top of page
birds.jpg

ডাঃ সুপ্তেন্দ্রনাথ সর্বাধিকারী

birds.jpg

পলাশ দে

birds.jpg

দীপন জুবেয়ার

Md. Ansu.jpg

মোঃ আসাদুজ্জমান চৌধুরী

হিমাদ্রীর হিমঘরনূপুরের নূপুর । শব্দহীন বিবেকের কঙ্কাল 

birds.jpg

রমেন্দ্রনারায়ণ দে 

birds.jpg

সঞ্চিতা চৌধুরী

birds.jpg

ফয়জল আবদুল্লা 

birds.jpg

পিয়ালী গাঙ্গুলী

birds.jpg

কিশোর ঘোষাল

birds.jpg

আইভি চ্যাটার্জী

দূর্গাবাড়ি । কবি সম্মান

birds.jpg

অমলেন্দু ঠাকুর

birds.jpg

সুরজিৎ মন্ডল

birds.jpg

ইন্দ্রানী ভট্টাচার্য্য

এমন  ও হয়ে যায় । শেষ ইচ্ছে

birds.jpg

অদিতি  ভট্টাচার্য্য

arun-maity.jpg

অরুণ মাইতি 

birds.jpg

মহঃ শামীম মিয়া 

এ মেডেল আমার মায়ের । বুকের ব্যাথা

birds.jpg

সঙ্ঘমিত্রা বসু

birds.jpg

অমিতাভ মৈত্র 

Mijanur Rahman.jpg

মিজানুর রহমান মিজান

birds.jpg

কিরণময় দাস

birds.jpg

অর্ঘ বক্সি

birds.jpg

গৌতম দাস

birds.jpg

সঞ্জীব গোষ্মামী

birds.jpg

ফরিদা  হোসেন

birds.jpg

কোয়েল দত্ত

birds.jpg

সপ্তর্ষি রায়বর্ধন

পথ ভোলা 

birds.jpg

সুব্রত মজুমদার

তিলোত্তমা । আমার দ্বৈত জীবন । প্রেম পত্র

সূচীপত্র
sea5.jpg

গল্প সমগ্র ১

প্রচ্ছদঃ সুরজিৎ সিনহা, হলদিয়া, পঃ বাংলা

ইকো পয়েন্ট

ইকো

পয়েন্ট

বিকাশ ব্যানার্জ্জী

নামটা শুনেই ইন্টার্ভিউ বোর্ডের চেয়ারম্যান চমকে উঠলেন। 'কি নাম যেন বললেন আপনার?।'

'স্যর, সায়ন  চক্রবর্তী - গোল্ড মেডালিস্ট, এম. বি. এ (মার্কেটিং), পুনে বিশ্ববিদ্যালয়।' দ্বিতীয়বারও সেই একই নামটা শোনার পর আশ্বস্ত হলেন যে তিনি কানে ভুল শোনেন নি। 'কিন্তু এ কি করে সম্ভব?', সেই একই নাম, সেই একই পদবী, গায়ের রঙ্গেরও কোন তফাত নেই, সেই একই বুদ্ধিদীপ্ত চাহনি আর সেই একই মিষ্টি হাসি, তার সব যেন কেমন গোলমাল হয়ে যেতে লাগল। হঠাৎ করে দৃষ্টি গেল দেওয়ালে টাঙ্গানো ক্যালেন্ডারের দিকে। কি আশ্চর্যজনক ব্যাপার, তারিখটাও সেই একই ৬ই আগস্ট হিরোশিমা দিবস। এই সব সাদৃশ্য কি নেহাতই কাকতালীয়? নাকি তা অন্য কিছু ইঙ্গিত বহন করছে? আজ থেকে বাইশ বছর আগে, ঠিক আজকের দিনেই, রাগের মাথায় তিনি নিজের হাতে তার পুরানো বন্ধু সায়ন চক্রবর্তীকে খাদে ফেলে খতম করে দিয়েছিলেন। তাহলে, সেই সায়ন চক্রবর্তী আবার এখানে ফিরে এলো কোথা থেকে? এই সমস্ত কথা ভাবতে ভাবতেই পাঁচতারা হোটেলের শীততাপ নিয়ন্ত্রিত চেম্বারে বসেও ঘামতে শুরু করলেন ওমেগা ফারমাসিউটিক্যলস লিমিটেড এর জোনাল সেলস ম্যানেজার প্রবাল ঘোষ দস্তিদার। পকেট থেকে রুমাল বের করে তিনি নিজের কপালের ঘাম মুছতে শুরু করলেন।

তার চোখের সামনে ভেসে উঠল বাইশ বছর আগের খান্ডালার ইকো পয়েন্টের সেই দৃশ্য। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য এম. বি. এ. পাশ করে তিনি ভাগ্যের সন্ধানে নবী মুম্বাইয়ে হাজির হন। নবী মুম্বাইয়ের বেলাপুরে তিনি একটা ওষুধের কোম্পানিতে চাকরি পেয়ে যান। কয়েক মাস চাকরি করার পর, ছুটির দিনে অফিসের বন্ধুদের সাথে বম্বের জুহু বিচ বেড়াতে গিয়ে তার একদিন হঠাৎ দেখা হয়ে গেল তার কলেজের পুরানো বন্ধু, মেধাবী ছাত্র সায়ন চক্রবর্তীর সাথে। কলেজ থেকে পাশ করার পর অনেক পুরানো বন্ধুর সাথেই প্রবালের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। তবে পুরানো বন্ধুদের মজা একটাই, দূরে যাওয়াও যেমন সহজ, কাছে আসাটা তার চেয়েও বেশি সহজ। নিজের পুরানো বন্ধুর সাথে জুহু বিচে বসে উইলস ফিল্টার সিগারেটে সুখ টান দিতে দিতে প্রবাল জানতে পারল যে তার পুরানো বন্ধু সায়ন এম.এস.সি পাশ করার পর আই. আই. টি. বম্বে থেকে পলিমার কেমিস্ট্রি নিয়ে পি. এইচ. ডি. করেছে। সিগারেট শেষ করে সমুদ্র সৈকতের ঠাণ্ডা হাওয়ায় দুই বন্ধু মিলে ভেলপুরি খেতে থাকল। সায়ন জানাল যে পি. এইচ. ডি. করার পর এখন সে পুনের ন্যাশনাল কেমিক্যাল ল্যাবরেটরিতে সায়েন্টিস্টের চাকরি করে। কথাগুলো শুনেই প্রবাল মনে মনে ভাবল, আমাদের দেশে বেকার সমস্যা যতই ভয়াবহ হোক না কেন, এই দেশে মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের চাকরির কোন অভাব নেই। ভেলপুরি খাওয়া শেষ হওয়ার পর সায়ন তাকে নেমন্তন্ন করল – 'প্রবাল আগামী  শনিবার - রবিবার তুই কি করছিস রে? আমার পুনের ফ্ল্যাটে চলে আয় না, দুটো দিন ধরে দুই বন্ধু মিলে চুটিয়ে আড্ডা মারব'। প্রবাল প্রথমে কিছুটা ইতস্তত: করতে থাকায় মুচকি হেসে সায়ন বলল - 'তোর জন্য কিন্তু আমার পুনের ফ্ল্যাটে একটা বিরাট বড় চমক অপেক্ষা করছে রে'।

প্রবাসে বাঙালি মানেই নিজের লোক, পরম-আত্মীয়।কলেজের পুরানো বন্ধুর সাথে ছুটির দুটো সুখের দিন কাটানোর লোভে প্রবাল শনিবার ভোরের বাসে চেপে সায়নের পুনের ফ্ল্যাটের উদ্দেশে রওনা দিল। এদিকে সায়ন যথা সময়ে পুনের শিবাজী নগর বাস স্ট্যান্ডে তার নতুন চেরি রেড রঙের মারুতি গাড়ি নিয়ে হাজির হল। এ. সি. কারে চেপে ঠাণ্ডা হাওয়ায় কার - স্টিরিওতে গান শুনতে মিনিট পনেরোর মধ্যেই প্রবাল বন্ধুর পুনের ফ্ল্যাটে হাজির হল। সায়নের ফ্ল্যাটের দরজার কলিং বেল বাজাতেই, মিলল সাঙ্ঘাতিক চমক, মেরুন রঙ্গের সালওয়ার কামিজ পরে গালে একমুখ হাসি নিয়ে ফ্ল্যাটের দরজা খুলতে এসেছে সায়নের স্ত্রী। তাদেরই কলেজের পুরানো বান্ধবী, পরমা সুন্দরী সাগরিকা। বন্ধুর ফ্ল্যাটের নরম সোফায় বসে ঠাণ্ডা পানীয়র গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে কলেজের সোনালী দিনগুলো প্রবালের চোখের সামনে ভাসতে লাগল। সাগরিকা শুধু পরমা সুন্দরীই নয়, তার মিষ্টি গলার জন্য পুরো কলেজে সে 'কোকিল-কণ্ঠী' বলে সুপরিচিত ছিল। ভগবানের এমনই বিচিত্র লীলা যে এই দুনিয়াতে সাধারণত: গায়ক গায়িকাদের চেহারা সুন্দর হয় না, কিন্তু সাগরিকার বেলায় এই নিয়মেরও ব্যতিক্রম ঘটেছে। টানা টানা চোখ, দুধে আলতা গোলা গায়ের রঙ, মিষ্টি হাসি সবকিছু মিলিয়ে সাগরিকা ছিল কলেজের সব ছেলেদের কাছে স্বপ্ন সুন্দরী। রূপসী সাগরিকাকে যে কলেজে কত ছেলে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছেল তার কোন হিসেব নেই। সায়ন কলেজের সেই স্বপ্ন সুন্দরীকে শেষে নিজের বউ হিসেবে পেল, ব্যাটা সত্যিই ভাগ্যবান, তাকে হিংসা না করে পারা যায় না। প্রবালের কাছে গিয়ে মুচকি হেসে সায়ন বলল - 'কিরে তোকে বলেছিলাম না চমকে দেব।' স্নান সেরে দুপুরে দুই বন্ধু মিলে একসাথে ডাইনিং টেবিলে খেতে বসলেন। তাদের দুজনকে হেসে হেসে সাগরিকা খাবার পরিবেশন করতে থাকল। সে তার নিজের হাতেই আজকের সব পদ রেঁধেছে - মাটন বিরিয়ানি, বুন্দি রাইতা, চিংড়ি মাছের মালাইকারি, নারগিসি কোফতা আর খাবার শেষে রয়েছে নলেন গুড়ের পায়েস। সাগরিকার শুধু গলায় জাদু নেই, তার হাতেও যে জাদু রয়েছে। সে ব্যাপারে প্রবালের আর কোন সন্দেহ রইল না। কথায় বলে – 'কোন পুরুষ মানুষের হৃদয়ে পৌঁছানোর সবচেয়ে সহজ রাস্তা হল তার পেট  দিয়ে।' প্রবাল মনে মনে ভাবতে লাগল যে এমন সর্বগুণ সম্পন্না নারীর প্রেমে পড়বে না, এমন সাধ্য বোধহয় এ জগতে কারও নেই। খাওয়া দাওয়া শেষ হওয়ার পর সবাই মিলে জমিয়ে আড্ডার আসর বসাল।চলতে থাকল হাসাহাসি, অন্তাক্ষরী, সায়নের আবৃতির আসর। সাগরিকাও অসাধারণ সুন্দর দুটো রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনাল গোপন কথাটি রবে না গোপনে' এবং 'আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ'। কিভাবে যে পুরো দিনটা কেটে গেল, তা টেরই পাওয়া গেল না। রাত্রিবেলায় খাওয়ার টেবিলে বসে সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল যে আগামীকাল রবিবার অর্থাৎ ৬ই আগস্ট সায়নের নতুন কারে করে সবাই মিলে লোনাভালা, খান্ডালা হিল স্টেশন বেড়াতে যাওয়া হবে। দেওয়ালের ক্যালেন্ডারের দিকে চোখ পড়তেই সাগরিকা হেসে উঠল – 'হিরোশিমা দিবসের দিনে আমরা সবাই বেড়াতে যাচ্ছি, কোন বোমা না ফাটলেই হল।' কলেজের দিনগুলো থেকেই সায়নের ছিল ফটোগ্রাফির সাঙ্ঘাতিক নেশা। পাহাড়, নদী,

ঝর্ণা, ফুল, পাখি, প্রজাপতি - সব কিছুই প্রাণবন্ত হয়ে উঠত তার ক্যামেরার লেন্সের জাদুতে। কথা মতো পরের দিন ভোরবেলায় সবাই মিলে সায়নের কারে করে লোনাভালা খান্ডালার উদ্দেশ্যে রওনা দিল। খান্ডালার রাজামাচি গার্ডেনে পৌঁছে সায়ন মেতে গেল তার নতুন ক্যানন এস. এল. আর ক্যামেরায় ফটো তুলতে। আগস্ট মাসের বর্ষায় বৃষ্টির ধারা সহ্যাদ্রি পর্বত বেয়ে নীচে নেমে সুন্দর জলপ্রপাতের আকার ধারণ করেছে। যেদিকেই চোখ যায় সেই দিকেই কেবল সবুজের সমারোহ। বৃষ্টির জলে ভিজে গাছের পাতাগুলো সবুজ পান্নার মত চকচক করছে। এই রকম অনাবিল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যে নিজেকে পেয়ে প্রকৃতি প্রেমিক সায়ন আনন্দে আত্মহারা, তার খুশির সীমা নেই। মনের আনন্দে গাছপালা, ফুল, পাখি, অর্কিডের ছবি তুলতে লাগল সায়ন। এদিকে সায়ন যখন ছবি তুলতে ব্যস্ত, তখন নিজের মনে গুনগুন করে গান জুড়ে দিল সাগরিকা। তার মিষ্টি গান শুনতে শুনতে প্রবালের কলেজের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেল। সাগরিকার প্রতি প্রবালের দুর্বলতা সেই কলেজের দিন থেকেই, কিন্তু সাহস করে নিজের মনের কথা কোনদিন সে সাগরিকাকে বলতে পারে নি। অনেকক্ষণ ধরে ছবি তুলে ক্লান্ত হয়ে সায়ন অবশেষে গরম গরম কফি আর বাটার কর্ণ কিনে আনতে  রাস্তার ওপারের দোকানে চলে গেল। কিছুটা সময়ের জন্য সাগরিকাকে কাছে একা পেয়ে তাকে নিজের পুরানো দুর্বলতার কথা সাহস করে প্রবাল জানিয়ে ফেলল। সাগরিকার নরম হাত ধরে বলে ফেলল প্রবাল - 'সাগরিকা তোমাকে আমার ভীষণ ভালো লাগে। সেই কলেজের দিনগুলো থেকেই আমি তোমার প্রেমে পাগল'। কথাগুলো শোনা মাত্রই এক ঝটকায় নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে প্রবালকে ভৎসনা করল সাগরিকা – 'তোমার লজ্জা করে না প্রবাল নিজের বন্ধুর স্ত্রীকে খারাপ নজরে দেখতে? ছিঃ, ছিঃ, তোমার শরীরে যদি মানুষের চামড়া থেকে থাকে তাহলে তুমি কোথাও গিয়ে ডুবে মরো'। সাগরিকার এমন সাঙ্ঘাতিক অপমানজনক কড়া কথা শুনে রাগে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে যায় প্রবাল। সাগরিকার প্রতিটি শব্দ তার বুকে তীরের মতো আঘাত করল। তবে প্রবাল এত সহজে ছেড়ে দেবার পাত্র  নয়, এই অপমানের প্রতিশোধ সে নিয়েই ছাড়বে, দৃঢ়  প্রতিজ্ঞা নিল সে।

খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ করে সায়নের কার এবার ছুটল খান্ডালার ইকো পয়েন্টের উদ্দেশে। পুরো ঘটনাটা ঘটে যাওয়ার পরে, কারের মধ্যে পরিবেশ একেবারেই থমথমে।প্রবাল আর সাগরিকা দুজনেই মুখ গোমড়া করে চুপচাপ বসে আছে। পুরো ঘটনাটা সম্বন্ধে অজ্ঞ সায়ন নীরবতা ভঙ্গ করল - 'কি ব্যাপার, তোমরা দুজনেই এমন গম্ভীর মুখ করে বসে আছ কেন? এত থমথমে পরিবেশ, ব্যাপারটা কি?' গম্ভীরভাবে উত্তর দিল সাগরিকা – 'কিছু হয় নি।' ইকো পয়েন্টে পৌঁছানোর পর সাগরিকা মনমরা হয়ে একটা বেঞ্চে চুপ করে একাকিনী বসে থাকল আর শিশুর মতো সরল সায়ন আবার মেতে গেল তার ফটো তোলার নেশায়। রসায়নের ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও সব গাছপালা, অর্কিডের বোটানিক্যাল নাম তার ঠোঁটস্থ। প্রবাল মনে মনে স্বীকার করল যে সায়নের মেধা আর প্রজ্ঞার প্রশংসা না করে কোন উপায় নেই। তার এই সাঙ্ঘাতিক প্রতিভার জোরেই সায়ন আজ সে জীবনে উচ্চ প্রতিষ্ঠিত, আর সেই জন্যই সাগরিকার মতো সর্বগুণ সম্পন্না নারী আজ তার স্ত্রী। এই সমস্ত কথা ভাবতে ভাবতেই প্রবালের মাথাটা গরম হয়ে গেল। হঠাৎ তার চোখে পড়ল ইকো পয়েন্টের রেলিঙের এক দিকটা ভাঙ্গা আর সেই জায়গাটার ঠিক নিচেই রয়েছে ভয়ানক খাদ। বৃষ্টির জলে ভিজে সেই রেলিঙের দিকে যাওয়ার রাস্তাটায় হাল্কা কাদা আর শ্যাওলা জমে গেছে, আর সেই রাস্তাটা হয়ে উঠেছে ভয়ানক পিছল। মুহূর্তের মধ্যে প্রবালের মাথায় খেলে গেল শয়তানি বুদ্ধি।

সায়নকে একা পাশে পেয়ে প্রবাল বলল - 'সায়ন, ওই রেলিঙের দিকটাতে গেলে নিচের উপত্যকার তুই খুব ভাল ভিউ পাবি। দারুণ ফটো আসবে কিন্তু'। আপন ভোলা সায়ন বন্ধুর কথায় অন্ধ বিশ্বাস করে সেই দিকটায় চলে গেল। ভাঙ্গা রেলিঙটার কাছে গিয়ে, সায়ন নীচের উপত্যকার সৌন্দর্যের ছবি তুলতে মেতে গেল। প্রবাল চারদিকটা একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিল। জায়গাটা একেবারে জনশূন্য। সায়ন যখন নিজের মনে ক্যামেরার ফোকাস ঠিক করতে ব্যস্ত, সেই সময় প্রবাল পেছন থেকে তাকে সজোরে ধাক্কা মেরে নিচের খাদে ফেলে দিল। 'বাঁচাও, বাঁচাও' - চিৎকার করতে করতে সায়ন কয়েক হাজার ফুটের নিচের খাদে পড়ে গেল। তার চিৎকার শুনে বেঞ্চ থেকে সাগরিকা দৌড়ে এল, কিন্তু ততক্ষণে সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। অসহায় সাগরিকা গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে থাকল - 'সায়ন, সায়ন'। আকাশ বাতাস ভেদ করে তার সেই হৃদয় বিদারক চিৎকার সহ্যাদ্রি পর্বতমালার গায়ে ধাক্কা খেয়ে প্রতিধ্বনিত হতে থাকল - 'সায়ন ... সায়ন ... সায়ন ... সায়ন ... সায়ন ... সায়ন।'

সাগরিকার সেই চিৎকার আজও প্রবালের কানে ভাসছে। ইকো পয়েন্টের সেই ভয়ানক স্মৃতি কোনদিনই প্রবাল ভুলতে পারবে না। আজ তাই ইন্টার্ভিউ চলাকালীন পুরানো বন্ধু সায়ন চক্রবর্তীর নামটা শুনেই তার খান্ডালার সেই ভয়ানক স্মৃতি  মনে পড়ে যায়। তার মনটা পৌঁছে গেছিল বাইশ বছর আগের খান্ডালায়। নিজের  পাশের চেয়ারে বসা ম্যানেজার উৎপলবাবুর বাঁজখাই গলার আওয়াজে হঠাৎ করে তার সম্বিৎ ফিরে এল। ইন্টারভিউ তখনো চলেছে, উৎপলবাবু একের পর এক প্রশ্ন করে চলেছেন সায়ন চক্রবর্তী নামের বাইশ বছরের সেই তরুণ যুবককে – 'আপনার সার্টিফিকেটগুলোই বলে দিচ্ছে যে আপনি মেধাবী ছাত্র। আচ্ছা, আপনি  বলতে পারেন কি বিপণনের বীজ মন্ত্র কি?' মুহূর্তের মধ্যেই সঠিক উত্তর দিল সেই মেধাবী ছাত্র - 'আগে নিজেকে বিক্রি কর, তারপরে নিজের পণ্যকে বিক্রয় কর'। তরুণ যুবকটি হাসিমুখে একের পর সঠিক উত্তর দিয়ে চলেছে। তার অনন্য সাধারণ মেধার দ্বারা ইন্টার্ভিউ বোর্ডের সকলকেই সে চমকে দিল। যুবকটির অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা ও মেধা দেখে প্রবালের প্রতি মুহূর্তেই নিজের পুরানো বন্ধু সায়নের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। তার চটপট সঠিক উত্তর দেওয়ার ক্ষমতা দেখে ম্যানেজার উৎপলবাবু উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠে বলেন – 'সায়ন বাবু, আপনাকে অভিনন্দন জানাই। আপনার মতো মেধাবী ছাত্রকে নিয়োগ করতে পেরে আমরা সকলেই আনন্দিত।' প্রবাল নিজের মনে শুধু বিড়বিড় করতে থাকল - 'তাহলে কি সায়নই পুনর্জন্ম নিয়ে আবার এখানে ফিরে এল নাকি?' এই সব সাতপাঁচ কথা ভাবতে ভাবতে প্রবাল নিজের মাথা চুলকোতে লাগল।

Comments

Top

প্রাণের বান্ধব

প্রাণের

বান্ধব 

বিকাশ ব্যানার্জ্জী 

'পোঁ-ঘড়াঙ্গ-ঘং-ধক-ধডাশ-পোঁ' - বিকট কর্কশ আওয়াজ করতে করতে একটা কয়লা বোঝই মালগাড়ী অতি মন্থর গতিতে অন্ডাল রেল ষ্টেশন অতিক্রম করে চলেছে। ষ্টেশনের ঠিক পাশেই অবস্থিত রেল কলোনি। রেল ষ্টেশনের মাইকের প্রতিটি ঘোষণাই কলোনির বাসিন্দারা নিজেদের কোয়ার্টার থেকে পরিষ্কার ভাবে শুনতে পান।তবে সেই ঘোষণা না শুনতে পেলেও তারা সঠিকভাবে বলে দিতে পারেন যে কোন ট্রেন ষ্টেশন অতিক্রম করছে। সব ট্রেনেরই নাম আর নম্বর তাদের সকলেরই মুখস্থ, ট্রেন তাদের জীবনের এক অপরিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এই রেল কলোনির ঠিক মাঝখানেই অবস্থিত একটা বিরাট বড় মাঠ, আর সেই মাঠের পাশেই রয়েছে গোটা পনেরো ছোট্ট সিঙ্গেল রুমের রেলের কোয়াটার। এই কোয়ার্টারেই থাকে রেলের গ্যাংম্যান বুধন মাহাতো। গ্রীষ্মকালের প্রখর রৌদ্রে তার শরীর তেতে পুড়ে যায়, বর্ষাকালে বৃষ্টির জলে তার গোটা শরীর ভিজে যায়। সারা বছর ধরেই ভারী, ভারী ওজন নিজের কাঁধের ওপর রেখে, রেল-লাইনের ওপর দিয়ে রোজ বিশ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে যায়। তবে সাঙ্ঘাতিক পরিশ্রমী এই রেল কর্মচারীর নিজের পাড়ায়  কেবল একটাই পরিচয় 'মাতাল বুধন'। কোলিয়ারির কাছাকাছি অবস্থিত বলে অন্ডালে প্রতি বছরই সাংঘাতিক গরম পড়ে। গ্রীষ্মের দাবদাহ সহ্য করতে না পেরে রেল কলোনির বাসিন্দারা প্রতিদিন সন্ধেবেলায় এই বড় মাঠেই  বসে থাকে। 'এর আগে কখনো এত সাঙ্ঘাতিক গরম এখানে পড়ে নি' – এই কথা বলতে বলতে রাত্রের স্নান সেরে গায়ে পাউডার লাগিয়ে মাঠে এসে বসলেন রেলের টি. টি. ই জনার্দনদা। তাঁর কথায় সায় জানাল কেবিন ম্যান মুকুল দাস - 'দাদা, আপনি ঠিকই বলেছেন। এই প্রচণ্ড গরমে আর নিজেদের ঘরে বসে থাকতে পারা যাচ্ছে না। এ বছর, একদিনের জন্যও কালবৈশাখীর দেখা নেই। বর্ষা যে কবে নামবে তা শুধু ভগবানই জানে।' গলদঘর্ম হয়ে হাঁসফাঁশ করতে থাকেন গার্ড নীহারবাবু - 'একটু যে গায়ের ঘামগুলো শুকোবে সেই সুযোগটুকুও নেই, গাছের একটা পাতাও কোথাও নড়ছে না রে বাবা।' গরমের গল্পে যখন সবাই মশগুল, সেই সময় হঠাৎ মাঠের পাশে অবস্থিত বুধনের বাড়ী থেকে হুংকার শোনা গেল। 'কারো বাপের ধার ধারি না, নিজের মেহনতের পয়সায় মদ খাই, তোর যদি না পোষায়, তাহলে তুই আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যা' – এই বলে নিজের স্ত্রী জয়াকে অশ্রাব্য গালাগালি দিতে শুরু করল মাতাল বুধন। মদ খেয়ে গালাগালি, চিৎকার, চেঁচামেচি করা বুধনের নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। প্রতিদিনই মদ খেয়ে এসে সে নিজের বাড়িতে অশান্তি করে। কলোনির পরিবেশ কলুষিত করছে বলে তার ওপরে পাড়ার সকলেই প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত। বহুদিন ধরেই কলোনির তাকে সকলে মিলে এই ব্যাপারে বুঝিয়ে চলেছে, কিন্তু তাদের সব প্রচেষ্টাই নিষ্ফল হয়ে গেছে। নিজেকে শোধরানো তো দুরের কথা, বুধনের মাতলামি যেন ইদানীং সব মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছিল। মাঠে বসে সকলে মিলে যখন বুধনের মাতলামি নিয়ে আলোচনা করছিল, এমন সময় তার স্ত্রী জয়ার কান্নার আওয়াজ শোনা গেল। 'আমাকে বাঁচাও গো, মেরে ফেলবে গো।' রাতের অন্ধকারেই বুধন নিজের বউকে মারতে মারতে বাড়ির থেকে বের করে দিচ্ছে, এই দৃশ্য নিজেদের চোখের সামনে দেখে সকলেরই মাথা গরম হয়ে গেল। রাগের মাথায় উপস্থিত জনতা গর্জন করতে থাকল। 'অনেক দিন ধরেই তোর অত্যাচার আমরা সহ্য করে চলেছি, কিন্তু আজ আমাদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেছে। - 'আজ তোরই একদিন নয় তো আমাদেরই একদিন' এই বলে সকলে মিলে বুধনকে দু-চার হাত লাগিয়ে দিল। প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণে মদ খেয়ে বুধনের শরীরের শক্তি বহুদিন আগেই নিঃশেষিত হয়ে গেছে। গণধোলাই খেয়ে টাল সামলাতে না পেরে, সে পাড়ার খোলা নোংরা ড্রেনে পড়ে যায়। মদ্যপ অবস্থায় ড্রেনে পড়ে গিয়ে,সেখান থেকে বেরিয়ে আসার ক্ষমতাও সে হারিয়ে ফেলেছে। হাউহাউ করে অসহায় ভাবে সে শিশুর মতন কাঁদতে থাকল - 'আমাকে ছেড়ে দাও গো, মরে যাবো গো,আমাকে বাঁচাও গো।'

স্বামীর করুণ আর্তনাদ শুনে জয়ার রাগ অভিমান মুহূর্তের মধ্যে কর্পূরের মতো উধাও হয়ে গেল। প্রাণপণ চেষ্টা করে সে নিজের দু-হাত দিয়ে নিজের স্বামীকে টেনে ড্রেন থেকে বের করে আনল। ড্রেনে পড়ে যাওয়ার পর, বুধনের গোটা গায়ে নোংরা পচা কাদাজল লেগে রয়েছে, আর তার ঠোঁটের কোণা দিয়ে রক্ত ঝরে পড়ছে। পায়ে চোট লাগার জন্য সে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে থাকে। নিজের স্বামীর এই রকম অসহায় অবস্থা দেখে জয়া চিৎকার করতে থাকে – 'আমার স্বামী, আমাকে মেরেছে, তা বেশ করেছে। কিন্তু তাই বলে এই অসুস্থ মানুষটাকে জানোয়ারের মতন মারতে, তোমাদের এতটুকু বিবেকে বাঁধল না গো?' এই বলে হাউ-হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে জয়া নিজের মাতাল স্বামীকে ধরে ধরে নিজেদের ঘরের ভেতরে নিয়ে গেল। মাতাল স্বামীর প্রতি জয়ার এই ধরণের অদ্ভুত ভালোবাসা দেখে পাড়ার সকলেই স্তম্ভিত হল। মহানায়ক উত্তমকুমারের অন্ধ ভক্ত জনার্দনদা গুনগুন করে নিজের মনে গান জুড়ে দিলেন - 'নারী চরিত্র বেজায় জটিল, কিছুই বুঝতে পারবে না, এরা কোন ল মানে না, তাই এদের নাম ললনা।' এ বছর বৃষ্টি নামার কোন লক্ষণই নেই, প্রতিদিন গ্রীষ্মের প্রখরতা বেড়েই চলেছে। গ্রীষ্মের প্রকোপ বৃদ্ধির সাথে সাথেই রেল কলোনিতে লোডশেডিং আর জলকষ্টের সমস্যা বাড়তে থাকল। সাঙ্ঘাতিক গরমে লোকদের প্রাণান্তকর অবস্থা হয়ে

উঠল। গ্রীষ্মের দাবদাহ থেকে পরিত্রাণ পাবার জন্য পাড়ার বাসিন্দারা মনস্থির করলেন বৃষ্টির সমবেত প্রার্থনা করে পাড়ায় চব্বিশ প্রহর হরিনাম সংকীর্তনের আয়োজন করা হবে। সেই মতো পাড়ার ক্লাবের ছেলেরা চাঁদা তুলে রেল কলোনিতে হরিনামের আয়োজন করল। আকাশ বাতাস মুখরিত হল 'জয় গৌর-নিতাই, জয় রাধা মাধব' ধ্বনিতে। পাড়ার সকলের সাথে সাথে মাতাল বুধনও হরিনাম সংকীর্তনে মেতে গেল। সে নিজের হাতে চায়ের কেটলি নিয়ে কীর্তন দলের লোকজনকে চা পরিবেশন করতে লাগল। গরম গরম চা খাওয়ানোর পর বুধন তাদের কাছে আবদার করল- 'ঠাকুর, তোমরা হলে গিয়ে গুণীজন। তোমাদের গান শুনে আমারও সবাইকে নাম গান শোনাতে ইচ্ছে করছে। তোমরা কিন্তু আমার গানের সাথে একটু বাজনা বাজিও গো।' সন্ধ্যাবেলায় স্নান সেরে নতুন ঘিয়ে রঙের পাঞ্জাবী পড়ে কপালে চন্দনের তিলক কেটে হাজির হল বুধন। মঞ্চে উঠে, উপস্থিত সকল শ্রোতাদের নমস্কার করে বুধন গান ধরল - 'ভজো গৌরাঙ্গ, কহ গৌরাঙ্গ, লহ গৌরাঙ্গের নাম রে, যে জনা গৌরাঙ্গ ভজে, সে হয় আমার প্রাণ রে।' বুধনের গানের মিষ্টি গলা শুনে সকলেই অবাক, মাতাল বুধনও যে এত সুন্দর গান গাইতে পারে, কলোনির কারোরই তা জানা ছিল না। পাড়ার জনার্দনদার স্ত্রী মাধবী বরাবরের ঠোঁট কাটা। বুধনের গান শেষ হবার পর,  তিনি তাকে জিজ্ঞেস করে ফেললেন - 'বুধনদা, আপনার যখন ভগবানের নাম গান এতই ভাল লাগে, তাহলে আপনি রোজ এত মদ খান কেন?' তার কড়া কথা শুনে বুধনের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল - 'বৌমা, আমি  কি  আর  শখ  করে  মদ খাই গো? উনিশ বছরের একমাত্র মেয়েটা চারদিনের জ্বরে দুনিয়া ছেড়ে চলে গেল, ওপরওয়ালার কি অদ্ভুত বিচার দেখ, তাই নিজের সব দুঃখ, যন্ত্রণা ভুলে থাকার জন্যই আমি রোজ মদ খাই।' বুধনের কথাগুলো শুনে উপস্থিত সকলের মনটা উদাস হয়ে গেল। সারাজীবন ধরে শুধু একের পর এক দুঃখ পাবার জন্যই কিছু মানুষ বোধহয় এই পৃথিবীতে জন্ম নেয়। সংসারে সুখের মুখ দেখবার সৌভাগ্য তাদের কোনদিনই হয় না। বুধনের সংসারে প্রতিদিনই অশান্তি  লেগে থাকত। নিজের মেয়ে হারানোর শোকে বুধনের স্ত্রী জয়া সবসময়  মনমরা  হয়ে থাকত। পাড়ার লোকদের সাথে সে খুব একটা বেশি কথা বলত না। নিজের দুঃখকে সে নিজের বুকের মধ্যেই লুকিয়ে রাখত। একদিন রাত ডিউটি সেরে বুধন যখন নিজের বাড়িতে ফিরল,সে নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারল না। সে দেখল তার ঘরের মেঝেতে জয়ার নিষ্প্রাণ দেহ পড়ে রয়েছে।রাত্রিবেলায় ঘুমোতে ঘুমোতেই জয়ার হৃদযন্ত্র চিরকালের মতো স্তব্ধ হয়ে গেছে। বুধনের বুকফাটা কান্নার আওয়াজে একে একে পাড়ার সব লোকজন জড় হয়ে যায়। তার ছোট্ট কোয়ার্টারে পাড়া প্রতিবেশীদের ভিড় জমে যায়। পাড়ার সবাই মিলে জয়ার নিষ্প্রাণ দেহ বুধনের ঘরের উঠোনে নামিয়ে রাখে। কলোনির এয়ো স্ত্রী-রা তার পার্থিব শরীরের পাশে ধুপ জ্বালিয়ে দিয়ে। তারা জয়ার সিঁথিতে লাল রঙ্গের সিন্দূর দিয়ে তার পায়ে আলতা লাগিয়ে দেয়। বুধনের দুঃখের কথা ভেবে পাড়ার সকলেরই চোখ ছলছল করতে থাকল। হঠাৎ সবার লক্ষ্য হল, বুধন তার নিজের বাড়ি থেকে গায়েব হয়ে গেছে। তখন সবাই মিলে তার খোঁজ চালাতে লাগল, কিন্তু আশেপাশের কোথাও তার দেখা মিলল না। এদিকে বেলা বাড়ছে, পাড়ার ক্লাবের ছেলেরা মৃতদেহ সৎকারের জন্য তাড়াহুড়ো করতে লাগল। কেবল বুধনের জন্যই সেই কাজ আটকে আছে বলতে থাকল সবাই। ধীরে ধীরে সকলের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যেতে থাকল আর মাতাল বুধনের ওপর সবাই রাগারাগি করতে থাকল।

পাড়ার সব বাসিন্দারা যখন তার ওপরে ভয়ানকভাবে বিরক্ত, সেই সময়ে নিজের দু-চোখ জবা ফুলের মতো লাল করে আকণ্ঠ মদ খেয়ে টলতে টলতে বুধন নিজের কোয়ার্টারে হাজির হল। বহুদিন আগেই ভগবান তার কাছ থেকে তার একমাত্র মেয়েকে কেড়ে নিয়েছিল। আজ সেই ভগবানই তার তেইশ বছরের পুরানো সাথী জয়াকে তার থেকে আবার ছিনিয়ে নিল। এত বড় পৃথিবীতে আজ বুধন একেবারে একা হয়ে পড়ল। টলবল করতে করতে জয়ার মরদেহর পাশে গেল বুধন। তার মাথায় নিজের হাত রেখে তাকে শেষবারের মতো প্রাণভরে আশীর্বাদ করল বুধন। সে উপলব্ধি করতে পারল যে সারা জীবন জয়াকে কোন সুখই দিতে পারে নি। অতীতের প্রতিটি ঘটনা তার চোখের সামনের ভেসে উঠল। তার মনে পড়ে গেল প্রতিদিন মদ্যপ অবস্থায় বাড়ি ফিরে এসে নিজের স্ত্রীকে সে কত অশ্রাব্য গালাগালি দিয়েছে। কতবার যে সে তার গায়ে সে হাত তুলেছে তার কোন হিসেব নেই। হাজার বার অপমান করা সত্ত্বেও, কিন্তু জয়া তার প্রচণ্ড খেয়াল রাখত। তার হয়ে সে পাড়ার সকলের সাথে ঝগড়া করত। জয়ার ভালোবাসার দাম সে কোনদিনই দিতে পারে নি। এই হৃদয়হীন, নিষ্ঠুর সমাজে আর কার জন্যই বা সে বেঁচে থাকবে। এই কথা ভাবতে ভাবতে, সাথীহারা বুধন হাউ-হাউ করে কাঁদতে লাগল। আকাশের দিকে ওপরে তাকিয়ে অদৃশ্য ওপরওয়ালার উদ্দেশে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বুধন গান জুড়ে দিল - 'প্রাণের বান্ধব রে, দাও দেখা দয়া করে।' মাতাল বুধনের দুঃখে দেখে সকলের প্রাণ কেঁদে উঠল। জয়ার মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে 'বল হরি হরিবোল' ধ্বনি দিয়ে, রাস্তায় খই ছড়াতে ছড়াতে, মন্থর গতিতে ক্লাবের ছেলেরা শ্মশানের উদ্দেশ্যে এগিয়ে চলল।

Comments

Top

গড্ডল

গড্ডল

কিশোর ঘোষাল

  -  'তোমার নামটা কি যেন হে?'

-  'মন্টু, আজ্ঞে, মন্টু মাজি।'

- 'জেরক্সটা করে আনলে আর অরিজিনালটা কোথায় হারালে, য়্যাঁ। এক নম্বরের গাড়ল তুমি একটি। যাও, শিগগির খুঁজে নিয়ে এস। যত্তোসব।'

সক্কাল সক্কাল ঝাড় খেয়ে গোলগাপ্পি মুখ করে ছোট সায়েবের চেম্বার থেকে বের হল মন্টু।

ব্যাপারটা হয়েছিল কি, জেরক্স টেরক্স সাধারণত বিকাশ করায়, সে আসেনি এখনও। এদিকে ছোট সায়েব চলে এসেছেন অন্য দিনের চেয়ে তাড়াতাড়ি। এসেই ছোট সায়েবের জেরক্স দরকার, অগত্যা মন্টু গিয়েছিল জেরক্স করাতে, দোকানেই ফেলে এসেছে অরিজিনালটা আর কপি সায়েবকে জমা করতে গিয়েই বিপত্তি।

বাঁধা দোকান অসুবিধা হবে না। মন্টু দৌড়ে গেল আবার দোকানে। শ্যামল ছিল দোকানে তাকে ব্যাপারটা বলতে মেশিনের ঢাকনা খুলে অরিজিনালটা ফেরত দিল। চলেই আসছিল মন্টু, কি মনে হতে শ্যামলকে জিগ্যেস করল – 'শ্যামলদা, গাড়ল মানে কি বলো তো, জানো?'

মন্টুদের আপিসের সঙ্গে মাসকাবারি খাতা সিস্টেমে তার কাজ চলে। পুরোটাই ধারে, এ মাসের টাকা পেতে পেতে পরের মাসের শেষ। তাও আবার কমিসন দিতে হয় বিকাশকে, কপিতে দশ পয়সা। আজ বউনি হবার আগেই মন্টু এসে জেরক্স করাতে তার মেজাজ বিগড়েই ছিল। তার ওপর ওই প্রশ্ন শুনে তেলে বেগুনে চটে উঠল শ্যামল - 'দ্যাখ মন্টু, বাড়াবাড়ির একটা সীমা আছে। তোদের সঙ্গে খাতা চালাই বলে, যখন তখন আসবি আবার যা খুশী বলবি?' ব্যাপারটা সুবিধের নয় বলে মন্টু আমতা আমতা করে কেটে পড়ে তৎক্ষণাৎ।

বাড়ি থেকে ছটায় সাইকেলে বেরিয়ে ছটা সাতাশের শেয়ালদা লোকাল ধরে মন্টু বালিগঞ্জ স্টেশনে পৌঁছয় সাতটা পনের নাগাদ। সেখান থেকে আপিস অব্দি হেঁটে আসতে আরও মিনিট কুড়ির ধাক্কা। এদিকে নটা থেকে আপিস শুরু। তার আগে বড়, মেজ, ছোট তিন সায়েবের চেম্বার, রিসেপশন ছাড়াও সবার চেয়ার, টেবিল, মনিটার, কি-বোর্ড, মাউস, ফোনের হাতল পরিষ্কার করা, সবার টেবিলে পুরোনো জল পালটে নতুন জল ভরে বোতল রাখা , হাজার কাজ। এর মধ্যে ঝাড়ুদার আসে ঘর, টয়লেট সাফ করতে, তার আবার একটু হাতটান আছে। নজর না রাখলেই গায়েব হয়ে যায় ছোট খাটো জিনিষপত্র। এসব সেরে পৌনে নটার মধ্যে চায়ের জল চাপাতেই হবে। তাও দুজায়গায়, একটা ছোট সসপ্যানে বড় তিন সায়েবের জন্যে আর অন্যটা ঢাউস সসপ্যানে বাকি সবার জন্যে। দুরকমের চায়েরও কোয়ালিটি আছে ‘ইস্পেসাল’ আর চালু। নটা বাজার পাঁচ সাত মিনিট আগে থেকে নটা পনের বিশ অব্দি সবাই চলে আসে। ওই সময়টায় মন্টু মড়ারও সময় পায় না। সবার পছন্দমতো হরেক রকমের চায়ের সাপ্লাই, চিনি ছাড়া, কড়া চিনি, ফিকা চিনি, লিকার চা, লিম্বু চা। ভুল চা দিয়ে ফেললেই আবার ঝাড়।

সেদিন সাড়ে নটা নাগাদ একটু ফাঁক পেয়ে এক কাপ কড়া চিনি চা নিয়ে মন্টু ভাবতে বসল সকালের ঘটনাটা নিয়ে। ছোট সায়েব এই মাসখানেক হল এসেছে। সব সময়েই যেন চড়ে থাকে, খুব কড়া মেজাজ। অথচ ওঁনার ঘরের এসিটাই সবচেয়ে জোর চলে, একবার ঢুকলেই কেমন যেন শীত ধরে যায়। কিন্তু পান থেকে চুন খসলেই মাথা একদম গরম। সাত ঝামেলার মধ্যে ‘অরজিনাল’ পেপারটা না হয় ভুলেই এসেছিল, তা বলে সক্কাল সক্কাল ওভাবে ঝাড়তে হবে? গাড়ল বলতে হবে? গাড়ল। এই শব্দটা মন্টুকে বহুবার শুনতে হয়েছে ছোটবেলা থেকে। আজকে ছোট সায়েব বলাতে মনে পড়ে যাচ্ছে সব। সিক্সে প্রথম ইংরিজি শেখার সময় মহিমবাবু এক ‘কেলাস’ ছেলের সামনে তাকে গাড়ল বলেছিলেন। গলায় গলায় বন্ধু নন্দকে ‘টিপিন’ ঘন্টায় মন্টু গাড়ল মানে জিগ্যেস করাতে নন্দ পাত্তা দেয়নি। পরের দিন এক ফাঁকে তাদের কেলাসের ‘ফাস্ট’ বয় রাজুকে জিগ্যেস করাতে ফিচেল হেসে উত্তর দিয়েছিল – 'গাড়ল মানে মন্টু মাজি।'

দু-দুবার চেষ্টা করেও সিক্স থেকে সেভেন উঠতে পারল না মন্টু, ইংরিজি আর অংকের যুগপৎ বজ্জাতিতে। গ্রিল কারখানার ওয়েল্ডার মন্টুর বাবা নিমাই মাজি একদিন তার মাকে ডেকে বলল – 'গাড়লটার নেকাপড়া কিসু হবে নি, কাল আমি ওরে নে যাব, হৃদয়বাবুকে বলা আছে। কম সে কম গিরিল বানানোটা শিখুক।' হৃদয়বাবু বাবার গ্রিল কারখানার মালিক।

নয় নয় করেও মাস ছয় সাত গ্রিল কারখানায় কাজ শিখতে চেষ্টার কসুর করে নি মন্টু। বার দশেক হাতে পায়ে ছ্যাঁকা খেল।ওয়েল্ডিং আর গ্যাস কাটিং করা গরম লোহার টুকরোর ওপর হয় দাঁড়িয়ে পড়ে, নয় তো হাত দিয়ে খামচে ধরতে গিয়ে। শেষের দিন ওয়েল্ডিং মেসিনের কানেকসনে হাত দিয়ে চেক করতে গিয়েছিল মেসিনে কারেন্ট আসছে কিনা। কারেন্ট ছিল এবং সেটা সবাই হাড়ে হাড়ে টের পেল, যখন মন্টু এক ঝটকায় চিৎপাৎ হল। বেশ কিছুক্ষণ টোটকা চিকিৎসায় চোখ ওলটানো মন্টু উঠে বসল। ধরাধরি করে সবাই অফিস ঘরে নিয়ে গিয়ে পাখার তলায় বসিয়ে দিল মন্টুকে। সামনেই ভোলাদার চায়ের দোকান থেকে এক গ্লাস গরম দুধও চলে এল মন্টুর সেবায়।মন্টুর দুধের গ্লাস যখন হাফ, হৃদয়বাবু সবাইকে বললেন 

কাজে যেতে। ঘরে রইল শুধু মন্টু আর তার বাবা নিমাই মাজি। গম্ভীর গলায় হৃদয়বাবু বললেন -

'নিমাই, তুমি এখন বাড়ি যাও মন্টুকে নিয়ে। আর কালকে

তোমার ছেলেকে আর এন না বাপু, কবে কোনদিন কি ঘটিয়ে বসবে। হাতে হ্যারিকেন হয়ে, ব্যবসা আমার লাটে উঠবে।'' না, না, বাবু, আপনি ঠিক কয়েচেন, এই কান মলতেসি, ওরে কাল থিকে আর আনব নি। তবে বাবু, কি যে করি ওটারে লিয়ে, একদম হাবা গবা, গাড়ল একখান। না শিখল নেকাপড়া না শিখল হাতের কাজ।' মুখ কাঁচুমাচু করে নিমাই মাজি দাঁড়িয়ে থাকে।

'ও নিয়ে ভেব না নিমাই, একটা কিছু হয়ে যাবে ঠিক। তুমি ওকে  নিয়ে  ঘরে  যাও  এখন। মন্টুর একটু রেস্ট দরকার।'

সেদিন রিকশ করে বাপের সাথে ঘরে ফিরেছিল মন্টু। ঘরে ফিরে মা খানিক হাউমাউ করেছিল, বাবাকে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল – 'ওই সব্বনেশে গিরিলের কারখানায় কচি ছেলেকে কেউ নে যায়? তোমার যেমন বুদ্ধি। কাল থিকে ও আর যাবে নি। কক্‌খনো যাবে নি আর।' বাবা কিছু বলে নি, বেরিয়ে গিয়েছিল বাড়ি থেকে।

গায়ে মাথায় মায়ের হাত বোলানোর আরামে মন্টু ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম ভাঙল শাঁখের আওয়াজে। প্রদীপ দেখিয়ে, ধূপ জ্বেলে, শাঁখ বাজিয়ে মা ঘরে এসে মন্টুকে জেগে ওঠা দেখে খুশি হল খুব। বিছানায় বসে মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল -

'কেমন বুজচিস বাবা, বল পাচ্চিস শরীলে?' মন্টু ঘাড় নেড়ে সায় দেয়।

'খিদে পেয়েচে, মুড়ি খাবি?' মন্টু আবার ঘাড় নেড়ে সায় দেয়। মা বিছানা থেকে নেমে ও ঘরে যাচ্ছিল, মন্টু ক্ষীণ স্বরে ডাকে -

'মা, শোন।' মা কাছে আসে।

'কি হয়েছে, বাবা?'। মন্টু মায়ের একটা হাত ধরে বলে - 'গাড়ল মানে কি, মা?'

'তোরে গাড়ল বলেচে? কে বলেচে? যে বলেচে সে নিজেই একটা গাড়ল।' বলে মা রেগে দুম দুম করে পা ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় মুড়ি আনতে।

হৃদয়বাবু হৃদয়হীন নন, সোজা সাপটা ভোলাভালা মন্টুকে তিনি পছন্দই করতেন। ছেলেটার বুদ্ধিসুদ্ধি কম। তা হোক, খাটিয়ে এবং বিশ্বাসী। এটুকু তিনি লক্ষ্য করেছিলেন। যে আপিসে এখন মন্টু কাজ করে, তারা ঘর বাড়ি তৈরির কাজ করে। এদের সঙ্গে হৃদয়বাবুর অনেকদিনের লেনদেন ও ব্যবসা। সেই সূত্রেই হৃদয়বাবু মন্টুকে ঢুকিয়ে দেন এই আপিসে। সেও প্রায় আজ বছর পাঁচেক হল। এর পরে আরও একবার গাড়ল কথাটা শুনতে হয়েছিল একদম অচেনা লোকের থেকে। বছর খানেক আগে আপিসে আসার সময় ঢাকুরিয়ার আগে ট্রেনটা মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে গেল। সামনে অবরোধ, ট্রেন আর যাবে না। কখন অবরোধ উঠবে কে জানে। মন্টু ট্রেন ছেড়ে বড় রাস্তায় এসে বাসে চেপে পড়েছিল আপিসে দেরী হয়ে যাবার ভয়ে। গড়িয়াহাটের মোড়ে চলন্ত বাস থেকে লাফ দিয়েছিল উলটো মুখ করে। পড়তে পড়তেও সামলে গিয়েছিল মন্টু, কিন্তু কানে এসেছিল বাস কন্ডাক্টারের মন্তব্যটা – 'দ্যাখ, দ্যাখ, আরেকটু হলে মরত গাড়লটা।' মন্টু সবার টেবিল থেকে এঁটো চায়ের কাপগুলো নিয়ে আসে। সিঙ্কে কল খুলে কাপ প্লেট ধুতে ধুতে ভাবে গাড়ল

মানে সত্যিই কি মন্টু মাজি?

কাপপ্লেট ধোয়াধুয়ি শেষ হবার আগেই বিকাশ এসে বলল -

- 'সকাল সকাল শ্যামলদাকে, কি বলেচিস, তুই?'

- 'কই সেরকম কিছু বলিনা তো'

– 'গাড়ল না কি বলেচিস যে? যা, এবার সরকারবাবু কেমন দেয়, দ্যাখ।'

এই অফিসের পত্তনের সময় থেকে সরকারবাবু আজ প্রায় বছর বিশেক একই সিংহাসনে সমাসীন। শুরুর দিন থেকে কোম্পানীর লাভ ক্ষতি, সাদা কালোর হিসেব তার হাতে। কোন সায়েব কোন ফুলে তুষ্ট হয়, তার হাল হকিকত নখের ডগায়। যে যতো বড় অফিসারই হোক না কেন, তাঁর মাতব্বরি মানতেই হবে। সরকারবাবুকে বিগড়ে দিলে বড় সায়েবদের কান ভাঙানি দিয়ে অতিষ্ঠ করে তুলবে যে কোন কলিগের জীবন। কাজেই সরকারবাবুকে সমঝে চলে না এমন কেউ নেই এই অফিসে।কাজেই বিকাশের কথায় মন্টুর শরীরটা কেমন ঠাণ্ডা হয়ে এল। এক পেট জল গিলে নিল জলের জগ উল্টে। তবুও গলার শুকনো ভাবটা কাটল না। মিয়োনো মুড়ির মত মন্টু গিয়ে দাঁড়াল সরকারবাবুর টেবিলের সামনে। শ্যামলদা দাঁড়ানো ওদিকের কোনটা ঘেঁষে, চুপচাপ মাথা গোঁজ করে। গলা ঝেড়ে সরকারবাবু সিনেমায় দেখা পাক্কা জজসায়েবি চাল মেরে বলতে শুরু করল - 'মন্টু, আজ সকালে জেরক্স করাতে গিয়ে শ্যামলকে তুমি কি বলেচ?'

সরকারবাবু অন্য সময় মন্টুকে তুই বলে, এখন তুমি বলছে মানে কেস গড়বড়, এটা মন্টু আগেও লক্ষ্য করেছে।

- 'আজ্ঞে খারাপ তো কিচু বলি না।' মন্টু শুকনো মিহি গলায় বলে।

- 'সকাল সকাল যেচে পড়ে আমায় গাড়ল বলিস নি?' শ্যামল খেঁকিয়ে ওঠে।

- 'আঃ, শ্যামল, অফিসের মধ্যে চেঁচামেচি আমি ভালবাসি না। তোমায় তো বললাম আমি দেকচি। খারাপ বলনি, তার মানে শ্যামল বাজে কথা বলচে?' শেষ কথাটা মন্টুকে বললেন সরকারবাবু।- 'আজ্ঞে, তা না।' মন্টুর মিনমিনে উত্তর। 'আসলে আমি... মানে... গাড়ল মানে কি, জান তি ... শ্যামলদাকে ...।'- 'গাড়লের মানে? তার মানে?' সরকারবাবু তাঁর চাকরি জীবনে অনেক থানা পুলিশ কোর্ট কাছারির এঁড়ে সওয়াল 

ম্যানেজ করেছেন, কিন্তু এমন প্রশ্নে তিনিও হতবাক। কিছুটা ধাতস্থ হয়ে জিগ্যেস করলেন,

- 'তা তোমার গাড়লের মানে হঠাৎ এমন জরুরি হয়ে উঠল কেন?'

খুব করুণ মুখে করে মন্টু আজ সকালের পুরো ইতিহাসটা ঘোষণা করল, সবার সামনে। শ্যামলদা খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে উঠল সব শুনে। মন্টুর ওই হাসি দেখে শেয়ালের কথা মনে পড়ল। তাদের বাড়ির পিছনে বাঁশঝাড়ে আছে একপাল। রাত্রে ঝোপেঝাড়ে টর্চ জ্বাললে, মাঝে মাঝে অবিকল ওই ভাবে ধেয়ে আসে, অবিকল ওই আওয়াজ, ওইরকম দাঁত, কোন ফারাক নেই। হাসছিল সবাই। মন্টু ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল হলে প্রায় সকলেই হাসছে, তার মানে সবাই শুনেছে সব কথা। এই সাবর্জনীন অপমানটা মন্টুরও গায়ে লাগে। সরকারবাবু হাসে নি, কিন্তু চোখে মুখে হাসির পরতটা বোঝা যাছিল। গম্ভীর মুখোসটা মুখে লেগে থাকা সত্ত্বেও। সরকারবাবু বললেন - 'ঠিক আছে এখন যা'। আস্তে আস্তে হল থেকে বেরিয়ে আসে মন্টু, মাথা নীচু করে। এই অপমানের মধ্যেও একটা ব্যাপারে সে নিশ্চিন্ত হয় চাকরিটা এখনই যাচ্ছে না। সরকারবাবু তাকে আবার আগের মতোই ‘তুই’ বলেছেন। বিকাশের কোন কাজ নেই? বসে বসে ‘প্রতিদিন’ পড়ছিল। ওটা রোজ দে-সায়েব নিয়ে আসেন। তার মানে দে-সায়েব চলে এসেছেন, বিনা চিনি লিকার চা। দে-সায়েবের চায়ের জল বসাল মন্টু।

দে-সায়েবও সরকারবাবুর মতো আদ্যিকাল থেকে আছে এই অফিসে। বড়ো সায়েবদের স্টেনো টাইপিস্ট। আলাদা খুপরি, গৌরবে চেম্বার। আগে ছিল টরেটক্কা টাইপ মেসিন, পরে ইলেক্ট্রনিক্‌স্‌। সে সব পাট উঠে গেছে বেশ ক’বছর। বাক্স বাজানো বন্ধ হয়ে কম্পিউটার চলে এসেছে। ইংরিজিতে দখল আর টাইপিংয়ের স্পিডের জন্যে আগে বড় সায়েবদের প্রিয় ছিলেন। এখন এক ছোঁড়া অরুণ এসেছে এই বছর পাঁচেক হল। কম্পিউটার জানে কিন্তু ইংরিজি শিখেছে ক্লাস সিক্স থেকে। ড্রাফট বানিয়ে দে-সায়েবের থেকে মেরামত করে নেয় ইংরিজিটা। দে-সায়েব আর অরুণ একে অপরের পরিপূরক হয়ে টিকে আছে কোন মতে।

অফিসের সময় নটা হলেও দে-সায়েব কদাচ সাড়ে দশটার আগে ঢোকেন না। মন্টু চা নিয়ে দে-সায়েবের ঘরে ঢুকল প্রায় এগারোটায়।

-'কিরে, তোকে নিয়ে কি মহাসভা চলছিল শুনলাম। তুইও কিছু ঘাপলা করেছিস না কি?'

আস্তে আস্তে ফুঁ মেরে আর লম্বা আওয়াজে টান দিয়ে চা পানের অভ্যাস। ভীষণ ধীর স্থিরভাবে সব কাজ করেন দে-সায়েব। এমনকি চোখের পাতা ফেলতেও বেশ সময় নেন তিনি। প্রতিটি কথা মুখ থেকে নামানোর আগে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পরখ করে নেন। মন্টুকে নিরুত্তর দেখে আবার বললেন 'যাক এতদিনে তুই মানুষ হলি বলতে হবে।'

'কেন, এর আগে কি সিলাম, গাড়ল?'

মন্টুর এ হেন কথায় দে-সায়েবের মতো নাচমকানো লোকও একটু থমকে গেলেন। চা পান থামিয়ে চোখ তুলে বললেন - 'কি ব্যাপারটা রে, আজ তোরও মেজাজ মনে হচ্ছে চড়া? কি হয়েছে কি?'

- 'ঘাপলা যদি করতি পারতুন তো আজ এই অপমানটা সহ্যি করতি হত না। আমি গাড়ল কিনা, সকলে তাই শুনায় ঘুরায়ে ফিরায়ে'। দে-সায়েব মৃদু হাসেন – 'অ্যাই, আমার কাছে ঝাল ঝাড়ছিস কেন, যদি ক্ষমতা থাকে যে বলেছে তাকে বলগে, যা সেখানে তো মেনিমুখো।'   

দে-সায়েব নির্ঝঞ্ঝাটে মানুষ, সাতে পাঁচে থাকেন না। থাকার উপায়ও নেই। কারণ এই অফিসে আজকাল তাঁকে আর প্রয়োজন নেই। দীর্ঘদিন ভাল কাজ করার সুবাদে, আজও তাঁকে পোষা হচ্ছে নিছক চক্ষু লজ্জার খাতিরে। যে কোনদিন অফিস বলতেই পারে, দরজা খোলা আছে হে, কেটে পড় ফুল অ্যান্ড ফাইন্যাল নিয়ে। তাঁর যা এলেম এই শেষ বয়সে অন্য কোথাও আর কিছু হবারও নয়।

অফিসে এই দে-সায়েবের সঙ্গেই মন্টুর যা দু-চারটে মনের কথা হয়। সেই অধিকারেই মন্টু একটু ঝাঁজ দেখিয়ে ফেলেছিল। দে-সায়েবের কথায় একটু লজ্জা পায়।

'সকাল থিকে আমারে লিয়ে যা চলতিসে...'

'সেটাই তো জিগ্যেস করছি, কি হয়েছে কি?'

মন্টু সব কথাই সবিস্তারে বলে দে-সায়েবকে। বলে আর কিছু না হোক হাল্কা হয় মনে মনে। সব শুনে টুনে দে সায়েব বেশ কিছুক্ষণ গুম মেরে থাকে। মন্টু একটু অপেক্ষা করে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। সোয়া এগারোটা বেজে গেছে, আরেক রাউন্ড চা না পেলে আবার হাল্লা শুরু করবে। অফিসের লোকগুলোর দশা দেখে মনে হয়, চা নয় যেন বেঁচে থাকার দাওয়াই নিচ্ছে। না পেলে হেদিয়ে টেঁশে যাবে।সকলের চা সাপ্লাই করে মন্টু দে সায়েবের জন্যে এক কাপ বিনা চিনি কফি নিয়ে ঢোকে। বড় সায়েবদের জন্যে কফি রাখা থাকে। কখনো সখনো সায়েবরা খায়, আর সরকারবাবু আর দে সায়েবের ইচ্ছে হলে। বাকি কেউ অ্যালাউড নয়।

- 'তখন চা টা রাগের মাথায় বানাইসিলাম, ঠিক হয় নি হবে। এখন এট্টু কফি খান, স্যার। আর বলেন দিকি গাড়ল কথাটা কি?' কফিতে একটা লম্বা চুমুক দিয়ে দে-সায়েব বললেন - 'মানে জেনে কি করবি? ধর আমি বললাম গাড়ল মানে খুব খারাপ কিছু। কি করবি?' মন্টুর দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করেন। মন্টু ইতস্ততঃ করে বলে,

- 'তা, সত্যি বটে। কিছুই করতে পারব নি। শুনেও চুপচাপ হজম করতিই হবে। মানেটা সত্যি কি খুব খারাপ, স্যার?'

- 'না, না, তা নয়। আসলে গাড়ল মানে ভেড়া। তার মানে বোকাসোকা, নিরীহ, ভিড়ের মধ্যে একাকার। আলাদা করে চেনা যায় না। একদম সাধারণ। কিছু বুঝলি? আমরা সবাই। তুই, আমি, এ অফিসে, বাসে ট্রামে ট্রেনে। রাস্তাঘাটে, চলার পথে। আমরা সবাই সাধারণ। আমরা সকলেই একে অন্যকে নিজের ধান্দা মত, সুবিধে মত গাড়ল বানাই, আবার প্রায়ই গাড়ল বনি।'

কফির কাপটা শেষ করে মন্টুর হাতে খালি কাপ প্লেট দিলেন দে-সায়েব, বললেন - 'মানে তো বললাম, কি কদ্দূর বুঝলি, তুইই জানিস। মানেটা জেনেই বা তোর কটা হাত পা গজাল আর কি করবি কে জানে'।

- 'আজ্ঞে, সকলের এঁটো কাপপ্লেটগুলো নে এসে ধুই গিয়ে, আপনের আজ কি টিপিন আনব বলে দে, ওদিকে আবার সায়েবরা কি বলে দেখি।'

Comments

Top

দণ্ডিতের

সাথে

ডাঃ সুপ্তেন্দ্রনাথ সর্বাধিকারী

স্বাস্থ্যকেন্দ্রের বা হেলথ সার্ভিসের ডাক্তারকে যে রোগী অজ্ঞান করা থেকে মড়া কাটা অবধি সবকিছুই করতে হয় সেটা তো বনফুল একাধিক গল্পে বাংলা সাহিত্যপ্রেমীদের জানিয়েছেন এবং সেই অভিজ্ঞতার ভাগ পেয়ে আমরাও ধন্য হয়েছি। আবার ডাক্তারের সামনে জমিদার এবং দরিদ্রতম প্রজাও সমান কাতরতা নিয়ে উপস্থিত হন| অন্যদিকে আবার পুলিশ তথা বিচারব্যবস্থার সঙ্গেও ডাক্তারদের একইরকম দহরম মহরম। সুতরাং ন্যায় অন্যায় প্রাণদান প্রাণনাশের ক্ষমতা যাদের আছে তাদের দৃষ্টিভঙ্গিরও কিছু মিল তো থাকতেই পারে।

এই গল্প একজন বিচারকের। ধরুন আমিই সেই ডাক্তার যে প্রায় বছর সাতেক আগে পোস্ট মর্টেম করেছিল এক ভদ্রমহিলার। তাতে মৃত্যু পরবর্তী পোড়া ছাড়া আর বিশেষ কিছুই পাইনি আমি। এতদিনে মামলা উঠেছে আদালতে - অগত্যা সাক্ষী দিতে গেছি কোর্টে।

পৌঁছে শুনি জজ সাহেব শুনানি মুলতুবি রেখেছেন - এবং একান্তে আমার সাক্ষাতপ্রার্থী। বুঝলাম "ডাল মে কুছ কালা"। সাধারণত সাক্ষ্য দেবার পরে জজ নিভৃতে ডাকলে কাটিয়ে দেওয়া যায় - কাজ আছে বলে - সই সাবুদ পরে হবে। কিন্তু এখনো আমার সাক্ষ্য দেওয়া হয়নি তাই আদালত ছেড়ে যাবার কোনো উপায় নেই। ভাবলাম উনি যাই বলুন না কেন আমি আমার মতেই দৃঢ় থাকব।

ঘরে ঢুকতেই আমায় সাদর অভ্যর্থনা করলেন জজ সাহেব। "দেখুন ডাক্তারবাবু, আপনাকে প্রভাবিত করতে ডাকিনি, তবে আমার মনে হয় যে আপনার পুরো কেসটা জানা দরকার। আমি যা জানি এবং ভেবেছি সবই আপনাকে বলছি - তারপরে আপনি যা ভালো বুঝবেন তাই করবেন।"

"আমায় যা বলার অনুমতি দেবেন আদালতে তার বেশি তো বলতে পারবনা, তাছাড়া যাই বলিনা কেন আপনি তো তার গুরুত্ব নাও দিতে পারেন।" 

"ঘটনাটা বছর সাতেক আগেকার। ভদ্রমহিলার ডেড বডি পাওয়া গেছলো ওনার বাড়ি থেকে মাইল তিনেক দুরে, আশেপাশে কেরোসিনের টিন বা দেশলাই বাক্স কিছুই ছিল না। যদি ধরেও নেওয়া যায় আত্মহত্যা, ভদ্রমহিলা নিশ্চয়ই গায়ে আগুন লাগিয়ে তিন মাইল যাননি! আর এও নয় যে গায়ে কেরোসিন ঢেলে তিন মাইল গিয়ে তারপরে গায়ে আগুন ধরিয়েছেন। এছাড়াও কয়েকজন পড়শী সেই রাতে ওই ভদ্রমহিলা আর তার স্বামীর মধ্যে তুমুল ঝগড়ার আওয়াজ পেয়েছিলেন। সবচেয়ে বড় কথা হলো যে ওনাদের আট বছরের ছেলে আর পাঁচ বছরের মেয়ে ওই ঘটনার সাক্ষী যে ওদের বাবা ওদের মাকে গলা টিপে মেরে ফেলে গায়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। এবং এই ঘটনার তারা লিখিত জবানবন্দিও দিয়েছে।" 

“তাহলে তো এটা একটা Open and shut case”।

"সেক্ষেত্রে আপনায় ডাকতাম না। সাত বছর বাদে এখন ছেলেটার বয়েস পনেরো আর মেয়েটার বয়েস বারো। ওরা দুজনেই জবানবন্দী অস্বীকার করছে আর বলছে যে তখন বাচ্চা ছিল তাই না বুঝেই সই করে দিয়েছে। আর প্রতিবেশীরা বলছেন যে পুলিশ ওদের ভয় দেখিয়ে ওদের থেকে জবানবন্দী আদায় করেছে।"

"তাহলে আপনি কি করতে চান?"   

"আমি জানি লোকটা খুন করেছে - আর ফাঁসির হুকুম দিতে পারি। ছেলেমেয়েরা এখন অস্বীকার করছে সম্ভবত ভয়ে - যদি বাবা ওদেরও মেরে ফেলে, অথবা, মাকে তো হারিয়েছ - আর বাবাকেও হারাতে চায় না। এবারে ভাবুন যদি ওদের বাবার ফাঁসি বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়, ওরা কিন্তু একেবারেই ভেসে যাবে - হয়তো অ্যান্টিসোস্যাল নয়তো ভিখিরী হবে - দুটো তাজা জীবন নষ্ট হবে অথচ যে গেছে সে তো আর ফিরে আসবেনা। আর যদি দৃষ্টান্ত হিসেবে ফাঁসির রায় দিই, আপনি কি মনে করেন যে অন্যরা তাই দেখে ভয় পাবে বা শিখবে? কখনোই না! ভাববে যে ও ম্যানেজ করতে পারেনি তাই ফেঁসে গেছে - আমি ঠিক বেরিয়ে যাব! হাঁ একটা বাজে জিনিস নিশ্চয়ই হবে, লোকটা ভাববে যে জজটাকে কেমন বুদ্ধু বানালাম! কিন্তু আশা করা যাই যে বাচ্চা দুটো অন্তত সিকিওর্ড লাইফ পাবে এবং নিশ্চয়ই সুনাগরিক হবে।"

ভদ্রলোককে দেখে আমার মনে হলো কথাগুলো আন্তরিক - অন্য কোনভাবে প্রভাবিত হয়ে ওপর চালাকি করছেন না।বললাম "উকিলবাবু যদি জিজ্ঞেস করেন উনি পুড়ে মারা গেছেন কিনা - আমার উত্তর না-ই হবে - আর যদি জানতে চান যে গলা টিপে মারা হয়েছে কিনা সেটাও আমার পক্ষে বলা সম্ভব হবেনা। যদি সম্ভাবনার কথা উকিলবাবু জিজ্ঞেস করেন তাহলে আমাকে বলতেই হবে যা যা কারণ হতে পারে - সুতরাং আপনি ওই প্রশ্নে objection sustain করতে পারেন।" Circumstantial evidence-এর ব্যাপারে তো আমার কিছুই বলার নেই। তাই আপনি যতটুকু জানতে চাইবেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে তার চেয়ে বেশি আমি কিছুই বলবনা। তারপরে তো সব আপনারই হাতে।” 

"অনেক ধন্যবাদ ডাক্তারবাবু। মুশকিল কি জানেন, এই কথা কারো সঙ্গে আলোচনাও করতে পারব না - ভুল বোঝার সম্ভাবনাও আছে অথচ রায় দেওয়ার আগে সবদিক ভালোভাবে দেখতে হয়। বাইরে আসামির উকিল বাহবা ও মোটা ফিজ নেবে - বলবে কেমন দারুণ কেস সাজিয়েছি - একদম বেকসুর খালাস!"

ফেরার পথে ভাবছিলাম তাহলে শুধু আমরাই জীবন রক্ষা করি না।

Comments

Top

নির্বাসন

নির্বাসন

মিজানুর রহমান মিজান

বিশ্বনাথ, সিলেট, বাংলাদেশ

টিপ দিন না - এত বিলম্ব কিসের? বলে সাজ্জাদ সাহেব বাঁ হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি ছেপে ধরে কার্বন পেপারে ঘষে মেডিকেল কার্ডে ছাপ দেন।

অনিচ্ছা সত্ত্বেও শুধু দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে রহিম সাহেব আঙ্গুলটি মুক্ত করে নেন। তাকে খুবই চিন্তিত মনে হয়। কারণ এ মুহূর্তে কেহই সহজে বিশ্বাস করবে না এল.এল.বি পরীক্ষার্থী রহিম সাহেব ডিম্বাকৃতি টিপ সহি দিয়ে সবেমাত্র বিদেশ ভ্রমণের ছাড়পত্র পেলেন।

অর্থ! এ নাট্য শালায় অর্থের জন্য মানুষ কি না করছে, মা হয়ে কোলের শিশুটিকে টাকার বিনিময়ে অন্যের হাতে সমর্পণ, পিতা-পুত্র সম্পর্কচ্ছেদ, নব দম্পতির বিচ্ছেদ। শুধুমাত্র অর্থের লোভেই এ সমস্ত ঘটনার সূচনা। কিন্তু সব ক্ষেত্রেই যে অর্থের লোভ তা নয়। কখন ও কখন ও এর ব্যতিক্রম পরিলক্ষিত হয়। ব্যতিক্রমটি প্রশমিত হয়ে পড়ে যারা চাষা-ভুষা, দীনহীন, সহায়-সম্বল হারা। সমাজে যারা প্রতিষ্ঠিত (সব নয়), যাদের অর্থ আছে তারা অর্থের জাদুকরী প্রভাবে ফেলে গোটা পৃথিবীটাকেই যেন লাটিম বানিয়ে খেলছেন। আমি কাউকে কটাক্ষ বা হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে বলছি না। যা সত্যি তা বলছি। কারণ সমাজে রুই, কাতলা আর অর্থের টানা পোড়নে আমরা সংকীর্ণতার এমন স্তরে এসে পৌঁছেছি, অর্থের প্রভাবে সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে¦ তেমন করে সুর ধরে বাজে না। আমরা যেন দর্জির ফিতার মাপে কাট ছাট করা মানুষ। রহিম সাহেব আমারই একজন বন্ধু, বাল্য সহচর। তিনির সুখ-দু:খ, সবটাই আমার নখ দর্পণে। যে দিন রহিম সাহেব আমার হাত ধরে কেঁদেছিলেন ,সে দিন আমার আবেগ প্রবণতা, অশ্রুকে ধরে রাখতে পারিনি। মনের অজান্তে নয়ন অশ্রু ভারাক্রান্ত। মাথাটা চক্কর শুরু করে। সবকিছু যেন ঝাপসা হয়ে যায় ঘটনার আকস্মিতায়।

মেট্রিক পাশ করেই হন্যে হয়ে ঘুরে একটা চাকুরী সংগ্রহ করতে পারেননি। এদিকে নাইট কলেজে ক্লাস করে বি.এ পাশ করেছেন। যেখানেই দেখেছেন, শুনেছেন আবেদন করতে কাল বিলম্ব করেননি। তথাপি চাকুরী পাওয়া তার পলেমঘ মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছাত্র হিসাবে ও তিনি মন্দ নন। যেহেতু একবার বৃত্তি পেয়েছেন সরকারী। চাকুরীর ব্যাপারে বর্তমানে একটু হতাশা, বিতৃষ্ণা ভাব জন্ম নিয়েছে।একদিন প্রতিবেশী এক ভদ্রলোক তাকে ডেকে বললেন – এই যে রহিম সাহেব লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু একটা চাকুরীতে জয়েন্ট করলে আপনার আট সদস্যের পরিবারে কষ্টের একটু লাঘব হত। চাকুরী না করলে আজ হয়ত একাহারি দিনাতিবাহিত হচেছ। কয়দিন পর সর্ষে ফুল দেখবেন। তবে আমার মামার অধীনে কোন চাকুরী নেই। এ প্রত্যাশা করো না। আমার চাকুরীর ব্যাপারে মামাকে অনেক কাঠখড় পোহাতে হয়েছে। শুনেছি অন্য একজনকে বাদ দিয়ে আমার দফারফা। মামা ঊর্ধ্ব¦তন কর্মকর্তা থাকায় রক্ষা।

মানুষ অল্প দু:খ বা আঘাত পেলে বিমর্ষ, নীরবতায় ভোগে। তার অধিক হলে কান্নাকাটি করে। কিন্তু অত্যধিক চাপে নিথর পাথর বনে যায়। তাই যে কোন ঘটনা অনেক ক্ষেত্রে রসিকতায় গুরু থেকে লঘু করার প্রয়াসে মনকে প্রবোধ বা সান্ত্বনার প্রচেষ্টা চালায়। এমনি রহিমসাহেব মনের শক্ত বোঝা লাঘবের উদ্দেশ্যে প্রতি উত্তর স্বরূপ বলেন চাকুরী করে কাকে খাওয়াব, চাকুরীর প্রয়োজনই বা কি? আরো কি যেন বলতে গিয়ে থেমে যান।

ভদ্রলোক এবার জোঁকের মত মাংসের সাথে মিশে যাবার উপক্রম। আরে রহিমসাহেব- এখন ও বিবাহ করেননি। আপনি যে পিতা-মাতা, ভাই-বোনকে একটু আদর, লালন পালন করবেন তা সহজেই অনুমেয়। ভাবী স্ত্রীর ভরণ পোষণের জন্য দেখছি এখন থেকেই নিমগ্ন। তাইত আমার ছেলেকে স্কুলেই দেই নাই। লেখাপড়া শিখে ছেলে মেয়েরা অমানুষ হয়ে যায়। ভুলে যায় জনক-জননীর কথা। শেষ পর্যন্ত ভদ্রলোক রহিম সাহেবের পিতা মাতার কাছে এ কথা ব্যক্ত করে ক্ষান্ত হন। প্রত্যেক জনক জননী তাঁর সন্তান সম্পর্কে অবগত। হোক সে সাদা-কালো, ভাল-মন্দ। সুতরাং রহিম সাহেব যে মাতাপিতার একান্ত বাধ্য সন্তান, অনুগত তা নূতন করে কেউ বলতে হবে না। তারাই ভাল জানেন রহিমের চাল-চলন, আচার-আচরণ আরো দশজন। অন্য দশটি সন্তানের চেয়ে তিনি অনেক অনেক উর্ধেব। তাই তারা অতি সহজে ঘটনাটি আঁচ করতে দ্বিধাবোধ করেননি, এ যে রহিমের প্রলাপ। তবে দু:খ হয় শুধু ভদ্রলোকের ব্যবহারে। হয়ত তিনি কথার মর্মার্থ বুঝতে পারেননি বা বুঝার চেষ্টা ও করেননি। কিন্তু পিতার কাছে ব্যক্ত করায় কতটুকু উপকৃত হয়েছেন, কত পার্সেন্ট মুনাফা লাভে বা সুনাম অর্জনে সক্ষম হয়েছেন। তাই জিজ্ঞাস্য?   

এবার রহিম সাহেবের মুখ নি:সৃত জীবনের অন্যান্য কিছু ঘটনাবলী পাঠক সমাজকে উপহার দেবার চেষ্টা করবো। তাহলে আসুন দেখি তিনি কি বলেন? স্থান-কাল-পাত্র ভেদে পৃথিবীতে প্রত্যেক জিনিষের মূল্য উঠা-নামা করে। তবে বর্তমানে জগতে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই মূল্যের নমনীয়তার চেয়ে ঊর্ধ্ব গতি অত্যধিক স্থায়িত্ব প্রাপ্ত। ১৯৭২ সালে পিতার শেষ সম্বল ২ কেদার জমি বিক্রি করে ১২ হাজার টাকা আদম বেপারী রসিদের হাতে তুলে দেই। কথা ছিল যদি বিদেশ পাঠাতে না পারেন, তবে টাকা ফেরত দেবার প্রাক্কালে ঐ সময়কার মূল্য হিসাবে পরিশোধ করতে হবে। দিনে দিনে মাস, মাসে মাসে বছর-এ ভাবে তিন তিনটি বছর অতিবাহিত বিদেশ পাঠানো আর হল না। চাইলাম টাকা তা ও অস্বীকার। শুরু করলাম বিচার। যাদের সম্মুখে টাকা দেয়া হয়েছিল, তারাই আসলেন বিচারক হয়ে। বিচারের নামে যে প্রহসন, তা আগে টের পাইনি। সে দিন হাড়ে হাড়ে টের পেলাম, নূতন করে অভিজ্ঞতা অর্জিত হলো। দুই একজন যারা ছিলেন সত্যিকার বিচারক রূপে, সৎ ও মহত হৃদয়ের অধিকারী, তারা পাত্তাই পেলেন না। কথায় বলে যত বড় শক্তিশালী, জ্ঞানী গুণী হোন না কেন, দশের কাছে আপনি নগণ্য। আপনার স্থান এখানে নয়, অন্যখানে, অন্য কোথাও। অন্যায়কে ন্যায় করতে হলে বর্তমানে হয় একশলা সিগারেট নতুবা এক কাপ চা-ই যথেষ্ট। সিগারেটের ক্রিয়া এক ঘণ্টা হলে চায়ের ক্ষেত্রে দ্বিগুণ। অর্থ হলেত কথাই নেই। যত বড় অপরাধ আর অপরাধী হোন না কেন এক পলকে মুক্তি। নেই অর্থ! আরে মশাই আপনার ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য নয়। করতালি পেতে হলে চাই একটু বন্ধুত্ব। বোধ হয় জানেন না, ”মধু থাকলে ভ্রমরের অভাব নেই”। পাছে পাছে গুণ গুণ গান কত মধুর। নি:শেষ হলে ছায়া দৃষ্টি গোচর মহাসমষ্যা। সুতরাং আমার বিচার ও তাই। মনকে শুধু প্রবোধ দিয়ে শান্ত হলাম।সুবিচার এক মাত্র খোদার কাছে, তিনিই অন্তর্যামী।

দূর সম্পর্কীয় এক ভদ্রলোক। ইয়া লম্বা দাঁড়ি। বয়স অনুমান পঞ্চাশের কাছাকাছি। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন। মনে হয় তিনির মত খোদা ভক্ত খুবই কম। কথায় কথায় ভাবুকতার রেশ। আমরা ৫ জন তরুণ, তারুণ্যের প্রতীক। একত্রে বসবাস করে আসছি দীর্ঘ একটি বছর। বাহির থেকে সহজে কেহ ধারণা করতে পারবে না ভিন্ন ভিন্ন পরিবার থেকে আগত। চাল-চলন, আচার-আচরণে আশপাশের সবাই অভিভূত “একটি বৃন্তে পাঁচটি ফুল“। যদি ও আমাদের প্রত্যেকে পৃথক বৈশিষ্ট্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। এখানে নেই জৌলুসটা, অহংকার ও আভিজাত্য। বেশ আনন্দঘন প্রতিটি ক্ষণ অতিবাহিত হয়। কিন্তু রফিক ছিল একটু চঞ্চলমতি, রসিক, একরোখা, বড় নীতি পরায়ণ, সদালাপি।আমি বরাবরই মিশুক স্বভাবের। প্রত্যেকের সাথে তাল মিলিয়ে, তার মনের অবস্থান, গতি বুঝে চলাফিরা করি যতটুকু সম্ভব। ঐ ভদ্রলোক পত্র লেখার উদ্দেশ্যে একদিন আমাদের বাসায় আগমন করেন। পরিচয় হয়, হৃদ্যতা গড়ে উঠে মোদের মাঝে। আসতেন ঘন ঘন। শোনাতেন অমোঘ বাণী, মিষ্টি কথার ফুল ঝুরি। রফিক ব্যতীত সকলেই তার অন্ধ ভক্ত। কিন্তু রফিক এমন ব্যবহার দিত যা ছিল স্বাভাবিক আসুন-বসুন। অতিরিক্ত ভক্তি, শ্রদ্ধা কোনটাই প্রশ্রয় দিত না তিনির বেলায়। এই হল কাল, অপরাধ। একদিন তিনি বলেই ফেললেন, ছেলেটার দেমাগ বেশী। আচ্ছা!

সেদিন থেকে তিনি ওর পেছনে যে লেগেছেন, তা যদি ও একটু আধটু অনুভব করেছিলাম। কিন্তু মনের দুর্বলতা বলে নিজে উড়িয়ে দিতাম। যেহেতু তিনি একজন বর্ষীয়ান, মুরবিব সমতুল্য। কিন্তু ভদ্রলোক নাছোড় বান্দা। তিনি পাড়া পড়শী ছেলে মেয়েদের ক্ষেপিয়ে তুললেন, রফিকের স্বভাব, চরিত্র সম্পর্কে। যার সংস্পর্শে রফিক কোন দিন যায়নি, ঘৃণা ছিল প্রচন্ড। সে সকল কলঙ্ক তার উপর রটানো হল। এমন কি আমাদের মধ্যে দু-দু‘টি দলে বিভক্ত করে ছাড়লেন। একদিকে আমি। অপর দিকে অন্য তিন জন। রফিক কিন্তু বেকায়দায় পড়ে গেছে। অনেক চেষ্টা করে ও কাউকে বুঝাতে পারি নি যে, এ হল প্রতিশোধের পালা, প্রতিহিংসার দাবানল। রফিক মনে করল তিন সদস্যের দলন্তর্ভুক্ত, ওরা বুঝে নিল বিপরীত। আমার প্রচেষ্টা হল অরণ্যে রোদন, মায়া কান্না। ঘটল বিস্ফোরণ। নিমেষে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল এত দিনের বন্ধুত্ব, মমত্ব, প্রীতি ও ভালবাসা। ছিটকে যে যেখানে সুবিধা পেল, সেখানেই আশ্রয়স্থল হল।এ সময় থেকে ভদ্রলোকের পাত্তাই নেই। হঠাৎ একদিন রাস্তায় সাক্ষাৎ জিজ্ঞেস করলাম, চাচা এ কি করলেন? উত্তরে উপহার পেলাম এক ঝলক হাসি। বললেন ছেলেটার দেমাগ দেখিয়ে দিলাম। আর কিছু নয়, অতি অল্প। আমি হতভম্ব। কোথায় আছি ? জীবিত না মৃত,চেতন না অচেতন অনুমানে আসছে না। আঁখিদ্বয় আপনা আপনি বুজে আসে। বাকশক্তি রহিত। দু‘ ঠোঁটে কালবৈশাখীর ঝড়। নীরবতা ব্যতীত আমি অগ্রসর হতে পারি নি ঘটনার আকস্মিকতায়। বুঝলাম যখন, তখন দু‘গন্ড বেয়ে তপ্ত অশ্রু বাহিত। চেয়ে দেখি তিনি অনেক দূর চলে গেছেন। আমার কথার সীমানা ছাড়িয়ে। কথায় না বলে, “অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ“। তা কিন্তু সহজে পরিচয় পাবেন না। কারণ বর্তমানে নিজকে চেনা বড় কঠিন। মানুষের মন মানসিকতা বুঝে উঠা মুশকিল। দীর্ঘ প্রচেষ্টা চালিয়ে পরবর্তীতে যে ফসল তুলে এনে ছিলাম। তা হল -ঘটনা সম্পর্কে প্রত্যেককেই সম্যক জ্ঞান দান, উপলব্ধি, আঁচ করতে সক্ষম হল। তখন কিন্তু নাগালের বাইরে

একত্রে বাস করা আমাদের পক্ষে দুষ্কর। আমরা সবাই তখন সাংসারিক। কাজের নিমিত্তে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে অবস্থানরত।

বাড়ী থেকে কলেজের দূরত্ব তখন ৯ মাইল। যোগাযোগের একমাত্র বাহন ট্রেন। যদি কোন ক্রমে ট্রেন ফেল হয় তখন শ্রীচরণের ভরসা। রীতিমত ট্রেন চড়েই লেখাপড়া করতে হয়। হয়ে গেলাম দৈনিক ট্রেন যাত্রী। সে দিন ট্রেনে বসে সিগারেট টানছি অন্যমনস্ক ভাবে। বিচিছন্ন চিন্তা জট পাকাচ্ছ। হঠাৎ কম্পার্টমেন্টে সোরগোল, লোকের চিৎকারে হক চকিয়ে গেলাম। ফিরে এলাম ভাবনা রাজ্য থেকে বাস্তব জগতের মোকাবিলা করতে। দামী চশমা , টাই, সুট-কোট পরা একজন লোককে অপদস্থ করার চেষ্টা চলছে। ঘটনা বুঝার ব্যাকুল আগ্রহ নিয়ে অগ্রসর হলাম কি হচেছ, কেন? পোষাকে মনে হচেছ শিক্ষিত, ভদ্র, খান্দানি বংশের লোক। ততক্ষণে পরিস্থিতি আয়ত্বে আনতে দু‘ব্যক্তি আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালিয়ে আয়ত্বে, নিয়ন্ত্রণে সক্ষমতা অর্জনে শুরু হল বিচার। ভদ্রলোক সীটে বসে পত্রিকা পড়ছেন। কিন্তু সীটের উপর পা তুলে ছড়িয়ে দিয়েছেন পার্শ্ববর্তী সীটে। বেশ আরামে বসেছেন অতিরিক্ত সিট দখলকারীর খাতায় নাম লিখে গৌরবান্বিত অহমিকায়। দ্বিতীয় ব্যক্তি সাধারণ শার্ট লুঙ্গি পরিহিত, নেই আভিজাত্য বা জৌলুসের চিহ্ন মাত্র। সারা কামরায় খালি সীট না পেয়ে অগ্রসর হন প্রথম ব্যক্তির ব্যক্তিগত কোর্টে। আসামী স্বরূপ হাজির হয়ে পা নামিয়ে বসার স্থান প্রদানের জন্য বার বার অনুরোধ করেন। আসামী এজন্য বলছি বর্তমানে আমাদের সামাজিক জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে হলে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার মন যুগিয়ে চলতে হবে, হচেছ। নতুবা রোষানলে পতিত হয়ে সারা জীবন ভর এর ভার সহ্য করতে হবে। তাই তো অনেক সময় অন্যায়কে চোখ বুজে মেনে নিতে হবে। যেহেতু “সুবচন নির্বাসনে“। প্রথম ব্যক্তি অনুরোধ উপেক্ষা করেন অবহেলা, অবজ্ঞায় “এটা দ্বিতীয় শ্রেণীর কামরা“ বলেই পত্রিকায় দৃষ্টিপাত। কিছুক্ষণ নীরবে দাড়িয়ে থেকে দ্বিতীয় ব্যক্তি আবারো অনুরোধ, মিনতি 'একটু জায়গা সাহেব, বড্ড ক্লান্ত।'

এবার কিন্তু বোমা ফাটলো। চোখ রাঙ্গিয়ে আগুনের স্ফুলিংগ বের করে প্রথম ব্যক্তি, “জায়গা, জায়গা“। বললাম না, এটা দ্বিতীয় শ্রেণীর কামরা। যান - তৃতীয় শ্রেণীর কামরায় প্রচুর জায়গা, ইচেছ করলে ঘুমিয়ে যেতে পারবেন। ওটা লাল টিকেটের গাড়ী। মান-সম্মান, মর্যাদা রক্ষা করা আপনাদের দৌরাত্ব্যে কঠিন। এখানে এসেও স্বস্থির নি:শ্বাসে বাধা। ট্রেনে ভ্রমণ আজ কাল বিপদজনক।

পার্শ্ববর্তী লোকজন আর ধৈর্য্য ধরতে পারলেন না। ধৈর্য্য, সহ্য জ্ঞান মানুষের মহৎ লক্ষণ। কিন্তু ধৈর্য্য এর সীমা আছে। যারা অতিরিক্ত ধৈর্য্যশীল, তারা ক্ষেপে গেলে লক্ষ্য থাকে সীমানার। সে সীমানা তখন হয়ে উঠে আগ্নেয়গিরির জ্বালা মুখ। গলিত ও উত্তপ্ত লাভা নির্গমণের পর স্বাভাবিক থাকে না। এখানে ও তদরুপ অবস্থার সৃষ্টি। বিশেষ করে একজন কলেজ পডুয়া ছাত্র অগ্রণী ভূমিকার স্রষ্টা রূপে কাজ করে। যাকে সহপাঠীরা নিরীহ, সহজ, সরল ও নিয়মতান্ত্রিকতার বাহক হিসাবে “ভাবুক“ বলে ডাকত। ছাত্রটি যখন হুংকার ছেড়ে গর্জে উঠে। এমনি সীট থেকে পা নেমে যায়। পরবর্তীতে ক্ষমা প্রার্থনা নি:শর্ত ভাবে। দ্বিতীয় ব্যক্তি বি.এ পাশ শিক্ষকতার মহান পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তি। তিনিই শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সহযোগি ব্যক্তি, দ্বিতীয় শ্রেণীর টিকেটধারী।

অসংখ্য তারকারাজি আকাশে উদিত আলো বিতরণের প্রত্যাশায়। কিন্তু চন্দ্রলোকের কাছে পরাজিত হয়ে মিটমিটে। তথাপি দৃষ্টি গোচরীভূত হতে পারে ক্ষীণ ও ম্রিয়মাণ। এক্ষেত্রে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, অতি দূরত্ব এদের কৈফিয়ত। তবু ও দু‘একটি আলোকবর্তিকার সফল উজ্জ্বল তারকা। আর অবশিষ্টগুলি ক্ষুদ্র বলে নীরব প্রতিবাদের ঝড় তুলে অনেক দুর থেকে বিদায় নেয়। ওদের হিসাব ক‘জন রাখারাখির প্রয়োজন বোধহয় নেই। তাই অভিমানে কিছু বলতে পারে না। শুধু চায় কর্তব্য জ্ঞান ও মূল্যবোধের পরিচয়। এক্ষেত্রে প্রতিরোধ কি সম্ভব ? হ্যাঁ অসম্ভব, যদি মেঘ এসে ঢ়েকে ফেলে, সারা আকাশে বিস্তৃতি লাভ করে। প্রশ্নগুলি আমাকে লক্ষ্য করেই। চার চোখের মিলন বেলা দেখলাম  অশ্রু ভারাক্রান্ত। জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কাঁদছ ? অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। কাঁদব কেন? কাঁদতে যে আমরা জানি না। হাসি কান্নার সংজ্ঞা অজ্ঞাত। শিখিনি, শিখতে পারিনি। বিমান বন্দরে সে দিন দেখলাম। পিতামাতা দীর্ঘ প্রবাস থেকে আগত ছেলের গলায় ধরে অঝোর কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছেন। তাদের কান্নায় যোগ দিয়ে ছেলেটি ও ঐ পথের যাত্রী হয়ে গেল। অপর পিতামাতা মৃত ছেলেকে কোলে নিয়ে কাঁদছেন। বলুন তো কোনটি হাসি, কোনটি কান্না? কিন্তু সারগর্ভে ভিন্নতা। কেউ স্বাগতম জানিয়ে, কেউ বিদায় সম্ভাষণের মাধ্যমে। তবে এটা চির বিদায়। জবাব দিন-কণ্ঠে উত্তেজনার রেশ।

হৃদয়ে একটা তুমুল ঝড় বয়ে গেল। দু‘ঠোট কেঁপে উঠলো। কিন্তু অদৃশ্য হাতের ছোঁয়ায় র‘ল অপ্রকাশিত। অনুভব করলাম আমার নয়ন কোনে পানি জমে আসছে। তাড়াতাড়ি পকেট থেকে রুমাল বের করে মুছে নিলাম। একটু পূর্বে না ওকে বলেছি “তুমি কাঁদছ“? লক্ষ্য করলাম রহিম আমার জবাবের তোয়াক্কা করছে না, বোধ হয় অভিমানে। সমস্ত জ্বালা বুকের ভিতর রেখে খুব টেনে টেনে কথা বলছে। “ছাত্র জীবন সুখের জীবন, যদি না হয় এক্জামিনেশন“ প্রথম জীবনে উহাকে গুরুত্ব দিতাম অধিক, ভাবতাম চিরন্তন সত্য। কিন্তু সে দিন থেকে মোর মনে হল, অনুভব করলাম পদে পদে “ছাত্র জীবন সুখের জীবন, বিত্তবান যদি হন“। কারণ স্কুলে গিয়েছি - শিক্ষক মহাশয় ক্লাস নিচেছন, তিনি এত সুন্দর করে পড়াতেন, বাড়ীতে পড়ার কোন প্রয়োজন হত না। ক্লাসেই বসে রপ্ত হত। কিন্তু দু‘দিনের অনাহারী, পেঠে আগুন জ্বলছে দাউ দাউ করে। বলুন- কেমন করে মনোযোগী হলাম? অমনোযোগীর অপরাধে শিক্ষক তৎক্ষণাৎ উপহার দিলেন দু‘গন্ডা বেত্রাঘাত। জ্বি-না কাঁটা গায়ে লবণ ছিটা নয় বিমূর্ত প্রতীক। শিক্ষককে অপরাধী সাব্যস্ত করছি না। তিনি তো আর জ্যোতিষ নন।

একদিন এক শিক্ষক বলে ছিলেন, “লেখাপড়া বক ধ্যান“। অন্বেষণ কর, ধ্যানে নিমগ্ন থেকো। সাফল্যের চরম শিখরে আরোহণ জলবৎ তরল। তিন দিনের উপবাসান্তে ঔষধ বিহীন ছোট বোন শিরিন যখন পরপারে পাড়ি জমাল, বক ধ্যান করেছি সত্য। কিন্তু লেখাপড়ায় নয়। জটের জ্বালায় অজ্ঞান হয়ে। ভাল ছাত্র ছিলাম। আশায় বুক বেঁধে তরণী ভাসালাম সাগরে। মাঝি হলাম, তবে বৈঠা বিহীন। ওপারে পৌছা হাস্যস্পদ নয় কি? তথাপি অন্ধের পথ চলার মত। সবাই যখন পঞ্চমুখ, চলে যাচেছ ঐ ঐ। অন্ধ ব্যক্তি ও সমস্বরে বলছে, জিজ্ঞেস করলে প্রতি উত্তরে, তোমরা না সবাই বলছো। আমি বললে অপরাধী।

আপনাদের সমাজ আমাকে এমন ভাবে বেঁধেছে। অদৃশ্য রশি পায়ে দিয়েছেন পরিয়ে আদর করে। সমাজ যতটুকু দেয় ততটুকুই। এক পা সামনে এগুলে টান পড়ে, মুখ থুবড়ে পড়ে যাই। রক্তক্ষরণ, ধুয়ে-মুছে শেষ। টেবলেটের প্রয়োজন আমাদের নেই।

তা নয় কি? জবাবের আশায় ধাক্কা মারে।

থতমতিয়ে উঠলাম। চৈতন্যোদয় হল। উত্তর কি দেব ভেবে পাইনি। সান্ত্বনার আশায় মুখে শুধু বললাম “তোমার প্রতিটি কথা অবশ্য আমি একাগ্রতায় শুনছি“। বলুন-তারপর জবাব পাব না আমি জানি। তবু ও বলবো যখন নদী প্রবাহিত। নদীর চলার পথে স্বল্প বাঁধ আটকিয়ে রাখতে পারে না। ভেঙ্গে অথবা একটু সুযোগ পেলে প্রবাহমান উচলিয়ে পড়ে। মানুষ যখন দু:খ বা আঘাত পায় ,তখন অন্যের কাছে বলে এবং সান্ত্বনার আশ্রয় খোঁজে। যদি ও ঐ ব্যক্তি তা দুর করতে বা লাঘব করতে অক্ষম।

উপবাস অবস্থায় প্রায়ই থাকতে হত। জাঁক-জমক ব্যতীত সাধারণ পোষাক পরা ছিল ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। মনে পড়ে শেখ সাদী (র:) ‘র পোষাককে আহার করানোর ঘটনা। জ্ঞানী, গুণী আর বুদ্ধিমান যতই থাকুন না কেন? আমরা যে শেখ সাদীর (র:) মূল্য, কদর বুঝি না। তবে হ্যাঁ, বুঝি তিনির পোষাকের। অতএব সহজেই অনুমেয় আমার মত শত শত অভাগার কথা। অবস্থার করুণ দৃশ্য। বেতনের চাপে কলেজের রোলকল বন্ধ হবার ঘটনা নতুন নয়, অনেক অনেক পুরাতন। মনের দৃঢ়তা, সাহস, জ্ঞানার্জনের অদম্য স্পৃহায় আকৃষ্ট হয়ে কোন রকমে ঠিকে থাকলাম, নৌকার হাল ধরলাম। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলাম। কিন্তু থমকে থমকে, খুড়িয়ে খুড়িয়ে চললাম।

”আগাছা সমুলে উৎপাটন বুদ্ধিমানের কাজ” এ নীতিতে বিশ্বাসী হয়ে আমার পিছনে কম করেন নি। যদি প্রকৃত জ্ঞানার্জন করে,“এক যে ছিল হিকমত আলী“ গল্পের হিকমত হয়ে যাই, আপনাদের কর্মকান্ড জেনে নেই। সুতরাং হিকমত যাতে অগ্রসর হতে না পারে, সে জন্য নির্বাসন দিলেন।

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবার শুরু করে। গলা ধরে এসেছে। তথাপি রাজ্যের বেদনা যেন জমাট বেঁধে আছে। তা থেকে রেহাই পেতে চায়। উজ্জ্বল ভবিষ্যতের অলীক কল্পনায় আরো দশ জনের অনুসারী হয়ে আদম বেপারীর শরণাপন্ন হলাম। ইচছা, দারুণ ইচ্ছা। প্রবাসে যাব, টাকা আসবে ইত্যাদি।

এক্ষেত্রে ও স্বাভাবিকতা নিয়ে নয় দুরু দুরু বক্ষে। অর্থাৎ অবৈধ ভাবে। এ ছাড়া পথ ছিল না মোর সম্মুখে। আরেকটু পরিষ্কার হবে আপনাদের কাছে - এক দিন গ্রামের এক লোক কথাচ্ছলে বলছে। এবার বাদশা মিয়া বল্ডারে অনেক লোক সৌদি আরব পাঠাচেছ। লোকটির কথা সঠিক ভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে পারি নি, হেড কোয়ার্টারে ঢুকে নাই। তবে হ্যাঁ, অনেকক্ষণ পরে বুঝলাম এর কথা। এটা হল ওমরাহ্ বা হজ্জ্ব ভিসার মাধ্যমে রোজগার করার অভিনব পন্থা অবলম্বন। আমি ও বর্তমানে ঐ পথের পথিক হয়ে গেলাম। রহিম নামের পরিবর্তে মছদ্দর আলী। আমি “জেনে শুনে বিষ করেছি পান“এর মত। প্রবাসে কতটুকু সান্ত্বনা বা সফলতা আসবে তা এক মাত্র ললাট লিখক বা ভাগ্য নিয়ন্তা জ্ঞাত।  

Comments

Top

অলক্ষ্মী

অপর্ণা চক্রবর্তী

কলকাতা

 

অলক্ষ্মী

চোদ্দবছর বয়সে প্রথম জেনেছিলাম - আমার জন্মের খবর পেয়ে ঠাম্মা মাথায় হাত দিয়ে বারান্দায় বসে পড়েছিল। আমি, বাবা মার দ্বিতীয় কন্যা সন্তান। এই ঘটনার ঠিক দেড় বছর পর আমার ভাইয়ের জন্ম হয়।

ঠাম্মা আমাকে সারাজীবন 'লক্ষ্মীছাড়ী' বলেই ডাকতো। ছোটবেলাতেই বুঝে গিয়েছিলাম বাড়ীতে আমার আর দিদির জন্য এক রকম ব্যবস্থা, আর ভাইয়ের জন্য অন্যরকম। পুজোয় ভাইয়ের জন্য চারটে জামা; আমার-দিদির একটা একটা। ভাইয়ের টিফিনবক্সে আপেল-কলা-মিষ্টি। আমার-দিদির যা হোক কিছু। এসব কড়া নিয়মের বাইরে বেরোনোর ক্ষমতা আমার মায়ের ছিলনা। দিদিও কখনো নিয়ম ভাঙার চেষ্টা করেনি। কিন্তু আমাকে বারবার ঠাম্মার কাছে শুনতে হয়েছে - "এ মেয়ের বড় নোলা, ভীষণ লোভ, এক্কেবারে অলক্ষ্মী এসেচে কোথা থেকে।" তবুও আমার বায়নার অন্ত ছিলনা। মা মাঝে মাঝেই আমার বায়না মেটাতে, সবাই কে লুকিয়ে পয়সা দিত। দিদিকে কখনো কিছু চাইতে দেখিনি।

আমি তখন ক্লাস সিক্স-এ। স্কুল থেকে ফিরে দেখি মা'র মুখ থমথমে। কিছু একটা হয়েছে আন্দাজ করতে পারছি। সন্ধ্যেবেলা পড়তে বসে দিদি বলল- "তুই মা কে এত বিপদে ফেলিস কেন? আজ ঠাম্মা দেখেছে, মার থেকে লুকিয়ে পয়সা নিচ্ছিস।" আমার থেকে সাড়ে তিন বছরের বড় দিদি সেদিন আমাকে বুঝিয়ে ছিল এ'বাড়ীতে মেয়েদের কি কি করতে নেই।মেয়েদের মুখফুটে কিচ্ছু চাইতে নেই; বেশী কথা বলতে নেই; লাফাতে নেই; দৌড়াতে নেই। মেয়েদের চিৎকার করতে নেই; ঘুড়ি ওড়াতে নেই; গুলি খেলতে নেই; পা ছড়িয়ে বসতে নেই; হা হা করে হাসতে নেই, সব সময় খাই খাই করতে নেই।

অবাক হয়ে সেদিন আমি ..."নেই"-য়ের ফর্দ শুনেছিলাম। দিদিকে খুব বেশীদিন এত 'নেই' মানতে হয়নি। আমার রোগা ভোগা দিদিটা বিয়ের ধকল সামলাতে পারেনি। বিয়ের দু'বছর পর, মাত্র বাইশে, শ্বশুরবাড়ীতেই মারা যায়।

সেদিন প্রথম আমার মা, সারাদিন বিছানায় শুয়ে ছিল। ঠাকুমা, ভাই আর বাবার মানবিকতা বোধকে, সেই একদিনের জন্য কিছুটা জাগ্রত অবস্থায় দেখেছিলাম। সারাদিন কেউ মাকে কোনো ফরমাইশ করেনি।সত্যি বলব- এত দুঃখের দিনেও, সেদিন আমার ভালো লাগছিল; একটাই কথা ভেবে- আমার কাকভোরে ওঠা মা, এই সুযোগে, একটা পূর্ণ দিনের বিশ্রাম তো পেল!! কলেজে এক অধ্যাপক, ফাঁকা ক্লাসরুমে আমার এক বান্ধবীর হাত চেপে ধরেছিল। ব্যাপারটা প্রিন্সিপল্ কে জানাতে গেলাম। তিনি বললেন- "গার্লস কলেজে ওসব হয়েই থাকে। এ'নিয়ে বেশী সোরগোল করো না। আমি দেখছি কি ব্যবস্থা নেওয়া যায়।" তিনি যে কি ব্যবস্থা নিয়ে ছিলেন আজও জানতে পারিনি।

কিন্তু, আমার ভাই ব্যাপারটা কোনো ভাবে জেনে, আমাকে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল। বাবার সামনে দাঁড়িয়ে সে সোজা ভাষায় আমাকে বলল- "তোর আর সেজেগুজে কলেজ যাবার দরকার নেই। বাড়িতে পড়ে পরীক্ষা দে।" আমি তো দিদির মত লক্ষ্মী মেয়ে নই, তাই অন্যের করে দেওয়া ব্যবস্থা, আমার পক্ষে মানা সম্ভব হয়নি।

আমার 'মেয়েবেলার', আর এক দিনের কথা খুব মনে পরে। বাড়ীতে কি একটা পুজো ছিল। দিদি মাকে রান্নাঘরে সাহায্য করছে। ঠাম্মা আমাকে ঠাকুরঘরে নিয়ে গিয়ে প্রসাদ, ঘট, ফুল বেলপাতা সাজানোর প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। 

পুজোর জোগাড় শেষ হল, আমার শিক্ষা সম্পূর্ণ হল। কিন্তু, আমার চোখ তখনো আটকে আছে, নারায়ণের জন্য সাজানো প্রসাদী নৈবেদ্যর থালায়। নৈবেদ্যর চূড়ায় চূড়ামণি হয়ে বসে আছে, বেশ বড় সাইজের একটা নলেনগুড়ের সন্দেশ।

যথা সময়ে পুজো শেষ হল। মা প্রসাদ ভাগ করার তোরজোড় করছে। হঠাৎ! সবকিছু সরিয়ে, সবাইকে অবাক করে দিয়ে, আমি - সেই মহার্ঘ্য সন্দেশ, ছোঁ'মেরে তুলে নিয়ে, মুখে পুড়ে দিলাম। মুখভর্তি সুস্বাদে আমি তখন অভিভূত।

হুঁশ ফিরল, যখন সন্দেশ ভরা গালে মায়ের প্রচন্ড এক চড় এসে পড়লো।

ঠাকুমার প্রভূত গালিগালাজ থেকে বুঝলাম- নৈবেদ্য যতই আমার সাজানো হোক; সেই প্রসাদের সিংহভাগের অধিকারী বাড়ীর পুরুষ সদস্যরা।

দু'গালে মায়ের পাঁচ আঙুলের দাগ নিয়ে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি। অনেক রাতে মায়ের ছোঁয়ায় ঘুম ভাঙলো। অভিমানে- রাগে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে রইলাম। কিন্তু, আমার চুলে হাত বুলাতে বুলাতে, মায়ের অসহায় কান্না, কোনোদিন ভুলতে পারি নি।

"মরার সময় ছেলের হাতের জল না পেলে স্বর্গবাস হয় না।" ঠাম্মার এই কথাটা বাবা মনে প্রাণে বিশ্বাস করতো। ভাই ছিল আমার বাবার সেই স্বর্গবাসের ইনভেস্টমেন্ট।

আমার ভাই, বর্তমানে ব্যাঙ্গালোরের এক বহুজাতিক সংস্থায় কর্মরত এবং বিবাহিত। তার অবাঙালী পরিবারকে নিয়ে সেখানেই নিরাপদ জীবন যাপন করছে। এ'শহরে খুব একটা আসার দরকার পড়ে না। এলেও অফিসের ভি.ই.পি গেস্টহাউজে থাকে। পূর্ব- দক্ষিণ খোলা বিশাল ফ্ল্যাটের অভ্যস্থ জীবন; এ'বাড়ীর স্যাঁতস্যাতে দেওয়ালে ওদের কষ্ট হয়। বাবা মারা গেছেন প্রায় দু'বছর হল। প্রভিডেন্ট ফান্ডের ষাট শতাংশ ছেলের ক্যারিয়ারে খরচ করেছেন। ইনভেস্টমেন্টের পুরোটাই যে জলে গেছে সেটা মৃত্যুর দিনেও বিশ্বাস করেতে পারেন নি।

ঠাকুমার প্রায় চুরাশী চলছে। বৃদ্ধার আর ছেলের হাতের জল পাওয়া হলনা। আমার ছাত্র পড়ানো আর স্কুলে চাকরীর টাকায়, সংসারটা কোনো মতে দাঁড়িয়ে আছে।

সেদিন সবে বাড়ীর দরজায় পা রেখেছি। মা ছুটে এল- "তাড়াতাড়ি আয়। সকাল থেকে কিচ্ছু খাচ্ছে না। বারবার তোকে খুঁজছে।"

ঘরে ঢুকে বৃদ্ধার মাথার কাছে বসলাম। মনে হল আমাকে দেখে, একটু যেন হাসলো। আমার হাতে ধরা দুধের গ্লাস থেকে দু'চুমুক মুখে দিয়েই, আবার ক্লান্তিতে মাথাটা বিছানায় এলিয়ে দিল। ইশারায় আমাকে কাছে ডাকলো। আমি মুখটা নামিয়ে আনলাম মুখের কাছে। খুব আস্তে, প্রায় নিভে যাওয়া কন্ঠে ঠাম্মা বলল - "লক্ষ্মীছাড়ী বিয়ে কোরিস; তোর মেয়ে হতে ইচ্ছা হয়। বুড়িটাকে ক্ষমা করে দিস।"

মা আর আমি সেদিন সারারাত জেগে বসে রইলাম। সারারাত ঠাম্মার বন্ধচোখ থেকে গড়িয়ে পড়া জল মুছলাম। এত দিন পরে বৃদ্ধার কাছে আমার 'অলক্ষ্মী' জন্ম সার্থক হয়েছে ।

Comments

Top

অজান্তেই
teacher.jpg

অজান্তেই

কৃষ্ণতরু বর্মন

ডালাস, টেক্সাস

 

ময় চলে যায়। রেখে যায় একমুঠো স্মৃতি। আর আমরা সবাই এই মুঠোর মধ্যেই খুবই সযত্নে, আলগোছে বাঁচিয়ে রাখি ফেলে আসা সময়ের চেনা সেই বিক্ষিপ্ত মূহুর্তগুলো, যা ফিকে হতে হতে এখনও বিলীন হয়ে যায় নি সময়ের এই চোরাস্রোতে। আর মনের ক্যানভাসে ভেসে আসা এই প্রত্যেকটি অবয়বের আড়ালেই কিন্তু থেকে যায় এক টুকরো ঘটনা, যা হঠাৎই মনের তীরে চলে আসে কোন এক ঢেউএর অযাচিত ঝাপটায়।

স্কুল জীবনের নানা ছোট-বড় ঘটনার সাক্ষী আমরা সবাই। হয়ত কিছুটা কম কিম্বা বেশী। আর সবচেয়ে বড় মজার ব্যাপার হল যে, এই ঘটনাগুলোর মধ্যে তেমন একটা নতুনত্ব কিছু নেই। বন্ধু মহলে যখন স্কুল কলেজের নানা পুরোনো প্রসঙ্গ উঠে আসে, নানা মজার ঘটনার মোড়কে ফেলে আসা সময়কে সাময়িকভাবে কাছে টানলেও বাস্তবিকভাবে তোমার আমার ঘটনায় খুব বেশী ফারাক থাকে না। আমার ঝুলিতে এমন কিছু থাকে না, যা তোমার থেকে আলাদা। তাই আলাদা করে স্কুল কলেজের প্রসঙ্গ আর নাই বা টানলাম। তবে একটা ছোট্ট উপলব্ধি যা আজও ভাবায়, হতেই পারে এটাই একমাত্র ব্যাতিক্রম।

পড়তাম বড়িষায়, বেহালা অঞ্চলের বেশ পুরোনো স্কুল। শুরুটা প্রাইমারীতে বাবার সাইকেলে চেপে ভোরের স্কুল। বেশ কষ্ট হত বিশেষ করে শীতকালে, ভালই ঠান্ডা পড়ত সেই সময়। তারপর একটু লায়েক হতেই হাই স্কুল, পিঠে ব্যাগ চাপিয়ে সাতাত্তর নম্বর বাস। বেশ কয়েকটা বছর কেটেছে ঐ স্কুলের ধুলো বালি গায়ে মেখে আর কাঠের শক্ত বেঞ্চিতে। আর পড়া না পারলে সে আর এক মজা। শাস্তি স্বরূপ বেঞ্চির ওপর দাঁড়ালেই বাইরের জগতটা চোখের সামনে আরও পরিস্কার। সেই চেনা সবুজ মাঠ, ঘাসের ফাঁকে ফাঁকে কয়েক পশলা বৃষ্টির জল, আর তাতে কিছু বোকা বকেদের সতর্কিত পদক্ষেপ। অদূরে পাঁচিলের ওপারে ব্যস্ত শহর। হাজার স্মৃতির ভীড়ে চেনা অচেনা কিছু বন্ধু বান্ধব, কিছু টুকরো টুকরো ঝরে পড়া কথা, কিছু সংলাপ বয়ে চলে নাটকের মত।  মান-অভিমানের অকারণ ক্ষুদ্র হিসাব নিকাশ সময়ের কালে কালে ক্যানভাস থেকে যা আজ সবই প্রায় বিলুপ্ত।  

প্রসঙ্গে ফিরে আসি। বাংলা পড়াতেন স্যার। একটু রোগা, ছিপছিপে চেহারার মানুষ। পড়তেন ধুতির সাথে অতি সাধারণ মানের পাঞ্জাবি। পায়ে সেকেলে আমলের সস্তার জুতো। খুবই স্বাভাবিক, কারণ তখনকার দিনে শিক্ষকরা খুব বেশী যে মাইনে পেতেন তা কিন্তু নয়। ক্লাসে ওনার খুব প্রিয় ছাত্রদের মধ্যে আমি পড়তাম না, আবার খুব যে অপছন্দ করতেন তাও নয়। তবে একদিনের একটা ঘটনার কথা বলি।  তখন বোধহয় আমি ক্লাস সিক্সে। কোন একটা কারণে স্যারের মনটা হয়ত ভাল ছিল না। ক্লাস চলাকালীন অতি সামান্য কথায় স্যার আমাকে শরৎবাবুর 

‘বহুরূপী’ গল্পের রামকমলের মত ভাল করে তুলোধুনে দিলেন। অথচ আজও আমার কারণটা অজানা। তফাৎ শুধু একটাই। শরৎবাবুর গল্পে কয়েকজন পেয়াদা মিলে রামকমলবাবুর শোচনীয় দশা করে ছেড়েছিল, আর বাস্তবে মানে আমার ক্ষেত্রে স্যার ছিলেন একাই একশো। পরে টিচার্স রুমে ডেকে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেও ব্যথা তাতে বিন্দুমাত্র কমে ছিল বলে তো মনে পড়ে না। কোন এক বন্ধু মারফত খবরটা পেয়েছিলাম। অমল স্যার অসুস্থ। খুবই সাধারণ ঘটনা। স্কুল ছেড়েছি বহু বছর আগে। কর্মসুত্রে দেশের বাইরে আরো বেশ কয়েক বছর। সত্যি বলতে কি -  ‘ও তাই নাকি? কেন কি হয়েছে?’ ব্যাস ওইটুকুই। কর্তব্য শেষ। আবার হাজার কথার ধাঁধায় হারিয়ে গেছি। মনে রাখিনি। সময় অনেক কিছুই শেখায়, ভোলায়। তাই আবার মানুষ নতুন করে বাঁচতে পারে, নতুন স্বপ্ন দেখতে পারে। সময়ের চোরা স্রোতে অনেক কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি আমরা সবাই, কম বেশী। জলের ধাক্কা খেতে খেতে  কখনো সখনো কাদা মাটিও পাথরে পরিণত হয় মনটাও খানিকটা তাই। তাই সাময়িক কিছু আবেগ আর সেন্টিমেন্টের ধুলো গা থেকে ঝেড়ে ফেলতে আর কতক্ষণ।  কিন্তু কেন জানিনা সাতপাঁচ না ভেবেই একদিন হঠাৎই চলে গেলাম অমল স্যারের বাড়ি । হয়ত না গেলেই ভাল করতাম। বকুলতলার ঠিক মোড়েই বাড়িটা। সরসুনার যাবার রাস্তায় একটু ঢুকেই বাঁ দিকে। একটু জীর্ণ, অযত্নের ছাপ বাড়ির চারপাশ ঘিরে। হয়ত যত্নটা বেশি জরুরী বাড়ির ভিতরের মানুষটার। বহু যুগ বাদে উনি চিনতে পারবেন তো! যাওয়াটা কি ঠিক হচ্ছে, কি বা ভাববেন। তাই একটু দ্বিধা নিয়েই দরজাতে টোকা। শরীর ভাঙলেও আমার চিনতে কিন্তু কোন অসুবিধা হয় নি স্যারকে । আর উনি যে

আমায় চিনবেন না, সেটা আমি আগে থেকেই জানতাম। একটু অবাক হয়ে ঝাপসা চোখে বললেন -  ‘কে’?

