
প্রবন্ধ ও আলোচনা



ভারতে দেবী
আরাধনার ইতিবৃত্ত
সুবিমল চক্রবর্তী
ডালাস, টেক্সাস
প্রাচীন কালের সিন্ধুনদের উপত্যকায় যে সভ্যতা গড়ে উঠেছিল সেই সভ্যতায় দেবীর আরাধনা প্রচলিত ছিল। সাড়ে চার থেকে সাড়ে তিন হাজার বছর আগে যাযাবর আর্যরা ভারত আক্রমণ করে এবং ভূমিপুত্রদের বশীভূত করে। সিন্ধুসভ্যতার দেবী আরাধনা নতুন বসতিস্থাপনকারী আর্যরা মাধ্যমে প্রচুর বিস্তার লাভ করে। শুধু তাই নয়, আরাধনার আচার অনুষ্ঠান সমূহ অনেক জটিল হয়ে ওঠে। আর্যরা অর্থনৈতিক ভিত্তি ছিল প্রধানত গবাদিপশু পালন। সম্ভবত কৃষি পদ্ধতি সম্পর্কে তাদের কোন জ্ঞানই ছিল না। কিন্তু তারা ছিল শক্তিশালী যোদ্ধা, তাই স্থানীয়দের পরাভুত করতে পেরেছিল সহজেই।
যাযাবর বৃত্তির চেয়ে একজায়গায় স্থায়ীভাবে বসবাস করে কৃষি কাজে মনোনিবেশ করলে যে নিরাপত্তা পাওয়া যায় এই সত্যটি তারা ক্রমশই উপলব্ধি করতে থাকে। তাই তারা কৃষিকাজে পারদর্শী হয়ে উঠতে থাকে। গঙ্গা ও যমুনা নদী বিধৌত ভারতের উর্বর ভূমি সহজেই যে পর্যাপ্ত ফসল ফলায় তা দেখে তারা অভিভূত হয়ে পড়ে। যাযাবরদের জন্য এটা ছিল একটা নূতন অভিজ্ঞতা। এই প্রথমবারের মত তাদের খাদ্য সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন ভাবে চলতে থাকে। অতএব, ‘পৃথিবী’—যা তাদের জীবনের নিশ্চয়তা বিধান করে তাদের কাছে হয়ে ওঠে প্রশংসিতা এবং পরিগণিত হয় দেবী হিসেবে। ‘পৃথিবী’ হ’ল উর্বরা নারীদাত্রী। তাদের কাছে এই দেবী ছিল মায়ের মত যে মা তাদেরকে এবং তাদের গবাদিপশুসমুহকে পালন করে এবং যার কৃষিভূমি তাদের নানাবিধ সাধ-আহ্লাদ এবং যাবতীয় আমোদ-প্রমোদকে নিশ্চিত করে তোলে। শস্য পাকার সময় কৃষিজমিতে তারা আবিষ্কার করল সোনালী স্তনযুক্তা এক নারীকে যে নারী থেকে উৎসারিত হচ্ছে সমস্ত আশীর্বাদ এবং সুখ।
অথর্ব বেদই হচ্ছে প্রথম বই যার মধ্যে রয়েছে ভূমি হিসেবে দেবী পৃথিবীর বিস্তারিত বর্ণনা। অপূর্ব সুন্দর একটা মন্ত্রের মাধ্যমে এই বেদে এই ভাবে এটি প্রকাশিত হয়েছে, 'অতীত ও বর্তমান কালের সমস্ত রাজাদের পত্নী এই দেবী আমাদের আয়ত্তের মধ্যে এনে দিন ভূমি। তিনি ধারণ করেন সবকিছু, লুক্কায়িত সমস্ত ধনরত্নের তিনিই আধার, সুঠাম স্তনযুক্তা এই দেবী যা কিছু জঙ্গম তার সব কিছুরই রক্ষাকর্ত্রী। মধুর জন্য এই দেবীকে আমরা দোহন করব, তিনি আমাদের উপর বর্ষণ করুন অপার মহিমা। এই ভূমি-যিনি আমার মা আমাকে দুগ্ধ দান করুন, দুগ্ধ দান করুন তাঁর সন্তানকে। তাঁর