বিনা আজ কোনো কথাই
হতে পারেনা আমার ব্যথার শুশ্রুষা,
পারেনা মুছতে প্রকৃতিরও এই অশ্রুঝর্ণা

(আর্সেনি তারকোভস্কি আর্সেনি তারকোভস্কির জন্ম ১৯০৭ সালের ২৫শে জুন বর্তমানে উইক্রেনের অন্তর্গত ক্রপাইনাৎস্কি শহরে। ১৯২১ সালে লেনিনের উপর ছন্দোবদ্ধ ধাঁধায় একটি কবিতা প্রকাশ করে রাজরোষে পড়েছিলেন এবং কোনক্রমে মৃত্যুদন্ড এড়ান। তিনি ছিলেন মূলত অনুবাদক। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ "শীতের পূর্বে" (Snow Before) ১৯৬২তে প্রকাশ করেন। ১৯৮৯ সালের ২৭শে মে মস্কোতে তিনি প্রাণত্যাগ ​করেন। মৃত্যুর পরে সোভিয়েত রাষ্ট্রীয় পুরস্কার লাভ করেন। তাঁর শেষ কাব্যগ্রন্থ "আশীর্বাদপুষ্ট আলো" (The Blessed Light) ১৯৯৩ সালে মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয়। তাঁর পুত্র বিখ্যাত চলচ্চিত্র রিচালক আন্দ্রেই তারকোভস্কি।)

বিদায়বেলা
(Farewell)
ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা

 

মি যদি মরে যাই
খুলে রেখো প্রেক্ষাবিতানখানি
ছোটো ছেলেটি কমলালেবু খাচ্ছে
(আমার অলিন্দ থেকে আমি যেন দেখতে পাই)
পক্কগম ঘরে তুলছে চাষি
(অলিন্দ থেকে শুনতে পাচ্ছি আমি)
যদি মরে যাই আমি
খুলে দিও প্রেক্ষা বিতানখানি।

(ফেদেরিকো গারসিয়া লোরকা স্প্যানিশ ভাষার 'জনমনের কবি 'লোরকা এক ক্ষণজন্মা কবি, চিত্রশিল্পী, নাট্যকার ও সংগীত পরিচালক। তাঁর জন্ম ১৮৯৮ সালের ৫ই জুন এবং মৃত্যু ১৯৩৬ সালের ১৯শে অগাস্ট মাত্র আটত্রিশ বছর বয়সে। লোরকা সরাসরি কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শ গ্রহণ করেননি; তারপরও তাঁকে রাজনৈতিক কারণে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। স্পেনের একসময়ের দাপুটে সামরিক কর্মকর্তা এবং পরবর্তীতে জাতীয়তাবাদী দক্ষিণপন্থিদের ঐক্যের প্রতীক ফাসিস্ত ফ্রান্সিসকো ফ্রাংকোর ফালাঞ্জিস্ট বাহিনীর - ‘বুদ্ধিজীবী নিপাত যাক’ কর্মসূচির মাত্র তিনদিনের মাথায় হত্যাকাণ্ডের শিকার হন বিশ্বসাহিত্যের এই প্রবাদপুরুষ। তিনি প্রজন্ম ২৭-এর (কবিদের সম্মিলনে গড়ে ওঠা সংগঠন, যারা ইউরোপিয়ান বিপ্লব স্প্যানিশ সাহিত্যে আনার চেষ্টা করে) একজন সদস্য হিসেবেই মূলত বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পান। তার রচিত অসংখ্য রচনা ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের পাঠকদের কাছে এবং ধীরে ধীরে তাঁর কাব্য-সাহিত্যপ্রতিষ্ঠা লাভ করে স্বতন্ত্র এক ধারায়। লোরকার ১৮ বছরের কবিতা রচনার মধ্যে ৪টি ধারায় ভাগ করা হয়:

১. প্রস্তুতির ও প্রাথমিক বছরগুলো (১৯১৮-১৯২৭)

২. জিপসি বালাদ (১৯২৬-২৮)

৩. নিউইয়র্কে লেখা কবিতা (১৯২৯-৩০)

৪. তার পরের কবিতা (১৯৩১-৩৬)

এর মধ্যে মৌলিক ও মূল্যবান হচ্ছে জিপসি বালাদ এবং নিউইয়র্কের কবিতা। মোটা দাগে জিপসি বালাদের মধ্যে লোরকা গীতলতা এবং চিত্রকল্প ব্যাবহার করে ঐতিহ্যগত লোকজ লোরকা নতুনত্ব ভরিয়ে দিলেন। নিউইয়র্কে লেখা কবিতাগুলোয়, যা পরে পোয়েতা এন নুয়েভা ইয়র্ক (নিউইয়র্কের কবিতা) কাব্য গ্রন্থে প্রকাশিত হয়, তিনি চিত্রকল্প এবং কোলাজ এমনভাবে বিচ্ছিন্ন আবার একই সঙ্গে সংগঠিত করেছেন যে এগুলো পরাবাস্তববাদী অভিধান প্রাপ্ত হয়ে উঠেছে।)

অতিথিশালা
(The Guest House)

মাওলানা জালালুদ্দিন রুমি


 

 

 

 

 

মানবজমিন অনন্য অতিথিশালা
প্রতি প্রত্যুষে নতুন নতুন পালা
কিছু উল্লাস, কিছুবা বিষাদ, কিছু ইতরতা
অতর্কিতে কয়েক পলের অতিথি সচেতনতা
সকলে স্বাগত, সকলে আদৃত
হোক না সে নানা দুখের দল,
হয়ত তারা হিংস্র মর্জি
সাফ করে কিছু দামি আসবাব,
তবু তাঁদেরও প্রাপ্য হোক
সম্মানিত আপ্যায়ন
হতে পারে ঘর ধোয় মোছে তারা
আসবে পরিহা অনুরঁজন।
কুচিন্তা হোক,শরম হোক,
হোক না কোনো খলতা
দুয়ারে দাঁড়িয়ে স্বাগত জানিও
হাসি মুখে রেখো ভদ্রতা।
যে হোক অতিথি কৃতজ্ঞ থেকো
তারা তো সকলে নারায়ণ
ভুলো না কখনো ভালো বা মন্দ
এরা করে কোনো দৈববার্তা বহন।

(মাওলানা রুমি ফার্সি সাহিত্যের এমন একটি নক্ষত্রের নাম, যার আলো মানুষকে প্রজ্বলিত করে চলেছে ৮০০ বছরের বেশি সময় ধরে। ১২০৭ সালে জন্ম নেয়া এই আধ্যাত্মিক কবি, ইসলামী ব্যক্তিত্ব, ধর্মতাত্ত্বিক, অতীন্দ্রবাদী এবং সুফি ১৭ ডিসেম্বর ১২৭৩ সালে মৃত্যুবরণ করেন।। তাঁর জ্ঞানের পরিসীমা শুধু পারস্য অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ থাকে নি। নিজ গুনে, স্বমহিমায় তা ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বে, সাহিত্য প্রেমী প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে। পশ্চিমা বিশ্বের নামী দামি সাহিত্যিক ইয়েটস, শেক্সপিয়র, নেরুদা, উইলিয়াম কার্লোসদের ছাপিয়ে মাওলানা রুমির মসনবি বই এখন সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়, পঠিত। এরই স্বীকৃতিস্বরুপ জিতে নিয়েছে আমেরিকার ‘বেস্ট সেলিং পয়েন্ট’ অ্যাওয়ার্ড। সারা বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয়েছে রুমির কবিতা সমূহ। মাওলানা রুমি তাঁর কবিতার মাধ্যমে যে দিক দর্শন এবং প্রেম আর ভালবাসার বার্তা তুলে ধরেছেন তা দেশ, কাল, জাতি এবং ভাষার গন্ডিকে অতিসহজেই অতিক্রম করে গিয়েছে। কবিতার পাশাপাশি তিনি বেশ কিছু গদ্যও লিখেছেন এবং সে গদ্যের মাধমে যে সংলাপ এবং উক্তি অবতারণা করেছেন, তা যুগে যুগে মানুষের হৃদয়কে জয় করে চলেছে। মাওলানা রুমি ছিলেন আধ্যাত্মিকতা, অতীন্দ্রিয়বাদ এবং সুফিবাদের শ্রেষ্ঠ ধারক এবং বাহক ছিলেন। তিনি তাঁর কবিতার মাধ্যমে মানবজাতির আত্মার রহস্য উন্মোচন করেছেন এবং সৃষ্টিকর্তার সাথে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে প্রেমকেই বেছে নিয়েছেন। )

arseny.jpg
Federico-Garcia Lorca.jpg
Rumi.jpg

যদি না থাকে মনে
(If You Forget Me)
পাবলো নেরুদা


 

মি স্বেচ্ছায় তোমায়
একটি মাত্র নিখাদ বার্তা
পৌঁছে দিতে চাই

বলছি তোমায় তাই:
যখন আমি বিলম্বিত হেমন্তের বাতায়ন পথে
রক্তিম শাখাপ্রশাখার অন্তরালে
স্ফটিকস্বচ্ছ চন্দ্রমাকে দেখি,
যখন আমি আগুনের কাছে গিয়ে
দুরবগত ভষ্মকে অথবা কাঠের গুড়ির
কুঞ্চিত ত্বক স্পর্শ করি,
এই সবকিছুই আমাকে তোমার কাছে
টেনে নিয়ে যায়,
ঠিক যেন যা কিছুর অস্তিত্ব রয়েছে চারিপাশে,
সুবাস,আলোক,ধাতববস্তু সকলই,
এমনকি সেই ডিঙিগুলি যাতে আমি অনায়াসে
সেই অপেক্ষারত তোমার কাছে
দ্বীপগুলোতে পৌঁছে যেতাম।

তবুও তোমার অন্দরে যদি তিল তিল
আমার প্রতি ভালোবাসা শুকিয়ে যায়
আমিও একে একে রুদ্ধ করে দেবো
ভালোবাসার সকল কবাটগুলোকে।

যদি বা হঠাৎ দেখি
আমাকে ভুলেছ তুমি, কিংবা
আমার প্রতি হয়েছ বিগতস্পৃহ,
যেন রাখো তবে তুমি
অনেক আগেই তোমাকে ভুলেছি আমি।

যদি তুমি ভাবো
আমার জীবনে ধ্বজা ওড়ানো ঝড়
নেহাত দীর্ঘ ক্লান্তকরুণ পাগলামিতে ভরা,
এবং যদি এটাই জাগিয়ে রাখো
তোমার হৃদয়ে যেখানে শিকড় গাড়া
সেই তীরেতেই ফেলে যাবে অনায়াসে

তবে একথা মনে রেখে দাও তুমি
সেই দিনেতে, সেই দন্ডে আমিও,
আমার সকল ভালোবাসার ডোর
এবং সকল শিকড়বাকড় বাঁধন
উপড়ে নিয়ে খুঁজবো অন্য কূল।

তবে কিনা যদি তুমি প্রতিটি দিন
প্রতি ঘন্টা অনুভবে বোঝো আমিই
তোমারই নিঠুর ভালোবাসা ডোরে বাঁধা
আমাদের এটাই গন্তব্য, একান্ত ভবিতব্য,
যদি প্রতিটি দিন একটি সুবাস ফুল
তোমার অধরে আমাকে খুঁজে মরে।

তবে আমার সোহাগ, আমার প্রাণেরই সখা,
আমার ভেতর প্রেমের আগুন
উঠবে আবার জ্বলে
আমার গভীরে নিভবে না আর কিছুই
যাবেনা আর কোনো কিছুই ফেলা,

তোমার আঁচেই জ্বলবে আমার আগুন,
হে প্রিয়তমা,
আর যতদিন থাকবে তোমার আয়ু
থাকবে আমার প্রেমের নিবিড় ডোর
চিরদিনের তোমার হাতেই বাঁধা।

(পাবলো নেরুদা - পরাবাস্তব এক বিপ্লবী বামপন্থী মহাকবি পাবলো নেরুদার আসল নাম নেফটালি রিকার্ডো রেইয়েস বাসোয়ালটো। ১৯০৪ সালের ১২ জুলাই;পাররাল নামে চিলির একটি শহরে নেরুদার জন্ম। অতি অল্প বয়েসেই লেখালেখি শুরু। মাত্র তেরো বছর বয়েসেই লেখা ছাপানো। ষোল বছর বয়েসে পুরোদস্তুর লিখিয়ে। ছদ্মনামটি তখনই নেওয়া।

শৈশবে চলে আসা টিমুকো শহরে মেয়েদের স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা কবি গ্যাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল কবিতা লেখার জন্য যোগাতেন উৎসাহ। ভাষায় অনূদিতও হল। দ্বিতীয় গ্রন্থটি তাঁকে যশ ও খ্যাতি এনে দেয়। কবির 'ক্যান্টো জেনারেল' এক বিচিত্র মহাকাব্য যাতে আছে ১৫টি পর্ব, প্রতিটি পর্বে আছে অনেকগুলি করে কবিতা। আলোচক বইটিকে দান্তের 'ডিভাইন কমেডি'র সঙ্গে তুলনা করেছেন।

ষাটের দশকের স্মরণীয় কাব্যসংকলন — 'ইসলা নেগ্রা' — কতকটা ডায়েরি ভঙ্গিতে, কাব্যিকতা বজায় রেখে এ কবিতাগুলি রচিত। নানা সময়ে তিনি গদ্যও কম লেখেননি, যা সংকলিত হয়েছে Passions and Impressions নামের বইতে। এখানে আছে কিছু ভারত স্মৃতি, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাৎ, কালীঘাট দর্শন প্রভৃতি।

১৯৭১ সালে নেরুদাকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য তাঁকে এই পুরস্কার প্রদান নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। রোগাক্রান্ত কবির জীবন সায়াহ্নেও কবিতা-রচনা চলে অবিরাম, প্রয়াণ ২৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৩।

পিনোশে সরকার প্রতিহিংসা বশত: তাঁর ভাল পারাইসো, সান্তিয়াগো, ইসলা নেগ্রার বাড়ি লুঠপাঠ করে, ধ্বংস করা হয় বিপুল সংগ্রহ। গার্সিয়া মার্কেজ বলেছিলেন—নেরুদা বিংশ শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ কবি।)

বনবালা
(A Girl)

এজরা পাউন্ড 

 

 

 

মার হাতে সেঁধিয়ে যায় বিলম্বলয়ে
আশ্চর্য একটা সহজ চারাগাছ,
ঊর্ধ্ব পথে আমার বাহু আঁকড়ে রয়
আমার বুকে আলিঙ্গনে জড়িয়ে যায়
আস্তে আস্তে নিম্নে চলন তন্তুবায়
আষ্টেপৃষ্ঠে ,ছাড়বে না আর আমার সাথ
শরীর ছেড়ে বিস্তারিত অনেক হাত।

তুই অপূর্ব অন্তরতর ইচ্ছে গাছ
শ্যাওলা শ্যামল তোর শরীর বিরল আজ
পেরিয়ে এসব তুই বাতাসি রক্তনীল
শৈশব তোর অহংমুখি  উর্দ্ধাসীন
এরও পরে আমার মনে সংশয় আজ
জগত তোকে বলবে না কি মূর্খ সাজ?

(এই কবিতার অবয়বে রয়েছে রোমক মিথ। সৌরদেব এপোলো (Apollo) এক পরী দেফনি (Daphne) এবং বীরযোদ্ধা  ইরোসের (Eros) কাহিনী) এজরা পাউন্ড আধুনিক মার্কিন সাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ কবি ও সমালোচক এজরা পাউন্ডের জন্ম ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দের ৩০ অক্টোবর আইডাহোর হেইলিতে।

"ইমাজিসম" ধারার প্রতিষ্ঠায় তিনি অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন। তাঁর কাব্যসঙ্কলন "রিপোস্টেস" কবিতা "হিউ সেলউইন মোবারলে" এবং অসমাপ্ত মহাকাব্য "দ্য  ক্যান্টোস" চিরায়ত বিশ্বসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে।

তিনি  টি. এ. এলিয়ট, রবার্ট ফ্রস্ট, জেমস জয়েস এবং আর্নেস্ট হেমিংওয়ের সৃষ্টিকর্ম নতুন করে মূল্যায়ন করেন। ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে মার্কিন সেনাবাহিনী রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে তাঁকে ইতালিতে গ্রেফতার করে।

প্রথমে তাঁকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা ক্যাম্পে কয়েদ রাখা হয়। দীর্ঘ ১৩ বছর কারাদণ্ড ভোগ করেন তিনি। ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দের ১৮ এপ্রিল তিনি মুক্তি লাভ করেন। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ১ নভেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়)

probondhoicon.jpg
Ezra Pound.jpg

আমার হৃদরোগ এবং
(Angina Pectoris)
নাজিম হিকমেত

জানেন ডাক্তারবাবু,আমার হৃদযন্ত্রের
অর্ধেকটা এখন রয়ে গেছে চীনদেশে
সেনাবাহিনীর সাথে কুচের তালে তালে
সেও চলেছে অবিরত পীত নদীর পাড়ে।

আর,প্রতিটি প্রত্যুষে, জানেন ডাক্তারবাবু,
প্রতি প্রত্যুষের সূর্যোদয়ে গ্রীসের মাটিতে
আমার এই হৃদয়ের জন্য নির্ধারিত থাকে
নিয়তির মতো ঘাতকের একটি করে বুলেট

আর ডাক্তারবাবু, প্রতিটি রাতে যখন
এই কয়েদখানার চোখ ঘুমে ঢলে আসে
এবং আরোগ্যালয়ে নামে জনহীন নিশুতি
আমার হৃদয় তড়িঘড়ি স্মৃতির সরণী বেয়ে
থমকে দাঁড়ায় ইস্তানবুলের আদিম ঘরে।


আর তারপরে দশ দশটা বছর পেরিয়ে
আমার চারিপাশের হতশ্রী মানুষগুলোকে
দেওয়ার মতো আছে শুধু একটি আপেল
বুঝুন ডাক্তারবাবু,মাত্র একটি লাল আপেল:
আমার এই হৃদয়।


আর এটাই,ডাক্তারবাবু, এটাই মাত্র কারণ
আমার হৃদযন্ত্রে রক্তগতির স্বল্পতার প্রদাহ,
তামাকের বিষ নয়,নয় এই সুদীর্ঘ কারাবাস
অথবা নয় ক্ষয়িষ্ণু অস্থির দুরারোগ্য ব্যাধি।


আমি গরাদের ফাঁক দিয়ে নিশাকাশে চাই,
আর এই ভার বুকের নিবিড় যন্ত্রণা নিয়েও
অনুভব করি আকাশের দূরতম নক্ষত্রটিও

(নাজিম হিকমতের জন্ম ১৫ জানুয়ারি ১৯০২ তুরস্কে এবং মৃত্যু ৩ জুন, ১৯৬৩ (৬১ বছর) সোভিয়েত ইউনিয়নে। তিনি পেশায় কবি ও নাট্যকার। নাজিমের কথা বলতে গেলেই অবধারিতভাবে যে নামটি আসে তা হলো মুস্তফা কামাল পাশা। প্রথমে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সঙ্গী পরবর্তীতে প্রধানতম শ্রেণীশত্রুতে পরিণত হওয়া  এই অত্যাচারী নায়ক মূলত প্রতিনিধিত্ব করছিলেন তার নিজের শ্রেণীরই। নাজিম তাই কলম ধরেছিলেন এই শ্রেণি বিভক্ত সমাজের বিরুদ্ধে। তাঁর রাজনৈতিক মতামত শাসকদলের বিপজ্জনক মনে হওয়ায় ১৯৩৮ থেকে ৬৫ অবধি তাঁর সকল লেখালেখি তুরস্কে নিষিদ্ধ ছিল। ১৯৫০ সালে তিনি পাবলো নেরুদার সঙ্গে যৌথভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন।)

শহুরিয়া সকালে
(Awakening in New York)
মায়া এঞ্জেলো

 

 

বাতায়ন পথে বাতাসের সাথে পর্দার খুনসুটি
দেবদূত আর সুপ্ত শিশুরা স্বপ্নের কাটাকুটি
শহর নিজেই জেগে ওঠে দেখি ভূতল করিডরে
আমি চেতাবনি জেগে উঠি রোজ টানটান পরিসরে
প্রভাত না হতে জীবন যুদ্ধ বিস্তৃত চারিধারে
ক্লান্ত যাপন অবহেলা আর অনাগ্রহের ভারে।।

(মায়া এঞ্জেলো ১৯২৮ সালে মিসৌরির সেন্ট লুইস শহরে জন্ম। কিন্তু শৈশবের বেশীরভাগ সময় কেটেছে আরকানসর ছোট্ট স্ট্যাম্প শহরে,নানীর পরিচর্যায়। সাহিত্যজীবনের দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরে লিখেছেন অজস্র কবিতা, প্রবন্ধ ও স্মৃতিকথা। আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘আই নো হোয়াই দা কেইজড বার্ড সিঙস’ লিখে আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক নন্দিত হন। ধর্ষণ, বর্ণবাদ, 

বিরুদ্ধে সাহসী ও দৃঢ় উচ্চারণের জন্য সবার কাছে দারুণ প্রশংসিত হয় তার এই আত্মজীবনী। সাহিত্যে বহুমুখী সৃষ্টিকর্মের জন্য পেয়েছেন অসংখ্য সম্মাননা। তার আরেক সফল রচনা ‘জাস্ট গিভ মি অ্যা কুল ডিঙ্ক অফ ওয়াটার ফর আই ডাই’ নামক কাব্যগ্রন্থ ১৯৭১ সালে মনোনীত হয়েছিল পুলিৎজারের জন্য। ১৯৯৩ সালে প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে নিজের লেখা কবিতা ‘পালস অফ মর্নিং’ আবৃত্তির জন্য লাভ করেন গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড।হলিউডের জনপ্রিয় অ্যাকশন হিরো ওয়েসলি স্নাইপস অভিনীত ‘ডন ইন দ্য ডেল্টা’ নামক চলচ্চিত্রের পরিচালক মায়া এঞ্জেলো। ছবিটি ১৯৯৮ সালে মুক্তি পেয়েছিল। মায়া এঞ্জেলোর কাব্যগ্রন্থের মধ্যে ‘জাস্ট গিভ মি অ্যা কুল ড্রিঙ্ক অফ ওয়াটার ফর আই ডাই’, ‘অন দ্য পালস অফ মর্নিং’, ‘অ্যান্ড স্টিল আই রাইজ’, ‘শেকার হোয়াই ডোন্ট ইউ সিঙ’ ‘ফেনোমেনাল ওম্যান’ বিশেষ সমাদৃত। আত্মজীবনীর মধ্যে ‘আই নো হোয়াই দা কেইজড বার্ড সিঙস’ ও ‘মম অ্যান্ড মি অ্যান্ড মম’ উল্লেখযোগ্য। ২০১১-এর ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা কাছ থেকে দেশের বেসরকারি লোকদের জন্য সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম পেলেন। ২০১৩ সালে বের হয় তার আত্মজীবনীমূলক অষ্টম বইটি। নাম- মম অ্যান্ড মি অ্যান্ড মম। এর পরের বছরের ২৮ মে ২০১৪ সালে তিনি ৮৬ বছর বয়সে ইহলোকের মায়া ছাড়লেন। )

সমাধিফলক -১

(TOMBSTONE 1 )

পোলো লেমেনস্কি

 

 

শরীর সম্পর্কিত সমাধিলিপি

খানে শায়িত আছেন সুমহান কবি

ইহলোকে লিখে তিনি যাননি এক কলি

এই নির্ভাষা, আমার হৃদয়ে যেন জাগে,

এটাই আসলে কবির সমগ্র রচনাবলী।

 


সমাধিফলক -২

(TOMBSTONE -2)

আত্মা সম্পর্কিত সমাধিলিপি

খানে শায়িত আছেন এক শিল্পী

অভিষঙ্গ যাপনের যিনি যাদুকর

কলার প্রাখর্যে তার হৃদয় বিদীর্ণ

বহুরূপী শিল্পীকে করুণা কর ঈশ্বর ।

(পলো লেমিনস্কি ব্রাজিলের পর্তুগিজ ভাষার প্রতিভাবান ভাষাবিদ, কবি, লেখক ও অনুবাদক পলো লেমিনস্কির ফিলহো ব্রাজিলের ক্যুরিতিবাতে ১৯৪৪ সালের ২৪শে অগাস্ট জন্ম গ্রহণ করেন এবং মাত্র ৪৪ বছর বয়সে ঐ শহরেই ১৯৮৯ সালের ৭ই জুন অতিরিক্ত মদ্য আসক্তির ফলস্বরূপ লিভার সিরোসিসে মারা যান। তিনি ছিলেন কান সাহিত্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কবি। নতুন ধারার বিপ্লবী এই কবি নানা আকৃতির কবিতার পাশাপাশি হাইকু লিখেও জনপ্রিয় হন।  কবিতার পাশাপাশি হাইকু লিখেও জনপ্রিয় হন। কবিতার পাশাপাশি তিনি সাহিত্য সমালোচনা, জীবনী রচনা, অনুবাদ শিক্ষকতা করেছেন। লেমিনস্কি ফরাসী, ইংরেজি, স্প্যানিশ, জাপানী, ল্যাটিন ও গ্রীক ভাষায় বিশেষ দক্ষ ছিলেন। জেমস জয়েস, স্যামুয়েল বেকেট, ইউকিও মিশিমা, মাৎসু বাশু প্রমুখের কাজ অনুবাদ করেছেন তিনি। তিনি নিজের নব্যধারার 'ঠাসবুনট কবিতা' (Concrete poems) এবং হাইকু’র জন্য বেশি বিখ্যাত ছিলেন। ঐ 'কংক্রিট কবিতা' আমাদের হাংরি প্রজন্মের সাহিত্য আন্দোলনকে প্রভাবিত করেছিল।)

Najim-Hikmet.jpg
Maya Angelou.jpg
Paulo-Leminski.jpg

Comments

Top

মাষ্টারমশাই

মাস্টারমশাই

দীপ মুখার্জী

সহকারী শিক্ষক, ইউ পি পাব্লিক স্কুল

লাভপুর, বীরভূম, পঃ বঙ্গ

oldman1.jpg

প্রবন্ধ

ষাঢ় মাসের সদ্য বিদায়ী পূর্ণিমার চাঁদ যেন আজ গা ঢাকা দিয়েছে এই বৃহৎ আকাশের দখল নেওয়া তরতাজা ঘন মেঘের আড়ালে। একটানা বৃষ্টিতে দিশে হারিয়ে অজানা লক্ষে বয়ে চলেছে কোপাই এর উজ্জীবিত জল। বাবুদের দালান বাড়ির মেঝে থেকে মাঝিদের উঠোন, আজ নিজেদের সব ভেদাভেদ ভুলিয়ে মনের আনন্দে উভয়েই জলমগ্ন। ওই মায়াবী নিস্তেজ চাঁদের আলোয় ও মাটির স্যাঁতসেঁতে গন্ধে মিশে গেয়ে যেন ঝিমিয়ে পড়েছে নিষ্প্রাণ এই পৃথিবী, কানে আসে শুধুই অস্থির ঝিঝি পোকার ডাক, তার পর সবটাই নিস্তব্ধ....।

খড়ের চাল বেয়ে এক নাগাড়ে গড়িয়ে পড়া বৃষ্টির জলে, নিকোনো মাটির বারান্দাটি যেন তার চিরাচরিত সাজ হারিয়েছে, দরজার পাশে দেওয়ালে ঝুলানো লণ্ঠনটি তার জীবনের শেষ আলোটুকু দিয়ে খানিকটা হলেও প্রাণ জুগিয়েছে মাস্টারমশাই এর আঙিনায়। বারান্দার এক প্রান্তে বসে মাঝবয়েসী মেয়েটি তার গুরুর রাত্রের আহারের ব্যবস্থাপনায় এমন ভাবে মগ্ন যে বৃষ্টির ছাঁটে ডবডবে ভিজে যাওয়া পরনের পোশাকটিও তার নিষ্ঠার সামনে হাসিমুখে পরাজয় স্বীকার করেছে। "অভাগী... অভাগী.." অন্ধকার ঘরের ভেতর থেকে গম্ভীর গলার ডাকটি শুনতে পেয়ে অভাগী তড়িঘড়ি কড়াইয়ের উপর একটি থালা ঢাকা দিয়ে বলে উঠলো, "আসছি বাবু..." তারপর দেওয়ালে ঝুলানো লণ্ঠনের শিখাটি একটু বাড়িয়ে সে অন্ধকার ঘরটিতে প্রবেশ করে। 

জন্ম থেকেই পিতৃহারা অভাগী পিতা রূপে যাকে জীবনের প্রতি মুহূর্তে নিজের কাছে পেয়েছে, গ্রামের বটবৃক্ষ রূপে যে নিজের সারাটা জীবন এই মাটিতে লালিত হাজারও অভাগা- অভাগীদের স্বার্থে উৎসর্গ করেছে, লণ্ঠনের ক্ষীণ আলোই সেই বৃদ্ধ বটবৃক্ষের গুটিয়ে যাওয়া মুখের চামড়ার দাগ আজ অনেকটাই স্পষ্ট, সময়ের স্রোতে কোপাই এর অজানা পথ ধরে বয়ে চলা তার চোখের জ্যোতি আজ অনেকটাই ম্লান, অফিসার ছেলের শহরের বিলাসবহুল বাড়ি প্রত্যাখ্যান করে ওই অন্ধকার ঘরটিকে বুকে আঁকড়ে ধরে রাখা মানুষটি আজ অনেকটাই নিঃসঙ্গ, অনেকটাই অসহায়।। 

"কি হয়েছে বাবু? জ্বর কমেনি বুঝি..?" লণ্ঠনটি ঘরের এক কোনে নামিয়ে অভাগী তার

মাস্টারমশাই এর কপালে হাত দিয়ে তার ভেঙে পড়া শরীরের তাপ অনুভব করলো। আলতো করে চোখ দুটি খুলে মাস্টারমশাই উত্তর দিলেন, "চিন্তে  করিস নে ক্ষেপি, আমি ঠিক আছি.." অভাগী হয়তো জীবনে প্রথমবার তার মাস্টারমশাই এর এই সান্ত্বনাই নিজের মনকে ভোলাতে পারলো না। পাশে রাখা মোটা চশমাটি কোনো প্রকারে পরে এবার মাস্টারমশাই অভাগীর দিকে তাকিয়ে প্রথমেই বিস্মিত হলেন তারপর সেই স্কুলঘরে হারিয়ে যাওয়া দৃঢ় স্বরে অভাগীকে ধমক দিলেন, "বৃষ্টিতে ভিজেছিস? শিগগিরি বাড়ি যা.."।

নিরীহ মেয়েটি মাথা নিচু করে তার গুরুর ধমকের উত্তরে মৃদু আওয়াজে বললো,"বাবু আপনার খাবার প্রায় তৈরি, আমি বেড়ে দিয়ে যায়?" "আজ্ঞে না। তুই আগে বাড়ি গেয়ে ভিজে শাড়িটা  ছাড়, আমি ঠিক খাবার বেড়ে নেব।" "কিন্তু..." কথাটি শেষ করবার আগেই বিরক্তি ভরা অসুস্থ মুখের দিকে চেয়ে অভাগী বললো,"ঠিক আছে আমি এলাম "এই বলে ঘরের চৌকাঠের বাইরে পা রাখতেই, পেছন থেকে আবার ডাক এলো, "অভাগী.." পেছন ফিরে তাকাতেই বৃদ্ধ মাস্টারমশাই অনেক কষ্টে উঠে বসে অসহায় কণ্ঠে তাকে জিজ্ঞাসা করলো, "কলকাতা থেকে কোনো ফোন আসেনি? হারু বলছিল দাদুভাইএর শরীরটা ভালো নেই রে..." ভিজে বস্ত্রে, ছলছলে চোখে অভাগী স্থির দাঁড়িয়ে থাকলো, ডাক্তারবাবুরা না ধরতে পারলেও সে জানতো তার মাস্টারমশাই এর অসুখের আসল কারণ।

"জানিস অভাগী যে রুদ্রকে কোনোদিন মায়ের অভাব বোধ করতে দিই নি, নিজে না খেয়েও যাকে খাইয়ে, পড়িয়ে মস্ত বড় অফিসার করে তুললাম সে কিনা বলে এই গ্রামে আমার কিছু হলে নাকি কাঁধ দেওয়ারও লোক পাবনা, সত্যিই কি পাবনা? আমি ওকে বলে এসেছি, অভাগীর কাঁধে যাবো কিন্তু তোকে আর কোনোদিন বিরক্ত করবোনা...." বলেই সেই হার কাঁপানো ধমক দেওয়া মানুষটি হঠাৎ নিরীহ শিশুর মতো অঝরে কান্নায় ভেঙে পড়ল... অভাগী এই দেবতা সমান মানুষটির জীবনের পরিহাস দেখে আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলোনা, কাঁদতে কাঁদতে কোথাও যেন সে বৃষ্টির জলে মিলিয়ে গেল.. ঘরের কোনে রাখা লণ্ঠনের আলোটিকেও আসতে আসতে গ্রাস করে নিলো নিঃসঙ্গতার অন্ধকার, তার পর সবটাই নিস্তব্ধ...।
 

Comments

Top

সসেজ ট্রি সমাচার

প্রবন্ধ

সসেজ ট্রি

সমাচার

মোহম্মদ জয়নুল আবেদিন

ডালাস, টেক্সাস

Wild Flowers

চেন্নাই ও কলকাতা ২০০২ ও ২০০৫
২০০২ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ দিকে ভারতের চেন্নাইয়ের (ভূতপূর্ব মাদ্রাজ) বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী “ম্যারিনা বীচে”-এ যে বৃক্ষটি দেখে আশ্চর্য হই সেটি তার ফলের কারণে। বেশ বড় গাছ থেকে শসার মত ধূসর ফল প্রায় ২ মিটার লম্বা রশির মত বোঁটায় ঝুলছিল। প্রথমে মনে করেছিলাম যে এটি বোধহয় কোন লতার ফল যা ঐ গাছ অবলম্বন করে বেড়ে উঠেছে। ভালভাবে লক্ষ্য করে দেখি যে না এটি লম্বা বোঁটাওয়ালা ঐ গাছেরই ফল। কিছুক্ষণ সাগরের তীর ধরে দক্ষিণ বরাবর হাঁটার পরই এর একটি ছোট গাছ দেখতে পাই ও এর যৌগিক পাতা স্পর্শ করে দেখার সুযোগ পাই। বলতে দ্বিধা নেই যে এমন খসখসে শক্ত পাতা আমি আগে কখনো দেখিনি। 
চেন্নাই থেকে ফেরার পথে কলকাতায় যাত্রা বিরতির সময় একদিন সস্ত্রীক হাওড়ার শিবপুর বোটানিক গার্ডেনে (৩১ ডিসেম্বর ২০০২) যাই। সেখানেও আবার দেখতে পাই লম্বা বোঁটায় ঝুলন্ত ধূসর শসার আকৃতির ফলসহ এই গাছ। এ গাছটিতেও কোন নেমপ্লেট ছিল না বলে এটি আমার কাছে অচেনাই থেকে যায়। ২০০৫ সালের শেষে দিকে কলকাতার পিয়ারলেস হাসপাতাল প্রাঙ্গণেও এরকম ফলসহ দুটি বৃক্ষ দেখতে পাই এবং জানতে পারি যে এটি হল আফ্রিকার গাছ “সসেজ ট্রি”। 

Sausage1.jpg
Sausage2.jpg

চিত্র-১. ও চিত্র-২, সসেজ ফুল ও ফল, Sausage tree Flower and Fruit at AERE Savar Dendrarium, Feb. & May 2019. (Picture Credit: Shampa Pal and M Z Abedin)

বাংলা নাম: সসেজ ট্রি, আফ্রিকার কাবাব গাছ,  হিন্দি: বালাম ক্ষিরা
ইংরেজি: ‍Sausage Tree, Cucumber tree বৈ: নাম: Kigelia africana (Lam.) Benth 
সমনাম: Kigelia Pinnata Jacq. DC,  পরিবার: BIGNONIACEAE (জ্যাকারান্ডা পরিবার)

এর জেনেরিক নাম কাইজেলিযা মোজাম্বিকের বান্টু নাম কিজেলি-কিয়া (Kigeli-keia) থেকে এসেছে। পালক সদৃশ পত্রিকা বিন্যাস থেকেই এর প্রজাতির নাম Pinnata এসেছে। মাংসের তৈরী কাবাবের মত সসেজের (Sausage) আকৃতির ফলের কারণে এর ইংরেজি নাম ”সসেজ ট্রি”। সসেজ ট্রি মূলত: আফ্রিকার মোজাম্বিক ও অন্যান্য উষ্ঞমণ্ডলীয় দেশের বৃক্ষ। এখন বাহারি বৃক্ষ হিসাবে এটি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রোপণ করা হয়। সসেজ ট্রি কাইজেলিয়া জেনাসের একমাত্র প্রজাতি, আমাদের বৃক্ষবাগানে বিগনোনিয়েসি পরিবারের আরো কয়েকটি বৃক্ষ রয়েছে যাদের গণেও এরকম কেবল একটি মাত্র প্রজাতি রয়েছে, যেমন কানাইডিঙ্গা (অরক্সিলাম), হনা(পাজানেলিয়া) ও রুদ্রপলাশ (স্পেথোডিয়া)।

Sausage3.jpg
Sausage4.jpg

চিত্র-৩ ও চিত্র-৪ সসেজ ফল, Sausage fruit (Internet)

বৃক্ষ মেলা, শের-এ বাংলা নগর, ঢাকা,  জুন ২০০৬
পরের বৎসর (২০০৬) জুন মাসে ঢাকার বৃক্ষ মেলায় হঠাৎ করেই পেয়ে যাই এ গাছের চারা। বিক্রেতারা নিজেরাও এই গাছের নাম জানত না। খসখসে পাতার কারণে এরা একে “ফাইকাস” বলেই ধরে নিয়েছিল। দুটি চারা নিয়ে এসে আমাদের এইআরই সাভার ডেনড্রারিয়ামে রোপণ করি। এগুলোর বৃদ্ধি সন্তোষজনক দেখে পরে আরো দুটি চারা রোপণ করি। এখনো তিনটি গাছটিকে আছে। 

রংপুর কারমাইকেল কলেজ, ২০০৮
ইতিমধ্যে জানতে পারি যে রংপুর কারমাইকেল কলেজ প্রাঙ্গণে দুটি বেশ পুরাতন সসেজ ট্রি আছে। তাই ২০০৮-এর জানুয়ারীর প্রথম দিকে ছুটে যাই ঐ গাছের খোঁজে। কলেজের প্রধান প্রবেশ পথ দিয়ে এগোলে মসজিদের সামনে একটি গাছ ও অপরটি তারও কিছুটা আগে। গাছের নীচে প্রচুর সসেজ ফল পড়েছিল। ঐ একই বৎসর এপ্রিলের ২৩ তারিখে আবার সুযোগ বুঝে রংপুর যাই ঐ গাছগুলিকে দেখার জন্য। এবার ফুল ফোটার সময় পৌঁছই। গাছ দুটিতে লম্বা থোকায় ফল, ফুল ও কলি একই সাথে ঝুলছিল। সাধারনতঃ মঞ্জরির উপরের ফুল যখন ফলে পরিণত হয়ে যায়, মাঝের দিককার ফুল ফুটতে থাকে এবং মঞ্জরির নীচের দিকে ফুলের কলিই থেকে যায়। সম্ভবত ১৯১৬ সালে কলেজ প্রতিষ্ঠার পর পরই প্রতিষ্ঠাতাদের কেউ দুর্লভ প্রজাতির এই গাছ এখানে রোপণ করেছিলেন।

পাতা: যৌগিক, তিনটি করে যৌগিক পাতা শাখাপ্রান্তে গুচ্ছাকারে থাকে। পাতা বিজোড়পক্ষল, পত্রিকা ২-৫ জোড়া, প্রান্তিক পত্রিকা ১টি, বড়। পত্রিকা শক্ত, খসখসে, চর্মবৎ, ডিম্বাকার, ১৫ সেমি. পর্যন্ত লম্বা, প্রায়ই ঢেউ খেলানো, পত্রিকাত্রাগ্র গোলাকার বা

চোখা, উপরিতল কালচে সবুজ, নীচটা ফ্যাকাসে সবুজ। পত্রাক্ষের (Rachis) গোড়ার পত্রিকাগুলি হ্রস্ববৃন্তক, আগারগুলি বৃন্তহীন, পার্শ্বপত্রিকামূল প্রতিসম (symmetrical) শীর্ষপত্রিকামূল অসম। জানুয়ারী - ফেব্রুয়ারীতে পাতা ঝরে যায়, মার্চ-এপ্রিলে উজ্জ্বল সবুজ নতুন পাতা দেখা দেয়।

ফুল: প্রস্ফুটনকাল ফেব্রুয়ারী - এপ্রিল, বৃক্ষ শাখা থেকে উদ্গত ২-৩ মিটার লম্বা ঝুলন্ত অনিয়ত মঞ্জরিতে ১২টি পর্যন্ত কালচে মেরুন রংয়ের ফুল ধরে। বোঁটায় ঝুললেও প্রতিটি ফুল মাটির সমান্তরালে অবস্থান করে।  ফুল বড়, ১০সেমি লম্বা, দুই ঠোঁটবিশিষ্ট হাঁ করা মুখ, ঠোঁটগুলির একটি ২ লতি ও অন্যটি ৩ লতিবিশিষ্ট।  ফুল মাংসল, মেরুন বা কলজে রংয়ের, বাইরের দিকে ফ্যাকাসে মেরুন, গলার ভেতরটা হলুদ বা সবুজ ডোরাময়। পুংকেশর ৪টি, একদিকে দলের সাথে সেঁটে থাকে, পুংদণ্ড পাটল বর্ণের, পরাগধানী তীরের মাথার মত। পাপড়ি কিছুটা ভাঁজ করা, ঢেউ খেলানো। বৃতি কাপসদৃশ, সবুজ। এটি নিশিপুষ্পী, এর অদ্ভুত ইঁদুরে গন্ধ বাদুরের পসন্দ, তাই পরাগায়ন বাদুড় বাহিত। একই পরিবারের কানাইডিঙ্গা, হনা, কাউয়াতুতি এবং রুদ্রপলাশও নিশিপুষ্পী এবং পরাগায়ন বাদুড় বাহিত

ফল: ফল বড়, বেরি জাতীয়, মেটে সবুজ, শসা বা সসেজের মত ভারী, ৩০-৬০সেমি. লম্বা, ওজন ৩-৭কেজি পর্যন্ত। একই বোঁটায় ১২টি পর্যন্ত ফুল দেখা গেলেও ৩/৪টি ফল টেকে। কচি ছোট ফল দেখতে দুই বীজওয়ালা বড় তেঁতুলের মত। স্বপরাগায়নের ফলে সৃষ্ট ফল ছোট। ফলের ভেতরটা কাষ্ঠল, আঁশময়, শাঁসের ভেতর বীজ অনেক। ফল খাবার অনুপযুক্ত। ব্যবহার: এ গাছটি বাহারি বৃক্ষ হিসাবে পথপার্শ্বে, পার্ক ও বাগানে রোপণ করা হয়। সসেজ ফলের ভাজা স্লাইস আফ্রিকায় স্থানীয়ভাবে বিয়ার গাজন প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত হয়। লোকজ চিকিৎসা ব্যবস্থায় ছালের ক্বাথ মাথাব্যথা ও পেটের অসুখে, পাতার ক্বাথ ম্যালেরিয়ায়, শুকনা ফলের গুঁড়া সিফিলিসজনিত ঘা ড্রেসিং - এ এবং বাত রোগে ব্যবহৃত হয়। ফল থেকে প্রাপ্ত বিয়ার শিশুকালীন হামের জন্য উৎকৃষ্ট। ফল কোষ্ট পরিষ্কারক, এছাড়াও ফল গর্ভপাত ঘটায় বলে জানা যায়। এর ফল থেকে ত্বকের ক্রীম ও শ্যাম্পু তৈরী হয়।  

ইতিপূর্বে এ সসেজ ট্রি-র চারা বাংলাদেশে পাওয়া যেত না, কারণ বীজ থেকে চারা করার চেষ্টা করে অনেকে ব্যর্থ হয়েছেন। ২০০৩-০৪ সালের দিকে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (BAU) প্রফেসর মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান ও তার সহকর্মীবৃন্দ বীজ থেকে ”স্ক্রেচিং” পদ্ধতিতে ৫০টি চারা করতে সক্ষম হন। বিরল এ বৃক্ষ প্রজাতিটির চারা উত্তোলন করে দেশে বিস্তার করার জন্য প্রফেসর মোস্তাফিজুরের নাম উদ্ভিদবিদ ও বৃক্ষপ্রেমীরা সর্বদা মনে রাখবে। আরো জানা গিয়েছে যে কারমাইকেল কলেজের বাগান মালী বাটুল সিংও ২০১৬ সালের শেষদিকে এ গাছের বেশ কয়েকটি চারা উত্তোলন করতে সক্ষম হন। আমাদের এইআরই সাভার ডেনড্রারিয়ামে ৩টি সসেজ ট্রি রয়েছে। 

সূত্র: ১. N. Dharani, Trees & shrubs of E. Africa, Struik Publ., Cape Town, SA, 2002, p.122 ২. T. K. Bose et al,  Trees of the World (Vol. 1), RPRC,  Bhubaneswar, Orissa, 1998,   p. 273 ৩. Pradip Krishen, Trees of Delhi, Dorling Kindersley , 2006, p.248 ৪. ইন্টারনেট, Kigelia africana (Internet)

রচনা: বাঞ্ছারামপুর, ১৩ মার্চ, ২০১৮ ও ডালাস, টেক্সাস, ৯ মে ২০২০ 
বি: দ্রঃ লেখাটিতে কোন তথ্যবিভ্রাট বা ভুল ভ্রান্তি থাকলে দয়া করে উল্লেখ করবেন, শুধরে নেব। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ঔষধ হিসাবে এর ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন। ধন্যবাদ: শম্পা পাল, আইএনএসটি, ফুলের ছবির জন্য এবং প্রফেসর মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (BAU), ময়মনসিংহ ও ডঃ আলিযা মমতাজ, ভূতপূর্ব ”বাউ” ছাত্রী, ফ্লোরিডা, যুক্তরাষ্ট্র, সসেজ ট্রি বিষয়ক তথ্যাদি শেয়ার করার জন্য। 

Comments

Top

ফান্ড রেইজিং

শ্রুতি-নাটক

ফান্ড রেইজিং এর 

ফান্ডা

সূর্য বন্দোপাধ্যায়

পোর্টল্যান্ড, ওরিগন, মাঃ যুক্তরাষ্ট্র

himadri1.jpg

 [আমেরিকার কোনো এক বাঙালীবহুল রাজ্যের কথা, যেখানে মানুষজন মাসে আট দশটা পার্টি করেই থাকে। কোনো এক বিপজ্জনক ভাইরাস এসে বসন্তকালটা মাটি করে দিয়েছে, কিন্তু সবাই আশা করে রয়েছে খুব শিগগিরই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, এবং সমস্ত বাঙালি আবার আগের জীবনে ফিরে যাবে। এরাজ্যের দুটি নামি জনপ্রিয় অথচ প্রতিদ্বন্দ্বী বাঙালি ক্লাব চালান দীপা এবং মিতা ]

মিতা : দীপা শোন, খুব দরকারি কথা বলছি।

দীপা: হ্যাঁ মিতা দি বোলো।

মিতা: দেখ, এখানে ইভেন্ট বা প্রোগ্রামগুলোর কি হবে ভেবেছিস?

দীপা: কেন, আউটডোর গ্যাদারিং তো হচ্ছেই আজকাল, বাকি সব ও নিশ্চয়ই ঠিক হয়ে যাবে।

মিতা : দেখ, এখন সবাই বলবে ছোট ছোট GROUP এ গ্যাদারিং করতে। তখন এই ছোট ছোট বাঙালি GROUP গুলো কিন্তু হেভি পপুলার হবে।

দীপা: হা, ডিসগাস্টিং, এতো এতো বাঙালি GROUP আর ক্লাব কোথা থেকে যে আসে?

মিতা: জানিস না আবার, ১০টা বাঙালি হলেই বলে GROUP, কুড়িটা বাঙালি হলেই ক্লাব তারপরে সেখানে দলাদলি, আর তারপরে আরেকটা ছোট রেবেল GROUP।

দীপা: হা জানি তো, আমাদের ক্লাব  থেকেই তো তোমাদের ক্লাবটা break আউট করেছিল না বছর কুড়ি আগে?

মিতা: এই, যা জানিস না তাই নিয়ে বকবক করিস কেন বলতো? কুড়ি বছর আগে তুই এখানে ছিলিস? তোদের ক্লাব এর পুরনো হর্তাকর্তা সবাই আমার বাড়িতে কতগুলো potluck করেছে জানিস?

দীপা: আচ্ছা বাদ দাও পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটে কাজ নেই। তুমি কি বলবে বলছিলে?

মিতা: বলছি এই ক্রাইসিস এর সময়ে আমরা সব বিভেদ ভুলে একটা জয়েন্ট কিছু ইভেন্ট করি, এই ছোট ক্লাবগুলো মাথাচাড়া দেয়ার আমরা সবাইকে স্টিম রোল করে দেব।

দীপা: আইডিয়াটা দারুণ, কিন্তু কি করবো? পয়লা বৈশাখ, পঁচিশে বৈশাখ সব তো হয়ে গেলো, পুজো আসতে অনেক দেরি।

মিতা: ফান্ড রেসিং করবো রে। কিছু টাকা ও আসবে, আর সোশ্যাল মিডিয়াতে দারুণ পাবলিসিটি ও হবে।

দীপা: হা, তার ওপরে তোমাদের ক্লাব এর তো প্রচুর স্পনসর আর প্রচুর ফলোয়ার। ওদের পুরোদমে কাজে লাগাতে হবে কিন্তু।

মিতা: তোদের ক্লাব এর কালচারাল প্রোগ্রাম গুলো দারুণ হয়, তোদের সব কটা ভালো সিঙ্গার আর ডান্সার লাগবে কিন্তু,  এখন তো দেশ থেকে আর্টিস্ট আনা যাবে না।

দীপা: ওকে। সানডে সকালে কথা বলছি।

*********************

 

দীপা: এই সীমা শোন, আমরা যে গার্লস জুম্ মিটিং এ পরের মাসের ফান্ড raiser টা নিয়ে কথা বলছিলাম, ওটায় কিন্তু তোকেই anchoring করতে হবে। আর ওপেনিং ইন্ট্রোডাকশন ও।

সীমা: আমি? কেন তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড করবে না?

দীপা: বেস্ট ফ্রেন্ড না ছাই! তুই আমার কলেজের জুনিয়র, আমার ছোট বোনের মতো, তাই তোকেই বলছি। আমি লাস্ট 3 মাসে এতো গুলো রান্নার ছবি পোস্ট করলাম, এতোগুলো শাড়ি চ্যালেঞ্জ পোস্ট করলাম, একটাও লাইক দিয়েছে?

সীমা: ও বেচারি অফিস নিয়ে এতো busy দেখার টাইম পায়নি হয়তো।

দীপা: সে যাই হোক, শোন তুই খুব ভালো কানেক্ট করতে পারিস অডিয়েন্স এর সঙ্গে, প্লাস তুই এতো famous হয়েছিস শর্ট ফিল্ম করে।

সীমাঃ আচ্ছা আমাদের এই ফান্ড রেসিং টা কিসের জন্য হবে?

দীপাঃ ভালো কথা, ওটা তো জিজ্ঞেস করাই হয়নি। দাঁড়া।

**********************

মিতা: হ্যাঁ রে বল।

দীপা: মিতা দি, বলছিলাম কি এই ফান্ড রেসিং টা কিসের জন্য হবে?

মিতা: কেন? ভিক্টিম দের সাহায্য করার।

দীপা: করোনা র না এমফান এর?

মিতা: যা হোক একটা কিছু করলেই হয়।

দীপা: অলরেডি কিন্তু কয়েকটা  ফান্ড রেসিং হয়ে গেছে এই সব নিয়ে

মিতা: তাহলে নেপোটিজম ভিক্টিম দের জন্য?

দীপা: নেপোটিজম ভিক্টিম দের জন্য ফান্ড রেসিং?

মিতা: হা, বলিউড এর যা গ্ল্যামার, আর বাঙালি রা আজকাল গ্ল্যামার জগতের এর ফ্যান, ফান্ড রেসিং এর টাকা দিয়ে গরিব লোকদের বাড়ি বানাবো বললে কেউ টাকা দিক বা না দিক, ফান্ড রেসিং এর টাকা দিয়ে বলিউড নেপোটিজম ভিক্টিমদের হেল্প করবো বললে সবাই দেবে। 

দীপা: কিন্তু এটা করে কি লাভ হবে?

মিতা:বলিউড এর নেপোটিজম ভিক্টিম অভিনেতা অভিনেত্রীরা ফেইসবুক এ ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করবে, এটা বললেই সবাই ঝাঁপিয়ে পড়বে।

দীপা: বলছো?

মিতা: দরকার হলে এটাও বলবো যে ইরফান খান এর পরিবারকে টাকা পাঠানো হবে।

দীপা: ইরফান খান তো ক্যান্সার এ মারা গেলেন। নেপোটিজম এর সঙ্গে কি সম্পর্ক?

মিতা: ধুর লোকজন অত মনে রাখে না।  ভালো অভিনেতা ছিলেন, অসাধারণ কিছু সিনেমা করেছেন, ফ্যামিলি ব্যাকআপ নিয়ে বলিউড এ আসেন নি, মারা গেলেন - এই সব কটা যোগ করলে তো নেপোটিজম দাঁড়ায় নাকি?

দীপা: আচ্ছা দাড়াও তোমার সঙ্গে রবিবার ডিটেল এ কথা বলছি।

********************

দীপা: ফান্ড রেসিং এর উদ্দেশ্যটা আমরা ওয়ার্ক আউট করছি। তুই তোর মতো স্ক্রিপ্ট লিখতে থাক। 

সীমা: আছে দীপা দি, এই ফান্ড রেসিং এর টাকাটা কিভাবে দুটো ক্লাব এ শেয়ার হবে।

দীপা: টাকা উঠলে তো শেয়ার হবে।  সবাই আসবে, ফ্রি তে ইভেন্ট দেখবে, দেখে বাহবা দিয়ে চলে যাবে, আমাদের ও ঝক্কি কম।। 

সীমা: তাহলে পুরো arrangement ফ্লপ?

দীপা: ফ্লপ কেন? সোশ্যাল মিডিয়া তে সবাই দেখবে এতো ভালো ইভেন্ট হলো, নেক্সট পুজো যখন হবে সবাই আমাদের প্রোগ্রাম দেখতেই আসবে।

সীমা: কিন্তু করোনার জন্য যারা রোজগার হারালো, এমফান এ যাদের বাড়ি ঘর ভেসে গেলো, তাদের জন্য আমরা কি কিছু করবো না? যখন তুমি কলেজ এ আমাদের লিডার ছিলে, তুমি তো বলতে ভণ্ড সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিপ্লব আনার কথা, তুমি তো বলতে বিত্তহীনদের অর্থহীন করে রাখার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে বিপ্লব আনার কথা।

দীপা: উফফ এখন কি আর ওই ছাত্র রাজনীতি করার মতো বয়েস আছে? বিপ্লব আমি এখনও করি কিন্তু সেটা with sophistication। সোশ্যাল পার্টি থেকে সোশ্যাল মিডিয়া সব জায়গাতে, সমস্ত ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে আমি আজও গর্জে উঠি।

সীমা: তুমি কিরকম চেঞ্জ হয়ে গেছো, জানো। সোসালিষ্ট লিডার থেকে কি করে এরকম সোশ্যাল লিস্ট এর লিডার হয়ে গেলে? 

দীপা: চেঞ্জ আমি একা হয়েছি? তোদের শিবুদা হয়নি? দুবছর ধরে স্টুডেন্ট ইউনিয়ন চালালো কমিউনিস্ট চিন্তাধারায়, আর আজকে ক্যাপিটালিস্ট হয়ে বসে আছে?

সীমা: শিবুদা ক্যাপিটালিস্ট?

দীপা: ক্যাপিটাল জমা করছে রে, আজকাল কলেজ এর যা খরচ, এখন থেকে প্রাণপণে পয়সা জমাচ্ছ বাচাদের জন্য। যে আগে প্রতি শুক্রবার আমাকে সিনেমা দেখতে নিয়ে যেত, সে আমায় লাস্ট ৬ বছরে একটাও সিনেমা নিয়ে যায় নি। এখন বলে যে অনলাইন আসা অবধি অপেক্ষা করতে, বাজে খরচ করা যাবে না এখন।

সীমা: আর মনে করো, একদিন তুমি নিপীড়িতদের জন্য নিজেদের বিলিয়ে দেয়ার ডাক তুলেছিলে।

দীপা: দেখ, রোমান্টিক ফুলিসনেস এর দিন গেছে। ব্যাগ  এ দুশো বা পাঁচশো টাকা সম্বল হলে নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার কথা বলা খুব সহজ, কিন্তু দুশো বা পাঁচশো যখন দুহাজার বা পাঁচ হাজার হয়ে যায়, টাকাটা যখন ডলার হয়ে যায়, মাথার ওপরে বাবা মার ছাতা থাকে না, নিজের সংসারের দায়িত্ব এসে যায়, তখন না এইসব বিলিয়ে দেয়ার কথা বার্তা খুব কঠিন হয়ে দাঁড়ায়

সীমা: কয়েকদিন আগে যে ফেইসবুক এ দেখলাম তুমি ভারত সেবাশ্রম এ পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়েছো।

দীপা: সত্যি কথা বলতে কি, আমার ডোনেশান-ও আমার স্ট্যাটাস মেইনটেইন করার একটা চেষ্টা। লোকে দেখবে যে আমি কত ভাবছি সমাজের জন্য, তাই বাধ্য হয়ে বাকিরাও স্টেটাস দেখানোর জন্য NGO তে টাকা দেবে। এইভাবেই আবার বিপ্লব আসবে।

সীমা: সত্যি বলতো, তোমার এই জীবনটা ভালো লাগে?

দীপা: নিশ্চয়ই। খারাপ কি বলতো জীবনটা?

সীমা: আগে তোমার পাশে দাঁড়ানোর মতো অনেক বন্ধু ছিল……

দীপা: এখনো আছে, একবার খালি বলতে হয় 'আয়রে সেলফি তুলবো'

সীমা: আমি সত্যিকারের বন্ধু বলছিলাম…

দীপা: ধুর পাগলী, যেটা সোশ্যাল মিডিয়াতে দেখা যায় সেটাই তো সত্যি রে।

সীমা: তুমি যে বলেছিলে এমন একটা জীবন দেখতে চাও যেখানে দরিদ্র আর ধনীর শ্রেণীভেদ থাকবে না।

দীপা: নেই তো। আজকাল এখানে সবাই শুধু বিত্তবানদের শ্রেণীভেদ করে। কার একটা গাড়ি আর কার দুটো গাড়ি, কার দুটো বেডরুম কার তিনটে বেডরুম আর কার চারটে বেডরুম.....

সীমা: তুমি যে স্বপ্ন দেখতে অশিক্ষা দূর কর।

দীপা: ওটা ছোটবেলার immaturity। এতো বোকা ছিলাম, ভাবতাম শিক্ষা মানে মনের বিকাশ, শিক্ষা মানে সামাজিক শিকল ভাঙার প্রয়াস।

সীমা: তো সেখানে ভুল কোথায়?

