top of page
মূল অসমীয়া  কবিতার বাংলা অনুবাদ
অনুবাদক -  বাসুদেব দাস
লিখেছেনঃ - 
প্রতীম বরুয়া ,বর্ণালী ভরালী, বিজয় রবিদাস, নীলিমা ঠাকুরীয়া হক, নীলকান্ত শইকীয়া, কমল কুমার মেধি, অজিত গগৈ, খনীন্দ্র কুমার ডেকা

তোমার কথা 
- প্রতীম বরুয়া 
                     
তোমার কথা মনে করে 
একটা কবিতা লিখতে বসেছিলাম 
কী বলে শুরু করব? 
কোথায় শেষ করব।
ভাবতে ভাবতেই 
সাদা কাগজে  
দু-ফোঁটা চোখের জল ঝরে পড়ল

বুঝতে পারলাম 
আমার ভালোবাসা 
খাঁটি ছিল।

 


জিৎদার জন্য একটি কবিতা
-  প্রতীম বরুয়া 
                      
বহু বছর পরে কাল জিৎদার মুখোমুখি৷
তিন রাস্তার মোড়ে৷বিকেলবেলায়৷

জিৎদা আমার কৈশোর-যৌবনের হিরো৷ 
সুঠাম-সবল চেহারা৷পেশীবহুল বাহু৷
আমাদের ক্রিকেট খেলার নায়ক জিৎদা৷
তাঁর দুরন্ত ফাস্ট বল৷আকর্ষণীয় বোলিং অ্যাকশন৷
গালি আর ফাইন লেগে তাঁর দুরন্ত ফিল্ডিং৷
উড়ন্ত ক্যাচ৷

এক বিশেষ ভঙ্গিমায় ব্যাটটা হাতে নিয়ে 
জিৎদা আমাদের শিখিয়েছিল-
প্রতীম এটা হুক শট৷এটা পুল...সুইপ,লেট কাট।
তাঁর দুরন্ত স্কোরের ড্রাইভে বল গিয়ে বাউণ্ডারি।
দর্শকের হাততালি।আমাদের ম্যাচ জেতার আনন্দোল্লাস।

সেই জিৎদার সঙ্গে গতকাল বিকেলে আমার মুখোমুখি।
বহু বছর পরে।
জিৎদা ধীরে ধীরে আসছে।

রাস্তার ওপাশ থেকে।
তাঁর বিবর্ণ মুখমণ্ডল।

অনুজ্জ্বল চাহনি।
বিষণ্ণ ক্লিষ্ট শরীর।
দুই কাঁধে ক্রাচ।ক্রাচ কাঁধে জিৎদা।
ক্রাচের ওপরে কষ্টকর তাঁর দেহের ভার।
জিনস পেন্ট পরিহিত জিৎদা।
নীল জিনসের বাঁ পা টা 
শূন্যে ঝুলে আছে।বাতাসে দুলছে।
আমাকে দেখে বললেন-রিক্সার জন্য পথ চেয়ে চেয়ে পথ হাঁটছিলাম।
একা।তোর সঙ্গে দেখা হয়ে ভালোই হল।

আমাকে একটু এগিয়ে দেতো।
আমার মোটর সাইকেলের পেছনের সিটে জিৎদা।

জিৎদাকে বাড়ি পৌছে দিচ্ছি।
জিনসের বাঁ পা টা শূন্যে ঝুলে আছে।

বাতাসে দুলছে।
আমি জিৎদাকে কিছু জিজ্ঞেস করিনি।

সবকিছুই আমি জানি।
পুরোনো কথাগুলো আমার মনে পড়ছে।

সেই খেলা সেই আনন্দোল্লাস।
সমস্ত খেলা জিতিয়ে দেওয়া আমাদের জিৎদা কোথাও কি হেরে গেল।
আমি জিৎদাকে কিছু জিজ্ঞেস করিনি।
নিয়তি ভারাক্রান্ত করে তুলেছে সময়।