পাহাড় সমূহ, বরফাচ্ছাদিত পর্বতমালা, এবং তাঁর অরণ্যানী আমার জন্য আনন্দস্বরূপ হয়ে থাক। পীতাভ, কৃষ্ণকায়, বিচিত্র কারুকাজময়, লোহিত-সমস্ত বর্ণের অধিকারিণী এই কৃষিভূমিতে, এই ধরিত্রীতে যা কিনা ইন্দ্র কর্তৃক সুরক্ষিত আমি যেন নিরুপদ্রব, নিরুদ্বেগ এবং অক্ষত জীবন যাপন করতে পারি। তিনি যা সৃষ্টি করেছেন তার মধ্যে মরণশীল প্রাণীরা বিচরণ করে। তিনি ধারণ করেন দ্বিপদ ও চতুষ্পদ জীবসমুহকে তোমার ভেতর থেকে উৎসারিত হয় যে সুরভি, হে দেবী পৃথিবী, সেই সুরভি উদ্ভিদ ও জল তাদের নিজেদের মধ্যে ধারণ করে।'
ধরিত্রীর এই প্রাচুর্য আর্যদের সমৃদ্ধিশালী করে ঠিকই, কিন্তু একই সঙ্গে তাদের মধ্যে একটা ভয় বেড়ে যায় যে, অন্যান্য শত্রুভাবাপন্ন যাযাবরগোষ্ঠী অথবা দেশীয় বাসিন্দারা বা ভূমিপুত্ররা জোরপূর্বক তাদের কাছ থেকে ভূমি কেড়ে নেওয়ার জন্য তাদেরকে আক্রমণ করতে পারে। তাদের ভুমি এবং শস্যভাণ্ডার লুটতরাজ এবং অন্যান্য উপদ্রবের কারণে বিনষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা সর্বদাই থেকে যায়। অপার উৎকর্ষ, ধনসম্পদ ও সমৃদ্ধির দেবী লক্ষ্মী যেন দেবী পৃথিবীর স্থান গ্রহণ করার গৌরব নিতে চাইলেন। কিন্তু এই ক্ষেত্রে আযরা একটা উভয়সঙ্কটের সম্মুখীন হল।
আর্যরা যে সময়টাতে উত্তর ভারত দখল করে নিয়েছিল, সেই সময় এই এলাকায় যারা বসবাস করত তাদের অর্থনৈতিক জীবন নির্ভরশীল ছিল কৃষিকাজের উপর। তারা উপাসনা করত তাদের শস্য দেবীকে। এই দেবীর প্রারম্ভিক নাম ছিল লক্ষ্মী, কারণ এই দেবী যুক্ত ছিলেন কর্দম ও জলকণার সঙ্গে এবং তিনি ছিলেন আর্য পূর্বকালীন সময়ের কৃষিকর্মও বৈষয়িক সমৃদ্ধির প্রতীক। পররতীকালে উত্তর ভারত দখলের পর আর্যরা যখন চাষবাসের পদ্ধতি আয়ত্ত করল এবং নিজেরাই যখন তাদের নিজেদের জন্য ফসল উৎপাদন করতে শিখল, তখন বিজিতদের মত তারাও সবকিছু উৎসর্গ করল লক্ষ্মীকে। কিন্তু তাদের সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠিত হতে পারত শুধুমাত্র আর্যরা পূর্বকালীন চাষবাসের দেবীকে অর্থাৎ লক্ষ্মীকে চূর্ণবিচূর্ণ করে, পরাস্ত করে এবং বিতাড়িত করে।
ফলত আর্যরা পূর্বকালীন সময়ের লক্ষ্মীর নাম দেওয়া হল অলক্ষ্মী এবং এই দেবীকে এখন দেখা হল একটা অপশক্তি হিসেবে। অত্যন্ত অমার্জিতভাবে এই অলক্ষ্মীকে তৈরি করা হল কাদা, জল এবং গোময় দিয়ে। আর্য পূর্ব কালীন দেবী
