top of page
সূচীপত্র
Saraswati3.jpg
জুন
২০২৫
srikrishna.jpg

প্রচ্ছদ - সুরজিৎ সিনহা ​

প্রচ্ছদঃ সুরজিত সিনহা

লেখক/লেখিকাবৃন্দ

পথশিশু
child.jpg

পথশিশু 

সঞ্জীব হালদার

শ্রীনগর, পূর্বপাড়া, কলকাতা

অনুগল্প

জুন ২০২৫ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

sanjib-halder.png

সোনারপুর প্লাটফর্মের টিকিট কাউন্টারের ধারে এক বছর তিন কি চারের শিশুকে রোজই দেখি মায়ের কোলে করে মার্বেলের মেঝেতে বসে আছে। শিশুটির মা নিত্যযাত্রীদের কাছ থেকে অর্থ সাহায্য সংগ্রহ করে। একদিন শিশুটি দেখি মায়ের পাশে বসে পাউরুটি ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে। দেখে মনে হল খিদে ও অপুষ্টিতে ভুগছে। আমি একটি বিস্কুটের প্যাকেট শিশুটির হাতে দিলাম। মাঝেমধ্যে যখনই এদিকে আসি ঐ শিশুটিকে ওখানেই দেখি মায়ের কোলে বসে আছে। আমিও তাকে প্রতিবার কোনও না কোনও খাবার কিনে দিয়ে যাই। সেবার দূর্গা পূজোয় আমার এক সহকর্মী শিশুটিকে নতুন জামা দিয়েছিল। এভাবে শিশুটির প্রতি কেমন যেন মায়া জন্মে গেল এক বছরের মধ্যে। আরও এক দুমাস পর হঠাৎ করে ঐ প্লাটফর্মের টিকিট কাউন্টারের ধারে কাছে শিশুটিকে আর দেখা গেল না। আমি আরও বার দুয়েক ঐ স্থানে আসলাম কিন্তু কোনও খোঁজ পেলাম না শিশুটির। আশপাশের দোকানীরাও কোনও খোঁজ দিতে পারল না। একরাতে দুঃস্বপ্নে দেখি প্লাটফর্মের অদূরেই এক পার্কের পাশের রাস্তায় শিশুটি না খেতে পেয়ে মারা গেছে। আমি ঘুমের

মধ্যে চেঁচিয়ে উঠি, “অসম্ভব।” বছর দুই ঐ প্লাটফর্মে আমার যাওয়া হয়ে ওঠে না। একদিন আমার ঐ সহকর্মীর আমন্ত্রণে আবার সোনারপুর যাওয়া হল। সেই টিকিট কাউন্টারের ধারে নতুন এক শিশু ও তার মা বসে আছে ভিক্ষা সংগ্রহের উদ্দেশ্যে। আমি একটি পাঁচ টাকার কয়েন নিয়ে যখনই হাত বাড়িয়ে দিতে যাব তখনই ছেঁড়া প্যান্ট পরা খালি পায়ে বছর ছয়েকের এক ছেলে এসে আমার হাতটা ধরে বলল, "কাকু ভালো আছো?”
“অনেকদিন পরে এলে? আমায় বিস্কুট দেবে না?"
আমি হতভম্ব হয়ে মৃদু কন্ঠে বললাম,
"তুই কি করে জানলি আমি বিস্কুট দেবো?" ছেলেটি শুধু বলল,  “আমি  জানি।”  আমি  জিজ্ঞাসা করলাম, “তুই কোথায় থাকিস?” সে  বলল,

“ঐ যে পার্কের  ধারে ঝুপড়িতে থাকি কাকু।" 
আমি বিষণ্ণমনে চেয়ে রইলাম প্লাটফর্মের গাড়িটার দিকে। ছেলেটি কখন যেন চলে গেছে। আমাদের দেশে এরকম পথশিশু অনেক আছে।

কবিতা: সৌভিক দাস

কবিতা
সৌভিক দাস

সাউথ গড়িয়া, বারুইপুর

এমন যদি হতো, আমি পাখির মতোন 


মন যদি হতো, আমি পাখির মতোন,
নীল আকাশে ভাসতাম, মেঘের স্বপ্নে গাথা মন।
দিগন্ত পেরিয়ে উড়ে যেতাম দূরে,
যেখানে দুঃখ নেই, নেই কোনো সুরে।

ডানা মেলে ঘুরতাম প্রান্তরের তীরে,
সাগরের গর্জন শুনতাম সুখের নীরে।
কেউ না থামাতো, কেউ না ডাকতো ফিরে,
স্বাধীনতায় ভাসতাম দিগন্তের সীমানা চিরে।

পাহাড়ের চূড়ায়, সবুজ বনানীতে,
ঘুড়তাম একা, মিশে যেতাম প্রকৃতির প্রাণীতে।
কোনো অভিমান, কোনো বাঁধন না থাকতো,
মুক্তির ডানায় আমি আকাশ ছুঁতে পারতাম।

কিন্তু আমি তো মানুষ, পাখি নই হায়,
দুঃখের বাঁধনে হৃদয় জড়ায়।
তবু স্বপ্ন দেখি, যদি একদিন পাই,
পাখির মতোন স্বাধীনতা, আকাশ হবে আমার ঠিকানাই

জুন ২০২৫ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

কবিতাঃ পার্থ সরকার

অনর্থক শব্দে বধির বাঁশি

তিন পয়সার উৎসব 

 

সরে গেছে 

পিছলে যাওয়ার দিনের ক্ষত 

বনিবনা নেই অক্ষত পরিচয়ের 

দারিদ্র্যের সাথে 

দুরন্ত ভুবনে মহিমাময় সাম্যভাব...! 

 

এক প্রস্থ দখিনা বাতাস ছিল 

যখন মগজ বারুদ ঠাসা  আর 

নদী-নালা-স্থলপথে...    

শৌখিন তেমন কিছু নয় 

একটা একতারার মতো 

সাদা ভাত আর একটু তরকারি... 

আর ভবিতব্য কে বলতে পারে ?  

 

উৎসব তিন পয়সার 

আর সরে গেছে যাবতীয় ঝড়ের সূত্র 

 

দেখার কোন বনিবনা নেই 

সাত সমুদ্র তেরো নদী পারে । 

কবিতা

পার্থ সরকার

অদ্ভত নির্জীবতা বন্ধুমহলে 

দ্ভুত নির্জীবতা 

উথলে ওঠে 

বন্ধুমহলে 

সদলবলে হাজির 

খৈনী মুখে দুর্গন্ধ 

অকাতরে উড়ে যায় পোশাক 

ক্লান্ত স্নায়ু 

সাদা স্রাব 

নির্বাচনী প্রচারে ফিনাইল 

মেতে ওঠে হাড়ভাঙা স্লোগান 

ভাইয়ের ঘাড়ে ভাইয়ের নখ 

তামাশা দেখে দুর্গন্ধ 

 

অদ্ভত ভ্রাতৃত্ব বন্ধুমহলে 

দলে দলে তুলে নেয় ক্ষুধা পাষণ্ড 

 

কোন পথে 

ঘাড়ভাঙা সহমরণ 

বলতে পারে না 

ভণ্ড তপস্বী ।

touch.jpg

ফেব্রুয়ারী ২০২৫ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

কবিতা

রাহুল রাজ 
ঢাকা, বাংলাদেশ

কিছুই হবে না পৃথিবীর

তোমার আমার মিলন না হলে কিছুই হবে না পৃথিবীর
দুঃখগুলো পুশে রেখে বুকে, দোষ দেব সব নিয়তির।

বুকের ভেতর স্মৃতিগুলো সব যত্নে রাখবো জমা
কিছুই হবে না এই সমাজের, যদি না করি ক্ষমা।

হাজার প্রেম র‌োজ ভেঙে, চাপা পড়ে ইতিহাসে
কত যুগলের মন ভারি হয় হতাশার নিঃশ্বাসে।

তোমার আমার মায়ার টান আবেগের সুতোয় বাঁধা
আমাদের প্রেম আমরা বুঝি, পৃথিবীর কাছে ধাঁধা।

প্রেম নদীর উল্টো স্রোতে দু’জনের দুই তীর-
তোমার আমার মিলন না হলে কিছুই হবে না পৃথিবীর।

কবিতাঃ রাহুল রাজ
village3.jpg

ফেব্রুয়ারী ২০২৫ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

maple_edited.jpg
কবিতাঃ রথীন্দ্রনাথ বড়াল

আজ সেই বারান্দায়—হোয়াটস্‌ অ্যাপের প্রোফাইল পিক্‌চারের ভীড়। 

কিংবা রবিঠাকুরকে সাথে নিয়ে সেলফি।

আছে এফ.এম.র বাণিজ্যিক পদচারণা

কিছু লোক তো বলে গেছেন—তিনিই বাঙালীর মেরা ইণ্ডাস্ট্রি।

সেই পরিধি বাড়ছে, তোমার ১৫৬ বছরেও।

ছবির ফ্রেম-এ রবিঠাকুরকে বন্দী করে,

গীতবিতান কিংবা গীতাঞ্জলীর সস্তা (সুলভ) সংস্করণে।

কিংবা ২৫শে বৈশাখের কবিতা পোস্টারে।

তুমি এসেছিলে—তাই তোমাকে নিয়ে বেশ আছি

ভালো থাকতাম, চারিদিক সুন্দর রাখতাম—

যদি তোমাকে একটু বোঝার চেষ্টা করতাম।

হে রবিঠাকুর—তুমি আছ ভীষণভাবে—

তাইতো চাক্ষুষ করতে জোড়াসাঁকো যাওয়া।

জোড়াসাঁকো থেকে ফিরে

 

হুদিনের সাধ পূর্ণ করে কবির আবাসে রবির জন্মদিনে।

সেই ঘর, আরাম কেদারা কিংবা দখিনের বারান্দা—সবই আছে।

আছে ছেলেবেলার রবি।

আছে বাল্মীকি প্রতিভার রবীন্দ্র কিংবা গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের জোব্বা পরা পদধ্বনি। 

ওই মহীরুহের ছায়ায় নিতান্ত অপরিসর মনে হয় এই অট্টালিকাকে। বরং—

বোলপুরের বিস্তীর্ণ প্রান্তর অনেক বেশী মানানসই, জোড়াসাঁকো থেকে শান্তিনিকেতন।

কবির প্রাণের আরাম।

জোড়াসাঁকোর সিঁড়ির বাঁকে বহু আনাগোনা—

অনুচ্চারিত স্বর—জ্যোতিদাদা কোথায় চললে?

গরমের সন্ধ্যায় যেখানে বাতাস সেবন,

কিংবা শীতে মিঠে রোদ পোহানো;

কবিতা

রথীন্দ্রনাথ বড়াল

ডঃ নগেন ঘোষ লেন, কলকাতা 

ফেব্রুয়ারী ২০২৫ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

himadri2.jpg
কবিতাঃ এহিয়া আহমেদ

কবিতা

এহিয়া আহমেদ

বরথল কছারী গাঁও, মৈরাবারী, মরিগাঁও, অসম

আমরা একটা পাথর

 

মরা নির্যাতিত, নিপীড়িত,

লাঞ্চিত-বঞ্চিত এবং শোষিত 

নিস্তব্ধ আমরা, 

আমরা ধৈর্য্যশীল, কর্মশীল,

শত বছর পেরিয়েও রয়েছি চুপ, থেমেছি চুপচাপ,

 

কেউ ছুঁয়ে যায়, কেউ এড়িয়ে যায়,

কেউ ভাঙতে চায়, কেউ গড়তে চায়।

আমাদের বুকে লেগে থাকে সময়ের ধুলো,

আলোর উষ্ণতায় ছাপ রেখে যায় দিন।

 

মেঘের ফোঁটা, বৃষ্টির রেণু—

আমাদের শরীরের ওপরে রেখে যায় চিহ্ন।

আমরা জেগে থাকি পাহাড়ে, নদীর পাশে,

 

আমরা ভাঙি ধীরে, তবু টিকে থাকি,

আমরা পাথর—শতাব্দীর সাক্ষী,

আমরা স্থিরতার প্রতীক, এক অনন্ত আঁচল।

ফেব্রুয়ারী ২০২৫ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

 কবিতাঃ দেবার্ঘ্য মুখার্জী

দুগগা মাইকি

শ্বিনের এই শারদপ্রাতে
পড়াশোনা সব উঠল লাটে
মা দুর্গার আশীর্বাদে সবাই খুশি আজ
খিচুড়ি লাবড়া মিষ্টিমুখ, নেই কিছুই কাজ
পাঞ্জাবি ও ধুতিপরা ছেলেরা সব হিরো,
পাড়ার কর্তারা বলছে ডাঁটে--
যা-যা, আজকে তোরা জিরো।

শাড়িপরা মেয়েরা হাঁটে, যেন র‍্যাম্পের ধাঁচে,
বন্ধুর সাথে রাতভর আড্ডা, বাড়ি ফিরে হাঁচে
সন্ধ্যা-আলোর আলপনাতে, সবাই খুশি আজ
চপ-ফুচকার লম্বা লাইন, নেই তো ক'দিন কাজ
দেখতে দেখতে এল দশমী, সিঁদুর খেলায় মাতি
রাতদুপুরে দুগগা মাইকি-- দিনটা ফাটাফাটি!

দুর্গাপুজো এমনই তো, আনন্দে আত্মহারা
আবার অপেক্ষা, পরের বছর হবই পাগলপারা।

কবিতা

দেবার্ঘ্য মুখার্জী

উৎসব সব শেষ, তাই পড়ার বোঝা বেশ

ৎসবের সব দিনগুলো শেষ, খুশিতে মোড়া ক্ষণ,
দুর্গাপুজো, কালীপুজো একে একে সবই হলো নিস্প্রাণ।
প্যান্ডেল ঘোরা, আলোর ঝলক সবাই নিলো বিদায়,
এখন শুধু বইখাতা আর পড়ার বোঝা মাথায়।

দুর্গা গেলো কৈলাশেতে, মা কালী তার মন্দিরে,
তাই আমাদের জীবন আবার বইয়ের পাতার ভিড়ে।
সামনে আবার টেস্ট পরীক্ষা, শত চিন্তার জাল,
উৎসব শেষে পড়তে বসা! এতো কাঁচা মরিচের ঝাল!

কদিন আগেও চারিদিকে পুজো পুজো গন্ধ
এখন বইয়ের পাতা দেখে মনটা লাগে দম বন্ধ।
মা বলছেন, আর পড়বি কবে  সময় এতো কম,"
আমার মাথায় ঘুরছে শুধু পুজোর গান আর ঢাকের দমাদম!

বন্ধুরাও সব হতাশ মুখে,
দিনগুলো সব, কাটবে দুখে।
উৎসব শেষ তাই পড়াই বাকি, সময়টা নিদারুণ,
সাদা পাতায় অঙ্ক কষ যোগ বিয়োগ আর গুণ

subho-bijaya_edited.jpg

ফেব্রুয়ারী ২০২৫ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

কবিতাঃ যশ চক্রবর্তী

চল যাই ২০২৫-এ 

সেখানে যেতে চাস কিনা বল

যেখানে টপ্পা খেয়াল করে ঠুকোঠুকি

স্নানঘরে গান করে মুখোমুখি

চল, সব কিছু ফুরোবার আগে চল

সেখানে যেতে চাস কিনা বল

যেখানে জলের সাথে জলের থাকাথাকি

জীবন ছুঁয়ে জীবন পাকাপাকি

চল, সব কিছু ফুরোবার আগে চল

সেখানে যেতে চাস কিনা বল

যেখানে ঝিম মেরে ঘুম আসে ভুল করে

সময়ের থেকে ঘোড়া ছোটে খুব জোরে

চল, সব কিছু ফুরোবার আগে চল

সেখানে যেতে চাস কিনা বল

যেখানে আকাশের গা থেকে আঁধার বিদায়

নিমেষেই ভালো কিছু পাশে এসে যায়

চল, সব কিছু ফুরোবার আগে চল

চল, সব কিছু ফুরোবার আগে চল

ইশতেহারে বৃষ্টি নামুক শান্তি অনর্গল

birds.jpg

কবিতা

যশ চক্রবর্তী 

শিকাগো, ইলিনয় 

jash.jpg

ফেব্রুয়ারী ২০২৫ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

রূপোর সরস্বতী

ছোট গল্প

রূপোর 

সরস্বতী 

বর্ণালী ঘোষদস্তিদার

banglow.jpg

ফেব্রুয়ারী ২০২৫ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

গুণমনি কাঁড়ার জোরসে বাইক ছুটিয়ে বাড়ির সামনে এসে তীক্ষ্ণস্বরে একটা হর্ন মেরে দাঁড়ালো। গুণমনির গিন্নি পুঁটুরানি তো অবাক! এইসময় তার পতিদেব সাধারণত ফেরে না! কিন্তু আজ এসেছে। নিশ্চয়ই কোন কারণ আছে পুঁটু ভাবে।
আজ সকালবেলায় শো কেসে অনেক দিনের  জমে থাকা পুরোনো আবর্জনা পরিষ্কার করে গেছিল গুণমনি।  আধভাঙা  রংচটা  কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুলগুলো মা বেঁচে থাকতে ফেলতে পারতো না। এখন নির্দ্বিধায় সরিয়ে দিয়ে সাফ করে দিল জঞ্জাল। খানিক খালি হলো শো-কেস। নতুন কিছু আসবে বোধহয়। ঠাঁই পাবে শূন্য জায়গায়। কিন্তু বস্তুটি কি সে সম্পর্কে পুঁটির কাছে কিছুই ভাঙেনি গুণমনি। 

আজকাল ইশকুলের পঠনপাঠন সেরে হর দিনই গুণমনিকে গভর্নিং বডির কেষ্টবিষ্টু থেকে শুরু করে এলাকার পঞ্চায়েত লিডার এমএলএ দের বাড়ি ধর্না দিতে হয়। এই করেই আলিশান বাংলো বানিয়েছে গুণমনি। দাদা পরশমণি চাষবাস নিয়ে ব্যস্ত। ছোটভাই রতনমণি কলেজে পড়ছে। মেজো গুণমনিই বৈষয়িক ব্যাপারে খুব চৌকস। ইশকুল মাস্টারি একটা জুটিয়েছে সে। কিন্তু তাতে  কতোই বা আয় হয়। তাছাড়া ক্লাস ফোর পাশ nগুণমনির তো চাকরিই হয়েছিল চিরকূট দেখে। সে আজ প্রায় দশবছর হলো। 

পুঁটির সঙ্গে রামবাবুদের আমবাগানে এক ভর গ্রীষ্মের দুপুরবেলায় ফষ্টিনষ্টি করতে গিয়ে দাদাদের হাতে বেবাক ধরা পড়ে গেছিল গুণমনি আর পুঁটু। ব্যস পুঁটুর দাদারা এলাকার সব বড়ো বড়ো মাতব্বর…..বললো “আমার বুনের ইজ্জত লুট করেছিস ওকে বিয়ে করতে হবে তোকে। নাহলে দেবো তোকে ফাঁসিয়ে।”
গুণমনির তো ভয়ে হাত-পা পেটের ভেতর সেঁধিয়ে যাবার যোগাড়।nকাঁচুমাচু মুখ করে দাদাদের পায়ে পড়লো গুণমনি “পুঁটুকে বিয়ে করতে আমার তো কোনো অসুবিধা নেই কিন্তু পুঁটুকে ঘরে তুলবো সে রেস্ত আমার কই?”
বছর দুই আগে বাপ মারা যাবার পরই পুঁটুর দুই দাদা ঘনশ্যাম আর রাধেশ্যাম ভাবছিল বোনটাকে কি করে পার করা যায়। খাবার পেট একটা কমে। 
পুঁটুও ইশকুল যেতো রোজ। কৃষ্ণভামিনী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়। দু’একবার ফেল করলেও টেনেটুনে ক্লাস নাইন অবধি উঠেছিল। কন্যাশ্রী পেলো। কিন্তু এখন আর লেখাপড়ায় মন বসে না। ইশকুলের পথেই পরিচয় গুণমনির সঙ্গে। মেয়ে ইশকুলের সামনে অনেক ছেলের ভীড়ে গুণমনিও ঝাড়ি মারতো। ভীড় জমাতো আরও অনেক জোয়ান মদ্দ। কারো বোন পড়ে কারো বা দিদি। গুণমনিরও কেউ হয়তো পড়ে কৃষ্ণভামিনীতে। সেই সুবাদে গুণমনির রোজ ইশকুলে যাতায়াত। 
অনেক মেয়ের ভীড়ে পুঁটুরানিকেই খুঁজতো গুণমনির চোখ। ঠোঁটের কোণে চিলতে হাসি ফুটিয়ে চোখের ইশারায় কিছু বলতে চাইতো ওর মন। শেষমেশ সত্যিই একদিন পুঁটু মন দিয়ে বসলো গুণমনিকে। আসলে পুঁটুর মনও আশ্রয় চাইছিল। বাবা থাকতে বোনের ওপর দাদাদের হম্বিতম্বি তেমন টিঁকতো না। কিন্তু বাবা গত হবার পর পুঁটির ওপর দাদাদের খবরদারি বড্ড বেড়ে গেল। সব্বসময় চোখে চোখে কড়া নজরদারি। পুঁটু কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে মিশছে, সব বিষয়ে তাদের কৌতূহল। 
দুই দাদাই দিনরাত হাঁকায় “বাবা মরে গেচে বলে ভাবিস না যে তুই খুব স্বাধীন হয়ে গেচিস। যখন-তখন যা খুশি করবি। এখন আমরাই তোর গার্জেন। আমাদের কথার বেচাল হলে না মজা দেখিয়ে ছাড়বো।”
দাদাদের অতিশাসনে হাঁপিয়ে উঠেছিল পুঁটি। দাদারা কি সত্যিই তার গার্জেন? না পুলিশ-দারোগা? মা কেও দেখে পুঁটি দাদাদের দাপটে কেমন সিঁটিয়ে থাকে সদ্যবিধবা মানুষটা। কথায় কথায় মা র ওপর চোটপাট করে। যেন এই বাড়িটাকে এই পরিবারটাকে কিনে রেখেছে দুজন ষন্ডাগন্ডা পুরুষমানুষ। 
গুণমনি আড়ালে দিনরাত বলে “তোমাকে পেয়ে আমি ত্রিভুবন ভুলে গেছি পুঁটি। কবে যে তোমাকে আমার ঘরে আমার ইস্তিরি করে নিয়ে গিয়ে তুলবো? তোমাকে কোনো কষ্ট পেতে দেবো না পুঁটুরানি দেখো। তুমি রাজরাজেশ্বরী  হয়ে মহা আরামে থাকবে আমার বাড়িতে।”
এসব কথা পুঁটুর কানে গুণমনি বলে বটে কিন্তু তার সে ক্ষমতা কোথায়? পুঁটুরানির জীবনের দায়িত্ব নেবে এমন আর্থিক সামর্থ্য নেই গুণমনির। না আছে স্থায়ী চাকরি না ব্যবসাপাতির আয়। 
পুঁটু কিন্তু নড়বার নয়। সম্পূর্ণ মনটাই সে দিয়ে বসেছে গুণমনিকে। বেশ জোর গলাতেই জানিয়ে দিয়েছে দাদাদের, গুণমনি কাঁড়ার ছাড়া কাউকেই সে বিয়ে করবে না। আইবুড়ো হয়ে থাকবে সারাজীবন তবু গুণমনি ছাড়া কারুর গলাতেই মালা দেবে না। তাকে এই স্পষ্ট কথা বলার সাহস জুগিয়েছে গুণমনিই। তার গলায় ব্যক্তিত্বের জোরালো আওয়াজ উঠেছে গুণমনিরই গুণে। 
কিন্তু গুণমনি যে পুঁটুকে ঘরের বৌ করে নিয়ে যাবে….তার পায়ের তলার মাটিটাই তো শক্ত নয়। নড়বড়ে। এখান-ওখান পার্টির খিদমত খেটে কিছু পয়সাকড়ি কখনও আসে কখনও কিছুই না। পেটে বিদ্যেও তেমন নেই যে ভদ্রলোকের মতো চাকরি-বাকরি একখানা জোটাবে। ক্লাস ফাইভ অবধি পড়ে ছেড়ে দিয়েছিল। তবে পার্টিতে বাধ্য অনুগত ছেলে হিসেবে কদর আছে তার। ভোটের সময় মাটি কামড়ে পড়ে থেকে টার্মের পর টার্ম দলকে জেতানো তো আছেই এছাড়াও কতো যে কাজ……..পাড়ায় অশান্তি লাগলে পুলিশ বা সরকারি জনপ্রতিনিধি সেখানে পৌঁছোনোর আগেই চলে গিয়ে বিবাদ-বিসম্বাদের মীমাংসা করা,হাট-বাজারে সওদাকারিদের কাছ থেকে তোলা আদায় করে দলের ফান্ডে পৌঁছে দেওয়া, দরকারে - অদরকারে দাদাদের হুকুম তামিল করা, এমন নানা কাজে একদম আয় হয়না তা নয় কিন্তু সেসব খুবই অনিয়মিত অনিশ্চিত। বিয়ে-থা করে সংসার ফেঁদে বসলে তো এরকম করে চলবে না। ফিক্সড ইনকাম কিছু থাকতেই হবে। এছাড়া দলের এটা সেটা করে বাড়তি রোজগার সে তো আছেই। 
দলের যে মাতব্বর দাদার ফরমাস খাটে গুণমনি,তাঁর শিক্ষা দপ্তরে খুব জানাশোনা। খোদ মন্ত্রীর সঙ্গে অষ্টপ্রহর ওঠাবসা। তাঁর অনুগ্রহেই সরকারি প্রাইমারি ইশকুলে হঠাৎই একটা চাকরির অফার পেয়ে গেল গুণমনি। মাস্টারের পদে চাকরি। মাস গেলে ভালো বেতন। বিনিময়ে পার্টি ফান্ডে দিতে হবে দশলাখ টাকা। 
পুঁটুকে বললো গুণমনি। পুঁটুই পরামর্শ দিল “তোমার ভাগের কিছু জমি বেচে ওই টাকা দিয়ে দিয়ে চাকরিটা নিয়ে নাও। মাস্টারদের এখনও কতো সম্মান সমাজে।” 
আসলে বাবা মারা যাবার পর দাদাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ পুঁটু মাঝেমাঝেই ভাবতো, যদি একটা চাকরি-বাকরি করে নিজের পায়ে দাঁড়ানো যায় তো দাদাদের নাকে ঝামা ঘষে দেবে। মা কে সঙ্গে নিয়ে সে আলাদা হয়ে যাবে দাদাদের সংসার থেকে। কিন্তু যতো উঁচু ক্লাসে উঠতে লাগলো পড়াশুনো কঠিন হোল। বন্ধু-বান্ধবরা টিউটরের কাছে পড়ে। সে উপায় পুঁটুর নেই। ওদিকে ততদিনে জৈবিক নিয়মে তার জীবনে এসে পড়েছে গুণমনির আহ্বান। সব মিলিয়ে নিজের জীবনে স্বনির্ভর হবার স্বপ্ন একসময় মিলিয়ে গেল পুঁটুর। সে গুণমনির স্বপ্নেই বিভোর হয়ে গেল। 

জমি বেচে লাখদশেক টাকা পার্টি ফান্ডে দিয়ে ইশকুল মাস্টারির চাকরিটা পেয়ে গেল গুণমনি। আর সরকারের ঘর থেকে অন্যান্য টিচারদের মতোই  তার নামেও বেতন আসতে লাগলো।  
বছর না ঘুরতেই পুঁটুর দাদাদের কাছে বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে বললো গুণমনি 

“পুঁটুরানিকে আমি ভালোবাসি। সেও ভালোবাসে আমায়। আমরা বিয়ে করতে চাই।”রাধেশ্যাম ঘনশ্যামও দেখলো এই মওকা। বাপমরা মেয়েটাকে ইশকুল টিচার পাত্রের হাতে তুলে দিতে পারলে বোনটাকে পার করাও হবে। পাড়াপড়শিও ধন্যধন্য করবে। ঠিক তাইই হলো। শেষমেশ চাকরির জোরেই পুঁটুরানিকে অত্যাচারী দাদাদের খপ্পর থেকে উদ্ধার করে  বিয়ে করে ঘরে তুললো গুণমনি। তার মনে হোল পুঁটু বড়ো পয়মন্তি। তার পয়েই এই সরকারি চাকরি। পরিবারে এমনিই গুণমনির কদরটা একটু বেশিই ছিল। আনপড় চাষাভুসো বাড়ির ছেলের সামাজিক পরিচয় এখন ইশকুল মাস্টার। সেই সুবাদে পুঁটুরও  কদর খানিক বেড়ে গেল। গুণমনি আর পুঁটু মহানন্দে সংসার করতে লাগলো। বাবা গত হতে বাবার কেনা জমির অংশ প্রমোটারকে দিয়ে বেশ কিছু টাকার মালিকও হলো গুণমনি। বাড়লো ব্যাংক ব্যালান্স। ফিরিতে ফ্ল্যাটও পেলো একখানা। পৈতৃক বাড়িটাকে সংস্কার করে হালফ্যাশনের বাংলোবাড়ি বানালো। একখানা গাড়িও কিনেছে গুণমনি। তবে বেশিরভাগ সময় সে বাইকই চড়ে। ইশকুলে যাতায়াত করে ওই মোটরবাইকটিতেই। পালিশ করা চকচকে  শরীরটায় সাফারিসুট - বুট পরে সে যখন বাইক হাঁকিয়ে যায় পুঁটুরানির মনটা ভরে ওঠে। তার মন বলে, কথা রেখেছে গুণমনি। তাকে সত্যিই রাজরানি করে রেখেছে। কিন্তু এর মধ্যে একদিন এমন একটা ঘটনা ঘটলো যাতে স্বামী গুণমনির কান্ডে বেশ লজ্জাই পেল পুঁটু। ক্লাস সিক্সের একজন ছাত্র গুণমনি স্যারকে একটা অঙ্কের প্রসেস জিগ্যেস করেছিল…….গুণমনি তো ক্লাস সিক্স পাশই করেনি, কি করে অঙ্ক নিজে কষবে? ছাত্রকে শেখাবেই বা কেমন করে? শুধু সেই