দীপা: ভুল, সব ভুল। এখন শিখে গেছি যে শিক্ষা হলো পয়সা কমানোর প্রয়াস, কিছু মেকি সামাজিক স্টেটাস এর পাথেয়, যার শেষ পরিণাম নিজেকে আরো হাজারটা সামাজিক শিকলে বেঁধে ফেলা।

এদেশের তথাকথিত শিক্ষিত বাঙালিদের দেখে ভুলটা বুঝে গেছি, অপ্রতিষ্ঠিত অশিক্ষিত লোকগুলোই  ভালো আছে। ওদেরকে আর আমাদের মতো শিক্ষিত করে কাজ নেই।

Comments

Top

ভ্রমণ

চীনের বৌদ্ধ তীর্থ

স্মৃতির আড়ালে  

চীনের বৌদ্ধ তীর্থ

পুথুও শান 

দেবযানী পাল

putu-shan1.jpeg
putu-shan2.jpeg

বেশ কয়েকবার চীন ভ্রমণ করে বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি। পূর্ব চীন সমুদ্রে পুথুও শান (Putuoshan) ভ্রমণের অভিজ্ঞতা অতুলনীয়। পুথুও শান কথাটির অর্থ হল পুথুও পাহাড়। এটি চীনের পূর্বদিকে জচিয়ান (Zhejiang) প্রদেশের অন্তর্গত (Zhoushan) দ্বীপপুঞ্জের একটি দ্বীপ। সাংহাইয়ের দক্ষিণে এই দ্বীপ চীনের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর। কথিত আছে যে  পুথুওশান পাহাড়ের চূড়াতে বসে করুণার অবতার  বৌদ্ধ দেবতা অবলোকিতেশ্বর পৃথিবী পর্যবেক্ষণ করেন। পুথুও পাহাড় সংস্কৃত ভাষাতে হল পোতলক, এই দেবতার স্বর্গলোকের আবাস। চীনে এ দেবতাকে কুয়ানইন (Guanyin) নামে ডাকা হয়। নির্দ্দিষ্টদিনে সাংহাইয়ের শিলিপু (Shilipu) বন্দরে এলাম পুথুও শান যাবার উদ্দেশ্যে। এসে দেখি বেজায় ভিড়, লোকে লোকারণ্য। বাক্স-পেট্র্যা, পোটলা-পুটলি, পাখির খাঁচা, বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে ছেলে-মেয়ে, বুড়ো-বুড়ি সবাই প্রতীক্ষা করছে জাহাজের। প্রাণবন্ত শিশুরা মায়ের সাথে। ওদের মাথায় চুলের তিনটি ঝুটি বাধা তিন পাশে। সবাই প্যন্ট পরা, তবে প্যন্টের মাঝখানে বড় ফুটো যাতে পায়খানা, পেচ্ছাপ পেলে বসে পরতে পারে সঙ্গে সঙ্গে। তিনতলা উঁচু জাহাজ লুওচিয়া শান (Luojia Shan) সন্ধ্যে ছয়টা নাগাদ সাংহাই ছাড়লো। বেলাশেষের আলোয় রাঙ্গা হুয়ানপু (Huangpu) নদী ধরে কিছুক্ষণ চলার পরে ইয়াংশে নদীতে ঢুকলো আমাদের জাহাজ। এই বিশাল নদীতে কত জাহাজ চলেছে, অপূর্ব দৃশ্য। কিছুক্ষণ পরেই আমরা পূর্ব চীন সমুদ্রে ঢুকলাম। আয়তনে বেশ বড় জাহাজটিতে খাবারের জায়গা, নাচের-গানের ঘর, সুভেনিরের দোকান, ও অন্যান্য সব কিছুই আছে। পরিষ্কার ঘরগুলিতে গরম জলের ফ্লাস্ক রয়েছে চা বা নুডলস খাবার জন্য। সান্ধ্যভোজন সেরে জাহাজের দুলুনিতে কখন যে ঘুমিয়ে পরেছি মনে নেই। রৌদ্রজ্জল শান্ত সকাল সাতটা নাগাদ ঘুম থেকে উঠে দেখি পুথুও শান দ্বীপের জাহাজ ঘাটাতে এসে পৌঁছেছি। জাহাজ থেকে নেমে ঘন সবুজ পাহাড় সারিতে ভরা দ্বীপটির নৈসর্গিক রূপে মুগ্ধ হয়ে গেলাম| বুঝলাম, কেন দ্বীপটিকে পূর্ব চীন সমুদ্রের রূপকথার দেশ বলা হয়। এখানকার

বাওথুও হোটেলে দিনকয়েক থেকে কয়েকটি বৌদ্ধ মঠ, মন্দির, সৌধ, প্যাগোডা দেখে ঘরে ফেরাই ছিল এ যাত্রার উদ্দেশ্য। দুপুরে এখানে বেশ গরম। বাইরে বেরিয়ে বেশ কয়েকটি সুভেনিরের দোকান, রেস্তোরাঁ আর সুপারর্মাকেট নজরে এলো। হরেকরকম খাবারের জিনিস ছাড়া এখানে ছাতা, জুতো, টুপি, মাদুর এমনকি জামাকাপড়ও মেলে। কিছুদূর এগিয়ে পথই পার্শে বেশ বড় এক খোলা বাজার নজরে এলো। প্রচুর শাকসব্জি, নানারকম ফল, থাইল্যান্ড থেকে আসা আম আর নানা সামুদ্রিক মাছ ইত্যাদিতে বাজার ভরা। বাজারে বেশির ভাগ বিক্রেতারাই মেয়ে। দেখলাম রোদের প্রকোপে অনেকেই ভিজে গামছা মাথায় দিয়ে পথ চলেছে। এসেই আমরা এই দ্বীপের সবচেয়ে পুরনো বৌদ্ধ মন্দির পুজি ছান সী (Puji Chan Si; Temple of Universal Blessing) দেখতে গেলাম।ধ্যনে সমাহিত অবলোকিতেশ্বর হলেন প্রধান দেবতা।  বিশাল ধাতব মূর্তির অপূর্ব মহিমান্বিত রূপ। মন্দিরে গুচ্ছ, গুচ্ছ মশালের মত ধুপ জ্বালায় এরা কিন্তু ফুলের ব্যবহার কম।
এখান থেকে বাসে কিছুদূর এগিয়ে ৩২ মিটার উঁচু ১৩৩৪ সালের পাঁচতলা তুওপাও (Duobao), বা অগণিত রত্নের প্যাগোডা দেখা হল। এই দ্বীপে বেশ কয়েকটি বৌদ্ধ মন্দির, পবিত্র গুহাও আছে। পাহাড়ের অনেক জায়গা থেকেই রজ্জু - যানে ওপরে উঠে চারিদিকের অপূর্ব দৃশ্য ও সমুদ্রের মন মাতানো রূপ দেখা যায়। পাথুরে সিঁড়ির ব্যবস্থা আছে সর্বত্র।পাহাড়ের আনাচে কানাচে অনেক গুহা মন্দিরও আছে।
হোটেলে ফিরে সান্ধ্য ভোজনের জন্য নিচে নামতেই প্রত্যেকটি খাবারের দোকানের মালিকরা ডাকাডাকি শুরু করল। দোকানের সামনে বড়, বড় প্লাস্টিকের বাটি ভরা হরেক রকমের তাজা মাছ আর নাম না জানা সামুদ্রিক জীব রয়েছে। এছাড়া, নানা রকমের তরকারী ঝুরিতে সাজানো। নির্দেশ দিলেই রান্না করে দেবে। পরিবারের সকলে মিলে রেস্তরাতে কাজ করে। অনেক মেয়েরা নিজের জন্মস্থান ও পরিবার ছেড়ে চীন দেশের অন্যান্য জায়গাতে বড় রেস্তোরাতে  কাজ নিয়েছে। অর্থ সঞ্চয় করে ফিয়ে যায় ওরা আপন, আপন ঘরে। আমাদের খাবার পরিবেশনের পরে ওরা ভারত সম্বন্ধে অনেক কিছু জানতে চেয়েছে। কেউ, কেউ ভারতীয় টাকা বা ডাকটিকিট সুভেনির হিসেবে চেয়েছে।
পরদিন বিকেলে পাঁচতলা উঁচু জাহাজ জিন পিং এ সাংহাই এর উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।জাহাজ যখন প্রায় দ্বীপ ছাড়বে, জানা গেল এক যাত্রী নাকি নামতেই ভুলে গেছে। আবার ফিরে নোঙ্গর  করলো জাহাজ। তারপর পুথও দ্বীপ ছাড়িয়ে আবার চললো। দিনের শেষে শুরু হল ঝড় আর মুষলধারে বৃষ্টি। অনেক রকম শব্দ করতে করতে, হেলতে দুলতে চললো জাহাজ। অন্ধকারের ঘোর, জলের অদ্ভুত শব্দ, মত্ত বাতাসের বেগে সমুদ্রের জল উথাল পাথাল। জাহাজের দোলানি কখনও সখনো অসহনীয়। যত জোরে বৃষ্টি বাতাসের শব্দ, তত জোরে জাহাজের চিনা যাত্রীরা কারাওকে (karaoke) গান গাইতে লাগলো। আমি করুণার দেবতা অবলকিতেশ্বরকে স্মরণ করে সারা রাত নিদ্রাহীন কাটালাম। অতি ভোরে বাইরে তাকিয়ে দেখি কোথায় ঝড়-বৃষ্টি। প্রত্যুষের রক্ত রাঙ্গা আলোতে সাংহাই এসে পৌঁছলাম।        

Comments

Top

গল্প

বাপের

বাড়ি

অপর্ণা চক্রবর্তী

টালিগঞ্জ, কলকাতা 

kolkata-sketch2.jpeg
aparnachakroborty.jpg
বাপের বাড়ি

বোধহয় এগারো বছর বয়সে আমি "গুপী গাইন বাঘা বাইন" সিনেমাটি প্রথমবার দেখেছিলাম। আমলকী গ্রামের কানু কাইনের ছেলে গোপী কাইনের গানবাজনার বড় শখ। এদিকে গ্রামের সবাই বেসুরো গোপীর গানে অতিষ্ঠ। তারা ঠাট্টা করে গোপীর নাম দিয়েছিল "গুপী গাইন"। এই ঠাট্টা তামাশার ফল স্বরূপ অবোধ গোবেচারা গোপী কাইনকে অপমানিত হতে হয় রাজামশাইয়ের কাছে। গোপীর বেসুরো গানের গুঁতোয় বিরক্ত হয়ে, আমলকী গ্রামের রাজা গোপীকে গাধার পিঠে চাপিয়ে গ্রাম ছাড়া করার নির্দেশ দেন।

সিনেমায় গাধাটি ধীরে সুস্থে দুলকি চালে বেরিয়ে যেতে থাকে গ্রাম থেকে। বিজয়ী গ্রামবাসীদের উচ্ছসিত হাস্যকলস্বর চারিদিকে ফেটে পড়ে। গাধা উপবিষ্ট, নতমস্তক, অপমানিত গোপীর জীবনে নেমে আসে বাপের বাড়ির সাথে অনন্ত বিচ্ছেদকাল।
আর গোপীকে  নিয়ে সমবেত মস্করার পিছনে, নিজেকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে থাকেন কানু কাইন। বুড়ো বয়সে জোয়ান পুত্র বিচ্ছেদের কান্না লুকোনোর চেষ্টা করেন, ধুতির খুঁটে। একলা ফিরে আসেন পুত্রহীন দরিদ্র ঘরখানিতে। ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজতে থাকে সত্যজিৎ সৃষ্ট অশ্রুতপূর্ব একটি দুঃখ মিশ্রিত সিম্ফনি।

এরপর গোপী কাইনের সত্যিকারের গুপী গাইন হয়ে ওঠার গল্প আমরা সবাই উপভোগ করি সিনেমায়। অনেক কর্মকান্ডের পর, গুপীর রাজকন্যা রাজত্ব অর্জন করা হয়ে গেলে, সিনেমা শেষ যায়।
কিন্তু, আমার কেন জানি না মনে হতে থাকে - গুপীর ফেলে আসা আমলকী গ্রামে, তার বাবা কানু কাইন তো বসে রইল একলা। গুপীর যে এত টাকা হলো‌, সে কি একবারও ফিরবে না তার বাপের বাড়ি? কি জানি হয়তো সিনেমার শেষেও ওই বুড়ো মানুষটা, একলা মাটির বাড়িতে প্রদীপ জ্বেলে গুপীর অপেক্ষায় দিন গুনছে।

এই অপেক্ষাতেই কেটে যেতে থাকে বাপের বাড়ির বাগানে, গাছেদের দিনগুলো।
ফেলে আসা পাশবালিশ, পুরনো বইখাতা, আলমারিতে থেকে যাওয়া জামা-কাপড়ও অপেক্ষায় থাকে।
সারাবছর অপেক্ষার পর হয়তো মধ্যবয়সী এবং প্রায় বৃদ্ধ মা-বাবার কাছে দূর্গারা ফেরে কিছু দিনের জন্য। বাঙালীর শ্রেষ্ঠতম উৎসবটি তো বাপের বাড়িরই উৎসব। দূর্গাপুজো। ব্যানার্জী বাবুর বাড়িতে পুজোর একমাস আগে থেকে ঘরদোর পরিচ্ছন্ন রাখার তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। কয়েক বছর প্রবাসে থাকা ছেলের আবার অভ্যাস বদল হয়েছে। ছেলের অভ্যাস মতো, বৌমা নাতি নাতনীদের মনের মতো ব্যবস্থাটুকু না করতে পারা পর্যন্ত মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। সকালের চা-টাও যেন পানসে লাগছে। সব কেমন বিস্বাদ - এলোমেলো -  অগোছালো। ব্যানার্জীবাবু আবার ছেলে অন্ত প্রাণ। ছেলে আসছে এবার পুজোয়।

কে বলল বাপের বাড়ি শুধু মেয়েদের হয়? পুজোয় কি শুধু দূর্গারাই বাপের বাড়ি আসে নাকি? আজকাল "বাপের বাড়ি" শব্দটিকে লিঙ্গ ভেদে প্রয়োগ করা ঠিক হবে কি না, একবার নিজেরাই ভেবে দেখুন।

অষ্টমীর দিন মিত্রকাকু, কাকীমাকে নিয়ে পাড়ার প্যান্ডেলে ভোগ খেতে খেতে, সবার প্রশ্নের উত্তরে গর্বিত কন্ঠে, হাস্যমুখে বলে গেলেন - "আরে বিদেশী কোম্পানি তো, ওদের আবার সাহেবী ক্যালেন্ডার মিলিয়ে ছুটি বুঝলেন কিনা। আসবে, সেই ডিসেম্বরে।"
ভোগ খাওয়া শেষে পরস্পরের লাঠি হয়ে হাঁটতে হাঁটতে, পাড়ার মোড়ের বাঁদিকে দোতলা ফাঁকা বাড়ির দরজায় মিলিয়ে গেলেন কাকু কাকীমা।

মুগের ডালে জিরে ফোরণ দিতে দিতে সাহা কাকীমা রোজ ভাবেন - "মেয়েটা কবে যে এত বড় হয়ে গেল, বুঝতেই পারিনি। এই তো সেদিন ওর ঘুমিয়ে পড়া মুখটা দেখলে বুকের মধ্যে একশো প্রদীপ জ্বলে উঠতো। ভাগ্যিস স্কাইপটা শিখিয়ে দিয়ে গেল। ওর ঘুমন্ত মুখটা দেখার জন্য এখনো কতদিন অপেক্ষা করতে হবে কে জানে।"

"কাজ না আরও কিছু, বল যে মায়ের কাছে আসতে ইচ্ছে করে না।" অসুস্থ, ক্ষীণকায়া সর্বজয়া, শহর থেকে সদ্য ফেরা অপুর কাছে আনন্দের সঙ্গে, উষ্মা প্রকাশ করেন এভাবেই। অভিমানী সব মায়েদের চিরন্তন অভিযোগ, পর্দায় সর্বজয়াকে দিয়ে বিলিয়েছেন সত্যজিৎ রায়। শহরে অপুর খাওয়া দাওয়ার খোঁজ নিতে নিতে হঠাৎ জিজ্ঞেস করেন -- ঠাকুরের রান্না, আমার থেকেও ভালো? অপুর স্বলজ্জ মাথা নাড়ায়, সর্বজয়ার মুখে তৃপ্তির হাসি। পৃথিবীর সব মায়েরাই বোধহয় এ প্রশ্নের উত্তরে সন্তানের মুখে "না" শুনতে চান।

ব্যাঙ্ক থেকে ফেরার পথটুকুতে আজ আর রিক্সা নিলেন না বিশ্বাসবাবু। তিনমাস আগে থেকে পেনশনের টাকা দু'হাজার করে কম তুলছেন। ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে ভাবলেন - পুজো আসছে। বাবি আসবে। তখন একটু খরচ বেশী হবে। এখন বুড়ো বুড়ির সংসারে বাজার খরচ একটু এদিক ওদিক হলে, ক্ষতি কিছু হবে না।

পুজো এসে পড়ে। পাড়ার থিম প্যান্ডেলে রাত জেগে শেষ পর্যায়ের সমবেত পরিশ্রম চলতে থাকে। সময় মতো ডিসেম্বরও এসে পড়ে। সাহেবী ক্যালেন্ডার মিলিয়ে ছুটি পায় প্রবাসী সন্তান।
সকাল থেকে উৎকণ্ঠা আর অন্যমনস্কতায় মায়েদের হাত থেকে জিনিসপত্র পড়ে যায়। বাঙালী মায়েরা মনে মনে হাসেন। হাত থেকে কিছু পড়ে যাওয়া তো অতিথি আগমনের ইঙ্গিত।
দূর্গা আসেন। জিশু আসেন। আর বাপের বাড়িতে বেড়াতে আসে মা-বাবার বাবিরা।
সে বাবি ছেলে হোক বা মেয়ে।

Comments

Top

গল্প

SaswatiBhattachrya.png

টার্ডি-গ্রাদা

শাশ্বতী ভট্টাচার্য্য

ম্যাডিসন, উইন্সকন্সিন

tardi1.png
টার্ডি-গ্রাদা

ম্পাদক ইমেলে স্বভাবসিদ্ধ মৃদুসুরে আর একবার মনে করিয়ে দিলেন, “বিজ্ঞান ভিত্তিক লেখাটা দিচ্ছেন তো? বেশি লেট হলে কিন্তু একটু  মুশকিল হয়ে যায়, এই আর কি।” এই লেট শব্দটা শুনে হঠাৎ কলেজ সহপাঠী অর্ণবের কথা মনে পড়ে গেল। কিছু কিছু মানুষ আছে যারা লেট লতিফ আখ্যাটা স্বগর্বে বহন করে বেড়াতে ভালোবাসে অর্ণব ছিল সেই প্রকৃতির। পরীক্ষায় ভালো ফল, ভালো গানের গলা নিয়েও অর্ণব কলেজ জীবনের টানা তিন বছর একটা মেয়ে বন্ধু যোগাড় করে উঠতে পারে নি। মেয়ে মহলের কানাঘুষোয় জানা গিয়েছিল, এক বছরের জুনিয়ার ইন্দিরাকে রেস্টুরেন্টে খাওয়ানোর প্রস্তাব দিয়ে অর্ণব বিকেল পাঁচটার বদলে রাত নয়টাতে ইন্দিরার হোষ্টেলের ঘরে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিল। অপেক্ষা করে করে হতাশ হয়ে মনক্ষুণ্ণ ইন্দিরা ততক্ষণে শাড়িটারি পাল্টে, মেক-আপ মুছে কাফতান পরে দই-চিড়ে মাখা খাচ্ছে। ইন্দিরার চেঁচামিচিতে এতটুকুও বিচলিত না হয়ে উল্টে অর্ণবই নাকি ইন্দিরাকে প্রশ্ন করে, ‘তিন-ঘন্টা বাড়তি সময় দিলাম, তুই এখনও তৈরী হতে পারলি না? সত্যি তোরা মেয়েরা না!’ গুজবে কান না দিয়ে আমাদের ক্লাসের কৃষ্ণা দ্বিতীয় সুযোগ দিয়েছিল। ‘ডিনার নয়, লাঞ্চ। আমি হরেনদার দোকান থেকে মোঘলাই নিয়ে আসি, তুই গিয়ে চট করে রাস্তার মোড় থেকে দুটো আইসক্রিম নিয়ে আয়, হোষ্টেলে রেফ্রিজারেটরের ফ্রীজারে একবার ঢুকিয়ে দিতে পারলেই হল। দৌড়ে যাবি, ছুটে আসবি। বুঝলি? গরমের দিনে ঝাল-ঝাল মোগলাই, তারপরে ঠান্ডা আইসক্রিম। আহা!
তিনদিন ধরে ওই মোঘলাই পরোটা একা খেয়েছিল কৃষ্ণা। লেট-লতিফবাবুটি আইসক্রিম নিয়ে যখন ফেরেন, দুধ আর ক্রীম দুই ভিন্ন তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের আস্তরণ হয়ে গিয়েছিল। শোনা যায়, কোন কৈফিয়ত দাবী করেনি কৃষ্ণা, অর্ণবের হাত থেকে আইসক্রিমের কাপটা নিয়ে ওর মাথায় উপুরহস্ত করেছিল। 

সেই দিনের সেই ঘটনার বহুবার ভেবেছি এমন কিছু আবিষ্কার হয় না কেন যা দিয়ে ঠান্ডা জিনিষ ঢেকে যায়, বাইরের গরম যাই হোক না কেন, ভিতরের উত্তাপের কোন পরিবর্তন হবে না। শুধু আইসক্রিম কেন, যে সব যায়গায় বরফ বা জমা কার্বনডাইঅক্সাইড (Dry Ice) বা তরলায়িত নাইট্রজেন (Liquid Nitrogen) বয়ে বেড়ানো বাড়তি একটা ঝামেলা; একটা বোঝা; প্রাণদায়ী ওষুধ বা টিকা বহন করা কতো সুবিধেই না হতো। অর্ণবকে সেটা বলতে ও বলেছিল তার চাইতে এমন কিছু একটা আবিষ্কার হোক না যার থেকে মানুষ আরো একটু বেশী সহনশীল হতে শেখে। 
বলা বাহুল্য আমার সাথে এই রকম কোন নাটকীয় কিছু হয় নি, তবে বন্ধু মহলে ওর থার্ডই নামের পিছনে আমার যথেষ্ট অবদান ছিল। লেট-লতিফ থেকে ইংরাজি টার্ডি শব্দটা অর্ণবের গোল-গাল চেহারার সাথে মানান সই হয়েছিল, আর তাই ওর নামটা টিকে গিয়েছিল। 
“দেখে নিস তোরা, একদিন আমার চেয়েও এক টার্ডি প্রাণীকে নিয়ে সবাই হইহই করবে।” অর্ণব উষ্মান্বিত হয়ে বলতো। 
“হ্যাঁ! তাকে খুঁজে পেলে তবে না?” আমার বরাবরের উত্তর যোগ হতো। 
অর্ণব হয়তো নিজেও সেদিন জানতো না, ওর কথাগুলো ফলে যাবে। 
সম্প্রতি ২০১৭ সালের মার্চে  মলিকুলার সেল নামক এক জার্নালে (১) এক বিশেষ প্রকারের টার্ডি প্রাণীকে নিয়ে লেখাটা চোখে পড়ে যেতে ভাবলাম, সব সময় তাড়াহুড়োই নয়, ক্ষেত্র বিশেষে ধীরে সুস্থে কাজ করাতেও আনন্দ আছে।  আজকের আলোচনাতে সেই টার্ডি প্রাণীর বিবরণই পাঠকের কাছে তুলে ধরবো।   

১৭৭৩ সালে জার্মান যাজক গোজী (J.A.E. Goeze) জলে ধোওয়া পরিষ্কার শ্যাওলার গায়ে এই বিচিত্র মোটা-সোটা জীবের সমাবেশ অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে দেখতে পান এবং জীবটির অস্তিত্ব নথিভুক্ত করেন। নাম দিয়েছিলেন জল-ভাল্লুক (ওয়াটার বিয়ার)। একটা পূর্ণ-বয়স্ক টার্ডিগ্রেদ (Tardigrade) আকারে বড়জোর 0.5 মিলিমিটার (0.02 ইঞ্চি), একমাত্র মাইক্রোস্কোপের সাহায্যে তাকে দেখতে পাওয়া যায়।  Strange is this little animal, because of its exceptional and strange morphology and because it closely resembles a bear en miniature. That is the reason why I decided to call it little water bear.” আট জোড়া পায়ের প্রতিটি পাতায় চার থেকে আটটা করে ধারালো নখের অবস্থান, যার ফলে ধোয়াধুয়ি করা সত্ত্বেও প্রাণীটি শ্যাওলার গায়ে বাঁদুরের মতো ঝুলে থাকতে সক্ষম হয়েছে। গম্ভীর প্রাণীটির ধীর পদক্ষেপ (Tardi Grada) চলাফেরা লক্ষ করে ইতালির বিজ্ঞানী লাজ্জারো স্পালান্জানী (Lazzaro Spallanzani) আবিষ্কারের তিন বছর পরে ১৭৭৬ সালে এই ক্ষুদ্র মেরু দন্তহীন প্রাণীটির নাম দেন টার্ডিগ্রেদ। 
বিশেষ কৌতূহলী পাঠকের জন্য জানাই এই ঘটনার মাত্র একশো আশি বছর আগে হ্যান্স লীপারসের (Hans Lippershey) কাজ থেকে অণুবীক্ষণ যন্ত্র বা মাইক্রোস্কোপ শব্দটা আমাদের কানে এসেছে, এবং ১৬৭৩ সালে এন্টনী ভন লিউইনহকের (Anton Van Leeuwenhoek) কাজ থেকে আমরা জানতে পেরেছি খালি চোখে দেখা যায় না এমন সব এ্যানিমালকুল (animalcule) বা ছোট্ট জন্তু-জানোয়ারে এই পৃথিবীটা কিলবিল করছে। মাইক্রোবায়োলজির (Microbiology) জনক বলতে আমরা লিউইনহকের কথাই বলে থাকি। এই বিজ্ঞানীর প্রসঙ্গে আবার পরে ফেরত আসবো।

এমন সহজ লভ্য ভদ্র-সদ্র প্রাণীকে নিয়ে গবেষণা হবে ধরে নেওয়া যায়। হয়েছেও তাই। বহু বিজ্ঞানীর সম্মিলিত চেষ্টায় টার্ডিগ্রেদ সম্বন্ধে নানা তথ্য জড়ো হয়েছে আমাদের ভাড়ারে। দুইশো একচল্লিশ বছর তো আর চাট্টিখানি কথা নয়। কিন্তু সাতিশয় ভদ্র এই প্রাণীটির বিজয় যাত্রার মূল রহস্য উদঘাটন করা বিজ্ঞানীর পক্ষে সহজ হয়নি।  শুধু একটির পর একটি নতুন তথ্য আবিষ্কার হয়েছে, যার একটা  নিয়ে আমি আজ লিখতে বসেছি।  আমরা জানতে পেরেছি বাসস্থান যতো অনুকূল হোক না কেন, টার্ডিগ্রেদের তাতে কিছু আসে-যায় না। 
হিম-শীতল পাহাড়ের চূড়া থেকে আগ্নেয়গিরির জঠর, গ্রীষ্ম-মন্ডলীয় ঘন-বর্ষণ বনাঞ্চল থেকে অতল সমুদ্র-তল কিম্বা কুমেরু থেকে বসত-বাড়ির পিছনের শ্যাওলায় পৃথিবীতে যতো রকমের সহজ কিম্বা কঠিন বাস-স্থানের কথা ভাবা যাক না কেন, টার্ডিগ্রেদ তার সাঙ্গপাঙ্গ  নিয়ে ঠিক উপস্থিত, তিনি ‘সর্বত্র বিদ্যতে’।
অক্সিজেনের অভাব? 
নো প্রব্লেম।
জলের অভাব?  
কুছ পরোয়া নেহি।  
রকেটে চেপে মহাশূন্যে পরিক্রমা?
আছি।
মনুষ্য নামে প্রাণী মেরে-ফেলা এক্সরের (Xray) তেজস্ক্রিয়তা?
মন্দ নয়।

সব কিছুই যেন বড়ো অদ্ভুত এই জীবটার।  
এর প্রজনন  যৌন (sexual) কিম্বা অযৌন বা পার্থেনোজেনেসিস (parthenogenesis) দুই প্রকারেরই হতে পারে। পাঠককে মনে করিয়ে দিই, অযৌন বা পার্থেনোজেনেসিস পুনরুৎপাদন প্রক্রিয়ায় একটি নারী প্রাণীর ডিম থেকে নতুন আরো কতোগুলো কন্যা সন্তান উৎপন্ন হয় সেই প্রজাতির পুরুষ পসার বা বীর্য ব্যতিরেকে। ইদানিংকালে আমরা বিজ্ঞানের জয়যাত্রার প্রশংসা করতে ক্লোনিংয়ের কথা বলে থাকি। একটি প্রাণী থেকে হুবহু এক প্রাণী সৃষ্টি।  
টার্ডিগ্রেদ সেই পদ্ধতি ব্যবহার করে চলেছে সেই কবে থেকে। তার জন্য কোন সায়েন্স কলেজে যেতে হয়নি এদের। পরিস্থিতি অনুকূল পেলে বা প্রয়োজন অনুসারে একটি মহিলা টার্ডিগ্রেদ নিজের ডিম থেকে তৈরী করে ফেলতে পারে অনেক কয়টা মেয়ে টার্ডিগ্রেদ। আবার মাঝে মাঝে যেন স্বাদ বদল করার মতো পার্থেনোজেনেসিস প্রক্রিয়ার একটু রদবদল করে মা টার্ডিগ্রেদ প্রসব করে ফেলে কতোগুলো পুত্রসন্তান। যৌন উপায়ে বংশবৃদ্ধির ফলে জিনের বিভিন্নতা (Gene-Diversity) বজায় থাকে, বিবর্তনের মাপকাঠিতে মহামারীর কবল থেকে একটা প্রজাতিকে বেঁচে থাকতে সাহায্য করে এই বিভিন্নতা।  
আবার অযৌন উপায় ব্যবহার করার ফলে টার্ডিগ্রেদ রাজ্যে কেউ কোনদিন প্রশ্ন করে না, “রাজকন্যা কম পড়িয়াছে?” দুয়োরাণীর এক মাত্র কন্যাকে নিয়ে রাজপুত্র কোটালপুত্র কোন মারামারি করার অবকাশ  থাকে না। সামান্য জলজ জীবাণু, কিম্বা উদ্ভিদ-জাত তরল পদার্থকে খাদ্য হিসাবে সম্বল করে, প্রায় পঞ্চাশ কোটি  বছর  আগে,  যেই যুগটাকে আমরা ক্যাম্ব্রিয়ান পিরিয়ড বলে থাকি, সেই তখন থেকে টার্ডিগ্রেদ এই পৃথিবীর যত্র-তত্রকে বাসভূমি করে ফেলেছে! আরো একটি তথ্য এখানে লুকিয়ে আছে। পৃথিবীতে বেশ ভাল সংখ্যার জীব এই পার্থেনোজেনেসিস উপায়েই বংশবৃদ্ধি করে থাকে। সাপ, টিকটিকির জগতে তার অজস্র উদাহরণ ছড়িয়ে আছে।  তবে এখনও পর্যন্ত কোন দুগ্ধপায়ী জন্তুর মধ্যে পার্থেনোজেনেসিস আমরা দেখি নি। 

আগে বলেছি টার্ডিগ্রেদকে যেমনি পাহাড়ের চূড়ায় পাওয়া গেছে, তেমনি আবার বেশ জীবিত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে আগ্নেয়গিরির অন্দরে। এই উদগ্র মাত্রার উত্তাপ শূন্যের নিচে দুইশো ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বা শূন্যের উপরে একশো-একান্ন ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডও হতে পারে। তুলনামূলক ভাবে, শূন্য ডিগ্রিতে জল জমে বরফ হয় আর একশো ডিগ্রিতে জল ফুটতে শুরু করে। ঘরে আমরা যে রেফ্রিজারেটর ব্যবহার করি তার ছোট্ট ফ্রিজার নামক কোটরে তাপমাত্রা বড্ডো জোর শূন্যের নিচে কুড়ি ডিগ্রি হলেও হতে পারে। 
আগেভাগেই বলে দেওয়া ভালো, টার্ডিগ্রেদ একমাত্র প্রাণী নয় যারা এই নানা প্রকার তাপ-মাত্রা বা কঠিন পরিস্থিতি জীবিত থাকার কৃতিত্ব দাবী করতে পারে। বৈজ্ঞানিক মহলায় যে এই সব প্রাণীকে নিয়ে নিতান্ত কৌতূহল, কেননা বিবর্তনের দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় একটি প্রাণী কি ভাবে প্রচন্ড পরিবেশকে মানিয়ে নিয়ে বেঁচে থেকেছে, সেই সহনশীলতা থেকে মানুষের শেখার আছে অনেক। 
এন্টন ভন লিউইনহকের ১৭০২ সালে প্রথম ক্রিপ্টোবায়োসিসের (Cryptobiosis) কথা উল্লেখ করেন। বাড়ির ছাত থেকে ধুলো-খড়-কাঠি তুলে নিয়ে এসে নিজের বানানো মাইক্রোস্কোপের নীচে ফেলে ধরে আবিষ্কার করেন তাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে লক্ষ লক্ষ প্রাণী, তাদের হাত পা আছে, বেশ নাদুস নুদুস চেহারা, ভালোই খাওয়া দাওয়া করে বেঁচে বর্তে আছে। 
পাঠক কল্পনা করে দেখুন লিউইনহকের বিস্ময়। 
কিন্তু বিজ্ঞানী লিউইনহকের কৌতূহল শুধু ওদের দেখতে পেয়েই সেইখানেই থেমে থাকেনি। তিনি সেই ছোট্ট জন্তুগুলিকে সম্পূর্ণ জলকণা বর্জিত অবস্থায় বেশ কিছুদিন রেখে দিয়ে তার পরে আবার জলের মধ্যে ফেলে লক্ষ করতে দেখলেন যে ছোট্ট জন্তুগুলি আবার যেন প্রাণ পেয়ে নড়তে চড়তে শুরু করলো। 
কেন যে জলবিহীন অবস্থায় মরে থাকা প্রাণীগুলো জল পেয়ে আবার বেঁচে উঠে চলাফেরা করতে শুরু করতে পারে বলে কল্পনা করেছিলেন লিউইনহক, সেই প্রশ্নের উত্তর আমরা জানতে পারবো না কোনদিন, কিন্তু সেদিন বিজ্ঞানের ভাষায় ক্রিপ্টোবায়োসিস নামে একটি নতুন শব্দ সংযুক্ত  হয়েছিল(৩)। 
প্রতিকূল থেকে অনুকূল পরিস্থিতি আসার মধ্যবর্তীর সময়ের যে ব্যবধান, সেই সময়টাকে বা যুগটাকে আমরা ক্রিপ্টোবায়োসিস বলে জানলাম। এই ক্রিপ্টোবায়োসিসের পর্যায় চলাকালীন একটি প্রাণী বিপাকের (মেটাবোলিজম) হার প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে আসে। সে খায় না, বিভাজন করে না, এমনি কি নিশ্বাস পর্যন্ত নেয়না। সুখটা ভাবে দেখুন একবার, কোন কাজ নেই কর্ম নেই, দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর শুধু তূরিয়ানন্দ সেজে

tardi2.jpg

ভ্যোম্ মেরে পরে থাকা! সুদিনের আসলেই আবার তড়াং করে লাফ মেরে উঠে পরে হাউ-মাউ-খাউ আর প্রজনন। পাঠকের আবার মনে মনে ক্রিপ্টোবায়োসিস করতে ইচ্ছা হচ্ছে না তো? ক্রিপ্টোবায়োসিস অনেক প্রকারের হতে পারে এবং তার নামগুলি অভাবের ভিত্তিতে দেওয়া হয়েছে। 
যেমন জলের অভাব থেকে যে ধরণের ক্রিপ্টোবায়োসিস হয় তার নাম এ্যনহাইড্রবায়োসিস (Anhydrobiosis)। সেই ভাবেই যথাক্রমে অত্যন্ত নীচু তাপ মাত্রা, লবণাক্ত জলের কঠিন পরিস্থিতি এবং অক্সিজেনের অভাব থেকে এসেছে ক্রায়োবায়োসিস (Cryobiosis), অস্মবায়োসিস (Osmobiosis) এবং এনাক্সোবায়োসিস ( anoxybiosis)। 
অজানা বিস্তৃত সাহারা মরুভূমি একা একা পার করার কথা মনে করুন পাঠক। বিশেষত: যখন সেই পথ কতোটা বিস্তৃত তা জানা নেই।  টার্ডিগ্রেদ পূর্বে বর্ণিত এ্যনহাইড্রবায়োসিসের প্রক্রিয়ায় জল-বর্জিত সময়টা অতিক্রম করে দেয়। 

প্রাণ-ধারণের সহজ সমীকরণে এমনকি টার্ডিগ্রেদের জন্যেও সেই বিস্তীর্ণ মরুপথ পার হওয়ার জন্য একটা বড়ো সড়ো আয়োজনের প্রয়োজন হয়। গাবদা-গোবদা গোলগাল ভালুক চেহারাটা একটা ছোট্ট বর্তুলের আকারে গুটিয়ে ফেলতে হয়। প্রসঙ্গত: এই বর্তুলাকৃতির বৈজ্ঞানিক নাম টান (Tun) এবং ছোট্ট এই জীবটাকে আগামী কার্যসূচীর নকশা করে নিজের শরীরে এই পরিবর্তনটা আনতে হয় বিপাক বা মেটাবোলিজম চলাকালী অবস্থাতেই। গত আড়াইশো বছর ধরে বিজ্ঞানী মহলের ধারণা ছিল অন্য অনেক এ্যনহাইড্রবায়োসিস করা ছোট্ট প্রাণী বা এ্যনিমালকুলসের মতো টার্ডিগেদেও কঠিন পরিস্থিতির সম্ভাবনা অনুভব করতে পারলেই এক বিশেষ প্রকারের চিনির পরমাণু তৈরী করে ফেলে এবং বিপাক চলাকালীন অধ্যায়েই শরীরের সমস্ত জলের কণার পরিবর্তে এই চিনির পরমাণু দিয়ে ভরে ফেলে নিজেকে এবং বর্তুলাকার ধারণ করার পথে দ্রুত এগিয়ে যায়। একবার টান হয়ে যেতে পারলেই হলো! আর চিন্তা নেই। 
সম্ভাব্য পথ পরিক্রমার আগে আমার আপনার ব্যাগ গুছিয়ে নেওয়ার মতো পরিকল্পনা মাফিক কাজ। 
পাঠক আশা করবো আপনিও আমার মতে একমত হবেন যে কর্মসূচীর নিরিখে এই ধীরেসুস্থে চলাফেরা করা প্রাণীটার ভীষণ সময়নিষ্ঠতা বা ইংরাজিতে পাঙ্কচুয়ালিটি স্যার উইন্সটন চার্চিল থেকে কিছু কম নয়। 
বিজ্ঞান-মনস্ক পাঠকের জন্য এই ট্রেহালোজ নামক চিনি সম্পর্কিত সামান্য কয়েক তথ্য। 

এই বিশেষ চিনির পরমাণু ট্রেহালোজ (Trehalose) প্রকৃতির রসায়নাগারে প্রস্তুত দুইটি গ্লুকোজ পরমাণু দিয়ে তৈরী এক ডাইসাকারাইড। বলা বাহুল্য গ্লুকোজ এক মোনো (এক) সাকারাইড। 
ট্রেহালোজের আবির্ভাব হয়ে ছিল বিবর্তনের রাস্তা ধরে প্রাগৈতিহাসিক যুগে এবং মোটামুটি একটিই কারণে। প্রাকৃতিক পীড়াদায়ক (stressful) অবস্থায় এই বিশেষ গুণাবলি সম্পন্ন চিনি শক্ত কাঁচের মতো বর্ম তৈরী করে বাইরের তান্ডব ঢেকে ফেলে প্রাণের আধারটিকে। এই প্রক্রিয়াকে ভিট্রিফিকেশন ( Vitrification) বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। 
বায়োগ্লাস (Bioglass) বা কাঁচের মতো বর্মের আচ্ছাদনে প্রাণটি সাড়াশব্দ  না করে মড়ার মতো পড়ে থাকবে অনুকূল পরিস্থিতির অপেক্ষায়। যেই সেই সুযোগটি আসবে, জলের সাহায্য নিয়ে ট্রেহালোজ ভেঙ্গে তৈরী হবে গ্লুকোজ। গ্লুকোজ ভেঙ্গে তৈরী হবে শক্তি, প্রাণের সব লক্ষণ আবার ফুটে উঠবে  শরীরে। 
এখানে মনে রাখা দরকার ট্রেহালোজের ব্যবহার এমন কিছু অভিনব ব্যপার  নয়। ট্রেহালোজ পাওয়া গিয়েছে প্রাণী জগতে। উদাহরণ স্বরূপ চিংড়ী মাছ, পঙ্গপাল, প্রজাপতি, মৌমাছি ইত্যাদির নাম করা যেতে পারে। পাওয়া গিয়েছে নানা গাছপালায়, সূর্যমুখী ফুলের বীজে, রাইয়ের বীজে। পাওয়া গিয়েছে নানা ব্যাকটেরিয়া বা ফাংগাসে।  

আগেই বলেছি, এই জীবটার সব কিছুই বড়ো চমকপ্রদ। উপরিযুক্ত ২০১৭ সালের প্রবন্ধে ইউনিভার্সিটি অফ নর্থ ক্যারোলীনার গবেষক থমাস বুথবাই (Thomas Boothby) প্রমুখ দেখিয়েছেন টার্ডিগ্রেড ট্রেহালোজ ব্যবহার না করে আরেক অভূতপূর্ব উপায়ে জল-বিহীন অবস্থায় দিনের পর দিন, বছরের পর বছর কাটাতে পারে। কি ভাবে ট্রেহালোজ ব্যবহার না করেও টার্ডিগ্রেড এই অসাধ্য সাধন করে আলোচনা করার আগে পাঠককে জীববিজ্ঞান সম্পর্কিত কিছু তথ্য মনে করিয়ে দেবো।

১৯১৫ সালে উইলিয়াম হেনরী ব্র্যাগ (Willium Henry Bragg) এবং তাঁর স্বনাম ধন্য পুত্র-সন্তান উইলিয়াম লরেন্স ব্র্যাগ (Willium Lawrence Bragg) এক্সরে (X-ray) ব্যবহার করে স্ফটিকের ভিতরে অণুর অবস্থান ব্যক্ত করেন। জন্ম হয় এক্সরে-ক্রিস্টালোগ্রাফি (Xray Crystallography) পদ্ধতি। এর পরে ১৯৩০ থেকে ১৯৫০ সাল অবধি প্রোটিনের ত্রিমাত্রিক গঠন জানার একটি হিড়িক পড়ে যায় বৈজ্ঞানিক মহলে। প্রকাশিত হয় কোলেস্টেরল, পেনিসিলিন, ভিটামিন বি টুয়েলফ, হিমোগ্লোবিন কিম্বা ইনসুলিনের ইত্যাদির ত্রিমাত্রিক গড়ন প্রণালী। এর ফলে বৈজ্ঞানিক মহলে একটা ধারণা তৈরী হতে থাকে যে কোন জৈবিক প্রোটিনকে একটি নির্দিষ্ট ত্রিমাত্রিক আকারের হতেই হবে। 
বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে সেই ধারনায় চিড় ধরতে থাকে। ২০১০ সালে ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটির এ.কে. ডাঙ্কার( A.K Dunker) একটা প্রবন্ধে এই অন্য মতবাদটাকে জোর গলায় প্রকাশ করলেন (৪)। ওঁনার বক্তব্য অনুসারে দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর ধরে অনুমান করে নেওয়া হয়েছে প্রোটিনের ত্রিমাত্রিক গড়নকে নির্দিষ্ট হতেই হবে, কিন্তু বাস্তবিকে  তার কোন মানেই নেই।  পরিবেশের ওপর নির্ভর করে সেই আকার বা বিন্যাস পাল্টাতেই পারে।  
এসে গেল প্রোটিনের জগতে ফ্লেক্সিবিলিটির যুগ।
স্বীকার করে নেওয়া হলো প্রোটিন প্রয়োজন অনুসারে নমনীয় (Flexible) বা গতিশীল ( Dynamic)। বিজ্ঞানের ইতিহাসে স্বাভাবিক ভাবেই আইডিপির (IDP, Intrinsically Disordered Protein) বা ইন্টিসিকালি ডিসরডারেড প্রোটিনের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকলো।  

পাঠক, আপনি যদি ধরে ফেলে থাকেন, কেন আমি ধান ভাঙ্গতে এসে শিবের গাজন আরম্ভ করেছি, কেনই বা হঠাৎ টার্ডিগ্রেডের আলোচনা মাঝপথে থামিয়ে রেখে এক্সরে ক্রিস্টালোগ্রাফি বা আইডিপি নিয়ে পড়েছি তাহলে বলবো আপনার অনুমান সঠিক। 
বুথবাই প্রমুখের গবেষণার মাধ্যমে এই কিছুদিন আগে আমরা জানতে পেরেছি টার্ডিগ্রেডের সাথে আইডিপির একটি সাক্ষাৎ যোগসূত্র আছে।  
আগের গবেষণা থেকে জানা ছিল, প্রায় মৃত টার্ডিগ্রেড বেঁচে উঠে আবার প্রাণের স্বাভাবিকত্ব পাবে কি না নির্ভর করে কতো তাড়াতাড়ি জলা-জায়গা থেকে জল-হীন জায়গায় ওদের স্থানান্তরিত করা হচ্ছে। 
তার মানে ওদের যদি ধীরে সুস্থে এ্যনহাইড্রবায়োসিসের পর্যায়ে যেতে দেওয়া হয়, তাহলে আরোগ্য লাভ ত্বরান্বিত হয়, তার মানে রক্ষাকবচ তৈরীর সময়টুকু ওদের দিতে হবে।  
আগের কাজ থেকে জানা আছে বহু-কোষী প্রাণীর শরীরে সবকয়টা জীনই সব সময়ই শরীরের সবকয়টা প্রোটিন তৈরীর কাজে লেগে থাকে না, আলোর সুইচের মতো জীন জ্বলা-নেভা করে  প্রয়োজন বানিয়ে নেয় ব্যবহারের উপযোগী প্রোটিন।  টার্ডিগ্রেডের  ক্ষেত্রেও এর অন্যথা হতে পারে না।  
এই সূত্রের ওপর নির্ভর করে গবেষকের দল দেখতে চেষ্টা করলেন ধীরে সুস্থে এ্যনহাইড্রবায়োসিসের পর্যায়ে যেতে দেওয়া টার্ডিগ্রেডের শরীরে কোন কোন বিশেষ জীন চালু হচ্ছে। ওঁনারা দেখলেন, সামনে বিষম দিন আসছে অনুভব করেই যেন টার্ডিগ্রেডের শরীরে হইহই করে চালু হয়ে উঠলো অনেক কয়টা জীন, এবং ঠিক সেই সব জীন যার থেকে তৈরী হয় অনিবন্ধি আকারহীন (amorphous)  প্রোটিন। 
এর পরের ব্যপারটাতো ছকে ফেলা!  
হই-হই করে ল্যাক প্যাকে নুডুলের মতো অসংগঠিত প্রোটিন থেকে গঠিত হওয়া কাঁচের বর্মের আশ্রয়ে ঢাকা পরে গেল প্রাণ।  খুব তাড়াতাড়ি নির্জলা জায়গায় নিয়ে গেলে ধীর স্থির প্রাণীটা এতোশত করে উঠতে পারে না বলেই আরোগ্য লাভ হয় না।   
মলিকুলার বায়োলজির  প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে কিছু ব্যাকটেরিয়া এবং ফাংগাসের শরীরে এই অনিবন্ধি আকারহীন প্রোটিন তৈরী করে গবেষকের দল দেখালেন টার্ডিগ্রেড প্রোটিন অন্য প্রাণীর শরীরেও জল বিহীন জায়গায় বেঁচে থাকার সম্ভাবনা প্রায় একশোগুন অবধি বাড়িয়ে দিতে পারে।  
এই আবিষ্কারের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা স্বয়ং বুথবাই এর ভাষায় "Essentially, what we envision is using these tardigrade proteins to stabilize sensitive proteins in a dried state, and then being able to ship and store these lifesaving drugs all over the world at room temperature."

হায়রে বেচারা অর্ণব! আমার কলেজ যুগে অনিবন্ধি প্রোটিনের ব্যবহার ছিল না। কিন্তু যেখানে মানুষ আছে, টার্ডি স্বভাব আছে। তবে টার্ডিগ্রেড প্রোটিনের ব্যবহারটা একবার শুরু করে দেওয়া গেলে এই যুগের অর্ণব আর চোট পাবে না। 
পাঠক যেই প্রশ্নটা করতে আপনার বাঁধছে, তার উত্তরটা আমিই সব প্রণোদিত হয়ে দিয়ে দিচ্ছি,  “হ্যাঁ, খুব সম্ভবত পালং শাক, ধনে পাতার সাথে  টার্ডিগ্রেড আপনি খেয়েছেন, তবে ওগুলো বিষাক্ত নয়, আর পেটের আম্লিক পরিস্থিতিতে টার্ডিগ্রেড মরে ভূত হয়ে গেছে, আপনি টেরও পান নি।”
               


দ্রষ্টব্য
১। Thomas C. Boothby, Hugo Tapia, Alexandra H. Brozena, Samantha Piszkiewicz, Austin E. Smith, Ilaria Giovannini, Lorena Rebecchi, Gary J. Pielak, Doug Koshland, Bob Goldste in Tardigrades Use Intrinsically Disordered Proteins to Survive Desiccation. Molecular Cell, 2017
২। Megumu Tsujimoto, Satoshi Imura, Hiroshi Kanda. Recovery and reproduction of an Antarctic tardigrade retrieved from a moss sample frozen for over 30 years. Cryobiology, 2016; 72 (1): 78
৩। Clegg, J. S. (2001). "Cryptobiosis — a peculiar state of biological organization". Comparative Biochemistry and Physiology B. 128 (4): 613–624.
৪। Dunker, A. K.; Lawson, J. D.; Brown, C. J.; Williams, R. M.; Romero, P.; Oh, J. S.; Oldfield, C. J.; Campen, A. M.; Ratliff, C. M. (2001-01-01). "Intrinsically disordered protein". Journal of Molecular Graphics & Modelling. 19 (1): 26–59.

Comments

Top

গল্প

বাড়িতে একা আছি

বাড়িতে

একা আছি

তন্ময় হালদার (তুফান)

beggar1.jpg

মি বাড়িতে একা আছি।

TV দেখছি, কেমন একা একা লাগছে। TV-তেও ভালো কিছু হচ্ছে না। Bore লাগছে। সমস্ত বাড়ি ঘুরে ফিরে দেখতে লাগলাম। অনেক বড়ো বাড়ি তো। 

তবুও আমি এখন এই বাড়িতে একা আছি।

যদিও একটু আগে অনেকেই ছিল বাড়িতে। Mr. সাহা, Mrs. সাহা, তাদের মেয়ে অনিশা, ছেলে অতনু, অতনুর তিন জন বন্ধু, বাড়ির কাজের লোক। এখন, সবাই কোথায় আমি জানি না। এই পরিবারটি অন্য ধরনের। Mr. সাহা ও Mrs. সাহা নাস্তিক। অনিশা ও অতনু ও একই। আমি নাস্তিকদের পছন্দ করি না। এরা Paranormal ব্যাপারকেও কুসংস্কার মনে করে। বিজ্ঞানকে একটু বেশি Seriously নিয়ে নিয়েছে। অনিশা মেয়েটিকে দেখে ভালো মনে হলেও, ভিতরে ভিতরে খারাপ। নিজের বাবার, মা, ভাইকে সহ্য করতে পারে না। খুব অহংকারী, হিংসুটে। অতনুও ভালো এর মধ্যে পরে না। তিনজন বন্ধু নিয়ে মেয়েদের পিছনে পড়ে থাকে। বাবা, মায়ের টাকা উড়ায়। সব বাজে অভ্যাস আছে। এই পরিবারটিকে আমার অসহ্য লাগে। 

কিন্তু, আমি এখন এই বাড়িতে একা আছি।

আগে আমি এখানে থাকতাম না। আজ এসেছি। আমি আগে আমার বাড়িতেই থাকতাম।
ওহ্! অতনুর কথা তো বলাই হলো না। আজ দুপুরে, সে তার তিন বন্ধুদের সাথে আমার বাড়িতে এসেছিল। হঠাৎ, একটা শব্দ হলো। অতনুর Room থেকে আসছে। অতনু এখনো আছে! আমি দোতলায় ওর Room সামনে এলাম। দরজা ভিতর থেকে Lock করা। খুব হাসি পাচ্ছে। কিছুক্ষণ হাসলাম। ও এখনো আছে, জানতাম না। দরজা ভেদ করে Room-এ ঢুকলাম। আমাকে দেখেই অতনু চিৎকার করে Shoot করল। মানতেই হবে পাকা হাত। তবে, বুলেটটি আমাকে ভেদ করে দেয়ালে গিয়ে বিঁধল। অতনু আরো জোরে চিৎকার করল। বলল, "কি ক্ষতি করেছি আমি তোর?" এখনো অহংকার!

আমি হাসতে হাসতে অতনুকে Celling পর্যন্ত তুললাম। বললাম, "ক্ষতি না, বিরক্ত করেছিস।" বলেই অতনুর মাথাটাকে ১৮০° তে ঘুরিয়ে দিলাম। তারপর, মেঝেতে আছড়ে ফেলে দিলাম।

ও হ্যাঁ, অতনুর কথা বলছিলাম। আজ দুপুরে, সে তার তিন বন্ধুদের সাথে আমার বাড়িতে এসেছিল, Plan Chat করতে। Paranormal-এ বিশ্বাস নেই। Just, Game মনে করে এসেছে। প্রমাণ করবে যে, ভূত নেই। Ouija Board নিয়ে খেলা। ভাবা যায়!? আমি চুপচাপ দেখছিলাম। যখনই, আহ্বান করল, আমি চলে এলাম। আমাকে দেখেই ভয় পেয়ে পালিয়ে গেল। আমিও সাথে চলে এলাম। বাড়িতে ঢুকতে কেমন লাগছিল, যদি মন্দির থাকে! 
কিন্তু, না।  কিছুই নেই! পবিত্র কোনো কিছু নেই। সব নাস্তিক তো। সবাইকে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে মেরেছি। সব থেকে ভয়ংকর ভাবে মেরেছি অতনুর এক বন্ধুকে, বিচ্ছিরি গালি দিচ্ছিল। 

যাইহোক, এখন কি করব? বাড়িতে তো আমি একাই আছি।

পরেরদিন, সকাল ১১:৩৭। Mr. সাহা-এর বাড়িতে Police-রা এসেছেন। তারা নিজেদের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। এসব মানুষ করতে পারে? Police Station-এ ফিরে যাওয়ার সময়, Inspector জয় Constable অনয়কে বললেন, "এই Case-টার গভীর Investigation করতে হবে। আমি রাতে একবার এখানে আসবো। যদি কোনো Clue পাই।" 
- "কিন্তু Sir, এসব তো কোনো ভূতের কাজ মনে হচ্ছে। আপনার একা এখানে আসা কি ঠিক হবে?"
- "আরে, ভূত বলতে কিছু আছে না কি?"

বলেই হাসতে লাগলেন Inspector জয়।

আমি সব শুনে মুচকি হাসলাম। 

হ্যাঁ। আমি এই বাড়িতে একা আছি।

Comments

Top

গল্প

আগমনীর সুর
Maitrayee Mukhopadhyay.jpg

আগমনীর সুর

মৈত্রেয়ী মুখোপাধ্যায়

পশ্চিম মেদিনীপুর, পঃ বাংলা

ladies.jpg

ঢাকে কাঠি পড়তে আর বাকি মাত্র কটা দিন। মুখুজ‍্যে বাড়িতে ব‍্যস্ততা তুঙ্গে। বাড়ির পুজো বলে কথা! কোথাও যেন কোনো খামতি না থাকে। ঠাকুরদালানে মা-জেঠিমাদের সাথে বসে ছোট্টো মোহর। ঠাকুরের বাসন-কোসন, জিনিসপত্র, গয়নাগাঁটি সব বের করা হচ্ছে, গোছানো হচ্ছে। মোহরের একা একা ভালো লাগছেনা। দাদা-দিদিরা সবাই ব‍্যস্ত, কেউ ফোনে, আবার কেউ বন্ধুদের সাথে আড্ডায়। মোহর ওদের থেকে বেশ ছোটো। একটু পরেই ঠাকুমা এক থালা নারকেলের ছই নিয়ে এসে বসতেই মোহর ধরল ঠাকুমাকে গল্প বলার জন্য।
- "আচ্ছা, কি গল্প শুনবে দিদিভাই?"
- "তোমার পুজোর গল্প।"
- "আমার পুজো!" হেসে ফেললেন ঠাকুমা।
- "ঠিক আছে, বলছি। শোন তবে।" নারকেলের নাড়ু বানাতে বানাতে শুরু হল গল্প বলা।
আমাদের সময়ে আকাশবাণীতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কন্ঠে মহালয়া দিয়ে শুরু হতো পুজোর দিন গোনা। আমার বাপের বাড়ি তো গ্ৰামে, সেখানে একটাই পুজো হতো। আটচালায় ঠাকুরের মেড়ে মাটি দেওয়া থেকে শুরু করে চক্ষুদান সব দেখতে যেতাম ছোটোরা। ভোরবেলা শিউলী ফুল কুড়িয়ে মালা গাঁথা, তার সাথে হিমেল হাওয়া! একটা বড় পুকুর ছিলো, পদ্ম ফুলে ভরে থাকতো। মাঠে-ঘাটে,নদীর পাড়ে কতো কাশফুল ফুটতো! নদীর দুপাশটা পুরো কাশে সাদা হয়ে থাকতো। কতো কাশফুল তুলেছি আমরা! পাশের গ্ৰামে জমিদার বাড়িতে সবাই মিলে যাত্রা দেখতে যেতাম। বেশ বড়ো করে মেলা বসতো তখন। পুতুলনাচও দেখেছিলাম কয়েকবার। এখন তো এসব উঠেই গেছে।
জানো দিদিভাই, বাবা কতো কষ্ট করে আমাদের লেখাপড়া শিখিয়েছে। শহর থেকে পুজোর নতুন জামা আনতো বাবা। প্রত‍্যেক ভাই-বোনের জন্য একটা করে জামা। তাতেই আমরা কতো খুশি হতাম। এখনতো দেখি একটায় চলেইনা কারো। আমরা অল্পেই খুশি থাকতাম। ঠাকুমা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন।

মোহর চুপ করে মন দিয়ে শুনছিলো।

- "তারপর? তারপর?"
একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলেন তিনি। আর একটা জিনিসের ওপর বেশ লোভ ছিলো আমার। কি বলো তো দিদিভাই?
- "কি?"
শারদীয়া পুজোসংখ‍্যা। বাবা একটা বই আনতোই। আর সেই নিয়ে আমাদের মধ‍্যে কাড়াকাড়ি পড়ে যেতো, কে বই আগে পড়বে! নতুন বইয়ের গন্ধ বুক ভরে নিতাম। এখনো একটু একটু পড়ি তা তো দেখেছোই দিদিভাই। আর একটা জিনিস খুব ভালোবাসতাম, মায়ের হাতের পায়েস আর আনন্দ নাড়ু। তারপর তো বিয়ে হলো পনেরো বছরে। তারপর থেকে বাড়ির পুজো নিয়েই সময় কেটে যায়। ছেলেবেলার দিনগুলো মনে পড়ে মাঝে মাঝে। প্রথম প্রথম পুজোয় বাপের বাড়ি যেতাম, তারপরে আর বাড়ির পুজোর দায়িত্ব এসে পড়ল ঘাড়ে। আর যাওয়া হতো না। বিজয়া দশমীতে চিঠি পাঠাতাম বড়োদের। দিনগুলো যেন কতো তাড়াতাড়ি হারিয়ে গেলো। বলতে বলতে কেমন আনমনা হয়ে গেলেন।
- "কত সুন্দর ছিলো ঠাম্মি তোমার ছোটোবেলা। আমি তো কাশ ফুল দূর থেকে একবার দেখেছিলাম, ট্রেনে যেতে যেতে। আগেই ভালো ছিলো।"
তার ছোট্ট দিদিভাইয়ের কথা শুনে হেসে ফেললেন।
করজোড়ে কপাল স্পর্শ করে মনে মনে বললেন, "আমার ছেলেমেয়েদের ভালো রেখো মা।ভালো রেখো।"
মোহরের যেন মনে হলো আকাশে - বাতাসে বাজছে আগমনীর সুর। বেশ অন্যরকম লাগছে ওর।
সেই সময় কোথায় যেন বেজে উঠলো গান,
"বাজলো তোমার আলোর বেণু।
মাতলো যে ভুবন,
আজ প্রভাতে সে সুর শুনে
খুলে দিনু মন।"

Comments

Top

গল্প

সারেঙ্গ বউ

সারেঙ বৌ

অপরাজিতা চিত্রলেখা ঘোষ

বেলঘোরিয়া, কলকাতা

fisherman.jfif

কবুল সারেঙ  চিন্তায় বেহুঁশ হয়ে ছুটতে ছুটতে নদীর পাড়ে আসে, “তোরে নিয়ে আর পারি না রে বৌ”
“না পারলি এই পানির মধ্যি ফেলায়ে দাও”
মকবুল সূচালো চোখে বিবির দিকে তাকিয়ে থাকে। বলে, “এই জলই তোকে খাবে। জলের মধ্যি তোর এত কি?”
"তোমার ঐ পাতার ছাপরা আমার একটুও ভাল লাগে না" জামিলা  জল থেকে উঠে স্বামীর মুখোমুখি দাঁড়ায়। জামিলা যে মকবুলের ঐ হোগলা ছাওয়া কুটিরে নিতান্ত বেমানান, সেটা মকবুলের চেয়ে বেশি আর কে জানে! মকবুল চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। তার চোখের দিকে তাকিয়ে জামিলা জিজ্ঞাসা করে,

‘আমারে বিয়া করেছিলা ক্যান?" মকবুল কপট রাগ দেখায়,

‘আমিও তো তাই ভাবি। মরতে তোরে বিয়া করলাম ক্যান। তাইলে তো আমায় এত জ্বলন জ্বলতে হত না!"
স্বামীর কথা শুনে জামিলা আবার ধুপধাপ পা ফেলে জলে নেমে যায়। 
এবার মকবুল খানিকটা স্নেহের সুরে ডাকে   
“জামিলা!”
“কও”
“ভাত দিবি নে?”
মকবুলের এই দীন আবেদনে জামিলা আর অনড় হয়ে থাকতে পারে না। ফিরতে হয় তাকে। সোয়ামির পিছন পিছন হাঁটতে হাঁটতে ঘরে ফেরে জামিলা। রোদের তাতাল আভায় মুখখানা লাল হয়ে যায়। কে জানে কেন, তার সারাক্ষণ ইচ্ছে হয় জলের ভেতর শরীর ডুবিয়ে বসে থাকতে। জল যেন তাকে ভালবাসার সুখ দেয়।

জামিলা মকবুলের তৃতীয় পক্ষ। পাকা মাগুর মাছের মত গায়ের রঙ। দোহারা গড়ন। চোখ গুলো ভাসা ভাসা। তার বয়স এখন ষোল-আঠেরোর মাঝামাঝি। মকবুলের প্রথম বিবি কলেরায় মরেছে। দ্বিতীয় পক্ষের বোঁটা বরাবরই রোগাভোগা ছিল। সেও কি এক অজানা রোগে দিন দিন শুকিয়ে যেতে লাগল। তারপর হাড় কখানা সার হয়ে একদিন চোখ বুজল। মকবুলের বিয়ে করার ইচ্ছেই চলে গেসল। বছর দুয়েক পর রাজু ঘটকের কারসাজিতে পাশের গাঁয়ের পাঁড় মাতাল হোসেন পাটোয়ারির মাতৃহীন কিশোরী মেয়েকে নগদ একশ টাকা কন্যে পণ দিয়ে যকবুল যখন বিয়ে করে আনল, তখন তার নিজের বয়স চল্লিশ পেরিয়েছে। মকবুলের হেলাফেলার সংসারে জামিলা যেন নূর পরী। মকবুল যেন প্রাণের চেয়ে বেশি ভালবাসে জামিলাকে। যদিও সে ভাল করেই জানে ঐ সদ্য যৌবনে পা দেওয়া বধূটির শরীর মনের জোয়ার সামাল দেওয়ার ক্ষমতা তার গেছে। মকবুল যত এসব ভাবে, তত বেশি করে জামিলাকে ভালবেসে ফেলে। আর ভাবে তার জোয়ান বয়সের দিনগুলোয় কেন যে সে জামিলাকে পেল না! এইসব ভাবতে ভাবতে যখন তার হতাশা আসে সে পূর্বেকার দিন গুলো মনে মনে জাবর কাটে.......
মকবুল তার বাপ-দাদার মতই পেশায় এবং নেশায় সারেঙ। জলই ছিল সে সময় তার ঘর বাড়ি, জীবন। দু- বেলা দু- মুঠো রুটি রুজির যোগাড় এখান থেকেই। চাঁদনি রাতে জলের গোপন ইশারা, গা ছমছমে রূপ তার শরীরকে শক্ত করে তুলত। অন্যরা যখন রাতের বেলা বড়ে মিয়ার হাঁকারে গুটি গুটি বাড়ির পথ ধরত, মকবুল তখন পাথরঘাটায় নাও লাগিয়ে পা ছড়িয়ে বসে থাকত ছইএর ওপর। জলের দিকে তাকিয়ে থাকত অপলকে। ভোরের দিকে যখন কুয়াশার জড়তা কাটিয়ে রোদের মিটিমিটি হাসি এসে পড়ত জলে, তখন সে মিল পেত তার আম্মিজানের প্রাণ জুড়ানো হাসির সাথে। পঞ্চমুখী পেরিয়ে ভরা জোয়ারের বিদ্যাধরী মাতলা নদীর মাতলামিকে সঙ্গী করে মকবুল চলে যেত মাঝ দরিয়ায়। তখন আকাশে কালো মেঘের আনাগোনা। নদীর বুকের ওপর দিয়ে বয়ে আসা আওলা বাতাস মকবুলের শরীর জুড়িয়ে দিত। সঙ্গী-সাথিরা যখন তাড়াতাড়ি নিরাপদ আশ্রয়ে নাও ভেড়াত, মকবুল তখন স্বচ্ছ জলের তলায় রূপোলি আঁশওলা চকচকে শরীরগুলোকে স্পষ্ট দেখতে পেত। লোকে তাকে বলত, একবগ্গা, গোঁয়ার---
নিঃশ্বাস দীর্ঘতর হয় মকবুলের। সময় তার অনেক জেদ আর গোঁয়ারতুমি গুঁড়িয়ে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। একবগ্গা, তেজী মকবুল সারেঙ এখন মেনে নিয়েছে মহাজনী শোষণ।অন্য সকলের মত সেও এখন আলিমুদ্দিনকে সমীহ করে চলে। আলিমুদ্দিন এই গোটা চরের মালিক। বেঁটে-খাটো, গাঁট্টাগোট্টা চেহারা। চোখদুটো লোভী, চকচকে। বিষয়বুদ্ধি তুখোড়। সমস্ত চরধূমানী ওর ভয়ে তটস্থ। অল্পদিনের মধ্যেই একটা টুরিস্ট লঞ্চ আর মাছ ধরার ট্রলারের মালিক। শীতের তিন-চার মাস টুরিস্ট পার্টির কল্যাণে নয় নয় করে চার -পাঁচ লাখ কামায়। বছরের বাকি সময় ঘড়ির কাঁটা ধরে মাছ ধরা ট্রলারের রমরমা। গত বর্ষার আগে এখানে কারো কারো জমি জমা ছিল। বন্যায় সে সব জমি ভেসে গেছে। এখন এ চর তার। কবে কোথায় কার জমি ছিল এসব শুনতে আলিমুদ্দিন রাজী নয়। এসব করেই তার সম্পত্তি বেড়েছে। বেড়েছে ক্ষমতা। আলিমুদ্দিনের দাপটে মকবুলদের শরীর বেগতিক হবার জো নেই। বর্ষার স্যাঁতসেঁতে হাওয়ায় জ্বর-জারিতে গা ম্যাজম্যাজ করলেও মাছের খোঁজে নাও ভেড়াতে হয়। বর্ষার বাদলে কিংবা গরমের জ্বলনে, মাঝির রেহাই নেই। মকবুল প্রায়ই

জামিলাকে বলে, "একদিন দেখবি আমাগো ঘাড়ের ওপর মাথাডা নাই" জামিলা মৃদু স্বরে বলে, "এমন কামে আমাগো কাম কি?"

---  "কাম না করলি খাব কি! খালি তো সেই খিদার জ্বালা। এই কপাল নিয়াই আমরা আইছি রে জামিলা। আমাদের পানিতেও মরণ, ডাঙায়ও মরণ" আগের মত আর শরীরে তাকৎ পায় না মকবুল। ঘরে দুটো পেট। ভাগ্যি ভালো মকবুলের দুই বিবির একজনও বাচ্চা বিয়োয়নি। জামিলারও সেরকম ভাবগতিক নেই। কে জানে, ছেলের বাপ হওয়া মকবুলের কপালে আদৌ আছে কি না! লোকে আড়ালে ফিসফিস করে, মকবুলেরই নাকি দোষ। সারা বেলা তেমন কোনো কাজ থাকে না জামিলার। সকাল বেলা এক হাঁড়ি ভাত রাঁধে আর একমুঠো শুঁটকির ভর্তা বাটে। ব্যস। মাঝে মাঝে পাশের ঘরের রাশুর মা জিজ্ঞাসা করে, "কি রে কি রান্দলি জামিলা?  