ছোট্ট একটা ঘর। সামনে এক ফালি বারান্দা। পাশে এক টুকরো জমিতে কিছু মরা ঘাস, ধুলো আর অযত্নের ফুল গাছ। ঘরের এক কোনে বিছানা। পাশের ছোট্ট টেবিলে ওষুধের খোলা বাক্স। আধো-আলো অন্ধকারে ঘরটা বড়ই অগোছালো। দ্বিতীয় কেউ থাকেন বলে তো মনে হল না। রাস্তার দিকের জানলাটা পাকাপাকি বন্ধ। মাথার কাছে জানলার ভাঙ্গা পাল্লা দিয়ে পর্দা উড়িয়ে বিকেলের আলতো হাওয়া। সিলিং ফ্যানটা ঘুরতে হয় তাই ঘুরছে। স্যার আমাকে ভাল করে দেখলেন। বুঝলাম ওনার চোখের ভাষায় তখন হাজার জিজ্ঞাসা। একটা টুল এগিয়ে দিয়ে নিজের মনে বললেন - ‘কেউ তো আর আসে না রে… যতদিন চাকরী করতাম… পড়াতাম... বাকি কথা আর শোনা গেল না। রুগ্ন শরীরটা নিয়ে বিছানায় বসলেন। ভাবলাম অনেক গল্প করব। কিন্তু হল না। স্কুল জীবনের অনেক কথাই মনে করতে পারলেন না। ছোট্ট এই ঘরটা ঘিরে কি রকম এক দুঃসহ নীরবতা। যেটুকু কথা হয়ত এখনও বেঁচে তার শীতলতা অত্যন্ত গভীরে, অতলে। সঙ্গে কেউ না থাকলে মানুষ বোধহয় কথা বলার অভ্যাসটাও হারিয়ে ফেলে। ঘরের অন্ধকারে হয়ত মন শীতল হয়, কিন্তু এই নিঃস্তব্ধতা! যা মানুষকে কুড়ে কুড়ে শেষ করে। হাঁপিয়ে উঠলাম। তাকালাম স্যারের দিকে। রুগ্ন, জীর্ণ শরীরের এক অব্যাক্ত যন্ত্রনা তার শান্ত চোখের প্রতিটি ইশারায়। এখনও হয়ত ভেবে চলেছেন কে এই ছেলেটি, কোন ব্যাচ, কোন সাল, কেনই বা এল? কি দরকার ছিল? চোখ তুলে বললেন - ‘শরীরটা ভাল নেই বুঝলি, সারাদিন তো প্রায় শুয়েই থাকি।’ অতি সামান্য, অতি সাধারণ আরো কিছু কথা - ‘কোথায় আছিস, কি করছিস।’  বললাম, বিনিময়ে কিছু পেলাম না, এক অভিব্যাক্তিহীন নিস্ফল চাহনি ছাড়া। পাথর চোখের দৃষ্টিতে বললেন - ভাল। ব্যাস ওইটুকুই তারপর আবার চুপচাপ। বেশীক্ষণ বসি নি। বসে থাকতে পারি নি। আর ঐ শীর্ণ হাতের চায়ের অফার ছেড়ে দিয়েছি অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে। উনি আর কিছু বলেন নি।  

দরজা পর্যন্ত এলেন । মাথায় হাত রেখে বললেন - ‘এলি ভাল লাগল। ভাল থাকিস।’ কোনও কথা বলতে পারিনি। কেন জানি না। প্রণাম সেরে সোজা রাস্তায়। তাকিয়ে ছিলেন যতদূর দেখা যায়। দূর থেকে হাত নেড়ে রাস্তার হাজার মানুষের ভীড়ে আমিও মিশে গেলাম নিমেষে।

ফেরার পথে স্কুলে থামতে হল। স্কুলের পরিকাঠামোগত পরিবর্তন বাইরে থেকেই নজরে পড়ে।  ভিতরে না ঢুকলে আসল পরিবর্তনটা বোঝা যায় না। শিক্ষকমহলে এখন তারুণ্যের জোয়ার। আমাদের সময় যারা ছিলেন তারা আর কেউ নেই। অনেকে মারাও গেছেন। আলাপ হল এই তরুন শিক্ষকদের সঙ্গে। প্রাক্তন বলাতে এল চায়ের অফার। এক ম্যাথের টিচারকে বললাম - ‘একটা ক্লাস রুমে যেতে চাই, অনুমতি দেবেন’?  ভদ্রলোক বিনয়ের সঙ্গে বলে উঠলেন - নিশ্চয়ই। আমিই নিয়ে যাচ্ছি আপনাকে।’ টিচার্স রুম থেকে বেরিয়ে একটু সোজা গেলেই একটা ছোট্ট ক্লাস রুম। ঐ ক্লাসেই পড়াতেন স্যার।  ভদ্রলোককে বললাম - ‘রুমটা আমি চিনি, আপনি ব্যস্ত হবেন না।’  সেই বেঞ্চ, ব্ল্যাক বোর্ড, বাতাসে চকের গুড়ো, জানলার ওপারে খেলার মাঠ সবই আছে। শুধু চলে গেছে সময় আর আমরা, এই মানুষগুলো। সময় আর জায়গা ছেড়ে দিতে হয়। এটাই জীবনের নিয়ম। বেঞ্চএ গিয়ে বসলাম। কে বলে আমরা সব ভুলে যাই! কই আমি তো কিছুই  ভুলিনি। একটা একটা করে মনে পড়ছে সব কথা। মনের ক্যানভাসে আবার স্পষ্ট হয়ে উঠছে সেই ভুলে যাওয়া মুখগুলো। দেবাশীষ, অভিক, চম্পক, দিব্যেন্দু, রূপম, পবিত্র আছি, আমরা সবাই আছে। আর ওই তো সামনেই চেয়ারে বসে বাংলা শিক্ষক আমাদের অমল স্যার। সামনে খোলা বাংলা কবিতা। কিছু বলিনি, কথা বলছিলাম নিজের সাথেই। চোখে চোক পড়তেই দেখলাম ভদ্রলোক একটু অবাক। হেসে বললাম - ‘চলুন আর দেরী করাবো না’।

স্যারের বাড়ি থেকে বেড়নোর সময় উনি কিন্তু একবার ও বলেন নি যে আবার আসিস।  কলকাতার ছাড়ার কয়েকমাস পরেই হঠাৎই সেই বন্ধুটির এস এম এস। স্যার আর নেই।  আমার মনে হল উনি জানতেন তাই আর আমায় আর আসতে বলেন নি।

(এটি একটি অনুগল্প হলেও বছর দশেক আগে স্যারের সঙ্গে শেষ দেখাটা আজও আমাকে ভাবায়। প্রতিটি মূহূর্ত অনুভব করি আজও। তবে পাঠকেরা দয়া করে আজ কেন এটা লিখতে বসলাম জিজ্ঞাসা করবেন না। কারণ উত্তরটা আমার জানা নেই)।

Comments

Top

দূর্গাবাড়ি
ladies.jpg

দুর্গাবাড়ি

আইভি চট্টোপাধ্যায়

কলকাতা

কালে এ বাড়ির কাজে এসেই বুঝতে পেরেছে, একটা কিছু হয়েছে। হাওয়া চলছে না, গুমোট। দাদা জলখাবার না খেয়েই বেরিয়ে গেল, বৌদিও বোধহয় অফিস যাবে না। মোবাইল হাতে বিছানায় শুয়ে পড়ল। সর্বক্ষণ মোবাইল নিয়ে কি করে কে জানে। একমাত্র মেয়ে কলেজের পড়া করতে বাইরে গেছে, এখানে সংসারে মিয়া-বিবি দুজনে মিলে একা। সে এখানে বলে নয়, পাড়ার সব বাড়িতেই এমন। হয় পড়া নিয়ে, নয় চাকরি নিয়ে ছেলেমেয়েরা সব বাইরে বাইরে। বাড়ি বলতে শুধু বুড়ো-বুড়ি। এরা অবশ্য বুড়ো-বুড়ি নয়, দুজনেই চাকরি করে। মেয়েটা এই দু’বছর হল পড়তে গেছে।

বৌদি মোবাইলে কথা বলছে, গলার আওয়াজে বেশ ঝাঁঝ। দাদার সঙ্গে ঝগড়া করছে বোধহয়। রাস্তাঘাটে কত ভিড়, গাড়ি চালাতে চালাতে কথা বলাই ঠিক নয়, আর ঝগড়া করছে বৌদি? বলব না ভেবেও ডেকেই ফেলল দুর্গা, ‘অ বৌদি, দাদা বাড়ি ফিরলে এসব কথা বোলো গো। ব্যাটাছেলে মানুষ, এমনিই মাথা গরম.. তার ওপর রাস্তাঘাটের আজকাল যা অবস্থা..’

‘তুই নিজের কাজ কর, আমার মাথাটাও কম গরম নয়। মাথা গরম দেখাচ্ছে..’ রাগ হলেও ফোন বন্ধ করেছে। একবার বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। আজ আকাশ মেঘলা, বাইরেটা নরম, সবুজ সবুজ। রাতে বৃষ্টি হয়েছিল, জলে ভিজে নিচের রাস্তাটাও মায়া মায়া শান্ত। তবু বোধহয় বৌদির মন শান্ত হল না। বাইরের ঘরের সোফায় বসল, আবার ঘরে গিয়ে ফোন হাতে খাটে শুয়ে পড়ল। খুব অস্থির।

‘না রে, আজ আসছি না’, অফিসে ফোন করছে, ‘আর বলিস না। আমার তো শান্তিতে থাকার উপায় নেই। জানিসই তো সব। পিতৃভক্ত ছেলে, বৌয়ের কথা সংসারের কথা ভাবে না।‘

কেন যে ঘরের কথা বলে এমন! যতই একসঙ্গে কাজ করো, কেউ বন্ধু নয়। বিয়ের পর বাপের ঘরে গিয়েও সব কথা বলতে নেই। আর এ তো বন্ধু। তোমার সোয়ামীকে নিয়ে কথা অন্যের কাছে বলবে কেন? বস্তীর ঘরে এমন হয়। তোমরা লেখাপড়া জানা মানুষ, কত বড় বড় চাকরি করছ, এটুকু বোঝো না?

‘শ্বশুরমশাইয়ের চোখের অপারেশন। নিজের এত টাকাপয়সা, ওঁর টাকায় খায় কে? অথচ অপারেশনের খরচ ছেলে দেবেই। রীতিমতো ঝগড়া করল আমার সঙ্গে।’

সকালে এ বাড়ির কাজে এসেই বুঝতে পেরেছে, একটা কিছু হয়েছে। হাওয়া চলছে না, গুমোট। দাদা জলখাবার না খেয়েই বেরিয়ে গেল, বৌদিও বোধহয় অফিস যাবে না। মোবাইল হাতে বিছানায় শুয়ে পড়ল। সর্বক্ষণ মোবাইল নিয়ে কি করে কে জানে। একমাত্র মেয়ে কলেজের পড়া করতে বাইরে গেছে, এখানে সংসারে মিয়া-বিবি দুজনে মিলে একা। সে এখানে বলে নয়, পাড়ার সব বাড়িতেই এমন। হয় পড়া নিয়ে, নয় চাকরি নিয়ে ছেলেমেয়েরা সব বাইরে বাইরে। বাড়ি বলতে শুধু বুড়ো-বুড়ি। এরা অবশ্য বুড়ো-বুড়ি নয়, দুজনেই চাকরি করে। মেয়েটা এই দু’বছর হল পড়তে গেছে।

বৌদি মোবাইলে কথা বলছে, গলার আওয়াজে বেশ ঝাঁঝ। দাদার সঙ্গে ঝগড়া করছে বোধহয়। রাস্তাঘাটে কত ভিড়, 

গাড়ি চালাতে চালাতে কথা বলাই ঠিক নয়, আর ঝগড়া করছে বৌদি? বলব না ভেবেও ডেকেই ফেলল দুর্গা, ‘অ বৌদি, দাদা বাড়ি ফিরলে এসব কথা বোলো গো। ব্যাটাছেলে মানুষ, এমনিই মাথা গরম.. তার ওপর রাস্তাঘাটের আজকাল যা অবস্থা..’‘তুই নিজের কাজ কর, আমার মাথাটাও কম গরম নয়। মাথা গরম দেখাচ্ছে..’ রাগ হলেও ফোন বন্ধ করেছে। একবার বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। আজ আকাশ মেঘলা, বাইরেটা নরম, সবুজ সবুজ। রাতে বৃষ্টি হয়েছিল, জলে ভিজে নিচের রাস্তাটাও মায়া মায়া শান্ত। তবু বোধহয় বৌদির মন শান্ত হল না। বাইরের ঘরের সোফায় বসল, আবার ঘরে গিয়ে ফোন হাতে খাটে শুয়ে পড়ল। খুব অস্থির।

‘না রে, আজ আসছি না’, অফিসে ফোন করছে, ‘আর বলিস না। আমার তো শান্তিতে থাকার উপায় নেই। জানিসই তো সব। পিতৃভক্ত ছেলে, বৌয়ের কথা সংসারের কথা ভাবে না।‘কেন যে ঘরের কথা বলে এমন! যতই একসঙ্গে কাজ করো, কেউ বন্ধু নয়। বিয়ের পর বাপের ঘরে গিয়েও সব কথা বলতে নেই। আর এ তো বন্ধু। তোমার সোয়ামীকে নিয়ে কথা অন্যের কাছে বলবে কেন? বস্তীর ঘরে এমন হয়। তোমরা লেখাপড়া জানা মানুষ, কত বড় ‘মেয়েটার খরচ লাগে না? সেখানে থাকার খরচ দিয়েই তুমি হাত গুটিয়ে নাও, তার শখ আহ্লাদ মেটানোর খরচ নেই? বন্ধুদের জন্মদিনের গিফট, বাইরে খেতে যাওয়া, ওদের জেনারেশন কি আমাদের মতো? তোমার বাবা ভাই বোনই সব? আমার মেয়েটা জলে ভেসে এসেছে? আর আমি নিজে? চাকরি না করলে তুমি একটা হাতখরচ তো দিতে। নাকি? চাকরি করি বলে নিজের সব খরচ আমার?’

এই রে, এবার যে কান্নাকাটি শুরু করল। শান্ত না হলে ছুটির কথাটা বলে কি করে? মনটা

একটু নরম করতে হবে। ঘর মুছতে মুছতে মুখ তুলল দুর্গা, ‘সবই বুঝছি বৌদি। তোমারও তো মা ভাই আছে। সেখানেও তো দিতে থুতে খরচ হয় কিছু। দাদা নিশ্চয় সবটা..’

থামিয়ে দিয়ে বলে উঠল, ‘দেখলি? তুই কেমন বুঝলি? এ লোকটা যদি বুঝত! আমি যদি এবার আমার বাপের বাড়ি টেনে আনি? তবে জানিস তো? ওদিকে আমার খরচা নেই। একেবারে ঝাড়া হাতপা। মাকে বলেই দিয়েছি, পরগোত্তর করে দিয়েছ, আর আমাকে কিছু বোলো না। ভাইয়ের সংসারে মানিয়ে গুছিয়ে থাকো, বৌটাকে জ্বালিও না। হ্যাঁ, আমার আপন পর নেই। পরের বাড়ির মেয়ে বলেই তাকে সব ঝামেলা নিতে হবে, তা যেন না হয়।’

কাজ শেষ করে দরজায় এসে দাঁড়াল।

বিছানায় উপুড় হয়ে মোবাইলে কি করছে বৌদি। ছবি দেখছে, ছবি তুলছে। বিছানার পাশে জলখাবার পড়েছিল, দাদা না খেয়ে বেরিয়ে গেছে, সেটার ছবি তুলল। মোবাইলে সেই ছবিটা নিয়ে দেখছে, আর খুটুর খুটুর করছে।

‘কি রে, কিছু বলবি? বিকেলে তাড়াতাড়ি আসিস, আজ তো বাড়িতেই আছি।‘

‘ওই কথাই বলছিলাম বৌদি। আজ বিকেলে একবার সোনারপুর যাব। ফিরতে রাত হবে। কাল সকাল সকাল চলে আসব।’

‘কেন? তোর শাশুড়ি আবার ডেকেছে নাকি? মেরেধরে তাড়িয়ে দিয়েছিল, এখান রোজগার করছিস বলে বারবার ডাক দিচ্ছে? নাকি তোর বর বেশি মা-মা করছে? নিজে তো রোজ ওসব খেয়ে সব টাকা উড়িয়ে দেয়..’

‘না গো। আমার বর যদি একটু মা-মা করত, তাইলে কি আর এত খারাপ হতে পারত? রোজ ওসব খেয়ে টাকা নষ্ট, শরীর নষ্ট.. সে কি বোঝে? কতবার লক্ষ্মী-সরস্বতীর মাথায় হাত রেখে পোতিগ্গে করেছে.. এমনিতে মেয়েদের এত ভালোবাসে.. কিন্তু নেশার এমন জোর..’

‘যাকগে, বাদ দে। আমি মরছি নিজের জ্বালায়.. এসব শোনার মন নেই আমার। কাল সকালে কামাই করবি না। আয় এখন, দরজা টেনে দিয়ে যাস।‘

প্রায় বেরিয়ে এসেছে, আবার ডাক দিল বৌদি, ‘তোর ননদের কথাটা মনে আছে তো? আমার বন্ধুর বাড়ি বাচ্চা সামলাবার কাজের কথা? বাড়িতে বসে আছে, মাসে অতগুলো টাকা রোজগার হবে, অমন সুন্দর বাড়িতে থাকতে পারবে.. বুঝিয়ে শুনিয়ে আনতে পারিস তো, এবারই নিয়ে আসিস। শিপ্রাকে আমি প্রায় কথা দিয়েই ফেলেছি। তোর ভরসায়, তুই কথা দিয়েছিলি।’

‘না বৌদি, মিনু আর কাজ করবে না। ওই কথা বলতেই যাচ্ছি আজ। আমাদের পাশের ঘরের তপন, চেনো তো ওকে? ইলেকট্রিকের কাজ করতে এসেছে কতবার.. নিজের দোকান দিয়েছে গতমাসে। ওর সঙ্গে মিনুর বিয়ে ঠিক করেছি। এই পুজোটা কাটলেই বিয়ে। তপনের মা বাবার মিনুকে খুব পছন্দ। তাই শাশুড়িমাকে আর মিনুকে আনতে যাচ্ছি। বুড়ো মানুষটা একা একা থাকে, দ্যাওর-জা দেখে না। মিনুটাও চলে যাবে এবার। আমার কাছেই থাকবে এখন থেকে। মিনুও চোখের সামনে থাকবে, নিজের সংসার নিয়ে।’

‘তুই কি পাগল? ওই দজ্জাল শাশুড়ি। সামলাতে পারবি? নিজের চারটে ছেলেমেয়ে। তোর মাও তো থাকে তোর কাছে। দুই বুড়িতে ঝগড়া করবে, আর তুই ভুগবি। আর তোদের ওই সোনারপুরের ঘর ছেড়ে শাশুড়ি আসবেই বা কেন? ছোট ছেলের সঙ্গে ওই নিয়েই ঝামেলা না?’

‘কি আর বলব বলো? আমার দ্যাওর তো আলাদা হাঁড়ি করেছে। নিত্যি ঝগড়া। বুঝিয়ে শুনিয়ে নিয়ে আসব। তবে এবার মিনুর বিয়ে। ঠিক চলে আসবে। এমনিতে আমার গণেশকে বড্ড ভালোবাসে, বড় নাতি বলে কথা.. নাতির টানও আছে।’

‘জানি না। এত কথা মাথায় নিতে পারছি না আমি। যা ভালো বুঝিস, কর। পরে আমায় বলতে আসিস না। আর অত ঝামেলা নিয়ে কাজে কামাই করলেও শুনব না আমি।’

‘না গো বৌদি। এখন তো খরচ আরো বাড়ল। আমার কাত্তিক অবিশ্যি কাজ করছে আজকাল। কেবল টিভির কাজ করছে, সেদিন বললাম না? মায়ে-পোয়ে চালিয়ে নেব। কাজে গাফিলতি করব না। কাজ চলে গেলে অতগুলো পেট খাবে কি? আসলে.. লোভে পড়েছি গো।‘

‘মানে? কার লোভ? কিসের লোভ?’ এমন অবাক যে, মোবাইল থেকে মুখ তুলেছে বৌদি।

‘মানে ওই বাসন্তীমাসি.. মানে তপনের মাযের একটা কথা। আমাকে বলেছে, মিনুকে যে আমরা নিচ্ছি তা তোকে দেখে রে দুগ্গা। তোর নামখানা সার্থক। চার ছেলেমেয়ে, লক্ষ্মী সরস্বতী কাত্তিক গণেশ। মাতাল সোয়ামী, মা দুগ্গার বুড়ো শিবের মতো। বুড়ো মাকে এনে রেখেছিস, আবার অবলা ননদের জন্যেও এত ভাবনা। শাশুড়ি অত অত্যাচার করেছিল, সব ভুলে তাকেও আশ্রয় দিচ্ছিস? এত মায়া, সব্বার জন্যে এত ভাবনা.. বাড়িখানা যে সত্যিই দুগ্গাবাড়ি করে ফেলেছিস। দুগ্গাবাড়ি থেকে মেয়ে আনছি, কত ভাগ্যি আমার!’

ঘামে ভেজা লজ্জা লজ্জা মুখ অপরূপ আলোয় টলটল, ঠিক মা দুর্গার তেল তেল মুখখানার মতো।          

Comments

Top

সান্ধ্যকালে

সূর্যময়ী

আবু রাশেদ পলাশ 

শেরপুর, বাংলাদেশ

girl.jpg
সান্ধ্যকালে সূর্যময়ী

শ্রাবণের মাঝামাঝি থেমে যাওয়া বর্ষাটা দিন দুই বিশ্রামের পর পূর্বাবস্থায় ফেরত যায়। আজকাল বৃষ্টি শুরু হলে থামে না সহসা। মধ্যাহ্নে সূর্যের দিকে দৃষ্টি গেলে বুড়ো মনে হয় ওকে। দিনমান পাংশুটে মেঘের আড়ালে ডাকা থাকে ওটা। গাঁয়ের পথে আলো আঁধারি খেলা হয় এ সময়। মাঝে মাঝে গুড়ুক গুড়ুক মেঘ ডাকে, বিদ্যুৎ চমকায় না। কর্মহীন গাঁয়ের বউয়েরা মেঝেতে বসে কাঁথা সেলায়। কিশোরীরা দল বেঁধে পুতুল বিয়ের খেলা করে সখীদের সাথে । উলঙ্গ, অর্ধউলঙ্গ উড়নচণ্ডী ছেলেগুলো হৈ হৈ রব তুলে কাদা জলে গড়াগড়ি খায়। দৃষ্টিগোচর হলে ধমক দেয় বাবারা - 'হারুনি, শিগগির উইঠা আয় হারামির পুত। ব্যারাম অইলে পাগারে চুবান দিমু নিজ্জস'।

আষাঢ়ে বর্ষা হয়। তার জলে বন্যা হয় করাতকান্দি। শ্রাবণে জলের ধারা থৈ থৈ করে গাঁয়ের সর্বত্র। আউসের ক্ষেত ভাসে সাদা জলে। এবারের বর্ষায় আবাদি জমি গেছে চাষিদের। শুকনো মরসুমে অনাহারে থাকতে হবে অনেককে। উত্তরপাড়ার বিনোদ বর্ষায় আবাদি জমি হারালে চিন্তিত হয়। বিকেলে বানের জলে ডুবে যাওয়া চারাগুলো টেনে তুলে সে। আলীনা পাড়ার আহালু বড়শীতে মাছ ধরতে এলে চোখাচোখি হয় দুজনের। তারপর হাঁক দেয় আহালু 

- 'বিনদেনি, চারাগুলান তুলো যে'?

- 'গরুরে খাওয়ামু মিয়া ভাই'।

- 'উঠে আহ বিড়ি খাই। দখিনা বাতাসে শইলে সার পাইনে গো'।

বর্ষার ধারা থেমে গেলে দখিনা বাতাস বয় গাঁয়ের সর্বত্র। হিমবাতাস আলিঙ্গন করলে বস্ত্রহীন শরীরে কম্পন ধরে সহসা। বড় ব্যাঙের ম্যাগো ম্যাগো শব্দগুলো তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। রাতে ঘরের পাশে ঝিঝি পোকার অবিশ্রাম আওয়াজ শুনা যায়। জানালা খুলে বাইরে তাকালে জোনাকির মিটিমিটি আলো জ্বলে এ সময়। এ আলো গাঁয়ের পথে পথিকের পথ চলা প্রাঞ্জল করে না কখনও। তবে ওর দিকে দৃষ্টি গেলে দিনভর উপোস বেহুলা, জমিলার মত মেয়েরা ক্ষণিকের জন্য পেটের খিদে ভুলে সত্যি।     

উত্তরপাড়ার হামিদ মাস্টার মারা গেছে পাঁচ বছর হতে চলল। কাছে কুলে কেউ নেই তার। একমাত্র ছেলেটা নিখোঁজ আজও। ইটে তৈরি প্রকাণ্ড বাড়িটার চারপাশে জঙ্গল গজিয়েছে অনেক আগেই। লোকে বলে বড় বাড়ি। রাতে শেয়ালের আওয়াজ শুনা যায় বড়বাড়ির চারপাশে। হামিদ মাস্টারের দ্বিতীয় বউ হাসিনা বেগম স্বামীর মৃত্যুর পর বাপের বাড়ি থাকে। বছর দুই আগেও এ পাড়ার জামাল কাজির সাথে যোগাযোগ ছিল তার। জামাল কাজির বড় ছেলে সমু পর মা বলে ডাকতো তাকে। এখন এ পাড়ায় গত সে। জামাল কাজি হামিদ মাস্টারের বাল্যবন্ধু। মৃত্যুর আগে সে বলেছিল - 'কাছে কুলে কেউ নাই যখন জমিগুলান বউরেই লিখে দেও হামিদ।'

জামাল কাজীর কথায় রাজি হয় নি হামিদ মাস্টার। সে বলেছিল - 'না, পুলা যদি ফেরত আসে জমিগুলান ওরে দিও জামাল।'

হামিদ মাস্টারের কথায় সেদিন আপত্তি করেনি হাসিনা বানু । অসম বয়সের যে মানুষের সাথে সংসার বেঁধেছে সে, আর যায় হোক এখন তো সে সত্তার কেউ। তার কাছে ভালবাসা ছাড়া আর কি বা চাওয়ার আছে? এরপর একদিন বড়ঘরের মেঝেতে গড়াগড়ি দেয় হাসিনা বানু। হামিদ মাস্টার মারা গেছে একটু আগে। সমু এখন করাতকান্দি প্রাইমারী স্কুলের হেডমাস্টার। জামাল কাজির কিনে দেওয়া সাইকেলটা এখনো আছে ওর। মোটা ফ্রেমের চশমাটা পড়ে বাইরে বের হলে সমীহ করে সবাই। বিকেলে বাড়ি ফেরার পথে হামিদ মাস্টারের বাড়িটা পাশ কাটিয়ে আসতে হয় সমুকে।ওদিকে দৃষ্টি গেলে পুরনো মানুষগুলোর কথা মনে হয় তার। দুবছর হতে চলল হামিদ মাস্টারের এক বিধবা বোন এসে বসতি গড়েছে এখানে। সাথে জুয়ান ছেলে তার, নাম ভুলা। বদের হাড্ডি, হাতে একটা ধারালো চাকু নিয়ে সারাদিন পাড়ায় ঘোরাঘুরি করে সে। নিরীহ মানুষগুলোর কাছে নিজেকে ডাকু বলে পরিচয় দেয়। লোকে বলে ভুলা ডাকু। ভুলা ডাকু দুর্ধর্ষ, এ পাড়ার কেউ লাগতে যায় না ওর সাথে। করাতকান্দির বখে যাওয়া ছেলেগুলোর সাথে বন্ধুত্ব করেছে সে। রাতে ওদের সাথে মেথর পাড়ার ভাত পচা মদ খেয়ে পড়ে থাকে রাস্তায়। সংসারের ধার ধারে না। বড়বাড়ির চারপাশে মৌসুমি ফলের বাগান। এগুলো বেচেই সারা বছর সুখে দিনাতিপাত করে মা-ছেলে।

এর মধ্যে একদিন জ্বরে পড়ে সমু। সেদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে রাস্তার কাদায় পড়ে যায় সে। বৃষ্টির পানিতে ভিজলে গায়ে জ্বর আসে ওর। সে জ্বর কমেনা সহসা। দিন দুই প্রায় অচেতন থাকার পর একদিন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ে সকালে। কিন্তু শরীরে শক্তি পায় না সে। হাতের চশমাটা চোখে দিলে উঠানে দৃষ্টি পড়ে ওর। ঝম ঝম বৃষ্টি হচ্ছে এখনও। সমু হাঁক দেয়, 

- 'মা, আজ কি বার কও তো?'

রাহেলা বানু বলে - 'বিসসুদবার।'

- 'বিসসুদবার?' সহসা চমকে উঠে সমু। গত দুইদিন প্রায় অচেতন ছিল মনে নেই তার। উত্তরপাড়ার হারেস আলীর ছেলে মনা সমুদের বাড়িতে চুক্তি খাটে। সমুর ডাক শুনলে এক সময় এসে ভেতরে দাঁড়ায় সে। হাতে একটা কাগজ দিয়ে সমু বলে,

- 'কাগজখান তর ঝুমু আপারে দিস মনা।'  উত্তর পাড়ায় হোসেন তালুকদারের বাড়িটা মসজিদের কুল ঘেঁষে। পাড়ায় সচ্ছল গেরস্ত সে। ঘরে বউ ছাড়াও একমাত্র মেয়ে আছে তার। নাম ঝুমু। সমুর সাথে মন দেওয়া নেওয়া করেছে সে।

ওদের সম্পর্কের বয়স হয়েছে বেশ। এখন সম্পর্কে স্থিত হওয়ার স্বপ্ন দুজনের। সময় পেলে গাঁয়ের পথ ধরে হাঁটে ওরা। নিতাই মাঝির ধান ক্ষেতের পাশ দিয়ে যে বড় সড়ক শহরমুখী চলে গেছে তার পাশে বসে গল্প করে দুজন।এরপর একদিন করাতকান্দি গ্রামে অপরিচিত মুখের আগমন ঘটে হঠাৎ। এক বিকেলে হাঁটু সমান কাদা মাড়িয়ে ভেজা কাকের মত নিজ বাড়িতে ফিরে আসে তারেক।

তারেকের কথা মনে আছে? হামিদ মাস্টারের ছেলে বাবার সাথে রাগ করে একদিন নিরুদ্দেশ হয়েছিল সে। সেই তারেক ফিরে এসেছে পনের বছর পরে। ও নিরুদ্দেশ হওয়ার পর বছরে একটা দুটো চিঠি লিখত বাবার কাছে। কিন্তু গ্রামে আসেনি কোনদিন। হামিদ মাস্টার মারা যাওয়ার আগে ছেলেকে দেখার ইচ্ছে হয়েছিল খুব। কত খুঁজেছে ওকে, সন্ধান দিতে পারেনি কেউ। তারেক ফিরে এলে গাঁয়ের মেয়েরা বলাবলি করে,

- 'হুনছনি বু, হামিদ মাস্টরের পুলানি ফেরত আইচে কাইল।'

- 'হাচানি, বাপের ভিটায় বাতি জ্বলব মালুম অয়।'

তারেকের ফেরার সংবাদে কিছুদিন জটলা করে গাঁয়ের ছেলে বুড়োরা। কুশলাদি জিজ্ঞেস করে ওর। এতদিন কোথায় ছিল, কি করত এসব কথা জানতে চায় সবাই। এদিকে তারেকের ফেরার খবর মনার মাধ্যমে জানতে পারে জামাল কাজি। তারপর লোক মারফত খবর পাঠায় সে -তারেক যেন একবার দেখা করে ওর সাথে। বয়সের বাড়ে ন্যুব্জ কাজি হাঁটতে পারে না এখন। লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়ালে শরীরটা ঠক ঠক কাঁপে তার। অবশেষে খবর পেয়ে তারেক স্বয়ং একদিন দেখা করতে যায় কাজি বাড়ি। তারেক এলে আহাজারি করে জামাল কাজি,

- 'আইলাগো বাজান? এতদিন পরে যে, বাপ আর নাইগো তোমার'।

সহসা জবাব দেয় না তারেক। এ কথার উত্তর কি হতে পারে জানা নেই তা। ও চুপ করে থাকলে জামাল কাজী আবার বলে - 'মরুন কালে তোমারে দেখুনের সাধ অইচিল তোমার বাপের, কত খুঁজলাম পাইলামনা তোমারে।'

- 'আপনের শরীর কেমুন কাকা?'

- 'ভালা, আইছ যহন যাইও না আর। মিসতিরি খবর দেও, ঘরখান মেরামত কর তাইলে।'

-  'একলা মানুষ ........?'

- 'বউরে নিয়া আহ বাজান। বাপের ভিটা ফেলায় রাখুন ভালানা'।

ঐদিন ফেরার পথে সমুর সাথে দেখা হয় তারেকের। তারপর চোখাচোখি হয় দুজনের। সমু দৃষ্টি সরিয়ে নিলে তারেক হাঁক দেয়,

- 'আমারে ভুইলে গেচিস গুল্লু?'

গুল্লু বললে পুরনো কথাগুলো মনে হয় সমুর। ছোটবেলায় গুলগুলি খাওয়ার নেশা ছিল ওর। তারেকের পকেটের টাকা কতবার ওর পেছনে খরচ হয়েছে তা কি ভুলা যায়? রাতে ঘুমানোর আগে মায়ের সাথে গল্প করে সমু। এক এক করে সবার কথা মনে হয় তখন।   করাতকান্দি গ্রামে হামিদ মাস্টারের বাড়িটা শহরমুখি সড়কের কূল ঘেঁষে। মস্ত বাড়ি। একপাশে তার মৌসুমি ফলের বাগান, অন্যপাশে প্রকাণ্ড বাঁশঝাড়। গ্রীষ্মের উন্মত্ত সূর্যও এখানে মৃত প্রায়। বাড়িতে দিনের এলো পড়ে না সহসা। হামিদ মাস্টারের গোছান সংসার। স্ত্রী খদেজা বেগম ছেলেকে নিয়ে সুদূরপ্রসারী স্বপ্ন দেখে। হামিদ মাস্টার খেতে বসলে হাতপাখায় বাতাস করে সে। এরপর একদিন রোগে পড়ে খদেজা বেগম, পচন রোগ।

দেশি-বিদেশি কত কবিরাজ, ডাক্তার দেখানো হয় রোগ ছাড়ে না তার। শরীরের মাংস পচে পোকা ধরে স্বস্থানে। তারপর আর বেশিদিন বাঁচেনি খদেজা বেগম। শেষ মুহূর্তে প্রিয়তমা স্ত্রীকে বাঁচানোর জন্য হামিদ মাস্টার যেন মরিয়া হয়ে উঠেছিল। স্ত্রী শোকে ভেতরে ভেতরে অশ্রু বিসর্জন দিত সে। মরার আগে খদেজা বেগম বলেছিল,   

- 'আপনেরে একখান কতা কমু, রাখবেন নি?'

- 'নিজ্জস, কও হুনি।'

- 'আমি মরে গেলে একখান নিকা কইরেন আপনে, কলানি থাকুন যায়?'

  প্রিয়তমা স্ত্রীকে সেদিন মিথ্যে আশ্বাস দেয় হামিদ মাস্টার। ভালবাসা দেহে হয়, মনেও। সব নারীতেই দেহ ক্ষুধা নিবারণ হয় হয়ত কিন্তু মন ক্ষুধা? খদেজা বেগমের সত্তায় যে রস আস্বাদন করেছে হামিদ মাস্টার, পর নারীতে সাধ্য কই?

খদেজা বেগম মারা যাওয়ার পর হামিদ মাস্টারের সংসারটা বদলে যায় দ্রুতই। মেয়ে মানুষহীন সংসার হয় না। স্নেহপাগল তারেকের দিকে দৃষ্টি গেলে ভেতরটা আঁকুপাঁকু করে তার। কাজিবাড়িতে তখন আনাগোনা বাড়ে হামিদ মাস্টারের। বন্ধু জামাল কাজির সাথে বসে খোশ গল্প করে সে। কাজি বলে,

- 'এবার একখান নিকা কর হামিদ।'

- 'নিকানি? পুলার গোসসা অইব মুনে কয়।'

- 'গসসানি, মিছা কতা। মাইয়া মানুষহীন সংসার অয়না ভাই।' এরপর সত্যি একদিন বিয়ে করে ঘরে দ্বিতীয় স্ত্রী আনে হামিদ মাস্টার। কেন যেন, পিতার এহেন কর্মে খুশী হয় না তারেক। কে জানে, নিজের মায়ের জায়গা হয়তো পর নারীতে দিতে নাখোশ সে। হাসিনা বেগম মানুষ ভাল, দেখতেও বেশ। অসম বয়সের স্বামী, আর অনাকাঙ্ক্ষিত পুত্র - তাদের নিজের বলে মেনে নিতে দেরি হয় না তার। গাঁয়ের মেয়েরা বলাবলি করে,

- 'হুনছনি বুজান, মাস্টারের বউ দেহি বেটির বয়স।'

- 'ছি! ছি! তবা তবা, সুরতে কালি মাখল মালুম অয়।' স্কুলে গেলে গাঁয়ের ছেলেরা ক্ষ্যাপায় তারেককে। ওদের ক্লাসের মতি কালো পাঠার মত চেহারা, সারাদিন তারেকের পেছনে পড়ে থাকে সে। একদিন ওর সাথে কলহ হয় তারেকের। মতি বলে, - 'জুয়ান মায়ের সোহাগ কেমুন কত হুনি।' এরপর মেট্রিক পরীক্ষা দিয়ে নিরুদ্দেশ হয় তারেক। সেবার হামিদ মাস্টার কত খুঁজেছে ওকে, পায় নি কোথাও। মাস দুই পর একটা চিঠি এসেছিল ডাক হরকরার মাধ্যমে। তারেকের চিঠি। তাতে লেখা - 'নিরুদ্দেশ হলাম বাজান, খুঁজো না আমারে।' এরপর শহরে কত কষ্ট করেছে তারেক। বাবার কাছে সহযোগিতা নেয় নি কোনদিন। সেই তারেক ফিরে এল এত বছর পর। কেন এল সে? নিজের প্রাপ্য বুঝে নিতে নাকি অন্য কোন কারণ আছে তার? ব্যাপারটা ভাবায় সমুকে।আজকাল প্রায়ই তারেককে বাবা-মার কবরের পাশে দেখা যায়। সাথে আনা সাদা রঙের চাদরটা গায়ে জড়িয়ে বসে থাকে সে। শরীর ভাল নেই। চোখগুলো দিনে দিনে শুকিয়ে যাচ্ছে ওর। পুরনো অসুখটা বেড়ে গেছে হঠাৎ। নাকে মুখে ঘা হতে শুরু করেছে এখন। প্রস্রাব হয় না সহসা, প্রস্রাবের রাস্তায় রক্ত আসে মাঝে মাঝে। খদেজা বেগম মারা যাওয়ার আগে এমন হয়েছিল তার। এখানে একাকী জীবনে অরুকেও মনে পড়ে খুব। অরুর কথা মনে আছে?তারেকের বউ। একই কলেজে পড়েছে ওরা। তারপর বিয়ে।করেছে নিজেদের পছন্দে আলীপুর শহরে একটা টিনের দুচালা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতো দুজন। অভাব ছিল, ভালবাসার কমতি ছিল না কোনদিন। সেই অরুকে ছেড়ে এসেছে তারেক। আসার আগে কলহ করে এসেছে সে। কে জানে এখন কেমন আছে অরু? আজকাল ওকে দেখতে ইচ্ছে করে খুব। যেদিন অরুকে ফেলে তারেক চলে আসছিল সেদিন কতনা কেঁদেছে মেয়েটা। ওর দিকে তাকিয়ে দয়া হয় নি পাষণ্ডটার। অরু বলেছিল,

- 'আমাকে সাথে নাও সোনা, তুমি ছাড়া বাঁচব না আমি।'  

ওর কথা শুনে ধমকে ছিল তারেক। বলেছিল - 'ছেড়ে দাও এবার। সংসারে বিতৃষ্ণা এখন।'

সেদিন বাসা থেকে বেড়িয়ে তারেকও কেঁদেছিল গোপনে। উপায় ছিল না তার। ভঙ্গুর জীবনে অরুকে কোন দিন স্বাচ্ছন্দ্য দিতে পারে নি সে। জীবন আকাশে ডুবন্ত সূর্যের বেলায় রৌদ্রজ্জ্বল পৃথিবী দেওয়ার  সামর্থ্য কই? তার চেয়ে কষ্ট পাক অরু, তবু যদি সুখী হয় কোনদিন। সঙ্গী বিহীন জীবন চলে না, সান্ধ্যকালে এসে আজ অন্তত এতটুকু বুঝতে পেরেছে তারেক। সেদিন হাসিনা বেগমের বউ হয়ে আসা এক অর্থে ঠিক ছিল হয়তো। সে না এলে একাকি জীবনে হামিদ মাস্টার কতদিন বাঁচত বলতো?

এর মধ্যে একদিন ঝুমুর সাথে সম্পর্কে টানাপড়েন তৈরি হয় সমুর। হোসেন তালুকদার মেয়ের জন্য পাত্র খুঁজে অনেকদিন ধরে। ঝুমুকে সংসারী দেখে হজে যাওয়ার ইচ্ছে তার। সম্প্রতি পাত্র একটা পেয়েছে সে। ছেলে ভাল, দেখতেও বেশ। তবে রাজি নয় ঝুমু। কারণ জিজ্ঞেস করলে সদুত্তর দেয় না সে। ফলশ্রুতিতে মেয়েকে মারে হোসেন তালুকদার। এরপর একদিন নদীর পাড়ে নৌকার গলুইয়ে বসে কথা বলতে দেখা যায় দুজনকে। ঝুমু বলে,

- 'কিছু কওনা যে সমু ভাই?'

সমু কথা বলেনা সহসা। জামাল কাজির কথা মনে হয় তার । অসুস্থ সে। এ সম্পর্ক সেও মেনে নিবে না এখন। সমু চুপ করে থাকলে ঝুমু আবার বলে,

- 'মুখখান দেখাইওনা আর। পুরুষ মানুষ এমুননি?' 

মন খারাপ হলে তারেকের কাছে আসে সমু। তারেকের শরীর খারাপ বিচলিত করে তাকে। সেদিকে ভ্রূক্ষেপ করে না তারেক। সে বলে,

- 'ঝুমুরে এবার ঘরে নে সমু, মেয়েটা ভাল দেখি।'

তারেকের ফিরে আসায় গাঁয়ের সবাই খুশি হলেও মনে মনে হয়তো খুশি হতে পারে না হরবলা বিবি। এতদিন যে সম্পত্তি একা ভোগ করে আসছিল সে, তা হঠাৎ হারানোর আশংকা হয় তার। পাড়ার মেয়েদের সাথে কথা বললে ভাইপোর নামে কুৎসা রটনা করে হরবলা বিবি।

- 'পুলানি, কেমুন পুলা কওতো, বাপ মরলে আহেনা যে? এমুন পুলার মুখে ঝাঁটা।'

তারেক বুঝতে পারে সবই। ভুলাও কেমন চোখ বড় বড় করে তাকায় আজকাল। তারেককে দেখিয়ে চাকু ধার দেয় সে। বখে যাওয়া ছেলেগুলোর সাথে কি সব পরামর্শ করে যেন।

একদিন সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে অবাক হয় সমু। বাড়িতে ঝুমুকে দেখে রীতিমত চমকে উঠে সে। অন্দরে দৃষ্টি দিলে দেখে দশ বারো জন মানুষ কি সব বলাবলি করছে। রাহেলা বেগম বলে, - 'ঝুমুরে আমার খুব পচন্দ, তর পচন্দ কস নাই যে?'

পরক্ষণে সবকিছু বুঝতে পারে সমু। সেদিন তারেকের কাছে গেছিল ঝুমু। কি যেন বলে এসেছে তাকে। তারপর তারেক স্বয়ং এ সবের ব্যবস্থা করেছে এখন। দৃষ্টিগোচর হলে তারেক বল্‌

- 'আজ যার হাত ধরেছিস, ছাড়িস না গুল্লু। সঙ্গীহীন মানুষ বাঁচে না রে।'

এরপর দিনে দিনে তারেকের অসুস্থতা বাড়ে আরও। তাড়াইল বাজারের বিরু ডাক্তার এসে স্যালাইন দিয়ে যায় ওকে। তারপর একদিন সকালে একটা বুনো গন্ধে ঘুম ভাঙে তারেকের। ঘরে কোথাও ইঁদুর মরেছে হয়তো। দিনের এলো তখনও ফুটেনি। বড় ঘরের দরজা খুলে দেখে অরু দাঁড়িয়ে। চোখাচোখি হলে রীতিমত চমকে উঠে তারেক। এ বাড়ির খবর জানার কথানা ওর। তবুও অরু চলে এসেছে কেমন করে যেন। এটা যে সম্পর্কের টান, ভেতরে যে সঙ্গীহীন রিক্ততা। এ ভাবনা কারও মনে আসে না তখন। তারপর মান-অভিমানের একপালা গান হয় দুজনের মধ্যে।

কয়েক বছর আগের কথা। সেবার খুব অসুস্থ হয়েছিল অরু। তারেকের মত। ডাক্তার বলেছিল কিডনি প্রতিস্থাপনের কথা। সরকারি অফিসের ছাপোষা কেরানি, কত বা বেতন হতে পারে তারেকের। দুবেলা ডাল-ভাত জোগান দেওয়ার সামর্থ্য ছিল হয়ত। স্ত্রীর চিকিৎসা নয়।ভালবাসা পাগল মানুষটা মরিয়া হয়েছিল সেদিন। উপায়ন্তর না দেখে নিজের একটা কিডনি দিয়েছিল অরুকে। সত্যিটা আজও জানা হয়নি অরুর। অবশেষে একদিন সমুর কাছে সত্য উন্মোচিত হয়, ততদিনে ছাড়পত্র এসে গেছে তারেকের। সমু বলে - 'জমিগুলান বেঁচো তারেক ভাই, চিকিৎসা কর নিজের।'

রাজি হয় না তারেক। সে বলে - 'দুর্দিনে যে বাপের কাজে আসি নাই, আজ নিজের জন্য তার সম্পদ ব্যবহার করি কি করে বলত? এত অকৃতজ্ঞও মানুষ হয়?'

তারেকের বউ অরু সন্তানসম্ভবা। আজকাল নিজের সন্তানের মুখ দেখতে ইচ্ছে করে তার। পরক্ষণে সন্দেহ হয় ছাড়পত্রের মেয়াদ কতদিন? তারপর রাতে পুরনো অতীতগুলো মনে করে সুখ-দুঃখের একপালা গান রচনা করে দুজন। পরমুহূর্তে তারেক বলে,

- 'কথা দাও সোনা'। অরু বলে - 'কি? - 'আমি মরে গেলে আবার বিয়ে করো তুমি। সঙ্গীহীন বাঁচা দায়।'সহসা তারেকের কথার জবাব দেয় না অরু। চোখাচোখি হলে অশ্রু বিসর্জন দেয় দুজনই।

Comments

Top

অস্ফুষ্ট 

আর্তি

আবু রাশেদ পলাশ 

শেরপুর, বাংলাদেশ

masjid.jpeg
অস্ফুষ্ট আর্তি

মিয়া বাড়ির মসজিদে ফজরের আযান ধ্বনিত হলে নিশিতে নিদ্রিত মানুষগুলোর নিদ্রা ভাঙে। রাতের গায়ে জোছনা শোভিত অন্ধকার তখন আরেকটি নতুন প্রভাতের ডাক শুনে দিনের আলোয় মুখ লোকায়। গেরস্ত বাড়ির মোরগটাও নিদ্রা ভাঙার গান জুড়ে এ সময়। শব্দ শুনে ঘুমকাতর শিশুগুলোকে মায়েরা ঠেলা দিয়ে তুলে দেয়। আধো ঘুমে ঢল ঢল শিশুগুলো বাইরে এসে ছাইয়ের গাঁদি থেকে পুড়া কাঠের কয়লা তুলে মাজন করতে করতে পুকুরের দিকে চলে যায়। একসময় প্রভাত কাকলীর মধ্যে আগমন ঘটে দিনের সূর্যটার।

গ্রামের নাম চৌহালী। তার জন্মের ইতিহাস কালগর্ভে বিলীন। ওর বুক জুড়ে বহমান কালীনদির স্রোত প্রবাহ এ গ্রামকে হিন্দু-মুসলমান পাড়ায় বিভাজিত করেছে। নদী নারী পুরুষের মিলনস্থল। স্থান, কাল নির্বিশেষে একই নদীর স্রোত জলে স্নান করে শুদ্ধ হয় সবাই। মুসলমান পাড়ার উত্তরে মিয়াদের বাস। অপেক্ষাকৃত জনবহুল এ জায়গাটা গায়ে টুগিপাড়া নামে পরিচিত। এখানে ভূমিহীন ঐসব মানুষেরা বসবাস করে নিম্নবিত্তের দৃষ্টিতেও যারা ছোটলোক। ছোটলোকদের থাকার জায়গাও সামান্য। ঘরগুলো একটার সাথে আরেকটা লাগানো। উঠানে তিল ধারণের জায়গা পাওয়াও  মুশকিল।

বুড়ো বাহারুদ্দিন মিয়াবাড়িতে বয়োজ্যেষ্ঠ। সংসারে স্ত্রী ছাড়াও একমাত্র মেয়ে আছে তার। নাম জরি। কয়েক বছর আগে উজানতলীর হাশেমের সাথে বিয়ে হয়েছিল ওর। সংসার টিকে নি সেখানে। স্বামী তালাক দিলে এখন বাপের বাড়ি এসে থাকে সে। বাহারুদ্দিনের ঘরের সাথে লাগানো ছোট ছোট ঘরগুলো যথাক্রমে আহালু, আরজ আর মধুর শুকনো মরসুমে মধু ভাঙ্গুরা বাজারে বড়কর্তার আরতে কাজ করে। সাথে ভোদরও। কাজ শেষে একই পথে বাড়ি ফিরে ওরা। রাতে মধু যখন বাড়ি ফিরে মিয়া বাড়ির প্রতিটি ঘরে তখন পিদিমের শেষ আলোটা নিভু নিভু করে। ভেতরে ডুকে ম্যাচের কাঠি জ্বালালে জরির রেখে যাওয়া কিছু একটা চোখে পড়ে তার। আনন্দে চোখগুলো জ্বলজ্বল করে তখন। খেতে বসলে জরির কণ্ঠ শুনা যায়।

- 'মধু ভাই আইলা'?

- 'হ,ঘুমাস নাই অহনো'?

- 'চইত মাসের গরমে পুইড়ে মরি'।

- 'হাচানি? গায়ে সার পাইনে আইজ জার করে কেবল'।

- 'কি কও, জরনি আহে দেহি'?

মধুর কপালে হাত দিয়ে শিউরে উঠে জরি। কখন যেন জ্বর এসেছে ওর। পরক্ষণে রসুন সমেত তেল গরম করে এনে দেয় তাকে। রাতে বিছানায় শুয়ে ভাবনায় পড়ে মধু। ভাবনার জগতে সমস্ত জায়গা জুড়ে বিচরণ করে জরি। শেষ রাতে ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ে ওর। সকালে বাইরে এসে জরিকে খুঁজে সে। দেখা পায় না কোথাও। আহালুর মেয়ে বুচি জানায় ভোরে মামার বাড়ি গেছে সে, আসবে ভর সন্ধ্যায়।মুসলমানপাড়ার খড়িমণ্ডল সচ্ছল গেরস্ত। ঘরে জোড়া বউ তার, সন্তান নেই। এ পাড়ায় সালিশ করে বেড়ায় সে। বাহারি পণ্যের ব্যবসা আছে বাজারে। একই পাড়ার শুলাই মণ্ডলের খাস লোক। মণ্ডলের ব্যবসা দেখাশুনা করে সে। বিকেলে ভাঙ্গুরা বাজারে নিজের আরতে বসলে লাভের টাকাগুলো শুলাই তুলে দেয় তার হাতে। সন্ধ্যায় ভাঙ্গুরা বাজারে সওদা করতে যেয়ে এক অচেনা রমণীকে দেখলে খড়িমণ্ডলের চোখ আটকে থাকে সেদিকে। মাঝে মাঝে ডানে বামে তাকায় মেয়েটি। সন্ধানী চক্ষুযুগল পরিচিত কাওকে খুঁজে ফিরে হয়তো। ব্যর্থ হলে আবার সস্থানে দাঁড়িয়ে থাকে সে। ফেরার পথে খড়িমণ্ডল নিজের নৌকায় তুলে নেয় তাকে। মণ্ডল বলে,

- 'কাগো বাড়ির বেটি তুমি'? 

- 'টুগি পাড়া মিয়া বাড়ি'।

- 'গেছিলা কই'?

- 'ধানশাইল মামুগো বাড়ি'।

- 'একলানি গেচিলা,ডরাও না'?

মণ্ডলের কথার জবাব দেয় না জরি। ও কথা না বললে মণ্ডলও চুপ হয়ে যায় একসময়। পরক্ষণে নৌকার পাটাতনের উপর একজোড়া সাদা পা দৃষ্টিগোচর হলে চক্ষু পড়ে থাকে সেদিকে। সে পা সহসা চোখের আড়াল হয় না, জরির প্রস্থানেও।

কর্তার আরতে কাজ না থাকলে বাড়িতে অলস সময় কাটায় মধু। ও বাড়ি থাকলে ট্রাঙ্কে রাখা আসমানি রঙা শাড়িটা পড়ে জরি, মাথায় জপজপে তেল দেয়। তারপর ওর সামনে পায়চারী করে অনেকবার। মধু নিজের ঘরের দাওয়ায় বসে হুঁকা টানে। মাঝেমাঝে আড়চোখে জরিকে দেখে সে। এরমধ্যে একদিন কালবৈশাখী ঝড় হয় গ্রামে। টুগি পাড়ায় আহালুর ঘর পড়ে যায় ঝড়ে। সে উছিলায় একদিন মিয়া বাড়িতে আগমন ঘটে খড়ি মণ্ডলের। মণ্ডল এলে বাহারুদ্দিনের ঘরের দাওয়ায় বসতে দেওয়া হয় তাকে। মনে মনে জরিকে খুঁজে সে। দৃষ্টিগোচর হলে পুলকিত হয় মণ্ডল । যাওয়ার সময় বলে যায়,

- 'আহালু একবার আইয়ো আমার বাড়ি, কিছু টেহা দিমুনি। ঘরখান তুলো শিগগির'।      

রাতে বাড়ি ফিরে ভাবনায় পড়ে মণ্ডল। নৌকার পাটাতনে দেখা একজোড়া সাদা পা আর বাহারুদ্দিনের বাড়ির দহলিজে দেখা একটা মেয়ে মানুষের মুখশ্রী ভেতরে জ্বালা ধরায় তার। মনে মনে ঘরে তৃতীয় স্ত্রী আনার পাঁয়তারা করে 

সে। হ্যাঁ, আরেকটা নিকা করবে খড়িমণ্ডল। নিকা করবে নৌকার পাটাতনে দেখা সেই সাদা পায়ের রমনিকেই। এরপর মাঝেমাঝেই শুলাইকে মিয়া বাড়ির আশেপাশে ঘোরাঘুরি করতে দেখা যায়। জরিকে খুঁজে সে। দৃষ্টিগোচর হলে খড়ি মণ্ডলের দেওয়া জিনিসগুলো তুলে দেয় ওর হাতে । জরি নিতে না চাইলে শুলাই বলে,

- 'ডরাও ক্যান, আমিনা তোমার কাহা অই'?

  বৈশাখ মাসের শেষের দিকে ব্যস্ততা বাড়ে ছেলেদের। ব্যস্ত হয় মেয়েরাও। সামনে আগত বর্ষাকে কেন্দ্র করে হিন্দু - মুসলমান পাড়ার ঘরে ঘরে জাল তৈরির সরঞ্জাম শোভা পায়। বড় ঘরের  দাওয়ায়  বসে দিনমান জাল বুননের কাজ

করে সবাই। আরজের ছেলে হুলু বাজার থেকে সুতা আর বঁড়শি কিনে এনে মধুর জন্য অপেক্ষা করে। মধুর কাছে মাছ ধরার ছিপ বানিয়ে নিবে সে। কিন্তু সহসা সময় হয় না মধুর। ও এখন হিন্দু পাড়ায় নৌকা মেরামতের কাজে ব্যস্ত । ভোদড়কে সাথে নিয়ে আগামী বর্ষাটা বড়কর্তার নৌকায় কাটানোর ইচ্ছে তার। রাতে বাড়ি ফিরলে দেখা হয় জরির সাথে। জরি বলে,

- 'হারাদিন কই থাহ মধু ভাই, দেহিনা যে?'

- 'কর্তার নাওয়ে কাম নিছি, বানের মসুম নাওয়ে থাকুম।'

- 'হলু হুতা,বশি কিননে আনছে। হেরে বশি বানায় দিও একখান।'

আরজের বউ জুলেখা মারা গেছে একবছর হতে চলল। মরার সময় কলেরা হয়েছিল মেয়েটার। স্ত্রী শোকে এখনো বিয়ে করেনি আরজ। মা মরা হুলু সারাদিন পুষা কুকুরের ন্যায় এ বাড়ি ও বাড়ি আনাগোনা করে। ওর দিকে দৃষ্টি গেলে ভেতরটা হাহাকার করে আরজ আলীর। মেয়ে মানুষহীন সংসার হয় না। যে ব্যাঘ্র একবার মাংসের সন্ধান পায়, পরমুহূর্তে লোভ সংবরণ করতে পারে না সে। আজকাল একাকি বিছানায় শুয়ে মেয়ে মানুষের অভাববোধ করে আরজ। নারী সত্ত্বার যে স্বাদ পেয়েছে সে, তার লোভ সামলানোর সাধ্য নেই তার। এখন ঘরে বউ দরকার। এরই মধ্যে হঠাৎ শুলাইয়ের সাথে কলহ হয় মধুর। একদিন সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার পথে জরিকে হেসে কথা বলতে দেখে সে। শুধু কথা বললে হয়তো কলহ করত না মধু। শুলাইয়ের দেওয়া জিনিসগুলো যখন জরি নিল তখনই রেগে গেল সে। পরক্ষণে শুলাইকে একটা ঘুষি মেরেছে মধু। তারপর চিৎকার করেছে ওর সাথে, 

- 'হারামিরপুলা ইনু কি?'

- 'আমি আইছিনি, তোমার বইন আইতে কয় যে?' তারপর যাওয়ার সময় শাসিয়ে যায় শুলাই। 'ছাড়ুম না,  মণ্ডলরে কয়ে শাস্তা করুম তরে।'

সেদিন জরির সাথে কথা বলে না মধু। বড়ঘরের দাওয়ায় থ মেরে বসে থাকে অনেকক্ষণ। খড়ি মণ্ডলের কথা মনে হলে অজানা আশংকা এসে ভীর করে নিজের মধ্যে। মুসলমানপাড়ায় এ মানুষটাকে যমের মত ভয় পায় সবাই । শুলাইকে মারার খেসারত দিতে হবে নিশ্চয়। শুলাই কি আর যে সে মানুষ। স্বয়ং খড়ি মণ্ডলের খাস লোক সে। এ পাড়ায় সবাই সমীহ করে তাকে। মধু বসে থাকলে এগিয়ে আসে জরি, মান ভাঙানোর চেষ্টা করে তার। - 'গোসসা অইছেনি মধু ভাই'? মধু সহসা জবাব না দিলে জরি আবার বলে - 'শুলাইরে হগল ফিরত দিমু, গোসসা ছাড়ান দেও অহন' এরপর ভাঙ্গুরা বাজারে গেলে ভয়ে ভয়ে থাকে মধু। সহসা খড়ি মণ্ডলের সামনে পড়ার

সাহস করে না সে। হঠাৎ একদিন আচমকা ডাক পড়ে মধুর। পরক্ষণে খড়ি মণ্ডলের আরতে গিয়ে বসতে হয় তাকে। মণ্ডল বলে,

- 'মধু মিয়া যে, ভালা আছ মুনে কয়?'

- 'হ, ভালাই। জলদি কয়ে ছাড়ান দেন কাম আছে মেলা।'

- 'বহ মিয়া তাড়া কিয়ের? মনা একখান বিড়ি দে মধুরে। শুলাইরে মারছ হুনলাম, বিবাদ ছাড়ান দেও। হেতো তোমার কাহা অয়।'

- 'কাহানি? আরেকদিন আইলে ঠ্যাং খান ভাঙে দিমু।'

তারপর আর কথা বাড়ায় না মধু। সোজা গাঁয়ের পথ ধরে সে। আরতে বসে রাগে ফোঁপায় শুলাই। খড়ি মণ্ডল ধমক দেয়,

- 'চেতস ক্যান হারামির পুলা, গোসসানি তর একলা অয়। ছাড়ুম না নিজ্জস।'

বর্ষা মরসুমের হিন্দু, মুসলমান পাড়ার ছেলেরা কাজে ব্যস্ত হয়। কালি নদীর উত্তাল ঢেউয়ের সাথে তখন সম্পর্ক গড়ে ওরা। মধুকে মালবোঝাই নৌকা নিয়ে যেতে হয় ইছামতী। বর্ডারে পণ্য চোরাচালানের ব্যবসা করে বড়কর্তা। এদিকে হিন্দু, মুসলমান পাড়ায় কোন কাজ না পেলে বিপাকে পড়তে হয় আরজকে। নৌকা, জাল কোনকিছুই নেই তার। হিন্দু পাড়ার যোগেশ ওর নৌকায় কাজ দিতে চেয়েছিল তাকে, গতকাল এসে না করে গেছে সে। অবশেষে উপায় না দেখে গণেশের নৌকায় দিনমজুরির কাজ নেয় আরজ। একদিন সন্ধ্যায় সওদা করে ফেরার পথে খড়ি মণ্ডলের সাথে দেখা হয় তার । মণ্ডল বলে,

- 'কার নাওয়ে কাম নিছ আরজ, ভালানি?'

- 'হিন্দু পাড়ার গনশা দিনমজুরি জুত নাইগো।'

- 'তাইলে আমার নায়ে আহ মিয়া, ভালা মজুরি দিমু নিজ্জস।'  হিন্দু, মুসলমান পাড়ার দরিদ্র জেলে সম্প্রদায় বর্ষার এ সময়ে অতিরিক্ত অর্থ উপার্জনের স্বপ্ন দেখে। চৈত্র মাসের ধরুন অভাবে জমানো অর্থ খরচ করতে হয় তখন। আজকের এই দুঃসময়ে খড়ি মণ্ডলের প্রস্তাবটা মনে মনে পুলকিত করে আরজকে। অবশেষে মণ্ডলের নৌকায় কাজ নেয় সে। বর্ষার মওসম শেষ হলে অলস সময় কাটাতে হয় সবাইকে। পানি কমলে কর্তার আরতে কাজ পাবে মধু। কালিনদীর পশ্চিমে দ্বীপসদৃশ খানিকটা জায়গা। বহুকাল ধরে চর জাগার পাঁয়তারা চলে সেখানে। নদীতে যখন থৈ থৈ পানি তখনো ওটা সগর্বে দাঁড়িয়ে থাকে স্বস্থানে। লোকে বলে ভাসান চর। অবসরে মধু জরিকে নিয়ে ভাসান চরে সময় কাটায়। অস্ফুট আর্তিগুলো দিনমান প্রকাশ করে না কেউ, মনে মনে নিজেদের সহচর ভাবে ওরা। এক এক করে দিন যায়। না বলা পিছুটান গভীর থেকে গভীরতর হয়। 

টুগি পাড়ার আরজ আলী বর্ষা মওসমে বড়কর্তার নৌকায় কাজ করে মোটা টাকার মালিক হয়। বাড়িতে টিনের দুচালা ঘর উঠে তার। এ পাড়ার সবাই এখন সমীহ করে তাকে। পলিসটার কাপড়ের একটা শার্ট আর সাদা লুঙ্গিটা পড়ে বাইরে বেড় হলে সালাম দেয় কেউ কেউ। এগুলো ভাল লাগে আরজের। এখন পাড়ায় নিজেকে বড় মানুষ ভাবে সে। ভাববেই তো খড়িমণ্ডলের খাস লোক সে। এ সম্মান টুগি  পাড়ায়  একমাত্র  তারই। বর্ষা  মওসম শেষ হলে খড়ি মণ্ডলের আরতে আবার কাজ পায় আরজ। বিকেলে মণ্ডল এলে খোশ গল্প করে দুজন। মণ্ডল বলে,

- 'এবার একখান নিকা কর আরজ, একলানি থাহুন যায়?'

খড়ি মণ্ডলের কথা শুনে লজ্জা পায় আরজ। কথার জবাব দেয় না সহসা। পরক্ষণে বলে,

- 'নিকানি? মাইয়া দেহেন তাইলে মিয়া ভাই।'

- 'মাইয়া একখান দেহা আছে, মত দেও মিয়া।'

- 'কে ডা, খুললে কন হুনি?'

- 'বাহারুদ্দিনের বেটি জরি। সুরতখান দলা দেহি?'

- 'হাচা। তই কাহা রাজি অবনি?'

- 'অবো নিজ্জস। মত দেও কতা কই।'

খড়ি মণ্ডলের কথায় মত দেয় আরজ। জরি মেয়ে ভাল, দেখতেও বেশ। মেয়ে মানুষহীন সংসারে আরজের স্ত্রীর পাশাপাশি হুলুর জন্য একজন মা দরকার। অপরিচিত মেয়ে মানুষের মা হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু? জরি থাকলে সে সন্দেহ নেই। বাড়ি ফিরে জরিকে নিয়ে ভাবে আরজ। ভেতরে কামনা তৈরি হয় তখন। অথচ জরির প্রতি এ ভাললাগা কয়েকদিন আগেও ছিল না তার। খড়ি মণ্ডলের বলা আচমকা কথাটা যেন প্রেমিক বানিয়ে দেয় তাকে। চোখের সামনে আনাগোনা করলে আড়চোখে জরিকে দেখে সে। বাড়ন্ত শরীরের প্রতিটি ভাঁজে ভাঁজে উত্তাল যৌবন খেলা করে ওর। দেখলে জ্বালা করে চোখে।

অবশেষে একদিন খড়ি মণ্ডল স্বয়ং নিকার প্রস্তাব নিয়ে যায় বাহারুদ্দিনের কাছে। বাহারুদ্দিন আপত্তি করে না তাতে। অভাবের সংসারে যেখানে দুমুঠো ভাত জোগাড় করার সামর্থ্য নেই তার, সেখানে আরজ সচ্ছল গেরস্ত। প্রস্তাব মন্দ নয়। সুখি হবে জরি। বিয়ে আগামী মাঘ মাসে হোক তাহলে। রাতে বাড়ি ফিরে বুচির মুখে সব শুনে মধু। জরিকে দেখা যায় না কোথাও। পরদিন ধলপ্রহরে আচমকা মধুর ঘরে এসে হাজির হয় সে। জরি বলে,

- 'হুনছনি হগল?' তৎক্ষণাৎ জবাব দেয় না মধু । ও জবাব না দিলে রেগে যায় জরি। তারপর আবার বলে - 'চুপ মাইরে আছ যে, বোবা অইছ মুনে কয়।'

মধুর মধ্যে অস্ফুট আর্তনাদ তৈরি হয় তখন। মনে মনে জরির জন্য ভালবাসা উতলে উঠে ঠিকই কিন্তু সত্যি বলার সাহস পায় না সে। সত্যি বলে লাভ কি, যন্ত্রণা ছাড়া? মধু খুব ভাল করে জানে যেখানে খড়ি মণ্ডল বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে, সেখানে ওর কথা শুনবে না বাহারুদ্দিন। বিয়ে জরির ঠিকই হবে। বিয়ে হবে আরজের সাথেই। পরক্ষণে মধু বলে দেয়,

- 'আমার কিছু কওনের নাই, হুলুর মা অ তুই।'

মধুর কথা মনে ধরে না জরির। ভেতরে দুঃখের ফোয়ারা বয় হয়তো। সেও বলে দেয়,

- 'দিলে ঘা দিলা মধু ভাই? ভুলুম না তোমারে নিজ্জস।'

অগ্রহায়ণ - পৌষ মাসে কালি নদীর পানি শুকায়। স্রোতস্বিনী নদী তখন কৃপণ হয়। ঢেউ থাকে না কোথাও, দু একটা মাছ ধরার ডিঙ্গি নৌকা চোখে পড়ে শুধু। সওদাগরের নাও ভাসে না আর। নদীর উপর জেগে থাকা ভাসানচর দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয় দিনে দিনে। চর দখলকে কেন্দ্র করে গ্রামের মানুষ বিভক্ত হয়। লাঠিয়াল বাহিনী গঠন করে বড়কর্তা আর খড়ি মণ্ডল দুজনই। লাঠি চালনায় বিশেষ দক্ষতা থাকায় হিন্দু পাড়ার দায়িত্ব নিতে হয় মধুকে। এ নিয়ে একদিন আরজের সাথে বেশ কলহ হয় তার। আরজ বলে - 'লাঠি চালন ছাড়ান দে মধু। চরের দহল মণ্ডলরে দিমু।' আরজের কথায় রাজি হয় না মধু । সেও বলে দেয় - 'জান দিমু, চর দিমুনা মণ্ডলরে।'

এরপর একদিন টুগি পাড়ায় শোকের মাতম উঠে ঘরে ঘরে। মাতম উঠে মিয়া বাড়িতেও। বুড়ি হবিরন বিবি অভিসম্পাত করে মধুকে – 'দিলে সবুর নাই হারামির, ভাইডারেই খাইল আইজ।' চর দখলকে কেন্দ্র করে কর্তা বাহিনী আর মণ্ডল বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ হয় চৌহালিতে।ক্ষুদ্র ভাসান চর রঞ্জিত হয় মানুষের রক্তে। আরজ আলী চর দখলে বাঁধা দিলে মধুর সাথে কলহ হয় তার। ক্ষুব্ধ মধু নিজের কাছে থাকা ধারাল কোঁচটা ছুড়ে দিলে ওটা গিয়ে পিঠে বিঁধে ওর। পরক্ষণে খুন খুন রব উঠে উপস্থিত সবার মুখে মুখে। মধু মিয়া খুন করেছে ওর ভাইকে। তারপর জেলে পড়ার ভয়ে গ্রামটা পুরুষশূন্য হয়ে যায় চোখের পলকে। হিন্দু পাড়ার ভোঁদড় পালানোর সময় মধুকে সাথে নিতে চাই তার। সে বলে,

- 'মধু বইনের বাড়ি পলামু, ল যায়।'

অকস্মাৎ কথা বলে না মধু। স্বস্থানে থ মেরে বসে থাকে সে। তারপর বলে দেয়,

- 'যামু না, ছাড়ান দে আইজ।'

ভাসান চর সংঘর্ষ মামলায় জেল হয় মধুর। খড়ি মণ্ডল ভূমি অফিসের লোকদের হাত করে চরের অধিকার নেয়। পরিস্থিতি শান্ত হলে আবার সবাই ফিরে আসে চৌহালি। ভাসান চরে নতুন প্রাণের উচ্ছ্বাস শুনা যায়। ওরা মধুর কথা জানে না। মধু এ পাড়ায় অতীত এখন। গ্রামে ফিরে ভোঁদড় দু একবার খুঁজ নিয়েছিল ওর। তারপর আর খুঁজ রাখা হয়নি মধুর।

এরপর একদিন খড়ি মণ্ডলের ঘরে নবজাতকের ক্রন্দন শুনা যায়। খুশিতে জোড়া বলদ জবেহ করে চৌহালি ভোগ দেয় সে। টুগি পাড়ার মেয়েরা বলাবলি করে,

- 'হুনছনি, মণ্ডলের ঘরে পুলা আইছে। পুলার দেহি চাঁদরূপ ।'

- 'কার কুলে অইলোগো বুচির মা?'

- 'আমাগো জরির।'

জরি এখন সংসার করছে খড়ি মণ্ডলের ঘরে।

মধুর খোঁজ আর সবার মত তারও অজানা।

Comments

Top

গতিময়

জীবন

পলাশ দে

train.jpg
গতিময় জীবন

বিজয় কুমার পেশায় কুলি। গুয়াহাটি প্লেটফর্মে বসে মদের নেশায় একের পর এক গলা ছেড়ে রফি ও কিশোরের পুরনো হিট গানগুলো গেয়ে যাচ্ছে। আর মাঝে মধ্যেই আবল তাবল বোকছে। কী যে সে বলে সে নিজেই জানে না।তাকে ষ্টেশনের টি-টি, গার্ড এমন কী ষ্টেশন মাষ্টার মাঝে মধ্যেই ডেকে বোঝান, সে তা কর্ণপাত করে না। তার সবচেয়ে বড় অভিমান, সে নেশাগ্রস্থ অবস্থায় কবুল করে। তার অভিমান এই তার স্ত্রী জয়া সে এই ষ্টেশনে এ. সি. ডিপার্টমেন্টে ক্লার্কের কাজ করে। বিজয়ের অভিমান সে একজন পুরুষ হয়ে সে তার স্ত্রীর অধীনে থাকতে পারে না। তাছাড়া সে যে ষ্টেশনের কুলি, তার স্ত্রী কি না সেই ষ্টেশনের একজন কর্মচারী। এই তার মনের বিরাট বিধুরতা। এদিকে কোন যাত্রীর মাল বোঝাই করার সময় সে তার স্ত্রীর পরিচয় দিয়ে নিজের বক্ষ স্বাস্থ্য করতে এক ফোঁটাও হেরফের করে না। সকলে আবার বিস্মিত ভাবে বোলে উঠে - 'এই কুলিটা বলে কি এর স্ত্রী কিনা এই ষ্টেশনের কেরানী।' কেউই বুঝে উঠতে পারেনি ব্যপারটা। আর নেশাগ্রস্ত এই বাতুলতার জন্য তার স্ত্রী জয়া তাকে বাড়ীতে অনেকবার বুঝিয়েছে। কত ভালোবাসা দিয়ে তাকে এই ব্যপারে পদভ্রষ্ট করতে চেয়েছে কিন্তু সে তার জায়গায় অটুট। মাঝে মধ্যে যখন ডিভর্সের কথা এসে যায় তখন কিছুদিন সে কাবু করে রাখে কিন্তু এ তার উল্কা প্রায় ন্যায়। এর কিছুদিন যেতে না যেতে সে সমস্ত শপথের পান্ডু লিপিগুলো অতীতের কাছে জমা রেখে সে আবার মাদক দ্রব্যে নিজেকে ডুবিয়ে ফেলে।  তখন তার স্ত্রী তাকে বলে - 'বুঝবে যেদিন আমি মরে যাব সেদিন যখন  তোমাকে  বোঝানোর  কেউ থাকবে না। তখন তুমি কপাল থাপ্‌ড়াবে। তখন আমেকে নিয়ে তোমার যা গর্ব সব মাটিতে মিলে যাবে। তখন দেখবে মজা, সেই সময় না - আমি আসব দেখতে, নাই বা তোমাকে বলবো এই সবছালিমাটি ছাড়ার কথা।' স্ত্রী জয়াকে বিজয় খুব ভালোবাসে।যখন তার নেশাঘোর কাটিয়ে ওঠে তখন সে চিরজীবনের জন্য মদ ছেড়ে দেবে বলে যে সে আজ পর্যন্ত কত ব্রত তার স্ত্রীর সম্মুখে বলে পালন করে যায় তার কোন ইয়ত্তা নেই। কিন্তু যেই ঘরের বাইরে কর্মের রণক্ষেত্রে নেমে পরে তেমনি সব কর্ত্তব্য থেকে বিমুর হয়ে সে লুটিয়ে পরে মদ্যপানে। এভাবে করে বেশ কিছুদিন কাটে। এদিকে দুটি-মেয়ে সন্তান রয়েছে বাড়ীতে, তারা স্কুলে পড়াশুনা করে। তাও আবার ইংরাজ়ী মাধ্যমে। তাদের পড়াশুনার সম্পূর্ণ খরচ জয়া নিজেই চালায়। জয়া পিউ পাশ। সে পিউ পাশ করার পর্‌ বিভিন্ন সার্কুলারের মাধ্যমে এদিকে সেদিকে চাকুরীর চেষ্টা করতে করতে

গুয়াহাটি ষ্টেশনের একটা কেরানীর চাকুরী জুটে যায়। আর কুলি বিজয়ের সাথে বিবাহ বন্ধন তাদের প্রেমের জুড়িতে সাফল্য। তাদের এই প্রেমের যুগল ঘটেছিল পাড়ার প্রতিবেশির সময়ে। একদিন হঠাৎ বিনা মেঘে বজ্রপাত হল বিজয়ের জীবনে। বিজয়ের স্ত্রী জয়া বাড়ী ফেরার পথে, পথ দূ্র্ঘটনায় মারা যায়। এরপর থেকে বিজয়ের জীবনে নেমে আসে এক অপ্রতাশিত অভিশাপ। যা সে স্বপ্নেও ভাবেনিই। প্রত্যেকদিন সে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় যেভাবে টোল হয়ে থাকত, সে আর সেভাবে থাকে না, মুখ দিয়ে তার আর গানও বের হয় না। সবাই দেখে আসে আর স্বান্তনা দেয়, তার স্ত্রীর মৃত্যু শোকে একেবারে মুর্ছিয়ে গেছে। যাত্রীদের মাল বহন করে পৌঁছিয়ে দেয়, কিন্তু এর বিনিময়ে সে তাদের কাছ থেকে পয়সা নেই না, আর কোন কথাও বলে না। সে স্বরণ করছে তার স্ত্রীর কথাগুলো। যখন বলত - 'আমাকে নিয়ে তোমার যা গর্ব সব মাটিতে মিলে যাবে।' সে এই কথাগুলো স্বরণ করে আর একা একা বসে কাঁদে। জয়ার মৃত্যুর পর যে সমস্ত গ্রাচুইটির টাকা থেকে শুরু করে যা যা পাওনা সেগুলো মিলে প্রায় দু-লক্ষ টাকা জয়ার সহকর্মীরা বিজয়ের হাতে দিয়ে দেয়। তখন বিজয়ের এক অসাধ্য সাধন দেখে সকলের তাক লেগে যায় বিজয় জয়ার সহকর্মীদের জানায় যে সে তার স্ত্রীর টাকাগুলো সরকারকে দান করে দেবে। আর এই টাকাটা দিয়ে সে তার স্ত্রীর স্মৃতি কামনার জন্য একটি বিদ্যালয় খুলতে চান, যা তে সেই বিদ্যালয়ে গরীব ছেলে মেয়েরা পড়াশুনার সুযোগ পায়। এ খবর উপর মহল পর্যন্ত পৌঁছে যায়। সবাই অবাক, কেউ কেউ বলছে - 'তোমার মাথা কি খারাপ হয় নি তো বিজয়। তুমি জানো তুমি কি বলছো, তোমার ভবিষ্যত তোমার দুই-মেয়ের কথা কি ভুলে যাচ্ছ। তাদের ভবিষ্যত কি হবে'। বিজয় বলল - 'আমি ঠিক বলছি এবং আমি এটাই চাই। আমি আমার মেয়েদের তাদের মামার বাড়ীতে রেখে দিয়ে এসেছি। আর আমার কথা সে ব্যবস্থা আমি করে ফেল্‌বো'। এরপর অবশেষে তার জবরদোস্তিতে তার ইচ্ছা অনুযায়ী একটা বিদ্যালয় খোলা হল এবং সেখানে বিভিন্ন গরীব ছেলে - মেয়েরা পড়াশুনার সুযোগ পেল। এদিকে কুলি বিজয় সে গুয়াহাটী ছেড়ে দিয়ে তার স্ত্রী ও সন্তারদের স্মৃতি রেখে সে তার স্বদেশে চলে যায়।

এই ঘটনার পর থেকে সে মদ খাওয়া ছেড়ে দেয় আর গান তার স্ত্রী জয়ার স্মৃতিতে নীরবতা পালন করার জন্য নিঃস্তব্ধ হয়ে যায়।

Comments

Top

অমানবিক

কিরণময় দাস

kolkatas6.jpg
অমানবিক

কেট থেকে রুমাল বের করে চশমাটা একবার মুছে নিল সুরেশ। সেপ্টেম্বর মাস, তবু বৃষ্টি নামবার কোনো লক্ষণ নেই। গুমোট গরমে ট্রাম বাসে যাতায়াত করা বড়ই কষ্টকর হয়ে উঠছে আজকাল। বয়সও বাড়ছে ধীরে ধীরে, তাই সত্য শক্তিও অনেক কমে এসেছে।

অন্যদিকে এমন সময়ে অফিসেই থাকে সুরেশ। আদর্শ স্কুলমাষ্টারের ছেলে হওয়ায় ফাঁকি দেওয়ার বদভ্যাস কখনও নেই তার। গত পনের বছরের চাকরি জীবনে কোনোদিনই সকাল সাড়ে নটার পর অফিসে ঢোকেনি সুরেশ। এখন সোয়া এগরোটা বাজে। সিনিয়ার ম্যনেজার শিখাদিকে ফোন করে সুরেশ তার আজকের অবস্থার কথা অলরেডি জানিয়ে রেখেছে ।

পাশের রুমে ডঃ সেনশর্মা ডেথ সার্টিফিকেটের কাগজ পত্র তৈরি করছেন। আজকের মত এমন ঘটনা আগে দুবার ঘটেছে সুরেশের জীবনে। তবে ডেথ সার্টিফিকেট হাতে নেওয়া এই প্রথমবার। আগে দুটো কেসেই শেষ অঙ্কটা সুখের ছিল, এবার ট্রাজেডি দিয়েই শেষ হল নাটকটা। নাটকই তো! বাস্তবের নাটক সবসময়েই মঞ্চের নাটকের থেকে বেশি রোমাঞ্চকর হয়।

আজকের মানুষ সবাই কি খুব আত্মকেন্দ্রিক? স্বার্থপর? নিজের স্বার্থের বাইরে কিছুই ভাবতে অভ্যস্ত নয়? অনেকদিন ধরে এই প্রশ্নটা মাথায় আসছে সুরেশের। একদিন ডিনার টেবিলে শোভার সাথে এই নিয়ে কিছুক্ষণ কথা হয়েছিল তার। শোভা বলেছিল - ‘স্বার্থপর নয়, আজকের দুনিয়ায় সবাই আসলে খুব অসহায়। ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশন, গ্লোবালাইজেশানের সাথে সাথে সবার অলক্ষ্যে মানুষ ধীরে ধীরে বড় বেশী পরজীবী হয়ে পড়েছে। হৃদয় বৃত্তি চাইলেও আজ বোধহয় সবসময় দেখানো যায় না'। 

পাশের বাড়ীর মিত্তিরবাবু এক রাতে মত্ত অবস্থায় চিৎকার করে বলছিলেন ‘দুনিয়ায় শালা মানুষ নেই রে আজ, সবই শুয়োর। ভবিষ্যতে পৃথিবীটাই হবে শুয়োরের খোঁয়াড়। শুয়োরের বাচ্চারা তো শুয়োরই হবে।‘ কথাগুলো শুনতে অশ্রাব্য লাগলেও একেবারে পাগলের প্রলাপ বলে মনে হয়নি সুরেশের। যে কারণেই হোক না কেন, ব্যাক্তিগত জীবনে হাজার ব্যাবস্থার মাঝে আজকের মানুষ নিজেদের মানবিক দায়-দায়িত্ব নিয়ে ভাববার সময়ও বোধহয় পায় না। আর এ সমস্যা তো উওরোওর বেড়েই চলেছে। তাহলে আগামী দিনের দুনিয়ায় মানুষ কি অসামাজিক হয়ে যাবে? পুরোপুরি অসামাজিক?

নিজের মনের এইসব নেগেটিভ চিন্তাভাবনা নিয়ে আজকাল বড়ো বেশী ভাবে সুরেশ। মাঝে মাঝে শোভা বলে, ‘তুমি আজকাল নেগেটিভ জিনিষপত্র নিয়ে বেশী ভাবছো, এবার পজিটিভ কিছু ভাবো। জীবনের নেগেটিভ দিকগুলো তুলে ধরার দায়িত্ব কবি-সাহিত্যিকদের, যারা হাবিজাবি চিন্তাভাবনাকেও শুধু ভাষার মাধুর্য দিয়ে পাঠকদের মন ভরায়। তোমার মত এইচ এস বি সি ব্যাঙ্কের প্রজেক্ট ম্যানেজার সারাক্ষণ নেগেটিভ চিন্তায় ডুবে থাকলে কাস্টমারেরা বিপদে পড়বে।‘  

‘মিঃ গুপ্ত, এই নিন ডেথ সার্টিফিকেট’। ডঃ সেনশর্মা এগিয়ে এসে সুরেশের হাতে ধরিয়ে দিলেন একটা খাম। ‘আপাতত এটি নিয়ে আপনি থানায় যান। পুলিশের হাতে 

ব্যাপারটা হ্যান্ড-ওভার করে দিন। এই ভদ্রলোকের বাড়ির লোক যদি কেউ থাকে, তবে পুলিশই তাদের সাথে যোগাযোগ করবে। ডেড বডিটা আপাতত আমাদের হেপাজতেই থাক।‘

‘ও-কে ডক্টর, থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ ফর ইয়োর টাইম,’ প্রফেশন্যাল ভয়েসেই বললো সুরেশ। প্রথা মতো হ্যন্ডশেক করে আবার নিজের চেম্বারে ঢুকে গেলেন সেনশর্মা। ব্যাপারটা লক্ষ্য করে নিজের মনেই একটু হাসলো সুরেশ। কলকাতার রাস্তার হাজার যাত্রীর সাথে এই ডাক্তারের কোনো তফাত নেই। সময়ের অভাব কি তবে সকলের?

বছর পনেরো আগে তার নিজেরও মনে হতো সময়টা সত্যিই কম। দিনের মধ্যে নয় ঘন্টা যায় অফিসের কাজে। যাতায়াতে আরও ঘন্টা দুয়েক। অর্থাৎ প্রায় অর্ধেক দিন চলে যায় পেশাগত কাজকর্মে। তারপর নিজের স্নান-আহার-বিশ্রাম ইত্যাদি ধরলে দিনের মাত্র কয়েকটা মুহূর্তই পড়ে থাকে নতুন কিছু চিন্তা করার জন্যে।

বাসে ভিড়টা সেদিন একটু অস্বাভাবিক ভাবেই বেশী ছিল। খিদিরপুর ফাঁড়ি পেরিয়ে বাসটা থামলেই কোনো রকমে বাস থেকে নেমে পড়েছিল সুরেশ। রাস্তা পেরিয়ে অটো ধরতে যাবে, এমন সময়ে রাস্তার পাশে দাঁড় করানো ট্যাক্সি থেকে এক বয়স্কা মহিলার গলা শুনে থমকে দাঁড়িয়ে ছিল সে। ‘এসো তো বাবা, আমাকে একটু হেল্প করো’। সারাদিনের ক্লান্তি ঘাম হয়ে ভিজিয়ে দিয়েছে তার শার্ট। সামনে এগিয়ে সুরেশ দেখেছিল, ট্যাক্সিতে বসে মাদার টেরিসা। তাদের পাড়ার রঘুদাদা অগিয়ান অবস্থায় শুয়ে আছেন ট্যাক্সির ভেতর।

‘আমি ওনাকে নিয়ে হসপিটালে যাচ্ছি, তুমি একটু সাথে যাবে?’,পরিষ্কার বাংলা উচ্চারণ ছিল মাদারের। যুগজননীর ডাকে সাড়া না দিয়ে সেদিন পারেনি সুরেশ। পরের দিন বিকেলে যখন অফিস ফেরত হাসপাতালে এসেছিল সুরেশ, মাদার সস্নেহে হাত বুলিয়ে দিয়েছিলেন তার মাথায়। প্রায় স্বগতোক্তির মতো করে বলছিলেন, ‘লাভ ইজ লাইফ, লাভ ইজ গড, লাভ ইস পীস।‘

পরবর্তী কালে বহুবার রঘুকাকা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন সুরেশের কাছে। বলেছেন, ’সেদিন তুই না থাকলে মারাই যেতাম আমি। তোর দেওয়া রক্তই আমাকে এখনও বাঁচিয়ে রেখেছে। জন্ম-জন্মান্তরে আমি তোর কাছে ঋণী হয়ে রইলাম।‘

‘আসলে আজকের মানুষ সবসময় একরাশ ভয় বুকে নিয়ে বাঁচে’, শোভা বলেছিল একদিন। ‘পুলিশ থেকে প্রশাসন, সবাই যদি নিজের দায়িত্বটুকু ঠিক মতো পালন করে, দুনিয়ায় তাহলে আর সমস্যা থাকে না‘।

‘না সমস্যা তবু রয়েই যাবে,‘ সুরেশ এক মত হয়নি শোভার সাথে। ‘দায়িত্ব শব্দটাই যে ওয়েল-ডিফাইন্ড নয়। পেশাগত দায়িত্ব, সাংসারিক দায়িত্ব না চাইলেও আমাদের করতে হয় কিছুটা বাধ্য হয়েই। কিন্তু মানবিক দায়িত্বে কোনো দায়বদ্ধতা নেই। তাই সেখানেই আমরা যত খুশী ফাঁকি দিতে পারি।‘ 

কিছুক্ষণ আগেও ট্যাক্সিতে আসতে আসতে সুরেশ ভাবছিল সে কথা। আজকের অভিজ্ঞতা মাত্র মিনিট পঞ্চাশের। কিন্তু কি ভয়াবহ! পুলিশ থেকে ট্যাক্সিওয়ালা সবাই খালি উপদেশ দিয়েই গা বাঁচাতে চায়! তিলোওমা কলকাতার এই কি তবে আসল রূপ?  ব্যাপারটা হ্যান্ড-ওভার করে দিন। এই ভদ্রলোকের বাড়ির লোক যদি কেউ থাকে, তবে পুলিশই তাদের সাথে যোগাযোগ করবে। ডেড বডিটা আপাতত আমাদের হেপাজতেই থাক।‘

‘ও-কে ডক্টর, থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ ফর ইয়োর টাইম,’ প্রফেশন্যাল ভয়েসেই বললো সুরেশ। প্রথা মতো হ্যন্ডশেক করে আবার নিজের চেম্বারে ঢুকে গেলেন সেনশর্মা। ব্যাপারটা লক্ষ্য করে নিজের মনেই একটু হাসলো সুরেশ। কলকাতার রাস্তার হাজার যাত্রীর সাথে এই ডাক্তারের কোনো তফাত নেই। সময়ের অভাব কি তবে সকলের?

বছর পনেরো আগে তার নিজেরও মনে হতো সময়টা সত্যিই কম। দিনের মধ্যে নয় ঘন্টা যায় অফিসের কাজে। যাতায়াতে আরও ঘন্টা দুয়েক। অর্থাৎ প্রায় অর্ধেক দিন চলে যায় পেশাগত কাজকর্মে। তারপর নিজের স্নান-আহার-বিশ্রাম ইত্যাদি ধরলে দিনের মাত্র

কয়েকটা মুহূর্তই পড়ে থাকে নতুন কিছু চিন্তা করার জন্যে। বাসে ভিড়টা সেদিন একটু অস্বাভাবিক ভাবেই বেশী ছিল। খিদিরপুর ফাঁড়ি পেরিয়ে বাসটা থামলেই কোনো রকমে বাস থেকে নেমে পড়েছিল সুরেশ। রাস্তা পেরিয়ে অটো ধরতে যাবে, এমন সময়ে রাস্তার পাশে দাঁড় করানো ট্যাক্সি থেকে এক বয়স্কা মহিলার গলা শুনে থমকে দাঁড়িয়ে ছিল সে। ‘এসো তো বাবা, আমাকে একটু হেল্প করো’। সারাদিনের ক্লান্তি ঘাম হয়ে ভিজিয়ে দিয়েছে তার শার্ট। সামনে এগিয়ে সুরেশ দেখেছিল, ট্যাক্সিতে বসে মাদার টেরিসা। তাদের পাড়ার রঘুদাদা অগিয়ান অবস্থায় শুয়ে আছেন ট্যাক্সির ভেতর।

‘আমি ওনাকে নিয়ে হসপিটালে যাচ্ছি, তুমি একটু সাথে যাবে?’, পরিষ্কার বাংলা উচ্চারণ ছিল মাদারের। যুগজননীর ডাকে সাড়া না দিয়ে সেদিন পারেনি সুরেশ। পরের দিন বিকেলে যখন অফিস ফেরত হাসপাতালে এসেছিল সুরেশ, মাদার সস্নেহে হাত বুলিয়ে দিয়েছিলেন তার মাথায়। প্রায় স্বগতোক্তির মতো করে বলছিলেন, ‘লাভ ইজ লাইফ, লাভ ইজ গড, লাভ ইস পীস।‘

পরবর্তী কালে বহুবার রঘুকাকা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন সুরেশের কাছে। বলেছেন, ’সেদিন তুই না থাকলে মারাই যেতাম আমি। তোর দেওয়া রক্তই আমাকে এখনও বাঁচিয়ে রেখেছে। জন্ম-জন্মান্তরে আমি তোর কাছে ঋণী হয়ে রইলাম।‘

‘আসলে আজকের মানুষ সবসময় একরাশ ভয় বুকে নিয়ে বাঁচে’, শোভা বলেছিল একদিন। ‘পুলিশ থেকে প্রশাসন, সবাই যদি নিজের দায়িত্বটুকু ঠিক মতো পালন করে, দুনিয়ায় তাহলে আর সমস্যা থাকে না‘।

‘না সমস্যা তবু রয়েই যাবে,‘ সুরেশ এক মত হয়নি শোভার সাথে। ‘দায়িত্ব শব্দটাই যে ওয়েল-ডিফাইন্ড নয়। পেশাগত দায়িত্ব, সাংসারিক দায়িত্ব না চাইলেও আমাদের করতে হয় কিছুটা বাধ্য হয়েই। কিন্তু মানবিক দায়িত্বে কোনো দায়বদ্ধতা নেই। তাই সেখানেই আমরা যত খুশী ফাঁকি দিতে পারি।‘ 

কিছুক্ষণ আগেও ট্যাক্সিতে আসতে আসতে সুরেশ ভাবছিল সে কথা। আজকের অভিজ্ঞতা মাত্র মিনিট পঞ্চাশের। কিন্তু কি ভয়াবহ! পুলিশ থেকে ট্যাক্সিওয়ালা সবাই খালি উপদেশ দিয়েই গা বাঁচাতে চায়! তিলোওমা কলকাতার এই কি তবে আসল রূপ?

মাঝবয়সী পুলিশ অফিসার সুরেশকে বলেছিল - ‘আপনার বয়স অল্প। কেন এসব বেকার ঝামেলায় নিজেকে জড়াতে চাইছেন? ঘরের খেয়ে বনের মোষ কি না তাড়ালেই নয়?’

তর্ক করার মত মনের অবস্থা তখন ছিল না সুরেশের। সে শুধু বলেছিল, ’স্যার, দয়া করে একটা জীপের ব্যাবস্থা করে দিন। এই ভদ্রলোকের যে অবস্থা, আর বেশী দেরি করলে হয়ত বাঁচানো যাবে না।‘

‘তাতে আপনার কি ক্ষতি হবে মশায়‘ টিপ্পনি কেটেছিল এক ছোকরা পুলিশ। ‘থানায় জীপগুলো পুলিশের কাজে ব্যবহার করার জন্যে। রোগীকে হসপিটালে নিয়ে যেতে হলে আম্বুলেন্স ডাকুন।‘

সে চেষ্টা আগেই করেছে সুরেশ। অন্ততঃ আট-দশটা আম্বুলেন্সকে ধরার চেষ্টা করেছে মোবাইল ফোনে। কোনোটা এনগেজড, কোনোটা ইন ডিউটি। ১০০ ডায়াল করেছে বার কুড়ি। সে চেষ্টা যে সফল হয় নি তা বলাই বাহুল্য।

দাড়িওয়ালা ট্যাক্সি ড্রাইভার জানালার কাঁচ নামিয়ে বলেছিল, ‘আপনার নিজের পেশেন্ট হলে তুলে নিতাম। এসব অচেনা লোককে গাড়িতে তুলবো না মশায়। মালিক জানতে পারলে আমার চাকরি যাবে।‘

তিনটে ড্রাইভার রিফিউজ করলেও চেষ্টার ত্রুটি করেনি সুরেশ। অজ্ঞান সওরোর্ধ বৃদ্ধটিকে একরকম পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে বার বার অনুরোধ করে চলেছিল সব ড্রাইভারকে। অবশেষে এই ছেলেটি আসতে রাজী হল। মানিব্যাগে মাত্র দুটো পঞ্চাশ টাকার নোট। ক্যাশমানি কাছে রাখার ভরসা পায় না সুরেশ। বাসে ভাড়া মাত্র সাড়ে ছটাকা, ট্রেনে মানথলি পাস কাটা থাকে তার।  তাই শতখানেকের বেশি টাকা সাথে রাখার কোনো প্রয়োজন নেই তার। এ টি এম কার্ড আছে সাথে, দরকার হলে টাকা তুলে নেওয়া যাবে।

খামের মধ্যে মুড়ে রাখা ডেথ সার্টিফিকেট টিকে নিজের হ্যান্ডব্যাগে রাখলো সুরেশ। এখন প্রায় বারোটা বাজে। লোকাল থানায় নিয়ে অসি কে ডেথ সার্টিফিকেট দেখাতে হবে। সদ্যমৃত ভদ্রলোকের নামটিও তার জানা নেই। পুলিশকে কেসটা হ্যান্ড ওভার করে তারপর অফিসে যাবে সে। যদিও এখন অফিসে যেতে খুব একটা ইচ্ছে করছে না, তবু যেতে হবে। বাড়িতে এখন কেউ নেই। একা একা সারাদিন বাড়িতে থাকা আরো বোরিং।

সিঁড়ি দিয়ে দোতলা থেকে নীচে নেমে এল সুরেশ। এটা এমার্জেন্সি সেকশান। সামনে অনেক আম্বুলেন্স, ট্যাক্সি, অনেক লোকজন। ধীরে ধীরে হাসপাতাল থেকে বাইরে বেরিয়ে আসার সময় হঠাৎ সুরেশ শুনলো কেউ যেন তাকেই বলছে ,’কি হল স্যার?’

চমকে পেছনে ফিরলো সুরেশ। ছোকরা ট্যাক্সি ড্রাইভারটি তার পেছনে দাঁড়িয়ে। এতক্ষণ অর্থাৎ প্রায় একঘন্টার উপর সে কি তাহলে এখানেই অপেক্ষা করছে? হঠাৎ খেয়াল হল সুরেশের, তাড়াহুড়ো করে নেমে যাবার সময় ট্যাক্সির ভাড়া মেটানো হয়নি। আসলে সেই মুহূর্তে ভাড়া দেওয়ার কথা মাথায় ছিল না তার।

‘স্যার উনি কেমন আছেন?’ যুবকটির প্রশ্নে ঘোর কাটলো সুরেশের। ‘না বাঁচানো গেলো না। যাক গে, তোমার ভাড়া কত হল ভাই?  মিছিমিছি তোমাকে এখানে এতক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখলাম।‘

‘আমি ভাড়ার জন্যে দাঁড়িয়ে নেই স্যার। রোগীকে হসপিটালে নিয়ে এলাম, আর খোঁজ না নিয়েই চলে যাবো? ভাড়া আর লাগবে না স্যার, রোগীই যখন বাঁচলো না, ভাড়া নিয়ে কি হবে? আমি সামান্য ট্যাক্সি ড্রাইভার, আমার সামর্থ্য আর কতটুকু! মানুষ হিসেবে মানুষের জন্য নয় এটুকু করলাম।‘

নিজের গালে যেন সজোরে থাপ্পড় খেলো সুরেশ। ড্রাইভারটি দূরে পার্ক করান ট্যাক্সিটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। চাবি দিয়ে দরজা খুলে গাড়ি স্টার্ট দিচ্ছে। আজান্তেই একবার তার দিকে হাত নাড়াল সুরেশ। একটু আগেই সে ভাবছিলো, কলকাতার মানুষমাত্রই বোধহয় অমানবিকতার নমুনা। দারোগা থেকে ডাক্তার সবাই মনুষ্যত্বের সারসত্যটুকু গা থেকে ধুয়ে মুছে ফেলেছে!

ছোকরা ড্রাইভারের শেষ কথাগুলো তখনো কানে বাজছে সুরেশের। সুবৃহৎ এই মহানগরী কলকাতা এখনও তবে ‘শুয়োরের খোঁয়াড়’ হয়ে যায় নি। মানবিকতার নমুনা এখানে আজও পাওয়া যায়, ভবিষ্যতেও নিশ্চয়ই যাবে। প্রত্যক্ষ প্রমানকে অস্বীকার করার তো কোনো উপায় নেই। আসলে মানুষ নিজের নিজের চোখ দিয়েই জগৎকে বিচার করে, ভুলটা সেখানেই। এই অসীম অনন্ত পৃথিবীর কাছে মানুষ অতি ক্ষুদ্র, অতি সামান্য। তাই সামান্যের সীমিত জ্ঞানে বিচিত্র মানবচরিত্রের বৈচিত্রকে মূল্যায়ন করা অসম্ভব।

রুমালে চশমাটা মুছে নিয়ে অটো স্ট্যান্ডের দিকে এগোতে লাগলো সুরেশ।

Comments

Top

অমানুষ 

দীপন জুবায়ের 

ঢাকা, ধানমন্ডী, বাংলাদেশ

doctor.jpeg
অমানুষ

কেট থেকে রুমাল বের করে চশমাটা একবার মুছে নিল সুরেশ। সেপ্টেম্বর মাস, তবু বৃষ্টি নামবার কোনো লক্ষণ নেই। গুমোট গরমে ট্রাম বাসে যাতায়াত করা বড়ই কষ্টকর হয়ে উঠছে আজকাল। বয়সও বাড়ছে ধীরে ধীরে, তাই সত্য শক্তিও অনেক কমে এসেছে।

অন্যদিকে এমন সময়ে অফিসেই থাকে সুরেশ। আদর্শ স্কুলমাষ্টারের ছেলে হওয়ায় ফাঁকি দেওয়ার বদভ্যাস কখনও নেই তার। গত পনের বছরের চাকরি জীবনে কোনোদিনই সকাল সাড়ে নটার পর অফিসে ঢোকেনি সুরেশ। এখন সোয়া এগরোটা বাজে। সিনিয়ার ম্যনেজার শিখাদিকে ফোন করে সুরেশ তার আজকের অবস্থার কথা অলরেডি জানিয়ে রেখেছে ।

পাশের রুমে ডঃ সেনশর্মা ডেথ সার্টিফিকেটের কাগজ পত্র তৈরি করছেন। আজকের মত এমন ঘটনা আগে দুবার ঘটেছে সুরেশের জীবনে। তবে ডেথ সার্টিফিকেট হাতে নেওয়া এই প্রথমবার। আগে দুটো কেসেই শেষ অঙ্কটা সুখের ছিল, এবার ট্রাজেডি দিয়েই শেষ হল নাটকটা। নাটকই তো! বাস্তবের নাটক সবসময়েই মঞ্চের নাটকের থেকে বেশি রোমাঞ্চকর হয়।

আজকের মানুষ সবাই কি খুব আত্মকেন্দ্রিক? স্বার্থপর ? নিজের স্বার্থের বাইরে কিছুই ভাবতে অভ্যস্ত নয়?  অনেকদিন ধরে এই প্রশ্নটা মাথায় আসছে সুরেশের। একদিন ডিনার টেবিলে শোভার সাথে এই নিয়ে কিছুক্ষণ কথা হয়েছিল  তার। শোভা বলেছিল - ‘স্বার্থপর নয়, আজকের দুনিয়ায় সবাই আসলে খুব অসহায়। ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশন, গ্লোবালাইজেশানের সাথে সাথে সবার অলক্ষ্যে মানুষ ধীরে ধীরে বড় বেশী পরজীবী হয়ে পড়েছে। হৃদয় বৃত্তি চাইলেও আজ বোধহয় সবসময় দেখানো যায় না'। 

পাশের বাড়ীর মিত্তিরবাবু এক রাতে মত্ত অবস্থায় চিৎকার করে বলছিলেন ‘দুনিয়ায় শালা মানুষ নেই রে আজ, সবই শুয়োর। ভবিষ্যতে পৃথিবীটাই হবে শুয়োরের খোঁয়াড়। শুয়োরের বাচ্চারা তো শুয়োরই হবে।‘ কথাগুলো শুনতে অশ্রাব্য লাগলেও একেবারে পাগলের প্রলাপ বলে মনে হয়নি সুরেশের। যে কারণেই হোক না কেন, ব্যাক্তিগত জীবনে হাজার ব্যাবস্থার মাঝে আজকের মানুষ নিজেদের মানবিক দায়-দায়িত্ব নিয়ে ভাববার সময়ও বোধহয় পায় না। আর এ সমস্যা তো উওরোওর বেড়েই চলেছে। তাহলে আগামী দিনের দুনিয়ায় মানুষ কি অসামাজিক হয়ে যাবে? পুরোপুরি অসামাজিক?

নিজের মনের এইসব নেগেটিভ চিন্তাভাবনা নিয়ে আজকাল বড়ো বেশী ভাবে সুরেশ। মাঝে মাঝে শোভা বলে, ‘তুমি আজকাল নেগেটিভ জিনিষপত্র নিয়ে বেশী ভাবছো, এবার পজিটিভ কিছু ভাবো। জীবনের নেগেটিভ দিকগুলো তুলে ধরার দায়িত্ব কবি-সাহিত্যিকদের, যারা হাবিজাবি চিন্তাভাবনাকেও শুধু ভাষার মাধুর্য দিয়ে পাঠকদের মন ভরায়। তোমার মত এইচ এস বি সি ব্যাঙ্কের প্রজেক্ট ম্যানেজার সারাক্ষণ নেগেটিভ চিন্তায় ডুবে থাকলে কাস্টমারেরা বিপদে পড়বে।‘  

‘মিঃ গুপ্ত, এই নিন ডেথ সার্টিফিকেট’। ডঃ সেনশর্মা এগিয়ে এসে সুরেশের হাতে ধরিয়ে দিলেন একটা খাম। ‘আপাতত এটি নিয়ে আপনি থানায় যান। পুলিশের হাতে 

ব্যাপারটা হ্যান্ড-ওভার করে দিন। এই ভদ্রলোকের বাড়ির লোক যদি কেউ থাকে, তবে পুলিশই তাদের সাথে যোগাযোগ করবে। ডেড বডিটা আপাতত আমাদের হেপাজতেই থাক।‘

‘ও-কে ডক্টর, থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ ফর ইয়োর টাইম,’ প্রফেশন্যাল ভয়েসেই বললো সুরেশ। প্রথা মতো হ্যন্ডশেক করে আবার নিজের চেম্বারে ঢুকে গেলেন সেনশর্মা। ব্যাপারটা লক্ষ্য করে নিজের মনেই একটু হাসলো সুরেশ। কলকাতার রাস্তার হাজার যাত্রীর সাথে এই ডাক্তারের কোনো তফাত নেই। সময়ের অভাব কি তবে সকলের?

বছর পনেরো আগে তার নিজেরও মনে হতো সময়টা সত্যিই কম। দিনের মধ্যে নয় ঘন্টা যায় অফিসের কাজে। যাতায়াতে আরও ঘন্টা দুয়েক। অর্থাৎ প্রায় অর্ধেক দিন চলে যায় পেশাগত কাজকর্মে। তারপর নিজের স্নান-আহার-বিশ্রাম ইত্যাদি ধরলে দিনের মাত্র কয়েকটা মুহূর্তই পড়ে থাকে নতুন কিছু চিন্তা করার জন্যে।

বাসে ভিড়টা সেদিন একটু অস্বাভাবিক ভাবেই বেশী ছিল। খিদিরপুর ফাঁড়ি পেরিয়ে বাসটা থামলেই কোনো রকমে বাস থেকে নেমে পড়েছিল সুরেশ। রাস্তা পেরিয়ে অটো ধরতে যাবে, এমন সময়ে রাস্তার পাশে দাঁড় করানো ট্যাক্সি থেকে এক বয়স্কা মহিলার গলা শুনে থমকে দাঁড়িয়ে ছিল সে। ‘এসো তো বাবা, আমাকে একটু হেল্প করো’। সারাদিনের ক্লান্তি ঘাম হয়ে ভিজিয়ে দিয়েছে তার শার্ট। সামনে এগিয়ে সুরেশ দেখেছিল, ট্যাক্সিতে বসে মাদার টেরিসা। তাদের পাড়ার রঘুদাদা অগিয়ান অবস্থায় শুয়ে আছেন ট্যাক্সির ভেতর।

‘আমি ওনাকে নিয়ে হসপিটালে যাচ্ছি, তুমি একটু সাথে যাবে?’,পরিষ্কার বাংলা উচ্চারণ ছিল মাদারের। যুগজননীর ডাকে সাড়া না দিয়ে সেদিন পারেনি সুরেশ। পরের দিন বিকেলে যখন অফিস ফেরত হাসপাতালে এসেছিল সুরেশ, মাদার সস্নেহে হাত বুলিয়ে দিয়েছিলেন তার মাথায়। প্রায় স্বগতোক্তির মতো করে বলছিলেন, ‘লাভ ইজ লাইফ, লাভ ইজ গড, লাভ ইস পীস।‘

পরবর্তী কালে বহুবার রঘুকাকা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন সুরেশের কাছে। বলেছেন, ’সেদিন তুই না থাকলে মারাই যেতাম আমি। তোর দেওয়া রক্তই আমাকে এখনও বাঁচিয়ে রেখেছে। জন্ম-জন্মান্তরে আমি তোর কাছে ঋণী হয়ে রইলাম।‘

‘আসলে আজকের মানুষ সবসময় একরাশ ভয় বুকে নিয়ে বাঁচে’, শোভা বলেছিল একদিন। ‘পুলিশ থেকে প্রশাসন, সবাই যদি নিজের দায়িত্বটুকু ঠিক মতো পালন করে, দুনিয়ায় তাহলে আর সমস্যা থাকে না ‘।

‘না সমস্যা তবু রয়েই যাবে,‘ সুরেশ এক মত হয়নি শোভার সাথে। ‘দায়িত্ব শব্দটাই যে ওয়েল-ডিফাইন্ড নয়। পেশাগত দায়িত্ব, সাংসারিক দায়িত্ব না চাইলেও আমাদের করতে হয় কিছুটা বাধ্য হয়েই। কিন্তু মানবিক দায়িত্বে কোনো দায়বদ্ধতা নেই। তাই সেখানেই আমরা যত খুশী ফাঁকি দিতে পারি।‘ 

কিছুক্ষণ আগেও ট্যাক্সিতে আসতে আসতে সুরেশ ভাবছিল সে কথা। আজকের অভিজ্ঞতা 

মাত্র মিনিট পঞ্চাশের। কিন্তু কি ভয়াবহ ! পুলিশ থেকে ট্যাক্সিওয়ালা সবাই খালি উপদেশ দিয়েই গা বাঁচাতে চায়! তিলোওমা কলকাতার এই কি তবে আসল রূপ?  ব্যাপারটা হ্যান্ড-ওভার করে দিন। এই ভদ্রলোকের বাড়ির লোক যদি কেউ থাকে, তবে পুলিশই তাদের সাথে যোগাযোগ করবে। ডেড বডিটা আপাতত আমাদের হেপাজতেই থাক।‘

‘ও-কে ডক্টর, থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ ফর ইয়োর টাইম,’ প্রফেশন্যাল ভয়েসেই বললো সুরেশ। প্রথা মতো হ্যন্ডশেক করে আবার নিজের চেম্বারে ঢুকে গেলেন সেনশর্মা। ব্যাপারটা লক্ষ্য করে নিজের মনেই একটু হাসলো সুরেশ। কলকাতার রাস্তার হাজার যাত্রীর সাথে এই ডাক্তারের কোনো তফাত নেই। সময়ের অভাব কি তবে সকলের?

বছর পনেরো আগে তার নিজেরও মনে হতো সময়টা সত্যিই কম। দিনের মধ্যে নয় ঘন্টা যায় অফিসের কাজে। যাতায়াতে আরও ঘন্টা দুয়েক। অর্থাৎ প্রায় অর্ধেক দিন চলে যায় পেশাগত কাজকর্মে। তারপর নিজের স্নান-আহার-বিশ্রাম ইত্যাদি ধরলে দিনের মাত্র

কয়েকটা মুহূর্তই পড়ে থাকে নতুন কিছু চিন্তা করার জন্যে। বাসে ভিড়টা সেদিন একটু অস্বাভাবিক ভাবেই বেশী ছিল। খিদিরপুর ফাঁড়ি পেরিয়ে বাসটা থামলেই কোনো রকমে বাস থেকে নেমে পড়েছিল সুরেশ। রাস্তা পেরিয়ে অটো ধরতে যাবে, এমন সময়ে রাস্তার পাশে দাঁড় করানো ট্যাক্সি থেকে এক বয়স্কা মহিলার গলা শুনে থমকে দাঁড়িয়ে ছিল সে। ‘এসো তো বাবা, আমাকে একটু হেল্প করো’। সারাদিনের ক্লান্তি ঘাম হয়ে ভিজিয়ে দিয়েছে তার শার্ট। সামনে এগিয়ে সুরেশ দেখেছিল, ট্যাক্সিতে বসে মাদার টেরিসা। তাদের পাড়ার রঘুদাদা অগিয়ান অবস্থায় শুয়ে আছেন ট্যাক্সির ভেতর।

‘আমি ওনাকে নিয়ে হসপিটালে যাচ্ছি, তুমি একটু সাথে যাবে?’,পরিষ্কার বাংলা উচ্চারণ ছিল মাদারের। যুগজননীর ডাকে সাড়া না দিয়ে সেদিন পারেনি সুরেশ। পরের দিন বিকেলে যখন অফিস ফেরত হাসপাতালে এসেছিল সুরেশ, মাদার সস্নেহে হাত বুলিয়ে দিয়েছিলেন তার মাথায়। প্রায় স্বগতোক্তির মতো করে বলছিলেন, ‘লাভ ইজ লাইফ, লাভ ইজ গড, লাভ ইস পীস।‘

পরবর্তী কালে বহুবার রঘুকাকা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন সুরেশের কাছে। বলেছেন, ’সেদিন তুই না থাকলে মারাই যেতাম আমি। তোর দেওয়া রক্তই আমাকে এখনও বাঁচিয়ে রেখেছে। জন্ম-জন্মান্তরে আমি তোর কাছে ঋণী হয়ে রইলাম।‘

‘আসলে আজকের মানুষ সবসময় একরাশ ভয় বুকে নিয়ে বাঁচে’, শোভা বলেছিল একদিন। ‘পুলিশ থেকে প্রশাসন, সবাই যদি নিজের দায়িত্বটুকু ঠিক মতো পালন করে, দুনিয়ায় তাহলে আর সমস্যা থাকে না ‘।

‘না সমস্যা তবু রয়েই যাবে,‘ সুরেশ এক মত হয়নি শোভার সাথে। ‘দায়িত্ব শব্দটাই যে ওয়েল-ডিফাইন্ড নয়। পেশাগত দায়িত্ব, সাংসারিক দায়িত্ব না চাইলেও আমাদের করতে হয় কিছুটা বাধ্য হয়েই। কিন্তু মানবিক দায়িত্বে কোনো দায়বদ্ধতা নেই। তাই সেখানেই আমরা যত খুশী ফাঁকি দিতে পারি।‘ 

কিছুক্ষণ আগেও ট্যাক্সিতে আসতে আসতে সুরেশ ভাবছিল সে কথা। আজকের অভিজ্ঞতা মাত্র মিনিট পঞ্চাশের। কিন্তু কি ভয়াবহ ! পুলিশ থেকে ট্যাক্সিওয়ালা সবাই খালি উপদেশ দিয়েই গা বাঁচাতে চায়! তিলোওমা কলকাতার এই কি তবে আসল রূপ?

মাঝবয়সী পুলিশ অফিসার সুরেশকে বলেছিল - ‘আপনার বয়স অল্প। কেন এসব বেকার ঝামেলায় নিজেকে জড়াতে চাইছেন? ঘরের খেয়ে বনের মোষ কি না তাড়ালেই নয়?’

তর্ক করার মত মনের অবস্থা তখন ছিল না সুরেশের। সে শুধু বলেছিল ,’স্যার, দয়া করে একটা জীপের ব্যাবস্থা করে দিন। এই ভদ্রলোকের যে অবস্থা, আর বেশী দেরি করলে হয়ত বাঁচানো যাবে না।‘

‘তাতে আপনার কি ক্ষতি হবে মশায়‘ টিপ্পনি কেটেছিল এক ছোকরা পুলিশ। ‘থানায় জীপগুলো পুলিশের কাজে ব্যাবহার করার জন্যে। রোগীকে হসপিটালে নিয়ে যেতে হলে আম্বুলেন্স ডাকুন।‘

সে চেষ্টা আগেই করেছে সুরেশ। অন্ততঃ আট-দশটা আম্বুলেন্সকে ধরার চেষ্টা করেছে মোবাইল ফোনে। কোনোটা এনগেজড, কোনোটা ইন ডিউটি। ১০০ ডায়াল করেছে বার কুড়ি। সে চেষ্টা যে সফল হয় নি তা বলাই বাহুল্য।

দাড়িওয়ালা ট্যাক্সি ড্রাইভার জানালার কাঁচ নামিয়ে বলেছিল, ‘আপনার নিজের পেশেন্ট হলে তুলে নিতাম। এসব অচেনা লোককে গাড়িতে তুলবো না মশায়। মালিক জানতে পারলে আমার চাকরি যাবে।‘

তিনটে ড্রাইভার রিফিউজ করলেও চেষ্টার ত্রুটি করেনি সুরেশ। অজ্ঞান সওরোর্ধ বৃদ্ধটিকে একরকম পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে বার বার অনুরোধ করে চলেছিল সব ড্রাইভারকে। অবশেষে এই ছেলেটি আসতে রাজী হল।

মানিব্যাগে মাত্র দুটো পঞ্চাশ টাকার নোট। ক্যাশমানি কাছে রাখার ভরসা পায় না সুরেশ। বাসে ভাড়া মাত্র সাড়ে ছটাকা, ট্রেনে মানথলি পাস কাটা থাকে তার।  তাই শতখানেকের বেশি টাকা সাথে রাখার কোনো প্রয়োজন নেই তার। এ টি এম কার্ড আছে সাথে, দরকার হলে টাকা তুলে নেওয়া যাবে। খামের মধ্যে মুড়ে রাখা ডেথ সার্টিফিকেট টিকে নিজের হ্যান্ডব্যাগে রাখলো সুরেশ। এখন প্রায় বারোটা বাজে। লোকাল থানায় নিয়ে অসি কে ডেথ সার্টিফিকেট দেখাতে হবে। সদ্যমৃত ভদ্রলোকের নামটিও তার জানা নেই। পুলিশকে কেসটা হ্যান্ড ওভার করে তারপর অফিসে যাবে সে। যদিও এখন অফিসে যেতে খুব একটা ইচ্ছে করছে না, তবু যেতে হবে। বাড়িতে এখন কেউ নেই। একা একা সারাদিন বাড়িতে থাকা আরো বোরিং।

সিঁড়ি দিয়ে দোতলা থেকে নীচে নেমে এল সুরেশ। এটা এমার্জেন্সি সেকশান। সামনে অনেক আম্বুলেন্স, ট্যাক্সি, অনেক লোকজন। ধীরে ধীরে হাসপাতাল থেকে বাইরে বেরিয়ে আসার সময় হঠাৎ সুরেশ শুনলো কেউ যেন তাকেই বলছে, ’কি হল স্যার?’

চমকে পেছনে ফিরলো সুরেশ। ছোকরা ট্যাক্সি ড্রাইভারটি তার পেছনে দাঁড়িয়ে। এতক্ষণ অর্থাৎ প্রায় একঘন্টার উপর সে কি তাহলে এখানেই অপেক্ষা করছে? হঠাৎ খেয়াল হল সুরেশের, তাড়াহুড়ো করে নেমে যাবার সময় ট্যাক্সির ভাড়া মেটানো হয়নি। আসলে সেই মুহূর্তে ভাড়া দেওয়ার কথা মাথায় ছিল না তার।

‘স্যার উনি কেমন আছেন?’ যুবকটির প্রশ্নে ঘোর কাটলো সুরেশের। ‘না বাঁচানো গেলো না। যাক গে, তোমার ভাড়া কত হল ভাই?  মিছিমিছি তোমাকে এখানে এতক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখলাম।‘

‘আমি ভাড়ার জন্যে দাঁড়িয়ে নেই স্যার। রোগীকে হসপিটালে নিয়ে এলাম, আর খোঁজ না নিয়েই চলে যাবো? ভাড়া আর লাগবে না স্যার, রোগীই যখন বাঁচলো না, ভাড়া নিয়ে কি হবে? আমি সামান্য ট্যাক্সি ড্রাইভার, আমার সামর্থ্য আর কতটুকু! মানুষ হিসেবে মানুষের জন্য নয় এটুকু করলাম।‘

নিজের গালে যেন সজোরে থাপ্পড় খেলো সুরেশ। ড্রাইভারটি দূরে পার্ক করান ট্যাক্সিটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। চাবি দিয়ে দরজা খুলে গাড়ি স্টার্ট দিচ্ছে। আজান্তেই একবার তার দিকে হাত নাড়াল সুরেশ। একটু আগেই সে ভাবছিলো, কলকাতার মানুষমাত্রই বোধহয় অমানবিকতার নমুনা। দারোগা থেকে ডাক্তার সবাই মনুষ্যত্বের সারসত্যটুকু গা থেকে ধুয়ে মুছে ফেলেছে!

ছোকরা ড্রাইভারের শেষ কথাগুলো তখনো কানে বাজছে সুরেশের। সুবৃহৎ এই মহানগরী কলকাতা এখনও তবে ‘শুয়োরের খোঁয়াড়’ হয়ে যায় নি। মানবিকতার নমুনা এখানে আজও পাওয়া যায়, ভবিষ্যতেও নিশ্চয়ই যাবে। প্রত্যক্ষ প্রমানকে অস্বীকার করার তো কোনো উপায় নেই। আসলে মানুষ নিজের নিজের চোখ দিয়েই জগৎকে বিচার করে, ভুলটা সেখানেই। এই অসীম অনন্ত পৃথিবীর কাছে মানুষ অতি ক্ষুদ্র, অতি সামান্য। তাই সামান্যের সীমিত জ্ঞানে বিচিত্র মানবচরিত্রের বৈচিত্রকে মূল্যায়ন করা অসম্ভব।

রুমালে চশমাটা মুছে নিয়ে অটো স্ট্যান্ডের দিকে এগোতে লাগলো সুরেশ।

Comments

Top

পাতালপুরী ও 

আগলি ডাকলিং 

অপর্ণা চক্রবর্তী

কলকাতা

ladies.jpg
পাতালপুরী

প্রতিমা, ওফেলিয়া, মোনরমা, অপরূপা, সালোনী। এমন আরও দু'চারটে পাতালপুরীর সন্ধান জানি। মাঝে মাঝে এর কোন একটায় আমিও ঘুরে আসি। সবগুলোই আমাদের পাড়ায়, আর আসে পাশে গড়ে ওঠা মধ্যবিত্তের বিউটি পার্লার। এখনকার গাল ভরা নাম 'স্যোলন্'। আমি বলি পাতালপুরী। একবার পাতাল প্রবেশ করলে আর চিন্তা নেই। পাতাল ফুঁড়ে বাইরে এলেই সক্কলকে তাক লাগিয়ে দেবার প্রতিশ্রুতি।

এ যেন "যাদুকর বরফি"-র কর্মশালা। তাকের ওপর শিশি-বোতল-কৌটোয় সাজানো ক্রীম-পাউডার-তেল-পালিশ। আরো কতো কি "সাপ-- ব্যাঙ -- শকুনির ঠ্যাং"। কড়ি ফেলুন, মালিশ করুন। মা-মাসীমা-প্রেমিকা-নায়িকা, সবার জন্য পাতালপুরীর অবারিত দ্বার।

ভিতরে সব সময় জটিল রাসায়নিক গবেষণা চলছে।

জন্মগত কোঁকড়া চুল সোজা হয়ে যাচ্ছে। আবার সোজা সোজা চুল -- "টং হেয়ার স্টাইল" নাম দিয়ে গুটিয়ে টঙে তুলে দেওয়া হচ্ছে। ওইরকম গরম রড চুলে প্যাঁচালে, চুলের বাবারও সোজা হয়ে থাকার সাধ্য থাকে না!

আপনার চোখের ওপর ভ্রুপল্লব জোড়া কি আকৃতিগতভাবে শুঁয়োপোকার যমজ ভাতৃদ্বয়? আঙুলে সুতোর পাক দিয়ে, সেই পাকের ফাঁকে ভুরুর চুল জড়িয়ে নিয়ে, এমন হ্যাঁচকা টান দেওয়া হবে! দেখবেন মিনিট কয়েকের মধ্যেই বাপ বাপ বলে মোটা ভুরু স্লীম হয়ে গেছে।

এবার চুলের রঙ বাহারের কথাই ধরা যাক! কমলা-বেগুনি-হলুদ এমন কি চুলে ঘাসের মতো সবুজ রঙও করাতে দেখেছি। মাথা না এশিয়ান পেইন্টসের শেড্ কার্ড, বোঝা দুষ্কর।

খসখসে গাল তুলতুলে বেড়াল বানাতে চান? চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়ুন পাতালপুরীর আরাম চেয়ারে। মুখের ওপর তাল তাল ক্রীম এসে পড়বে। তারপর ময়ান দিয়ে ময়দা মাখার মতো, সেই ক্রীম সহযোগে, কষে আপনার মুখমন্ডল দলাই-মলাই করা হবে। এরপর গরম-ঠান্ডা-বরফ ঠান্ডা, যেমন তাপমাত্রার জল চান, ঠিক তেমনটি দিয়ে মুখ ধোয়ানো হবে। তারপরের পর্বটা আরও মজার। কেবলমাত্র নাসারন্ধ্র বাদ রেখে, সমস্ত মুখে গোবরের মতো ফেসপ্যাক লেপে, দু'চোখে শসার চাকতি অথবা ভেজা তুলো লাগিয়ে দিয়ে, প্রায় আধঘন্টা আপনাকে ম্যাফরিনেটেড মুরগির মতো বিশ্রাম দেওয়া হবে।

একবার পার্লারের একটি মেয়েকে বলেছিলাম --

- শসার জায়গায় তুলসী পাতা দে' না; আমার ইহকাল পরকাল এক হয়ে যাক।

সে কি বুঝল আমি জানি না। উত্তর দিল -

- তুলসী পাতা তো নেই দিদি! তুলসী কোলন্ আছে। দেব?

আজকাল পুরুষরাও নিয়মিত পাতাল প্রবেশ করছেন। ত্বকের যত্ন, চুলের কায়দা, গোঁফ দাড়ির সাথে - কিছু অবাঞ্ছিত লোমও কামিয়ে ফেলেন শুনেছি। যদিও পুরুষের শরীরে কোন লোমই অবাঞ্ছিত নয় বলেই জানি। আর লোমহীন শরীরের পুরুষ!! আমার চোখে, - ''একটি রোমহর্ষক দৃশ্য''।

বাবুঘাটে গিয়ে, মুক্ত বাতাসে উপুড় হয়ে খাটিয়ার শুয়ে তেল মালিশ করাতে দেখেছেন? মালিশওয়ালা হাত পা দুমড়েমুচড়ে,  পিঠের ওপর কিলিয়ে কাঁঠাল পাকিয়ে দিলেও; মালিশ যিনি হজম করছেন, তিনি চোখ বন্ধ করে, মুখে- "এ আরামের ভাগ হবে না" - ভাব বজায় রেখে শুয়ে থাকেন। একবার, এমন ভাবে খোলা হাওয়ায় শুয়ে, পালোয়ানি মালিশ হজম করার খুব ইচ্ছা আমার।

যারা রাস্তায় ইঁট পেতে বসে, একমুখ ফেনা মেখে, আকাশে দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে নাপিতের কাছে দাড়ি চাঁচেন, তাদের দেখেও আমরা খুব হিংসা হয়। উপায় থাকলে আমিও ওইভাবে, খোলা আকাশের নীচে বসে ক্ষৌরকর্ম করিয়ে নিতাম। আর গোঁফ-দাড়ি কামানোর অছিলায়, ঠোঁটটাকে একবার বাঁদিকে, একবার ডানদিকে বেঁকিয়ে, অচেনা পথ চলতি সবাইকে মুখ ভেংচাবার সুযোগ হাতছাড়া করতাম না।

কিন্তু, মহিলা জন্মের জন্য, আমার আর দাড়ি গজালো না। তাই কমানোর দরকারও পড়ল না। অন্যক স্বপ্নগুলো পূরণের আশাও চিরতরে অস্তমিত হল। বাধ্য হয়ে আমি চারদিকে আয়না ঢাকা মহিলা বিউটি পার্লারে যাই। আয়নার ভিতরে আয়না, তার ভিতরে আয়নার প্রতিবিম্ব গুনি; আর সংসারের বলি হওয়া, মাসিমারা বলিরেখা লুকোতে এলে, তাদের সাথে জমিয়ে গল্প করি।

কয়েক দিন আগে, পার্লারের কর্মী মেয়েদের মধ্যে একটা অচেনা নতুন মুখ দেখলাম। ছোটখাটো চেহারার কালো মেয়েটিকে, সহকারীর কাজে বহাল করা হয়েছে।

ছড়ানো শিশি-বোতল, ক্রীমের কৌটো সে খুব ভয়ে ভয়ে তাকে তুলে রাখছে, নামাচ্ছে। সামান্য ঠোকাঠুকিও হতে দিচ্ছে না। প্রতিটা শিশির অস্তিত্ব যেন তার নিজের অস্তিত্বের থেকেও অনেক বেশী দামী।

কারো মাথায় শ্যাম্পু করে দেওয়ার সময় বারবার কাস্টমারদের সুবিধা অসুবিধা জিজ্ঞাসা করছে। যেন একটা চুল ছিঁড়ে গেলে তার হাজতবাস হবে। নেলপলিশ পরানোর সময় নিজের কাঁপা হাত সামলাতে গলদঘর্ম হচ্ছে। তেষ্টার জলটুকু গলায় ঢালতে গিয়েও শঙ্কিত চোখে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।

অতি সাবধানী হওয়া সত্ত্বেও মাঝে মধ্যে কাজে সামান্যা ভুল করে, উচ্চপদস্থদের কাছে প্রবল বকা খাচ্ছে মেয়েটা।

ওকে দেখে ভাবলাম - প্রথম প্রথম সবাই সব কাজে একটু থতমত খায়। এরপরে আরো দু'তিন বার পার্লারে গেছি। কিন্তু মেয়েটার অবস্থায় কোন পরিবর্তন লক্ষ্য করি নি। অথচ, সে যথেষ্ট মনোযোগ দিয়েই কাজ করে।

এর মধ্যে ওর নামও জেনেছি - পূর্ণিমা।

অমাবস্যার রঙ মাখা মুখের দিকে ভালো করে দেখলে, ওর নামটা বেমানান লাগে না।

পার্লারের চড়া আলোয়, চারদিকের আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে, নিজের অজান্তেই ও মাঝে মাঝে চমকে ওঠে। ভীতু মুখটা লুকোতে, ঠোঁটে সব সময় একটা বোকা হাসি লেপ্টে রেখেছে। সে হাসির কদর করতে সবাই জানে না।

শীর্ণ - দুর্বল - দলছুট মেয়েটা যেন, - "হান্স অ্যাসন্ডারসন" - এর ফেয়ারীটেলের পাতা থেকে উঠে আসা, আমার ছেলেবেলার -

"আগলি ডাকলিং"- এর মানসরূপ।

- গল্পের ছোট্ট হাঁস শাবকের মতনই, কোন আনন্দযজ্ঞে সে অংশগ্রহণ করতে পারে না। সবার থেকে বিতাড়িত হয়ে, বিপন্ন বোধ করে। তবুও অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই থামায় না।

আমার পাড়ার কাছের বস্তিতেই পূর্ণিমারা থাকে।

একদিন রাস্তার পাশের কলপাড়ে ওকে দেখলাম। একই রকম মনোযোগ দিয়ে, হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে থালা বাটি মাজছে।

- তুই এখানে থাকিস ?

আমাকে দেখে এক গাল চাঁদের হাসি হেসে বলল-

- হ্যাঁ  দিদি। ওই বস্তিতে। চলো না একবার আমাদের ঘরে।

কথাটা বলেই বুঝতে পারে হয়তো কিছু ভুল বলে ফেলেছে। আবার সেই ভীতু মুখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।

আমি হেসে বললাম - চল। চা খাওয়াতে হবে কিন্তু।

ছয় বাই দশের ছোট্ট ঘর। কিন্তু বেশ পরিপাটি। আসবাব বলতে একটা তক্তপোশ, দু'তিনটে টুল, একটা ট্রাঙ্ক, আর দরমার গায়ে একটা ছোট তাক ঝোলানো। তাতে নানান টুকিটাকি জিনিস। ঘরের সামনে একচিলতে বারান্দা। বারান্দার একপাশে প্লাস্টিক ঘিরে রান্নার ব্যবস্থা।

- বাড়িতে কে কে থাকিস পূর্ণিমা ?

- আমি আর মা থাকি দিদি। মা দু'বাড়িতে বাসন মাজার কাজ করে। মার শরীর ভালো থাকে না গো। হাঁপের রোগ আছে। বেশী কাজ করতে পারে না। ঘর ভাড়া, খাওয়ার খরচ, মায়ের ওষুধ। তাই আমি কাজে লেগে পড়লাম।

কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে গেল। আগে কখনো ওকে এত কথা বলতে শুনিনি।

- তুই সব সময় এতো ভয়ে ভয়ে থাকিস কেন?

আমার প্রশ্ন শুনে করুন হাসি হাসল মেয়েটা । তারপর মুখ নামিয়ে স্টোভে চায়ের জল বসালো।

নিজেকে সব সময় ভাষায় প্রকাশ করতে হবে এমন তো কোন নির্দিষ্ট নিয়ম নেই। ওর এই স্বলাজ করুন হাসিটাই আমার প্রশ্নের উত্তর। মেয়েটার মধ্যে একটা সুক্ষ্ম আভিজাত্য আছে, যেটা ওর চারপাশের সব কিছু থেকে, ওকে আলাদা করে রেখেছে।

চা ফুটছে। কেরোসিনের স্টোভ নেভানোর গন্ধের সঙ্গে চায়ের সুঘ্রাণ মিশে, এই দরিদ্র বিকেলের একটা বিশেষ গন্ধ তৈরী করেছে।

দারিদ্রতার মধ্যে যে দুঃখ, তারও বোধহয় একটা নেশা আছে। সেই দুঃখের খোলস ছেড়ে বেড়িয়ে আসা খুব কঠিন। ক্রীম-পাউডারের মেকী বৈভব সেই নেশা কাটাতে পারে না। দৈন্যতা - দারিদ্রতা - ব্যর্থতা মানুষের জীবনে পরম ঐশ্বর্য। এই সম্পদ কখনো হেলাফেলা করতে নেই। দুঃখহীন জীবনের মূল্যবোধ বড়ো কম।

বিলাস - প্রাচুর্যের মেকী চাকচিক্যে সহজেই চোখ ধাঁধিয়ে যায়। আমরা যেন সেই মিথ্যা জৌলুসকে ভয় করতে শিখি। এই মেয়েটা দুঃখী বলেই সবথেকে সুন্দর।

তবু কোন দিন গল্পের "ডাকলিং"- এর মতোই ও যেন রাজহাঁসের দলে মিশে যেতে পারে। দৈন্যকতাই ওকে সেই শক্তি যোগাবে।

চা খেয়ে উঠে পড়লাম।

- চলি রে "আগলি ডাকলিং"

অবাক হয়ে প্রশ্ন করল.

- "আগলি ডাকলিং" কি দিদি?

​- পরের দিন যখন চা খেতে আসব, তোর জন্য একটা বই আনব। গল্পের বই। তোর মতো সুন্দর একটা হাঁসের গল্প। "আগলি ডাকলিং"--এর গল্প।

শিশুর মতো একদিকে মাথা ঝাঁকালো ও। উজ্জ্বল চাঁদের হাসিতে ভেসে গেল দরিদ্রের কুঁড়ে ঘর।

Comments

Top

উদরাময়োপাখ্যান

অমলেন্দু ঠাকুর

toilet.jpeg
উদারাময়োপাখ্যান

বারে দেশে গিয়ে কিন্তু ওই লোকাল ট্রেনে করে হাওড়া থেকে বর্ধমান যাব, আর যত খাবার দাবার উঠবে সব খাব। খুব মজা হবে‘ - তুলতুলি চোখ বড় বড় করে বলল।

- ‘হুম, কতদিন পরে আবার ওই ট্রেনে চাপব!’ – অম্বরও বলে, একটু থেমে আবার বলে ‘শুধু একটাই অসুবিধা এই ট্রেন এর মধ্যে কোন টয়লেট থাকে না, নিম্নচাপ পেলে একটু কেলো ব্যাপার’।

- ‘দু ঘন্টার ত ব্যাপার! তোমার মাথায় খালি আজেবাজে চিন্তা’ – তুলতুলি বলে।

- ‘চাপ পেলে এক মিনিটই মনে হয় যেন এক ঘন্টা, দু-ঘন্টা তো খুবই বিপজ্জনক। আমি যে ঘরপোড়া গরু, তাই সিঁদুরে মেঘ দেখলে একটু ভয় পাই’ - অম্বর গম্ভীরভাবে বলে। 

ইন্ডিয়া যেতে এখনও দেরি আছে বেশ কয়েকদিন, যদিও এই সময়টাই অম্বরের বেশ ভাল লাগে, বেশ একটা একটা যাব যাব ভাব। গেলেই তো ফিরে আসার পালা। আবার সেই গতানুগতিক জীবনের মধ্যে ঢুকে পড়া।

সবই ভাল কিন্তু এই সুটকেস প্যাকিং জিনিসটা সাথেই করে। নিজের গা বাঁচাতে অম্বর তাই মাঝে মাঝে বলে 'জানো তো, এই প্যাকিং জিনিসটাও কিন্তু একটা আর্ট! সবাই এটা পারে না!’

- 'এবারে আমরা যেদিন পৌঁছব, সেদিন কি জা্ন ত?’ – তুলতুলি বলে।

- ‘কি? না তো...’

- 'জামাইষষ্ঠী!, মা কিন্তু অনেক কিছু রান্না করবে বলেছে’

- 'ও, তাই নাকি? দারুন ত!’

অম্বর মুখে খুব উল্লসিত দেখালেও ভিতরে অতটা হয় না। দেশে গেলে খাওয়া দাওয়ার যা বহর প্রতেকদিনই মনে হয় জামাইষষ্ঠী। কিন্তু মুখে কিছু বলে না।

  প্লেনটা ভোরের দিক করে কলকাতায় নামল। নামার ঠিক ঘন্টাখানেক আগে একটা ব্রেকফাস্ট দিয়েছিল প্লেনে। দারুন লেগেছিল অম্বরের খেতে, তুলতুলি পুরোটা খেতে পারেনি, অম্বর ওরটাও সাবড়ে দিয়েছে। তার ওপর এক গ্লাস জল মেরে পেটটা বেশ একটু চাপ চাপই লাগছে।

তুলতুলিদের বাড়ী পৌঁছে, চান করে জামাইষষ্ঠীর জন্য রান্না করা লোভনীয় সব খাবার খেয়ে অম্বর শরীরটা একটু এলিয়ে দিল। পেটটা একটু থম্‌ মেরে থাকলেও সুস্বাদু খাবারের লোভ সারাজীবন অম্বরকে পরাজিত করে এসেছে, এবারেও তাই তার ব্যতিক্রম হয় নি, তাই পেটের কথা চিন্তা না করে, নিজের সাধ্যমতো যতটা পেরেছে সাবড়েছে।

হালকা নিদ্রা নিমেষে গ্রাস করে নিল অম্বরকে।

তুলতুলির ধাক্কা আর ডাকাডাকিতে ঘুম ভেঙ্গে গেল - ’এই ওঠ, ওঠ, এবার তৈরী হয়ে নাও, বেরোতে হবে, গাড়ী এসে গেছে, হওড়া যাব, ওখান থেকে ট্রেন’

পাঁচ দশ মিনিট লাগল সবকিছু করে তৈরী হতে। তৈরী হতে হতে অম্বর বুঝতে পারল তার পেটের মধ্যে সেই থম্‌ মারা অবস্থাটা এখনো বর্তমান। তলপেটের নিচের দিকে হালকা ব্যাথা। তাই বেরনোর আগে একবার বাথরুমে ঢুকল। ভিতর থেকে শুনতে পেল, তুলতুলি বলছে ‘তোমার এই বেরনোর আগে যত্তসব’

অম্বর বসে বসে কয়েকবার নিচের দিকে ঠেলা মারল, কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। বাইরে থেকে তুলতুলি আবার তাড়া দিচ্ছে। তাই অম্বর আর দেরী না করে শেষবারের মত, একখানা জমপেশ করে ঠেলা মারল, শুধু ‘ঠুস্‌সস..’ শব্দযোগে কিঞ্চিত বায়ু নির্গত হল মাত্র, যেটা অম্বরের একেবারেই মনঃপুতঃ হল না।

  হাওড়া স্টেশন এ পৌঁছে ওরা একটা কর্ড লাইন এর লোকাল ট্রেন এ চড়ে বসল। দারুন লাগছিল অম্বরের, দু একটা স্টেশন পরে, চারিদিকের শহুরে ভাবটা কেটে গেল, এখন জানলার পাশ দিয়ে শুধু মাঠ, ঘাট, খাল, বিল, ছোট ছোট গ্রাম, শহরতলীর দোকানপাট সরে যেতে থাকল।

‘এই মুড়ি এলে নিও কিন্তু দুটো, ট্রেন এর ঝালমুড়ি নাকি দারুন বানায়’ – তুলতুলি বলে।

‘হুঁ, নেবো‘ অম্বর বলে।

একটু থেমে আবার আস্তে আস্তে তুলতুলির কানে কানে বলে ‘একটা কি সুন্দর গন্ধ দেখেছ হাওয়াতে!, এই বাইরে মাটি, ঘাষ, আম, কাঁঠাল, কচি ধান, খালের আধপচা জল, আর তার সাথে ট্রেন এর লাইন আর তার পাশে পাথর, প্রখর রোদ্দুর আর তার উত্তাপ সব মিলে কেমন একটা গন্ধ তৈরী হয়েছে বতাসে, বুঝতে পারছ?’

‘বা...ব্বা! হল কি তোমার? তুমি আবার এসব গন্ধ কবে থেকে পেতে শুরু করলে? এদিকে ঘরে বাথরুম দীর্ঘদিন পরিস্কার না করায় যখন নোংরা গন্ধ বেরোয়, সে গন্ধ ত পাও না! কারণ পরিস্কারটা তোমাকে করতে হবে বলে। তখন ত বল, ‘কই  আমি ত কোন গন্ধ পাচ্ছি না’ তুলতুলি আস্তে চেপে চেপে বলে।

অম্বর আর কথা বাড়াল না। বেশ কিছু লোক ইতিমধ্যে ঢুলতে শুরু করেছে, কিছু লোক দরজার সামনে দাঁড়িয়ে গল্পে মত্ত। একটা ছাত্র ছাত্র দেখতে ছেলে আস্ত একটা বাই সাইকেল নিয়ে উঠে অন্য দিকের দরজার পাশে দাঁড়িয়ে।

কাঁচা সরষের তেলের গন্ধ নাকে এল অম্বরের।

‘মুড়ি ঝাল, ঝাল মুড়ি, মুড়ি বলেন’ বলতে বলতে একটা রোগা প্যাটকা ছেলে কামরার অপর প্রান্ত এদিকটাতে এল, বুকে ঝালমুড়ি তৈরীর যাবতীয় কাঁচামাল ঝোলান।

‘আমার পেটটা বেশ সুবিধের মনে হচ্ছে না, একটাই নিচ্ছি’ – অম্বর বলল।

‘ধ্যাত্তেরিকা, তোমার এই এক হয়েছে’ – তুলতুলি খুব্ধ হয়ে বলে।

একটা প্যাকেট নিয়ে অম্বর একটু খেল, বাকিটা তুলতুলিকে দিল।

অম্বরের খুশি খুশি ভাবটা ধীরে ধীরে কেমন যেন উবে যেতে থাকল। কিছুক্ষণ পরে বুঝতে পারল, এটা তার পেটের জন্য। পেটের ‘চিনচিনে’ ব্যথাটা এবার মনে হল ‘মোচড়ে’ রুপান্তরিত হচ্ছে। এই ট্রেনে আবার কোন বাথরুম নেই না, কথায় বলে না! ‘যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যা হয়’। কিছু বিশ্রী পূর্ব অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করে অম্বরের ভিতরে ভিতরে কেমন ভয় লাগল।

‘কি গো, শরীর ঠিক আছে তো? কেমন একটা করে বসে আছ ‘ – তুলতুলি কিছুক্ষণ পরে বলল।

‘না, মানে ওই পেটটা একটু সমস্যা করছে’ – অম্বর বলল, কথা বলতে তার একটুও ভাল লাগছিল না, কথা বললে যেন পেটের মোচড়টা বাড়ছে।

‘সেকি? নেমে যাবে পরের স্টেশনে? তারপর কম্মো সেরে পরের ট্রেন ধরব।‘

‘না, দেখা যাক‘

  এখনো বর্ধমান পৌঁছতে প্রায় তিরিশ থেকে চল্লিশ মিনিট দেরী আছে। এতক্ষণ আটকে রাখা যাবে কি? অম্বর চোখ বন্ধ করে অন্য কিছু চিন্তা করতে চেষ্টা করল। তুলতুলিও একটু আপসেট হয়ে পড়েছে মনে হচ্ছে। বেচারী ট্রেনে কত কিছু  খাবে বলে প্লান করেছিল।

এদিকে যত সময় যেতে শুরু করল অম্বরের অবস্থাও আরও সঙ্গিন হতে থাকল। লোকজনের কথাবার্তা, হকারদের আনাগোনা, ট্রেন স্টেশনে থামলে যাত্রীদের চিৎকার চেঁচামেচি তার কিছুই মাথাতে ঢুকছিল না। বরঞ্চ তাতে আরও পাগল পাগল লাগতে শুরু করল।

ট্রেনটা মাঝে মাঝে উপরে নীচে দুলছে, এই দুলুনিটা কি ভাল লাগত অন্য সময় হলে। এখন এটা মনে হল অসহ্য।বেশি দুললে ভয় হয় এই বুঝি অঘটন ঘটে। ব্যাথাটা ধাপে ধাপে বাড়ছে।

গাংপুর ছাড়ল, এরপরই বর্ধমান। অম্বরের প্রায় দমবন্ধ অবস্থা। তুলতুলিও কোন কথা বলছে না, অম্বর মনে মনে একটা প্লান করে নিল, বর্ধমানে ট্রেন থেকে নেমে কি করবে।

তুলতুলিকে বলল ‘শোন, জানি না কত নম্বর প্লাটফরমে আমাদের ট্রেন দাঁড়াবে, যেখানেই দাঁড়াক না কেন, নেমেই আমি সোজা এক নম্বর প্লাটফরমের দিকে যাব, ওখানে একটা টয়লেট আছে।‘

‘ঠিক আছে’ – তুলতুলি বলে।

‘তুমি ওখানেই অপেক্ষা করো। আমি ওখানেই ফিরে আসব।‘ – অম্বর বলল। পা দুটো কেঁপে কেঁপে উঠছে অম্বরের।

তুলতুলিকে বলল ‘সব লোক আগে বেরিয়ে যাবে, তারপর বেরব, ধাক্কাধাক্কিতে অঘটন হতে পারে‘ পাঁচ নম্বরে ঢুকেছে ট্রেন।ওভার ব্রীজে অসম্ভব ভীড়, পিলপিল করে লোক উঠছে  আর  নামছে,  এক পৌঁছতে পারলে হয়! 

মনে পড়ল একবার বিদ্যাসাগর মহাশয় মায়ের সাথে দেখা করার জন্য একটা গোটা নদী সাঁতরে পেরিয়েছিলেন, স্রেফ মনের জোরে, মায়ের টান বলে কথা। তাকেও পারতে হবে। বিড়বিড় করে বলল ‘বিদ্যাসাগর মহাশয়ের তলপেটের নিচের দিকে তো আর জীবানুতে মরণকামড় দিচ্ছিল না, দিলে উনি বুঝতেন কত ধানে কত চাল’। 

জনসমুদ্রের মধ্যে সাঁতরে যখন এক নম্বরে এল, তখন দেখল প্রায় অক্ষতই আছে। অম্বর সময় নষ্ট না করে তাড়াতাড়ি টয়লেটের জায়গাটা খুঁজতে শুরু করল। অবশেষে খুঁজে পেল সেই বহু আকাঙ্খিত জায়গা। লেখা আছে ‘এখানে পয়সা দিয়ে পায়খানা ও প্রস্রাব করা হয়’ ঢোকার মুখে পয়সা দিতে যাবে, ছেলেটি জিজ্ঞেস করল - ‘সলিড না লিকুইড?’

‘অ্যাঁ?’ কি বলছে অম্বর হঠাৎ করে বুঝে উঠতে পারল না। পরক্ষণেই বুঝতে পারল কি বলতে চাইছে লোকটি। সেন্স অব হিউমার আছে ছেলেটার বলতে হবে, যাই হোক, হবে তো লিকুইড, কিন্তু যেতে হবে সলিডের জায়গায়, ওকে নিশ্চই অত ভেঙ্গে বলার দরকার নেই।

‘সলিড, ভাই’ – অম্বর বলল।

‘পাঁচ টাকা‘ – লোকটি বলল।

অম্বরের এখন যা অবস্থা, পাঁচ টাকা কি, পাঁচ হাজার টাকাও দিতে রাজী আছে ওই নোংরা তিন ফুট বাই তিন ফুট ঘরে কিছুক্ষণ বসতে পারার জন্য।

টাকা মিটিয়ে ভিতরের দিকে এগোল অম্বর। আর এক সেকেন্ডও মনে হচ্ছে ধরে রাখা যাবে না।

ভিতরে গিয়ে যে দৃশ্য দেখল তাতে অম্বরের মাথায় যেন বজ্রপাত হল।

সে দেখল দুই সারিতে মোট ষোলোটি টয়লেট, প্রতেকটা টয়লেটের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। তার মানে ভিতরে ষোলো জন ভাগ্যবান বসে আছেন। এবং প্রত্যেক টয়লেটের সামনে একজন করে লোক দাঁড়িয়ে, এদের মধ্যে পাঁচটা টয়লেটের সামনে আবার দুজন করে দাঁড়িয়ে।

অনেক আগে এখানে বহুবার এসেছে, কোনদিন এরকম হউসফুল পায় নি, ষোলোটার মধ্যে একটা ত অন্তত খালি থাকবে! যেন অমিতাভ বচ্চনের সদ্য মুক্তি পাওয়া কোনো হিট ছবির টিকিট কাউন্টারেরর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সেটা তবু ভাল, ব্লাকএ টিকিট কেনা যেত, এখানে সে উপায়ও নেই।

ব্লাকের কথায় মাথায় এল, ‘যাবে নাকি একবার, ওই মোড়ায় বসা লোকটাকে একবার বলে দেখতে, একটু টাকা দিয়ে যদি আগেভাগে ঢোকার ব্যবস্থা করা যায়, ‘শালা, যেন তিরুপতির মন্দিরে এসেছে, ঘুষ দিয়ে মন্দিরে আগে ঢোকার ব্যবস্থা করছে...’ অম্বর মনে মনে বিড়বিড় করল।

ভাবামাত্র অম্বর ফিরে গেল ছেলেটির কাছে।

‘ভাই, আমি একটু বেশি পয়সা দিচ্ছি, আমাকে একটু আগেভাগে করে দেবার ব্যবস্থা করে দাও না!, আর ধরে রাখতে পারছি না’ – অম্বর কাঁচুমাঁচু মুখ করে বলল। বলতে বলতে অম্বর একটা পাঁচশ টাকার নোট বার করে দেখাল।

‘হবে না দাদা, সরি, আপনার অবস্থাটা বুঝতে পারছি, কিন্তু সকলেরই ওই এক সিচুয়েশন...’ – ছেলেটি বলল।

একটু থেমে ছেলেটি আবার বলল - ‘আপনি ওখানে যারা লাইনে দাঁড়িয়ে আছে, তাদের মধ্যে কাউকে বলে দেখুন, তারা যদি আপনাকে আগে যেতে দেয়’।

অম্বরের ইচ্ছা হল লোকটার গলাটা টিপে ধরে, কিন্তু কিছু করার নেই। চারিদিকে শোনা যায় দেশটা নাকি অসৎ, লোভী, ঘুসখোর লোকে ভরে গেছে, কই যখন দরকার তখন ত পাওয়া যায় না! ভগ্ন মনোরথ হয়ে অম্বর আবার আগের জায়গায় ফিরে এল। একটা লোকের পিছনে দাঁড়াল। ভিতরের একটা লোকও এখনো বেরোয় নি। কেউ কেউ আবার সেল ফোনে কথাও বলছে। ‘এবার বেরো না রে বাবা!’ – অম্বর মনে আবার গালি পারতে লাগল।

কোনটা যে আগে বেরোবে, কে জানে! সে যে লাইনে দাঁড়িয়েছে, সেটা কি আগে বেরোবে? নাকি অন্যটা? কেউ জানে না, এটাও একটা গ্যাম্বেল, তাদেরই জিৎ হবে, যারা ভাগ্যবান।

বাইরে দাঁড়ান কয়েকজন লোক ইতিমধ্যে অস্থির হয়ে পড়েছে। তাদের চোখমুখ দেখে মনে হল বুঝি ‘এই হয় কি সেই হয়’।

অম্বরের মনে হল যদি পায়খানার যন্ত্রনা মাপার কোনো যন্ত্র থাকলে বেশ হত, কে কোন লেভেলএ আছে এবং সেই লেভেল অনুযায়ী তাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হত। অম্বরের দুই পা আবার কাঁপতে লাগল, অনেকক্ষণ ধরে রেখেছে সে, এবার মনে হল সবকিছু নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যাবে।

সে তার সামনে দাঁড়ানো লোকটাকে বলল – ‘দাদা, আমাকে কি একটু আগে যেতে দেবেন, প্লিজ, আমি বেশি সময় নেব না, দু মিনিট নেবো, অবস্থা খুবই সঙ্গিন! ’

‘না দাদা, পারব না, আমার যে কি অবস্থা আমি নিজেই বুঝছি, মুখ দেখে হয়ত বুঝতে পারছেন না, কিন্তু ভিতরে পুরো তোলপাড় চলছে ‘- লোকটি বলল।

‘ও!’ – অম্বর আর কথা বাড়াল না।

‘শুধু আমি না, আমার এক বন্ধুও আছে এখানে‘ – লোকটি আবার বলল।

‘অ্যাঁ ... মানে?’ – অম্বর বলল।

‘আর বলবেন না, সকালে একসাথেই ট্রেন ধরে হওড়া থেকে কলকাতা আসছিলাম, তো সকাল থেকে যাবতীয় খাওয়া দাওয়া একই রকম হয়েছে বলতে পারেন, তাই বোধহয় পায়খানাটাও একই সাথে পেল। তো আমরা যখন এলাম, একটা খালি ছিল, তো আমি আমার বন্ধুকে আগে যেতে দিলাম, হেঁ হেঁ.. বুঝলেন কিনা’ – লোকটি অন্য একটা টয়লেটের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলল।

‘তা আপনি ওটার দরজার সামনেই দাঁড়াতে পারতেন, যদি উনি একটু বুঝে সুঝে একটু তাড়াতাড়ি করতেন হয়ত।‘ – অম্বর বলল।

‘ওরে বাবা! বলছেন কি মশাই? জেনেশুনে এই ভুল করব ভেবেছেন?‘ – লোকটি বলে।

‘কেন?‘ – অম্বর একটু আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল।

‘আর বলবেন না, একবার ঢুকলে কমপক্ষে আধঘন্টা ধরে রাখুন, পাঁচ বছর ধরে একই মেসের একই রুম এ আছি মশাই... হেঁ হেঁ’ – লোকটি মাথা নাড়তে নাড়তে বলল।

‘বলেন কি দাদা’ – অম্বর চোখ বড়বড় করে বলল।

‘হেঁ, হেঁ, সেজন্যই ত এখানে দাঁড়িয়েছি মশাই, তবে আপনি একদম চিন্তা করবেন না, আমি কিন্তু ঢুকব আর বেরোব’ – লোকটি একটু চোখ নাচিয়ে বলল।

‘সবাই তাই বলে’ – অম্বর মনে মনে বলল।

লোকটির বন্ধু যে টয়লেটাতে আছেন, তার সামনে যিনি দাঁড়িয়ে আছেন, সেই ভদ্রলোকের মুখের দিকে একবার আরচোখে তাকাল অম্বর, বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি হবে, চোখেমুখে প্রচুর প্রত্যাশা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, কিন্তু উনি তো আর জানেন না, কি মোক্ষম জায়গায় তিনি দাঁড়িয়েছেন। 

হঠাৎ ‘ফওওওওশশশশশশশশ...’ করে একটা আওয়াজ হল। 

ফ্লাশের আওয়াজ।

‘আঃ, কি মিষ্টি আওয়াজ! এই আওয়াজের মধ্যেই তো লুকিয়ে আছে এখানে দাঁড়ানো বাইশজন লোকের দুঃখ, দুর্দশা ও হতাশার অবসানের মঙ্গলধ্বনি!’ – অম্বর চোখ বন্ধ করে সেই আওয়াজ শুনল।

অম্বরের কর্নকুহরে এই মুহুর্তে ফ্লাশের আওয়াজ সুরসম্রাট মিঞা তানসেনের সুরের থেকেও মধুর শোনাল। পরিস্থিতি মানুষকে কোথায় নিয়ে যায়!

ফ্লাশের আওয়াজ হওয়া মাত্র সবাই একটু সচেতন হয়ে গেল। সবাই দেখতে লাগল কার দরজা খোলে, যেন লটারীর রেজাল্ট বেরিয়েছে, কার ভাগ্যে শিকে ছিঁড়েছে কে জানে।

ছিটকিনি খোলার আওয়াজ হল, অম্বরদের সারির তিন নম্বর দরজাটা খুলল, সেই দরজার সামনে অবশ্য অলরেডি দুইজন দাঁড়িয়ে। চোখেমুখে তৃপ্তির আভাষনিয়ে একজন বেরোল, ঘেমে নেয়ে একশেষ অবস্থা।

তার সামনে যিনি ছিলেন, এই মুহুর্তে তিনিই এখন সবার হিংসার পাত্র। ভিতরের লোকটি বেরিয়ে এলে, ইনি টপ করে ঢুকে ছিটকিনি বন্ধ করে দিলেন।আবার সেই অসীম প্রতীক্ষা! এক সেকেন্ডও আর কাটতে চাইছে না। অম্বরের তলপেটের নীচে জীবানুরা যেন বিশ্বযুদ্ধ শুরু করে দিয়েছে।

অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ছিড়েখুঁড়ে ধংস করে দেবে মনে হচ্ছে। অম্বর পেটের কাছে হাত দুটো চেপে একটু উবু হয়ে বসে পড়ল। আর পারছে না, শেষরক্ষা বোধহয় আর করা গেল না।

হঠাৎ কানে এল সেই সুমধুর আওয়াজ, হ্যাঁ একটা ফ্লাশ হয়েছে। খুব কাছ থেকে আওয়াজটা শোনাল। তাহলে এটা কি তারই লাইনে হল?

যা ভেবেছিল ঠিক তাই, তাদের সামনের টয়লেটের দরজা খুলল, যিনি বেরলেন তাঁর মুখ দেখে মনে হল ঠিক মনের মতো করে হয়নি। সামনের লোকটা তড়িঘড়ি করে ঢুকতে গেল, দরজাটা ঠেলে ভিতরে পা রাখতেই হঠাৎ থমকে দাঁড়াল।

‘কি ব্যাপার দাদা, যান তাড়াতাড়ি, এরপর তো আমি’ – অম্বর বসে বসেই বলল। 

‘না মানে...ঠিক বুঝতে পারছি না’ – বলে লোকটি ইতস্তত করতে লাগল। 

অম্বর ঝট করে উঠে পড়ল, ব্যাপারটা কি! লোকটির পাশ দিয়ে উঁকি মেরে টয়লেটের মধ্যে যা দেখল, তাতে তার মনে হল,  ‘ভগবান যা করেন, মঙ্গলের জন্যই করেন’।

দেখে যা বুঝল, আগেরজন ঠিকঠাক শুট্‌ করতে পারেন নি, তাই বর্জ্যটি নির্দিষ্ট গর্তে না পড়ে দিকভ্রষ্ট হয়েছে, যার ফলস্বরুপ পায়খানার প্যানটার পিছনের দিকে বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে একটা গাঢ় হলুদ রঙের সেমি-লিকুইড পদার্থ কায়েম করে বসেছে। কয়েকটা জায়গা অল্প উঁচু হয়ে আছে। ফুলকপি, আলু দিয়ে খিচুড়ী করে বড় থালাতে ঢাললে যেমন দেখতে লাগে, অনেকটা সেরকম। 

লোকটির ইতস্ততা দেখে অম্বর আর মহামুল্যবান সময় আর নষ্ট করল না।

‘আমার কোন অসুবিধা হবে না, দাদা’ - বলে সে লোকটাকে পাশ কাটিয়ে টয়লেটের ভিতরে ঢুকে গেল‘ বেরনোর আগে সব পরিস্কার করে দেব, কোন চিন্তা করবেন না, এই গেলাম আর এলাম’ – বলে অম্বর ভিতর থেকে ছিটকিনি বন্ধ করে দিল।

‘এই, এই, তাড়াতাড়ি বেরোবেন কিন্তু ... কি মুস্কিল!’ – লোকটা হাঁ হাঁ করে উঠল।

এক ঝট্‌কায় যতটা বেরোবার বেরিয়ে গেল, বেশিরভাগটাই মনে হল বায়ু, তার সাথে খলমল করে কিছু খুচরো খাচরা বেরল, তারপর আবার সেই ‘ন যযৌ, ন তস্থৌ’। এবার ঠেলে ঠেলে পাঠাতে হবে। কিন্তু বেশি কিছু করা গেল না, এদিকে বাইরের লোকটা দরজাতে নক্‌ করতে শুরু করেছে।

অম্বরের এখনো যা অবস্থা মনে হচ্ছে অনন্তকাল ধরে এখানে বসে থাকলেই বেশ হত।

পরিস্কার হয়ে এবং করে যখন বেরল, দেখল লোকটা বেশ ছটফট করছে, তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেল অম্বর।

অম্বর বুঝতে পারল, তার পেটের অবস্থা মোটেই ভাল না, যত তাড়াতাড়ি পারা যায় ওষুধটা কিনে নিতে হবে।

বাইরে বেরিয়ে অম্বর দেখল, তুলতুলি ইতিমধ্যে এসে বাইরেটায় দাঁড়িয়ে আছে।

‘কি গো, হল শান্তি? বাব্বা... সেই কখন গেছ, ওখানে অপেক্ষা করতে পারলাম না, তাই এখানে চলে এলাম।‘ - তুলতুলি বলল।

‘হু, হয়েছে, কিন্তু মনে হচ্ছে যেন আবার এখুনি যাই’ – অম্বর বিমর্ষ মুখে বলল।

‘এ বাবা, সে কি গো, ইসস, ওষুধটা আসার সময় খেয়ে নিলে ভাল হত।‘ – তুলতুলি বলে।

‘হ্যাঁ, এখন চল, একটা ট্যাক্সি ধরে রওনা দিই, যাবার পথে বাজারের দোকান থেকে তুলে নেব।‘ - অম্বর বলে।

স্ট্যান্ড থেকে একটা ট্যাক্সি ধরে ওরা অম্বরদের বাড়ীর দিকে রওনা হল। আরও চল্লিশ মিনিট লাগবে ওদের পৌঁছতে। যাবার পথে ওষুধ কিনে খেয়েছে। দেখা যাক কি হয়।

ট্যাক্সিটা শহর ও শহরতলী ছেড়ে ফাঁকা জায়গার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। চারিদিকে শুধু ধানক্ষেত, বেলা পরে এসেছে,  অম্বর জানলার কাচটা একটু নামিয়ে দিল, হাল্কা মিষ্টি একটা হাওয়া দিচ্ছে, অম্বর জানলা দিয়ে বাইরের চলমান দৃশ্য দেখতে লাগল।

তুলতুলি ফোনে কথা বলছে, ফোনের কথপোকথন শুনে অম্বর বুঝল, অনেক কিছু নাকি রান্না হচ্ছিল, সেসব নাকি নাকি এখন বন্ধ, পেট খারাপের খবর শুনে। অম্বর ঠিক খুশি হল না শুনে। 

কথাবার্তায় শুনল, অম্বরের ছোড়দি এসেছে। ছোড়দির সাথে অনেকদিন বাদে দেখা হবে ভেবে অম্বর মনে মনে খুশি হল। ছোড়দিও নাকি অনেক কিছু রান্নাবন্না করার প্লান করেছিল, এসব শুনে সে নাকি আজ সব বন্ধ রেখেছে, ঠিক থাকলে কাল করবে বলেছে।

‘নাঃ যেভাবেই হোক কালকের মধ্যে ভাল হতেই হবে’ – অম্বর মনে মনে বলে। হঠাৎ পেটটা বেশ একটু মোচড় দিল,তারপর একটা ‘খলখল’ করে শব্দ, যেন পেটের মধ্যে একটা ‘ঝর ঝর ঝর্না’। তুলতুলিও শুনেছে, মুখ ঘুরিয়ে ওকে দেখল, অম্বর ভাবল এটা আবার না ফোনে বলে দেয়, তাহলে আর রান্নাবান্নাই চড়বে না। শুধু ট্যাবলেট, জল, গাঁদাল পাতার ঝোল আর মুড়ি খেয়ে থাকতে হবে।

গিয়েই একবার বাথরুমে ঢুকতে হবে, পেট ব্যাথাটা আবার বাড়ছে। আর ভাল লাগছে না, কিভাবে যে নিস্তার পাওয়া যাবে কে যানে, অম্বর ভিতরে ভিতরে অস্থির হয়ে পড়ে, মঝে মাঝে মনে হচ্ছে, ডাক্তারের কাছে গিয়ে বলে যে তলপেটের ভিতরে নীচের দিকটা যদি কেটে বাদ দেওয়া যায়, এরকম বেয়ারা জীবানু অম্বর জম্মে দেখে নি।

বাড়ী পৌঁছে অম্বর সোজা বাথরুমে ঢুকল। প্রথম ঝটকায় ‘ফলাৎ’ করে তরল পদার্থটা বেরিয়ে গেল। শুরু হল আবার ঠেলাপর্ব। একটাই শান্তি যে, বাইরে থেকে কেউ নক্‌ করবে না বেরিয়ে আসতে বলার।

ভিতরে বসে অম্বর শুনতে পেল, তার পেটের অবস্থার কিভাবে ভাল করা যায় সে নিয়ে বেশ জোর কদমে আলোচনা শুরু হয়ে গেছে। কেউ বলছে সারাদিন মুড়ি ভেজানো জল খেয়ে থাকতে, কেউ বলছে একটু ভাতের সাথে গাঁদালের ঝোল খেতে, কে একজন আবার বলল কষা মাংস দিয়ে গরম গরম ভাত খেলে নাকি পায়খানা এঁটে যায়। কে বলল এটা? তুলতুলির মত গলাটা শোনালো, যেই বলুক, অম্বরের বেশ মনে ধরল দাওয়াটি।

অম্বর বেরিয়ে এল। অনেকটা স্বস্তি লাগছে, সলিড কিছু বেরিয়েছে। ওষুধটা ভাল।

ছোড়দি বলল‘ তাহলে একটু লুচি ভাজি? কয়খানা ফুলকো লুচি আর কষা মাংস খা আজ’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ সেই ভাল...’ বলে অম্বর ভিতরে চলে গেল। একটু বিশ্রামের প্রয়োজন। অম্বর একটু ভাল বোধ করতে লাগল। রাত্রে যখন খেতে বসল, বেশ ভাল খিদে পেয়েছে, তৃপ্তি করে খেয়ে অম্বর ঘুমোতে গেল।

  ...মাঝ রাতের দিকে অম্বরের পেট ব্যাথায় আবার ঘুম ভেঙ্গে গেল, ঠিক বুঝতে পারল না কোথায় সে, এক্ষুনি বাথরুমে যাওয়া দরকার, বেরিয়ে এসে খুব আশ্চর্য হয়ে গেল, একি? এ কোথায় সে, এটা ত বর্ধমানের সেই নবাবের হাটের ১০৮ শিব মন্দির এর জায়গাটা, বাথরুম এ যেতে গিয়ে এখানে কি করে এল, সামনে সারি সারি মন্দির, অম্বর আরও আশ্চর্য হল, যখন দেখল, মন্দির গুলির ভিতরে কোনো শিবলিঙ্গ নেই, তার পরিবর্তে রয়েছে একটা পায়খানার প্যান, একটা জলের কল আর একটা প্লাস্টিকের মগ। অম্বর মনে মনে ভীষণ খুশি হল, ১০৮ টা টয়লেট! এবং দু একটা ছাড়া সবই প্রায় ফাঁকা! অম্বর দৌড়ে একটা মন্দিরে ঢুকল, মনে মনে ভাবল ‘ইসস! এত ফাঁকা টয়লেট আর সে কিনা শুধু একটা তে করেই ক্ষ্যান্ত থাকবে? সে কি করে হয়?’ তাই কিছুটা করে সে ব্রেক মেরে দিল, তারপর বেরিয়ে এসে আবার একটাতে ঢুকল, ...তারপর আবার একটাতে... তারপর আবার একটা... ...বাতাসে একটা গানের সুর ভেসে আসছে ‘আহা কি আনন্দ, আকাশে বাতাসে...’, আজ অম্বরের সত্য সত্যই খুব আনন্দ হচ্ছে, এইভাবে একটার পর একটা টয়লেটে সে হানা দিতে লাগল... প্রায় দশটা টয়লেটে ঢোকার পর, সে পেট ফাঁকা করল... আনন্দে আত্মহারা হয়ে চিৎকার করে উঠল অম্বর...

  অমনি অম্বরের ঘুমটা গেল ভেঙ্গে। চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষন বসে রইল, মনে মনে হাসল স্বপ্নটার কথা ভেবে। তিন বছর আগে যখন এদেশে এসেছিল, তখন বর্ধমানের নবাবহাটে ১০৮ মন্দিরে গিয়েছিল, আর সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী যখন বলেছিল ‘Build toilet first, temple later’, অম্বরের কথাটা বেশ মনে ধরেছিল। স্বপ্নটা এ দুটোরই খিচুরী।

  অম্বর চোখ খুলল, ভোর হয়ে এসেছে। জানলার ফাঁক দিয়ে হাল্কা আলো ঘরের মধ্যে এসে পড়েছে। তুলতুলি এখনো ঘুমিয়ে রয়েছে। জানলার পাশেই একটা পেয়ারা গাছ, কয়েকটা চড়াই পাখি সেখানে কিচিরমিচর করছে, ওরা বোধহয় খুব সকাল সকাল ওঠে। জানলার পাশ দিয়েই চলে গেছে লাল মাটির রাস্তা সোজা স্টেশনের দিকে। লোকজনের যাতায়াতের শব্দ ভেসে আসছে। প্যাঁক, প্যাঁক শব্দ করতে করতে একটা রিক্সা চলে গেল। হঠাৎ একটা রাস্তার কুকুর কেঁউ কেঁউ করে উঠল, নির্ঘাত রিক্সার চাকা কুকুরটার লেজে বা পায়ের ওপর দিয়ে গেছে। বাইরের কোথাও  থেকে উনুনের ধোঁয়ার ও তার সাথে তেলেভাজার গন্ধ নাকে এল। অম্বর ভাবল, এইসব কিছুর আস্বাদন পেতেই এই দেশে বার বার আসা যায়। এই জিনিসগুল ওখানে ভীষণভাবে মিস করে। যদিও এটা অনেকটা ‘নদীর ওপার কহে ছাড়িয়া নিশ্বাস...’ এর মত।

  শরীরটা বেশ আজ ঝরঝরে লাগছে, পেটে আর কোন ব্যথা নেই, ওষুধ, লুচি আর কষা মাংস ভালই কাজ করেছে মনে হচ্ছে। রান্নাঘরে খুটখাট আওয়াজ পেল অম্বর, কড়াইতে গরম তেলে কিছু একটা পড়ল বোধহয়, আজ আবার ছোড়দি অনেক কিছু রাঁধবে বলেছে, তারই বোধহয় তৈয়ারি চলছে। বরাবরের পেটুক অম্বরের ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে উঠল। চোখটা ধীরে ধীরে আবার বুজে এল। অম্বর আবার ঘুমিয়ে পড়ল। 

Comments

Top

তুমি না থাকলে 

অর্ঘ বক্সি

morning1.jpg
তুমি না থাকলে

তিনি মারা গেছেন। খবরটা এখনও পৌঁছোয়নি সবার কানে। তিনি তো মারাই গেছেন। একাই মারা গেছেন ক্লান্তির কোন এক সাময়িক বিরতির মাঝখানে। শুনতে ভালবাসতেন হংসধবনি। করতে ভালবাসতেন হঠাৎ করে ফেলা কাজ। মাপতেন জল মাটি পৃথিবীর। বলতেন মহামায়া সততঃ গর্ভিণী। হরি তোমার সর্বরূপে মাতৃরূপ সার। ভেবে সংকুচিত হতেন, এই ভেবে কতখানি প্রাকৃতিক অপচয় জীবনধারণে, শূন্য করে অনেক ভাঁড়ার। নিজেকে খুঁজতেন, আশ্বস্ত করতেন সুখনাগরদোলাতে। ওহো নাগর নাগর হে শনিবার। খুঁজতেন জেগে থেকে ঘুম পর্যন্ত, ক্লান্তির বিরতিতে দুধকলা খেতেন। অঙ্গে প্রত্যঙ্গে একা তার বসে বসে থাকা। বলতেন মনে থাকে কি থাকে না ফেয়ারি জিয়নমালা জাদুকরী অ্যালিসিয়া, মৌমাছি দেহচর্যায় রত কস্মিনকাল, রোদকে বারবার এড়িয়ে যেতে চাওয়া বিকেলবেলায় ক্রমশঃ পূর্বদিকে সরে যেতে যেতে নির্বোধ প্রয়াসে, দুলে দুলে মহাকাব্যের মত। বিষবৃক্ষের ঝুড়ি গল্প বলে ও নীল ঘোড়ে কা সওয়ার, হেঁকে যায় হরকরা নিয়ে তার রণপা বিভূতি, সে উড্ডান বালকের তালপাতা ব্যতিরেকে নিরাশ্রয়। দেবনাগরী হিতপোদেশ ঝুমুরেও রয়েছে, এক একাকার ও অবিকৃত, গথাম শহরে ঝোলে উল্লম্ব উল্লম্ব সব বাদুড়, ভার্টিকাল অপেরা-অ্যান্টেনা, চোখ খোঁজে আরাম খোঁজে ত্বকে ত্বকে গ্রীন চকমকি মেঘমল্লার, তাহার সন্তান প্রাক্তন বিশেষ্যতে নেইকো জিরিয়ে, ভেঙ্গে দেয় বৃত্ত ইতিহাস, সব ভেসে গেলে প্রজাতির মত সব মানুষ হয়ে ওঠে কামানুষ জিভ, সে কলহপ্রবণ জিভ তবে হত হোক, কখনো কখনো শব্দভেদী এক ভাষ্য- ‘হত্যা’ -নতুন এক  শব্দ  প্রজনন - স্থানু  হয় - গদ্যে বসে আলো করে। অনেক কিছু করতেন দুধকলায়, খেতেন, কালসাপ পুষতেন যতনবিলাসী, সেই কলাকৈবল্য মিশে থাকে ব্যপন হয়ে রিংকেলে রিংকেলে আর ঘটনা জমে পেসিফিটেড চায়ের কাপে ইস্কাবনের টেক্কায়, তেপায়ার মেহগনি ফিগারে। ত্বক খুঁজতো জামা জামা চাদর চাদর বাতাস বাতাস বৃষ্টি বৃষ্টি ঋতু ঋতু গতি গতি কারখানা গলা হাত হাতমোজা পায়জামা দড়ি দড়ি শিমূল শিমূল মানবায়ব কোটর গর্ভ মানুষ শ্বাসপ্রশ্বাস গলা গলা খাঁকাড়ি। একরকম কাগজে শিকলি বানাতেন ঘর সাজানোর, কেক আন্দাজমত মোমবাতি অথচ দেখো কেউ বলবার নেই হ্যাপি বার্থ ডে, আর্চিস নিজেই নিজেকে, মাতুন মাতুন একজোড়া হাততালি কেক কাটবার। বলতেন মানুষ তো নয়, সুস্বাদু একাকীত্ব রান্না 

করে যারা মানবক, কুলীন সাধক। তার সাথে পূর্বপরিচয় আছে নাকি তোমার? তার পরিচয় আছে পুঁজির জন্ম ছকে, বেস কি সুপার স্ট্রাকচার, নির্ণয় ও নির্মিতিতে আয়না কখনো কি ভুলও দেখায় অস্তিত্ববাদী – মানুষের তরে খাটা সুদের প্রথম টাকায়, পরিযায়ী পরীদের শরীরচর্চায়। ভোট উত্তেজনা তাকে দেখো বারবার আলোড়িত করে, গণতান্ত্রিক পুরাণিয়া কৃষ্ণ যাদব, ফির সচ্ কো বিগল যায় হাঁ আসে, যে যার মতো বসে এঁকে বানাও নিজেকে।তিনি মারা গেছেন জানা গেল দরজার থেকে। বলা ভাল দরজার প্রতিধবনিতে বোঝা গেল চলে যাওয়া সন্দেহাতীত নয়। তবে কি সুইসাইড? এখন এই যে দীর্ঘভণিতার গদ্যালাপ তিনি যে চলে গেছেন তা ধীরে ধীরে বোধগম্য করে। বুঝে নিতে পারা যায় তিনি গেছেন গিয়ে। বাসিবাস ছাড়তে ছাড়তে ভাবে, মড়া চামড়া ফেসিয়ালে চেঁচে ভাবে কোথায় গেলেন, এই তো ছিলেন  খেয়ালে, এভাবে  চলে যাওয়া যায়? বেঁচে থাকলে বাজার যেতেন, সাড়ে আটটায় মৃগেল পুঁটি ধনেলঙ্কা, সন্ধেবেলা প্রিয় হংসধবনি ক্যাসেটে হাল্কা ছিমছাম। লোকটা কি তবে বিবাহিত নয়? তিনি যে মারা গেছেন কথকতা নিজেই তা বোঝে হস্তাক্ষর গতির থেকে খানিক পিছিয়ে।

তিনি চলে গেলে কনডাক্টর বৈশাখীকে বলে দেবে ১০নং ট্যাঙ্ক, বাস খালির তাড়ায়। চলে গেছেন বলে কিছুদিন ফোনে অহেতুক রিং রিং অপেক্ষা। স্বচ্ছন্দে তারপর ফুটিয়ে জল খাবে পিলেজ্বর। তার আগে এক্ষণে বুঝিয়ে দেওয়া হল তিনি গেছেন, আর ফিরবেন না, ফেরা যায় না অসমাপিকা। এ তো স্বাভাবিক বড়, স্টক এক্সচেঞ্জ ঠিক করে দুর্গাপুজোর দিনক্ষণ। অবাক লাগে না আর yourself contradictory। তবুও কারোরই চলে যাওয়া ভাল নয়, বিশেষ করে শূন্য থেকে পূর্ণ করে দিয়ে যায় যারা, তাদের মরণে কদিন অঘোষিত কার্ফিউ হ্রদয়বীণাতে। প্রতিমার কাঁচামাটি শুকোতে চায় না আর। আঙুলের টিপসই ললাটে নয়নে রয়ে যায় ফসিলের মতো। তিনি চলে গেলে প্রভু ক্রমশঃ স্বাধীন দাস দর্শন বুঝে হিংসুটে হয়ে ওঠে। দাসভক্ত। জ্ঞানের গুঁতোয় পার্থ তুলে নেয় গাণ্ডীব। মাটি তিন আঙুল উপরে উঠে আসে, সংগঠক একত্র করে ৪৯ অভিমন্যু আস্তাবলে, অত্যন্ত বিরহে।

তিনি নেই জেনে গদ্যও অবাধ্য হয়ে শেষ হতে চায় না কখনো।  

Comments

Top

শেষ দেখা 

দীপশিখা তরফদার

autoriksha.jpg
শেষ দেখা

টোতে উঠলাম। আজ ও খুব সুন্দর করে সেজেছে তা বলব না। কিন্তু আজকে ওকে একটু আলাদা রকম সুন্দর লাগছে। ঠোট দেখে মনে হচ্ছে বলবে বলবে করেও অনেক কথা আটকে আছে সেখানে। চোখ দেখে মনে হচ্ছিল নিস্প্রাণ, ম্রিতপ্রায়, যেন হাজারো যন্ত্রনা বয়ে নিয়ে বেরচ্ছে চোখ দুটি। আর তার ভারেই সে শীর্ণপ্রায় হয়ে পড়েছে। মুখটা বেশ ফ্যাকাশে দেখাচ্ছিল। অটোতে উঠে ও বসল জানলার ধারে আর আমি ঠিক তার পাশে। কিন্তু ও যেন এখানে ছিলই না। মনে হচ্ছিল ও হয়তো স্বপ্নের জগতে ওর ভাঙ্গা ছড়ানো স্বপ্নগুলো জড়ো করতে ব্যস্ত ছিল।

অটো স্টার্ট দিল। কিন্তু সেই শব্দেও ওর ঘুম ভাঙল না। আমিও কিছু বলার চেষ্টা করলাম না। আস্তে আস্তে অটোর গতি বাড়ল। ওর দু একটা খোলা চুলে ঢেউ খেলে যাচ্ছিল বাতাস। হাওয়াকে কাটিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলাম আমরা। কিন্তু ও টু শব্দ পর্যন্ত করল না। শুধুমাত্র বাইরের দিকে আলোগুলোর দিকে তাকিয়ে ছিল। কে জানে সেখানেই হয়ত সে জীবনের হারিয়ে যাওয়া আলোকে খুজে বেরাচ্ছিল। কিন্তু আমি খুঁজে ছিলাম সেই মেয়েটাকে যাকে আমি দেখছি, সেই হাসি ঠাট্টায় মজায় দিন কাটানো মেয়েটাকে। কিন্তু শত চেষ্টা করেও আমি তাকে খুঁজে পেলাম না। মনে হচ্ছিল মেয়েটা কোন বন্ধ কুঠুরিতে বসে আমাকে বারবার করে ডাকছে। কিন্তু আমি ছিলাম নিরুপায়। এবার অটো ব্রিজে উঠল। বড় বড় দোকান আর বিল্ডিং এর রঙিন আলোতে কাউকে দেখানোর সাহস নেই তার। সেগুলো বাইরে বার করতেও রাজি নয় সে। তার পরিমাণটা এত বৃহৎ যে মাঝে মাঝেই তার মলিন মুখটা কুঁকড়ে উঠছে। আর আমার এই ভেবে ভয় লাগছিল যে তার মধ্যে কিছু কিছু আমারই দেওয়া। আস্তে আস্তে আমি ওর জল ভরা চোখটাও আবিস্কার করলাম ওই রঙিন আলোতে। ছোট্ট ছোট্ট চোখ দুটো জলের ভার আর বইতে পারল না, তাই  দু-ফোঁটা জল নেমে এল গাল বেয়ে। কিন্তু কেউ জানতে পারল না কোথায় পড়ল সেই জল। শুধু আমি দেখলাম হাতের উপর পড়ে থাকা জলের ফোঁটাগুলোকে মুছে ফেলল সালয়ারে। হাতের পেছন দিক দিয়ে দুটো গাল। যাতে কেউ কিছু না দেখতে পায়, যাতে কেউ কিছু না বুঝতে পারে। কিন্তু কিছুই লোকাতে পারল না, না আমার থেকে না নিজের কাছ থেকে। ওর নিস্তব্ধতা অনেক না বলা কথা বলল আমায়। নিজের ভুলটা হঠাৎ আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। ঝকঝকে ঝলঝলে নীল লাল সবুজ আলোর রোশনাই বার বার পড়ছিল ওর দুটো মলিন চোখে। কিন্তু  সেই সাদা কালচোখে তারা কোন স্থায়িত্ব খুঁজে পাচ্ছিল না। অটো এসে এবার স্ট্যান্ডে দাঁড়ালো। আমরা নামলাম। আর অটো থেকে নেমেই মনে হয় আমরা

ঠিকমতো দুজনের চোখে চোখ রাখলাম। আর তখনই ওর অবর্ণনীয় স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম ওর মুখটা। যেন মনে হচ্ছে জীবনের সমস্ত যন্ত্রনা নিজের মধ্যে নিয়ে নিয়েছে। তা মুখটা দেখে আমার মনের ভেতর এক অজানা যন্ত্রণায় মুচড়ে উঠল। হাঁটতে শুরু করলাম দুজন রাস্তার দুদিক দিয়ে। সেই মুহূর্তে বুঝতে পারলাম ও নিজেকে কেন একলা বলত। এত মানুষের ভিড়ের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল, কিন্তু প্রচণ্ড একা ও সবার থেকে আলাদা মনে হচ্ছিল ওকে। আমার হঠাৎ মনে হচ্ছিল ওর সমস্ত দুঃখকে নিয়ে নিই। ওকে ভারমুক্ত করি। কিন্তু ও যেন নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল। তাই চেয়েও তাকে খোলসমুক্ত করতে পারলাম না। আমি আর ওর এই খামখেয়ালিপনাকে সহ্য করতে পারলাম না। ওকে আস্তে করে নিজের দিকে হ্যাঁচকা টান কাছে আসার জন্য। কিন্তু ও আরও দূরে সরে গেল। আমি বুঝতে পারলাম ওর যন্ত্রণাটা। কারণ তার কিছু অংশ হয়তো আমার বুকেও বিধছিল। ধীর গতিতে সেই চেনা রাস্তায় হাঁটছিলাম। কিন্তু আজ যেন সব কিছু পালটে গেল। সেই চেনা রাস্তাগুলো  অচেনা  অচেনা  মনে  হচ্ছিল। যেখানে আমরা একসাথে হাত ধরে চলেছি। যেখানে আমি প্রথম ওর কাঁধে হাত দিয়েছিলাম। আর ও আমার হাতে হাত। আজ সেই চিরপরিচিত প্রাণশক্তিহীন রাস্তাগুলোর মধ্যে প্রাণ সঞ্চার ঘটল। তারা হঠাৎ এক অস্তিত্ব লাভ করল। তারা যেন ওর মতই পালটে যেতে থাকল। আমার দিকে তাকিয়ে ওঁরা সমস্ত দুঃখের জবাব চাইতে থাকল। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই আমার কাছে কোন প্রশ্নের সঠিক উত্তর ছিল না। তারা আমার দিকে এক ঝাঁক প্রশ্ন নিয়ে তাকিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত লেকের গেটে এসে আমাদের পা থামল। এই সেই জায়গা যেখানে আসার জন্য আমাদের দুজনকে কত অসুবিধার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছিল। আমাদের জীবনের রঙিন ঘটনার স্মৃতি হয়েছিল এই জায়গাটা। এখানেই আমরা প্রথম সবচেয়ে কাছে এসেছিলাম ঘনিষ্ঠ হয়েছিলাম।

হঠাৎ দেখলাম ও হাঁটা বন্ধ করে দাঁড়িয়ে পড়েছে। তখন আমার মনে পড়ল এই রাস্তাটিই আমাদের হাজারও স্মৃতির সাক্ষী হয়ে রয়েছে। তার মধ্যে কিছু কান্না ভেজানো, কিছু হাসি মাখানো। আমি ওর স্থিরতার  কারণ বুঝতে পারলাম।

ও আর দাঁড়িয়ে না থেকে হাঁটতে শুরু করল সঙ্গে আমিও। কিন্তু হাঁটতে হাঁটতে নিজেকে ওর সাথে মেলাতে পারছিলাম না। নিজেকে একদম আলাদা মনে হচ্ছিল। এবার আমি ওর এই নিস্তব্ধতা আর সহ্য করতে পারছিলাম না। আমি ওর হাতটা টান দিয়ে নিজের কাছে নিয়ে এলাম। এখন ও আর ছাড়ানোর চেষ্টা করল না। আমি ওকে করলাম জিজ্ঞেস, 'তুমি কি সত্যি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে?' উত্তরটা খুব চেনাশোনাই ছিল। 

Comments

Top

নূপুরের নূপুর 

ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

গাজীপুর, বাংলাদেশ

girl1.jpg
নূপুরের নূপুর

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর এ দীর্ঘদিন যাবত শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত আছেন। শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে তিনি যেমন অবদান রেখে চলেছেন তেমনি সৃষ্টিশীল লেখার ক্ষেত্রেও তাঁর পদচারণা। তিনি মনে করেন বিজ্ঞান চর্চা, শিক্ষা ও সংস্কৃতি একে অন্যের পরিপূরক। তিনি একাধারে শিক্ষাবিদ, গবেষক, গল্পকার, প্রাবন্ধিক, কবি, গীতিকার, নাট্যকার, সমাজ সংস্কারক ও সাংস্কৃতিক কর্মী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দর্শনে বিশ্বাসী এই মানুষটির ছোটবেলা থেকেই লেখায় হাতেখড়ি। কৈশোর ও তারুণ্যে তিনি বাংলা একাডেমি, খেলাঘর,  কঁচিকাচার মেলা সহ বিভিন্ন সংগঠনে কাজ করেছেন। এই সময় তাঁর প্রবন্ধ, কবিতা বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। প্রকৌশল বিদ্যা অধ্যায়নের সময় তিনি প্রগতিশীল কর্মী হিসেবে কাজ করে সহিত চর্চা করে গেছেন। এ সময় তাঁর লেখাগুলো বিশ্ববিদালয়ের ম্যাগাজিনে এখনও সংরক্ষিত আছে। এছাড়াও অনেকদিন ধরেই তিনি দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে লিখে চলেছেন। বাংলা ও ইংরেজি দুই সাহিত্যেই তাঁর সমান দক্ষতা রয়েছে। সমাজ, রাষ্ট্র, প্রকৃতি, বিজ্ঞান, শিক্ষা, পরিবর্তন, সম্ভাবনা ও মানুষ তাঁর লেখার মূল উপজীব্য বিষয়।  তিনি একজন ভাল বক্তা। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের টক্ শো সহ বিভিন্ন সৃজনশীল অনুষ্ঠানে তাকে অতিথি হিসেবে দেখা যায়। ভারতরে প্রাক্তন কেন্দ্রীয় তথ্যমন্ত্রী অজিত কুমার পাঁজা কলকাতা দূরদর্শনের একটি প্রতিযোগিতায় তাঁর প্রেরিত প্রবন্ধে মোহিত হয়ে নিজ হাতে পুরস্কার তুলে দেন। অনুষ্ঠানটি সরাসরি সে সময় সম্প্রচারিত হয়। এই খবরটি আজকাল, সংবাদ, বাংলাবাজার সহ বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এছাড়া তিনি ফিলিপিন্স, চীন, বি-টিভি  সহ দেশ বিদেশের বিভিন্ন পুরুস্কারে ভূষিত হন। বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট ও বঙ্গবন্ধু প্রকৌশলী পরিষদের একজন কর্মী হিসেবে তিনি কাজ করে চলেছেন। 

রুমঝুম করে নূপুর বাজছে। নূপুরের নূপুর। দাদি বললেন, 'সাবধান, শব্দ যেন বাইরে না যায়"। নূপুর এ কথা শুনে আরো জোরে নূপুরের শব্দ করতে থাকলো। মা রান্নাঘর থেকে বললেন, 'নূপুর, শব্দ করে নেচে চলার বয়স তোমার নেই। এখন থামো।'

নূপুর নাছোড়বান্দা। এবার আরো জোরে শব্দ করে করে নূপুর নূপুরের ঝংকার তুললো। নূপুরের বাবা জানালার পাশ থেকে উঁকি মেরে মিটি মিটি হেসে বললো, 'বাজা মা, যত জোরে পারিস, বাজা।' কথাটা শুনে নূপুরের মা অনেকটা রাগতস্বরে বললো, 'তোমার আস্কারা পেয়ে পেয়ে মেয়েটা দিনে দিনে বেহায়া হয়ে যাচ্ছে। মেয়ে তো আর ছোট নেই। ওর বিয়ের একটা ব্যবস্থা করো।' বাবা এবার মেয়ের মুখের দিকে তাকালেন। কচি মুখ। দুধে আলতা মাখানো গায়ের রং আর মুখে লজ্জা ভরা জড়তা। বয়সের চেয়ে বেড়েছে বেশি। বাবার মনে পড়লো কিছুদিন আগেও তো ও গাঁয়ের ছেলে মেয়েদের সাথে একসাথে খেলতো। সন্ধ্যে হবার আগেই তিনি খুকি খুকি বলে সারা গায়ে খুঁজে বেড়াতেন। নূপুর খুব দুষ্টুমি করতো। কখনও সবুজ ধানক্ষেতে, কখনও ঝোপেঝাড়ে আবার কখনও পুকুরে ডুব দিয়ে কচুরিপানার আড়ালে লুকাতো। বাবার মন অজানা আশংকায় আতংকিত হতো। এরপর মেয়ে যখন বাবাকে এসে জড়িয়ে ধরতো তখন বাবার মনে হতো স্বর্গ যেন তার হাতে এসেছে। বাবা আর মেয়ে কোরাস গান গাইতে গাইতে বাড়ি ফিরত। আজ কিনা তার বিয়ের বয়স হয়েছে। অনেকদিন পর বাবার বুকটা ধপ করে উঠলো। তার আদরের ধন তাকে ছেড়ে চলে যাবে। চোখ দিয়ে ক'ফোঁটা জল মনের অজান্তে ঝরে পড়লো।

ভালো পাত্র সন্ধানের জন্য ঘটককে খবর দেওয়া হলো। বুড়ো ঘটক শক্ত লাঠিতে ভর করে নূপুরদের বাড়িতে এলো। তারপর একটার পর একটা সুপাত্রের গুণকীর্তনের কাহিনী। কেউ যেন কারো চেয়ে কম নয়।  যে পাত্র যত বড় তার দাম তত বেশি। বড় মানে বয়স বড় না। বড় মানে যার ধন 

সম্পদ বেশি। বাবার চোখ বড় বড় হয়ে উঠে। আরও বড় ঘর চান তিনি। একটা পাত্রকে নূপুরের বাবার মনে ধরলো। ঢাকায় নাকি বড় ব্যবসা করে। আর চার পাঁচটা বাড়ি। বিয়ে ঠিক হয়। বাবা মায়ের আবেগী বিরহ ব্যথায় চোখ ভিজে আসে। বুক ফাটে তো মুখ ফুটে না। কষ্টের মাঝে হাসি ধরে রাখা যে আরও কষ্টের তা তারা বুঝতে পারে। আর নূপুর কতইবা বয়স তার ষোলো কিংবা সতেরো। বিয়ের মানেই সে বুঝেনা। সে শুধু জানে বিয়ে করলে মা হওয়া যায়। যেমন ছোটবেলায় সে পুতুলের মা হত। বিয়ে দিতো আরেক পুতুলের সাথে। ওর কাছে বিয়ে একটা খেলা। পুতুল খেলার মতো।

বর আসলো। মাথায় পাগড়ি। আর মুখে রুমাল চেপে আছে। যেন দুনিয়ার যত লজ্জা ঢাকার চেষ্টা। নূপুর পায়ে আলতা দিয়েছে। মাথায় গাঁদা ফুল। বরপক্ষ সোনার গয়না দিয়েছে। কে জানে আসল নাকি নকল। নূপুর শখ করে তার নূপুর দুটো পায়ে দিয়েছে। তার দাদির বিয়ের নূপুর। দাদি বৌকে নূপুর দেননি কিন্তু নূপুরকে দিয়েছেন। বৌ অধিকার আদায় করতে পারেনি কিন্তু নাতনি অধিকার আদায় করে নিয়েছে।

কাজী সাহেব বিয়ে পড়াতে আসলেন। বিয়ে হলো। এবার বিদায়ের পালা। আর ভিতরের জমাট বাধা কান্না ধরে রাখতে পারল না মা বাবা। মা বাবার কান্না দেখে নূপুর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।

মা বাবাকে ছেড়ে অন্য লোকের সাথে যেতে হবে। কথাটা শুনে নূপুর মন ভেঙে পড়লো। নূপুরের শব্দ থেমে গেলো। জোর করে বর নূপুরকে টেনে হিঁচড়ে গাড়িতে তুললো। পুরুষের শক্ত হাতের কব্জির নির্মম আঘাতে নূপুরের কোমল আর নরম হাতের চামড়া থেকে ছিটকে বের হলো ক'ফোঁটা নিষ্পাপ রক্ত। রাতের রাস্তা দিয়ে হিমঘরের লাশের মতো নূপুর চলছে বরের সাথে। চোখের পাতাগুলো আগের মতো লুকোচুরি খেলছে না। ওদিকে নেশায় মাতাল বর। নূপুরের এই প্রথম মনে হলো বিয়ে তো পুতুলের বিয়ে নয় গাড়িটা একটা বড় শহরে ঢুকলও। রংবেরঙের বাতি। শহরটা যেন কোনও এক নর্তকীকে বরণ করার জন্য জলসা ঘরের মতো সেজেছে। মাটি ফুঁড়ে রংবেরঙের পানি বের হয়ে যাচ্ছে।

বাড়ির বাইরে থেকে মানুষগুলোকে নেশায় বুদ হওয়া মরা লাশের মতো লাগছে নূপুরের। ওর মনে হ”যাচ্ছে মানুষের শব দেহগুলো হাঁটছে কিন্তু সেখানে কোনও প্রাণ নেই। এটা শহর নাকি মৃত্যুপুরী। গাড়িটা একটা অভিজাত বাড়ির সামনে থামলও। নূপুরকে আবার টেনে নামাল তার বর। কলিং বেল টিপতেই বাড়ির দরজাটা খুলে গেলো।

নূপুর দেখলো বড় বড় বোতল হাতে ছেলেগুলো কি যেন যাচ্ছে। খুব দুর্গন্ধ মনে হলো তার। দমটা বন্ধ হওয়ার মতো অবস্থা। সবাই যেন রঙিন জগতে প্রবেশ করেছে আর তাস খেলছে। নূপুরকে দেখে ছেলেগুলোর চোখ বড় বড় গোল গোল হয়ে গেলো। বর নূপুরকে বললো শিল্পপতির ছেলে।

প্রথমে শিল্পপতির ছোট ছেলে এগিয়ে এলো। মাতাল ছেলেটা নরপশুর চোখ নিয়ে বরকে বললো,

'কাঁচা মালটা কার জন্য এনেছিস। আজ একে আমি ভোগ করবো।'

বর বললো, 'এটাতো আপনার বাবার জন্য।'

শিল্পপতির সেজো ছেলেটা ছোট ভাইকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো। সেও কামুক চোখে নূপুরের দিকে তাকিয়ে বললো, 'এটাকে আজ আমি ভোগ করবো।'

একথা শুনে শিল্পপতির বড় ছেলে সেজো ভাইকে ঘুসি মেরে সরিয়ে দিয়ে বললো, 'এটা আমার ভোগের জন্য আর কারো জন্য নয়।' তিন ভাইয়ের বন্ধুদের মধ্যে মারামারি শুরু হয়ে গেলো। নূপুর খুব শঙ্কিত আর আতংকিত। এতটা অসহায় নিজেকে সে কখনো ভাবেনি। তার মনে হলো বিয়ে মানে কি বিক্রি হওয়া। আর সেকি পণ্য যে সবাই তাকে ভোগ করবে। সে আজ নিলামের পণ্য হয়ে গেছে। নিথর দেহটা বইবার শক্তি ছিল না তার শুধু কষ্ট আর ঘৃণা কাজ করছিলো কোনও একটা আবেগের জায়গায়। বাবা মায়ের সম্পকের্র কথা মনে পড়লো। পরস্পরের মধ্যে ছিল বোঝাপড়া, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা আর সম্মানবোধ। চার পাঁচজন গানম্যান নিয়ে মাতাল শিল্পপতি দোতালার সামনে এসে দাঁড়ালেন।

তিনি বেসামাল হয়ে ছেলেদের চিৎকার করে বললেন, 'এটা আমার ভোগের জন্য। তোরা কেউ ভাগ পাবিনা।'

এবার নূপুরকে ভোগ নিয়ে তিন ছেলে, তাদের বন্ধু আর শিল্পপতির  মধ্যে  মারামারি শুরু হলো। সবাই টেনে হিঁচড়ে নূপুরকে তাদের অধিকারে নিতে চাইছে। যেন আজ ভোগের সাথে ভোজ হবে। মহাভোজ। আর নূপুরের মুখটা বোবা হয়ে গেছে কিন্তু নূপুরের নূপুর যেন আকাশ পাতাল ভেদ করে বাজছে ।

এরপর গোলাগুলির শব্দ। নিঃশব্দ সবকিছু। নূপুর অচেতন হয়ে পড়েছে। এরপর কিছু মনে নেই। একটা হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে। বাবা মা আর দাদি কাঁদছে। দুধে আলতার মুখটা ভয়ে বিবর্ণ হয়ে গেছে। শরীর পরতে পরতে ছোপ ছোপ রক্ত। চোখ দুটোর নিচে কালো দাগ আর স্থির। কি যেন ওই নিষ্প্রাণ দেহটা বলতে চায়। পারেনা। হাসপাতালের ফটকের বাইরে পুলিশ প্রহরা। আর সাংবাদিকদের উৎসুখ চোখ । সরকার তিন সদস্য বিশিষ্ট একটা তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। সবাই যেন নড়েচড়ে বসেছে। সব দোষ যেন নূপুরের। সবাই চোখে যেন রঙিন চশমা পড়েছে। পাপীদের বানিয়েছে মহাপুরুষ আর নিষ্পাপ অবলা মেয়েটাকে বানিয়েছে পাপী। বিচিত্র বিচার। বিচিত্র সমাজ। সমাজপতি আর উচ্চবিত্তরা  যেভাবে দেখেন সেভাবে সবকিছু নিজের মতো বানিয়ে দেখাতে চান সমাজ আর মানুষকে। কেননা ওদের খুঁটির জোর খুব শক্ত। বড় বড় পত্রিকায় নূপুরকে খল নায়িকা বানিয়ে নূপুরের ছবি এসেছে। পত্রিকা লিখেছে, কলগালের্র ভোগের জের হিসেবে শিল্পপতিসহ তার তিন ছেলে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে। একটা নিষ্পাপ মেয়ে নূপুর আজ হয়ে গেলো কলগার্ল। সে হয়তো কলগালের্র মানেই বুঝেনা। বাবা মায়ের দুশ্চিন্তায় কপালে ভাঁজ পড়লো আর চোখ বুজে পানি এলো। এই সমাজ নূপুরকে কি আর গ্রহণ করবে। বেজে উঠবে কি আর নূপুরের নূপুরের ঝংকার। নূপুরের পায়ের নূপুরগুলোও কি যেন বলতে চায়। পারেনা। কারণ তাদের তো জীবন নেই। যেমন নূপুরের জীবন বলে আজ কিছু নেই। 

Comments

Top

হিমাদ্রীর হিমঘর

ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

গাজীপুর, বাংলাদেশ

d2dd669cd332f54bf7950a1155f0b079.jpg

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর এ দীর্ঘদিন যাবত শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত আছেন। শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে তিনি যেমন অবদান রেখে চলেছেন তেমনি সৃষ্টিশীল লেখার ক্ষেত্রেও তাঁর পদচারণা। তিনি মনে করেন বিজ্ঞান চর্চা, শিক্ষা ও সংস্কৃতি একে অন্যের পরিপূরক। তিনি একাধারে শিক্ষাবিদ, গবেষক, গল্পকার, প্রাবন্ধিক, কবি, গীতিকার, নাট্যকার, সমাজ সংস্কারক ও সাংস্কৃতিক কর্মী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দর্শনে বিশ্বাসী এই মানুষটির ছোটবেলা থেকেই লেখায় হাতেখড়ি। কৈশোর ও তারুণ্যে তিনি বাংলা একাডেমি, খেলাঘর,  কঁচিকাচার মেলা সহ বিভিন্ন সংগঠনে কাজ করেছেন। এই সময় তাঁর প্রবন্ধ, কবিতা বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। প্রকৌশল বিদ্যা অধ্যায়নের সময় তিনি প্রগতিশীল কর্মী হিসেবে কাজ করে সহিত চর্চা করে গেছেন। এ সময় তাঁর লেখাগুলো বিশ্ববিদালয়ের ম্যাগাজিনে এখনও সংরক্ষিত আছে। এছাড়াও অনেকদিন ধরেই তিনি দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে লিখে চলেছেন। বাংলা ও ইংরেজি দুই সাহিত্যেই তাঁর সমান দক্ষতা রয়েছে। সমাজ, রাষ্ট্র, প্রকৃতি, বিজ্ঞান, শিক্ষা, পরিবর্তন, সম্ভাবনা ও মানুষ তাঁর লেখার মূল উপজীব্য বিষয়।  তিনি একজন ভাল বক্তা। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের টক্ শো সহ বিভিন্ন সৃজনশীল অনুষ্ঠানে তাকে অতিথি হিসেবে দেখা যায়। ভারতরে প্রাক্তন কেন্দ্রীয় তথ্যমন্ত্রী অজিত কুমার পাঁজা কলকাতা দূরদর্শনের একটি প্রতিযোগিতায় তাঁর প্রেরিত প্রবন্ধে মোহিত হয়ে নিজ হাতে পুরস্কার তুলে দেন। অনুষ্ঠানটি সরাসরি সে সময় সম্প্রচারিত হয়। এই খবরটি আজকাল, সংবাদ, বাংলাবাজার সহ বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এছাড়া তিনি ফিলিপিন্স, চীন, বি-টিভি  সহ দেশ বিদেশের বিভিন্ন পুরুস্কারে ভূষিত হন। বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট ও বঙ্গবন্ধু প্রকৌশলী পরিষদের একজন কর্মী হিসেবে তিনি কাজ করে চলেছেন। 

হিমাদ্রীর হিমঘর

ভিনয় করার খুব ইচ্ছে ছিল হিমাদ্রির। চেহারাটাও খারাপ ছিলোনা। ছিমছাম গড়নের। মুখটা গোলগাল আর শ্যাম বর্ণের। কিন্তু 'পরিবার থেকে বরাবরই একটা বাঁধা কাজ করেছে। এটাকে রক্ষণশীলতা বলা ঠিক হবে না কিন্তু' অভিনয়ে গিয়ে মেয়েরা ভালো থাকে না। পাল্লায় পড়ে নষ্ট হয়ে যায়। এই ভয়টা কাজ করতো সব সময়।

হিমাদ্রির মা বাবা দুজনেই উচ্চ শিক্ষিত। মেয়ে লেখাপড়া করে বড় হবে। এরপর একটা ভালো পাত্র দেখে বিয়ে দিবেন। মেয়েকে সুখে থাকতে দেখবেন। এতটুকুই।মানুষ অনেক কিছু আশা করে। আশা মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। কিন্তু' সব আশা পূরণ হবে এটাও ঠিক নয়।

সময় গড়ায়। ইদানীং হিমাদ্রি ফেসবুকে বেশ সময় দিচ্ছে। অনেকটা নেশার মতন। বয়স কম। আবেগের বয়স। ভালো লাগা আর ভালোবাসার বয়স। সুদর্শন ছেলেদের খুঁজে খুঁজে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায়। আবার পত্রপত্রিকা, ম্যাগাজিন এগুলো থেকে সিনেমার নায়কদের ফেসবুক এড্রেস খুঁজে বের করে। তাদের স্পেশাল রিকোয়েস্ট পাঠায়। সাথে মেসেঞ্জারে রোমান্টিকতায় ভরা মেসেজ লিখে। টুইটারে হলিউড, বলিউড আর টলিউড নায়কদের ফলোয়ার হয়। মনে মনে একটা আশা। যদি কেউ ফেসবুক বন্ধু হয়। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো হিমাদ্রি মেয়ে হলেও ফেসবুকে ওর কোনো মেয়ে বন্ধু নেই।

অনেক সুদর্শন ছেলেরা ওর ফেসবুক বন্ধু। হিমাদ্রি আসলে এতটাই সহজ সরল আর বোকা, সে জীবনের অনেক কিছুই জানেনা আর বোঝে না। মনটা খেজুরের রসের মতো মিষ্টি আর কোমল। অনেক কদাকার চেহারার বয়স্ক মানুষও যে সুদর্শন মানুষের ছবি ফেসবুকে নিজের চেহারা বলে চালায় এটা বোঝার বয়স এখনো তার হয়নি।

বসুন্ধরার স্টার সিনেপ্লেক্সে কোনো নূতন ছবি আসলেই প্রথম শো’টা তার দেখতেই হবে। এখানে তার একটা ছেলেমানুষি আছে। নায়িকারা নায়কের যে যতই ভালো অভিনয় করুক না কেন তার মতামত সব সময় নায়কের পক্ষে। এ নিয়ে বন্ধু বান্ধবীদের সাথেও তার মাঝে মাঝে তর্ক  হয়। ওরা বলে তুই খুব একচোখা। কিন্তু 'হিমাদ্রি অনড়। নাহ্‌ যতই বলো নায়ক যদি ভালো অভিনয় না করতো তাহলে নায়িকার জন্য সিনেমাটা সুপার ফ্লপ হতো। আবার নায়কদের জন্য তার খুব কষ্ট হতো। খুব বিষণ্ণ হয়ে সে বন্ধুদের বলতো অমুক সিনেমায় মোটা ধুমসি নায়িকাকে কোলে নিতে ওর খুব কষ্ট হয়েছে। আর যখন ও কষ্ট করে দৌড়চ্ছিল তখন আমার ওর কষ্টে চোখে পানি এসে গিয়েছিলো। ইদানীং বন্ধুরা এসব দেখে শুনে তার সাথে আর তর্ক করে না। বরং এটা নিয়ে সবাই মজা করে। রাত হয়। জানালার বাইরে ঝলমলে তারা। সোনালী চাঁদ। জোনাকিদের  আলো আঁধারের খেলা।  প্রতীক্ষা করে হিমাদ্রি। বাড়তে থাকে রাত বাড়তে থাকে প্রতীক্ষা। যদি কোন সুপার স্টার তার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট গ্রহণ করে। এভাবে রাত যায়। দিন যায়। স্বপ্নগুলো ডানা মেলে। আবেগ বাড়ে। কষ্ট বাড়ে। নিজেকে ঘুড়ির মতো মনে হয়। তার মন উড়ছে, প্রাণ উড়ছে কিন্তু'সেই পিপাসার্ত মনের টান যে রয়েছে অন্যজনের হাতে। মাঝে মাঝে ওর মনে হয় ঘুড়ি হয়ে ঐ নাটাইয়ের কন্ট্রোলটাও যদি তার হাতে থাকতো।

খুব শীত পড়েছে এবার। হিমালয়ের জমাট বাধা ঠান্ডা বাতাস শরীরের চামড়া ভেদ করে যেন হৃৎপিন্ড কাঁপিয়ে দিচ্ছে। শরীরের সাথে মনেও পড়েছে শীতের জড়তা। জড়তা বা তীব্রতা। সালমান শাহ, জাফর ইকবাল, মান্না ওদের জন্য হু হু করে মন কাঁদে। চোখ ফেটে পানি বের হয়ে আসে একটা চাপা কষ্টে। সেই চোখের পানি শীতের তীব্রতায় বরফ হয়। আবার শিশির বিন্দু  হয়ে খোলা ঘাসে দোল খায়। কচুর পাতার উপর আছড়ে পড়ে তীব্র আর্তনাদে। হাহাকার করে দখিনা বাতাস রোদের উত্তাপে।

রাজ্জাক, ফারুক, আলমগীর এদের বুড়ো চেহারা দেখে বুকটা কষ্টে আঁতকে উঠে হিমাদ্রির। কত মেয়ের দিন কেটেছে তাদের স্বপ্ন দেখে। আবার তাদের না পেয়ে বুক ভেঙেছে। মন ভেঙেছে। ঘর ভেঙেছে। কপাল পুড়েছে। অনেকে পাগল হয়ে এখনও হেমায়েতপুরে। মাঝে মাঝে হিমাদ্রির মনে হয় সুচিত্রা সেনই ভালো করেছেন। নিজের নায়িকা ইমেজ ধরে রাখার জন্য মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সে নিজেকে লোকচক্ষুর আড়ালে রেখেছিলো। আর মৃত্যুর পরেও যাতে কেউ তার মুখ দর্শন না করে সে কথাও বলে গিয়েছিলেন। এই না নায়িকা। চির সবুজ নায়িকা কিন্তু 'অন্যরা তা করতে পারেনি বলে ব্যথাটা হিমাদ্রিরই যেন বেশি। এই অভিমান থেকে তাদের উপর ওর খুব রাগ ও ক্ষোভ হতো।

এরপর আসে বসন্ত। মনে রং লাগে। প্রকৃতি যেন জানালা দিয়ে বুকের গহীনে কড়া নাড়ে। গুন গুন করে হিমাদ্রি গায় রবি ঠাকুরের গান 'আহা আজি এ বসন্তে, এত ফুল ফোটে, এত বাঁশি বাজে, এত পাখি গায়'। হাবুডুবু খায় প্রেম জলে। স্বপ্নে উঁকি মারে নায়কের দুটি প্রেমিক চোখ। প্রাণের দোলায় দুলতে থাকে বাসন-ী রঙের প্রেম। পাগল মন জ্বলে পুড়ে মরে প্রেম যাতনায়। কথা বলে সুর  ‘শোন গো দখিনা হাওয়া, প্রেম করেছি আমি"। বসন - যে প্রেমিক হৃদয়কে তীর মারতে পারে তা হিমাদ্রি বুঝতে পারলো। খুব আনন্দ লাগছে তার। মনে হলো গোটা পৃথিবীর রানী মহারানী হয়ে গেছে সে। তুলোর মতো কচি কচি গায়ের লোমগুলো খাড়া হয়ে উঠলো তার আবেগে শিহরণে।

দারুণ একটা ঘটনা ঘটে গেছে হিমাদ্রির জীবনে। রোমাঞ্চিত হলো যেন চার দেয়ালের খসে পড়া রং। আর পুরনো টেবিলটা ভাঙা চেয়ারের গায়ে লেগে চটকে পড়লো যেন কাঠের কিছু অংশ। হিমাদ্রি মাকে জড়িয়ে ধরে। মাকে বলে, জান আজ কি হয়েছে।

মা বলে, কি হয়েছে বল না পাগলী মেয়ে। কিন্তু মুখের আনন্দ যেন কথা বেরুতে দিচ্ছে না।ছুটে যায় বাবার কাছে। বাবাকে বলে বাবা ওগো বাবা কি হয়েছে আজ জান। বল না মাগো কি হয়েছে, বাবা বলে। হিমাদ্রি বলে কিছু না। আমাকে আজ খুব আনন্দ লাগছে। কথাটা বলে দৌড়ে ছুটে যায় নিজের ঘরে। বাবা মনে মনে বলে, পাগলী মেয়েটা আমার ছোটই রয়ে গেলো। বাবা  নিজের কাজে মন দেয়। ঘটনা আর কিছু না তবে ঘটেছে অঘটনের মতো। তিনজন সুপার ডুপার হিট টলিউডের নায়ক ফেসবুক ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করেছে।চাঁদের হাসির আজ তাই বাঁধ ভেঙেছে। নায়কদের তারকা বলে । হিমাদ্রি জানে ওরা থাকে আকাশে। আজ আকাশ থেকে তারারা ঝরে পড়ে হিমাদ্রির হাতের মুঠোয় এসেছে। থ্রি পিসটা বদলে টি শার্ট আর টাইট জিনসের প্যান্ট পড়ে নেয় হিমাদ্রি। অনেকটা শ্রীলংকান আর কেরালার স্মার্ট মেয়েদের মতো লাগছে তাকে। এখন  তো আর যেন তেনো জিনিস পরা যায় না।

পারফিউমটা একটু বেশি করেই স্প্রে করে। লম্বা কুঁচ কুঁচে কালো চুলগুলো আঁটোসাঁটো করে বেঁধে নেয়। এবার বসে পড়ে ফেসবুকে। বর্তমান সময়ের শাকিব খান, ফেরদৌস, অনন্ত, আরিফিন শুভ, বাপ্পি, সাইমন, ইমন, নিরব, জায়েদ সবাইকে রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিল। কিন্তু অন্যরা মন ভাঙলেও ওদের মধ্যে তিনজন মন গড়েছে। ওদের চেয়ে তিনজনের প্রতি মায়াটা বেড়ে গেলো হিমাদ্রির। যেন হিমালয়ের বরফগলা মায়া। মায়াবতীর মায়া। এদের প্রত্যেকের সিনেমা সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছে। আর প্রত্যেকের বৈশিষ্ট্যগুলো ডিজিটাল নোটবুকে সযত্নে নোট করে রেখেছে। খবর প্রত্যেকের সাক্ষাৎকারের ছবিসহ খবর কাঁচি দিয়ে কেটে কেটে এলবামে সংরক্ষণ করেছে। কে বেগুনের চড়চড়ি পছন্দ করে। কে সরপুঁটি খেতে ভালোবাসে। কে কলিজা দিয়ে সিঙ্গারা খেতে ওস্তাদ। এরকম খুঁটিনাটি সবকিছুর বিন্দু বিসর্গ  হিমাদ্রির মুখস্থ। 

হিমাদ্রি চাই ওদের চমকে দিতে। চমকের পর চমক দেখাতে। ওরা হিমাদ্রীকে না দেখলেও ওদের যে হিমাদ্রি প্রতিদিন কাছ থেকে দেখছে এটা সে তাদের বলতে চায়। ওরা তিনজনই ফেসবুকে একটিভ আছে। একটু সংকোচিত আর লজ্জা লজ্জা চোখে ও লিখে ধন্যবাদ বন্ধু তোমাকে। অপেক্ষা করতে থাকে ওদের উত্তরের। অপেক্ষা আর অপেক্ষা। কিছুক্ষণ পর ওপাশ থেকে সাড়া মেলে। একজন লিখে তোমাকেও হে লজ্জাবতী। অন্যজন লিখে তোমাকেও। আরেকজন লিখে থ্যাংকস, মাই ডিয়ার। বসন্তের লজ্জার লাল রং চর জাগার মতো যেন দুই গালে জেগে উঠে।  

সময় গড়ায়। বসন্ত শেষে গ্রীষ্ম। মনের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে ওদের পরস্পরের মনোজগতে। সম্পর্কের ভীত গড়ে উঠে।এরপর বর্ষা আসে। মাঝে মাঝে ওদের সাথে মান অভিমানের পালা চলে। অভিমানী বর্ষা জল ঝরায় হিমাদ্রির মায়াবী নীল চোখে। অভিমান বিরহ চলতে থাকে অদেখা দুই ভুবনের সাথে। আসে শরৎ। কাশফুল, নীল আকাশ আর সবুজের চঞ্চলতা কাজ করে সবার মনের ভিতরের আরেক মনে। সাদা মেঘের মতো সম্পর্কগুলো আরো গভীর হয়। হিমাদ্রির সাথে ওদের রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরি খেলা চলে। লুকোচুরি মানে এই কান্না এই হাসি। ঝরা পাতার বেদনার সুর নিয়ে দেখা মেলে হেমনে-র। বেদনা তবু কোথায় যেন একটা আনন্দ। মহানন্দ। কবি জর্জ এলিয়ট মতো প্রিয় প্রিয়তমারূপে কল্পনা করে ওরা পরস্পরকে। যেন কল্পিত সময়ের নায়ক নায়িকা হয়ে সম্পর্কগুলো বলে উঠে ‘হে অপরূপা সুন্দরী ঋতু হেমন্ত/তোমার সঙ্গে আমার অন্তরাত্মা এখন বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ!'

আবার আসে শীত। একটি বছর গত হয় সম্পর্কের। অদেখা মনোজগৎ যেন দেখতে চায় অদেখাকে। হিমাদ্রির মন ব্যাকুল হয়ে উঠে। আকুল হয় ওদের একবার দেখবার জন্য দুটি উদগ্রীব চোখ। ও লিখে তোমাদের সাথে দেখা করতে মন যে বড় চাইছে। আমার আশা কি তোমরা পূরণ করবে না। ওরা কিছু বলে না। হিমাদ্রি চোখে কুয়াশা দেখে। শীতের  বিড়ম্বিত কুয়াশা। যাতে দূরের যাত্রীর আশা নেই আছে দুরাশা। বরফের মতো কষ্টে কঠিন হয় বুকের ভিতরটা। শব্দহীন আবেগ তাড়িত হয় সে। ও খুব ইমোশনাল হয়ে উঠে। এবার সে লিখেই ফেলে তোমরা যদি দেখা না করো তবে আমি মৃত্যুকে আলিঙ্গন করবো। আর চিরকুটে তোমাদের কথা বলে যাবো। এবার ওপাশ থেকে উত্তর আসে ওকে, চলে এসো এই ঠিকানায়। তিনজনের তিন ঠিকানা। এবার হিমাদ্রির চোখ মুখ নেচে উঠে । খরার পরে বৃষ্টি  যেমন মাটির তৃষ্ণা মেটায়। মিট মিট করে জ্বলা মোমবাতির আলো যেন সূর্যের আলো হয়ে যায়। পতঙ্গরা যেমন জীবনের মায়া ভুলে আগুনে ঝাঁপ দেয়। তেমনি হিমাদ্রি অদেখা ভুবনকে দেখতে চায়। ওটা আলো না আলেয়া সেটা বোঝার মতো সময় তার নেই প্রথম নায়কের দেওয়া ঠিকানায় সে রওনা হয়। একটা ট্যাক্সি ভাড়া নেয়। দুরু দুরু ভয় তার মুখের মধ্যে ছাপ ফেলে। একটা চিন্তা আর অনিশ্চয়তার ভাঁজ কপালে পড়ে তার। এতো বড়মাপের নায়কের কাছে যাচ্ছে সে। তাও একা। মা বাবাকে বলে আসেনি। একটা অপরাধ বোধও কাজ করে তার মধ্যে। আর মোবাইলটাও আনতে ভুলে গেছে।

ট্যাক্সি এগুতে থাকে গন্তব্যের দিকে। ড্রাইভার গাড়ির আয়না দিয়ে বারবার তার দিকে তাকাচ্ছে। লোলুপ দৃষ্টি আর একটা চোরা চোরা ভাব। ভাল লাগছে না হিমাদ্রির। মেয়ে হয়ে জন্ম নেয়াই খুব কষ্টের। নাকি পাপ। সবাই মধু খুঁজে। বয়সের বালাই নেই। ট্যাক্সিটা থামতে বলে হিমাদ্রি। হাতে লাল গোলাপ। সামনে একটা বস্তি। ছোট ছোট নোংরা ছেলে মেয়েরা মাটিতে গড়াগড়ি গড়ি খাচ্ছে। মহিলাদের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি। আবার কয়েকটা মাতালও টালমাটাল। এদিক ওদিক থেকে ময়লার দুর্গন্ধ নাকে আসছে। রুমালটা মুখে চেপে রাখে সে।

লাল গোলাপ হাতে নায়কের এই জায়গায়ই আসার কথা। বস্তির ওদিকটা থেকে মুখোশ পড়ে একটা মানুষ গোলাপ হাতে এগিয়ে আসে হিমাদ্রির দিকে। খুব উত্তেজনা হিমাদ্রির মধ্যে। এবার তাহলে স্বপ্ন পুরুষের দেখা মিলবে। ফুল বিনিময় হয় পরস্পরের মধ্যে। লাল কোট আর সবুজ প্যান্ট পড়েছে লোকটা। আর একটা চটাইয়া রঙের টাই। হাতে ব্রেসলেট। ঢাকাইয়া সিনেমার নায়করা যা পড়ে।

কথা হয়। কথার পর কথা। লোকটার কথার ধরণ দেখে সন্দেহ হয় হিমাদ্রির। ও লোকটাকে বলে তোমার মুখোশটা এখন খোলো। লোকটা খুলতে চায় না। জেদ বাড়ে হিমাদ্রির। টেনে খুলে ফেলে মুখোশটা। আঁতকে উঠে। এতো সেই নায়ক নয়। তবে কে। রেগে উঠে হিমাদ্রি। চোখ দুটো রক্ত বর্ণ। প্রতারক বলে লোকটাকে গালি দেয় সে। লোকটা এবার বলে থামুন। আপনি ভদ্র ঘরের মেয়ে। এভাবে চেঁচালে লোকজন জমা হয়ে যাবে। অনূর্ধ্ব করে বলে আমার কথাটা একটু শুনুন। তারপর যা করার করবেন।

হিমাদ্রি মাটির দিকে তাকায়। মনে হয় মাটিটা দু'ফাঁক হয়ে যাক আর তাতে সে ঢুকে পড়বে। অপমান বোধ হয়, নিজের চুল নিজে ছিঁড়তে ইচ্ছে করে। এরপর নিজেকে সামলে নিয়ে ঠান্ডা হয়। যেন ঝড়ের পরে গভীর নিস্তব্ধতা। লোকটার দিকে মাথা তুলে তাকায়। লোকটা মাথা নিচু করে। চোখাচোখি হতে চায় না বোধহয়। বিব্রতকর অবস্থা। লোকটা বলে ওটা আমার একটা ফেক আইডি। নায়কের ছবি দিয়ে নায়কের নামে খুলেছি।

আমি একটা ছোটখাটো সরকারি চাকুরী করি। খুব সামান্য বেতন পাই। বাবা অনেক আগেই মারা গেছেন। মা শয্যাশায়ী। দুটো কিডনিই নষ্ট। প্রতি সপ্তাহে ডায়ালাইসিস করাতে হয়। পাঁচটা বিবাহযোগ্য বোন। টাকার অভাবে তাদের বিয়ে হচ্ছে না। অনেকে এখন ওদের আইবুড়ি বলতে শুরু করেছে। ওদের চরিত্র নিয়েও কথা বলছে। ভয়ে থাকি যদি ওরা আত্মহত্যা করে। দুটো ভাই। ঐ যে মাটিতে লুটোপুটি খাচ্ছে। আমার আজকের পোশাক আশাক সব ভাড়া করা।

আমি বড়লোকদের মেয়েদের ফেক আইডি খুলে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করি। খারাপ কিছু নয়। আমার অবস্থা দেখে তো আর আমার সাথে কেউ বন্ধুত্ব করবে না। তাই নায়কের ছবি দিয়ে আমার দিকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করি। যদি কেউ আমাকে ভালোবেসে ফেলে। আমার পরিচয় জানার পরও আমাকে বিয়ে করে। তাহলে এভাবে প্রতারণা করে হলেও আমার ভাগ্য ফিরবে। আমার পরিবারটাকে বাঁচাতে পারবো। এটাকে আমি অন্যায় মনে করি না। জাস্ট গিভ এন্ড টেক। আপনি যেমন আপনার বন্ধুত্বের স্বার্থে নায়কের সাথে সম্পর্ক গড়তে  চেয়েছিলেন। আমি তেমনি আমার পরিবারের স্বার্থে আপনার সাথে সম্পর্ক গড়তে চেয়েছিলেন। হিমাদ্রির মাথা এবার নিচু হয়ে আসে। ও বুঝতে পারে পৃথিবীকে জানার ওর আরও অনেক বাকি আছে। এটাও একটা অভিজ্ঞতা। খারাপ ভালো বিষয় না। এটাই জীবন এটাই হয়তো বাস্তবতা।

সে নিঃশব্দে জায়গাটা ত্যাগ করে। আকাশের দিকে তাকায়। একটা রিকশা ভাড়া করে। গন্তব্য দ্বিতীয় নায়ক। ক্রিং ক্রিং শব্দ করে রিকশা গলির রাস্তা ছেড়ে বড় রাস্তায় উঠে। কুঁচকানো চামড়ার একটা শীর্ণকায় একটা বৃদ্ধ টেনে চলেছে ওটা। টানছে তো টানছে। যেন মরণের সাথে জীবনের লড়াই। জয়নুল আবেদিনের ছবির মতো। যেন গরুর গাড়িটা ঠেলে নিয়ে চলেছে একজন রক্ত মাংসের মানুষ। রিকশা আর মানুষের চেয়ে ওর ওজন কম। প্রতি পদে পদে লড়ায়ের পর লড়াই। হিমাদ্রি বুঝতে পারে কিন্তু করার তো কিছু নেই। একটা বৃদ্ধাশ্রমের কাছে থামতে বলে রিকশাটা।

হিমাদ্রি ভাবে। নায়করা জনসেবাও করে। তার প্রিয় নায়ককে সে বৃদ্ধ বৃদ্ধাদের সেবা করতে দেখবে নিজ চোখে। আনন্দ আর কৌতূহল বাড়ে। বৃদ্ধাশ্রমে একগুচ্ছ সাদা বেলি ফুল নিয়ে ঢুকে পড়ে হিমাদ্রি। এদিক ওদিক তাকায়। প্রাণহীন শশ্মান কিংবা গোরস্তান। ওই অসহায় মুখগুলো কার প্রতীক্ষায় যেন বসে আছে। আপনজনেরা যদি কখনও ফিরে আসে।ক্লান্তিহীন সকালে কিংবা নির্জন দুপুরে। মা বাবার মুখগুলো ভাসে হিমাদ্রির প্রচ্ছন্ন চিন্তায়। তার বিয়ে হয়ে গেলে হয়তো বৃদ্ধ বয়সে তার বাবা মাকে এখানে কেউ রেখে যাবে। পুরুষশাসিত সমাজ। তার বাবা মাকে তার কাছে রাখার অধিকার দিবে কিনা সে জানে না। তবে সে অধিকারের জন্য লড়বে। এটা তার বিশ্বাস। বিড়বিড় তার কুন্ঠিত কণ্ঠ থেকে বের হয় নচিকেতার আক্ষেপের গান:

ছেলে আমার মস্ত মানুষ, মস্ত অফিসার

মস্ত ফ্ল্যাটে যায় না দেখা এপার ওপার।

নানান রকম জিনিস আর আসবাব দামী দামী

সবচেয়ে কম দামী ছিলাম একমাত্র আমি।

ছেলের আমার আমার প্রতি অগাধ সম্ভ্রম

আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম!