মুহূর্তে ছাত্রটার পাকামি দেখে মাথাটা গরম হয়ে গিয়েছিল। ছাত্রটাকে আচ্ছা করে পিটিয়ে অঙ্ক শেখার শখ মিটিয়ে দিয়েছিল গুণমনি। সে খবর টিভিতে দেখেছে সবাই। সোশ্যাল মিডিয়াতেও ভাইরাল হয়ে গেছে। রাতের বিছানায় গুণমনির লোমশ বুকে হাত রেখে পুঁটু জিগ্যেস করলো “তুমি তো মাস্টারমশাই। ছেলেটা অঙ্ক জিগ্যেস করলো তুমি তাকে মারলে কেন? শিখিয়ে কেন দিলে না?"
গুণমনি অস্বস্তিতে পড়ে জবাব দিল “ওসব বাজে খবর। ভুল খবর। ওসব বিশ্বাস কোরো না।”
“কিন্তু টিভিতে যে দেখালো। মোবাইলেও ফুটলো…ওই তো তোমার বুলু সাদা জামাটা তো দেখাও গেল…..”।
“আরে পুঁটু ও অন্য লোক। আমি কখনও এ কাজ কত্তে পারি?” 
পুঁটু চুপ করে রইল। মিডিয়া নাম বলে নি কিন্তু ছবি দেখিয়েছে। একটু আবছা কিন্তু বেশ বোঝা গেছিল যে ওটা গুণমনি। ঘটনা ঘটেছে অঘোরনাথ ইন্সটিট্যুশনে। ওখানেই মাস্টারি করে গুণমনি। পার্টির ক্ষমতাশালী দাদার দৌলতে পাওয়া চাকরি। পুঁটুর খারাপ লেগেছিল খুব। ছেলেটাকে না মেরে অঙ্কটা টুকে নিয়ে বাড়িতে এলে পুঁটুও একটু চেষ্টা করে দেখতে পারতো কষা যায় কি না……কিন্তু পুঁটুর এখন করণীয়ই বা কি? সোমত্ত বোনের ওপর দাদাদের উদয়াস্ত গা জোয়ারির অসময়েই গুণমনি তাকে বিয়ে করে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে ঘরে তুলেছিল। সেই স্বামীর সঙ্গে বেইমানি সে করবে কেমন করে?  তাছাড়া এরকম একটু-আধটু তো হতেই পারে। ওই ইশকুলে মাস্টারি করেই তো মাস গেলে মোটা টাকা বেতন ঘরে আনে গুণমনি। তাতেই তো সংসারের যাবতীয় শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে। আগের মতো চাল নেই চুলো নেই বাউন্ডুলে হয়ে থাকলে থাকতো নাকি পুঁটুর এতো সুখ?
“কি? কি আবার ভাবতে শুরু করলে আমার পুঁটুরানি? এখন এসো তো আমার কাছে…….বলেই সবল বাহু দিয়ে গুণমনি চওড়া বুকের ওমে টেনে নেয় পুঁটুরানিকে। আদরে আদরে ভুলিয়ে দেয় সব সংশয় সন্দেহ মনের খটকা। 
এভাবেই বেশ চলছিল গুণমনি আর পুঁটুর সুখী দাম্পত্য। কিন্তু শুধু এইটুকুতেই কি মন ভরে? আর্থিক সাচ্ছল্য এসেছে অনেক। কিন্তু বড়ো পদে থাকতে না পারলে সামাজিক সম্মান তেমন জোটে না। দলের লোকদের পদিয়ে পটিয়ে খানিক কাঠখড় পুড়িয়ে ইশকুলের গভর্নিং বডির সদস্যপদ পেলো গুণমনি। হোমরাচোমরা না হলে কি লোকে মান্যিগন্যি করে? এখন এই পদের জোরেই গুণমনির জুটবে নানা উপহার, উত্তরীয়, পুষ্পস্তবক। এখান-ওখান বক্তৃতা দেবার আমন্ত্রণ। অন্য শিক্ষকরা নিজেদের স্বার্থ মেটাতে পায়ে গিয়ে পড়বে তার। সে রাজনৈতিক নেতাদের মতো ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ঝুলিয়ে বলবে “খুব চেষ্টা করছি। যতো তাড়াতাড়ি পারি আপনার ফাইলটা কমপ্লিট করে দেব।” তারপর ফাইল ফেলে রেখে দেবে মাসের পর মাস। যারা উদয়াস্ত তাকে তেল দেবে, টু-পাইস ঘুস দেবে শুধু তাদেরই ফাইল নেড়েচেড়ে দেখবে গুণমনি। 

দেখতে দেখতে দলের যোগাযোগ কাজে লাগিয়ে বহু উদ্দেশ্যই সাধন হলো গুণমনির। শুধু সমস্যা ইশকুলের হেডমিস্ট্রেস ওই চপলা মুখার্জি? তাঁকে নিয়ে বেজায় ঝামেলায় থাকে গুণমনি। একনম্বর টেটিয়া মহিলা। প্রতিটা কাজ এক্কেবারে নিয়ম মেনে কড়া আইন ফলো করে নিখুঁত করে করবেন উনি। গুণমনি ভাবে এই মহিলাকে একবার হাত করতে পারলে সব সমস্যা মিটে যেতো। কিন্তু মহিলা মেয়ে তো নয় যেন নিরেট শক্ত বাদাম। ভাঙা অসম্ভব। শুধু তাই নয়, চতুর্দিকের অগোছালো এলোমেলো ঢালাও দুর্নীতি আর অসততার মধ্যে থেকেও উনি কি করে যেন নিজেকে রাজহাঁসের ডানার মতো নিষ্কলঙ্ক রেখেছেন, নিজের হাত এতোটুকুও ময়লা করেননি সেটা খুবই বিস্ময়ের। টাকাকড়ির লোভ, পদের মোহ, এসব প্রলোভন জয় করা কি এতোই সহজ? গুণমনি মাঝে মাঝে অবাক হয়ে ভাবে। চপলা দেবীর সততার শক্তির কাছে বারবার গো-হারান হেরে যেতে হয় গুণমনিকে।

একশো বছরের পুরোনো অঘোরনাথ ইনস্টিট্যুশনের নতুন বিল্ডিং হয়েছে। নাম “অঘোরনাথ শতবার্ষিকী ভবন”। অঘোরনাথ সেন ছিলেন এই এলাকার একজন বিদ্যোৎসাহী মানুষ। ধনী ও সমাজহিতৈষী। একশো বছর আগে তাঁরই নির্দেশে বসতবাটিটির একাংশে তৈরি হয় এই ইশকুল। শুরু হয়েছিল প্রাথমিক বিদ্যালয় দিয়ে। এখন এলাকার অন্যতম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। শতবর্ষের দীর্ঘ পথ অতিক্রম করার পর এর একটি বিশেষ ভবন তৈরি হয়েছে। স্থানীয় এমএলএ দ্বারোদ্ঘাটন করবেন। এমনিতে সম্বৎসর বিভিন্ন কমিটি বিভিন্ন কাজ নিজেদের দায়িত্বে চালায়। কিন্তু এ বাদেও চপলা দেবী ইশকুলের যে কোনো বড়ো কাজের আগে মিটিং ডাকেন। সবাইকে নিয়ে বসে বিভিন্ন কাজের দায়িত্ব ভাগ করে দেন। এবারও তার অন্যথা হলো না। অতিথি অভ্যাগতদের বরণ করার জন্য কিছু উপহার প্রদান প্রয়োজন। এমনিতে শতবর্ষ নামাঙ্কিত মেমেন্টো, উত্তরীয়, একটি করে চারাগাছ আর মিষ্টান্নর ব্যবস্থা তো করাই হয়েছে। এর সঙ্গে একটি সুন্দর উপহার দিলে মন্দ হয় না। সভায় সবাই একমত হয়। কিন্তু কি সেই উপহার? “কলকাতার এক নামকরা দোকানে পাওয়া যায় রূপোর সরস্বতী। শতবর্ষপ্রাচীন ইশকুলে সমাগত অতিথিবর্গকে এমন একটা মহার্ঘ্য উপহার এই যেমন একটা রূপোর সরস্বতী  দিলে কেমন হয়?” গুণমনি প্রস্তাবটি দেয়। 
“এর দাম কতো গুণমনিবাবু? কোনো আইডিয়া আছে আপনার?” চপলা দেবী প্রশ্ন করেন।
“দুহাজারের মতো হবে আন্দাজ” গুণমনি জবাব দেয়। 
“বাবা তাহলে তো দাম ভালোই। কখানা কিনতে হবে আমাদের? এমএলএ সাহেবের জন্য একটি বাইরের একাডেমিক অতিথি দুজনের জন্য দুটি ,আর একটি এক্সট্রা তিন চারটি কিনলেই তো হবে না কি?” চপলা দেবী বলেন। 
“না মানে আমি বলছিলাম মঞ্চে তো পরিচালন সমিতির সদস্যরাও থাকবেন…..একই মঞ্চে থেকে তিনজন পেলেন আর বাকি রা পেলেন না এটা ভালো দেখায় কি?” গুণমনির যুক্তি।
“কিন্তু বাকিরা তো এই স্কুলেরই শিক্ষক গুণমনিবাবু…….তারা নিজেরাই নিজেদের উপহার দেবেন?এটা কেমন কথা?”
সভায় উপস্থিত অন্যান্য শিক্ষকরা চপলা দেবীর মতেই সায় দেন। 
ইতিহাসের শিক্ষক রমা বসু বলেন “আরে আমাদেরই তো স্কুল। আমরা হলাম হোস্ট। আমাদের অতিথি ওঁরা। অতিথিদের উপহার তো আমরা দেবো। আমরা নেবো কেন?”
“আমিও সেটাই ভাবছিলাম। অতিথিদের উপহার দিয়ে বরণ করে নেবো আমরা। সেক্ষেত্রে আমাদের নিজেদের উপহার নেওয়ার প্রশ্ন নেই।“ চপলা দেবী বলেন।
সভায় উপস্থিত অন্য সদস্যরা এই প্রস্তাবেই সায় দিলেন। পরিকল্পনা মতো তিন/চারটি রূপোর সরস্বতী কিনে আনা হোল। অতিথিদের জন্য। আসল দিনটি এলো। অতিথিরা এলেন। নতুন ভবনের দ্বারোদ্ঘাটন করলেন। তাঁদের উপহার দেওয়া হোল একটি রূপোর সরস্বতী, একটি চারাগাছ, একটি মেমেন্টো, একটি শতবার্ষিকী নামাঙ্কিত উত্তরীয়, ও একটি মিষ্টান্নের প্যাকেট। 
গভর্নিং বডির সদস্যদের নাম ডেকে মঞ্চে তোলা হোল। সবাই একে একে উঠলেন। উঠলেন বর্ষীয়ান শিক্ষকরাও। কিন্তু গুণমনি কোথায়? সঞ্চালক বারবার নাম ধরে ডাকতে লাগলেন “পরিচালন সমিতির মাননীয় সদস্য গুণমনি কাঁড়ার…. আপনাকে মঞ্চে আসন গ্রহণ করতে অনুরোধ করছি……” কিন্তু গুণমনি নেই……কোথায় গেল সে?

রূপোর সরস্বতীটা তার নতুন বাড়িতে বেশ মানাতো। বাড়িতেও কতো কদর বাড়তো তার। এসব ভাবতে ভাবতে বিকেলবেলায় সাধারণ সময়ের ঢের আগে মুখ কালো করে একরকম লুকিয়ে বাড়ি ফিরে এলো গুণমণি। 
“রূপোর সরস্বতীটার জন্য আজ শো কেসটা সাফ করেছিলাম জানো পুঁটু?”
পুঁটু আর গুণমনির বিয়ের দশবছর কেটে গেছে। পুঁটুর এখন সাহস বেড়ে গেছে অনেক। পুঁটু বললো “ঘরে রূপোর সরস্বতী সাজিয়ে কি তুমি তোমার বিদ্যে ঢেকে রাখতে পারবে? তোমার ঘরে ও জিনিস না মানায় না। ওতে সরস্বতীর অপমান। বরং যার ঘরে মানায় সরস্বতী তাঁর ঘরেই যান”।
গুণমনির কিন্তু মন মানে না। এলাকার এমএল এর হাত থেকে হাসিমাখা মুখে রূপোর সরস্বতী নিচ্ছে সে এমন একটা ছবি শো-কেসে বাঁধিয়ে রাখা গেল না। ফেসবুকেও দেওয়া গেল না। তার মনটা কেমন খচখচ করতে করতে থাকে। সব হলো ওই হেডমিস্ট্রেস চপলা মুখুজ্যের জন্য। আচ্ছা অদ্ভুত মহিলা। অমন লোভনীয় রূপোর সরস্বতী মূর্তিটা…..নিজেও নিলেন না, কাউকে নিতেও দিলেন না? রাগে গজগজ করতে থাকে গুণমনির ভেতরটা। 
পাশাপাশি মনটাও “কু” গাইতে থাকে….. বেশ ক’বছর আগে কেমন করে গুণমনি এই মাস্টারির চাকরিটা পেয়েছিল সে রহস্য যদি জেনে যান চপলা? কিম্বা কেমন করে গুণমনি হলো গভর্নিং বডির সদস্য….
হেডমিস্ট্রেস চপলা মুখার্জির চোখের দিকে তাকালেই আজকাল আত্মবিশ্বাসে বড়ো রকম টান পড়ে গুণমনির।

 

চেনা  বটতলা

রথীন্দ্রনাথ বড়াল

ডঃ নগেন ঘোষ লেন, কলকাতা 

প্রবন্ধ

চেনা বটতলা

ফেব্রুয়ারী ২০২৫ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

banglow.jpg

​‘টতলার বই’ তথা বটতলার আদি প্রকাশনার সাথে আমার পরিচয় মামাবাড়ির সূত্রধরে। ইতিহাস খুলে দেখলাম উনিশ শতকে বাঙালী মননে শিক্ষা চেতনা আসার সাথে সাথে প্রকাশনার তাগিদ প্রকাশ পায়-সেই সূত্র ধরে বেশ কিছু ছাপাখানা তৈরী হয় মূলতঃ উত্তর কলকাতা বা আদি কলকাতায়। যেমন, গরাণহাটা, আহিরীটোলা, চিৎপুর, শোভাবাজার, জোড়াসাঁকো প্রভৃতি। বিষয় বৈচিত্র্যে এই ‘বটতলা’ অভাবনীয়। সমাজজীবনের চলন সহজ সরল ভাষায় সেই লেখকরা লিখে গেছেন মনের ভাব অনাবৃত রেখে। বটতলার ইতিহাস কিছু গ্রন্থকার লিখেছেন। বটতলার কিছু বই সংরক্ষণ করে প্রকাশনাও হয়েছে। এই বটতলার দেড়শ-দুশ বছরের ইতিহাস – ৬০-৭০ দশকে এই বই পাড়াকে কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। সেই প্রাচীন প্রকাশনার কিছু ঝলক পরবর্তী প্রজন্মের জন্য লিপিবদ্ধ করা এই ক্ষুদ্র প্রয়াসের উদ্দেশ্য।
বটতলার বিস্তৃত অবস্থানের মধ্যে আমি যে বটতলার কথা লিখতে বসলাম – সেটা কলকাতার আদি চিৎপুর রোডে অবস্থিত। বর্তমানে নাম হয়েছে ‘রবীন্দ্র সরণী’। সার্থক নাম। ঠাকুর পরিবারের জোড়াসাঁকো বাড়ির খুব কাছে আর রবীন্দ্রনাথের প্রথম স্কুল ‘ওরিয়েণ্টাল সেমিনারী’র ঠিক বিপরীতে সারি সারি প্রকাশনা সংস্থা, নানা যাত্রা কোম্পানীর সাথে সহাবস্থান করত। যেমন - ‘টাউন কলিকাতা লাইব্রেরী’, ‘সুলভ কলিকাতা লাইব্রেরী’, ‘ডায়মণ্ড লাইব্রেরী’  প্রভৃতি। এই একবিংশ শতাব্দীর প্রথম চতুর্ভাগে একমাত্র ডায়মণ্ড লাইব্রেরীর সগৌরব উপস্থিতি দেখতে পাই। বাকীরা বাংলা প্রকাশনার আধুনিক ধারায় তাল রাখতে না পেরে বোধহয় অস্তিত্ব বিপন্ন করেছে। এবার দেখে নেওয়া যাক—এই প্রকাশকরা কি ধরনের বই প্রকাশ করত বা ছাপত। যাত্রাপাড়ায় অবস্থানের জন্য বোধহয় মূলতঃ যাত্রার বই প্রকাশিত হত এখান থেকে। এছাড়া বিভিন্ন দেবদেবীর পূজা পদ্ধতি প্রকাশ করে সারা বাংলাকে, বিশেষতঃ পুরোহিত শ্রেণীকে সমৃদ্ধ করে এসেছে এই প্রকাশনা। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়—দূর্গাপূজা পদ্ধতি, কালীপূজা পদ্ধতি, সরস্বতীপূজা পদ্ধতি ইত্যাদি। গ্রাম্য সংস্কৃতির মেরুদণ্ড যাত্রাপালা। আজকের টেলিভিশন, ভিসিআর, ভিডিও, সিনেমা, তারপর আধুনিক ইণ্টারনেটের প্রভাবে যাত্রার সেই ঝনঝনানো বাজনা আজ অনেকটাই স্তিমিত। কিন্তু ৬০, ৭০, ৮০-র দশকে ছিল যাত্রার রমরমা। সেই যাত্রার আতুরঘর এই প্রকাশনাগুলো। আমার মাতামহ বা দাদুর প্রকাশনা সংস্থা ছিল—‘সুলভ কলিকাতা লাইব্রেরী’। বাংলার অন্যতম প্রাচীন প্রকাশনা। পরে এই ‘সুলভ কলিকাতা’—ভাগ হয় ‘টাউন কলিকাতা লাইব্রেরী’ ও ‘সুলভ কলিকাতা লাইব্রেরী’ নামে পাশাপাশি দুই ভায়ের দোকানে। বিখ্যাত যাত্রার পালাকার ছিলেন শ্রীব্রজেন্দ্রকুমার দে। ব্রজেন

দে’র পালা করার জন্য সব যাত্রা কোম্পানী মুখিয়ে থাকত। সুলভের কর্ণধার শ্রী প্রফুল্ল চন্দ্র ধরের ব্রজেনবাবুর সাথে সখ্যতার খাতিরে ওনার সবচেয়ে বেশী পালা ছাপা হয় এই ‘সুলভ কলিকাতা লাইব্রেরী’ থেকেই। সৌরীন্দ্রমোহন চট্টোপাধ্যায়, বিনয় মুখোপাধ্যায়ের বিখ্যাত অনেক পালার প্রকাশক ছিলেন দাদু। পূজাপদ্ধতি, যাত্রাপালার পাশাপাশি ‘হঠযোগ সাধনা’, ‘যাদু প্রদর্শন’, ‘হস্তবিচার’ ইত্যাদি বিষয়েও বটতলার বই সমান জনপ্রিয় ছিল। গল্প শুনেছি – এখনকার পি. সি. সরকার মানে প্রদীপ সরকারের বাবা প্রতুল সরকার। তাঁর গুরু ছিলেন গণপতিবাবু।এই মুহূর্ত্তে তাঁর পদবী মনে পড়ল না। তাঁর যাদুবিদ্যার বই-র প্রকাশক ছিলেন দাদু। তাঁর একটি মেয়ে দ্বিখণ্ডিত করার খেলায় দাদুর অনুমতিক্রমে আমার বড় মাসীকে নিয়ে যেতেন।
বটতলার বই-এর গল্প থেকে অন্য গল্পে চলে এলাম। এই বটতলার প্রকাশকরা বাংলা সাহিত্যের নবপ্রাণ সঞ্চারক হলেও—আর্থিক ভাবে অধিকাংশজনই সম্পন্ন  হতে পারতেন না। তার একটা কারণ এইসব বইয়ের অতি স্বল্পমূল্য। বিক্রি যদি হয় পাহাড় প্রমাণ, লভ্যাংশ - একটি ছোট ঢিপি। কিন্তু তাঁদের কম্প্রোমাইজ-এর (বাংলা প্রতিশব্দ না জানা থাকায় লিখলাম) বা প্রচারের কোন পরিকল্পনা ছিল না। দাদু, শ্রীপ্রফুল্লচন্দ্র বলেছিলেন—‘আমরা প্রকাশক, বই-এর গুরুত্ব বুঝে খদ্দের আসবে। কিন্তু রিটেলারদের অসুবিধা, সাজিয়ে গুছিয়ে বলতে হয় খদ্দের ধরার জন্য।’
পাহাড় প্রমাণ বিক্রির কথা বললাম। কিন্তু তার পরিমাণ সম্পর্কে আমার সঠিক ধারণা নাই। ভাষা ভাষা ধারণা হয় পোস্টে আসা চিঠিপত্র দেখে। বটতলায় কাউণ্টার বিক্রির চেয়ে বেশী বিক্রি ছিল গ্রামগঞ্জ থেকে আসা চিঠিপত্রের মাধ্যমে। এই চিঠি আসত প্রধানতঃ পোস্টকার্ডের মাধ্যমে। ইনল্যাণদও মাঝে মাঝে আসত। বিশ-পঁচিশটা পোস্টকার্ড একসাথে করে বাণ্ডিল করা হত। সেইরকম অজস্র বাণ্ডিল এক জায়গায় জড়ো করে রাখা হত। সেটিও পাহাড়ের আকার ধারণ করলে কি করা হত ঠিক মনে নাই। সেই সময় এই বটতলার বই-এর চাহিদাকে জনপ্রিয়তা না বলে ‘সামাজিক প্রয়োজনীয়তা’ বলে চিহ্নিত করাই ঠিক হবে। সামাজিক পটপরিবর্তনের সাথে সাথে – এই বই-এর চাহিদাও কমতে থাকে। এইসময় দরকার ছিল দক্ষ হাতে আধুনিকীকরণ। সেটা বোধহয় সম্ভব হয়নি উত্তরসুরীদের অক্ষমতায়। ফলে সেই প্রকাশনার ধারা আর ধরে রাখা সম্ভব হয়নি—পরবর্তী প্রজন্ম ঐতিহ্যকে সম্মান না করে অর্থ উপার্জনের নানা পথ বেছে নিয়েছে হয়ত। সেই সব বই-এর ভগ্নাংশ হয়ত কলেজ স্ট্রীটের কোন প্রকাশক রক্ষা করে চলেছেন আগামী গবেষণার আকর হিসাবে। বাংলার আদি প্রকাশনার প্রবাহমান স্রোতের ইতিহাসটুকু অন্ততঃ রক্ষিত হোক।

আমরা বাঙালি

প্রবন্ধ

আমরা

বাঙালি 

অনিশা দত্ত 
সল্টলেক, কলকাতা 

women.jpg

ফেব্রুয়ারী ২০২৫ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

লেখিকা পরিচিতি: প্রাক্তন অধ্যাপিকা (ফলিত গণিত) বর্ধমান উইমেন্স কলেজ নামী পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখিকা, পুস্তক প্রণেতা আকাশবাণী কলকাতায় প্রাক্তন কথক। সায়েন্স এ্যসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল এর পক্ষে ‘বিজ্ঞান মেলা ‘ পত্রিকার প্রাক্তন সম্পাদক।

ইদানীং একটা শব্দ প্রায়ই শোনা যায় ‘বাঙালিয়ানা’। শব্দটা হয়ত ব্যাঙ্গার্থে ব্যবহৃত হয়। বরং শুদ্ধ ভাষণে বলা যাক বাঙালির বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন বা বঙ্গসংস্কৃতির উপস্থাপনা, প্রাচীন ঐতিহ্য ও বহমান সভ্যতাকে উত্তরোত্তর সংস্কৃত ও সমৃদ্ধতর করে তোলাটাই ‘বাঙালিয়ানার’ সার্থকতা। এক সময় বলা হত, ‘What Bengal thinks today, India will think tomorrow.’ অর্থাৎ আমাদের বাংলা হল, ভারতের পথপ্রদর্শক। ব্রিটিশ সরকার ভারত ছাড়ার সময় বাংলার চরম সর্বনাশ করে গেছে, “বঙ্গভঙ্গ”। আমরা ছোটবেলা থেকে জেনেছিলাম, পূর্ববঙ্গ- পশ্চিমবঙ্গ। তারপর আমাদের যৌবনে ভাষা - আন্দোলনে জয়ী হয়ে গর্বিত পূর্ববঙ্গ হয়ে গেল পৃথক রাষ্ট্র। ঘোষিত হল নতুন নাম, ‘বাংলাদেশ‘! ব্যক্তিগত আবেগে আমার খুব দুঃখ হয়েছিল, পূর্ববঙ্গর নতুন নামকরণ হল বাংলাদেশ আর আমরা একপেশে পশ্চিম বাংলা। ‘আ মরি’ বাংলা ভাষা, মোদের গরব মোদের আশা’ - এতো আমাদেরও ভাবাবেগ। ‘কোথায় ফলে সোনার ফসল, সোনার কমল ফোটেরে! সে আমাদের বা্ংলাদেশ, আমাদেরই বাংলা রে‘। এই একই ভাবনায় পশ্চিম বাংলা ও আপ্লুত থাকে। কবিগুরুর বঙ্গ প্রণতিতে, ‘বা্ংলার বায়ূ, বাংলার ফল, ….পুণ্য হউক, পুণ্য হউক…’এ তো দুই বাংলারই প্রাণের কথা। কিন্ত পূর্ব বাংলা, ‘বা্ংলা দেশ’ নামেই জিতে গেল। একটা সময় গেছে, যখন বাঙ্গালী সমাজ ঘোর কুসংস্কারে নিমজ্জিত ছিল। তখন বঙ্গদেশকে ‘আচারের তুচ্ছ মরুবালুরাশি বিচারের স্রোতঃ পথ ফেলেছিল গ্রাসি’….। সে সময়ে, বিশ্বকবি বড় বেদনায় সখেদে ব্যাঙ্গোক্তি করতে বাধ্য হয়েছিলেন, ‘সাত কোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙ্গালী করে, মানুষ করনি’ ‘সেই তমসাচ্ছন্ন অন্ধকার আজ দূরীভূত। সঙ্কীর্ণমন্যতা থেকে বেরিয়ে এসে বাঙালী, বিশ্ব দরবারের মুক্ত অঙ্গনে পা রেখেছে। সমাজ-সংস্কারে, সাধনায়–সংগ্রামে, কর্মনিষ্ঠায়-মননে, সাহিত্য-সংস্কৃতিতে, বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে বাংলার অব্যাহত অগ্রগতিতে পথ দেখিয়েছেন প্রাতঃস্মরণীয় বঙ্গসন্তান,……

ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর, রামমোহন রায়, ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ, স্বামী বিবেকানন্দ, আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু, বিপ্লবী সুভাষচন্দ্র বসু প্রমুখ…. কত নাম করব! বর্তমানে বাংলাদেশের জনসংখ্যা সতেরো কোটি ছুঁইছুঁই, আর পশ্চিম বাংলার জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে দশ কোটি। অর্থাৎ এখন সাত কোটির বদলে সাতাশ কোটি বাঙালির যৌথ দায়িত্ব বাংলার ঐতিহ্যকে সদা গৌরবোজ্জ্বল করে তোলা। বা্ংলার ইতিহাসে স্থাপত্য-ভাস্কর্য, চারুকলা-কারুকলা ইত্যাদির অবদান অনন্য। হস্তশিল্প–কুটিরশিল্প, মৃৎশিল্প, তন্তশইল্প–ঢাকাই শাড়ি, বাটিক-ছাপা, সুদৃশ্য কাঁথা সীবন, মুর্শিদাবাদ রেশমী শাড়ি, সবই বাংলার স্বকীয়তা। লোক-সংস্কৃতিতে লোকনৃত্য, পল্লীগীতি, বাউল গান ইত্যাদি এখনও সমান জনপ্রিয়। বাংলার ঢে্ঁকি ছাঁটা চাল, আচার, বড়ি, মোয়া, মোরব্বা, আমসত্ত্ব ইত্যাদি আজও আদরণীয়। বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য বাংলার মিষ্টান্ন বৈচিত্র্য। এগুলি তো ‘বাঙালিয়ানা’র ই এক অঙ্গ।  

বাঙ্গালী আবেগপ্রবণ জাতি। ‘বুকভরা মধু, বাংলার বধূ….. মা বলিতে প্রাণ করে আনচান চোখে আসে জল ভরে’। বাঙ্গালী পরিবারে প্রেম-প্রীতি, ভালবাসা-সখ্যতার মাধুর্য, কর্তব্য-দায়িত্ব, শ্রদ্ধা-সহবৎ এর মর্যাদা, সর্বোপরি ত্যাগের মহিমা যে কোনও জাতিকে পরাজিত করবে। কিন্ত ক্ষোভের বিষয়, ইদানীং বঙ্গ সংস্কৃতি খানিক অবক্ষয়ের দিকে। বাঙালির সমাজ ও সংসার যে বন্ধনে আবদ্ধ থাকত, তা’ এখন আর তেমন সুদৃঢ় নয়। কালের যাত্রায় সভ্যতার দৃষ্টিভঙ্গী বদলায়, সমাজে সংসারে পরিবর্তন আসে। কিন্তু Universal Moral Values বা বিশ্বজনীন আদর্শ মূল্যবোধ অপরিবর্তনীয়। চিরন্তন শাশ্বত।

নূতন প্রজন্মের জীবনের মূলমন্ত্র হচ্ছে ‘আমার জীবন, আমার’, যা নিঃসংশয়ে বঙ্গ সংস্কৃতির পরিপন্থী। বাংলার ঐতিহ্যে মজ্জায়-মজ্জায়, মর্মে-মর্মে যে সনাতন নীতি নিহিত রয়েছে তা’ স্বার্থসর্বস্ব আত্মকেন্দ্রিক নয়। সাবেক বাঙালিয়ানার অন্তরের অনুভব হল, ‘সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।‘ বাঙালি যেন তার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে সদা গৌরবোজ্জ্বল রেখে বলতে পারে, ‘আমরা বাঙালী বাস করি সেই তীর্থে ব্রজ বঙ্গে।‘ দুই বাংলারই প্রাণের আকুতি হল, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’।

দীপাঞ্জনা

সঞ্জীব চক্রবর্তী

হিন্দুস্তান রোড, কলকাতা 

দীপাঞ্জনা

গল্প

himadri2.jpg

ফেব্রুয়ারী ২০২৫ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

ঠাৎ দেখা
সবুজে ডুবে থাকা ছোট্ট পোড়া লাল রঙা বাড়িটা। মাধবী লতার ঝালর ঢাকা সাদা কাঠের ফটক। নাটকের গা ঘেঁসে নীলকণ্ঠ ফুলের সাজি নিয়ে দাঁড়িয়ে অনেক কালের পুরনো জ্যাকারান্ডা।
রাধাচূড়ার হলুদ ফুলের আলপনা আঁকা কালো পিচের সরু রাস্তাটা চলে গেছে কলা ভবনের দিকে। দূর থেকে প্রথম দেখেছিলাম - মাধবী লতার ঝালরে মোড়া ফটক পেরিয়ে পিচের রাস্তা ধরে মেরুন রঙা ছাতা মাথায় তুই চলেছিস সেই পথে। এ কি দেখলাম ---কলেজের মাস্টার মশাইদের অবোধ্য অনেক বিশ্লেষণের জীবন্ত উদাহরণ --  
“তন্বী শ্যামা শিখরদশনা পক্ববিম্বাধরোষ্টী মধ‍্যে ক্ষামা চকিতহরিণীপ্রেক্ষণা নিম্ননাভিঃ”। 
অগ্নি স্নাত উজ্জ্বল বৈশাখী রোদের ছাতা চোঁয়ানো  লালের আভায় তোর উজ্জ্বল শ্যাম স্বেদাক্ত মুখে প্রতিফলিত হচ্ছিল অজন্তা গুহায় বৌদ্ধ চিত্রকরের স্বপন চারিণী কোন নশ্বর রাজরানীর অমর প্রস্তর চিত্রের প্রতিচ্ছবি। শ্রমণ চিত্রকরের স্বপ্ন জড়িয়ে গেল আমার চোখে।
পরে জেনে ছিলাম নতুন এসেছিস কলা ভবনে। আলাপের পরিস্থিতি খুঁজে ফিরতাম --তবে টের পেলাম ওই শান্ত সৌন্দর্য ঘিরে আছে অলঙ্ঘ্য অদৃশ্য বলয়। বহ্নি বিবিক্ষু পতঙ্গরা সেই অদৃশ্য বলয়ে বাধা পেয়ে মরে।