-- "কি আর রান্দব? শুঁটকির ভর্তা করেছি"

-- "আমারে কয়ডা শুঁটকি দিবি? ঘরে রান্দবার কিছু নাই" জামিলা নিঃশব্দে একমুঠি শুঁটকি এনে দেয়। সারাদিন তেমন কিছু করার থাকে না বলে বুকটা খাঁ খাঁ করে। মৃত মায়ের কথা মনে পড়লে মনটা বাউরা হয়ে যায়। তখন ওর জলের কাছে যেতে ইচ্ছে করে।
ভালবাসা জিনিসটা কি বুঝে উঠতে পারে না জামিলা তবে বুড়ো মরদের কষ্টটা সে বোঝার চেষ্টা করে। এই বয়সেও যা খাটনি খাটে লোকটা, মায়া লাগে জামিলার। দুবেলা ভাতের পাতে দুটো একটা জ্যান্ত মাছ না দিলে হয়? তাই প্রতিদিন বেলা পড়লে নদীর চরে সে মাছের সন্ধানে যায়। জোয়ার-ভাঁটায় ভেসে থাকা দেশে সকালে বিকালে জোয়ারের জল নামে। তখন নদীর চরে মাছ- ধরুনেদের হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। জামিলার কপালে তেমন জোটে না। তাই এখন ভোর রাত থাকতে উঠে সে নদীর চরে মাছ খুঁজতে যায়। জল-কাদা মেশানো প্যাঁকপেঁকে পাঁকে হাত চালালেই পটপট উঠে আসে হৃতে। সদ্য ধরা মাছগুলোকে কচুপাতায় মুড়ে একটা ছোট মাটির খুরিতে রাখে। মুখে গামছা চাপা দেয়। তারপর খুড়িটাকে কাদার মধ্যে দাবিয়ে রেখে বুক জলে শরীর ডুবিয়ে বসে থাকে জামিলা। ঘন্টাখানেক জলে ডুবে সর্বাঙ্গ ঠান্ডা করে যখন সে সটান উঠে দাঁড়ায়, তখন অন্য এক নারী মূর্তি সে। শরীরের স্পষ্ট ভাঁজে ভাঁজে যেন অতল অবগাহনের রহস্য। সকাল - বিকেল জলে ডুবে থাকা জল পরী জামিলা। একদিন বেলাবেলি নাও নিয়ে বাড়ি ফেরবার সময় মকবুল দূর থেকে দেখেছিল তার জামিলাকে। পড়ন্ত সূর্যের আলোয় রক্ত - মাংস দিয়ে গড়া ভাস্কর্যের মত এক নারী মূর্তি। দেখেছিল, আলিমুদ্দিনের কড়া দৃষ্টি নাও টহল দিতে দিতে ঐ নারী মূর্তিকে দেখে চকচকে লোভী দৃষ্টিতে কেমন বদলে গিয়েছিল।গোধূলি বিকেলের মরচে রঙ আলোয় সিক্ত বসনা জামিলার নারী শরীরের উদ্দাম উদ্ভাস আলিমুদ্দিনের শরীরে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিল। আর কাঁপন ধরিয়েছিল মকবুল সারেঙের মনে।

আজ ভোর থেকেই কেমন যেন গুমোট ধরে আছে। ভোরবেলাকার গাছের পাতা কোনো নরম হাওয়া দিচ্ছে না। সূর্য ওঠার আগে এক রকম কুসুমরঙা বাতাস বয়। নদীর ঘোলা জল আর পাড়ের গাছ গাছালির সঙ্গে তার মিতে পাতানো থাকে। আজ সে সব কিছুর বালাই নেই। কি একটা অদ্ভুত পাখি ডেকে চলেছে একটানা, ঠররর্ ঠররর্.... বকগুলো নিশ্চুপ এক ঠ্যাঙে দাঁড়িয়ে শিকার খুঁজছে। ভোরের আবছা আলো আঁধারির রহস্যে, পাঁকে ডুব দিলে তার কাপড়-চোপড় বশে থাকে না। বুকের আঁচল সরে যায়। কোল আঁচল খুলে পড়ে সায়ার বাঁধন থেকে। "এই ভোর রাত্তিরেকে আর আমায় দেখতে আসবে” ভেবে সেও অত সামলাতে যায় না। আপন মনে বিচরণ করে নিজের একান্ত প্রিয় জগতটাতে। 

হঠাৎ খচ্ খচ্ খচ্ ---- কান খাড়া করে জামিলা। কিসের যেন একটা খচর-মচর শব্দ ভেসে আসছে পাড়ের হেঁতাল ঝোপের পাশ থেকে! পা কেঁপে ওঠে জামিলার। বড়ে মিঁয়া না কি! 
“দোহাই মা বনবিবি”
“দোহাই মা ফতেমা, রক্ষা কর মা ----” জোড় হাত করে কপালে ঠেকায় জামিলা। 
হলুদ-কালো কিছু একটা নড়ে উঠল না হেঁতালের ঝোপে! কি ওটা! তাহলে কি!
জামিলা বুঝতে পারে হলুদ-সবুজ হেঁতালের ঝোপ থেকে জ্বলজ্বলে লোভী দুটো চোখ তাকিয়ে রয়েছে তার দিকে.......
ভয় পায় জামিলা। পিছন ফিরে জলের দিকে পা বাড়ায়। ঠিক তক্ষুনি ঘাড়ের কাছে গরম নিঃশ্বাস। জামিলার ঘাড়ের ওপর থাবা দিয়ে সে তাকে লেপ্টে ফেলে পাঁকে। হিংস্র জানোয়ারটা এবার একটা থাবা বসায় জামিলার ভরাভর্তি বুকে। জামিলা প্রাণপণে চিৎকার করতে চায় কিন্তু ততক্ষণে আর একটা থাবা জামিলার মুখে চেপে বসেছে সাঁড়াশির মত.......

দিনের আলো পরিষ্কার হতেই প্রতিবেশীদের গুঞ্জন। জামিলাকে নাকি বড়ে মিঁয়া ধরেছে।কেউ কেউ বলছে হেঁতাল গাছে থাকা শাঁকচুন্নির কথা। ভয়ে গলার নলি শুকিয়ে গেছে মকবুলের। চোখের পানি মরে গেছে। কারো কোনো কথা তার কানে ঢুকছে না। খরখরে চোখে চরের ওপারে জঙ্গলের দিকে তাকায় অশক্ত মকবুল। যেন স্পষ্ট দেখতে পায় হিংস্র ধকধকে দুটো লোভী চোখ---- সঙ্গে সঙ্গে জামিলার সেদিনের উদ্ভিন্ন যৌবনা স্পষ্ট শরীরটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। খিদে তৃষ্ণা, এক বুক যন্ত্রণা, ঘৃণা আর আক্রোশে নদীর চরে এক দলা থুতু ছেটায় মকবুল, “শালা! জানোয়ার!”

Comments

Top

গল্প

পিছুটান

সীতানাথ সেন

বাঁকুড়া, বাংলা 

airport.jpg
পিছুটান

প্তকদের ফ্লাইট যখন বিশাখাপত্তনমের মাটি ছুঁলো তখন সন্ধ্যা সাতটা। এয়ারপোর্ট থেকে বেড়িয়ে গাড়ি নিয়ে পৌঁছে গেল হোটেল ডলফিনে। অনলাইন বুকিং করাই ছিল তাই খুব একটা ঝামেলা পোয়াতে হয়নি। রিসেপশনে সামান্য কাজ সেরে লাগেজ নিয়ে সোজা রুমে পৌঁছালো সপ্তক আর সম্প্রীতি।
বিয়ের অষ্টমঙ্গলা পার হতেই ওরা হানিমুনে চলে এসেছে ভাইজ্যাক। সম্বন্ধ করে বিয়ে, তাই নিজেদের বুঝে  নিতে হানিমুনে আসতে দেরি করেনি। জায়গাটা অবশ্য দুজনে একমত হয়ে ঠিক করা। একসাথে পাহাড় আর সমুদ্র দুটোকেই পাওয়ার যাবে। পাঁচটা দিন ওরা কীভাবে কাটাবে তার আগাম প্ল্যান প্রোগ্রাম করে রেখেছে। কাল সকাল থেকে শুরু হয়ে যাবে ওদের প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যাবার পালা।
দুদিন এদিক ওদিক ঘুরেছে, তাই আজ আর কোনদিকে নয় শুধু রামকৃষ্ণ বিচের মনোরম পরিবেশে সোনালী বালির উপর হেঁটে, দৌড়ে আর সমুদ্র দেখে কাটাবে ঠিক করলো। সূর্যোদয় দেখবে বলে একেবারে সকালেই বিচে চলে এসেছে। বালির ওপর দুজনে অনেকক্ষণ হাত ধরে হাঁটলো। সম্প্রীতি ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ে বললো,

— আর পারছি না। এবার কিছু খাবার নিয়ে এসো, আমি বসছি।

সপ্তক কথা মত খাবার আনতে গেল। সম্প্রীতি সেখানেই বসে সমুদ্রের ঢেউ দেখতে লাগলো। পিছন থেকে কেউ ডাকল, 

— বৌদি শুনছো? পিছন ফিরে তাকালো সম্প্রীতি। আবার প্রশ্ন, 

— হানিমুনে এসেছো বুঝি? সম্প্রীতি উত্তর দিল, 

— হ্যাঁ। আপনাকে মানে তোমাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না।।
— আমি দিয়া। সপ্তকদা আমাকে চেনে। সপ্তকদার নৈহাটীর পিসিমণির বাড়ির পাশেই আমার বাড়ি।
— কিন্তু আমায় কিভাবে চিনলে?
— পিসিমণির কাছে তোমাদের বিয়ের ছবি দেখে। আমরাও এসেছি। পিসিমণি কাছে শুনেছিলাম তোমরাও আসবে।
দিয়াকে দেখে বোঝা যাচ্ছে ওর নতুন বিয়ে হয়েছে। তাই সম্প্রীতি জানতে চাইলো, 

— বিয়ে কবে হলো?
— তোমাদের লগ্নেই।
— শ্বশুরবাড়ি?
— কল্যাণী।
— তাই, আমাদের ওখানেই!
— তোমরা কি এখন হোটেলে ফিরবে?
— একবার সাবমেরিন মিউজিয়ামে ঢোকার ইচ্ছে রয়েছে। তোমরা কোথায় উঠেছো?
— সোনার বাংলায়।
আরও কিছুটা সময় গল্প চললো, বিষয় — সপ্তক। সম্প্রীতি বুঝতে পারছে সপ্তককে খুব ভালো জানে দিয়া। বেশ ভেতর থেকে তার সপ্তকদার কথাগুলো বেড়িয়ে আসছে! একটু অস্বস্তিই লাগছে। হঠাৎ গল্প থামিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে দিয়া বললো, 

— না বৌদি, এখন আসছি। দেখি আমার কর্তাটি খাবার আনতে কোথায় গেলো। তোমরা আজ একবার আমাদের হোটেলে এসো, জমিয়ে গল্প করা যাবে। বলেই হাঁটা দিলো।
খাবার নিয়ে সপ্তক ফিরলো। দুজনে বালির উপর বসেই খেতে শুরু করলো। খেতে খেতে সম্প্রীতি বললো

— দিয়ার সাথে দেখা হলো। খাওয়া থামিয়ে সপ্তক বললো, 

— দিয়া বলতে?
— নৈহাটীর পিসিমণিদের পাশে বাড়ি।
— কী বলছো তা কী করে সম্ভব!

— ওরাও হানিমুনে এসেছে। সোনার বাংলাতে উঠেছে। একবার যেতে বলেছে আমাদের।

— কিন্তু...আর মুখে কিছু বললো না সপ্তক। কিন্তু মনের ভেতর যেন ভূমিকম্প শুরু হলো — দিয়া! কী করে সম্ভব! সে তো...! ফিরে গেলো পুরোনো দিনে। কলেজে তখন থার্ড ইয়ার। দিয়ার সাথে কৈশোরের বন্ধুত্ব তখন ভালোবাসায় মোড় নিয়েছে। এখন দুজন দুজনকে চোখে হারায়। একজন আর একজনকে ছাড়া কিছু ভাবতেই পারে না। হঠাৎ এলো দুঃসংবাদ। দিয়ার বাবা দিয়ার বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লেগেছে।

দিয়া সপ্তককে বলেছিলো,

— কিছু করো। সপ্তক বলেছিল,

— এ অবস্থায় সে কী বা করবে! দিয়াকে বলেছিলো বাবাকে বোঝাতে। অপেক্ষা করা ছাড়া কিছুই তো করার নেই। দিয়া জানতো বলে কোন লাভ হবে না, তাই সপ্তকের হাত ধরে পালাতে চেয়েছিল। সপ্তক সাহস দেখাতে পারে নি। তাই দিয়া চরম সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সপ্তক সব কষ্ট চেপে নিজেকে সব আনন্দ থেকে সরিয়ে নিয়েছিল। শেষে মায়ের জন্য সংসার জীবনে প্রবেশ। তাহলে সেই দিয়া... কী করে সম্ভব! হোটেলে ফিরে সম্প্রীতিকে সপ্তক বললো,

– একটা কথা বলছিলাম। সম্প্রীতি বলল্‌

— কী?

— আমি একবার বিকালে সোনার বাংলা হোটেলে যাবো।

— আমি বাদ! মুচকি হাসলো সম্প্রীতি।

— প্লিজ, আমাকে ফিরতে দাও তারপর সব বলবো। 

বিকালে সপ্তক হোটেল সোনার বাংলায় হাজির হলো। সবে রিসেপশন কাউন্টারের দিকে পা বাড়িয়েছে, কাউন্টার থেকে একটি ছেলে বললো,

— কী ব্যাপার স্যার ফিরে এলেন! এনি প্রবলেম? সপ্তক বলল,

— মানে! আমি তো এইমাত্র এলাম।

— আপনারা তো এইমাত্র হোটেল ছাড়লেন!

— আমরা মানে...?

— আপনি আর মিসেস দিয়া মুখার্জী।

— হ্যাঁ আমি ওই দিয়া মানে মিসেস দিয়া মুখার্জীর সাথেই দেখা করতে এসেছি। কিন্তু এ কী বলছেন! আমি?

— হ্যাঁ, আপনি

— মিঃ সপ্তক মুখার্জী। তাছাড়া আপনার আধার কার্ডও জমা করেছেন।

— কই দেখান তো একটু? নিজের আধার কার্ডের জেরক্স কপি দেখে চমকে ওঠে সপ্তক। আর কথা না বাড়িয়ে সরি বলে হোটেল থেকে বেড়িয়ে এলো। উদ্ভ্রান্তের মতো ফুটপাথ ধরে এগোতে লাগলো। ততক্ষণে সূর্য নিভে সন্ধ্যে হবো হবো। পিছন থেকে যেন আকাশ বাণী হলো।

—সপ্তকদা ভালো আছো? চমকে ওঠে সপ্তক

— কে!

— আমি দিয়া। এতোদিন তো আমি তোমার পাশে পাশেই থেকেছি। তুমি সুখী হয়েছো আমি খুব খুশি হয়েছি। তুমি মন দিয়ে সংসার করো। আর আমার কথা ভেবে মন খারাপ করো না।— কিন্তু আমি...

— ওটা তুমি না, ও আমার কামনা বাসনা ছিল। সব কিছুর যুক্তি খুঁজো না, পাবে না।

— একবার দেখা দেবে না আমায়?

— কষ্ট বাড়বে তোমার। পিছনে ফিরো না সামনে এগিয়ে যাও। আমায় তুমি বিদায় দাও।

— আর ডেকো না। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো সপ্তক, তারপর ধীর পায়ে এগিয়ে চললো হোটেল ডলফিনের দিকে।

গল্প

ওদের কথা

Comments

Top

ওদের কথা

রীনা নন্দী

বিপিন বিহারী গাঙ্গুলী স্ট্রীট, কলকাতা 

saint1.jpg

র্ম না কি নেশার মত। মানুষকে বুঁদ করে রাখে। মানুষে মানুষে হানাহানি বাড়িয়ে তোলে। এ’যুগে ধর্মের তেমন কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। – এমন কত মতই যে ওড়াউড়ি করে আধুনিক বাতাসে!

কিন্তু ধর্মের প্রকৃত অর্থ তো মনুষ্যত্বকে ধারণ করা – সেটাই তো ঠিক, না কি! শাস্ত্র তো মিথ্যা কথা বলে না। ভুঁইচাঁপাতলার রাধামাধব মন্দিরের সামনে বসা নেলিন বাবাজি ফুলের মালাগুলোয় জলের ঝাপটা দিতে দিতে এইসব ভাবে। নানারকম ভাবনা চিন্তা সারা দিনই তার মাথায় ঘোরে ফুল, মালা বিক্রি করতে করতে।

নেলিন বাবাজি মন্দিরের সামনে বসে সারাটা দিনভর পুজোর ফুল বেচলেও আসলে সে নাস্তিক এবং কম্যুনিষ্ট। তার বাপ গদাধরও ছিল তাই। নাস্তিক এবং কম্যুনিষ্ট। সে ছিল রীতিমত পার্টি সদস্য। গদাধর ছেলে হতে নাম রেখেছিল লেনিন। ইচ্ছেটা ছিল লেনিনের মত নামজাদা কম্যুনিষ্ট হবে তার ছেলে। নেতা হবে গর্ব করার মত!

তা গদাধরের সন্তান ভাগ্য আর অত উচ্চস্তরের হল না। ছেলে তার নেতা হওয়া তো দূরের ব্যাপার বাপ যে পার্টিতে ঢুকিয়ে দিয়েছিল সেই পার্টিতে নিজের সদস্য পদটুকুও বজায় রাখতে পারলো না। আর পারবে কী করে! সে মন্দিরের সামনে ফুল মালা বেচে। দোকানের বিক্রি বাড়াতে হরেক ঠাকুরের ছবি টাঙিয়ে মালা দেয়, ধূপ ধুনো দেয়। আর সেই নিয়েই পার্টি অফিসের বড় নেতার সঙ্গে কূটকচালি লেগে গেল একদিন। সে এঁড়ে বাছুরের মত তর্ক চালালো। পার্টির নেতাবাবুকে সে বলেছিল, ‘মন্দিরে আসা ভক্তজনের কাছে বিক্রিবাটা বাড়াতে আমাকে এসব করতেই হয় বাবু। আর এতে দোষেরই বা কি আছে বলুন! বাপ্‌ মা মরলেও তো তেনাদের ছবিতে মানুষ ধূপ ধুনো দেয়। এঁনারাও তো আমার কাছে সেই রকমই ; ভোলেবাবা, মাকালী, মালক্ষ্মী।’

তা পার্টির বড় নেতাবাবু এইসব ছোট মুখে বড়কথা মোটেই ভাল চোখে দেখলো না। ‘কী! জ্ঞান দিচ্ছে এই ব্যাটা ছুঁচোটা! এত সাহস! দাও ব্যাটাকে বেশ করে বাঁশ। ’তো শেষমেষ হল কি, নানারকম খুচরো দোষ চাপিয়ে নেলিনের পার্টি সদস্যপদটি কেড়ে নিলো ওরা। পার্টির অনেকেই ভাবলো – যাক্‌গে আপদ গেছে। আবার কয়েকজন মনে মনে আওড়ালো – লঘুপাপে গুরুদন্ড হয়ে গেল লোকটার। আর যাই হোক্‌ লোকটাতো সৎ ছিল!

 


এ’রকম দু’ধরনের চিন্তা ভাবনা সর্ব বিষয়েই লোকে মনে মনে পোষণ করে; তো সে নিয়ে তো আর বসে থাকলে চলে না। তাই এক্ষেত্রেও তেমনটিই হল। ব্যাপারটা ধামাচাপা পড়ে গেল অল্পদিনেই। শুধু গদাধরের ছেলের পিতৃদত্ত নামটা অর্থাৎ লেনিন লোকেদের জিভের প্যাঁচে পড়ে আর কিছুটা অবজ্ঞা উপেক্ষার হাওয়ায় ‘নেলিন বাবাজি ’হয়ে রয়ে গেল। রাধামাধব মন্দিরের সামনে বসে ফুল বেচে তাই নেলিনের পিছনে যুক্ত হয়েছে বাবাজি।

ঘটনাক্রমে এ’ভাবে স্তিমিত হতে হতেও আবার একটু বুড়বুড়ি কাটলো নেলিনদের পাড়ায়। আসলে যা হয় – ঘটনারও একটা ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। পার্টিগত ভাবে নেলিন অনাথ হওয়ায় উড়োখবর লোক মারফৎ এদিক সেদিক পৌঁছালো। অন্যসব বড় মেজ ছোট দল ভাবলো এইভাবে সাধারণ এক নিম্নবিত্ত মানুষকে দল থেকে তাড়ানোটা জনগণ ভালো চোখে দেখবে না নিশ্চয়। সুতরাং এই ব্যাপারটা নিয়ে কিছুটা গা ঘামানো উচিত। এতে তাদের পার্টির ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে জনগণের সামনে।

সুতরাং সবুজ পার্টির লোকজন এসে ধর্ণা দেয় নেলিন বাবাজির ফুল মালার দোকানের সামনে। সেই পার্টির মেজ নেতা বিক্রম দত্ত দেখা হলে বলে, ‘নেলিন বাবা তুমি যা করেছ ঠিক করেছো। একশো পার্সেন্ট ঠিক। রুজি রোজগার বলো আর ধর্মবিশ্বাসই বলো, সে সব তোমার পার্সোনাল ব্যাপার তাই নিয়ে পার্টির মাথাব্যথার দরকার কি! এসব তুমি আমাদের দলে পাবে না। তুমি নির্ভাবনায় আমাদের পার্টিতে এসো।’

নেলিন আর কি বলে। আমতা আমতা করে ঘাড় নাড়ে। বলে, ‘বিক্রমদা আমি গরিব মানুষ আমাকে তো আমার পেটটা চালাতে হবে। সুতরাং দোকানে ঠাকুর দেবতা রাখতে হবে, ধূপ ধুনোও দিতে হবে। গরিবের রুজি রোজগারের পরে তো আর সব। ’বিক্রম দত্ত সঙ্গে সঙ্গে বলে, ‘একদম ঠিক কথা, তুমি আমাদের দলে চলে এসো। তোমার খদ্দেরও বেড়ে যাবে। শুধু একটা ব্যাপার, একটু সমস্যা রয়েছে, তুমি তোমার বাপ মার দেওয়া লেনিন নামটা সরাও।’

বিক্রমদা আমার নাম আসলে লেনিন হলেও এখন তো সকলে ডাকে নেলিন বাবাজী বলে। নামে আর কী এসে যাবে বলুন।’

‘না ভাই নামে এসে যায়। নামটা বদলে চলে এসো।’

বিক্রমের সামনে নেলিন আর বিশেষ কিছু বলেনি। তবে মনে মনে গজ্‌গজ্‌ করে। ভাবে, বিক্রমদার যেমন কথা! বাপ মার দেওয়া নাম কি চাইলেই বদলানো যায়! ও যে পারে পারুক আমি পারবোনা বাবা। তাতে তোমাদের দলে আমাকে না নেবে তো আর কি হবে।


সুতরাং ওই দলেও আর যাওয়া হয় না তার। এমন ভাবেই আরো অনেকে অনেক কথা বলে। কেউ আবার তার নামের সঙ্গে তার ভগবান প্রীতিকে লড়িয়ে দিতে চায়। এরফলে একটা জিনিস হয়, সেটা হল নেলিন বাবাজী হাড়ে হাড়ে টের পায় তার বাপের দেওয়া নামের মাহাত্ম্য। আর লাল, সবুজ, গেরুয়া, কালো – সব দল থেকে দূরে থাকার শিক্ষাটাও তার হয়ে যায়।

তারপর থেকে সে নিজেকে ভাবে একজন স্বাধীন মনের আস্তিক কম্যুনিষ্ট! সাম্প্রতিককালে সে অবশ্য নাস্তিক, আস্তিক এসব কোনোকিছু নিয়েই তেমন ভাবে না। এমন চুপচাপ থাকার পর নেলিন বাবাজি ওর শুখনো মুখের দিকে তাকিয়ে আঁচ করে – হয়ত বেণুর খাওয়া হয়নি ; কিছু পয়সা চায়। সে বলে, ‘তো এই নেলিন সেদিন দেখে বেণু পাগলি তার দোকানের সামনে হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। জিজ্ঞাসা করে, ‘কী ব্যাপার বেণু, কিছু বলবি?’ 

বেণু এই নে পাঁচটা টাকা, দুটি ভাত ডাল খেয়ে আয়।’

বাবাজির থেকে হাত বাড়িয়ে টাকা নিয়ে বেণু স্টেশনের ধারের ভাতের হোটেলের দিকে হাঁটা দেয়। বাবাজির চোখে বেণুর নিরীহ, নম্র মুখ ভাসে। শরীরে জড়ানো ছেঁড়াখোঁড়া মলিন শাড়ি ভাসে। ধুলো ময়লার আস্তরণ পড়া যুবতী শরীর ভাসে। আর তারই সঙ্গে মাথায় ভাবনা ঘুরপাক খায়। বেণুটার মা বাপ নেই। মাথাটাও তেমন চলে না। অথচ শরীরে এখনও যৌবন ...... ! পেটে ভাততো চাই রোজ! মেয়েটার যে কী করে চলবে কে জানে! আর কেই বা ওকে দেখবে। একবার অন্যরকম একটা চিন্তা উঁকি দিয়ে যায় নেলিন বাবাজির মনে। কিন্তু তার নিজেরই তো চলে না! সুতরাং সে জোর করে চিন্তাটাকে সরিয়ে দিতে চেষ্টা করে মাথা থেকে। ভাবে, এই পৃথিবী নিজের মত ঠিকই চলে যায়। যার যেমন কপাল ঠিক তেমনভাবেই। সে আর ভেবে কি করবে।

আজকাল সে কপালটা খুব বেশি করে মানে। কখনও সখনও ভাবে, হয়ত মন্দিরের ভিতর যে বসে আছে সেই শেষ কথা!

এইভাবেই নেলিন বাবাজি আর বেণুর দিন কাটে; দিন কেটে যাচ্ছিলো কোনোক্রমে। কিন্তু জীবনেরও নিজস্ব কিছু চলন আছে। গাছের শিকড় যেমন মাটির ভিতর নিজের পথ খুঁজে নেয়, নদী যেমন আপন পথ করে নেয়, তেমনি মানুষের জীবনও বেঁচে থাকার একটা পথ ঠিক খুঁজে নেয়।


বেশ কিছুদিন গায়েব থাকার পর বেণুকে সেদিন আবার দেখলো নেলিন বাবাজি। একেবারে অন্য সাজে। স্টেশন বাজারে দেখা ওর সঙ্গে। তবে ছেঁড়াখোঁড়া শাড়ি পরে নয়। পরনে গেরুয়া শাড়ি। গলায় জড়ানো কন্ঠিসাজ – তুলসীর মালা, হাতে একটা কাঁসার ছোট্ট থালা তাতে চন্দনবাটা। বাজার শুরু হয়েছে যেখানে – সেই সাইকেল সারাইয়ের দোকানের ছেলেটার কপালে চন্দন পরিয়ে দিচ্ছে।

বেণুকে চেঁচিয়ে ডাকে বাবাজি। বলে ‘কী ব্যাপার রে? এতদিন কোথায় ছিলিস। ’কাছে সরে আসে বেণু। বলে, ‘এখানে ছিলাম না তো। বাজারের সব্জিউলি মাসির সঙ্গে ওর বাপের ঘরে গেছিলাম। সেই নদীয়া না কোথায় বলে না – সেই সেখানে। ওখানে একটা আস্‌সম আছে। সেখান থেকে এই হারটা আমায় দেছে।’

নেলিন বাবাজি ওর গলার দিকে তাকিয়ে দেখে তুলসীর মালা জড়ানো। – ওহ্, তাহলে কোনো বোষ্টমের আখড়ায় গেছিলো। বেণুটা বোষ্টম হয়ে গেলো না কি!

বেণুর কথায় ভাবনায় ছেদ পড়ে নেলিন বাবাজির। ও বলে, ‘একটা মানত করলাম গো বাবাজি। ওইখানে রাধামাধবের মন্দির আছে আস্‌সমে, সেইখানে। যতদিন না সেইটা হয় ততদিন এইযে দেখছো মাথার চুলটায় জটা হয়েছে ওইটা থাকবে। চুলটা আঁচড়াবোও না, কাটবোও না। ঠিক পাগলিদের মত থাকবো বুঝলে বাবাজি – হি হি হি। ’

– ‘তুইতো এমনিই পাগলিরে বেণু। জটা থাকলেও পাগলি না থাকলেও পাগলি। তা এই ভালো হয়েছে। মাথায় জটা, গলায় তুলসীর মালা, গেরুয়া শাড়ি, কপালে রসকলি! পুরো বোষ্টুমি!’

– ‘হ্যাঁগো নেলিন বাবাজি বোষ্টুমিই তো হয়ে গেছি। এই যে দেখো হাতে চন্দনের থালা। এই চন্দনের টিকা সক্কলের কপালে দিচ্ছি আর – “জয় রাধামাধব ওর ভালো কর” বলছি। আর হাত পাতছি সামনে। সকলে দু’চার পয়সা দিচ্ছে। আস্‌সমের বাবাজি এমনটা করতে বলেছে। একে না কি বলে মাধুকরি। এই পয়সা দিয়ে স্টেশন বাজারের হোটেল থেকে ভাত আর ডাল কিনে খেয়ে নেবো। ঐ লোকটা আর দু’টো খেতে চাইলে দূর্‌ দূর্‌ করে কুকুরের মত তাড়িয়ে দেবে না। তোমার থেকেও আর পয়সা চাইবো না গো বাবাজি।’


বেণু শেষ কথাটা বলে অদ্ভুত হাসে। বাবাজির ঐ হাসিটা দেখে বুকের ভিতর কেমন টনটনানি লাগে। আহারে মেয়েটার বড় কষ্ট ছিল। তার থেকে এই ভালো হয়েছে! দু’বেলা খেতে তো পাবে দু’চারটে পয়সা যোগাড় হলে। আর ...... সরাসরি ভিক্ষে তো করতে হচ্ছে না মেয়েটাকে। ধর্ম ওকে নিজের আড়ালে দুটো ভাত দিতে পারছে তো! হয়ত ধর্মভয় ওর যুবতী শরীরের উপর থেকে কুদৃষ্টিও কিছুটা দূরে রাখতে পারবে! আর কেউতো পারলো না কোথাও সেভাবে। যতই পাইক পেয়াদা লাগাও; দেখছে তো চারদিকে। অবশ্য ধর্মের পান্ডারাও অনেকসময় ......।

সে যাইহোক আজীবন কম্যুনিস্ট বলে নিজেকে প্রতিপন্ন করা নেলিন আপাতত ধর্মকে মনে মনে স্যালুট দেয়। ভাবে, যে মানতই করুক বেণু, বেশ লাগছে ওকে এই সাজে। লোকে বলতো আগে পাগলি বেণু এখন হয়তো বলবে বেণু বোষ্টুমি! ভালই হল একদিক থেকে।

এদিকে বেণু বাবাজির সামনে দাঁড়িয়ে আনমনে কিছু ভাবে আর ফিক্‌ ফিক্‌ করে হাসে। বলে, ‘মানতটা কিন্তু বলবো না বাবাজি। তুমি আমায় কাল থেকে দুটি করে কুঁচো ফুল দিও। মন্দিরে ঠাকুরের পায়ে ছুঁইয়ে রাধামাধবের প্রসাদি ফুল দেবো সক্কলকে।’

নেলিন বাবাজি অবাক হয়ে দেখে এক নতুন বেণুকে। কে বলবে মেয়েটা ক্ষাপাটে। তার বেশ লাগে ওকে। সে অনেকদিন পর সত্যিকারের খুশি হয়। খুব গভীর এক দর্শন তার মনের ভিতর আঁকিবুকি কাটে। ভাবে, ধর্ম আমাদের কী দেয় কেউ তেমন জানে না বটে কিন্তু বেণুকে একটা জীর্ণ জীবন থেকে খুব তুচ্ছ হলেও একটা স্বাভাবিক মানুষের জীবন দিতে পারে হয়ত। কম্যুনিস্ট নেলিন ভাবে লেনিন, মার্ক্সের মতো বড় বড় নেতারাও তো তাই-ই চাইতেন! মানুষ খেয়ে পরে বেঁচে থাকবে; শান্তিতে থাকবে। এই জন্যই পৃথিবীটাকে তার মাঝে মাঝে বেশ আশ্চর্য লাগে। কখন যে এখানে কি হয় তার কোনো ঠিক ঠিকানা নাই! এখন যেটা হয়েছে সেই ব্যবস্থাটা যে মন্দ হয়নি সেটা ঠিক। তবে বেণু পাগলিটা বোষ্টুমি হয়েও সেই পাগলিই রয়ে গেছে ! কী সব মানতের কথা বলে গেল। সঙ্গে আবার মিচ্‌কে হাসি হাসে। কী মানত সেটা আবার তাকে বলবে না। সত্যি! মেয়েমানুষগুলো ঢঙ্ জানে বটে!

Comments

Top

গল্প

বঙ্গ সংস্কৃতিতে

লৌকিক দেবদেবী

চূড়ামণি হাটি

সরসুনা, কলকাতা

Debdebi2.jpg
লৌকিক দেবদেবী
Debdebi3.jpg
Debdebi1.jpg

সংশয়াচ্ছন্ন নিরাপত্তাহীন সূচনা পর্বে মানুষের মন স্থিতি নিরাপত্তা খুঁজতে গিয়ে অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়েছে এবং নানা বিশ্বাসে বিশ্বাসীও হয়েছে। অলৌকিক জাদু বিশ্বাস কিংবা ভয় ও আবেগ থেকে বিশ্বাস। এই বিশ্বাসের উপর ভড় করেই লৌকিক রূপে অলৌকিক শক্তিকে ধরার চেষ্টা করেছে। কোনোটি ভয়ঙ্কর আর কোনোটি স্নিগ্ধ শান্ত। এই নানা রূপের দেব দেবীরা তাই অলৌকিক হয়েও লৌকিক। এ কল্পনা পৌরাণিক-তান্ত্রিক এবং বৈদিক যুগেরও আগের। নিরাকার থেকে আকার এবং বিবর্তনের সূত্র ধরে কোন কোন ক্ষেত্রে রূপ পরিবর্তন। লোকসমাজ  নানান লোকাচার-বিশ্বাস-সংস্কারের মধ্য দিয়ে নানা অনুভূতিকে আশ্রয় করে তাদের দেবদেবীদের বৈচিত্র্যে ভরিয়ে দিয়েছে। আবার কোথাও কোথাও ঠাকুরের থান আছে কিন্তু ঠাকুর নেই; মানতের উপকরণের ভীড়ে স্থানটি পূরণ হয়েছে। এ সকল দেবদেবীদের নিয়ে মুখে মুখে ছড়িয়ে গেছে নানা কাহিনী, সুর ও নৃত্য ভঙ্গী। পূজারীরা সাধারণত সমাজের যে কোন স্তরের মানুষ। অর্থাৎ সর্বত্র ব্রাহ্মণ নির্ভর নয়।

পশ্চিমবঙ্গের গ্রাম বাংলায় সাধারণত: পথের ধারে, পুকুর-নদী পাড়ে, মাটির চালা ঘরে, গাছের তলায় এক প্রকার অযত্নেই পরে থাকে লৌকিক দেবদেবীরা। গাছতলা হিসেবে বেছে নেওয়া হয় শাল, বেল, বট, অশ্বত্থ, মহুয়া, তেঁতুল, নিম, কাঁঠাল, সিজ-ফণীমনসার তলা। কাঠ, পাথর কিংবা মাটির ঢিবি এবং বৃক্ষও তেল-সিঁদুর নিয়ে দেবদেবী তুল্য হয়েছে। রোগ মুক্তি, ভূত-প্রেত সহ হিংস্র জীব জন্তু ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে মুক্তি কিংবা কৃষির পাশাপাশি পরিবারের ও গৃহপালিত পশুর মঙ্গল কামনার মতো বিষয়গুলি প্রার্থনার বিষয় হয়েছে। সামান্য উপকরণ নিয়েই পুঁজও দেওয়া, ব্রত-উপবাস, দন্ডিকাটা, বুকে মাটির ধুনুচি রেখে ধুনো পোড়ানো, বাণ ফোঁড়া, মাদুলি-তাবিজ ধারণ, পুরোহিতের দেওয়া ওষুধ খাওয়া; ঠিক এর পাশাপাশি পশুবলি দেওয়া, রেশম বস্ত্র বা গামছা দেওয়া; আর জ্যান্ত দেওয়া সম্ভব নয় বলে ছলনার আশ্রয় করে দেওয়া হয় হাতি-ঘোড়া রূপ ছলন। কিন্তু দেবদাসী দেওয়ার ইচ্ছা দেখায় নি। আসলে দেবদাসীরা লৌকিক সমাজের নৃত্যগীতে পটু সেবাদাসী। পরবর্তীকালে এরা উচ্চবর্গের শিকার। 

একই নামাঙ্কিত দেবদেবী যেমন নানা অঞ্চলে পূজিত; তেমনি এটাও লক্ষ্যণীয় নির্দিষ্ট কোনো নামে পূজিত হচ্ছেন কোনো গ্রাম্য দেবতা। এই সকল লৌকিক দেবদেবীদের জেলাভিত্তিক একটা অস্পষ্ট ভাগ করা যেতে পারে। চব্বিশ পরগণা জুড়ে মাকাল, আটেশ্বর, মুণ্ডহীন জরাসুর, ভাত রান্নার হাঁড়ির পেছনে গোবরের দলা বসিয়ে মুখ আর কড়ির চোখ নিয়ে ঘেঁটু দেবতা। নারায়ণী ও দণ্ডবক্ষ মুনি পুত্র বাঘের হাত থেকে রক্ষাকারী দেবতা দক্ষিণ রায়। মানুষ ধরে দক্ষিণ রায় খেতেন বলে সম্রাট মুকুট সমেত বারাঘট হয়তো উৎসর্গীকৃত ছলন হয়েই দেবতার পুঁজও লাভ করছে। দক্ষিণ রায় প্রসঙ্গে উঠে আসে যুদ্ধ জয়ী গাজীর কথা। দুখে কাঠুরিয়ার কোলে বনবিবি ও তার ভাই শা-জঙ্গলি। ঠিক যেমন, কথায় বলে বাচ্চাকে পেঁচোয়

পেয়েছে; তাহলে পেঁচো অর্থে ভূত; কিন্তু অপদেবতা রূপ নিলো পেঁচো ঠাকুর হয়ে। রঙ কালো এবং দাঁতগুলো মুখের বাইরে। শিবের অনুকরণে পঞ্চানন্দ। কুমীরের থেকে রক্ষা পেতে কালু রায় ঘোড়ার পিঠে নবাব মূর্তির পীর বা গাজী। মেদিনীপুরের জয়চন্ডী, বীরঝাপটা, কানু রায়, মাচাইসিনী, বরাম, গরাম, সরগ, হিঙ্গলেস্বরী, স্বাস্থ্যবান যোদ্ধা ভীম। হুগলীর দ্বারিকাচন্ডীর পুঁজও হয় ঘট ও ঘটের উপর ডাব রেখে, বিশালাক্ষী দেখতে কালির মতো কিন্তু জিভ মুখের ভেতর। হাঁড়ি সম্প্রদায়ের দ্বারা পূজিত হন পতি দুর্গা। হাওড়া জেলায় সপ্তমাতৃকা, ক্ষেত্রপাল, বসন্ত রায়, বাঁকা রায়। পুরুলিয়ায় রায়বাঘিনী, বসন্তকুমারী, জাহির বুড়ি, চাকরাসিনি, গারোয়া, বাঘমুর্তিতে বাঘুত। বর্ধমান ও বাঁকুড়া জেলায় ঝগড়াতঞ্জরী, মহাদানা, পাথরখণ্ড বা মুণ্ড মূর্তির বা ভয়ঙ্করী নারী মূর্তিতে রঙ্কিণী। কচ্ছপ আকৃতির বা গোলাকার কালো পাথরের ধর্মরাজের নানা নাম কিন্তু অন্তিম শব্দ রায়। অবশ্য শূন্য পুরাণে উপাস্য দেবতা ধর্ম ঠাকুর। বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মস্থানের ক্ষয় প্রাপ্ত টুকরো খণ্ড সাধারণ মানুষের হাত ধরে ধর্মঠাকুর  জ্ঞানেই পূজিত হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে পুজো ব্রাহ্মণরা করলেও সেবা করেন অব্রাহ্মণরাই। চন্ডীও নানা নামে পরিচিত। মনসার পুঁজও হতো ঘটে। পরের দিকে কিছু কুমোর সাপ ও নারী মুখ দিলেন এঁকে। পাশাপাশি গুরুত্ব পেলো মাটির খোলার চারিদিকে আটটি ফণা যুক্ত নারী মূর্তি। স্তম্ভের উপর অর্ধবৃত্তাকারে বহু ফণা যুক্ত মনসার চালি। এক ফণার সর্প মূর্তি বা স্বপনরই। আদিতে শীতলার রূপ ছিল বসন্তের চিহ্ন দেওয়া  মাটির ঢেলা, কাঠ বা পাথর। পরবর্তীকালে গাধার পিঠে কুৎসিতের বদলে সুন্দরী দেবী মূর্তি। চালের গুঁড়ির কিংবা মাটির তৈরি  সন্তান কোলে কাঁঠাল বৃক্ষতলে ষষ্টী জননী। গল্প কথায় আকৃতি থাকলেও বাস্তবে আকৃতিহীন গরম ঠাকুর। বাম হাত বুকের কাছে মুষ্টিবদ্ধ আর ডান হাতে অসি নিয়ে লাল পাথরের খাঁদুরানী। কালো পাথর এবং পাশে এক জোড়া খড়ম ও ত্রিশূল নিয়ে সন্ন্যাসী। বাঘ বা কলসির উপর চাপানো মুণ্ড মূর্তিতে কিংবা কুকুরের পিঠে গদা ধরে পুরুষ মূর্তিতে ভৈরব। যদিও হাতির পিঠে থাকাটাই স্বাভাবিক। একটি বা তিনটি ঢিবি নিয়ে ঘঘর বুড়ি। পিতল বা তামার ঘটে স্থাপিত গোলাকৃতি শিলাই হলো সোনামণি। হাঁ-মুখো বিশালাক্ষী। বীরভূমে বাবা কুদড়ো বুড়ো, শিলাখণ্ডে সাত ভাই ও সাত বোন, শিলাখণ্ডে অস্পষ্ট নারী মূর্তিতে বাসনী আর কাটা হাত হলো সুভিক্ষা ঠাকুরের প্রতীক। নদীয়ার যশোদায়িনী, বদর, কাঁচা ঘট, বুড়ো শিবের মুণ্ড মূর্তি। মুর্শিদাবাদের মেলেনি মাসী, জীয়ৎ কুণ্ডেশ্বরী, ডোমনি। মালদার সোনা রায়, বুলবুলচণ্ডী, মাটির ঢিবির উপর চামুণ্ডার মুখ আঁকা মুখোশে দেবী জহরাকালী। দিনাজপুরে মহারাজ। কোচবিহারের ডাংধরা, মশান ঠাকুর, বিশালাকার শিব মূর্তির মহাকাল। জলপাইগুড়ির তিস্তাবুড়ি, জুরাবন্ধ, মান্থনি, কালীমনসা, সোলার মনসা করন্ডী। অনাবৃষ্টি হলে মেয়েরা রাতে লোকালয় থেকে দূরে উলঙ্গ অবস্থায় বৃষ্টির দেবতা হুদুমদেওয়র পুঁজও কর; পুরুষ প্রবেশ নিষিদ্ধ। দার্জিলিং - এ ঠাকুরানী, ভীমসেন, জকা, দারুবুদ্ধ। 

ব্রতের দেবদেবীদের সন্তুষ্ট করে লৌকিক সমাজে কামনা বাসনার ইচ্ছাটিও রয়েছে। কিন্তু এ দেবদেবীরা ঘরোয়া হয়ে যেন ঘরেরই কেউ। এছাড়া আছে গোয়াল, মাঠ, ঢেঁকিশাল ও ধানের মড়াই পুঁজও। যেখানে পুরুষরাও মেয়েলি মানসিকতার সঙ্গে সঙ্গ দিয়েছে। একই ভাবে লোকধর্ম প্রসঙ্গটিও এসে যায়। অষ্টাদশ শতকের গোড়ায় উপযুক্ত কারোর নেতৃত্বে শাস্ত্রীয় ধর্মমতের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে লোক সমাজের মতকে গুরুত্ব দিতেই সৃষ্টি হয়েছিল মতুয়া, বলাহাড়ি, সাহেবধনী, কর্তাভজা, বলরামী, খুশী বিশ্বাসী, লালনশাহীর মতো ছোটো ছোটো লোকধর্মগুলি। কিন্তু এ মুহূর্তে এ ধর্মগুলি খুব জনপ্রিয় না হলেও কড়া অনুশাসন ও আচরনবিধির জাল বিস্তার করতে করতে সৃষ্টি রহস্যের সহজ সরল রূপটি হারিয়ে গেছে। বরঞ্চ লৌকিক দেব দেবীর পূজার্চনা-ব্রত উৎসব অনেক বেশী মুক্ত আনন্দের পরিচয় দেয়।

Comments

Top

গল্প

বধির
SanojCharaborty.jpg

বধির 

সনোজ চক্রবর্তী 
পুঃ মেদিনীপুর, পঃ বাংলা 

oldman1.jpg

এক                        
                                                        

"বাবা, বাজার দর যেভাবে বাড়ছে এবার কিন্তু পেনশনের টাকাটা একটু বাড়াতে হবে।"
রঞ্জন অফিস বের হচ্ছিল, বিশ্বম্ভরের দরজায় দাঁড়িয়ে আর্জিটা পেড়েই ফেলল সে। কদিন ধরেই স্ত্রী মিতালি জেদাজেদি করছিল কথাটা বলার জন্য।
বিশ্বম্ভর এক বাটি মুড়ি জলে ভিজিয়ে খাচ্ছিলেন। তাঁর অধিকাংশ দাঁতই গেছে তাই শক্ত কিছু খেতে পারেন না।
মুখের মুড়িটা শেষ করে তিনি বললেন টেনশন বাড়াতে যাবে কেন! আমি টেনশন করি না, দেখো আমি ঠিক একশ পার করে দেবো। রঞ্জু তোমরা আমাকে নিয়ে অতো উদগ্রীব হয়ো না, যাও, সাবধানে যাও তোমার আবার অফিসের দেরি না হয়ে যায়।"
এই হয়েছে এক মুশকিল বিশ্বম্ভর কি শুনতে যে কি শোনেন তার তল পাওয়া ভার। রঞ্জন বাবার কাছে গিয়ে পেনশনের ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলবে ভাবছিল, অফিসের কথা মনে করিয়ে দিতে সে হাত উল্টে ঘড়ি দেখল।
"না এবার সত্যিই বেরিয়ে পড়তে হয়।  অফিস ফেরৎ রাতের দিকে বাবাকে নিয়ে আর একবার চেষ্টা করা যাবে।" -- এটা ভেবেই  ঘর থেকে বেরিয়ে প্রণামের মুদ্রায় কপালে আঙুল ছুঁইয়ে হাঁটার গতি বাড়াল রঞ্জন।  জানালা দিয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন বিশ্বম্ভর যতক্ষণ সে নজরের বাইরে না যায়।
মনে মনে বললেন -- "দুগ্গা... দুগ্গা।"

 

দুই
                                                      
বিশ্বম্ভর রিটায়ার্ড করেছেন তা প্রায় বছর পঁনেরো। পেনশন কমিউটেশন আর গ্র্যাচুইটির টাকায় বাউড়িয়ায় ছোট্ট একটা বাড়ি হয়েছে বিশ্বম্ভরদের। কর্মজীবনে স্থিতু হওয়ার সুযোগ ছিল না। রেল কোয়ার্টারে আজ পাটনা তো কাল ভুবনেশ্বর।
ছন্নছাড়া জীবনের জন্য রঞ্জনের এডুকেশনটাও যুতসই হল না। রিটায়ার্ডম্যান্টের আগে আগে বাউড়িয়ার একটা চট কলে রঞ্জনের একটা বন্দোবস্ত হয়েছিল। মাইনে সামান্য তাতে কি! ঘরে থেকে, খেয়ে অফিস করার মজা আছে। বরাবরই সে মজা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন বিশ্বম্ভর।
বিশ্বম্ভরের খাটো শোনার সমস্যাটা শুরু হয়েছে রিটায়ার্ডম্যান্টের পর থেকেই। ক্রমশ শোনার ক্ষমতা কমছে তাঁর। বেশ উঁচিয়ে বল্লে তবেই শুনতে পান এখন, এমন হয় কখনও কখনও অনেক চেঁচামেচিতে সাড়া মেলে না।
রেলের গার্ড ছিলেন বিশ্বম্ভর, হতে পারে জীবনভোর ট্রেনের তীব্র হর্ণের কারণেই একটু একটু করে কম জোরী শব্দগুলো অনুভূতির বাইরে চলে গিয়েছে তাঁর।
শব্দ ছাড়া মানুষের যে কি কষ্ট আবার শব্দই যে কি যন্ত্রণাময় তা এক জীবনে বিশ্বম্ভরের থেকে এতো ভাল কেউ উপলব্ধি করতে পারেন নি। কত কিছুই শুনতে পান না তিনি আজকাল! ঠোঁট নাড়া দেখে বুঝে নিতে চেষ্টা করেন। ছেলে বৌমা বিরক্ত বোধ করে, অশান্তি হয়। কম শুনলেও বিশ্বম্ভর ঠিক বুঝে যান কোনটা রাগের কথা কোনটা মজার আবার কোনটা বিদ্রুপ।
মাঝে মাঝে তাঁর মনে হয় দিনের পর দিন তিনি যেন এক নিঃশব্দের বাসিন্দা হয়ে যাচ্ছেন।

তিন

                         

"তুমি কি কোথাও বের হচ্ছ বৌমা?" আমতা আমতা করে প্রশ্ন করেন বিশ্বম্ভর।

- হ্যাঁ, না, মানে!

- হয়েছে কি বৌমা, কুমড়ো ফুল এনেছিলাম বাজার থেকে, ব্যাসন, কাঁচা লঙ্কা আর একটু পেয়াজ দিয়ে ভেজে দিও?"

- "বাঃ এক মাথা রোদ নিয়ে বাজার ঘুরে এলেন? অথচ সংসারের টুকিটাকি আনতে সাধাসাধির শেষ থাকে না! তার উপর একই কথা দুবার নয়, চারবার বলো, নয়তো চেঁচিয়ে বলো। তাতেও রক্ষা কই! বলবো সোয়াবিন উনি নিয়ে হাজির তারপিন!"

গলা নামিয়ে বললেও মিতালির চাপা রাগ গোপন থাকে না।

- আমাকে কিছু বল্লে বৌমা?

- না, মানে বলছিলাম, আপনার বয়স হচ্ছে বাবা, এ বয়সে এতো তেল পিয়াজ.….

- না বৌমা, অতবড় মিথ্যা তোমার শত্রুও বলতে পারবে না। তুমি আমায় মস্ত তোয়াজেই রেখেছ বৌমা। না হলে এই  বয়সে এসে যা সব শুনি... আমার মতো বুড়োরা আজ আর কেউ ভাল নেই বৌমা!

- থাকবে কি করে! ভিমরতির কি শেষ আছে আপনাদের?

- বাসমতি? বাঃ, বৌমা বাঃ বাসমতি চালের খিচুড়ির সঙ্গে কুমড়ো ফুলের বড়া, দারুণ জমে যাবে কিন্তু।

- খিচুড়ি? আবদার আর কি?

- ঘি? মরা পেটে, সেকি সহ্য হবে বৌমা?

- উফফ আর সহ্য হয় না, এ সংসারে আর কিছু দিন থাকলে পাগল হয়ে যাব আমি।

রাগে ফোঁসফোঁস করতে থাকে মিতালি। বিশ্বম্ভরের মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে তিনি বুঝতে পেরেছেন কিছু একটা বেফাঁস বলে ফেলেছেন তিনি। পরিস্থিতি আয়ত্বে আনতে মিহি সুরে বলেন-

- কোথায় যাচ্ছ, সেটা তো বল্লে না বৌমা?

- পার্লার।

- জানলার পর্দা কিনতে? আমার জানালার জন্য একটা নিও বৌমা। রাগে মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। পার্লার কথাটা চেঁচিয়ে বলতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিল মিতালি। কথাটা ওনাকে বোঝাতে গিয়ে পাঁচ কান করে কি লাভ! "জাহান্নামে!" দাঁত দাঁত কথাটা বলে বাড়ি থেকে হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল মিতালি। জানালা দিয়ে বৌমার দিকে অপরাধী চোখে তাকিয়ে রইলেন বিশ্বম্ভর। অস্ফুটে  বললেন "দুগ্গা... দুগ্গা... ওখানে যদি নিজের থেকে যাওয়া যেত, তোমার আগে আমিই চলে যেতেম বৌমা!"

চার
                             
- কতদিন পর কুমড়ো ফুল খাচ্ছি! আর একটা হবে মিতালি?
- কোলেস্টেরল লেভেল বেড়েছে, একটু তো রেস্ট্রিকশন মেনে চল, বাপের মতো অতো লোভ ভাল নয়।
- জান মিতালি মা ভাজত, উফ গরম গরম কুমড়ো ফুলের বড়া, আজও মুখে লেগে আছে!
রঞ্জনের গলা উদাসী। ডান হাত থেমে গেছে একটু হলেও  নস্টালজিক হয়ে পড়ে সে।
- সে কি আমি পারি! তোমার মায়ের হাতে জাদু ছিল! ঝাঁঝিয়ে উঠে মিতালি।
- সবটাই এতো গায়ে পেতে নাও কেন বুঝি না!
- বুঝবে কি করে, বাড়িতে থাক কত সময়? কত করে বললাম বাবাকে একটা ডাক্তার দেখাও।
- দেখাও বললেই কি হয়, টাকা পয়সারও তো একটা ব্যাপার নাকি?
- তা আমার কথা ধরতাই দিচ্ছ কি! পেনশনের কথাটা বলেছিলে বাবাকে?
- হু, বলেছিলাম বুঝতে পারেন নি।
- আবার বলো, বুঝিয়ে বলো। দেখো রঞ্জন পেনশনের আর একটু বাড়তি টাকা চাই  আমাদের। ডাক্তার দেখানো, ঔষধ পত্তর, তার উপর যদি হিয়ারিং এড- এর কথা বলে
- সবটাই বুঝছি, কিন্তু দিলে তো।
- দেবে না বললেই হল! একটা মানুষ সংসার এর কুটিটি না নেড়ে পায়ের উপর পা তুলে খাচ্ছেন তার উপর অতো গুলো ডাক্তারি খরচ!
- দেখি কাল ডাক্তারের কাছে যাওয়ার আগে বলব একবার, না হলে ফিরে ঔষধ পত্তর দেখিয়ে কিছু বের করার চেষ্টা করতে হবে।
- সে তুমি যা ভাল বোঝ তাই কর, মদ্দা কথা এমন কালা মানুষকে নিয়ে আমি আর পারছি না।

- আর একটা বড়া হবে? প্রসঙ্গ ঘোরাতে, মিতালিকে সকাতর বলে রঞ্জন।
- দুটো কুমড়ো বড়া খেয়েছ, এটাই কিন্তু শেষ। কুমড়ো বড়ায় কামড় দিয়ে, বাঁ হাতে মিতালিকে নিজের কাছে টেনে নেয় রঞ্জন। আদর মিশিয়ে বলে,

- এতো শুধু জাদু নয়, নিখুঁত ইন্দ্রজাল।

পাঁচ
 

মাথার উপর চারটে ফ্যান থাকলেও সচল আড়াইটি।  দুটো ঠিকঠাক চললেও তৃতীয়টি ঘুরছে প্রবল অনিচ্ছায়। দক্ষিণের সবকটা জানালা বন্ধ থাকায় ফ্যান চললেও গুমোট গরম। ডাক্তারবাবু সকাল বিকেল ত্রিশ, ত্রিশ ষাট জন পেশেন্ট দেখেন। কুড়ি জন পেশেন্টের ওয়েটিং-এর জন্য স্পেসটা ইনসাফিশিয়েন্ট। এ ধরনের পেশেন্ট সাধারণত একা আসতে পারেন না। পেশেন্ট আর কম্পিনিয়ন মিলিয়ে প্রায় জনা চল্লিশের জন্য জায়গাটা নিতান্তই কম।' বিশ্বম্ভর সেন' ডাক পড়তে স্বস্তি পেল রঞ্জন।  এসির ঠান্ডা আর বেশ মিষ্টি একটা গন্ধ ভরে আছে রুমটায়। ডাক্তারবাবুর মুখোমুখি দুটি চেয়ার, গুছিয়ে বসল বাবা-ছেলে।
ডাক্তার গুপ্তের বয়স হলেও শরীর এখনও টানটান। চেয়ারটাকে টেবিলের দিকে এগিয়ে নিয়ে এসে পেন তুলে নেন ডাক্তার গুপ্ত।
- পেশেন্টে কে?
 