করিষিনীর কথা স্মরণে রেখে এই অবয়ব গড়ে তোলা হল। এখানে উল্লেখ্য যে, করীষ শব্দের অর্থ গোময় অর্থাৎ গোবর। এই দেবীর হাতে শস্য ঝাড়ার কুলা যা দিয়ে সে শস্য ঝাড়ছে। যতদিন না পর্যন্ত আর্য পূর্ব কালীন সৌভাগ্যের অবসান ঘটল, আর্যদের সাফল্য এবং কৃষি ক্ষেত্রে সৌভাগ্য যেন প্রতিষ্ঠিত হতে পারছিল না। মজার ব্যাপার হচ্ছে ঋগ্বেদের লক্ষ্মীর অপর দুটো নাম হচ্ছে জয়া বা জ্যেষ্ঠা যার আভিধানিক অর্থ হচ্ছে সবার চাইতে বড়। এর একটা অর্থ দাঁড়ায় যে, এই দেবী হচ্ছে আর্য পূর্ব কালীন সময়ের দেবী যার স্থান দখল করেছিল পরবর্তী সময়ে আর্যদের সৌভাগ্যের দেবী।
আর্যদের আচার অনুষ্ঠানে জল সব সময়ই একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। উত্তর ভারতে গঙ্গা ছিল সবচেয়ে দীর্ঘ মনোরম নদী। বৈদিক যুগের শেষের দিকে যখন সিন্ধু সভ্যতা গঙ্গার দুই তীরে উন্নতির চরম শিখরে আরোহণ করেছিল, তখন থেকেই গঙ্গা দেবী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। স্বর্গ, সমুদ্র, হিমালয়, ঋষি জাহ্নু, ব্রহ্মা, শিব ও বিষ্ণু, এবং অন্যান্য দেবীদের সঙ্গে এই দেবীর পৌরাণিক যোগাযোগ তার পবিত্রতার ভাব মূর্তিকে বাড়িয়ে দিয়েছে। এমনকি অদ্যাবধি এই দেবী উপাসিত হয়ে থাকে পার্থিব বা বৈষয়িক সৌভাগ্যের জন্য। শুধু তাই নয়, চূড়ান্ত বা অন্তিম মুক্তির জন্যও এই দেবী আরাধ্যা। প্রয়াগে গঙ্গা নদী মিলিত হয় যমুনা নদীর সঙ্গে। এই সঙ্গম স্থল পুণ্যার্থীদের জন্য একটা পবিত্র স্থান। গঙ্গা এবং যমুনা উভয়ই হিন্দু দেব-দেবীদের মধ্যে দুজন প্রধান দেবী হিসেবে স্বীকৃত। আর্য উপনিবেশকারীদের সভ্যতা আরও কয়েকটি নদীর, যেমন সরস্বতী ও দৃশদবতী এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য - উপর নির্ভরশীল ছিল।
আর্যরা ধন সম্পদের অগাধ ভাণ্ডার গড়ে তুলতে পেরেছিল। তার ফলে তাদের জীবনে এসেছিল অবসর। আর এই অবসরকে তারা ব্যবহার করেছিল যাবতীয় সৃষ্টিশীল কাজকর্মে। তারা সমর্থ হয়েছিল বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানের পরিধি বাড়িয়ে তুলতে। শিল্পকলায় তারা প্রভূত উন্নয়ন সাধন করতে সমর্থ হয়েছিল। বিদ্যাদায়িনী সরস্বতী প্রতিষ্ঠিতা হল দেবী হিসেবে। এমনকি আর্যদের আগমনের পূর্বে ঋগ্বেদের যুগে বিশ্বাস করা হত যে, সরস্বতী নদীর রোগ নিরাময়ের ক্ষমতা ছিল, এবং তাকে চিহ্নিত করা হয়েছিল বেদের প্রাথমিক নিরাময়ের দেবতা অশ্বিনদের অন্যতমা হিসেবে। প্রাথমিক যুগের আর্য উপনিবেশের সময় সরস্বতী নদী আর্যদের উপনিবেশের পূর্ব সীমানা ছিল। মনুসংহিতায় উল্লেখ আছে, আর্যদের প্রাচীন বাসভূমি ব্রহ্মাবর্ত সরস্বতী ও দৃশদবতী নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত ছিল। দৃশদবতী নদী পরবতী কালে বালুর কারণে প্রবাহ হারিয়ে ফেলে এবং লুপ্ত হয়ে হয়ে যায়। প্রাথমিক পর্যায়ে সরস্বতী নদী আর্যদের উপনিবেশ সম্প্রসারণে এবং সভ্যতা সংস্কৃতির উৎকর্ষ সাধনে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল। আর্যরা সম্পূর্ণভাবে নিরক্ষর, গবাদিপশু পালক ও যাযাবর ছিল। তারা যেহেতু লিখতে বা পড়তে জানত না, মুখের ভাষা অর্থাৎ ‘বাক’ তাদের কাছে ছিল অত্যন্ত মূল্যবান। তাই তাদের সংস্কৃতির যা মূলত ছিল বলি
প্রদানের ধর্ম মুল ভিত্তি ছিল ‘বাক’, মুখে উচ্চারিত মন্ত্র। একই সঙ্গে তাদের গবাদিপশু সরস্বতী নদীর উভয় কুলে খুঁজে পেল বিস্তর চারণভূমি। আর্যরা ধীরে ধীরে যখন স্থায়ীভাবে বসতি গড়তে শুরু করল, তারা সৃষ্টি করল জটিল এবং বিশদ বলি প্রদানের আচার-অনুষ্ঠান। তাদের বিদ্যা সাধনার এক বিরাট অংশ বিধৃত হল এই উৎসর্গ বা বলির মন্ত্র সমূহে। ফলত, সরস্বতী হয়ে উঠল জ্ঞান বা বিদ্যার দেবী। ‘বাক’ বা মুখনিঃসৃত বাণী এবং উৎসর্গ বা বলির জন্য নির্বাচিত মন্ত্রাবলী সরস্বতী বা বাগদেবীর ধারণার উৎস হয়ে থাকল। এক পুরাণে উল্লেখিত আছে, অনার্য বা অসুরদের সঙ্গে আর্যদের এক আপস রফার সময় ‘বাক’ দেবী অনার্যদের সঙ্গে প্রতারণা করে তাদের পক্ষে না গিয়ে আর্যদের পক্ষ অবলম্বন করে। বস্তুত, এই পৌরাণিক কাহিনী ভারতের ভূমিপুত্রদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতির উপর আর্যদের ভাষা ও সংস্কৃতির প্রভুত্ব স্থাপনের ইতিহাস। বিশ্ব নিয়ন্ত্রক শক্তি হিসেবে ‘বাক’ দেবী কয়েকটি বৈদিক পুরাণে ও উল্লেখিত আছে।
ইতিমধ্যেই আর্যরা জ্ঞান ও সম্পদের জন্য পরিচিত হয়ে উঠল। ফলত তাদের সুপরিকল্পিত সম্প্রদায় সমূহের উপর বাইরের শত্রু কর্তৃক আক্রমণের ভয় বৃদ্ধি পেল। তবে যোদ্ধারা সদা প্রস্তুত ছিল। কিন্তু তাদের নিজেদেরকে এবং তাদের সহায় সম্পত্তি রক্ষা করা ক্রমশই কঠিন হয়ে উঠতে থাকল। তখন তাদের প্রয়োজন হয়ে পড়ল শক্তি, সাহস এবং বীরসুলভ সহিষ্ণুতার যার দ্বারা তারা আক্রমণকারীদের হঠিয়ে দিতে পারবে । মজার ব্যাপার হল, এই সময় কালে যত পুরাণের জন্ম হয়েছে সেগুলোর প্রায় সবগুলোতেই অনার্যদের চিত্রিত করা হয়েছে অসুর হিসেবে। দেখানো হয়েছে, তারা ছিল অসভ্য, অপশক্তি, কামুক, এবং কালো জাদুবিদ্যার অধিকারী। এই অপশক্তির মোকাবিলার স্বার্থে