প্রথম আলাপ
স্নাতকোত্তর শেষ বছর। শান্তিনিকেতনের দিনগুলো হারিয়ে যাওয়ার পালা। বছর শেষে ঝাঁপ দিতে হবে জীবন জোয়ারে। ঠিক হয়েছিল কলা ভবনে কবিগুরুর জন্মদিনে শাপমোচন মঞ্চস্থ হবে। আয়োজনে ছিলাম আমি। পালা করে বাড়িতে বাড়িতে শুরু হল রিহার্সাল। তোকে দেওয়া হল কমলিকার চরিত্র। সেই প্রথম আলাপ। আলাপের আদিতে নাম জানা খুবই জরুরী। নাম জানলাম – রঞ্জনা। জোর কদমে রিহার্সাল শুরু। একটি দায়িত্ব পেয়েছিলাম, রিহার্সালের পর ফেরার পথের নির্জন রাস্তাটা তোকে পার করে দেওয়া। নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়, হরেক ফুলের মৃদু গন্ধ ছড়ান রাস্তায় সাইকেল ঠেলে হাঁটতে হাঁটতে তোকে বাড়ি পৌঁছে নিজের পথ ধরতাম। মনে হয় তোর মনের আগল সেই সময় ভাঙতে শুরু করেছিল। সবাই চিন্তিত ছিলাম এই অল্প সময়ে মঞ্চ সাজানোর ফুল যোগাড়ের সমস্যায়। তখন জানিয়েছিলি তোদের বাগানের  ফুলের খবর। ভয় দেখিয়ে ছিলিস বাঘের মত ওত পেতে বাগান পাহারায় থাকে তোর দাদু। তোর প্রশ্রিত হাসির ভরসায় এক বিকেলে তোদের বাড়িতে এলাম  ফুলের আশায়। ভয় ভয়ে ভিতরে আসি। বারান্দায়, পাশের বাড়ির ছোট দুটো ছেলে মেয়ে সঙ্গে ইকিরমিকির চামচিকির খেলায় তুই তখন ভয়ানক ব্যস্ত। বাঘা দাদু বসেছিলেন বাগানের ধারের বারান্দায় এক আদ্যিকালের চেয়ারে। দাদুর সবই ছিল বিশাল। চেয়ার, শরীর, মাথার টাক, পাকা গোঁফ ও তীক্ষ্ণ ঘূর্ণায়মান আঁখি যুগল – বাঘই বটে। কার সাধ্য বাগানের ফুল চুরি করে। কিন্তু বাঘা দাদুর গাম্ভীর্যের খোলস সরে গিয়ে প্রকাশ পেয়েছিল প্রাণ প্রাচুর্যে ভরা এক মানুষের। তাঁর ভরাট গলায় রবীন্দ্র কবিতা পাঠ, শান্তিনিকেতনের পুরনো মজাদার গল্প, কমলিকা চরিত্রে তোর মহড়ার বর্ণনা শুনে বাঘা দাদুর প্রাণ খোলা হাসি। সঙ্গে ছিল মাসিমার তৈরি ডিম ভাজা, মালপো। সেই  সন্ধ্যা কখন রাত ছুঁয়েছিল জানতে পারি নি। তোর চোরা কটাক্ষের স্মৃতি আর দাদুর ফুলের আশ্বাস নিয়ে ফিরলাম। 
তারপর? 
“ভোরের বেলা ফুল তুলেছি, দুলেছি দোলায়–বাজিয়ে বাঁশি গান গেয়েছি ---” 
বৈশাখে কোন একদিন শুরু হয়েছিল পথ চলা ----। চারিদিক তখন জীবন সমুদ্রের সুগন্ধি সফেন।আঁকাবাঁকা কোপাই এর মজা জলে পা ডুবিয়ে তোকে দেখেছি তপ্ত অপরাহ্ণে। জ্যৈষ্ঠের অস্তগামী সূর্যের গোধূলি আলোয় দেখেছিলাম তোর স্বপ্ন ভাসা চোখ। সোনাঝুরি, ইউক্যালিপটাসের বনে- বৃষ্টি ভেজা আষাঢ়ে বাতাসে পথ হারিয়েছি উঁচু নিচু ভুলভুলাইয়া খোয়াই এর প্রান্তরে। শ্রাবণের দামাল বৃষ্টি যখন মিলেছিল লাল মাটির বুকে, তোর মনের আগল গেল সম্পূর্ণ মুছে--- বৃষ্টি ভেজা শরীরী অধৈর্যতার মাঝে বলেছিলি – ‘দীপ দা-এতো দিন কোথায় ছিলে?’ 
শরতের বাতাস কাশের বনে নিয়ে এসেছিল আগমনীর সুর – আশ্বিনে সাঁওতাল পল্লীর ঢাক মাদলের বোলে নেচে উঠেছিল তোর শরীর – আমার মন। 
এরপর? এরপর – বাতাস জানান দিল হেমন্তের। দিনের শেষে হিম ভেজা ছাতিম ফুলের গন্ধ মেখে শান্তিনিকেতনে সন্ধ্যা নামে। 
ডাক আসে মুম্বাই থেকে। বসতে হবে চাকরির পরীক্ষায়।
কলেজের পরীক্ষা মিটতেই ছুটি কোলকাতায় মুম্বাই মেল ধরতে। বোলপুরে ট্রেন ছাড়া অবধি দাঁড়িয়ে ছিলি। কথা ছিল চাকরির পাকা খবর এলেই যাব তোদের বাড়ি। তোর বাষ্পীয় চোখে কিছু কথা যেন বাকি রয়ে গেল। বলেছিলিস ইমেলে চোখ রেখ।
তোর না বলা কথায় মনে ধন্দ নিয়ে পাড়ি দিলাম পশ্চিম সাগর পারের অচেনা শহরে। 
“হায় মাঝে হল ছাড়াছাড়ি গেলেম কে কোথায় ---”
ঝড়ের মত এক সপ্তাহ কেটে গেল মহার্ঘ চাকরির লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায়। ফোন করা যায় নি কারণ মুঠো ফোনে ছিল বাঘা দাদুর চরম অনীহা। সু-খবর পেলাম – রাত তখন অনেক। চাকরির খবর আর ফেরার দিনক্ষণ জানাতে ইমেলে খুলে চোখে অন্ধকার ঘনিয়ে আসে। বোলপুর স্টেশনে তোর না বলা কথার ধন্দ ঘুচে গেল। বাঘা দাদু তোর বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে। পৃথিবীর রঙ সব মুছে গেল। থাকে শুধু আরব সাগরের অন্ধকার। 
তোর দোষ নেই। মাঝ রাতে অনেকটা পথ পেরিয়ে চলে গেছিলাম জুহু সৈকতে। চারিদিকে তখন জীবন সমুদ্র ফেনিল গরল। রাত আর ভোরের সন্ধিক্ষণে জীবনের নতুন অধ্যায় মনে প্রশ্ন জেগেছিল কে আমি - ? পাই নি উত্তর। ফিরে এসেছিলাম স্বত্তাহীন নতুন জীবনে।
বহু দিন চলে গেল। সময় কাটাতে চলে যেতাম জাহাঙ্গীর আর্ট গ্যালারি। বেশি সময় পেলে – পাড়ি দিতাম ঔরঙ্গাবাদ হয়ে অজন্তার গুহায় গুহায় – খুঁজতাম হাজার বছর আগে শ্রমণ চিত্রকরের সৃষ্টি কোন রাজমহিষীর অবিনশ্বর গুহা চিত্র যার প্রতিফলন দেখেছিলাম তোর মুখে কোন এক বৈশাখী তপ্ত দুপুরে।  
পাঁচ পাঁচটা বছর পার হয়ে গেল – আর ফেরা হয় নি শান্তিনিকেতনে।
আবার দেখা যদি হল সখা প্রাণের মাঝে আয় .....
দিনটা ছিল শনিবার। পশ্চিমী শহরের দীর্ঘ অপরাহ্ণ। অলস পায়ে জাহাঙ্গীর আর্ট গ্যালারিতে ঘোরা ফেরার পর কাছের ক্যাফের এক কোনে না- ছোঁয়া কফির কাপ নিয়ে বসে ছিলাম। নিরুৎসুক দৃষ্টি ছিল ক্যাফের কাঁচের দরজায়। হঠাৎ সারা শরীর শিরশিরিয়ে ওঠে– দু হাতে ঘন ঘন চোখ মুছি –  পাঁচ বছর আগে শেষ দেখা সেই পরিচিত দেহ ভঙ্গী, তখন সে এসে বসেছে কাঁচের দরজার কাছে। রহস্যময়ী মনের কারসাজিতে বোধ হয় দৃষ্টি হয়েছিল অস্বচ্ছ। আবছা প্রতিবিম্ব ভাসে ক্যাফের দরজার কাঁচে। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারি নি। এগিয়ে যাই দরজার দিকে। আড় চোখে দেখি কফির কাপে মাথা ঝুঁকিয়ে বসা মানুষটিকে-  
“আরে দীপ দা?” তোর গলার স্বরে চোখের বিভ্রম মুছে গেল। তবে  মনের ভিতর সযত্নে সাজানো ছবিটা চুর চুর হয়ে ভেঙে ছড়িয়ে পড়েছিল। একি চেহারা হয়েছে তোর ! সমুদ্রের তরঙ্গ দোলায় গা ভাসান প্রাণবন্ত নৌকা - এখন তার ভাঙা চোরা কঙ্কালসার দেহটা লোকচক্ষুর আড়ালে কাত হয়ে পড়ে আছে বালি চরে। নিস্তব্ধতায় ঢাকা পড়ে যায় ক্যাফের অভ্যন্তরের কলতান। অতীতের কবিতা হারিয়ে গেল। 

কিছু সময় যায় অবান্তর কথায়। শেষে তোর মনের আগল খুলে গেল। গত পাঁচ’বছরের জমানো মনের কথা বাঁধ ভাঙা জলের মত বেরিয়ে আসে। শুনলাম বাঘা দাদুর জবরদস্তির কাছে হার মেনে

তাঁর ঠিক করা কুন্তলের সঙ্গে বিয়েতে রাজি হতে হয় তোকে। পরে বুঝতে পেরেছিলি বিশাল চাকরি করা কুন্তল মাদকাসক্ত। প্রথমে মানসিক পরে ক্রমবর্ধমান শারীরিক নির্যাতনে দিশাহারা হয়ে আইনি বিচ্ছেদের পথে হাঁটতে বাধ্য হয়েছিস। এখন চাকরি হারা কুন্তল নেশা মুক্তি কেন্দ্রের পাকাপাকি বাসিন্দা। আরো জানলাম বাঘা দাদু আর নেই, তুই চলে যাবি মুম্বাই ছেড়ে।
স্তম্ভিত হয়ে বসে ছিলাম। বুঝতে পারি তোর অসহায়তা। এই জগদ্দল পাথরের ভার লাঘব কি ভাবে সম্ভব বুঝে উঠতে পারি নি – সঙ্কোচ কাটিয়ে প্রস্তাব দিয়েছিলাম এক সঙ্গে কাটিয়ে দেওয়া যাক বাকি জীবন – কিন্তু তুই অদ্ভুত হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলি সেই প্রস্তাব। তবে বলেছিলি “সামনের সপ্তাহে চলে যাব - চল তোমার সেই বৌদ্ধ চিত্রকরের গুহা চিত্র দেখে আসি।” অস্বস্তি জড়ানো আনন্দিত মনে রাজি হয়েছিলাম। ছুটি নিয়ে দু’জনে পৌঁছে গেলাম অজন্তায় – দু’দিনের বাসা বাঁধালাম অশ্বখুরাকৃতি গুহা পাহাড়ের কাছে।
কিন্তু কোথায় পাব সেই নশ্বর নারীর অমর প্রাচীর চিত্র? পরদিন সকালে বেরিয়ে পড়লাম খাড়া পাহাড়ে পাথর খোদা গুহাগুলির উদ্দেশ্যে। তোর অদ্ভুত পরিবর্তন লক্ষ করি - যেন তুই ফিরে গেছিস সেই পাঁচ বছর আগের জীবনে। হাজারো প্রশ্নে আমি নাস্তানাবুদ। তোর মানসিক চাপে কালো হওয়া মুখে লেগেছিল রঙের ছোঁয়া। গুহা চিত্র দেখাটা নেহাতই ছিল তোর অজুহাত! না - ভোলা তোর সেই চোখের, প্রাণের কথাগুলো আবার যেন মূর্ত হয়ে উঠল। তুইও বোধ হয় এই স্বল্প কিছু পাওয়া সময়ের সম্পূর্ণ নির্যাস নিংড়ে বার করে নিতে চেয়েছিলি। গিরি প্রাকারের মাথায় মাথায় ছড়ানো সবুজের গায়ের আলো ম্লান হয়ে আসে। তোর ফেরায় মন ছিল না। চলে গেছিলাম কাছের ভিউ পয়েন্টে। বসে ছিলাম রুক্ষ পাথরের পাঁচিলে। নিচের গিরি খাতে ওয়াঘার নদীর প্রায় শুকনো খাত অন্ধকারময়। পাথর চুঁইয়ে পড়া ঝোরার ক্ষীণ শব্দ। তুই একেবারে নিশ্চুপ, গভীর চিন্তায় মগ্ন। স্বপ্নাচ্ছন্ন রাত গভীর হয় .....। বেশ রাতে ফিরে এলাম আস্তানায়। কাল থেকেই আবার চিরতরের বিচ্ছেদ। ফিরেই নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করেছিলি। তোর কাছে যাওয়ার স্বাধীনতা হারিয়ে গেছে। অস্বস্তির বোঝা ভারি হয়ে ওঠে। দাঁড়ালাম সামনের লম্বা বারান্দায়। অশ্বখুরাকৃতি অন্ধকারাচ্ছন্ন পাহাড়ে ঝরে পড়ে একটা দুটো উল্কা। ঘরে গিয়ে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ আধো ঘুম ভাঙে দরজায় টোকার শব্দে। দরজা খুলতে দেখি প্রায়ান্ধকার গিরি পর্বতের পটভূমিতে তোর সিলুয়েট। আমার বুকের মাঝে ঝাঁপিয়ে, গভীর আবেগে অঝোর কান্নায় ভেঙে পড়লি। 
তারপর? ঘুম ভাঙল বেশ বেলায়। উঠে তোকে পাশে দেখতে পাই নি তবে শয্যায় ছড়িয়ে ছিল তোর চিহ্ন -। সন্দেহ কেটে গেল। বোধ হয় গত রাতটা ছিল অসম্ভব এক স্বপ্নের। – তোর ঘরে যাই - দেখি খালি ঘর। চলে যাই লজের রিসেপশনে। শুনলাম রাতেই গাড়ি ঠিক করে ছিলিস ভোরে এয়ারপোর্ট পৌঁছনোর জন্য। ঘরের টেবিলে আমার নাম লেখা একটি খাম চোখে পড়ে। মাথার ঠিক ছিল না। খামটা পকেটে নিয়ে বেরিয়ে পড়ি।   
সূর্য তখন মধ্য গগনে। দু ধারে গিরি প্রাচীর। শেষ প্রান্তের প্রাচীরের গায়ে একটি পর্যটক শূন্য ভাঙা চোরা গুহা। অন্ধকার গুহায় কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া সামান্য কিছু গুহা চিত্রের নিদর্শন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। গুহার  সামনেই গিরি শ্রেণীর মাঝে অতলস্পর্শী খাদ। অনেক নিচে দেখা যায় ছোট বড় পাথর ছড়ান নদী খাত।  

গত তিন দিন অনুভব করেছি আমার ভিতরে যেন বিপ্লব ঘটে গেছে। এই বিপ্লব আমার শিরায় শিরায় উঠিয়ে ছিল বিষের স্রোত। সেই তীব্র বহতা বিষাক্ত অন্ত: স্রোত একান্তই আমার- রঞ্জনার কোন সম্পর্ক নেই। মধ্য দিনের তাপ, রুক্ষ পাথরে প্রতিফলিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে আমার শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। কাল রাতে হঠাৎ মনের গহনে চাপা অগ্নুৎপাতের বিষাক্ত লাভা লেপে দিয়েছিল এক অপাপ বিদ্ধ শরীরে। মনের এই পাপ কি লুকিয়ে ছিল সেই “প্রথম দেখা”র দিন থেকে? 
আর সহ্য করতে পারলাম না। দু পা এগিয়ে দাঁড়ালাম খাদের ধারে। তাকিয়ে থাকি বহু নিচের নদী খাতে। তীব্র আকর্ষণ অনুভব করি গভীরতার। সম্মোহিত অবস্থায় টের পাই পকেটের আমার নাম লেখা সাদা খামের অস্তিত্ব। কৌতূহলী মনের টানে ফিরি প্রায়ান্ধকার গুহায়।
থর থর আঙুলে খামের ভেতরের কাগজে দেখি সন্মোধনহীন কিছু লেখা .......৷   
“সে দিন বলেছিলে – চল জীবনটা আবার আরম্ভ করি এক সাথে। শরীর মন কেঁপে উঠেছিল। কিন্তু নিজের দুর্বলতা চাপা দিতে হেসে উঠেছিলাম। একটা ব্যর্থ জীবন তোমার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে চরম অন্যায়। সেই তো এক গুচ্ছ মন্ত্রের মৌখিক শপথ। জীবন দিয়ে টের পেয়েছি তার অসারতা। সেই সময় মনের ভিতর আনাগোনা করেছিল - দুটো আলাদা স্বত্তা এক হয়ে আর একটি পবিত্র তৃতীয় স্বত্তার যদি সৃষ্টি হয় – ক্ষতি কি? 
তোমাকে আমার সাথে চির জীবনের মত জড়িয়ে নিয়ে ফিরে যাচ্ছি। বাকি জীবনটা তুমি সাথে না থেকেও, আমার জীবনসঙ্গী হবে। চাক্ষুষ দেখা আর নাই বা হল।”
পরিত্যক্ত গুহার পাষাণ প্রাচীরে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। দিনের আলো নিভে আসে। ফিরে গেলাম মুম্বাই শহরে। 
“সবায় নিয়ে সবার মাঝে লুকিয়ে আছ তুমি
সেই তো আমার তুমি ”
দু দশক পেরিয়ে গেল। নিঃসঙ্গ জীবনে ক্লান্তির ছায়া পড়ে। দেহ মনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে আছে রঞ্জনার স্মৃতি –  অজন্তার সেই দুটো দিনের কথা। কোথায় সে আছে জানার সুযোগ পাই নি। মন বলে – অনেক তো হল! এবার ফিরে যাই আমাদের শান্তিনিকেতনে। 
চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে ফিরে এলাম। আমাদের সব হতে আপন, পুরনো শান্তিনিকেতন খুঁজে পেলাম না। শেষে ডেরা বাঁধালাম শহরের উপকণ্ঠে। আমার ছোট্ট বাড়ির প্রবেশ পথের দেওয়ালে লেখা থাকল -- তৈত্তিরীয় উপনিষদের একটি ছত্র:
“”সত্যাত্ম প্ৰাণাৰামং মন আনন্দং””
২৫শে বৈশাখ এসে গেল। কাগজ বিলি করা ছেলেটি বলে কলা ভবনে মঞ্চস্থ হবে ‘শাপ মোচন’ নৃত্য নাট্য।
এক ঝাঁক পুরনো স্মৃতি নিয়ে সেই দিন বিকেলে হাজির হলাম কলা ভবনে। 
মুগ্ধ চোখে দেখছি কত বছর আগের দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি। বেশি আকর্ষিত করে কমলিকা চরিত্রে নৃত্যরতা মেয়েটি। অবাক চোখে বিভ্রম জাগে – হুবহু মিল খুঁজে পাই কত বছর আগের কমলিকা চরিত্রের সাথে। ভিড় সরিয়ে এগিয়ে যাই মঞ্চের সামনে। বিস্মিত হই – মনে হল মেয়েটি আমার পরিচিতা! ভেবে উঠতে পারি না – এত মিল কি ভাবে সম্ভব! ভবনের বাইরে এসে ঠিক করি অনুষ্ঠানের শেষে –আলাপ করব। প্রায় দেড় ঘণ্টা বাদে – দূর থেকে দেখি মেয়েটি আসছে সঙ্গে এক বয়স্কা মহিলা। একটু আলো অন্ধকারে কাছে আসতে চমকে উঠি মহিলা কে দেখে – আরে .... ! বয়সের ছাপ পড়ে কত পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু সঙ্গে থাকা কমলিকা চরিত্রের মেয়েটি কে? তার চলা ফেরার ভঙ্গিমা, মুখ আমার অতি পরিচিত। দ্রুত পা’য়ে এগিয়ে যাই। থমকে দাঁড়ায় রঞ্জনা – এক লহমায় খুশিতে ঝলমলিয়ে ওঠে তার চোখ মুখ – কবে এলে? কেমন আছ? উত্তর দিয়ে মেয়েটিকে দেখে, ফিরে তাকাই রঞ্জনার দিকে। আমার চোখের প্রশ্ন বুঝে স্মিত হেসে মাথা ঝুঁকিয়ে বলে “আমার মেয়ে দীপাঞ্জনা”-- কয়েকটি পা এগিয়ে আর একবার ফিরে তাকিয়ে - রঞ্জনা হারিয়ে গেল মঞ্চ থেকে ফেরা জনতার ভিড়ে। 
ফিরে আসি আমার গাছ গাছালি ঘেরা ছোট আস্তানায়। 
বারান্দায় বসে চেয়ে থাকি আকাশের দিকে। দূর আকাশে এখনো দেখা যায় বিশাখা নক্ষত্র। রাত হয়ে উঠেছে গভীর। রহস্যময়ী মন অকারণে হয়ে উঠেছে প্রফুল্ল। মনের মাঝে ভেসে ওঠ ----
‘আমার প্রাণের আরাম- মনের আনন্দ- আত্মার শান্তি।’  

গল্প

মনের গহনে
সোমদেব পাকড়াশী  

​লেক গার্ডেন্স, কলকাতা

oldman1.jpg
মনের গহনে

ফেব্রুয়ারী ২০২৫ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

বেশ কয়েকটা ফুচকা সাঁটিয়ে বুজুর তখন বেশ ফুরফুরে ভাব। আরো গোটা দুই শাল পাতার ঠোঙায় নেবার আগে সবে তেঁতুলের বাকী জলটা সুরুৎ করে গালে দেবে - হঠাৎ  চিনি দিদির এক হ্যাঁচকা টানে সুখস্বপ্নটা গেল কেঁচে। খুব বিরক্ত হয়ে সে কিছু বলার আগেই চিনি দিদি ফিস্ ফিস্ করে বলল,'বড় গলিতে ছবি দাঁড়িয়ে, তোকে ডাকছে। আজ পাশের পাড়ার সঙ্গে তোদের খেলা নাকি - তার টিমটা ফাইনাল করবে।’ বুজু তাড়াহুড়ো করে একটা স্যান্ডো গেঞ্জি পড়ে চোখমুখ না ধুয়েই চুপিসাড়ে পিছনের গলিতে হাজির হল। হাজির তো হতেই হবে - ছবি ওর ক্লাস ফোর এর বেস্ট ফ্রেন্ড। আর মাঠেও  ওকে ছাড়া বুজুর চলে না।                                                      বুজুদের বাড়ির উঁচু আর তিনদিক খোলা টানা বারান্দাওয়ালা বাড়ীর একদম শেষের দিকে ছোট্ট একটুকু গলির একপাশে পরপর রান্নাঘর, চানের ঘর আর এককোনে গোয়াল ঘর। রান্নাঘরের শেষ ধরে টানা দুমানুষ সমান উঁচু দেওয়াল। আরো কিছুটা এগিয়ে দেওয়ালটা সামনের ছোট বাগানের শেষ কোনা ধরে ঘুরে গিয়েছে। দেওয়ালের খালি অংশটা প্রায় সারা বছর ধরে ঘুঁটে দেওয়ার কাজে কাজে লাগে। রান্নাঘরটা পেরোলেই দেওয়ালটায় একমানুষ সমান উঁচুতে একটা ছোটমতো খোঁদল আছে। তাতে বুজুর মতো ছোটরা ইচ্ছে হলে আরামসে গলে যেতে পারে। খুব দরকারে বুজু বাড়ির বাইরে যাবার এই শর্টকাট ব্যবহার করে - তবে চুপি চুপি। আজও তাই পিছনের বড় গলিতে চোখের নিমেষে হাজির হতে তার কোন অসুবিধা হল না। খোঁদলটা গলে দিল একটা ছোট্ট লাফ। গলিতে নামার পর খেয়াল হল তাড়াহুড়োয় চপ্পলটা পড়া হয়নি। তবে টিম করার জন্য কাগজ পেন্সিল সবই নিয়ে আসবে ছবি, খুব গোছালো আর করিৎকর্মা ছেলে ও।                                               
দুই বন্ধুই খেলাধুলাতে বেশ ভাল। বিশেষ করে নানা ফুটবল টুর্নামেন্টে খেলার জন্য ওরা হামেশা ডাক পায়।
সেবার পাল পাড়ার নেতাজী সংঘ হঠাৎ চার দশ হাইট এর টুর্নামেন্ট এ তাকে ডেকে নিল। কিন্তু বাইরে মাপিয়ে দেখা গেল তার উচ্চতা আধ ইঞ্চি মত বেশী।   
করিৎকর্মা ছবি এ সমস্যার দ্রুত সমাধান করে ফেলল। ও চটকরে একটা বেল্ট বুজুর প্যান্টের ভেতর দিক দিয়ে একটা বিশেষ কায়দায় পরিয়ে রাম টাইট করে বেঁধে দিল। কি হলো ঠিক বোঝা গেল না - হাইট মাপার জায়গায় দেখা গেল মাপ পাক্কা চার দশ, মানে চার ফুট দশ ইঞ্চি।            ‘বড়ো গলি”টা বেশ লম্বা চওড়া। হয়তো সে কারণেই এই নাম হয়েছে। গলি ধরে এগিয়ে গেলে একদিকে একটা বড় মাঠ। অপর দিকে বড় পিচ রাস্তা - বাস রাস্তায় পড়তে দু তিন মিনিট হাঁটা পথ । গলির পথ ধরে সেদিকে যেতে যেতে ছবি বলল, 'শোন, আজ আর বেশী সময় হাতে নেই, আটটায় ম্যাচ। টিম মোটামুটি তৈরি আছে।… আর শোন, আজ কিন্তু ফুটবল ম্যাচটা হবে না, আজ মিলন সংঘের সাথে হকি ম্যাচ নিয়েছি। তুই চট করে বাড়ী থেকে খেলার ড্রেসটা পরে মিলন সংঘের মাঠে আয়। ওখানেই হকি স্টিক পাবি। তবে তোর দাদার হকি স্টিকটা নিয়ে আসতে পারলে আরো ভাল। আমি ব্যাকে আছি, তুই সেন্টার  ফরোয়ার্ড। ভাবিস না, জিতব আমরাই’। 

বাড়ী ফিরতে বুজুর হঠাৎ মনে পড়লো হরিণঘাটার দুধ আনা বাকি। সেটা সেরেই তাকে আটটার মধ্যে মাঠে যেতে হবে। সকালের জলখাবার সেরে ‘বড় গলি’টা ধরে অল্প এগিয়ে চৌরাস্তার মোড়ে এসে বাঁদিকে ঘুরতেই ছোট্ট, নামকরা ‘পলা’র ঘুগনীর দোকানটা পেরোল ও। এরপর সামান্য হাঁটলে ডান হাতে গাড়িবারান্দাওয়ালা বিশাল দালান বাড়ি বাস রাস্তার দিকে মুখ করে। এর একতলায় ছড়িয়ে বহু পুরানো আর বড় বাজার। দালানের বাইরের দিকে নানান দোকান। একটা ঘরে হরিণঘাটার দুধের বুথ।                                                 
কার্ডে সবই লেখা আছে, তবু রোজের অভ্যাস মত খালি বোতল দুটো আর কার্ডটা দিতে দিতে বুজু বেশ ভারিক্কিচালে বলল, 'একটা কাউ মিল্ক আর একটা বাফেলো মিল্ক, দুটোই হাফ লিটার।‘ আসলে বাংলার সাথে দুটো একটা ইংরেজি শব্দ থাকলে তার কথা বলতে বেশ মজা লাগে। একজন শুভ্রকেশ ভদ্রলোক বুথেই কার্ড হাতে দাঁড়িয়ে। শ্যামলা, গোলগাল, মাথা ভর্তি কোঁকড়া চুলের বুজুকে তার ভারী ভাল লেগে গেল। কিছুটা যেন খাতির জমাতেই বললেন,

'বলতো দাদাভাই বাফেলো মানে কী?’ মুহূর্তে জবাব এল,

'বাফেলো মানে মহিষ'।

'বাফেলো বানান তুমি জান?’

'হাঁ, এইতো', বুজু খুব একটা গর্বের সঙ্গে বলল,

'ঐ তো ,…. বি-ইউ-এফ-এফ-এ-এল-ও।‘ বয়স্ক লোকটি উৎসুকভাবে তার দিকে তাকাতে বুজু দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে যোগ করল,

'হাঁ ,হাঁ - , একদম শেষে একটা ডাবলু আছে'। 

‘হাঁ বাবা, এতবড় বাফেলো - শেষে একটা ডাবলু থাকাই ভাল - কি বল?

'তা, তুমি কোন ক্লাসে পড়?' বুজুকে প্রশ্ন করায় মুহূর্তে জবাব এলো

'ক্লাস ফোর।‘

'খুব ভাল  --- ঘরে গিয়ে একবার বইতে বানানটা দেখে নিও কিন্তু' – শুভ্রকেশী মৃদু হেসে নিষ্ক্রান্ত হলেন।

দুধ নিয়ে আসার পথে ক্লাসের সমীরের সাথে দেখা। জ্ঞানবাবু স্যারের ছেলে।                           ‘কিরে বুজু,’, সমীর বলল,

‘খবর জানিস তো?’