 

পাশের ঘরের মানুষ
- বীরেশ্বর বরুয়া 

পাশের ঘরের মানুষ চলে গেল 
ভাড়াটিয়া লোক ছিল
এখন অন্য কোথাও 
ভাড়া-ঘর নিয়ে থাকবে।
আমারও শেষ বিদায়ের পরে 
আমার ঘরের মানুষেরা 
অনুভব করবে 
আমার বন্ধুরা মেনে নেবে 
যে আমার শেষ বিদায় 
পাশের ঘরের মানুষের মতো
একটি সাধারণ ঘটনা।
এই পৃথিবীতে আসলে 
আমরা সকলেই পাশের ঘরের মানুষ।

তাস

- বীরেশ্বর বরুয়া 


 আমরা চার বন্ধু ছিলাম।
 প্রতিদিনই বিকেলে তাস খেলতাম।
 ব্রিজ,ফ্লা্‌স,রামি ইত্যাদি।
 মাঝেমধ্যে ঝগড়াও করতাম।
 পরবর্তীকালে আমাদের মধ্যে 
 পুনরায় সম্প্রীতি ফিরে এসেছিল 
 একদিন একজন বন্ধুর মৃত্যু হল।
 শ্মশানে গেলাম।
 শ্রাদ্ধে ও ছোট-খাট কাজে জড়িত রইলাম।
 বাকি তিনজন বন্ধু মিলে
 পুনরায় তাসখেলা শুরু করলাম। 
 তারপরে দ্বিতীয় বন্ধুর মৃত্যু হল।
খবরের কাগজে প্রবন্ধ লিখলাম।
শোক-সভার আয়োজন করলাম।
বাকি দুই বন্ধু মিলে 
তাস খেলতে থাকলাম।
একদিন তৃতীয় বন্ধুরও মৃত্যু হল
অন্য কোনো সঙ্গীর খোঁজে আমার বেরোতে ইচ্ছা করল না।
এখন প্রতিদিনই বিকেলে একা
তাসজোড়া নিয়ে 
আমি পেশেনস খেলা শুরু করেছি। 

অবশেষে একদিন আমিও থাকবনা৷
তাসজোড়া থেকে যাবে।
অন্য কেউ খেলতেও পারে। 

শীত
- বর্ণালী ভরালী

রাতগুলো দীর্ঘ
আর নিশ্বাসগুলো ছোট হয়ে এসেছে
চারপাশে যেন উড়ছে রূপালি আবির 

পাথরে বসে থাকা প্রেমিক-প্রেমিকা যুগলের 
ঠোঁটের বাষ্পে ঝাউবনগুলো কাঁপতে শুরু করেছে

ওরা দুজন সূর্যকে বুকের মধ্যে ডাকছে

বুঝতে পেরেছি, আফ্রিকার গভীর অরণ্য থেকে 
কুণ্ডলী পাকিয়ে আসছে শীত 

শুকনো পাতার মর্মরধ্বনি তুলে 
হ্যাঁ, এ রকমতো শীতেই হয়৷

মৃত্যু
বর্ণালী ভরালী

 

মূল অসমীয়া থেকে বাংলা অনুবাদঃবাসুদেব দাস 
আসতে চেয়েছ যদি এসো
পরিষ্কার করে রাখব জীর্ণ পদুলি 
উদযাপন করব তোর বিষাদ ঐশ্বর্য 

তুই যে শীতল,যাকে নিয়ে তোর দম্ভ 
যার অস্তিত্ব অনাড়ম্বর হয়েও শাশ্বত 
বাতাসে বাতাসে যা ছড়িয়ে থাকে
গোধূলি গোপালের বেগুনি নিদ্রায় নিদ্রায় 
হাজারটা স্বপ্নের মধ্যেও যা উঁকি দেয়না 