- আমার বাবা। বিশ্বম্ভরের দিকে আঙুল দেখায় রঞ্জন। ইশারায় পেশেন্টকে নিজের পাশে ডেকে নেন ডাক্তার গুপ্ত। 

- বাবার নাম?
- "কার বাবা?" রঞ্জন বোকা বোকা মুখে জানতে চায়।
- কার আবার, আপনার।
- বিশ্বম্ভর সেন।
- বয়স?
- বয়স, বাবা এখন সাতাত্তর।
- কি করতেন?আই মিন পেশা?
- বাবা রেলে কাজ করতেন, এখন বাড়িতে।
ডাক্তারবাবু বিশ্বম্ভরের মাথাটা নিজের দিকে নিয়ে কানটা টেনে ভেতরে ছোট্ট টর্চের আলো ফেলে দেখতে থাকলেন।
- তা আপনার কত দিনের সমস্যা?
- পূর্ব জন্মের তপস্যা ডাক্তার বাবু, না হলে
এমন ছেলে বৌমা কেউ পায়!
ডাক্তারবাবু নিজেই নিজের নিচের ঠোঁটে কামড়ে ধরেন। চোখ দুটো ছোট হয়ে আসে।  বোঝাই যাচ্ছে স্থির হয়ে একটা কিছু মেলানোর চেষ্টা করছেন।
রঞ্জন বাবার কাছে সরে গিয়ে একটু গলা চড়িয়ে বলে -
- তপস্যা নয় বাবা ডাক্তারবাবু সমস্যার কথা বলছেন।
বিশ্বম্ভর উত্তর হীন তাকিয়ে থাকেন ছেলের দিকে।
"এ ধরনের পেশন্টরা অনেক সময় জোরে বললেও শুনতে পান না। দেখতে পাচ্ছেন না কি রকম ব্ল্যাঙ্ক তাকিয়ে আছেন আপনার দিকে।" কথাটা শেষ করে ডাক্তারবাবু সমস্যা কথাটা অনেকটা সময় নিয়ে বললেন। বললেন, মানে ঠিক বললেন না। শব্দ না করে ঠোঁটের এক্সপ্রেশনে বললেন। এবং অদ্ভুৎ বিষয় এবার কিন্তু ঠিকঠাক বুঝে গেলেন বিশ্বম্ভর।
"রিটায়ার্ডম্যান্টের পর থেকেই আমি কম শুনতে থাকি।"
"দেখুন মিস্টার, কি যেন নাম আপনার?"
ডাক্তারবাবুর কথা শেষ হওয়ার আগেই রঞ্জন হাসি হাসি মুখে বলে--
- আমি - রঞ্জন সেন।

- দেখুন রঞ্জনবাবু বেশি শব্দের জায়গায় দীর্ঘ দিন কাজ করার ফলে এধরনের বধিরতা আসতে পারে আবার ভাইরাস ইনফেকশন সহ আরো নানান কারন থাকতে পারে। সেগুলো পরীক্ষা না করে বলা সম্ভব নয় তবে আমার প্রেডিকশন প্রথম কারণটা, সেখান থেকেই সম্ভবত এই হিয়ারিং লস।
ডাক্তারবাবু অটোস্কোপ যন্ত্র দিয়ে বিশ্বম্ভরকে ভালো করে দেখেন। পরীক্ষা করার পর একটা কাগজ আর পেন দেন ওনার হাতে। তাতে এক, দুই, তিন এভাবে কতকগুলো প্রশ্ন লেখা

- সমস্যা কি দু'কানেই? 
- কান খোটার অভ্যাস আছে কিনা?
- কানে কোন দিন আঘাত পেয়েছেন কি?
- কান চুলকোয়?
কানের ময়লা গন্ধ কিনা? - এইসব প্রশ্ন আরকি।
সম্ভবত শুনতে পাবেন না ধরে নিয়ে লিখে জানানোর ব্যবস্থা।
বিশ্বম্ভর কাগজটা নিজের কোলের উপর রেখে লিখতে শুরু করেন।
এরমধ্যে ডাক্তারবাবুর ফোন ব্যস্ত হয়ে যান। খরচপাতি কোন জায়গায় দাঁড়াবে সেসব নিয়ে উৎকন্ঠা বাড়তে থাকে রঞ্জনের।
লেখা শেষে কাগজটা কাঁপাকাঁপা হাতে ডাক্তারবাবুর দিকে বাড়িয়ে দেন বিশ্বম্ভর।
ডাক্তারবাবু অবাক হয়ে তাকান বিশ্বম্ভরের দিকে।
পুরো কাগজটাই ফাঁকা, একটা প্রশ্নেরও উত্তর নেই সেখানে। একেবারে উপরে বড়বড় করে
লেখা -  'একান্তে কথা বলতে চাই।'
লোকটাকে তো মেন্টালি ঠিকঠাকই মনে হয়।
তবে কি বলতে চান ভদ্রলোক!
ডাক্তার গুপ্ত ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না - ভদ্রলোক ছেলেকে আড়াল করতে চাইছেন কেন! তবে কি ভদ্রলোক ছেলেকে বিব্রত করতে চাইছেন না। চাইছেন না এ বয়সে এসে  ছেলের টাকা পয়সা খরচ করতে।
কি আশ্চর্য, কেবল সন্তানের সুখের জন্য পিতা শব্দময় জগৎকেও উপেক্ষা করতে পারেন!
স্বেচ্ছায় মেনে নিতে পারেন শব্দ-শৈথিল্য!
ডাক্তারবাবু একবার ভাবেন ওনার ছেলেকে একটু বাইরে যেতে বলবেন। তারপর মনে হয় সেটা ঠিক হবে না যদি কোনো সন্দেহ হয়।
শেষমেশ পরীক্ষার বাহানায় নিজেই বিশ্বম্ভরকে নিয়ে চলে যান পাশের কামরায়।

 

ছয়
                          
দু'চোখ ভর্তি জল নিয়ে ডাক্তারবাবুর হাত দুটো ধরে ফেলেন বিশ্বম্ভর। ঘটনার আকস্মিকতায় কি করবেন বুঝে উঠতে পারেন না ডাক্তার গুপ্ত। স্বান্তনা দেওয়ার মতো করে বলেন -
-- দেখুন মিস্টার সেন এটা বয়সের একটা সমস্যা। এটা যে কারো জীবনেই আসতে পারে। হয়তো আপনি চাইছেন না ছেলেকে বিব্রত করতে, চাইছেন না ওদের খরচ হোক  কিন্তু পরে পরে সমস্যাটা যখন আরো বড় হবে তখন আপনার পরিবারের কি হবে ভেবে দেখেছেন?
- আমি সব ঠিকঠাক শুনতে পাই ডাক্তারবাবু।
নিজের চমকে যাওয়াটা লুকাতে পারেন না ডাক্তার গুপ্ত। বিশ্বম্ভরের মুঠো থেকে নিজের হাতটা সরিয়ে নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করেন -
- তবে এখানে এসেছেন কেন?
- আমি তো আসতে চাই নি, ছেলে নিয়ে এসেছে। চিকিৎসার নামে আমার পেনশনের  আরো কিছু টাকা নেবে বলে।
- মানে?
- অবসরের পর থেকে ছেলে চাপ দিতে থাকে টাকার জন্য, ঘরে বসে, টিভি দেখে, কাগজ
পড়ে সময় কাটে বৌমার সহ্য হয় না। দিনে দিনে হায়-হুকুম বাড়তে থাকে। মুখে যা আসে তাই শোনাতে শুরু করে। গ্র্যাচুইটির টাকায় বানানো বাড়িটা ওদের নামে লিখে দিতে চাপাচাপি শুরু হয়। আমি অবশ্য চেয়ে ছিলাম বাড়িটা পেয়ে যদি ওরা খুশি হয় না হয় লিখেই দেবো। আমার অবর্তমানে তো ওরাই পাবে। মানসিক টানা পোড়েন সহ্য না করতে পেরে নিরুপায় হয়ে আমার এক  কলিগ 'সৌমিত্র'কে সবটা খুলে বলি।  সে আমাকে বলে - "লোভের কোনো শেষ নেই। তাই এখন থেকে এভাবে সবটা আলগা করে দিলে পরে বিপদে পড়তে পারি।" ওই  আমাকে কানে কম শোনার পরামর্শটা দেয়। ও বলে - "অন্ধ, বোবা, কালা এদের কাছে কারো কিছু এক্সপেকটেশন থাকে না। তুই বরং বধির হয়ে যা। সব শুনেও
না শোনার ভান করবি। প্রথম প্রথম তোর ছেলে বৌমা একটু রাগ দেখাবে, দেখবি পরে  পরে বিরক্ত হয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছে।"
সেই থেকেই...
বিশ্বম্ভরের পিঠে হাত রাখেন ডাক্তার গুপ্ত।
বিশ্বম্ভর অনুভব করেন ডাক্তারবাবু নয়, যেন পিঠে হাত রেখেছে 'সৌমিত্র'।

সাত
                          
কাগজে খসখস করে কতকগুলো ঔষধ লিখে দিলেন ডাক্তার গুপ্ত। চশমা মুছতে মুছতে রঞ্জনের দিকে তাকিয়ে বললেন -
"বয়স হয়েছে, এই বয়সে একটা কিছু স্থায়ী সমাধান চটজলদি হয় না। বরং ব্যাপারটা লং প্রসেস, কতকগুলো ঔষধ লিখে দিলাম, বেশি খরচ নয়, মাস ছয়েক কন্টিনিউ করুন। একটু যত্ন নিন, একটু ভালবাসা, তারপর যদি না হয় ছ'মাস পরে আসুন আর একবার।
ডাক্তারবাবুকে নমস্কার জানিয়ে উঠে পড়ে রঞ্জন।

আট
                            
ঔষধ খাওয়ার আগে প্রেসক্রিপশন থেকে নাম্বার নিয়ে সুযোগ খুঁজে ডাক্তার গুপ্তকে ফোন ধরেন বিশ্বম্ভর -
- ডাক্তার বাবু আমি বিশ্বম্ভর সেন আজ সকালে গিয়েছিলাম আপনার চেম্বারে।
ওপ্রান্ত থেকে ডাক্তার গুপ্ত বলেন -
- খুব বুঝেছি, কেমন আছেন?
- ভাল, কিন্তু ডাক্তারবাবু আমি তো শুনতে পাই, তা ঐ ঔষধগুলো কি খাব?
ডাক্তার গুপ্ত হাঃ হাঃ করে হেসে উঠেন।
-কেন খাবেন না মশাই,  সবকটাই খাবেন। মশাই ওগুলো সবই ভিটামিন।
- আর ঐ কানের ড্রপটা?
- ওটা কানের ময়লা পরিস্কার করে। কিছু মনে করবেন না মিস্টার মিত্র মনের ময়লা পরিস্কারের কোনো ঔষধ থাকলে আপনার ছেলে বৌমার জন্য প্রেশক্রাইব করতাম।
ফোনের এপ্রান্তে তখন অদ্ভুৎ নিঃশব্দতা।
সেই নিঃশব্দতায় রাগ, অভিমান, ভালোবাসা, প্রত্যাশা, হতাশা মিলে মিশে একাকার।
নৈশব্দও যে কত বাঙ্ময় হয় তা ফোন কানে ভালো মতই টের পাচ্ছিলেন ডাক্তার গুপ্ত।

Comments

Top

গল্প

SanojCharaborty.jpg

অপবাদ 

সনোজ চক্রবর্তী 
পুঃ মেদিনীপুর, পঃ বাংলা 

cremation.jfif
অপবাদ

রীরে ঘি মাখাতে গিয়ে শিউরে উঠল অতীন্দ্রর স্ত্রী।
সংসারে লাবন্যই ছিল অতসীর বড় আশ্রয়। ঘি-এর শিশিতে আঙুল ভরে চুপটি করে বসে রইল লাবন্য। তার দু'চোখ ঝাপসা হয়ে এলো ক্রমে। চোখে দেখা যায় না! শরীরটা বস্তা সেলাইয়ের মতো সেলাই করা! দয়া মায়া হীন হাতে যেন এফোড় ওফোড়!
অথচ পোষ্টমোর্টমের আগে ডোমগুলোর হাতে করকরে পাঁচশ টাকা গুঁজে দিয়েছিল অতীন্দ্র, বলেছিল - "একটু যত্ন করে সেলাই দিও বাপু।"
বয়সে চার বছর তিন মাস সতেরো দিনের বড় অতসী। পরপর চার বোনের পর অতীন্দ্র।বাপ-মায়ের বড় প্রিয় ছিল অতসী। হবে না কেন, অতসীর কোলেই তো অতীন্দ্র এলো। তা না হলে মুখার্জি বংশের প্রদীপে সোলতে থাকত কোথায়!
বাপ মায়ের সংসারে এমন নিবিড় ভাবে শিকড় ছড়িয়ে গেল যে সময়ে বিয়েই করা হয়ে উঠে নি অতসীর। অবশ্য ভেতরের খবর অন্য, রণো মাস্টারের জন্যই নাকি সিঁথিতে সিঁদুর উঠল না অতসী মুখার্জির।
"ছিঃ ছিঃ ছিঃ বামুন ঘরের মেয়ে হয়ে শেষে কিনা দুলের সঙ্গে, এর চেয়ে দড়ি কলসি জুটল না তোর!"
রণো আর অতসীর সম্পর্ক টের পেয়ে মেয়ের মুখের উপর এ কথা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিল ব্রজমোহন।
ব্রজমোহনদের জমিদারি গেছে অনেক কাল, তাতে কি! শাল ছিঁড়ে গেলেও শালই হয়। তাছাড়া রণোদের পূর্বপুরুষ এককালে পালকি বইত মুখার্জি পরিবারের। যদিও পালকির যুগ গেছে বহুকাল, কাজের ধরন ধারনও পাল্টেছে তবুও জন্মসুত্রে যে জাতিগন্ধ নিয়ে মানুষ ভূমিষ্ট হয়, তাই বয়ে বেড়াতে হয় জীবনভোর।
সম্পর্কটা জানাজানি হতেই কোনো রকম উচ্চবাচ্য না করে বাড়িতে রণোকে গান শেখাতে আসতে বারণ করে দিয়েছিলেন ব্রজমোহন। অনেক চেষ্টায় অতসী আর রণোর ভালবাসার গল্প লুকিয়ে রাখা যায় নি। একসময় সিংহিপুরে সকলের মুখে মুখে ঘুরেছে সে খবর। খবর ছড়িয়ে পড়ার কিছু কাল পরে হার্ট অ্যারেস্ট হয়ে মারা যায় ব্রজমোহন।
সেই থেকে সংসার সামলানোর দায় বর্তায় অতসীর উপর। একটু একটু করে নিজেকে স্বেচ্ছাবন্দী করে নিয়েছিল অতসী। রণোও অনেক কাল অপেক্ষা করে শেষ পর্যন্ত বিয়ে করে নিয়েছিল পাশের বাগদি পাড়ায় নিমাই হাতির ছোট মেয়েকে।

ঝুমি নদীর পাড়ে ভেঙে পড়েছে লোকজন। ব্যস্ত হাতে চিতা সাজাচ্ছে একদল লোক। কীর্তনের সুর বিষণ্ণ করেছে বাতাস। পিসির পা ছুঁয়ে বসে আছে অতীন্দ্রর ছেলে। অতীন্দ্র সিগারেটে ভারি টান দিয়ে ফেলে দিল সিগারেটটা। পুরোহিতের পরামর্শে ব্যস্ত হল লোকাচারে। অনতিদূরে অভিমানী ঝুমি বয়ে চলেছে নিঃশব্দে। শীর্ণকায় ঝুমি এবার অতসীর সব অপবাদ বয়ে নিয়ে যাবে সাগর জলে। ঝুমির কাছেই তো বরাবর অতসী তার কষ্ট জানিয়ে এসেছে। মুখার্জী বাড়ির পিছন থেকেই বয়ে গেছে ঝুমি। অতসী ঘরের জানালা খুললেই কথা বলত ঝুমি। জানালার গরাদে হাত রাখলে ঝুমি আরো নিবিড় হত অতসীর। ঝুমি কুলকুল শব্দে অতসীর সব দুঃখ, যন্ত্রণা, বিরহ যেন বয়ে নিয়ে যেতো রণোর কাছে।এখন মজতে মজতে দুলে পাড়ায় দক্ষিণ দিক থেকে অনেকটা সরে এসেছে ঝুমি। ঝুমির সঙ্গে অতসীর যোগাযোগ থাকলেও রণোর সাথে আজকাল সাক্ষাৎ হয় না ঝুমির।

ভোরের আবছা আলোয় মাছ ধরতে আসা বাগদী পাড়ার লোকজন প্রথম নজর করেছিল,  মুখার্জী বাড়ির পিছনে ঝুমির চরে গলায় দড়ি, ঝুলছে একটা মেয়ে মানুষক একটু করে বেড়ে গিয়েছিল ভিড়টা। মির ঢাল বরাবর একদল পুলিশকে আসতে দেখে ভিড়টা ভাঙতে থাকে। ধরাধরি করে নামানো হয়েছিল বডি। জিভ বেরিয়ে এসেছে, হাত-পা টানটান। পেটটা কিন্তু একেবারে সমতল। ভাঙা ভিড়ে ফিসফিসিয়ে উঠেছিল সাঁতেদের ছোট বউ -
"মরার আগে পেট খসালি যখন, তবে মরতে গেলি কেন!"
তখন দ্বিতীয় দফার লকডাউন সবে শুরু হয়েছে, একদিন দুপুরবেলা অতসীকে রণো মাস্টারের ঘরে ঢুকতে দেখে সাঁতেদের ছোট বউ। প্রথমটায় কেউ আমল দেয় নি। তা কি করে সম্ভব!
ব্রজমোহন চলে যাওয়ার পর এতো কাল অতসীকে, মুখার্জী  বাড়ির বাইরে পা রাখতে দেখে নি কেউ। হ্যাঁ এক কালে সম্পর্ক ছিল ঠিকই কিন্তু তেরো বছরে সে স্মৃতিতে পলি জমেছে বিস্তর। তাছাড়া বছর সাতের সন্তান নিয়ে ভরা সংসার রণোর।
সারা জীবন সুরের কারবার করা রণোর বউয়ের গলায় সুর তো নেই বরং গলায় জোরে দুলে পড়ার সবাই রীতিমত সমীহ করে তাকে। সব মিলিয়ে শুরুতে সাঁতেদের ছোট বৌকে উপেক্ষা করার যুক্তি ছিল যথেষ্ট। সপ্তাহ খানেক পর, গত পরশু সন্ধে বেলায় অতসীকে ফের দেখা যায় রণোর বাড়ির পথে। পেটটা বেশ উঁচু, ভরা ভরা। সিংহিপুর ফের একবার মেতে উঠে পুরানো কাসুন্দি ঘাটতে। চারদিকে ফিসফাস। আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ে অতসী অন্তঃসত্ত্বা। তার পেটে নাকি রণো মাস্টারের সন্তান। লোকনিন্দার ভয়ে নিজে ঘরবন্দী হয় অতীন্দ্র। লাবন্য ছেলেকে নিয়ে বাপের বাড়ি যাওয়ার তোড়জোড় শুরু করে। তের বছর আগের ঝড়টা শক্তি বাড়িয়ে ফের একবার আছড়ে পড়ে অতসীর জীবনে। ভোর রাতে বাবার গলা স্পষ্ট শুনতে পায় অতসী "দড়ি,কলসি জুটল না তোর!"
নিভে যাওয়ার আগে ধুকধুক করে জ্বলছে চিতার আগুন। ভাঙা কলসিটা পড়ে আছে চিতার পাশেই। অনেক সময় হল অতীন্দ্ররা ফিরে গেছে শ্মশান থেকে। অন্ধকার নেমে এসেছে ঝুমির তীরে। সেই অন্ধকার ছিঁড়ে উন্মত্তের মতো চিতার দিকে ছুটে আসে একটা ছায়া মূর্তি, পেছন পেছন আরো দু'জন। শ্মশানের মাঝে দু পা ছড়িয়ে বসে পড়ে রণো। সে উন্মত্তের মতো দু'হাতে চাপড়াতে থাকে শ্মশানের মাটি। ঝুমির চরে লুটিয়ে পড়ে গোঙাতে থাকে থেকে থেকে। তীক্ষ্ণ গোঙানীর মধ্যেও রণোর কন্ঠ বেয়ে উঠে আসে মালকোষ রাগ। মন্দ্র সপ্তকে আলাপ ছড়িয়ে পড়ে ঝুমির চরে। রণোর সুরে ভারি হয়ে উঠে শ্মশানের আকাশ বাতাস। ভেঙে খানখান হয়ে যায় শ্মশানের নিঃস্তব্ধতা। রণোর সুরে ঘুঙুরের মতো মুখর হয়ে উঠে ঝুমি। ভয় পেয়ে যায় রণোর বউ আর ছেলে। তারা শক্ত হাতে সামালে নিতে চায় রণোকে।লকডাউনে রণোর গানের ক্লাস মাস দুয়েক বন্ধ। প্রায় দিনই না খেয়ে কাটছিল রণোদের। খবর পেয়ে গত সপ্তাহে খানিকটা চাল ডাল দিয়েছিল অতসী। গত পরশুর সন্ধ্যায় ফের লুকিয়ে পেট কাপড়ে অনেকটা চাল নিয়ে আসে সে।
ক'দিনের অনাহারের শরীর পরশু দু মুঠো ভাত পেয়েছে। না হলে সামাল দেওয়ার সামান্য শক্তিও ছিল না শরীরে।
ছেলে, বৌ এর উপর ভর করে ফেরার পথ চলে রণো। একটু একটু করে মিলিয়ে আসে চিতার আগুন। শুধু ঝুমির বাতাসে পাক খেতে থাকে মালকোষের রেশটুকু।

Comments

Top

saptarshi.jpg

ভূঁইচাঁপা 

সপ্তর্ষি রায়বর্ধন

কলকাতা 

maple1.jpg

গল্প

ভূঁইচাঁপা

শেষ মুহূর্তে কিছুতেই পাওয়া গেল না অভীকদার ফোনটা। এদিকে প্লেন ধরতে যাওয়ার তাড়া ছিল। হাওয়া অফিসের স্পষ্ট নির্দেশ ছিল বিকেলের পর থেকেই তুষারপাত হবে। সকালবেলায় উঠে অরূপ একটা ছোট কাগজে লিখে ফেলেছিল তার টু ডু লিস্ট্‌। তারপর ডেস্কের সামনে দেওয়ালের বোর্ডে পিন দিয়ে গেঁথে দিয়েছিল কাগজটাকে। যাতায়াত মিলিয়ে দশদিনের মামলা – একটা সুটকেস আর একটা হ্যাভার স্যাক গুছিয়ে নিয়েছে সে – যার মধ্যে রয়েছে অভীকদার জন্য বেশ কিছু বই আর জার্নাল। অভীকদা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক বিশ্বভারতীতে। কলেজ স্ট্রীট আর ইন্টারনেট খুঁজে যখন কোন বই পাওয়া যায় না, তখনই অরূপের কাছে জরুরী ইমেল। সেই ছোটবেলা থেকে পূর্বপল্লীতে পাশাপাশি বাড়িতে তাদের বাস। অতএব অগ্রজ হিসেবে অনুজের ওপর এই দাবী খুব স্বাভাবিক। 
এবারে পুজোর সময় থেকেই অরূপ ঠিক করে রেখেছিল শীতকালে দেশে যাবে। এদেশে শীতকালটা বড্ড কষ্টদায়ক। গত তিরিশ বছর ধরে মার্কিন দেশে থেকে অনেক কিছু অভ্যাস হলেও বছরের এই সময়টা তার কাছে একটা বিরাট বড় চ্যালেঞ্জও। বালিটমোর শহরটাকে সে মোটামুটি চিনেছে তিল তিল করে গত ছয় বছরে – জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরিসূত্রে।  রমিংটন অঞ্চলে একটা ছিমছিমে দোতলা বাড়ি কিনেছিল সে। নীলিমা যখন শাম্বকে নিয়ে দেশে   চলে যায়, তখন ওরা ছিল নিউজার্সিতে। সে সময়টা ছিল বড্ড কষ্টের। অনেকভাবে একটা  বোঝাপড়ার জায়গায় আসবার চেষ্টা করেছিল অরূপ। শান্তিনিকেতনের পথে হেঁটে হেঁটে, সোনাঝুরির হাওয়া গায়ে মেখে। দিগন্ত বিস্তৃত খোয়াই আর তার পাশে বয়ে যাওয়া কোপাই – এর মাঝে নীলিমাকে জেনেছিল অরূপ। মাঝের বছরগুলো কেটে গেছে কিরকম স্বপ্নের মত। 
এক কাপ কফি হাতে অরূপ এসে দাঁড়িয়েছিল তার ডেস্কের সামনে। বিশাল কাঁচের জানালার ওপারে পাতা ঝরে যাওয়া সিডার, ম্যাপল আর ওক্‌ গাছের সারি। এখনও এখানে ওখানে বরফ আর জল জমে আছে সামনের কালো ড্রাইভওয়ের ওপরে। বাড়ির বাগানে আকাশমণির কমলা ফুলের থোকা এখনও রয়ে গেছে কিছু। সাহেবরা বলে হানিসা্‌ক্‌ল। কফির কাপে চুমুক দিতেই, নড়ে উঠল মোবাইল ফোনটা। ‘আবোল তাবোল’ হোয়াটস্‌ অ্যাপ গ্রুপে ময়ূখের লেখা ভেসে উঠল ‘কিরে, রওনা দিবি কখন? বরফ পড়ে রাস্তা বন্ধ হয়ে যায় নি তো .........’। 
ফোনটা হাতে তুলে নিয়ে অরূপ উত্তর লেখে ‘এখন পর্যন্ত অল ওয়েল! আসছি বন্ধু ......’।

‘ওরে, আমার মালগুলো আনছিস তো?’  
অরূপের হঠাৎ চমক ভাঙ্গে; তাই তো, ময়ূখের গিটারের জন্য কেনা বিদেশী ক্যাপো আর ডিজিটাল টিউনার তো নেওয়া হয়নি। দেখেছ, এখুনি ভুল হয়ে যাচ্ছিল। কফির কাপটা খাবার টেবিলে রেখে, তিনদিন আগের ক্যুরিয়রে আসা একটা বাক্স সুটকেসে ঢোকাল অরূপ। 
অরূপ শান্তিনিকেতনের পাট চুকিয়ে চলে এলো কলকাতায়। ভর্তি হয় প্রেসিডেন্সি কলেজে। নীলিমা তখনও বিশ্বভারতীতে। পূর্বপল্লীর বাড়িতে একটা ছোট্ট চিলেকোঠা ছিল। বাড়িটার নাম অরূপের ঠাকুরদা রেখেছিলেন “বাঁশরী”। ছাদের আশে পাশে ছিল দুটো আমগাছ আর একটা মস্ত বড় কৃষ্ণচূড়া। এই গাছগুলোর নিবিড় ছায়া একটা অদ্ভুত আলো আঁধারি তৈরি করত  ঘরটার ভেতরে। অরূপ যখন পাঠভবনের অষ্টম শ্রেণীতে, সে সময় ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ দেখেছিল। আসলে ঠাকুরদার কোন এক বন্ধু নাকি কাজ করতেন টালিগঞ্জ পাড়ায় আর তিনি  ছিলেন সত্যজিৎ রায়ের ইউনিটে। তার কথাতেই ছবিটা দেখা হয়েছিল চিত্রা সিনেমা হলে। অরূপের বড় ভালো লেগেছিল ছবিতে দেখানো বাংলো বাড়ির সেই মাচার ওপর কাঠের ঘরখানা আর তার লাগোয়া ‘রোমিও জুলিয়েট ব্যালকনি’! ‘বাঁশরী’-র চিলেকোঠা সে সময় খালিই পড়েছিল।
শীতের এক দুপুরে সেখানে একা একা বসে থাকতে অরূপের মনে হল ঘরটাতে থাকলে কেমন হয়। ঠাকুরদাকে বলাতে কাজ হল। এক সপ্তাহের মধ্যে চিলেকোঠা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে সেখানে থাকতে শুরু করল অরূপ।
ঐ বাড়িটার অনেক স্মৃতি। সুমিত তার ছোট্ট ছেলে বাগালকে নিয়ে এসেছিল সেই কবে। আউট হাউসে থাকত মা ছেলে মিলে। শান্তিনিকেতন ছিল অন্যরকম – ফাঁকা ফাঁকা। পূর্বপল্লীর ঢোকার মুখে বাঁক ঘুরলেই আলোপিসীদের মস্ত বাড়ি। কত ফুল ফুটত বাগানে সারাবছর ধরে। উল্টোদিকেই কুমুদের বাড়ি। ওর জ্যাঠামশাই ছিলেন বিশ্বভারতীতে অধ্যাপক। আরও এগিয়ে গেলে পূর্বপল্লীর ছায়ামাখা সরণির আশেপাশে কত মহৎ মানুষের বাড়ি আর কি সুন্দর নাম তাদের। ‘সোনাঝুরি’ ‘স্বাগতবিদায়’, ‘রুদ্রপলাশ’ এমন কত কি। 
পৌষমেলায় বসত বাউলদের আখড়া। তিনদিন ধরে সেখানে নানারকম গান বাজনা। যেদিন ভাঙ্গামেলা শুরু হ’ত – সেদিন বাউলরা পাড়ায় পাড়ায় বাড়ি বাড়ি যেত – গান শোনাতে। আর ছিল বহুরূপীর দল। বসন্ত উৎসবে শান্তিনিকেতনের অন্যরূপ। আগের রাতে বৈতালিক – গান গাইতে গাইতে প্রদক্ষিণ করা হত ক্যাম্পাস। সে এক অদ্ভুত অনুভূতি। পরের দিন দোল। কলাভবনের সামনে, মেলার মাঠে, গৌড় প্রাঙ্গণে ছেলেমেয়েরা দলে দলে জড়ো হ’ত। গলায় গান – হাতে বাজনা – পায়ে ছন্দ। ছোটবেলা থেকে এই দেখে বড় হয়েছে অরূপ আর নীলিমা। আমেরিকা এসেও কয়েকবছর খুব মন খারাপ হ’ত ওদের। হাডসন নদীর পাশে দাঁড়িয়ে নীলিমা বলেছিল “আমাদের কোপাই অনেক সুন্দর – না রে?”
কয়েকবছর বাদে শাম্বর জন্ম। 
দেশে যাতায়াত করবার সময় বেশ কিছু রেকর্ড আর ক্যাসেট এনেছিল ওরা। রবি ঠাকুরের গানে ওরা খুঁজত নিজেদের শৈশব। 
এই অপরিচিত দেশের জল, আকাশ, সাগর, নদী আস্তে আস্তে চিনল ওরা। জীবন বড় গতিময়। সম্পর্কগুলোও সেই গতিময়তার বাইরে নয়। 

সুবীরের সঙ্গে আলাপটাই ধরা যাক। 
জন হপকিন্সে এসেছিল সে গবেষণার কাজ নিয়ে। অন্য কিছু বন্ধু বান্ধবের এক পার্টিতে আলাপ ওদের। বয়সের ফারাক ছিল বটে, কিন্তু মানসিকভাবে সুবীর ছিল ভীষণ পরিণত। অরূপ এবং নীলিমার কাছে পুরনো হতে সময় লাগে নি। বাংলা গান, নাটক, সাহিত্য তার ভালবাসার জায়গা। জ্ঞানগম্যিও কম নয়। অনেকদিন এই দেশে থেকে কিরকম যেন একটা দমবন্ধ করা পরিবেশের মধ্যে পড়েছিল নীলিমা। তার জগতটা ঘুরে মরছিল দৈনন্দিন পাকচক্রে। অরূপ ব্যস্ত তার কাজকম্ম নিয়ে। এখন তার অনেক অনেক ব্যস্ততা। পূর্বপল্লীর রোমিও জুলিয়েট ব্যালকনি এখনো ভেসে বেড়ায় নীলিমার স্বপ্নে। একটা বিশাল অমলতাস গাছ ছায়া দিত; হলুদ ফুলের থোকা হাত দিয়ে ধরা যেত বারান্দা থেকে। অরূপ আর সে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দিত এখানে। কখনো কখনো আসত পারমিতা আর অমিত। ওরা তখন কলাভবনের ছাত্র-ছাত্রী।   
সময়ের সাথে সাথে সেই ছবি মলিন হয়েছে। অরূপ আর নীলিমার সযত্নে বাঁচিয়ে রাখা স্বপ্নগুলো শুকনো পাতার মত কবেই ঝরে পড়ে গেছে কেজো জীবনের আনাচে কানাচে। শাম্বর জন্মের পর জীবনটা যেন আরও কেমন গতানুগতিক হয়ে গেল। সকাল হলেই অরূপের অফিস, শাম্বর স্কুল। তারপর একটা লম্বা অবসর। তারপরে ডিপার্টমেন্ট স্টোরে বাজার – টেলিভিশন সেটের দিকে চ্যানেল বদলানো – কখনও কখনও বইয়ের দোকান। আর সপ্তাহান্তে  বঙ্গ সন্তানদের আড্ডা আসর।  

সুবীরের উপস্থিতিটা ক্রমশ পেয়ে বসল নীলিমাকে। অদ্ভুত একটা আকর্ষণ ওর কথাবার্তায়, ব্যবহারে। মার্কিন মুলুকে আসা তার নেহাতই পড়াশুনো করে ডিগ্রি পাবার তাগিদে। জীবনের সুখ আনন্দের খোঁজে সে দেশে ফিরে যেতে চায়। 
“বুঝলে – এসব দেশে বেশি দিন থাকা মানে নিজেকে যন্ত্রর মন্তর ঘরে তালা বন্ধ করে রাখা”
অরূপ পারবে – ও নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে সাহেবদের সঙ্গে। আমার দ্বারা হবে না।  
এক সন্ধ্যায়, সুবীর এসেছিল বারকশায়র ড্রাইভের পুরনো বাড়িতে। তখনত সন্ধ্যে হয়নি। একটা অদ্ভুত মায়াবী আলো চারিদিকে। পিছনের এক চিলতে লনে কফি টেবিলের দুদিকে – সুবীর আর নীলিমা দু পেয়ালা গরম কফি হাতে। হঠাৎ নীলিমার বুকের ভেতরটা হু হু করে উঠল। একরাশ হাওয়া এসে জুড়িয়ে দিল শরীর। সেদিন সুবীরের কাছে উন্মুক্ত হ’ল সে। 
‘দূরে কোথায় দূরে দূরে – আমার মন বেড়ায় গো ঘুরে ঘুরে’ বেজে উঠল অরূপের ফোনে। বহুদিন আগে, এই গানটা রিংটোন করেছিল সে। নীলিমার খুব প্রিয় গান। পূর্বপল্লীর বাড়ির ছাদে, খুব ভোরে অথবা গোধূলি বেলায় খোয়াইয়ের দিগন্তে দেখা যেত রঙের খেলা। সত্যিই অচিনপুরের দেশ মনে হ’ত।  
অভীকদার ফোন। বল অভিকদা – রওনা হবে তো। কিছুতেই পাচ্ছিলাম না তোমার লাইন – ওদিকের কি খবর? 
এখানে তো সব ঠিকই আছে। তুই পৌঁছবি কখন? পরশু বেলাবেলি চলে আসব। কেমন ঠাণ্ডা পড়েছে? মেলা তো আজ শুরু তাই না?
হ্যাঁ – এই তো যাব খানিক বাদে। আর বাড়ির ব্যাপারটা?
তুই চিন্তা করিস্‌ না – মোটামুটি কথা এগিয়েছে। কলকাতায় ডাক্তারি করেন ভদ্রলোক। মনে তো হয় পছন্দ হয়েছে। পৌষমেলা উপলক্ষ্যে এসেছেন। তুই পৌঁছলেই বলেছি ফোন করব –পরের প্রশ্নটা করবার আগে অরূপ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। 
“অভীকদা – আর ও?”
হ্যাঁ – আসবে বলেছে। তাহলে রাখি রে – তুই কিন্তু সাবধানে আসিস। মহাদেব থাকবে এয়ারপোর্টে – দেখবি সাদা রঙের গাড়ি। 
ওকে বাই – অভীকদা দেখা হচ্ছে। পারমিতা আর অমিতকে বোলো – আমি আসছি। 

ফোনটা টুক্‌ করে কেটে গেল। নিঃশব্দে কাটল কয়েকটা মিনিট। সামনের পার্কে কয়েকটা বাচ্চা ছেলে একটা ফুটবল নিয়ে দাপাদাপি করছে। শাম্বর জন্য মনটা খারাপ হ’ল। কিছু জামাকাপড় আর বই কিনেছি ওর জন্য। কে জানে পছন্দ হবে কিনা ছেলের। আর এক ঘণ্টা বাদেই যাত্রা শুরু। খুব কেজো জীবনের মাঝে এধরণের অবকাশ – একটা দ্বীপের মতই। জীবনের রূপ রং গন্ধের মাঝে নীলিমা আর সে তৈরি করেছিল এক ভালবাসার সাতমহলা। অঙ্গীকার বদ্ধ ছিল নিজেদের কাছে – আর একটা স্বপ্নের কাছে। সব কিরকম অদ্ভুতভাবে ভেঙে পড়ল একদিন। 
শাম্বর জন্মদিন ছিল সেদিন। অনেক বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে সুবীরও আমন্ত্রিত। কথায় কথায় রাত বাড়ে – পরের দিন রবিবার, অতএব ছুটি। একটু বেশি নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল সুবীর সে
রাতে। 
আজ রাতে আর বাড়ি ফেরাটা বোধহয় ঠিক হবে না সুবীর – থেকে যাও – মৃদু আলোয় মোড়া বৈঠকখানা ঘরের মধ্যে তিনটি মানুষ। বলছ? ঠিক আছে – যাব না। তবে নীলিমা – গান শোনাতে হবে কিন্তু। 
নীলিমা খানিকটা অন্যমনস্ক ছিল। “নীলিমা – কি বলছে সুবীর তোকে – শুনতে পেয়েছিস ?” একটা ঘোরের মধ্যে ছিল নীলিমা। অরূপের কথা তার সম্বিৎ ফিরিল। মৃদু হেসে বলল – কিরে বল, সুবীর – সে সব কবে চুকেবুকে গেছে। 
সুবীর হুইস্কির গ্লাসটা হাতে নিয়ে নীলিমার পাশে এসে বসল তারপর উদাত্ত কণ্ঠে বলে উঠল। যে নদীর দুদিকে দুটো মুখ। 

এক মুখে সে আমাকে আসছি বলে দাঁড় করিয়ে রেখে অন্য মুখে ছুটতে ছুটতে চলে গেল।আর যেতে যেতে বুঝিয়ে দিলআমি অমনি করেই আসি অমনি ক’রে যাই। বুঝিয়ে দিলআমি থেকেও নেই,না থেকেও আছি। এ কবিতা এখনও মনে আছে তোমার? নীলিমা নরম গলায় প্রশ্ন করল। আছেই তো – দরকার মত সব মনে পড়ে। তোমারও আছে – একবার ধরে ফেল দেখবে স্রোতস্বিনী হয়ে দুকুল ছাপিয়ে যাবে। সত্যি সে রাতটা অন্যরকম ছিল। যখন ভোর হ’ল – অরূপ তার বিছানায় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন – শাম্ব তার ঘরে স্বপ্নে কার সাথে খেলা করছে। নীলিমা বুঝল সুবীরের সঙ্গে এক অদৃশ্য টানে সে বাঁধা পড়েছে। অরূপ তার কাছ থেকে মানসিকভাবে অনেকটা দূরে। এর একমাস পরেই অরূপকে জানালো কথাটা নীলিমা। কথাটা শুনে নিজের কানকে প্রথমে বিশ্বাস করতে পারল না অরূপ। তোর কি হয়েছে নিলি ? হঠাৎ এরকম একটা decision নিচ্ছিস্ ? শাম্বর কথা ভেবেছিস্‌ একবার? let’s talk it out না অরূপ। আমি দেশে ফিরতে চাই। এবং শাম্বসহ। শাম্ব দেশে চলে যাবে? কি বলছিস্‌ ? হ্যাঁ – সুবীর দেশে ফিরে যাচ্ছে – and me want to settle there ………। আমি চাই না শাম্ব আমাকে ছাড়া এই দেশে থাকুক – বড় হোক। - আমার দিকটা ভেবে দেখেছিস্‌ ? বাবা হিসেবে ওর ওপর তো আমার কিছু দাবি থাকতে পারে – থাকতে পারে আর আছের মধ্যে বিস্তর ফারাক। দরজাটা টেনে বন্ধ করল অরূপ। চাবি বন্ধ করার পালা। বাংলাতে লেখা “চিলেকোঠা”। বোর্ডটা জ্বলজ্বল করছে কালো বার্নিশ করা দরজার ওপর। নামটা নীলিমার দেওয়া – বোর্ডটা উড কাটিং করে বানিয়ে দিয়েছিল অমিত নিজে হাতে। হলুদরঙা  ট্যাক্সিটা দাঁড়িয়েছিল গেটের কাছেই। হাড় কাঁপানো হাওয়া এখনও চলেছে। চাকাওয়ালা সুটকেসখানা টানতে টানতে ট্যাক্সির কাছে এগুতেই – ড্রাইভার এসে গাড়ির ট্রাঙ্ক খুলে দিল। বেশ ভারী হয়েছে সুটকেসটা। সেটাকে ড্রাইভার ভেতরে তুলে দিয়ে অরূপ দরজা খুলে গাড়িতে বসল। To the airport – through Howard street please…… গাড়ি ছুটে চলল। শাম্বর বয়স এখন প্রায় বারো। কলকাতা ফিরে গিয়ে নীলিমা ওকে ভর্তি করেছিল শান্তিনিকেতন পাঠভবনে। দায়িত্ব নিয়েছিলেন অভীকদা।  খবরটা শুনে অভীকদা কষ্ট পেয়েছিলেন। কি জানিস নীলিমা – তোদের মধ্যে যে দেওয়ালটা তৈরি হয়েছে – কেন তার শাস্তি এই শিশুটা পাবে – সেটা আমি বুঝতে পারছি না। ওতো কোন দোষ করেনি। - কিন্তু, আমি তো অনেক আগেই চেয়েছিলাম শাম্ব এখানে পড়াশুনা করুক, বলল নীলিমা। - তার তো অন্য রাস্তাও ছিল। সব ছেড়েছুড়ে – অরূপের সঙ্গে সম্পর্কটাকে এভাবে ভেঙেচুড়ে আসতে হবে। নিশ্চয়ই এটা ঠিক মনে করেছিস – তাই করেছিস।  - তোমার কাছ থেকে তো পাওয়ার শেষ নেই আমার – এবার শাম্বও পাক – তোমায় ওর local guardian হতে হবে। - সে না হয় হল – কিন্তু ছেলেটাকে একবারও জিজ্ঞেস করেছিস ও কি চায়? নীলিমা চোখ ভরা জল নিয়ে তাকিয়ে থাকে বাগানের দিকে। কথা বলে না। কলকাতা এয়ারপোর্টের বাইরে এসে মহাদেবকে খুঁজে পেতে দেরী হ’ল না। গাড়ি ছুটে চলেছে বেলঘড়িয়া এক্সপ্রেসওয়ে ধরে নিবেদিতা সেতুর দিকে। আবোল তাবোল। আওয়াজ দিন। ময়ূখ লিখেছে “কিরে নেমেছিস্‌ - কতদূরে?” অরূপ তার কলকাতার সিম থেকে এবার ফোন করল ময়ূখকে। কিরে কেমন আছিস্‌? কখন পৌঁছলি তুই? কাল রাতে – তোর কতক্ষণ লাগবে? শোন, আজ পারমিতা -

অমিতের ওখানে night stay আমাদের। হ্যাঁ হ্যাঁ – ঠিক আছে য়ে বাবা – তুই জিনিসপত্র অভীকদার ওখানে রেখে বিকেল বিকেল মেলার মাঠে চলে আসিস। ওখান থেকেই আমরা চলে যাব। আর কি খবর? ও শোন তোর জিনিসপত্র এনেছি, রাতে নিয়ে যাব। ওকে ওকে – তাড়াতাড়ি আয়, ঠাণ্ডায় জমে যাচ্ছি মাইরি। অদ্ভুত চরিত্রের মানুষ ময়ূখ। প্রেসিডেন্সিতে পড়বার সময় আলাপ হয়েছিল ওর সাথে। খুব ভাল গানের গলা – সব গানেই সহজ গতি, রবীন্দ্র সঙ্গীত নিয়ে খুব sensitive। বিভিন্ন আড্ডায় অরূপের দাবি মেনে সে নানা রকম গান গাইত – আলোচনা চলত সুরের চলন, বাঁধন নিয়ে। মাঝে মাঝে চরমে পৌঁছত তর্কাতর্কি। 

বিদেশে যাবার পর ময়ূখের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়নি। যত দিন গেছে, বন্ধুত্ব গাঢ় হয়েছে। পারমিতা আর অমিতকে ওর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল একবার বসন্ত উৎসবে। সেবার ময়ূখও এসেছিল অরূপের সঙ্গে – নীলিমার সঙ্গে দেখা হতেই বলে বসল “আপনি কি সেন?”
নীলিমা অপ্রস্তুত হয়ে হেসে ফেলেছিল সেদিন। নাই সেন নই – তবে একটু আধটু সুর আছে গলায়। বাঃ বাঃ – তাতেই হবে। অরূপ, বাপু তুই আবার রাগ করিস নি যেন আমরা duet গাইলে। 
দাদাবাবু শক্তিগড়ে দাঁড়াবেন না টেনে বেড়িয়ে যাব? মহাদেবের প্রশ্নে অরূপের চিন্তা বিঘ্নিত হয়। তোমার অসুবিধে না হলে – আর দাঁড়াতে হবে না। দেখে নাও – আসলে অরূপ চাইছে যত তাড়াতাড়ি শান্তিনিকেতনে পৌছনো যায়। 
অবশেষে পূর্বপল্লীর রাস্তার ভিড় ঠেলে গাড়ি ক্রমে পৌঁছল অভীকদার বাড়ির সামনে। মেলার জন্য চারদিকে সাজো সাজো রব।  
কতদিন পরে এইসময় শান্তিনিকেতন এল অরূপ। একরাশ হাসি মুখে নিয়ে অভীকদা বেড়িয়ে এসে জড়িয়ে ধরল অরূপকে। 
আয় অরূপ – মহাদেব দাদাবাবুর জিনিসপত্র গুলো ঐ পিছনের ঘরে রেখে এস – 
অভীকদার বাগানটার দিকে একবার তাকাল অরূপ। পেছনের পাঁচিলের ওপারে “বাঁশরী”- তার বাল্য কৈশোর জীবনের স্মৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে এখনও। বাগানে নানা ফুলের মেলা – মাঝখানে মোরাম বিছানো পথ।  
আস্তে আস্তে এগুলো দুজনে বাড়ির ভিতরে। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে অভীকদা এসে বসল বারান্দায় রাখা বেতের চেয়ারে। অরূপ বসেছে, নিচু দেওয়ালটার ওপরে। ছাত্রাবস্থায় এভাবেই পড়াশুনো চলত তাদের। অভ্যাসটা যায় নি। 
তা ওদেশের কি খবর বল অরূপ? শুনছি ওবামা নাকি এবার একটু বেকায়দায়?  
বাদ দাও ওদেশের কথা। তোমাদের এখানের খবর শোনাও। এখন নাকি মান্ডলিক আচার বিচার চলছে। 
বলতে পারিস – রঙ বদলিয়েছে – চরিত্র বদলায়নি। 

এরকম দু’চার কথার পরই হঠাৎ খুব চুপচাপ হয়ে গেল দুজনে। মেলার মাঠের ওদিক থেকে ক্ষণে ক্ষণে মাইকে ঘোষণা ভেসে আসছে। আস্তে আস্তে সন্ধ্যা নামছে। ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক শুরু হয়েছে থেকে থেকে। 
- নীলিমা এসেছিল? স্তব্ধতা ভাঙে অরূপ। 
- এসেছিল – শাম্বকে হস্টেল থেকে নিয়ে। ও চাইছে শাম্বকে কলকাতা নিয়ে যেতে”। 
- আমাকে তো কিছু জানায় নি। শাম্বর ব্যাপারে কোনরকম decision নেবার আগে তো আমায় জানানোর কথা নীলিমার। 
- সেটা আমি কিছু বলতে পারি না – তবে হ্যাঁ, ও ছেলে অন্য ধাতের বুঝলি।
কথাটা আর এগুতে পারল না, কারণ ময়ূখের ফোন। “এই হতভাগা – তুই কি আসবি না আমায় যেতে হবে ? নিশ্চয়ই অভীকদার সঙ্গে ভাটাচ্ছিস বসে বসে – শিগগীর আয়”।  
- হ্যাঁরে আসছি। তোরা কোনখানে রে?
- শোন তুই ঢুকে সোজা চলে আসবি কলাভবনের স্টলের কাছে দেখবি একটা বড়সড় তেলেভাজা আর রোলের দোকান – ওখানেই পারি আমাদের। 
- আচ্ছা আসছি। 
পারমিতা আর অমিতের ছোট ছিমছাম বাড়িটা খুব ভাল লাগে অরূপের। প্রান্তিক থেকে গোয়ালপাড়া যাবার পথে একটা বিশাল পুকুর আছে। তার চারপাশে বাঁশ গাছের জঙ্গল এখনও রয়েছে। উত্তুরে হাওয়া এসে খেলা করে গাছের পাতায় পাতায়। অদ্ভুত একটা শিরশির শব্দ। এই পুকুরটাকে বাঁয়ে রেখে খানিক এগুলেই উত্তরপল্লী সেখানেই সাঁওতালদের গ্রাম ঘেঁষে বাড়িটা – “মিতা”। 
পৌষমেলার মাঠে খানিকক্ষণ এদিক ওদিক করে মন খারাপ হয়ে গেল অরূপের। কোথায় যেন হারিয়ে গেছে সেই পুরনো দিনের মেলা। বইয়ের স্টল হাতে গোনা – হাতের কাজ নিয়ে যারা এসেছে তারা প্রান্তিক – বাউলের গান ছাপিয়ে – মোবাইলর special offer এর ঘোষণা। ভাল লাগল না। 
- অরূপদা, আমাদের এখানে কিন্তু তেলেভাজা একটা শিল্প। বলল পারমিতা। চারজনে মিলে একটা টোটো ভাড়া করে ফিরে এলো ওদের বাড়িতে। 

তারপর সন্ধ্যে পেরিয়ে গভীর রাত পর্যন্ত চলল আড্ডা, গান, তর্কাতর্কি। ভাল স্কচ এনেছিল অরূপ। অমিত রান্না করেছিল অনেক কিছু। হিমঝরা শীতের রাতে পূর্ণিমার আলোয় ভরে আছে “মিতা”র উঠোন। 
তখন অনেক রাত। পারমিতা জিজ্ঞাসা করল, নীলিমা কেমন আছে অরূপদা?”
এর উত্তর জানা নেই অরূপের। শাম্বর জন্য মনটা আনচান করছিল। প্রশ্নের উত্তর দিল না সে। বলল – শাম্বকে অনেকদিন দেখি নি।  
- গতকাল এসেছিল মেলায়, অভীকদার সঙ্গে, বলল পারমিতা।  
- কিরকম বদলে গেল সবকিছু পুট্‌ করে। দিনে দিনে হয়ত একটু একটু করে নদীর পাড় ভাঙছিল। টের পাইনি। আর সুযোগও ছিল না – কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ততা, টানাপোড়েন – কিন্তু do I deserve this?” 
- তুমি নাকি বাড়িটা বিক্রি করে দিচ্ছ? অভীকদা বলছিল।  
- হ্যাঁ, সেরকমই ভেবেছি। ঐ বাড়িটার অনেক স্মৃতি – পুরনো বাড়িটার পরতে পরতে ছায়ার মত সেগুলো লেগে আছে। ও রেখে আর কি হবে!
রত্তিরে খাওয়া দাওয়া হতে অনেক দেরী হয়েছিল। খুব সকালে ঘুম ভেঙে গেল অরূপের। দূর কোথায় বাঁশী বাজাচ্ছে কেউ। চারিদিক কুয়াশা মোড়া। হলদেটে চাঁদ এখনও জেগে। অমিতের কাছ থেকে একটা মোটা চাদর ধার করেছিল কাল। সেটা গায়ে দিয়ে আস্তে আস্তে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে এলো সে। এসে দাঁড়াল সেই পুকুর পাড়ে। বেশ ঠাণ্ডা হাওয়া। বাঁশবনের পাতায় পাতায় ঘষা লেগে অদ্ভুত একটা শব্দ হচ্ছে। ওদেশে এখন রাত আটটা বাজে। 
নীলিমার কফি খাওয়ার সময় ছিল এটা। সারাদিনের জমে থাকা গল্প হত ওদের। শাম্বকে রবীন্দ্রনাথের ছড়া, কবিতা, গান শোনাও। আয়তাকার গভীর চোখ দুটোতে তার অপার বিস্ময় আর একটা খুশি খুশি ভাব।
যখন বুঝতে শিখল, জানতে চাইত শান্তিনিকেতন ব্যাপারটা কি! কি আছে সেখানে? ওটা কি রূপকথার দেশ ? নীলিমার শেখানো পদ্য আওড়াত নরম গলায় - 
কাঁধে মই, বলে ভুঁইচাপার গাছ 
দই ভাঁড়ে ছিপ ছাড়ে, খোঁজে কইমাছ,
ঘুটে ছাই মেখে লাউ রাঁধে ঝাউপাতা –
কী খেতাব দেবতায় ঘুরে যায় মাথা – 

অরূপ বলত – ঐ যে ভুঁইচাপা গাছ যেখানে আছে সেই হ’ল আমাদের দেশ – সেই হ’ল শান্তিনিকেতন শাম্ব। তোর বাড়ি। 
খানিক দূরে ধুয়ো উঠছে। অরূপের মনে পড়ল এরকম একটা জায়গায় রাস্তার ধারে মুক্তিদা কাঠ আর শুকনো পাতায় আগুন জ্বালিয়ে মাটির উনুনে খেজুরের রস জ্বাল দিত। দুএক পা এগুতেই দেখতে পেল বয়স্ক এক ব্যক্তিকে। উবু হয়ে বসে আছে সদ্য আগুন দেওয়া উনুনের পাশে। এক বিশাল কড়ায় খেজুরের রস। মিষ্টি গন্ধ। 
অরূপ এসে দাঁড়াল। মুক্তিদাকে চেনা যায় না। 
- কেমন আছ মুক্তিদা – চিনতে পারছ?
- কে বটে ? চিনাচিনা লাগে – চোখে দেখি না ............ 
- আমি অরূপ – পূর্বপল্লীর অরূপ –
- উ – সে পরাণকর্তার নাতি – চিনতে পারি নাই রে দাদা। কুবে এসেছ বটে? বিদেশে থাকো নাকি?” 
- হ্যাঁ, এই এসেছি কিছুদিনের জন্য। মেলাটা কাটিয়ে ফিরে যাব।
শাম্বর বয়সী একটা রোগা ছেলে গুঁড়িমুড়ি মেরে বসে আছে মুক্তিদার গা ঘেঁষে। 
- আমার নাতি – সুখরামের বিটা।
- কি নাম রে তোর?
- মুর নাম তীর্থনাথ” – জবাব আসে। এক নিঃশ্বাসে বলে, ডাক নাম হ’ল মুংরি। 
মুক্তিদা খেজুরের রস খাওয়াল। পয়সা নিল না কিছুতেই। 
খানিক বেলায় অরূপ ফিরে এলো অভীকদার বাড়িতে। “কিরে কেমন হ’ল তোদের আড্ডা ?” 
- ভালই – আসলে এতদিন পরে দেখা, বুঝলে না ......
- সবই তো বুঝলাম রে – কিন্তু আসল লোকের সঙ্গে তো এখনও দেখা হওয়া বাকি। 
- শাম্ব?
- হু – সে আসবে বলেছে আজ।  
“বাঁশরী”র মরচে পড়া গেটটা একটু ঠেলতেই খুলে গেল একটা বিজাতীয় আওয়াজ করে। আগাছায় ভরে রয়েছে পায়ে চলা পথটা। বড় জাম গাছটা আরও ঝাঁকড়া হয়ে ডাল মেলেছে। ঠাকুরদার বড় সখের একটা সিমেন্টের বেদি ছিল – তার উপরে লোহার খাঁচায় ছিল আকাশমণি লতা। বালটিমোরের বাড়ির সামনের বাগানে আকাশমণির কমলা ফুল দেখে মনে পরে এই জায়গাটার কথাই বারে বারে। পায়ে পায়ে এগুতে থাকে অরূপ বাড়িটার দিকে। শুকনো পাতারা চাপা পড়ে তার পায়ের নীচে। 
অমলতাস ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে। ঐ তো, “রোমিও-জুলিয়েট ব্যালকনি”। কত কত স্বপ্ন দেখা ঐ ছোট্ট বারান্দায়।   
সদর দরজার চাবিটা অভীকদার কাছ থেকে চেয়ে এনেছিল অরূপ। তালায় হালকা মরচে পড়েছে। দরজা খুলে দাঁড়াল একতলার বৈঠকখানায়। ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে আছে পুরনো আসবাব। মেহগনি কাঠের তৈরি সেই বুকসেলফ। আরও কত কি।  
সন্তর্পণে সিঁড়ি বেয়ে উঠে খোলা ছাদে এসে দাঁড়ায় অরূপ। সারা শরীর তার কৈশোরের গন্ধ; অমলতাস এর হলুদ ফুলের গালিচা তৈরি হয়েছে ছাদের কোণ ঘিরে। ঘরের দেওয়ালে অমিতের আঁকা “পৌষমেলা” ক্যানভাসটা এখনও রয়েছে। বিবর্ণ, কিন্তু অক্ষত। শান্তিনিকেতন ছেড়ে যাবার আগে অনেকবার ভেবেছে ওটাকে নিয়ে যাবে সঙ্গে করে। হয়ে ওঠে নি। এবার অমিতকেই ফেরত দিয়ে যাবে মনস্থ করল সে। 
ওপর থেকে একবার কুয়োতলার দিকে নজর গেল অরূপের। জুঁই, টগর আর বেলফুলের গাছ ছিল ওখানে অনেক। বাগালের মা সুমতিদিদির বিশ্বাস ছিল ফুলের গন্ধে নাকি কুয়োর জল পবিত্র হয়ে যায়। হবেও বা। এই বয়সে এসে বিশ্বাস – অবিশ্বাসের গণ্ডি বড় ঝাপসা।  
কুমুদের বাড়িটা নজরে পড়ল। 
পৌষমেলায় বাউলরা এসে ঐ বাড়িতে গান শুনিয়ে যেত। কে থাকে ঐ বাড়িতে কে জানে। কুমু, রোশনি ওরা কি কলকাতায় থাকে?
আস্তে আস্তে নীচে নেমে আসে অরূপ। 
শান বাঁধানো লাল রঙের বেদিটা ভেঙে গেছে জায়গায় জায়গায়। কালো লাল পিঁপড়ে দৌড়ে বেরোচ্ছে এদিক ওদিক। 
নীলিমা কি সত্যিই নিয়ে যাবে ছেলেটাকে এখান থেকে। হাজার মাইল দূরে থাকে সে – সে তো যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিল ওদেরকে নিজের কাছে ধরে রাখতে। অর্থকষ্ট ছিল না – ছিল না সামাজিক নিরাপত্তার অভাব – তবে কেন এরকম একটা পথ বেছে নিল?  
কতক্ষণ বসেছিল ওখানে অরূপ জানে না। 

চমক ভাঙল খুব নিচু গলায় একটা আদুরে ডাকে, বাবা – তুমি এখানে কেন বসে আছ?
শাম্ব দাঁড়িয়ে। একমাথা ভর্তি কোঁকড়া কালো চুল। সাদা কুর্তা আর হালকা নীল রঙের জিন্স – সঙ্গে কালো জ্যাকেট। হাত বাড়িয়ে দিল অরূপ। 
শাম্ব এসে জড়িয়ে ধরল। 
- মা এসেছিল?
- Yes, she was here for a short time. She wanted me to come over to Calcutta with her.
- তুই যেতে চাস ? Go and continue with your studies – no harm পরে তুই USAতে আসতে পারিস। আমার কাছে থাকবি।  
- বাবা, I want to be here with অভীকজ্যেঠু। আমি এখানে তো ঠিক আছি – ভাল আছি। আমার বন্ধুরা রয়েছে – perhaps, I won’t be happy there!
অরূপের হৃদয় তোলপাড় হয়। এ গাছের শিকড় তো অনেক গভীরে। মা বাবার থেকে দূরে থেকে শাম্ব অনেক স্বাবলম্বী। 
- শাম্ব, এই বাড়িটা তোর ভাল লাগে? আগে এসেছিস কখনও? 
- অনেকবার – অভীকজ্যেঠু আমায় বলেছে – এটা আমার great great grand pa-র বাড়ি ছিল। I like that balcony over there – । 
শাম্বর হাতটা কোলে নিয়ে অরূপ বসে রইল আকাশমণি গাছের নীচে। উত্তুরে হাওয়ায় শুকনো পাতারা উড়ে গেল এদিক ওদিক। সময় এসে থমকে দাঁড়াল।
- আরে তোরা বাপ-ব্যাটা এখানে বসে আছিস? সেই ডাক্তার ভদ্রলোক ফোন করেছিলেন – বাড়ি দেখতে আসতে চান ……। 
অভীকদা ছেড়ে দাও – “বাঁশরী” বিক্রি করব না। ওটা থাক। শাম্বর বড় পছন্দ একে। অভীকদার মুখে একচিলতে হাসি। 
 

Comments

Top

গল্প

তিনটি বিয়ের গল্প

তিনটি

বিয়ের গল্প

সূর্য্য বন্দোপাধ্যায়

পোর্টল্যান্ড, ওরিগন, মাঃ যুক্ত্ররাষ্ট্র

marriage1.png

প্রথম বিয়ে:  

নব্বই এর দশক।  আমার এক কাকার বিয়েতে কলকাতার বাইরে এক মফস্বলে গিয়েছি। সবে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছি, নিজেকে বেশ বড়ো মনে করি তখন। তাছাড়া মাবাবা ও কেউ সঙ্গে যায়নি। 'বেশি পাকামি করো না' জাতীয় কথা বলার কেউ নেই। তাই সুযোগ পেলেই যেকোনো কাজের দায়িত্ব নেয়ার চেষ্টা করছি। অবশেষে বিয়ের দিন সকালে একটা গুরুতর কাজের দায়িত্ব পেলাম। পাত্রীর বাড়ি তে গায়ে হলুদের তত্ত্ব নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব।

বিয়ের দিন সকালেই আমার বড় কাকা অসুস্থ হয়ে পড়েন, ওনার ওপরেই দায়িত্ব ছিল তত্ত্ব পার্টিকে নেতৃত্ব দিয়ে নিয়ে যাওয়ার। ওনার অসুস্থতার কারণে আমিই তখন একমাত্র অবশিষ্ট । আমার একটু কৌতূহল হলো "আচ্ছা এই বিয়েতে আমি কি একা বরযাত্রী?"

যেই কাকার বিয়ে তিনি বোঝালেন "না রে, আমার তিন জন মামা ও তাদের পরিবার ও আসবেন, আর খুড়তুতো জ্যাঠতুতো বাহিনী ও  ট্রেন এ করে আসছে"

আমি একটু অবাক হলাম "সেই তিন মামারা কেউ তত্ত্ব নিয়ে যাবেন না?"

কাকার উত্তর "আজকে তো বুধবার, ওদের অফিস আছে, ওদের ছেলে মেয়েদের স্কুল আছে, তাই ওরা সন্ধ্যে বেলায় আসবে বলেছ। দাদার যে শরীর খারাপ হয়ে যাবে, সেকথা ওরা কি করে জানবে বল?"

জিগ্যেস করলাম "আর তোমার খুড়তুতো জ্যাঠতুতো বাহিনী?"

কাকা উদাস ভাবে বললেন "ট্রেন লেট আছে খবর পেলাম, সকাল আটটায় আসার কথা ছিল, শুনছি বিকেল চারটেয় ঢুকবে।"

তারপরে একটু উৎসাহ নিয়েই বললেন "তুই তো এখন বড়ো হয়েছিস, তোকে আরও একটা কাজ দেব। তুই বিকেল এর দিকে স্টেশন এ চলে যাস, যদি শুনিস যে ট্রেন আরও লেট হবে তাহলে আমার শ্বশুরমশাইকে বলিস যে বরযাত্রীর বাস স্টেশন এ পাঠিয়ে দিতে। আমি তুই আর বাবা বরের গাড়িতে চলে যাবো।"

আমি একটু অবাক হলাম "তোমার তিন মামা কি করে যাবেন?"

কাকা এক গাল হাসলেন "ওরা তো আমার শ্বশুরবাড়ির দুটো গলি পেরিয়ে থাকেন, ওদের ফোন করে দিবি, ওরা হেঁটেই চলে যাবে"।

কাজের দায়িত্ব ক্রমেই বেড়ে চলেছে। আমি তাও জিগ্যেস করলাম" তোমার মামারা আমায় চিনবেন?"

কাকা দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করলেন, "নিশ্চয়ই চিনবে, আমার পৈতের অনুষ্ঠানে তোকে দেখেছিলো, তুই তখন সবে হাঁটা শুরু করেছিস, কত্ত খেলা করেছিল তোর সঙ্গে" এরপরে আর নিশ্চিন্ত না হয়ে থাকা যায় না। কিন্তু শেষ প্রশ্নটা তাও করেই ফেললাম "হঠাৎ করে যদি বলি বরযাত্রীর বাস স্টেশন এ পাঠিয়ে দিতে তোমার শ্বশুরমশাই আমার কথা শুনবেন? "কাকা আশ্বস্ত করলেন "নিশ্চয়ই শুনবেন, তাই তো তোকেই পাঠাচ্ছি তত্ত্ব নিয়ে। একবার তত্ত্ব নিয়ে গেলে আমার শ্বশুরবাড়ির সবাই তোকে চিনে যাবে, সবাই জানবে তোর ওপর আমাদের সবার এতো ভরসা আছে । তুই যা বলবি সবাই সেটাকে গুরুত্ব দেবে।  তাই তো বলছি আর দেরি না করে বেরিয়ে পর, আর আমার শ্বশুরবাড়ির সবার সঙ্গে ভালো করে আলাপ জমিয়ে ফিরবি"

এরপরে আর কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকে না। তাই অবশেষে আমি এই গুরু দায়িত্ব গ্রহণ করলাম। ছোটবেলায় বিয়েবাড়ি বলতে খাওয়া দাওয়াই বুঝতাম, অন্য কোনো ব্যাপারে মাথা ঘামাতাম না। কোনো এক বিয়েবাড়িতে তো পাত্র পাত্রীর সঙ্গে দেখাও করিনি, সোজা খেতে বসে গিয়েছিলাম। এই প্রথম তত্ত্ব জিনিষটা জানলাম। এখনকার বাঙালি পাঠক পাঠিকাগণ সবাই নিশ্চয়ই জানেন তত্ত্ব ব্যাপারটা। তাই সেটা নিয়ে বিশেষ বর্ণনা করার চেষ্টা করছি না। কিন্তু তখনকার দিনে এতো আড়ম্বর ছিল না। সুসজ্জিত গাড়ি নয়, সাধারণ সাইকেল রিক্সা করে আমি যাত্রা শুরু করলাম। দু হাত এ দই আর মিষ্টির হাঁড়ি, পায়ের নিচে জোড়া ইলিশ, আর কোলে শাড়ীর বাক্স নিয়ে আমি চলেছি। রিক্সাওয়ালা কে সারা রাস্তা ধরে অনুরোধ করে গেলাম আস্তে চালানোর জন্য, নইলে হাত থেকে হাঁড়ি পিছলে যাবে। রিকশাওয়ালা ও ক্রমাগত বলে গেলো “দাদা আরেকটু জোরে চালাতে দিন, নইলে স্কুল ছুটির সব প্যাসেঞ্জার হাতছাড়া হয়ে যাবে”। 

অবশেষে হবু কাকিমার বাড়ি পৌঁছলাম। মিষ্টি শাড়ি ইত্যাদি হাত বদল হলো, সৌজন্য বিনিময়, চা শরবত সহযোগে পরিচয়পর্বের মাঝে খবর পেলাম রিক্সাওয়ালা আবার ফিরে এসেছে। আমি হন্তদন্ত হয়ে দৌড় দিলাম, আন্দাজ করলাম যে ওকে টাকা দেয়া হয়নি।

রিক্সাওয়ালা এক গাল হেসে বললো, “দাদা জোড়া ইলিশটা তো রিকশাতেই রয়ে গেলো, কেউ তো নামালেন না, তাই আবার দিতে এলাম, এই আঁশটে গন্ধ নিয়ে কি আর স্কুল এর প্যাসেঞ্জার পাবো”! কলকাতার রিক্সায় একবার একটা টুপি ফেলে এসেছিলাম, সেটা আর ফেরত পাইনি। তাই  মফস্বলের এই সরল কিন্তু সৎ রিক্সাওয়ালার কথা সারাজীবন মনে থাকবে 
 

দ্বিতীয় বিয়ে:

পরের ঘটনাটি আমার এক মাসতুতো দাদার বিয়ে। ততদিন এ দশক, শতাব্দী সব বদলে গেছে। বাঙালিদের অনাড়ম্বর জীবনযাত্রাও কিছুটা বদলে গেছে। বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানগুলো একটু আড়ম্বর করে না করলে বাকিরা নিন্দা করেন। তাই সব অনুষ্ঠান এখন আর পঞ্জিকার তিথি দেখে হয় না, নামকরা কাটারার আর ভালো বিয়েবাড়ি কখন পাওয়া যায় সেই অনুযায়ী হয়। আমার এই দাদাটি (এবং হবু বৌদি) আমেরিকায় থাকে, ওর ছুটির সুবিধে এবং কলকাতার সেরা বিয়েবাড়ি পাওয়ার সুবিধে দুটো মিলিয়ে মিশিয়ে পৌষ মাসে বিয়ে ঠিক হলো।

ততদিনে আমি তত্ত্ব নেয়ার ব্যাপারে পারদর্শী হয়ে গেছি। আমি ঘোষণা করলাম "আমি তত্ত্ব নেয়ার ব্যাপারে এখন এক্সপার্ট। কবে নিতে হবে, কোথায় নিতে হবে বোলো।"

মাসিমা বুঝিয়ে বললেন "ঐসব চিন্তা নেই, সব কিছু outsourced।"

আমার হতভম্ব মুখ দেখে দাদা বোঝালো "আরে বুঝিস না, আমি আর তোর বৌদি, সবাই বিদেশ এ থাকি, আমাদের বন্ধুদের ভালো করে ফটো আর ভিডিও দেখাতে হবে তো। তাই এখন প্রফেশনাল আর্টিস্ট ভাড়া করেছি তত্ত্ব সাজানোর জন্য।"

আমি একটু অবাক হলাম "তত্ত্ব মানে তো কয়েকটা শাড়ি আর মিষ্টি, ওতে সাজানোর কি আছে?"

দাদা বোঝালো "ফটোতে যাতে ভালো দেখায়, তাই এখন অনেক ডেকোরেশন করতে হয়। মিনিমাম সংখ্যার জিনিষকে ম্যাক্সিমাম সংখ্যার ডালায় সাজানো, ঘরের লোকজন কি পারে ওই আর্টিস্ট লেভেল এর সাজাতে? "

আমি একটু কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইলাম "বৌদির বাড়ির তত্ত্ব ও কি outsourced?"

দাদা উৎসাহের সঙ্গে বললো "হ্যাঁ রে, এক আর্টিস্ট করছে, যাতে ব্যাপারটা same লেভেল এর হয়। আর তাছাড়া ডিসকাউন্ট ও আছে"

আমি অবাক হয়ে গেলাম "তত্ত্ব সাজানোর ও ডিসকাউন্ট?"

দাদা বোঝালো "হ্যাঁ রে, দুটো ফ্যামিলি একসঙ্গে কন্ট্রাক্ট দিলে কুড়ি% ছাড়, আমরা তো ঐজন্যই দুই বাড়ির কাজও এক পুরোহিত দিয়েই করাচ্ছি। ওখানেও ডিসকাউন্ট !"