 ‘কী রে ?’                                                                                                          ‘আজ তো স্কুল ছুটি।‘                                                                              

‘কীসের ছুটি,কাল স্কুলে কিছু বলল নাতো ?’                                                        

'আরে, নোটিশ বোর্ডে টাঙিয়ে দিয়েছে তো। তুই তো দেখলাম ড্রিল স্যারের ক্লাসটা শেষ হতেই ফুটবল নিয়ে মাঠে। গত পরশু স্কুল ইন্সপেক্টর এসেছিলেন তো - তাই আজ ছুটি দিয়েছে।‘ - সমীরের এই খুশ খবরে বুজুও বেশ উদ্বেল।   

কাল রথের ছুটি, পরশু রবিবার - দুধের বোতল দুটো একছুট্টে ঘরে রেখেই হকি মাঠে পৌঁছনো আশু প্রয়োজন,ভাবছিল বুজু। এতগুলো পরপর ছুটিতে কখন কি মজা করা যায় সেসব শলা করতে ছবিকে তার দরকার সবার আগে। আনমনে ঘরে ফেরার পথে একটা খটকা তার মনে মাঝে মাঝেই ঘুরে ফিরে আসছিল ---- তবে কি বাফেলো বানানে কোনও ভুল হল? ----- ভাবতে ভাবতে চলার পথে হঠাৎ বাঁ হাত থেকে দুধের বোতলটা গেল পড়ে।   
বুকটা ছাঁৎ করে উঠলো আজ কপালে কি আছে কে জানে। ভয়ে ভয়ে মাথা নিচু করে সেটা তুলতেই বোঝা গেল বোতলটা অক্ষত। দেখল, একটা ছোট্ট বালির ঢিপির মত জায়গায় পরে বোতলের সিলটা পর্যন্ত খোলেনি।……আজ সকাল থেকে কেন যেন সবকিছু ভাল ভালই যাচ্ছে,   
বারান্দার কোনে রাখা হকি শ্যু টা পরে, দাদার হকি স্টিকটা নিয়ে বুজু বেরোবে এমন সময় বাইরের দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ। এক দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলতেই ও দেখল একজন মাঝবয়সী লোক হাসিমুখে দাঁড়িয়ে। হাতে চ্যাপ্টা পিচবোর্ডের বাক্স, বেঙ্গিকে খুঁজছেন। কিন্তু মা’র ডাকনাম এ লোকটা জানল কী করে। মাকে ডাকতে যেতেই বুজুকে তিনি থামালেন - বুজুর হাতে ওই বাক্সটি আর একটি ছোট্ট খাম ধরিয়ে দিয়ে বললেন, 'তোমার মায়ের হাতে এই চিঠি আর লাড্ডূর বাক্সটা দেবে, বলবে - সামু কাকু এসে পরে দেখা করে যাবে। আজ আমার হাতে সময় বড় কম। ঘরে গিয়ে মাকে সব দিতে চিঠিটা পড়তে পড়তে মা বলল, 'বুজু, একটু দাঁড়িয়ে যা, তোর মেজকা দিল্লী থেকে লাড্ডু পাঠিয়েছেন- সামুর হাত দিয়ে। একটা খেয়ে যাবি নাকি?’

'’বাক্সর উপর ও গুলো কী  লেখা মা?', ইতিমধ্যে বাক্সটার গায়ে হিন্দিতে লেখাগুলোর দিকে নজর পড়েছে বুজুর।      

'ও কিছু না, লিখেছে - দিল্লীর লাড্ডু খেলেও পস্তাবি না খেলেও পস্তাবি’,  হাসতে হাসতে মা বুজুর হাতে একটা লড্ডু দিল।  

'হাঁ, এই চিঠিতে বুজুর জন্য একটা দারুণ খবর আছে। তোর জন্য একটা দুচাকার সাইকেল কিনতে কাকীমা টাকা দিয়েছে সামুকে। ও দিন কয়েকের মধ্যে সাইকেলটা দিয়ে যাবে।' এ খবরে আনন্দে লাফাতে লাফাতে বুজু দৌড় দিল মাঠের দিকে।                                                             গলি দিয়ে বেরোতে যাবে, জ্যাঠাতো ভাই শিবুর সাথে দেখা। সে সমবয়সী, ওদের পাশের বাড়িতে থাকে। কথা বলতে বলতে এগিয়ে যাওয়ার পথে ওর কাঁধে হঠাৎ মৃদু চাপড় পড়ল। ফিরে দেখে রবিদা। ওর বড় পিসির ছেলে।

'বুজুবাবু, মাঠ থেকে ফিরবে কখন?’

‘এইতো, ঘন্টা খানেক বাদেই। কেন রবিদা?’

‘চিড়িয়াখানায় যাবি তো বল, শিবুও যাচ্ছে ‘  

‘আজ?’, বিশাল উত্তেজনা চেপে বুজুর প্রশ্ন।

‘হাঁ,আজই তো।‘

'চল চল, বড়মামীকে বলে এসেছি আমি। ওখানেই খেয়ে নিবি দুপুরে।‘- রবিদার মুখে প্রশ্রয়ের হাসি। বুজুকে যে এতটা স্নেহ করেন রবিদা, এ তার জানা ছিল না। সে খুব খুশি আর অবাক হয়ে একদৌড়ে মিলন সংঘের মাঠে হাজির হল।

বড়দিদি বারবার করে বলে রাখা সত্ত্বেও বাড়ি ফিরতে দেরীই হয়ে গেল বুজুর - সন্ধ্যা পার হয়ে গেল।

রবিদার সাথে চিড়িয়াখানায় পশুপাখি দেখা ছাড়াও খাওয়া দাওয়া, হরেক মজার পর ফেরার পথে আবার ছবির সাথে পাড়ায় দেখা। সে একদম টেনে নিয়ে গেল রথের মেলায়। ম্যাজিক এর দোকান থেকে ম্যাজিক বাক্স আর কৃষ্ণনগর এর ঘাড় - নাড়া বুড়ো কেনার ইচ্ছে গত বছরই তার ছিল। কিন্তু

আগেই এটা সেটা কিনে, নাগর দোলায় চড়ে আর নানা রকম খাবার সাঁটিয়ে প্রায় ফতুর হয়ে গেছিল সেবার। আর এবার তো দুটো পকেটই ফাঁকা। সেকথা ছবিকে বলতেই ঘনিষ্ঠ বন্ধুটি আজ যেন কল্পতরু, 'শোন, আজ মেলায় তোর পছন্দের ভাল ভাল যা যা কেনার দুটো করে কিনব - একটা তোর আর একটা আমার। বাবা আজ অনেকগুলো টাকা আমাকে পাব্বুনী দিয়েছে। বুজুর মনে হল ছবির এই উদারতার কারণ হয়ত আজ হকি ম্যাচ জেতায় তার করা দুখানা গোল।

রথের মেলায় পছন্দের কেনা কাটা, নানান মজা, খাওয়া দাওয়া এসব সারতেই বিকেল প্রায় গড়িয়ে গেল...... সন্ধ্যার মুখে মুখেই ‘একটা লোকের দুটো মাথা' দেখানর তাঁবুটা থেকে একটা ভয়ার্ত কাতর গোঙানোর আওয়াজ শুরু হতে - দুই বন্ধু ভয়ে ভয়ে সে এলাকা থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়ল। …….                                                                                          

এরপর আবার দু’খানা ‘আধতেল’ ঘুড়ির লোভে পাড়ার দীপুদার প্রতিশ্রুতি মত তার বাড়ি যাওয়া - সেখানে মাসিমার সাথে দু – একটা কথার পরে সান্ধ্য পূজার প্রসাদ খাওয়া শেষ হতে দীপুদার লোটা ঘুড়ি দুটো পুরানো আলমারীর মাথায়, বেশ কিছুটা মাঞ্জা দেওয়া সুতোর সঙ্গে পাওয়া - এ সমস্ত মিলিয়ে আরো বেশ কিছুটা সময় কেটে গেছে।

কিন্তু দিদিকে সঙ্গে নিয়ে স্কুলে যেতে হবে যে - কয়েকটা ফার্স্ট আর সেকেণ্ড প্রাইজ নেবার আছে তার। অনেক দেরী হয়ে গেল। এর মধ্যে যদি প্রাইজ দেওয়া হয়ে যায়? … বুজু হন হন করে বাড়ীর দিকে এগুতে লাগল। 
বাইরের দরজার কড়া নেড়ে ঢোকার আগেই পিছন থেকে দিদির ডাক।  

‘কিরে? এত দেরী করলি - কখন স্কুলে যাবি আজ?'   
‘চল না, এখুনি যাব। এইতো চিড়িয়াখানা দেখে ফিরলাম। বিশুও তো সঙ্গে ছিল।‘ - বুজু সভয়ে আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল। 
'সে সব ঘরে গিয়ে ভাল করে শুনব।' দিদি থামিয়ে দিয়ে বলল।

'এখন ব্যাগে কী কী এনেছি দেখ'- দরজা খোলার আগেই, দিদি কাঁধে ঝোলান সাইড ব্যাগ থেকে রঙিন ফিতে বাঁধা বড় একটা কাগজের প্যাকেট বার করে দেখাল।                                        ‘বল তো, কী আছে এতে?’                                                                                    ‘কি জানি।‘                                                                                                      ‘এতে আছে আজ স্কুলে বুজু বাবুর পাওয়া সব কটা প্রাইজ। গত তিন বছরের জন্য দিয়েছে ছ ছটা সুন্দর বই। এছাড়া  দুবছর পর পর প্রথম হওয়ার জন্য আবার বিশেষ পুরস্কার - একটা খুব ভাল ফাউন্টেন পেন। সাথে একটা নতুন রকম ড্রয়িংবক্স।‘- দিদি এক নিঃশ্বাসে সব বলে গেল। চমক আর আনন্দে তাল না রাখতে পেরে বুজু একটানে দিদির হাত থেকে সেই প্যাকেটটা কেড়ে নিতে গেলে বুজুর মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দিদি আদরের কণ্ঠে বলল,

'আগে ঘরে চল, সবাই মিলে একসাথে তোর প্রাইজগুলো দেখব। তোরই তো সব। আমি তোর দেরী দেখে হেডস্যারের সাথে কথা বলে প্রাইজগুলো তোর হয়ে নিয়ে এলাম। স্যার কত প্রশংসা করলেন তোর।“                                                  
ঘরে ঢুকে মুগ্ধ বিস্ময়ে পুরস্কার পাওয়া বইগুলোর ওপর প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল বুজু।

‘ওরেব্বাস, …. এতো সব সুন্দর বই’, তার স্বগতোক্তি,‘

’নেতাজী, …. বিবেকানন্দ ,…. আর এটা  - মাদাম কুরীর জীবনী। …..আবার সুকুমার রায়ের পাগলা দাশু, হযবরল, ….. আর এটা .. এটা  কার লেখা?------

ও এটা তো বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আম আঁটির ভেঁপু।‘

---- বুজুর এই প্রাপ্তি বহু প্রতীক্ষিত, নতুন আনন্দে আজ তাই সে উচ্ছল, প্রায় আত্মহারা।

---- তার এত আনন্দ হচ্ছে ----- মনে হচ্ছে যেন সে আজ সব পেয়ে গেছে।

---- গোটা দিনটাই যেন সে সব পেয়েছির দেশে ভেসে ভেসে চলেছে। ….. কিন্তু মা কোথায়?

বুজু আনন্দে দুটো ডিগবাজি খেয়ে, মাকে এসব কথা তক্ষুনি জানাতে ডাক দিল,

'মা  .......।  ও..ও মা।'

আরে, ঐ তো  রান্না  ঘরে  পিছন  ফিরে মা।

'মা  .......। ও মা।' …. কিন্তু  মা  সারা  দিচ্ছে না কেন? ‘....... ও ..ও  মা..আ' এবার আরো একটু জোরে মা কে ডাকল সে।                                                                               অস্ফুট কিছু শব্দে ঘুমটা ভেঙে গেল বিজনবাবুর। ভোরের আলো তখনও ফোটেনি ভাল করে। কিন্তু 'মা' --- 'মা বলে কে ডাকছে শুনলেন যেন তিনি। নিজেই কি ডাকছিলেন ঘুমের ঘোরে? মা কে ডাকছিলেন? কিন্তু ---- মা আর এখন কোথায়? মা তো কবেই ---। পাশে তার স্ত্রী মণিমা গভীর ঘুমে। তাকেই কি খুঁজছিলেন?

ইতিমধ্যে ভোরের নরম আলো জানালা পথে এসে ঘরকে রঙ্গীন করে তুলেছে। ওদিকে বাইরের গাছগাছালি থেকে পাখীর কাকলির টুকরো টাকরা ঘরে ভেসে আসছে। আলোর পরশে সুপ্তির আবেশ থেকে বোধের উত্তরণে ধীরে ধীরে ভরে উঠল বুজু অর্থাৎ বিজন বিহারী রায়ের মন।           কিন্তু, বিজনবাবুর আজ আর কোনো কিছুতেই তাড়া নেই। তিনি চোখ মেলে তাকালেন না ... ... আজ ধীরে ধীরে কেন যেন নানা কথা এই সময় মনে পড়ছে তার। কত পুরানো কথা মনে ভীড় করে আসছে একে একে.......... 

বিজনবাবুর মনে পড়লো, …… সেদিন হকি ম্যাচে দুটো গোল করে একটাও পাওয়া যায়নি। রেফারি সঠিক ফল্ট আর ‘ডি এর নিয়ম ভাঙার অজুহাতে দুটো গোলই নাকচ করে - যদিও একদম জেনুইন ছিল গোল দুটো।                                                                                      ---- এ ছাড়া, এতো বাড়ির সবাই জানে, যেদিন সকালে দিল্লী থেকে কাকিমার পাঠান লাড্ডু ওদের ঘরে আসার কথা, মা অন্যত্র ব্যস্ত থাকায় কী ভাবে যেন তা লাগোয়া পাশের ঘরের আত্মীয় বৌদির হস্তগত হয়। ফলে একটিও বুজুদের হাতে এসে পৌঁছয়নি। ‘দিল্লি কা লাড্ডু না খেয়েই এইভাবে পস্তাতে হয়েছিল সেবার।
…… আর, দু চাকার সাইকেল! …………                                                                     অনেকদিনের শখ ছিল তার - অনেকদিনের - একটা নতুনা দু চাকার সাইকেলের। বড় কাকীমা সেবার দিল্লী থেকে এসে স্কুলে বুজুর পর পর দুবার ফার্স্ট হওয়াতে খুব খুশী হয়ে তাকে একটা দু চাকার সাইকেল দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফিরে যাওয়ার পর সে বেশ ক’বছর শুধু অধীর অপেক্ষায় থেকেছে তা নয়, দেয়ালের ওই ছোট গর্ত পেরিয়ে লাফ দিয়ে নেমে এক দৌড়ে সামনের চিঠি ফেলার বাক্সে চুপি চুপি কত যে চিঠি পাঠিয়েছে কাকীমাকে তার ইয়ত্তা নেই। ….. অবশ্য অতি দীর্ঘ ও বৃথা অপেক্ষার পর তার কলেজ জীবনে কেনা হয়েছিল সেটি। নিজের স্কলারশিপের টাকায়। 
কেন দীপুদার প্রতিশ্রুত সেই ‘আধতেল’ ঘুড়ি ----?  দীপুদার কথা মত তার বাড়িতে বসার ঘরের টেবিলে, উপরে, নীচে,আনাচে কানাচে কোথাও কোনো ঘুড়ি পাওয়া যায়নি সেদিন। বোকা বোনে গিয়ে বিমর্ষ মুখে ফেরার পথে অবশ্য মাসিমা সান্ধ্য পুজোর প্রসাদী একটা প্যাঁড়া বুজুকে দিয়েছিলেন।        

--- আর, সেই রথের মেলার কেনা 'ঘাড়নাড়া বুড়ো', 'ম্যাজিক বাক্স', লটারিতে 'চকোলেট আইসক্রিম? ... কোথায় কী! সেদিন বাড়িথেকে পাওয়া সামান্য কিছুর সঙ্গে জমানো টিফিনের পয়সা থেকে অল্প কিছু , আর বড়দের এর তার থেকে চেয়েচিন্তে যৎসামান্য পাব্বুনী জোগাড় করা গেলেও ছবির সঙ্গে সারা মেলা ঘুরে তাড়িয়ে তাড়িয়ে তেলেভাজা, ঘুগনি, জিলিপি, পাঁপড়ভাজা এসব উদরস্থ করার পর ওসব কেনার পয়সাই বা আর ছিল কোথায়?
সেদিন শিবুদার চিড়িয়াখানা দেখানোর কথা মনে পড়লে এখনো বিজনবাবুর বেশ অস্বস্তিকর লাগে। সেদিনের বালক বুজু বাড়িতে প্রায় একটা পর্যন্ত রবিদার জন্য অপেক্ষা করে করে ধৈর্যের বাঁধ ভাঙলে পাশের বাড়িতে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে শিবু আর রবিদা চিড়িয়াখানায় ঠিক সময়েই রওনা হয়েছে - বিশাল লম্বা ভীড় থাকাতে লাইনে দাঁড়ান একজনকে দুটোর বেশী টিকেট না দেওয়ায় নাকি বুজুর জন্য অনেক চেষ্টাতেও টিকেট জোগাড় করা যায়নি।
বিজনবাবুর অল্পস্বল্প মনে পড়ল সে সময় পূজার মরশুমে পাড়ার বিভিন্ন প্যান্ডেলে আবৃত্তি প্রতিযোগিতার কথা। মনে পড়লো, বেশ কয়েকবার, সে সময়, বুজু  প্রথম বা দ্বিতীয় হয়েছিল। কিন্তু হলে কি হবে প্রতিশ্রুত মেডেলগুলি তাকে দাওয়া হয়নি কখনই। পরে বুঝেছিল ওটাই তখনকার মোটামুটি দস্তুর। মনে লাগেনি। ------কিন্তু, স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষায় পর পর প্রথম, দ্বিতীয় হবার পুরস্কারগুলো!
এখনো পরিষ্কার মনে আছে ------
অনেকক্ষণ অপেক্ষার পরও সেদিন পুরস্কার প্রাপকদের মধ্যে তার নাম শোনা গেল না। মঞ্চের পিছনদিকে গিয়ে  অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডস্যারকে কিছু বলার জন্য ভয়ে ভয়ে এগিয়ে যেতেই তিনি ওকে প্রায় মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে বললেন, 'এই এদিকে একদম ঘোরাঘুরি করবি না। যা, ওই সামনে গিয়ে বস।‘ ….. বুজুর সাধ্য ছিল না এব্যাপরে আর কিছু বলার। কিন্তু কে জানে কেন, তার নাম আর ডাকাই হ’ল না।                                                                  
অবশ্য এই কাক ভোরে মণিমাকে ডেকে তোলা কি ঠিক হবে? নাঃ, থাক এখন -----। সবপেয়েছির দেশে ঘুরে আসার, ইচ্ছা পূরণের এই সদ্য পাওয়া অনির্বচনীয় পরিতৃপ্তি, প্রাপ্তির অসামান্য এ সম্পদ মনের ছোট্ট মনিকোঠায় পরম আদরে পুরে ফেললেন তিনি। এটি আর হাতছাড়া করা চলবে না। কেবল মাত্র দুজনে, তিনি আর বুজু, এ সম্পদ বারেবারে উপভোগ করবেন। যখন ইচ্ছা, আজীবন।          

অঘ্রান প্রায় শেষের দিকে। সুপ্তির পূর্ব মুহূর্তে স্মিত আস্যে পাতলা চাদরখানা গায়ে ভাল করে টেনে নিলেন বিজনবাবু।

গল্প

সম্বর্ধনা

কিশোর ঘোষাল

এস এন রায় রোড, কলকাতা

সম্বর্ধনা
talking1.jpeg

ফেব্রুয়ারী ২০২৫ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

জ সকাল থেকেই রজতশুভ্রবাবু বাড়িতে একেবারে হুলস্থূল কাণ্ড শুরু করে দিয়েছেন। গিন্নিকে ব্যতিব্যস্ত করে দিচ্ছেন, এমন কী মেয়েকেও ছাড়ছেন না। বারোটা পঞ্চান্নর কাটোয়া লোকালটা তাঁকে ধরতেই হবে। বারোটা পঞ্চান্নয় হাওড়া থেকে ট্রেন ধরা মানে তাঁকে অন্ততঃ সোয়া একঘন্টা আগে বেরোতে হবে। চিল্কা, তাঁর মেয়ে একবার বলেছিল, “আজ রোববার বাবা, আজকে তো আর অন্যদিনের মতো জ্যাম হবে না, পঁয়তাল্লিশ মিনিট আগে বেরোলেই চলবে। তাছাড়া চিন্তা করো না, আমি তোমাকে ওলা বা উবের বুক করে দেবো...সাঁ সাঁ করে হাওড়া পৌঁছে যাবে”। মেয়ের কথাটা মনঃপূত হয়নি রজতশুভ্রবাবুর, দাড়ি কামাতে কামাতে বললেন, “তোমাদের মতো - আমি শিরে সংক্রান্তি করতে পারবো না, বাপু। আমি একটু ধীরস্থির, হাতে সময় নিয়েই বেরোতে চাই। তোর মাকে বল, পঞ্চব্যঞ্জন কিচ্ছু রান্না করতে হবে না, দুটো ভাতে-ভাত ডিমসেদ্ধ করে দিক, আমি সোয়া এগারোটা নাগাদ খেতে বসবো”। অন্যদিন রজতশুভ্রবাবু একবার সোজা আর একবার উল্টো রেজারে শেভ করেন, আজ তিনবার করলেন, সোজা দুই, উল্টো এক। গালে মাছি বসলে, নির্ঘাৎ পা পিছলে যাবে! 
মেয়ের মুখে বাবার লাঞ্চের অর্ডার শুনে, খুন্তি হাতেই শুক্লা, রজতশুভ্রবাবুর গিন্নি, বেরিয়ে এলেন রান্নাঘর থেকে, বললেন, “তোমার কী মাথা-টাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি? যাচ্ছো একটা শুভ কাজে, তার আগে অলক্ষুণে ওই জিনিষটার নাম না বললেই চলছিল না?” রজতশুভ্রবাবু অবাক হয়ে গিন্নি এবং মেয়ের মুখের দিকে তাকালেন, অলক্ষুণে বস্তুটা কী সেটাই বুঝতে পারছিলেন না। গিন্নির পেছনে দাঁড়ানো মেয়ে ঠোঁট নেড়ে ফিসফিস করে বলল, “পাখিরা যে বস্তুটি তাদের বাসায় পাড়ে, সেটি গোল তাই অলক্ষুণে”। ভ্রূকুটি করে ঘাড় ঘুরিয়ে একবার মেয়ের দিকে তাকিয়ে গিন্নি আবার বললেন, “ভাত-মুগের ডাল, ঘি, পটলভাজা আর চারাপোনা ভাজা। শুভ কাজে মৎস্যমুখ করে যাওয়াটাই দস্তুর...”! রজতশুভ্রবাবু আর কথা বাড়ালেন না, সুবোধ বালকের মতো শ্বাস ফেলে বললেন, “বেশ, তা না হয় হল, কিন্তু সোয়া এগারোটা মানে এগারোটা পনের”। 
গিন্নি তাড়াহুড়ো করে রান্নাঘরে ঢুকতেই, রজতশুভ্রবাবু কাবার্ড থেকে জামা প্যান্ট গেঞ্জি রুমাল বের করতে লাগলেন। তাঁর পেছন পেছন মেয়েও এসে দাঁড়াল। বলল, “বাবা, আজকের দিনে রোজ অফিসে পরে যাওয়া একঘেয়ে জামা-প্যান্টগুলো পরো না, প্লিজ। ধুতি-পাঞ্জাবি না পরো, অন্ততঃ পাজামা-পাঞ্জাবি পরো”। কথাটা রজতশুভ্রবাবুর মাথাতেও এসেছিল, কিন্তু একটু লজ্জা-লজ্জা করছিল বলে, ও পথে হাঁটেননি। তিনি মেয়ের দিকে সস্নেহে তাকিয়ে প্রশ্রয়ের মৃদু ধমক দিয়ে বললেন, “ধুস্‌, এ কি বিয়েবাড়ি যাচ্ছি নাকি? অত সাজগোজ দেখলে লোকে বলবে কী?”
“কী আবার বলবে? যাঁরা তোমাকে ডেকেছেন, তাঁরা কী তোমাকে অফিসের কাজের জন্যে ডেকেছেন?”
“তা না... ইয়ে... তা অবিশ্যি ঠিক। তবে...ওসব পরে আমার কেমন যেন মনে হচ্ছে, একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে”!
“কিচ্ছু হবে না। আচ্ছা, তুমি এক কাজ করো, তুমি এখন চান করতে যাও, ততক্ষণে আমি সব বের করে রাখছি। আজকে চুলে একটু শ্যাম্পু দিও, বাবা। শ্যাম্পু করে আবার মাথায় গুচ্ছের তেল দিও না যেন, তোমার যা মাথা ঠাণ্ডার বাতিক...জুলপি দিয়ে তেল গড়ালেই হয়েছে আর কী!”
মেয়ের ভালোবাসা ও আদরে রজতশুভ্রবাবুর মনটা বেশ একটু মাখোমাখো হয়ে উঠল, খুব দুর্বল স্বরে তিনি প্রতিবাদ করে উঠলেন, “তোরা আমাকে কী পেয়েছিস বল তো? মা আর মেয়ে, যা নয় তাই বলে চলেছিস তখন থেকে। বলি, আমি কী তোদের হাতের পুতুল, যেমন সাজাবি, তেমন সাজতে হবে”! ফিক করে হেসে মেয়ে বলল, “তা নয় তো কী! যাও, যাও চানটা সেরে এস দেখি, ওদিকে পৌনে এগারোটা বাজতে চলল, সে খেয়াল আছে?” রজতশুভ্রবাবু কিছুটা চমকে উঠে বললেন, “ওঃ তাই তো! তোদের পাল্লায় পড়ে আমার যাওয়াটাই না ভেস্তে যায়। বললে তো আর শুনবি না, যা পারিস কর, আমি চানে চললাম”।

চান করে বেরিয়েই গামছাপরা রজতশুভ্রবাবু মেয়েকে ডাক দিলেন, “কই রে, টিকলু, কোথায় রাখলি তোর সব সঙের সাজ?” রজতশুভ্রবাবু মেয়েকে আদর করে টিকলু ডাকেন। টিকলু বাক্স থেকে বাবার স্যাণ্ডেলজোড়া বের করেছে। অনেকদিন ব্যবহার না হওয়াতে উড়ো ধুলো পড়েছিল, সাদা কাপড়ে সে দুটো মুছে চকচকে করতে করতে বলল, “তুমি আগে খেতে বস, বাবা। খেয়ে উঠে পাজামা-পাঞ্জাবি পরবে! বলা যায় না, ডালভাত পড়লে, পাঞ্জাবিতে দাগ ধরে যেতে পারে!”
রজতশুভ্রবাবু এবার একটু বিরক্তই হলেন, বললেন, “তার মানে? আমাকে কী বাচ্চা ছেলে পেয়েছিস? ভাত খেতে বসে থ্যাপথ্যাপ করে ভাত-ডাল গায়ে মাখব”? রান্নাঘর থেকে গিন্নি ভাতের থালা সাজিয়ে খাবার টেবিলে সাজিয়ে দিতে দিতে বললেন, “বাচ্চা ছেলেরও অধম! মেয়ে বাপকে ঠিকই চিনেছে! বসে পড়ো, সোয়া এগারোটা বলেছিলে, এখন মোটে এগারোটা পাঁচ। খেয়ে উঠেই দৌড়বে নাকি? একটু জিরিয়ে তারপর বেরোবে!” কিচ্ছু করার নেই, গামছা ছেড়ে ঘরে পড়ার পাজামাটা পরেই খেতে বসলেন রজতশুভ্রবাবু। গরমভাত, গাওয়াঘি। মুগেরডাল, বেগুনভাজা, পটলভাজা আর চারাপোনার সরষেঝাল। বেশ তৃপ্তি করেই খেলেন এবং আঁচাতে গিয়ে বুঝলেন, অন্যদিনের তুলনায় খাওয়াটা একটু বেশিই হয়ে গেছে! 
সোফায় আরাম করে বসে মেয়েকে বললেন, “তোর মায়ের না কাণ্ডজ্ঞান নেই! এক থালা ভাত খাইয়ে দিল। এইভাবে এখন যাওয়া যায়?” মুচকি হেসে টিকলু বলল, “ভালোই তো, ভাতটা কিছুক্ষণ পেটে থাকবে। সেখানে গিয়ে কী জলখাবার দেবে, কখন দেবে – তার কোন ঠিকানা আছে?  আরামসে একটু গড়িয়ে নাও না, তোমার হাতে এখনও মিনিট পনের সময় তো আছে!” রাগরাগ মুখ করে রজতশুভ্রবাবু মেয়েকে বললেন, “দে একটু মৌরিভাজা দে, যেমন মা তার তেমনি মেয়ে...হুঃ!” 
হাওড়ায় পৌঁছে টিকিট কেটেও হাতে আধঘন্টার মতো সময় রয়ে গেল। চিল্কা ঠিকই বলেছিল, আরো মিনিট পনের পরে বের হলেই চলত, কারণ আজ রোববার, কলকাতার রাস্তাঘাট অনেকটাই ফাঁকা। তবে হাওড়া স্টেশন চত্বরে ভিড় গিসগিস করছে, কোত্থাও বসার জায়গা খালি নেই। এক-একটা পরিবার প্রচুর লটবহর সমেত এক-একটা বেঞ্চ দখল করে বসে আছে। তাঁর সঙ্গে অবিশ্যি লটবহর বলতে কাঁধে ঝোলানো একটা কাপড়ের ব্যাগ। তার মধ্যে তাঁর লেখা সদ্য প্রকাশিত খানচারেক বই। চশমার খাপ। আর মৌরিভাজা-জোয়ানের ছোট্ট একটা কৌটো। এই ব্যাগটাও চিল্কা দিয়েছে, বাবার এই সাহিত্য সম্মানের কথা শুনে, কদিন আগে দক্ষিণাপণ থেকে কিনে এনেছিল। আগে বলেনি মেয়েটা, আজ একেবারে তাঁর হাতে তুলে দিল। রজতশুভ্রবাবু একটু লাজুক হেসে বলেছিলেন, এসবের আবার কী দরকার ছিল, আমার পুরোনো হাতব্যাগটাতো ছিলই! বাবার বই-টইগুলো ব্যাগে ভরতে ভরতে চিল্কা বলল, “আজ তুমি সাধারণ অফিসযাত্রী নও বাবা, তুমি সম্বর্ধনা নিতে যাওয়া সম্মানের সাহিত্যিক!” হাওড়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্মের একধারে দাঁড়িয়ে, মেয়ের কথাগুলো মনে করে, বড়ো তৃপ্তি পেলেন, রজতশুভ্রবাবু। “পাগলি, বড়ো হয়ে গেল কত। এই সেদিনের পুঁচকে মেয়েটা, এত কিছু বুঝতে শিখল কবে?” মনে মনে ভাবলেন তিনি। 