রোদ-বৃষ্টি স্পর্শ করতে পারেনা যার ভাবনা
সেখানে তুই পাপড়ি মেলে ফুটে উঠ বন-বাহারের মতো
মূর্ছার সেই অলৌকিক ক্ষণে
নিমেষের মধ্যে উড়িয়ে দাও যখন আজন্ম যাতনা 
মানুষগুলো মনেমনে গুণগুণ করে 
বধ্যভূমির একটা গান
আর বিলীন হয় এক একটি শোকযাত্রায়৷

টীকাঃ পদুলি- মানুষের বাড়িতে প্রবেশ করার সামনের পথটুকু। 
গোধূলি গোপাল-সন্ধ্যামালতী ফুল 
      


হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডা বাতাস
- বিজয় রবিদাস
 
হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডা বাতাসে
কুণ্ডলি পাকিয়ে উড়ে গিয়েছিল দীর্ঘশ্বাসগুলি
নদীর তীরে গ্রামটি নিস্তব্ধতা মেখে শুয়েছিল

কুয়াশার চাদরের নিচে দিয়ে 
বয়ে যাচ্ছিল উষ্ণ এক শিহরণ

বয়ে চলা নদীর ওপর দিয়ে আমাদের অতীত 
মুমূর্ষু জীবন গাথার হাজার পৃষ্ঠাজোড়া 
বিষণ্ণতার মহাকাব্য 
 

ভিক্ষার পাত্রে তুমি নেচে উঠ
- বিজয় রবিদাস

মন্দিরের সিঁড়িতে চিৎকারগুলি 
বাতাসে দুলতে থাকে
 
সোমবারের দিনটির জন্য কি 
ওরা অপেক্ষারত প্রেমিক তোমার

হাতে নৈবেদ্য ধূপ দীপ উপচার 
ঘন্টধ্বনিতে জেগে উঠ তুমি
ব্রহ্মপুত্রের ঢেউয়ে ঢেউয়ে ধ্বনি প্রতিধ্বনি 

মন্দিরের সিঁড়িতে বিষণ্ণ চিৎকার
অন্য এক পৃথিবীর সভ্যতা 
ভিক্ষার পাত্রে তুমি নাচতে থাক

তোমাকে ওরা লালন করছে 
ওদের জন্যই তুমি বাঁশি বাজাতে থাক
স্নান কর

শঙ্খ ধ্বনির ঢেউয়ে ঢেউয়ে 
জেগে উঠে এই রোগাক্রান্ত শহর। 
 

বিচ্ছেদের প্রাক মুহূর্তে
- নীলিমা ঠাকুরীয়া হক


আমি যদি নৈঋতে,তুমি ঈশাণকোণে
একই বিছানায় ঘুমোই
অথচ হাজার আলোক বর্ষের দূরত্বে৷

কয়েকটি শীত যেন একসঙ্গে জমাট বাঁধে 

বরফে হারিয়ে যায় বিছানার উষ্ণতা 
হৃদয় ভাঙ্গার শব্দে স্তব্ধ সময়৷
আত্মার পতন না আত্মহনন 
বিচ্ছেদের প্রাক মুহূর্তে 
জটিল সমস্ত কথোপকথন
আমি যদি নৈঋতে,তুমি ঈশাণকোণে
তবুওতো কামনা করি 
স্পর্শ কর আমাকে স্পর্শের উর্দ্ধে
বিষাদ মাতাল এক টুকরো কলজের আর্তনাদে
কেঁপে ওঠেনা কেন অন্য একটি কলজের লৌহপ্রাসাদ 
কেবল একবার যদি পেতাম 
সেই অমল স্পর্শ
স্পর্শের বাইরের সেই স্পর্শ
মোমের মতো গলার জন্য,বাতাসের মতো ভেসে বেড়ানোর জন্য... 
স্বপ্নের উৎস ধরে হারিয়ে যেতাম
বিশাল পৃথিবীর কোনো কোণে,বিমল সুখে৷
একবারও পড়েনা কি মনে 
রোপণ করেছিলে প্রেম এবং বিশ্বাসের বীজ,সতেজ অঙ্কুর।
কোথায় যেন ভুল হল 
তুমি রোদ দিলেনা,আমিও পরিচর্যা করলাম না 
সম্পর্কের সমাধি সাজিয়ে বসে আছি দুজন 
যেন আকস্মিক গর্ভস্রাবে পরিশ্রান্ত নারী 
তারচেয়েও পরিশ্রান্ত বিচ্ছেদিত গর্ভপিণ্ড 
রক্তের কুণ্ডে ভাসে প্রেমের সমাপ্তি। 