দূরে একটু আবডালে পুকুর পাড়ের ভেজা শেওলারগুলোর দিকে তার চোখ পড়ে। খুব অযত্নে পড়ে আছে পুকুরটা। কচুরিপানা আর ধসে পড়া ইটের গাঁথুনি। ইতিহাসের সাক্ষীর মতো। ওদিকটাতেই কে যেন বেলফুল হাতে বসে আছে। ধীরে ধীরে রোমাঞ্চ নিয়ে সে সেদিকে হাঁটতে থাকে। একি! মাথায় হাত হিমাদ্রির। দুপাটি ফোকলা দাঁত চেপে চেপে একটি বৃদ্ধ কিলিয়ে হাসছে। আর বলছে হ্যালো বিউটিফুল ইয়াং লেডি আমি তোমার সেই ফেসবুকের হিরো নাম্বার ওয়ান। আমার চেহারা কি সেরকম লাগছে না। রাগ হয় হিমাদ্রির। আবার প্রতারণা। এবার হিমাদ্রি ধমকের স্বরে বলে বুড়ো বয়সে ভীমরতি ধরেছে? বুড়ো থেবড়া কোথাকার। না মাগো না,  বুড়ো বলে আদর আর আবদারের স্বরে। অনেক কষ্ট নিয়ে ফেক ফেসবুক খুলেছি। একাকীত্ব আর ভালো লাগে না গো মা, ভালো লাগে না।

এবার শান্ত হয় হিমাদ্রি। তবু মনের উত্তাপ কমে না। একটু উদ্ধত হয়ে বলে নিজের ছবি দিয়ে নিজের নামেই তো একটা আসল ফেসবুক আইডি খুলতে পারতেন। আ মোর জ্বালা সেটা ভাবেন নি। বুড়ো হয়েছেন। এক পা কবরে চলে গেছে। তারপরও ভন্ডামি।

বুড়ো এবার কোমরের আলগা হওয়া লুঙ্গিটা শক্ত করে বাঁধে। বুড়োর দেহে যেমন ভাঙ্গন ধরেছে, লুঙ্গিটাতেও তেমনি পচন ধরেছে। মুখটা বিমর্ষ করে বুড়ো বলে আমি যদি আমার ছবি দিয়ে ফেসবুক আইডি খুলতাম। তবে তো মা কেউ এই বুড়োর বন্ধু হতো না। তুমি কি হতে মা। জানি হতে না। তাই এই প্রতারণা। শুধু একাকীত্ব দূর করার জন্য। তোমার মতো এখন আমার অনেক বন্ধু। তাই সময় কেটে যায় ফেসবুকে। ছেলে ফেলে চলে গেলো। আর কোনোদিন আসলো না। তোমাকে সাদা বেলফুল আনতে বলেছি। কারণ আমার জীবনের রং নেই রস নেই রূপ নেই। রঙিন যৌবন আজ সাদা হয়ে গেছে। এবার হিমাদ্রি কিছুটা হালকা হয়। একটু দরদের সুরে বলে তোমার বুড়ি নেই। বুড়ো ককিয়ে কেঁদে উঠে বলে আছে, তবে বেঁচে নেই। অন্তরের গভীরে আছে। এখন তুমি যা বিচার করো । হিমাদ্রি ভাবে আর ভাবে। কুল পায় না কিনারাও পায় না। একটা গভীর কষ্টের অনুশোচনা ভিতর থেকে দুমড়ে মুচড়ে উঠে। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ে জলের ধারা। কাঁদতে কাঁদতে বের হয়ে যায় সে। এটা অভিজ্ঞতা না অনুভব বুঝে উঠতে পারে না হিমাদ্রি ।

  হাঁটতে হাঁটতে রমনা পার্কের বটগাছটার নিজে কালো গোলাপ হাতে দাঁড়ায় হিমাদ্রি। এরপর অপেক্ষা আর অপেক্ষা। সময় গড়ায়। নির্জনতা নেমে আসে। মনে নানান চিন্তা ভর করে। স্বপ্ন খুঁজে বাস্তবতাকে। আবার ভয়ে সারা গা ঝম ঝম করে উঠে। এটা আবার অদৃশ্য কোন আত্মার ফেসবুক আইডি না তো! অশরীরী একটা রহস্যময় আত্মার ছায়া খুঁজতে থাকে হিমাদ্রি। বটগাছটার নিচে পুরাতন আঁকা বাঁকা খানদানি শেকড় শক্ত করে ধরে রেখেছে গাছটাকে। বটগাছটার নিচে বসতে গিয়ে শেকড়ের চাপায় আটকে পড়া একটা কালো গোলাপ আর চিরকুট চোখে পরে হিমাদ্রির। শঙ্কিত হয়ে চিরকুট আর গোলাপটা হাতে নেয়। নিজের গোলাপটা ওখানে সযত্নে রেখে দেয়। চিরকুটের অক্ষরগুলো কথা বলে। সেখানে লেখা আছে আমি অন্ধকার জগতের একজন মানুষ। তাই কালো গোলাপ আনতে বলেছিলাম। আমি তোমার সেই স্বপ্নের নায়ক নই আমি খল নায়ক। একজন পেশাদার খুনি। আমি লুকোচুরি খেলছি আমার এই পাপের জীবনটা নিয়ে। আমার ঘর নেয় আপনজনও নেয়। আমাকে না দেখায় ভালো না চেনাই ভালো । আমি প্রতারণা করতে চাইনি। কিন্তু 'আমিও তো মানুষ। সমাজে আমার জায়গা নেই। এই সন্ত্রাসীর সাথে কেউ বন্ধু হতে চাইবে না। এটা জানি বলেই শুধু মানুষ বলে মানুষের আলোকিত জীবনটাকে অনুভব করবো বলে এই ফেক ফেসবুক আইডি খোলা এর বেশি কিছু নই। ক্ষমা করবেন সুখী হন। ভালো থাকুন।আঁধারের খোঁজ না করাই ভালো।

লোকটার জন্য ঘৃণা হয় হিমাদ্রির। আবার ভাবে আর ভাবে। ভাবনা যেন চেতনাকে ক্ষত বিক্ষত করে। হিমাদ্রি ভাবে কে এই মানুষটাকে মানুষ থেকে অমানুষ বানালো। এর উত্তর তার জানা নেই। আর মনে মনে ভাবে পাপ কে ঘৃণা করো পাপীকে নয়। তবে অদেখা মানুষের যে ফেসবুক আইডি থাকে আর কোথাও না কোথাও একটা ভালো মন একটু হলেও অবশিষ্ট থাকে। তার বোধ তৈরী হলো তার মধ্যে। এটা কি সমাজের রূপ নাকি বিবেক বুঝে উঠতে পারলো না হিমাদ্রি। সামনে এগুতেই মানুষের শোরগোল শুনতে পায় হিমাদ্রি। শুটিং হচ্ছে। অনেক মানুষ বৃত্তের মত্ত গোল করে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু বিন্দুতে কি আছে? জানতে চায় সে। সবাই বলছে আজ খুব স্মরণীয় দিন তাদের জন্য। তিনজন সুপার ডুপার হিট নায়ক একই সিনেমায় অভিনয়ের জন্য শুটিংএ এসেছে। হিমাদ্রির ওই তিনজন।

কিন্তু বাস্তবের নায়ক খলনায়কদের দেখতে দেখতে সিনেমার নায়কদের প্রতি নেশা কেটে যায় হিমাদ্রির। ফিরে যায় বাবা মায়ের বুকে। আর কাঁদে আর কাঁদে। কাঁদতে কাঁদতে ভাবে। ভাবে আর ভাবে। মা বাবা সব শুনেন। বলেন এটাই জীবন। আর জীবনে দেখার অনেক কিছু বাকি আছে তোমার। হিমাদ্রি ওই পাঁচ বোনের বিয়ে দিবে বলে ঠিক করে। ছোট দুটো ছেলের লেখাপড়ার ভার নেই সে। প্রতি সপ্তাহে বৃদ্ধাশ্রমে যায় ওদের সেবা করতে। আর অন্ধকার জগতের মানুষগুলোকে আলোকিত হবার পথ দেখায়।

বিশ বছর পর। সমাজকে নিজের মতো সাজাতে পেরেছে কিনা জানে না হিমাদ্রি। তবে চেষ্টা  করে যাচ্ছে। যাবে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। সমাজ আর মানুষের ভিতরে ঢুকার চেষ্টা করে সে । তাদের বুঝতে, চিনতে আর বদলাতে চেষ্টা করে। সে আজ পরিণত একজন মানুষ। জীবন তাকে অনেক শিখেয়েছে এখন সে জীবনকে শেখাতে চায়। এখন সে আর নায়কদের পিছনে ঘোরে না। নায়করা তার সিনেমায় অভিনয় করার জন্য তার পিছনে পিছনে ঘুরে। সে অভিনেতা অভিনেত্রী বানায়। এখন তার চোখে সবাই সমান। আর তাদের পরিচয় হলো মানুষ।

তারপরও হিমাদ্রি ভাবে আর ভাবে। একদিন ভাবতে ভাবতে কোথায় যাবে সে নিজেও জানে না। ভাবনার হিমঘরের ঠিকানায় তাকে পৌঁছুতেই হবে। ভাবনাকে বাস্তব করার জন্য।

Comments

Top

লিগ্যাল আওয়ার্স

সুরজিত মণ্ডল

জলঙ্গি, পশ্চিমবাংলা

deerhunting.jpg
লিগ্যাল আওয়ার্স

ড় বড় উঁচু ঘনসবুজ সেন্টিপিড ঘাসগুলোর মাঝে লালচে খয়েরী মসৃণ ছোট লোমআলা শরীরটা পড়ে ছিলো; দেখলে প্রথমে মনে হবে দেহে প্রাণ নেই। অ‍্যাশলেরা এভাবেই বিশ্রাম নেয় .... হরবখত্ই নেয়। কখনো কখনো অকস্মাৎ কোনো শব্দে ছুঁচলো মুখটা তুলে ডাইনে বাঁয়ে দেখে, ঘাড় নাড়ায়; সাদা লেজটা উঁচিয়ে ভবিতব‍্যর সন্ধান করে ... নাহ্। কিছুই নেই দেখে আবার শুয়ে পড়ে।

মনে পড়ে হঠাৎ করেই, কাছেই লোটো ছিলো একটু আগেও - গেলো কোথায় এখন?

সোনার টুকরো একটাই ছেলে তার। বাপে বেশীরভাগ সময়েই গভীরে গিয়ে গা ঢাকা দিয়ে থাকলেও অ‍্যাশলে গত এক-দেড় বছরে কখনো চোখের আড়াল করেনি লোটোকে; ছুটে ছুটে বেড়াতে বেড়াতে কখন যে বড় হয়ে উঠেছে একটু করে খেয়ালই করেনি সে। ঝুপসি আঁধার রাতে মায়ের পেটের কাছে মুখ গুঁজে পড়ে থাকতো লোটো, কানটা খাড়া করে। স্নেহ বশতঃ গা চেটে দিয়ে অদ্ভুত তৃপ্তি পেতো অ‍্যাশলে; খুব যত্ন করে রাখতে হয় ছোটদের। মায়ের কথা মনে পড়ে যায় তার; একপায়ে একটু খুঁড়িয়ে চলতো। অ‍্যাশলে কত বড় হয়ে যাওয়ার পরেও মা কেমন শাসন করতো, চোখে চোখে রাখতো ... যেন বখে না যায়। মা তাকে ছেড়ে চলে গেছিলো লিগ্যাল আওয়ার্সে; কতজনেই যায় যদিও।

লুইজিয়ানা স্টেটের এই আলেকজান্ডার স্টেট ফরেস্ট সাদা লেজওয়ালা হরিণের বাসভূমি .... উত্তর আমেরিকার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সুইটগাম, ব্ল‍্যাকগাম, পীচ আর পাইনের ভীড়ে অবাধ বিচরণ তাদের। স্বপ্নের মতো লাগে ...মাঝে মাঝে নিঃসঙ্গ রাস্তাগুলো, এল ডি এ এফ এর কর্মীরা যাতায়াতের সুবিধার্থে চলে গেছে বহুদূর। কড়া নিরাপত্তায় থাকে অ‍্যাশলে, লোটোরা।

হঠাৎ একটা শব্দে কানখাড়া হয়ে যায় অ‍্যাশলের। দূরে কিছু একটা নড়লো না? সমস্ত ইন্দ্রিয় সচকিত হয় তার .... পাইন গাছের যে সারিটা আড়াআড়ি দৃষ্টিকে বাধা দেয়, সেখানে দুটো গাছের মাঝে একটা ছোট্ট লালচে খয়েরী শরীর উঁকি দিলো। ঐ তো লোটো! অনাবিল আনন্দে ভরে যায় অ‍্যাশলের সারা শরীর; সামনে দৌড়ানোর সময় সাদা, অপেক্ষাকৃত বড় লেজটা উঁচিয়ে ছুটে যায় সে ... লোটো অনুসরণ করে। শীতকালের ধূসর রংটা এখন আর গায়ে মাখেনা অ‍্যাশলে; গরম পড়তে শুরু করলেই লালচে খয়েরী লোম ফিরে পাবে,সে জানে। এখন কিছু নতুন পাতার প্রয়োজন; লোটো ছটফট করতে করতে মায়ের পেছনে চলে। এখন বেলা পড়ে এসেছে, এর পর আর কোথাও যাবে না সে। নিশ্চিন্ত ‌শান্তিতে মায়ের পেটের কাছে শুয়ে থাকতে চায় ... আহ্। অ‍্যাশলে তাকিয়ে তাকিয়ে লোটোকে দেখে; বীর সাহসী পুঙ্গব আর কি দুরন্ত এই ছোট্ট হোয়াইট টেল হরিণটা। সাতমাসের গর্ভধারণ সার্থক অ‍্যাশলের, মুখটা উজ্জ্বল আর যথানিয়মে কানটা আন্দোলিত হয় তার।
খবরটা ছিলোই আগে থেকে, লুইজিয়ানা ওয়াইল্ডলাইফ অ‍্যান্ড ফিশারিজ ডিপার্টমেন্টের কাছে। কিন্তু সঠিক সময়ে, তৈরী হয়ে না গেলে ধূর্ত, শেয়ালের মতোই সতর্ক চোরাশিকারি কে ধরা জেগে জেগে স্বপ্ন দেখার সামিল। তাই,অনুসন্ধানরত এনফোর্সমেন্ট ডিভিশনের লংগিনো আর রজার জনসন খুব সাবধানেই ব‍্যালার্ড রোডে নৈশ পথচারী হয়েছিলেন। অনুমান নির্ভুল। একটা ট্রাক দাঁড়িয়ে​ আছে, রাস্তার ধারেই। এতরাতে এসময় কেউ ট্রাক নিয়ে দাঁড়াবেনা, যদি না তার অসৎ উদ্দেশ্য থাকে; পূর্ব অভিজ্ঞতা অন্ততঃ তাই বলে মিঃ লংগিনোকে। একটু ভেতরের দিকেই ঢোকা যাক, দেখতে হবে ব‍্যাপারটা কি।

পাইন আর বীচের সারিতে ঘন গম্ভীর অন্ধকার দেখাচ্ছে রাস্তার দুপাশটাই। বামদিকে চওড়া বিস্তীর্ণ তৃণভূমিকে পেছনে রেখে দুইজনে ডানদিকে যেখানে ট্রাকটা দাঁড় করানো আছে, সেদিকে এগোতে শুরু করেন।

পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়ানো‌ কোন সমস‍্যা নয়; সে দিনে রাতে যখনি হোক। রজার জনসন যখন ইশারায় লংগিনোকে থামতে বললেন, তখন তিনি বুঝে ফেলেছেন ঘটনা কি ঘটেছে .... হ‍্যাঁ, স্পষ্ট চারচাকা গাড়ির আওয়াজ একটা; গুড়গুড় শব্দটা চাপা, কিন্তু দিব‍্যি শোনা যাচ্ছে। সামনে হাত বিশেক দূরে একটা চলাচলের রাস্তা আছে বটে; সেখানে এত রাতে চারচাকা গাড়ি ... চড়াৎ!! বুল-ব‍্যারেল রাইফেলের শব্দটা শুনেই মিঃ লংগিনো ছুটতে শুরু করলেন সামনের রাস্তার দিকে ... এরাস্তায় ছোটা একেবারে নতুন না তার কাছে, কাজে এসে এসেই প্রথম দিকে একবার হান্টিং সিজনেও ফ্রীকোয়েন্ট ভিজিট করতে হয়েছিলো। তুলনায় স্থূলকায় রজার জনসন একটু পিছিয়ে গেলেন। রাস্তার কাছে আসতেই চোখে পড়ে গেলো; দাঁড়িয়ে আছে আবছা মত একটা প্রাইভেট কারের আদল। হাঁচোড়-পাঁচোড় দৌড়ে হাঁফিয়ে গিয়েছিলেন মিঃ লংগিনো, নাগালের মধ‍্যেই গাড়িটাকে দেখে চীৎকার করে উঠলেন,

- "হল্ট!!"

গুমরে উঠল আলো নিভে থাকা অন্ধ দৈত‍্যটা ...একটা ঝাঁকুনি দিয়ে চলতে শুরু করল প্রবল গর্জনে। দূরে সরে যাচ্ছিলো যন্ত্রটা, হাঁফাতে হাঁফাতে উত্তেজিত রজার জনসন মিঃ লংগিনোর দিকে ফিরে বললেন, - "স‍্যার, হারি আপ! কল এমার্জেন্সি ... রাইট নাউ! দে আর পোচারস্!"

অ‍্যাশলের কাছে যখন ছুটে এসে মুখটা নীচু করে বসে পড়েছিলো লোটো, তখন অ‍্যাশলে প্রথমে আঁচ করতেই পারেনি ঘটনা কি। থরথর করে কাঁপছিলো ছোট্ট লোটো। অবাক অ‍্যাশলে বকবে কি, লোটো মায়ের মুখের দিকেই তাকাচ্ছে না একবার। গলাটা নামিয়ে অ‍্যাশলে লোটোর মুখের কাছে যেতেই চমকে ওঠে,আরে! পোড়া পোড়া একটা গন্ধ! এটা তার চেনা গন্ধ ... মা কে নিয়ে যাওয়ার আগে মায়ের গায়েও পেয়েছিলো অ‍্যাশলে, তখন সে ছোটো ছিলো, অনেক। ঐ দুপেয়েগুলো নিয়ে আসে লাঠি একটা, কখনো কখনো বা অনেক... তারপরই এই গন্ধটা আসে।

গলার সাদা লোমগুলোর মাঝে একটা বিসদৃশ কালচে পোড়া ভাব ... ছোট্ট সোনাটা বেঁচে গিয়েছে বরাতজোরে, অ‍্যাশলে ভাবে। লোটোর গলায় মুখ ঘষে অ‍্যাশলে। গলাটা ছুঁয়ে বেরিয়ে গেছে মরণ। হতভাগা ছোঁড়ার বাপটার জন‍্য রাগ হয় অ‍্যাশলের, কোনো কাজেই আসেনা, লিগ্যাল আওয়ার্সে ওকেও নিয়ে গেছে কিনা কে জানে ... চিকি চিকি শব্দে লোটো চমকে চমকে ওঠে; মা ডাকছে, মা কাঁদছে।

 

শেষ কথাটুকু 

সকাল দশটা। মিঃ লংগিনো বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন উঠতি শখের শিকারীদের নতুন নিয়মকানুন গুলো ... তারা উজ্জ্বল চোখে শুনছিলো। ওকডেল থেকেই এসেছে বেশীরভাগ। অ‍্যালান পারিসেরও দু-একজন আছেন। ট‍্যাগিং সিস্টেম নিয়ে বলছিলেন তিনি। অ‍্যান্টলার্স ট‍্যাগ যে আলাদা ভাবে করতে হবে, সেটা এদের জানা দরকার; থাকে কিছু আনপড়্ একেবারেই।

- "ডীয়ার হান্টিং ট‍্যাগ উইল বি অ‍্যলাউড আপ টু সিক্স ইন্ডিভিজুয়ালি। উই প্রিজার্ভ দেম হিয়া ফর গেম হান্টিং, নট ফর পোচিং ইন ইন ইল্লিগাল আওয়ার্স ... ইকুইপড্ উইথ নাইট ভিশন অর এনিথিং এলস্।" কথার শেষটুকু বলার সময় কোঁচকানো সাদা ধবধবে মুখে বিরক্তি স্পষ্ট বোঝা যায়।

আজ অ‍্যাশলে তার পাঁজরার হাড় লোটোটাকে কোত্থাও বেরোতে বারণ করে দিয়েছে ... সবে কাল যমের ঘর থেকে ফিরেছে, ওরা যে এখনো নেই, কে বলবে! এমনিতে তেমন কোন ভয় নেই ... এখন সকালবেলা মানে লিগ্যাল আওয়ার্স। ঐ ছুটকো- ছাটকা দু-একটা যা পড়ে, তাই ...

Comments

Top

আমি,

সে ও সখা 

গৌতম দাস

office.jpg
আমি সে ও সখা

  বনীর আর আমার বাড়ির মাঝে শুধু পাঁচিলের ব্যবধানই ছিল না, আরও অনেক ব্যবধান ছিল আমাদের মাঝে। আমি লম্বা, গায়ের রঙ পাকা গমের মত, বাদামী কটা চোখের সাথে আমার একমাথা এলোমেলো চুল, অন্য দিকে অবনী বেঁটে, তার গায়ের রঙ কালো, চোখে মুখে একটা যেন দুঃখের ভাব সব সময় লেগে থাকে, তবু আমাদের এক স্কুল, এক ক্লাস, এক টিফিন বাক্স, এক ঘুড়ি, এক লাটাই, আমি হাসলে ও-ও হাসে, আমি কাঁদলে, ওর চোখের কোনেও জলের ফোঁটা টলোমলো করতে থাকে। পড়াশুনাতে অবনী ভালো, প্রতি পরীক্ষায় ও ক্লাসে প্রথম পাঁচ জনের মধ্যে থাকে, পরীক্ষা শেষে রেজাল্ট বার হলে আমি পাড়ার সব বন্ধুদের ডেকে ডেকে অবনীর রেজাল্টের খবর দেই আর রাতে পড়ার বইটাকে সামনে রেখে নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করি, আমি কেন পারি না অবনীর মতো পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করতে?

 

২  

ক্লাস নাইন, প্রথম কবিতা লিখল অবনী। ওর সেই কবিতা ও আমায় ওদের চিলেকোঠার ঘরটায় ডেকে নিয়ে গিয়ে শোনালো। নদী, পাখী, আকাশকে নিয়ে লেখা অবনীর কবিতা আমি আমার আলাপচারিতায় সবাইকে ডেকে ডেকে শোনালাম। শুধু শোনানোই নয়, কবিতাটা আমি আমাদের স্কুল ম্যাগাজিনেও দিয়ে দিলাম। সবাই যখন ওর কবিতা পড়ে ভবিষ্যতের এক তুর্কি কবির সন্ধান পেলো আমি তখন অনেক রাত অবধি সাদা কাগজের বুকে চাঁদ তারাকে নিয়ে কবিতা লেখার ব্যর্থ চেষ্টা করলাম। 

 

স্কুলের পড়া শেষে আমরা এখন মফঃস্বলের কলেজে, দুজনার বাবা আমাদের দুজনকে আলাদা আলাদা দুটো সাইকেল কিনে দিলেও আমরা একটা সাইকেলেই যাতায়াত করি। যাওয়ার সময় আমি পিছনে, অবনী তখন সাইকেল চালায় আর ফেরার সময় আমার পিছনে বসে অবনী রাস্তা দেখে। দূরের ইটভাটার চিমনি থেকে বেরতে থাকা কালো ধোঁয়া দেখে গভীর ভাবে নজর করে আমাদের পাশ কাটিয়ে চলতে থাকা মানুষের স্রোতটাকে। অবনীর কবিতায় এখন প্রকৃতির থেকে মানুষের কথাই বেশী, শাসন শোষণ সাম্যবাদ গণতন্ত্র, ভারী ভারী শব্দে তার কবিতা এখন মোড়া থাকে রাতে সবাই ঘুমিয়ে পরলে কলেজের ইউনিয়ন ঘর থেকে নিয়ে আসা ‘লাল লন্ঠন’ বইটা খুলে আমি পড়তে শুরু করি, অচেনা নামের বিদেশী নেতাদের বিবৃতি বুঝে ওঠবার ব্যর্থ চেষ্টা করি, অনেক চেষ্ঠা করেও আমি কিন্তু ঐ সব নাম আর বিপ্লব মাখা শব্দগুলি নিয়ে একটাও কবিতাও লেখার সাহস করে উঠতে পারি না। 

 

কলেজ শেষ, রেল স্টেশনের চায়ের দোকানে এখন সিগারেটের ধোঁয়ায় আমাদের দিন কাটে, অবনীর কবিতায় আবার প্রকৃতি ফিরে এসেছে, তবে রূপক হয়ে, আকাশ এখন তার কবিতায় পুরুষ, সমুদ্রের জলে এখন সে ইলোরার চোখ খুঁজে পায়। ইলোরা আমাদের গাঁয়ে থাকে না, দূরের শহরে তার বাস। কবে যেন কেমন করে অবনীর সঙ্গে তার আলাপ হয়েছে, ক্রমশ সেই আলাপ পরিণত হয়েছে প্রেমে।ইলোরার সঙ্গে আমার এখনও আলাপ হয়নি। তবে অবনীর কবিতার মধ্য দিয়ে ইলোরাকে আমি চিনি, দিনান্তের আলোর রঙে অবনী তার শাড়ির আঁচলের বর্ননা করে, মেঘদের ভাষায় ইলোরার খুনসুটির কথা বলে, আর যখন অবনীর কবিতায় আমি বৃষ্টিকে দেখি তখন বুঝি, ইলোরার মন বুঝি খারাপ।

 

কলেজ স্ট্রীটের কফিহাউসের টেবিলে ত্রিভুজ আমরা এখন। ত্রিভুজের শীর্ষ বিন্দুর পাদদেশে হলুদ শাড়ি, সঙ্গে মানান সই টিপ, চুড়ি, কানের দুল, কাঁধের শান্তিনিকেতনের ঝোলাটা টেবিলের ওপর রাখা। কফির কাপ সামনে রেখে অবনী শোনাচ্ছে তার নতুন কবিতা'এসো সূর্য, পুড়ে মরবার জন্য আমরা তৈরি', মরবার জন্য আমি তৈরি নই, কারণ, আমি মরে গিয়েছি, তবে একা মরিনি, আমার সঙ্গে টেবিলের ওপারের হলুদ দ্বীপটাও পুড়ে গিয়েছে আজ। বাড়ি ফিরে অনেকক্ষণ আজ আয়নার সামনে দাঁড়ালাম আর আয়নার আমিটাকে ইলোরা মনে করে তার সেই চোরা চাহনিগুলির মানে খুঁজতে থাকলাম। আর তারপর একটা হারিয়ে যেতে থাকা হলুদ দ্বীপের কথা ভাবতে ভাবতে কখন যেন ঘুমিয়ে পরলাম।

অবনী এখন বঙ্গ সমাজের প্রতিষ্ঠিত কবি, তার লেখা নিয়ে শহরে প্রায়ই সাহিত্য সভা হয়।

কবি অবনী বেশীরভাগ সময়ই অবশ্য সেই সব সভায় যেয়ে উঠতে পারে না, সে এখন খুব ব্যস্ত, ইলোরার সঙ্গে আমন্ত্রিত অতিথি হয়ে আমি কখনো কখনো ঐ সভাগুলোতে হাজির হই। ইলোরা এখন আর আমার দিকে চুরি করে তাকায় না, আমাদের মধ্যে এখন আর কোনো কবিতার আলো-ছায়া নেই, অনেকদিন আগেই স্বচ্ছ গদ্যে আমরা নিজেদের-নিজেদের মনের কথা একে অন্যকে জানিয়েছি। গ্রামের পাঁচিলের ব্যবধান পার করে অবনী কখনও আমার ঘরে এসে খেলত না, আমাকেই যেতে হতো ওর সেই চিলেকোঠার ঘরে। শহরের রাস্তার ব্যবধান মুছে আমিই যাই ওদের ফ্লাটে, বেশীরভাগ সময়ই তখন অবনী বাড়ি থাকে না, ওর বেডরুমের বিছানা থেকে আমি আর ইলোরা তখন কবিতার সব বই সরিয়ে দেই, আর তারপর রূপক ছাড়াই আমরা প্রথমে আলাদা-আলাদা করে, শেষে একসঙ্গে নিজেদের শরীর দুটো চিনে নেই। ইলোরা তার রাতের অতৃপ্তি দিনের আলোয় আমার কাছে নিঃশেষ করে পূরণ করে নেয়।

অবনীর মৃতদেহ দাহ করে কিছুক্ষণ হল আমি আর ইলোরা ওদের ফ্লাটে ফিরে এসেছি। সকালের খবরে কাগজে কবি অবনী সেনের অনেকগুলি ঘুমের ওষুধ খেয়ে মারা যাওয়ার খবরটা প্রকাশ পাওয়ার পর ওর অসংখ্য গুণমুগ্ধ ভক্তবৃন্দ এতক্ষণ ভিড় করে ছিল। পঞ্চভূতে ওর শরীরটা বিলীন হওয়ার পর একে একে তারা সবাই বিদায় নিয়েছেন। আমি আর ইলোরাও ফিরে এসেছি, আমার আজ আর বাড়ি ফিরে যাওয়ার তাড়া নেই, অবনী নেই, তাই আজ রাতে আয়নার সামনে আমাকে আর দাঁড়াতে হবে না, নিজের কাছে আজ আমার আর হেরে যাওয়া নেই, ইলোরার পাশেই সারা রাত আজ আমি থাকব। ইলোরাকে বলবো ও যেন ওর সব হলুদ শাড়ি পুড়িয়ে ফেলে আর তার সঙ্গে সেই শান্তিনিকেতনের ব্যাগটাও যেটা অবনী ওকে প্রথম উপহার হিসেবে দিয়েছিল।

ইলোরার শরীরটা এখন  থেকে প্রতি রাতে শুধু আমার পুরুষ হাতটাই জড়িয়ে থাকবে, কবিতার অক্ষম শব্দগুলি আর কখনো তা স্পর্শ করবে না।

  আমার কলকাতার সাহিত্য মঞ্চের ডাকা স্মরণ সভায় দুজনার কথাই এক সঙ্গে উচ্চারিত হল আজ। কবি অবনী এবং তার ধর্মপত্নী ইলোরার মৃত্যুতে সমগ্র সাহিত্য সমাজ আজ শোকাচ্ছন্ন, ইলোরার আত্মহত্যা যে স্বামীর প্রতি তার অখণ্ড ভালোবাসারই নিদর্শন আর সেই ভালবাসাই যে অবনীর কবিতায় বারবার ভাষা আর শব্দের মোচড়ে ফুটে উঠত, সেই নিয়ে সভায় উপস্থিত কারোর কোন দ্বিমত ছিল না। অবনীর অভিন্ন হৃদয় বন্ধু হিসেবে আমাকেও আজ অনেক গুণীজনের মাঝে বসে থাকতে হয়েছিল, কিন্তু কেউ খেয়াল করেনি, অনেকের মাঝে থেকেও আজ আমায় একটা ভয় যেন বারবার জড়িয়ে ধরছিল। খালি মনে হচ্ছিল আজ রাতে আবার অবনী ফিরে আসবে আর তার হাতে ধরা থাকবে ইলোরাকে লিখে যাওয়া তার শেষ কথাগুলি - না, কবি অবনী তার জীবনের শেষ লাইনগুলি কবিতায় লিখে যায়নি, শেষ অবধি দিনগুলির মৃত্যু হল। আকাশের বুকে সন্ধ্যা নামল, মাটির পৃথিবীতে সন্ধ্যা নামল, আমি তোমার হাত দুটো ধরলাম।

বললাম - 'আমাকে আর একবারের জন্যও কি তুমি ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারো না কবে কার সেই শেষ হয়ে যাওয়া চুম্বনে?' তুমি মাথা নাড়লে, ওপাশ ফিরে শুলে, ঘুমোলে না, বালিশে গড়িয়ে পড়লো না তোমার চোখের জল। আশ্লেষের অতৃপ্তি ভরা তোমার সেই চোখের জল টলমল করতে থাকলো, সযত্নে তুমি তাকে তুলে রেখে দিলে দিনের আলো ফোটার জন্য। দিনের আলোয় আমি যখন আবছা তখন তুমি বৃষ্টি, তুমি তখন হাসি, তুমি তখন কান্না, তুমি তখন অয়নের পৌরুষে উচ্ছল জল তরঙ্গ হয়ে বাজতে থাকা প্রেমের কবিতা, তোমার সেই বসন্ত উৎসবে আমি যেন নিতান্তই এক অনাহূত অতিথি।

আমার ইলোরা, মৃত্যু নিয়ে ভাবছি এবার একটা কবিতা লিখব, আসন্ন মৃত্যুর অদ্ভুত শিহরণকে বেঁধে ফেলব শব্দের বাঁধনে, কবিতাটা কিছুটা লেখার পর একদিন আবার আমরা তিনজনে গিয়ে বসব কফি হাউসটায়। স্কোয়ার শেপের টেবিলে আমাদের যে ত্রিভুজ গড়ে উঠবে তার শীর্ষ বিন্দুতে থাকব আমি সেদিন, অর্ধ সমাপ্ত কবিতাটা তোমাদের শোনানোর পর আমি দেখতে থাকব তোমার আর অয়নের চোখে ভেসে ওঠা অনুভূতি, যদি দেখি তা ভয়ার্ত তবে বুঝব কবি হিসেবে আমি ব্যর্থ কিন্তু যদি দেখি তোমাদের চোখেও আমার মত অদেখা মৃত্যুর রোমাঞ্চ ফুটে উঠেছে তবে বুঝব প্রেমিক হিসেবে ব্যর্থ হলেও আমিই সেই কবি যাকে তুমি একদিন ভালো বেসেছিলে আর হাত ধরে বলেছিলে 'এ হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে (চলো) এক সঙ্গে (দুজনে) জ্বলে পুড়ে ছাই (হয়ে যাই)'।

Comments

Top

ছবিঘর স্টুডিও

রমেন্দ্র নারায়ণ দে

লরেল, ম্যারিল্যান্ড

talking.jpeg
ছবিঘর স্টুডিও

মি কী বাচ্চুদার সঙ্গে একটু কথা বলতে পারি? উনি এখন দোকানে আছেন কী?  

সামনের দুটো সিঁড়ি ভেঙে দোকানটায় ঢুকে কাউন্টারের সামনে গিয়ে শুভেন্দু জিজ্ঞাসা করল। কাউন্টারের পিছনের ছেলেটির চোখেমুখে কিছুটা বিস্ময়, কিছুটা কৌতুক। সে বলল- 'আপনি কোন বাচ্চুদার সঙ্গে কথা বলতে চান?'

বাচ্ছুদা মানে সুভাষ মিত্র, শুভেন্দু বলল - 'এই ছবিঘর স্টুডিও যিনি খুলেছিলেন সেই প্রভাস মিত্রের ছেলে'।

- 'ও', কাউন্টারের ছেলেটি মুচকি হেসে বলল - 'অনেকদিন পর এদিকে এলেন কী?'

- 'তা বলতে পারেন' সন্মতির মাথা নাড়িয়ে শুভেন্দু বলল - 'বেশ অনেকদিন পর।'

- 'সেটা বুঝেছি।' কাস্টমারের জন্য পাতা চেয়ার দেখিয়ে ছেলেটি বলল  - 'বসুন একটু। আমি দেখে আসছি।'

ছেলেটি দোকানের ভিতরে চলে গেল। চেয়ারে বসে চারদিকে তাকাতে তাকাতে শুভেন্দু ভাবল দোকানটা বোধহয় আগের মত অত ভাল আর চলে না। আগের মত রমরমা চললে এমন হতশ্রী চেহারা হত না।

বাইরে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আশে পাশের দোকানপাটের হাল দেখে ভাবনাটা আরও জোরদার হল। টাউনের পুরো এদিকটাই কেমন যেন পুরোনো ঝরতি-পরতি শ্যাবি হয়ে গেছে। আগে এদিকটাই তো টাউনের মূল সেন্টার ছিল। ঝকঝকে সব দোকানপাট, সিনেমা হল, রেস্টুরেন্ট এ সবে ভরা আলো ঝলমলে মফঃস্বল টাউন। মনে আছে ওদের জন্মদিনের ছবি তুলবার জন্য কত আগে থেকে বাবাকে এখানে এসে বাচ্চুদাকে বলে রাখতে হত।

এতটা এসে ভাবনাটা আটকে গেল শুভেন্দুর। তাই তো, বাবা ওঁকে বাচ্চুদা বলে ডাকতেন। মনে পড়ল চেনাজানা সবাই ওঁকে বাচ্চুদা বলে ডাকত। মুখের ফস্কে তাই ও একটু আগে দোকানের ছেলেটাকে বাচ্চুদার সঙ্গে দেখা করতে চায় বলে ফেলেছে। আসলে ওর বলা উচিৎ ছিল বাচ্চু জেঠুর সঙ্গে দেখা করতে চায়।

  এর মধ্যে ছেলেটি দোকানের ভিতর থেকে একজন বয়স্ক লোককে নিয়ে বেরিয়ে এসেছে। ভাবনায় রত শুভেন্দুকে ডেকে বলল - 'ইনি হলেন বিভাস মিত্র, আমার কাকা, আপনি যে বাচ্চুদার সঙ্গে দেখা করতে চান তাঁর মেজো ছেলে। বাচ্চুদা, মানে আমার ঠাকুরদা গত হয়েছেন প্রায় বারো বছর হল।'

প্রাথমিক বিহ্বলতা কাটিয়ে উঠে লজ্জিত গলায় শুভেন্দু বলল - 'আমিও এই একটু আগে সেটা খেয়াল করেছি। আমার বলা উচিৎ ছিল বাচ্চু জেঠুর সঙ্গে দেখা করতে চাই।'

হাসি হাসি মুখে বিভাস মিত্র বলল - 'সে আমরা বুঝতে পেরেছি।' একটু থেমে আবার বলল - 'আচ্ছা, আপনি কী জয়নগর পাড়ার নবকাকু মানে নবেন্দু মুখার্জীর ছেলে?' হাসি মুখে শুভেন্দু বলল - 'ঠিক ধরেছেন, আমার নাম  শুভেন্দু।'

- ' হুম, ঠিক ধরবো তো বটেই।' বিভাস মিত্রের হাসি আরো বড় হল। বলল - 'আপনি হলেন আমাদের এ শহরের রত্ন ছেলে, আমেরিকায় থাকা শুভ।'

- 'আমাকে আপনি আঁজ্ঞে করবেন না প্লিজ' শুভেন্দু তাড়াতাড়ি বলল - 'আমিও আপনাকে চিনতে পেরেছি। আপনি তো বিভুদা, আমাদের স্কুলের ফুটবল টীমের স্টার প্লেয়ার।'

প্রথম দেখা ছেলেটি বিভাস মিত্রের ভাইপো এবার কথার মধ্যে ঢুকে পড়ল। বলল - 'কাকামনি, তুমি এঁর সঙ্গে কথা বল। আমি ভিতরে গিয়ে তোমাদের জন্য চা-টা কিছুর ব্যবস্থা করি।'

ছেলেটি ভিতরে চলে গেলে বিভাস বলল - 'আমার বড়দার ছেলে প্রকাশ। দোকানটা আজকাল ওই চালায়।'

  তারপর এ কথা সে কথা। পুরোনো দিনের কথা, নতুন দিনের কথা। এখানকার হালচালের কথা, আমেরিকার নানা কথা। বিভাস বলল -'তোমরা তো এখানের পাট চুকিয়েই দিলে। আমাদের স্কুলের স্টার স্টুডেন্ট তুমি দারুন রেজাল্ট করে কলকাতায় পড়তে গেলে, তারপর সেখান থেকেই আরো পড়তে সেই যে আমেরিকায় গেলে আর এ মুখো হলে না।'

শুভেন্দু বলল - 'কপালে যেমন লেখা।'

- 'তোমার কপালে লেখা তো ভালোই ভাই। পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত দেশে সুখে সাচ্ছন্দে আছো।'

ওর সৌভাগ্যকে সাধারণ বোঝাতে শুভেন্দু বলল - 'ওই আর কী। নদীর ও পাড়টা যত সবুজ মনে হয়, আসলে অতটা সবুজ না বিভুদা।'

বিভাস বলল - 'সে আমরা যারা সে দেশটা দেখি নি তারা কিছুটা বেশি করে ভাবি হয়তো, তবুও আমেরিকা ইজ আমেরিকা।'

শুভেন্দু কী আর বলবে হাসিমুখে চুপ করেই রইল। একটু বাদে বিভাস আবার বলল -'তোমার ছোট বোন মিলির বিয়ে হয়ে যাবার পরই তোমাদের বাড়িটা কেমন যেন ফাঁকা হয়ে গেল। নবকাকু কাকীমাও একে একে চলে গেলেন।' 

কথায় কথায় প্রসঙ্গটা মনখারাপের জায়গায় এসেই গেল। ওদের বাড়িটা ফাঁকা এমনি এমনি হয়নি। শিবু গুণ্ডার কবলে পড়ে বাবা একে একে হারালেন প্রথমে জামাইকে, তারপরে মেয়েকে। এসব ভাবতে বসলে একদিকে যেমন মনখারাপ হয়, অন্যদিকে তেমনি আসে ভীষণ এক অপরাধবোধ। নিজের ছেলেকে দরকারের সে সময় কাছে পেলে বাবা শিবু গুণ্ডার পাল্লায় যেতেন না।

  এসব বুকে মোচড় মারা কথা শুভেন্দু মনে আনতে চায় না, কিন্তু না এনে তো উপায়ও নেই। জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে আজ যখন স্ত্রী গত হয়েছে, ছেলেমেয়েরা তাদের নিজেদের জীবনে, তখন একা শুভেন্দুকে অতীত ধরেছে প্রবল টানে। আজ শুভেন্দু সেই পুরোন দিনকে ফিরে পেতে চায় যাকে ও অবহেলা করেছে বছরের পর বছর।

  বিদেশিনীকে বিয়ে করার পর জীবনের ধারা বদলে গিয়েছিল শুভেন্দুর। বাবা মা এমন কি এত আদরের ছোট বোন মিলিকেও কী করে যেন দূরে সরিয়ে রেখেছিল সে। যে সব দিনের কথা ও ইচ্ছে করে ভুলে থাকত, সে সব দিনগুলো আজকাল ওকে তাড়িয়ে বেড়ায় সারাক্ষণ। কেমন 

যেন একটা আকুল ইচ্ছায় ও সঞ্চয় করতে চায় হারিয়ে যাওয়া সে সব দিনের সব ছবি। তাই তো আজকে ওর এই ছবিঘর স্টুডিওতে আসা। ওদের ছোটবেলায় ওর আর মিলির প্রত্যেক জন্মদিনে বাবা এই ছবিঘর স্টুডিওতে এসে ছবি তোলাতেন। তাছাড়াও বছরের অন্যসব অনুষ্ঠানের দিনগুলোতেও ছবি তোলা হত। ওদের কত কত ছবি এই স্টুডিওতে উঠেছিল। যদি সেগুলোর কিছু কোন রকমে পাওয়া যায়। 

  মিলির বিয়ে হয়েছিল বাবা মা-র অপছন্দে। আশিস ওদের পাড়ার লাগোয়া বস্তির ছেলে। একে নিচু জাত নস্কর, তার ওপর ওর মা বাবুদের বাড়িতে ঠিকে ঝিয়ের কাজ করে। যদিও ছেলেটি পড়াশুনায় খুব ভাল, ক্লাসের প্রথম সারির ছাত্র, তবুও বস্তিতে থাকা বাসার কাজের ঝিয়ের ছেলে। বাবা মা মানতে পারেনি কিছুতেই। 

  শুভেন্দু তখন শিকাগোতে নিজের লাইফের নানা সম্ভাবনা নিয়ে ব্যস্ত। তখন না ছিল ফোনের এমন সুদিন, না ছিল ওদের এখানের বাড়িতে কোন ফোন। বাবা চিঠি লিখেছিলেন বার বার। শুভেন্দুকে বলেছিলেন একবার দেশে এসে মিলির সঙ্গে কথা বলতে, ওকে বোঝাতে। বাবা মার বিশ্বাস ছিল দাদার কথা মিলি অত সহজে ফেলে দিতে পারবে না, সে দাদাঅন্ত প্রাণ। কিন্তু শুভেন্দু আসতে পারেনি। পড়াশুনা আর নানা কাজের দোহাই দিয়েছে। তখন তার জুলিয়ার সঙ্গে কোর্টশিপের চূড়ান্ত পর্যায়, তখন শিকাগো ছেড়ে কোথাও ক’দিনের জন্য যাওয়াও তার পক্ষে সম্ভব না। বরং মিলির এ ঘটনার কথা শুনে শুভেন্দু নিজে পড়ে গিয়েছিল নতুন ভাবনায়, জুলিয়ার কথা বাবা মাকে বলবে কী করে! 

অনেক ভেবেচিন্তে শুভেন্দু বড় করে একটা চিঠি লিখেছিল মিলিকে। সেটাতে সে কিছুতেই লিখতে পারেনি মিলি তুই এই অসম প্রেম থেকে বেরিয়ে আয়। বার কয় শুভেন্দু সেটা লিখেছিল, কিন্তু লিখেই কেটে দিয়েছে। মনের ভিতরের কী একটা তাড়নায় মনে হয়েছিল সে নিজে যা করতে পারবে না সেটা ছোট বোনকে করতে বলে কী করে! চিঠিটার ছত্রে ছত্রে কেবল লিখেছিল, মিলি, তুই বাবা মার মনে কষ্ট দিস না। পাড়ার মাস্তান ছেলেদের পাণ্ডা শিবুর চোখ ছিল দেখতে ভাল আকর্ষনীয়া মিলির ওপর, কিন্তু গুণ্ডা ছেলে বলে মিলি ওকে পাত্তা দিত না। মিলির এই দেমাক শিবুর কাছে অসহ্য। অবাধ্য মেয়ের সমস্যায় ছেলেকে কাছে না পাওয়া বাবাকে সুযোগ বুঝে কব্জা করেছিল শিবু। সকালবেলা বাজার থেকে ফেরার পথে নবেন্দু মুখার্জীর পাশে পাশে চলতে চলতে শিবু বলেছিল - 'কাকু, ভারী ব্যাগটা আমাকে দিন, আপনার বেশ কষ্ট হচ্ছে।'

- 'না না, তার দরকার নেই।'

 - 'আরে দিন না' শিবুর বিনয় বচন, 'আমরা ছোটরা থাকতে আপনারা বাবা কাকা জেঠারা মোট বইবেন কেন?' 

  সেই শিবুর নবেন্দু মুখার্জীর বাড়িতে ঢুকে পড়া। তারপর শুরু হয়েছিল বাবাকে সাহায্য করার ছলায় মেয়েকে কব্জা করার ধান্ধা। সেটা কিছুতেই না পেরে শুরু হয়েছিল মেয়েকে হেনস্থা করতে রাস্তাঘাটে আশিসের ওপর অত্যাচার। দু দুবার বেধরক মারধোর করা হল আশিসকে। ওর মার বাসার কাজ চলে যেতে লাগল একের পর এক। বস্তির ঘরে এসে ভাঙচুরও হল।

তারপর বাবা কি শিবু যা ভাবতে পারেনি তাই হয়েছিল। মিলি আর আশিস মন্দিরে গিয়ে মালা বদল করে বিয়ে করে এসেছিল। মিলি গিয়ে উঠেছিল আশিসের বস্তির ঘরে। এতে একদিকে নবেন্দু মুখার্জীর অপমান, অন্যদিকে শিবুর মাস্তানির ইগোতে চড়ম আঘাত। শিবুর মাথায় তখন খুন চেপে গেছে। বাবার কাছে এসে বলেছিল - 'কাকু, ব্যাপারটা আপনি আমার হাতে ছেড়ে দিন, আমি শালা আশিসকে এবার দেখাব কত ধানে কত চাল।' ছেলের

ওপর অভিমানে বাবা কিছু জানান নি বলে শুভেন্দু এসবের কিছুই জানত না। বাবাও তখন অত বুঝতে পারেন নি। চার মাসের মাথায় পুলিশ আশিসকে এরেস্ট করল, ওর ব্যাগে পাওয়া গেল কোকেনের পুরিয়া ভরা বাক্স। রাগে দুঃখে ঝলসানো মিলি এসে বাবা মাকে বলল - 'এসব নোংরামি করে তোমরা আশিসকে আটকে রাখতে পারবে না। যে করেই হোক আমি ওকে ছাড়িয়ে আনবো।'

এই বলে রণচণ্ডী মূর্তি ফিরে যাবার মুখে ঘুরে দাঁড়িয়ে গমগমে গলায় বলল - 'আর একটা কথা জেনে রাখো, যদি আশিসের কিছু হয়, তাহলে তোমরা আমার মরা মুখ দেখবে।'

শেষরক্ষা তবুও হয় নি। শিবুর চেলারা হাজতে গিয়ে আশিসকে ড্রাগ পুশার বলে গালাগাল দিত। মিলির নামে বলত নানা নোংরা কথা। অপমানে জর্জরিত আশিস আর পারেনি, কোর্টে কেস চলাকালিন হাতের শিরা কেটে নিজের জীবন নিয়ে নিল। আঘাতের পর আঘাত, আশিসের মা এ ধাক্কা নিতে পারল না। এত কষ্ট করে মানুষ করা ছেলের অকালে জীবনাবসানের শোকে জ্ঞান হারিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। তিনদিনের মাথায় হার্টফেল করে সকল সুখ দুঃখের ঊর্ধে চলে গেল।

মিলির উন্মাদ অবস্থা, মাথার ওপর আকাশটা ভেঙে পড়েছে। রাগে দুঃখে চোখে নেই একবিন্দু জল। বাবা মা দেখা করতে এলে চূড়ান্ত ঘৃণায় মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল। তারপর উধাও। কোথায় যে মেয়েটা চলে গেল কেউ জানে না।

বিভসের কথার পিঠে শুভেন্দু বলল - 'মিলির বিয়ের পর আমাদের বাবা শিবুর খপ্পরে পড়েছিল, আপনারা নিশ্চয়ই সেসব জানেন।'

'জানি' - বিভাস বলল, 'পুরোটা না হলেও অনেকটাই জানি। তোমাদের মত আরো কতজনের যে ক্ষতি করেছে এই শিবু সেসব আমাদের জানা।'

অথচ আজ সে কোথায়, আর আমরা কোথায়, শুভেন্দু আক্ষেপ করল - 'আজ পারবো তাকে গিয়ে এ নিয়ে কিছু বলতে! পারবো তাকে বলতে যে আমার একমাত্র বোনটি কোথায় হারিয়ে গেলো ওর নষ্টামির জন্য।'

- 'সে চেষ্টা কর না, ফল ভালো হবে না।'

- 'না  না, সে চেষ্টার কথা আমি ভাবছিও না। দলবাজি আর রাজনীতির দৌলতে শিবু গুণ্ডা আজ মাননীয় মন্ত্রী শিবপ্রসাদ। তার দাপট বেড়েছে বই কমেনি, সে আমি জানি।' প্রকাশ এসে দুকাপ চা আর বিস্কিট দিয়ে গেল। হাতের ভঙ্গিতে শুভেন্দুকে চায়ের কাপ নিতে অনুরোধ জানিয়ে নিজের কাপটা হাতে তুলে নিল বিভাস। চায়ের কাপে হাল্কা চুমুক দিয়ে বলল - 'এসব কথা আলোচনা করে এতদিন বাদে দেখা হওয়ার ভালো সময়টুকু নষ্ট করে দিও না শুভ।'

একটু থেমে আবার বলল - 'কী আর বলবো, এই যে টিকিস টিকিস করে দোকানটা চালাচ্ছি, তার জন্যও মাসে মাসে তোলা দিতে হয় শিবুর তহবিলে।'

- 'বলেন কী!'

- 'হ্যাঁ ভাই। এ দেশ ছেড়ে চলে গিয়ে কত ঝামেলা থেকে যে বেঁচে গিয়েছো সে তোমরা জান না। মাথা নাড়িয়ে শুভেন্দু বলল - 'কষ্ট কোথায় জানেন বিভুদা, মিলি বড় আদরের ছিল আমাদের সবার, বিশেষ করে আমার। আমাকে জিজ্ঞাসা না করে ও তো কোন কিছু করতো না। দাদা যা বলবে তাই ঠিক। এতো ডিপেনডেন্ট ছিল আমার ওপর যে আমি বাড়ি থেকে চলে যাবার পর মিলি নিশ্চয়ই নানা সময়ে নানা বিষয়ে দিশেহারা ফিল করত। জানেন বিভুদা, প্রত্যেক বছর ভাইফোঁটার চন্দন আর রাখী ও চিঠিতে করে আমার কাছে পাঠাতো আমেরিকায়।'

  সত্যিই, মিলিটা যে কোথায় চলে গেল। দঃখ ভরা গলায় বিভাস বলল - 'এসব কথা না পারবে ভুলতে, না পারবে গিলতে। কষ্ট তো হবেই।' ধক করে ধাক্কা লাগল শুভেন্দুর বুকে। ভুলেই তো ছিল ও এসব কথা, তা নইলে আদরের বোনের জীবনের চরম সঙ্কটের সময়ও তো সে আসে নি পাশে দাঁড়াতে। কী করে! কী করে শুভেন্দু এমন স্বার্থপর হয়েছিল! নিজের ওপর ধিক্কারে ক্ষতবিক্ষত শুভেন্দুর চোখেমুখে ব্যথার ছায়া দেখে বিভাস বলল - 'থাক এসব কথা শুভ, অন্য কথা বলো। আজকে আমাদের এই স্টুডিওতে কী কোন কাজে এসেছ, না জাস্ট এমনি বেড়াতে।'

ছোট একটা কাজ আছে মাথায়, প্রকাশের দিয়ে যাওয়া চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে শুভেন্দু বলল - 'আচ্ছা বিভুদা, আপনার কী মনে আছে আমাদের প্রত্যেক জন্মদিনে বাবা মা আমাকে আর মিলিকে নিয়ে এই স্টুডিওতে এসে ছবি তোলাতো। 

- 'কেন মনে থাকবে না, মনে আছে সব। বাবা খুব যত্ন করে সেসব ছবি তুলতেন। মনে আছে বাবা মজা করে বলতেন - আর কিছু হোক না হোক, আমার একটি খদ্দের বাঁধা। নব ওর ছেলে মেয়ের জন্মদিনে ছবি তুলতে আসবেই।'

-'বলছিলাম কী' শুভেন্দু ঢোক গিলে বলল - 'সেসব ছবি আপনারা ফাইলে রাখেন কী?'

- 'রাখা হতো, তবে প্রিন্ট না। আমরা নেগেটিভগুলো ফাইলে রাখতাম।'

- 'আছে? আমাদের সেই ছোটবেলার জন্মদিনের ছবিগুলোর নেগেটিভ আছে?'

নেতিবাচক মাথা নাড়াল বিভাস। বলল - 'এতো পুরোনো নেগেটিভ মনে হয় আর নেই ভাই। আসলে কী জানো, এই জোলো আবহাওয়ায় নেগেটিভ স্টোর করা খুব সমস্যার। ফাঙ্গাস পড়ে নষ্ট হয়ে যায়। তার ওপর এখন তো ডিজিটাল ক্যামেরা এসে গেছে, নেগেটিভের টেগেটিভের কোন ব্যাপার আর নেই। এখন তো ইমেজ ফাইল কমপিউটারে আর্কাইভ করি।' 

- 'হ্যাঁ, সে তো জানি। বলছি পুরোনো কোন নেগেটিভই নেই, সব ফেলে দিয়েছেন?'

- 'কিছু আছে একটা ডেসিকেটারের মধ্যে, তবে সেগুলো কী, না দেখে সেটা বলতে পারবো না।'

আবেদনের গলায় শুভেন্দু বলল - 'বিভুদা, আমাদের পুরোনো কিছু ছবি যদি পাওয়া যায় এই আশায় আপনার কাছে এসেছি। দেখুন না একটু যদি সে রকম কোন নেগেটিভ থাকে এই ডেসিকেটারের মধ্যে'।

- 'দেখবো অবশ্যই', সহৃদয় স্বরে বিভাস বলল, 'তুমি এতো দূর থেকে এসেছো এই আশায়, দেখবো বটেই। তবে একটু সময় দাও ভাই। তুমি তিন চার দিন পরে আবার এসো। যদি কোন নেগেটিভ পাই, তাহলে আমি প্রিন্ট করে রাখবো।'

তিনদিন পরে সহাস্যে শুভেন্দুকে আহ্বান করে বসাল বিভাস। শুভেন্দুর মনে হল ওর ভাগ্য বোধহয় ভাল, নিশ্চয়ই নেগেটিভ পাওয়া গেছে, তা নইলে বিভাসের এমন উৎসাহ হত না। আশা ভরা গলায় জানতে চাইল - 'পাওয়া গেছে কিছু নেগেটিভ বিভুদা? আমার কপালটা কী তাহলে ভালো?'

কিছুটা আশা কিছুটা ক্ষোভের গলায় বিভাস বলল - 'পাওয়া গেছে, তবে অনেক না। খুব পুরোনোগুলো তো এমনিতেই

ছিল না। তোমাদের জন্মদিনের ছবিগুলো পাওয়া গেলো না ভাই।'

- 'কী, কী পেয়েছেন তাহলে?'

- 'পেয়েছি পরে তোলা দুটো ছবি, এই দুটো ছবি' বলে টেবিলের ওপরে সাদাকালো দুটো ছবি রাখল বিভাস।

সিঁথিতে সিঁদুর পরা, মাথায় ঘোমটা দেয়া, হাসিমুখ মিলি। চোখে আনন্দঘন চাহনি। পাশে চোখে চশমা পরা, মাথার চুলে মাঝখানে সিঁথি, বুদ্ধিদীপ্ত চেহারার ছেলে, মুখে সাবলিল হাসি।

এ নিশ্চয়ই আশিস। আশিসকে শুভেন্দু কখনো দেখেনি, কিন্তু ছবি দুটো দেখে এ আন্দাজটা সহজেই করতে পারল। শুভেন্দুর মনের ভিতরের ভাবনার স্রোত অনুমান করে বিভাস বলল - 'মিলি আর আশিস। বিয়ের পর দুজনে ছবি তুলতে এসেছিল এই স্টুডিওতে।'

ছবিদুটো হাতে তুলে নিল শুভেন্দু, কিন্তু দেখবে কী করে, চোখ দুটোই যে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। পুরোনো দিনের ছবি ও চেয়েছিল, কিন্তু এমন ছবি যে পাবে সেটা ভাবতে পারেনি। এই দুটো মানুষই যে শুভেন্দুর বুকে ধাক্কা মারে আজকাল। কেবল মনে হয় ও যদি সময়মত আসত তাহলে এই দুটো মানুষের জীবন এভাবে অকালে শেষ হয়ে যেত না। কোথায় আছে মিলি? আছে কী কোথাও? আর আশিস, সে কী ওপর থেকে দেখতে পায় কী অপরিসীম অপরাধবোধ নিয়ে সারাটা জীবন কাটাচ্ছে শুভেন্দু। বুকের ভিতরের কষ্টটা যেন ওপরে উঠে গলার কাছে আটকে গেছে। শুভেন্দু না পারছে ছবি দুটো ভাল করে দেখতে, না পারছে কোন কথা বলতে।

শুভেন্দুর এই অবস্থা দেখে সমমর্মিতার গলায় বিভাস বলল - 'আর কোন ছবি পাওয়া গেল না, জাস্ট এ দুটো ছাড়া'।

চোখের জল মুছে শুভেন্দু বলল - 'এমনই দুটো ছবি দিলেন বিভুদা যা আমি এই প্রথম দেখলাম।'

- 'তাই! এ ছবি তুমি আগে দেখোনি?'

- 'না বিভুদা। ছবিঘর স্টুডিওর কল্যাণে আমার আদরের বোন মিলিকে আজ বধু বেশে দেখতে পেলাম। আর ওর ভালোবাসার আশিসকে তো আমি দেখিনি কোনদিন, আজ এই প্রথম দেখতে পেলাম।'

শুভেন্দুর ঘাড়ে সৌহার্দের হাত রেখে বিভাস বলল - 'শুভ, এ ভগবানেরই ইচ্ছা। সে জন্যেই বোধহয় শুধু এই দুটো নেগেটিভই পাওয়া গেল।'

মুখ তুলে বিভাসের দিকে তাকিয়ে সজল চোখে শুভেন্দু বলল - 'আর কোন ছবির দরকার আমার নেই বিভুদা। অন্যসব ছবি তো আমার মনের ভিতরে আছে। আজ আপনি এমন দুটো ছবি দিলেন যা আমার দেখা ছিল না, জানা ছিলো না। এ ছবিদুটো আমার কাছে মিলিকে নতুন রূপে ফিরে পাওয়া। এ ছবি দুটো খুঁজে দেবার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ বিভুদা, অসংখ্য ধন্যবাদ।' 

Comments

Top

এমনও হয়ে যায়

ইন্দ্রাণী ভট্টাচার্য 

women.jpg
এমন ও হয়ে যায়

ফেসবুকে খোলা চ্যাট উইন্ডোটার দিকে তাকিয়ে আপনা আপনি ভ্রূ কুঁচকে গেল দেয়ার। ‘উফফ, আবার সেই এক বায়না!' মেয়ে বটে একখানা। যখনি দেখ এক কথা, কি চাপ রে বাবা। কি কুক্ষণে যে দীপের এই বন্ধুকে লিস্টে অ্যাড করেছিল সে। শনিবার, ল্যাবে কেউ নেই-ই প্রায়, কাজের ফাঁকে তাই ফেসবুকে লগ ইন করেছিল দেয়া, যদি কোনও বন্ধুকে পেয়ে যায়, আগড়ম বাগড়ম বকবে একটু। তা না এই পাগলীর পাল্লায় পড়বে কে জানত!

উত্তর দেবে না চুপচাপ অফ লাইন হয়ে যাবে ভাবতে ভাবতে আনমনে ল্যাবের জানলার বাইরে চোখ রাখে দেয়া। যে দিকে তাকাও শুধু বরফ। গত সাতদিন অবিশ্রান্ত তুষারপাত হচ্ছে মন্ট্রিয়ালে। এরকম সময়ে কি যে ভয়ঙ্কর বিষাদময় হয়ে যায় জীবনটা, কলকাতার জনতা যদি বুঝত। তার বন্ধুরা যখন গদগদ হয়ে ‘ইসস কি লাকি তুই’, ‘ আহহ বরফ পড়লে কি রোমান্টিক লাগে বল, আমি তো সিওর হানিমুনে তোর কাছে মন্ট্রিয়ালে আসব’, রাগে হাড় জ্বলে যায় তার। মুখে প্লাস্টিক হাসি সেঁটে সবাইকে সাদর আমন্ত্রণ জানায় সে আর মনে মনে বলে ‘আয় না, দেখে যা দিনের পর দিন মাইনাস তিরিশ ডিগ্রি সইতে কি রকম জান নিকলে যায়, বরফ নিয়ে আদিখ্যেতা ওই প্রথম কদিনই ভাল লাগে, একটু রোদ্দুরের জন্য হাপিত্যেস করে বসে থাকার আকুতি আর কলকাতা কি করে বুঝবে! দেয়াই  কি আর সেকথা এ দেশে আসবার আগে বুঝত ছাই! হানিমুন! এই ঠাণ্ডায়! হুহ। দীপের সাথে প্ল্যান করাই আছে তার, বরফ দেখে দেখে ঘেন্না ধরা আঁখি আর দিল দুটোকেই একটু বিশ্রাম দিতে, বিয়ের পরে কোনও সমুদ্র সৈকতে যাবে তারা, দেশ বিদেশ যেখানেই হোক, পকেট বুঝে ফাইনাল করবে সেটা।  

‘হ্যালো ইউ দেয়ার?', এই নিয়ে তৃতীয় বার একই মেসেজ উইন্ডোতে ব্লিঙ্ক করতে দেখে চিন্তার তার ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হল সে। ‘ডু ইউ নো ইফ দীপ স্পোক টু হিম?' এ তো আচ্ছা জ্বালা হল! কবে কোন স্মরণাতীত কালে রিয়ার সম্পর্ক হয়েছিল দীপেরই বন্ধু শীর্ষর সাথে। ওরা সবাই একসাথে টিউশন পড়তে যেত রাসবিহারীতে না কোথায়। দেয়া সিনেও ছিল না তখন। তবে দীপের কাছে শুনেছে তুমুল প্রেম হয়েছিল রিয়া আর শীর্ষর।

অধিকাংশ টিন এজ লাভের পরিণতি যা হয়, রিয়া-শীর্ষর কাহিনীও তার ব্যতিক্রম নয়। স্কুল শেষ করেই লন্ডন পাড়ি দেয় শীর্ষ, অবধারিত ভাবেই ভেঙ্গে যায় সম্পর্কটা। এক এক করে দশটা বছর কেটে গেছে তারপর, গঙ্গা, টেমস দিয়ে বয়ে গেছে বহু কিউসেক, লন্ডন থেকে ফ্লোরিডা হয়ে শীর্ষ আপাতত থিতু হয়েছে নিউজার্সিতে, অজস্র মেয়ের সাথে মন দেওয়া নেওয়া হয়েছে তার, দীপের জীবনে এসেছে দেয়া,  পি-এই-ডি করতে একসময় দেশ ছেড়েছে তারাও, বদলায়নি শুধু রিয়া।

কি করে আজকালকার একটা শিক্ষিত স্মার্ট মেয়ে দশ বছর আগেকার প্রেম আঁকড়ে বসে থাকতে পারে, কিছুতেই মাথায় ঢোকে না দেয়ার। শুরুর দিকে মেয়েটার জন্য মায়ায় মনটা ভরে গিয়েছিল তার। কিন্তু যত দিন গেছে ততই দেয়া বুঝতে পেরেছে কি পরিমাণ সময় রিয়ার কাউন্সিলিং করে নষ্ট করেছে সে। এই মাথাটাই নিজের রিসার্চ এ ঘামালে আরেকটা পেপার নামিয়ে দেওয়া যেত অনায়াসে। ভাল হয়েছে। দীপের সাবধান বাণী কানে না নেওয়ার ফল। ও পইপই করে দেয়াকে না করেছিল। কিন্তু দেয়া তখন সুপার কনফি! বলে কত বিগড়া হুয়া বন্ধুকে সৎ পথে ফিরিয়ে এনেছে সে, আর এটুকু পারবে না!  

কিন্তু রিয়া যে কি চীজ সেটা তো আর মালুম ছিল না! সব চেষ্টা  বৃথা করে দিয়ে রিয়ার সেই এক কথা, দীপ-দেয়া কি পারে না আবার শীর্ষকে তার কাছে ফিরিয়ে দিতে? আরে, শীর্ষ কি সুইস চকলেট নাকি যে  তাদের কথায় গলে গিয়ে রিয়ার মুঠোয় চলে আসবে? এরকম মারাত্মক প্রেমের কথা নিজে করা তো দূরে থাক, দেয়া বাবার জন্মেও শোনে নি কোনদিন।  সবাই খুব হিসেবী বলে জানে দেয়াকে। তার সবকিছুই খুব মাপা। প্রেম ভালবাসা আবেগের ক্ষেত্রেও নিজস্ব একটা ফর্মুলা মেনে চলে সে। সতের বছর বয়সে বাড়ি ছাড়বার পর জীবন তাকে অনেক কিছু দেখিয়েছে, শিখিয়েছে। একটা কথা কখনই নিজেকে ভুলতে দেয় না দেয়া, ঠিক মুহূর্তে দাঁড়ি টানতে পারলে অনেক অনভিপ্রেত সংঘর্ষ এড়িয়ে  যাওয়া যায়। নিজের একটা ছোট দুনিয়া বানিয়ে নিয়েছে সে আর সেখানে যারা আছে তাদের নিয়ে ছাড়া আর বিশেষ কিছু নিয়ে ভাবে না দেয়া। এজন্য তার বন্ধুবান্ধবরা তাকে ‘রবো দিদি’  বলে খ্যাপালেও  দেয়া তাতে থোড়াই কেয়ার করে। হু-হু বাবা, আপনি বাঁচলে বাপের নাম। যত বেশি লোককে হৃদয়ের কাছাকাছি আসতে দেবে তত ঝাড় খাবে, এটা একেবারে সার সত্য। ভুল জায়গায় ইনভেস্ট করবার মত এক্সট্রা ইমশন তার কোন কালেই ছিল না, ভবিষ্যতেও হবার চান্স নেই। সেই দেয়াও যে রিয়াকে নিয়ে এত মাথার চুল ছিঁড়েছে তার প্রধান কারণ কিন্তু দীপ। শীর্ষর সাথে ওরকম আকস্মিক বিচ্ছেদে প্রবল ধাক্কা খেয়েছিল রিয়া, অন্ধের মত নির্ভর করেছিল দীপের ওপরে। আর দীপ ও প্রাণপণ চেষ্টা করেছিল ওর ক্ষতবিক্ষত মনটায় খানিকটা হলেও সান্ত্বনার প্রলেপ দিতে।

কিন্তু এতকিছুর পরেও রিয়াকে বোঝাতে না পেরে হাল ছেড়ে দেয় সে। দীপের হাত ধরবার পর, অসম্ভব বুদ্ধিমতী দেয়া যেদিন বুঝতে পেরেছিল দীপ আর রিয়ার ভেতরের ইকুয়েশনটা ঠিক কি রকম, সেদিন থেকেই নিজের মত করে রিয়াকে আপন করে নেবার চেষ্টা করেছে সে। অনেক অনেক কথা বলে নিজেকে বোঝানোর প্রচেষ্টায় বিশ্বাস করে না দেয়া, কিন্তু দীপ যাকে নিজের বোনের সম্মান দিয়েছে, তাকে আপন করে নিতে কোনও ত্রুটি রাখতে চায়নি সে।একটা সময় দীপই তাকে বলে রিয়া কোনদিনই বুঝবে না, ওর বয়স ষোল বছরেই আটকে আছে। কেউ বুঝতে না চাইলে তাকে কখনো জোর করে এসব কথা বোঝানো যায় না। দীপ দশ বছরে যেটা পারেনি সেটা দেয়া কি করে ছয় মাসে করে দেখাবে ভাবছে? বছর ঘুরে যাবার পর দেয়াও ক্লান্ত এখন। এই রিয়ার জন্যই এতদিনের পার্মানেন্ট এগনি আন্ট পোষ্টটায় ডাহা ফেল দেয়া। জীবনে প্রথমবার। বন্ধুদের কাছে তার প্রেস্টিজটা এখন থাকে  কোথায়? নাহ, রিয়াটা বিচ্ছিরি রকমের হোপলেস কেস। যন্তর জিনিস মাইরি। দশ বছরে আরেকটা কাউকে জোটাতে পারলি না? শরৎচন্দ্র লেডি দেবদাস লিখলেও এতখানি কল্পনা করতে পারতেন না দেয়া বাজি রেখে বলতে পারে। একি যা তা অবসেশন রে বাবা।   আরেকটা ব্যাপারে অবাক না হয়ে পারে না দেয়া। রিয়া পর্ব কিন্তু ফাটল ধরাতে পারেনি শীর্ষ-দীপের বন্ধুত্বে। এত কিছুর পরেও অম্লান আছে দুজনের পারস্পরিক বোঝাপড়া। স তিনেক আগে শীর্ষ মন্ট্রিয়ালে এসেছিল অফিসের কাজ নিয়ে, পাঁচতারা হোটেলের

বুকিংকে গুলি মেরে উঠেছিল দীপের কাছে। দেয়ার সাথে সেই প্রথম মোলাকাত। দুই বন্ধুর বোতল খুলে বসে ননস্টপ আড্ডা আর পার্টিবাজির মাঝে একটু নিরালা পেয়ে, দীপের ভয়াল ভ্রূকুটি উপেক্ষা করে, রিয়ার বর্তমান মানসিক অবস্থা বর্ণনা করেছিল সে। একটু চুপ থেকে আবেগহীন গলায় জানিয়ে দিয়েছিল শীর্ষ, লরা বলে আমেরিকান মেয়েটির সাথে তার সম্পর্কের কথা। গত দুবছর ধরে একসাথে থাকে ওরা, বিয়ে করবে যে কোনদিন। রিয়া তার জীবনে এক ধুসর স্মৃতিমাত্র। তাকে নিয়ে আলোচনা করবার ইচ্ছা কি সময় কোনটাই যে শীর্ষর নেই সেটাও রাখঢাক না করেই স্পষ্ট করে দিয়েছিল সে। সামান্য হলেও অপমানিত বোধ করেছিল দেয়া শীর্ষর এই ব্যবহারে, তাকে কি রিয়ার উকিল মনে করে কথাগুলো শোনাল শীর্ষ?

আর আরও বেশি রাগ হয়েছিল বোকা মেয়েটার ওপর।আত্মসম্মান বলে কিছুই কি তোর নেই রে? এ কি রকম মোহ যা এত অনায়াসে মানুষকে নিজের অস্তিত্ব সম্মন্ধেও মূল্যহীন করে তোলে? কিন্তু অক্ষম  ক্রোধে, হতাশায় মনে মনে রিয়ার চতুর্দশ পুরুষ উদ্ধার করলেও, শীর্ষর সাথে ওর কথা হয়েছে বলা দূরে থাক, দেখা যে হয়েছিল সেটুকু অব্দি বলে মেয়েটাকে আরও অতল খাদের দিকে ঠেলে দেবার কথা ভাবতেও পারেনি দেয়া।  এভাবেই কেটে গেছে আরও একটা বছর। দেয়া পুরোপুরি নির্লিপ্ত করে নিয়েছে নিজেকে রিয়া সংক্রান্ত গল্প থেকে। রিয়াও কোন অলীক কারণে যখন তখন শীর্ষ-শোকগাথা প্রকাশ করা থেকে বিরত হয়েছে। হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে দেয়া। খুব কমই কথা হয় তার রিয়ার সাথে এখন। আর হলেও কেমন আছ, ভাল আছির বেশি টানতে দেয় না সে।বিশেষত শেষ কটা মাস পাগলের মত ব্যস্ত ছিল দীপ-দেয়া। অবশেষে এসেছে সেই বহু প্রতীক্ষিত সময়। এই নভেম্বরে কলকাতাতে বিয়েটা সেরে ফেলবে দুজনে। কিন্তু তার আগে বসদের দিমাগ ঠাণ্ডা রাখবার উপযোগী ডেটা সাপ্লাই করা, শপিং, ছুটির দরখাস্ত, টিকিট কাটা সব মিলিয়ে একেবারে নাকানিচোবানি খেয়েছে তারা।

একেবারে প্লেনে উঠে বসে সেই সাঙ্ঘাতিক চিন্তাটা স্ট্রাইক করল দেয়াকে। ওহ মাই গড! কি হবে এখন? দীপ সবে ওয়াইনটা খতম করে খোশমেজাজে কম্বল মুড়ি দেবার মওকায় ছিল, ধড়মড় উঠে বসেছে দেয়ার খোঁচায়। ‘কিসের কি হবে’? দীপের প্রশ্নে গলা কেঁপে যায় দেয়ার। এত তালগোলে মগজে এটা রেজিস্টারই করেনি যে তাদের বিয়ে উপলক্ষে  মর্ত্যলোকে এই প্রথম মুখোমুখি সাক্ষাৎকার হতে চলেছে শীর্ষ – লরার সাথে রিয়ার। তাদের বউভাত কাম রিসেপশনের আগের দিন স্টেট্‌স থেকে এসে পৌঁছচ্ছে শীর্ষরা আর দীপের বোন হিসেবে রিয়া তো এই বিয়েতে খুবই সম্মানীয় অতিথি। কেসটার গুরুত্ব বুঝে ততক্ষণে দীপও থতমত। রিয়াকে কোনও ভরসা নেই, হাইপার হয়ে কি যে করে বসবে এই আশঙ্কায় কাঁটা হয়ে কেটে যায় বাকি পথটা। অবশেষে গত্যন্তর না দেখে সবটাই ভগবানের ওপর ছেড়ে দিয়ে দমদমে নামে দেয়ারা। খুব স্বাভাবিক ভাবেই জেট ল্যাগ, অজস্র ব্যস্ততা আর বাঙালি- বিয়ের হট্টগোলে প্রায় নিজেদের নামগুলোই পরের কদিনে ভুলতে বসেছিল ওরা। রিয়াকেও বিয়ের দিন যেটুকু দেখেছিল, যথেষ্ট উচ্ছল এবং প্রাণবন্ত বলেই মনে হয়েছে দেয়ার। কিন্তু তা বলে নিশ্চিন্ত হতে পারেনি এতটুকু। বিয়েতে তো আর শীর্ষরা ছিল না!

  ভালয় ভালয় চুকে গেছে বিয়ে। প্রথমবার শ্বশুরবাড়িতে আসবার অভিজ্ঞতাটা খুব অদ্ভুত লাগছে দেয়ার। কলকাতাতে থেকেও মা-বাবার কাছে বাড়িতে নেই। দীপ, ওর মা-বাবা, ওদের বাড়ির আর সকলেই তার অত্যন্ত পরিচিত হওয়া সত্ত্বেও মনটা কেমন যেন ভারভার হয়ে আছে। শ্যামবাজার থেকে তাদের বাড়ি পনের মিনিটও লাগে না, সকালেই কথা হয়েছে মা-বাবা-বোনের সাথে। কিন্তু তাও কিরকম যেন  মনে হচ্ছে সে কোথায়ও একটা আলাদা হয়ে গেছে। ভীষণই হুজুগে বাড়ি দীপদের। কিন্তু এই মজাদার মানুষগুলোর কারুরই সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না এই মুহূর্তে। সকলেই গড়িয়ে নিচ্ছে একটু ইভনিং শোতে বেস্ট পারফরমান্স করবে বলে। আর দীপের তো টিকিটির ও দেখা মিলছে না। উফফ, কিছু বন্ধু আছে বটে ছেলেটার। কোন মতে বিয়েটা সেরে সারাক্ষণ টইটই করে বেড়াচ্ছে সে। এই একলা দুপুরে কি করে এখন দেয়া। ধুত। সন্ধ্যেবেলাতেই তো দেখা হবে বাড়ির সবার সঙ্গে, খামখা এরকম করছে কেন সে। মন খারাপটাকে পাত্তা দেবে না বলে একরকম জোর করেই নিজেকে ঘর থেকে টেনে বার করল দেয়া।

বারান্দা পেরিয়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে সামনের ছোট ঘরটাতে ঢুকেই স্থাণু হয়ে গেল সে। এটা কি দেখছে ও? ভাল করে চোখ দুটোকে কচলে নিয়ে আবার তাকাল দেয়া। নতুন ইক্কতের আঁচল কাঁধে ফেলে আড়ষ্ট দাঁড়িয়ে লরা আর কি পরম যত্নে ওর শাড়ির কুঁচি সাজাচ্ছে রিয়া। তার সাথে চোখাচোখি হতেই উচ্ছসিত হাসির ঝড়ে রিয়ার প্রশংসায় মেতে ওঠে লরা।  বলতে থাকে ‘লুক দেয়া, রিয়া আর আমি কিরকম বন্ধু হয়ে গেছি, হোয়াই টু ব্রিং আ ম্যান বিটউইন আওয়ার ফ্রেন্ডশিপ? ক্যান ইউ টেক ওয়ান পিকচার  অফ আস নাও, ইট উড বি ফান!' বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ দেয়ার মুখ কোনও এক অদৃশ্য বলে ফিরে যায় রিয়ার দিকে, স্তব্ধ হয়ে দেখতে থাকে সেখানেও লরার ভাবনারই প্রতিচ্ছবি। সদ্য খুঁজে পাওয়া বন্ধুত্বের দৃঢ় প্রতিশ্রুতিতে উজ্জ্বল মুখ দুটোকে শীর্ষর ছায়া কোনওখানে ছিটেফোঁটা মেঘলা করতে পারেনি। পাশাপাশি হাত রেখে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকা দুই নারীকে ক্যামেরাবন্দী করতে করতে অনেক ছোটবেলার কথা মনে পড়ছিল দেয়ার। একবার কালীপূজোর সময় বাবা এক রকমের রংমশাল নিয়ে এসেছিলেন, যেগুলো জ্বালালেই লাল-নীল-সবুজ-গোলাপি আলো একসাথে বিচ্ছুরিত হতে দেখে বিমোহিত হয়ে গিয়েছিল দেয়া সমেত বাকি সব বন্ধুরা। ভালবাসা, মমতার যে এত অন্যরকম রঙ হতে পারে, জানা ছিল না দেয়ার। সঙ্গে সঙ্গে কেন জানে না তার মনে হচ্ছিল মায়ার বাঁধন নামক ঝাড়লন্ঠনটার যে একটা অপূর্ব দ্যুতি থাকে সেটা এরকম অবলীলায় জাগিয়ে তোলার জাদুকাঠিটা বোধহয় একমাত্র মেয়েদেরই আয়ত্তে। হাজার চেষ্টাতেও এ রহস্য আজীবন অজানাই থেকে যাবে পুরুষের কাছে।

শীর্ষ অধ্যায়কে এভাবে পেছনে ফেলে বেরিয়ে আসতে পারবে রিয়া, কোনদিন স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি দেয়া। কান্নাকাটি সহজে আসে না তার। কিন্তু আজ এই আশ্চর্য দুর্লভ পলের সাক্ষী হয়ে নিজের অজান্তেই কখন চোখ ভরে উঠেছে জলে বুঝতেও পারেনি সে। তাদের বিয়েতে সবচেয়ে বড় উপহারটা দেওয়ার জন্য লরা আর রিয়া দুজনের কাছেই আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবে তারা। নির্ভার হৃদয়ে আনন্দের খবরটা দিতে দীপের মোবাইল নাম্বার ঘোরায় দেয়া।

Comments

Top

victoria.jpeg
মধুমিতা সংবাদ

হাওড়া স্টেশান থেকে বোম্বে মেল ছেড়ে দিল। ট্রেন ছেড়ে দেবার আগে যা হয়, প্রথমে রিসার্ভেশান লিস্টের সামনে বিরাট ভিড় তার কিছু পরেই আস্তে আস্তে ভিড়টা ট্রেনের দিকে ঘুরে গেল। কেউ কুলির মাথায়, কেউ নিজেরাই জিনিস পত্র নিয়ে সবাই প্রায় একই সঙ্গে যে যার কামরার দিকে যাবার প্রচেস্টা শুরু করলো। প্রত্যেকবার কোন দূর পাল্লার ট্রেন ছাড়ার সময় যা হয়, এবারও তাই কেউ কুলিকে ডাকছে, কেউ সঙ্গের বাচ্চাকে সামলাচ্ছে, কেউ বা বিরক্ত হয়ে কোন আত্মীয়কে সাবধান করছে। ভিড়টা এবার আস্তে আস্তে সরে এসে কামড়ার দরজার বাইরে যে লিস্টটা আঠা দিয়ে সেঁটে দেওয়া তার ওপর হুমড়ি খেয়ে পরলো। আবার ঠিক সেই আগের মতো ধাক্কাধাক্কি খানিকটা কথা কাটাকাটি, এগুলো পার হয়ে কিছু লোক আস্তে আস্তে নিজের টিকিটের নাম্বার অনুযায়ী সঠিক গেটের দিকে এগুলো। এখানেও প্রতিবার যা হয় কুলিরা মাথায় করে আনা লাগেজ দুম দাম করে ঠিক ট্রেনের গেটের সামনে ফেলতে লাগলো মানুষের যাতায়াতের পথ প্রায় বন্ধ সুতরাং আবার মানব জট। আর শুধু মাত্র প্যাসেঞ্জারের ভিড় তো নয়, প্রত্যেক প্যাসেঞ্জারের বন্ধু বান্ধব বা অন্য আত্মীয়রা সবাই সি. অফ. করতে এসেছে, কাজেই প্ল্যাটফর্মে অসংক্ষ্য মানুষের এই ক্ষণিকের অবস্থান।

  মধুমন্তীর লাকটা ভালো এ. সি. টু টায়ারের একটা ছোট কুপে একটা সিট পেয়ে গেছে, মাত্র চারটে সীট, তার মধ্যে একটা তার। সঙ্গে বেশী জিনিস পত্র নেই, কাজেই গেটের সামনের ভিড় এড়িয়ে কোনক্রমে সে নিজের কুপে ঢুকে পরলো। ভাই লোকেশ সঙ্গে এসেছিল, সে হাতের সুটকেসটা দুটো সীটের মাঝখানে রাখলো, এখনও এই কূপে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। মধুমন্তী জানলার কাছে নিজের হ্যান্ড ব্যাগটা রেখে তার পাশেই নিজের ভারি শরীরটা নিয়ে বসল একটু তাড়াতাড়ি নড়াচড়া করলেই তার এখন হাঁপ লাগে। ট্রেন ছাড়তে এখন মিনিট পনের দেরি কাজেই লোকেশও কূপের দরজাটা বন্ধ করে এসে একটা ফাঁকা সীটে বসে পরল।

লোকেশ - 'কি রে দিদি, চা খাবি নাকি? বলি এক কাপ?'

মধুমন্তী - 'দূর, এই তো বাড়ী থেকে খেয়ে এলাম'। বলে হ্যান্ড ব্যাগ থেকে একটা বই বার করে রাখল, ট্রেনের এই ট্রাভেলগুলো সে বই না পড়ে কাটাতে পারে না। বইটা শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের বিখ্যাত উপন্যাস পার্থীব।

লোকেশ - 'আরে ছাড় তো, সে তো প্রায় দের ঘন্টা আগে'।

মধুমন্তী - 'তোর খেতে ইচ্ছে হলে খা না'।

লোকেশ - 'আমিও খাব, তুইও'।

এই বলে সে দরজার কাছে মুখটা নিয়ে গেল, বাইরে তখন ভিড়টা একটু পাতলা। বাইরের ভিড়টা তখন কামরার ভিতরে গমগম করছে। নানা রকম কন্ঠস্বরে নানা প্রকার সাংসারিক কথা বার্তা ভেষে আসছে।

ঠিক পাশের কোন কিউবিকল থেকে কোন ভদ্রলোক চিৎকার করে বলে উঠলেন – 'এ্যাই পাপাই, রাত্রে কিন্তু তুই ওপরে উঠে যাবি, মা ওপরে উঠতে পারবে না। ঘুম পাবার আগেই বলবি'।

পাতলা কন্ঠে উত্তর এল – 'ঠিক আছে, ঠিক আছে, এখন তো জানলার ধারে একটু বসতে দাও'।

আবার অন্য কোন ধার থেকে ভেষে এল – 'শোন মিলু, রাত্রে কি খাবে? ভেজ না ননভেজ'? মহিলা উত্তর দিলেন – 'ভেজ ভেজ, ট্রেনে আমি মাংস একদম খেতে পারি না'। একটা বাচ্চা পাশ থেকে বলে উঠল – 'বাবা, আমি কিন্তু মাংস খাব'। সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রমহিলার জবাব এলো – 'না বাপ্পা, তুই ওই সব ঝাল মসলা একদম খাবি না। পেট খারাপ হলে কি হবে? গতবার মাসির বাড়ী যাবার সময় কি হয়েছিল মনে নেই? বরঞ্চ নেমে হোটেলে উঠে যত ইচ্ছে মুরগী খাস, কেউ মানা করবে না'।

মধুমন্তী বুঝতে পারলো কামরাটা প্রায় ভরে এসেছে, এখন পর্যন্ত অবশ্য এই কুপে কারো পদার্পন ঘটে নি। বছরের এই সময় অবশ্য ট্রেনে খুব একটা ভিড় হবার কথাও নয়। লোকেশ বাইরের দিকে তাকিয়ে চাওয়ালা খুঁজছিল, ওকে মুখ বাড়াতে দেখে একজন এগিয়ে এল, হাতে একটা বড় কেটলি, একটা ব্যাগে বেশ কিছু প্লাস্টিকের গ্লাস, চায়ে গরম ।

লোকেশ - 'এই যে ভাই, দুটো'।

লোকটা দুটো ছোট্ট কাপে গরম চা এগিয়ে দিল। লোকেশ কাপ দুটো ভেতরে নিয়ে জানালার কাছে ছোট্ট কাঠের স্ট্যান্ডে রাখল, তারপর একটা দশ টাকার নোট বারিয়ে দিল... লোকটা ছোঁ মেরে টাকাটা নিয়েই পাশের অন্য কোন কিউবিকলের দিকে দৌড়াল, হয়তো অন্য কোন যাত্রী ডেকেছে চায়ে গরম। মধুমন্তী একটা কাপ নিজের দিকে টেনে নিল। এমন নয় যে তার এখন ভীষণ চা তেষ্টা পেয়েছে 

কিন্তু কেনা হয়ে যাবার পর নাটক করার কোন মানে হয় না। আর তাছাড়া সে বরাবরই দেখেছে যে বাড়ীর চা থেকে এই সব বাইরের দোকানের চা খেতে তার বেশী ভালো লাগে, বেশ কষা কষা, একটু বেশী গাঢ়, একটু তেতো ভাব, বাড়ীতে এমন চা কিছুতেই করা যায় না। প্ল্যাটফর্মের চায়ের একটাই প্রবলেম, বড্ড কম দেয়, ভাঁড়টা এতোই ছোট যে দুটো আঙ্গুল একসাথে ঢোকান যায় না। লোকেশ এই সামান্য চা টুকু বেশ ছোট ছোট চুমুক দিয়ে তৃপ্তি করে খাচ্ছিল, মধুমন্তী তিন চুমুকে মেরে দিয়ে কাগজের কাপটা সিটের তলায় রেখে দিলো, এখন বাইরে ফেলার কোন উপায় নেই, প্ল্যাটফর্মে মানুষ গিজগিজ করছে, পরে ট্রেন চলতে শুরু করলে একসময় ফেলে দিতে হবে।

মধুমন্তী তার হাত ব্যাগ থেকে চশমাটা বার করলো। আর কয়েক মিনিট পরেই ট্রেন ছাড়বে, তখন কামরা ফাঁকা হয়ে গেলে জমিয়ে বইটা পরা শুরু করবে, এটাই আজ রাত্রের প্ল্যান।

আর চোখে একবার লোকেশকে দেখল, এখন বেশ বিনিত হয়ে দিদি দিদি করছে, চা খাওয়াল, কিন্তু বাবা মারা যাবার পর থেকেই তার এই ভাই এবং ভাইয়ের বউয়ের সাথে তার সম্পর্ক মোটেই ভাল না। মূলত সম্পত্যি নিয়েই যত গণ্ডগোল, যদিও আরো সাংসারিক ব্যাপারও আছে।মধুমন্তীর বিয়ের আগে ঠিকই ছিল, ভাই বোন বেশ ভালোই সম্পর্ক ছিল। প্রথমে মধুমন্তীর বিয়ে হোল, ভালো চাটার্ড অ্যাকাউনটেণ্ট পাত্র, বেশ বড় ফার্মে চাকরী। সে সময়ও সম্পর্ক ঠিক ছিল। লোকেশ খুব অ্যাভারেজ ছিল পড়াশুনায়, গড়িয়া কলেজ থেকে কোন রকমে বি.এ. পাশ করে বেকার হয়ে বসে ছিল। ওই সময় থেকেই বোধহয় প্রেম ট্রেম চলছিল কলেজেরই কোন মেয়ের সাথে। বছর দুয়েক কোন চাকরী জোটে নি, এই সময় বাবার বন্ধু সুবোধকাকুর রেফারেন্সে বজবজের বাটা কোম্পানিতে একটা ছোট চাকরী হয়ে গেল।

চাকরী হবার পর এক বছরও হয়নি লোকেশ বিয়ে করলো হঠাৎ-ই। মধুমন্তী তখন বিয়ের পরে দিল্লীতে, সবটা ভালো জানা নেই, তবে সম্ভবত মাকে বলেছিল, আর মা বাবাকে। বাবা আগেকার দিনের পিউরিটার্ন মানুষ। লোকেশের বউ, মানে তখনকার বান্ধবী বনানী তাকে দ্বারিকবাবুর পছন্দ হোল না। ওনার বক্তব্য দুই ফ্যামিলিতে মানাচ্ছে না। দ্বারিকবাবু আগেকার দিনের গ্র্যাজুয়েট চমৎকার ইংরাজী লিখতেন, সরকারী কর্মচারি ছিলেন, সারা জীবন সততার সঙ্গে চাকরী করে বেশ কয়েক বছর রিটায়ার করেছেন। আর বনানীরা একাত্তরের দেশ বিভাগের পর ভারতে আসেন। বহুদিন ঢাকুরিয়ার লাইনের ধারে জবর দখল জমির ওপর মাটির বাড়ীতে থাকতেন। পরে যাদবপুরের ওদিকে একটা টালি দেওয়া একতলা বাড়ীতে চলে যেতে হয়। বনানীর দুই ভাইয়ের কেউই স্কুলের গন্ডি পেরোতে পারে নি, বনানী নিজে হায়ার সেকেন্ডারি পাস করে কোন এক সময় গড়িয়া কলেজে ভর্তি হয়েছিল, অবশ্য শেষ অবধি ডিগ্রি কমপ্লিট করতে পারে নি। এই রকম পরিস্থিতিতে বাড়ীতে বেশ অশান্তিই চলছিল এই বিয়ের ব্যাপার নিয়ে। এই সময় মধুমন্তী কলেজের শেষ ধাপে অবশ্য এর পরেই তার বিয়ে হয়ে যায় জয়ন্তর সাথে, রীতিমত কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে দেখে শুনে, যাকে বলে অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ। বিয়ের পরে মধুমন্তী আরো মাস পাঁচেক ছিল, শেষ পরীক্ষাটা কমপ্লিট করে সোজা দিল্লিতে, জয়ন্ত তখন ওখানেই পোস্টেড। যাই হোক, এই রকম পরিস্থিতিতে লোকেশ দুম করে একদিন বনানীকে সিঁদুর পড়িয়ে সোজা বাড়ীতে এনে হাজির, ভায়া কালীঘাট।

  দ্বারিকবাবু এমনিতেই লোকেশের পছন্দের ব্যাপারে ভয়ংকর চোটে ছিলেন। দুপুরে খাবার ঠিক আগে হঠাৎ দুজনকে দেখে তিনি প্রথমে রেগে বাঘের মতো চিৎকার করে উঠেছিলেন, কিন্তু ওনার স্ত্রী মনিদীপা সামলে দিলেন, তাছাড়া গন্ডগোল দেখে পাড়ার কিছু মানুষও এগিয়ে এলেন। পাড়ায় একটা কেলেঙ্কারির ভয়ে দ্বারিকবাবুও সামলে গেলেন। কিন্তু সেই যে চুপ করলেন, তারপর সবার সাথেই কথা খুব কম বলতেন, তাঁর মৃত্যুর আগে পর্যন্ত। ছেলের বউ বনানীর সাথে তাঁর কোনদিনই বনেনি। এহেন দ্বারিকবাবুও একটা ভুল করলেন, নিজে একটা উইল করলেন, তাও রীতিমত উকিলের পরামর্শ নিয়ে কিন্তু কোর্টে গিয়ে রেজিস্ট্রি করালেন না। তাঁর দেহান্তের পর এই নিয়ে বিরাট গন্ডগোল, উকিলবাবু দ্বারিকবাবুর শেষ উইল নিয়ে বাড়ীতে এলেন, সব পড়াপড়ি হোল কিন্তু ওই রেজিস্ট্রি না করা নিয়ে লোকেশ এবং তার শ্বশুরবাড়ি একেবারে তুলকালাম। দ্বারিকবাবু ছেলে এবং মেয়েকে সমান ভাগ করে দিয়ে গেছিলেন, কিন্তু লোকেশ মানতে চাইল না। একটু বেশী সম্পত্তির লোভে তার শালারা এসে উপস্থিত, তাদের বোনের দৌলতে তাদেরও যদি কিছু প্রাপ্তি হয়। এই নিয়ে কোর্ট অবধি গরাল, জয়ন্ত অবশ্য এসব চায়নি কিন্তু মধুমন্তী ব্যাপারটা ছারল না কোর্টে গেল এবং মামলার রায় খুব পরিস্কার, সম্পত্তি সমান দু ভাগই হবে। অবশ্য মা মনিদীপা বেঁচে থাকতে তিনিই সমস্ত সম্পত্তির মালিক থাকবেন। বনানী অবশ্য সেই চরিত্রের মেয়ে যারা হাতে কিছু ক্ষমতা এলে আরো বেশী কিছুর জন্য ঝাঁপিয়ে পরে। এদের চরিত্রের আরো একটা দিক হোল মানুষ যত নরম বা ভদ্র হয় এরা ততই নখ দন্ত বিস্তার করে। গরীব ঘরে মানুষ হওয়ায় মানুষের তাচ্ছিল্য বা অপমান বনানীদের অনেক সহ্য করতে হয় তাই মনের মধ্যে একটা আগুন ছিলোই। দ্বারিকবাবু যতদিন জীবিত ছিলেন, বাড়ীতে তাও কিছু নিয়ম ছিল, তাঁর চলে যাবার পর বনানী একছত্র হয়ে পরলো এতদিন দ্বারিকবাবুর সরব বীতস্পৃহা তার মনে যে হলাহলের সৃস্টি করেছিল তার ছোবল এখন মনিদীপার ওপর পরতে শুরু করলো। মধুমন্তী পুরো ব্যাপারটা জানত না, তবে কিছুটা শুনেছিল। বছর তিনেক আগে হঠাৎ একবার কলকাতায় এসে পুরো ব্যাপারটা জানতে এবং বুঝতে পেরে আর দেরি করেনি, পরের দিনই উকিল ডেকে ইঞ্চি মেপে বাড়ী এবং সামনের সামান্য জমি ভাগ করিয়েছিল। তারপর নিজের ভাগে মা মনিদীপার থাকার ব্যাবস্থা করে দিয়েছিল। রাত দিনের কাজের লোক এখন সর্বদা মনিদীপার সাথে থাকে, যখন কলকাতায় আসে মধুমন্তীও তখন মার সাথেই থাকে।

মধুমন্তী প্ল্যাটফর্মের দিকে ফাঁকা চোখে তাকিয়ে ছিল, আসলে কিছুই দেখছিল না, অতীতের এই সব ভাবনা মনের মধ্যে মেঘের মতো উড়ে যাচ্ছিল, এমন সময় কামড়ার বাইরে রেলের গার্ড আর টিকিট কালেক্টর এসে দাঁড়ালেন। ধড়মড় করে লোকেশ উঠে পরল,

- 'দিদি, উঠি রে... এবার ট্রেন ছাড়ছে বোধহয়।'

মধুমন্তী - 'হ্যাঁ, আয়, ভাল থাকিস। বনানীকে আর বাচ্চাটাকে আমার ভালোবাসা দিস।'

লোকেশ - 'সাবধানে যাস। মোবাইলটা খোলা রাখিস, মাঝখানে ফোন করব।'

মধুমন্তী - 'অত ব্যাস্ত হবার কিছু নেই, বহুবার তো যাতায়াত করলাম, ফোন খোলাই থাকবে'।

লোকেশ নেমে গেল, তারপর দারুন দায়িত্ববান ভাইয়ের মতো জানালার কাছে এসে দাঁড়াল। আরো মিনিট খানেক পরে ট্রেন সত্যিই নরে উঠল। মধুমন্তী একটা শান্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল, এতো সব ভনিতা তার ভালো লাগে না। মধুমন্তী খুব ভালো মতোই জানে যে লোকেশ অভিনয় করছে, গত পনের দিন, যতদিন সে কলকাতার বাড়ীতে মার সাথে ছিল ততদিন বনানীর সাথে খুব ভালো করে কথা কোন দিন হয় নি। লোকেশ যে দিন ঠিক সময়ে বাড়ীতে ফিরত সেদিন ঘরে বসে চা খেয়ে টিভির মধ্যে ডুবে যেত। তবে লোকেশের এখন আবার নেশা করার অভ্যাস হয়েছে যেটা আগে ছিল না। ছাত্র অবস্থায় যেটা ছিল তা হোল ঐ পূজার সময় লুকিয়ে চুরিয়ে প্যান্ডেলের পিছনে গিয়ে চোঁ করে কিছুটা চোলাই মেরে দেওয়া, ওটা সবাই ঐ বয়সে করে থাকে, লোকেশও করতো। চাকরি পাবার পর বোধহয় সেটা রেগুলার হয়ে গিয়েছে। লোকেশ মাইনে বেশী পায় না, গত দশ বছরে একটা মাত্র প্রমোশান পেয়েছে, কাজেই দেশী চোলাইয়ের পেছনে জলের মতো টাকা ওরানোয় বনানীর সাথে তার তুমুল লাগে, সন্ধ্যা বেলায় বাড়ীতে তান্ডব লেগে যায়। আর রাগলে বনানীর মুখ দিয়ে একেবারে ঢাকুরিয়ার লাইনের ধারের বস্তির ভাষা বেরিয়ে আসে, তখন কানে হাত চাপা দেওয়া ছাড়া কোন গতি থাকে না। কিছুই আর গোপন নেই, সারা পাড়াই বেপারটা জানে। এই পরিবেশে মনিদীপা সারাক্ষন পূজোর ঘরেই কাটিয়ে দেন। এখানে থাকে না বলে মধুমন্তী বেঁচে গেছে। আজকে হাওড়া স্টেশানে দিদিকে নিয়ে আসার পেছনে লোকেশের হয়তো কোন মতলব ছিল, অন্তত মধুমন্তীর তো তাই মনে হয়। আগে লোকেশ মাঝে মাঝেই জয়ন্তর কাছে টাকা চেয়েছে, হয়তো আজকেও চাইত.

তবে সে সারাক্ষণ ট্যাক্সিতে অন্য দিকে তাকিয়ে বসে থাকায় লজ্জায় কথাটা পারতে পারে নি। আর কারণ তো একটাই, সারাক্ষণ ভ্যান ভ্যান করে সেই একই কথা – 'দিদি, ছেলেটাকে মানুষ করতে হবে, এই আয়ে কি করে করবো' এই সব। ওই সব কথা মধুমন্তী গত দশ বছরে অনেক শুনেছে, মাঝে মাঝে জয়ন্তকে বলে কিছু টাকাও দিয়েছে। কিন্তু লোকেশের স্বভাব পাল্টায় নি, তার নেশার খরচ আরো বেড়ে গেছে, তাই সে এখন আর টাকা দেয় না। লোকেশের ছেলে পাপাই, সে মা আর বাবার লড়াই, চিৎকার, গালিগালাজ এই সবের মাঝে পড়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, গত বছর সে ক্লাসে ফেল করেছে এবং তার কোন দোষ না থাকা সত্তেও প্রবল পেটানি খেয়েছে। মধুমন্তী সবই বোঝে কিন্তু লোকেশের ফ্যামিলিতে তার আর কিছু করার নেই। শুধু তাই নয়, আরো আছে বনানীর বাপের বাড়ী। বনানীর ভায়েরা মাঝে মাঝেই এসে দিনের পর দিন থেকে যায়, লোকেশের কাছ থেকে মাঝে মাঝেই টাকাও নেয়। এই রকম গন্ডগোলের ফ্যামিলি থেকে মধুমন্তী দূরেই থাকতে চায়, তার ছেলে মেয়েদের সে কোন দিনই কলকাতায় আনে না। আর যদিও বা আসে, তারা তাদের মামার বাড়ীতেই থাকে। রাতের খাওয়ার বা শোয়ার এখনও অনেক দেরি, তাই পাশে রাখা শীর্ষেন্দুর বইটা পরবে কিনা ভাবছিল। ঠিক এমন সময় কূপের দরজাটা হড়াম করে খুলে গেলো আর একজন ভদ্রমহিলা হাতের দুটো মাঝারি মাপের স্যুটকেস দরজার সামনে ট্রেনের মেঝের ওপর রেখে হাঁপাতে লাগল। মধুমন্তী ভালো করে মহিলার দিকে তাকাল, আন্দাজে মনে হয় মহিলার বয়স প্রায় তারই মতো, এই মধ্য চল্লিশের কাছাকাছি বা একটু বেশী, তবে পঞ্চাশের নিচে। মুখটা দেখে একটু বেশি প্রৌঢ় বলে মনে হয়, যেন জীবনের অনেক ওঠা পরার মধ্যে দিয়ে গেছেন। মহিলা একটু স্থুলাঙ্গী, মধুমন্তী একবার অপাঙ্গে নিজের দিকে তাকাল, বয়সের সাথে সাথে তার নিজের ওজনও বেড়েছে। মহিলা একটা মাঝারি দামের সুন্দর কাজ করা ছাপা শাড়ি পরে আছে, মোটামুটি ভাল পছন্দের পরিচায়ক। গলায় একটা বেশ পাতলা হার আসল না নকল বোঝা মুশকিল।

ভদ্রমহিলা এবার দু পা এগিয়ে এসে মধুমন্তীর ঠিক বিপরিত চেয়ারে বসলেন, তারপর একটা রুমাল নিয়ে মুখের আর গলার ঘাম মুছলেন। তারপর মধুমন্তীর দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন, 

- 'একটু দেরি হয়েছিল, তাই অন্য কামড়ায় উঠে পড়েছিলাম। তারপর খুঁজে এই দুই হাতে দুটো স্যুটকেস নিয়ে আসতে একটু দেরি হোল'।

মধুমন্তী লক্ষ্য করল যে এই বয়সেও ভদ্রমহিলার হাসিটা অনবদ্য, ঝিকমিকে সাদা দাঁতের সারি দিয়ে সাজানো, এক কথায় মনোমুগ্ধকর। 

মিতালী নিজের সিটে জমিয়ে বসলো। স্যুটকেস দুটো এখনও দরজার পাশেই রয়েছে, থাক, দরজাটা তো বন্ধই আছে। সে সিটে বসেই বসেই একটু হাঁপিয়ে নিল, তার বয়স এখনও পঞ্চাশের নিচে, কিন্তু হার্টে ট্রাবল আছে, হাঁটুতে একটু বাতও ধরেছে। বেশ কিছু দিন হোল ডাক্তারের উপদেশে নি-ক্যাপ ব্যাবহার করছে, তাতে হাঁটতে কিছুটা সুবিধা হয়। বয়সের সাথে সাথে শরীর ভারি হয়েছে, একটু পরিশ্রম করলেই বুক ধক ধক করে... আজকেও করছে, তবে একটু বসলেই সামলে যায়।

একটু বসতেই শরীরটা সামলে গেল। মিতালী আর চোখে সামনের মহিলার দিকে তাকাল। মহিলাও বোধহয় তার দিকেই তাকিয়ে ছিল, দুজনার চোখাচোখি হতে দুজনাই একটু লজ্জা পেয়ে অন্য দিকে তাকাবার ভান করল। মিতালী লক্ষ্য করলো যে সামনের ভদ্রমহিলা বেশ দামি একটা সিনথেটিক সিল্কের শাড়ী পড়ে আছে, গলায় একটা মোটা হার, বেশ পয়সা ওয়ালা ঘরের বউ বলে মনে হয়। বয়স তো দেখে তার কাছাকাছি বলেই মনে হয়, তবে বলাও যায় না। গায়ের রঙ এক সময় বোধহয় বেশ ফর্সাই ছিল, এখন বয়সের চাপে একটু ময়লা হয়েছে, তবুও বাঙ্গালী সমাজে একে ফর্সাই বলা যায়। মুখের কাটিং বেশ ভালোই ছিল একসময়, বয়সের তারনায় মুখটা একটু ভারি হয়ে গেলেও গালের কাছে সুন্দর স্পটে একটা তিল যেন মুখটাকে বেশ শ্রীময় করে তুলেছে। ঠোঁটে হাল্কা ন্যাচারাল কালারের লিস্টিক, চোখ দুটো বড় বড়, তাতে যত্ন করে কাজল দেওয়া। ভদ্রমহিলা একটা বই নিয়ে একটা পাতা খুলে বসে আছেন অনেকক্ষণ ধরে, কিছুই পড়ছেন বলে মনে হয় না। হয়তো একটু আনমনা, মনে হয় মিতালীকে দেখেই কিছু ভাবার চেস্টা করছেন।

মধুমন্তী নিজের সিটে বসেছিল, বইয়ের পাতায় মন বসছে না। বার বার সমনে বসে থাকা মহিলার দিকে চোখ চলে যাচ্ছে। এই সুন্দর গালে টোল পরা হাঁসি, একটু তাকালেই মনে হয় হাঁসিটা যেন ঠোঁট থেকে আস্তে আস্তে চোখের মধ্যে ছড়িয়ে পরেছে, এ যেন বড় চেনা। কিন্তু কার? এই মুখ কি সত্যিই চেনা? কোথায়, কবে দেখা হয়েছিল? অল্প বয়সে এই মুখ নিশ্চিত আকর্ষনিয় ছিল বহু মানুষের কাছে, বয়সের সাথে সাথে মুখে একটু চর্বি জমে গেছে, কিন্তু এই বয়সেও চিবুকের চমৎকার ভাঁজ, ভাসা ভাসা হাল্কা বাদামি রোম্যান্টিক চোখ, অল্প কোঁচকান চুল, এ যেন তার ভীষণ চেনা, বহু আগেকার কোন চেনা মানুষ কিন্তু কে? মধুমন্তী ডুবুরীর মতো তার অতীত স্মৃতির সমুদ্রে ডুব দিয়ে কিছু হারিয়ে যাওয়া মানুষের মুখ খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করতে লাগলো। ভদ্রমহিলাও কি কিছু মনে করার চেষ্টা চালাচ্ছেন? মাঝে মাঝে তার দিকেই তাকাচ্ছেন যেন?

এতক্ষণে ট্রেনটা হাওড়া স্টেশানের চৌহদ্দি পেরিয়ে গেছে কিন্তু এখনও বেশ ঢিকির ঢিকির করেই চলেছে। মধুমন্তী এই সময় একটু রিফ্রেশ হবার প্রয়োজন ফিল করল, সেই প্রায় শেষ বিকেলে বাড়ী থেকে বের হওয়া, ট্যাক্সি করে হাওড়া স্টেশান, তারপর আবার অপেক্ষা, কখন ট্রেন প্ল্যাটফর্মে লাগে, তারপর এতক্ষণ ধরে বসে থাকা, এখন একবার যেতেই হবে। তারও তো বয়স গুটি গুটি পঞ্চাশের দিকে পা বাড়িয়েছে, রক্তে চিনির পরিমান বেশ বেশী, মাঝে মাঝেই টয়লেটের দিকে যেতে হয়, বয়সের ধর্ম। ডাক্তার বলেই দিয়েছে যে সুগার কন্ট্রোলে রাখার জন্য ওষুধ খেয়ে যেতে হবে সারা জীবন, এ রোগের কোন পার্মানেন্ট কিওর হয় না। মধুমন্তী কোলের বইটা পাশে রেখে উঠে দাঁড়াল – -- 'সরি, আমি  একটু  বাইরে থেকে ঘুরে আসছি, তারপর আপনার সাথে আলাপ করব'।

মিতালী - 'হ্যাঁ, হ্যাঁ, আপনি আসুন, আমি আর একটু গুছিয়ে বসি। স্যুটকেস্টা সরিয়ে দেব'?

মধুমন্তী - 'না, না, পাশ দিয়ে অনেক জায়গা আছে'।

মধুমন্তী উঠে আস্তে আস্তে হেঁটে সাবধানে স্যুটকেসটা পেরিয়ে কূপ থেকে বেরিয়ে এসে আবার দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ করে দিল। মিতালী আনমনে ঘাড় ঘুরিয়ে মধুমন্তীর দিকে তাকিয়ে ছিল, ভদ্রমহিলার গা থেকে ভারি সুন্দর একটা পাউডারের সুবাস আসছে। মহিলা পেছন ফিরে দরজার দিকে যেতেই সুন্দর করে বাঁধা মাথার খোঁপাটা দেখা গেল, আটকান মাথার কাঁটা গুলো যে বেশ দামি এটা বুঝতে মিতালীর কোন অসুবিধা হোল না, আঙ্গুলের নখে চমৎকার নেল পলিশ। ভদ্রমহিলার সুন্দর ভাবে পরা শাড়ী নতুন বলে কোথাও একটু ভাঁজ পরেছে, বা হাত দিয়ে কামরার দরজাটা টানতেই আঁচলটা একটু সরে গেল, বাঁ কাঁধের ওপর একটা ছোট্ট ট্যাটু, বহু দিনের পুরনো কিন্তু ভালো করে দেখলে আজও বোঝা যায়। এটা দেখে মিতালীর একটা লম্বা শ্বাস পরল, স্বস্তির না অন্য কিছুর কে জানে। মিনিট দশেক পড়ে মধুমন্তী ফিরে এল, মুখে হাতে জল টল দিয়ে বেশ ফ্রেস লাগছে, ততক্ষণে কামরার ভেতরটা একটু অন্যরকম হয়ে গেছে, স্যুটকেস দুটো এখন মহিলার সীটের পাশে রাখা রয়েছে তাতে যাতায়াতের অনেকটা জায়গা বেরেছে।​মধুমন্তী ভেতরে ঢোকার পর অন্য মহিলা তাঁর সুন্দর সাদা দাঁতের ঝলকানি দেওয়া হাঁসি হেসে 

বললেন, মিতালী - 'কি, এবার একটু ভালো লাগছে'?

মধুমন্তী - 'উফ, সেই বিকেল থেকে বসে আছি স্টেশানে, ভীষণ চাপ লাগছিল, আমার তো আবার সুগার আছে, বার বার যেতে হয়, এখন অনেক হাল্কা ফিল করছি।

মিতালী - 'সুগার তো তবু ভালো, আমার আবার হার্টে গন্ডগোল, তার ওপর আবার হাঁটুতে বাত, খুব জোরে হাঁটতেও পারি না। আজকে একটু দেরি করে স্টেশানে ঢুকেছিলাম, আর একটু হলে ট্রেনটাই ছেড়ে যাচ্ছিল। সেই জন্য একটু জোরে হেঁটেছি আর তারপর তো দেখলেন, কামরায় ঢুকে প্রায় পাঁচ মিনিট ধরে হাঁপালাম।

মধুমন্তী রুমাল দিয়ে মুখটা মুছতে মুছতে সীটের ওপর বসলো, তারপর পায়ের ওপর একটা পা তুলে দিয়ে আরাম করে হ্যালান দিয়ে বসে প্রশ্ন করলো, 

মধুমন্তী - 'আপনিও একদম শেষ অবধি তো'?

মিতালী - 'না না, আমি নাগপুর পর্যন্ত'।

মধুমন্তী - 'তাহলেও তো অনেকটা দূর, আলাপের অনেক সময় আছে। নাগপুর তো কাল দুপুরে, তাই না'?

মিতালী - 'হ্যাঁ, দুপুর দুটোর পরে'।

মধুমন্তী - 'তাহলে আসুন, বেশ জমিয়ে বসে গল্প করি। এখনই শুয়ে পরছেন না তো? নেক্সট স্টেশান তো সেই খড়গপুর'।

মিতালী - 'এতো তাড়াতাড়ি তো ঘুমোই না। তাছাড়া খড়গপুরে একবার চা তো খেতেই হবে। আমার তো আবার রাতে কিছু খেতেও হবে'।

মধুমন্তী - 'সে তো বটেই। আমার আবার ট্রেনে একদম ঘুম আসে না, একটু ইনসমনিয়া আছে, রেগুলার রাতে ওষুধ খেতে হয়, তবে ট্রেনে খাই না, সকালে খুব শরীর খারাপ লাগে'।

কামরার দরজা ভিতর থেকে বন্ধ, হঠাৎ কারোর ঢুকে পরার সম্ভাবনা নেই। ট্রেন এখন বেশ জোরেই চলছে, খড়গপুর আস্তে এখনও অনেক দেরি। ওরা দুজনে চুপচাপ বসে আছে, কে প্রথমে শুরু করবে বোধহয় তারই প্রতিক্ষা।

দুজনারই বোধহয় মনের কোথাও একটা খটকা লেগে আছে একটু চেনা চেনা লাগছে কিন্তু কিছুতেই মনে পরছে না।

দুত্তেরিকা বলে মিতালীই শুরু করলো

মিতালী - 'আচ্ছা, আপনি, মানে কোলকাতাতেই মানুষ তো'?

মধুমন্তী - মানে? এখানেই জন্ম, লেখা পড়া, সমস্ত কিছু। বিয়ের পর তো কলকাতার বাইরে চলে গেলাম'।

মিতালী - 'কোথায় পড়াশুনো করেছেন?'

মধুমন্তী - 'যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে, বাংলা অনার্স। আপনি?'

মিতালী - 'ওমা সে কি, আমিও তো। আচ্ছা আমি একটা আন্দাজ করি, আপনি কি মধু, মানে আমাদের মধুমন্তী'

মধুমন্তী দুই হাত সামনে এনে মুখ ঢাকলো, উত্তেজনায় চোখ দুটো বড় বড়, একটু কাঁপা গলায় সে প্রায় চিৎকার করে উঠলো – 'আর তুই আমাদের মিতু, মানে মিতালী, রাইট!'

মিতালী একটু হাসলো, আবার সেই ঝকঝকে দাঁতগুলো ঝলকে গেল।

মিতালী - 'আমি কিন্তু আগেই তোকে চিনেছিলাম। মানে তোর মুখের হয়তো কিছু পরিবর্তন হয়েছে তবু চেনা যায়। তুই যখন ওয়াশরুমে যাচ্ছিলি তখন তো পিঠের ওই ছোট্ট উল্কিটা দেখলাম, সেই যে কলেজের থার্ড সেমেস্টারে আমরা কয়েকজন পুরী বেড়াতে গিয়েছিলাম তখনই তো ওটা করালি।' 

মধুমন্তী - 'ওমা ওটা এখনও আছে? ওটার কথা তো ভুলেই গিয়েছিলাম, ওটার কথা এখন তো আমার এখন তো আমার বাড়ীতে আর কেউ বলে না।'

মিতালী - 'আর ওই বইটা, কলেজে পড়ার সময় শীর্ষেন্দু তোর কি ভীষণ ফেভারিট ছিল, আমরা তো সবাই জানতাম।'

মধুমন্তী - 'আমারো কিন্তু তোর মুখটা ভীষণ চেনা লাগছিল, কিন্তু সেই কলেজের পর তো আর দেখা হয়নি তাই একটু কনফিউসড ছিলাম। তোর হাঁসিটা একদম সেই রকম সুন্দর আছে, সেই স্মাইল যার জন্য যাদবপুরের কতো ছেলে ফার্স্ট সেমেস্টার থেকে তোর প্রেমে পরেছে, আমরা কয়েকজন তো তোর এই হাঁসির জন্য কি জেলাস ছিলাম।'

মিতালী - 'বাপরে! সে সব কতকাল আগেকার কথা। এখন তো পুরনো ছবির অ্যালবাম নিয়ে বসলে নিজেকে আর নিজেই চিনতে পারি না, মুখ টুখ সব কি চেঞ্জ হয়ে গেছে।'

মধুমন্তী - 'আর তোর ওই ছোট্ট জড়ুলটা, কানের ঠিক নিচে। ওটাও তো কি ভীষণ ফেমাস ছিল, ওটা নিয়েও তো কে যেন কবিতা লিখেছিল, নামগুলো সব ভুলে গেছি, কি যেন ... আমল না বিমল কি একটা নাম ছিল।'

মিতালী একটু লাজুক হাসলো। একটু যেন দীর্ঘশ্বাসও পরলো পুরনো কথা ভেবে – 'বাদ দে ওসব কথা, কত কাল আগের। আয় একটু পাশে বসে সেই কলেজের মতো গল্প করি। তোর সাথে কত বছর পড়ে দেখা, তা প্রায় বাইশ তেইশ বছর তো হোল, তাই না।'

মধুমন্তী আস্তে করে উঠে এসে মিতালীর পাশে বসলো, তারপর বললো – 'হ্যাঁ ওই রকম তো হবেই। সেই বিয়ের পর তো এই প্রথম দেখা।'

ট্রেন তখন অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে তীব্র বেগে ছুটে চলেছে।

এ. সি. কামরার জানলা বন্ধ, তার বাইরে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার, মাঝে মাঝে দুরের কোন গ্রামের বাড়ীর বা রাস্তার আলো কয়েক মুহুর্তের জন্য জানলায় এসেই আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। কখনো দূরের কোন টাউনশিপের আলো কালো আকাশের পটভূমিতে অসংখ্য তারার মতো দেখা দিয়েই খানিক পরে দিগন্তে মিলিয়ে যাচ্ছে। একটা ইনটারস্টেট হাইওয়ে অনেকক্ষণ ধরে একটা উজ্জ্বল সরিসৃপের মতো রেল লাইনের পাশে লেপটে ছিল, খানিক পড়ে সেটাও যেন বিরক্ত হয়ে বাঁ দিকে বেঁকে অন্ধকারে হারিয়ে গেল। দূর থেকে স্ট্রীট লাইট গুলো অন্ধকারে অনেকটা মোমবাতির মতো দেখাচ্ছিল, বোম্বে মেল তাদের হেলায় পিছনে ফেলে সামনে এগিয়ে গেল।

মিতালী আর মধুমন্তী দুজনে পাশাপাশি বসে জানলার দিকে তাকিয়েছিল। তাদের মন কিন্তু হারিয়ে গিয়েছিল তেইশ বছর আগের কোন সময়ে। জীবন তো বড়ই ছোট, আর তেইশ বছর অনেকটা সময়।

হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করে মধুমন্তী সোজা যাদবপুরের বাংলা অনার্সে ভর্তি হয়ে গেল। এই ব্যাপারে বাড়ীতে বিশেষ কোন ডিসকাসান হোল না, বাবা সোমনাথ ঘোষ যাদবপুরের মেকানিকালের ছাত্র ছিলেন। ব্যাস, বাড়ীতে ফতোয়া জারি মেয়েকে ওই যাদবপুরেই পড়তে হবে, যা পাওয়া যায়। আর তাছাড়া বাড়ীও লর্ডস বেকারির কাছে, ওখান থেকে রোজ কলেজে যাতায়াত করতে শুবিধাই হবে।

মধু ভর্তি হোল এবং রোজ যাতায়াত শুরুও করল। প্রথমে যা হয়, কারুর সাথেই বিশেষ আলাপ নেই, কাজেই ক্লাস আর বাড়ী, মাঝে একটু চা আর ভেজিটেবিল চপ। কিন্তু সাত দিন যেতে না যেতেই প্রায় ছ সাত জনের একটা গ্রুপ হয়ে গেল। মধু আর মিতু একই গ্রুপে ছিল। তারপর কয়েক মাস এই রকম ভাবেই কেটে গেল। বাড়ীর শাসন থেকে মুক্ত হয়ে কোএড কলেজে এসে এদের সবাই একটা নতুন জীবন পেয়েছে। এই ভাবে প্রথম সেমেস্টার এলো এবং গেলো। কারো রেসাল্ট ভালো হল কারও বা বাজে, কিন্তু কেউ খুব একটা মাথা ঘামাল না। এর মধ্যে কারও কারও বন্ধুত্ব আরও গভীর হয়েছে। সেদিন অ্যামিনিটি সেণ্টারে বসে কথা হচ্ছিল,

- 'কি রে, ক্লাস কেমন চলছে?'