সব মিলিয়ে মিনিট পনের লেট করলেও নির্বিঘ্নেই স্টেশনে পৌঁছলেন রজতশুভ্রবাবু। এর মধ্যে তাঁর সঙ্গে দু বার ফোনে যোগাযোগ হয়েছে সমিতির কর্তার। তাঁরা স্টেশনে আসছেন রজতশুভ্রবাবুকে রিসিভ করতে। রজতশুভ্রবাবু কামরার দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন। ট্রেন প্ল্যাটফর্মে তখনো দাঁড়ায়নি, থামার আগে গড়িয়ে চলেছে ধীরে ধীরে। সব স্টেশনের কংক্রিটের প্ল্যাটফর্ম, মাথার ছাউনি, ওভারব্রিজ – প্রায় একই রকম হয়। তবুও রজতশুভ্রবাবু প্রত্যেকটির আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য অনুভব করেন। আর সেই বৈশিষ্ট্যটি বানিয়ে তোলে, সেখানকার ফেরিওয়ালারা, অপেক্ষারত যাত্রীরা, এমনকি প্ল্যাটফর্মে বসে থাকা ভিখিরিরাও! কলকাতা থেকে কিছুটা দূরের অচেনা এই স্টেশনের প্ল্যাটফর্মের দিকে তাকিয়ে, সেই বৈশিষ্ট্যটিই লক্ষ্য করছিলেন তিনি। 
“এই তো...অ্যাই বিপিন, এই দিকে, এই দিকে...স্যার এই কামরাতে রয়েছেন”। বলতে বলতে এক ভদ্রলোক ট্রেনের গতির সঙ্গে তাল রেখে প্ল্যাটফর্মে হাঁটতে হাঁটতে হাত তুলে নমস্কার করে জিগ্যেস করলেন, “আপনিই রজতশুভ্‌ভোবাবু তো”। 
“হ্যাঁ”। ভদ্রলোক নিজের কৃতিত্বে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে উঠলেন, “তবে? কোনদিন দেখাসাক্ষাৎ নেই, তবু কেমন চিনে নিয়েছি বলুন স্যার? আমি গণপতি দলুই, আমাদের সমিতির সেক্কেটারি, আমিই আপনার সঙ্গে ফোনে কথাবাত্তা বলছিলাম...আসুন স্যার, আসুন, সাবধানে নেমে আসুন”। ট্রেন দাঁড়িয়ে যেতে রজতশুভ্রবাবুকে গণপতিবাবু সাদরে আহ্বান জানালেন, আর তাঁর পাশে এই মাত্র উপস্থিত হলেন আরেকজন। প্ল্যাটফর্মে নেমে দাঁড়াতেই, তিনি একগাল হাসিমুখে নমস্কার করে বললেন, “আমি বিপিন হাজরা, স্যার। সমিতির কোষাধ্যক্ষ। হে হে হে হে, আপনার মতো মানুষের পায়ের ধুলোতে আমাদের শহর ধন্য হয়ে গেল, স্যার। বাইরে গাড়ি রাখা আছে। এই গরিবের বাড়ি গিয়ে একটু বিশ্রাম আর জলযোগ সেরে নেবেন, তারপর সাড়ে ছটা নাগাদ আপনাকে অনুষ্ঠানে নিয়ে যাবো, স্যার”। 
রাস্তা দেখিয়ে গণপতিবাবু ও বিপিনবাবু আগে আগে হাঁটতে লাগলেন। ওভারব্রিজ পার হয়ে, একনম্বর প্ল্যাটফর্মে গিয়ে বাইরের রাস্তায় পা দিলেন তাঁরা। সামনেই অজস্র রিকশার জটলা, একটু দূরে কিছু টোটোও রয়েছে। 
“বিপিনকাকা, এই যে এদিকে...চলে আসুন...” টোটোগুলোর কাছেই দাঁড়িয়ে থাকা এক ছোকরা হাত তুলে তাঁদেরই ডাকল। বিপিনবাবুও দাঁতের শোকেস সাজিয়ে বললেন, “ওই তো, বিষ্টু...হে হে হে হে হে...ওই আমাদের সারথি স্যার...চলুন, ওদিকে যাই। রেল কোম্পানি এই পর্যন্ত আসতে ওদের অ্যালাউ করে না। এটুকু স্যার, হাঁটতেই হবে”। 
রজতশুভ্রবাবু বললেন, “এ আর এমনকি? কিন্তু সাড়ে ছটায় অনুষ্ঠান শুরু হলে কতক্ষণে শেষ হবে গণপতিবাবু? আমার আবার ফেরাটা...”
“ও নিয়ে আপনি একদম টেনশন করবেন না, স্যার। আটটা পঁচিশের হাওড়া লোকাল আপনাকে ধরিয়ে দেব। তারপরেও সেই সাড়ে দশটা পর্যন্ত আরও চারখানা ট্রেন তো আছেই! কিচ্ছু চিন্তা করবেন না, স্যার!” 
রজতশুভ্রবাবু একটু আতঙ্কিত স্বরে বললেন, “আটটা পঁচিশ হলে তাও ঠিক আছে, এগারোটার মধ্যে বাড়ি পৌঁছতে পারব! কিন্তু তার থেকে দেরি হলে, বিপদে পড়ে যাবো যে, ভাই...”। 
গণপতিবাবু এবং বিপিনবাবু একই সঙ্গে হৈ হৈ করে বললেন, “আটটা পঁচিশের ট্রেন আপনাকে না নিয়ে যাবে না, স্যার”। হাঁটতে হাঁটতে তাঁরা টোটোর সামনে এসে গিয়েছিলেন, গণপতিবাবু বললেন, “উঠে পড়ুন, স্যার। আপনাকে আতান্তরে ফেলবো না, স্যার, আপনাকে নিরাপদে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বও তো আমাদের, না কী বলেন, স্যার!”
কোন কথা না বলে রজতশুভ্রবাবু মাথা নিচু করে টোটোয় চড়ে বসলেন, তাঁর পাশে বসলেন, গণপতিবাবু। আর ড্রাইভার বিষ্টুর পাশে বসলেন বিপিনবাবু। সবাই উঠে পড়তেই বিষ্টু গাড়িতে স্টার্ট দিল, বিপিনবাবু বললেন, “প্রথমে আমার বাড়িতে চল, বিষ্টু, ওখানে স্যার একটু ফ্রেস-ট্রেস হয়ে রেস্ট নেবেন। তারপর তুই সোয়া ছটা নাগাদ চলে আসবি, স্যারকে নিয়ে আমি ফাংশনে যাবো”। 
গণপতিবাবু বললেন, “আমাকে কাছারিপাড়ার মোড়ে নামিয়ে দিয়ে, তোমরা বেরিয়ে যাও, বিপিন। আমি বরং ওদিকে যোগাড়-যন্ত্র কেমন হচ্ছে দেখে নিই, বুজেছো? যে দিকে না দেখবে, সেদিকেই ব্যাটারা তোমায় ডোবাবে...”।  
বিপিনবাবু বললেন, “তুমি বড্ডো টেনশন করো গণাদা। ওখানে নিতাই আছে, হাবলা আছে। এমন অনুষ্ঠান ওরা কম করেছে! ঠিক সামলে নেবে। জানেন স্যার, আমাদের এই দিকটাতে শিল্প-সাহিত্য নিয়ে খুব আগ্রহ”। শেষ কথাগুলো বিপিনবাবু ঘাড় ঘুরিয়ে রজতশুভ্রকে বললেন, তিনি আরো বললেন, “এই অঞ্চলে আমাদের এই সমিতি, “সরস্বতী কলা ও শিল্প মণ্ডলী”, বহুদিনের প্রাচীন। সেই আমাদের বাপ-ঠাকুরদাদের আমল থেকে আমাদের সমিতি, বছরে দুটো সাংস্কৃতিক ফাংশন করে। পঁচিশে বোশেখ আর সরস্বতী পুজোয়। তাছাড়া সারা বছর কিছু না কিছু হুজুগ তো লেগেই আছে...। স্বাধীনতা দিবস, বিজয়া সম্মিলনী... কী বলো, গণাদা? আমাদের এখানে কম গুণীলোকের পা পড়েছে, বলো?” গণপতিবাবু বললেন। 
“সে আর বলতে? কত লোকের নাম বলবো, মিলন মুখুজ্জ্যে, দিগীন সান্যাল, অনুভব চৌধুরি...”
রজতশুভ্রবাবু ওঁদের কথা শুনছিলেন, আর রাস্তার দুধারের শহর দেখছিলেন। প্রাচীন শহর। পুরোনো পুরোনো আদ্যিকালের ভাঙাচোরা বাড়ি, তার মধ্যে আধুনিক ঝাঁ চকচকে বাড়িও রয়েছে। চাঁদসীর ক্ষত চিকিৎসালয়ের ঝুপসি ঘর, তার পাশেই ঝলমলে সিটি মার্কেট। টিমটিমে লক্ষ্মী জুয়েলার্সের পাশেই কলকাতার ঝলমলে গয়নার দোকানের শাখা। গলায় ফিঁতে ঝোলানো বিষণ্ণ দরজির দোকানের পাশেই, নামী ব্র্যাণ্ডের শোরুম...।
বিপিনবাবু বললেন, “হ্যাঁ, তারপরে তোমার ধরো, পীযুষ বটব্যাল, তনুময় হালদার, শেখর বিশ্বাস...তারপর ওই যে গো, খুব নাম করা, হাসির গল্প লিখতেন...মনে পড়েছে বিনয় দত্ত... কতজনের নাম আর বলবো, স্যার। আমাদের অনুষ্ঠান দেখলেই বুঝবেন, আমাদের এখানে শিল্প-সংস্কৃতির খুব চর্চা...”
কাছারিপাড়ার মোড়ে গণপতিবাবু নেমে গেলেন, তারপরেও প্রায় মিনিট দশেক বিপিনবাবুর কথা শুনতে শুনতে, গাড়ি এসে দাঁড়াল, বিশাল তিনতলা এক বাড়ির সামনে। বেগুনি আর হলুদ রংয়ে উজ্জ্বল বর্ণময়। 
টোটো থেকে নেমে বিপিনবাবু আরেকবার বিষ্টুকে সোয়া ছটায় আসার কথা মনে করিয়ে দিয়ে বললেন, “আসুন স্যার। এই হচ্ছে গরিবের কুটির...কই রে, বুল্টি, হারু, তোদের মাকে ডাক, কে এসেছেন দেখ...” বিপিনবাবুর ডাকে বাড়ির ভেতর থেকে এক কিশোরী আর একটি বালক দৌড়ে বেরিয়ে এল... “হেঁ হেঁ হেঁ হেঁ এইটি আমার কন্যা বুল্টি আর পুত্র হারু, প্রণাম করো মা, প্রণাম করো জ্যেঠুকে...লজ্জা কী...কতো বড়ো সাহিত্যিক জানো...”। বাড়ির দরজায় বিপিনবাবুর গৃহিণী এসে দাঁড়ালেন। রজতশুভ্রবাবুর মনে হল, একটু অগোছালো ভাবে পরা, কিন্তু তাঁর পরনের শাড়িটা খুবই দামী এবং তাঁর দুই বাহু এবং গলা ভর্তি সোনার গয়না। জোড়হাত তুলে নমস্কার করে বললেন, “কী ভাগ্যি আমাদের, আপনার মতো মানুষ আমাদের বাড়ি এলেন, আসুন আসুন, ভেতরে আসুন...বুল্টি ওঁনাকে ভেতরে নিয়ে বসার ঘরে বসা...কতদূর থেকে এসেচেন”!
বসার ঘরে সোফায় গিয়ে বসতেই, চঞ্চলা কিশোরী বলে উঠল, “আমি কিন্তু আপনার সব লেখা পড়ি”।

রজতশুভ্রবাবু ভীষণ আশ্চর্য হলেন। এই মফস্বল শহরের বিপিনবাবুর মতো ধনী ও বিষয়ী ভদ্রলোকের কন্যা, তাঁর সব বই পড়ে? তিনি অবাক স্বরে বললেন, “তাই নাকি? তা কী কী বই পড়েছো?”“বই? বই কী করে পড়বো? বাবা গল্পের বই কিনতেই দেয় না। বলে, ও সব না পড়ে পড়ার বই পড়, তাতে আখেরে কাজ হবে। আমি আপনার লেখা মোবাইলে পড়ি, ওয়েব ম্যাগাজিনে! আপনার লেখা ভূতের গল্প, গোয়েন্দা গল্প, হাসির গল্প - সব পড়ি। রিসেন্ট যে ভূতের গল্পটা লিখেছেন, ওই যে ভূতেরা বাঁশবনের ভেতর নিজেদের মুণ্ডু খুলে নিয়ে ভলিবল খেলছিল, আর মিহির গিয়ে সেটাকে লুফে নিল...দারুণ মজার হয়েছে, জানেন!”স্মিতমুখে রজতশুভ্রবাবু বললেন, “বাঃ। তোমার মতো ছোট্ট এক ভক্ত পেয়ে আমার খুব আনন্দ হল, বুল্টি। কোন ক্লাসে পড়ো। টেন না ইলেভেন?” দু হাতে কান ঢেকে বুল্টি বলে উঠল, “ও মা আপনি আমাকে বাচ্চা ভেবেছেন বুঝি? আমি রীতিমতো কলেজে পড়ি, সেকেণ্ড ইয়ার, হিস্ট্রিতে অনার্স”। 

কিছুটা অপ্রস্তুত রজতশুভ্রবাবু হেসে বললেন, “সত্যি তোমাকে দেখে বুঝতেই পারিনি, তুমি এত বড়ো। তোমার ভাল নাম কী, বুল্টি?”“ভালো নামটা বিচ্ছিরি, চন্দ্রাবলি। আপনি আমাকে বুল্টি বলেই ডাকবেন। ওই নামেই আমার

বন্ধুরাও ডাকে। আপনি ফেসবুক করেন? আপনাকে আমি ফ্রেণ্ড রিকোয়েস্ট পাঠাবো, অ্যাক্সেপ্ট করবেন, প্লিজ। আরেকটা কথা বলবো, আংক্‌ল্‌? রাগ করবেন না, বলুন?”
বুল্টির সহজ সরল আচরণ খুবই ভাল লাগছিল রজতশুভ্রবাবুর, এই প্রথম তিনি বুল্টিকে একটু লজ্জা পেতে দেখলেন, অবাক হয়ে জিগ্যেস করলেন, “কী বলবে, বল না! রাগ করব কেন?”
“আপনার সঙ্গে কয়েকটা সেলফি নেবো, প্লিজ। মা এখনি আপনার জন্যে জলখাবার নিয়ে আসবে, তার আগেই...”।
“বেশ তো, নাও না! তোমার মতো ভক্ত পাঠিকার সঙ্গে সেলফি নিতে রাগ করব কেন? আমাকে কিন্তু মনে করে, পাঠিয়ে দেবে...”। এরপর আর কিছু বলতে হল না, বুল্টি রজতশুভ্রবাবুর পাশে বসে এবং দাঁড়িয়ে চটপট বেশ কয়েকটা সেলফি তুলে নিয়ে বলল, “আপনার হোয়াটস্‌ অ্যাপ নাম্বারটা বলুন, আমি সেভ করে নিয়ে, এখনি শেয়ার করছি...”।
“৯২...”
এই সময়েই ঘরে এলেন বিপিনবাবুর স্ত্রী এবং তাঁর পিছনে স্বয়ং বিপিনবাবু। সামনের টেবিলের ওপর প্লেট সাজাতে সাজাতে বিপিনবাবুর স্ত্রী বললেন, “দোকানের ছাইপাঁশ নয়, এসব কিন্তু আমার নিজের হাতে বানানো, না বললে চলবে না, দাদা। অনেকদূর থেকে এসেছেন, নিশ্চয়ই খিদে পেয়ে গেছে। নিন শুরু করুন। বুল্টির পাল্লায় পড়েছেন তো, দাদা। ও মেয়ে দিনরাত ফোনে মগ্ন ... হয় ফেসবুক নয় হোয়াট্‌স্‌ অ্যাপ। আসতে না আসতেই আপনার ফোন নাম্বারটাও নিয়ে নিল, দেখবেন খুব জ্বালাবে...”। 
টেবিলের ওপর সাজানো গরম গরম লুচি, বেগুনভাজা এবং ঘুগনির বাটি দেখে রজতশুভ্রবাবু সত্যি সত্যি খিদেটা অনুভব করলেন।  বললেন, “না, না জ্বালাবে কেন? খুব ভালো মেয়ে। ইয়ে, মানে হাতটা একটু ধুলে হত...”। 
এতক্ষণ বিপিনবাবু হেঁ হেঁ হেঁ হেঁ ছাড়া অন্য কথা বলেননি, এখন হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলেন, “সে কী, বুল্টি মা? জেঠুকে বাথরুমটা দেখাওনি? তোমাকে বলে গেলাম যে...! আমার সঙ্গে আসুন দাদা, মুখহাতটা ধুয়ে নেবেন...”। 
হাতমুখ ধুয়ে খেতে শুরু করার আগে রজতশুভ্রবাবু ব্যাগ থেকে নিজের একটি বই আর কলম বের করলেন। প্রচ্ছদের দুটো পৃষ্ঠা পরে লিখলেন, “স্নেহের বুল্টি ও হারুকে”, নিচেয় সই করলেন। তারপর বইটি বুল্টির হাতে তুলে দিতে দিতে বললেন, “বিপিনবাবু, আপনাদের বাড়িতে এমন আপ্যায়ন পাবো, ভাবতেই পারিনি। আপনাদের আপ্যায়নের কৃতজ্ঞতায় আমার এই সামান্য উপহার। বইটি পড়ে আপনার পুত্রকন্যার মুখে যদি হাসি ফোটে, ভীষণ আনন্দ পাবো”। 
বুল্টি আনন্দে প্রায় লাফিয়ে উঠল, বলল, “ওয়াও, আমাকে দিলেন? উইথ অটোগ্রাফ! থ্যাংকিউ, থ্যাংকিউ থ্যাংকিউ সোওওও মাচ,  আংক্‌ল্‌!” 
বিপিনবাবু বললেন, “ঠিক আছে, মা, ঠিক আছে। জ্যেঠুকে প্রণাম করো। হেঁ হেঁ হেঁ হেঁ...” 

বিষ্টু কথার খেলাপ করেনি। সোয়া ছটাতেই এসেছিল এবং বিপিনবাবুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে অনুষ্ঠানের মাঠে আসতে মিনিট দশেকও লাগল না। খুব কিছু বাহুল্য নেই। ছোট্ট মণ্ডপ, ছোট্ট মঞ্চ। ফুলটুল দিয়ে পরিচ্ছন্ন সাজানো। মঞ্চের পেছনে টানটান করে ফেস্টুন টাঙানো, “গুণীজন সম্বর্ধনা ২০১৯ – সরস্বতী কলা ও শিল্প মণ্ডলী, মোহনপুর, হুগলি”। দর্শক বা শ্রোতাও মন্দ হয়নি। বেশ কিছু বয়স্ক মানুষ, অনেকগুলি কলেজে পড়া ছেলেমেয়ে, বুল্টিদের সমবয়সী বন্ধু-বান্ধবই হবে। আরও রয়েছে, বাচ্চা বাচ্চা স্কুলের ছেলেমেয়েরা, তারা মঞ্চের নিচে শতরঞ্চিতে বসে খুব কলবল করছে।
তিনি মাঠে ঢুকতেই মাইকে ঘোষণা চলতে লাগল, “আমাদের আজকের অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি স্বনামধন্য সাহিত্যিক শ্রীযুক্ত রজতশুভ্র মাড়িক উপস্থিত হয়েছেন। তাঁকে সম্বর্ধনা দেওয়ার জন্যেই আমাদের আজকের এই অনুষ্ঠান। বন্ধুগণ, এই অনুষ্ঠান কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হয়ে যাবে। আপনারা দলে দলে এসে যোগ দিয়ে এই অনুষ্ঠানকে সাফল্যমণ্ডিত করে তুলুন”। একই ঘোষণা চলতে লাগল, বারবার, লাগাতার। রজতশুভ্রবাবুর মনে হল, টিকলুটা আজ সঙ্গে এলে, পুরো ব্যাপারটা খুব এনজয় করত!
স্থানীয় বিশিষ্ট মানুষজনের সঙ্গে পরিচয় ও নমস্কার পর্ব শেষ করে, রজতশুভ্রবাবুকে নিয়ে গণপতিবাবু মঞ্চে উঠলেন। মঞ্চের ওপর পাঁচটি চেয়ার। মাঝখানের চেয়ারটি ছেড়ে রেখে সকলেই বসলেন। রজতশুভ্রবাবুকে পাশে নিয়ে বসলেন গণপতিবাবু। সকলেই প্রস্তুত কিন্তু সকলেই সভাপতির প্রতীক্ষা করতে লাগলেন, যিনি মাঝের ওই চেয়ারটিকে অলংকৃত করবেন। 
মাইকে বার বার ঘোষণা হচ্ছে, তাঁর নাম এবং পল্লিবাসীবৃন্দদের দলে দলে যোগ দিয়ে এই অনুষ্ঠানকে সাফল্যমণ্ডিত করে তোলার আহ্বান। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই অনুষ্ঠান শুরু হবে... কিন্তু ক্ষণে ক্ষণে রজতশুভ্রবাবুর ঘড়ির কাঁটা যেন দৌড়তে লাগল, সাড়ে ছয়, পৌনে সাত...সাত...সাতটা দশ...। 
রজতশুভ্রবাবু নিচু হয়ে পাশে বসা গণপতিবাবুকে বললেন, “গণপতিবাবু, এখনও শুরু হল না, শেষ হতে হতে অনেক রাত হয়ে যাবে যে...আমার ফেরার ট্রেন...”
গণপতিবাবু একটু অস্বস্তি নিয়ে বললেন, “তাই তো, কি করা যায় বলুন তো। সভাপতিমশাই গত একঘন্টা ধরে বলছেন, পাঁচমিনিটের মধ্যে আসছি...তাঁকে ছাড়া অনুষ্ঠান শুরুও করা যায় না...”।
“তাহলে বরং আমাকেই ছেড়ে দিন। নটা সাড়ে নটা হয়ে গেলে, খুব মুশকিলে পড়ে যাবো...”।
“কী বলছেন, স্যার? আপনাকে আমন্ত্রণ করে নিয়ে এসেছি, আর আপনি চলে যাবেন...এ যে মোহনপুরের লজ্জা। ছি ছি ও কথা মুখেও আনবেন না, স্যার। কিছু একটা ব্যবস্থা করে ফেলব স্যার”। গণপতিবাবু বিপিনবাবু এবং আরো কয়েকজন ভলান্টিয়ারকে ডাকলেন, জিজ্ঞাসা করলেন, “কী খবর হে?” কাঁচুমাচু হয়ে সকলেই বলল, “শুনেছি অন রোড,  রওনা হয়েছেন। বারবার ফোন করলে, দাদা খুব বিরক্ত হন, স্যার”।
রজতশুভ্রবাবু দুশ্চিন্তার শেষ সীমায়, সাড়েসাতটা নাগাদ সভাপতি মশাইয়ের গাড়ি এসে দাঁড়াল, মাঠের গেটে। অনেকেই হৈচৈ করে তাঁকে অভ্যর্থনা করার জন্যে এগিয়ে গেল। গণপতিবাবুর সঙ্গে রজতশুভ্রবাবুও  উঠে গিয়ে মঞ্চের ধারে দাঁড়ালেন। সভাপতিমশাই আসছেন। তাঁকে ঘিরে আসছে, অন্ততঃ জনা ত্রিশেক ছোকরা। মাইকে ঘোষণা হচ্ছে বারবার, “সভাপতিমশাই চলে এসেছেন, আমাদের অনুষ্ঠান এখনই শুরু হবে। সকল পল্লিবাসীদের অনুরোধ করা হচ্ছে, তাঁরা যেন অবিলম্বে এখানে উপস্থিত হয়ে অনুষ্ঠানকে সাফল্যমণ্ডিত করে তোলেন”। 
ভিড়ের মধ্যে বোঝা যাচ্ছিল না, কিন্তু মঞ্চে ওঠার সিঁড়িতে বোঝা গেল গোলগাল আকারের সভাপতিমশাই কিছুটা তরল অবস্থায় রয়েছেন। দুজনের কাঁধে ভর দিয়ে মঞ্চে উঠে সকলের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হল। সকলেই প্রচুর পরিমাণে হেঁ হেঁ হেঁ হেঁ বললেন, কিন্তু তিনি কিছুই বললেন না, শুধু শুনলেন। আর ভিখারিকে ভিক্ষে না দেওয়ার সময় লোকে যেমন কপালে হাত তোলে, সেভাবে হাত তুলতে লাগলেন। শেষে রজতশুভ্রবাবুর সঙ্গে পরিচয় হল। মঞ্চের ওপর নিজের চেয়ারে আরাম করে বসতে না বসতেই, কেউ একজন একটা মাইক ভাঁজ করে তাঁর মুখের কাছাকাছি ফিট করে দিয়ে গেল। 
রাজকীয় আসনে আড় হয়ে বসে, সভাপতিমশাই মোলায়েম স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, “ড়জতসুভ্‌ভোবাবু, আপনি কী করেন?” মাইক একটু দূরে হলেও, উপস্থিত শ্রোতারা সে কথা স্পষ্টই শুনতে পেল। 
রজতশুভ্রবাবু সবিনয়ে বললেন, “আমি? ওই একটু আধটু লিখিটিখি আর কী”!
“ধূর মশাই, কী লেকেন সেটাই তো জানতে চাইছি”। 
“ইয়ে..মানে গল্প-সল্প, ছোটোদের জন্যে, বড়দের জন্যে...”। 
“গল্প লেকেন? কই আপনার নাম তো শুনিনি কোনদিন। রবিঠাকুর বলুন, শরৎ, বঙ্কিম বলুন, সবার নাম শুনেছি, কিন্তু আপনার নাম, নাঃ কক্‌খনো শুনিনি। ও গণপতিদা, এ সব কাকে ধরে আনচো মাইরি, সম্বদ্ধনা দেবে বলে? আমাদের ক্লাবের একটা পেস্টিজ নেই? আমাদের এই পল্লির একটা সুনাম নেই?” 
মঞ্চে এবং সামনের শ্রোতা ও দর্শকদের সকলেই স্তব্ধ, নির্বাক। সভাপতিমশাইয়ের গলা এখন চড়ছে, মাইকে সে কণ্ঠ সকলেই শুনছে। সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে সভাপতিমশাই বললেন, “আমাকে এই সভার সভাপতি করেচো। আর আমিই জানিনা উটকো কাকে না কাকে সম্বদ্ধনা দিচ্চো। আমাকে একবার জিগ্যেস করতে পারতে! আমাদের হারাধন রয়েচে, দেঁতো নারাণ রয়েছে, ওরাও তো লেকে। দেয়াল লেকে, ফেস্টুন লেকে...আমাদের পোচারের বক্তব্য লেকে। ঘরের ছেলেদের ছেড়ে দিয়ে, উটকো বহিরাগত কেন?”
রজতশুভ্রবাবু সবিনয়ে বললেন, “আপনাদের সকলকে খুবই বিড়ম্বনায় ফেললাম। তাহলে আমি এখন আসি?” এখন আটটা বাজতে দশ, এখনও বেরোলে তিনি অনায়াসে আটটা পঁচিশ পেয়ে যাবেন। এসময়ে হঠাৎই তাঁর মনে হলে, টিকলুটা ভাগ্যিস আসেনি, এলে কী ঝকমারিই না হত!
“আসি নয়, কেটে পড়ুন। ছাতারমাথা কী লিকছেন, আমরা কেউ জানতেই পারলাম না, আর আপনি চলে এলেন সম্বদ্ধনা নিতে...ও গণপতিদা, এসব আপদ বিদেয় করে অনুষ্ঠান শুরু করুন তো!”
ওদিকে মাঠের গেটের কাছে তখন জোর হট্টগোল শুরু হয়েছে, একদল উত্তেজিত ছেলেমেয়ে দৌড়ে আসছে মঞ্চের দিকে। তাদের বক্তব্য আমন্ত্রিত একজন গুণীব্যক্তিকে এভাবে অপমান করার অধিকার সভাপতিমশাইকে কে দিয়েছে? মঞ্চে ওঠার আগেই তাদের বাধা দিল সভাপতিমশাইয়ের সঙ্গীসাথিরা। সেখানে ভীষণ উত্তেজনা, মারামারি শুরু হবার উপক্রম। রজতশুভ্রবাবুর কানেও ওদের উত্তেজিত কথাবার্তা কানে আসছিল। তিনি অসহায় বোধ করতে লাগলেন, তাঁকে নিয়ে এমন হাঙ্গামা শুরু হবে, তিনি কল্পনাও করেননি। মঞ্চের ওপরেও শুরু হয়ে গেল বিশ্রী বিশৃঙ্খলা। রজতশুভ্রবাবু আতঙ্কে পিছিয়ে গেলেন মঞ্চের একদম পিছনদিকে। সামনে তখন তাণ্ডব চলছে মঞ্চের ওপর। 
হঠাৎ মণ্ডপের পিছনের কাপড় সরিয়ে মঞ্চে উঠে এল বুল্টি আর বিষ্টু। বুল্টি রজতশুভ্রবাবুর হাত ধরে বলল, “আংক্‌ল্‌, তাড়াতাড়ি চলে এসো আমার সঙ্গে, এসব নোংরা ঝামেলার মধ্যে তুমি জড়িও না”। রজতশুভ্রবাবু মঞ্চের দিকে একবার দেখলেন, তারপর ওদের সঙ্গে লাফ দিয়ে নেমে এলেন মাটিতে। তিনজনে দৌড়ে গেটের বাইরে এসে, চেপে পড়লেন বিষ্টুর টোটোতে। বুল্টি আর রজতশুভ্রবাবু পিছনে বসতেই, বিষ্টু টোটোতে স্টার্ট দিল। 