 

মৃত্যু
 - নীলিমা ঠাকুরীয়া হক
  
কীভাবে তোমার সঙ্গ ছাড়ি 
জননীর জরায়ুতে লগ্ন আমাদের৷

তোমার ছায়ার চেয়েও বিশ্বস্ত 
অন্ধকারেও বসে থাকি তোমার মুখোমুখি৷

আর কতদিন কথা না থাকবে 
প্রতিদিন বাড়ে আমার প্রেম৷

আমি নিশ্চিতভাবে জানি 
আমার জন্যই একদিন 
সব ছেড়ে আসবে 
আমার একটি চুম্বনের জন্য৷

হয়তোবা পেছনের দুয়ারের জানালা খুলে রাখবে 
কোনো এক অভিসারের রাতে 
আমি পেছনের দুয়ার দিয়ে প্রবেশ করব
বেরোব কিন্তু সামনের দরজা দিয়ে
আলগোছে তোমাকে জড়িয়ে ধরে৷ 


 

মকৰাৰ কাহিনী
- নীলকান্ত শইকীয়া


শিল্পী আৰু অন্ধ স্তাৱকৰ অতপালিত
ভয় খাই বিহুৱে মঞ্চ এৰি
পোনে পোনে গাঁও পালেহি
গাৱেঁ আথে বেথে আদৰি
কি খুৱাম কি বুৱাম লগালে
ক'লে, এতিয়া আৰু ভয় নাই
ইয়াত তুমি নিৰাপদ।
তথাপি বিহুৰ মন মৰা
গাৱেঁ কথাটো মন কৰি সুধিলে
কাৰণটোবা কি
বিহুৱে কলে, এই গায়ক গায়িকাহঁতে
মোকেই খুন্দি পিহি খাই আছিল
গাড়ী ঘৰ ফ্লেট, বিধে বিধে পোছাক
আৰু পুহিছিল পৰিয়াল
এতিয়া হিন্দী গানৰ জেদত লাগি
মোকেই যদি হেৰুৱাই 
ইহঁতৰ কি দশা হব।
আকৌ খাচ হিন্দীকে শুনাওঁ বুলি আয়োজকে মুম্বাইৰ কলকতাৰ 
শিল্পী অনালে 
ইহঁতৰ চকুপানী কোনে মচিব।
হেজাৰ হওক - মই মকৰাৰ মাক
ইহঁত মোৰ সন্তান
এৰোঁ কেনেকৈ ।
ৰাতিটো থাকি পুৱাতেই বিহু 
পুনৰ গুৱাহাটীৰ বাছত উঠিল।
             
 
 

সংযোজন - জানুয়ারী ২০১৮

সুখী মানুষ
-    কমল কুমার মেধি

আজকাল খুব সহজে দেখতে পাই
সুখী মানুহ

পথে-ঘাটে হাটে-বাজারে 
দেখি সুখের হাসি
এতগুলি হাসি

আর আমি অসুবিধায় পড়ি
প্রতিটি সুখী হতের করমর্দনে
আমি হয়ে পড়ি অস্থির
কোনও সুখী দুচোখের সঙ্গে আমি
বিনিময় করতে পারি না সংলাপ