- 'দূর বাদ দে, ওই একই, বাংলার পদাবলী। ওই দিকটা দ্যাখ।'

- 'ওয়াও! ওটা শতাব্দী নয়, ও কি সত্যিই প্রেম ট্রেম করছে নাকি?'

- 'ওই যে দ্যাখ, নীল সার্ট পরা ছেলেটা। ওর নাম বানীব্রত, ওর সাথেই তো কয়েকবার দেখেছি।'

- 'ধুর, আরো কয়েক মাস যাক, তারপর দেখিস। ওরকম বন্ধুত্ব তো কলেজে কতোই হয়।'

- 'তাছাড়া শতাব্দী জেভিয়ার্সের মেয়ে, ওর ওরকম টুকটাক বন্ধু প্রচুর আছে।'

- 'আচ্ছা মধু, তোর সেই প্রেমিকের কি হোল?'

- কে, চিতু মানে চিত্য? আরে দূর! ওতো আমার পাঠভবনের বন্ধু, অনেক দিন থেকে চিনি। ভীষন ভাল ছেলে, ওকে ওরকম বলিস না।

- 'আরে খারাপ কি বললাম, আর প্রেম করা কি খারাপ কিছু নাকি? ওর যদি তোকে ভালো লাগেই, তো সেটা খারাপ কিছু নাকি?

- তোরা না ভীষণ বাজে কথা বলিস। আমি অনেক দিন থেকেই কো-এডে পড়ছি... ঠিক আছে? প্রেম আমার কাছে নতুন কিছু নয়। ও সব আমরা ক্লাস টুয়েলভে সিনেমা দেখতে যাবার নাম করে একটু আধটু করেছ্‌, ওই ঢাকুরিয়া লেকে। কাজেই আমাকে প্রেমের নামে আওয়াজ দিও না, কোন লাভ নেই। ফ্যাক্ট হচ্ছে, চিত্য শুধুই বন্ধু, পিরিয়ড।

এই সময় মিতালী হুড়মুড় করে টেবিলে এসে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে রুমাল দিয়ে ঘাম মুছতে লাগলো। মধু ওর দিকে ফিরে একবার দেখল।

- 'কি রে, তোর আবার কি? এতো দেরী কেন? তোদের কি আবার এক্সট্রা টাইম নিয়ে পড়াচ্ছে নাকি?'

- 'না না, ক্লাসের পর একবার লাইব্রেরীতে ঢুকেছিলাম একটা বইয়ের ব্যাপারে, কিন্তু পেলাম না। যাক তোরা তো শুরু করে দিয়েছিস দেখছি, কি খাওয়া যায় বলতো? আমার আবার আজকে মাত্র দশ টাকা বাজেট।'

- 'দূর, রোজ যা খাস তাই খা। গোটা দুই ভেজিটেবিল চপ আর চা।'

- 'হ্যাঁ, দাঁড়া কাউন্টারে বলে আসি।'

মিতালী উঠে গেল কাউন্টারের দিকে। মিনিট পাঁচেক বাদে খাবারের প্লেট হাতে আবার টেবিলে এসে বসলো। অবশ্য ওদের টেবিলে অনেকেরই প্লেটে তখনও আধ খাওয়া খাবার পরে আছে।

মিতালী - 'ওফ, যা খিদে পেয়েছে না। দুটো চপে পেট ভরবে কিনা কে জানে।'

শ্রীপর্না - 'এই মিতু, তোর চপ দুটো একটু বড় কেন? আমাদেরটা দ্যাখ কেমন ছোট্ট ডিমের মতো আর তোরটা কেমন ক্রিকেট বলের মতো, চেঞ্জ করবি? আমারটাও গরম।'

মিতালী - 'অ্যাই, একদম নজর দিবি না। এই খিদের সময় খাচ্ছি তোদের জন্য পেট খারাপ না হয়।'

ঝুমুর - 'অ্যাই মিতু, কাল তোকে সন্ধ্যাবেলায় এইট বি-তে একটা ছেলের সাথে দেখলাম। নতুন কলেজে ঢুকেই প্রেম ট্রেম করছিস নাকি?'

মিতালী চপে একটা বড় কামড় বসিয়ে খানিকক্ষণ চিবাল, তারপর সুরুত করে একটু চা খেয়ে ঝুমুরের দিকে ফিরলো।

মিতালী - ঝুম, বড্ড গোয়েন্দাগিরি করছিস দেখছি। তুই ওখানে কি করছিলি শুনি?'

ঝুমুর - 'আমার আবার কি, ক্লাসের পর একটু আড্ডা দিতে আমরা কয়েকজন একটা চায়ের দোকান খুঁজছিলাম, হাঁটতে হাঁটতে ওদিকে চলে যাই। কথা ঘোরাস না, তোর ব্যাপারটা বল।'

মিতালী - 'কিছুই নয়। আমি লোকনাথ স্টোরে গিয়ে একটা নোটসের খাতা কিনছিলাম, হঠাৎই পুলকের সাথে দ্যাখা, ব্যাস, আবার কি?'

ঝুমুর - 'এই আবার চেপে গেলি, বাজারের পাশের ওই চায়ের দোকানে তোরা চা খাচ্ছিলি আর মাথা নাড়িয়ে নাড়িয়ে হাসাহাসি করছিলি, ঠিক কি না?'

মিতালী - 'উফ! হ্যাঁ। কিন্তু তাতে কি? পুলকের সাথে আমার দিনে পাঁচবার দ্যাখা হয়, পাশের জিওলজী বিল্ডিঙে ওদের ক্লাস, রাস্তায় দেখা হলে কথা বলবো না? আর আমি কি রাম গরুরের ছানা যে হাসবো না।'

মধুমন্তী - 'আঃ এবার চাপ। আচ্ছা ঐ ছেলেটাকে দেখেছিস । ঐ যে সবুজ জামা পরা, কেমন আনমনা ভাবে মোগলাই খেয়ে যাচ্ছে, ওর নাম জানিস?

ঝুমুর - 'কেন... প্রেম করবি?'

মধুমন্তী - 'তোর মাথাতে শুধু ঐ। জিজ্ঞাসা করছি কারণ সেদিন দেখলাম গড়িয়াহাট দিয়ে কেমন ক্যাবলার মতো একা হেঁটে যাচ্ছে, বোধহয় ফিজিক্সে ভর্তি হয়েছে।

মিতালী - 'তা গড়িয়াহাটে দেখলি যখন তখন কথা বললি না কেন? ডেকে আলাপ করলেই তো পারতিস।

মধুমন্তী - 'আরে সেরকম কিছু নয়। একা একা ঘুরে বেড়ায় তাই জানতে চাইছিলাম। আর তোরা তো সব টেলিফোন ডাইরেক্টরি সবার ফোন নাম্বার আর বাড়ীর অ্যাড্রেস মুখস্থ।'

শ্রীপর্না - 'বাবা শুধু কি আমরাই, তোকেও তো সেদিন দেখলাম ওই এস. এফ. আই. এর তরুন লীডার নীলুদার সাথে দারুণ আড্ডা মারতে, তারপরে বোধহয় চাও খাওয়াল, ঠিক না?'

মধুমন্তী - 'আরে সেটা ভোটের ব্যাপারে, ক্লাসে এবার হাওয়া কোন দিকে সেটাই জানতে চাইছিল।'

ঝুমুর - 'আর বিমল, ওই যে ঐ পাশে বসে আছে? ওর সাথেও তো তোর বেশ হুঁ হুঁ চলে।'

মধুমন্তী এবার একটু হাঁসলো, তারপর চোখ দিয়ে মিতালীকে দেখিয়ে বললো – 'ওটা ওর জন্য। বিমল মিতালীর সাথে আলাপ করতে চায়। আমি তো মিতুকে বলেইছি, ও তো লজ্জাতে আলাপই করতে চাইছে না।'

মিতালী - 'দ্যাখ তা নয়, সবে তো সেকেন্ড সেমেস্টার, এরপর আরও দু বছর আছে। তাছাড়া বাংলা নিয়ে পড়ছি... এম. এ. না করলে ইভেন টিচিং চাকরীও জুটবে না। কাজেই অনার্স তো পেতে হবে। ও বন্ধুত্ব করতে চাইলে করতে পারে কিন্তু এখনই প্রেম ট্রেম করতে চাই না।'

ঝুমুর - 'আহা একবার আলাপ করে দেখতে পারতিস কেমন ছেলে, ও কুইক কোন ডিসিশান নিতে চাইলেই তো হল না তোরও তো একটা ওপিনিয়ান আছে।'

এই রকম কথা হতে হতেই হঠাৎ বিমল তার টেবিল ছেড়ে এদিকেই এগিয়ে এল।

বিমল - 'হাই, তোরা সব এখানে গল্প করছিস, আমাদের ওই টেবিলে চল না, আমরা অনেকে আছি।

মধুমন্তী - 'আমাদের বেশী টাইম নেই রে, খেয়েই উঠে পড়ব, খুব ইম্পর্ট্যান্ট ক্লাস আছে। চারটের পর আমি ফ্রি, তারপর আর ক্লাস নেই, তখন জমিয়ে আড্ডা দিতে পারি।

বিমল - 'আমি সাড়ে চারটেতে ফ্রি, তাহলে পৌনে পাঁচটায় এখানেই? কি রাজি? ঝুমুর, মিতালী, শ্রীপর্না, তোদের কি অবস্থা? কতক্ষণ ক্লাস আছে? ঝুমুর। আমরা সবাই  বাংলা   অনার্স  যদিও স্পেশালাইজেশান আলাদা 

আলাদা, আর এখন তো সবই কমন সাবজেক্ট, কাজেই আমরাও সবাই এসে যাব।

বিমল - 'ঠিক আছে, তাহলে ঐ কথাই রইল।'

সে আবার নিজের টেবিলে ফিরে গেল। ওরাও যে যার চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে উঠে পড়ল।

আবার বাস্তবে। মধুমন্তী বা মিতালীর সেই উনিশ কুড়ি বছর বয়সের স্মৃতি ছেড়ে এই প্রায় পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই জীবনে। ট্রেন মাঝে মাঝে কর্কশ শব্দে হর্ন দিতে দিতে গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে সামনের দিকে ছুটে চলেছে। অনেকটা মানুষের জীবন যেমন ভবিষ্যতের দিকে ধেয়ে যায়, সেই রকম। জানলার বাইরে শুধু অন্ধকার, মাঝে মাঝে রেলওয়ের পোস্ট থেকে আলোর তীর এসে কামড়ার মধ্যে ঢুকছে আবার মুহুর্তে ট্রেন সেই আলোর রেখাকে পিছনে ফেলে রেখে অন্ধকারে ঢুকে পরছে। ওরা দুজনে চুপচাপ পাশাপাশি বসে আছে, কিন্তু দুজনার মন আজ হঠাৎ যেন কোন ফেলে আসা অতীতে হারিয়ে গেছে, এ যেন বস্তবে থেকেও সময়ের নদীতে উজান বেয়ে চলা।

আরো কত স্মৃতি। ওরা দুজনে এবার আস্তে করে দুজনার দিকে ফিরলো। দুজনার চোখে এক অদ্ভুত দুতি।

মিতালী - 'আচ্ছা মধু, তোর সেই সব দিনের কথা মনে পড়ে?'

মধুমন্তী - 'এখন বড়ই পড়ছে জানিস, কিন্তু বাড়ীতে এত ব্যস্ত থাকি যে এসব কথা ভাবার মতো সময় বার করতে পারি না, তোর সাথে আমাদের পুরনো কারোর যোগাযোগ আছে?'

মিতালী - না, সেই যে বিয়ে হয়ে কলকাতার বাইরে চলে গেলাম। ব্যাস, হয়ে গেল। শ্রীপর্না বলেছিল যে রেগুলার ফোন করবে, কিন্তু কোথায়? বোধহয় বার দুয়েক করেছিল সেই সময়। তারপর আর কি হল, কোন ফোন পাই নি। আর তখন তো মোবাইলের যুগ ছিল না। পাশের বাড়ী থেকে ফোন করতাম বা রিসিভ করতাম। ওকে ফোন করার ইচ্ছা থাকতো কিন্তু লজ্জায় আর পাশের বাড়ীতে গিয়ে করা হয়ে ওঠে নি। তাছাড়া তখন প্রথম বিয়ে হয়েছে একটু মানিয়ে চলার ব্যাপারও ছিল। তারপর যখন একটু গিন্নি হলাম, ততদিনে পর্নার ফোন নম্বর কোথায় হারিয়ে গেছে। তোর কি অবস্থা?

মধুমন্তী - 'ওই একই অবস্থা। তখন তো চিঠির যুগ, বাড়ীতেও চিঠিই লিখতাম। তোদের সবার অ্যাডড্রেস তো ছিল না। হঠাৎ বিয়ে ঠিক হল, তাড়াতাড়িতে যাদের কাছে পেয়েছিলাম তা সঙ্গে ছিল, তোর ও তো প্রায় আমার এক মাসের মধ্যেই ঠিক হল। তুই তো আবার ওই সময় ম্যালেরিয়ায় ভুগছিলি, তোর সাথে কলকাতা ছেড়ে যাবার আগে আর দেখাই হল না। ঝুমুরকে কয়েকটা চিঠি দিয়েছিলাম, ও উত্তরও দিয়েছিল। ওর চিঠিতেই শুনেছিলাম যে পর্না আর অভিষেকের মধ্যে একটা সিরিয়াস প্রেম চলছে। ওরা বিয়ের জন্যও রেডি, কিন্তু পর্নার বাবার নাকি ভীষণ আপত্তি। তারপর কি হল জানি না, কারণ গোটা তিনেক চিঠির পর ঝুমুর উত্তর দেওয়া বন্ধ করে দিল, বোধহয় ওর ও বিয়ের কথা চলছিল কোন এক এন. আর. আই. ফ্যামিলির সাথে, ও বোধহয় বিয়ের পর আমেরিকা চলে গিয়েছিল। আর কারোর কথা জানি না।

মিতালী - 'তোর ওই উল্কিটা দেখে মনে পরলো, আমাদের সেই পুরী ট্রিপটার কথা মনে আছে? ওখানেই তো তুই ওটা করালি, তারপর তোর সে কি ভয়। বাবা রেগে যাবে!

মধুমন্তী একটু হাসলো – 'বাবাঃ, মনে থাকবে না। আমরা বোধহয় পাঁচ কি ছয়জন মেয়ে আর প্রায় সাতজন ছেলে একসাথে ট্রেনে, সে কি হল্লা। পাশের কামড়ার লোকজন তো রেগে অস্থির। তোর মনে আছে হোটেলে গিয়ে রাত্রে ওরা কি করেছিল?

মিতালী - 'তা আর থাকবে না। রাত্রে সমুদ্রের ধারে বসে ড্রিঙ্ক করার ফন্দিটা তো অজয়ের ছিল। তা এতো খেলো যে পুলক আর অত্রীকে তো পাঁজাকোলা করে হোটেলে নিয়ে আসতে হয়েছিল। তাও একটা গার্ড সমুদ্রের ধারে এসে না পরলে ওরা তো ওই অবস্থায় জলে চান করতে নাবতো, আমার যা ভয় করছিল, ওই অবস্থায় নাবলে নিশ্চয়ই পুলকটা ডুবে যেতো। মধুমন্তী - 'হু... আর একটা ব্যাপার কিন্তু বাদ দিয়ে গেলি। বিমলের প্রেম নিবেদন?

মিতালী। ওর কথা ছাড়, ওটা একটা পাগল ছিল। বলে তুমি বললেই কালীঘাটে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করবো। বাবার কাছে যাবার সাহস নেই কারণ ডিগ্রি পেতে অনেক দেরী, চাকরিই বা কে দেবে। বাবা তো এক কথায় হাঁকিয়ে দিত, তাই কথায় কথায় কালীঘাট, দক্ষিণেশ্বর, এই সব।

মধুমন্তী - 'সে তুই যাই বল, ও কিন্তু তোকে সত্যিই ভালবাসত।'

মিতালী - 'হতে পারে, কিন্তু ভেবে দ্যাখ তখন আমাদের সবে সেকেন্ড ইয়ার, অত তাড়াতাড়ি কোন ডিসিশান নেওয়া যায় না। সবে তো তখন কলেজে ঢুকেছি। আর বাবা আগেকার দিনের রাশভারী লোক, তার ওপর স্কুল টিচার পড়াশুনো শেষ না করে বিয়ের কথায় কান দিতেন না।

মধুমন্তী - 'সে তো ঠিকই, বাদ দে ওসব কথা, কবে চুকে গেছে। আচ্ছা তোর সেই স্প্রিং ফেস্টটার কথা মনে আছে, সেটাও তো বোধহয় সেকেন্ড ইয়ারেই, সেকেন্ড সেমেস্টার। যেবার স্টুডেন্টস ইউনিয়ন থেকে আমাদের ভলান্টিয়ার করেছিল?

মিতালী - 'ওঃ মাই গড! দারুণ মনে আছে। কি এনজয়ই না করেছিলাম। লেডিস হস্টেলে সারারাত জেগে নানা পোস্টার লেখা। আর ঘন্টায় ঘন্টায় বাইরে এসে ওই ছেলেদের গ্রুপে বসে চা খাওয়া আর আড্ডা। ওরা তো ইউনিয়ান রুমে রীতিমতো পার্টি করছিল কিশোর কুমারের গান আর নাচ। অবশ্য কাজও ছিল অনেক ওই পোস্টার গুলো টাঙানো সারা ইউনিভার্সিটি জুড়ে, কোথায় কি অনুষ্ঠান তার সুচি লিখে সেঁটে 

দেওয়া। তাও আবার সারা ক্যাম্পাস জুড়ে, আর্টস, সায়েন্স আর ইঞ্জিনীয়ারিং সব প্রমিনেন্ট জায়গায়। তার পরের দিন যখন গেলাম তখন বাবা ভয়ঙ্কর রেগে গিয়েছিল।

মধুমন্তী - 'আমার বাবা তো দুদিন কথাই বলে নি। তবে মা সামলে দিয়েছিল।'

মিতালী - 'আর যূথীর জন্মদিনের পার্টি? মনে আছে? বাপ সে কি নাচ! সৈকত আর প্রশান্ত তো টেবিলের ওপর উঠে নাচতে শুরু করলো। তাও সেদিন শনিবার, কোন ক্লাস নেই। আমরা ভেবেছিলাম কোন প্রফ ডিপার্টমেন্টে আসে নি। ও বাবা স্বয়ং হেড এসে হাজির । মঞ্জুলীকাদি কিন্তু একদম রাগেন নি। সব দেখে একটু হেসে চলে গেলেন, শুধু বলেছিলেন – শব্দটা একটু কম করিস।'

মধুমন্তী - 'ভীষণ ভাল টীচার ছিলেন মঞ্জুলীকাদি, আর কি ভাল মানুষ। ওনারা নিশ্চয়ই কবেই মারা গেছেন।'

মিতালী মধুমন্তীর দিকে তাকিয়ে একটু মাথা নাড়ল, তারপর নিজের স্যুটকেসের বাইরের ফ্ল্যাপটা খুলে একটা ছোট্ট টিফিন বক্স বার করলো।

মিতালী - 'আয় মধু, সেই কলেজের মতো আমরা খাবারটা ভাগ করে খাই।'

এই বলে মিতালী বক্সটা খুললো। ভিতরে খুব সাধারণ কিছু

বার। গোটা তিনেক পরোটা আর আলু পেঁয়াজের তরকারি। মধুমন্তী একটু হাসলো – 'তোর সেই পরোটা ভালোবাসা আর গেল না । তোর মনে আছে, সেই যে যাদবপুরের সায়েন্স ফ্যাকাল্টীতে ঢোকার গেটের ঠিক অপোসিটে একটা ছোট্ট চায়ের দোকান ছিল, সেখানে আরও অনেক কিছুই পাওয়া যেত।'

মিতালী - 'হ্যাঁ হ্যাঁ, জানি কেস্টদার দোকান। আমরা মজা করে কেস্টদার কেবিন বলতাম। ওখানে সেই পরোটা আর একটু ঝোল ঝোল আলুর তরকারি, ওঃ এখনও মুখে লেগে আছে।'

মধুমন্তী - 'সেই কতবার যে খেয়েছি, বসার তো জায়গা ছিল না, ছোট্ট দোকান কিন্তু রাস্তায় দাঁড়িয়েই মেরে দিতাম। বিকাল পাঁচটার পর গরম পরোটা ভাজত, ওখানে দাঁড়াবার জায়গা থাকত না।'

মিতালী এক টুকরো পরোটা ছিঁড়ে তরকারির সাথে মুখে দিল, তারপর বেশ তাড়িয়ে তাড়িয়ে চিবতে চিবতে মুখের ফাঁক দিয়ে বললো – 'তবে এই পরোটা কিন্তু একদম ঠান্ডা ,আয় আর দেরি করিস না। হাত লাগা, ভালোই লাগবে, আজ দুপুরে নিজেই বসে বসে রান্না করেছি।

মধুমন্তীর একটু অসুবিধে হচ্ছিল, ট্রেনে হাত ধোবার অসুবিধা থেকে বলে সে খুব কিছু খায় না, খেলেও শুকনো কিছু সঙ্গে রাখে। এখন আবার ওয়া রুমে যেতে তার ভালো লাগছিল না, সে বোতলের জলে হাতটা একটু ভিজিয়ে নিল।

মধুমন্তী - 'মিতু, আমার কিন্তু একটুও খিদে নেই, বাড়ী থেকে প্রচুর কিছু খেয়ে এসেছি, তাই সামান্যই খাব। শুধু তোর অনারে, তোর হাতের রান্না বলে।'

মধুমন্তী খানিকটা পরোটা ছিঁড়ে তরকারির সাথে মুখে দিল। বেশ ভালো স্বাদ। পরোটাটা ময়েন দেওয়া, বেশ ঝুরঝুরে, খানিকটা নিমকির মত, তরকাড়িটায় টক, ঝাল আর মিষ্টির সুন্দর ব্যালান্স, তার ওপর ধনে পাতার গন্ধটা দারুণ ম্যাচ করছে।

মিতু গোগ্রাসে কিছুক্ষণ খেল, তারপর মধুর দিকে তাকিয়ে বললো – 'কি রে, আর নিলি না যে? ভালো লাগলো না?'

মধু চুপচাপ জানলার বাইরে গাঢ় অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে বসেছিল। তার বার বার মনে পড়ছিল যাদবপুরে ও আর মিতু কতবার এই পরোটা বা ভেজিটেবিল চপ এক প্লেট থেকে ভাগ করে খেয়েছে। মিতুর কথায় সে ঘার ফেরাল, তারপর আর এক টুকরো পরোটা আর তরকারি নিয়ে মুখে পুরলো।সত্যিই দারুণ রেঁধেছে মেয়েটা, ওর নিজের হাতের রান্না অতটা ভালো নয়। পরোটাটা আরামে পেটোস্থ করে মধু মিতুর দিকে তাকিয়ে বললো – 'আর নয় মিতু, আমার পেটে আর জায়গা নেই, তুই বাকিটা শেষ কর। আমি হাতটা ধুয়ে আসি।'

মধুমন্তী ওয়াস রুমের দিকে চলে গেল। মিনিট দশেক পড়ে মিতালীরও খাওয়া শেষ। সে বাথরুমে গিয়ে হাত ধুয়ে এসে আবার সিটে বসলো। আবার দুই বন্ধু মুখোমুখি দুই চেয়ারে।

মিতালী - 'এসব তো অনেক হল, আচ্ছা এবার তোর কথা কিছু বল। আমি তো তোর খবর কিছুই জানি না। কোথায় আছিস, কেমন বর্‌, কেমন সংসার!

মধুমন্তী খানিক্ষণ চুপচাপ বাইরের দিকে তাকিয়ে বসে রইল। যাদবপুরের জীবন শেষ হবার পর তার জীবন অনেকটা বয়ে গেছে। স্বচ্ছল ফ্যামিলির জয়ন্তর সাথে বিয়ে হবার পর তার জীবনের নতুন অধ্যায়ের শুরু। তারপর নানা চড়াই উৎরাই পার হতে হয়েছে। এখানে, এই ট্রেনের কামরায় সমস্ত কিছু উজাড় করে বলা হয়তো সম্ভব নয়।

মধুমন্তী - 'আর কি, সবার যেমন যায়। বিয়ে হল, তুই তো এলি না, মানে তোর তো আসার মত শরীরের অবস্থা ছিল না। তারপর পরীক্ষা, যদিও তোর সাথে ঐ সময় কয়েকবার দেখা হয়েছিল কিন্তু তখন তো আমরা সবাই এম. এ. ফাইনালের জন্য দারুণ ব্যাস্ত। পরীক্ষা যেই শেষ হল, ব্যাস, ওর সাথে সোজা দিল্লী মানে ওর কর্মক্ষেত্রে। ওদের ফ্যামিলির ফার্ম, সারা ভারতে নানা ফার্মে অডিট করে বেড়ায়, ওটাই ওদের বিসনেস। সেই রকম এখনো চলছে, এখন অবশ্য আমরা কয়েক বছর বোম্বেতেই আছি।

মিতালী - 'আর অন্য সব, বাচ্চা কটা?'

মধুমন্তী। একটা ছেলে, একটা মেয়ে, মেয়েই বড়।'

মিতালী একটু মুচকি হাসল। তারপর বললো - 'বাঃ, বেশ গুছিয়ে নিয়েছিস তাহলে। খুব ভাল। আমি কিন্তু পরে তোর বিয়ের সব খবর শুনেছিলাম, ঝুমুর, শ্রীপর্না ওদের কাছ থেকে। দারুণ হিংসে হয়েছিল জানিস, হ্যান্ডসাম বর, স্বচ্ছল শ্বশুরবাড়ি, একটা মেয়ে আর কি চায়। মধুমন্তী একটু  হাসল,  মিতু  ব্যাপার গুলো  একটু বেশী সরল করে নিচ্ছে। এটা ঠিকই যে তার বিবাহিত জীবনের 

শুরুটা হয়েছিল বেশ ভালোভাবে, ঐ যে বাংলায় যাকে বলে সোনায় সোহাগা, মুখে কানে মধু দেওয়ার পর যেন সব কিছুই মিষ্টি। কিন্তু আজ জীবনের এই জায়গায় এসে সে বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবে না যে তার জীবনের সব কিছুই হিংসে করার মতো। একটু থেমে সে বললো – 'মধুমন্তী, আচ্ছা আমারটা তো শুনলি, এবার তোর কথা কিছু বল। তোরও তো আমার বিয়ের একমাসের মধ্যেই বিয়ে হল। যদিও আমি নতুন বিয়ে হওয়ায় যেতে পারিনি।' 

মিতালী এবার একটু বাইরে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইল। একদিকে মধু, যার জীবন ফুলে ফলে ভরানো, স্বামী, সন্তান, হাই সোসাইটিতে ঘোরাফের্‌ তাছাড়া গাড়ী বাড়ী তো বহুদিন থেকেই আছে। তার নিজের ফ্যামিলি যদিও মোটের ওপর স্বচ্ছল। বাবা নিজে খোঁজ খবর নিয়েই বিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু সেটাও ঠিকঠাক গেল না, জীবনটা শুরু তাও মন্দ হয়নি। কিন্তু মাঝ বয়সে আসার আগেই কেমন ওলট পালট হয়ে গেছে।

মিতালী - 'আমার ব্যাপারটাও প্রায় তোরই মতো। বাবা সব ঠিকঠাক করলো, দুম করে বিয়েটা হয়ে গেল, আমার তো নিজের কোন মতামত ছিল না। আমাদের ফ্যামিলি একটু সেকেলে, মেয়েদের মতামত খুব একটা নেওয়া হয় না।'

মধুমন্তী - 'ওই পরীক্ষার ব্যস্ততায় তোকে তো কিছু জিজ্ঞাসা করা হয় নি, কিন্তু রিক্তা, শম্পা, এদের তো জানিস, মোটামুটি গেজেট। ওদের কাছ থেকেই শুনেছিলাম যে তোর বরও বেশ বড় ইঞ্জিনীয়ার, বেশ বড় ফার্মে চাকরী করে। কিছু তো বল।'

মিতালী -'বড় ফার্ম আর কি, সিভিল ইঞ্জিনীয়ারিং ডিসিপ্লিনে গ্র্যাজুয়েট করে কলকাতায় মোটামুটি একটা চাকরী করছিল। কয়েক বছর এক্সপেরিয়েন্স হয়ে গেলে কলকাতার বাইরে চলে যায়। ততদিনে অবশ্য আমার সাথে বিয়ে হয়েছে, তাই আমিও ওর সাথে চলে গেলাম।'

মধুমন্তী - 'তারপর, আর কি? ইস্যু কটা?'

মিতালী - 'একটাই, মেয়ে, শর্বরী। এই তো হায়ার সেকেন্ডারী পাস করে কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে পড়ছে।'

এই সব কথা বলতে বলতে ওরা খেয়াল করে নি যে ট্রেনের গতি কমে আসছিল। গাড়ী ক্রমশ আরও স্লো হয়ে এল। খড়গপুর জাংশান। গাড়ী খড়গপুরের বিশাল লম্বা প্ল্যাটফর্মে ঢুকে আস্তে আস্তে স্থির হয়ে দাঁড়াল। রাত বেশ হয়েছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও প্ল্যাটফর্মে বেশ কিছু যাত্রী রয়েছে, গাড়ী ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে একটা হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। প্রত্যেক কামড়ার এনট্র্যান্সের সামনে ছোটখাট একটা করে লাইন তৈরী হল। একই সঙ্গে ঠেলাঠেলি করে নানা ভেন্ডার নানা রকম জিনিস বিক্রির জন্য কামড়ার মধ্যে ঢুকে এল। সেই সঙ্গে সেই মধুর ডাক – চায় গরম। মিতালী আর মধুমন্তী এর জন্যই বসেছিল, ওরা কামড়ার দরজা খুলে করিডোরে উঁকি মারলো। মিতালীই প্রথমে ডাক দিল – 'এই চা, এদিকে এসো,এই যে এদিকে।'

দুজনে দু কাপ চা নিয়ে আবার দরজা বন্ধ করে বসল। এই সব স্টেশানের চায়ের একটা বেশ আমেজ আছে যেটা বাড়ীর চায়ে পাওয়া যায় না, বেশ গাঢ় এবং একটু কষা, বেশ তাড়িয়ে তাড়িয়ে খাওয়ার মতো। এর মধ্যে আবার গাড়ী ছেড়ে দিয়েছে। আস্তে আস্তে খড়গপুর স্টেশান পিছনে পড়ে রইল। ট্রেন আবার তার গতি বাড়িয়ে অন্ধকারের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল।

তারপর আর বেশী কথা হল না, দুজনাই একটু ক্লান্ত বোধ করছিল, তাছাড়া আবার কালকে সকালে উঠতে হবে। চা খাওয়া হয়ে গেলে ওরা আরো কিছুক্ষণ সেই যাদবপুরের স্মৃতি চারণ করে একবার করে টয়লেটে গেল। তারপর কালকে আরও কথা বলার প্রতিজ্ঞা করে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ল। 

শুয়ে পড়ে মধুমন্তীর তখনই ঘুম এল না। একে তো তার ঘুমের একটা প্রবলেম আছেই, তার ওপর আবার কোন ওষুধ খাওয়া হয়নি। ট্রেনে সে এমনিই ওষুধ খায় না যদি সকালে উঠতে কোন অসুবিধা হয়। আজ আবার মনের মধ্যেও হাজার জোনাকির উড়াউড়ি। আজ এতদিন পড়ে সেই কলেজ জীবনের এক হারিয়ে যাওয়া বন্ধুর দেখা। তার কত খুশী হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে কেমন যেন সব পানসে লাগছে, কেমন যেন একটা হেরো হেরো ভাব। মিতালী বোধহয় তার দামি শাড়ী, মোটা সোনার চেন দেখে তাকে দারুণ হ্যাপী ভেবেছে। তার ফ্যামিলিতে বড় গাড়ী, টাকার কোন অভাব নেই কিন্তু সেটা বড় চাদর, তার তলায় ঢাকা অনেক ময়লা।

প্রথম যখন তার বিয়ে হল তখন বড়ই ভালো লেগেছিল।. বড় লোক শ্বশুরবাড়ী, গাড়ী, বাড়ী। সারা ভারতের নানা জায়গায় ফ্যামিলি বিসনেস ছড়ানো। প্রথম প্রথম স্বপ্নের মত দিন কাটছিল। বিয়ের পরে অবশ্য মাত্র দিন দশেক শ্বশুরবাড়ীতে ছিল, তারপর আবার কলেজে যাতায়াত কারণ পরীক্ষা সামনে এম. এ. ফাইনাল। সে যাই হোক, মাস চারেকের মধ্যে সব মিটে গেল আর তারপর সে তার স্বামী জয়ন্তর সাথে দিল্লী। তখন সেটাই তার কর্মস্থল। বিয়ের প্রথম কয়েকটা বছর কিন্তু কেটেছিল চমৎকার হাসিখুশি স্বাস্থবান স্বামী, অঢেল ফ্যামিলি ইনকাম, দিল্লীর বাঙালী সারকেলে এই ফ্যামিলির বেশ সুনাম। উইক এন্ড হলেই গাড়ীতে কোথাও ঘুরতে যাওয়া, মাসে একটা দুটো গেট টুগেদার বা পার্টি তো লেগেই থাকত, এছাড়া কারো জন্মদিন বা কারো ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি, এসব ইনভাইটেশান প্রায়ই আসত। কিন্তু সম্ভারের সাথে সাথে এল আরো অনেক কিছু। সেই হ্যান্ডসাম স্বাস্থবান জয়ন্ত একটু একটু করে পালটে যেতে লাগল। আগে যেমন অফিসের কাজ হয়ে গেলেই গাড়ী চালিয়ে সোজা বাড়ী আসতো তা আস্তে আস্তে পালটে গেল। অফিসের পর কোথাও আড্ডা মেরে জয়ন্ত ফিরত। মাঝে মাঝে সেটা রাত দশটা পেরিয়ে যেতে লাগল। তখন মধুমন্তীর ছোট্ট দুটো বাচ্চাও হয়ে গেছে। বড় মেয়ে পার্বতী আর তার থেকে বছর দেড়েকের ছোট ছেলে বিশ্বজিৎ। যতদিন যেতে লাগল ততই কিন্তু জয়ন্ত বেপরোয়া হয়ে যেতে লাগল। প্রথমে শুধু বন্ধুদের সাথে আড্ডা, তারপর তাস আর মদ। ফিরতে ফিরতে মাঝরাত পেরিয়ে যেতে লাগল। বাবা মা সবাই কলকাতায়, কাজেই লাগাম দেওয়ার কেউ নেই। মধুমন্তীর শাসন, বকুনি, চোখের জল কিছুই কোন কাজে এল না। অ্যাকাইন্টস আর অডিটিং এর ব্যবসা যতই ফেঁপে উঠছিলো ততই জয়ন্ত বেপরোয়া হয়ে উঠতে লাগলো। বাচ্চাদের খাইয়ে দাইয়ে ঘুম পারিয়ে ক্লান্ত দুটি চোখে রাত জাগা আর অন্ধকারে চোখের জল ফেলা, এটাই তখন মধুমন্তীর রোজকার কাজ। আর মাঝ রাত্রে নেশায় সম্পূর্ন মাতাল হয়ে তার ভেরী সাকসেসফুল স্বামীর টলতে টলতে অ্যাপার্টমেন্টের সিড়ি দিয়ে ওপরে ওঠায় সাহায্য করা যাতে বেশী শব্দে পড়শীদের ঘুম না ভাঙে। এটাও না হয় মানা যেত। কিন্তু জয়ন্তর নিচে নামার আরও বাকি ছিল। সেটাও ঘটলো। তার নামে অন্য মেয়ের সাথে সম্পর্ক রাখার কথা দিল্লীর বাঙালী মহলে ছড়িয়ে পড়ল। তাও আবার নিজের অফিসের সেক্রেটারির সাথে।অবাঙালী মিষ্টি একটা মেয়ে, নাম প্রিয়াঙ্কা। মিষ্টি কিন্তু বোধহয় একটু বেশী মিষ্টি, বড় বেশী উজ্জ্বল আর ডেয়ারিং। মাঝে মাঝে অফিসের কাজে দিল্লীর বাইরে তো যেতেই হত, কাজের এক্সকিউস দিয়ে সেক্রেটারিও যেত।সেখানেই সম্পর্কটা খুব কাছের হয়ে দাঁড়িয়েছিল, শারীরিক হয়ে গিয়েছিল। নিজেদের ফ্যামিলির ফার্ম কাজেই কারুর কোন বাধা দেওয়ার ব্যাপার ছিল না। মধুমিতা প্রথম প্রথম খুব একটা পাত্তা দেয় নি। ওরকম তো কতই শোনা যায়, তার ওপর হাই ফ্লাইং কনসাল্ট্যান্ট,নলোকের জেলাসি তো থাকবেই। কিন্তু ব্যাপারটা ওখানেই শেষ হল না। যখন একটা ট্যুরে গিয়ে তিন দিনের কাজের শেষে ওরা দুজন সিমপ্লি ভ্যানিস করে গেল একটা উইক এন্ডে। সোমবার জয়ন্ত ফিরেও এল। মুখে সেই এক কথা – আরে, কাজের ব্যাপারে কি আর অত দিন মেপে চলা যায়, এক দু দিন এক্সট্রা লাগতেই পারে। কিন্তু ততদিনে মধুমন্তীও অনেক সেয়ানা হয়ে গেছে, দুই বাচ্চার মা, তার ওপর বয়স প্রায় চল্লিশ ছুঁইছুঁই। জয়ন্তর গালের, গলার আর ঠোঁটের ছোট কাটা দাগ, জামা কাপড়ে লেগে থাকা মেয়েদের লম্বা চুল সব কিছুই এক দিকেই ইঙ্গিত করছে। মধুমন্তী সেই দিনই কলকাতায় তার শ্বশুর শাশুড়ির সাথে যোগাযোগ করল। ওনারা অবশ্য কিছুই জানতেন না। পনের দিনের মধ্যে ওনারা কলকাতা থেকে দিল্লী এলেন। অফিসের অন্যান্য এক্সিকিউটিভদের সাথে ডিসকাস করে ওনারা জয়ন্তকে ইমিডিয়েটলি মুম্বাইতে পাঠিয়ে দিলেন, ওখানেও একটা অপেক্ষাকৃ্ত ছোট অফিস ছিল। সেটা মধুমন্তীর জীবনে একটা বিশাল দিকদর্শন। সমস্ত জীবনটা ওলট পালট করে দেবার মতো। সেই থেকে মধুমন্তী এবং জয়ন্ত সঠিক অর্থে আর স্বামী স্ত্রী রইল না, কিন্তু তারা এক ছাদের তলায় বাস করতে লাগল, সংসারটা ভাঙল না শুধুমাত্র বাচ্চা দুটোর জন্য, তাদের বয়স তখন প্রায় চোদ্দ আর বারো বছর। অবশ্য এতো ঘটনার পরেও জয়ন্ত খুব একটা পালটাল না, অফিসের পড়ে তার তাস আর ড্রিঙ্কসের আসর চলতেই থাকল, মুম্বাই তো নাইট লাইফের জন্য বিখ্যাত যদি পকেটে টাকা থাকে আর ঐ একটা জিনিস জয়ন্তর পকেটে প্রভূত পরিমানেই ছিল।

আজকে মিতালীকে দেখে মধুমন্তীর বড় ভাল লাগলো। কি সুন্দর মাথায় বড় করে সিঁদুর দিয়েছে, মুখের মধ্যে এখনও কেমন একটা খুশীর জ্যোতি। সেই কথায় কথায় এক মুখ হাঁসি। সাদা দাঁতগুলো এত সুন্দর যেন বাঁধানো, নিশ্চয় স্বামী সংসার নিয়ে দারুণ সুখী মিতালী। এতদিন পরে প্রিয় বন্ধুর সাথে দেখা হওয়া সত্ত্বেও মধুমন্তীর মনে কিসের যেন একটা শুন্যতা। কোথাও একটা হেরে যাবার বেদনা, আজ সত্যি সত্যিই তার ঘুম এল না। ঘর অন্ধকার। ট্রেন সমানে কোন অন্ধকারের হাতছানিতে এক অজানা ভবিষ্যতের দিকে ছুটে চলেছে। এই রকম সময় মিতালীর দারুণ একটা আমেজ আসে। তাকে ঘুমের জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। ঘুম নিজেই এসে তার চোখে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু আজ তার ব্যতিক্রম। মিতালী চোখ বুজে অনেকক্ষণ ধরে ঘুমের আরাধনা করে গেল কিন্তু আজ আর 

ঘুমের দেখা নেই। মাথাটা যেন একটু দপ দপ করছে, প্রেসারটা বেড়ে গেল কিনা কে জানে।

ধুমন্তীকে দেখে এত ভালো লাগল।সে আর মধু যাদবপুরে ভীষণ ক্লোজ ফ্রেন্ড ছিল। মধুর বিয়ের সময় সে অসুস্থ ছিল তাই যেতে পারে নি, কিন্তু বিয়ের পর যখন মধু ফিরলো তখন জোর একটা আড্ডা মারার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু এম.এ. ফাইনাল ঘাড়ের ওপর এসে যাওয়ায় সেরকম কোন সুযোগ পাওয়া যায় নি। তা সে পরীক্ষাও শেষ হল। কিন্তু ও হরি, পরীক্ষা শেষ হতে না হতেই মধু হাওয়া,প্রথমে কয়েকদিন শ্বশুরবাড়ী তারপর সোজা দিল্লী একবার জানিয়েও গেল না, ঠিকানা তো নয়ই। এই শেষের দু সপ্তাহের কথা তো সে ওই শ্রীপর্না, ঝুমুর এদের কাছ থেকে শোনা অথচ মধু তার কত কাছের বন্ধু। ভীষণ অভিমান হয়েছিল। আর রাগ। ভেবেছিল আর সারাজীবন ওর সাথে কোন রকম যোগাযোগ রাখবে না। মধুর শ্বশুরবাড়ীর আর দিল্লীর ঠিকানা সে শ্রীপর্নার কাছ থেকে জোগাড় করেছিল কিন্তু কোন চিঠি লেখেনি। আজ অবশ্য এই ঠিকানার কথা সে মধুকে বলেনি, সে সব অনেক দিনের কথা, এখন এইসব রাগ অভিমানের কথা এখন এই বয়সে আর তুলতে ইচ্ছে করে না। আর তার জীবনও তো অনেক ওঠা-পড়ার মধ্যে দিয়ে গেছে।

বাবা বিয়ে ঠিক করেছিলেন। অনেক দেখে শুনে, ছেলে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনীয়ার। মোটামুটি ভালো অবস্থা, কলকাতায় একটা ছোট বাড়ী, একটা চাকরী। এই রকম পাত্র মিতালীদের বাড়ীর যা অবস্থা তাতে ভালোই বলতে হবে কারণ মিতালীর বাবা একজন স্কুল টীচার, তাঁর পক্ষে এর থেকে বেশী সম্ভ্রান্ত কোন ফ্যামিলির সাথে মেয়ের বিয়ে ঠিক করা সম্ভব ছিল না। মিতালী কোন আপত্তি করে নি, সেটা তার স্বভাবও না। বিয়ের প্রথম বছরগুলো বেশ ভালোই কাটছিল। প্রবীর কলকাতার বিড়লা টেকনিক্যাল সার্ভিসেস – এ জয়েন করেছিল। মল্লিক বাজারের মোড়ে অফিস, প্রথম কয়েক মাস সেখানেই ছিল। তারপর তাকে দূর্গাপুরে সাইটে পাঠিয়ে দিল। এই সময় তার সবে বিয়ে হয়েছে। মিতালী প্রথম প্রথম তার কলকাতার শ্বশুরবাড়ীতেই রয়ে গেল, প্রতি শুক্রবার প্রবীর বাড়ী আসত আবার সোমবার সকাল পাঁচটায় সোজা হাওড়া হয়ে দূর্গাপুর। এই ভাবে মাস পাঁচেক যাওয়ার পর প্রবীর দূর্গাপুরেই একটা ছোট্ট বাড়ী ঠিক করল আর মিতালী খুশির ভেলায় ভাসতে ভাসতে প্রবীরের সাথে থাকতে ওখানে সিফট করে গেলো। শুরুটা ভালোই হল। ওখানে প্রবীরের নানা কলীগের সাথে আলাপ। তাদের ফ্যামিলির সাথে জানাশোনা, প্রায় প্রতি উইক এন্ডেই কোথাও না কোথাও পার্টি, খাওয়া দাওয়া, ওয়েদার ভালো থাকলে কারো বাগানে বা পার্কে গ্রিল এন্ড স্টেক পার্টি। দিনগুলো যেন স্বপ্নের মতো, যাদবপুরের কলেজ লাইফ থেকে আলাদা কিন্তু তাও দারুণ। মিতালী নিজেকে সত্যিই বড় সুখী ভাবতে শুরু করেছিল। কিন্তু এত সুখ কি আর সয়। প্রবীর সাইট ইঞ্জিনীয়ার ছিল, সেটাই তার অফিসিয়াল ডেসিগনেশান, কিন্তু কেমন করে যেন তার ইনকাম বাড়তে লাগলো। মাইনে তো আছেই সেই সঙ্গে মাসের নানা সময়ে টাকার বাণ্ডিল বাড়ীতে আসতে শুরু করলো। সেই সঙ্গে জীবনে এল লাক্সারি আর অন্যান্য অনুসংগ। প্রবীর টাকার বাণ্ডিল এনে যে সবসময় ব্যাঙ্কে রাখতো তাও তো নয়, আলমারির ভিতরে ঠেসে বা কোন স্যুটকেসের মধ্যে রেখে দিত। মিতালী অতশত বোঝেনি প্রথম দিকে, তার প্রশ্নের উত্তরে প্রবীর বলেছিল যে সে কিছু প্রাইভেট কনসালটেন্সি করে, এটা তারই টাকা। মিতালী তাতেই খুশি ছিল, ছ মাসের মধ্যে তারা বড় বাড়ীতে উঠে গেল। বাড়ীতে এলো দামি টেলিভিশান, ভি. সি. আর., ওয়াসিং মেশিন ইত্যাদি, দামি সেন্ট, সোনার গয়না, বছরে তিন চারটে দামি শাড়ি এগুলোও বাড়ীতে ঢুকে পড়ল। সুখী গৃহিনী হিসাবে মিতালী প্রায়ই বাড়ীতে খাওয়া দাওয়ার আয়োজন করত। বেশীর ভাগ সময়ই প্রবীরের কলীগদের, সেই সঙ্গে পাড়া প্রতিবেশী। এই ভাবে বেশ কিছুদিন গড়িয়ে গেল। এল তাদের প্রথম সন্তান, শর্বরী। ঘটা করে অন্নপ্রাশন হল। বাচ্চা সুস্থ্য ভাবে বেড়ে উঠছিল কিন্তু হঠাৎ ঝড় এল। তাতে মিতালীর সুখে আর গর্বে সাজানো সংসার ভেসে গেল।

     সেদিন সকালে প্রবীর যেমন অফিসে যায় বেরিয়ে গেল। মিতালী দুপুরে শর্বরীকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে একটা ম্যাগাজিন নিয়ে খাটে শুয়েছিল। এই সময় ফোনটা এলো, প্রবীর জানাল যে তার অফিসে আজ একটু কাজ বেশী আছে তাই ফিরতে একটু দেরি হবে। এরকম প্রায়ই হয়, সাইটে অনেক সময়ই কাজ সন্ধ্যের পরও চলে কাজেই মিতালী খুব বেশী চিন্তিত হয়নি। প্রায় সাড়ে পাঁচটার সময় প্রবীরের এক কলীগ এসে খবরটা জানাল। সাইটে ধুন্ধুমার কান্ড, একটা ট্রেসেল পুরো ভেঙে পড়েছে সেই সঙ্গে কনভেয়ার বেল্টের একটা বিরাট সেকশান, দুজন ওয়ার্কার স্পট ডেড, আরো পাঁচ জন জখম। তার মধ্যে তিনজন মারাত্মক ভাবে। পুলিশ এসেছে দুপুরের দিকেই, প্রবীর ছাড়াও আরো পাঁচজন সাইট ইঞ্জিনীয়ারের অ্যাকটিভিটির ওপর ইনটারোগেশান চলছে, প্রবীর আজ রাতে নাও ফিরতে পারে। ছেলেটা চলে গেল, মিতালী একা ঘরের মধ্যে থম মেরে বসে রইল, বাচ্চা শর্বরী কিছুই না বুঝে তার রঙিন বলটা নিয়ে সারা ঘর দাপিয়ে খেলে যেতে লাগলো।

তার পরের দিন সকালেও প্রবীর এল না। দুপুর গড়িয়ে বিকেলের দিকে যাচ্ছিল। প্রায় চারটের সময় প্রবীর ঢুকলো, সেই সঙ্গে আরো অনেকে। পুলিশের লোক অনেকেই ছিল, কেউ প্রপার পুলিশের বেশে কেউবা প্লেন ড্রেসে। সারা বাড়ী সার্চ হল। সারা বাড়ী মানে বাথরুম, কিচেন, সমস্ত ড্রয়ার, আলমারি , বুক সেলফ, বাক্স, ট্রাঙ্ক, বিছানার তোষকের তলা ইত্যাদি তন্ন তন্ন করে খোঁজা। পাওয়াও গেল। প্রবীরের আনা সেই সব টাকার বান্ডিল অনেক কটাই পুলিশের হাতে পড়লো। পুলিশ আবার প্রবীরকে নিয়ে চলে গেল। যাবার আগে প্রবীর কি অসহায় ভাবে একবার মিতালীর দিকে তাকাল। চোখ দুটো কেমন ছল ছল করছে অপমানে।বাচ্চাটার দিকে একবার তাকিয়ে সে চলে গেল। তখন প্রায় সন্ধ্যা সাতটা, অন্ধকারে পুলিশের গাড়ীর লাল আলোটা দূরে মিলিয়ে গেল। মিতালী আগের দিনের মত আবার বাচ্চাটাকে নিয়ে একা বাড়ীতে বসে রইল।

তারপর কয়েকদিন যেন মিতালীর ওপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেল। প্রবীর পুলিশের কাস্টডিতেই রইল, সেই সঙ্গে তার আরও তিন-চার জন কলীগ। তবে অফিসের অন্যন্য কলীগেরা মিতালীর খোঁজ খবর রাখছিল, তাদের কাছ থেকেই মিতালী জানতে পারল সব। ওই কন্সাল্ট্যান্সির ব্যাপারটা সব বাজে কথা। প্রবীর ঘুষ খেত, তবে সে একা নয়, তার একটা দল ছিল। তারা কন্ট্র্যাকটারদের কাছ থেকে বাজে কোয়ালিটির মাল পাস করে দিত এবং তার জন্য মোটা টাকা পেত, সেই সব টাকা চার জন কলীগের মধ্যে ভাগ হত আর মিতালী ওই সব টাকাই প্রবীরকে বাড়ীতে আনতে দেখেছে। বিড়লা টেকনিক্যাল সার্ভিসেস ব্যাপারটা খুব সিরিয়াসলি নিল। পুলিশ তাদের ইনভেস্টিগেশান খুব প্রম্পটলি এগিয়ে নিয়ে গেল। স্টীল সাপ্লায়ারদের লগ আর মেটেরিয়াল মিলিয়ে খুব তাড়াতাড়ি ব্যাপারগুলো পরিস্কার হয়ে গেল কারা ব্যাপারটার মধ্যে জড়িত ছিল। কত টাকা কার কার কাছে গিয়েছে এবং কোন সাপ্লায়ার কোম্পানির কোন কোন অফিসার এর মধ্যে জড়িত তাও জানা গেল। মূল ঘটনার মাস খানেক পরে মামলা কলকাতায় চলে গেল। মিতালীও তার বাচ্চা এবং কিছু জিনিসপত্র নিয়ে বাড়ী ছেড়ে দিয়ে কলকাতায় শ্বশুরবাড়ী চলে গেল। মামলা প্রায় একবছর চলল। যারা অপরাধী তাদের অবশ্য কোন ডিফেন্স নেই কারণ সবারই বাড়ী থেকে আন-একাউন্টেড টাকা পাওয়া গেছে, অপরাধ স্বীকারও করেছে ওরা সবাই। এই অবস্থায় একটা পারডন পাওয়া গেল। বিড়লা কোম্পানি জেল টার্ম ডিম্যান্ড করল না কিন্তু যারা এই চক্রে জড়িত তাদের চাকরী গেল। প্রবীর আবার বেকার এবং এবার গায়ে একগাদা ময়লা নিয়ে। প্রবীর প্রায় দুবছর কোন চাকরী পায় নি। তারপর পাড়ার একজন রিটায়ার্ড অফিসারের ইঞ্জিনীয়ার ছেলের দয়ায় একটা ওভারসিয়ারের চাকরী পেল।তাও এই ধ্যারধ্যারে সাইটে, নাগপুর থেকে আরো দেড়শ কিলোমিটার ইন্টিরিয়ারে। দুবার বাস পালটে যেতে হয়। স্কুল কলেজের প্রচন্ড অসুবিধা, কোনক্রমে হায়ার সেকেন্ডারী পাশ করার পরই শর্বরীকে কলকাতায় পাঠিয়ে দিয়েছে কলেজে পড়ার জন্য। এখানে সে একটা ছোট্ট কোয়ার্টারে প্রবীরের সাথে থাকে। একবার ধাক্কা খেয়ে প্রবীর কিছুদিন সোজা পথে ছিল। এখানে আসার প্রায় বছর দুই অবধি সব ঠিকঠাক। কিন্তু তারপর আবার কিছু ধরিবাজ অবাঙালি লো লেভেল কলীগের সাথে মেশা শুরু করল। সন্ধ্যাবেলাগুলো ওদের সাথেই কাটায়, কি করে কে জানে। শোনা যায় একটা সোসাল ক্লাবের মত আছে, সেখানে তাস টাস খেলা হয়, মাঝে মাঝে মদটদও চলে। বাড়ীতে আর টাকা আনে নি এটাই মিতালীর কাছে একটা শান্তি, অন্য যা কিছু করে মিতালী বিশেষ জিজ্ঞাসা করে না। ওরা শুধু এখন এক বাড়ীতে থাকে, এই পর্যন্ত। এই হচ্ছে মিতালীর এখন পর্যন্ত জীবন চড়িত। কিন্তু একথা কি আর মধুমন্তীকে বলা যায়। মেয়েটা কি হ্যাপী, পাশের বাঙ্কে কেমন শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে, এতদিন পড়ে হঠাৎ দেখা, ওকে এসব একদম বলা যাবে না। আর তাছাড়া, এতদিন পরে যাদবপুরের সেই ক্লোজ ফ্রেন্ডশিপও যেন কোথায় ফিকে হয়ে গেছে। সময় সব কেড়ে নিয়েছে। এপাস ওপাস করতে করতে মিতালী কখন যেন ঘুমিয়ে পড়লো। পাশের বাঙ্কে চোখ বুজে জেগে থাকা মধুমন্তীর একটা দীর্ঘ্যশ্বাস পড়লো। সকাল এল। মধুমন্তী একটু চোখ পিটপিট করে একবার চোখ খুললো। ঠিকই তো ,সকাল হয়ে গেছে। ট্রেনের একঘেয়ে দোলানি অবশ্য রয়েইছে। ওপাশের বাঙ্কে অবশ্য মিতালী এখন পা গুটিয়ে দলা পাকিয়ে ঘুমিয়ে আছে। আর চোখে একবার ঘড়ি দেখল। প্রায় আটটা কুড়ি তার মানে ভাটপাড়া জাস্ট পেরিয়েছে, তাই ট্রেনটা বোধহয় একটু আস্তেও চলছে। একবার আড়মোড়া ভেঙে মধুমন্তী উঠে পড়লো। নাঃ, একবার বাথরুমে যেতেই হবে। রাতে তাকে মাঝে মাঝে উঠতেই হয় কিন্তু কাল রাতে যাওয়া হয়নি। বাথরুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে বেশ করে মুখে চোখে জল দিয়ে ফিরে এসে মধু দেখলো যে মিতালীও উঠে বসে আছে। চোখে এখনো একটু ঘুম ঘুম ভাব, চোখ মুখ ঘুমের জন্য একটু ফোলা। মধুকে দেখে একটু হাসলো, মিতালী - 'কি... বাথরুম কি ফাঁকা?' মধুমন্তী - 'ও, তুই আগেই উঠে পড়েছিস। মটকা মেরে পড়েছিলি। যা, বাথরুম এখনও ফাঁকা।' মিতালী আবার তার ট্রেডমার্ক হাসিটা দিয়ে বাইরে চলে গেল। মধুমন্তী ভালোভাবে বসতে না বসতেই মিতালী ফিরে এল, মুখে চোখে জলের ছাপ, কপালের ঠিক ওপরের চুলটাও একটু ভিজে রয়েছে। ফিরে এসেই ধপাস করে সিটে বসে বলল – 'মিতালী। এইবার জমিয়ে একটু চা দরকার।'

মধুমন্তী -  'তোর সেই চা চা বাতিক আর গেল না, সেই যাদবপুর থেকে দেখে আসছি। আগে তো কিছু মুখে দিবি। দাঁড়া, আগে কিছু ব্রেকফাস্ট অর্ডার দিই।'

ওরা কামড়ার দরজাটা খুলে একটু উঁকি ঝুঁকি মারতেই একজন উর্দ্দি পরা ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন, ওরা ব্রেকফাস্টের অর্ডার দিল – ডাবল ডিমের ওমলেট, ব্রেড বাটার আর কফি।

তারপর ওরা আবার দুজনে গল্পে ডুবে গেল কারণ খাবার আস্তে অন্তত মিনিট পনের লাগবে।

মিতালী - 'প্রায় সাড়ে আটটা বাজে, তার মানে একটু পরেই বোধহয় রায়পুর আসবে।'

মধুমন্তী - 'তা তো আসবে, কিন্তু দুপুর এসে গেলেই তো তুই নেবে যাবি। আমার এত খারাপ লাগছে না, এত দিন পড়ে দেখা অথচ তোকে যে বাড়ীতে নিয়ে গিয়ে বেশ আরাম করে একটু গল্প করবো তার উপায় নেই।'

তারপর দুই বন্ধু আবার সেই পুরাণ দিনের গল্পে মেতে উঠল। ওরা দুজনে যেন সেই পুরাণ যাদবপুরের দিনে ফিরে গেছে। আরতীদির সেই লিটারেচারের ক্লাস করতে করতে হঠাৎ হঠাৎ লেকচার টপিক ভুলে যাওয়া, স্প্রিং ফেস্টের সময় ব্রাত্যর নাটকের পাঠ ভুলে হঠাৎ স্টেজ থেকে পালিয়ে যাওয়া, নীলেশ আর জয়তীর ঢাকুরিয়া লেকে প্রেম করতে গিয়ে সোজা বাবার সামনে পরে যাওয়া এবং তারপর না চেনার ভান করে চলে যেতে গিয়ে রাস্তার মাঝখানে চড় খাওয়া, এই সব কথা মনে করে দুজন যেন আবার কলেজ পড়ুয়া তরুণী হয়ে গেছে। অমলিন হাসির মাঝে দুজনাই যেন কোথায় বর্তমানকে ভোলার নাটক করে যাচ্ছে।

এর মধ্যে সকালের ব্রেকফাস্ট দেওয়া হয়েছে, অমলেট, ব্রেড আর কফি খাওয়া চলেছে সেই সঙ্গে গল্প। বেশীর ভাগ বন্ধু বান্ধব আজ কোথায় ছড়িয়ে ছিটকে গেছে। তাদের খবর আর পাওয়া বোধহয় সম্ভব নয়, তাছাড়া তাদের দুজনার বয়সও প্রায় পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই, কাজেই নিজের সংসার ছেড়ে নতুন করে পুরানো সহপাঠিদের খোঁজার সময় নেই। সময় বোধহয় এই রকমই, জীবনে নতুন অনেক কিছু দেয় কিন্তু পুরানো অনেক কিছু ভাসিয়ে নিয়েও যায়। কাবেরীর কথাটা অবশ্য ওরা দুজনেই কোথাও শুনেছে। ওর বোধহয় ওদের ব্যাচে সব থেকে ভাল বিয়ে হয়েছে। স্বামী হলিউডের মুভি প্রোডাকশান লাইনে আছে, দেদার পয়সা, এল. এ.-তে বেশ বড় বাংলোতে থাকে। কিন্তু কলকাতায় এলেই পুরনো যাদের সাথে যোগাযোগ আছে তাদের সবার সাথে কলকাতায় দেখা করতে যায়, ভীষণ সাধাসিধে স্বভাবের, একদম যাদবপুরের মতোই রয়ে গেল, আর হাজব্যান্ড ভাস্করও ভীষণ মজার লোক। কথার কোন শেষ নেই, বিশেষ করে দুই বন্ধুর যখন প্রায় বাইশ বছর পড়ে দেখা।

কিন্তু ট্রেন বেগে সামনের দিকে চলেছে, ঘড়ির কাঁটাও ঘুরে চলেছে। সময় কখনও থেমে থাকে না। কারো ভালো লাগালাগির ধার ধারে না।সময়ের কোন বন্ধু নেই, হয়তো কোন শত্রুও নেই। একটা সময় ঘড়ির কাঁটা বারোটার ঘরে পৌঁছাল। ওদের দুজনারহুঁশ ছিল না, কিন্তু গার্ড এসে লাঞ্চের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করল। ওদের মন আবার বাস্তবে ফিরে এল। আর মাত্র দুটি ঘণ্টা, তারপর মিতালী তার গন্তব্যস্থল নাগপুরে নেমে যাবে। ওদের দুজনের মনেই কোথায় একটা সুর বেজে উঠল, প্রায় একই সঙ্গে। লাঞ্চ আসার আগেই ওরা যা করার করল। সঙ্গে তো লেখার মত কিছু নেই, মিতালী একটা পুরনো সাদা খাম বার করল আর মধুমন্তী একটা শাড়ীর ব্রাউন পেপারের প্যাকেট। এই মুহুর্তে এর থেকে ভালো কিছু পাওয়া গেল না। একটা লেখার পেন অবশ্য দুজনার কাছেই ছিল, তাড়াতাড়ি করে দুজনে তাদের ঠিকানা আর মোবাইল নাম্বার এক্সচেঞ্জ করল। আবার কবে দেখা হয় কে জানে, আর দেখা নাও হতে পারে। এর মধ্যেই লাঞ্চ এসে গেল। ডিমের ঝোল আর ভাত।

খাওয়ার মধ্যেও কথার ছুটি নেই। ভাত আর তরকারি চিবুতে চিবুতেও সেই পুরনো হারিয়ে যাওয়া দিনগুলোর মধ্যে ওরা ভেসে যাচ্ছিল। কিন্তু খানিক পরেই গার্ড এসে জানিয়ে গেল যে গাড়ী রাইট টাইমেই আছে এবং আর আধ ঘন্টা বাদে নাগপুর এসে যাবে।

ব্যাস, দুজনার সব কথাই হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল। আর মাত্র তিরিশ মিনিট, ব্যাস, তারপর আবার দুজনে দুজনার ছোট্ট বৃত্তের মধ্যে হারিয়ে যাবে। সেই বর, বাচ্চা, শ্বশুর শাশুরী আর কিছু কাছের লোক, আর কেউ নেই। পুরনো দিনের কলেজের বন্ধু বান্ধবরা সেই বৃত্তের মধ্যে নেই। তারা যেন অন্য কোন প্ল্যানেটে বাস করে। এটা অনেকটা কসমিক তত্তের মতো, তাদের অস্তিত্ব জানা আছে কিন্তু বাস্তব জীবনে দেখাশোনার কোন উপায় নেই। ওরা ট্রেন প্রায় ঠিক টাইমেই নাগপুর স্টেশানে পৌঁছাল। ওরা দুজনেই তার আগেই পাশাপাশি বসেছিল।

সেই যাদবপুরেরই মতো, আরতীদির ক্লাস করার সময় যেমন বসতো। দুজনেরই মনে বরষার ঘন কাল মেঘ। চোখের কোনগুলোও যেন একটু ভিজে। গাড়ী থামার একটু আগেই মিতালী নামার দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে ছিল, পাশে তার প্রিয় বন্ধু মধুমন্তী। গাড়ী থামলে মধু ওর স্যুটকেস গুলো নামাতে সাহায্য করল। মিতালীর হাঁটুর অবস্থা এমনিতেই ভাল না। প্ল্যাটফর্মে নেমে মিতালী একটু সরে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল, দরজার সামনে মধুমন্তী। ওরা দুজনের দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করছিল যদিও ওদের মুখগুলো বড়ই করুণ দেখাচ্ছিল। চোখ দুটো ছলছল করছে।

মিনিট কয়েক পরে ট্রেনের বাইরে গার্ড সিটি দিল, মধুমন্তী হাত নেড়ে চিৎকার করল –

মধুমন্তী - 'মিতু, চিঠি দিস কিন্তু। মাঝে মাঝে ফোন করিস।'

মিতালী - 'দেব, দেব। তুইও ফোন করিস। নাম্বার আর ঠিকানাটা হারাস না যেন।'

মধুমন্তী - 'না না, আমার হ্যান্ড ব্যাগে রেখে দেব।'

গাড়ী আস্তে আস্তে প্ল্যাট ফর্ম ছাড়িয়ে এগিয়ে এল। মিতালী চিৎকার করে কি একটা বললো কিন্তু মধুমন্তী শুনতে পেল না। সে শুধু হাত নাড়লো। দূর থেকে মিতালীও হাত তুললো । তারপর গাড়ীটা একটা বাঁকে এসে গেল আর মিতালী আর স্টেশানটা কিছু বড় গাছ আর ঝোপের আড়ালে হারিয়ে গেল।

আনমনে মধুমন্তী নিজের সিটে এসে বসল। ট্রেন তখন আবার ফুল স্পীডে দৌড়চ্ছে। মিতালীর দেওয়া অ্যাড্রেস আর মোবাইল নাম্বার এখনো তার হাতে ধরা। সে আস্তে করে সেটা তার নিজস্ব হ্যান্ডব্যাগে ভরে রাখল।

তার মনটা একটা বিতৃষ্ণায় ভরে আছে। নিজের ওপরই একটা রাগ। এতদিন পরে তার কলেজের বন্ধু মিতালীর সাথে দেখা, কত ভালো লাগার কথা। ভালো তো লাগছিলও, কত কথা হল, কত পুরনো স্মৃতি, সেই সঙ্গে আবার সারা জীবনের যোগাযোগ রাখার সুযোগ, যে বন্ধুত্ব জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত থেকে যায়। কিন্তু যখন

অ্যাড্রেস লিখে দিল তখন মধুমন্তী তার কোয়ার্টার নাম্বারটা ভুল লিখল, তার মুম্বাইয়ের পুরনো কোয়ার্টার নাম্বার যা তার এখনকার বাড়ী থেকে অনেক দূরে, মুম্বাইয়ের সম্পূর্ন অন্য এরিয়ায়, ফোন নাম্বারটা দুটো নাম্বার ভুল লিখল যাতে মিতালী তাকে কোনদিন ফোন করতে না পারে। কিন্তু তার কি বা করার ছিল? তার জীবনে স্বাচ্ছন্দ এসেছে, তার বাড়ীতে দুটো গাড়ী, বেশ বড় সি ভিউ অ্যাপার্টমেন্ট, সেটাই কি সব? মদ্যপ হাসব্যান্ড, ছেলে মেয়ে দুটোর হাতে পয়সা মেয়ের নীরব কথোপকথন, এর মধ্যে হঠাৎ মিতালী এসে পরলে সে কি দেখবে? মধুমন্তী জানে তার বিয়ে নিয়ে বহু বন্ধুর মধ্যেই একটু জেলাসি ছিল কিন্তু এই তার পরিণতি? না, এটা তার পরাজয় আর মধুমন্তী তার জীবনের ট্র্যাজেডি সবার সামনে উজার করতে চায় না। মিতালী বড় মিষ্টি আর স্বচ্ছ মেয়ে, তাকে সব কিছু বলা যায় না। তার থেকে মিতালীর অ্যাড্রেস আর নাম্বারটা থাক, হয়তো কোনদিন সে ফোন করবে দুপুরের দিকে যখন বাড়ীটা একটু ফাঁকা থাকে। 

  স্টেশান থেকে বার হয়ে মিতালী একটা বাস স্টপে এসে দাঁড়াল। তার জার্নি এখনো অনেক দূর, বেশ কয়েক ঘন্টার। বাসে লাইনটা একটু বড় কিন্তু তাও মিনিট পাঁচেকের মধ্যে বাসে উঠে একটা জানলার পাশের সিট পেয়ে গেল। স্যুটকেস দুটো সিটের ওপরের লফটে তুলে দিয়ে বেশ হাত পা ছড়িয়ে বসল। বাইরের দিকে তাকাল, এখনো বেশ লম্বা লাইন। বাস ছাড়তে আরো মিনিট কুড়ি বাকি, তবে এই পথ তার ভীষণ চেনা কাজেই চিন্তার কিছু নেই। তার মধুমন্তীর কথা মনে পড়ল, কত সুখী মেয়ে, তার বহুদিনের প্রিয় বন্ধু। সেই বন্ধুকে সে তার জীবনের সব কিছু বলতে পারে নি। তার স্বামী ঘুষ খেয়ে ধরা পরেছিল, চাকরী চলে যায়, কোনক্রমে জেলে যেতে হয়নি। নতুন চাকরীতে গিয়েও তার স্বভাব পালটায় নি, অত্যন্ত নিম্ন মানের সন্দেহ জনক বন্ধুদের গ্রুপে থাকে। তাদের কাজকর্ম সম্পর্কে মিতালীর কোন শ্রদ্ধা নেই, কোথাও না কোথাও বাজে কাজকর্ম চলছে। টাকার কারবারও হয়ত আছে, সাইটে এই ব্যাপারগুলো থেকেই যায়। মিতালী মনে মনে জানে যে সে জীবনে হেরো, মধুমন্তীর কি সুন্দর পবিত্র মুখটার দিকে চেয়ে সে নিজের জীবনের সত্যি কথাগুলো বলতে পারে নি। সে মিষ্টি হেসে ঠিকানা আর ফোন নাম্বার লিখে দিয়েছিল।কিন্তু সেটাও সঠিক ছিল না। ঠিকানাটা পুরনো কোয়ার্টারের যেটা মিতালীরা প্রায় দেড় বছর আগে ছেড়ে নতুন সাইটে চলে এসেছে, মোবাইল নাম্বারটাও পুরনো সিমের যেটা ওরা আর ইউজ করে না। কাজেই মধুমন্তী সত্যি সত্যি চেষ্টা করলেও তার সাথে আর যোগাযোগ করতে পারবে না। মিতালী পুরনো বন্ধুর সাথে ছাত্র জীবনের গল্প করতে পারে কিন্তু মধুমন্তী যদি হঠাৎ এসে পরে আর তার জীবনের বর্তমান পরিস্থিতি দেখে সেটা সে সহ্য করতে পারবে না। আর মধুমন্তীরা পয়সাওয়ালা লোক, হঠাৎ এদিক সেদিক কোথাও বেড়াতে যাবার পথে চলেও আসতে পারে, সঙ্গে ফ্যামিলী কার তো থাকেই। তাই মিতালী সে পথ চিরদিনের মত বন্ধ করে দিয়েছে। এতক্ষণে অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে মধুমন্তীকে নিয়ে। সেই সঙ্গে বোধহয় এ জীবনের মত মিতালীর জীবন থেকে মধুমন্তী হারিয়েও গেল।

  জানলার কাচের ফাঁক দিয়ে একটু একটু হাওয়া মিতালীর গালে মুখে এসে লাগছিল, মুখের ঘামে সেই হাওয়া লেগে বেশ একটু ঠান্ডা লাগছিল। বেশ আরাম দায়ক অনুভূতি।কিন্তু তার মনের মধ্যে আগুন থামবার নয়।

মানুষ মাঝে মাঝে দ্বিতীয়বার সুযোগ পায়। মধুমন্তী আর মিতালীও কলেজ ছাড়ার বাইশ বছর পর একবার সুযোগ পেয়েছিল দুজনের জীবনকে কাছাকাছি আনার, বন্ধুত্বের শিকল দৃঢ় করার। কিন্তু জীবনের অদ্ভুত কিছু খেলায় দুজনেই মানসিক ভাবে হেরে যাওয়ায় ওরা আবার যা যার নিজের বৃত্তে ফিরে গেল। আবার কোনদিন দেখা হওয়ার কোন সুযোগ আসবে কিনা জানা নেই। ওরা যেন দুটো জীবন্ত ধূমকেতু, কোন দৈবিক নিয়মে কিছুক্ষণের জন্য কাছাকাছি এসেছিল, আবার যে যার নিজের পথে চলে গেল। দুজনের কাছেই রয়ে গেল নতুন কিছু স্মৃতি।

Comments

Top

ক্যাশ বাক্স  

সঞ্চিতা চৌধুরী

childhood1.jpeg
ক্যাশ বাক্স

রিমলির বাবার একটা ক্যাশবাক্স আছে। রিমলির খুব পছন্দ ওই ক্যাশবাক্সটা। ভাবে যে ওর কাছেও এমনি এক ক্যাশবাক্স থাকে। কী সুন্দর ক্যাশবাক্সটা - ভেতরে অনেক রকম মাপের খোপ খোপ করা আছে। বাইরেটা দারুন ভাবে কারুকাজ করা। রিমলির বাবা কাশ্মীর থেকে এনেছিলেন। পাইন কাঠের  ক্যাশবাক্স।

রিমলির বাবার কাশ্মীরে দোকান এবং হোটেল ছিল কাশ্মিরে যখন গন্ডগোল লাগল রিমলির বাবা পরিবার নিয়ে এই পশ্চিমবাংলার গ্রামে পৈত্রিক বাড়িতে চলে আসেন, সঙ্গে নিয়ে আসেন ওই ক্যাশবাক্স, রিমলি তখন অনেক ছোট।রিমলির কিছুই মনে নেই। রিমলি মা'র মুখে শুনেছে কাশ্মিরের গল্প। মা কাশ্মীরের গল্প করতে খুব ভালবাসেন। যখনই রিমলি গল্প শুনতে চায় মা কাশ্মীরের গল্প বলতে শুরু করেন, কেমন করে বাবা আর মা বিয়ের পরে কাশ্মীরে বেড়াতে গেছিলেন, বাবা কাশ্মীরের সৌন্দর্য দেখে অভিভূত হয়ে থেকে যান কাশ্মীরে। বাড়ি কেনেন এক পাহাড়ি বন্ধুর সাহায্য নিয়ে। পশ্চিমবাংলার শিক্ষকতার চাকরি ছেড়ে দিয়ে কাশ্মীরে ছোট হোটেল এবং দোকানের ব্যবসা ফেঁদে বসেন।

পাহাড়ের নীচে ঢালু জমিতে ছিল ওদের বাড়ি, মা বাবা মিলে ছাগল, মুরগি পুষতেন, বাড়ির সামনে ছোট জমিতে মরশুমি সব্জি ফলাতেন। খুব ঠাণ্ডার সময় আগুন জ্বালিয়ে উত্তাপ নিতেন বাবার পাহাড়ি বন্ধুরা মিলে - এইসব গল্প করতে করতে মা স্মৃতিমেদুর হতেন, মা’য়ের স্বপ্নিল চোখ যেন কাশ্মীরের উঁচুনিচু পাহাড়ি পাকদণ্ডী ধরে ঘুরে বেড়াত। পশ্চিমবাংলার গ্রামে বসে গ্রীষ্মের কাঠফাটা দুপুরে, গল্প শুনতে শুনতে রিমলির চোখের সামনেও যেন ঠাণ্ডা পাহাড়ি কাশ্মীরের ছবি ফুটে উঠত।

রিমলি এখানে এসে নতুন স্কুলে ভর্তি হল। গ্রামের স্কুল, বেশ দূরে। বাবা বলেছেন একটা সাইকেল কিনে দেবেন - নতুন দোকানটা একটু সুন্দর করে গুছিয়ে নেওয়ার পরে।

বাবা এখানে এসে একটা মনিহারী দোকান খুলেছেন, খুব বেশি জিনিষ নেই দোকানে, আসলে বাবার মূলধনও তো কম, তবে ধীরে ধীরে দোকানে জিনিষ আনবেন বাবা। সবে তো এসেছেন, সময় লাগবে দোকান ভরে উঠতে।

রিমলি স্কুল থেকে ফিরে বাবাকে হাতে হাতে সাহায্য করে। রিমলির খুব ভালো লাগে বাবাকে সাহায্য করতে।

সেদিন বাবা রিমলিকে বললেন যে মা হসপিটাল গেছেন একটা ছোট ভাই কিনে আনতে, শুনে রিমলি খুব খুশি হল, সত্যি তো রিমলির খেলার সঙ্গী নেই, অনেকদিন ধরেই মাকে বলছিল একটা ভাই কিনে আনতে, আজ মা কথা রেখেছেন। উফ্‌, মা যে কি ভাল। খুশিতে রিমলি দু-পাক নেচে নিল ঘুরে ঘুরে, আর ভাইকে নিয়ে কি কি খেলবে তার ফর্দ করতে লাগল।

মা ভাইকে নিয়ে যখন এলেন, রিমলি খুব হতাশ হল, আরে এত ছোট্ট! শুধু ঘুমচ্ছে আর ঘুমের মধ্যে মুচকি মুচকি হাসছে, একে নিয়ে আর কিই বা খেলা যাবে! বাবা অবশ্য বলেছেন কিছুদিনের মধ্যে খেলার উপযোগী হয়ে উঠবে, ঠিক আছে রিমলি অপেক্ষা করবে, তবে একটু ছুঁয়ে নেড়ে তো দেখাই যায়  ভাইয়ের ছোট ছোট হাত পা দেখে রিমলির হাসি পায়।

ইতিমধ্যে রিমলির নতুন সাইকেলও চলে এসেছে।  এখন রিমলির খুশির সীমানা নেই। স্কুল থেকে ফিরেই কিছু খেয়ে নিয়ে সাইকেল শিখতে হয়। সাইকেলটা বড়, হাফ প্যাডেল করে করে চালাতে হয়। বাবা বলেছেন আগে ব্যালেন্স করা শিখতে। কতবার যে সাইকেল থেকে পড়ে গিয়ে হাত পা কেটে  গেছে তার ইয়ত্তা নেই, তবু রিমলি দমে নি।বাবা রিমলির সাইকেল শেখার মনোযোগ দেখে মুচকি হাসেন। রিমলি বাবাকে খুব ভালোবাসে আবার ভয়ও পায়। বাবার 

হাসিমুখ দেখে রিমলির উৎসাহ আরও বেড়ে যায়। বাবাকে খুশি করতে রিমলি যা খুশি করতে পারে। রিমলির মনে হয় বাবা বুঝি পৃথিবীর সবচেয়ে বড়, ভালো, সুন্দর মানুষ। রিমলির বাবা প্রায় ছয় ফুট লম্বা, বড় বড় চোখ, গম্ভীর গলার আওয়াজ, হাসলে দাঁতের সুন্দর সাজানো সারি দেখা যায়। রিমলিরও দাঁতের পাটি বাবার মতই সাজানো।বাবার দোকান এখন খুব সুন্দর হয়ে গেছে, অনেক জিনিষ এসেছে দোকানে। ভাই বড় হয়ে গেছে, হামাগুড়ি দিচ্ছে, ছোট্ট দুটো দাঁত বেড়িয়েছে, যা হাতের কাছে পাচ্ছে তাতেই একবার করে কামড় বসাচ্ছে। রিমলির স্কুলের বন্ধুরা ভাইকে দেখতে চেয়েছিল, রিমলি ওদের নিয়ে এসে ভাইকে দেখিয়েছে। ভাই সবাইকে চিমটি কেটে দিয়েছিল, ওরা ভাইয়ের কাণ্ড দেখে খিল খিল করে হেসেছে। বন্ধুদের ভাইকে দেখাতে পেরে রিমলির গর্বে বুক ফুলে গেছিল। বাবা নিজের দোকান থেকে বন্ধুদের সবাইকে চকোলেটদিয়েছিলেন। ক্লাস সিক্সে রিমলি স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম হলে বাবা টাকা দিয়েছিলেন নিজের ইচ্ছেমত গল্পের বই কেনার। রিমলি মা আর ভাইয়ের সঙ্গে গিয়ে শহর থেকে কিনে এনেছিল লীলা মজুমদারের দশটা বড় গল্পের সংকলন ‘দশ দিগন্ত’।

রিমলির জীবন সমস্ত আনন্দে কানায় কানায় পুর্ণ ছিল, সময় বয়ে চলছিল মন্দাক্রান্তা ছন্দে।

ধীরে ধীরে রিমলির মাধ্যমিক পরীক্ষা চলে এল। রিমলির ভাইও অনেক বড় হয়ে গেছে, স্কুলে গিয়ে বেশ দুষ্টুমি করা শিখেছে। রিমলি পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে এখন আর ভাইয়ের সঙ্গে খেলার সময় পায় না, তবে ভাই কে পড়াতে বেশ লাগে রিমলির, কেমন যেন একটা দিদিমণি ভাব জাগে মনে।

রিমলিদের বাড়িতে সন্ধ্যে হতে না হতেই রাতের খাওয়া দাওয়া শেষ হয়ে যায় তারপর বাবা দোকানের হিসাব পত্র নিয়ে বসেন বসার ঘরে, মা বোনা নিয়ে বসেন, রিমলি নিজের ঘরে বসে ক্লাসের পড়াশুনা নিয়ে, ভাই সারাদিনের দুষ্টুমির পরে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।

কিছুদিন ধরে রিমলির আবার অভ্যাস হয়েছে রাত জেগে পড়ার, বন্ধুদের মুখে শুনেছে ওরা রাত জেগে পড়ে তাই রিমলিও শুরু করেছে।

শীতের সন্ধ্যে, রিমলিদের খাওয়া দাওয়া হয়ে গেছে, যে যার নিজের কাজে ব্যস্ত। রাত প্রায় সাড়ে বারটা, মা রিমলির পড়ার ঘরে উঁকি মেরে দেখলেন রিমলি টেবিলে ঝুকে বই পড়ছে।

এগিয়ে এসে মা রিমলির কাঁধে হাত রেখে বললেন, 'যা মা, ঘুমতে যা, অনেক রাত হয়েছে।' রিমলি বলল, 'যাচ্ছি।' মা চিন্তিত সুরে বললেন, 'রিমলি, দেখ না, বাবা কেমন করছে, কেমন যেন টলতে টলতে বিছানার দিকে গেল। কিছুই বুঝতে পারছি না।'

রিমলি মায়ের কথা কিছু বুঝল না, আলো নিবিয়ে শুতে গেল।

সকালে মায়ের উৎকণ্ঠিত চিৎকারে ঘুম ভাঙ্গল, 'রিমলি রিমলি, ওঠ্‌ ওঠ্‌। আয় এদিকে।' ঘুমচোখে উঠে মায়ের চিৎকারের উৎস বুঝে উঠতে সময় লাগল কয়েক সেকেন্ড। মায়ের চিৎকার আসছে বাথরুম থেকে, কিছু বুঝতে না পেরে রিমলি দৌড়ে গেল বাথরুমের দিকে, মায়ের কাছে।

বাবা বাথরুমে পরে আছেন হাঁটু মুড়ে, মা কোনরকমে ধরে আছেন বাবাকে তোলার চেষ্টা করছেন, বাবার মুখ দিয়ে কোন আওয়াজ আসছে না, চোখ আধবোজা। রিমলি তাড়াতাড়ি গিয়ে বাবাকে ধরল। বাবাও অর্ধ অচেতন অবস্থায় আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন ওঠার, তাই দুজনে মিলে কোনরকমে ধরাধরি করে বিছানায় আনতে পারল বাবাকে। মা রিমলিকে বললেন, 'সাইকেলটা নিয়ে এক্ষুনি যা, ডাক্তারবাবুকে ডেকে নিয়ে আয়, আর শিবুকে খবর দে।' শিবু বাবার দোকানে কাজ করে, কিছুদিন হল নতুন এসেছে, খুব ভাল কাজের ছেলে। রিমলি যন্ত্রের মত সাইকেল বের করে প্রথমে ডাক্তারবাবুকে ডেকে পরে শিবুকে খবর দিতে গেল।

ডাক্তার এবং শিবু দুজনেই খবর শোনা মাত্র দেরী না করে পৌঁছে গেল রিমলিদের বাড়ি।

ডাক্তারবাবু বাবাকে দেখলেন, ছোট হাতুড়ি দিয়ে হাঁটুতে মেরে মেরে সচেতনতা পরীক্ষা করলেন, বললেন, 'মনে হচ্ছে সেরিব্রাল হেমারেজ, এক্ষুনি হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে।' শিবু সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির বন্দোবস্ত করে বাবাকে নিয়ে গেল হসপিটালে সঙ্গে গেল মা। রিমলি রয়ে গেল বাড়িতে ভাইকে নিয়ে।

বাবাকে হসপিটালে ভর্তি করে মা ফিরে এসে রিমলি আর ভাইকে নিয়ে গেল।

হসপিটালে বাবাকে রিমলি দেখল, অক্সিজেন, স্যালাইন ইত্যাদির আড়ালে বাবাকে যেন অচেনা মনে হচ্ছিল।

নার্স এসে বললেন বাবার পোশাকটা পাল্টাতে হবে, ঘামে ভিজে গেছে। মা, শিবু আর দুজন নার্স মিলে বাবাকে ঘিরে পোশাক পাল্টাচ্ছিলেন, রিমলি কেবিনের দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে করুণ ভাবে দাঁড়িয়েছিল, বাবাকে দেখা যাচ্ছিল না ওরা আড়াল করে রেখেছিল বাবাকে, হঠাৎ বাবা চোখ খোলে আর বাঁ হাত দিয়ে অক্সিজেন, স্যালাইন খুলে ফেলতে চায়, হাতের ধাক্কা দিয়ে ওদের সরিয়ে দেয়, মুহুর্তের জন্যে ওরা একটু সরে যায়, ওদের শরীরের ফাঁকদিয়ে বাবার দৃষ্টি গিয়ে পড়ে রিমলির করুণ মুখে। বাবার সঙ্গে রিমলির চোখাচোখি হয়, বাবা চোখ নাচিয়ে যেন প্রশ্ন করেন, কি ব্যাপার, এত করুণ কেন মামনি, কি হয়েছে, সবার চোখের আড়ালে হয়ে যায়, কারণ ওরা ব্যস্ত পুনরায় অক্সিজেন, স্যালাইন লাগানোতে। বাবা আবার অচেতন হয়ে পড়েন।

পুরো একদিন কেটে যাওয়ার পরেও বাবার শরীরের কোন উন্নতি না হওয়াতে ডাক্তার বললেন, শহরের বড় হসপিটালে নিয়ে যেতে। বড় হসপিটালের ডাক্তাররা বললেন, ‘চব্বিশ ঘণ্টা না কাটলে কিছুই বলা যাবে না।’ মা শুরু থেকেই দিন রাত বাবার কাছেই থাকছেন, মা রিমলিকে শহরের বড় হসপিটালে নিয়ে যান নি, ভাইয়ের কাছে থাকতে বলেছিলেন। শিবুর মা রিমলিদের সঙ্গে এসে থাকছিলেন।

পরের দিন মা আর শিবু ফিরে এল বাবার মৃতদেহ নিয়ে, ডাক্তারদের কথামতো চব্বিশ ঘণ্টা কাটার ঠিক এক ঘণ্টা  আগে বাবা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বাবা নীরবে চলে গেলেন, কোন কথা বলতে পারেন নি।

অসময়ের মৃত্যু বুঝি বা এমনি নীরবে আসে, জীবনের পরিপুর্ণতার কোন পরোয়া না করে। সব কাজ, অকাজ, স্বপ্ন, বাস্তব, আশা, আকাঙ্খাকে মুলতুবি রেখে হাত ধরতে হয় মৃত্যুর। শূন্য থেকে এসে শূন্যে মিলিয়ে যাওয়া, এই হয়ত জীবনের পরিণতি।

প্রত্যেক মৃত্যুই এক দর্শনের জন্ম দেয় - জীবনদর্শন। বাবার মৃত্যু রিমলির জীবনে কি দর্শনের জন্ম দিল কে জানে, তবে মা বোবা হয়ে গেছেন, ভাই তো এতো ছোট যে কিছুর মানেই বুঝতে পারছে না, রিমলিকে জিঙ্গেস করছে, “দিদি, বাবা কোথায় রে?” রিমলি কোন জবাব দিতে পারে না, শুধু জলভরা চোখে ভাইকে জড়িয়ে ধরে, এক বিরাট শূন্যতা ঘিরে ধরে।

বর্তমান জীবনের চাহিদা এত তীব্র যে মানুষকে সমস্ত শোকের উপরে প্রলেপ লাগাতে বাধ্য করে।

দুই সপ্তাহ পরে রিমলিকে শিবুর সাহায্যে বাবার দোকানের এবং ক্যাশবাক্সের দায়িত্ব নিতে হল, মা এখনও শোক কাটিয়ে উঠতে পারেন নি। রিমলি এখন বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না যে বাবা নেই, মনে হচ্ছে এই তো কোথাও বেড়াতে গেছেন, চারিদিকে বাবা থাকার নিদর্শন ছড়িয়ে আছে, বাবার ব্যবহারের দাড়ি কামাবার রেজার, ছোট আয়না, পাজামা, কুর্তা, চশমা, ঘড়ি, বাবার লেখা হিসাবের খাতা সবকিছু যেমনকার তেমনি পড়ে আছে শুধু মানুষটা নেই। রিমলির বুকটা দুঃখে মুচড়ে ওঠে, ক্যাশবাক্সের দিকে তাকিয়ে চোখ ঝাপসা হয়।

দোকানে খদ্দের আসতে শুরু হলে দ্রুত হাত চালিয়ে জিনিষ পত্র মেপে দিতে হয় রিমলিকে, সমস্ত হিসাব বুঝে নিতে হয় পাই পাই করে, ঐ সুন্দর ক্যাশবাক্সের মালিকানার যে এত কঠিন দায়ভার, এত পরিশ্রম তা ছোট রিমলি জানত না। রিমলি চেয়েছিল ঐ রকম ক্যাশবাক্স, কিন্তু এইভাবে চায় নি।

জীবন থেমে থাকে না, শত ব্যাথা, বেদনা, কষ্ট, শোক বুকে নিয়ে জীবন চলেছে তার পরিণতির দিকে,পূর্ণতার দিকে। মা এখন দোকানের দ্বায়িত্ব নিয়েছেন, মা চান রিমলি পড়াশুনা করে বড় হোক, রিমলিও তাই চায়।

ধাপে ধাপে সিঁড়ি চড়তে চড়তে রিমলি আজ জীবনের মধ্য বেলায়। রিমলি আজ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইনান্সিয়াল কনসালটেন্ট, আজ রিমলি আরও বড় ক্যাশবাক্স সামলায়। বাবার পাইন কাঠের ক্যাশবাক্স আজও রিমলির কাছে সযত্নে রাখা আছে বাবার স্মৃতি হিসাবে।

জীবনের পথে চলতে চলতে রিমলি বুঝেছে বৃহত্তর ক্ষেত্রে সারাটা পৃথিবী ক্যাশবাক্সের পেছনে ছুটছে, কেউ  ছোট ক্যাশবাক্সের পেছনে কেউ বা বড় ক্যাশবাক্সের পেছনে, সবাই চায় নানান মাপের ক্যাশবাক্সের মালিকানা, এবং পেয়েও যায় তবে কি মূল্যে তা পাওয়া হল তার হিসাব অনেকেই রাখে না। রিমলিও চেয়েছিল, তবে রিমলি ভাবে তার কাছে ক্যাশবাক্সের মূল্যটা যেন খুব বেশি হয়ে গেল, এত বেশি মূল্য দিয়ে তো রিমলি চায় নি ক্যাশবাক্সটা।

হয়তো কোন কোন জিনিষের মূল্য তার আসল দামের চেয়েও অনেক বেশি অথবা অমূল্য।

Comments

Top

চিত্ত বিনোদন

অদিতি ভট্টাচার্য্য

kolkatas6.jpg
চিত্ত বিনোদন

 ‘ইস্ একটুর জন্যে মিস্ট্রি এগটা হাতছাড়া হয়ে গেল, সবাই একেবারে তক্কে তক্কে থাকে দেখছি। পাবলিশ হতে না হতেই ঝাঁপিয়ে পড়ে’ নিজের মনেই বললেন সোনালী। বলেই আবার নিজের ছেলে-মানুষীর কথা ভেবে হেসেও ফেললেন।

-  ‘না এবার ল্যাপটপটা বন্ধ করি, কোমরটা ব্যথা করছে, একটু শুতে হবে' ল্যাপটপ অফ করে শুয়ে পড়লেন সোনালী। শুয়ে শুয়ে কত কথা মনে পড়তে লাগল, ‘বুড়ো বয়েসের এই এক দোষ, খালি পুরোনো কথা মনে আসে,’ ভাবলেন তিনি।

তবে এই ল্যাপটপ আর ইন্টারনেট তাঁকে নিঃসঙ্গতা থেকে মুক্তি দিয়েছে তা স্বীকার করেন তিনি, তা নইলে একা ফ্ল্যাটে সময় কাটতে চাইত না। দেখেন তো অনেককে। ল্যাপটপটা তাঁর মেয়ে সর্বাণীর কিনে দেওয়া। সে আর তার হাজব্যাণ্ড দুজনেই শিকাগোর একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করে। যমজ ছেলে মেয়ে নিয়ে বহুদিন থেকেই ওখানে সেটল্ড। ডেস্কটপ একটা সোনালীর ফ্ল্যাটে আগেও ছিল, তাঁর হাজব্যাণ্ড সমরেশ কিনেছিলেন। মেয়ের পাঠানোই মেইলও পড়া যেত, ইন্টারনেটে অনেক কিছু করাও যেত। তিনিই সোনালীকে কম্পিউটার হ্যাণ্ডল করা শিখিয়েছিলেন, ই মেইল পাঠানো, চ্যাট করা, কথা বলা সব কিছু। কিন্তু তিনি হঠাৎ মারা যেতে এসবে ভাঁটা পরে গেল, ডেস্কটপটাও গোলমাল শুরু করল।

এরপর সর্বাণী একরকম জোর করেই মাকে শিকাগো নিয়ে গেল ওখানে থাকবার জন্যে। কিন্তু সোনালীর কেন জানি না ওখানে থাকতে ভাল লাগত না, খুব একাকীত্বে ভুগতেন। এর আগেও সমরেশের সঙ্গে এসেছেন, কিন্তু দু তিন মাসের বেশী থাকতে পারেন নি। তাও তখন সমরেশ সঙ্গে থাকতেন, কিন্তু এখন তো মেয়ে, জামাই, নাতি, নাতনী বেরিয়ে গেলেই পুরো অ্যাপার্টমেন্টে একা হয়ে যান, কথা বলারও কেউ নেই।

শেষ পর্য্যন্ত তিনি যখন আর ওখানে থাকতেই চাইলেন না তখন সর্বাণী এই ল্যাপটপটা কিনে আনল আর তাঁর দুই নাতি নাতনী পিকু আর পিয়া মহা উৎসাহে দিম্মাকে আবার সব কিছু নতুন করে শেখাতে বসল। নিজের মেইল চেক করা থেকে নেট সার্চ করা কিছুই বাদ গেল না। দিম্মারও শেখার উৎসাহ বরাবরই আছে তাই পিকু পিয়ার কাছ থেকে আনেক কিছু শেখা হয়ে গেল।

কলকাতায় ফিরে আসার পর ল্যাপটপ নিয়ে আরো বেশী সময় কাটাতে লাগলেন। তাঁর প্রতিবেশী বন্ধুরা তাঁর উৎসাহ দেখে বলেছিল, ‘নতুন খেলনা তো, প্রথম প্রথম উৎসাহ থাকবে, কদিন যাক, আর ভাল লাগবে না।’

কিন্তু বাস্তবে তার উল্টো হল। সোনালী ইন্টারনেটে এটা সেটা খুঁজতে লাগলেন। একদিন ফেসবুকের সন্ধান পেলেন, নামটা শোনা ছিল নাতি নাতনীর কাছ থেকে, ভাসা ভাসা কিছু ধারণাও ছিল। সাহস করে সোনালী বন্দ্যোপাধ্যায় নামে অ্যাকাউন্ট খুলে ফেললেন। প্রথম প্রথম যেন থই পেতেন না, কি করবেন, কোথায় ক্লিক করবেন, কোথায় করবেন না। এই করতে করতে একদিন ফার্মভিল খেলা শুরু। শুরুতে ঠিকঠাক ম্যানেজ করতে পারতেন না, মাউসও বাগ মানত না, কিন্তু হাল ছাড়েন নি। এইসব কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে চোখ লেগে এসেছিল বুঝতেও পারেন নি। ঘুম ভাঙল কাজের মেয়ে কল্পনার ডাকে। সে বিকালের চা তৈরী করে ডাকছে।চা খেতে খেতেই তাঁর বন্ধু মিসেস দত্ত এসে গেলেন।

- ‘কি ব্যাপার, আপনার তো আর দেখাই পাওয়া যায় না, শরীর টরীর ঠিক আছে তো?’ জানতে চাইলেন মিসেস দত্ত।

‘- হ্যাঁ হ্যাঁ সব ঠিক আছে। আসলে আর বেরোনো হচ্ছে না। এই বই, টিভি, ইন্টারনেট এইসব নিয়েই সময় কেটে যাচ্ছে।’

- ‘ও সেই ল্যাপটপ নিয়েই পড়ে আছেন এখনো? কি করেন আপনি ইন্টারনেটে? ভাল লাগে এসব আপনার এই বয়েসে?’

- ‘না,না ইন্টারনেটে অনেক কিছু জানা যায় জানেন তো? কত রকম রান্নার রেসিপি, ঘর সংসারের দরকারী কাজের কথা।’

- ‘হ্যাঁ দিদা তো এখন ওই কম্পিউটার দেখে উমাদিকে রান্না করতে বলে, ওতে নাকি সব লেখা আছে, ’ কল্পনা চা, বিস্কুট, চিপস্ নিয়ে এসেছিল, সেও কথায় যোগ দেয়।

- ‘ধন্যি মানুষ বটে আপনি। বুড়ো বয়েসে যে কেউ এসব নিয়ে পড়ে থাকতে পারে তা বাপু জানতাম না। যাক্ গে বলতেই ভুলে যাচ্ছিলাম, সরমাদির ছেলে বউ অন্য ফ্ল্যাটে চলে গেল, জানেন তো? সরমাদি একাই থাকছেন, অসুস্থ মানুষ, ভাবছেন ওল্ড এজ হোমে চলে যাবেন,’ মিসেস দত্ত কথা শেষ করে পট্যাটো চিপস্ মুখে দিলেন।

সেই চিপস্ দেখে সোনালীর খেয়াল হল যে তিনি ফার্মে আলু লাগিয়েছিলেন, তুলতেই ভুলে গেছেন, নষ্ট না হয়ে যায়। মনে পড়া মাত্রই তাঁর উশখুশানি শুরু হল। কিন্তু মুখে কিছু বলতেও পারছেন না, মিসেস দত্তর কথায় হুঁ হাঁ করে যাচ্ছেন। অবশেষে আশেপাশের প্রতিবেশীদের সব খবর জানিয়ে, নিজের শরীরের খবর, নিজের স্বামী, ছেলে মেয়েদের খবরাখবর সব দিয়ে দেড় ঘন্টা পরে মিসেস দত্ত বিদায় নিলেন।

তিনি ওঠা মাত্রই কল্পনা বলে উঠল, ‘আমি কিন্তু এখন কাজলনয়না দেখব। কাল রাতে দেখা হয় নি, এখন রিপিট হবে।’

- ‘হ্যাঁ হ্যাঁ তুই দেখ,’ সোনালী নিজের বেডরুমের দিকে রওনা দিলেন।

- ‘তুমি কি এখন আবার ওই কম্পিউটার নিয়ে বসবে? কি যে কর বাবা বুঝি না। ভালোও লাগে তোমার ঘরে বসে খালি কম্পিউটার করতে নয় বই পড়তে,’ কল্পনা নিজের মনেই গজ গজ করতে থাকে। সোনালী কোন দিকে কান না দিয়ে ল্যাপটপ খুলে ফেসবুকে লগ ইন করলেন। করতেই দেখলেন যে বারবারা তাঁকে মেসেজ দিয়েছেন যে তাঁর ফসল নষ্ট হতে শুরু করছিল, তিনি আনউইদার করে দিয়েছেন। সোনালী তাড়াতাড়ি নিজের ফার্মে গিয়ে সব আলু হারভেস্ট করে সোনালী কোনোদিকে কান না দিয়ে ল্যাপটপ খুলে ফেসবুকে লগ ইন করলেন। করতেই দেখলেন যে বারবারা তাঁকে মেসেজ দিয়েছেন যে তাঁর ফসল নষ্ট হতে শুরু করছিল, তিনি আনউইদার করে দিয়েছেন। সোনালী তাড়াতাড়ি নিজের ফার্মে গিয়ে সব আলু হারভেস্ট করে ফেললেন। তারপর ফাঁকা প্লটে সোয়াবিন লাগিয়ে বারবারাকে একটা থ্যাংক ইউ মেসেজ পাঠালেন। বারবারা ফার্মভিলে তাঁর নেবার, ইংল্যাণ্ডে থাকেন, তাঁর চেয়েও বছর দুয়েকের বড়। সোনালীর আনেক নেবারই সোনালীর সমবয়স্ক বা বড়। সত্যি কথা বলতে সোনালী এদের দেখেই উৎসাহ পান। এরা যদি খেলতে পারে তিনি নয় কেন?

খেলতে খেলতে এ সব ভাবতে ভাবতেই দেখলেন এমিলি অনলাইন আছেন, চ্যাট করতে চান। সোনালী এখন আস্তে আস্তে এসবে অভ্যস্ত হচ্ছেন।

- ‘হাই, হাও আর ইউ?’ চ্যাট উইনডোতে এমিলির মেসেজ ফুটে উঠল।

- ‘আই অ্যাম ফাইন, থ্যাংকস্।’

- ‘ডু ইউ নীড এনি গিফট? টেল মি।’

- ‘ক্যান ইউ সেন্ড মি আ স্যাডল্? আই নীড টু কমপ্লিট দ্য প্যাডক।’ 

- ‘ও সিওর, এনিথিং এলস্? লেট মি নো।’

- ‘নো, নট নাও, থ্যাংকস্। এমিলি, ডু ইয়োর ফ্যামিলি মেমবারস নো দ্যাট ইউ প্লে?’

- ‘ইয়া মাই হাজব্যাণ্ড, সান, ডটার, ইভেন মাই লিটিল গ্র্যাণ্ড ডটার নো দ্যাইট আই অ্যাম অ্যাডিক্টেড টু ইট। নাও মাই লাইফ রিভলভস অ্যারাউণ্ড ফার্মভিল। বাট হোয়াই?’

- ‘উই আর ওল্ড এনাফ, স্টিল উই প্লে………’

- ‘সো হোয়াট? দেয়ার ইজ নো রুল দ্যাট ওল্ড পিপল কান্ট প্লে। ইউ আর নট মার্ডারিং পিপল হানি, ইউ আর ওনলি প্লেইং গেমস। ডোন্ট থিংক অ্যাবাউট আদারস, ডু হোয়াট ইউ লাইক।’

- ‘ইয়েস ইউ আর রাইট।’

- ‘আই অ্যাম রেইসিং দ্য বার্ন, প্লীজ হেল্প। আই হ্যাভ পোস্টেড ইট অন মাই ওয়াল।’

- ‘আই উইল।’

‘থ্যাংকস্। আইহ্যাভ টু লীভ নাও, সি ইউ লেটার, বাই।’

‘বাই’

এমিলি অফ লাইন হয়ে গেলেন। সোনালী ভাবলেন সত্যিই তো তিনি তো কোনো অন্যায় কাজ করছেন না। তাহলে কেন তিনি  তিনি তাঁর এই খেলা প্রীতির কথা বলতে লজ্জা পান? এমিলি কত সহজে বলে দিল, ‘ডু হোয়াট ইউ লাইক।’ কিন্তু তিনি এটাও জানেন এখানকার লোকেদের মানসিকতাই আলাদা, তিনি কখনোই কাউকে একথা বলতে পারবেন না। যাক্ গে, কাউকে বলতে না পারলেও নিজেতো খেলতে পারবেন, সময়ও বেশ ভাল কেটে যায়, এই যথেষ্ট।সোনালী আবার খেলায় মগ্ন হয়ে গেলেন। অর্চার্ডের জন্যে আরো ছ’টা ব্রিক আর তিনটে নেইল লাগবে। এসব করতে করতেই সারা সন্ধে কেটে গেল।

কল্পনা এসে ডাকল, ‘এবার তোমার এ সব বন্ধ করে খেতে এস দিদা। তোমায় খেতে দিয়ে আমি খুন কা রিস্তা দেখব, সাড়ে ন’টায় শুরু হবে।’

সোনালী তাড়াতাড়ি ল্যাপটপ বন্ধ কতে খেতে উঠে গেলেন।খুন কা রিস্তার একটা সিনও মিস হলে কল্পনার মুড অফ হয়ে যাবে। খেতে খেতে সোনালীর মনে হল মিসেস দত্তকে ফার্মভিলের কথা বললে ওনার কি প্রতিক্রিয়া হবে। ভাবতে গিয়ে নিজেই হেসে ফেললেন। ভাগ্যিস কল্পনা দেখে নি, সে খুন কা রিস্তায় মগ্ন।

পরের দিন সকালবেলায় সোনালী ডাইনিং টেবিলে বসে জলখাবার খাচ্ছেন, কানে এল উমা আর কল্পনার কথা।রান্নাঘরে দুজনের জোর গল্প চলছে, কোন সিরিয়ালে শাশুড়ি তার ছেলের বউ-এর রান্না করা তরকারীতে একগাদা নুন মিশিয়ে দিয়েছে।

- ‘এসব করেছে মুস্কানকে নীচা দেখাবার জন্যে,’ কল্পনার মন্তব্য।

আগে এসব কথা শুনে সোনালী অবাক হতেন, এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছেন।

- ‘এই নাও তোমার চা,’ উমা চা নিয়ে এসে ডাইনিং টেবিলে রাখল।

- ‘হ্যাঁ রে তোরা যে এইসব সিরিয়াল দেখিস, কে কার রান্নায় নুন মিশিয়ে দিয়েছে জব্দ করার জন্যে এসব তোদের ভালো লাগে দেখতে?’ সোনালী আর না জিজ্ঞেস করে থাকতে পারলেননা। ‘ভালো লাগে না মানে? সিরিয়াল দেখতে ভালো লাগবে না? শুধু তোমারই এক দেখি ভালো লাগে না।’

- ‘হ্যাঁ রে তোর ছেলে মেয়ে দুটো তো দু দিন ধরে পড়তে আসছে না। কি ব্যাপার? স্কুলেও যাচ্ছে না?’ চা-এ চুমুক দিয়ে সোনালী জানতে চাইলেন।

উমার ছোট ছোট ছেলে মেয়ে দুটোকে তিনি পড়ান। একজন ক্লাস টু আর একজন কেজি ওয়ানে পড়ে।

- ‘পাশের বাড়িতে বিয়ে আছে, সেখানেই পড়ে আছে।কোনরকম ধরে বেঁধে ইস্কুলে পাঠাচ্ছি,’ উমা বলল।

ব্রেকফাস্ট শেষ করে উঠতে না উঠতেই মিসেস দত্তর ফোন এল যে আজ বিকেলে মিসেস সেনের ফ্ল্যাটে বৈকালিক আড্ডা বসবে। শুনেই সোনালীর যেটা প্রথম মনে হল সেটা হল সাড়ে ছ’টায় সোয়াবিন হারভেস্ট করার টাইম। তার মানে সাতটা সাড়ে সাতটার মধ্যে বাড়ি ফিরতে হবে।ব্রেকফাস্ট খেয়ে খবরের কাগজে চোখ বুলিয়ে তিনি ল্যাপটপ নিয়ে বসলেন খেলার জন্যে। দেখলেন গিফট বক্সে যা যা জমা হয়েছে তাতে প্যাডকটা কমপ্লিট হয়ে যায়। তিনি প্রথমেই তাই সেটা কমপ্লিট করে তার মধ্যে গোটা ছ’য়েক ঘোড়া ঢুকিয়ে দিলেন।খেলতে খেলতে নেবারদের সঙ্গে টুকটাক চ্যাটিংও চলছে।সোনালীর সব নেবারই যে বয়স্ক তা নয়,কিছু অল্প বয়সী ভারতীয়ও আছে। অল্প বয়সী মানে বাইশ তেইশ যমন আছে তেমন ত্রিশ একত্রিশও আছে। তাদেরই একজন রূপমের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। রূপম সোনালীকে মডার্ণ দিদা বলে ডাকে। সেই থেকে সোনালী তাঁর অল্প বয়সী নেবারদের মধ্যে এই নামেই পরিচিত এবং জনপ্রিয়ও বটে। তাঁর এই খেলা প্রীতির জন্যে তাঁকে এরা খুব ভালোবাসে। তিনি কিছু বুঝতে না পারলে যথেষ্ট হেল্পও করে, আবার নিজেদের অনেক কথা তাঁর সঙ্গে শেয়ারও করে।

- ‘তুমি তো দেখছি প্যাডক কমপ্লিট করে ফেলেছ।’

- হ্যাঁ, এই মাত্র করলাম।’

- ‘চলো আমি তোমাকে একটা ঘোড়া গিফট পাঠাচ্ছি।’

- ‘শুনতে বেশ লাগছে, ঘোড়া গিফট।’

- ‘এখানে তুমি হাতী, ঘোড়া সব পেতে পারো।’

- ‘সত্যি সত্যি তো আর কোনোদিন নিজের এরকম ফার্ম হবে না, তাই খেলেই দিব্যি শখ মেটাচ্ছি।’

- ‘এক্স্যাক্টলি। একদম ঠিক বলেছ। তুমি যে এই বয়েসেও এত সিরিয়াসলি খেলো, উই অ্যাপ্রিশিয়েট দ্যাট।’

- ‘থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ!’

- ‘আচ্ছা আমার একটা প্রব্লেম সল্ভ কর তো। নেকস্ট শনিবার আমার মার বন্ধুর মেয়ের বিয়ে। মার হুকুম সকাল থেকে রাত অবধি আমাকে ওখানে থাকতে হবে। মার খুব ক্লোজ ফ্রেণ্ড। বাবা, বোন তো যাচ্ছেই কিন্তু আমিও না গেলে নাকি মার প্রেস্টিজ থাকবে না। অথচ ওই শনিবারই আমার এক বন্ধুর দাদার বিয়ে। সন্ধেবেলায় বরযাত্রী যাবার কথা, সব বন্ধুরা মিলে কিরকম মস্তি হবে বলো তো। এদিকে মা কিছুতেই রাজী হচ্ছে না।’

- ‘হুঁ খুব গুরুতর সমস্যা। তুমি এক কাজ কর। সকাল থেকে মার বন্ধুর মেয়ের বিয়ে অ্যাটেণ্ড কর। শুধু গেস্ট হিসেবে যেও না, গিয়ে বেশ কাজকর্ম কর, নিজের বাড়ির মতো, বুঝলে। সন্ধেবেলা নিজের বন্ধুর বাড়ি চলে যাও।তাহলে দু-দিকই রক্ষা হবে। আর ইতিমধ্যে মাকেও বুঝিয়ে বল যে তুমি তো একেবারে যাবে না বলছ না, শুধু একটা দিনকেই ভাগ করে নিতে হবে। কি এই সলিউশন চলবে?’

- ‘চলবে মানে? দৌড়বে। তুমি আমাকে যা রিলিফ দিলে।’

- ‘যাক্, বুড়ির সলিউশন পছন্দ হল।’

- ‘আরে তুমি বুড়ি কোথায়? তুমি তো মডার্ণ দিদা। বুড়ি হলে তুমি ফার্মভিল খেলতে?’

- ‘তা ঠিক মনটাকে আমি বুড়ি হতে দিই নি।’

ইতিমধ্যে মোবাইল বেজে ওঠাতে রূপমের সঙ্গে চ্যাট করা বন্ধ করতে হল। ফোন শেষ করে আরও কিছুক্ষণ খেলে তখনকার মত ল্যাপটপ বন্ধ করলেন সোনালী।

বিকালবেলায় মিসেস সেনের ফ্ল্যাটে সবাই জড়ো হয়েছেন।পরস্পর পরস্পরের সংবাদ সংগ্রহ করা চলছে। দেখতে দেখতে আড্ডা জমে উঠল। আড্ডার বিষয় নিজেদের খবর থেকে টিভি সিরিয়াল, বাজার দর, শাড়ী, জামা কাপড় কেনা কিছুই বাদ যাচ্ছে না। এই করতে করতে উঠল সময় কাটানো, রিক্রিয়েশনের প্রসঙ্গ।

- ‘আমাদের আর রিক্রিয়েশন কি আছে? এই গল্প আর টিভি দেখা,’ বললেন মেসেস দস্তিদার।

- ‘তাও একেক সময় মনে হয় যেন সময় আর কাটতে চাইছে না। ছেলেমেয়েরা সব বাইরে, যে যার সংসার নিয়ে ব্যস্ত,’ মিসেস মিত্রর মন্তব্য।

- ‘এখন তো কত কিছু করার আছে। কত রকম সিডি পাওয়া যায়, গান শোনা যায়, নিজের পছন্দ মতো সিনেমা দেখা যায়,’ সোনালী বললেন।

- ‘ধুর, সিডি লাগাও, দেখো, অত ঝামেলা পোষায় না। কোথায় কোন মেশিন খারাপ হয়ে গেল, তখন আবার মেকানিক ডাকো। আমার এসব একদম পোষায় না। এসব কি আমাদের করার বয়স?’ মিসেস দত্ত সোনালীকে একদম নস্যাৎ করে দিলেন।

- ‘ঠিক বলেছেন। আমরা কোথায় একটু গল্প গুজব করব নিজেদের মধ্যে, তবে না ভালো লাগে। আমি তো বলি সবাইকে যখন ইচ্ছে আমার ফ্ল্যাটে চলে এসো, আড্ডা মারব,’ বললেন মিসেস সেন।

- 'আপনি অবশ্য ল্যাপটপ নিয়ে অনেকক্ষণ সময় কাটান, আপনি মনে হয় বোর ফিল করেন না,’ সোনালীর উদ্দেশ্যে বললেন মিসেস দত্ত।

- ‘আরে হ্যাঁ, আপনার রান্না করে যে উমা সে বলছিল যে দিদা নিকি সব সময় ঘরে বসে কম্পিউটারে কি করে, বেশী টিভিও দেখে না।কি করেন আপনি এতক্ষণ ল্যাপটপ নিয়ে?’ মিসেস সেনের জিজ্ঞাসা।

- ‘আনেক কিছু করি। গান শুনি, ইচ্ছে মতো সিনেমা দেখি, নেট সাফিং করি। তাছাড়া উমার ছোট ছোট ছেলে মেয়ে দুটোকে পড়াই। আমার সময় বেশ কেটে যায়,’ বললেন সোনালী

- ‘ভাল লাগে এসব নেট টেট দেখতে? দেখেনই বা কি ইন্টারনেটে?’ আবার জিজ্ঞাসা কলেন মিসেস সেন।

- ‘দেখার তো কত কিছুই আছে, সে রান্নার রেসিপি বলুন কি সেলাই-এর ডিজাইন। সবই পাওয়া যায়। মেয়ে, জামাই, নাতি, নাতনীর সঙ্গে চ্যাটও করি,’ সোনালীর উত্তর।

মুখে এইটুকু বললেন আর মনে মনে ভাবলেন আমি তো আর এমিলির মতো জোর গলায় বলতে পারলাম না 'মাই লাইফ নাও রিভলভস্ অ্যারাউণ্ড ফার্মভিল।' বললে তোমরা আমায় পাগল ভাবতে। তাছাড়া তোমরা কেউ জানোই না ফার্মভিল কি।

- ‘আপনার পোষায় ওই পুঁটকে পুঁটকে বাচ্ছা দুটোকে পড়াতে? ধৈর্য্য থাকে?’ এবার প্রশ্ন মিসেস দত্তর।

- ‘হ্যাঁ, বাচ্ছাদের পড়াতে বেশ লাগে। তবে মেয়েটা রোজ আসতে চায় না, ছোট তো’ সোনালী বললেন।

- ‘এই দেখুন জিজ্ঞেস করতেই ভুলে যাচ্ছি মিসেস ব্যানার্জ্জী, পরশু আপনার বাড়িতে কে এসেছিল? এই সন্ধে সাতটা নাগাদ? আমি বাইরে যাচ্ছিলাম, দেখলাম অল্প বয়সী একটি ছেলেকে সিকিউরিটি আপনার ফ্ল্যাট চেনাচ্ছে,’ মিসেস মিত্র জানতে চাইলেন।

- ‘পরশু সন্ধেবেলা’ সোনালী মনে করার চেষ্টা করলেন, ‘ও পরশু সন্ধেবেলা অভিষেক এসেছিল। ও ও শিকাগোতে থাকে। সর্বাণী ওর হাত দিয়ে কয়েকটা জিনিস পাঠিয়েছিল, সেইগুলো দিতে এসেছিল।’

- ‘ও তাই বলুন, মেয়ে জিনিসপত্র পাঠিয়েছে। কি কি এল?’ মিসেস মিত্রর অদম্য কৌতুহল।

- ‘তেমন কিছু নয়, টুকটাক কয়েকটা জিনিস।’

- ‘টুকটাকটা কি তাই শুনি,’ মিসেস মিত্র নাছোড়বান্দা।

- ‘ওই তো কয়েকটা বডি লোশন, ক্রীম, দুটো শো পিস আর নাতি নাতনীর ফাংশনের একটা সিডি।’

- ‘নাতি নাতনীর সিডি একলাই দেখলেন, আমাদের বললেন না?’ মিসেস দস্তিদারের অনুযোগ।

- ‘আসবেন, যে কোন সময়ে আসবেন, দেখাব,’ সোনালী হাসলেন।

- ‘ঠিক আছে, কাল সন্ধে সাতটা নাগাদ যাবো। কতক্ষণের সিডি? সাড়ে আটটার আগে ফিরে আসতে হবে।’

- ‘কেন সাড়ে আটটায় কি আছে?’