আমি হাল ছেড়ে দিলাম "তাহলে আমায় কি করতে হবে?"

মাসিমা উৎসাহের সঙ্গে বললো "তুই বরং জুতো পাহারা দিস, বিয়েতে একটা নিয়ম আছে না জুতো লুকিয়ে রাখার?"

আমি একটু চিন্তিত হয়েই বললাম "আমি কিন্তু কোনো বিয়েতে কারোর জুতো লুকিয়ে রাখার নিয়ম দেখিনি, যদিও এটা ঠিক যে খাওয়া দাওয়া ছাড়া বিশেষ কিছু আমি খেয়াল করতাম না আগে।"

দাদা একগাল হেসে বললো "কি যে বলিস, বলিউড এর সিনেমায় দেখিস নি?" আমি প্রতিবাদ করলাম "সেটা তো সিনেমা!"

দাদা বললো "আরে তুই বুঝিস না, আমেরিকায় গিয়ে যখন সবাইকে বিয়ের ছবি, ভিডিও ইত্যাদি দেখাবো, ওরা তো সিনেমায় যা দেখে তার সঙ্গে মিলিয়ে দেখবে যে BIG INDIAN WEDDING হয়েছে কিনা। তোর বৌদি কিন্তু আগেই বলে রেখেছে, একটুও খুঁত থাকলে চলবে না, একদম বলিউড স্টাইল এর BIG INDIAN WEDDING চাই"।

আমি বুঝলাম যে এটাই এখনকার নীতি, মানিয়ে নেওয়া ভালো। সিনেমাতে জুতো লুকোনোর পরে যে টাকা দেয়া দেখায়  সেটাও হবে কিনা জানতে চাইলাম। মাসিমা খুব উত্তেজিত হয়ে ফোনের দিকে ছুটে গেলেন বৌদির বাড়িতে ফোন করতে।

"আচ্ছা জুতোর ব্যাপারটা হচ্ছে তো?"

"জুতো? মানে জামাইকে নতুন জুতো দিচ্ছি কিনা জানতে চাইছেন? ওটা মনে হয় তত্ত্বর সঙ্গে যাবে। বিয়ের মণ্ডপে চাই নাকি?"

"আরে না না, আমি জুতো লুকোনোর কথা বলছিলাম"।

"ও আচ্ছা, হ্যাঁ মানে আমি ঠিক জানি না, কেন বলুন তো?"

"আসলে কতজন ভাইবোন মিলে লুকোবে সেটা জানা থাকলে সেইমতো একটা হিসেবে, মানে সেইমতো একটু ক্যাশ, মানে বুঝেছেন তো? মানে আজকাল যেরকম দেখায় টিভিতে "

"ওহ আচ্ছা আচ্ছা, বুঝেছি। দাঁড়ান, একটু পরেই জানাচ্ছি"।

আধঘন্টার মধ্যেই বৌদির বাড়ি থেকে খবর এলো যে মামাতো মাসতুতো খুড়তুতো পিসতুতো বাহিনী মিলিয়ে ওরা মোট পঁচিশ ভাই বোন। মিনিট দশেক পরে খবর এলো যে বৌদির কিছু বান্ধবীও যোগদান করবেন এই জুতো চুরির মহান কর্মযজ্ঞে, তাই মোটামুটি পঁয়ত্রিশ জনের হিসেবে করে আসাই ভাল। মাসিমা কাগজ পেন নিয়ে হিসেবে করে দাদাকে বললো যে মাথাপিছু দুশো ধরে নিয়ে সাত হাজার ক্যাশ রেডি করে আমার কাছে গচ্ছিত রাখতে।  সাত হাজার ডলার শুনে দাদা আর্তনাদ করে উঠেছিল, কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই সামলে উঠলো যখন মাসিমা বোঝালেন ওটা সাত হাজার টাকা, ডলার নয়। সেই মতো আমরা সন্ধ্যাবেলায় রওনা হলাম। 

আমি ভাই হিসেবে খুবই কর্তব্যপরায়ণ। খুবই নিষ্ঠার সঙ্গে সারা সন্ধ্যে জুতো পাহারা দিয়েছিলাম। এতই নিষ্ঠার সঙ্গে পাহারা দিয়েছিলাম, যে বিয়েতে কন্যা সম্প্রদানের পরেই বৌদির বাবার গর্জন শোনা গেলো "আমার চটি কে লুকিয়ে রাখলি রে? আজ অবধি কোনো বিয়েতে মেয়ের বাবার জুতো লুকোনো দেখিনি, সিনেমাতেও না!"

কি আর করা, আমি তো দায়িত্ব নিয়ে দাদার চটি সামলে রেখেছিলাম, আর বাকিরা তাই ভুল করে দাদার শ্বশুরমশাইয়ের চটিজোড়া হাতিয়ে নিয়ে গেছে। ওদের খুব একটা দোষ দেওয়াও যায়না, আসলে দুই জোড়া চটি তো এক দোকান থেকে একসঙ্গেই কেনা, ওখানেও তো ডিসকাউন্ট!!

তৃতীয় বিয়ে :

আরো একটি দশক পেরিয়ে গেছে। বাঙালিদের বিয়ে এখন পুরোদস্তুর BIG INDIAN WEDDING স্টাইল এর সাড়ম্বর বিয়ে।  এক দশক আগেই তো  কুষ্ঠি – ঠাকুরমশাই - পঞ্জিকা ছেড়ে ক্যাটারের ডেকোরেটর এর মর্জিমতো বিয়ের দিন ঠিক হতো।এই দশক এ দেখা গেলো অনুষ্ঠানের  প্রতিটি পদক্ষেপ নেয়া হয় ফটোগ্রাফার এর মর্জি  মতো।ফটো ঠিকমতো ফোকাস না হলে ৩ বারের জায়গায় ৫-৬ বার ও মালা বদল করতে হয়।আগুন এর ঔজ্জ্বল্যর সঙ্গে বৌয়ের বেনারসির ঔজ্জ্বল্য যতক্ষণ না মিলছে, ততক্ষন অবধি বর বৌ আগুনের ধারে পাক খেয়েই যায়, অনেকসময় সাত এর বেশি।কিছু কিছু অনুষ্ঠানে আবার ক্যাটারের, ডেকোরেটর ইত্যাদিকে দেখাশোনা করার জন্য ইভেন্ট ম্যানেজার থাকেন, বাড়ির কোনো আত্মীয়কে সেই দায়িত্ব নিতে হয়না, ওনারা নিশ্চিন্তে নির্বিঘ্নে সেলফি তুলতে থাকেন।

পরের ঘটনা সেইরকম যুগের একটি বিয়ের।আমেরিকা থেকে ছুটিতে দেশে এসেছি, সেইসময়ে এক বান্ধবীর বিয়ে।বিয়েবাড়িতে সিঁড়ির মুখে একটা হোঁচট খেয়ে পুরো একটা দরজার ফুল, মালা ইত্যাদি ছিঁড়ে ফেলেছি।বেশি কেউ দেখার আগেই ব্যাপারটা সামলে ফেলতে হবে এই ভেবে তাড়াতাড়ি ডেকোরেটর কে ডেকে আনলাম। ঠিক এই সময়েই বরযাত্রীরা দলবল নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে এলো।আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি, হঠাৎ পেছন থেকে ক্রূদ্ধ তরুণী কণ্ঠ ভেসে এলো "আপনার কিকোনো আক্কেল নেই, দেখছেন যে বর বেচারি অনেক কষ্টে ধুতি সামলিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠছে, আর সেখানে আপনি রাস্তা আটকে কি করছেন?"

নিজের ভুলটা যথা সম্ভব চেপে রাখাই ভালো।তাই আমি একটু আমতা আমতা করেই বললাম "ওই একটু ফুলগুলো ঠিকঠাক আছে কিনা দেখছি" 

তরুণী আবার গর্জে উঠলেন "আচ্ছা বলুন তো, বিয়েতে কোনটা বেশি দরকার, ফুল দিয়ে সাজানো গেট নাকি বর?"

আমি ওনাদের কে বরযাত্রীদের ঘরের দিকে নিয়ে যাওয়ার পথে  নিরীহ ভাবেই বললাম "আমরা তো জানি যে বর বেশি দরকারি, কিন্তু আজকালের বর - বৌরা আবার সাজসজ্জার দিকেও খুবই গুরুত্ত্ব দেন, নইলে ছবি ভালো আসে না"

তরুণী দেখলাম একটু শান্ত হলেন।  হ্যা এটা একদম ঠিক কথাই বলেছেন, ভালো করে সাজান না যত পারেন, আমি খালি ভয়পাচ্ছিলাম ঐটুকু জায়গা দিয়ে বর যেতে পারবে কিনা" আমি তরুণীকে ভরসা যোগালাম "আমি তো জানতাম যে এই বিয়ের পাত্র নাকি অসাধ্য সাধন করতে পারেন । আর আপনি ভাবছেন এই জায়গা দিতে যাতে পারবেন না।"

তরুণী ভ্রূকুটি করলেন "মানে, কি বলতে চাইছেন?"

আমি মোক্ষম দৃষ্টি ভঙ্গি তুলে ধরলাম "আজকাল ভালো ক্যাটারের এর জন্য ৫-৬ মাস আগে বলতে হয়, ভালো বিয়ে বাড়ি পেতে গেলে এক দেড় বছর আগে নাম লেখাতে হয়, আর ভালো পাত্রী পাওয়া তো বহু বছরের সাধনার কাজ।কিন্তু শুনেছি উনি নাকি এই সমস্ত কঠিন কাজ এক বছরের মধ্যেই করে ফেলেছেন, তাই বলছিলাম" দেখলাম কথাটা তরুণীর মনে ধরেছে। "ভালোই তো ডায়ালগবাজি পারেন দেখছি" বলে মুচকি হেসে চলে গেলেন।মনে হলো যে উনি নিশ্চই ঠান্ডা হয়েছেন এতক্ষনে, তবুও সাবধানের মার্ নেই।আমি তাই ওনাকে ঠান্ডা রাখার জন্য আরো দুটো এক্সট্রা আইস-ক্রিম ও দিয়ে এলাম, বিয়েরদিনে বরযাত্রী কে চটিয়ে কাজ নেই।

পরের কিছু ঘন্টা নির্বিঘ্নেই কাটলো। বিপত্তি ঘটলো বাসর ঘরে।আমাকে দেখে সেই তরুণী চমকে গেলেন "আপনি বাসরঘরে কি করছেন? আপনার কাজ তো হয়ে গেছে নাকি?" আমিও একটু ঘাবড়ে গেলাম, আমার কাছে যেটা সবচেয়ে গুরুত্ত্বপূর্ণ কাজ, অর্থাৎ ভুরিভোজ, সেটা তো এখুনি শেষ করেই এসেছি।তরুণী কি করে সেটা বুঝে গেলেন? আমি একটু প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বললাম যে "বাসর ঘরে একটুগল্প গুজব করতে এলাম সবার সঙ্গে, এই আর কি"

তরুণী ও মুচকি হেসে বললেন "আপনি তো খুবই কর্তব্যপরায়ণ ইভেন্ট ম্যানেজার দেখছি, আজ অবধি কোনো ইভেন্ট ম্যানেজার কে বাসরঘর সামলাতে দেখিনি"

আমি খুবই বিনয়ের সঙ্গে জানালাম যে আমার কোনো কিছু ম্যানেজ বা সামলানোর ক্ষমতা খুবই সীমিত, আমি তাই পাত্রীর বন্ধু হিসেবেই এসেছি।

Comments

Top

রাখগারি রহস্য

রাখগারি রহস্য

বিবেকানন্দ পন্ডা
 

archaeological.jfif

গল্প

ডঃ ঝার সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল দিল্লী যাওয়ার সময় ট্রেনে।  সেবার আমরা আর সৌমেনরা যাচ্ছিলাম ল্যান্সডাউন। ছিলাম পূর্বা এক্সপ্রেসে। আসানসোলের কাছে ট্রেন থামতেই এক সৌম্য দর্শন ভদ্রলোক উঠে পড়লেন কামরায়। বয়স ৫৫ কি ৫৬, এক মুখ কাঁচা পাকা দাড়ি। আমরা টু টিয়ার এ সি কামরাতে ছিলাম জানলা বরাবর। ভদ্রলোক বসলেন সাইডে জানলার পাশে। মিনি আর গোপলা নিজেদের মধ্যে বকবক করে যাচ্ছিল। আমিও আবার বেশি সময় চুপ করে থাকতে পারিনা। একটু পরেই ভদ্রলোকের সঙ্গে আমাদের আলাপ জমে উঠল। উনি ডঃ পরিতোষ ঝা, মগধ বিশ্ববিদ্যালয়ের আরকিওলজি বিভাগের প্রধান। আসানসোল, বরাকর, বিদ্যাসাগর পেরিয়ে এসে পড়লাম ঝাড়খন্ডে। দুদিকে ঢেউ খেলানো জঙ্গলে ঢাকা সবুজ পাহাড়। দুরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছোট ছোট গ্রাম, দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। জানলার বাইরে দেখতে দেখতে কথা বলছিলাম পরিতোষ ঝা-র সঙ্গে। উনি দিল্লি যাচ্ছেন একটা  conference এ paper পড়তে। কথায় কথায় বলে ফেললাম "দেখুন দেখি, পাকিস্তানের কি ভাগ্য, সব থেকে প্রাচীন সভ্যতার স্থানটি তো ওখানেই রয়েছে"? উনি আমার দিকে কিছুক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে থেকে বললেন " আপনার কেন এমন মনে হল? "আমি একটু আমতা আমতা করে বললাম "আসলে হরপ্পা আর মাহেঞ্জদরো এই দুটো বিখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক স্থলই তো এখন পাকিস্তানে, তাই বলছিলাম।"
"একেবারেই ঠিক বলেননি। আপনি লোথালের নাম শুনেছেন?"
"হ্যাঁ তা শুনেছি, গুজরাতের একটা জায়গা, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আছে।"
"ঠিক বলেছেন, তবে এ যে সে জায়গা নয়। এর বয়স মাহেঞ্জদরোর সমান সমান বা তার চাইতেও বেশি। তাছাড়া এরকম আর ৭/৮ টি নিদর্শন এই ভারতেই আছে।" 
"তাই! তবে আমি তো জানতাম যে সিন্ধু সভ্যতার জায়গাগুলো ওই সিন্ধু আর তার শাখা নদী গুলোর আশপাশে ছড়ান রয়েছে।"
"আপনি ঠিক বলেছেন, এই তো কয়েকদিন আগে হরিয়ানার রাখগারিতে এরকমই এক পুরনো সভ্যতার চিহ্ন পাওয়া গেছে, আর এই সভ্যতার বয়স সাড়ে পাঁচ হাজার বছর। আমি আর আমার বন্ধু, পুনার ডেকান কলেজের প্রফেসর সিন্দে দুজনেই তখন এক সঙ্গে রাখগারি তে খননের কাজ করছিলাম। আমি দিল্লির conference এ এটা নিয়েই paper পড়তে যাচ্ছি।" 
"কি বলেন! রাখগারির সভ্যতা সাড়ে পাঁচ হাজার বছরের পুরনো? তার মানে মাহেঞ্জদরোর থেকেও প্রাচীন?" 
"শুধু প্রাচীন বললে ভুল হবে, এখানে যা পাওয়া গেছে তা কিন্তু মাহেঞ্জদরোতেও পাওয়া যায় নি।"
আমি একটু বিস্মিত হয়ে বললাম "মানে?"
"পুরনো কোন মাটির পাত্র, গয়না, থালা বাসন তো প্রায় সব প্রত্নতাত্ত্বিক খননে পাওয়া যায়, কিন্তু এই রাখগারিতেই পাওয়া গেল নরকঙ্কাল, সাড়ে পাঁচ হাজার বছরের প্রাচীন নরকঙ্কাল, মিশরের মমির থেকেও পুরানো, ভাবতে পারছেন?"
"আচ্ছা, এই কঙ্কাল গুলো কি পিরামিডের মত কোন সমাধি মন্দিরে পাওয়া গেছে?"
"না না কোন পিরামিড টিরামিড নয়, তবে যে কোন কবর ই তো একধরনের সমাধি মন্দির, তাই না?এই কঙ্কালগুলো পাওয়া গেছে কবরের মধ্যে, মাটির নিচে। একটা দুটো নয়, একসাথে অনেকগুলো কবর, যাকে বলে হরপ্পান যুগের শ্মশান। বুঝুন দেখি কি অদ্ভুত ব্যাপার। এতদিন প্রত্নতাত্ত্বিকরা হরপ্পান যুগের একটা 'ডি এন এ' পাওয়ার জন্যে হাপিত্যেশ করে বসে থাকত, আর রাখগারিতে 'ডি এন এ' র ছড়াছড়ি।" আমি অবাক হয়ে বললাম "তার অর্থ হরপ্পান যুগের লোকেরা কেমন ছিল, কেমন খাওয়া দাওয়া করত, এবার থেকে সব জানতে পারব আমরা?"  
ডঃ ঝা একটু জোর দিয়ে বলে উঠলেন, "অবশ্যই পারব, আর তা হবে এক যুগান্তকারী ব্যাপার।"
ট্রেন ঝাঁঝাঁ স্টেশন ছাড়িয়ে এগিয়ে চলল, আমরা আবার দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষ করে একটু বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। আমার আবার ট্রেনে ঘুম হয় না। ডঃ ঝা কে দেখলাম ল্যাপটপ বের করে কিছু দেখছেন, বললাম " কিছু কাজ করছেন?" উনি ল্যাপটপটা বন্ধ করে ব্যাগের মধ্যে রাখতে রাখতে বললেন "তেমন কিছু না, ওই কনফারেন্সের পেপারটাতে একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম।" বললাম "আমাদের মত সাধারণ মানুষদের তো এই সব আর্কিওলজিক্যাল জায়গা খোঁড়াখুঁড়ি দেখার কোন অভিজ্ঞতা নেই, তাই আপনি ব্যস্ত না থাকলে আপনার মুখে সেই গল্প শুনবো।"
"না না, এখন তো কোন কাজ নেই, ট্রেনে বসে সময় কাটানো এক সমস্যা। সত্যি বলতে কি, যারা প্রত্নতত্ত্ববিদ নয় তাদের কাছে এই খোঁড়াখুঁড়িটা একটা বোরিং ব্যাপার। এতো আর কোন পুরনো দুর্গ বা রাজপ্রাসাদ দেখা নয় যে গাইড এসে আপনাকে জানিয়ে দেবে, এটা অমুক রাজার সিংহাসন ওটা তমুক রানীর স্নানের জায়গা। এখানে হয়ত একটা ভাঙ্গা মূর্তি বা এক টুকরো হাড় পেলেন, সেটাই আপনার সূত্র।"
"ও তাই!"
"হ্যাঁ, বলতে পারেন প্রত্নতত্ত্ববিদরা এক একজন ডিটেকটিভ। ওই সামান্য সূত্র থেকেই বের করে আনেন অমূল্য সব ঐতিহাসিক  তথ্য। তবে ডিটেকটিভদের থেকেও কাজটা শক্ত।"
"আমার কিন্তু এই সব প্রত্নতাত্ত্বিক জায়গা দেখতে খুব ভাল লাগে।" 
পরিতোষ ঝা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলে উঠলেন "আজকাল কেউ আর এই সব প্রত্নতাত্ত্বিক জায়গার মূল্য বোঝে না। সব নষ্ট করে ফেলছে নয় তো চড়া দামে বাইরে পাচার করে দিচ্ছে। তাই আপনার কথা শুনে ভাল লাগল।" আমি বললাম "আচ্ছা, রাখগারি তে আপনার কোন স্মরণীয় অভিজ্ঞতা নেই?" ডঃ ঝা একটু চুপ করে আস্তে আস্তে বললেন, "নেই আবার! এমন একটা ঘটনা ঘটেছিল, যা আমি সারা জীবনেও ভুলব না।" আমি নতুন গল্পের গন্ধ পেয়ে উৎসাহের সঙ্গে বললাম, "কি--কি সেই ঘটনা?"
আমাদের কথার মাঝে চা ওলা এল। আমরা সবাই চা নিয়ে বসলাম। মিনি তার দাদাইয়ের সঙ্গে গল্পে মেতে আছে। পরিতোষ ঝা-র গল্পের কথা কানে যেতেই নন্দিতা নড়েচড়ে বসল। 

চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ডঃ ঝা শুরু করলেন "২০১২ এর নভেম্বর মাস, তারিখটা ঠিক মনে নেই। প্রফেসর সিন্দে আগে থেকেই রাখগারিতে খননের কাজ চালাচ্ছিল। আমার যেতে কয়েকদিন দেরি হয়েছিল। দিল্লী এয়ারপোর্ট এ নেমে একটা গাড়ি নিলাম রাখগারির জন্য। রাখগারির দূরত্ব দিল্লী থেকে ১৫০ কিমি। বিকেল ৪ টা নাগাদ রাখগারির থেকে ২৫ কিমি দূরে পৌঁছে গেলাম। এর পর রাস্তার অবস্থা খুব একটা ভাল নয়। সন্ধের ঠিক আগে আগে পৌঁছে গেলাম রাখগারিতে। এই রাখগারিতে কোন হোটেল পাওয়া তো দুরস্থান, একটা ভাল খাওয়ার জায়গাও নেই। সিন্দে আমার জন্য লোক পাঠিয়েছিল। তার কাছ থেকে জানলাম, সবথেকে বড় ৯ নম্বর টিলাটার পাশে তাঁবুতে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। শেষ আধ কিলোমিটার গাড়ি যাবে না, তাই হেঁটেই পাড়ি জমাতে হল। বিকেলের পড়ন্ত আলোতে দেখলাম চারিদিকে ধু ধু পাথুরে মাঠ, মাঝে মাঝে অনুচ্চ পাথুরে টিলা। চারিদিকে ছড়িয়ে আছে ভাঙা ইটের টুকরো, ইতিউতি উঁকি মারছে পুরনো ভেঙ্গে পড়া ইটের দেওয়াল, যার বেশির ভাগটাই মাটির নিচে। মাঝে মাঝেই চোখে পড়ছে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার সাইন বোর্ড। কোথাও বড় গাছ চোখে না পড়লেও ছোট ছোট ঘাস আর ঝোপে ঢেকে রয়েছে গোটা এলাকাটা। এর মধ্যেই ভাল ঠাণ্ডা পড়তে শুরু করেছে। গ্রামের গরুগুলো চারিদিকে দলবেঁধে ঘুরে বেড়াচ্ছে। গিয়ে দেখলাম মোট ৪ টে তাঁবু পড়েছে। একটা তে সব শ্রমিকদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে, দু নম্বর তাঁবু টা আমার আর সিন্দের জন্য। তিন নম্বর তাঁবুটাতে আছেন সাউথ সিওল ইউনিভার্সিটি র দুই অধ্যাপক, ওয়াও ইয়ং জুন আর এন জিন ও। আর চার নম্বর তাঁবু -তে আছে তিনজন পি এইচ ডি র ছাত্রী, তানিয়া, এশা আর মুথুলক্ষ্মী। তানিয়া আর এশা বাঙ্গালী আর মুথুলক্ষ্মী তামিল মেয়ে। খাওয়ার সময় সিন্দের কাছ থেকে জানলাম রাখগারি তে সব মিলেয়ে প্রায় নয়টি টিলা আছে। তার মধ্যে পাঁচ নম্বর ঢিপিটা একটা আস্ত গ্রাম, তাই ওখানে কোন খোঁড়াখুঁড়ি করা সম্ভব হয় নি। খুব ক্লান্ত ছিলাম, তায় আবার রাতে খুব ঠাণ্ডা ছিল, তাই সিন্দেকে গুড নাইট বলে শুয়ে পড়লাম। পর দিন সকালে প্রাতঃভ্রমণ করতে গিয়ে ইয়ং ও জিনের সঙ্গে পরিচয় হল। প্রফেসর ইয়ং অ্যানথ্রপলজি নিয়ে কাজ করেন। ডঃ জিন এর কাজটা একটু অন্য রকম, উনি ডি এন এ বিশেষজ্ঞ। ডি এন এ phenotyping করেন, মানে ডি এন এ র গঠন থেকে কম্পিউটারে লোকটির probable face এবং habit কি হতে পারে তা ফুটিয়ে তোলেন। সকালে হাঁটতে হাঁটতে জায়গাটার একটা ম্যাপ মনের মধ্যে এঁকে নিলাম। রাখগারির এই জায়গাটা  ৫৫০ একর, মহেঞ্জোদড়োর প্রায় দ্বিগুণ বড়। 
    সকাল আটটা নাগাদ ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়ে পড়লাম সাত নম্বর ঢিবিটার দিকে, মূল খনন কাজটা ওখানেই হচ্ছে। সাত নম্বর ঢিবিটা বেশ উঁচু, চারিদিকে পোড়ামাটির ছোট ছোট ইটের দেওয়ালের ধ্বংসাবশেষ। এর মধ্যে ওই তিনজন ছাত্রীও চলে এল। তানিয়া ও মুথুলক্ষ্মী পুনা কলেজে পি এইচ ডি করে আর এশা মগধ বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার কাছে কাজ করছে। পুনাতে সিন্ধের কিছু কাজ ছিল, তাই ও আমাকে প্রোজেক্টের কাজগুলো বুঝিয়ে দিয়ে দিল্লীর পথ ধরল। আমি জিন ও ইয়ং ঢিবিটার ওপরে রোদ্দুরে বসে কথা বলছিলাম। একটু দূরে ১২ জন স্থানীয় লোক খুব সাবধানে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ করছিল। মেয়েরা ওখানেই ছিল, ওদের কে বলে দিয়েছিলাম কোথাও অন্যরকম কিছু দেখলেই আমাদের জানাতে। আমি ইয়ং এর সঙ্গে কথা বলে বোঝার চেষ্টা করছিলাম ডি এন এ phenotyping কিভাবে করা হয়। এমন সময় তানিয়া দৌড়তে দৌড়তে এসে বলল "স্যার, আসুন, কিছু একটা আছে মনে হয়।" আমি জিন ও ইয়ং তিনজনেই দৌড়ে গেলাম। একটা ইটের দেওয়ালের পাশ থেকে আলগা মাটি সরিয়ে নেওয়া হচ্ছিল আলতো ভাবে, কিন্তু কিছু পরেই নিচের ইটের আস্তরণ দেখা দেয়। মুথুলক্ষ্মী বলে ওঠে "স্যার মনে হচ্ছে এর নিচে একটা কবর আছে।" যে লোকগুলো কাজ করছে তাদের নেতা বুধিয়া বলল "স্যার, আগের বারে  আমরাই কাজ করেছিলাম, তখনো এরকমই ইটের ছাতের নিচে কবর পাওয়া গিয়েছিল।" আমি জিন আর ইয়ং কে ইংরাজী তে সব বুঝিয়ে বললাম। জিন খুব উত্তেজিত হয়ে বলল "ঝা, তুমি এখন এদের খোঁড়াখুঁড়ি বন্ধ করতে বল, এরপর আমাদের খুব সতর্ক হয়ে কাজ করতে হবে। যদি এতে কোন কঙ্কাল থাকে, তা যাতে মানুষের হাত লেগে সঙ্ক্রমিত না হয়ে যায় তা খেয়াল রাখতে হবে।" আমি বললাম, "কিন্তু জিন, এই খোঁড়াখুঁড়ির সময় তো ছোঁয়াছুঁয়ি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি, তা আটকাবে কি করে?"
"সবাইকে কবরটা খোলার কাজ করতে হবে না। তুমি এদের থেকে কয়েকজনকে বেছে নাও, তারা ওই ওপরের ইটগুলো সরিয়ে গ্লাভস আর অ্যাপ্রন পরে কাজ করবে।

আমি ওদের থেকে বুধিয়া, হরেন আর নগেন কে বেছে নিলাম। রামু এই দলে আসতে চাইছিল, আমি ওকে বুঝিয়ে অন্য কাজ  করতে বললাম। ছাত্রীরাও ওদের সাথে হাত লাগাল। ওপরের ছাত যাতে না ধসে যায়, তাই ইটগুলো সরাতে বুধিয়ারা সময় নিচ্ছিল। বিকেল নাগাদ ওপরের ইট গুলো মোটামুটি সরান গেল। দুই ফুট নিচে চোখে পড়ল প্রায় মাটির সঙ্গে মিশে থাকা পাশাপাশি দুটো নরকঙ্কাল। আমি অবাক হয়ে গেলাম। রাখগারি তে আমি আগেও এসেছি, আর কঙ্কাল পেয়েছি, কিন্তু একই কবরে দু দুটো নরকঙ্কাল এই প্রথম। দীর্ঘদিন মাটিতে থাকার জন্য কঙ্কালের পাশের মাটি শক্ত পাথরের মত হয়ে রয়েছে। জিন ও ইয়ং প্রথমে ফটাফট কতকগুলো ছবি তুলে নিল, তার পর আমি, জিন ও ইয়ং ওই তিন ছাত্রীর সঙ্গে হাত লাগালাম কফিনটা পরিস্কার করতে, বুধিয়া দের হাত লাগাতে বারণ করলাম। মাটির কফিন টা খুব ছোট  নয় প্রায় ৭ ফুট বাই ৪ ফুট। দুটো কঙ্কালের মাথাই উত্তর দিক করে রাখা। একটা লম্বায় ৫ ফুট ২ ইঞ্চি, আর একটা একটু ছোট, ৫ ফুট। বড় কঙ্কালের পায়ের গোড়ালির  হাড়টা ভাঙা আর মুখটা কাত করে ছোট কঙ্কালের দিকে ঘোরানো। মাথার কাছে পোড়া মাটির ভাঁড়, পুতুল, চুড়ি আর কি সব নীল নীল মাটির ভেতর থেকে উঁকি দিচ্ছে, তবে মাটি না সরালে ঠিক বোঝা যাবে না।

সন্ধে হতে আর বেশি বাকি নেই, জিন বলল "আর দেরি করা ঠিক নয়। আমি বরং এখন এই কঙ্কাল গুলোর থেকে ডি এন এ টেস্টের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিস সংগ্রহ করে নিচ্ছি, তা না হলে পরে করো হাত লেগে গেলে সঠিক ডি এন এ পাওয়া যাবে না।" এর পর প্রায় আধ ঘণ্টার চেষ্টায় জিন দুটো কঙ্কালের হাড়ের নমুনা সংগ্রহ করে বিশেষ বাক্সের মধ্যে রাখল। আমি জানি আন্তর্জাতিক বাজারে এই প্রাচীন কঙ্কালের দাম কোটি কোটি টাকা। তাই এই কঙ্কাল দুটো উদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত এই জায়গাতে পাহারার ব্যবস্থা করতে হবে। বুধিয়াকে পাঠিয়ে পাশের থানা থেকে দু জন হোমগার্ডের ব্যবস্থা করলাম। ঠিক হল ওই দু জন হোমগার্ডের সাথে আমাদের শ্রমিকরা মানে বুধিয়ার দলবল সারারাত পাহারা দেবে। মেয়েদের বলে দিয়েছিলাম, যা যা দেখছে তা যেন লিখে রাখে। সন্ধের পর চা খেতে খেতে সিন্দেকে ফোনে সব জানালাম। সিন্দে জানাল যে ওর ফিরতে আরো ২/৩ দিন সময় লাগবে। 

সেদিন রাতে আমি একাই ছিলাম তাঁবুতে। আমি ডাইরিতে সব লিখে যখন ঘুমতে গেলাম তখন রাত ১১ টা। হঠাৎ রাতে কিছু একটা পড়ার শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল। উঠে আলো জ্বালাতে গিয়ে দেখলাম লোডশেডিং। মোবাইলের আলোয় দেখলাম রাত ৩টে। একটু বসে আর কোন শব্দ না শুনতে পেয়ে আবার শুয়ে পড়লাম। পরদিন সকালে উঠে আমি যখন


সাত নম্বর ঢিবিটার কাছে পৌঁছলাম তখন একটা গোলমাল শুনতে পেলাম। এশা এসে আমায় যা বলল তার থেকে বুঝলাম যে কাল রাতে যখন লোডশেডিং হয়েছিল তখন কেউ বা কারা এসে ঐ কবরের মধ্যে খোঁড়াখুঁড়ি করেছে। আমি তাড়াতাড়ি গিয়ে দেখি চোর কঙ্কালের কোন ক্ষতি করে নি, তবে মাথার কাছের পোড়া মাটির জিনিসগুলোকে খুঁড়ে বের করেছে, কিন্তু কিছুই নিয়ে যায় নি, সব যত্ন করে পাশে সরিয়ে রেখেছে। দেখলেই বোঝা যায় চোর বেশ পাকা হাতের লোক। কিছুতেই বুঝতে পারলাম না চোর কেন এসেছিল, কঙ্কাল, পোড়া মাটির জিনিসপত্র সব ঠিক ঠাক আছে। তবে চোর কেন এসেছিল, কিসের জন্য এত খোঁড়াখুঁড়ি করল? তানিয়া বলল "স্যার, গতকাল বিকেলে দেখছিলাম কঙ্কালের মাথার কাছে মাটির ভেতর থেকে নীল রঙের কিছু একটা উঁকি দিচ্ছে,  চোর ওটার জন্য আসে নি তো!" আমিও কাল ওই নীল রঙের পদার্থটা দেখেছিলাম, এখন আর নেই, আমার মনে হল তানিয়ার কথা ঠিক হতেও পারে। যাই হোক থানায় খবর দেওয়া হল, কিছুক্ষণের মধ্যে দারোগা অমরেন্দ্র সিং দলবল নিয়ে পৌঁছে গেলেন। দারোগা সবাই কে জিজ্ঞাসা করলেন। লোডশেডিং এর সময় হরেন পাহারাতে ছিল, জেরায় সে জানাল যে ওই সময় সে নেশা করে ঘুমিয়ে পড়েছিল। চোর যে জায়গাটা খোঁড়াখুঁড়ি করেছিল সেখানে খুঁজে এক টুকরো নীল পাথর পাওয়া গেল। সবাইকে জেরা করে থানায় ফেরার সময় দারোগা অমরেন্দ্র সিং বললেন "প্রফেসর সাহাব, আমি এই পাথরটা নিয়ে যাচ্ছি, পরীক্ষা করে দেখতে হবে কি পাথর এটা। আর আমি খবর নিয়ে জানলাম কাল রাতে লোডশেডিং হয় নি, কেউ একজন মেন সুইচ বন্ধ করে দিয়েছিল। এখন চলি, পরে কোন খবর থাকলে আপনাকে জানাব।"

সেদিন বিশেষ কোন কাজ হল না। সন্ধ্যে নাগাদ দারোগা সাব ফোন করে জানালেন যে ওই নীল পাথরটা 'লাপিস লাজুলি'। চমকে উঠলাম। কি বিচ্ছিরি ব্যাপার, এটা আমার মাথায় আগেই আসা উচিত ছিল। প্রাচীন কালে নীল রঙ বানান সম্ভব ছিল না, এমন কি হালে ব্রিটিশ সময়েও  কৃত্রিম নীল রঙ বানান যেত না, তাই নীল চাষ হত। কিন্তু তার ও আগে নীল চাষ করে যে নীল রঙ বানান যায় তাও কেউ জানত না। সেই সময়ে যে সব ছবি আঁকা হয়েছে তাতেও নীল রঙ ব্যবহার করা হয়েছে। অজন্তার ছবিতে যে উজ্জ্বল নীল রঙ ব্যবহার হয়েছে তা হল আফগানিস্তানের এক ধরনের পাথরের গুঁড়ো। এই পাথরই হল লাপিস লাজুলি। অজন্তার যুগের মানুষরা এই পাথরের ব্যবহার জানলেও আজ থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগে হরাপ্পার মানুষরাও যে এই পাথরের ব্যবহার জানত, সে প্রমাণ এর আগে পাওয়া যায় নি। প্রাচীন কালে গাঢ় নীল রঙের এই পাথর খুবই মহার্ঘ ছিল, সোনার থেকেও দামি। তবে এখন এত দামি না হলেও মূল্যবান পাথরের দলে পড়ে।  সন্ধ্যার পর আমি সাত নম্বর স্তূপের কাছে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিলাম কে ওই লাপিস লাজুলি চুরি করল, আর নিয়ে কোথায়ই বা রাখল? টিলা থেকে একটু দুরেই এসে পড়েছিলাম, দিনের আলো প্রায় ছিল না বললেই চলে, হঠাৎ যেন মাটি ফুঁড়ে দুটো ছায়ামূর্তি আমার সামনে চলে এল। আমি একটু হকচকিয়ে গেলাম, ভাল করে তাকিয়ে দেখলাম ভুত টুত নয় দুটো মানুষ, একটা পুরুষ আর একটা মেয়ে। অন্ধকারে এর বেশি কিছু বুঝতে পারলাম না। ওরা কিছু একটা বলছে ওই সুড়ঙ্গের দিকে দেখিয়ে, কিন্তু আমি ওদের ভাষা একটুও বুঝতে পারছি না, তবে ওদের কথায় তামিল টান আছে তা বেশ বুঝতে পারলাম। অন্ধকার নেমে এসেছে, আমি ওদের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা নিরাপদ নয় মনে করে ফেরার পথ ধরলাম। ওরাও নাছোড়, আমার পিছু পিছু আসতে লাগল। আমার তাঁবুর সামনে যে আলো জ্বলছিল তার আলোতে এবার লোকটি ও মহিলাটি কে ভালো করে দেখতে পেলাম। দুজনেই কালো ও বেঁটেখাটো আর কালো। দুজনের মুখেই আদিমতার ছাপ রয়েছে, পরনের পোশাকটি ও অদ্ভুত, মনে হচ্ছিল যে ভারতের কোন প্রাচীন জনপদ থেকে উঠে এসেছে। বেশ কিছুদিন আগে আমি দক্ষিণ ভারতের নীলগিরি পর্বত এলাকাতে কাজ করেছিলাম। এই দুজনের চেহারার সঙ্গে ওখানের আদিবাসীদের চেহারার অনেক মিল। ওরা সমানে কথা বলে চলেছে, আর আমি একটা কথাও বুঝতে না পেরে বোকার মত দাঁড়িয়ে রয়েছি। হঠাৎ আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এল। মুথুলক্ষ্মীকে মোবাইলে কল করে আমার তাঁবুর কাছে তাড়াতাড়ি আসতে বললাম। কয়েক মিনিটের মধ্যে মুথুলক্ষ্মী এলে আমি ওকে বললাম "দ্যাখ তো ওরা কি বলছে বুঝতে পারছ কি না"? মুথুলক্ষ্মী কিছুসময় ওদের সঙ্গে কথা বলে বলল "স্যার, ওদের ভাষা ঠিক তামিল নয়, তবে তামিলের সঙ্গে কিছু মিল আছে। আমিও বেশি কিছু বুঝতে পারছি না, আমি ওদের দুটো শব্দ বুঝতে পেরেছি, সুড়ঙ্গ আর পাথর।" আমি মুথুলক্ষ্মীকে বললাম জেনে নিতে যে ওরা কোথায় থাকে। মুথুলক্ষ্মীর প্রশ্ন ওরা ঠিকমত বুঝল কি না কে জানে, হাত তুলে দূরে অন্ধকারের দিকে কোথাও দেখাল, তার পর যেমন হঠাৎ এসেছিল, তেমনই হঠাৎ অন্ধকারে চলে গেল। গোটা ঘটনার আকস্মিকতাতে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। 'দক্ষিণ ভারতের এই উপজাতি দম্পতি এখানে এল কি করে?'  
পরদিন দারোগা অমরেন্দ্র সিং এলে আমি উনাকে সব জানালাম। উনি সব শুনে বললেন " আপনি একটা মস্ত ভুল করেছেন, ওই দুজনকে ছাড়া উচিত হয় নি, বসিয়ে রেখে আমায় খবর দিলে ভাল হত। ওরা যে সুড়ঙ্গের কথা বলছিল সেটা কোথায় জানেন কি?" 
"সাত নম্বর টিলার পশ্চিমে ঘাঘার নদীর দিকটায় একটা সুড়ঙ্গ কাল দেখেছিলাম, এছাড়া আর কোন সুড়ঙ্গ আছে কি না আমার জানা নেই। ওরা তো ওই দিকেই বারবার হাত দেখাচ্ছিল।"
"তাহলে ওখানেই চলুন, দেখি কি আছে ওখানে।"
আমরা সুড়ঙ্গের কাছে গিয়ে দেখলাম, কয়েক ধাপ ইটের সিঁড়ি নিচে নেমে গেছে, ইটগুলো ভেঙ্গে খুলে বেরিয়ে এসেছে। নিচটা ঘন অন্ধকার, আর চারিদিকে চাপ চাপ ধুলো বালি জমে রয়েছে হাজার বছর ধরে। কয়েক ধাপ নেমে টর্চের আলো ফেলতেই চমকে উঠলাম, ধুলো বালির ওপর টাটকা পায়ের ছাপ, তার মানে কেউ সদ্য এখানে নেমেছিল! সুড়ঙ্গটা ঠিক সুড়ঙ্গ নয়, মাটির তলায় ঢুকে যাওয়া ভেঙে পড়া একটা ইটের ছাত। সাপের ভয়ে আলো ফেলে সাবধানে এগুচ্ছিলাম, হঠাৎ তীব্র আলোর ঝলসানি চোখে এসে লাগল। চমকে ভাল করে তাকিয়ে দেখি, একটা আস্ত পাথরের ওপর টর্চের আলো পড়ায় ঝলমলে নীল আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে। অমরেন্দ্র সিং অস্ফুট ভাবে বলে উঠলেন "লাপিস লাজুলি!" আমি অবাক হয়ে বললাম "তাই তো দেখছি, এ কি করে সম্ভব?" দারোগা বললেন, "মনে হয় চোর কবর থেকে এই পাথর তুলে নিয়ে এসে এখানে লুকিয়ে রেখে গেছে পরে নিয়ে যাবে বলে। আপনারা কেউ ওটা এখন ছোঁবেন না, ওতে চোরের হাতের ছাপ আছে।" 

কিছুসময় পরে হাতের ছাপ সংগ্রহ করে অমরেন্দ্র সিং আর তার দলবল ওই পাথর তা নিয়ে ওপরে উঠে আসে। লাপিস লাজুলির এই পাথরটির ওজন প্রায় ৫ কেজি, বাজারে দাম প্রায় কোটির কাছাকাছি। এতবড় লাপিস লাজুলি আমি আগে কখনো দেখি নি। পালিশ করা না থাকলেও পাথর থেকে নীল দ্যুতি ঠিকরে বেরুচ্ছে। অমরেন্দ্র সিং বললেন, "আমার মনে হয় চোর কাছাকাছিই আছে, তাই এখানে যারা কাজ করে আমি তাদের সবার হাতের ছাপ নেব।" সবার হাতের ছাপ নিয়ে অমরেন্দ্র সিং থানায় ফিরে গেলেন। লাপিস লাজুলি-টিও থানায় রাখার ব্যবস্থা করা হল। বিকেলে অমরেন্দ্র সিং এসে শ্রমিকদের মধ্যে রামু কে গ্রেফতার করে চুরির দায়ে। চকচকে নীল পাথর দেখে রামুর মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি জাগে। রাতে হরেনের গুটখার সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দেয়। পরে হরেন ঘুমিয়ে পড়লে কারেন্টের মেন সুইচ অফ করে পাথর সরিয়ে ফেলে, তারপর আবার সুইচ অন করে।  এরপর দারোগার নির্দেশে চারিদিকে কড়া পাহারার ব্যবস্থা হল। এই ঘটনার পর আরো কিছুদিন রাখগারির খনন কাজ চলে। ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ আমরা সেবারের মত খনন শেষ করে ফিরে আসি। কঙ্কাল দুটো উদ্ধার করে মিউজিয়ামে পাঠান হয়। জিন ও ইয়ং এর পর নিজের দেশ সাউথ কোরিয়াতে ফিরে যায়।  

কিছুক্ষণ চুপ করে ডঃ ঝা বলতে শুরু করেন, "আমি অনেক জায়গাতেই কাজ করেছি, পুরানো জিনিস চুরিও হয়েছে, কিন্তু এমন অদ্ভুত ভাবে চুরি হওয়া জিনিস ফিরে পাওয়ার ঘটনা আমার জীবনে আর কখনো ঘটে নি।" নন্দিতা জিজ্ঞাসা করল, "আচ্ছা সেই উপজাতি দম্পতি, মানে যারা লাপিস লাজুলি-র হদিশ দিয়েছিল, তাদের কোন খোঁজ পাওয়া যায় নি?"
"না। আশেপাশের গ্রামগুলিতে পুলিশ অনেক খবর নিয়েছে, ওইরকম অদ্ভুত দম্পতিকে কেউ কোনদিন দেখেছে বলে বলতে পারল না। একেবারে কর্পূরের মত উবে গেল।"
আমি বললাম, "সত্যিই খুব অদ্ভুত। এর কোন  ব্যাখ্যা নেই"। গল্প শুনতে শুনতে রাতের খাবার চলে এসেছিল। ট্রেন প্রায় ৩ ঘণ্টা দেরিতে চলছে। খাওয়া শেষ করে আমরা ডঃ ঝা কে এরকম একটা সুন্দর গল্প বলার জন্য শুভরাত্রি জানিয়ে শুয়ে পড়লাম।

পরদিন সকালে দেখি ট্রেন আরো দেরি করছে, সকাল ১০ টার আগে দিল্লী পৌঁছবে না। তাও আমরা গোছগাছ করে তৈরি হয়ে নিলাম। ডঃ ঝা খবর কাগজ পড়তে পড়তে চা খাচ্ছিলেন। নন্দিতা বলল "আপনার কাছ থেকে রাখগারি নিয়ে অনেক কিছু জানলাম। আর লাপিস লাজুলি ফিরে পাওয়ার রহস্যটা এখনো হজম করতে পারি নি, কি করে এটা সম্ভব?" ডঃ ঝা মুচকি হেসে বললেন, "জগতে কত অদ্ভুত ঘটনাই তো ঘটে, সবকটার ব্যাখ্যা কি বিজ্ঞান দিতে পারে?" নন্দিতা মাথা নেড়ে বলে "তা অবশ্য ঠিক, হয়ত পরে পাওয়া যাবে।" ডঃ ঝা খবরের  কাগজটা সরিয়ে রেখে বললেন "আর কিছু পরেই তো আমরা দিল্লী পৌঁছব, তার আগে বরং গল্পের শেষটুকু বলি।" আমি আর নন্দিতা প্রায় সমস্বরে বলে উঠলাম "এখনো গল্প শেষ হয় নি!" পরিতোষ ঝা হাসতে হাসতে বললেন "না"। তার পর আবার শুরু করলেন, "সেই ঘটনার প্রায় ৬ মাস পর আমি, সিন্দে, জিন আর ইয়ং মিলে রাখগারির ওপর একটা গবেষণা মূলক পেপার লিখব ভাবছিলাম। একদিন রাতে আমি আমার ইউনিভার্সিটির কোয়াটার্সে বসে কিছু কাজ করছিলাম, হঠাৎ জিনের কাছ থেকে একটা ই মেল পেলাম। জিন লিখেছে, 

'প্রিয় প্রফেসার ঝা, 
আশা করি তুমি ও তোমার পরিবারের সবাই ভাল আছো। ইণ্ডিয়াতে খুব গরম পড়েছে শুনলাম। আমাদের কোরিয়াতে বরফ গলে গিয়ে একেবারে মনোরম আবহাওয়া। কখনো সময় করে চলে এসো কোরিয়াতে, আমি নিজে তোমাকে ঘুরে দেখাবো আমাদের দেশ। আশা করি তোমার খুব ভালো লাগবে। এবার কাজের কথায় আসি। রাখগারির কঙ্কাল দুটোর ফেনোটাইপিং হয়ে গেছে। টেকনিক্যাল ডিটেলস আমি পরে পাঠাব। ওই দুটো কঙ্কালের একটি পুরুষের, ব্য়স প্রায় ২৬/২৭ আর অন্যটি এক মহিলার, বয়স আনুমানিক ২০/২২। দুজনের হাড়ের নমুনা থেকে এক বিশেষ ধরনের ক্রোমোজোম পাওয়া গেছে। আমি খুঁজে দেখলাম, এই ক্রোমোজোমটির সঙ্গে দক্ষিণ ভারতীয় বিশেষ করে ইরুলা উপজাতির ক্রোমোজোমের খুব মিল। তুমি এই উপজাতির সম্পর্কে কিছু জানলে আমায় জানিয়ো। আর কম্পিউটারে মুখমণ্ডল তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। ছবিগুলো এই মেলের সঙ্গে পাঠালাম। ভাল থেকো--জিন'

আমি মেলটা পড়ে ছবিগুলো ডাউনলোড করলাম। উপজাতি এক পুরুষ ও এক নারীর মুখ ভেসে উঠল কম্পিউটারে। খুব চেন চেনা লাগছিল মুখগুলো, কোথায় যেন দেখেছি। হঠাৎ মনে পড়ল এই দুজন ই তো আমায় রাখগারি তে লাপিস লাজুলি-র হদিশ দিয়েছিল। দুটো মুখ ই হুবহু মিলে গেছে। এ ও কি সম্ভব! আমার কি কোথাও ভুল হচ্ছে, তা তো নয়। কাউকে এ কথা বললেও কেউ বিশ্বাস করবে না, উল্টে আমায় পাগল ভাববে। এখন বেশ মনে করতে পারছি, পুরুষটি একটু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছিল, আর রাখগারিতে পাওয়া বড় কঙ্কাল মানে পুরুষ কঙ্কালটির বাঁ পায়ের গোড়ালি ভাঙ্গা। আমার তখন মাথা গোলমাল হওয়ার উপক্রম। আমি ছাড়া আর একমাত্র মুথুলক্ষ্মী দেখেছিল ওই দম্পতিকে। আমি সঙ্গে সঙ্গে ফোন করলাম মুথুলক্ষ্মীকে, বললাম, 'আমি তোমায় ই-মেলে দুটো ছবি পাঠাচ্ছি, দেখে জানাও তুমি ওদের আগে কোথাও দেখেছ কি না।' মুথুলক্ষ্মীকেই মেল করার ১০ মিনিট পরে ও আমায় ফোন করে বলে, 'স্যার, আমি ঠিক মনে করতে পারছি না, তবে রাখগারির সেই দম্পতি যারা লাপিস লাজুলির হদিশ দিয়েছিল তারা হলেও হতে পারে।' পরে আমি সিন্দেকে বলেছিলাম সব ঘটনা। সিন্দে হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলেছিল 'তুমি কি দেখতে কি দেখেছ, এই সব নিয়ে আর কাউকে কিছু বোলো না। আসলে পুরনো প্রত্নতাত্ত্বিক জায়গাগুলোতে রাতের আলো আঁধারির মায়াবী পরিবেশে একপ্রকার মানসিক বিভ্রম তৈরি হয়। তুমি এরকম উদ্ভট চিন্তা করতে থাকলে পরে তোমার মানসিক সমস্যা হবে।' সিন্দের কথা শোনার পর ভয়ে আর কাউকে এই কথা বলতে পারি নি, যদি সবাই আমায় পাগল ভাবে। তবে আমি জানি এটা আমার মানসিক বিভ্রম নয়, সব কিছুই সত্যি। তাই বলছিলাম জগতে যা ঘটে তার সবকিছুর ব্যাখ্যা  পাওয়া যায় না।" ডঃ ঝা-র গল্প যে এমন একটা মোড় নেবে তা আমাদের সবার কল্পনার বাইরে ছিল। হতবাক হয়ে বললাম, "তাহলে আপনার সঙ্গে হরপ্পান যুগের মানুষদের দেখা হয়ে গেল বলুন।" ডঃ ঝা মাথা নেড়ে বললেন "তা বলতে পারেন। ওই দম্পতি নীলগিরি পাহাড়ের উপজাতিদের মত দেখতে ছিল, আর ডি এন এ টেষ্ট বলছে ইরুলা উপজাতির ডি এন এ সঙ্গে কঙ্কালের ডি এন এ-র খুব মিল। আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি, এই ইরুলা উপজাতি নীলগিরি পাহাড়ের ঢালেই থাকে।" আমাদের কথার মধ্যেই ট্রেন এসে দাঁড়াল নিউদিল্লী স্টেশনে। ডঃ ঝা কে বিদায় জানিয়ে আমরা ল্যান্সডাউনের পথ ধরলাম। ডঃ ঝা'র গল্প আমাদের মনে অনেক বিস্ময় আর কৌতূহলের সঙ্গে বেশ কিছু প্রশ্নও রেখে গেল।


 

গল্প

Comments

Top

রংতুলি 

চৈতালি সরকার  

পূর্ব বর্ধ্মান, পঃ বাংলা
 

oldman.jpg
রংতুলি

গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ নিমাইদাকে পাগল ছাড়া কিছুই ভাবে না। আর ভাববে নাইবা কেন? নিমাইদা এমন এমন কাজ করেন যা একজন সুস্থ লোক ভাবতেই পারেনা। কখনও আপন মনে হাসেন কখনও কারণ ছাড়াই কাঁদতে বসেন। আবার মাঝে মাঝে সারারাত আকাশ ভর্তি তারা দেখেই কাটিয়ে দেন। 
নিমাইদার নিজের বলতে কেউ নেই। কাজকর্ম সেরকম কিছু করেন না। তবে এক কালে নিমাইদার প্রচুর সম্পত্তি ছিল। শোনা যায় ওনার পূর্বপুরুষ জমিদার ছিলেন। সেসব সময়ের সাথে সাথে কমতে শুরু করেছে। এখন শুধু বাড়িটাই সার। জমিজমা যেটুকু ছিল বেশিরভাগ দখল হয়ে গেছে। বাকীটা ভাগে দেওয়া। এসবের হিসাবনিকাশ রাখেন বিভূতিদা। নিমাইদার গার্ডিয়ান। ছোট থেকে নিমাইদাকে মানুষ করেছেন। চুলগুলো সনপাপড়ির মতো সাদা। ভাঙা চোয়াল জুড়ে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। গায়ের রং ধুসর। কেউ বয়স জিজ্ঞেস করলে বিভূতিদা বলেন,  সাহেব আমলের লোক আমি। নিমাইদা এর বিপরীত মানচিত্র যেন। যেমন দুধসাদা গায়ের রং তেমন কালো চুলের বাহার। উঁচু লম্বা চেহারার মধ্যে আভিজাত্যের ছটা। কখনও নিজের শরীরের যত্ন নেননা, তবু মনে হয় কেউ পিতৃস্নেহে সাজিয়ে রেখেছে। এর কৃতিত্ব অবশ্য সবটাই বিভূতিদার।

নিমাইদার নিজস্ব একটা ঘর আছে। সেখানে কাউকে ঢুকতে দেন না। বিভূতিদাকে পর্যন্ত নয়। দুপুরে খাওয়ার পর দরজা বন্ধ করে দেন। কোনো কোনো দিন রাত্রি হয়ে গেলেও খোলেননা। আবার মন ভালো থাকলে সেই ঘরে একবার ও যাননা। রাস্তায় রাস্তায় ঘোরেন আর কী যেন খুঁজে বেড়ান। হাতে থাকে একটা খাঁচা।  টিকটিকি, ব্যাঙ, মাকড়সা যা পান তাই খাঁচায় ভরে নেন। তখন দেখে মনে হয় নিমাইদা একজন বিজ্ঞানী। পশুপাখি, কীটপতঙ্গ নিয়ে রিসার্চ করছেন। আর বিজ্ঞানীরা একটু পাগলাটে হয়, তাই এই ধারণা সবার মনে গেঁথে যায়। তবে আরও ভয়ঙ্কর ব্যাপার ঘটে সেদিন, যেদিন কুকুর বেড়াল পর্যন্ত নিমাইদার রিসার্চের অঙ্গ হয়ে উঠল। দু -চারদিন পর পরই বিভূতিদা বাড়ি থেকে মরা বেড়াল কুকুর পাশের পচা খামে ফেলতে শুরু করল। ক্রমে পরিবেশের বারোটা বাজল। এই নিয়ে গ্রামের লোকজন এক হয়ে মিটিং ডাকতে বাধ্য হল। বিভূতিদা সেখানে উপস্থিত হলেন। সবাই বলল নিমাইদার আচরণে দিন দিন গ্রামের মানুষ অতিষ্ট হয়ে উঠেছে। এ গ্রাম ছেড়ে তোমরা অন্য কোথাও চলে যাও। বিভূতিদাও পরাধীন ভারত দেখেছে। বিদ্রোহ করলেন, তবু হার মানলেন না। শেষপর্যন্ত গ্রামের লোকেরাই পিছু হটল। তবে নিমাইদাকে একঘরে করল গোটা গ্রাম।  

কয়েকদিন ধরে দেখা যাচ্ছে নিমাইদা আর পশুপাখি হত্যা করেননা। ভালো মানুষের মতো শুধু চাঁদ তারা দেখেন। গ্রামের লোকেরা বলাবলি করতে লাগল আচ্ছা জব্দ হয়েছে নিমাইটা।একদিন বঙ্কা, রঘু, সতু সবাই নিমাইদার বাড়ির সামনে দিয়ে আসছে। সবে সন্ধ্যে নেমেছে। সতু পাকামি করে নিমাইদার বাড়ি ঢুকে পড়ল। বঙ্কা, রঘুর কোনো বারণই কানে নিলনা একদিন বঙ্কা, রঘু, সতু সবাই নিমাইদার বাড়ির সামনে দিয়ে আসছে। সবে সন্ধ্যে নেমেছে। সতু পাকামি করে নিমাইদার বাড়ি ঢুকে পড়ল। বঙ্কা, রঘুর কোনো বারণই কানে নিল না 

সতু। নিমাইদা উঠোনে বসেছিলেন আমগাছের তাকিয়ে, সতুকে সামনে পেয়ে খপ করে ল্যাটা মাছের মতো চেপে ধরলেন। তারপর সটান নিজের ঘরে নিয়ে চলে গেলেন। ঐ দেখে অন্যেরা তো পগাড়পার। অসময়ে নিমাইদার বাড়ির সামনে যাওয়ার জন্য কেউ বাড়িতে কিছু লিক করল না। সবার ধারণা সতু আর বেঁচে ফিরবে না। সবাই অপেক্ষা করতে লাগল বেড়াল কুকুরের মতো সতুর দেহটার জন্য।

রাত্রি ক্রমশ বাড়ছে সতুর দেখা নেই। বাড়ির লোক গরু খোঁজার মতো এগ্রাম সেগ্রাম খুঁজতে লাগল। হঠাৎ নিমাইদার কথা মনে পড়তে সতুর বাড়ির লোকেরা কয়েকজন গ্রামের লোককে সঙ্গে করে চড়াও হল ওনার বাড়িতে। রাত তখন এগারোটা হবে। নিমাই নিমাই বলে ডাকতে উনি নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। সবাই নিমাইদার ওপর ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ার আগেই সতু হাতে মুড়ি সন্দেশ নিয়ে এগিয়ে এল। সবাই তো বেশ অবাক, এমন দৃশ্য দেখতে পাবে কেউ কল্পনা করেনি। যাইহোক সে যাত্রায় সতু বাড়ি ফিরে এল।

বঙ্কা সেদিন সতুর বন্ধুত্বে সুড়সুড়ি দিয়ে কথা আদায়ের চেষ্টা করল। এর আগে অনেকেই অনেক চেষ্টা চালিয়েও সতুর মুখ খুলতে পারেনি। ওর সাফ কথা নিমাইদার বাড়িতে কী ঘটেছে কিছু মনে নেই। কিন্তু বন্ধুদের খুলে বলতেই হবে। সতু শুরু করল অনেকটা গল্পের মতো করে, "নিমাইদা সেদিন নিজের  ঘরে নিয়ে গিয়ে আমায় বড় বড় রসগোল্লা দিলেন। তারপর বড় একগ্লাস শরবত। ঐ সব খাওয়ার পর কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি মনে নেই।" এইটুকু শোনার পরই রঘু হিন্দি সিনেমার নায়কদের মতো বলে উঠল, "বুঝেছি। শরবতে ছিল ঘুমের ওষুধ। নিশ্চয়ই নিমাইদার অন্য কোনো মতলব ছিল।" বঙ্কু চোখ পাকিয়ে বলল, " নিমাইদা তান্ত্রিক নয় তো!" প্রশ্নগুলো নিজেদের মধ্যে ঘুরতে লাগল। কেউ কারোর বাড়ির লোককে জানালনা।

অনেকদিন কেটে গেছে। আলোচনা থিতিয়ে শুকনো মাটি প্রায়। হঠাৎ একটা মস্ত গাড়ি এসে নিমাইদার বাড়ির সামনে দাঁড়াল। গ্রামের লোকের কৌতূহলী দৃষ্টি নিমাইদার বাড়ির চারপাশে উঁকিঝুঁকি মারছে। বঙ্কা, সতু ...... সবাই সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে আছে। এক্ষুনি নিমাইদাকে বাইরে আনা হবে। ততক্ষণে গ্রামে গ্রামে উড়োচিঠির মতো ছড়িয়ে গেছে নিমাইদা কোনো সাধারণ লোক নন। কলকাতা থেকে গাড়ি এসেছে। কী হয় সেটাই দেখার জন্য মুগ্ধচোখে তাকিয়ে সবাই। সাদা পাজামা পাঞ্জাবিতে নিমাইদাকে জমিদার জমিদার লাগছে। কয়েকজন লোক নিমাইদাকে হাল্কা মেকআপ করে দিলেন। তারপর? ক্যামেরা অন, বিখ্যাত চিত্রকর নিমাইসাধন চৌধুরী ঘুমন্ত বালকের নিষ্পাপ চিত্র অঙ্কনের জন্য রাষ্ট্রীয় চিত্রশিল্পের শ্রেষ্ঠ অ্যাওয়ার্ড পাচ্ছেন। ছোট্ট ইন্টারভিউ থেকে জানা গেল এর আগে নিমাইসাধন মৃত বেড়াল কুকুর অনেক এঁকেছেন। সেগুলো গ্যালারিতে রাখা থাকবে। ঘুমন্ত বালক তাঁর অসামান্য কীর্তি। ভয়ে সতুর গলা শুকিয়ে এল। সঙ্গে একটুকরো দীর্ঘশ্বাস। মনে মনে ভাবল, ভাগ্যিস নিমাইদা সেদিন মৃত বালকের ছবি আঁকার চেষ্টা করেননি!
তাহলে সতুকে বাড়ির লোকরা আর ফিরেই পেতো না। 