সুখী মানুষদের সঙ্গে দেখা হলে
আমার অসুখ বেড়ে যায়
রাতের পর রার আমার ঘুম আসে না
মনে পড়ে প্রিয় বন্ধুদের কথা
যারা দুঃখের কবিতা লেখে 

এত বেপরোয়া সুখী মানুষগুলি যখন
হাঁটু গেড়ে প্রণাম করে শনিবারের ফুটপাথে
আমি বড় অসহায় হয়ে পড়ি

সুখী মানুষদের চেয়ে সুখী হয়তো 
তাঁদের ঈশ্বর
সেই ঈশ্বরকে দেখার জন্য’আমি ব্যাকুল হয়ে পড়ি
খুঁজে খুঁজেও যখন খুঁজে না পাই 
পলায়মান ঈশ্বর
সুখী মানুষগুলির প্রতি আমার করুণা জন্মায়
করুণা জন্মায় সেই ঈশ্বরের প্রতি
যিনি মানুষের মধ্যে থাকতে পারেন না

সুখী মানুষদের সঙ্গে দেখা হলে তাই
আমার অসুখ বাড়ে। 

রাজপথে চিৎ হয়ে পড়ে আছে একজন মানুষ
বুকে আটকে রয়েছে ঘাতক বন্দুকের বিষ-ধাতু
যদিও দেহ নির্বাক-নিথর স্ব-রক্তে স্নাত
আকাশচুম্বি দৃষ্টি দুহাতে প্রতিবাদী ভঙ্গি
মুখাবয়বেই যার পরিচয় – একজন খেটে খাওয়া মানুষ
এই মাটির সন্তান
তাঁর মৃত্যুর খবর নেওয়া উচিত ছিল
সবারই চোখ-কান বন্ধ। 

ক্যামেরার সামনে আজকাল হরতাল-ধর্মঘট চলে
আলোচনা-বিলোচনা, কাঁদানো গ্যাস, গুলি চালনা
গ্রেপ্তার আর জেল-হাজতে প্রেরণ
মৃত্যুও যেখানে একটা অতি সামান্য ঘটনা। 

মাকে নিয়ে যে নিত্য চিন্তিত গর্বিত
তাঁর কথা প্রত্যক্ষদর্শী পাখিরা না পেতে পারে না
এটা যেন তার কর্মেরই অভিন্ন অংশ
যার মধ্য দিয়ে জীবন উদযাপন, রীতি-নীতি, পূজা-পার্বণ
নিজে হয়ে ভাবনার সূত্রধর। 
পাখিরা কথা বলে, 
সারা শরীরে আলো ছিটিয়ে
পায়রার পৃথিবী কিভাবে
সাগরের মাঝখানে স্থাপিত
বুদ্ধের মূর্তির দিকে তাকিয়ে থাকে

কথা বলে –
মাঝখানে কেমন ব্যবধানের জলজ। 
যেখানে পশুপাখির মৃত্যুতেও  মানুষ
মুক্তভাবে চোখের জল ফেলে
স্বয়ং মানুষের জন্যে কেন এত কৃপণ
এপারে যদি জয় জয়কার
ওপারে কেন হাহাকারময় জগত। 
সূর্য অস্ত যায় রাজপথে
নিহ গৃহে ফিরে যায়
পাখিগুলি আঁধারে আঁধারে যেন 
দ্বিতীয়বার নিরীক্ষণ করে –
পাখিরা উড়ে যাবার ঠিক আগে
চিৎ হয়ে  পড়েছিল যেজন
সেই মানুষটি যেন তখন সেখানে ছিল না
ছিল কেবল তিনি ফেলে যাওয়া
দুটো ঊর্ধ্বমুখী চোখ, দুটো প্রতিবাদী হাত
যার চারপাশে তৃষ্ণার্ত হয়ে ঘুরে বেরচ্ছিল
অগণন নীরব প্রশ্নধারী। 

হে জন গণ মন, হে উচ্ছল জলধি তরং’কোথায় সেই গ্রহণের বাসরঘর, কোথায় নিস্তার
কোন দিকে উড়ে মাটির পতাকা? 