- ‘ও আপনি তো আবার সিরিয়াল দেখেন না। সাড়ে আটটা থেকে ভালোবাসা কারে কয় হয়,’ মিসেস দস্তিদার উত্তর দিলেন।

- ‘এই দেখেছেন মোহনা কিন্তু সন্দেহ করতে শুরু করেছে যে ছেলেটা আসলে অন্ধ নয়, সেজে আছে,’ মিসেস সেন বলেউঠলেন।‘ আজ মনে হয় মোহনা সবার সামনে বলে দেবে,’ বললেন কিছুক্ষণ বাকী সবার আলোচনা শোনার পর তিনি বললেন, ‘এবার আমি উঠি।’ সোনালী চুপ করে রইলেন, কারণ তিনি ভালোবাসা কারে কয় দেখেন না, তাই আলোচনায় যোগ দিতে পারলেন না।

- ‘কি করবেন বাড়ি গিয়ে? একলা মানুষ, বাড়িতে তো আর কেউ নেই। বসুন, বসুন,’ মিসেস দস্তিদার বলে উঠলেন।

সোনালী ইঙ্গিতটা বুঝলেন। একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ‘না, আপনি যার কথা বলছেন সে সঙ্গী নেই। কিন্তু সেই আমাকে আরো কিছু সঙ্গীর সঙ্গে পরিচয় করে দিয়েছিল যারা আছে, থাকবে। তাদের সঙ্গে সময় কাটাতেও আমার খুব ভালো লাগে।’

- ‘আরও সঙ্গী?’ মিসেস দস্তিদার হতবম্ব।

- ‘হ্যাঁ। বই, ইন্টারনেট, গান এইসব। আমি এখন আসি, পরে আবার দেখা হবে,’ সোনালী আস্তে আস্তে বেরিয়ে গেলেন। 

- ‘অদ্ভুত মানুষ বাবা। গল্প গুজব ভাল লাগে না,

ভাল লাগে ঘরে বসে ইন্টারনেট দেখতে। কি করে বলুন তো?’ মিসেস সেন বললেন। - ‘বাদ দিন তো। আসলে আমাদের সঙ্গে বসে গল্প করবে না, তাই ওসব বলে চলে গেল,’ মিসেস মিত্রর মন্তব্য। ক্রমশ সোনালীই ওঁদের গল্পের খোরাক হয়ে উঠলেন। এই রকম ভাবে বেশ কয়েক মাস কোথা দিয়ে কেটে গেল সোনালী বুঝতেও পারলেন না। এই ক’মাসে তিনি খেলায় আরো বেশী রপ্ত হয়েছেন, কথোপকথনে আরো স্বচ্ছন্দ হয়েছেন। দেখতে দেখতে ডিসেম্বর মাস এসে গেল।সোনালীর মেয়ে সপরিবার দেশে আসছে দু বছর পর।সোনালীও তার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। ঠিক করলেন খেলা এবার কিছুদিন বন্ধ রাখবেন। বন্ধুদের সেই মর্মে মেসেজও পাঠিয়ে দিলেন। সোনালীর ফ্ল্যাট জমজমাট। পিকু, পিয়া বড় হয়ে গেলেও দিম্মার সঙ্গে তাদের খুব ভাব। তাদের মা বাবা মার্কেটিং-এ গেছে, তারা যায় নি, দিম্মার কাছে রয়েছে। পিকু ল্যাপটপ নিয়ে বসে মেইল চেক করছে। করতে করতেই বলল,      

- ‘দিম্মা, তুমি তো খালি বলতে তুমি নাকি আনেক কিছু করো ল্যাপটপে, কি কর?’

- ‘ওই তো জিজ্ঞেস কর না উমাকে, কত দিন রান্নার রেসিপি বলে রান্না করিয়েছি।’

---‘ও শুধু রান্নার রেসিপি?’ পিয়া বলল।

- ‘আমি আর কত কি করব?’ সোনালী হাসলেন।

- ‘দিম্মা তোমাকে বলেছি না কত কিছু করা যায়, তুমি শুধু রান্নার রেসিপি দেখলে?’ পিকু হতাশ।

- ‘দেখ, কত গেমস খেলা যায়। এই পিকু দিম্মাকে কতগুলো ভালো গেমস দেখা তো,’ পিয়া উঠে গিয়ে পিকুর পাশে বসল।

সোনালীর হাসি পাচ্ছিল, শেষে আর থাকতে না পেরে বললেন, ‘সেদিন কি হল সায়ন, সব ক্রপ উইদার করে গেল, ঠিক সময় হারভেস্ট করলে না কেন আর সাদৃতা তোমার প্লে পেনের জন্যে বেবী ব্ল্যাংকেট পেয়েছ তো?’

পিকু, পিয়া চমকে উঠে দিম্মার দিকে তাকাল।

- ‘কি বলছ তুমি? তার মানে তুমি’ পিকুর মুখে আর কথা যোগাচ্ছে না।

- ‘হ্যাঁ তার মানে আমি ফার্মভিল খেলি আর তোমাদের দুজনেরই নেবার,’ মিটিমিটি হাসছেন সোনালী।

- ‘তুমি আমাদের নেবার! আমাকে ব্ল্যাংকেট কে কে দিয়েছিল?’ পিয়া মনে করার চেষ্টা করে, ‘ও ইয়া সোনালী ব্যানার্জ্জী সেন্ট মি মোস্ট অফ দেম।’

- ‘তুমি সোনালী ব্যানার্জ্জী? কিন্তু তোমার নাম তো নীহারিকা,’ পিকু আবাক।

- ‘নীহারিকা ব্যানার্জ্জী নামে খুলি নি। প্রথমে লজ্জা করছিল, সবাই বুঝে যাবে, ভাববে বুড়ো বয়েসে এ সব করে।তাই সোনালী ব্যানার্জ্জী নামে অ্যাকাউন্ট খুললাম। তারপর ফার্মভিল এতো ভাল লেগে গেল যে একদিনও খেলা বাদ দিই নি।’

- ‘হঠাৎ সোনালী নাম চুজ করলে কেন?’ পিয়ার প্রশ্ন।

- ‘হঠাৎ নয় রে, একেবারেই হঠাৎ নয়,’ একটু থেমে সোনালী আবার বললেন, ‘নীহারিকা নাম তোদের দাদুভাই-এর, কেন জানি না ভাল লাগত না। সোনালী বলে ডাকত আমায় বাড়িতে। তোদের মাকে জিজ্ঞেস করিস, মাও জানে। কিন্তু আমার জন্মদিন তো প্রোফাইলে দেওয়া ছিল, সিক্সটিনথ্ জুন। তোরা তো বার দুয়েক আমার সঙ্গে চ্যাটও করেছিস। অবশ্য আমিও ডিসক্লোজ করি নি। আমি খুব মজা পেতাম জানিস তো? তোরা বোধহয় ভাবতেও পারিস নি যে আমি ফার্মভিল খেলব তাই না?’

- ‘একদম না। আমরা ভাবতাম তুমি একটু আধটু মেইল চেক কর আর আমাদের সঙ্গে কথা বলো। কিন্তু এখন জেনে দারুন লাগছে যে আমাদের দিম্মা ফেসবুকে চ্যাট করে, ফার্মভিল খেলে। ট্রুলি মডার্ণ। উই আর প্রাউড অফ ইউ দিম্মা।’

পিকু, পিয়া দিম্মাকে আনন্দে জড়িয়ে ধরল।

Comments

Top

নির্বাসন

ফরিদা হোসেন

girl.jpg
নির্বাসন

ন্ধকার থাকতেই ঘুম ভেঙ্গে গেল কামরান সাহেবের। অন্যদিনও ভাঙ্গে। একই সময়ে, একই নিয়মে ফজরের আযানের ধ্বনিতে।

তিন তলার চিলে কোঠায় থাকেন বিখ্যাত সাংবাদিক কামরান হোসেন। পুরোন ঢাকায় নিজেদের বাড়ি। নীচের দুই তলায় থাকে ছোট দুই ভাই স্ব-পরিবারে। ছাত্র জীবনের অভ্যেস ওর খুব ভোরে ওঠা। একেবারে আযানের সাথে সাথে। তারপর নামাজ পড়ে সামনের বড় ছাদে যোগ ব্যায়াম করেন অনেক্ষণ ধরে। পঞ্চাশের কামরান সাহেবের সুঠাম, সজীব আর প্রাণবান সৌন্দর্যের কথা অনেকেই আলোচনা করে। অনেক মেয়ের চোখের ঘুম কেড়ে নেয়া কামরান আজ ঘুমাতে পারছিলেন না একেবারেই। অনেক রাতে যাও আসলো তাও অল্পক্ষণের জন্যে। আযানের আগেই ঘুম ভেঙ্গে গেল আবার।

টেবিল ল্যাম্পটা তখনো জ্বলছে। ঘুম আসবার জন্যে একটা বই নিয়েছিলেন হাতে। চোখ লেগে আসায় বাতিটা আর নেভানো হয়নি। বাইরের দিকে তাকালেন কামরান।ঘুটঘুটে অন্ধকার চারদিকে। বাতি নিভিয়ে পাশ ফিরলেন। একটু পর আবার জ্বালালেন বাতিটা। বুকের ভেতরটায় কি যেন এক অস্থিরতা। গত কালকের ঘটনাটা কিছুতেই যেন ভুলতে পারছেন না তিনি। এরকম হওয়ার তো কোন কারণ নেই। উচিৎও নয়।

জীবনের প্রথম যৌবনের সন্ধিক্ষণ থেকে আজ পর্যন্ত বহু ঘাত-প্রতিঘাত, আর বহু চড়াই-উৎরাই পার হয়ে বর্তমানে একটা স্থায়ী মঞ্চে এসে অবস্থান করছেন তিনি। পুরোন ঢাকার এক চিলে কোঠায় তৈরী করেছেন আপন নিবাস। মাঝারি আকারের ঘরটিতে রয়েছে বুক সেলফ ভর্তি বই আর পত্র-পত্রিকা। রয়েছে টিভি, ফ্রিজ, আর ক্যাসেট প্লেয়ার। চমৎকার লোভনীয় একটা ঘর নিঃসন্দেহে।

পা বাড়ালেই চমৎকার একটা ছাদ। ঝুলন- বাগানের মতো একেবারে। নীচে থেকে উঠে এসেছে বিভিন্ন রং-এর বাগুন ভেলিয়ার ঝাড়। এখানে দাঁড়িয়ে কামরান একটু একটু করে আঁধার কাটিয়ে ভোর হওয়া দেখেন। ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে স্বাদ বদলানো হাওয়ার স্পর্শ নেন।

প্রেস ক্লাবে এক লেখকের পুস্তক প্রকাশনা উৎসব শেষে বাইরে গাছের নীচে দাঁড়িয়ে ছিলেন কামরান। অনুষ্ঠানের বক্তা হিসেবে আমন্ত্রিত ছিলেন তিনি। চমৎকার আর মূল্যবান বক্তব্যের জন্যে ইতিমধ্যেই যথেষ্ট সুখ্যাতি ছড়িয়েছে ওঁর। আজকেও সাহিত্য ও জীবন নিয়ে এতো সুন্দর বলেছেন তিনি যে সবাই খুব বিমোহিত হয়ে গিয়েছিল। ওর চমৎকার সুনাম সৌন্দর্য, আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব, বাচনভঙ্গি নিঃসন্দেহে দৃষ্টি আকর্ষণ করবার মতো।

এমনি সময় পাশে এসে দাঁড়ালো এক তরুণী। বয়স ২৫ কি ২৬ হবে। কাঁধে ঝোলানো কাপড়ের ব্যাগ। লম্বা বেণী।

বলল-

- আপনি কি যাচ্ছেন?

কামরান একটু অবাক হয়ে বললেন 

- আমাকে কিছু বলছেন?

মেয়েটি চোখে চোখ রেখে বলল

- জী। এতো নাম শুনেছি আপনার।

- নাম ! হাসলেন কামরান

-  সুনাম না দুর্নাম?

কিন্তু' হাসলো না মেয়েটি।

বলল- কার্ডে আপনার নাম দেখে আর একবার দেখতে এলাম।

- দেখতে এলেন? আমাকে? রিয়েলী?

কামরান যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না।

মেয়েটি বলল- আমার নাম রুমানা। একটা কলেজে পড়াচ্ছি।

কামরান বললেন- 'বেশ ভালো কথা। কিন্তু' আমি তো এসব জানতে চাইনি।'

- চাননি। কিন্তু' আমি জানালাম।

কামরান যেন একটু ভাবলেন।

তারপর বললেন- 'ও আচ্ছা। কিন্তু' আপনাকে এর আগে কখনো দেখেছি বলে তো মনে পড়ে না। রুমানা বলল-

- দেখেছেন। লক্ষ্য করেনি। প্রয়োজন হয়নি তাই। আমি আপনার সব অনুষ্ঠানেই যাই।

কামরান এবার গভীরভাবে দেখলেন রুমানাকে।

তারপর বললেন-

'বা ! আপনি তো ভারী চমৎকার করে কথা বলতে পারেন।

রুমানা এর কোন উত্তর দিল না।

ছোট একটা ডাইরী মেলে ধরলো কামরানের সামনে।

বলল-

- একটা অটোগ্রাফ দেবেন ?

এবার যেন একটু অপ্রস্তুত'ত হলেন কামরান-রুমানার চোখের দৃষ্টি আর কণ্ঠস্বরে।

বললেন- অটোগ্রাফ ?

রুমানা বলল- আমার অনেক দিনের ইচ্ছে। আজ আপনার সাথে কথা বললাম। অটোগ্রাফটিও থাকবে আমার কাছে। প্লীজ-

কামরান তাকালেন রুমানার মুখের দিকে। তারপর একসময় ডাইরিটা হাতে নিয়ে লিখলেন- “শুভেচ্ছা রইলো-কামরান হোসেন।”

রুমানা বলল- ধন্যবাদ। বিরক্ত করলাম। কিছু মনে করবেন না।

না, না, মনে করবার কি আছে-

কামরানের কথা শেষ হবার আগেই রাস-রাস্তার দিকে এগিয়ে গেল রুমানা। তেমনি দাঁড়িয়ে রইলেন কামরান।

এক বিস্মিত অনুভূতি যেন কিছুক্ষণের জন্যে আচ্ছন্ন করে রাখলো ওকে। কি স্পষ্ট আর দৃঢ় দৃষ্টিভঙ্গি মেয়েটির !

কি চমৎকার আত্ম পরিচিতির ধরন! কতো প্রাঞ্জল !

কামরান হোসেনের মতো অভিজ্ঞ, বিচক্ষণ আর ঝানু সাংবাদিককে যেন ভাবিয়ে দিলে গেল।

জীবনের চলার পথে কতো মানুষ এসেছে গেছে। চুলে পাক ধরেছে। আজ এই অবেলায় কেন চিত্তের এই অস্থিরতা! যদিও কামরানের সমাধিস' বুকের ভেতরটা একেবারেই স'বির বহু বছর থেকে। এখন আর কোন দক্ষিণা হাওয়া খুলে দেয় না আচমকা ভোরের দুয়ার। সংযত পরিমিত আর মার্জিত জীবন-যাপন ও কর্ম জগতের সুখ্যাতি কামরান হোসেনের জন্যে তৈরী করেছেন এক বিশেষ সম্মানিত আসন। সাংবাদিকতা জগতে যা সত্যি বিরল। দেশ বিদেশের রেডিও টিভিতেও আছে যার একটি আলাদা পরিচিতি।

বাড়ি ফিরে রুমানা নামের মেয়েটির কথা বারবার মনে পড়তে লাগলো কামরানের। বয়সে তাঁর অর্ধেক হবে মেয়েটি। উজ্জ্বল শ্যামলা, চমৎকার চোখ মুখের গড়ন। ব্যক্তিত্বময় চেহারা। রুচিশীল মার্জিত আচরণ। কথা বলার সেই ভঙ্গি-

‘এতো নাম শুনেছি আপনার-’

- আশ্চর্য ! পাগল নাকি মেয়েটি!

নিজেকেই বারবার প্রশ্ন করলেন তিনি। ছাদে পায়চারী করতে করতে নিজের মনকে বার বার শাসন করতে চেষ্টা করলেন কামরান। ছিঃ ছিঃ! যে পাঠ চুকিয়ে দিয়ে মনের দুয়ার বন্ধ করে দিয়েছে বহু বছর আগে, সেখানে কন আজ এই অনাহুত করাঘাত?

কেন জগদ্দল পাথরের দেয়াল কাঁপতে যাচ্ছে অজানে-।

না, না এ হয় না।

এ হওয়া উচিত নয়।

কামরান সংসারে বাবা-মার তিক্ততা দেখেছে শৈশব থেকে। প্রায় খুঁটিনাটি জিনিষ নিয়ে লেগে যেতেন দু’জনে। কখনো কখনো একে অপরকে গালাগালি করতেন অকথ্য ভাষায়। এক-একদিন স্কুল থেকে এসে এইসব দেখতেন কামরান।

ছোট তাই বোনগুলো এখানে সেখানে বসে কাঁদতো।

স্কুলের ব্যাগটা দাওয়ায় ফেলে রেখে বাইরে চলে যেতেন তিনি। খুব খারাপ লাগতো এই সব। বাড়িতে দূর সম্পর্কের এক চাচা থাকতো। খুব ফর্সা ছিলেন দেখতে। কাপড় পড়তেন খুব আঁটসাঁট করে। কথায় কথায় হাসতেন প্রচুর।

মানুষের গায়ে হাত দিয়ে কথা বলার অভ্যেস ছিল তার।

চাকরির খোঁজে ওদের বাড়িতে এসে সেই যে থেকেছেন-আর নড়বার নামও নেই।

বাবা ইশারা ইঙ্গিতে অনেকবার বলেছেন। তবুও-

মায়ের সাথে চাচার সম্পর্কটা একেবারেই ভালো লাগতো না কামরানের। বাবা যখন বাড়িতে থাকতেন না, কামরান বহুদিন দেখেছে, মাকে চাচার ঘর থেকে বের হতে। এসবে অসহ্য হয়ে-না খেয়ে, এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াতেন কামরান। কিন্তু' মাকে কিছু বলার সাহস হতো না। কতদিন ভেবেছে বাবাকে বলে দেবে চাচার কথা। চাচা যেন অন্য কোথাও চলে যায়। কিন্তু' বলার সুযোগ আর আসেনি ওর।

তার আগেই ওদের পাঁচ ভাই বোনকে রেখে ওই চাচার সাথে পালিয়ে গিয়েছিলেন মা। দু’বছরের ছোট বোনটা খুব কেঁদেছিল সেদিন- 

মায়ের ওপর অসম্ভব রাগ হলেও ছোট বোন মুন্নীর কথা ভেবে মায়ের ফিরে আসাটা খুব চাচ্ছিলেন কামরান।

সংসারের বড় সন্তান হয়ে ওই বয়সেই অনেক কিছু বুঝতে শিখেছিলেন তিনি। এক একদিন রাতে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদতেন কামরান।

কেন মা এমন করলেন ?

চাচাকে নিয়েই না হয় এ বাড়িতে থাকতেন।

বই এ পড়েছে- “মায়ের তুলনা নেই এ জগতে”।

কিন্তু' এ কেমন মা ওর?

বই এ কি তাহলে মিথ্যে কথা লেখা আছে?

স্কুলের ছেলেরা নানা কথা বলে।

ক্লাস শেষ হলে মাথা নিচু করে বাড়ি ফিরে আসতে হয় তাকে।

মা চলে যাওয়ার পর থেকে বাবাকে কখনো হাসতে দেখেন নি কামরান।

উদয়াস্ত পরিশ্রম করেছেন পাঁচটি ছেলেমেয়েকে মানুষ করবার জন্যে।

বাড়ির বুড়ী দাইমার কাছেই থাকতো মুন্নী আর বুলা।

সব ভাই বোনদের খুব যত্ন করতো সেই দাইমা।

ওই দাইমাকে একেক সময় মা ডাকতে ইচ্ছে করতো কামরানের।

সেই প্রথম সুন্দরী মেয়েদের ওপর থেকে মন বিষিয়ে উঠেছিল তাঁর।   

এরপর বাবা আর বিয়ে করেন নি। বন্ধু বান্ধবরা অনেক বুঝাতেন। বলতেন- এতোগুলো ছোট ছোট ছেলেমেয়ে সামলানোর জন্যে ঘরে একটা বউ আনা দরকার।

বাবা বলতেন- 

- নিজের সন্তানদের ফেলে রেখে চলে গেছে একজন। আর পরের সন-সন্তানদের সামলাবার জন্যে আরেকজন আসবে কোন দায়ে ঠেকে ? খুব শিক্ষা হয়েছে আমার। 

শিক্ষা হয়ে গেছে কামরানেরও। কিন্তু' সেটা আরো পরে।বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শেষ করে একটা স্কলারশীপ নিয়ে বিদেশে যাবার চেষ্টায় খুব ব্যস- হয়ে পড়েছিলেন কামরান।

এরই মধ্যে ওর জীবনে এলো নীলা। অল্প কদিনের মধ্যেই জয় করে নিল কামরানের মতো ছেলেকে।

নতুন করে আশার আলো দেখলো কামরান।

রাতটুকুন ছাড়া সবসময় সবকাজের সঙ্গী এখন শুধু নীলা।

ভালোবাসার কাঙ্গাল কামরানও নিজেকে ধন্য মনে করলো নীলার মতো মেয়ের ভালোবাসা পেয়ে।

একদিন সুযোগ বুঝে নীলা বলেই বসলো যে-

কামরানকে ছেড়ে তার পক্ষে এখানে একা থাকা কোন রকমেই সম্ভব নয়।

কাজেই-

তারও যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। কামরানও একেবারে মরিয়া হয়ে উঠলো নীলাকে সাথে নিয়ে আমেরিকা যাবার জন্যে।

বহু খাটাখাটনি আর আনুষ্ঠানিকতার পর দু’জনার যাওয়ার প্রস্তুতি'তি পর্ব  সারা হলো।

ছোট ভাই দুটি মোটামুটি দাঁড়িয়ে গেছে।

বিয়ে হয়ে গেছে বোন দুটির। দু’টো বাড়ির একটি ভাড়া দিয়ে, অন্যটিতে সবাই থাকে।

কামরান এখন অনেকটা দায় মুক্ত। নিজেকে নিয়ে ভাববার সময় এসেছে ওর। বাবা সবই জানতেই।

ওদের যাবার আগে কলমা পড়িয়ে বিয়ে দিলেন ঘরোয়াভাবে। ঘনিষ্ঠ দু’একজন ছাড়া বাইরের কেউ জানতো না। নীলার কোন গার্জেন ছিল না। বাড়িতে সৎ মা।

বাবা কিছু কিছু হাত খরচ দেন বটে; কিন্তু তাতে কিছুই হয় না। 

বিকেলের দিকে পারটাইম কিছু কাজ ও টিউশনি করে চলতো ওর। ঢাকায় হলে থাকতো। কাজেই ও নিজেই নিজেই গার্জেন ছিল। কামরানের জীবনের যত গ্লানি, হতাশা আর দুঃখকে অল্প কদিনের মধ্যে ভুলিয়ে দিল নীলা, ভালোবাসার প্লাবনে। এবং একদিন দু’জনেই চলে গেল আমেরিকা, প্রায় দুই বছরের জন্যে।

প্রায় বছর খানেক পরের কথা। একদিন কামরান বাইরে থেকে এসে দেখে-ব্যাগ গোছাচ্ছে নীলা।

জিজ্ঞেস করতেই বলল-

- আমার এক বান্ধবীর সাথে দেখা হঠাৎ একটা ষ্টোরে, খুব ধরেছে- ওর বাড়িতে দুদিন থাকতে। আমাদেরও তো দেশে ফেরার সময় হয়ে এলো। তাই ভাবছিলাম-

এক কথায় রাজী হয়ে গেলেন কামরান।

বললেন-

- বেশ তো থাকো। কিন্তু' ডার্লিং দুদিনের বেশী নয়। তোমাকে ছাড়া আমার অবস্থান বুঝতেই পারছো-

- অফ কোর্স-

হাসলো নীলা।

পরদিন সকালে বের হবার আগে কামরান বললেন-

- চল তোমায় আগে তোমার বান্ধবী  বাসায় পৌঁছে দিয়ে তারপর একটু এ্যাম্বিসিতে যাব।

নীলা কামরানের গলা জড়িয়ে ধরলো আহ্লাদে।

বলল-- নো থ্যাঙ্কস। তোমাকে কষ্ট করতে হবে না ডার্লিং। আমার বান্ধবী নিজে এসে নিয়ে যাবে আরো ঘন্টা খানেক

পরে। ততক্ষণে আমি তোমার দু’দিনের রান্নাটা রেডি করে ফ্রীজে রাখি। বাকি কাজও গুছিয়ে রেখে যাচ্ছি সব। আমার এ্যাবসেন্সে যেন তোমার কোন কষ্ট না হয়।

নীলাকে কাছে টেনে আদর করলেন কামরান।

বললেন-

- ‘ও’ কে’ । সত্যি নীলা তুমি আমার জীবনে আছো বলেই-

কামরানের মুখে হাত চাপা দিল নীলা।

বলল-

- আর একটিও কথা নয়। তোমার কাজের দেরি হয়ে যাচ্ছে। এসব আবেগের কথা বলার জন্যে সারাটা জীবন তো পড়েই রয়েছে।

হেসে বেরিয়ে গেলেন কামরান। নীলা ওকে গেট পর্যন্ত- এগিয়ে দিল।

    এরপর দুদিন অতিবাহিত হয়ে তৃতীয় দিন ভোরে টেলিফোন বেজে উঠলো। কামরান ঘুম চোখেই রিসিভার তুলে নিল। হ্যালো বলার আগেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো নীলার কণ্ঠ।

- গুডমর্নিং ডার্লিং। সরি এতো ভোরে তোমার ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিলাম। কামরান বালিশটা টেনে নিল বুকের কাছে।

ঘুম জড়ানো চোখে বলল-

- গুডমর্নিং নীলা- কই কখন আসছো তুমি? ভীষণ মিস করছি তোমাকে।

ওদিক থেকে নীলার কণ্ঠ হেসে উঠলো জল তরঙ্গের মতো।

বলল-

- সরি ডার্লিং। আমি আসছি না।

কামরান বললেন-

- ইয়ার্কি রাখো। প্লীজ লক্ষ্মীটি- বড় তাড়াতাড়ি।

নীলা আবার হাসলো।

বলল-

- বিশ্বাস হচ্ছে না? আলমারীটা খুলে দেখ। আমি আমার সব কিছু নিয়ে চলে এসেছি। আর কখনই আমি তোমার কাছে ফিরে যাব না। কোন বান্ধবী নয়- বন্ধু এখানে চমৎকার বয়ফ্রেন্ড পেয়েছি আমি জীবনকে উপভোগ করবার জন্যে। অনেক বড় চাকরি করে।

কামরান বলল-

- নীলা তুমি কি পাগল হয়ে গেছো? আমাদের ভালোবাসা, বিয়ে এতো দিনের দাম্পত্য জীবন-

নীলা বলল-

- সব মিথ্যে। তুমি দেশে ফিরে গিয়ে আরেকটা বিয়ে করে নিও প্লীজ। বাই

ওপাশ থেকে রিসিভার রেখে দিল নীলা।

কামরান যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলেন না।

ও স্বপ্ন দেখছে নাতো?

হাতে মুখে বার কয়েক চিমটি কেটে দেখলেন-

না। জেগেই আছে সে।

কিন্তু' এ কি করে সম্ভব?

নীলার মতো মেয়ে.......?

উঠে আলমারীটা খুললেন কামরান। এবং স্তব্ধ হয়ে গেলেন। ভেতরটা একেবারে ফাঁকা। নীলার কোন চিহ্ন নেই কোথাও । সব শূন্য।

আবার বিছানায় এসে বসে পড়লেন কামরান। মাথাটা ঝিম ঝিম করতে লাগলো। কামরান ভেবে পান না কেন নীলা এমন করলো।

কি দরকার ছিল এই প্রতারণার? কিসের অভাব ছিল ওর?

প্রাচুর্য্যের? এতদিনের প্রেম, ভালোবাসা, দাম্পত্য জীবন-সব মিথ্যে হয়ে গেল আরেকজনের অর্থের কাছে?

কি করে এই প্রলোভনে পড়ে গেল নীলা? কি করে ছেড়ে যেতে পারলো সে কামরানকে।

একটু পরেই আবার ফোন বেজে উঠলো।

রিসিভার তুলেই নীলার কণ্ঠ শুনলেন কামরান।

- এতক্ষণে তোমার নিশ্চয়ই বিশ্বাস হয়ে গেছে যে আমি সত্যি তোমাকে ছেড়ে চলে এসেছি।

শোন, তোমার টাকা পয়সা আমি কিছুই আনিনি। কারণ ওটা আনলে তোমার দেশে ফিরে যেতে কষ্ট হবে।

তুমি এতো ভালো যে, তোমাকে আর কষ্ট দিতে চিনে। শোন, আমাকে ফিরে পাবার কোন রকম চেষ্টা চালাবে না। তাহলে বিপদে পড়বে। আমি চাই, তোমার কাজ শেষ করে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাও।

লাইনটা কেটে গেল ওপাশ থেকে। রিসিভার হাতে বসে রইলেন কামরান। একটি কথাও বলতে পারলেন না। হঠাৎ করে ওর অসতী মায়ের কথা মনে পড়ে গেল। নীলা আর মায়ের মুখটা যেন মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে চোখের সামনে। মাথাটা আবার ঝিমঝিম করতে লাগলো। মনে হলো চারদিকে কারা যেন অসংখ্য কাঁসর বাজাচ্ছে। আর সেই অসহ্য ঝনঝনানি শুনতে শুনতে ক্রমশ কোথায় যেন তলিয়ে যাচ্ছেন কামরান। সে যেন হারিয়ে যাচ্ছে এতদিনের পরিচিত লোকালয় থেকে। তলিয়ে যাচ্ছে সমুদ্রের অতল গভীরে........। এই দুর্ঘটনার অল্প কিছুদিন পরেই দেশে ফিরে এলেন কামরান একেবারে অন্য মানুষ হয়ে । কথা বলেন কম।

লোক জনের সাথে মেলামশো করেন একেবারেই হিসেব করে। কাজ ছাড়া যেন আর কোন কিছুরই প্রবেশ নিষেধ ওঁর জীবনে। এতো বড় বাড়ির চিলে কোঠাটাইা বেছে নিলেন নিজের জন্যে। সেখানে তৈরী করে নিলেন আপন ভুবন। এরপর কেটে গেছে অনেকগুলো বছর-

বাবা মারা গেছেন। সব ভাইরা সংসারী হয়েছে। সবার শ্রদ্ধা ভালোবাসা আর নিজের কর্মব্যস্ততা'তা নিয়ে কেটে যাচ্ছিল জীবন। দেশের একজন বিশিষ্ট সাংবাদিক, কলামিষ্ট হিসেবে প্রচুর সুখ্যাতি সর্বত্র। এক নামে চেনে সবাই। বুদ্ধিজীবী মহলে এমন শিক্ষিত, জ্ঞানী, মার্জিত, রুচিবান আর সুদর্শন ব্যক্তিত্ব খুব কমই চোখে পড়ে। পরিবারের লোকজন ছাড়া বাইরের কেউ জানো না তার জীবনের গভীর দুর্ঘটনার কথা। বেশীর ভাগ মানুষ জানে কনফার্ম ব্যাচেলার হিসেবে। জানে না তার অতীতের ইতিহাস।

দেশে আসার পর এতোটা বছর পথ চলতে বহু মেয়ের সাথেই পরিচয় হয়েছে কামরানের ঘনিষ্ঠ হতে চেয়েছে কেউ কেউ। কিন্তু' অত্যন্ত-সতর্কতার সাথে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করেছে কামরান।

বারবার মা আর নীলার মুখটা মনে পড়েছে শুধু। একেক সময় মনে হয়েছে সব মেয়েরাই বোধহয় কম বেশী একরকম হয়।

অসতী-দ্বিচারিণী-নষ্টা আর ছলনাময়ী।

কখনো কখনো সুখী দম্পতিকে দেখে কামরানের বুকটা খুশীতে ভরে যেতো প্রথমে এবং পরক্ষনেই আবার মনে হতো ভেঙ্গে যাবে না তো ও ঘর?

বন্ধু-বান্ধব ও ভাইবোনের ছেলে মেয়েরা বড় হয়েছে এখন। কারো কারো বিয়েও হয়েছে। মাঝে মাঝে ওরাই পাকড়াও করে কামরানকে বিয়ের জন্যে। ওদের আবদারে হেসে জোড়হাত করেন কামরান।

বলেন-

-'আমার এতো ছেলে মেয়ে। ওদের দেখা শোনা করা এখন আমার সবচে বড় কাজ। বিয়ের ঝামেলায় আর যেতে চাইনা।

সবাই বোঝে এ হচ্ছে কামরানের এড়িয়ে যাওয়ার কায়দা।

সেই কামরান হোসেন দেখতে দেখতে প্রায় পঞ্চাশের কোঠায় এসে পৌঁছেছেন কদিন আগে। পরিবারের ছেলে মেয়েরা খুব ধুমধামের সাথে ছাদে কামরানের জন্ম দিনও পালন করেছে অত্যন্ত- আন-আন্তরিকতার সাথে।

ছেলেমেয়েদের এই নির্মল ভালোবাসার গভীরতায় আবেগে আপ্লুত হয়ে যান কামরান। আর তখনই ওঁর বুকের ভেতরটা চিনচিন করে ওঠে এক অব্যক্ত ব্যথায়।

কি যেন একটা থাকার কথা ছিল...........

কোথায় যেন একটা ক্ষত রয়ে গেল। কিছুতেই যেন আর হিসেবে মেলাতে পারেন না কামরান।

এরই মধ্যে এলো সেই হঠাৎ হাওয়ার ঝটকা-

হঠাৎ আলোর ঝলকানি।

এতদিনের বন্ধ দুয়ারে আঘাত হানলো আবার।

অন্ধকার আকাশে আলো ফুটি ফুটি করছে একটু একটু করে। ভোরের ভেজা ঠান্ডা হাওয়ায় চোখের পাতা আর অবিন্যাস- চুলগুলো কেমন ভেজা ভেজা।

অভিমানী।

কামরানের মনে হলো শেষ রাতের জোছনা চুইয়ে শিশির স্নাত হয়েছে হয়তো-বা কতক্ষণ?

অনেকক্ষণ একাকী আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। কোথাও কেউ নেই, চারদিকের মহাশূন্যতা ছাড়া।

Comments

Top

উপভোগ

ফয়সল আবদুল্লাহ

কারওয়ান বাজার, ঢাকা, বাংলাদেশ

kolkatas1.jpg
উপভোগ

সুপ্রভার মনে হলো তার উপমাগুলো ব্যাগে পুরে তালা লাগিয়ে দেয়ার দিন এসে গেছে। এ যুগে নাকি এসব অচল। রিজুর ভাষায় এ নাকি সেকেলে গন্ধ ছড়ায়। রঞ্জিতকে আদর করে রিজু ডাকে সুপ্রভা। এই রিজু তার কবিতার সমঝদার। মাপ মতো প্রশংসা সমালোচনা দুটোই করে। তবেই ইদানীং রিজুর সবকিছুতে কেমন যেন আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। কবিতা-গদ্য সবই এড়িয়ে চলছে।

সুপ্রভা বিজ্ঞানের ছাত্রী। তার সবকিছুতেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে যুক্তি আসবেই। রঞ্জিতকে সে মাঝে মাঝে বোঝানোর চেষ্টা করে, কবিতায় কাল ব্যাপারটা অন্যরকম। সুপ্রভার কাছে কবিতার সংজ্ঞা হলো, কালকে আলগোছে একপাশে সরিয়ে পরিচ্ছন্ন কিছু অনুভূতি। রঞ্জিত আবার এসব শুনতে পছন্দ করে না। ভ্রূ কুঁচকে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। আজও যেমনটি আছে।

সুপ্রভা বলল, এই যে তুমি এখনকার ভিজুয়াল প্রডাকশনগুলোকে অতিমাত্রায় মেলোড্রামাটিক বলছ, এটা ভুল। রঞ্জিত রিকশাওয়ালার পিঠে মৃদু স্পর্শ করে বলে, আসে- চালান, সামনে স্পিডব্রেকার। সামনে যাই থাকুক তাতে সুপ্রভার মাথা ব্যথা নেই। সে বলেই যা”যাচ্ছে, ‘দুই হাজার কোটি বছর আগের কথা ভেবে দেখ, কী ছিল? দুচার রকম গ্যাস, সেই গ্যাসের তৈরি তারা সূর্য। আর এখন? সৌরজগত, পৃথিবী, চাঁদ.. আবার সেই চাঁদকে প্রিয়ার মুখের সঙ্গে মেলানোর মতো কবি- সাহিত্যিকও ঝটপট গজিয়ে গেলো। প্রকৃতির চেয়ে বড় মেলোড্রামাটিক কিছু আছে আর!

এই যে আমি তুমি রিকশায়, এটাও এক রকম অতিরঞ্জিত। কী দরকার ছিল বল!’ রঞ্জিত এবার কথা বলার পয়েন্ট খুঁজে পায়। ‘হ্যাঁ সুপু ঠিকই বলেছ, যথার্থ, অতিরঞ্জিত, ভালোই’। ‘সব কিছুতে বেঁকে বস কেন!’ সুপ্রভা ভ্রূ কোঁচকায়। রঞ্জিত তা খেয়াল করে না। দুজন দুদিকে চেয়ে থাকে। কিন্তু' সুপ্রভা বেশিক্ষণ চুপ থাকতে পারে না। অল্প কিছু সময়ের জন্য রঞ্জিতকে কাছে পায়। বাকি সময় ছেলেটার কাজের শেষ নেই। কিছুদিন নাটকের পেছনে তো আবার সিনেমা। পড়াশোনা লাটে উঠেছে অনেক আগে। কাজ নিয়ে রঞ্জিতের সঙ্গে কথা বলে সুপ্রভা তাই সস্তি- বোধ করে না। কিন্তু' আর কীই বা বলে! কবিতা শুনিয়ে আর কদিন! আলগোছে রঞ্জিতের হাতের উপর হাত রাখে সুপ্রভা। কিছুটা চমকে ওঠে রঞ্জিত। ব্যাপারটা সুপ্রভা বেশ উপভোগ করে।

- রজু

- কী?

রঞ্জিতের কণ্ঠ বেশ শান। মনের সঙ্গে তার গলার স্কেল কখনো পাল্টায় না।

- কেমন আছ?

- ভালো, কেন?

- এমনি, কিছু না।

সুপ্রভা হাত সরিয়ে নিঃশব্দে হেসে সামনে তাকায়। রঞ্জিতের দৃষ্টিও সামনে। তবে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্থ।

সাদার উপর হাল্কা নীল ফুল। এ শাড়িটায় সুপ্রভাকে বেশ সরল দেখায়। আয়নায় শুধু চুলটা ঠিকাছে কিনা দেখে। ড্রইং রুমে এক তরুণ সাংবাদিক অপেক্ষা করছে। বেচারা একজন শখের ফটোগ্রাফারও। কম্বিনেশনটা অদ্ভুত। সুপ্রভার পছন্দেই বিয়ে হয়েছে। আর রঞ্জিত? তার সঙ্গে সবচে ভালো মেলানো যাবে প্লুটোর সঙ্গে। সমঝোতার মাধ্যমেই সুপ্রভার জীবন হতে সে বিদায় নিয়েছে। কিন্তু' কক্ষপথ থেকে হারিয়ে যায়নি। এখনো সেই ডকুড্রামা, অ্যাডফার্মে খেটে বেড়ায়। তেমন একটা পরিচিতি পায়নি। আবার অখ্যাতও নয়। বিয়ে করেনি। তাই যখন তখন কাজের সময় তৈরি হয়ে যায়।

সুপ্রভার ইন্টারভিউ শেষ হয়। হাঁফ ছেড়ে বাঁচে সে। মনে মনে ধন্যবাদ দেয় সাংবাদিককে। প্রথম প্রেম সংক্রান্ত- বিব্রতকর প্রশ্নটা না করার জন্য। হয়তো তরুণ বলেই জিজ্ঞেস করার সাহস পায়নি।

সুপ্রভার স্বামী আড্ডা থেকে ফিরেছেন। যথারীতি আজও তার হাতে গোটা দশেক পত্রিকা। ছুটির দিনে একসঙ্গে সবগুলো পত্রিকায় তার স্ত্রীর কবিতা ছাপা হয়। কবিতা খুব একটা বোঝেন না। তারপরও বন্ধুদের দেখানোর জন্য তিনি নিজেই আবৃত্তি করে শোনান। এ নিয়ে সুপ্রভা বেশ রাগ দেখিয়েও সুবিধে করতে পারেনি। আজও নিশ্চয়ই সবাইকে শুনিয়ে এসেছে। সবাই কি আর অতো কবিতা পছন্দ করে! এ জিনিসটাই বোঝানো গেলো না তাকে। তবে সুপ্রভা ব্যাপারটা এক অর্থে উপভোগও করে। ‘পত্রিকাগুলো দয়া করে জায়গামতো রেখো, টেবিলে ছিটিয়ে রেখো না।’ সুপ্রভার স্বামী দেবব্রত চক্রবর্তী। তিনি কখনোই পত্রিকা ছিটিয়ে রাখেন না। বিশেষ করে শুক্রবারের পত্রিকাগুলোর কপালে যত্নআত্তি একটু বেশিই জোটে। আস- পত্রিকাই তিনি তুলে রাখেন। সুপ্রভা সব জেনেও এ কথা বলবে। আসলে এ বলাটাও সে বেশ উপভোগ করে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কথা কাটাকাটি হয় কিনা এ প্রশ্নটা এদের বেলায় অবসান-র। দেবব্রত যথেষ্ট মনযোগী শ্রোতা আর সুপ্রভাও গুছিয়ে কথা বলে। এভাবে বছর-খানেক চললে তাদের সংসারটাকে অনায়াসে গ্রহের মর্যাদা দেয়া যায়।

কক্ষপথ থেকে কখনো চুল পরিমাণ সরবে না। অন্যদিকে আবেগময় দুটো প্রান্তও আছেই।

প্রতিথযশা একটি দৈনিকের আয়োজনে কবিতা পাঠের আসরে কী করে যেন সুপ্রভার সঙ্গে রঞ্জিতের দেখা হয়ে গেল। মাঝে কয়েকবার রাস-রাস্তায় শুধু চোখাচোখি হয়েছিল। এখন একেবারে সামনাসামনি। সুপ্রভাই প্রথম বলে।

- কেমন আছ রজু?

রঞ্জিত কেমন যেন দ্বিধাগ্রস্থ। রজু সম্বোধনের জন্য নয়। সুপ্রভাকে সে মনে মনে খুঁজছিল।

সে কারণেই তাৎক্ষণিকভাবে উত্তরটা দিতে পারে না। মৃদু হাসে। মাথা ঝাঁকায়। সুপ্রভাও হাসে।

সেই হাসিতেও দুর্বোধ্য সরলতা। রঞ্জিত হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে উঠে।

- হ্যাঁ, এই তো! তারপর, এদিকে হঠাৎ?

সুপ্রভা উত্তর দেয় না। রঞ্জিত আবার বলল, অনেকদিন পর তাই না? সুপ্রভা সম্মতিসূচক মাথা ঝাঁকায়। রঞ্জিতের বিব্রতবোধ বুঝতে সে কিছুটা দেরি করেছে। তবে কথা বলায় তার একটুও দ্বিধা নেই।

- কী করছো এখন?

- কিছু না। ভাবছি আগে বিয়ে করবো, তারপর সব কাজ।

- বেশ তো, তাই কর।

- তোমার জলবালিকাটা বেশ ভালো হয়েছে।

সুপ্রভা শব্দ করে হাসে। রঞ্জিত কেমন যেন বোকা বোকা চোখে সুপ্রভার হাসি দেখে।

- তুমি আগের মতোই আছ রঞ্জিত। ঠিকমতো না পড়েই বল কিনা ভালো।

রঞ্জিতের ভেতরটা অতি ক্ষুদ্র সময়ের জন্য পুলকিত হয়। মুহূর্তে মনে পড়ে যার সঙ্গে দেখা করতে সে এখানে এসেছে সে যে কোনো মুহূর্তে অফিস ছেড়ে বের হয়ে যেতে পারে। কিন্তু' মন থেকে খুব একটা তাড়া অনুভব করছে না। সুপ্রভার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, শোনো, আমি কিন্তু' পড়ি, সত্যিই পড়ি!

তাই! সুপ্রভার চোখে অস্পষ্ট কৌতুক। প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, চলো চা খাই। অনেকদিন রাস্তায়দাঁড়িয়ে চা খাওয়া হয়নি। সুপ্রভার সাংসারিক বিষয়ে প্রশ্ন করতে রঞ্জিতের ইচ্ছে করলো না।

সময় বড্ড কম। এ সময় অহেতুক কোনো আলাপ নয়।প্রসঙ্গক্রমে সুপ্রভা তার স্বামীর প্রসঙ্গ টেনে আনলো।

- বাচ্চা নেয়ার সিদ্ধান্তটা-ও আমার উপর ছেড়ে দিয়েছে। ক্যামেরা পাগল মানুষ। সংসার নিয়েও তার ভাবার সময় নেই।

রঞ্জিতের মনে হলো, এ মুহূর্তে তার কিছুটা হলেও ঈর্ষা অনুভব হওয়ার কথা। নাটকের পেছনে দৌড়ে জীবনটাই হয়তো তার কাছে নাটকের মতো হয়ে গেছে। তাই হয়তো সুপ্রভার কথাটা নিছক একটা ডায়ালগের মতোই মনে হয়েছে।

- তুমিও কি ব্যস-?

- নাহ্‌, এই যে দেখছো না!

- হুঁ

দ্রুত শেষ হয়ে আসে চা-পর্ব। রঞ্জিতের মনে হলো, এর বেশিক্ষণ থাকাটা উচিৎ হবে না। সুপ্রভা তাকে বিদায় জানাবে, এটা সে কেন যেন মেনে নিতে পারছে না। তাই সে-ই আগে বলল, বিয়ের পর তোমাকে একদিন বাসায় নিয়ে যাব। আমার বৌকে নিয়ে একটা কবিতা লিখে দিয়ে আসবে।

সুপ্রভা বালিকার মতো দ্রুত উপর-নিচ মাথা ঝাঁকায়। রঞ্জিত চলে যায়। রঞ্জিতের হুট করে চলে যাওয়াটাও বেশ উপভোগ করে সুপ্রভা।

দেবব্রতকে এখন আর পত্রিকা যত্ন করে তুলে রাখতে হয় না। সুপ্রভার একটা ঢাউস সাইজের বই বেরিয়েছে। বইয়ের গোটা দশেক কপি শোকেয়ে সাজিয়ে রেখেছেন। নিকট বা দুঃসম্পর্কের যেই আসুক না কেন, একটা কপি ধরিয়ে দেবেন। সুপ্রভা এ জন্য প্রায়ই বলে, তোমার মতো ক্রেতারখোঁজ পেলে প্রকাশকরা দরজায় লাইন দেবে। দেবব্রত তার স্বভাবসুলভ হাসি হাসেন। মূলত, এ হাসিটার জন্যই সুপ্রভা কথাটা বলে।

বিচ্ছেদের পর রঞ্জিত সুপ্রভার ছাপা হওয়া কোনো কবিতা পড়েনি। কবিতা এখন আর তার ভালই লাগে না। তবে দৈনিকের পাতায় সুপ্রভার নাম সে আগ্রহভরেই খোঁজে। সেই নামের দিকে কিছুক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়েও থাকে। আর রাতে যেটুকু অবসর মেলে, তখন পুরনো ডায়রিটা বের করে। ডায়রির ভেতর অনেকগুলো টুকরো কাগজ। প্রতিটিতে সুপ্রভার হাতে লেখা কবিতা। রঞ্জিত কখনো পড়ে, কখনো শুধুই হাত বুলোয়। কবিতাগুলো বড় বেশি সরল, তবে দুর্বোধ্য নয়। এখনকার চেয়ে অনেক কাঁচা হাতে লেখা। মিনিট দশেক পর ডায়রিটা কাপড়ে মুড়িয়ে ড্রয়ারের ভেতর গুঁজে রাখে রঞ্জিত। স্মৃতিকাতরতা স্মৃতিকাতরতা  নয়, ব্যাপারটা সে বেশ উপভোগ করে। 

Comments

Top

ছেঁড়া কাগজ

দীপন জুবেয়ার

ধানমন্ডি, ঢাকা

village1.jpg
ছেঁড়া কাগজ

বাড়ির চারপাশ এখন ফাঁকা। কদিন আগেও চারদিকে গাছ-গাছালিতে ভরা ছিল। রাজ্জাকের চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করতেই গাছ-গাছালি সব বিক্রি করা হয়েছে। মৃত্যুশয্যায় শুয়েও রাজ্জাক ভীষণ প্রতিবাদ করেছিলো, গাছগুলো যেন বিক্রি করা না হয়। কিন্তু' তার প্রতিবাদ শোনবার মত অবসর ছিল না তখন তার হতদরিদ্র পরিবারের। তার চিকিৎসার টাকা জোগাতে শেষমেশ ওই গাছগুলোই বিক্রি করতে হলো। রাজ্জাকের ছোট টিনশেডের বাড়িটা এখন কেমন যেন শ্মশানের মত লাগছে। গাছ বিক্রির টাকায় ডাক্তারের কথামত তার সিটিস্ক্যান করা হলো। সিটিস্ক্যান করে দেখা গেল মাথার ভেতর বড়-সড় এক টিউমার বাসা বেধেছে। ডাক্তার গম্ভীর মুখে বলল, রুগীর অবসর বেশি ভালো না। কোন আশা দেখছি না। বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যান। যে কদিন বাঁচে ভালো কিছু খেতে দিন। ওনার মনের ইচ্ছেগুলো পূরণ করবার চেষ্টা করেন, সময় শেষ। অনেক দেরি হয়ে গেছে। এখন আর আমোদেরও কিছুই করবার নেই।

ডাক্তারের কথামত রাজ্জাককে বাড়ি ফিরিয়ে আনা হল। লাভের লাভ কিছুই হলো না, মাঝখান দিয়ে এত শখের গাছগুলো গেল। রাজ্জাকের বউ মরা কান্না শুরু করে দিলো, তার সাথে ছেলে মেয়েরাও। যখন সুস্থ' ছিলো রাজ্জাক, তখন যে কতকিছু খেতে চাইত মন, কিন্তু' যাকে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়, দিন আনা- দিন খাওয়া অবস্থা তার শক কি আর পূরণ হবার এই সংসারে? কোনদিন একটা ভালো কিছু খেতে পারেনি সে, কিছু খেতে গেলেই ছেলে - মেয়েগুলোর কথা মনে পড়ে যেত। কিন্তু' সবার জন্যে ভালো কিছু কেনার সামর্থ্য তার ছিল না।

নিয়তির কি খেলা! এখন সে কিছুই খেতে পাওে না অথচ তার চারপাশে কত-কত ভালো-ভালো খাবার পড়ে আছে। কিছুই মুখে দিতে পারে না রাজ্জাক। জোর করে যা কিছু খাওয়ানো হয়, কিছুক্ষণ পর সব উগরে দেয়। দুদিন ধরে কথা বন্ধ হয়ে গেছে তার, কারও সাথে কথা বলতে পারে না। সারাদিন-রাত মরার মত পড়ে থাকে তেল চিটচিটে বিছানার উপর। হঠাৎ দেখলে বোঝাই যায় না, মরা না জীবিত। অতি:ক্ষীণ নিশ্বাস নেওয়ার জন্যে বুকের সামান্য ওঠানামার দিকে খেয়াল করলেই শুধু বোঝা যায়, না এখনও মরে নি, বেঁচে আছে। হঠাৎ হঠাৎ উঠে বসে চারদিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকায়। কাউকে সামনে পেলে তার দিকে তাকিয়ে নিজের মাথায় হাত দিয়ে আঘাত কওে আর হু হু করে কাঁদে। মাথায় আঘাত কওে বোঝাতে চায় ভীষণ যন্ত্রণা। কিন্তু' কারও সাধ্য নেই তার যন্ত্রণা কমাবার। শুধু তাকিয়ে থেকে চোখের পানি ফেলা ছাড়া কারও যে কিছু করার নেই।

রাজ্জাকের দুই মেয়ে। দু-জনেরই বিয়ে হয়েছে। বাবার মাথায় টিউমার ধরা পরবার পর তারা এসে উপস্থিত'ত হয়েছে বাচ্চা-কাচ্চা স্বামী সহ। রাজ্জাক যখন একটা প্রায়ান্ধকার ঘরে শুয়ে মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছে ঠিক তখন ঘরের বাইরে দুই মেয়ে-জামাই আর ছেলের তুমুল গন্ডগোল হচ্ছে সম্পত্তি ভাগাভাগি নিয়ে। কেউ কারও ভাগ ছাড়তে চায় না একফোঁটাও। হতদরিদ্র রাজ্জাকের অল্প কিছু জমিজমা আছে, সারা জীবনের হাড়ভাঙা খাটুনির ফল। ওইগুলো নিয়েই এই গন্ডগোলের সূত্রপাত। উচ্চকন্ঠে গন্ডগোলের শব্দে আশ-পাশের বাড়ির কিছু মানুষ জমে গেছে। গন্ডগোলের একপর্যায়ে রাজ্জাকের একমাত্র ছেলে হায়দার ভীষণ উত্তেজিত কন্ঠে ঘোষণা করলো, বাবার যেখানে যা আছে সব আমার, এর এককনাও আমি কাওরে দেব না। 

হায়দারের বড় বোনও কোন অংশে কম যায় না। সেও গলা ফাটিয়ে চিৎকার কওে বলল, বড্ড লায়েক হয়েছিস তুই না ? আমিও দেখে নেব কি কওে জমিজমা আদায় করতে হয়। তার স্বামী যদিও একটু মিনমিনে স্বভাবের, কিন্তু' বউ এর কথা শুনে চট করে অন্যরকম হয়ে গেল। সে তার বউকে লক্ষ্য কওে বলল, তোমার আব্বা ছেলে জন্ম দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু' মানুষ করতে পারেনি। বিরাট অমানুষ হইছে।

দুলাভায়ের কথা শুনে হায়দার সত্যিই যেন অমানুষ হয়ে গেল। বয়স-সম্পর্কের ভুলে সে আরও উচ্চকন্ঠে গলা ফাটিয়ে বলল, তোরা যা পারিস করিস, আমিও দেখে নেব কার কত ক্ষমতা। আব্বা সব কিছু আমার নামে লিখে দেছে। এর এককনাও আমি কাউরে দেব না।

ধীরে ধীরে আশপাশে লোকজন বাড়তে লাগলো। সবাই নীরব দর্শক। এ ধরনের পারিবারিক গন্ডগোল বাইরের মানুষের কাছে বেশ উপভোগ্য হয়। বেশীরভাগই মহিলা, মুখে কুলুপ এঁটে দাড়িয়ে আছে। কারও মুখে টু শব্দ নেই। কিছুক্ষণের ভেতর গাঁয়ের দু-চারজন বয়ষ্ক লোক এসে গের রাজ্জাকের বাড়ির আঙিনায়। এরা কিন্তু' নীরব দর্শক না। এসব ক্ষেত্রে এরা নিজেদেরকে জাহির করবার একটা সুযোগ পায়। সবার থেকে বয়স্ক জব্বার মোল্লা সামনে এগিয়ে এসে বলল, কি শুরু করলে তোমরা? তোমাদেরও বাপের কতটুক জমি আছে? এই নিয়ে এত কামড়া-কামড়ি! ছিঃ, ছিঃ, ছিঃ, বাপটা মৃত্যুশয্যায় আর ছেলে-মেয়েদেরও কান্ড দেখ! ঘোর কলিকাল।

এতক্ষণ যারা চুপ ছিলো তাদের ভেতর এখন মৃদু গুনগুন শুরু হলো। এতক্ষণ সাহস করে কেউ কথা বলতে পারেনি। জব্বার মোল্লার সায় পেয়ে নানা মুখে নানা মন-ব্য শুরু হলো। একজন তার পাশের জনকে লক্ষ্য করে বলল বেশ হতাশ গলায় বলল, সারাজীবন এত কষ্ট কওে এত সব জমিজমা-টাকাপয়সা করে লাভ কি বলেন? আপনি চোখ বুজলেই সব শেষ। ছেলে-মেয়েদের অবস্থা দেখলেন ভাই ? দুনিয়ার হালচাল দিনদিন কি যে হচ্ছে! আগে তোর বাপের জীবন না জমি ভাগাভাগি? এসব অপগন্ড মানুষ করে লাভ কি?

বাইরের লোকজনের কথাবার্তায় হায়দারদের গন্ডগোল কিছুটা ঝিম ধরে গেল। হাজার হলেও গাঁয়ের মুরুব্বি মানুষ। মাথা যতই গরম হোক, তাদেও মুখের ওপর কথা বলতে গেলে দশবার ভাবতে হয়। হায়দার বারান্দায় উঠে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ল, মুখ থমথমে। মুখ দেখেই বোঝা যায় ভীষণ বিরক্ত। আছে সেটা বোঝা যাচ্ছে, বোঝা যাচ্ছে তার বুকের ক্ষীণ ওঠানামা দেখে। মুখে কোন কথা নেই, মাঝেমাঝে যখন একটু চোখ খোলে নিজের হাত দিয়ে মাথায় আঘাত করে।

কিছুই খেতে চায় না, মুখের সামনে খাবার ধরলেই হাত দিয়ে সরিয়ে দেয়। বেশী সমস্যা হয়েছে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ায়। সে যে কখন কি বলতে চায়, কিছু দরকার কিনা কিছুই বোঝা যাচ্ছে  না। এক এক করে ঘরে লোক জমতে শুরু করেছে। যারা বাইরে দাড়িয়ে ভাই-বোনের ঝগড়া দেখছিল তারাই এখন রাজজাকের ঘরে ভীড় জমাতে শুরু করেছে। সবাই আসছে ঘরে কিন্তু' তার নিজের ছেলে-মেয়েদের কোন খোজ নেই। তারা বাইরে দাড়িয়ে আছে থমথমে মুখে। তাদের মাথায় এখন বাবার চিন্তা না, জমির চিন্তা। কিভাবে কে কতটা দখল করবে সেই চিন্তায় অস্থির, বাবাকে নিয়ে ভাববার সময় কই? আর তাছাড়া বাবাকে তো তারা খরচের খাতায় তুলে দিয়েছে। এখন শুধু অনর্থক ঘন্টা-দিন গোনা, মরার অপেক্ষা। মরলেই হয়, তারপর শুরু হবে আসল খেলা। কার কতটুকু ক্ষমতা দেখা যাবে।

হায়দারের মাথার ভেতর নানান ফন্দি ঘুরপাক খাচ্ছে, সে থম মেরে বারান্দায় বসে ছিল, কিন্তু' বাবার ঘরে যতই হৈ চৈ বাড়ছে তার বিরক্তিও বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। একসময় প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে হায়দার উঠে দাঁড়ালো। নাহ্ এখানে আর বসা যাবে না। একলাফে উঠোন পেরিয়ে বাড়ির সীমানা থেকে বেরিয়ে আসল সে। হনহন করে হাটা দিলো রসুলপুর বাজারের দিকে। রাগে সর্ব-শরীর জ্বলছে। এখন একটা সিগারেট টানার দরকার। পকেটে নেই এক পয়সা! আগে যা টুকটাক হাত খরচ মায়ের কাছ থেকে চেয়ে নিত, এখন সে উপায়ও নেই। বাবার পেছনে হাজার হাজার টাকা জলের মত খরচ হয়ে গেল। রাস্তা দিয়ে হাটতে হাটতে হঠাৎ তার সব রাগ বাবার উপর গিয়ে পড়লো। মনে মনে বলে ফেলল- শালার বুড়া মরেও না। রাগ তো হবেই, মুখে মুখে বোনদের সাথে যতই  হম্বিতম্বি করুক সে তো জানে বাবা কিছুই তার নামে লিখে দেয়নি। দেবেই বা কি করে? দেবার সময় পেল কই? সুস্থ' মানুষ আচমকা বেডে পড়ে গেল। এখন তো কথাও বলতে পারে না। কথা বলতে পারলেও একটা ব্যবস্থা করা যেত, সবার সামনে মুখ দিয়ে বলিয়ে নেওয়া যেত।

হায়দারের ভীষণ অস্থির অস্থির লাগছে। বাবা মরার পর সে পারবে তো বোনদের সাথে টেক্কা দিতে? মাধার ভেতর দুঃচিন্তার ঝড় নিয়ে সে বজলুর চায়ের দোকানে ঢুকল। ঢুকেই বজলুকে বলল, একটা সিগারেট দে।

বজলু বিরক্ত গলায় বলল, আর বাকী দিতে পারব না। তোর আগের টাকা শোধ কর আগে।

হঠাৎ কি যে হলো হায়দারের মাথার ভেতর, সে হিংস্র বাঘের মত একলাফে বজলুর গলা চেপে ধরল। অনর্গল গালিগালাজ করতে করতে বলল, তুই দিবি না মানে? তোর বাপ দেবে।

চায়ের দোকানে সবসময়ই কিছু অলস খরিদ্দার বসে থাকে। তাদের একজন হায়দারকে টানতে টানতে দোকানের বাইরে নিয়ে গেল, কি হইছে তোর? তুই কি পাগল হলি? বাকী টাকা শোধ করতে পারিস না আবার গায়ে হাত তুলিস?

এবার যেন হায়দার কিছুটা স্বাভাবিক হল। কোন কথা না বলে হনহন করে আবার বড়ির দিকে হাটা দিল।

পেছন থেকে বজলুর রাগান্বিত কন্ঠস্বর ভেসে এলো, ফুটানি মারাস না? বাকী টাকা ক্যামনে আদায় করি দেখিস। হায়দার বজলুর কথায় কর্ণপাত করে না। সে বাড়ির দিকে হাটতে থাকে ধীরে ধীরে। এখন আর সেই ভীষণ উত্তেজিত ভাবটা নেই তার। এখন তাকে অনেকটা অসহায় বিধ্বস্ত লাগছে। নাহ্, মাথা গরম করে এমন একটা কাজ করা ঠিক হয়নি তার। বজলু তার কতকালের পুরনো বন্ধু। বিপদে-আপদে তাকে দেখেছে অনেকবার। বাড়ির আঙিনায় পৌঁছে সে দেখল, আরো বেশী লোকজন জমে গেছে। আচমকা তার মনের ভেতর একটা ধাক্কার মতো লাগলো। বুড়ার কিছু হয়ে গেল নাকি? হায়দার এক ছুটে তার বাবার অন্ধকার-জীর্ণ-মলিন-গুমোট ঘরে ঢুকে গেল। একে তো ছোট ঘর, মহিলাদের ভীড়ে ঘরে ঢোকাই মুশকিল। সে দেখল, বাবাকে দুজন পিঠে হাত দিয়ে বসিয়েছে আর মা

বাবাকে খাওয়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু' সে হাত দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছে সবকিছু, মুখ দিয়ে একটা গোঙানোর মত শব্দ হচ্ছে শুধু। কিছুই খেতে চাচ্ছে না, নিজের হাত দিয়ে বারবার মাথায় আঘাত করছে। ঘরের ভেতর ফল-মুল আরো কত কি খাবার জমে গেছে।হায়দার বাইরে বেরিয়ে আসল। আচ্ছা তার বুকের ভেতর এমন ধাক্কার মত লাগলো কেন! সে একটু আগেই বুড়ার মৃত্যু কামনা করছিল। তাহলে বুকের ভেতর এমন করে মোচড় দিয়ে উঠলো কেন? এটাই কি রক্তের টান? হবে হয়ত। তার মনটা ভীষণ খারাপ হলো বাবার কথা চিন্তা করে। আহারে, যে মানুষ সুস্থ থাকতে একটা ভালো কিছু কিনে খেতে পারেনি কোনদিন।সংসার চালাতেই সারাজীবন হিমশিম খেয়েছে শুধু। অথচ আজ তার সামনে দেখ সব ভালো ভালো খাবার পড়ে আছে, কিন্তু একবিন্দুও মুখে দিতে পারছে না। নিয়তির কি আজব বিচার !

অভাবের সংসারে হায়দারের লেখাপড়া হয়নি বেশিদূর। কোনরকমে ক্লাস সেভেন উঠতেই বন্ধ হয়ে গেল। তার বাবাও সামান্য লেখাপড়া জানে, এটা তার জানা আছে। বাবার হাতের লেখা ছিল অদ্ভুত সুন্দর, যেটা নিয়ে মানুষের মুখে কত কথা শুনেছে সে, ছোটকাল থেকে। আপদ-মস-ক খেটে-খাওয়া, একজন কৃষকের এমন মুক্তার মত হাতের লেখা দেখে করো বিশ্বাস হয় না প্রথম প্রথম। তারপর একসময় বাবার হাতের লেখার কথা ছড়িয়ে পড়লো জনে জনে। হায়দার ছোটবেলা থেকে দেখছে তার বাবার কাছে কত লোক আসত একটা চিঠি লিখে নেবার জন্যে। বাবা বিরক্ত হতো না। হয়ত মনে মনে একটু গর্বও ছিল তার এজন্যে। একজন হতদরিদ্র মানুষের আর কিই বা থাকে একজীবনে গর্ব করার মত? নুন আনতে পান-া ফুরোয় যার সংসারে তার গর্ব আসবে কোথা থেকে? ছোটবেলার কথা মনে পড়তেই আরো মন খারাপ হলো হায়দারের। বাবার পিঠে চড়ে সমস্ত- এলাকা ঘুরে বেড়াত সে। পুকুরের এমাথা থেকে ওমাথা সাঁতার দিত।

কি মনে করে সে আবার বাবার ঘরে ঢুকল। তাকে এখনও জোর করে খাওয়াবার চেষ্টা চলছে। বাবাকে ওষুধগুলো পর্যন্ত খাওয়ানো যাচ্ছে না। হায়দার একদৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকিয়ে দাড়িয়ে রইল। একটু পর সে খেয়াল করলো বাবা হাত নেড়ে তাকে কি যেন বোঝাবার চেষ্টা করছে।

কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থেকে হায়দারের মনে হলো, হ্যাঁ সে বোধহয় বুঝতে পেরেছে বাবার ইঙ্গিত। বাবা কাগজ-কলম চাচ্ছে। সে একছুটে তার ঘর থেকে অনেক খুঁজে কাগজ-কলম নিয়ে আসল। কলমটা ভালো না, দাগ পড়ে না ভালো। মহিলাদের ভীড় ঠেলে বাবার সামনে যেয়ে কাগজ-কলম রাখল সে। বাবা তার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলো, যেন চিনতে পারছে না। তারপর শুকনো-চিমসানো মুখে একটুকরা মৃদু হাসি দেখা গেল। হ্যাঁ, তারমানে সে কাগজ-কলমই চাচ্ছিল। কাঁপা-কাঁপা হাতে সে কোনরকমে লিখলো, “বাবা তুই ওদেরও বল আমি কিছুই খাব না এখন। আমারে একটু শানি-তে ঘুমাতে দে তোরা। ঘরের থাইকে সবাইওে চাইলে যাতি বল।” অনেক কষ্টে এটুকু লিখেই শুয়ে পড়লো বাবা। হায়দারের হাতে কাগজের লেখা অংশটুকু দিয়ে বাকি কাগজটা ছিঁড়ে নিজের কাছে রাখলো বাবা। কলমটাও। হায়দার সকলকে ঘর থেকে হটিয়ে দিল। মাকে জোর করে বাইরে নিয়ে গেল। গম্ভীর গলায় বললো, “সে ঘুমাইতে চায়, তোমরা তারে যন্ত্রণা দিয়ো না, কেউ ঘরে ঢুকবা না এখন।” মা কান্নাজড়িত কন্ঠে বললো, “কিন্তু' সকাল থেইকে তো কিছুই খাইলো না তোর বাপে, ওষুধও খায় না। হায়দার রাগি গলায় বললো, “এখন তার খাবার ইচ্ছা নেই, যখন ইচ্ছা হবে কাগজে লিখে জানাবে। তোমরা কেই যেন ঘরে ঢুগবানা। ”লোকজন এবার যার যার বাড়ির পথ ধরলো, একটু একটু করে ফাঁকা হলো বাড়িটা। তারপর শুনশান নীরবতা।

হায়দার থমথমে মুখে চেয়ারের উপর বসে পড়লো ঠিক তার বাবার ঘরের সামনে। কিছুক্ষণ আগেও তার মধ্যে যে হিংস্র ভাবটা ছিল এখন তার বিন্দু মাত্র নেই। বরং, একটু ভালো করে লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে তার দু-চোখে এখন এক অদ্ভুত শূণ্যতা বিরাজ করছে। ফাঁকা দৃষ্টিতে দুরের মাঠের দিকে তাকিয়ে আছে। একসময় তার অজানে- চোখ দুটো জ্বালা করে উঠলো। সে দ্রুত তার ঘরে ঢুকে দরজা টেনে দিলো। দ্রুত হাত দিয়ে ভেজা দু-চোখ মুছে ফেলল। তার এমন হচ্ছে কেন? বাবা যে আর বাঁচবে না এটা তো এখন সবাই জানে। তাহলে এই শেষ সময়ে এসে তার চোখ ভিজে যাচ্ছে কেন? হায়দার তার খাটের ওপর শুয়ে পড়লো । শরীরে কুলানো যাচ্ছে না আর। তবু বুক ফেটে কান্না বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। কিন্তু' তাকে তো এখন দুর্বল হলে চলবে না, সংসারের সব দায়িত্ব এখন তার। না আর কাঁদতে না হায়দার। তাকে শক্ত হয়ে দাড়াতে হবে, এছাড়া যে আর উপায় নেই তার। বাবা যতদিন সুস্থ- ছিলো ততদিন কাউকে একটুও বুঝতে দেয়নি কিভাবে চলে যাচ্ছে সংসারটা।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলেছে। বাড়িতে রান্না-বান্না, খাওয়া-দাওয়া একরকম বন্ধ। ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে আসছে। উথাল-পাতাল চিন্তা করতে করতে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল সে।

উচ্চরো কান্নার শব্দ আর হৈ-চৈ না হলে আরো কতক্ষণ ঘুমাতো জানে না হায়দার। কান্নার শব্দে ঘুম ভাঙলো তার। গভীর ঘুমের ঘোর কাটতে একটু সময় লাগলো তার। তারপর একলাফে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে আসলো হায়দার। বাড়ি লোকে - লোকারণ্য। মহিলারা সব মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কান্না সামলাচ্ছে যেন। হায়দার বাবার ঘরে ঢুকতে যাবে এমনসময় তার সেই ঝগড়াটে বড়বোন দু-হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলো তাকে। “ভাইরে আব্বা আর নাইরে ভাই”। হায়দার ফ্যালফ্যাল করে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকলো তার বোনের দিকে। তারপর সে যেন সম্বিত ফিরে পেল। ঘুমের রেশ কেটে গেছে পুরোটাই। তার বুকের ভেতর থেকে একটা লম্বা দীর্ঘ:শ্বাস বেরিয়ে আসল। “বাবা নেই?” সে আর বাবার ঘরে ঢুকলো না, আস্তে করে চেয়ারে বসে পড়লো। চারদিকে শুধু কান্নাকাটি আর বিলাপের আওয়াজ, কিন্তু কিছুই যেন তাকে স্পর্শ করছে না। সে আবার সেই শূন্য দৃষ্টিতে বাইরে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে বসে থাকলো। সন্ধ্যা নেমেছে অনেক আগেই। তারমানে সে লম্বা সময় ঘুমিয়েছে। ধীরে ধীরে বাড়িতে লোকজনের ভীড় আরও বাড়ছে।

এখন অনেক কাজ। বাবাকে দাফন করতে হবে। কিন্তু' পাথরের মত শক্ত হয়ে বসে থাকলো। বাবার মৃত মুখ দেখতে ইচ্ছে করছে না তার। সময়ের হিসাব নাই। এভাবে কতক্ষণ বসে থাকলেও সে জানে না। একসময় গ্রামের মুরুব্বিরা বাবার লাশ নিয়ে উঠনে বেরিয়ে আসলো। এখানে এখন তার বাবাকে গোসল করানো হবে। শেষবারের মত। মানুষের ভীড় এখন লাশকে ঘিরে। বাবার ঘর মুহুর্তের ভেতর শূন্য-ফাঁকা হয়ে গেল। শুধু ঘরের এককোনে মা একা বসে আছে মৃতের মত। তার বোধহয় আর কান্নার শক্তিটুকুও নেই।

পায়ে পায়ে সে বাবার বিছানার কাছে যেয়ে দাড়ায়। এখানেই একটু আগে তার জীবিত বাবা শুয়ে ছিল। সেই মানুষ কোথায় চলে গেল। বাবার খাটের ওপর জীর্ণ-মলিন চাঁদর। ঘরে একটা অল্প পাওয়ারের বাল্ব জ্বলছে, যেটা গোটা পরিবেশটাকে আরও করুণ করে তুলেছে। মা মরার মত বসে আছে, মাঝে মাঝে শুধু বুক চেরা দীর্ঘ:শ্বাস ফেলছে। এটা-সেটা ভাবতে ভাবতে হায়দারের চোখ আটকে গেল একটা লাল কলমের উপর, যেটা আজ সে বাবাকে দিয়েছিল। বাবার বালিসের পাশে পড়ে আছে ওটা। কি মনে করে সে কলমটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগলো। আর ঠিক তখনই তার মনে পড়ে গেল, বাবা কাগজের একটা ছেড়া অংশ তার কাছে দিয়েছিল। বাকিটুকু নিজের কাছে রেখেছিল। মুহুর্তেই হায়দারের মাথার ভেতর যেন ঝড় বয়ে গেল। সে একলাফে খাটের উপর উঠে কি যেন খুঁজতে লাগলো। বাবার চিটচিটে বালিশটা তুলে ধরতেই সে জিনিসটা পেয়ে গেল, যেটা সে খুঁজছিল। একটুকরা ছেড়া কাগজ। কাগজটাতে কাঁপা-কাঁপা হাতে কিছু লেখা আছে। কাগজটা চোখের সামনে মেলে ধরে প্রবল উত্তেজনায় সে পড়া শুরু করলো, “বাজানরে, আমি সারাজীবন তোদেরে ভালো কিছু খাওয়াইতে পারি নাই, এখন আমার চারপাশে অনেক অনেক ভালো খাবার। তোদেরে না দিয়ে আমি এইগুলান কেমনে খাই, তুই বল? আমি চাইলে যাবার পর তোরা এইগুলান খাস বাপজান। তোর মারে দেখিস।”

হায়দার একবার, দুবার, তিনবার, বারবার লেখাগুলো পড়তে লাগলো। তার দু-চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ে কাগজের টুকরাটা ভিজে ন্যাতান্যাতা হয়ে গেল। একসময় হায়দার গলা ছেড়ে কেঁদে উঠলো “বাজানরে”। সাথে সাথে ঘরের ভেতর ছুটে আসলো অনেক মানুষ, পুরুষ-মহিলা আর মুরুব্বিরা প্রায় সবাই, যেন এতক্ষণ কারও মনে ছিল না হায়দারের কথা। একজন হায়দারের মাথায় হাত রেখে সান-নার সুরে বললো, “বাবারে কান্দিস না, কারও বাপ-মা চিরদিন বাঁচে না। কিন্তু হায়দারের কানে তখন কারও কথাই ঢুকছে না, তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে সেই ছোটবেলার একটা দৃশ্য, বাবা কাঠ-ফাটানো রোদে সমস্ত- শরীর পুড়িয়ে মাঠ থেকে বাড়ি ফিরেই হাঁক দিতো, “কই, বাজান তুই কই? আয় গা ধুয়ে আসি”। হায়দারও অপেক্ষায় থকত, কখন বাজান বাড়ি ফিরবে। সে ছুটে এসেএকলাফে বাজানের কাঁধে উঠে বসতো। তাকে পিঠে নিয়ে পুকুরের এপাশ থেকে ওপাশ যেয়েই বাজান বলতো, “চল বাপ, গরম-গরম ভাত খাই।”

হায়দার আরেকবার “বাজান” বলে ফুঁপিয়ে উঠলো। তার সমস্ত শরীর কেঁপে-কেঁপে উঠতে লাগলো। সে তার হাতের ছেড়া কাগজটা কাউকে দেখতে দিলো না। ঝাপসা চোখে চারদিকে তাকিয়ে দেখল, অনেক অনেক খাবার সেখানে। সত্যিই বাজান কিছুই খায়নি। সব রেখে গেছে তাদের জন্যে। হায়দারের বুকটা যেন ভেঙে যাচ্ছে।

মা উঠে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। হায়দার মাকে জোর করে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কাঁদতে কাঁদতে বললো, “বাজানওে আমার কিচ্ছু লাগবে না। শুধু তুমি ফিরে আসো আমার কাছে।”

বাইরে তখন রাজ্জাকের মৃতদেহের গোসল শেষ করে জানাজার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।  

Comments

Top

বোর্ডিং লাউঞ্জ 

অরুণ মাইতি 

girl.jpg
বোডিং লাউঞ্জ
arun-maity.jpg

'Excuse me!'

কলকাতা এয়ারপোর্টের লাউঞ্জে বসে শ্রেয়সী একটু তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল। বেশ কয়েকদিন খুব ধকল গেছে । খুড়তুত বোনের বিয়ের উপলক্ষে থেকে এসেছিল সে। বিয়েটা খুব আনন্দে কেটেছে, কিন্তু ঘুম হয় নি। আজ ভোরের ফ্লাইট ছিল। রাত শেষ হতে না হতেই বেরিয়ে পড়তে হয়েছে তাকে। ফ্লাইট এক ঘণ্টা দেরিতে ছাড়ছে। তাই সে চোখ বুজে বসে অপেক্ষা করছিল। কখন যে তন্দ্রা এসে গেছে বুঝতে পারে নি। একটু বিরক্ত হয়েই সে চোখ খুলল।

'Excuse me! Are you Miss Shreyosi Roy?'

কিছুক্ষণের জন্য সে আগন্তুকের দিকে তাকিয়ে রইল – তারপরই উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল - 'আরে গৌতম না? What a pleasant surprise!'

আর অর্ণবও চাকরি নিয়ে আসাম চলে গিয়েছিল। আর কারুর টেলিফোন নাম্বার আমার কাছে ছিল না।' শ্রেয়সী – 'হ্যাঁ, তখন মুম্বাই শিফট করে গিয়েছিলাম। বাবা তো আগেই ওখানে বদলি হয়ে গিয়েছিল। পরীক্ষার পর খুব জোরাজুরি করলেন ওখান থেকে ফার্দার স্টাডি করার জন্য। মায়েরও তাই ইচ্ছে ছিল।' গৌতম – 'ছাড় পুরানো কথা। সবই পরিস্থিতি। তা এখন কী করছিস? মুম্বাইতেই আছিস?'

শ্রেয়সী – 'না। আমি এখন ব্যাঙ্গালোরে থাকি। ওখানে একটা স্কুলে পড়াই। তুই?' গৌতম – 'আমি ফ্রিল্যান্সার। আপাতত দিল্লীতে আছি। যখন যেমন কাজ পাই করি।'একটু হেসে গৌতম বলল 'আমি ভাবতেই পারছি না তুই নাকি স্কুল টিচার। তোর থেকে ভীতু বোধহয় কলেজে আর কেউ ছিল না।' তা তোর কথা ক্লাসে কেউ শোনে?'
শ্রেয়সী – 'স্কুলে খোঁজ নিয়ে দেখ, কড়া টিচার হিসেবে আমার বদনাম আছে। দশ বছর আগের আমি আর এখনকার আমি-র মধ্যে অনেক তফাত।'
গৌতম – 'তা ঠিক। মোটা হয়েছিস। দিদিমণি মার্কা একটা চশমাও হয়েছে দেখছি।'
শ্রেয়সী – 'তবে তুই একদম বদলাস নি। যেই রকমটা ছিলি সেই রকমটাই রয়েছিস।'
গৌতম – 'তারপর, বিয়ে করেছিস?'
শ্রেয়সী – 'হ্যাঁ। বিয়ে ছয় বছর হয়ে গেছে।'
গৌতম – 'গ্রেট! তা তোর Mr. X কেমন আছে?'
শ্রেয়সী – 'Mr. X! তোর এখনো মনে আছে সেই কথা?'
গৌতম – 'মনে থাকবে না। তোকে সবাই যা খেপাতো ঐ ভদ্রলোককে নিয়ে। তবে ওকে নিয়ে কবিতাগুলো অসাধারণ লিখেছিলি। আমি কপি করে রেখেছিলাম লেখাগুলো। এখনো থাকে আমার সঙ্গে।'

দীর্ঘশ্বাস ফেলে শ্রেয়সী বলল 'না রে, ঐ চ্যাপ্টারটার আর কিছু হল না।'

গৌতম – 'ও, sorry to hear that, ঐরকম তো জীবনে হয়েই থাকে। তা কর্তা কী করে? ছেলেমেয়ে হয়েছে?'

শ্রেয়সী – 'ও সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার ওখানে একটা বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করে। আর চার বছরের এক দুরন্ত মেয়ে আছে।'

গৌতম – 'অসাধারণ। তা ওরা কোথায়? দেখছি না তো?'

শ্রেয়সী – 'ওরা আসে নি। কাজিনের বিয়ে ছিল। ও ছুটি পায় নি। শাশুড়িমা মেয়েকে এই গরমে পাঠাল না।'

গৌতম – 'তা ভালোই করেছেন। এখানে যা গরম তাতে ওর ভীষণ কষ্ট হতো। ব্যাঙ্গালোরের ওয়েদার তো খুব ভালো।'

শ্রেয়সী – 'হ্যাঁ। ওখানে এতটা গরম পড়ে না। প্লেজেন্ট ওয়েদার। তা তোর খবর বল। বিয়ে করেছিস?'

গৌতম – 'না।'

শ্রেয়সী – 'এখনো বিয়ে করিস নি কেন? গার্ল ফ্রেন্ড আছে নিশ্চয়ই?'

গৌতম – 'না না। সে রকম কিছুই নেই।'

শ্রেয়সী – 'তাহলে সারাজীবন ব্যাচেলর থাকার প্ল্যান করছিস নাকি?'

গৌতম – 'সেইরকমই ইচ্ছে আছে। বিয়ে করব না।'

শ্রেয়সী – 'হমম। ডাল মে কুচ কালা হ্যাঁয়। প্রেম ঘটিত কিছু ব্যাপার মনে হচ্ছে। খুলে বল।'

গৌতম – 'আরে তেমন কিছু না। একজনকে ভালো লাগতো, তারপর সেইরকম ভাবে আর কাউকে ভালো লাগে নি।'

শ্রেয়সী – 'ও, তা কাজের সূত্রে কাউকে পছন্দ হয়েছিল?'

গৌতম – 'না। কাজের সূত্রে নয়। তার আগে।'

শ্রেয়সী – 'কলেজের সময়?' গৌতম সম্মতিসূচক একটু হাসল।

শ্রেয়সী – 'কী সাংঘাতিক! সবাই আমায় খেপাতিস আর তুই নিজে ডুবে ডুবে জল খাচ্ছিলি। আমরা এক ফোঁটা টের পাই নি। কলেজ মানে তো আমি নিশ্চয়ই চিনি।'

গৌতম হাসতে থাকলো।

শ্রেয়সী – 'তুই হাসি থামা। তার নাম বল।'

গৌতম – 'ছাড় না পুরানো কথা ঘেঁটে কী লাভ?'

শ্রেয়সী – 'তুই থাম। দাঁড়া, আমি গেস করি – শর্মিষ্ঠা?'

গৌতম – 'না।'

শ্রেয়সী – 'তাহলে অনন্যা?'
গৌতম – 'না।'
শ্রেয়সী – 'ঋতু?'
গৌতম – 'না। কাটা না।'
শ্রেয়সী – 'চুপ কর। তাহলে কী স্নিগ্ধা, রত্না, নিশা বা অপলার মধ্যে কেউ?'
গৌতম – 'না। ওদের কেউ না?'
শ্রেয়সী – 'তাহলে কে? আমাদের সিনিয়র বা জুনিয়র কেউ?'
গৌতম – 'না।'
শ্রেয়সী – 'আর তো কাউকে মনে পড়ছে না। তুই নামটা বল।'
কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর দীর্ঘশ্বাস ফেলে গৌতম বলল – 'আর একজনই তো বাকি রইলো।'
'আর একজন - ' কথাটা অস্ফুটভাবে উচ্চারণ করেই শ্রেয়সী স্তব্ধ হয়ে গেল। স্তম্ভিত হয়ে সে গৌতমের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণের জন্য, তারপর চোখ নামিয়ে নিলো মেঝের দিকে।

নিস্তব্ধ অবস্থায় কেটে গেল কিছুটা সময়। ডিপার্টচার এনাউন্সমেন্ট তাদের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করল। শ্রেয়সী গৌতমের দিকে না তাকিয়েই বলল, 'তুই তো এখানে আছিস, লাগেজগুলোর একটু খেয়াল রাখ। আমি রেস্ট রুম থেকে আসছি।'
সে দ্রুতপদে টয়লেট এর দিকে প্রস্থান করলো। গৌতম খুবই অস্বস্তিতে পড়ে গেল। সে ভাবতে পারে নি শ্রেয়সী এইরকম রিয়াক্ট করবে। তাকে সে কলেজের সময় থেকে ভালবাসে। কিন্তু বলতে পারে নি। এতদিন বাদে দেখা হবার পর আজ তা জানানোর কোন প্রয়োজনই ছিল না। সে এখন বিবাহিত। এই কথার তো আজ কোন মানে নেই। নিজেকে দোষারোপ করতে থাকল সে।

অনেকক্ষণ হয়ে গেছে। শ্রেয়সী এখনো ফেরে নি।  বোর্ডিং-এর লাইনটা ক্রমশ ছোট হতে শুরু করেছে। মাত্র সাত-আট জন বাকি। গৌতম চিন্তায় পড়ে গেল। শ্রেয়সী এতই বা দেরী করছে কেন? তার কী একটু এগিয়ে দেখা উচিত? কিন্তু ব্যাগগুলোর কী হবে?
বেশিক্ষণ তাকে ভাবতে হল না। শ্রেয়সী ফিরে এল। তাড়াহুড়ো করে ব্যাগ থেকে বোর্ডিং পাসটা বার করতে করতে আপনমনে বলল - 'উঃ, বড্ড দেরী হয়ে গেল।'
ভ্যানিটি ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে আর হ্যান্ডব্যাগের ট্রলিটা খুলে হাতে নিয়ে গৌতমের দিকে ফিরে বলল – 'আর কথা হল না। পারলে যোগাযোগ রাখিস। ফেসবুকে আমার নাম দিয়ে সার্চ করলেই পেয়ে যাবি। ছবি দেওয়া আছে তাই চিনতে অসুবিধা হবে না। চল, আজ আসি।'

শ্রেয়সী এগিয়ে গেল। কিন্তু দুই-পা পরেই দাড়িয়ে পড়ল। গৌতমের দিকে ফিরে অভিমানীর সুরে বলল – 'আগে কথাটা কেন বলতে পারলি না গৌতম। আমার Mr. X যে তুই ছিলি বুদ্ধু।' শ্রেয়সী দ্রুতপদে বোর্ডিং গেটের দিকে এগিয়ে গেল।

Comments

Top

arun-maity.jpg

পায়রা 

অরুণ মাইতি 

pigeon1.jpg

মায়ের সাথে ভাল করে কথা শেষ না করেই রচনা মোবাইল ফোনটাকে বিছানার এক কোনে ছুঁড়ে ফেলে দিল। রাগে, হতাশায় তার শরীর কাঁপতে থাকল। নিমেষের মধ্যে চোখ থেকে জল বেরিয়ে এল। বিছানায় আছড়ে পড়ে, বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদতে থাকলো সে।

মা কী করে তার সঙ্গে এইরকমটা করতে পারল? এক মাস ধরে যে প্ল্যানটা সে করেছিল, মা সেটা শেষ মুহূর্তে নষ্ট করে দিল। তাও কি না একটা তুচ্ছ পায়রার জন্য! এই কী একমাত্র সন্তানের প্রতি মায়ের ভালবাসা নিজের মেয়ের থেকে একটা অজানা পায়রা মায়ের কাছে বড় হল? আর কোথাকার কোন পায়রা, উড়ে এসে জুড়ে বসলো আর তার সমস্ত প্ল্যান বানচাল করে দিল। তার সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ল ঐ পায়রাটার ওপর।

রচনার স্বপ্নভঙ্গ মনের কথা বর্ণনা করতে গেলে জটিলতাই বাড়বে। তাই পাঠকদের সুবিধার জন্য ঘটনার প্রেক্ষাপট আমি যথাসম্ভব সংক্ষেপে বলছি।

রচনা তার স্বামী অবিনাশের সঙ্গে হায়দ্রাবাদে থাকে। তাদের দুই বছরের ছেলে শুভ (ডাকনাম বিল্টু) কিছুদিন যাবত প্লে-স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে। অবিনাশ একটা অ্যাকাউন্টিং ফার্মে অডিটের এর কাজ করে। কর্মী সংখ্যা কম বলে অফিসে তার কাজের চাপ প্রচুর। সে বেশ সকালবেলা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় এবং দেরীতে ফেরে। হপান্তগুলোতেও রেহাই নেই। প্রায় প্রতি শনিবার অফিস যেতে হয়। রচনা বাড়িতে বিল্টুকে নিয়ে একাই থাকে। বিল্টু ভীষণ দুরন্ত ছেলে, ফলে তাকে সারাদিন সামলে আর সংসারের বাকি কাজ করে সে বেশ ক্লান্ত থাকে। অবিনাশ বাড়ি ফিরলে তকে সে ভাল করে সময় দিয়ে পারে না। অবিনাশ যদিও এই নিয়ে নালিশ করে না, তবু এই ব্যাপারটা নিয়ে সে বেশ বিষণ্ণ থাকে। রচনার মা কলকাতায় থাকেন। তার বাবা সাত বছর হল গত হয়েছেন। মা কাকাদের সঙ্গে একই বাড়িতে থাকেন। কিন্তু সম্পত্তির ঝামেলার জন্য তাদের সঙ্গে মুখ দেখাদেখি বন্ধ। বিয়ের পর থেকেই বিধবা মা একাই সংসার চালান। যদিও উনার একজন সঙ্গী ছিল – একটি পোষা বিড়াল। কিন্তু দুই মাস হল সে মারা গেছে। রচনার মা পশুপাখি খুব ভালবাসেন। রচনা ছোটবেলা থেকেই বাড়িতে কুকুর, বিড়াল দেখে অভ্যস্ত। তার ছোটবেলা থেকে বিয়ে পর্যন্ত কোন সময়ে এমন হয়নি যে তাদের বাড়িতে কোন পশুপাখি ছিল না। এক এক সময় তার মায়ের উপর ভীষণ রাগ হতো এই নিয়ে। তার মা এত বেশি সময় ওদের দিতেন যে সে নিজেকে অবহেলিত মনে করত। এই ব্যাপারে মাকে বললে উনি বলতেন যে ওরা কথা বলতে পারে না বলে ওদের অনেক বেশি যত্ন নেওয়া প্রয়োজন। অক্টোবর মাসের শেষের দিকে একদিন অবিনাশ রচনাকে এসে জানায় নভেম্বরের শেষের দিকে সে একসপ্তাহের জন্য ছুটি পাবে। এত কম দিনের ছুটিতে কলকাতায় যাওয়া সম্ভব নয়। তাই সে প্রস্তাব দেয় কোথাও ঘুরতে যাওয়ার জন্য। রচনার মন খুশিতে ভরে যায়। বিল্টু জন্মাবার পর থেকে তাদের কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয় নি। সে মনে মনে ঠিক করে কেরালা যাওয়ার। কেরালার ব্যাকওয়াটারে তার যাবার ইচ্ছে অনেকদিনের। অবিনাশও রাজি হয়ে যায়। রচনার মা তার বাবার মৃত্যুর পর কোথাও ঘুরতে যান নি। বহুদিনের বিড়ালটা মারা যাবার পর মায়ের মনটা খুব ভালো থাকে না। এছাড়া বিল্টু মায়ের কাছে খুব ভালো থাকে। তার বিল্টুকে একেবারে সময় দিতে হয় না। তাই মা তাদের সাথে বেড়াতে গেলে সে অবিনাশকে পুরো সময়টাই দিতেপারবে। এই কথা ভেবে সে অবিনাশকে রাজি করায় তার মাকে আনবার

জন্য। সেই মতো যাবার এক সপ্তাহ আগে তার মায়ের ট্রেন এর টিকিট কাটা হয়। উদ্দীপ্ত রচনা মনে মনে ঠিক করতে থাকে কোন দিন তারা কোথায় ঘুরতে যাবে, কোন পোশাকটাপরবে। উত্তেজনায় কেটে যায় বেশ কিছু দিন। মায়ের রওনা হবার হপ্তাখানেক আগে হঠাৎ এক সমস্যার উদয় হয় – সেই পায়রা। তার মা বিকেলে ছাতে হাঁটতে গিয়ে দেখতে পান একটি পায়রা পড়ে আছে। ডানায় আঘাত পাবার জন্য উড়বার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। তার মা তাকে ঘরে নিয়ে এসে সেবা শুশ্রূষা করতে থাকেন। রচনা আপত্তি জানায় – কিন্তু উনি আশ্বাস দেন যে রওনা হবার আগেই পায়রাটা সুস্থ হয়ে উঠবে। পাখিরা তাড়াতাড়ি সেরে উঠে। কেটে যায় আরো কিছুদিন। কিন্তু পায়রাটি সুস্থ হয়ে ওঠে না। দুদিন আগে তার মা গড়িমসি শুরু করেন। পায়রাটি সুস্থ না হলে তিনি যাবেন কী করে। রচনা উনাকে পশু চিকিৎসালয়ে যেতে পরামর্শ দেয়। সেই মতো তার মা গিয়ে কিছু ওষুধ নিয়ে আসেন। কিন্তু তবু পায়রাটি উড়বার মতো সক্ষমতা পায় না।

আজ তার মায়ের রওনা হবার কথা ছিল। অবিনাশ ও বিল্টু বেরিয়ে যাবার পর সে মাকে ফোনে করেছিল। কিন্তু তার মা জানান যে তিনি যেতে পারবেন না। পায়রাটা এখনো পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠে নি। একটা অবলা প্রাণী ঘটনাক্রমে ওনার আশ্রয়ে এসে পড়েছে। উনি চলে এলে পায়রাটা কোন ভাবেই বাঁচবে না আর সেই মৃত্যুর জন্য উনিই দায়ী হবেন। বৃদ্ধ বয়েসে এতবড় পাপ উনি করতে পারবেন না। রচনা অনেক বোঝানোর চেষ্টা করে কিন্তু উনি সিদ্ধান্তে অনড় থাকেন। এটাই রচনার আশাভঙ্গের উপাখ্যান। বিছানার বালিশটা তার কান্নায় ভিজে গেছে। মনটাকে শক্ত করার চেষ্টা করে সে। সে তার মাকে চেনে। সিদ্ধান্তের নড়চড় কোন ভাবেই হবে না। ওদিকে বিল্টুর ফেরার সময় হয়ে আসছে। অবিনাশকেও জানাতে হবে। কী মুখ নিয়ে সে তাকে এই কথা বলবে? সাময়িক কান্নায় আবার ভেঙে পড়ে সে। বাকি দিনটা তার কেটে যায় দুঃখ, অভিমান ও কান্নার মধ্যে দিয়ে। রাতে অবিনাশের বুকে অনেকক্ষণ কেঁদে হালকা হয় সে।

ভীষণ বৃষ্টির মধ্যে পরদিন সকালে রচনার ঘুম ভাঙে। তার দুঃখে সমব্যথী হয়েই বোধহয় আকাশটা এত কাঁদছে। বিল্টুকে আজ স্কুলে পাঠানো যাবে না। রান্নাঘরে ব্রেকফাস্ট বানাতে গিয়ে অবিনাশের ডাকে সে বসার ঘরে ছুটে আসে। টেলিভিশনের পর্দায় তাজা খবরটা তাকে হতভম্ব করে দেয়। কলকাতা হায়দ্রাবাদগামী ট্রেন ওড়িশাতে লাইনচ্যুত হয়েছে। কমপক্ষে পঞ্চাশ জনের মৃত্যুর আশঙ্কা করা হচ্ছে। অসংখ্য মানুষ আহত। এই ট্রেন-এই তার মায়ের আসার কথা ছিল। শিহরিত হয়ে সে সোফায় ধপ করে বসে পড়ে। চোখ বুঝে হাতজোড় করে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে। যে পায়রাটাকে কাল সারাদিন ধরে শাপশাপান্ত করেছে, তার জন্য মা এতবড় বিপদের হাত থেকে বাঁচল। অবলা প্রাণীর প্রতি কৃতজ্ঞতায় তার মন ভরে যায়। মায়ের প্রতি সব অভিমান নিমেষের মধ্যে উধাও হয়ে যায়। একটু ধাতস্থ হবার পর মাকে ফোন করে। মায়ের ক্রন্দনরত কণ্ঠস্বর শুনে সে ভয় পেয়ে যায়। মায়ের এলোমেলো কথোপকথন থেকে সে জানতে পারে যে – কাল রাতে একজন প্রতিবেশী এসেছিলেন। তাই বসার ঘরের জানলাটা খোলা হয়েছিল। রাতে উনি সেটা বন্ধ করতে ভুলে যান। এই সুযোগে পাশের বাড়ির হুলো বেড়ালটা ঘরে ঢুকে পায়রাটাকে হত্যা করেছে। নিজেকে অপরাধী মনে করে পড়ে থাকা পালকগুলোর পাশে বসে ভীষণ কাঁদছে তার মা ।

Comments

Top

মনই জানে

কোয়েল দত্ত

girl1.jpg
মনই জানে

সুপর্ণা আজ বেশ সকাল সকালই রান্নাটা সেরে ফেলেছে। শুধু এক তরকারি ডাল ভাত করতে আর এমন কি সময় লাগে? কয়লার উনুন বলে যা সমস্যা। অনেক দিন বাদে আজ নৈহাটির বাইরে যাচ্ছে, সময়ে পৌঁছানোটা খুব জরুরী। এখন শুধু স্নান করে পাপানকে তৈরী করতে পারলেই কাজ শেষ। পাশের বাড়ির রমা বৌদিকে বলে রেখেছে কয়েক ঘণ্টার জন্য পাপানকে একটু সামলে দিতে। সকাল বেলা কাজের সময় এ রকম প্রতিবেশীর বাচ্চা দেখতে হলে যে বেশ মুশকিল হয় সুপর্ণা সেটা বোঝে। তাই পাপানকে নিয়েই সব জায়গায় যায়। কিন্তু আজ একেবারেই তা সম্ভব নয়। সকালের ভীড় ট্রেনে একা ওঠানামা করাটা বেশ কঠিন। তার উপর অনেক বছরের অনভ্যাস। বৌদির মেয়ে রূপূর আজ কলেজ ছুটি, ওই পাপানকে সামলে দেবে বলেছে, তাই একটু নিশ্চিন্ত সুপর্ণা। রূপূ, শ্বশুর মশাই এর সাথে গল্প করতে খুব পছন্দ করে। বাবা মানে সুপর্ণার শ্বশুর মশাই ভাটপাড়ার এক জুট মিলের সুপার ভাইজর ছিলেন। পাট জাত জিনিসের চাহিদায় ঘাটতির ফলে কর্মী ছাঁটাই, বেতন হ্রাস এসব নিয়ে শ্রমিক আন্দোলন চলে অনেকদিন ধরে। অবশেষে দুবছর আগে পাকাপাকি ভাবে তালা ঝুলে যায় কারখানায়। উনার গল্পের বই পড়ার খুব নেশা, খুব সুন্দর করে গল্প বলেনও।  রূপূ কলেজের ছুটি ছাটাতে মাঝে মাঝে এসে বাবার সাথে গল্প করে যায়। বাবার শরীরটা খারাপ নাহলে আজ পাপানকে উনিই সামলে দিতেন। আজকাল পাপানের সাথে ছুটোছুটি করতে পারেন না, অল্পতেই হাঁপিয়ে ওঠেন। আগে তো মাঝে মাঝে সুপর্ণার সকালে স্কুলে যাবার দেরী হয়ে গেলে বাবা রান্নার কাজেও হাতে হাতে সাহায্য করতেন। সুপর্ণা বাড়ির কাছেই একটা প্রাইভেট প্রাইমারি স্কুলে পড়ায়। কয়েক ঘণ্টার ব্যাপার, তাই চাকরিটা করতে পারে। মর্নিং স্কুল, পাপান ওই সময় ঘুমোতো, ওর ঘুম থেকে উঠতে উঠতে সুধাদি চলে আসত। পাপানকে সুধাদি খাবার খাইয়ে দিত। তারপর বাবার কাছে বসে খেলা করত কিছুক্ষণ। তারমধ্যেই সুপর্ণা বাড়ি ফিরে আসত। শ্বশুর মশাই এত ভাল বলেই বোধহয় সুপর্ণা এখনও সংসারটা করতে পারছে। এখন অবশ্য রুটিনটা একটু বদলেছে। সুধাদিকে কিছুদিন হল আসতে বারণ করেছে। সুপর্ণা এখন পাপানকে ওর সাথে স্কুলে নিয়ে যায়। ও কমন রুমে বসে নিজে নিজে খেলে। কখনও ক্লান্ত হয়ে ওখানেই ঘুমিয়ে পড়ে।

ইন্দ্রনীল আর সুপর্ণা নৈহাটি কলেজে পড়াশোনা করত। ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ছিল ইন্দ্র, সুপর্ণার এক বছরের সিনিয়র। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক স্তরের পার্ট ওয়ান পরীক্ষায় রেকর্ড মার্কস পেয়ে তখন কলেজে বেশ জনপ্রিয়।

বেশ ভালো ডিবেট করত আর সাথে অল্প সল্প ছাত্র রাজনীতি। লম্বা, তামাটে গায়ের রঙের সুদর্শন ছেলেটির জন্যে কলেজের মেয়েদের বেশ সম্ভ্রম মিশ্রিত ভালোলাগা ছিল। স্নাতকোত্তর করে কলেজে ছাত্র পড়াবে এমনি স্বপ্ন ছিল ওর। অন্যদিকে সুপর্ণা, বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। ওর বাবা কলকাতা হাইকোর্টের  বিচারপতি। বেশ সচ্ছল পরিবারে ওর বেড়ে ওঠা। ওর বাবার ইচ্ছে ছিল বি এ পাশ করে আই এ এস পরীক্ষার প্রস্তুতি নিক সুপর্ণা।  ওদের সম্পর্কের কথা বাড়িতে জানাজানি হতেই শুরু হয় তুমুল অশান্তি। ইন্দ্রনীলের যতই উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ থাক না কেন ওর নিম্নবিত্ত পরিবারকে কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি সুপর্ণার বাবা। আবেগ তাড়িত সুপর্ণা গোপনেই তৃতীয় বর্ষে পড়তে পড়তে  বিয়ে করে নেয় ইন্দ্রকে। সুপর্ণার বাপের বাড়ির দরজা বন্ধ হয়ে যায় চিরদিনের মত। নব্বই এর দশকের অস্থির সমাজ জীবন ইন্দ্রকে নাড়া দেয় ভীষণভাবে। একের পর এক কল কারখানা বন্ধ হচ্ছে, কোন নতুন শিল্প সংস্থান নেই, চাকরীর পরীক্ষায় চরম দূর্নীতি, সর্বত্র অযোগ্যদের জয়গান। অল্প অল্প করে রাজনীতিতে যুক্ত হতে শুরু করে ইন্দ্র। সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন তখন ওর চোখে। নবীন প্রজন্মের রাজনীতির প্রতি আকর্ষণ বাড়ানোই তখন ওর একমাত্র ধ্যান জ্ঞান।পড়াশোনা প্রায় বন্ধের পথে। মিটিং - মিছিল দিয়ে শুরু হল- তারপর পাড়ার দাদা - আর শেষে এলাকার গুণ্ডা। রোজগার বলতে তোলাবাজি  আর রাজনীতির কিছু কালো টাকা। সুপর্ণার সে সব অসৎ পথে রোজগার করা টাকা ছুঁয়ে দেখতেও ঘেন্না করে। অথচ বিয়ের পর পর যখন ইন্দ্র আস্তে আস্তে রাজনীতির চোরা স্রোতে গা ভাসাচ্ছে, বাড়িতে মা, বাবা, সুপর্ণার সাথে সেই নিয়ে নিত্য দিন অশান্তি, সুপর্ণার শ্বশুর মশাই বারবার ওকে এ সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে যেতে বলতেন' শুরুতেই সব শেষ করে দিলে কষ্টটা কম হয় রে মা। তোর অনেকখানি জীবন এখনো বাকি।' বাপের বাড়ির অমতে বিয়ে না করলে হয়তো সুপর্ণা ভেবে দেখত বিয়ে ভাঙ্গার কথা। কিন্তু সে পথও বন্ধ। বি এ পাশ করে একটা চাকরি যোগাড় করতে হবে এটাই ছিল তখন ওর একমাত্র লক্ষ্য। কিন্তু পরিবারে এক বিপর্যয় ঘটে গেল, হঠাৎই স্ট্রোকে শ্বাশুড়ী মারা গেলেন।

সার তখন অথৈ  জলে। পার্ট টু পরীক্ষা দেওয়া হল না। তার পরের বছর সুপর্ণা নয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা, পরীক্ষা সেবারও দেওয়া হল না। এখন মাঝে মাঝে পরীক্ষা দেওয়ার কথাটা ভাবলেও সংসারের সব দিক সামলাতে সামলাতে পড়াশুনাটা আর করা হয়ে ওঠে না। গত আট মাস হল শ্বশুর মশাই এর প্রস্টেট ক্যান্সার ধরা পড়েছে, প্রাথমিক ষ্টেজ, ডাক্তার বলেছেন ঠিক মত চিকিৎসা হলে ভাল হয়ে ওঠবেন। চিকিৎসা বেশ খরচ ও সময় সাপেক্ষ। এর জন্য নিয়মিত বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা আছে। সম্বল বলতে শ্বশুর মশাই এর জুট মিল বন্ধ হবার সময় পাওয়া এক কালীন কিছু অর্থ আর সুপর্ণার স্কুল থেকে পাওয়া সামান্য বেতন। তাছাড়া একটা বাচ্চারও অনেক খরচ, সামনের বছরেই আবার পাপানকে স্কুলে ভর্তি করাতে হবে। এখন তো মোটা টাকা ডোনেশন ছাড়া কোন ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলই ভর্তি নেয় না। সুপর্ণা এসব ভেবে কিছু কুল কিনারা করতে পারে না। শ্বাশুড়ী মারা যাবার পর থেকে এ বাড়িতে ওর একমাত্র বন্ধু শ্বশুর মশাই । বিনা দ্বিধায় সবকিছু এতদিন উনার সাথেই শেয়ার করে এসেছে। বাবা কি না করেছেন সুপর্ণার জন্য, অন্তঃসত্ত্বা থাকা কালীন প্রত্যেক মাসে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া, সময়ে সময়ে খাবার দেওয়া, এমনকি কখনো কখনো উনি সুপর্ণার জন্য ওর পছন্দ মত কিছু খাবারও নিজের হাতে বানিয়ে ওকে খাইয়েছেন। পাপান জন্মানোর পর ইন্দ্র যখন রাতের পর রাত বাড়ির বাইরে কাটাত, বাবা পাপানকে নিয়ে সারারাত জেগে বসে থাকতেন।  

কিছু দিন হল সকালের খবরের কাগজ আর কেবল কানেকশন বন্ধ করে দিয়েছে। এরকম দুঃসময়ে মেয়েদের গয়নাগাটি কাজে আসে কিন্তু সুপর্ণার সেসবেরও কোন বালাই নেই কারণ ওর আর ইন্দ্রের বিয়েটাই হয়েছিল মন্দিরে। বাপের বাড়ির কেউ আসেনি সেখানে। আর গয়না বলতে শ্বাশুড়ীর দেওয়া লোহা বাঁধানো আর কানের একটা দুল। সুপর্ণা টাকা রোজগারের পথ খুঁজে পায় না। বাড়িতে কিছু বাচ্চাকে পড়ানো শুরু করেছে ইদানিং। কিন্তু সেতো সামান্য কটা টাকা। এদিকে বাবার ওষুধের খরচ মাসে দশ হাজার টাকার উপরে। নিরুপায় হয়ে ছ’মাস আগে ইন্দ্রকে টাকার কথা বলেছিল। দু’হাজার টাকা ও সাথে সাথে দিয়েছিল। কিন্তু তারপর একবারও খবর নেয়নি বাবার অসুস্থতার। সকাল বেলা বেরোয় আর অনেক রাতে বাড়ি ফেরে। সুপর্ণা রাতের খাবার ঢাকা দিয়ে রাখে। কখনও খায়, কখনও আবার খায় না। সারাদিন কি খায় কে জানে? পাপান নিজের বাবাকে ঠিক মতো চেনে কিনা সুপর্ণার সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। ইন্দ্র অবশ্য বিয়ের পর পর অনিয়মিত হলেও নিজে থেকেই সুপর্ণাকে টাকা দিতে চাইত। সুপর্ণা প্রতিবারই সেই টাকা ফেরত দিয়ে দিয়েছে। ইন্দ্রও সেই থেকে চিরদিনের মতো টাকা দেওয়া বন্ধ করে দেয়। সুপর্ণা আর যাই করুক দ্বিতীয়বার ইন্দ্রকে টাকার কথা বলবে না।
এই আট মাসে এক লাখ চল্লিশ হাজার মতন খরচ হয়ে গেছে। সবই বাবার পি এফ, গ্রাচুইটির টাকা। এভাবে খরচ হতে থাকলে এ ভান্ডার ফুরোতে আর কিছু মাস মাত্র। গত মাসে বাবার দুটো ওষুধ ইচ্ছে করে কেনেনি সুপর্ণা। এ মাসের টেস্ট রিপোর্ট তাই বেশ খারাপ। ডাক্তারের কাছে ওষুধ না খাওয়ানোর ব্যাপারটা পুরোপুরি গোপন করে গেছে সুপর্ণা। ডাক্তারবাবুও রিপোর্ট খারাপ আসায় খুব অবাক হয়ে গিয়েছেন। পাড়ার ওষুধের দোকানে কিছু ওষুধ পাওয়া যায় না। এডভান্স দিলে তবেই কলকাতা থেকে আনিয়ে দেয়। ধার বাকিতে দিতে চায় না। বাবা বুঝতে পেরেছেন যে উনি একটা ওষুধ উনি কম খাচ্ছেন। কিন্তু সুপর্ণাকে কিছু জিজ্ঞেস করেননি। বাবার চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারে না।
বাবার প্রেসক্রিপশন আর ওষুধের বিলগুলো টেবিলের উপর রাখল সুপর্ণা।' বাবাকে আমি একটু একটু করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছি। আমি পরিকল্পনা করে খুন করছি।  আমার মরে যেতে ইচ্ছে করে, কিন্ত সাহস নেই। বিশ্বাস করুন আমি চেষ্টা করেছিলাম দুবার কিন্তু পারিনি। আমি না থাকলে পাপানকে দেখার কেউ থাকবে না। ইন্দ্রনীলকে ছাড়া আমার চলে যাবে কিন্ত বাবাকে ছাড়া - - । আমি কাকে মারব ডাক্তারবাবু? বিশ্বাস করুন আমি মানসিক বিকারগ্রস্ত নই। হ্যাঁ, আমি ভালোবাসি, খুব ভালোবাসি। এ অন্যায় নয়। '
কথা বলতে বলতে ভীষণ হাঁপাচ্ছে সুপর্ণা। উদ্ভ্রান্তের মত চেয়ে আছে। কোটোরাগত চোখের নীচে কেউ যেন কয়েক প্রলেপ কালি লেপে দিয়েছে । চোয়ালটা ভিতরে ঢুকে গেছে । শীর্ণ শরীরটাকে কোন রকমে চেয়ার থেকে তুলে দরজার দিকে দু পা এগিয়ে গিয়ে পিছিয়ে আসল। চিৎকার করে বলল' ডঃ তরফদার বলুন না আমি কি করব?' মনোবীদ ডঃ তরফদার এ গল্পের চরিত্রগুলোকে বেশ কিছুদিন ধরেই চেনেন। ইন্দ্রনীল রায় গত কয়েক মাস হল উনারই চিকিৎসাধীন। কোন ভালোবাসা অন্যায়? তাহলে ইন্দ্রনীলের সন্দেহটাই কি ঠিক?

Comments

Top

অর্ধ শতক

পিয়ালী গাঙ্গুলি

talking.jpeg
অর্ধ শতক

ত রাত্তিরে মোবাইলে টুং টাং। হোয়াটস্যাপ চেক করল রু। ঠিকই আন্দাজ করেছিল। পিসতুতো দাদা।

- কি করছিস? ছেলে ঘুমলো?

- এই সবেমাত্র। যুদ্ধ করে। তুমি কি করছ?

- এডিটিংয়ের প্রচুর কাজ আছে, সেসবই করছি

- তা জলপথে নিশ্চয়ই? ক পেগ চলছে?

- হিসেব করি নি - অত খাও কেন?

- কেউ বারণ করার নেই বলে জবাবটা দুবার টাইপ করেও মুছে দিল রু। এই নিয়ে এখন কথা বলতে গেলে ঘুমের বারোটা বেজে যাবে। সকালে আর উঠতে পারবে না। কি সুন্দর দেখতে ছিল প্রণবদাকে, রীতিমত হ্যান্ডসাম যাকে বলে। আর কি চেহারা হয়েছে এখন। সেই যে বুদ্ধদেব গুহার 'রুহাহা' তে ঋজুদা যেমন বলেছিল রুদ্রকে কোনো জলো জায়গায় ছেড়ে দিলেই তিতিরের হিপ্পো দেখা হয়ে যাবে। ঠিক তেমন। একগাদা অসুখও বাধিয়ে রেখেছে। উশৃঙ্খল জীবনযাপন আর অতিরিক্ত মদ্যপান। সৃষ্টিশীল মানুষগুলো কেন যে এমন হয়? ছোটবেলা থেকেই দারুণ ছবি তোলে। সেটা অবশ্য জেনেটিক, বাবার থেকে পাওয়া। খুব কম বয়সেই প্রেস ফটোগ্রাফার। এখন শুধু ফ্রিল্যান্সিংই করে। ডোনা বৌদিকেও দেখতে খুব সুন্দর ছিল। ভিন্ন ধর্ম নিয়েও বাড়িতে কোনো অশান্তি হয়নি। কদিন পরেই রাজপুত্রর মত ফুটফুটে ছেলে আকাশ। সবই ঠিক চলছিল। কি যে হল কে জানে! রু তখন অনেকেই ছোট। এসব জটিলতা বোঝার বয়স হয়নি।। এখন বয়েস হয়েছে, কিন্তু এখন আর ওসব পুরনো কথা ঘাঁটতে ইচ্ছা করে না। এক যুগের বেশি হয়ে গেল ওরা আলাদা থাকে। কোনোরকম আইনি সেপারেশন বা ডিভোর্স হয়নি। শ্বশুরবাড়ির সাথেও সম্পর্ক আছে দাদার। একদিন বৌদির প্রসঙ্গ তুলতে দাদা বলেছিল "তোর বৌদির সঙ্গে এখন আমার সম্পর্কটা অনেকটা গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ডের মত"। বৌদি সপ্তাহে এক দুদিন আসে। ঘর গুছিয়ে, কিছু রান্না বান্না করে, জামাকাপড় কেঁচে দিয়ে চলে যায়। ছেলে বড় হয়ে গেছে। সে এখন অস্ট্রেলিয়ায় সেটেল্ড। বিয়েও হয়ে গেছে। বাবা মা পালা করে গিয়ে ছেলের কাছে থাকে। দুজনেরই দুজনের প্রতি এখনও টান আছে সেটা বোঝা যায়। রু কয়েকবার চেষ্টা করেছে দাদার কাউন্সেলিং করার, বিশেষ লাভ হয়নি। "আমি তো তাকে যেতে বলিনি, সে নিজের ইচ্ছায় গেছে। নিজে থেকে ফিরলে ফিরবে, আমি কিছু বলব না"। বৌদির সাথে 

বহুদিন যোগাযোগ নেই তাই বৌদির মনের কথা জানার বা বৌদির কাউন্সেলিং করার কোনো উপায় নেই। এই ফেসবুক, হোয়াটস্যাপের যুগে যোগাযোগ করাটা কোনো ব্যাপারই নয়। আসলে রুয়েরই অস্বস্তি লাগে। তিন্নি শেরুকে নিয়ে ভবানীপুর এসেছিল। রু ও টিনটিনকে নিয়ে মায়ের কাছে গেছিল। তিন্নি রুয়ের পিসতুতো বোন, ছোট পিসীর মেয়ে। ওদের ছেলে দুটো পিঠোপিঠি। দুটোতে খুব ভাব। তাই তিন্নি আর রু মাঝে মাঝেই একসাথে ভবানীপুরে আসে। ওদেরও একটু আড্ডা হয়, বাচ্চা দুটোও ছাদে চুটিয়ে খেলতে পারে। রু বলল "এই সামনের ৩০ তারিখে ফ্রি আছিস?"

-"হ্যাঁ, কেন রে"?

- প্রণবদার ফিফটিয়েথ বার্থডে। ভাবছি ওকে সারপ্রাইজ

দেব। তুই আসতে পারবি?