Comments

Top

গল্প

চেন রিয়্যাকশন

চেন

রিয়্যাকশন

জীৎ ভট্টাচার্য্য 
 

talking.jpeg

খন আর কেঁদে কি হবে? কতবার বলেছিলাম। কিছুতেই শুনলো না তখন আমার কথা।আর শুনবেই বা কি করে? ও যে কোনোদিন আমাকে ভাল করে দেখতেই পায়নি।
কলেজ ক্যান্টিনে বসে প্রথম দেখেছিলাম রঞ্জনাকে। আমি তখন এক শান্ত শিষ্ট ছেলে। সবে সবে মফঃস্বল থেকে বেরিয়ে এসেছি। বড় শহরে বড় কলেজে ভর্তি হয়েছি। মেয়েরা যে কি বস্তু তা আমার মফস্বলের ব্যাচেলর গ্যাঙ এর ছেলেরা পৈ পৈ করে বলে দিয়েছিল।
"দেখ তরুন, এমনিতে তুই একটু ভালো ছেলে। ওইসব কলকাতার মেয়েদের সাথে মিশবি না। ওরা কিন্তু হেব্বি চালাক"
পাঁচবার ঘাড় নাড়িয়ে শুনেছিলাম। সত্যি মনে হয়েছিল তখন। আর কেনই বা হবেনা? বারো ক্লাস অব্দি কোনো মেয়ের দিকে তাকাতে পারিনি। কিরকম একটা ভয় ভয় করতো। আসলে তারও একটা বিশেষ কারণ আছে। অনেক ছেলেবেলাতে আমার একটু নার্ভের প্রবলেম ছিল। না, না, সেরকম কিছু না। পাগলামি কিছু করতাম না। খালি মাঝে মাঝে চোখের সামনে অন্ধকার হয়ে যেত। কখন হতো, তাও বুঝতে পারতাম না। আমি ভাবতাম ঘুমাচ্ছি, কিন্তু সেটা আসলে ঘুম ছিল না। আমার জ্ঞান হারিয়ে যেত।
আমার মা বাবা অনেক চেষ্টা করেছিল ব্যাপারটা ধামাচাপা দিতে। কিন্তু আগুন জ্বললে ধোঁয়া তো উঠবেই। পাড়ায় খবর ছড়িয়ে গেল, সেখান থেকে স্কুলে। ব্যাস, হয়ে গেলাম আমি ইংরেজি সিনেমার ফ্রিক, হিন্দি বা বাংলা চলচ্চিত্রের পাগল ছেলেটা। যাকে, সবাই একটু এড়িয়ে চলে, শিক্ষকরা একটু আলতো আস্কারা দেয় আর মেয়েরা ঘুরেও তাকায় না। হ্যাঁ, লোকের কাছে বাল্যকাল সব থেকে স্মরণীয় থাকলেও আমার কাছে সেটা ছিল না। তাই একপ্রকার জোর করে কলকাতার কলেজে ঢুকেছিলাম যাতে ছেলেবেলার ছায়াগুলো আবার আমাকে অন্ধকার আর অবজ্ঞার জগতে টেনে না নিয়ে যেতে পারে। নতুন শহর, নতুন কলেজ, নতুন জীবন। আমার যেন নতুন জন্ম হলো। বড় হয়ে উঠব সাধারণ মানুষের মতো । হ্যাঁ, আমি সাধারণ হতেই চাই। ঐটাই আমার লক্ষ্য ছিল। 
কারণ সাধারণ জীবন যে কি, সেটা আমি বুঝিনি। খালি বুঝেছিলাম অঞ্জন দত্তের গানগুলো । আমার একাকিত্বের সাথী ছিল সেগুলো। সেই জমানায় ছুটির দিনে দুপুর বেলাতে যখন নরম আলো আমার বিছানায় এসে বসে থাকত, তখন আড্ডা দিতাম ব্যাকগ্রাউন্ডে অঞ্জন দত্তের গান চালিয়ে। তার প্রত্যেকটা গান আমাকে ছুঁয়ে যেত। বাবাকে জোর করে রাজি করিয়েছিলাম গিটার এর জন্য। তাকে দেখেই আমার গিটার শেখা। 
পুরানো গিটার এলবামের একটা গান ছিল, "তুমি আসবে বলে তাই, আমি স্বপ্ন দেখে যাই"। প্রেমে পরে গেছিলাম কথাগুলোর সঙ্গে। ভাবতাম অঞ্জন দত্ত কতটা প্রেমের সাগরে ডুবে দিয়েছিলেন যে এইরকম একটা গান লিখতে পেরেছিলেন। কতটা ভালোবাসতে জানতেন তিনি। ঈর্ষা হতো, কবে আমার জীবনে এরকম প্রেম আসবে?
কিন্তু সেই ঈর্ষা আমার বেশিদিন থাকলো না। কারণ আমি আমার রঞ্জনাকে পেয়ে গেছিলাম কলেজের ক্যান্টিনে। বুঝেছিলাম প্রেমের মোহ কাকে বলে। প্রথমবার, প্রথমবার আমি অঞ্জন দত্তের গানের বিপরীতে গাইতে লাগলাম। "রঞ্জনা, তোমায় ছেড়ে যাবো না" দুমড়ে মুচড়ে দিলাম তার গানটাকে। আমি এই রঞ্জনার জন্য বারবার আসবো। বারবার বাঁচবো আবার বারবার মরবো। 
সেই থেকে বাসে, ট্রামে, ট্রেনে, দিনে, রাতে, স্বপনে, শয়নে রঞ্জনা আর রঞ্জনা। আমার জীবনে হঠাৎ করে এত আনন্দ  আমার মাথার শিরা উপশিরাগুলোর আর সহ্য হলো না। বেঁকে বসলো। আমার সাধারণ জীবনে আর বড় হয়ে ওঠা হল না। একদিন সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে হঠাৎ মাথা ঘুরে গেল। চোখের সামনে অনেক্ষণ ধরে রঞ্জনাকে দেখেছিলাম। 
নীল রঙের শাড়ি পরে হাঁটছিল আমার সামনে দিয়ে। ল্যাভেন্ডার এর গন্ধে আমার শরীরের লোমগুলো খাড়া হয়ে গেছিল সেই সময়। মনে হচ্ছিল যা দেখছি সব সত্যি, এই স্বপ্নই আমার সত্যি। আমি এই স্বপ্ন থেকে বেরোতে চাই না। প্রথমবার কারুর চোখে আমি অপমান দেখিনি। প্রথমবার কেউ আমার সাথে প্রাণভরে গল্প করেছে। একে আমি স্বপ্নেও হারাতে চাই না।
কিন্তু সমস্ত স্বপ্নের মতো আমার টাও ভেঙে গেল। মাস খানেক হাসপাতালের বিছানায় ছিলাম। চোখ খুলতেই দেখি মা বাবার চোখে জল। সব জানতে পারলাম। স্ট্রোক হয়েছিল আমার। কোমাতে চলে গেছিলাম। আমার ছোটবেলার নার্ভ অ্যাটাক এর জন্য দায়ী।
কিছুদিন পরে আবার অনেক গন্ডা রিপোর্ট আসে। আমি খুলেও দেখলাম না। রঞ্জনাকে দেখার জন্য আমার প্রাণ খাঁচা বন্দি নবাগত বাঘের মতো করছে। তীব্র হুঙ্কারে ফেটে পড়ছে । কিন্তু ডাক্তাররা যে নারাজ। আমাকে ছাড়া যাবে না। নিজেকে কিছুদিন গন্ডিতে থাকা সীতার মতো মনে হচ্ছিল। পারছিলাম না আর থাকতে। তাই একদিন পালিয়ে চলে গেলাম রঞ্জনার কাছে। আমার রঞ্জনার কাছে। কিন্তু গিয়ে যা দেখলাম তাতে আমার হৃদয়ে যে বসন্তের রঙ ধরেছিল তা আচমকা বর্ষার জলে ভেসে গেল।
দেখি ক্যান্টিনে, অনিন্দ্য বলে একটা সিনিয়ারের সাথে বসে চা খাচ্ছে রঞ্জনা। মাথাটা কেমন ঘুরতে লাগলো। মনে হচ্ছিল আবার হাসপাতালে চলে যাই। আর একটা স্ট্রোক আসুক। আবার কোমায় চলে যাই, তাহলে হয়ত রঞ্জনা আমাকে একটু পাত্তা দেবে। 
আমাকে দেখতেই সে স্বাভাবিক ভাবে বলে উঠল, ”এই তরুন, এতদিন কোথায় ছিলে?”
এতো সহজভাবে আমাকে জিজ্ঞেস করলো যেন মনে হল সত্যি আমাকে মিস করছিল। আজ পর্যন্ত কেউ আমাকে মিস করেনি কখনও। কিন্তু এই মেয়েটা আমাকে মিস করেছে। আমাকে বন্ধু ভেবেছে। আমি সারাজীবন কি এই বন্ধুত্বের  মর্যাদা রাখতে পারবো? ----
“একটু বাড়িতেই  ছিলাম। শরীর খারাপ হয়েছিল"।
সে আবার আমার সাথে স্বাভাবিক ভাবে কথা বলতে লাগলো। যেন কোন কিছুই হয় নি। কিন্তু আমি স্বাভাবিক হতে পারলাম না। আসতে আসতে নিজেকে দূরে রাখতে শুরু করলাম । খালি চুপি চুপি দেখতাম ওকে। ঐ আমার ভালো লাগা। বড় কিছু চাই নি। খালি সাধারণ হবার চেষ্টা করেছি। শুনেছি সাধারণ ছেলেদের খুব সুন্দরি বান্ধবী হয় না। কিন্তু আমার সুন্দরি বান্ধবী চাই না। আমার খালি রঞ্জনাকে চাই। 
আমার শরীর আরও ঢলে পড়তে লাগলো। দিনদিন কঙ্কালের মতো হয়ে যাচ্ছি। লোকে দেখে আমাকে নাক শিটকে চলে যায়, কিন্তু রঞ্জনা ...রঞ্জনা এখনও আমাকে দেখে হাত নাড়ায়। ও ভালো থাকুক, সুখে থাকুক। ওর ঐ মৃগনয়নী চোখে কোনদিন আমি জল দেখতে পারবো না ডাক্তার আবার এক গণ্ডা টেস্ট করাল। কিন্তু আমার সেইদিকে কোন ধ্যান নেই।এক সন্ধেতে দেখি বাবা চোখের জল ফেলছেন। এরকম ভাবে কখনও তাকে কাঁদতে দেখিনি । মায়ের চোখের জল দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছিলাম, কিন্তু বাবার চোখের জল যেন বুকটা কাঁপিয়ে তুলছিল। আমি বুঝতে পারলাম, আমার আর বেশী সময় নেই। অবশেষে সেই দিনটা চলেই এলো, ধুপ ধুনো পুড়ল খুব। আমার ব্যাচেলর গ্যাংগের ছেলেরা এসেছিল সবাই। অদ্ভুত লাগছিল। যারা কোনদিন আমার সাথে ভালো করে কথা বলেনি এখন তারা আমার সাদা চাদরে মোড়া জড় দেহের উপর অশ্রু বিসর্জন করছিল। কত কথা লোকের মুখে। কেউ বলছিল, অল্প বয়সে ছেলেটা চলে গেল। আবার কেউ বলছিল, অনেকদিন ধরেই ভুগছিল। কিন্তু আসলে ভুগছিল আমার মা বাবা। এতো বছর ধরে আমাকে মায়ার জালে জড়িয়ে রেখেছিল। এখন তাদের একটু শান্তি হবে হয়ত। দাহ হওয়ার কিছুদিন পরে আমি দেখা করতে গেলাম রঞ্জনার সাথে। সেই ক্যান্টিনে। আমাকে কেউ দেখতে পায় না, কিন্তু আমি সবার মাঝে থাকি। আমি এখন সত্যি সাধারণ হয়ে উঠতে পেরেছি। কেউ আমাকে বাধা দেয় না আর আমি বসে বসে  ওদের সব আলোচনা শুনি। ওদের সব হাসি ঠাট্টার সঙ্গী হয়ে গিয়েছিলাম। মাঝে একদিন আমার মৃত্যুর টপিক উঠেছিল, কিন্তু রঞ্জনা আমাকে সেভাবে বোঝেনি কখনও। তাই চোখের জল ফেলারও প্রয়োজন হয়নি। আমিও চাই না ওর ঐ সুন্দর চোখ থেকে জল ঝরুক। খালি একবার "তাই নাকি" বলেছিল। এইটুকুই দরকার ছিল। রঞ্জনার মুখ থেকে একবার "তাই নাকি" শোনা। এরপর থেকে আমি রঞ্জনার সাথেই থেকে গেলাম। ওর ওঠা বসা সবকিছুর সঙ্গী হয়ে গেলাম। এমনকি যেদিন রঞ্জনা প্রথমবার অনিন্দ্যর ঠোঁটে চুমু খেয়েছিল সেইদিনও আমি ওর সাথে ছিলাম। কিন্তু দেখতে পেয়েও দেখিনি। খারাপ যেমন লাগছিল তেমন ভালোও লাগছিল। ভালো লাগছিল রঞ্জনার জন্য। মেয়েটা জীবনের সাধারণ আনন্দ গুলো উপভোগ করতে পারছে বলে। ঠিক দুদিন পরেই কলেজের এক নতুন বর্ষের মেয়ে নয়নার সাথে দেখতে পেলাম অনিন্দ্যকে। মিষ্টি দেখতে নয়নাকে, কিন্তু রঞ্জনার সামনে কিছুই নয়। আমি আর নিজেকে আটকাতে পারলাম না। ছুটে গেলাম রঞ্জনার কাছে। গিয়ে দেখি সে একটা গ্রিটিংস কার্ড বানাচ্ছে। তাতে সুন্দর করে অনিন্দ্যর নাম লিখেছে। খুব ঈর্ষা হচ্ছিল, খুব। আজ পর্যন্ত কেউ আমাকে কোন গ্রিটিংস কার্ড দেয়নি। আমি চেঁচিয়ে বললাম ,”রঞ্জনা, তুই করিস না। চোখের জল ফেলতে হবে তোকে" কিন্তু সে শুনতে পেল না। জীবনের সমস্ত ভালোবাসা দিয়ে সে গ্রিটিংস কার্ডটা বানাচ্ছিল। আমি আবার বারণ করলাম। কিন্তু কোন ফল হল না। কার্ড বানানো শেষ হতেই রঞ্জনা ছুটে গেল অনিন্দ্যকে দেওয়ার জন্য। আমিও ছুটলাম, আর চীৎকার করতে লাগলাম ,”রঞ্জনা, ও আর আসবে না। রঞ্জনা "কিন্তু কে কার কথা শোনে। আমি দেখলাম কলেজের এক গুপ্ত যায়গায় অনিন্দ্য আর ওর নতুন প্রেমিকা নয়না কোন এক গুপ্ত কাজে লিপ্ত ছিল। নয়নার হাত দুটো ধরে কিছু অনিন্দ্য একটা করতে যাচ্ছিল। কিন্তু নয়না বাধা দিচ্ছিল, হয়ত ও সম্পূর্ণ ভাবে অনিন্দ্যকে মেনে নিতে পারছিল না। কিন্তু তাতে আমার কিছু যায় আসেনা। আমার চিন্তা আমার 
রঞ্জনাকে নিয়ে। সে ঐদিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। আমি আবার রঞ্জনাকে

আমি আবার বলে উঠলাম, ”রঞ্জনা ঐদিকে যাস না।" কিন্তু রঞ্জনা ঐদিকেই গেল। এবং যা দেখল তা  আর সহ্য করতে পারল না। এক সমুদ্র দুঃখ বুকে নিয়ে ছুটে চলে গেল কলেজের ছাদের উপর। যা হবার তাই হল। রঞ্জনার চোখ দিয়ে মুক্ত গড়িয়ে পড়লো। একটার পর একটা। আর আমি সেগুলো কুড়নোর বৃথা চেষ্টায় নেমে পরলাম। প্রথমবার আমার নিজেকে ভুত বলে অপরাধী মনে হচ্ছিল। প্রথমবার আমি রঞ্জনার চোখে জল দেখলাম। আমি আর থাকতে পারলাম না। ওর কান্নার সুরে আমিও কাঁদতে লাগলাম। কতবার বললাম কাঁদিস না রঞ্জনা, কাঁদিস না। কিছুক্ষণ পরে রঞ্জনার কান্না থেমে গেল। হয়ত আমার কথা শুনতে পেয়েছে। হয়ত বুঝতে পেরেছে যে মিথ্যে মানুষের জন্য সত্যি চোখের জল ফেলাটা উচিত না। সে চুপ করে বসে রইল আর আমি তাকিয়ে রইলাম ওর চোখ দুটোর দিকে। বড় ইচ্ছে করছিল ওর শরীরের ভেতরে ঢুকে আমি ওর প্রতিটা রক্ত কণাকে ছুঁয়ে দেখি। প্রতিটা শিরা উপশিরা, প্রতিটা নিঃশ্বাসকে প্রশ্ন করি যে এক মুহূর্তের জন্য ও কোনদিন আমাকে নিয়ে কিছু ভেবেছিল কিনা। ছোটবেলায় অনেক সিনেমা বা গল্পতে পড়েছিলাম ভুত নাকি মানুষের দেহে ভর করে। তাকে দিয়ে অনেক কিছু করাতে পারে। এমনকি তাকে নিজের করে রাখতে পারে। একবার সেই ইচ্ছে মনের ভেতরে উঁকি মারছিল। আটকালাম না আর নিজেকে। একবার জানতেই হবে আমাকে। ঢুকে পরলাম ওর শরীরের ভেতরে কোনরকমে মারকাট করে। রঞ্জনাকে আমি হারাতে পারবো না। ও আমার, শুধু আমার। মাথায় আর একটা বুদ্ধি খেলল। রঞ্জনাকে এই পার্থিব দেহ থেকে মুক্ত করতে হবে। ওকে আমার এই জগতে নিয়ে আসতে হবে। সামনের ছাদের কাছে নিয়ে গেলাম ওকে। একই দেহে দুই আত্মা থাকা সত্ত্বেও আমি ওর মনের অবস্থা বুঝতে পারছিলাম না। হয়ত বুঝতে চাইছিলাম না। জেদ চেপে গেছিল আমার মধ্যে। আমি ফিসফিস করে বললাম ,”রঞ্জনা তুই আমায় ছেড়ে কোথাও যাবি না"।
এক লাফ মেরে দিলাম ছাদের উপর থেকে। ব্যসমাটিতে রঞ্জনার দেহ পড়তেই রক্তারক্তি কাণ্ড। আশেপাশে তখন খুব একটা লোকজন ছিল নাআমি দেখলাম রঞ্জনা ওর দেহ থেকে মুক্তি পেয়েছে। আমি ছুটে জড়িয়ে ধরলাম ওকে। প্রথমবার কোন মেয়েকে এতো কাছে পেয়েছি আমি। নিজের করে, রঞ্জনা শুধু আমার। আজীবনকালের জন্য। 
“তুই আমার রঞ্জনা!! তুই শুধু আমার"।
কিন্তু রঞ্জনার ঠোঁটে হাসি নেই। ওর চোখে বিদ্বেষ। এমন বিদ্বেষ ভরা চাহনিতে আমায় কেউ কখনও দেখেনি। ভয় লাগতে শুরু করলো।
“রঞ্জনা", আমি ডেকে উঠলাম।
রঞ্জনা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ”এইসব তুই করেছিস? কেন করলি এইরকম?”
আমি আমতা আমতা করে বললাম, ”আমি তোকে ভালোবাসি রঞ্জনা। আমি তোকে ভালোবাসি"।
“কিন্তু আমি যে অনিন্দ্যকে ভালোবাসি, তোকে আমি বন্ধু ছাড়া কোন কিছুই ভাবিনি। আমাকে এখুনি, এখুনি অনিন্দ্যর কাছে যেতে হবে", বলেই সে দৌড়ে চলে গেল অনিন্দ্যর কাছে। 
আমিও পিছনে ধাওয়া করলাম,“রঞ্জনা, রঞ্জনা"।
কিন্তু রঞ্জনা আমার কথা শুনল না। সে এগিয়ে চলে গেল অনিন্দ্যর কাছে। আমি তার পিছু পিছু গিয়ে দেখি অনিন্দ্য আর নয়নার মাঝে এক টানাপড়েন চলছে। আর রঞ্জনা চুপচাপ দাড়িয়ে সেটা দেখছে। 
এইদিকে নয়না কাঁদতে কাঁদতে অনিন্দ্যকে বলছে, ”আমি তোমাকে ভালোবাসি না। আমি সাজাদ কে ভালোবাসি"।
অনিন্দ্যর চোখ দুটো রাগে জ্বলজ্বল করছে। "সাজাদ তো অনামিকাকে ভালবাসে"।
নয়না কান্নায় ফেটে পড়লো। সে বলল, ”না অনিন্দ্যদা, সাজাদকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারব ন...
এইদিকে আমি রঞ্জনার দিকে তাকিয়ে দেখি সে অনিন্দ্যর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে । এই দৃষ্টি আমি চিনি। কারণ এই দৃষ্টি কোন এক সময় আমার ছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম কি হতে চলেছে। আমি রঞ্জনাকে উদ্দেশ্য করে বললাম, ”একদম ভাবিস না এইসব কিছু রঞ্জনা। একদম না। তুই শুধু আমার, তুই শুধু আমার"।
কিন্তু রঞ্জনা আমার দিকে রক্তচক্ষু নিক্ষেপ করে বলল, ”আমি অনিন্দ্যকে ভালোবাসি। ও শুধু আমার"। 
আমি বুঝতে পারলাম কি হতে চলেছে। আমার দেখানো রাস্তা দিয়েই সেও চলছে। অনিন্দ্য দেখি আবার নয়নার হাত ধরে বলছে, ”আমি তোকে ভালোবাসি নয়না"।
মনে মনে কেমন একটা হল। পুরো ঘটনাটা একটা বাংলা সিনেমার মতো ঘটে গেল চোখের সামনে দিয়ে।
আমি আবার বললাম, ”রঞ্জনা, এটা করিস না। ও তোকে ভালবাসে না। আমি ভালোবাসি, আমি"।
কিন্তু কে কার কথা শোনে। রঞ্জনার আত্মা অনিন্দ্যর শরীরে ঢুকে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে অনিন্দ্য ঘোর চোখে পা বাড়াল সেই ছাদের সিঁড়ির দিকে। আমি বুঝতে পারছিলাম কি হতে চলেছে। তাদের পিছন পিছন আমিও দৌড়ে গেলাম বর্গিদের ঘোড়ার মতন। টগবগ টগবগ করে সিঁড়ি দিয়ে উঠতেই দেখি সেই একই কাণ্ড। একটা দেজাভু আসছে আমার মধ্যে। আমি জানি কি হতে চলেছে। বন্য শিয়ালের মতো প্রথম হুক্কা হুওা হয়ত আমিই করেছিলাম । এখন সব শিয়াল আমার অনুকরণ করছে। নিমেষের মধ্যে অনিন্দ্যর দেহটা মাটিতে পরে গেল, আবার এক রক্তারক্তি কাণ্ড।
সমস্ত ঘটনা যেন সাইকেলের চাকার মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে আমার চোখের সামনে দিয়ে। আমি চুপচাপ ছাদের উপর বসে রইলাম। দেখলাম কিছুক্ষণ পরে দৌড়ে এলো নয়না। বুঝলাম অনিন্দ্য নয়নার উপর ভর করেছে। অতৃপ্ত প্রেমের ইচ্ছে তার মধ্যেও সেই একইরকম ভাবে রয়ে গেছে যেটা আমার মধ্যে ছিল। তাই নিজের অন্তরের অপূর্ণ ভালোবাসাকে জীবিত কিংবা মৃত, যেকোনো অবস্থাতেই পূরণ করতে চায়। খানিকটা আমার মতোই। আমি সারাজীবন সাধারণ মানুষ হবার চেষ্টা করেছি, কিন্তু এখন দেখছি আমি সাধারণই ছিলাম। এই অনিন্দ্য, রঞ্জনার মতোই একই জিনিস নিয়ে ভাবতাম। একই প্রেম আমার মধ্যেও ছিল। খালি বুঝতে একটু দেরী হয়ে গেছে। অনেকটাই দেরী হয়ে গেছে। যে চেন রিয়াক্সান আমি শুরু করেছি সেটা কোথায় গিয়ে থামবে, সেটাই দেখার।
চোখের সামনে আবার সেই একই দৃশ্য। অন্য আর এক শিয়াল আমার ডাকে সাড়া দিয়েছে । ছুটে এলো সাজাদ। একই  ছাদ, একই  জায়গা, একই সময়, একই পরিস্থিতি, একই অতৃপ্ত ভালোবাসা এবং একই পরিণতি। তারপর দেখি অনামিকা, তারপর আরও কত নাম না জানা লোকজন। আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলাম, মরে গিয়েও শান্তি নেই।
প্রায় তিরিশ জন একদিনে সুইসাইড করেছে। খবরে খবরে ছড়িয়ে পড়লো। টি ভি তে ব্রেকিং নিয়ুজ, সি বি আই তদন্ত চালু হয়েছে। ঘটনার সূত্রপাত কোথা থেকে সেই নিয়ে বিদেশ থেকেও বিশেষজ্ঞরা এসে হাজির। সারা পৃথিবীতে খবর ছড়িয়ে পড়েছে। লোকে মোমবাতি নিয়ে হাজির হয়েছে রাস্তায় রাস্তায়। 
তবে এর মধ্যে থেকে কেউ একজন বলে উঠল সব কিছু শুরু হয়েছে আমার মৃত্যুর হওয়ার পর থেকেই। আমার মৃত্যুর পরেই নাকি সবাই ডিপ্রেশনে চলে গেছিল। সবাই আলাদাভাবে আমাকে নিয়ে নাকি ভাবত। কি জানি? আমার তো কোনদিন সেরকম মনে হয়নি। কিন্তু কি আর করা যায়? কেসের মোড় ঘুরে গেল। আমি রাতারাতি অসাধারণ হয়ে গেলাম। পলিটিকাল পার্টির ক্যাডারও  হয়ে গেলাম।
"তরুন বিশ্বাসের মৃত্যু আমরা ভুলছিনা, ভুলব না"
মনে মনে একটু আনন্দও লাগছিল। হতে চেয়েছিলাম সাধারণ, কিন্তু হয়ে উঠলাম অসাধারণ । কলেজের ছাদের উপরই আমাদের বাসস্থান হয়েছে। এখনও অব্দি তদন্ত চলছে, তাই পড়াশুনা বন্ধ। এমনিতেও লোকে খুব একটা করতো না আর এখন তো আশা করাটাই বৃথা।দূরে দেখি রঞ্জনা বসে আছে। আমি ভাবলাম আর একবার প্রেম নিবেদন করি। ওর জন্যই তো সব কিছু। আমার আরদ্ধ দেবী ও। 
ও দেখি আমার দিকে কট কট করে তাকাচ্ছে। কিছুদিন আরও আমার উপর রাগ করে থাকবে। কিন্তু তারপর আমি মানিয়ে নেব। এই কোলাহলে সব আত্মারা নিজেদের ব্যর্থ প্রেমকে গভীর সমুদ্রে ঝিনুকের মতো খুঁজে বেড়াচ্ছে। কিন্তু রঞ্জনা বসে আছে চুপচাপ করে । হয়ত ও হাঁপিয়ে গেছে। হয়ত ও সত্যি সত্যি আমার কথা ভাবছে।
জানি না, মেয়েদের বোঝা একটু কঠিন। ওর শরীরে ঢুকেও বুঝতে পারলাম না তো এখন কি করে আর বুঝব । 
তবে এইটুকু বুঝেছি যে এটাই আমার সুযোগ। ও আমার দিকে আর আমি ওর দিকে, একভাবে তাকিয়ে আছি। কারুর চোখের পলক পরছেনা। ব্যাস, এইভাবেই যেন থাকতে পারি। এইটুকুই তো চেয়েছিলাম। এই  জন্যই তো এতো কিছু। একবার ও কাছে আসলেই হবে। ওর চোখের দিকে অনন্ত কাল ধরে তাকিয়ে থাকতে পারি। আমি আর রঞ্জনা। আমাদের এই অনন্ত প্রেমকাহিনীর তরী সময়ের গতিপথে চিরকাল ভেসে বেড়াবে। 
আমি মনে মনে বললাম ,”রঞ্জনা। তোকে ছেড়ে  আমি যাবনা"।

Comments

Top

গল্প

মৃত্যুর আহবান

মৃত্যুর আহ্বান

স্বরূপ ঘোষ

সন্তোষপুর, কলকাতা

 

city.jpg

"খন আর সেইরকম অপরাধ কথায়। যে কটাও বা হচ্ছে তা অতি সাধারণ। তাতে নেই কোন রোমাঞ্চ, নেই কোন জৌলুস।" চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিয়ে কথাগুলো বলল অবনীদা। চায়ের দোকানে সন্ধ্যের আড্ডা বসেছে। অবনীদা বলে চলল, "তোমরা শার্লক হোমসকে দেখ, পয়রোর কেসগুলো দেখ। আমাদের বাংলার ফেলু মিত্তির, ব্যোমকেশ বা শবরদের দেখ। আহা! সত্যিই অসাধারণ। ওইগুলোকে বলে অপরাধ। অপরাধগুলো যেন এক একটা রাঘব বোয়াল। তবে না তা সমাধানে আনন্দ আছে। যদিও -", অবনীদা আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু কেউ একজন বলে উঠল, "সে আপনি যতই বলুন, ঐসব গল্পের গোয়েন্দা। আর অপরাধগুলোও রঙচরিয়ে লেখা। বাস্তবে ঐরকম আর আপনি পাচ্ছেন কই?" অবনী দা থামার লোক নয়। আবার শুরু করল, “তা ভায়া আপনি দারোগা প্রিয়নাথের নাম শুনেছেন? উনি তো একসময়ে আমাদের লালবাজারে সশরীরে উপস্থিত ছিলেন। ওনার সব কেস গুলোই কিন্তু ছিল বাস্তব ঘটনা। যাকে বলে একেবারে রিয়েল ইন্সিডেন্ট। না কি ওনার ব্যাপারে আদৌ কিছু জানা নেই?” “ওরম মনে হয়।” আবার আর একজন কী যেন বলে উঠল। তর্ক বেশ জমে উঠেছে বুঝতে পারলাম। আমি উঠে পড়লাম। সন্ধ্যে সাতটা বাজে। ঝমঝম করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে, সাথে ঝড়। এখনই বাড়ি ফিরতে হবে, নাহলে মা চিন্তা করবে। এই মা জাতিটা ঈশ্বরের এক অদ্ভুত সৃষ্টি। এনারা যেন নিজের স্বামী ও সন্তানদের কিছুতেই চোখের আড়াল হতে দেবেন না। এদিকে ফোনটাও বাড়িতে ফেলে এসেছি। আর যা বৃষ্টি হচ্ছে তা সহজে থামবে বলে বোধ হয় না। তাই সাত পাঁচ না ভেবে হাঁটা দিলাম বাড়ির দিকে। মিনিট দুয়েকের হাঁটা। তাই এইটুকু ভিজে গেলেও অসুবিধা নেই। যদিও এই ভেজার জন্য ওই মা নামক ঈশ্বরের অপূর্ব সৃষ্টির থেকে বকুনি নিশ্চিত। 
বাড়ির খুব কাছে এসে বুঝতে পারলাম আজ রাস্তার আলো গুলো নিভে গেছে। কোলকাতা শহরের ঝড়-বৃষ্টিতে রাতে এ ধরণের আলোর কৃপণতা খুব একটা অকল্পনীয় নয়। বাড়ির রাস্তা আমার জন্ম থেকে চেনা, তাই অন্ধকারে হাঁটতে অসুবিধা হচ্ছে না। ভাবছিলাম অবনী দার কথা। এক মজার মানুষ। পুলিশের চাকরি পেতে হবে বলে বিশ্বের সব ধরণের গোয়েন্দা গল্প পড়ে শেষ করে ফেলেছে। বাড়ির সামনের রাস্তাটায় জল জমেছে তাই চলতে গিয়ে একটু বেগ পেতে হচ্ছে। অন্ধকারের মধ্যে হঠাৎ কে যেন আমার হাতটা টেনে ধরল। এই সময় আবার কে এল। অন্ধকারে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। আমি একটু চেঁচিয়েই জিজ্ঞেস করলাম। উত্তর এল অবনীদার থেকে। বলল, “চল, একটু যেতে হবে।” আমি তো অবাক। এই তো চায়ের দোকানে ছিল অবনীদা তর্ক-বিতর্কের মহা আসরে, একান্ত যদি আমার পিছুও নেয় তবুও তো কিছু সময় লাগবে, অন্তত আমার বাড়ি পৌঁছানোর আগে তো নয়ই, ইত্যাদি ভাবনায় মাথাটা গুলিয়ে গেল। অবনীদা আবার বলে উঠল, “চল।” একে বৃষ্টিতে ভিজে গেছি পুরো, তার উপর আবার অন্য কোথাও যেতে হবে এই অন্ধকারে। মনটা সায় দিচ্ছিল না যেতে। আমি একটু জোর দিয়েই জিজ্ঞেস করলাম কোথায় যেতে হবে। উত্তরে অবনী দা বলল, “পল্টুদের বাড়ি। কারণটা ওখানে গেলে বুঝবি। এখুনি চল।”

পল্টুকে আজ সন্ধ্যের চায়ের আড্ডায় দেখিনি, তাই মনে হল যাওয়াটা দরকার। বাড়ির সামনে থেকে বাঁক নিয়ে পল্টুদের বাড়ির পথ ধরলাম। মিনিট পাঁচেকের পথ, রাস্তা আমার চেনা। ছোটবেলা থেকেই যাতায়াত পল্টুদের বাড়িতে। তবুও আজ যেন অন্ধকারটা বড়ই নিরেট। অবনীদা কেও দেখা যাচ্ছে না ভাল করে, তাই সামনে তার একটা ছায়ামূর্তি কল্পনা করে এগিয়ে চললাম। এই ঝড়-বৃষ্টির দিনগুলোতে তিলোত্তমা কোলকাতার মায়াবী রূপের ভিতরের অংশটা প্রত্যক্ষ করা যায়। রাস্তার আলো গুলো নিভে যেন এক নির্জন দ্বীপের রূপকথা রচিত হয়েছে। আর আমি যেন সেই দ্বীপের জলরাশি দিয়ে চলতে চলতে এক অজানা সমুদ্র স্নানের পথে এগিয়ে চলেছি। পল্টুদের বাড়ির সামনে পৌঁছে বুঝলাম ওদের বাড়িতেও বিদ্যুৎ বিভ্রাট ঘটেছে। ওদের বাড়ির সামনে জলটা একটু বেশীই জমেছে। কিন্তু অবনী দা কোথায়? আমার চারপাশে তো কাউকে দেখছি না। এতক্ষণ খেয়াল করিনি। ডাক দিলাম অবনীদার নাম ধরে। কিন্তু বৃষ্টির আওয়াজের কাছে আমার ডাক নিতান্তই গৌণ। ভাবলাম হয়তো

আমার আগেই অবনীদা পল্টুদের বাড়ি ঢুকে গেছে। আমিও আর অপেক্ষা না করে সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেলাম। অন্ধকার সব ঘর। পল্টুদের বাড়ি আগেও অনেকবার এসেছি, তাই ঘরগুলো খুঁজে পেতে অসুবিধে হচ্ছে না। পল্টুদের বাড়িতে পল্টু আর ওর মা-বাবা থাকেন। কাকু কাকিমা খুব ভাল মানুষ, অনেক গল্প করে গেছি এই বাড়িতে। কিন্তু আজ কারোর সাড়া শব্দ নেই। পল্টুই বা কোথায়, আর অবনীদা টাই বা গেল কোথায়? তবে কি ওরা আমার সাথে মজা করছে! এই পরিস্থিতিতে মজা করাটা বেশ বেমানান। মনে মনে একটু রাগই হল। তাই আর কাউকে না ডেকে একটা ঘরে ঢুকে পড়লাম। আজ সমগ্র পরিস্থিতির মত এই ঘরটাও অন্ধকার। চোখ পড়ল সামনের খাটের দিকে। মনে হল দুজন মানুষ শুয়ে আছে। শুয়ে থাকার ভঙ্গি একটু আলাদা। ঘরের জানালা খোলা। বৃষ্টির জলে ঘর ভেসে যাচ্ছে। আবছা অন্ধকারে কিছুটা পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করলাম। কাউকে ডেকেও যখন কোন সাড়া পেলাম না, তখন এগিয়ে গেলাম ঐ খাটের দিকে। কাছে গিয়ে বুঝলাম পল্টুর বাবা আর মা। কিন্তু ওনারা ওরকম ভাবে কেন রয়েছেন? ওনারা কি অন্ধকারে আমায় দেখতে পায়নি? আমি ওনাদের ডাকার জন্য হাত বাড়ালাম, আর ঠিক তখনই এক প্রচণ্ড ধাক্কায় মাটিতে পড়ে গেলাম। ফিরে দেখি অবনীদা। সাথে পল্টু ও পাড়ার অন্যরা। ওদের হাতে মোবাইলের টর্চের আলো। অবনী দা এবার চেঁচিয়ে উঠে বলল, “কী করছিস? ধরিস না?” এবার আমি আলোয় দেখলাম ঘরটা ভাল করে। চোখ পড়ল এতক্ষণে ঐ খাটের দিকে। চমকে উঠলাম। চোখ খুলে অদ্ভুতভাবে পড়ে রয়েছে দুটো নিষ্প্রাণ দেহ। অবনীদা বলল, “আজ সন্ধ্যেবেলা পল্টুদের বাড়িতে শর্ট-সার্কিট হয়। পল্টুর বাবা সুইচ বোর্ডে হাত দিতে গিয়ে, আর ওর মা ওর বাবাকে ধরতে গিয়ে!” ঘরটা একদম শান্ত। আমি কথা লোপ পেয়েছে। অবনীদা বলে চলল, “পল্টু তখন বাড়ি ছিল না। বাড়ি ফিরে এইসব দেখে ও আমাদের ডাকতে যায়। ততক্ষণে তুই চায়ের দোকান থেকে চলে এসেছিস।” আমি নিস্পলক দৃষ্টিতে তখনও ঐ খাটের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। অবনীদার কথাগুলো যেন বৃষ্টি শেষে মাটির সোঁদা গন্ধের মত মনে হচ্ছিল। এবার অবনীদা বলল, “কিন্তু তুই এখানে কী করে এলি? তোকে কে খবর দিল?” এতক্ষণে আমি ধড়ে প্রাণ পেলাম। বললাম, “কেন তুমি।” অবনীদা এক অপরিচিত বিস্ময়ের সুরে বলল, “গাঁজা –টাজা টানছিস নাকি আজকাল?” আমি চুপ করে রইলাম। আমার বোধ বুদ্ধি সব যেন লোপ পেয়েছে। মনে হল মৃত্যু যেন নিঃশব্দে আমাকে মৃত্যুর খুব কাছে নিয়ে এসে দেখা দিয়ে গেল। ভূত-ভৌতিক, অলৌকিকতা নিয়ে তখন আর ভাবার পর্যায়ে ছিলাম না। পল্টুদের বাড়ির ঘড়িতে তখন ঢং ঢং শব্দে আটটা বাজল। 
এই ঘটনার পর বহুদিন কেটে গেছে। পল্টু আমাদের পাড়া ছেড়ে আড্ডা ছেড়ে ওর মাসির বাড়ি মালদায় চলে গেছে। আর এখানে কোনদিনও আসেনি। মাঝেমধ্যে ফোনে বা ওয়াটসঅ্যাপে কথা হয়। অবনীদা এখন চায়ের আড্ডা ছেড়ে কোলকাতা পুলিশে সাব-ইন্সপেক্টর পদে কর্মরত। ওর জন্য ওটাই মনের মত চাকরি। দেখতে দেখতে আমারও কলেজ জীবন শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু সেইদিনের কথা এখনো মনে পড়ে। কাকু কাকিমার কথা, পল্টুর কথা। এখনো এক অস্বাভাবিক শূন্যতা অনুভব করি। অনেকদিন পর্যন্ত সেই মৃত্যুভয় আমাকে তাড়া করে বেড়াত। ঐ ঘটনার পর বেশ কিছুদিন ম্যালেরিয়া তেও ভুগেছিলাম। ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য বললে হয়তো আমার মা, বাবা ও পাড়ার লোকেরা ভৌতিক উপাখ্যানের এক উপন্যাস রচনা করে বসত। তাতে সৃষ্টি অপেক্ষা ধ্বংসই বেশী প্রাধান্য পেত। তাই সেইসব কথা কাউকে আর বলিনি কোনদিন। আর আমি নিজেও তো সেই ঘটনার কোন উত্তর খুঁজে পাইনি এই একবিংশ শতাব্দীর বিশ্বে। হয়তো কিছু অজানা জিনিস চিরদিন অজানাই থেকে যেতে চায়। পল্টুদের বাড়িটা এখন সরকারী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। সকলে সেখানে যায় ডাক্তার দেখাতে। আমিও গেছি কয়েকবার। একদিন এক সন্ধ্যেবেলা যেখানে মৃত্যুর আহ্বান হয়েছিল, যে মৃত্যুপুরী কেড়ে নিয়েছিল দুটো নিষ্প্রাণ তাজা প্রাণ; আজ সেই পুরীই মানুষের জীবন দানে ব্রতী হয়েছে। সময়ের এ এক অদ্ভুত পরিহাস।

Comments

Top

গল্প

পাঁঠার পাঠ

জয়দীপ চক্রবর্তী

goat1.jfif
oldman2.jpg
পাঁঠার পাঠ

বানপুরের বেবুনগঞ্জ থানার সামনে বেশ ভিড়। দায়িত্ব মজুমদার নামের এক পুলিশ কর্মীর একটি কাজ এখন আলোচনার বিষয়-বস্তু। গ্রামের লোকেরা থানার সামনে জড়ো হয়ে যে যার নিজের মত পোষণ করছে। থানা থেকে একজন হাবিলদার বেরিয়ে সকলে মাস্ক পরে আছে কি না পর্যবেক্ষণ করে, সকলকে সামাজিক দূরত্ব বাজায় রেখে আলোচনা করার নির্দেশ দিয়ে আবার থানায় ঢুকে গেল। 
খবরটা থানার বড়বাবুর কানে যাওয়া মাত্রই উনি বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। কি করবেন কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না। এই দায়িত্ব মজুমদারের দায়িত্ব পালন নিয়ে এর আগেও দু-একবার বেশ সমস্যায় পড়তে হয়েছে বড়বাবুকে। কিন্তু এবারের সমস্যাটা একটু ভিন্ন ধরনের।  দায়িত্ব যদি এভাবেই তার দায়িত্ব পালন করে চলে, তবে যে চাকরির স্থায়িত্ব নিয়ে বড় প্রশ্ন উঠবে, তা নিশ্চিত। গ্রামের লোক বেশ ক্ষেপে গিয়েছে। পরিস্থিতি আয়ত্তে আনতে দায়িত্ব মজুমদারের সাথে আলোচনায় বসলেন বড়বাবু।    
- অ্যারেষ্ট করে নিয়ে এসেছ?
- হ্যাঁ, স্যার। আমার কাছে অপরাধীর ক্ষমা নেই। সে যেই হোক। এই পুলিশের পোশাকটার অনেক দায়িত্ব স্যার।  
- সে ঠিক, তবে এই অপরাধে একটা ....
- অপরাধ নয় স্যার? চারপাশের পরিবেশে, ছদ্মবেশে কোরোনা যেভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাতে বিনা মাস্কে রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো অপরাধ নয়?
- সে হয়ত অপরাধ, কিন্তু অনেক মানুষই যেখানে মাস্ক ছাড়া ঘুরে বেড়াচ্ছে, সেখানে একটা ....
- আইনের চোখে সবাই সমান স্যার। অনেক মানুষ করছে বলে,অপরাধীকে ছেড়ে দেব, তেমন পুলিশ আমি নই। শাস্তি ওকে পেতেই হবে।
- তা কি শাস্তি দেবে ভেবেছ? 
- প্রাণ-দণ্ড। 
- অ্যাঁ, বল কি? এই সামান্য অপরাধে প্রাণ-দণ্ড?
- নিরপরাধে প্রতিদিন কত লক্ষ লক্ষ পাঁঠার প্রাণ যাচ্ছে। আর এ তো একটা বড় অপরাধ করেছে।
আলোচনা দীর্ঘস্থায়ী হল না। একটা ময়লা ফতুয়া আর পাজামা পরা মাঝ-বয়সী একটি লোক থানায় ঢুকে দুজনের আলোচনায় ব্যাঘাত ঘটাল। থানায় ঢুকেই লোকটি করজোড়ে বড়বাবুকে অনুরোধ করল, ছেড়ে দিন স্যার।
বড়বাবু, দায়িত্বর থেকে এই লোকটির দিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে, ভুরু কুচকে জিজ্ঞাসা করলেন, কাকে?
- পাঁঠাটাকে স্যার। বিনয়ের সাথে বলল লোকটা। 
- তুমি কে? বড়বাবুর প্রশ্ন। 
- আমি পাঁঠার মালিক স্যার। 
অসম্ভব। ছাড়ার প্রশ্নই ওঠে না। সজোরে প্রতিবাদ করে নিজের দায়িত্বজ্ঞানের পরিচয় দিল দায়িত্ব।  লোকটার সকল প্রশ্নের উত্তরের দায়িত্ব, দায়িত্ব মজুমদার স্বেচ্ছায় নিয়ে নেওয়ায়, বড়বাবু লোকটার সাথে আর কথা না বলে নিজের মোবাইলে মননিবেশ করলেন। সংবাদপত্র পাঠ, পরিচিতদের সাথে যোগাযোগ, অপরিচিতদের সাথে পরিচিত হওয়া, বিনোদন, সবই এখন এই মোবাইলেই সম্ভব। এই যন্ত্র এখন সমগ্র মানবজাতির কাছেই একম, আর অদ্বিতীয়ম।
এদিকে দায়িত্ব মজুমদার পাঁঠার মালিককে প্রশ্ন করে চলেছেন। 
- তোমার পাঁঠা কি করেছে জানো? এই মহামারির সময়ে, মাস্ক ছাড়া রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছে। তুমি তোমার পাঠাকে মাস্ক পরিয়ে রাস্তায় বার কর না কেন? 
- কিভাবে পরাবো স্যার? মাস্ক পরালে তা খেয়ে নেয়। আমি গরিব মানুষ। এতো মাস্ক কোথায় পাবো স্যার? নিজের লুঙ্গি কেটে একটা মাস্ক বানিয়ে পরালাম, পাঁঠাটা সেটা খেয়ে নিলো। 
- মাস্ক খেয়ে নিয়েছে? হ্যাঁ কথায় তো আছেই, ছাগলে কি না খায়, আর ..
- আমারটা ছাগল নয় স্যার, পাঁঠা।
- ঐ হল। আস্ত পাঁঠা একটা।  

- একদম ঠিক কথা স্যার। এবারে এই আস্ত পাঁঠাটাকে আস্ত অবস্থাতেই ফিরিয়ে দিন স্যার।

- ফিরিয়ে দিন বললেই কি ফিরিয়ে দেওয়া যায়? তোমার পাঁঠার যদি কোরোনা হয়ে থাকে, আর ও যদি ঐ রোগ নিয়ে হাঁচি দেয়, তবে সেই হাঁচি থেকে কত লোক অসুস্থ হয়ে পরতে পারে সেটা জানো? পাঁঠারা তো আর মুখে হাত দিয়ে হাঁচে না। 

- না স্যার, আমার পাঁঠা হাঁচে না। আর ওর কোরোনাও হয় নাই। গায়ে হাত দিয়া দেখেন, গা একেবারে ঠাণ্ডা। 

- জ্বর না হলেও কোরোনা হতে পারে। পরীক্ষা না করে নিশ্চিন্ত হওয়া যাবে না। 

- স্যার, শুনেছি নাকে মুখে হাত না দিলে কোরোনা হয় না। আমার পাঁঠা নাকে মুখে একদমই হাত দেয় না। তাই ওর কোরোনা হবে না স্যার। 

- তোমার পাঁঠার কোরোনা না হলেও সে অন্যকে কোরোনার ভাইরাস ছড়াতে পারে। পাঁঠাকে শেখাতে পারো না, যে মাস্ক পরার জন্য, খাওয়ার জন্য নয়। 

- পাঁঠাকে কিভাবে পাঠ দেবো স্যার? ও কি পাঠ নেবে? পাঁঠাদের তো কোনও পাঠশালা নেই যে সেখানে ভর্তি করে দেবো। 

- পাঁঠার পাঠশালা থাকলেও কোন শালা পাঁঠাকে পাঠশালায় পাঠাবে? আচ্ছা পাঁঠা মাস্ক খায় কেন? পাঁঠাকে তুমি খেতে দাও না?

- দি তো। কাঁঠাল পাতা খেতে দি। সেটা খাওয়ার জন্যই তো পাঁঠাটা মাস্ক খেয়েছিল। মাস্ক পরে তো ও কাঁঠাল পাতা খেতে পারবে না, তাই। 

- তুমি মাস্ক পরিয়ে পাঁঠাকে খেতে দিয়েছ? পাঠ তো পাঁঠার নয়, তোমার দরকার দেখছি।

- সপরিবারে পাঠশালায় গিয়ে পাঠ নিয়ে আসবো। এবারে স্যার, আমাকে আমার পাঁঠা দেন।

- কোনোভাবেই তোমাকে পাঁঠা দেওয়া যাবে না। তোমার পাঁঠার প্রাণদণ্ড হবে।

- প্রাণদণ্ড তো আমিই দেবো। আমি ওরে পাঁঠার দোকানে বেঁচবো। ওখানেই ওর প্রাণদণ্ড হবে। আপনারে নয় কেজি খানেক মাংস দিয়ে দেবো। 

- তুমি আমাকে ঘুষ দিচ্ছ? পাঁঠার পা-ও তুমি পাবে না। পাঠাটা বিনা মাস্কে অনেকক্ষণ ঘুরে বেরিয়েছে। ওর শরীরে যদি ভাইরাস ঢুকে থাকে, তবে ওর মাংস যারা খাবে, সবার কোরোনা হবে। 
- মাংসের দোকানদাররে বলবো, পাঁঠাটাকে কাটার আগে স্যানিটাইজারে ভালো ভাবে স্নান করিয়ে নিতে। তাহলেই আর কোনও সমস্যা হবে না। 
বড়বাবু এবারে মোবাইল থেকে দৃষ্টি সরিয়ে দুজনের কথোপকথনে মন দিয়েছে। এই আলোচনা যত দীর্ঘই হোক না কেন, এ যে কোনও মীমাংসার দিকে যাবে না এটা ওনার কাছে স্পষ্ট। তাই বাধ্য হয়েই সেই কথোপকথনের মধ্যে ঢুকলেন উনি। 
- ঠিক আছে। আপনার বক্তব্য তো শুনলাম। এবারে আপনি একটু বাইরে গিয়ে দাঁড়ান। আমরা দুজনে একটু আলোচনা করে নি। একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছেই তোমাকে ডেকে নিচ্ছি। 
বড়বাবুর কথায় সম্মতি প্রকাশ করে ঘরের বাইরে বেরল লোকটা। থানার বাইরে একটা পুলিশের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। তার পাশে একটা কাঁঠাল গাছ। সেই গাছের সাথেই পাঁঠাটাকে বেঁধে রাখা হয়েছে। পাঁঠা সেই কাঁঠাল গাছের পাতার নাগাল পাচ্ছে না। একজন হাবিলদার ঐ গাছ থেকে পাতা ছিঁড়ে পাঁঠার মুখের সামনে ধরছে। আর পাঁঠা তা মহানন্দে ভক্ষণ করছে। অ্যারেস্ট হয়ে থানায় বন্দি হয়ে আছে বলে কোনও তাপ-উত্তাপই ওর আচরণে প্রকাশ পাচ্ছে না। পাঁঠার মালিক পাঁঠার কাছে দাঁড়িয়ে পাঁঠার খাওয়া দেখতে লাগল। 
লোকটি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে, দায়িত্ব মজুমদার, বড়বাবুকে বলল,
- স্যার এতে আর আলোচনার কি আছে? দোষ করেছে, শাস্তি পাবে। মানুষ করলে দোষ,আর পাঁঠার বেলায় সাত খুন মাপ, এমন তো কোথাও লেখা নেই!
- শাস্তি দিলে তার ফলটা কি হবে, সেটা একবারও ভেবে দেখেছ? নিউটনের তৃতীয় সূত্র মনে আছে তো?
- হ্যাঁ সার। প্রত্যেক ক্রিয়ার সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে। কিন্তু এই ক্রিয়ার কি বিপরীত প্রতিক্রিয়া হবে স্যার? 
- হবে না, অলরেডি প্রতিক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। 
- কি প্রতিক্রিয়া স্যার?
- পাঁঠা সহ এই থানার ছবি ফেসবুকে পোস্ট করেছে একজন। আর তার নিচে লিখেছে, মাস্ক না পরায় একটি পাঁঠাকে গ্রেপ্তার করল এক পুলিশ পাঁঠা। 
- আমি পাঁঠা? এই খবর কেউ পড়েনি তো?
- পড়েনি মানে? অলরেডি দুশো লাইক আর দেড়শো কমেন্ট পড়ে গেছে।
- দুশোজন লাইক দিয়েছে, মানে দুশো লোক আমার এই কাজ কে সমর্থন করেছে। কি বলেন স্যার!
-  একদমই না। এখন কারও বাবা-মা মারা গেলেও সে ফেসবুকে পোস্ট করে। আর সেই পোস্টেও লাইক পরে।
- তাহলে তো বেশ সমস্যা স্যার। 
- এটা কোনও সমস্যাই নয়। এর চেয়েও বড় সমস্যা আছে।
- সেটা কি স্যার?
- ঐ ছবির নিচে যারা কমেন্ট করেছে, তাদের মধ্যে একজন লিখছে, 
- কি লিখেছে স্যার? 
- লিখেছে, সে নাকি পার্কে তোমাকে একটা মেয়েকে কিস করতে দেখেছে। তখন তোমাদের কারও মুখেই মাস্ক ছিল না।
- কি করে থাকবে স্যার? মাস্ক পরে কি কিস করা যায়?
- সে যায় না। কিন্তু তোমরা এই মহামারির সময়ে সোশ্যাল ডিস্টেন্স মেন্টেন করনি, মাস্ক পরনি, প্রকাশ্যে কিস করেছ। তিনটেই অপরাধ। অথচ তোমার কোনও কিছু হল না। আর একটা নিরীহ পশু মাস্ক না পরার অপরাধে গ্রেপ্তার হয়ে গেল!
- কিসের কেসটা এভাবে লিক হয়ে পাবলিক হয়ে গেলে আমি তো কেস খেয়ে যাবো স্যার!
- সে তো খাবেই। তবে এটাও কোনও সমস্যা নয়। এর চেয়েও বড় সমস্যা আছে।
- এরচেয়েও বড় সমস্যা? সেটা কি স্যার? 
- এখন মিডিয়া খবরের জন্য ওত পেতে থাকে। খবরটা যখন সোশ্যাল মিডিয়াতে ছড়িয়েছে, তখন নিশ্চিত ভাবে এতক্ষণে মিডিয়ার কানে পৌঁছে গেছে। অল্পক্ষণের মধ্যেই মিডিয়ার দল থানায় ছুটে এসে তোমার ইন্টারভিউ নেবে। আর কাল এই খবর দুনিয়া ডট কমের মাধ্যমে খবরটা রাষ্ট্র হবে।
- এখন আমি তবে কি করবো স্যার?
- যে ভুল তুমি করে ফেলেছ, সেটা তো মুছে ফেলা যাবে না। আপাতত পাঁঠার মালিককে পাঁঠা ফেরত দিয়ে তোমার পাপ কিছুটা লঘু কর।
- আমি এখুনি পাঁঠা ফেরত দিয়ে দিচ্ছি স্যার। 
দায়িত্ব মজুমদার তৎক্ষণাৎ থানা থেকে বেরিয়ে পাঁঠাটা ওর মালিককে দিয়ে দিল। আর সেই সঙ্গে পকেট থেকে একটা মাস্ক বের করে পাটার মালিকের হাতে দিল। আর বলল,
- এই মাস্ক পরিয়ে পাঠাকে নিয়ে যাও। আর দেখো এই মাস্ক যেন ও খেয়ে না ফেলে।
- না স্যার। কাঁঠাল পাতা খেয়ে ওর পেট এখন ভর্তি। ও এখন আর মাস্ক খাবে না। মাস্ক তো সুস্বাদু খাবার নয়, যে ও খাবে।
- সেটা তুমি জানলে কি করে? তুমি মাস্ক খেয়েছ নাকি?
- না স্যার। ঐ মাস্ক খাওয়ার সময় পাঁঠার মুখ দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম। ঠেলায় পরেই পাঁঠাটা মাস্ক খেয়েছিল। চললাম স্যার।
পাঁঠার মালিক আনন্দে পাঁঠার গলার দড়ি ধরে ওকে টানতে টানতে এগিয়ে চলল। কিছুটা যাওয়ার পর একটি নিউজ চ্যানেলের গাড়ি তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে, থানাটা কোথায় জিজ্ঞাসা করল। লোকটা পেছন ফিরে আঙ্গুলের ইশারায় থানা দেখিয়ে দিয়ে আবার নিজের গন্তব্যের দিকে পা বাড়াল। 

 

Comments

Top

গল্প

সব চরিত্র অকাল্পনিক

রিমি ঘোষ দস্তিদার

পি আর ঠাকুর গর্ভমেন্ট কলেজ, ঠাকুরনগর

girl.jpg
সব চরিত্র অকাল্পনিক

য়স বেড়ে বেড়ে প্রাপ্তবয়স্কের তকমা তো সবাই অর্জন করে। কিন্তু প্রাপ্তমনস্কের তকমা? গুটিকতক পায়। আমি আজ বস্তাপচা, বহু-ঘাঁটা একটা চিরপরিচিত বিষয় নিয়েই একটা ঘটনা লিখব। ভাবছেন পুরোনো বিষয়ই যদি হয়, তাহলে এত ঢাক-ঢোল পিটানো কেন বাপু ?নিত্যনতুন বিষয়ের কি অভাব পড়েছে? উঁহু। তা নয়। চেনা বিষয় যখন অচেনা বোঝাপড়ায় মেটাতে হয়, তখন তা খানিক নতুন হয়ে ওঠে বটে। এ তেমনই এক কাহিনী।

নেহা কলেজে সদ্য জয়েন করেছে। ফ্যাকাল্টি। শহুরে কলেজ। ঝকঝকে আদব কায়দা। পদে পদে উন্নয়নের বেজায় আয়োজন। কলেজে যেদিন প্রথম জয়েন করলো, বেশ ভালো লেগেছিল সেদিন ওর। দু-একজন বাদে সবাই খুব আন্তরিক। হুল্লোড়ে। স্টাফরুমটা বিশাল বড়। বিশাল একটা টেবিল। অনেকগুলো চেয়ার। সকল টিচারদের কাছেই ঘরটা দম ফেলার একটা জায়গা। ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে তুমুল আড্ডা চলে। চলে সুখ-দু:খের কথালাপ। রিসেস পিরিয়ডে রীতিমতো বসে পাত পেরে খাওয়ার আসর। আর এর মাঝেমাঝে তো চা-সিগারেটের ধোঁয়া ওঠা তর্ক-বিতর্ক আছেই। তবে ক্লাস নিয়ে যে সবাই খুব সচেতন, তেমন নয়। দু-একজন তো একেবারেই গা-ছাড়া। তাদের কাছে কলেজে আসাটাই একটা বিশাল ব্যাপার। নিত্য নতুন শাড়ি। জামদানি। ঘিচা। হ্যান্ডলুম। ব্যাগ। লেদার বাটিক না কোচ লাইট। পাঞ্জাবী। ফেব্রিক। কাঁথাষ্টিচ। দেশ-দশের সমালোচনা। ছেলেমেয়েদের নিয়ে মাথাব্যাথা নেই। না ভুল হলো, আছে। অপ্রয়োজনের মাথাব্যাথা। কার জামার সাইজ ছোটো! কার জিনস টাইট। কোন ছেলেটা কোন মেয়েটার সাথে বেশিক্ষণ সিঁড়িতে বসছে। এইসব! কো-এড কলেজ। মহিলা-পুরুষ সব টিচারই আছে। নেহা বরাবরই খোলা মনের মানুষ। বলিয়ে-কইয়ে। আবার প্রয়োজনে শান্ত। এমনিতে গোছানো কিন্তু সময়ে সময়ে এলোমেলো। একদিন পরপর তিনটে ক্লাস নিয়ে স্টাফরুমে ঢুকেছে। রোজকার মতোই দেখল ওর কিছু মেল-কলিগ (ভিন্ন ভিন্ন বয়সী) সিগারেট- ব্রেক নিচ্ছে। নেহা রেজিষ্টারটা জায়গামতো রেখে চেয়ারে শরীরটা এলিয়ে দিতে দিতে সহজ গলায় বলল - “দাও তো একটা সিগারেট। ভীষণ টায়ার্ড লাগছে” ঘরে আরও চার-পাঁচ জন ছিল। এমনকি প্রিন্সিপাল স্যারও। নেহার কথায় বোধ করি বাজ পড়ল ঘরে। বা দুম করে আসা কোনো দু:সংবাদের মতো সবার মুখ প্রায় ফ্যাকাশে হয়ে গেল। নেহা খানিক অবাক হল। এবার সে হাত বাড়িয়ে বলল - কই দাও। খানিক সামলে নিয়ে একজন বলল - তুমি! মানে তুমি স্মোক করো? প্রিন্সিপাল ওই দিকের চেয়ার থেকে গলা তুললেন - যাহ! ও ইয়ার্কি মারছে। তোরা এটুকু বুঝলি না? হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ। নেহা আরো অবাক হয়ে বলল- না। ইয়ার্কি মারছি না। সত্যি চাইছি। রোজই প্যাকেটটা আনতে ভুলে যাই। ঢোকার সময় যে কিনব, তাও ক্লাসের তাড়াহুড়োয় খেয়াল থাকে না। আচ্ছা। না থাকলে দিও না। আমি আনিয়ে নিচ্ছি”। বাকিদের মুখ চাওয়াচাওয়ি থেকে আন্দাজ করল- ও এখন ভিন গ্রহের জীব। ঘরের হাওয়াটা আরেকটু খেলতে দিয়ে নেহা পার্সটা হাতে নিয়ে বাইরে এলো। কলেজের উল্টোদিকেই পান - সিগারেটের দোকান। একটা ক্লাসিকের প্যাকেট কিনল। একটা দেশলাই। সাথে কয়েকটা লজেন্স। কলেজে ঢুকতে গিয়ে চোখে পড়ল – সিঁড়ির পাশে দাঁড়িয়ে বীণাদি মোবাইলে কথা বলছে। এতক্ষণ তো ষ্টাফ রুমেই ছিলেন। চোখাচোখি হতেই নেহা স্বাভাবিক হাসলো কিন্তু বীণাদি যেন আড়ষ্ট। ফোনের গলাটাও কেমন চাপা হয়ে গেল। নেহা পাশ দিয়ে চলে এসে ষ্টাফরুমে ঢুকলো। যারা ছিল, তারা আছেই। আরও কয়েকজনও ক্লাস নিয়ে এসে পড়েছে। নেহা নিজের চেয়ারে গিয়ে একটু জল খেয়ে সিগারেটের প্যাকেটটা খুলল। থমথমে চোখগুলির হুল ফোটানো পর্যবেক্ষণটা বেশ বুঝতে পারছিল। পাশের চেয়ারের সুলেখাদি এবার প্রায় আঁতকে চেঁচিয়ে উঠল। উনি আবার নেহার ডিপার্টমেন্টাল হেড। এবং ঐ গা-ছাড়া, ক্লাস না নেওয়া, পরনিন্দায় মশগুল থাকা একজন বয়স্ক অধ্যাপিকা।

- তুই সিগারেট খাবি?

- হ্যাঁ। কেন?

- আমাদের এখানে এসব চলে না।

- কিন্তু এতক্ষণ তো চলছিল।

- সে কৈফিয়ৎ তো তোকে দিতে পারব না। এখানে তুই সিগারেট খেতে পারবি না। বেলেল্লাপানা বাইরে গিয়ে করো।

- কৈফিয়ৎ তো তোমার কাছে চাই নি। আর এই বেলেল্লাপানাটা কী? সিগারেট খাওয়াটা নাকি শুধুমাত্র মেয়েদের সিগারেট খাওয়া?

- আমি তোর সাথে তর্ক করতে চাইছি না। যেটা বললাম সেটা কর।

- স্যরি। ভেরি স্যরি। প্রথমত, তুমি আমার গার্জিয়ান নও to say what to do or not apart from my scheduled academic responsibility of this institution। দ্বিতীয়ত, গার্জিয়ান হলেও আমার ব্যক্তিগত ইচ্ছে-অনিচ্ছে নিয়ে কথা বলার অধিকার তাদের নেই কারণ আমি অ্যাডাল্ট। আমি নিজের পয়সায় সিগারেট খাই। তৃতীয়ত, এখানে আসা অব্দি দেখে আসছি, এখানে সিগারেট খাওয়াটা অ্যালাউড। নিয়ম বিরুদ্ধ কোনো কাজ আমি করছি না।

প্রিন্সিপাল এতক্ষণে ফিল্ডে নামলেন। দু-একটা স্টুডেন্ট পর্দা সরিয়ে কোনো টিচারকে ডাকার চেষ্টা করছিল। কেউ কেউ হাতের ইশারায় তাদের ফিরিয়ে দিল। ব্যাপারটা জমেছে বেশ।

- দ্যাখ্। এই কলেজের একটা নিয়মশৃঙ্খলা আছে তো। সবেমাত্র জয়েন করেছিস। একটু দেখে বুঝে নে। এখানে অতিরিক্ত স্মার্টগিরি ফলানো যায় না।

- কোন নিয়ম শৃঙ্খলাটা ভেঙেছি আমি? আর কোনটাই বা অতিরিক্ত স্মার্টগিরি? সিগারেট খাওয়ার সাথে স্মার্টগিরির কোনো সম্পর্ক নেই। ঐটা আসে বুদ্ধি-বিবেচনার মাধ্যমে। গ্রামবাংলায় বহু মহিলা কাজের ফাঁকে পা ছড়িয়ে বসে বিড়ি টানে। সেটাকেও আপনি স্মার্টগিরি বলবেন? আর আমি তো আসার দিন থেকে দেখছি এখানে রীতিমতো সিগারেট খাওয়ার আসর বসে। না দেখে না বুঝে তো আমি কোনো কাজ করি নি। আমার হাতে সিগারেট থাকলে সেটা স্মার্টগিরি আর আপনাদের হাতে সিগারেট থাকলে সেটা সমঝদারি?