আরযরা ‘শক্তি’ এবং ‘মাতৃকা’ অর্থাৎ মাতৃদেবতা উপাসনার পুজাপদ্ধতি বা ধর্মবিশ্বাসের সূত্রপাত করল। এই দেবীরা হল পুরুষ দেবতাদের মধ্য থেকে উদ্ভুত নারী দেবী অথচ পুরুষ দেবতাদের তুলনায় অনেক বেশী শক্তিশালী। দেব-দেবীর যে পদ্ধতি গড়ে উঠল তার মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান হল দুর্গা, চণ্ডিকা, চামুণ্ডা এবং কালীর। এই দেবীদের চিত্রিত করা হল বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিতা শক্তিশালী ও সশ্রদ্ধ ভয় বা বিস্ময় উদ্রেককারী ভয়াল দর্শনা রণরঙ্গিণী দেবী হিসেবে। কালী, চামুণ্ডা, ধুনাবতী এবং ছিন্নমস্তা দেবীরা এদের অন্তর্ভুক্ত। এই দেবীসমুহের কল্পনা এমনভাবে করা হয়েছিল যাতে তারা আরযদের শত্রুদের উপর ভীষণ ত্রাসের সঞ্চার করতে সমর্থ হয়। এই দেবীসমূহের অর্চনা জটিল আচার অনুষ্ঠানের এবং পশুবলি বা উৎসর্গের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হত। প্রায়ই এই আচার অনুষ্ঠান ও বলি চলত কয়েকদিন ধরে।সেই সময় মাতৃকা ছাড়াও দশ মহাবিদ্যার তান্ত্রিক গ্রুপ প্রচলিত ছিল। দশমহাবিদ্যার প্রথম ছিল কালী, অন্য নয় দেবীর নাম তারা, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, ছিন্নমস্তা, ভৈরবী, ধুনাবতী, বগলা, মাতঙ্গী এবং কমলা।
বিপদনাশিনী বা উদ্ধারকরত্রী ‘তারা’ পরবর্তী কালে বৌদ্ধ তান্ত্রিকেরা উপাস্যা হিসেবে গ্রহণ করে। ষোড়শী ছিল ষোড়শ বর্ষীয়া সুন্দরী তরুণী দেবী। ভুবনেশ্বরী তারই এক রূপ যে হল সমগ্র বিশ্বের অধিপতি। যখন সে ছিন্নমস্তা, তখন সে ধারণ করেছে এক ভয়ঙ্কর মূর্তি। এই অবস্থায় সে নিজের বাম হস্তে ধারণ করে নিজেরই মস্তক এবং পান করতে থাকে ছিন্ন মস্তক থেকে উৎসারিত রক্ত।
ভৈরবী রূপেও সে ধারণ করে ভয়াল দর্শনারূপ। ক্রুদ্ধ এবং সংহারকারী শিবের সে স্ত্রী রূপ। ধূমাবতী সম্ভবত একমাত্র দেবী রূপ যার পরিধানে আছে বৈধব্যের বেশ। এই দেবী চিত্রিত হয়েছে কৃশকায়া বৃদ্ধা রমণী হিসেবে যার সৌন্দর্য ও মহিমাসবই নিঃশেষিত। মলিন ও ছেঁড়া বসন পরিহিতা এবং অবিন্যস্ত কেশযুক্তা এই দেবী হাতে ধারণ করে শস্য ঝাড়ার ঝুড়ি। এই দেবীর ছিল দীর্ঘ নাসিকা এবং তার চোখ থেকে যেন ঝরে পড়ছে নিষ্ঠুরতা। এই দেবীকে মনে হবে তার রয়েছে অনন্ত ক্ষুধা এবং তৃষ্ণা। তাকে দেখে মনে হবে সে ধূর্ত, কলহপ্রিয় এবং প্রবঞ্চক। সে ধারণ করে আছে সমস্ত বদ গুণ যা কোনবিধবার জন্য শোভাপায় না। সে যেন সেই বিধবা যার আনন্দের জগতে সহসাই যবনিকাপাত হয়েছে যার ফলে তার মধ্যে হাহাকার করছে অপূর্ণকামনা বাসনা সমূহ। যাই হোক, এই ধূমাবতী রূপ পরোক্ষ ভাবে এবং একক ভাবে সাক্ষ্য দেয় যে বিধবাকে তুষ্ট করার জন্য তাকে পূজা করা হত।