- হ্যাঁ, আমি চলে আসব।

- কেকটা ভাবছি কিনে নেব। আর পায়েসটা আমি বাড়ি থেকে করে আনব। তুই পারলে নিউ মার্কেট থেকে ফিফটি লেখা ক্যান্ডেল আর তিনটে বার্থডে ক্যাপ কিনে রাখিস। একটা ওই বুড়ো ধারি বার্থডে বয়ের আর দুটো তোর আর আমার ছেলের জন্য। না না, ফোনে অর্ডার করে খাবার আনব না। এইখান থেকে তো এইটুকু। 'চাং হোয়া' থেকে গিয়েই খাবার নিয়ে আসব। রু আর তিন্নির দুজনেরই একই দাবী। দাদার আর রাজি না হয়ে উপায় নেই। খাবার দাবার, বোতল টোতল সব কিনে এনে তারপর একেবারে কেক কাটা। তিন্নি একগাদা বেলুনও কিনে এনেছে। সেগুলোও ফোলানো হয়নি। খাবার প্যাক করে সোজা বাড়ি। ডান পকেটে হাত ঢুকিয়ে চাবি বার করে দরজা খুলল প্রণব। আলো জ্বালাতেই তো অবাক। সারা বাড়ি বেলুন দিয়ে সাজানো। টেবিলে কেক রাখা, ফিফটি লেখা মোমবাতি গোঁজা। বোনেদের দিকে তাকিয়ে প্রণব বলল - তোরা কখন এসব করলি? এই তো আমার সঙ্গেই বেরলি। তোদের বরেরাও তো একসঙ্গেই ছিল।

- আমরা তো সাজাই নি

-তার মানে?

- ঘরে যাও, তার মানে টা বুঝবে ওই থপথপে চেহারায় প্রায় উসাইন বোল্টের মত গতিতে প্রণব বেডরুমে ঢুকল

-তুমি? তুমি কবে ফিরলে? তোমার তো এখন অস্ট্রেলিয়ায়... একটা গোলাপী শাড়ি পড়েছে ডোনা, মাথায় গোলাপ ফুল গোঁজা। অপূর্ব লাগছে দেখতে। লাগেজ থেকে বার করে আলমারিতে নিজের জামাকাপড় গোছাচ্ছে। আজই ফিরেছে ছেলের কাছ থেকে। এখনও জেট ল্যাগ কাটেনি। "এই সরি, তোমাদের প্রেমালাপে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছি", বলে রু আর তিন্নি ওদের হাত ধরে টানতে লাগল। "চলো চলো, কেক কাটতে হবে। আকাশ ইজ অন্য স্কাই"। ডাইনিং টেবিলে কেকটা সাজানো। মাঝে ল্যাপটপে আকাশের মুখ। "হ্যাপি ফিফটিয়েথ বার্থডে বাবা। নাও এবার কেকটা কাটো"। ফুঁ দিয়ে মোমবাতি নিভিয়ে কেকে ছুরি ঠেকাতেই রুয়ের বর ওপরের বেলুনটা ফুটো করে দিল। ঝরঝর করে ঝরে পড়ল টফি আর চকোলেট। টিনটিন আর শেরুর কি আনন্দ। দুই খুদে তখন মেঝে থেকে চকোলেট কুড়োতে ব্যস্ত। এদিকে তিন্নির বর তখন ফোম স্প্রে করছে। প্রণবের মুখে একটা লজ্জা মেশানো হাসি "কি যে করিস না তোরা! আমায় একেবারে বাচ্চা বানিয়ে দিলি। যা তা! "স্কাইপে এবার আকাশের গলা "কি বাবা, বার্থডে গিফ্ট কেমন লাগল?" প্রণব খানিকটা হতবাক। এখনও বুঝলে না বাবা? মা তোমার কাছে ফিরে এসেছে, শি ইজ ব্যাক। আজ থেকে তোমরা আবার একসাথে থাকবে"। ডোনা ততক্ষণে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আলতো করে প্রণবের হাতটা চেপে ধরে বলল "আই স্টিল লাভ ইউ"। "ইয়ে" বলে সকলের একসঙ্গে হাততালি। অনির্বাণ ইতিমধ্যে আকাশের পাঠানো শ্যাম্পেনের বোতল টা খুলে ফেলেছে। শ্যাম্পেন আর আনন্দের ফোয়ারা তখন মিলেমিশে একাকার। বেশ অনেকদিন ধরেই কলকাঠি নাড়ছিল রু। প্রথমে ফেসবুক, হোয়াটস্যাপ তারপর ফোন। বৌদির মনের কথাটা পরিষ্কার হয়ে গেছিল। কেমিক্যাল রিয়াকশন হওয়ারই ছিল, অভাব ছিল শুধু ক্যাটালিস্টের। ছোটবেলা থেকেই ইঁচড়ে পাকা রু এ কাজটা ভালোই পারে।

Comments

Top

সব চরিত্র

কাল্পনিক

সঙ্ঘমিত্রা বসু

hospitalbed1.jpeg
সব চরিত্র কাল্পনিক

শির দশকের মাঝের কোলকাতা। কম্পিউটার সবে হাঁটি হাঁটি পা পা। ইন্টারনেটের জালে মানুষ তখনও জড়িয়ে যায় নি। বইমেলা, ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, কফি হাউসের আঁতলামিতে মাখামাখি কলেজ জীবন।এসপ্ল্যানেড চত্বর ছিল কলেজ পালিয়ে সিনেমা দেখার একমাত্র ঠিকানা। ঠিক সেই সময় কলেজের অ্যানুয়াল ফেসটের রিহার্সাল চলছে পুরোদমে।“চিত্রাঙ্গদা”। রাজ্যপাল আসছেন প্রধান অতিথি হয়ে। সাজোসাজো রব চারিদিকে। অনেক বাছাবাছির পর ফাইনাল সিলেকশন হয়েছে। অর্জুনের ভূমিকায় কলেজের ডাকসাইটে সুন্দরী দেবাংগনা। সুরূপা হবে আরেক সুন্দরী শ্রীরূপা। হালকা লালচে কোঁচকানো চুলে আপেল রঙা মেয়ে। আমরা তাকে ‘ইরানি কন্যা’ বলে ডাকি।নাচে সে অনবদ্য।কিন্তু সমস্যা তাকে নিয়ে অন্য জায়গায়। রিহার্সালে তাকে নিয়ম করে আনাটাই এক সমস্যা। একে তার অসংখ্য বয়ফ্রেন্ড, তার সঙ্গে ঘনঘন মুড অফ। বড় বেশি খামখেয়ালি সেই মেয়ে। মুড অফ হলে রিহার্সাল ছেড়ে কোনায় গিয়ে মাথা গুজে বসে পড়ে। ম্যাম এর তাড়া খেলে খুব অনিচ্ছা সহকারে উঠে আসে। ওর বিকল্প পাওয়া না যাওয়ায় আমাদের হাত পাও বাঁধা। আমি ছিলাম গানের গ্রুপে। তাই শ্রীরূপার রোজকার নাটক দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে যেতাম।    বিনা ঝামেলায় নির্দিষ্ট দিনেই শেষ পর্যন্ত “চিত্রাঙ্গদা” মঞ্চস্থ হল। অনুষ্ঠানের পরই শুরু হয়ে গেল পুজোর ছুটি। কারো সাথেই বিশেষ যোগাযোগ থাকতো না ওই একমাস। হোস্টেল এর মেয়েরা যে যার বাড়ি ফিরে গেল। শ্রীরূপা ও ফিরে গেল নিজের বাড়ি, বর্ধমানের কাছে কোথায় যেন। সবাই বলল, যাক একমাস একটু মাথা টাকে বিশ্রাম দিক। পুজোর ছুটিটা কেটে যায় কেমন যেন পলক ফেলার আগেই। খোলার সাথে সাথে লাইব্রেরি, পড়ার চাপ, বাড়ি ফেরার ব্যস্ততা, ক্লান্তি সব মিলিয়ে ব্যতিব্যস্ত দিনপঞ্জি। অফ পিরিয়ডেও আড্ডা মারার সময় নেই। হটাত একদিন কানে এলো শ্রীরূপা ছুটি র পর আর কলেজে আসে নি। ডিপার্টমেন্ট আলাদা হওয়ায় এতদিন জানতেই পারিনি। হাওয়ায় উড়ল খবর, কোন এক দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরে এলো আরও রোমহর্ষক রূপ নিয়ে। শোনা গেল, শ্রীরূপা নাকি পালিয়ে গেছে কোন এক কাশ্মীরি শালওয়ালার সাথে। উচ্চবিত্ত অধ্যুষিত সেই মহিলা কলেজে খবরটা বেশ মুখরোচক চাটনি হিসেবে কদিন ধরে সবাই বেশ তারিয়ে তারিয়ে খেল। সামনে পরীক্ষা, আস্তে আস্তে যে যার জগতে ফিরে গেল। শ্রীরূপা ও চাপা পড়ে গেল বিস্মৃতির অতলে। কাজের সূত্রে দূর্গাপুর এসেছি। মাঝে কেটে গেছে বেশ কিছু বছর। উঠেছি এক আত্মীয়র বাড়িতে। সকালে চা খেতে খেতে নজর গেল উল্টো দিকের বাড়ির বারান্দার দিকে। হুইল চেয়ারে বসা এক বয়স্ক মানুষকে দেখাশোনা করছে একজন আয়া শ্রেণীর মহিলা। ঠিক তাদের পাশেই বারান্দার পিলারে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে অবিন্যস্ত পোশাকের আরেক জন অল্পবয়সী মহিলা। সাইড প্রোফাইলটা ভীষণ নাচেনা লাগলো। কিন্তু কিছুতেই মেলাতে পারলাম না কারো সঙ্গে। পরদিন সকালে

এলাম কলকাতায়। মাথায় রয়ে গেল একটা জিজ্ঞাসা চিহ্ন। কিছুদিন পর কাজের সূত্রে যেতে হল আবার সেই দূর্গাপুরে। এবার হটাতই সামনা সামনি পড়ে গেলাম সেই মহিলার। আত্মীয়া আলাপ করিয়ে দিলেন। আমায় চিনতে পারল কিনা বুঝতে না পারলেও আমি কিন্তু চিনে ফেলেছি সেই ইরানি সুন্দরী কে। কেমন এক ঝাপসা দৃষ্টির ঘোর লাগা এক নারী । অপরিচিতির আবছা হাসি হেসে চলে গেল। এবার আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে বেশ কয়েক বছর। আমেরিকা প্রবাসী বড় কন্যাটি সন্তানসম্ভবা। দিদিকে দেখাশোনার জন্য পাঠানো হল সদ্য মাধ্যমিক দেওয়া কিশোরী বোনটিকে। মা বাপের উদ্দেশ্য তো মহৎই ছিল। কিশোরী তো খুশিতে আটখানা। স্বপ্নের মত দিন কেটে যাচ্ছে দিদি আর নতুন জামাই বাবুর সাথে। নতুন নতুন মানুষ, নতুন পরিবেশ, নতুন ধরনের জীবনযাপন পদ্ধতি। এরমধ্যে শুরু হল দিদির কিছু শারীরিক সমস্যা। ডাক্তারের পরামর্শে দিদিকে ভর্তি করা হল হাসপাতালে। জামাই বাবু নিজেও ডাক্তার। বিরাট অনিশ্চয়তার শেষে ফুটফুটে এক কন্যা সমেত দিদি বাড়ি ফিরল। বাড়ি ফেরার দু চার দিনের মধ্যে সহজাত মেয়েলি প্রবৃত্তির বশে দিদি বুঝল তার সংসারের ছন্দটা কোথায় যেন কেটে গেছে। যে কিশোরী বোনটা তার কাছে এসেছিল তাকে যেন আর ফিরে পাওয়া যাচ্ছে না। জামাইবাবুটি কিন্তু দিব্যি নির্বিকার। দিদি ব্যস্ত হয়ে পড়ল বোনকে দেশে পাঠানোর জন্য। স্বতঃ প্রণোদিত হয়ে সে দায়িত্বটিও লুফে নিলেন দায়িত্ববান জামাইবাবু। বাড়ি ফিরে এলো বিভ্রান্ত সেই কিশোরী। যুগটা আশির দশক। ডোমেস্টিক ভায়লেন্সের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ব্যাপার টা সেযুগে তেমন সোচ্চার হয়ে ওঠে নি। অন্য দিকে এন আর আই জামাইকে বেশি জিজ্ঞাসাবাদ করার সাহস বা ক্ষমতা ও তার মধ্যবিত্ত মা বাপের মোটেই ছিল না। দুটি মেয়ের জীবন নিয়ে ছেলেখেলা করে দিব্যি পার পেয়ে গেল সেই এন আর আই জানোয়ারটা। দিদির জোড়া তাপ্পি দেয়া সংসারটা টিকিয়ে রেখে ছোট বোন ফিরে এল তার পুরনো জীবনে। স্বভাবের এক বিচিত্র পরিবর্তন এল তার মধ্যে। পুরুষ সঙ্গ তার অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেল। এই ব্যাপারে কোন বাছবিচার পর্যন্ত করত না সে। শরীরকে হাতিয়ার করে সেই সুন্দরী নতুন এক খেলায় মেতে উঠল। লেখা পড়া কিন্তু এর সাথেই দিব্যি চালিয়ে যেত। প্রথম গণ্ডগোল বাঁধল বাড়ি ছেড়ে কলকাতায় পড়তে এসে। সামান্য পরিচিত এক কাশ্মীরি ছেলের সঙ্গে অন্তর্ধানটাই ছিল ওর জীবনের শেষ ভুল। বহু সন্ধানের পর শ্রীনগরের চল্লিশ কিমি দূরের এক গ্রাম থেকে যখন ওকে উদ্ধার করা হল তত দিনে ও সম্পূর্ণ নার্ভাস ব্রেকডাউনের শিকার। বহু চিকিৎসাতেও সাড়া দিল না তার শরীর। আংশিক স্মৃতিভ্রংশ নিয়ে বাতিল মানুষের দলে পড়ে গেল সেই মেয়ে। এরপর ও আমার নজরে এসেছে সে বেশ কয়েকবার। কখনও বারান্দায় বসে আছে। কখনও বা জানালা ধরে দাঁড়িয়ে আছে অবিন্যস্ত শরীর নিয়ে। চোখের দৃষ্টিতে অদ্ভুত এক শূন্যতা। কার ভুলে যে নষ্ট হয়ে গেল তার জীবন সে হিসেব বোধহয় কোনদিন আর মেলাতে পারল না আমাদের পথ হারানো সেই “ইরানি সুন্দরী”।

Comments

Top

বাতিক

অদিতি ভট্টাচার্য্য

bighouse1.jpg
বাতিক

ন্দনপুর একটি অখ্যাত ছোট শহর। এই শহরের সরকারী হাসপাতালে বদলী হয়ে এসেছে অল্প বয়সী ডাক্তার অরিন্দম সেন। অরিন্দম কলকাতার ছেলে। ডাক্তারী পাশ করার পর এত দিন পর্যন্ত সব পোস্টিংই হয়েছে কলকাতার আশেপাশের কোন না কোন শহরে। এই বারই প্রথম এত দূরে হল। চন্দনপুরের নাম সে প্রথম শুনল বদলীর অর্ডার আসার পর। অনিচ্ছুক মনে সে গেল বটে কিন্তু গিয়ে তার মনের ভাব পালটে গেল। দেখল চন্দনপুর ছোট হলেও বেশ জমজমাট শহর। দোকানবাজার, স্কুল, কলেজ সবই আছে এবং ভালোই আছে। কিছুদিনের মধ্যেই একটা বাড়ি ঠিক করে ফেলে সে সপরিবার বাস করতে শুরু করল। পরিবার বলতে স্ত্রী শ্রেয়া আর বছর তিনেকের ছোট্ট মেয়ে তিতলী।অরিন্দমদের প্রতিবেশীরা দেখা গেল খুব ভালো। নতুন জায়গায় অরিন্দমদের কোন অসুবিধে হতে দিলেন না। তা সে তিতলীর স্কুলে ভর্তির ব্যাপারই হোক বা কাজের লোক ঠিক করাই হোক। কিছুদিনের মধ্যেই দেখা গেল তিতলী নিজের বাড়িতে কম, আশেপাশের বাড়িতে বেশী থাকছে। আশেপাশের বাড়ির জেঠু, জেঠীমা, দাদা, দিদিরা তার খুবই প্রিয় হয়ে উঠেছে। আস্তে আস্তে অরিন্দম, শ্রেয়ার জায়গাটা ভালো লেগে গেল। তিনজনে মিলে শহরটা প্রায় পুরো ঘুরেই ফেলল।

ঘুরতে গিয়েই চোখে পড়েছে শহরের এক প্রান্তে লেকের ঠিক উল্টোদিকে বিরাট জায়গা জুড়ে পাঁচিল ঘেরা সুদশ্য রায়চৌধুরী নিবাস। এই রায়চৌধুরীদের সম্পর্কে নানান কথা সারা শহরে ছড়িয়ে আছে। হাসপাতালে কলিগদের কাছ থেকে, পাড়াপ্রতিবেশীদের কাছ থেকে প্রায় সবই একদিনে জেনে ফেলেছে অরিন্দমরা। রায়চৌধুরীরা ছিল এ অঞ্চলের জমিদার। চন্দনপুর তখন গ্রাম ছিল। আশেপাশের আরো কয়েকটা গ্রামও অদের জমিদারীর অন্তর্গত ছিল। ধীরে ধীরে সময় বদলাল, চন্দনপুর জমজমাট শহর হয়ে গেল, জমিদারীও আর রইল না, কিন্তু শহরের লোকের কাছে রায়চৌধুরী নিবাস জমিদার বাড়ি হিসেবেই বেশী পরিচিত। অবশ্য চন্দনপুর শহরে রায়চৌধুরীদের প্রচুর সম্পত্তি এখনো আছে। পুরোনো বাড়ি সংস্কার করে রায়চৌধুরী নিবাস এখন হাল ফ্যাশনের এক প্রাসাদোপম বাড়ি। কাজের লোকজন বাদ দিলে এই বিশাল বাড়িতে এখন বাস করেন রায়চৌধুরী পরিবারের মাত্র দুজন, সমরেন্দ্রনাথ রায়চৌধুরী এবং তাঁর স্ত্রী মণিকুন্তলা।

যে কোন জমিদার পরিবার সম্পর্কেই নানান কথা শোনা যায়। তাদের অত্যাচার, বিলাস বৈভব, শখ শৌখিনতা, কখনো কখনো কোন কোন প্রজাবৎসল জমিদারের দানধর্মের কথাও। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ছিল না। তবে রায়চৌধুরীদের সম্পর্কে যা সবচেয়ে বেশী লোকের মুখে মুখে প্রচারিত ছিল, শহরে নতুন কেউ এলেই পুরোনো বাসিন্দারা যার গল্প করতে ভালোবাসেন তা হল এই বংশের লোকেদের অদ্ভুত অদ্ভুত সব বাতিকের কথা। এই বাতিক যে কোনো এক নির্দিষ্ট পুরুষেই সীমাবদ্ধ তা নয়। দেখা গেছে রায়চৌধুরীদের প্রতি জেনেরাশনের মানুষ কম বেশী কোনো না কোনো বাতিকে আক্রান্ত ছিলেন। আরো অদ্ভুত ব্যাপার শুধুমাত্র পুরুষ সদস্যরাই বাতিকগ্রস্ত ছিলেন, কোন মহিলা নন।

উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে। সমরেন্দ্রনাথের বাবা সুরেন্দ্রনাথের কথাই ধরা যাক। নানান সমাজসংস্কারমূলক কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। গানবাজনা ভালোবাসতেন। প্রতি বছর শীতকালে চন্দনপুরে যে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আসর বসে তার প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন সুরেন্দ্রনাথই। বাতিক ছিল তাঁর পোশাক আশাকের ব্যাপারে। তাঁর মতে ধুতি, উত্তরীয়ই সনাতন হিন্দু পোশাক, তাই তা ছাড়া আর কিছু পরিধান করা উচিত নয়। সঙ্গে খড়ম। খড়মের যুগ সেটা ছিল না, তাই জমিদার বাড়িতে ছুতোর মিস্ত্রী আসত খড়ম তৈরী করতে। সারা বছর, সব সময়ে, ঘরে বাইরে এই এক পোশাক। শুধু শীতকালে এর ওপর একটা শাল জড়াতেন। সুযোগ পেলে অন্যদেরও এই পোশাক পরার জন্যে বলতেন। চন্দনপুরের বয়স্ক বাসিন্দারা 

এখনো মনে করতে পারেন ধুতি উত্তরীয় পরা সুরেন্দ্রনাথ খড়মের খটখট আওয়াজ তুলে জলসায় প্রবেশ করছেন।সমরেন্দ্রনাথের পিতামহের ব্যাপারটা আবার একটু অন্যরকম। তিনি পবিত্র অপবিত্র, শুদ্ধ অশুদ্ধ এসব নিয়ে বড় বেশী মাথা ঘামাতেন। পানীয় জলে গঙ্গাজল মিশিয়ে তবেই তিনি তা পান করতেন, তাঁর রান্নাও হত গঙ্গাজলে। তাঁর সঙ্গে সবসময় একজন লোক থাকত যে গঙ্গাজল ছেটাতে ছেটাতে তাঁর আগে আগে চলত আর তিনি কোনো অপবিত্র স্পর্শের ভয়ে নাক মুখ কুঁচকে তার পেছনে পেছেনে। বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, দোকানবাজার কোথাওই এর ব্যতিক্রম হত না। লেকের ধারে সান্ধ্য ভ্রমণের সময়েও একই নিয়ম বলবৎ থাকত।  সমরেন্দ্রনাথের  প্রপিতামহের  ধারণা ছিল যে তিনি একজন অত্যন্ত প্রতিভাময় সংস্কৃত কবি। এই ধারণা থেকেই তিনি সবসময় সংস্কৃতে কথা বলতেন। সঙ্গে দোভাষী থাকত তাঁর কথা অন্যদের বুঝিয়ে দেবার জন্যে। একান্ত বাধ্য হলে বাড়ির মধ্যে স্ত্রী ছেলেমেয়ের সঙ্গে আকারে ইঙ্গিতে মনের ভাব প্রকাশ করতেন কিন্তু ভুলেও মুখে একটাও বাংলা শব্দ উচ্চারণ করতেন না। শেষ বয়সে বাড়াবাড়িটা এমন পর্যায়পৌঁছয় যে তিনি নিজেকে মহামুনি বাল্মীকির সমকক্ষ ভেবে নিজেদের বাগানের এক প্রান্তে একটি কুটির বানিয়ে সেখানেই বসবাস করতে শুরু করেন এবং সংস্কৃত কাব্য রচনায় মন দেন। যদিও তিনি ঠিক কি রচনা করেছিলেন তা কেউ বলতে পারে না।

অরিন্দমরা এসবই লোকমুখে শুনেছে এবং একাধিকবার শুনেছে। কখনো কখনো সমরেন্দ্রনাথের প্রপিতামহের বাতিক সমরেন্দ্রনাথের পিতামহের ঘাড়ে চেপেছে কিন্তু বাতিকের গল্পগুলো বদলায় নি। অরিন্দমরা শুনেছে আর ভেবেছে সত্যিই এরকম হয়! সঙ্গে সঙ্গে সমরেন্দ্রনাথকে দেখার ইচ্ছেও প্রবল হয়েছে। হাজার হোক উনিই রায়চৌধুরী বংশের একমাত্র জীবিত পুরুষ। ওনার কোনো বাতিক আছে কিনা সেটা জানার কৌতুহলও আছে।

সেদিন এক রবিবার সন্ধ্যেবেলা। অরিন্দমদের বাড়িতে ওদের প্রতিবেশী মাখন দাস আর তাঁর স্ত্রী গৌরী গল্প করতে এসেছেন। চা টা-এর সঙ্গে গল্প ভালোই জমে উঠেছে এমন সময় তিতলী কাঁদো কাঁদো মুখে এসে বলল, ‘দেখো না মামমাম, আমার ডলটা পাচ্ছি না।’

‘কোন ডলটা?’ জানতে চাইল শ্রেয়া।

‘যেটা পিঙ্ক ঝালর দেওয়া ফ্রক পরা। যেটার গলায় লাল নীল পুঁতির মালা পরিয়ে দিয়েছিলে তুমি।’

‘কাল তুমি ওটা নিয়ে পার্কে খেলতে গিয়েছিলে না? আমি তখনই বারণ করেছিলাম, কিন্তু তুমি শোন নি। ডলটা ফেরত এনেছিলে পার্ক থেকে? আজ সকালে খেলেছ ডলটা নিয়ে?’

‘মনে নেই মামমাম,’ তিতলীর দুচোখ ভরা জল।

‘কাল সন্ধ্যে গেল, আজ সকাল গেল, এখন তোমার ডলের কথা মনে পড়ল?’ শ্রেয়া বেশ বিরক্ত, ‘পার্কে কত লোক থাকে, কে নিয়ে নিয়েছে।’‘কেঁদো না, কেঁদো না। আমি ওরকম ডল আবার তোমায় কিনে দেব,’ অরিন্দম মেয়েকে

আদর করতে করতে বলে। ‘আজকালকার বাচ্ছাদের এই এক ব্যাপার। এত খেলনা যে কখন কোনটা হারাচ্ছে, কোনটা কোথায় রাখছে খেয়ালও থাকে না। পরে যখন খুঁজে পায় না, তখন মন খারাপ। মহুয়ার ছেলেটাও সেদিন কোথায় কি বল হারিয়ে মুখ গোমড়া করে ছিল,’ বললেন গৌরী।‘ হ্যাঁ পার্কেই হারিয়েছে মনে হয়। না হলে যাবে কোথায়? কমলাকে তো বেশ বিশ্বাসী বলেই মনে হয়,’ শ্রেয়া বলল।

‘না, না কমলাকে সন্দেহ কর না। এখানে যারা কাজ করে তাদের কারুরই ওরকম স্বভাব নেই। তোমার একটা ছুঁচও এদিক থেকে ওদিক হবে না। কিছু দরকার হলে ওরা চাইবে, কিন্তু চুরি করবে না। আমার ছেলে মেয়ে যখন ছোট ছিল তখন মিনতি বলে একজন কাজ করত। সে তো আমার বাচ্ছাদের পুরানো জামা কাপড়, খেলনা চেয়েই নিত। ওদেরও তো ইচ্ছে করে।’

‘এই দেখো বলতেই ভুলে যাচ্ছি, সামনের রবিবার চন্দনপুরের বাসিন্দাদের একটা মিটিং আছে ঊষারানী মেমোরিয়াল হলে। চন্দনপুরের সুবিধে অসুবিধে নিয়ে।

অরিন্দম তুমি যেয়ো। সমরেন্দ্রনাথবাবুও আসবেন, এই সুযোগে আলাপ হয়ে যাবে’ প্রভাত বললেন। ‘সমরেন্দ্রনাথ রায়চৌধুরী? ওই রায়চৌধুরী নিবাসের?’ অরিন্দম প্রশ্ন করল।

‘হ্যাঁ সমরেন্দ্রনাথ রায়চৌধুরী' প্রভাত হাসলেন, ‘অবাক হচ্ছ যে? রায়চৌধুরী বংশের লোক বলে?’

‘যেখানে যাচ্ছি সেখানেই তো নতুন লোক দেখে ওই গল্পই শোনাচ্ছে সবাই। একেক জনের একেক পিকিউলিয়ারিটিজ,’ বলল অরিন্দম।

‘পিকিউলিয়ারিটিজই বলো কি বাতিকই বলো, সত্যিই অদ্ভুত লোক ছিল সব। আর এসব গল্পর এক বর্ণও মিথ্যে ভেব না কিন্তু, সব সত্যি।’

'সমরেন্দ্রনাথবাবুরও কি?’

‘না না সমরেন্দ্রনাথবাবুর কোন বাতিক-টাতিক নেই। একেবারে আর পাঁচটা স্বাভাবিক লোকের মতই তিনি, অরিন্দমের কথার মাঝখানেই বলে উঠলেন প্রভাত - ‘খুব আশ্চর্য ব্যাপার, একেবারে যেন দৈত্যকূলে প্রহ্লাদ! সমরেন্দ্রনাথবাবুই বোধহয় রায়চৌধুরী বংশের একমাত্র পুরোপুরি স্বাভাবিক লোক। অথচ ভাগ্যের কি পরিহাস দেখো, উনি নিঃসন্তান। ওনার মারা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রায়চৌধুরী বংশও লুপ্ত হবে।’

‘ওনার কোন ভাই-টাইও নেই?’ শ্রেয়ার প্রশ্ন।

‘না, কেউ নেই। সুরেন্দ্রনাথের ছয় মেয়ের পর এই এক ছেলে। সুরেন্দ্রনাথের ছোট দুই ভাই ছিল। একজন তো অল্প বয়স থেকেই সংসার ত্যাগী। দীর্ঘদিন কোথায় উধাও হয়ে যেত, আবার কিছুদিনের জন্যে বাড়ি ফিরে আসত। শেষে কোন সাধুর আখড়ায় পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করে। আরেকজনের ধারণা ছিল যে ঘরের বাইরে বেরোলেই বাইরের পরিবেশ, বাইরের লোকের সংস্পর্শে এলেই অসুস্থ হয়ে পড়বে। তাই নিজের ঘর থেকেই বেরতো না। চন্দনপুরে কেউ তাকে কোনদিন দেখেছে কিনা সন্দেহ। বলা বাহুল্য সে বিয়েও করে নি’ প্রভাত উত্তর দিলেন।

‘মানুষ হিসেবেও সমরেন্দ্রনাথবাবু আর ওনার স্ত্রীর কোন তুলনা হয় না। যে কোন কাজে ওনাদের সাহায্য পাওয়া যায়। কলোনীর লোকেদের জন্যে কম করেছেন ওনারা? ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলোর পড়াশোনার ব্যবস্থা করা, কলোনীর ভেতর জল, আলোর ব্যবস্থা করা, রাস্তাঘাট পাকা করা, সবই তো ওনাদের জন্যে হয়েছে। কার অসুখে ডাক্তার বদ্যির খরচ জোগান, কার মেয়ের বিয়েতে গয়না দেওয়া, সব ওনারা। কমলারা কি সাধে জমিদারবাবু আর গিন্নীমা বলতে অজ্ঞান? ওনাদের জন্যে বোধহয় ওরা প্রাণও দিতে পারে’ গৌরী বললেন।

রবিবার মিটিং-এ যাবার কোন ইচ্ছে না থাকলেও সমরেন্দ্রনাথ রায়চৌধুরীকে দেখার আগ্রহেই অরিন্দম গেল। মিটিং শেষ হবার পর পরিচয়ও হল। প্রভাতই আলাপ করিয়ে দিলেন। ধুতি পাঞ্জাবী পরা সুন্দর সুপুরুষ সমরেন্দ্রনাথকে প্রথম দর্শনেই অরিন্দমের ভালো লেগে গেল। চেহারায় আভিজাত্যের ছাপ স্পষ্ট। প্রথম আলাপেই সমরেন্দ্রনাথ সহাস্যে অরিন্দমকে বললেন ‘কি আমাদের বংশের সব গল্প শোনা হয়ে গেছে তো?’ অরিন্দম একটু অপ্রস্তুতে পড়ল, তারপর সামলে নিয়ে বলল, ‘এই শহরের উন্নতির পেছনে আপনাদের কত অবদান তাও শুনেছি।’

বাড়ি ফিরে আসার আগে ফোন নম্বর বিনিময় হল। সমরেন্দ্রনাথ অরিন্দমকে স্ত্রী মেয়েকে নিয়ে রায়চৌধুরী নিবাসে যাবার আমন্ত্রণ জানালেন। অরিন্দম ফিরে এসে শ্রেয়াকে বলল, ‘সত্যিই কি ভালো ভদ্রলোক। কত গল্প শুনেছি রায়চৌধুরী বংশের সম্পর্কে এই কদিনে। ওনাকে দেখলে মনে হয় না যে উনিও ওই বংশের একজন।’

কয়েক মাস কাটল। একদিন হঠাৎ রাত ন’টা নাগাদ সমরেন্দ্রনাথের ফোন এল অরিন্দমের মোবাইলে। মণিকুন্তলা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। ওনাদের ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান শহরে নেই, যদি অরিন্দম এসে মণিকুন্তলাকে দেখে যায়। অরিন্দম সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে গেল। এই প্রথম সে রায়চৌধুরী নিবাসে গেল। সমরেন্দ্রনাথই অরিন্দমকে দোতলায় নিজেদের ঘরে নিয়ে গেলেন। সেদিন সমরেন্দ্রনাথ যেন একটু বেশী গম্ভীর। হয়ত স্ত্রীর অসুস্থতার কারণে। অরিন্দম মণিকুন্তলাকে দেখতে শুরু করলে সমরেন্দ্রনাথ ‘আপনি দেখুন, আমার একটা জরুরী কাজ আছে’ বলে উঠে চলে গেলেন। অরিন্দম একটু অবাক হল, স্ত্রী অসুস্থ বাড়িতে ডাক্তার ডাকতে হয়েছে, এই অবস্থায় কি এমন জরুরী কাজ থাকতে পারে? সে আবার নিজের কাজে মন দিল। ঘরে একজন পরিচারিকা ছিল আর ঘরের বাইরে একজন চাকর দাঁড়িয়ে ছিল। অরিন্দম ওষুধ লিখে তাকে ডেকে সেগুলো তাড়াতাড়ি কিনে আনতে বলল। অরিন্দম ওঠার উপক্রম করছে এমন সময় মণিকুন্তলা কিছু বলতে চাইলেন।

অরিন্দম বাধা দিয়ে বলল, ‘আপনি কথা বলবেন না, বিশ্রাম করুন। ওষুধগুলো ঠিক মতো খাবেন। আমি এখন আসছি, দরকার হলে আবার ফোন করবেন।’ সে বাইরে বেরিয়ে এল। করিডোরের একপাশে সারি সারি ঘর, বেশীর ভাগই বন্ধ। একটা ঘরের সামনে এসে সে দাঁড়িয়ে পড়ল। যখন এসেছিল তখন এই ঘরটাও বন্ধ ছিল। এখন খোলা, দরজার পর্দা অল্প টানা। ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে ঘরে আলো জ্বলছে আর ঘরের ভেতর সমরেন্দ্রনাথ দাঁড়িয়ে আছেন। ঘর ভর্তি বাচ্ছাদের খেলনায়। সমরেন্দ্রনাথ একটা করে খেলনা তুলছেন, পরম মমতায় তার ওপর হাত বোলাচ্ছেন, তারপর আবার যথাস্থানে রেখে দিচ্ছেন। হঠাৎ অরিন্দমের দৃষ্টি পড়ল একটা ছোট টেবিলের ওপর। আরো কয়েকটা খেলনার মধ্যে চোখ আটকে গেল একটা পুতুলে। গোলাপী ঝালর দেওয়া ফ্রক পড়া সোনালী চুলের বড়সড় একটা ডল, গলায় লাল নীল পুঁতির মালা। অরিন্দমের মনে হল তার পা দুটো যেন মাটিতে আটকে গেছে। পুতুলটা যে তার বড্ড চেনা। 

Comments

Top

নেপথ্যে

অদিতি ভট্টাচার্য্য

kolkatas2.jpg
নেপথ্যে

ছোটো কাজ? ফোটো তোলা? সুদর্শনের ফোটোশুট ছোটো কাজ? কিরকম ফোটোগ্রাফার আপনি?’ তোর্সার গলায় বিস্ময়।

‘এটা সেরকম ফোটো শুট ছিল না। এই লাইনে আছেন, এখনো কিছুই জানেন না দেখছি। বড় বড় হিরো হিরোইনদের দু-একটা অনেক ছোটোখাটো অ্যাডট্যাডেও ইউজ হয়। সেইরকম দু একটা স্টিল তুলতে আসা,’ অপলক ব্রেকফাস্ট ফেলেই উঠে যাওয়ার চেষ্টা করে।

কিন্তু তোর্সা যেতে দিলে তো, ‘আরে খাবার ফেলে রেখে পালাচ্ছেন কেন? ঠিক আছে, আমি সুদর্শনের ব্যাপারে কোন কথা জিজ্ঞেস করব না। বসতে পারি তো এখানে?’

এরপর আর যাওয়াও হল না, তোর্সাকে বসতে বলতেও হল।

না, সুদর্শনকে নিয়ে আর কোন কথা হয় নি। তোর্সার সিরিয়াল, বনধ, কলকাতার ট্র্যাফিক জ্যাম এসব নিয়ে কথাবার্তাতেই ঘন্টা দুয়েক কেটে গেল। এরপর যে যার ঘরে ঢুকে গেল, আর দেখা হয় নি, শুধু মোবাইল নম্বর বিনিময় হল। পরের দিন তো অপলক কলকাতায় ফিরে এল।অপলকের বিশেষ খবর পাবলিক ভালোই খেল। শুধু তোমাকে চাই হইহই করে চলছে। হাউসফুলের পর হাউসফুল।

  এই সময় একদিন তোর্সার ফোন এল, ‘কি আমাকে মনে পড়ছে তো? রায়চকে সুদর্শন আর কুহেলিকার ছবিগুলো কিন্তু ভালই তুলছিলেন। অনেকে আবার এর মধ্যে অন্য গন্ধও পাচ্ছে। শুধু তোমাকে চাই হিট করেছে তো, তাই অনেকের হিংসে হচ্ছে। সুদর্শন যে ফাটাফাটি অভিনয় করল সেটা দেখছে না। আর আপনিও তো ছবি তুলেছেন শুধু ছোটোখাটো অ্যাডের জন্যে, তাই না?’

সর্বনাশ! অপলক কি বলবে ভেবে পেল না, আবার ফোন কেটে দিতেও পারল না। কলকাতায় ফিরে এসে তোর্সাকে ফোন না করলেও ওকে বেশ ভালো লেগেছিল অপলকের। এর মধ্যে ফেলে আসা দিনগুলোর একটা এপিসোডও মিস করে নি। কি করি কি করি ভেবে শেষ পর্যন্ত তোর্সার সঙ্গে দেখা করতে চাইল।

  এরপর বেশ কয়েক মাস কেটে গেছে। অপলকের কাজে এস.কে খুব খুশী। অপলককেও খুশী রাখার ব্যবস্থা করেছেন। খুব শিগগির মুম্বাইতে ট্রান্সফারও হয়ে যাবে। এহেন সময়ে অপলক একদিন অফিসে ঢুকতেই ঋষি আর ইলিনা এল ওর কাছে। ঋষির হাতে একটা খাম। ‘কি ব্যাপার বস? কি চালাচ্ছ তুমি?’ চোখ নাচিয়ে ঋষি জিজ্ঞেস করল, ‘হঠাৎ যেন খুব বিজি হয়ে গেছ মনে হচ্ছে। সপ্তাহ দুয়েক আগে দেখলাম সিটি সেন্টার থেকে বেশ অনেক কিছু খরিদ্দারি করে বেরোচ্ছ, সঙ্গে একটা মেয়ে। আমাকে দেখে হেসে হাত নেড়ে চলে গেলে, খুব তাড়া ছিল মনে হয়! মনে পড়ছে তো? পরশু দিন দেখলাম রেস্টুর‍্যান্টে আরেকজনের সঙ্গে খুব সাঁটাচ্ছ? বিশ্বাস হচ্ছে না? এই দেখো, ফোটো দেখো,’ ঋষি খামটা থেকে গোটা তিনেক ছবি খামটার ওপর ছড়িয়ে দিল।

অপলক আর তোর্সার বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে তোলা ছবি।

অপলক অবাক হয়ে গেল, ঋষি ওকে এভাবে ফলো করে ছবি তুলেছে!

‘কি ব্যাপার অপলক? কন্ট্রোভার্সি তৈরী করতে করতে নিজে কোন কন্ট্রোভার্সিতে জড়াচ্ছ? এ মেয়েটা তো সিরিয়াল করে। একে কোথা থেকে পাকড়ালে?’ এবার প্রশ্ন ইলিনার।

‘কোন কন্ট্রোভার্সি নেই। অ্যাবসলিউটলি নো কন্ট্রোভার্সি,’ হেসে বলল অপলক, ‘নিজের জীবনে কোন কন্ট্রোভার্সি পছন্দ করি না আমি। ঋষি যাকে দেখেছে আমার সঙ্গে সিটি সেন্টারে সে আমার বোন। ঠিকই বলেছে ঋষি, খরিদ্দারিটা বেশীই হয়ে গেছিল সেদিন। কি আর করা যাবে! ছোটো বোনেরা বরাবরই দাদাদের পকেট কাটতে ভালোবাসে। আর যদি সামনে দাদার বিয়ে থাকে তাহলে তো কথাই নেই!’‘বিয়ে?’ ঋষি আর ইলিনা একসঙ্গে বলে উঠল।‘হ্যাঁ বিয়ে। বললাম না কোন কন্ট্রোভার্সি নেই। তোর্সার সঙ্গে আমার বিয়ে, সামনের মাসের ফিফথ। এই যে তোমাদের দুজনের কার্ড,’ অপলক ব্যাগ থেকে নেমতন্ন কার্ড বার করে ওদের দুজনের হাতে ধরাল, ‘খুব অবাক হচ্ছ তো? কি করব বলো। এমন চাকরী করি যে লোককে বোঝানোই মুশকিল। একমাত্র তোর্সাই দেখলাম এসব ব্যাপার শুনে খুব এক্সাইটেড হয়ে উঠল।

বলল, এসব কাজে বেশ মজা আছে,

অন্য সব জবের মতো মনোটোনাস নয়। আমিও তাই আর দেরী না করে ঝুলে পড়লাম!’  সুদর্শন আর কুহেলিকা রায়চকের রিসর্টে গেছে। শুটিং এ নাকি খুব ধকল গেছে, একটা ব্রেকের দরকার ছিল ওদের। অপলককেও অবিলম্বে যেতে হবে রায়চকে, এটাকে বেশ মুখরোচক খবর হিসেবে পরিবেশন করার জন্যে। এটার জন্যে অপলক প্রস্তুত ছিল না, কিন্তু কি আর করা যাবে, যেতে তাকে হলই। যদিও একথাটা তাকে বলার জন্যে স্টুডিওতে কেন ডাকা হল সেটা ঠিক বুঝতে পারল না।

  রায়চকে পৌঁছে দেখল তার জন্যেও ঘর বুক করা আছে।চেক ইন করে সুদর্শন আর কুহেলিকার সঙ্গে দেখা করল।ব্যাপারটা তাদেরও জানা ছিল, কাজেই সুইমিং পুলের ধারে, বাগানে দুজনের একসঙ্গে দু চারটে ছবি নিয়ে দিব্যি একটা খবর তৈরী করে যথাস্থানে পাঠিয়ে দিতে অপলকের কোনো অসুবিধেই হল না। কয়েক ঘন্টার মধ্যেই পুরো দুনিয়া জেনে যাবে যে শুধু তোমাকে চাই আর শুধুমাত্র অভিনয়েই সীমাবদ্ধ নেই, সুদর্শন আর কুহেলিকা একে অপরের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছে। এ নাকি শুধু তোমাকে চাই তে স্বামী স্ত্রীর ভূমিকায় মন প্রাণ ঢেলে অভিনয় করার ফল। ব্যাস সিনেমা হিট হওয়া আটকায় কে! অপলকের হাইকও পাক্কা।

  কাজ সেরে অপলক বাইরে বেরোল। তখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে। রাতটা এখানে কাটিয়ে সে কাল ভোরে কলকাতা ফিরবে। দেখল রিসর্টের সামনে বেশ হট্টগোল। কি না অত্যন্ত জনপ্রিয় সিরিয়াল ‘ফেলে আসা দিনগুলো’র পুরো ক্রু এখানে এসেছে। আগামী কয়েকটা এপিসোডের শুটিং নাকি রায়চকেই হবে। আশপাশ থেকে লোক তাই ঝেঁটিয়ে এসেছে তাদের প্রিয় চরিত্রদের দেখতে। প্রতি সন্ধ্যেবেলা আটটা থেকে সাড়ে আটটা যারা তাদের টিভির সামনে আটকে রাখে, এত কাছ থেকে তাদের দেখার সুযোগ কি কেউ হাতছাড়া করতে চায়? তাছাড়া এত গোপনীয়তা সত্ত্বেও কি করে যেন রটে গেছে যে  সুদর্শন এখানে আছে। তাই তাকে দেখার জন্যেও লোক হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। যদিও  সুদর্শনের টিকিটিও দেখতে পাবে বলে মনে হয় না। 

কিছুক্ষণ বাইরে ঘুরে টুরে রাত ন’টা নাগাদ রিসর্টে নিজের ঘরে ঢুকে একটা নিউজ চ্যানেল চালাতেই অপলকের আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেল। হুগলীর একটি গ্রামে দুজন কর্মী খুনের প্রতিবাদে রাজ্যের প্রধাণ বিরোধী দল আগামী কাল চব্বিশ ঘন্টার বাংলা বন্ধ ডেকেছে। যদিও শাসক দলের পক্ষ থেকে বন্ধ ব্যর্থ করার আহ্বান জানানো হয়েছে কিন্তু বিরোধী দলের লোকজন তাদের শরীরের শেষ রক্ত বিন্দু দিয়েও বন্ধ সফল করবে বলেছে। অতএব কাল রাস্তায় বেরোলে গোলমালে পড়ার আশঙ্কাই বেশী। এখন বাধ্য হয়েই কাল গোটা একটা দিন এখানে আটকে থাকতে হবে। অপলক বেশ বিরক্ত হল। কিন্তু করারও কিছু নেই। পরের দিন সকালে অপলক ঘুম থেকে বেশ দেরী করে উঠল। চা আর ব্রেকফাস্ট নিয়ে রিসর্টের বাগানে গিয়ে বসল।

আজ তো সারাদিন চুপচাপ বসে থাকা আর টিভি দেখা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই। সবে গরম চা এ একটা চুমুক দিয়েছে এমন সময় এক মহিলা কন্ঠের আওয়াজ ভেসে এল, ‘একটু শুনবেন?’

অপলক তাকাল। একটি অল্প বয়েসী সুন্দরী মেয়ে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে, মুখটা যেন চেনা চেনা।

‘আমাকে বলছেন? বলুন?’

‘আমি তোর্সা, তোর্সা মিত্র।’

তোর্সা আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু অপলক তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘আপনাকে কোথাও দেখেছি, আপনি কি টিভি সিরিয়ালে’

তোর্সা হেসে বলল,‘হ্যাঁ ফেলে আসা দিনগুলোয় আমি চুমকির রোল করি। তাছাড়া দু একটা অ্যাডও করেছি।’

‘আই সি, তাই জন্যে চেনা চেনা লাগছে। আমার খুব একটা সিরিয়াল টিরিয়াল দেখা হয় না, তবে মোটামুটি খবরাখবর রাখি।’

‘আমার তো এন্ট্রি সবে হয়েছে, লাস্ট কয়েকটা এপিসোডে।’

‘কি বলতে এসেছিলেন বলুন,’ অপলক জানতে চাইল।‘শুনছিলাম আপনার সঙ্গে  সুদর্শনের চেনাশোনা আছে। আপনি নাকি সুদর্শন আর কুহেলিকার ছবি তুলেছেন এখানে। আমি  সুদর্শনের খুব ফ্যান, যদি একটু দেখা করার সুযোগ করে দেন।  সুদর্শন আর কুহেলিকার নাকি কড়া ইনস্ট্রাকশন আছে কাউকে দেখা না করতে দেওয়ার।’ অপলক সতর্ক হল। সুদর্শন যে এখানে আছে এ খবরটাই যথেষ্ট গোপন রাখতে বলা হয়েছে।

সে বলল, ‘আপনাকে কে বলল এসব কথা?’ ‘রিসর্টেরই একজন বলেছে। প্লীজ বলুন না দেখা করিয়ে দেবেন?’ তোর্সা নাছোড়বান্দা। ‘না না আমার সঙ্গে সেরকম কিছু চেনাশোনা নেই। একটা ছোটো কাজ ছিল তাই আসা,’ অপলক এড়ানোর চেষ্টা করে।

যে শাশুড়ির প্রতিটি কথায় শ্যামলী গায়ে জ্বালা ধরত, ফোস্কা পড়ত, তাকে আজ নিজের বড় আপনজন বলে মনে হল। মনে হল জিজ্ঞেস করে- ‘মা, আমি চলে গেলে আপনি কার সম্বন্ধে ছেলের কাছে অভিযোগ জানাবেন?’ কিন্তু, কিছু না বলে চুপ করে চায়ে চুমুক দিল।

শাশুড়ি যেন কিছু বুঝতে পেরেছেন, চা খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলেন, 'তোমার কিছু হয়েছে বৌমা? তোমার কি শরীর খারাপ?'

আজ শাশুড়ির প্রশ্ন যেন এক বন্ধুর মত শোনাল। শ্যামলী জবাব দিল, 'না মা, কিছু হয় নি। চলুন আজ বিকেলে আমরা শপিং করতে যাই।' শাশুড়ি আরও অবাক হলেন, যার কদিন পরে ডিভোর্স হবে, যে কদিন পরে চলে যাবে, যাকে নিয়ে শাশুড়ির মন খারাপ, সে বলছে শপিং করার কথা।

‘ছোটো কাজ? ফোটো তোলা? সুদর্শনের ফোটোশুট ছোটো কাজ? কিরকম ফোটোগ্রাফার আপনি?’ তোর্সার গলায় বিস্ময়।

‘এটা সেরকম ফোটোশুট ছিল না। এই লাইনে আছেন, এখনো কিছুই জানেন না দেখছি। বড়ো বড়ো হিরো হিরোইনদের দু একটা অনেক ছোটোখাটো অ্যাডট্যাডেও ইউজ হয়। সেইরকম দু একটা স্টিল তুলতে আসা,’ অপলক ব্রেকফাস্ট ফেলেই উঠে যাওয়ার চেষ্টা করে।

কিন্তু তোর্সা যেতে দিলে তো, ‘আরে খাবার ফেলে রেখে পালাচ্ছেন কেন? ঠিক আছে, আমি সুদর্শনের ব্যাপারে কোনো কথা জিজ্ঞেস করব না। বসতে পারি তো এখানে?’

এরপর আর যাওয়াও হল না, তোর্সাকে বসতে বলতেও হল। না, সুদর্শনকে নিয়ে আর কোনো কথা হয় নি। তোর্সার সিরিয়াল, বনধ, কলকাতার ট্র্যাফিক জ্যাম এসব নিয়ে কথাবার্তাতেই ঘন্টা দুয়েক কেটে গেল। এরপর যে যার ঘরে ঢুকে গেল, আর দেখা হয় নি, শুধু মোবাইল নম্বর বিনিময় হল। পরেরদিন তো অপলক কলকাতায় ফিরে এল।

অপলকের বিশেষ খবর পাবলিক ভালোই খেল। শুধু তোমাকে চাই হইহই করে চলছে। হাউসফুলের পর হাউসফুল। এই সময় একদিন তোর্সার ফোন এল, ‘কি আমাকে মনে পড়ছে তো? রায়চকে সুদর্শন আর কুহেলিকার ছবিগুলো কিন্তু ভালোই তুলছিলেন। অনেকে আবার এর মধ্যে অন্য গন্ধও পাচ্ছে। শুধু তোমাকে চাই হিট করেছে তো, তাই অনেকের হিংসে হচ্ছে। সুদর্শন যে ফাটাফাটি অভিনয় করল সেটা দেখছে না। আর আপনিও তো ছবি তুলেছেন শুধু ছোটোখাটো অ্যাডের জন্যে, তাই না?’

সর্বনাশ! অপলক কি বলবে ভেবে পেল না, আবার ফোন কেটে দিতেও পারল না। কলকাতায় ফিরে এসে তোর্সাকে ফোন না করলেও ওকে বেশ ভালো লেগেছিল অপলকের। এর মধ্যে ফেলে আসা দিনগুলোর একটা এপিসোডও মিস করে নি। কি করি কি করি ভেবে শেষ পর্যন্ত তোর্সার সঙ্গে দেখা করতে চাইল।

এরপর বেশ কয়েক মাস কেটে গেছে। অপলকের কাজে এস.কে খুব খুশী। অপলককেও খুশী রাখার ব্যবস্থা করেছেন। খুব শিগগির মুম্বাইতে ট্রান্সফারও হয়ে যাবে। এহেন সময়ে অপলক একদিন অফিসে ঢুকতেই ঋষি আর ইলিনা এল ওর কাছে। ঋষির হাতে একটা খাম।

‘কি ব্যাপার বস? কি চালাচ্ছ তুমি?’ চোখ নাচিয়ে ঋষি জিজ্ঞেস করল, ‘হঠাৎ যেন খুব বিজি হয়ে গেছ মনে হচ্ছে। সপ্তাহ দুয়েক আগে দেখলাম সিটি সেন্টার থেকে বেশ অনেক কিছু খরিদ্দারি করে বেরোচ্ছ, সঙ্গে একটা মেয়ে। আমাকে দেখে হেসে হাত নেড়ে চলে গেলে, খুব তাড়া ছিল মনে হয়! মনে পড়ছে তো? পরশু দিন দেখলাম রেস্টুর‍্যান্টে আরেকজনের সঙ্গে খুব সাঁটাচ্ছ? বিশ্বাস হচ্ছে না? এই দেখো, ফোটো দেখো,’ ঋষি খামটা থেকে গোটা তিনেক ছবি খামটার ওপর ছড়িয়ে দিল।

অপলক আর তোর্সার বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে তোলা ছবি।

অপলক অবাক হয়ে গেল, ঋষি ওকে এভাবে ফলো করে ছবি তুলেছে!

‘কি ব্যাপার অপলক? কন্ট্রোভার্সি তৈরী করতে করতে নিজে কোন কন্ট্রোভার্সিতে জড়াচ্ছ? এ মেয়েটা তো সিরিয়াল করে। একে কোথা থেকে পাকড়ালে?’ এবার প্রশ্ন ইলিনার।

‘কোনো কন্ট্রোভার্সি নেই। অ্যাবসলিউটলি নো কন্ট্রোভার্সি,’ হেসে বলল অপলক, ‘নিজের জীবনে কোনো কন্ট্রোভার্সি পছন্দ করি না আমি। ঋষি যাকে দেখেছে আমার সঙ্গে সিটি সেন্টারে সে আমার বোন। ঠিকই বলেছে ঋষি, খরিদ্দারিটা বেশীই হয়ে গেছিল সেদিন। কি আর করা যাবে! ছোটো বোনেরা বরাবরই দাদাদের পকেট কাটতে ভালোবাসে। আর যদি সামনে দাদার বিয়ে থাকে তাহলে তো কথাই নেই!’

‘বিয়ে?’ ঋষি আর ইলিনা একসঙ্গে বলে উঠল।

‘হ্যাঁ বিয়ে। বললাম না কোনো কন্ট্রোভার্সি নেই। তোর্সার সঙ্গে আমার বিয়ে, সামনের মাসের ফিফথ। এই যে তোমাদের দুজনের কার্ড,’ অপলক ব্যাগ থেকে নেমতন্ন কার্ড বার করে ওদের দুজনের হাতে ধরাল, ‘খুব অবাক হচ্ছ তো? কি করব বলো। এমন চাকরী করি যে লোককে বোঝানোই মুশকিল। একমাত্র তোর্সাই দেখলাম এসব ব্যাপার শুনে খুব এক্সাইটেড হয়ে উঠল। বলল, এসব কাজে বেশ মজা আছে, অন্য সব জবের মতো মনোটোনাস নয়। আমিও তাই আর দেরী না করে ঝুলে পড়লাম!’

Comments

Top

নীড়ে ফেরা

সঞ্চিতা চৌধুরী

doctor.jpeg
নীড়ে ফেরা

হরের নামকরা মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ চৌধুরী খসখস করে নিজের প্যাডে প্রেসকিপশন লিখতে লিখতে বললেন, 'এই ঔষধগুলো আপনাকে আরো ছয় মাস খেয়ে যেতে হবে। আপনার স্ট্রেস লেভেল একটু কমান। প্রেশার বেড়ে গেছে, সেই সঙ্গে হাইপো থাইরয়েড। ঔষধ ছাড়া চলবে না।'

গত কয়েবছর ধরে শ্যামলীকে গাদাগুচ্ছের এন্টি ডিপ্রেশন, এন্টি স্ট্রেস এর ঔষধ খেয়ে যেতে হচ্ছে।চাকরিতে পজিশনের জন্যে মারকাটারি শীতল যুদ্ধ, এগিয়ে যাওয়ার লড়াই, কর্পোরেট দুনিয়ার চোরা রাজনীতি শ্যামলীকে ক্লান্ত করে দিয়েছে।

শ্যামলী ডাক্তারের চেম্বার থেকে শুকনো মুখে বেড়িয়ে নিজের ঝা চকচকে নতুন গাড়ী চালিয়ে আবার অফিস মুখো রওনা দিল।

এখন অফিসে অনেক কাজ। একটা বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পাওয়া যাবে, কথাবার্তা চলছে। তার জন্যে প্রোজেক্ট লেখার কাজ শেষ করতে হবে, প্রেজেন্টেশন বানাতে হবে, বিদেশী ডেলিগেটদের সামনে লেকচার দেবার জন্যে তৈরি হতে হবে, শ্যামলীর উপরে সমস্ত দায়িত্ব। এই কাজের সাফল্যের উপরে শ্যামলীর চাকরির ঊর্ধ্বমুখী ভাগ্য নির্ভর করছে। এইটা উৎরে গেলে একধাপে অনেক উঁচুতে ওঠা যাবে, হয়তো বিদেশেও যেতে হতে পারে। কাছের প্রতিদ্বন্দ্বী নীতাকে হারিয়ে এই কাজের দায়িত্ব পাওয়াতে শ্যামলী খুব খুশি। তাই গত কয়েক মাস ধরে শ্যামলী নিজেকে নিংড়ে কাজ করে চলেছে।

উপরে, আরও উপরে ওঠার তীব্র নেশা শ্যামলীকে কলেজ জীবন থেকেই তাড়া করত। শ্যামলী কোনদিনই থামতে জানে নি। পড়াশোনায় শ্যামলী যে খুব ভাল ছিল তা নয়, মাঝারি মেধার শ্যামলী জেদ আর পরিশ্রমের জোরে বরাবর ভালই রেজাল্ট করেছিল। টাকার নেশা পেয়ে বসেছিল কলেজেই, তাই অন্যান্য বন্ধুরা যখন তৈরি হচ্ছিল উচ্চশিক্ষার জন্যে শ্যামলী তখন এক ভাল কোম্পানিতে চাকরি পেয়ে যায় এবং যথারীতি কলেজের পরেই শ্যামলীর চাকরি জীবন শুরু হয়।

যুগটা তখন ছিল বেকারত্বের যুগ, সেই যুগে একটা ভাল চাকরি যোগাড় করা সবার কাছেই ঈর্ষনীয় ছিল, শ্যামলীকে তাই কলেজের বন্ধুরা অনেকেই ঈর্ষা করেছিল।

বিকাশ তখন বেকার ছিল, কিন্তু বিকাশ শ্যামলীর প্রেম আরও ঘন হয়েছিল তখন। বিকাশকে নিজের টাকায় সিনেমা দেখিয়ে, রেস্তরাঁতে খেয়ে নারী স্বাধীনতার মূর্ত পূজারি শ্যামলীর দিন ভালোই কাটছিল।

বিকাশ-শ্যামলীর কাছের বন্ধু অনন্যা এম এস সি আর পি এইচ ডি করতে চলে গেল, ওর বাবা মিলিটারির কর্নেল ছিলেন। অনন্যার সঙ্গে মাঝে মাঝে চিঠি পত্রের আদান প্রদান হত, কখনও ফোনেও যোগাযোগ হত।

উন্নতিশীল দেশে উন্নতির হাওয়া খুব তাড়াতাড়ি লাগে। অনেক বিদেশী কোম্পানি আর বিদেশী ব্যঙ্ক ঢুকে পড়ল দেশে। আমেরিকা নিজেদের কাজ এই দেশের মানুষদের দিয়ে করাবে বলায় চাকরির মন্দার বাজারে জোয়ার এলো। চাকরির বাজারে তখন আই টি, ম্যানেজমেন্ট ছাত্র ছাত্রিদের ঊর্ধ্বমুখী চাহিদা। বিকাশ ততদিনে ম্যানেজমেন্টের কোর্স পাশ করে একটা বিদেশী ব্যঙ্কে উচ্চ পদে জাঁকিয়ে বসেছে।

শ্যামলী দেখল ম্যানেজমেন্টের কোর্স করা নেই বলে পিছিয়ে পড়েছে, তাই পুরোন চাকরি ছেড়ে ম্যানেজমেন্টের কোর্স করতে চলে গেল ব্যঙ্ক থেকে লোন নিয়ে। তারপর শ্যামলীকে আর পিছু ফিরে দেখতে হয় নি, সামনেই ছিল খাড়া সিঁড়ি, সেই সিঁড়ি ধরে উঠে পড়তে খুব বেশী সময় লাগে নি জেদি, পরিশ্রমী শ্যামলীর।

ততদিনে বিকাশের সঙ্গে বিয়েও হয়ে গেছে। আজ চার বছরের ছেলেও আছে শ্যামলীর। ছেলে সারাদিন শাশুড়ির কাছে থাকে। শাশুড়িই ছেলেকে স্কুল থেকে নিয়ে আসে, স্কুলে পৌঁছে দেয়।

শ্যামলীর শাশুড়ি প্রমীলাদেবী একটু পুরোন ধাঁচের মানুষ। নারী স্বাধীনতা, মেয়েদের চাকরি ব্যপারটাকে খুব বেশি যে ভালো নজরে দেখেন তা নয়। প্রমীলাদেবী নিজের সংসারেও ঘর সংসারের কাজকেই গুরুত্ব দিয়েছেন। শ্যামলীর দেরী করে বাড়ি ফেরা, রাত জেগে কাজ করা ইত্যাদি নিয়ে প্রায়ই কথা শোনান।

প্রমীলাদেবী প্রায়ই বলেন, “আমার নাতি সুকুটার একদম যত্ন আত্তি হচ্ছে না বৌমা। বিকাশেরও যত্ন চাই বৌমা, সংসারের প্রতি একটু নজর দাও। শুধু চাকরি করে গেলে চলবে?”   

অফিস ফেরত ক্লান্ত, বিধ্বস্ত শ্যামলী শাশুড়ির কথায় বিরক্ত হলেও ঝামেলা না বাড়িয়ে মলিন হাসি হেসে বলে, “আপনি তো আছেন মা।”'

শ্যামলীর কথায় শাশুড়ি আরো তেতে পুড়ে তেজের সঙ্গে বলে ওঠেন, “আমি কি আর চিরদিন? নিজের সংসারের দায়িত্ব নিতে না শিখলে তো বিয়ে কেন করলে, বাচ্চা কেন নিলে? এতোকাল নিজের সংসারে খেটে এলাম এখন ছেলের। বুড়ো বয়সে যে একটু বিশ্রাম নেবো উপায় নেই। কালে কালে যে 

আর কত দেখতে হবে কে জানে।” গ্রামে বড় হয়ে ওঠা প্রমীলাদেবী শহুরে পালিশ দিয়ে কথা বলতে শেখেন নি।

প্রমীলাদেবীর কথায় শ্যামলীর গায়ে যেন ফোস্কা পড়ে গেল, তাঁর কথার কোন জবাব না দিয়ে তাড়াতাড়ি নিজের রুমে গিয়ে কিছু খেয়ে অফিসের কাজ নিয়ে বসল। অনেক কাজ, মাথা একেবারে গরম হয়ে আছে, আজ শ্যামলীকে রাত জাগতেই হবে। বিকাশ এখনো ফেরে নি।

ঐ ঘরে সুকু শাশুড়ির সঙ্গে বসে পড়ছে। সুকুটাও হয়েছে তেমনি, একদম মায়ের কাছে ঘেঁসে না, এইটুকু বাচ্চাও বোঝে মা ব্যস্ত অফিসের কাজ নিয়ে, মাকে বিরক্ত করতে নেই, হয়তো শাশুড়িই বুঝিয়েছে।

শ্যামলী জানে আজ আবার শুরু হবে ছেলের কাছে শাশুড়ির গাদাগুচ্ছের অভিযোগ। বিকাশ অফিস থেকে ফিরলেই শাশুড়ি শ্যামলীর সংসারের প্রতি অমনোযোগের হাজার ফর্দ মেলে ধরবেন। বিকাশও তালে তাল মেলাবে, শ্যামলীকে বোঝাতে আসবে। তারপরে ব্যপারটা ঝগড়ায় পরিণত হবে, অবশেষে স্বামী স্ত্রীতে কথা বন্ধ হবে। শ্যামলী আবার ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুমোবে। স্ট্রেস কমাতে ডাঃ চৌধুরীর ঔষধ গুলো খেয়ে যেতে হবে। শ্যামলী আর বিকাশের সেটা প্রায় নিত্য দিনের ঘটনা। অন্যান্য সময়ে বিকাশের সঙ্গে কথা বলার কোন বিষয় খুঁজে পায় না। অফিসের  রেষারেষি,  ইনকাম  ট্যাক্স  ছাড়া  যেন  দুজনের কাছে অন্য কোন কথা নেই।

বিকাশ দেরী করে অফিস থেকে এসেও অফিসের কাজ নিয়ে বসে, শ্যামলীও বসে। মায়ের কথায় বিরক্ত বিকাশ শ্যামলীকে বলে, “অফিসের কাজ অফিসেই সেরে নাও না কেন? ঘরে তো সুকুকে একটু সময় দাও।”

শ্যামলী জবাব দেয়, “দেখো উন্নতি করতে হলে কিছু তো কম্প্রোমাইজ করতে হবে। তুমিও তো সময় দিতে পারো। সবকিছু কি আমাকেই করতে হবে?”

বিকাশ রাগের মাথায় পরামর্শ দিল, “তুমি তো এই চাকরি ছেড়ে অনন্যার স্কুলে চাকরি করতে পারো। সময় কম লাগবে, ছেলের পেছনে সময় দিতে পারবে। আমি বলছি না যে তুমি চাকরি কোর না, কর চাকরি কিন্তু বাড়িতেও একটু সময় দাও। মা কত আর করবেন।”

“ইইসস, ম্যাগ্যোঃ! ছিঃ, স্কুলের চাকরি একটা চাকরি হল? আমি স্কুলের চাকরি ঘৃণা করি।” শ্যামলী মাথা ঝাঁকিয়ে উত্তর দিল।

উচ্চাকাঙ্ক্ষী শ্যামলীর আঁতে ঘা লাগে। এত ভালো চাকরি ছেড়ে শেষে কিনা বিকাশ স্কুলের সামান্য চাকরি করার কথা বলছে সামান্য সংসারের জন্যে। শ্যামলীর স্ট্যাটাস, পজিশনের কোন মূল্য নেই বিকাশের কাছে?

“হ্যাঁ, তা তো বটেই। যারা তোমাকে বাচ্চা বেলায় হাতে ধরে ধরে শেখালো, যারা তোমাকে সারাজীবনের শিক্ষা দিল, যাদের প্রেরণায়, পরিশ্রমে তুমি আজ এখানে তাদের চাকরিকে তুমি ঘৃণা করবে বই কি। তোমার শিক্ষকেরা তোমাকে শিক্ষা না দিলে আজ তুমি কোথায় দাঁড়াতে স্বার্থপর নারী?” বিকাশ বেশ ঝাঁজালো সুরে বলল।

“তোমার শিক্ষকদের প্রতি তোমার কোন শ্রদ্ধা নেই, না থাকুক। তাদের ঘৃণা করার অধিকারও তোমার নেই। যে মানুষেরা তোমার জন্যে করেছে তাদের প্রতি নূন্যতম কৃতজ্ঞতা বোধ টুকুও তোমার নেই। থাক, তোমার মত মানসিকতার মেয়ে আমার ছেলের শিক্ষার দায়িত্ব নাই বা নিলে। তুমি আর কি শেখাবে? শেখাবে তো অশ্রদ্ধা, অকৃতজ্ঞতা, স্বার্থপরতা। একদিন তোমার ছেলেই তোমাকে অশ্রদ্ধা করবে। থাক আমি আমার ছেলেকে নিজে সময় দেবো। তুমি থাকো তোমার সিঁড়ি ভাঙ্গা চাকরি নিয়ে।” রাগান্বিত উচ্চ স্বরে বিকাশ যোগ করল।

ঘরে বাইরে মানসিক চাপে শ্যামলীর মনে হচ্ছে ভারসাম্য বজায় রাখতে পারবে না।  

সম্পর্কের শীতলতা এমন এক জায়গায় পৌঁছল যে দুজনেরই মনে হল, দূরে সরে যাওয়াই ঠিক। এই সম্পর্ক ভেঙ্গে ফেলাই ঠিক। ঠিক হল ডিভোর্স হবে পারস্পরিক বোঝাপড়ায়। যেহেতু, শ্যামলীও উচ্চ পদে চাকরি করে, খোরপোষ নিয়ে কোন ঝামেলা করবে না। বিকাশ কিছুতেই সুকুর স্বত্ত্ব ছাড়তে রাজী নয়, তাই শ্যামলীও সুকুর বাবার কাছে থাকার ব্যপারটা মেনে নিল। স্থির হল কিছুদিনের মধ্যে শ্যামলী এক আলাদা ফ্ল্যাট ভাড়া করে চলে যাবে।

প্রমীলাদেবী কত বোঝালেন বিকাশকে, বললেন, “স্বামী স্ত্রীতে ঝগড়া তো কত হয় তা বলে ডিভোর্স দিতে হবে, এ কেমন কথা। তুই সুকুর কথা ভাবলি না?”

বিকাশ জবাব দিয়েছিল, “তুমি বুঝবে না মা। তাছাড়া ও থেকেও কি সুকুকে সময়

দিয়েছিল?” শ্যামলীকেও প্রমীলাদেবী বোঝালেন, “মেয়েদের এতো রাগ ভালো নয় বৌমা। বিকাশ না হয় না বুঝল, তুমি তো মানিয়ে নিতে পারো! তোমার জেদ ছেড়ে দাও বৌমা। সংসারের জন্যে কিছু তো আত্মত্যাগ করতে হয়।”

প্রমীলাদেবীর কথায় আবার শ্যামলীর গায়ে জ্বালা ধরল, ধমনী-শিরা উপশিরায় রক্ত চলাচল দ্বিগুণ হল, মুখে তার আঁচ টের পেল। কাঁধ নাচিয়ে শাশুড়ির সামনে থেকে সরে গেল নিতান্তই অবজ্ঞা ভরে। মনে মনে বলল, 

“আপনিও তো ছেলের কাছে আমার নামে অনেক অভিযোগ করতেন, ভালোই তো হয়েছে। এখন আবার বোঝাতে আসা কেন?”

যাইহোক, শ্যামলীর প্রেজেন্টেশন মোটামুটি তৈরি। পরের সপ্তাহে বিদেশি ডেলিগেটদের সামনে শ্যামলীর চাকরির ঊর্ধ্ব মুখী ভাগ্য পরীক্ষা।

সেদিন অফিসে গিয়ে শুনল বিদেশি ডেলিগেটদের সামনে প্রেজেন্টেশন দেবে নীতা, শ্যামলী নয়। শ্যামলীর মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল, হঠাৎ এই শেষ মুহূর্তে কেন প্রার্থী বদল ঘটল, শ্যামলী কিছুতেই বুঝে উঠতে পারল না। বসকে জিজ্ঞাসা করেও কোন সদুত্তর পাওয়া গেল না।

জেদি, আত্মবিশ্বাসী, অহংকারী শ্যামলী কিছুতেই এই হার মেনে নিতে পারলো না। কোন ঘৃণ্য চোরা রাজনীতিতে ওকে সরিয়ে নীতাকে এই কাজের দায়িত্ব দেওয়া হল কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিল না।  

হঠাৎ করে শ্যামলীর নিজেকে খুব একাকী মনে হল। ইন্টারনেটে এখন কত সামাজিক নেটওয়ার্ক- অর্কুট, ফেসবুক, টুইটার তৈরি হয়েছে মানুষের একাকীত্ব কাটানোর জন্যে, কিন্তু সত্যি কি মানুষের একাকীত্ব কাটাতে পেরেছে? নাকি মানুষ আরও একা হয়ে গেছে? কাছের যারা ছিল তারা মনের দিক থেকে দূরে সরে গেছে। আজকাল আর কেউ কাউকে মনের দিক থেকে জানার চেষ্টা করে না। সবাই শুধু নিজের মনকে রক্তাক্ত করে একে অপরের সঙ্গে তুলনা করে। এক নির্জন একাকীত্ব শ্যামলীকে ধীরে ধীরে ঘিরে ধরছে। অফিসের জন্যে কত কি ত্যাগ করতে হয়েছে শ্যামলীকে। ছোট্ট সুকুর বেড়ে ওঠার সঙ্গী হতে পারে নি, শুধু অন্ধ ভাবে এগিয়ে যাওয়ার, উপরে ওঠার পথ খুঁজেছে। অফিসের অতিরিক্ত কাজের চাপের জন্যেই বিকাশের সঙ্গে মনোমালিন্য ডিভোর্স পর্যন্ত গড়াচ্ছে, শ্যামলীর উপরে ওঠার অদম্য বাসনা তাতে একটুকুও দমে নি, বরং শ্যামলী ভেবেছে এবার আরো ভালো করে কাজ করে একদিন এই কোম্পানির ম্যানেজার হবে।

আর, আজ? গত দীর্ঘ কয়েক মাসের রাতজাগা পরিশ্রম সম্পূর্ণ অর্থহীন হয়ে গেল। অফিসে কত সহজেই ওকে সরিয়ে শূন্যস্থান পূর্ণ হয়ে গেল।

শ্যামলীর সংসারেও কি তাই? ছোট্ট সুকু কি মায়ের জায়গা অন্য কাউকে দিতে পারবে? আর বিকাশ? বিকাশও কি ওকে ছাড়া থাকতে পারবে? নাকি অন্য কাউকে বিয়ে করবে? বিকাশ-শ্যামলীর সংসার, একদা শ্যামলী নিজের হাতে বড় ভালোবেসে সাজিয়েছিল, সেখানে অন্য কেউ এসে শ্যামলীর জায়গা নিয়ে নেবে? শ্যামলীর মনে হল নিজের সংসার থেকেও ওর উপস্থিতি আবছা হয়ে যাচ্ছে, ওর  প্রয়োজনীয়তা  কমে যাচ্ছে,  নিজের আপনজনেরাই ওকে ভুলে যাচ্ছে। এতোই সহজ শ্যামলীকে সরিয়ে ফেলা? মানুষ ভালোবেসে অপরের কাছে নিজেকে প্রয়োজনীয় করে তোলে, আর শ্যামলী কি করেছে? নিজেকে ওদের কাছে অপ্রয়োজনীয় করে তুলেছে? ওদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে? শ্যামলীর নিজেকে নিঃস্ব, রিক্ত, ক্লান্ত, পরাজিত বলে মনে হচ্ছিল।

সেদিন শ্যামলী খুব তাড়াতাড়ি অফিস থেকে ফিরে এল। শাশুড়ি খুবই অবাক হয়ে গেলেন। শ্যামলী ফিরেই দুই কাপ চা বানিয়ে শাশুড়ির সামনে এক কাপ রেখে নিজেও চা খেল।

যে শাশুড়ির প্রতিটি কথায় শ্যামলী গায়ে জ্বালা ধরত, ফোস্কা পড়ত, তাকে আজ নিজের বড় আপনজন বলে মনে হল। মনে হল জিজ্ঞেস করে- ‘মা, আমি চলে গেলে আপনি কার সম্বন্ধে ছেলের কাছে অভিযোগ জানাবেন?’ কিন্তু, কিছু না বলে চুপ করে চায়ে চুমুক দিল।

শাশুড়ি যেন কিছু বুঝতে পেরেছেন, চা খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার কিছু হয়েছে বৌমা? তোমার কি শরীর খারাপ?”

আজ শাশুড়ির প্রশ্ন যেন এক বন্ধুর মত শোনাল। শ্যামলী জবাব দিল, “না মা, কিছু হয় নি। চলুন আজ বিকেলে আমরা শপিং করতে যাই।”

শাশুড়ি আরও অবাক হলেন, যার কদিন পরে ডিভোর্স হবে, যে কদিন পরে চলে যাবে, যাকে নিয়ে শাশুড়ির মন খারাপ, সে বলছে শপিং করার কথা।

শ্যামলী জানে শাশুড়ির বয়স হলেও শপিং করতে খুব ভালোবাসেন। সংসারের টুকিটাকি জিনিস, নাতির জন্যে খেলনা ইত্যাদি দরকারি-অদরকারি জিনিস কিনতে খুব ভালোবাসেন।

বিকাশ অফিস থেকে ফিরে শ্যামলীকে সুকুর সঙ্গে বসে পড়াতে দেখে খুবই অবাক হলেও কিছু বলল না।

পরের দিন শ্যামলী সারাদিন ঘরে থাকল। সংসারের নানান ছোটখাট কাজ শাশুড়ির সঙ্গে মিলে মিশে করল। শাশুড়ি কোন অপ্রীতিকর প্রশ্নই করলেন না। সুকুকে স্কুলে পৌঁছে দিল, সময় মত নিয়ে এল স্কুল থেকে। সুকুও মা’কে পেয়ে খুব খুশি, লাফাতে লাফাতে স্কুল থেকে ফিরল।

বিকাশ কয়েকদিন ধরে শ্যামলীর এই পরিবর্তন লক্ষ্য করছিল, কিন্তু কিছু বলছিল না। শেষে আর থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করল, “শ্যামলী তোমার কি হয়েছে?”

শ্যামলী বলল, “কিছু না।”

বিকাশ বলল, “মনে আছে তো সামনের মাসে উকিলের কাছে যেতে হবে। কেস ফাইল করতে হবে।”

“হ্যাঁ মনে আছে।” শ্যামলী জবাব দিল।

কিছুক্ষণ উভয়পক্ষের নীরবতা, শ্যামলী বলে উঠল, “আচ্ছা, ডিভোর্সের পরে তুমি আবার বিয়ে করবে নাকি? মানে এই সংসারে আমার জায়গা অন্য কেউ নেবে? সুকু অন্য কাউকে মা বলে ডাকবে?”

তেতো মুখে বিকাশ জবাব দিল, “জানি না।”

“ডিভোর্সটা কি জরুরি? আমি যদি স্কুলে চাকরি করি, বাড়ীতে সুকুকে সময় দি?” শ্যামলী জানতে চাইল।

বিকাশ অসম্ভব অবাক হয়ে শ্যামলীর দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি করবে স্কুলে চাকরি? তুমি না স্কুলের চাকরি ঘৃণা কর? তাছাড়া তোমার সিঁড়ি ভাঙ্গা চাকরি তুমি এতো সহজে ছেড়ে দেবে?” নিতান্তই ব্যাঙ্গের সুরে বিকাশ বলল।

শ্যামলী মাথা নাড়ল, বলল, “সিঁড়ি ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে সাপের মুখেও পড়তে হয়, বিকাশ, তখন আবার শুরু থেকে শুরু করতে হয়। আমি ঐ চাকরি ছেড়ে দিয়েছি।”

“কেন?” বিকাশ অবাক সুরে জানতে চাইল। ওর কৌতূহল যেন বাঁধ মানছিল না।

শ্যামলী মাথা নেড়ে বলল, “এমনিই। থাক না অফিসের কথা।”

আবার নীরবতা, শ্যামলীর চোখে জল দেখে বিকাশ নীরবতা ভাঙ্গল, জিজ্ঞেস করল, “কি হয়েছে?”

“আমি তোমাদের ছেড়ে থাকতে পারবো না। তোমাদের আমি হারাতে চাই না।” কান্না মেশানো গলায় শ্যামলী জবাব দিল। আবার বলল, “তোমরা কি আমাকে ছাড়া থাকতে পারবে?”

জেদি, আত্মবিশ্বাসী, অহংকারী শ্যামলীর এইভাবে ভেঙ্গে পড়া দেখে বিকাশের মনে পড়ে গেল প্রথম দিকের সদ্য পরিচিত শ্যামলীর কথা, যাকে প্রথম দেখাতেই প্রেমে পড়ে গেছিল বিকাশ, যাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল। সত্যি বিকাশেরও কষ্ট হবে শ্যামলীকে ছেড়ে থাকতে।

এতোদিনে সংসারের চড়াই উৎরাই পার হতে গিয়ে দুজনেই যেন ভুলে গিয়েছিল নিজেদের রঙ্গিন প্রেমের দিনগুলোর কথা। আজ যেন এক দমকা হাওয়ায় দুজনেরই মনে পড়ে গেল সেই দিনগুলোর কথা।

  এতোদিন দুজনেই যেন অহংবোধের দূর্গের ঘেরাটোপে নিজেদের বন্দী রেখেছিল। দুজনেই যেন চাইছিল সেই অহংবোধের দূর্গ থেকে কেউ একজন আগে বেড়িয়ে এসে সন্ধির হাত বাড়াক। শেষ পর্যন্ত শ্যামলীই সেই অহংবোধের চাদর সরিয়ে সন্ধির হাত বাড়াল।

শ্যামলী অনন্যার স্কুলে যোগ দিয়েছে। অনন্যা স্কুল খুলেছিল বাবার নামে, সেই স্কুল এখন অনেক বড় হয়েছে। অনন্যার স্কুলে সুকুও পড়ে। এখন মা আর ছেলে এক সঙ্গে স্কুলে যায় আর ফিরে আসে।  

ছোটবেলা লাভ ক্ষতির অঙ্কে ভুল হলে শিক্ষকেরা লাল কালির দাগ দিয়ে অংক শুদ্ধ করে দিতেন। আজ যেন জীবনের খাতায় লাভ ক্ষতির অঙ্কের হিসাব জীবনরূপী শিক্ষক শুদ্ধ করে দিলেন। অঙ্কে শূন্য পেতে পেতে পাইয়ে দিলেন একশোয় একশো। সেই মহান শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধায় শ্যামলীর মাথা নিজের অজান্তেই নত হয়ে যায়।

চিল অথবা বাজপাখিও তো আকাশে অনেক উঁচুতে ওড়ে। এতো উঁচুতে ওড়ে যে আকাশ ছুঁয়ে ফেলে। নিজেকে অনেকটা ভগবানের কাছাকাছি মনে করে, কিন্তু ক্লান্ত ডানায় যখন সোনালী রোদ্রের গন্ধ মুছে যায়, ঠিক তক্ষুনি তাকে এই পৃথিবীর বুকে খড়কুটো দিয়ে বানানো নীড়ে ফিরতে হয়। সেখানেই তার প্রকৃত শান্তি, তার প্রকৃত বিশ্রাম, তার সন্তানদের বেড়ে ওঠা।

Comments

Top

এ অনুভুতির

পরিমাপ কত

মিজানুর রহমান মিজান

বিশ্বনাথ, সিলেট, বাংলাদেশ

youngman.JPG
এ অনুভূতি

রীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে পাঁচ দিন অতিবাহিত হলে ও রায়হান কলেজে যাওয়া থেকে বিরত। ফলাফল জানার আগ্রহ যেন একেবারেই নেই। উদাসী মনোভাব দর্শনে অনুভুত হয় সে যেন পরিক্ষা দেয়নি। এ উদাসীভাব যে কারো আসা স্বাভাবিক বলে বিবেচ্য অতি সহজে। অনেকের ক্ষেত্রে কল্পনাতীত ব্যাপার হয়েই থাকবে চিরদিন, চিরকাল। বাস্তব হিসেবে গণ্য করতে সময় ও মেধা ব্যয়িত হবে অনেক। তাহলে বিষয়টি পরিস্কার করা যাক এক্ষণে।

রায়হান অতি দরিদ্র পরিবারের সন্তান। এস. এস. সি নিয়মিত কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে পাশ করলে ও পরবর্তীতে আর নিয়মিত হওয়া সম্ভব হয়নি তার পক্ষে। অর্থ্যাৎ দিবাভাগে চাকুরী এবং নৈশ বিভাগে কলেজে পাঠ এ তার নিয়মতান্ত্রিকতা হয়ে দাড়ায়। এভাবে একদিন এইচ. এস. সি পাশ করে। পূর্বের দু’বৎসর এগার মাইল দুরবর্তী শহরের কলেজে যাতায়াতের মাধ্যমে উভয়কুল সঞ্চালিত হত। কিন্তু এইচ. এস.সি পাশের পর পল্লীর একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চাকুরী গ্রহণের ফলে যাতায়াতের পরিশ্রমটুকু হয় বন্ধ। এটাই বা কম কিসে? অন পক্ষে অর্থনৈতিক দৈন্যতার কবলে জর্জরিত আপাদমস্তক রায়হানদের। সুতরাং এ চাকুরী অনেক অনেক প্রশান্তির ছোঁয়া সমৃদ্ধি ঘটে রায়হানের ক্ষেত্রে।

লেখাপড়ার প্রতি তীব্র আকর্ষণবোধ রায়হানের ধ্যান-ধারণা, চিন্তা চেতনায় সর্বক্ষণ। তা সত্ত্বেও প্রতিবন্ধকতা জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে আছে জড়িয়ে ভালবাসায়। ভর্তির টাকাটা এক জনের নিকট থেকে ধার হিসেবে প্রাপ্তিতে মনের আকাঙ্খা এ মুহুর্তে পূর্ণতা পায়। ডিগ্রি প্রথম বর্ষে পনের দিন অত্যন্ত আগ্রহ সহকারে ক্লাস করে। অত:পর দারিদ্রতার কষাঘাত আঘাত হানে সাইক্লোনের ভয়াবহতায়। হৃদয় বন্দরে ছুটির ঘণ্টা ধবনি তোলে তরঙ্গায়িত হিল্লোলে। 

একটি রাত্রের আরাধনা মহান প্রভুর দরবারে রায়হানের ”আমার পড়ার পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে, আমি পরাজিত জীবন যুদ্ধের এক সৈনিক, ধৈর্য ও সহনশীলতায় যাব এগিয়ে এ মোর আর্তি, আক্ষেপ”। শহরে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। চাকুরী নিয়ে ব্যতিব্যস্ত- জীবন যাপন এবং সঙ্গে টুকটাক ব্যবসা করে পরিচালনা পরিবার পরিজনের একমাত্র পুত্র সন্তান হবার সুবাদে। দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ তাড়া করে অহরহ এ পরিবারের একমাত্র অবলম্বন ভেবে। দিন যায়, মাস যায়, আসে বছর ঘুরে। রায়হান এক প্রকার সম্পূর্ণরূপে ভুলে গেছে লেখাপড়ার কথা। প্রথম বর্ষ থেকে দ্বিতীয় বর্ষে উত্তীর্ণ হবার পরিক্ষা অনুষ্টিত হয় যথা নিয়মে। রায়হান থেকে যায় তা থেকে অনেক দুরের বাসিন্দা হয়ে। আবারো দিনে দিনে মাস , বছর শেষে আসে ঘুরে নির্বাচনী পরীক্ষা। এ পরীক্ষার মাত্র পনের দিন পূর্বে এক বন্ধুর সাথে জরুরী প্রয়োজনে সাক্ষাৎ প্রার্থী রূপে যেতে হয় কলেজ প্রাঙ্গনে। কিছুক্ষণ করে অবস্থান। রায়হানের মনের বন্ধ দরজায় কড়া নাড়ে ধীরে ধীরে লেখাপড়ার ধ্যান-ধারণা। মনটা আনচান করে সঙ্গী সাথীরা পরীক্ষা দেবে, পাশ করবে, উন্নত জীবন যাপনসহ জ্ঞানের পরিধি হবে বিস্তৃত। আসবে অনেক অনেক ......। 

এ ধারণাবোধ থেকেই পরিক্ষায় অংশ গ্রহণের পন্থা অবলম্বনে নেমে পড়ে। আসে না বাড়িতে থেকে যায় শহরে। সন্ধ্যার পর বয়োজৈষ্ট পরিচিত এ ব্যক্তিকে নিয়ে চলে যায়

অধ্যক্ষের বাস ভবনে। রায়হানের পরীক্ষা দেবার দৃঢ় মনোবল, ইচ্ছা, প্রত্যয়ের কথা শুনে অধ্যক্ষ মহোদয় হতবাক। কারণ ডিগ্রি পরীক্ষা, ক্লাসে উপস্থিতি বিহীন, বেতন দু’বৎসরের বাকি, বার্ষিক মান্নোয়ন পরীক্ষা ব্যতীত দ্বিতীয় বর্ষে কিভাবে উত্তীর্ণ ইত্যাদি চিন্তায় বিভোর হন অধ্যক্ষ সাহেব। সর্বোপরি কোন বই ক্রয় করে ও রায়হানের হাতে রক্ষিত নয়।

অধ্যক্ষ সাহেব ছাত্র হিসেবে রায়হানকে মেধাবী জ্ঞাত হলে ও সুন্দর একটি উপমার মাধ্যমে না সুচক সম্মতি প্রদান করেন। উপমাটি হচ্ছে - রায়হান তুমি সাগরের ওপারে যেতে চাও বা প্রয়োজন। কিন্তু তোমার হাতে কোন বৈঠা নেই, মাঝি নেই, আছে শুধু নৌকা। এমতাবস্থায় সাগর পাড়ি দেয়া কি সম্ভব? প্রতি উত্তরে রায়হান গভীর শ্রদ্ধা ও আন্তরিকতায় জানায় স্যার, তা সম্ভব নয় জানি। কিন্তু আমার একান্ত ইচছা পরিক্ষা দেয়া। এক্ষেত্রে আমার এক মাত্র সম্বল, সম্পদ আপনার মত শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক মহোদয়ের দোয়া। আপনার দোয়াই আমার পরম ও চরম অতুলনীয় সম্পদ পরীক্ষা নামক ক্ষেত্রে। স্যার একটু গভীর চিন্তায় হন নিমগ্ন। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে জানান নির্বাচনী পরীক্ষায় অংশ গ্রহণের অনুমতি প্রদান করা হল। বাকি অংশ পরবর্তীতে বিবেচ্য। অধ্যক্ষের সম্মতি পেয়ে রায়হানের আনন্দ যেন উপচে পড়ে। এ আনন্দের প্রকাশ সম্ভব নয়। শুধু অনুভুতিতে ধারণা করা যায়। রায়হান সব কিছু ভুলে যায়। এখন একটিই ধ্যান-ধারণা লেখাপড়া। শুরু করে বন্ধু ও পরিচিত জনদের নিকট থেকে বই সংগ্রহ। একেকটি বই দু’তিন দিন রেখে দিয়ে আসে ফিরিয়ে। এভাবেই পাঠ গ্রহণ চলে রায়হানের। পাঁচ বিষয়ের নির্বাচনী পরীক্ষায় চার বিষয়ে পরীক্ষা দেয়। একটি বিষয়ের বই সংগ্রহার্থে অক্ষমতাহেতু সে বিষয়ে পরীক্ষা দেয়া সম্ভব হয়নি। ফলাফল প্রকাশিত হলে অধ্যক্ষ মহোদয় চার বিষয়ের নম্বর দেখে চুডান- পরিক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ প্রদান করেন স্বত:স্ফুর্ত ভাবে এবং সঙ্গে থাকে তিনির দোয়া।

রায়হান যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সেখানে তারই এক সহপাঠি ও কর্মরত। সহপাঠি নিয়মিত ক্লাস এবং কোচিং করেছেন। তাছাড়া পরীক্ষার নিমিত্তে দু’মাসের ছুটি ও নেন। কিন্তু রায়হান যে ক’দিন পরিক্ষা সে ক’দিনের অর্থ্যৎ দশ দিনের ছুটি নেয়। পরীক্ষা হয় সমাপ্ত।

ফলাফল প্রকাশের তারিখ জ্ঞাত হলে ও রায়হান সন্দিহান হয়ে দেখতে বা জানতে যেতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে, এ ভেবে যদি ফলাফল মন্দ হয়। পাঁচ দিন অতিক্রান্তে- ঘনিষ্ট বন্ধুর পীড়াপীড়িতে সন্ধ্যার পর চলে যায় কলেজে। লোক চক্ষুর অন্তরালে। সেখানে উপস্থিত হয়ে প্রথমেই পেয়ে যায় পূর্বে অধ্যক্ষের সহিত যে শিক্ষক সহায়তা করেছিলেন তিনিকে। রায়হানকে দেখে ঐ শিক্ষক উদগ্রীব হয়ে পড়েন ফলাফল জানার প্রত্যাশায়। তিনি নিজে গিয়ে ফলাফল দেখে রায়হানকে জানান শুভ সংবাদ। রায়হান কৃতজ্ঞতার অপূর্ব আবেশে সশ্রদ্ধ সালাম জানিয়ে চলে অধ্যক্ষের নিকট সুখবর পৌছাতে। অধ্যক্ষ মহোদয় সুসংবাদ বপেয়ে সস্নেহে মাথায় বুলিয়ে দেন হাত এবং প্রাণ খোলে করেন দোয়া প্রভুর দরবারে। রায়হান কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাষা হারিয়ে বাক শক্তি রহিত। তারপর অনুসন্ধান চালায় সহপাঠি সম্পর্কে জানার। সেখানে প্রাপ্তি সংযোগ ঘটে বিফলতার। এ পরীক্ষা পাশের অনুভুতি রায়হানের ক্ষেত্রে কি পরিমাণ তা কি পরিমাপ করা সম্ভব? অথবা রায়হানের ক্ষেত্রে ভূবনের শ্রেষ্টতম অর্জনের উৎকৃষ্ট অনুভুতি হয়ে রয়েছে চির জাগরুক, অম্লান ও অক্ষয়।

Comments

Top

বুকের ব্যাথা 

আবু আফজাল মোহাঃ সালেহ

thief.jpg
বুকের ব্যাথা

লাজুক প্রকৃতির ছেলে আরিফ। বুকে প্রচন্ড ব্যথা।মাঝে মধ্যে বুকের ব্যথা প্রচন্ড হয়। তখন ভালো ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে ওষুধ খেতে হয়। কিন্তু কিসের ব্যথা? কীভাবে ব্যথা হ’ল বুকে? বাড়ির কিংবা আশেপাশের কেউ-ই বলতে পারে না। বুকের ব্যথার জন্যে হাসপাতালে ভর্তির সময় আরিফ’কে চেনা যায় না। শরীর আর চেহারা বিদঘুটে আকার ধারণ করে। পাশের রুম থেকে আরিফের ছোট ভাই ইব্রাহিম দীর্ঘ নিঃস্বাসের শব্দ পায়। কিন্তু সেও ভেবে পায়না তার ভাই আরিফের আসল অসুখটা। বেশ কয়েক বছর আগে ওপাড়ার এক বিয়ে অনুষ্ঠানে জেবার সাথে তার পরিচয়। দেখতে সুন্দর, সুঠামো, চোখদু’টি কাজল কালো।কথা কাটাকাটি হচ্ছিল জেবা আর আরিফের মধ্যে। ইব্রাহিমের বয়স ছিল দশ কি বারো। বোঝার ক্ষমতা হয়েছিল যথেষ্ট। বেকার, লাজুক ইত্যাদি কথা ভেসে উঠছিল। তার ভাই আরিফ বেকার- সে কথা কি বারবার বলছিলো জেবা? ‘আমার ভাইতো চোখতুলে কথা বলেনি কোনদিন! তাহলে কবিতা লেখা যার নিয়ে তিনি কি এই জেবা? মিলাতে কষ্ট হয়! বেকার বলেই কি বারবার প্রত্যাখান করছিলো জেবা? তবে মনে আছে বুকের ব্যথা সেদিন-ই পেয়েছিল আরিফ। হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিলো সেদিন। ইব্রাহিমের সাথে খোলামেলা কথা হ’ত আরিফের। লাজুক কিন্তু গম্ভীরভাবের মানুষ আরিফ। তবে বলতো, চাকুরি পেতেই হবে। চাকুরি জীবনের মাপকাঠি। আমার

কি নেই! মানুষজন আমাকে অন্যভাবে দেখে। গুরত্ব দেয় না। আব্বা চাকুরে ছিলেন। সবাই তাকে সম্মান করতেন, মানতেনও। অতএব পড়াশুনা করে চাকুরি করতে হবে।

তাহলে সেদিনকার জেবু আপুর কথায় ব্যথিত হয়েছিল আরিফ ভাইয়া! জেবার মতো বউ পোষা তো ভাইয়ার পক্ষে কিছুই না। যা সম্পদ-সম্পত্ত্বি আছে তাতে রাজার হালে থাকতে পারবে তারা। তাহলে প্রত্যাখান কেন? না অন্য কিছু! - ভেবে পাইনা ইব্রাহিম। কীসব চিন্তা করছি! আমার কথাতো ঠিক নাও হতে পারে। আরিফ ভাই তো সব কথায়-ই খুলে বলে তাকে। একবার এক সুন্দরী-ধনাঢ্য মেয়ে ভাইয়াকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিল- সে কথা পর্যন্তও বলেছিলো! এবং বলেছিল প্রেম-ট্রেম বুঝিনা। -- তাহলে আজ? কয়েক বছর পর টেম্পুতে এক সুন্দরী মহিলা সাথে হ্যাংলা আর বিশ্রী এক পুরুষ। পুরুষটাকে আমি ভালোভাবেই চিনলাম। ওপাড়ার বাউন্ডেলে ছেলে, কয়েকবার এস-এস-সি পরীক্ষা দিয়ে ফেল করেছে। লোকে তাকে বখাটে হিসেবে জানে এবং চেনে। তার বাবা শ্রম বিক্রি করে থাকে। তাদের দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে ভাইয়া। মনে মনে ভাবি প্রেম মনে হয় জেগে উঠেছে ভাইয়ার। এবার ভাবি পাব নিশ্চয়! অনেকদুর যাওয়ার পর ভাইয়া বলল - সুন্দরীরা কি হ্যাংলা আর বখাটেদের প্রেমেই পড়ে! মনে মনে ভাবি, বখাটে ঐ ছেলের সাথে মহিলাটি কি জেবা, জেবু আপু? আস্তে আস্তে ভাইয়ের বুকের ব্যথা যায় বেড়ে!

Comments

Top

saptarshi.jpg

পথভোলা

সপ্তর্ষি রায়বর্ধন

collegestreet1.jpeg
পথভোলা

কিচেনের দিক থেকে মাইকেলের গলা ভেসে এল “হ্যালো – ফোর, এক্সট্রা চিজ্ চিকেন ওয়ালা লার্জ পিৎজা – যাদবপুর ৮বির কাছে – হু ইস্ গোয়িং”?

বাইকের ওপর বসে সুরজিত মাত্র ঝিনুকের হোয়াটস্অ্যাপ মেসেজটা পড়ছিল – “কখন আসছ তুমি”? অভ্যস্ত আঙুলগুলি টুকটুক করে বিদ্যুৎগতিতে লিখল – “এই তো আর ঘণ্টাখানেক বাদেই হয়ে যাবে”। “তাড়াতাড়ি এসো, আমি অপেক্ষা করব। আজ তোমার জন্য পোস্তবাটা, আরেকটা ভাল জিনিস রান্না করে রেখেছি”। “হুমম্” – এটা লিখে তার সঙ্গে কতগুলো স্মাইলি জুড়ে দিল সুরজিত। ঝাপসা লাগল মোবাইলের পর্দাটা। সারাদিন ধরে দৌড়োদৌড়ি চলে ওর মত ছেলেদের। দম ফেলবার সময় নেই। খালি হই হই করে দৌড়ে চলা। কখনো এই বাড়ি কখনো ওই বাড়ি। হাতের তালুর মত করে তারা চিনে নিয়েছে দক্ষিণ কলকাতার এই অঞ্চলটাকে। রাস্তা, গলি, তস্য গলি, পুকুরের পাড়, মিলন সংঘের মাঠ, হাফ ডজন কালী আর শনি মন্দির, স্কুল বাড়ি, বউদির দোকানের মোড়, যাদবপুরের হস্টেল, সুকান্ত সেতু, সন্ধ্যাবাজার, শ্রীরামপুর, তালতলা – বটতলা মার্কা একগাদা রিক্সা স্ট্যান্ড, বান্টি পেট্রোল প্যাম্প, হিন্দুস্থান মোড় – অমুক ব্যাঙ্কের তমুক এটিএম এরকম শত সহস্র ল্যান্ডমার্ক তাদের মুখস্ত। 

এরা হল ‘পিৎজা কিংস’ নামে বিখ্যাত এক সংস্থার হোম ডেলিভারি এক্সিকিউটিভ। বাড়িতে বসে সুস্বাদু পিৎজা খাবার ব্যবস্থা – তাও আবার গরমাগরম। ক্রেতার কাছে এরা খাবার পৌঁছে দেবার প্রতিশ্রুতি দেয় কখনও সাত কখনও বা পনের মিনিটে। দেরী হলে বা ঠাণ্ডা হলে সে খাবার ফেরত দেবার গ্যারান্টিও থাকে। ক্রেতাস্বার্থে তাই এদের বিদ্যুৎগতিতে ধাবমান হতে হয় মোটরসাইকেলে – এ গলি সে গলি দিয়ে, ট্রাফিক জ্যাম এড়িয়ে, লাল আলোর সিগন্যালের ভ্রুকুটি বাঁচিয়ে কখনও বা অমান্য করে। আজ থেকে বছর পাঁচেক আগে সুরজিত এখনে চাকরি যোগাড় করেছিল। যদিও তার বিএ ইংলিশের বিদ্যেবুদ্ধিটা খুব একটা কাজে লাগেনি, আসল চাহিদা ছিল তার বাইক চালাবার লাইসেন্স আছে কিনা। একটা ছোটখাট পরীক্ষাও দিতে হয়েছিল – ঐ দ্ধিচক্রমানের সওয়ারী হয়ে – এক কিলোমিটার রাস্তা তাও কত কম সময়ে ঘুরে আসা যায়।

সুরজিতের চাকরিটা হয়ে গেছিল। দরকারও ছিল খুব টাকাপয়সার সে সময়। কলেজ ছাড়বার পর বাইকটা বিক্রি করে দিতে হয়েছিল পয়সা যোগাড় করবার তাগিদে। বাবা মারা যেতেই আসলে সংসারের হাল ধরতে হয়েছিল সুরজিতকে। মাঝখানে বছরগুলো বড়সড় যুদ্ধের। কলেজের রঙীন দিনগুলো কখন হারিয়ে গেছে। বন্ধু, বান্ধবীদের সঙ্গে নিয়মিত আড্ডা, খাওয়া দাওয়া, সিনেমা – সব মিলিয়ে বেশ কেটে যাচ্ছিল। সেই বয়সে প্রেমও এসেছিল নিয়ম মেনে। অতগুলো মেয়ের মাঝে পিকু কেন যে বেশী ভাল লাগত – সে বোঝেনি প্রথমে। যেদিন বুঝল – সেদিন পিকু কলেজ আসেনি। একে তাকে জিজ্ঞাসা করেও ঠিক আন্দাজ করা গেলনা পিকু কোথায় – তার কি হয়েছে। সারাদিন অস্থিরতায় কাটিয়ে শেষে আর থাকতে না পেরে হাজির হয়েছিল পিকুদের পেল্লায় বাড়ির সামনে। কলেজে বন্ধু হিসেবে অতি অনায়াসেই সুরজিত পৌঁছে গেল বাড়ির অন্দরমহলে।

পিকু জ্বরে গৃহবন্দি। খাটের পাশে বসে প্রায় একঘণ্টা গল্প হল দুজনের। সেই রাতে সুরজিত বুঝল পিকুর সঙ্গে তার সম্পর্কটা একটু অন্য সুরে তালে বাঁধা পড়েছে।

যেদিন পিকু সুস্থ হয়ে ফিরে এলো সেদিন থেকে সুরজিত যেন কিরকম দলছুট হয়ে পড়েছিল। দুজনের একসঙ্গে থাকা, ঘোরাফেরা নিয়ে কম মন্তব্য শুনতে হয়নি। তবু ওদের আশেপাশের বন্ধুরা জেনে গিয়েছিল সব।

এ সবের সাক্ষী ছিল আরেকজন। সে হল সুরজিতের সেই মোটরবাইক। আহা, বড় যত্নে রেখেছিল তাকে। আর যেদিন পিকুর সঙ্গে ঘুরতে যাওয়া – কাছাকাছি অথবা দূরে, সেদিন সেই যন্ত্রযানের গায়ে যেন পুলকের বাতাস। খুব ভালবাসত পিকু ওটায় চড়তে। আর সুরজিতের হাতে ওটা হয়ে উঠত রূপকথার পক্ষীরাজ।

তারপর একদিন এল সেই ভয়ঙ্কর দিনটা ৬ই ডিসেম্বর। কিছু ধর্মান্ধ লোক শাবল গাঁইতি মেরে কয়েক ঘণ্টার চেষ্টায় গুঁড়িয়ে দিল একটা শতাব্দী প্রাচীন মসজিদ। দিনটা ছিল রবিবার। কি একটা কথা বলবার জন্য পিকু সেদিন সুরজিতকে দুপুরবেলা যেতে বলেছিল তার বাড়িতে।

সুরজিত চটপট দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে বেরিয়ে গেছিল তার বাহন নিয়ে। কিন্তু, সে পৌঁছতে পারেনি পিকুর বাড়ি। কারণ মাঝরাস্তাতে তাকে পুলিশ আটকায়। শহরে কারফিউ জারি হয়েছিল সেদিন।

বাড়ি ফিরে সুরজিত এঘর সেঘর করল। পিকুর সঙ্গে দেখা হলনা – কথা বলতে গেলে যেতে হবে পাড়ার মোড়ের টেলিফোন বুথে। কিন্তু সেও আজ বন্ধ। টিভির সামনে বসে বসে দেখছিল সেই দৃশ্য বারবার – দুই হাত তুলে পতাকাধারী কিছু লোকের এক অদ্ভুত উন্মাদনা।

শীতের সন্ধ্যায় ফাঁকা রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল সুরজিত। কি বলতে চেয়েছিল পিকু? প্রশ্নটা বারবার ঘুরপাক খাচ্ছিল তার মাথায়। পৃথিবীতে সমস্যার সমাধান কখনো কখনো হয় অকস্মাৎ। এ ক্ষেত্রেও তাই হল। পথে দেখা হল তড়িৎদার সাথে। কয়েকটা বাড়ি পরেই তড়িৎদাদের বাড়ি।

“আরে তুই এভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছিস রাস্তায় কি ব্যাপার”?

“তুমিও তো বেড়িয়েছ” – শুকনো হাসি হেসে বলল সুরজিত।

“আর বলিস না – সিগ্রেটের খোঁজে গেছিলাম রে। একটাও নেই, মাধবের দোকান বন্ধ। সেই রায়পুরের মোড়ে গিয়ে পেলাম।

“তড়িৎদা – শোন না গো – তোমাদের বাড়ির ফোনটা কাজ করছে ? একটা ফোন করা যাবে খুব জরুরী”

– “কেন করা যাবে না ? চল আমার সঙ্গে – বউদির হাতে একটু চা খেয়ে যাবি। শোন একটাই শর্ত – ঢুকেই তুই বলবি – বউদি চা খেতে এলাম – তাহলে আমিও পাব এক কাপ”।

বারান্দা পেরিয়ে তড়িৎদার বৈঠকখানায় ঢুকেই কালো ফোনটার দিকে এগিয়ে গেল সুরজিত। “বিশাখা – কোথায় তুমি” – বলে একটা হাঁক ছাড়ল তড়িৎদা। তারপর ফিসফিসিয়ে বলল “শোন তুই ফোন মেরে দে, আর বিশাখা এলে ওই ডায়লগটা দিতে ভুলবিনি ভাই, আমি চট করে একটু বাথরুম ঘুরে আসি”। এই বলে তড়িৎদা চলে গেল।

এই মুহূর্তে এই দশ ফুট বাই দশ ফুট ঘরটায় সুরজিত একা। তার চোখ টেলিফোনের দিকে। কিরকম একটা অজানা আশঙ্কা বুকে নিয়ে টেলিফোনের সাতটা নম্বর ডায়াল করল সুরজিত। ফোনের ওপারে মাসিমার গলা পাওয়া গেল। পিকুকে চাইতেই তিনি বলে উঠলেন “আরে সুরজিত তোমরা ঠিক আছ তো? যা অবস্থা শহরটার – ধর ধর দিচ্ছি” – সমান্তরাল লাইনে পাওয়া গেল পিকুর গলা।   

“কেমন আছিস তুই জিৎ - কোথা থেকে ফোন করছিস”?

“তড়িৎদার বাড়িতে আমি – আজ যেতে পারলাম না তোদের ওখানে – তাই – কি ব্যাপার বলত – কি বলবি বলছিলি”? পিকুর গলায় কেমন একটা হতাশার সুর টের পেল সুরজিত। বুকের কাঁপুনিটা বাড়ল। ফোনের রিসিভারটা আরও জোরে সে চেপে ধরল কানের পাশে। ও প্রান্তে পিকু কাঁদছে মনে হল।

“জিৎ ফেব্রুয়ারিতে বিয়ে ঠিক হয়েছে আমার”। নিজের কানকে বিশ্বাস হল না সুরজিতের। মনে হল কে যেন একটা ভারী জিনিস ফেলে দিল তার বুকের ওপর।

“কেন কার সঙ্গে”? আছে কেউ একজন, তুই এর চেয়ে বেশী কিছু জানতে চাস না – তুই ভালো থাকিস জিৎ ...............” ওপাশে কট্‌ করে ফোন কেটে যাবার শব্দ হল। সুরজিত বুঝল একটা অসম্ভব কষ্ট অনুভব করছে সে। আরও যেন ঘরটা চেপে ধরছে তাকে। কাউকে কিছু না জানিয়ে অন্ধকার রাস্তায় নেমে এল সে।

বাড়িতে গিয়ে নিজের ঘরে শুয়ে পড়ল সুরজিত। কান্নাটা দলা পাকিয়ে গলার কাছে এবার সেটা চোখ ভেঙে নেমে এল অঝোরে। পরের কিছুদিন সুরজিতের জীবনেও যেন কারফিউ নেমে এসেছিল। রাস্তাঘাট খালি – বাতাসে ফিসফিস – এক অন্তহীন নিস্তব্ধতা। সুরজিতের মানিয়ে নিতে কষ্ট হচ্ছিল, যদি একবার কথা বলত পিকু।

দেখতে দেখতে ফেব্রুয়ারি মাসটা চলে গেল। পরিচিত বন্ধু-বান্ধবদের কাছে জানতে পেরেছিল পিকুর সঙ্গে বিয়ে হয়েছে কৃষ্ণেন্দুর। বিয়ের পর তারা চলে যায় দিল্লীতে।

বাবাকে যেদিন হাসপাতালে ভর্তি করেছিল সুরজিত, সেদিন কলকাতার বুকে আকাশ ভেঙে পড়েছিল। এ্যাম্বুলেন্স বাবাকে নিয়ে চলেছে, পিছনে তার বাইকে সুরজিত। অঝোর বৃষ্টিধারায় চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছিল। জামাকাপড় সপসপে ভিজে। ঘটনার আকস্মিকতায় রেইনকোট পড়তেও ভুলেছে সে।

     তারপর বছর তিনেকের একটা যুদ্ধ লড়তে হল সুরজিতকে। বাবার চিকিৎসার বিল মেটাতে সুরজিত আর তার মা হিমসিম খেত। যেদিন কল সেন্টারে প্রথম চাকরি পেল, সেদিন সুরজিতের অনেক বছর বাদে মনে হল ভাগ্য হয়ত এবার সদয় হল। বিছানায় শুয়ে চোখ বুজে অনেকদিন পর সে হঠাৎ দেখল পিকুকে।

সজোরে কেউ একটা ধাক্কা মারল সুরজিতকে। “আরে এই জিৎ, ৮বির কাস্টমার তো তুই যাবি না কি – অলরেডি সাত মিনিট ধরে ফুড রেডি, প্যাক হয়ে আছে – তুই শালা ঘুমোচ্ছিস। বস্‌ ভ্যালেন্টাইন্স ডে তে তোরা যদি এভাবে ডিউটি করবি – তবে কাজ ছেড়ে দে” – মাইকেলের উদ্ধত ভঙ্গি দেখে সুরজিত খুবই বিব্রত হয়ে পড়ল সত্যিই তো ঝিনুকের টেক্সট্‌ মেসেজ পড়তে পড়তে সে একটু ঘুমিয়েই পড়েছিল। “না না বস্‌, তুমি চিন্তা কোর না – আমি বেরিয়ে যাচ্ছি – টাইমের মধ্যে পৌঁছবো”। কার্ডবোর্ডের বাক্সটা বাইকের পিছনে লাগানো ধাতব কেরিয়ারের মধ্যে ঢোকাতে ঢোকাতে বলল সুরজিত। ঘড়িতে রাত সোয়া নটা। অর্থাৎ হিসেব মত নটা বেজে পঁচিশ মিনিটে পৌঁছতে হবে। দশ মিনিটে এতটা রাস্তা যাওয়া যায় কিনা তা ভাববার, বিচার করবার সময় নেই সুরজিতের। কারণ তার কাছে কোন বিকল্প নেই। যদি না পৌঁছতে পারে এবং কাস্টামার যদি বলে পিৎজা ঠাণ্ডা, তাহলে তার দায় বইতে হবে সুরজিতকে – “পিৎজা কিংস” এর মালিক কে নয়। একরাশ কালো ধোঁয়া ছেড়ে বাইকটা অদৃশ্য হল এক অন্ধকার গলির ভেতর। সুরজিতের সামনে এখন শুধুই দ্রুত ধাবমান কালো রাস্তা। যানবাহন, পথচারীদের নিপুণহাতে কাটিয়ে সে এগিয়ে চলেছে তার গন্তব্যের দিকে। তাই তো আজ যে ভ্যালেন্টাইন্স ডে ! এতক্ষণে ঝিনুকের মেসেজের মানে বুঝল সে। সারপ্রাইস আইটেম বোধহয় ওই জন্যই। ঝিনুকের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল কল সেন্টারে কাজ করতে গিয়ে। ভীষণ সাদাসিধে মেয়ে কল সেন্টারের যে আবহ-আচার – তার বাইরে ছিল ঝিনুক। পিকুর ছেড়ে যাওয়াটা যেমন মেনে নিতে পারেনি সুরজিত, ঝিনুকের সঙ্গেও স্বাভাবিক হতে তার সময় লেগেছিল অনেক। কিন্তু, ধীরে ধীরে ওরা বুঝতে পারছিল পরস্পর নির্ভরতা।

অবশেষে একদিন পিকুর শূন্যতা কাটিয়ে তার জীবনে সম্পূর্ণভাবে এলো ঝিনুক। যেদিন “পিৎজা কিংস” এর চাকরিটা পেল সুরজিত, ঝিনুক খুব ভয় পেয়েছিল। কারণ সে কোনদিন সুরজিতের বাইকে চড়েনি, তার আগেই বাইকটা বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছিল সে। সুরজিত বুঝিয়েছিল ঝিনুককে “আরে দূর, অত চিন্তার কি আছে, আর আমার সাথে তো মোবাইলও থাকে। যখন ইচ্ছে ফোন বা মেসেজ কোর আমায়”। 

“আরে ও ভাই – আস্তে যান না – লোক মারবেন নাকি” ? সুরজিতের সম্বিত ভাঙল, এক গম্ভীর গলার হঠাৎ চীৎকারে। বিক্রমগড়ের ওই রাস্তাটা ধরে গেলে যাদবপুর তাড়াতাড়ি পৌঁছানো যাবে – তাই সুরজিত বাইক নিয়ে তড়িঘড়ি ঢুকে পড়েছিল ওই রাস্তায় গলফগ্রীণ থেকে। কে জানত এখানে জনসভা করে দেশোদ্ধার করবে কোন এক রাজনৈতিক দল। রাস্তায় চেয়ার পেতে চায়ের কাপ হাতে লোকজন বসে মাথা নেড়ে শুনছে লম্বা চওড়া বুকনি।

তাদের পাশ কাটিয়ে যেতে গিয়েই এই বিপত্তি। কি আর করা, বাইক থেকে নেমে স্টার্ট বন্ধ করে হাঁটতে হল বেশ কিছুটা পথ। ঘড়ির কাঁটা বোঝাল চার মিনিট নষ্ট হয়েছে। আবার সুরজিত সওয়ার হয়। প্রচণ্ড গতিবেগে সে ধাবিত হয় গন্তব্যের দিকে। হিসেব মত ডান হাতের গলির দ্বিতীয় সাদা বাড়িটার সামনেই শেষ হবে তার যাত্রাপথ। বাইকের স্টার্ট বন্ধ করে পিৎজার গরম বাক্সটা বার করতে গিয়ে চোখ পড়ল ঘড়ির দিকে – সাড়ে নটা ছুঁই ছুঁই। মনে হল তার পকেটে রাখা মোবাইল ফোনে টুংটাং করে বোধহয় একগাদা এসএমএস ঢুকল। কিন্তু সেদিকে দেখবার সময় নেই। দরজার বেল বাজাতেই একটি মিষ্টি মধুর পিয়ানোর সুর বেজে উঠল ওপারে। এক বুক শঙ্কা নিয়ে সুরজিত কেতাবী ঢংয়ে বলে উঠল “স্যার – পিৎজা এ্যাট ইউর ডোর স্টেপ – গুড ইভনিং!!” দরজা খুলে গেছে। “কটা বাজে আপনার ঘড়িতে ভাই”, ঠাণ্ডা গলায় বললেন সেই ভদ্রলোক – যিনি ততক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছেন সুরজিতের সামনে। “আপনি এই ডেলিভারিটা ফেরত নিয়ে যেতে পারেন – ইউ আর বিয়ন্ড টাইম, ঐ ঠাণ্ডা খাবার আমরা খাব না”।

এরকম ছোটখাট দেরী মাঝেমাঝেই হয় কিন্তু আজ পর্যন্ত কখনো সুরজিতকে এভাবে ফিরে আসতে হয়নি। “ স্যার – খুবই দুঃখিত, আসলে রাস্তাটা একটু ক্রাউডেড ছিল – আর আজকের দিনটা তো একটা বিশেষ দিন – সো সার্ভিস ইস্‌ লিটল স্লো ............” সুরজিত বলিষ্ঠ ভাবে বলবার চেষ্টা করে। “দ্যাটস্‌ ইউর প্রবলেম – নট মাইন, আপনি ফেরত নিয়ে যান ওগুলো”। মুহূর্তের মধ্যে সুরজিত বুঝতে পারে এতগুলো দামী খাবার এভাবে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া মানে এ মাসের মাইনে থেকে একটা বড় ধাক্কা। ঝিনুকের মুখটা মনে পড়ে। ও মুখ ফুটে চায়নি, কিন্তু ভেবেছিল আজ বাড়ি যাবার পথে একটা উপহার কিনে নিয়ে যাবে। সেটাও কি কিনতে পারবে সে ? সাহস করে এবার সুরজিত শেষ চেষ্টা করল। “স্যার – আপনি একটু বোঝবার চেষ্টা করুন ............”।

“জিৎ” –

পরিচিত গলাটা হঠাৎ যেন বিদ্যুতের শিহরণ খেলিয়ে দিয়ে গেল সুরজিতের সারা শরীরে। তার খুব চেনা এ গলার স্বর – ডাকবার ভঙ্গী, সম্ভাষণ। ততক্ষণে আলো আঁধারি ভেদ করে সে দেখতে পেয়েছে পিকুকে। বয়স বেড়েছে পিকুর; একটু স্থুলকায় “তুমি কেমন আছ ? ভেতরে এসো”। সুরজিত দাঁড়িয়ে। প্রায় এক যুগ আগে যে সময় হঠাৎ দাঁড়িয়ে, পড়েছিল তার মতই। বোঝা গেল অন্দরমহলে একটা ছোট খাট পার্টি চলেছে। সুরজিত কোনরকমে শুকনো গলা থেকে আওয়াজ বার করল” পিকু তোমরা এখানেই থাক ? শুনেছিলাম যে দিল্লী চলে গেছ। “গেছিলাম। একবছর হল কলকাতা ফিরে এসেছি। ভেতরে এসো জিৎ - প্যাকেটগুলো দাও – কত হয়েছে” ? যান্ত্রিক মানবের মত প্যাকেটগুলো হাতে দিল সুরজিত, সঙ্গে রঙীন বিল “পিৎজা কিংস” এর। “আজ আমাদের বিবাহবার্ষিকী। কৃষ্ণেন্দুর বন্ধুবান্ধব এসেছে। তাদের জন্যই এগুলো”। সুরজিত মুহূর্তের মধ্যে পাকা সেলসম্যান হয়ে ওঠে, “ম্যাডাম, একবার দেখে নিন – গরম আছে কিনা আর সবরকম স্পাইস আর সসের প্যাকেটগুলো দিয়েছে কিনা – প্লিজ দেখে নিন”। “জিৎ তুমি বস আজ এতদিন পরে দেখা আমাদের – তুমি রাতে খেয়ে যাবে। পিকু ঠিক আগে যে ভাবে সিদ্ধান্ত নিত নিজের মত করে – ঠিক সেভাবেই কথাগুলো বলল সুরজিতের মাথায় হঠাৎ যেন পাথরের ইমারতে শাবল মারার শব্দ হতে লাগল। একটা অন্ধকার রাস্তায় মনে হল সে দৌড়ে চলেছে, কালো আকাশের ক্যানভাসে তারায় তারায় কিছু দিগ নির্দেশ। কোনরকমে টাকাগুলো পকেটে গুঁজে, একছুটে বেরিয়ে এলো সে রাস্তায়। ফুটপাতের ছাতিম তলার নীচে দাঁড়িয়ে তার বাইক – পেছনে জ্বলজ্বল করছে লাল রঙে লেখা “পিৎজা কিংস”। যেন ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে। এক মুহূর্তে সময় নষ্ট না করে সে চেপে বসল তার উপর। ধাতব স্টার্ট তুলে রওনা হল তার বাহন।

     সুরজিত চলেছে তার পক্ষীরাজে রাতের হাওয়া এসে চাবুক মারছে তার কানের পাশে। কে যেন লিখেছিল সেই গানটা “মগজে কারফিউ”? চলন্ত দ্ধিচক্রমানের চাকার ঘর্ষণে সেখানে যে ঠেলে উঠেছে স্মৃতির চকমকি। পেরিয়ে যাচ্ছে সে তালডাঙার পুকুর, মেটে মসজিদ, নিয়ন রাঙানো ফ্যাক্টরি গেট, গলফক্লাবের মাঠ – আর একটু পড়ে শেষ হবে যাত্রাপথ। ফেলে আসা পথ ভুলে যেতে চায় সে। এখন তার লক্ষ্য একটাই – দশটা বেজে দশ মিনিটে বাড়িতে ঢুকে তাকে দাঁড়াতে হবে ঝিনুকের সামনে – শুকনো হাসি আর চলতে চোখের জল নিয়ে বলবে “খেতে দাও খিদে পেয়েছে খুব” ...........................