আবার সুলেখাদির সেই খরখরে গলা।

- দ্যাখো অবনীদা, দ্যাখো! এবার উচ্ছন্নে যাবে এই কলেজ। কারা সব ঢুকেছে দ্যাখো। সব নামী-দামী আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রী নিয়ে আসে। এই তো অবস্থা।

- কী অবস্থা? না। let me get the clear picture, please. Why are you reacting in that manner? সমস্যাটা কোথায়? বলে এবার সিগারেটটা ধরিয়েই ফেলল নেহা। দেশলাই কাঠিটা নিভিয়ে নীচের বাস্কেটে ফেলতে ফেলতে বলল- এ ঘরে কোথাও যদি লেখা থাকত- no smoking zone. তাহলেও বুঝতাম। বা এসে যদি দেখতাম এ ঘরে কেউ স্মোক করছে না, তাও ভাবতাম। এই ঘরে তো সবই চলছে। তাহলে আমার সিগারেট খাওয়ায় বাধাটা কোথায়? আর আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সিগারেট খাওয়ানো শেখানো হয়-সেটাই বা কে বলল তোমাকে?

- অনেক কিছু দেখা আছে আমার।

- কিছুই দেখা নেই। চোখ বন্ধ করে থাকলে আদপে কোনো কিছুই দেখা যায় না। তবে হ্যাঁ-

জীবনানন্দ অনেকদিন আগেই লিখেছিলেন- এ-পৃথিবীতে আজ/যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ, চোখে দ্যাখে তারা। আর সিগারেট খাওয়াটা আধুনিক সংস্কৃতি নয়। প্রিন্সিপালের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি তো ভারতীয় সংস্কৃতির ইতিহাস জানেন। না, মানে জানেন বলে দাবী করেন। নেশা করাটা ভারতীয় সংস্কৃতির একটা অংশ এবং সেটা নারী-পরুষ নির্বিশেষে। এত প্রাচীন একটা প্রতিষ্ঠান যেখানে ইতিহাস কথা বলে; সেখানের অংশীদার হয়ে তো এই সামান্য তথ্যটা জানা উচিত আপনার।

- উচিত -অনুচিত আমাকে শেখাতে আসিস না। এবার প্রিন্সিপাল প্রায় দাঁত খিঁচিয়েই উঠল।

- উহু। শেখাচ্ছি না। তবে ভুল মন্তব্য করলে সংশোধন তো করে দিতেই হবে। অন্তত আমার সামনে।

- এখানের একটা ঐতিহ্য আছে। এরকমটা কোনোদিন হয় নি এখানে। সমস্ত প্রতিষ্ঠানের একটা নিজস্ব নিয়ম থাকে।

- বেশ তো। তা সেই ঐতিহ্যের মাপ কি নারী-পুরুষ ভেদে আলাদা? এরকমটা কোনোদিন হয় নি মানে বলতে চাইছেন মেয়েরা এখানে কোনোদিন স্মোক করে নি। প্রতিষ্ঠানের নিয়মটা কি সেইরকম কিছু?

- হ্যাঁ তাই।

- সেটাকেই আপনারা ঐতিহ্যে আঘাত বলে ধরে নিচ্ছেন।

- তাছাড়া আবার কী? মেয়েদের চালচলনের একটা বাঁধন থাকবে না?

- অদ্ভুত! কীসের বাঁধন? আর বাঁধনটা কে ঠিক করবে? আপনারা? নিজেদের খেয়ালখুশি মতো করে বানিয়ে নেবেন? সিগারেট খাচ্ছে সবাই। আজ একটা মেয়ে সিগারেটে ফুঁ দিলেই আপনাদের গেলগেল আর্তনাদ ওঠে। কেন বলুন তো? সমাজের অভিভাবক হতে চান? তাহলে সবার জন্য একটাই নিয়ম বানান। একদিকে বলছেন, এটা বেলেল্লাপানা! অথচ একটু আগেই আপনি যখন ওদের সাথে বসে সিগারেটে টান দিচ্ছিলেন, সেটা নিতান্তই স্বাভাবিক?

- বড় বড় কথা! আমরা expect করেছিলাম তুই ভদ্রতাটা জানবি। অন্তত বড়দের সম্মান-শ্রদ্ধা করতে জানবি।

- expectation টা কাজে দিল না। তাই তো? আমি সিগারেট খেলে যদি বড়দের সম্মানহানি হয়, তাহলে ওরা সিগারেট খেলেও তো একই জিনিস হওয়ার কথা - তাই না? ওরা তো আমারই বয়সী বা একটু বড়। সেখানে তো প্রিন্সিপাল হয়ে আপনি নিজেই সিগারেট অফার করেন ওদের। বাকিরা সবাই সেটা entertain করে। আমি না সত্যিই একটু গুলিয়ে ফেলছি। কোনটা ভদ্রতা, কোনটা অভদ্রতা ঠিক বুঝলাম না। কলেজের কলিগদের ব্যক্তিগত রুচি-অরুচিতে interfere করাটা বুঝি ভদ্রতার পরিচয়?

- সবে এসেছিস! কাগজপত্র হেড অফিসে যাওয়া এখনও বাকি। খেয়াল রাখিস।

এবার নেহা না হেসে পারল না।

- থ্রেট দিচ্ছেন? বাহ! সিগারেট খেলাম বলে? অবশ্য আপনি আমার ইমিডিয়েট বস। আপনি power exploit করতেই পারেন। তবে একটু বুঝেশুনে এগোবেন। স্টাফরুমে সিগারেটে আগুন দেওয়ার জন্য যদি কাগজপত্র আটকে যায়, তাহলে সেই আগুনটা কিন্তু বাইরেও ছড়াবে। সেই তাপটা সহ্য করতে পারবেন তো? সিগারেটের বাটটা ash-tray তে গুঁজে দিতে দিতে বলল নেহা।

বাকিরা এবার মুখ চাওয়াচাওয়ি করে নিজেদের কাজে মন দিল।

- তবে হ্যাঁ। আমার একদম ক্লোজ যারা বসো, তাদের যদি সিগারেটের ধোঁয়ায় অসুবিধা হয়, নিশ্চয়ই বোলো, আমি অন্য জায়গায় গিয়ে খাব। আশা করি, সেটা হয়তো বিশেষ সমস্যা হবে না। কারণ তোমরা এখানে ধোঁয়া খেতে অভ্যস্ত।

পরের ক্লাসটা অফ ছিল। সুলেখাদি, প্রিন্সিপাল স্যার, বাণীদি একে একে স্টাফরুমের বাইরে গেল। এবার নেহার গুষ্টি উদ্ধার হবে। ষ্টাফরুমে দু-একজনের চোখে প্রশ্রয়টা নজর এড়ালো না নেহার। মোবাইলটা হাতে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় মাঝারি সাইজের একটা লেখা পোষ্ট করল নেহা।

“আমি আপনি সবাই জানি সিগারেট খাওয়া স্বাস্থ্যের পক্ষে খুব খারাপ। মারাত্মক হানিকর। এখন তো সিনেমা দেখতে বসলেই আপনাকে কতকটা বাধ্যতামূলকভাবেই সিগারেট খাওয়ার সাবধান বানী শুনতে হয়! সুতরাং কেউ যদি আপনার শুভাকাঙ্খী হয়ে আপনাকে সিগারেট খেতে মানা করে তাহলে সেখানে মানবিকতার সূক্ষ প্রকাশ থাকে। কিন্তু আমাদের তথাকথিত‘সমাজ প্রতিপালক’-রা (যারা প্রকৃতপক্ষেই নিজেদের সামাজিক বলে দাবী করেন, সমাজের প্রকৃত অভিভাবক বলে ভাবার অঙ্গীকার নিয়েছিলেন কোনো এক সময়, জন্মসূত্রে বা কর্মসূত্রে) কি সত্যি সত্যিই সিগারেট এবং স্বাস্থ্য-এই দুইয়ের পারস্পারিক সমানুপাতিক অবক্ষয় নিয়ে সাংঘাতিক চিন্তিত থাকেন? যদি তাই হয়, তাহলে তো তার নারী পুরুষ নির্বিশেষে এই চিন্তার ধারক হওয়া উচিত! নারী সিগারেট খেলেই সে বখে যাওয়া, অন্যরকম! কই পুরুষদের বেলায় তো তা হয় না। অফিস- কাছারি, কলেজ, পাড়ার মোড়, চায়ের দোকান, আড্ডার ঠেক- সর্বত্রই পুরুষের জটলা এবং তামাকের ধোঁয়া ভীষণ পরিচিত চিত্র।দুই অপরিচিত পুরুষের আলাপের শুরুতে সিগারেট দেওয়া নেওয়ার প্রথা মান্যতাপ্রাপ্ত কিন্তু সেই আলাপের গন্ডিতে মহিলা থাকলে চট করে সেই অফার অনেকেই করেন না বা করতে চান না। অফিসের সাময়িক আড্ডায় বা কলেজের ষ্টাফরুমের অফ পিরিয়ডের খানিক বিশ্রামের ক্লান্তিতে বা কোন খবরের উচ্চকিত সমালোচনার মেজাজে পুরুষদের সিগারেট ধরানো খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু এই স্বাভাবিক ব্যাপারটাই অস্বাভাবিক হয়ে যায় যদি কোনো মহিলার ঠোঁটে সিগারেটের টুকরো পুড়তে থাকে। সুতরাং বিড়ি / সিগারেট খেয়ে স্বাস্থ্য রসাতলে গেলেও পুরুষদের নিয়ে বিশেষত কেউ মাথা খুব একটা ঘামান না। অতএব সমাজের কাছে প্রশ্নটা কিন্তু বিষ খাওয়ার মতো ভয়ংকর স্বাস্থ্যজনিত সমস্যা একেবারেই নয়। বরং প্রশ্নটা লিঙ্গভেদের। যে কারণে উঠতি বয়সের একটা ছেলের ঘর থেকে যখন পোড়া তামাকের গন্ধ আসে, বড়রা হয়তো একটু চ্যাঁচামেচি করে ফেলে, যদিও নিতান্তই কপটতার ঢঙে! আড়ালে আবডালে গা টেপাটেপিও চলে। খানিকটা প্রশান্তি। যাক ছেলে বড় হয়ে গেল!কখনো বা গর্বিত বাবার চোরা হুঙ্কার- আরে এই বয়সে আমিও টেনেছিলাম গো লুকিয়ে.. ছেলে তো! বিড়ি সিগারেট না টানলে আর কিসের পৌরুষ! হুহ!!” কিন্তু তারুন্যের চৌকাঠে পা দেওয়া একটি মেয়ের ঘরে সিগারেটের প্যাকেট দেখলে কি হয় বলুন তো? সময় বদলেছে। সমাজের কথোপকথন কিন্তু বদলায়নি। পুরুষ যা যা করবে নারী তা করবে কেন? পুরুষমানুষের নেশা থাকতে পারে তাই বলে মেয়েমানুষের নেশা!! নৈব নৈব চ! আর তাছাড়া দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা ‘ছেলেমানুষ’ পুরুষদের খেলা করার পুরুষশাসিত সমাজের বুকে মেয়েরা আগুন জ্বালিয়ে ধোঁয়া ছাড়লে কার-ই বা সহ্য হয় বলুন তো! পুড়ে যাওয়ার ভয় তো সবাই পায়! আহা বলেন কি! পুরুষ মানুষই তো!দেবতা তো আর নয়! অমরত্বের প্রত্যাশা তো আর করতে পারে না। সমাজের অভিভাবকদের কাছে আমার অনুরোধ, উপদেশও মনে করতে পারেন, যদি সিগারেট না খাওয়ার পক্ষেই সওয়াল করতে হয়, তাহলে দু-তরফেই করুন। চোখ রাঙাতে হলে রাঙান ক্রমশ কালো হতে থাকা ফুসফুসের অকাল দহনকে! এবং মনে রাখবেন ফুসফুস নামক যন্ত্রটি নারী পুরুষ উভয়ের শরীরেই বর্তমান”।

Comments

Top

গল্প

মিঠি

মিঠি

হীরক সেনগুপ্ত

talking1.jpeg

              

 ১

তদূরে আছে এখন! হয়ত ব্রীজ পার হয়ে গেছে। ফোনের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এই বুঝি বেজে উঠবে। 'আর একটু খানি। এসে গেছি!' 

কর্ণকে  ফোনে কথা বলতে বলতে সেদিন হাঁপাচ্ছে মনে হল? ভেঙে ভেঙে কথা বলছে। 

যাঃ কর্ণ হাঁপাবে? হাসি পেল মিঠির। মিড-অফে বল ঠেলেই দৌড়ত খরগোশের মতো।    

ঘড়িতে দু'টো। এখানে তবু কিছু লোকজন। টিফিন করছে। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। ভাগ্যিস! কিছুদিন আগেই ঘুরে গেছে টাটা ক্যান্সার হাসপাতাল। নইলে এ জায়গা চিনতেও পারত না। অথচ কথা ছিল, সায়েন্স কলেজের সিঁড়ি। তখন এসব কোথায়? গ্রাম  সব ধানের জমি

আজ আসবে কর্ণ! পঁচিশ বছর পর।  

'চিনতে পারব?' সম্বল তো স্মৃতি। ক্রিকেটার কর্ণ। ছিপছিপে। স্ট্যালিয়ন। সবুজ গালিচার ওপর দিয়ে ভেসে যাচ্ছে, সাদা মেঘ! ঝাঁকড়া মানুষের চেহারায় কত আবহ-বিকার। নিজেকে দিয়েই তো বোঝে। কোমর ছাপিয়ে ছিল পাটের মতো স্ট্রেট চুল। বন্ধুরা শরীর নিয়ে ঠেস দিত ।' তুই ভাই বাইচ-নৌকো। নাভিটা দেখ, যেন জলশয্যায় শালুক পাতা! তুই আমাদের সঙ্গে হাঁটলে থাকলে, আমরা সব ফেকলু' 'তোর তো শাড়ি পড়তে আয়না লাগে না। কোমর ন বাবা, ঘোরানো সিঁড়ি। আমাদেরই চোখ টানে। ছেলেদের কথা বাদই দিলাম..!' কর্ণ বলত, 'কাজল পড় কেন? তোমার তো ভোরের চোখ। কাজলে আগুন টলমল করে। শিশির-বিন্দুই মানায় ভালো। টিপ নয়' টিপই  উঠল না কপালে। টিপের পাতা নিলেই, কথাটা ঝুপ করে নেবে আসত আয়নায় ভেতর!

আগুনেই খেয়ে নিল যাবতীয় নিশান। ভেতরে বাইরে ঝাঁঝড়া। সময়ের গভীর আঁচড়। 

মিঠির বারণ শোনেনি। কর্ণ এসেছিল। সি-অফে। এয়ারপোর্ট তখন উন্মুক্ত। টিকিট কেটে বসাও যায়। বেদনার কৃষ্ণমেঘ। প্রবল বৃষ্টি। যেন বল্লমের তীক্ষ্ণফলা। ফুঁড়ে দিচ্ছে সময়ের আশ্চর্য উজ্জ্বল গ্রন্থি। 'আমি থাকব। যাব  না' 'ফ্লাইট মিস্ হয়ে যাবে''হোক' মায়ের গলা। 'তোমরা এখানে? 

মাইকে কতবার ডাকছে' তারপর তো গ্রীন-চ্যানেল ...আড়ালে ঢেকে দিল কর্ণ'কে।

 ৭

বাবা, আমার তো কলেজের চাকরিটা ছিলই। ও নাই বা করত চাকরি। কর্ণ তো ভালো খেলে। স্টেট রিপ্রেজেন্ট করেছে। সেটা কি কোন যোগ্যতা নয়? তবুও বলেছিলাম। দেখো, ঠিক চাকরি পেয়ে যাবে। মা'ও তো  চেনে। তবু আমায় জোর করে বিদায় করলে। 

 ৮

কর্ণ'র স্পোর্টস-কোটায় চাকরিও হল। সেই জোরহাট কলেজেই। আবারও দেখা তো হল। ইস! একটুর জন্য। লন্ডভন্ড জীবন! যদি আমার কথাটা ভাবতে বাবা! 

 ৯

আর্য চৌধুরী বস্। আইটি কোম্পানির। এবং আমারও! আর্য'র জুতো পালিশ। কোট পরিষ্কার। বাথরুম সাফ। গাড়ি মোছা। তেল-মোবিল চেক। বাজার হাট। সব একার হাতে। 

কলেজের ক্লাসের ফাঁকে ছুটে আসি ফ্ল্যাটে। দিতির জন্য খাবার বানাই। আর্য'র সংসার তো, আমায়  ছাড়া অচল।

১০

কলেজের চাকরি ছাড়ার পর বুঝেছি। বিদেশে নিয়ে যাওয়াটা আসলে আর্যর ছক। সবাই জানলো মেয়ে ইংল্যান্ডে! কী চমৎকারই না বিয়ে। কত লোক জ্ঞান দিল, 'দরকার কি দু'পয়সার চাকরির?'

১১

বাবা, এ জীবন যার যার তার তার। মনের মতো গড়তে চাইলেও জীবন অনির্ণেয়। অনির্দেশ্য। 

১২

মেয়েদের জোর শিক্ষায়। স্বোপার্জিত অর্থে। এই জোর ছাড়া অসহায়। শ্বশুরবাড়িতে মেয়েরা আজীবন ছিন্নমূল। এটা হল টব। বিয়ের পর মেয়েরা যেখানে পোঁতা থেকে যায়। বাঁচলে ভালো। মরলেও ক্ষতি নেই। সবই অন্যের। যা জোটে, সবটাই কৃপা।

১৩   

স্ত্রী আক্ষরিক অর্থেই দশভুজা।  স্বমহিমায় প্রজ্বলিত। 

১৪

বিদেশেই বুঝলাম, স্ক্রিপ্ট লেখাই ছিল। আর্যর দরকার কাজের লোকের। হেঁজিপেঁজি নয়। শিক্ষিত। চটপটে । আদব কায়দা জানা। এমন।  অ্যাটেন্ড্যান্ট কাম রাঁধুনি। আর ভীতু ছেলেরা যা করে। রোগভোগ বাধবে না। অথচ যৌনকর্মঠ বাঁধা মেয়ে। যৌন ব্যতিচারের নীরব অভিমুখ।

১৫

তবুও বাঁচিয়ে রেখেছি নিজস্বতার গোপন কুঠুরি। যেখানে আমি আমার মতো। আমি ভালো। আমি মন্দ। আমার স্বপ্ন। ঐ স্বপ্নে আছে থামিয়ে রাখা দুঃসাহসের চূড়ান্ত উদ্দীপনা। কোটি কোটি ইচ্ছে মুকুল। দুর্বিনীত স্বেচ্ছাচার। অস্ফুট স্বপ্ন। সেখানে আমি নির্দ্বিধায় মুক্ত। শ্লীলতাহীন। নগ্ন। 

১৬

আজ আমরা রাস্তা অবরুদ্ধ করে দেব। আমাদের শ্বাসবন্ধ হাওয়ায় থাকবে দমকা চুম্বন। বিজ্ঞাপিত হব সর্বত্র। উজ্জ্বল আভায়। আমরা থাকব অনড়। জেদী। যুগলবন্দী।

১৭

দিতি সব জানে। আমার মেয়ে। তার চেয়েও বেশি, আমার একমাত্র বন্ধু। ওর কাছে উজাড় করেছি  নিজেকে। 

ছোট ছোট ভালোলাগা হারানোর দুঃখ। বয়ঃসন্ধির স্রোতস্বিনী রোমাঞ্চে নুড়ি অন্বেষণের মুহূর্ত। বন্ধুত্বের আড়ি ভাবের আনন্দ। সরস্বতী পুজোয় শাড়ি পড়বার উন্মুখ প্রতীক্ষা। নির্জন দীর্ঘদুপুরে  প্রথম প্রেমের চমকলাগা আনন্দের আতঙ্ক। গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে কিশোরী আমি। একটু দূরে কর্ণ। তাকাতেও আনন্দিত ভয়। আমার একটু সরে যাওয়া। ওর ছায়া পড়েছে আমার বাঁ পায়ের কড়ে আঙুলে। ঐ ছায়াটুকুরও কী আলোড়ন! উন্মাদনা। যেন ছায়ার চোরাবালিতে ডুবে যাব। মনে হয় মাটি খুঁড়ে আঁচলে বেঁধে নিই ঐ ছায়া টুকু! ইস।

১৮ 

জীবনের অবসন্নতা দিতি খুব কাছ থেকে দেখেছে। আর্যর বিরক্তি ছিল মেয়ে জন্মানোয়। তাই না বলতেই আমাকে আঁকড়ে ধরেছে।  হয়ত আমার মধ্যে নিজেকেই দেখে।

১৯       

কর্ণ আমরা প্রমিস করে ছিলাম,মনে আছে?

'দ্যাখো যদি বেঁচে থাকি। ফিরে আসবো এখানে। কলেজের সিঁড়িতে'।

‘কবে বল’।

‘পঁচিশ বছর পর’।

'প্রমিস কর'।

'প্রমিস। প্রমিস। প্রমিস'।

মিঠি হাসছে। কর্ণ হাতের ওপর হাত রাখছিল।

'প্রমিস'।

২০

আজ আমি ক্ষমা চাইব। ইচ্ছে করেই বন্ধ করে দিয়েছিলাম। আমাকে খোঁজার সমস্ত পথ। তোমাকে বলবন,কি হয়েছিল একদিন। তখন অক্সফোর্ডে। ক্যাসেটে গান শুনছি বিছানায় শুয়ে। আর্য এল, আমার শরীর চাই তক্ষুনি। হঠাৎ বুঝলাম একটা কর্কশ আটা মাখার বেলন । আমার যোনিতে অসুরশক্তিতে চাপ দিচ্ছে। বিছানায় কাতরাচ্ছি। আর্যর হিংস্র গলা। 'তোমার কি এত আঠা?' সংজ্ঞা হারানো আগে কোনক্রমে বললাম, 'কি?' 'এ ক্যাসেটকে পাঠিয়েছে, আমি জানি না ভেবেছো? তোমার মা কথায় কথায় আমাকে সব বলে ফেলেছে।এ ক্যাসেট কর্ণ পাঠিয়েছে' 'বেশ করেছে। এতে ওর গান আছে'।

'ও তাই বুঝি'।

হেসে ওঠে। ক্যাসেটটা ছুঁড়ে দিল ফায়ার প্লেসে। ব্যথার মধ্যেও হেসে উঠি। হায়রে এভাবে কি স্মৃতি মোছে? শুধু মনে আছে ঐ দিন আমার শেষ কথা ছিল, 'তোমার সংসারে তো কোথাও ঘাটতি রাখিনি'।

২১

দীর্ঘসময়, শুধুই তছনছ। কর্ণের সঙ্গে আমার কোন যোগাযোগই ছিল না। তবুও আর্যর সন্দেহ। আক্রোশে আর্য  বারবার আমাকে পীড়ন করেছে। হার মেনে আরও ভয়ানক হয়েছিল। চেপে ধরা শ্বাসে, রুদ্ধ ফুসফুসের অলিগলি নীল। কখনও সিগারেটের আগুন, মহোৎসবে মেতেছে আমার তালুতে। কত রক্তাক্ত দহনকাল।

২২

যা করেছি, বেশ করেছি। যা করব, বেশ করব। এ আমার জীবন। আমাদের ঘোষিত স্বাধীনতার উদযাপনের ক্ষণ, আসবে। নিশ্চয়ই আসবে।

২৩    

ডাক্তারবাবু বলেছিলেন। উইল পাওয়ারটাই আসল। বাঁচার ইচ্ছেটা জরুরি। আপনি হয়ত পারবেন। যন্ত্রণায় ছটফট করছি। কষ্ট হচ্ছে। তবুও দিতিকে জিজ্ঞেস করেছি,

'কিরে কিছু পেলি?'

'মা, কাকুর তো ট্রেসই নেই কোথাও'।

চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। কলেজে যে নম্বর দিয়েছিল, ডায়াল করলে শুধু রিং হয়ে যায়।

সোশ্যাল মিডিয়ার কিচ্ছু বাদ রাখিনি। ওকে বললাম, 'কর্ণ হাসত। বলত এ হল গোপন বিষাদের পাপড়ি মোড়া, অন্তরঙ্গ আশীর্বাদ । থাক এ এমন গোপনই থাক।

'কলেজেরও কেউ টের পায়নি'।

 ২৪     

অবশেষে  দিতিই খুঁজে পেল। ইস্টার্ন কোলফিল্ডের ক্যালেন্ডারের ছবিতে।

চিত্র: কর্ণ বসু', নাম দেখে। 

ভাগ্যিস ফটোগ্রাফিটাও ছাড়নি বিদেশ থেকে ফিরেছি কুড়ি বছর হল। দিতি পাগলের মতো খুঁজেছে।পাঁচ বছরের বেশি। ওরই আগ্রহ যেন বেশি ছিল।

২৫ 

কর্ণ, জানি তোমার অভিমান। ততদিনে ফেসবুক-মেসেঞ্জার ঝড় তুলেছে। নোটিফিকেশন এসেছিল। 'কর্ণ বাসু, ওয়েভড!'

আমি ইমিডিয়েটলি ব্লক করি। পাছে আর্য সন্ধান পায়। ও তো ভয়ানক নজরদারি চালাতো। ভাবতো সুন্দরী বউ, যদি হাতছাড়া হয়! '

'হায় রে! বিশ্বাস করতো, যন্ত্রণা হয়তো ভুলিয়ে দিতে পারে সমস্ত অতীত। তীব্র আকাঙ্ক্ষাকে।

২৬

অপেক্ষার প্রতিটি মুহূর্ত। সন্তর্পণে বাঁচিয়ে রেখেছি! দিতি ক্রমশ হতাশ হচ্ছে। আমিও ভাবছি । এত সাধ-আহ্লাদ, সব অর্থহীন,ছায়ার মত  মিলিয়ে যাবে? উল্কা যে এতদিন জ্বলেছে, ছাই হয়নি। এই অপেক্ষার জ্বালানিই তো বাঁচিয়ে রেখেছে!  

২৭

'কোলফিল্ডে'র থেকে পাওয়া ফোন নাম্বারে দিতিই রিং করে ছিল। রিং হয়ে হয়ে থেমে গেল । ওর কি টেনশন। যদি এটাও ভুল হয়? বেশ কয়েকবার এমন হল। দিতি মেসেজ  করল।

'হে য়্যাম দিতি। ইউ নো প্রজ্ঞা পারমিতা মুখার্জি? আই মিন উল্কা'   

মুহূর্তে পাল্টা ফোন ।

'ইয়েস, কর্ণ বাসু স্পিকিং' 

দিতি ফোনটা দিল। আমি চুপ।কি জবাব দেব? ভাষা, শব্দ হারিয়েছে। জ্বরে যেন বেহুঁশ। হার্টবিট ভয়ানক বেড়ে গেছে। দিতি ঠেলছে।

'মা, ওপাশে ফোনটা ধরে আছে তো, উত্তর দাও'।

গলা কাঁপছে!

'কর্ণ?'

ইয়েস, ইউ?

'উল্কা?

'ইউ আ’নট জোকি়ং?'

'নো। য়্যাম নট'

'ইউ…... উল্কা'

ফোনের ভিতরে চিৎকার করছে যেন!

'প্লিজ রিপিট'।

'উল্কা ইয়ার।কেমন আছো? একবার আসবে! এক নিঃশ্বাসে অনেক কথা বললাম।

২৮     

ছেঁড়া  তমসুক, জুড়ে যায়। রঙিন অতীত-ঘুড়ি উড়ছে। বর্তমানের আকাশে।

'কখন আসব?'

'তুমি বল'।

'নজরুল তীর্থ। চেন?

আগে হলে বলতাম কোথায়? এখন বললাম,

'আচ্ছা!'

'ঠিক তো'।

'কখন আসবে?'

'দেড়টা'

'তুমি?'

'আমিও'।

গলা ফ্যাঁস ফ্যাঁসে। ভাঙা। সিগারেট খায়? ঘরঘর শ্বাস টানার শব্দ। সুস্থ আছে তো?

২৯  

শেষ পর্যন্ত  কথা হলো! উফ: কাঁটা দিচ্ছে। পঁচিশ বছরের বেশি! দিতি ছিল চার বছরের।এখন  তিরিশের বুড়ি ছোঁয়া লেডি!

৩০

গা গোলাচ্ছে। ওষুধটার এই সমস্যা। মুখের ঘা'টাও জ্বালাচ্ছে। ব্যাগ ঘাঁটলো। নেই। দিতি অনেকবারই বলেছিল।

'ওষুধটা খেয়েই যাও'।

মনেও ছিল। শেষ মুহূর্তে ভুলে গেল। শরীরটাও ম্যাজ ম্যাজ করছে।

৩১  

কর্ণ'র আজ দেরি হচ্ছে? ওতো পৌঁছে যেত আগেভাগেই। 

আর্য তখন ইংল্যান্ডে। মিঠি কোলকাতায় মায়ের কাছে। তখনও বিদেশে যায় নি। ভিসা আসেনি।

স্কাইব্যাগ কিনতে বেরিয়ে ছিল। কর্ণ'র সঙ্গে রাস্তায় ‌দেখা। 

'একবার আসবে বাড়িতে ?'

কর্ণ হেজিটেট করছিল। মা বলল’

'কি এত ভাবছো,চলে এসো।আমারও ভালো লাগবে।

'আচ্ছা'

'এসো কিন্তু। মুসুড়ি ডালের বড়া আর চা খাওয়া যাবে'

মা'র কি অনুশোচনা ছিল? কর্ণকে আপন করতে না পারায়? টের পেয়ে ছিল! নিষ্পেষণের ঘ্রাণ?

৩২

কর্ণ এসেছিল। বেশ তাড়াতাড়িই আমি বললাম; 'আমার ভয় করছে'

'কিসের ভয়?'

মিঠির চোখে দীপাবলি। কর্ণ'র কাঁধে হাত। 'সামনের মাসে এমন সময়, আমি কত দূরে।ভেবেছ?'

'না। ভাবিনি। কষ্ট হয়' কর্ণ'র কোমর জড়িয়ে ধরেছিল মিঠি।  

'অ্যাই, এমন করছো! মুখটা দেখি। এমন করলে যাবো কী করে? '

'না গেলেই নয়?' 

মিঠির গরম শ্বাস আর নোনতা জল নেমেছিল। কর্ণ'র আশ্রয়ে। 

সংরক্ষিত দ্রা়ক্ষাক্ষেতে, অনাবৃত মেঘমল্লার। হৃদয়ে অবিরত হংসধ্বনি। বিস্তীর্ণ মিঠির শঙ্খ।সিক্ত, নন্দিত। সমাজ সংসার, খড়কুটো। মিঠি বলল,

'এই অধিবাস তোমার, কর্ণ '           

৩৩

হর্ণের তীক্ষ্ণ আওয়াজ। মিঠি চমকে ওঠে। রিয়ারভিউ আয়নায় দেখল। এক মহিলা । ড্রাইভিং শিখছে। রুমাল ভিজল কখন! নাকবন্ধ। আজকাল নাকবন্ধ হলে শ্বাসকষ্ট হয়। ইনহেলারের কথাও মনে ছিলনা। কত ওষুধ খাবো? 

৩৪

হাসপাতালে শুয়ে একটাই প্রার্থনা করেছি। কিছুদিন একটু বাঁচিয়ে রাখ ভগবান। কাঁকড়ার কামড়ে ছিন্নভিন্ন করে দিওনা। ডিভোর্সের পর আনন্দেই ছিলাম আমরা। আজ দিতি নেই। শরীর খারাপে ভয়ই করছে। 

৩৫

'কাকুকে চিনতে পারবে? ' 'ছয়'পাঁচ। নজর যাবেই। গাড়ির নম্বরও বলেছি'

৩৬    

মিঠি বাইরে দেখে। মেঘ করেছে। শীতের স্নিগ্ধতা। তিন চারটে বাচ্চার স্কেটিং। একজন এজেড, প্যারাম্বুলেটর ঠেলছে। দূরে, হুইলচেয়ারে‌ একজন, মলের রেলিঙে ব্যাগ ঝোলাচ্ছে। একটা লোক ঘুরেঘুরে মোবাইল চার্জার,ব্যাক-কভার বিক্রি করছে। সিগারেটের স্টল। ফুচকাওলার গাড়ি ঘিরে পাঁচ-ছটা, মেয়ে। 

নজরুল-তীর্থ ঘিরে ঝলমলে পতাকা। একটার মাথায় শালিক। ফুটপাতে, দোকানে, লোকজন। আগের মত ফাঁকা নেই আর।

৩৭

কর্ণ যদি বলে, 'মিঠি ,আজ আমার কাছে থাকবে?' ভাবনাটা ঘুরপাক খায়। কাঁচা হলুদের গন্ধ। শিরশির করে শরীর। জ্বালাযন্ত্রণা নিমেষে উধাও। কই, কোথায়? কোন লম্বা মাথার লোক তো দেখতে পাচ্ছে না কোথাও। মজা করে লুকিয়ে নেই তো? সেই স্কেটিয়ের বাচ্চাগুলো এখন গাড়ির কাছে। ডিকিতে টকটক করে গেল। মিঠি রিংব্যাক করবে?

'নাহ থাক। গাড়ি চালাচ্ছে 'ফোন ফোনটা কেটে দিল কেউ।  কর্ণ আসেনি? কোথায় ও?'

 ৩৮

আবার গাড়িতে টোকা। কেউ নেই। উফ:, কাঁচ নাবিয়ে দরজাটা আলতো খুলেছে। বাচ্চা দু'টো খুব কাছে। এবার বকবে। হুইলচেয়ারে ব্যাগ ঝুলিয়ে হকারটাও এসেছে। মিঠি ঘাড় নেড়ে বোঝাল, দরকার নেই। দূরে তাকিয়ে থাকে। ‌‌ঝলমলে জীবনে ঢেউ। লুকোচুরি খেলে যাচ্ছে। 

৩৯

 কর্ণ, কর্ণ কোথায় ? অস্থির মিঠি। আজ কি আর আসবে না কর্ণ? চারটে বাজতে চলল।

Comments

Top

গল্প

কালঘূর্ণি

মানস দাস

riksha2.jpg
কালঘূর্ণি

- কিছু বলল? 
- না স্যার। এখনও পর্যন্ত কিছুই না। 
- কখন তুলেছ? 
- আজ সকালেই স্যার। 
- বয়স কত? 
- বাচ্চা ছেলে একদম। 
- আহ্হ্....বাচ্চা মানে কত বাচ্চা?  
- খুবই কম বয়স স্যার। 
- কিছুই কি বলছে না। 
- আজ্ঞে হ্যাঁ। বলছে না কিছুই।     
- নাম কী ছোকরার? 
- ইয়ে,  মানে জানি না স্যার। 
- জানি না মানে...  নামটাও বলেনি নাকি!  
- আজ্ঞে না স্যার। 
- সেরেছো! নামটুকুও বলাতে পারোনি মুখ দিয়ে। তুমি ত দেখছি আমাদেরও নামটাম আর কিচ্ছু রাখবে না হে শেষে তিনকড়ি - বলতে বলতে নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন থানার বড়বাবু। হেড কনস্টেবল তিনকড়ি সামন্ত মাথা চুলকাচ্ছিল বড়বাবুর কথা শুনে।   
- চল তবে। দেখে আসি একবার তোমার বাছাধনটিকে... 
বলে গটগটিয়ে নিজের ঘর ছেড়ে পাশের একটা ছোট ঘরে প্রবেশ করলেন তিনি। পেছন পেছন তিনকড়ি। এ ঘরে আলো ঢোকে কম। আঁধারময় কালো ঘর। ঝুল কালি মাখা।দেওয়ালে কস্মিনকালের পাতা ছেঁড়া এক ক্যালেন্ডার।ঘরে একটা মাত্র ছোট বেঞ্চ আর একখানি কাঠের চেয়ার। ছেলেটিকে বেঞ্চে বসানো হয়েছিল। ছেলে মানে ছেলেই। একেবারে কচি আর কি! বয়স মেরে কেটে পনের কি পনেরোর কিছু বেশি হবে হয়তো। পাতলা গড়ন। মুখে সবে গোঁফের রেখার প্রকাশ ঘটছে। একমাথা চুল।উস্কো খুস্কো। দেখেই বোঝা যায় এ ছেলে চুলে কাঁচি ছোঁয়ায় না সহজে। গায়ে নীল চেক টি শার্ট আর সাদা রং য়ের ট্র্যাকস্যুট। আজ সকালে সোজা ঘর থেকে তুলে আনা হয়েছে থানায়। মানসিক প্রস্তুতির হয়তো সুযোগই মেলে নি বেচারির।  
ঘরে ঢুকে চেয়ারটি টেনে নিলেন বড়বাবু। একেবারে মুখোমুখি গিয়ে বসলেন ছেলেটির। আপাদমস্তক একবার পর্যবেক্ষণ করলেন। মনে মনে বিশ্বাস আনতে চাইছিলেন যে, কাজটা ওই বাছাধনেরই। কিন্তু বাছাধন যেন কীরকম অস্বাভাবিক শান্ত। চুপটি করে বসে আছে বেঞ্চে।দুচোখের স্থির নজর তার মাটির দিকে। মুখ যেন পাথরের মতো বোবা। এখনো সে ঠিকমত ধাতস্থ হতে পারছে না পুরোটায়। অবিশ্বাসী একটা মন যেন তার শ্বাস প্রশ্বাসকে রুদ্ধ করে দিতে চাইছে ক্রমে ক্রমে। তাই এক প্রস্তর মূর্তি যেন সকাল সকাল থানায় বসে নিরুত্তর সবেতেই।    
দাসপুরের নগেন চোর ফেরার এখন। নগেন মন্ডলের চামচেটা ধরা পড়ে একলহমায় কেঁচিয়ে দিয়েছে তার জীবনটা। সাদামাটা স্কুলের জীবন, মালার ভালোবাসা সব গেল তার।স্কুলের সহপাঠী মালাটাকে সে খুব ভালোবাসত। আড়নজরে সবাই ওকে হিংসুটে বলে। অবশ্য তাতে তার আপত্তি বিশেষ এসে যায়নি। মাংস মিষ্টি দুটোই যে ছিল ওর। আর তাছাড়া তার মত উড়োবাজ ছেলের এর চাইতে বেশী আশা করা ঠিকও নয়। হ্যাঁ.. মেয়েটা তবে অসম্ভব হিংসুটে। নিজের চেয়ে অন্য কারো ভালো কিছু সে দেখতে পারে না। ওই কারণেই তো  স্কুলে রুম্পাকে সে সহ্য করতে পারত না। ওদের ক্লাসের টপার রুম্পা। শুধু ক্লাস নয়, গোটা স্কুলেই ওর জুড়ি ছিল না কেউ। রুম্পা ছিলই তো অফুরান এক মেয়ে। পড়াশোনার মাথাটা ছিল যেমন ক্ষিপ্র, তেমনি অসম্ভব সুন্দরী। গায়ের রংটা ঠিক ফর্সা নয়, গোলাপি সাদা বলতে যা বোঝায় ঠিক তাই। মেমদের মত। আবার গাইতও বেশ। সরস্বতী  লক্ষ্মী সব যেন ওতেই উপচে পড়েছিল। এমন মেয়ে তো ওদের স্কুলে সবারই প্রায় প্রথম দেখায় প্রেমে পড়ার মত বিষয়। মালা, শতরূপা, প্রিয়া সবাই এরা কেমন ফিঁকে ফিঁকে যেন ওর কাছে। প্রপোজের সিংহভাগটাই যেত রুম্পার কাছে। আস্তে আস্তে দেমাক তৈরী হচ্ছিল মেয়েটার। ওদের মতো ছেলেগুলোকে দেখে বলত, কাজ কর্ম নেই।পড়াশোনা নেই। খালি ভালোবাসা! মেরুদণ্ডহীন সব কোথাকার! 
পি কে হার্ড ওয়ারের প্রশান্ত পালের ছেলে জয়ন্ত ওকে প্রেম নিবেদন করেছিল একবার, একতাড়া লাল গোলাপ আর দামী একটা নেকলেস দিয়ে।বড়লোকের ছেলে। এই বয়সেই দু তিনবার বাইক চেঞ্জ করা হয়ে গেল তার।
- লোফার কোথাকার!  

- রুম্পা বলেছিল।
মালার ভেতরে ভেতরে কেমন জ্বলুনি হোত। ওদের সব ব্যাপারে রুম্পার কেমন নাক সিটকানো! সহ্য হত না ওর। 
মালা একদিন ওকে বলল, আমার আর কি বল! আমি  তো আর মহারানী রুম্পাদেবী নই যে, সবাই আমায় চেয়ে চেয়ে দেখবে। গোলাপ দেবে। গিফট্ র প্যাকেট দেখাবে! 
সেদিনই সুযোগ বুঝে জাল ফেলল ও। মালাকে মনের কথা বলল।মালা রাজীও হল সঙ্গে সঙ্গে। তারপর থেকে তার সাথে মালার সম্পর্কটা ভালোবাসার।    
একবার সরোজ স্যারের বাড়ীতে পড়তে গিয়ে এক কান্ড! টিউশন শেষে ফেরার পথে রুম্পাকে একা পেয়ে প্রপোজ করে বসে নিলয়টা। সেবার ঠাঁটিয়ে এক চড় কষিয়েছিল রুম্পা। বহুদিন পা রাখেনি নিলয় স্কুলে। মালার সাথে বহুদিনের বন্ধুত্ব নিলয়ের। কাজেই এরপর রুম্পার সাথে মালার সম্পর্কও খারাপের দিকে এগোয়। তবু মালাটা বলে যেত, মেয়েটার এক অংশও পেলে দেখাতাম ঘ্যাম শুধু ওই খায় না, আমিও পারি দেখাতে। 
আশ্চর্য হয়ে ও বলেছিল, তোর তা খাবার দরকারই বা কি। তুই তো আর সিঙ্গেল নোস। 
- প্রেম ছাড়াও অনেক কিছু কখনো কখনো দরকার হয় মেয়েদের, তুই কি বুঝবি তা!   

মালা  তির্যকভাবে উত্তর দেয়।
মালার এসব কথা শুনে ও বলেছিল - খামোখা যা নেই তা নিয়ে মাথাব্যাথা করে কী লাভ বল্। 
- তার মানে আমার কিছু নেই তাইতো...  
- আমি কি তাই বললাম নাকি! 
- বলিসনি, কিন্তু বোঝা যায়। 
- কি বোঝা যায়!  কিচ্ছু বোঝা যায় না - মালার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে। 
মালা উদাস হয়ে থাকে। 
ও বলে চলে, - রুম্পা ঠিকই তো বলে, পড়াশোনা না করলে তাকে তো সবাই লোফারই বলবে। কে পাত্তা দেবে বল্! 
- আর তুই নিজে কী... , মালা নীরবতা ভাঙ্গে।
- কিছু না ঠিকই।তবে ওদের মতো নয় নিশ্চয়।
মালা ফের চুপ করে থাকে। 
- এই মালা... মালা শোন না, বলি ওদের সাথে আমাদের না জড়িয়ে থাকলে কি চলে না। কেউ না হোক, আমি তো আছি তোর জন্য। সত্যি নয়  কি! 
মালা উত্তর দেয় না। চুপ করে চেয়ে থাকে অন্য পানে। ভারী অদ্ভুত লাগে মেয়েটাকে। কত যে ওর চাওয়া, কে জানে! 
- কি রে...  কিছু বলবি না। নেই আমি!   
- আছিস তো! একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ওর দিকে চেয়ে  বলে মালা। 
 

সে উত্তরে কোনো গভীরতা খুঁজে পায় না ও।    

- কী ভাবছিস এত সকাল থেকে? নিচু গলায় প্রশ্নটা ছাড়েন  বড়বাবু। 
তাতে ছেলেটির ভাবনার ঘোর কেটে যায়। কিন্তু কোনো উত্তর দেয় না।     
- তা হঠাৎ এসব বুদ্ধি দিল কে তোকে? বড়বাবু ফের জিজ্ঞাসা করেন।
বাছাধন নিরুত্তর থাকে আবার আগের মত। 
- দেখেছেন স্যার, কেমন হতচ্ছাড়া ছেলে!  মুখে টুঁ শব্দটিও করছে না। চুপ করে কিস্যু লাভ নেই বাছা। যা জানো বলে ফেল মানে মানে। অন্য রাস্তাও জানা আছে আমাদের, তিনকড়ি হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে পড়ে। 
বড়বাবু ইশারায় ওকে চুপ করতে বলেন। ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করেন,

- কী নাম যেন মেয়েটার... তোদের স্কুলে...পড়াশোনায় বেশ ভালো... ওর কী অবস্থাটা এখন, খবর আছে ! 
চোখ তুলে অসহায় দৃষ্টিতে বড়বাবুর দিকে তাকায় ছেলেটি। প্রায় বুজে আসা গলায় প্রথমবার মুখ খোলে, - একটু জল পাব স্যার? 
তিনকড়ি এক গ্লাস জল এনে দেয়। কাঁপা কাঁপা হাতে একটু খায়। 
দুহাত মুড়ে তাতে চিবুকখানি ভর দিয়ে একটু ঝুঁকে গম্ভীরকন্ঠে তারপর জিজ্ঞাসা করেন বড়বাবু,  - তোর নামটা কী বলত আগে?  
- লাল্টু, জবাব দেয় ছেলেটি। 

                                      *********

লাল্টু দাঁড়িয়েছিল এঁদো গলিটার ঠিক শেষ প্রান্তে। এই সুযোগটাই সে খুঁজছিল কদিন থেকে। মনোজ স্যারের বাড়ীর সামনে যে গলিটা তেমাথা পর্যন্ত চলে গিয়েছে, সেটা একেবারে জনহীন থাকে সন্ধ্যে বেলা থেকে। মাঝে ভোম্বলদের বাড়ীর কাছে  যে ল্যাম্পপোষ্টটা সেটা ছাড়া আর একটাও আলো পড়ে না কোথাও। বাবলুদার চপের দোকানটা আছে অবশ্য। তবে সেটা তেমাথা লাগোয়া প্রায়। গলিতে এই ভর সন্ধ্যেয় দু একটা কুকুর ডাকে বটে। তবে এসব খবর  জানে না তারা।
কাজটা ঠিক গলির প্রথম দুটো বাঁকের মধ্যেই সেরে ফেলতে হবে ওকে। কারণ, এর মাঝে গলির ডানদিক ঘেঁষে যে সরু প্যাসেজটা কলতলার পাশ দিয়ে মেঠো পথে চলে গেছে, সেদিকেই পালাতে হবে কাজ শেষে। একটু দূরে মায়ের মন্দিরে রাত নটার ঘন্টাধ্বনি পড়ছে এখন। আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা মাত্র। 
ঠিক সোয়া নটা বাজতেই সে চুপিসাড়ে এগিয়ে যায় কলতলার দিকে। এই সময়ই রুম্পা বেরিয়ে আসে মনোজ স্যারের বাড়ী থেকে। এমনিতে মনোজ স্যার টিউশন ফিউশন দেন না কাউকে। রুম্পা ক্লাসের টপার।তাই অনুরোধের ঠেলায় পড়ে ওকে একটু আধটু দেখিয়ে টেখিয়ে দেন আর কি! আর এটাই এখন লাল্টুর কাছে এনে দিয়েছে এক মওকা। প্রায় অন্ধকারাচ্ছন্ন গলিতে চোখ-কান খাড়া করে অপেক্ষা করতে থাকে সুনির্দিষ্ট মুহূর্তটার জন্য। ওই তো বেরিয়েছে এবার। ছাতা নিয়ে হেঁটে হেঁটে আসছে রুম্পা। গলি বরাবর এদিকেই।বৃষ্টিটা শুরু হয়েছে খানিক আগে। এখন বেশ জোরেই চলছে তার পতনকর্ম। রুম্পার পাশে পাশে রুম্পার মা। আরও একটা ছাতায়। ঠিক কলতলার কাছে আসতেই মুখের গামছাটা শক্ত করে জড়িয়ে নেয় লাল্টু। চোখদুটো শিকারী ঈগলের ন্যায় সজাগ। হাতের মুঠোয় জিনিসটা আরো একবার দেখে নিয়ে ভালো করে বাগিয়ে ধরে। রুম্পা গলির ডানদিক ঘেঁষেই এগিয়ে আসছে। নিঃশব্দে কলতলাটা ওরা পেরোতেই পেছন থেকে লাল্টু একধাক্কায় রুম্পার মাকে ঠেলে ফেলে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওর হাতের জিনিসটা রুম্পার গায়ে মুখে ঢেলে দেয় অবিশ্বাস্য ক্ষীপ্রতায়।

- অ্যাসিডটা তুই পেলি কোত্থেকে বড়বাবু জিজ্ঞেস করেন।  
- নগেন মন্ডলের কাছে , ধীরে ধীরে জবাব দেয় লাল্টু। 
- নগেনকে তুই চিনিস? 
নগেন মন্ডল ওদের বছর দুয়েকের সিনিয়র এবং বছর দুয়েক আগেই ওটা স্কুল ছেড়ে দিয়ে চোর চামারির কাজে ঢুকে পড়ে। মালার পেছনেও বেশ কিছুদিন পড়ে ছিল। খুব ভালো করেই চেনে লাল্টু ওকে। পাকা শয়তান একটা। কিন্তু ওর সন্ধানটা দিল কে পুলিশকে? 
আচমকা প্রশ্নটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল তার।
বড়বাবু বললেন, এভাবে ধরা পড়ে যাবি ভাবিসনি তাইতো... 
সম্বিত ফেরে লাল্টুর। সত্যিই তো এভাবে সে ধরা পড়বে ভাবেনি কখনো। কিন্তু কে তাকে ধরিয়ে দিল সেটাও তার জানা প্রয়োজন। কে তার এমন সর্বনাশ ডেকে আনল?  তার শত্রু কোনো...  কে থাকতে পারে.. কাউকেই তো সেভাবে...  
- ভাবছিস।ভেবে আর কী করবি?  এই বয়সে এমন কর্ম ভালোবাসার পাল্লায় পড়ে হওয়া ছাড়া আর কী.. 
লাল্টু চমকে ওঠে। তাহলে কি... তার কথাতেই তো এ কুকর্ম। 
শিরদাঁড়া বেয়ে তার হিমস্রোত বয়ে যায় একটা। নির্মম সত্যিটা কি সে উপলব্ধি করতে পারছে! হয়ত পারছে। আর কেউ না হলেও সে পারছে এবার।                           
হাউহাউ করে কেঁদে ওঠে লাল্টু বড়বাবুর সামনে। কঠোর বাস্তবটা তার কালো অন্ধকারে তলিয়ে যেতে থাকে ক্রমশ। বড় ভুল করে ফেলেছে জীবনে সে। বড় ভুল!  

                             

*********

- শেষমেশ সব জ্বালা চুকল তাহলে বল্।
- বাব্বাহ্। কাঁটাগুলো এতক্ষণে সব গেল মনে হচ্ছে।
- লাল্টুটা খুব সরল ছিল... 
- সরল মনই অসাধ্য সাধন করে জেনে রাখ তবে।
- তা যাহ্ বলেছিস। 
- রুম্পাটার যা ঘ্যাম হয়েছিল... দেখ এবার কেমন লাগে... 
- আর আমার প্রপোজটা...
- কাকে?  রুম্পাকে!  
- ওটা ইনফ্যাচুয়েশন। তার শাস্তিও সে ভোগ করছে। আমি বলছি তোর কথা। 
- হ্যাঁ....  ভেবে দেখলাম। তুই বেটার অপশন।
- সত্যি বলছিস্।
- সত্যি বলছি।    
- তিন সত্যি করে বল.. 
- তার আর কি দরকার। আমি তোর কাছেই রয়েছি নিলয়....।
ঘন অন্ধকার ঘেরা স্যাঁতস্যাঁতে গলিটায় এই মূহুর্তে আর কেউ নেই। শুধু দুটো শরীর, দুটো অপরিণত প্রাণ মিশে যাচ্ছিল একে অপরে অকপটে।        
আরো একটা অস্পষ্ট ছায়ামূর্তি আড়ি পেতে কিছুটা তফাতে এখন। ওদের গোপন কার্যালাপ শুনে চলেছে একেবারে নিঃসাড়ে। নিলয় বেরিয়ে যায় একটুপর।মেয়েটি একা একা হেঁটে চলে। তার পেছু নেয় ওই ছায়া এবার। মৃদুস্বরে বিড়বিড় করতে থাকে, পেছন লাগা!ভেবেছিলি শেষ করে দিবি। কিচ্ছু হবে না তোর...দেখাচ্ছি মজা....গলির আঁধার শেষ হবার আগেই ঝাঁপিয়ে পড়ে মেয়েটির ওপর। 
- আর কটাকে চাই তোর! তোর পাল্লায় পড়ে কতজনের যে সর্বনাশ হল...  হতচ্ছাড়ি দ্যাখ এবার... , বলতে বলতে হাতের অ্যাসিডের গোটা বোতলটা ঢেলে দেয় হসহস করে মেয়েটার সর্বাঙ্গে।  
গলির ক্ষীণ আঁধারের শেষটুকুতে এসে শরীরটা তার বীভৎসভাবে জ্বলে পুড়ে যেতে যেতে মালা অস্পষ্ট  চিনতে পারে ছায়া মূর্তি নগেনকে...। 

Comments

Top

গল্প

মনের নাগাল পাইলাম না

মনের নাগাল পাইলাম না

অভিজিৎ চক্রবর্তী

youngman.JPG

বাগেশ্বর প্রাইভেট ডাকঘর

প্রিয়তমা হরসুন্দরী,
যে সব কথা তোমায় সোশ্যাল মিডিয়ার বুকে কহিতে পারি না, সেসব কথা লইয়া তোমারেই পত্র লিখিতে বসি। জানি, এ পত্র তুমি পাইবে বহু পরে; যখন এই তালাবন্ধ অচলাবস্থা (lockdown), করোনার গ্রাস হইতে মুক্তি পাইয়া আমরা পরস্পর সাক্ষাৎ করিব, তবে। তখন তোমায় হাতে গরম পত্র দিব, তুমি পড়িবে। কিন্তু আজ আমি লিখিতে না বসিলে লেখা সম্পন্ন হইবে না। তাই লিখিয়াই ফেলি। 

তুমি কহিয়া থাকো আমি নাকি তোমার "ডাক্তার"! তোমার এই কথায় বরাবর আমার সঙ্কোচ লাগে, কারণ ডাক্তারি আমি পড়ি নাই। তুমি কহিয়া থাকো: আমি নাকি তোমার মন বুঝিতে পারি! আজকাল এই দাবি টুকু ও করিতে পারি না। 

 আজকাল তোমার মনের অবস্থা বুঝিতে পারি না। না:, কারো মনই পূর্ণভাবে বুঝা যায় না। মন হইল বিমূর্ত বিষয়। এই বিমূর্ত বিষয়টির আভাস টাইপ (type) করিয়া বুঝানো সম্ভব নহে জানি। কমা (comma), ডট ডট (dotdot) ইত্যাদি দিয়া ইহাকে ব্যক্ত করিতে পারা যায় না। তবুও চেষ্টা করিয়া থাকি যেন কথার প্রকাশভঙ্গী (tonning and throwing) বুঝিয়া মনের ভাব ধরিতে পারি। তুমি অদ্ভুতভাবে চুপচাপ হইয়া গেছো। কথা কহ নির্লিপ্ত ভাবে, অথচ তোমার মনের মধ্যেকার উচাটন আমি ধরিতে পারি। বুঝিতে পারি এই নিদারুণ বিরহ যন্ত্রণায় কাতর হইতেছ। এই অচলাবস্থা না কাটিলে কিছুই করিবার নাই ---- ইহা জানিয়া আরো মানসিক উতলা হইয়া পড়। সবই বুঝিতে পারি, খানিক হইলেও পারি। হয়ত নিশ্চুপ হইয়া থাকা অপেক্ষা কিছু কওয়া অনেক বেশী সমীচীন। সেকারণেই তুমি কহিয়া যাও, আমি চুপ রহি। প্রতিমুহূর্তে ভবি: হয়ত আমিই ভুল, তুমি সঠিক। কারণ তুমি এতই চাপা নিজে কষ্ট পাইলেও মুখ ফুটে কহিবে না। বরাবর আমাকর্তৃক "তোমার কী হইয়াছে?" প্রশ্নের "কিছু হয় নাই" উত্তর পাইয়া নিজের অহং আঘাত পাইয়া থাকে সত্য , তবে মনে ভাবি সত্যই

"কিছু না হইলে" আমা অপেক্ষা অধিক সুখী কেহ হইবে না। কিন্তু পরে সত্য প্রকাশিত হয়। তুমি স্বীকার করিয়া লও যে সত্যই তোমার মনোকষ্ট চলিতেছে, উচাটন চলিতেছে। তখন অভিমান করিতে ইচ্ছা হয়। কেন তুমি পূর্বে ইহা কহিতে পারো না। মাঝে মাঝে গলা বুজিয়া আসে। সামলাইয়া লই, কারণ: পুরুষের কান্না সাজে না। পুরুষের কাঁদিলে চলিবে কেন? বুক ফাটিয়া গেলেও চোয়াল শক্ত ও মাথা সটান করিয়া তাহাকে থাকিতে হইবে। সংসারের শিক্ষাই ইহা।

আমি জানি তুমি শুনিবে না। তবু কহিব: যদি আমার "কী হইয়াছে?" প্রশ্নের উত্তরে "কিছু হয় নাই" এর পরিবর্তে "প্রকৃত সত্য" বলিতে পারো, তবে কহিয়া দেখিও। তবে জোর নাই। কারণ আমি আর যাহা কিছু করিয়া থাকি না কেন, মন বুঝিতে পারি না। তাই দাবী বা জোর খাটাইবার বিশেষ শক্তি পাই না। কারণ আমি জানি, বুঝি সব ই। জানি, আমি উদ্বিগ্ন হইয়া পড়িতে পারি দেখিয়া তুমি আরো চাপিয়া যাও। জানি তুমি আমায় কতখানি ভালোবাসো। কিন্তু সত্য কহি, সেই উদ্বিগ্নতা অনেক বেশী ভয়াবহ যেথায় আমি বুঝিতে পারি তোমার মন ভালো নাই; অথচ তুমি স্বাভাবিক থাকিবার ভান করিয়া আমায় চিন্তামুক্ত রাখিতেছ। মনে ভাবি: কেন এত বার করিয়া বলিবা সত্ত্বেও তুমি তোমার মনের অসোয়াস্তিটুকুর ভাগ দিতে পারো না আমায় ? জানি, কিছুই দিবার সামর্থ্য নাই আমার, দিতেও পারি নাই এক কণা। তুমি যে কথা দিয়েছিলে দুঃখের ভাগ দিবে মোরে। কিন্তু দিতে পারো কই? নিজের মনে দুঃখ চাপিয়া থাকো, আমায় ' পর ' করিয়া দাও। ইহাই দেখিতেছি। 

মাঝে মাঝে ভাঙিয়া পড়ি। ঈশ্বরকে ডাকি যেন তিনি শক্তি দেন, যাতে সর্বতোভাবে ভাঙিয়া পড়িলেও তোমায় খোঁচাইবার (poke) শক্তিটুকু থাকে। ইহাই প্রার্থনা।

ভালো থাকিও, সুস্থ থাকিও। নিজের শরীর ও মনের যত্ন লইয়ো --- ইহার অধিক আর কিছুই চাহি না ঈশ্বরের নিকটে।
ভালোবাসা,

শুধু তোমারই, হরিদাস ।

Comments

Top

গল্প

টুনটুনি

অপরাজিতা চিত্রলেখা ঘোষ

women.jpg
টুনটুনি

বেশ ভোরে ঘুম ভাঙল অয়নিকার। সুশোভনের গায়ে চাদরটা টেনেটুনে দিয়ে সে দক্ষিণের জানলার সামনে এসে দেখলো ধূসর ক্যানভাসের মত আকাশ। চোখের পলক ফেলার আগেই বৃষ্টি নেমে এলো ঝমঝমিয়ে। সঙ্গে সঙ্গে অয়নিকার মাথায় হুড়মুড়িয়ে এলো চিন্তা; “এই বৃষ্টিতে টুনির মা আসবে তো!!” ভাবতে ভাবতেই ডোরবেলের আওয়াজ। অয়নিকা এগিয়ে গিয়ে আইহোলে চোখ রাখতেই হুস করে তার বুকের বোঝা নেমে গেল। দরজা খুলে হাসলো অয়নিকা, “ভাবলাম এই বৃষ্টিতে তোরা বুঝি এলিই না”। টুনির মা নয়, টুনি এসেছে। ভেতরে ঢুকে ভেজা ছাতাটা দরজার পাশে রাখতে রাখতে বললো টুনি, “ভালোই বৃষ্টি হচ্ছে গো মামী, রাস্তায় এই এতখানি জল জমে গেছে”। 
“তোর মা এলোনা আজ?”
টুনি মাথা নাড়ল, “নাগো মামী, কাল সন্দে থেকে ছোট ভাইটার গায়ে জ্বর। মা কদিন আসবে না। আমায় একলাকেই এই কটাদিন সব বাড়ি কাজ সামলাতে হবে”। 

টুনির মা অনেকদিন ধরেই কাজ করছে এ বাড়িতে। প্রায় বছর ছয়েক। টুনটুনির বয়স তখন এগারো কি বারো। সাত-আট বছরের বোন আর কোলের ভাইটাকে নিয়ে টুনি রোজ আসতো মায়ের জলখাবার নিতে। ভাই-বোনকে একটা জায়গায় বসিয়ে মায়ের হাতে হাতে কাজ করে দিত। টুনির বাপ্ টা একটু কুড়ে গোছের। গায়ে গতরে খাটতে চায় না। বৌ- মেয়ে মূলত ঝি এর কাজ করেই চার-পাঁচটা পেটের খাবার যোগাড় করে। চার নম্বর লাইনের বস্তিতে একটা এক কামরার ঘুপচি ঘরে থাকে ওরা। আটশো টাকা ভাড়া। ক্যানিং এর কাছাকাছি কোনো একটা গ্রামে ওদের “দেশ”। দুটো মাটির ঘর আর একচিলতে ধানি জমি আছে সেখানে।  মাসে একবার করে চার- পাঁচ দিনের জন্য ওরা “দেশে” যায়। টুনি ওরফে টুনটুনি এখন ষোল-সতেরো বছরের তরুণী। পুঁইলতার ডগার মতন শ্যামলা, চিকন্, বাড়ন্ত। লোকের বাড়িতে এঁটো বাসন মাজলেও তার সাজপোশাকের ভারি বাহার। অয়নিকার পাশের বাড়ির যে মহিলা জামাকাপড়ের ব্যবসা করেন, টুনি তার কাছে সারা বছর পছন্দমত জামাকাপড় কেনে, ইনস্টলমেন্টে। অর্থাৎ মাসে মাসে দু-একশো করে দ্যায় আরকি। এছাড়া কাছেপিঠে এ মেলা ও মেলা সে মেলায় ঘুরে ঘুরে টিপ, কাজল, বাহারি চুড়ি তো আছেই। অয়নিকার কাছ থেকেও টুকটুক করে জামা, চুড়িদার, ছোট হয়ে যাওয়া কারুকাজ করা ব্লাউজ, ভ্যানিটি ব্যাগ ইত্যাদি উপরি পাওনা সারা বছর। টুনির এহেন শৌখিনতা অয়নিকা বেশ পছন্দ করে মনে মনে। সে নিজেও আগাগোড়া শৌখিন এবং রুচিশীল। সুশোভনও যথেষ্ট স্নেহ করে টুনিকে।  চার নম্বর রেল গেট থেকে শুরু করে অয়নিকাদের পাড়া, রানীপার্ক--- যেখানে যেখানে ওদের যাতায়াত, সর্বত্র এই হাসি খুশি কাজের মেয়েটি টুনটুনি বা টুনি নামে খ্যাত। ওর আসল নাম রহিমা, রহিমা খাতুন। 