ছবির আড়ালে থাকে অনেক ছবি  
- খনীন্দ্র কুমার ডেকা

 

কেবল ছবি দেখে বলা যায় না সমস্ত কথা
যেভাবে মুখ দেখে ধরা যায় না মানুষের আসল মুখ
যেভাবে আকাশে দেখে বোঝা যায় না আবহাওয়ার পূর্বাভাস
যেভাবে শরতের নদী দেখে ধরা যায় না বর্ষার গর্জনের কথা

শৈশবে পড়েছিলাম – ছবি সত্যি কথা বলে
তবে সত্যের আড়ালে ও তো থাকে অন্য অনেক সত্য
যেভাবে মুখের আড়ালে থাকে অন্য বহু মুখ
মুখোশ খোলার পরেও থেকে যায় অন্য বহু মুখোশ
একজন নারীর মধ্যে লুকিয়ে থাকে অন্য বহু নারী

ছবির ভেতরেও লুকিয়ে থাকে অন্য বহু ছবি
কাহিনীর ভেতরেও যেভাবে থাকে অনেক কাহিনী
খবরের আড়ালে যেভাবে থাকে অপ্রকাশ্য অনেক খবর
প্রাপ্তির পরেও থেকে যায় শেষহীন অপ্রাপ্তি
পথের শেষেও যেভাবে থাকে পথের শুরু
এক একটি গানের ওপারে যেভাবে থাকে
    গাওয়া না গাওয়া অনেক গাল
কেবল ছবি দেখে ধরা যায় না সমস্ত কথা

ছবির আড়ালেও থাকে অন্য বহু ছবি
মুখের আড়ালে থাকে বহু মুখ
সত্যের আড়ালে থাকে অনেক গোপন সত্যএকটি মিথ্যার আড়ালে যেমন থাকে
    অন্য বহু মিথ্যার মিছিল। 

প্রেমকাব্য

- অজিত গগৈ

 

সমস্ত ভালোবাসাই অসম্পূর্ণ
মানুষ সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে নিজেকে
সেইজন্যই অতি সহজে অন্যের প্রেমে পড়ে
আর ভালোবাসার তুলাদন্ডে জুখে দেখতে চায় নিজেকে 

এটাই মানুষের ভুল
একটা ভুল পথে চলে কিছু মানুষ নিজেকে বিনাশ করে
অবশ্য দুই একজন সিদ্ধার্থের মতো নিজের থেকে বেরিয়ে গিয়ে পুনর্নির্মিত হয় 

আমি প্রেম সর্বজ্ঞ নই যদিও
প্রেম কৃষ্ণের নাম লেখা সেই তুলসী পাতার মতো – “বিশ্বাসে মেলায়...“
নাহলে কৃষ্ণগহ্বরের মতো
পরিপূর্ণ শূন্য 

নাহলে প্রেম একটি রূপকথার মতো
‘আমাদের কাপড়-চোপড় ময়লা হল বলে যাকে
নতুন করে আরম্ভ করতে পারি

প্রেমাস্পদের বাইরে কিছু মানুষ নিজেকে মারে যদিও বেশিরভাগই মরে না
কারোকে ভোলার জন্যে দুটো উজাগরী রাত যথেষ্ট
কিছু হা-হুতাশ, অন্তর্দ্বন্দ্ব
হয়তো চোখের জল, হয়তো সুরার সাহচর্য
হয়তো সিগারেটের ধোঁয়ায় কুন্ডলিতে উড়িয়ে পাঠানো কিছু অভিমান।