স্টেশনে পৌঁছে জানা গেল ট্রেন মিনিট পঁচিশ লেট। টিকিট কাটার তাড়া নেই, রজতশুভ্রবাবু আসার সময়েই রিটার্ন টিকিট কেটেছিলেন। হাতে প্রায় মিনিট কুড়ি সময় রয়েছে। 
বিষ্টু বলল, “একটু চা খাবেন, স্যার? আপনি টোটোতেই বসুন, আমি নিয়ে আসছি, বুল্টি চা খাবি তো?” বুল্টি কোন উত্তর দিল না, বিষ্টুর চোখে চোখ রেখে সম্মতি জানাল। 
বিষ্টু চা আনতে যাওয়ার পর, বুল্টি বলল, “আপনার নিশ্চয়ই খুব খারাপ লাগছে, তাই না, আংক্‌ল্‌”? এ কথার উত্তর আর কী দেবেন, রজতশুভ্রবাবু? তিনি চুপ করে, বুল্টির দিকে তাকালেন। রজতশুভ্রবাবুর চোখে চোখ রেখে বুল্টি বলল, “আমাদের শহরের লোক কিন্তু এমন না, আংক্‌ল্‌, তারা ভীষণ ভালো। দু-একজন লোকের জন্যেই এমন বদনাম হয় আমাদের। আপনার এই অপমান আমরাও সহ্য করব না, আংক্‌ল্‌। এরপর আপনাকে আমাদের কলেজে ডাকব, তখন দেখবেন আমরা কত ভাল!”
রজতশুভ্রবাবু হাসলেন, বললেন, “তোমাদের বাড়ির সকলকে এবং তোমার মতো মিষ্টি একটি মেয়েকে না দেখলে, হয়তো খারাপ ধারণা নিয়েই বাড়ি ফিরতাম। কিন্তু তোমাদের তো কোন দোষ নেই...”।
বিষ্টু এই সময়েই চা নিয়ে এল, ছোট একটা প্লেটে বসানো, কাগজের কাপে তিন-কাপ। রজতশুভ্রবাবু এবং বিল্টুকে চা দিয়ে, নিজের কাপ নিয়ে বসল, সামনের সিটে। 
বিষ্টু চায়ে হাল্কা চুমুক দিয়ে বলল, “আমরা জানতাম স্যার, এরকম কিছু একটা হবে”!
রজতশুভ্রবাবু বেশ অবাক হয়ে বললেন, “তোমরা জানতে?”
বুল্টি বলল, “হ্যাঁ স্যার। ওই সভাপতির মতো বাজে লোক এই শহরে আর একজনও নেই। ক্ষমতা আছে, টাকা আছে, মনে করে, ও যা খুশি করতে পারে। বড়োরা ওকে আর ওর দলকে ভয় পায়। আমরা পাই না”। 
রজতশুভ্রবাবু বললেন, “তোমরা মানে?”
বুল্টি বলল, “আমরা মানে, আমাদের কলেজের ছেলেমেয়েরা। বিষ্টুদার মতো মানুষরা। টোটো চালায় বলে, বিষ্টুদাকে কম ভাববেন না, আংক্‌ল্‌। আমাদের কলেজ থেকেই ভালোভাবে পাশ করা গ্র্যাজুয়েট ও। ইংরজিতে অনার্স। কিন্তু চাকরির বাজার তো জানেন, স্যার, চাকরি কোথায়?”
রজতশুভ্রবাবু বললেন, “তাই নাকি? বাঃ, এ তো খুব ভালো কথা।”
বিষ্টু একটু হতাশ গলায় বলল, “আমরা বুল্টিদের পাড়াতেই থাকি, কাকু, ওদের কয়েকটা বাড়ি পরেই আমাদের বাড়ি। আমার বাবা বীণাপাণি স্কুলে পড়াতেন। তাঁর ছেলে এখন টোটো চালায়!”
বুল্টি ঝংকার তুলে বলল, “বাজে বকিস না, বিষ্টুদা, টোটো চালানো খারাপ, আংক্‌ল্‌ আপনি বলুন তো?”
রজতশুভ্রবাবু সঙ্গে সঙ্গে বললেন, “মোটেই না, এ তো ব্যবসা। আগে আমাদের বাড়ির ছেলেমেয়েরা এসব লাইনে যেত না, আজকাল যাচ্ছে। খারাপ কেন হবে? তা ছাড়া হাত গুটিয়ে ঘরে বসে না থেকে যে কোন একটা কাজ নিয়ে থাকা ভাল।”
বিষ্টু বলল, “তাও যদি নিজের টাকায় টোটোটা কিনতে পারতাম, বিয়ের আগেই শ্বশুরের দেওয়া টোটো...”।
বুল্টি এবার রণমূর্তি ধারণ করল, বলল “তুই কী রকম অকৃতজ্ঞ রে বিষ্টুদা। বাবা তোকে দান করেছে, নাকি ভিক্ষে দিয়েছে? তোকে লোন দিয়েছে, আর সে তুই মাসে মাসে শোধও করছিস। লোকে তো ব্যাংক থেকেও লোন নেয়। আমার বাবা যে তোকে এত বিশ্বাস করে, সেটার মূল্য দিতে শেখ, বিষ্টুদা...”।
এতক্ষণ বিষ্টু আর বিল্টুর কেমিস্ট্রিটা বুঝেও না বোঝার ভান করছিলেন, এখন রজতশুভ্রবাবুর কাছে বিষয়টা পরিষ্কার হল। বিষ্টু তার মানে বিপিনবাবুর হবু জামাই। রজতশুভ্রবাবু হো হো করে হেসে উঠলেন। তাঁর এই উচ্ছ্বসিত হাসি দেখে বুল্টি এবং বিষ্টু দুজনেই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে রজতশুভ্রবাবু বললেন, “তোমাদের সমিতির সম্বর্ধনার কথা কিছুদিনের মধ্যে ভুলে যাবো। কিন্তু তোমাদের এমন রাজযোটকের মিঠে সম্বর্ধনা কিন্তু কোনদিন ভুলব না, মা বুল্টি! আমার মেয়েও তোরই বয়সি, তাকে আজ সঙ্গে নিয়ে এলে বেশ হত, তোর মতো মিষ্টি মেয়ের সঙ্গে তার বেশ আলাপ হত”!  
বুল্টি আচমকা লজ্জা পেয়ে গেল খুব, মুখ নিচু করে বলল, “তাহলে একটা কথা দিন কাকু”। 
রজতশুভ্রবাবু বুল্টির মাথায় হাত রেখে বললেন, “কী কথা বল তো”?
“আমাদের বিয়ের সময় আপনাকে কিন্তু আসতেই হবে”। 
রজতশুভ্রবাবু একটু আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লেন, একটা হাত বিষ্টুর কাঁধে আর অন্য হাত বুল্টির মাথায় রেখে বললেন, “এখানে আসার সময় এমন সম্বর্ধনার কথা কল্পনাও করিনি, নিশ্চয়ই আসব, খবর দিস”।  
স্টেশনের মাইকে তখন ঘোষণা হচ্ছে, ডাউনে হাওড়া যাওয়ার গাড়ি এক নম্বরে আসছে, এই ট্রেন গ্যালপিং সব স্টেশন ধরবে না। 

প্রবন্ধ

বাংলার

পূর্ব-পশ্চিম 

রথীন্দ্রনাথ বড়াল

ডঃ নগেন ঘোষ লেন, কলকাতা 

বাংলার পূর্ব-পশ্চিম
fisherman.jfif

ফেব্রুয়ারী ২০২৫ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

মেরিকায় পৌঁছে অবাক হয়েছিলাম বাসে চেপে। গাড়ীর স্টিয়ারিং উল্টোদিকে অর্থাৎ ভারতবর্ষের ডানদিকের বদলে বাঁদিকে। আপ-ডাউন রাস্তার চলনও উল্টো। থাকার ঘরে ঢুকে দেখলাম—আলো-পাখা জ্বালানোর সুইচ্‌ উল্টো। মানে আমাদের দেশে – নীচে নামালে আলো জ্বলে – ওদেশে ওপরে ওপরে তুললে আলো জ্বলবে। আজ আমেরিকার আর ভারতের বৈপরিত্যের কথা বলতে বসিনি। বলতে চেয়েছি—পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গের প্রতিদিনের ব্যবহারিক বৈপরিত্য।
মামাবাড়ি গেলে দেখা হল বেবেদিদিদের সাথে। খেলাধূলা-খাওয়াদাওয়া চলতে থাকত। আমরা ঘুম থেকে উঠে ব্রাশ না করে কিছু মুখে দিতাম না। কিন্তু বেবিদিদি ও আরো ওই বাড়ির দাদাদিদিদের দেখতাম—দিব্যি, ঘুম থেকে উঠে প্রাতঃরাশ সারতে। তাদের দাঁতমাজা স্নানের আগে। জানিনা এই ব্যবস্থা পূর্ববঙ্গের সব জায়গায় চালু কিনা। মুখ ধোওয়ার পর স্নান। আমরা স্নান করতাম খাওয়ার মানে মধ্যাহ্নভোজের আগে। কোনোদিন বাদ পড়লে—সেদিন আর স্নান করা হত না। কিন্তু অপরপক্ষে দেখতাম খাওয়ার আগে স্নানের বাধ্যবাধকতা না থাকা। আগে করলেও চলে পরে করলেও চলে। স্নানের আগে সারা অঙ্গে সরিষার তেল আর মাথায় নারকেল তেল মাখা অবশ্য কর্তব্য ছিল। কিন্তু পূর্ববঙ্গের দাদা-দিদি-বন্ধুদের মধ্যে এই বাধ্যবাধকতা ছিল বলে মনে হয়নি বরং স্নানের পর তেল মাখার প্রচলন ছিল কিংবা আছে বলেই মনে হয়। আর একটি বিষয়—গামছার ব্যবহার। গামছা ঘটিদের জীবনযাপনের অতি প্রয়োজনীয় উপাদান। বাবা-কাকা-দাদুদের স্নানের আগে পরে গামছা পরে কাটাতে দেখেছি। আর আমদাদুতো জীবনটা কাটিয়ে দিলেন গামছা পরেই। শখ করে বিভিন্ন জায়গা থেকে ভালো গামছা আনানো অনেক ঘটি বাবুদের অভ্যাস ছিল। বিশেষতঃ বাঁকুড়ার গামছা কিংবা উড়িষ্যার গেরুয়া গামছা। এই গামছা প্রীতি ওপার বাংলার মানুষের বোধহয় কম। গামছার পরিবর্তে অন্য প্রথা নিশ্চয়ই প্রচলিত ছিল।

স্নানের পরই আসে খাওয়ার কথা। এর বৈচিত্র্যের কথাতো বলে শেষ করা যায় না। কিছু কথা উল্লেখ করি—যেগুলো চোখে পড়েছে। ভুল কিছু বললে অবশ্যই ক্ষমা করবেন। প্রথমে বলি, পান্তা খাওয়ার কথা। আমরা ঘটিরা তো ভুলেও পান্তা খাব না। অরন্ধনের একদিনই এই পান্তাভাত অল্প করে খাওয়া হত। অথচ ওপার বাংলার মানুষের মধ্যে পান্তা খাওয়ার মধ্যে বিপুল ভালবাসা দেখেছি। নদীমাতৃক পূর্ববঙ্গের মাছ আর শাকপাতা খাওয়ার অভ্যাসও—পশ্চিমবঙ্গের থেকে অনেকটা আলাদা।

নানারকম শাক, মান, কচু, ওল ইত্যাদির ব্যবহার এপার বাংলার মানুষের জানা ছিল না। কিন্তু ওপার বাংলার মামীমা, দিদাদের হাতের এইসব নিরামিষ পদ আমায় বার বার মোহিত করেছে। মাছের বৈচিত্র্য সত্যিই বাংলাদেশকে মানে পূর্ব-পশ্চিম দুই বাংলাকেই সমৃদ্ধ করেছে। রুই, কাতলা, ইলিশ, চিংড়ির জনপ্রিয়তা দুই বাংলায় থাকলেও— দুই বাংলার জন্য দুটো আলাদা তালিকা অবশ্যই আমি তৈরী করে দিতে পারি। পশ্চিমবাংলা—পারশে, ট্যাংরা, তপশে, ভাঙ্গ, গুরজারি, নেদশ ইত্যাদি ইত্যাদি। আর পূর্ব বাংলার—আর, বোয়াল, চিতল পাবদা। এই চারটি মাছ আমরা ছোটবেলায় খাওয়ার সুযোগ পায়নি। পশ্চিমবাংলার তালিকার মাছ পূর্ববঙ্গের ভাইবোনেরা কতটা খেয়েছে ঠিক জানা না থাকলেও—ব্যবহারের প্রকট বৈপরিত্য অবশ্যই ছিল আছে। বেলে, গুলেও পশ্চিমবাংলার প্রিয় মাছ। ভেটকি, পমফ্রেট দুই বাংলারই প্রিয়। আর শুঁটকি মাছের নানা পদ—একান্তই পূর্ববঙ্গের। এই বঙ্গের কাউকে আমি শুঁটকি চাখতে দেখিনি। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। তবে মূল পার্থক্য বোধহয়—পরিশ্রম, অধ্যাবসায় আর মানসিকতায় সেক্ষেত্রে পূর্ববঙ্গ আমাদের পশ্চিমবঙ্গকে কম করে ৫ গোল দিয়েছে। পশ্চিমবাংলার বাঙালীদের মধ্যে এক বড় অংশকে দেখেছি—কোন উদ্যোগ ছাড়া পৈতৃক বিষয় সম্পত্তির ওপর নির্ভর করে জীবন কাটাতে। কেউ কেউ পৈতৃক ব্যবসা দেখাশুনা করতেন। ব্যবসার শ্রীবৃদ্ধি অনেক ক্ষেত্রেই ঘটেনি। বরং সংকুচিত হতে হতে সেই সব ঐতিহ্যশালী প্রতিষ্ঠান চিরতরে বিলীন হয়ে গেছে। আমার মামাবাড়ীর ঐতিহ্যশালী সুপ্রাচীন বটতলার বইয়ের ব্যবসার কথা মনে আসে। অন্যত্র সে আলোচনা করব। মা-মাসী-কাকীদের কোনোরকম চাকরীক্ষেত্রে যোগদানের উৎসাহ দেখিনি কিংবা সামাজিক পরিস্থিতি সেকাজে বিরত করেছে। অপরপক্ষে পূর্ববাংলার মানুষদের কঠোর পরিশ্রমে ও কৃচ্ছ্বসাধনে এই বাংলায় প্রতিষ্ঠিত হতে দেখেছি। বিভিন্ন সরকারী-বেসরকারী পদে তাদের যোগদান উল্লেখযোগ্য। ওপার বাংলার মা-মাসীরাও স্কুল কলেজে শিক্ষকতা করেছেন কিংবা ক্ষুদ্র সংগঠন/ব্যবসায় মনোনিয়োগ করেছেন। অলসতা সর্বক্ষেত্রে এবাংলাকে পিছিয়ে দিয়েছে। অপরপক্ষে উদ্যম ওপার বাংলার মানুষকে এগিয়ে দিয়েছে একটু একটু করে। এপার বাংলার মানুষ তাদের পাঁচমহল বাসস্থান রক্ষা করতে পারেনি। ভাড়া দিতে দিতে এক এক মহল হাতছাড়া হয়েছে। তারপর পুরোটাই প্রোমোটরদের দখলে। ওপার বাংলার কাকুরা, জ্যেঠুরা নিঃস্ব অবস্থায় এসে এক কামরা ঘরে অবর্ণনীয় কষ্ট করে—আজ তারা সুস্থ পরিচ্ছন্ন বাসস্থানের অধিকারী হয়েছেন। অপরপক্ষে, এ পারের অট্টালিকায় বট-অশ্বত্থের ঝুড়ি প্রায়শই দেখা যায়—যেগুলির সংস্কার করা অধিকাংশ ক্ষেত্রে সম্ভব হয়নি। তাই ধ্বংস ক্রমশই ত্বরান্বিত হচ্ছে।

অনুগল্প

সনোজ চক্রবর্তী

পূর্ব মেদিনীপুর, পঃ বাংলা

গল্প/প্রবন্ধ

coffeehouse.jpeg
SanojCharaborty.jpg
অনুগল্প-সনোজ চক্রবর্তী

ফেব্রুয়ারী ২০২৫ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

চাই নিশ্ছিদ্র বুন্ধতা

মাদের স্কুলে প্রার্থনা লাইনে রোজদিন একটা করে বানী পাঠ করা হয়। এটা আমাদের বর্তমান হেডস্যারের ভাবনা। এই বানী পাঠের দৌলতে কত নতুন নতুন বানী, ভাব-ভাবনা ঝুলিতে ভরতে পারি,আর তার ভালোলাগায় সকালটা শুরু হয় চমৎকার।

গত সোমবার সকালের বানী ছিল প্রাক্তন রাষ্ট্রপ্রধান প্রয়াত এপিজে আবদুল কালাম মহাশয়ের।

বানীটার নিখুঁত উদ্ধৃতি করতে পারলাম না-- সামগ্রিক ভাবে বিষয়টা ছিল বন্ধুত্বের উপর---

★বৃষ্টি হলে ছাদের ফুটো জানা যায়

বিপদে পড়লে বন্ধু চেনা যায়।★

মনে ধরল কথাগুলো। যদিও বন্ধুত্ব নিয়ে মহামতি চানক্যের শ্লোক সকলের জানা। ছেলেবেলায় সংস্কৃত পাঠ্যে পড়েছি--

উৎসবে ব্যসনে চৈব

দুর্ভিক্ষে রাষ্ট্রবিপ্লবে।

রাজদ্বারে শ্মশানে চ

যঃ তিষ্ঠতি স বান্ধবঃ।

ছেলেবেলায় বারবারই মনে হয়েছে -- এমন একজন বন্ধু হয়ে উঠতে হবে। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বুঝেছি-- এমন বন্ধু হয়ে ওঠা শুধু কঠিনই নয় অন্তত আমার পক্ষে সম্ভবও নয়। ছেলেবেলার ধূলোখেলার বন্ধু থেকে স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় কম কিছু বন্ধুতো জোটে নি।

আজ বলতে দ্বিধা নেই তাদের সত্যিকার বন্ধু হয়ে ওঠা দূরস্থ ক'জনের ভাল বন্ধু হতে পেরেছি!

তারাও বা ক'জন পেরেছে! শ্লোকটার মাপকাঠিতে বন্ধু হয়ে ওঠা সে আমার কম্ম ছিল না। এমন মহৎ বন্ধু আমি কোন কালেই হতে পারি নি, পারবও না। তা বলে বন্ধু হিসাবে সুযোগ সুবিধামতো পাশে থাকি নি এমনটা নয় আবার পাশে পাইনি সেটাও বললে মিথ্যে বলা হয়।

সে হিসাবে বন্ধুত্ব একটা পারস্পরিক দায়বদ্ধতা। এখনও পুরানো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ হলে নস্টালজিক হয়ে পড়ি। পুরোনো দিনের আলাপচারিতা ওঠে আসে।

আবার একই দিন-রাত্রে আবর্তিত হয়ে কোন এক সময়ের খুব অতি বন্ধু আমাকে পশ্চিম গোলার্ধের লোক ভেবে বসে, আমি তাকে পূর্বের। বুঝতে পারি একটা সময়, সেই সময়ের প্রয়োজন ধরে রেখেছিল আমাদের দু'জনকে। আজকের সময় ইথার বন্ধুতার সময়। অজানা, অচেনা অসমবয়সী বন্ধুত্বের বিশ্বলোক আমাদের আঙুলে আঙুলে।

এই বন্ধুত্বের কোন দায় নেই-- পরস্পরের প্রয়োজন নেই, বন্ধুত্ব বাঁচানোর পরিশ্রম নেই। এমন কি কখন শুরু হল কখন শেষ হল বা হবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। চানক্য শ্লোক মাফিক বায়বীয় এই বন্ধুত্বের তেমন কোন অস্তিত্বই নেই। তার মধ্যেও যে আকর্ষণ কাজ করে তা কেবল অদেখার অদৃশ্য মোহ।

যতদূর জানি আবদুল কালাম মহাশয় সংস্কৃত সাহিত্যে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন। চানক্য শ্লোক নিশ্চিতভাবেই ছিল তাঁর কন্ঠস্থ। তবুও বন্ধুত্বের ওইরূপ একটা প্রমাণ মান থেকেও কেন তিনি নতুন করে বন্ধুত্বের উপর এমন দু'কলম লিখলেন!

এটা অনেকাংশেই ঠিক বিপদে আমরা ক্রমশ নির্বান্ধব হয়ে পড়ছি। বিপদে বন্ধু পাশে থাকবে এটা যেমন চাইব তেমনই বন্ধুর বিপদে পাশে থাকার নিশ্চয়তা থাক। ঐ যে "ফুটো" ওটাই আসল কথা।

ফুটোটার দায় কার! ফুটোটা না থাকলে জল পড়বে কোথা থেকে। তাই বন্ধুত্ব নিশ্ছিদ্র হোক।

কোথাও বন্ধুত্বকে নিজেই ছেঁদা করে ফেলে-- বিপদে অবাঞ্ছিত প্রত্যাশা করে বসছি না তো আমরা!

​​

চায়ের কাপটা টেবিলে নামিয়ে বুক সেল্ফ থেকে মোটা বইটা টেন নিল নৈঋতদা। সূচিপত্র বরাবর আঙুলটা দ্রুত নামতে নামতে স্থির হল "সেভিয়ার দম্পতি ও অদ্বৈতসাধনা" - টপিকটার ফেভিকলে। চশমা ও ভ্রুঁ জোড়ার ভিতর থেকে সরু দৃষ্টি ছু়্ঁড়ে দিয়ে নৈঋতদা বলল,

- কুমায়ুন ফেরত দু-পর্বের যে লেখাটা পোষ্টালি, সেটার মেটেরিয়াল এখান থেকে ঝেপেছিস?

লজ্জা মিশিয়ে বললাম-- 'খানিকটা।'

পুরোটা ঝেপেও মিথ্যে বললাম কারন নৈঋতদার এতবড়ো টপিকটা পড়ার সময় কোখায়!

- 'দেখ, কটা লেখা একেবারে মৌলিক হয় বলতো, তাছাড়া এধরনের লেখা মৌলিক হবেই বা কেমন করে! তবে তথ্য ঋণ স্বীকার করা উচিত ছিল।' কথাগুলো শেষ হতে না হতেই নৈঋতদা বলল,

- 'তবে পুরো বিষয়টাকে প্রেজেন্ট করেছিস বেশ। তোর এটা ভাল আসেও।'

নৈঋতদার মুখের কথা টেনে নিয়ে বললাম-- 'আর ছবিগুলো?'

- 'না, ছবির দিকটায় তোকে আরো খাটতে হবে।'

কথাটা শেষ করে চা'য়ে শেষ চুমুক রাখল নৈঋতদা। আমার লেখালেখির বেশিটাই যে ঝাপা এটা বুঝলেও বইটা যে নৈঋতদার, মানে সেটাও যে ঝাপা। তা বুঝে ফেলার আগে বইটা তড়িঘড়ি নৈঋতদার হাত থেকে নিয়ে সেল্ফে তুলে রাখলাম।

খানিকটা কলার উচুঁ করার ভঙ্গিতে বললাম,

- 'লেখাটা নিজের দেওয়াল ছাড়া তিনটে গ্রুপে টাঙিয়েছিলাম।'

নৈঋতদা চা'য়ের কাপ আমার হাতে দিয়ে বলল,

দেখেছি, একটা গ্রুপে তো লেখাটায় তিন'শ সাঁইত্রিশটা কমেন্ট বাহান্নটা শেয়ার দেখলাম।

- 'বাহান্ন নয় দাদা বিরাশি' আর বেশি বাড়িয়ে বলতে সাহস হল না।

লোকটা সেয়ানা গ্রুপটায় গিয়ে পথে বসাতে পারে।

- 'অথচ দেখ নিজের দেওয়ালে.....'

আমাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই নৈঋতদা মাস্টারমশাইয়ের মতো বুঝিয়ে বুঝিয়ে বলতে শুরু করল-

- নিজের দেওয়ালে লাইক বা কমেন্ট জোটেনি বলে ভাবিস না,যে তোর বন্ধু বান্ধব প্ততিবেশি কাকা পিসিরা পড়ে নি। সবসময় লাইক কমেন্ট এগুলো পাঠ প্রতিক্রিয়া হবে এমন সরল ভাবনা করতে নেই।

আমি অবাক হয়ে বললাম-- 'তবে!'  নৈঋতদা আরো স্থিতধী হয়ে বলল,

- না পড়েও তো লাইক দেওয়া যায়,

- যায় না কি?

আমি সম্মতির ঘাড় দোলালাম।

- কমেন্ট পড়েও কমেন্ট করা যায়। কি রে-- হয় না কি! প্রতিবেশির পাঠ প্রতিক্রিয়া কেমন জানিস?

কাপালে হাজার রেখার আঁকিবুকি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে মিটমিট হাসছে নৈঋতদা। আমি একেবারে চুপ। নৈঋতদা ফের শুরু করল,

- তোর আবাল্য বন্ধুর তোর প্রতি ঈর্ষা তোর প্রতিবেশি দাদা বা খুঁড়োর তোকে এড়িয়ে চলা অহেতু সমালোচনা, আড়ালে আবডালে গালমন্দ -- এগুলোই আসল পাঠ প্রতিক্রিয়া। কথাগুলো হাওয়ায় ভাসিয়ে দিয়ে নৈঋতদা সেল্ফ থেকে বইটা ফের নামিয়ে নিল। বইটার উপর আলতো আদুরে হাত বুলিয়ে বলল, - আটান্নটা শেয়ারের জন্য একদিন বিরিয়ানি খাইয়ে দিস।

তোমরা তো আগেই জেনেছ--

বজ্রের সঙ্গে মেঘের বিয়েটা হয়ে গেল ঠিকই

কিন্তু পাহাড়টাকে --

সে কোন দিনই ভুলতে পারল না।

মেঘ লুকিয়ে লুকিয়ে চিঠি পাঠাত পাহাড়কে।

বৃষ্টি দিয়ে লেখা সে চিঠি--

কান্না হয়ে ভিজিয়ে দিত পাহাড়টাকে

বজ্রকে লুকিয়ে--

মেঘ চুপটি বসে থাকত।

বসে থাকত পাহাড়ের গা'ঘেসে

বসে থাকত কালো শাড়িতে।

পাহাড়ের পিঠে পিঠ রেখে বলত----

কষ্ট কথা.....

লাল শাড়ি আর পরে নি মেঘ।

শোকের রং নাকি কালো।

একদিন মেঘ পাহাড়কে বলেছিল--

'বলতো পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর সেতুর নাম কি?'

উদাস গলায় পাহাড় বলেছিল--

'বিরহ'।

ম্লান হাসি হেসেছিল মেঘ।

পাহাড় প্রশ্ন করেছিল--

'পৃথিবীর কুৎসিত ভাষা কি বলতো?'

মেঘ মূহুর্ত সময় না নিয়ে জানিয়েছিল --

'ব্রজের চিৎকার'।

তারপর তারা ডুবে গিয়েছিল--

একে অপরের আলিঙ্গনে।

আর ঠিক তখনই--

রক্তচক্ষু বজ্র এসে হাজির।

রগ ফুলিয়ে--

দিগবিদিক কাঁপিয়ে দিল চিৎকারে---

আশ্চর্য!

মেঘ বা পাহাড় কেউ ভয় পায় নি।

বরং আরো দৃঢ় হয়েছিল তাদের আলিঙ্গন।

আর বজ্র!

চিৎকার করতে করতে--

নিজেই হয়ে গিয়েছিল বধির।

পরদিন মেঘ পরে ছিল ধপধপে সাদা শাড়ি।

পাহাড় মুচকি হেসে বলেছিল--

'আজ বুঝি আর শোক নেই!'

'এ আমার বৈধব্য উল্লাস-- বজ্রের চোখ রাঙানিকে

উদ্ধত চিৎকারকে গলা টিপে মেরে ফেলার বৈধব্য।'---

আঁচলটা হাওয়ায় উড়িয়ে জানিয়েছিল মেঘ।

সৃষ্টির আদি আলো দিয়েছিল সূর্য

শুধু আলো নয় বেঁচে থাকার উত্তাপও।

সূর্য আর চাঁদ দু'জনা

ভাগাভাগি করে নিয়েছিল দিন-রাত।

দিনের বেলা সূর্যের আলো...

আর রাতে চাঁদের চলকে আসা জ্যোৎস্না।

সূর্যেরও তো ক্লান্তি আসে.....

সারাদিনের খাটাখাটুনির পর রাতে ঘুমুতে ইচ্ছে যায়।

বিশ্রামের জন্যই তো....

ঈশ্বর রচনা করেছেন রাত্রি।

রাতের আলোর অভাব ঘুঁচিয়েছিল পাহাড়।

কিভাবে?

পাথর ভেঙেই বেরিয়েছিল প্রথম আলো।

যেদিন মানুষ প্রথম আলো জ্বেলেছিল

হয়তো সেদিনের কোন ধনতেরাসে....

সন্ধ্যা সবিতা...

পাহাড়টাকে দিয়েছিল একটা সাতনরী হার।

দিয়েছিল ভালোবেসে....

তারপর থেকে প্রতি সন্ধ্যায় পাহাড়টা...

সূর্যাস্তের আলোয় স্নান সেরে...

সাতনরী হারে সাজে....

অভিসারে যায়....

আজব রোগী 

ডাঃ রুদ্রজিৎ পাল

কসবা, কলকাতা 

প্রবন্ধ

আজব রুগী
doctor.jpg
Rudrajit Paul.jpg

ফেব্রুয়ারী ২০২৫ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

চেম্বারে তরুণ ডাক্তারবাবু বসে আছেন, এক বৃদ্ধা পা টেনে টেনে ঢুকলেন। সঙ্গে এক ছেলে। 

“আসুন দিদা। বসুন। নাম কী বলুন।“ বৃদ্ধা নাম বললেন। ডাক্তারের আবার প্রশ্ন, “বয়স কত?”

এবার সেই রোগী ছেলের দিকে তাকালেন। তারপর ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে বললেন,

“দেখুন না কত লেখা আছে।“

এই সময়ে ছেলে একতাড়া পুরনো কাগজ এগিয়ে দিল ডাক্তারের দিকে। ডাক্তার বললেন,

“আপনার বয়স কত আপনি জানেন না?”

“না বাবা। ওই কাগজে যেটা লেখা আছে, সেটাই।“

“তাও আন্দাজে বলুন। কত হবে? ষাট?”

“হ্যাঁ। হতে পারে।“

“নাকি সত্তর?”

“সেটাও হতে পারে।“

ছেলে এইসময়ে বলল, “এইসব কাগজে দেখুন লেখা আছে কিনা। কত দেওয়া আছে মনে নেই।“

ডাক্তার আশা ছেড়ে দিয়ে নিজের আন্দাজ মত একটা বয়স লিখে বললেন,

“কী সমস্যা বলুন।“ 

“প্রচণ্ড গ্যাস। কিচ্ছু হজম হয় না। আর বুক পেট সবসময়ে এক হয়ে থাকে।“

“আর?”

“এটাই তো। গ্যাসের জন্য মাথায় ব্যথা। গ্যাসের জন্য পিঠে শিরদাঁড়া জুড়ে ব্যথা। আর পায়ের তলায় কেমন নিটপিট করে।“

“কাউকে দেখিয়েছেন?”

“কত্ত ডাক্তার দেখালাম। সেই যাদবপুরের ভুবনকে চেন? খুব বড় ডাক্তার। তাঁকে তো কতবার দেখালাম। সব বড় বড় ডাক্তার ফেল মেরে গেছে। কত টাকার ওষুধ আমার ছেলেরা কিনে দিল। কিচ্ছু হয় না। দেখ না, কত ওষুধ এখানে।“

এই বলে সেই রোগী একটা কালো পুঁটুলি বার করে ডাক্তারের টেবিলে ঢেলে দিলেন। টেবিলের ওপর ছড়িয়ে পড়ল নানা সময়ের অজস্র ওষুধের স্ট্রিপ। তার কোনটা তিনটে খেয়ে তারপর বাকিটা পড়ে আছে, আর কোনটা পুরো ভর্তি, কিন্তু এক্সপায়ারি ডেট পেরিয়ে গেছে। ডাক্তার আর্তনাদ করে উঠলেন, “এগুলো কী? এত পুরনো ওষুধ নিয়ে কী করছেন?”

“এই তো সব ওষুধ। “

ছেলে তখন বলল, “স্যার। মার যখন গ্যাস হয়, তখন এই ব্যাগ থেকে ওষুধ বার করে খায়।“

“এই ব্যাগ থেকে বার করে? এখানে তো দেখছি ভিটামিন, ব্যাথার ওষুধ সবরকম আছে। কোনটা খায় তাহলে?”

“জানি না স্যার।“

“এই তো দেখছি একটা ঘুমের ওষুধও আছে। এটাও খায় নাকি? কে দিয়েছে এটা?”

“ওই তো ভুবন দিয়েছে।“

“কবে?”

কেউ কোনও উত্তর দিল না। 

ডাক্তার আবার বললেন, “তাহলে এগুলোই আপনার সমস্যা তাই তো?”