কৌমারী রূপে এই দেবী কুমারী পূজার উপর গুরুত্ব আরোপ করে, এবং দেবী সরস্বতী রূপে সে চিত্রিত হয় নিঃসন্তান স্ত্রীরূপে, এবং অপর সমস্ত রূপে সে মাতা রূপিণী দেবী যার স্বামী ও সন্তানরা জীবিত।
বগলা দেবী রূপে বগলামুখী হিসেবেও পরিচিত (সম্ভত ‘বক’ শব্দ থেকে উদ্ভূত) এই দেবীর রয়েছে বকের শির। এই দেবী ছিল কুটিল জাদুবিদ্যা এবং বিষাক্ত দ্রব্যের প্রতীক। বিস্ময়ের ব্যাপার হলেও এই দেবীর মুখায়বে প্রতিফলিত হয় যন্ত্রণা; মনে হয় কোন সংঘর্ষ জনিত কোন কষ্ট তাকে বিদীর্ণ করছে।
‘মাতঙ্গ’ শব্দের অর্থ হচ্ছে হস্তী। মাতঙ্গী হস্তীর যে শক্তি তার প্রতীক। শিব পরচিত ছিল হস্তীহন্তা হিসেবে এবং মাতঙ্গী ছিল তার স্ত্রী। তাকে কল্পনা করা হত একজন সুন্দরী নারী হিসেবে। সে বসে আছে এক সিংহাসনের উপর এবং উপবিষ্টা থেকে প্রদর্শন করছে হিতকর ক্ষমতা। কমলা হিসেবে এই দেবী সদাশিবের স্ত্রী। সে সুন্দরী ও সুপ্রসন্ন এবং শুভমঙ্গলময়ী।
তদুপরি দেবীদের ছিল আরো আটটি রূপ। এই দেবীদের দেখানো হয়েছে সংসার বিবাগী সন্ন্যাসিনীরূপে। এই দেবীরা হল ত্রিপুরা, ভীষণা, চণ্ডী, কর্ত্রী, ধরত্রী, হরত্রী, বিধায়িনী, করাল ও শূলিনী। আমারা দেখতে একই দেবী একই নাম একাধিক গ্রুপে উল্লেখিত হয়েছে।
কালীর যে ভিন্ন ভিন্ন রূপ আমরা দেখছি, সেগুলো নির্ধারিত হয়েছে কোন অঞ্চলে সে পূজিতা হয়েছে এবং কীউদ্দেশ্য সাধনের জন্যও এই পূজার আয়োজন করা হয়েছে। যেমন, এই দেবীকে আমরা দেখেছি শ্মশানকালী, ভদ্রকালী, গৃহকালী, মহাকালী, রক্ষাকালী, ইত্যাদি হিসেবে। এমনকি, ডাকাতদেরও কালী রয়েছে; বাংলায় এই দেবী ডাকাতে কালী হিসেবে পরিচিত। ডাকাতি করার জন্য যাত্রার প্রাক্কালে ডাকাতের দল ধুমধামসহকারে এই দেবীর পূজা করে। কালীর এই সমস্ত রূপই স্থানীয় ভাবে জনপ্রিয় ও পূজিতা অপরাপর দেবীদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করে। সে যা-ই হোক, দেবীদেরকে পূজা করবার প্রচণ্ড এই ধর্মীয় বিশ্বাস কিন্তু নারী জাতিকে বিশেষ মর্যাদা প্রদানে সমর্থ হয়নি। বরঞ্চ, নিষ্ঠুর ও কঠোর পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীরা ভীষণভাবে পুরুষের পদানত থেকেছে এবং ভীষণভাবে তারা নিগৃহীত হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। নারীর