টুনটুনির কাছে একটা ভাঙাচোরা স্ক্রিন টাচ ফোন আছে। থার্ড কিংবা ফোর্থ হ্যান্ড হবে। ফোন টা কোমরে ওড়নার সঙ্গে কায়দা করে বেঁধে নিয়ে কাজে আসে ও। এসেই আগে কোনো কথা না বলে অয়নিকার চার্জারে নিজের ফোন টা চার্জএ বসায়। এটা এ বাড়িতে ওর প্রথম কাজ। তারপর কাজে হাত দ্যায়। আধ ঘণ্টা- পঁয়তাল্লিশ মিনিট চার্জ হতে না হতেই শুরু হয় টুনির ফ্যানদের ফোন, মেসেজ আসার পালা। একটা করে ফোন কিংবা মেসেজ আসে আর অমনি টুনি কাজ ফেলে ছুটে ছুটে দেখতে আসে কার ফোন বা কি মেসেজ এলো! অয়নিকার একটু আধটু বিরক্তি লাগলেও সে মুখে কিছু বলে না। টুনিকে সে সত্যিই স্নেহ করে। তাছাড়া এমন পরিস্কার পরিচ্ছন্ন বিশ্বস্ত কাজের লোক পাওয়া আজকাল যে বেশ সমস্যা তা অয়নিকা খুব ভালো করে বোঝে। তা সেই টুনি একদিন সকালে এসে বললো “মামী,আজ একটু তাড়াতাড়ি ছুটি নোবো”।
অয়নিকা জিজ্ঞাসা করলো “কেন রে? কি ব্যাপার?”
টুনি একগাল হেসে বললো “বন্ধুদের সাতে সিনিমা যাব গো মামী, শারুপ খানের বই দিয়েছে”।
অয়নিকাও হা হা করে হেসে ফেলল টুনির শাহরুখ খান উচ্চারণ শুনে। তারপর বললো “আচ্ছা যাবি’খন। তবে বিকেলের আগেই ফিরে আসিস”।অয়নিকার কথামতো বিকেল নাগাদই ফিরে এলো টুনি। খুব হাসি খুশি। অয়নিকার সঙ্গে দেখা করে বাড়ি চলে গেল। 
দিন পনেরো পর আবার একদিন বললো কামারহাটিতে নাকি কিছু একটা মেলা বসেছে। বন্ধুদের সঙ্গে দেখতে যাবে।
সপ্তাহখানেকের মধ্যেই আবার সেই এক গল্প। এবার বলল “মামী, তোমার একটা শাড়ি দাও না। প’রে যাব। বন্ধুর জন্মদিন আছে”।
অয়নিকা শিক্ষিতা ও আধুনিকা হলেও একটু সহজ সরল এবং স্নেহপ্রবণ। আলমারি খুলে বছর পাঁচেক আগে পুজোয় কেনা কালোর ওপর জরির কাজ করা একটা সিল্ক বের করে দিলো টুনিকে। টুনি বললো “মামী বাসন এখন মাজবো না। ফিরে এসে মাজবো। বিকেলের আগেই ফিরে আসবো”। কিন্তু এলো না। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে গেল। সন্ধ্যে পেরিয়ে রাত। তাও টুনটুনি এলো না।  অয়নিকা মনে মনে ভেবে নিলো ‘হয়তো বন্ধুর বাড়ি থেকে ফিরতে দেরি হয়ে গেছে দেখে বাড়ি ফিরে গেছে। এখানে আর আসে নি’। এঁটো বাসন গামলায় যেমন ডাঁই করে রাখা ছিলো, তেমনি পড়ে রইল। সকালে টুনি এসে মাজবে-এই আশায়। পরদিন ভোর পাঁচটা নাগাদ বেল বাজলো। “উঃ, এত ভোরে আবার কে এলো!” ঘুম জড়ানো চোখে দরজা খুলতে উঠলো অয়নিকা। দরজা খুলতেই হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকে পড়লো টুনির মা। তারপর মেঝেতে ধপাস করে বসে পড়ে কান্না জুড়ে দিল “দিদিগোওওও কাল সারারাত্তির টুনি বাড়ি ফিরে নিইইইই”। টুনির বাবা দাঁড়িয়ে ছিলো দরজার পাশে গুটিশুটি মেরে। চোখ থেকে তখনো ঘুম ছাড়েনি অয়নিকার। আগের দিন খাটুনিটাও বেশি হয়ে গেছে। প্রথমটায় বুঝতে পারলো না সে। তবে  কিছু একটা বিপদ হয়েছে আন্দাজ করে জিজ্ঞাসা করলো “কাঁদছো কেন? কি হয়েছে?” কান্না কান্না গলায় টুনটুনির মা পুনরাবৃত্তি করলো “আমার সব্বোনাশ হয়ে গেছে দিদি গো---------" শোনা মাত্র অয়নিকাও হতভম্ব হয়ে ধপ্ করে বসে পড়ল সোফায়। প্রথমেই তার মনে এলো, ”কি হবে এখন! এতগুলো বাসন কে মাজবে?” তারপরেই মনে হলো “কোথায় গেলো টুনি! কোনো বিপদে পড়লো না তো?” টুনির ফোন নম্বর ছিলো অয়নিকার কাছে। কিন্তু যতবারই নম্বরটা টিপে কানে দিলো, ততবারই এক কথা, “সুইচড অফ”। সুশোভন সবকিছু শুনে অয়নিকাকেই দোষারোপ করে বললো “এই ঘটনাটা ঘটার জন্য তুমি কিছুটা হলেও দায়ী।তুমি মেয়েটাকে এখান ওখান ছেড়ে দিতে”। অয়নিকা অবাক হয়ে বললো “ও মা, কি কথা বলছো তুমি? ছেলেমানুষ, একটু আধটু সিনেমা দেখতে যেতে চাইলে,মেলায় যেতে চাইলে, যেতে দেব না? ওর কি কোনো শখ আহ্লাদ নেই? শুধু লোকের বাড়ি কাজ করে করেই মরবে? সুশোভন বিরক্তি নিয়ে বললো, ”শখ আহ্লাদ! ভালোই শখ আহ্লাদ করতে গেছে। ঠেলা সামলাও এবার”

সারা দিনটা খুবই বাজে কাটলো অয়নিকার। কাজের লোক এর ভাবনাটা যদিও গেছে। কাল থেকে টুনির মা নিজেই আবার কাজ করবে বলেছে। কিন্তু টুনটুনির ভাবনাটা কিছুতেই মন থেকে ঝেড়ে ফেলে দিতে পারছে না অয়নিকা। ফোনটা এলো রাত সাড়ে ন’টার সময়। অয়নিকা তখন মুখ ব্যাজার করে রুটি করছে। ফোনে রিং টোনএর শব্দ পেয়ে গ্যাস জ্বালিয়েই চলে এলো অয়নিকা ফোন টা ধরতে। অচেনা নম্বর। অয়নিকা ফোনটা রিসিভ করে হ্যালো বলতেই ওপার থেকে ভেসে এলো “হ্যালো মামী, আমি বিয়ে করেছি। মাকে বোলো আমি ভালো আছি। আমার জন্যে চিন্তা না করতে।আমার বর আমাকে খুব ভালবাসে”।
অয়নিকা শুধু জিজ্ঞাসা করলো, “কোথায় আছিস তুই?”
টুনি বললো, “জায়গাটা চিনতে পারছি না। তবে কিষ্ণনগরের কাছাকাছি কোথাও হবে। কিষ্ণনগর লোকালএ এসেছি।“ তারপর বললো “ফোনে চাজ কম। তোমার সঙ্গে পরে কথা বলবো। এখন রাখছি”।  অয়নিকা আর কিছু বলার আগেই ফোনটা কেটে গেল। তারপরের দিন টুনি আবার ফোন করলো। এবার জানালো, সে একটা হিন্দুদের ছেলেকে বিয়ে করেছে। সিঁথিতে সিঁদুর পরেছে। হাতে শাঁখা পলা। মামীর কালো শাড়িটা পরে ওকে এত ভালো দেখতে লাগছিল যে সব্বাই বৌ দেখে খুব প্রসংসা করেছে।
অয়নিকার জিজ্ঞাসা করলো “ওখানে সবাই জানে তোর পরিচয়?”
টুনি বললো, “না এখানে সবাই আমাকে মীনা বলে ডাকে। বর ছাড়া আর কেউ জানে না যে আমি মুসলমান”।
অয়নিকার বুকের ভেতরে ভাললাগার সুশীতল বাতাস বয়ে গেল। মানুষে মানুষে ভালবাসার কাছে কত তুচ্ছ জাত-ধর্মের বিভেদ। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে অয়নিকা জানতে চাইল, “তোর বর কি করে?” টুনি জানালো ওখানেই কোনো একটা ছোটখাটো মিষ্টির দোকানে কাজ করে। তারপর থেকে দুদিন কাটলো, তিনদিন কাটলো, চারদিন কাটলো, টুনি আর ফোন করলো না। দৈনন্দিন জীবন প্রবাহে আস্তে আস্তে কমে এলো টুনির চর্চা। তবে অয়নিকার খাটুনি এখন একটু বেশি, টুনির অভাবে। টুনির মা একবেলা এসে শুধু বাসনটা মেজে দিয়ে যায়। অয়নিকা গুণে দ্যাখে প্রায় একমাস হতে চললো টুনি গেছে। যাক্ বাবা, বিয়ে করেই ফেলেছে যখন, যেখানেই থাক্ ভালো থাক্। অয়নিকা মনে মনে আশীর্বাদ করে।কিন্তু বিধাতা বোধহয় অন্য কিছু লিখে রেখেছিলেন টুনির কপালে। একমাস চারদিনের মাথায় ফিরে এলো টুনি। সিঁথির সিঁদুর মুছে, হাতের শাঁখা-পলা খুলে। টুনির শ্বশুরবাড়ির লোকজন ও পাড়ার লোকজন যেভাবেই হোক জানতে পেরে গিয়েছিল, টুনি হিন্দু নয়, মুসলমানের মেয়ে। অথচ ও বাড়িতে রাধা-কৃষ্ণের মূর্তি আছে, আর টুনি সেখানে রোজ সন্ধ্যে প্রদীপ জ্বালায়। একদিন গ্রামের  প্রধান বেশ কিছু লোকজন নিয়ে হাজির হলেন টুনিদের বাড়ি।বললেন টুনির বর যদি টুনিকে না পরিত্যাগ করে, তাহলে সে ঐ পরিবার, প্রতিবেশী বা আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে পারবে না। ঐ বাড়ি এবং ওদের সম্পত্তি থেকে তাকে  বঞ্চিত করা হবে। এছাড়াও ওরা ঐ গ্রামেই থাকতে পারবে না এবং জীবনে কোনোদিন ঐ গ্রামের ত্রিসীমানায় আসতে পারবে না। পাড়ার লোক এবং পঞ্চায়েত স্পষ্ট জানিয়ে দিলো যে টুনিকে রাখলে ওদের পরিবারকেও একঘরে করা হবে। ফোন করে ওরা ডেকে পাঠালো টুনির বাবা মাকে। টুনির বাবা মা পৌঁছলে, টুনিকে উঠোনে দাঁড় করিয়ে গ্রামসুদ্ধু লোকের সামনে টুনির বর টুনির মাথায় এক বালতি জল ঢেলে সিঁদুর ধুয়ে  দিলো। খুলে নিলো টুনির হাতের শাঁখা পলা। টুনি কাঁদলো না। দাঁড়িয়ে রইলো পাথরের মতো। তারপর ভিজে কাপড়টা ছেড়ে একটা শুকনো কাপড় পরে বেরিয়ে এলো বাড়ি থেকে। টুনি আবার ফিরে এলো তার মায়ের সংসারে। পরের দিন থেকে আবারও লেগে গেল পরের বাড়ির কাজে, বাসন মাজা, কাপড় কাচা, ঘর মোছা ----

টুনটুনি অনেক বদলে গেছে। অয়নিকা ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলো, টুনটু্নির মধ্যে সেই চেনা টুনটুনিটা আর নেই। কাজ করছে অথচ কোনো কাজে মন নেই। সবসময় অন্যমনস্ক। বাসন মাজলে বাসনে এঁটো লেগে থাকে। ঘর মোছে, যেখানকার নোংরা সেখানেই পড়ে থাকে। মা ডাকছে, ও বসে আছে তো বসেই আছে। উঠতে বসতে ওর মা গালিগালাজ শাপশাপান্ত করে চলেছে। টুনি যেন শুনেও শুনছে না। অয়নিকা কিছু বলে না। মনে মনে ভাবে, কটা দিন যাক, আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। তবে বেশিদিন কাটলো না। পঁচিশ-ছাব্বিশ দিনের মাথায় টুনি আবার পালিয়ে গেল। পরের দিন ওর মা কাজ করতে এসে জানালো, এবার টুনি যার সঙ্গে গেছে সেই ছেলেটা নাকি ওর আগের বরেরই বন্ধু। তবে তার থেকে বয়সে অনেকটা বড়। সে টুনিকে কথা দিয়েছে বিয়ে করবে। টুনটুনির মা এবার আর কোনো কান্নাকাটি করলো না। অয়নিকাও সেরকম কোনো দুঃখ পেল না। বরং সেদিন সন্ধ্যেবেলা চা খেতে খেতে সুশোভনের সঙ্গে টুনটুনি প্রসঙ্গ আলোচনার সময় মন্তব্য করলো, “মেয়েটার স্বভাবটাই খারাপ হয়ে গেছে”।

টুনটুনি বসে আছে কাঁচরাপাড়া স্টেশনে।তিন দিন আগে সে পালিয়ে এসেছে বাবুরাম এর সঙ্গে। আজ ওদের বিয়ে করার কথা। টুনিকে স্টেশন এ একটা ফাঁকা জায়গায় বসিয়ে খাবার কিনতে গেছে বাবুরাম। তা সে গেছে তো গেছে। টুনি বসে অপেক্ষা করছে টানা তিন চার ঘণ্টা। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল। তাও বাবুরামের পাত্তা নেই। টুনির খুব কান্না পাচ্ছে তবু সে জোর করে কান্না চেপে রেখেছে। কোথায় যাবে এখন সে! এ পথ তো সে নিজেই বেছে নিয়েছে। শীতের বেলা। সন্ধ্যে নেমে আসছে ঝপ করে। প্রায় সন্ধ্যের মুখে টুনটুনির সামনে এসে দাঁড়ালো একটা কালো মত ষণ্ডামার্কা ছেলে। পানের কালচে ছোপ ধরা দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বললো, “আমাকে বাবুরাম পাঠিয়েচে তোমায় নিয়ে যেতে। এখন থেকে তুমি আমার কাচে থাকবে। বাবুরাম পরে এসে তোমাকে নিয়ে যাবে”। টুনি অনুভব করলো খুব তাড়াতাড়ি অন্ধকার নেমে আসছে তার চারপাশে। তার খুব শীত শীত লাগছিলো।শরীরে মনে কোথাও তার আর এতটুকু শক্তি নেই। সে হাত বাড়িয়ে ষণ্ডামার্কার একটা হাত ধরলো তারপর যন্ত্রের মত তার সঙ্গে হাঁটতে শুরু করলো। কয়কপা হেঁটে একটা এঁদো গলির মুখে একটা নোংরা হতশ্রী এক কামরার ঘরে এসে ঢুকলো। ষণ্ডামার্কার সঙ্গে টুনি থাকলো আট দশ দিন। ষণ্ডামার্কার শখ মিটতে সে টুনিকে নিয়ে গেলো একদিন মোতি মিঞার কাছে। মোতি মিঞার জহুরির চোখ। টুনটুনিকে দেখে সে বললো, “বয়সটা অল্প, জৌলুসও আছে। রোজগার পাতি ভালোই হবে, কি বলিস?” মোতি মিঞার কথায় ষণ্ডামার্কা হেসে উঠলো খ্যাঁকখ্যাঁক করে। মোতি মিঞা নিজের কাছে টুনিকে তিনদিন রেখে চার দিনের দিন তুলে দিলো সৌদি আরব গামী জাহাজে। ভোর চারটেয় ছাড়লো জাহাজ। শীতের ভোর তখনো ঘুম ভাঙায়নি সূর্যের। টুনটুনির পরিশ্রম ক্লান্ত মা তখনো ওঠেনি ঘুম থেকে। বেলঘরিয়ার বাড়িতে সুশোভন আর অয়নিকাও তখন ঘুমোচ্ছে অঘোরে। 

Comments

Top

গল্প

দেবতার দর্শন 

ভবঘুরে (পিন্টু মিত্র)

ইংল্যান্ড

sadhu.jpg
দেবতার দর্শন

বাপ মা দেওয়া একটা নাম আছে। কদিন পাঠশালায় যাওয়া আসার জন্য একটি তোলা নামও দেওয়া হয়েছিল কিন্তু এখন আর ভরসা করে ও নামটা লেখার মত বুকের পাটা নেই। কারণ আমার আগে বেশ কজনা পৃথিবীতে এসে নামটার সাথে বেশ জমকালো সব পদবী বসিয়ে সর্বজনের সমীহ এবং শ্রদ্ধা আদায় করে নেওয়ায় আমি ওই আঁধারেই পড়ে রইলাম আর সকলের চোখ বাঁচিয়ে এখনকার বর্তমান ভবঘুরে নামটাই বেছে নিয়েছি।
কোন পিছটান নেই, আর ভবিষ্যৎ এর কামনা আকাঙ্ক্ষাও নেই। বলার মত, জাহির করার মত ও কিছুই নেই। থাকার মধ্যে আছে শুধু ঝোলান একটা পুঁটুলি যাকে আপনারা বলেন ব্যাকপ্যাক - আদিকালের ভাষায় যাকে বলা হত বোঁচকা। যার মধ্যে রাখা থাকে নিতান্ত প্রয়োজনীয় কিছু রোজকার জিনিষপত্র। সারাদিনটাই ঘুরে বেরাই গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। কেন জানেন - এখনও ওই প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষ জনদের সঙ্গে দুদন্ড কথা বলা যায় মন প্রাণ খুলে। শুনতে ভাল লাগে ওদের সাদা মনের দুটো কথা। চেনা যায় গ্রাম্য পরিবেশকে, সমাজকে - সাদামাটা মনের মানুষ জনদের। পৃথিবীটা যে এখনও পূর্ণ হয়ে যায়নি কপটতায় - শঠতায় - বিশ্বাসহীনতায় - স্বার্থপরতায় সেটা পরিপূর্ণ অনুভব করা যায় সেখানেই। অবশ্য সে সব গ্রাম, শহর বা শহরতলী থেকে অনেক অনেক দুরে। ওরাই এই আধ বুড়ো মানুষটাকে দু মুঠো আহার দেয় - সে রাত বিরেতেও - দেয় দুর দুরান্ত থেকে টিঊকলের জল একটা ঝকঝকে তোবড়ানো অ্যালমুনিয়ামের গেলাসে। এরা হয়ত জানেনা আপ্যায়নের রীতিনীতি, হয়ত জানেনা শহুরে আদব কায়দা। ধার ধারেনা নকল নাটুকে শিষ্টাচার। যেটা জানে সেটা নিখাদ আন্তরিকতা। আপন করে নেবার অকপট আচরণ যা ওদের কাছেই কিছু শহুরে বাবুদের শিখতে হবে।

এখন থেকে প্রায় ষাঠ বছর আগের কথা- যে সময় এক টাকার কদর ছিল অনেক। গ্রাম বাংলায় তখন সবে বিজলী বাতি প্রবেশর অনুমতি আদায় করেছে, তবে আজকের মতন ঘরে ঘরে নয়, সীমিত স্থানে এবং সীমিত সময়ের জন্য মাত্র। সে সময় আমার জীবনযাত্রা ছিল সেই পশ্চিমা এক কবিতার মত - 
   জঁহা ভই সাঁঝ ওঁহি বসেরা।
   জব খুলি জাগ তো ভই সবেরা ।।
যেখানেই নামে সন্ধ্যা সেখানেই হয় রাত্রিবাস আর ঘুম ভাঙ্গলেই হয় চরৈবেতি।
এমনই এক সন্ধ্যায় এসে হাজির হই কোন এক গন্ডগ্রামের হাটতলায়। জমজমাট হাট বাজার। বিজলী বাতির রোশনীর জেল্লায় চলছে সব বেচা কেনা।বসি আমি একধারে নির্বিকার মুখে, মাঝে মাঝেই কান আসছে এদের টুকরো টুকরো কথাবার্তা - হাসি মসকরার আলাপচারিতা। একটু অন্য মনষ্কও যেন হয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ ওদের মধ্যে এক বয়স্কজন এগিয়ে এসে জানতে চায় আমার সম্বন্ধে। কে আমি, কেন এসেছি, কার কাছে এসেছি, নানান কথা। আমার সব কথা শোনার পরই উনি বলেন, “বড় কঠিন সময় এসেছেন মশাই। আপনার এ সময় এভাবে আসাটা ঠিক হয়নি। একে তো লোকজন কোন মানুষজনকে সহজে বিশ্বাস করতে চায় না। এখন সবার চোখে দেখবেন সন্দেহের ছায়া।কেও কাউকেই বিশ্বাসকরতে চায় না। সবাই কারই ধারনা আমি ভাল মানুষ তাই সবাই বুঝি আমায় ঠকায়। খুব সাবধান মশাই। সঙ্গে পয়সাকড়ি থাকলে কারুকেই কাছে ঘেঁষতে দেবেন না। যাই হোক তা রাত কাটাবেন কোথায়? এদিকে আবার নতুন উৎপাত আরম্ভ হয়েছে। রাত বাড়লেই শেয়ালের আনাগোনা বাড়ে। এই তো গত সপ্তাহেই  শান্ত বাগদী শহর থেকে ফিরছিল। বাস গোড়ার কাছেই শেয়ালের কামড়ে একবারে রক্তারক্তি। দস্তুর মতন ঘায়েল। শেষ পর্যন্ত সদর হাসপাতাল আর বাড়ি ঘুরে ঘুরে এখন একটু সুস্থ হয়েছে। যাই হোক আমি এখন বরং এই বড় মুদির দোকানে বলে দিয়ে যাচ্ছি ওদের দোকান বন্ধ হলে তখন না হয় ওদের ওই দোকানের রোয়াকে আপনি আজকের রাতটা কাটাবেন।”
এরপরই ভদ্রলোক বলেন, “আমি এবার চলি। আমাকে অনেকটা পথ যেতে হবে। সেই পুব পাড়ায়। আপনি তো বললেন কাল ভোরে ই চলে যাবেন ভিন গাঁয়ের উদ্দেশে, তা হলে আর দেখাই হবে না আমাদের। আমার আবার মশাই দেরীতে শোয়া আর দেরীতে ওঠাটাই রোজকার অভ্যাস। হ্যাঁ, আর একটা কথা তো জানাই হল না - মশাই এর নামটা?”
“ভবঘুরের তো আর নাম হয় না। আজ এখানে কাল সেখানে। হয়ত আর এ জীবনে আমাদের দেখাই হবে না। তাহলে আর নাম পরিচয়ের প্রয়োজন কি বলুন?”
“তা যা বলেছেন। যাই হোক এবার আমি আসি, হাটতলাও তো খালি হয়ে এল বলে।”
ভদ্রলোক চলে যাবার পর এবার আমি চারদিকে চেয়ে দেখি। সত্যি মানুষ জনের ভিড় পাতলা হয়ে এসেছে। ভাবি হে ঈশ্বর তোমাকে স্মরণ করেই আজ রাতটা এই রোয়াকে বসেই কাটাব। এক সময় ধীরে ধীরে সমস্ত দোকানের ঝাঁপ বন্ধ হয়ে যায়। বড় মুদির দোকানের ফাঁক গলে এক চিলতে আলো বাইরে এসে পড়ছিল। সেই দিকে চেয়েই বসেছিলাম। নিশ্ছিদ্র অন্ধকার ভেদ করে এক অদ্ভুত ভাব প্রবণতা। কেমন যেন এক অজানা কৌতূহল, সেই দিকেই মগ্ন হয়েছিল মন, আবদ্ধ হয়েছিল দৃষ্টি তাই হঠাৎ গা ঘেঁসে বসে থাকা এক পুরুষ মানুষের নেশা গ্রস্ত জড়ানো ভাষার খসখসে শব্দ শুনে চমকে উঠলাম।
“ইখানে বসে থাকলে হবে? সারা রাত তো বসে থাকতে পারবেক নাই। শুবে কোথায়?”
“কেন, এই শান বাঁধানো রোয়াকে?”
“বটে বটে, তা রেতে খাবার কি হবে? কে আনবে তুমার জন্য রেতের ভাত?”
“আমার রাতের খাবার দরকার নেই। এখানেই শুয়ে রাতটা কাটিয়ে দেব। আজ দুপুরে যা খেয়েছি তাতে আর খিদে নেই।”
“বটে বটে, তুমার মুখটা তো দেখছি শুকনো। যাকগে সি কথা। তা ইখানে এসে মরার শখ হল কেনে বল দেখি? আরও তো অনেক থান ছিল পিথীবিতে।”
“এখানে শুলে মরব কেন? এত লোক তো এখানে আছে, তারা সবাই মরে নাকি?”
“তুমি তো অজানা মানুষ আছ না, তা তুমি কি করে জানবে বলো। ই যে মুদির দোকান দেকচ না ইটাতে সব ধেড়ে ধেড়ে ইঁদুর গুলান আসে রেতের বেলা - খাবার লোভে। আর তাদের পিছু নিয়ে আসে করাইতরা। ওদের আহার তো ওই সব ইঁদুরগুলান না।”
“করাইত আবার কারা? তারা সব ইঁদুর খায় কেন? অন্য কোন ভাল খাবার পায় না খাবার জন্য?”
“আঃ ভগবান, এ মানুষটা করাইতদের নাম শোনেনি। ই দেখো, রেতের বেলায় ওদের নাম করতে নেই না। লতা লতা বলতে হয়। ও একবার ছোবল দিলে বাপ বলতে সময় দেয় না। যাগগে যাগ সে সব কথা। তুমি আমার সাথে চলগো, উঠো। আমাদের দাওয়াতে রাতটা কাটাবে নিশ্চিন্তিতে, আরামে।”
এরপর আর কথা বলতে দেয় না। মনে মনে ভাবছি এ কোন মাতালের পাল্লায় পড়লাম রে বাবা। আমি ও শেষ মোক্ষম চালটা দিয়ে বলি, “তোমার ঘর ও তো মনে হচ্ছে এই গ্রামেই তা করাইতরা তো সেখানেও থাকতে পারে - যেতে ও পারে তাই না?”
এবার মাতাল হো হো করে হেসে বলে, “আমাদের ঘরের তিসিমানার ধারে কাছে আসার হেম্মত হয়নি ওদের। আমাদের ঘর দিনে রেতে পাহারা দেয় 
শেতল। কার বাবার

খ্যামতা আর সাহস হবে গো ময়েশ বাউরে ঘরের দিকে পা বাড়ায়। আর ও একজন আছে গো - সেই বাগিনি আমার ইস্ত্রি। অবশ্য তোমাকে সংগে দেকলে আজ আর কিছুটি বলবে নি। তা না হলে আমাকে এই সন্ধেবেলা এমন দেকে না সে এক অনাছিষ্টি কান্ড বাদায়। সেই তখনকার ওর মুরতি দেখে মায় ওই শেতলটা পর্যন্ত পুকুর পাড়ে গিয়ে ঠায় বসে থাকে। খাবার সময় হলে আমার ইস্ত্রিই তাকে ডেকে নে আসে, বুঝলে। সে আর কত কাকে বলব বল না। গাঁয়ের লোকে বলে, ‘ময়েশ তোর অশেষ সজ্জি জ্ঞান। অন্য কেউ হলে কবে বেবাগি হয়ে যেত’। ”মনে হয় ততক্ষণে মহেশের ঘরের সামনে এসে গেছি। মাটির দাওয়ার সামনে এসে মহেশ বেশ মোলায়েম গলায় হাঁক দেয়, “কই রে ছিরি - একবার বাইরে এসে দাক না কেনে কাকে এনেছি সাথে করে।”  সম্ভবত মহেশর গলায় ‘শ্রী’ শব্দটা ছিরি হয়েছে। ওই ছিরি নামের মহিলার গলার যে শব্দটা ভেসে আসে তা বোধ হয় মিষ্টি গলার শহরের অনেক অন্তঃপুর বাসিনিদের স্বরকেও মলিন করবে বলে মনে হয়। তবে ওনার কথাগুলো সব কানে খোঁচা দেবার মতন। ভিতর থেকে যে শব্দ কটা ভেসে আসে তা সে সবও খুব একটা শ্রুতি মধুর নয়।
“এই রেতের বেলা কাকে নে ঘরে এলে। এবার যেন বলবেনি যে হাঁড়িয়া খাবার লেগে একটু কিছু ভেজে দে না ছিরি। ঘরে এক ফোঁটাও তেল নেই রয়েছে একটা মাত্র আলু।”
এরপরই হাতে কেরোসিনের কুপি নিয়ে যে মহিলা ঘর থেকে বার হয়ে আসে - ইষৎ ময়লা রং পরনে সাদামাটা একটা খাটো লাল পাড় শাড়ী। 
আমার সেই ছোটবেলার প্রথম দেখা মা দুর্গা যেন নতুন রূপে এই মহেশের ঘরে। আমি অপলক ছোখে চেয়ে দেখি একবার ওর দিকে আর একবার মহেশের দিকে। আমার ওই হতভম্ব অবস্থা দেখে ছিরি অবাক হয়ে মহেশকে বলে, “মানুষটাকে দেকে তো মনে হচ্চে সারাদিনে দুমুটো অন্ন ও জোটেনি তার উপর রেতের বেলা একে থাকতে দেব কুথা? ঘর তো একটাই।”
“সে সব হয়ে যাবে রে ছিরি। কথায় আছে না - জীব দেছেন যিনি আহার ও দেবেন তিনি। আর একটা কথা বলে না - সুজন হলে কচু পাতায় পাঁচজনা শুতে পারে। তা শেতলাকে দেকছিনি। তাকে কি খেদিয়ে দিলি নাকি?”
“খেদালেও সে কি যাবে নাকি আমাদের ছেড়ে? ওই তো নোকটার পেছনে বসে আছে।”
ঘুরে দেখি এক পেল্লায় বাঘা কুকুর, রং কুচকুচে কালো-লকলকে লাল জিব বার করে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে আছে আমার দিকে। 
ওর দিকে তাকিয়ে মহেশ বলে, “শেতলা একে দ্যাখ ভাল করে।এ আমাদের আপন জন, দেখবি একে যেন কেও ছুঁতে না পারে। ওর তিসীমানায় যেন পোকা মাকড়টিও না আসতে পারে।”
এরপর তো ওই জীবটি প্রথমে আমাকে আগা পাস্তালা শুঁকতে আরম্ভ করে। তারপর বলা নেই কওয়া নেই আমাকে ভর করে হঠাৎ দু পা তুলে দেয় সটান আমার বুকের উপর। এরপরই আমার আমার মুখটা শুঁকে চেয়ে দ্যাখে মহেশর মুখে পানে। মহেশ আর ওর বৌ কুকুরের কান্ড কারখানা দেখে  হেঁসে কুটো কুটি। এরপরই মহেশ শেতলাকে বলে, “ওরে ওই শেতলা ওর মুখে তো সে গন্ধ পাবিনি। এ তো ও পথে হাঁটে না রে।” 
কুকুরটা কি বুঝলো কে জানে - নেমে যায় আমার বুক থেকে। তবে বসে থাকে আমার সামনে, দাওয়ার নিচে। আমাকে একটা চাটাই পেতে বসিয়ে রেখে ওরা দু জনে ঘরে ঢুকে যায়। কিচুক্ষণের মধ্যেই শোনা যায় ওদের বাগবিতন্ডা, সামান্য কটা কথা কানে আসে আমার, গেলাস নিয়ে বচসা - খাওয়া নিয়ে কথা কাটাকাটি।ওদের ওই বচসার মধ্যেই কখন আমার চোখ জড়িয়ে আসে। চোখ খুলতে বাধ্য হলাম মহেশে ডাকে। দেখি দাওয়ার ওধারে  কলাপাতার উপর লাল চালের ফেনা ভাত আর আধখানা সেদ্ধ আলু। আমি মহেশকে প্রশ্ন করাতে সে জানায় সে একটু পরে খাবে। কেন না ওরা দু জনে এক সাথে খেতে বসে। ওটাই ওদের রোজকার আনন্দ বলেই এক গাল হাসি। আর ছিরি ও যেন ওর কথায় লজ্জা পায়।
আমার ক্ষিদে পেয়েছিল আর তার উপর ছিলাম ক্লান্ত তাই তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে আবার এসে শুয়ে পড়ি। এবার দেখি আমার হাত ধুয়ে আসার অবসরে ওরা একটা বড় চাটাই পেতে তার উপর আমার বোঁচকাটা রেখে বেশ ভাল মতন শোবার ব্যবস্থা করে রেখেছে।আমার খাবার পর ওরা শেতলকে খাবার দেয় একটা মাটির সরাতে। আমি ও লম্বা হয়ে শুয়ে থাকি।একবার ঘুম ভেঙ্গে গেলে তারপর আর ঘুম আসতে চায় না সহজে। তবু ও আমি জেগে আছি জানতে যদি ওদের কথা বলার অসুবিধা হয় তাই আমি ঘুমের ভান করে নিথর হয়ে শুয়ে থাকি। ওদের ও ততক্ষণে কথা আরম্ভ হয়ে গেছে সন্তর্পণে। প্রথমে মৃদু পরে সাধারণ স্বরে।
সারাংশ থেকে যতটা জানা যায় - ওই পাল মশাই যার সাথে হাটতলায় আমার আলাপ হয়, তার বাড়িতেই মহেশ মুনিশ খাটে। সারাদিন গোয়ালবাড়ির তত্বাবধান করে। গরু মোষ বাছুর ইত্যাদি মিলিয়ে তা প্রায় পোনেরটা, সব দেখাশোনার ভার মহেশের উপর। অসুরের মত খাটতে পারে লোকটা। ওই অকথ্য খাটনির জন্য সেখান থেকে ও পায় জলখাবার, দুপুরের ভাত আর সাঁঝবেলায় ঘরে ফেরার সময় এক কাটা করে ওই লাল কাঁড়া চাল আর নগদ একটা টাকা। আর ছিরি ঘরের কাজ করে ওই গাঁয়েরই বাবুদের বাড়ি, সকাল যায়।  ওখানেই পায় জলখাবারটা। দুপুরের ভাত তরকারিটা থালায় করে নিয়ে আসে ঢাকা দিয়ে। ওটাই ওরা দুজনে ভাগ করে খায় । দুজন মানে ছিরি আর শেতল।রাতের চালটা দিয়ে ওরা গরম ভাত আর আর সামান্য কিছু সবজি বা চুনো মাছ এনে রান্না করে খায়। সেদিন ও মহেশ রাতের চালটা যখন আনছিল সেই সময় কোঁড়া পাড়ায় রাস্তার পাশে একটা বাড়ি থেকে দুটো বাচ্ছার কান্না শুনে মহেশ দাঁড়িয়ে পড়ে। শিশুদের ওই কান্নার রহস্য ওর অজানা নয়। অনেকদিন থেকে শিশুর কান্না শুনছে সারা বিশ্ববাসী তবু মানব সন্তানরা মুখ ফিরিয়ে থাকে সেদিক থেকে। মহেশ শুনতে পায় রাজা কোঁড় ঘোর জ্বর লেগে আজ তিন দিন থেকে কাজে যেতে পারেনি। তাই ঘরে একদানা ও অন্ন নেই।মহেশ আগু পিছু না ভেবে ওদের ঘরে ঢুকে বেশ কিছুটা চাল ওদের দিয়ে আসে। ঘরে আসার আগে হাটতলাটা ঘুরে তাকে যেতেই হোত। কারণ ওখানেই তো জগা শুঁড়ির ভাটিখানা তা সেখান থেকে এক আনার চোলাই না খেয়ে ঘরে ঢোকা যায়? আজ ও তাই করেছিল। আর তারই মাঝে দেখা আমার সাথে। আমার অদৃষ্ট আর ওদের দুর্ভাগ্য।
এরপর আর আমার অনুমান করতে অসুবিধা হয় না যে কটা চাল ও আজ ঘরে এনেছিল তার সিংহ ভাগ লেগেছে আমাদের পেট ভরাতে, আমাদের মানে আমার আর শিতলের। ওদের রাত কেটেছে কি খেয়ে জানিনা। খুব ভোরেই বার হয়ে পড়ি সেখান থেকে। মনে মনে ভাবি - ছোটবেলা থেকেই তো দেবী দেবতার কথা শুনে এসেছি কিন্তু চোখে দেখিনি কোনদিন। কিন্তু জানিনা কোন পুন্যবলে দেখা পেলাম তাদের।
নিজের ক্ষুধার গ্রাস যে মানুষ নিজের ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য নিজের মুখে না তুলে অন্য ক্ষুধিত প্রাণীদের জঠর জ্বালার নিবৃতির জন্য অনায়াসে হাসিমুখে তাদের মুখে তুলে দেয় তারা সামান্য মানুষ নয় - দেবী দেবতা।

Comments

Top

গল্প

চোরের ওপরে

চোরের ওপরে

কল্যান সেনগুপ্ত

কলকাতা

theif.jpg

মাঘ মাসের রাত্রি, জানলার মধ্যে দিয়ে ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা হাওয়া মুখে ঝাপটা মারছে। কামরা প্রায় খালি হয়ে এসেছে। অনেকটা পথ, চোখটা  লেগে এসেছে। পাশে বসা ছেলেটা ঘাড় কাত করে আস্তে আস্তে বলে-দাদা আমাকে নেবেন?
চোখ খুলে ছেলেটিকে মেপে দ্যাখে রতন। একটা সরল সাদাসিধে মুখ, আধা নোংরা একটা পায়জামা আর শার্ট, উষ্কখুষ্ক চুল,পায়ে একটা হাওয়াই চটি, দেখে মনেহয় অনেকদিন সাবান পড়েনি গায়ে, খানিক অযত্ন চেহারায়। খোঁচর বলতো মনে হয়না। চেয়ে থাকে মুখের দিকে। মুখে একটা অদ্ভুত সারল্য। দলে আসতে চাইছে?কেন আর কি কিছু কাজ জোটেনি?
আবারও বলে ছেলেটি করুণ স্বরে বলে – পেটে ক্ষিধে, কি ছুতো একটা করে খেতে হবে,দাদা নেবেন আপনার দলে?
কোন দলের কথা বলছ ভাই? রতন ছুড়ে দেয়? কি জানে ব্যাটা সেটা জানা দরকার। আজ্ঞে আপনার কাছে কাজ শিখতে চাই? আপনার কথা অনেক শুনেছি আসতে যেতে। আজ দেখেই তাই গুটি গুটি আপনার পাশে এসে বসেছি। 
একটু বাজিয়ে দেখতে হবে - কি নাম?
ভোলা। আজ্ঞে ভোলা পাল। শুনেছি আপনি  জাদুকরের মতন কাজ করেন। যার মাল উধাও হচ্ছে সেও যখন জানতে পারবে তখন জাদুকর উধাও।
না, না, আমি সেরকম কিছু জানিনা। রতন লজ্জিত হয়। ভুল করছ। তুমি যাকে খুঁজছ আমি সে নই বলে উঠতে যায় ভোলা হাত ধরে বসিয়ে দেয়। দেখা যখন পেয়েছি দাদা আপনাকে আজ ছাড়ব না। একটা প্রণাম করি দাদা?
রতন কেমন নরম হয়ে পরে - করবি? চাইছিস যখন কর। আজকাল ত কেউ সেরকম করতেই চায়না আমাদের লাইনে। তা কি করিস? 
ভোলা উঠে বসে সীটে – সেরকম কিছু নয় সামান্য কিছু চলন্ত বাসে, রাস্তায় পকেট মারা।
আর কিছু?ব্লেড চালাতে পারিস? তোর গুরু কে? 
তেমন কেউ নেই। নিজে নিজে শিখেছি প্রচুর মার খেয়ে।.
মুখ বুজে খেতে পারিস? পারলে সেটা একটা গুণ । ভোলা দাঁত বার করে মাথা চুলকে খ্যাঁক খ্যাঁক হাসতে থাকে। রতন কাছে ডাকে, কঠিন পরীক্ষায় ফেলে দেয় - এই কামরায় পকেট কেটে দেখা দেখি। তবে বুঝব তোকে নেওয়া যায় কিনা।
ভোলা বলে - সে হবে নাহয়।
না, না এই কামরাতেই দেখাতে হবে।
একটু অপ্রস্তুত হয়ে পরে ভোলা। এদিক ওদিক তাকাতে থাকে।রতন মুচকি হেসে নিশ্চিন্ত হয় যে রাস্তাঘাটে উটকো ঝামেলা না হওয়াই ভাল।আশেপাশের লোকজন কি শুনবে কি ভাববে কে জানে।
ভোলা সামনে বাদাম ওয়ালা দেখে চোখের ইশারায় জিজ্ঞাসা করে - চলবে?
রতন মাথা নাড়ে। দুটো বাদামের প্যাকেট নিয়ে দাম দিতে যায় পিছন থেকে মানিব্যাগ বার করে।রতনের চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। ভোলার হাতে মানিব্যাগটা চেনা চেনা লাগে। নিজের প্যান্টের পিছনে হাত দিয়ে রতন হেসে ফালে, মানিব্যাগটা ভোলার হাতে।
কি করেছিস? তুই তো জব্বর জিনিষ। বেড়ে হাত তোর, তোকে তো বাজিয়ে দেখতেই হবে।আয়! আয়! বুকে আয় মানিক। রতন দুহাত বাড়িয়ে দেয়। ভোলা হাসতে হাসতে ব্যাগটা ফেরত দেয় - দেখে নেন সব ঠিকঠাক আছে কিনা। রতন জিজ্ঞাসা করে - দুটো প্রশ্ন। কে আছে তোর বাড়ীতে? আর কি কি নাম আছে তোর?
ভোলার মুখ ম্লান হয়ে যায় - দাদা বাবা ছোট বেলায় চলে গেছে, মা আবার একটা বিয়ে করেছে। নতুন বাবাটা একদমই দেখতে পারেনা। দুবার ফেল করতেই সেভেনে স্কুল ছাড়িয়ে দিয়েছে।আমার ক্ষিধেটা একটু বেশী তবু ভাল করে খেতেও দেয়না দুবেলা।
তোর মা কিছু বলেনা?
মার কষ্ট হয় সামনে কিছু বলেনা। নতুন বাবার মাথা খুব গরম, একটু কাজে এদিক ওদিক হলেই ক্যালায় লাঠি দিয়ে। বলে ঘুরে হাত চেপে ধরে রতনের – দাদা আমাকে সঙ্গে নেন, আপনার সব ফাইফরমাশ খেটে দেব। গা হাত পা টিপে দেব, রান্না করে খাওয়াব। শুধু আমাকে হাতে করে শেখান আপনার কাজ।
রতন খানিক নরম হয়ে পরে রান্নার কথাতে। আহা! কতদিন জমিয়ে কিছু খাওয়া হয়নি।রোজ ঘরে ফিরে সেই ভাতে ভাত সেদ্ধ খাওয়া সবাই মিলে। রান্নাটা ওরা কেউই জানেনা। ছেলেটা গুণী, কাজে আসবে। সারাদিন পরে ফিরে এলে গা হাতপা টিপে দেবে বলছে। ভোলা রতনের সঙ্গে ওদের বাড়ীর পথ ধরে।
শোন শুধু পকেটমার হলে হবেনা। আজকাল সবরকম কাজই জেনে রাখতে হবে। হ্যাঁ! দৌড়ানও প্র্যাকটিস করতে হবে। বলত কেন?
উত্তর আসে – কেন?ম্যারাথনে নামব নাকি?
রতন উত্তর দেয় হেসে - স্রেফ পালাতে, পালাতে পারাটাও একটা আর্ট বুঝলি।
মাথা নাড়ে ভোলা।
রাস্তায় মোবাইল, হার, ব্যাগ, টাকা কেড়ে নিয়ে পালানো,ব্যাঙ্ক ডাকাতি করে পালানো। চলন্ত ট্রেন থেকে নেমে পালানো। পালানর কি শেষ আছে? সব কিছু জেনে রাখতে হবে। এমন কি সময় খারাপ পড়লে মাদক পাচারও করতে হতে পারে। কখন কি কাজে লাগবে তো জানা নেই। একাগ্রতা লাগে, কখনও গল্প,কখনো ভুল বুঝিয়ে কাজ হাসিল করতে হবে। ভোলা বাধ্য ছাত্রর মতন মাথা নাড়ে। সত্যি ত দৌড়ানো যে রোজ শিখতে হয় সে ভাবে ত ভাবেনি কখনো।
স্টেশন থেকে নেমে হাঁটতে হাঁটতে রতন সুযোগ মত জ্ঞান দেয়। ভোলা শোনে আর মাথা নাড়ে।
রতন হাসে - তুই তো ব্যাটা গল্প আর ভুল বোঝানো দুই ভাল পারিস।
ভোলা মাথা চুলকায় - কি যে বলেন দাদা।
ওতো সামান্যই। অনেক কিছু শেখার আছে, পেয়েছি যখন আপনাকে আর ছাড়ছিনা।
আচ্ছা রান্না জানিস বলছিস তাহলে আজই লেগে পড়। দেখি আজ তোর রান্নার দৌড়। ভাল কিছু রান্না করে খাওয়া দেখি।বউ চলে যাওয়ার পর ভাল মন্দ তেমন কিছু পড়েনি অনেকদিন।
ও আপনি কিছু চিন্তা করবেন না। আজ থেকে আপনাদের রান্নার ভার আমার।
রতন চেয়ে হাসে, আর কি কি জানে জানতে হবে।ওস্তাদ ওস্তাদ ভাবটা নেই। কেমন একটা সরল বোকা বোকা ভাব। একদম গোড়া থেকে শেখাতে হবে একে।
গ্রামের প্রান্তে ভাঙ্গাচোরা একটা বাড়িতেই আপাতত রতন, কালু, তপা, দেবীপ্রসাদ, মানিক এদের আস্তানা। এদিকটায় মানুষজনের আনাগোনা কম। এসে থেকে ভোলাই একমাত্র সারাদিন বাড়িতে থাকে, এখনও ওদের সঙ্গে বেরতে শুরু করেনি, শুধু সকালে বিকালে দৌড় প্র্যাকটিস চলছে। ঘরদোর ঝাড়াপোঁছা করে আর রান্না করে বাড়ির হাল একদম ধাঁ চকচকে করে দিয়েছে। রবিবারের দুপুর বেলা খাওয়াদাওয়া শেষে ভোলার মাথা টিপে দেওয়াতে প্রায় চটকা লেগে এসেছিল রতনের। চটকা ভাঙতেই রতন বলে ওঠে - বেড়ে হয়েছিল বুঝলি আজ মাংসের ঝোলটা। আহা! অনেকদিন বাদে মায়ের হাতের রান্না মনে পড়ে গেল। কোথায় শিখলি বাপ? এইকাজ করেও পেট চালাতে পারিস তো তাহলে।
ভোলার গলায় অভিমান, বলে - আপনাকে গুরু মেনে আপনারই কাছে কাজ শিখতে এসেছি। তাহলে কি আর শেখাবেন না আমায়?
না,না আশ্বস্ত করে মানিক। গুরু শেখাবে বলেছে যখন ও নিয়ে চিন্তা করিস না।
ভোলা মাথা চুলকে বলে - আজকাল শুধু পকেট মেরে চলেনা।অন্য কিছুও করতে হয়।তেমন বাদুর ঝোলা বাস আর কোথায়? পকেটে পয়সা হয়েছে। পাতাল রেল আর ট্যাক্সি, প্রাইভেট গাড়ির এখন রমরমা।
কালু ফোঁড়ন কাটে-এখন বড় ইনকাম হচ্ছে মোবাইল হাপিশ করা। চোখের পলকে তুলে নাও, ছিনিয়ে নাও, চোর বাজারে রাতারাতি বেঁচে দাও। ব্যাস!কোনও বিশেষ ঝামেলা নেই।স্মার্ট মোবাইল মালিকেরা একটু সফি হয় বুঝলি, ভোলা বলে - সফিটা কি?
মানে একটু নরম আরকি, তেমন চোরের পিছনে ছোটা, পুলিশে গিয়ে ঝামেলা করা হুজ্জত করা এগুলো করতে চায়না। তবে মহিলা হলে ওতে হাত দিতে যেওনা।
কেন দাদা? ভোলা শুধোয়।
রতন হাসতে হাসতে পরিষ্কার করে - ওড়ে বাবা! প্রথমত মোবাইল এরা হাতছাড়া করেনা, আর নিলেও জান দিয়ে শেষ অবধি লড়ে যাবে। দৌড়াদৌড়ি, পুলিশ,পাড়া, আত্মীয় সবাই জেনে যাবে। তাদেরও কান ঝালাপালা হয়ে যাবে। মহিলা বলে হেলা ফেলা কোর না। আর যদি ধরা পড়ে যাস তাহলে এমন ক্যালাবে যে বাবার নাম ভুলিয়ে দেবে।
ভোলা মাথা নাড়ে - ঠিক আছে দাদা মহিলা একদম নয়। 
নানা রকম শেখা রান্না এখানে কাজে লেগে যায়। ভাঙ্গাবাড়িতে রোজ ফিস্টি। কিন্তু ভোলার মন ভরে না। কিছুই ত শেখা হচ্ছে না। কালু দেখায় কতরকম মোবাইল হাপিশ করার নকশা। ভোলার মুখ হা হয়ে যায়। তপা আর দেবীপ্রসাদ হাসতে হাসতে বলে ওঠে বন্ধ কর বন্ধ কর মশা ঢুকে যাবে মুখে। রতন গম্ভীর হয়ে বলে – এখানে সময় জ্ঞানটাই আসল। একটু এদিকওদিক হলেই গেল। সোজা মামার বাড়ি। এমন ভাবে হবে যে যখন হবে তখন দেখা সত্ত্বেও কিছু করতে পারবেনা।  মানিক - তবে ভোলা গাড়ি থেকে ড্রাইভার এর মোবাইল তুলতে আরেকজন হলে ভাল হয়। ভোলা বলে কেন? আরেকটু খুলে বল। কালু আর দেবীপ্রসাদ অভিনয় করে দেখায়। গাড়ি জ্যাম এ ফেঁসে আছে। ড্রাইভার এর সামনে ধর মোবাইল। বাঁদিক থেকে কেউ এসে কিছু জানতে চাইবে আর এই ফাঁকে ডানদিক থেকে আরকজন তুলে নেবে আর জ্যামের মধ্যে হারিয়ে যাবে। ড্রাইভার গাড়ী ছেড়ে যেতেও পারবেনা। তবে সাবধান বড় গাড়ি হলে হাত নাও যেতে পারে। একবার হাত চেপে ধরলেই কেলো।
আর গয়না ছিনতাইটা নিয়ে কিছু বলেন - ভোলা। আবদার করে। হাসতে হাসতে বলে - আমি একবার সাইকেল করে হার ছিনতাই করে পালাতে গিয়ে সাইকেল থেকে পড়ে সে এক কেলেঙ্কারি। পুরো হাটুরে মার। সেবার মার খেয়ে হাতটা বেঁকে ছিল অনেকদিন। মানিক ভোলার থুঁতনি ধরে বলে - ও দিয়ে হবে না, ও দিয়ে হবে না। মোটর সাইকেল চাই। বা ট্রেন থেকে নিয়ে নেমে পড়া যে কোনো একটা চলবে।
রতন বলে – এবার ভোলাকেও নিয়ে বেরতে হবে। শোন ভোলা, ধরা পড়লে কি করবি?
ভোলা হাসে - মুখ বন্ধ, কোন ভাবেই নাম বলা যাবে না বন্ধুদের। জেল থেকে ছাড়া পাওয়া অবধি।

ছাড়া পাওয়ার ব্যবস্থা আমরাই করব - রতন বলে। ঘরগুলো তে এখন ধুলো নেই। পরিষ্কার ঝকঝক করছে। তপা বাড়ি ফিরে রাত্রে বলেই ফেলে কেমন অচেনা মনেহয় বাড়ি এলে।সবাই বাড়ি ফিরে এলে। ভোলা আজকাল হাতসাফাই, ছিনতাই এগুলো হাতেনাতে করে সড়গড় হচ্ছে।

একদিন বিকেলে মানিক ট্রেন থেকে নেমে প্ল্যাটফর্ম ধরে বাইরে বেরবার পথ ধরেছে এমন সময় পিছন থেকে কেউ হাত রাখে কাঁধে। মানিক পিছন ফেরে। এক দাড়িওয়ালা বুড়ো।
কাঁপা গলায় বলে - আরে মানিক আমায় চিনতে পারছিস না? মানিক চিনতে পারেনা।আপনি কে?
আমাকে চিনতে পারছিস না?
মানিক বিরক্ত হয় – না, আমি চিনি না আপনাকে। বুড়ো ছাড়েনা। তুই এখানে থাকিস?বলিসনি তো?
পুলিশ বা খোঁচর নয়ত? মানিক বলে - আমার দেরী হচ্ছে। আমি আপনাকে চিনিনা। সামনে গাছতলাতে বুড়ো হাত ধরে মানিককে বসিয়ে দেয়।

– তুই আমাকে চিনতে পারছিস না? সেই শিয়ালদহ স্টেশনে আলাপ হয়েছিল। ট্রেন বন্ধ ছিল সেদিন মনে পড়েছে? তারপরই আবদার করে - দশটা টাকা দিবি বাপ? মানিক ভেবে পায়না কোথায় দেখেছে বুড়োকে। একথা সেকথায় বুড়ো – চা খাওয়াবি বাপ?
মানিক বিরক্ত হয়। আমাকে যেতে দিন আমার তাড়া আছে। আচ্ছা চল তোর বাড়ি আজ, টাকাটা বড় দরকার আজ। হঠাৎ এদিকওদিক তাকিয়ে বুড়ো নিচু স্বরে বলে - চলে গেছে বুঝলি। মানিক ভাল করে তাকিয়ে উল্লসিত হয়ে হাত ঝাঁকাতে থাকে ভোলার। একদমই চিনতে পারিনি তোকে। ব্যাপারটা কি? মানিক মাথার টুপিটা খুলে ধুলো ঝেড়ে বলে – আগে চা খাওয়া। আজ চা খাওয়া হয়নি। বিকেল হলে আমি স্টেশন অবধি আসি হাঁটতে হাঁটতে। আজ চা খাব বলে বসেছি দেখলাম দুটো প্লেন ড্রেসের খোঁচর তোর পিছন নিয়েছে। তোকে না থামালে ওরা আমাদের বাড়ি চিনে ফেলবে। তাই সামনের বসা পাগলা বুড়ো ভিখিরির টুপিটা নিয়ে একটু ধুলো মেখে তোকে থামালাম। ওরা কিছুক্ষণ দেখে অপেক্ষা করে চলে গেল। ভোলা হাসতে হাসতে বলে - কিন্তু মেকআপ কেমন ছিল বল? মানিক ম্লান হাসে – তাহলে এখানকার বাড়িও পাল্টাতে হবে। তুই ছিলি বলে আজ বাঁচলাম কিন্তু পুলিশ তো জেনে গেছে আমরা কোথায় থাকি। 

শনিবার চোর বাজার যাওয়া হবে। সারা সপ্তাহের চোরাইমালের লেনদেন হবে। টাকাপয়সা ভাগাভাগি হবে। আগের দিন সকালে গুনগুন করে গান গেয়ে ভোলা কচুর শাক রান্না করছে বড়ি দিয়ে, কারণ মানিক খেতে চেয়েছে। ভোলা ভাবছে এই যৌথখামার মন্দ নয়। পাশের ঘরে তপা জ্বরে কাত। বেরনো হয়নি। হঠাৎ রান্নাঘরের জানলা দিয়ে চোখ যায় বাইরে।পাচিলের এপারে দুটো ঠ্যাঙ ঝুলছে। জানলার কাছে এসে দেখে রোগা পায়জামা পরা মানুষ ভুতের দুটো পা। পা দুটো দুলছে নামবে নামবে করছে। দৌড়ে গিয়ে ভোলা তপাকে ডেকে বাগানে দৌড়ায়। নিচু হয়ে গিয়ে দুজনে মিলে এক হ্যাঁচকা টান ব্যাস। ধুপুস করে মাটিতে পরে ভুত। ওড়ে বাবা! কে টানল আমায়? কে কে? ভোলা আর তপা সামনে এসে দাড়ায়।কিরে কি মতলব? এখানে চুরি? তোর সাহস দেখে বলিহারি। আর্ত স্বর চোরের গলায় - না না দাদা। আমি চোর নই। তাহলে তুই কি? এখানে বেড়াতে এসেছিস? তপা হাত চেপে ধরে।বল তুই কি? ভুত? হেসে ওঠে। আজ্ঞে আমি আম পারতে এসে ছিলাম।
তপা হা!হা! করে হেসে ওঠে - শীতকালে আম? কোন দেশে থাকিস তুই? চাঁদু এখানে তো এইসময় আম হয়না। তোদের দেশে হয় বুঝি?
বিশ্বাস করুন দাদা গরিব মানুষ আমরা।
ভোলা বলে - ধরা পরলে আমিও তাই বলি। অন্য কিছু বল। এটা কেউ খাবে না।
- আজ্ঞে, আপনাদের বাগানের অনেক আম, কাঁঠাল, কলা খেয়ে আমাদের পেট ভরে। ঘরে কিছু না থাকলে আপনাদের বাগানে এসেছি আগেও।
ভোলা বলে - তাহলে আগেও এসেছিস বলছিস?
এখন ত আমি আসীনই আপনারা আমাকে টেনে নামিয়েছেন।
তপা রেগে ওঠে – আমাদের বাগানের পাঁচিলে বসে ছিলি কেন? বল তোর পিছনে কে কে আছে?
না বাবু কেউ নেই। বিশ্বাস করুন।
এরপর তোকে বিশ্বাস করার কোন কারণ নেই।
চোর ভোলা আর তপার হাত চেপে ধরে - ছেড়ে দিন দাদা।আর হবেনা। এই কান মলছি নাকে খত দিচ্ছি।চুরি করেই পেট চালাই। তবে আর কোনদিন আপনাদের চত্বরে পা রাখব না।
তপা - এমনিতে তো তোকে ছাড়া যাবেনা। একটু বাজিয়ে দেখি কি বল?
ভোলা - ওত আম খেতে এসেছে এই গরম কালে। আয় চল ওকে গরমে স্নান করাই।
চোর বেচারি আকুল স্বরে চেঁচিয়ে ওঠে - দাদা এত বড় শাস্তি দেবেন না। আপনারা আর যা শাস্তি দেবেন দিন। মাথা পেতে নেব। শুধু ওইটা দেবেন না মরে যাব।
ভোলা হাসতে থাকে - মরে যাবি? মড়া এত সোজা নয় রে। আয় দেখি মরে যাস কিনা?
তপা চোরের হাতটা ধরে টানে। আয় চল চল দেরি হয়ে যাচ্ছে।
কাঁদ কাঁদ স্বরে বলে-আপনাদের পায়ে পড়ি আমাকে ছেড়ে দিন। আমি আসলে শীতকালটা দাদা খুব দরকার না পরলে স্নান করিনা।
বুঝেছি তো-তপা হাসে
জলে আমার ভীষণ ভয়। 
তবেতো তোকে চৌবাচ্চায় চোবাবই। চল, চল।
প্রায় চোখে জল এসে যায় চোরের-আমার এত বড় সর্বনাশটা করবেন না দাদা। জল গায়ে পরলে আমি কেঁপেই মরে যাব। আপনারা খুনের দায়ে পড়বেন।
কিসের দায় সেটা আমরা বুঝব।
চোর হাত জোর করে - আমায় ছেড়ে দিন এমন জানলে আসতাম না।আমি বাড়ী যাব। 
বলিস কি? ভোলা বালতি নিয়ে এগোয়।
এবার একেবারে হাঁটু মুড়ে পায়ে পরে যায় ব্যাটা। নাকে খত দিচ্ছি। আর আসব না দাদা।হাসতে হাসতে ভোলা বলে এইখানে নাকে খত দে দেখি। শেষে দিব্বি কেটে ছাড়া পায় সে।
সে চলে যেতেই ভোলা শুধোয় – ওকে কেউ পাঠায় নি তো? কি বলিস? সব মালপত্র সব জড়ো করা আছে?
তপা হাত ঝেড়ে ঘরের দিকে যেতে যেতে বলে - মনে তো হয়না। আরেকটু জেরা করলে হত। তুই ভাগ্যিস দেখতে পেয়েছিলি নাহলে কি হত কে জানে। গুরুর ঘরটাও খোলা ছিল।আমিও অন্যঘরে ছিলাম। ভোলা নিঃশ্বাস ফেলে যাক বাঁচা গেছে এই যাত্রা। নাহলে গুরুকে মুখ দেখানই ভার হত।
আগের রাতে রুটি আর কষা মাংস খেয়ে শুতে শুতে দেরি হয়েছে। ঘুম ভাঙ্গে মানিকের ধাক্কাধাক্কি আর চিৎকারে - গুরু ওঠ, গুরু ওঠ, সর্বনাশ হয়ে গেছে।
রতন ঘুম ভেঙ্গে ধড়মড় করে উঠে বসে। কি? কি হয়েছে? চেল্লাছিস কেন সাতসকালে?রতন এর মাথা গরম হয়ে যায়। কালু, মানিক দেবীপ্রসাদ, তপা এসে দাঁড়িয়েছে। ভোলা নেই।
মানে? কি বলছিস?
কালু চিৎকার করে ওঠে।ওকে সকাল থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। শালা ওই সপ্তাহের সব রোজগার নিয়ে পগারপার।
মানিক বলে - ভোলা ব্যাটা সব মালপত্র নিয়ে কেটে পড়েছে।
রতনের বিশ্বাসই হতে চাইছে না। কেমন হতচকিত হয়ে পরে। কি বলছিস? কখন থেকে ভোলা নেই? 
মানিক বলে সকালে উঠে তোমার ঘরে এসে দেখি ও নেই। আলমারির দিকে চোখ পরতেই দেখি খোলা।
সম্বিত ফিরে পেয়ে রতন বলে তাড়াতাড়ি যা ষ্টেশনে দ্যাখ ওকে ধরা যায় কিনা। দেবীপ্রসাদ দৌড়ায়। মানিক কালু মাথায় হাত দিয়ে বসে পরে - সারা সপ্তাহের মাল জড়ো করা ছিল।এতগুলো মোবাইল, সোনার হার, টাকা, মানিব্যাগ, ঘড়ি, কানের দুল, কত কিছু সব ওই আলমারিতে ছিল। বিশ্বাসই করা যাচ্ছেনা। কালু এঘর ওঘর পায়চারী করতে করতে বলে - ওকে এত তাড়াতাড়ি বিশ্বাস করা উচিত হয়নি। রাস্তার কুকুর রাস্তায় ফিরে গেছে। একবার কোথাও ওকে পাই, পাই পয়সা বুঝে নেব। রতন গুম হয়ে যায়। দোষটা ওরই। ওর জন্যে সবারই বিরাট ক্ষতি হয়ে গেল। রতনকে সবাই মানে বলে কিছু বলতে পারছেনা।
এমন সময় পাশের ঘর থেকে চিৎকার ভেসে আসে কালুর - গুরু পেয়েছি পেয়েছি। বলতে বলতে একটা পুটুলি নিয়ে ছুটে আসে রতনের ঘরে। ব্যাটা পারেনি নিয়ে পালাতে।
উত্তেজিত মানিক বলে কোথায় পেলি? রতনের মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। 
আরে পাশের ঘরেরে দরজার সামনে পড়ে ছিল। নিশ্চয় তাড়া ছিল বা কেউ আমাদের ঘুম থেকে উঠে পরেছিল তাই তাড়াহুড়োতে ফেলে গেছে, কি মাল মাইরি।
বলে - খুলে দ্যাখ, সব ঠিকঠাক আছে কিনা?
মানিক খুলতে যায়। রতন উদাস ভাবে বলে। দরকার নেই মনেহয় ঠিকই আছে। উত্তেজনায় মানিক মাটিতে উপুড় ফালে সব। মালপত্র সঙ্গে একটা কাগজ। মানিক এগিয়ে দেয় রতনের দিকে।
দাদা,
পারলে অধম কে ক্ষমা করবেন। আমার গুরুদেবকে দেওয়া প্রশিক্ষণ শেষ
করার সময় হয়ে গেছে। এই কাজটুকু ওনাকে দেখিয়ে আমার কাজ শেষ। খাবারে ঘুমের ওষুধ না মেশালে আমি পারতাম না। শেষ ধাপ দেখাতে হত। ডেকে এনে দেখিয়ে দিয়েছি। পাশের ঘরে পুঁটুলিতে সব রেখে গেলাম তাড়াতাড়িতে আলমারিতে রাখা হল না। আপনি বলেছেন হাত আর মাথা দুই লাগে, আমি বলি দরকারে অভিনয়টাও লাগে। পেরেছি কিনা আপনি বলবেন।অনেক কিছু শিখলাম আপনার কাছে। পারলে ক্ষমা করে দেবেন, আপনার অনুগত 
ভোলা।
দেবীপ্রসাদ ফিরে আসে – না, গুরু ষ্টেশনও নেই। রতন চিঠিটা এগিয়ে দেয়।
রতন বন্ধ পুঁটুলির দিকে তাকিয়েই থাকে। আনমনে বলে ওকে আর পাওয়া যাবেনা। মানতেই হবে অভিনয়ে ব্যাটা দারুণ পাকা। একদম পাক্কা বাটপার, দেখে নিস এ লাইনে খুব উন্নতি করবে।

Top

Please mention the "name of the article and the author" you would like to comment in the following box... Thank you.

মতামত
bottom of page