“হ্যাঁ বাবা।“

ডাক্তার প্রেসক্রিপশান লিখে নিলেন। তারপর বললেন, “এবার বুঝে নিন। এই কটা ওষুধ আছে। এই দুটো খাওয়ার আগে আর এই শেষেরটা খাওয়ার পরে। আর এই যে লেখা আছে, সেই টেস্ট করিয়ে

আসবেন।“

ছেলে প্রেসক্রিপশানটা তুলে নিল। তারপর দেখে বলল, “ডাক্তারবাবু এইটা খাওয়ার আগে?”

“হ্যাঁ, দেখুন লেখা আছে।“

“খাওয়ার আগে মানে কি পাঁচ মিনিট আগে না জাস্ট খেতে বসার আগে?”

“ওটা যেভাবে খুশি খাওয়া যায়।“

“আচ্ছা ডাক্তারবাবু, এটা খেলেই কমবে তো?”

“হ্যাঁ কমবে। একটু সময় লাগবে।“

“মানে আজকে রাত্রে কী একটু রিলিফ পাবে?”

“আজকে রাত্রে হবে কিনা জানি না। কিন্তু আস্তে আস্তে হবে।“

“জানেন না ডাক্তারবাবু, সারা রাত পেটে গ্যাস বলে জেগে থাকে। কাউকে শুতে দেয় না। সেই পুজোর পর থেকেই চলছে।“

“সে তো প্রায় দুমাস হয়ে গেছে। এতদিন দেখান নি কেন?”

“প্রথমে আমরা হোমিওপ্যাথি করলাম। তারপর আগের যে ওষুধ ছিল, সেটা দোকানে বলে কিনে এনে দিলাম। এত কিছু করলাম। কিছুতেই কমছে না।“

“আচ্ছা, কমবে। যেভাবে বলেছি খাওয়ান।“

এবার সেই রোগী উঠে দাঁড়ালেন। চেয়ার ঠেলে সরিয়ে বেরোনোর জন্য দরজা অবধি চলে গেলেন। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, “মেয়ে বলেছে একবার প্রেশারটা দেখতে।“

ডাক্তারবাবু বললেন, “আপনার সমস্যা তো গ্যাস। তাহলে প্রেশার দেখে কী হবে?”

ছেলে বলল, “হ্যাঁ, একটু দেখে দিন। আসলে আগে মায়ের প্রেশার ছিল। সেরে গেছে বলে বন্ধ করে দিয়েছি আমরা।“

“এটা তো এতক্ষণ বলেননি! আর প্রেশারের ওষুধ বন্ধ করেছেন কেন?”

“আসলে বুঝলেন এক ওষুধ বেশিদিন খেলে কিডনি নষ্ট হয়ে যায়। সেই জন্য।“

“এটা কে বলল?”

“আমাদের পাশের বাড়ির একজন বলল। সে বলল,

----মাসিমা আপনি এতদিন এক ওষুধ খাবেন না। সেইজন্য বন্ধ করেছি।“

“কী ওষুধ খাচ্ছিলেন? সেই কাগজ আছে?”

“প্রেশারের ওষুধ বাবা। ওই যে সাদা সাদা ছোট বড়ি। এক পাতার দাম চল্লিশ টাকা। সেইটা।“

ডাক্তার হাল ছেড়ে প্রেশার চেক করলেন। “ঠিক আছে এখন।“

ছেলে বলল, “ঠিক আছে তো?”

“হ্যাঁ, বললাম তো।“

“মানে ওষুধ লাগবে না?”

“এখন না।“

“পরে লাগতে পারে?”

“বেড়ে গেলে লাগবে।“

রোগী আর তার ছেলে প্রায় চেম্বার ছেড়ে বেরিয়ে চলে যাচ্ছে, আবার ছেলে ফিরে এসে বলল, “ডাক্তারবাবু, একটা কথা বলা হয়নি। আমার মায়ের কিন্তু লিভার খারাপ। প্রায় দশ বছর থেকে পিজিতে চিকিৎসা চলছে।“

ডাক্তারবাবু এবার চীৎকার করে বললেন, “আসল অসুখের কথা না বলে আপনি পুরো সময় ধরে গ্যাসের গল্প শুনিয়ে গেলেন? আবার নাম লেখান কালকে। আজকে আর হবে না।“ 

ফেস্টিভ্যাল

অফার
ডাঃ রুদ্রজিৎ পাল

কসবা, কলকাতা

গল্প

ফেস্টিভ্যাল অফার
Rudrajit Paul.jpg

ফেব্রুয়ারী ২০২৫ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

ladies.jpg

শ্রেয়সীদি খুব উত্তেজিত। একটা অনলাইন শপিং ওয়েবসাইটে বছর শেষের বিশেষ ডিসকাউন্ট সেল দিচ্ছে। ৩১শে ডিসেম্বর বিকেল সাতটা থেকে নটা ---শুধু এই সময়ের জন্যই এই অফার খোলা থাকবে। তার আগেও নয়, পরেও নয়। আর কম নয়, পঞ্চাশ থেকে আশি শতাংশ অবধি ছাড়। পাগল ছাড়া কেউ এই সুযোগ ছাড়ে? 
শ্রেয়সীদি সবাইকে বলে রেখেছে, ওই সময়ে যেন কেউ ফোন না করে। ফোন নয়, ভিডিও কল নয়। বাড়িতে সায়নদা আছে, শ্রেয়সীদির বর। তাকেও শাসিয়ে রেখেছে, 
“তুমি ওই সময়ে নেটফ্লিক্স দেখবে না। ওটা দেখলে ওয়াইফাই স্লো হয়ে যাবে। আমি সবকিছু বুকিং করতে পারব না। বাম্পার অফার হাতছাড়া হয়ে যাবে!”। সায়নদা প্রথমে প্রতিবাদ করতে গিয়েছিল, “ওইদিন একটা নতুন ফ্যান্টাসি সিরিজের নতুন সিজনের প্রিমিয়ার আছে। আমি এর আগের সিজনটা দেখেছি। প্রায় ক্লিফহ্যাঙ্গারে শেষ হয়েছিল। এই সিজনে কী হল…” কথা শেষ করার আগেই শ্রেয়সীদি চীৎকার করে উঠেছে, “আমি ওইসব জানি না। নেটফ্লিক্সে পরেও দেখতে পারবে। নটার পরে যত খুশি দেখো। কিন্তু নটার আগে যদি নেটফ্লিক্স চালিয়ে ওয়াইফাই স্লো করে দাও, তাহলে আমি নেটফ্লিক্সের পাসওয়ার্ড চেঞ্জ করে দেব। আর কোনদিন দেখতে পারবে না!” সায়নদা আর কথা বাড়ায়নি। তাও আর একবার আস্তে করে বলেছিল, “একবার প্রিমিয়ার হয়ে গেলে ফেসবুকে আমাদের গ্রুপে সবাই স্পয়লার দিয়ে দেবে। তখন আর দেখে কী হবে?” শ্রেয়সীদি আবার চেঁচিয়ে উঠেছে, “তাহলে ওই দুই ঘণ্টা ফেসবুকের বাইরে থাক! তাহলেই আর স্পয়লার চোখে পড়বে না। জানো গতবার এরকম সেল থেকে মিসেস রাউত কী দারুণ একটা এক্সারসাইজ বাইক কিনেছিলেন।" সায়নদা হেসে বলে, “সেই বাইক? তুমি একবার কিনবে বলে ঠিক করেছিলে না? ওসব দিয়ে কী হয়? আমি দেখেছি সব বাঙালি বাড়িতেই এই বাইক কিছুদিন পরেই হয়ে যায় জামাকাপড় মেলার স্ট্যান্ড!”
“একদম বাজে কথা বলবে না। নিজে কুঁড়ের বাদশা, তাই সবাইকে ভাবো নিজের মতন। আমি যদি কোনদিন কিনি, তাহলে দেখবে রেগুলার কাজে লাগাবো”। 
সায়নদা আর কী করবে? অনেকদিন পরে টিভি খুলে বসল। একটা বাংলা নিউজ চ্যানেল। সন্ধ্যে সাতটার সময়ে খুলেই দেখে, ও মা! এত চীৎকার কিসের? একটা স্টুডিয়োতে পাঁচ ছয় জন লোক বসে আছে আর সবাই সবার ওপর চীৎকার করে চলেছে। সায়নদা গলা তুলে জিজ্ঞাসা করল, “হ্যাঁ গো, এখন সাতটায় খবর হয় না?” শ্রেয়সীদি তখন সবে সাইট খুলেছে। অলরেডি হোয়াটসঅ্যাপে এক বন্ধু আপডেট দিয়েছে যে সত্তর পারসেন্ট ডিস্কাউন্টে একটা ভ্যাকুয়াম ক্লীনার বুক করে ফেলেছে। শ্রেয়সীদির প্রচণ্ড চাপ লাগছে। এরকম কিছু একটা বুক না করতে পারলে পরদিন বন্ধুদের চ্যাটের সময়ে লজ্জায় পড়ে যেতে হবে। তখন সায়নদার প্রশ্ন শুনে প্রথমে অন্যমনস্কভাবে বলল, “খবর তো আমার হয়ে গেছে। জানো, মিসেস মাধবন অলরেডি একটা দারুণ ডিল পেয়ে গেছেন”। সায়নদা বুঝল এখন আর শ্রেয়সীদি এই জগতে নেই। উনি এখন ঢুকে গেছেন অফার আর ডিস্কাউন্টের মধ্যে। সায়নদা চুপচাপ টিভি দেখতে শুরু করল। কিন্তু এ কী প্রোগ্রাম? পাঁচ-ছজন লোক বসে আছেন। কী বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে  কে জানে? শুধু দেখা যাচ্ছে একসাথে সবার মাইক অন করা আর সবাই একসাথে কথা বলছে। আবার প্রোগ্রামের নাম দিয়েছে, “দিনের শেষের আড্ডা”! এর নাম আড্ডা? কিন্তু অন্য কোন চ্যানেলে যাবেন? আজকাল অনলাইনে সিনেমা, সিরিয়াল ইত্যাদি সব দেখে দেখে এমন অভ্যাস হয়ে গেছে যে টিভি দেখতে ভালোই লাগে না। অগত্যা ভলিউম একটু কমিয়ে এটাই দেখতে শুরু করলেন। একবার ফেসবুকের গ্রুপে ঢুকেছিলেন। যেই দেখলেন যে অনেক মেম্বার সেই সিজন প্রিমিয়ারের সম্পর্কে আপডেট দিচ্ছে, অমনি বন্ধ করে দিলেন। 
এদিকে শ্রেয়সীদির তো তখন নিঃশ্বাস ফেলার সময় নেই। প্রথমেই জামা কাপড়ের লিঙ্কে ক্লিক করেছেন। পর পর অফার আসছে। একটা হলুদ কুর্তি বেশ পছন্দ হল। সায়নদাকে ডেকে একবার বললেন, “এই দেখে যাও তো”। সায়নদা তখন সেই ঝগড়ার মধ্যে ঢুকে গেছেন। একজন কলেজের প্রফেসর অন্য একজন প্রোফেসরকে মুখের ওপর “অশিক্ষিত” বলে দিয়েছেন। এবার ক্যামেরা ঘুরে গেছে সেই আক্রান্তের দিকে। স্টুডিয়োতে সবাই চুপ। কী হয় কী হয় ভাব। সায়নদার প্রায় নিঃশ্বাস বন্ধ। কী হবে? সেই প্রোফেসর কী চীৎকার করবেন, না স্টুডিয়ো ছেড়ে চলে যাবেন? নাকি বেশ লঙ্কাবাটার মত উত্তর দেবেন? এই সময়ে শ্রেয়সীদি ডেকে পাঠাল, “দেখে যাও তো!” সায়নদা টিভির দিকে চোখ রেখেই বলল, “কেন?” “আরে দেখ না। এই কুর্তিটা বুক করে দেব? আর মাত্র সাতাশ মিনিট ডিলটা খোলা থাকবে। আর বলছে মাত্র দু পিস আছে। এখনই না নিলে কিন্তু হাওয়া হয়ে যাবে”। 
“আরে তোমার ভালো লাগলে নিয়ে নাও”।
“একবার দেখবে না?”
“একটু পরে আসব”। আসলে তখন সেই প্রোফেসর বেশ যুতসই একটা জবাব দিচ্ছেন। অন্যজনের পুরনো ইতিহাস টেনে এনে, তার পরিবারের ইতিহাস টেনে এনে মোটামুটি হাটে হাড়ি ভাঙছেন। ক্যামেরা একবার দেখাছে বক্তাকে, আর একবার দেখাচ্ছে তার টার্গেটকে। এই সময়ে ওঠা যায়? 
শ্রেয়সীদি আবার চিল্লিয়ে ওঠে, “এলে না তো? তাহলে বুক করে দিলাম কিন্তু…” 
“দাও না। ডিস্কাউন্ট তো। কত আর দাম হবে?”
“ঠিক আছে। এর পরে কিন্তু কিছু বলবে না”।
“দাও দাও”।
শ্রেয়সীদি তো বুক করে তার স্ক্রীনশট নিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে পোস্ট করে দিয়েছেন। পাঁচ মিনিট পরেই চীৎকার। “এ বাবা, তুমি একটু বলতে পারলে না?”
তখন বিজ্ঞাপনের বিরতি চলছে। সায়নদা সবে জল খেয়ে পরের রাউন্ডের জন্য রেডি হচ্ছেন। এই সময়ে এই চীৎকার। বিরতির ঠিক আগে একজন নতুন বক্তা এসে একটা জব্বর গালাগালি দিয়েছেন। সায়নদা সবে ভাবছিল যে এরকম গালাগালি প্রাইমটাইম টিভিতে বিপ না করে প্রচার করল কী করে? সায়নদার চিন্তার রেশ কেটে গেল। উঠে এসে বলল, “কী হয়েছে?”
“দেখ না, এই যে কুর্তি বুক করলাম, সাইজে ছোট!” “কত ছোট?”
“আমার থার্টি টু লাগে। এটা থার্টি”।
“আগে দেখো নি?”
“দেখলে কী আর তোমাকে ডাকি? তখন তো ডিল পাবো বলে ক্লিক করে দিলাম। সাইজ দেখার সময় ছিল না।”
“তাহলে ক্যান্সেল করে দাও”।
“আমি হোয়াটসঅ্যাপে দিয়ে দিয়েছি। সবাই লাইক করেছে আর ক্ল্যাপ ইমোজি দিয়ে দিয়েছে। এখন ক্যান্সেল করলে লোকে কী বলবে?”
“লোকে কী বলবে সেই জন্য তুমি ছোট জামা কিনবে? টাকা নষ্ট করবে?”

“সেটা তুমি বুঝবে না। আগের বার এইরকম হলুদ জামা কিনে তানিয়া ফেসবুকে কয়েকশো ছবি দিয়েছিল। প্রচুর লাইক পড়েছিল। তখন থেকেই আমি ঠিক করেছি যে ওইরকম জামা কিনে সেটা পরে কালকে নিউ ইয়ারস ডে তে ছবি দেব। আর যদি এখন সেটা কিনে ক্যান্সেল করি, তাহলে সবাই কী বলবে?”

“অন্য জামা দেখো। তাহলেই হবে!”

সায়নদা আবার এসে টিভির সামনে বসে পরে। বিরতি শেষ। সেই গালাগালি নিয়ে এখন চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে। ওটা কাকে দেওয়া হয়েছে? বক্তার দাবি তিনি কোন ব্যাক্তিকে নয়, সিস্টেমকে গালাগালি দিয়েছেন। অন্য একজন বক্তা মানহানির মামলার ভয় দেখাচ্ছেন। সায়নদার মন অনলাইন সেল থেকে সরে গেছে। 

শ্রেয়সীদি কিছুক্ষণ পরে বলল, “বুঝলে ক্যান্সেল আর করলাম না। কালকে ওটাই টেনেটুনে পরে ছবি তুলে নেব। তারপর আমি তো ওয়েট লুজ করছিই, কিছুদিন পরেই ওটা ফিট করে যাবে”।টিভিতে তখন চীৎকার চলছে, “আপনি এই সময়ের পক্ষে মিসফিট! আপনি পঞ্চাশের দশকে ফিরে যান…” সায়নদা সেই শুনতে শুনতে বলে দিল,

“ঠিক আছে। ফিট করে যাবে। নিয়ে নাও”।

“আর এমনকি বেশি দাম। মাত্র চার হাজার”।
“অ্যাঁ!” সায়নদা মাথা ঘোরায়, “তুমি যে বললে ডিসকাউন্ট? এত দাম কেন?”
শ্রেয়সীদি বলে, “আরে ডিসকাউন্ট দিয়েই এই দাম। নইলে কী আর কিনি? এমনি সময়ে, দেখে যাও না, দাম প্রায় আট হাজার”।
সায়নদা উঠে দেখতে যাচ্ছিলেন। এই সময়ে প্রোগ্রামের সঞ্চালক বলে উঠলেন, “এই ভুল প্ল্যানিং এর ফলেই কিন্তু গত বছর প্রায় এগারশো কোটি টাকা জলে গেছে”।
ব্যাস, সায়নদা আবার জমে গেলেন। একটু আগেই একজন নেতা সেই প্ল্যানিং এর প্রশংসা করছিলেন। এবার ক্যামেরা তার মুখের দিকে। চার হাজার টাকায় সাইজে ছোট জামা কেনার প্রসঙ্গ ওখানেই চাপা পড়ল। 
মাঝে মাঝেই শ্রেয়সীদি টুকটাক কথা ছুঁড়ে দিচ্ছিলেন। “এই জানো, এই কফি টেবিলের জন্য একটা সেরামিকের ভাস কিনলাম”, “আমাদের রান্নাঘরের জন্য একটা স্ট্যান্ড কিনে নিলাম” বা “তোমার নেকটাইটা পুরনো হয়ে গেছে। একটা লাল রঙের কিনলাম” ইত্যাদি। কিন্তু সায়নদার তখন সেসব মাথায় নেই। এক ঘণ্টা হয়েছে। ঝগড়ার তখন মধ্যগগন। কিছুদিন আগের একটা বক্তৃতার ক্লিপ দেখাচ্ছে। এর পরেই শুরু হবে সেটার চুলচেরা বিচার। এখন আর কফি টেবিলের ভাস নিয়ে ভাবার সময় আছে?
একটু পরে শ্রেয়সীদি বলল, “তোমার জিপে একাউন্ট এর পাসওয়ার্ডটা বল তো”।
“কেন?” সায়নদা একটু চমকে ওঠে। 
“আমার জিপে একাউন্টে সব শেষ”।
“সব শেষ? মানে? কী কিনেছ?”
“কিছুই না। এই দেখ না আমার কার্ট!”
সায়নদা উঠে আসে। চেয়ে দেখে সেই কার্টের লিস্ট। “এতগুলো দেয়ালে ঝোলানোর ছবি কিনেছ কেন? কোথায় রাখবে? আমাদের বাড়িতে কী আর জায়গা আছে?” 
“কিনে নিলাম। আমাদের কিছু কিছু বেশ পুরনো হয়ে গেছে। ভাবছিলাম চেঞ্জ করব। এই দেখ, প্রায় ৫০ পারসেন্ট কমে পেয়েছি। এই ছবি যদি তুমি গড়িয়াহাটের দোকানে কিনতে যাও, গলা কেটে নেবে!”
সায়নদা ছবিটা দেখলেন। এমন কিছু সুন্দর লাগল না। একটা বিখ্যাত আমেরিকান পেন্টারের ছবির প্রিন্ট। কিন্তু শ্রেয়সীদি এমন হাসিমুখে ছবিটা দেখালেন যে সায়নদা আর কিছু বললেন না। আর সাহস করে সেই ছবির দামের দিকে তাকালেনও না। 
টিভি থেকে ভেসে আসছে এক বিখ্যাত লেখকের গলার শব্দ। এবার প্রোগ্রামে ওনাকে জুম কলে নিয়েছে। এটা না দেখলে হবেই না। সায়নদা গুটি গুটি পায়ে আবার সোফার দিকে পা বাড়ালেন। তাও পাসওয়ার্ডটা দেওয়ার সময়ে একবার বললেন, “এই তো সেদিন দেওয়ালি সেলের সময়ে গুচ্ছের জিনিস কিনলে। বেশিরভাগ প্যাকেজ অবধি খোলা হয় নি। আবার কিনে কী হবে?”
“তুমি যাও তো। বললাম এসে আমাকে সাপোর্ট কর। আমাকে ঠিকঠাক জিনিস চিনিয়ে দাও। সেসবের নাম নেই। একদিন ছুটিতে বাড়ি আছ। সেটাও টিভির সামনে বসেই কাটিয়ে দিলে”।
সায়নদার মুখে অনেকগুলো কথা এসে গিয়েছিলঃ টিভির সামনে বসতে চাই নি। তুমি নেটফ্লিক্স দেখতে দিলে না তাই বসেছি। তুমি নিজে কী করছ? কার কথা শুনে অনলাইন সেল হবে, সেই আনন্দে সব কাজ ছেড়ে রাবিশ সব বুক করছ। তার বেলা? কিন্তু এসব বললে টিভির এই জমাটি প্রোগ্রাম মাথায় উঠবে, লাভ কী? তাছাড়া যা কেনার সে তো কেনা হয়েই গেছে। দেখা যাক না, কীরকম হয়। সেই মনে আছে গত দেওয়ালিতে একটা ড্রিমক্যাচার কিনেছিল। সে তো দুদিন পরেই দড়ি ছিঁড়ে পড়ে গেল। কিন্তু এখন বেশ ধুলো ঝাড়তে কাজে লাগে। 
কিন্তু এসব কথা বলা যায় না। আর তখন সায়নদার ফেভারিট টপিক নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। দেশের উদার অর্থনীতি এনে লাভ হয়েছে না ক্ষতি? সেই সময়ে ঝগড়া শুরু হলে মুশকিল। তাই সায়নদা চুপ করে গেলেন। নটার সময়ে প্রোগ্রাম শেষ। তখন দেখা যাবে। 
ইতিমধ্যে প্রায় পনেরো মিনিট শ্রেয়সীদির মুখে কথা নেই। একবার দুবার নিচু গলায় কীসব মন্তব্য করেছিল, সায়নদা শোনার চেষ্টা করেনি। যা কিনছে কিনুক। এর আগেও হয়েছে। কিছু জিনিস পেয়েছে বাড়ির রান্নার মাসি, কিছু পেয়েছে বাড়ির কেয়ারটেকারের বউ। এবারও তাই হবে। একবার দুবার সায়নদার মোবাইলে একাউন্ট ডেবিট হওয়ার মেসেজ এসেছে। তার মানে অনলাইন বুকিং চলছে। তা চলুক। 
একবার শ্রেয়সীদি বলল, “অনেকদিন ধরে শখ ছিল। এরকম অফার পেলে ছাড়া যায়? কিনে নিই, কী বল?” সায়নদা তখন মগ্ন দেশের কৃষিব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন নিয়ে। যখন প্রোগ্রামের আর পাঁচ মিনিট বাকি, তখন শ্রেয়সীদি একবার ডাকল। “দেখে যাও। এটাই ফাইনাল করলাম”। তখন কী আর টিভির সামনে থেকে ওঠা যায়? একজন বক্তা প্রায় টেবিলের ওপর উঠে সুদীর্ঘ বক্তব্য রাখছেন। অন্যরা মুখ খুলে তীর্থের কাকের মত বসে আছে। কিন্তু সেই বক্তার গলার জোর এতটাই যে লাগসই উত্তর দিয়ে উঠতে পারছে না। টিভি স্ক্রীনের একদিকে গ্রাফ ভেসে উঠছে। শেষ তিন বছরের সালতামামি। একদিকে সেই বক্তৃতা আর অন্যদিকে সেই গ্রাফের নীচে লেখা দেখানো হচ্ছে যে বক্তা ভুল বলছেন। সায়নদা বলল, “এখন দাড়াও। একটু পরে আসছি”। শ্রেয়সীদি তাও কীসব বলছিল। “তোমার আমার দুজনেরই কাজে লাগবে”, “আর বাইরে যেতে হবে না”। “দারুণ কমে পাচ্ছি” ইত্যাদি। সায়নদা খুব একটা মন দিয়ে শোনেনি। শেষে শ্রেয়সীদি চীৎকার করল, 
“আরে সেল তো আর পাঁচ মিনিটেই শেষ। যদি এখন ক্লিক না করি তাহলে কিন্তু হাত ফস্কে যাবে”।
“তাহলে করে দাও”।
“ ঠিক তো?”
“আরে করে দাও না”।
“এটা কিন্তু তোমার আমার দুজনেরই কাজে লাগবে। ওই যে জামাটা কিনলাম, সেটাও পরতে পারব”।
“ঠিক আছে। করে দাও”।
নটা বাজল। টিভির প্রোগ্রামও শেষ। অনলাইন সেলও শেষ। শ্রেয়সীদি বিজয়গর্বে টেবিল থেকে উঠে দাঁড়াল। “এই শেষ অফারটা যে পাব ভাবতে পারিনি।” সায়নদার তখন মাথা ঘুরছে। টানা দু ঘণ্টা চীৎকার আর টেবিল বাজানো শুনে শুনে তিনি ক্লান্ত। “বা!” উনি না দেখেই বললেন, “ ভালোই বাজার হল তাহলে।”
শ্রেয়সীদির তখন সময় নেই। হোয়াটসঅ্যাপে পোস্ট করছেন যে কত কম দামে কী কী জিনিস পেয়ে গেছেন। একবার মুখ তুলে বললেন, “তাহলে ওটা এলেই তোমার সোফার পাশে দিয়ে দেব।”
এতক্ষণে সায়নদার টনক নড়ল। “কী দিয়ে দেবে? সেই স্ট্যান্ড? সে তো রান্নাঘরে বললে…”
“আরে নানা। সে তো রান্নাঘরেই থাকবে। আমি বলছি সেই বাইকের কথা!”
“বাইক মানে?”
“কেন, এতক্ষণ ধরে যা যা বললাম, কিছুই শোনোনি? কী বললাম তোমায়? লাস্ট মোমেন্টে দেখি সেই ইনডোর এক্সারসাইজ বাইক সিক্সটি পারসেন্ট কমে দিচ্ছে। আমার ইচ্ছে ছিল আর দুটো বেড কভার কিনব। কিন্তু এটা দেখে সব ছেড়ে এটাই নিয়ে নিলাম।”
ততক্ষণে হোয়াটসঅ্যাপের পোস্ট দেখে ফোন আসতে শুরু করেছে। সায়নদা শুনতে পেলেন, “আরে তানিয়া। দারুণ ব্যাপার বল। আমি ভাবতেই পারিনি এত কমে এটা পেয়ে যাব।”
সায়নদা একটু হাঁপ ছাড়লেন। যাক, কমেই পেয়েছে। হঠাৎ ওনার মনে পড়ল সেই নেটফ্লিক্সের সিরিজের কথা। তাড়াতাড়ি মোবাইলে খুলতে গিয়ে দেখলেন অনেকগুলো মেসেজ এসেছে। সব একাউন্ট ডেবিট হওয়ার মেসেজ। শেষেরটা খুলেই সায়নদার চোখ কপালে। এ কী? এর নাম সিক্সটি পারসেন্ট? এ তো গালে থাপ্পড় মেরে টাকা নেওয়া!
ওদিকে শুনতে পেলেন শ্রেয়সীদি কাকে ফোনে বলছে, “হ্যাঁ রে, আমিও ভাবিনি। মাত্র পয়তাল্লিশ হাজারে এরকম বাইক পেয়ে যাব। নেক্সট উইকেই ডেলিভারি দেবে। তখন তোকে ডাকব। এসে দেখে যাস।”
সায়নদার আর নেটফ্লিক্সের সিরিজ দেখার ইচ্ছে রইল না। 

বাগান করার ঝকমারি

ডাঃ রুদ্রজিৎ পাল

কসবা, কলকাতা 

sprint.jpg
বাগান করার ঝকমারি

প্রবন্ধ

Rudrajit Paul.jpg

ফেব্রুয়ারী ২০২৫ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

মাদের পাড়ার অভিষেকদার খুব বাগানের শখ। বাড়ির সামনে কোন জায়গা নেই। কিন্তু তাতে কী? বাড়ির প্রত্যেক জানলা, বারান্দা, আর বাড়ির ছাদে তাঁর গাছ-গাছালির জগৎ। আর ঘরের ভেতরেও রয়েছে হরেক রকম ইনডোর প্ল্যান্ট। অভিষেকদার বউ, মানে আমাদের গার্গীবৌদির প্রাণ ওষ্ঠাগত। যত অভিষেকদার গাছের সংখ্যা বাড়ছে, ততই বৌদির ব্লাড প্রেশার বাড়ছে। আমাকে দেখতে পেলেই বলে,

“বুঝলি সায়ন, মনে হয় এবার বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে”।

“কেন বৌদি?” আমি উতলা হয়ে বলি। বৌদি আমাকে প্রায়ই নানা বিদেশী সিনেমা পেন ড্রাইভে করে দেখতে দেন। সিনেমার উৎস শুকিয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় আমি বিচলিত হয়ে উঠি। 
“তোর দাদার গাছের জন্য। সেদিন জানিস, একটা কোন দেশের ইনডোর প্ল্যান্ট এনে রেখেছে বিছানার পাশে। কালকে আমি রাত্রে শুতে গেছি, সেই গাছের ডালে আটকে আমার নতুন শাড়িটার আঁচল ছিঁড়ে গেল!”
“এ বাবা!” শাড়ির শোকে কাতর বৌদিকে আমি সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করি। 
“আরে সে তো হল। কিন্তু তোর দাদা কী করল জানিস? সেই আঁচলে লেগে কেন গাছের ডাল ভেঙ্গে গেছে, সেই নিয়ে বাড়িতে তুলকালাম করল কাল রাতে”।
হাতের ব্যাগটা তুলে দেখাল বৌদি।

“এই দেখ সায়ন। সেই শাড়ি নিয়ে যাচ্ছি এখন রিপেয়ার করতে!” 
“আর দাদা?” আমি জিজ্ঞেস করি।
“দাদা? তিনি এখন নতুন কোন ফুলগাছের জন্য সার বানাচ্ছেন”।
বাস্তবিক, অভিষেকদার বাড়ির ভেতর ঢুকলে মাথা ঘুরে যায়। অদ্ভুত সব গাছ! উনি নিজে কাজ করেন আই টি ফার্মে। বেশ উঁচু পোস্ট। মাসে দুবার বিদেশ যেতেই হয়। আর যেখানেই যান, সেখান থেকে নিয়ে আসেন নানা বিচিত্র গাছ। তারপর শুরু হয় তার তোষামোদ। বৌদি আরেকদিন আমায় বলল,

“এবারে আমি কিন্তু খুনোখুনি করে ফেলব সায়ন!”