চড়ুই পাখি 

ও জ্যৈষ্ঠকথন 

আবু রাশেদ পলাশ

office.jpg
চড়ুইপাখি

বশেষে মৃদুলের কাছে দোলার চিঠি আসে শেষবার। হলুদ খামে মোড়ানো নীলরঙা চিঠি। চিরকুট সদৃশ, তাতে লেখা - 'আমি অপেক্ষায় আছি মৃদুল, এসে নিয়ে যাও শিগগির'। সম্পর্কে দীর্ঘবিচ্ছেদ মানুষে মানুষে দূরত্ব সৃষ্টি করে ক্রমাগত। আজ অনেকদিন দোলার বিশেষ খোঁজ জানে না মৃদুল। ও যেদিন অভিমান করে ঘর ছেড়েছিল, তারপর কতবার যোগাযোগের চেষ্টা করেছে মান ভাঙেনি দোলার। বারংবার বিভিন্ন অজুহাতে এড়িয়ে গেছে তাকে। এক এক করে দিন গেছে। পথিমধ্যে চশমাবিহীন খোলা চোখে চশমা এঁটেছে একজন। দোলা কি জানে, বিচ্ছেদের দীর্ঘসুত্রিতায় মৃদুলের জীবনে পরিবর্তন কতটুকু?

আজ অফিসে যায় নি মৃদুল। সকালে একবার কালবৈশাখী হয়েছে নিজের মধ্যে। দোলার চিঠি হাতে পেতেই বুকে চিনচিন ব্যথা হয়েছে তার। একদিন বিশ্বনাথপুর একটা ছোট দু-চালা ঘর নিয়ে সংসার পেতেছিল দুজন। চড়ুই পাখি সদৃশ উনিশ বছর বয়সী একটা কিশোরী মেয়ের অগোছালো সংসার। বাড়ির উঠানে ফুলের বাগান, ভেতরে অকারণ অভিমান আর আড়ালে স্বামীভক্তি। কত সুখী ছিল ওরা! দোলার লাগানো ফুল গাছগুলো মরে গেছে এখন। মাহীন নবজাতক নিরাপদ কতখানি? দোলার অবর্তমানে এগুলোকে বাঁচাতে পারেনি মৃদুল। এবার ফিরে এলে এ দৃশ্য হয়তো মর্মাহত করবে ওকে। অভিমান করে হয়তো হাতের কাছে থাকা কাঁচের প্লেটটা ছুঁড়ে দিবে মৃদুলের দিকে। তারপর আহত মৃদুল আর্তনাদ করলে হয়তো সেই কেঁদে একাকার হবে তখন। মন্দ কি, এর আগেও এমন হয়েছে। তখন তো খারাপ লাগে নি মৃদুলের। এমনই কিছু অগোছালো ভাবনা এলে অন্যমনস্ক হয় মৃদুল । তারপর মোবাইলের রিংটোন বাজলে সম্বিত ফিরে পায় সে । ওপারে কণ্ঠ শুনা যায়, 

- 'অপেক্ষা করো মৃদুল, বাইরে যাব দুজন।'

আমাদের দেশে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো আপাদমস্তক পাতাঝরা বৃক্ষের ন্যায়। বিশেষ কোন সৌন্দর্য নেই এদের। দৃষ্টি গেলে কেমন হাহাকারবোধ হয় নিজের মধ্যেই। আমাদের মৃদুল আগাগোড়া মধ্যবিত্তের প্রতিচ্ছবি। কর্মজীবনে উপজেলা শিক্ষা অফিসে স্বল্প বেতনে চাকরি শুরু করেছিল সে। সম্প্রতি সেখানে পদন্নতি হয়েছে তার কিন্তু বেশভূষায় পরিবর্তন ঘটেনি তেমন। উঁচুদরে কেনা কাপড়গুলো আলনাতে সাজানো থাকে তদ্রুপ। মাঝেমাঝে শখে পরে আয়নার সামনে দাঁড়ালে নিজেকে কেমন বেমানান ঠেকে তার। মৃদুল এমনই।

ধনুয়া গ্রামে উসমান সাহেবের বাড়িটা হাটখোলা বাজারের কূলঘেঁষে। লোকে বলে তালুকদার বাড়ি। মেয়ে দোলা মৃদুলের সংসার থেকে ফেরার পর বাবার বাড়ি এসে থাকে। স্থানীয় একটা স্কুলে বাচ্চাদের পড়ায় সে। দুরন্ত শিশুগুলো চোখের সামনে আনাগোনা করলে মাতৃত্বের সাধ জাগে নিজের মধ্যে। অভিমানের বিষবাষ্পে পুড়ে যে মৃদুলকে একদিন ত্যাগ করেছিল সে, আজকাল তারই অভাববোধ হয় খুব। পিদিম নেভা রাতে একাকি বিছানায় শুয়ে থাকলে ওর স্পর্শ অনুভব করে সে। যাকে নিজের দেহ মন সঁপে দিয়েছে দোলা তাকে কি ভুলা যায়? বারংবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে সে। পরদিন আতিয়া বানু কিছু জিজ্ঞেস করলে বলে দেয় - 'মৃদুলরে আসতে বলছি মা । ও এলে ফিরে যাব কিন্তু?' আতিয়া বানু আপত্তি করে না তাতে । মেয়ের সুবুদ্ধিতে বরং খুশি হয় সে।

বিশ্বনাথপুর সরকারি কলেজে পড়ার সময় বড়বাজারের কাছে একটা মেসে থাকত মৃদুল। পনের-বিশ জন উড়নচণ্ডী ছেলেদের অগোছালো জীবন ছিল ওটা। মৃদুলদের সংসারে অভাব ছিল তখন। নিজের খরচ জোগাতে টিউশনি করত সে। স্নাতকোত্তর পড়ার সময় একই কলেজের দিনার সাথে বন্ধুত্ব হয়েছিল মৃদুলের। সাদা-কালো জীবনে ঐ একজনের সাথেই মিশেছে সে। তখন কত সুখময় মুহূর্ত ছিল ওদের! দিনাদের সচ্ছল পরিবার ছিল। ওর ছোটভাই শিহাব অংক পড়তো মৃদুলের কাছে। সুযোগ পেলে শহরের রাস্তা ধরে হাঁটত দুজন। এ নিয়ে বন্ধুদের কাছে একবার বিপাকে পড়তে হয়েছিল মৃদুলকে। শরতের কোন এক বিকেলে গাঁয়ের পথ ধরে হেঁটেছিল দুজন। শহরমুখি যে সড়কটা ধনুয়া গ্রামের দিকে চলে গেছে সে সড়কের পাড় ধরে হেঁটেছিল ওরা।  

ঘটনাচক্রে মেসের ছেলেদের সামনে পড়েছিল মৃদুল। সন্ধ্যায় মেসে ফিরলে শত সহস্র প্রশ্ন শুনতে হয়েছিল তাকে - 'মেয়েটা কে রে মৃদুল?'

- 'কেউ না, পরিচিত।'

- 'পরিচিত? তাই বল।'

সেদিন সবাই হেসেছিল ওদের নিয়ে। তারপর নানা অজুহাতে দিনাকে নিয়ে ক্ষেপাত সবাই। মৃদুলের অস্বস্তি হত মাঝেমাঝে। দিনাকে ভাল সে বাসেনি কখনই। অথবা ওকে ভালবাসা সম্ভবও ছিল না তার। মৃদুল খুব ভাল করেই জানত অন্তরঙ্গতা ওদের যতই হোক দূরত্ব ওদের আকাশচুম্বী। কিন্তু মন? তাকে বাঁধার সাধ্য কার? স্নাতকোত্তর পাশ করার পর মৃদুল বুঝেছিল দিনাকে হয়তো ভালবাসে সে।

ততদিনে দিনা সংসার পেতেছে অন্য কোথাও। স্নাতকোত্তর শেষ করে বেকার বসে থাকার উপায় ছিল না মৃদুলের। ওদের সংসারে তখন নিদারুণ অভাব। সেবার বিশ্বনাথপুর উপজেলা শিক্ষা অফিসে চাকরিটা দিনার তদবিরে পেয়েছিল সে। সে সুত্রে দিনার প্রতি কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই তার। চাকরি পাওয়ার পর মৃদুলের মধ্যে পরিবর্তন আসে সামান্য। ওদের সংসারে সচ্ছলতা আসে ধীরে ধীরে। মাস শেষে বাড়ি গেলে বিয়ের তাগিদ দেয় মা। ছেলেকে সংসারি দেখার ইচ্ছে তার । মা বলে - 'চাকরি অইচে অহন একখান বিয়া কর বাপ।'

- 'বিয়ানি ? দিলে সবুর দেও কয়দিন।'

- 'উসমান সাবরে কইয়ে থুইচি, মাইয়া দেখ শিগগির।'

আক্তিয়ারা বেগম পীড়াপীড়ি করলে পাকা কথা দিতে হয় মৃদুলকে। দোলা মেয়ে ভাল, দেখতেও বেশ। ওর সাথে বিয়ে হলে অসুখি হবে না মৃদুল। তারপর একদিন স্বাভাবিক নিয়ম মেনে বিয়ে হয়ে যায় দুজনের। উঠতি যৌবনে দিনার প্রতি ভাললাগা হয়তো দিনকে দিন নিজের মধ্যে পোষে রাখে মৃদুল। কিন্তু সংসার ধর্মের মোহে পড়লে সত্য অব্যক্তই থেকে যায় দোলার কাছে।

বিয়ের পর দোলাকে নিয়ে একটা ভাড়া বাসায় উঠে মৃদুল। একটা ছোট সংসার হয় ওদের। সংসারে সচ্ছলতা সামান্যই, কিন্তু সুখবোধ ষোল-আনা। সেখানে দোলার কৈশোরিক চপলতাগুলো বর্তমান। মাঝেমাঝে ছোট ছোট ব্যাপার নিয়ে খুনসুটি হয় ওদের। তারপর অকারণ কেঁদে চোখ ভাসায় কিশোরী। ও অভিমান করলে সহসা কাছে আসার সাহস করে না মৃদুল। তবুও একসময় ভয়ে ভয়ে সামনে এসে দাঁড়ায় সে। তারপর বলে - 'অভিমান ভুলো পাখি, খিদে পাইছে যে।' তাৎক্ষণিক কথা বলে না দোলা। ও কথা না বললে উল্টো রেগে যায় মৃদুল। তারপর মান অভিমানের একপালা গান হয় দুজনের মধ্যে। অবশেষে বশ্যতা স্বীকার করে দোলা। তারপর বলে - 'খেতে আস আমারও খিদে পাইছে খুব।'

অবসরে দোলাকে নিয়ে পাড়া ঘুরে মৃদুল। বিশ্বনাথপুর ছোট থানা শহর। দুরন্ত যৌবনের বেশিরভাগ সময় এখানে কেটেছে তার। এ শহরের প্রতিটা গলি মুখস্ত ওর। দোলা আবদার করলে গাঁয়ের মেঠোপথ ধরে হাটে দুজন। সুবিস্তৃত ধানক্ষেতের আইল ধরে হাটে ওরা। দূর্বাঘাসে তখন কিশোরীর নরম পায়ের চিহ্ন পরে। সময় ধরে ওর নিগুঢ় মুগ্ধতায় মেতে থাকে মৃদুল। কথা বলে না সহসা। দোলা বলে - 'কি দেখ অমন করে?' মৃদুল বলে - 'কিছু না, চল যাই।' সেদিন একটু দেরি করে বাড়ি ফিরে ওরা। 

মৃদুলের সংসারে মানুষ ওরা দুজন। সুযোগ পেলে আক্তিয়ারা বেগম এসে ঘুরে যায় এখান থেকে। দোলার ব্যস্ততা বাড়ে তখন। অগোছালো সংসারে স্থিরতা আসে দুজনের মধ্যে। আক্তিয়ারা বেগম মেজাজি মানুষ। কড়া করে কথা বলেন তিনি। দোলার খারাপ লাগে না।একাকী সংসারে কথা বলার মানুষ পেলে খুশি হয় সে। সপ্তাহ খানেক থেকে বিদায় নেন আক্তিয়ারা বেগম। যাওয়ার আগে দোলাকে নিভৃতে ডেকে বলে যায় - 'আর কতদিন একলা থাকবা গো নাতির মুখ দেখাও শিগগির।' দোলা কথা বলে না সহসা। আক্তিয়ারা বেগম বিদায় নিলে অদ্ভুত ভাবনায় পরে সে। মৃদুল এলে শিহরণ হয় নিজের মধ্যে। চড়ুই পাখি সদৃশ যে চপলমতি কিশোরী অল্পপরিচিত একজনের হাত ধরে এখানে এসে সংসার পেতেছে, সে যে ইতোমধ্যেই পাকাপোক্ত গৃহিণী হয়ে উঠেছে দোলাকে দেখে সহজেই তা অনুমান করা যায়। মৃদুলের ভালবাসাপূর্ণ দায়িত্বশীলতা মুগ্ধ করে তাকে। তারপর রাতে একই বিছানায় শুয়ে স্বপ্ন বুনে দুজন। ভাঙা ভাঙা অগোছালো স্বপ্ন, রুপকথার ন্যায় যেখানে না বলা কত কথা ভাষা পায়।

চৈত্র মাসের গোঁড়ার দিকে ব্যস্ততা বাড়ে মৃদুলের। চাকরির অজুহাতে রাত করে ঘরে ফিরতে হয় তাকে। একাকি সময়ে ঘরে বিড়াল পোষে দোলা। ওর পোষা বিড়ালটা চারপাশে আনাগোনা করে সারাদিন। উঠানে লাগানো ফুলগাছগুলো পরিচর্যা করে সময় ধরে। রাতে ক্লান্ত মৃদুল বাড়ি ফিরলে আহ্লাদিত হয় সে। নিজের কৈশোরিক চপলতাগুলো প্রকাশ করতে গেলে ধমক দেয় মৃদুল। আবার মনক্ষুন্ন হয় দোলা। তবে অভিমান ওদের দীর্ঘস্থায়ী হয় না কখনই।

আশ্বিনে ভরা পূর্ণিমা হয়। চাঁদের আলো এসে মৃদুলের বাড়ির উঠানে আশ্রয় নেয়। মৃদুল আর দোলা উঠানে বসতি গড়ে তখন। ঝিঁ ঝিঁ পোকার আওয়াজগুলো ক্রমশ ম্লান হতে হতে থেমে যায় একসময়। দুজনের ঘোর কাটে না সহসা। ওরা জেগে থাকে রাতের শেষ অবধি।মৃদুল আর দোলার সংসার হয়তো সারাজীবন এমনই হতে পারতো যদি ওদের জীবনে অযাচিতের মত দিনার আগমন না হত। একদিন ভালবেসে যে মানুষটার হাত ধরে ঘর ছেড়েছিল দিনা সম্প্রতি তার সাথেই সম্পর্কে বিচ্ছেদ ঘটেছে তার। জীবনের এ কঠিন সময়ে নিজের বাবা-মার কাছেও উপেক্ষিত সে। শিহাবটাও কেমন পরিবর্তন হয়ে গেছে এখন। অবশেষে নিরুপায় দিনা মৃদুলের সংসারে এসে উঠে। দোলা আপত্তি করে না তাতে। শহুরে জীবনে দিনা নামে মৃদুলের বন্ধু ছিল কেউ এটা দোলা শুনেছে ওর কাছেই। আপনজনের কাছে বিতাড়িত দিনা মৃদুলের সংসারে আশ্রয় পেলে স্বস্তি আসে ওর।

মৃদুলের বন্ধুত্বপূর্ণ সহযোগিতা ভেতরে ভেতরে বাঁচার প্রেরণা দেয় তাকে। সবুজের কথা মনে হলে দুঃখ পায় সে। মৃদুল বলে -'আবার সংসারে ফিরে যা দিনা।'

দিনা বলে - 'সাধ্য কই, জোর করে ঘর হয় কি?' 

এরপর দিনে দিনে পরিবর্তন হয় মৃদুল স্বয়ং। দিনার আগমনের পর কাজে মনোযোগ কমে ওর। সুযোগ পেলে দিনাকে সময় দেয় সে। দিনার প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নেই তার। দুঃসময়ে দিনা কি না করেছে ওর জন্য! বিশ্বনাথপুর শহরের কূলঘেঁষে যে নদীটা অজানার উদ্দেশ্যে বহমান তার পাড় ধরে হাটে ওরা। 

পরিচিত কেউ দৃষ্টিগোচর হলে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে দুজনই। তারপর ফেরার পথে হয়তো রাতের খাবার খেয়ে বাড়ি ফিরে দুজন। চপলমতি দোলা মৃদুলের জন্য অপেক্ষা করে বাড়িতে। নিশীথের অন্ধকার ঘনতর হলে তাড়া দেয়' - খেতে এসো মৃদুল।                      

মৃদুল বলে - 'খেয়ে আসছি চড়ুই পাখি। খেয়ে নাও তুমি।' আজকাল মৃদুলের কথায় সহজেই মন খারাপ হয় দোলার। এটা নতুন নয়। ওদের সম্পর্ক হাটখোলার আচারের ন্যায়, টক-ঝাল। সেখানে অভিমান কতবারই তো হয়েছে। তবে দোলার আজকের এ মন খারাপ অন্য কারণে। মৃদুলের পরিবর্তনটা সহজেই বুঝতে পারে সে। অথচ এমন সে কখনই ছিল না। রাতে একই বিছানায় শুয়ে অশ্রু বিসর্জন দেয় দোলা, মৃদুলের কাছে সেটা অজানায় থেকে যায় দিনের পর দিন। এরপর মৃদুলের কাছে নিজেকে কেমন অস্তিত্বহীন ঠেকে দোলার। সম্পর্কে হয়তো সন্দেহ ডুকে তখনই। পালপাড়ার অবিনাশ মৃদুলের বাল্যবন্ধু। দোলাদের পাশের গ্রামে থাকে সে। দোলার সাথে পরিচিত বিয়ের আগে থেকেই। এখন নিউমার্কেটে কাপড়ের ব্যবসা করে সে। এর মধ্যে একদিন কোন কাজে বাইরে গেলে দোলার সাথে দেখা হয় অবিনাশের। অবিনাশ জোড়াজুড়ি করলে একটা কফি হাউজে গিয়ে বসে দুজন। অবিনাশ বলে,

- 'মৃদুলরে দেখলাম সেদিন দিনার সাথে।'

দোলা বলে - 'ওর বন্ধু, তোমারো বোধহয়?'

- 'না, আমার না।'

একই কলেজে পড়ার সুবাদে দিনা পরিচিত অবিনাশের কাছে। তবে ওদের বন্ধুত্ব হয়নি কোন কালেই। পরক্ষণে দোলা ফিরতে আগ্রহী হলে অবিনাশ বলে, 

- 'সংসারে বারোমাস জ্যৈষ্ঠমাস। সামাল দিস দোলা।'

অবিনাশের কথার অর্থ বুঝে না চপলা। বাড়ি ফিরলে অজানা আশংকায় ভেতরে বিনাভাষী আর্তনাদ হয় তার। তারপর একদিন মৃদুলের দৃষ্টির অগোচরে ওর পুরনো বইপত্র ঘাঁটতে গেলে সত্যি আবিষ্কৃত হয়। কোনকালে দিনার প্রতি ভাললাগা ছিল মৃদুলের। এ সত্য আজও দোলার কাছে প্রকাশ করেনি মৃদুল। এরপর সম্পর্কে বিষ ঢুকে দুজনের। মৃদুলকে সহসা বিশ্বাস করতে পারে না দোলা, কেমন নপুংসক মনে হয় যেন!

এর কিছুদিন পর এক রাতে ঘুম ভেঙে যায় দোলার। মৃদুল তখন নিজ শয্যায় অনুপস্থিত। সন্ধানী চক্ষুযুগল কৌতূহলি হলে দিনার ঘরে মৃদুলের অস্তিত্ব আবিস্কার করে সে। ওরা কি যেন ব্যাপার নিয়ে কথা বলে সময় ধরে। মৃদুল আর দিনার কথাগুলো স্পষ্ট বোঝা যায় না দোলার ঘর থেকে । সত্য সন্ধানে অপারগ দোলা ভেতরে ভেতরে অশ্রু বিসর্জন দেয়। মৃদুল ঘরে ফিরলে সম্পর্কে টানাপড়েন তৈরি হয় দুজনের মধ্যে। দোলা বলে,

- 'আসলা যে, পুরনো প্রেম তাই না?'

তারপর এক-দুই কথায় কলহ করে দুজন। সকালে মৃদুল ঘুম থেকে উঠে দেখে ঘরে নেই দোলা। ধলপ্রহরে বাপের বাড়ি গিয়ে উঠে সে।

এরপর বেশ কয়েকবার দোলাকে ফেরানোর চেষ্টা করেছে মৃদুল। রাজি হয় নি মেয়েটা, রীতিমত অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছে তাকে। এরপর আশাহত মৃদুল আর কোনদিন আনতে যায়নি দোলাকে। মাঝখানে কেটে গেছে দুটো বছর। প্রথম জীবনে দোলার অনুপস্থিতি বিধ্বস্ত করেছিল মৃদুলকে। আশাহত দিনগুলোতে দিনার ভালবাসাপূর্ণ হাতের স্পর্শ ছিল ওর উপর। সে দিনগুলোতে দিনা কি না করেছে ওর জন্য! ওর অগোছালো সংসারকে বাঁচিয়েছে সে। দিনে দিনে দিনার প্রতি নির্ভরতা বেড়েছে মৃদুলের। এরপর কখন যে বিবাহ বহির্ভূত একটা নিষিদ্ধ সম্পর্কে জরিয়েছে দুজন জানা হয়নি আজও। সে সম্পর্ক শয্যা অবধি আসতে সময় নেয়নি বেশিদিন। এখন ওরা আত্মার আত্মীয়। সম্পর্ক ওদের দেহ-মন মিলেই। কি এক উদ্ভট বিশ্বাসে বেঁচে আছে দুজন! যেখানে দুজনের মনের মিল সেখানে বিয়ের গুরুত্ব কি?

দোলা যে এতদিন পর ফিরতে চাইবে মৃদুলের জীবনে ভাবেনি মৃদুল। আচমকা ভাবনার দোলাচলে পড়লে পিষ্ট হয় সে। যেন করাত কাঁটার মত করে নিজেকে ফালাফালা করে কেউ। দিনার কাছে সত্যি অপ্রকাশিত। এখন সম্পর্কে দুজন স্ত্রী তার। একজন ধর্মমতে অন্যজন মৌনসম্মতিতে। আজকাল মৃদুল অন্যমনস্ক থাকলে দৃষ্টি এড়াই না দিনার। একদিন যেচে জানতে চায় সে, - তুমি কেমন বদলে গেছ, কিছু হয়েছে কি?'

দিনার কথার সদুত্তর দেয় না মৃদুল। এরপর একদিন ধনুয়া গ্রামে দেখা যায় তাকে। ও এলে আহ্লাদিত হয় দোলা। তারপর বড় পুকুরের পাড়ে বসে গল্পের ঝাঁপি খোলে সে। 

- 'চোখে চশমা নিছ কতদিন হল?'

- 'অনেকদিন।'

- 'হাতের কবজটা ফেলে দিছ তাই না?'

- হুম, বিশ্বাস নেই আমার।'

- আমার যে আছে। বিড়ালটা এখনও আছে, আমার ফুলগাছগুলো?'

সহসা জবাব দেয় না মৃদুল। দোলার ছেলে মানুষীতে নিজেকে বেমানান ঠেকে তার। সে বলে, - 'কিছু বলব আজ, ভুল বুঝো না পাখি। অবশেষে সত্যি প্রকাশিত হয় দোলার কাছে। জীবনের পড়ন্ত বেলায় এসে দিনাকে নিয়ে সুখী হতে চায় মৃদুল। এ জীবনে মৃদুল ব্যতিত দোলার হয়তো সব আছে। কিন্তু দিনার জীবনে মৃদুল ছাড়া কেউ নেই আর। মনের অগোচরে যে মানুষকে নিজের সহচর ভেবেছে দিনা, অকস্মাৎ তার প্রস্থান হয়তো মৃত্যুর কারণ হবে ওর। মৃদুলের বলা সহজ সত্যিগুলো বাকরুদ্ধ করে দোলাকে। উসমান সাহেবের কাছে সত্য উন্মোচিত হলে হুংকার করে সে। তাতে বাঁধ সাধে দোলা। সে বলে,

- 'ওরে যেতে দেও বাবা, আমি ভাল থাকব নিশ্চয়।'

মৃদুল বেড়িয়ে এলে বাঁশের দেউরির পাশে এসে দাঁড়ায় দোলা। প্রিয়তমের প্রস্থান দৃশ্যে অশ্রু বিসর্জন দেয় সে। দোলাদের বড়ঘরের কোণায় চড়ুই পাখি বাসা করেছে সম্প্রতি। একদিন ওদের দিকে দৃষ্টি গেলে নিজের কথা মনে হয় দোলার। মৃদুলের চড়ুই পাখি বাপের বাড়িই আশ্রিতা। ওর চোখের পানি চোখে শুঁকিয়েছে কবেই, এখন সেখানে শুধুই জ্যৈষ্ঠের খরা।

পুরস্কারের মূল্য

দিলীপ ঘোষ

সিঙ্গাপুর

hospital1.jpg
পুরস্কারের মূল্য

সুরঞ্জনবাবু প্রিন্সিপ্যাল হবার পর থেকেই ‘কলকাতা ভ্যালু স্কুলে’ একটা পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে, যেন একটা নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে স্কুলের শিক্ষা পদ্ধতিতে। কেবলমাত্র পুঁথিগত শিক্ষা ছাড়াও উনি চান ছাত্রদের নৈতিক মূল্যবোধের উন্নয়ন। সুরঞ্জনবাবু মনে করেন আজকের সমাজের মানবিক অবক্ষয়ের হাত থেকে দেশকে বাঁচানোর একমাত্র উপায় নতুন প্রজন্মকে সঠিক ভাবে গড়ে তোলা। ওনার নির্দেশমতোই ‘ভ্যালু এডুকেশনের’ ওপর যোগ করা হয়েছে একটা ক্লাস, তাছাড়া শুরু হয়েছে ছাত্রদের দিয়ে সমাজের বিভিন্ন সেবামূলক কাজ।   
এবছর প্রিন্সিপ্যাল ঘোষণা করেছেন যে বাৎসরিক পুরস্কার প্রদানের দিন পরীক্ষায় কৃতি ছাত্রদের পুরস্কৃত করার সাথে আর একটি বিশেষ পুরস্কারপ্রদান করা হবে, তবে কি ভাবে হবে সেই নির্বাচন তার কোনও উল্লেখ করা হয় নি। সেই থেকেই ছাত্র এবং অভিভাবকদের মধ্যে বেশ কৌতূহল জন্মেছে – কি সেই বিশেষ পুরস্কার?

প্রতি বছর পুরস্কারপ্রদানের এই অনুষ্ঠানটা বেশ ঘটা করে অনুষ্ঠিত হয়। এবছরও ফাংশন হল ভিড়ে ঠাসা এবং প্রতিটা অনুষ্ঠানের শেষে হাততালির শব্দই বলে দিচ্ছে যে অনুষ্ঠানটা সকলেই বেশ উপভোগ করছেন। কিন্তু প্রথম থেকেই একটা অদ্ভুত ব্যাপার সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে যে আজ শতচ্ছিন্ন গেঞ্জি এবং লুঙ্গি পরা এক বৃদ্ধ মানুষ প্রিন্সিপ্যালের সাথে এসেছেন এই অনুষ্ঠান দেখতে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের শেষে প্রিন্সিপ্যাল যখন ওই মানুষটাকে মঞ্চে নিয়ে গিয়ে ঘোষণা করেন যে আজকের অনুষ্ঠানের স্কুলের বিশেষ অতিথি ভোলানাথ নস্কর, সকলের বিস্ময় আরও বেড়ে যায়। সংক্ষিপ্ত ভাষণের শেষে প্রিন্সিপ্যাল ঘোষণা করেন 'অনুগ্রহ করে শুনবেন, এক বিশেষ কারণে এবছর ক্লাস ফাইভের প্রথম পুরস্কারটি কোন ছাত্রকে প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না, এর জন্য আমরা দুঃখিত।'
কথাটা ঘোষণার সাথেই এক চাপা উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে  'সে কি কথা? সায়ন্তন প্রাইজ পাবে না, তা কি করে হয়? প্রতিবছর সে যে শুধু স্কুলে প্রথম স্থান পায় তাই নয়, স্কুলের বাইরের প্রতিটা প্রতিযোগিতা জিতে স্কুলের নাম উজ্জ্বল করে - সে পুরস্কার কি করে না পায়?' সায়ন্তনের বাবা-মা যেন নিজেদের কানকেই বিশ্বাসই করতে পারেন না, সায়ন্তনকে জিজ্ঞেস করতে থাকেন 'হ্যাঁ রে, তুই কি জানিস কিছু?' সায়ন্তন মাথা নেড়ে বোকার মত থাকিয়ে থাকে বাবা-মায়ের দিকে। বিস্ময়ের ঘোর কাটার আগেই আশপাশে বসে থাকা অভিভাবকদের প্রশ্ন শুরু হয়ে যায় 'আমাদের তো বিশ্বাসই হচ্ছে না যে অমন ভালো ছেলে সায়ন্তন আজ কোনও পুরস্কারই পাবে না? আপনারা কি খবরটা আগে জানতেন?' সায়ন্তনের বাবা একটু মুচকি হেসে জবাব দেন 'আপনারা সকলে যে সায়ন্তনকে এত ভালোবাসেন, সেটাই তো আমাদের কাছে সবথেকে বড় পুরস্কার।' এই অল্প বয়সেই সায়ন্তন নিজের স্কুল ছাড়াও বিভিন্ন আন্তঃ স্কুল প্রতিযোগিতায় এত পুরস্কার পেয়েছে যে একটা পুরস্কার না পাওয়ার জন্য ওর বাবা-মায়ের এতটা বিচলিত হবার কথা নয়, কিন্তু তবুও মনে হয় স্কুলের এই বাৎসরিক পুরস্কারটার যেন একটা অন্য বৈশিষ্ট্য আছে। অফিসে যতই কাজ থাকুক, আজ পর্যন্ত সায়ন্তনের প্রতিটা পুরস্কার গ্রহণ অনুষ্ঠানে ওর বাবা উপস্থিত থেকেছেন। এবারও অনেক চেষ্টা করে দিল্লির ট্যুরটা একদিন পিছিয়ে তবে আসতে 
পেরেছেন এই অনুষ্ঠানে, তবে এমনটা স্বপ্নেও ভাবেননি যে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকেও ছেলের প্রাইজ নেওয়া দেখা হবে না। কথাটা শোনার পর থেকেই বেশ বিব্রত বোধ করছেন সায়ন্তনের বাবা-মা, ছেলের প্রাইজ না পাওয়ার থেকেও তার কারণটা না জানার জন্য বেশী অস্বস্তি লাগছে তাঁদের। মনে হচ্ছে অনুষ্ঠানটা কখন শেষ হবে।     

পুরস্কারপ্রদান শুরু হয়ে গেছে, এক এক করে ছাত্ররা মঞ্চে উঠে প্রিন্সিপ্যালের হাত থেকে পুরস্কার নিচ্ছে। ক্লাস ফাইভের পুরস্কার পর্বে প্রথম পুরস্কার বাদ দিয়ে সরাসরি দ্বিতীয় স্থানাধিকারির নাম ‘সঞ্জয় দত্ত’ ঘোষণা করতেই দর্শকাসন থেকে দাঁড়িয়ে উঠে সঞ্জয়ের মা প্রিন্সিপ্যালের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করেন 'আপনার কথামতো এবছর যদি কোন ছাত্র প্রথম স্থান না পেয়ে থাকে, তবে নিয়মমতো সঞ্জয়ের প্রথম পুরস্কারটা পাওয়া উচিত।' একটু চুপ করে থেকে প্রিন্সিপ্যাল বলেন 'প্রথম পুরষ্কারের ব্যাপারে হয়তো একটু বোঝার ভুল হয়েছে, আমি

শুধু এইটুকুই জানিয়েছি যে এবছর প্রথম পুরস্কারটি কোন ছাত্রকে প্রদান করা হবে না, তবে তার অর্থ এই নয় যে প্রথম স্থান কেউ পায় নি। সঞ্জয় আমাদের খুবই প্রিয় ছাত্র এবং প্রতি বছরের মতো এবারও সঞ্জয় ভালো ফল করে দ্বিতীয় স্থান পেয়েছে। আশা করি ও নিজের যোগ্যতায় আরও ভালো ফল করবে ভবিষ্যতে।'

পুরস্কারবিতরণ শেষ করে প্রিন্সিপ্যাল দর্শকদের উদ্দেশ্যে বলেন 'অনুষ্ঠানটি ধৈর্য সহকারে দেখার জন্য উপস্থিত সকলকে জানাই আমাদের অসংখ্য ধন্যবাদ। বাৎসরিক পুরস্কারপ্রদানের এখানেই সমাপ্তি। এবার অনুষ্ঠানের অন্তিম পর্বে প্রদান করা হবে পূর্বঘোষিত সেই বিশেষ পুরস্কার, তবে সেটি ঘোষণার আগে আমি একটি ছোট্ট কাহিনী বলতে চাই।দৈনন্দিন জীবনে কত ঘটনাই তো ঘটে, কিন্তু কটা আঁচড় কাটে আমাদের মনে? আসলে  আকর্ষণীয় ঘটনা ছাড়া অন্য কিছু চোখ মেলে দেখার প্রয়োজনই বোধ করি না আমরা। বয়স বাড়ার সাথে আমরা নিজ ভাবনায় এতটাই বিভোর হয়ে যাই যে অন্য কিছুই আর আমাদের সেভাবে ভাবায় না। কিন্তু পথচলতি রাস্তায় একটা সামান্য দৃশ্য এড়ায় নি এক কিশোরের দৃষ্টি। গাড়িতে বসে ওই দৃশ্য দেখে বাবাকে আবদার করেছিল যে এরপর বাড়ি থেকে স্কুল যাবার ওই দশ মিনিটের পথ হেঁটেই যেতে চায় সে। ছেলের এই সামান্য আবদার এক কথায় মেনে নিয়েছিলেন ওর বাবা ও মা। তারপর থেকে বাবা-মায়ের হাত ধরে স্কুল যাবার পথে সে করুণ চোখে তাকিয়ে দেখত এক বয়স্ক মানুষের পিঠে মস্ত এক ভারি বস্তা চাপিয়ে দোকান থেকে দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাক অবধি মাল বহনের বেদনাদায়ক সেই দৃশ্য। বস্তার ভারে নুয়ে পরা শীর্ণকায় মানুষটিকে দেখে জলে ভরে উঠত তার দুচোখ, মনে মনে ভাবতো কি ভাবে সে এই মানুষটার কষ্ট লাঘব করতে পারে?  হ্যাঁ, আমি অত্যন্ত গর্বের সাথে জানাচ্ছি যে এই কিশোরটি আমাদের স্কুলেরই এক অত্যন্ত প্রিয় ছাত্র, যার মেধার পরিচয় আমরা সকলে আগেই পেয়েছি। আজ আমরা জানবো সমাজে দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের প্রতি তার ভালোবাসার কাহিনী, যা আমরা জানতে পেরেছি স্কুলে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এক রচনা প্রতিযোগিতার মাধ্যমে। সায়ন্তনের লেখা ওই অনবদ্য রচনাটি শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত হয়েছে। আমি এখন অনুরোধ করছি সায়ন্তনকে মঞ্চে আসার জন্য এবং আহ্বান জানাচ্ছি সায়ন্তনের বাবা-মাকে মঞ্চে উপস্থিত থেকে অনুষ্ঠানের অনুষ্ঠানের এই বিশেষ পর্বে তাঁদেরকে সামিল করতে। বাবা-মায়ের হাত ধরে গুটি গুটি পায়ে মঞ্চে এসে ওঠে সায়ন্তন, এগিয়ে এসে ওকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেন ওই বয়স্ক মানুষটা। দর্শকাসনে তখন এক চাপা গুঞ্জন 'একটা সামান্য রচনার জন্য এতো ঘটা করে পুরস্কারের পালা?'প্রিন্সিপ্যাল আবার বলতে শুরু করেন 'এবার আমাদের সেই বিশেষ পুরস্কারের সময়। আপনাদের অবগতির জন্য জানাই যে এই পুরস্কারটি আমার মায়ের দশম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে নিবেদিত আর পুরস্কারের অর্থমূল্য নগদ দশ হাজার টাকা। আমার মা ছিলেন এক উদারমনা ব্যক্তিত্ব, তাঁর মহানুভবতার কথা মাথায় রেখেই এই পুরস্কার। তিনি বিশ্বাস করতেন যে প্রতিযোগিতার দ্বারা মানুষ জয় করতে পারে অনেক কিছু, কিন্তু তা দিয়ে চরিত্র গঠন করা যায় না। তাই এই পুরস্কারটি এক মহান উদ্দেশ্যে সৃষ্ট, যা কোনও প্রতিযোগিতার সাথে যুক্ত নয়।পুরস্কার পেলে খুশী কে না হয়? ‘পুরষ্কারের মূল্য’ নামক ওই রচনা প্রতিযোগিতায় সায়ন্তন লিখেছিল যে প্রতিটা পুরষ্কারের মূল্যই তার কাছে অপরিসীম, তাকে দেয় এক অনাবিল আনন্দ, যোগায় এক বিশেষ অনুপ্রেরণা। কিন্তু অন্যকে দুঃখী দেখেও কি কেউ আনন্দে থাকতে পারে? না, আমাদের সায়ন্তনও তা পারে না, আর তাই সে ইচ্ছা প্রকাশ করে ‘যদি আমার কোনও পুরস্কার ঘোচাতে পারে অন্যের দুঃখ, তবে তাই হবে আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার।’ তার একান্ত ইচ্ছা যদি সে এবছর কোনও পুরষ্কারের জন্য মনোনীত হয়, তা দিয়ে ও একটা মাল বহনের ট্রলি গাড়ি কিনে দিতে চায় ওই মানুষটিকে। সায়ন্তনের এই সিদ্ধান্তে আমরা সকলেই অভিভূত। আমার মায়ের নামাঙ্কিত এই পুরস্কারটির এর চেয়ে ভালো সদ্প্রয়োগ আর কি বা হতে পারে? তাই আসুন আমরা সবাই মিলে করতালি দিয়ে অভিনন্দন জানাই সায়ন্তনকে এই ট্রলিটি শ্রীযুক্ত ভোলানাথ নস্করের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য। সারা হল যখন হাততালিতে ফেটে পরছে, প্রিন্সিপ্যাল মাইকটা ভোলানাথ বাবুর হাতে দিয়ে বলেন 'আমাদের স্কুলের ছাত্রদের জন্য কিছু বলুন।' কোনোমতে চোখের জল মুছে বলেন 'মানুষ হও মানুষের জন্য।' 

Comments

Top

তিলোত্তমা

সুব্রত মজুমদার

womenday.jpeg
তিলোত্তমা

সুব্রত মজুমদারের জন্ম কলকাতায়। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স এন্ড টেক্নলোজি, থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে তিনি পাড়ি দেন সুদূর আমেরিকায়। সেখানেই তাঁর পেশাগত জীবনের পাশাপাশি চলতে থাকে লেখালেখি। নানা ধরেনের ওয়েবজাইনে তাঁর লেখা ছাপা হয়েছে এবং তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করা ও ভিন্ন স্বাদের লেখাগুলি অগণিত পাঠকদের মনোরঞ্জন ও প্রশংসা অর্জন করেছে। লেখকের মূল বৈশিষ্ট্য তাঁর ভ্রমন ও অ্যাডভেঞ্চার প্রিয়তা।

নে আছে মেয়েটিকে প্রথম দেখেছিলাম যখন আমি কলেজের ফার্ষ্ট ইয়ারে পড়তে ঢুকেছিলাম। কলকাতার আশেপাশের কোন একটা ছোট জায়গা থেকে এসেছিল।মনে আছে এই কারণে নয় যে মেয়েটি ডাকসাঁইটে সুন্দরী বা অসাধারন ভালো পড়াশুনায় ছিল বলে। বরঞ্চ উল্টোটাই বলা যেতে পারে। মেয়েটির চেহেরার মধ্যে ছেলেদের আকর্ষণ করার মত বা মেয়েদের হিংসে করার মত কিছু ছিল না। সাধারন সাজ পোষাক পরে সাধারন চেহেরাটাকে আরও সাধারন করে রাখত। মাথার চুলকে টেনে বেঁধে একটা বড় খোঁপা আর সাদা পোষাকেই সবসময়ে দেখতাম তাকে। কপালে দিত না টিপ ঠোঁটে মাখত না কোন রং।আমাদের ক্লাসে মেয়েদের সংখ্যা ছিল এগারো, ওই মেয়েটি আসার পর হল বারো। আমরা ছেলেরা আড়ালে বলতাম দ্যা ডার্টি ডজন। আমরা লক্ষ্য করলাম যে মেয়েটি কারো সঙ্গে কথাবার্তা বলে না, নিজের মনে চুপচাপ উদাস হয়ে বসে থাকে। জোর করে প্রশ্ন করলে শুধু হাঁ বা না বলে উত্তর দেয়। কথা বাড়াবার কোনরকম চেষ্টা করেনা। ওকে আমরা হাসতেও কখন দেখিনি। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ যেচে আলাপ করতে গিয়েছিল কিন্তু মেয়েটির ঠান্ডা বরফের মত স্বভাবের জন্য বেশি দুর এগোতে পারেনি। অবশেষে সবাই একসময়ে আমরা হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম। মেয়েরা বলত ওর নাকি ভীষণ দেমাক, আমরা ছেলেরা সেকথা মানতাম না। মেয়েটির নাম জেনেছিলাম আশা। আমরা অনেক রকম নাম দিয়েছিলাম মেয়েটির। কেউ বলত যোগিণী, কেউ বলত সরস্বতী ঠাকুর আবার কেউ কেউ ডাকতো মাস্টারনী বলে। মেয়েটির ডানদিকের গালের ঠিক মাঝখানে ছিল একটা ছোট্ট কলো রংয়ের তিল। আমি মেয়েটির নাম দিয়েছিলাম তিলোত্তমা।

খবরটা প্রথম এনেছিল অনন্যা। ওর এক আত্মীয়ের সঙ্গে নাকি আশার বাড়ির লোকেদের চেনাশোনা আছে। ওনারা আশাকে ছোট থেকে বড় হতে থেকে দেখেছেন। ছোটবেলার থেকে আশা নাকি খুব হাসিখুশি স্বভাবের মেয়ে। চেহেরাতেও একটা লালিত্য ছিল। কিন্তু বিয়ের পর থেকে সব কিছু ওলট পালট হয়ে গিয়েছিল আশার জীবনে। জেনেছিলাম আশার বয়স উনিশ। বিয়ে হয়েছিল গ্রামাঞ্চলের এক উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারে। বরের বয়স ছিল আশার থেকে অনেকটা বেশি। উপায় ছিল না। একে অভাবের সংসার, তারপর দেখতে ভালো না, রং ময়লা, বিয়ে হচ্ছিল না। বাবা আর মা অনেক ধার দেনা, অনেক পনের বিনিময়ে জামাইকে কিনেছিলেন। কিন্তু সুখ আশার কপালে লেখা ছিল না। বিয়ের প্রথম সপ্তাহ শেষ হওয়ার আগেই আশার বর মারা যায় মোটর সাইকেল একসিডেন্টে।শ্বশুরবাড়ির লোকেরা আশাকে দোষ দেয় তাদের ছেলের মৃত্যুর জন্য। অপয়া আর রাক্ষুসী বলে তাকে অপবাদ দেয়। অনেক কান্নাকাটি অনেক হাতেপায়ে ধরাধরি করেছিল আশা শ্বশুরবাড়ির লোকজনের কাছে মানিয়ে নেওয়ার জন্য। কিন্তু কোন কাজ হল না। অবশেষে একদিন শ্বশুরবাড়ির লোকেরা আশাকে তার বাপের বাড়ি তুলে দিয়ে গেল। অসহায় বাবা মা আর কি করবে, মেয়েকে তো আর ফেলে দিতে পারে না। অনিচ্ছা সত্ত্বেও আশাকে তাঁরা আশ্রয় দিতে বাধ্য হয়ে ছিলেন। জীবনের ওপর বিতৃষ্ণায় আশা একবার আত্মহত্যা করবার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু সময়মত  আমার খেলা চলতে লাগল। আমার চিরকুটে লেখা কথার সংখ্যা ধিরে ধিরে বাড়তে লাগল আর সেই সঙ্গে পরিবর্তন হতে সুরু করল আশার ব্যবহারের। আশা আজকাল অন্যদের সঙ্গে কথা বলে, পিছন ফিরে ছেলেদের দিকে তাকায়। ছেলেদের সঙ্গে কথা বলতে ভয় পায় না, ঠাট্টা ইয়ার্কিতেও যোগদান করে। আমার  কেন যেন মনে হত ধরা পড়ে যাওয়ায় বেঁচে যায়। অবশেষে এক কাকিমার প্রশয়ে আশা ঠিক করে ও পড়াশুনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াবে। কাকিমাই সব খরচা বহন করার ব্যবস্থা করেন। সব শোনার পর আশার ওপর আমাদের মন দুঃখ আর সহানুভুতিতে ভরে উঠেছিল। আমার সব বন্ধুরাই কোন না কোন ভাবে আশাকে তার অজান্তে সাহায্য করার চেষ্টা করত। কেন জানিনা আমি আশাকে কোন সাহায্য করিনি, উলঠে আমি তার সঙ্গে ভয়ানক এক খেলায় মেতে উঠেছিলাম কাউকে না জানিয়ে।

আমি আশাকে প্রেমপত্র লিখতে শুরু করলাম। না খামের ভিতরে পোরা, সুন্দর রঙ্গিন কাগজে লেখা স্ট্যাম্প আটকানো চিঠি নয়। খাতার পাতা থেকে ছেঁড়া ছোট চিরকুটে লেখা প্রেমপত্র। আমি শুধু তিনটে কথা লিখতাম চিরকুটে - '‘আমি তোমায় ভালবাসি'। তক্কে তক্কে থাকতাম এবং সুযোগ পেলেই সবার অজান্তে আমার লেখা চিরকুটটা আশার বইয়ের দুটো পাতার মাঝখানে গুঁজে দিতাম। তারপর অনামি এক লেখকের চিরকুটে লেখা ওই তিনটি কথা পড়ে আশার কি প্রতিক্রিয়া হয় সেটা দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম। আদি অনন্ত কাল ধরে চলে আসা পৃথিবী বিখ্যাত এই তিনটি কথায় ঘায়ল  হয়নি এমন মানুষ দুনিয়ায় কোথাও আছে কি না আমার জানা ছিল না। প্রথম চিঠিটা লেখার পর প্রায় তিনদিন উদগ্রিব হয়ে অপেক্ষা করার পরেও আশার মধ্যে কোন পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম না। ধরে নিলাম যে তার মানে হয় আশা বইটার ভিতরে রাখা চিরকুটটা দেখার সুযোগ পায়নি অথবা আশা মানুষ নয়। আমিও হেরে গিয়ে হাল ছেড়ে দেবার পাত্র নয়। একদিন সুযোগ বুঝে আবার একটা চিরকুট রেখে দিলাম দুটো পাতার মাঝখানে। প্রফেসর ক্লাসে আসার আগে আমরা ছেলেরা আর মেয়েরা নানারকম হাসি আর ঠাট্টায় মসগুল হয়ে থাকতাম। আর উনি ক্লাসে প্রবেশ করার সাথে সাথে সব বন্ধ হয়ে যেত। আশা কোনদিন আমাদের এই হাসিঠাট্টায় যোগ দিত না। একটা বইয়ের মধ্যে মাথা গুঁজে বসে থাকত। আজ আমি শুধু আশাকে লক্ষ্য করছিলাম। আজ যেন আশাকে একটু অন্যমনস্ক লাগছে। মনের ভুল কিনা

জানিনা, একটা পরিবর্তনও আশার মধ্যে মনে হল লক্ষ্য করলাম। সবসময়ে প্রথম সারির বেঞ্চে বসা আশাকে এর আগে কখন ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনের সারিতে বসা ছেলেদের দিকে তাকাতে দেখিনি। আজ দুবার দেখলাম আশা ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনের দিকে তাকাল। একবার তো প্রায় আমার সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গিয়েছিল। আমার বুকের ভিতরটা ধক্‌ করে উঠেছিল। ধরা পড়ে গেলাম নাকি? না দেখলাম ঘাড়টা ঘুরিয়ে আশা আবার সামনের দিকে ফিরে মাথা নিচু করে বসে পড়ল। আর একটা ব্যাপার লক্ষ্য করলাম। কোন ছেলে উঠে দাঁড়িয়ে প্রফেসরকে প্রশ্ন করলে আশা আজকাল মাথা ঘুরিয়ে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে থাকে। আশা যেন একটা কিছু খুঁজছে ওর চোখ দেখে আমি বুঝতে পারতাম। আশার চোখদুটো সবসময় কাকে যেন খুঁজে বেড়ায়। আমি যত আশার ব্যবহারের পরিবর্তন দেখতাম ততো মনে মনে খুশি হতাম। একবার একটা পরিক্ষা করার ইচ্ছে হল। চিরকুটে লিখলাম তোমায় হাল্কা নীল রং এর শাড়ী আর খোলা এলো চুলে দেখতে চাই। যদি একটা টিপ পরতে পার তো আরও ভাল হয়। পরের দিন ক্লাসে ঢুকে আশাকে দেখলাম না। লাস্ট বেঞ্চে বসে আগের দিনের হোমওয়ার্কটা তন্ময় হয়ে চেক্‌ করছিলাম শেষ বারের মত, জমা দেওয়ার আগে। অর্ণবের কনুইয়ের ধাক্কায় চমক ভাঙ্গল। অর্ণব আঙ্গুল দিয়ে সামনের দিকে তাকাতে বলল। সামনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম এক অদ্ভুত ব্যাপার। যা দেখলাম তাতে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। ক্লাসের সব ছেলেরা আর মেয়েরা অবাক হয়ে তাদের সামনে দাঁড়ানো আশার দিকে তাকিয়ে আছে। সবাই ওর দিকে তাকিয়ে আছে বলে আশার সারা মুখে একটা লজ্জা মেশানো সুন্দর হাসি। সব থেকে অবাক হলাম আমি। আশার পরনে আজ হাল্কা নীল রঙ্গের শাড়ী আর চুলটা খোলা। কপালে পরেছে একটা বড় টিপ আর ঠোঁটে লাগিয়েছে একটা পাতলা রং। আশাকে আজ সত্যি সুন্দর লাগছে দেখতে। মেয়েটা এত সুন্দর দেখতে আগে কখনো লক্ষ্য করিনি তো।

ভাগ্যের চক্র কাকে কখন কোথায় নিয়ে যায় কেউ জানে না। আমার সুযোগ এল এক নামকরা কলেজে এনজিনীয়ারিং পড়তে যাওয়ার। একদিন সবাইকার কাছে থেকে বিদায় নিয়ে আমি আমার নতুন কলেজ জীবনের জন্য যাত্রা শুরু করলাম। আশার কাছ থেকেও বিদায় নিয়েছিলাম অন্যদের মতই। অল্পদিনের আলাপে আলাদা করে আমাকে মনে রাখার কথা নয় আশার। আমাকে বিদায় জানিয়েছিল অন্যদের মতই। তাতে আন্তরিকতা হয়ত ছিল, ছিল না কোনরকম ঘনিষ্ঠতা। আমি শুধু মনে মনে বলেছিলাম তিলোত্তমা তুমি ভালো থেকো, তোমার ভালো হোক। তারপর অনেক যুগ কেটে গেছে। আমার জীবনে এসেছে অনেক পরিবর্তন। আমি দেশ ছেড়ে আমেরিকায় বসবাস শুরু করেছি। এখানে সাজানো অথচ একটি ছোট্ট নির্জন শহরে আমার  বসবাস। এখানে আমার নিজের বলে কেউ নেই। একাকি নিঃসঙ্গতায় আমার জীবন কাটে। প্রায় দুটো যুগ কেটে গেছে দেশ ছেড়ে এসেছি। ফেলে আসা দেশের কথা মাঝে মাঝে মনে পড়ে। যখন মন খারাপ লাগে তখন মাঝে মাঝে দেশে গিয়ে স্পঞ্জের মত ভিজিয়ে নিয়ে আসি যতটা পারি দেশের সব কিছুকে নিজের দেহে আর মনে। একবার দেশে যাওয়ার একটা সুযোগ এলো যখন আমন্ত্রন পেলাম আমার এক নিকট আত্মীয়ের বড় মেয়ের বিয়েতে আসার জন্য। অনেক দিন দেশের কোন বিয়ে বাড়ি আমার যাওয়া হয়নি, তাই সুযোগটা হাতছাড়া করলাম না।

দেখলাম বিয়ের ব্যাপারে অনেক কিছুর পরিবর্তন হয়েছে আবার অনেক কিছু একই রকম আছে। আমার ওপর ভার পড়েছিল ছেলের বাড়ির লোকেদের আদর আপ্যায়নের যেন ত্রুটি না হয় তার খোঁজখবর রাখার জন্য। দেখলাম ছেলের বাড়ির লোকজন খুবই ভদ্র, তাঁরা অল্পেই খুশী, তাই আমার কাজ অনেক কম মনে হচ্ছিল। হঠাৎ ছেলের বাড়ির একজন আমাকে দেখে এগিয়ে এল। আমার নাম ধরে ডাকল। আমি চিনতে পারলাম। আমার সেই ছেলেবেলার বন্ধু অর্ণব। দুই বন্ধু ফিরে গেলাম অনেক বছর আগের সেই ফেলে আসা দিনগুলোতে। এক ভদ্রমহিলা একসময়ে অর্ণবের কাছে এসে দাঁড়াল। অর্ণব আলাপ করিয়ে দিল। চিনতে পারলাম অনন্যাকে। আমরা তিনজনে মিলে গল্প জুড়ে দিলাম। আমাদের সব বন্ধুদের কথা শুনছিলাম অনন্যার কাছে। আমার ভীষণ ইচ্ছে করছিল আশার কথা জানার জন্য। কিন্তু ভিতর থেকে কে যেন আমায় বাধা দিচ্ছিল। হঠাৎ অনন্যাই আশার কথা ওঠাল। জানতে পারলাম যে আশা ডক্‌টোরেট করেছে মাইক্রোবায়োলজিতে। নামকরা বিলিতি কম্পানিতে উচ্চপদে কাজ করে আশা। বিয়ে করেছে, দুটি সন্তান, একটি ছেলে একটি মেয়ে। খুব সুখের সংসার আশার। তাছাড়া নানারকম সমাজ কল্যান প্রতিষ্টানের সঙ্গেও নিজেকে ব্যস্ত রাখে সে। এত হাসিখুশি আমুদে আর এত পপুলার যে আমি নাকি দেখলে চিনতেই পারব না যে এই আশাই আমাদের সেই আশা।

একটু বাদে ওরা দুজনেই আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে উঠে গেল। আমি একা দাঁড়িয়ে রইলাম একটা ফাঁকা জায়গা খুঁজে নিয়ে। মনে মনে খুশি হলাম আমার তিলোত্তমা ভাল আছে জেনে। আজ এতদিন বাদে এতগুলো বছর পেরিয়ে আসার পর আমার হঠাৎ মনে পড়ে গেল ছেলেবেলায় আশাকে লেখা আমার সেই প্রেমপত্রের কথা। সেই চিরকুটে লেখা প্রেম প্রেম খেলার কথা। অনেক ছোট ছোট ঘটনা সিনেমার ফ্লাসব্যাকের মত ফিরে এল আমার মনের আয়নায়। আশার সচেতনতাকে জাগিয়ে তোলার জন্য আমার নিজের তৈরি সেই ভয়ঙ্কর খেলার ফল যে কিছুটা সাহায্য করেছে আশার জীবনে, জেনে আমার মনটা খুশিতে ভরে গেল।

Comments

Top

বিবর্ণ কৃষ্ণচূড়া

বিবেক পাল

নেতাজি পল্লী ,সোনারপুর ,কলকাতা

riksha.jpg
বিবর্ণ কৃষ্ণচূড়া

বেদনাদ্যূতি গাহিছে ওরে প্রাণ

তোমার লাগি জাগেন ভগবান,

নিশীথে ঘন অন্ধকারে

ডাকেন তোরে প্রেমাভিসারে

দুঃখ দিয়ে রাখেন তোর মান

তোমার লাগি জাগেন ভগবান"

অফিস থেকে ফেরার পথে এই বাঁশতলার নীচ দিয়ে যাবার সময় রোজ  যে এই লাইন গুলি মনে পড়ে এ কথা বলব না। তবে যেদিন তাড়া থাকে না  বা সঙ্গে কেউ থাকে না, এক কথায় একটু নির্জনতা থাকলেই আমার কানের কাছে বাজতে থাকে। আজ যেন বেশি করে অনুরণিত হচ্ছে লাইন কটা। 

তখন ও আমার গোঁফের উপর কালো রেখা স্পষ্ট হয় নি। বিছানায় পড়লেই সটান নিদ্রা দেবীর কোলে মাথা রাখতে পারি, নিজেকে হারিয়ে ফেলার ভাবনা মনের মধ্যে স্থান পায় নি। হাঁটার সময় নিজেকে বারবার দেখার অভ্যাস তৈরী হয় নি। এক কথায় আমি আমাতে আছি, আমি বিভক্ত হই নি। সেই সময় এক মুখ আঁধারী সন্ধ্যায় ফুটবল খেলে  বাবার ভয়ে পা টিপে টিপে বাড়ি ফেরার পথে এ বাঁশতলা থেকে কবিতার লাইন শুনে ঘাড় ফেরাতেই এক সাদা পোশাক পড়া ব্রহ্মদত্যি সাঁ করে বাঁশ গাছের আড়ালে অদৃশ্য হতে দেখে ছুটে এক্কেবারে আছাড় খেয়ে পড়েছিলাম সটান বারান্দার উপর। তারপর মূর্ছা, মূর্ছা ছাড়তে পাক্কা তিনদিন কি ধুম দিয়ে জ্বর!

এরপরের দিন সন্ধ্যা হবার আগেই মাঠ ছেড়ে দৌড় লাগাতে দেখে ঘনাদা তো ধরল চেপে হাত দুখানা। “কি হল তুই পালাচ্ছিস যে বড় জানিস আমরা এক গোলে এখনও পিছিয়ে আমরা, স্টাইকার মাঠ ছাড়ালে গোল করবে কে”?  কিছুতেই বলতে পারছিলাম না আসল কারণটার কথা।

ঘনাদার চাপে রয়ে তো গেলাম, কিন্তু কিছুতেই আর বাড়ি ফিরতে পা তুলছি  না দেখে ঘনাদা জিজ্ঞেস করল-- কিরে বাবলা  আজ বাবা নেই বাড়িতে?

আমি মাথা ঝাঁকালাম।

--তবে ?

আমি চুপ করে আছি দেখে ঘনাদা যেন অন্য কিছুর গন্ধ পেল, বলল – ও চাঁদু তোমার ও জুট গেছে এই বয়সে, চাঁদ উঠলেই বুঝি রাস্তার পাশে আসবে?

আমি চমকে উঠি, কি বলছে ঘনাদা!

রঞ্জনদা বলে -- হবে না দুই বুড়ো দামড়া দামড়ি যদি রোজ সন্ধ্যা বেলা কৃষ্ণলীলা করে বাঁশতলায়, তাহলে ওই টুকু ছেলের আর কি দোষ বল।

সেই প্রথম যেন আমার মাথায় কমপ্লেক্স থিংকিং এর  যেন উদয় হয়েছিল। ও তাহলে ওদিন বাঁশ তলায় ভূত ছিল না, দামড়া দামড়ি মানে -- নারীপুরুষ ছিল। কিন্তু কে হতে পারে আমাদের পাড়ার, বেশি সময় ভাবতে হয় নি তাহলে কি...

একছুটে মাঠ ছেড়ে আবিস্কারের নেশায় একেবারে বাঁশতলা ,যা ভেবেছিলাম তাই মঞ্জুলাদির কোলে মাথা দিয়ে শুভময় মানে শুভদা  শুয়ে আছে Iবাঁশ গাছের ফাঁক দিয়ে শুভদার মুখে চাঁদের আলো এসে পড়েছে। মঞ্জুলাদি শুভদার মুখে ঝুঁকে পড়েছে আর শুভদা এই লাইনগুলো বলছে  - 

“আমি তো ছিলাম ঘুমে

তুমি মোর শির চুমে

গুঞ্জরিলে কি উদাত্ত মহা মন্ত্র  মোর কানে কানে,

চলরে অলস কবি

ডেকেছে মধ্যাহ্ন রবি

হেথা নয় হেথা নয় অন্য কোনখানে।”   

আমি একবারে বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম এই দৃশ্য দেখে। আমি তো এর আগে কোনদিন কোন নারী পুরুষকে এই ভাবে এত কাছাকাছি  দেখিনি। তাই নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছিল। আমার পায়ের চাপে মনে হয় বাঁশের শুকনো পাতার খসখসে আওয়াজে ওরা টের পেয়েছিল। শুভদা ধরপর করে উঠে বসে পিছন ফিরে আমাকে দেখে ঠিকরে উঠেছিল একেবারে। মঞ্জুলাদি আমাকে একনজরে দেখে চিনতে পেরেছিল  বোধহয়, একদম কোন ব্যস্ততা না দেখিয়ে খুব শান্ত গলায় বলেছিল -- কিরে  বাবলা তুই এখানে এত রাত্রে? 

আমার গলাটা শক্ত আঠায় যেন আটকে যাচ্ছিল। কথা বলতে পারছিলাম না চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলাম। মঞ্জুলাদি আমার কাছে উঠে এসে আমার মাথায় হাত রেখে বলেছিল তুই পড়তে না বসে এখানে কি করছিস ভাই?

শুভদা আমাকে দেখে বোধহয় ভয় পেয়ে গিয়েছিল। সে ধীরে ধীরে চলে যাবার জন্য পা বাড়াতে আমি ওর পাঞ্জাবি টেনে ধরে নিঃশব্দে কেঁদে ফেলেছিলাম।

মঞ্জুলাদি ওই সামান্য চাঁদের আলোয় আমার চোখের জল দেখতে পেয়ে বলেছিল -- তুই কাঁদছিস কেন ভাই?

শুভদা ও আমার পাশ ঘেসে দাঁড়িয়ে বলেছিল -- দোষ তো আমরা করেছি তুই কাঁদছিস কেন?

আমি খুব কাঁদছিলাম। মঞ্জুলাদি তার আঁচল দিয়ে আমার চোখের জল মুছিয়ে দিতে আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে না পেরে বলেছিলাম -- তোমাদের লোকে খারাপ কথা বলে তোমরা জান না ?

কি খারাপ কথা বলে? শুভদা জানতে চায়। আমি আবার কাঁদতে কাঁদতে বলি -- তোমাদের আমি খুব ভালবাসি, তোমাদেরকে কেউ খারাপ কথা বললে আমার খুব কষ্ট হয়’। 

আমি  জীবনে সেই যেন  প্রথম মানুষের মুখের ছবি মুহুর্তে পাল্টে যেতে দেখেছিলাম। মঞ্জুলাদি, শুভদা কোন কথা না বলে সেই আলো আঁধারিতে আমার মুখের প্রতিটি রেখাকে যেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে  পড়ছিল। আর ততই আমি জোরে ফুপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলাম।

মঞ্জুলাদি আমার হাত ধরে বাঁশ তলা থকে সোজা রাস্তায় চলে এসেছিল। তারপর আমার বাড়ির সামনে এসে আমার হাত ছেড়ে ঢলে পড়া চাঁদের আলো আঁধারে কখন মিলিয়ে গিয়েছিল আমি বুঝতে পারিনি। তারপর থেকে নাকি মঞ্জুলাদি আর শুভদাকে ওখানে সন্ধ্যা কেন দিনে-রাত্রে কেউ দেখেনি।

একদিন ঠিক পুজোর আগে এক খুব সকালে মঞ্জুলাদি আমার বাড়িতে এসে বলল -- বাবলা চল একটু বাঁশ তলাতে যাব। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে রইলাম, কিন্তু জিজ্ঞেস করতে সাহস হল না – ‘কেন এত সকালে বাঁশতলাতে যাব ’কেমন ভয় লাগছিল মনে শুভদার কিছু হয়নি তো।

কিন্তু না ওখানে গিয়ে মঞ্জুলাদি আমাকে জড়িয়ে অনেক সময় কাঁদল, তারপর একটা কাগজ আমার হাতে দিল।

আমি বললাম -- তোমার সাথে শুভদার ঝগড়া হয়েছে, কাগজটা আমি শুভদাকে দিয়ে আসব?

মঞ্জুলাদি বলল – না আমি আজ পাঁশকুড়া চলে যাচ্ছি ওখানে একটা স্কুলে আমি চাকরি পেয়েছি।

-- তবে এ কাগজটা নিয়ে আমি কি করব?

-- তুই বড় হলে পড়বি।

-- আমি এখন তো পড়তে পারি।

-- পারিস, কিন্তু এর মানে বুঝতে পারবি না। আরো একটু বড় হলে এটা পড়ে আমাকে লিখে জানাবি।

আমি হেসে ফেলেছিলাম – তোমার মাথা খারাপ হয়েছে মঞ্জুলাদি তাহলে আমি বড় হলে  নাহয় দিতে।

-- তখন যদি তোর সাথে  আমার দেখা না হয়।

-- কি বলছ মঞ্জুলাদি তুমি কি কক্ষনো এখানে ফিরবে না?

মঞ্জুলা দি মাথা নাড়ে।

--কেন?

--সে তুই বুঝবি না। নিশ্চয়ই তোমার কারুর উপর রাগ হয়েছে। এই কাগজটা যে বোঝে তাকে দাও সে বুঝলে কাজ হবে।

--কাকে দেব বল, তোর মতো আমাকে যে কেউ এত ভালবাসে না।

আমি কেন জানি না কিভাবে মুখ ফসকে বলে ফেলেছিলাম –শুভদাও না?

মঞ্জুলাদি আমার গালটা আলতো করে টিপে দিয়ে বলেছিল -- দূর পাগলা তুই শুধু আমাকে ভালবাসিস না তোর শুভদাকে ও তুই আমার মত ভালবাসিস। আমি এখন যাই রে আমার সকাল নটায় ট্রেন, তুই খুব ভাল থাকিস।তোকে অনেক বড় হতে হবে ভালো করে পড়াশোনা করিস।

মঞ্জুলাদিকে পা বাড়াতে দেখে আমি বলেছিলাম — শুভদাও কি তোমার সাথে যাচ্ছে মঞ্জুলাদি?

--নারে। আমার সেই  বয়সেও কেন জানি না মনে হয়েছিল মঞ্জুলাদি আর শুভদা  যে অভিন্ন।

--তবে তুমি চলে গেলে তার কি হবে?

--আমি কি করে বলব তুই তোর শুভদাকে জিজ্ঞেস করিস – বলে আর দাঁড়ায়নি মঞ্জুলাদি যেন ছুটতে ছুটতে চলে গিয়েছিল।

সেই কাগজটা হাতে নিয়ে আমার তখন মনে হয়েছিল যেন আমি অনেকটা বড় হয়ে গেছি। এটা কাগজ নয় একটা চিঠি। চিঠিটা আমাকে মঞ্জুলাদি নয় আমার কোন প্রেমিকা আমার হাতে দিয়েছে। এটাকে সংগোপনে লুকিয়ে রাখতে হবে। এ আমার কাছে স্মৃতি। হাত পা কাঁপছিল। কি লিখেছে মঞ্জুলাদি একবার খুলে দেখব? না মঞ্জুলাদি যে আমাকে বারণ করেছে পড়তে। আবার মনে হয়েছিল মঞ্জুলাদি খারাপ কিছু করতে যাচ্ছে না তো! আমার কাছে তার মনের কথাগুলো লিখে রেখে যাচ্ছে যাতে ....

কিন্তু আমি পারিনি পড়তে কাগজটা রোল করে প্যান্টের দড়ির ঘরে ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম। কেউ যেন জানতে  না পারে। তারপরে স্নানের আগে ওটাকে খুব সন্তর্পনে আমাদের খড়ের চালের ফাঁকে লুকিয়ে রেখেছিলাম, যাতে ...

তারপরে মঞ্জুলাদির  আর কোন খবর পাইনি।

মঞ্জুলাদির কথা রেখে ছিলেম ক্লাস এইটে ওঠার পর কাগজটা বের করে পড়ে আমি চমকে উঠেছিলাম। এত রবীন্দ্রনাথের কবিতার অংশ। কেন এই লাইন কটা লিখে আমাকে দিলেন মঞ্জুলাদি। বারবার পড়েও আমি সেদিন  অর্থ বুঝতে পারিনি।

শুধু তখন মনে হয়েছিল কত গভীরতা ছিল এই সামান্য গ্রাম্য মেয়েটির। কত সামান্য বয়সে অসামান্য সংস্কৃতি ও শৈল্পিকবোধ তার জীবনে জাগ্রত হয়েছিল। এই অঞ্চলের যত সংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শিল্প চর্চা বলতে তো ছিল মঞ্জুলাদি সেই মঞ্জুলাদির জন্যে ....

মঞ্জুলাদি তো মানুষ ছিল, তার শরীর মন চাহিদা কি অন্য দশটা মানুষের মত হতে পারতো না! আর এই গ্রামের যদি একটা সঠিক মানুষ বলতে কেউ থেকে থাকত সে শুভদাই ছিল।

শুভদা মঞ্জুলাদি বোধ হয় মনে করত তারা গ্রামের মানুষের চোখের মণি ছিল। শিক্ষা, দীক্ষা, সংস্কৃতি, সুস্থ চেতনার যে প্রবাহ মানুষের মনে বইয়ে দিয়েছে তাতে গ্রামের মানুষ তাদেরকে অন্য চোখে দেখবে।

তবু একটা কথা অনেকবার মনে হয়েছিল আমার কথাতে যদি শুভদা মঞ্জুলাদির তাদের ধারনার  চমক।  তাহলে কেন মঞ্জুলাদি শুভদার উপর  অভিমান করল কেন তাকে সঙ্গে নিল না -- উত্তর পাই নি।

আমার মনের মধ্যে অভিমান বাসা বেঁধেছিল শুভদা মঞ্জুলাদির উপর। আমি সেই বয়সে তাদের কাছে মুখ ফুটে না বললেও হাবেভাবে বোঝাতে পেরেছিলাম তোমরা আমার জীবনের রোল মডেল। অথচ লোক দুটো একটুকরো কাগজ দেওয়া ছাড়া আর কিছু করেনি এমন কি আমাকে মনে ও রাখে নি ...

তেমনি এই গ্রামের অনেক মানুষের উপরও আমার ক্ষোভ ছিল যারা অন্যায়ভাবে এমন দুটো ভাল মানুষকে গ্রাম ছাড়তে বাধ্য করেছিল।

আজ অনেকদিন পর সেই মঞ্জুলাদি গ্রামে ফিরেছে। আমি সেই বাঁশতলা দিয়ে চলেছি অফিস থেকে ফিরে সংবাদটা পেয়েই। আমার হাতের মুঠোয় মঞ্জুলাদির দেওয়া সেই কাগজের টুকরো। কেমন হলদেটে হয়ে গেছে, একটু জোরে চাপ পড়লে ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে যাবে তথাপি খুব আলতো করে ধরে রেখেছি একবুক জিজ্ঞাসা নিয়ে।

অনেকদিন মঞ্জুলাদির বাড়িতে যাই নি। ওদের বাড়ির সামনে কৃষ্ণচূড়া গাছটা একদিন লাল ফুলের আভায় যেন চারিদিক মাতিয়ে রাখত। কতদিন আমি শুভদা আর মঞ্জুলাদিকে কৃষ্ণচূড়া ফুলের পরাগ দন্ড নিয়ে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা করতে দেখেছি। মঞ্জুলাদি হেরে গিয়েও কেমন হেসে খোলা চুলে শুভদার গায়ে লুটিয়ে পড়ত। সেই কৃষ্ণ চূড়া গাছটাকে এমন বিবর্ণ দেখে মনে হল তাহলে কেমন দেখব মঞ্জুলা দিকে। আজ প্রায় কুড়ি বছর পর নিশ্চয়ই মঞ্জুলাদির চুলে রুপোলি ঝিলিক ধরেছে। আর শুভদার নিশ্চয়ই সারা মাথা, গালভর্তি কাঁচা পাকা চুলের প্রলেপ। কি মোটা হয়েছে না রোগা? তেমনি টকটকে গায়ের রং আছে তো নাকি তাদের?

মঞ্জুলাদিকে ডাকতে ডাকতে ঘরের মধ্যে ঢুকে গেলাম। বারান্দায় একটা ষাট ওয়াটের বাল্ব জ্বলছে। কাউকে দেখতে পেলাম না। খাঁ খাঁ করছে বাড়িটা কাউকে তো দেখছি না তবে কি মঞ্জুলাদি ফেরেনি যা শুনেছি সব মিথ্যা। বড় ইচ্ছা ছিল....

শোবার ঘরগুলো অন্ধকার। সেই একটা ঘর থেকে অত্যন্ত ক্ষীণ শব্দ এলো --আয় বাবলা এই ঘরে আয়।

সেই পরিচিত কন্ঠস্বর কিন্তু এত নিস্প্রভ কেন!

--তুমি কোথায় মঞ্জুলা দি?

---আমি এই ঘরে, তোর সামনে।

--অন্ধকারে বসে আছ কেন মঞ্জুলাদি? কখন এলে গ্রামে তোমার স্কুল ছুটি?

মঞ্জুলাদি কি উত্তর দিল বোঝা গেল না। আমার গলার আওয়াজ পেয়ে মঞ্জুলাদির ছোট ভাগ্নে ঘরের সুইচটা অন করে দিতে বিছানার উপর বসে থাকা একটা নারী মূর্তিকে দেখে ভয়ে শিউরে উঠলাম। কে বসে ওখানে? মঞ্জুলাদি! বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছিল না ওই কঙ্কালসার বিধবাকে দেখে। এ কি বিভৎস চেহারা হয়েছে মঞ্জুলাদির! দুহাত কখন আমার চোখের উপর পড়েছে জানি না।

--তোর সেই চেনা মঞ্জুলা দিকে বড় অপরিচিত লাগছে না রে বাবলা?                         আমার দুচোখ জলে ভর্তি হয়ে গেল। কথা বলতে পারছিলাম না খুব কষ্টে বললাম - শুভদা কতদিন আগে মারা গেছে  মঞ্জুলা দি?

কোটরাগত দুটো চকচকে চোখ দিয়ে আমার দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকাল মঞ্জুলাদি তারপর খুব ধীর গলায় বলল শুভদা মারা গেছে মানে?

আমি কথা বলতে পারছিলাম না কি বলছে দি? মঞ্জুলাদি বিধবা অথচ বলছে শুভদা মারা গেছে মানে তাহলে ....

আমি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়েও থাকতে পারছিলাম না আমি যেন ক্রমান্বয়ে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ছিলাম নীরবতা ভাঙ্গার জন্যে বললাম তুমি ভালো আছ  তো মঞ্জুলাদি?

--কথা এড়িয়ে যাস না বাবলা তুই যেন আমাকে কিছু বলতে গিয়ে ও থেমে গেলি?

যেন হাতেনাতে ধরা পরে গিয়ে কিংকর্তব্যবিমুড় হয়ে বলি --কই আমি তোমাকে তো কিছু  জিজ্ঞাসা করিনি।

এই মুহুর্তে কিছু বলতে হয়ত চাইছিস না, কিন্তু বলতে তো চাস-- জানতে তো চাস। নাহলে আমি এসেছি শুনে মাত্র এই রাত্রিতে ---

দুটো প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য কতদিন ধরে আকুলিবিকুলি করছি মঞ্জুলা দিকে সামনে পেলে আমার সে জিজ্ঞাসার উত্তর নেব। কিন্তু এখন আমি কোনটা জিজ্ঞেস করব আগে-- রবীন্দ্রনাথের লাইন কটা কেন তুমি আমাকে দিয়ে দিয়ে গিয়েছিলে মঞ্জুলাদি কি বলতে চেয়েছিলে ওই লাইন কটার মধ্যে দিয়ে। আমি আজ পর্যন্ত যে বুঝে উঠতে পারিনি ...

পরের প্রশ্নটা করতে পারছি না, এই প্রশ্নটা আমার কাছে যেন ক্রমশঃ বিভীষিকা হয়ে উঠছে বুকের কাছে এসেও গলার কাছে দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। 

Comments

Top

ক্লিক ক্যামেরা 

অমিতাভ মৈত্র

নেতাজি পল্লী ,সোনারপুর ,কলকাতা

riksha.jpg
ক্লিক ক্যামেরা

সাউথ সিটি মলের একটা জুতোর দোকান থেকে বেরিয়েই চোখ চলে গেল উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে থাকা একজন ভদ্রলোকের দিকে। লোকটি একগাল দাড়ি সমেত ঘাড়টাকে ডান দিকে একটু কাত করে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। ভাবছি তাকাবো কি তাকাবো না। হয়তো অন্য কারুর দিকে তাকিয়ে আছে। না, দেখছি আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। একটু এগিয়ে যেতেই মনে হলো দাড়িটা বাদ দিলে লোকটা হয়তো চেনা কিন্তু কি তাঁর নাম, কি ভাবে চেনা বা কোথায়, কবে দেখেছি মনে পড়ছে না। কাছাকাছি পৌঁছতে যে নামে আমাকে ডাকলেন তাতে বোঝা গেলো আমি না চিনতে পারলেও ভদ্রলোক আমাকে চেনেন। 
আগন্তুক: কি রে চিনতে পারছিস না? তুই ডাকু তো, নাকি ভুল করলাম। আমি বললাম, “নামটা তো ঠিক আছে। কিন্তু আমি তো ঠিক…”  

আগ: সেকি, আমাকে চিনতে পারছিস না?      
বললাম, “ঠিক মনে করতে পারছি না। অথচ চেনা চেনা লাগছে।”                              
আগ: মিত্র স্কুলে পড়তিস তো…সেই পূরবী সিনেমার উল্টো দিকে?     

বললাম, “হ্যাঁ… পড়তাম।”                                        

আগ: সুজনকে চিনতে পারছিস না? শেষ চার বছর এক সঙ্গে ছিলাম সব ক্লাসে… মনে কি পড়ছে?

এবার আমার সব মনে পড়ে গেলো। সুজন ক্লাস সিক্স-সেভেন পর্যন্ত পড়াশুনোয় খুব একটা ভাল ছেলে ছিল না। বেশ কয়েক বার ফেল করার ফলে ক্লাস এইটে যখন আমার সেকশনে এলো তখনই সে আমার থেকে বয়েসে তিন বছরের বড়। ক্লাস এইটে উঠে সুজন ক্রমশঃ একদম বদলে গেল। অঙ্কে মাথাটা ওর এতো ভাল হয়ে উঠলো যে সব সেকশন মিলিয়ে সুজনের নম্বর থাকতো সবার ওপরে। হায়ার সেকেন্ডারীতেও সুজন ভাল রেজাল্ট করেছিল।
ক্লাস টেন থেকেই ও আমাকে অঙ্ক করাতো, যদিও দুজনেই আমরা একই ক্লাসের ছাত্র ছিলাম। আমার আর এক বন্ধু ও আমি সপ্তাহে দুদিন সুজনের কাছে অঙ্কের তালিম নিতাম। অঙ্ক করাতে ও আমাদের বাড়িতেই আসতো। তিন বন্ধুতে আমরা বাড়ির ছাতের ঘরে নির্ঝামেলায় পড়াশুনো করতাম। অন্য গল্প বা আড্ডা যে হতো না তা নয়। যথেষ্টই হতো। কিন্তু অঙ্কের মাস্টার হিসেবে সুজন ছিল বেশ কড়া… বেশী অন্য কথা বা আড্ডা ও পছন্দ করতো না। 
মাঝে মাঝে সুজনের কোলুটোলার বাড়িতেও আমরা পড়তে যেতাম। ওর বাড়ি ছিল কোলুটোলার এক ঘিঞ্জি গলিতে। বাড়িতে পড়তে যাওয়ার সুবাদে সুজনের বাবা, মা ও ছোট ভাই-এর সঙ্গেও আমার বেশ আলাপ হয়ে গিয়েছিল। 
সুজনকে এতদিন পরে দেখে একটু বেশী উত্তেজিত হয়ে হাত বাড়ালাম।                    
বললাম, “কি আশ্চর্য! তুই আমাকে চিনতে পেরেছিস? আমি তো চিনতে পারতাম না। তার ওপরে এক গাল বিচ্ছিরি দাড়ি রেখেছিস। কয়েদী কয়েদী দেখতে লাগছে।”  
সুজন কিন্তু হাত বাড়ালো না, বললো, “হ্যান্ড সেক করবো কেন? তোর আমাকে প্রণাম করা উচিৎ। একে তোর থেকে আমি বয়েসে বড়, তার ওপর তোর অঙ্কের টিচার ছিলাম।” আমি বললাম, “বাজে বকিস না তো, চল কোথাও একটু বসি।” 
ফুড কোর্টে গিয়ে মুখোমুখি দুটো চেয়ারে দুজনে বসলাম। চা আর সামান্য স্ন্যাক্সের সঙ্গে বহু পুরনো কথা ফিরে ফিরে আসছিলো। আমার বাবা, মা এমন কি দাদাও মারা গেছেন শুনে খুব অবাক হলো। সুজন ভুলে গিয়েছিল আমার বাবা বেঁচে থাকলে আজ তাঁর বয়েস হতো একশো পাঁচ আর মা আটানব্বই। আমার ছেলে ও মেয়ে আছে শুনে খুব খুশী হলো। হঠাৎ মাথাটা এগিয়ে দিয়ে নীচু গলায় জিজ্ঞেস করলো, “যার সঙ্গে স্কুল জীবনে প্রেম করতিস তাকেই বিয়ে করেছিস তো, নাকি অন্য কাউকে?” আমার স্কুল জীবনের প্রেমিকাই আমার বর্তমান স্ত্রী এই কথা শুনে আরো খুশী হলো। হঠাৎ খেয়াল করলাম সুজন আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টে, কি যেন ভাবছে ও।

জিজ্ঞেস করলাম, “কি ভাবছিস এতো?” প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে আমাকেই জিজ্ঞেস করলো, “আচ্ছা ডাকু, তোর এখনও ফটোগ্রাফির শখ আছে? এখন ছবি তুলে বেড়াস?”

বললাম, “ছবি তুলি কখন কখন, যেমন সবাই তোলে। শখ বলতে যা বোঝায় সেই রকম কিছু নেই। তবে দুখানা ভাল ক্যামেরা আছে। আর আছে কিছু প্রয়োজনীয় লেন্স।” তাই শুনে বললো, “স্কুল জীবনে তো খুব ছবি তুলে বেড়াতিস। মাঝে মাঝে পড়াশুনো ছেড়ে কলকাতার বাইরেও যেতিস ছবি তুলতে।”

অবাক হয়ে বললাম, “তোর এতো কথা মনে আছে? আমি তো সবই প্রায় ভুলে গেছি।”
সুজন বলল,  “সব ভুলেছিস কিন্তু একটা ভীষণ সুন্দর ক্যামেরার কথা তোর ভোলার কথা নয়।”                       
আমি বললাম, “কোন ক্যামেরার কথা বলছিস?”              
সুজন: সেকি রে! সেই ছোট্ট ক্লিক ক্যামেরাটা, যেটা এতো ছোট ছিল যে হাতের মুঠোর মধ্যে চলে আসতো। তোর দাদা সিঙ্গাপুর থেকে এনেছিলেন তোর জন্যে।                     

আমি: ওরে বাবা! সেটার কথাও তোর মনে আছে? সিঙ্গাপুর নয় হংকং থেকে এনে দিয়েছিলেন। ছোট্ট ছোট্ট ফিল্ম রোল ছিল। একটা রোলে দশটা সাদা-কালো ছবি উঠতো। দশটা ফিল্ম রোল প্রায় এক মুঠোয় চলে আসতো। দাদা দশটা রোলের দুটো বাক্স এনেছিলেন। অর্থাৎ আমার কাছে কুড়িটা এই রকম ছোট্ট ফিল্ম রোল ছিল। ক্যামেরাটার ভারি সুন্দর একটা চামড়ার ছোট্ট ব্যাগ ছিল। ক্যামেরার শাটারে আঙুলের হালকা চাপে একটা শব্দ হতো, ক্লিক!”               

: যাক তোর সব মনে আছে তাহলে।                          

আমি: মনে থাকবেনা কেন। তবে অনেক কাল আগের ঘটনা তো। জানিস সুজন ক্যামেরাটা আশ্চর্য রকম ভাবে হারিয়ে গিয়েছিল। কোথাও আর কোনদিন খুঁজে পাইনি। মাঝে মাঝে ক্যামেরাটার কথা খুব মনে হয়। খুব বেশীদিন ওটা ব্যবহার করার সুযোগই হলো না। মাত্র দুটো ফিল্ম রোল ব্যবহার করেছিলাম। আটটা রোলের সেই ফিল্মের ব্যবহার করা বাক্সটাও ক্যামেরার সঙ্গেই উধাও হয়ে যায়। যাকগে ওসব কথা, তোর কথা বল।       

সু: আমার কথা আর কি বলবো। নবদ্বীপ কলেজে সারা জীবন পড়িয়েছি। একটি ছেলে আমার। বউ মেয়েটা ভাল কিন্তু আমার সঙ্গে খুব একটা বনিবনা নেই। আমার ছেলে আর বৌ, থাকেনা আমার সঙ্গে।                                

আমি: তোর বউ মানুষ ভাল অথচ তোর সঙ্গে বনিবনা নেই, এটা কি রকম? তোকে যতোটা চিনেছিলাম, তাতে এইটুকু বুঝি, তুই নির্ঝঞ্ঝাট মানুষ।                             

সু: না রে ডাকু, সমস্যাটা আমাকে নিয়েই।                  

আমি: সে আবার কি? সমস্যাটা যখন তোকে নিয়েই, সেটা মিটিয়ে ফেললেই হয়। তুই তো জানিস তোর সমস্যাটা কি। এমন কোন সমস্যা কি যা তুই চেষ্টা করেও মেটাতে পারছিস না? পরকীয়া প্রেম-ট্রেম না তো?                    

মন এক গাল হেসে বলল, “আরে না রে বাবা, ওসব কিছু নয়। ব্যপারটা আর একটু জটিল ছিল।”                        

আমি বললাম, “জটিল ছিল কেন বলছিস? এখন কি ব্যপারটা মিটে গেছে?”                   সু: এখন কিছু নিয়েই আর কিছু ভাবি না। আমি এখন সব সমস্যার বাইরে।                  

আমি: কি সব হেঁয়ালি মার্কা কথা বলছিস বুঝতে পারছি না। একটু খোলসা করে বলতো।     সু: বলবো বলেই তো তোর জন্যে এখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তোকে আমি অনেকদিন যাবৎ খুঁজেছি একটা পরামর্শের জন্যে। তোর কোন খবর পেলাম না। পুরনো বন্ধু-বান্ধবদের কাছে তোর অল্প স্বল্প কিছু বিচ্ছিন্ন খবর ছাড়া তোর বর্তমান ঠিকানা বা কার্যকলাপ সম্বন্ধে কিছুই জানতে পারলাম না। তারপর অনেক ভেবে সমস্যা সমাধানের একটা পথ খুঁজে পেলাম। Decide করে ফেললাম আমাকে কি করতে হবে। এখন আর আমার ততো অশান্তি নেই। কিন্তু তোকে কয়েকটা কথা না জানিয়ে আমি পুরোপুরি শান্তি পাচ্ছি না। আমি বললাম,  “বল না, কি বলবি।”            

সুজন বলল,  “এখানে বলা যাবেনা।”                          

হঠাৎ আমার হাত দুটো চেপে ধরে বলল, “আমাকে কথা দিতে হবে ডাকু একবারের জন্যে আমার বাড়িতে একদিন আসবি। আর কখন তোর কাছে কিছু চাইবো না। কথা দে ডাকু। সুজনের হাতদুটো কন কন করছে ঠান্ডা, আমি হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম,  “তুই এই রকম করছিস কেন? আমি তোর বাড়িতে যাবো, এটা কি এমন একটা ব্যাপার। নিশ্চয়ই যাবো। আমি কি তোর বাড়িতে কখন যাইনি?”      

সু: হ্যাঁ গিয়েছিস, অনেক কাল আগে। তখন পরিবেশ ছিল অন্য রকম। এখন সব বদলে গেছে। সময় বদলে দিয়েছে এই শরীর আর মনটাকে। রাগ, দুঃখ, অভিমান সবকিছু শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।                                    

সুজন একটু থামলো। কিছুক্ষণ চুপ করে কি যেন ভাবলো। তারপরে ভীষণ করুণ মুখে বললো, “তোর কাছে কথাটা না বলতে পেরে আমি খুব কষ্ট পাচ্ছি। কাল একবার আয় না সন্ধ্যের দিকে। আমার বাড়ি নিউ টাউনে, নস্কর পাড়ার হরি মন্দিরের কাছে। আসবি তো। তোর হাতে একটা জিনিস তুলে না দিয়ে আমি শান্তি পাচ্ছি না।”                           জিজ্ঞেস করলাম, “জিনিসটা কি?” একটু ম্লান হেসে সুজন বললো, “কালকেই তো আসছিস, কালকেই দেখিস।”                 

সুজনকে কথা দিলাম আমি যাবো। নিজের গাড়িতে সুজনকে ইস্টার্ন বাইপাসের ওপরে নির্দিষ্ট বাস স্টপে নামিয়ে দিয়ে বাড়ি ফিরলাম। সারা রাস্তাই সুজন আমার ভাবনা জুড়ে রইলো। কি এমন ঘটেছে ওর জীবনে যার জন্যে ওকে ওর পরিবারকে ছেড়ে যেতে হয়েছে। কি সমস্যা ওকে এই বিপাকে ফেলেছে। সমস্যাটা কি অর্থনৈতিক, শারীরিক না মানসিক। নাকি সুজন কোন গর্হিত কর্মের নায়ক, যার জন্যে সমাজ তাকে ত্যাগ করেছে। কিন্তু আমি যে সুজনকে চিনতাম সে অতি ভাল মানুষ। তার পক্ষে সেই রকম কোন গর্হিত কর্ম করা সম্ভব বলে আমি মনে করি না।পরের দিন সল্টলেকে আমার অফিস থেকে বিকেল পাঁচটা নাগাত বেরিয়ে পড়লাম। শীতের সন্ধ্যে যেন সন্ধ্যে থেকেই লেপ মুড়ি দেবার প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। রাজারহাট ছেড়ে নিউটাউন রোডের রাস্তা ধরে এগিয়ে চলেছি সুজনের নির্দেশিকা মতো। প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট ড্রাইভ করার পর নিউটাউন রোডের ওপরে ডান দিকে গাড়ি ঘোরালাম। নস্করপাড়া জায়গাটা শহর নয় বরং বলা যায় শহরতলি। আগে থেকেই সুজনের সঙ্গে কথা বলা ছিল, ফলে নিউটাউন রোডের একটা মোড়ে ও আমার জন্যে অপেক্ষা করছিল বাকী পথটা আসতে, আমার যাতে কোন অসুবিধে না হয়। কলকাতার বাইরে শহরতলিতে এলে ছেলেবেলায় কলকাতার শীতের কথা মনে পড়ে। সুজন একটা মাফলারে মাথা, কান, মুখ আর গলা ঢেকে রাস্তায় অপেক্ষা করছিল। শুধু চোখ দুটোকে শীতের সন্ধ্যে উপভোগের সুযোগ দিয়েছিল। গাড়ির নম্বর দেখে দূর থেকে হাত না নাড়লে ওকে আমি নির্ঘাৎ চিনতে পারতাম না।এখানে একটা বাড়ির পাঁচতলার ওপরে দু কামরার একটি ছোট্ট ফ্ল্যাট নিয়ে সুজন থাকে। বাড়িতে ঢুকেই সামনে সিঁড়ি। প্রতি তলায় সিঁড়ির দুদিকে দুটো করে ফ্ল্যাট। বাড়িতে কোন লিফ্ট থাকবে এটা আশা করাটাই অন্যায়। পাঁচ তলায় উঠে বাঁদিকের ফ্ল্যাটটাই সুজনের। এতোগুলো সিঁড়ি ভেঙে একটু হাঁপিয়ে গেছি। বহুদিন লিফ্টের ভরসায় থাকতে থাকতে আর সিঁড়ি ভাঙার পরিশ্রম এড়াতে এড়াতে শরীর হঠাৎ এই বেয়াড়া পরিশ্রমটাকে খামোখা একটা বাড়াবাড়ি অত্যাচার হিসেবে গণ্য করে আজকাল। সুজন চাবি ঘুরিয়ে দরজা খুলতেই বুঝলাম বাড়িতে কোন দ্বিতীয় ব্যক্তি নেই। দরজার পিছনে হাত বাড়িয়ে সুইচ টিপতেই টিমটিমে একটা আলো জ্বললো। এক চিলতে ডাইনিং রুমের ডানদিকে একটা ঘর। সুজনের সঙ্গে সেই ঘরে ঢুকলাম। ঘরে দুখানা টিনের চেয়ার ছাড়া আছে একখানা পালিশ ওঠা টেবিল। এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়ে আছে অসংখ্য বই আর পুরনো খাতা। ঘরের কোণে একটি টোল খাওয়া স্টিলের থালা তার ওপরে উল্টে রাখা একটি তুবড়োনো স্টিলের গ্লাস। ঘরের বাঁদিকে একটি দরজা আধ খোলা। মনে হলো এটা বারান্দায় যাওয়ার দরজা। সুজন আমাকে একটি চেয়ারে বসিয়ে রেখে বেশ কিছুক্ষণ হলো বাড়ির ভেতোরে গেছে। চা-টা করছে নাকি। বারান্দার দিক থেকে একটা ঠান্ডা হাওয়া ঢুকছে ঘরে। রাস্তায় আলো কম ফলে বাইরেটা কেমন যেন আলো আঁধারি। ঘরের একটাস্যাঁত স্যাঁতে গন্ধ ঠান্ডা হাওয়ায় ভর করে ঘরে ভেসে বেড়াচ্ছে। সুজন এখনও এলো না। কি করছে কে জানে। রান্না বান্না করতে বসে গেল নাকি। বাড়িতে বলে এসেছি বাইরে খাবো, রাত হবে ফিরতে। সুজনের এখানে খাওয়ার ব্যবস্থা থাকবে এই আশা আমি করিনি।

কিন্তু সুজনের সঙ্গে কথা বলে এতোটা রাস্তা গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফিরতে রাত হবে জানি। পরিবারের সবাইকে জাগিয়ে রেখে বসিয়ে রাখাটা অস্বস্তিকর। তাই এইটুকু মিথ্যের আশ্রয় নিতে হয়েছে। পরে সব খুলে বললে পাপটা আর পাপ থাকেনা। এবার ধৈর্য হারিয়ে যে দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকেছিলাম সেইদিকে একটু এগিয়ে গিয়ে সুজনের নাম ধরে ডাকলাম। সাড়া পেলাম, “এক্ষুনি আসছি…একটু বোস।” বসে থাকা মানে ফিরতে রাত হওয়া। সুজনকে বোঝাতে হবে আমি কিন্তু বেশীক্ষণ বসতে পারবো না। বাইরে এবার সুজনের পায়ের শব্দ পেলাম। ঘরে ঢুকলো সুজন।

বললাম, “শোন, আমাকে তো বাড়ি ফিরতে হবে। কি বলবি বলছিলি বল।”                     “হ্যাঁ, এইবার বলবো।” বললো সুজন। এক সময় সুজন বলতে শুরু করলো, “দেখ ডাকু আমি M.Sc. complete করার পরই নবদ্বীপ কলেজে পড়ানোর একটা চাকরী পেয়ে যাই। বছর দুয়েক পরেই বিয়ে করি। নবদ্বীপ থেকে সপ্তাহের শেষে যাতায়াত সহজেই করা যেতো বলে বৌকে নবদ্বীপে আমার কাছে রাখতাম না। ও কলকাতার কোলুটোলায় আমাদের পৈতৃক বাড়িতে মা-বাবা, ভাই ও অন্য সবার সঙ্গে থাকতো। তুই তো জানিস আমাদের পরিবারে তখন অনেক লোকজন। কাকা, জ্যেঠা সবাই একসঙ্গে থাকতাম। স্কুল জীবন থেকেই আমার একটা বদ অভ্যাস ছিল। তুই হয়তো কোনদিন টের পাসনি। আসলে স্কুলে পড়াকালীন এই বদ অভ্যেসটা আমার ততোটা বাড় বাড়ন্ত ছিল না। কলেজে পড়তে পড়তে এটা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে।”  আমি জিজ্ঞেস করলাম, “বদ অভ্যেসটা কি?”                সুজন চুপ করে থাকে। ওকে একটু সময় দিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলাম, “কিরে বল। তোর কথা শুনতেই তো এলাম।” এবারেও চুপ করে আছে। কিন্তু কি যেন এক যন্ত্রণা ওকে কুরে কুরে খাচ্ছে। হঠাৎ বলতে শুরু করলো, “জানিস ডাকু, যেদিন ধরা পড়লাম প্রথম, ঠিক করলাম এবারে যদি কোন মতে বেঁচে যাই আর কখন এ কাজ করবো না। কয়েকজন জানলেও ছেলে-বউ জানতে পারলো না। কলেজের প্রিন্সিপাল কথা দিয়েছিলেন তিনি কাউকে বলবেন না। কিন্তু আমাকে কথা দিতে হয়েছিল তাঁকে…এ কাজ আমি আর কখন করবো না।”                                

সুজন বলে যাচ্ছিল। আমি বাধা দিয়ে জিজ্ঞেস করিনি অপরাধটা কি ছিল।   

সুজন বলতে থাকে, “কি করেছিলাম জিজ্ঞেস করবি না? জিজ্ঞেস না করলেও তোকে আজ শুনতে হবে। ডাকু আমি চুরি করেছিলাম….আমার colleague এর দামী পেন। ধরা পড়ে গেলাম। যখন আমার colleague এর পেন চুরি যায় সেই ঘরে দ্বিতীয় ব্যক্তি একমাত্র আমিই ছিলাম। পরের ঘন্টায় আমার ক্লাস ছিল। চুরি করা পেন সমেত ধরা পড়ার ভয়ে একটু বেশী সাবধান হয়ে ছিলাম। পেন সমেত আমার ব্যাগটা আলমারির মধ্যে তালা দিয়ে রাখলাম। যা কেউই সাধারণতঃ করেনা।  আমার colleague-এর সন্দেহ এতে আরো বাড়ে। আমি ক্লাসে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি প্রিন্সিপালকে তাঁর বদ্ধমূল সন্দেহের কথা জানান। প্রিন্সিপালের কাছে ছিল ওই আলমারির দ্বিতীয় চাবি। দিনের শেষে আমাকে প্রিন্সিপাল ডেকে পাঠান। হাতেনাতে ধরা পড়ে স্বীকার করতে বাধ্য হই আমি চুরি করেছি। আমার অনুরোধে সমস্ত ব্যাপারটা একমাত্র আমি, কলেজের প্রিন্সিপাল আর আমার colleague শুধু জানলো । কিন্তু বুঝতে পারতাম আমাকে প্রিন্সিপাল ও আমার শিক্ষক বন্ধু তার পর থেকে সাধারণতঃ এড়িয়ে চলেন এবং একটু ঘৃণা মেশানো করুণার চোখে দেখেন।  তারপর কিছুদিন আমি এই প্রবূত্তিকে জোর করে মন থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করি…পারিনি। আমার স্ত্রীর দাদা, বিদেশ থেকে তার বোনের জন্যে নিয়ে এলো সোনা, রূপোয় কাজ করা একটা সুন্দর গয়না রাখার বাক্স। বাক্সর ডালা খুললেই একটি ছোট্ট পুতুল-মেমসাহেব বেরিয়ে এসে নাচের ভঙ্গিতে ঘুরতে থাকে আর তালে তালে বাজতে থাকে সুন্দর, মিষ্টি বাজনা। দেখেই মনে হলো এটা আমার চাই। একেবারে আমার নিজের করে এটাকে আমায় পেতেই হবে। তখন আমার মাথায় এর বিপদজনক ফলাফল নিয়ে ভাবার কোন ক্ষমতা ছিল না। সুযোগ খুঁজছিলাম…..সুযোগ পেয়েও গেলাম। আমার স্ত্রী এবং ছেলের বেশ কয়েক ঘন্টার অনুপস্থিতিতে গয়নার বাক্সটা সরিয়ে ফেললাম। সেটাকে লুকিয়ে রাখলাম আমার পড়ার ঘরে এক গোপন জায়গায়। আমার স্ত্রী তার সুন্দর গয়নার বাক্সের খোয়া যাওয়াটা টের পেলো সাতদিন পরে। অনেক খোঁজ করেও না পেয়ে নিশ্চিত হলো বাড়ির কাজের মাসি নিশ্চয়ই এ কাজ করেছে। তাকে সরাসরি দোষারোপ না করেও নানা অন্য কথায় আমার স্ত্রী তার সন্দেহের কথা ঝিকে শোনাতে থাকলো। ফলাফল যা হওয়ার তাই হলো। প্রবল ঝগড়া-ঝাঁটির মধ্যে দিয়ে সে কাজ ছেড়ে চলে গেল। মেয়েটি কাজ ছেড়ে চলে যাওয়ায় আমার স্ত্রীর সন্দেহটা আরো দৃঢ় হলো যে এই চুরি কাজের মাসিই করেছে। আমি নিশ্চিন্ত হলাম। আবার আমার চুরির এই প্রবৃত্তি ক্রমশঃ বেড়েই চললো। নিজেকে আটকাবার সমস্ত ক্ষমতা আমার লোপ পেলো। যখনই মনের মতো কিছু দেখতাম, সেটা যারই হোক, আমার নিজের করে পাওয়ার জন্যে এবং চুরি করার জন্যে ফন্দি আঁটতাম।আমার এক ছাত্রীকে পড়াতে যেতাম তার বাড়িতে। ভাল পারিশ্রমিক পেতাম। সপ্তাহে দুদিন যেতাম সেখানে। বিদেশ থেকে আনা অপূর্ব সব Curio-তে সাজানো ঘর থেকে গোটা তিনেক বাছাই করা Curio ও দামী হাত ঘড়ি বেশ কিছুদিনের ব্যাবধান রেখে রেখে সরিয়ে ফেললাম। এখানেও সাধারণ নিয়মে চাকরী খোয়ালো বাড়ির পুরনো চাকর। আমি আলোচনাতেও এলাম না। এইভাবে সবার অলক্ষ্যে লুকিয়ে রাখা চুরি করা জিনিষের সংখ্যা বেড়েই চলেছিল। শেষ চুরিটা করেছিলাম এক শিক্ষক বন্ধুর বাড়িতে তার মেয়ের জন্মদিনের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়ে। জিনিসটা ছিল একটা বিদেশী রিমোট কন্ট্রোল খেলনা গাড়ি। একটু বিশেষ রকম আকর্ষণীয় ছিল এই খেলনাটা।   আমি টের না পেলেও আমার শিক্ষক বন্ধুরা কোথাও কখন একত্রিত হলেই এই অদ্ভুত চুরির ঘটনাগুলো নিয়ে আলোচনা করতেন। তাঁরা লক্ষ্য করেছিলেন এবং পরে গভীর অনুসন্ধান করে দেখলেন প্রত্যেকটা চুরিতে আমিই উপস্থিত ছিলাম। আমার প্রিন্সিপাল যে কথা গোপন রেখেছিলেন এতদিন, পরে তা আর গোপন ছিল না। প্রিন্সিপাল গোপনীয়তা ভাঙতেই আমার ওপর সন্দেহটা বন্ধুদের আরো দৃঢ় হলো আমার অজান্তে। আমার স্ত্রীর কানে কথাটা কবে কিভাবে পৌঁছেছিল আমি জানিনা। মাঝে মাঝে আমার চুরি করা জিনিসগুলো নাড়া ঘাঁটা করে এক অনাবিল আনন্দ অনুভব করতাম। আর সেইটাই আমার কাল হলো। আমার স্ত্রীর কানে নানা কথা পৌঁছনোর পর থেকে তিনি আমাকে গোপনে লক্ষ্য রাখতেন। রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে পরীক্ষার খাতা দেখার নাম করে আমি পড়ার ঘরে ঘন্টার পর ঘন্টা সময় কাটাতাম। অসতর্ক হয়ে পড়েছিলাম আর সেই সুযোগে স্ত্রী ও আমার ছেলে গোপনে দেখে ফেলেছিল আমার লুকোনোর জায়গাটা। যে রাত্রে ধরা পড়লাম সেই রাত্রে রাত দশটা নাগাত পড়ার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করেছিলাম। গোপন জায়গায় খোঁজ করতে গিয়ে দেখলাম সর্বনাশ যা হওয়ার তা হয়ে গিয়েছে। কোন জিনিসই সেখানে নেই। কেউ সরিয়ে নিয়েছে আমার অজান্তে। আমি কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। সারা শরীর আমার কাঁপছে। একটা সমূহ বিপদ আমার সামনে। দরজায় টোকা দিয়ে আমার ছেলে আমাকে ডাকছে। বলছে দরজা খুলতে। খুললাম দরজা। বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল ছেলে আর তার মা। দুজনের মুখ ছিল থমথমে। আমার স্ত্রীর নির্দেশে পাশের ঘরে গেলাম। স্ত্রীর চোখে জল। নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম কিছুক্ষণ। খাটের ওপর ছড়িয়ে আছে আমার চুরি করা সমস্ত সামগ্রী। কথা বললো আমার ছেলে, “বাবা একবার তাকিয়ে দেখ। এই জিনিসগুলো তোমার কাছ থেকে পাওয়া গেছে। আমরা দুজনেই পর পর বেশ কয়েক রাত তোমাকে লক্ষ্য করেছি এবং দুজনেই নিজেদের চোখে যা দেখেছি তা অবিশ্বাস্য। মার গয়নার বাক্সটা পর্যন্ত তুমি…..। তুমি একি করলে বাবা। তুমি বন্ধুদেরও বাদ দাওনি। তোমার বন্ধু ও ছাত্রীদের বাড়ি থেকে তাদের অজান্তে তুমি যা যা লুকিয়ে এনেছো সব আমি সবাইকে ফেরৎ দেবো কথা দিয়েছি। তোমার কলেজের বন্ধুরা পুলিশে যাচ্ছিল। মার অনুরোধে তাঁরা তোমাকে পুলিশের হাতে তুলে দেননি। আমরা কি করবো তুমিই বলো। বাড়ি থেকে বেরোনোর মুখ নেই আমাদের।” ডুকরে ডুকরে কাঁদছিল আমার স্ত্রী। এক সর্বহারার কান্না আমাকে যেন এক ঘোর থেকে টেনে বার করলো। ডাকু আমি দেখলাম এক ভয়াবহ সর্বনাশের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি আমি। বাইরের সুস্থ পৃথিবী আমাকে বর্জন করেছে। কয়েক দিন পড়ার ঘর থেকে আর বেরতে পারলাম না। খেতে ডাকতো কখন ছেলে, কখন স্ত্রী। ওদের সামনে যাওয়ার মুখ ছিল না আমার। গ্রহের ফেরে আমি একি করলাম!তোর কথা খুব মনে হতে লাগলো। কয়েক জনের কাছে সাবধানে ফোন করলাম তোর খোঁজ নিতে….কোন খোঁজ পেলাম না। কিন্তু আমার কাছে যে একটা চোরাই জিনিস রয়েই গেছে, সেটার খবর কেউ পায়নি। সেটা তোর কাছে রাখবো। আজ তোকে খুঁজে পেয়েছি। সবাই আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। এবার তুইও যাবি। এই প্যাকেটটা তোর কাছে রাখ ডাকু। বাড়ি গিয়ে খুলে দেখিস।” আমি নিতে আপত্তি করায় হঠাৎ উঠে দাঁড়ালো সুজন। দৌড়তে আরম্ভ করলো বারান্দার দিকে। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমার দিকে হাত তুলে বিদায় জানিয়ে লাফিয়ে পড়লো নীচে। সুজন, বলে চিৎকার করে ডাকলাম। একটা বীভৎস শব্দ শুধু কানে এলো।। বারান্দা থেকে অন্ধকার ভেদ করা সামান্য আলোয় যন্ত্রণায় ছটফট করা সুজনের দেহটা এক পলক দেখেছিলাম। কতো সময় কেটে গিয়েছিল জানিনা। দূর থেকে কার একটা ডাকে কষ্ট করে তাকালাম। ঝাপসা দৃষ্টিতে দেখলাম অনেকগুলো চোখ ঝুঁকে আমাকে দেখছে। আমি তাকাতেই সবাই চেঁচিয়ে উঠলো, “ডাক্তারবাবু… উনি তাকিয়েছেন।” ভীড়ের মধ্যে থেকে একজন চশমা পরা ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন আমার দিকে। এবার খেয়াল করলাম মাটিতে শুয়ে আছি। ডাক্তার ভদ্রলোক আমার পাল্স দেখলেন। হাত দুটো সোজা করে ওপরে তুলতে বললেন। চোখ দুটো পরীক্ষা করলেন ভাল করে। তারপরে জিজ্ঞেস করলেন, “কেমন লাগছে এখন?” বললাম, “ভাল।” যদিও মনে হলো মাথাটা খুব ভার হয়ে আছে। আমার স্ত্রী আমার হাতটা চেপে ধরলো…চোখে তার জল। অনেক প্রশ্ন মনে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল পাশে আমার ছেলে আর মেয়ে। মনে পড়ছে গতকালের ঘটনা। ছেলেকে কাছে ডেকে ফিস ফিস করে জিজ্ঞেস করলাম, “সুজনের কি খবর জানিস? কেমন আছে সুজন?” ছেলে বলল, “কে সুজন? তুমি কার কথা বলছো?” ভাল করে তাকিয়ে দেখলাম আমি একটা নির্মানাধীন বাড়ির সম্ভবতঃ দোতলার মেঝেতে শুয়ে আছি। যতদূর মনে পড়ে সুজনের ফ্ল্যাট ছিল পাঁচ তলার ওপরে আর সেটা Under construction ছিল না। ছেলেকে জিজ্ঞেস করলাম, “আমি কি এইখানেই শুয়েছিলাম?” উত্তর পেয়েছিলাম “হ্যাঁ”। আমাকে এই বাড়িতে কাজ করতে আসা মিস্ত্রিরা অজ্ঞান অবস্থায় সকালে আবিষ্কার করে। গত রাত্রের গোটা ঘটনার বিবরণ দিয়েছিলাম ডাক্তারের কাছে। আমার গল্প ডাক্তার বিশ্বাস করেনি। তাঁর ধারনা হয়েছিল কোন বন্ধুর পাল্লায় পড়ে ওই বাড়িতে সেই রাত্রের কোন নেশার আড্ডায় আমি একজন শরীক ছিলাম। তখনও ঘোর কাটেনি তাই সুজন নামে সেইদিন রাত্রের কোন সাকরেদকে খুঁজছিলাম। ছেলে, মেয়ে কেউই সুজনকে চিনতো না কিন্তু গল্প শুনেছে অনেক আমার কাছে। আমার স্ত্রীর সঙ্গে সুজনের অবশ্য আলাপ ছিল। তাদের পক্ষেও সুজনের গল্প বিশ্বাস করা কঠিন হয়েছিল। বাড়িতে ফিরে আমার ছেলে হঠাৎ একটা কাগজের মোড়ক আমার হাতে দিয়ে বললো, “এইটা তোমার মাথার কাছে পড়ে ছিল। কেউ খুলতে ভয় পাচ্ছিল। ”এই মোড়কটা আমার চেনা। কাল রাত্রে জোর করে সুজন তার শেষ চোরাই জিনিসটা আমার কাছে রেখে গেছে। মোড়কটা খুলতে এবার আমার কেমন অস্বস্তি লাগছে। খুলে ফেললাম মোড়ক। ভেতরের চোরাই জিনিসটি দেখে আমার চক্ষু স্থির। মলিন হয়ে যাওয়া ছোট্ট চামড়ার ছেঁড়া ব্যাগ থেকে উঁকি মারছে হংকং থেকে পঞ্চাশ বছর আগে দাদার আনা ছোট্ট সেই ক্লিক ক্যামেরা। কাগজের মোড়ক থেকে বেরিয়ে এলো সেই ব্যবহার করা ফিল্মের বাক্স। রাংতায় মোড়া আটটা ফিল্ম রোলে একটা স্যাঁতস্যাঁতে প্রাচীন গন্ধ। ক্যামেরাটা হাতে নিয়ে শাটার দিলাম। আশ্চর্য! ক্যামেরা বলল, “ক্লিক”। নিজের আগ্রহে আর একদিন নস্কর পাড়ায় গিয়ে, সুজনের খোঁজ করেছিলাম। জেনেছিলাম সুজন সেন নামে একজন ভদ্রলোক সস্ত্রীক তাঁর ছেলেকে নিয়ে যে বাড়িতে বছর পাঁচেক আগে থাকতেন সেই বাড়িটা ভাঙা পড়েছে। আর শোনা যায় সুজন সেন তাঁরই বাড়ির পাঁচতলার বারান্দা থেকে এক রাত্রে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেন, বেশ কয়েক বছর আগে। সেই জমিতেই এই নতুন ফ্ল্যাট বাড়িটা তৈরী হচ্ছে। এখন সুজন বোধহয় এই ভয়ঙ্কর প্রবৃত্তিমুক্ত। নস্কর পাড়ার হরি মন্দিরের আনাচে কানাচে, অশ্বত্থ গাছের ঝুরি নামা অন্ধকারে, দাড়ি মুখো যে লোকটিকে, মাঝে মাঝে শীতের সন্ধেবেলায়, মাফলারে সারা মুখ আর মাথা ঢেকে ঘুর ঘুর করতে দেখা যায়, সে যে সুজন সেন তা আমার থেকে ভাল কেউ জানেনা।  

মতামত

Please mention the "name of the article and the author" you would like to comment in the following box... Thank you.

bottom of page