মানসিক ও শারীরিক যন্ত্রণা সহ্য করবার সামর্থ্যকে শ্লাঘার বস্তু হিসেবে দেখা হয়েছে এবং এইসব নিয়ে তৈরি হয়েছে বিভিন্ন সাহিত্য। গৌরবান্বিত করা তাদের সংসারের জন্য পুরুষের জন্য তাদের ত্যাগকে। তাদেরকে বসানো হয়েছে দেবীর আসনে। সীতা ও রাধা হচ্ছে প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এখানে উল্লেখিত অন্যান্য দেবীদের মত এই দুই দেবীর স্বর্গীয় গুণাবলী ছিল না। তাদের প্রধানতম সদগুণ ছিল যে তারা তাদের স্বামীর প্রতি ছিল অনুগত এবং উৎসর্গীকৃত।
সন্তানের জন্মদান এবং শৈশব অবস্থায় তাদের পালনই ঐতিহ্যগত ভাবে নারীর জন্য নির্ধারিত হয়েছে। দেবী ষষ্ঠীসদাশয়া এবং মাতৃস্নেহে পরিপূর্ণা এবং এই দেবীর মধ্যে বিধৃত হয়েছে এই স্বর্গীয় ক্ষমতা। সন্তানহীনাকে সন্তানদানের স্বর্গীয় ক্ষমতাও দেওয়া হয়েছে দেবী ষষ্ঠীকে।
রবীন্দ্রযুগে
নারীর অগ্রগতি
পারোমিতা চট্টোপাধ্যায়

অষ্টাদশ শতাব্দীতে বাংলার নারী সমাজ অনেক পিছনে ছিল। তাদের অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে আসার প্রথম দিশারি বিদ্যাসাগর মহাশয়। স্ত্রী শিক্ষা প্রচলনে তার অবদান অনস্বীকার্য। তাছাড়া বিধবা বিবাই প্রচলন, বহু বিবাহ রোধ তিনি আইনের মাধ্যমে ঘটান। তৎকালীন হিন্দু সমাজপতিদের বহু বিদ্রুপ সহ্য করেও তিনি তার কাজে অচল ছিলেন। বেথুন স্কুল প্রতিষ্ঠা তার অন্যতম কৃতিত্ব। আজকে নারী যে জায়গায় আছে তার জন্য বিদ্যাসাগর চিরস্মরণীয়।
পরবর্তীকালে স্ত্রী শিক্ষাকে রক্ষা ও নারী প্রগতির ক্ষেত্রে ব্রাহ্মসমাজ রবীব্দ্রনাথ এবং ঠাকুর পরিবারের অবদান অসীম। বহুবিবাহ নামক নারকীয় প্রথা থেকে মুক্তি পাবার জন্য সে সময় বহু হিন্দু কুলীন ব্রাহ্মসমাজের অন্তর্ভুক্ত হন। ঠাকুরবাড়ি ও ব্রাহ্মসমাজের মহিলারা নারী মুক্তি ও নারী প্রগতির দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। ঠাকুরবাড়ির মেয়ে বঁধুদের যে দুতিনটি নাম উজ্জ্বল তার মধ্যে প্রথমেই উঠে আসে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের কন্যা স্বর্ণকুমারী দেবী। তিনি নারী কল্যানমুলক কাজ আরম্ভ করেন তার প্রতিষ্ঠিত সখি সমিতির মধ্যে দিয়ে। বিধবাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার জন্য তার প্রচেষ্ঠা প্রশংসার দাবী রাখে। অসহায় বিধবাদের যন্ত্রনা, তাদের মর্মবেদনা তিনি তার বহু নাটকে ফুটিয়ে তোলেন। স্বর্ণকুমারীর জনপ্রিয় নাটকের মধ্যে একটি ছিল ‘কাহাকে’। এই নাটকের মাধ্যমে তিনি শিক্ষিতা আধুনিকা নারীদের অধিকার বোধ বিশ্লেষণ করেন। কবিতা লিখতেন, গান লিখতেন। তাছাড়া সংস্কারের কাজের জন্য তিনি এই কাব্য ও উপন্যাসের জগৎ ছেড়ে মন দিয়েছিলেন প্রবন্ধ লেখার কাজে। তিনি দীর্ঘদিন ‘ভারতী’ প্রত্রিকা সম্পাদনা করেন। দুঃস্থ মেয়েদের স্বাবলম্বী করার জন্য হাতের কাজ শেখানোর চেষ্টা উল্লেখযোগ্য। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাকে জগৎতারিণী স্বর্ণপদক দেওয়া হয়। এরপরে যার নাম আসে তিনি হলেন মহর্ষির মধ্যম পুত্র সত্যেন্দ্রনাথের পত্নী জ্ঞানদানন্দিনী। তিনি বাংলার নারী জাগরণের অন্যতমা ছিলেন। বাঙালি মেয়েদের আধুনিক শাড়ি পড়ার ধরণ তিনি আবিষ্কার করেন। তিনি তখনকার দিনে ভারতীয় রমণী যিনি স্বামীর সাথে বিলেত যান এবং ভারতের বহু শহরে ভ্রমণ করেন। সঙ্গীত, কাব্য, অভিনয় সব কিছুতেই তার অদম্য উৎসাহ ছিল। ভারতী পত্রিকায় স্ত্রীশিক্ষা বিষয়ক একটি প্রবন্ধ লেখেন।
এছাড়া ছোটদের জন্য ‘বালক’ পত্রিকা প্রকাশ করেন। তার রচিত ছোটদের ‘সাত ভাই চম্পা’ ও ‘তাক ডুমা ডুম’ খ্যাতি অর্জন করেন। রবীন্দ্রনাথের তৃতীয় ভ্রাতা হেমেন্দ্রনাথের পত্নী নিপময়ীর নাম উল্লেখ করা বিশেষ প্রয়োজন। তার ছবি আঁকা অসাধারণ প্রতিভা পরবর্তীকালে তার সন্তানের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। ‘পুণ্য’ পত্রিকায় তার আঁকা ছবি প্রকাশিত হয়। স্বর্ণকুমারী দেবীর কনিষ্ঠা কন্যা সরলাদেবীর নাম খুবই উল্লেখযোগ্য। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হন। রবীন্দ্রনাথের অনেক গানের স্বরলিপি তিনি দেন। ‘বন্দেমাতারম’ সঙ্গীতে সুর তিনি দেন। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে তিনি সক্রিয় ভাবে যুক্ত ছিলেন। তার রচিত গ্রন্থ জীবনের ঝরা পাতা থেকে তার এবং ঠাকুরবাড়ি সম্পর্কে অনেক তথ্য পাওয়া যায়।
জ্ঞানদানন্দিনীর কন্যা ইন্দিরাদেবীর নাম অত্যন্ত সুপরিচিত। রবীন্দ্রনাথের খুব কাছের এবং স্নেহ ভাজন ছিলেন। রবীন্দ্রসংগীতের প্রচুর স্বরলিপি তিনি রচনা করেন। সবশেষে আসা যাক রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে। ক্ষিতিমোহন সেনের ‘রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতন’ বইটিতে রবীন্দ্রনাথের মতে নারীর সাধনায় নারী সম্মন্ধে কবির মনোভাব সুন্দরভাবে আলোকিত হয়েছে। মহাত্মা গান্ধীর অনুরোধে গুজরাটে সাহিত্য সভায় যোগ দেবার জন্য গুরুদেব গুজরাট যাত