মানুষ সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে নিজেকে
সেইজন্য নিজেকে ভোলার তুলাদন্ডে নিজের জীবনটা যথেষ্ট নয়। 


 

নারী
- বর্ণালী বরগোহাঁই

জলের কোনও রঙ থাকে না নারীর মতো
না কি নারীর কোনো রঙ থাকে না জলের মতো

আমি নারী
আমার নিজস্ব রঙ আছে
নিজের স্বপ্ন আছে
ইচ্ছা-অনিচ্ছার স্বপ্ন উড়ানোর জন্যে
একটা আকাশ আছে
সমস্ত সম্ভাবনার ফসলে তা সমৃদ্ধ

আমি নারী
তিন কালের জন্মদাত্রী
আমি ফল্গু হয়ে খসে পড়ি
ধোঁয়া হয়ে উড়ি
কীভাবে তুমি আমার নাম দিলে
বিছানার নারী

আমি নারী
কোনো তুলাদন্ডের তুলনায় আমাকে হেয় কর না

আমারও নিজস্ব রঙ আছে
তুলিকায় বোলানোর জন্য একটি আকাশ

নরকাসুর
- নীলিম কুমার

 

যেখানে যায় নরকাসুর
হৃদয়ে নিয়ে যায়
কামাখ্যা

প্রেমিক 
নরকাসুর

তাঁর চেতনার
ডানপাশে কামাখ্যা
বামপাশে কামাখ্যা
প্রার্থনার নারী
কামাখ্যা

স্বপ্নেও সেই রক্তকেশী নারী নৃত্যরতা

বাস্তবেও

নরকাসুরের জ্বলজ্বল চোখের সামনে
বিদ্যুৎলতা চুল্লিতে ঘিরে
নৃত্যরততা কামাখ্যা 

অন্য কোনো জায়গা ছিল না নরকাসুরের
যেখানে কামাখ্যা ছিল না
অন্য কোনো হৃদয় ছিল না নরকাসুরের
কামাখ্যাহীন

ভুল কোথায় ছিল নরকাসুরের
ভুল কোথায় ছিল নরকাসুরের

নরকাসুর একদিন
পাশে চেয়েছিল কামাখ্যাকে
প্রেমিক যেভাবে চায়
প্রেয়সীকে

প্রেমিক ছিল 
নরকাসুর
ছলনা ছিল
বেচারা নরকাসুর
সারা রাত পাথরের সিঁড়ি
নিজের বুকে তৈরি করেছিল

সেই সিঁড়ির নাম
প্রেম
আর ভোর না হতেই ডেকে উঠা
সেই মুরগিটা
যার কন্ঠে কামাখ্যা ছিল
তার নাম প্রতারণা

ভুল ছিল না নরকাসুরের ভুল ছিল না

এত ছলনার শেষে
নরকাসুর কোথায় রাখবে এখন
তাঁর আত্মা
কোথায় রাখবে এখন
তাঁর দিন এবং রাতগুলি

তাই সে নিজেকে
ভেঙে ফেলেছিল

নরকাসুর ভেঙে ফেলেছিল
প্রেমিক নরকাসুরকে

আর হয়ে উঠেছিল
অন্য এক নরকাসুরকে 

খিলখিল করে হাসতে হাসতে 
ছলনাময়ী কামাখ্যা লুকিয়ে ছিলেন
রাঙ্গা জবার মালাগুলির আড়ালে 
টকটকে লাল সিঁদূর আর
বলিদানের রক্তের আড়ালে

সেই কামাখ্যাকে দেখার জন্য
মানুষ যখন
নরকাসুরের বুকের সিঁড়ি দিয়ে উড়ে যায়
তিলমাত্র বিচলিত হয় না কামাখ্যা
কিন্তু বল ধর্মপ্রাণ নগরবাসী
কিছুটা বিচলিত হওয়াটা
উচিত ছিল না কামাখ্যার? 

bottom of page