“কেন বৌদি?” আমি আতঙ্কিত হই। হঠাৎ করেই এই কথা কেন? সিনেমা সাপ্লাই দিয়ে বৌদি আমার হিরো। তাঁর হঠাৎ এরকম ভিলেনের মত কথা কেন? 
“কাল থেকে তোমার দাদা কী একটা সার বানাচ্ছে, নতুন ক্যাকটাসে দেবে বলে। তার গন্ধ যদি দেখতে!” 
“এ বাবা! বাড়ির মধ্যেই বানাচ্ছে?”
“নইলে কোথায় আর ওই জিনিস রাখবে? রাস্তায় বসে করলে কুকুররাও ছুটে পালিয়ে যাবে! আর কোথায় বানাচ্ছে জানো? রান্নাঘরে!! আমি সকালে রান্নাঘরে ঢুকতে গিয়ে সেই গন্ধে প্রায় নাড়ি উল্টে এসেছিল”।
তবে অভিষেকদার একাগ্রতা আছে। গাছের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। সম্প্রতি দেখলাম বাড়ির বাইরের দেওয়ালে হুক লাগিয়ে কিছু গাছের টব ঝুলিয়েছে। বেশ সুন্দর সব পাতাবাহার গাছ ঝুলছে। 
একদিন অভিষেকদার সাথে রাস্তায় দেখা হল।

“কেমন আছ দাদা?”
“এই চলছে ভাই”। অভিষেকদার গলাটা কেমন যেন ম্রিয়মান লাগল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “কেন? কিছু হয়েছে? বৌদির শরীর খারাপ?”
“গার্গী? না না। ও ভালোই আছে। কিন্তু আমার একটা নতুন অর্কিড কাল থেকে নেতিয়ে পড়েছে। সেই জন্য ভাবছি কী করব!”
“আরে দাদা। দুএকটা গাছ ওরকম হবেই। কিন্তু বাড়িতে তো আর জায়গা রাখলে না”।
দাদা একটু হাসে। “আরে ধুর। এ আর কী? কালকে ইউটিউবে দেখছিলাম নিউ ইয়র্কের এক মহিলা। জানিস। বাড়ির মধ্যে পুরো ট্রপিক্যাল রেইন ফরেস্ট বানিয়েছে। কী দারুণ হয়েছে, ভাবতে পারবি না!”
বাড়ির ভেতর রেইন ফরেস্ট বানালে বৌদির অবস্থা কী হবে, সেই ভেবে আমি আশঙ্কিত হয়ে উঠি। “কিন্তু দাদা, এত গাছ কী ভালো? বৌদির তো অনেক পরিশ্রম হচ্ছে!”
“একটু গারডেনিং করা খুব ভালো ব্যায়াম জানিস”। দাদা বলেন,

“বিদেশে গারডেনিং করার জন্য ডাক্তাররা উপদেশ দেন”।
এভাবেই দাদার বাগান দিন দিন শ্রীবৃদ্ধি হতে থাকে। দাদার ফেসবুক পেজ ভরে ওঠে নানা ফুলের ছবিতে। এমনকি দাদার বাগানের ছবি এত জনপ্রিয় হল যে ফেসবুকে দাদার নামে ফ্যানপেজ অবধি চালু হয়ে গেছে। বৌদি প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছেন। দেখা হল একদিন বাজারে। আমি বললাম, “একি বৌদি? তুমি এই বৃষ্টির মধ্যে বাজারে এসেছ কেন? কালকেই তো দেখলাম অনেক কিছু কিনে নিয়ে গেলে”।
“আর কী বলব? কালকে তোমার দাদা কোন সাউথ আমেরিকার গাছের বীজ রাখার জন্য ফ্রীজ থেকে সব সবজি বার করে দিয়েছে। আমার কিছুই বলেনি। আজকে সকালে উঠে দেখি সব সবজি মেঝের ওপর, পচে গেছে। তাই এখন আবার এলাম”। বৌদিকে আর সাহস করে সেই ট্রপিক্যাল রেইন ফরেস্টের গল্পটা বলতে পারলাম না। কী জানি। হয়ত দাদাকে বলে দেবে, “যদি অতই ট্রপিক্যাল ফরেস্টের শখ, তাহলে বাড়িতে কেন? যাও সেই দেশেই থেকে যাও!” 
যাই হোক, এই বাগান পাগল দাদার ফেসবুক পেজে একদিন দেখি এক ঘোষণাঃ “নতুন বছরে সারপ্রাইজ আসছে”
আমি কৌতূহলী হয়ে উঠলাম। নতুন কী দেখাবেন দাদা? এই গত সপ্তাহেই তো গেছিলাম। কিন্তু নতুন কিছু তো চোখে পড়েনি। লাস্ট যে টবে বাতাবি লেবুর গাছ আর আপেল গাছ দেখেছিলাম, তাতেও তো ফল এসে গেছে। সেটা ফেসবুকে সবাই দেখেও নিয়েছে। আর তাহলে নতুন কী? 
সন্ধ্যেবেলা চলেই গেলাম দাদার বাড়ি। বৌদি দরজা খুললেন।

“কী ব্যাপার গো?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “দাদা কী সব সারপ্রাইজ…”
“আমি জানি না বাবা। তুমি দেখ গিয়ে। দুদিন হল ওই নিজের ঘরে আর নিজের ছাদে কী করছে কে জানে। কাউকে ঢুকতে দিচ্ছে না”।
আমি গিয়ে ছাদের দরজায় টোকা মারি।

“কে?” দাদার গলা শোনা গেল।

“আমি দাদা, সায়ন”।

কিছুক্ষণ পরে দাদা দরজা খুলে প্রথমে আমার পেছনে আর কেউ আছে কিনা দেখে, তারপর আমাকে ছাদে ঢুকতে দিল। “কী ব্যাপার?” আমি প্রশ্ন করি, “ফেসবুকে ক্রিপ্টিক মেসেজ, বাড়িতে

নিজের ঘরে দরজা বন্ধ। কী করছ?”

“আস্তে আস্তে বলছি দাঁড়া”।
দাদা আমাকে টেনে নিয়ে গেল ছাদের এক কোণে। এদিকটা একটা লোহার খাঁচা মত বানানো।

“এই দেখ—"
একটা টবে দেখলাম একটা ছোট গাছ। ঘন সবুজ পাতা। “কী এটা দাদা?”
“বলছি। কিন্তু প্রমিস কর যে কাউকে বলবি না?”
“আরে নিশ্চয়ই। কোনদিন বলেছি?”
“বউদিকেও না?”
“তুমি না বললে বলব না!”
“ঠিক আছে। এটা কী গাছ জানিস?”
“না। চেনা লাগছে না!”
“এটা হল ইস্তানবুলের প্যারাডাইজ ফ্লাওয়ার!”
“সে আবার কী?”
“তুর্কির এক অখ্যাত গ্রামে এই ফুল ফোটে। বছরে মাত্র পাঁচ দিন। এটা সেই গাছ!”
“সে কী! তুমি পেলে কী করে?”
“সে এক গল্প। আমার ফেসবুক পেজের এক ফ্যান আমাকে সেদিন মেসেঞ্জারে বলল”।
“তুমি কিনলে?”
“আরে এসব ফুলের কী দাম হয়? সেই ফ্যানের বাবার প্রিয় গাছ ছিল এটা। তিনি মারা গেছেন সম্প্রতি। সেই লোকটি অন্য শহরে চলে যাচ্ছে বাড়ি বিক্রি করে। সে আমাকে দিয়ে দিল”।
“কিন্তু,” আমার সন্দেহ যায় না,“ এরকম রেয়ার গাছ কলকাতায় আছে আমরা কেউ জানি না! আমাদের কথা ছাড়, তুমি এত দেশ বিদেশের গাছ লাগাও, তুমিও জানতে না যে কলকাতায় কারুর কাছে এরকম গাছ আছে?”
“আরে ও বলেছে যে ওর বাবা সব সময়ে প্রচার এড়িয়ে চলতে চাইতেন। তাই এই গাছের কথা উনি কাউকে বলেন নি”।
“প্যারাডাইজ ফ্লাওয়ার?” আমার সন্দেহ যেন যায় না। “তুমি দেখেছ সেই ফুলের ছবি?”
“এই দেখ, আমাকে হোয়াটসআপে পাঠিয়েছে”।
চেয়ে দেখলাম। সত্যিই সুন্দর ফুল। হালকা গোলাপি রঙের বড় বড় পাপড়ি, মাঝখানটা লাল। পাপড়ি এক সারিতে নয়, প্রায় চার-পাঁচ সারি পাপড়ি মেলে আছে ফুলটা। এত সুন্দর ফুল সত্যিই আমরা কেউ দেখিনি। 
“বাহ!” আমার মুখ দিয়ে আপনিই বেরিয়ে গেল। “এই ফুল হবে ওই গাছে?”
“হবে মানে? আর তিন দিন!”

“সে কী! আমি বলে উঠি। কুঁড়ি এসে গেছে এরই মধ্যে?”
“আরে কুঁড়ি ছিলই। আমাকে যখন বিক্রি করেছে, তখনই কুঁড়ি ছিল। ওই দেখ না!”
সত্যিই দেখলাম একটা ডালে ছোট ছোট কুঁড়ি। আগে চোখে পড়েনি।

“কিন্তু এত ছোট কুঁড়ি?” আমি একটু ক্ষুণ্ণ হলাম, “ছবির ফুলগুলো তো বেশ বড় বড় গো”।
“আরে এতেই হবে। এই ফুল একবার ফুটলে দুসপ্তাহ থাকে। আস্তে আস্তে বড় হবে”।
দাদাকে কংগ্র্যাটস জানিয়ে চলে আসছি, দাদা একটু ডাকল, “এই সায়ন, আমাকে পাঁচ হাজার টাকা ধার দিতে পারবি?”
“সে কী? কেন?”

“আসলে এই গাছটার দাম নিয়েছে সাড়ে ছয়। এখন আমার হাতে এই ফোনের ই এম আই দেওয়ার টাকাও নেই”।
“সাড়ে ছয়?” আমার মুখ আপনি থেকেই হাঁ হয়ে গেল, “তবে যে বললে এমনিই দিয়ে দিয়েছে!”
“ধুর, এমনি কী হয়? উনি আমাকে ক্যাটালগ দেখালেন বিদেশে এর চারার দাম প্রায় পাঁচশ ডলার। নেহাত উনি চলে যাবেন তাই কম দামে আমাকে দিয়ে দিলেন”।
এরপর কেটে গেল দিন তিনের। আমার নিজের অফিসের কাজে এই কথাটা ভুলেই গিয়েছি। হঠাৎ একদিন মা আমাকে ডেকে বলল, “কী ব্যাপার রে? অভিষেকরা বাড়ি বন্ধ করে কোথায় গেছে?”
“বাড়ি বন্ধ করে?” আমি অবাক হলাম।“ কই জানি না তো!”
পরের দিন গিয়ে দেখি সত্যিই বাড়ি বন্ধ। অভিষেকদাকে ফোন করলাম। ফোন আউট অফ রিচ। বৌদির ফোনেও লাগলো না। অবশেষে বিকালে ফোনে বৌদিকে পেলাম।

“কী হয়েছে বৌদি? তোমরা কোথায়?”
বৌদি প্রায় কান্নাভেজা গলায় বললেন, “কেন? জানো না?”
“না তো? কী হয়েছে?”
অবশেষে জানা গেল সেই ঘটনার কথা। দাদা টানা দুদিন নাওয়া খাওয়া ভুলে ছাদের সেই গাছের পাশে বসে ছিলেন। অবশেষে তিন দিনের মাথায় ভোরবেলা ফুটল সেই ফুল। বেশ ছোট ফুল। কিন্তু তাও, ইস্তানবুলের প্যারাডাইজ ফ্লাওয়ার বলে কথা। দাদা ভোর পাঁচটাতেই ফেসবুক লাইভ করে সেই গাছ দেখিয়েছেন সবাইকে। তারপর কিছুক্ষণের জন্য ফোন বন্ধ করে ঘুমোতে গেছেন।
আটটার সময়ে উঠে ফেসবুক খুলেই বজ্রপাত। দাদার পেজে ব্যাঙ্গ আর রসিকতার বন্যা বয়ে যাচ্ছে। আজকের ছেলে মেয়েরা যখন ফেসবুকে ট্রোল করে, তখন কিন্তু ভদ্রতা-সভ্যতার ধার ধারেনা। “জালিয়াত”, “জোচ্চোর” “নতুন সুদীপ্ত সেন” ইত্যাদি বাছা বাছা বিশেষণে দাদাকে ভূষিত করা হয়েছে। কী হল কেসটা?
দাদা স্ক্রোল করতে করতে অবশেষে বুঝতে পারলেন ব্যাপারটা। ফেসবুকে ছবি দেখার পরেই চারিদিকের বাগানপ্রেমীরা রে রে করে উঠেছেন। এটা প্যারাডাইজ ফ্লাওয়ার? চালাকির জায়গা পাওনি? এটা হল ঘেঁটু ফুল। গ্রামের মাঠেঘাটে হয়ে থাকে। সেই ফুলের গাছ দাদাকে বিক্রি করে গেছে প্যারাডাইজ ফ্লাওয়ার নামে। অন্য কোন ফুলের ছবি দিয়েছে দাদার মোবাইলে। আর দাদাও ফেসবুকে চমক দেওয়ার লোভে আর কিছু না দেখেই সেই গাছের ছবি দিয়ে দিয়েছেন। ঘেঁটু ফুলের অন্য নাম ভাঁট ফুল। তাই দাদার পেজে কমেন্ট এসেছে, “ভাঁট ফুলের ছবি দিয়ে ভাঁট বকছেন?” 
এখন দাদা-বৌদি লুকিয়ে আছেন ভাটপাড়ায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে। দাদার ফেসবুক পেজ ডিলিট করে দিয়েছেন। বৌদি শেষে বললেন,

“তাও ভালো যে বিনা পয়সায় গাছটা পেয়েছিলেন। এই জংলি গাছ যদি টাকা দিয়ে কিনতেন তাহলে আরও লজ্জার শেষ থাকতো না”।
আমি আর সাহস করে বৌদিকে গাছের দামটা বলতে পারলাম না। 

প্রবন্ধ

শ্রীময়ী
সোমা বান্দ্যোপাধ্যায়

অধ্যক্ষ

নরসিংহ দত্ত কলেজ, হাওড়া

childhood1.jpeg
শ্রীময়ী

ফেব্রুয়ারী ২০২৫ ।। মতামত ।। সূচীপত্র

নেকদিন কাছেপিঠে কোথাও যাওয়া হয়নি। বেরিয়ে পড়া হয়নি টুক করে কোথাও। বর্ষা এবার এক লুকোচুরি খেলায় মেতেছে। অঙ্কের ঘাটতি পুরণ হয়েছে কিনা জানিনা কিন্তু চাষীর মন সে ভরাতে পারেনি এখনও। আমার সবুজ বাংলা নির্মল হয়ে উঠেছে বর্ষার ছোঁয়া পেয়ে। সমস্ত প্রকৃতি তারুণ্যের তেজে হাতছানি দিয়ে ডাকে। সেই ডাকে সাড়া দিতে বেরিয়ে পড়লাম দলবেঁধে। আমাদের গন্তব্য একটুকরো সুন্দরবন। মাতলা নদীর বাঁধের আড়ালে লুকিয়ে থাকা অপরূপ সুন্দর এক গ্রাম বনঘেরি। জল আর জঙ্গলে ঘেরা এই গ্রাম সম্বৎসর তাল মিলিয়ে চলে মাতলার প্রলয়নাচনের সঙ্গে।
শহর থেকে চলতে শুরু করে গগনচুম্বী অট্টালিকার জঙ্গল পার হয়ে  চলে এসেছি সবুজের দেশে। ঠিক কখন যে প্রকৃতিটা ধূসর থেকে সবুজ হয়ে গেল, খেয়াল করতে পারিনি। প্রচন্ড গুমোট গরম। ধানক্ষেতে জমে থাকা জলে ভেসে উঠেছে নীল আকাশ আর একরাশ সাদা মেঘের জলছবি। সে ছবিতে ঠোক্কর মারছে দুধ সাদা বক, শামুকখোলের দল। বাড়ন্ত ঘনসবুজ ধানগাছ সমস্ত ছবিটাতে লাগিয়ে দিয়েছে জীবনের রঙ।
কৃষ্ণমোহন, জয়নগর, ধপধপি ছাড়িয়ে আমরা ঢুকে পড়েছি কৈখালী যাওয়ার রাস্তায়। কাছারিবাজার ছাড়িয়ে গাছের আড়ালে ঢালে নেমে যাওয়া রাস্তাটা আমরা খেয়াল করিনি।  খানিকটা এগিয়ে আবার যখন ফিরে এলাম, রাস্তাটা দেখে প্রথম প্রশ্ন মনে এলো- গাড়ি ঢুকবে তো? রাস্তার পাশের দোকানে বসে থাকা এক ছোকরা মাতব্বরের ভঙ্গিতে বলে- গাড়ি এখানে রেখে টোটো নিয়ে চলে যান। তা কি করে সম্ভব? বনঘেরি গ্রামে আমাদের দুটো রাত কাটানোর পরিকল্পনা। গাড়ি রাস্তায় ফেলে রেখে গেলে কি করে চলবে? কোনওরকমে ঢুকে পড়া হলো ঢালে নেমে যাওয়া ঢালাই রাস্তায়। সাপের মত এঁকে বেঁকে ক্রমশ: গ্রামের পেটের মধ্যে ঢুকে পড়া রাস্তাটা গাড়ি চালানোর পক্ষে যথেষ্ট বিপজ্জনক। খাড়া ঢালাই রাস্তার দুধারে মাটির বাঁধ নেই। গাড়ির চাকা পড়লেই সবশুদ্ধ হুড়মুড়িয়ে উলটে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা। কোনওরকমে হরিনাম জপতে জপতে পৌঁছে গেলাম ‘বাবাহরি হোমস্টে’ তে। জানা গেল রাস্তার ধারে বসে থাকা একদল মাতব্বর এভাবেই পর্যটকদের বিভ্রান্ত করে এবং রাস্তায় গাড়ি রাখার জন্য একটা মোটা টাকা আদায় করে। তোলাবাজির সূক্ষ্ম নিদর্শন।
বাবাহরি হোমস্টে এখনও ঠিক বাণিজ্যিক অতিথি আবাস হয়ে ওঠেনি। সূর্য্য নস্করের বসতবাড়ির মধ্যেই কয়েকটা ঘর পর্যটকদের চাহিদামতো সাজিয়ে গুছিয়ে নেওয়া হয়েছে।  হোমস্টের আসল স্বাদ পাওয়া গেল এখানে। বাড়িতে ঢুকতেই দৌড়ে এলো গোলগাল শামলাবরণ ছোট্ট একটি মেয়ে। একগাল হাসি সঙ্গে করে। অচেনা লোকজন দেখে নাচতে লাগল ধেই ধেই করে। আদর করে জিগ্যেস করলাম- ‘কি নাম তোর!’
‘চিময়ি’।
‘চিন্ময়ী’?
না। ‘চিময়ি’
বেগতিক দেখে ছোটখাটো চেহারার এক প্রৌঢ়া বললেন - ওর নাম শ্রীময়ী। 
সূর্য্য আর চন্দনার সাজানো সংসার এই হোমস্টে। সঙ্গে আছেন সূর্য্য নস্করের মা আর তাদের চার কন্যা - মমতা, সুজাতা, তাপসী আর শ্রীময়ী। মমতা আর সুজাতা কৈখালী রামকৃষ্ণ আশ্রমের ইংরাজি মাধ্যম কো-এডুকেশন স্কুলের দ্বাদশ এবং নবম শ্রেণীতে। তাপসী বনঘেরি অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেনীতে, শ্রীময়ী তৈরী হচ্ছে স্কুলে যাওয়ার জন্য।  শহুরে মানুষরা যাকে প্রিস্কুল এডুকেশন বলি ওরা বলে ‘টিউশুনি’। প্রিস্কুলে পড়া অনেক বাচ্ছার থেকে বোধহয় একটু  বেশিই শিখেছে শ্রীময়ী। শ্রীময়ীর সবথেকে বড় সম্পদ ওর সারল্য আর মিষ্টি গ্রামীন ভাষা। আমরা কিন্তু শ্রীময়ীর অতিথি নই। কেউ দাদু, কেউ কাকু, কেউ কাকী, কেউ আবার ঠাম্মা। মিনিট পাঁচেক সময়ও নেয়নি ও এই সম্পর্কগুলো তৈরি করে ফেলতে। চন্দনা দু একবার চোখ পাকালেও তার কোনও তোয়াক্কাই করেনা শ্রীময়ী। আমাদের খাবার টেবিলের মাঝখানে বসেই চালিয়ে যায় তার দস্যিপনা।
কথায় কথায় কখন ওদের পরিবারটার সঙ্গে মিলে গেলাম আমরা। হয়ে গেলাম এমন কেউ যাদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া যায় সুখ দু:খের কিছু কথা। বড় অদ্ভুত এদের জীবনযাত্রা। মাতলা নদী থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে এদের বাস। মাছকে ঘিরেই বেঁচে থাকা। বেঁচে থাকার লড়াই যে কি অসম্ভব কঠিন হতে পারে তার হদিস মিলল এই নস্কর পরিবারের রোজনামচা থেকে। 

এই হোমস্টের খাবার মেনুতে মাছের জয়জয়কার। ভাতের পাতে ছোট ছোট আমোদী, পারসে মাছ ভাজা, নদীর টাটকা রুই মাছের ঝাল। কি অপূর্ব যে তার স্বাদ। কিন্তু সে মাছ ধরার কাহিনী শুনলে শিহরন জাগে। দুপুরে এক রাউণ্ড ঘুমিয়ে বিকেলে  আমরা নদীর পাড়ে বেড়াতে গেলাম। তখন ভাটা চলছে। নদীর পাড় অনেক উঁচু করে ইট দিয়ে বাঁধানো। বাঁধের নীচে এক কোমর কাদা। সে কাদায় হাঁটা যে কি পরিশ্রমসাধ্য তা চোখে না দেখলে বোঝা যায় না। বাঁধের উপর একদল মানুষ বসিয়েছে তাসের আড্ডা। আর একদল ছেলেমেয়ে কাঁচের গুলি নিয়ে পিল খেলছে হৈ হৈ করে। সামনে বিস্তীর্ণ নদী মেলে ধরেছে তার সৌন্দর্য।  কেমন যেন কেঁপে ওঠে বুকটা। সন্ধ্যায় মুড়ি আর বেগুনি নিয়ে আমরা গল্প জুড়লাম সূর্য্যর সঙ্গে। সন্ধ্যে সাতটা সাড়ে সাতটায় সূর্য্য যাবে নদীতে জাল ফেলতে। তখন ভরা জোয়ার। বাঁধের পাশে একবুক জলে দাঁড়িয়ে খোঁটায় বেঁধে রেখে আসবে তার জালখানা। বুকসমান জলের উথাল পাথাল স্রোতের সঙ্গে লড়াই করে জাল খাটাবে একদল সূর্য্য নস্কর। কখনো এক কোমর জলে হেঁটে, কখনও এক বুক জলে সাঁতার কেটে জাল খাটাতে কেটে যাবে তিন সাড়ে তিন ঘন্টা। পেটানো লোহার মত আঁটোসাটো ক্লান্ত সূর্য্য যখন বাড়ি ফিরল

তখন আমরা খাবার টেবিলে ঝড় তুলেছি। সামনে মুরগির ঝোল আর  নরম রুটি। সূর্য্য অতিথি আপ্যায়নে এতটুকু কার্পণ্য করে না। বাঙালির আলোচনা দু’পা এগোলেই রাজনীতির কানাগলিতে ঢুকে পড়ে। আমরাও ব্যতিক্রম নই। আমাদের এক বন্ধু রাজনীতির বিভিন্ন বিষয়ে জানতে একটু বেশীই উৎসুক। কথায় কথায় এসে পড়ে ভোটের কথা, বিভিন্ন সরকারি পরিষেবার কথা, প্রকল্পের কথা। সমস্ত প্রশ্নের গুছিয়ে উত্তর দেয় সূর্য্য। দু:খ করে বলে বহুদিন ধরে জব কার্ড তার আছে, কিন্তু তা কোনও কাজে লাগে না। ভোটের নামে দাদাগিরি আর ভোটের দিনের আতঙ্কের কথা বলতে গলা কাঁপে না সূর্য্যর। মনে হয় কাউকে বলতে পেরে গায়ের জ্বালা বোধহয় কিছুটা মিটছে। মাছ ধরতে গিয়ে ডাকাতের মুখে অনেকবার পড়েছে সূর্য্য। বুক চিতিয়ে চালিয়ে যাওয়া সে লড়াইয়ের  গল্পও শোনায় আমাদের। সে গল্পের ছত্রে ছত্রে রয়েছে মাছুয়াদের এককাট্টা লড়াইয়ের কাহিনী। সূর্য্যর গলায় আক্ষেপ শোনা যায়। সেই ডাকাবুকো মাছুয়ারা আজ সরকারি ভাতার দিকে তাকিয়ে থাকে জুলজুল করে। খেটে খাওয়ার সুখ আর কেউ চেটেপুটে অনুভব করেনা।
‘মাছের কাজে বিস্তর কষ্ট গো দিদি। তাও যেদি ঠিকমতো দাম পাওয়া যেত। সক্কালসক্কাল বাজার ধরতি না পারলি সব কষ্ট বেগার। ওই জন্যিই সব মাছের কাজ ছেড়ি দে অন্য ধান্দায় নামতিছে নয়তো ভাতা নে বাড়ি বসি আছে’
কথা প্রসঙ্গে জানা যায় মাছধরা সূর্য্য নস্করের কয়েক পুরুষের পেশা হলেও বনঘেরি গ্রামে তাদের বসত খুব বেশিদিনের নয়। সূর্য্যর ছোটবেলা কেটেছে কলকাতার লেক গার্ডেন্সে।  বিঘের পর বিঘেক
জুড়ে ছিল মাছের ভেড়ি। সেই ভেড়িতেই সূর্য্যর জাল টানার হাতেখড়ি। বাবা লেক গার্ডেন্স এলাকায় রিক্সা চালাতেন। সেই সঞ্চয় বুকে করেই সমস্ত সংসার নিয়ে চলে আসেন মাতলার ধারে। কিছুটা জমি আর বসত বাড়ি নিয়ে গড়ে তোলেন সাজানো সংসার। ধীরে ধীরে গতরে খেটে সূর্য্য তৈরী করেছে বেশ বড় একটা বাড়ি, বাড়ির পিছনে পুকুর, চারিদিকে বাগান। হোমস্টেটাকে বেশ বড় করে বানানোর পরিকল্পনা আছে ওর। কিন্তু ‘নদীর ধারে বাস ভাবনা বারোমাস’ তাই একটু করে এগোয় আর প্রকৃতির ক্ষণিক তান্ডবে পিছিয়ে পড়ে কয়েক যোজন। কিন্তু আয়েসে পাওয়া ভাতার কাছে বিক্রি করেনি  দুচোখের স্বপ্নটুকু।
সন্ধ্যেবেলা আমাদের আড্ডা বেশ জমে উঠেছে। হাসির রোল উঠছে দেদার। হঠাৎ নি:শব্দে আমাদের সকলের মাঝে এসে গ্যাঁট হয়ে বসল শ্রীময়ী। ‘ঠাম্মা বিস্কুট দাও’। অনাবিল সরলতায় মাখা শ্রীময়ী আমাদের অবাক করে দেয়। এভাবেও পরকে আপন করা যায়? আমাদের পরিবারের বাচ্চারা কি পারে? এমন করে চাইলে আমাদের বাচ্চাদের তো আমরা চোখ রাঙাই। সহবতের অভাব মনে করি। আর এই ছোট্ট শ্রীময়ী কেমন অবলীলায় আমাদের নাতনি হয়ে ওঠে। গোটা খাটে ডিগবাজি খেয়ে, নেচে, খেলে আমাদের আড্ডার দফারফা করে সকলের হৃদয় জিতে নিল শ্রীময়ী। আমার বন্ধু বলে - ‘চল তোকে আমাদের সঙ্গে কলকাতায় নিয়ে যাই’। শ্রীময়ীর দৃপ্ত উত্তর - ‘না। কি জন্যি যাবো?
মাছের কাজে যতই কষ্ট হোক সূর্য্য নস্কর সব সয়ে নিয়েছে। ছেলে নেই বলে এতটুকু দু:খ নেই ওর মনে। প্রত্যয়ী সূর্য্য স্বপ্ন দেখে মেয়েরা ওর মানুষের মত মানুষ হবে। অনেকদূর লেখাপড়া করবে। দশ জনের একজন হবে। শ্রীময়ীর দস্যিপনায় একটু ছেদ টানতে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরি। 
‘এই তুই ইস্কুলে যাবি না?’
‘যাবো তো। আগের বছর। বাবা বলি দ্যাছে’
‘ইস্কুলে কি পড়বি’
‘বাংলা, অঙ্ক, ছড়া কবিতা সব’
‘বড় হয়ে কি হবি তুই?’
‘ডাক্তার’
‘তাহলে তো কলকাতা যেতে হবে’
‘না যাবো না। কি জন্যি যাবো?’
সত্যিই রে মা! কি জন্যি যাবি! এ শহর সরলতার সম্মান দেয় না। এই একরত্তি মেয়েটা কেমন করে যেন বুঝে ফেলেছে কলকাতার গোপন কথা। ডাক্তারই হোক আর শ্রীময়ীই হোক, পরিবারের বাইরে কেউ নিরাপদ নয়! পরিবারের মধ্যে? তাতেও সন্দেহ আছে। এতটুকু বুক, রুদ্ররূপী মাতলার সামনে চিতিয়ে দাঁড়ায়। শহরের চোরাকুঠুরীতে বুক ভরে শ্বাস নেওয়ার স্বাধীনতা নেই। কি জন্যি শহরে যাবে? ধুলোমাখা পা আর আদুল গায়ের এই মেয়ে যেন একখন্ড হীরে। আঁচড়ে কামড়ে খুবলে খাবে শহরের ওই নরপিশাচগুলো। কি জন্যি শহরে যাবি! এ শহরে ডাক্তারের চোখ ফেটে রক্ত ঝরে। ছাল ছাড়ানো কচি পাঁঠার মত টেনে চিরে ফেলে ডাক্তারের দুখানা পা। কি জন্যি শহরে যাবি! আঘাতে আঘাতে জর্জরিত ডাক্তার যখন আর্তনাদ করে মা কে ডাকে, এ শহর বার্তা দেয়- আসুন আমরা উৎসবে ফিরি। অনুদানের ফোয়ারা আর মাতব্বরের হুমকি নেচে বেড়ায় শ্মশানকালীর বেশে। লকলকে তার জিব। খুঁটি পুজো আর কার্ণিভালের আলোর ঝলকানিতে চাপা পড়ে যায় সেই অন্ধকার রাত। মাটির প্রতিমার রূপে আপ্লুত হাজার হাজার চোখের আড়ালে হারিয়ে যায় সেদিন জ্বলে ওঠা এক দল হায়নার দৃষ্টি। এ শহরে ছড়িয়ে আছে রাশি রাশি হায়নার দল যাদের সামনে কেউ আয়না ধরে না। বলে না দেখো কি কদর্য দেখাচ্ছে তোমায়। তারিখের পর তারিখ, তারপর আবার তারিখ - আদালতের প্রহসনে হারিয়ে যায় আসল তারিখটা। শূণ্য যদি কিছু হয় তা শুধু ওই পোড়াকপালি মার বুকটা। বেশ তো আছিস এমন প্রকৃতির কোলে, মায়ের বুকটা জুড়ে। এমন হায়নার চিড়িয়াখানায় তুই কি জন্যি যাবি??

মতামত

Please mention the "name of the article and the author" you would like to comment in the following box... Thank you.

bottom of page